৫৪. আলােচ্য ফাইল, নম্বর ৪এল-৬৮/৫৮, নিয়ে করাচিস্থ ডিরেক্টর অব মাইনরাল কনসেশানস, গভর্নমেন্ট অব
পাকিস্তান-এ একটা জটিলতার সৃষ্টি হয় মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকা ছিল পাঁচ বর্গমাইলের মধ্যে। ১৯৫৭ সালের ১৩ মার্চের এক নােটে জনাব কাদরী উল্লেখ করেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার এখনাে সেন্ট্রাল মাইনিং অ্যাক্ট ইন্যাক্ট বা সংশােধন করেনি, প্রাদেশিক আইনসভাও প্রাদেশিক সরকারকে ইজারা, মাইনিং কনসেশন ইত্যাদি অনুমােদন দেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে কোনাে আইন প্রণয়ন করেনি এবং তখনাে এসব বিষয় হ্যান্ডল করার মতাে কোনাে টেকনিক্যাল স্টাফও ছিল না। আরাে বলা হয় যে, একটি আইন পাস হওয়ার পথে এবং এটি পাস হলেই প্রাদেশিক সরকার মাইনিং লিজ ও কনসেশন দেওয়ার আইনগত ক্ষমতা পাবে। সেক্রেটারি আরও জানান, সেই আইন পাস হওয়া পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ইজারা অনুমােদন ও চুক্তি স্বাক্ষর স্থগিত থাকবে। মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ তারিখের মাইনিউটে নিমােক্ত ভাষায় লিপিবদ্ধ করেন :
“মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কো. (পাক) লি.কে ইজারা দেওয়া যেতে পারে। পাকিস্তান সরকারকে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও চূড়ান্ত করার জন্য অনতিবিলম্বে এই সরকারের অধীনে একজন কর্মকর্তাকে ডেপুটেশনে পাঠানাের জন্য অনুরােধ জানানাে গেলাে।” সেই মাইনিং ইজারার জন্য প্রাদেশিক সরকারের আপকালীন অনুমােদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের (ডিপার্টমেন্ট) ১৯৫৭ সালের ২৫ মার্চ তারিখের এক আদেশের, প্রদ- ১১(ক) মাধ্যমে জানানাে হয় বলে প্রতীয়মান হয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডেপুটি সেক্রেটারি জনাব এ. খায়ের কর্তৃক করাচিস্থ পাকিস্তান সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি বরাবর ইস্যুকৃত ২৬ মার্চ ১৯৫৭ তারিখের মেমাে নম্বর ৬৭৭. আইএনডি. (প্রদর্শনী-১১) থেকে দেখা যায়, কিছুদিনের মধ্যে সেই ইজারা চূড়ান্তকরণের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারকে সহায়তা করার জন্য একজন সুযােগ্য অফিসারকে পাঠানাের জন্য অনুরােধ জানানাে হয়।
৫৫. ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল ও মেসার্স | কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে তার স্থলে নিয়ােগ করার প্রস্তাব দিয়ে আদেশ পাস করার সময় শেখ মুজিবুর রহমান সেই কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে তাদের পিট মাইনিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইজারা দেওয়া হােকমর্মে এক আদেশ জারি করেন।
৫৬. হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল করার পর কয়লা উত্তোলন ও হ্যান্ডল করার জন্য কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে এবং একই পার্টিকে স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের অনুমােদন, সঙ্গে একটি অতিরিক্তি আদেশের মাধ্যমে ৫০০ টন কয়লা আমদানির অনুমােদন এবং একই পার্টিকে পিট মাইনিং অপারেশনের জন্য ইজারা দেওয়ার মাধ্যমে অধিকতর কনসেশন দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হলাে এসব আদেশ শেখ মুজিবুর রহমান তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে কথিত বন্ধু আবু নাসেরকে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য করেছিলেন কিনা। আরাে প্রশ্ন হলাে এই আবু নাসের শেখ মুজিবুর রহমানকে এরকম কাজে প্ররােচনা বা সহায়তা করেছেন কিনা।
৫৭. জনাব আজিজুদ্দীনের মতে, ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির পরিণতিতে যেটি দাঁড়ায় তা হলাে ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও ৭ এপ্রিল তারিখের আদেশ দুটি পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত করে যে, শেখ মুজিবুর রহমান এগুলাের মাধ্যমে তাঁর বন্ধু আবু নাসেরকে কোনাে আর্থিক সুবিধা দিতে আগ্রহী ছিলেন।
৫৮. তবে আপিলকারী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীর মতে, এসব নথিপত্র থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এরকম কোনাে
কল্পনারও সুযােগ নেই যে, আপিলকারী মুজিবুর রহমান অসৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে এসব কাজ করেছেন।
২০১
৫৯. সরকার পক্ষে জনাব আজিজুদ্দীন এই পর্যায়ে এই যুক্তি তুলে ধরেন যে, সংশ্লিষ্ট অপরাধী কোনাে ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট-এর অপরাধ করেছেন কিনা তা প্রমাণের জন্য ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ উপাদান প্রাসঙ্গিক নয়। অন্য কথায় তার যুক্তি হলাে, শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্দেশ্য যা-ই হােক না কেন, তর্কিত আদেশসমূহের মাধ্যমে আবু নাসের আর্থিকভাবে সুবিধা বা মূল্যবান কোনাে জিনিস পেয়েছেন- এটাই এই সিদ্ধান্তে পৌছানাের জন্য যথেষ্ট যে, তিনি দুর্নীতি দমন আইন ১৯৪৭ সালের আইন ২-এর ৫(১)(ক) ধারার
অধীনে অপরাধ করেছেন।
৬০. অন্যদিকে জনাব সােহরাওয়ার্দীর যুক্তি হলাে, এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে mens rea বা ক্রিমিনাল ইনটেনশন অপরিহার্য উপাদান (sine qua non)। তার যুক্তি হলাে, দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭-এর ৫ ধারার উপধারা (১)-এর দফা (ঘ)-তে পরিষ্কারভাবে বলা আছে, সংশ্লিষ্ট অপরাধীর আচরণ এমন হতে হবে যাতে মনে হয় তিনি বিপথগামী হয়েছেন এবং একই সঙ্গে তিনি তার পদের অপব্যবহারও করেছেন বলে মনে হবে।
৬১. সরকারপক্ষের বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট এটা নিয়ে তর্ক করেননি যে, দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭ (১৯৪৭ সালের ২ নম্বর আইন)-এর ধারা ৫ উপধারা (১)-এর (ক) (খ) (গ) দফায় প্রয়ােজনীয় অপরিহার্য উপাদান বা mens rea-এর উপাদানের শর্তকে নাকচ করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় না। তবে তিনি এই যুক্তি দেখিয়েছেন যে, উপরে উদ্ধৃত একই উপধারার (ঘ) দফাকে অন্য দফাগুলাে থেকে স্বতন্ত্র করে পড়া যায় বা পড়া উচিত। তার মতে, এই দফার ভাষা এরকম যে, কোনাে সুনির্দিষ্ট আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করা হলে-এটা নির্দেশ করে যে, সংশ্লিষ্ট অফিসার তার পদের অপব্যবহার করেছেন। অন্যদিকে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর যুক্তি ছিলাে এই যে, “এবিউজ” শব্দটা কেবল অন্যায় ব্যবহার বােঝাতে পারে না, তা অবশ্যই তার পদের অপব্যবহারও বােঝায়। জনাব আজিজুদ্দীন Saluran Bahani v. The State (1957) 9 DLR 667 মামলায় বিধৃত নীতিমালার কথা উল্লেখ করেছেন।… to the decision of which one of us was a party and has contended that in order to prevent corruption the Legislature should be deemed to have dispensed with the element of mens rea for an offence of this nature just as in statutes relating to food offences the Legislature seems to have dispensed with the same |
Daluram Bahani মামলাটির উদ্ভূত হয়েছে East Bengal Essential Foodstuffs Anti-Hoarding Order, 1956 read with that of Central Ordinance X of 1956-এর অধীন অপরাধের কিছু নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন থেকে। এটা সুবিদিত যে, এই মামলায় উদ্ধৃত Halsbury’s Laws of England-এর কিছু অনুচ্ছেদে বিধৃত হয়েছে যে, যখন কোনাে আইন কোনাে কাজ করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং আপাতদৃষ্টিতে mens rea-কে নাকচ করে, বলা হয়েছে, তখন কাজটা নিজেই mens rea বহন করে। [কাজটা করলেই mens rea আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। সাধারণত খাদ্য অপরাধসংক্রান্ত আইনে একটি সীমা নির্দিষ্ট করা থাকে যা কমবেশি মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে অনুসরণ করা যাবে। সাবজেক্ট পরিষ্কার ইঙ্গিত পেয়ে যান যে, ফর দ্য পিরপস অব হিজ গাইডেন্স- এই এই মানদণ্ড অত্যাবশ্যকীয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনাে আইনে বলা থাকে যে, কোনাে ব্যক্তি ২০ মণের বেশি পরিমাণ চাল তার গুদামে মজুদ করতে পারবেন না, তাহলে এটা নির্ধারণ করার জন্য কোনাে ব্যক্তিকে বিশেষ বেগ পেতে হবে না যে, কোনাে পরিমাণের বেশি কেউ মজুদ করতে পারবে না। ফলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি কোনাে।
২০২
জিনিস ২০ মণের বেশি মজুদ করেন তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবে আইন-নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলেন, এবং তিনি এই অভিযােগ করতে পারবেন না যে, তিনি আইন জানতেন না কিংবা তার সীমা লঙ্ঘনের কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না। এরকম ক্ষেত্রে বলা যায় যে, আইনসভা পরােক্ষভাবে mens rea-এর উপাদানকে নাকচ করেছে। তবে বর্তমান ক্ষেত্রে মনে হয়, আইনের ভাষা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কেউ পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে তার পদের অপব্যবহার করে আর্থিক সুবিধা আদায় করেছেন কিনা, তার নিজের জন্য কিংবা অন্য কারাে জন্য। অবটেইন’ শব্দটি যিনি কিছু অবটেইন করবেন সেই ব্যক্তির পক্ষ থেকে কিছু প্রচেষ্টা থাকাকে ইমপ্লাই ও প্রিসাপােজ করে। এটি এমন প্রচেষ্টা যা মনের সচেতন অবস্থা ছাড়া সম্ভব নয়। যদি কোনাে ব্যক্তি নিজের জন্য কিংবা অন্য কারাে জন্য কোনাে কিছু অর্জন করতে চান বা করেন, তাহলে অবশ্যই তিনি কিছু প্রচেষ্টা করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। কারণ স্বাভাবিক নিয়মে প্রচেষ্টা ছাড়া তা অবটেইন বা অর্জন করা সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে অবটেইন’ শব্দটির তাৎপর্য হলাে, পাবলিক সার্ভেন্ট তার পদকে বিপথে ব্যবহার করেছেন, স্বাভাবিকভাবে নয়। সর্বোপরি, সংশ্লিষ্ট পাবলিক সার্ভেন্ট তার নিজের জন্য কিংবা অন্য কারাে জন্য আর্থিক সুবিধা বা মূল্যবান জিনিস আদায়ের জন্য কাজটি অন্যায্যভাবে করেন। আমাদের মত হলাে, কাক্ষিত কোনাে জিনিস স্বাভাবিক উপায়ে আদায় বা অর্জন করলে ক্ষমতার অপব্যবহার করার প্রয়ােজন পড়ে না। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার তখনই হয় যখন সংশ্লিষ্ট পাবলিক সার্ভেন্ট তার নিজের বা অন্য কারাে জন্য মূল্যবান জিনিস বা আর্থিক সুবিধা আদায় করতে চান এবং নিজ বা বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য নিজের পথ থেকে সরে যান। পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে পদের অপব্যবহার করা হয়েছে। এমন অনুমান করার ক্ষেত্রে পাবলিক সার্ভেন্টের পক্ষ কোনাে ধরনের অন্যায্যতার ইঙ্গিত থাকাটা অত্যাবশ্যক। এক্ষেত্রে সৎ উদ্দেশ্যের অভাব আবশ্যিক উপাদান। অন্যথা, আইন প্রণেতাদের উদ্দেশ্য যদি এমন হয় যে, কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তা সৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে দায়িত্ব পালন করার সময়ে মেকানিক্যাল প্রক্রিয়ায় ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট-এর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন, তাহলে কোনাে কর্মকর্তাই ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট-এর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঝুঁকি বা আশঙ্কা থেকে মুক্ত বা নিরাপদ থাকবেন না। কেবল মন্ত্রীই নন, মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি কিংবা অন্যান্য কর্মকর্তারা ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্ট-এর অপরাধে আটকে পড়ার ঝুঁকিতে থাকেন, যদিও তিনি হয়তাে তার সর্বোচচ সদাকাতক্ষা ও সর্বোচ্চ বিবেক নিয়ে এবং কোনাে ধরনের অন্যায্যতার আশ্রয় না নিয়েই স্বাভাবিক ধারায় নিজের দায়িত্ব পালন করছিলেন। অপরদিকে, রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী দাবি জানিয়েছেন, একই ধারার অন্য অংশ থেকে মনে হয় যে, একজন মানুষ দোষী কি না তা সাব্যস্ত করার জন্য mens rea অপরিহার্য উপাদান। (আইন প্রণেতাগণ একটি ধারার চতুর্থ দফায়, অর্থাৎ, দুর্নীতি দমন আইন-এর ৫(১) ধারার (ঘ) দফায়, এসে ভিন্ন চিন্তা করবেন তার কোনাে কারণ থাকতে পারে না।) যদি আইন প্রণেতারা সত্যি সত্যিই মনে করতেন (ঘ) দফার জন্য mens rea অপরিহার্য উপাদান হওয়া উচিত নয়, তাহলে তারা আরাে উপযােগী কোনাে অভিব্যক্তি বা কনস্ট্রাকশন রাখতে পারতেন যার মাধ্যমে মনে হতে পারত যে, আইনসভা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কিংবা প্রয়ােজনে mens rea নাকচ করতে চেয়েছেন। দুর্নীতি দমন আইনের ৫ নম্বর ধারার পুরাে রূপরেখা ও কাঠামাে, সুনির্দিষ্টভাবে, (১) উপদফার (ক) (খ) (গ) দফা থেকে মনে হয় যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা বিকৃত পন্থায় নিজের বা অন্য কারাে জন্য কিছু সুবিধা প্রাপ্তির চেষ্টা করেছেন কিনা, যেখানে মন্ত্রীর পক্ষ থেকে এমন আচরণ বা কর্মকাণ্ড ছাড়া স্বাভাবিক পন্থায় আর্থিক সুবিধা আদায় সম্ভব ছিল না। আলাদা আলাদা ফ্যাক্ট বিবেচনা করেই তা নির্ণয় করতে হবে। দুর্নীতি দমন আইনের ৫ ধারার (১) উপধারার (ঘ) দফার ভাষা ইঙ্গিত করে যে, আইন প্রণেতারা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে বা
২০৩
কোনােভাবেই ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্টের অপরাধের ক্ষেত্রে পnens rea বা ক্রিমিনাল ইনটেনশন উপাদানকে নাকচ করতে চাননি। আমাদের মতে, ক্রিমিনাল ইনটেনশন ক্রিমিনাল লায়াবিলিটির অপরিহার্য শর্ত (sine qua non) এবং তা দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭-এর ৫(১) ধারার বিধান অনুযায়ী অপরাধ সংঘটিত হওয়ার জন্য অপরিহার্য উপাদান। সুতরাং, বর্তমান মামলায় এটা খুঁজে পেতে হবে যে, ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও ৭ এপ্রিল তারিখের আদেশ, যার ফলে কাজী আবু নাসের আর্থিকভাবে সুবিধাভােগী হয়ে থাকতে পারেন, সেগুলাে জারির সময় শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কোনাে ক্রিমিনাল ইনটেনশন ছিল কিনা।।
৬২. জনাব আজিজুদ্দীন এরপর যুক্তি দেখান যে, যদি এটাও হয় যে ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্টের ক্ষেত্রে mens rea গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তবু নথিভুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও আবু নাসেরের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল এবং মুজিবুর রহমান তার বন্ধু আবু নাসেরের জন্য আর্থিক সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। ফলে এই বন্ধুত্বের প্রশ্নটি বিবেচনার দিকে যেতে হয়। বিবেচনা করতে হবে যে, প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম কিনা যে, দুই আপিলকারীর মধ্যে এমন ধরনের বন্ধুত্ব ছিল যা শেখ মুজিবুর রহমানকে আবু নাসেরকে সুবিধা দিতে প্ররােচিত করে।
৬৩. নথি থেকে প্রতীয়মান হয় না যে, এরকম কোনাে দালিলিক প্রমাণ আছে যা ইঙ্গিত করে যে দুই আপিলকারীর মধ্যে এরকম বন্ধুত্ব ছিল। জনাব আজিজুদ্দীন অবশ্য ১৯৫৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখ সম্বলিত এক্সিবিট-১২-র প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যেখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে কিছু মৌখিক আলােচনার উল্লেখ রয়েছে। আবু নাসের নিজেকে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের ম্যানেজিং এজেন্ট হিসেবে পরিচয় দেন এবং ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় আবু নাসেরের ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৬ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজ বরাবর পাঠানাে একটি চিঠির (প্রদর্শনী-১২) মাধ্যমে। সেই চিঠিতে তিনি বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর সঙ্গে তার মৌখিক আলােচনার কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু তিনি এখানে এমনকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নামও উল্লেখ করেননি। আমাদের মতে, এই চিঠি ধরন ও কাঠামাের দিক থেকে কমবেশি অফিসিয়াল করেসপন্ডেন্সই মনে হয়। এখানে যে মৌখিক আলােচনার কথা বলা হয়েছে তা ছিল সফট কোক উৎপাদনের আইডিয়া-সংক্রান্ত। এটা অস্বাভাবিক নয় যে, একজন জনপ্রিয় মন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন প্রয়ােজনে বিভিন্ন লােক আলাপ-আলােচনা করবেন। এটা নিয়েও কোনাে সন্দেহ নেই যে, একজন মন্ত্রী সব শ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত এবং রাষ্ট্রের স্বার্থেই বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করা কমবেশি তার কর্তব্যের অংশ। ফলে আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে কঠিন যে, অন্য কোনাে পরিপ্রেক্ষিত ছাড়া কেবল এই ডকুমেন্ট থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় না বা এটা প্রতিষ্ঠিত হয় না যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও আবু নাসেরের মধ্যে এমন গভীরতর বন্ধুত্ব ছিল যে কারণে তিনি জনাব নাসেরকে সাহায্য করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন।
৬৪. জনাব আজিজুদ্দীন এরপর এই প্রসঙ্গে ১৩ ও ১৪ নম্বর সাক্ষীর মৌখিক সাক্ষ্যের কথা উল্লেখ করেন। ১৩ নম্বর সাক্ষী ৩৩ বছর বয়স্ক খােরশেদ আলম নারায়ণগঞ্জ পাকিস্তান জুট অ্যাসােসিয়েশন অফিসের কেরানি। তার সাক্ষ্য ছিলাে, তিনি আপিলকারী শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার পূর্ব থেকে কলকাতায় থাকার সময় থেকে চিনতেন। তিনি ১৯৫৪ সালে আপিলকারী নাসেরের ১১২, ডি-লিসলে রােড, নারায়ণগঞ্জের বাসায় মুজিবুর রহমানকে যাওয়া-আসা করতে দেখেছেন এবং এর পরে মন্ত্রী হওয়ার আগে-পরে চার-পাঁচবার যেতে দেখেছেন। তিনি আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জের ডিরেক্টর অব জুট প্রাইসেস হিসেবে
২০৪
