You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

৮৮. এই প্রসঙ্গে আমরা একজন বিখ্যাত জুরিস্ট Md. Bidwas এর বিখ্যাত উক্তি যা তার “Philosophy of Law” বইতে উল্লেখিত হয়েছে তা উদ্ধৃত করতে চাই -“Jurisprudence is said to be the daughter of philosophy. Every law must have its own philosophy. But a legal philosophy devoid of moral quality, if based purely on legal relations, may ultimately reduce the terms to be related to a cipher. This skeleton of legal relations may so dominate over the members of the social order that they vanish altogether. So the social order must be “good” one and one in which both the individual and the community are properly balanced and harmonized.”
“It must not be forgotten that life of law is logic though law cannot stand divorced from life either. The end of law is justice which is twofold: natural and conventional. Natural justice is law because it is right, while conventional justice is law because it is law.”
৮৯. এই যুক্তির ভিত্তিতে সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) আইন, ১৯৭৯ এর অনুমােদনের কারণে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ একটি কৌশলগত আইনের অবস্থান (a technical status of law) অর্জন করেছে। কিন্তু প্রকৃতি এবং স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি হওয়ার কারণে শাব্দিক অর্থে এটি সত্যিকার অর্থে কোনও আইন হতে পারে না। এছাড়া, এটি আমাদের সংবিধান পরিপন্থি হওয়ার কারণে এটি কোনও আইন হতে পারে না এবং তা বাতিল।
৯০. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল খুনিদের রক্ষা করা বা দায়মুক্তি প্রদান করা, যা মৌলিক মানবাধিকার যা জাতিসঙ্ঘ সনদ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনভেনশনস এর পরিপন্থি। এই প্রসঙ্গে, William Shakespeare এর নাটক –
The Life and Death of King John এর উদ্ধৃতি দেওয়া যথাযথই :
“There is no sure foundation set on blood,
No certain life is achieved by others’ death.”
৯১. আল্লাহ রাব্বল আল-আমীন একজন ব্যক্তি কর্তৃক অন্য একজন ব্যক্তিকে হত্যা করাকে অপছন্দ করেছেন এবং অনুমােদন দেননা এবং পবিত্র কোরআনে এরূপ খুনের শাস্তি ঘােষণা করেছেন নিমােক্তভাবে :
“If a man kills a Believer
Intentionally, his recompense
Is Hell, to abide therein
(For ever) : And the wrath and the curse of Allah
Are upon him, and
A dreadful penalty
Is prepared for him.”
Sura No. IV (Nissa), Veres-93.
(The meaning of the Glorious Quran by Abdullah Yusuf Ali, Vol. 1-Page 210).
৪০১

আর যে-কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনাে বিশ্বাসীকে হত্যা করবে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল থাকবে ও আল্লাহ্ তার ওপর ক্রুদ্ধ হবেন, তাকে অভিশাপ দেবেন ও তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত করে রাখবেন। (সুরা নিসা, আয়াত নং- ৯৩)
৯২. তাই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনার পবিত্র চেতনাকে ক্ষুন্ন করেছে যেখানে বর্ণিত হয়েছে “অঙ্গীকার করিতেছি যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্র উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সকল মহান আদর্শ।” [২০১১ সালের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশােধনীর পূর্বের অবস্থা।
৯৩. জনাব মােহাম্মদ কোরবান আলী, পিটিশনারদের পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট, যিনি তার বিজ্ঞ জুনিয়র জনাব মােঃ জাহাঙ্গীর আলম খান কর্তৃক সহায়তাপ্রাপ্ত হচ্ছেন, তিনি তার মক্কেলের জন্য প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেছেন। তিনি তার শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও এরূপ একটি সাংবিধানিক মামলায় আদালতকে তাঁর মূল্যবান সহযােগিতা প্রদান করেছেন। তার প্রয়াস এবং সহযােগিতা প্রশংসনীয়।
৯৪. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব কে. এস. নবী যিনি সিনিয়র আইনজীবিগণ কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে এই আদালতকে সর্বতােভাবে সহায়তা করেছেন এবং তিনি তাঁর মক্কেলের যথা : রেসপন্ডেন্টগণের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য কোনও উপায় বাদ রাখেননি। সাংবিধানিক পয়েন্টে তার বিস্তারিত, বিশদ এবং সুবিস্তৃত যুক্তিতর্ক আদালতকে এরূপ অত্যন্ত জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে সাহায্য করেছে। আদালতকে সহায়তা করার জন্য তার প্রয়াস প্রকৃতপক্ষে প্রশংসনীয়।
৯৫. আমরা ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি ছয়জন বিজ্ঞ এবং বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞকে যারা হলেন জনাব সৈয়দ হিমেদ, জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হােসেন, জনাব রফিক-উল হক, জনাব এম. নুরুল্লাহ এবং জনাব এম. আমীর-উল ইসলাম যারা তাদের প্রচণ্ড পেশাগত চাপ থাকা সত্ত্বেও তাদের মূল্যবান সময় ব্যয় করে কষ্ট স্বীকার করে আমাদেরকে সহায়তা করেছেন। বার-এর উপরােক্ত সিনিয়র সদস্যগণ এবং দেশের বিখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞগণের মূল্যবান মতামত, প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসতে সাহায্য করেছে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যে, এই মামলার ফলাফল জনস্বার্থের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ যা জাতির উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। আমাদের সম্মুখে তাদের উপস্থাপিত ন্যায়নিষ্ঠ, মূল্যবান এবং সত্যনিষ্ঠ মতামত প্রকৃতই প্রশংসনীয় এবং ঐশ্বর্যময়। অতএব, আমরা তাঁদের মূল্যবান সহায়তা এই রায়ে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছি। ৯৬. একজন বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব বজলুর রহমান আদালতের সম্মুখে কিছু কথা বলার জন্য অনুমতি চেয়েছেন। তিনি বলেন যে, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ একটি সঠিক এবং বৈধ আইন (Legislation)। এমন কোনও আইন প্রণীত হতে পারে না যা মানুষ হত্যাকারীদের সুরক্ষা এবং দায়মুক্তি প্রদানের জন্য, যা মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। একজন ব্যক্তি যিনি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছেন তাকে রক্ষা করার জন্য এরূপ একটি আইন করার অনুমােদন আমাদের সংবিধান দেয় না।
৯৭. আমরা উভয়পক্ষের বিস্তারিত যুক্তিতর্ক শ্রবণ করেছি এবং বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরিদের প্রদত্ত মতামত বিবেচনা করে দেখেছি। আমরা তাদের কর্তৃক উদ্ধৃত আইনগত এবং সাংবিধানিক বিধানাবলিও আমাদের চিন্তার মধ্যে রেখেছি। আমাদের মত হচ্ছে যে, জনাব অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তিতর্ক এবং ছয় জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে পাঁচ জনের প্রদত্ত ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫-এর বাতিলকরণ আইনগতভাবে এবং সাংবিধানিক সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় এবং সেই কারণে, তা আমাদের কাছে গ্রহণযােগ্য হয়েছে।
৪০২

৯৮. আমাদের বিস্তারিত আলােচনা এবং উপরােক্ত সিদ্ধান্তসমূহের সংক্ষিপ্তসার নিমােক্তভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে :
(১) উভয় রিট পিটিশন বর্তমান আকারে রক্ষণীয়।
(২) ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬, (আইন নং ২১/১৯৯৬) একটি বৈধ প্রকৃতির আইন. (Legislation) এবং তা সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) নয়।
(৩) ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ (অধ্যাদেশ নং ৫০/১৯৭৫) একটি বাতিল আইন কেননা এটি সংবিধান পরিপন্থি।
(৪) যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স (নং ৫০/১৯৭৫) সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং ২১/১৯৯৬ সংবিধানের কোনও বিধানকে লঙ্ঘন এবং ক্ষুন্ন করে না, সেহেতু, ধানমণ্ডি থানার মামলা নং ১০(১০) ১৯৯৬ এবং লালবাগ থানার মামলা নং ১১(১১)/১৯৭৫ দায়ের করাকে আইনগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে করা হয়েছে এবং বেআইনিভাবে করা হয়েছে মর্মে ঘােষণা করার
প্রার্থনা এই রায়ের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করা হলাে।
(৫) দেশের ছয়জন বিজ্ঞ জুরিস্ট এর মধ্যে পাঁচজন (জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ব্যতীত) অ্যামিকাস কিউরি (Amicus Curiae) হিসেবে আদালতকে সহায়তা প্রদান করেছেন। তাঁরা তাঁদের এই মত প্রকাশ করেছেন যে, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং ২১/১৯৯৬ একটি বৈধ প্রকৃতির আইন এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) হওয়ার কারণে তা একটি বাতিল আইন। ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং ২১/১৯৯৬ এর বৈধতা সম্পর্কে এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ এর বাতিল সংক্রান্তে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অ্যামিকাস কিউরির মতামত সাংবিধানিকভাবে এবং আইনগতভাবে সঠিক বলে প্রতীয়মান হয় এবং সেই কারণে তা গৃহীত হলাে।
৯৯. ফলে, দুইটি রিট পিটিশনে ইস্যুকৃত উভয় রুল উপযুক্ত সিদ্ধান্তসহ এই রায়ের মাধ্যমে খারিজ (ডিসচার্জড) করা হলাে, কোনও খরচাদেশ ছাড়া। পিটিশনারদের পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব কোরবান আলী সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩-এর অধীনে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে আপিল পেশ করার জন্য সার্টিফিকেট প্রার্থনা করেন। যেহেতু, বর্তমান মামলাগুলােতে সংবিধানের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত তাই প্রার্থনা মতে সার্টিফিকেট মঞ্জুর করা হলাে।

সমাপ্ত।।

৪০৩

১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট-এর বৈধতা বিষয়ে
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
আপীল বিভাগের রায় (বাংলায় অনূদিত)
১৯৯৭ সালের ১৮ ও ১৯ নং সিভিল আপিল
১৮ বিএলডি (আপিল বিভাগ) (১৯৯৮) পৃ. ১৫৫

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
আপীল বিভাগ
(দেওয়ানি অধিক্ষেত্র)
১৯৯৭ সালের ১৮ ও ১৯ নং সিভিল আপিল

সিভিল আপিল- ১৮/১৯৯৭
শাহরিয়ার রশিদ খান …..আপিলকারী
বনাম
বাংলাদেশ ও অন্যান্য …………প্রতিপক্ষ
সিভিল আপিল- ১৯/১৯৯৭
কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান……আপিলকারী
বনাম
বাংলাদেশ ও অন্যান্য
প্রতিপক্ষ
রায়ের তারিখঃ ০২ এপ্রিল ১৯৯৮
বিচারপতিবৃন্দ
বিচারপতি এ,টি,এম, আফজাল, প্রধান বিচারপতি
বিচারপতি মােস্তাফা কামাল
বিচারপতি লতিফুর রহমান
বিচারপতি মােহাম্মদ আবদুর রউফ
বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী

আপিলকারী পক্ষে আইনজীবী
কোরবান আলী, অ্যাডভােকেট
ইন্ট্রাক্টেড বাই-মিসেস আজরা আলী, অ্যাডভােকেট অন রেকর্ড (উভয় মামলায়)

রেসপনডেন্ট পক্ষে আইনজীবী
কে.এস. নবী, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং
আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল
শাহাবুদ্দিন আহমেদ, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
এম. ফারুক, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
ওবায়দুর রহমান মােস্তফা, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
বজলুর রহমান, অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
ইন্ট্রাক্টেড বাই-জনাব শরিফ উদ্দিন চাকলাদার, অ্যাডভােকেট-অন-রেকর্ড (উভয় মামলায়)
৪০৬

রায়

বিচারপতি এ, টি, এম, আফজাল, প্রধান বিচারপতি
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩(২)(ক)-এর অধীনে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক সার্টিফাইডকৃত এই দুটি আপিলে আইনের একটি মৌলিক প্রশ্ন জড়িত এবং তা হলাে- ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সালের ২১ নং আইন) (১৪ নভেম্বর ১৯৯৬ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত) সংবিধান পরিপন্থি কি না। আপিলগুলাের শুনানি শেষে আমরা সর্বসম্মত ও দ্বিধাহীন সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, এটি সংবিধান পরিপন্থি নয় এবং এটি একটি বৈধ আইন। এখন আমরা এই আপিলগুলাের ঘটনার দিকে যাচ্ছি এবং আমাদের সিদ্ধান্তের কারণ প্রদান করছি।
২. ১৮/১৯৯৭ নং সিভিল আপিলের আপিলকারী এই মর্মে ঘােষণা চেয়ে ৫৩২১/১৯৯৬ নং রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন যে, এই আইনটি বাতিল, অবৈধ, সংবিধানবিরুদ্ধ এবং আইনগতভাবে অকার্যকর; অধিকন্তু, ধানমণ্ডি থানার ২.১০.৯৬ তারিখের ১০(১০) ৯৬ নং এবং লালবাগ থানার ৪.১১.৭৫ তারিখের ১১ (১১)৭৫ নং মামলাগুলাে ছিল বেআইনি ও বাতিল।
৩. এই আপিলকারী ছিলেন ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগদানকারী একজন ক্যাপ্টেন যিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। অন্যান্য বক্তব্যের মধ্যে তিনি তার রিট আবেদনে দাবি করেন তিনি বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিভাগেও দায়িত্ব পালন করেছেন তবে ১৯৮২ সালে তিনি ব্যক্তিগত কারণে সেখান থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি ব্যবসা ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই সম্পৃক্ত হন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর সকালে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের জন্য কিছু কাজ বা বিষয় সম্পাদনে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এবং সামরিক আইন ঘােষণার ভিত্তিহীন অভিযােগে তাকে ১৩.৮.৯৬ তারিখে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আপিলকারী যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তিনি পূর্বোক্ত ফৌজদারি মামলাগুলাে সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন।
৪. আপিলকারী দাবি করেন যে, যখন ১৯৭৫ সালে তৎকালীন বাকশাল সরকার কর্তৃক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এবং সারা দেশে যখন অর্থনৈতিক সংকট ও গুরুতর অস্থিরতা বিরাজ করেছিল তখন ১৫ আগস্ট (১৯৭৫) একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এবং ক্ষমতায় থাকা সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল এবং এই কার্যক্রমে ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নং রােডের বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে এবং অন্য কয়েকটি স্থানেও কিছু অযাচিত ঘটনা ঘটেছিল। এই আপিলকারী যিনি তখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর একজন মেজর ছিলেন তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতনদের আদেশ অনুসারে তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং তারা কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার এবং মেজর জেনারেল ইত্যাদি পদমর্যাদায় তার উধ্বর্তন ছিলেন।
৫. আপিলকারী দাবি করেন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা সম্পর্কিত সমস্ত কার্যকলাপ ২৬.৯.৭৫ তারিখের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ (১৯৭৫ সালের ৫০ নং অধ্যাদেশ) দ্বারা অনুমােদন করা হয়েছিল, যার পুরাে বিষয়টি ২৩শে এপ্রিল ১৯৭৭ তারিখের ১ নং প্রক্লেমেশন অর্ডার এবং সংবিধানের ৫ম সংশােধনী দ্বারা অনুমােদিত ও বৈধ করা হয়েছে। আপিলকারী দাবি করেন ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট এর বিধানাবলি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ এর বিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
৬. এই অ্যাক্ট-এর সাংবিধানিকতা বিভিন্ন অবস্থান থেকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে যা নিম্নলখিত আলােচনার সময় লক্ষ করা হবে।

৪০৭

৭.. অপর সিভিল আপিল নং- ১৯/১৯৯৭ নং এর আপিলকারী হলেন কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান, যার মা মাহমুদা রহমান তার ছেলের পক্ষে ৫৩১৩/১৯৯৬ নং রিট পিটিশন দায়ের করে একই প্রতিকার প্রার্থনা করেন, অপর কেসে যেভাবে করা হয়েছে (তার আবেদনে কেবল ধানমণ্ডি থানার ২.১০.৯৬ তারিখের ১০(১০)৯৬ নং মামলা উল্লেখ করা হয়েছে)।
৮. সৈয়দ ফারুক রহমানও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
৯. রিট আবেদনে বলা হয় ১৯৭৫ সালে সংবিধানের ৪র্থ সংশােধনীর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিলােপ করে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করার পরে দেশে অস্থিরতা বিরাজ করেছিল। এইরূপ পরিস্থিতিতে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সরকার পরিবর্তন হয়েছিল, সামরিক আইন জারি হয়েছিল এবং একটি নতুন সরকার অস্তিত্ব লাভ করে। সরকার পরিবর্তন এবং সামরিক আইন ঘােষণাকালে ঐ সময়ের একজন জুনিয়র কর্মকর্তা উক্ত ফারুক রহমানকে ১৫.৮.৭৫ তারিখে ও তৎপরবর্তীকালে সেনাবাহিনীতে তার ঊর্ধ্বতনদের আদেশে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল।
১০. বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদ এবং ২০ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের প্রক্লেমেশন এর অধীনে তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করে ২৬.৯.৭৫ তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেছিলেন এবং এর ফলে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং সামরিক আইন ঘােষণার প্রয়ােজনে গৃহীত পদক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত কিছু কাজকর্মের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। দায়মুক্তি দেওয়া সেই কর্মকাণ্ডগুলাে পরবর্তীতে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ প্যারাগ্রাফে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এবং প্রকৃতপক্ষে তা সংবিধানের অংশ করা হয়েছে।
১১. পেনাল কোড এর ধারা ১২০বি/৩০২/১৪৯/৩২৪/৩৪/৩০৭/১০৯ এর অধীনে উপরিউক্ত ফৌজদারি মামলাটি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা সূত্রে শুরু হয়েছিল যা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এর এবং উপরি-উক্ত ৪র্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ এ এবং ১৮ এর বিধানের বিপরীত। ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ যার মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ রহিত করা হয় তা বেআইনি, বাতিল এবং সংবিধান পরিপন্থি।
১২. রেসপন্ডেন্ট সরকারের পক্ষে এফিডেভিট-ইন-অপজিশন দাখিল করা হয়, যেখানে আপিলকারীদের দাবি ও বক্তব্যসমূহ অস্বীকার করা হয় এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দাবি করা হয় যে, ২০ আগস্ট ১৯৭৫-এ দেশের রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের সদস্য এবং নারী ও শিশুসহ বিভিন্ন স্থানে অন্যদের হত্যা করাকে সরকার পরিবর্তনের জন্য প্রয়ােজনীয় মর্মে বিবেচনা করা যায় না। উক্ত হত্যাকাণ্ড এমন অপরাধ ছিল যা কোনও আইন দায়মুক্তি দিতে পারে না বা দায়মুক্তি দেয়নি। সংবিধানের কোনও বিধান ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সংবিধানের অংশ করেনি, ২০ আগস্ট ১৯৭৫ এবং ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ এর মধ্যবর্তী সময়কালে প্রণীত কোনও আইন বা অধ্যাদেশ বাতিল করার সংসদের ক্ষমতা চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ প্যারাগ্রাফে হ্রাস করা হয়নি। ঐ সময়ে প্রণীত বেশ কয়েকটি অধ্যাদেশ পরবর্তী সময়ে অধ্যাদেশ বা সংসদের আইন দ্বারা বাতিল করা হয়েছে এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধানের অংশ নয় বরং এটি একটি সাধারণ আইন, এর বাতিলকরণ সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদকে আকৃষ্ট করে না এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি বৈধভাবেই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ দ্বারা বাতিল করা হয়েছে যা বৈধ এবং সাংবিধানিক।
৪০৮

১৩. উভয় রিট আবেদনের বিষয় একই ছিল বলে হাইকোর্ট বিভাগ রিট পিটিশনগুলাে একত্রে শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব মােঃ কোরবান আলী নিজেই রিটপিটিশনকারীদের পক্ষে এবং সরকার রেসপন্ডেন্ট পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল প্রতিনিধিত্ব করেন। দেখা যায় যে, আদালতের অনুরােধে বারের ছয় জ্যেষ্ঠ সদস্যও অ্যামিকাস কিউরি হিসাবে হাজির হয়ে তাদের বক্তব্য দিয়েছিলেন। শেষ দিকে একজন ইন্টারভেনরও ছিলেন। বিজ্ঞ কৌসুলিগণের বক্তব্য, যেটিই তাঁরা বলেছেন তা হাইকোর্ট বিভাগ তর্কিত রায়ে যথেষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এই শ্রমসাধ্যরচিত দীর্ঘ রায়ের যে বিষয়টি যে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য, তা হলাে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলসহ সকল কৌসুলিবৃন্দের (খন্দকার মাহবুবউদ্দিন এবং দরখাস্তকারীর কৌসুলি ব্যতীত) পেশকৃত দীর্ঘ বক্তব্য যেখানে দাবি করা হয়েছে। উক্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ ছিল একটি বাতিল আইন। এইরূপ বক্তব্যের সমর্থনে সকল reasonings হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে এবং তদনুসারে হাইকোর্ট বিভাগ সিদ্ধান্ত প্রদান করেছে যে :
“উপরােক্ত বিবেচনায় ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(২) এবং ২৬(২) এর অধীনে বাতিল মর্মে সিদ্ধান্তে আসি। আমরা যেহেতু, ১৯৭৫ এর অর্ডিন্যান্স নং-৫০ বাতিল ঘােষণা করছি সেহেতু, এটি যেদিন জারী হয়েছিল অর্থাৎ ২৬.৯.১৯৭৫ তারিখে সেদিন সংবিধানের দৃষ্টিতে এটির কোন আইনগত অস্তিত্ব ছিলনা এবং এখনাে নেই।”
যদিও অন্য একটি জায়গায় হাইকোর্ট বিভাগ এই অভিমত দেন:
“মার্শাল ল প্রত্যাহারের পরেও সংবিধানের অন্যান্য আইন” এর মধ্যে সুরক্ষিত এবং শর্তাধীন হিসাবে অন্যান্য আইনের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স একটি বিদ্যমান আইন হিসাবে অব্যাহত ছিল এবং চ্যালেঞ্জ করা মাত্রই এই আইনটি আদালতের বিচারিক পর্যালােচনা সাপেক্ষে হয়।”
আবার পর্যবেক্ষণ করা হয়:
“সুতরাং, আমাদের কাছে এটি প্রতীয়মান হয় যে, বাতিল আইনটি এত দিন কোনও আদালত কর্তৃক বাতিল ঘােষণা না করা সত্ত্বেও সংসদ কর্তৃক আইনগতভাবে তা বাতিল করা হয়েছিল এবং সেজন্য ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে কোনও অবৈধতা বা অসাংবিধানিকতা হয়নি।”
এবং শেষে পর্যবেক্ষণগুলাে নিম্নরূপে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছিল:
(১) এই সিদ্ধান্ত হয় যে, উভয় রিট পিটিশন তাদের বর্তমান আকারে রক্ষণীয়।
(২) এই সিদ্ধান্ত হয় যে, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সালের ২১ নং আইন) একটি বৈধ আইন এবং তা সংবিধান পরিপন্থি নয়।
(৩) এই সিদ্ধান্ত হয় যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ (১৯৭৫ সালের ৫০ নং অর্ডিন্যান্স) সংবিধানের পরিপন্থি বিধায় এটি বাতিল।
(৪) এই সিদ্ধান্ত হয় যে, যেহেতু, ১৯৭৫ সালের ৫০ নং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধান পরিপন্থি এবং ১৯৯৬ সালের ২১ নং ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট সংবিধানের কোনও বিধান লঙ্ঘন করে না, সেহেতু, ধানমণ্ডি থানার ১০(১০)/১৯৯৬ এবং লালবাগ থানার ১১(১১)/১৯৭৫ নং মামলাগুলাে আইনি কর্তৃত্ববিহীন ও অবৈধ মর্মে যে ঘােষণা প্রার্থনা করা হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করা হলাে।
৪০৯

(৫) দেখা গেছে যে, অ্যামিকাস কিউরি হিসাবে আদালতকে সহায়তাকারী দেশের ছয়জন বিজ্ঞ আইনবিদের মধ্যে জনাব খােন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমেদ ব্যতীত পাঁচজন তাদের মতামত ব্যক্ত করেন যে, ১৯৯৬ সালের ২১নং ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট একটি বৈধ আইন এবং ১৯৭৫ সালের ৫০ নং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধান পরিপন্থি হওয়ায় তা বাতিল। ১৯৯৬ সালের ২১ নং ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট এর বৈধতার বিষয়ে এবং ১৯৭৫ সালের ৫০ নং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এর অসামঞ্জস্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অ্যামিকাস | কিউরিগণের দেওয়া মতামত সাংবিধানিকভাবে এবং আইনত সঠিক মনে হয়েছে এবং সেজন্য এই মতামত গৃহীত হলাে।
১৪. রিট আবেদনসমূহে জারি হওয়া রুলগুলাে ২৮ জানুয়ারি ১৯৯৭ তারিখের রায় ও আদেশ দ্বারা ডিসচার্জ (খারিজ) করা হয়েছিল, তবে রিট পিটিশনকারীদের প্রার্থনা অনুযায়ী সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩(২)(ক) এর অধীনে সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছিল। সুতরাং, আমাদের নিকট এই আপিলগুলাে অধিকার হিসেবে দায়ের করা হয়েছে।
১৫. আমরা লক্ষ্য করছি যে, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের একটি উল্লেখযােগ্য অংশ ছিল সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এবং একজন ব্যতীত অন্য সকল অ্যামিকাস কিউরি দ্বারা সমর্থিত এই বক্তব্য নির্ভর যে, ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স ছিল একটি বাতিল আইন এবং এই যুক্তি আদালত গ্রহণ করেন। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে বাতিল ঘােষণা করা হয়। সিদ্ধান্তের যথার্থতা এবং শুদ্ধতার প্রশ্ন বাদে আমরা। বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি কেন উক্ত অধ্যাদেশের viresকে সিদ্ধান্তের জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় করা হয়েছিল, যেখানে কোনও পক্ষই এই অধ্যাদেশটি ultra vires মর্মে কোনও ঘােষণার প্রার্থনায় আদালতের সামনে আনেনি। বিবেচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য রিট পিটিশনরাগণ কর্তৃক যে প্রশ্নটি সরাসরি উত্থাপিত হয়েছিল তা হলাে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ ছিল ultra vires। হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য এটিই ছিল একমাত্র সাংবিধানিক প্রশ্ন।
১৬. ভালাে বা মন্দ যাই হােক, আইনটি (অ্যাক্ট) অর্ডিন্যান্সটিকে বাতিল করেছে। কোনও আইন রহিতকরণ এর অর্থ হলাে পরবর্তি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সেটি সম্পূর্ণ রদকরণ (abrogation)। Statute Lato (Seventh Edition) গ্রন্থের ৩৫১ পৃষ্ঠায় CRAIES বলেন: “The effect of a repeal before 1890 without any express savings was thus stated by Tindal C.J. in Kay V. Goodwin, where he said: “I take the effect of repealing a statute to be obliterate it as completely from the records of the Parliament as if it had never been passed, and it must be considered as a law that never existed except for the purpose of those actions which were commenced, prosecuted and concluded whilst it was an existing law.” And in Surtees v. Ellison, Lord Tenterden said: “It has long been established that, when an Act of Parliament is repealed, it must be considered (except as to transactions past and closed) as if it had never existed”.
[১৭] সুতরাং, কোনও আইন বাতিল করার ফলাফল এমন যেন এই আইন কখনও বিদ্যমান ছিল না এবং এই
আইনের অধীনে নেওয়া কার্যক্রমগুলাের উদ্দেশ্য ব্যতীত আইনটি সংসদের রেকর্ড থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত। আইনের এই অবস্থানে রহিতকরণ আইন (Repeal Act) প্রণয়নের পরে ইনডেমনিটি
৪১০

অর্ডিন্যান্সটির অস্তিত্ব ছিল না। আর সেজন্য যে অধ্যাদেশের এমনকি অস্তিত্ব নেই সেই অধ্যাদেশকে অকার্যকর ঘােষণা করাটা অচিন্তনীয় ছিল। সেহেতু, বলতে গেলে এটি পরস্পরবিরােধী ছিল।
১৮. তারপর আবারাে কেন সরকার অথবা অন্য কেউ নিজেকে সংসদের চেয়ে জ্ঞানী বিবেচনা করবে? যখন সংসদ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, এটা অবশ্যই ধরে নিতে হবে যে, সংসদ অর্ডিন্যান্সকে একটি বৈধ এবং চলমান আইন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। অন্যথায় অর্ডিন্যান্সটি বাতিলের কোন প্রয়ােজনীয়তা হতাে না। যদি সংসদ অর্ডিন্যান্সটিকে বাতিল বিবেচনা করত তাহলে এটি বাতিল না করে একটি ঘােষণামূলক আইন প্রণয়ন করতে পারত। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রধান যুক্তি ছিল যে, অজ্ঞাতসারেই একটি বাতিল অর্ডিন্যান্স আইনসভায় তােলা হয় যা ছিল বিব্রতকর। যেটির জন্য রহিতকরণ আইন প্রণয়ন অপ্রয়ােজনীয় মর্মে প্রমাণিত হয়েছিল।
১৯. অতঃপর হাইকোর্ট ডিভিশন নিজেই পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ অনুচ্ছেদ দ্বারা সুরক্ষা প্রদান করায় সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরও দায়মুক্তি অর্ডিন্যান্সটি কার্যকর ছিল এবং আরও লক্ষ্য করেন যে, আদালতের এখতিয়ার রদ করা হলেও আদালত যে কোন আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিবেচনা করতে পারেন, যদি দেখেন যে, আইনটি অসদুদ্দেশ্যে কর্তৃত্ব এবং এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে (Coram non judice) প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি বােঝা যায় না যে, অর্ডিন্যান্সটি সংবিধান পরিপন্থি। বিবেচনায় হাইকোর্ট বিভাগ কীভাবে তা বাতিল ঘােষণা করতে পারে।
২০. উপযুক্ত হেতু সমূহের মধ্যে এখতিয়ার ব্যতীত ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ হতে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ সময়ে প্রণীত সকল আইন বিষয়ে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল অথবা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন অজুহাতে এই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না” (প্যারা ১৮)। হাইকোর্ট ডিভিশন এই বিষয়টি গ্রহণ করেছেন এবং কীভাবে এখতিয়ারের এই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেছে তার ব্যাখ্যা প্রদান না করেই অর্ডিন্যান্সটি বাতিল ঘােষণা করেন।
২১. যেকোন দৃষ্টিকোণ থেকেই এটি প্রতীয়মান হয় যে, হাইকোর্ট বিভাগ প্রদত্ত রায়ের মূল বিষয় অর্থাৎ অর্ডিন্যান্সটি বাতিল ছিল মর্মে যে পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয় তা ছিল একটি অপ্রয়ােজনীয় এবং অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত এবং সেহেতু, তা সমর্থন করা যায় না।
২২. এখন আমরা প্রকৃত ঘটনা আলােকপাত করছি। আপিলকারীগণের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব কোরবান আলী আমাদের সামনে বেশ কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন যেমনটি তিনি অ্যাক্টটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক মর্মে তারযুক্তি কোর্ট বিভাগে উপস্থাপন করেছিলেন। তার পুরাে উপস্থাপনার প্রধান অবলম্বন যে বিষয়ে। জনাব কোরবান আলী নিজেই জ্ঞাত ছিলেন তা ছিল এই যে, চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ অনুচ্ছেদের জন্য ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের অংশে পরিণত হয়েছিল যা সাধারণ আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় রহিত করা যায় না। অর্ডিন্যান্সটি বাতিল করার লক্ষ্যে, বিজ্ঞ আইনজীবী উপস্থাপন করেন যে, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসরণপূর্বক উল্লিখিত প্যারাগ্রাফ সংশােধন করা সমীচীন ছিল, যা করা হয়নি। ফলে অ্যাক্টটি সংবিধানের পরিপন্থি হয়েছে এবং সেহেতু, একটি সাধারণ আইন হিসেবে। রহিতকরণ অ্যাক্টটি (Repeal Act) পাস করায় ক্ষমতার অপপ্রয়ােগ হয়েছে।
২৩. বিজ্ঞ আইনজীবীর উপস্থাপিত বক্তব্য পরীক্ষা ও উপলব্ধির লক্ষ্যে প্রাসঙ্গিক আইনটিকে রেফারেন্স হিসেবে নিম্নে অনুলিপি করা হলাে :
২৪. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এক্সট্রা অর্ডিনারি গেজেটে প্রকাশিত হয়, যা নিম্নরূপ :
৪১১

GOVERNMENT OF THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH MINISTRY OF LAW, PARLIAMENTARY AFFAIRS AND JUSTICE
(LAW and parliamentary Affairs Division)
NOTIFICATION
Dacca, the 26th September 1975.
No. 692-Pub.- The following Ordinance made by the President of the People’s Republic of Bangladesh, on the 26th September, 1975, is hereby published for general information:
THE INDEMNITY ORDINANCE, 1975
ORDINANCE NO. L OF 1975
AN
ORDINANCE
To restrict the taking of any legal or other proceedings in respect of certain acts or things done in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitating the historical change and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975.
WHEREAS it is expedient to restrict the taking of any legal or other proceedings in respect of certain acts or things in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitating the historical change and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975,
AND WHEREAS Parliament is not in session and the President is satisfied that circumstances exist which render immediate action necessary,
NOW, THEREFORE, in pursuance of the Proclamation of the 20th August, 1975, and in exercise of the powers conferred by clause (1) of article 93 of the Constitution of the People’s Republic of Bangladesh, the President is pleased to make and promulgate the following Ordinance: Short title-
This Ordinance may be called the Indemnity Ordinance, 1975
Restrictions on the taking of any legal or other proceedings against persons in respect of certain acts and things.-(1) Notwithstanding anything contained in any law, including a law relating to any defense service, for the time being in force, no suit, prosecution or other proceedings, legal or disciplinary, shall lie, or be taken, in, before or by any court, including the Supreme Court and Court Martial, or other authority against any person, including a person who is or has, at any time,
৪১২

been subject to any law relating to any defense service, for or on account of or in respect of any act, matter or thing done or step taken by such person in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step toward, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975
(2) For the purposes of this section, a certificate by the President, or any person authorised by him in this behalf, that any act, matter or thing was done or step taken by any person mentioned in the certificate in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step towards, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975, shall be sufficient evidence of such act, matter or thing having been done or step having been taken in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or any necessary step towards, the change of such Government and the Proclamation of Martial Law on that morning.
KHANDAKER MOSHTAQUE AHMED
President.
DACCA.
The 26th September, 1975

২৫. ১৯৭৭ সালের প্রক্লেমেশন অর্ডার নং ১ দ্বারা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে প্যারাগ্রাফ ৩এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল এবং দ্বিতীয় যা ১৯৭৮ সালের প্রক্লেমেশন অর্ডার নং ৪ দ্বারা সংশােধন করা হয়েছিল এবং তা নিম্নরূপ :
3A (1) The Proclamations of the 20th August, 1975, and 8th November, 1975, and the Third Proclamation of the 29th November, 1976, and all other Proclamations and Orders amending or supplementing them, hereinafter in this paragraph collectively referred to as the said Proclamations and all Martial Law Regulations, Martial Law Orders and all other laws made during the period between the 15th day of August, 1975 and the date of revocation of the said Proclamations and the withdrawal of martial Law (both days inclusive) hereinafter in this paragraph referred to as the said period, shall be deemed to have been validly made and shall not be called in question in or before any Court or Tribunal on any ground whatsoever.
(2) All orders made, acts and things done, and actions and proceedings taken, or purported to have been made, done or taken, by the President or the Chief Martial
৪১৩

Law Administrator or by any other person or authority during the said period, in exercise or purported exercise of the powers derived from any of the said Proclamations or any Martial Law Regulation or Martial Law Order or compliance with any order made or sentence passed by any court or authority in the exercise or purported exercise of such powers, shall be deemed to have been validly made, done or taken and shall not be called in question in or before any Court, or Tribunal on any ground whatsoever.
(3) No suit, prosecution or other legal proceeding shall lie in any Court or Tribunal against any person or authority for or on account of or in respect of any order made, act or thing done, or action or proceeding taken whether in the exercise or purported exercise of the powers referred to in sub-paragraph (2) or in execution of or in compliance with orders made or sentences passed in exercise or purported exercise of such powers.
(4)……..
(5)…………
(6)………
(7) All laws in force immediately before the revocation of the said prosecution and withdrawal of Martial Law shall, subject to the proclamation revoking the said proclamations and withdrawing the Martial law, continue in force until altered, amended or repealed by the competent authority.
(8)………
(9)……..
(10) In this paragraph, ‘law’ includes Ordinance, rules, regulations, bye-laws,
orders, notifications and other instruments having the force of law. ২৬. সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) অ্যাক্ট, ১৯৭৯ (১৯৭৯ সালের ১ নং আইন) দ্বারা প্যারাগ্রাফ ১৮ সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয় এবং তা নিম্নরূপ :
18. All Proclamations, Proclamation Orders, Martial Law Regulations, Martial Law Orders and other laws made during the period between the 15th August, 1975, and the 9th April, 1979 (both days inclusive), all amendments, additions, modifications, substitutions and omissions made in this Constitution during the said period by any such Proclamation, all orders made, acts and things done, and actions and proceedings taken, or purported to have been made, done or taken, by any person or authority during the said period in exercise of the powers derived or purported to have been derived from any such Proclamation, Martial Law Regulation, Martial Law Order or any other law, or in execution of or in
৪১৪

compliance with any order made or sentence passed by any court, tribunal or authority in the exercise or purported exercise of such powers, are hereby ratified and confirmed and are declared to have been validity made, done or taken and shall not be called in question in or before any court, tribunal or authority on any ground whatsoever.
The Indemnity (Repeal) Act, 1996 reads:
১৯৯৬ সনের ২১ নং আইন
The Indemnity Ordinance, ১৯৯৫ এর রহিতকরণকল্পে প্রণীত আইন
যেহেতু The Indemnity Ordinance, ১৯৭৫ (Ordinance L of 1975) রহিত করা সমীচীন ও প্রয়ােজনীয়,
সেহেতু এতদ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইলঃ
১। সংক্ষিপ্ত শিরােনাম। – এই আইন The Indemnity (Repeal) Act, 1996 নামে অভিহিত হইবে।
২। Ord. L of ১৯৭৫ এর রহিতকরণ। -(১) The Indemnity Ordinance, 1975 (L of 1975 যাহা XLX of 1975 নম্বরে মুদ্রিত), অতঃপর উক্ত Ordinance বলিয়া উল্লেখিত, এতদ্বারা রহিত করা হইল।
(২) এই আইন বলবৎ হইবার পূর্বে যে কোন সময় উক্ত Ordinance এর অধীনকৃত কোন কার্য, গৃহীত কোন ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ অথবা অর্জিত কোন অধিকার বা সুযােগ-সুবিধা, অথবা সরকার বা কোন কর্তৃপক্ষের জন্য সৃষ্ট কোন দায়-দায়িত্ব, যদি থাকে, এর ক্ষেত্রে General Clauses Act, 1897 (X of 1897) এর Section 6 এর বিধানাবলী প্রযােজ্য হইবে না এবং উক্তরূপ কৃত কার্য, গৃহীত ব্যবস্থা, প্রদত্ত সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ বা অর্জিত অধিকার বা সুযােগ-সুবিধা বা সৃষ্ট দায়-দায়িত্ব উপ-ধারা (১) দ্বারা উক্ত Ordinance রহিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে এইরূপে অকার্যকর, বাতিল ও বিলুপ্ত হইয়া যাইবে যেন উক্ত Ordinance জারী করা হয় নাই এবং উক্ত Ordinance এর কোন অস্তিত্ব ছিল না ও নাই।
.
আবুল হাশেম
সচিব।

২৭. ইনডেমিনিটি অর্ডিন্যান্সটি সংবিধানের অংশে পরিণত হয়েছিল এই চূড়ান্ত বক্তব্য দাঁড় করাতে গিয়ে জনাব কোরবান আলী DLRSC (1) এ প্রতিবেদিত Dosso মামলার সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে এই যুক্তি দেখান যে, খন্দকার মােশতাক আহমেদ কর্তৃক ২০ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে মার্শাল ল’ ঘােষণার মাধ্যমে একটি। নতুন আইনগত আদেশ কার্যকারিতায় এসেছিল এবং রাষ্ট্রের সংবিধানকে উক্ত ঘােষণা ও মাশাল ল’ বিধানের অধীন করা হয়েছিল। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি সংবিধানের অধীনে প্রণীত শুধু একটি অর্ডিন্যান্স ছিল না, এটি ছিল এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল, যেহেতু তা supra-constitutional instrument of Proclamation প্রয়ােগ করে ২০ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে প্রণীত হয়েছিল। চতুর্থ তফসিলের ৩এ (১) অনুচ্ছেদে এটি বিধৃত রয়েছে যে, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ হতে মার্শাল ল’ ঘােষণা প্রত্যাহারকরণের তারিখ
৪১৫

পর্যন্ত প্রণীত ঘােষণা, মার্শাল ল’ রেগুলেশনস এবং অন্য সকল আইন’ বৈধভাবে প্রণীত বলে ধরে নেয়া হবে এবং সেগুলাে সম্পর্কে কোনও আদালত অথবা ট্রাইব্যুনালের কোনও কারণেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। অনুচ্ছেদ ১৮ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে উল্লিখিত সময়ে প্রণীত সকল ঘােষণা এবং অন্য সকল আইনকে নিশ্চিত ও অনুমােদন করা হয় এবং সেই একই সুরক্ষা ইতােমধ্যে যা অনুচ্ছেদ ৩এ দ্বারা প্রদান করা হয়েছিল। জনাব কোরবান আলী Halima Khatun 30 DLR(AD)207, Haji Joynal Abedin 32 DLR(AD)110, Ehteshamuddin Iqbal 33 DLR(AD)154 ইত্যাদি মামলার উদ্ধৃতি দিয়ে নিবেদন করেন যে, Coram non judice (কতৃত্ব) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্পাদিত ব্যাতিরেকে মার্শাল ল’ সময়কালে কৃত কার্যাদি ও বিষয়সমূহকে প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ দায়মুক্তি দিয়েছে মর্মে এই আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এরপর জনাব কোরবান আলী নিবেদন করেন, যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ দ্বারা শুধুমাত্র ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত করা হয়নি, বরং তার অধীনে সম্পাদিত সকল ক্রিয়াকলাপকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছিল যেটি অর্ডিন্যান্সেরও উদ্দেশ্য ছিল, যথা উদাহরণস্বরূপ সম্পাদিত কিছু ক্রিয়াকলাপের বিষয়ে আইনি কার্যক্রম গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান অর্ডিন্যান্সটিকে সংবিধানের অংশ করারই নামান্তর। অতএব, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের আশ্রয় না নিয়ে চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ সংশােধন না করে সাধারণ প্রক্রিয়ায় অর্ডিন্যান্স বাতিল করা যায় না, যদিও সেটি করা হয়েছে।
২৮. এবার বিপরীতভাবে বিজ্ঞ কৌসুলির উপস্থাপিত বক্তব্যেও বিশ্লেষণ করা যাক। সর্বপ্রথম এবং সর্বশেষ যুক্তি হলাে অর্ডিন্যান্সে ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ “act and things done” এবং প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ অর্ডিন্যান্সটিকে সংবিধানের অংশে পরিণত করার কারণ। আমরা উপস্থাপিত বক্তব্যের যৌক্তিকতা দ্বারা সন্তুষ্ট হওয়া থেকে অনেক দূরে। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি প্রণয়ন করা হয়েছিল এই অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন পূর্ব সময়ে কৃত কোনও কাজ বা বিষয় (act and things done) সম্পর্কে কোন আইনগত বা অন্যকোন কার্যক্রম গ্রহণ রুদ্ধ করার জন্য, অর্থাৎ কোনও প্রস্তুতি বা কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বা কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ যা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকালে ঐতিহাসিক পরিবর্তন ও মার্শাল ল’ ঘােষণার সথে সম্পর্কিত ছিল। অন্যদিকে, কোনও প্রক্লেমেশন অথবা “any other Law” হতে উদ্ভূত ক্ষমতা অথবা উদ্ভূত হয়েছে বলে ধরে নিয়ে তা প্রয়ােগ করে “act and things done” কে প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ অধীনে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। এগুলাে নিশ্চিতকরণ এবং অনুমােদিত হয়েছে এবং তা বৈধভাবে প্রণীত, সম্পাদিত বা গৃহীত হয়েছে মর্মে ঘােষণা করা হয়েছে এবং কোনও গ্রাউন্ডেই তা যেটিই হােক না কেন সে বিষয়টি সম্পর্কে কোনও আদালত অথবা ট্রাইব্যুনাল অথবা কর্তৃপক্ষের নিকট প্রশ্ন তােলা যাবে না। স্পষ্টরূপে, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এ সংঘটিত কর্মকাণ্ড যেগুলাে সম্পর্কে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স দ্বারা দায়মুক্তি প্রদান করা হলেও সেটা করতে গিয়ে উক্ত অর্ডিন্যান্স হতে উদ্ভূত ক্ষমতা অথবা উদ্ভূত হয়েছে ধরে নিয়ে তা প্রয়ােগ করা হয়নি। অতএব, ৩এ এবং ১৮ প্যারাগ্রাফে বর্ণিত শব্দগুচ্ছ “act and things done” এর সাথে তাদের কোন যােগসূত্র নেই।
[২৯] যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে যে, ২০ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের প্রক্লেমেশন এর অধীনে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছিল, প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ এটির বৈধতা ও যেকোনও হেতুতেই এটিকে চ্যালেঞ্জ হতে দায়মুক্তির ঘােষণা করেছিল এবং এছাড়া সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) অ্যাক্ট, ১৯৭৯ এর মাধ্যমে প্যারাগ্রাফ ১৮ অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে এটি অনুমােদন ও নিশ্চিত করা হয়েছিল। এভাবে অর্ডিন্যান্সটি নিজেই সংবিধানে সংযােজিত হয়েছে। এটাকে সাধারণ আইন দ্বারা বাতিল করা যায় না।
৪১৬

[৩০] আবারাে আমরা উপস্থাপিত বক্তব্যের সমর্থনে যে কারণগুলাে দেখানাে হয়েছে সেগুলাে দ্বারা সন্তুষ্ট হওয়া থেকে অনেক দূরে। এটা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই যে, অর্ডিন্যান্সটিকে ব্যক্তভাবে সংবিধানের অংশ করা হয়নি। সংসদ সেটা করতে চাইলে এটিকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে কোনও অসুবিধা ছিল না। এখন এটা দেখানাের প্রয়াস নেয়া হচ্ছে যে, অর্ডিন্যান্সটি পরােক্ষভাবে সংবিধানের অংশে পরিণত হয়েছে। সাধারণ নীতি হলাে সংবিধান-যা বাংলাদেশের নাগরিকের অভিপ্রায়ের সন্নিবেশন-এমন কোনও কিছু থাকা উচিত নয় যা এমন একটি আইনকে রক্ষা করে যেটি সংবিধানের এমন সকল আদর্শ বিরােধী যেগুলাের উপর ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে।
৩০. সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে। প্রণীত হয়েছিল। এই অর্ডিন্যান্সটি প্রণয়নে ২০ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের প্রক্লেমেশন এর উপর নির্ভর করলেও তা কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না, কারণ প্রক্লেমেশনটির প্রণেতা খােন্দকার মােশতাক আহমেদ যাই করতে পারুক না কেন, কথিত প্রক্লেমেশন এর অধীনে একটি অর্ডিন্যান্স ইস্যু করতে পারেন না। তিনি সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতির একটি ভিন্ন মস্তকাবরণ ধারণ করে অর্ডিন্যান্সটি জারি করেছিলেন। সুতরাং, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সে কোন extra magic ছিল না যা স্বাভাবিক সময়ে টিকে থাকার জন্য সংসদের সামনে পেশ করা প্রয়ােজন ছিল। প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ দ্বারা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সে যা আরােপ করা হয়েছে তা হলাে বৈধতার মােহর এবং চ্যালেঞ্জ হতে দায়মুক্তি প্রদান করা। প্যারাগ্রাফ ১৮-ও এই wibalspan cagarina e ferroso PC Black’s Law Dictionary Organics “Ratify” opet “to approve and sanction, to make valid, to confirm”। এসবের অর্থ এই যে, সংবিধান ঘােষণা করে যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বৈধভাবেই প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং এই বিষয়টি সম্পর্কে কোনও কারণেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। এটাই সংবিধানের অনুশাসন এবং তদতিরিক্ত কিছু নয়। অর্ডিন্যান্সটি সংবিধানের অংশে পরিণত হয়েছে এবং ১৪২ অনুচ্ছেদের আলােকে এটি রহিত করতে হবে- এটি বলা মানে এমন কিছু পড়া যা সুস্পষ্টভাবেই সংবিধানে নেই। সম্পূরক যুক্তিটি হলাে ৩এ এবং ১৮ প্যারাগ্রাফের প্রয়ােজনীয় সংশােধনী ব্যতীত অর্ডিন্যান্সটি বাতিল করা যায় না যা সমানভাবে অসমর্থনযােগ্য। যুক্তির প্রাণ হিসেবে যা প্রতীয়মান হয় তা হলাে যেহেতু, সংবিধানের সংশােধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্ডিন্যান্সটিকে অনুমােদন প্রদান করা হয়েছিল, সেহেতু সেটি বাতিলের জন্যও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়ােজন। আমরা এই বক্তব্যের সাথে একমত নই। আইন প্রণয়নের কাজ হতে আইন অনুমােদনের কাজটি গুণগতভাবে ভিন্ন। একটি অধ্যাদেশকে সংবিধানে অনুমােদন প্রদান করা হলেও তা অধ্যাদেশই থাকে সংবিধানের অংশে পরিণত হয় না।।
৩২. এ সংক্রান্তে প্যারাগ্রাফ ৩ক এর ক্লজ (৭) দেখা যেতে পারে যা প্রকৃত অর্থেই অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটি বলে যে, মাশাল ল প্রত্যাহারের অব্যবহিতপূর্বে কার্যকর থাকা সকল আইনের (অধ্যাদেশ ও আইন- ক্লজ-১০) কার্যকারিতা অব্যাহত থাকবে আসবে যদি না তা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তা পরিবর্তিত, সংশােধিত অথবা বাতিল করা হয়। সুতরাং, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে এই ধরনের আইন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। কোথাও অনুশাসন নাই যে, আইনে কোনও পরিবর্তন আনয়নের জন্য চতুর্থ তফসিল যথাযথভাবে সংশােধন করতেই হবে।
৩৩. রেসপনডেন্টগণ তাদের অ্যাফিডেভিট-ইন-অপজিশনে একই সময়কালের অধ্যাদেশগুলাের একটি তালিকা দিয়েছেন যেগুলাে পরবর্তীকালে অধ্যাদেশ অথবা সংসদ আইন দ্বারা বাতিল করা হয়েছিল। অতএব ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলকরণ কোনও ব্যতিক্রম ছিল না, বরং তা স্বাভাবিক legislative process
৪১৭

এর মাধ্যমে করা হয়েছিল। অ্যাফিডেভিট-ইন-অপজিশনের প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদ যেখানে রেসপনডেন্ট পক্ষের যুক্তিতর্কও রয়েছে যেটি আমাদের কাছে সঠিক মনে হয়েছে এবং এটি নিম্নে তুলে ধরা হলাে। Repeal Actটি ক্ষমতার অপপ্রয়ােগ করে প্রণয়ন করা হয়েছিল মর্মে আপিলকারীগণ পক্ষের এরূপ যুক্তির উত্তরও সেটি প্রদান করবে। বর্ণিত পঠিত প্যারাগ্রাফটি বলে :
It is submitted that no provision of the constitution had made the Indemnity Ordinance, 1975 a part of the constitution. It is also submitted that the paragraph 3A and 18 of the fourth schedule of the Constitution has not curtailed the power of Parliament to repeal any act of parliament or Ordinance made during the period between the 20th August 1975 and the 9th April, 1979. Besides, the Parliament possesses legislative power under article 65 of the constitution and the power of parliament to repeal laws and ordinance has been recognised by Article 149 of the constitution. In this connection, it may be stated that several Ordinance made between the 20th August, 1975 and the 9th April, 1979 have been repealed by Ordinance or by Act of parliament. Some instances are given below:
Industrial Relations (Regulation) Ordinance, 1975 was repealed by Act XXIX of 1980, Section-17;
Khulna Division Development Board Ordinance, 1979 was repealed by Ordinance XLVI of 1986, Section-2; Rajshahi Division Development Board Ordinance, 1979 was repealed by Ordinance No. XLVI of 1986, Section-2; Dhaka Division Development Board Ordinance, 1979 was repealed by Ordinance No. XLVI of 1986, Section-2;
Electoral Rolls Ordinance, 1979 was repealed by Section-18, Ordinance, No. LXI of 1982;
Bangladesh Railways Board Ordinance, 1979 was repealed by Ordinance No. XXIV of 1983, Section-2;
Off-shore Island Development Board Ordinance, 1977 was repealed by Ordinance No. XXXVIII of 1982, Section-3(e);
Haor Development Board Ordinance, 1977 was repealed by Ordinance No. XXXVIII of 1982, Section-3(e);
Environment Pollution Control Ordinance, 1977 was repealed by Act I of 1985, Section-21;
Bangladesh Standards Institution Ordinances, 1977 was repealed by Ordinance No. XXXVII of 1985; Section-38;
Presidential Election Ordinance, 1978 was repealed by Act XXVII of 1991, Section-13;
৪১৮

State-Owned Manufacturing Industries Workers (Terms and conditions of Service) Ordinance, 1979 was repealed by Ordinance XXXIX of 1985, Section-6.
৩৪. এ পর্যায়ে আমরা মনে করি হাইকোর্ট ডিভিশনের রায়ের যে অংশে উক্ত বিষয় নিয়ে আলােচনা হয়েছে তা উদ্ধৃত করার এটাই সময়। আমাদের মতে দীর্ঘ রায়ের এই অংশটি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক এবং যুক্তিসঙ্গত। আমাদের উপরিল্লিখিত অভিমতকে নিম্নের উদ্ধৃতি নিশ্চিত করে:
According to Mr. Korban Ali and Mr. Khondaker Mahbubuddin Ahmed this Ordinance was made a part of the constitution by paragraph 3A and 18 of the 4th schedule of the Constitution. But it appears that neither the 4th schedule nor any other provision of the constitution provides that this Indemnity Ordinance No. 50 of 1975 should be treated as a part of the constitution. Rather by paragraph 3A and 18 of the 4th schedule of constitution it was protected and continued as existing law in the category of “Other Laws” which were promulgated in between the period from 15th August, 1975 and 9th April, 1979. Since it was an ordinary piece of legislation being saved, protected and continued under paragraphs 3A and 18 of the 4th schedule of the constitution, it can be amended or repealed by simple majority members of the Parliament. In paragraph 3a(7) of the 4th schedule of the constitution a clear provision has been laid down of the effect that all laws made during the period from 15.8.75 to 9.4.79 were protected, but the same can be amended, altered and repealed by the authority. It means, the Parliament is the actual authority for repealing of law, nowhere in the 4th schedule or in any other provision of the Constitution it was stipulated that the laws which were continued and saved under paragraphs 3A and 18 of the 4th schedule of the Constitution would require two-third majority members of the Parliament for necessary amendment or alteration or repeal. Since there was no provision like that, we cannot import such a provision and as such we hold that the Indemnity Ordinance No. 50 of 1975 can be amended or altered or repealed by simple majority members of the Parliament and two-third majority of the members of the Parliament was not at all required for the same. The learned Attorney General as well as other five learned Amicus-Curiae expressed their views that this Indemnity (Repeal) Act, 1996 has been legally passed by a simple majority members of the Parliament and to pass such all law, two-third majority of the members of the Parliament was not at all necessary.
৩৫. জনাব কোরবান আলীর পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নিবেদন এই যে, যদি যুক্তির খাতিরে এটি স্বীকার করা হয় যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি বৈধভাবে বাতিল করা হয়েছিল, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের ঘটনার জন্য আপিলকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করাটা বেআইনি ছিল কারণ অর্ডিন্যান্সটি বাতিল হলেও বর্ণিত অর্ডিন্যান্স এর অধীনে তারা যে অধিকার ও সুবিধাসমূহ অর্জন করেছিল তা অক্ষুন্ন থাকবে। স্পষ্টরূপেই এই নিবেদনের ভিত্তি হলাে General Clauses Act, 1897 এর ৬ ধারা। এটা সত্য যে, একটি repealing Act কোনও বাতিলকৃত আইনের অধীনে অর্জিত অধিকার, সুবিধাদিকে প্রভাবিত করতে পারে
৪১৯

না। অধিকন্তু সেখানে একটি অগ্রগণ্যতার শর্ত থাকে যা ৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে তা হলাে “Unless a different intention appears”। এই মামলার বিভিন্ন অভিপ্রায় আইনটির ২ ধারায় পর্যাপ্তভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে। সেহেতু, যদিও এটি একটি ঘটনাগত প্রশ্ন ছিল যে, আপিলকারীদের উপর অভিযােগে বর্ণিত আরােপিত কর্মকাণ্ডের জন্য repealed Ordinance এর অধীনে প্রত্যক্ষভাবে সবকিছু বাতিল করে আইনসভা উক্ত অধ্যায়কে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছেন।
৩৬. জনাব কোরবান আলী কর্তৃক অন্য নিবেদন এই যে, তিনি নিজেই উপলব্ধি করেছেন, অধিক জোর মােটেই কোন বিশ্বাসযােগ্যতা বহন করে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি উপস্থাপন করেন যে, অ্যাক্টটি একটি ভূতাপেক্ষ (ex post facto) আইন যা সংবিধানের ৩৫ (১) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। উক্ত বিষয়ে কোনও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি কারণ আইনটি কোনও কিছুকে শাস্তিযােগ্য করেনি যা অভিযােগে বর্ণিত কর্মকাণ্ড সংঘটনের সময় ততটা শাস্তিযােগ্য ছিল না। এরপর তিনি যুক্তি দেখান যে, অ্যাক্টটি অসদুদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল কারণ বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা দলটি পূর্ববর্তী সংসদে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি বাতিলের জন্য কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক সরকার পরিবর্তনের পরপরই বিদ্বেষপূর্ণভাবে অর্ডিন্যান্সের অধীনে আপিলেন্টগণ কর্তৃক ভােগকৃত সুরক্ষা বাতিলের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।
৩৭. আইন প্রণয়নে পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন আইনসভার প্রতি বিদ্বেষ আরােপ করা আদালতের জন্য অনুমােদিত নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন সংবিধানের কোনও বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, আদালত অন্য কোন হেতু বিবেচনায় আইনটি বাতিল করতে পারে না। আইনসভার অভিসন্ধি বিষয়ে Cooley তার A treatise on the Constitutional Limitations এর ১৮৬ নং পৃষ্ঠায় বলেন:
From what examination has been given to this subject, it appears that whether a statute is constitutional or not is always a question of power, that is, whether the legislature in the particular case, in respect to the subject-matter of the act, the manner in which its object is to be accomplished, and the mode of enacting it, has kept within the constitutional limits and observed the constitutional conditions. If so, the courts are not at liberty to inquire into the proper exercise of the power in any case. They must assume that legislative discretion has been properly exercised. If evidence was required, it must be supposed that it was before the legislature when the act was passed; and if any special finding was required to warrant the passage of the particular act, it would seem that the passage of the act itself might be held equivalent to such finding. And although it has sometimes been urged at the bar, that the courts ought to inquire into the motives of the legislature where fraud and corruption were alleged, and annual their action if the allegation were established, the argument has in no case been acceded to by the judiciary, and they have never allowed the inquiry to be entered upon.
৩৮. জনাব কোরবান আলী অসদুদ্দেশ্যের প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন, কারণ ফৌজদারি মামলাসমূহ শুরু করা হয়েছিল ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলের পূর্বেই। এটা লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, এ ধরনের বিষয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে কার্য করার কর্তৃত্ব এবং কোনও অভিপ্রায়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা নয়। এটা বলা যাবে না যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এর অধীনে কথিত প্রতিবন্ধকতা প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (FIR) রুজু
৪২০

করার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করেছিল। কোনও একটি পর্যায়ে এটা সপক্ষে উপস্থাপন করতে হবে। যেহেতু ইতােমধ্যে অর্ডিন্যান্সটি বাতিল করা হয়েছে, সেহেতু প্রতিবন্ধকতা আর কাজ করছে না এবং প্রসিডিং এর বিরােধিতা করে অসদুদ্দেশ্যের কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
৩৯. উপরােক্ত আলােচনার আলােকে এই আপিলসমূহ মঞ্জুরযােগ্য নয় এবং তা বিনা খরচায় খারিজ (ডিসমিস) করা হলাে।।
বিচারপতি মােস্তাফা কামাল:
মাই লর্ড বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি এবং আমার ভ্রাতা বিজ্ঞ বিচারপতি লতিফুর রহমান প্রদত্ত রায় পড়ার পর এটাই অনুধাবন করেছি যে, আর তেমন কিছু বলার বাকি নেই। দুজনের সাথেই আমি সম্পূর্ণ একমত।
কিন্তু, তারপরও এই আপিলগুলাের সাংবিধানিক গুরুত্বের আলােকে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ ব্যক্ত করছি।
৪১. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ শুরু থেকেই বাতিল- হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকদের একপেশে এই চিন্তাবিষ্টতা আমাকে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণের দিকে তাড়িত করে যা বিজ্ঞ বিচারকগণ এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল তর্কিত রায়ের সমর্থন করার সময় কোন উত্তর প্রদান করেননি।
৪২. প্রথমত, হাইকোর্ট বিভাগে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ শুরুতেই বাতিল ঘােষণা চেয়ে যে-কোনাে নাগরিক রিট দায়ের করতে পারতাে। কিন্তু বিগত ২১ বছরে অর্ডিন্যান্সটি বলবৎ থাকাবস্থায় কেউ তা করেনি। উক্ত অর্ডিন্যান্সটি ১৪ নভেম্বর ১৯৯৬ সালে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) আইন, ১৯৯৬ পাস করে বাতিল করা হয়। রিট-আবেদনকারী-আপিলকারীগণ ১৯৯৬ সালের রহিতকরণ আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে স্ব স্ব রিট পিটিশন দায়ের করেন। সরকার-রেসপনডেন্টের যুক্তি হলাে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ শুরু থেকেই বাতিল। তারা দুইটি রিট পিটিশনের রেসপনডেন্ট হিসেবে উল্লিখিত অর্ডিন্যান্সটি শুরু থেকেই বাতিল এই ঘােষণা চায়নি, বস্তুত তা চাইতে পারেনি। তথাপি হাইকোর্ট বিভাগ রেসপনডেন্টের পক্ষে অপ্রার্থিত এবং অনাহুত ঘােষণা প্রদান করেন যে, উক্ত অর্ডিন্যান্সটি শুরু থেকেই বাতিল। বিষয়টি এমন হলাে যে, একজন বাদি তার জমিতে স্বত্ব ঘােষণার মামলা করলাে, বিনিময়ে সিদ্ধান্ত পেল যে, সে তার বাবার অবৈধ সন্তান। হাইকোর্ট বিভাগ রেসপনডেন্ট পক্ষের যুক্তির যথার্থতা গ্রহণ করতে পারে বা নাও করতে পারে, কিন্তু আপিলকারীদের দ্বারা আনীত রিট পিটিশনে অন্য একটি আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ঘােষণা দিতে পারে না। রিট পিটিশনে রেসপনডেন্টের পক্ষে ঘােষণা দেওয়া গ্রহণযােগ্য নয়, কারণ রিট পিটিশনার-ই ঘােষণা পাওয়ার প্রার্থনায় রিট দায়ের করেন, রেসপনডেন্ট নন। এ ধরনের ঘােষণার জন্য আলােচ্য অর্ডিন্যান্সটিকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করার সাহস কেউ দেখায়নি। যদি হাইকোর্ট বিভাগ এ ধরনের প্রথাবিরুদ্ধ পদক্ষেপ নিতে পারে তাহলে তা ভয়ংকর এক নজির স্থাপন করবে।
৪৩. দ্বিতীয়ত, সংসদ ইতােমধ্যেই ১৪ নভেম্বর ১৯৯৬ তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ বাতিল করেছে। হাইকোর্ট বিভাগ পরবর্তীতে ২৮.০১.৯৭ তারিখে একই অর্ডিন্যান্স শুরু থেকেই বাতিল বলে ঘােষণা করতে পারে না। এটা এমন যে, একই মকিং বার্ডকে দুইবার হত্যা করা। যখন একটি আইনকে ইতােমধ্যেই বাতিল করা হয়েছে, সেই আইনকে পুনরায় বাতিল ঘােষণা করা মৃত ঘােড়াকে দ্বিতীয়বার হত্যা করার। শামিল। যার অর্থ এটাও দাড়ায় যে, সংসদের কার্যক্রম অনর্থক হয়েছিল এবং ১৯৯৬ সালের রহিতকরণ আইন সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়ােজনীয় ছিল। হাইকোর্ট বিভাগ কি সংসদের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রমকে অন্তঃসারশূন্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারে এবং যখন তর্কিত বিষয়টি চূড়ান্তভাবে অন্যান্য বিষয়ের উপর
৪২১

নির্ভর করে নিষ্পত্তি করা যেত তখন কি স্বেচ্ছায় একটি সমান্তরাল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সিদ্ধান্ত দিতে পারে? আইন ব্যাখ্যার প্রধান একটি নীতি হলাে যতক্ষণ পর্যন্ত কোনাে মামলায় সিদ্ধান্ত দেওয়া না হয়। ততক্ষণ পর্যন্ত কোনাে আইন বা তার অংশকে অসাংবিধানিক বা বাতিল বলা যাবে না।
৪৪. তৃতীয়ত, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ রাষ্ট্রের দুই বিভাগের নিকট থেকে দুই ধরনের নিয়তির শিকার হয়েছে। সংসদ আইনটি বাতিল করেছে এবং হাইকোর্ট বিভাগ এটাকে শুরু থেকেই বাতিল বলে ঘােষণা করেছে। একটি আইনকে একই সময়ে সংসদ কর্তৃক বাতিল করা এবং হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক শুরু থেকেই বাতিল ঘােষণা করা যায় না, কারণ রহিতকরণ এবং ঐরূপ ঘােষণার ফলাফল ভিন্ন। রিপিল বা আইন বাতিলের ফলাফল সম্পর্কে বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি CRAIES on Statute Law (Seventh Edition) বইয়ের ৩৫১ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করেছেন। যখন সংসদের কোনাে আইন বাতিল করা হয় তার অর্থ হচ্ছে (অতীত এবং সম্পন্ন কার্যক্রম ব্যতীত) কখনােই আইনটির অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু রিপিল বা আইন বাতিল সবসময় একটি বৈধ এবং বিদ্যমান আইন সম্পর্কিত হয়। BLACK’S Law Dictionary (Fifth Edition)- এর ১১৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় “Repeal”-এর সংজ্ঞা নিন্মােক্তভাবে প্রদান করা হয়েছে :
“The abrogation or annulling of a previously existing law by the enactment of a subsequent statute which declares that the former law shall be revoked and abrogated, (which is called “express” repeal), or which contains provisions so contrary to or irreconcilable with those of the earlier law that only one of the two statutes can stand in force, (called “implied” repeal. To revoke, to rescind or abrogate by authority.”
৪৫. সুতরাং বিদ্যমান কোনও আইন-ই কেবল বাতিল করা যায়। কিন্তু কোনাে আদালত যদি কোনাে আইনকে শুরুতেই বাতিল বলে ঘােষণা করে তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায় আইনের বইয়ে কখনােই ঐ আইনের অস্তিত্ব ছিল না। কোনাে সময়েই উক্ত আইনটির অস্তিত্ব কোনােভাবেই ছিল না। বাতিলকৃত আইনের অধীনে | কোনাে কার্যক্রম চলতে পারে না। বাতিল আইনের ক্ষেত্রে পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজড ট্রানজ্যাকশনের প্রশ্নই ওঠে না। যখন একটি আইনকে সংসদ কর্তৃক বাতিল করা হয় তখন বাতিলকৃত আইনের অধীন অর্জিত, উদ্ভূত বা সংঘটিত কায়েমি অধিকার, বিশেষাধিকার, আইনগত বাধ্যবাধকতা এবং দায়-দায়িত্ব এসব সংরক্ষণ ও বহাল রাখার জন্য জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ৬ ধারার সহায়তা নেওয়া যায়, যদি না রহিতকরণ আইন দ্বারা ভিন্ন কোনাে অভিপ্রায় পরিলক্ষিত হয়। ১৯৯৬ সালের এই রহিতকরণ আইন এর ২ ধারায় এ ধরনের ভিন্ন অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে যার ফলে রহিতকৃত অর্ডিন্যান্সের অধীনে পুর্বের কত কাজ, গৃহীত পদক্ষেপ, বিবৃতি বা আদেশ অথবা নির্দেশনা বাতিল করা হয়েছে। যদি এখানে ধারা ২ না থাকতাে তাহলে রহিতকৃত অর্ডিন্যান্সের অধীনে কৃত কর্মকাণ্ড, বিবৃতি, সুবিধাদির বৈধতা বলবৎ থাকতাে। আবার, রহিতকরণ আইনের মর্ম অনুযায়ী একটি আইনকে prospectively ev retrospectively বাতিল করা হয়। বর্তমান মামলায়, ১৯৯৬ সালের Repeal Act ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫-কে ভাবীসাপেক্ষে (prospectively) বাতিল করেছে (এতদ্বারা রহিত করা হইল)। এর অর্থ হচ্ছে ১৩ নভেম্বর ১৯৯৬ পর্যন্ত। এটি বিদ্যমান একটি আইন ছিল। যখন কোনাে আইনকে সংসদের মাধ্যমে বাতিল করা হয়, আইন গ্রন্থ হতে এর অন্তর্ধান বাতিল করার দিন থেকে তা কার্যকর হয়। আইনসভার নির্দেশনা অনুযায়ী তা ভূতাপেক্ষ বা ভাবীসাপেক্ষ হতে পারে। কিন্তু যদি আদালত কোনাে আইনকে শুরুতেই বাতিল মর্মে ঘােষণা করে তাহলে আইন গ্রন্থ হতে বাতিলকৃত আইনটির অন্তর্ধান আইনটি প্রণয়নের দিন থেকে ভূতাপেক্ষভাবে
৪২২

(retrospectively) কার্যকর হবে; কখনােই ভাবীসাপেক্ষ (prospectively) নয়। আদালত কর্তৃক কোনাে আইন শুরু থেকেই বাতিল মর্মে ঘােষণা করা হলে কোনাে অধিকার জন্মে না। বাতিলকৃত আইন থেকে কোনাে বাধ্যবাধকতা বা দায়দায়িত্ব উদ্ভূত হয় না। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে বলা না থাকলে রহিতকৃত আইন থেকে উদ্ভূত অধিকার বা বাধ্যবাধকতা বহাল থাকে। হাইকোর্ট বিভাগ একটি আইন রহিত করা এবং আইনটিকে শুরু থেকেই বাতিল মর্মে ঘােষণা করার মধ্যকার পার্থক্যটি মাথায় রাখেননি এবং সেহেতু, সাংবিধানিক ভ্রান্ত ধারণার চোরা গর্তে নিমজ্জিত হয়ে অপ্রয়ােজনীয় ভিন্ন একটি নিজস্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন যা সংসদের অভিপ্রায় থেকে আলাদা যেখানে ইতােমধ্যেই আইনটি রহিত করা হয়েছিল।
৪৬. চতুর্থত, হাইকোর্ট বিভাগে একজন এমিকাস কিউরি যথার্থই বলেছেন যে, একটি বাতিল আইন দুইভাবে পরিহার করা যায়, যথা- কোর্টের মাধ্যমে আইনটি শুরুতেই বাতিল মর্মে ঘােষণা চাওয়া অথবা সংসদের মাধ্যমেই ঘােষণামূলক আইন প্রণয়ন করে তা বাতিল করা। ইতােমধ্যেই দেখা গেছে যে, আইনটির ঐরূপ বাতিল চেয়ে কেউ কখনাে আদালতে আসেননি। সংসদও ঘােষণামূলক কোনাে আইন প্রণয়ন করেনি। হাইকোর্ট বিভাগ ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, “a void law though not declared void so long by any Court was legally repealed by the Parliament”. হাইকোর্ট বিভাগ আবারও রিপিল এবং ঘােষণামূলক আইন প্রণয়নের (repeal and enactment of a declaratory statute) মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন।
৪৭. COOLEY 015 A Treatise on the Constitutional Limitations (Eight Edition), Volume ১’ এর ১৮৮ পৃষ্ঠায় Austin on Jurisprudenceসহ অন্যান্য বিষয়ে বলতে গিয়ে উদ্ধৃত 7657690 67, “A declaratory statute is one which is passed in order to put an end to a doubt as to what is the common law, or the meaning of another statute, and which declares what it is and ever has been”. তিনি ১৯১ পৃষ্ঠা বর্ণিত U.S. decisions উদ্ধৃত P659 7699, “To declare what the law is, or has been is a judicial power, to declare what the law shall be, is legislative. One of the fundamental principles of all our Governments is that the legislative power shall be separate from the judicial”. Avevi, “If the legislative would prescribe a different rule for the future from that which the courts enforce, it must be done by statute, and cannot be done by a mandate to the courts which leaves the law unchanged, but seeks to compel the courts to construe and apply it, not according to the judicial, but according to the legislative judgment. But in any case the substance of the legislative action should be regarded rather than the form; and if it appears to be the intention to establish by declaratory statute a rule of conduct for the future, the courts should accept and act upon it, without too nicely inquiring whether the mode by which the new rule is established is or is not the best, most decorous, and suitable that could have been adopted.”
৪৮. বর্তমান মামলার ক্ষেত্রে আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনাে আদালত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ শুরুতেই বাতিল মর্মে ঘােষণা করেনি। সুতরাং, সংসদ উক্ত অর্ডিন্যান্সটি শুরু থেকেই বাতিল মর্মে ঘােষণামূলক আইন প্রণয়ন করতে পারতাে কিন্তু তা করা হয়নি। সংসদ উক্ত অর্ডিন্যান্সকে বিদ্যমান আইন হিসেবে গণ্য
৪২৩

করে এবং তা বাতিল করে। হাইকোর্ট বিভাগ এই ধারণা পােষণ করে মৌলিক ভুল করেছে যে, সংসদ বৈধভাবে একটি বাতিল আইনকে রহিত করেছে। কিন্তু এটা চিন্তা করেনি যে, একটি বাতিল আইনকে বাতিল ঘােষণা করতে হবে একটি ঘােষণামূলক আইন দ্বারা এবং কেবল বিদ্যমান কোন আইনকেই রহিত (repeal) করা যায়।
৪৯. পঞ্চমত, রহিতকরণের (repeal) ক্ষেত্রে একই সংসদ বা পরবর্তী কোনাে সংসদ দ্বারা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ পুনরুজ্জীবিত করে রহিতকরণ আইন রহিত হতে পারে। কিন্তু যখন কোনাে আদালত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ শুরু থেকেই বাতিল মর্মে ঘােষণা করে তখন সংসদ একই আইন পুনরায় প্রণয়ন করতে পারে না। এটি অসাংবিধানিক হিসেবে বিবেচিত হবে। চিরকালের জন্য এটির কবর রচিত হয়। এই পার্থক্যটি হাইকোর্ট বিভাগের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে।
৫০. এখন পরবর্তী প্রশ্ন হলাে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাতিল করার যােগ্যতা সংসদের আছে কি না এবং আপিলকারীদের যুক্তি অনুসারে সংবিধান সংশােধন না করে তা করা যাবে কিনা। অবশেষে হাইকোর্ট বিভাগ অবশেষে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিয়েছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যুক্তিগুলাে সুর্নিদিষ্টভাবে সূত্রবদ্ধ ছিল না।
৫১. এটা সর্বজ্ঞাত যে, মার্শাল ল’ আমাদের দেশের সাংবিধানিক পদ্ধতির অংশ নয়। এটা সংবিধানের বাইরের বিধান (extra-constitutional dispensation)। যখন মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান সংবিধান স্থগিত করে, যেমনটি পাকিস্তানে আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে করেছিলেন এবং নতুন একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন যেমনটি তিনি ১৯৬২ সালে করেছিলেন, তখনও ১৯৬২ সালের সংবিধানে কনস্টিটিউশান (ফার্স্ট এমেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট, ১৯৬৩ এর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২২৩এ সংযুক্ত করে তাদের জন্য ইনডেমনিটি সম্পর্কিত বিধান রাখার প্রয়ােজন হয়েছিল; কিন্তু অনুচ্ছেদ ২২৩এ ভবিষ্যতে ইনডেমনিটি সম্পর্কিত বিধান তৈরির ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে দিয়েছিল। ইনডেমনিটি সম্পর্কিত বিধান ১৯৬২ সালের সংবিধানে রাখা হয়নি, কারণ ১৯৫৬ সালের পুরাতন সংবিধানকে কবর দেওয়া হয়েছিল এবং এভাবে এটি লঙ্ন করার দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল। কিন্তু যখন বিদ্যমান সংবিধান স্থগিত বা চলমান রেখে (ঘােষণাপত্র এবং মার্শাল ল রেগুলেশন সাপেক্ষে) মার্শাল ল’ আরােপ করা হয়, তখন মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে যেন মার্শাল ল প্রত্যাহার করার পর সংবিধানে মার্শাল ল’ আরােপ এবং তার অধীনে কৃত সকল কর্মকাণ্ড সংযুক্ত, অনুমােদিত এবং নিশ্চিত প্রতিপন্ন করা হয় এবং তাদের দ্বারা গৃহীত সংবিধান। পরিপন্থি পদক্ষেপের বৈধতা দেওয়ার জন্য সংবিধান সংশােধন করা হয়। এই সুরক্ষা ছাড়া বিদ্যমান সংবিধান যদি পুনরুজ্জীবিত করা হয় তাহলে মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সংবিধানের কাজে তাদের অসাংবিধানিক হস্তক্ষেপের জন্য বিচারের মুখােমুখি হবে। আমাদের বাংলাদেশে দুইটি মার্শাল ল’-তে প্রণীত আইনসমূহের পরম্পরা লক্ষ্যণীয়, যেমন- Proclamation, Proclamation Orders, Martial Law Regulations, Martial law Orders, Martial Law Instructions ইত্যাদি। মার্শাল ল’ বলবৎ থাকাকালীন এই আইনগুলাে মার্শাল ল’ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকৃতির কিছু আইন আছে যা কিছু সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকা সরকার, হােক তা জনগণের ভােটে নির্বাচিত কোনাে গতান্ত্রিক সরকার। বা মার্শাল ল’ সরকার বা এমনকি সংবিধান (ত্রয়ােদশ সংশােধন) আইন, ১৯৯৬ অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রণয়ন করে, কিন্তু এই আইনগুলাে মার্শাল ল’ সরকার চালানাে বা নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য। চলমান প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয় সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশ প্রণয়ন করতে হয়। সরকারের এবং বিধিবদ্ধ সংস্থার চাকা সচল রাখার জন্য রুলস, রেগুলেশনস, বাই-লজ, অর্ডারস, নােটিফিকেশনস এবং আইনের
৪২৪

কার্যকারিতাসম্পন্ন অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্ট বিদ্যমান আইনের অধীনে গঠন ও প্রকাশ করতে হয়। মার্শাল ল’ শাসনামলে এমনকি অধ্যাদেশ ঘােষণা করতে বা রুলস, রেগুলেশন ইত্যাদি তৈরি করতে মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষের সাংবিধানিক কর্তৃত্ব থাকে না। কারণ তাদের ক্ষমতার উৎস সংবিধান নয়, বরং সংবিধানের বাইরে গিয়ে সংবিধানে উপর হস্তক্ষেপ। এ কারণে তাদেরকে মার্শাল ল’ শাসনামলে জারীকৃত গঠিত ঐসকল অধ্যাদেশ, রুলস, রেগুলেশনস ইত্যাদিও অনুমােদন ও অনুসমর্থন সংবিধানে নিশ্চিত করতে হয়। বাংলাদেশের দুইবারের মার্শাল ল’ শাসনামলের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলাে যখন মার্শাল ল ঘােষণা, মার্শাল রেগুলেশনস ইত্যাদি যা মার্শাল ল’ শাসনামলের কর্মকাণ্ড যেগুলাের উভয় মার্শাল ল প্রত্যাহার করার সাথে সাথে স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে, কিন্তু অন্যান্য আইন (other laws) যেমন, অধ্যাদেশ, রুলস, রেগুলেশনস ইত্যাদিকে অনুমােদন দেওয়া হয়েছিল –“to continue in force until altered, amended or repealed by the competent authority”। পাকিস্তানের জিয়াউল হক আরও একধাপ এগিয়ে ভীষণভাবে সংশােধিত সংবিধানে মার্শাল ল’ রেগুলেশনসকে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানিয়েছিলেন। Constitution (Eighth Amendment) Act, 1985 এর মাধ্যমে পাকিস্তান সংবিধানে ২৭০ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপিত করে বিদ্যমান থাকা রাষ্ট্রপতির সকল আদেশ, অধ্যাদেশ, মার্শাল ল’রেগুলেশনস, মার্শাল ল অর্ডারস, আইনসমূহ, নােটিফিকেশনস, রুলস, অর্ডারস অথবা বাই-লজগুলাে “to continue in force until altered, repealed or amended by the competent authority” করা হয়েছিল। “Competent authority” এর সংজ্ঞাটি ব্যাখ্যার মাধ্যমে দেওয়া। হয়েছিল। যথাযথ আইনপ্রণয়নকারী সংস্থাকে রাষ্ট্রপতির সকল আদেশ, অধ্যাদেশ, মার্শাল ল রেগুলেশন, মার্শাল ল অর্ডারস, আইনসমূহ সম্পর্কে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (competent authority) হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। নােটিফিকেশনস, রুলস, অর্ডারস, বাই-লজ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ যার আইন অনুসারে এগুলাে তৈরি করা, পরিবর্তন করা, বাতিল করা বা সংশােধন করার ক্ষমতা রয়েছে সেই কর্তৃপক্ষকে এ ক্ষেত্রে competent authority করা হয়েছিল। সংবিধানে একটি সপ্তম তফসিল যুক্ত করা হয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতির কিছু আদেশ ও অধ্যাদেশ সেখানে উল্লেখ করা হয় যা কেবল সংবিধান সংশােধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্ভব সেগুলাে এবং অন্যান্য সকল আইন যথাযথ আইনপ্রণয়নকারী সংস্থা কর্তৃক ঐ সকল আইন সংশােধনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা যেতে পারে।
৫২. উপরে বর্ণিত জিয়াউল হকের পাকিস্তান সংবিধানের মতাে আমাদের সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩এ(৭) অনুচ্ছেদে “competent authority” সংজ্ঞায়িত বা ব্যাখ্যায়িত হয়নি। কিন্তু ঐরূপ সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা না থাকলেও এটা বােঝা কঠিন নয় যে, কে একটি অধ্যাদেশ পরিবর্তন, সংশােধন বা বাতিল করতে পারেন এবং কে রুলস, রেগুলেশনস ইত্যাদি এর ক্ষেত্রে ঐরূপ করতে পারেন। আমাদের সংবিধানের অধীনে একটি অর্ডিন্যান্স কোন বিধিবদ্ধ সংস্থা (statutory body) দ্বারা সংশােধন করা যেতে পারে না। এটি কেবল সংসদ দ্বারা সংশােধন করা যেতে পারে। রুলস, রেগুলেশনস, বাই-ল’জ ইত্যাদি কেবল সেই কর্তৃপক্ষের দ্বারা পরিবর্তন, সংশােধন বা বাতিল করা যেতে পারে যাদেরকে এগুলাে সংশ্লিষ্ট আইনের মাধ্যমে পরিবর্তন, সংশােধন বা বাতিল করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যদি এই অর্ডিন্যান্স, রুলস, রেগুলেশনস ইত্যাদি দেশের অপরিবর্তনীয় আইন হিসেবে বােঝানাে হতাে তাহলে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩এ এবং ১৮ পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতিস্থাপিত ২৭০এ অনুচ্ছেদের মতাে নির্দিষ্ট হওয়া উচিত ছিল। এটি উল্লেখ করা প্রয়ােজন ছিল যে, “any other laws” সংশােধন করার জন্য সংবিধান সংশােধনের জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে সেটি অনুসরণ করা প্রয়ােজন। এই ধরনের কোনাে বিধানের অনুপস্থিতিতে মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত এই সাধারণ আইনসমূহ পরিবর্তন,
৪২৫

সংশােধন বা রহিতকরণে সাধারণ প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করতে হবে যেভাবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়। সংসদ উপযুক্ততার সাথে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ প্রণয়ন করেছে।
৫৩. এখন ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এ ফিরে আসা যাক। “indemnity” শব্দটি BLACK’S Law Dictionary-এর ৬৯২ পৃষ্ঠায় এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে-
“A legislative act, assuring a general dispensation from punishment or exemption from prosecution to persons involved in offenses, omissions of official duty, or acts in excess of authority, is called an indemnity, strictly it is an act of indemnity,”
৫৪. বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ পুরােটাই উদ্ধৃত করেছেন। এই অর্ডিন্যান্স কাউকে শাস্তি থেকে সাধারণ অব্যাহতি দেয়নি, কিন্তু সম্ভাব্য অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদেরকে মামলা থেকে কেবল অব্যাহতি দিয়েছে। এই আইনটি কোনও প্রক্লেমেশন, মার্শাল ল’ রেগুলেশন, মার্শাল ল অর্ডার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রণীত হয়নি। এটি অর্ডিন্যান্স আকারে অর্থাৎ সাধারণ আইন হিসাবে করা হয়েছিল। আপিলকারী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব কোরবান আলী এই আইনের সাংবিধানিক ও আইনগত অবস্থান সম্পর্কে গভীরভাবে অবগত আছেন এবং সেহেতু, তার মূল বক্তব্য ছিল যে, যদিও অর্ডিন্যান্সটি যা ছিল ২০ আগস্ট ১৯৭৫ এর প্রক্লেমেশনের পুনরুক্তি (rehash) সেহেতু তা প্রক্লেমেশনের একটি অংশ। তিনি দাবি করেন, সুতরাং এটি বাতিলের জন্য সংসদেও দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়ােজন। বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি প্রক্লেমেশন এবং অর্ডিন্যান্স এর মধ্যে factual and contextual পার্থক্য বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এবং তাই এটি নিয়ে আমার আর আলােচনা করার প্রয়ােজন নেই। এটি সরাসরি নির্দেশ করে যে, আপিলকারীর নিকট অর্ডিন্যান্সটি যতই গুরুত্বপূর্ণ হােক না কেন তা অর্ডিন্যান্স অর্থাৎ সাধারণ আইন হিসেবে রয়েছে, অর্থাৎ একটি সাধারণ আইন কখনােই অরহিতযােগ্য নয়। সাংবিধানিক আইনের মৌলিক নীতি হচ্ছে আইনসভা কোনও অরহিতযােগ্য আইন পাশ করতে পারে না। COOLEY যেমনটি তাঁর “A treatise on the Constitutional Limitations” (Eighth Edition) গ্রন্থের প্রথম ভলিউমের ২৪৭ পৃষ্ঠায় 167699, “To say that the legislature may pass irrepealable laws, is to say that it may alter the very constitution from which it derives its authority, since, in so far as one legislature could bind a subsequent one by its enactments, it could in the same degree reduce the legislative power of its successors; and the process might be repeated, until, one by one, the subjects of legislation would be excluded altogether from their control, and the constitutional provision that the legislative power shall be vested in two houses (in our constitution, in House of the Nation) would be to a greater or less degree rendered ineffectual”। এই কারণ আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ১৯৯৬ সালের রহিতকরণ আইন একই অথবা পরবর্তী সংসদ কর্তৃক রহিতও করা যেতে পারে। এটি আইনসভার একটি অন্তর্নিহিত ক্ষমতা।
৫৫. উপরে বর্ণিত পর্যবেক্ষণসহ আমি পুনরায় বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি মহােদয় কর্তৃক প্রদত্ত রায়ের সাথে
একমত পােষণ করছি।
৪২৬

বিচারপতি লতিফুর রহমান : মাননীয় প্রধান বিচারপতির রায়টি আমার মনােযােগ সহকারে পাঠ করার সুযােগ হয়েছে। যদিও আমি শ্রদ্ধার সাথে তার সাথে একমত, তথাপি, মামলায় জড়িত সাংবিধানিক ইস্যুগুলাের গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় আমি আরও কিছু কথা যুক্ত করতে চাই।
৫৭. মূল রায়টিতে মাননীয় প্রধান বিচারপতি ইতােমধ্যেই রিট পিটিশনের ঘটনাবলি বর্ণনা করেছেন এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫; ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ এবং সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩-এ এবং ১৮ প্যারাগ্রাফগুলাে উদ্ধৃত করেছেন। সুতরাং, আমি এই supporting রায়ে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করার প্রয়ােজন বােধ করছি না।
৫৮. এই দুইটি সার্টিফিকেট আপিল, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ৫০২১ এবং ৫৩১৩ নং রিট পিটিশন হতে উদ্ভূত ১৯৯৭ সালের ১৮ এবং ১৯ নং সিভিল আপিল, যা শাহরিয়ার রশিদ খান এবং কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমানের পক্ষে তার মাতা মাহমুদা রহমান কর্তৃক দায়ের করা হয়েছিল। ঐ রিট পিটিশনগুলােতে ইস্যুকৃত উভয় রুলই হাইকোর্ট বিভাগের একটি common judgment দ্বারা বাতিল করা হয়েছিল।
রিট পিটিশনগুলােতে আপিলকারীগণ দুইটি প্রতিকার প্রার্থনা করেছিল, যথা-
কেন ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ অকার্যকর, অবৈধ, সংবিধান পরিপন্থি এবং আইনগতভাবে অকার্যকর মর্মে ঘােষণা প্রদান করা হবে না।
কেন ০২.১০.৯৬ তারিখের ধানমন্ডি থানার মামলা নং ১০(১০) ৯৬ এবং ০৪.১১.৭৫ তারিখের লালবাগ থানার মামলা নং ১১(১) ৭৫ কে বেআইনি এবং বাতিল ঘােষণা করা হবে না।
৫৯. কেন এবং কীভাবে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ প্রণীত হয়েছিল, তার পটভূমি বর্ণনা করা জরুরি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সকল সদস্য যারা তার ধানমন্ডির বাসভবনে অবস্থান করছিলেন এবং আরও কিছু ব্যক্তিকে সেনা সদস্যদের একটি দল হত্যা। করেছিল, যারা রেডিও বাংলাদেশের মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করেছিল। পরবর্তীকালে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রিসভার একজন ঊর্ধ্বতন সদস্য, তার ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টের প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করেছিল। এই প্রক্লেমেশন অর্ডার এর মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রপতির পদটি অধিগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দপ্তরে প্রবেশ করেছিলেন। এই প্রক্লেমেশনে তিনি ঘােষণা দেন যে, তদনুসারে সামরিক আইনের প্রবিধান এবং আদেশসমূহ এবং তার প্রদত্ত অন্যান্য আদেশ সমূহসাপেক্ষে সংবিধান বলবৎ পরবর্তীকালে, ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টের প্রক্লেমেশনের প্রেক্ষিতে এবং সংবিধানের ৯৩(১) অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৯৭৫ সালের ৫০ নং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি জারি করেছিলেন। বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে সামরিক আইন জারি বা এর প্রস্তুতি বা তা কার্যকর করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বা এজন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ এর সাথে যারা তাদের কৃতকর্ম দ্বারা যুক্ত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত বা অন্য কোনাে কার্যক্রমগ্রহণে বিধি-নিষেধ আরােপ করার জন্যই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি জারি করা হয়েছিল।
৬০. এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ পরবর্তীতে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট (১৯৯৬ সালের ২১ নং আইন) নামক রহিতকরণ আইনের মাধ্যমে রহিত করা হয়েছিল। হাইকোর্ট বিভাগ এবং আমাদের
৪২৭

সামনে বিবেচনার জন্য মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, এই রহিতকরণ আইনটি সংসদ কর্তৃক এর plenary legislative power বলে বৈধভাবে প্রণীত হয়েছিল কিনা। এটা দেখা গিয়েছিল যে, ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্টের প্রক্লেমেশন এর মাধ্যমে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ সারা দেশে সামরিক আইন জারি করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদটি দখল করেছিল। তিনি এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতার কথিত প্রয়ােগের মাধ্যমে ঘােষণা করেছিলেন, যেন সংসদ অধিবেশন না থাকায় এটি একটি সাধারণ আইন যা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল।
৬১.প্রথম সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেয়ার পর এবং সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর, চতুর্থ তফসিলটি সংশােধন করা হয়েছিল। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ৩এ নং প্যারাগ্রাফটি ১৯৭৭ সালের ১নং প্রক্লেমেশন এর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছিল এবং ১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় প্রক্লেমেশন অর্ডার নং-৪ দ্বারা তা সংশােধিত হয়েছিল। পরবর্তীতে, সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) আইন, ১৯৭৯ (১৯৭৯ সালের ১নং আইন) এর মাধ্যমে ১৮ নং প্যারাগ্রাফটি চতুর্থ তফসিলের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। এই সাংবিধানিক সংশােধনীর মাধ্যমে ১৮ নং প্যারাগ্রাফটি চতুর্থ তফসিলে সন্নিবেশিত করা হয়েছিল, যা সাংবিধানিক সংশােধনীসহ সামরিক আইন চলাকালীন যা কিছু করা হয়েছিল সেগুলােকে বৈধতা প্রদান করেছিল এবং এই সকল কর্ম ও বিষয়ের ক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে মূল আলােচনাটি ছিল, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫-এর সাংবিধানিকতা সম্পর্কে।
৬২. হাইকোর্ট বিভাগের রায়টি হতে প্রতীয়মান হয় যে, আপিলকারীগণ এবং রেসপন্ডেন্ট পক্ষের আইনজীবীগণ এবং এই মামলার অ্যামিকাস কিউরিগণও মূলত অর্ডিন্যান্সটির সাংবিধানিকতা নিয়ে যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছিলেন। বিজ্ঞ আইনজীবীগণের যুক্তিতর্ক বিবেচনার পর, বিজ্ঞ বিচারপতিগণ সিদ্ধান্ত দেন যে, অর্ডিন্যান্সটি সংবিধান পরিপন্থি এবং ফলস্বরূপ, তাঁরা এমনভাবে এটিকে বাতিল ঘােষণা করেন, যেন এটি জারি করার দিন এবং এর পরবর্তীতেও সংবিধানের দৃষ্টিতে অর্ডিন্যান্সটির কোনাে আইনি অস্তিত্ব ছিল না। অতএব, বিজ্ঞ বিচারপতিগণ আদেশ অংশের ৩নং দফায় নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তটি প্রদান করেন :
“It is held that the Indemnity Ordinance, 1975 (Ordinance No. 50 of 1975) is void since it is repugnant to the Constitution.”
এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, উভয় রিট পিটিশনেই অর্ডিন্যান্সটির ব্যাপারে কোনাে আপত্তি উত্থাপন করা হয়নি, বরং রিট পিটিশনারগণের মামলাটি ছিল ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ বাতিল, বেআইনি, সংবিধান পরিপন্থি এবং এর কোনও আইনি কার্যকারিতা ছিল না মর্মে ঘােষণা করা নিয়ে। রহিতকরণ আইনকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল, মূল অর্ডিন্যান্সটিকে নয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, মূল অর্ডিন্যান্সটির বিষয়ে কোনাে ঘােষণা দেয়াটা অযাচিত ছিল, কেননা রিট পিটিশনে হাইকোর্ট বিভাগের সামনে অর্ডিন্যান্সটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয় নি। যেহেতু, রহিতকরণ আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল, সেহেতু হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারপতিগণের দায়িত্ব ছিল শুধুমাত্র রহিতকরণ আইনেরই বৈধতা যাচাই করা, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিজ্ঞ বিচারপতিগণ তাদের বৈধ সীমা অতিক্রম করেছেন এবং অযাচিতভাবে একসাথে এমন একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন যে বিষয়টি এই মামলায় নির্ধারণের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা আদৌ ছিল না। তাদের শুধুমাত্র রহিতকরণ আইনের সাংবিধানিকতা নির্ণয়ে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত ছিল।
৪২৮

৬৩. আপিলকারীগণের পক্ষে উপস্থিত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব কোরবান আলী উভয় আপিলেই মূলত একটি পয়েন্টের উপর জোর দেন এবং তিনি অকপটভাবেই বলেন যে, যদি এই পয়েন্ট আদালতের কোনাে আনুকূল্য না পায়, তবে তার অন্যান্য আনুষঙ্গিক পয়েন্টগুলাের আর বিশেষ কোনাে গুরুত্ব থাকবে না। তার মূল যুক্তি হচ্ছে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফ দ্বারা সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত হওয়ায় এটি সংবিধানের অংশে পরিণত হয়েছে এবং সেহেতু সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফের সংশােধন ব্যতীত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটিকে বাতিল করা যাবে না। তিনি এভাবে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফের মাধ্যমে অর্ডিন্যান্সটিকে সাংবিধানিক আইনের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে এবং সেটিকে সংবিধানের অংশে পরিণত করা হয়েছে যা সাংবিধানিক সংশােধনের পদ্ধতি অনুসরণ না করে অর্ডিন্যান্সটিকে সংসদ কর্তৃক একটি সাধারণ আইনের মতাে রহিত করা যাবে না। তার আপত্তিটি মূলত প্রক্রিয়া নিয়ে, সংসদের বাতিল করার ক্ষমতা নিয়ে নয়। তার উত্থাপিত আরাে দুটি গ্রাউন্ড হলাে :
(১) সরকারের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের পরপরই রহিতকরণ আইনের মাধ্যমে অর্ডিন্যান্সটিকে বাতিল করা এবং অভিযুক্ত আপিলকারীদের বিরুদ্ধে দুইটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা পরিষ্কারভাবে এটাই ইঙ্গিত দেয় যে, অত্যন্ত দ্রুততার সাথে অর্ডিন্যান্সটিকে বাতিলের মাধ্যমে আপিলকারীদের হয়রানি এবং ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে রহিতকরণ আইনটি প্রণীত হয়েছে।
(২) রহিতকরণ আইনটি (১৯৯৬ সালের ২১ নং আইন) একটি colorable legislation ছাড়া কিছুই নয়, কেননা এই আইনের মাধ্যমে চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফগুলাে পরােক্ষভাবে সংশােধন করা হয়, যা সরাসরিভাবে সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রয়ােগ করে করা যেত না।
আমি মূলত জনাব কোরবান আলীর মূল যুক্তিতর্ক নিয়েই আলােচনা করবাে, কেননা প্রকৃতপক্ষে মামলার সম্পূর্ণ বিষয়টি মূল যুক্তিতর্ককে ঘিরে আবর্তিত হয়।
৬৪. আমাদের সংবিধানের ১৪২ নং অনুচ্ছেদটি সংবিধানের কোনাে বিধান সংশােধনের ক্ষমতা এবং পদ্ধতি বিধৃত করে। ১৪২ নং অনুচ্ছেদটি একটি বিশেষ পদ্ধতি বিধৃত করেছে যেখানে বলা আছে যে, কোনও সাংবিধানিক সংশােধন করতে হলে তা সংসদের মােট সদস্য সংখ্যার অনুন দুই-তৃতীয়াংশ ভােটে হতে হবে। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩এ. এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফের মাধ্যমে কিছু সামরিক আইনের ঘােষণা, প্রবিধান, আদেশ এবং অন্যান্য আইনকে বৈধতা, অনুমােদন এবং নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছিল এবং এগুলােকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আমাদেরকে নির্ধারণ করতে হবে যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফ যুক্ত করার ফলে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি কোনাে সাংবিধানিক
আইনের মর্যাদা প্রাপ্ত হয়েছিল কি না এবং এটি সংবিধানের অংশ হিসেবে পরিণত হয়েছিল কি না।।
৬৫. এ বিষয়টির নির্ধারণ মূলত ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফের উপ-প্যারাগ্রাফগুলাের পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষণের উপর নির্ভর করে, যে প্যারাগ্রাফগুলাে অর্ডিন্যান্সটিকে এবং তৎকালীন বলবৎ অন্যান্য আইনগুলােকে বৈধতা প্রদান করেছিল। চতুর্থ তফসিলের ৩এ প্যারাগ্রাফের ১ উপ-প্যারাগ্রাফে বলা আছে যে, সামরিক আইন বলবৎ থাকাকালীন সময়ে যে সকল প্রক্লেমেশনস, মার্শাল ল’ রেগুলেশনস ইত্যাদি এবং অন্যান্য আইনসমূহ (all other laws) প্রণয়ন করা হয়েছিল সেগুলাে বৈধভাবে প্রণীত হয়েছিল বলে ধরে নিতে হবে এবং কোনাে আদালত বা ট্রাইব্যুনালের সামনে এগুলাের বিষয়ে কোনাে গ্রাউন্ডেই প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
৪২৯