দায়িত্বে থাকাকালীন রুহুল কাদের সি.এস.পিকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আবু নাসেরের বাসায় দুপুরের খাবার খেতে দেখেছেন। এই সাক্ষীর জেরা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আপিলকারী আবু নাসের তাকে একটি মেয়েকে কিডন্যাপ করতে নিষেধ করেছিলেন, যাতে তিনি ও তার কাজিন গ্রেফতার হয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়েছেন। তিনি জেরায় এই ইঙ্গিত অস্বীকার করেন। তার সাক্ষ্যের প্রাসঙ্গিক অংশ হলাে, তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে আবু নাসেরের বাসায় যেতে দেখেছেন এবং এরপর আরাে চার-পাঁচবার যেতে দেখেছেন। স্বীকৃতভাবে ৩১ মে, ১৯৫৪ থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন কারণে অন্তরীণ ছিলেন। তবে সাক্ষী তার ক্রস-এক্সামিনেশনে তার কথার প্রমাণ হিসেবে বলেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেখেছেন। আমাদের মতে, এই সাক্ষী (১৩ নম্বর সাক্ষী) এরকম একটা ধারণা দিতে চেয়েছেন যে, মাঝে মাঝে তিনি আপিলকারী শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছেন, কেবল ১৯৫৪ সালের নির্বাচন যা মার্চ মাসের কোনাে এ হয়েছিল তার আগেই নয়, ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়েও। তবে কোথাও এরকম কোনাে ইঙ্গিত নেই যে, নির্বাচনের পরে কেবল জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সময়েই তিনি শেখ মুজিবর রহমানকে দেখেছেন। অন্যদিকে, তার সাক্ষ্য থেকে যে ইঙ্গিত যৌক্তিক মনে হয় তা হলাে সরকারি হেফাজতে থাকার সময়েও তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবশ্যই দেখেছেন। এই ভাষ্য এটাই ইঙ্গিত করে যে, সাক্ষী সম্ভবত নিশ্চিত নন তিনি কী বলতে চান। মনে হয়, তিনি যে কোনােভাবে প্রসিকিউশনকে সমর্থন করতে চেষ্টা করছিলেন এবং এই ব্যাপারে তিনি ঠিক কী জানেন সেটার পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন প্রতিফলন তুলে ধরতে খুব আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয় না। তার অন্য বক্তব্য, অর্থাৎ তিনি রুহুল কাদেরকে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আবু নাসেরের বাড়িতে দুপুরের খাবার খেতে দেখেছেন তা অন্য কোনাে সাক্ষীর সাক্ষ্যের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ নয়। ফলে প্রতীয়মান হয় যে, এই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণযােগ্য ও বিশ্বস্ত বলে গৃহীত হতে পারে না। ১৪ নম্বর সাক্ষী জনাব রহিম নেওয়াজ চৌধুরী ৭৩, ডি-লেসলি রােডে বসবাসরত ব্যবসায়ী। তার সাক্ষ্যে দাবি করা হয়, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রী হওয়ার আগে আবু নাসেরের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতে দেখেছেন। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে জয়ের পর একবার তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছেন নাসেরের বাড়িতে যেতে, যখন তিনি জনাব সােহরাওয়ার্দী, জনাব নুরুদ্দীন ও অন্যদের সম্মানে ডিনার পার্টি দিয়েছিলেন। তিনি আরও দাবি করেন, তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এটি বিবৃত করেছিলেন। তার এই ভাষ্য ১৫ নম্বর সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তার মতে, ১৪ নম্বর সাক্ষী তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে। বলেননি যে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে আবু নাসেরের অফিসে দেখেছেন। ফলে, ১৪ নম্বর সাক্ষী শেখ মুজিবুর রহমানকে আবু নাসেরের অফিসে দেখেছেন তার সাক্ষ্যের এই অংশ গ্রহণযােগ্য নয়। যদিও ১৫ নম্বর সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুর রহমান তার সাক্ষ্যে বলেছেন যে, ১৪ নম্বর সাক্ষী বলেছেন যে, মুজিবুর রহমানকে তিনি প্রায়ই নাসেরের বাসভবনে যেতে দেখেছেন। কিন্তু ১৪ নম্বর সাক্ষী নিজে বলেছেন, তিনি তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেননি যে, তিনি মুজিবকে প্রায়শই নাসেরের বাড়িতে যেতে দেখেছেন। ফলে, শেখ মুজিবুর রহমান প্রায়শই আবু নাসেরের বাড়িতে গেছেন। তার এই ভাষ্য গ্রহণযােগ্য নয়। ১৪ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে সর্বোপরি যা গ্রহণ করা হচ্ছে তা হলাে, জনাব সােহরাওয়ার্দী, নুরুদ্দীন প্রমুখের সম্মানে দেওয়া ডিনার পার্টিতেই কেবল একবার শেখ মুজিবুর রহমানকে নাসেরের বাড়িতে দেখা গেছে। এটা থেকে এই অনুমান করা কঠিন যে, নাসের ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। যাদের
২০৫
সম্মানে ডিনার পার্টি দেওয়া হয়েছিল তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। এর চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া না গেলে আমাদের পক্ষে এই মতে পৌছানাে কঠিন যে, ডিনার পার্টি দেওয়া হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে, তাঁকে প্রধান অতিথি করে। বরং এখানে এই সম্ভাবনাই বেশি যে, সােহরাওয়ার্দীর মতাে ব্যক্তিত্বের সম্মানেই ঐ ডিনার পার্টি দেওয়া হয়েছিল।
৬৫. ফলে দেখা যায়, ১৩ ও ১৪ নম্বর সাক্ষী ও তাদের একের বক্তব্য অন্যের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতীয়মান হয় না। তারা যা বলেছেন, তা আসলে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য। কেবল এরকম সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে কঠিন যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও আবু নাসেরের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। এখানে এটা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, নাসের একজন ভারতীয় নাগরিক এবং তার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি সম্পর্কের কোনাে প্রমাণ নেই।
৬৬. পরবর্তী যে প্রশ্ন সামনে আসে তা হলাে, তর্কিত আদেশসমূহ জারি করার সময় মুজিবুর রহমান বিধিমালা ও অফিসিয়াল প্রসিডিউরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আচরণ করেছেন কিনা; অর্থাৎ, তিনি অবৈধভাবে তা করেছেন কিনা।
৬৭. বিজ্ঞ স্পেশাল জজ পেয়েছেন যে, আর্থিক বিধিমালা ও স্বাভাবিক অফিসিয়াল প্রক্রিয়ার স্পষ্ট লঙ্ঘন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারির তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান তর্কিত আদেশসমূহ জারি করেছেন। ৪ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যে বলা হয়েছে যে, ২৫০০ রুপির অধিক পরিমাণের যে কোনাে কন্ট্রাক্টের ক্ষেত্রে দরপত্র আহ্বান করা বাধ্যতামূলক। Apart from the question as to whether such a rule has the authority or force as having been framed under the authority of the Constitution or of the Government of India Act, 1935, it seems to us that such a provision in the rule is not attracted in cases of handling agencies which are granted to parties and for which remuneration is paid on commission basis. কিন্তু এরকম কোনাে সাক্ষ্যও নেই যার ভিত্তিতে বলা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান যখন কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের পক্ষে আদেশ জারি করতে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর সামনে এরকম কোনাে বিধিমালা উপস্থাপন করা হয়েছিল। অন্যদিকে, ১১ নম্বর সাক্ষী যিনি তখনকার সেক্রেটারি ছিলেন তিনি বরং সমঝােতার আকারে প্রস্তাব করেন যে, এজেন্সি মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেড ও মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেওয়া হােক। যদি কোনাে টেন্ডার ছাড়া সরাসরি নিয়ােগ দেওয়ার বিরােধী এরকম কোনাে বিধি থাকতাে, তাহলে সেক্রেটারির দায়িত্ব ছিল তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে জানানাে। এটা চিন্তা করা দুঃসাধ্য যে, সেক্রেটারি যেখানে সংশ্লিষ্ট বিধি উল্লেখ করেন না, মন্ত্রী যিনি বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসংখ্য পার্টিসংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট নিয়ে আরাে বেশি ব্যস্ত থাকেন, তিনি এই প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধি খুঁজে বের করবেন। আমরা মনে করি না যে, যদি এরকম বিধি থাকে যা বর্তমান। আদেশকে কাভার করে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী তা জ্ঞাতসারে লঙ্ঘন করেছেন; কিংবা এটাও মনে করি না যে, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে বাদ দিয়ে তৎপরিবর্তে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে এজেন্ট নিয়ােগ করার সময় সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের বিবেচনার জন্য কোনাে বিধি মন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘটনার ধরন অনুযায়ী এরকম কোনাে বিধি গােচরে আনা হলেও কোনাে কারণ ছাড়া তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি না। এরকম কোনাে বিধিমালা যদি না থাকে তাহলে
২০৬
এখন প্রশ্ন হলাে, কার ব্যক্তিগত মতামত প্রাধান্য পাবে। সেক্রেটারির মতামতকে সবচেয়ে যৌক্তিক হিসেবে গ্রহণ করা হবে, নাকি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী মন্ত্রীর মতামতই যথার্থ হিসেবে গৃহীত হবে? ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্টের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য এটা বিবেচনা করা প্রাসঙ্গিক যে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মুজিবুর রহমান অসদুদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে কাজ করেছেন কিনা যা ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে বিবেচিত হবে। ১১ নম্বর সাক্ষী জনাব কাদরীর সাক্ষ্যেই রয়েছে যে, একজন মন্ত্রী বিধিসাপেক্ষে তার সেক্রেটারির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারেন। সাক্ষ্যে আরও রয়েছে যে, পুরনাে সংবিধান অনুযায়ী রুলস অব বিজনেস প্রণীত হয়নি। এরকম বিধিমালা থাকায় সেক্রেটারির পরামর্শ, ব্যক্তিগত মতামত গ্রহণ করা। হবে কিনা সে বিষয়ে মন্ত্রী তার সর্বোচ্চ বিবেচনা প্রয়ােগ করবেন এবং এটি মন্ত্রীর এখতিয়ার।
এটা নিয়ে বিতর্ক নেই যে, রাষ্ট্র পরিচালনার উদ্দেশ্যে নীতি প্রণয়ন করা মন্ত্রীর দায়িত্ব। ফলে, দায়িত্ব পালনকালে তিনি একটা বিস্তৃত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পুরনাে সংবিধান অনুযায়ী, একজন মন্ত্রী কেবল গভর্নরের প্রতি দায়বদ্ধ তা নয়, বরং একদিক থেকে জনগণের কাছেও দায়বদ্ধ। ফলে এটা খুব সম্ভব যে, কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্ত্রী আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করতে পারেন। যদি সেক্রেটারির পক্ষ থেকে কোনাে আপত্তি থাকে এবং সেই আপত্তি গ্রহণ করা হয় তবে আমাদের মতে তা কেবল এটাই নির্দেশ করে
না যে, মন্ত্রী প্রশ্নবিদ্ধ মােটিভ দ্বারা প্ররােচিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ৪ নম্বর সাক্ষী জনাব মুয়িদ খান কর্তৃক অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ তারিখে প্রেরিত একটি নােট, এক্সিবিট ৭, প্রাসঙ্গিক হতে পারতাে। যেখানে উল্লেখ করা হয় যে, কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির নিয়ােগ নিয়মিত প্রক্রিয়ায় হয়নি, কারণ নিয়ােগের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তারিখসম্বলিত সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থ উপদেষ্টা জনাব ডি. কে. পাওয়ারের পরবর্তী নােটে দেখা যায়, তিনি ৪ নম্বর সাক্ষীর সঙ্গে একমত হলেও এই প্রসঙ্গ তুলে আনছেন যে, এ ব্যাপারে কোনাে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ছিল না। এটা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডকে চুক্তিভিত্তিক নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল, যেখানে বলা ছিল যে, সরকার তার ইচ্ছেমতাে এজেন্সি বাতিল করতে পারবে। জনাব মুয়িদ খানও এই চুক্তি বাতিল করাতে কোনাে দোষ খুঁজে পাননি। অন্য প্রশ্ন যেখানে বলা হয়, মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানির নিয়ােগ সম্পূর্ণ অবৈধ না হলেও অসদুদ্দেশ্যপ্রণােদিত কিনা। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, উপরে দেখানাে হয়েছে যে, এই ব্যাপারে কোনাে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা বা প্রক্রিয়া ছিল না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী যেহেতু শিল্পোন্নয়নের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন, তিনি হয়তাে চিন্তা করেছেন যে, স্টিম কোল থেকে সফট কোক উৎপাদনের জন্য মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি উপযুক্ত পার্টি হতে পারে। আর তারা হয়তাে বছর বছর ক্রমান্বয়ে এই উৎপাদন বাড়ানাের ব্যাপারে উৎসাহী হবে, যদি প্রকিউরিং ও হ্যান্ডলিং এজেন্সি তাদের দেওয়া হয়; তাহলে তা নতুন উদ্যোগের প্রাথমিক আর্থিক সমস্যার ধাক্কা সামলাতে পারবে। এটাও হয়তাে তার মনে ছিল যে, কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি সফট কোক উৎপাদন বাড়াতে পারলে তারা আমদানি কমাতে উৎসাহী হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর এসব যুক্তি বৈধ কিংবা যথার্থ কিনা তা বিবেচনা করা এই মামলায় আমাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের যা বিবেচনা করতে হবে তা হলো, as to whether these might be bonafide plausible reasons which probably weighed with him in the matter of selecting a party like Messrs. Coal Mining and Trading Company Limited for the purpose of giving the agency. কেবল এটা উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মন্ত্রী হয়তাে চিন্তা করেছেন, এ ধরনের ব্যবস্থা শিল্পায়নের পক্ষে কল্যাণকর হবে এবং উপরের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় এই অনুমান ভিত্তিহীন মনে হয় না।
২০৭
৬৮. পরবর্তী প্রশ্ন হলাে, মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডের প্রতিনিধিত্বকারী আবু নাসের প্রস্তাবিত সফট কোক উৎপাদনের আইডিয়াটি কেবল হাস্যকর কিনা এবং এটা যে একটা ধাপ্পাবাজি তা জেনেও শেখ মুজিবুর রহমান আবু নাসের ও তার ফার্মকে এজেন্সি দিয়েছেন কিনা।
৬৯. দেখা যায়, এই আইডিয়ার উদ্ভব হয় ১৯৫৫ সালের ৬ ডিসেম্বর, যখন কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি উপরে উল্লিখিত প্রস্তাবটি দেয়। প্রস্তাবটি প্রদর্শনী-ক(১৬)-তে যুক্ত করা হয়েছে। আরও দেখা যায়, কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি দরপত্র কমিটির মাধ্যমে এজেন্সি পেতে ব্যর্থ হওয়ার পর আবু নাসেরের পক্ষ থেকে ২ নম্বর সাক্ষী নবাবজাদা হাসান আলীকে অংশীদারী ব্যবসার জন্য অ্যাপ্রােচ করা ছাড়া অন্য কোনাে উদ্যোগ দেখা যায়নি। এরকম কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যে, ১৯৫৬ সালের মার্চ মাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরও আবু নাসের প্রত্যক্ষ-পরােক্ষভাবে এজেন্সি পাওয়ার চেষ্টায় ছােটাছুটি করছেন।
অন্যদিকে, ১৯৫৬ সালের ১২ নভেম্বর আবু নাসের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে তার প্রস্তাবের ব্যাপারে একটা রিমাইন্ডার দেন এবং এই রিমান্ডার প্রদ-ক(১৮)-তে সংযুক্ত করা হয়েছে। সাক্ষ্য-প্রমাে আবু নাসের একই বিষয়ে ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজকেও রিমাইন্ডার দিয়েছিলেন এবং সেখানে উল্লেখ করেছেন যে, তার সঙ্গে মন্ত্রীর মৌখিক আলাপ হয়েছে। সেখানে এটা বলা হয় যে, সরকার টনপ্রতি ৬ রুপি সাশ্রয় করতে পারবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ততদিনে সফট কোক উৎপাদনের বিষয়টি প্রাদেশিক পর্যায়ে আলােচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে, আবু নাসেরের পক্ষে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গে যােগাযােগ করাটা দোষণীয় কিছু ছিল না। এভাবে প্রতীয়মান হয় যে, সংশ্লিষ্ট পার্টি তর্কিত আদেশ পাস হওয়ার অনেক আগে থেকেই এই বিষয় নিয়ে দৌড়ঝাপ করছিলাে। এই পার্টি যখন জানতে পারে যে, মেসার্স হা লিমিটেডের স্থলে তাদের নিয়ােগ দেওয়া হচ্ছে এবং সফট কোক উৎপাদনের অনুমােদন দেওয়া হচ্ছে তখন তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে জানায় যে, এই দুটি বিষয় শুরু করার জন্য তাদের তিন বছর সময় লাগবে। যা হােক, এ বিষয়ে তাদের ও সরকারের মধ্যে সমঝােতা হয় এবং প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৫৮ সালের ২৫ জুলাইয়ের এক চিঠিতে এই ফার্ম সরকারকে জানায় যে, সেপ্টেম্বর ১৯৫৮-র মধ্যে তারা তা সম্পন্ন করতে পারবে। তারা আরাে জোর দেয় যে, বিহারের আমজাদ হােসেন ধানবাদ নামে এক লােককে নিয়ােগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে তিনি আসতে পারেননি।
৭০. বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, ফার্মটি তাদের এজেন্সি সাপ্লাই পালন করতে সমস্যার মুখােমুখি হচ্ছে এবং ১৯৫৮ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখসম্বলিত নােটিশ, এক্সিবিট ১৯,-এর মাধ্যমে তিন মাসের নােটিশে তাদের চুক্তি বাতিল করা হয়। নােটিশে তাদের চুক্তি বাতিল করা হয়। তবে দেখা যায়, নােটিশ টাইম শেষ হওয়ার পর্বে পাকিস্তান সরকারের কোল কমিশনার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প সচিব বরাবর এক চিঠিতে জানান যে, ব্যাপারটি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের ডেপুটি ডেভেলপমেন্ট কমিশনার জনাব এ.এইচ. এস. আলমের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক করাচি সফরকালে আলােচিত হয়েছে। স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের বিষয়টি বৈদেশিক সরকারের সঙ্গে আলােচিত হয়। প্রদর্শনী- ক(৮) ও ক(৯) থেকে দেখা যায় যে, ১৯৫৯ সালের ৪ মার্চ একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং আবু নাসের আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। আমন্ত্রিত অন্যান্যের মধ্যে চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি অংশগ্রহণ করেনি। এক্সিবিট-ক(৯) থেকে দেখা যায়, এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে, পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানিকে স্টিম কয়লা থেকে সফট কোক উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ১০০ টন দেওয়া হতে পারে। ১৯৫৯ সালের ৩১ মার্চ তারিখসম্বলিত এক চিঠিতে, প্রদর্শনী-ক(১০), রিজিওনাল কোল কন্ট্রোলার পাকিস্তান সরকারের কোল
২০৮
কমিশনারকে কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেডকে সফট কোক উৎপাদনের জন্য ১০০ টন গ্রেড ২ স্টিম কয়লা বরাদ্দ দেওয়ার অনুরােধ করেন। প্রদর্শনী-ক(১১)-এর মাধ্যমে রিজিওনাল কোল কন্ট্রোলার অফিস, পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট, ঢাকা মেসার্স কোল মাইনিং কোম্পানিকে ১০০ টন গ্রেড ২ স্টিম কয়লার জন্য টনপ্রতি ৩২ রুপি দরে ৩,২০০ রুপি জমা দিতে বলেন। এটা ছিল ১৯৫৯ সালের ২৯ এপ্রিল। ১৯৫৯ সালের ১২ জুলাইয়ের চিঠি, প্রদর্শনী-ক(১২) রিজিওনাল কোল কন্ট্রোলার অফিস, পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট, ঢাকা করাচিস্থ পাকিস্তান সরকারের কোল কমিশনারকে অবগত করেন যে, ব্যবস্থা অনুযায়ী ১০০ টন কয়লা সেই মাসেই পেয়েছেন এবং ফার্ম অর্থাৎ মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ে থেকে ইজারায় জমি অধিগ্রহণ, শ্রমিকদের জন্য শেড নির্মাণ, ফায়ার ব্রিকস, কাদামাটি ও প্রয়ােজনীয় চুলার জন্য (দেশি ভাট্টা), পানির পাম্প, তেলের ইঞ্জিন, ইত্যাদি সকল প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। ১৯৫৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের চিঠি, প্রদর্শনী-ক(২৯), মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড ডিরেক্টর জেনারেল ইন্ডাস্ট্রিজ, ট্রেড অ্যান্ড কমার্সকে জানান যে, তারা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রথম পর্যায়ে বরাদ্দকৃত একশ টন ভারতীয় কোকিং কয়লা থেকে সাফল্যের সঙ্গে সফট কোক উৎপাদন করেছেন এবং তা বিতরণের জন্য প্রস্তুত। উৎপাদিত সফট কোকের স্যাম্পল রিজিওনাল কোল কন্ট্রোলারের নির্দেশনায় সংশ্লিষ্ট স্মারকপত্রের বিপরীতে খুলনার কোল ইন্সপেক্টর উত্তোলন করেছেন। ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর তারিখের পরবর্তী চিঠি, প্রদর্শনী-ক(৩৯), থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা (কোল মাইনিং কোম্পানি) পূর্ব পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল ট্রেড অ্যান্ড কমার্সকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন যে, স্বল্প খরচে কোকিং কোল থেকে সফট কোক উৎপাদন করা হয়েছে এবং নতুন করে সফট কোক উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার ব্যাপারে তাদের হাতে কোনাে তথ্য নেই। পরবর্তীকালে ১৯৫৯ সালের ৫ নভেম্বর তারিখের ডেপুটি ডিরেক্টর ট্রেড অ্যান্ড কমার্স থেকে মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি বরাবর প্রেরিত চিঠি, প্রদর্শনী-ক(১৩) থেকে দেখা যায়, যশাের জেলার সিংঘিয়া থেকে ৮০ টন উৎপাদিত সফট কোক ১৬, বি.কে. দাস রােড, ঢাকাস্থ মেসার্স আব্দুর রাজ্জাক অ্যান্ড সন্স বরাবর ডেসপ্যাচ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এই পত্র বিনিময় নির্দেশ করে, বরং নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, মেসার্স কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি লিমিটেড যথাযথ সুযােগ-সুবিধা দেওয়া হলে স্টিম কোল থেকে সফট কোক উৎপাদনে খুবই সিরিয়াস ও আন্তরিক। প্রদ-৩০, ডিরেক্টর জেনারেল, ডিপার্টমেন্ট অব সাপ্লাই অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও ডিরেক্টর জেনারেল ইন্ডাস্ট্রিজ ট্রেড অ্যান্ড কমার্স-এর মধ্যকার পত্রবিনিময় থেকে দেখা যায়, তাদের মতে কোল মাইনিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি সফলভাবে সফট কোক উৎপাদন করেছে এবং প্রাপ্ত স্যাম্পলের রাসায়নিক পরীক্ষা থেকে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেছে। তারা আরাে যা চাইছিলেন তা হলাে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা।