৬৬. আমি ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফের একটি যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদানের চেষ্টা করবাে, যেহেতু তা আইন প্রণেতাদের অভিপ্রায়কে তুলে ধরবে এবং যা সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের অধীন ক্রান্তিকালীন এবং সাময়িক বিধান গ্রহণ করার রীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এখানে সংবিধানের ক্রান্তিকালীন এবং সাময়িক বিধান বলতে প্রাক-সাংবিধানিক আইনসমূহ এবং মার্শাল ল’ রেগুলেশনস এবং আদেশসমূহ ইত্যাদি এবং সামরিক শাসন চলাকালীন বাংলাদেশে যে আইনসমূহ প্রণীত হয়েছিল সেগুলােকে বােঝানাে হয়েছে।
৬৭. সামরিক আইনের ধারণাটি আমাদের সংবিধান থেকে দূরে। আমাদের সংবিধান কখনই সামরিক আইন আরােপের কথা বলে না। যদিও এটা সত্য যে, বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল এবং তখন বহু মাশাল ল’ প্রক্লেমেশনস, প্রবিধান এবং আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। ঐরূপ সামরিক শাসন চলাকালীন বহু কার্যাবলি মাশাল ল’ প্রক্লেমেশনস এবং আইন ইত্যাদিও উপর ভিত্তি করে করা হয়েছিল। সুতরাং, এই সকল কার্যাবলির সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য এগুলােকে সাংবিধানিক বৈধতা, অনুমােদন এবং নিশ্চিতকরণ প্রদান করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। সামরিক আইন জারি করার মাধ্যমে বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানাে হয়েছিল এবং সাংবিধানিক অনুমােদন বহির্ভূত একটি নতুন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ফলস্বরূপ ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফের সহায়তায় এটিকে সংবিধানের আওতাভুক্ত করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে সামরিক আইন চলাকালীন যা কিছু করা হয়েছিল, সেগুলােকে ভূতাপেক্ষ অনুমােদন দেয়া হয়েছিল। এই প্যারাগ্রাফগুলাে ইনডেমনিটি অ্যাক্টের মতােই, যেটি প্রত্যেকবার সামরিক শাসন জারির পর গৃহীত হয়েছিল এবং সেই সময়ে কৃত সকল কার্যাবলিকে অনুমােদন এবং বৈধতা প্রদান করেছিল।
৬৮. আমি ৩এ প্যারাগ্রাফের উপ-প্যারাগ্রাফ (৭) উদ্ধৃত করবাে, যা নিম্নরুপ :
“All laws in force immediately before the revocation of the said Proclamations and withdrawal of Martial Law shall, subject to the Proclamation revoking the said Proclamations and withdrawing the Martial Law, continue in force until altered, amended or repealed by the competent authority”.
“Subject to the proclamation revoking the said proclamations and withdrawing the Martial Law” এই অভিব্যক্তিটির মাধ্যমে এটা বুঝানাে হয়েছে যে, যদি সামরিক শাসন চলাকাল বলবৎ থাকা “all laws in force” এবং যে প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে সামরিক আইন বাতিল এবং প্রত্যাহার করা হয়েছে তার মধ্যে কোনাে বিরােধ সৃষ্টি হয়, তাহলে শেষেরটিই প্রাধান্য পাবে। প্রকৃতপক্ষে, “আইনসমূহ” এবং মার্শাল ল’ প্রক্লেমেশনের মধ্যে কোনাে বিরােধ নেই। এই আইনগুলােকে ততক্ষণ পর্যন্ত সুরক্ষিত এবং বলবৎ রাখা হয়েছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না এগুলাে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিবর্তিত অথবা বাতিল না হয়েছিল। ৩এ প্যারাগ্রাফের(৮) উপ-প্যারাগ্রাফটি উল্লিখিত প্রক্লেমেশনস, মার্শাল ল’ রেগুলেশনস এবং মার্শাল ল’ অর্ডারস, যেগুলাে সামরিক শাসন চলাকালীন প্রণয়ন করা হয়েছিল, সেগুলাের ক্ষেত্রে জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট, ১৮৯৭ এর প্রয়ােগ সম্পর্কে বলেছে। কিন্তু, জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টটিকে আইন’-এর ক্ষেত্রে প্রযােজ্য করা হয়নি, যা পরিষ্কারভাবে এটাই নির্দেশ করে যে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিবর্তিত, সংশােধিত অথবা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আইনের প্রভাব অব্যাহত থাকবে।। এর উপ-প্যারাগ্রাফ (১০) আইনকে সংজ্ঞায়িত করেছে যেগুলাের মধ্যে পড়ে অর্ডিন্যান্স, রুলস, রেগুলেশনস, বাই-লজ, অর্ডারস, নােটিফিকেশনস এবং অন্যন্য ইট্রুমেন্টস, আইনে যেগুলাের
৪৩০

কার্যকারিতা রয়েছে। এই উপ-প্যারাগ্রাফটি সাব-অর্ডিনেট আইনগুলােকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, সাংবিধানিক কোনও আইনকে নয়। ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফের উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর ঐ আইনসমূহের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলাে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাতিল, পরিবর্তিত অথবা সংশােধিত না হয়। যদি ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফগুলাে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হতাে, তাহলে সাংবিধানিক বিধান এবং আইনের ক্ষেত্রে চরম বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতাে। এমে সাংবিধানিক বিধানের অন্তর্বর্তীকালীন পরিসমাপ্তি ঘটতাে এবং আলােচ্য সময়কাল সংবিধানের বাইরে চলে যেত। সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদান করা ব্যতীত কীভাবে মার্শাল ল’ রেগুলেশনস এবং সামরিক আইনের অধীনে গৃহীত কার্যাবলি এবং ঐ সময়কালে সামরিক আদালত কর্তৃক আরােপিত দণ্ডসমূহকে যেত? আমি মনে করি যে, প্রক্লেমেশনের মাধ্যমে সামরিক আইন বাতিল এবং প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেটির সাথে অর্ডিন্যান্সটির কোনাে বিরােধ নেই। সামরিক আইন বাতিল হয়ে যাওয়ায় সাধারণ দেওয়ানি আইনের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে।
৬৯. সুতরাং, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সংবিধানে ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফসমূহ সন্নিবেশিত করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, যা কিছুকে সুরক্ষা এবং বৈধতা প্রদান করা হয়েছিল, সেগুলাে ব্যতীত চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮নং প্যারাগ্রাফের আর কোনাে কিছু অনুসন্ধান করার সুযােগ নেই। চতুর্থ তফসিলে এরূপ অন্তভুক্তির অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে, লিগ্যাল ফিশন থিওরি প্রয়ােগের মাধ্যমে সামরিক আইন এবং এর প্রবিধানসমূহকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করা। সুতরাং, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত এই অনুমােদন এবং বৈধতা প্রদানকারী ক্লজেস এর মাধ্যমে অর্ডিন্যান্সটিকে সংবিধানের অংশে পরিণত করা হয়নি, বরং এটিকে কেবলমাত্র সাংবিধানিক বৈধতা এবং নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে। ৩এ প্যারাগ্রাফের (৫) উপ-প্যারাগ্রাফে এই অভিপ্রায়টিই ব্যক্ত হয়েছে যে, সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর, সংশােধন এবং পরিবর্তনসহ সংবিধানের কার্যক্রম নিরবিচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত থাকবে।
৭০. এই ইনডেমনিটি অ্যাক্টটি শুধুমাত্র অতীতের অবৈধ কার্যাবলিকে ন্যায্যতা প্রদানের জন্যই প্রণীত হয়নি, বরং তা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সকালে যারা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের সাথে যুক্ত ছিল এবং সামরিক আইন জারি করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত বা অন্য কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল। A.V. Dicey তাঁর “The Law of the Constitution, 10th Edition” শীর্ষক বইয়ের ২৩৩ পৃষ্ঠায় অ্যাক্ট অব ইনডেমনিটিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন যে, “though it is the legislation of illegality, it itself a Law | সুতরাং, এটা প্রতীয়মান হয় যে, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স-এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সকালে সংঘটিত নির্দিষ্ট কিছু অবৈধ কাজকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। এটা অনুমান করতে হবে যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ একটি বৈধ অধ্যাদেশ, যা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। এটা অবশ্যই বলতে হবে যে, সাংবিধানিক আইন এবং সাধারণ আইন’ এর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, অর্ডিন্যান্সটি নিজে একটি সাধারণ আইন এবং সাংবিধানিক বিধানসমূহের ধারণাগত কিছু স্বতন্ত্র এবং গুণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা সাধারণ আইনে পরিলক্ষিত হয় না।।
৭১. আইনসভা তার প্রজ্ঞায় ভেবেছিল যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ একটি সাধারণ আইন, যেটিকে বাতিল ঘােষণা করা উচিত এবং ফলস্বরূপ, ১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর ইনডেমনিটি (রিপিল) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ এর মাধ্যমে এটিকে রহিত করা হয়েছিল। এই অর্ডিন্যান্সটি অন্যান্য সকল অর্ডিন্যান্সের মতােই
৪৩১

যেগুলাে সামরিক আইন চলাকালীন জারি করা হয়েছিল এবং যেগুলাে সংসদের আইন সংশােধন, পরিবর্তন অথবা বাতিল করার যে ক্ষমতা রয়েছে তার অন্তর্গত। এরূপ প্রত্যেক সংশােধনের জন্য সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করার প্রয়ােজনীয়তা নেই। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই এরূপ অর্ডিন্যান্স রহিত করার জন্য যথেষ্ট, কারণ এটি একটি বিদ্যমান সাধারণ আইন।
৭২. অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনাব কোরবান আলী যে যুক্তি প্রদর্শন করেছেন সেটির কোনাে ভিত্তি নেই। এই দুইটি রিট পিটিশনে অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনাে বিবৃতি দৃশ্যমানভাবে অনুপস্থিত। আরজিতে অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে যেহেতু কিছু বলা নেই, সেহেতু, বিজ্ঞ আইনজীবীর এই যুক্তিটি ভিত্তিহীন। অসৎ উদ্দেশ্যের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ঘটনা উল্লেখে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এছাড়াও, যেহেতু অর্ডিন্যান্স প্রণয়নের ক্ষমতা একটি আইনি ক্ষমতা, সেহেতু, অসৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরূপ যুক্তি বিভ্রান্তিমূলক। K. Nagraj Vs. State of A.P., AIR 1985 Supreme Court 551 মামলায় এই সিদ্ধান্ত দেয় হয় যে :
“The legislature, as a body, cannot be accused of having passed a Law for an extraneous purpose. Its reasons for passing a Law are those that are stated in the Objects and Reasons and if none are so stated, as appear from the provisions enacted by it. Even assuming that the executive, in a given case, has an ulterior motive in moving a legislation, that motive cannot render the passing of the Law malafide. This kind of transferred malice is unknown in the field of legislation.”
G.C. Kanungo Vs. State of Orissa, A.I.R. ১৯৯৫ S.C. ১৬৫৫ মামলায় বলা হয়েছে যে, একটি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভার অসৎ বা অন্য কোনাে উদ্দেশ্য ছিল এরূপ কোনও অভিযােগ কখনই সেই আইনটিকে অসাংবিধানিক আইনে পরিণত করতে পারে না।
৭৩ Doctrine of colourable legislation এর অর্থ হলাে, আইনসভা পরােক্ষভাবে এমন কোনও আইন প্রণয়ন করতে পারবে না, যেটি তারা প্রত্যক্ষভাবে প্রণয়ন করতে পারে না। যেহেতু, আমি বলেছি যে, অর্ডিন্যান্স বাতিল করার সাধারণ ক্ষমতা আইনসভার রয়েছে, সেহেতু, কোনােভাবেই এ মামলাটিতে colourable exercise of legislative power এর প্রশ্ন উত্থাপনের আদৌ কোনও সুযােগ নেই। আইনসভা যথার্থভাবেই একটি সাধারণ আইন হিসেবে অর্ডিন্যান্সটিকে রহিত করেছে। আমার উপরে উল্লেখিত বক্তব্যের পর চতুর্থ তফসিলের ৩এ এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফ সংশােধন নিয়েও কোনাে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযােগ নেই। বিচারপতি মােহাম্মদ আবদুর রউফ : আমার মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক লিখিত মূল রায়টি এবং আমার বিজ্ঞ ভ্রাতাবৃন্দ মাননীয় বিচারপতি মােস্তাফা কামাল এবং মাননীয় বিচারপতি লতিফুর রহমান কর্তৃক লিখিত রায়টির সম্পূরক অংশ পড়ার সুযােগ হয়েছে।
৭৫. বিবেচনার জন্য যে বিষয়সমূহ আমাদের সামনে উত্থাপন করা হয়েছিল সেগুলাে সম্পর্কে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে মূল রায়ে ব্যাখ্যা এবং সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে। আমি আর কোনাে কিছু যােগ করতে চাইছি না এবং উভয় আপিল খারিজ করে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবং মাননীয় বিচারপতি মােস্তাফা কামাল যে রায় দিয়েছেন সেটির সাথে সম্পূর্ণ একমত পােষণ করছি।
৪৩২

বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী : আমার মাননীয় প্রধান বিচারপতি কর্তৃক লিখিত রায় এবং মাননীয় বিচারপতি মােস্তাফা কামাল এবং মাননীয় বিচারপতি লতিফুর রহমান কর্তৃক লিখিত রায় পড়ার সুযােগ হয়েছে।
৭৭. আমাদের সামনে দুটো সাংবিধানিক প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে :-
(১) সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ নং প্যারাগ্রাফ বলে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের অংশে পরিণত হয়েছিল কি না এবং
(২) সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের কম সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হওয়া ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬-এর দ্বারা অর্ডিন্যান্সটি বাতিল করা সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের লঙ্ন ছিল কি না।।
৭৮. মাননীয় প্রধান বিচারপতি সম্পূর্ণভাবে এই আপিলসমূহে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলাের মীমাংসা করেছেন। আমি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ নং প্যারাগ্রাফটির বৈধতা বিবেচনা না করেই তার রায়ের সাথে একমত পােষণ করেছি, কারণ এ বিষয়টি আমাদের সামনে উত্থাপিত হয়নি।
৪৩৩

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের
সদস্যবৃন্দের হত্যার বিচার বিষয়ে
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
আপীল বিভাগের চূড়ান্ত রায় (বাংলায় অনূদিত) মেজর বজলুল হুদা বনাম রাষ্ট্র, ৬২ ডিএলআর
আপিল বিভাগ (২০১০), পৃ. ১,

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
আপীল বিভাগ
২০০৭ সালের ৫৫-৫৯ নম্বর ফৌজদারি আপিল, তৎসহ ২০০৭ সালের ২ নম্বর জেল আপিল, তৎসহ ২০০১ সালের ৮ নম্বর ফৌজদারি বিবিধ পিটিশন, তৎসহ ২০০০ সালের ৩ নম্বর ফৌজদারি রিভিউ পিটিশন।
মেজর মাে. বজলুল হুদা (আর্টিলারি)
………. আপিলকারী লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান
……… আপিলকারী
লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (অব.)
•••••• আপিলকারী
লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দীন আহমেদ (সেকেন্ড আর্টিলারি)
…….. আপিলকারী
মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ
…. আপিলকারী
বনাম
রাষ্ট্র ………… রেসপনডেন্ট (সকল মামলায়)

রায়ের তারিখ : ১৯ নভেম্বর ২০০৯

বিচারপতিবৃন্দ
বিচারপতি মাে. তাফাজ্জল ইসলাম
বিচারপতি মাে. আবদুল আজিজ
বিচারপতি বি. কে. দাস
বিচারপতি মাে. মােজাম্মেল হােসেন
বিচারপতি এস কে সিনহা

আপিলকারী পক্ষের আইনজীবীবৃন্দ
খান সাইফুর রহমান, সিনিয়র অ্যাডভােকেট (ইন্ট্রাকটেড বাই অ্যাডভােকেট অন রেকর্ড নূরুল ইসলাম ভুইয়া এবং নওয়াব আলী)
আব্দুর রেজাক খান, সিনিয়র অ্যাডভােকেট (ইট্রাকটেড বাই অ্যাডভােকেট অন রেকর্ড নওয়াব আলী)।
আব্দুল্লাহ্ আল মামুন, অ্যাডভােকেট (ইট্রাকটেড বাই অ্যাডভােকেট অন রেকর্ড মােঃ নূরুল ইসলাম ভুইয়া এবং মােঃ নওয়াব আলী)
৪৩৬

রেসপনডেন্ট/রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীবৃন্দ
মাহবুবে আলম, অ্যাটর্নি-জেনারেল (সকল মামলার)
এ. কে. এম. জহিরুল হক, অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল
এ. এস. এম. আব্দুল মবিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
মােঃ মােতাহের হােসেন সাজু, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
মাহফুজা বেগম, অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
সরদার মােঃ রাশেদ জাহাঙ্গীর, অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
মােঃ একরামুল হক, অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
এ. বি. এম. আলতাফ হােসাইন, অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
খােন্দকার দিলীরুজ্জামান, অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী, অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
(উপরােক্ত অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অ্যাসিস্টেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ইন্ট্রাকটেড বাই অ্যাডভােকেট অন রেকর্ড সুফিয়া খাতুন)

আনিসুল হক, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট চিফ প্রসিকিউটর)
মােশাররফ হােসেন কাজল, অ্যাডভােকেট
আবদুল মতিন খসরু, অ্যাডভােকেট
নুরুল ইসলাম সুজন, অ্যাডভােকেট
শেখ ফজলে নূর তাপস, অ্যাডভােকেট
তৌফিকা করিম, অ্যাডভােকেট
মমতাজ উদ্দিন মেহেদী, অ্যাডভােকেট
এনামুল কবির ইমন, অ্যাডভােকেট
ইমতিয়াজ উদ্দিন আসিফ, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর-এর সাথে)

আজমালুল হােসেন কিউ সি, সিনিয়র অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)
তৌফিক নেওয়াজ, সিনিয়র অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)
মােঃ মহসিন রশিদ, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর-এর সাথে)
এ. এফ. এম. মেসবাহ উদ্দিন, সিনিয়র অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)
ইউসুফ হােসেন হুমায়ুন, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)
মােঃ আবু জাফর সিদ্দিক, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)
জাহাঙ্গীর হােসেন সেলিম, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)
এস. এম. রেজাউল করিম, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)
রবিউল আলম বুদু, অ্যাডভােকেট (গভর্নমেন্ট প্রসিকিউটর)।
৪৩৭

নাসেরকে উপরতলা থেকে নামিয়ে অফিসসংলগ্ন বাথরুমে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের ২ নম্বর সাক্ষী রমা ওরফে আবদুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতির কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকেও নিচে আনা হয়। শেখ রাসেল এজাহারকারীর সঙ্গে ছিল। সে তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চাইলে সেনাবাহিনীর একজন লােক তাকে এজাহারকারীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং তার মায়ের কাছে নিয়ে যাবার কথা বলে উপরে নিয়ে যায়। এরপর এজাহারকারী ফের গুলির আওয়াজ শুনতে পান।
এরপর বজলুল হুদা গেইটের কাছে যায় এবং ফারুক রহমানের জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে জানায়, সবাইকে শেষ করা হয়েছে। এজাহারকারী বুঝতে পারে যে, রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দসহ বাড়ির অন্যান্য নিকটজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঐ সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় ট্যাঙ্কগুলাে কালাে পােশাকধারী সেনাসদস্যদের নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। প্রায় সকাল ৮টার সময় কর্নেল জামিলের মৃতদেহ সেখানে নিয়ে আসা হয়। এজাহারকারী দেখছিলেন মেজর ডালিম বাড়ির মধ্যে সেনাসদস্যদের সাথে কথা বলছিল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রি. তারিখ সকালবেলা রাষ্ট্রপতি, বেগম মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রােজী জামাল, শেখ নাসের এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসারগণকে ঐ বাড়িতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এজাহারকারী ঘটনার পরপরই। লালবাগ থানায় এজাহার দায়ের করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। পরিশেষে, দীর্ঘদিন পর, এজাহারকারী বিগত ০২.১০.১৯৯৬ তারিখ ধানমন্ডি পুলিশ স্টেশনে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের ঘটনার বিষয়ে এজাহার দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করে, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে, খসড়া মানচিত্র ও সূচি প্রস্তুত করে, আলামত জব্দ করে, সাক্ষীদের পরীক্ষা করেন এবং তাদের জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করে। কতিপয় অভিযুক্তর স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করার জন্য তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট উপস্থাপন করে এবং পরিশেষে এই আপিলকারীগণসহ মােট ২০ জন আসামির বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২/১০২বি/৩২৪/৩০৭/২০১/৩৮০/১৪৯/৩৪/১০৯ ধারায় অভিযােগপত্র দাখিল করে।
৩. যে ১৯ জন আসামি বিচারের মুখােমুখি হয়েছিল তাদের মধ্যে ১৪ জন পলাতক ছিল। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিগণের নিকট এটা প্রতীয়মান হয়েছিল যে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি হয়েছিল এবং যখন পুলিশ তাদের কোথাও খুঁজে পাচ্ছিল না তখন তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধান অনুযায়ী ক্রোক করা হয় এবং এভাবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৮৭ এবং ৮৮ ধারার শর্তসমূহ প্রতিপালিত হয় এবং যেহেতু আসামিরা পলাতক ছিল, সেহেতু পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৩৯বি ধারার বাধ্যবাধকতা প্রতিপালিত হয়েছে। নথি পৃষ্ঠে প্রতীয়মান হয়, আসামিদের আদালতে উপস্থিত করার জন্য সকল সম্ভাব্য এবং বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।
৪. বিজ্ঞ দায়রা জজ ০৭.০৪.১৯৯৭ তারিখের ১৫ নম্বর আদেশবলে আসামিদের বিরুদ্ধে নিমােক্ত অভিযােগ গঠন করেন।

প্রথম অভিযােগ :
আসামিরা প্রয়াত খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, প্রয়াত মাহবুবুল আলম চাষী, রিসালদার সৈয়দ সারােয়ার হােসেন ও ক্যাপ্টেন এম মােস্তফা হােসেনের যােগসাজশে তাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভের প্রতিবিধান করা, যৌথস্বার্থ হাসিল করা এবং অবৈধ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিগত পদমর্যাদা বৃদ্ধি ও উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের
৪৩৯

তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর আত্মীয়স্বজন ও পরিবার-পরিজনদের হত্যা করার জন্য ১৯৭৫ সালের মার্চ মাস থেকে বিভিন্ন তারিখে ও বিভিন্ন স্থানে যথা ঢাকা সেনানিবাসে লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদের বাসভবনে, কুমিল্লার বার্ড-এ, গাজীপুরের সালনায়, খােন্দকার মােশতাক আহমদের গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দি থানার দাসপাড়ায় ও ঢাকার ৫৪ নম্বর আগা মসিহ লেনের বাসভবনে, রমনা পার্কে, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের সেনানিবাসস্থ বাসভবন ও অন্যান্য স্থানে একত্রে মিলিত হয় ও ষড়যন্ত্র করে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্টের দিবাগত রাতে ক্যান্টনমেন্ট থানার অন্তর্গত বালুঘাটে সমবেত হয় এবং নিজেদের ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করতে গিয়ে আসামিরা ১৫ আগস্ট সকালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবার পরিজনসহ ১১ ব্যক্তিকে হত্যা করে। এভাবে তারা পেনাল কোডের ১২০বি ধারার অধীন একটি অপরাধ সংঘটিত করে।

দ্বিতীয় অভিযােগ :
উক্ত পূর্বকল্পিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন এবং নিজেদের অভিন্ন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে (উক্ত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করতে) প্রথম অভিযােগে উল্লিখিত আসামিরা প্রয়াত খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, প্রয়াত মাহবুবুল আলম চাষী, রিসালদার সৈয়দ সারওয়ার হােসেন ও ক্যাপ্টেন এম মােশতাক আহমেদের যােগসাজশে তাদের ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ এবং যৌথস্বার্থ ও উচ্চাভিলাষ হাসিল করার জন্য ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান, স্টেনগান, রাইফেলের মতাে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর রােডস্থ ৬৭৭ নম্বর বাড়িটিতে হামলা চালায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল, রােজী জামাল ও ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে। তাছাড়া তারা পুলিশের এএসআই সিদ্দিকুর রহমান, সেনাবাহিনীর সিপাই শামসুল হক এবং রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব কর্নেল জামিলকেও হত্যা করে এবং এভাবে তারা পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারায় শাস্তিযােগ্য অপরাধ সংঘটিত করে।
৫. বিচারিক আদালতের বিজ্ঞ জজ স্বেচ্ছায় সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট করার অভিযােগে পেনাল কোডের ২০১ ধারায় আরেকটি অভিযােগও গঠন করেন।
৬. বিচারিক আদালতে উপস্থিত আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) অভিযােগসমূহের ব্যাপারে নিজেদের নির্দোষ দাবি করে এবং বিচার প্রার্থনা করে। তাদের পছন্দ অনুযায়ী নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীরা তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করেন এবং অন্যদিকে রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত বিজ্ঞ | আইনজীবীরা বাকি ১৪ জন পলাতক আসামির আত্মপক্ষ সমর্থন করেন।
৭. রাষ্ট্রপক্ষ ৬১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে কয়েকজন সাক্ষীকে টেন্ডার্ড করা হয় এবং আসামিপক্ষ তাদের জেরা করেনি। আসামিপক্ষ কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করেনি। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হবার পর কাঠগড়ায় উপস্থিত তিন আপিলকারীকে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা করা হয়। এ সময় তারা জবাবে পুনরায় নিজেদের নির্দোষ দাবি করে। জেরার ধরন থেকে যেটি পাওয়া যায় তা হলাে আসামিপক্ষ অভিযােগসমূহ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল এবং আপিলকারীরা নির্দোষ এবং যেভাবে ঘটনা সম্পর্কে অভিযােগ করা হয়েছে ঘটনা সেভাবে ঘটেনি; সেনাবাহিনীর কিছু লােকের সফল বিদ্রোহের পরিণতি হিসেবে ঘটনাটি ঘটেছে।
৪৪০

৮. বিচারিক আদালত অতঃপর প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং মামলার প্রকৃত ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিগত ০৮.১১.১৯৯৮ তারিখে প্রদত্ত রায় ও আদেশ দ্বারা চারজন আসামি, যথা ১) তাহের উদ্দীন ঠাকুর, ২) অনারারি ক্যাপ্টেন এ ওয়াহাব জোয়ার্দার, ৩) দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও ৪) এলডি মাে. আবুল হাশেম মৃধাকে (পলাতক) খালাস প্রদান করেন এবং বাকি ১৫ জন আসামিকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারা ও ১২০খ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন এবং আপিলকারীরাসহ এই ১৫ জন দোষী সাব্যস্ত আসামির সবাইকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং তাদের প্রতি পেনাল কোডের ১২০বি ধারায় পৃথক কোনাে দণ্ডাদেশ আরােপিত হয়নি। আপিলকারীগণসহ উপরােক্ত ১৫ জন আসামি পেনাল কোডের ২০১ ধারার অভিযােগে দোষী প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে ঐ অভিযােগ থেকে খালাস দেওয়া হয়।
৯. দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশের তর্কিত রায় ও আদেশ দ্বারা সংক্ষুব্ধ হয়ে আপিলকারী ফারুক রহমান ১৯৯৮ সালের ২৬১৬ নম্বর ফৌজদারি আপিল দায়ের করে, আপিলকারী সুলতান শাহরিয়ার ১৯৯৮ সালের ২৬০৪ নম্বর ফৌজদারি আপিল দায়ের করে এবং আপিলকারী মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ১৯৯৮ সালের ১৬১৭ নম্বর ফৌজদারি আপিল দায়ের করে। আপিলকারী বজলুল হুদা মামলার বিচারকালে যদিও পলাতক ছিল, তথাপি ব্যাংককে তার বিরুদ্ধে বন্দি বিনিময় কার্যপ্রক্রিয়ার দ্বারা বিচারিক আদালতের রায় ঘােষণার দিন অর্থাৎ ০৮.১১.১৯৯৮ তারিখে তাকে ব্যাংকক থেকে ঢাকায় ফেরত আনা হয়। সে তার প্রতি আরােপিত দোষী সাব্যস্তকরণ আদেশ ও দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে নিয়মিত আপিল হিসেবে ১৯৯৮ সালের ২৬১৩ নম্বর ফৌজদারি আপিল দায়ের করে।
১০. পরবর্তীকালে দুজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স ও উপরােক্ত চারটি আপিল মামলার সব কটির শুনানি একত্রে অনুষ্ঠিত হয়। দুই বিচারকের মধ্যে প্রিজাইডিং বিচারক বিচারপতি মাে. রুহুল আমীন বর্তমান আপিলকারীদের এবং তাদের সঙ্গে আরও চারজনকে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ১৯৯৭ সালের ৩১৯ নম্বর দায়রা মামলায় বিচারিক আদালত কর্তৃক প্রদত্ত পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারা এবং ১২০বি ধারায় আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ডাদেশ দিয়ে যে রায় প্রদান করা হয়েছিল তা বহাল রাখেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতির সংশােধন সাপেক্ষে বর্তমান আপিলকারীদের মধ্যে চারজনসহ আরও চারজনের ক্ষেত্রে ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করেন। তিনি ডেথ রেফারেন্স আংশিকভাবে গ্রহণ করেন এবং পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারা ও ১২০বি ধারায় আপিলকারী মহিউদ্দীনসহ (আর্টিলারি) ৫ আসামির দণ্ডাদেশ এবং সাজা বাতিল করেন এবং তদনুযায়ী কেবল তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ডেথ রেফারেন্সটি গ্রহণ করা হয়নি।
১১.বেঞ্চের অপর বিচারক বিচারপতি জনাব খায়রুল হক অবশ্য আপিলকারীসহ আসামি ১৫ জনের সবাইকে আনীত অভিযােগের ব্যাপারে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তদনুযায়ী বিচারিক আদালতের প্রদত্ত রায় ও সাজা বহাল রাখেন এবং ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করেন।
১২. ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্স এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত আপিলগুলাের ক্ষেত্রে রায় দ্বিধাবিভক্ত হওয়ায় উপরােক্ত ডেথ রেফারেন্স ও সংশ্লিষ্ট আপিলগুলাে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারায় বিধান অনুযায়ী প্রয়ােজনীয় আদেশের জন্য মাননীয় প্রধান বিচারপতি সমীপে পেশ করা হয়। মাননীয় প্রধান বিচারপতি তখন ডেথ রেফারেন্স ও তৎসম্পর্কিত আপিলগুলাে নিষ্পত্তি করার জন্য বিচারপতি ফজলুল করিমকে তৃতীয় বিচারক হিসাবে নিয়ােগ প্রদান করেন।
৪৪১

১৩. তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক তখন কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার বিধান অনুযায়ী মাত্র ৬ জন আসামির ক্ষেত্রে উপরােক্ত ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানি করেন। এই ৬ আসামির মধ্যে আপিলকারী মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল, যার বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা দ্বিধাবিভক্ত রায় দিয়েছিলেন।
১৪. তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক শুনানির পর মামলার ঘটনা, পরিস্থিতি এবং নথিভুক্ত তথ্য-প্রমাণাদি বিবেচনা করে এই অভিমত দেন যে, রাষ্ট্রপক্ষ আসামি মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাসেম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন এবং আনীত অভিযােগের বিষয়ে তারা নির্দোষ সাব্যস্ত হওয়ায় তিনি তাদের অভিযােগ থেকে খালাস প্রদান করেন। তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক অবশ্য আপিলকারী মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মােসলেম উদ্দীন ওরফে মােসলেহউদ্দীনকে পেনাল কোডের ১২০বি/৩০২ এবং ৩৪ ধারায় আনীত অভিযােগের বিষয়ে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পােষণ করে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে প্রদত্ত তাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং তদনুযায়ী তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করেন এবং আসামি লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৭ নম্বর ফৌজদারি আপিলটি খারিজ করেন। ঢাকার বিজ্ঞ দায়রা জজ ১৯৯৭ সালের ৩১৯ নম্বর দায়রা মামলায় আসামি ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, মেজর আহমদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করে যে দণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক তা বাতিল করে দেন। তিনি বিচারপতি মাে. রুহুল আমিনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে তাদেরকে নির্দোষ সাব্যস্ত করেন এবং তদনুযায়ী ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার ও মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত ডেথ রেফারেন্সটি গ্রহণ করেননি।
১৫. মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) দেশের বাইরে পলাতক থাকায় তার অনুপস্থিতিতেই বিচার সম্পন্ন করে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে সে গ্রেফতার হয়। তাকে দেশে। ফেরত আনা হয় এবং কারাগারে প্রেরণ করা হয়। সে ২০০৭ সালের ৯ নম্বর জেল পিটিশন দাখিল করে। পরবর্তী পর্যায়ে সে বিলম্ব মওকুফের একটি আবেদন পেশ করে উল্লেখ করে যে, এই মামলা এবং তাকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা প্রদানের রায় সম্পর্কে সে কিছুই জানত না। রাষ্ট্র একটি এফিডেভিট দাখিল করে এর বিরােধিতা করে। দু পক্ষের বক্তব্য শুনানির পর বিলম্ব মওকুফ হওয়ায় সে ২০০৭ সালের ৩৪৩ নম্বর ক্রিমিনাল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল দায়ের করে যা ২০০১ সালের ক্রিমিনাল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নম্বর ৯৫, ৯৬, ৯৭ ও ৯৮-এর সঙ্গে একত্রে একই সাথে শুনানি হয়।
১৬. লিভ টু আপিলের জন্য উপরে উল্লিখিত সকল পিটিশনে আইনের একই প্রশ্ন ও তথ্য উত্থাপিত হওয়ায় সেগুলাে সম্পর্কে একটি আদেশ দ্বারা লিভ মঞ্জুর করা হয়। লিভ মঞ্জুরের আদেশ নিম্নরূপ :
“(ক) ডেথ রেফারেন্স ও তৎসম্পর্কিত ফৌজদারি আপিলসমূহ বিবেচনায় নিয়ােজিত হাইকোর্ট ডিভিশনের ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকরা দুটি পৃথক ও সমান্তরাল রায় দিয়েছেন এবং নিজ নিজ রায়ে স্বাক্ষর করেছেন। পৃথকভাবে স্বাক্ষরিত এই দুটি আলাদা আলাদা রায়কে হাইকোর্ট ডিভিশনের রায় বলে গণ্য করা যায় না। এ থেকে দেখা যায় বিজ্ঞ বিচারকরা ভিন্নমত অবলম্বন করে রায় (dissenting judgments) দিয়েছেন এবং এটা বিজ্ঞ বিচারকদের ১৪.১২.২০০০
৪৪২

তারিখে প্রদত্ত আদেশ থেকে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে যে, ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্সে তাদের প্রদত্ত রায়টি ছিল একটি দ্বিধাবিভক্ত রায়। তদানুযায়ী বিজ্ঞ বিচারকরা প্রয়ােজনীয় আদেশ/নির্দেশের জন্য বিষয়টি মাননীয় প্রধান বিচারপতির নিকট প্রেরণ করেন। অতঃপর মাননীয় প্রধান বিচারপতি ডেথ রেফারেন্সটি সামগ্রিকভাবে নিষ্পত্তি অর্থাৎ ১৫ জন দোষী সাব্যস্ত আসামির মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য ১৫.১.২০০১ তারিখে এক আদেশ দ্বারা বিচারপতি মােহাম্মদ ফজলুল করিমকে তৃতীয় বিচারক হিসেবে নিয়ােগ প্রদান করেন। বিষয়টির এই পটভূমিতে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ এই দৃঢ় অভিমত পােষণ করেছেন যে, ডেথ রেফারেন্স মামলাটি সামগ্রিকভাবে নিষ্পত্তির জন্য তৃতীয় বিচারকের কাছে পাঠানাে হয়েছিল। কাজেই বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক শুধু ছয়জন দোষী সাব্যস্ত আসামির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আইনগত ভুল করেছেন যার ফলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ব্যর্থ হয়েছে।
(খ) ঘটনাটি ঘটেছিল ১৫.৮.১৯৭৫ তারিখে ভােরবেলায়। অথচ এজাহারকারী রাষ্ট্রপক্ষের ১ নম্বর সাক্ষী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম ঘটনা সংঘটিত হবার পর সার্বক্ষণিক ঢাকায় ছিলেন এবং ঘটনার পর ১৯৭৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গভবনে অভ্যর্থনাকারী হিসেবে যােগ দেন এবং দীর্ঘ ২১ বছরেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ০২.১০.১৯৯৬ তারিখে এজাহার দায়ের করার আগ পর্যন্ত তিনি চাকরিরত ছিলেন। এজাহার দায়েরের এই অযৌক্তিক বিলম্ব থেকে রাষ্ট্রপক্ষের এই অসৎ উদ্দেশ্য ও দুরভিসন্ধি ফুটে ওঠে যে, আবেদনকারীদের অন্যায়ভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে বানােয়াট ও সাজানাে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগসহ নিম্ন আদালত ঘটনার সাথে দণ্ডিত আবেদনকারীদের সংশ্লিষ্টতা বিচারকালে এবং তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা প্রদানের ক্ষেত্রেও এই দিকটি বিবেচনায় নিতে ব্যর্থ হয়ে ভুল করেছেন।
(গ) মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ ও বিষয়াদি থেকে যদিও দেখা যায় যে, এটি কোনাে সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল , বরং তা ছিল একটি বিদ্রোহ, যার পরিণতিতে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিল। তথাপি দরখাস্তকারীসহ দোষী ব্যক্তিদের সাধারণ হত্যা মামলার মতাে সাধারণ ফৌজদারি আদালতে বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। কাজেই বিচারটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ।
(ঘ) মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ ও বিষয়াদি থেকে প্রতীয়মান হবে যে, এখানে হত্যার জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের কোনাে বিষয় ছিল না, যা ছিল তা হচ্ছে তদানীন্তন মুজিব সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিদ্রোহ সংঘটনের একটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। সুতরাং দণ্ডিত দরখাস্তকারীদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত দণ্ড বাতিলযােগ্য।
(ঙ) দণ্ডিত দরখাস্তকারীদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২ ধারা, তৎসহ ৩৪ ধারার অধীনে আনীত | হত্যার অভিযােগ যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়নি এবং এর ফলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়েছে।”
বিচার চলাকালেই প্রতীয়মান হয়েছে যে, রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের সাক্ষ্য, আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দেওয়া দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি, রাষ্ট্রপক্ষের ১৫ ও ৮ নম্বর সাক্ষী কর্তৃক প্রমাণিত বিচারবহির্ভূত স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি (extra-judicial confession), ইলেক্ট্রনিক সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে আপিলকারীসহ অপরাপর আসামির
৪৪৩

বিরুদ্ধে মামলাটি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল। অন্যদিকে আপিলকারীরা ও অপর আসামিরা প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল যে, তারা নির্দোষ এবং উপরােক্ত তিন আপিলকারীর দোষ স্বীকারােক্তির জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ছিল না। তদানীন্তন সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর এক সফল বিদ্রোহের পরিণতিতে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজন নিহত হয়েছিলেন।
তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক কর্তৃক পুরাে রেফারেন্সটি সকলের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ কেবল দণ্ডিত ৬ জনের পরিবর্তে দণ্ডিত ১৫ জনের বিষয়ে শুনানি করা উচিত ছিল- এই যুক্তি সম্পর্কে আপিলকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণের অভিন্ন নিবেদন হলাে এই যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকরা যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন রায় দিয়েছেন তাই তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের উচিত ছিল পুরাে ডেথ রেফারেন্সটির ওপর শুনানি গ্রহণ করা।
কিন্তু তিনি কেবল ৬ জন আসামির ক্ষেত্রেই রেফারেন্সটির শুনানি করেছেন। কাজেই ডেথ রেফারেন্স ও আপিলগুলাের নতুন করে শুনানির জন্য বর্তমান রেফারেন্স এবং সেই সঙ্গে আপিলগুলাে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের কাছে পুনঃপ্রেরণ (remand) করা উচিত।
১৭. আপিলকারী ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীন (আর্টিলারি)-এর বিজ্ঞ আইনজীবী খান সাইফুর রহমান নিবেদন করেন যে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি আংশিক রেফারেন্স নয় বরং পুরাে ডেথ রেফারেন্সটি নিষ্পত্তির জন্য তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের নিকট পাঠিয়েছিলেন। কাজেই তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের সম্পূর্ণ রেফারেন্সটির ওপর শুনানি করা উচিত ছিল। তর্কিত রায়টি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযােগ্য কোনাে রায় নয়, কারণ বিজ্ঞ বিচারকগণ কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৭ ধারার বিধানাবলি লঙ্ঘন করে আলাদা আলাদাভাবে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং সেই অভিমতে স্বাক্ষর করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণ যেহেতু ডেথ রেফারেন্স এবং সেই সঙ্গে আপিলসমূহের শুনানি করেছেন, কাজেই কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ এই উভয় ধারাই এক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে এবং সে কারণে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের অভিমতই হবে চূড়ান্ত অভিমত এবং এর ভিত্তিতেই আবশ্যিকভাবে রায় ও আদেশ হতে হবে, যা বর্তমান আপিলসমূহের ক্ষেত্রে প্রতিপালিত হয়নি। আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) ক্ষেত্রে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের অভিমতটি কোনােভাবে একটি সমবর্তী অভিমতও নয়, বিশেষ করে যখন প্রথম বিজ্ঞ বিচারক তাদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি অবিশ্বাস করেছেন, দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক যেখানে তা বিশ্বাস করেছেন।
১৮. আপিলকারী সুলতান শাহরিয়ারের পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুর রাজ্জাক খান আরাে নিবেদন করেন যে, দণ্ডাদেশের উপর হাইকোর্ট বিভাগের সর্বসম্মত অনুমােদন না থাকায় বর্তমান আপিলসমূহে আইনের দৃষ্টিতে দণ্ডাদেশ অনুমােদিত হয়নি মর্মে গণ্য হবে। মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণের অভিমতকেও ‘রায়’ বলে গণ্য করা যায় না। এক্ষেত্রে Muhammad Shafi os The Croan 6 DLR (WP) 104 (FB) 478 Abdur Raziq vs State 16 DLR (WP) 73 Navona no 36301504 যে, দণ্ডাদেশ অনুমােদনের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা দিলে তৃতীয় বিচারকের মতামতই চুড়ান্ত বলে গণ্য হবে যা এক্ষেত্রে হয়নি। হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণ Hethubha vs State of Gujarat AIR 1970 SC 1266, Union of India vs Ananti Padmanabhaiah (1971) SCC (Crl) 533, Sajjan Singh vs State of UP (1999 SCC 315 (Cri) 44 978 Mahim Mandal vs State 15 DLR 615 Tony নীতিমালা বিবেচনায় নেননি এবং দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা বহাল রেখে ভুল করেছেন।
১৯. মেজর মাে. বজলুল হুদা ও মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)-এর পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী আবদুল্লাহ আল-মামুন এক্ষেত্রে খান সাইফুর রহমান ও আবদুর রেজাক খান কর্তৃক পেশকৃত বক্তব্য সমর্থন করেন।
৪৪৪

২০. রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী (চিফ প্রসিকিউটর) জনাব আনিসুল হক এই মর্মে বক্তব্য পেশ করেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণ যে ছয়জন আসামির ক্ষেত্রে মতামত দিতে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন, শুধু সেই ছয়জন আসামির মামলার শুনানি করে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক অত্যন্ত যৌক্তিক কাজ করেছেন; কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৭ ধারাটিতে কেবল কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৪ ধারায় প্রদত্ত রেফারেন্সের ক্ষেত্রে অনুমােদনের পদ্ধতির কথাই বলা আছে। কোড অব ক্রিমিনাল। প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারায় ব্যবহৃত যা তিনি উপযুক্ত মনে করেন এবং ‘অভিমত অনুসারে রায় ও আদেশ প্রদান করতে হবে’- বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ এবং উপরােক্ত বক্তব্যগুলাে সতর্কতার সাথে বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, যে মামলার ব্যাপারে কোনাে মতপার্থক্য নেই অথবা কোনাে মতপার্থক্য আছে সেই মামলাটি নিষ্পত্তি করার জন্য আইনসভা তৃতীয় বিচারককে বিস্তৃত স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রদান করেছে এবং রায় ও আদেশ এরূপ মতামতকেই অনুসরণ করবে। বর্তমান আপিলসমূহে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে ০৬.০২.২০০১ তারিখে প্রদত্ত আদেশে বলেছেন যে, উপরােক্ত ৯ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি যাদের ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারকগণ দ্বিধাবিভক্ত মতামত প্রকাশ করেননি তাদের মামলার বিষয়টি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার বিধানাবলির আলােকে শুনানির জন্য বিবেচনা করা হয়নি। তবে শুধ আসামি আবদুল মাজেদের মামলাটিতে পেনাল কোডের দুটি পৃথক ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্তকরণের ব্যাপারে মতপার্থক্য আছে এবং অপর পাঁচ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির (condemned prisoners) মামলাগুলাে, যাদের ব্যাপারে অভিমত প্রকাশে বিজ্ঞ বিচারকগণ সমভাবে বিভক্ত …’ এবং তদনুযায়ী তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারায় বর্ণিত শর্তাবলির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আপিলকারীগণসহ ৯ দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তির দণ্ডাদেশ অনুমােদন করে রেফারেন্স ও আপিলগুলাে যথাযথভাবে নিষ্পত্তি করেছেন।
২১. উপরােক্ত বক্তব্যের সমর্থনে জনাব আনিসুল হক কয়েকটি মামলার বিষয়ে উল্লেখ করেন। সেগুলাে হচ্ছে:
Babu vs State of UP (AIR 1965 SC 467), Union of India vs Ananti Padmanabhaiah AIR 1971 SC 1836, Tanviben Pankajkumar Divctia vs State of Gujarat (1997) 1 SCC 156 = AIR 1997 SC 2193, Sharat Chandra Mirta vs Emperor ILR 38 Cal 202, Ahmed Sher vs Emperor, AIR 1931 Lah 513, Subedor Singh vs Emperor AIR 1943 Allahabad 272, Nemai Mandal vs State of West Bengal AIR 1966 Cal 194, State of UP vs Dan Singh (1997) 3 SCC 747, Granda Venkata vs Corporation of Calcutta (22 CWN 745), State vs Abul Khair 44 DLR 284 1 উক্ত বক্তব্য সমর্থন করে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল ও জনাব আজমালুল হােসেন কিউ.সি. আরও কিছু যুক্তি উত্থাপন করেন এবং কয়েকটি সিদ্ধান্তের উদ্ধৃতি দেন। জনাব আজমালুল হােসেন বলেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ নম্বর ধারার মধ্যে এই দিক দিয়ে মৌলিক পার্থক্য আছে যে, ৩৭৮ ধারায় যেখানে ‘বিচারকগণের একটি বেঞ্চ’ কথাটা ব্যবহার করা হয়েছে, সেখানে ৪২৯ ধারায় ব্যবহার করা হয়েছে ‘আপিল আদালত গঠনকারী বিচারকগণ’। আবার ৪২৯ ধারাটিতে ‘একই আদালতের কথাগুলাে ব্যবহার করা হয়নি, যেমন ব্যবহার করা হয়েছে অপর ধারাটিতে। বিজ্ঞ আইনজীবী আরাে বলেন যে, একটা রেফারেন্সের ওপর অন্তত দুজন বিচারক কর্তক শুনানি হওয়া দরকার হয় এবং ৩৭৮ ধারায় ব্যবহৃত ‘বিচারকদের বেঞ্চ কথাটার অর্থ হলাে কোনাে দণ্ডাদেশ কার্যকর হবার জন্য অন্তত দুজন বিচারকের দ্বারা অনুমােদিত ও স্বাক্ষরিত হতে হবে এবং ৩৭৪-৩৭৮ ধারাগুলাে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পাঠ করলে এই দাঁড়াবে যে, তৃতীয় বিচারকের মতামতের প্রশ্নটা তখনই আসে যখন বেঞ্চের বিচারকদের মতামতে পার্থক্য দেখা
৪৪৫

দেয় এবং যে ক্ষেত্রে কোনাে নির্দিষ্ট আসামি বা আসামিদের ব্যাপারে মতামতের পার্থক্য থাকে না সেক্ষেত্রে তৃতীয় বিচারকেরও মামলা বা মতামত প্রদানসংক্রান্ত কিছু করার থাকে না।
২৩. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৪, ৩৭৬, ৩৭৭, ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার বিধানসমূহ নিচে তুলে ধরা :
“374. Sentence of death to be submitted by Court of Session- When the Court of
Session passes sentence of death, the proceedings shall be submitted to the High Court Division and the sentence shall not be executed unless it is confirmed by the High Court Division.”
“376. Power of High Court Division to confirm sentence or annul conviction- In any case submitted under section 374, the High Court Division
(a) may confirm the sentence, or pass any other sentence warranted by law,
or
(b) may annul the conviction, and convict the accused of any offense of
which the Sessions Court might have convicted him, or order a new S t rial on the same or an amended charge, or
(c) may acquit the accused person :
Provided that no order of confirmation shall be made under this section until the period allowed for preferring an appeal has expired, or, if an appeal is presented within such period, until such appeal is disposed of.”
“377. Confirmation of new sentence to be signed by two Judges-In every case so submitted, the confirmation of the sentence, or any new sentence or order passed by the High Court Division, shall, when such Court consists of two or more judges, be made, passed and signed by at least two of them.”
“378. Procedure in case of difference of opinion- When any such case is heard
before a bench of Judges and such Judges are equally divided in opinion, the case, with their opinions thereon, shall be laid before another Judge, and such Judge, after such hearing as he thinks fit shall deliver his opinion, and the judgment or order shall follow such an opinion.”
“429. Procedure where Judges of Court of Appeal are equally divided- When the Judges composing the Court of Appeal are equally divided in opinion, the case, with their opinions thereon, shall be laid before another Judge of the same Court, and such Judge, after such hearing (if any) as he thinks fit, shall deliver his opinion, and the judgment or order shall follow such opinion.”
৪৪৬

উপরােক্ত বর্ণনাসমূহে দেখা যায় যে, দায়রা আদালত কোনাে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৪ ধারায় সেই দণ্ডাদেশ অনুমােদনের জন্য মামলার কার্যক্রম হাইকোর্ট বিভাগের কাছে পেশ করতে হবে। ৩৭৪ ধারায় কোনাে মামলার কার্যক্রম পর্যালােচনাকালে হাইকোর্ট বিভাগ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আপিল করেছে কি করেনি সেটা বিবেচনা না করে নিজ থেকেই তার আপিল আদালত হিসেবে ক্ষমতা প্রয়ােগ করে কাজ করেন এবং সে অনুযায়ী সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালােচনা করে আসামি দোষী না নির্দোষ সে সম্পর্কে হাইকোর্ট বিভাগকে একটা স্বাধীন উপসংহারে পৌছাতেই হয়। হাইকোর্ট বিভাগের মৃত্যুদণ্ড অনুমােদনের ক্ষমতা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৬ নম্বর ধারাতেই দেওয়া হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আসামিকে দণ্ডাদেশ প্রদান করা যুক্তিযুক্ত হয়েছে কিনা এবং মামলার পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যৌক্তিক হয়েছে- এই মর্মে নিজের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের ওপর একটি দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে।
২৪. এটিও প্রতীয়মান হয় যে, যদিও কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের সপ্তবিংশ অধ্যায়ে ৩৭৮ ধারাটি ‘দণ্ডাদেশ অনুমােদনের জন্য পেশের বিষয়ে শিরােনামে অন্তর্ভুক্ত এবং ৪২৯ ধারাটি আপিল সম্পর্কে শিরােনামে একত্রিশতম অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত, তথাপি উভয় ধারায় ব্যবহৃত ভাষা প্রায় একই রকম। উভয় ধারায় বর্ণিত তিনি যেমন উপযুক্ত মনে করেন’- কথাগুলাের দ্বারা এটা বােঝানাে হয়েছে যে, তৃতীয় বিচারক যেরূপ উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে তিনি মতপার্থক্য নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। সে অনুযায়ী তিনি যদি মনে করেন যে, বিচারকরা যেখানে দ্বিধাবিভক্ত মতামত প্রদান করেননি এমন অভিযুক্ত আসামির ক্ষেত্রে যুক্তিতর্ক শােনার কোনাে প্রয়ােজন নেই তাহলে সেই শুনানির ব্যাপারে তিনি অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। আরও প্রতীয়মান হয় যে, উভয় ধারায় বর্ণিত সমভাবে বিভক্ত’ শব্দাবলির অর্থ হচ্ছে এই যে, একজন আসামির অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা কিংবা তার বিরুদ্ধে গঠিত অভিযােগ কিংবা যে কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়ে বিচারকদের অভিমতের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে। তবে নির্দিষ্ট একজন আসামির ব্যাপারে। এবং যে অপরাধের অভিযােগ আনা হয়েছে সে বিষয়ে বিচারকরা যখন পরস্পরের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছান সে ক্ষেত্রে এ কথা বলা যায় না যে, বিচারকরা অভিযুক্ত আসামির ব্যাপারে সমভাবে বিভক্ত।
২৫. ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিভিন্ন হাইকোর্টের অভিমত হলাে এই যে, আরেকজন বিচারকের কাছে যা পেশ করা হয়েছে তা হলাে মামলা’ এবং দ্বিতীয়ত, সেই মামলার রায় বা আদেশ ঐ বিচারকের দেওয়া অভিমতকে অনুসরণ করবে এবং তৃতীয় বিচারকের রায়ই চূড়ান্ত রায় বলে গণ্য হবে।
২৬. Sarat Chandra Mitra os Emperor ILR 38 Cal 202 মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় যে :
“আমি দুই দরখাস্তকারীর বিচারের প্রশ্নে উদ্বিগ্ন নই, যেখানে আপিল আদালতের বিচারকগণ একজনের ক্ষেত্রে তাঁদের অভিমত প্রদানে একমত পােষণ করতে পারেন, অন্যদিকে অপরজনের ক্ষেত্রে বিচারকগণ সমভাবে বিভক্ত হতে পারেন। এরকম অস্পষ্টতার মধ্যেও এরূপ অভিমত দেওয়া বহাল রাখা সম্ভব যে, মামলা’ শব্দটার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যায় অন্য বিচারকের নিকট যা পেশ করা হয়েছে তা হচ্ছে হাজতি আসামির মামলা, যার বিষয়ে বিচারকগণ সমভাবে বিভক্ত ছিলেন। আমি এখন শুধু সেই অনিশ্চিত অবস্থাটা নিয়ে চিন্তা করছি যেখানে আপিল আদালতের বিচারকগণ একজন আসামি কর্তৃক অপরাধ সংঘটন প্রশ্নে অভিমত প্রদানের ক্ষেত্রে ইতােমধ্যেই বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, যদিও মামলার কতিপয় বিষয়ে তাঁরা একমত। এরূপ অস্পষ্টতার মধ্যে অন্য বিচারকের নিকট যা পেশ করা
৪৪৭

হয়েছে তা হচ্ছে মামলা, এটা সেই বিষয় বা বিষয়াবলি নয় যেখানে বিচারকগণ সমভাবে বিভক্ত অভিমত প্রদান করেছিলেন। এটা স্পষ্টতই বােঝায় যে, কোনাে নির্দিষ্ট একজন আসামির প্রশ্নে পুরাে মামলাটিই তৃতীয় বিচারকের নিকট পেশ করা হয়েছে এবং তৃতীয় বিচারকের দায়িত্ব হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় বিবেচনা করে মামলায় তাঁর অভিমত প্রদান করা।” Ahmed Sher vs Emperor AIR 1931(Lah) 513, Subedar Singh vs Emperor, AIR 1943 All 272, Nenai Mandal vs State of West Bengal, AIR 1966 Cal 194 মামলাগুলােতেও উপরােক্ত পর্যবেক্ষণসমূহ অনুসৃত হতে দেখা গেছে।
২৭. Mohini Mandal of State, 15 DIR 615 মামলায় অবশ্য দেখা গেছে, কোড অব ক্রিমিনাল
প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারায় বর্ণিত মতানৈক্য আসামি দোষি না নির্দোষ সেই বিষয়েও হতে পারে কিংবা যথাযথ দণ্ডাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও হতে পারে। তা যে ব্যাপারেই হােক না কেন, মতানৈক্য থাকায়। দুটি ধারা অনুযায়ী অন্য বিচারকের নিকট রেফারেন্স পাঠাতে হবে। মামলাটি যে বিচারকের নিকট তাঁর অভিমতের জন্য পেশ করা হবে তিনি আসামির পুনর্বিচারের আদেশ দেওয়াসহ উপযুক্ত বলে বিবেচিত যে কোনাে আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার রাখেন অথবা দণ্ডাদেশ অনুমােদন করতে গিয়ে একজন বিচারক কোনাে একটি নির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ না করেও আসামিকে দণ্ডাদেশ ও সাজা প্রদানের বিষয়টি গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দণ্ডাদেশ বা সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে মতানৈক্য রয়েছে।।
২৮. Babu vs State (পূর্বোক্ত) মামলায় তৃতীয় বিচারকের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ক্ষমতার বিষয়টি ভারতের সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের বিবেচনার জন্য উত্থাপিত হয়েছিল। সেই মামলায় তিন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যাপারে ডিভিশন বেঞ্চে মতপার্থক্য ঘটেছিল এবং বেঞ্চ থেকে দুটি পৃথক পৃথক রায় প্রদান করা হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্টে আপিলের গ্রহণযােগ্যতার প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়। সে সম্পর্কে নিমােক্ত অভিমত দেওয়া হয়-
“৪২৯ ধারা অনুসারে তৃতীয় বিচারকই নির্ধারণ করবেন তিনি কোন কোন বিষয়ের যুক্তিতর্ক শুনবেন এবং এটা স্বীকৃত যে মতানৈক্য নিরসনের ক্ষেত্রে তিনি যা উপযুক্ত মনে করেন তা করার ব্যাপারে তিনি স্বাধীন। আমাদের মতে এজাহার প্রশ্নে বিচারপতি টাকরুর এটা বলা যথেষ্ট ছিল যে, প্রয়ােজন থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি নির্ধারণে তিনি তা বিবেচনা করেননি। কিন্তু বিচারপতি মাথরুর যা বলেছেন তার সবকিছুর সাথে তিনি একমত ছিলেন। এমতাবস্থায় বিচারপতি টাকরুর সিদ্ধান্ত যথাযথ ছিল এবং এজাহার বিষয়ে আলােচনা করা বা এ বিষয়ে সংশয়ের উপর ভিত্তি করে সার্টিফিকেট দেওয়া যায় না।”
২৯. Hethubha (পূর্বোক্ত) মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট নিমােক্ত অভিমত দিয়েছেন :
“Babu vs State of uttar Pradesh, (1965) 2 SCR 771= AIR 1965 SC 1467 মামলায় এই আদালত বলেছিলেন যে, কোন কোন বিষয়ের ওপর যুক্তি-তর্কের শুনানি হবে তা তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকই নির্ধারণ করবেন। সুতরাং তিনি যেভাবে উপযুক্ত মনে করবেন সেভাবে মতপার্থক্য নিরসন করার ব্যাপারে তিনি স্বাধীন। বিচারপতি মেহতা এখানে গােটা মামলাটি পর্যালােচনা করেছেন। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারায় বলা আছে যে, আপিল আদালতের বিচারকরা অভিমত দেওয়ার ক্ষেত্রে যখন সমভাবে বিভক্ত থাকেন তখন তাদের অভিমতসহ মামলাটি একই আদালতের অন্য একজন বিচারকের নিকট পেশ করতে হবে এবং সেই বিচারক যদি কোনাে যুক্তি-তর্ক থাকে তবে তা শুনানির পর উপযুক্ত অভিমতটি দেবেন এবং রায় ও আদেশ ঐ অভিমতের অনুগামী হবে।
৪৪৮

এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়; প্রথমত, মামলাটি অন্য একজন বিচারকের নিকট পেশ করা হবে এবং দ্বিতীয়ত, রায় ও আদেশ তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের অভিমতের অনুগামী হবে। অতএব এটা সুস্পষ্ট যে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক পুরাে মামলাটি বিচার করবেন বা করতে পারবেন।”
৩০. Ananti Padmanabhaiah (পূর্বোক্ত) মামলায় দেখা গেছে যে, আসাম ও নাগাল্যান্ড হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ প্রথম দুটি যুক্তি সর্বসম্মতিক্রমে নাকচ করে দিয়েছিলেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তদন্তকারী সংস্থাকে মামলাগুলাের তদন্ত করার অনুমতি দেওয়ার সময় চিন্তাভাবনা করে দিয়েছিলেন কিনা এবং ১৯৬-এ ধারায় অনুমােদন প্রয়ােজন ছিল কিনা এ দুটো বিষয়ে অভিমত দিয়ে গিয়ে বেঞ্চের বিচারকরা বিভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। বিষয়টি তখন তৃতীয় বিচারকের নিকট পেশ করা হয়। তৃতীয় বিচারক অভিমত দেন যে, তদন্তকারী সংস্থাকে তদন্ত পরিচালনার অনুমতি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ করেছেন এবং সেই কারণে তিনি মামলার কার্যধারা বাতিল (quash) করে দেন। তর্কিত প্রশ্নটা ছিল এই যে, দিল্লির ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক তদন্ত পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি আগে যেখানে ডিভিশন বেঞ্চে উত্থাপিত হয়নি, সেখানে বিষয়টি তৃতীয় বিচারকের কাছে উত্থাপন করা যায় কি না। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি এ এন রায় এ ব্যাপারে Hethubha মামলায় গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গি অনুমােদন করেছিলেন। সেই মামলায় পরিলক্ষিত হয় যে, তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক পুরাে মামলাটিই বিচার করতে পারেন। এক্ষেত্রে আইনে কোনাে বিরােধ নেই এবং মামলাটির বিচার করা তৃতীয় বিচারকের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা। মামলার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে যদি কোনাে বিষয় উত্থাপিত হয় তবে তিনি সেই বিষয়টিও নিষ্পত্তি করতে পারবেন। ভারতে ১৯৭৩ সালে সংশােধনীর দ্বারা ৪২৯ ধারার স্থলে ৩৯২ ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে :
“৩৯২ আপিল আদালতের বিচারকরা যেখানে সমভাবে বিভক্ত সেখানকার কার্যবিধি এই অধ্যায়ের অধীনে কোনাে আপিলের শুনানি যখন হাইকোর্টের বিচারকদের বেঞ্চে হয় এবং বিচারকরা অভিমত দিতে গিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েন তখন তাদের অভিমতসহ আপিলটি সেই আদালতের অপর একজন বিচারকের কাছে পেশ করা হবে এবং সেই বিচারক যেমন উপযুক্ত মনে করবেন সেভাবে শুনানি অনুষ্ঠানের পর তার অভিমত প্রদান করবেন এবং রায় ও আদেশ সেই অভিমতকে অনুসরণ করবে।” “শর্ত থাকে যে, বেঞ্চের বিচারকদের একজন কিংবা যেখানে আপিলটি এই ধারায় আরেক বিচারকের কাছে পেশ করা হয়েছে তখন সেই বিচারক যদি প্রয়ােজন মনে করেন তাহলে
বিচারকদের বৃহত্তর একটি বেঞ্চে মামলাটির নতুন করে শুনানি ও নিষ্পত্তি হবে”।
এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, উপরােক্ত একটি শর্ত যােগ করার ফলে ডিভিশন বিচারকদের একজন কিংবা ভারতের হাইকোর্টের তৃতীয় বিচারক প্রয়ােজন মনে করলে নতুন করে শুনানি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আপিলটির ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য একটি বৃহত্তর বেঞ্চে প্রেরণ করতে পারেন। আমার মতে, ভারতের সুপ্রীম কোর্টের পরস্পরবিরােধী বক্তব্য সম্পর্কে সংশয় দূর করার লক্ষ্যে আইনসভা ঐ শর্ত বা দফাটি যােগ করে এই সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে কোনাে বিষয় বা বিষয়াবলি নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে ডিভিশন বেঞ্চ যদি প্রয়ােজন মনে করেন তাহলে আপিলটি নতুন করে শুনানির জন্য বৃহত্তর একটি বেঞ্চের কাছে পাঠাতে পারেন এবং অনুরূপভাবে তৃতীয় বিচারক ডিভিশন বেঞ্চের নিষ্পত্তিকৃত আপিল মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনাে বিষয়ে বেঞ্চের অভিমতের সঙ্গে একমত না হলে তাঁকে আপিলটি বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠানাের অনুরূপ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
৪৪৯

৩১. Taiben Pankaj Kumar Dioetia 0s State of Gujarat মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেয়া হয় যে,
“৩৯২ (আমাদের ৪২৯ ধারা) ধারা সাদামাটাভাবে পাঠ করলেই পরিষ্কার বােঝা যায় যে, তৃতীয় বিচারক কোন কোন বিষয়ের ওপর যুক্তি-তর্ক শুনবেন তা তিনিই নির্ধারণ করবেন এবং এ কথার মধ্য দিয়ে এটা অপরিহার্যরূপে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে, তৃতীয় বিচারক যেভাবে উপযুক্ত মনে করবেন সেভাবেই মতানৈক্য দূর করে আপিলটির নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে স্বাধীন।”
৩২. State of uPV Dan Singh, (1997) 3 SCC 747 মামলায় অবশ্য সুপ্রীম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলাে বিবেচনা না করেই নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন-
তৃতীয় বিচারক যখন সামগ্রিকভাবে আপিলের শুনানি করেন তখন তার অভিমত দেওয়ার ঐচ্ছিক ক্ষমতাই শুধু থাকে না, উপরন্তু কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৯২ ধারার শর্ত অনুযায়ী তিনি বিচারকদের বৃহত্তর একটি বেঞ্চে আপিলটির পুনঃশুনানি ও নিষ্পত্তি চাইতে পারেন। এটা এই বিধান অনুযায়ী একটা উপায় যা দুই বিচারক যথা বিচারপতি বি এন কাটজু ও বিচারপতি রাজেশ্বর সিংয়ের যে কোনাে একজনের প্রয়ােগ করার সুযােগ ছিল। কিন্তু তারা তা প্রয়ােগ না করতে মনস্থ হন। এ থেকে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় যে, তৃতীয় বিচারকের অভিমত অনুসারে যে রায় ও আদেশ দেওয়া হয় তার দ্বারাই আপিলের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে। এই অবস্থায় হাইকোর্ট তার ১৯.৫.১৯৮৮ তারিখের চূড়ান্ত আদেশ দ্বারা আপিলটি নিষ্পত্তি করার পরই কেবল বিশেষ লিভ পিটিশন দাখিল করা যেতে পারে। উক্ত আদেশটি যদিও ৩২ জন আসামির মধ্যে মাত্র ১০ জনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে অভিপ্রেত, তারপরও আদেশটি পূর্বেকার ১৫.৪.১৯৮৭ তারিখের আদেশের সঙ্গে পাঠ করতে হবে এবং আইনে এর ফলটা হবে এই যে, ১৯.৫.১৯৮৮ তারিখের আদেশটি চূড়ান্ত আদেশরূপে গণ্য হবে। ঐ আদেশে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয় এবং ৩২ জন আসামির মধ্যে দুজন আসামিকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩২৫ ধারা তৎসহ ৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং বাকি আর সব আসামিকে খালাস প্রদান করা হয়।
৩৩. Sajjan Singh (1999) SCC (Cri) 44 মামলায়ও সুপ্রীম কোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ Babu-র AIR 1965 SC 1467 এবং Hetubha মামলা, AIR 1970 SC 1266-তে গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। তাঁরা তৃতীয় বিচারকের দেওয়া অভিমত অনুমােদন করেননি এবং নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেন-
“আইনের বিবরণ এখন যথেষ্ট স্পষ্ট। সংবিধানের ২৩৬ অনুচ্ছেদ বা ১৩৪ অনুচ্ছেদ বা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৯ ধারার অধীনে বিশেষ লিভ পিটিশন আকারে এই আদালতে দায়েরকৃত আপিলের রায়ের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিচারকের অভিমতটাই প্রকৃত গুরুত্ব বহন করে। সুতরাং, তৃতীয় বিচারক কর্তৃক পুরাে মামলাটি স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করে দেখার প্রয়ােজন হয় এবং এ কথা বলা চলে যে, তিনি ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারকের দুই অভিমতের সেই অংশটি দ্বারা বাধ্য যেখানে কোনাে পার্থক্য নেই। বস্তুত তৃতীয় বিচারক ডিভিশন বেঞ্চের এ ধরনের কোনাে অভিমতের দ্বারা বাধ্য নন। তিনি বিষয়টি এমনভাবে শুনানি করবেন না, যেন তিনি তিন বিচারকের বেঞ্চে বসে আছেন যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমত প্রাধান্য পাবে। সুতরাং, আমাদের অভিমত হচ্ছে ডিভিশন বেঞ্চের দুজন বিচারক যে তিন আপিলকারী গদরাজ সিং, মেহেরবান সিং ও বাবু সিংকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন এবং তাদের দণ্ডাদেশ ও সাজা বহাল রেখেছিলেন তাদের ব্যাপারে বিচারপতি প্রসাদের দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক ছিল না এবং এক্ষেত্রে তার হাত বাঁধা ছিল না।”
৪৫০

অবশ্য উপরােক্ত পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও Sajjan Singh-এর মামলায় আদালত তৃতীয় বিচারকের অভিমতের ক্ষেত্রে এই যুক্তিতে হস্তক্ষেপ করেননি যে, তিন আপিলকারীর সবার ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আমরা সবিস্তারে শুনেছি বিধায়, যখন আপিলকারীদের মাত্র সামান্য কয়জন বিচারপতি প্রসাদের গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে বলা যেতে পারে তখন এই পর্যায়ে বিষয়টি পুনঃপ্রেরণ করা বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি না”। সুপ্রীম কোর্ট অতঃপর গুণাগুণের ভিত্তিতে আপিলটি শুনানি শেষে খারিজ করে
দিয়েছিলেন।
৩৪. State Vs Abdul Khair (পূর্বোক্ত) মামলায় তিনজন আসামির মধ্যে একজন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল এবং অপর দুজন মােটরবাইক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদেরকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু আপিলে বিভক্ত রায় দিতে গিয়ে একজন বিজ্ঞ বিচারক অপর দুই আসামিকে খালাস দিয়েছিলেন। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারার অধীনে আপিল মামলায় তৃতীয় বিচারক যে লােকটি হত্যা করেছিল, সেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বাদ দিয়ে কেবল অপর দুজনের মামলার শুনানি করেছিলেন।
৩৫. Nernai Mondal Vs State of West Bengal AIR 1966 Cal 194 মামলায় অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। সেই মামলায় বলা হয়েছিল যে, ভিন্ন ভিন্ন অভিমতসহ মামলাটি তৃতীয় বিচারকের কাছে পেশ করা হয়। তৃতীয় বিচারকের কর্তব্য হচ্ছে, যেসব বিষয়ে দুই বিচারকের মতপার্থক্য ঘটেছে শুধু সেই বিষয়গুলােই নয়, বরং মামলাটি নিষ্পত্তি করা।
৩৬._Bhagat Ram Vs State of Rajasthan AIR 1972 SC 1502 মামলায় পেনাল কোডের ১২০বি, ২১৮, ৩৪৭ ও ৩৮৯ ধারার অধীনে আনীত অপরাধের অভিযােগ থেকে দুই আসামি বি(B) এবং আর(R)-এর খালাসের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার যে আপিল দায়ের করেছিল তা খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে পেনাল কোডের ১৬১ ধারা ও দুর্নীতি দমন আইনের (Prevention of Corruption Act) ৫ (১)(এ) ধারার অধীনে অপরাধের ক্ষেত্রে ‘বি’কে খালাস দেওয়ার আদেশের যথার্থতা নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকদের মধ্যে মতপার্থক্য হওয়ায় বিষয়টি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারার অধীনে তৃতীয় একজন বিচারকের কাছে পাঠানাে হয়। উপরােক্ত অবস্থায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এই পর্যবেক্ষণ দেন যে, ১২০বি, ২১৮ ও ২৪৭ ধারার অধীনে অপরাধের ক্ষেত্রে আসামি ‘বি’-এর খালাসের বিষয়টি নতুন করে উন্মুক্ত করা তৃতীয় বিচারকের দায়িত্ব নয়। কেননা এই মামলায় বিচারিক আদালতের বিচারকের দেওয়া খালাসের আদেশ বহাল রেখে ডিভিশন বেঞ্চ সুস্পষ্ট আদেশ প্রদান করেছেন এবং যেহেতু পুরাে মামলাটি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারার অধীনে তৃতীয় বিচারকের কাছে পাঠানাে হয়নি, সেহেতু তৃতীয় বিচারক শুধু মতপার্থক্যের বিষয়টিই বিবেচনা করে নিজ উপসংহারে
পৌছাতে পারেন।
৩৭. Muhammad Shafi Vs The Croon 6 DLR (WP) 104 (FB) মামলায় আপিলকারীদের আনীত আপিলে বিজ্ঞ বিচারকরা এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হন যে, “তৃতীয় বিচারক একটি বিচারকদের বেঞ্চের কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করেছেন এবং সেই কারণে সিন্দ কোর্ট অ্যাক্টের ১২ ধারার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁর নিজেকে একজন একক বিচারক হিসেবে মনে না করে একটি বেঞ্চ হিসাবে গণ্য করা উচিত।” আমি মনে করি উপরােক্ত মামলার দৃষ্টান্তটি এই মামলায় প্রয়ােগের কোনাে যুক্তি নেই।
৩৮. Abdur Raziq Vs State 16 DLR (WP) 73 মামলায় পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার কোথাও বর্ণিত নেই যে, কোনাে বিচারক কর্তৃক আসামির
৪৫১

অনুকূলে অভিমত দেওয়া হলে তৃতীয় বিচারককে সেই অভিমত অনুসরণ করতে হবে কিংবা তিনি তা অনুসরণ করতে পারেন। কিন্তু এই ধারণাটি মেনে নেওয়া হলে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারায় “সেই বিচারক শুনানির পর তাঁর বিবেচনায় যা উপযুক্ত তেমন অভিমত দেবেন এবং রায় বা আদেশ সেই অভিমত অনুযায়ী হবে”- এই কথাগুলাে ব্যবহার করার কোনাে প্রয়ােজন হবে না।
৩৯. এখানে উল্লেখ্য যে, Babu-র মামলায় (AIR 1965 SC 1467) ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের গৃহীত অভিমতে এই বিষয়টি দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়েছে এবং পরবর্তী মামলাগুলােতেও এই মামলায় উক্ত সিদ্ধান্তটি অনুসৃত হয়েছে। তাই ঐ অবস্থান থেকে সরে আসার কোনাে অকাট্য যুক্তি নেই। কারণ ঐ অবস্থানটি আইনের বিধানাবলির সঠিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।।
৪০. অধিকন্তু এটি যদি ধরে নেওয়া হয় যে, তৃতীয় বিচারকের উচিত ছিল সব দণ্ডিত আসামির রেফারেন্সের শুনানি করা, তারপরও যেহেতু আমরা Sajjan Singh-এর মামলায় (পূর্বোক্ত) যেমন করা হয়েছিল তেমনিভাবে আপিলকারীদের আপিল গুণাগুণের ভিত্তিতে সবিস্তারে শুনানি করেছি, তাই এ কথা বলার উপায় নেই যে, আপিলকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৪১. রায়’-এর ক্ষেত্রে পেশকৃত বক্তব্য থেকে দেখা যায়, ছয় আসামিকে দোষী সাব্যস্তকরণ নিয়ে মতপার্থক্য থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ডিভিশন বেঞ্চে ১৪ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে নিমােক্ত আদেশ জারি করেন-
“ডেথ রেফারেন্স আংশিক গ্রহণ করা হয়েছে, ২০০০ সালের ২৬০৪, ১৯৯৮ সালের ২৬১৩ এবং ১৯৯৮ সালের ২৬১৬ নম্বর ফৌজদারি আপিল খারিজ করা হয়েছে। বিচারপতি মােঃ রুহুল আমিন কর্তৃক ১৯৯৮ সালের ২৬১৭ নম্বর ক্রিমিনাল লিভ টু আপিল পৃথক রায়ের মাধ্যমে মঞ্জুর করা হয়।
“(বিও) বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক কর্তৃক ডেথ রেফারেন্স অংশত গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৮ সালের ক্রিমিনাল লিভ টু আপিল নম্বর ২৬০৪, ২৬১৩, ২৬১৬ এবং ২৬১৭ খারিজ করা হয় পৃথক রায়ের মাধ্যমে।”
(বিও) “১৪.১২.২০০০। ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্সের রায় বিভক্ত হওয়ায় কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারার বিধান অনুযায়ী প্রয়ােজনীয় আদেশ জারির জন্য বিষয়টি মাননীয় প্রধান বিচারপতি সমীপে পেশ করা হােক।”

বিচারপতি মাে. রুহুল আমিন
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক

৪২. এরপর আপিলকারীরা ন্যায়বিচারের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সকল বন্দি সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্সের শুনানি প্রার্থনা করে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের নিকট দরখাস্ত পেশ করে এবং শুনানির পর তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক বিজ্ঞ আইনজীবীর বক্তব্য সবিস্তারে শােনেন এবং তারপর ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০১ তারিখের আদেশ দ্বারা আবেদনটি নিমােক্ত যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করেন :
“উপরের আলােচনা এবং ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকগণের সমভাবে বিভক্ত অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে আমার অভিমত এই যে, উক্ত নয়জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি, যাদের ব্যাপারে অভিমত
৪৫২

প্রদানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারকগণ বিভক্ত নন, তাদের মামলাগুলাে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার বিধানাবলির আলােকে শুনানির প্রয়ােজন নেই। তবে শুধু আসামি আব্দুল মাজেদের ব্যাপারে পেনাল কোডের দুটি পৃথক ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা নিয়ে যে মতপার্থক্য রয়েছে সেটি সংশ্লিষ্ট মামলাটি এবং অপর পাঁচ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি, যাদের ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারকরা মতামত দিতে গিয়ে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন অর্থাৎ একজন বিজ্ঞ বিচারক দোষী সাব্যস্ত করেছেন ও অন্য বিজ্ঞ বিচারক খালাস দিয়েছেন তাঁদের মামলাগুলাে অভিমত প্রদানের জন্য এই আদালতের সম্মুখে রয়েছে। এই আদালত কর্তৃক অভিমত প্রদানের পর পুরাে ডেথ রেফারেন্সটি নিষ্পত্তির জন্য রায় ও আদেশ সেই অভিমতকে অনুসরণ করবে।”
৪৩. এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আপিলকারীরা তৃতীয় বিচারকের উপরােক্ত আদেশের ব্যাপারে আপত্তি করেনি এবং তাদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ এরপর আপিল ও ডেথ রেফারেন্স সংক্রান্ত যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছিলেন। এরপর তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক শুনানি শেষে নিমােক্ত অভিমত প্রদান করেন :
“এই রায়ের গর্ভে উপরােক্ত আলােচনা, যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে আমার অভিমত এই যে, ঢাকার বিজ্ঞ দায়রা জজ আসামি লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মােসলেমউদ্দীন ওরফে মােসলেউদ্দীনকে পেনাল কোডের ১২০বি ও ৩০২/৩৪ ধারায় সঠিকভাবেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন এবং তাদেরকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন এবং আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়ে আমি লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মােসলেমউদ্দীন ওরফে মােসলেউদ্দীনের সঙ্গে সম্পর্কিত ডেথ রেফারেন্সটি গ্রহণ করলাম। আসামি লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) পেশকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৭ নম্বর ফৌজদারি আপিলটি খারিজ করা হলাে। তবে ঢাকার বিজ্ঞ দায়রা জজ ৩১৯/৯৭ নম্বর দায়রা মামলায় আসামি ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার ও মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলামকে যে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ প্রদান করেছেন তা বাতিলযােগ্য এবং সেই কারণে তা বাতিল করা হলাে এবং তদনুসারে আমার ভ্রাতা বিচারপতি মাে. রুহুল আমিনের সঙ্গে একমত হয়ে ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার ও মেজর আহমেদ শরিফুল ইসলাম ওরফে শরিফুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স নাকচ (rejected) করা হলাে।”
৪৪. অতঃপর হাইকোর্ট ডিভিশনের ৩০ এপ্রিল, ২০০১ তারিখের রায় ও আদেশ দ্বারা আপিলকারী মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)সহ তিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি আসামির ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ বজায় রাখা হয় এবং তাদের ডেথ রেফারেন্স গৃহীত হয় এবং ডেথ রেফারেন্সটি নিমােক্তভাবে নিষ্পত্তি করা হয় :
“ফলাফলের ভিত্তিতে, মৃত্যুদণ্ড অনুমােদন করে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর মাে. বজলুল হুদা, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, বীর উত্তম, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল এসএইচবিএম নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল আজিজ পাশা, লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), রিসালদার মােসলেমউদ্দীন ওরফে মােসলেউদ্দীন ও ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্স গৃহীত হলাে এবং তদনুযায়ী আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৬ নম্বর ফৌজদারি আপিল,
৪৫৩

আসামি লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬০৪ নম্বর ফৌজদারি আপিল, আসামি মেজর মাে. বজলুল হুদা দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৩ নম্বর ফৌজদারি আপিল এবং লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৭ নম্বর ফৌজদারি আপিল খারিজ করা হলাে।
“তবে আসামি ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসারের সঙ্গে সম্পর্কিত ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্স নাকচ করা হলাে এবং তদনুযায়ী এই আসামিদের দণ্ডাদেশ ও সাজা বাতিল করা হলাে এবং এই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ থেকে তাদের খালাস দেওয়া হলাে।”
৪৫. আমার মতে, তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের প্রদত্ত ঐ রায় ও আদেশটি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার বিধানের সাথে সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ। দ্বিতীয় যুক্তি অর্থাৎ বিলম্ব প্রসঙ্গে আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা বলেছেন, এজাহার দায়েরে অত্যধিক বিলম্ব হয়েছে এবং ২১ বছরের এই অযৌক্তিক বিলম্বের কারণে রাষ্ট্রপক্ষ সাজানাে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে আপিলকারী ও অন্যান্য আসামিকে অসত্যভাবে জড়িয়ে অসত্য কাহিনি তৈরি করেছে যা আপিলকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পরবর্তী সময়ে এ কথা যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ১৯৭৫ সালের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারির কারণে এই বিলম্ব ঘটেছে তথাপি ২৬.৬.১৯৯৬ থেকে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার তারিখ থেকে প্রায় তিন মাস সময় কেন লাগল তার কোনাে ব্যাখ্যা নেই।
৪৬. অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ কেবল এজাহার দায়েরের বিলম্বের কারণগুলােই ব্যাখ্যা করেননি উপরন্তু এই বিলম্ব এবং ঘটনার পর এজাহার দায়েরে তথ্যদাতার অসমর্থতা প্রমাণের জন্য অকাট্য তথ্যপ্রমাণও উপস্থাপন করেছে। এই বিলম্বের কারণ হলাে, পরবর্তী সরকারগুলাে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের দ্বারা আপিলকারী ও অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল এবং আপিলকারী ও অন্যান্য আসামিকে রক্ষা করেছিল। ঘটনার পর প্রতীয়মান হয়েছে, আপিলকারীরা ও অন্য আসামিরা শুধু যে তৎকালীন সরকারগুলাের আশ্রয়ে ছিল তা নয়, উপরন্তু তারা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান পদে অধিষ্ঠিতও ছিল। মেজর রশিদ ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ফারুক রহমানের সঙ্গে মিলে ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিল। ফারুক রহমানও ১৯৮০-এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং বজলুল হুদা ছিল ফ্রিডম পার্টির সম্পাদক।
পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের হত্যায় জড়িত আসামিদের অধিকাংশকে বিদেশি মিশনগুলােতে নিয়ােগ দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন; যদিও তারা প্রকাশ্যে ঘােষণা করেছিল যে, তারাই তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করেছে। এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা যেখানে তখনকার একের পর এক ক্ষমতাসীন সরকার বর্তমান আপিলকারীসহ আসামিদের আশ্রয় দিয়েছিল ও রক্ষা করেছিল। বিধায়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত এজাহারকারী আশঙ্কা করছিলেন যে, মামলা দায়ের করা হলে তাঁর জীবনের উপর ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। উপরােক্ত বক্তব্যের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ State vs Fazal, 39 DLR (AD) 166, Md. Shamsuddin @ Lalu vs State, 40 DLR (AD) 69, Tara Singh vs State of Punjab 1991 Supp (1) SCC 536, Jamna vs State of UP 1994 Supp (1) SCC 185 978 State of HP vs Shreekanthia Shekari (2004) 8 SCC 153 VTECN57
৪৫৪

উল্লেখ করেন। এখানে প্রতীয়মান হয় যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকরা বিলম্ব সম্পর্কিত ব্যাখ্যাটি বিশ্বাস করেছিলেন এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রপক্ষ অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে বিলম্বের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে।
৪৭. প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পর্যবেক্ষণ দেন যে :
“এ মামলায় এজাহার দায়েরে বিলম্বের বিষয়টির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কয়েক বছর পার হবার পর এজাহার দায়ের হওয়ায় কারসাজি করা ও ঘটনার সঙ্গে মিথ্যাভাবে জড়ানাের অভিযােগ মামলার গুণাগুণকে নাকচ করে দেয়- এমন বক্তব্য বিবেচনাযােগ্য নয়।”
৪৮. দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক মন্তব্য করেন :
“এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী ও অন্যান্য সাক্ষীর সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যায়, বেশির ভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর দেশত্যাগে বাধ্য হবার আগ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গভবনে অবস্থান করত এবং অলিখিত কমান্ড কাউন্সিলের নামে দেশ চালাত। দেশত্যাগের পরও যে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল না তা নয়। আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান সাভার ও বগুড়া সেনানিবাসে বিদ্রোহ ঘটানাের চেষ্টা করেছিল। মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ১৯৭৬ সালে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ড নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পুনরায় ১৯৮০ সালে তারা সরকার উৎখাতের আরেক দফা চেষ্টা চালায়। কিন্তু তারপরও কোনাে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনােরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। বরং তাদের সবাইকে তাদের বকেয়া বেতন দেওয়া হয়েছিল। আসামি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিল (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষীর বর্ণনামতে)। কাজেই নিজের জীবনাশঙ্কা সম্পর্কে তথ্যদাতা যা বলেছেন তা অযৌক্তিক বলা যায় না। এমতাবস্থায় এজাহার দায়েরে বিলম্বের কারণে মামলা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে না। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলার অভিযােগ প্রমাণ করা সর্বদাই রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব। সেহেতু, এজাহার দায়ের করার ব্যাপারে বিলম্ব সম্পর্কে আপিলকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর বক্তব্যের মধ্যে সারবত্তা নেই।”
৪৯. তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকও বিলম্বের ব্যাখ্যাটি বিশ্বাস করেছেন। বিজ্ঞ বিচারকরা তাঁদের যুক্তির সমর্থনে এই উপমহাদেশের বেশ কিছু সিদ্ধান্তও উদ্ধৃত করেন।
৫০. এটা সত্য যে, বিলম্বে এজাহার দায়ের করার ফলে ঘটনা-পরবর্তী চিন্তা দ্বারা ব্যাপারটিকে কখনাে কখনাে অতিরঞ্জিত করা হয়। তবে এ ব্যাপারে উচ্চতর আদালতগুলাের সঙ্গতিপূর্ণ অভিমত হলাে এই যে, মামলা দায়েরে স্রেফ বিলম্বের ব্যাপারটাই রাষ্ট্রপক্ষের মামলাকে অবিশ্বাস করার ভিত্তি হতে পারে না। কেননা
নানা ধরনের পরিস্থিতির কারণে মামলা দায়েরে বিলম্বিত হতে পারে।
৫১.. অবশ্য Shreekant Thai (পূর্বোক্ত) মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় যে, এজাহার দায়ের করার সময় বিলম্বের বিষয়ে কোনাে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছিল কিনা তা অনুসন্ধান এবং বিবেচনার জন্য আদালতে তুলে ধরা হয়েছিল। বিলম্বের ব্যাখ্যা দেওয়া হলে আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু এইটুকু দেখা যে, প্রদত্ত ব্যাখ্যাটি সন্তোষজনক কিনা। রাষ্ট্রপক্ষ যখন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয় এবং এই বিলম্বের কারণে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা সাজানাে ও অতিরঞ্জিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন এটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে বিলম্বের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান আসামিকে অসত্যভাবে মামলায় জড়ানাের কিংবা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা দুর্বলসংক্রান্ত যুক্তিসমূহ নাকচ করার জন্য যথেষ্ট।
৪৫৫

৫২. এই মামলার এজাহারে এজাহারকারী ১৪ জন আসামিকে সম্পৃক্ত করে এজাহার দায়ের করেছেন এবং তাদের মধ্যে কেবল বজলুল হুদার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের সুনির্দিষ্ট অভিযােগ করেছেন; আরাে তিনজন আসামিকে শনাক্ত করেছেন এবং অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাকি আসামিদের সম্পৃক্ত করেছেন। এজাহারকারীর যদি আপিলকারী ও অন্যান্য আসামিকে জড়িত করার অথবা তাদের বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশন করার দুরভিসন্ধি থাকত তাহলে প্রত্যেক আসামি যে যে ভূমিকা পালন করেছিল সুস্পষ্টভাবে এজাহারে উল্লেখ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথ অবলম্বন করেননি। এ থেকে এটি প্রতিভাত হয় যে, এজাহারকারী ঘটনাস্থলে যা দেখেছেন এবং তদন্তকারী সংস্থা মামলার তদন্তকালে আপিলকারী ও অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে তাদের যােগসাজশ সম্পর্কিত যে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছেন এজাহারে সেটিরই সঠিক বর্ণনা করা হয়েছে।
৫৩. আরাে দেখা যায় যে, ঘটনার পর খােন্দকার মােশতাক আহমেদ অন্যায়ভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তিনি ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট সামরিক আইন জারি করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন সাধনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনাে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে কিংবা সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত কোনাে কাজ বা বিষয়ের ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত বা অপর কোনাে কার্যক্রম গ্রহণের উপর বিধিনিষেধ আরােপ করে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেন। দেখা। যাচ্ছে যে, উক্ত অধ্যাদেশ জারির পর একটি এজাহার দায়ের করা যেতে পারত কি পারত না সেটা আইনি ব্যাখ্যার বিষয় এবং আরও দেখা যায় যে, উক্ত অধ্যাদেশটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও ফেলেছিল।
৫৪. আরও উল্লেখ করতে হয় যে, লে. কর্নেল শাফায়াত জামিল (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী) তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন যে, আপিলকারী ফারুক রহমান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেজর রশিদ সর্বদাই বঙ্গভবনে অবস্থান করতেন; তাদের সহযােগী অফিসাররা রেডিও স্টেশনে অবস্থান করতেন; একটি অলিখিত বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ রাখতেন এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদের নেতৃত্বে দেশ শাসন করতেন। ঘটনার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকারগুলাে ১৫ আগস্টের ঘাতকদের নিরাপত্তা দেওয়ায় ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনাে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না।
৫৫. স্বীকৃত মতে, তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর বাসভবনে থাকা তাঁর পরিবারের অপর সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। উপরােক্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থন না থেকে থাকলে ক্ষমতাসীন সরকারগুলাের বাধ্যবাধকতাপূর্ণ দায়িত্ব ছিল মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে মামলা রুজু করা এবং ঘাতকদের বিচার করা। কিন্তু এই নির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে আইনের প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব পথে চলতে দেওয়া হয়নি। বরং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করে ক্ষমতাসীন সরকার আপিলকারীদেরসহ আসামিদের রক্ষা করতে চেয়েছিল এবং আরও বলতে হয় যে, প্রাথমিকভাবে তাদের কয়েকজন অপসারিত সেনা অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করে বৈদেশিক মিশনগুলােতে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল।
৫৬. আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আরাে বলতে হয়, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে কেউ দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ঘাতকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করে থাকলেও সরকার এই মামলা রুজু করতে আইন অনুযায়ী বাধ্য ছিল, বিশেষ করে যখন একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে পরিবার-পরিজনসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা
৪৫৬

করা হয়েছিল। আরাে বলতে হয় যে, আপিলকারীরাসহ অপর আসামিরা হত্যাকাণ্ডের অপরাধই শুধু করেনি, তারা একটি শিশু ও তিন নিরপরাধ নারীকে হত্যা করে মানবতার বিরুদ্ধে বর্বরতা সংঘটন করেছে। উপরন্তু উক্ত হত্যাপরাধ একটি আমলযােগ্য অপরাধ বিধায়, কেউ যদি নিহতদের পক্ষ থেকে এমন অপরাধের জন্য এফআইআর দায়ের না-ও করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৭৩ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই এমন অপরাধের তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করা।
৫৭. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আজমালুল হােসেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারগুলাের ন্যায়বিচার প্রয়ােগের পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট সময়ে ন্যায়বিচার প্রয়ােগ পদ্ধতিটি সব দিক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, যেটির দায়মােচন করা যায় না। ন্যায়বিচার প্রয়ােগ ব্যবস্থার এই ব্যর্থতা দেশে সুবিশাল বিপর্যয়কর প্রভাব রেখেছে, যার পুনরাবৃত্তি দেশের স্বার্থেই ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। জনাব হােসেন বলেন, এটা হলাে ইতিহাসের অংশ, যা মুছে দেওয়া যায় না। আগা থেকে গােড়া পর্যন্ত গােটা প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল, যা আমাদের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ ধরনের অনুশীলন চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত এবং আর যেন এর পুনরাবৃত্তি ঘটে।
৫৮. উপরিউক্ত বক্তব্যগুলাের মাঝে সারবত্তা আছে। কারণ ন্যায়বিচার আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বদান্যতা, মহানুভবতা, কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব ও করুণা থেকে ন্যায়বিচার আলাদা। ন্যায়বিচার হলাে সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মর্মমূলে রয়েছে নিরপেক্ষতার ধারণা। আরাে বলা যায়, সরকার মানুষের নয়, আইনের। আইন যখন শেষ হয়ে যায় তখন শুরু হয় স্বৈরাচার। স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার অতি বৈপরীত্য হলাে আইন। বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের মধ্যে হত্যাপরাধ কিংবা হত্যা সংঘটনে আদেশ প্রদান অবশ্যই বেআইনি ও অনৈতিক। সেই কারণে নাৎসিরা কখনই গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, বরং বন্দিশিবিরের কয়েদিদের হত্যার আদেশ সর্বদাই গােপন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এমনকি নাৎসিরাও স্বীকার করে যে, এ ধরনের আচরণ আইনের কোনাে ব্যবস্থায়ই কখনাে যৌক্তিক ছিল না।
৫৯. একটা দেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রয়ােগ ও আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা। জনগণের স্বার্থেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত অপরাধীর অপরাধ যত দ্রুত সম্ভব নির্ণয় করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যা করার পর এই ধারণাটি উপেক্ষিত হয়েছে। একটা শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে অপরাধকর্মে জড়িত প্রতিটি অপরাধীর বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব বিচার মােটামুটি দ্রুতগতিতে হওয়া উচিত। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলাে হচ্ছে নাগরিকদের জন্য একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত ও কার্যকর উপায়ে ন্যায়বিচার প্রয়ােগ করতে গিয়ে নাগরিক ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকারের ভারসাম্য বিধান করা। সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের সুযােগ না থাকলে আইনের শাসন অর্থহীন।
৬০. আমার কাছে মনে হয়েছে, এফআইআর দায়েরে বিলম্বের কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দেওয়া ব্যাখ্যা বিশ্বাস করার পক্ষে বিজ্ঞ বিচারকরা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়েছেন। তদুপরি এটা নথিতে থাকা সাক্ষ্যপ্রমাণ নির্ভর হওয়ায় সংবিধানের ১০৩ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে এক্ষেত্রে এই বিভাগের হস্তক্ষেপ করার সুযােগ অত্যন্ত সীমিত।
৪৫৭

৬১. অতএব আমার অভিমত হচ্ছে, বিলম্বের কারণ যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যাত হওয়ায় এ বিষয়ে এই বিভাগের হস্তক্ষেপের কোনাে প্রয়ােজন পড়ে না। তৃতীয় ভিত্তি অর্থাৎ বিদ্রোহের ব্যাপারে আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা এই অভিন্ন বক্তব্য পেশ করেছেন যে, লিপিবদ্ধ সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে প্রকাশ পায় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তন ছিল কিছুসংখ্যক সেনা অফিসারের বিদ্রোহের ফল; তাই বিচারকার্যটি ১৯৫২ সালের আর্মি অ্যাক্টে অনুযায়ী কোর্ট মার্শালে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল এবং তদনুযায়ী কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধানের অধীনে আপিলকারীদের এই বিচারটি ছিল এখতিয়ারবহির্ভূত এবং এই বক্তব্যের সমর্থনে আর্মি অ্যাক্টের ৩১(এ), ৫৯(৩), ৯২(২), ৯৪ ও ৯৫ ধারা; পেনাল কোডের ৫ ও ১৩৯ ধারা এবং কোড অব
ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯(২) ধারাগুলাে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
৬২. জনাব খান সাইফুর রহমান আরাে নিবেদন করেন যে, ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে তাৎক্ষণিক ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল এবং এটি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি ছিল একটা সহজ-সরল বিদ্রোহ এবং তদুপরি পেনাল কোডের ৩৪ ধারা কিংবা ১২০এ ধারার আওতাধীনে এ সংক্রান্ত কোনাে চুক্তি বা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বা পূর্বপরিকল্পিত পরিকল্পনা বা পূর্ব আয়ােজিত পরিকল্পনার অস্তিত্ব ছিল না। বিজ্ঞ আইনজীবী আরাে যুক্তি দেখান যে, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের ঘটনায় কোনাে অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার কিংবা সেনা আইনের অধীন নয় এমন অপর কোনাে ব্যক্তি যােগ দিয়ে থাকলেও আর্মি অ্যাক্টের ৩১ ধারার পরিসীমার মধ্যে সেটাও হবে বিদ্রোহ এবং সে অনুযায়ী তাদেরকেও সেনা আইনের অধীনেই কোর্ট মার্শালে বিচার করা উচিত ছিল। উপরন্তু বর্তমান আপিলে উল্লিখিত রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এই দিক দিয়ে যে, তাদের উভয়ই ছিলেন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং তারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। বর্তমান আপিলের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার ইউনিটের অফিসার ও জওয়ানরা ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভােরবেলায় রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সরকারি বাসভবনে হত্যা করেছিল। অন্যদিকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে সেনাসদস্যরা ১৯৮১ সালের ২৯ মে দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যেখানে ছিলেন, সেই সার্কিট হাউসে তাকে হত্যা করে। যেহেত, উভয় হত্যাকাণ্ড একইভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তাই আপিলকারীদের, যদি তারা ১৫ আগস্টের ঘটনায় আদৌ জড়িত থেকে থাকে, কোর্ট মার্শালে বিচার হওয়া উচিত ছিল, যেমনটি হয়েছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বেলায়। অধিকন্তু, রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তার হত্যাকাণ্ডের বিচার কোর্ট মার্শালে হওয়া উচিত ছিল। এই বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞ আইনজীবী Jamil Huq os Bangladesh, 34 DLR (SC) 125 মামলাটি
উদ্ধৃত করেন।
৬৩. অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক বলেন, ঘটনাটি ‘বিদ্রোহ’ নয়, বরং তা ছিল পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং সেই কারণে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধানের অধীনে আপিলকারীদের বিচারে আইনগত কোনাে বাধা নেই, যা আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এর ৫৯, ৯২, ৯৪, ৯৫ ধারা, নেভি অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১-এর ৩৫ ধারা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার বিধানসমূহে পরিদৃষ্ট হবে। জনাব হকের এই বক্তব্য অনুমােদন করে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এর সঙ্গে যােগ করেন যে, আপিলকারীরা বিচারিক আদালতে এ বিষয়টি উত্থাপন করেনি এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করার অসদুদ্দেশ্য নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে প্রথমবারের মতাে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছে। উপরন্তু, নথিতে থাকা সাক্ষ্যপ্রমাণ বিদ্রোহের ব্যাপারটা
৪৫৮