৭১. এসব কিছু পরিষ্কারভাবে এটি নির্দেশ করে যে, মেসার্স কোল কোম্পানি কিংবা কাজী আবু নাসের সফট কোক উৎপাদনের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলেন এবং তিনি সত্যি সত্যি একটি কারখানা তৈরি করেছিলেন। ১২ নম্বর সাক্ষী আবদুল জলিল খান বলেন যে, কারখানা নির্মিত হয়েছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্য তিনি দর্শনা সফর করেননি কিংবা সিঙ্ঘিয়ায় যাননি। তিনি আরাে বলেন যে, তিনি আবু নাসেরের ফাইল থেকে এটা নির্ণয় করতে পারেননি যে, নাসের জুলাই, ১৯৫৮-র মধ্যে কারখানা নির্মাণ করেছেন। সংশ্লিষ্ট ফাইল ও অন্যান্য অফিস রেকর্ডস যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে এটা বুঝতে না পারার কোনাে কারণ আমরা খুঁজে পাই না। ১৫ নম্বর সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তা ফজলুর রহমান বলেন, জনাব নাসের কোকিং প্ল্যান্ট নির্মাণ করেছেন কিনা তা নির্ণয় করার জন্য তিনি বিবেচনা প্রয়ােগ করেছেন। তবে তিনি এই মত দেন যে,
২০৯
এরকম কোনাে কারখানা নির্মিত হয়নি। তবে পরবর্তী জেরায় তিনি স্বীকার করেন যে, তিনি পরবর্তী সময়ে জানতে পারেন যে, জনাব নাসের ১০০ টন হার্ড কোল থেকে সফট কোক উৎপাদন করেন এবং সরকার তা একটা পার্টিকে বরাদ্দও দিয়েছে। তিনি আরাে জানান যে, চার্জশিট জমা দেওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে, নাসের একটি ফ্যাক্টরি তৈরি করেছেন। তার সাক্ষ্যে তিনি বলেন যে, ১৯৫৯ সালের ২৭ এপ্রিল কাজী আবু নাসেরকে তিনি জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন নাসের উল্লেখ করেননি যে, তিনি যশােরের সিঙ্ঘিয়ায় একটি কোল কোকিং কারখানা তৈরি করেছেন। তবে তিনি অবশ্য এটাও জানিয়েছেন যে, তিনি নাসেরকে আসলে কারখানা নির্মাণের ব্যাপারে জিজ্ঞেসই করেননি। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন না করা হলে কোনাে ব্যক্তি কীভাবে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দিতে পারেন তা কৌতূহলােদ্দীপক। অন্যদিকে, আমরা এরকম চিন্তা করতে চাই যে, যদি ১২ ও ১৫ নম্বর সাক্ষী মন্ত্রণালয়ে থাকা সংশ্লিষ্ট নথিপত্র নিয়ে একটু সক্রিয় আগ্রহ দেখাতেন, তারা তাহলে আবিষ্কার করতে পারতেন এরকম কারখানা নির্মাণ কেবল চলমানই নয়, বাস্তবে তা নির্মিতও হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পার্টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এরপরও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মনে কোনাে সন্দেহ থাকলে তারা অন্তত প্রসিকিউশন শুরু হওয়ার আগে এবং কথিত অপরাধ আমলে নেওয়ার আগে কিংবা বিচার কার্যক্রম পর্যায়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন।
৭২. আরও প্রতীয়মান হয় যে, সফট কোক কারখানা আদৌ তৈরি হয়েছে কিনা- এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ পরিপ্রেক্ষিত হলেও আপিলকারীদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের কাছে তা সরাসরি সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরা হয়নি।
৭৩. প্রচুর নথিভুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ হাতে থাকায় আমাদের পক্ষে বিজ্ঞ স্পেশাল জজের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন, যাঁর মতে, সফট কোক উৎপাদনের আইডিয়াটি পাক্কা ধাপ্পাবাজি এবং এরকম কারখানা কখনােই স্থাপিত হয়নি। রেকর্ডের ভিত্তিতে এটা বলা আরাে কঠিন যে, প্রস্তাবটি তােলা হয়েছিল ১৯৫১ সালের ৬ ডিসেম্বর যখন শেখ মুজিবুর রহমান পদে ছিলেন না এবং যখন তা অফিসিয়াল লেভেলের সকল স্তরে মনােযােগ পেতে শুরু করে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও ৭ এপ্রিলের দুটি আদেশের মাধ্যমে দুটি বিষয়কে একসঙ্গে করে ((১) প্রকিউরিং অ্যান্ড হ্যান্ডলিং এজেন্সি ও (২) সফট কোক উৎপাদনের অনুমােদন) দেওয়ার ক্ষেত্রে অসৎ উদ্দেশ্য দ্বারা তাড়িত হয়েছেন এবং সফট কোক উৎপাদনের এ সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকে কিছু আর্থিক সুবিধা দেওয়ার জন্য নিপাট ধাপ্পাবাজি বা সূক্ষ্ম কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয় তা জেনেও জনাব নাসেরকে কোনাে সুবিধা দিতে চেয়েছেন। আমরা এটাও মনে করি না যে, যে পরিপ্রেক্ষিতে মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের এজেন্সি বাতিল করে তার পরিবর্তে একই শর্তে (টার্মস) মেসার্স কোল মাইনিংকে নিয়ােগ দিয়ে ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও ৭ এপ্রিলের তর্কিত আদেশ জারি করা হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে কোল মাইনিংকে সফট কোক উৎপাদনের অনুমােদন দেওয়া এবং গােপালগঞ্জ মহকুমায় পিট মাইনিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রভিশনাল লিজ প্রদানের বিষয় দুটি hypothesis of
guilt-এর মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়।
৭৪. মেসার্স হাসান আহমেদ লিমিটেডের একই টার্মসে মেসার্স কোল মাইনিং কোম্পানিকে নিয়ােগ দেওয়ার ব্যাপারে বলা যায় যে, মন্ত্রীর সামনে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ছিল না। এটা বলা কঠিন যে, তিনি এ ব্যাপারে অসৎ উদ্দেশ্য দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। অন্যদিকে, তিনি কাজী আবু নাসেরকে একটা পর্যায়ে দরপত্র কমিটি কর্তৃক যথার্থ ও যৌক্তিক বিবেচিত টার্মসই দিয়েছেন।
২১০
৭৫. এটা বলা যায় যে, শিল্পের প্রসারের নামে আর্থিক সুবিধা অর্জনের জন্য দুই আপিলকারীর মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব বা ঘনিষ্ঠতার তত্ত্বটি উপরে বর্ণিত অবস্থার সাথে যায়। It may be pointed out that the circumstances as set out above, fit in with the theory of deep friendship or intimacy between the appellants culminating in the obtaining of pecuniary advantage over Messrs. Hasan Ahmed Ltd., on the pretext of advancing industrialization. আরেকটি তত্ত্ব, ব্যবসায়ী কাজী আবু নাসেরের মনে যা-ই থাকুক না কেন, নিশ্চিতভাবেই ১৯৫৫ সালের ১৬ মার্চ নাগাদ জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এরকম চিন্তা করার যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত ছিল যে, মেসার্স হাসান আহমেদ লি.কে নিয়ােগ দেওয়া ন্যায্য হবে না এবং শিল্পায়নকে উৎসাহিত করা ও মেসার্স কোল মাইনিংকে নিয়ােগ দেওয়ার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করার লক্ষ্যে চুক্তির শর্তানুযায়ী সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী চুক্তি বাতিল করার যথেষ্ট কারণ ছিল। কেবল টেন্ডার আহবান না করার এই বিকল্প তত্ত প্রসিকিউশনের থিউরি বা হাইপােথেসিস অব গিল্ট-এর চেয়ে অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। এটি সুবিদিত যে, বিকল্প যৌক্তিক অনুমান হাজির থাকলে কেবল অবস্থাগত সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা করা যায় না। 6989, Siraj v. Crown(1957) 9 DLR (SC) 177, Fazlul Elahi alias Sajawal v. The Crown (1953) 5 DLR (FC) 207 3 Emperor on the Prosecution of Hurjee Mull v. Imam Ali Sircar, 8 CWN 278
৭৬. জনাব নাসের কর্তৃক এবেটমেন্ট অর্থাৎ প্ররােচনার অপরাধসংক্রান্ত প্রশ্নে প্রসিকিউশনের একমাত্র সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিলাে, দরপত্র কমিটি থেকে এজেন্সি পেতে ব্যর্থ হয়ে তিনি নবাবজাদা হাসান আলীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। আমাদের মতে, একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে এটা অস্বাভাবিক কিছু হিসেবে দেখার সুযােগ নেই। তিনি যে কোনাে উপায়ে এজেন্সি পাওয়া ও দখল করার জন্য চেষ্টা করছিলেন- এই ধারণার পক্ষে অন্য কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। বরং অফিস রেকর্ড থেকে দেখা যায়, কাজী আবু নাসের না চেয়েও এজেন্সি পেয়েছেন। অন্য কথায়, তিনি এজেন্সি পাওয়ার জন্য আর কোনাে আবেদন করেননি এবং মন্ত্রী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্রণােদিত হয়ে এবং উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলাে বিবেচনা করে মেসার্স কোল মাইনিং অর্থাৎ আবু নাসেরকে এজেন্সি দিয়েছেন।
৭৭. ইতিমধ্যে উল্লিখিত হয়েছে ট্রায়াল জজ দেখেছেন যে, কাজী আবু নাসের কিংবা কোল মাইনিং কোম্পানি স্বাধীনতার পর থেকে একচ্ছত্র ব্যবসা করে আসছেন। সুতরাং, এই কোম্পানিই এজেন্সি পাওয়ার ক্ষেত্রে নির্ভরযােগ্য হবে এরকম অনুমানে কোনাে দোষ থাকতে পারে না।
৭৮. সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা যায় যে, এজেন্সি পেতে ব্যর্থ হয়ে কাজী আবু নাসেরের পরবর্তী চেষ্টা ছিল পিট মাইনিং কার্যক্রমের অনুমােদন পাওয়া এবং স্টিম কোল থেকে সফট কোক উৎপাদনের অনুমােদন পাওয়া। ১৯৫৫ সালের ২৫ নভেম্বরের ২১(ক) এক্সিবিট নির্দেশ করে যে, তিনি পিট মাইনিং অপারেশনের অনুমােদন বা লাইসেন্স পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
৭৯. ইতিমধ্যে বলা হয়েছে যে, এক্সিবিট ১২ থেকে এরকম কোনাে ইঙ্গিত পাওয়া যায় না যে, শেখ মুজিবুর রহমান ও কাজী আবু নাসেরের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। পাসকৃত আদেশ দুটি পাস হয়েছে ১৯৫৭ সালের ২১ মার্চ ও ৭ এপ্রিল। দালিলিক, মৌখিক বা অন্য কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যার ভিত্তিতে এই উপসংহারে আসা যায় যে, মেসার্স হাসান আহমেদ অ্যান্ড ব্রাদার্সের এজেন্সি বাতিল করার পর এজেন্সি প্রকিউর ও হ্যান্ডলিং করার উদ্দেশ্যে আবু নাসের শেখ মুজিবুর রহমানকে কোনাে প্ররােচনা দিয়েছেন বা ইন্সটিগেট ও প্রম্পট করেছেন।
২১১
বিজ্ঞ স্পেশাল জজের সঙ্গে একমত হওয়া কঠিন যে, সফট কোক উৎপাদনের ধারণা কাজী আবু নাসেরের পক্ষ থেকে হাসান আহমেদ অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেডের কাছ থেকে এজেন্সি কেড়ে নেওয়ার জন্য ধাপ্পাবাজি ও সূক্ষ্ম কৌশল ছাড়া কিছু নয়। এটা মানাও কঠিন যে, আবু নাসের পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছেন এবং তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্ররােচনা ও এবেট করার প্রধান কুশীলব। মেসার্স কোল মাইনিং কোম্পানি না চাইতেই এজেন্সি পেয়েছিলাে। অন্যদিকে দেখা যায়, বেশ সংখ্যক পার্টি কোনাে দরপত্র জমা দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর একজন সফল হলে অন্যরা যেমন দৃশ্যপট থেকে সরে যান এবং সৌভাগ্যের অন্য স্বাভাবিক রাস্তার খোঁজে নামেন, তিনিও তেমনিভাবে এই প্রকল্প ত্যাগ করেছিলেন।
৮০. এসব কারণে আমাদের মনে হচ্ছে যে, প্রকিসিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারার অধীনে ক্রিমিনাল মিসকন্ডাক্টের অপরাধে দোষী কিংবা কাজী আবু নাসের দুর্নীতি দমন আইন, ১৯৪৭-এর একই ধারার অধীনে তৎসহ পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১০৯ ধারা অনুযায়ী অপরাধ সংঘটনে প্ররােচনা (এবেটমেন্ট) প্রদানের অপরাধে দোষী। সুতরাং, এই দুটি আপিল মঞ্জুর করা হলাে। আপিলকারীদের বিরুদ্ধে জারি হওয়া কনভিকশন ও সাজা বাতিল করা হলাে এবং তারা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ থেকে খালাস পেলেন। আমরা আপিলকারীদের তাঁদের নিজ নিজ জামিননামা (বেইল বন্ড) থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি।
২১২
[২]
ছয় দফাসংক্রান্ত সব ধরনের খবর প্রকাশ নিষিদ্ধ করে সরকারি আদেশ সংক্রান্ত মামলা : তফাজ্জল হােসেন বনাম পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ (১৯৬৬ সালের ২৬০ নম্বর পিটিশন)
রায়টির সারাংশ
ঘটনার সারসংক্ষেপ:
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহােরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরােধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানি বৈষম্য ও শােষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান ও বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার সনদ হিসেবে ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছয় দফার মূল কথা ছিল লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা এবং বৈদেশিক সম্পর্ক ও প্রতিরক্ষা ছাড়া সকল বিষয় প্রদেশের কাছে হস্তান্তর করা। বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গেই তা সর্বমহলে ব্যাপক আলােড়নের সৃষ্টি করে এবং বাঙালির মুক্তির সনদ’ হিসেবে স্বীকৃত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক-কর্তৃত্ববাদী সরকার এবং কায়েমি স্বার্থবাদী গােষ্ঠীসমূহের জন্য ছয় দফার ন্যায্য দাবিসমূহ এক অশনি সংকেত আকারে হাজির হয়। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উপর নেমে আসে অত্যাচার-নিপীড়নের খড়গ। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দকে কারাবন্দি করা হয়। ছয় দফার পক্ষে প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খড়গ নেমে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক-এর উপর। বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রাম ও ছয় দফার পক্ষে সরব থাকার কারণে এই পত্রিকার বিরুদ্ধে নেমে আসে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা।
পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২ বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও আইয়ুব-দোসর মােনায়েম খান দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া)-এর বিরুদ্ধে ৭ এপ্রিল ১৯৬৬, ২ জুন ১৯৬৬ ও ৭ জুন ১৯৬৬ তারিখে পরপর তিনটি নিষেধাজ্ঞা আদেশ জারি করেন। প্রথম নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশটি জারি করা হয় দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তফাজ্জল হােসেনের বিরুদ্ধে এবং বাকি দুটি আদেশ পাঠানাে হয়েছিল মুদ্রাকর ও প্রকাশককে উদ্দেশ্য করে।।
প্রথম নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশে ইত্তেফাক সম্পাদককে আদেশের তফসিলে উল্লিখিত সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে কোনাে মতামত, খবর, বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল—পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করে কিংবা দুই অংশের মধ্যে শােষণের অভিযােগ তােলে এমন মতামত বা প্রতিবেদন; ছাত্রদের আন্দোলন-হরতালের খবর ইত্যাদি। ২ জুন ১৯৬৬ তারিখে জারিকৃত দ্বিতীয় আদেশটি ছিল নিবৃত্তিমূলক। এর মাধ্যমে পরবর্তী ৭ জুন ছয় দফার সমর্থনে এবং বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তির দাবিতে আহুত প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল-সংক্রান্ত কোনাে খবরাখবর, মতামত, কিংবা প্রতিবেদন তৈরি বা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ করা হয় দুই সপ্তাহের জন্য। ৭ জুনের স্বতস্ফূর্ত হরতালে পুলিশের সঙ্গে জনতার ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে, লাঠিচার্জ করে, বিভিন্ন জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেদিনই জারি করা হয় ইত্তেফাক-এর
২১৩
বিরুদ্ধে তৃতীয় নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ। এই আদেশে কেবল হরতাল ও প্রতিবাদ দিবস পালনের খবর প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয় তা-ই নয়, বরং এ দিন সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ অর্থাৎ, উপরােক্ত পুলিশি তৎপরতার খবর, মতামত, মন্তব্য-বিবৃতি, এমনকি আলােকচিত্র মুদ্রণ বা প্রকাশও দুই সপ্তাহের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
ইত্তেফাক সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক উপরােক্ত আদেশসমূহ লঙ্ঘন করেছেন-এই অভিযােগে ১৬ জুন গভর্নর মােনায়েম খান পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২ বিধির (২) উপবিধি মােতাবেক এক আদেশ জারি করে মানিক মিয়ার মালিকানাধীন নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করেন। এই নিউ নেশন প্রেসেই ইত্তেফাক পত্রিকা মুদ্রিত হতাে। দৈনিক ইত্তেফাক-এর ১৩, ২৫ ও ২৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের সংখ্যায় প্রকাশিত কয়েকটি খবরের মাধ্যমে ৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযােগ করা হয়। বলা হয়, ৯ জুন ১৯৬৬ তারিখের ইত্তেফাক (মানিক মিয়া কর্তৃক মুসাফির ছদ্মনামে লিখিত রাজনৈতিক মঞ্চ) এবং ১২ জুন ১৯৬৬ তারিখের ইত্তেফাক তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশই লঙ্ঘন করেছে।
দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ চ্যালেঞ্জ করে সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিট আবেদন দায়ের করেন।
আদালতের রায়
আদালত সর্বসম্মত রায়ে ১৬.৬.১৯৬৬ তারিখের নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ আইনি কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে জারিকৃত ও আইনি কার্যকারিতাবিহীন বলে ঘােষণা করেন এবং সরকারকে উক্ত আদেশটি প্রত্যাহার বা বাতিল করার নির্দেশনা দেন।
২১৪
রায়টির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ
পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট
তফাজ্জল হােসেন
•••••••••••••••••••••••••••••••••পিটিশনার
বনাম
পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ
…রেসপনডেন্ট
(১৯৬৬ সালের ২৫০ নম্বর পিটিশন 0২)
রায়ের তারিখ
৯ আগস্ট ১৯৬৬
বিচারপতিবৃন্দ
বিচারপতি সিদ্দিকী, বিচারপতি এম. আর. খান, বিচারপতি এস. ডি. আহমেদ,
বিচারপতি এ. এম. সায়েম ও বিচারপতি আবদুল্লাহ
পিটিশনার পক্ষের আইনজীবী
মাহমুদ আলী কাসুরী, ফকির শাহাবুদ্দীন আহমেদ, কামাল হােসেন, মাে. আমিনুল ইসলাম, মােজাম্মেল হক খান, ফরিদুদ্দীন আহমেদ ও কে. এস. নবী,
১-৩ নং রেসপন্ডেন্ট পক্ষের আইনজীবী
সৈয়দ শরীফুদ্দীন পীরজাদা, অ্যাটর্নি জেনারেল;
টি. এইচ. খান, অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নমেন্ট প্লিডার ও এম. নুরুল্লাহ।
…………………………………………………….