সমর্থন করে না, বরং তা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই প্রকাশ করে এবং সে মােতাবেক আপিলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ যথাযথভাবেই গঠিত হয়েছে। এমনকি যদি এটি ধরেও নেয়া যায় যে, আর্মি অ্যাক্টের ৮(২) ধারার সাথে ৫৯(২) ধারার পঠিত অর্থে ঘটনাটা একটা সিভিল অপরাধ (civil offence) তথাপি আর্মি অ্যাক্টের ৯৪ ধারা অনুসারে এমন অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার ফৌজদারি আদালতের রয়েছে। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাংবিধানিকভাবে আইনগত ব্যক্তিত্ব, অবস্থান ও সুরক্ষা ভােগ করার বিষয়টি একটিমাত্র আইন অর্থাৎ আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২ কিংবা সেই আইনের কোনাে বিধানের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাঁকে ‘সেনা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনার পরিবর্তে সংবিধানের আলােকে বিবেচনা করতে হবে।
৬৪. রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী তৌফিক নেওয়াজ নিবেদন করেন, তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের সময় বলবৎ থাকা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের কতিপয় বিধানে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ও আইনগত ব্যক্তিত্বের যে পুরাে চিত্রটি দেওয়া ছিল সেটি অত্যন্ত স্পষ্ট। সে অনুযায়ী তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাংবিধানিকভাবে আইনগত ব্যক্তিত্ব এবং অবস্থান ও সুরক্ষা ভােগ করার বিষয়টি সংবিধানের আলােকে বিবেচনা করতে হবে, তা সে সময়ের একটিমাত্র আইন অর্থাৎ আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২ কিংবা সেই আইনের কোনাে বিধানের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাঁকে ‘সেনা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন হবে না এবং সেই কারণে কোর্ট মার্শালের পরিবর্তে ফৌজদারি আদালতে আপিলকারীদের বিচার করা আইনসম্মত।
৬৫. দেখা যায় যে, আসামিপক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরাকালে কিংবা ডিফেন্স সাজেশন দিয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সময় বিদ্রোহের কোনাে অজুহাত (plea) নেয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা আসামিপক্ষের বিদ্রোহের অজুহাতের সমর্থনে কিছু না বলায় আসামিপক্ষের উচিত ছিল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, বিদ্রোহে জড়িত অফিসার ও জওয়ানরা তাদের দাবিনামা পেশ করেছিল, যে দাবিনামা মেনে না নেওয়ায় তারা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে। কিন্তু পক্ষান্তরে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষীকে এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, মেজর ডালিম যখন হত্যাকাণ্ডের খবর বেতারে ঘােষণা করছিল, সে সময় রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী দেশে মার্শাল ল জারি এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার কথা জানতেন। সাক্ষীকে এই সাজেশন প্রদানের মধ্য দিয়ে আসামিপক্ষ বলতে চেয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার পর সামরিক আইন ঘােষিত হয় এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং এই ডিফেন্স সাজেশন দ্বারা আসামিপক্ষ এই সমর্থনসূচক কৈফিয়ত দাঁড় করাতে চেয়েছিল যে, যেহেতু ঐ হত্যাকাণ্ড ছিল সেনাবাহিনীর সফল বিদ্রোহের পরিণতি, তাই এমন হত্যাকাণ্ড কোনাে হত্যাপরাধ নয়।।
৬৬. অবশ্য এটি প্রতিভাত হয় যে, রাষ্ট্রপতি নিহত হবার পর সংবিধানের বিধানাবলি অনুযায়ী তদানীন্তন উপ-রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সংবিধানের সেই বিধানগুলােকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। তদুপরি, কোনাে বিদ্রোহ হয়ে থাকলে ক্ষমতাসীন সরকারের উচিত ছিল ঘটনায় জড়িত অফিসার ও জওয়ানদের বিদ্রোহের জন্য আর্মি অ্যাক্টের অধীনে বিচার করা। অথচ এ ধরনের কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া তাে হয়ইনি, বরং ঘাতকরা সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছিল। বেতার কেন্দ্রের কর্মচারী মােঃ রিয়াজুল হক (রাষ্ট্রপক্ষের ৩৭ নম্বর সাক্ষী) জবানবন্দি প্রদানকালে বলেছেন, মেজর ডালিম সকাল ৯টায় তিন বাহিনীর প্রধানদের এবং সেই সঙ্গে বিডিআর প্রধান ও পুলিশের আইজিকে ২
৪৫৯

নম্বর স্টুডিওতে নিয়ে আসে এবং পট পরিবর্তনের পক্ষে তাদের আনুগত্যমূলক বিবৃতি সেখানে রেকর্ড ও সম্প্রচার করা হয়। লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদের পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৫ নম্বর সাক্ষী) এই সাজেশন দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকালে এক সফল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং সেই অভ্যুত্থানে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধানের সবাই তাদের অনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি (শফিউল্লাহ) ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি এবং খােন্দকার মােশতাক ঘাতকদের ‘সূর্যসন্তান’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ফারুক রহমানের পক্ষে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল সাফায়াত জামিল (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী) বলেন, ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ পরবর্তী সরকারগুলাে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের নিরাপত্তা ও আনুকূল্য দিয়েছিল এবং ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা ও ঘাতকরা বঙ্গভবনে অবস্থান করত এবং তারা একটা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে মােশতাক সরকারকে চালাত।
৬৭. সাক্ষীদেরকে দেওয়া উপরােক্ত ডিফেন্স সাজেশনের মাধ্যমে আপিলকারীরা ঘটনাটিকে এক সফল সামরিক অভ্যুত্থান হিসাবে আখ্যা দিয়েছিল। সরকারগুলােও তাদের নিরাপত্তা দিয়েছিল ও সূর্যসন্তান’ হিসেবে ঘােষণা দিয়ে তাদের পুরস্কৃতও করেছিল এবং আপিলকারীরা বিদ্রোহের পক্ষে কোনাে কেস তুলে ধরার চেষ্টা করেনি। আরাে দেখা যায় যে, ৩৪২ ধারার অধীনে প্রদত্ত বিবৃতিতে তারা এই প্রশ্নে দৃশ্যত নীরব ছিল। হাইকোর্ট বিভাগে আপিলের পর্যায়ে এসে তারা তাদের অবস্থান বদলে ফেলে, যদিও এই কৈফিয়তের সমর্থনে কোনাে বস্তুগত প্রমাণ নেই।
আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এ বিদ্রোহের কোনাে সংজ্ঞা দেওয়া না হলেও সেই আইনের ৩১ ধারায় বিদ্রোহের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নেভী অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১-এর ৩৫ ধারায় বিদ্রোহের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে :
“35. In this Ordinance, mutiny means a combination between two or more persons subject to service law, or between persons two at least of whom are subject to service law
to overthrow or resist lawful authority in the armed forces of Bangladesh or any forces co-operating therewith or in any part of any of the said forces;
(b) to disobey such authority in such circumstances as to make the disobedience subversive of discipline, or with the object of avoiding any duty or service, or in connection with operations against the enemy; or
(c) to impede the performance of any duty or service in the armed forces of Bangladesh or in any forces co-operating therewith, or in any part of any of the said forces.”
এ বিষয়ে কোনাে বিতর্ক নেই যে, ‘বিদ্রোহ’-এর এই সংজ্ঞাটি নেভী অর্ডিন্যান্স ১৯৬১-এর 4(xxxiv) ধারায় প্রদত্ত ‘service law’-এর সংজ্ঞার আলােকে আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এ সজ্ঞায়িত বিদ্রোহের ক্ষেত্রে
৪৬০

প্রযােজ্য। ঐ ধারা অনুসারে ‘service law’ বলতে এই অধ্যাদেশ, আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২, এয়ার ফোর্স অ্যাক্ট ১৯৫৩ এবং এসবের অধীনে প্রণীত বিধি ও বিধানসমূহকে বােঝায়।
৬৮. খান সাইফুর রহমান নিবেদন করেন যে, আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৫৯ ধারায় ব্যবহৃত সক্রিয় সৈন্যদলে থাকাকালীন (অ্যাকটিভ সার্ভিস) কথাটা এই মামলার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। তথাপি উপরােক্ত বক্তব্য স্ববিরােধী, কারণ আপিলকারীরা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর কতিপয় বিধানের ওপর নির্ভর করে ফৌজদারি আদালতের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে।
৬৯. জনাব হকের মতে, নেভী অর্ডিন্যান্স ১৯৬১-এর ৩৫ ধারায় প্রদত্ত বিদ্রোহের এই সংজ্ঞাটি আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৩১ ধারার সঙ্গে পাঠ করতে হবে এই উপসংহারে পৌছার জন্য যে, আপিলকারীদের কার্যকলাপ বিদ্রোহের মতাে দুষ্কর্মের আওতার মধ্যে পড়ে না। ৩১ ধারার (ক) বিধিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আইনসম্মত কর্তৃপক্ষকে উৎখাত করা বা প্রতিহত করার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু নথিপত্রে এমন কিছুরই উল্লেখ নেই যা থেকে এটি প্রমাণ হয় যে, আপিলকারীরা ও অন্য আসামিরা সম্মিলিতভাবে কর্তৃপক্ষের অবাধ্যতা করেছে কিংবা অগ্রাহ্য বা অবজ্ঞা করেছে কিংবা কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যার ফলে তাদের সেই কর্মকাণ্ড বিদ্রোহের আওতার মধ্যে পড়ে। তদুপরি, রেকর্ডকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ বরং আপিলকারীদের ও অন্য আসামিদের, যারা সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুব্ধ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, কর্মকাণ্ড মেনে নিয়েছিল এবং তাদের কয়েকজনকে সরকার পুরস্কৃতও করেছিল।
৭০. আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৫৯ (১) ধারায় বলা আছে যে, উপধারা (২)-এর বিধানাবলি সাপেক্ষে আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীন কোনাে ব্যক্তি যদি কোথাও সিভিল অপরাধ সংঘটিত করে তাহলে সে সেনাবাহিনী আইনের অধীনে অপরাধের জন্য দোষী বলে গণ্য হবে। আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৮(২) ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী সিভিল অপরাধ বলতে এমন অপরাধকে বােঝায়, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হলে ফৌজদারি কোর্টে সেই অপরাধের বিচার করা যাবে। কাজেই এ ব্যাপারে কোনাে বিরােধ বা বিতর্কের অবকাশ নেই যে, আপিলকারীদের কার্যকলাপ ‘সিভিল অপরাধের মতাে দুষ্কর্মের মধ্যে পড়ছে। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের অধীনে গঠিত একটি ফৌজদারি আদালতে আপিলকারীদের বিচারের ব্যাপারে কোনাে আইনগত বাধা নেই। অবশ্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৫৯(২) ধারায় বলা আছে যে, সেনাবাহিনী আইনের আওতাধীন কোনাে ব্যক্তি যদি আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর আওতাধীন না-থাকা কোনাে ব্যক্তিকে হত্যা করে তাহলে সে সেনাবাহিনী আইনের অধীনে বিচারযােগ্য হবে না। যদি না সে সৈন্যদলে সক্রিয় থাকাকালীন অবস্থায় এই অপরাধ করে।।
৭১. সক্রিয় সৈন্যদল (active service) কথাটা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৮(১) ধারায় নিমােক্তরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
“active service”, as applied to a person subject to this Act, means the time during which such person is attached to, or forms part of a force which is engaged in operations against an enemy, or is engaged in military operations in, or is on the line of march to a country or place wholly or partly occupied by an enemy, or is attached to or forms part of a force which is in military occupation of a foreign country;”
৪৬১

৭২. আপিলকারীদের ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযােগ আনা হয়নি যে, সক্রিয় সৈন্যদলে থাকাকালীন অবস্থায় তারা হত্যাপরাধ করেছে এবং আপিলকারীরাও দাবি করেনি যে, তারা সক্রিয় সৈন্যদলে থাকা অবস্থায় ঐ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। রেকর্ডভুক্ত এমন উপকরণও নেই যা থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, আপিলকারীরা শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে নিয়ােজিত থাকাকালে কিংবা কোনাে সামরিক অভিযানে নিয়ােজিত থাকাকালে অথবা শত্রু কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে অধিকৃত কোনাে দেশ বা স্থান অভিমুখে অগ্রসরমাণ থাকাকালে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল।
৭৩. উপরােক্ত আইনের প্রাসঙ্গিক বিধান অনুযায়ী আপিলকারীরা যদি সক্রিয় সৈন্যদলে না থাকাকালীন অবস্থায় সিভিল অপরাধ সংঘটিত করে তাহলে ফৌজদারি আদালতে বিচারের পথে সেনাবাহিনী আইনের বিধানগুলাে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। উপরন্তু, সাধারণ ফৌজদারি আদালতে সিভিল অপরাধের বিচারের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর নবম অধ্যায়ে ৯৪ ও ৯৫ ধারাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৯৪ ধারায় আগেই মেনে নেওয়া হয়েছে যে, আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এ শাস্তিযােগ্য কোনাে কাজ বা বিচ্যুতির ক্ষেত্রে কিংবা যে ক্ষেত্রে কোনাে অপরাধ সেনাবাহিনী আইনের আওতাভুক্ত এবং একই সময় তা দেশে বলবৎ যে কোনাে আইনের আওতাভুক্ত বলে গণ্য সেই অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয়ের সমান্তরাল এখতিয়ার থাকবে। এক্ষেত্রে কোন আদালতে মামলাটি রুজু করা হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব একজন অনুমােদিত অফিসারের ঐচ্ছিক ক্ষমতার উপর ছেড়ে দেওয়া হবে। অনুমােদিত অফিসার যদি সিদ্ধান্ত নেন যে, মামলাটি কোর্ট মার্শালে রুজু হওয়া উচিত, তবে সেক্ষেত্রে অপরাধীকে সামরিক হেফাজতে আটক রাখা হবে। অবশ্য একই সময়ে যদি কোনাে ফৌজদারি আদালত মনে করে যে, উক্ত অপরাধের বিচার ফৌজদারি আদালতেই হতে হবে তাহলে ৯৫ ধারার অধীনে নােটিশ জারি করে অপরাধীকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করতে পারে অথবা সরকারের কাছে রেফারেন্স প্রেরণসাপেক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে পারে। রিকুইজিশন পাওয়ার পর অনুমােদিত অফিসার অপরাধীকে হয় উক্ত আদালতের কাছে হস্তান্তর করবেন, নয়তাে কার আদেশ চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে তা নির্ধারণের জন্য বিষয়টি সরকারের কাছে পাঠাবেন।
৭৪. আমি জনাব তৌফিক নেওয়াজের এই বক্তব্যের সঙ্গেও একমত যে, সংবিধানে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতির যে অবস্থান নির্দেশ করা ছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু একটিমাত্র আইন আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর কারণে এবং সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবার জন্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে সেনাবাহিনীর সদস্য বলে গণ্য করা যায় না।
৭৫. আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আরাে নিবেদন করেছেন যে, পেনাল কোডের ১৩৯ ধারা ও কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার আলােকে ফৌজদারি আদালতে আপিলকারীদের বিচার অনুষ্ঠানে বাধা আছে।
৭৬. পেনাল কোডের ১৩৯ ধারাটি সপ্তম অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত যেখানে ১৩১ থেকে ১৪০ ধারা বিধৃত রয়েছে। দেখা যাবে যে, ১৩১ ধারায় বিদ্রোহ ঘটাতে সহায়তা করা বা কোনাে সৈনিক, নাবিক বা বিমানসেনাকে তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে প্ররােচিত করার চেষ্টা, ১৩২ ধারায় বিদ্রোহ সংঘটনে প্ররােচিত করা, যদি ঐসব কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় এবং অন্য ধারাগুলােয় অপরাপর অপরাধ সংঘটনে প্ররােচনা দেওয়ার কথা রয়েছে এবং ১৩৯ ধারায় ১৩১ থেকে ১৩৮ পর্যন্ত ধারাসমূহে বর্ণিত অপরাধসমূহ সংঘটনে সহায়তাদানের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২, নেভী অর্ডিন্যান্স ১৯৬১, এয়ার ফোর্স অ্যাক্ট ১৯৫৩-এর আওতাধীন যে কোনাে ব্যক্তিকে পেনাল কোডের বিধান অনুযায়ী শাস্তিদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্রোহে সহায়তার মতাে অপরাধ সংঘটনের জন্য নয়, বরং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও
৪৬২

হত্যার গুরুতর অপরাধের জন্য আপিলকারীদের বিচার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান। আপিলগুলাের ক্ষেত্রে পেনাল কোডের ১৩৯ ধারার কোনাে প্রয়ােগ বা কার্যকারিতা নেই। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই ধারাটি এক বিশেষ প্রকৃতির এবং এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী আইনের আওতাভুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই ধারায় বিধৃত “is liable to be tried either by a Court to which this Code applies or by a Court Martial” কথাগুলাের অর্থ হলাে এই যে, যে অপরাধের জন্য অপরাধীর বিচার করা হবে সেটা হতে হবে এমন অপরাধ যা ফৌজদারি আদালত এবং কোর্ট মার্শালও আমলে নিতে তথা বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারে। এই কথাগুলাে অপরাধকে আমলে নিতে দুই আদালতের প্রাথমিক এখতিয়ারকে বুঝিয়েছে এবং অপরাধের গুণাগুণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ারকে বােঝায়নি। উপরের আলােচনা অনুসারে ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয় আদালতে বিচারযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে এই দুই আদালতের এখতিয়ারগত সংঘাত এড়ানাের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৯৪ ও ৯৫ ধারায় উপযুক্ত বিধান রাখা হয়েছে।
৭৭. এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতে প্রযােজ্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫০-এর ১২৫ ও ১২৬ ধারা এবং আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৯৪ ও ৯৫ ধারা অক্ষরে অক্ষরে এক।
৭৮. Balbir Singh vs State of Punjab (1995) 1 SCC 90 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“কোনাে অপরাধের বিচারের ব্যাপারে ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয়েরই যখন এখতিয়ার থাকে তখন কোন আদালতে মামলাটি রুজু করা হবে তা নিজের বিবেচনা বা বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রথমত আপরাধী যে গ্রুপ, উয়িং বা স্টেশনে কর্মরত সেটির কমান্ডিং অফিসারের বা অনুমােদিত অপর কোনাে অফিসারের হাতে থাকবে। সেই অফিসার যদি ঠিক। করেন যে কোর্ট মার্শালে মামলা রুজু করা উচিত হবে, তাহলে সেটা রুজু করার জন্য অপরাধী বা অপরাধীদের বিমানবাহিনীর হেফাজতে আটক রাখতে হবে। কাজেই যখন এয়ার ফোর্স অ্যাক্টের আওতাধীন কোনাে ব্যক্তি, যিনি সক্রিয় সৈন্যদলে থাকাকালীন অবস্থায় অপরাধ করেন, তখন তার বিচার করার বিকল্প ক্ষমতা প্রথমত থাকবে বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষের। এ ধরনের আসামিকে ফৌজদারি আদালতে হাজির করা হলে আদালত ঐ ব্যক্তির বিচারে অগ্রসর হবেন না, তাকে বিচার করবেন না কিংবা বিচারের জন্য তাকে সােপর্দ করার লক্ষ্যে তদন্ত পরিচালনা করবেন না। আদালত এটা নির্ধারণ করার জন্য আসামির কমান্ডিং অফিসারকে নােটিশ দেবেন যে, তারা কোর্ট মার্শালে আসামিকে বিচার করতে চান নাকি ফৌজদারি আদালতকে বিচারকাজ করতে অনুমতি দিতে চান। বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ যদি কোর্ট মার্শালে ঐ ব্যক্তির বিচার না করার সিদ্ধান্ত নেন কিংবা ১৯৫২ সালের বিধানাবলির ৪ নম্বর বিধি অনুযায়ী অনুমােদিত সময়সীমার মধ্যে ফৌজদারি আদালত কর্তৃক জানিয়ে দেওয়া বিকল্প পন্থাটি অবলম্বন করতে ব্যর্থ হন সেক্ষেত্রে আসামিকে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অনুযায়ী সাধারণ ফৌজদারি আদালতে বিচার করা যেতে পারে।”
৭৯. Joginder Singh vs State of Himachal Pradesh, AIR 1971 SC 500 মামলায় সুপ্রীম কোর্ট নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“এটা আরাে স্পষ্ট যে, ফৌজদারি আদালতেও বিচার হতে পারে, আবার কোর্ট মার্শালেও বিচার হতে পারে এমন অপরাধের ক্ষেত্রে সাধারণ ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শালের মধ্যকার এখতিয়ারগত
৪৬৩

সংঘাত এড়ানাের জন্য ১২৫ ও ১২৬ ধারায় ও বিধিসমূহে উপযুক্ত বিধান রাখা হয়েছে। তবে লক্ষ করতে হবে যে, প্রথম ক্ষেত্রে কোন আদালতে মামলা রুজু করতে হবে তা নির্ধারণের জন্য ১২৫ | ধারায় উল্লিখিত অফিসারকে বিবেচনামূলক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেই হেতু, আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তি যে সেনাবাহিনী, আর্মি কোর, ডিভিশন বা স্বাধীন ব্রিগেডে কর্মরত, তার কমান্ডিং অফিসার অথবা নির্দিষ্ট করে দেওয়া অপর কোনাে অফিসারকে ১২৫ ধারার অধীনে তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন আদালতে মামলাটি রুজু করা হবে। তিনি যখন তার এই বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ করে সিদ্ধান্ত নেবেন, মামলাটি একটি কোর্ট মার্শালে রুজু করতে হবে তখনই কেবল ১২৬(১) ধারার বিধানাবলি কার্যকর হবে। এ কাজের জন্য মনােনীত অফিসার যদি তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ না করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, মামলাটি কোর্ট মার্শালে রুজু হতে হবে তাহলে আইনের বিধান অনুসারে ফৌজদারি আদালতের সাধারণ এখতিয়ার প্রয়ােগে আর্মি অ্যাক্ট স্বভাবতই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।”
৮০. Major EG Barsay os State of Bombay, AIR 1961 SC 1762 মামলায় বিচারপতি সুভা রাও এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“অতএব এই আইনের উদ্দেশ্য স্বপ্রমাণিত (self-evident)। এটা আইনের ২ নম্বর ধারায় বর্ণিত সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। এই আইনে সুনির্দিষ্ট সাজার ব্যবস্থাসহ নতুন অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং আগে থেকে বিদ্যমান অপরাধের জন্য উচ্চতর সাজার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সত্য বলে ধরে নেওয়া দেওয়ানি অপরাধকে এই আইনের অধীন অপরাধ বলে পরিগণিত করে তােলা হয়েছে। এখানে এখতিয়ারগত সংঘাত নিরসনের সন্তোষজনক। ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উপরন্তু এই আইনে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে একজন আসামিকে উপর্যুপরি কোর্ট মার্শাল ও ফৌজদারি আদালতে বিচারের সুযােগ রাখা হয়েছে। এই আইনের অধীনে শাস্তিযােগ্য কার্য বা অকরণ (omissions), যদি তা ভারতে বলবৎ অপর যে কোনাে আইনেও শাস্তিযােগ্য হয়ে থাকে, সেসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ারের পথে এই আইন দৃশ্যমান কোনাে বাধা নয়। এই আইনের প্রয়ােজনীয় নিহিতার্থ দ্বারা কোনাে নিষেধাজ্ঞা টানাও সম্ভব নয়। ১২৫, ১২৬ ও ১২৭ ধারায় এ ধরনের কোনাে সিদ্ধান্তে আসার সুযােগ নেই। কেননা এই সব ধারায় একই অপরাধের ক্ষেত্রে | ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শালের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় কেবল এখতিয়ারগত সংঘাত নিরসনের
ব্যবস্থাই করা হয়নি, একই অপরাধের ক্ষেত্রে আসামির উপর্যুপরি বিচারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
৮১. আপিলকারীরা Jamil Huq মামলার ওপর আস্থাসহকারে নির্ভর করেছিল। সেই মামলায় রিট আবেদনকারীদের ১৯৮১ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে সংঘটিত বিদ্রোহের অপরাধের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীনে কোর্ট মার্শালে বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ঐ বিদ্রোহের পরিণতিতে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রাণ হারিয়েছিলেন। আবেদনকারীরা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীনে গঠিত কোর্ট মার্শালের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন। হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত শুনানির পর রিট পিটিশন প্রত্যাখ্যান করেন। আপিল বিভাগ আলােচ্য মামলার ঘটনাদি বিবেচনায় এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন :
“কোর্ট মার্শাল যদি যথাযথভাবে গঠিত হয়ে থাকে এবং সংঘটিত অপরাধ যদি কোর্ট মার্শাল কর্তৃক আমলযােগ্য হয়, তাহলে বাকিটা সাক্ষ্যপ্রমাণ নির্ভর একটি প্রশ্ন, যে বিষয়ে সকল কর্তৃপক্ষের অভিমত হলাে এই যে, হস্তক্ষেপ করার মতাে এখতিয়ার রিটের নেই। ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে এখতিয়ার দেওয়া
৪৬৪

হয়েছে কিনা সে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখাই শুধু এই আদালতের কাজ এবং যখন এই উপসংহারে পৌছানাে হয় যে, এখতিয়ার প্রদান করা হয়নি, তখন ওখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায়।”
৮২. দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমান মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতির সাথে ঐ মামলাটি কোনােভাবে প্রযােজ্য নয়।
৮৩. আপিলকারী বজলুল হুদার বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুল্লাহ-আল-মামুন অবশ্য RV Grant, Daois Riley and Topley, (1957) 2 All ER 694 মামলাটির উল্লেখ করেছেন।
৮৪. উপরােক্ত মামলাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, সাইপ্রাসের নিকোশিয়ায় অনুষ্ঠিত জেনারেল কোর্ট মার্শালে বিদ্রোহের অপরাধের দায়ে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ঘটনার রাতে ও গােলমাল বেঁধে গিয়েছিল। আপিলকারীদের যে হােটেলে মােতায়েন রাখা হয়েছিল, সেই হােটেলের ছাদে তারা এক বৈঠকে মিলিত হয়। তারপর তারা নীচে নেমে আসে এবং কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া তাদের অভাব-অভিযােগের প্রতিকার না হওয়ায় তারা উচ্ছঙ্খল আচরণে লিপ্ত হয়ে ব্যারাকের পানশালা ভাঙচুর করে। ওয়ারেন্ট অফিসার তাদের ছত্রভঙ্গ হবার নির্দেশ দিলেও তারা ছত্রভঙ্গ হয়নি। লর্ডসভা (House of Lords) তাদের দোষী সাব্যস্তকরণের বিষয়ে নিমােক্ত যুক্তিতে হস্তক্ষেপ করতে চাননি।
“আমি সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সবিস্তারে পাঠ করে সময় গ্রহণ করার প্রয়ােজন আছে বলে মনে করিনি। আদালত এই মর্মে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট যে, সেখানে সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল যার ভিত্তিতে কোর্ট মার্শাল সঠিক পথে অগ্রসর হয়ে রায় দিতে পেরেছিল যে, একটা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। সিদ্ধান্তে পৌছানাের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে থাকলে তার ভিত্তিতে তাদের দেওয়া সিদ্ধান্তের সমালােচনা আমরা করতে পারি না। আমি যেসব কারণের কথা যথাসম্ভব সংক্ষেপে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি, সেগুলির ব্যাপারে আদালতের অভিমত হলাে এই যে, কোর্ট মার্শালকে ভুল পথে চালিত করা হয়নি। যদিও জজ-অ্যাডভােকেট কথা প্রসঙ্গে সমালােচনা করতে গিয়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছিলেন সেগুলি নিয়ে হয়তাে অগ্রসর হয়েছে এবং জজ-অ্যাডভােকেট এমন কিছু বলেননি যা কোর্ট মার্শালকে বিপথগামী করতে পারে। অতএব এই সব যুক্তির ভিত্তিতে আপিলগুলি, আমাদের মতে, নাকচ করে দেয়া উচিত।”
৮৫. বর্তমান আপিলগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এমন কিছু রেকর্ডভুক্ত নেই যা থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ আপিলকারীদের এবং আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীনে অপর আসামিদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ লঙ্ঘনের দায়ে মামলা রুজু করেছিলেন। সেখানে কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণও নেই যে, সমষ্টিগতভাবে কর্তৃপক্ষকে অমান্য করা হয়েছিল, যখন তারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। আসামিরা সক্রিয় সৈন্যদলে’ ছিল না এবং তারা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৮(২) ধারায় বিধৃত অর্থের আওতার মধ্যে দেওয়ানি অপরাধ (civil offence) করেনি। কাজেই, ফৌজদারি আদালত আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করে এখতিয়ারবহির্ভূত কিছু করেনি।
৮৬. আরও দেখা যায় যে, বিতর্ক এড়ানাের লক্ষ্যে বিজ্ঞ দায়রা জজকে আপিলকারী ও অন্যান্য আসামির বিচারের জন্য অনুমােদিত কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যদিও তারা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীন কোনাে অপরাধ করেনি। অতএব, আপিলকারীদের পক্ষ থেকে বিজ্ঞ আইনজীবীরা বিচারের ফোরাম নিয়ে যে আপত্তি তুলেছেন আমি তার মধ্যে কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাইনি।
৮৭. চতুর্থ ও পঞ্চম বিষয় অর্থাৎ ষড়যন্ত্র ও হত্যার প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনা করার আগে আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) প্রদত্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে আইনত গ্রহণযােগ্য কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। কারণ ঐসব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক
৪৬৫

জবানবন্দি যদি সাক্ষ্য হিসেবে আইনত গ্রহণযােগ্য হয় তাহলে সেখানে দেওয়া বিবৃতি ষড়যন্ত্র ও হত্যা উভয় যুক্তিকে প্রতিপন্ন করার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে। আর সেই সব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি যদি আইনত গ্রহণনযােগ্য না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপক্ষকে রেকর্ডভুক্ত অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে উভয় যুক্তিকে প্রমাণ করতে হবে।
৮৮. আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সম্পর্কে আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবী নিবেদন করেন যে, পুলিশ কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় আপিলকারীদের তাদের রিমান্ডে রেখে নির্যাতন ও জবরদস্তির মাধ্যমে এসব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি বিবৃতি আদায় করেছে এবং সেই কারণে সেগুলাে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি ছিল না। এটি প্রথম বিজ্ঞ বিচারক কর্তক যুক্তি প্রদর্শন করে দেওয়া রায় থেকেই প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক এসব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিকে স্বেচ্ছায় প্রদত্ত স্বীকারােক্তি হিসেবে গ্রহণ করে আইনগত ভুল করেছেন এবং তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করে আইনগত ভুল করেছেন। আরাে বলা হয়েছে যে, ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকরা যেহেতু সুলতান শাহরিয়ার ও ফারুক রহমানের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে তাঁদের অভিমতের ক্ষেত্রে সমভাবে বিভক্ত ছিলেন, সেহেতু তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকেরও উচিত ছিল তাদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে বিবেচনায় নেওয়া।
৮৯. অপরদিকে জনাব আনিসুল হক এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, প্রথম বিজ্ঞ জজ রেকর্ডভুক্ত বিষয়াবলির ভুল ব্যাখ্যাই শুধু করেননি, উপরন্তু আইনের ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে উপরােক্ত অপরাধ স্বীকারােক্তিমূলক বিবৃতি অবিশ্বাস করেছেন এই যুক্তিতে যে, দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে আসামিদের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৬৭(২) ধারায় বর্ণিত মতে মেয়াদের। বাইরে একটি ব্যবস্থা’ (“device”) বলে পুলিশ রিমান্ডে রাখা হয়েছিল। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপক্ষের ৬১ নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন এবং নিবেদন করেন যে, আপিলকারী ফারুক রহমানকে ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বর্তমান মামলা রুজু হবার আগে লালবাগ থানার ১১(১১)৭৫ নম্বর মামলায় দু দফায় ১৩ দিনের এবং সুলতান শাহরিয়ারকে ১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর বর্তমান মামলায় গ্রেফতার দেখানাের আগে ঐ একই মামলায় ৩ দফায় ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী ফারুক রহমানকে ৩২ দিন পুলিশ রিমান্ডে রাখার পর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছিল এবং একইভাবে শাহরিয়ারকে ৩৪ দিন পুলিশ রিমান্ডে রাখার পর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছিল- এই মর্মে বিজ্ঞ প্রথম বিচারকের অভিমতগুলাে সঠিক নয়।
৯০. নথি থেকে এটি দৃষ্ট হয় যে, সুলতান শাহরিয়ারকে ১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর বর্তমান মামলায় গ্রেফতার দেখানাে হয়েছে। তাকে ১৯৯৬ সালের ৩০ নভেম্বর ৭ দিনের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং তারপর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। ফারুক রহমানকে ১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর বর্তমান মামলায় গ্রেফতার দেখানাে হয় এবং তারপর তাকে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ৭ দিনের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং এরপর ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। মহিউদ্দীনকে (আর্টিলারি) ১৯৯৬ সালের ১৯ নভেম্বর ৭ দিনের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং অতঃপর ১৯৯৬ সালের ২৭ নভেম্বর সে তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
৪৬৬

৯১. রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী বলেছেন, তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারার অধীনে প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর সুলতান শাহরিয়ারের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং স্বীকারােক্তিতে কী কী আছে তা আসামির কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার পর তিনি স্বীকারােক্তির সঠিকতা সম্পর্কে একটি সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন। দেখা যায় যে, সুলতান শাহরিয়ার উক্ত সাক্ষীর এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেননি যে, তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারায় আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করেছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী অবশ্য স্বীকার করেন যে, ফর্মের ৮ নম্বর কলামে কোনাে মন্তব্য ছিল না। এটি না থাকার ব্যাখ্যা তিনি এইভাবে দিয়েছিলেন যে, আসামি যেহেতু তার কাছে কোনােরকম দুর্ব্যবহারের অভিযােগ করেনি, তাই তিনি উক্ত কলামটি পূরণ করেননি। অবশ্য এই সাক্ষী এই মর্মে তাকে দেওয়া ডিফেন্স সাজেশন অস্বীকার করেন যে, জবরদস্তি ও নির্যাতনের মাধ্যমে আসামির স্বীকারােক্তি রেকর্ড করেছিলেন এবং আসামিকে অন্যায়ভাবে পুলিশ হাজতে আটক রাখা হয়েছিল, রেকর্ডকৃত স্বীকারােক্তি আসামিকে পড়ে শােনানাে হয়নি এবং এই স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত ছিল না। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী আরাে বলেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারা অনুসারে প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর তিনি ফারুক রহমানের স্বীকারােক্তি রেকর্ড করেছিলেন। তার স্বীকারােক্তি লিপিবিদ্ধ করার পর আসামিকে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাঠানাে হয়। একই দিনে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসামির প্রাপ্তি স্বীকার করেন এবং সে মর্মে একটি সার্টিফিকেটও ইস্যু করেন। আইনের প্রয়ােজনীয় বিধান অনুযায়ী দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি সম্পর্কে দোষ স্বীকারকারী আসামি ফারুক রহমান এই সাক্ষীর দেওয়া বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী এই ডিফেন্স সাজেশনও অস্বীকার করেন যে, তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় সিআইডির একজন এএসপি, তদন্তকারী অফিসার ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা তার কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী অবশ্য স্বীকার করেন যে, তিনি ফর্মের ৩, ৪, ৮ ও ১০-এর কলাম পূরণ করেননি; তবে তিনি এই ডিফেন্স সাজেশন অস্বীকার করেন যে, ফারুক রহমান তাকে পুলিশের নির্যাতনের কথা অবহিত করেছিলেন।
৯২. রাষ্ট্রপক্ষের ৫২ নম্বর সাক্ষী বলেছেন যে, মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারায় বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। তারপর একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করেছিলেন এবং আসামির স্বীকারােক্তি রেকর্ড করা হয়ে গেলে তাকে জেলহাজতে পাঠানাে হয়েছিল। মহিউদ্দীনও (অর্টিলারি) আইনের নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসারে তার বক্তব্য রেকর্ড করা সম্পর্কে এই সাক্ষী যা বলেছেন সেটাকে চ্যালেঞ্জ করেনি। রাষ্ট্রপক্ষের ৫২ নম্বর সাক্ষী অবশ্য স্বীকার করেন যে, ফর্মের এক নম্বর কলামটি শূন্য ছিল। তবে তিনি আসামিপক্ষের এই সাজেশন অস্বীকার করেন যে, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তার কাছে কোনাে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেনি কিংবা তদন্তকারী অফিসারের তৈরি করা একটি স্বীকারােক্তিতে সই করেছিল অথবা আসামির স্বাক্ষর পুলিশের উপস্থিতিতে জোর করে আদায় করা হয়েছিল এবং তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য বা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ছিল না। ফর্মের ১ নম্বর কলামে যা দেখা যায় তা হলাে রাষ্ট্রপক্ষের ৫২ নম্বর সাক্ষী সেখানে উল্লেখ করেছিলেন যে, মহিউদ্দীনকে ১৯৯৬ সালের ২৭ নভেম্বর সকাল ১১টায়। হাজির করা হয়েছিল এবং তার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছিল বেলা ২টায়। কাজেই আসামিকে হাজির করার সময় ও তারিখ এবং তার বক্তব্য রেকর্ড করার সময় যথাযথভাবেই উল্লেখ করা হয়েছিল। ফর্মের ৩ ও ৪ নম্বর কলাম হলাে আসামির স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার সময় ম্যাজিস্ট্রেটদের অনুসরণীয় কিছু নির্দেশাবলি ও পথনির্দেশনা। ৩ নম্বর কলামটি হচ্ছে দোষ স্বীকারকারী আসামিকে ৫ নম্বর কলামে বর্ণিত
৪৬৭

বিষয়াবলির প্রত্যেকটি ব্যাখ্যা করা এবং জবানবন্দি দেওয়ার আগে সাবধানে চিন্তাভাবনা করে দেখার জন্য তাকে সতর্ক করে দেওয়া-সংক্রান্ত। অবশ্য দেখা যায় যে, ৫ নম্বর কলামে আসামিকে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা দরকার ৬ নম্বর কলামে তাকে যথাযথভাবেই সেসব প্রশ্নের মুখােমুখি করা হয়েছিল। উপরােক্ত কলামগুলাে যথাযথভাবে পূরণ করা হয়েছিল। কাজেই এ ব্যাপারে আসামির কোনাে অভিযােগ-অনুযােগ থাকা উচিত নয়। এই সাক্ষী তাকে দেওয়া এই ডিফেন্স সাজেশন অস্বীকার করেন যে, জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তার কক্ষে পুলিশ অফিসার উপস্থিত ছিল। ৮ নম্বর কলামটি হচ্ছে। আসামি যে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছে সে ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টির যুক্তি বা কারণ-সম্পর্কিত। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন যে, আসামির দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আইন অনুযায়ী রেকর্ড করা হয়েছিল এবং আসামি তার দেওয়া জবানবন্দির সঠিকতায় সন্তুষ্ট হয়ে স্বাক্ষর দিয়েছিল। ১০ নম্বর কলামে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার পর আসামিকে প্রেরণ করার সময়টা উল্লেখ থাকে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন যে, জবানবন্দি রেকর্ড করার পর আসামিকে তিনি একই দিনে রেকর্ডসহ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
৯৩. দেখা যায় যে, স্বীকারােক্তি করতে ইচ্ছুক আসামিকে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই বাস্তবতা সম্পর্কে আশ্বাস লাভ করা যে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের ব্যাপারে কোনােরকম প্ররােচনা, হুমকি বা প্রতিশ্রুতির কারণে এই স্বীকারােক্তি দেওয়া হয়নি।
৯৪. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪৫ অধ্যায়ে সাধারণভাবে নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রম নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। কিছু কিছু অনিয়ম আছে, যেগুলাের কারণে মামলার কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ বা অকার্যকর হয় না। এগুলাে ৫২৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে। এই শ্রেণির মামলাগুলােতে আসামির ক্ষতিগ্রস্ত হবার কোনাে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ এই ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, এগুলাের কারণে মামলার কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ বা অকার্যকর হবে না। আরাে কতিপয় অনিয়ম আছে যেগুলাে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত এবং এসব ক্ষেত্রে আসামির ক্ষতির কারণ ঘটুক আর না ঘটুক, মামলার কার্যক্রমই অকার্যকর হয়ে যায়। ৫৩০ ধারায় এগুলাের উল্লেখ আছে। ৫৩১, ৫৩২, ৫৩৩, ৫৩৫ ও ৫৩৬ (২) ও ৫৩৭ ধারায় তৃতীয় এক শ্রেণির অনিয়ম নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। সেখানে মােটামুটিভাবে প্রশ্নটা হচ্ছে, ভুলের কারণে আসামির কোনাে ক্ষতি হয়েছে কিনা কিংবা ন্যায়বিচার ব্যর্থ হয়েছে কিনা। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কয়েক ধরনের ভ্রান্তিকে সতর্কতার সঙ্গে শ্রেণিবিন্যস্ত করেছে এবং এসব ভ্রান্তির ক্ষেত্রে কী করণীয় তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আদালত আইনসভার সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে কার্যকারিতা দিতে বাধ্য। এ নিয়ে আর কোনাে জল্পনা-কল্পনার কোনাে অবকাশ নেই। কেবল এক শ্রেণির মামলায় আদালত স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন আর সেগুলাে হলাে এমন মামলা যার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোনাে
বিধান রাখা হয়নি।
৯৫. বর্তমানের সুনির্দিষ্ট মামলায় কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের শুধু ৫৩৩ ধারাটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এ ব্যাপারে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৭ ধারার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা কালে সংঘটিত কোনাে ভুলভ্রান্তি বা বিচ্যুতি বা অনিয়মের ক্ষেত্রে এই ধারা কোনােভাবে প্রযােজ্য হবে না।
৯৬. ৫৩৩ ধারাটি নিম্নরূপ : “533. Non-compliance with provisions of section 164 or 364(1)-If any Court, before which a confession or other statement of an accused person
৪৬৮

recorded or purporting to be recorded under section 164 or section 364 is tendered or has been received in evidence, finds that any of the provisions of either of such sections have not been complied with by the Magistrate recording the statement, it shall take evidence that such person duly made the statement recorded; and, notwithstanding anything contained in the Evidence Act, 1872, section 91, such statement shall be admitted if the error has not injured the accused as to his defense on the merits.
(2) The provisions of this section apply to Courts of Appeal, Reference and Revision.”
৯৭. ১৬৪ বা ৩৬৪ ধারার কোনাে বিধান পালন না-করা থেকে উদ্ভূত কোনাে ভুল সংশােধনের একটা পদ্ধতির ব্যবস্থা এই ধারায় করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলাে, এ জাতীয় বিধান পালন না করার কারণে ন্যায়বিচারের ব্যাঘাত রােধ করা। রেকর্ডকৃত আসামির জবানবন্দি এই ধারা অনুসারে গ্রহণ করা যেতে পারে, জবানবন্দি যথানিয়মে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সে মর্মে সাক্ষ্য গ্রহণ করে, যদি বিধান পালন না করার কারণে আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে থাকে। ১৬৪ ও ৩৬৪ ধারার কোনাে বিধান প্রতিপালনে ব্যর্থতার কারণে রেকর্ডকৃত দোষ স্বীকারােক্তি বা বক্তব্য যদি অগ্রহণযােগ্য হয়, তাহলে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৯১ ধারায় যা-ই থাকুক না কেন এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি যথানিয়মে জবানবন্দি প্রদান করেছে- এটা প্রমাণ করার জন্য অপরিহার্য সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা যেতে পারে এবং এভাবে প্রমাণিত জবানবন্দিটি গ্রহণ যেতে পারে এবং মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বিধান প্রতিপালন পালন না করার ত্রুটি তখনই দূর হবে যখন গুণাগুণের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের ক্ষেত্রে আসামির কোনাে ধরনের ক্ষতি সাধিত হবে না।
৯৮. Mohammad Ali vs Emperor, 35 Cr LJ 385 (FB) মামলায় এই অভিমত নিমােক্তভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে :
“কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারাগুলাের বিধানসমূহের আলােকে, বিশেষ করে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৩ ধারায় বিধৃত বিধানগুলাের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা কঠিন যে, কেবল প্রশ্নোত্তর রেকর্ডভুক্ত করার কাজটা বাদ দেওয়াটা এক মারাত্মক ক্রটি। প্রশ্নোত্তর রেকর্ডভুক্ত করেই কোনাে একটা স্বীকারােক্তির মাধ্যমে উপাত্ত জোগানাে যায়, যার ভিত্তিতে আদালত এ স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত কিনা সে সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেন। এ কথা বলাও সমভাবে কঠিন যে, এসব তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করার সময় বিচারিক আদালতের পক্ষে এমন স্বীকারােক্তি যে স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে সেটা মূল্যায়ন করতে পারা সর্বদাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ত্রুটি বা ঘাটতিটা নিঃসন্দেহে এক মারাত্মক অনিয়ম এবং কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে এই কারণে গুণাগুণের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে আসামি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এ ধরনের ক্ষেত্র বাদে এমন একটা ত্রুটি বা ঘাটতি সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তােলার ব্যবস্থা রয়েছে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৩ ধারার বিধানাবলিতে। আসামির জবানবন্দি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হয়েছে কিনা সে মর্মে খােদ আসামির জবানবন্দিতে অন্তর্নিহিত সাক্ষ্য থেকে অথবা আসামির জবানবন্দি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হয়েছে মর্মে অন্য
৪৬৯

সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে আদালত অবাধে উপসংহারে পৌঁছতে পারেন। প্রশ্নোত্তরের রেকর্ডভুক্তি বাদ পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আদালতের সেই উপসংহারে পৌছানাের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এ কথাও বলা যায় না যে, এসব তথ্য ও উপাত্ত ছাড়া আদালতের পক্ষে এমন উপসংহারে আসা “অসম্ভব” যে, স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য যেখানে ত্রুটিটা শুধু এই নয় যে, আসামির বক্তব্য আদৌ যথাযথ আকারে ও আইনানুযায়ী রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি, উপরন্তু সেই জবানবন্দি মােটেই যথাযথভাবে দেওয়া হয়নি, সেক্ষেত্রে অবস্থাটা ভিন্ন রকম হয়ে দাড়াবে।”
৯৯. অবশ্য Kehar Singh-এর মামলায় (AIR 1988 SC 1883) Kehar Singh-এর স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছিল যেখানে নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল :
“উপরােক্ত সিদ্ধান্তগুলাে বিচার-বিবেচনা করে দেখা হলে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ১৬৪(২) ধারার বিধানাবলি অনুযায়ী স্বীকারােক্তি লিপিবদ্ধ করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারােক্তি প্রদানকারী ব্যক্তির কাছে এটি ব্যাখ্যা করবেন যে, তিনি দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য নন এবং তিনি স্বীকারােক্তি দিলে সেটি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ম্যাজিস্ট্রেটের যদি এ কথা বিশ্বাস করার কারণ ঘটে যে, স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হচ্ছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট সেই স্বীকারােক্তি লিপিবদ্ধ করবেন। কাজেই ১৬৪ ধারার (২) উপধারার প্রতিপালন বাধ্যতামূলক ও একান্ত প্রয়ােজনীয় এবং সেটা পালন করা না হলে সেই স্বীকারােক্তি সাক্ষ্যপ্রমাণে অগ্রহণযােগ্য হবে। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪৬৩ ধারায় (পুরাতন ৫৩৩ ধারা) এই বিধান বিধৃত রয়েছে যে, যে ক্ষেত্রে স্বীকারােক্তির ব্যাপারে প্রশ্নোত্তরগুলাে রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি, সে ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা নজির এটি প্রমাণ করা যায় যে, বস্তুতপক্ষে ২৮১ ধারার (পুরানাে ৩৬৪ ধারা) সঙ্গে পঠিত ১৬৪ ধারার (২) উপধারার শর্তাবলি প্রতিপালিত হয়েছে। আদালত যদি এমন সিদ্ধান্তে আসেন যে, সংশ্লিষ্ট ধারার শর্তাবলি বস্তুতপক্ষে প্রতিপালিত হয়েছে তবে সেক্ষেত্রে শুধু স্বীকারােক্তি যথাযথ আকারে রেকর্ডভুক্ত না হবার কারণে সেটি সাক্ষ্যপ্রমাণে অগ্রহণযােগ্য হবে না এবং এ সংক্রান্ত ত্রুটিটা ৪৬৩ ধারায় দূর হয়ে যাবে। তবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৬৪ (২) ধারার বাধ্যতামূলক শর্তাবলি যদি প্রতিপালন করা না হয় এবং সাক্ষ্যপ্রমাণে যদি বেরিয়ে আসে যে, উপরােক্ত উপধারায় যেভাবে বলা আছে সেভাবে ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে ঐ জাতীয় কোনাে ব্যাখ্যা প্রদান করেননি, তাহলে এই উল্লেখযােগ্য ত্রুটিটা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪৬৩ ধারায় দূর করা যাবে না।”
১০০. অবশ্য দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম বিজ্ঞ জজ আপিলকারীদের উপর্যুপরি রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়টি এবং আইনের বিধানসমূহ কথিত মতে প্রতিপালিত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলােকে গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছিলেন যে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে আপিলকারীদের অন্যান্য মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার ব্যাপারটি ছিল উপরােক্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপক্ষের গৃহীত ‘কৌশল’। নথিপত্র থেকে আরাে দেখা যায় যে, সুলতান শাহরিয়ার স্বীকারােক্তি দেওয়ার ৫২ দিন পর ১৯৯৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঐ স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করে। ফারুক রহমান স্বীকারােক্তি করার ৪৩ দিন পর ১৯৯৩ সালের ১ মার্চ তা প্রত্যাহার করে এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তি প্রদানের ৩০ দিনেরও বেশি সময় পার হবার পর তার স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করে। স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের আবেদনপত্র পেশের ব্যাপারে এত বিলম্ব সম্পর্কে আসামিপক্ষের তরফ থেকে কোনাে ব্যাখ্যা না থাকায় এটি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আপিলকারীদের
৪৭০

প্রদত্ত বক্তব্যে যেসব কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল তা স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের মাধ্যমে নস্যাৎ করার জন্য পরবর্তী চিন্তাভাবনাপ্রসূত এক কৌশল।
১০১. Joygun Bibi 12 DLR (SC)157 মামলায় স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের ফল সম্পর্কে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“আমরা এ ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারকদের দেওয়া আইনের ব্যাখ্যা সমর্থন করতে অপারগ। স্বীকারােক্তির প্রত্যাহার হলাে একটা পরিস্থিতি, যা প্রথমত এই স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে কিনা সেই প্রশ্নে এবং দ্বিতীয়ত স্বীকারােক্তিটা সত্য কিনা পরবর্তী সেই প্রশ্নের উপর কোনাে ধরনের প্রভাব ফেলে না। স্বীকারােক্তি যিনি প্রদান করেন পরবর্তীকালে তিনি সেটিতে অবিচল না থাকলে কেবল এটিই স্বীকারােক্তিটা স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছিল কিনা, এবং স্বেচ্ছায় দেওয়া হলে স্বীকারােক্তিটা সত্য ছিল কিনা সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার উপর সরাসরি কোনাে প্রভাব ফেলতে পারে না। কেননা অভিযােগের পরিণতির সরাসরি মুখােমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে অভিযুক্ত করে দেওয়া বিবৃতি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি ঐ সকল পরিণতির নৈকট্য বিচারে পুরােপুরি ব্যাখ্যাযােগ্য, স্বীকারােক্তিটা স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে কিনা কিংবা তাতে উল্লেখ করা কথাগুলাে সত্য কিনা তার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকার কোনাে প্রয়ােজনই নেই। বিজ্ঞ বিচারকরা প্রথমত এই দুটো প্রশ্নের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে এবং জবাবগুলাে ইতিবাচক হওয়ায় অন্যান্য তথ্য পরিস্থিতির সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে দোষ স্বীকারােক্তিটা আবদুল মজিদের দোষী সাব্যস্তকরণ সমর্থনের জন্য যথেষ্ট- এ কথা ঘােষণা করে অত্যন্ত সঠিক কাজ করেছেন। স্বীকারােক্তিটা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত এবং সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ায় স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি নিতান্তই গুরুত্বহীন। এই অবস্থায় অপরাধ স্বীকারােক্তিকে সহ-আসামির বিরুদ্ধে বিবেচনায় নিতে বিজ্ঞ বিচারকদের অপারগতা বােধ করার কোনাে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কথা আবদুল মজিদের স্বীকারােক্তি ছাড়া জয়গুন বিবির বিরুদ্ধে যদি অন্য কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ না থেকে থাকে তাহলে স্বীকারােক্তিটা স্রেফ একটা বিবেচনাযােগ্য বিষয় হওয়ায় এবং জয়গুন বিবির বিরুদ্ধে সেটার সাক্ষ্য প্রমাণ হওয়ার বৈশিষ্ট্য বা যােগ্যতা না থাকায় আইনত সঠিকভাবেই বলা যেতে পারত যে, কেবল স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্তকরণ টেকে না। যদি স্বীকারােক্তিও প্রত্যাহার করে নেওয়া হতাে তাহলে এমন উপসংহারের পক্ষের যুক্তিগুলাে নিঃসন্দেহে জোরালাে হতাে। কিন্তু বর্তমান মামলায় আবদুল মজিদের স্বীকারােক্তি কোনােক্রমেই জয়গুন বিবির বিরুদ্ধে বিবেচনাযােগ্য একমাত্র বিষয় নয়। দেখা যাবে যে, গৃহপরিচারিকা জহুরার দেওয়া সাক্ষ্য থেকে আলােচ্য রাতে, বিশেষ করে হত্যার সময় ও পরে জয়গুন বিবির গতিবিধি ও আচরণের এক অতি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। জহুরার সাক্ষ্য ও আব্দুল মজিদের স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে জয়গুন বিবিকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার জবাবে তিনি তার সে রাতের আচরণের কোনাে ব্যাখ্যা দেননি। তিনি নির্দোষ এবং তার স্বামীর ছােটভাই সাত্তার তার বিরুদ্ধে এই মামলা সাজিয়েছে- এই কথাগুলাের পুনরাবৃত্তির মধ্যেই তিনি তুষ্ট থেকেছেন।”
১০২. State vs Mithun alias Gul Hassan, 16 DLR (SC) 598 মামলায়ও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, যা নিম্নরূপ-
“স্বীকারােক্তিগুলাের ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাইকোর্ট এই বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথভাবে সচেতন ছিলেন যে, judicial or extrajudicial স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করা হলে সেটা স্বীকারােক্তিকারীর বিরুদ্ধে
৪৭১

আইনত বিবেচনায় নিতে হবে এবং যদি সেই স্বীকারােক্তি সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত বলে প্রতিভাত হয় সেক্ষেত্রে সেটার সমর্থনে আরাে কিছু খুঁজতে যাওয়ার আদৌ প্রয়ােজন পড়ে না। এটা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয় যে, judicial or extrajudicial স্বীকারােক্তি যদি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় বা না হয়, তারপরও সেটি দোষী সাব্যস্ত করার একমাত্র আইনসিদ্ধ ভিত্তি হতে পারে, যদি আদালত এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, স্বীকারােক্তিটা সত্য ও স্বেচ্ছায় প্রদত্ত এবং তা নির্যাতন বা জবরদস্তি বা প্ররােচনার দ্বারা আদায় করা হয়নি। একটি নির্দিষ্ট মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতিতে আদালত একমাত্র এমন স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে কাজ করবেন কিনা সে প্রশ্নটা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিষয়টা স্বীকারােক্তির গুরুত্ব ও এর সাক্ষ্যগত মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, আইনে এর গ্রহণযােগ্যতার সঙ্গে নয়।”
১০৩. Mohd. Hussain Umar vs KS Dalipsinghhi, AIR 1970 SC 45, Ram Prakash vs State of Punjab AIR 1959 SCI, 47 State vs Fazu Kazi alias Kazi Fazlur Rahman 29 DLR (SC) 271 মামলায়ও একই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
১০৪. স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির গুরুত্ব প্রসঙ্গে উচ্চতর আদালতগুলাের অভিমত হলাে এই যে, স্বীকারােক্তি আইন অনুসারে রেকর্ডভুক্ত করা হলে, সেটি সত্য, স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ও অভিযােগমূলক চরিত্রের বলে প্রমাণিত হলে এবং সামগ্রিকভাবে জবানবন্দিটি পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে, মামলার বাকি অংশের তুলনায় সেটা সঙ্গতিপূর্ণ তাহলে সেই স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। একটি মামলায় এর সমর্থনে কী পরিমাণ তথ্য প্রয়ােজন হতে পারে সেটা সর্বদাই হবে এমন একটি বিষয় যা প্রতিটি মামলার পরিস্থিতির আলােকে নির্ণয় করতে হবে। কখনাে কখনাে সমর্থনমূলক সাক্ষ্যপ্রমাণ না-ও পাওয়া যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে স্বীকারােক্তিটি প্রত্যাহার করা হােক বা না হােক, আদালত সেই স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে স্বীকারােক্তিকারীর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন, যদি দেখা যায় যে স্বীকারােক্তিটা সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত এবং যদি তা নির্যাতন, জবরদস্তি বা প্ররােচনার মাধ্যমে আদায় করা না হয়ে থাকে। এ ধরনের মামলাকে দেখার উপযুক্ত পন্থা হলাে স্বীকারােক্তিকে একেবারেই বিবেচনা থেকে বাদ দিয়ে প্রথমে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখা এবং এর ভিত্তিতে যদি তা বিশ্বাসযােগ্য হয়, যদি দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়, তাহলে সত্যিই সেটা করা যায় কিনা তা দেখা। যদি স্বাধীনভাবে এটি বিশ্বাস করা সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই স্বীকারােক্তিকে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে সাহায্যার্থে তলব করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। আদালত যেখানে অপর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করতে প্রস্তুত নন তখন তেমন পরিস্থিতিতে বিচারক সাহায্যার্থে স্বীকারােক্তির প্রতি দৃষ্টি দিতে পারেন এবং
অপর সাক্ষ্যপ্রমাণকে সমর্থিত করার জন্য সেটা ব্যবহার করতে পারেন।
১০৫. দেখা যায় যে, সুলতান শাহরিয়ারের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি হচ্ছে সেরনিয়াবাতের বাসভবনের সামনে এবং তারপর বেতার কেন্দ্রে তার উপস্থিতি-সংক্রান্ত, যা অপর দুজনের অর্থাৎ সৈয়দ ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দ্বারা সমর্থিত। তার পরবর্তী আচরণ-সম্পর্কিত তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রাষ্ট্রপক্ষের ১৫, ৪২ ও ৪৬ নম্বর সাক্ষী কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। ফারুক রহমানের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আসামি সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১, ৪, ১১, ১২, ১৫, ২১, ৪২ ও ৪৬ নম্বর সাক্ষী তাদের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাগুলাে সমর্থন করেছেন। মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি অপরাপর স্বীকারােক্তিকারী আসামি কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাসমূহে সমর্থিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১৭, ১৮, ২৭ ও ৩৪ নম্বর সাক্ষীও তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সমর্থন
৪৭২

করেছেন। রাতের কুচকাওয়াজে তার উপস্থিতি সম্পর্কে সে যে স্বীকারােক্তি দিয়েছে তা রাষ্ট্রপক্ষের ১১, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৯ ও ৩৫ নম্বর সাক্ষী কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে।
১০৬. পরবর্তী প্রশ্ন হলাে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় উপরােক্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত বলে যদি প্রতিভাতও হয় তাহলেও কি তা স্বীকারােক্তি প্রদানকারী ও সহ-ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আপিলকারীদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য কিনা। ১০৭. দেখা যায় যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা কেবল তখনই কার্যকর হবে যখন আদালত এ কথা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে বলে সন্তুষ্ট হন যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ সংঘটন বা অভিযােগযােগ্য অন্যায় করার জন্য একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে। অর্থাৎ কোনাে ব্যক্তির কার্যক্রমকে তার ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারার আগে সেই ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের একটা পক্ষ ছিল- এই মর্মে আপাত গ্রহণযােগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে। এ ধরনের যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অস্তিত্ব থাকলে অভিপ্রায় গৃহীত হবার পর সেই অভিন্ন অভিপ্রায় প্রসঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন কিছু বললে, লিখলে বা করলে তা। অন্যদের বিরুদ্ধেও প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। সেটা শুধু ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যই নয়, উপরন্তু এই বিষয়টিও প্রমাণ করার জন্য যে, অপর ব্যক্তিও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। ঐরূপ কাজের সাক্ষ্যগত মূল্য দুটো অবস্থার দ্বারা সীমাবদ্ধ : যথা, কাজটি তাদের অভিন্ন অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে এবং তাদের যে কোনাে একজন মনে মনে পােষণ করেছে এমন একটা সময়ের পর সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে হতে হবে।
১০৮. ষড়যন্ত্র বলতে বােঝায় যে, একটা অপরাধ সংঘটনের জন্য দুই বা ততধিক ব্যক্তির যৌথ কর্মকাণ্ডের চেয়েও বেশি কিছু; সেটা যদি ভিন্নভাবে হয়, তাহলে দুই বা ততােধিক ব্যক্তি কর্তৃক একত্রে সংঘটিত যে কোনাে অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ ধারা প্রযােজ্য হবে এবং সে অনুযায়ী সেই অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে শ্রুতিমূলক সাক্ষ্যের (hearsay evidence) ব্যবহার হবে যার মােকাবিলা করা অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে। অসম্ভব হবে। এই ধারার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ষড়যন্ত্র চলাকালে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে ষড়যন্ত্র কার্যকর করার বিষয় নিয়ে যেসব যােগাযােগ বা কথাবার্তা হয়েছিল, সে-সংক্রান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণকে মেনে বা স্বীকার করে নেওয়া। এখন প্রশ্ন হলাে, ১০ ধারার ব্যাখ্যা এত বিশদ করা সম্ভব কিনা যাতে করে অতীতে একটা ষড়যন্ত্র সম্পন্ন হবার পর সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রকৃত কার্যক্রমে কী কী করা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে একজন ষড়যন্ত্রকারীর দেওয়া স্বীকারােক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
১০৯. Emperor of India os Abani Bhusan Chakraborty, 15 CNN 25 মামলায় প্রশ্ন উঠেছিল, সহ-আসামিদের স্বীকারােক্তি এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অধীনে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় কিনা। উপরােক্ত সিদ্ধান্তে ফুল বেঞ্চ নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন:
“প্রথম সাক্ষ্যটির কাজ যা আমরা কিছুক্ষণ আগে উল্লেখ করেছি। ব্রিটিশ রাজের পক্ষ থেকে যুক্তিসহকারে বলা হয়েছে যে, ঐ বক্তব্যটা ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার বিধানাবলির আওতার মধ্যে আসে এবং সেহেতু, সেটিকে অবনীর সহবন্দিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য বলে গণ্য করতে হবে। এটি বলা হয়েছে যে, ঐ বক্তব্যটি যদি কোনােক্রমে ১০ ধারার মধ্যে না পড়ে তাহলে ৩০ ধারার বিধানাবলির অধীনে এটা সহ-আসামিদের একজনের স্বীকারােক্তি হবে এবং বিচার চলাকালে এই স্বীকারােক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে। মি. রায় যথেষ্ট মাত্রায় যুক্তিসহকারে বলেছেন যে, যে অবস্থায়ই
৪৭৩

হােক না কেন এর গুরুত্ব তার সহযােগীর বক্তব্যের গুরুত্বের চেয়ে বেশি হতে পারে না এবং বস্তুতপক্ষে এর গুরুত্ব একজন সহযােগীর সাক্ষ্যের গুরুত্বের চেয়ে কম। কারণ একজন সহযােগীকে তার বক্তব্যের সঠিকতা যাচাই করার জন্য জেরা করা যেতে পারে। অন্যদিকে অবনী যখন বন্দি ছিল তখন তার এই স্বীকারােক্তির সঠিকতা পরীক্ষা করার উপায় নেই। সেই যুক্তির মধ্যে অবশ্যই যথেষ্ট সারবত্তা থাকায় আমরা এই উপসংহারে পৌছেছি যে, অবনীর জবানবন্দিকে এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অধীনে সাক্ষ্য হিসেবে যথাযথ গণ্য করা করা চলে না। আমাদের মতে ঐ ধারাটির উদ্দেশ্য হলাে ষড়যন্ত্র চলাকালে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে ষড়যন্ত্র কার্যকর করা নিয়ে যে যােগাযােগ ঘটেছিল সে-সংক্রান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ দেওয়া। কোনাে সন্দেহ নেই যে, ষড়যন্ত্রের মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপারে ১০ ধারার ব্যাপ্তি ইংল্যান্ডের আইনের চেয়েও বেশি। তবে আমরা মনে করি না যে, ঐ ধারাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সাক্ষ্যকে সহ-আসামির স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে পরিণত করা এবং সেটিকে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে কিংবা ষড়যন্ত্রকারী ও অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যােগাযােগ বা কথাবার্তা আদান-প্রদানের মতাে একই অবস্থানে ফেলা। তবে ৩০ ধারার ব্যাপারে আমাদের অভিমত হলাে, বক্তব্যটা একজন সহ-আসামির স্বীকারােক্তি হওয়ায় সেটাকে ওই ধারার আওতায় দেখা যেতে পারে। কিন্তু জেরার মাধ্যমে এই বক্তব্যকে যাচাই করে দেখা সম্ভব হয় না বিধায় এর গুরুত্ব খর্ব হয়ে যায়।”
১১১. এই বিষয়টি তখন Mirza Akbar os King Emperor, AIR 1940 (PC) 176 মামলায় বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রিভি কাউন্সিলের মাননীয় সদস্যরা বিভিন্ন ক্ষমতা ও এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা বিচার-বিবেচনা করে নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন :
“নীতিটা এই হওয়ায় মহামান্য বিচারপতিরা মনে করেন যে, ১০ ধারার কথাগুলােকে এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাখ্যা করতে হবে। কথাগুলাের এমন বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়াও সম্ভব নয়, যাতে করে একজন ষড়যন্ত্রকারীর অনুপস্থিতিতে ষড়যন্ত্রকারীর দেওয়া বিবৃতিকে তার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অতীতে এই ষড়যন্ত্র সম্পন্ন হয়ে যাবার পর সেই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার গতিপথে যেসব কাজ হয়েছিল, বিবৃতি বা বক্তব্যটা হলাে সেই সম্পর্কিত, অভিন্ন অভিপ্রায়টা হলাে অতীতের। বিচারপতিদের রায়ে উল্লিখিত অভিন্ন অভিপ্রায়’ কথাগুলাের দ্বারা সেই সময়ে অস্তিত্বমান অভিন্ন অভিপ্রায়কে বােঝানাে হয়েছে যখন ষড়যন্ত্রকারীদের একজন এ বিষয়ে বলেছিল, করেছিল বা লিখেছিল। অভিন্ন অভিপ্রায়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি একবার দেখানাে হয়ে গেলে ষড়যন্ত্র চালু থাকা অবস্থায় যে বিষয়গুলাে সম্পর্কে বলা হয়েছিল, করা হয়েছিল কিংবা লেখা হয়েছিল সেগুলােই অভিন্ন অভিপ্রায়ের সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। তবে এ কথা বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে যে, অভিন্ন অভিপ্রায় বা ষড়যন্ত্র যখন আর কার্যকর না থাকে, যখন এর কোনাে অস্তিত্বই আর থাকে না, তখন তৃতীয় পক্ষের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হলে বা সে সম্পর্কে কোনাে বিবৃতি বা স্বীকারােক্তি দেওয়া হলে তা অপর পক্ষের বিরুদ্ধে গ্রহণযােগ্যতা পাবে। তাহলে এক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের কোনাে অভিন্ন অভিপ্রায় নেই, যার প্রসঙ্গ ধরে এই জবানবন্দি ভিত্তি হতে পারে। মহামান্য বিচারপতিদের রায়ে ১০ ধারাটিতে এই নীতিমালা বিধৃত হয়। এটাই হলাে সেই
৪৭৪

ব্যাখ্যা যা ভারতে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সঠিকভাবেই ১০ ধারার ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা হয়েছে, যেমন 55 Bom 839 নম্বর মামলা এবং 38 Cal 169 নম্বর মামলা। এই মামলাগুলােয় ষড়যন্ত্র চলাকালে ষড়যন্ত্র কার্যকর করার প্রসঙ্গ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের নিজেদের মধ্যেকার যােগাযােগ এবং গ্রেফতারের পর কিংবা ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যাবার পর সেই অতীত ঘটনাবলির বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রদত্ত বিবৃতির মধ্যে সঠিকভাবেই পার্থক্য টানা হয়েছিল।”
১১২. দেখা যাবে যে, ‘in reference to their common intention’ কথাটা অত্যন্ত ব্যাপক এবং পেনাল কোডের ৩৪ ধারায় ব্যবহৃত ‘অভিন্ন অভিপ্রায় অনুসারে’ (‘in furtherance of the common intention’) কথাগুলাের চাইতে বৃহত্তর অর্থগত পরিধি জোগানাের জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে উপরের ঐ কথাগুলাে ব্যবহার করা হয়েছিল। এর ফলে ষড়যন্ত্র প্রণীত হবার পর একজন ষড়যন্ত্রকারী যা কিছু বলেছেন, করেছেন বা লিখেছেন সেটাই অপর ষড়যন্ত্রকারী ষড়যন্ত্রের ময়দানে প্রবেশ করার আগে বা ষড়যন্ত্রের ময়দান ত্যাগ করার পর তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
১১৩. ১০ ধারা বিশ্লেষণ করে Bhagaban Swarup vs State of Maharashtra, AIR 1965 SC 682 মামলায় নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে:
“এমনিভাবে যা বলা হয়েছে, করা হয়েছে বা লেখা হয়েছে তা এমন ষড়যন্ত্রকারী বলে বিশ্বাস করা প্রত্যেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটা প্রাসঙ্গিক তথ্যমাত্র। সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এবং এমন যে কোনাে ব্যক্তি যে সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল তা দেখিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এটা প্রাসঙ্গিক তথ্য।” ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে কিংবা এমন এক ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তা প্রমাণ করার কাজেই শুধু এই তথ্যকে ব্যবহার করা যেতে পারে। সংক্ষেপে এই ধারাটি নিমােক্তভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে-
“(১) আদালতের এ কথা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি জোগানাের মতাে আপাত গ্রহণযােগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সদস্য;
(২) উক্ত শর্তটি পূরণ হলে ষড়যন্ত্রের অংশীদারদের যে কোনাে একজন তাদের অভিন্ন অভিপ্রায় সম্পর্কে কোনাে কিছু বলেছেন, করেছেন বা লিখেছেন এমন যে কোনাে কিছু অপরজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।
(৩) তার বলা, করা বা লেখা যে কোনাে কিছু তাদের যে কোনাে একজনের দ্বারা অভিপ্রায় ব্যক্ত হবার পর সে-ই বলেছে, করেছে বা লিখেছে বলে ধরে নিতে হবে;
(৪) ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আরেকজনের বিরুদ্ধে উক্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেও এটা প্রাসঙ্গিক হবে; তা সেই ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হবার আগে কিংবা সে ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে যাবার পর সেটি বলা, করা বা লেখা হলে; এবং
(৫) একজন সহ-ষড়যন্ত্রকারীর অনুকূলে নয়, বরং তার বিরুদ্ধেই কেবল এটা ব্যবহার করা যাবে।”
১১৪. Zulfiqar Ali Bhutto vs State PLD 1979 SC 53 478 State vs Nalini (1999) 5 SCC 283 মামলায়ও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। Maqbool Hussain vs State, 12 DLR SC 217 মামলায় রেজিস্টারে তাঁর নাম পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ঘুষের টাকা দেওয়ার সময় তহশিলদারকে অপর দুই আসামি
৪৭৫

যা বলেছিল বলে কথিত তার ওপরই সম্পূর্ণরূপে মকবুল হােসেনের বিরুদ্ধে মামলাটি দাঁড়িয়েছিল। বিচারে ঐ দুই আসামি তাদের কথিত বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রশ্ন যেটা উঠেছিল তা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে দুই সহ-আসামির জবানবন্দি এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ও ৩০ ধারা বলে রাষ্ট্রপক্ষের হাতে ছিল কিনা। এ-সংক্রান্তে অভিমত নিমােক্তভাবে দেওয়া হয়েছিল :
১১৫. এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় ঘােষণা করা আছে যে, যেখানে এ কথা বিশ্বাস করার মতাে যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ বা নালিশযােগ্য অন্যায় সংঘটনের জন্য একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে, সেখানে ঐ ব্যক্তিবর্গের কেউ অভিন্ন অভিপ্রায় ব্যক্ত করার পর তাদের কেউ একজন অভিন্ন। অভিপ্রায় প্রসঙ্গে কিছু বললে, করলে বা লিখলে সেটা এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করে এমন প্রতিটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে এবং ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের কাজে ও সেই ষড়যন্ত্রে ঐ ব্যক্তিদের যে কেউ জড়িত ছিল তা প্রমাণ করার ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক ঘটনা বলে পরিগণিত হবে। এই ধারাটির সরল পাঠ এটি পরিষ্কার করে যে, ১০ ধারাটি আকৃষ্ট করার জন্য সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের কর্মকাণ্ড বা বক্তব্য ছাড়াও পূর্ববর্তী ষড়যন্ত্রের আপাত গ্রহণযােগ্য কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ অবশ্যই থাকতে হবে। আপিলকারী ও দুই রেভিনিউ অফিসারের মধ্যে পূর্ববর্তী ষড়যন্ত্রের এমন সাক্ষ্যপ্রমাণ এই মামলায় দৃশ্যমানভাবে অনুপস্থিত।
১১৬. তদনুযায়ী যখন এটি বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গগত কারণ থকে যে, কোনাে অপরাধ সংঘটনের জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে; অভিন্ন অভিপ্রায় সাদরে গৃহীত হবার পর ষড়যন্ত্রকারীদের একজন যদি সেই অভিন্ন অভিপ্রায় সম্পর্কে কোনাে কিছু বলে বা করে থাকে বা লিখে থাকে তাহলে সেটা ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যই শুধু নয়, সেই ষড়যন্ত্রে যে অপর ব্যক্তিও জড়িত ছিল তা প্রমাণের জন্যেও অপর ব্যক্তির বেলায় প্রাসঙ্গিক। এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় সাক্ষ্যপ্রমাণের গ্রহণযােগ্যতার ব্যাপারে দুটো আপত্তি থাকতে পারে। প্রথমত, ষড়যন্ত্রকারী যার সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ-ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে গৃহীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে যা সহ-ষড়যন্ত্রকারী আদালতে মােকাবিলা করছে না এবং দ্বিতীয়ত, বাদিপক্ষ এ কথা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অস্তিত্বই শুধু প্রমাণ করে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্র করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে সহ-ষড়যন্ত্রকারীকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রতিনিধিত্বের সম্পর্কের অস্তিত্ব ক্রিয়াশীল হয়।
১১৭. অবশ্য ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য অর্জিত হবার পর বা ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যাবার পর কিংবা ষড়যন্ত্র পরিত্যক্ত হবার পর কিংবা তা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর কিংবা ষড়যন্ত্রকারী মাঝপথে ষড়যন্ত্র পরিত্যাগ করার পর কোনাে বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া হলে তা সহ-ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে গ্রহণযােগ্য হবে না। এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার বিধান ষড়যন্ত্রের অস্তিত্বের সময়েই শুধু প্রযােজ্য হবে বিধায়, ষড়যন্ত্রের মেয়াদ বা সময় বা কাল নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
১১৮. উপরে উল্লিখিত আইনগত অবস্থানের আলােকে দেখা যায় যে, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দেওয়া উপরােক্ত স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আপিলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণের জন্য প্রাসঙ্গিক ঘটনা নয়। আগেই বলা হয়েছে যে, আইনের বিধানাবলি পাশ কাটিয়ে ও কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধানাবলি পালন না করে আসামিদের উপর্যুপরি রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রথম বিজ্ঞ বিচারক স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলােকে গ্রহণ করেননি এবং বলেছিলেন যে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে আপিলকারীদের অন্য মামলার ব্যাপারে রিমান্ডে নেওয়া ও আপিলকারীদের গ্রেফতার দেখানাের ব্যাপারটা তাঁর মতে রাষ্ট্রপক্ষের গৃহীত একটা কৌশল।।
৪৭৬

১১৯. এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উক্ত অপরাধ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলােকে যদি বিবেচনার বাইরে রাখা হয় তবে সে ক্ষেত্রে রেকর্ডভুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ শুধু তদানীন্তন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র প্রকাশ পায়, নাকি প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যার ষড়যন্ত্র প্রকাশ করে।
১২০. এই প্রশ্নটি এবং সেই সঙ্গে পঞ্চম ভিত্তি অর্থাৎ হত্যার অভিযােগ বিবেচনা করে দেখার আগে সংবিধানের ১০৩(৩) অনুচ্ছেদের পরিধিও বিবেচনা করে দেখতে হবে। কারণ উপরের এই প্রশ্নটি নিষ্পত্তি করতে গেলে ঘটনা ও তথ্যাবলির প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই সামনে আসবে।
১২১. ১০৩(৩) অনুচ্ছেদটি ভারতের সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদের মতাে হুবহু একই কথায় প্রকাশ করা হয়েছে।
১২২. আলােচ্য প্রশ্নে এই বিভাগের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ছাড়াও Hargun Sundar Das vs State of Maharashtra, AIR 1970 SC 1214 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট দোষী সাব্যস্তকরণের বিরুদ্ধে এক আপিল মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যায়নে নিজের এখতিয়ারের পরিধি পর্যালােচনাকালে নিমােক্ত অভিমত ব্যক্ত করেছেন-
“এই আদালত সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদ-বলে প্রায়শই যে কথার উল্লেখ করে এসেছে আমরা তার যথাযথ পুনরাবৃত্তিটুকুই করতে পারি। এই আদালত সাধারণত ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালােচনা করতে যান না, যদি না আইনবিরুদ্ধ কোনাে কিছুর দ্বারা কিংবা পদ্ধতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়মের দ্বারা বিচারকার্য কলুষিত হয় কিংবা স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের রীতিনীতি লঙ্ঘন করে বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং তার ফলে আসামির প্রতি অন্যায় করা হয় অথবা আপিলের অধীনে কোনাে রায় বা আদেশের পরিণতিতে ন্যায়বিচার প্রয়ােগে গুরুতর ব্যর্থতা ঘটে। এই অনুচ্ছেদে এই আদালতকে উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলােতে হস্তক্ষেপ করার বিশেষ বিবেচনামূলক ক্ষমতা সংরক্ষিত করেছে, যখন বিশেষ বিশেষ কারণে আদালত মনে করবেন যে, ন্যায়বিচারের বৃহত্তর স্বার্থে এই হস্তক্ষেপ করার প্রয়ােজন আছে।”
১২৩. Metro vs State of UP, AIR 1971 SC 1050, Subedar vs State of UP, AIR 1971 SC 125472 | Rain Sanjiban Singh os State of Bihar, AIR 1996 SC 3265 মামলায়ও একই রকম অভিমত
ব্যক্ত হয়েছে।
১২৪. ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আপিলকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের ৭ নম্বর সাক্ষী লে. কর্নেল আবুল বাশার বিএ, রাষ্ট্রপক্ষের ৯ নম্বর সাক্ষী লে. কর্নেল (অব) আবদুল হামিদ, রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী এএলডি সিরাজুল হক, রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী হাবিলদার মাে. আমিনুর রহমান (অব), রাষ্ট্রপক্ষের ২৫ নম্বর সাক্ষী নায়েক মাে. ইয়াসিন, রাষ্ট্রপক্ষের ৩৭ নম্বর সাক্ষী মাে. রিয়াজুল হক, রাষ্ট্রপক্ষের ৪০ নম্বর সাক্ষী অনারারি লেফটেন্যান্ট সৈয়দ আহমদ, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী কর্নেল শাফায়াত জামিল, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৫ নম্বর সাক্ষী মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৭ নম্বর সাক্ষী মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৮ নম্বর সাক্ষী এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার এবং রাষ্ট্রপক্ষের ৪৯ নম্বর সাক্ষী রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খানের প্রদত্ত সাক্ষ্য স্পষ্টতই বিদ্রোহ। ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত এবং প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার-পরিজনদের হত্যা করার অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব বর্তমান আপিলগুলাের ক্ষেত্রে নেই। অথচ বিজ্ঞ বিচারকরা পেনাল কোডের ১২০বি ধারায় আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ বেআইনিভাবে বহাল রেখেছেন।।
৪৭৭

১২৭. ইংল্যান্ডের কমন ল অনুসারে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে একটা বেআইনি লক্ষ্য অর্জনের জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে একটা ঐকমত্য- এখানে বেআইনি কথাটা বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। অপরাধটা হলাে একত্র হওয়া। যতক্ষণ এ জাতীয় পরিকল্পনা শুধু অভিপ্রায়ের মধ্যে ন্যস্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত তা অভিযােগযােগ্য নয়। যখন দুজন সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য একমত হয় তখন খােদ পরিকল্পনাটাই একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সেই কারণে মতৈক্য অনুসারে পরবর্তী কোনাে কাজ করা না হলেও অপরাধটা সম্পন্ন হয়ে যায় এবং যদি এমন হয় যে, আলাপ-আলােচনার পর্যায় অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু সেখানে সংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র। বাস্তবায়নে কী পন্থা অবলম্বন করা হবে সে বিষয়টি নিষ্পত্তি না করলেও সেটা হবে ‘ষড়যন্ত্র। এমন কোনাে কথা নেই যে, ষড়যন্ত্রের অভিযােগ আনা হয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে সেই ষড়যন্ত্রের একজন সহযােগীও হতে হবে।।
১২৮. এ বিষয়টি ইংলিশ আইনে (English Law) ভালােভাবেই নিষ্পত্তি করা আছে। রাসেল অন ক্রাইম (দ্বাদশ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২) থেকে নিমােক্ত অনুচ্ছেদটি কার্যকরভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে-
“ষড়যন্ত্রের অপরাধের মূল কথাটা তাহলে সেই অপরাধটি করা নয় বা যে উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র প্রণীত সেটি কার্যকর করা নয় কিংবা সেগুলাে করার চেষ্টা করা নয় কিংবা সেগুলাে করতে অন্যদের প্ররােচিত করা নয়, বরং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলাের মধ্যে একটা স্কিম তৈরি করা বা মতৈক্য গড়ে তােলা। মতৈক্য অপরিহার্য। কেবল পরিকল্পনা অবগত হওয়া কিংবা তা নিয়ে আলােচনা করাটাই যথেষ্ট নয়।”
১২৯. গ্ল্যানভিল উইলিয়ামস (Glanville Williams) তাঁর ক্রিমিন্যাল ল (দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৮২) গ্রন্থে বিষয়টা উদাহরণ সহকারে ব্যাখ্যা করেছেন-
“লােয়া মামলায় (Lowa case) প্রশ্নটা উঠেছিল, তবে দুষ্কর্মে সহযােগিতার প্রসঙ্গের তুলনায় বরং ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গটিই সেখানে আলােচিত হয়। ক’-এর বিরুদ্ধে ‘খ’-এর একটা ক্ষোভ ছিল। ‘খ’, ‘গ’কে বলল, সে যদি ‘ক’কে চাবুক মারে তাহলে কেউ একজন তার জরিমানার টাকা পরিশােধ করবে। ‘গ’ জবাব দিল, তার জরিমানার টাকা কেউ পরিশােধ করুক তা সে চায় না। ‘খ’-এর বিরুদ্ধে তার নিজেরই একটা ক্ষোভ আছে এবং সুযােগ পাওয়ামাত্র সে তাকে চাবুক মারবে। ‘গ’ প্রথম সুযােগেই ‘ক’কে চাবুক মারল। ‘খ’কে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। কারণ সমন্বিত কার্যক্রমের ব্যাপারে তার কোনাে মতৈক্য ছিল না, সহযােগিতা করারও কোনাে ঐকমত্য ছিল না।
১৩০. তিনি ব্যাখ্যা করেছেন-
“আরেকজন কর্তৃক কোনাে অপরাধ সংঘটিত হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আগে থেকে জানা থাকলে বা সেটি সংঘটনে মানসিক সম্মতি থাকলেই কেউ ষড়যন্ত্রকারী হয়ে যায় না। তবে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় অতি সামান্য অংশগ্রহণ করলেই তা ষড়যন্ত্রকারী হবার জন্য যথেষ্ট।”
১৩১. Regina os Murphy, (1837) 173 ER 502 (508) মামলায় বিচারপতি কোলরিজ জুরিগণের মামলার সার সংকলনকালে প্রাসঙ্গিকভাবেই বলেছিলেন-
“আমি আপনাদের বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, যদিও অভিন্ন ষড়যন্ত্রই (common design) হলাে অভিযােগের মূল বিষয়, তথাপি এ কথা প্রমাণ করার প্রয়ােজন পড়ে না যে, ঐ দুই পক্ষ একত্র হয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে এই অভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে, অভিন্ন পন্থায় সেই ষড়যন্ত্রকে এগিয়ে নিতে এবং সেটাকে বাস্তবায়িত করতে সুস্পষ্টভাবে একমত হয়েছিল। কারণ অতি স্পষ্টরূপে প্রতিষ্ঠিত ষড়যন্ত্র
৪৭৯

মামলাগুলাের মধ্যে অনেক মামলার ক্ষেত্রে এই ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার কোনাে উপায় নেই এবং এই ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার কোনাে বাধ্যবাধকতা আইন বা যৌক্তিক ধারণা কোনােটিতেই নেই। যদি দেখা যায় যে, এই দুই ব্যক্তি তাদের কৃতকর্মের দ্বারা অনেক সময় একই পন্থায় একই লক্ষ্য অনুসরণ করেছে এবং অনুসৃত লক্ষ্যটি অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজটিকে সম্পন্ন করার জন্য একজন কাজের একটি অংশ ও অপরজন অন্য অংশ সম্পন্ন করছে, সেক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে এই উপসংহার টানা যায় যে, তারা সেই লক্ষ্য অর্জনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আপনাদের নিজেদেরই যে প্রশ্নটা করতে হবে তা হলােষড়যন্ত্র যেহেতু বেআইনি- তাদের কি এই অভিন্ন ষড়যন্ত্র ছিল এবং এমন অভিন্ন পন্থায় তারা কি সেই ষড়যন্ত্র অনুসরণ করেছিল?”
১৩২. অতএব এটি দেখা যাবে যে, ষড়যন্ত্রের অপরাধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে একটা বেআইনি কাজ করতে দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে মতৈক্য। মতৈক্য অনুসারে বেআইনি কাজটি করা হতেও পারে, না-ও হতে পারে, তথাপি ঐরূপ মতৈক্যই হলাে অপরাধ এবং তা শাস্তিযােগ্য।
১৩৩. ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত আইনটি তদানীন্তন ভারতে এসেছিল পেনাল কোডের ১২০এ ও ১২০বি ধারার মাধ্যমে। এই ধারা দুটি উল্লেখ করলে দেখা যাবে, কোনাে শাস্তিযােগ্য অপরাধ করাই যেখানে ষড়যন্ত্র, সেখানে প্রকাশ্য কাজকে গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত করাপূর্বক এই ধারাগুলাে ইংলিশ আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেছে এবং ১২০এ ধারার বিধানগুলাে এসব বৈশিষ্ট্যকে সন্দেহাতীতভাবে পরিষ্কার করে তুলবে। কোনাে বেআইনি কাজ করার কিংবা বেআইনি পন্থায় কোনাে আইনি কাজ করার জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির ঐকমত্যে আসাই হলাে ষড়যন্ত্রের অপরাধের সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান ও বৈশিষ্ট্য। ১০ ধারায়ও পেনাল কোডের ১২০এ ধারার প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। সেখানে বলা আছে-
“দুই বা ততােধিক ব্যক্তি যখন (ক) একটা বেআইনি কাজ কিংবা (খ) বেআইনি পন্থায় বেআইনি নয় এমন কোনাে কাজ করতে বা করার কারণ ঘটাতে একমত হয়, তখন সেই মতৈক্যটাই একটা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত।” ঐ ধারার সঙ্গে একটা বিধান যােগ করা আছে, যেখানে বলা আছে, অপরাধ সংঘটনে মতৈক্য ছাড়া আর কোনাে মতৈক্যকে ষড়যন্ত্র বলে বােঝাবে না। অতএব, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা প্রয়ােগের জন্য ষড়যন্ত্র মামলার আপাত মর্মকথা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কথা বিশ্বাস করার অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি থাকতে হবে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি পেনাল কোডের ১২০এ ধারার ভাষার আলােকে একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে। Kehar Singh os State, AIR 1988 SC 1883 মামলায় ১২০এ ধারাটি নিমােক্তভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে“এই ধারাটিকে মূলত দুভাবে ভাগ করা যেতে পারে : প্রথম অংশে বলা আছে, যেখানে এ কথা বিশ্বাস করার মতাে যুক্তি আছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ বা অভিযােগযােগ্য অন্যায় করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে এই পূর্ববর্তী শর্তটি পরণ হবার পরই শুধ ধারার পরবর্তী অংশটি ক্রিয়াশীল হয়। এ কথা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ধারার এই অংশ বিশ্বাস করার এই যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির কথা বলা হয়েছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে। এটা স্পষ্টতই ১২০এ ধারার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেখানে বলা আছে, যখন দুই বা ততধিক ব্যক্তি কাজটা করতে বা করার কারণ ঘটাতে একমত হয়। এর সঙ্গে একটি অনুবিধি যােগ করে ব্যাপারটিকে আরাে সুরক্ষিত করা হয়েছে। সেই অনুবিধিটা হলাে, অপরাধ সংঘটনে মতৈক্য ছাড়া কোনাে মতৈক্য অপরাধজনক ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে না। কাজেই এটি আবশ্যক হবে যে, ১০ ধারা প্রয়ােগের জন্য ষড়যন্ত্র মামলার আপাত যথার্থতা প্রমাণ করতে হবে। ধারার দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, এমন ব্যক্তিদের কোনাে একজন প্রথম অভিন্ন অভিপ্রায়
৪৮০

পােষণ করার পর সেই অভিন্ন অভিপ্রায় প্রসঙ্গে তাদের কোনাে একজন বলেছে, করেছে বা লিখেছেএমন যে কোনাে কিছুই হচ্ছে ঐ ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেককে ষড়যন্ত্রকারী বলে বিশ্বাস করার জন্য একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য। উপরন্তু, ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এবং এমন ব্যক্তিদের যে কোনাে একজন যে সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্যও এটা এক প্রাসঙ্গিক তথ্য। এটা পরিষ্কার যে, এই দ্বিতীয় অংশে সেই সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা অন্য অবস্থায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে না। এটা সুস্থিরীকৃত যে, একজন আসামির কাজ বা কর্মকাণ্ড অপর আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। তবে ষড়যন্ত্রের মামলাগুলােতে ১০ ধারায় একটা ব্যতিক্রমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ধারার এই দ্বিতীয় অংশ তখনই কার্যকর হবে যখন প্রথম অংশটি সুস্পষ্টরূপে প্রতিষ্ঠিত হবার পর অর্থাৎ ১২০এ ধারা বিধৃত বক্তব্যের আলােকে দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে- এ কথা বিশ্বাস করার অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি থাকে। কেবল তখনই আসামিদের একজনের কর্মকাণ্ড বা বক্তব্যকে অপর আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।।
১৩৪. পরবর্তীকালে Suresh Chandra Bahri os Gurbachan Singh, AIR 1994 SC 2420 মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“ওপরের এই প্রেক্ষাপটে আমরা ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০এ ধারার বিধান উল্লেখ করতে পারি। এখানে অপরাধজনক ষড়যন্ত্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা আছে যে, যখন দুই বা ততােধিক ব্যক্তি (১) একটা বেআইনি কাজ বা বেআইনি পন্থায় বেআইনি নয় এমন কাজ করতে বা করার কারণ ঘটাতে সম্মত হয়, তখন এমন ঐকমত্যই একটা অপরাধজনক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত হয়। তবে অপরাধ সংঘটনে ঐকমত্য ছাড়া কোনাে ঐকমত্য অপরাধজনক ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে না, যদি না ঐ ঐকমত্য ছাড়া এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক পক্ষ ঐকমত্য অনুযায়ী কোনাে কাজ করে। কাজেই ১২০এ ধারায় সন্নিবেশিত বিধানগুলাের ওপর দ্রুত চোখ বােলালে দেখা যাবে যে, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র মানে কোনাে বেআইনি কাজ করার জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে একটা ঐকমত্য কিংবা এমন কাজ যেটি নিজেই হয়ত বেআইনি নয়, তবে তা বেআইনি পন্থায় করা বা বাস্তবায়িত হয়। কাজেই অপরাধজনক বা দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্র অপরাধের অপরিহার্য উপাদান হলাে একটা অপরাধ সংঘটনে ঐকমত্য। যেখানে ঐকমত্যটা হলাে এমন এক কাজ করার জন্য, যে কাজটা নিজেই একটা অপরাধ, সে ক্ষেত্রে বাদিপক্ষকে দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডের কোনাে প্রমাণ দেওয়ার দরকার পড়ে না। কারণ এমন পরিস্থিতিতে ঐ ধরনের একটি মতৈক্যের প্রমাণ দিয়ে দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রতিপাদন করা হয়। অন্য কথায়, যখন কথিত ষড়যন্ত্রটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০এ ধারার (২) উপধারার বিধানের সঙ্গে পঠিত ১২০বি ধারায় বর্ণিত প্রকৃতির গুরুতর অপরাধ সংঘটন-সম্পর্কিত হয় তখন সে ক্ষেত্রে এমন এক অপরাধ সংঘটনের জন্য আসামিদের মধ্যে মতৈক্য থাকার একটিমাত্র প্রমাণই কেবল ১২০বি ধারা বলে দোষী সাব্যস্ত হবার জন্য যথেষ্ট এবং আসামিদের বা তাদের কোনাে একজনের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের সমর্থনে কোনাে প্রমাণের প্রয়ােজন হবে না। এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যেসব বিধান রয়েছে, ষড়যন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্রকারীদের নিজেদের মধ্যকার ঐকমত্য হওয়ায় ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনে প্রকাশ্য কোনাে কাজ করতেই হবে এমন কোনাে প্রয়ােজন নেই। তাই এই শর্তাবলি ও উপাদানগুলাের অস্তিত্ব যদি প্রতিপাদন করা যায় তাহলে ঐ কাজটি ১২০বি ধারায় সন্নিবেশিত বিধানসমূহের আওতায় পড়বে। কেননা তা না হলে একটা ষড়যন্ত্রের চরিত্রই হলাে সেটা সম্পূর্ণ গােপনীয়তার মধ্যে চিন্তা করতে ও থাকতে হবে, নইলে
৪৮১

গােটা উদ্দেশ্যই বানচাল হয়ে যেতে পারে। এটা একটা সাধারণ অভিজ্ঞতা এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অতি বিরল ক্ষেত্রেই কেবল একজন অপরাধ সংঘটনে দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণের মুখােমুখি হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত প্রমাণেরই অস্তিত্ব থাকে, যেখান থেকে একটা অপরাধ ঘটাতে দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে ঐকমত্য সংক্রান্ত উপসংহারে পৌঁছানাের মতাে অনুমান ন্যায়সঙ্গতভাবেই টানা যেতে পারে।”
১৩৫. সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ষড়যন্ত্রের অপরাধ সংঘটনে প্রথমে সেই ষড়যন্ত্রে দুই বা ততােধিক ব্যক্তিকে একত্রে যুক্ত হতে হবে; দ্বিতীয়ত, সেই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার উদ্দেশ্যে অবশ্যই ষড়যন্ত্র অনুসারে কোনাে কাজ বা বেআইনি বিচ্যুতি থাকতে হবে। ষড়যন্ত্রের সহযােগীকে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তির সঙ্গে অপরাধকর্মে যুক্ত হতে হবে এমন কোনাে কথা নেই। যে ষড়যন্ত্র অনুযায়ী অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে সেটিতে সে সম্পৃক্ত থাকলে সেটাই যথেষ্ট। ৫ক অধ্যায়ে ১২০এ ধারাবলে সংজ্ঞায়িত এক নতুন অপরাধের পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। সেই অপরাধের নাম অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। কোনাে বেআইনি কাজ কিংবা বেআইনি নয় এমন কাজ বেআইনি পন্থায় করা বা করার কারণ ঘটানাের জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির স্রেফ একমত হওয়াটাই হলাে সেই অপরাধ। ঐ ধারায় একটা বিধান রয়েছে যাতে বলা আছে যে, অপরাধ সংঘটনে ঐকমত্য হওয়া ছাড়া কোনাে ঐকমত্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে না, যদি না। ঐকমত্যের বিষয়টি বাদে এমন ঐকমত্যের সঙ্গে যুক্ত এক বা একাধিক পক্ষ ঐকমত্য অনুসারে কোনাে কাজ করে।
১৩৬. সুতরাং, উপরে নির্দেশিত নীতির হিসাবে প্রত্যেক ষড়যন্ত্রকারী অভিন্ন উদ্দেশ্য অর্জনে সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় তার পৃথক ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকে এ ব্যাপারে সচেতন যে, সাধারণ ষড়যন্ত্রে তার একটা ভূমিকা পালন করার আছে, যদিও সে ঐ ষড়যন্ত্রের সব গােপন বিষয় কিংবা যেসব পন্থায় অভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল করা হবে সেগুলাে না-ও জানতে পারে। অশুভ পরিকল্পনার উদ্যোক্তা হতে পারে গুটিকয়েক ব্যক্তি, কয়েকজন এ থেকে ঝরে পড়তে পারে এবং কয়েকজন পরবর্তী পর্যায়েও যােগদান করতে পারে, তবে এই ষড়যন্ত্র ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অব্যাহত থেকে যায়। সময়ান্তরে উপযুক্ত বা সুবিধাজনক বলে পরিগণিত হতে পারে এমন সব পন্থায় অভিন্ন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা থাকতে পারে। অভিন্ন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কৃত হতে পারে। নতুন নতুন পন্থাও উদ্ভাবিত হতে পারে। ষড়যন্ত্রকারীদের অভিন্ন উদ্দেশ্য তখন হয় অভিন্ন পরিকল্পনাকে আরাে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করা। ষড়যন্ত্রকারীরা আগন্তুক বা বহিরাগতের উপস্থিতিতে আলােচনা করে না। একাত্মতা ও গােপনীয়তা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের উপাদান বিধায় এটি প্রমাণ করার জন্য প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া কঠিন। অতএব, এটা পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কিত সাক্ষ্য এবং অপরাধ সংঘটনের আগে ও পরে অভিযুক্তের আচার-আচরণ দ্বারা প্রমাণ করা যায়।
১৩৭. রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ আপিলকারীরা তাদের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ পূরণ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যার এক ষড়যন্ত্র এঁটেছিল এবং সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট এক নৈশ কুচকাওয়াজের আয়ােজন করেছিল এবং সেই নৈশ কুচকাওয়াজে আপিলকারী ফারুক রহমান ও অন্যান্য সহ-আসামি কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী জওয়ানদের উত্তেজিত করে তুলেছিল, অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অ বের করে নিয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােতে অফিসার ও জওয়ানদের মােতায়েন করেছিল এবং তারপর তাদের কয়েকজন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে এসে তাকে ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের নৃশংসভাবে হত্যা
৪৮২

করে। ঐ ধরনের বার্ষিক নৈশ কুচকওয়াজ সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাত ১১টায় শেষ হয়। কিন্তু ১৪ আগস্টের নৈশ কুচকাওয়াজ ১৫ আগস্ট ভাের পর্যন্ত চলেছিল। উপরন্তু কুচকাওয়াজে সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিটকে। যুক্ত করার কোনাে বিধান ছিল না। অথচ আপিলকারীরা ও অন্যান্য অভিযুক্ত তাদের অপরাধমূলক লক্ষ্য হাসিলের জন্য বিধি লঙ্ঘন করে ল্যান্সার ইউনিট ও আর্টিলারি ইউনিটকে একত্র করেছিল। তদুপরি, এ ধরনের মহড়ায় গােলাবারুদ বহনের ওপর যদিও নিষেধাজ্ঞা ছিল, তথাপি আপিলকারীরা ও সহ-অভিযুক্তরা তাদের অভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য অস্ত্রভাণ্ডার থেকে গােলাবারুদ বের করে নিয়েছিল। বিচারিক আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ অনুমােদন করে হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় প্রদান করেন তার বিরুদ্ধে সংবিধানের ১০৩(৩) অনুচ্ছেদবলে দায়ের করা এই আপিলের সীমিত সুযােগের প্রতিও লক্ষ রাখা প্রয়ােজন। রেকর্ডকত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভুল ব্যাখ্যা, তা পাঠ না করা কিংবা তা বিবেচনা না করার কারণে আপিলকারীদের বিচার ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে সে মর্মে আপিলকারীরা কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। তা সত্ত্বেও আমরা, আপিলকারীদের যেহেতু মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, সেহেতু বিজ্ঞ আইনজীবীদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে রেকর্ডকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণের গুণাগুণের ভিত্তিতে সবিস্তারে আপিলের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের সুযােগ দিয়েছি।
১৩৮. আগেই বলা হয়েছে যে, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৮, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ৩২, ৩৪, ৩৯, ৪০, ৫৩ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর রাষ্ট্রপক্ষ নির্ভর করেছিল। রাষ্ট্রপক্ষের ১১ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি একটা ইউনিটের সদস্য ছিলেন। প্যারেড ময়দানে পৌছার পর তিনি কুচকাওয়াজে বিশৃঙ্খলা দেখতে পান। ফারুক রহমান মেজর আহমেদ হােসেনসহ সেখানে আসেন। তারপর ফারুক রহমান ও অন্য অফিসাররা মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) অফিসে যান এবং তিনি আরও লক্ষ করেন যে, মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) অফিসে আরও কিছু লােক সাদা পােশাকে উপস্থিত, যাদেরকে তিনি অফিসার মনে করেছিলেন। মধ্যরাত প্রায় ১২টায় তিনি তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন, সাদা পােশাকধারী লােকেরা তার অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে এবং তাদের পিছু পিছু মহিউদ্দীনও (ল্যান্সার) নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে এবং হুদাকে তার কাছে আসতে বলে। সে সময় হুদা মেজর ডালিমকে কিছুটা অপেক্ষা করতে বলে এবং এরপর তাদের দুজন মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) পিছু পিছু যায়। মহিউদ্দীন এরপর এদের দুজনের জন্য ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করে।
১৩৯. রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী বলেন, প্যারেড ময়দানে তিনি ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অপর কয়েকজন অভিযুক্তকে দেখেছিলেন। কুচকাওয়াজ রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলেছিল। তারপর তাদেরকে ফল-ইন করতে বলা হয়। প্যারেড ময়দানে তিনি লক্ষ করেছিলেন, ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন, মেজর শরিফুল আহমেদ হােসেন, লে. নাজমুল হােসেন আনসার প্যারেড ময়দানের পাশে জেসিওদের সঙ্গে কোনাে কিছু নিয়ে কথা বলছে। এরপর তারা তাদের সামনে আসে। তিনি উর্দিপরা তিনজন অপরিচিত অফিসারকে দেখতে পান। ফারুক রহমান তাদেরকে মেজর ডালিম, বজলুল হুদা বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। অপর ব্যক্তির নাম তিনি মনে করতে পারেননি। ফারুক রহমান তাদের উদ্দেশে বলে, ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশ হবে, যেখানে রাষ্ট্রপতি রাজতন্ত্র ঘােষণা করবেন। তারা রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। তিনি ও অন্যান্য অফিসার যেসব নির্দেশ দেবেন জেসিওদের তা মান্য করতে হবে। এরপর ফারুক রহমান তাদের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং সেই নির্দেশ অনুসারে তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র বের করে নেয়। এরপর মহিউদ্দীন তৎক্ষণাৎ তাদের বাহনে উঠার। নির্দেশ দেয় এবং তার নির্দেশ অনুসারে তারা চারটি ট্রাকে গিয়ে ওঠে। তিনি সেখানে জওয়ানসহ আরাে দুটি ট্রাক দেখেন। পরবর্তীকালে তিনি জানতে পারেন যে, তারা ছিল আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান, যারা
৪৮৩

এদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করবে। এরপর তারা একত্রে অগ্রসর হয় এবং বালুরঘাট, মহাখালী রােড, ফার্মগেট হয়ে ৩২ নম্বর রােডে এসে মিলিত হয়। মহিউদ্দীন তাদের ৩২ নম্বর রােড দিয়ে কাউকে চলাচল করতে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সে তাদের আরাে বলেছিল, গােলাগুলির আওয়াজ শুনলে তারা না যেন ভয় না পায়। কারণ অন্যরাও তাদের নিজেদের লােক।
১৪০. রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন ল্যান্সারের সদস্য এবং সেদিনের নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ঐ নৈশ কুচকাওয়াজে ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) উপস্থিত ছিল। কুচকাওয়াজ রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলেছিল। সে সময় মেজর আবদুর রশিদ তাদের ইউনিটে আসে। তারপর মােসলেম উদ্দিন ও অন্যান্য সেনা অফিসার সেখানে আসে এবং একটি ট্রাকে ওঠে। তারপর তারা তাকে (সাক্ষী) ও অন্যদের তাদের অনুসরণের নির্দেশ দেয়। তাদের বহনকারী যানটি মহাখালীতে এসে থামলে তিনি (সাক্ষী) দেখতে পান, আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ানরা সেখানে দাঁড়িয়ে। সে সময় আর্টিলারি ইউনিটের এক অফিসার তাদের বাহনে এসে ওঠে এবং তারপর বাহনটি ইন্দিরা রােড-মিরপুর রােড-সাত মসজিদ রােড হয়ে মিরপুর রােডের ৩২ নম্বরে, যেখানে তাদের মিলিত হবার কথা, সেখানে এসে থামে।
১৪১. রাষ্ট্রপক্ষের ১৪ নম্বর সাক্ষী উল্লেখ করেন, তিনি ল্যান্সার ইউনিটের সদস্য। তিনি বলেন, তিনি নৈশকালীন কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিলেন, যা ১৪ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল। তিনি (সাক্ষী) সেখানে ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন, মেজর আহমদ শরিফুল হােসেন, লে. কিসমত ও লে. নাজমুল হােসেন আনসার এবং সাদা পােশাকধারী আরাে কয়েকজনকে দেখতে পান। তিনি (সাক্ষী) মেজর রশিদের সাথে আর্টিলারি ইউনিটের কয়েকজন অফিসারকেও দেখতে পান। মেজর ফারুক তাদের ফল-ইন করতে বলে। এক জরুরি দায়িত্ব পালনের জন্য তাদেরকে ফল-ইন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর সে (মেজর ফারুক) সাদা পােশাক পরা ব্যক্তিদের মেজর ডালিম ও সুলতান শাহরিয়ার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাকে (সাক্ষী) ও অন্যদের বলে যে, এই দুই অফিসার তাদের সঙ্গে কাজ করবে এবং তাদের এ দুজনের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। সে তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নির্দেশ পালনে অবহেলা করা হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভাের ৪টায় ফারুক রহমান ট্যাঙ্কগুলাে মুভ করার নির্দেশ দেয়। মেজর ফারুক নিজেই একটি ট্যাঙ্কের কমান্ড গ্রহণ করে। ট্যাঙ্কগুলাে একই সময় চলতে শুরু করে এবং কয়েকটি ট্যাঙ্ক বালুরঘাট-ক্যান্টনমেন্ট-মহাখালী হয়ে রেডিও স্টেশনে আসে। সেখানে পৌঁছার পর সুলতান শাহরিয়ার, মেজর ডালিম, মেজর শরিফুল হােসেন কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে রেডিও স্টেশনে প্রবেশ করে। এর কিছুক্ষণ পর ফারুক রহমান ও আবদুর রশিদ রেডিও স্টেশনে এসে ঢােকে।
১৪২. রাষ্ট্রপক্ষের ১৭ নম্বর সাক্ষী বলেন, আলােচ্য সময় তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের সদস্য এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল পাপা ব্যাটারির কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ প্যারেডে যােগ দিয়েছিলেন, যা রাত ১২টা অবধি চলেছিল। এরপর ১ নম্বর ইউনিটের কামানের হাবিলদারের নির্দেশে তারা কামানের গােলা নেন। তিনি (সাক্ষী) লক্ষ করেন, নৈশ কুচকাওয়াজের সময় রেজিমেন্টের কয়েকজন অফিসার কামানের পেছনে কথা বলছিল। এদের মধ্যে তিনি আবদুর রশিদ, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন। মােস্তফা, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ও আরাে দুজনকে চিনতে পারেন। এরা তাদের কাছে আসে এবং সুবেদার হাশেমকে কিছু নির্দেশনা দেয়। এরপর হাশেম সৈন্যদলকে ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয় এবং ছয়টি কামান ছয়টি ট্রাকের সঙ্গে যুক্ত করে। এরপর রাত সাড়ে তিনটা/চারটার দিকে কামানবাহী ট্রাকগুলাে চলতে শুরু করে। তিনি (সাক্ষী) মেজর মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) বাহনটিতে ছিলেন। তাদের ট্রাকটি ৪টার দিকে
৪৮৪

ধানমন্ডি লেকের পাশে এসে থামে। এরপর মহিউদ্দীন তাদেরকে ৩২ নম্বর রােড ও রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরের দিকে তাক করে কামান বসানাের নির্দেশ দেয়। অতঃপর মহিউদ্দীন তাদেরকে যখনই বলবে তখনই কামানের গােলা ছুড়বার নির্দেশ দেয়। এর কিছুক্ষণ পর তারা রাষ্ট্রপতির বাসভবন থেকে | গােলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসতে শােনেন। সে সময় মহিউদ্দীনের নির্দেশ অনুযায়ী তারা চার রাউন্ড কামানের গােলা ছােড়ে। দেখা যাচ্ছে যে, আসামিপক্ষ এই সাক্ষীর এই সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। কাজেই, মহিউদ্দীনের কামান বসানাে ও কামানের গােলাবর্ষণ সম্পর্কে মহিউদ্দীনের নির্দেশ সম্পর্কে তার সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়ে গেছে।।
১৪৩. রাষ্ট্রপক্ষের ১৮ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের গােলন্দাজ। এই ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ছিল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল ব্যাটারি কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের পাপা ব্যাটারিতে ছয়টি কামান ছিল। মহিউদ্দীনের নির্দেশে কামানসহ তারা নতুন বিমানবন্দর হয়ে বালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং রাত সাড়ে ১২টা/১টা পর্যন্ত তাদের নৈশ ট্রেনিং চালিয়ে যান। ট্রেনিং চলাকালে খন্দকার আবদুর রশিদ ও মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ট্রেনিং পরিদর্শন করে। রাত সাড়ে তিনটা/চারটার দিকে তাদেরকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র এক করে বাহনে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর তাদের সারি বেঁধে দাঁড় করানাে হয়। অতঃপর মহিউদ্দীনের উপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের বলে, তাদেরকে একটা জরুরি কাজ করতে হবে এবং সেটা হলাে রক্ষীবাহিনীকে বাধা দেওয়া। সে তাদেরকে তার বাহনটির পিছু পিছু আসার নির্দেশ দেয়। তখন তাদের ইউনিটটিও রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরের দিকে অগ্রসর হয়।
১৪৪. রাষ্ট্রপক্ষের ২১ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন উপরােক্ত একই আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান। তিনি সেদিনের নৈশ কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিলেন। রাত দুটোর দিকে মেজর আবদুর রশিদ, মহিউদ্দীন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও আরাে কতিপয় অফিসার এয়ারপাের্ট রানওয়েতে যেখানে তারা বসা ছিলেন সেখানে আসে। সে সময় মেজর রশিদ জরুরি কাজে যেতে হবে বলে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হতে বলে। এরপর তার নির্দেশে তারা গােলাবারুদ নেন। অতঃপর বজলুল হুদা তাদের ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয়। ট্রাকগুলাে এরপর ধানমন্ডির দিকে যেতে শুরু করে। ৪টা/সাড়ে ৪টার দিকে তাদের কয়েকজনকে। ৩২ নম্বর রােডে নেমে যেতে বলা হয়। যারা নেমে গেল তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হলাে, ৩২ নম্বর রােড দিয়ে একজন মানুষকেও যেন চলাচল করতে না দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের ২২ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন। হতভাগ্য রাতটিতে তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিলেন এবং কুচকাওয়াজ রাত ১২টা পর্যন্ত চলেছিল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর রাত প্রায় ২টা/২.৩০টার দিকে মেজর আবদুর রশিদ সেখানে আসে মেজর মহিউদ্দীন, মােস্তফা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও আরাে কতিপয় অজ্ঞাতনামা অফিসারসহ। এ সময়ে মেজর আবদুর রশিদ তাদের অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে খোঁজখবর করে এবং তারা তাদের অস্ত্র দেখায়। এরপর সে তাদের বলে, তাদের এক জরুরি কাজে নেওয়া হবে এবং প্রয়ােজন হলে তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করবে। তারা অস্ত্র ও গােলাবারুদ ট্রাকে তােলার পর বিএইচএম (BHM) তাদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে ও ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয়। এরপর তাদের ট্রাক ৩২ নম্বর রােডের দিকে এগিয়ে যায়। ফজরের আজানের সময় তাদের কয়েকজনকে ৩২ নম্বর রােডে ট্রাক থেকে নেমে যেতে বলা হয় এবং ৩২ নম্বর রােডে কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। আসামিপক্ষ তার সাক্ষ্যের অভিযােগমূলক অংশটুকু চ্যালেঞ্জ করেনি।
৪৮৫

১৪৫. রাষ্ট্রপক্ষের ২৩ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ল্যান্সার ইউনিটের জওয়ান ছিলেন। হতভাগ্য রাতটিতে তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, ফারুক রহমান ট্যাঙ্কের সামনে এলাে ও লে. কিসমতের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললাে। এরপর লে. কিসমত স্কোয়াড্রনকে সারি বেঁধে দাঁড় করানাের জন্য রিসালদার শামসুল হককে নির্দেশ দিলাে। এরপর ফারুক রহমান, লে. কিসমত ও রিসালদার শামসুল হক সেখানে এলাে এবং ফারুক রহমানের নির্দেশ অনুসারে তাদের মধ্য থেকে ট্যাঙ্কের ছয়জন ড্রাইভার ও আরও কয়েকজন জওয়ানকে বেছে নেওয়া হলাে। এরপর সে জওয়ানদের ছয়টি ট্যাঙ্ক বণ্টন করে দিলাে এবং অফিসারদের ডিউটিও ভাগ করে দিলাে। রাত ৩/৩.৩০টার দিকে মেজর ফারুক রহমান আবার এলেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী অফিসার ও জওয়ানরা ট্যাঙ্কে গিয়ে উঠল এবং তারপর ট্যাঙ্কগুলােকে গ্যারেজ থেকে বের করে এনে সিগন্যাল গেটে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হলাে। পরে ফারুক রহমান একটি ট্যাঙ্কে গিয়ে ওঠে এবং অন্য অফিসারদের বাকি ট্যাঙ্কগুলােতে ওঠার নির্দেশ দেয়। এরপর তার নির্দেশে ট্যাঙ্কগুলাে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়।
১৪৬. রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী বলেন, প্রাসঙ্গিক সময়টিতে তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান। মেজর আবদুর রশিদের নির্দেশে তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং তার নির্দেশেই মার্চ করে এয়ারপাের্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। যাওয়ার আগে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিতে বলা হয়েছিল। মেজর রশিদ তাদের বলেছিলেন, জরুরি কাজের জন্য তাদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে। এরপর তাদের ব্যাটারি কমান্ডার তাদের ল্যান্সার ইউনিটে নিয়ে যায়। তিনি ল্যান্সার ইউনিটের জওয়ানদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানাে অবস্থায় দেখতে পান। ল্যান্সার ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ফারুক রহমান দুটি ইউনিটকে একত্র করে ব্রিফ করে। সে সময় তিনি আর্টিলারি ইউনিটের কতিপয় সদস্যকে সেখানে উপস্থিত দেখতে পান। তিনি কয়েকজন অপসারিত সেনা অফিসারকেও সেখানে দেখেন। মেজর রশিদ ও ফারুক রহমান ওই সব অফিসারকে মেজর ডালিম, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর সুলতান শাহরিয়ার ও ক্যাপ্টেন মাজেদ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর মেজর আবদুর রশিদ ও মেজর ডালিম তাদের বলে, তারা রক্তের বিনিময়ে দেশকে মুক্ত করেছে। বর্তমান সরকার নারীর ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, মানুষ অনাহারে মরছে। কাজেই এ সরকারকে উৎখাত করতে হবে। এরপর ফারুক রহমান ও মেজর আবদুর রশিদ তাদের গােলাবারুদ নেওয়ার নির্দেশ দেয় এবং তাদের নির্দেশ অনুসারে তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে গােলাবারুদ নেয় এবং শহরের দিকে অগ্রসর হয়।
১৪৭. আসামিপক্ষ ফারুক রহমান কর্তক ল্যান্সার ও আর্টিলারির দুটি ইউনিটকে একীভূত করা, ইউনিটগুলাের উদ্দেশ্যে ফারুক রহমানের ব্রিফিং এবং সেখানে মেজর আবদুর রশিদের উপস্থিতি সম্পর্কিত এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। জেরার সময় এই সাক্ষী বলেছিলেন, বার্ষিক কুচকাওয়াজে বিভিন্ন ইউনিটের যৌথ কুচকাওয়াজের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। তিনি জবানবন্দিতে দেওয়া তার এই মূল বক্তব্যটাই পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ফারুক রহমানের নির্দেশেই তাদের ইউনিটকে ল্যান্সার ইউনিটের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছিল। মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের নির্দেশে তারা গােলাবারুদ সঙ্গে। কথাটিও অস্বীকার করা হয়নি।
১৪৮. প্রাসঙ্গিক সময়ের আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান রাষ্ট্রপক্ষের ২৫ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, রাত ৩/৩.৩০টার দিকে ক্যাপ্টেন মােস্তফার নির্দেশে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয়। এরপর তারা মার্চ করে ট্যাঙ্ক ইউনিটের একটি খােলা জায়গায় যায় এবং সেখানে ট্যাঙ্ক ইউনিটের জওয়ানদের উপস্থিতি লক্ষ করে এবং তাদেরকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। তাদের আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ এবং ট্যাঙ্ক ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ফারুক রহমান তাদের ব্রিফ করে। মেজর রশিদ, ক্যাপ্টেন মােস্তফা, মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন মাজেদ ও অন্যান্য
৪৮৬

অফিসার সেখানে উপস্থিত ছিলে। মেজর ডালিম সেখানে বক্তৃতা দেয়। এরপর ফারুক রহমান ও মেজর রশিদও বক্তৃতা করেন। তারা বলে, তারা অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। সরকার | মা-বােনদের ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, মানুষজন অনাহারে মরছে- এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। এরপর তারা তাদেরকে গােলাবারুদ নিতে বলে এবং তখন তাদের নির্দেশে তারা গােলাবারুদ নেয় এবং মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর তিনি (সাক্ষী) সেরনিয়াবাতের পরিবার-পরিজনদের হত্যার ঘটনাও বর্ণনা করেন। মহিউদ্দীন কর্তৃক জেরাকালে এই সাক্ষী বলেন, গুলিগােলা ল্যান্সার অ্যামুনিশন স্টোরের সামনে তূপীকৃত অবস্থায় ছিল এবং ফারুক রহমানের নির্দেশ অনুসারে তারা সেই গুলিগােলা নেয়। আসামিপক্ষ কোনােভাবেই এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি।
১৪৯. রাষ্ট্রপক্ষের ২৬ নম্বর সাক্ষী বলেন, প্রাসঙ্গিক সময়ে তিনি আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল উক্ত ইউনিটের পাপা ব্যাটারির কমান্ডার মেজর রশিদ তাকে গােলাবারুদের গুদামের চাবিটা তার কাছে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। রাত প্রায় ১১/১১.৩০টার দিকে মেজর রশিদ ও ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার ইউনিটের ১০/১২ জন জওয়ানসহ গােলাবারুদের ভাণ্ডারের সামনে আসে এবং মেজর রশিদের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি গােলাবারুদ ভাণ্ডারের তালা খুলে দেন। এরপর মেজর রশিদের নির্দেশে জওয়ানরা কামান, রাইফেল, স্টেনগান, এসএমজি, পিস্তল ইত্যাদি নিয়ে নেয়। আসামিপক্ষ এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেই কারণে তার সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের ২৭ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি আলােচ্য সময়ে ফিল্ড আর্টিলারির জওয়ান ছিলেন। নৈশ কুচকাওয়াজে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এরপর প্যারেড ময়দান থেকে তারা নিউ এয়ারপাের্ট রােড অভিমুখে অগ্রসর হন। রাত ৩/৩.৩০টার দিকে মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) সেখানে আসে; তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করা এবং কয়েকজন জওয়ানকে মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে ওঠার নির্দেশ দেয়। তারপর মেজর মহিউদ্দীন তাদের বলে, রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালাবে এবং তাদের এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি (সাক্ষী) দেখতে পান যে, একটা কামান গাড়ির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। আর চারটি কামানও অন্য গাড়িগুলাের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এরপর তারা এগিয়ে চলেন এবং মহাখালী-ফার্মগেট-গ্রিন রােড-এলিফ্যান্ট রােড ও মিরপুর রােড হয়ে কলাবাগান এলাকায় লেকের কাছে আসেন। এরপর তাদের গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়। এরপর মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তাদের বলে, এই সড়ক দিয়ে কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হবে না। আসামিপক্ষ সাক্ষীপ্রদত্ত এই সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি।
১৫০. রাষ্ট্রপক্ষের ৩২ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান। সেই ইউনিটে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিলেন তাদের কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং সেই কুচকাওয়াজে তিনি মেজর রশিদ, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), মেজর জুবায়ের সিদ্দিক, ক্যাপ্টেন মােস্তফা ও লে. হাসানকে চিনতে পারেন। কুচকাওয়াজ রাত ৩টা/সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলেছিল। এরপর হাবিলদার মােস্তফা তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। সে সময় ঐ অফিসাররা ও মেজর ডালিম সেখানে উপস্থিত ছিল। মেজর রশিদের নির্দেশে হাবিলদার মােস্তফা তাদেরকে অস্ত্র ও গুলিগােলা দেয়। এরপর তারা সামনে অগ্রসর হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের পাশের রাস্তায় তাদের নেমে যাওয়ার এবং এই রাস্তা দিয়ে কাউকে চলাচল করতে না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আসামিপক্ষ এই সাক্ষীপ্রদত্ত সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেটি অবিতর্কিত রয়েছে।
৪৮৭

১৫১. রাষ্ট্রপক্ষের ৩৪ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন। সেই ইউনিটে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল ব্যাটারি কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং কুচকাওয়াজ শেষে ছয়টি ট্যাঙ্কসহ নতুন বিমানবন্দরে যান। রাত প্রায় আড়াইটায় তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয় এবং তারপর একটি বাহনে ওঠার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর তারা ফার্মগেট হয়ে মিরপুর রােড ধরে লেকের পূর্বদিকে অগ্রসর হন। সেখানে পৌছে তারা অবস্থান গ্রহণ করেন। কামানগুলাে সেখানে স্থাপন করা হয়। সে সময় মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) কামানের পিছনে এসে দাঁড়ায় এবং ঐ সড়ক দিয়ে কাউকে চলাচল করতে না দেওয়ার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়। আসামিপক্ষ এই বক্তব্যটিও চ্যালেঞ্জ করেনি।
১৫২. রাষ্ট্রপক্ষের ৩৯ নম্বর সাক্ষী বলেন, আলােচ্য সময়টিতে তিনি ল্যান্সার ইউনিটের ড্রাইভার ছিলেন। তার ইউনিটে ফারুক রহমান ছিল ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার। তিনিও (সাক্ষী) নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং মহিউদ্দীন, মেজর শরিফুল ইসলাম ও অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কুচকাওয়াজে উপস্থিত দেখতে পান। ফারুক রহমান তাদের বলে যে, একটা জরুরি উদ্দেশ্যে ট্যাঙ্ক বাইরে নিতে হবে এবং এজন্য তাদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেয়। এরপর জওয়ানদের নিজ নিজ কাজে যেতে বলে। এ সময়ে মেজর ডালিম ও আরেক অফিসার তাদের ইউনিটে আসে। মেজর ডালিম ইউনিফর্ম চাইলে তাকে ইউনিফর্ম দেওয়া হয়। অতঃপর ট্যাঙ্ক ইউনিটটি বিমানবন্দর হয়ে বঙ্গভবন অভিমুখে অগ্রসর হয়।।
১৫৩. রাষ্ট্রপক্ষের ৪০ নম্বর সাক্ষী বলেন যে, প্রাসঙ্গিক সময়ে তিনি ল্যান্সার ইউনিটের লেফটেন্যান্ট ছিলেন এবং ফারুক রহমান ছিল সেই ইউনিটের কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ প্যারেডে যােগ দিয়েছিলেন এবং প্যারেডটি মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। মহিউদ্দীন এরপর তা ফারুক রহমানের কাছে হস্তান্তর করে। প্যারেড রাত ২/২.৩০টা পর্যন্ত চলেছিল, যদিও তা শেষ হবার কথা ছিল রাত ১২টায়। ফারুক রহমান তাকে রেজিমেন্টের দিকে খেয়াল রাখতে ও গেট বন্ধ করে দিতে বলে। তার (সাক্ষীর) প্রশ্নের জবাবে ফারুক রহমান তাকে আরও বলে যে, তারা স্বৈরাচারী সরকারকে অপসারণ করতে যাচ্ছে। আসামিপক্ষ সাক্ষীর এই বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করেনি; যদিও সাক্ষী এটি স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, মেজর ফারুক রহমান ও অন্যরা সরকার উৎখাত করতে চলেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের ৫৩ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের সুবেদার মেজর এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল ঐ ইউনিটের পাপা ব্যাটারি কমান্ডার। ফারুক রহমান তাদের কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদের অফিসে আসত। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে সে বহুবার তার সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, মেজর রশিদ আগস্টের নৈশ ট্রেনিং কর্মসূচির আয়ােজন করেছিল এবং ঐ কর্মসূচি অনুযায়ী ১৪ আগস্টের রাতটা এ কাজের জন্য ধার্য করা হয়। মহিউদ্দীন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের প্যারেডের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং পরে তা মেজর রশিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি (সাক্ষী) আরও বলেছেন যে, রাত আনুমানিক দশটার দিকে মেজর রশিদ এবং ফারুক রহমান তার অফিসের বারান্দায় এসেছিল এবং কিছু সময় পরে একসঙ্গে তারা একটি জিপে করে এই স্থান ত্যাগ করে।
১৫৪. উপরের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে, মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক রহমান, নথিদৃষ্টে যারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তাদের পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৪ আগস্ট রাতে নৈশকালীন কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল। নথিদৃষ্টে আরাে দেখা যায় যে, মেজর রশিদ খােন্দকার মােশতাকেরও একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আরাে দেখা যায় যে, প্রথম ল্যান্সার ইউনিটের কামান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মােমেন ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ছুটিতে ছিলেন এবং ইউনিটের টু আইসি হিসেবে ফারুক রহমান কর্নেল মােমেনের
৪৮৮

অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে প্রথম ল্যান্সার ইউনিটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ ও অন্য আসামিদের সাথে যােগসাজসে ১৪ আগস্ট রাতে নৈশকালীন কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল এবং এটিকে ১৫ আগস্টের শুরুর সময় পর্যন্ত প্রলম্বিত করে। অপসারিত সেনা অফিসাররাও ঐ কুচকাওয়াজে অংশ নেয় এবং এরপর অফিসাররা মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) অফিসে গােপন আলােচনা করে। ফারুক রহমান, বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে এভাবে উত্তেজিত করে যে, রক্ষীবাহিনী তাদের আক্রমণ করবে অথবা রাজত্ব কায়েম করবে এবং এরপর তাদের নির্দেশনা অনুসারে জওয়ানরা ভারী অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়েছিল, যা কেবল যুদ্ধের সময়ই ব্যবহার করা হয়।
১৫৫. অত্রএব, এটি প্রতিভাত হয় যে, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-১৩, পি.ডব্লিউ-১৪, পি.ডব্লিউ-২৩, পি.ডব্লিউ-২৪, পি.ডব্লিউ-২৫, পি.ডব্লিউ-৩৫, পি.ডব্লিউ-৩৯ এবং পি.ডব্লিউ-১১ ফারুক রহমানকে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার সময় চিনতে বা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন; পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-১৪ এবং পি.ডব্লিউ-৩৯ মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) চিনেছিলেন এবং পি.ডব্লিউ-১৭, পি.ডব্লিউ-১৮, পি.ডব্লিউ-২১, পি.ডব্লিউ-২২, পি.ডব্লিউ-২৬, পি.ডব্লিউ-২৭, পি.ডব্লিউ-৩২, পি.ডব্লিউ-৩৪ এবং পি.ডব্লিউ-৫৩ মহিউদ্দীনকে (আর্টিলারি) চিনতে পেরেছিলেন; পি.ডব্লিউ-১৪ সুলতান শাহরিয়ারকে চিনেছিলেন এবং পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-২১ এবং পি.ডব্লিউ-২২ বজলুল হুদাকে চিনতে পেরেছিলেন। উপরন্তু, অভিযােগে সম্পৃক্তপূর্বক এই সাক্ষীদের প্রদত্ত সাক্ষ্যের এই অংশ ডিফেন্স চ্যালেঞ্জ করেনি। যেমন, নির্ধারিত সময়ের পরও রাত সাড়ে তিনটা-চারটা পর্যন্ত ঐ নৈশ কুচকাওয়াজ চলমান ছিল। যদিও সেনাবাহিনীর দুটি ভিন্ন ইউনিটকে একীভূত করে নৈশ কুচকাওয়াজের কোনাে বিধান ছিল না, তারপরও ঐরূপ একীভূত করা হয়েছিল এবং তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে গােলাবারুদ নিয়েছিল যা ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর্মি রুল ভঙ্গ করে শান্তিপূর্ণ সময়ে তারা ট্যাঙ্ক ও কামান ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়েছিল এবং সেগুলাে ঘটনার ঠিক আগে নিয়ােজিত করেছিল এবং কয়েকজন অপসারিত সেনা অফিসার নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিল; অভিযুক্ত অফিসারদের মধ্যে গােপন বৈঠক হয়েছিল; জওয়ানদের উত্তেজিত করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে এবং ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কয়েকজন অফিসার এবং দুটি ইউনিটের জওয়ানরা আপিলকারীগণসহ ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আসে। এরপর তারা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গিয়েছিল এবং তাঁকে (প্রেসিডেন্ট) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। যখন অন্য অফিসার, জওয়ানরা কয়েকজন আপিলকারীসহ অন্য কটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিয়ােজিত ছিল।
১৫৬. অধিকন্তু, আপিলকারীদের ঘটনা-পূর্ববর্তী আচরণ সম্পর্কে সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে, পি.ডব্লিউ-১১ ঐ নৈশকালীন কুচকাওয়াজে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং বজলুল হুদাকে চিনতে পেরেছিলেন। ১৪ আগস্ট রাতের ঐ নৈশ কুচকাওয়াজে পি.ডব্লিউ-১২ মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), ফারুক রহমান এবং বজলুল হুদাকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৩ মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং ফারুক রহমানকে এবং পি.ডব্লিউ-১৪ মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) ও শাহরিয়ারকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৭ ও পি.ডব্লিউ-১৮ ১৪ আগস্ট রাতে ঐ প্যারেড গ্রাউন্ডে লে. কর্নেল মহিউদ্দীনকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২১ ও পি.ডব্লিউ-২২ ঐ প্যারেড গ্রাউন্ডে লে. কর্নেল মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) এবং বজলুল হুদাকে এবং পি.ডব্লিউ-২৩ সেখানে লে. কর্নেল ফারুক রহমানকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ফারুক রহমান, এ. কে. এম মহিউদ্দীন আহমেদ (অর্টিলারি) এবং লে. কর্নেল শাহরিয়ারকে পি.ডব্লিউ-২৩ প্যারেড গ্রাউন্ডে শনাক্ত করেছিল। মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) এবং ফারুক রহমানকে ঐ নৈশ
৪৮৯

কুচকাওয়াজে পি.ডব্লিউ-২৫ চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৭ মহিউদ্দীন আহমেদকে (আর্টিলারি) কলাবাগান এলাকায় চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩২ মহিউদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন নৈশ কুচকাওয়াজের সময়। পি.ডব্লিউ-৩৪ কলাবাগান এলাকায় লে. কর্নেল মহিউদ্দীনকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩৫ কর্নেল মহিউদ্দীনকে চিনেছিলেন নৈশ কুচকাওয়াজের গ্রাউন্ডে। পি.ডব্লিউ-৩৯ নৈশ কুচকাওয়াজ গ্রাউন্ডে ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) চিনতে পেরেছিলেন।
পি.ডব্লিউ-৪০ বলেছেন যে, ফারুক রহমান তাকে বলেছিল যে, তারা স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত করতে চলেছে। কিন্তু সরকার উৎখাতের পরিবর্তে তারা প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগটি বিবেচনা করতে গিয়ে উপরে বিস্তারিতভাবে আলােচিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে যেটি দৃষ্ট হয় তা হলাে, আপিলকারীরা তাদের সহ-আসামিগণসহ তাদের সৈনিকদের নিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলাে অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলাের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং আর্টিলারিসহ সেনা মােতায়েন করেছিল এবং এরপর তাদের অভীষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়েছিল। আসামিদের কৃত এই সব কর্ম ছিল একই সময়ের তর্কিত পরিকল্পনা অনুসারেযেখানে ছিল একটি গােষ্ঠী ও লক্ষ্যের ধারাবাহিকতা। আপিলকারীদের এই সব আচরণ প্রাসঙ্গিক যা তাদের দোষ ছাড়া অন্য কোনাে যৌক্তিক ব্যাখা দেয় না।
১৫৭. অবশ্য প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পি.ডব্লিউ-২৪কে এই কারণে বিশ্বাস করেননি যে, ফারুক রহমানের পক্ষেজেরা করাকালে তাকে দেওয়া এই সাজেশনের উত্তরে তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, পুলিশের বক্তব্যমতে তিনি আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এই আশঙ্কায় যে, তা না হলে তাকে মামলায় একজন। করা হবে; যেহেতু তাকে সেরনিয়াবাতের বাসভবনে উপস্থিত পাওয়া গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক অবশ্য পি.ডব্লিউ-২৪কে এই কারণে বিশ্বাস করেছেন যে, জেরায় প্রদত্ত তার বক্তব্য সামগ্রিকভাবে পর্যালােচনা করলে তা এটি বলে যে, তিনি (সাক্ষী) ঐ সাজেশনটি অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞ দায়রা জজ অসাবধানতাবশত তার (সাক্ষী) বক্তব্য ‘হ্যা-সূচকভাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং এটি প্রতিভাত হয় যে, কর্নেল মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) পক্ষে প্রদত্ত প্রায় অনুরূপ ডিফেন্স সাজেশন পি.ডব্লিউ-২৪ অস্বীকার করেছেন। তদুপরি, এই সাক্ষী ঘটনার প্রায় ২২ বছর পর ১৯৯৭ সালের ১৯ অক্টোবর আদালতে সাক্ষ্য দেন। এই বিলম্বিত সময়ে এসে সেরনিয়াবাত হত্যা মামলায় তার সম্পৃক্ত হওয়ার কোনাে শঙ্কা ছিল না; যেহেতু, দীর্ঘ সময় আগে মামলাগুলাে দায়ের হয়েছিল। তাছাড়া উপরােক্ত বক্তব্য আদালতে সাক্ষ্য প্রদানকালে দেওয়া হয়েছিল, পুলিশের কাছে নয়।
১৫৮. তদনুযায়ী, বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারকের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত পােষণ করছি যে, বিজ্ঞ দায়রা বিচারক অসতর্কতাবশত কথিত ডিফেন্স সাজেশনটি ‘হা-সূচক’ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন, যদিও পি.ডব্লিউ-২৪ উত্তরে ‘না-সূচক জবাব দিয়েছিলেন।
১৫৯. প্রথম বিজ্ঞ বিচারক আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার, বজলুল হুদা এবং অন্য আসামিদের বঙ্গভবনে চিনতে পারা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-৪৬কেও এই কারণে বিশ্বাস করেননি যে, নথিতে এমন কিছু নেই যা থেকে এটি প্রতিভাত হতে পারে যে, তিনি (সাক্ষী) তাদেরকে আগে থেকেই চিনতেন। বিজ্ঞ বিচারকের এই অভিমতটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ বিজ্ঞ বিচারক নিজেই বঙ্গভবনে এই আপিলকারীদের উপস্থিতির বিষয়টি বিশ্বাস করেছেন এবং এই কারণে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে এই বিরুদ্ধ অনুমান করেছেন যে, তারা জুনিয়র অফিসার হিসেবে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত
৪৯০

ছিল বলে ধরে নেওয়া যায় না। পি.ডব্লিউ-১৫ এবং ৪৭, তারাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তারা তাদেরকে বঙ্গভবনে দেখেছিলেন। অতএব, বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক যথার্থভাবেই পি.ডব্লিউ-৪৬কে বিশ্বাস করেছেন।
১৬০. রাষ্ট্রপক্ষের মামলা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, অন্য আসামিদের সাথে আপিলকারীরা ১৪ আগস্ট রাতের নৈশ কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল। যদিও আর্মি রুলে অনুরূপ অনুশীলনে অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নেওয়ার বিধান ছিল না, তারপরও তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নিয়েছিল এবং এরপর তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রােড অভিমুখে, যেখানে প্রেসিডেন্ট বাস করছিলেন, মিন্টু রােড যেখানে কেবিনেট মন্ত্রীগণ অবস্থান করছিলেন সেখানে, রেডিও স্টেশন এবং রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল। তারা রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর ও ৩২ নম্বর রােড লক্ষ্য করে কামান স্থাপন করেছিল- রক্ষীবাহিনী বা অন্য কোনাে বাহিনীর তরফ থেকে কোনাে প্রতিরােধ দেখা দিলে সেগুলাে ব্যবহার করার জন্য। তারা অস্ত্র, কামান ও ট্যাঙ্ক, যা স্বাভাবিক সময়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করা যেত না, তাদের সাথে নিয়েছিল। এইসব অস্ত্র, গােলাবারুদ ও ভারী অস্ত্রাদি যেমন, কামান এবং ট্যাঙ্ক, এগুলাে তারা ঘটনার ঠিক পূর্বমুহূর্তে নিয়েছিল এবং সেগুলাে স্থাপন করেছিল মূলত সরকার এবং অন্য কোনাে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি-আক্রমণ প্রতিরােধ ও প্রতিহত করার লক্ষ্যে। আপিলকারীরা ও অন্য আসামিদের এইরূপ কর্মকাণ্ড ঐ ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তারা একটি সাজানাে পথে পরিকল্পিত পন্থায় পূর্বপরিকল্পিত হত্যার এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য একটি সাজানাে পথে ব্যবস্থা নিয়েছিল।
১৬১. আপিলকারীগণ ও অন্য আসামিদের পরবর্তী আচরণের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ পি.ডব্লিউ-৮, ৯, ১২, ১৫, ১৬, ২০, ২৩, ৩৭, ৪২, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৯ এবং ৬০কে পরীক্ষা করেছে। পি.ডব্লিউ-৯ বলেন যে, ১৫ আগস্ট রাত ৩টার সময় পি.ডব্লিউ-৪৫-এর নির্দেশ অনুসারে তিনি পরিস্থিতি জানার জন্য প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যান, যেখানে ভবনের গেটে বজলুল হুদা তাকে গ্রহণ করেছিল এবং মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) তত্ত্বাবধানে একটি হেলিকপ্টারযােগে প্রেসিডেন্টের মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় পাঠানাে হয়েছিল।
পি.ডব্লিউ-১২ বলেন যে, ১৫ আগস্ট সকাল ০৭.১৫ মিনিটে তিনি (সাক্ষী) যখন ৩২ নম্বর রােড থেকে একটি ট্যাঙ্কসহ মিরপুর রােড অভিমুখে আসছিলেন তখন তিনি ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৫ বলেন যে, ঘটনার দিন বিকেল ০৪টার সময় তিনি বঙ্গভবনে ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার, বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) দেখেছিলেন। ১৫ আগস্ট সকালে যখন তিনি (সাক্ষী) প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দক্ষিণ অভিমুখে যাচ্ছিলেন তখন পি.ডব্লিউ-১৬ মিরপুর রােডস্থ কলাবাগানে সাংহাই রেস্টুরেন্টের সামনে একটি জিপে ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৬ বঙ্গভবনে যাওয়ার পর সেখানে সেনা সদস্যগণসহ মহিউদ্দীনকেও (আর্টিলারি) দেখেছিলেন।
পি.ডব্লিউ-২০ বলেন যে, ঘটনার পরে তিনি (সাক্ষী) বঙ্গভবনে শাহরিয়ার, ফারুক রহমান ও অন্য অফিসারদের দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৩ বলেন যে, ঘটনার পরে তিনি (সাক্ষী) ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) ল্যান্সার ইউনিটে দেখেননি এবং শুনেছিলেন যে, তারা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিল।
পি.ডব্লিউ-৩৭ বলেন যে, ঘটনার পরে ১৫ আগস্ট সকাল ৭টায় তিনি (সাক্ষী) রেডিও স্টেশনের স্টুডিও ২-এ শাহরিয়ারকে সহ-আসামিদের সাথে দেখেছিলেন, যখন তারা খােন্দকার মােশতাকের বাংলাদেশ রেডিওর বক্তৃতা প্রস্তুত করছিল।
৪৯১

পি.ডব্লিউ-৪২ বলেন যে, ১৫ আগস্ট তিনি (সাক্ষী) রেডিও স্টেশনে শাহরিয়ার, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন, যখন সেখানে সেনাপ্রধান, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান রেডিওর মাধ্যমে তাদের আনুগত্য সম্প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) বজলুল হুদা ও নূরকেও দেখেছিলেন, যখন তিনি ১৫ আগস্ট সকাল ১১টায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভিকটিমদের ছবি তােলার জন্য ৩২ নম্বর রােডে গিয়েছিলেন। তিনি (সাক্ষী) অপরাহ্নে বঙ্গভবনে শাহরিয়ার রশিদ, ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অন্য আসামিদেরও দেখেছিলেন।
পি.ডব্লিউ-৪৪ বলেন যে, ১৫ আগস্ট এবং ৪ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসাররা যখন ব্যাংককে অবস্থান করছিল তখন ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ তথাকথিত “সিপাহি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সর্বময় ক্ষমতার একজন নেতা হিসেবে আসেন এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনসমূহে চাকরির ব্যবস্থা করে তাদের প্রত্যাবাসন করেন। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, ঐ অফিসাররা জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। এরপর তাদেরকে চাকরি থেকে অপসারিত করা হয়েছিল এবং তারপর তারা পলাতক হিসেবে বিদেশে জীবনযাপন করছিল। আপিলকারীগণ এই সাক্ষীর এসব বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করেনি।
পি.ডব্লিউ-৪৫ বলেন যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বজলুল হুদা, ফারুক আহমেদ (রহমান) এবং অন্য সহ-আসামিরা উপস্থিত ছিল। ঘটনার দিন বঙ্গভবনে বেলা ৩.৩০ মিনিটে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ যখন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন তখন তার পাশে ফারুক রহমান, শাহরিয়ার, বজলুল হুদা, ফারুক আহমেদ এবং অন্য সহ-আসামিরা বসে ছিলপি.ডব্লিউ-৪৬ এটি দেখেছিলেন।
পি.ডব্লিউ-৪৭ও ফারুক রহমান, শাহরিয়ার, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং বজলুল হুদাকে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ও তার কেবিনেটের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখেছিলেন। ০৩ নভেম্বরের ঘটনার পর মেজর আব্দুর রশিদ এবং অন্য আসামিরা ব্যাংককে চলে যায়।
পি.ডব্লিউ-৪৯ বলেন যে, ১৫ আগস্ট রেডিও স্টেশনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদের আনুগত্য সম্প্রচারের পর মেজর ডালিম তাকে (সাক্ষী) ফারুক রহমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
পি.ডব্লিউ-৬০ বলেন যে, ১৯৭৬-এর ৮ জুন তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি নথি খােলা হয়, কিছু সেনা আফিসারকে আত্তীকরণের জন্য। তারপর ১৫ আগস্ট, ১৯৭৬ তারিখের সেনা সদর দফতরের একটি স্মারকপত্র মূলে মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা, সুলতান শাহরিয়ার এবং অন্য আসামিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছিল।
১৬২. বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক অবশ্য এই অভিমতে আসেন যে, আপিলকারীদের কয়েকজনকে ও অন্য আসামিদের বিদেশি মিশনগুলােতে ন্যস্ত করার বিষয়টিকে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততার জন্য তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল বলে গ্রহণ করা যায় না এবং সেহেতু, ঐরূপ চাকরিতে ন্যস্তকরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে বিরুদ্ধ অনুমান গ্রহণ করা যায় না।
১৬৩. কিন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে, তাদের অনেকেই ছিল অপসারিত সেনা অফিসার এবং পি.ডব্লিউ-৪৪ ও ৪৭ এটি প্রমাণ করেছেন যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে তাদেরকে চাকরিতে আত্তীকৃত করা হয়েছিল এবং এর আগে যখন খােন্দকার মােশতাক আহমেদ,
৪৯২

একজন নির্ধারিত ব্যক্তি, খালেদ মােশাররফ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তারা ৩ মার্চ তারিখ বিকেলে দেশত্যাগ করেছিল। পি.ডব্লিউ-৪৪, ৪৫ ও ৪৭-এর প্রদত্ত সাক্ষ্য পি.ডব্লিউ-৬০-এর সাক্ষ্যের সাথে একত্রে পাঠ করলে এটি স্পষ্ট হবে যে, আপিলকারীরা এবং সহ-আসামিরা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারেই নৈশকালীন কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল।
তারপর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কোনাে অনুমােদন ছাড়া ট্যাংক এবং অন্যান্য অস্ত্রাদিসহ বের হয়ে আসে এবং তাদের কয়েকজন ৩২ নম্বর রােডস্থ প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যকে যেন সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী কোনােভাবে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে সেজন্য তাদেরকে প্রতিরােধ করার লক্ষ্যে অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, যেমন রেডিও স্টেশন, মিন্টু রােড, বিডিআর সদর দফতর, রক্ষীবাহিনী সদর দফতরে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর তারা সেনাপ্রধান, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানকে তাদের আনুগত্য প্রকাশের জন্য ও খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। এরপর তারা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিল এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে ও রেডিও স্টেশন প্রহরায় রেখেছিল যেন অন্য কেউ খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে উৎখাত করেতে না পারে। তারা প্রেসিডেন্টের ও কেবিনেটের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল, যদিও তারা সেনাবাহিনীর ছােট অফিসার হিসেবে ঐরূপ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যােগ দেওয়ার অবস্থানে ছিল না।
আপিলকারী সুলতান শাহরিয়ারসহ তাদের কয়েকজন ছিল অপসারিত অফিসার এবং তাদের কয়েকজন মৃতদেহগুলাে সত্ত্বারের ব্যবস্থা করেছিল। ৩ নভেম্বরের ঘটনার পর দেশ থেকে পালিয়ে তারা ব্যাংককে আশ্রয় নেয় এবং তারপর প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক বিভিন্ন বাংলাদেশ দূতাবাসে আত্তীকৃত হয়। এরপর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে তাদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কারণে চাকরি থেকে তারা অপসারিত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছিল। এই সব পরিস্থিতি এটিই প্রমাণ করে যে, তারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। অন্য আসামিরা ছাড়া আপিলকারীদের এসব কর্ম ও আচরণ এভিডেন্স অ্যাক্টের ৮ ধারা অনুসারে প্রাসঙ্গিক এবং তা অধিকতর প্রমাণ হিসেবে আপিলকারীদের ও অন্য আসামিদের দোষ প্রমাণের জন্য সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
১৬৪. উপরােক্ত সাক্ষ্য এটি প্রমাণ করে যে, আপিলকারীগণ ও অন্য আসামিরা প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র রচনা করেছিল।
১৬৫. পঞ্চম যুক্তি সম্পর্কে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা সম্পর্কে আপিলকারীগণের পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী এই সাধারণ বক্তব্য রাখেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নথিভুক্ত সাক্ষ্য হালকাভাবে বিবেচনা করেছেন এবং কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করে আপিলকারীদের মৃত্যুদণ্ড বহাল বা অনুমােদন করেছেন এবং এটি বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে অভিযােগসমূহের সমর্থনে নথিতে কোনাে আইনানুগ সাক্ষ্য ছিল না। আপিলকারীগণ অন্য আসামিদের সাথে নৈশকালীন কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিল কেবল একটি রুটিন। কাজ হিসেবে এবং তাই প্যারেডে তাদের উপস্থিতি প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে তাদেরকে সম্পৃক্ত করে না। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন সরকারকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে এবং ঐ অভ্যুত্থানের পরিণতিতেই প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আর্মিরা হত্যা করেছিল, যেখানে আপিলকারীরা জড়িত ছিল না।।
৪৯৩

১৬৬. আপিলকারী বজলুল হুদা ও মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুল্লাহ-আল-মামুন আরাে নিবেদন করেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের মামলার সমর্থনে এমন কোনাে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য নেই যে, এই আপিলকারীগণকে ঘটনাস্থলে এজাহারকারী চিনতে পেরেছিলেন। বজলুল হুদা শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছিল এই অভিযােগের ভিত্তি নথিতে থাকা স্ববিরােধী সাক্ষ্য; এবং প্রসিকিউশন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের, যেমন শেখ ইউনুস আলী, কর্নেল মশিউদ দৌলা এবং কর্নেল মাহমুদুল হাসানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উইথহেল্ড করেছে। কারণ তাদের সাক্ষ্য প্রসিকিউশন পক্ষের জন্য অনুপযােগী হতে পারত। অতএব, ঐ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের উইথহেল্ড করার জন্য প্রসিকিউশনের বিপক্ষে একটি বিরুদ্ধ অনুমান গ্রহণ করা যেতে পারে। মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) প্রেসিডেন্টকে দোতলা থেকে নীচে নিয়ে এসেছিল এই অভিযােগটি নথিতে থাকা কোনাে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্যের উপর নির্ভরশীল নয়। ঘটনাস্থলে সাক্ষীগণ কর্তৃক মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) চিনতে পারার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব ও অবিশ্বাসযােগ্য গল্প এবং তাছাড়া, ঘটনাস্থলে বজলুল হুদা ও মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) উপস্থিত থাকার বিষয়টি সম্পর্কে নথিতে থাকা সাক্ষ্যপ্রমাণাদিও স্ববিরােধী।
১৬৭. আপিলকারী সৈয়দ ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমান আরাে নিবেদন করেন যে, আপিলকারীগণ কর্তৃক প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা সংঘটনের অভিযােগের সমর্থনে কোনাে সাক্ষ্য নেই এবং ঘটনা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১ কোনাে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নন; মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) এজাহার নামীয় কোনাে অভিযুক্ত নন এবং মামলায় তার অন্তর্ভুক্তি একটি সৃজিত বিষয়। সাক্ষীদের বক্তব্য মতে, ঘটনার ঠিক পূর্বে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে পতাকা উত্তোলন ও বাদ্য বাজানাের গল্পটি বিশ্বাসযােগ্য নয়। কারণ পি.ডব্লিউ-১-৩ বলেছেন যে, আক্রমণকারীরা ঐ সময় ইতােমধ্যেই প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ছিল। ফারুক রহমান সংশ্লিষ্ট সময়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ছিল সে মর্মে নথিতে আদৌ কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। কলাবাগান খেলার মাঠে কামানসহ মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) উপস্থিত থাকার বিষয়টি বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য পেশের মাধ্যমে সমর্থিত হয়নি। ট্যাংক সৈনিকদের সাক্ষী হিসেবে না আনায় প্রসিকিউশনের বিপক্ষে একটি বিরুদ্ধ অনুমান গ্রহণ করা যায় যে, তাদেরকে উপস্থাপন করা হলে তারা প্রসিকিউশন কেস সমর্থন করত না। প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের মুখ থেকে প্রকাশিত সাক্ষ্যের আলােকে ঘটনার প্রকৃত পরিকল্পনাকারী ছিল জোবায়দা রশিদ। আরাে নিবেদন করা হয় যে, পি.ডব্লিউদের সাক্ষ্য থেকেও এটি স্পষ্ট হবে যে, প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত হওয়ার জন্য আপিলকারীদের সাধারণ অভিপ্রায় অথবা পূর্বপরিকল্পিত মন ছিল না এবং সেহেতু, ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ
ছিল বেআইনি।
১৬৮. সুলতান শাহরিয়ারের পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুর রাজ্জাক খান আরাে নিবেদন করেন যে, প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যায় সুলতান শাহরিয়ারের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কোনাে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য নেই এবং তিনি ধানমন্ডির ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে যাননি। বালুরঘাটে নৈশ কুচকাওয়াজে তার উপস্থিতি প্রমাণের জন্য পি.ডব্লিউ-১৪-এর সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে হাইকোর্ট বিভাগ আইনগত ভুল করেছেন, যদিও আদৌ কোনাে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য ছিল না এবং যদি পি.ডব্লিউ-১৪-এর সাক্ষ্য অবিশ্বাস করা যায়, তখন সেখানে সাক্ষ্য থাকছে কেবল ১৫ আগস্ট ৬টায় রেডিও স্টেশনে সুলতান শাহরিয়ারের উপস্থিতি সম্পর্কে। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনার সাথে এটির কোনাে সম্পর্ক নেই। কারণ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে পুনঃনিয়ােজিত হয়ে রেডিও স্টেশনে তার উপস্থিতি ছিল তার অফিসিয়াল কর্তব্যের অংশ, যা সে তার কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে পালন করেছিল।
৪৯৪

১৬৯. বিজ্ঞ আইনজীবীগণ তাদের বক্তব্যের সমর্থনে Nurul Islam os State, 43 DLR (AD) 6, Hazrat Khan@ Hazrat Ali vs State, 54 DLR 636, Moslem Uddin vs State, 38 DLR (AD) 311, Safdar Ali vs Crown, 5 DLR (FC) 107 978 Moyez Uddin vs State, 31 DLR (AD) 37 মামলাগুলাে উদ্ধৃত করেন। জনাব আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, সাক্ষীদের জবানবন্দি থেকে যে সাক্ষ্য সামনে এসেছে তা হত্যার অভিযােগটি প্রমাণিত করেছে। তাছাড়া দ্য সানডে টাইমস (প্রদর্শনী-এক্স)-এর কপি এবং ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য (বস্তু প্রদর্শনী-১২ ও ১৩)- এগুলােও হত্যার অভিযােগটি প্রমাণ করেছে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জনাব আজমালুল হােসেইন হত্যার অভিযােগটি প্রমাণের জন্য পি.ডব্লিউ-৮ ও ১৫ কর্তৃক ব্যক্ত মােতাবেক আপিলকারীদের এক্সট্রা জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির উপর নির্ভর করেছেন। ১৭০. প্রথমে সানডে টাইমস (প্রদর্শনী-এক্স)-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য (বস্তু প্রদর্শনী ৩২ ও ১২) সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হলাে :
১৭১. পি.ডব্লিউ-৫৮ ০৮.৫.১৯৭৬ তারিখের সানডে টাইমস-এর কপি প্রদর্শন করেন যা ডিফেন্সের আপত্তিসহ প্রদর্শনী-এক্স হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, এবং তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, যখন তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন তিনি অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডি-র অনুরােধে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের তৎকালীন কাউন্সিলরের মাধ্যমে সানডে টাইমস-এর কপি সংগ্রহ করেছিলেন, যেখানে আপিলকারী ফারুক রহমান তার সম্পৃক্ততা স্বীকার করে বলেছিল, “আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যায় সাহায্য করেছিলাম, dare to put me on trial.” পি.ডব্লিউ-৫৮ কাউন্সিলরের স্বাক্ষরিত যে ফরওয়ার্ডিং পত্রটির মাধ্যমে বর্ণিত পত্রিকাটি তাকে পাঠানাে হয় সেটিও তিনি প্রমাণ করেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৫৮ ১৯৭৬-এর ২ আগস্ট যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে সম্প্রচারিত একটি ভিডিও ক্যাসেট প্রদর্শনী-৩২ হিসেবে আপত্তিসহ প্রমাণ করেন। এর সাথে ছিল নােটারি পাবলিক Keith Robert Hopkins কর্তৃক এই মর্মে ইস্যুকৃত সার্টিফেকেট যে, তার জ্ঞান, তথ্য ও বিশ্বাস মতে বর্ণিত ভিডিও ক্যাসেট একটি টেলিভিশন প্রােগ্রামের একটি বৈধ কপি। তাছাড়া স্থানীয় ভিডিও রেকর্ডার পি.ডব্লিউ-৫৯ জনাব বখতিয়ার হােসেইনও ভিডিও ক্যাসেটটি (প্রদর্শনী-১২) প্রমাণ করেছেন, যেখানে মেজর রশিদ ও ফারুক রহমান অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছে যে, তারা শেখ মুজিবকে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করেছে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, সানডে টাইমস (প্রদর্শনী-এক্স)-এর সংখ্যাটি এভিডেন্স অ্যাক্টের ৩ ধারার অধীনে একটি দলিল, যেখানে ফারুক রহমান প্রেসিডেন্টের হত্যাকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ স্বীকার করেছে। তাছাড়া, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনাটি বাংলাদেশের একটি মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা হওয়ায় এ সম্পর্কে কোনাে গ্রন্থ বা দলিল এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫৭ ধারার বিধানের অধীনে জুডিশিয়াল নােটিশে নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া, ফারুক রহমান অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে তার দেওয়া বর্ণিত সাক্ষাৎকারের বিষয়টি জেরায় অস্বীকার করেনি। তাই ভিডিও ক্যাসেট, বস্তু প্রদর্শনী-৩২ ও প্রদর্শনী-১২ সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
১৭২. যা হােক, এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫৭ ধারার শর্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আদালত নিজেই কিছু বিষয় যা খুব ভয়ংকর তা আমলে নিতে পারেন বা যদি এটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে, সেটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে হয়। কিন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে, সানডে টাইমস-এর একটি সংখ্যায় একজন সাংবাদিকের কাছে আপিলকারী ফারুক রহমানের দেওয়া কথিত বক্তব্য শ্রুত সাক্ষ্য প্রকৃতির; যেহেতু, ঐ আপিলকারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিককে প্রসিকিউশন পরীক্ষা করেনি।
৪৯৫

তবে ভারতে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৩ ধারার ২ উপধারা নিমােক্তভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে :
“(2) all documents including electronic records produced for the inspection of the Court; such documents are called documentary evidence.” সেহেতু, ভারতে উপরােক্ত সংশােধনীর আলােকে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক উপায়ে ধারণকৃত ভিডিও ক্যাসেট, কমপ্যাক্ট ডিস্ক এবং ভিডিও কনফারেন্সিং সাক্ষ্য হতে পারে।
১৭৫. ভারতের সুপ্রীম কোর্ট State of Maharashtra vs Dr Praful B. Desai, (2003) 4 SCC 601 মামলায় এই সিদ্ধান্ত দেন যে, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে কোনাে সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলে তা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের শর্তাদির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১৭৬. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৩ ধারায় সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতির বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বিস্তৃত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, অন্য কোনাে বিধান না থাকলে XX, XXII এবংXXIII অধ্যায়ের অধীনে গৃহীত সকল সাক্ষ্য আসামির উপস্থিতিতে নিতে হবে, অথবা যখন তার আইনজীবীর উপস্থিতিতে তার ব্যক্তিগত উপস্থিতি নিশ্চিত হবে। এ থেকে দেখা যায়, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় যদিও আসামির শারীরিক উপস্থিতি প্রয়ােজন, তথাপি কোনাে কোনাে পরিস্থিতিতে তা সম্পন্ন করা যেতে পারে।
১৭৭. তদুপরি, ১৮৭২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্ট একটি প্রসিডিউরাল আইন এবং একই সাথে একটি চলমান স্ট্যাটুট। ফ্রানসিস বেনিওন (Francis Benion)-এর মতে, কোনাে চলমান স্ট্যাটুট ব্যাখ্যার নীতি এটি হওয়া উচিত যে, পার্লামেন্ট চায় যে, একটি আইন প্রথমত যেভাবে প্রণীত হয়েছিল সেখানে পরিবর্তন
৪৯৬

আনতে আদালত যেন ঐ বিদ্যমান আইনের কথাগুলাে ব্যাখা করেন। যখন এটি আইন হিসেবে বিদ্যমান থাকে তখন এটিকে সব সময় ব্যক্ত (speaking) হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
১৭৮ . তদুপরি , National Textile Workers’ Union vs PR Ramakrishnan, AIR 1983 SC 75 7/100137 বিচারপতি ভগবতি সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“We cannot allow the dead hand of the past to stifle the growth of the living present. Law cannot stand still; it must change with the changing social concepts and values. If the bark that protects the tree fails to grow and expand along with the tree, it will either choke the tree or if it is a living tree, it will shed that bark and grow a new living bark for itself. Similarly, if the law fails to respond to the needs of changing society, then either it will stifle the growth of the society and choke its progress or if the society is vigorous enough, it will cast away the law which stands in the way of its growth. Law must therefore constantly be on the move adapting itself to the fast-changing society and not lag behind.”
১৭৯. অতএব, এটি এখন মূল্যায়ন করার উপযুক্ত সময় যে, প্রযুক্তির উন্নয়ন কীভাবে বিচারব্যবস্থার কার্যক্রমে রূপান্তর ঘটিয়ে আনছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির বাস্তবতায় বিদ্যমান আইনের প্রয়ােগ বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং এজন্য প্রায়শই নতুন আইন সৃষ্টির প্রয়ােজন হয় সেগুলাের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য। তদুপরি, একই সময়ে এটিও মনে রাখতে হবে যে, কোনাে নির্দিষ্ট প্রযুক্তির সুবিধা বা বিকল্প হিসেবে এটির অপব্যবহারের বিষয়ে নতুন প্রযুক্তির অনুশীলন স্বভাবতই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
১৮০. ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সামনে চ্যালেঞ্জগুলাে হলাে দ্রুত ও কার্যকর বিচারের ক্ষেত্রে আসামির অধিকারকে স্থিত করা। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মেশিনারিকে অবশ্যই অপরাধের উদ্ভূত ধরন ও অপরাধীর আচরণ কার্যকরভাবে নিষ্পত্তি করার চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হতে হয়। এটি তাই প্রত্যাশিত যে, দেশে বিদ্যমান সকেল আইন বা আইনের সকেল অংশ সংশােধিত হতে হবে এবং নতুন উপযুক্ত আইনও প্রণয়ন করতে হবে সমাজের পরিবর্তনের প্রয়ােজনের প্রতি সাড়া দিয়ে, যেটি ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য সম্পর্কে ভারতে করা হয়েছিল।
১৮১. তদুপরি, কীভাবে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে সে সম্পর্কে পূর্বে উল্লিখিত বিদ্যমান আইনের ব্যক্ত বিধানগুলাের কারণে আমার মত এটি যে, এই মামলায় প্রসিকিউশন কর্তৃক উপস্থাপিত ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য ব্যবহার করা যেতে পারে না।
১৮২. আপিলকারীদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযােগের সমর্থনে এক্সট্রা জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি পি.ডব্লিউ-৮ ও ১৫ কর্তৃক বিবৃত হয়েছে এবং সেগুলাে জেরা করাকালে ডিফেন্স কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়।
১৮৩. প্রতীয়মান হয় যে, পি.ডব্লিউ-৮, যিনি সংশ্লিষ্ট সময়ে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন, তার জবানবন্দিতে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের বাসভবনের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয়ের পর চিফ অব আর্মি স্টাফ কর্তৃক নিয়ােজিত হয়ে তিনি (সাক্ষী) ১৫ আগস্ট রাত ৮.৪৫ মিনিটে বাসভবন পরিদর্শন করেন। পি.ডব্লিউ-৮
৪৯৭

বলেছিলেন যে, মেজর নূর চৌধুরী এবং বজলুল হুদা তাকে গ্রহণ করে এবং এরপর বজলুল হুদা তাকে বাসভবনের ভেতরে নিয়ে যায়। তিনি (সাক্ষী) প্রকৃত পরিস্থিতি যা প্রত্যক্ষ করেছেন তা বর্ণনা করেছেন এবং তা নিম্নরূপ :
“ক্যাপ্টেন হুদা আমাদিগকে বাড়ির ভিতর নিয়া গেলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রিসিপশন রুমে টেলিফোন টেবিলের পাশে শেখ কামালের লাশ গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে দেখি। আমি তখন বজলুল হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, শেখ কামালকে কেন মেরেছেন? উত্তরে বজলুল হুদা জানায়, শেখ কামাল ফোনে বাহিরে খবর দিতেছিল- সেই জন্য তাহাকে মেরেছি। ঐ রুমের টেবিলের সামনে লুঙ্গি পরা গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় আরাে একজনের লাশ দেখিতে পাই। ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, কেন তাকে মেরেছেন? জবাবে হুদা জানায়, সে পুলিশের লােক, তাকে চলে যেতে বললে সে তর্ক শুরু করে দেয়- তাই তাকে আমরা মেরেছি।
“তৎপর বজলুল হুদা আমাদিগকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। সিঁড়ির দক্ষিণ দিকে বাথ দেখাইয়া বলে, ‘এখানে শেখ নাসেরের লাশ আছে।
“আমরা বাথরুমে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় শেখ নাসেরের লাশ দেখি। হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, তাকে কেন মেরেছেন?’ ক্যাপ্টেন হুদা কোনাে উত্তর দেয় না।
“এরপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা আমাদেরকে নিয়া সিঁড়ির দিকে ওঠে। সিঁড়ির কয়েক ধাপ উঠিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ দেখিয়া আমরা হতভম্ব হইয়া যাই। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত বুকের বাম পাশে, পেটের ডান দিকে, ডান হাতে অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় পা ভাঁজ করে চিত হইয়া সিঁড়ির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়িয়া আছেন। পাশে তাহার চশমাও দেখিতে পাই। আমি ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা কেন দেশের প্রেসিডেন্টকে এইভাবে মারলেন?
উত্তরে ক্যাপ্টেন হুদা বলিলেন, আমি যখন দলবলসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যাই সে তখন বলে-
“তােমরা কেন আমার বাসায় আসিয়াছে- কে পাঠাইয়াছে- শফিউল্লাহ কোথায়? এই বলিয়া আমাকে ঝটকা মারে। তখন আমি পড়ে যাই। ইহার পর আমরা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করি। তারপর আমাদেরকে নিয়া ক্যাপ্টেন হুদা খাবার ঘরের পাশে গেলে আমরা সেখানে (বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের দরজায়) বেগম মুজিবের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখিতে পাই। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় আরাে চারিটি লাশ পড়িয়া থাকিতে দেখি। তখন আমি ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, কেন এদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন? জবাবে ক্যাপ্টেন হুদা বলে, সশস্ত্র সৈনিকরা Out[of] control হইয়া এদেরকে হত্যা করিয়া লুটপাট করিয়াছে এবং সেই জন্য সে সৈনিকদের বাহিরে রাখিয়াছে। ক্যাপ্টেন হুদা আরাে জানায়, কর্নেল জামিলকে বাহিরে মেরে তার লাশসহ গাড়ি বাড়ির ভিতরে পিছনে রাখা হইয়াছে।”
১৮৪. অতএব এটি প্রতীয়মান হয় যে, আপিলকারী বজলুল হুদা এই সাক্ষীর কাছে এটি স্বীকার করেছিল যে, সে শেখ কামালকে হত্যা করেছিল, কারণ তিনি (শেখ কামাল) ঘটনা সম্পর্কে তথ্যাদি বাইরে দিচ্ছিলেন। সে (আপিলকারী) আরাে স্বীকার করে যে, একজন নিরাপত্তাকর্মী তাদের সাথে তর্কে জড়ালে তাকেও তারা হত্যা করেছিল। এরপর শেখ নাসেরের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন হুদা নীরব থেকেছিল এবং প্রেসিডেন্টের হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে সে জবাব দিয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট জানতে চেয়েছিলেন
৪৯৮

কেন তারা সেখানে এসেছে এবং শফিউল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং এ কারণে সে তাকে গুলি করে। এরপর নারী সদস্যদের হত্যার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বজলুল হুদা জবাবে বলেছিল যে, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সিপাইরা তাদের হত্যা করেছে। পি.ডব্লিউ-৮-এর কাছে বজলুল হুদার ঐসব স্বীকারােক্তি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে অস্বীকার করা হয়নি। তার এই সাক্ষ্য অখণ্ডিত রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলাে, বজলুল হুদার সক্রিয় ভূমিকা এবং শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করা সম্পর্কে এটিকে এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যায় কিনা কিংবা অন্য আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং মহিউদ্দীনকে দোষী সাব্যস্তকরণে এই সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করা যেতে পারে কিনা। এই সাক্ষ্য থেকে এটি প্রতিভাত হয় যে, পি.ডব্লিউ-১৫ বঙ্গভবনে অবস্থানকালে দেখেছিলেন যে, ফারুক রহমান, মেজর আব্দুর রশিদ, সুলতান শাহরিয়ার, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা এবং অন্যরা নিজেদের মধ্যে গল্পচ্ছলে কথা বলছিল এবং তখন তারা এটি প্রকাশ করেছিল কীভাবে তারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারেরসদস্যদের হত্যা করেছিল।
১৮৫. আপিলকারীগণের পক্ষে এই যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, নিম্ন আদালতে প্রসিকিউশন এই পয়েন্টটি উত্থাপন করেনি এবং সেহেতু, এই পয়েন্টটি এই পর্যায়ে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে না। তাছাড়া এই সাক্ষী কর্তৃক তার কথিত বক্তব্যটি পি.ডব্লিউ-৫কে জানানাে হয়নি এবং সেহেতু, কোনাে অবস্থাতেই সেটিকে এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। পি.ডব্লিউ-১৫ তার জবানবন্দিতে বলেন :
“যেহেতু আমরা বঙ্গভবনে কাজ করার সুবাদে অভিজ্ঞ ছিলাম, সেই কারণে মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের উপর দায়িত্ব দেয়। সেই অনুযায়ী আমরা উক্ত দায়িত্ব পালন করি। এরপর মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর সুলতান শাহরিয়ার, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, রিসালদার মােসলেম উদ্দিনের কথাবার্তায় জানতে পারি যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে অর্থাৎ তার স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই ছেলের বউ ও ভাই শেখ নাসের এবং কর্নেল জামিলকে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রােডস্থ বাড়িতে হত্যা করে।”…“তাহারা দাপটের সাথে বলিত, দেশকে বাচাইবার জন্য আমরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়াছি।”
১৮৬. আপিলকারীগণ এই সাক্ষীকে জেরা করার মাধ্যমে বা কোনাে সাজেশন দেওয়ার মাধ্যমে ঐ সকল জবানবন্দি অস্বীকার করেনি। সুলতান শাহরিয়ারের পক্ষে এই সাক্ষীকে তার দেওয়া উপরােক্ত জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে সংশয়যুক্তভাবে সাজেশন দেওয়া হয়েছিল, সরাসরিভাবে নয়। এখন প্রশ্ন হলাে, উপরােক্ত জবানবন্দি একস্ট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কিনা। যেহেতু, সেটি উপরােক্ত আসামি কর্তৃক এই সাক্ষীকে জানানাে হয়নি যে, তারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল। এটিও প্রতীয়মান হয় যে, এই পয়েন্টটি নিম্ন আদালতে তুলে ধরা হয়নি। কিন্তু যে ঘটনার কারণে সে বিচারের সম্মুখীন, তৎসম্পর্কে একজন আসামি কর্তৃক প্রদত্ত ঐরূপ কোনাে বক্তব্য এই মামলায় জড়িত পয়েন্টের সাথে সরাসরি প্রাসঙ্গিক কিনা সেটি একটি আইনের প্রশ্ন হওয়ায় এর তাৎপর্য বা প্রভাব বিবেচিত হওয়া উচিত।
১৮৭. উপরে বিধৃত জবানবন্দি থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, স্বীকৃত মতে ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তাদের মধ্যে কথাবার্তাকালে বলেছিল যে, তারা প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের সদস্যদের কর্নেল জামিলসহ হত্যা করেছিল। এটি ঠিক যে, এই সাক্ষী তার এই বক্তব্য
৪৯৯

পি.ডব্লিউ-১৫কে না বললেও সে তা শুনেছিল। দেখা যায় যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ২৪-৩০ ধারায় ‘আডমিশন’ ও ‘কনফেশন’-এর গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। সাক্ষ্য-সম্পর্কিত সাধারণ বিধির ক্ষেত্রে এগুলাে ব্যতিক্রম এবং এগুলাের স্থান প্রাসঙ্গিক ঘটনা’ (relevant fact) হিসেবে, যেহেতু, সেগুলাে বক্তব্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ইতিবাচক কথা। ঐরূপ আ্যাডমিশন বা কনফেশনের সাক্ষ্যগত মূল্য (probative value) তা অন্যকে বলা হলাে কিনা তার উপর নির্ভর করে না। এগুলাে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে, যদি তা সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হয়।
১৮৮. স্বীকারােক্তিমূলক বিবৃতি হলাে সাংঘর্ষিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ, অপরাধবােধে জর্জরিত বিবেককে রুদ্ধ করে রাখার এক সচেতন প্রয়াস; বা অপরাধ সংঘটন করার অজুহাত বা ন্যায্যতা সম্পর্কে যুক্তি; বা অপরাধটির সাথে সম্পৃক্ত থাকার এক অনুশােচনাপূর্ণ উক্তি বা অপরাধকর্মের জন্য উৎফুল্ল হওয়া বা
গর্ববােধ করা- এই বিষয়গুলাে এক ধরনের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য।
১৮৯. Sahoo os State of uttar Pradesh, AIR 1966 SC 40 মামলার ঘটনা থেকে দেখা যায় যে, দণ্ডিত সাহু
তার পুত্রবধূর (সুন্দর পত্তি) সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ঘটনার আগে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় এবং সুন্দর পত্তি আব্দুল্লাহ নামে এক প্রতিবেশীর বাসায় দৌড়ে পালায়। দণ্ডিত ব্যক্তি তাকে সেখান থেকে বাসায় ফিরিয়ে আনে এবং বাসার একটি কক্ষে তার সাথে রাত্রিযাপন করে। ঘটনার দিন সকালে সুন্দর পত্তিকে ঐ কক্ষে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়, কিন্তু দণ্ডিত ব্যক্তিকে সেখানে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। সুন্দর পত্তিকে ঐদিন বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ১২/১৩ দিন পরে সে মৃত্যুবরণ করে। দণ্ডিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযােগে বিচার শুরু হয়। মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষ কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষ্য ছিল এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি এবং অবস্থাগত সাক্ষ্য। এক্সট্রা জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তিটি চারজন সাক্ষী দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছিল, যারা বলেছিল যে, ঘটনার দিন সকাল ৬টার সময় তারা দণ্ডিত ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছিল, যখন সে বিড়বিড় করে বলছিল, সে সুন্দর পত্তিকে শেষ করে দিয়েছে এবং এর ফলে প্রতিদিনের ঝগড়াঝাটিও শেষ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিড়বিড় করে বলা ঐ কথাগুলাে, যা চারজন সাক্ষী কর্তৃক প্রমাণিত, তা এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি
হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কিনা।
১৯০. এই মামলার ঘটনার আলােকে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল নিম্নরূপ :
“But there is a clear distinction between the admissibility of evidence and the weight to be attached to it. A confessional soliloquy is a direct piece of evidence. It may be an expression of conflict of emotion, a conscious effort to stifle the pricked conscience; an argument to find excuse or justification for his act; or a penitent or remorseful act of exaggeration of his part in the crime. The tone may be soft and low; the words may be confused; they may be capable of conflicting interpretations depending on witnesses, whether they are biased or honest, intelligent or ignorant, imaginative or prosaic, as the case may be. Generally they are mutterings of a confused mind. Before such evidence can be accepted, it must be established by cogent evidence what were the exact words used by the accused. Even if so much was established, prudence and
৫০০

justice demands that such evidence cannot be made the sole ground of conviction. It may be used only as a corroborative piece of evidence.”
১৯১. জনাব আজমালুল হােসেন কিউসি এ বিষয়ে State of uP os MK Anthonv, AIR 1985 SC 48 মামলাটি উদ্ধৃত করেন। ঐ মামলায় আসামি তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করেছিল। ঐ মামলায় পি.ডব্লিউ-৯ বলেছিল যে, সে আসামিকে সংলগ্ন একটি কক্ষে বসে থাকতে দেখেছিল এবং তাকে দেখে এই সাক্ষী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “কী হয়েছে” ? এবং পরে হত্যার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে জবাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলেছিল, “যে ভুল সে করেছে সেজন্য ঈশ্বর যেন তাকে ক্ষমা করেন, সে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করেছে।” বিজ্ঞ দায়রা জজ তার সেই বিবৃতিটি নিম্নোক্তভাবে উদ্ধৃত করেন :
“হে ঈশ্বর, আমাকে ক্ষমা করাে, আমি এক ভয়ানক কাজ করেছি; আমি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যা করেছি।”
১৯২. ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের সামনে এই প্রশ্নটি এসেছিল যে, সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৯ কর্তৃক প্রদত্ত বর্ণনা মতে উপরােক্ত এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্তকরণের ভিত্তি হতে পারে কিনা। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট সাহু ও অন্যান্য (উপরে বর্ণিত) মামলায় গৃহীত সিদ্ধান্তের আলােকে এই মামলার বিষয়টি বিবেচনা করেছিলেন এবং এই অভিমত প্রদান করেছিলেন যে, এমন কোনাে আইন বা যুক্তি নেই যে, যতক্ষণ পর্যন্ত সাক্ষ্য হিসেবে এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি অন্য কোনাে সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা বিশ্বাস করা যাবে না। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট এআইআর ১৯৭৪ এসসি ১৫৪৫ (১৯৭৫), ১ এসসিআর ৭৪৭, এআইআর ১৯৭৫ এসসি ২৫৮, এআইআর ১৯৬৬ এসসি ৪০ এবং এআইআর ১৯৭৭ এসসি ২২৭৪ মামলায় দেওয়া পূর্বের সিদ্ধান্তগুলাের বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত মতামত প্রদান করেন :
“It thus appears that extra-judicial confession appears to have been treated as a weak piece of evidence but there is no rule of law nor rule of prudence that it cannot be acted upon unless corroborated. If the evidence about extra-judicial confession comes from the mouth of witness/witnesses who appear to be unbiased, not even remotely inimical to the accused, and in respect of whom nothing is brought out which may tend to indicate that he may have a motive for attributing an untruthful statement to the accused; the words spoken to by the witness are clear, unambiguous and unmistakably convey that the accused is the perpetrator of the crime and nothing is omitted by the witness which may militate against it, then after subjecting the evidence of the witness to a rigorous test, on the touchstone of credibility, if it passes the test, the extra-judicial confession can be accepted and can be the basis of a conviction. In such a situation to go in search of corroboration itself tends to cast a shadow of doubt over the evidence. If the evidence of extra-judicial confession is reliable, trustworthy and beyond reproach the same can be relied upon and a conviction can be founded thereon.”
৫০১

১৯৩. কিন্তু বর্তমান আপিলগুলােতে পি.ডব্লিউ-৮ এবং ১৫ কর্তৃক ব্যক্ত এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কারণ, বজলুল হুদা কর্তৃক যেটিই স্বীকার করা হােক না কেন তা পি.ডব্লিউ-৮ কর্তৃক প্রমাণিত হওয়ায় তা প্রত্যক্ষ প্রকৃতির সাক্ষ্য। কিন্তু এতে শ্রুত সাক্ষ্যের উপাদান রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১৫ পরােক্ষ প্রকৃতির। তদুপরি, আপিলকারীদের স্বীকারােক্তিমূলক বিবৃতি তাদের কথাবার্তায় হুবহু প্রতিভাত হয়নি, যেমনটি হয়েছিল উপরে বর্ণিত মামলায়।
১৯৪. এখানে এটি প্রতীয়মান হয় যে, আপিলকারী বজলুল হুদার বিরুদ্ধে প্রণীত অভিযােগ প্রমাণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ এএফএম মহিতুল ইসলাম (পি.ডব্লিউ-১), হাবিলদার মাে: কুদুস শিকদার (পি.ডব্লিউ-৪), নায়েক সুবেদার আব্দুল গনি (পি.ডব্লিউ-৫), হাবিলদার গানার সােহরাব আলী (পি.ডব্লিউ-৬), এ.এল.ডি সিরাজুল হক (পি.ডব্লিউ-১২), লে. নায়েক আব্দুল খালেক (পি.ডব্লিউ-২১), হাবিলদার আব্দুল আজিজ (পি.ডব্লিউ-২২)-কে সাক্ষী হিসেবে পরীক্ষা করেছে। হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ তাদের প্রদত্ত রায়ে বিস্তারিতভাবে এই সাক্ষীদের সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন।
১৯৫. এজাহারকারী পি.ডব্লিউ-১ ঘটনার সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে প্রেসিডেন্টের পি.এ হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি (সাক্ষী) বলেছেন যে, ঘটনার দিন ভাের ৪.৩০/০৫টার সময় টেলিফোন মেকানিক আব্দুল মতিন তাকে (সাক্ষী) ঘুম থেকে ডেকে তােলেন এবং বলেন যে, প্রেসিডেন্ট তার (সাক্ষী) সাথে ফোনে কথা বলতে চাইছেন। এরপর তিনি (সাক্ষী) ফোন ধরলে প্রেসিডেন্ট তাকে বলেন যে, দুষ্কৃতকারীরা তাঁর ভগ্নিপতি সেরনিয়াবাতের বাসায় আক্রমণ করেছে এবং পুলিশ কন্ট্রোল রুমে তাকে (সাক্ষী) যােগাযােগ করতে নির্দেশ দেন। তিনি (সাক্ষী) চেষ্টা করেও পুলিশ কন্ট্রোল রুমে যােগাযােগ করতে ব্যর্থ হন; যদিও গণভবনে সংযােগ পান, কিন্তু কেউ উত্তর দেয়নি। ইতােমধ্যে প্রেসিডেন্ট নীচে অফিস রুমে নেমে আসেন এবং নিজেই তার (সাক্ষী) কাছ থেকে রিসিভারটি নিয়ে কথা বলতে চান। ঠিক সেই সময় এক ঝাঁক বুলেট অফিস রুমের দেয়ালে আঘাত করে, কাচের জানালা ভেঙে যায়, তখন তারা টেবিলের পাশে নীচে শুয়ে পড়েন। গুলিবর্ষণের কিছুক্ষণ পরে প্রেসিডেন্ট দোতলায় চলে যান এবং শেখ কামাল নীচে নেমে বারান্দায় দাঁড়ান। ঠিক সেই সময় খাকি এবং কালাে পােশাকধারী ৩/৪ জন সেনা কর্মকর্তা হাতে অস্ত্রসহ তাদের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং আপিলকারী বজলুল হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করলে তিনি লুটিয়ে পড়েন এবং তিনি (শেখ কামাল) পি.ডব্লিউ-১ (সাক্ষী)-কে আক্রমণকারীদের এটি বলতে বলেন যে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে। পি.ডব্লিউ-১ আক্রমণকারীদেরকে শেখ কামালের পরিচয় জানালে আপিলকারী বজলুল হুদা শেখ কামালকে লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করে। একটি বুলেট তার পায়ে এবং অন্যটি রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৫০-এর পায়ে আঘাত করেছিল। শেখ কামাল ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন।
ঘটনার এক পর্যায়ে পি.ডব্লিউ-৫০ তাকে (পি.ডব্লিউ-১) পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে চায় এবং যখন ঘাতকরা দরজার কাছে আসে তখন বজলুল হুদা তার চুল ধরে টেনে পেছনে নিয়ে আসে। তার (বজলুল হুদা) সাথে আরেকজন সশস্ত্র সেনা কর্মকর্তা ছিল। বজলুল হুদা পি.ডব্লিউ-১ এবং অন্যদের মেইন গেটের সামনে লাইন করে দাঁড় করায়। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পরে তারা বঙ্গবন্ধুর উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পান। এরপরই তিনি (সাক্ষী) এলােপাতাড়ি গুলি ও নারীদের আর্তচিৎকার শুনতে পান। তিনি (সাক্ষী) এটিও বর্ণনা করেছেন যে, শেখ নাসেরকে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং কীভাবে- ফারুক রহমানের জিজ্ঞাসায় বজলুল হুদা বলেছিল, “অল আর ফিনিশড”।।
৫০২

তিনি (পি.ডব্লিউ-১) বজলুল হুদার ঐ কথা শুনে বুঝতে পেরেছিলেন যে, প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ডিফেন্স এই সাক্ষীকে জেরা করাকালে শেখ কামালের হত্যাসম্পর্কিত এই সাক্ষীর সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেহেতু, এই সাক্ষীর সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়েছে। পি.ডব্লিউ-৪ ফিল্ড আর্মি রেজিমেন্টের একজন জওয়ান। ঘটনার সময় তিনি তার কোম্পানির অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সাথে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে কর্তব্যরত ছিলেন। এই সাক্ষী বলেন যে, বজলুল হুদা ও অন্য তিনজন ছিলেন ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের সেনা কর্মকর্তা। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভাের ৫টার সময় তিনি (সাক্ষী) সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাবকে রােড নম্বর ৩১ বাসভবনের সামনে জিপ থেকে নামতে দেখেছিলেন। প্রেসিডেন্টের বাসভবন প্রহরার জন্য ঐ বাড়িটিকে অস্থায়ী ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করে সেখানে তিনি (সাক্ষী) ও অন্য গার্ডরা অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি (সাক্ষী) অন্য গার্ডদের সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হন এবং সেখানে পৌছে তারা বিউগলের সুরে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তখন তিনি (সাক্ষী) দেখেছিলেন লেকের দক্ষিণ দিক থেকে প্রেসিডেন্টের বাসভবন লক্ষ করে এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণ হচ্ছে এবং ঐ সময় কালাে ও খাকি পােশাকধারী সেনা কর্মকর্তারা ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে চিৎকার করতে করতে বাসভবনে প্রবেশ করছিল। তখন তিনি (সাক্ষী)। গেটের কাছে বজলুল হুদা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) ও অন্যদের দেখেছিলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা শেখ। কামালকে দেখে বজলুল হুদা স্টেনগান থেকে তাকে গুলি করে এবং শেখ কামাল অভ্যর্থনা কক্ষের ভেতরে লুটিয়ে নিচে পড়ে যান। বজলুল হুদা আবার শেখ কামালকে গুলি করে এবং তাঁকে হত্যা করে।
তারপর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) তার ফোর্সসহ গুলি করতে করতে দোতলায় উঠেছিল। বজলুল হুদা এবং নূর হােসেন ফোর্সসহ তাকে অনুসরণ করে। এই সাক্ষীও তাদের নির্দেশনা অনুসারে তাদেরকে অনুসরণ করেছিল। এ সময় তিনি (সাক্ষী) দেখেছিলেন যে, মহিউদ্দীন ও তার ফোর্স প্রেসিডেন্টকে নীচতলার দিকে নিয়ে আসে, যখন প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘তােরা কী চাস? এবং এর পরপরই বজলুল হুদা ও নূর হােসেন তাদের স্টেনগান থেকে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করলে তিনি সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন। বজলুল হুদা ও মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)-কে এই সাক্ষী গেটে দেখেছিলেন। বজলুল হুদা, মেজর নূর হােসেন ও তার ফোর্স দোতলার দিকে যাচ্ছিল যখন বজলুল হুদা এবং মেজর নূর হােসেন প্রেসিডেন্টকে সিঁড়িতে গুলি করেছিল- মর্মে এই সাক্ষীর জবানবন্দি তার জেরাতে বজলুল হুদা কর্তৃক অস্বীকৃত হয়নি বা কোনাে। সাজেশনও দেওয়া হয়নি এবং সেহেতু, এই সাক্ষীর সাক্ষ্যের incriminating part অখণ্ডিত (uncontroverted) রয়েছে। আপিলকারী মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এই সাক্ষীর এই মর্মে প্রদত্ত সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ করেনি যে, এই সাক্ষী তাকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের গেটে চিনতে পেরেছিল এবং দেখেছিল মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) ও তার ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নীচতলার দিকে নিয়ে আসছে।
১৯৬. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৫ও আর্টিলারি ইউনিটের একজন জওয়ান, যিনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি বলেন যে, তিনি ঘটনার দিন ভাের ৫টার সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন এবং তারপর পতাকা উত্তোলনের পর তিনি (সাক্ষী) দেখেন যে, প্রেসিডেন্টের বাসভবন লক্ষ করে এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছে। এ সময় তিনি (সাক্ষী) গার্ড রুমের দিকে যান। ৫/৭ মিনিট পরে গুলিবর্ষণ থেমে যায়। এ সময় তিনি বজলুল হুদা, মেজর নূর এবং খাকি ও কালাে পােশাকধারী অন্য জওয়ানদের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে একটি গাড়ি থেকে নামতে দেখেন। বজলুল হুদা তার কাছে কিছু জানতে চায় এবং তারপর ওয়্যারলেসে আরেকজনের সাথে কথা বলে। এর ঠিক পরপর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং তার ফোর্স পূর্ব দিক থেকে এসে ‘হ্যান্ডস আপ’ বলে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে প্রবেশ করে। তখন তাকে (সাক্ষী) ও অন্য নিরাপত্তা প্রহরীদের গার্ডরুমে আটক
৫০৩

করে রাখা হয়েছিল। এই সাক্ষী (পি.ডব্লিউ-৫) বজলুল হুদা ও মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) চিনতে পেরেছিল, যখন তারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলিবর্ষণ করতে করতে প্রবেশ করছিল- সাক্ষীর এই বিবৃতি ডিফেন্স চ্যালেঞ্জ করেনি।
১৯৭. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৬ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গার্ড রেজিমেন্টের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, ১৫ আগস্ট ভাের ৪.৩০ মিনিটে হাবিলদার গনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গার্ড রুমের সামনে সব সিকিউরিটি স্টাফকে ফল-ইন করিয়ে রাখে। এর কিছুক্ষণ পর কালাে পােশাকধারী ফোর্স নিয়ে ২/৩টি ট্রাক এসে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের পশ্চিম দিকে এসে থামে এবং লেকের দিক থেকে প্রেসিডেন্টের বাসভবন লক্ষ করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছিল। পি.ডব্লিউ-১ ও পি.ডব্লিউ-৪ প্রদত্ত সাক্ষ্য সমর্থন করে এই সাক্ষী বলেন যে, বজলুল হুদা ও কালাে পােশাকধারী ল্যান্সার ইউনিটের একজন অফিসার এবং আর্টিলারি ইউনিটের কয়েকজন জওয়ান প্রেসিডেন্টের বাসভবনে প্রবেশ করেছিল। এর কিছুক্ষণ পর বজলুল হুদা ও আরেকজন শেখ কামালকে গুলি করে এবং গুলির আঘাতে তিনি রিসিপশন কক্ষের ভেতরে লুটিয়ে পড়েন। বজলুল হুদা তখন তাকে লক্ষ করে আবার গুলি করে। এরপর বজলুল হুদা ও অন্য একজন অফিসার দোতলায় যায়। এর কিছুক্ষণ পরে তিনি (সাক্ষী) গুলিবর্ষণের আওয়াজ ও নারীদের আর্তচিৎকার শুনতে পান। এই সাক্ষীর জেরাতে তার দেওয়া জবানবন্দির incriminating অংশ বজলুল হুদা কর্তক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি এবং সেহেত, পি.ডব্লিউ-৬ দেখেছিলেন যে, বজলুল হুদা শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করেছিল মর্মে পি.ডব্লিউ-৬ প্রদত্ত সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়েছে।
১৯৮. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১১-এর বর্ণনামতে ১৪ আগস্ট রাতে তিনি তার দোকানের সামনে আয়ােজিত নৈশকালীন প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি (সাক্ষী) বজলুল হুদা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং ফারুক রহমানকে চিনতে পেরেছিলেন। এই সাক্ষী আরাে বলেন যে, ভাের ৪টার সময় তিনি অন্যদের সাথে একটি গাড়িযােগে রওনা হয়ে ভাের ৪.৩০ মিনিটে যখন প্রেসিডেন্টের বাসভবনের ৮০ গজ পশ্চিমে আসেন তখন তাদেরকে গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়। এরপর রিসালদার সারওয়ার তাদেরকে মহিউদ্দীনের আদেশ অনুসরণ করতে বলে। মহিউদ্দীন তাদেরকে নির্দেশ দেয় বাসভবনের সামনে কারাে চলাচলের অনুমতি না দিতে এবং কর্তব্যরত পুলিশদের নিরস্ত্র করতে বলে।
এরপর তিনি (সাক্ষী) বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ভেতর থেকে গুলিবর্ষণ এবং হ্যান্ডস আপ’ বলার শব্দ শুনতে পান। রিসালদার সারওয়ার তাকে নির্দেশ দেয়, যেন কেউ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করতে না পারে এবং সেই সময় মহিউদ্দীন, মেজর নূর, বজলুল হুদা ও অন্যরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর তিনি (সাক্ষী) বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ভেতর থেকে গুলিবর্ষণের আওয়াজ ও নারীদের আর্তচিৎকার শুনতে পান। এরপর মহিউদ্দীন, মেজর নূর, বজলুল হুদা বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসে এবং তখন মেজর নূর সুবেদার মেজরকে নির্দেশ দেয় সব শেষ হয়েছে কিনা তা দেখতে। সারওয়ারের মাধ্যমে বজলুল হুদা তাকে নির্দেশ দেয় লেকের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা লােকজনকে সরিয়ে দিতে। এরপর তিনি (সাক্ষী) ট্যাঙ্ক চলাচলের শব্দ শুনতে পান এবং একটি ট্যাঙ্ক প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে আসে, যেটি থেকে ফারুক রহমান নেমে আসে। মহিউদ্দীন, মেজর নূর, বজলুল হুদা ও অন্যরা তার কাছে আসে এবং কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে। এরপর ফারুক রহমান ট্যাঙ্ক নিয়ে চলে যায়। ঘটনার সাথে বজলুল হুদার সম্পৃক্ততা বিষয়ে এই সাক্ষীর জবানবন্দি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি এবং সেহেতু,এই সাক্ষীর সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়ে গেছে।
১৯৯, সংশ্লিষ্ট সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১২ ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটে কর্তব্যরত ছিলেন। | ফারুক রহমান ছিল এই ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার। পি.ডব্লিউ-১২ বলেন যে, প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি।
৫০৪

আপিলকারী বজলুল হুদা এবং অন্য অভিযুক্ত ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) দেখেছিলেন। প্যারেডের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছিল রাত ৩.৩০-এর পরে যখন তিনি (সাক্ষী) আপিলকারী বজলুল হুদা, ফারুক রহমান, মহিউদ্দীনসহ (ল্যান্সার) অন্যদের দেখেছিলেন এবং ফারুক রহমান তাদের সাথে মেজর ডালিম, বজলুল হুদা ও অন্য একজনকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফারুক রহমান ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাদেরকে জানায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা মিটিং অনুষ্ঠিত হবে এবং প্রেসিডেন্ট সেই মিটিংয়ে দেশে রাজতন্ত্র চালুর ঘােষণা দেবেন এবং তারা ঐ রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। তাই তারা সেনাবাহিনীর লােকদের তাদের নির্দেশ অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছে।
এরপর ফারুক রহমান ভাণ্ডার থেকে অস্ত্র আনার নির্দেশ দেয় এবং সেই নির্দেশ অনুসারে তারা অস্ত্রশস্ত্র বের করে প্যারেড গ্রাউন্ডে আসে। এরপর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) তাদেরকে গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দেয়। সেনা কর্মকর্তারা তিনটি ট্রাকে ওঠে এবং অন্যরা ওঠে আরেকটি ট্রাকে। ভাের ৪.৩০ মিনিটে তারা বালুরঘাট ক্যান্টনমেন্ট রেল ক্রসিং, ফার্মগেট ও মিরপুর রােড হয়ে ধানমন্ডি ৩২-এ গিয়েছিল। ৩২ নম্বর রােডের মাথায় এসে মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) তাদেরকে ট্রাক থেকে নামার নির্দেশ দেয়। এরপর মহিউদ্দীন। (ল্যান্সার) তাদেরকে ব্রিফ করে যে, তারা যেন গুলিবর্ষণের শব্দ পেয়ে ভীত না হয়। এরপর রােড ৩২-এ কাউকে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার জন্য সে তাদেরকে নির্দেশ দেয়। এরপর সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১২ প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর সংঘটিত অন্য ঘটনাগুলােও বর্ণনা করেন। বজলুল। হুদা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), ডালিম ও ফারুক রহমানকে প্যারেড গ্রাউন্ডে চিনতে পারা এবং প্রেসিডেন্টের বাসভবন অভিমুখে গাড়িবহর অগ্রসর হওয়া সম্পর্কে তাদের অপরাধের দায় উল্লেখে এই সাক্ষী তার জবানবন্দিতে যা বলেছেন তা চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
২০০. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-২১ সংশ্লিষ্ট সময়ে পাপা ব্যাটারির দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি বলেন যে, নৈশকালীন প্যারেডে তিনি যােগ দিয়েছিলেন এবং তারপর তাকে অন্য | সেনাদের সাথে বিমানবন্দর রানওয়ের দক্ষিণ দিকে রাখা হয়। রাত অনুমান ০২টার সময় মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা এবং অন্যদের সাথে নিয়ে কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ সেখানে আসে। মেজর রশিদ তাদেরকে অস্ত্র ও গােলাবারুদসহ প্রস্তুত হতে বলেছিল- জরুরি এক দায়িত্বে তাদের প্রেরণ করা হবে এই কথা বলে। রাত ৪.৩০ মিনিটে ৩২ নম্বর রােডে ট্রাক এসে পৌঁছায় এবং তখন তাদেরকে ট্রাক থেকে নামতে বলা হয়। কমান্ডিং অফিসার তখন তাদেরকে নির্দেশ দেয় ৩২ নম্বর রােডে কাউকে চলাচলের অনুমতি না দিতে। তারপর ফজরের আজানের পরে তিনি (সাক্ষী) পূর্ব দিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনেছিলেন এবং এরপর তিনি (সাক্ষী) জানতে পারেন যে, আপিলকারী এবং অন্য অভিযুক্তরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে।
২০১. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-২২ সংশ্লিষ্ট সময়ে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির একজন সিপাহি ছিলেন। তিনি বলেন যে, ১৪ আগস্টের নৈশকালীন প্যারেডে তিনি রাত ১২টা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। রাত অনুমান ২.৩০ মিনিটে কমান্ডিং অফিসার খােন্দকার আব্দুর রশিদ আপিলকারী বজলুল হুদা ও অন্য অফিসারদের সাথে সেখানে আসে। মেজর রশিদ তাদেরকে এক বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিল এবং বলেছিল, প্রয়ােজনে তাদের গুলি ছুড়তে হতে পারে। তিনি (সাক্ষী) ৩২ নম্বর রােডে তাদের আসা। ও আপিলকারীকে চিনতে পারা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-২১ প্রদত্ত সাক্ষ্য সমর্থন করেছেন। আপিলকারী এই সাক্ষীকে জেরা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
২০২. আপিলকারী মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)-এর বিরুদ্ধে প্রণীত হত্যার অভিযােগ প্রমাণের জন্য প্রসিকিউশন পক্ষ পি.ডব্লিউ-৪, ৫, ৭, ১১, ১২, ২১, ২২-কে পরীক্ষা করেছে।
৫০৫

২০৩. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৪ বলেন যে, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের প্রবেশপথে তিনি মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) ও বজলুল কে চিনতে পেরেছিলেন। এই আপিলকারী (মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)] তার ইউনিটের ফোর্সসহ গুলি করতে করতে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দোতলায় যায়। তারপর তারা প্রেসিডেন্টকে নিচতলায় নামিয়ে আনতে থাকে এবং তখন বজলুল হুদা ও মেজর নূর সিঁড়িতে তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) গুলি করে হত্যা করে। প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর এই আপিলকারী ও অন্যরা নীচে নেমে আসে এবং দক্ষিণ দিকে চলে যায়। ঘটনার সাথে আপিলকারীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে এই সাক্ষীর প্রদত্ত দোষারােপমূলক বক্তব্য তাকে জেরা করাকালে এই আপিলকারী চ্যালেঞ্জ করেনি। সেহেতু, আপিলকারী তার ফোর্সসহ প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গুলি করতে করতে প্রবেশ করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে অস্ত্রের মুখে নিচে নামিয়ে এনেছিল মর্মে এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়ে গেছে।
২০৪. এই আপিলকারী তার ফোর্সসহ গুলি করতে করতে বাসভবনে প্রবেশ করেছিল মর্মে পি.ডব্লিউ-৪-এর প্রদত্ত সাক্ষ্য পি.ডব্লিউ-৫ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। আপিলকারী রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের প্রদত্ত জবানবন্দি চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেহেতু এই সাক্ষীর বর্ণনা মতে ঘটনাস্থলে আপিলকারীকে চিনতে পারা এবং হত্যাকাণ্ডে তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অবিতর্কিত রয়েছে। পি.ডব্লিউ-১১ প্যারেডে আপিলকারীকে চিনতে পেরেছিলেন এবং দুজনকে সিভিল ড্রেসে দেখেছিলেন, যারা ১৪ আগস্ট রাত ১২টায় আপিলকারীর অফিস থেকে বের হয়ে এসেছিল এবং সেই সময় আপিলকারী তাদের একজনকে ‘হুদা’ নাম ধরে ডেকে তার কাছে আসতে বলেছিল। এই সাক্ষী এটিও বলেন যে, যে দুজন সিভিল ড্রেসে ছিল তাদের জন্য আপিলকারী আর্মি ড্রেসের ব্যবস্থা করেছিল। বজলুল হুদার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে এই সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালােচনাকালে এই আপিলকারীর সম্পৃক্ততার বিষয়টিও আলােচনা করা হয়েছে।
২০৫. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১২-এর বর্ণনামতে, তিনিও ১৪ আগস্ট রাতে প্যারেড গ্রাউন্ডে এই আপিলকারীকে চিনতে পেরেছিলেন। আপিলকারী প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাদের গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দেয় এবং এরপর তারা ছয়টা ট্রাকযােগে বালুরঘাট, ক্যান্টনমেন্ট রেল ক্রসিং-মহাখালী রােড ও ফার্মগেট হয়ে রাত ০৪.৩০ মিনিটে ধানমন্ডি ৩২ রােডের মাথায় এসে পৌছায়। তিনি (সাক্ষী) আপিলকারীর সাথে একই ট্রাকে ছিলেন এবং রােড ৩১-এর মাথায় আপিলকারী তাদের সবাইকে ট্রাক থেকে নামার নির্দেশ দেয়। এরপর এই আপিলকারী তাদেরকে ব্রিফ করে বলে যে, তারা যেন বাসভবনের ভেতরে থাকা মেজর ডালিমের ফোর্সের গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনে ভীত না হয়। এরপর আপিলকারী কয়েকজন ফোর্স সাথে নিয়ে রােড ৩২-এর বাসভবনে প্রবেশ করেছিল। আপিলকারী তার ফোর্সসহ ৩২ নম্বর রােডে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে প্রবেশ করেছিল। এ সম্পর্কে এই সাক্ষীর জবানবন্দির incriminating part আপিলকারী কর্তৃক জেরাতে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। আপিলকারী বজলুল হুদার অপরাধমূলক সম্পৃক্ততা বিবেচনার সময় এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে। প্যারেড গ্রাউন্ডে তার উপস্থিতি এবং ঘটনার ঠিক আগে ৩২ নম্বর রােডে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে প্রবেশ সম্পর্কে এই সাক্ষী তার জবানবন্দিতে যা বলেছেন তিনি তা তার জেরাতেও পুনরায় নিশ্চিত করেছেন।
২০৬. বজলুল হুদার সম্পৃক্ততা বিবেচনার সময় পি.ডব্লিউ-২১-এর যে সাক্ষ্য ইতােমধ্যে আলােচনা করা হয়েছে তা পি.ডব্লিউ-২২ সাক্ষ্য প্রদানপূর্বক সমর্থন করেছেন। তিনি (পি.ডব্লিউ-২২) আরাে বর্ণনা করেছেন যে, তাকে পি.ডব্লিউ-২১ ও অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সাথে একটি খালের পাশে ৩২ নম্বর রােডে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন কমান্ডার তাদের নির্দেশ দিয়েছিল, যেন কোনাে বহিরাগত ৩২ নম্বর রােডে প্রবেশ করতে না পারে। এরপর গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনতে পেয়ে তিনি (সাক্ষী) নায়েক নজরুল, সিপাহি
৫০৬