02.Tofazzal Hossain vs. Province of East Pakistan. 18 DLR (1966)736.
২১৫
রায়
বিচারপতি সিদ্দিকী
১. ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন তারিখসম্বলিত ৯৮৫-রাজনৈতিক (II) [Order No 985-Poll(II)] নম্বর আদেশ চ্যালেঞ্জ করে পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই আবেদনটি দায়ের করেছেন দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক জনাব তফাজ্জল হােসেন। তাঁর হয়ে আবেদনটি করেছেন তাঁর ছেলে ও কনস্টিটিউটেড অ্যাটর্নি জনাব মঈনুল হােসেন। উপরােক্ত আদেশের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ১, রামকৃষ্ণ রােড, ঢাকায় অবস্থিত জনাব তফাজ্জল হােসেনের মালিকানাধীন নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস হিসেবে পরিচিত একটি প্রেস সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করেছেন। ইতিপূর্বে দৈনিক ইত্তেফাক’– যা নিউ নেশন প্রেসে মুদ্রিত হয়— এ কিছু বিষয় মুদ্রণ ও প্রকাশনার উপর জারি করা প্রদেশের গভর্নরের নিষেধাজ্ঞার কথিত লঙ্ঘনের জন্য পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধির ৫২ বিধি অনুযায়ী প্রেসটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
২. এটা সর্বজনবিদিত যে, জনাব তফাজ্জল হােসেন বাংলা দৈনিক ইত্তেফাক’-এর স্বত্বাধিকারী, সম্পাদক,মুদ্রাকর ও প্রকাশক এবং তিনি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসেরও মালিক ও অভিভাবক।
৩. বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৫২ বিধির (১) উপবিধির (খ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর দরখাস্তকারীর বিরুদ্ধে ৭ এপ্রিল ১৯৬৬, ২ জুন ১৯৬৬ ও ৭ জুন ১৯৬৬ তারিখে পরপর তিনটি নিষেধাজ্ঞা আদেশ (যথাক্রমে সংযুক্তি ডি, ডি (১) ও ডি (২) জারি করেছেন। নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশসমূহে অর্পিত ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। তবে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৬৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে পাকিস্তান গেজেট (অতিরিক্ত)-এ প্রকাশিত SHO III (জ)/৬৫ নম্বর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক সরকারকে দেওয়া ক্ষমতাবলে গভর্নর আদেশসমূহ জারি করেছেন। প্রথম নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশটি তফাজ্জল হােসেনের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক হিসেবে। বাকি দুটি আদেশ তার বিরুদ্ধে হয়েছিল মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে। প্রথম নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশে দরখাস্তকারীকে আদেশের তফসিলভুক্ত কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে কোনাে মতামত, খবর, বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। দ্বিতীয় আদেশে দরখাস্তকারীর প্রতি ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগ আহুত প্রতিবাদ দিবস পালনসম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন তৈরি বা প্রকাশ করা নিষিদ্ধ করা হয় এবং তৃতীয় আদেশের মাধ্যমে ৭ জুন ১৯৬৬ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও প্রতিবাদ দিবস এবং এসব বিষয়ে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসংক্রান্ত খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি, প্রতিবেদন বা আলােকচিত্র মুদ্রণ বা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
৪. দরখাস্তকারী উপরােক্ত আদেশসমূহ লঙ্ঘন করেছেন এই যুক্তিতে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৫২ বিধির (২) উপবিধি মােতাবেক এক আদেশ (সংযুক্তি-বি) জারি করে দরখাস্তকারীর নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করেন।
৫. ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল, ১৯৬৬ সালের ২ জুন ও ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তারিখের তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশকে দরখাস্তে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং নিম্নরূপ উদ্ধৃত করা হয় :
২১৬
“৭.৪.৬৬
পূর্ব পাকিস্তান সরকার
স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তর
শাখা ২
আদেশ
নম্বর : ৪৬৬-Poll (II), তারিখ: ঢাকা, ৭ এপ্রিল ১৯৬৬
যেহেতু, গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণার অনুভূতি সৃষ্টি করবে বা করতে পারে এবং জনগণকে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এমন প্ররােচনামূলক মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যার বিরুদ্ধে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৫২ বিধির (১) উপবিধির (বি) দফা মােতাবেক এবং ১৯৬৬ সালের ৩ এপ্রিলের ৪৬০ (৯) Poll (II) নম্বর আদেশ বাতিল করে গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রের কাছে পাঠানাে বিষয় ছাড়া ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তফাজ্জল হােসেনকে নিমােক্ত তফসিলে উল্লিখিত বিষয়ে অন্য কোনাে বিষয় তৈরি বা প্রকাশ করার উপর তিন মাসের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, যা অবিলম্বে কার্যকর হবে।
উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞা বর্তমান আদেশসহ ১৯৬৬ সালের ৩ এপ্রিল তারিখের- ৪০(৯)-Poll (II) নম্বর আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য হবে।
তিন মাসের উক্ত মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সেই আদেশ রদ, বাতিল বা সংশােধনের জন্য ইত্তেফাক-এর জনাব তফাজ্জল হােসেন সরকারের কাছে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন।
তফসিল
(ক) পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট করে কিংবা এর সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করতে পারে বা করার আশঙ্কা রয়েছে এমন যে কোনাে ধরনের মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
(খ) রাষ্ট্রের এক অংশ কিংবা এক শ্রেণির লাভের জন্য অন্য অংশ বা অপরাপর শ্রেণি কর্তৃক শােষণের অভিযােগসংবলিত কোনও মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
(গ) বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের মধ্যে শত্রুতা বা বিদ্বেষের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে বা করার অভিপ্রায় রয়েছে এমন যে কোনাে ধরনের মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
(ঘ) ছাত্রদের হরতাল, ছাত্রদের আন্দোলন, ছাত্র-গােলযােগ, ছাত্রদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষোভ এবং সেই ব্যাপারে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপসংক্রান্ত কোনাে মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
গভর্নরের আদেশক্রমে
স্বাক্ষর : জেড, হক
৭.৪.৬৬
সেকশন অফিসার, পূর্ব পাকিস্তান সরকার
২১৭
প্রাপক
জনাব তফাজ্জল হােসেন
সম্পাদক, ইত্তেফাক, ঢাকা
“২.৬.৬৬
পূর্ব পাকিস্তান সরকার
স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তর
শাখা ২
আদেশ
৮৭৭-Poll (II) নম্বর, তারিখ : ঢাকা, ২ জুন ১৯৬৬।
যেহেতু, গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক হরতাল ও পিকেটিং সম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যা সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে হত করতে পারে, প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে শিল্প-শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করতে প্ররােচিত করতে পারে, গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত, বিলম্বিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে এবং জননিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে;
এবং যেহেতু, গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আশু পদক্ষেপ প্রয়ােজন।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৬২ বিধির (১) উপবিধির (এইচ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গভর্নর জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক জনাব তফাজ্জল হােসেনকে নিমােক্ত তফসিলে উল্লিখিত বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রে পাঠানাে বিষয় ছাড়া অন্য কোনাে বিষয় তৈরি বা ছাপানাের উপর দুই সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারি যা অনতিবিলম্বে কার্যকর করতে সন্তুষ্ট হবে।
এখানে উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞা বর্তমান আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য হবে।
উপরােক্ত দুই সপ্তাহের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সেই আদেশ রদ, বাতিল বা সংশােধনের জন্য ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক জনাব তফাজ্জল হােসেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের সচিবের কাছে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন।
তফসিল
৭.৬.৬৬ তারিখে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত প্রতিবাদ দিবস’ পালন এবং সেই সংক্রান্ত খবর, মতামত, মন্তব্য ও প্রতিবেদন।
গভর্নরের আদেশক্রমে
স্বাক্ষর : জেড. হক
সেকশন অফিসার, পূর্ব পাকিস্তান সরকার
২১৮
প্রাপক,
জনাব তফাজ্জল হােসেন
সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক, ইত্তেফাক
১, আর. কে. মিশন রােড, ঢাকা।
“৭.৬.৬৬
পূর্ব পাকিস্তান সরকার
স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তর
সেকশন ২।
আদেশ
৯০২-Poll (II) নম্বর, তারিখ : ৭ জুন, ১৯৬৬
যেহেতু, গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল ও প্রতিবাদ দিবস এবং সেই ব্যাপারে গৃহীত সরকারি পদক্ষেপসংক্রান্ত বা এর সঙ্গে কোনােভাবে সম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি, প্রতিবেদন ও আলােকচিত্র প্রকাশ জননিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে;
বর্তমান পরিস্থিতিতে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি, ১৯৬৫-এর ৫২ বিধির (১) উপবিধির (খ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গভর্নর জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ইত্তেফাক-এর সম্পাদক/মুদ্রাকর ও প্রকাশক জনাব তফাজ্জল হােসেনকে নিমােক্ত তফসিলে উল্লিখিত বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রে পাঠানাে বিষয় ছাড়া অন্য কোনাে বিষয় তৈরি বা ছাপানাের উপর দুই সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারি করতে সন্তুষ্ট হয়েছেন যা অনতিবিলম্বে কার্যকর হবে।
এখানে উল্লিখিত নিষেধাজ্ঞা বর্তমান আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য হবে।
উপরােক্ত দুই সপ্তাহের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সেই আদেশ রদ, বাতিল বা সংশােধনের জন্য উপরােল্লিখিত ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক জনাব তফাজ্জল হােসেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন।
তফসিল
১৯৬৬ সালের ৭ জুলাই তারিখে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত প্রতিবাদ দিবস’ পালন এবং সেই ব্যাপারে সরকার গৃহীত পদক্ষেপসংক্রান্ত বা সম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য ও প্রতিবেদন।
গভর্নরের আদেশক্রমে
স্বাক্ষর: জেড. হক
৮.৬.৬৬
সেকশন অফিসার, পূর্ব পাকিস্তান সরকার
২১৯
প্রাপক,
জনাব তফাজ্জল হােসেন
সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক, ইত্তেফাক
১, আর. কে. মিশন রােড, ঢাকা।
“১৬.৬.৬৬
পূর্ব পাকিস্তান সরকার
স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) দপ্তর
আদেশ
নম্বর : ৯৮৫-Poll (II), তারিখ : ১৬ জুন ১৯৬৬
যেহেতু, গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণার অনুভূতি সৃষ্টি করবে বা করতে পারে এবং জনগণকে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে প্ররােচিত করতে পারে এমন প্ররােচনামূলক মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যার বিরুদ্ধে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক।
বর্তমান পরিস্থিতিতে, যেহেতু, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৫২ বিধির (১) উপবিধির (খ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গভর্নর জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ইত্তেফাক-এর প্রকাশক ও মুদ্রাকরকে নিমােক্ত তফসিলে (ক) উল্লিখিত বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রে প্রেরিত বিষয় ছাড়া অন্য কোনাে বিষয় তৈরি বা প্রকাশ ৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখ থেকে তিন মাসের জন্য নিষিদ্ধ করে ৪৬৬ পল (২) নম্বর, ঢাকা ৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের, আদেশ জারি করেছেন;
এবং যেহেতু, গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ঢাকার দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক হরতাল ও পিকেটিং সম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ করছে যা সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব পালনে হস্তক্ষেপ করতে পারে, প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে শিল্প-শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করতে প্ররােচিত করতে পারে, গণপরিবহণ ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত, বিলম্বিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে এবং জননিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে;
এবং যেহেতু, ফলে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৬২ বিধির (১) উপবিধির (খ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গভর্নর উপরােক্ত উদ্দেশ্যে ২ জুন ১৯৬৬ তারিখসম্বলিত ৮৭৭ পল (২) নম্বর আরেকটি আদেশ জারি করে ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক জনাব তফাজ্জল হােসেনকে নিমােক্ত তফসিলে (খ) উল্লিখিত বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রে পাঠানাে ম্যাটার ছাড়া অন্য কোনাে ম্যাটার তৈরি বা ছাপানাের উপর ২ জুন ১৯৬৬। থেকে দুই সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হােক, যা অনতিবিলম্বে কার্যকর হবে;
এবং যেহেতু গভর্নর এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের হরতাল ও প্রতিবাদ দিবস এবং সেই ব্যাপারে গৃহীত সরকারি পদক্ষেপ সংক্রান্ত বা এর সঙ্গে কোনােভাবে সম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি, প্রতিবেদন ও আলােকচিত্র প্রকাশ জননিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে;
এবং যেহেতু, ফলে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি, ১৯৬৫-এর ৫২ বিধির (১) উপবিধির (খ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গভর্নর ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তারিখসম্বলিত ৯০২ পল (২) নম্বর আদেশ জারি করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও
২২০
শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আপনি ইত্তেফাক-এর সম্পাদক/মুদ্রাকর ও প্রকাশক জনাব তফাজ্জল হােসেনকে নিমােক্ত তফসিলে (গ) উল্লিখিত বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক সংবাদপত্রে পাঠানাে বিষয় ছাড়া অন্য কোনাে বিষয় তৈরি বা ছাপানাের উপর ৭ জুন ১৯৬৬ থেকে দুই সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন; এবং
যেহেতু, তফসিল (ঘ)-তে উল্লিখিত নিমােক্ত প্রকাশনার মাধ্যমে আপনি ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক উপরােক্ত নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন করেছেন :
বর্তমান পরিস্থিতিতে, এখন, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা ৫২ বিধির (২) উপবিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী গভর্নর ১, রামকৃষ্ণ মিশন রােডে অবস্থিত নিউ নেশন প্রেস, যা উপরােল্লিখিত তফসিলে উল্লিখিত প্রকাশনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে তা অনতিবিলম্বে সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘােষণা করতে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
উপরােল্লিখিত জনাব তফাজ্জল হােসেন, ইত্তেফাক-এর মুদ্রাকর/প্রকাশক ও সম্পাদক আজ থেকে এক মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে এই আদেশ রদ, বাতিল বা সংশােধনের জন্য নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন।
তফসিল ক
(ক) পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি বিনষ্ট করে কিংবা এর সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করতে পারে বা করার আশঙ্কা রয়েছে
এমন যে কোনাে ধরনের মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
(খ) রাষ্ট্রের এক অংশ কিংবা এক শ্রেণির লাভের জন্য অন্য অংশ বা অপরাপর শ্রেণি কর্তৃক শােষণের অভিযােগ তােলে এমন মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
(গ) বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের মধ্যে শত্রুতা বা বিদ্বেষের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে বা করার অভিপ্রায় রয়েছে এমন যে কোনাে মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
(ঘ) ছাত্রদের হরতাল, ছাত্রদের আন্দোলন, ছাত্র-গােলযােগ, ছাত্রদের বিভিন্ন ধরনের ক্ষোভ এবং সেই ব্যাপারে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপসংক্রান্ত কোনাে মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন।
তফসিল খ
৭.৬.৬৬ তারিখে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত প্রতিবাদ দিবস’ পালন এবং সেই সংক্রান্ত বা সম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য ও প্রতিবেদন।
তফসিল গ
১৯৬৬ সালের ৭ জুলাই তারিখে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত প্রতিবাদ দিবস’ পালন এবং সেই ব্যাপারে সরকার গৃহীত পদক্ষেপসংক্রান্ত বা সম্পর্কিত খবর, মতামত, মন্তব্য ও প্রতিবেদন।
তফসিল ঘ
১. ১৯৬৬ সালের ৯ জুন, ঢাকা সংখ্যার ১ ও ২ পৃষ্ঠায় গুলিবর্ষণের মুলতবী প্রস্তাব অগ্রাহ্য’ শিরােনামের খবর।
২. ৯ জুন, ঢাকা সংখ্যার ৪ পৃষ্ঠায় রাজনৈতিক মঞ্চ’ ক্যাপশনের প্রকাশনা।।
২২১
৩. ১২ জুন ১৯৬৬ তারিখের ১ ও ১০ পৃষ্ঠায় ৬ দফার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ পৰ্য্যায়ক্রমিক কর্মসূচি শিরােনামের খবর।
৪. ছয় দফার প্রশ্নে কোনাে আপােষ নাই’ শিরােনামে ১৯৬৬ সালের ১৩ এপ্রিল সংখ্যার খবর।
৫. সংগ্রাম চলবেই-পল্টনের বিশাল জনসমুদ্রে নেতৃবৃন্দের ঘােষণা’ শীর্ষক ১৯৬৬ সালের ২৫ এপ্রিল সংখ্যার ১ নম্বর পৃষ্ঠার খবর।
৬. দীর্ঘসূত্রিতার ফল’ শীর্ষক ২৭.৪.৬৬ তারিখের প্রকাশনা।
গভর্নরের আদেশক্রমে
স্বাক্ষর অপাঠ্য
১৬.৬.৬৬
সেকশন অফিসার, পূর্ব পাকিস্তান সরকার
প্রাপক,
তফাজ্জল হােসেন,
সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক, ইত্তেফাক
১, আর. কে.মিশন রােড, ঢাকা।
৬. দরখাস্তকারীর আইনজীবী জনাব কাসুরী প্রথম তিন দিন যুক্তি-তর্ক শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন এবং এরপর আদালতের অনুমতিক্রমে তাঁর বিজ্ঞ জুনিয়র জনাব কামাল হােসেনের কাঁধে মামলা পরিচালনার দায়ভার অর্পণ করেন। জনাব কাসুরী আমাদের বিবেচনার জন্য বিভিন্ন বিষয়/প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যা এই বিজ্ঞ আইনজীবীর মতে ১৬.৬.৬৬ তারিখের বাজেয়াপ্তির আদেশকে ভিত্তিহীন করে দেয়। জনাব কাসুরীর উত্থাপিত প্রায় ডজনখানেক প্রশ্নের মধ্যে, আমার মতে, কেবল দুটি গুরুতর বিবেচনা পাওয়ার যােগ্য। সুতরাং, আমি সেই দুটি বিষয়/প্রশ্ন নিয়েই আলােচনা করছি।
৭. দরখাস্তকারীর পক্ষে জনাব কাসুরী জোরালােভাবে যুক্তি উত্থাপন করেন যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫ (১৯৬৫ সালের ২৩ নম্বর অধ্যাদেশ)-এর অধীনে প্রণীত পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২ বিধির (১) উপবিধি, যার অধীনে তর্কিত বাজেয়াপ্ত আদেশ জারি করা হয়েছে, উক্ত অধ্যাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় তা কার্যকারিতাশূন্য এবং অকার্যকর, যেহেতু ৫২ বিধির (১) উপবিধিতে সেই বিচার-বিবেচনার কথা কল্পিত হয়েছে, তা গভর্নর কর্তৃক নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে করা হয়নি।
৮. এটা সর্বজনবিদিত যে, ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকালে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচারের নীতি অনুসারে যুদ্ধ ঘােষণা ছাড়াই পাকিস্তানের উপর আক্রমণ করে আকস্মিকভাবে গুরুতর আঘাত হানে ভারত। এই পরিস্থিতিতে একই দিন পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ৩০(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিমােক্ত জরুরি অবস্থা ঘােষণা জারি করা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের জন্য অপরিহার্য করে তােলে :
যেহেতু, প্রেসিডেন্ট এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, একটি মারাত্মক জরুরি পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেখানে পাকিস্তান যুদ্ধাক্রান্ত হওয়ার আশু বিপদের মধ্যে রয়েছে;
২২২
সেহেতু, এখন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩০-এর (১) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট এই মর্মে জরুরি অবস্থা ঘােষণা জারি করতে সন্তুষ্ট হয়েছেন।
যুগপভাবে কিংবা এর অব্যবহিত পরে প্রেসিডেন্ট ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের সংবিধানের ৩০(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫ নামে ১৯৬৫ সালের ২৩ নম্বর অধ্যাদেশ জারি করেন। এই অধ্যাদেশের ৩(ক) উপধারা অনুযায়ী অফিসিয়াল গেজেট নােটিফিকেশনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারকে উক্ত অধ্যাদেশ অনুযায়ী বিধি প্রণয়নের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই অধ্যাদেশের ৩ ধারায় প্রদত্ত কর্তৃত্বের বলে সেদিনই, অর্থাৎ ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা নামে বেশ সংখ্যক বিধি জারি করেন।
৯. উত্থাপিত প্রশ্নে পক্ষদ্বয়ের যুক্তি অনুধাবন করার জন্য সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদের পাশাপাশি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারা এবং পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২ বিধির প্রাসঙ্গিক বিধানসমূহ উদ্ধৃত করা প্রয়ােজন। সেগুলাে নিম্নরূপ :
সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদ-
“(1) If the President is satisfied that a grave emergency exists
(a) in which Pakistan, or any part of Pakistan, is (or is in imminent danger
of being) threatened by way of external aggression; or
(b) in which the security or economic life of Pakistan is threatened by
internal disturbances beyond the power of a Provincial Government control. The President may issue a Proclamation of Emergency .
(2) A Proclamation of Emergency shall, as soon as is practicable, be laid before the National Assembly.
(3) The President shall, when he is satisfied that the grounds on which he issued a Proclamation of Emergency have ceased to exist, revoke the Proclamation.
(4)If, at a time when a Proclamation of Emergency is in force (whether or not the National Assembly stands dissolved or in session at that time), the President is satisfied that immediate legislation is necessary to assist in meeting the emergency that gave rise to the issue of the Proclamation, he may, subject to this Article, make and promulgate such Ordinances as appear to him to be necessary to meet the emergency, and any such Ordinance shall, subject to this Article, have the same force of law as an Act of the Central Legislature.
(5)An Ordinance made and promulgated under this Article shall, as soon as is practicable, be laid before the National Assembly.
(6)The National Assembly shall have no power to disapprove of the Ordinance but if, before the Ordinance ceases to have effect, the National Assembly, by
২২৩
resolution approves of the Ordinance, the Ordinance shall be deemed to have become an Act of the Central Legislature.
(7) An Ordinance made under the Article shall, unless it has been sooner approved by the National Assembly, or repealed by the President, cease to have effect, and shall be deemed to have been repealed, at the time when the Proclamation of Emergency by virtue of which it woe made is revoked.
(8) The power of the President to make laws by the making and promulgation of Ordinance under this Article extends only to the making of laws within the legislative competence of the Central Legislature.
(9) Nothing contained in paragraphs 5, 6, 7, 8, 9 and 13 of the fundamental rights conferred by Chapter I of Part II of: this Constitution shall, while a Proclamation of Emergency is in force, restrict the power of the State as defined in Article 5 of this Constitution to make any law or to take any executive action which it would, but for the provisions contained in the said paragraphs, be competent to make or to take, but any law so made shall, to the extent of incompetency, cease to have effect, and shall be deemed to have been; repealed, at the time when the Proclamation is revoked.
(10) While a Proclamation for Emergency is in force, the President may by order; declare that the right to move any Court for the enforcement of such of the fundamental rights conferred by Chapter I of part II of this Constitution as may be specified in the order, and any proceeding in any Court which is for the enforcement, or involves the determination of any Question as to the infringement, of any of the rights so specified shall remain suspended for the period during which the Proclamation is in force, and any such Order may be made in respect of the whole or any part of Pakistan.
অধ্যাদেশের ৩ ধারার (১) উপধারা এবং (২) ও (৩) উপধারার প্রাসঙ্গিক অংশ –
(1) The Central Government may, by notification in the Official Gazette, make such rules as appears to it to be necessary or expedient for ensuring the security, the public safety and interest and the defense of Pakistan, or for securing the maintenance of public order or the efficient conduct of military operations or prosecution of war, or for maintaining supplies and services
essential to the life of the community.
(2) Without prejudice to the generality of the powers conferred by sub-section
(XI), the rules may provide for, or may empower any authority to make orders providing for, all or any of the following matters, namely
২২৪
(3)The rules made under sub section (1) may further-
(i) provide for the arrest and trial of persons contravening any of the rules
or any order made thereunder;
(ii) provide that any contravention of, or any attempt to contravene, and
any abetment of, or attempt to abet, the contravention of any of the provisions of the rules, or any order made under any such provision, shall be punishable with imprisonment for a term which may extend to
seven years, or with fine, or with both;
(iii) provide for the seizure, detention and forfeiture of any property in
respect of which such contravention, attempt or abetment as is referred to in the preceding clause has been committed, and for the adjudication of such forfeiture whether by a Court or by any other authority;
(iv) confer power and impose duties upon the Central Government or any
provincial Government, or upon officers and authorities or any such Government, as respect any matter;
(v) prescribe the duties and powers of public Servants, and other persons as
regards preventing the contravention of, or securing the observance of, the rules or any order made thereunder;
(vi) provide for preventing obstruction and deception or, and disobedience
to any person acting, and interference with any notice issued, in pursuance of the rules or any order made thereunder;
(vii) prohibit attempts by any person to screen from punishment any one,
other than the husband or wife of such person, contravening any of the rules or any order made thereunder;
(viii) empower or direct any authority to take such action as may be specified in the rules or as may seem necessary to such authority for the purpose of ensuring the security, the public safety or interest for the defense of Pakistan; and
(ix) provide for charging fees in respect of the grant or issue of any license,
permit, certificate or other document for the purposes of the rules.
পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২ বিধি-
(1) The Central Government may, for the purpose of ensuring the security, the public safety or the defense of Pakistan, or for securing the maintenance of public order or the efficient conduct of military operations or prosecution of
২২৫
war, by order addressed to a printer, publisher or editor or to printers, publisher and editor generally-
(a) require that all matter, or any matter to a particular subject or class of
subjects, shall, before being published in any document or class of documents, be submitted for Scrutiny to an authority specified in the order;
(b) prohibit or regulate the making or publishing of any document or class
of documents, or of any matter relating to a particular subject or class of subjects, or the use of any press, as defined in the press and Publication Ordinance, 1960.
(2) If any person contravenes any order made under sub-rule (1), then, without prejudice to any other proceedings which may be taken against such person, the Central Government may declare to be forfeited to it every copy of any document published or made in contravention of such order and any press, as defined in the Press and Publication Ordinance, 1960, used in the making of such document; And, if the document so forfeited is a newspaper, the Central Government may also cancel the declaration made and subscribed in respect of such newspapers under section 7 of that Ordinance.
১০. দরখাস্তকারীর বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব কাসুরী দাবি করেন যে, যদিও ৩ ধারার (১) উপধারার অধীনে আইনসভা (প্রেসিডেন্ট) কর্তৃক কেন্দ্রীয় সরকারকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং একই ধারার (২) উপধারা ব্যাখ্যামূলক, তবু এই ধারার (৩) উপধারাকে ব্যাখ্যামূলক বলা যাবে না। বরং তা (১) উপধারার মতাে একই ভিত্তিতে দাঁড়ানাে। তিনি যুক্তি দেখান যে, (৩) উপধারা একটি মৌলিক বিধান এবং সেখানকার বিধানগুলাে বাধ্যতামূলক। তিনি যুক্তি দেখান যে, (৩) উপধারার শুরুর “may” শব্দটিকে অবশ্যই “shall” আকারে পড়তে হবে এবং ফলস্বরূপ এই উদ্দেশ্যে প্রণীত বিধিতে (বর্তমান ক্ষেত্রে বিধি ৫২(২) বিচারর বিধান রাখা বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক। আমি জনাব কাসুরীর এই অভিমত গ্রহণ করি না। যদি উপধারা (৩)-এর may শব্দটি shall হিসেবে পড়তে হয় তাহলে বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের উপর সেই উপধারার বিভিন্ন দফায় উল্লিখিত বিভিন্ন উদ্দেশ্যের জন্য বিধি প্রণয়ন করা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। আমার মতে, এই may’-কে may’ হিসেবেই পড়তে হবে, shall হিসেবে নয়। আইনসভা যখন আইনটি প্রণয়ন করছিল এবং ৩ ধারার (১) উপধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করার পর অন্যান্য কিছু বিষয়ে বিধি প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়াটাকে সমীচীন বিবেচনা করেছে এবং ৩ ধারার (৩) উপধারা প্রণয়ন করেছে। উপধারার শুরুর কথাগুলাে থেকে তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে, যেখানে বলা হয় : “(3) the Rules made under sub-section (1) may further’। আমার মতে, আইনপ্রণেতাগণ উপরােক্ত শব্দগুচ্ছ দ্বারা যা বােঝাতে চেয়েছেন তা হলাে : (১) উপধারার কর্তৃত্বে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতার পাশাপাশি বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ এই উপধারার অর্থাৎ (৩) উপধারার অন্যান্য অনেক দফায় উল্লিখিত অন্যান্য বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন। কিন্তু বিধি-প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ (৩) উপধারার অন্যান্য দফায় উল্লিখিত বিষয়ে বিধি প্রণয়ন
২২৬
করতে উদ্যোগী হলে, তখন সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসংবলিত বিধানাবলি রাখতে হবে। অন্য কথায় বলা যায়, (৩) উপধারায় বর্ণিত বিষয়ে কর্তৃপক্ষ বিধি প্রণয়ন করার বা না করার স্বাধীনতা থাকবে, তবে বিধি প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকলে কর্তৃপক্ষ ঐ উপধারার বিভিন্ন অনুচ্ছেদে উল্লিখিত নির্দেশনাসমূহ লঙ্ঘন করে কোনাে বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন না। উদাহরণস্বরূপ : শাস্তির মেয়াদ, স্বামী-স্ত্রী সংক্রান্ত ব্যতিক্রমসমূহ, বিচারসংক্রান্ত বিধান ইত্যাদি। সংক্ষিপ্তভাবে বলতে পারি যে, যদিও উপধারা ৩ একটি সক্ষমকারী প্রকৃতির ধারা, এখানে বিধি-প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষকে অন্তত শাস্তির মেয়াদ, বিচারের বিধান এবং স্বামী-স্ত্রী সংক্রান্ত ব্যতিক্রমসমূহ, (৩) উপধারার (ii), (iii) ও (vii)-এই তিন দফার নির্দেশনা বাদ দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি; যদি তারা এই বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়ন করতে চান। উপধারা (৩)-এর ভাষা বাধ্যতামূলক এবং সেখানকার may’ শব্দটি Frederic Guilder Julius 0s. the Right Reo. The Lord Bishop of Oxford; They Rev. Thomas Thellusson Carter, 5 Appeal Cases 214 মামলার সিদ্ধান্তের কর্তৃত্ব বলে shall আকারে পড়তে হবে আমার পক্ষে এই যুক্তি গ্রহণ করা কঠিন এজন্য যে, আমি সেই মামলায় এরকম কোনাে নিয়ম খুঁজে পাইনি। বরং, বিশপ মামলা পড়ে আমি যা বুঝতে পারি তা হলাে, যখন কোনাে আইনে কোনাে এনাবলিং বিধান থাকে, তখন সেই বিধানের অধীনে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ সেই বিধান অনুযায়ী কাজ করতে পারেন, না-ও পারেন। তবে যদি সেই অনুযায়ী কাজ করবেন। বলে স্থির করেন তাহলে তা অবশ্যই আইনের বিধান মেনে করতে হবে। এটা বলা যাবে না যে, উপধারা (৩) একটি বাধ্যতামূলক বিধান এবং কেন্দ্রীয় সরকার ‘may’-কে ‘shall’ হিসেবে পড়ে সেই উপধারা অনুযায়ী বিধি প্রণয়ন করতে বাধ্য।
১১. দরখাস্তকারীর পক্ষে আমাদের সামনে ১৬ ডিএলআর ৫৩৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত রায়টি (M. Norman os. Dacca Improvement Trust and others) (1964) 16 DLR 537) উদ্ধৃত করা হয়। রায়ের বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়ে আমি শুধু সম্মান রেখে বলতে চাই যে, আমি সেই রায়ের মতামতের সঙ্গে একমত পােষণ করতে অপারগ। সেই মামলায় ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী সার্ভিস রুলস প্রণয়ন ব্যতিরেকে প্রধান প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করায় ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ত্রুটি ধরা হয় এবং প্রধান প্রকৌশলীকে বরখাস্ত করার পদক্ষেপকে বাতিল ঘােষণা করা হয়। বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ, যারা উপরােক্ত মামলায় রায় প্রদান করেছেন, তাঁদের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখেই আমি কেবল বলতে চাই, প্রধান প্রকৌশলীকে দরখাস্তকারীর আগে নিয়ােগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের ট্রাস্টিবৃন্দের জন্য বিধি প্রণয়ন জরুরি ছিল না। কারণ, বেঙ্গল জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ১৭ ধারায় বিধৃত রয়েছে যে, নিয়ােগকারী কর্তৃপক্ষই বরখাস্তকারী কর্তৃপক্ষ। আর আমার মতে, চার্জশিট প্রদান এবং প্রয়ােজনীয় শুনানি প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়ম অনুসরণ করা হলে কোনাে কর্মচারীকে বরখাস্ত করার জন্য ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্টের জন্য এ বিষয়ে কোনাে বিধি প্রণয়নের প্রয়ােজন ছিল না।
১২. পূর্ববর্তী দফার লঙ্ঘন করে বা লঙ্ঘনের প্রয়াসের মাধ্যমে বা প্ররােচনা দিয়ে কোনাে সম্পত্তি জব্দ, আটক এবং বাজেয়াপ্তকরণ কিনা তা নির্ধারণ কোনাে আদালত বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক হতে হবে। এ বিষয়টি ধারা ৩-এর উপধারা (৩)-এর দফা (iii)-এ বিধিবদ্ধ রয়েছে। যদি উপধারা (৩)-এর দফা (iii) ও (২) উপধারার যে কোনাে দফার সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে, এই দুই উপধারায় আইনসভা কর্তৃক উল্লিখিত নির্দেশনামালার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। (২) উপধারায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে খুবই সাধারণভাবে। অন্যভাবে বলা যায়, তা নিছক ব্যাখ্যামূলক প্রকৃতির এবং কেন্দ্রীয় সরকার ৩(১) ধারায় উল্লিখিত কোনাে বিষয় বা সে-সংক্রান্ত কোনাে ব্যাপারে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা রাখেন, সেটার দিকনির্দেশনার জন্য উপধারা (২)-এ কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এটা আরাে পরিষ্কার হয় যখন
২২৭
কেউ উপধারা (২)-এর শুরুর কথাগুলাের দিকে নজর দেন। কিন্তু উপধারা (৩) ভিন্ন ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এই উপধারার কিছু দফায় কিছু বিষয় সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে এবং সেখানে দেওয়া নির্দেশনা ইতিবাচক প্রকৃতির বলে প্রতীয়মান হয়। (৩) উপধারার (iii) দফায়, আমার মতে, নির্দেশনা দেওয়া হয়। যে, যখনই বিধিমালার কোনাে বিধান লঙ্ঘন, লঙ্ঘনের চেষ্টা বা প্ররােচনার জন্য কোনাে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ বিধি প্রণয়ন করা হবে তখন (অর্থাৎ, বাজেয়াপ্তকরণ বিধি) অবশ্যই এরকম বাজেয়াপ্তকরণের অ্যাডজুডিকেশনে (বিচার)- কোন আদালত বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ করবে তা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করবে- সেটি থাকতে হবে। যদি ৩ ধারার (২) উপধারাকে উপরােক্ত আলােচনার ভিত্তিতে পড়া যায়, তাহলে যে উপসংহারে পৌঁছানাে যায় তা হলাে, যদি দফা (ii)-এ উল্লিখিত কারণসমূহের জন্য কোনাে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধি প্রণীত হয় এবং (৩) দফা অনুযায়ী অ্যাডজুডিকেশনের কোনাে বিধান না রাখা হয় তাহলে সেই বিধিকে খারাপ বা অকার্যকর বলা যাবে না, যদি না সেখানে (৩) উপধারার (iii) দফায় প্রদত্ত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকে। বর্তমান মামলায় বিধিমালার ৫২(২) বিধির অধীনেই বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ দেওয়া হয়েছে এবং এই ক্ষেত্রে অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপবিধির (৩) দফা দ্রষ্টব্য। এই বিধিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষমতা দেওয়া হলেও অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার দফা (iii) অনুযায়ী ‘অ্যাডজুডিকেশনের বিধান রাখা হয়নি।
১৩. এখন এটি বিবেচনা করতে হবে যে, অ্যাটর্নি জেনারেলের উত্থাপিত বক্তব্য অনুসারে ৩ ধারার (৩) উপধারা কেবল একটি সক্ষমতা প্রদানকারী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিধি-প্রণয়ন ক্ষমতা ৩ ধারার (১) উপধারা থেকে উদ্ভূত এবং ফলে (৩) উপধারার বিভিন্ন দফায় উল্লিখিত বিষয়াবলির জন্য বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে (৩) উপধারার বিভিন্ন দফা যেমন (ii), (iii) ও (vii) দফার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রতিপালনের প্রতি নজর না দেওয়ার স্বাধীনতা কেন্দ্রীয় সরকারের রয়েছে।
১৪. আমার কাছে (৩) উপধারার বিভিন্ন দফায় বিধি প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদত্ত নির্দেশনা বাধ্যতামূলক বলেই মনে হয়। উদাহরণস্বরূপ (৩) উপধারার (২) দফার কথা উল্লেখ করা যায়। এই দফায়, অনধিক ৭ বছর দণ্ড বা জরিমানা বা উভয় শাস্তির উল্লেখ করা হয়েছে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি ছিল যে, (৩) উপধারা কেবল একটি সক্ষমতা প্রদানকারী ধারা এবং (১) উপধারায় যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে সেহেতু এমনকি কোনাে আদেশ লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের চেষ্টা বা প্ররােচনার জন্য কারাে বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা, বিধি লঙ্নের জন্য শাস্তির বিধানসংক্রান্ত বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার স্বাধীন। নিঃসন্দেহে এটা সত্য যে, (৩) উপধারা একটি সক্ষমতা প্রদানকারী ধারা। কিন্তু প্রশ্ন হলাে, তার ব্যাপ্তি কতটুকু? আমার মতে, এটা কেবল ততক্ষণ পর্যন্তই সক্ষমতা প্রদানকারী যে, কেন্দ্রীয় সরকার উপধারার বিভিন্ন দফায় উল্লিখিত বিষয়ে বিধিও প্রণয়ন করতে পারেন, কিন্তু তার বেশি নয়। তারা উপধারার কিছু দফায় আইনসভা কর্তৃক প্রদত্ত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বিধি প্রণয়ন করতে পারেন। কিন্তু তারা কি (১) উপধারায় প্রদত্ত অথরিটির অধীনে এবং (৩) উপধারার (২) দফায় প্রদত্ত নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ৭ বছরের অধিক শাস্তির বিধান রেখে বিধি প্রণয়ন করতে পারেন? যদি তা-ই হয়, তাহলে তা কি অধ্যাদেশের বিধানেরই লজ্জন হিসেবে বিবেচিত হবে না? আমার মতে, তা লঙ্নই হবে। যদি বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি সঠিক হয়, তাহলে আইন প্রণেতারা (২) দফায় কারাদণ্ডের মেয়াদ উল্লেখ করতেন না এবং বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের বিচার-বিবেচনার উপর ছেড়ে দিতেন। কিন্তু আইন প্রণেতারা তা করেননি। এটা থেকে নিরাপদভাবেই বলা যায় যে, আইন প্রণেতা কেন্দ্রীয় সরকারকে অপরাধীর প্রসিকিউশন ও শাস্তিসংক্রান্ত বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দিলেও অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার কোনাে