খালেক ও অন্যদের সাথে নিয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হন এবং একটি বাড়ির সামনে আর্টিলারি ইউনিট ও ল্যান্সার ইউনিটের সেনা কর্মকর্তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে, বাড়িটি প্রেসিডেন্টের বাসভবন। এরপর তিনি (সাক্ষী) গার্ডদের, কামান্ডার নজরুল, খালেক ও অন্যদের সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে প্রবেশ করে মৃতদেহগুলাে দেখতে পান। এরপর তিনি (সাক্ষী) বাসভবন থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বাসভবনের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় যে, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) ও অন্যরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। অপরাধে যুক্ত করে এই সাক্ষী কর্তৃক বিবৃত জবানবন্দি তার জেরায় আপিলকারী কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি এবং সেহেতু, তার সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়ে গেছে।
২০৭. ফারুক রহমানের বিরুদ্ধে প্রণীত হত্যার অভিযােগ প্রমাণের জন্য প্রসিকিউশন পি.ডব্লিউ-১, ৪, ১১ এবং ১২-কে পরীক্ষা করেছে।
২০৮. পি.ডব্লিউ-১ সাক্ষ্য প্রদানকালে বলেন যে, ঘটনার সময় তিনি প্রেসিডেন্টের বাসভবনের গেটে ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন এবং তখন ফারুক রহমান জানতে চাইলে বজলুল হুদা বলেছিল- “অল আর ফিনিশড”। এই সাক্ষী কর্তৃক আপিলকারীকে চিনতে পারার বিষয়টি তার জেরাতে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
২০৯. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৪-এর বর্ণনামতে, ঘটনার সময় মেজর ফারুক ট্যাঙ্কে চড়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের গেটের সামনে এসেছিল এবং সেই সময় মেজর নূর, মেজর আজিজ পাশা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা ও অন্যরা তার কাছে আসে ও কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলে। এই সাক্ষী ডেকে উপস্থিত ফারুক রহমানকে শনাক্ত করেন এবং বলেন যে, এর কিছুক্ষণ পরে ফারুক রহমান বজলুল হুদা ও সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাবকে ডাকে এবং বজলুল হুদাকে মেজর পদমর্যাদার ও সুবেদার আব্দুল ওয়াহাবকে লেফটেন্যান্ট পদমর্যাদার ব্যাজ পরিয়ে দেয় এবং তারপর তাদেরকে যথাক্রমে মেজর হুদা ও লেফটেন্যান্ট জোয়ার্দার বলে সম্বােধন করে। ঘটনার সময় বা প্রায় একই সময়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের গেটে এই আপিলকারীর উপস্থিতি সম্পর্কে এই সাক্ষী তার জবানবন্দিতে যা বলেছেন তা এই আপিলকারী কর্তৃক অস্বীকৃত হয়নি।
২১০. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১১ জবানবন্দি প্রদানকালে বলেন যে, ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট নৈশকালীন প্যারেডে তিনি টু-আইসি ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন এবং সেই সময় রিসালদার মােসলেহ উদ্দিন তাকে স্যালুট দিয়েছিল। এই সাক্ষী এরপর প্রেসিডেন্টের বাসভবন অভিমুখে সৈন্যদের যাত্রার বিষয়টি বর্ণনা করেন। তিনি (সাক্ষী) এরপর হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা দেন। এই সাক্ষী আরাে বলেন যে, ফারুক রহমান একটি ট্যাঙ্কযােগে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটের সামনে এলে মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর নূর, বজলুল হুদা, রিসালদার সারওয়ার ও আর্টিলারি ইউনিটের অন্য সেনা কর্মকর্তারা তার কাছে। আসে এবং কিছু সময় তার সাথে কথা বলে। এরপর ফারুক রহমান ট্যাঙ্ক নিয়ে চলে যায়। এই সাক্ষী ডকে উপস্থিত ফারুক রহমানকে শনাক্ত করেন। প্যারেড গ্রাউন্ডে এই সাক্ষী তাকে চিনতে পেরেছিলেন এবং তিনি (সাক্ষী) ঘটনার সময় বা প্রায় একই সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটের সামনে তাকে দেখেছিলেন মর্মে এই সাক্ষী প্রদত্ত জবানবন্দি ফারুক রহমান কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
২১১. পি.ডব্লিউ-১১-কে সমর্থন করে পি.ডব্লিউ-১২ বর্ণনা করেন যে, তিনি ১৪ আগস্ট রাতের প্যারেডে ফারুক রহমান এবং অন্য অভিযুক্তদের দেখেছিলেন। এই সাক্ষী আরাে বলেন যে, ফারুক রহমান প্যারেড পরিদর্শন করেছিল এবং আরডিএম নৈশ ক্লাস অনুসরণ করতে নির্দেশ দেয় এবং তারপর তাদেরকে রাত ০৩.৩০-এ ফল-ইন অবস্থানে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং
৫০৭

অন্য আশুযুক্তরা প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এবং এরপর তারা তাদের (সৈন্যদের) সামনে আসে। এরপর এই সাক্ষী প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে রােড ৩২ নম্বর অভিমুখে সৈন্যদের যাত্রা করার বিষয়টি বর্ণনা করেন। ঘটনাস্থলে পৌঁছানাের পর কীভাবে গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন সেটিও এই সাক্ষী বর্ণনা করেছেন। আপিলকারী সুলতান শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে প্রণীত হত্যার অভিযােগটি প্রমাণের জন্য সাক্ষী হিসেবে প্রসিকিউশন পি.ডব্লিউ-১৪-কে পরীক্ষা করেছে এটি দেখানাের জন্য যে, বালুরঘাটে নৈশকালীন প্যারেডে সে (সুলতান শাহরিয়ার) উপস্থিত ছিল, যেখানে প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
২১২. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১৪ সাক্ষ্যদানকালে বলেন যে, বালুরঘাটে নৈশকালীন প্যারেডে তিনি উপস্থিত ছিলেন। প্যারেড শেষ হয়েছিল রাত ২.০০/২.৩০ মিনিটে। ঐ সময় তাদেরকে ফল-ইন অবস্থানে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। প্যারেড গ্রাউন্ডে আসার পর তিনি (সাক্ষী) ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন এবং অন্য অভিযুক্তদের ও দুজন সিভিল পােশাকধারীকে দেখেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) তাদের সাথে মেজর রশিদকে আর্টিলারি ইউনিটের কয়েকজন অফিসারের সাথে দেখেছিলেন। ফারুক রহমান একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তাদেরকে ফল-ইন পজিশনে থাকার নির্দেশ দেয় এবং তারপর সিভিল ড্রেসে থাকা দুজনকে মেজর ডালিম ও মেজর সুলতান শাহরিয়ার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। আপিলকারী ফারুক রহমান বলেছিল পি.ডব্লিউ-১৪ ও অন্য জওয়ানরা তাদের সাথে কাজ করবে এবং তাদের এসব নির্দেশনা মানতে সৈন্যরা বাধ্য ছিল। এরপর এই সাক্ষী ট্যাঙ্কগুলাের চলাচল এবং অন্যান্য ঘটনা বর্ণনা করেন। ডিফেন্স এই সাক্ষীর এই মর্মে প্রদত্ত জবানবন্দি অস্বীকার করেনি যে, বালুরঘাটে রাত ২টা থেকে ২.৩০ পর্যন্ত নৈশ প্যারেডে এই সাক্ষী সিভিল পােশাকে এসেছিল বা ফারুক রহমান আপিলকারীকে জওয়ানদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। নৈশ প্যারেডে আপিলকারীর অংশগ্রহণ এবং তাকে চিনতে পারার বিষয়ে এই সাক্ষীর সাক্ষ্য, যা অপরাধের দায় আরােপমূলক, তা অবিতর্কিত রয়ে গেছে।
২১৩. স্বীকৃতমতে এই আপিলকারী সেনাবাহিনী থেকে একজন বরখাস্তকৃত/অব্যাহতি প্রাপ্ত অফিসার। এ কারণে ১৯৭৫-এর ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে তার আর্মির প্যারেডে উপস্থিত থাকার কথা ছিল না। আপিলকারী পক্ষে বিজ্ঞ কৌসুলি দাবি করেছেন যে, এই আপিলকারী বালুরঘাটে উপস্থিত ছিল- এটি দেখানাের জন্য পি.ডব্লিউ-১৪-এর সাক্ষ্যের কোনাে সমর্থনমূলক প্রমাণ নেই। কিন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে, বালুরঘাটে তার উপস্থিতি সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১৪-এর জবানবন্দি এই আপিলকারী অস্বীকার করেনি। পি.ডব্লিউ-১৪-এর জবানবন্দি তুলে ধরে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারার অধীনে পরীক্ষার সময়ও আপিলকারী এ বিষয়ে কোনাে ব্যাখ্যা দেয়নি। এমন কোনাে বিধি বা আইন নেই যে, কোনাে সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য সমর্থিত না হলে তা গ্রহণ করা যাবে না।
২১৪. সাধারণ নিয়ম হিসেবে আদালত একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা যদি সমর্থিত না-ও হয়ে থাকে। আইন যদি সমর্থনের বিষয়টির উপর জোর দিয়ে না থাকে, তবে সমর্থনের উপর আদালতের জোর দেওয়া উচিত নয়, যদি ঐরূপ একক সাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি এমন হয় যে, তা সমর্থিত হওয়া প্রয়ােজন এবং একক সাক্ষীর সাক্ষ্য সমর্থিত হওয়া প্রয়ােজন ছিল বা ছিল না সেই প্রশ্নটি অবশ্যই নির্ভর করে প্রত্যেক মামলার ঘটনা ও অবস্থাদির উপর।
২১৫. মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)-এর বিরুদ্ধে প্রণীত হত্যার অভিযােগ প্রমাণের জন্য প্রসিকিউশন সাক্ষী হিসেবে পি.ডব্লিউ-১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭, ২৯, ৩২, ৩৪ এবং ৩৫-কে পরীক্ষা করেছে। সংশ্লিষ্ট সময়ে পি.ডব্লিউ-১৭ ছিলেন টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের একজন নায়েক, যার পাপা ব্যা
৫০৮

ছিল আপিলকারী। তিনি (সাক্ষী) ১৪ আগস্ট ১৯৭৫-এ বালুরঘাটে নৈশ প্যারেডে আপিলকারীর উপস্থিতির বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই সাক্ষী প্যারেড সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন যে, প্যারেডের পরে মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) পাপা ব্যাটারির কামানের পেছনে দাড়িয়ে ছিল এবং সুবেদার হাশেমকে ডেকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। তারপর হাশেম জওয়ানদের ডেকে নির্দেশনার বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়। এরপর আপিলকারী তাদেরকে ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয় এবং এই সাক্ষীসহ কিউবেক ব্যাটারি থেকে ৪/৫ জন বন্দুকধারীকে ডেকে পাঠায়। তারপর হাশেম ছয়টি কামানের ট্রাক পরীক্ষা করে দেখেছিল। এরপর রাত ৩.৩০/৪টার সময় কামান বােঝাই ট্রাকগুলাে অগ্রসর হতে শুরু করে। এই সাক্ষী একই গাড়িতে আপিলকারীর সাথে ছিলেন। রাত ৪টার দিকে ট্রাকগুলাে কলাবাগান এলাকায় পৌছায়।
এরপর আপিলকারীর নির্দেশে কামানগুলাে ৩২ নম্বর রােডে প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও রক্ষীবাহিনী হেড কোয়ার্টার লক্ষ করে স্থাপন করা হয়েছিল। এই সাক্ষী আরাে বলেন যে, আপিলকারীর নির্দেশে তারা চার রাউন্ড কামান-গােলা ছুড়েছিল এবং কিছুক্ষণ পরে যখন সকালের আলাে ফুটে উঠেছিল তখন তারা আপিলকারীর নির্দেশে কামানগুলাে বন্ধ করে এবং সেগুলাে ট্রাকে তুলে ব্যারাকে ফিরে যায়। এই সাক্ষী প্রদত্ত সাক্ষ্যের দোষারােপমূলক অংশ তার জেরাতে আপিলকারী কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
২১৬. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১৮ টু-ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের একজন সেনা কর্মকর্তা। তিনি বলেন যে, আপিলকারী তাদের ব্যাটারি কমান্ডার ছিলেন। এই সাক্ষী ১৪ আগস্ট রাতের নৈশ প্যারেড, যেখানে এই আপিলকারী ও অন্য অভিযুক্তরা উপস্থিত ছিল, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, নৈশ প্রশিক্ষণটি রাত ১২.৩০ থেকে রাত ১টা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং এই আপিলকারী ঐ প্যারেড পরিদর্শন করেছিল। পি.ডব্লিউ-১৭-কে সমর্থন করে এই সাক্ষী বলেন যে, রাত অনুমান ৩.৩০/৪টার সময় আবুল কালাম তাদের ফল-ইন পজিশনে রাখে এবং তখন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ও আপিলকারী সেখানে আসে এবং ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের বলে যে, রক্ষীবাহিনীকে নজরদারিতে রাখার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাদের করতে হবে এবং তাদেরকে গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দেয়। এই সাক্ষী এরপর বর্ণনা করেন যে, তাদের গাড়িগুলাে ধানমন্ডি অভিমুখে যাত্রা করে যখন তিনি (সাক্ষী) চার রাউন্ড গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরে এই আপিলকারী তাদেরকে কামানগুলাে জড়াে করতে বলেছিল। তার নির্দেশ অনুসারে তারা গণভবনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং সেখানে পৌঁছার পর আপিলকারী গাড়ি থেকে নেমে যায় এবং এক ঘণ্টা পরে ফিরে এসে তাদেরকে নিউ মার্কেট হয়ে রেডিও স্টেশন যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
২১৭. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-২১ টু-ফিল্ড আর্টিলারি পাপা ব্যাটারির একজন সিপাহি। তিনি সাক্ষ্য দানকালে বলেন যে, পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল আপিলকারী। তিনি (সাক্ষী) নৈশ প্যারেড, যেখানে আপিলকারী মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ও অন্য অভিযুক্তরা উপস্তিত ছিল, সে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, রাত অনুমান ৪.০০/৪.৩০ মিনিটে অস্ত্রসহ তাদের ট্রাক ৩২ নম্বর রােড অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল এবং রােড ৩২-এ গিয়ে থামার পর সেনাবাহিনীর কয়েকজনকে গাড়ি থেকে নামতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ৩২ নম্বর রােড ধরে কাউকে চলাচলের অনুমতি না দিতেও তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য ডিফেন্স কর্তৃক কোনােভাবেই চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। পি.ডব্লিউ-২২, ২৪ এবং ২৫ বিমানবন্দর এলাকায় পাপা ব্যাটারির টু-ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের ১৪
৫০৯

আগস্ট রাতের প্যারেডের বর্ণনা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে, কমান্ডার আপিলকারী ঐ প্যারেডে উপস্থিত ছিল। তদের সাক্ষ্য এই আপিলকারী কর্তৃক অস্বীকৃত হয়নি। পি.ডব্লিউ-২৫ আরাে বলেছেন যে, প্যারেড শেষে ফারুক রহমান তাদেরকে ব্রিফ করেছিল।
২১৮. সংশ্লিষ্ট সময়ে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-২৭ মহিউদ্দীন (আর্টিলারি)-এর অধীন পাপা ব্যটারির টু-ফিল্ড আর্টিলারির সিপাহি ছিলেন। তিনি (সাক্ষী) ১৪ আগস্ট রাতের নৈশ প্যারেড বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, আপিলকারীর নির্দেশে ও তার আদেশে তিনি একটি গাড়িতে ওঠেন এবং গাড়িটি যখন বালুরঘাটে আসে তখন আপিলকারী তাদের বলেছিল যে, রক্ষীবাহিনী সৈন্যদের আক্রমণ করতে পারে। তারপর তিনি একটি গাড়িতে কামান যুক্ত রয়েছে দেখেন এবং অন্য গাড়িগুলােতেও কামান যুক্ত ছিল। এরপর তারা মহাখালী-ফার্মগেট-গ্রিন রােড-এলিফ্যান্ট রােড হয়ে কলাবাগান অভিমুখে অগ্রসর হন। এরপর কলাবাগানের কাছে তাদের কয়েকজনকে গাড়ি থেকে নামতে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং আপিলকারী তাদের নির্দেশ দিয়েছিল যেন ঐ রাস্তায় কেউ চলাচল করতে না পারে। এই সাক্ষী আরাে বলেন যে, যখন সূর্য উদিত হয় তখন একটি আর্মির গাড়িতে করে তাদেরকে গণভবনে নিয়ে গিয়েছিল এবং সেখানে তিনি রেডিও মারফত মেজর ডালিমের কণ্ঠে শুনেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে এই সাক্ষীর সাক্ষ্যের দোষারােপমূলক অংশ এই আপিলকারী চ্যালেঞ্জ করেনি।
পি.ডব্লিউ-২৯ টু-ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের পাপা ব্যাটারির একজন সিপাহি। তিনি বলেন যে, আপিলকারী পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। এই সাক্ষী নৈশ প্যারেডের বিস্তারিত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, রাত ০৩.৩০ মিনিটে প্যারেড সমাপ্ত হয়েছিল এবং তারপর তাদেরকে বালুরঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যেখানে তারা সেনা কর্মকর্তাদের গাড়িতে অস্ত্র বােঝাই করতে দেখেন। তাদেরকেও অস্ত্র লােড করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর তারা শহরের দিকে যাত্রা শুরু করে।
২১৯. পি.ডব্লিউ-৩২ আপিলকারীর কমান্ড অধীন টু-ফিল্ড আর্টিলারির একজন সিপাহি। তিনি বলেন যে, ১৪ আগস্ট নৈশ প্যারেডে তিনি অংশ নিয়েছিলেন এবং তাদের ইউনিটকে ফল-ইন পজিশনে রাখা হয়েছিল আপিলকারী ও অন্য অফিসাররা সেখানে উপস্থিত ছিল। তদেরকে রাত ৩./০৩.৩০ মিনিটে দ্বিতীয় বারের জন্য ফল-ইন পজিশনে রাখা হয়েছিল যখন সেখানে মেজর রশিদ ও অন্য অভিযুক্তরা উপস্থিত ছিল। মেজর রশিদের আদেশে তারা ট্রাকে ওঠেন এবং তখন নায়েক শামসুল ইসলাম তাকে গােলাবরুদ দেয়। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, ফজরের আজানের পূর্বে তাদের ট্রাক চলতে শুরু করে এবং যখন তারা তেজগাঁও বিমানবন্দরের পাশে পৌছান তখন লেফটেন্যান্ট হাসান তাদেরকে ঐ সড়ক দিয়ে কোনাে যানবাহন চলাচলের অনুমতি না দিতে নির্দেশ দেয়। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, তিনি এরপর জানতে পেরেছিলেন যে, আপিলকারী এবং অন্য সহযােগী আসামিরা ঘটনার সাথে জড়িত ছিল। আপিলকারী এই সাক্ষীর সাক্ষ্য কোনােভাবে চ্যালেঞ্জ করেনি।
২২০. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৩৪ আপিলকারীর কমান্ড অধীন টু-ফিল্ড আর্টিলারির একজন সুবেদার। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, ১৪ আগস্টের নৈশ প্রশিক্ষণে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের ইউনিট ছয়টি বন্দুকসহ চেয়ারম্যান বাড়ি হয়ে নতুন বিমানবন্দর অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল এবং রাত দশটার দিকে গান এরিয়ার কাছে মহিউদ্দীন (আর্টিলারি)-এর অধীনে বন্দুকের গুলিবর্ষণের আওয়াজ শুনতে পান। রাত ২.৩০ মিনিটে তাদেরকে ফল-ইন পজিশনে রাখা হয়েছিল এবং এরপর তারা একটি গাড়িতে উঠে
৫১০

মহাখালী হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি অভিমুখে অগ্রসর হয় এবং সেখান থেকে তাদের গাড়ি উত্তর দিকে মােড় নিয়ে মিরপুর রােড ধরে এগােতে থাকে। এরপর গাড়িটি একটি লেকের পাশে থামে এবং তখন আপিলকারী বন্দুকের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ঐ সড়কে কাউকে চলাচলের অনুমতি না দিতে। আপিলকারী এই সাক্ষীর সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ করেনি।
২২১. পি.ডব্লিউ-৩৪-কে সমর্থন করে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৩৫ বলেন যে, তিনি টু-ফিল্ড আর্টিলারির পাপা
ব্যাটারির একজন সুবেদার মেজর ছিলেন এবং এটির কমান্ডার ছিল আপিলকারী। এই সাক্ষী ১৪ আগস্টের নৈশ প্রশিক্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা দেন এবং বলেন যে, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আপিলকারীদের কাছে প্যারেডটি হস্তান্তর করেছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, ঘটনার পর তিনি প্রেসিডেন্টের হত্যার কারণ সম্পর্কে ফোর্সকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং তখন তিনি (সাক্ষী) জানতে পারেন যে, এই আপিলকারী ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। আপিলকারী এই সাক্ষীর জাবানবন্দি চ্যালেঞ্জ করেনি।
২২২. নথিতে থাকা সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ১৫ আগস্টে শেখ কামাল এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে আপিলকারী বজলুল হুদার অংশগ্রহণ সম্পর্কে তার বিরুদ্ধে নথিতে অবিতর্কিত সাক্ষ্য রয়েছে। পি.ডব্লিউ-১, ৪ এবং ৬ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী এবং তারা বর্ণনা করেছেন যে, বজলুল হুদা শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করেছিল। পি.ডব্লিউ-৪ এটিও বলেছেন যে, বজলুল হুদা মেজর নূরকে সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্টকে গুলি করে হত্যা করেছিল। তাছাড়া, এই তিনজন সাক্ষী ছাড়াও পি.ডব্লিউ-৫ এবং ৭ ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বজলুল হুদাকে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১১, ২১ এবং ২২ এই আপিলকারীকে নৈশ প্যারেডেও দেখেছিলেন, যেখান থেকে সে অন্যদের সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে এসেছিল এবং শেখ কামাল ও প্রেসিডেন্টকেও হত্যা করেছিল। সুতরাং, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনায় এই আপিলকারীর সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল মর্মে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য রয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে হত্যার অভিযােগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
২২৩. আপিলকারী ফারুক রহমানের বিরুদ্ধে প্রণীত হত্যার অভিযােগ সম্পর্কে বলতে গিয়ে পি.ডব্লিউ-১১ এবং ১২ বলেন যে, তারা নৈশ প্যারেডে তাকে দেখেছিলেন, যেখান থেকে সে তার ফোর্সসহ ধানমন্ডি অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল এবং তারপর তাকে ঘটনার সময় বা প্রায় কাছাকাছি সময়ে একটি ট্যাঙ্কসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দেখা গিয়েছিল এবং সে তখন বজলুল হুদা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), নূর হােসেন ও অন্যদের সাথে কথা বলছিল। এরপর সে (ফারুক রহমান) প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিল। এই সাক্ষীদের সাক্ষ্য এটি পর্যাপ্তভাবে প্রমাণিত করে যে, এই আপিলকারীও ঘটনার সাথে জড়িত ছিল। হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে হত্যার সাথে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
২২৪. মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) সম্পর্কে দেখা যায় যে, পি.ডব্লিউ-৪ ও ৫ এই আপিলকারীকে দেখেছিলেন যখন সে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গুলিবর্ষণ করতে করতে প্রবেশ করছিল। পি.ডব্লিউ-৪ এটিও বলেছেন যে, তিনি দেখেছিলেন আপিলকারী বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ি বেয়ে যখন নিচে নামিয়ে নিয়ে আসছিল তখন বজলুল হুদা এবং মেজর নূর তাঁকে (প্রেসিডেন্ট) গুলি করে হত্যা করে। তাছাড়া, এই দুজন সাক্ষী, পি.ডব্লিউ-১১ ঘটনার সময় বা এর কাছাকাছি সময়ে তাকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনের গেটে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১২ও
৫১১

ঘটনার ঠিক পূর্বে তাকে (মহিউদ্দীন) দেখেছিলেন, যখন সে ট্রাক থেকে ৩২ নম্বর রােডের প্রবেশপথে নেমেছিল। এই সাক্ষীগণ ছাড়া পি.ডব্লিউ-২১ এবং ২২ও তাকে দেখেছিলেন, যখন ৩২ নম্বর রােডের মাথায় তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং, আমি দেখতে পাই যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে যথার্থ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। পি.ডব্লিউ-১৪-এর প্রদত্ত সাক্ষ্য আলােচনাকালে এটিও বলা হয়েছে যে পি.ডব্লিউ-১৪ কর্তৃক এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, বালুরঘাটে ১৪ আগস্টের নৈশ প্যারেডে আপিলকারী সুলতান শাহরিয়ার উপস্থিত ছিল এবং সে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল।
২২৫. আপিলকারী মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭, ২৯, ৩২, ৩৪ এবং ৩৫ নৈশ প্যারেডে তার উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন, যেখান থেকে তার ইউনিটের সেনারা কলাবাগান লেক সার্কাস খেলার মাঠের দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও রক্ষীবাহিনী সদর দফতর লক্ষ করে কামান স্থাপন করেছিল। এই সাক্ষীরা এটি প্রমাণ করেছেন যে, মহিউদ্দিনের আদেশে তার সেনারা কলাবাগান খেলার মাঠ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও রক্ষীবাহিনী সদর দফতর লক্ষ করে চার রাউন্ড কামানের গােলা নিক্ষেপ করেছিল। এই আপিলকারী সাক্ষীর এই জবানবন্দি অস্বীকার করেনি। নথিতে থাকা এই সাক্ষ্যের আলােকে এটি বলা যায় না যে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনায় এই আপিলকারীকে সম্পৃক্ত করার পর্যাপ্ত কোনাে উপকরণ নেই। নৈশ প্যারেডে অংশগ্রহণের ঘটনাটিকে ব্যতিক্রম হিসেবে অনুমান করা যায় না। এমনকি কলাবাগান খেলার মাঠে কামানসহ তাকে চিনতে পারার পর এবং ঘটনার সময় প্রেসিডেন্টের বাসভবন ও রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর লক্ষ করে কামানের গােলা নিক্ষেপের বিষয়টির পরও বিজ্ঞ প্রথম বিচারক এটিকে কোনাে ব্যতিক্রম হিসেবে গ্রহণ করেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, আপিলকারী ঘটনার সাথে জড়িত ছিল এবং অন্য সহযােগী আসামিদের হত্যাকাণ্ড সংঘটনে সহায়তা করেছিল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে অত্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।
২২৬. আরাে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, প্রসিকিউশন পক্ষের উপরােল্লিখিত সাক্ষীগণের সকলেই ল্যান্সার ও আর্টিলারি ইউনিটের সেনাসদস্য। আপিলকারীগণ ও অন্য সহ-অভিযুক্তরা ঐ ইউনিটগুলােতে কর্মরত ছিল। তাদের সাথে সাক্ষীদের কোনাে শত্রুতা ছিল বা প্রসিকিউশনকে সমর্থন করতে গিয়ে সাক্ষ্য দেওয়াটা সাক্ষীদের অভিপ্রায় ছিল তা দেখাতে ডিফেন্স ব্যর্থ হয়েছে। ডিফেন্স এই সাক্ষীদের সাক্ষ্য কোনােভাবে খণ্ডন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সাক্ষীগণ কর্তৃক মৌলিক বিষয়গুলাে সম্পর্কে প্রদত্ত সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ না করে বরং তারা (আপিলকারীগণ) কার্যত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাদের অংশগ্রহণ স্বীকার করেছে। সাক্ষীদের সকলেই নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযােগ্য। তাদের সাক্ষ্য নাকচ করার কোনাে জোরালাে কারণ নেই। হাইকোর্ট ডিভিশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ এবং বিজ্ঞ দায়রা বিচারকও তাদেরকে নিরপেক্ষ ও নির্ভরযােগ্য সাক্ষী হিসেবে বিশ্বাস করেছেন। প্রথম বিজ্ঞ বিচারকও বজলুল হুদা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), ফারুক রহমান এবং সুলতান শাহরিয়ারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিশ্বাস করেছেন পি.ডব্লিউ-১, ৪, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ২২, ২৫ প্রদত্ত সাক্ষ্য বিশ্বাস করেই। কিন্তু তিনি (প্রথম বিজ্ঞ বিচারক) ঘটনার সাথে মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)-এর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১৬, ১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ৩২ এবং ৩৫ প্রদত্ত সাক্ষ্য বিশ্বাস করেননি। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পি.ডব্লিউ-৪৪ এবং ৪৫-এর সাক্ষ্যের খণ্ডিত বিবেচনার ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, প্যারেডের কমান্ডিং অফিসারের সাথে দণ্ডিত ব্যক্তির উপস্থিত থাকা ছিল ডিউটির অংশ এবং ১৪ আগস্ট রাতের সেই প্যারেড পূর্ব নিয়ম অনুসারে নির্ধারিত ছিল।
৫১২

প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এই স্বীকৃত ঘটনা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, আপিলকারীরা অন্যদের সাথে নিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে ষড়যন্ত্র রচনা করেছিল, ভাণ্ডার থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়েছিল, ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী আর্টিলারি সরিয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আর্টিলারির সাথে সেনা নিয়ােজিত করেছিল এবং তারপর তারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল, যা ইতােমধ্যে আলােচনা করা হয়েছে।
২২৭. এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনাে সাক্ষী বিশ্বাসযােগ্য ও নির্ভরযােগ্য কিনা সে মর্মে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট ডিভিশন প্রদত্ত কোনাে সিদ্ধান্ত একটি ঘটনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত কিনা এবং সেই সিদ্ধান্ত এই কোর্টের (আপিল বিভাগ) প্রতি বাধ্যকর ও সেটিকে কি অবশ্যই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করতে হবে? আপিলকারীর বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ Nurul Islam [43 DLR (AD) 6] মামলাটি উদ্ধৃত করেন। চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১, ৩, ৭ এবং ৮-এর সাক্ষ্যে দৃশ্যমান অসামঞ্জস্য ও বৈপরীত্য আছে কিনা, যা প্রসিকিউশন কেসের সত্যতাকে সন্দেহাবুত করে, সেটি বিবেচনা করার জন্য এই মামলায় আপিল বিভাগ লিভ মঞ্জর করেছিলেন। আপিল বিভাগ তাদের সাক্ষ্য পর্যালােচনায় এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, তাদের সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করা কঠিন এবং এই পর্যবেক্ষণ দেন যে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ড বহাল রাখতে গিয়ে এই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের সাক্ষ্যের গুরুত্বপূর্ণ অসামঞ্জস্য বিবেচনা করেননি। ফলে, বিজ্ঞ আইনজীবী কর্তৃক উদ্ধৃত সিদ্ধান্তটি বর্তমান মামলায় প্রযােজ্য নয়।
২২৮. আপিলকারীর বিজ্ঞ আইনজীবী কর্তৃক Hazrat Ali (54 DLR 636) মামলাটিও উদ্ধৃত করা হয়েছে, যেখানে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে যে, যখন অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা সংশ্লিষ্ট প্রসিকিউশন কেসের অন্যতম অংশ সম্পর্কে সাক্ষীদের সাক্ষ্য আদালত কর্তৃক অবিশ্বাস করা হয়, তখন ঐ সাক্ষীদের সাক্ষ্য অন্য কোনাে সূত্র থেকে প্রাপ্ত স্বতন্ত্র সমর্থন ছাড়া গ্রহণ করা যেতে পারে না। এই মামলায় হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক প্রদত্ত পর্যবেক্ষণ বিতর্কিত নয়। বর্তমান আপিলগুলােতে বিজ্ঞ আইনজীবী সাক্ষীদের সাক্ষ্যে কোনাে বড় ধরনের অসংগতি, যা প্রসিকিউশন কেসের অন্যতম অংশকে অবিশ্বাস্য প্রতিপন্ন করতে পারে, তা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন।
২২৯. আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবী কর্তৃক Muslim Uddin [38 DLR (AD) 311] মামলাটিও উদ্ধৃত করা
হয়। ঐ মামলায় মৃতের স্ত্রী মাজেদার (পি.ডব্লিউ-১) সাক্ষ্যের, যা অন্য একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৩, যাকে পুলিশ ঘটনার অনেক পরে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল, দ্বারা সমর্থিত ছিল। তার উপর নির্ভর করে হত্যার অভিযােগে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। হাইকোর্ট ডিভিশন তার দণ্ডাদেশ বহাল রেখেছিলেন। মৃত ব্যক্তির স্ত্রী পি.ডব্লিউ-১-এর সাক্ষ্য বিবেচনায় আপিল বিভাগ এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, সে (মৃতের স্ত্রী) ঘটনার সময় কুঁড়েঘরে উপস্থিত ছিল, কিন্তু অন্য সাক্ষীগণ কর্তৃক এটি সমর্থিত হয়নি এবং বিস্তারিত বর্ণনাসহ অনেক আসামিকে চিনতে পারা তার (মৃতের স্ত্রী) পক্ষে একেবারে অসম্ভব ছিল। ঐ মামলায় আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন যে-
“কোনাে ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে আদালতের সামনে মূল কাজ হলাে তর্কিত ঘটনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ যা প্রসিকিউশন সাক্ষীগণ কর্তৃক তাদের জেরায় দেওয়া উত্তরগুলাে বিবেচনার উপর নির্ভর করে।
“অতএব, কোনাে মামলায় সাক্ষীর জবানবন্দিকে বদলে দেওয়া বা জেরাকারীর নিজ মামলা প্রতিষ্ঠা করতে প্রত্যাশিত ঘটনা বের করে আনার জন্য জেরা অনিবার্যভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জেরার উদ্দেশ্য দুটি : জেরাকারী পক্ষের (আসামি) কেস তুলে ধরা এবং সাক্ষীর বিশ্বাসযােগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
৫১৩

“সাক্ষী জবানবন্দিতে কেবল সেই ঘটনাগুলােই ব্যক্ত করেন যা প্রসিকিউশন পক্ষে যায় এবং যা অপর পক্ষে যায় তা সে ব্যক্ত করে না।
“কোনাে ফৌজদারি মামলায় জেরার লক্ষ্য হলাে সেই ঘটনাগুলােই তুলে আনা যা ডিফেন্সের বক্তব্যকে সমর্থন করে এবং যা প্রসিকিউশন পক্ষকে সমর্থন করে না। প্রতিপক্ষ অবশ্যই তাদের নিজেদের সাক্ষী তলব করে তাদের অনুকূল ঘটনাগুলাে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কিন্তু, “there is something dramatic in proving one’s own case from the mouth of the witnesses of the opponent .
“পূর্বের পর্যবেক্ষণে যেমনটি বলা হয়েছে, বর্তমান আপিলগুলােয় সাক্ষীগণ কর্তৃক প্রদত্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যের দোষারােপমূলক অংশ ডিফেন্স চ্যালেঞ্জ করেনি। সেহেতু, তাদের সাক্ষ্য অখণ্ডিত রয়ে গেছে। ডিফেন্স সাক্ষীদের জেরা করে তাদের অনুকূল ঘটনা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। সেহেতু, এই মামলায় (মুসলিম উদ্দিন) প্রদত্ত সিদ্ধান্ত আসামিপক্ষকে সাহায্য করার পরিবর্তে প্রসিকিউশন কেসকেই সহায়তা করছে।”
২৩০. আপিলকারীগণ কর্তৃক উদ্ধৃত Safdar Ali os Crocon [5 DLR (FC) 107(64)] মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যে, কোনাে ফৌজদারি মামলায় প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স কর্তৃক উপস্থাপিত সমগ্র সাক্ষ্য মূল্যায়ন করা আদালতের দায়িত্ব। সমগ্র সাক্ষ্য পরীক্ষার পর যদি আদালত এটি মনে করেন যে, আসামির পক্ষে তুলে ধরা ‘ডিফেন্স’টি সত্য এবং এটি পরিষ্কার যে, ঐরূপ ধারণা সমগ্র প্রসিকিউশন কেসে প্রভাব ফেলে, তাহলে ঐ অবস্থায় আসামি সন্দেহের সুবিধা পাওয়ার অধিকারী। অনুগ্রহ হিসেবে নয়, বরং তার অধিকার হিসেবে। কারণ প্রসিকিউশন তার কেস যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমাণ করেনি।
২৩১. উপরে বর্ণিত আইনের ভাষ্য ফৌজদারি বিচার পরিচালনায় একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি হওয়ায় তা বিতর্কিত নয়। কিন্তু বর্তমান আপিলগুলােয় আপিলকারীগণ কর্তৃক তুলে ধরা ডিফেন্স ভার্শন প্রসিকিউশন কেসকে পরিবর্তন করে না, বরং তা প্রসিকিউশন কেসকে সমর্থন করে।
২৩২. তাছাড়া, Movezuddin [31 DLR (AD) 37] মামলাতেও নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে :
“We like to observe that the contradiction in the statement of a witness, either with his own statement or with the statement of another witness, is a task of appreciation of the evidence, and therefore, it is within the jurisdiction of the trial Court and the Court of appeal on fact, to deal with the question. No doubt there is a certain rule of prudence governing the case of contradicting statements. It is first to be seen whether the alleged statement is a discrepant statement or contradictory statement. The discrepant statement is one which is either irrelevant or incoherent, but it is not irreconcilable. A discrepant statement is not fatal to the credibility of a witness. A contradictory statement is one which is conflicting and is not reconcilable with other statements either of his own or any other witness. The question in such case is, that it is open to a Court of fact either to reject the whole evidence of a witness as untrustworthy or to reject the contradictory part as unreliable or to rely upon that portion, which in the opinion of the Court, fits in with other evidence and the facts and circumstances of the case.”
৫১৪

২৩৩. তদনুসারে ঘটনাস্থলে মেজর বজলুল হুদার উপস্থিতি এবং তাকে সাক্ষীগণ চিনতে পেরেছিলেন সে সম্পর্কে সাক্ষীদের সাক্ষ্যের কিছু অংশ তুলে ধরে জনাব মামুন যে যুক্তি দেখিয়েছেন তা খুবই ক্ষুদ্র বিষয় ও তা সাক্ষীদের বক্তব্যের অসামঞ্জস্য তুলে ধরে না। বিজ্ঞ আইনজীবী সাক্ষীদের কোনাে পরস্পরবিরােধী বক্তব্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। বরং, তিনি আমাদের জিজ্ঞাসায় এটি এড়িয়ে গেছেন যে, বজলুল হুদার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে সাক্ষীদের দোষারােপমূলক বক্তব্য জেরাতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল কিনা।
২৩৪. সুলতান শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে প্রণীত অভিযােগ বিবেচনার সময় এর আগে সংবিধানের ১০৩(৩) অনুচ্ছেদের অধীনে ঐরূপ ঘটনাসম্পর্কিত বিষয়গুলাে বিবেচনা করার প্রশ্নটি ইতােমধ্যে আলােচনা করা হয়েছে।
২৩৫. জনাব মােঃ আব্দুর রাজ্জাক খান নিবেদন করেন যে, সুলতান শাহরিয়ার ঘটনাস্থল বা এর কাছে উপস্থিত ছিল না এবং তার কোনাে ওভার্ট অ্যাক্ট না থাকায় বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অন্য আসামিদের সাথে তার অংশগ্রহণ না থাকায় তাকে ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্তকরণ সম্পূর্ণ বেআইনি। সুলতান শাহরিয়ারকে পেনাল কোডের ৩৪ ধারার আওতায় আনতে হলে এটি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যে, তার কিছু ওভার্ট অ্যাক্ট ছিল বা ঘটনার সাথে সম্পর্কিত এমন কোনাে কাজ সে করেছিল, যার দ্বারা সেও পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অপরাধ সংঘটনে অন্য অপরাধ সংঘটনকারীদের সাথে অংশ নিয়েছিল এবং সেও সেটির পক্ষে কোনাে কাজ করেছিল। পি.ডব্লিউ-১৪ তাকে বালুরঘাটে প্যারেডে দেখেছিলেন। কিন্তু এটি ছাড়া। তার (সুলতান শাহরিয়ার) বিরুদ্ধে নথিতে অন্য কোনাে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য নেই যা থেকে বলা যায় যে, সে কোনােভাবে কথিত ঘটনার সাথে জড়িত ছিল। তাছাড়া, ঘটনার পরে ১৫ আগস্ট ভাের ৬টার সময় রেডিও স্টেশনে সুলতান শাহরিয়ারের উপস্থিতি ছিল তার অফিসিয়াল ডিউটির অংশ এবং সে কারণে তাকে হত্যার অভিযােগে দায়ী করা যায় না। জনাব রাজ্জাক খান আরাে নিবেদন করেন যে, যেহেতু সুলতান শাহরিয়ার ৩২ নম্বর রােডের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে উপস্থিত ছিল না এবং হত্যাকাণ্ডে সে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি, সেহেতু, তার কাজ (অ্যাক্ট) তাকে সেই অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে না। যে অপরাধ মূল অপরাধীরা সংঘটিত করেছিল। Md. Shamsul Hoque 0s State 20 DLR 540, Amor Kumar Thakur vs State 40 DLR (AD) 147, Hazrat Ali vs State 44 DLR (AD) 51 এবং Dharan Pal os State of Haryana (1978) 4 SCC 440 মামলাসমূহে প্রদত্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে তার (সুলতান শাহরিয়ার) ঐ অ্যাক্ট বড়জোর হত্যা প্ররােচনার অপরাধ যা পেনাল কোডের ১০৯ ধারার অধীনে শাস্তিযােগ্য।
২৩৬. জনাব খান আরাে নিবেদন করেন যে, ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হওয়ার পর ষড়যন্ত্রের অভিযােগে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
২৩৭. জনাব খান সাইফুর রহমান নিবেদন করেন যে, ফারুক রহমান এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি)-কে ৩২ নম্বর রােডের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে উপস্থিত পাওয়া যায়নি এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) কর্তৃক কলাবাগান খেলার মাঠে আর্টিলারি সেনা মােতায়েন করার সাথে প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের তার কোনাে সম্পর্ক নেই। অতএব, তাদের দুজনকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে বেআইনিভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। যদি দেখা যায় যে, সংঘটিত অপরাধটি একটি ‘বিদ্রোহ ছিল, তবে তা হবে একটি সেনা অপরাধ’ (মিলিটারি অফেন্স) এবং তাহলে সাধারণ অভিপ্রায় ও তা থেকে উ দ্ভূত দায়বদ্ধতা সম্পর্কিত পেনাল কোডের ৩৪ বা ৩৮ ধারার বিধান কোনােভাবে বর্তমান আপিলগুলাের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে না।
৫১৫

২৩৮, অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক এবং অ্যাডভােকেট জেনারেল নিবেদন করেছেন যে, সুলতান শাহরিয়ারের
ক্ষেত্রে ৩৪ ধারা প্রযােজ্য নয় তা ধরে নেওয়া হলেও তার জন্য সে প্রকৃত কোনাে সুবিধা পাবে না। কারণ, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে তার অংশগ্রহণ প্রসিকিউশন কর্তৃক প্রমাণিত হয়েছে। জনাব হক এটিও নিবেদন করেন যে, যেহেতু ১২০এ ধারাটি একটি স্বতন্ত্র অপরাধ, সেহেতু সুলতান শাহরিয়ারকে পেনাল কোডের ১২০বি ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ড প্রদান করা যেতে পারে।
২৩৯. কোনাে কিছুকে সাধারণ অভিপ্রায় (common intention) হিসেবে গণ্য করা ও ঐ অভিপ্রায় থেকেউদ্ভূত দায়িত্ব নিরূপণের ক্ষেত্রে ৩৪, ৩৫ এবং ৩৮ ধারার প্রকৃত সারমর্মকে, যা নিচে বিধৃত, পরীক্ষা করতে হবে :
“34. When a criminal act is done by several persons, in furtherance of the common intention of all, each of such persons is liable for that act in the same manner as if it were done by him alone.
35. Whenever an act, which is criminal only by reason of its being done with a criminal knowledge or intention, is done by several persons, each of such persons who joins in the act with such knowledge or intention is liable for the act in the same manner as if the act were done by him alone with that knowledge or intention.
38. Where several persons are engaged or concerned in the commission of a criminal act, they may be guilty of different offenses by means of that act.”
২৪০. এই বিধানগুলাে পাঠ করলে দেখা যায় যে, ৩৪ এবং ৩৫ ধারা অপরাধের সামগ্রিক ফলাফলের জন্য দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে, যখন ৩৮ ধারা কেবল ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা (individual responsibility) সৃষ্টি করে। ৩৪ ধারা প্রযােজ্য হবে যেখানে সাধারণ অভিপ্রায় রয়েছে এবং যখন সবার সাধারণ অভিপ্রায়। অনুসারেই একটি অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হয়, তখন প্রত্যেকেই সমভাবে দায়ী হবে। ৩৫ ধারাটির ক্ষেত্রে বা প্রত্যেক আসামির অপরাধটি সম্বন্ধে জ্ঞান বা অপরাধ সংঘটনের অভিপ্রায়ের অস্তিত্ব থাকতে হবে, যদি কর্মটিকে অপরাধমূলক সাব্যস্ত করতে জ্ঞান বা অভিপ্রায় প্রয়ােজন হয়। অতএব, যদি দুইজন ব্যক্তি একজন তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রহার করে এবং এটি করতে গিয়ে যদি তাদের একজনের অভিপ্রায় হয় তার মৃত্যু ঘটানাে এবং অন্যজনের অভিপ্রায় হয় কেবল গুরুতর জখম করা, তাহলে সেখানে কোনাে সাধারণ অভিপ্রায় নেই। তাদের কৃত অপরাধগুলাে হবে ভিন্ন প্রকৃতির। সাধারণ অভিপ্রায়ে যদি অপরাধটি সংঘটিত হয় বা এটি সংঘটনে যদি প্রত্যেক আসামির প্রয়ােজনীয় অভিপ্রায় বা জ্ঞান থেকে থাকে তাহলে ঘটনার ফলাফল অন্যরকম হবে। একই ধরনের কর্ম থেকে উদ্ভূত দায়ের বিভিন্ন মাত্রার বিষয়টি ৩৮ ধারায় বিধৃত রয়েছে।
২৪১. নিম্নে বর্ণিত উদাহরণটি বিষয়টিকে পরিষ্কার করবে :
“A attacks Z under such circumstances of grave provocation that his killing of Z would be only culpable homicidal not amounting to murder. B having
৫১৬

ill-will towards Z and intending to kill him, and not having been subject to the provocation, assists A in killing Z. Here, though A and B are both engaged in causing Z’s death, B is guilty of murder, and A is guilty only of culpable homicide.”
২৪২. ৩৪ ধারায় বিধৃত সাধারণ অভিপ্রায়ের অর্থ হলাে, একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক কর্মটিতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মনের যুগপৎ সচেতনতা এবং যদি তাদের কেউ কমন ডিজাইন কার্যকর করতে সাহায্য করে তাহলে সেই ব্যক্তি তার কর্মের দ্বারা পরিকল্পিত অপরাধ সংঘটনে সহ-অংশগ্রহণকারী হিসেবে অংশ নিয়েছে বলে গণ্য হবে। এই ধারাটির সারমর্ম হলাে মূল অপরাধ সংঘটনে সেই ব্যক্তিকে অবশ্যই শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে। এর সাথে অবশ্যই থাকতে হবে সক্রিয় অংশগ্রহণ, যা কারাে কর্তৃক নিষ্ক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণেও হতে পারে, যেমন, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা বা ঘটনার কাছাকাছি উপস্থিত থাকা; সহ-অংশগ্রহণকারীরা যারা প্রকৃত পরিকল্পিত অপরাধটি সংঘটিত করে তাদেরকে সাধারণ অভিপ্রায় অনুসারে সাহায্য করা এবং সময়মতাে তার ভূমিকা পালনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখা।
২৪৩. এখন প্রশ্ন হলাে, উপরের নীতিটি যদি বর্তমান আপিলগুলাের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা হয় তাহলে ফলাফল কী হবে?
২৪৪. যেমনটি আগে বলা হয়েছে, আপিলকারীরা নাইট প্যারেডে অংশ নিয়েছিল এবং এটির ব্যবস্থা করা হয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। আপিলকারীরা ও অন্য আসামিরা কমান্ড অফিসারের অধীন জওয়ানদের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, যেমন রক্ষীবাহিনী সদর দফতর, বিডিআর সদর দফতর, রেডিও স্টেশন, মিন্টু রােড এবং ৩২ নম্বর রােডে নিয়ােজিত করেছিল। রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর এবং বিডিআর সদর দফতরে সেনা মােতায়েন ছিল তাদের পূর্বপরিকল্পনার অংশ, এই আধাসামরিক বাহিনীকে প্রতিরােধ করা- যদি তারা কোনাে তথ্য পায় বা সহযােগিতা চাওয়া হলেও তারা যেন প্রেসিডেন্টকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে না পারে। রেডিও স্টেশনে সেনা মােতায়েনের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের পক্ষে কোনাে ব্যক্তি সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক ব্যক্তি বা অন্য কোনাে উৎস থেকে কোনাে সাহায্য চাওয়া হলে তা প্রতিরােধ করা। মিন্টু রােডে সেনা মােতায়েনের উদ্দেশ্যও ছিল মন্ত্রিদের প্রতিরােধ করা, যেন তারা প্রেসিডেন্টের সুরক্ষার জন্য জনসাধারণ বা অন্য কোনাে বাহিনীকে জমায়েত করতে না পারে।
২৪৫. মামলার নথি থেকে দেখা যায় যে, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ৩২ নম্বর রােডের কাছে কলাবাগান খেলার মাঠে কামানসহ নিয়ােজিত ছিল; সুলতান শাহরিয়ার নিয়ােজিত ছিল রেডিও স্টেশনে; ফারুক রহমান রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর থেকে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে এসেছিল; মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা এবং কয়েকজন অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার জন্য। অস্ত্র ও কামানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আপিলকারীদের আনাগােনা ছিল অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ- কোনাে বাধা ছাড়া প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য। বজলুল হুদা ও মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) হত্যাকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। দেখা যায় যে, ফারুক রহমান হত্যাকাণ্ডে অংশ না নিলেও সে ঘটনার সময় তাদের সবার সাধারণ অভিপ্রায় অনুসারে কর্মটি বাস্তবায়নের জন্য প্রেসিডেন্টের বাসভবনের কাছে হত্যাকাণ্ডের সময় কামানসহ
৫১৭

উপস্থিত ছিল; তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে অন্যরা যদি প্রতিরােধ করতে আসে সেজন্য। এবং যদিও তার অংশগ্রহণ ছিল পরােক্ষ এবং বিক্ষিপ্ত, তারপরও সে ঘটনাস্থলে বা ঘটনাস্থলের কাছেই উপস্থিত ছিল। মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) কলাবাগান খেলার মাঠে তার সেনা ও কামানসহ অবস্থান নিয়ে সহযােগী আসামি বজলুল হুদা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) ও অন্যদের, যারা প্রেসিডেন্টের বাসভবন প্রহরায় নিয়ােজিত ছিল তাদের সহযােগিতা করেছিল, যদি ফোর্স প্রেসিডেন্টকে উদ্ধার করার জন্য আসে তবে তাদের প্রতিরােধ করা এবং সেই উদ্দেশ্যে সে চারটি কামানের গােলা নিক্ষেপ করে অন্যদের জানান দিতে যে, সে কামানের গােলা ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত আছে। অতএব, ফারুক রহমান এবং মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) কর্মকাণ্ড ৩৪ ধারার (পেনাল কোডের) আওতায় পড়ে। কারণ তারা প্রয়ােজন হলে অপরাধ সংঘটনে অংশ নিতে প্রস্তুত ছিল।
২৪৬. এটি স্বীকৃত যে, সুলতান শাহরিয়ার ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না। ঘটনার পূর্বে সে রেডিও স্টেশনে নিয়ােজিত ছিল। আগেই বলা হয়েছে, তার কাজটি ছিল কেউ রেডিও স্টেশন থেকে সাহায্য চাইলে তাকে প্রতিরােধ করা। কাজেই প্রশ্ন ওঠে, যেহেতু সে ঘটনাস্থলে শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিল না, সেহেতু তার ঐ কাজটি কি ৩৪ ধারার (পেনাল কোডের) আওতায় পড়ে? হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ মনে করেছেন যে, সে (সুলতান শাহরিয়ার) অন্য আসামিদের সাধারণ অভিপ্রায়ের অংশীদার ছিল; যদিও তার অংশগ্রহণ সক্রিয় ছিল না, পরােক্ষ ছিল যা ৩৪ ধারার (পেনাল কোডের) আওতায় পড়ে। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, নৈশ প্যারেডে উপস্থিত না থাকলেও রেডিও স্টেশনে তার উপস্থিতি ছিল, যা সেই ঐকমত্যের অংশ, যেটিতে সে অন্য দণ্ডিতদের সাথে অংশ নিয়েছিল, প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঘটনা সংঘটনের উদ্দেশ্যে। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, নৈশ প্যারেডে তার উপস্থিত থাকা, রেডিও স্টেশনে তার উপস্থিতি ঐ ঐকমত্যের অংশ ছিল যেটিতে সে অন্য দণ্ডিতদের সাথে মিলিতভাবে ঐকমত্য পােষণ করেছিল, প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঘটনাটি (হত্যাকাণ্ড) সংঘটনের লক্ষ্যে। দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারকও ভাের ৪.৩০/০৫.০০টার সময় রেডিও স্টেশনে তার (সুলতান শাহরিয়ার) উপস্থিতির বিষয়টি নজরে নিয়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ এ প্রসঙ্গে উপসংহারে আসতে নিম্নবর্ণিত মামলাগুলাে বিবেচনায় নিয়েছেন :
Barendra Kumar Ghose vs Emperor, AIR 1925 (PC) 1, Shreekantiah Ramayya Muni Palli, vs State of Bombay, AIR 1955 SC 287, Tukaram Gonapat vs State of Maharashtra, AIR 1974 SC 514, Ramaswami vs State of TN, AIR 1976 SC 2027, Abdur Rahman Mandol vs State, 29 DLR (SC) 247, Bangladesh vs Abed Ali, 36 DLR (AD) 234, Abdus Samad vs State 44 DLR (AD) 233 478 State vs Tajul Islam 48 DLR 305.
২৪৭. ইতােমধ্যে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে যে, পেনাল কোডের ৩৪ ধারার মূল বৈশিষ্ট্য হলাে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের উপাদান। সব ক্ষেত্রে এইরূপ অংশগ্রহণের জন্য শারীরিক উপস্থিতির প্রয়ােজন নেই। সাধারণ অভিপ্রায়ের অর্থ হলাে, ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজটিতে অংশ নেওয়া। এই ধারা অনুসারে সকল ব্যক্তি কর্তৃক একত্র হয়ে সাধারণ অভিপ্রায়ে কোনাে অপরাধ সংঘটন করা। যারা উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাহায্য করে তাদের সকলেই সমভাবে দোষী হবে। অতএব, তদনুসারে সাধারণ অভিপ্রায় একটি অপরাধ, যা সংঘটিত হয়েছে তা সংঘটনের অভিপ্রায় এবং আসামিদের প্রত্যেকে সেই অভিপ্রায় বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করেছে।
৫১৮

২৪৮. Barendra Kumar Ghosh (পূর্বোক্ত) মামলায় প্রিভি কাউন্সিলের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ এই ধারায় অন্তর্গত নীতিটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করেছন। এই মামলায় তিনজন ব্যক্তি পােস্ট মাস্টারকে লক্ষ করে গুলি করেছিল, যাদের মধ্যে একজন ছিল আপিলকারী বরেন্দ্র কুমার। সে খুবই ব্যতিক্রমী পােশাক পরিহিত ছিল, যে কারণে তাকে আলাদাভাবে চিনতে পারা গিয়েছিল; এবং এই ব্যক্তিরা যখন ঠিক রুমের ভেতরে ছিল তখন ঘরের দরজা দিয়ে আরেকজনকে অন্যদের সাথে বাইরে আঙিনার ঠিক প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। এই ব্যক্তি সশস্ত্র অবস্থায় ছিল, কিন্তু সে কোনাে গুলিবর্ষণ করেনি। বরেন্দ্রর পক্ষে এই ডিফেন্স নেওয়া হয়েছিল যে, সে রুমের বাইরে ছিল এবং সে আঙিনায় দাঁড়িয়ে ছিল এবং খুব ভীত অবস্থায় ছিল। সে গুলিবর্ষণকারী দলের একজন হিসেবে উপস্থিত ছিল কিনা বা সে এই দলের কামান্ডার ছিল কিনা বা রিজার্ভ ছিল কিনা বা দলের পাহারায় নিয়ােজিত ছিল কিনা- এই বিষয়গুলাে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা প্রমাণের জন্য বিশেষ কোনাে গুরুত্ব নেই। কেন সে সেখানে ছিল এবং কেন সে নিজেকে সরিয়ে রাখেনি তা সে বলেনি। এমনকি আঙিনায় তার সঠিক অবস্থানটি কী ছিল তা-ও সে নির্দেশ করেনি। বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ বরেন্দ্রর সাজা বহাল রাখতে গিয়ে ৩৪ ধারার ব্যাপ্তি ব্যাখা করে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“By section 33 a criminal act in section 34 includes a series of acts and, further “act includes omission to act, for example, an omission to interfere in order to prevent a murder being done before one’s very eyes. By section 37, when any offense is committed by means of several acts whoever intentionally cooperates in the commission of that offense by doing any one of those acts, either singly or jointly with any other person, commits that offense. Even if the appellant did nothing as he stood outside the door, it is to be remembered that in crimes as in other things “they also serve who only stand and wait.” By section 38 when several persons are engaged or concerned in the commission of a criminal act, they may be guilty of different offenses by means of that act. Read together, these sections are reasonably plain. Section 34 deals with the doing of separate acts, similar or diverse by several persons; if all are done in furtherance of a common intention, each person is liable for the result of them all, as if he had done them himself for “that act” and “the act” in the latter part of the section must include the whole action covered by “a criminal act” in the first part, because they refer to it.”
২৪৯. অতএব, পেনাল কোডের ৩৪ ধারার মূল বৈশিষ্ট্য হলাে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের উপাদান। সব ক্ষেত্রে এইরূপ অংশগ্রহণ শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে হওয়ার প্রয়ােজন নেই। ঘটনাস্থলে আসামির শারীরিক উপস্থিতি পূর্বশর্ত- এমন মামলার সাথে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট ঐসব মামলার পার্থক্য টেনেছেন যেখানে অনুরূপ বা পৃথক কোনাে কর্ম দ্বারা আসামির উপস্থিতি প্রয়ােজন নয় যা তাকে এই ধারার আওতায় আনতে পারে।
৫১৯

২৫০. Ramasoani (পূর্বোক্ত) মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে যে, ৩৪ ধারার পূর্ববর্তী ৩৩ ধারার সাথে একত্রে পড়লে এটি পরিষ্কার হয় যে, ৩৪ ধারায় বর্ণিত কোনাে কাজ (act) একক কোনাে কাজ হিসেবে ধারাবাহিক কাজের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ, “যখন কোনাে অপরাধমূলক কাজ কয়েকজন ব্যক্তি কর্তৃক কৃত হয়”। অতএব, ৩৪ ধারার এই ব্যাখ্যা এটি বােঝায় যে, “যখন অপরাধমূলক কর্ম কয়েকজন ব্যক্তি কর্তৃক কৃত হয়”। সংঘটিত অপরাধমূলক কাজে (criminal action) বিভিন্ন সহযােগীদের কৃত কাজ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু সকলে অবশ্যই একই পথে বা অন্যভাবে ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজে অংশ নেয়। এবং যুক্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ভিকটিমকে কেউ যেন উদ্ধার করতে আসতে না পারে সেজন্য একজন পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বা অন্য কোনােভাবে- সে সাধারণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন সহজ করার জন্য। ঐ ধরনের ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে পরিকল্পিত অপরাধ সংঘটনে তার সহযােগী অংশগ্রহণকারীদের মতােই একটি কাজ (act) করে। শারীরিক সহিংসতা সম্পর্কিত কোনাে অপরাধে ৩৪ ধারার প্রয়ােগের জন্য এটি প্রয়ােজন যে, যে ব্যক্তি অপরাধ সংঘটনে প্ররােচনা বা সহায়তা দেয় তাকে অবশ্যই ঐ অপরাধের প্রকৃত সংঘটনে সহায়তার জন্য শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে, যে অপরাধ সংঘটন যৌথ অপরাধমূলক উদোগের (the joint criminal venture) উদ্দেশ্য। যারা এভাবে বা অন্য কোনােভাবে সাধারণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়তা করে তা অপরাধমূলক কাজে তাদের প্রকৃত অংশগ্রহণের নামান্তর। ৩৪ ধারার সারমর্ম হলাে, একটি নির্দিষ্ট ফলাফলের জন্য অপরাধমূলক কাজে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের মানসিক ঐকমত্য। ঐরূপ ঐকমত্য ঘটনাস্থলেও গড়ে উঠতে পারে এবং এভাবে ঐকমত্যটি সকলের অভিপ্রায়ে হতে পারে।
২৫১. Sreekantiah, (পূর্বোক্ত) মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যে-
“The essence of section 34 that the person must be physically present at the scene of occurrence coupled with actual participation which, of course, can be of a character such as standing by a door, provided that is done with the intention of assisting in furtherance of common intention of them all and there is a readiness to play his part in the prearranged plan when the time comes for him to act”. A five-member Bench of this Court also took similar view in Abdur Rahman Mondal’s case (supra) as follows:
“The common intention to bring about a particular result may well develop on the spot as between a number of persons. All that is necessary is either to have direct proof of prior concert or proof of circumstances which necessarily lead to that inference or the incriminating acts must be incompatible with the innocence of the accused and incapable of explanation on any other reasonable hypothesis. Further, it is the essence of section 34 that the person must be physically present at the actual commission of the crime.”
২৫২. Rasool Bux vs State 22 DLR (SC) ২৯৭ মামলায় পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট বরেন্দ্র ঘােষ মামলায় দেওয়া অভিমতটি অনুমােদন দিয়েছেন এবং প্রিভি কাউন্সিল পর্যবেক্ষণের আলােকে মামলাটি বিবেচনা করেছেন। ঐ মামলায় লালু বক্স ও রসুল বক্স মােসাম্মৎ রােশনাকে তার বাবার বাড়ি থেকে, প্রয়ােজনে
৫২০

বলপ্রয়ােগ করে, অপহরণের পরিকল্পনা করেছিল। তারা দুজনই মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় ছিল। যখন আঙিনায় তাদের উপস্থিতি জানা যায় তখন তারা তাদের মূল পরিকল্পনা ত্যাগ করেছিল। কিন্তু। প্রয়ােজনে তারা তাদের বহন করা অস্ত্র ব্যবহার করে পালিয়ে যেতে সংকল্পবদ্ধ ছিল। পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “সাধারণ অভিপ্রায়, যদি তা শুরুতে উপস্থিত না-ও থাকে, তবু তা মুহুর্তের উত্তেজনায় তৈরি হতে পারে যখন তারা দেখে যে, তারা অন্যদের দ্বারা ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েছে…”। তাদের পালিয়ে যাওয়া প্রতিরােধ করতে যারা এগিয়ে এসেছিল তাদের একজনকে লালু বক্স গুলি করেছিল এবং রসুল বক্সও দুটি গুলি চালিয়েছিল। পর্যবেক্ষণে আরাে বলা হয়েছে যে, তারা পালিয়ে যাওয়ার জন্য সাধারণ অভিপ্রায়ে বাধা প্রদানকারীদের প্রতিরােধ করার জন্য গুলি চালিয়েছিল। অতএব, এটি কীভাবে বলা যায় যে, তারা তাদের দুজনই সাধারণ অভিপ্রায় বাস্তবায়নের জন্য গুলি চালায়নি।”
২৫৩. Tajul Islam মামলায় (পূর্বোক্ত) হাইকোর্ট বিভাগ অভিযােগের সমর্থনে প্রসিকিউশন কর্তৃক উত্থাপিত সাক্ষ্যে দেখেন যে, বাদশা তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিল যে, সে বিরজা রানীর দ্বিতীয় পুত্রকে পা দিয়ে চেপে ধরেছিল এবং অভিযুক্ত ইনু তাকে দা দিয়ে দুই টুকরাে করে কেটেছিল। স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী অপর অভিযুক্ত বলেছিল যে, অপরাধ সংঘটনের জন্য তারা বিরজা রানীর বাড়িতে গিয়েছিল এবং কেউ কেউ নৌকায় বা বিরজার প্রতিবেশীদের বাড়ির দরজার সামনে বা রাস্তায় পাহারা দেওয়ার জন্য অবস্থান করছিল। অনুমিত হয় যে, অপরাধ সংঘটনে কেউ যেন বাধা দিতে এগিয়ে না আসতে পারে সেজন্য। মামলার ঘটনার আলােকে বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“In an offense involving physical violence, normally presence at the scene of the occurrence of the offender sought to be rendered liable on the principle of joint liability is necessary; such is not the case in respect of other offenses where offense consists of adverse acts which may be done at a different time and place.”
২৫৪. Noor Mohammad Mohol Yusuf Momin 0s State of Maharashtra (পূর্বোক্ত) মামলায় বিচারিক আদালত মােঃ তকি হাজী হুসেইন মােমিনকে ৩০২ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন এবং আপিলকারীসহ অপর তিনজন অভিযুক্তকে খালাস প্রদান করেছিলেন। খালাসের বিরুদ্ধে আনীত আপিলে বােম্বে হাইকোর্ট খালাসের আদেশ বাতিল বা রিভার্স করে আপিলকারী ও অন্য দুজনকে ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০বি এবং ৩০২ ধারা তৎসহ ৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করেন। আপিলকারীকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২/১০৯ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়ছিল এবং দুটি অভিযােগে তাদেরকে যাবজ্জীবন করাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। আপিলকারীকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্তকরণ নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ দিয়ে বাতিল করা হয়েছিল :
“From the evidence it seems highly probable that at the time of the actual murder of Mohd. Yahiya the appellant was either present with other three co-accused or was somewhere nearby. But this evidence does not seem to be enough to prove beyond reasonable doubt his presence at the spot in the company of the other accused when the murder was actually committed…we
৫২১

are, therefore, inclined to give to the appellant the benefit of doubt in regard to
the charge under section 302 read with section 34, IPC.”
২৫৫. শারীরিক সহিংসতা ছাড়া অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে ৩৪ ধারার প্রয়ােগের বিষয়টি Tukaram Ganput (supra) মামলায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যেখানে আপিলকারী তুকারামসহ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল যে, তারা একটি কোম্পানির গুদাম ভেঙে সেখান থেকে কয়েক বান্ডিল তামার তার চুরি করেছিল। এবং একটি লরিতে করে নিয়ে গিয়েছিল। লরিটি একটি weigh-bridge-এ এসে থেমেছিল, যেখানে সেগুলাে বিক্রির জন্য দালালরা উপস্থিত ছিল। অপরাধস্থলে আপিলকারীদের উপস্থিতির বিষয়ে কোনাে সাক্ষ্য ছিল না। নিম্ন আদালতগুলাের ঐকমত্যসূচক সিদ্ধান্ত ছিল এই যে, আপিলকারীর দখলে চুরি হওয়া গুদামের ডুপ্লিকেট চাবি ছিল যা ফ্যাক্টরিতে খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং সে weigh-bridge-এ উপস্থিত ছিল। আপিলকারী তার কাছে গুদামের চাবি থাকা ও weigh-bridge-এ তার উপস্থিতির বিষয়ে কোনাে ব্যাখ্যা দেয়নি। ঘটনার প্রেক্ষাপটে সাধারণ অভিপ্রায়’-এর নীতি প্রয়ােগ করে সুপ্রীম কোর্ট নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ দিয়ে আপিলকারীর দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন :
“Mere distance from the scene of crime cannot exclude culpability under section 34 which lays down the rule of joint responsibility for a criminal act performed by a plurality of persons. In Barendra Kumar Ghosh vs King Emperor (1924) 52 IA 40 (AIR 1925 PC 1) the Judicial Committee drew into the criminal net those ‘who only stand and wait.’ This does not mean that some form of presence, near or remote, is not necessary, or that mere presence without more, at the spot of crime, spells culpability. Criminal sharing, overt or covert, by active presence or by distant direction, making out a certain measure of jointness in the commission of the act is the essence of section 34. Even assuming that presence at the scene is a prerequisite to attract section 34 and that such propinquity is absent, section 107 which is different in one sense, still comes into play to rope in the accused. The act here is not picking the godown lock but housebreaking and criminal house trespass. This crime is participated in by those operating by remote control as by those doing physical removal. Together operating in concert, the criminal project is executed. Those who supply the duplicate key, wait at the weigh-bridge for the break-in and bringing of the booty and later secrete the keys are particeps criminis.”
২৫৬. নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে এটি ছিল ২ নম্বর আসামির ভূমিকা। এই আইনগত অনুমানকে কি সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর বলা যায়?
২৫৭. উপরের সিদ্ধান্তটিতে যৌথ দায়ের নীতিগুলাে আলােচিত হয়েছে। কেবল অপরাধ সংঘটনস্থল থেকে দূরে থাকলেই সেটিকে যৌথভাবে অপরাধ সংঘটনে পেনাল কোডের ৩৪ ধারার অধীনে ব্যক্তির অংশগ্রহণমূলক দায়কে বাইরে রাখতে পারে না। অবশ্য হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ আপিলকারী সুলতান
৫২২

শাহরিয়ারের উপস্থিতি সম্পর্কে উপরােক্ত সিদ্ধান্তটির ratio decidendi মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর ফলে আমি মনে করি যে, প্রসিকিউশনকে সুলতান শাহরিয়ারের উপস্থিতি এবং সকলের সাধারণ অভিপ্রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অপরাধ সংঘটনে তার অংশগ্রহণ ছিল তা প্রমাণ করতে হবে, তার অপরাধটিকে পেনাল কোডের ৩৪ ধারার আওতায় আনার জন্য।
২৫৮. ষড়যন্ত্র সফল হলে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে দোষী সাব্যস্তকরণ আদেশ প্রদান করা যায় না- এ মর্মে যে সাবমিশন রাখা হয়েছে তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, AIR 1938 Mad 130-এ রিপাের্টেড Shamsul Hoque মামলায় যেটি 8DLR48-এ রিপাের্টেড মামলাতে অনুসরণ করা হয়েছে, সেখানে এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যে, যখন দুই বা ততােধিক ব্যক্তি কোনাে অপরাধ সংঘটন করেছে বলে দাবি করা হয় তখন অপরাধ সংঘটনে দায়ী ব্যক্তিকে মূল অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত করা উচিত এবং যে ব্যক্তিরা। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনে সহযােগিতা করেছে তাদেরকে ১০৯ ধারার (পেনাল কোডের) অধীনে অভিযুক্ত করা যায়। দেখা যায় যে, AIR 1938 Mad 130-এ রিপাের্টেড মামলা, যা 8 DLR 48-এ রিপাের্টেড মামলাতে অনুসরণ করা হয়েছে, তা পরবর্তীকালে AIR 1961 SC 1241 (অনুচ্ছেদ ৭ ও ৮)-এ রিপাের্টেড Kandinalla Subbaiah-এর মামলায় উল্টে দেওয়া (overruled) হয়েছে। Annur Kumar Thakur মামলাসম্পৃক্ত ঘটনা এবং আইনের নীতিগুলাে সম্পূর্ণ আলাদা। যেহেতু আসামির বিরুদ্ধে প্রণীত অভিযােগ ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে যেখানে এই আদালত কোনাে আইনানুগ সাক্ষ্য পাননি যে, “নন্দলালের মৃত্যু ঘটাতে ২-৪ নম্বর আপিলকারীদের নিজস্ব কোনাে অভিপ্রায় ছিল, বিশেষ করে যখন সে রাতের বেলায় তাদের অনুরােধে মেডিয়েশনে অংশ নিতে গিয়েছিল।”
২৫৯. Hazrat Ali মামলায় আপিল বিভাগ নথিতে থাকা সাক্ষ্য মূল্যায়নে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, হজরত আলী জহুরা খাতুনের হত্যার অপরাধ সংঘটনে সহযােগিতা (abetted) করেছিল এবং সেহেতু তাকে ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্তকরণ ৩০২/১০৯ ধারায় পরিবর্তন করেছিলেন।
২৬০. Dharan Pal মামলায় এটি লক্ষ করা হয়েছিল যে, সাধারণ অভিপ্রায়ের অস্তিত্ব বা অন্য কিছু নির্ভর করে প্রত্যেক মামলার ঘটনা ও অবস্থাদির উপর এবং তথ্যপ্রমাণের অভাবে “মূল অপরাধী কর্তৃক সংঘটিত প্রত্যেক অপরাধের জন্য তার সঙ্গী বা সঙ্গীদের যৌক্তিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।” উপরের মামলাগুলাের ঘটনা বর্তমান মামলার ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
২৬১. অতএব, দেখা যায় যে, ১২০এ ধারায় সংজ্ঞায়িত ষড়যন্ত্র এবং ৩৪ ধারায় বিধৃত সাধারণ অভিপ্রায় অনুসারে কর্ম করার মধ্যে তেমন তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য নেই। প্রথমটির ক্ষেত্রে অপরাধের সারমর্ম হলাে, আইনভঙ্গের জন্য ঐকমত্য পােষণ ও সম্মিলিত হওয়া। এমনকি যদি বেআইনি কর্মটি এর ফলে হয়ে থাকে তখন অপরাধটির সারমর্ম ৩৪ ধারার অধীনে অন্য সব আসামির সাধারণ অভিপ্রায়ে সংঘটিত একটি অপরাধমূলক কর্ম; যার অর্থ এই যে, সেখানে অপরাধমূলক আচরণের একাত্মতায় ঐ কর্ম সংঘটিত হলে ঐ ব্যক্তি শাস্তিযােগ্য হবে, যেন কর্মটি সে নিজে একাই করেছে।
২৬২. ১২০বি ধারার উপধারা (১) কোনাে অপরাধ সংঘটনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের জন্য প্ররােচনার শাস্তির সমান শাস্তি আরােপ করে। এই ধারা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ১০৭ ধারায় সংজ্ঞায়িত প্ররােচনার (abatement) অপূর্ণতা পূরণের জন্য এই ধারাটি প্রবর্তিত হয়েছে। ১০৭ ধারার অধীনে “দ্বিতীয়ত” এটি বিধৃত হয়েছে যে, কোনাে ব্যক্তি ঐ কাজ করতে প্ররােচিত (abate) করে, যখন সে অন্যদের সাথে ষড়যন্ত্রে মিলিত হয় ঐ কাজ করার জন্য, যদি ঐ ষড়যন্ত্র অনুসারে সেটি করতে কোনাে কাজ বা বেআইনি
৫২৩

ব্যত্যয় (omission) হয়ে থাকে। কোনাে অপরাধ সংঘটনে প্ররােচনা (abatement) ১০৯ ধারা এবং ১১৬ ধারার অধীনে, যেটি হয় শাস্তিযােগ্য, যদি অপরাধটি সংঘটিত না-ও হয়ে থাকে। কিন্তু এটি পরিষ্কার যে, কোনাে ষড়যন্ত্র প্ররােচনা (abatement) হিসেবে গণ্য হবে না, যদি কোনাে কাজ বা বেআইনি ব্যত্যয় ঐ ষড়যন্ত্র অনুসারে না হয়ে থাকে। অতএব, ১২০বি ধারা প্রযােজ্য হবে সেই সব মামলায় যেখানে দেখা যাবে যে, কোনাে মারাত্মক অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্র রচনা করা হয়। কিন্তু বর্তমান আপিলগুলােতে কোনাে কাজ বা বেআইনি ব্যত্যয় হয়নি। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের বর্ধিত সংজ্ঞা ১২০এ ধারায় বিধৃত হয়েছে, যেখানে ১০৭ ধারার সারমর্ম অনুসারে যে কাজগুলাে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্ররােচনার (abatement) অন্তর্ভুক্ত নয়। ১২০বি ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে, যেখানে পেনাল কোডে ঐরূপ ষড়যন্ত্রের শাস্তির জন্য কোনাে স্পষ্ট বিধান নেই।
২৬৩. Noor Mohammad Mohol Yusuf Momin (পূর্বোক্ত) মামলায় ৩৪, ১০৭ এবং ১০৯ ধারার ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যগুলাে নিম্নবর্ণিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
“So far as section 34. Indian Penal Code is concerned, it embodies the principle of joint liability in the doing of a criminal act, the essence of that liability being the existence of a common intention. Participation in the commission of the offense in furtherance of the common intention invites its application. Section 109. Indian Penal Code, on the other hand, may be attracted even if the abettor is not present when the offense abetted is committed provided that he has instigated the commission of the offense or has engaged with one or more other persons in a conspiracy to commit an offense and pursuant to that conspiracy some act or illegal omission takes place or has intentionally aided the commission of an offense by an act or illegal omission. Turning to the charge under section 120B. Indian Penal Code, criminal conspiracy was made a substantive offense in 1913 by the introduction of chapter V-A in the Indian Penal Code. Criminal conspiracy postulates an agreement between two or more persons to do, or cause to be done, an illegal act or an act which is not illegal, by illegal means. It differs from other offenses in that mere agreement is made an offense even if no step is taken to carry out that agreement. Though there is close association of conspiracy with incitement and abetment the substantive offense of criminal conspiracy is somewhat wider in amplitude than abetment by conspiracy as contemplated its very nature is generally hatched in secret. It is, therefore, extremely rare that direct evidence in proof of conspiracy can be forth-coming from wholly disinterested quarters or from utter strangers. But, like other offenses, criminal conspiracy can be proved by circumstantial evidence. Indeed, in most cases proof of conspiracy is largely inferential though the inference must be founded on solid facts. Surrounding circumstances and antecedent and subsequent conduct, among other factors,
৫২৪

constitute relevant material. In fact, because of the difficulties in having direct evidence of criminal conspiracy, once reasonable ground is shown for believing that two or more persons have conspired to commit an offense then anything, done by anyone of them in reference to their common intention after the same is entertained becomes, according to the law of evidence, relevant for proving both conspiracy and the offenses ‘committed pursuant thereto.”
২৪৮ . State of Andhra Pradesh vs Kandimalla Subbaiah, AIR 1961 SC 1241 মামলায় বিবেচনার জন্য যে পয়েন্টটি উত্থাপন করা হয়েছিল তা হলাে, যদি প্ররােচনার পরিণতিতে কোনাে অপরাধ সংঘটিত। হয়ে থাকে, যখন এটি ষড়যন্ত্রের ফলে সংঘটিত হয়, তখন প্ররােচনার কারণেই অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে এবং তা মূল অপরাধ সংঘটনের জন্য শাস্তিমূলক কিনা। সুপ্রীম কোর্ট এই পয়েন্টে নিম্নবর্ণিত উত্তর দিয়েছিলেন :
“Conspiracy to commit an offense is itself an offense and a person can be separately charged with respect to such a conspiracy. There is no analogy between section 120B and section 109 IPC There may be an element of abetment in a conspiracy; but conspiracy is something more than an abetment. Offenses created by sections 109 and 120B, IPC are quite distinct and there is no warrant for limiting the prosecution to only one element of conspiracy, that is, abetment when the allegation is that what a person did was something over and above that. Where a number of offenses are committed by several persons in pursuance of a conspiracy it is usual to charge them with those offenses as well as with the offense of conspiracy to commit those offenses.”
২৬৫. পরবর্তিকালে State of Andhra Pradesh vs Cheemalapati Ganeswara Rao, AIR 1963 SC 1850
-এই মামলায় নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল :
“The offense of conspiracy is an entirely independent offense and though other offenses are committed in pursuance of the conspiracy the liability of the conspirators for the conspiracy itself cannot disappear. In the Indian Penal Code, as originally enacted, conspiracy was not an offense. Section 120B, which makes criminal conspiracy punishable, was added by the Indian Criminal Law Amendment Act, 1913 (VIII of 1913) along with section 120A. Section 120A defines conspiracy and section 120B provides for the punishment for the offense of conspiracy. Criminal conspiracy as defined in section 120A consists of an agreement to do an illegal act or an agreement to do an act which is not illegal by illegal means. Section 120B provides that whoever is a party to a conspiracy to commit an offense punishable with death, imprisonment for life or rigorous imprisonment for a term of two
৫২৫

years or upwards shall be punishable in the same manner as if he has abetted such offense unless there was an express provision in the Code for the punishment of such conspiracy. Criminal conspiracy was, however, not an unknown thing before the amendment of the Indian Penal Code in 1913. But what the amendment did was to make that conspiracy itself punishable. The idea was to prevent the commission of crimes by, so to speak, nipping them in the bud. But it does not follow that where crimes have been committed the liability to punishment already incurred under section 120B by having entered into a criminal conspiracy is thereby wiped away. No doubt, as already stated, where offenses for committing which a conspiracy was entered into have actually been committed it may not, in the particular circumstances of a case, be desirable to charge the offender both with the conspiracy and the offenses committed in pursuance of that conspiracy. But that would be a matter ultimately within the discretion of the Court before which the trial takes place.”
২৬৬. তদনুসারে আপিলকারীদের ১২০বি ধারার অধীনেও যথাযথভাবেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সাক্ষ্য ও এই মামলায় প্রযােজ্য আইনের সার্বিক পর্যালােচনায় আমার মতামত হলাে এই যে, হাইকোর্ট বিভাগ যৌক্তিকভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, আপিলকারীরা ও অন্য আসামিরা বাসভবনে অবস্থানরত প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার ষড়যন্ত্র রচনা করেছিল এবং তাঁদের ও অন্য তিনজন নিরাপত্তা কর্মীকে হত্যার মাধ্যমে তারা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করেছিল।
২৬৭. তবে উপরােক্ত আলােচনার আলােকে আমার মতামত হলাে এই যে, আপিলকারী ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং বজলুল হুদার আইনি দণ্ড পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার পরিবর্তে পেনাল কোডের ৩০২ ধারার সাথে পঠিতব্য ১২০বি এবং ৩৪ ধারার অধীনে হওয়া উচিত ছিল এবং সুলতান শাহরিয়ারের দণ্ড পেনাল কোডের ৩০২/১২০বি ধারার অধীনে হওয়া উচিত ছিল।
২৬৮. তদনুসারে তাদের প্রতি আরােপিত দণ্ড সংশােধন করা হলাে। আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবী দণ্ড হ্রাসের প্রশ্ন উত্থাপন করে নিবেদন করেন যে, যেহেতু আপিলকারীরা দীর্ঘকাল ডেথ সেলে রয়েছে এবং এমনকি এই ডিভিশন এটি পেয়েছেন যে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ যথার্থভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রণীত অভিযােগ প্রমাণিত পেয়েছেন, সেহেতু ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলকারীদের প্রতি আরােপিত দণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে হাসকরণ করা হােক।
২৬৯. বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমান এই প্রসঙ্গে Nurul Hoque Kazi os State 7 BLC (AD) 52 মামলার একটি সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করেছেন। ২৭০. বিজ্ঞ কৌসুলি জনাব আব্দুল্লাহ-আল-মামুন নিবেদন করেছেন যে, আপিলকারীরা দীর্ঘকাল হলাে ডেথ সেলে রয়েছে। তাদের সাজা ঘােষণার পর তা কার্যকর করতে এইরূপ প্রলম্বিত বিলম্ব অমানবিক সাজা, নির্যাতনতুল্য এবং তা সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বিধৃত মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। এই অনুচ্ছেদের বিধান হলাে, কোনাে ব্যক্তিকে নির্যাতন করা যাবে না বা নিষ্ঠুর অমানবিক সাজা দেওয়া যাবে না বা
৫২৬

আচরণ করা যাবে না। মামলাসমূহে বর্ণিত নীতির আলােকে এই আপিলকারীদের প্রতি আরােপকৃত দণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হওয়ার যােগ্য।
২৭১. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এই যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, আপিল শুনানি শেষ করতে বিলম্ব রাষ্ট্রপক্ষের কোনাে অবহেলা নয়। বরং এটি প্রকৃতপক্ষে আসামি-আপিলকারীদের অবহেলার জন্য। আসামিগণসহ আপিলকারীরা পরিকল্পিতভাবে পরিণতি জেনে সজ্ঞানে নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। সেহেতু, সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে তারা কোনাে বিশেষ অনুকম্পা পেতে পারে না।
২৭২. জনাব আনিসুল হক অবশ্য এই যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আপিলকারীরা সর্বোচ্চ দণ্ড পাওয়ার যােগ্য। কারণ তারা কেবল নির্মমভাবে জাতির পিতা ও দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করেনি, তারা তিনজন নারী এবং একজন শিশুকে হত্যা করেছে। তারা তাদের কর্ম দ্বারা মানবতার বিরুদ্ধেও অপরাধ সংঘটিত করেছে। তারা দেশের সর্বমান্য পরিবারের বংশের বাতি নিভিয়ে দিয়েছে এবং তারা এই কাজ করেছে এই উদ্দেশ্যে যেন ভবিষ্যতে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নিতে না পারে। ফলে যখন কেউ এরকম চরম নৃশংস, হিংস্র এবং নারকীয় প্রক্রিয়ায় কোনাে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে এবং যখন হত্যাকাণ্ডের শিকার নিদোষ একজন শিশু বা অসহায় নারী বা সর্বজনপ্রিয় ও সম্মানিত কোনাে নেতা হন তখন চরম দণ্ডই যথাযথ প্রতিকার। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ কৌসুলি Machhi Singh os State of Punjab, (1983) 3 Supreme Court Cases 470 মামলাটি উদ্ধৃত করেছেন।
২৭৩. আমাদের নিজেদের সন্তুষ্টির জন্য আমরা হাইকোর্ট বিভাগের নথি আনিয়েছি এবং আদেশনামা পর্যালােচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, আপিলকারীরা কখনােই হাইকোর্ট বিভাগে বা আপিল বিভাগে আপিল নিষ্পত্তিতে কোনাে চেষ্টা করেনি। বরং রাষ্ট্রপক্ষই হাইকোর্ট বিভাগে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য বারবার প্রার্থনা করেছে এবং এইরূপ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ গঠন করা হয়েছিল। হাইকোর্ট বিভাগে ডেথ রেফারেন্স নিস্পত্তির পর আপিলকারীরা লিভ পিটিশন দাখিল করার পর পিটিশনগুলাে শুনানির জন্য কোনাে পদক্ষেপ নেয়নি। কেবল রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনেই লিভ পিটিশনগুলাের এবং আপিলগুলােরও শুনানি হয়েছিল। সর্বোপরি আপিলকারী বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) মামলার বিচার চলাকালে পলাতক ছিল এবং ডেথ রেফারেন্স শুনানির সময় মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) কয়েক বছর পরে বিলম্ব মার্জনার প্রার্থনাসহ লিভ পিটিশন দাখিল করেছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপক্ষের কোনাে অবহেলার কারণে বিলম্ব ঘটেনি। যেহেতু, কনডেমড প্রিজনার ডেথ রেফারেন্স এবং তাদের আপিলগুলাের শুনানির জন্য কোনাে সময়। কোনাে পদক্ষেপ নেয়নি, সেহেতু তারা কনডেমড সেলে তাদের আটককালের কারণে এটি নিবেদন করতে অধিকারী নয় যে, তারা নির্যাতন বা নিষ্ঠুরতা, অমানবিক বা অবমাননাকর সাজা বা আচরণের শিকার হয়েছে। তাছাড়া, তারা এই পয়েন্টটি কখনাে উত্থাপন করেনি। বরং, তাদের আচরণ থেকে এটি পরিষ্কার যে, তারা নিজেরাই আপিলগুলাে নিষ্পত্তিতে বিলম্ব ঘটানাের চেষ্টা করেছে।
২৭৪. ৩৬৭ ধারার উপধারা (৫) মূলত ছিল নিম্নরূপ :
“যদি কোনাে আসামি মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিযােগ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয় এবং আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনাে দণ্ড আরােপ করেন সেক্ষেত্রে আদালত তার রায়ে কারণ উল্লেখ করবেন যে, কেন তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়নি।”
৫২৭

২৭৫. এটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মৃত্যুদণ্ড প্রদান করাটা ছিল একটা নিয়ম (rule) এবং স্বল্প দণ্ড প্রদান ব্যতিক্রম (exception) যা ছিল মৃত্যুদণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে একটি বিবেচনা (discretion)। তদুপরি এই বিধান ১৯৭৯ সাল থেকে কার্যকর হওয়া Ordinance No. XLIX of 1978-এর দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, যা নিম্নরূপ :
“Section 367(5) provides that “if the accused is convicted of an offense punishable with death or, in the alternative, with imprisonment for life or imprisonment for a term of years, the Court shall in its judgment state the reasons for the sentence awarded.”
২৭৬. এই সংশােধনীর ফলাফল হলাে মৃত্যুদণ্ড বা হ্রাসকৃত সাজা প্রদানের বিষয়টি প্রতিটি মামলার ঘটনা বিবেচনায় আদালতের সতর্ক বিবেচনার উপর অর্পণ করা হয়েছে। Abul Khair os State, 44 DLR (AD) 225 মামলায় আপিল বিভাগ এই সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, সাজা বা দণ্ড হাস করার জন্য বিলম্ব নিজে কোনাে extenuating circumstances নয়। আপিল বিভাগ প্রদত্ত পর্যবেক্ষণটি নিম্নরূপ :
“Delay by itself in the execution of sentence of death is by no means an extenuating circumstance for commuting the sentence of death to imprisonment for life. There must be other circumstances of a compelling nature which together with delay will merit such commutation. We find no compelling extenuating circumstances in this case and therefore, find no ground whatsoever to interfere.”
২৭৭. ভারতে ১৯৭৩ সালে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরে ৩৬৭(৫) ধারাটি নতুনভাবে প্রণীত হয়। ধারা ৩৫৪(৩)-এ সমজাতীয় বিধান রয়েছে, যা নিম্নরূপ :
“Section 354(3) When the conviction is for a sentence punishable with death or, in the alternative, with imprisonment for life or imprisonment for a term of years, the judgment shall state the reasons for the sentence awarded, and, in case of sentence of death, the special reason for such sentence.”
২৭৮. এই নতুন বিধানের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান এখন একটি নতুন বিধি। কেবল ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ উল্লেখে মৃত্যুদণ্ড আরােপ করা যেতে পারে। Jagmohan Singh vs State of uP, AIR 1973 SC 947 মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে যে-
“A large number of murders is undoubtedly of common type. But some at least are diabolical in conception and cruel in execution. In some others where the victim is a person of high standing in the country, society is liable to be rocked to its very foundation. Such murders cannot simply be whisked away by finding alibis in the social maladjustment of the murderer. Prevalence of such crimes speaks, in opinion of many, for the inevitability of death penalty not only by way of deterrence, but as a total emphatic disapproval by the society.”
৫২৮

২৭৯. Bachan Singh vs State of Punjab, AIR 1980 SC 898 মামলায় বচ্চন সিংকে তিন ব্যক্তিকে হত্যার জন্য ৩০২ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাঞ্জাব হাইকোর্ট কর্তৃক বহাল রাখা হয়েছিল। স্পেশাল লিভের মাধ্যমে সে একটি ডিভিশন বেঞ্চে শুনানির জন্য এসেছিল। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারার অধীনে প্রাপ্ত ঘটনায় নিম্ন আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড আরােপের ‘বিশেষ কারণ ছিল কিনা তা বিবেচনার জন্য লিভ গ্রান্টেড হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্টে দ্বৈত বেঞ্চ ৩০২ ধারার অধীনে হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ডের সাজা প্রদান এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারা ৩৫৪(৩)-এ বিধৃত দণ্ড প্রদানের প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা সম্পর্কে সিদ্ধান্তের জন্য বিষয়টি একটি সাংবিধানিক বেঞ্চে প্রেরণ করেন। সুপ্রীম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রাখেন এবং নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন।
“Attuned to the legislative policy delineated insections 354(3) and 235(2) propositions (iv)(a) and (v) (b) in Jagmohan, shall have to be recast and may be stated as below: (a) The normal rule is that the offences of murder shall be punished with the sentence of life imprisonment. The Court can depart from that rule and impose the sentence of death only if there are special reasons for doing so. Such reasons must be recorded in writing before imposing the death sentence, (b) While considering the question of sentence to be imposed for the offence of murder under section 302, Penal Code, the Court must have regard to every relevant circumstance relating to the crime as well as the criminal. If the Court finds, but not otherwise, that the offense is of an exceptionally depraved and heinous character and constitutes, on account of its design and the manner of its execution, a source of grave danger to the society at large, the Court may impose the death sentence.”
২৮০. ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ক্ষেত্রে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট Nalini, 1999 5 SCC 253 মামলায় কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারা অনুসারে প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছিলেন। এই মামলায় বিচারপতি DP Wadhwa পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যে-
“Cruelty of the crime committed has known no bounds. The crime sent shock waves in the country. General elections had to be postponed. It was submitted more than once that principal perpetrators in the present case are already dead but then for the support which Nalini (A-1), Santhan (A-2), Murugan (A-3) and Ariuv (A-18) afforded for commission of the crime it could not have been committed. Each one of these four accused had a role to play. Crime was committed after previous planning and executed with extreme brutality. There were as many as two dry runs as to how to reach Rajiv Gandhi after penetrating the security cordon. A former Prime Minister of the country was targeted because this country had entered an agreement with a foreign country in exercise of its sovereign powers. Rajiv Gandhi being the head of the
৫২৯

Government at that time was signatory to the accord which was also signed by the head of the Government of Sri Lanka. The Accord had the approval of Parliament. It was not that Rajiv Gandhi had entered into the Accord in his personal capacity or for his own benefit. Though we have held that object of the conspiracy was not to commit any terrorist act or any disruptive activity, nevertheless murder of a former Prime Minister for what he did in the interest of the country was an act of exceptional depravity on the part of the accused, an unparalleled act in the annals of crimes committed in this country. In a mindless fashion not only was Rajiv Gandhi killed but along with him others died and many suffered grievous and simple injuries. It is not that intensity of the belt bomb strapped on the waist of Dhanu was not known to the conspirators as after switching on the first switch on her belt bomb Dhanu asked Sivarasan to move away. Haribabu was so keen to have pictures of the crime that he met his fate in the blast itself. We are unable to find any mitigating circumstance not (sic) to upset the award of sentence of death on the accused.”
২৮১. ইন্দিরা গান্ধী হত্যা মামলায় তথা Kehar Singh vs State AIR 1988 SC 1883 মামলায় কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারার প্রেক্ষাপটে মৃত্যুদণ্ডের মতাে চরম দণ্ড প্রদান সম্পর্কে একই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। এই মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট কেহার সিং এবং সাওয়ান্ত সিংয়ের মৃত্যুদণ্ডের সাজা বহাল রেখেছিলেন Ozha J পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যে-
“Then there is the question of a sentence which was argued to some extent. But it must be clearly understood that it is not a case where X is killed by Y on some personal ground for personal vendetta. The person killed is a lady and no less than the Prime Minister of this country who was the elected leader of the people. In our country we have adopted and accepted a system wherein change of the leader is permissible by ballot and not by bullet. The act of the accused not only takes away the life of a popular leader but also undermines our system which has been working so well for the last forty years. There is yet another serious consideration. Beant Singh and Satwant Singh are persons who were posted on the security duty of the Prime Minister. They are posted there to protect her from any intruder or from any attack from outside and therefore if they themselves resort to this kind of offense, there appears to be no reason or no mitigating circumstance for consideration on the question of sentence. Additionally, an unarmed lady was attacked by these two persons with a series of bullets and it was found that a number of bullets entered her body. The manner in which mercilessly she was attacked by these 2 persons on whom the confidence was reposed to give her
৫৩০

protection repels any consideration of reduction of sentence. In this view of the matter, even the conspirator who inspired the persons who actually acted does not deserve any leniency in the matter of sentence. In our opinion, the sentence awarded by the trial COURT and maintained by the High Court appears to be just and proper.”
২৮২. কোন কোন মামলায় মৃত্যুদণ্ড আরােপ করা যেতে পারে সেটির শ্রেণিবিভক্তির পর ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট Machhi Singh (supra) মামলায় নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“When the victim of murder is (a) an innocent child who could not have or has not provided even an excuse, much less a provocation, for murder (b) a helpless woman or a person rendered helpless by old age or infirmity (c) when the victim is a person vis-a-vis whom the murderer is in a position of domination or trust (d) when the victim is a public figure generally loved and respected by the community for the services rendered by him and the murder
is committed for political or similar reasons other than personal reasons.”
২৮৩. জনাব মামুন কর্তৃক উদ্ধৃত Pratt-এর মামলায় প্রতীয়মান হয় যে, জ্যামাইকায় বিদ্যমান বিধি অনুসারে প্রিভি কাউন্সিলের জুডিশিয়াল কমিটিতে আপিল দায়েরের জন্য একটি কঠোর সময়সীমা রয়েছে এবং সেখানে এই বিধানও রয়েছে যে, ঐ সময়সীমা কালে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর স্থগিত থাকবে। ঐ মামলায় আরাে কিছু বিষয় (প্লি) উত্থাপিত হয়েছিল। প্রিভি কাউন্সিল তাদের ঐ সকল প্লি গ্রহণ করেছিলেন এবং নিম্নবর্ণিত কারণ উল্লেখে তাদের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে হ্রাস বা পরিবর্তন করেছিলেন :
“Prolonged delay in carrying out a sentence of death after that sentence had been passed could amount to inhuman…punishment or other treatment contrary to section 17(1) of the Jamaican Constitution irrespective of whether the delay was caused by the shortcomings of the state or the legitimate resort of the accused to all available appellate procedures. A state that wished to retain capital punishment had to accept the responsibility of ensuring that execution followed as swiftly as practicable after sentence, allowing a reasonable time for appeal and consideration of reprieve and, if the appellate procedure enabled the prisoner to prolong the appellate hearings over a period of years, the fault was to be attributed to the appellate system that permitted such delay and not to the prisoner who took advantage of it.”
২৮৪. Henfield-এর মামলায় প্রিভি কাউন্সিল Pratt-এর মামলায় বর্ণিত নীতিগুলাে অনুসরণ করেন এবং আবেদন গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা প্রদান করে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“They therefore reviewed the relevant considerations, at pp. 34-35, and concluded that in any case in which execution was to take place more than five
৫৩১

years after sentence there would be strong grounds for believing that the delay was such that execution thereafter would constitute inhuman punishment contrary to section 17(1).”
২৮৫. Guerra-এর মামলায় প্রিভি কাউন্সিল Pratt-এর মামলায় গৃহীত নীতিগুলাে অনুসরণ করেন এবং নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“Where a person was sentenced to death in a common law jurisdiction, execution was required to be carried out by the state as swiftly as practicable after sentence, allowing a reasonable time for appeal and consideration of reprieve, since under the common law a long-delayed execution was not in accordance with the due process of law. In Trinidad and Tobago such an execution, if not stayed, would constitute a cruel and unusual punishment contrary to section 5(2)(b) of the Constitution and would not be in accordance with the due process of law under section 4(a) of the Constitution.” It thus appears that the principles laid down in the above decisions are not applicable in the present case, applying the principles of due process of law as applicable in a common law jurisdiction is not applicable to our legal judicial system since we have codified laws on the subject and (2) there are uniform decisions of our Superior Court that mere delay is not a legal ground for commutation of a sentence.”
২৮৬. প্রতীয়মান হয় যে, উপরে বর্ণিত সিদ্ধান্তগুলােয় দেওয়া নীতিগুলাে বর্তমান মামলাগুলাের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। কমন ল জুরিসডিকশনে প্রযােজ্য ডিউ প্রসেস অব ল-এর নীতি আমাদের বিচারব্যবস্থায় প্রযােজ্য নয়। যেহেতু সংশ্লিষ্ট আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং আমাদের উচ্চ আদালতের অভিন্ন সিদ্ধান্ত রয়েছে, সেহেতু দণ্ডাদেশ বা সাজা পরিবর্তন করার জন্য কেবল বিলম্ব কোনাে আইনানুগ যুক্তি নয়।
২৮৭. তদনুসারে, আমি মনে করি যে, আপিলকারীগণসহ আসামিরা পরিকল্পিতভাবে পরিণতি জেনে সজ্ঞানে বর্বর অপরাধ সংঘটিত করেছে এবং সেহেতু দণ্ড প্রদানের বিষয়ে তারা বিশেষ কোনাে সহানুভূতি পেতে পারে না। অতএব, আমি আপিলগুলােতে কোনাে মেরিট পাই না এবং তদনুসারে আপিলগুলাে ইতােমধ্যে বর্ণিত পরিবর্তনসহ (মােডিফিকেশন) খারিজ (ডিসমিসড) করা হলাে। বিচারপতি মােঃ আব্দুল আজিজ আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি তফাজ্জল ইসলাম প্রদত্ত রায়, যেখানে ঘটনার গুণাগুণ, সাক্ষ্য, আইন ও কেস ল আলােচিত হয়েছে তা আমি পড়েছি এবং আমি এর সাথে সম্পূর্ণ একমত। আমি আমার বিজ্ঞ ভ্রাতাবৃন্দ বিচারপতি জনাব মােঃ মােজাম্মেল হােসেন ও বিচারপতি জনাব সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রদত্ত পর্যবেক্ষণসমূহের সাথেও একমত।
২৮৯, আমার বিজ্ঞ ভ্রাতাবৃন্দের সাথে একমত হয়ে মামলায় প্রকাশিত ঘটনা ও অবস্থাদি এবং কৌসুলিগণের নিবেদন এবং হত্যার শিকার প্রেসিডেন্টের দুই ভগ্ন হৃদয়ের কন্যার অবর্ণনীয় কষ্ট ও বেদনা এবং ১৯৭৫ সাল থেকে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড সংঘটনকারীদের বিচারের আওতায় আনতে না পারার সমগ্র জাতির লজ্জার পরিপ্রেক্ষিতে আমি কিছু যুক্ত করার সুযােগ নিচ্ছি।
৫৩২