২২৮
দফার অধীনে প্রণীত বিধির অধীনে জারিকৃত আদেশ লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ৭ বছরের বেশি শাস্তি দেওয়াকে প্রয়ােজনীয় বা সমীচীন মনে করেননি। আইন প্রণেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে এবং সচেতনভাবে শাস্তির মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং তা বিধি প্রণয়নের ক্ষমতাপ্রাপ্ত অধস্তন আইন প্রণয়ন কর্তৃপক্ষের ইচ্ছের উপর ছেড়ে দেননি। আমি অ্যাটর্নি জেনারেলকে যখন জিজ্ঞেস করি যে, কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমান ক্ষেত্রে বিধি। অনুযায়ী ৭ বছরের বেশি মেয়াদের শাস্তির বিধান করতে পারেন কিনা তিনি সরলভাবেই স্বীকার করেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার তা করতে পারেন না। যদি তা-ই হয় তাহলে এটা বলা যায় না যে, (৩) উপধারার (ii), (iii) ও (vii) দফায় প্রদত্ত নির্দেশনা এবং (২) উপধারার বিভিন্ন দফায় প্রদত্ত নির্দেশনার তাৎপর্য একই রকম। অন্য কথায় বলা যায়, যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা (১) উপধারা থেকে উদ্ভূত হয়েছে, (৩) উপধারার কোনাে দফার অধীনে বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা এই উপধারার কিছু দফায় প্রদত্ত সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা লঙ্ঘন করতে পারে। এই যুক্তি আরাে শক্তিশালী হবে যদি আমরা (৩) উপধারার (vii) দফার দিকে নজর দিই। (vii) দফায় এটা বলা হয়েছে যে, কোনাে বিধি বা আদেশ লঙ্ঘনের কারণে ঐ ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী ছাড়া অন্য কাউকে শাস্তি থেকে বাঁচানাের চেষ্টা করাকে নিষিদ্ধ করে বিধি প্রণয়ন করা যেতে পারে। এখন প্রশ্ন, যদি বিধি-প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ (৩) উপধারার (xii) দফায় প্রদত্ত বিষয়ে কোনাে বিধি প্রণয়ন করেন, তখন তাতে (vii) দফায় উল্লিখিত ক্যাটাগরিতে স্বামী বা স্ত্রী কাউকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন কি? আমার মতে, তা পারেন না। কারণ যদি স্বামী বা স্ত্রী কাউকে বাদ না দিয়ে কোনাে বিধি প্রণয়ন করা হয়, আমার মতে, সেই বিধি হবে বিধি-প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাবহির্ভূত এবং তার ব্যাপ্তি এতদূর যে বিধিটি খারাপ বলে বিবেচিত হবে। এই ব্যাপ্তি এবং উপরােল্লিখিত কারণসমূহ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা ৩ ধারার (১) উপধারা থেকে উদ্ভূত হয়, তবু (৩) উপধারার (ii), (iii) ও (vii) ইত্যাদি বিভিন্ন দফায় উল্লিখিত বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে উল্লিখিত দফাগুলাের অধীনে বিভিন্ন বিষয়াবলিতে বিধি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেই দফায় প্রদত্ত নির্দেশনা মান্য করতে সরকার বাধ্য। বর্তমান মামলায় গভর্নর কর্তৃক নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার ক্ষেত্রে ৫২(২) বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়ােগ করা হয়েছে। নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রকাশনার কাজে ব্যবহার করতাে, যেখানে উপরােল্লিখিত নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ অমান্য করে কিছু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। বিধি ৫২(২) প্রসঙ্গে ৩ ধারার (৩) উপধারার (iii) দফা। দ্রষ্টব্য। (৩) উপধারার (iii) দফার মতাে এখানে অ্যাডজুডিকেশনের বিধান রাখা হয়নি। সেক্ষেত্রে বিধি-প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ আইন প্রণেতাদের নির্দেশনা লঙ্ন করেছেন এবং ৫২(২) বিধিতে অ্যাডজুডিকেশনের বিধান না থাকাটা অধ্যাদেশের বিধানসমূহের লঙ্ঘন এবং তার ব্যাপ্তি এতটুকু যে, আমার মনে হয়, ৫২(২) বিধি অধ্যাদেশের (৩) উপধারার (৩) দফার আওতার বাইরে এবং পরিণামে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন জারিকত পিটিশনারের নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসসংক্রান্ত বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ আইনের চোখে খারাপ। প্রতিকারের বিধান ছাড়া কোনাে শাস্তি দেওয়া যায় না-আইনের এই সুপ্রতিষ্ঠিত নীতির অনুসরণেই আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আইন প্রণেতাগণও পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারায় বাজেয়াপ্তকরণের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে, আমার মনে হয়, এই নীতি বিস্মৃত হননি। ফলে, অ্যাডজুডিকেশন বিধান থেকে আইন প্রণেতাগণের উদ্দেশ্যও পরিষ্কারভাবে বােঝা যাবে। আমি স্বীকার করি যে, মামলার সব দিক, বিশেষত যে জাতীয় জরুরি অবস্থা আমরা অতিবাহিত করছি, তা উদ্বেগের সাথে বিবেচনা করার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এই প্রসঙ্গে ২৫(৩), ২৬(১), ৫১(৩), ৯২(২), ১৫৩(২), ১৯৮ ও ২০০(২) বিধির কথা উল্লেখ করা যায়। এসব বিধিতে সম্পত্তি জব্দ ও আটকের বিধান রাখা হয়েছে। জব্দ ও আটকের ক্ষেত্রে অ্যাডজুডিকেশনের প্রশ্ন আসে না।
২২৯
কিন্তু ৩ ধারার (৩) উপধারার (iii) দফায় উল্লিখিত বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিতে অ্যাডজুডিকেশনের বিধান রাখা বাধ্যতামূলক বলে প্রতীয়মান হয়।
১৫. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল তার যুক্তির সমর্থনে Eruperor os. Sibnath Banerji and others, AIR 1945 Privy Council 156 মামলায় প্রিভি কাউন্সিলের রায়ের উপর নির্ভর করেছেন।
১৬. কিন্তু এই মামলায়, ভারত প্রতিরক্ষা আইনে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার মতাে একই রকম একটি বিধান ছিল, যা বাের্ডের সম্মানিত সদস্যদের বিবেচনার আওতায় আসেনি। তারা কেবল পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ-এর (১) ও (২) উপধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ভারত রক্ষা আইনের বিধানসমূহই বিবেচনা করেছিলেন। অবশ্যই বাের্ড বলেছিলেন যে, (২) উপধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বিধান কেবল ব্যাখ্যামূলক। অধ্যাদেশ এবং তার অধীনে প্রণীত ৬২(২) বিধির ভাষা বেশ পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন এবং অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার (৩) দফায় ব্যবহৃত ভাষা থেকে সাধারণ ও প্রচলিত নীতি ব্যতিরেকে অন্য কোনাে ধরনের ব্যাখ্যার নীতি অনুসরণ না করেই আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য সহজেই উদ্ধার করা যায়। যদি মাথা না ঘামিয়ে এবং অন্য কোনাে কর্তৃত্ব/নজিরের সাহায্য না নিয়েই কেবল আইনের বিধানগুলাের সহজ-স্বাভাবিক পাঠ থেকেই আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য বােঝা যায়, তাহলে আদালতও আইনের শব্দগুলাের সহজ-স্বাভাবিক অর্থ দিতে বাধ্য। বর্তমান মামলায়, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, ৩ ধারার (৩) অধ্যাদেশের (iii) দফার কথাগুলাে পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন এবং কথাগুলাের মধ্যেই আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে এবং ফলে তা বােঝার উদ্দেশ্যে আমি কোনাে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্ত/অভিমতের সাহায্য নেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করিনি এবং কাউকে তা করার প্রস্তাবও করি না।
১৭. দরখাস্তকারী কর্তৃক উত্থাপিত দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিলাে তর্কিত আদেশটি ন্যাচারাল জাস্টিস’ নীতির যুক্তিতে খারাপ। বলা হয়, বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ জারি করার আগে বাজেয়াপ্তকারী কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল দরখাস্তকারীকে কারণ দর্শানাের সুযােগ দেওয়া। অভিযােগ করা হয়, দরখাস্তকারীকে এই সুযােগ না দেওয়ায় বাজেয়াপ্তকরণ আদেশের মাধ্যমে ন্যাচারাল জাস্টিস’ নীতির লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং ফলে এই যুক্তিতে তর্কিত আদেশটি বাতিল করে দেওয়া উচিত।
১৮. সন্দেহ নেই যে, বর্তমানে বিচারিক ঘােষণার মাধ্যমে ন্যাচারাল জাস্টিস’ নীতির আওতা নির্বাহী বিভাগের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তসমূহের উপর পর্যন্তও ব্যাপ্ত হয়েছে। তবে এটা অপরিবর্তনীয় বিধি নয়। এরকম পরিস্থিতি হতে পারে, যেখানে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার আগে কর্তৃপক্ষের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির পূর্ব-শুনানি করার সময় ছিল না। এরকম ক্ষেত্রে কেবল পূর্ব-শুনানি না হওয়ার কারণে আদালত কোনাে আদেশ বাতিল করবে না। বর্তমান ক্ষেত্রে, ৩ ধারার ৩ উপধারার (iii) দফায় অ্যাডজুডিকেশনের বিধান থাকায় আবেদনকারীর পূর্ব-শুনানির অধিকার গুরুত্ব হারায়। যদি এখানে বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে অ্যাডজুডিকেশনের কোনাে বিধান না থাকতাে, তবে ন্যাচারাল জাস্টিস’ নীতির ভিত্তিতে পূর্ব-শুনানির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতাে। সুতরাং, আমি মনে করি, অ্যাডজুডিকেশন বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান মামলায় দরখাস্তকারীর এই পয়েন্টের কোনাে গুরুত্ব নেই। রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে, তর্কিত আদেশের বিরুদ্ধে কোনাে বক্তব্য দেবেন কিনা তা দরখকাস্তকারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এবং তা আদেশেই উল্লেখ আছে। এটাই বাজেয়াপ্তকারী কর্তৃপক্ষের পক্ষে ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি মেনে চলার জন্য যথেষ্ট। ন্যাচারাল জাস্টিস প্রশ্নে আমাদের সুপ্রীম কোর্টের বেশ কয়েকটি রায় এবং Sayyid Abul A’la Maududi & others vs. The Government of West Pakistan & another
২৩০
(1965)17 DLR (SC) 209 মামলায় তারা যেভাবে এই নীতির প্রশ্নটির বিহিত করেছেন তার ভিত্তিতে আমি মনে করি না এই যুক্তি সমর্থনযােগ্য।
১৯. দরখাস্তকারীর পক্ষে আরেকটি যুক্তি ছিল যে, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার আদেশটি তফাজ্জল হােসেনের বিরুদ্ধে ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে জারি করা হয়েছে, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের ‘কিপার হিসেবে করা হয়নি। এর ভিত্তিতে জনাব কাসুরী দাবি করেন যে, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস ইত্তেফাক’-এর বিভিন্ন সংখ্যা মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে ব্যবহার করা হলেও এবং সরকারের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন করে নিবন্ধ প্রকাশ করার অভিযােগ থাকলেও তা বাজেয়াপ্ত করা যাবে না। কারণ সেই প্রেসের কিপারের বিরুদ্ধে কোনাে আদেশ জারি করা হয়নি। আমার মতে, এই যুক্তির কোনাে সারবত্তা নেই। এটা দরখাস্তকারী কর্তৃক স্বীকৃত যে, জনাব তফাজ্জল হােসেন দৈনিক ইত্তেফাক’-এর মালিক, মুদ্রাকর, প্রকাশক ও সম্পাদক এবং একই সঙ্গে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ও কিপার। ফলে, ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক তফাজ্জল হােসেনের বিরুদ্ধে জারি করা আদেশের কথা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ও কিপার হিসেবে তিনি জানতেন। নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘনের পরিণতি সম্পর্কেও তিনি জানতেন। আইনি অজ্ঞতাকে কেউ অজুহাত হিসেবে দাবি করতে পারেন না। ৫২ বিধির (২) উপবিধিতে বিধৃত রয়েছে যে, প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনাে প্রেস যদি নিষেধাজ্ঞামূলক আটকাদেশ জারি করা হয়েছে এমন বিষয়ে কোনাে সংবাদপত্র/কাগজ প্রকাশ করে, তাহলে নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘনের জন্য সরকার সেই প্রেসকে বাজেয়াপ্ত করতে পারে। জনাব কাসুরী এই অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন যে, আইনের চোখে জনাব তফাজ্জল হােসেন দুজন ব্যক্তি একটি ইত্তেফাক-এর মালিক, সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক এবং আরেকটি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ও কিপার। ফলে, যদি ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক তফাজ্জল হােসেনের কাছে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার নােটিশ পাঠানাে হয় এবং সেই প্রেসের মালিক ও কিপারের কাছে কোনাে নােটিশ না পাঠানাে হয়, তাহলে উক্ত আদেশের মাধ্যমে নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যাবে না। তাঁর মতে, সরকার যদি নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করতে চাইতাে, তাহলে তারা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের ‘কিপার হিসেবে তফাজ্জল হােসেনের কাছে নােটিশ পাঠাতাে। তফাজ্জল হােসেন নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ও কিপার এবং ইত্তেফাক-এর প্রকাশক, মুদ্রাকর ও সম্পাদক হওয়ায় সেই পত্রিকায় কোনাে আপত্তিকর লেখা/প্রবন্ধ নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসে ছাপা হওয়ার পরও জনাব তফাজ্জল হােসেনকে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ও কিপার হিসেবে নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘনের অপরাধে দোষী বলা যাবে না মর্মে জনাব কাসুরীর এই চুলচেরা যুক্তিতে কোনাে বলবত্তা খুঁজে পাই না। নােটিশ পাঠানাে ও তা জারির ক্ষেত্রে প্রযােজ্য সাধারণ নীতিমালা এবং এই বিষয়ে আদালত প্রণীত বিধিমালা ও নিয়মের অর্থ/ব্যাখ্যা অনুসারে, আমার কাছে মনে হয়, নিউ নেশন প্রেসের মালিক ও কিপার হিসেবে নােটিশ পাঠানাের পরিবর্তে ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে জনাব তফাজ্জল হােসেনের কাছে নােটিশ পাঠানাে যথার্থ ছিল। জনাব কাসুরীর যুক্তিতে কিছু ভার থাকতাে যদি ইত্তেফাক পত্রিকাটি উদাহরণস্বরূপ মওলানা আকরম খাঁর ‘আজাদ’ প্রেস থেকে ছাপা হতাে এবং ‘আজাদ’ প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের নােটিশ পাঠানাে হতাে ‘ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক তফাজ্জল হােসেনের কাছে। সুতরাং, আমি জনাব কাসুরীর এই যুক্তি মেনে নিতে অপারগ যে, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের জন্য প্রেসের মালিক ও কিপার তফাজ্জল হােসেনকে ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে নেটিশ জারি করার তর্কিত আদেশ আইনত এবং বাস্তবত খারাপ। আমি নির্দ্বিধায় জনাব কাসুরীর এই যুক্তি অগ্রাহ্য করছি।
২৩১
২০. এরপর জনাব কাসুরী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৬ ধারার প্রেক্ষাপটে যুক্তি দেখান যে, সংবাদপত্র বা প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার পরিবর্তে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অধ্যাদেশের বিধানাবলির আশ্রয় নেওয়া যেত। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৫ ধারা নিম্নরূপ :
“১৫. এই অধ্যাদেশের কর্তৃত্ববলে কার্যাধীন কোনাে কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি সাধারণ জীবন-জীবিকা ও সম্পত্তির অধিকার উপভােগের উপর জননিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যতটা কম সম্ভব হস্তক্ষেপ করবেন।”
২১. এই ধারার বিধানাবলি থেকে জনাব কাসুরী বলতে চেয়েছেন যে, মারাত্মক জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সংহতি ও প্রতিরক্ষার প্রসঙ্গ উঠলেও পাকিস্তানের কোনাে নাগরিকের বিরুদ্ধে ন্যূনতম পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভেবেছেন আইনপ্রণেতাগণ। তিনি দাবি করেন যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বদলে কর্তৃপক্ষ প্রেস ও পাবলিকেশন অধ্যাদেশের অধীনে অন্য কোনাে শাস্তি দিতে পারতাে। এই কথা বলার মাধ্যমে তিনি ১৫ ধারার সেই অংশটুকুর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যেখানে সাধারণ জীবন-জীবিকা ও সম্পত্তির অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, সাধারণ জীবন-জীবিকা ও সম্পত্তিরঅর্থাৎ ১৫ ধারা অনুযায়ী জনাব তফাজ্জল হােসেনের প্রেস- অধিকারের উপর ন্যূনতম হস্তক্ষেপ না করার বদলে তাকে তার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যা ১৫ ধারার লঙ্ঘন। আমার বলতেই হচ্ছে, জনাব কাসুরীর এই যুক্তি এক মিনিটও টিকতে পারে না। যদি কোনাে অপরাধীর বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুটি আইন থাকে, সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রতিটি মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যেটা যথার্থ মনে করেন সেই আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। এই বিষয়টি ইতােমধ্যে আমাদের আদালতসমূহ এবং অন্যান্য দেশে আরাে বেশ আগে থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত। এ প্রসঙ্গে ইমার্জেন্সি রিকুইজিশন অব প্রপার্টি অ্যাক্ট-এর অধীনে দায়েরকৃত মামলায় এই হাইকোর্ট ও আমাদের সুপ্রীম কোর্টের বিভিন্ন রায়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে মামলার কয়েক পক্ষ অজুহাত উত্থাপন করেছিল যে, সরকারি কাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণের জন্য ওই আইন (ইমার্জেন্সি রিকুইজিশন অব প্রপার্টি অ্যাক্ট) ছাড়া অন্য আইন— অর্থাৎ, ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট বলবৎ ছিল। এরকম যুক্তি আদালত সবসময় নাকচ করে দিয়েছে। ফলে, এটা বেশ পরিষ্কার যে, জনাব কাসুরীর এই দাবির কোনাে সারবত্তা নেই। এই বিষয়ে আলােচনা শেষ করার আগে আমি এই অভিমত দিতে চাই যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির অধীনে কৃত কোনাে অপরাধসংশ্লিষ্ট মামলার ক্ষেত্রে ১৫ ধারার বিধানাবলির সাহায্য নেওয়া যায় না। ১৫ ধারার বিধানাবলি বিশেষ প্রেক্ষাপটের জন্য প্রণীত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যখন জরুরি পরিস্থিতিতে কজন নাগরিকের ১০ কক্ষের বাড়ির ২টি কক্ষে এয়ার রেইড ওয়ার্ডেন পােস্ট স্থাপনের দরকার হয়, তখন আইনপ্রণেতাদের নির্দেশনা হলাে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে দুটি কক্ষের মালিকানা ও দখলে নিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট নাগরিকের অসুবিধা করে এবং বাকি আট কক্ষ উপভােগের অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করে পুরাে বাড়িটাই নিয়ে নেবে না। অথবা, যখন জরুরি পরিস্থিতিতে সরকারি কাজের জন্য একজন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির সেবার প্রয়ােজন হয়, যিনি সরকারি চাকুরে নন, এরকম ক্ষেত্রে তার স্বাভাবিক জীবন-জীবিকার উপর হস্তক্ষেপ হতে হবে ন্যূনতম এবং ততদূর পর্যন্ত যতদূর রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন বেসরকারি টাইপিস্টকে জরুরি অবস্থা চলাকালীন রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যে কোনাে বাজে কাজের জন্য, ধরা যাক দিনে চার ঘণ্টা, রিকুইজিশন করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিল, তখন কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশনা হলাে তাকে ২৪ ঘণ্টার জন্য নয়, ৪ ঘণ্টার জন্যই রিকুইজশন দেওয়া, বাকি ২০ ঘণ্টা তার স্বাভাবিক | জীবন-জীবিকা নির্বাহ করার জন্য রাখা। এভাবে এটা পরিষ্কার যে, বর্তমান ক্ষেত্রে আবেদনকার প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫-এর বিধানাবলির আশ্রয় নিতে পারবেন না।
২৩২
২২. জনাব কাসুরির পরবর্তী যুক্তি ছিল যে, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের সাতটি প্রিন্টিং মেশিন ছিল, এবং এর মধ্যে মাত্র চারটি দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশনার কাজে ব্যবহার করা হতাে। সেই পত্রিকায় আক্রমণাত্মক লেখা/প্রবন্ধ প্রকাশিত হতাে। সুতরাং চারটির বেশি প্রিন্টিং মেশিনসম্বলিত সম্পূর্ণ নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার আদেশটি খারাপ। কারণ সেই মেশিন ও প্রেসের অন্য যন্ত্রপাতিগুলাে ইত্তেফাক’-এর আক্রমণাত্মক সংখ্যাগুলাে মুদ্রণের জন্য ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৬০ সালের প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের, সেই ২ ধারার
(কে) ও (এল) দফার অধীনে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ও কিপার জনাব তফাজ্জল হােসেন ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের কাছে একটি ডিক্লারেশন দাখিল করেছিলেন (যা বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন)। ২ ধারার (কে) ও (এল) প্রদত্ত ‘প্রেস’ ও ‘প্রিন্টিং প্রেস’-এর সংজ্ঞা নিম্নরূপ :
(কে) ‘প্রেস’ বলতে প্রিন্টিং প্রেস, সেখানকার সকল মেশিন, সরঞ্জাম, প্ল্যান্ট ও অংশ এবং ডকুমেন্ট মাল্টিপ্লাই করার কাজে ব্যবহৃত সব জিনিসকে অন্তর্ভুক্ত করে।
(এল) প্রিন্টিং প্রেস’ বলতে ইঞ্জিন, মেশিনারি, টাইপ, লিথােগ্রাফিক স্টোন, সরঞ্জাম (ইমপ্লিমেন্ট), চিমটি এবং প্রিন্টিংয়ের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য প্ল্যান্ট বা জিনিসকে অন্তর্ভুক্ত করে।
২৩. এই দুটি দফায় ‘প্রেস’ ও ‘প্রিন্টিং প্রেস’-এর সংজ্ঞা থেকে এটা পরিষ্কার যে, কোনাে অনুমােদিত প্রেস বা প্রিন্টিং প্রেস বলতে একটি প্রিন্টিং প্রেস ও তার সব মেশিন, ইমপ্লিমেন্টস, প্ল্যান্ট ও কোনাে অংশ এবং ডকুমেন্ট মাল্টিপ্লাই করার জন্য কোনাে ম্যাটেরিয়ালস, ইঞ্জিন, মেশিনারি, টাইপ, লিথােগ্রাফিক স্টোন, চিমটি এবং মুদ্রণের জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য প্ল্যান্ট বা ম্যাটেরিয়ালসকে অন্তর্ভুক্ত করে। নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ও কিপার হিসেবে জনাব তফাজ্জল হােসেন ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের কাছে যে ঘােষণাপত্র জমা করেছিলেন তা থেকে আমরা এমন কিছু পাই না যাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস নামে পরিচিত প্রেসটিকে, যেখান থেকে ইত্তেফাক প্রকাশিত হতাে, কেবল ৪টি মেশিন রাখার অনুমােদন দেওয়া হয়েছিল। অন্য কথায়, উপরােক্ত সব মেশিন ও অন্যান্য জিনিসপত্র সাধারণভাবে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এর অধীনে ‘প্রেস’– নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস নামে অনুমােদিত প্রেসের উপাদান বলা যায় এবং এ সকল জিনিসই সেই প্রেসের অন্তর্ভুক্ত এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসে এক বা একাধিক মুদ্রণযন্ত্র থাকুক কিংবা সেই একটি বা একাধিক মুদ্রণযন্ত্র সেই আক্রমণাত্মক কাগজ ছাপানাের জন্য ব্যবহৃত হােক না কেন, তা অবশ্যই পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে একটি ইউনিট হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে, আমি দরখাস্তকারীর এই যুক্তিতে কোনাে মেরিট খুঁজে পাই না। এই প্রসঙ্গে জনাব কাসুরী বলেন, যদিও তর্কিত আদেশটি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসসংক্রান্ত, তবু কর্তৃপক্ষ প্রেস প্রাঙ্গণের ভেতরের পাখা, টেবিল, চেয়ার, র্যাক ইত্যাদিও বাজেয়াপ্ত করেছে। দরখাস্তকারী তার আবেদনে দাবি করেন যে, যে ভবনে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস ছিল সেই ১, রামকৃষ্ণ মিশন রােডস্থ বাড়িটি বাজেয়াপ্ত ও সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিপক্ষ এই দাবি অস্বীকার করেন এবং জনাব কাসুরী আমাদের বলেন যে, ১, রামকৃষ্ণ মিশন রােডের পাকা ভবন নয় বরং এটি ‘এল’ সাইজের একটি আধাপাকা কাঠামাে, যেখানে অবস্থিত ছিল প্রেস- সেটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে এবং এখানে থাকা প্রিন্টিং প্রেসের সাথে সম্পর্ক নেই এমন অন্যান্য জিনিসপত্র। আমার কোনাে সন্দেহ নেই যে, কর্তৃপক্ষ নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস (প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স-এর সংজ্ঞানুযায়ী) ছাড়া অন্য কিছু বাজেয়াপ্ত করেনি এবং তা করার কোনাে উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। যা ঘটেছে তা হলাে, প্রেস ভবনটি বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ বাস্তবায়নের সময় প্রেস হাউজ বন্ধ ও সিল মারা হয়েছে, যেখানে প্রেসসংশ্লিষ্ট ছাড়াও আরাে কিছু জিনিস ছিল। সেজন্য এটা বলা যাবে না যে, এই বাড়াবাড়ির কারণে তর্কিত আদেশটি মন্দ হয়েছে।
২৩৩
২৪. এরপর দরখাস্তকারীর পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে, তর্কিত আদেশটি সত্যায়ন করেছেন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একজন সেকশন অফিসার। ফলে তা যথাযথ ও বৈধভাবে তৈরি করা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের রুলস অব বিজনেস-এ বিধৃত রয়েছে যে, গভর্নরের কোনাে আদেশ সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি কিংবা সেকশন অফিসার সত্যায়ন করতে পারেন। সুতরাং, তর্কিত আদেশটি একজন সেকশন অফিসার কর্তৃক সত্যায়িত হওয়ায় তার বৈধতা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন উঠতে পারে না। বিধায়, দরখাস্তকারীর এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করা হলাে।
২৫. দরখাস্তকারীর পরবর্তী যুক্তি ছিল যে, আদেশটি যেহেতু গভর্নরের নামে জারি করা হয়েছে, সেহেতু এটা অবশ্যই গভর্নরের ব্যক্তিগত সন্তুষ্টিতে হতে হবে। আর এই সন্তষ্টি’ অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। বর্তমান মামলায় গভর্নরের সন্তুষ্টি অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়ার কোনাে প্রশ্ন আসে না। আদেশটি পরিষ্কারভাবে বলে যে, গভর্নর সন্তুষ্ট হয়েই আদেশটি জারি করেছেন। এটি কেবল সত্যায়ন এবং স্বাক্ষর করেছেন একজন সেকশন অফিসার। ফলে, গভর্নরের সন্তুষ্টির বিষয়টি অন্যের উপর ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নটি বর্তমান মামলায় রয়েছে।
২৬. এরপর যুক্তি দেখানাে হয় যে, তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণ আদেশটি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৫ ধারার লঙ্ঘন করে করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এর অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু সেই অধ্যাদেশের অধীনে আদেশটি জারি করা হয়নি এবং সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ, প্রেসটিকেই বাজেয়াপ্তকরণের শাস্তি দিয়ে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনেই জারি করা হয়েছে। সুতরাং তা অবশ্যই অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণােদিত ছিল। এই প্রশ্নে জনাব ক বলেন, ইত্তেফাক’ বিরােধী ধারার পত্রিকা হওয়ায় এবং বর্তমান প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের সমালােচনায় মুখর থাকায় বিরােধী পক্ষের টুটি চেপে ধরার জন্য তর্কিত আদেশটি জারি করা হয়েছে। আমি যখন তাঁকে “বিরােধী পত্রিকা”র সংজ্ঞায়ন করতে এবং ইত্তেফাককে সেই ক্যাটাগরিতে ফেলতে বলি, তখন তিনি তা করতে পারলেন না। আবেদনপত্রে যেসব অসৎ উদ্দেশ্যের অভিযােগের উল্লেখ করা হয়েছে তা প্রতিপক্ষ কঠোরভাবে অস্বীকার করেন। প্রতিপক্ষ হলফনামা-জবাবে তা সাফল্যের সঙ্গে খণ্ডন করেছেন এবং এটা বলা যায় যে, আবেদনকারী বর্তমান মামলায় তথ্য-উপাত্তের দিক থেকে অসৎ উদ্দেশ্য প্রমাণ করেননি বা করতে পারেননি। ফলে, দরখাস্তকারীর বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব কামাল হােসেন নিবেদন করেন যে, এটা আইনগতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে প্রণােদিত। আমি ইতােমধ্যে দরখাস্তকারীর উত্থাপিত অন্য একটি প্রশ্ন-প্রসঙ্গে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৫ ধারা নিয়ে আলােচনা করেছি এবং সেখানে আমার যুক্তি ও পর্যবেক্ষণসমূহ বর্তমান প্রশ্নের সঙ্গে সম্পর্কিত ১৫ ধারার বিধানাবলির ক্ষেত্রেও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।
২৭. এখন, দরখাস্তকারীর বিরুদ্ধে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এর বিধানাবলির পরিবর্তে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের বিধানাবলি অনুযায়ী শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে এই মতে আসতে আমার কোনাে দ্বিধা নেই যে, প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের পরিবর্তে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের বিধানাবলি অনুযায়ী তর্কিত আদেশটি জারি করা আইনগতভাবে অসৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত নয়। কারণ, কোনাে সুনির্দিষ্ট ঘটনার বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসার ক্ষেত্রে একের অধিক আইন থাকলে কোন সুনির্দিষ্ট আইনি বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তা কর্তৃপক্ষের হাতে। এক্ষেত্রে মামলার তথ্য-উপাত্ত ও ঘটনা বিবেচনায় নিতে হবে এবং পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোনাে একটি নির্দিষ্ট আইনের আশ্রয় না নিয়ে অন্য আইনের আশ্রয় নিয়েছেন কর্তৃপক্ষের এমন কর্তৃত্ব নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলতে পারেন না।
২৮. এরপর দাবি করা হয় যে, দৈনিক ইত্তেফাক’-এ যেসব প্রবন্ধ প্রকাশ করার মাধ্যমে ৭ এপ্রিল, ২ জুন ও ৭ জুনের নিষেধাজ্ঞামূলক আটকাদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে দাবি করা হচ্ছে সেগুলাে আক্রমণাত্মক বা
২৩৪
নিষেধাজ্ঞা আদেশের লঙ্ঘনমূলক নয়। সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রিট এখতিয়ারের অধীনে বসে আমি এসব লেখা/প্রবন্ধের গুণাগুণ বিচার করতে পারি না। ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমার ক্ষমতা কেবল চ্যালেঞ্জকৃত আদেশটি আইন অনুযায়ী এবং কর্তৃত্বের অধীনে জারি করা হয়েছে কিনা তা দেখা। যদিও বর্তমান মামলার তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ অমান্য করার জন্য প্রেস বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত অবশ্যই বাজেয়াপ্তকারী কর্তৃপক্ষের বিষয় এবং তা কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টির উপর ভিত্তি করে হতে হবে। তবু আমরা আক্রমণাত্মক লেখাগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি না এই সহজ কারণে যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার (iii) দফায় আদালত বা সরকার কর্তৃক নিয়ােজিত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিষয়টির গুণাগুণ বিচারের বিধান রয়েছে এবং এই আদালত উক্ত কাজের জন্য নিযুক্ত নয়। মামলার ঘটনা বিবেচনায় এই আদালত তা করতেও পারে না। আমি যেটা করতে পারি তা হলাে, মামলার কার্যক্রম চালানাের মতাে কোনাে উপাদান রয়েছে কিনা সেদিকে দৃষ্টি সময় Sayyid Abul A’la Maududi & others vs. The Government of West Pakistan and another 1965 (DLR) SC209 মামলায় মাননীয় বিচারপতি হামুদুর রহমানের পর্যবেক্ষণ আমার উপর বাধ্যকর। যেসব বিষয়ে লেখা প্রকাশ না-করার জন্য তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ জারি করা হয়েছে এবং কী অমান্য করার জন্য তর্কিত আদেশটি জারি করা হয়েছিল তা বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন এবং আবেদনপত্রের সঙ্গে তা সংযুক্ত করা হয়েছে। এগুলাের দিকে দৃষ্টি দিলে আমার পক্ষে এটা বলা সম্ভব নয় যে, তর্কিত আদেশটি জারি করার সমর্থনে বাজেয়াপ্তকারী কর্তৃপক্ষের কাছে কোনাে বিষয়বস্তু ছিল না।।
২৯. এরপর দরখাস্তকারীর পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয় যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর এবং প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক তার কর্মকর্তাদের কাছে তা হস্তান্তর আইনত দোষণীয়। দরখাস্তকারীর এই যুক্তিরও কোনাে ধরনের সারবত্তা নেই বলেই আমার মনে হয়। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) ও (৫) উপধারা নিম্নরূপ :
(4)The Central Government may by order direct that any power or duty which by rules under sub section (1) is considered or imposed upon the Central Government shall in such circumstances and under such conditions, if any, as may be specified in the direction be exercised or discharged.
(a) by any officer or authority subordinate to the Central Government, or
(b) by any Provincial Government or by any officer of authority
subordinate to such Government, or
|
(c) by any other authority.
(5) A Provincial Government may by order direct that any power or duty which has been directed under sub section (4) to be exercised or discharged by the Provincial Government, shall, in such circumstances and under such conditions, if any, as may be specified in the direction, be exercised or discharged by any officer or authority, not being an officer or authority subordinate to the Central Government.
২৩৫
এই দুটি ধারাই আবেদনকারীর আপত্তির বিরুদ্ধে পরিষ্কার জবাব। আইন অনুযায়ী কোনাে কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তার ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেই হস্তান্তরিত ক্ষমতা পুনঃহস্তান্তর করার ক্ষমতা প্রদানের এখতিয়ার আইনসভার রয়েছে। যখন আইনপ্রণেতাগণ কর্তৃক কোনাে আইনে ক্ষমতা হস্তান্তর, পুনঃহস্তান্তরের বিধান রাখা হয়, তখন সেই ক্ষমতা হস্তান্তর বা পুনঃহস্তান্তর কিংবা সেই হস্তান্তরিত বা পুনঃহস্তান্তরিত ক্ষমতাবলে গৃহীত কোনাে পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ বা প্রশ্ন করা যাবে না।
৩০. দরখাস্তকারী অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) ও (৫) উপধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন, এই যুক্তিতে যে, এগুলাে সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যুক্তি দেওয়া হয় যে, উপরােক্ত ২ উপধারা অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকারের কাছে ক্ষমতা অর্পণ কেবল সংবিধানের ১৪৩ (১) ও (২) অনুচ্ছেদের কঠোর অনুসরণের মাধ্যমেই করা যাবে। বলা হয়, যেহেত, স্বীকতভাবেই প্রাদেশিক সরকারের সম্মতি নেওয়া হয়নি এবং পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ যেহেতু সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ কর্তৃক পাসকৃত কোনাে আইন নয়’, সেহেতু, প্রাদেশিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সংবিধানের লঙ্ঘন। এই প্রসঙ্গে সংবিধানের ২৮, ১৩৫, ১৩৬, ১৪৩ (১) ও (২) অনুচ্ছেদ এবং প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) ও (৫) উপধারার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
Article 28 of the Constitution :
“When the President has assented to or is deemed to have assented to, a Bill passed by the National Assembly, it shall become law and shall be called an Act of the Central Legislature!!
Article 135 of the Constitution :
“The executive authority of the Republic extends-
(a) to all matters with respect to which the Central Legislature has exclusive
power to make laws under clause (1) of Article 131;
(b) where a law made by the Central Legislature in pursuance of clause (2),
clause (3) or clause (4) of Article 131 provides that the law shall be
administered by the Central Government to the execution of that law; and
(c) in relation to a part of Pakistan not forming part of a province to all matters.
Article 136 of the Constitution:
“(1) Subject to clause (2) of this Article, the executive authority of the province extends to all matters with respect to which the Legislature of the province has power to make laws.
The executive authority of a province does not extend to the execution of a law made by the Central Legislature to which paragraph (b) of Article 135 applies.
Article 143 (1) and (2) of the Constitution :
“143- (1, Notwithstanding anything in this Constitution, the President may, with the consent of a Provincial Government, entrust either conditionally or
২৩৬
unconditionally to that Government, or to any officer or authority of that Government, functions in relation to any matter to which the executive authority of the Republic extends.
(2) “An Act of the Central Legislature may, notwithstanding that it relates to a matter with respect to which a Provincial Legislature has no power to make laws, confer powers and impose duties, or authorize the conferment of powers and the imposition of duties, upon a Provincial Government or officers or authorities of a Provincial Government.”
Sub sections (4) & (5) of section 3 of the Defense of Pakistan Ordinance :
(4)The Central Government may by order direct that any power or duty which by rules under sub-section (1) is conferred or imposed upon the Central Government shall in such circumstances and under such conditions, if any, as may be specified in the direction be exercised or discharged
(a) by any officer or authority subordinate to the Central Government, or
(b) by any Provincial Government or by any officer or authority
subordinate to such Government, or
(c) by any other authority.
(5) A Provincial Government may by order direct that any power or duty which has been directed under sub-section (4) to be exercised or discharged by the Provincial Government, shall, in such circumstances and under such conditions, if any, as may be specified in the direction, be exercised or discharged by any officer or authority, not being an officer or authority subordinate to the Central Government.