২৯০. নিরীহ নিরস্ত্র ব্যক্তি এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করা ইসলাম ধর্মে একটি মহাপাপ এবং অন্য ধর্মেও তা সভ্যতা ও মানবতার বিরুদ্ধে একটি বড় অপরাধ। ইসলাম ধর্মে হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড একমাত্র সাজা। অন্য ধর্মগুলােতেও এবং ফৌজদারি আইনে কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ছাড়া অনুরূপ
সাজার বিধান রয়েছে।
২৯১. আপিলকারীদের বিজ্ঞ কৌসুলিগণ দণ্ডপ্রাপ্ত আপিলকারী লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার এই তিনজনের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিসহ নথিতে থাকা ঘটনাদি, সাক্ষ্য ও তথ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
২৯২. বর্তমান মামলায় দেখা যায়, দণ্ডপ্রাপ্তরা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে (ফজর নামাজের সময়) প্রজাতন্ত্রের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট, জাতির পিতা এবং প্রজাতন্ত্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তাদের ৩ (তিন) পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং ৯-১০ বছর বয়সী কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, শেখ কামাল ও শেখ জামালের স্ত্রীদের এবং প্রেসিডেন্টের ভ্রাতা শেখ নাসের রহমান, অন্যদের এবং নিরাপত্তা অফিসার সহ ১১ (এগারাে) ব্যক্তিকে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর রােডে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
২৯৩. রেসপন্ডেন্ট পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর জনাব আনিসুল হক এইরূপ নিরস্ত্র ব্যক্তি, নারী এবং শিশুকে কোনাে প্ররােচনাহীনভাবে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে দানবিক ও বর্বর বলে অভিহিত করেছেন, যা সভ্যতার জানা নেই এবং যা মানব ইতিহাসে বিরল।
২৯৪. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব মাহবুবে আলম এই ঘটনাকে বেদনাদায়ক ও অমানবিক বলে অভিহিত করেছেন (তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন যখন তিনি শেখ রাসেল হত্যার সাক্ষ্য তুলে ধরছিলেন)। জনাব আজমালুল হােসেন কিউ. সি. এটিকে horrendous killing হিসেবে বর্ণনা করছেন। সিনিয়র আইনজীবী জনাব তৌফিক নেওয়াজ, সিনিয়র আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী জনাব আবদুল মতিন খসরু, সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রীম কোর্ট বার অ্যাসােসিয়েশনের সাবেক সভাপতি জনাব এএফএম মেসবাহউদ্দিন আহমেদ সর্বোচ্চ বার এবং দেশের সকল বারের পক্ষে দু চোখে অশ্রু ঝরিয়ে ঘটনাটিকে বেদনাদায়ক, নির্মম ও নিষ্ঠুর হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এটি করতে গিয়ে তাঁরা ইয়াজিদের পিশাচ বাহিনীর হাতে সংঘটিত কারবালা হত্যাযজ্ঞের’ কথাটি মনে করিয়ে দেন। দণ্ডপ্রাপ্তরা কীভাবে ঘটনা সংঘটিত করেছিল এবং কীভাবে অপরাধীরা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারগুলাের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় সুরক্ষিত হয়েছিল, আশ্রয় পেয়েছিল, পুরস্কৃত হয়েছিল- সে মর্মে নথিতে থাকা সাক্ষ্য তুলে ধরে তারা (বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ) সকলেই বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ঘটনা বর্ণনাপূর্বক বিচার প্রার্থনা করেছেন।
২৯৫. রেসপন্ডেন্ট পক্ষের বিজ্ঞ কৌসুলিগণ নথিতে থাকা সাক্ষ্য ও তথ্যাদির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন করেন যে, দণ্ডিত অপরাধীরা সময়ে সময়ে তদানীন্তন মন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, ডেপুটি চিফ অব আর্মি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যিনি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সেনাপ্রধান হয়েছিলেন ও পরবর্তীকালে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও এরপর প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতা দখল করেছিলেন তাদের সাথে মিলিত হয়ে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আলােচনা করেছিল। এসব থেকে উঠে এসেছে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুব সকালে কর্নেল সাফায়েত জামিলের কাছ থেকে প্রেসিডেন্ট হত্যার কথা শুনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতিক্রিয়া, স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের একজন পুলিশ
৫৩৩

অফিসার কীভাবে পি.ডব্লিউ-১ এএফএম মহিতুল ইসলামকে নাটকীয় ভাষায় তার এফআইআর গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে তাঁর জীবন ও চাকরির প্রতি হুমকি দিয়ে তাঁকে বের করে দিয়েছিল। এসবই বাস্তবে হয়েছিল খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, যিনি ঘটনার পর প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তার কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারির অব্যবহিত পর। অপরাধীদের ১৯৭৫-এর ৪ নভেম্বরে তার/মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ কর্তৃক বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীর তফশিলে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক এবং পরবর্তীকালে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ কর্তৃক ও এরপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতায় তাদেরকে (অপরাধীদের) বাংলাদেশের বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। তারা (রেসপন্ডেন্ট পক্ষের বিজ্ঞ কৌসুলিবৃন্দ) প্রশ্ন রাখেন- ঐরূপ বর্বর গণহত্যার বিচারের পরিবর্তে কীভাবে রাষ্ট্র তাদের রক্ষাকারীর ভূমিকা রেখেছিল, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র এবং পাবলিক এক্সচেকার ব্যবহার করে কীভাবে জাতির আবেগের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের বিচারের আওতায় না এনে কুখ্যাত অপরাধীদের আশ্রয় ও চাকুরি দিয়েছিল, যা আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে অবমাননা করেছে।
২৯৬. সিনিয়র কৌঁসুলি জনাব আজমালুল হােসেন কিউ.সি তীব্রভাবে সরকার তথা রাষ্ট্রের ভূমিকা তুলে ধরেন। জনগণের অভিভাবক হিসেবে যার দায়িত্ব নাগরিকদের অধিকার, স্বাধীনতা এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষিত ও নিরাপদ রাখা। কিন্তু প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধানস্বীকৃত নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা ছিনতাই করেছিলেন। বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারির পর তা রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বর্বর অপরাধীদের বিচারের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিতে ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি (কৌসুলি) আরাে বলেন যে, তৎকালীন সরকার অপরাধীদের সুরক্ষাকারীর ভূমিকা নিয়েছিল, তাদের বিচার করার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে, যা ছিল বিচারব্যবস্থা ও আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় ধরনের ব্যর্থতা।
২৯৭. জনাব হােসেন আরাে নিবেদন করেছেন যে, দলীয় কার্যক্রম দ্বারা সংবিধান রুদ্ধ করা হয়েছিল; যদিও সামরিক আইন কোনাে আইন নয়, এটি এক জংলি আইন। আমাদের সুপ্রীম কোর্ট সামরিক আইনকে ‘পূর্বোক্ত সংবিধান হিসেবে অভিহিত করেছেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি যিনি একজন নাগরিক তাকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করা হয়েছিল, যিনি পরবর্তীকালে ছিনতাইকারীর শপথ পরিচালনায় বাধ্য হয়েছিলেন, যিনি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিলেন।
২৯৮. রেসপন্ডেন্ট পক্ষে বিজ্ঞ কৌসুলি জনাব আনিসুল হক গভীর দুঃখের সাথে এটি উল্লেখ করেছেন যে, বিচার পাওয়ার জন্য ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা দেখার জন্য দণ্ডিত আসামিদের দায়েরকৃত আপিলগুলাে দ্রুত শুনানির লক্ষ্যে প্রসিকিউশন বিফলভাবে গভীর বেদনা, উদ্বেগ ও অসম্মান নিয়ে হাইকোর্ট ডিভিশনের এই কোর্ট থেকে ঐ কোর্টে ঘুরেছেন। কিন্তু বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ শুনানি করতে অস্বীকার করেছেন বিব্রত বােধ করে, কী কারণে তা তারাই ভালাে জানতেন। তিনি (বিজ্ঞ কৌসুলি) এটি বলে শেষ করেন যে, কোনাে ভীতি ছাড়া ও পক্ষ অবলম্বন না করে বিচার করার শপথ নেওয়া বিজ্ঞ বিচারকদের এই মামলায় ঐরূপ দৃষ্টিভঙ্গি ভবিষ্যতে অবশ্যই আর কোনাে মামলায় যেন পুনারবৃত্তি না ঘটে, কোড অব কন্ডাক্ট-এ বিধৃত কারণে। আপিলকারীদের বিজ্ঞ কৌসুলিবৃন্দ এই সুযােগ নিয়েছিলেন এবং বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দের বিব্রত হওয়ার কারণে আপিলগুলাে শুনানিতে বিলম্ব হওয়ায় কনডেমড সেলে আপিলকারীদের প্রলম্বিত অবস্থানের কারণে দণ্ডিতদের প্রতি আরােপকৃত মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তনের যুক্তি নিয়েছেন।
৫৩৪

২৯৯. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সাক্ষ্যে পাওয়া নির্মমতার গভীরতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিবেদন করেন যে, যখন ক্রন্দনরত রাসেল তার মায়ের কোলে ফিরে যেতে চেয়েছিল, যখন জখমপ্রাপ্ত নাসের বাথরুমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন ও পানির জন্য কাঁদছিলেন, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব যখন তাঁর স্বামী বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়িতে রক্তের মাঝে মৃত পড়ে থাকতে দেখেন এবং কেঁদে কেঁদে তাকেও মেরে ফেলতে বলেন তখন নরপিশাচরা সব বর্বরতার সীমা ছাড়িয়ে কারবালার নরপিশাচ ইয়াজিদের মতাে পৈশাচিক বলপ্রয়ােগে বুলেটে ঝাঁঝরা করে তাদের সবাইকে নীরব করে দিয়েছিল।
৩০০. জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন যে, তৎকালীন সরকার ঐ অপরাধীদের কেবল প্রশ্রয় দেয়নি, লে. কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমানকে দেশে ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের এবং দৈনিক মিল্লাত’ নামে একটি জাতীয় দৈনিক প্রকাশের, সাধারণ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও অনুমতি দিয়েছিল। মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব.) খােন্দকার আব্দুর রশিদকে ১৯৯৬-এর সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল এবং তারা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল এবং খােন্দকার রশিদকে বিরােধীদলীয় নেতা করা হয়েছিল, জনগণের ঘৃণা ও বিরােধিতা সত্ত্বেও। তিনি নিবেদন করেন যে, এটি কেবল কোনাে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনা ছিল না, অপরাধীরা চেয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ, মূল্যবােধ ও অর্জনকে হত্যা করতে।
৩০১. জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল আরাে বলেন যে, বর্বর অপরাধীরা, যাদের আইন ও বিচারের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা নেই, তারা কোনাে ক্ষমা বা অনুকম্পা কোনােটিই পাওয়ার যােগ্য নয়, এবং অন্য কোনাে দেশ, যাদের আইন ও বিচারের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা নেই সেখানে অর্থাৎ কোনাে মুসলিম দেশ যেটি ইসলাম ও মানবতার বড় শত্রু সেখানে আশ্রয় নেওয়ারও যােগ্য নয়।
৩০২. জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল এটি নিশ্চিত করতে জোরালােভাবে নিবেদন করেছেন যে, ভবিষ্যতে কোনাে বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি কোনাে শক্তি বা চাপের কাছে যেন নতি স্বীকার না করেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ গ্রহণ না করেন বা বিচার বিভাগের অমর্যাদা করে কোনাে ক্ষমতা দখলকারীর শপথ পরিচালনা না করেন। আমরা রেসপন্ডেন্ট পক্ষের বিজ্ঞ কৌসুলিগণকে শ্রবণ করেছি। তাঁদের নিবেদন বিবেচনার দাবি রাখে।
৩০৩. হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিক ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট খুব প্রত্যুষে (ফজর নামাজের সময়) তৎকালীন লালবাগ থানা ও বর্তমান ধানমন্ডি থানাধীন রােড ৩২, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দাপ্ত/* রিক বাসভবনে। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা সেখানে তদানীন্তন প্রেসিডেন্টের ১১ (এগারাে) জনকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। প্রেসিডেন্টের দুই কন্যা শেখ হাসিনা, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বােন শেখ রেহানা ঐ সময় বিদেশে অবস্থান করায় সৌভাগ্যক্রমে মৃত্যু থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, তাঁরা রাতারাতি এতিম হয়ে পড়েন।
৩০৪. নথিতে থাকা সাক্ষ্য ও তথ্যাদি থেকে দেখা যায় যে, দণ্ডিত আসামিরা ব্যক্তিগত অর্জন ও স্বার্থে নিরস্ত্র প্রেসিডেন্ট, তাঁর স্ত্রী, ভাই এবং তিন পুত্র ও তাদের স্ত্রীদের কোনাে প্ররােচনা ও প্রতিরােধ ছাড়া হত্যা করেছিল। পি.ডব্লিউ জনাব মহিতুল ইসলাম, প্রেসিডেন্টের তৎকালীন পি.এ, গুলিবর্ষণে শরীরে জখমপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করে লালবাগ পুলিশ স্টেশনে যান ঘটনার বিষয়ে এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) দায়ের করতে। কিন্তু পুলিশ অফিসার হত্যাকাণ্ডের তথ্য রেকর্ড করার পরিবর্তে তাকে বের করে দিয়েছিল।
৫৩৫
৩০৫. হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব সরকারের একজন মন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হন। তিনি ২৬.৯.১৯৭৫ তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেন। এরপর দ্রুত দেশের পট পরিবর্তিত হয়েছিল। সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল, দণ্ডিত আসামিদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে অপসারণ করা হয়, জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান এবং পরবর্তীকালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও এরপর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এরপর জেনারেল এইচ এম এরশাদ প্রেসিডেন্ট হন, ১৯৯০-এ গণঅভ্যুত্থানে অপসারিত হওয়া পর্যন্ত। ২৩.৪.১৯৭৭ তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কর্তৃক আদেশ নং-১, ১৯৭৭ জারি করা হয় এবং সংবিধানের পরবর্তী পঞ্চম তফশিলে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দণ্ডিত আসামিদেরসহ দুষ্কৃতকারীদের সব হত্যাকাণ্ড এবং তাদের কৃত সব কর্ম ও অপরাধের বিচার থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। দণ্ডিত আসামিদের বাংলাদেশের বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।
৩০৬. ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের শেষে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর পি.ডব্লিউ-১ জনাব মহিতুল ইসলাম বর্তমান এফআইআর দায়ের করেন যার ভিত্তিতে ধানমন্ডি পুলিশ স্টেশন কেস নং- ১০(১০) ১৯৯৬ তারিখ- ০২.১০.১৯৯৬ শুরু হয়। সরকার সংসদে একটি বিল উত্থাপন করে এবং ২৬.৯.১৯৭৬ তারিখে জারিকৃত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ বাতিল করে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স রিপিলিং অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নম্বর-২১), ১৯৯৬ তারিখ ১৪.১১.১৯৯৬-এর মাধ্যমে। দণ্ডিত আসামি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান (তার মায়ের মাধ্যমে) এবং লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার খান যথাক্রমে ১৯৯৬ সালের রিট আবেদন নম্বর-৫৩১৩ এবং ১৯৯৬ সালের রিট আবেদন নম্বর-৫৩২১ দায়ের করে Repealing Act চ্যালেঞ্জ করে এবং ধানমন্ডি থানার কেস ও লালবাগ থানা পুলিশ স্টেশন কেস নম্বর- ১১(১১), ১৯৭৫ তারিখ ০৪.১১.১৯৭৫ হাইকোর্ট ডিভিশনে চ্যালেঞ্জ করে এবং অ্যাপিলেট ডিভিশনে চ্যালেঞ্জ করে যথাক্রমে সিভিল আপিল নম্বর-১৮/১৯৯৭ এবং সিভিল আপিল নম্বর-১৯/১৯৯৭ দায়ের করে ব্যর্থ হয়েছিল। রিট আবেদনগুলােয় হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ বাতিল করে Indemnity Repeal Act being Act No. 21 of 1996 বহালপূর্বক প্রদত্ত রায় ও আদেশ এই ডিভিশন বহাল রাখেন (সূত্র: 49 DLR 133 Ges 1998 BLD (AD) 155]। এরপর বর্তমান মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। দণ্ডিত আসামিরাসহ ২০ জন চার্জশিটভুক্ত আসামিদের বিচারে (১৫ জন) পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারা তৎসহ ১২০বি ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল এবং বিজ্ঞ দায়রা জজ কর্তৃক দায়রা মামলা নম্বর-৩১৯/১৯৯৭- এ ০৮.১১.১৯৮ তারিখে প্রদত্ত রায়ে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয় লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দীন (আর্টিলারি)-এর উপস্থিতিতে এবং বাকি আসামিদের অনুপস্থিতিতে। তিনি (দায়রা জজ) অনুমােদনের জন্য হাইকোর্ট ডিভিশনে ডেথ রেফারেন্স নম্বর-৩০/১৯৯৮ প্রেরণ করেন। বিচারের সম্মুখীন হওয়া বর্ণিত ৩ (তিন) দণ্ডিত আসামি ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনে আপিল দায়ের করে।
৩০৭. সংক্ষেপে উপরােক্ত ঘটনাদি যা মানবিক মূল্যবােধ, নৈতিকতা, অধিকার ও স্বাধীনতা, আইনশৃঙ্খলা ধ্বংসের এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারির কারণে ডিউ প্রসেস অব ল-এর মাধ্যমে নাগরিকের বিচার পাওয়ার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত অধিকারকে প্রতিরােধ ও বঞ্চিত করার এক বিস্ময়কর চিত্র। সভ্য সমাজের কাছে এটি কেবল অশ্রুত ও অপ্রত্যাশিত ছিল না, বরং ছিল অচিন্ত্যনীয় যে, সরকার
৫৩৬

সংবিধান প্রয়ােগকারী হিসেবে এবং নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতার, দেশের আইনশৃঙ্খলার অভিভাবক হিসেবে নাগরিকের বিচারপ্রাপ্তিতে সহায়তা করতে বাধ্য থাকলেও এর পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র এবং জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ বেআইনিভাবে ও কোনাে কর্তৃত্ব ছাড়া অপব্যবহার করে তাদের নিজেদের স্বার্থ ও রাজকীয় উচ্চাশা পূরণে অপরাধীদের সুরক্ষা, পুনর্বাসন ও প্রশ্রয় দেয়।
৩০৮. বিচার প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করা মানুষের মাঝে প্রতিবাদ সৃষ্টি করে যা অবশেষে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলে। বিজ্ঞ বিচারকদের বিব্রত হওয়ার কারণে বিচার প্রদানে বিলম্বও লজ্জাজনক এবং তা একই সময়ে বিচার বিভাগের জন্য সার্বিকভাবে অসম্মানজনক যা ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যকে হতাশ করে এবং বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাকে হালকা করে; অমানবিক পরিবেশের এবং বিচার বিভাগের প্রতি তাদের আস্থাকে নষ্ট করার ধারণা সৃষ্টি করে, যার ভয়াবহ পরিণতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ক্ষতিকর।
৩০৯. এটি লজ্জাজনক যে, আমরা ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না সুবিধাবাদী সরকারের ঐরূপ বিশ্বাসঘাতকতা, অনৈতিকতা
এবং কর্তৃত্বহীন কর্মকাণ্ডের ও গভর্নমেন্ট মেশিনারিজের অপব্যবহারের সমালােচনা করতে, নিন্দা জানাতে। স্বজন হারানাে কোনাে পরিবারের বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। উচিত নয় কয়েক দশক ধরে বেদনা, নিপীড়ন ও অসম্মান নিয়ে বিচার প্রার্থনায় তাদের ছুটতে হবে কালাে আইনের আবরণে সরকারি বাধার বিরুদ্ধে। এমনকি কোনাে বিজ্ঞ বিচারক তার শপথের প্রতি অনুগত থেকে, কোনাে ভীতি ও পক্ষপাত থেকে দূরে থেকে আচরণবিধির বাইরে গিয়ে বিচার সম্পন্ন করতে বিব্রত বােধ করা উচিত নয়। সরকারের ঐরূপ কর্মকাণ্ড চূড়ান্তভাবে দায়িত্বহীন, দুঃখজনক, অমর্যাদাকর এবং লজ্জাজনক, কেবল জাতির জন্য নয়, বিশ্বের সভ্য সম্প্রদায়ের জন্যও, যা আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তির হানি করেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করতে এবং বিশ্বাস করতে চাই যে, বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ তাদের নীতিহীন ভূমিকার পুনরাবৃত্তিতে জড়িত হবেন না এবং সরকারি ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং আইন ব্যবহার করে সরকার পর্যায়ে কোনাে বর্বর অনৈতিক কাজের পুনরাবৃত্তি যেন না হয়।
৩১০. জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল এই বলে শেষ করেন যে, জনগণের এটি জানার সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে যে, কীভাবে এবং কোন ক্ষমতাবলে দণ্ডিত আসামিদের ঐরূপ পৈশাচিক অপরাধসমূহ সংঘটনের পর ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে সুবিধাভােগী সরকার সুরক্ষা দিয়েছিল ও পৃষ্ঠপােষকতা করেছিল, দেশের ও পাবলিক এক্সচেকারের সুনামের বিনিময়ে।
৩১১. বর্তমান মামলার পরিপ্রেক্ষিতে, এটি বলা বাহুল্য, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের নিবেদন নিয়ে কথা বলা আমাদের জন্য কঠিন। কিন্তু আমরা একমত যে, প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের জানার অধিকার রয়েছে কীভাবে এবং কোন ক্ষমতাবলে সরকার অপরাধীদের বিচারের পরিবর্তে তাদের সুরক্ষা দিতে, আশ্রয় দিতে ও পুনর্বাসিত করতে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ সরকার কর্তৃক ব্যয় করা হয়েছিল।
৩১২. তারপরও স্বৈরাচার ও অবিশ্বস্ত সরকারের অপকর্ম ও পৈশাচিক শক্তির চেয়ে আইনের হাত অনেক বেশি লম্বা ও শক্তিশালী। বর্তমান মামলায় এটি প্রতিভাত হয়েছে যে, বিলম্বিত বিচার সবসময় বিচারকে অস্বীকতি নয়, বরং বিচার প্রতিকার প্রার্থীর প্রাপ্য। এই দেশের জনগণের প্রতি আমাদের উচ্চ সম্মান। রয়েছে। তারা সবসময় গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অধিকার ও সংস্কৃতি বহাল রাখতে সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে উচ্চকিত কষ্ট ও প্রতিকূলতার মাঝেও গণতান্ত্রিক চেতনা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। আমরা বিশ্বাস করি যে, সরকারকে জবাবদিহিতায় রাখতে জনগণ তাদের গণতন্ত্রের অগ্রসেনার ভূমিকা অব্যাহত রাখবে।
৫৩৭

৩১৩. স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন ও ভালােবাসেন এবং তাদের সাফল্য প্রদান করেন। একজন হত্যাকারী সবসময়ই একজন হত্যাকারী এবং একজন সন্ত্রাসী সবসময়ই সন্ত্রাসী এবং মানবকূল ও মানবতার শত্রু এবং আইনের দৃষ্টিতে একজন অপরাধী। ঐরূপ কোনাে হত্যাকারীকে সুরক্ষা ও আশ্রয় দেওয়াটা একটা বড় অপরাধ, একটা বড় পাপ এবং পাপ কাউকে ছাড়ে না।

বিচারপতি বি কে দাস
আমি আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি মােঃ তফাজ্জল হােসেন প্রদত্ত রায় ও আদেশের সাথে একমত।

বিচারপতি মােঃ মােজম্মেল হােসেন
আমি আসামি আপিলকারীগণ কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগের ডেথ রেফারেন্স নম্বর ৩০/১৯৯৮ এবং এতদসঙ্গে ১৯৯৮ সালের ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬০৪, ২৬১৩, ১৬১৬ এবং ২৬১৭-এ এবং ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ৪৩৪/২০০৭-এ আসামি আপিলকারীদের বিরুদ্ধে বিজ্ঞ দায়রা জজ কর্তৃক ০৮.১১.১৯৯৮ তারিখে দায়রা মামলা নম্বর ৩১৯/১৯৯৭-এ পেনাল কোড, ১৮৬০-এর ৩০২, ৩৪ এবং ১০২বি ধারার অধীনে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহালপূর্বক প্রদত্ত রায়ের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ৫৫-৫৯/২০০৭-এ আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি মােঃ তফাজ্জল হােসেন প্রদত্ত রায় ও আদেশ পড়েছি। আমি মামলায় গুরুত্বপূর্ণ আইনের কিছু প্রশ্ন সম্পর্কে, যেগুলাের সুদূরপ্রসারী পরিণতি রয়েছে সেগুলাে নিয়ে আমার চিন্তা ও মত প্রদান করছি।
৩১৬. ইতােমধ্যে আমরা আপিল খারিজ করে সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদান করেছি যা রায়ের অংশ।
৩১৭. যেহেতু, আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা তাঁর প্রদত্ত রায় ও আদেশে মামলার ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, আমি সেগুলাের পুনারবৃত্তি করছি না। বর্ণিত আপিলগুলাের উদ্ভব হয়েছে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ধানমন্ডি রােড নম্বর ৩২-এর ৬৭৭ নম্বর রাষ্ট্রপতির বাসভবনে রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নারকীয় ও বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে। এজাহারকারী পি.ডব্লিউ-১ যিনি ঘটনার সময় রাষ্ট্রপতির বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন, তিনি ০২.১০.১৯৯৫ তারিখে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) দায়ের করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে বর্তমান আপিলকারীগণসহ ২০ (বিশ) জন আসামির বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২/১২০বি /৩২৪/৩০৭/২০১/ ৩৮০/১৪৯/৩৪/১০৯ ধারার অধীনে চার্জশীট দাখিল করেন। বিজ্ঞ দায়রা জজ, ঢাকা ০৭.০৪.১৯৯৭ তারিখের ১৫ নম্বর আদেশ প্রদানের মাধ্যমে ২০ (বিশ) জন আসামির বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১২০বি, ৩০২, ৩৪ এবং ২০১ ধারার অধীনে অভিযােগ গঠন করেন। আসামি জুবাইদা রশিদ হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ক্রিমিনাল রিভিশন মামলার অনুবলে অব্যাহতি পেয়েছিল। সে মােতাবেক আপিলকারীগণসহ ১৯ (উনিশ) আসামি বিচারের সম্মুখীন হয়। বিচারকালে সর্বমােট একষট্টি জন সাক্ষীকে পরীক্ষা করা হয়েছিল। ডিফেন্স কর্তৃক কোনাে সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হয়নি। অতঃপর বিচারিক আদালত তার প্রদত্ত ০৮.১১.১৯৯৮ তারিখের রায় ও আদেশে আপিলকারীগণসহ ১৫ (পনের) আসামিকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪/১২০বি ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ৪ (চার) জন আসামিকে খালাস প্রদান করেন। আপিলকারীগণসহ বর্ণিত ১৫ (পনের) জনকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। বিজ্ঞ দায়রা জজ, ঢাকা আসামি-আপিলকারীদেরসহ পনেরজনকে পেনাল কোডের ১২০বি ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করলেও এজন্য কোনাে পৃথক দণ্ড আরােপ করা হয়নি।
৫৩৮

৩১৮. বিজ্ঞ দায়রা জজ, ঢাকা কর্তৃক ০৮.১১.১৯৯৮ তারিখে প্রদত্ত রায় এবং দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগে দণ্ডিত আপিলকারী লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬০৪/১৯৯৮; মেজর মােঃ বজলুল হুদা ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬১৩/১৯৯৮; লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬১৬/১৯৯৮; লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) ক্রিমিনাল আপিল নম্বর২৬১৭/১৯৯৮ এবং মেজর (অব) একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ৪৩৪/২০০৭ দায়ের করে।
৩১৯, অতঃপর বিচারপতি মােঃ রুহুল আমীন এবং বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সমন্বয়ে গঠিত মাননীয় হাইকোর্ট ডিভিশন একত্রে ডেথ রেফারেন্স নম্বর ৩০/১৯৯৮ এবং বর্ণিত পাঁচটি ক্রিমিনাল আপিল শুনানি করেন। ডিভিশন বেঞ্চ বর্তমান আপিলকারীগণসহ ১৫ (পনের) জন আসামিকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ড সম্পর্কে রায় ও আদেশ প্রদান বিষয়ে বিভক্ত মতামত প্রদান করেন। হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ প্রথম বিচারক বিচারপতি মােঃ রুহুল আমীন চার দণ্ডিত আপিলকারী, যথা লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর মােঃ বজলুল হুদা এবং মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং অন্য পাচ দণ্ডিত, তথা লে. কর্নেল আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল শরি ডালিম, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল এসএইএ মবিনুর চৌধুরী এবং লে. কর্নেল মােঃ আজিজ পাশা সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করেন। আপিলকারী লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (অব) কর্তৃক দাখিলকৃত ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬০৪/১৯৯৮, আপিলকারী মেজর মােঃ বজলুল হুদা কর্তৃক দায়েরকৃত ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬১৩/১৯৯৮ এবং আপিলকারী লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান কর্তৃক দায়েরকৃত ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬১৬/১৯৯৮ খারিজ করা হয়েছে। বর্ণিত চার আপিলকারীসহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ৯ (নয়) জনকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ এবং ১২০বি ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখা হয় এবং বিজ্ঞ দায়রা জজ কর্তৃক পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে প্রদত্ত দণ্ড হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ প্রথম বিচারক কর্তৃক বহাল রাখা হয় এবং এভাবে বিজ্ঞ দায়রা জজ প্রদত্ত রায় ও আদেশ বহাল রাখা হয়। ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে পেনাল কোডের ৩০২, ৩৪ এবং ১২০ বি ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্তকরণ ও প্রদত্ত দণ্ডের বিষয়টি বিজ্ঞ প্রথম বিচারক সংশােধন করে পেনাল কোডের ১২০বি ধারার অধীনে তাকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, যেহেতু সে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার ছিল। কিন্তু পেনাল কোডের ৩০২ এবং ৩৪ ধারার অধীনে তাকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ড প্রদান রদ করা হয়। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক আপিলকারী লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স খারিজ করেছেন এবং তার দায়েরকৃত ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬১৭/১৯৯৮ মঞ্জুর করেছেন এবং তার বিষয়ে বিজ্ঞ দায়রা জজ কর্তৃক প্রদত্ত দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ রদ করেছেন। তদনুসারে, হাইকোর্ট ডিভিশনের প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এই পাঁচ দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিসম্পর্কিত বিজ্ঞ দায়রা জজ প্রদত্ত রায় ও আদেশ রদ করেছেন।
৩২০. ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বর্তমান আপিলকারীগণসহ সকল ১৫ (পনের) আসামির ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করেছেন এবং ১৫ (পনের) আসামীকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ সম্পর্কে প্রদত্ত রায় ও আদেশ বহাল রেখেছেন এবং বর্ণিত আপিলগুলাে খারিজ করেছেন।
৩২১. হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ প্রদত্ত উপরােক্ত বিভক্ত মতামতের আলােকে মামলাগুলাে তাঁদের মতামতসহ কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার অধীনে হাইকোর্ট বিভাগের তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক বিচারপতি ফজলুল করিম সমীপে প্রেরিত হয়। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক বর্ণিত ছয় আসামিসংশ্লিষ্ট
৫৩৯

ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য গ্রহণ করেছিলেন, সেই সব বিষয়ে যেগুলাে সম্পর্কে ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ তাঁদের মতামত প্রদানে বিভক্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ, ঐ ৬ (ছয়) আসামি, যারা দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞ প্রথম বিচারক কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হয়নি। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক ৩০.০৪.২০০১ তারিখে প্রদত্ত তাঁর রায় ও আদেশ দ্বারা লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ এবং রিসালদার মােসলেমউদ্দিন ওরফে মােসলেহউদ্দিন-সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স সম্পর্কে বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারকের প্রদত্ত মতামত গ্রহণ করেন এবং আপিলকারী লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) কর্তৃক দায়েরকৃত ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ২৬১৭/১৯৯৮ খারিজ করেন। কিন্তু বিজ্ঞ প্রথম বিচারকের সাথে একমত হয়ে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক তিন আসামি যথা, ক্যাপ্টেন মােঃ কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার এবং মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স খারিজ করেন এবং তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ রদ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ থেকে তাদের খালাস প্রদান করেন।
৩২২. হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ এবং আপিল খারিজ করে ৩০.৪.২০০১ তারিখের রায় ও আদেশের বিষয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে দোষী আপিলকারীরা তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল দায়ের করেন। আপিল বিভাগ একত্রে শুনানি অন্তে পাঁচটি গ্রাউন্ডে একটি কমন লিভ মঞ্জুর আদেশ দেন, যা আমার বিজ্ঞ বিচারক ভাই মােঃ তাফাজ্জুল ইসলাম তার রায়ে পুনরালােচনা করেছেন।
৩২৩. প্রথম গ্রাউন্ডের বিষয়ে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের সুযােগ ও এখতিয়ার সম্পর্কে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব খান সাইফুর রহমান, ৫৬/২০০৭ ও ৫৮/২০০৭ নম্বর ফৌজদারি আপিলের আপিলকারীদের পক্ষে নিবেদন করেছেন যে, ডিভিশন বেঞ্চের প্রথম বিজ্ঞ বিচারক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) কর্তৃক প্রদত্ত একটি স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি অগ্রাহ্য করেছেন, যেগুলাে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত মর্মে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। তবে শুনানি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য বাকি দুটি স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এবং এ কারণে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৭ ধারাসহ ৪২৯ ধারার বিধান অনুসারে চূড়ান্ত মতামতের ভিত্তিতে রায় প্রদান করার জন্য ৩৭৮ ধারার লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। তার যুক্তির সমর্থনে তিনি Hethubha os. State of Gujarat reported in 1970 (1) SCC (Cr) 280, Union of India vs. Anantha Padma Nabiah reported in 1971 SCC (Cri), Sajjan Singh vs. State of MP reported in 1999 SCC (Cri) 44 Ges Mohim Mondal os. State reported in 15 DIR 615 মামলার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেছেন।
৩২৪. রেসপন্ডেন্ট-রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আনিসুল হক কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৭, ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার বিধানগুলি উল্লেখ করেন এবং নিবেদন করেন যে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতের মামলাগুলিতে নেওয়া সিদ্ধান্তসমূহ থেকে দেখা যায় যে, মামলাটি কীভাবে পরিচালনা করতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিস্তৃত অধিকার বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারককে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি মামলাটি কীভাবে (এবং কী পদ্ধতিতে) শুনবেন তা বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে বিবেচনা করবেন। তারপর তিনি নিবেদন করেন যে, যেক্ষেত্রে মামলায় একাধিক আসামি রয়েছে এবং ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন, সেক্ষেত্রে বিচারকরা যে আসামির মামলায় তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন সেই আসামির মামলাটি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের সামনে উত্থাপন করা হবে এবং অন্যদিকে, যখন বিজ্ঞ বিচারকরা সব আসামির ক্ষেত্রে সমভাবে বিভক্ত হন তখন অভিযুক্তের পুরাে মামলাটি বিজ্ঞ তৃতীয়
৫৪০

বিচারকের কাছে প্রেরণ করা হয়। এই প্রসঙ্গে জনাব হক যুক্তি দেন যে, এ বিষয়ে উপমহাদেশের সিদ্ধান্তগুলাে দুটি ভাগে বিভক্ত, প্রথমত, যেখানে সকল আসামির বিষয়ে মতামতের পার্থক্য রয়েছে এবং দ্বিতীয়ত, যেসব মামলায় কয়েকজন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত বা খালাস প্রদানের বিষয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ বা আইনের কোনাে পয়েন্টে মতামতের পার্থক্য থাকে। এই প্রসঙ্গে জনাব হক Dharan Singh Vs. State of UP reported in 1964 (1) CrLJ 78, Babu Vs. State of UP reported in AIR 1965 SC 1467, Hethubha Vs. State of Gujarat reported in AIR 1970 SC 1266, Union of India Vs. BN Anantha Padma Nabiah reported in AIR 1971 SC 1836, State of Andhra Pradesh Vs. PT Appaiah reported in 147 AIR 1981 SC 265 and (1980) 4 SCC 316, Tanviben Pankajkumar Divetia Vs. State of Gujarat reported in 1997 SCC 7156, Sajjan Singh Vs. State of MP reported in (1999) I SCC 315, Mattar Vs. State of UP reported in (2002) 6 SCC 460, Radha Mohan Singh Vs. State of UP reported in (2006) 2 SCC 450, Sarat Chandra Mitra Vs. Emperor reported in ILR 38 Cal 202, Ahmed Sher Vs. Emperor reported in AIR 1931 Lah 513, Subedar Singh Vs. Emperor reported in AIR 1943 Allahabad 272, Nemai Mondal Vs. State of West Bengal reported in AIR 1966 Calcutta 194, Bhagat Ram Vs. State of Rajasthan reported in AIR 1972 SC 1502, State of UP Vs. Dan Singh reported in (1997) 3 SCC 747, Grenade Venkata Vs. Corporation of Calcutta reported in 22 CWN 745, Muhammed Shaft Vs. Crown 6 DLR (WP) 104, Abdur Raziq Vs. State reported in 16 DLR (WP) 73, Mahim Mondal Vs. State reported in 15 DIR 615 478 State Vs. Abul Khair reported in 44 DLR 284 মামলার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেন।
৩২৫. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল জনাব মাহবুবে আলম বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের সুযােগ ও এখতিয়ারের বিষয়ে জনাব আনিসুল হকের মতাে অভিন্ন মতামত প্রদান করেন। তিনি নিবেদন করেন যে, যখন কোনাে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন এবং সহাবস্থানে না। তখন কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার বিধান প্রযােজ্য হয়, এবং তদনুসাে তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারা উল্লেখ করে নিবেদন করেন যে, যখন ডিভিশন | বেঞ্চের বিচারকরা তাদের মতামতে বিভক্ত হন, তখন তাদের মতামতসহ মামলাটি একই আদালতের অপর একজন বিচারকের সমীপে পেশ করা হবে এবং তিনি যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে শুনানির পরে এই বিচারক তাঁর মতামত প্রদান করবেন এবং উক্ত মতামত অনুসারে রায় ও আদেশ হবে এবং এরপরে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের মতামতই আদালতের চূড়ান্ত রায় হিসেবে গণ্য হবে।
৩২৬. তিনি যুক্তি দেন যে, Babu Vs. State of uP reported in AIR 1965 SC 1467 মামলার সিদ্ধান্ত অনুসারে ৩৭৭ ধারা মােতাবেক কমপক্ষে দুই বিচারপতির দ্বারা রায় স্বাক্ষরের বিধানটি বি ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সম্পর্কে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল Sarat Chandra Mitra Vs. Emperor reported in 15 CWN 18 = ILR 38 Cal 202, Ibrahim Vs. State reported in PLD 1959 (WP) Lahore 715, the case of Mahim Mondal Vs. State reported in 15 DIR 615, Sajjan Singh Vs. Madhya Pradesh reported in AIR 1998 SC 2756 472 maniche againST State Vs. Md. Foysal Alam Ansari and others in Death Reference No. 81 of 2003 with Criminal Appeal No. 2798 of 2003 978 Jail Appeal No. 842 of 2003 মামলাগুলােতে বিধৃত সিদ্ধান্তসমূহ তুলে ধরেন।
৫৪১

৩২৭. এই বিষয়ে উপমহাদেশের উচ্চতর আদালতসমূহের সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করার পর বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, এই মামলায় বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের আনীত দরখাস্ত শােনেন ও বিবেচনা করেন এবং ৬.২.২০০১ তারিখে প্রদত্ত আদেশে যথাযথ মতামত দেন যে, ৯ জন দোষী সাব্যস্ত বন্দির মামলা শুনানির জন্য বিবেচনা করা হয়নি এবং যাদের বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকগণ সমভাবে বিভক্ত এমন বাকি ৬ (ছয়) জনের মামলার শুনানি করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।
৩২৮. জনাব আজমালুল হােসেন, বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট রেসপন্ডেন্ট-রাষ্ট্রপক্ষে বিশেষ প্রসিকিউটর হিসেবে উপস্থিত হয়ে আমাদের নিকট কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের অধ্যায় XXVII-এর বিধান তুলে ধরেন, যেখানে সাজা নিশ্চিতকরণের বিধান উল্লেখ করা আছে এবং সেই সাথে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের পার্ট ৭-এ অধীন অধ্যায় XXXI-এর বিধানও তুলে ধরেন, যেখানে ফৌজদারি আদালতের রায় ও আদেশের ফলে উদ্ভূত আপিলের বিধান উল্লেখ করা আছে। তিনি উপস্থাপন করেন যে, যেক্ষেত্রে দায়রা আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন এবং হাইকোর্ট বিভাগের নিশ্চিতকরণ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হবে না। সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের কার্যক্রমের বিশদ বিধান কোডের অধ্যায় XXVII-এ দেওয়া রয়েছে। আইনটির পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে মি. হােসেন নিবেদন করেন যে, বিচারকগণ যখন সাজা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন তখন ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারকের দ্বারা এটি প্রদত্ত বা স্বাক্ষরিত হতে পারে না এবং তদনুসারে তাদের মতামতসহ মামলাটি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের কাছে প্রেরণ করা হবে, যিনি যেভাবে উপযুক্ত বলে মনে করেন সেভাবে শুনানির পরে (যদি থাকে) তার মতামত প্রদান করবেন এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারা অনুসারে মামলাটি তাদের মতামতসহ একই আদালতের অপর একজন বিচারকের সামনে পেশ করা হবে, যিনি যেভাবে উপযুক্ত বলে মনে করেন সেভাবে শুনানির পরে (যদি থাকে) তার মতামত প্রদান করবেন এবং রায় ও আদেশ তার এই মতামত অনুসারে হবে। ৭৫ ডিএলআর ৬১৮-এ বর্ণিত মামলা ব্যতীত তিনি এই বিষয়ে আর কোনাে নজির উল্লেখ না করে বিস্তৃত বিবরণ উপস্থাপন করেন। তিনি নিবেদন করেন যে, একই আদালতের বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের কাছে তাদের মতামতসহ মামলাটি প্রেরণের অর্থ হলাে এর মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগে আপিলের বিষয় চূড়ান্ত হতে হবে। যদি না দুজন বিচারক তাদের সম্মতি দেন। তিনি আরাে নিবেদন করেন যে, বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক স্বাধীন, কারণ এই শুনানি (যদি থাকে) যেভাবে তিনি উপযুক্ত মনে করেন” এই শব্দগুচ্ছের দ্বারা সেই পরিস্থিতিকে নির্দেশ করা হয়েছে যে, যেখানে এবং যেভাবে তিনি উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে মামলাটি শুনবেন- তা সম্পূর্ণ বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের বিবেচনার অধীন এবং এর মাধ্যমে এটি স্বীকৃত যে, তৃতীয় বিচারক যেভাবে উপযুক্ত বলে মনে করেন তিনি সেভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরােপুরি স্বাধীন। অন্য কথায়, মি. হােসেন কঠোর প্রচেষ্টায় এই যুক্তি তুলে ধরেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারাসহ ৩৭৮ ধারা অনুসারে তৃতীয় বিচারক কোনাে যুক্তি-তর্ক শুনবেন কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাঁরই। তদনুসারে, তিনি উল্লেখ করেন যে, যাদের বিষয়ে মতামতের পার্থক্য রয়েছে তাদের অর্থাৎ উপরােক্ত সেই য় দোষী ব্যক্তির মামলা বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অন্য কোনাে দোষী আপিলকারীদের মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত শুনানি না করে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক যে মতামত দিয়েছেন তার মাঝে কোনাে অবৈধতা নেই। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের XXVII অধ্যায়ে সাজা নিশ্চিতকরণের জন্য বক্তব্য
৫৪২

প্রদানের বিধান বিধৃত হয়েছে। কোডের ৩৭৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, যে ক্ষেত্রে দায়রা জজ মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগে মামলার কার্যক্রম দাখিল করা হবে এবং হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত প্রদত্ত দণ্ড কার্যকর করা হবে না। সুতরাং মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে হাইকোর্ট বিভাগের কাছে মামলার কার্যক্রম জমা দিতে হবে। কোডের ৩৭৭ ধারা অনুসারে, সাজা নিশ্চিতকরণের আদেশ হাইকোর্ট বিভাগের কমপক্ষে দুজন বিচারক প্রদান করবেন এবং স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকরা যখন তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন, তখন কোডের ৩৭৮ ধারার বিধান অনুযায়ী, “তাদের মতামতসহ মামলাটি অন্য বিচারকের সামনে পেশ করা হবে এবং উক্ত বিচারক যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে শুনানির পর তার মতামত প্রদান করবেন এবং এই মতামত অনুসারে রায় ও আদেশ হবে। আইনের বিধান অনুসারে দেখা যায় যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের সপ্তম খণ্ডের XXXI অধ্যায়ে আপিলের বিষয়ে বিস্তারিত বিধান রয়েছে কোডের ৪১০ ধারা এমন একটি বিধান যা কোনাে দায়রা জজ/অতিরিক্ত দায়রা জজ কর্তৃক অনুষ্ঠিত বিচারে দোষী সাব্যস্ত অভিযুক্তকে হাইকোর্ট বিভাগের কাছে আপিল দায়ের করতে অধিকারী করে। এটি আইনের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি যে, একবার ফৌজদারি আপিল দায়ের করা হলে তা অবশ্যই গুণাগুণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং তা কখনােই শুনানির অভাবে খারিজ করা যাবে না। আপিলের শুনানির সময় আপিলকারী বা তার আইনজীবী আদালতে অনুপস্থিত থাকলেও, আপিল আদালত মামলার রেকর্ডটি পর্যালােচনা করা এবং মামলার গুণাগুণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব বা কর্তব্য এড়াতে পারবেন না। ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা যখন আপিল আদালত হিসাবে তাদের মতামতে সমভাবে বিভক্ত হবেন, “তাদের মতামতসহ মামলাটি একই আদালতের আরেকজন বিচারকের কাছে উত্থাপন করা হবে” এবং উক্ত বিচারক যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে তিনি শুনানির পরে (যদি থাকে) তাঁর মতামত প্রদান করবেন এবং রায় ও আদেশ এই মতামত অনুসারে হবে। কোডের ৩৭৮ ধারার সাথে ৪২৯ ধারার বিধান মনােযােগ সহকারে পড়ে দেখা যায় যে, যদিও এই উভয় ধারার বিধানগুলি প্রকৃতির ক্ষেত্রে অভিন্ন, যখন একটি ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা তাদের মত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন তখন ৪২৯ ধারা অনুসারে, “মামলা, তাদের মতামতসহ একই আদালতের আরেকজন বিচারকের কাছে উত্থাপন করা হবে এবং উক্ত বিচারক যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে তিনি শুনানির পরে (যদি থাকে) তার মতামত প্রদান করবেন এবং রায় ও আদেশ এই মতামত অনুসারে হবে।
৩২৯. উপরের শব্দগুচ্ছ থেকে আমরা দেখতে পাই যে, “অন্য একজন বিচারক”-এর পর “একই আদালতের এবং “এই শুনানি” ও এরপর “যদি থাকে”- এই অভিব্যক্তি ৩৭৮ ধারায় নেই। কোডের ৪২৯ ধারায় এই দুটি অভিব্যক্তি যুক্ত করে আইনপ্রণেতাগণ এই কথাটি বলতে চেয়েছিলেন যে, আপিল নিষ্পত্তি করার সময় ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকগণ যখন তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন, তখন তাদের মতামতসহ মামলাটি একই আদালতের অন্য বিচারকের নিকট প্রেরণ করা হবে। এর অর্থ হলাে আপিল আদালতের একজন বিচারক, যিনি কোনাে বক্তব্য শুনবেন কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে “সম্পূর্ণ স্বাধীন” এবং বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে মতামতের পার্থক্যগুলি সমাধান করে আপিলের সিদ্ধান্ত নিতেও স্বাধীন।
৩৩০. শুনানি চলাকালীন উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের সুযােগ এবং এখতিয়ার সম্পর্কে বিস্তৃত বক্তব্য প্রদান করেন। আমাদের নজরে এসেছে যে, ২০০৭ সালের ৫৬ এবং ২০০৭ সালের ৫৮ নম্বর ফৌজদারি আপিলের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমান, যার যুক্তিগুলি অন্যান্য
৫৪৩

আপিলকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ গ্রহণ করেছেন, 1999 SCC (CRI) 44, ILR 38 Cal 202, 1970 (1) SCC (Cr) 280, 1971 SCC (Cri) 535, 15 DLR 615-এ প্রতিবেদিত মামলার নজির উত্থাপন করেন এবং তিনি আরাে বলেন যে, “শুনানি”-এর সাথে যেভাবে তিনি উপযুক্ত মনে করেন”-এর কোনাে সহ-সম্পর্ক নেই এবং তদনুসারে, দুজন বিচারকের দ্বারা রায় স্বাক্ষরিত না হওয়ায় ৩৭৭ ধারার বিধান লজ্জিত হয়েছে এবং আইনের দৃষ্টিতে কোনাে রায়ই হয়নি। ফলে রায় এবং দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজার আদেশ আইনে কার্যকর নয়। সতর্কতার সাথে যাচাই করে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, রেসপন্ডেন্ট পক্ষ তাদের বক্তব্যের সমর্থনেও একই মামলাগুলির উপর নির্ভর করে। এই প্রসঙ্গে প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্তগুলি 915720p posat antalons Goals 163719701737 i Dharam Singh Vs. State of UP reported in 1964 (1) CrLJ 78 মামলায় সব আসামির বিষয়ে মতামতের পার্থক্য ছিল। এক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের বিচারক ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২ ও ১৪৯ ধারার অধীনে দশ আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং দুই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খালাস প্রদান করেন। রাষ্ট্রপক্ষ খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং দশজন অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ তাদের মতামতে বিভক্ত হয়ে যান এবং বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের সামনে বিষয়টি পেশ করা হয়, যিনি একজন বিচারকের সাথে একমত হয়ে দশজন আপিলকারীকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং একজন অভিযুক্তকে খালাস প্রদান করেন, যেখানে রায় ও আদেশ বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের মতামত অনুসারে হয়।
৩৩১. Babu Vs. State of the uP reported in AIR 1965 SC 1467 মামলায়, আপিলটি ছিল ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০৪ এবং ৩৪ ধারার অধীনে অভিযুক্ত আপিলকারীকে দোষী সাব্যস্তকরণ এবং সাজা প্রদানের আদেশের বিরুদ্ধে। বিজ্ঞ প্রথম বিচারক সাক্ষ্যের কিছু অংশ অবিশ্বাস করে আপিল খারিজ করেন এবং বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক আপিল মঞ্জুর করেন। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারা অনুসারে, কোনাে বক্তব্য যদি থাকে তা তিনি শুনবেন কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তৃতীয় বিচারকের এবং এটি স্বীকৃত যে, তিনি যেভাবে যথাযথ বলে মনে করবেন সেভাবে তিনি পার্থক্য সমাধানে সম্পূর্ণ স্বাধীন। Hethubha Vs. State of Gujarat reported in AIR 1970 SC 1266 মামলায়, বিচারিক আদালত ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২ ধারাসহ ৩৪ ধারার অধীনে তিনজন আসামিকে খালাস প্রদান করেন, তবে সব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ৩০৪ পার্ট-২ ধারা তৎসহ পঠিতব্য ৩৪ ধারার অধীনে দণ্ডনীয় অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাদের পাঁচ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অভিযুক্ত নম্বর-১-হেথুভা এবং নম্বর-২- রণুভা ৩২৩ ধারার অধীন দণ্ডনীয় অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং ৩ নম্বর আসামি মালুবাকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩২৩ ধারাসহ ৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। অভিযুক্ত ১ ও ২-কে তিন মাসের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং ২ নম্বর আসামিকে দুই মাসের জন্য সাজা দেওয়া হয় এবং সব সাজা একই সাথে চলার কথা থাকে। সব আসামি গুজরাটের হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেন। বিচারপতি ডিভান সিদ্ধান্ত দেন যে, ধারা ৩০২-এর অধীনে অপরাধের জন্য আসামি ১ দোষী ছিল এবং অভিযুক্ত ২ এবং ৩-কে ধারা ৩২৪সহ ধারা ৩৪-এর অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিচারপতি শেলাত সব আসামিকে খালাস প্রদান করেন। কারণ তিনি অভিযুক্তের পরিচয় সংক্রান্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। মামলাটি কোডের ৪২৯ ধারার অধীনে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক বিচারপতি মেহতার সামনে উত্থাপিত হয়, এবং তিনি ৩০২ ধারা অনুসারে ১
৫৪৪

নম্বর আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ৩০২ ধারাসহ ৩৪ ধারার অধীনে অভিযুক্ত ২ ও ৩-কে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তাদের সবাইকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের দণ্ডিত করেন। ধারা ৩২৩-এর অধীনে অভিযুক্ত ১ এবং ২-এর এবং ধারা ৩২৩সহ ধারা ৩৪-এর অধীন অভিযুক্ত ৩-এর সাজা বহাল রাখা হয়। ধারা ৩০৪ পার্ট ২-এর অধীনে সব আসামিকে দোষী সাব্যস্তকরণের বিষয়টি উপরে বর্ণিত মতে পরিবর্তন করা হয়। আপিলের সময় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন যে, তৃতীয় বিচারক পুরাে মামলাটি পরিচালনা করতে পারেন।
৩৩২. union of India Vs. BN Anantha Padma Nabiah reported in AIR 1971 SC 1836 মামলায়, সব অভিযুক্ত ব্যক্তির বিষয়ে মতামতের পার্থক্য ছিল। তৃতীয় বিচারকের কাছে মামলাটি প্রেরণ করা হয়। 46969 Jetta Golo Bhagat Ram Vs. State of Rajasthan reported in (1972) 3 SCR 303 মামলাটি বিবেচনা করেন, যেখানে তৃতীয় বিচারক সিদ্ধান্ত দেন যে, ভগত রাম ভারতীয় পেনাল কোডের ৩৮৯ ধারা সেই সাথে ১২০বি, ২১৮ এবং ৩৪৭ ধারার অধীন অপরাধের জন্য দোষী ছিলেন। এটি সিদ্ধান্ত হয় যে, যেহেতু প্রথম এবং দ্বিতীয় বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চ পেনাল কোডের ৩৪৭, ২১৮, ৩৮৯ এবং ১২০বি ধারার অধীনে অভিযােগের বিষয়ে ভগতকে খালাস দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, সেহেতু তৃতীয় বিচারকের জন্য এই বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার এবং ভগত রামকে ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০বি এবং ২১৮ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করাটা অনুমােদিত ছিল না। এক্ষেত্রে দুই বিচারকের মধ্যে মতামতের পার্থক্যের কারণে ভগত রামের সাজা ও সাজা খালাস সম্পর্কিত পুরাে বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য উন্মুক্ত ছিল না। Hethubha Vs. State of Gujarat reported in AIR 1970 SC 1266 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এই পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন যে, ভগত রামের মামলায় কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারার পরিধি নিশ্চিত করা হয়নি। ধারা ৪২৯-এর অধীনে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা তৃতীয় বিচারকের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করেন কিনা সে মর্মে কোনাে প্রশ্নও তােলা হয়নি বা এই তিনটি মামলায় এই বিষয়ের সিদ্ধান্তের প্রতি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণও করা হয়নি। Babu Vs. State of UP reported in AIR 1966 SC 1467, Hethubha Vs. State of Gujarat reported in AIR 1970 SC 1266 472 Union of India Vs. BN Anantha Padma Nabiah reported in AIR 1971 SC 1836, যা ভগত রামের মামলার সিদ্ধান্ত হওয়ার সময় প্রতিবেদিত হয়নি। এই তিনটি মামলা বিবেচনা করে সুপ্রীম কোর্ট Babu Vs. State of uP reported in AIR 1966 SC 1467 মামলায় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারা অনুসারে এটি তৃতীয় বিচারকের এখতিয়ার যে, তিনি কোনাে বক্তব্য, যদি থাকে, শুনবেন কিনা তার সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং এটি স্বীকৃত যে, তিনি যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে পার্থক্য নিরসন করার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীন। Hethubha Vs. State of Gujarat reported in AIR 1970 SC 1266 2671? ata GPIT AIR 1965 SC 1467-এ বর্ণিত সিদ্ধান্ত পর্যালােচনা করে বলেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারায় দুটি বিষয় লক্ষণীয়: প্রথমত, মামলাটি অন্য বিচারকের সামনে রাখা হবে এবং দ্বিতীয়ত, রায় ও আদেশ বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের মতামত অনুসারে হবে। তদনুসারে, সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন যে, বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক পুরাে মামলাটি পরিচালনা করতে পারেন বা করবেন এবং বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক, যার কাছে মামলাটি ৪২৯ ধারা অনুসারে উত্থাপন করা হয়েছিল, পুরাে মামলাটির উপর সিদ্ধান্ত নিয়ে সীমা ছাড়িয়ে। | যাননি। তদনুসারে আপিলটি খারিজ করা হয়েছিল।
৫৪৫

৩৩৩. Andhra Pradesh Vs. PT Appaiah reported in AIR 1981 SC 265 মামলায় ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২ এবং ৩৪ ধারার অধীনে দুজন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং তাদের প্রত্যেককে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছিল। আপিলের সময় ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা আঘাত করে। অভিযুক্তরা যে অপরাধ করেছিল তার প্রকৃতির বিষয়ে পৃথক মতামত দেন। বিচারপতি মাধব রেডিড পেনাল কোডের ৩০৪ অনুচ্ছেদ ১-এর অধীনে শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন এবং বিচারপতি শ্রীরামুলা দায়রা জজ ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযুক্তকে যথাযথভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন মর্মে সিদ্ধান্ত। নিয়ে আপিল খারিজ করে দেন। তবে তৃতীয় বিচারক বিচারপতি রামচন্দ্র রাজু উভয় আসামিকেই খালাস প্রদান করেন। সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন যে, যে তৃতীয় বিচারকের সামনে এই মামলাটি মতামতের জন্য উত্থাপন করা হয়, তিনি পুরাে মামলাটি পরিচালনা করতে সক্ষম এবং তিনি কেবল অপর দুই বিচারকের মধ্যে মতপার্থক্য সম্পর্কিত বিষয়ে তাঁর রায় সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য নন। সুপ্রীম কোর্ট union of India Vs. BN Anantha Padina Nabiah reported in AIR 1971 SC 1836 মামলার ক্ষেত্রে করা পর্যবেক্ষণগুলির উপর নির্ভর করেন, যা নিম্নরূপ: Hethubha Vs. State of Gujarat মামলায় সাম্প্রতিক অপ্রতিবেদিত সিদ্ধান্তে এই প্রশ্নটি বিবেচনার জন্য উত্থাপিত হয়েছিল। এই আদালত সিদ্ধান্ত নেন যে, বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক পুরাে মামলাটি পরিচালনা করতে পারতেন। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারার ভাষা এই মর্মে সুস্পষ্ট যে, আপিল কোর্টের বিচারকদের মতামত নিয়ে মামলাটি একই আদালতের অপর একজন বিচারকের সামনে উত্থাপন করা হবে। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারার অপর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যটি হলাে, রায় বা আদেশ বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের মতামত অনুসারে হবে।
৩৩৪ . Tanviben Pankajkumar Divetia Vs. State of Gujarat reported in AIR 1997 SCC 7156 মামলায়, অভিযুক্ত আপিলকারীকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২ ধারাসহ ৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, যার বিরুদ্ধে তিনি গুজরাট হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেছিলেন। হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২ ধারাসহ ১২০বি ধারা এবং ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২ ধারার অধীনে অভিযােগের দায় থেকে আপিলকারীর খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনীত আপিল খারিজ করে দেন। একজন বিচারক অভিযুক্তকে খালাস দেন এবং অপর বিচারক অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেন। বিষয়টি তৃতীয় বিচারকের কাছে প্রেরণ করা হয়। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক পেনাল কোডের ৩০২ ধারার অধীনে আপিলকারীকে দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখেন। তদনুসারে, হাইকোর্ট আপিলকারীর আপিল খারিজ করে দেন। আপিলে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে: “কোনাে বক্তব্য, যদি থাকে, তবে তা শুনবেন কি শুনবেন না সে বিষয়ে তৃতীয় বিচারক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী এবং এটি অনস্বীকার্য যে, তৃতীয় বিচারক যেভাবে যথাযথ মনে করেন সেভাবে তিনি বিভেদের সমাধান করে আপিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।”
৩৩৫. বিচারপতি জনাব জি এন রায় নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন:
Babu Vs. State of uttar Pradesh, (AIR 1965 SC 1467) মামলায় এই আদালতের সাংবিধানিক বেঞ্চ এই সিদ্ধান্ত নেন যে, যেখানে তৃতীয় বিচারক দুই বিচারকের মধ্যে মতামতের পার্থক্য দেখা গিয়েছিল এমন কোনাে নির্দিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়ােজনীয়তা বিবেচনা করেন না, কিন্তু কেবল
৫৪৬

ইঙ্গিত দেন যে, যদি তার এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা প্রয়ােজন হতাে, তাহলে তিনি দুজনের মধ্যে একজন এই বিষয়ে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাঁর সাথে তিনি একমত, তাহলে এই ধরনের সিদ্ধান্তও আইনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ততীয় বিচারক যেভাবে উপযুক্ত বলে মনে করেন সেভাবে তিনি আপিলের সিদ্ধান্ত নিতে যে 9781a, of Hethubha Vs. State of Gujarat, (AIR 1970 SC 1266) 978 Union of India Vs. BN | Anantha Padna Nabiah, AIR 1971 SC 1836 মামলায় পুনঃউচ্চারিত হয়েছে। State of A. PV PT Appaiah, AIR 1981 SC 365 মামলায়, এই আদালত কর্তৃক এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, এমনকি উভয় বিচারকই যদি কোনাে মামলায় অভিযুক্ত দোষী ছিলেন এমন সিদ্ধান্তও নেন কিন্তু অভিযুক্ত কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের প্রকৃতি সম্পর্কে মতপার্থক্য থেকে যায়, তাহলেও তৃতীয় বিচারকের জন্য গুণাগুণের ভিত্তিতে মামলাটি বিবেচনা করে অভিযুক্তকে নির্দোষ বলে ধরে নিয়ে আপিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথ
উন্মুক্ত ছিল।
৩৩৬. Sajjan Singh os. State of MP reported in (1999) 1 SCC315 পৃষ্ঠা ৩২৪ অনুচ্ছেদ ১০-এ সুপ্রীম কোর্ট বলেছেন, যে রায়ের ক্ষেত্রে সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদের অধীনে অথবা সংবিধানের ১৩৪ অনুচ্ছেদের অধীনে অথবা কোডের ৩৭৯ ধারার অধীনে বিশেষ অনুমতি নিয়ে আপিল দায়ের হয়
সেক্ষেত্রে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর মতামত গুরুত্বপূর্ণ।
৩৩৭ . Mattar vs. State of UP (2002) 6 SCC 460 7/2013 96701 OPTICP Indian Penal Code-43 ৩০২ এবং ৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলাকালে একজন অভিযুক্ত মারা যায়। হাইকোর্টে বিজ্ঞ প্রথম বিচারক আপিলকারীকে খালাস দেন এবং বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক আপিলকারীকে দোষী সাব্যস্ত করেন। বিষয়টি তাঁদের কাছে প্রেরণ করা হলে তিনি আপিল খারিজ করেন এবং অভিযুক্ত আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করেন। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট বলেন যে, এই পরিস্থিতিতে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর স্বাধীনভাবে বিষয়টি পরীক্ষা করে মতামত প্রকাশ করা উচিত। কারণ ব্যাখ্যা ব্যতীত শুধু কোনাে একটি মতের সাথে একমত নির্দেশ করাটাই গ্রহণযােগ্য নয়।
৩৩৮. Radha Mohan Singh os. State of uP(2006) 2 SCC 450 মামলায় ইন্ডিয়ান পেনাল কোড-এর ১৪৯ ধারার সাথে পঠিত ১৪৭, ১৪৮, ৩২৩, ৩২৪ এবং ৩০২ ধারার অধীনে পাঁচজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোড-এর ১৪৯ ধারার সাথে পঠিত ৩০২ ধারার অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। অভিযুক্ত আপিলকারী এলাহাবাদ হাইকোর্টে আপিল করেন। দ্বৈত বেঞ্চে বিজ্ঞ প্রথম বিচারক বিচারপতি আগারওয়াল আপিল মঞ্জুর করেন এবং আরােপিত দণ্ড ও সাজা বাতিল করেন কিন্তু বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক বিচারপতি মিশ্রা আপিলটি খারিজ করেন এবং বিজ্ঞ দায়রা আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্তকরণ ও আরােপিত দণ্ড বহাল রাখেন। বিষয়টি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর কাছে প্রেরণ করা হলে তিনি সকলের দণ্ড বহাল রাখেন। আপিলে সুপ্রীম কোর্ট বলেন, বিচক্ষণতার নীতি অথবা বিচারিক শিষ্টাচার কোনাে হিসেবেই আসামিদের খালাসের পক্ষে থাকা বিচারকের মত গ্রহণ করার কোনাে বাধ্যবাধকতা বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর নেই। আপিলকারী কর্তৃক উত্থাপিত এই যুক্তি গ্রহণ করা সম্ভব নয়।
৩৩৯. Sarat Chandra Mitra os. Emperor reported in ILR 38 Cal 2002 মামলায় দ্বৈত বেঞ্চের বিজ্ঞ
বিচারকগণ একজন অভিযুক্ত শরৎচন্দ্র মিত্রর বিষয়ে সমভাবে বিভক্ত ছিলেন এবং বিষয়টি বিজ্ঞ তৃতীয়।
৫৪৭

বিচারক-এর সামনে পেশ করা হয়। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট বলেন যে, দুজন বন্দির মামলায়, যাদের দণ্ড বিষয়ে আপিল আদালতের বিচারকগণের মতামত বিভক্ত ছিল, ওই বন্দির মামলার বিষয়টিই একমাত্র বিষয় যা অপর বিচারকের সামনে নেওয়া উচিত। তবে যেক্ষেত্রে একজন অভিযুক্তের অপরাধ বিষয়ে তারা সমানভাবে বিভক্ত, যদিও নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে তারা একমত, ওই অভিযুক্তের সম্পূর্ণ মামলাটি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর সামনে পেশ করা হয় এবং শুধু সে পয়েন্টে নয় যেখানে মতপার্থক্য রয়েছে, বরং মামলার বিষয়ে মতামত প্রকাশের আগে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনা করা তার কর্তব্য।
৩৪০. Nemai Mondal vs. State of West Bengal reported in AIR 1966 Calcutta 194 মামলার ১০ জন আপিলকারী ছিলেন। দ্বৈত বেঞ্চের উভয় বিজ্ঞ বিচারক সর্বসম্মত ছিলেন যে, আপিলকারী… ১, ৯, ১০-এর দণ্ড বাতিল হবে। অতএব আপিলকারী ১, ৯, ১০-কে মুক্ত করে দেওয়া হয় এবং তাদের ব্যাপারে কারাে কোনাে মতপার্থক্য ছিল না। যে ভিন্নমতের বিষয় সিদ্ধান্তের জন্য আসে তা হলাে আপিলকারী ২-৮-এর বিষয় এবং তা বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক দ্বারা সমাধানকৃত। বিচারপতি মুখার্জি বলেন, যেসব মামলায় মতপার্থক্য রয়েছে তা বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর সামনে পেশ করা উচিত।
৩৪১. State of uP os. Dan Singh reported in (1997) 3 SCC 74732 মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ইন্ডিয়ান পেনাল কোড-এর ১৪৭, ৩০২/১৪৯, ৪৩৬/১৪৯, ৩০৭/১৪৯ ধারার অধীনে এবং Protection of the Civil Rights Act, 1955-এর ৪(iv), (x) ধারা এবং ৫.৭ ধারার অধীনে অভিযুক্ত করা হয়। দায়রা জজ, দান সিং এবং অন্যান্যসহ ৩২ জন অভিযুক্তকে খালাস দেন। রাজ্য এলাহাবাদ হাইকোর্টে আপিল দায়ের করে। বিচারপতি কাটজু জিৎ সিং ও কিষাণ সিং নামে দুজন অভিযুক্তকে ইন্ডিয়ান পেনাল কোড-এর ৩২৫ ও ৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তাদের পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন এবং ৩০ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খালাস প্রদান করেন। বিচারপতি রাজেশ্বর সিং পৃথক মতামত প্রদানের মাধ্যমে ৬ জন পুরুষ এবং চারজন নারী অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ২২ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খালাস প্রদান করেন। ২২ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির খালাস বিষয়ে প্রদত্ত প্রথম আদেশটি ছিল দ্বৈত বেঞ্চের। পরবর্তীকালে মামলাটি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর কাছে নেওয়া হয়। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক বিচারপতি মাথুর, দশজন অভিযুক্ত যাদের বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারকগণ ভিন্নমত পােষণ করেছেন, তাদের আপিল শুনানির পর বিচারপতি কাটজুর সাথে একমত হন যিনি জিৎ সিং এবং কিষাণ সিং নামে দুজন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন এবং ৩০ জন অভিযুক্তকে খালাস প্রদান করেছিলেন। রাজ্য কর্তৃক ৩২ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে একটা বিশেষ অনুমতির (স্পেশাল লিভ) আবেদন দাখিল করা হয়। একজন নারীর ক্ষেত্রে অনুমতি (লিভ) মঞ্জুর হয়নি এবং এর ফলে তাদের খালাস চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং ২৮ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুমতি (লিভ) মঞ্জুর হয়। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ দেন :
“According to this section, if there is a difference of opinion amongst the Judges of the Bench, then their opinions are laid before another Judge. It is only after the Third Judge gives his opinion that the judgment or order follows. It is clear from this that the judgment or order which can be appealed against, under Article 136 of the Constitution, is only that which follows after the opinion of the Third Judge has been delivered. What BN Katju and Rajeshwar Singh, JJ. wrote was not their judgments but they were their opinions. Due to disagreement amongst them,
৫৪৮

section 392 of the Code of Criminal Procedure required the appeal as a whole to be laid before the Third Judge (vs. P Mathur, J in this case) whose opinion was to prevail. The first order of 15-4-1987 was clearly not contemplated by section 392 of the Code of Criminal Procedure and is, therefore, non est.”
৩৪২. যখন বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক সামগ্রিকভাবে আপিলটি শােনেন তখন শুধু মতামত প্রদানের বিকল্পই তাঁর থাকে না, বরং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর-এর ধারা ৩৯২-এর প্রােভাইসাে-এর অধীনে তিনি বৃহত্তর বেঞ্চ দ্বারা আপিলটি পুনঃশুনানি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য চাইতে পারেন। এটা এমন একটা বিকল্প যা এই প্রােভাইসাে-এর অধীনে বিচারপতি বিএন কাটজু এবং বিচারপতি রাজেশ্বর সিং এই দুজন বিচারকের যে কোনাে একজনের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু তারা তা করেননি। যা স্পষ্ট তা হলাে আপিলটি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়েছে রায় এবং আদেশ প্রদানের দ্বারা যা বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর মতামত অনুসরণ করে। স্পেশাল লিভ পিটিশন হওয়ায়, হাইকোর্ট কর্তৃক ১৯.৫.১৯৮৮ তারিখে চূড়ান্ত আদেশের মাধ্যমে আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার পরেই কেবল এটি দায়ের করা যেত। যদিও এই আদেশটি ৩২ জন অভিযুক্তর মধ্যে মাত্র ১০ জনের সাথে সম্পর্কিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে; আদেশটি পূর্বের ১৫.৪.১৯৮৭ তারিখের আদেশের সাথে একত্রে পড়তে হবে এবং এর প্রভাব হবে এটা যে, ১৯.৫.১৯৮৮ তারিখের আদেশটি চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে, যার মাধ্যমে রাজ্যের আপিল আংশিকভাবে মঞ্জুর হয়েছিল, যেখানে ৩২ জনের মধ্যে মাত্র দুজন অভিযুক্তকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩৪ ধারার সাথে পঠিতব্য ৩২৫ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং অন্য সব অভিযুক্তকে খালাস প্রদান করা হয়েছিল।
৩৪৩. Grenade Venkata vs. Corporation of Calcutta reported in 22 CWN745 মামলায় ভেজাল ঘি বিক্রির জন্য একজনকে Calcutta Municipal Act-এর ৪৯৫ এ(১) ধারার অধীনে অভিযুক্ত করা হয়। এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কর্পোরেশনের সহকারী এনালিস্ট, যিনি বিতর্কিত ঘির নমুনা বিশ্লেষণে নির্দিষ্ট কিছু প্রক্রিয়া প্রয়ােগ করেছিলেন এবং প্রাপ্ত ফলাফল থেকে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, কিছু শতাংশ বিদেশি চর্বি দিয়ে ঘি ভেজাল করা হয়েছিল, তার জেরার মাধ্যমে প্রাপ্ত প্রমাণের উপর নির্ভর করতে ম্যাজিস্ট্রেট আসামিপক্ষকে অনুমতি দিয়েছিলেন। কোনাে পক্ষ থেকে অপর কোনাে সাক্ষীকে পরীক্ষা করা হয়নি এবং আসামিপক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, এই বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড কাজ অনুসারে এ ধরনের কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আসামিপক্ষ এনালিস্টকে জেরা করেছিল। ম্যাজিস্ট্রেট আসামিপক্ষকে এই প্রমাণের উপর নির্ভর করার অনুমতি দিয়েছিলেন, যা রায়ে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। দণ্ডের বিরুদ্ধে দুজন বিচারকের সামনে রুল শুনানি হয়, যাদের উভয়েই একমত পােষণ করেন যে দণ্ড বহাল থাকতে পারে না। বিচারপতি চিট্টি এই ভিত্তিতে পুনর্বিচারের পক্ষে ছিলেন যে, এখানে কোনাে সন্তোষজনক তদন্ত ছিল না এবং বিচারপতি স্মিথার অন্যভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিষয়টি বিজ্ঞ ততীয় বিচারক বিচারপতি উডােফ-এর সামনে নেওয়া হলে তিনি বলেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২০ ধারার অধীনে কোনাে মামলা প্রেরণ করা হলে, যে বিষয়ে প্রেরণকারী উভয় বিচারক একমত, সেই বিষয়ে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক ভিন্নমত হবেন না, যদি না এরকম করার মতাে যথেষ্ট ভিত্তি থাকে। Muhammed Shafi vs. Croon reported in 6 DLR (WP)104 মামলায় হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চ পর্যবেক্ষণ দেন যে, ধারা ৩৭৮ অথবা ৪২৯ কোনােটিই আইনসংক্রান্ত প্রশ্নে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে বা পরবর্তী সময়ে পুরাে মামলায় বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর মতামত প্রদানের বিষয়ে বাধা
৫৪৯

দেয় না। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর-এর ৪২৯ ধারার অধীনে যে বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর নিকট মামলাটি আনা হয়েছে তিনি বিচারকগণের বেঞ্চের কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করেন এবং সেজন্য তাঁকে একক বিচারক হিসেবে নয় বরং একটি বেঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। মামলাটি এমন নয় যা একক বিচারক দ্বারা পরিচালিত বরং এমন, যা তিনজন বিচারক দ্বারা পরিচালিত, যদিও বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক দুজন অসম্মত বিচারকের পরবর্তী পর্যায়ে তা পরিচালনা করেন।
৩৪৪. Mahin Mondal os. State reported in 15 DLR 615 মামলায় আপিলকারী মহিম মণ্ডলসহ অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে পেনাল কোডের ৩০৪, ১৪৮ এবং আরাে অন্যান্য ধারার অধীনে বিচার করা হয়েছিল। মহিম মণ্ডলকে পেনাল কোডের ৩০৪ এবং ১৪৮ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এ যথাক্রমে পাঁচ বছর ও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অভিযুক্ত আসাব মণ্ডলকে পেনাল কোডের ৩২৩ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। আপিলকারী মহিম মণ্ডল তাকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ড প্রদানের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করেন। আপিল গ্রহণের পর একটি ডিভিশন বেঞ্চ কেন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এই কোডের অধীনে প্রদত্ত দণ্ড এবং সাজা বাতিল করা হবে না- তস্মর্মে কারণ দর্শানাের জন্য স্বতঃপ্রণােদিত রুল জারি করেন। রিভিশন মামলাটি ওই একই আদালত কর্তৃক জারিকৃত রুল থেকে উদ্ভূত। আপিল এবং রিভিশন মামলাটি শুনানির পর, অভিযুক্ত মহিম মণ্ডল দাঙ্গার জন্য দণ্ডপ্রাপ্ত হতে পারেন কিনা এই বিষয়ে একটি দ্বৈত বেঞ্চের মতামত ভিন্ন হয়। ফলে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারার অধীনে বিষয়টি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক বিচারপতি মােরশেদের নিকট নেওয়া হয়। এই মামলায় বিচারপতি মােরশেদ বলেন, সম্পূর্ণ মামলাটি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর নিকট রাখা দরকার এবং এই মামলায় মতামত প্রদানের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় বিবেচনা করা তাঁর দায়িত্ব। State Os. Abul Khair reported in 44 DLR 284 মামলায় ডিভিশন বেঞ্চের দুজন বিচারক দুজন আপিলকারীর দোষী সাব্যস্তকরণ এবং সাজার বৈধতা বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করেন, কিন্তু আবুল খায়ের নামক একজন অভিযুক্তের দণ্ডের বিষয়ে একমত পােষণ করেন। মামলাটি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক-এর নিকট নেওয়া হয়। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক মােশাররফ এবং মইনুদ্দিন নামক দুজন অভিযুক্ত অর্থাৎ যাদের বিষয়ে বিচারকগণ ভিন্নমত পােষণ করেছিলেন, শুধু তাদের মামলাটি সমাধান করেন।
৩৪৫. ক্রিমিনাল আপিল নম্বর ৫৬ এবং ৫৮/২০০৭ মামলায় আপিলকারী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমান বলেন যে, নথিতে থাকা উপকরণ ও প্রমাণাদির সুস্পষ্ট বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বর্তমান মামলাটি একটি বিদ্রোহের মামলা, যা প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের হত্যার দিকে পরিচালিত হয় এবং এটা শুধু হত্যার মামলা নয় এবং সে কারণেই কোর্ট মার্শালের পরিবর্তে সাধারণ ফৌজদারি আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত আপিলকারীকে দণ্ড প্রদান এই বিচারকে ত্রুটিপূর্ণ করেছে। জনাব খান যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে ঘটে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার আগের রাতে ঢাকা সেনানিবাসে ঘটে যাওয়া ধারাবাহিক বিষয়াদি, কার্যক্রম, ব্রিফিং, অনুশীলন এবং ঘটনাগুলাে সুস্পষ্টভাবে বিদ্রোহ গঠন করে এবং এগুলাে শুধু হত্যা মামলা নির্দেশ করে না। ক্যান্টনমেন্ট ঘটনাস্থলের অন্তর্ভুক্ত এবং ক্যান্টনমেন্ট কার্যক্রম, ব্রিফিং এবং অনুশীলন মামলার ঘটনার অন্তর্ভুক্ত এবং সেজন্যই পেনাল কোডের ৩৪ বা ১২০এ ধারার অধীনে কোনাে | চুক্তি বা পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা, প্রাক-কনসার্ট, সাধারণ উদ্দেশ্য, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র অথবা সাধারণ
৫৫০

অভিপ্রায়ের লক্ষ্যবস্তু এমন বিষয় আইনত অনুমেয় নয়। জনাব খান পরবর্তী সময়ে উল্লেখ করেন যে বিদ্রোহের সময় কোনাে ব্যক্তির হত্যা কোর্ট মার্শাল কর্তৃক বিচারযােগ্য এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৫৯ ধারা উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, যেহেতু, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অপরাধ সংঘটনের সময় সক্রিয় চাকরিতে ছিলেন, সেহেতু, ফৌজদারি আদালতের পরিবর্তে মার্শাল কোর্টে সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারে তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি Jamil Huq vs. Bangladesh reported in 34 DLR 161 (AD) 125 মামলাটি উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, ১৯৮১ সালের ২৯/৩০ মে রাতে সংঘটিত বিদ্রোহ, যার ফলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যু ঘটে, তার বিচার হয়েছিল কেবল কোর্ট মার্শাল দ্বারা আর্মি অ্যাক্ট-এর ৩১ ধারার বিধান অনুযায়ী এবং একইভাবে সক্রিয় চাকরিতে থাকা সেনাকর্মীদের দ্বারা ১৫ আগস্টের দুর্ভাগ্যজনক রাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচার ফৌজদারি আদালতের পরিবর্তে কোর্ট মার্শাল দ্বারা হওয়া উচিত ছিল এবং সেই হিসেবে অভিযুক্ত আপিলকারীর দণ্ড ও সাজা আইনে সমর্থিত নয়। জনাব খান যুক্তি দেন যে, বিদ্রোহের ক্ষেত্রে এবং হত্যার ক্ষেত্রে শাস্তির তীব্রতা একরকম নয় এবং পার্থক্য হলাে কোর্ট মার্শাল দ্বারা একটি বিচারে আপিলকারীদের সুবিধা যেহেতু সেখানে হত্যার জন্য সাজার ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের একটি বিকল্প রয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তিনি আরাে যুক্তি দেন যে আর্মি অ্যাক্ট-এর ৩১ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ডের বিকল্প অন্য যে কোনাে সাজা আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এ উল্লিখিত হিসেবে অনেক কম শাস্তি বহন করে। জনাব খান সাইফুর রহমান বলেন যে, প্রতিপক্ষ কর্তৃক আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এর ধারা ৯১ ও ৯২-এর বিধানের ভিত্তিতে এই মামলা বিচারের জন্য ফৌজদারি আদালত অথবা কোর্ট মার্শালের যুগপৎ এখতিয়ারের আবেদন আর্মি অ্যাক্ট-এর ৯২(২) ধারার প্রােভাইসাের পরিপ্রেক্ষিতে এর শক্তি হারিয়েছে এবং মামলা বিচারের যুগপৎ এখতিয়ারের প্রশ্নে ভুল ধারণা করা হয়েছে।
৩৪৬. রেসপন্ডেন্ট পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আনিসুল হক বলেন যে, বর্তমান মামলাটি বিদ্রোহের নয়, বরং কেবল হত্যা মামলা হওয়ায় অভিযুক্ত আপিলকারীকে ফৌজদারি আদালতে বিচার করায় বেআইনি কোনাে কিছু ঘটেনি। কারণ, যদি তর্কের খাতিরেও স্বীকার করি, বিদ্রোহের সাথে খুনও ঘটেছিল। জনাব হক উপস্থাপন করেন যে, আর্মি অ্যাক্ট-এর ধারা ৯৪ ও ৯৫-এর বিধান অনুসারে খুনের মতাে সিভিল অপরাধের মামলার ক্ষেত্রে কোর্ট মার্শাল এবং ফৌজদারি আদালত উভয়েরই যুগপৎ এখতিয়ার ছিল এবং একই সাথে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার অধীনে প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণভাবে পালন করা হয়েছিল এবং ফৌজদারি আদালতে মামলার বিচার করায় বেআইনি কিছু সংঘটিত হয়নি। জনাব আনিসুল হক বলেন যে, অনুমতি মঞ্জুরের আদেশ নম্বর ৩-এর বক্তব্যে এখানে কি বিদ্রোহ আছে যা হত্যা অথবা কেবল হত্যা সংঘটিত করেছে”- এই অংশটুকু ভুল বােঝা হয়েছে; কারণ বর্তমান মামলার মতাে খুনের জন্য আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এর ৫৯(২) ধারার অধীনে এখানে যুগপৎ এখতিয়ার আছে। পরবর্তীকালে তিনি বলেন, বর্তমান মামলায় যুগপৎ এখতিয়ার থাকায় দায়রা আদালত আর্মি অ্যাক্ট-এর ৯৪ ও ৯৫ ধারা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার বিধান পুরােপুরি পালন করে বিচার করেছেন যা দায়রা আদালতের ২৪.৩.১৯৯৭ তারিখের আদেশ দ্বারা প্রমাণিত এবং সে হিসেবে বিচার সম্পন্ন করায় বেআইনি কিছু সংঘটিত হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি MSK_Ibratos. Commander-in-Chief, Royal Pakistan Navy reported in 4 DLR (SC) 128, Balbir Singh vs. Punjab reported in 1995 1 SCC 90 মামলার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেন।
৫৫১

অনুকূলে অভিমত দেওয়া হলে তৃতীয় বিচারককে সেই অভিমত অনুসরণ করতে হবে কিংবা তিনি তা অনুসরণ করতে পারেন। কিন্তু এই ধারণাটি মেনে নেওয়া হলে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারায় “সেই বিচারক শুনানির পর তাঁর বিবেচনায় যা উপযুক্ত তেমন অভিমত দেবেন এবং রায় বা আদেশ সেই অভিমত অনুযায়ী হবে”- এই কথাগুলাে ব্যবহার করার কোনাে প্রয়ােজন হবে না।
৩৯. এখানে উল্লেখ্য যে, Babu-র মামলায় (AIR 1965 SC 1467) ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের গৃহীত অভিমতে এই বিষয়টি দৃঢ়ভাবে সমর্থিত হয়েছে এবং পরবর্তী মামলাগুলােতেও এই মামলায় উক্ত সিদ্ধান্তটি অনুসৃত হয়েছে। তাই ঐ অবস্থান থেকে সরে আসার কোনাে অকাট্য যুক্তি নেই। কারণ ঐ অবস্থানটি আইনের বিধানাবলির সঠিক ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।।
৪০. অধিকন্তু এটি যদি ধরে নেওয়া হয় যে, তৃতীয় বিচারকের উচিত ছিল সব দণ্ডিত আসামির রেফারেন্সের শুনানি করা, তারপরও যেহেতু আমরা Sajjan Singh-এর মামলায় (পূর্বোক্ত) যেমন করা হয়েছিল তেমনিভাবে আপিলকারীদের আপিল গুণাগুণের ভিত্তিতে সবিস্তারে শুনানি করেছি, তাই এ কথা বলার উপায় নেই যে, আপিলকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৪১. রায়’-এর ক্ষেত্রে পেশকৃত বক্তব্য থেকে দেখা যায়, ছয় আসামিকে দোষী সাব্যস্তকরণ নিয়ে মতপার্থক্য থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ডিভিশন বেঞ্চে ১৪ ডিসেম্বর ২০০০ তারিখে নিমােক্ত আদেশ জারি করেন-
“ডেথ রেফারেন্স আংশিক গ্রহণ করা হয়েছে, ২০০০ সালের ২৬০৪, ১৯৯৮ সালের ২৬১৩ এবং ১৯৯৮ সালের ২৬১৬ নম্বর ফৌজদারি আপিল খারিজ করা হয়েছে। বিচারপতি মােঃ রুহুল আমিন কর্তৃক ১৯৯৮ সালের ২৬১৭ নম্বর ক্রিমিনাল লিভ টু আপিল পৃথক রায়ের মাধ্যমে মঞ্জুর করা হয়।
“(বিও) বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক কর্তৃক ডেথ রেফারেন্স অংশত গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৮ সালের ক্রিমিনাল লিভ টু আপিল নম্বর ২৬০৪, ২৬১৩, ২৬১৬ এবং ২৬১৭ খারিজ করা হয় পৃথক রায়ের মাধ্যমে।” (বিও)
“১৪.১২.২০০০। ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্সের রায় বিভক্ত হওয়ায় কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারার বিধান অনুযায়ী প্রয়ােজনীয় আদেশ জারির জন্য বিষয়টি মাননীয় প্রধান বিচারপতি সমীপে পেশ করা হােক।”

বিচারপতি মাে. রুহুল আমিন
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক

৪২. এরপর আপিলকারীরা ন্যায়বিচারের জন্য মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সকল বন্দি সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্সের শুনানি প্রার্থনা করে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের নিকট দরখাস্ত পেশ করে এবং শুনানির পর তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক বিজ্ঞ আইনজীবীর বক্তব্য সবিস্তারে শােনেন এবং তারপর ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০১ তারিখের আদেশ দ্বারা আবেদনটি নিমােক্ত যুক্তিতে প্রত্যাখ্যান করেন :
“উপরের আলােচনা এবং ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকগণের সমভাবে বিভক্ত অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে আমার অভিমত এই যে, উক্ত নয়জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি, যাদের ব্যাপারে অভিমত
৪৫২

প্রদানের ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারকগণ বিভক্ত নন, তাদের মামলাগুলাে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার বিধানাবলির আলােকে শুনানির প্রয়ােজন নেই। তবে শুধু আসামি আব্দুল মাজেদের ব্যাপারে পেনাল কোডের দুটি পৃথক ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা নিয়ে যে মতপার্থক্য রয়েছে সেটি সংশ্লিষ্ট মামলাটি এবং অপর পাঁচ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি, যাদের ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারকরা মতামত দিতে গিয়ে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন অর্থাৎ একজন বিজ্ঞ বিচারক দোষী সাব্যস্ত করেছেন ও অন্য বিজ্ঞ বিচারক খালাস দিয়েছেন তাঁদের মামলাগুলাে অভিমত প্রদানের জন্য এই আদালতের সম্মুখে রয়েছে। এই আদালত কর্তৃক অভিমত প্রদানের পর পুরাে ডেথ রেফারেন্সটি নিষ্পত্তির জন্য রায় ও আদেশ সেই অভিমতকে অনুসরণ করবে।”
৪৩. এটা প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আপিলকারীরা তৃতীয় বিচারকের উপরােক্ত আদেশের ব্যাপারে আপত্তি করেনি এবং তাদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ এরপর আপিল ও ডেথ রেফারেন্স সংক্রান্ত যুক্তিতর্ক উত্থাপন করেছিলেন। এরপর তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক শুনানি শেষে নিমােক্ত অভিমত প্রদান করেন :
“এই রায়ের গর্ভে উপরােক্ত আলােচনা, যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে আমার অভিমত এই যে, ঢাকার বিজ্ঞ দায়রা জজ আসামি লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মােসলেমউদ্দীন ওরফে মােসলেউদ্দীনকে পেনাল কোডের ১২০বি ও ৩০২/৩৪ ধারায় সঠিকভাবেই দোষী সাব্যস্ত করেছেন এবং তাদেরকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন এবং আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়ে আমি লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মােসলেমউদ্দীন ওরফে মােসলেউদ্দীনের সঙ্গে সম্পর্কিত ডেথ রেফারেন্সটি গ্রহণ করলাম। আসামি লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) পেশকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৭ নম্বর ফৌজদারি আপিলটি খারিজ করা হলাে। তবে ঢাকার বিজ্ঞ দায়রা জজ ৩১৯/৯৭ নম্বর দায়রা মামলায় আসামি ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার ও মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলামকে যে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ প্রদান করেছেন তা বাতিলযােগ্য এবং সেই কারণে তা বাতিল করা হলাে এবং তদনুসারে আমার ভ্রাতা বিচারপতি মাে. রুহুল আমিনের সঙ্গে একমত হয়ে ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার ও মেজর আহমেদ শরিফুল ইসলাম ওরফে শরিফুল ইসলাম সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স নাকচ (rejected) করা হলাে।”
৪৪. অতঃপর হাইকোর্ট ডিভিশনের ৩০ এপ্রিল, ২০০১ তারিখের রায় ও আদেশ দ্বারা আপিলকারী মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)সহ তিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দি আসামির ক্ষেত্রে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ বজায় রাখা হয় এবং তাদের ডেথ রেফারেন্স গৃহীত হয় এবং ডেথ রেফারেন্সটি নিমােক্তভাবে নিষ্পত্তি করা হয় :
“ফলাফলের ভিত্তিতে, মৃত্যুদণ্ড অনুমােদন করে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর মাে. বজলুল হুদা, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, বীর উত্তম, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল একেএম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল এসএইচবিএম নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল আজিজ পাশা, লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), রিসালদার মােসলেমউদ্দীন ওরফে মােসলেউদ্দীন ও ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদের সঙ্গে সম্পর্কিত ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্স গৃহীত হলাে এবং তদনুযায়ী আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৬ নম্বর ফৌজদারি আপিল,
৪৫৩

আসামি লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬০৪ নম্বর ফৌজদারি আপিল, আসামি মেজর মাে. বজলুল হুদা দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৩ নম্বর ফৌজদারি আপিল এবং লে. কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) দায়েরকৃত ১৯৯৮ সালের ২৬১৭ নম্বর ফৌজদারি আপিল খারিজ করা হলাে।
“তবে আসামি ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসারের সঙ্গে সম্পর্কিত ১৯৯৮ সালের ৩০ নম্বর ডেথ রেফারেন্স নাকচ করা হলাে এবং তদনুযায়ী এই আসামিদের দণ্ডাদেশ ও সাজা বাতিল করা হলাে এবং এই মামলায় তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ থেকে তাদের খালাস দেওয়া হলাে।”
৪৫. আমার মতে, তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের প্রদত্ত ঐ রায় ও আদেশটি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার বিধানের সাথে সম্পূর্ণরূপে সঙ্গতিপূর্ণ। দ্বিতীয় যুক্তি অর্থাৎ বিলম্ব প্রসঙ্গে আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা বলেছেন, এজাহার দায়েরে অত্যধিক বিলম্ব হয়েছে এবং ২১ বছরের এই অযৌক্তিক বিলম্বের কারণে রাষ্ট্রপক্ষ সাজানাে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে আপিলকারী ও অন্যান্য আসামিকে অসত্যভাবে জড়িয়ে অসত্য কাহিনি তৈরি করেছে যা আপিলকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পরবর্তী সময়ে এ কথা যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ১৯৭৫ সালের দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারির কারণে এই বিলম্ব ঘটেছে তথাপি ২৬.৬.১৯৯৬ থেকে অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার তারিখ থেকে প্রায় তিন মাস সময় কেন লাগল তার কোনাে ব্যাখ্যা নেই।
৪৬. অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ কেবল এজাহার দায়েরের বিলম্বের কারণগুলােই ব্যাখ্যা করেননি উপরন্তু এই বিলম্ব এবং ঘটনার পর এজাহার দায়েরে তথ্যদাতার অসমর্থতা প্রমাণের জন্য অকাট্য তথ্যপ্রমাণও উপস্থাপন করেছে। এই বিলম্বের কারণ হলাে, পরবর্তী সরকারগুলাে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের দ্বারা আপিলকারী ও অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল এবং আপিলকারী ও অন্যান্য আসামিকে রক্ষা করেছিল। ঘটনার পর প্রতীয়মান হয়েছে, আপিলকারীরা ও অন্য আসামিরা শুধু যে তৎকালীন সরকারগুলাের আশ্রয়ে ছিল তা নয়, উপরন্তু তারা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান পদে অধিষ্ঠিতও ছিল। মেজর রশিদ ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। ফারুক রহমানের সঙ্গে মিলে ‘ফ্রিডম পার্টি’ নামে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিল। ফারুক রহমানও ১৯৮০-এর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল এবং বজলুল হুদা ছিল ফ্রিডম পার্টির সম্পাদক।
পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের হত্যায় জড়িত আসামিদের অধিকাংশকে বিদেশি মিশনগুলােতে নিয়ােগ দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন; যদিও তারা প্রকাশ্যে ঘােষণা করেছিল যে, তারাই তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করেছে। এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা যেখানে তখনকার একের পর এক ক্ষমতাসীন সরকার বর্তমান আপিলকারীসহ আসামিদের আশ্রয় দিয়েছিল ও রক্ষা করেছিল। বিধায়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত এজাহারকারী আশঙ্কা করছিলেন যে, মামলা দায়ের করা হলে তাঁর জীবনের উপর ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। উপরােক্ত বক্তব্যের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ State vs Fazal, 39 DLR (AD) 166, Md. Shamsuddin @ Lalu vs State, 40 DLR (AD) 69, Tara Singh vs State of Punjab 1991 Supp (1) SCC 536, Jamna vs State of UP 1994 Supp (1) SCC 185 978 State of HP vs Shreekanthia Shekari (2004) 8 SCC 153 মামলাগুলো
৪৫৪

উল্লেখ করেন। এখানে প্রতীয়মান হয় যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকরা বিলম্ব সম্পর্কিত ব্যাখ্যাটি বিশ্বাস করেছিলেন এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রপক্ষ অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে বিলম্বের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে।
৪৭. প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পর্যবেক্ষণ দেন যে :
“এ মামলায় এজাহার দায়েরে বিলম্বের বিষয়টির পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কয়েক বছর পার হবার পর এজাহার দায়ের হওয়ায় কারসাজি করা ও ঘটনার সঙ্গে মিথ্যাভাবে জড়ানাের অভিযােগ মামলার গুণাগুণকে নাকচ করে দেয়- এমন বক্তব্য বিবেচনাযােগ্য নয়।”
৪৮. দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক মন্তব্য করেন :
“এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী ও অন্যান্য সাক্ষীর সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যায়, বেশির ভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর দেশত্যাগে বাধ্য হবার আগ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে বঙ্গভবনে অবস্থান করত এবং অলিখিত কমান্ড কাউন্সিলের নামে দেশ চালাত। দেশত্যাগের পরও যে তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল না তা নয়। আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান সাভার ও বগুড়া সেনানিবাসে বিদ্রোহ ঘটানাের চেষ্টা করেছিল। মেজর খন্দকার আব্দুর রশিদ ১৯৭৬ সালে সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ড নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পুনরায় ১৯৮০ সালে তারা সরকার উৎখাতের আরেক দফা চেষ্টা চালায়। কিন্তু তারপরও কোনাে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনােরকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। বরং তাদের সবাইকে তাদের বকেয়া বেতন দেওয়া হয়েছিল। আসামি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিল (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষীর বর্ণনামতে)। কাজেই নিজের জীবনাশঙ্কা সম্পর্কে তথ্যদাতা যা বলেছেন তা অযৌক্তিক বলা যায় না। এমতাবস্থায় এজাহার দায়েরে বিলম্বের কারণে মামলা ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে না। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মামলার অভিযােগ প্রমাণ করা সর্বদাই রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্ব। সেহেতু, এজাহার দায়ের করার ব্যাপারে বিলম্ব সম্পর্কে আপিলকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর বক্তব্যের মধ্যে সারবত্তা নেই।”
৪৯. তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকও বিলম্বের ব্যাখ্যাটি বিশ্বাস করেছেন। বিজ্ঞ বিচারকরা তাঁদের যুক্তির সমর্থনে এই উপমহাদেশের বেশ কিছু সিদ্ধান্তও উদ্ধৃত করেন।
৫০. এটা সত্য যে, বিলম্বে এজাহার দায়ের করার ফলে ঘটনা-পরবর্তী চিন্তা দ্বারা ব্যাপারটিকে কখনাে কখনাে অতিরঞ্জিত করা হয়। তবে এ ব্যাপারে উচ্চতর আদালতগুলাের সঙ্গতিপূর্ণ অভিমত হলাে এই যে, মামলা দায়েরে স্রেফ বিলম্বের ব্যাপারটাই রাষ্ট্রপক্ষের মামলাকে অবিশ্বাস করার ভিত্তি হতে পারে না। কেননা নানা ধরনের পরিস্থিতির কারণে মামলা দায়েরে বিলম্বিত হতে পারে।
৫১.. অবশ্য Shreekant Thai (পূর্বোক্ত) মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় যে, এজাহার দায়ের করার সময় বিলম্বের বিষয়ে কোনাে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছিল কিনা তা অনুসন্ধান এবং বিবেচনার জন্য আদালতে তুলে ধরা হয়েছিল। বিলম্বের ব্যাখ্যা দেওয়া হলে আদালতের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু এইটুকু দেখা যে, প্রদত্ত ব্যাখ্যাটি সন্তোষজনক কিনা। রাষ্ট্রপক্ষ যখন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয় এবং এই বিলম্বের কারণে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা সাজানাে ও অতিরঞ্জিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তখন এটি প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে বিলম্বের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান আসামিকে অসত্যভাবে মামলায় জড়ানাের কিংবা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা দুর্বলসংক্রান্ত যুক্তিসমূহ নাকচ করার জন্য যথেষ্ট।
৪৫৫

৫২. এই মামলার এজাহারে এজাহারকারী ১৪ জন আসামিকে সম্পৃক্ত করে এজাহার দায়ের করেছেন এবং তাদের মধ্যে কেবল বজলুল হুদার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটনের সুনির্দিষ্ট অভিযােগ করেছেন; আরাে তিনজন আসামিকে শনাক্ত করেছেন এবং অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাকি আসামিদের সম্পৃক্ত করেছেন। এজাহারকারীর যদি আপিলকারী ও অন্যান্য আসামিকে জড়িত করার অথবা তাদের বিরুদ্ধে অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশন করার দুরভিসন্ধি থাকত তাহলে প্রত্যেক আসামি যে যে ভূমিকা পালন করেছিল সুস্পষ্টভাবে এজাহারে উল্লেখ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে পথ অবলম্বন করেননি। এ থেকে এটি প্রতিভাত হয় যে, এজাহারকারী ঘটনাস্থলে যা দেখেছেন এবং তদন্তকারী সংস্থা মামলার তদন্তকালে আপিলকারী ও অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে তাদের যােগসাজশ সম্পর্কিত যে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছেন এজাহারে সেটিরই সঠিক বর্ণনা করা হয়েছে।
৫৩. আরাে দেখা যায় যে, ঘটনার পর খােন্দকার মােশতাক আহমেদ অন্যায়ভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং তিনি ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট সামরিক আইন জারি করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন সাধনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনাে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে কিংবা সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত কোনাে কাজ বা বিষয়ের ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত বা অপর কোনাে কার্যক্রম গ্রহণের উপর বিধিনিষেধ আরােপ করে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেন। দেখা। যাচ্ছে যে, উক্ত অধ্যাদেশ জারির পর একটি এজাহার দায়ের করা যেতে পারত কি পারত না সেটা আইনি ব্যাখ্যার বিষয় এবং আরও দেখা যায় যে, উক্ত অধ্যাদেশটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও ফেলেছিল।
৫৪. আরও উল্লেখ করতে হয় যে, লে. কর্নেল শাফায়াত জামিল (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী) তাঁর জবানবন্দিতে বলেছিলেন যে, আপিলকারী ফারুক রহমান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেজর রশিদ সর্বদাই বঙ্গভবনে অবস্থান করতেন; তাদের সহযােগী অফিসাররা রেডিও স্টেশনে অবস্থান করতেন; একটি অলিখিত বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ রাখতেন এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদের নেতৃত্বে দেশ শাসন করতেন। ঘটনার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকারগুলাে ১৫ আগস্টের ঘাতকদের নিরাপত্তা দেওয়ায় ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনাে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না।
৫৫. স্বীকৃত মতে, তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর বাসভবনে থাকা তাঁর পরিবারের অপর সব সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। উপরােক্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থন না থেকে থাকলে ক্ষমতাসীন সরকারগুলাের বাধ্যবাধকতাপূর্ণ দায়িত্ব ছিল মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে মামলা রুজু করা এবং ঘাতকদের বিচার করা। কিন্তু এই নির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে আইনের প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব পথে চলতে দেওয়া হয়নি। বরং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করে ক্ষমতাসীন সরকার আপিলকারীদেরসহ আসামিদের রক্ষা করতে চেয়েছিল এবং আরও বলতে হয় যে, প্রাথমিকভাবে তাদের কয়েকজন অপসারিত সেনা অফিসার হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করে বৈদেশিক মিশনগুলােতে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল।
৫৬. আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আরাে বলতে হয়, নিহত বা ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে কেউ দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির ঘাতকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের না করে থাকলেও সরকার এই মামলা রুজু করতে আইন অনুযায়ী বাধ্য ছিল, বিশেষ করে যখন একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে পরিবার-পরিজনসহ নিষ্ঠুরভাবে হত্যা
৪৫৬

করা হয়েছিল। আরাে বলতে হয় যে, আপিলকারীরাসহ অপর আসামিরা হত্যাকাণ্ডের অপরাধই শুধু করেনি, তারা একটি শিশু ও তিন নিরপরাধ নারীকে হত্যা করে মানবতার বিরুদ্ধে বর্বরতা সংঘটন করেছে। উপরন্তু উক্ত হত্যাপরাধ একটি আমলযােগ্য অপরাধ বিধায়, কেউ যদি নিহতদের পক্ষ থেকে এমন অপরাধের জন্য এফআইআর দায়ের না-ও করে থাকেন, সেক্ষেত্রে ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৭৩ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই এমন অপরাধের তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করা।
৫৭. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আজমালুল হােসেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারগুলাের ন্যায়বিচার প্রয়ােগের পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট সময়ে ন্যায়বিচার প্রয়ােগ পদ্ধতিটি সব দিক দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল, যেটির দায়মােচন করা যায় না। ন্যায়বিচার প্রয়ােগ ব্যবস্থার এই ব্যর্থতা দেশে সুবিশাল বিপর্যয়কর প্রভাব রেখেছে, যার পুনরাবৃত্তি দেশের স্বার্থেই ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। জনাব হােসেন বলেন, এটা হলাে ইতিহাসের অংশ, যা মুছে দেওয়া যায় না। আগা থেকে গােড়া পর্যন্ত গােটা প্রশাসন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল, যা আমাদের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এ ধরনের অনুশীলন চিরতরে বন্ধ হওয়া উচিত এবং আর যেন এর পুনরাবৃত্তি ঘটে।
৫৮. উপরিউক্ত বক্তব্যগুলাের মাঝে সারবত্তা আছে। কারণ ন্যায়বিচার আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বদান্যতা, মহানুভবতা, কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব ও করুণা থেকে ন্যায়বিচার আলাদা। ন্যায়বিচার হলাে সমাজের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মর্মমূলে রয়েছে নিরপেক্ষতার ধারণা। আরাে বলা যায়, সরকার মানুষের নয়, আইনের। আইন যখন শেষ হয়ে যায় তখন শুরু হয় স্বৈরাচার। স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার অতি বৈপরীত্য হলাে আইন। বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের মধ্যে হত্যাপরাধ কিংবা হত্যা সংঘটনে আদেশ প্রদান অবশ্যই বেআইনি ও অনৈতিক। সেই কারণে নাৎসিরা কখনই গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেনি, বরং বন্দিশিবিরের কয়েদিদের হত্যার আদেশ সর্বদাই গােপন ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল। এমনকি নাৎসিরাও স্বীকার করে যে, এ ধরনের আচরণ আইনের কোনাে ব্যবস্থায়ই কখনাে যৌক্তিক ছিল না।
৫৯. একটা দেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার লক্ষ্য হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দেশের নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখা। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের রক্ষাকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রয়ােগ ও আইনের শাসন সুনিশ্চিত করা। জনগণের স্বার্থেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত অপরাধীর অপরাধ যত দ্রুত সম্ভব নির্ণয় করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যা করার পর এই ধারণাটি উপেক্ষিত হয়েছে। একটা শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে অপরাধকর্মে জড়িত প্রতিটি অপরাধীর বিচার করা গুরুত্বপূর্ণ এবং এসব বিচার মােটামুটি দ্রুতগতিতে হওয়া উচিত। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলাে হচ্ছে নাগরিকদের জন্য একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত ও কার্যকর উপায়ে ন্যায়বিচার প্রয়ােগ করতে গিয়ে নাগরিক ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অধিকারের ভারসাম্য বিধান করা। সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের সুযােগ না থাকলে আইনের শাসন অর্থহীন।
৬০.আমার কাছে মনে হয়েছে, এফআইআর দায়েরে বিলম্বের কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের দেওয়া ব্যাখ্যা বিশ্বাস করার পক্ষে বিজ্ঞ বিচারকরা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়েছেন। তদুপরি এটা নথিতে থাকা সাক্ষ্যপ্রমাণ নির্ভর হওয়ায় সংবিধানের ১০৩ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে এক্ষেত্রে এই বিভাগের হস্তক্ষেপ করার সুযােগ অত্যন্ত সীমিত।
৪৫৭

৬১. অতএব আমার অভিমত হচ্ছে, বিলম্বের কারণ যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাখ্যাত হওয়ায় এ বিষয়ে এই বিভাগের হস্তক্ষেপের কোনাে প্রয়ােজন পড়ে না। তৃতীয় ভিত্তি অর্থাৎ বিদ্রোহের ব্যাপারে আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা এই অভিন্ন বক্তব্য পেশ করেছেন যে, লিপিবদ্ধ সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে প্রকাশ পায় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তন ছিল কিছুসংখ্যক সেনা অফিসারের বিদ্রোহের ফল; তাই বিচারকার্যটি ১৯৫২ সালের আর্মি অ্যাক্টে অনুযায়ী কোর্ট মার্শালে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল এবং তদনুযায়ী কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধানের অধীনে আপিলকারীদের এই বিচারটি ছিল এখতিয়ারবহির্ভূত এবং এই বক্তব্যের সমর্থনে আর্মি অ্যাক্টের ৩১(এ), ৫৯(৩), ৯২(২), ৯৪ ও ৯৫ ধারা; পেনাল কোডের ৫ ও ১৩৯ ধারা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯(২) ধারাগুলাে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
৬২. জনাব খান সাইফুর রহমান আরাে নিবেদন করেন যে, ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে তাৎক্ষণিক ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিল এবং এটি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি ছিল একটা সহজ-সরল বিদ্রোহ এবং তদুপরি পেনাল কোডের ৩৪ ধারা কিংবা ১২০এ ধারার আওতাধীনে এ সংক্রান্ত কোনাে চুক্তি বা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বা পূর্বপরিকল্পিত পরিকল্পনা বা পূর্ব আয়ােজিত পরিকল্পনার অস্তিত্ব ছিল না। বিজ্ঞ আইনজীবী আরাে যুক্তি দেখান যে, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের ঘটনায় কোনাে অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার কিংবা সেনা আইনের অধীন নয় এমন অপর কোনাে ব্যক্তি যােগ দিয়ে থাকলেও আর্মি অ্যাক্টের ৩১ ধারার পরিসীমার মধ্যে সেটাও হবে বিদ্রোহ এবং সে অনুযায়ী তাদেরকেও সেনা আইনের অধীনেই কোর্ট মার্শালে বিচার করা উচিত ছিল। উপরন্তু বর্তমান আপিলে উল্লিখিত রাষ্ট্রপতির হত্যাকাণ্ড ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সাদৃশ্য আছে। এই দিক দিয়ে যে, তাদের উভয়ই ছিলেন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি এবং তারা সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। বর্তমান আপিলের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার ইউনিটের অফিসার ও জওয়ানরা ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভােরবেলায় রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সরকারি বাসভবনে হত্যা করেছিল। অন্যদিকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে সেনাসদস্যরা ১৯৮১ সালের ২৯ মে দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে এসে তিনি যেখানে অবস্থান করছিলেন, সেই সার্কিট হাউসে তাকে হত্যা করে। যেহেত, উভয় হত্যাকাণ্ড একইভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তাই আপিলকারীদের, যদি তারা ১৫ আগস্টের ঘটনায় আদৌ জড়িত থেকে থাকে, কোর্ট মার্শালে বিচার হওয়া উচিত ছিল, যেমনটি হয়েছে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বেলায়। অধিকন্তু, রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তার হত্যাকাণ্ডের বিচার কোর্ট মার্শালে হওয়া উচিত ছিল। এই বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞ আইনজীবী Jamil Huq os Bangladesh, 34 DLR (SC) 125 মামলাটি উদ্ধৃত করেন।
৬৩. অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক বলেন, ঘটনাটি ‘বিদ্রোহ’ নয়, বরং তা ছিল পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং সেই কারণে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধানের অধীনে আপিলকারীদের বিচারে আইনগত কোনাে বাধা নেই, যা আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এর ৫৯, ৯২, ৯৪, ৯৫ ধারা, নেভি অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১-এর ৩৫ ধারা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার বিধানসমূহে পরিদৃষ্ট হবে। জনাব হকের এই বক্তব্য অনুমােদন করে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এর সঙ্গে যােগ করেন যে, আপিলকারীরা বিচারিক আদালতে এ বিষয়টি উত্থাপন করেনি এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করার অসদুদ্দেশ্য নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগে প্রথমবারের মতাে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছে। উপরন্তু, নথিতে থাকা সাক্ষ্যপ্রমাণ বিদ্রোহের ব্যাপারটা
৪৫৮

সমর্থন করে না, বরং তা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাই প্রকাশ করে এবং সে মােতাবেক আপিলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ যথাযথভাবেই গঠিত হয়েছে। এমনকি যদি এটি ধরেও নেয়া যায় যে, আর্মি অ্যাক্টের ৮(২) ধারার সাথে ৫৯(২) ধারার পঠিত অর্থে ঘটনাটা একটা সিভিল অপরাধ (civil offence) তথাপি আর্মি অ্যাক্টের ৯৪ ধারা অনুসারে এমন অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার ফৌজদারি আদালতের রয়েছে। তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাংবিধানিকভাবে আইনগত ব্যক্তিত্ব, অবস্থান ও সুরক্ষা ভােগ করার বিষয়টি একটিমাত্র আইন অর্থাৎ আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২ কিংবা সেই আইনের কোনাে বিধানের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাঁকে ‘সেনা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনার পরিবর্তে সংবিধানের আলােকে বিবেচনা করতে হবে।
৬৪. রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী তৌফিক নেওয়াজ নিবেদন করেন, তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের সময় বলবৎ থাকা সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের কতিপয় বিধানে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ও আইনগত ব্যক্তিত্বের যে পুরাে চিত্রটি দেওয়া ছিল সেটি অত্যন্ত স্পষ্ট। সে অনুযায়ী তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাংবিধানিকভাবে আইনগত ব্যক্তিত্ব এবং অবস্থান ও সুরক্ষা ভােগ করার বিষয়টি সংবিধানের আলােকে বিবেচনা করতে হবে, তা সে সময়ের একটিমাত্র আইন অর্থাৎ আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২ কিংবা সেই আইনের কোনাে বিধানের অধীনে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হওয়ায় তাঁকে ‘সেনা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা সমীচীন হবে না এবং সেই কারণে কোর্ট মার্শালের পরিবর্তে ফৌজদারি আদালতে আপিলকারীদের বিচার করা আইনসম্মত।
৬৫. দেখা যায় যে, আসামিপক্ষ রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরাকালে কিংবা ডিফেন্স সাজেশন দিয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সময় বিদ্রোহের কোনাে অজুহাত (plea) নেয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা আসামিপক্ষের বিদ্রোহের অজুহাতের সমর্থনে কিছু না বলায় আসামিপক্ষের উচিত ছিল রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, বিদ্রোহে জড়িত অফিসার ও জওয়ানরা তাদের দাবিনামা পেশ করেছিল, যে দাবিনামা মেনে না নেওয়ায় তারা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে। কিন্তু পক্ষান্তরে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষীকে এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, মেজর ডালিম যখন হত্যাকাণ্ডের খবর বেতারে ঘােষণা করছিল, সে সময় রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী দেশে মার্শাল ল জারি এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়ার কথা জানতেন। সাক্ষীকে এই সাজেশন প্রদানের মধ্য দিয়ে আসামিপক্ষ বলতে চেয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার পর সামরিক আইন ঘােষিত হয় এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদ দেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন এবং এই ডিফেন্স সাজেশন দ্বারা আসামিপক্ষ এই সমর্থনসূচক কৈফিয়ত দাঁড় করাতে চেয়েছিল যে, যেহেতু ঐ হত্যাকাণ্ড ছিল সেনাবাহিনীর সফল বিদ্রোহের পরিণতি, তাই এমন হত্যাকাণ্ড কোনাে হত্যাপরাধ নয়।।
৬৬. অবশ্য এটি প্রতিভাত হয় যে, রাষ্ট্রপতি নিহত হবার পর সংবিধানের বিধানাবলি অনুযায়ী তদানীন্তন উপ-রাষ্ট্রপতির উচিত ছিল রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করা। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সংবিধানের সেই বিধানগুলােকে উপেক্ষা করা হয়েছিল। তদুপরি, কোনাে বিদ্রোহ হয়ে থাকলে ক্ষমতাসীন সরকারের উচিত ছিল ঘটনায় জড়িত অফিসার ও জওয়ানদের বিদ্রোহের জন্য আর্মি অ্যাক্টের অধীনে বিচার করা। অথচ এ ধরনের কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া তাে হয়ইনি, বরং ঘাতকরা সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছিল। বেতার কেন্দ্রের কর্মচারী মােঃ রিয়াজুল হক (রাষ্ট্রপক্ষের ৩৭ নম্বর সাক্ষী) জবানবন্দি প্রদানকালে বলেছেন, মেজর ডালিম সকাল ৯টায় তিন বাহিনীর প্রধানদের এবং সেই সঙ্গে বিডিআর প্রধান ও পুলিশের আইজিকে ২
৪৫৯

নম্বর স্টুডিওতে নিয়ে আসে এবং পট পরিবর্তনের পক্ষে তাদের আনুগত্যমূলক বিবৃতি সেখানে রেকর্ড ও সম্প্রচার করা হয়। লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদের পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৫ নম্বর সাক্ষী) এই সাজেশন দিয়ে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সকালে এক সফল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং সেই অভ্যুত্থানে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিন প্রধানের সবাই তাদের অনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি (শফিউল্লাহ) ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি এবং খােন্দকার মােশতাক ঘাতকদের ‘সূর্যসন্তান’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ফারুক রহমানের পক্ষে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল সাফায়াত জামিল (রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী) বলেন, ১৫ আগস্টের ঘাতকদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ পরবর্তী সরকারগুলাে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের নিরাপত্তা ও আনুকূল্য দিয়েছিল এবং ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা ও ঘাতকরা বঙ্গভবনে অবস্থান করত এবং তারা একটা বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে মােশতাক সরকারকে চালাত।
৬৭. সাক্ষীদেরকে দেওয়া উপরােক্ত ডিফেন্স সাজেশনের মাধ্যমে আপিলকারীরা ঘটনাটিকে এক সফল সামরিক অভ্যুত্থান হিসাবে আখ্যা দিয়েছিল। সরকারগুলােও তাদের নিরাপত্তা দিয়েছিল ও সূর্যসন্তান’ হিসেবে ঘােষণা দিয়ে তাদের পুরস্কৃতও করেছিল এবং আপিলকারীরা বিদ্রোহের পক্ষে কোনাে কেস তুলে ধরার চেষ্টা করেনি। আরাে দেখা যায় যে, ৩৪২ ধারার অধীনে প্রদত্ত বিবৃতিতে তারা এই প্রশ্নে দৃশ্যত নীরব ছিল। হাইকোর্ট বিভাগে আপিলের পর্যায়ে এসে তারা তাদের অবস্থান বদলে ফেলে, যদিও এই কৈফিয়তের সমর্থনে কোনাে বস্তুগত প্রমাণ নেই। আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এ বিদ্রোহের কোনাে সংজ্ঞা দেওয়া না হলেও সেই আইনের ৩১ ধারায় বিদ্রোহের জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নেভী অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১-এর ৩৫ ধারায় বিদ্রোহের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে :
“35. In this Ordinance, mutiny means a combination between two or more persons subject to service law, or between persons two at least of whom are subject to service law
|
to overthrow or resist lawful authority in the armed forces of Bangladesh or any forces co-operating therewith or in any part of any of the said forces;
(b) to disobey such authority in such circumstances as to make the disobedience subversive of discipline, or with the object of avoiding any duty or service, or in connection with operations against the enemy; or
(c) to impede the performance of any duty or service in the armed forces of Bangladesh or in any forces co-operating therewith, or in any part of any of the said forces.
” এ বিষয়ে কোনাে বিতর্ক নেই যে, ‘বিদ্রোহ’-এর এই সংজ্ঞাটি নেভী অর্ডিন্যান্স ১৯৬১-এর 4(xxxiv) | ধারায় প্রদত্ত ‘service law’-এর সংজ্ঞার আলােকে আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এ সজ্ঞায়িত বিদ্রোহের ক্ষেত্রে
৪৬০

প্রযােজ্য। ঐ ধারা অনুসারে ‘service law’ বলতে এই অধ্যাদেশ, আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২, এয়ার ফোর্স অ্যাক্ট ১৯৫৩ এবং এসবের অধীনে প্রণীত বিধি ও বিধানসমূহকে বােঝায়।
৬৮. খান সাইফুর রহমান নিবেদন করেন যে, আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৫৯ ধারায় ব্যবহৃত সক্রিয় সৈন্যদলে থাকাকালীন (অ্যাকটিভ সার্ভিস) কথাটা এই মামলার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। তথাপি উপরােক্ত বক্তব্য স্ববিরােধী, কারণ আপিলকারীরা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর কতিপয় বিধানের ওপর নির্ভর করে ফৌজদারি আদালতের প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করেছে।
৬৯. জনাব হকের মতে, নেভী অর্ডিন্যান্স ১৯৬১-এর ৩৫ ধারায় প্রদত্ত বিদ্রোহের এই সংজ্ঞাটি আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৩১ ধারার সঙ্গে পাঠ করতে হবে এই উপসংহারে পৌছার জন্য যে, আপিলকারীদের কার্যকলাপ বিদ্রোহের মতাে দুষ্কর্মের আওতার মধ্যে পড়ে না। ৩১ ধারার (ক) বিধিতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর আইনসম্মত কর্তৃপক্ষকে উৎখাত করা বা প্রতিহত করার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। কিন্তু নথিপত্রে এমন কিছুরই উল্লেখ নেই যা থেকে এটি প্রমাণ হয় যে, আপিলকারীরা ও অন্য আসামিরা সম্মিলিতভাবে কর্তৃপক্ষের অবাধ্যতা করেছে কিংবা অগ্রাহ্য বা অবজ্ঞা করেছে কিংবা কর্তৃপক্ষের আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যার ফলে তাদের সেই কর্মকাণ্ড বিদ্রোহের আওতার মধ্যে পড়ে। তদুপরি, রেকর্ডকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষ বরং আপিলকারীদের ও অন্য আসামিদের, যারা সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুব্ধ ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, কর্মকাণ্ড মেনে নিয়েছিল এবং তাদের কয়েকজনকে সরকার পুরস্কৃতও করেছিল।
৭০. আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৫৯ (১) ধারায় বলা আছে যে, উপধারা (২)-এর বিধানাবলি সাপেক্ষে আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীন কোনাে ব্যক্তি যদি কোথাও সিভিল অপরাধ সংঘটিত করে তাহলে সে সেনাবাহিনী আইনের অধীনে অপরাধের জন্য দোষী বলে গণ্য হবে। আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৮(২) ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী সিভিল অপরাধ বলতে এমন অপরাধকে বােঝায়, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হলে ফৌজদারি কোর্টে সেই অপরাধের বিচার করা যাবে। কাজেই এ ব্যাপারে কোনাে বিরােধ বা বিতর্কের অবকাশ নেই যে, আপিলকারীদের কার্যকলাপ ‘সিভিল অপরাধের মতাে দুষ্কর্মের মধ্যে পড়ছে। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের অধীনে গঠিত একটি ফৌজদারি আদালতে আপিলকারীদের বিচারের ব্যাপারে কোনাে আইনগত বাধা নেই। অবশ্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৫৯(২) ধারায় বলা আছে যে, সেনাবাহিনী আইনের আওতাধীন কোনাে ব্যক্তি যদি আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর আওতাধীন না-থাকা কোনাে ব্যক্তিকে হত্যা করে তাহলে সে সেনাবাহিনী আইনের অধীনে বিচারযােগ্য হবে না। যদি না সে সৈন্যদলে সক্রিয় থাকাকালীন অবস্থায় এই অপরাধ করে।।
৭১. সক্রিয় সৈন্যদল (active service) কথাটা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৮(১) ধারায় নিমােক্তরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে :
“active service”, as applied to a person subject to this Act, means the time during which such person is attached to, or forms part of a force which is engaged in operations against an enemy, or is engaged in military operations in, or is on the line of march to a country or place wholly or partly occupied by an enemy, or is attached to or forms part of a force which is in military occupation of a foreign country;”
৪৬১

৭২. আপিলকারীদের ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে এমন অভিযােগ আনা হয়নি যে, সক্রিয় সৈন্যদলে থাকাকালীন অবস্থায় তারা হত্যাপরাধ করেছে এবং আপিলকারীরাও দাবি করেনি যে, তারা সক্রিয় সৈন্যদলে থাকা অবস্থায় ঐ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।
৭৩. রেকর্ডভুক্ত এমন উপকরণও নেই যা থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, আপিলকারীরা শত্রুর বিরুদ্ধে অভিযানে নিয়ােজিত থাকাকালে কিংবা কোনাে সামরিক অভিযানে নিয়ােজিত থাকাকালে অথবা শত্রু কর্তৃক সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে অধিকৃত কোনাে দেশ বা স্থান অভিমুখে অগ্রসরমাণ থাকাকালে ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল।
৭৩. উপরােক্ত আইনের প্রাসঙ্গিক বিধান অনুযায়ী আপিলকারীরা যদি সক্রিয় সৈন্যদলে না থাকাকালীন অবস্থায় সিভিল অপরাধ সংঘটিত করে তাহলে ফৌজদারি আদালতে বিচারের পথে সেনাবাহিনী আইনের বিধানগুলাে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। উপরন্তু, সাধারণ ফৌজদারি আদালতে সিভিল অপরাধের বিচারের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর নবম অধ্যায়ে ৯৪ ও ৯৫ ধারাকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৯৪ ধারায় আগেই মেনে নেওয়া হয়েছে যে, আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এ শাস্তিযােগ্য কোনাে কাজ বা বিচ্যুতির ক্ষেত্রে কিংবা যে ক্ষেত্রে কোনাে অপরাধ সেনাবাহিনী আইনের আওতাভুক্ত এবং একই সময় তা দেশে বলবৎ যে কোনাে আইনের আওতাভুক্ত বলে গণ্য সেই অপরাধের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয়ের সমান্তরাল এখতিয়ার থাকবে। এক্ষেত্রে কোন আদালতে মামলাটি রুজু করা হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব একজন অনুমােদিত অফিসারের ঐচ্ছিক ক্ষমতার উপর ছেড়ে দেওয়া হবে। অনুমােদিত অফিসার যদি সিদ্ধান্ত নেন যে, মামলাটি কোর্ট মার্শালে রুজু হওয়া উচিত, তবে সেক্ষেত্রে অপরাধীকে সামরিক হেফাজতে আটক রাখা হবে। অবশ্য একই সময়ে যদি কোনাে ফৌজদারি আদালত মনে করে যে, উক্ত অপরাধের বিচার ফৌজদারি আদালতেই হতে হবে তাহলে ৯৫ ধারার অধীনে নােটিশ জারি করে অপরাধীকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করতে পারে অথবা সরকারের কাছে রেফারেন্স প্রেরণসাপেক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে পারে। রিকুইজিশন পাওয়ার পর অনুমােদিত অফিসার অপরাধীকে হয় উক্ত আদালতের কাছে হস্তান্তর করবেন, নয়তাে কার আদেশ চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে তা নির্ধারণের জন্য বিষয়টি সরকারের কাছে পাঠাবেন।
৭৪. আমি জনাব তৌফিক নেওয়াজের এই বক্তব্যের সঙ্গেও একমত যে, সংবিধানে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতির যে অবস্থান নির্দেশ করা ছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে শুধু একটিমাত্র আইন আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর কারণে এবং সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হবার জন্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে সেনাবাহিনীর সদস্য বলে গণ্য করা যায় না।
৭৫. আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীরা আরাে নিবেদন করেছেন যে, পেনাল কোডের ১৩৯ ধারা ও কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার আলােকে ফৌজদারি আদালতে আপিলকারীদের বিচার অনুষ্ঠানে বাধা আছে।
৭৬. কোডের ১৩৯ ধারাটি সপ্তম অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত যেখানে ১৩১ থেকে ১৪০ ধারা বিধৃত রয়েছে। দেখা যাবে যে, ১৩১ ধারায় বিদ্রোহ ঘটাতে সহায়তা করা বা কোনাে সৈনিক, নাবিক বা বিমানসেনাকে তার কর্তব্য থেকে বিচ্যুত করতে প্ররােচিত করার চেষ্টা, ১৩২ ধারায় বিদ্রোহ সংঘটনে প্ররােচিত করা, যদি ঐসব কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে বিদ্রোহটি সংঘটিত হয় এবং অন্য ধারাগুলােয় অপরাপর অপরাধ সংঘটনে প্ররােচনা দেওয়ার কথা রয়েছে এবং ১৩৯ ধারায় ১৩১ থেকে ১৩৮ পর্যন্ত ধারাসমূহে বর্ণিত অপরাধসমূহ সংঘটনে সহায়তাদানের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২, নেভী অর্ডিন্যান্স ১৯৬১, এয়ার ফোর্স অ্যাক্ট ১৯৫৩-এর আওতাধীন যে কোনাে ব্যক্তিকে পেনাল কোডের বিধান অনুযায়ী শাস্তিদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে বিদ্রোহে সহায়তার মতাে অপরাধ সংঘটনের জন্য নয়, বরং অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও
৪৬২

হত্যার গুরুতর অপরাধের জন্য আপিলকারীদের বিচার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান। আপিলগুলাের ক্ষেত্রে পেনাল কোডের ১৩৯ ধারার কোনাে প্রয়ােগ বা কার্যকারিতা নেই। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই ধারাটি এক বিশেষ প্রকৃতির এবং এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী আইনের আওতাভুক্ত ব্যক্তিদের বিষয়ে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার নিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই ধারায় বিধৃত “is liable to be tried either by a Court to which this Code applies or by a Court Martial” কথাগুলাের অর্থ হলাে এই যে, যে অপরাধের জন্য অপরাধীর বিচার করা হবে সেটা হতে হবে এমন অপরাধ যা ফৌজদারি আদালত এবং কোর্ট মার্শালও আমলে নিতে তথা বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারে। এই কথাগুলাে অপরাধকে আমলে নিতে দুই আদালতের প্রাথমিক এখতিয়ারকে বুঝিয়েছে এবং অপরাধের গুণাগুণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ারকে বােঝায়নি। উপরের আলােচনা অনুসারে ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয় আদালতে বিচারযােগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে এই দুই আদালতের এখতিয়ারগত সংঘাত এড়ানাের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৯৪ ও ৯৫ ধারায় উপযুক্ত বিধান রাখা হয়েছে।
৭৭. এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ভারতে প্রযােজ্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫০-এর ১২৫ ও ১২৬ ধারা এবং আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৯৪ ও ৯৫ ধারা অক্ষরে অক্ষরে এক। ৭৮. Balbir Singh os State of Punjab (1995) 1 SCC 90 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“কোনাে অপরাধের বিচারের ব্যাপারে ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শাল উভয়েরই যখন এখতিয়ার থাকে তখন কোন আদালতে মামলাটি রুজু করা হবে তা নিজের বিবেচনা বা বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রথমত আপরাধী যে গ্রুপ, উয়িং বা স্টেশনে কর্মরত সেটির কমান্ডিং অফিসারের বা অনুমােদিত অপর কোনাে অফিসারের হাতে থাকবে। সেই অফিসার যদি ঠিক। করেন যে কোর্ট মার্শালে মামলা রুজু করা উচিত হবে, তাহলে সেটা রুজু করার জন্য অপরাধী বা অপরাধীদের বিমানবাহিনীর হেফাজতে আটক রাখতে হবে। কাজেই যখন এয়ার ফোর্স অ্যাক্টের আওতাধীন কোনাে ব্যক্তি, যিনি সক্রিয় সৈন্যদলে থাকাকালীন অবস্থায় অপরাধ করেন, তখন তার বিচার করার বিকল্প ক্ষমতা প্রথমত থাকবে বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষের। এ ধরনের আসামিকে ফৌজদারি আদালতে হাজির করা হলে আদালত ঐ ব্যক্তির বিচারে অগ্রসর হবেন না, তাকে বিচার করবেন না কিংবা বিচারের জন্য তাকে সােপর্দ করার লক্ষ্যে তদন্ত পরিচালনা করবেন না। আদালত এটা নির্ধারণ করার জন্য আসামির কমান্ডিং অফিসারকে নােটিশ দেবেন যে, তারা কোর্ট মার্শালে আসামিকে বিচার করতে চান নাকি ফৌজদারি আদালতকে বিচারকাজ করতে অনুমতি দিতে চান। বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ যদি কোর্ট মার্শালে ঐ ব্যক্তির বিচার না করার সিদ্ধান্ত নেন কিংবা ১৯৫২ সালের বিধানাবলির ৪ নম্বর বিধি অনুযায়ী অনুমােদিত সময়সীমার মধ্যে ফৌজদারি আদালত কর্তৃক জানিয়ে দেওয়া বিকল্প পন্থাটি অবলম্বন করতে ব্যর্থ হন সেক্ষেত্রে আসামিকে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর অনুযায়ী সাধারণ ফৌজদারি আদালতে বিচার করা যেতে পারে।”
৭৯. Joginder Singh os State of Himachal Pradesh, AIR 1971 SC 500 মামলায় সুপ্রীম কোর্ট নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“এটা আরাে স্পষ্ট যে, ফৌজদারি আদালতেও বিচার হতে পারে, আবার কোর্ট মার্শালেও বিচার হতে পারে এমন অপরাধের ক্ষেত্রে সাধারণ ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শালের মধ্যকার এখতিয়ারগত
৪৬৩

সংঘাত এড়ানাের জন্য ১২৫ ও ১২৬ ধারায় ও বিধিসমূহে উপযুক্ত বিধান রাখা হয়েছে। তবে লক্ষ করতে হবে যে, প্রথম ক্ষেত্রে কোন আদালতে মামলা রুজু করতে হবে তা নির্ধারণের জন্য ১২৫ | ধারায় উল্লিখিত অফিসারকে বিবেচনামূলক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সেই হেতু, আসামি বা অভিযুক্ত ব্যক্তি যে সেনাবাহিনী, আর্মি কোর, ডিভিশন বা স্বাধীন ব্রিগেডে কর্মরত, তার কমান্ডিং অফিসার অথবা নির্দিষ্ট করে দেওয়া অপর কোনাে অফিসারকে ১২৫ ধারার অধীনে তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন আদালতে মামলাটি রুজু করা হবে। তিনি যখন তার এই বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ করে সিদ্ধান্ত নেবেন, মামলাটি একটি কোর্ট মার্শালে রুজু করতে হবে তখনই কেবল ১২৬(১) ধারার বিধানাবলি কার্যকর হবে। এ কাজের জন্য মনােনীত অফিসার যদি তার বিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়ােগ না করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যে, মামলাটি কোর্ট মার্শালে রুজু হতে হবে তাহলে আইনের বিধান অনুসারে ফৌজদারি আদালতের সাধারণ এখতিয়ার প্রয়ােগে আর্মি অ্যাক্ট স্বভাবতই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।”
৮০. Major EG Barsay os State of Bombay, AIR 1961 SC 1762 মামলায় বিচারপতি সুভা রাও এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“অতএব এই আইনের উদ্দেশ্য স্বপ্রমাণিত (self-evident)। এটা আইনের ২ নম্বর ধারায় বর্ণিত সেনাবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। এই আইনে সুনির্দিষ্ট সাজার ব্যবস্থাসহ নতুন অপরাধ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং আগে থেকে বিদ্যমান অপরাধের জন্য উচ্চতর সাজার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সত্য বলে ধরে নেওয়া দেওয়ানি অপরাধকে এই আইনের অধীন অপরাধ বলে পরিগণিত করে তােলা হয়েছে। এখানে এখতিয়ারগত সংঘাত নিরসনের সন্তোষজনক। ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। উপরন্তু এই আইনে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে একজন আসামিকে উপর্যুপরি কোর্ট মার্শাল ও ফৌজদারি আদালতে বিচারের সুযােগ রাখা হয়েছে। এই আইনের অধীনে শাস্তিযােগ্য কার্য বা অকরণ (omissions), যদি তা ভারতে বলবৎ অপর যে কোনাে আইনেও শাস্তিযােগ্য হয়ে থাকে, সেসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ারের পথে এই আইন দৃশ্যমান কোনাে বাধা নয়। এই আইনের প্রয়ােজনীয় নিহিতার্থ দ্বারা কোনাে নিষেধাজ্ঞা টানাও সম্ভব নয়। ১২৫, ১২৬ ও ১২৭ ধারায় এ ধরনের কোনাে সিদ্ধান্তে আসার সুযােগ নেই। কেননা এই সব ধারায় একই অপরাধের ক্ষেত্রে | ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শালের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাষায় কেবল এখতিয়ারগত সংঘাত নিরসনের ব্যবস্থাই করা হয়নি, একই অপরাধের ক্ষেত্রে আসামির উপর্যুপরি বিচারেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
৮১. আপিলকারীরা Jamil Huq মামলার ওপর আস্থাসহকারে নির্ভর করেছিল। সেই মামলায় রিট আবেদনকারীদের ১৯৮১ সালের ২৯ মার্চ দিবাগত রাতে সংঘটিত বিদ্রোহের অপরাধের জন্য আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীনে কোর্ট মার্শালে বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ঐ বিদ্রোহের পরিণতিতে বাংলাদেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রাণ হারিয়েছিলেন। আবেদনকারীরা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীনে গঠিত কোর্ট মার্শালের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে রিট করেছিলেন। হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত শুনানির পর রিট পিটিশন প্রত্যাখ্যান করেন। আপিল বিভাগ আলােচ্য মামলার ঘটনাদি বিবেচনায় এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন :
“কোর্ট মার্শাল যদি যথাযথভাবে গঠিত হয়ে থাকে এবং সংঘটিত অপরাধ যদি কোর্ট মার্শাল কর্তৃক আমলযােগ্য হয়, তাহলে বাকিটা সাক্ষ্যপ্রমাণ নির্ভর একটি প্রশ্ন, যে বিষয়ে সকল কর্তৃপক্ষের অভিমত হলাে এই যে, হস্তক্ষেপ করার মতাে এখতিয়ার রিটের নেই। ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে এখতিয়ার দেওয়া
৪৬৪

হয়েছে কিনা সে বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখাই শুধু এই আদালতের কাজ এবং যখন এই উপসংহারে পৌছানাে হয় যে, এখতিয়ার প্রদান করা হয়নি, তখন ওখানেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যায়।”
৮২. দেখা যাচ্ছে যে, বর্তমান মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতির সাথে ঐ মামলাটি কোনােভাবে প্রযােজ্য নয়।
৮৩. আপিলকারী বজলুল হুদার বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুল্লাহ-আল-মামুন অবশ্য RV Grant, Daois Riley and Topley, (1957) 2 All ER 694 মামলাটির উল্লেখ করেছেন।
৮৪. উপরােক্ত মামলাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, সাইপ্রাসের নিকোশিয়ায় অনুষ্ঠিত জেনারেল কোর্ট মার্শালে বিদ্রোহের অপরাধের দায়ে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। ঘটনার রাতে ও গােলমাল বেঁধে গিয়েছিল। আপিলকারীদের যে হােটেলে মােতায়েন রাখা হয়েছিল, সেই হােটেলের ছাদে তারা এক বৈঠকে মিলিত হয়। তারপর তারা নীচে নেমে আসে এবং কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া তাদের অভাব-অভিযােগের প্রতিকার না হওয়ায় তারা উচ্ছঙ্খল আচরণে লিপ্ত হয়ে ব্যারাকের পানশালা ভাঙচুর করে। ওয়ারেন্ট অফিসার তাদের ছত্রভঙ্গ হবার নির্দেশ দিলেও তারা ছত্রভঙ্গ হয়নি। লর্ডসভা (House of Lords) তাদের দোষী সাব্যস্তকরণের বিষয়ে নিমােক্ত যুক্তিতে হস্তক্ষেপ করতে চাননি-
“আমি সাক্ষ্যপ্রমাণাদি সবিস্তারে পাঠ করে সময় গ্রহণ করার প্রয়ােজন আছে বলে মনে করিনি। আদালত এই মর্মে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট যে, সেখানে সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল যার ভিত্তিতে কোর্ট মার্শাল সঠিক পথে অগ্রসর হয়ে রায় দিতে পেরেছিল যে, একটা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। সিদ্ধান্তে পৌছানাের জন্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে থাকলে তার ভিত্তিতে তাদের দেওয়া সিদ্ধান্তের সমালােচনা আমরা করতে পারি না। আমি যেসব কারণের কথা যথাসম্ভব সংক্ষেপে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি, সেগুলির ব্যাপারে আদালতের অভিমত হলাে এই যে, কোর্ট মার্শালকে ভুল পথে চালিত করা হয়নি। যদিও জজ-অ্যাডভােকেট কথা প্রসঙ্গে সমালােচনা করতে গিয়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করেছিলেন সেগুলি নিয়ে হয়তাে অগ্রসর হয়েছে এবং জজ-অ্যাডভােকেট এমন কিছু বলেননি যা কোর্ট মার্শালকে বিপথগামী করতে পারে। অতএব এই সব যুক্তির ভিত্তিতে আপিলগুলি, আমাদের মতে, নাকচ করে দেয়া উচিত।”
৮৫. বর্তমান আপিলগুলির ক্ষেত্রে দেখা যায়, এমন কিছু রেকর্ডভুক্ত নেই যা থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ আপিলকারীদের এবং আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীনে অপর আসামিদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের নির্দেশ লঙ্ঘনের দায়ে মামলা রুজু করেছিলেন। সেখানে কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণও নেই যে, সমষ্টিগতভাবে কর্তৃপক্ষকে অমান্য করা হয়েছিল, যখন তারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। আসামিরা সক্রিয় সৈন্যদলে’ ছিল না এবং তারা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৮(২) ধারায় বিধৃত অর্থের আওতার মধ্যে দেওয়ানি অপরাধ (civil offence) করেনি। কাজেই, ফৌজদারি আদালত আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করে এখতিয়ারবহির্ভূত কিছু করেনি।
৮৬. আরও দেখা যায় যে, বিতর্ক এড়ানাের লক্ষ্যে বিজ্ঞ দায়রা জজকে আপিলকারী ও অন্যান্য আসামির বিচারের জন্য অনুমােদিত কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, যদিও তারা আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর অধীন কোনাে অপরাধ করেনি। অতএব, আপিলকারীদের পক্ষ থেকে বিজ্ঞ আইনজীবীরা বিচারের ফোরাম নিয়ে যে আপত্তি তুলেছেন আমি তার মধ্যে কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাইনি।
৮৭. চতুর্থ ও পঞ্চম বিষয় অর্থাৎ ষড়যন্ত্র ও হত্যার প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনা করার আগে আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) প্রদত্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে আইনত গ্রহণযােগ্য কিনা তা যাচাই করে দেখতে হবে। কারণ ঐসব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক
৪৬৫

জবানবন্দি যদি সাক্ষ্য হিসেবে আইনত গ্রহণযােগ্য হয় তাহলে সেখানে দেওয়া বিবৃতি ষড়যন্ত্র ও হত্যা উভয় যুক্তিকে প্রতিপন্ন করার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে। আর সেই সব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি যদি আইনত গ্রহণনযােগ্য না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপক্ষকে রেকর্ডভুক্ত অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে উভয় যুক্তিকে প্রমাণ করতে হবে।
৮৮. আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সম্পর্কে আপিলকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবী নিবেদন করেন যে, পুলিশ কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় আপিলকারীদের তাদের রিমান্ডে রেখে নির্যাতন ও জবরদস্তির মাধ্যমে এসব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি বিবৃতি আদায় করেছে এবং সেই কারণে সেগুলাে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি ছিল না। এটি প্রথম বিজ্ঞ বিচারক কর্তক যুক্তি প্রদর্শন করে দেওয়া রায় থেকেই প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক এসব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিকে স্বেচ্ছায় প্রদত্ত স্বীকারােক্তি হিসেবে গ্রহণ করে আইনগত ভুল করেছেন এবং তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করে আইনগত ভুল করেছেন। আরাে বলা হয়েছে যে, ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকরা যেহেতু সুলতান শাহরিয়ার ও ফারুক রহমানের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে তাঁদের অভিমতের ক্ষেত্রে সমভাবে বিভক্ত ছিলেন, সেহেতু তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকেরও উচিত ছিল তাদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে বিবেচনায় নেওয়া।
৮৯. অপরদিকে জনাব আনিসুল হক এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, প্রথম বিজ্ঞ জজ রেকর্ডভুক্ত বিষয়াবলির ভুল ব্যাখ্যাই শুধু করেননি, উপরন্তু আইনের ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে উপরােক্ত অপরাধ স্বীকারােক্তিমূলক বিবৃতি অবিশ্বাস করেছেন এই যুক্তিতে যে, দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার আগে আসামিদের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৬৭(২) ধারায় বর্ণিত মতে মেয়াদের। বাইরে একটি ব্যবস্থা’ (“device”) বলে পুলিশ রিমান্ডে রাখা হয়েছিল। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্রপক্ষের ৬১ নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেন এবং নিবেদন করেন যে, আপিলকারী ফারুক রহমানকে ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বর্তমান মামলা রুজু হবার আগে লালবাগ থানার ১১(১১)৭৫ নম্বর মামলায় দু দফায় ১৩ দিনের এবং সুলতান শাহরিয়ারকে ১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর বর্তমান মামলায় গ্রেফতার দেখানাের আগে ঐ একই মামলায় ৩ দফায় ১৫ দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী ফারুক রহমানকে ৩২ দিন পুলিশ রিমান্ডে রাখার পর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছিল এবং একইভাবে শাহরিয়ারকে ৩৪ দিন পুলিশ রিমান্ডে রাখার পর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছিল- এই মর্মে বিজ্ঞ প্রথম বিচারকের অভিমতগুলাে সঠিক নয়।
৯০. নথি থেকে এটি দৃষ্ট হয় যে, সুলতান শাহরিয়ারকে ১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর বর্তমান মামলায় গ্রেফতার দেখানাে হয়েছে। তাকে ১৯৯৬ সালের ৩০ নভেম্বর ৭ দিনের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং তারপর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। ফারুক রহমানকে ১৯৯৬ সালের ৩ অক্টোবর বর্তমান মামলায় গ্রেফতার দেখানাে হয় এবং তারপর তাকে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ৭ দিনের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং এরপর ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা হয়। মহিউদ্দীনকে (আর্টিলারি) ১৯৯৬ সালের ১৯ নভেম্বর ৭ দিনের জন্য পুলিশ রিমান্ডে নেওয়া হয় এবং অতঃপর ১৯৯৬ সালের ২৭ নভেম্বর সে তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
৪৬৬

৯১. রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী বলেছেন, তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারার অধীনে প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর সুলতান শাহরিয়ারের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং স্বীকারােক্তিতে কী কী আছে তা আসামির কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার পর তিনি স্বীকারােক্তির সঠিকতা সম্পর্কে একটি সার্টিফিকেটও দিয়েছিলেন। দেখা যায় যে, সুলতান শাহরিয়ার উক্ত সাক্ষীর এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেননি যে, তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ৩৬৪ ধারায় আসামির জবানবন্দি রেকর্ড করেছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী অবশ্য স্বীকার করেন যে, ফর্মের ৮ নম্বর কলামে কোনাে মন্তব্য ছিল না। এটি না থাকার ব্যাখ্যা তিনি এইভাবে দিয়েছিলেন যে, আসামি যেহেতু তার কাছে কোনােরকম দুর্ব্যবহারের অভিযােগ করেনি, তাই তিনি উক্ত কলামটি পূরণ করেননি। অবশ্য এই সাক্ষী এই মর্মে তাকে দেওয়া ডিফেন্স সাজেশন অস্বীকার করেন যে, জবরদস্তি ও নির্যাতনের মাধ্যমে আসামির স্বীকারােক্তি রেকর্ড করেছিলেন এবং আসামিকে অন্যায়ভাবে পুলিশ হাজতে আটক রাখা হয়েছিল, রেকর্ডকৃত স্বীকারােক্তি আসামিকে পড়ে শােনানাে হয়নি এবং এই স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত ছিল না। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী আরাে বলেন যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারা অনুসারে প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার পর তিনি ফারুক রহমানের স্বীকারােক্তি রেকর্ড করেছিলেন। তার স্বীকারােক্তি লিপিবিদ্ধ করার পর আসামিকে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পাঠানাে হয়। একই দিনে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসামির প্রাপ্তি স্বীকার করেন এবং সে মর্মে একটি সার্টিফিকেটও ইস্যু করেন। আইনের প্রয়ােজনীয় বিধান অনুযায়ী দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার বিষয়টি সম্পর্কে দোষ স্বীকারকারী আসামি ফারুক রহমান এই সাক্ষীর দেওয়া বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী এই ডিফেন্স সাজেশনও অস্বীকার করেন যে, তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় সিআইডির একজন এএসপি, তদন্তকারী অফিসার ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তা তার কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষের ৫১ নম্বর সাক্ষী অবশ্য স্বীকার করেন যে, তিনি ফর্মের ৩, ৪, ৮ ও ১০-এর কলাম পূরণ করেননি; তবে তিনি এই ডিফেন্স সাজেশন অস্বীকার করেন যে, ফারুক রহমান তাকে পুলিশের নির্যাতনের কথা অবহিত করেছিলেন।
৯২. রাষ্ট্রপক্ষের ৫২ নম্বর সাক্ষী বলেছেন যে, মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারায় বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন। তারপর একটি সার্টিফিকেট ইস্যু করেছিলেন এবং আসামির স্বীকারােক্তি রেকর্ড করা হয়ে গেলে তাকে জেলহাজতে পাঠানাে হয়েছিল। মহিউদ্দীনও (অর্টিলারি) আইনের নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসারে তার বক্তব্য রেকর্ড করা সম্পর্কে এই সাক্ষী যা বলেছেন সেটাকে চ্যালেঞ্জ করেনি। রাষ্ট্রপক্ষের ৫২ নম্বর সাক্ষী অবশ্য স্বীকার করেন যে, ফর্মের এক নম্বর কলামটি শূন্য ছিল। তবে তিনি আসামিপক্ষের এই সাজেশন অস্বীকার করেন যে, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তার কাছে কোনাে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেনি কিংবা তদন্তকারী অফিসারের তৈরি করা একটি স্বীকারােক্তিতে সই করেছিল অথবা আসামির স্বাক্ষর পুলিশের উপস্থিতিতে জোর করে আদায় করা হয়েছিল এবং তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য বা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ছিল না। ফর্মের ১ নম্বর কলামে যা দেখা যায় তা হলাে রাষ্ট্রপক্ষের ৫২ নম্বর সাক্ষী সেখানে উল্লেখ করেছিলেন যে, মহিউদ্দীনকে ১৯৯৬ সালের ২৭ নভেম্বর সকাল ১১টায়। হাজির করা হয়েছিল এবং তার বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছিল বেলা ২টায়। কাজেই আসামিকে হাজির করার সময় ও তারিখ এবং তার বক্তব্য রেকর্ড করার সময় যথাযথভাবেই উল্লেখ করা হয়েছিল। ফর্মের ৩ ও ৪ নম্বর কলাম হলাে আসামির স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার সময় ম্যাজিস্ট্রেটদের অনুসরণীয় কিছু নির্দেশাবলি ও পথনির্দেশনা। ৩ নম্বর কলামটি হচ্ছে দোষ স্বীকারকারী আসামিকে ৫ নম্বর কলামে বর্ণিত
৪৬৭

বিষয়াবলির প্রত্যেকটি ব্যাখ্যা করা এবং জবানবন্দি দেওয়ার আগে সাবধানে চিন্তাভাবনা করে দেখার জন্য তাকে সতর্ক করে দেওয়া-সংক্রান্ত। অবশ্য দেখা যায় যে, ৫ নম্বর কলামে আসামিকে যেসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা দরকার ৬ নম্বর কলামে তাকে যথাযথভাবেই সেসব প্রশ্নের মুখােমুখি করা হয়েছিল। উপরােক্ত কলামগুলাে যথাযথভাবে পূরণ করা হয়েছিল। কাজেই এ ব্যাপারে আসামির কোনাে অভিযােগ-অনুযােগ থাকা উচিত নয়। এই সাক্ষী তাকে দেওয়া এই ডিফেন্স সাজেশন অস্বীকার করেন যে, জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তার কক্ষে পুলিশ অফিসার উপস্থিত ছিল। ৮ নম্বর কলামটি হচ্ছে। আসামি যে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছে সে ব্যাপারে ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টির যুক্তি বা কারণ-সম্পর্কিত। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর জবানবন্দিতে বলেছেন যে, আসামির দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আইন অনুযায়ী রেকর্ড করা হয়েছিল এবং আসামি তার দেওয়া জবানবন্দির সঠিকতায় সন্তুষ্ট হয়ে স্বাক্ষর দিয়েছিল। ১০ নম্বর কলামে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার পর আসামিকে প্রেরণ করার সময়টা উল্লেখ থাকে। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলেছেন যে, জবানবন্দি রেকর্ড করার পর আসামিকে তিনি একই দিনে রেকর্ডসহ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
৯৩. দেখা যায় যে, স্বীকারােক্তি করতে ইচ্ছুক আসামিকে প্রশ্ন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই বাস্তবতা সম্পর্কে আশ্বাস লাভ করা যে, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের ব্যাপারে কোনােরকম প্ররােচনা, হুমকি বা প্রতিশ্রুতির কারণে এই স্বীকারােক্তি দেওয়া হয়নি।
৯৪. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪৫ অধ্যায়ে সাধারণভাবে নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রম নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। কিছু কিছু অনিয়ম আছে, যেগুলাের কারণে মামলার কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ বা অকার্যকর হয় না। এগুলাে ৫২৯ ধারায় উল্লেখ করা আছে। এই শ্রেণির মামলাগুলােতে আসামির ক্ষতিগ্রস্ত হবার কোনাে প্রশ্ন ওঠে না। কারণ এই ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, এগুলাের কারণে মামলার কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ বা অকার্যকর হবে না। আরাে কতিপয় অনিয়ম আছে যেগুলাে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত এবং এসব ক্ষেত্রে আসামির ক্ষতির কারণ ঘটুক আর না ঘটুক, মামলার কার্যক্রমই অকার্যকর হয়ে যায়। ৫৩০ ধারায় এগুলাের উল্লেখ আছে। ৫৩১, ৫৩২, ৫৩৩, ৫৩৫ ও ৫৩৬ (২) ও ৫৩৭ ধারায় তৃতীয় এক শ্রেণির অনিয়ম নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। সেখানে মােটামুটিভাবে প্রশ্নটা হচ্ছে, ভুলের কারণে আসামির কোনাে ক্ষতি হয়েছে কিনা কিংবা ন্যায়বিচার ব্যর্থ হয়েছে কিনা। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কয়েক ধরনের ভ্রান্তিকে সতর্কতার সঙ্গে শ্রেণিবিন্যস্ত করেছে এবং এসব ভ্রান্তির ক্ষেত্রে কী করণীয় তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। এ ধরনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আদালত আইনসভার সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে কার্যকারিতা দিতে বাধ্য। এ নিয়ে আর কোনাে জল্পনা-কল্পনার কোনাে অবকাশ নেই। কেবল এক শ্রেণির মামলায় আদালত স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন আর সেগুলাে হলাে এমন মামলা যার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট কোনাে বিধান রাখা হয়নি।
৯৫. বর্তমানের সুনির্দিষ্ট মামলায় কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের শুধু ৫৩৩ ধারাটিকে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এ ব্যাপারে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৭ ধারার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করা কালে সংঘটিত কোনাে ভুলভ্রান্তি বা বিচ্যুতি বা অনিয়মের ক্ষেত্রে এই ধারা কোনােভাবে প্রযােজ্য হবে না।
৯৬. ৫৩৩ ধারাটি নিম্নরূপ :
“533. Non-compliance with provisions of section 164 or 364(1)-If any Court, before which a confession or other statement of an accused person
৪৬৮

recorded or purporting to be recorded under section 164 or section 364 is tendered or has been received in evidence, finds that any of the provisions of either of such sections have not been complied with by the Magistrate recording the statement, it shall take evidence that such person duly made the statement recorded; and, notwithstanding anything contained in the Evidence Act, 1872, section 91, such statement shall be admitted if the error has not injured the accused as to his defense on the merits.
(2) The provisions of this section apply to Courts of Appeal, Reference and Revision.”
৯৭. ১৬৪ বা ৩৬৪ ধারার কোনাে বিধান পালন না-করা থেকে উদ্ভূত কোনাে ভুল সংশােধনের একটা পদ্ধতির ব্যবস্থা এই ধারায় করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলাে, এ জাতীয় বিধান পালন না করার কারণে ন্যায়বিচারের ব্যাঘাত রােধ করা। রেকর্ডকৃত আসামির জবানবন্দি এই ধারা অনুসারে গ্রহণ করা যেতে পারে, জবানবন্দি যথানিয়মে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সে মর্মে সাক্ষ্য গ্রহণ করে, যদি বিধান পালন না করার কারণে আসামির আত্মপক্ষ সমর্থনের বিষয়টি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে থাকে। ১৬৪ ও ৩৬৪ ধারার কোনাে বিধান প্রতিপালনে ব্যর্থতার কারণে রেকর্ডকৃত দোষ স্বীকারােক্তি বা বক্তব্য যদি অগ্রহণযােগ্য হয়, তাহলে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৯১ ধারায় যা-ই থাকুক না কেন এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি যথানিয়মে জবানবন্দি প্রদান করেছে- এটা প্রমাণ করার জন্য অপরিহার্য সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা যেতে পারে এবং এভাবে প্রমাণিত জবানবন্দিটি গ্রহণ যেতে পারে এবং মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বিধান প্রতিপালন পালন না করার ত্রুটি তখনই দূর হবে যখন গুণাগুণের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থনের ক্ষেত্রে আসামির কোনাে ধরনের ক্ষতি সাধিত হবে না।
৯৮. Mohammad Ali vs Emperor, 35 Cr LJ 385 (FB) মামলায় এই অভিমত নিমােক্তভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে :
“কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারাগুলাের বিধানসমূহের আলােকে, বিশেষ করে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৩ ধারায় বিধৃত বিধানগুলাের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা কঠিন যে, কেবল প্রশ্নোত্তর রেকর্ডভুক্ত করার কাজটা বাদ দেওয়াটা এক মারাত্মক ক্রটি। প্রশ্নোত্তর রেকর্ডভুক্ত করেই কোনাে একটা স্বীকারােক্তির মাধ্যমে উপাত্ত জোগানাে যায়, যার ভিত্তিতে আদালত এ স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত কিনা সে সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারেন। এ কথা বলাও সমভাবে কঠিন যে, এসব তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করার সময় বিচারিক আদালতের পক্ষে এমন স্বীকারােক্তি যে স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে সেটা মূল্যায়ন করতে পারা সর্বদাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ত্রুটি বা ঘাটতিটা নিঃসন্দেহে এক মারাত্মক অনিয়ম এবং কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে এই কারণে গুণাগুণের ভিত্তিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে আসামি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এ ধরনের ক্ষেত্র বাদে এমন একটা ত্রুটি বা ঘাটতি সম্পূর্ণরূপে সারিয়ে তােলার ব্যবস্থা রয়েছে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৩ ধারার বিধানাবলিতে। আসামির জবানবন্দি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হয়েছে কিনা সে মর্মে খােদ আসামির জবানবন্দিতে অন্তর্নিহিত সাক্ষ্য থেকে অথবা আসামির জবানবন্দি স্বেচ্ছায় প্রদত্ত হয়েছে মর্মে অন্য
৪৬৯

সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে আদালত অবাধে উপসংহারে পৌঁছতে পারেন। প্রশ্নোত্তরের রেকর্ডভুক্তি বাদ পড়ে যাওয়ার ব্যাপারটি আদালতের সেই উপসংহারে পৌছানাের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এ কথাও বলা যায় না যে, এসব তথ্য ও উপাত্ত ছাড়া আদালতের পক্ষে এমন উপসংহারে আসা “অসম্ভব” যে, স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে। অবশ্য যেখানে ত্রুটিটা শুধু এই নয় যে, আসামির বক্তব্য আদৌ যথাযথ আকারে ও আইনানুযায়ী রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি, উপরন্তু সেই জবানবন্দি মােটেই যথাযথভাবে দেওয়া হয়নি, সেক্ষেত্রে অবস্থাটা ভিন্ন রকম হয়ে দাড়াবে।”
৯৯. অবশ্য Kehar Singh-এর মামলায় (AIR 1988 SC 1883) Kehar Singh-এর স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠেছিল যেখানে নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল :
“উপরােক্ত সিদ্ধান্তগুলাে বিচার-বিবেচনা করে দেখা হলে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ১৬৪(২) ধারার বিধানাবলি অনুযায়ী স্বীকারােক্তি লিপিবদ্ধ করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট স্বীকারােক্তি প্রদানকারী ব্যক্তির কাছে এটি ব্যাখ্যা করবেন যে, তিনি দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য নন এবং তিনি স্বীকারােক্তি দিলে সেটি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ম্যাজিস্ট্রেটের যদি এ কথা বিশ্বাস করার কারণ ঘটে যে, স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হচ্ছে তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট সেই স্বীকারােক্তি লিপিবদ্ধ করবেন। কাজেই ১৬৪ ধারার (২) উপধারার প্রতিপালন বাধ্যতামূলক ও একান্ত প্রয়ােজনীয় এবং সেটা পালন করা না হলে সেই স্বীকারােক্তি সাক্ষ্যপ্রমাণে অগ্রহণযােগ্য হবে। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪৬৩ ধারায় (পুরাতন ৫৩৩ ধারা) এই বিধান বিধৃত রয়েছে যে, যে ক্ষেত্রে স্বীকারােক্তির ব্যাপারে প্রশ্নোত্তরগুলাে রেকর্ডভুক্ত করা হয়নি, সে ক্ষেত্রে সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা নজির এটি প্রমাণ করা যায় যে, বস্তুতপক্ষে ২৮১ ধারার (পুরানাে ৩৬৪ ধারা) সঙ্গে পঠিত ১৬৪ ধারার (২) উপধারার শর্তাবলি প্রতিপালিত হয়েছে। আদালত যদি এমন সিদ্ধান্তে আসেন যে, সংশ্লিষ্ট ধারার শর্তাবলি বস্তুতপক্ষে প্রতিপালিত হয়েছে তবে সেক্ষেত্রে শুধু স্বীকারােক্তি যথাযথ আকারে রেকর্ডভুক্ত না হবার কারণে সেটি সাক্ষ্যপ্রমাণে অগ্রহণযােগ্য হবে না এবং এ সংক্রান্ত ত্রুটিটা ৪৬৩ ধারায় দূর হয়ে যাবে। তবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৬৪ (২) ধারার বাধ্যতামূলক শর্তাবলি যদি প্রতিপালন করা না হয় এবং সাক্ষ্যপ্রমাণে যদি বেরিয়ে আসে যে, উপরােক্ত উপধারায় যেভাবে বলা আছে সেভাবে ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে ঐ জাতীয় কোনাে ব্যাখ্যা প্রদান করেননি, তাহলে এই উল্লেখযােগ্য ত্রুটিটা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪৬৩ ধারায় দূর করা যাবে না।”
১০০. অবশ্য দেখা যাচ্ছে যে, প্রথম বিজ্ঞ জজ আপিলকারীদের উপর্যুপরি রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়টি এবং আইনের বিধানসমূহ কথিত মতে প্রতিপালিত না হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলােকে গ্রহণ করেননি। তিনি বলেছিলেন যে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে আপিলকারীদের অন্যান্য মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার ব্যাপারটি ছিল উপরােক্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপক্ষের গৃহীত ‘কৌশল’। নথিপত্র থেকে আরাে দেখা যায় যে, সুলতান শাহরিয়ার স্বীকারােক্তি দেওয়ার ৫২ দিন পর ১৯৯৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঐ স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করে। ফারুক রহমান স্বীকারােক্তি করার ৪৩ দিন পর ১৯৯৩ সালের ১ মার্চ তা প্রত্যাহার করে এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তি প্রদানের ৩০ দিনেরও বেশি সময় পার হবার পর তার স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করে। স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের আবেদনপত্র পেশের ব্যাপারে এত বিলম্ব সম্পর্কে আসামিপক্ষের তরফ থেকে কোনাে ব্যাখ্যা না থাকায় এটি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, আপিলকারীদের
৪৭০

প্রদত্ত বক্তব্যে যেসব কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল তা স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের মাধ্যমে নস্যাৎ করার জন্য পরবর্তী চিন্তাভাবনাপ্রসূত এক কৌশল।
১০১. Joygun Bibi 12 DLR (SC)157 মামলায় স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের ফল সম্পর্কে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“আমরা এ ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারকদের দেওয়া আইনের ব্যাখ্যা সমর্থন করতে অপারগ। স্বীকারােক্তির প্রত্যাহার হলাে একটা পরিস্থিতি, যা প্রথমত এই স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে কিনা সেই প্রশ্নে এবং দ্বিতীয়ত স্বীকারােক্তিটা সত্য কিনা পরবর্তী সেই প্রশ্নের উপর কোনাে ধরনের প্রভাব ফেলে না। স্বীকারােক্তি যিনি প্রদান করেন পরবর্তীকালে তিনি সেটিতে অবিচল না থাকলে কেবল এটিই স্বীকারােক্তিটা স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছিল কিনা, এবং স্বেচ্ছায় দেওয়া হলে স্বীকারােক্তিটা সত্য ছিল কিনা সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার উপর সরাসরি কোনাে প্রভাব ফেলতে পারে না। কেননা অভিযােগের পরিণতির সরাসরি মুখােমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে অভিযুক্ত করে দেওয়া বিবৃতি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি ঐ সকল পরিণতির নৈকট্য বিচারে পুরােপুরি ব্যাখ্যাযােগ্য, স্বীকারােক্তিটা স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে কিনা কিংবা তাতে উল্লেখ করা কথাগুলাে সত্য কিনা তার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকার কোনাে প্রয়ােজনই নেই। বিজ্ঞ বিচারকরা প্রথমত এই দুটো প্রশ্নের নিষ্পত্তি করতে গিয়ে এবং জবাবগুলাে ইতিবাচক হওয়ায় অন্যান্য তথ্য পরিস্থিতির সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে দোষ স্বীকারােক্তিটা আবদুল মজিদের দোষী সাব্যস্তকরণ সমর্থনের জন্য যথেষ্ট- এ কথা ঘােষণা করে অত্যন্ত সঠিক কাজ করেছেন। স্বীকারােক্তিটা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত এবং সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ায় স্বীকারােক্তি প্রত্যাহারের ব্যাপারটি নিতান্তই গুরুত্বহীন। এই অবস্থায় অপরাধ স্বীকারােক্তিকে সহ-আসামির বিরুদ্ধে বিবেচনায় নিতে বিজ্ঞ বিচারকদের অপারগতা বােধ করার কোনাে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কথা আবদুল মজিদের স্বীকারােক্তি ছাড়া জয়গুন বিবির বিরুদ্ধে যদি অন্য কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ না থেকে থাকে তাহলে স্বীকারােক্তিটা স্রেফ একটা বিবেচনাযােগ্য বিষয় হওয়ায় এবং জয়গুন বিবির বিরুদ্ধে সেটার সাক্ষ্য প্রমাণ হওয়ার বৈশিষ্ট্য বা যােগ্যতা না থাকায় আইনত সঠিকভাবেই বলা যেতে পারত যে, কেবল স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে তাকে দোষী সাব্যস্তকরণ টেকে না। যদি স্বীকারােক্তিও প্রত্যাহার করে নেওয়া হতাে তাহলে এমন উপসংহারের পক্ষের যুক্তিগুলাে নিঃসন্দেহে জোরালাে হতাে। কিন্তু বর্তমান মামলায় আবদুল মজিদের স্বীকারােক্তি কোনােক্রমেই জয়গুন বিবির বিরুদ্ধে বিবেচনাযােগ্য একমাত্র বিষয় নয়। দেখা যাবে যে, গৃহপরিচারিকা জহুরার দেওয়া সাক্ষ্য থেকে আলােচ্য রাতে, বিশেষ করে হত্যার সময় ও পরে জয়গুন বিবির গতিবিধি ও আচরণের এক অতি পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। জহুরার সাক্ষ্য ও আব্দুল মজিদের স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে জয়গুন বিবিকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার জবাবে তিনি তার সে রাতের আচরণের কোনাে ব্যাখ্যা দেননি। তিনি নির্দোষ এবং তার স্বামীর ছােটভাই সাত্তার তার বিরুদ্ধে এই মামলা সাজিয়েছে- এই কথাগুলাের পুনরাবৃত্তির মধ্যেই তিনি তুষ্ট থেকেছেন।”
১০২. State vs Mithun alias Gul Hassan, 16 DLR (SC) 598 মামলায়ও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, যা নিম্নরূপ:
“স্বীকারােক্তিগুলাের ক্ষেত্রে দেখা যায়, হাইকোর্ট এই বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথভাবে সচেতন ছিলেন যে, judicial or extrajudicial স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করা হলে সেটা স্বীকারােক্তিকারীর বিরুদ্ধে
৪৭১

আইনত বিবেচনায় নিতে হবে এবং যদি সেই স্বীকারােক্তি সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত বলে প্রতিভাত হয় সেক্ষেত্রে সেটার সমর্থনে আরাে কিছু খুঁজতে যাওয়ার আদৌ প্রয়ােজন পড়ে না। এটা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত বিষয় যে, judicial or extrajudicial স্বীকারােক্তি যদি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় বা না হয়, তারপরও সেটি দোষী সাব্যস্ত করার একমাত্র আইনসিদ্ধ ভিত্তি হতে পারে, যদি আদালত এ মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, স্বীকারােক্তিটা সত্য ও স্বেচ্ছায় প্রদত্ত এবং তা নির্যাতন বা জবরদস্তি বা প্ররােচনার দ্বারা আদায় করা হয়নি। একটি নির্দিষ্ট মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতিতে আদালত একমাত্র এমন স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে কাজ করবেন কিনা সে প্রশ্নটা অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিষয়টা স্বীকারােক্তির গুরুত্ব ও এর সাক্ষ্যগত মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, আইনে এর গ্রহণযােগ্যতার সঙ্গে নয়।”
১০৩. Mohd. Hussain Umar vs KS Dalipsinghhi, AIR 1970 SC 45, Ram Prakash vs State of Punjab AIR 1959 SCI, 47 State vs Fazu Kazi alias Kazi Fazlur Rahman 29 DLR (SC) 271 মামলায়ও একই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
১০৪. স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির গুরুত্ব প্রসঙ্গে উচ্চতর আদালতগুলাের অভিমত হলাে এই যে, স্বীকারােক্তি আইন অনুসারে রেকর্ডভুক্ত করা হলে, সেটি সত্য, স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ও অভিযােগমূলক চরিত্রের বলে প্রমাণিত হলে এবং সামগ্রিকভাবে জবানবন্দিটি পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় যে, মামলার বাকি অংশের তুলনায় সেটা সঙ্গতিপূর্ণ তাহলে সেই স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। একটি মামলায় এর সমর্থনে কী পরিমাণ তথ্য প্রয়ােজন হতে পারে সেটা সর্বদাই হবে এমন একটি বিষয় যা প্রতিটি মামলার পরিস্থিতির আলােকে নির্ণয় করতে হবে। কখনাে কখনাে সমর্থনমূলক সাক্ষ্যপ্রমাণ না-ও পাওয়া যেতে পারে এবং সেক্ষেত্রে স্বীকারােক্তিটি প্রত্যাহার করা হােক বা না হােক, আদালত সেই স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে স্বীকারােক্তিকারীর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন, যদি দেখা যায় যে স্বীকারােক্তিটা সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত এবং যদি তা নির্যাতন, জবরদস্তি বা প্ররােচনার মাধ্যমে আদায় করা না হয়ে থাকে। এ ধরনের মামলাকে দেখার উপযুক্ত পন্থা হলাে স্বীকারােক্তিকে একেবারেই বিবেচনা থেকে বাদ দিয়ে প্রথমে আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখা এবং এর ভিত্তিতে যদি তা বিশ্বাসযােগ্য হয়, যদি দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে বলে ধারণা করা হয়, তাহলে সত্যিই সেটা করা যায় কিনা তা দেখা। যদি স্বাধীনভাবে এটি বিশ্বাস করা সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই স্বীকারােক্তিকে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে সাহায্যার্থে তলব করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। আদালত যেখানে অপর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কাজ করতে প্রস্তুত নন তখন তেমন পরিস্থিতিতে বিচারক সাহায্যার্থে স্বীকারােক্তির প্রতি দৃষ্টি দিতে পারেন এবং অপর সাক্ষ্যপ্রমাণকে সমর্থিত করার জন্য সেটা ব্যবহার করতে পারেন।
১০৫. দেখা যায় যে, সুলতান শাহরিয়ারের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি হচ্ছে সেরনিয়াবাতের বাসভবনের সামনে এবং তারপর বেতার কেন্দ্রে তার উপস্থিতি-সংক্রান্ত, যা অপর দুজনের অর্থাৎ সৈয়দ ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দ্বারা সমর্থিত। তার পরবর্তী আচরণ-সম্পর্কিত তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রাষ্ট্রপক্ষের ১৫, ৪২ ও ৪৬ নম্বর সাক্ষী কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। ফারুক রহমানের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আসামি সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১, ৪, ১১, ১২, ১৫, ২১, ৪২ ও ৪৬ নম্বর সাক্ষী তাদের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাগুলাে সমর্থন করেছেন। মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি অপরাপর স্বীকারােক্তিকারী আসামি কর্তৃক গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাসমূহে সমর্থিত হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের ১৭, ১৮, ২৭ ও ৩৪ নম্বর সাক্ষীও তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি সমর্থন
৪৭২

করেছেন। রাতের কুচকাওয়াজে তার উপস্থিতি সম্পর্কে সে যে স্বীকারােক্তি দিয়েছে তা রাষ্ট্রপক্ষের ১১,
২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৯ ও ৩৫ নম্বর সাক্ষী কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে।
১০৬. পরবর্তী প্রশ্ন হলাে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় উপরােক্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত বলে যদি প্রতিভাতও হয় তাহলেও কি তা স্বীকারােক্তি প্রদানকারী ও সহ-ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে আপিলকারীদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যাওয়ার পরও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ প্রমাণের জন্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য কিনা।
১০৭. দেখা যায় যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা কেবল তখনই কার্যকর হবে যখন আদালত এ কথা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে বলে সন্তুষ্ট হন যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ সংঘটন বা অভিযােগযােগ্য অন্যায় করার জন্য একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে। অর্থাৎ কোনাে ব্যক্তির কার্যক্রমকে তার ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারার আগে সেই ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের একটা পক্ষ ছিল- এই মর্মে আপাত গ্রহণযােগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে। এ ধরনের যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অস্তিত্ব থাকলে অভিপ্রায় গৃহীত হবার পর সেই অভিন্ন অভিপ্রায় প্রসঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের একজন কিছু বললে, লিখলে বা করলে তা। অন্যদের বিরুদ্ধেও প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। সেটা শুধু ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যই নয়, উপরন্তু এই বিষয়টিও প্রমাণ করার জন্য যে, অপর ব্যক্তিও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। ঐরূপ কাজের সাক্ষ্যগত মূল্য দুটো অবস্থার দ্বারা সীমাবদ্ধ : যথা, কাজটি তাদের অভিন্ন অভিপ্রায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে এবং তাদের যে কোনাে একজন মনে মনে পােষণ করেছে এমন একটা সময়ের পর সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে
হতে হবে।
১০৮. ষড়যন্ত্র বলতে বােঝায় যে, একটা অপরাধ সংঘটনের জন্য দুই বা ততধিক ব্যক্তির যৌথ কর্মকাণ্ডের চেয়েও বেশি কিছু; সেটা যদি ভিন্নভাবে হয়, তাহলে দুই বা ততােধিক ব্যক্তি কর্তৃক একত্রে সংঘটিত যে কোনাে অপরাধের ক্ষেত্রে ১০ ধারা প্রযােজ্য হবে এবং সে অনুযায়ী সেই অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে শ্রুতিমূলক সাক্ষ্যের (hearsay evidence) ব্যবহার হবে যার মােকাবিলা করা অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে। অসম্ভব হবে। এই ধারার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ষড়যন্ত্র চলাকালে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে ষড়যন্ত্র কার্যকর করার বিষয় নিয়ে যেসব যােগাযােগ বা কথাবার্তা হয়েছিল, সে-সংক্রান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণকে মেনে বা স্বীকার করে নেওয়া। এখন প্রশ্ন হলাে, ১০ ধারার ব্যাখ্যা এত বিশদ করা সম্ভব কিনা যাতে করে অতীতে একটা ষড়যন্ত্র সম্পন্ন হবার পর সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের প্রকৃত কার্যক্রমে কী কী করা হয়েছিল সে প্রসঙ্গে একজন ষড়যন্ত্রকারীর দেওয়া স্বীকারােক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
১০৯. Emperor of India vs Abani Bhusan Chakraborty, 15 CNN 25 মামলায় প্রশ্ন উঠেছিল, সহ-আসামিদের স্বীকারােক্তি এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অধীনে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় কিনা। উপরােক্ত সিদ্ধান্তে ফুল বেঞ্চ নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন: “প্রথম সাক্ষ্যটির কাজ যা আমরা কিছুক্ষণ আগে উল্লেখ করেছি। ব্রিটিশ রাজের পক্ষ থেকে যুক্তিসহকারে বলা হয়েছে যে, ঐ বক্তব্যটা ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার বিধানাবলির আওতার মধ্যে আসে এবং সেহেতু, সেটিকে অবনীর সহবন্দিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য বলে গণ্য করতে হবে। এটি বলা হয়েছে যে, ঐ বক্তব্যটি যদি কোনােক্রমে ১০ ধারার মধ্যে না পড়ে তাহলে ৩০ ধারার বিধানাবলির অধীনে এটা সহ-আসামিদের একজনের স্বীকারােক্তি হবে এবং বিচার চলাকালে এই স্বীকারােক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে। মি. রায় যথেষ্ট মাত্রায় যুক্তিসহকারে বলেছেন যে, যে অবস্থায়ই
৪৭৩

হােক না কেন এর গুরুত্ব তার সহযােগীর বক্তব্যের গুরুত্বের চেয়ে বেশি হতে পারে না এবং বস্তুতপক্ষে এর গুরুত্ব একজন সহযােগীর সাক্ষ্যের গুরুত্বের চেয়ে কম। কারণ একজন সহযােগীকে তার বক্তব্যের সঠিকতা যাচাই করার জন্য জেরা করা যেতে পারে। অন্যদিকে অবনী যখন বন্দি ছিল তখন তার এই স্বীকারােক্তির সঠিকতা পরীক্ষা করার উপায় নেই। সেই যুক্তির মধ্যে অবশ্যই যথেষ্ট সারবত্তা থাকায় আমরা এই উপসংহারে পৌছেছি যে, অবনীর জবানবন্দিকে এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অধীনে সাক্ষ্য হিসেবে যথাযথ গণ্য করা করা চলে না। আমাদের মতে ঐ ধারাটির উদ্দেশ্য হলাে ষড়যন্ত্র চলাকালে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারীর মধ্যে ষড়যন্ত্র কার্যকর করা নিয়ে যে যােগাযােগ ঘটেছিল সে-সংক্রান্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ দেওয়া। কোনাে সন্দেহ নেই যে, ষড়যন্ত্রের মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণের ব্যাপারে ১০ ধারার ব্যাপ্তি ইংল্যান্ডের আইনের চেয়েও বেশি। তবে আমরা মনে করি না যে, ঐ ধারাটির উদ্দেশ্য হচ্ছে সাক্ষ্যকে সহ-আসামির স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে পরিণত করা এবং সেটিকে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে কিংবা ষড়যন্ত্রকারী ও অন্যান্য ব্যক্তির মধ্যে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যােগাযােগ বা কথাবার্তা আদান-প্রদানের মতাে একই অবস্থানে ফেলা। তবে ৩০ ধারার ব্যাপারে আমাদের অভিমত হলাে, বক্তব্যটা একজন সহ-আসামির স্বীকারােক্তি হওয়ায় সেটাকে ওই ধারার আওতায় দেখা যেতে পারে। কিন্তু জেরার মাধ্যমে এই বক্তব্যকে যাচাই করে দেখা সম্ভব হয় না বিধায় এর গুরুত্ব খর্ব হয়ে যায়।”
১১০. “আমরা এক মুহূর্তের জন্য এমন সাক্ষ্যকে ষড়যন্ত্রের সহযােগীর বক্তব্যের চেয়ে বেশি কিছু বলে স্থান দিচ্ছি না; তেমনি আবার নিরপেক্ষ সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত ঐসব বক্তব্যের যে যে অংশের দ্বারা আসামিরা বা তাদের বিরুদ্ধে আনীত ষড়যন্ত্রের অভিযােগে জড়িয়ে পড়ে সেগুলাে ব্যতীত ঐসব বক্তব্যের দ্বারা কোনােভাবে নিজেদেরকে প্রভাবিত হতে দিতেও পারি না।”
১১১. এই বিষয়টি তখন Mirza Akbar vs King Emperor, AIR 1940 (PC) 176 মামলায় বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রিভি কাউন্সিলের মাননীয় সদস্যরা বিভিন্ন ক্ষমতা ও এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা বিচার-বিবেচনা করে নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন :
“নীতিটা এই হওয়ায় মহামান্য বিচারপতিরা মনে করেন যে, ১০ ধারার কথাগুলােকে এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাখ্যা করতে হবে। কথাগুলাের এমন বিশদ ব্যাখ্যা দেওয়াও সম্ভব নয়, যাতে করে একজন ষড়যন্ত্রকারীর অনুপস্থিতিতে ষড়যন্ত্রকারীর দেওয়া বিবৃতিকে তার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। অতীতে এই ষড়যন্ত্র সম্পন্ন হয়ে যাবার পর সেই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার গতিপথে যেসব কাজ হয়েছিল, বিবৃতি বা বক্তব্যটা হলাে সেই সম্পর্কিত, অভিন্ন অভিপ্রায়টা হলাে অতীতের। বিচারপতিদের রায়ে উল্লিখিত অভিন্ন অভিপ্রায়’ কথাগুলাের দ্বারা সেই সময়ে অস্তিত্বমান অভিন্ন অভিপ্রায়কে বােঝানাে হয়েছে যখন ষড়যন্ত্রকারীদের একজন এ বিষয়ে বলেছিল, করেছিল বা লিখেছিল। অভিন্ন অভিপ্রায়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি একবার দেখানাে হয়ে গেলে ষড়যন্ত্র চালু থাকা অবস্থায় যে বিষয়গুলাে সম্পর্কে বলা হয়েছিল, করা হয়েছিল কিংবা লেখা হয়েছিল সেগুলােই অভিন্ন অভিপ্রায়ের সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। তবে এ কথা বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে যে, অভিন্ন অভিপ্রায় বা ষড়যন্ত্র যখন আর কার্যকর না থাকে, যখন এর কোনাে অস্তিত্বই আর থাকে না, তখন তৃতীয় পক্ষের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হলে বা সে সম্পর্কে কোনাে বিবৃতি বা স্বীকারােক্তি দেওয়া হলে তা অপর পক্ষের বিরুদ্ধে গ্রহণযােগ্যতা পাবে। তাহলে এক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের কোনাে অভিন্ন অভিপ্রায় নেই, যার প্রসঙ্গ ধরে এই জবানবন্দি ভিত্তি হতে পারে। মহামান্য বিচারপতিদের রায়ে ১০ ধারাটিতে এই নীতিমালা বিধৃত হয়। এটাই হলাে সেই
৪৭৪

ব্যাখ্যা যা ভারতে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে সঠিকভাবেই ১০ ধারার ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা হয়েছে, যেমন 55 Born 839 নম্বর মামলা এবং 38 Cal 169 নম্বর মামলা। এই মামলাগুলােয় ষড়যন্ত্র চলাকালে ষড়যন্ত্র কার্যকর করার প্রসঙ্গ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের নিজেদের মধ্যেকার যােগাযােগ এবং গ্রেফতারের পর কিংবা ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যাবার পর সেই অতীত ঘটনাবলির বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রদত্ত বিবৃতির মধ্যে সঠিকভাবেই পার্থক্য টানা হয়েছিল।”
১১২. দেখা যাবে যে, ‘in reference to their common intention’ কথাটা অত্যন্ত ব্যাপক এবং পেনাল কোডের ৩৪ ধারায় ব্যবহৃত ‘অভিন্ন অভিপ্রায় অনুসারে’ (‘in furtherance of the common intention’) কথাগুলাের চাইতে বৃহত্তর অর্থগত পরিধি জোগানাের জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবে উপরের ঐ কথাগুলাে ব্যবহার করা হয়েছিল। এর ফলে ষড়যন্ত্র প্রণীত হবার পর একজন ষড়যন্ত্রকারী যা কিছু বলেছেন, করেছেন বা লিখেছেন সেটাই অপর ষড়যন্ত্রকারী ষড়যন্ত্রের ময়দানে প্রবেশ করার আগে বা ষড়যন্ত্রের ময়দান ত্যাগ করার পর তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
১১৩. ১০ ধারা বিশ্লেষণ করে Bhagaban Swarup vs State of Maharashtra, AIR 1965 SC 682 মামলায় নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে-
“এমনিভাবে যা বলা হয়েছে, করা হয়েছে বা লেখা হয়েছে তা এমন ষড়যন্ত্রকারী বলে বিশ্বাস করা প্রত্যেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটা প্রাসঙ্গিক তথ্যমাত্র। সেই সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এবং এমন যে কোনাে ব্যক্তি যে সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল তা দেখিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রেও এটা প্রাসঙ্গিক তথ্য।” ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে কিংবা এমন এক ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তা প্রমাণ করার কাজেই শুধু এই তথ্যকে ব্যবহার করা যেতে পারে। সংক্ষেপে এই ধারাটি নিমােক্তভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে
“(১) আদালতের এ কথা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি জোগানাের মতাে আপাত গ্রহণযােগ্য সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সদস্য;
(২) উক্ত শর্তটি পূরণ হলে ষড়যন্ত্রের অংশীদারদের যে কোনাে একজন তাদের অভিন্ন অভিপ্রায় সম্পর্কে কোনাে কিছু বলেছেন, করেছেন বা লিখেছেন এমন যে কোনাে কিছু অপরজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে।
(৩) তার বলা, করা বা লেখা যে কোনাে কিছু তাদের যে কোনাে একজনের দ্বারা অভিপ্রায় ব্যক্ত হবার পর সে-ই বলেছে, করেছে বা লিখেছে বলে ধরে নিতে হবে;
(৪) ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়া আরেকজনের বিরুদ্ধে উক্ত উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেও এটা প্রাসঙ্গিক হবে; তা সেই ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হবার আগে কিংবা সে ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে যাবার পর সেটি বলা, করা বা লেখা হলে; এবং
(৫) একজন সহ-ষড়যন্ত্রকারীর অনুকূলে নয়, বরং তার বিরুদ্ধেই কেবল এটা ব্যবহার করা যাবে।”
১১৪ . Zulfiqar Ali Bhutto vs State PLD 1979 SC 53 478 State vs Nalini (1999) 5 SCC 283 মামলায়ও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত হয়েছে। Maqbool Hussain vs State, 12 DLR SC 217 মামলায় রেজিস্টারে তাঁর নাম পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ঘুষের টাকা দেওয়ার সময় তহশিলদারকে অপর দুই আসামি
৪৭৫

যা বলেছিল বলে কথিত তার ওপরই সম্পূর্ণরূপে মকবুল হােসেনের বিরুদ্ধে মামলাটি দাঁড়িয়েছিল। বিচারে ঐ দুই আসামি তাদের কথিত বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রশ্ন যেটা উঠেছিল তা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে দুই সহ-আসামির জবানবন্দি এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ও ৩০ ধারা বলে রাষ্ট্রপক্ষের হাতে ছিল কিনা। এ-সংক্রান্তে অভিমত নিমােক্তভাবে দেওয়া হয়েছিল :
১১৫. এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় ঘােষণা করা আছে যে, যেখানে এ কথা বিশ্বাস করার মতাে যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ বা নালিশযােগ্য অন্যায় সংঘটনের জন্য একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে, সেখানে ঐ ব্যক্তিবর্গের কেউ অভিন্ন অভিপ্রায় ব্যক্ত করার পর তাদের কেউ একজন অভিন্ন। অভিপ্রায় প্রসঙ্গে কিছু বললে, করলে বা লিখলে সেটা এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে বিশ্বাস করে এমন প্রতিটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে এবং ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের কাজে ও সেই ষড়যন্ত্রে ঐ ব্যক্তিদের যে কেউ জড়িত ছিল তা প্রমাণ করার ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক ঘটনা বলে পরিগণিত হবে। এই ধারাটির সরল পাঠ এটি পরিষ্কার করে যে, ১০ ধারাটি আকৃষ্ট করার জন্য সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের কর্মকাণ্ড বা বক্তব্য ছাড়াও পূর্ববর্তী ষড়যন্ত্রের আপাত গ্রহণযােগ্য কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ অবশ্যই থাকতে হবে। আপিলকারী ও দুই রেভিনিউ অফিসারের মধ্যে পূর্ববর্তী ষড়যন্ত্রের এমন সাক্ষ্যপ্রমাণ এই মামলায় দৃশ্যমানভাবে অনুপস্থিত।
১১৬. তদনুযায়ী যখন এটি বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গগত কারণ থেকে যে, কোনাে অপরাধ সংঘটনের জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে; অভিন্ন অভিপ্রায় সাদরে গৃহীত হবার পর ষড়যন্ত্রকারীদের একজন যদি সেই অভিন্ন অভিপ্রায় সম্পর্কে কোনাে কিছু বলে বা করে থাকে বা লিখে থাকে তাহলে সেটা ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যই শুধু নয়, সেই ষড়যন্ত্রে যে অপর ব্যক্তিও জড়িত ছিল তা প্রমাণের জন্যেও অপর ব্যক্তির বেলায় প্রাসঙ্গিক। এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় সাক্ষ্যপ্রমাণের গ্রহণযােগ্যতার ব্যাপারে দুটো আপত্তি থাকতে পারে। প্রথমত, ষড়যন্ত্রকারী যার সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ-ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে গৃহীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে যা সহ-ষড়যন্ত্রকারী আদালতে মােকাবিলা করছে না এবং দ্বিতীয়ত, বাদিপক্ষ এ কথা বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অস্তিত্বই শুধু প্রমাণ করে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্র করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে সহ-ষড়যন্ত্রকারীকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রতিনিধিত্বের সম্পর্কের অস্তিত্ব ক্রিয়াশীল হয়।
১১৭. অবশ্য ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য অর্জিত হবার পর বা ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যাবার পর কিংবা ষড়যন্ত্র পরিত্যক্ত হবার পর কিংবা তা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর কিংবা ষড়যন্ত্রকারী মাঝপথে ষড়যন্ত্র পরিত্যাগ করার পর কোনাে বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া হলে তা সহ-ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে গ্রহণযােগ্য হবে না। এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার বিধান ষড়যন্ত্রের অস্তিত্বের সময়েই শুধু প্রযােজ্য হবে বিধায়, ষড়যন্ত্রের মেয়াদ বা সময় বা কাল নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
১১৮. উপরে উল্লিখিত আইনগত অবস্থানের আলােকে দেখা যায় যে, ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) দেওয়া উপরােক্ত স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি আপিলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণের জন্য প্রাসঙ্গিক ঘটনা নয়। আগেই বলা হয়েছে যে, আইনের বিধানাবলি পাশ কাটিয়ে ও কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধানাবলি পালন না করে আসামিদের উপর্যুপরি রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রথম বিজ্ঞ বিচারক স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলােকে গ্রহণ করেননি এবং বলেছিলেন যে, যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে আপিলকারীদের অন্য মামলার ব্যাপারে রিমান্ডে নেওয়া ও আপিলকারীদের গ্রেফতার দেখানাের ব্যাপারটা তাঁর মতে রাষ্ট্রপক্ষের গৃহীত একটা কৌশল।।
৪৭৬

১১৯. এখন প্রশ্ন হচ্ছে, উক্ত অপরাধ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলােকে যদি বিবেচনার বাইরে রাখা হয় তবে সে ক্ষেত্রে রেকর্ডভুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ শুধু তদানীন্তন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র প্রকাশ পায়, নাকি প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যার ষড়যন্ত্র প্রকাশ করে।
১২০. এই প্রশ্নটি এবং সেই সঙ্গে পঞ্চম ভিত্তি অর্থাৎ হত্যার অভিযােগ বিবেচনা করে দেখার আগে সংবিধানের ১০৩(৩) অনুচ্ছেদের পরিধিও বিবেচনা করে দেখতে হবে। কারণ উপরের এই প্রশ্নটি নিষ্পত্তি করতে গেলে ঘটনা ও তথ্যাবলির প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই সামনে আসবে।
১২১. ১০৩(৩) অনুচ্ছেদটি ভারতের সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদের মতাে হুবহু একই কথায় প্রকাশ করা হয়েছে।
১২২. আলােচ্য প্রশ্নে এই বিভাগের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ছাড়াও Hargun Sundar Das os State of Maharashtra, AIR 1970 SC 1214 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট দোষী সাব্যস্তকরণের বিরুদ্ধে এক আপিল মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ মূল্যায়নে নিজের এখতিয়ারের পরিধি পর্যালােচনাকালে নিমােক্ত অভিমত ব্যক্ত করেছেন-
“এই আদালত সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদ-বলে প্রায়শই যে কথার উল্লেখ করে এসেছে আমরা তার যথাযথ পুনরাবৃত্তিটুকুই করতে পারি। এই আদালত সাধারণত ফৌজদারি মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালােচনা করতে যান না, যদি না আইনবিরুদ্ধ কোনাে কিছুর দ্বারা কিংবা পদ্ধতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়মের দ্বারা বিচারকার্য কলুষিত হয় কিংবা স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের রীতিনীতি লঙ্ঘন করে বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হয় এবং তার ফলে আসামির প্রতি অন্যায় করা হয় অথবা আপিলের অধীনে কোনাে রায় বা আদেশের পরিণতিতে ন্যায়বিচার প্রয়ােগে গুরুতর ব্যর্থতা ঘটে। এই অনুচ্ছেদে এই আদালতকে উপযুক্ত ক্ষেত্রগুলােতে হস্তক্ষেপ করার বিশেষ বিবেচনামূলক ক্ষমতা সংরক্ষিত করেছে, যখন বিশেষ বিশেষ কারণে আদালত মনে করবেন যে, ন্যায়বিচারের বৃহত্তর স্বার্থে এই হস্তক্ষেপ করার প্রয়ােজন আছে।”
110. Metro vs State of UP, AIR 1971 SC 1050, Subedar vs State of UP, AIR 1971 SC 125 এবং Rain Sanjiban Singh vs State of Bihar, AIR 1996 SC 3265 মামলায়ও একই রকম অভিমত ব্যক্ত হয়েছে।
১২৪. ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আপিলকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের ৭ নম্বর সাক্ষী লে. কর্নেল আবুল বাশার বিএ, রাষ্ট্রপক্ষের ৯ নম্বর সাক্ষী লে. কর্নেল (অব) আবদুল হামিদ, রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী এএলডি সিরাজুল হক, রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী হাবিলদার মাে. আমিনুর রহমান (অব), রাষ্ট্রপক্ষের ২৫ নম্বর সাক্ষী নায়েক মাে. ইয়াসিন, রাষ্ট্রপক্ষের ৩৭ নম্বর সাক্ষী মাে. রিয়াজুল হক, রাষ্ট্রপক্ষের ৪০ নম্বর সাক্ষী অনারারি লেফটেন্যান্ট সৈয়দ আহমদ, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী কর্নেল শাফায়াত জামিল, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৫ নম্বর সাক্ষী মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৭ নম্বর সাক্ষী মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৮ নম্বর সাক্ষী এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার এবং রাষ্ট্রপক্ষের ৪৯ নম্বর সাক্ষী রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খানের প্রদত্ত সাক্ষ্য স্পষ্টতই বিদ্রোহ। ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত এবং প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার-পরিজনদের হত্যা করার অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব বর্তমান আপিলগুলাের ক্ষেত্রে নেই। অথচ বিজ্ঞ বিচারকরা পেনাল কোডের ১২০বি ধারায় আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ বেআইনিভাবে বহাল রেখেছেন।।
৪৭৭

১২৫. অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক নিবেদন করেন যে, প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যা করার অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগের সমর্থনে পর্যাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ নথিভুক্ত আছে। তিনি আরাে বলেন যে, আসামিপক্ষ বিদ্রোহ সংঘটনের অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করায় এবং নিজেদের যুক্তি প্রতিপন্ন করতে ব্যর্থ হওয়ায় আপিলকারীরা হত্যাকাণ্ড সংঘটনের অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। বিশেষ করে আপিলকারীদের এই স্বীকারােক্তির আলােকে যে, তারা একটা অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল এবং রাষ্ট্রপক্ষের ১১ নম্বর সাক্ষী এলডি বশির আহমেদ, রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী এএলডি সিরাজুল হক, রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ নম্বর সাক্ষী দফাদার শফিউদ্দীন সরদার, রাষ্ট্রপক্ষের ১৪ নম্বর সাক্ষী দফাদার আব্দুল জব্বার মৃধা, রাষ্ট্রপক্ষের ২৫ নম্বর সাক্ষী রিসালদার আবদুল আলীম মােল্লা, রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী হাবিলদার মাে. আমিনুর রহমান, রাষ্ট্রপক্ষের ২৩ নম্বর সাক্ষী নায়েক মাে. ইয়াসিন, রাষ্ট্রপক্ষের ৩৫ নম্বর সাক্ষী সুবেদার মেজর আনিসুল হক চৌধুরী, রাষ্ট্রপক্ষের ৩৯ নম্বর সাক্ষী রিসালদার মনসুর আহমেদ, রাষ্ট্রপক্ষের ৪০ নম্বর সাক্ষী অনারারি লেফটেন্যান্ট সৈয়দ আহমেদ, রাষ্ট্রপক্ষের ৪৪ নম্বর সাক্ষী কর্নেল শাফায়াত জামিল ও রাষ্ট্রপক্ষের ৫৩ নম্বর সাক্ষী ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমানের প্রদত্ত সাক্ষ্য দ্বারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের হত্যাকাণ্ড সংঘটনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ প্রমাণিত হয়েছে এবং সেহেত রাষ্ট্রপতি ও তার। পরিবারের অপর সদস্যদের হত্যাকাণ্ড সংঘটনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকরা ন্যায়বিচার পালনে কোনাে ব্যর্থতার পরিচয় দেননি।
১২৬. অপরাধমূলক বা দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্রের উপাদানগুলাের বৈশিষ্ট্য হলাে : (ক) দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে একটা মতৈক্য, (খ) একটা বেআইনি কাজ করার জন্য, বা (গ) বেআইনি পন্থায় কোনাে আইনগত কাজ করা, এবং (ঘ) ষড়যন্ত্র অনুযায়ী একটা দৃশ্যমান কোনাে কাজ করা। উপরন্তু, পেনাল কোডের ১২০বি ধারার আওতাধীন কোনাে অপরাধ সংঘটনে অপরাধজনক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ প্রমাণ করতে হলে রাষ্ট্রপক্ষের এটা প্রমাণ করার প্রয়ােজন নেই যে, অপরাধ সংঘটনকারীরা বেআইনি কাজ করতে কিংবা করার কারণ ঘটাতে সুস্পষ্টভাবে একমত হয়েছিল। তাদের ঐরূপ মতৈক্যের ব্যাপারটা প্রয়ােজনীয় অনুমান দ্বারাও প্রমাণ করা যেতে পারে। কোনাে একটা ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনেক সময় বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন কাজ করার প্রয়ােজন হয় এবং তারা যদি প্রথমবারের মতাে কোনাে ষড়যন্ত্রে যুক্ত হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে পরবর্তী কোনাে পর্যায়েও তারা সেই ষড়যন্ত্রের সদস্য হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য যদি তাদের কাজটা ঐ ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। এ কথা নিঃসন্দেহ সত্য যে, ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে একটা মতৈক্য সম্পন্ন হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরাধ সম্পন্ন হয়ে যায় এবং সে ক্ষেত্রে তারা ১২০বি ধারার অধীনে শাস্তিযােগ্য হবে। অপরাধের মর্মবস্তু হলাে ব্যক্ত বা নিহিতার্থ মতৈক্যের মিশ্রণ; একটা ষড়যন্ত্রের দোষাবহ কার্য হচ্ছে সেই ষড়যন্ত্রের বাস্তবায়ন নয়, বরং কোনাে অপরাধ সংঘটিত করতে একমত হওয়া। যদি মানসিক মিলন দৃষ্ট হয় তবে সেটাই বেআইনি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ঐকমত্য প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। প্রত্যক্ষ কিংবা অবস্থাগত সাক্ষ্য দ্বারা এটা প্রমাণ করা যেতে পারে। জনসাধারণের চোখের সামনে উন্মুক্ত উঁচু স্থানে বসে সরব আলােচনার চাইতে একান্ত গােপনীয়তা হলাে ষড়যন্ত্রের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য। ষড়যন্ত্র সৃষ্টির ক্ষণ, তারিখ ও স্থান সম্পর্কে, ষড়যন্ত্র সৃষ্টির কাজে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে, ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য হিসেবে তারা তাদের সামনে যেসব বিষয় নির্ধারণ করেছে সে সম্পর্কে এবং যেভাবে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা হবে সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ দেওয়া সব সময় সম্ভব নয়। এগুলাে সবই অনুমানের বিষয় যা মামলার ঘটনাবলি ও তথ্যাদি থেকে চিত্রায়িত হতে পারে।
৪৭৮

১২৭. ইংল্যান্ডের কমন ল অনুসারে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে একটা বেআইনি লক্ষ্য অর্জনের জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে একটা ঐকমত্য- এখানে বেআইনি কথাটা বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত। অপরাধটা হলাে একত্র হওয়া। যতক্ষণ এ জাতীয় পরিকল্পনা শুধু অভিপ্রায়ের মধ্যে ন্যস্ত, ততক্ষণ পর্যন্ত তা অভিযােগযােগ্য নয়। যখন দুজন সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য একমত হয় তখন খােদ পরিকল্পনাটাই একটা কাজ হয়ে দাঁড়ায়। সেই কারণে মতৈক্য অনুসারে পরবর্তী কোনাে কাজ করা না হলেও অপরাধটা সম্পন্ন হয়ে যায় এবং যদি এমন হয় যে, আলাপ-আলােচনার পর্যায় অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু সেখানে সংশ্লিষ্ট ষড়যন্ত্র। বাস্তবায়নে কী পন্থা অবলম্বন করা হবে সে বিষয়টি নিষ্পত্তি না করলেও সেটা হবে ‘ষড়যন্ত্র। এমন কোনাে কথা নেই যে, ষড়যন্ত্রের অভিযােগ আনা হয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে সেই ষড়যন্ত্রের একজন সহযােগীও হতে হবে।।
১২৮. এ বিষয়টি ইংলিশ আইনে (English Law) ভালােভাবেই নিষ্পত্তি করা আছে। রাসেল অন ক্রাইম (দ্বাদশ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২০২) থেকে নিমােক্ত অনুচ্ছেদটি কার্যকরভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে-
“ষড়যন্ত্রের অপরাধের মূল কথাটা তাহলে সেই অপরাধটি করা নয় বা যে উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্র প্রণীত সেটি কার্যকর করা নয় কিংবা সেগুলাে করার চেষ্টা করা নয় কিংবা সেগুলাে করতে অন্যদের প্ররােচিত করা নয়, বরং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলাের মধ্যে একটা স্কিম তৈরি করা বা মতৈক্য গড়ে তােলা। মতৈক্য অপরিহার্য। কেবল পরিকল্পনা অবগত হওয়া কিংবা তা নিয়ে আলােচনা করাটাই যথেষ্ট নয়।”
১২৯. গ্ল্যানভিল উইলিয়ামস (Glanville Williams) তাঁর ক্রিমিন্যাল ল (দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৮২) গ্রন্থে বিষয়টা উদাহরণ সহকারে ব্যাখ্যা করেছেন-
“লােয়া মামলায় (Lowa case) প্রশ্নটা উঠেছিল, তবে দুষ্কর্মে সহযােগিতার প্রসঙ্গের তুলনায় বরং ষড়যন্ত্রের প্রসঙ্গটিই সেখানে আলােচিত হয়। ক’-এর বিরুদ্ধে ‘খ’-এর একটা ক্ষোভ ছিল। ‘খ’, ‘গ’কে বলল, সে যদি ‘ক’কে চাবুক মারে তাহলে কেউ একজন তার জরিমানার টাকা পরিশােধ করবে। ‘গ’ জবাব দিল, তার জরিমানার টাকা কেউ পরিশােধ করুক তা সে চায় না। ‘খ’-এর বিরুদ্ধে তার নিজেরই একটা ক্ষোভ আছে এবং সুযােগ পাওয়ামাত্র সে তাকে চাবুক মারবে। ‘গ’ প্রথম সুযােগেই ‘ক’কে চাবুক মারল। ‘খ’কে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। কারণ সমন্বিত কার্যক্রমের ব্যাপারে তার কোনাে মতৈক্য ছিল না, সহযােগিতা করারও কোনাে ঐকমত্য ছিল না।
১৩০. তিনি ব্যাখ্যা করেছেন-
“আরেকজন কর্তৃক কোনাে অপরাধ সংঘটিত হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আগে থেকে জানা থাকলে বা সেটি সংঘটনে মানসিক সম্মতি থাকলেই কেউ ষড়যন্ত্রকারী হয়ে যায় না। তবে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনায় অতি সামান্য অংশগ্রহণ করলেই তা ষড়যন্ত্রকারী হবার জন্য যথেষ্ট।”
১৩১. Regina vs Murphy, (1837) 173 ER 502 (508) মামলায় বিচারপতি কোলরিজ জুরিগণের মামলার সার সংকলনকালে প্রাসঙ্গিকভাবেই বলেছিলেন-
“আমি আপনাদের বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, যদিও অভিন্ন ষড়যন্ত্রই (common design) হলাে অভিযােগের মূল বিষয়, তথাপি এ কথা প্রমাণ করার প্রয়ােজন পড়ে না যে, ঐ দুই পক্ষ একত্র হয়েছিল এবং প্রকৃতপক্ষে এই অভিন্ন ষড়যন্ত্র করতে, অভিন্ন পন্থায় সেই ষড়যন্ত্রকে এগিয়ে নিতে এবং সেটাকে বাস্তবায়িত করতে সুস্পষ্টভাবে একমত হয়েছিল। কারণ অতি স্পষ্টরূপে প্রতিষ্ঠিত ষড়যন্ত্র
৪৭৯

মামলাগুলাের মধ্যে অনেক মামলার ক্ষেত্রে এই ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার কোনাে উপায় নেই এবং এই ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার কোনাে বাধ্যবাধকতা আইন বা যৌক্তিক ধারণা কোনােটিতেই নেই। যদি দেখা যায় যে, এই দুই ব্যক্তি তাদের কৃতকর্মের দ্বারা অনেক সময় একই পন্থায় একই লক্ষ্য অনুসরণ করেছে এবং অনুসৃত লক্ষ্যটি অর্জনের উদ্দেশ্যে কাজটিকে সম্পন্ন করার জন্য একজন কাজের একটি অংশ ও অপরজন অন্য অংশ সম্পন্ন করছে, সেক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে এই উপসংহার টানা যায় যে, তারা সেই লক্ষ্য অর্জনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। আপনাদের নিজেদেরই যে প্রশ্নটা করতে হবে তা হলােষড়যন্ত্র যেহেতু বেআইনি- তাদের কি এই অভিন্ন ষড়যন্ত্র ছিল এবং এমন অভিন্ন পন্থায় তারা কি সেই ষড়যন্ত্র অনুসরণ করেছিল?”
১৩২. অতএব এটি দেখা যাবে যে, ষড়যন্ত্রের অপরাধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে একটা বেআইনি কাজ করতে দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে মতৈক্য। মতৈক্য অনুসারে বেআইনি কাজটি করা হতেও পারে, না-ও হতে পারে, তথাপি ঐরূপ মতৈক্যই হলাে অপরাধ এবং তা শাস্তিযােগ্য।
১৩৩. ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত আইনটি তদানীন্তন ভারতে এসেছিল পেনাল কোডের ১২০এ ও ১২০বি ধারার মাধ্যমে। এই ধারা দুটি উল্লেখ করলে দেখা যাবে, কোনাে শাস্তিযােগ্য অপরাধ করাই যেখানে ষড়যন্ত্র, সেখানে প্রকাশ্য কাজকে গুরুত্বহীন বিষয়ে পরিণত করাপূর্বক এই ধারাগুলাে ইংলিশ আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেছে এবং ১২০এ ধারার বিধানগুলাে এসব বৈশিষ্ট্যকে সন্দেহাতীতভাবে পরিষ্কার করে তুলবে। কোনাে বেআইনি কাজ করার কিংবা বেআইনি পন্থায় কোনাে আইনি কাজ করার জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির ঐকমত্যে আসাই হলাে ষড়যন্ত্রের অপরাধের সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান ও বৈশিষ্ট্য। ১০ ধারায়ও পেনাল কোডের ১২০এ ধারার প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। সেখানে বলা আছে-
“দুই বা ততােধিক ব্যক্তি যখন (ক) একটা বেআইনি কাজ কিংবা (খ) বেআইনি পন্থায় বেআইনি নয় এমন কোনাে কাজ করতে বা করার কারণ ঘটাতে একমত হয়, তখন সেই মতৈক্যটাই একটা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত।” ঐ ধারার সঙ্গে একটা বিধান যােগ করা আছে, যেখানে বলা আছে, অপরাধ সংঘটনে মতৈক্য ছাড়া আর কোনাে মতৈক্যকে ষড়যন্ত্র বলে বােঝাবে না। অতএব, এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা প্রয়ােগের জন্য ষড়যন্ত্র মামলার আপাত মর্মকথা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ কথা বিশ্বাস করার অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি থাকতে হবে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি পেনাল কোডের ১২০এ ধারার ভাষার আলােকে একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে। Kehar Singh vs State, AIR 1988 SC 1883 মামলায় ১২০এ ধারাটি নিমােক্তভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে“এই ধারাটিকে মূলত দুভাবে ভাগ করা যেতে পারে : প্রথম অংশে বলা আছে, যেখানে এ কথা বিশ্বাস করার মতাে যুক্তি আছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটা অপরাধ বা অভিযােগযােগ্য অন্যায় করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে এই পূর্ববর্তী শর্তটি পরণ হবার পরই শুধ ধারার পরবর্তী অংশটি ক্রিয়াশীল হয়। এ কথা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ধারার এই অংশ বিশ্বাস করার এই যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির কথা বলা হয়েছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে। এটা স্পষ্টতই ১২০এ ধারার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেখানে বলা আছে, যখন দুই বা ততধিক ব্যক্তি কাজটা করতে বা করার কারণ ঘটাতে একমত হয়। এর সঙ্গে একটি অনুবিধি যােগ করে ব্যাপারটিকে আরাে সুরক্ষিত করা হয়েছে। সেই অনুবিধিটা হলাে, অপরাধ সংঘটনে মতৈক্য ছাড়া কোনাে মতৈক্য অপরাধজনক ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে। কাজেই এটি আবশ্যক হবে যে, ১০ ধারা প্রয়ােগের জন্য ষড়যন্ত্র মামলার আপাত যথার্থতা প্রমাণ করতে হবে। ধারার দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, এমন ব্যক্তিদের কোনাে একজন প্রথম অভিন্ন অভিপ্রায়
৪৮০

পােষণ করার পর সেই অভিন্ন অভিপ্রায় প্রসঙ্গে তাদের কোনাে একজন বলেছে, করেছে বা লিখেছেএমন যে কোনাে কিছুই হচ্ছে ঐ ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেককে ষড়যন্ত্রকারী বলে বিশ্বাস করার জন্য একটা প্রাসঙ্গিক তথ্য। উপরন্তু, ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এবং এমন ব্যক্তিদের যে কোনাে একজন যে সেই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্যও এটা এক প্রাসঙ্গিক তথ্য। এটা পরিষ্কার যে, এই দ্বিতীয় অংশে সেই সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যা অন্য অবস্থায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে না। এটা সুস্থিরীকৃত যে, একজন আসামির কাজ বা কর্মকাণ্ড অপর আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে না। তবে ষড়যন্ত্রের মামলাগুলােতে ১০ ধারায় একটা ব্যতিক্রমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ধারার এই দ্বিতীয় অংশ তখনই কার্যকর হবে যখন প্রথম অংশটি সুস্পষ্টরূপে প্রতিষ্ঠিত হবার পর অর্থাৎ ১২০এ ধারা বিধৃত বক্তব্যের আলােকে দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে ষড়যন্ত্র করেছে- এ কথা বিশ্বাস করার অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি থাকে। কেবল তখনই আসামিদের একজনের কর্মকাণ্ড বা বক্তব্যকে অপর আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।।
১৩৪. পরবর্তীকালে Suresh Chandra Bahri vs Gurbachan Singh, AIR 1994 SC 2420 মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন-
“ওপরের এই প্রেক্ষাপটে আমরা ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০এ ধারার বিধান উল্লেখ করতে পারি। এখানে অপরাধজনক ষড়যন্ত্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। বলা আছে যে, যখন দুই বা ততােধিক ব্যক্তি (১) একটা বেআইনি কাজ বা বেআইনি পন্থায় বেআইনি নয় এমন কাজ করতে বা করার কারণ ঘটাতে সম্মত হয়, তখন এমন ঐকমত্যই একটা অপরাধজনক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত হয়। তবে অপরাধ সংঘটনে ঐকমত্য ছাড়া কোনাে ঐকমত্য অপরাধজনক ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে না, যদি না ঐ ঐকমত্য ছাড়া এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক পক্ষ ঐকমত্য অনুযায়ী কোনাে কাজ করে। কাজেই ১২০এ ধারায় সন্নিবেশিত বিধানগুলাের ওপর দ্রুত চোখ বােলালে দেখা যাবে যে, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র মানে কোনাে বেআইনি কাজ করার জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে একটা ঐকমত্য কিংবা এমন কাজ যেটি নিজেই হয়ত বেআইনি নয়, তবে তা বেআইনি পন্থায় করা বা বাস্তবায়িত হয়। কাজেই অপরাধজনক বা দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্র অপরাধের অপরিহার্য উপাদান হলাে একটা অপরাধ সংঘটনে ঐকমত্য। যেখানে ঐকমত্যটা হলাে এমন এক কাজ করার জন্য, যে কাজটা নিজেই একটা অপরাধ, সে ক্ষেত্রে বাদিপক্ষকে দৃশ্যমান কর্মকাণ্ডের কোনাে প্রমাণ দেওয়ার দরকার পড়ে না। কারণ এমন পরিস্থিতিতে ঐ ধরনের একটি মতৈক্যের প্রমাণ দিয়ে দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রতিপাদন করা হয়। অন্য কথায়, যখন কথিত ষড়যন্ত্রটি ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০এ ধারার (২) উপধারার বিধানের সঙ্গে পঠিত ১২০বি ধারায় বর্ণিত প্রকৃতির গুরুতর অপরাধ সংঘটন-সম্পর্কিত হয় তখন সে ক্ষেত্রে এমন এক অপরাধ সংঘটনের জন্য আসামিদের মধ্যে মতৈক্য থাকার একটিমাত্র প্রমাণই কেবল ১২০বি ধারা বলে দোষী সাব্যস্ত হবার জন্য যথেষ্ট এবং আসামিদের বা তাদের কোনাে একজনের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের সমর্থনে কোনাে প্রমাণের প্রয়ােজন হবে না। এমন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে যেসব বিধান রয়েছে, ষড়যন্ত্রের অপরিহার্য উপাদান অপরাধ সংঘটনে ষড়যন্ত্রকারীদের নিজেদের মধ্যকার ঐকমত্য হওয়ায় ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি ব্যক্তিকে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনে প্রকাশ্য কোনাে কাজ করতেই হবে এমন কোনাে প্রয়ােজন নেই। তাই এই শর্তাবলি ও উপাদানগুলাের অস্তিত্ব যদি প্রতিপাদন করা যায় তাহলে ঐ কাজটি ১২০বি ধারায় সন্নিবেশিত বিধানসমূহের আওতায় পড়বে। কেননা তা না হলে একটা ষড়যন্ত্রের চরিত্রই হলাে সেটা সম্পূর্ণ গােপনীয়তার মধ্যে চিন্তা করতে ও থাকতে হবে, নইলে
৪৮১

গােটা উদ্দেশ্যই বানচাল হয়ে যেতে পারে। এটা একটা সাধারণ অভিজ্ঞতা এবং বলার অপেক্ষা রাখে যে, অতি বিরল ক্ষেত্রেই কেবল একজন অপরাধ সংঘটনে দণ্ডনীয় ষড়যন্ত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণের মুখােমুখি হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত প্রমাণেরই অস্তিত্ব থাকে, যেখান থেকে একটা অপরাধ ঘটাতে দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে ঐকমত্য সংক্রান্ত উপসংহারে পৌঁছানাের মতাে অনুমান ন্যায়সঙ্গতভাবেই টানা যেতে পারে।”
১৩৫. সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ষড়যন্ত্রের অপরাধ সংঘটনে প্রথমে সেই ষড়যন্ত্রে দুই বা ততােধিক ব্যক্তিকে একত্রে যুক্ত হতে হবে; দ্বিতীয়ত, সেই ষড়যন্ত্র কার্যকর করার উদ্দেশ্যে অবশ্যই ষড়যন্ত্র অনুসারে কোনাে কাজ বা বেআইনি বিচ্যুতি থাকতে হবে। ষড়যন্ত্রের সহযােগীকে অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তির সঙ্গে অপরাধকর্মে যুক্ত হতে হবে এমন কোনাে কথা নেই। যে ষড়যন্ত্র অনুযায়ী অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে সেটিতে সে সম্পৃক্ত থাকলে সেটাই যথেষ্ট। ৫ক অধ্যায়ে ১২০এ ধারাবলে সংজ্ঞায়িত এক নতুন অপরাধের পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। সেই অপরাধের নাম অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র। কোনাে বেআইনি কাজ কিংবা বেআইনি নয় এমন কাজ বেআইনি পন্থায় করা বা করার কারণ ঘটানাের জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির স্রেফ একমত হওয়াটাই হলাে সেই অপরাধ। ঐ ধারায় একটা বিধান রয়েছে যাতে বলা আছে যে, অপরাধ সংঘটনে ঐকমত্য হওয়া ছাড়া কোনাে ঐকমত্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হবে না, যদি না। ঐকমত্যের বিষয়টি বাদে এমন ঐকমত্যের সঙ্গে যুক্ত এক বা একাধিক পক্ষ ঐকমত্য অনুসারে কোনাে কাজ করে।
১৩৬. সুতরাং, উপরে নির্দেশিত নীতির হিসাবে প্রত্যেক ষড়যন্ত্রকারী অভিন্ন উদ্দেশ্য অর্জনে সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় তার পৃথক ভূমিকা পালন করে। প্রত্যেকে এ ব্যাপারে সচেতন যে, সাধারণ ষড়যন্ত্রে তার একটা ভূমিকা পালন করার আছে, যদিও সে ঐ ষড়যন্ত্রের সব গােপন বিষয় কিংবা যেসব পন্থায় অভিন্ন উদ্দেশ্য হাসিল করা হবে সেগুলাে না-ও জানতে পারে। অশুভ পরিকল্পনার উদ্যোক্তা হতে পারে গুটিকয়েক ব্যক্তি, কয়েকজন এ থেকে ঝরে পড়তে পারে এবং কয়েকজন পরবর্তী পর্যায়েও যােগদান করতে পারে, তবে এই ষড়যন্ত্র ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত অব্যাহত থেকে যায়। সময়ান্তরে উপযুক্ত বা সুবিধাজনক বলে পরিগণিত হতে পারে এমন সব পন্থায় অভিন্ন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা থাকতে পারে। অভিন্ন পরিকল্পনাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কৃত হতে পারে। নতুন নতুন পন্থাও উদ্ভাবিত হতে পারে। ষড়যন্ত্রকারীদের অভিন্ন উদ্দেশ্য তখন হয় অভিন্ন পরিকল্পনাকে আরাে এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাজ করা। ষড়যন্ত্রকারীরা আগন্তুক বা বহিরাগতের উপস্থিতিতে আলােচনা করে না। একাত্মতা ও গােপনীয়তা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের উপাদান বিধায় এটি প্রমাণ করার জন্য প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া কঠিন। অতএব, এটা পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্পর্কিত সাক্ষ্য এবং অপরাধ সংঘটনের আগে ও পরে অভিযুক্তের আচার-আচরণ দ্বারা প্রমাণ করা যায়।
১৩৭. রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিসহ আপিলকারীরা তাদের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা ও ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ পূরণ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার-পরিজনকে হত্যার এক ষড়যন্ত্র এঁটেছিল এবং সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট এক নৈশ কুচকাওয়াজের আয়ােজন করেছিল এবং সেই নৈশ কুচকাওয়াজে আপিলকারী ফারুক রহমান ও অন্যান্য সহ-আসামি কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী জওয়ানদের উত্তেজিত করে তুলেছিল, অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অ বের করে নিয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােতে অফিসার ও জওয়ানদের মােতায়েন করেছিল এবং তারপর তাদের কয়েকজন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে এসে তাকে ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের নৃশংসভাবে হত্যা
৪৮২

করে। ঐ ধরনের বার্ষিক নৈশ কুচকওয়াজ সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাত ১১টায় শেষ হয়। কিন্তু ১৪ আগস্টের নৈশ কুচকাওয়াজ ১৫ আগস্ট ভাের পর্যন্ত চলেছিল। উপরন্তু কুচকাওয়াজে সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিটকে। যুক্ত করার কোনাে বিধান ছিল না। অথচ আপিলকারীরা ও অন্যান্য অভিযুক্ত তাদের অপরাধমূলক লক্ষ্য হাসিলের জন্য বিধি লঙ্ঘন করে ল্যান্সার ইউনিট ও আর্টিলারি ইউনিটকে একত্র করেছিল। তদুপরি, এ ধরনের মহড়ায় গােলাবারুদ বহনের ওপর যদিও নিষেধাজ্ঞা ছিল, তথাপি আপিলকারীরা ও সহ-অভিযুক্তরা তাদের অভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য অস্ত্রভাণ্ডার থেকে গােলাবারুদ বের করে নিয়েছিল। বিচারিক আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডাদেশ অনুমােদন করে হাইকোর্ট বিভাগ যে রায় প্রদান করেন তার বিরুদ্ধে সংবিধানের ১০৩(৩) অনুচ্ছেদবলে দায়ের করা এই আপিলের সীমিত সুযােগের প্রতিও লক্ষ রাখা প্রয়ােজন। রেকর্ডকত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভুল ব্যাখ্যা, তা পাঠ না করা কিংবা তা বিবেচনা না করার কারণে আপিলকারীদের বিচার ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে সে মর্মে আপিলকারীরা কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। তা সত্ত্বেও আমরা, আপিলকারীদের যেহেতু মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, সেহেতু বিজ্ঞ আইনজীবীদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে রেকর্ডকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণের গুণাগুণের ভিত্তিতে সবিস্তারে আপিলের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের সুযােগ দিয়েছি।
১৩৮. আগেই বলা হয়েছে যে, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৮, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ৩২, ৩৪, ৩৯, ৪০, ৫৩ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর রাষ্ট্রপক্ষ নির্ভর করেছিল। রাষ্ট্রপক্ষের ১১ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি একটা ইউনিটের সদস্য ছিলেন। প্যারেড ময়দানে পৌছার পর তিনি কুচকাওয়াজে বিশৃঙ্খলা দেখতে পান। ফারুক রহমান মেজর আহমেদ হােসেনসহ সেখানে আসেন। তারপর ফারুক রহমান ও অন্য অফিসাররা মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) অফিসে যান এবং তিনি আরও লক্ষ করেন যে, মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) অফিসে আরও কিছু লােক সাদা পােশাকে উপস্থিত, যাদেরকে তিনি অফিসার মনে করেছিলেন। মধ্যরাত প্রায় ১২টায় তিনি তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন, সাদা পােশাকধারী লােকেরা তার অফিস থেকে বেরিয়ে আসছে এবং তাদের পিছু পিছু মহিউদ্দীনও (ল্যান্সার) নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে এবং হুদাকে তার কাছে আসতে বলে। সে সময় হুদা মেজর ডালিমকে কিছুটা অপেক্ষা করতে বলে এবং এরপর তাদের দুজন মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) পিছু পিছু যায়। মহিউদ্দীন এরপর এদের দুজনের জন্য ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করে।
১৩২. রাষ্ট্রপক্ষের ১২ নম্বর সাক্ষী বলেন, প্যারেড ময়দানে তিনি ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অপর কয়েকজন অভিযুক্তকে দেখেছিলেন। কুচকাওয়াজ রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলেছিল। তারপর তাদেরকে ফল-ইন করতে বলা হয়। প্যারেড ময়দানে তিনি লক্ষ করেছিলেন, ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন, মেজর শরিফুল আহমেদ হােসেন, লে. নাজমুল হােসেন আনসার প্যারেড ময়দানের পাশে জেসিওদের সঙ্গে কোনাে কিছু নিয়ে কথা বলছে। এরপর তারা তাদের সামনে আসে। তিনি উর্দিপরা তিনজন অপরিচিত অফিসারকে দেখতে পান। ফারুক রহমান তাদেরকে মেজর ডালিম, বজলুল হুদা বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। অপর ব্যক্তির নাম তিনি মনে করতে পারেননি। ফারুক রহমান তাদের উদ্দেশে বলে, ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সমাবেশ হবে, যেখানে রাষ্ট্রপতি রাজতন্ত্র ঘােষণা করবেন। তারা রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। তিনি ও অন্যান্য অফিসার যেসব নির্দেশ দেবেন জেসিওদের তা মান্য করতে হবে। এরপর ফারুক রহমান তাদের অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নেওয়ার নির্দেশ দেন এবং সেই নির্দেশ অনুসারে তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র বের করে নেয়। এরপর মহিউদ্দীন তৎক্ষণাৎ তাদের বাহনে উঠার। নির্দেশ দেয় এবং তার নির্দেশ অনুসারে তারা চারটি ট্রাকে গিয়ে ওঠে। তিনি সেখানে জওয়ানসহ আরাে দুটি ট্রাক দেখেন। পরবর্তীকালে তিনি জানতে পারেন যে, তারা ছিল আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান, যারা
৪৮৩

এদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করবে। এরপর তারা একত্রে অগ্রসর হয় এবং বালুরঘাট, মহাখালী রােড, ফার্মগেট হয়ে ৩২ নম্বর রােডে এসে মিলিত হয়। মহিউদ্দীন তাদের ৩২ নম্বর রােড দিয়ে কাউকে চলাচল করতে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সে তাদের আরাে বলেছিল, গােলাগুলির আওয়াজ শুনলে তারা যেন ভয় না পায়। কারণ অন্যরাও তাদের নিজেদের লােক।
১৪০. রাষ্ট্রপক্ষের ১৩ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন ল্যান্সারের সদস্য এবং সেদিনের নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ঐ নৈশ কুচকাওয়াজে ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) উপস্থিত ছিল। কুচকাওয়াজ রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত চলেছিল। সে সময় মেজর আবদুর রশিদ তাদের ইউনিটে আসে। তারপর মােসলেম উদ্দিন ও অন্যান্য সেনা অফিসার সেখানে আসে এবং একটি ট্রাকে ওঠে। তারপর তারা তাকে (সাক্ষী) ও অন্যদের তাদের অনুসরণের নির্দেশ দেয়। তাদের বহনকারী যানটি মহাখালীতে এসে থামলে তিনি (সাক্ষী) দেখতে পান, আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ানরা সেখানে দাঁড়িয়ে। সে সময় আর্টিলারি ইউনিটের এক অফিসার তাদের বাহনে এসে ওঠে এবং তারপর বাহনটি ইন্দিরা রােড-মিরপুর রােড-সাত মসজিদ রােড হয়ে মিরপুর রােডের ৩২ নম্বরে, যেখানে তাদের মিলিত হবার কথা, সেখানে এসে থামে।
১৪১. রাষ্ট্রপক্ষের ১৪ নম্বর সাক্ষী উল্লেখ করেন, তিনি ল্যান্সার ইউনিটের সদস্য। তিনি বলেন, তিনি নৈশকালীন কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিলেন, যা ১৪ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত চলেছিল। তিনি (সাক্ষী) সেখানে ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন, মেজর আহমদ শরিফুল হােসেন, লে. কিসমত ও লে. নাজমুল হােসেন আনসার এবং সাদা পােশাকধারী আরাে কয়েকজনকে দেখতে পান। তিনি (সাক্ষী) মেজর রশিদের সাথে আর্টিলারি ইউনিটের কয়েকজন অফিসারকেও দেখতে পান। মেজর ফারুক তাদের ফল-ইন করতে বলে। এক জরুরি দায়িত্ব পালনের জন্য তাদেরকে ফল-ইন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর সে (মেজর ফারুক) সাদা পােশাক পরা ব্যক্তিদের মেজর ডালিম ও সুলতান শাহরিয়ার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং তাকে (সাক্ষী) ও অন্যদের বলে যে, এই দুই অফিসার তাদের সঙ্গে কাজ করবে এবং তাদের এ দুজনের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। সে তাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নির্দেশ পালনে অবহেলা করা হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভাের ৪টায় ফারুক রহমান ট্যাঙ্কগুলাে মুভ করার নির্দেশ দেয়। মেজর ফারুক নিজেই একটি ট্যাঙ্কের কমান্ড গ্রহণ করে। ট্যাঙ্কগুলাে একই সময় চলতে শুরু করে এবং কয়েকটি ট্যাঙ্ক বালুরঘাট-ক্যান্টনমেন্ট-মহাখালী হয়ে রেডিও স্টেশনে আসে। সেখানে পৌঁছার পর সুলতান শাহরিয়ার, মেজর ডালিম, মেজর শরিফুল হােসেন কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে রেডিও স্টেশনে প্রবেশ করে। এর কিছুক্ষণ পর ফারুক রহমান ও আবদুর রশিদ রেডিও স্টেশনে এসে ঢােকে।
১৪২. রাষ্ট্রপক্ষের ১৭ নম্বর সাক্ষী বলেন, আলােচ্য সময় তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের সদস্য এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল পাপা ব্যাটারির কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ প্যারেডে যােগ দিয়েছিলেন, যা রাত ১২টা অবধি চলেছিল। এরপর ১ নম্বর ইউনিটের কামানের হাবিলদারের নির্দেশে তারা কামানের গােলা নেন। তিনি (সাক্ষী) লক্ষ করেন, নৈশ কুচকাওয়াজের সময় রেজিমেন্টের কয়েকজন অফিসার কামানের পেছনে কথা বলছিল। এদের মধ্যে তিনি আবদুর রশিদ, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন। মােস্তফা, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ও আরাে দুজনকে চিনতে পারেন। এরা তাদের কাছে আসে এবং সুবেদার হাশেমকে কিছু নির্দেশনা দেয়। এরপর হাশেম সৈন্যদলকে ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয় এবং ছয়টি কামান ছয়টি ট্রাকের সঙ্গে যুক্ত করে। এরপর রাত সাড়ে তিনটা/চারটার দিকে কামানবাহী ট্রাকগুলাে চলতে শুরু করে। তিনি (সাক্ষী) মেজর মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) বাহনটিতে ছিলেন। তাদের ট্রাকটি ৪টার দিকে
৪৮৪

ধানমন্ডি লেকের পাশে এসে থামে। এরপর মহিউদ্দীন তাদেরকে ৩২ নম্বর রােড ও রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরের দিকে তাক করে কামান বসানাের নির্দেশ দেয়। অতঃপর মহিউদ্দীন তাদেরকে যখনই বলবে তখনই কামানের গােলা ছুড়বার নির্দেশ দেয়। এর কিছুক্ষণ পর তারা রাষ্ট্রপতির বাসভবন থেকে | গােলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসতে শােনেন। সে সময় মহিউদ্দীনের নির্দেশ অনুযায়ী তারা চার রাউন্ড কামানের গােলা ছােড়ে। দেখা যাচ্ছে যে, আসামিপক্ষ এই সাক্ষীর এই সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। কাজেই, মহিউদ্দীনের কামান বসানাে ও কামানের গােলাবর্ষণ সম্পর্কে মহিউদ্দীনের নির্দেশ সম্পর্কে তার সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়ে গেছে।।
১৪৩. রাষ্ট্রপক্ষের ১৮ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের গােলন্দাজ। এই ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ছিল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল ব্যাটারি কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের পাপা ব্যাটারিতে ছয়টি কামান ছিল। মহিউদ্দীনের নির্দেশে কামানসহ তারা নতুন বিমানবন্দর হয়ে বালুরঘাটের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং রাত সাড়ে ১২টা/১টা পর্যন্ত তাদের নৈশ ট্রেনিং চালিয়ে যান। ট্রেনিং চলাকালে খন্দকার আবদুর রশিদ ও মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ট্রেনিং পরিদর্শন করে। রাত সাড়ে তিনটা/চারটার দিকে তাদেরকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র এক করে বাহনে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর তাদের সারি বেঁধে দাঁড় করানাে হয়। অতঃপর মহিউদ্দীনের উপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের বলে, তাদেরকে একটা জরুরি কাজ করতে হবে এবং সেটা হলাে রক্ষীবাহিনীকে বাধা দেওয়া। সে তাদেরকে তার বাহনটির পিছু পিছু আসার নির্দেশ দেয়। তখন তাদের ইউনিটটিও রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরের দিকে অগ্রসর হয়।
১৪৪. রাষ্ট্রপক্ষের ২১ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন উপরােক্ত একই আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান। তিনি সেদিনের নৈশ কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিলেন। রাত দুটোর দিকে মেজর আবদুর রশিদ, মহিউদ্দীন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও আরাে কতিপয় অফিসার এয়ারপাের্ট রানওয়েতে যেখানে তারা বসা ছিলেন সেখানে আসে। সে সময় মেজর রশিদ জরুরি কাজে যেতে হবে বলে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হতে বলে। এরপর তার নির্দেশে তারা গােলাবারুদ নেন। অতঃপর বজলুল হুদা তাদের ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয়। ট্রাকগুলাে এরপর ধানমন্ডির দিকে যেতে শুরু করে। ৪টা/সাড়ে ৪টার দিকে তাদের কয়েকজনকে। ৩২ নম্বর রােডে নেমে যেতে বলা হয়। যারা নেমে গেল তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হলাে, ৩২ নম্বর রােড দিয়ে একজন মানুষকেও যেন চলাচল করতে না দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের ২২ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন। হতভাগ্য রাতটিতে তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিলেন এবং কুচকাওয়াজ রাত ১২টা পর্যন্ত চলেছিল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর রাত প্রায় ২টা/২.৩০টার দিকে মেজর আবদুর রশিদ সেখানে আসে মেজর মহিউদ্দীন, মােস্তফা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও আরাে কতিপয় অজ্ঞাতনামা অফিসারসহ। এ সময়ে মেজর আবদুর রশিদ তাদের অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপারে খোঁজখবর করে এবং তারা তাদের অস্ত্র দেখায়। এরপর সে তাদের বলে, তাদের এক জরুরি কাজে নেওয়া হবে এবং প্রয়ােজন হলে তারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করবে। তারা অস্ত্র ও গােলাবারুদ ট্রাকে তােলার পর বিএইচএম (BHM) তাদের কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করে ও ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয়। এরপর তাদের ট্রাক ৩২ নম্বর রােডের দিকে এগিয়ে যায়। ফজরের আজানের সময় তাদের কয়েকজনকে ৩২ নম্বর রােডে ট্রাক থেকে নেমে যেতে বলা হয় এবং ৩২ নম্বর রােডে কাউকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। আসামিপক্ষ তার সাক্ষ্যের অভিযােগমূলক অংশটুকু চ্যালেঞ্জ করেনি।
৪৮৫

১৪৫. রাষ্ট্রপক্ষের ২৩ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ল্যান্সার ইউনিটের জওয়ান ছিলেন। হতভাগ্য রাতটিতে তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, ফারুক রহমান ট্যাঙ্কের সামনে এলাে ও লে. কিসমতের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললাে। এরপর লে. কিসমত স্কোয়াড্রনকে সারি বেঁধে দাঁড় করানাের জন্য রিসালদার শামসুল হককে নির্দেশ দিলাে। এরপর ফারুক রহমান, লে. কিসমত ও রিসালদার শামসুল হক সেখানে এলাে এবং ফারুক রহমানের নির্দেশ অনুসারে তাদের মধ্য থেকে ট্যাঙ্কের ছয়জন ড্রাইভার ও আরও কয়েকজন জওয়ানকে বেছে নেওয়া হলাে। এরপর সে জওয়ানদের ছয়টি ট্যাঙ্ক বণ্টন করে দিলাে এবং অফিসারদের ডিউটিও ভাগ করে দিলাে। রাত ৩/৩.৩০টার দিকে মেজর ফারুক রহমান আবার এলেন। তার নির্দেশ অনুযায়ী অফিসার ও জওয়ানরা ট্যাঙ্কে গিয়ে উঠল এবং তারপর ট্যাঙ্কগুলােকে গ্যারেজ থেকে বের করে এনে সিগন্যাল গেটে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রাখা হলাে। পরে ফারুক রহমান একটি ট্যাঙ্কে গিয়ে ওঠে এবং অন্য অফিসারদের বাকি ট্যাঙ্কগুলােতে ওঠার নির্দেশ দেয়। এরপর তার নির্দেশে ট্যাঙ্কগুলাে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়।
১৪৬. রাষ্ট্রপক্ষের ২৪ নম্বর সাক্ষী বলেন, প্রাসঙ্গিক সময়টিতে তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান। মেজর আবদুর রশিদের নির্দেশে তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং তার নির্দেশেই মার্চ করে এয়ারপাের্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। যাওয়ার আগে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিতে বলা হয়েছিল। মেজর রশিদ তাদের বলেছিলেন, জরুরি কাজের জন্য তাদের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে। এরপর তাদের ব্যাটারি কমান্ডার তাদের ল্যান্সার ইউনিটে নিয়ে যায়। তিনি ল্যান্সার ইউনিটের জওয়ানদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানাে অবস্থায় দেখতে পান। ল্যান্সার ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ফারুক রহমান দুটি ইউনিটকে একত্র করে ব্রিফ করে। সে সময় তিনি আর্টিলারি ইউনিটের কতিপয় সদস্যকে সেখানে উপস্থিত দেখতে পান। তিনি কয়েকজন অপসারিত সেনা অফিসারকেও সেখানে দেখেন। মেজর রশিদ ও ফারুক রহমান ওই সব অফিসারকে মেজর ডালিম, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর সুলতান শাহরিয়ার ও ক্যাপ্টেন মাজেদ বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর মেজর আবদুর রশিদ ও মেজর ডালিম তাদের বলে, তারা রক্তের বিনিময়ে দেশকে মুক্ত করেছে। বর্তমান সরকার নারীর ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, মানুষ অনাহারে মরছে। কাজেই এ সরকারকে উৎখাত করতে হবে। এরপর ফারুক রহমান ও মেজর আবদুর রশিদ তাদের গােলাবারুদ নেওয়ার নির্দেশ দেয় এবং তাদের নির্দেশ অনুসারে তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে গােলাবারুদ নেয় এবং শহরের দিকে অগ্রসর হয়।
১৪৭. আসামিপক্ষ ফারুক রহমান কর্তক ল্যান্সার ও আর্টিলারির দুটি ইউনিটকে একীভূত করা, ইউনিটগুলাের উদ্দেশ্যে ফারুক রহমানের ব্রিফিং এবং সেখানে মেজর আবদুর রশিদের উপস্থিতি সম্পর্কিত এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। জেরার সময় এই সাক্ষী বলেছিলেন, বার্ষিক কুচকাওয়াজে বিভিন্ন ইউনিটের যৌথ কুচকাওয়াজের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না। তিনি জবানবন্দিতে দেওয়া তার এই মূল বক্তব্যটাই পুনর্ব্যক্ত করেন যে, ফারুক রহমানের নির্দেশেই তাদের ইউনিটকে ল্যান্সার ইউনিটের সঙ্গে একীভূত করা হয়েছিল। মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের নির্দেশে তারা গােলাবারুদ সঙ্গে। কথাটিও অস্বীকার করা হয়নি।
১৪৮. প্রাসঙ্গিক সময়ের আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান রাষ্ট্রপক্ষের ২৫ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, রাত ৩/৩.৩০টার দিকে ক্যাপ্টেন মােস্তফার নির্দেশে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয়। এরপর তারা মার্চ করে ট্যাঙ্ক ইউনিটের একটি খােলা জায়গায় যায় এবং সেখানে ট্যাঙ্ক ইউনিটের জওয়ানদের উপস্থিতি লক্ষ করে এবং তাদেরকে ছয়টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। তাদের আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ এবং ট্যাঙ্ক ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার ফারুক রহমান তাদের ব্রিফ করে। মেজর রশিদ, ক্যাপ্টেন মােস্তফা, মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন মাজেদ ও অন্যান্য
৪৮৬

অফিসার সেখানে উপস্থিত ছিলে। মেজর ডালিম সেখানে বক্তৃতা দেয়। এরপর ফারুক রহমান ও মেজর রশিদও বক্তৃতা করেন। তারা বলে, তারা অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। সরকার | মা-বােনদের ইজ্জত রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, মানুষজন অনাহারে মরছে- এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। এরপর তারা তাদেরকে গােলাবারুদ নিতে বলে এবং তখন তাদের নির্দেশে তারা গােলাবারুদ নেয় এবং মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর তিনি (সাক্ষী) সেরনিয়াবাতের পরিবার-পরিজনদের হত্যার ঘটনাও বর্ণনা করেন। মহিউদ্দীন কর্তৃক জেরাকালে এই সাক্ষী বলেন, গুলিগােলা ল্যান্সার অ্যামুনিশন স্টোরের সামনে তূপীকৃত অবস্থায় ছিল এবং ফারুক রহমানের নির্দেশ অনুসারে তারা সেই গুলিগােলা নেয়। আসামিপক্ষ কোনােভাবেই এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি।
১৪৯. রাষ্ট্রপক্ষের ২৬ নম্বর সাক্ষী বলেন, প্রাসঙ্গিক সময়ে তিনি আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল উক্ত ইউনিটের পাপা ব্যাটারির কমান্ডার মেজর রশিদ তাকে গােলাবারুদের গুদামের চাবিটা তার কাছে রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। রাত প্রায় ১১/১১.৩০টার দিকে মেজর রশিদ ও ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার ইউনিটের ১০/১২ জন জওয়ানসহ গােলাবারুদের ভাণ্ডারের সামনে আসে এবং মেজর রশিদের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি গােলাবারুদ ভাণ্ডারের তালা খুলে দেন। এরপর মেজর রশিদের নির্দেশে জওয়ানরা কামান, রাইফেল, স্টেনগান, এসএমজি, পিস্তল ইত্যাদি নিয়ে নেয়। আসামিপক্ষ এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেই কারণে তার সাক্ষ্য অবিতর্কিত রয়ে গেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের ২৭ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি আলােচ্য সময়ে ফিল্ড আর্টিলারির জওয়ান ছিলেন। নৈশ কুচকাওয়াজে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। এরপর প্যারেড ময়দান থেকে তারা নিউ এয়ারপাের্ট রােড অভিমুখে অগ্রসর হন। রাত ৩/৩.৩০টার দিকে মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) সেখানে আসে; তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করা এবং কয়েকজন জওয়ানকে মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) সঙ্গে গাড়িতে গিয়ে ওঠার নির্দেশ দেয়। তারপর মেজর মহিউদ্দীন তাদের বলে, রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালাবে এবং তাদের এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি (সাক্ষী) দেখতে পান যে, একটা কামান গাড়ির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। আর চারটি কামানও অন্য গাড়িগুলাের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এরপর তারা এগিয়ে চলেন এবং মহাখালী-ফার্মগেট-গ্রিন রােড-এলিফ্যান্ট রােড ও মিরপুর রােড হয়ে কলাবাগান এলাকায় লেকের কাছে আসেন। এরপর তাদের গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়। এরপর মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তাদের বলে, এই সড়ক দিয়ে কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হবে না। আসামিপক্ষ সাক্ষীপ্রদত্ত এই সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি।
১৫০. রাষ্ট্রপক্ষের ৩২ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান। সেই ইউনিটে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিলেন তাদের কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং সেই কুচকাওয়াজে তিনি মেজর রশিদ, মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), মেজর জুবায়ের সিদ্দিক, ক্যাপ্টেন মােস্তফা ও লে. হাসানকে চিনতে পারেন। কুচকাওয়াজ রাত ৩টা/সাড়ে ৩টা পর্যন্ত চলেছিল। এরপর হাবিলদার মােস্তফা তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। সে সময় ঐ অফিসাররা ও মেজর ডালিম সেখানে উপস্থিত ছিল। মেজর রশিদের নির্দেশে হাবিলদার মােস্তফা তাদেরকে অস্ত্র ও গুলিগােলা দেয়। এরপর তারা সামনে অগ্রসর হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরের পাশের রাস্তায় তাদের নেমে যাওয়ার এবং এই রাস্তা দিয়ে কাউকে চলাচল করতে না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। আসামিপক্ষ এই সাক্ষীপ্রদত্ত সাক্ষ্য চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেটি অবিতর্কিত রয়েছে।
৪৮৭

১৫১. রাষ্ট্রপক্ষের ৩৪ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন। সেই ইউনিটে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল ব্যাটারি কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং কুচকাওয়াজ শেষে ছয়টি ট্যাঙ্কসহ নতুন বিমানবন্দরে যান। রাত প্রায় আড়াইটায় তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয় এবং তারপর একটি বাহনে ওঠার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর তারা ফার্মগেট হয়ে মিরপুর রােড ধরে লেকের পূর্বদিকে অগ্রসর হন। সেখানে পৌছে তারা অবস্থান গ্রহণ করেন। কামানগুলাে সেখানে স্থাপন করা হয়। সে সময় মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) কামানের পিছনে এসে দাঁড়ায় এবং ঐ সড়ক দিয়ে কাউকে চলাচল করতে না দেওয়ার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়। আসামিপক্ষ এই বক্তব্যটিও চ্যালেঞ্জ করেনি।
১৫২. রাষ্ট্রপক্ষের ৩৯ নম্বর সাক্ষী বলেন, আলােচ্য সময়টিতে তিনি ল্যান্সার ইউনিটের ড্রাইভার ছিলেন। তার ইউনিটে ফারুক রহমান ছিল ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার। তিনিও (সাক্ষী) নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং মহিউদ্দীন, মেজর শরিফুল ইসলাম ও অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কুচকাওয়াজে উপস্থিত দেখতে পান। ফারুক রহমান তাদের বলে যে, একটা জরুরি উদ্দেশ্যে ট্যাঙ্ক বাইরে নিতে হবে এবং এজন্য তাদের প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেয়। এরপর জওয়ানদের নিজ নিজ কাজে যেতে বলে। এ সময়ে মেজর ডালিম ও আরেক অফিসার তাদের ইউনিটে আসে। মেজর ডালিম ইউনিফর্ম চাইলে তাকে ইউনিফর্ম দেওয়া হয়। অতঃপর ট্যাঙ্ক ইউনিটটি বিমানবন্দর হয়ে বঙ্গভবন অভিমুখে অগ্রসর হয়।।
১৫৩. রাষ্ট্রপক্ষের ৪০ নম্বর সাক্ষী বলেন যে, প্রাসঙ্গিক সময়ে তিনি ল্যান্সার ইউনিটের লেফটেন্যান্ট ছিলেন এবং ফারুক রহমান ছিল সেই ইউনিটের কমান্ডার। তিনি (সাক্ষী) নৈশ প্যারেডে যােগ দিয়েছিলেন এবং প্যারেডটি মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। মহিউদ্দীন এরপর তা ফারুক রহমানের কাছে হস্তান্তর করে। প্যারেড রাত ২/২.৩০টা পর্যন্ত চলেছিল, যদিও তা শেষ হবার কথা ছিল রাত ১২টায়। ফারুক রহমান তাকে রেজিমেন্টের দিকে খেয়াল রাখতে ও গেট বন্ধ করে দিতে বলে। তার (সাক্ষীর) প্রশ্নের জবাবে ফারুক রহমান তাকে আরও বলে যে, তারা স্বৈরাচারী সরকারকে অপসারণ করতে যাচ্ছে। আসামিপক্ষ সাক্ষীর এই বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করেনি; যদিও সাক্ষী এটি স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, মেজর ফারুক রহমান ও অন্যরা সরকার উৎখাত করতে চলেছে। রাষ্ট্রপক্ষের ৫৩ নম্বর সাক্ষী বলেন, তিনি ছিলেন আর্টিলারি ইউনিটের সুবেদার মেজর এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল ঐ ইউনিটের পাপা ব্যাটারি কমান্ডার। ফারুক রহমান তাদের কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদের অফিসে আসত। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে সে বহুবার তার সঙ্গে কথা বলেছে। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, মেজর রশিদ আগস্টের নৈশ ট্রেনিং কর্মসূচির আয়ােজন করেছিল এবং ঐ কর্মসূচি অনুযায়ী ১৪ আগস্টের রাতটা এ কাজের জন্য ধার্য করা হয়। মহিউদ্দীন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের প্যারেডের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং পরে তা মেজর রশিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি (সাক্ষী) আরও বলেছেন যে, রাত আনুমানিক দশটার দিকে মেজর রশিদ এবং ফারুক রহমান তার অফিসের বারান্দায় এসেছিল এবং কিছু সময় পরে একসঙ্গে তারা একটি জিপে করে এই স্থান ত্যাগ করে।
১৫৪. উপরের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে, মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক রহমান, নথিদৃষ্টে যারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তাদের পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৪ আগস্ট রাতে নৈশকালীন কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল। নথিদৃষ্টে আরাে দেখা যায় যে, মেজর রশিদ খােন্দকার মােশতাকেরও একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। আরাে দেখা যায় যে, প্রথম ল্যান্সার ইউনিটের কামান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মােমেন ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ছুটিতে ছিলেন এবং ইউনিটের টু আইসি হিসেবে ফারুক রহমান কর্নেল মােমেনের
৪৮৮

অনুপস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে প্রথম ল্যান্সার ইউনিটের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার মেজর রশিদ ও অন্য আসামিদের সাথে যােগসাজসে ১৪ আগস্ট রাতে নৈশকালীন কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল এবং এটিকে ১৫ আগস্টের শুরুর সময় পর্যন্ত প্রলম্বিত করে। অপসারিত সেনা অফিসাররাও ঐ কুচকাওয়াজে অংশ নেয় এবং এরপর অফিসাররা মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) অফিসে গােপন আলােচনা করে। ফারুক রহমান, বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে এভাবে উত্তেজিত করে যে, রক্ষীবাহিনী তাদের আক্রমণ করবে অথবা রাজত্ব কায়েম করবে এবং এরপর তাদের নির্দেশনা অনুসারে জওয়ানরা ভারী অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়েছিল, যা কেবল যুদ্ধের সময়ই ব্যবহার করা হয়।
১৫৫. অত্রএব, এটি প্রতিভাত হয় যে, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-১৩, পি.ডব্লিউ-১৪, পি.ডব্লিউ-২৩, পি.ডব্লিউ-২৪, পি.ডব্লিউ-২৫, পি.ডব্লিউ-৩৫, পি.ডব্লিউ-৩৯ এবং পি.ডব্লিউ-১১ ফারুক রহমানকে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার সময় চিনতে বা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন; পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-১৪ এবং পি.ডব্লিউ-৩৯ মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) চিনেছিলেন এবং পি.ডব্লিউ-১৭, পি.ডব্লিউ-১৮, পি.ডব্লিউ-২১, পি.ডব্লিউ-২২, পি.ডব্লিউ-২৬, পি.ডব্লিউ-২৭, পি.ডব্লিউ-৩২, পি.ডব্লিউ-৩৪ এবং পি.ডব্লিউ-৫৩ মহিউদ্দীনকে (আর্টিলারি) চিনতে পেরেছিলেন; পি.ডব্লিউ-১৪ সুলতান শাহরিয়ারকে চিনেছিলেন এবং পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-২১ এবং পি.ডব্লিউ-২২ বজলুল হুদাকে চিনতে পেরেছিলেন। উপরন্তু, অভিযােগে সম্পৃক্তপূর্বক এই সাক্ষীদের প্রদত্ত সাক্ষ্যের এই অংশ ডিফেন্স চ্যালেঞ্জ করেনি। যেমন, নির্ধারিত সময়ের পরও রাত সাড়ে তিনটা-চারটা পর্যন্ত ঐ নৈশ কুচকাওয়াজ চলমান ছিল। যদিও সেনাবাহিনীর দুটি ভিন্ন ইউনিটকে একীভূত করে নৈশ কুচকাওয়াজের কোনাে বিধান ছিল না, তারপরও ঐরূপ একীভূত করা হয়েছিল এবং তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে গােলাবারুদ নিয়েছিল যা ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আর্মি রুল ভঙ্গ করে শান্তিপূর্ণ সময়ে তারা ট্যাঙ্ক ও কামান ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়েছিল এবং সেগুলাে ঘটনার ঠিক আগে নিয়ােজিত করেছিল এবং কয়েকজন অপসারিত সেনা অফিসার নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিল; অভিযুক্ত অফিসারদের মধ্যে গােপন বৈঠক হয়েছিল; জওয়ানদের উত্তেজিত করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে এবং ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কয়েকজন অফিসার এবং দুটি ইউনিটের জওয়ানরা আপিলকারীগণসহ ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আসে। এরপর তারা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গিয়েছিল এবং তাঁকে (প্রেসিডেন্ট) ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। যখন অন্য অফিসার, জওয়ানরা কয়েকজন আপিলকারীসহ অন্য কটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিয়ােজিত ছিল।
১৫৬. অধিকন্তু, আপিলকারীদের ঘটনা-পূর্ববর্তী আচরণ সম্পর্কে সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে, পি.ডব্লিউ-১১ ঐ নৈশকালীন কুচকাওয়াজে লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং বজলুল হুদাকে চিনতে পেরেছিলেন। ১৪ আগস্ট রাতের ঐ নৈশ কুচকাওয়াজে পি.ডব্লিউ-১২ মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), ফারুক রহমান এবং বজলুল হুদাকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৩ মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং ফারুক রহমানকে এবং পি.ডব্লিউ-১৪ মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) ও শাহরিয়ারকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৭ ও পি.ডব্লিউ-১৮ ১৪ আগস্ট রাতে ঐ প্যারেড গ্রাউন্ডে লে. কর্নেল মহিউদ্দীনকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২১ ও পি.ডব্লিউ-২২ ঐ প্যারেড গ্রাউন্ডে লে. কর্নেল মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) এবং বজলুল হুদাকে এবং পি.ডব্লিউ-২৩ সেখানে লে. কর্নেল ফারুক রহমানকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। ফারুক রহমান, এ. কে. এম মহিউদ্দীন আহমেদ (অর্টিলারি) এবং লে. কর্নেল শাহরিয়ারকে পি.ডব্লিউ-২৩ প্যারেড গ্রাউন্ডে শনাক্ত করেছিল। মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) এবং ফারুক রহমানকে ঐ নৈশ
৪৮৯

কুচকাওয়াজে পি.ডব্লিউ-২৫ চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৭ মহিউদ্দীন আহমেদকে (আর্টিলারি) কলাবাগান এলাকায় চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩২ মহিউদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন নৈশ কুচকাওয়াজের সময়। পি.ডব্লিউ-৩৪ কলাবাগান এলাকায় লে. কর্নেল মহিউদ্দীনকে চিনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩৫ কর্নেল মহিউদ্দীনকে চিনেছিলেন নৈশ কুচকাওয়াজের গ্রাউন্ডে। পি.ডব্লিউ-৩৯ নৈশ কুচকাওয়াজ গ্রাউন্ডে ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৪০ বলেছেন যে, ফারুক রহমান তাকে বলেছিল যে, তারা স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত করতে চলেছে। কিন্তু সরকার উৎখাতের পরিবর্তে তারা প্রেসিডেন্ট এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগটি বিবেচনা করতে গিয়ে উপরে বিস্তারিতভাবে আলােচিত সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে যেটি দৃষ্ট হয় তা হলাে, আপিলকারীরা তাদের সহ-আসামিগণসহ তাদের সৈনিকদের নিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলাে অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল, সেই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলাের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল এবং আর্টিলারিসহ সেনা মােতায়েন করেছিল এবং এরপর তাদের অভীষ্ট উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়েছিল। আসামিদের কৃত এই সব কর্ম ছিল একই সময়ের তর্কিত পরিকল্পনা অনুসারেযেখানে ছিল একটি গােষ্ঠী ও লক্ষ্যের ধারাবাহিকতা। আপিলকারীদের এই সব আচরণ প্রাসঙ্গিক যা তাদের দোষ ছাড়া অন্য কোনাে যৌক্তিক ব্যাখা দেয় না।
১৫৭. অবশ্য প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পি.ডব্লিউ-২৪কে এই কারণে বিশ্বাস করেননি যে, ফারুক রহমানের পক্ষে জেরা করাকালে তাকে দেওয়া এই সাজেশনের উত্তরে তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, পুলিশের বক্তব্যমতে তিনি আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এই আশঙ্কায় যে, তা না হলে তাকে মামলায় একজন। করা হবে; যেহেতু তাকে সেরনিয়াবাতের বাসভবনে উপস্থিত পাওয়া গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক অবশ্য পি.ডব্লিউ-২৪কে এই কারণে বিশ্বাস করেছেন যে, জেরায় প্রদত্ত তার বক্তব্য সামগ্রিকভাবে পর্যালােচনা করলে তা এটি বলে যে, তিনি (সাক্ষী) ঐ সাজেশনটি অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞ দায়রা জজ অসাবধানতাবশত তার (সাক্ষী) বক্তব্য ‘হ্যা-সূচকভাবে লিপিবদ্ধ করেন এবং এটি প্রতিভাত হয় যে, কর্নেল মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) পক্ষে প্রদত্ত প্রায় অনুরূপ ডিফেন্স সাজেশন পি.ডব্লিউ-২৪ অস্বীকার করেছেন। তদুপরি, এই সাক্ষী ঘটনার প্রায় ২২ বছর পর ১৯৯৭ সালের ১৯ অক্টোবর আদালতে সাক্ষ্য দেন। এই বিলম্বিত সময়ে এসে সেরনিয়াবাত হত্যা মামলায় তার সম্পৃক্ত হওয়ার কোনাে শঙ্কা ছিল না; যেহেতু, দীর্ঘ সময় আগে মামলাগুলাে দায়ের হয়েছিল। তাছাড়া উপরােক্ত বক্তব্য আদালতে সাক্ষ্য প্রদানকালে দেওয়া হয়েছিল, পুলিশের কাছে নয়।
১৫৮. তদনুযায়ী, বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারকের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত পােষণ করছি যে, বিজ্ঞ দায়রা বিচারক অসতর্কতাবশত কথিত ডিফেন্স সাজেশনটি ‘হা-সূচক’ভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন, যদিও পি.ডব্লিউ-২৪
উত্তরে ‘না-সূচক জবাব দিয়েছিলেন।
১৫৯. প্রথম বিজ্ঞ বিচারক আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার, বজলুল হুদা এবং অন্য আসামিদের বঙ্গভবনে চিনতে পারা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-৪৬কেও এই কারণে বিশ্বাস করেননি যে, নথিতে এমন কিছু নেই যা থেকে এটি প্রতিভাত হতে পারে যে, তিনি (সাক্ষী) তাদেরকে আগে থেকেই চিনতেন। বিজ্ঞ বিচারকের এই অভিমতটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ বিজ্ঞ বিচারক নিজেই বঙ্গভবনে এই আপিলকারীদের উপস্থিতির বিষয়টি বিশ্বাস করেছেন এবং এই কারণে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে এই বিরুদ্ধ অনুমান করেছেন যে, তারা জুনিয়র অফিসার হিসেবে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত
৪৯০

ছিল বলে ধরে নেওয়া যায় না। পি.ডব্লিউ-১৫ এবং ৪৭, তারাও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তারা তাদেরকে বঙ্গভবনে দেখেছিলেন। অতএব, বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক যথার্থভাবেই পি.ডব্লিউ-৪৬কে বিশ্বাস করেছেন।
১৬০. রাষ্ট্রপক্ষের মামলা থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, অন্য আসামিদের সাথে আপিলকারীরা ১৪ আগস্ট রাতের নৈশ কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল। যদিও আর্মি রুলে অনুরূপ অনুশীলনে অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নেওয়ার বিধান ছিল না, তারপরও তারা অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নিয়েছিল এবং এরপর তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রােড অভিমুখে, যেখানে প্রেসিডেন্ট বাস করছিলেন, মিন্টু রােড যেখানে কেবিনেট মন্ত্রীগণ অবস্থান করছিলেন সেখানে, রেডিও স্টেশন এবং রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল। তারা রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর ও ৩২ নম্বর রােড লক্ষ্য করে কামান স্থাপন করেছিল- রক্ষীবাহিনী বা অন্য কোনাে বাহিনীর তরফ থেকে কোনাে প্রতিরােধ দেখা দিলে সেগুলাে ব্যবহার করার জন্য। তারা অস্ত্র, কামান ও ট্যাঙ্ক, যা স্বাভাবিক সময়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করা যেত না, তাদের সাথে নিয়েছিল। এইসব অস্ত্র, গােলাবারুদ ও ভারী অস্ত্রাদি যেমন, কামান এবং ট্যাঙ্ক, এগুলাে তারা ঘটনার ঠিক পূর্বমুহূর্তে নিয়েছিল এবং সেগুলাে স্থাপন করেছিল মূলত সরকার এবং অন্য কোনাে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি-আক্রমণ প্রতিরােধ ও প্রতিহত করার লক্ষ্যে। আপিলকারীরা ও অন্য আসামিদের এইরূপ কর্মকাণ্ড ঐ ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় তারা একটি সাজানাে পথে পরিকল্পিত পন্থায় পূর্বপরিকল্পিত হত্যার এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য একটি সাজানাে পথে ব্যবস্থা নিয়েছিল।
১৬১. আপিলকারীগণ ও অন্য আসামিদের পরবর্তী আচরণের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ পি.ডব্লিউ-৮, ৯, ১২, ১৫, ১৬, ২০, ২৩, ৩৭, ৪২, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৯ এবং ৬০কে পরীক্ষা করেছে। পি.ডব্লিউ-৯ বলেন যে, ১৫ আগস্ট রাত ৩টার সময় পি.ডব্লিউ-৪৫-এর নির্দেশ অনুসারে তিনি পরিস্থিতি জানার জন্য প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যান, যেখানে ভবনের গেটে বজলুল হুদা তাকে গ্রহণ করেছিল এবং মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) তত্ত্বাবধানে একটি হেলিকপ্টারযােগে প্রেসিডেন্টের মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় পাঠানাে হয়েছিল।
পি.ডব্লিউ-১২ বলেন যে, ১৫ আগস্ট সকাল ০৭.১৫ মিনিটে তিনি (সাক্ষী) যখন ৩২ নম্বর রােড থেকে একটি ট্যাঙ্কসহ মিরপুর রােড অভিমুখে আসছিলেন তখন তিনি ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৫ বলেন যে, ঘটনার দিন বিকেল ০৪টার সময় তিনি বঙ্গভবনে ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার, বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) দেখেছিলেন। ১৫ আগস্ট সকালে যখন তিনি (সাক্ষী) প্রেসিডেন্টের বাসভবনের দক্ষিণ অভিমুখে যাচ্ছিলেন তখন পি.ডব্লিউ-১৬ মিরপুর রােডস্থ কলাবাগানে সাংহাই রেস্টুরেন্টের সামনে একটি জিপে ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৬ বঙ্গভবনে যাওয়ার পর সেখানে সেনা সদস্যগণসহ মহিউদ্দীনকেও (আর্টিলারি) দেখেছিলেন।
পি.ডব্লিউ-২০ বলেন যে, ঘটনার পরে তিনি (সাক্ষী) বঙ্গভবনে শাহরিয়ার, ফারুক রহমান ও অন্য অফিসারদের দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৩ বলেন যে, ঘটনার পরে তিনি (সাক্ষী) ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) ল্যান্সার ইউনিটে দেখেননি এবং শুনেছিলেন যে, তারা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিল।
পি.ডব্লিউ-৩৭ বলেন যে, ঘটনার পরে ১৫ আগস্ট সকাল ৭টায় তিনি (সাক্ষী) রেডিও স্টেশনের স্টুডিও ২-এ শাহরিয়ারকে সহ-আসামিদের সাথে দেখেছিলেন, যখন তারা খােন্দকার মােশতাকের বাংলাদেশ রেডিওর বক্তৃতা প্রস্তুত করছিল।
৪৯১

পি.ডব্লিউ-৪২ বলেন যে, ১৫ আগস্ট তিনি (সাক্ষী) রেডিও স্টেশনে শাহরিয়ার, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন, যখন সেখানে সেনাপ্রধান, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধান রেডিওর মাধ্যমে তাদের আনুগত্য সম্প্রচারের জন্য এসেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) বজলুল হুদা ও নূরকেও দেখেছিলেন, যখন তিনি ১৫ আগস্ট সকাল ১১টায় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ভিকটিমদের ছবি তােলার জন্য ৩২ নম্বর রােডে গিয়েছিলেন। তিনি (সাক্ষী) অপরাহ্নে বঙ্গভবনে শাহরিয়ার রশিদ, ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অন্য আসামিদেরও দেখেছিলেন।
পি.ডব্লিউ-৪৪ বলেন যে, ১৫ আগস্ট এবং ৪ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসাররা যখন ব্যাংককে অবস্থান করছিল তখন ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ তথাকথিত “সিপাহি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সর্বময় ক্ষমতার একজন নেতা হিসেবে আসেন এবং ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনসমূহে চাকরির ব্যবস্থা করে তাদের প্রত্যাবাসন করেন। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, ঐ অফিসাররা জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। এরপর তাদেরকে চাকরি থেকে অপসারিত করা হয়েছিল এবং তারপর তারা পলাতক হিসেবে বিদেশে জীবনযাপন করছিল। আপিলকারীগণ এই সাক্ষীর এসব বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করেনি।
পি.ডব্লিউ-৪৫ বলেন যে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বজলুল হুদা, ফারুক আহমেদ (রহমান) এবং অন্য সহ-আসামিরা উপস্থিত ছিল। ঘটনার দিন বঙ্গভবনে বেলা ৩.৩০ মিনিটে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ যখন প্রেসিডেন্টের চেয়ারে উপবিষ্ট ছিলেন তখন তার পাশে ফারুক রহমান, শাহরিয়ার, বজলুল হুদা, ফারুক আহমেদ এবং অন্য সহ-আসামিরা বসে ছিলপি.ডব্লিউ-৪৬ এটি দেখেছিলেন।
পি.ডব্লিউ-৪৭ও ফারুক রহমান, শাহরিয়ার, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং বজলুল হুদাকে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ও তার কেবিনেটের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে দেখেছিলেন। ০৩ নভেম্বরের ঘটনার পর মেজর আব্দুর রশিদ এবং অন্য আসামিরা ব্যাংককে চলে যায়।
পি.ডব্লিউ-৪৯ বলেন যে, ১৫ আগস্ট রেডিও স্টেশনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদের আনুগত্য সম্প্রচারের পর মেজর ডালিম তাকে (সাক্ষী) ফারুক রহমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
পি.ডব্লিউ-৬০ বলেন যে, ১৯৭৬-এর ৮ জুন তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি নথি খােলা হয়, কিছু সেনা আফিসারকে আত্তীকরণের জন্য। তারপর ১৫ আগস্ট, ১৯৭৬ তারিখের সেনা সদর দফতরের একটি স্মারকপত্র মূলে মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা, সুলতান শাহরিয়ার এবং অন্য আসামিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়েছিল।
১৬২. বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক অবশ্য এই অভিমতে আসেন যে, আপিলকারীদের কয়েকজনকে ও অন্য আসামিদের বিদেশি মিশনগুলােতে ন্যস্ত করার বিষয়টিকে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ততার জন্য তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল বলে গ্রহণ করা যায় না এবং সেহেতু, ঐরূপ চাকরিতে ন্যস্তকরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে বিরুদ্ধ অনুমান গ্রহণ করা যায় না।
১৬৩. কিন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে, তাদের অনেকেই ছিল অপসারিত সেনা অফিসার এবং পি.ডব্লিউ-৪৪ ও ৪৭ এটি প্রমাণ করেছেন যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখে তাদেরকে চাকরিতে আত্তীকৃত করা হয়েছিল এবং এর আগে যখন খােন্দকার মােশতাক আহমেদ,
৪৯২

একজন নির্ধারিত ব্যক্তি, খালেদ মােশাররফ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে তারা ৩ মার্চ তারিখ বিকেলে দেশত্যাগ করেছিল। পি.ডব্লিউ-৪৪, ৪৫ ও ৪৭-এর প্রদত্ত সাক্ষ্য পি.ডব্লিউ-৬০-এর সাক্ষ্যের সাথে একত্রে পাঠ করলে এটি স্পষ্ট হবে যে, আপিলকারীরা এবং সহ-আসামিরা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারেই নৈশকালীন কুচকাওয়াজের ব্যবস্থা করেছিল।
তারপর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কোনাে অনুমােদন ছাড়া ট্যাংক এবং অন্যান্য অস্ত্রাদিসহ বের হয়ে আসে এবং তাদের কয়েকজন ৩২ নম্বর রােডস্থ প্রেসিডেন্টের বাসভবনে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্যকে যেন সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনী কোনােভাবে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে সেজন্য তাদেরকে প্রতিরােধ করার লক্ষ্যে অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, যেমন রেডিও স্টেশন, মিন্টু রােড, বিডিআর সদর দফতর, রক্ষীবাহিনী সদর দফতরে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার পর তারা সেনাপ্রধান, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানকে তাদের আনুগত্য প্রকাশের জন্য ও খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল। এরপর তারা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিল এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে ও রেডিও স্টেশন প্রহরায় রেখেছিল যেন অন্য কেউ খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে উৎখাত করেতে না পারে। তারা প্রেসিডেন্টের ও কেবিনেটের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল, যদিও তারা সেনাবাহিনীর ছােট অফিসার হিসেবে ঐরূপ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যােগ দেওয়ার অবস্থানে ছিল না।
আপিলকারী সুলতান শাহরিয়ারসহ তাদের কয়েকজন ছিল অপসারিত অফিসার এবং তাদের কয়েকজন মৃতদেহগুলাে সত্ত্বারের ব্যবস্থা করেছিল। ৩ নভেম্বরের ঘটনার পর দেশ থেকে পালিয়ে তারা ব্যাংককে আশ্রয় নেয় এবং তারপর প্রয়াত জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক বিভিন্ন বাংলাদেশ দূতাবাসে আত্তীকৃত হয়। এরপর জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে তাদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কারণে চাকরি থেকে তারা অপসারিত হয়ে বিদেশে অবস্থান করছিল। এই সব পরিস্থিতি এটিই প্রমাণ করে যে, তারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। অন্য আসামিরা ছাড়া আপিলকারীদের এসব কর্ম ও আচরণ এভিডেন্স অ্যাক্টের ৮ ধারা অনুসারে প্রাসঙ্গিক এবং তা অধিকতর প্রমাণ হিসেবে আপিলকারীদের ও অন্য আসামিদের দোষ প্রমাণের জন্য সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
১৬৪. উপরােক্ত সাক্ষ্য এটি প্রমাণ করে যে, আপিলকারীগণ ও অন্য আসামিরা প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র রচনা করেছিল।
১৬৫. পঞ্চম যুক্তি সম্পর্কে অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা সম্পর্কে আপিলকারীগণের পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী এই সাধারণ বক্তব্য রাখেন যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নথিভুক্ত সাক্ষ্য হালকাভাবে বিবেচনা করেছেন এবং কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করে আপিলকারীদের মৃত্যুদণ্ড বহাল বা অনুমােদন করেছেন এবং এটি বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে অভিযােগসমূহের সমর্থনে নথিতে কোনাে আইনানুগ সাক্ষ্য ছিল না। আপিলকারীগণ অন্য আসামিদের সাথে নৈশকালীন কুচকাওয়াজে যােগ দিয়েছিল কেবল একটি রুটিন। কাজ হিসেবে এবং তাই প্যারেডে তাদের উপস্থিতি প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে তাদেরকে সম্পৃক্ত করে না। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন সরকারকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে এবং ঐ অভ্যুত্থানের পরিণতিতেই প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের আর্মিরা হত্যা করেছিল, যেখানে আপিলকারীরা জড়িত ছিল না।।
৪৯৩

১৬৬. আপিলকারী বজলুল হুদা ও মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুল্লাহ-আল-মামুন আরাে নিবেদন করেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের মামলার সমর্থনে এমন কোনাে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য নেই যে, এই আপিলকারীগণকে ঘটনাস্থলে এজাহারকারী চিনতে পেরেছিলেন। বজলুল হুদা শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছিল এই অভিযােগের ভিত্তি নথিতে থাকা স্ববিরােধী সাক্ষ্য; এবং প্রসিকিউশন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের, যেমন শেখ ইউনুস আলী, কর্নেল মশিউদ দৌলা এবং কর্নেল মাহমুদুল হাসানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে উইথহেল্ড করেছে। কারণ তাদের সাক্ষ্য প্রসিকিউশন পক্ষের জন্য অনুপযােগী হতে পারত। অতএব, ঐ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের উইথহেল্ড করার জন্য প্রসিকিউশনের বিপক্ষে একটি বিরুদ্ধ অনুমান গ্রহণ করা যেতে পারে। মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) প্রেসিডেন্টকে দোতলা থেকে নীচে নিয়ে এসেছিল এই অভিযােগটি নথিতে থাকা কোনাে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্যের উপর নির্ভরশীল নয়। ঘটনাস্থলে সাক্ষীগণ কর্তৃক মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) চিনতে পারার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে অবাস্তব ও অবিশ্বাসযােগ্য গল্প এবং তাছাড়া, ঘটনাস্থলে বজলুল হুদা ও মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) উপস্থিত থাকার বিষয়টি সম্পর্কে নথিতে থাকা সাক্ষ্যপ্রমাণাদিও স্ববিরােধী।
১৬৭. আপিলকারী সৈয়দ ফারুক রহমান ও মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমান আরাে নিবেদন করেন যে, আপিলকারীগণ কর্তৃক প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা সংঘটনের অভিযােগের সমর্থনে কোনাে সাক্ষ্য নেই এবং ঘটনা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১ কোনাে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নন; মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) এজাহার নামীয় কোনাে অভিযুক্ত নন এবং মামলায় তার অন্তর্ভুক্তি একটি সৃজিত বিষয়। সাক্ষীদের বক্তব্য মতে, ঘটনার ঠিক পূর্বে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে পতাকা উত্তোলন ও বাদ্য বাজানাের গল্পটি বিশ্বাসযােগ্য নয়। কারণ পি.ডব্লিউ-১-৩ বলেছেন যে, আক্রমণকারীরা ঐ সময় ইতােমধ্যেই প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ছিল। ফারুক রহমান সংশ্লিষ্ট সময়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ছিল সে মর্মে নথিতে আদৌ কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই। কলাবাগান খেলার মাঠে কামানসহ মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) উপস্থিত থাকার বিষয়টি বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য পেশের মাধ্যমে সমর্থিত হয়নি। ট্যাংক সৈনিকদের সাক্ষী হিসেবে না আনায় প্রসিকিউশনের বিপক্ষে একটি বিরুদ্ধ অনুমান গ্রহণ করা যায় যে, তাদেরকে উপস্থাপন করা হলে তারা প্রসিকিউশন কেস সমর্থন করত না। প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের মুখ থেকে প্রকাশিত সাক্ষ্যের আলােকে ঘটনার প্রকৃত পরিকল্পনাকারী ছিল জোবায়দা রশিদ। আরাে নিবেদন করা হয় যে, পি.ডব্লিউদের সাক্ষ্য থেকেও এটি স্পষ্ট হবে যে, প্রেসিডেন্ট ও তাঁর | পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত হওয়ার জন্য আপিলকারীদের সাধারণ অভিপ্রায় অথবা পূর্বপরিকল্পিত মন ছিল না এবং সেহেতু, ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ ছিল বেআইনি।
১৬৮. সুলতান শাহরিয়ারের পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আব্দুর রাজ্জাক খান আরাে নিবেদন করেন যে, প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যায় সুলতান শাহরিয়ারের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কোনাে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য নেই এবং তিনি ধানমন্ডির ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে যাননি। বালুরঘাটে নৈশ কুচকাওয়াজে তার উপস্থিতি প্রমাণের জন্য পি.ডব্লিউ-১৪-এর সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে হাইকোর্ট বিভাগ আইনগত ভুল করেছেন, যদিও আদৌ কোনাে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য ছিল না এবং যদি পি.ডব্লিউ-১৪-এর সাক্ষ্য অবিশ্বাস করা যায়, তখন সেখানে সাক্ষ্য থাকছে কেবল ১৫ আগস্ট ৬টায় রেডিও স্টেশনে সুলতান শাহরিয়ারের উপস্থিতি সম্পর্কে। প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনার সাথে এটির কোনাে সম্পর্ক নেই। কারণ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে পুনঃনিয়ােজিত হয়ে রেডিও স্টেশনে তার উপস্থিতি ছিল তার অফিসিয়াল কর্তব্যের অংশ, যা সে তার কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে পালন করেছিল।
৪৯৪

১৬৯. বিজ্ঞ আইনজীবীগণ তাদের বক্তব্যের সমর্থনে Nurul Islam os State, 43 DLR (AD) 6, Hazrat Khan@ Hazrat Ali vs State, 54 DLR 636, Moslem Uddin vs State, 38 DLR (AD) 311, Safdar Ali vs Crown, 5 DLR (FC) 107 978 Moyez Uddin vs State, 31 DLR (AD) 37 মামলাগুলাে উদ্ধৃত করেন। জনাব আনিসুল হক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, সাক্ষীদের জবানবন্দি থেকে যে সাক্ষ্য সামনে এসেছে তা হত্যার অভিযােগটি প্রমাণিত করেছে। তাছাড়া দ্য সানডে টাইমস (প্রদর্শনী-এক্স)-এর কপি এবং ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য (বস্তু প্রদর্শনী-১২ ও ১৩)- এগুলােও হত্যার অভিযােগটি প্রমাণ করেছে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জনাব আজমালুল হােসেইন হত্যার অভিযােগটি প্রমাণের জন্য পি.ডব্লিউ-৮ ও ১৫ কর্তৃক ব্যক্ত মােতাবেক আপিলকারীদের এক্সট্রা জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির উপর নির্ভর করেছেন।
১৭০. প্রথমে সানডে টাইমস (প্রদর্শনী-এক্স)-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য (বস্তু প্রদর্শনী ৩২ ও ১২) সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হলাে :
১৭১. পি.ডব্লিউ-৫৮ ০৮.৫.১৯৭৬ তারিখের সানডে টাইমস-এর কপি প্রদর্শন করেন যা ডিফেন্সের আপত্তিসহ প্রদর্শনী-এক্স হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, এবং তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, যখন তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন তিনি অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডি-র অনুরােধে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের তৎকালীন কাউন্সিলরের মাধ্যমে সানডে টাইমস-এর কপি সংগ্রহ করেছিলেন, যেখানে আপিলকারী ফারুক রহমান তার সম্পৃক্ততা স্বীকার করে বলেছিল, “আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যায় সাহায্য করেছিলাম, dare to put me on trial.” পি.ডব্লিউ-৫৮ কাউন্সিলরের স্বাক্ষরিত যে ফরওয়ার্ডিং পত্রটির মাধ্যমে বর্ণিত পত্রিকাটি তাকে পাঠানাে হয় সেটিও তিনি প্রমাণ করেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৫৮ ১৯৭৬-এর ২ আগস্ট যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনে সম্প্রচারিত একটি ভিডিও ক্যাসেট প্রদর্শনী-৩২ হিসেবে আপত্তিসহ প্রমাণ করেন। এর সাথে ছিল নােটারি পাবলিক Keith Robert Hopkins কর্তৃক এই মর্মে ইস্যুকৃত সার্টিফেকেট যে, তার জ্ঞান, তথ্য ও বিশ্বাস মতে বর্ণিত ভিডিও ক্যাসেট একটি টেলিভিশন প্রােগ্রামের একটি বৈধ কপি। তাছাড়া স্থানীয় ভিডিও রেকর্ডার পি.ডব্লিউ-৫৯ জনাব বখতিয়ার হােসেইনও ভিডিও ক্যাসেটটি (প্রদর্শনী-১২) প্রমাণ করেছেন, যেখানে মেজর রশিদ ও ফারুক রহমান অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছে যে, তারা শেখ মুজিবকে তাঁর পরিবারসহ হত্যা করেছে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, সানডে টাইমস (প্রদর্শনী-এক্স)-এর সংখ্যাটি এভিডেন্স অ্যাক্টের ৩ ধারার অধীনে একটি দলিল, যেখানে ফারুক রহমান
টর হত্যাকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ স্বীকার করেছে। তাছাড়া, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সংঘটিত ঘটনাটি বাংলাদেশের একটি মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা হওয়ায় এ সম্পর্কে কোনাে গ্রন্থ বা দলিল এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫৭ ধারার বিধানের অধীনে জুডিশিয়াল নােটিশে নেওয়া যেতে পারে। তাছাড়া, ফারুক রহমান অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসকে তার দেওয়া বর্ণিত সাক্ষাৎকারের বিষয়টি জেরায় অস্বীকার করেনি। তাই ভিডিও ক্যাসেট, বস্তু প্রদর্শনী-৩২ ও প্রদর্শনী-১২ সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
১৭২. যা হােক, এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫৭ ধারার শর্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আদালত নিজেই কিছু বিষয় যা খুব ভয়ংকর তা আমলে নিতে পারেন বা যদি এটি পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে, সেটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে হয়। কিন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে, সানডে টাইমস-এর একটি সংখ্যায় একজন সাংবাদিকের কাছে আপিলকারী ফারুক রহমানের দেওয়া কথিত বক্তব্য শ্রুত সাক্ষ্য প্রকৃতির; যেহেতু, ঐ আপিলকারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিককে প্রসিকিউশন পরীক্ষা করেনি।
৪৯৫

১৭৩. ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের গ্রহণযােগ্যতা বিষয়ে দেখা যায় যে, কোনাে পক্ষ যখন কোনাে প্রাসঙ্গিক ঘটনা ও ঘটনাদি সম্পর্কে কোনাে ব্যক্তির বক্তব্য বা স্বীকৃতি, যা কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা ভিডিও ক্যাসেটে ধারণকৃত বা কোনাে টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত কোনাে সাক্ষাৎকার, তখন তাকে মূল কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা ভিডিও ক্যাসেট বা টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটির সাথে অবশ্যই অনুষ্ঠানটির প্রযােজক কর্তৃক অনুষ্ঠানটি রেকর্ডের তারিখ এবং স্থান সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ দিতে হবে এবং সনদপত্রে দেওয়া অনুষ্ঠানটির প্রযােজকের স্বাক্ষরও প্রমাণ করতে হবে। বর্তমান আপিলসমূহে এই
আবশ্যকতাগুলাে পূরণ করা হয়নি।
১৭৪. কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা ভিডিও ক্যাসেটে বা কোনাে টিভি চ্যানেলে ধারণকৃত কোনাে বক্তব্যের গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে, যদি আসামি তার বক্তব্য বা স্বীকারােক্তি অস্বীকার না করে, তবে ঐরূপ ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে কোনাে বাধা নেই। তদুপরি, যদি আসামি বক্তব্যটি বা স্বীকারােক্তিটি অস্বীকার করে তাহলে এর গ্রহণযােগ্যতার প্রশ্নটিকে বিদ্যমান এভিডেন্স অ্যাক্টের অধীনে দেখতে হবে। এভিডেন্স অ্যাক্টের ৩ ধারায় ‘সাক্ষ্য’-র ধারণাটি সংজ্ঞায়িত হয়ে প্রতিভাত হয়, যা নিম্নরূপ :
“’Evidence’ means and includes-
(1) all statements which the Court permits or requires to be made before it by
a witness, in relation to matters of fact under enquiry; such statements are called oral evidence;
(2) All documents produced for the inspection of the Court, such documents are called documentary evidence.
” তবে ভারতে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৩ ধারার ২ উপধারা নিমােক্তভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে :
“(2) all documents including electronic records produced for the inspection of the Court; such documents are called documentary evidence.”
সেহেতু, ভারতে উপরােক্ত সংশােধনীর আলােকে ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক উপায়ে ধারণকৃত ভিডিও ক্যাসেট, কমপ্যাক্ট ডিস্ক এবং ভিডিও কনফারেন্সিং সাক্ষ্য হতে পারে।
১৭৫. ভারতের সুপ্রীম কোর্ট State of Maharashtra vs Dr Praful B. Desai, (2003) 4 SCC 601 মামলায় এই সিদ্ধান্ত দেন যে, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে কোনাে সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলে তা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের শর্তাদির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
১৭৬. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৩ ধারায় সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতির বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বিস্তৃত রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, অন্য কোনাে বিধান না থাকলে XX, XXII এবংXXIII অধ্যায়ের অধীনে গৃহীত সকল সাক্ষ্য আসামির উপস্থিতিতে নিতে হবে, অথবা যখন তার আইনজীবীর উপস্থিতিতে তার ব্যক্তিগত উপস্থিতি নিশ্চিত হবে। এ থেকে দেখা যায়, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় যদিও আসামির শারীরিক উপস্থিতি প্রয়ােজন, তথাপি কোনাে কোনাে পরিস্থিতিতে তা সম্পন্ন করা যেতে পারে।
১৭৭. তদুপরি, ১৮৭২ সালের এভিডেন্স অ্যাক্ট একটি প্রসিডিউরাল আইন এবং একই সাথে একটি চলমান স্ট্যাটুট। ফ্রানসিস বেনিওন (Francis Benion)-এর মতে, কোনাে চলমান স্ট্যাটুট ব্যাখ্যার নীতি এটি হওয়া উচিত যে, পার্লামেন্ট চায় যে, একটি আইন প্রথমত যেভাবে প্রণীত হয়েছিল সেখানে পরিবর্তন
৪৯৬

আনতে আদালত যেন ঐ বিদ্যমান আইনের কথাগুলাে ব্যাখা করেন। যখন এটি আইন হিসেবে বিদ্যমান থাকে তখন এটিকে সব সময় ব্যক্ত (speaking) হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
১৭৮. Onifa, National Textile Workers’ Union vs PR Ramakrishnan, AIR 1983 SC 75 মামলায় বিচারপতি ভগবতি সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“We cannot allow the dead hand of the past to stifle the growth of the living present. Law cannot stand still; it must change with the changing social concepts and values. If the bark that protects the tree fails to grow and expand along with the tree, it will either choke the tree or if it is a living tree, it will shed that bark and grow a new living bark for itself. Similarly, if the law fails to respond to the needs of changing society, then either it will stifle the growth of the society and choke its progress or if the society is vigorous enough, it will cast away the law which stands in the way of its growth. Law must therefore constantly be on the move adapting itself to the fast-changing society and not lag behind.”
১৭৯. অতএব, এটি এখন মূল্যায়ন করার উপযুক্ত সময় যে, প্রযুক্তির উন্নয়ন কীভাবে বিচারব্যবস্থার কার্যক্রমে রূপান্তর ঘটিয়ে আনছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির বাস্তবতায় বিদ্যমান আইনের প্রয়ােগ বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং এজন্য প্রায়শই নতুন আইন সৃষ্টির প্রয়ােজন হয় সেগুলাের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য। তদুপরি, একই সময়ে এটিও মনে রাখতে হবে যে, কোনাে নির্দিষ্ট প্রযুক্তির সুবিধা বা বিকল্প হিসেবে এটির অপব্যবহারের বিষয়ে নতুন প্রযুক্তির অনুশীলন স্বভাবতই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়।
১৮০. ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সামনে চ্যালেঞ্জগুলাে হলাে দ্রুত ও কার্যকর বিচারের ক্ষেত্রে আসামির অধিকারকে স্থিত করা। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মেশিনারিকে অবশ্যই অপরাধের উদ্ভূত ধরন ও অপরাধীর আচরণ কার্যকরভাবে নিষ্পত্তি করার চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হতে হয়। এটি তাই প্রত্যাশিত যে, দেশে বিদ্যমান সকেল আইন বা আইনের সকেল অংশ সংশােধিত হতে হবে এবং নতুন উপযুক্ত আইনও প্রণয়ন করতে হবে সমাজের পরিবর্তনের প্রয়ােজনের প্রতি সাড়া দিয়ে, যেটি ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য সম্পর্কে ভারতে করা হয়েছিল।
১৮১. তদুপরি, কীভাবে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে সে সম্পর্কে পূর্বে উল্লিখিত বিদ্যমান আইনের ব্যক্ত বিধানগুলাের কারণে আমার মত এটি যে, এই মামলায় প্রসিকিউশন কর্তৃক উপস্থাপিত ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য ব্যবহার করা যেতে পারে না।
১৮২. আপিলকারীদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযােগের সমর্থনে এক্সট্রা জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি পি.ডব্লিউ-৮ ও ১৫ কর্তৃক বিবৃত হয়েছে এবং সেগুলাে জেরা করাকালে ডিফেন্স কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি বলে প্রতীয়মান হয়।
১৮৩. প্রতীয়মান হয় যে, পি.ডব্লিউ-৮, যিনি সংশ্লিষ্ট সময়ে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ছিলেন, তার জবানবন্দিতে বলেন যে, প্রেসিডেন্টের বাসভবনের প্রকৃত অবস্থা নির্ণয়ের পর চিফ অব আর্মি স্টাফ কর্তৃক নিয়ােজিত হয়ে তিনি (সাক্ষী) ১৫ আগস্ট রাত ৮.৪৫ মিনিটে বাসভবন পরিদর্শন করেন। পি.ডব্লিউ-৮
৪৯৭

বলেছিলেন যে, মেজর নূর চৌধুরী এবং বজলুল হুদা তাকে গ্রহণ করে এবং এরপর বজলুল হুদা তাকে বাসভবনের ভেতরে নিয়ে যায়। তিনি (সাক্ষী) প্রকৃত পরিস্থিতি যা প্রত্যক্ষ করেছেন তা বর্ণনা করেছেন এবং তা নিম্নরূপ :
“ক্যাপ্টেন হুদা আমাদিগকে বাড়ির ভিতর নিয়া গেলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রিসিপশন রুমে টেলিফোন টেবিলের পাশে শেখ কামালের লাশ গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে দেখি। আমি তখন বজলুল হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, শেখ কামালকে কেন মেরেছেন? উত্তরে বজলুল হুদা জানায়, শেখ কামাল ফোনে বাহিরে খবর দিতেছিল- সেই জন্য তাহাকে মেরেছি। ঐ রুমের টেবিলের সামনে লুঙ্গি পরা গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় আরাে একজনের লাশ দেখিতে পাই। ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, কেন তাকে মেরেছেন? জবাবে হুদা জানায়, সে পুলিশের লােক, তাকে চলে যেতে বললে সে তর্ক শুরু করে দেয়- তাই তাকে আমরা মেরেছি।
“তৎপর বজলুল হুদা আমাদিগকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। সিঁড়ির দক্ষিণ দিকে বাথ দেখাইয়া বলে, ‘এখানে শেখ নাসেরের লাশ আছে।
“আমরা বাথরুমে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় শেখ নাসেরের লাশ দেখি। হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, তাকে কেন মেরেছেন?’ ক্যাপ্টেন হুদা কোনাে উত্তর দেয় না।
“এরপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা আমাদেরকে নিয়া সিঁড়ির দিকে ওঠে। সিঁড়ির কয়েক ধাপ উঠিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ দেখিয়া আমরা হতভম্ব হইয়া যাই। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত বুকের বাম পাশে, পেটের ডান দিকে, ডান হাতে অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় পা ভাঁজ করে চিত হইয়া সিঁড়ির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়িয়া আছেন। পাশে তাহার চশমাও দেখিতে পাই। আমি ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা কেন দেশের প্রেসিডেন্টকে এইভাবে মারলেন?
উত্তরে ক্যাপ্টেন হুদা বলিলেন, আমি যখন দলবলসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যাই সে তখন বলে-
“তােমরা কেন আমার বাসায় আসিয়াছে- কে পাঠাইয়াছে- শফিউল্লাহ কোথায়? এই বলিয়া আমাকে ঝটকা মারে। তখন আমি পড়ে যাই। ইহার পর আমরা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করি। তারপর আমাদেরকে নিয়া ক্যাপ্টেন হুদা খাবার ঘরের পাশে গেলে আমরা সেখানে (বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের দরজায়) বেগম মুজিবের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখিতে পাই। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় আরাে চারিটি লাশ পড়িয়া থাকিতে দেখি। তখন আমি ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, কেন এদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন? জবাবে ক্যাপ্টেন হুদা বলে, সশস্ত্র সৈনিকরা Out[of] control হইয়া এদেরকে হত্যা করিয়া লুটপাট করিয়াছে এবং সেই জন্য সে সৈনিকদের বাহিরে রাখিয়াছে। ক্যাপ্টেন হুদা আরাে জানায়, কর্নেল জামিলকে বাহিরে মেরে তার লাশসহ গাড়ি বাড়ির ভিতরে পিছনে রাখা হইয়াছে।”
১৮৪. অতএব এটি প্রতীয়মান হয় যে, আপিলকারী বজলুল হুদা এই সাক্ষীর কাছে এটি স্বীকার করেছিল যে, সে শেখ কামালকে হত্যা করেছিল, কারণ তিনি (শেখ কামাল) ঘটনা সম্পর্কে তথ্যাদি বাইরে দিচ্ছিলেন। | সে (আপিলকারী) আরাে স্বীকার করে যে, একজন নিরাপত্তাকর্মী তাদের সাথে তর্কে জড়ালে তাকেও তারা হত্যা করেছিল। এরপর শেখ নাসেরের মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন হুদা নীরব থেকেছিল এবং প্রেসিডেন্টের হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে সে জবাব দিয়েছিল যে, প্রেসিডেন্ট জানতে চেয়েছিলেন
৪৯৮

কেন তারা সেখানে এসেছে এবং শফিউল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এবং এ কারণে সে তাকে গুলি করে। এরপর নারী সদস্যদের হত্যার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে বজলুল হুদা জবাবে বলেছিল যে, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সিপাইরা তাদের হত্যা করেছে। পি.ডব্লিউ-৮-এর কাছে বজলুল হুদার ঐসব স্বীকারােক্তি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে অস্বীকার করা হয়নি। তার এই সাক্ষ্য অখণ্ডিত রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলাে, বজলুল হুদার সক্রিয় ভূমিকা এবং শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করা সম্পর্কে এটিকে এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যায় কিনা কিংবা অন্য আপিলকারী ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং মহিউদ্দীনকে দোষী সাব্যস্তকরণে এই সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করা যেতে পারে কিনা। এই সাক্ষ্য থেকে এটি প্রতিভাত হয় যে, পি.ডব্লিউ-১৫ বঙ্গভবনে অবস্থানকালে দেখেছিলেন যে, ফারুক রহমান, মেজর আব্দুর রশিদ, সুলতান শাহরিয়ার, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা এবং অন্যরা নিজেদের মধ্যে গল্পচ্ছলে কথা বলছিল এবং তখন তারা এটি প্রকাশ করেছিল কীভাবে তারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল।
১৮৫. আপিলকারীগণের পক্ষে এই যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, নিম্ন আদালতে প্রসিকিউশন এই পয়েন্টটি উত্থাপন করেনি এবং সেহেতু, এই পয়েন্টটি এই পর্যায়ে বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে না। তাছাড়া এই সাক্ষী কর্তৃক তার কথিত বক্তব্যটি পি.ডব্লিউ-৫কে জানানাে হয়নি এবং সেহেতু, কোনাে অবস্থাতেই সেটিকে এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। পি.ডব্লিউ-১৫ তার জবানবন্দিতে বলেন : “যেহেতু আমরা বঙ্গভবনে কাজ করার সুবাদে অভিজ্ঞ ছিলাম, সেই কারণে মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের উপর দায়িত্ব দেয়। সেই অনুযায়ী আমরা উক্ত দায়িত্ব পালন করি। এরপর মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর সুলতান হরিয়ার, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, রিসালদার মােসলেম উদ্দিনের কথাবার্তায় জানতে পারি যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে অর্থাৎ তার স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই ছেলের বউ ও ভাই শেখ নাসের এবং কর্নেল জামিলকে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রােডস্থ বাড়িতে হত্যা করে।”…“তাহারা দাপটের সাথে বলিত, দেশকে বাচাইবার জন্য আমরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়াছি।”
১৮৬. আপিলকারীগণ এই সাক্ষীকে জেরা করার মাধ্যমে বা কোনাে সাজেশন দেওয়ার মাধ্যমে ঐ সকল
জবানবন্দি অস্বীকার করেনি। সুলতান শাহরিয়ারের পক্ষে এই সাক্ষীকে তার দেওয়া উপরােক্ত জবানবন্দির পরিপ্রেক্ষিতে সংশয়যুক্তভাবে সাজেশন দেওয়া হয়েছিল, সরাসরিভাবে নয়। এখন প্রশ্ন হলাে, উপরােক্ত জবানবন্দি একস্ট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কিনা। যেহেতু, সেটি উপরােক্ত আসামি কর্তৃক এই সাক্ষীকে জানানাে হয়নি যে, তারা প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল। এটিও প্রতীয়মান হয় যে, এই পয়েন্টটি নিম্ন আদালতে তুলে ধরা হয়নি। কিন্তু যে ঘটনার কারণে সে বিচারের সম্মুখীন, তৎসম্পর্কে একজন আসামি কর্তৃক প্রদত্ত ঐরূপ কোনাে বক্তব্য এই মামলায় জড়িত পয়েন্টের সাথে সরাসরি প্রাসঙ্গিক কিনা সেটি একটি আইনের প্রশ্ন হওয়ায় এর তাৎপর্য বা প্রভাব বিবেচিত হওয়া উচিত।
১৮৭. উপরে বিধৃত জবানবন্দি থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে, স্বীকৃত মতে ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার এবং মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তাদের মধ্যে কথাবার্তাকালে বলেছিল যে, তারা প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারের সদস্যদের কর্নেল জামিলসহ হত্যা করেছিল। এটি ঠিক যে, এই সাক্ষী তার এই বক্তব্য
৪৯৯

পি.ডব্লিউ-১৫কে না বললেও সে তা শুনেছিল। দেখা যায় যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ২৪-৩০ ধারায় ‘আডমিশন’ ও ‘কনফেশন’-এর গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। সাক্ষ্য-সম্পর্কিত সাধারণ বিধির ক্ষেত্রে এগুলাে ব্যতিক্রম এবং এগুলাের স্থান প্রাসঙ্গিক ঘটনা’ (relevant fact) হিসেবে, যেহেতু, সেগুলাে বক্তব্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ইতিবাচক কথা। ঐরূপ আ্যাডমিশন বা কনফেশনের সাক্ষ্যগত মূল্য (probative value) তা অন্যকে বলা হলাে কিনা তার উপর নির্ভর করে না। এগুলাে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে, যদি তা সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত হয়।
১৮৮. স্বীকারােক্তিমূলক বিবৃতি হলাে সাংঘর্ষিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ, অপরাধবােধে জর্জরিত বিবেককে রুদ্ধ করে রাখার এক সচেতন প্রয়াস; বা অপরাধ সংঘটন করার অজুহাত বা ন্যায্যতা সম্পর্কে যুক্তি; বা অপরাধটির সাথে সম্পৃক্ত থাকার এক অনুশােচনাপূর্ণ উক্তি বা অপরাধকর্মের জন্য উৎফুল্ল হওয়া বা
গর্ববােধ করা- এই বিষয়গুলাে এক ধরনের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য।
১৮৯. Sahoo vs State of uttar Pradesh, AIR 1966 SC 40 মামলার ঘটনা থেকে দেখা যায় যে, দণ্ডিত সাহু তার পুত্রবধূর (সুন্দর পত্তি) সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ঘটনার আগে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় এবং সুন্দর পত্তি আব্দুল্লাহ নামে এক প্রতিবেশীর বাসায় দৌড়ে পালায়। দণ্ডিত ব্যক্তি তাকে সেখান থেকে বাসায় ফিরিয়ে আনে এবং বাসার একটি কক্ষে তার সাথে রাত্রিযাপন করে। ঘটনার দিন সকালে সুন্দর পত্তিকে ঐ কক্ষে আহত অবস্থায় পাওয়া যায়, কিন্তু দণ্ডিত ব্যক্তিকে সেখানে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। সুন্দর পত্তিকে ঐদিন বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ১২/১৩ দিন পরে সে মৃত্যুবরণ করে। দণ্ডিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযােগে বিচার শুরু হয়। মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষ কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষ্য ছিল এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি এবং অবস্থাগত সাক্ষ্য। এক্সট্রা জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তিটি চারজন সাক্ষী দ্বারা প্রমাণ করা হয়েছিল, যারা বলেছিল যে, ঘটনার দিন সকাল ৬টার সময় তারা দণ্ডিত ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছিল, যখন সে বিড়বিড় করে বলছিল, সে সুন্দর পত্তিকে শেষ করে দিয়েছে এবং এর ফলে প্রতিদিনের ঝগড়াঝাটিও শেষ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছিল, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিড়বিড় করে বলা ঐ কথাগুলাে, যা চারজন সাক্ষী কর্তৃক প্রমাণিত, তা এক্সট্রা-জুডিশিয়াল স্বীকারােক্তি হিসেবে গ্রহণ করা যাবে কিনা।
১৯০. এই মামলার ঘটনার আলােকে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল নিম্নরূপ :
“But there is a clear distinction between the admissibility of evidence and the weight to be attached to it. A confessional soliloquy is a direct piece of evidence. It may be an expression of conflict of emotion, a conscious effort to stifle the pricked conscience; an argument to find excuse or justification for his act; or a penitent or remorseful act of exaggeration of his part in the crime. The tone may be soft and low; the words may be confused; they may be capable of conflicting interpretations depending on witnesses, whether they are biased or honest, intelligent or ignorant, imaginative or prosaic, as the case may be. Generally they are mutterings of a confused mind. Before such evidence can be accepted, it must be established by cogent evidence what were the exact words used by the accused. Even if so much was established, prudence and
৫০০

Previous                         Next