৩১. দরখাস্তকারীর পক্ষে উপস্থাপিত এই যুক্তির প্রত্যুত্তরে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন যে, সাংবিধানিক
দলিলপত্রের ব্যাখ্যা ও গঠনের নিয়ম অনুসারে, সাংবিধানিক দলিলপত্রের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব উদার ও বিস্তৃত ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। সেগুলাের সংকীর্ণ ও অনুদার ব্যাখ্যা করা উচিত নয়। তিনি এক্ষেত্রে Mohammad Nur Hussain vs. The province of East Pakistan and others, 11 DLR (SC) (1959) 423 72103 আমাদের সুপ্রীম কোর্টের রায় এবং James 0s. Commonwealth of Australia, 1935(SC) 578 মামলার রায়ের উপর নির্ভর করেছেন। তিনি দাবি করেন যে, ১৪৩ অনুচ্ছেদ একটি ক্ষমতা প্রদানকারী বিধান এবং তার জন্য প্রাদেশিক সরকারের পূর্বসম্মতির প্রয়ােজন হয় না। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, প্র সরকারের সম্মতির বিষয়টি তার কর্মকাণ্ড থেকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। এ-প্রসঙ্গে তিনি ৩০(১)(ক) অনুচ্ছেদের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, যেখানে সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা এবং অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেখানে অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রাদেশিক সরকারের কাছে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করার ক্ষেত্রে তার কর্তৃত্বের উপর কোনাে সীমাবদ্ধতা
২৩৭
আরােপ করা হয়নি। তাঁর মতে, যদি অধ্যাদেশের অধীনে প্রেসিডেন্টের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণের বিষয়টি প্রাদেশিক সরকারের পূর্বসম্মতি সাপেক্ষ হয় তাহলে সেই ক্ষমতা সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। সংবিধানের ৩০(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সাপেক্ষে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং এই অনুসারে প্রণীত অধ্যাদেশ কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ কর্তৃক প্রণীত আইনের মতাে সমান মান্যতা পাবে। ৩০ অনুচ্ছেদের (৮) উপ-অনুচ্ছেদে বিধৃত রয়েছে যে, এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা কেবল কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেন্দ্রীয় সরকারের আইন প্রণয়ন করার ক্ষমতা কেবল ১৩১ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিষয়েই ব্যাপ্ত নয়, বরং ১৪৩(২) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত অন্যান্য বিষয়েও ব্যাপ্ত। ফলে, দেখা যায় যে, ৩০(৪) অনুচ্ছেদ ও তার সঙ্গে পঠিত সেই অনুচ্ছেদের (৮) উপ-অনুচ্ছেদের অধীনে প্রণীত কোনাে অধ্যাদেশ সংবিধানের ১৪৩(২) অনুচ্ছেদের। অধীনে, কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ যা করতে পারে, তা করতে সক্ষম। ৩০ অনুচ্ছেদের (২) উপ-অনুচ্ছেদের বিধানাবলির দৃষ্টিকোণ থেকে ৩০ অনুচ্ছেদের অধীনে প্রণীত অধ্যাদেশের মান্যতা কেন্দ্রীয় আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইনের মতাে সমান থাকে না। এর ফলে ১৪৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলিকে আকৃষ্ট করে না মর্মে দরখাস্তকারীর যুক্তি অসমর্থনীয় এবং অগ্রহণযােগ্য। তাছাড়া দেখা যাবে যে, সংবিধানের কোথাও এমন ইঙ্গিত নেই যে, যেখানেই Act of legislature’ কথাটা ব্যবহার করা হােক না কেন কোথাও অধ্যাদেশকে বাদ দেওয়া হয়নি। জাতীয় পরিষদ যা করতে সক্ষম ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট যে তা করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত এই ব্যাপারটা আরাে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যদি সংবিধানের ২২৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলির প্রসঙ্গ টানা যায়। সাংবিধানিক দলিলপত্রের ব্যাখ্যা সংকীর্ণ ও অনুদার নয়, বরং বৃহত্তর ও বিস্তত ব্যাখ্যা প্রদান মানদণ্ড অনুযায়ী ১৪৩ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি পাঠ করলে দেখা যাবে, আইন পরিষদ প্রণীত আইন এবং অধ্যাদেশের মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। ফলে, ১৪৩ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত প্রাদেশিক সরকারের সম্মতি অপরিহার্যভাবে আগেই নিতে হবে না বা ঘােষিত হতে হবে না। সুতরাং, আমার মত হলাে, অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) উপধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক সরকারের উপর আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ ও কর্তব্য আরােপ করা বৈধ ও আইনসম্মত। প্রাদেশিক সরকারের আচরণ থেকেই তা অনুমান করা যায়। যেমন, প্রাদেশিক সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক তাকে এমন ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে যা সাধারণ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় নির্বাহী বিভাগের আওতাধীন ছিল। ১৪৩ অনুচ্ছেদের সম্মতি শব্দটি সরলার্থসূচক, নিষেধাজ্ঞামূলক নয় এবং তা পরােক্ষ সম্মতিকে বাদ দেয়নি। যেখানে কোনাে আইন ‘সম্মতির প্রশ্নে সংবিধানে নিষিদ্ধ, তখন সেই আইন ১৪৩ অনুচ্ছেদের চেয়ে ভিন্নভাবে হতে হবে। যেরক উদাহরণ সংবিধানের ১৪০ (২) ও (৪) এবং ৯৯ (১) অনুচ্ছেদে সহজেই পাওয়া যাবে। বর্তমান ক্ষেত্রে কোনাে সন্দেহ নেই যে, এই হস্তান্তরিত ক্ষমতার ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারের পরােক্ষ সম্মতি ছিল এবং আমার মতে, ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে উদ্ভূত জাতীয় জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রাদেশিক সরকার সম্মতি দেয়নি তা ভাবার কোনাে কারণ নেই। তাছাড়া, যেসব ব্যাপারে কেন্দ্রীয় আইন প্রণীত হয় সেসব ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেই, তা সত্তেও সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে কে ক্ষমতা হস্তান্তর ও দায়িত্ব অর্পণ করবে কিংবা ক্ষমতা হস্তান্তর ও দায়িত্ব অর্পণের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় আইনসভার আইনকে দেওয়া হয়। সংবিধানের ৩০ ধারা অনুযায়ী প্রণীত অধ্যাদেশের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় পরিষদের আইনের সমান হওয়ায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে বৈধভাবে প্রাদেশিক সরকার ও তার কর্মকর্তাদের উপর ক্ষমতা হস্তান্তর ও দায়িত্ব অর্পণ করা যায় এবং বর্তমান ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। সুতরাং, আমি দরখাস্তকারীর এই যুক্তিতে কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাই না যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা
২৩৮
অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) ও (৫) উপধারার অধীনে হস্তান্তরিত কর্তৃত্বের বলে প্রাদেশিক সরকার ও এর কর্মকর্তাবৃন্দ যে ক্ষমতা প্রয়ােগ করেছেন তা অবৈধ বা অসাংবিধানিক। অ্যাটর্নি জেনারেল বর্তমান ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রাদেশিক সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রসঙ্গে ‘Salus Populi Suprerna_Lex নীতিমালার উপর নির্ভর করেছেন। কারণ, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ উপরােল্লিখিত সম্ভাব্য অ্যাভেইলেবল সুস্পষ্ট আইনি বিধানাবলির আলােকে আইনসিদ্ধ এবং বৈধ।।
৩২. এরপর দরখাস্তকারীর যুক্তি ছিল যে, তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণ আদেশটি এই কারণেও খারাপ যে, তাতে অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) উপধারা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী জারিকৃত আদেশের সঙ্গে সংযুক্ত তফসিলের ২ নম্বর কলামের শর্তাদি ১ নম্বর কলামে উল্লিখিত ৫২ বিধির আলােকে প্রতিপালিত হয়নি। ১৯৬৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার নিমােক্ত আদেশ জারি করেন :
“In exercise of the powers conferred by sub-section (4) of section 3 of the Defense of Pakistan Ordinance, 1965, the Central Government is pleased to direct that the powers and duties of the Central Government under the Defense of Pakistan Rules specified in column No. 1 of the schedule below shall, in the circumstances and under the conditions, if any, specified in column 2 of the schedule, be exercised and discharged in the Provinces by the Provincial Government concerned.”
৩৩. এই আদেশের সঙ্গে ২ কলামের একটি তফসিল সংযুক্ত করা হয়েছিল। প্রথম কলামে বিধিসমূহ উল্লেখ করা হয় এবং দ্বিতীয় কলামে কোন কোন পরিস্থিতি এবং কোন কোন শর্তসাপেক্ষে আইন প্রণয়নের জন্য অর্পিত ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রয়ােগ ও পালন করতে হবে তা উল্লেখ করা হয়। তফসিলের ২ নম্বর কলামে ৪৬ বিধির বিপরীতে যেসব পরিস্থিতি ও শর্ত উল্লেখ করা হয় তা নিম্নরূপ :
“Column I
Column II
Rule 46 1. The powers shall be exercised only when –
(a) no orders in this behalf have been made by the Central Government;
and
(b) it is not possible to obtain immediate orders of the Central
Government.
2. A report shall be made to the Central Government of any action taken by the Provincial Government under this rule.
The circumstances and Conditions mentioned against rules 51, 52, 56 and 56 are as follows:
“Column I
Column II
Rules 61, 62, 55 & 56
The same condition as mentioned against rule 48.
২৩৯
On the 7th of April, 1966, the Central Government by Notification No. S R.O. 43(R)/66 amended entries against rule 46 by substituting those by the following:
“A report shall be made to the Central Government of any action taken by the
Provincial Government under this Rule.”
৩৪. দরখাস্তকারী কর্তৃক এই যুক্তি দেওয়া হয় যে, ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিলের সংশােধনীর মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত ৪৬ বিধির বিপরীতে প্রথমে যুক্ত পরিস্থিতি ও শর্তাদি সূত্র হিসেবে ৫১, ৫২, ৫৫ ও ৫৬ বিধির ক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে প্রযােজ্য করা হয়। ফলে, বর্তমান ক্ষেত্রে ৪৬ ধারার বিপরীতে উল্লিখিত শর্তাদি যা ৫২ বিধির জন্যও প্রযােজ্য তা প্রতিপালিত না হওয়ায় তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণের আদেশটি আইনত খারাপ। সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক ক্ষমতা প্রয়ােগের শর্তাদি ও পরিস্থিতি উল্লেখ সংবলিত অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) উপধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক জারিকৃত আদেশকে কল্পনার রং চড়িয়েও আইন বলা যাবে না। এটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল। এটা আইন নয়। এটা সম্পূর্ণতই একটি নির্বাহী আদেশ। আইন প্রণয়নের নীতিমালা নির্বাহী আদেশের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হয় না এবং এটা তৎসময়ের তাৎপর্য বিবেচনা করেই পড়তে হবে। ফলে, ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিলের সংশােধন-পূর্ব ৪৬ ধারার বিপরীতে উল্লিখিত শর্তাদি ও পরিস্থিতি ৭ এপ্রিলের নতুন আদেশে প্রতিস্থাপিত শর্তাদি তথা কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানানাের শর্ত ৫২ ধারার জন্য প্রযােজ্যতা রয়ে যাওয়ায়, সংশােধন-পূর্ব শর্তাদি ও পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনাে প্রশ্ন নেই। তফসিলের ৪৬ বিধির বিপরীতে উল্লিখিত পূর্বতন শর্তাদি ও প্রেক্ষাপট নতুন শর্তাদি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ায় এবং সেগুলাের সূত্রে ৫২ ধারা প্রযােজ্য করায়, প্রাদেশিক সরকারের বাধ্যবাধকতা থাকে কেবল তর্কিত আদেশসংক্রান্ত ব্যাপারে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানানাে। সুতরাং, আমি দরখাস্তকারীর এই যুক্তিতে কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাই না।
৩৫. বর্তমান দরখাস্তকারী ও হলফনামাদাতা জনৈক মােতাহার হােসেন সিদ্দিকী সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ১৯৬০ সালের ১৫৩ ও ১৬০ নম্বর পিটিশনেও এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। আমার বিজ্ঞ বিচারপতি আবদুল্লাহকে নিয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ ডিভিশন বেঞ্চ ১৯৬৬ সালের ৫ মে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন। স্পেশাল বেঞ্চ এই প্রশ্নে বিস্তারিত পর্যালােচনা করেন এবং দুইজনের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এই যুক্তি নাকচ করে দেন। আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি আবদুল্লাহ ভিন্নমত পােষণ করেন এবং সেই ব্যাপারে তিনি অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা আমাকে জানান। এই প্রশ্নে আমি যা বলেছি তার বাইরে আমি বিচারপতি সালাহউদ্দীন ও বিচারপতি সায়েমের মতামতের সঙ্গে একমত এবং ভ্রাতা বিচারপতি আবদুল্লাহর সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করছি।
৩৬. দরখাস্তকারীর দরখাস্তে উল্লিখিত সবগুলাে প্রশ্ন তারা নিষ্পত্তি করেন।
৩৭. পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক দাখিলকৃত এবং স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব বােরহানউদ্দীন আহমেদের শপথযুক্ত পাল্টা হলফনামায় উল্লিখিত কিছু বিষয়ে জেরা করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারিকে শমন দেওয়ার জন্য শুনানিকালে আমাদের কাছে একটি আবেদন করা হয়। আমরা এই আবেদন মঞ্জুর করার প্রয়ােজনীয়তা পাইনি। ফলে দরখাস্তটি খারিজ করা হয়।
৩৮. আমার মতে, তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ প্রদানসংক্রান্ত পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২(২) বিধিতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার (iii) দফায় উল্লিখিত অ্যাডজুডিকেশনের
২৪০
বিধানাবলিবিহীন বিধিটি ওই অধ্যাদেশের পরিধিবহির্ভূত বিধায়, তর্কিত আদেশটি টিকতে পারে না। সুতরাং, কেবল এই যুক্তিতেই আমি রুল চূড়ান্ত ঘােষণা করছি এবং পক্ষদ্বয়কে নিজেদের খরচ বহন করার আদেশ প্রদান করছি।
৩৯. এই মামলা সম্পর্কে আলােচনা শেষ করার আগে, আমি এই কথা না বলে পারছি না যে, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল, জনাব মাহমুদ আলী কাসুরী ও জনাব কামাল হােসেন আদালতকে ব্যাপকভাবে সহযােগিতা করেছেন এবং বারের বিজ্ঞ সদস্যদের উঁচু মানের যুক্তি-তর্ক শােনাটা আনন্দদায়ক ছিল। তারা নিজ নিজ পক্ষের মামলা সক্ষমতার সঙ্গে পরিচালনা করে বার ও বেঞ্চের মর্যাদা সমুন্নত করেছেন। আমি আনন্দিত যে, আমার বিজ্ঞ ভ্রাতৃবৃন্দ, যাঁরা এই মামলায় আমার সঙ্গে বসেছেন, তাঁরা এই প্রসঙ্গে কোনাে ভিন্ন মত পােষণ করেন না।
৪০. বিচারপতি এম. আর. খান
আমি আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি সিদ্দিকী প্রদত্ত রায়ের সঙ্গে একমত পােষণ করছি। কেবল সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের অ্যাডজুডিকেশনসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আমার মত কিছুটা ভিন্নতর, যা আমি আলােচনা করতে চাই।
৪১. প্রশ্নটির যথাযথ অনুধাবনের জন্য আমি মামলার ঘটনা সংক্ষেপে উল্লেখ করতে চাই।
৪২. দরখাস্তকারী জনাব তফাজ্জল হােসেন বাংলা দৈনিক পত্রিকা ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক। তিনি ইত্তেফাক’-এর স্বত্বাধিকারীও। ১, রামকৃষ্ণ মিশন রােড, ঢাকায় অবস্থিত নিউ নেশন প্রেস, যা আবেদনকারীর সেই পত্রিকা ছাপানাের কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি তার মালিকানাধীন এবং এই প্রেসের কিপারও তিনি।
৪৩. পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২ বিধির (১) উপবিধির (বি) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ৭ এপ্রিল, ২ জুন ও ৭ জুন ১৯৬৬ তারিখে দরখাস্তকারীর বিরুদ্ধে পরপর তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ জারি করেন। এই আদেশগুলাে সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের অধীনে করা বর্তমান আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং ক্রমানুসারে ‘ডি’, ‘ডি’ ও ‘ডি২’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশসমূহে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণের কথা উল্লেখ করা না হলেও প্রতীয়মান হয় যে, আদেশসমূহ একই তারিখে পাকিস্তান গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় ১৯৬৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখ প্রকাশিত ৩ (আর)/৬৫ নম্বর এস.আর.ও.-র মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক সরকারকে প্রদত্ত ক্ষমতার ভিত্তিতে জারি হয়েছে। প্রথম নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশটি দরখাস্তকারীকে পাঠানাে হয়েছিল ‘ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক হিসেবে এবং বাকি দুটি আদেশ পাঠানাে হয়েছিল তাঁকে পত্রিকাটির সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে। প্রথম আদেশের মাধ্যমে দরখাস্তকারীর প্রতি সংশ্লিষ্ট তফসিলে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দ্বিতীয় আদেশে আওয়ামী লীগের ৭.৬.৬৬ তারিখে প্রতিবাদ দিবস পালনসংক্রান্ত খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি ও প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশের বিষয়ে দরখাস্তকারীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তৃতীয় আদেশের মাধ্যমে ৭ জুন তারিখে হরতাল ও প্রতিবাদ দিবস পালন এবং এই ব্যাপারে সরকার কর্তৃক গৃহীত কোনাে পদক্ষেপসংক্রান্ত খবর, মতামত, বিবৃতি, প্রতিবেদন ও আলােকচিত্র তৈরি, মুদ্রণ ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
৪৪. নিষেধাজ্ঞা জারি থাকাকালীন দরখাস্তকারী দৈনিক ইত্তেফাক’-এ কিছু বিষয় প্রকাশ করার মাধ্যমে উপরােক্ত নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশাবলি লঙ্ন করেছেন এই গ্রাউন্ডে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন গভর্নর পাকিস্তান।
২৪১
subjects, or the use of any press, as defined in the Press and Publications Ordinance, 1960.
(2) If any person contravenes any order made under sub-rule (1), then, without prejudice to any other proceedings which may be taken against such person, the Central Government may declare to be forfeited to it every copy of any document published or made in contravention of such order and any press, as defined in the Press and Publications Ordinance, 1960, used in the making of such document; and, if the document so forfeited is a newspaper, the Central Government may also cancel the declaration made and subscribed in respect of such newspaper under section 7 of that Ordinance.
(3) If any person contravenes any order made under this rule, he shall be
punishable with imprisonment for a term which may extend to five years, or
with fine, or with both.
৪৬. স্পষ্টত ৫২ বিধির (২) উপবিধির অধীনে কোনাে দলিল এবং সেই দলিল প্রস্তুতকারী প্রেস বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার (iii) দফা থেকে উদ্ভূত। অন্য কথায়, ৫২(২) বিধির কর্তৃত্বের ভিত্তি হলাে ৩(৩) ধারার (iii) দফা। উপরােক্ত (iii) দফায় বলা হয়েছে, কোনাে বিধি বা বিধি অনুযায়ী দশ লঙ্ঘন, লঙ্ঘনের চেষ্টা বা প্ররােচনার জন্য সম্পত্তি জব্দ, আটক ও বাজেয়াপ্ত করার বিধান বিধিমালায় থাকতে পারে এবং আদালত কিংবা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাজেয়াপ্তকরণের বিষয়টি বিচার করার বিধান থাকতে পারে। সম্পত্তি জব্দ ও ক্রোক করার সাধারণ ক্ষমতা ১৯৮ বিধিতে দেওয়া হয়েছে। ২৫(৩), ২৬(১), ৫১(৩), ৯২(২), ১৫২(২), ২০০(২) ইত্যাদি বিধিতে সম্পত্তি জব্দ ও ক্রোক করার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বিধানও রয়েছে। ১৯(৯), ২৫(৪), ১৩০(৩) ও ১৩১(৮) বিধিমালা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কোনাে বিধির অধীনে জারিকৃত আদেশ লঙ্ঘন হলে বিচার করতঃ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা এসব প্রত্যেক বিধিতেই আদালতকে দেওয়া হয়েছে। আবার ১৩৭(৭) বিধিবলে উল্লিখিত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্তকরণের যথার্থতা নিরূপণ করার ক্ষমতা জেলা কালেক্টরকে দেওয়া হয়েছে। তবে ৫২(২), ৫৫, ৯২(৩) ও ১৫২(৪) বিধি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এসব বিধির কোনাে বিধির অধীনে। জারিকৃত আদেশ লঙ্ঘনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও বাজেয়াপ্তকরণের যথার্যতা নিরূপণের বিধান রাখা হয়নি। ফলে, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফার সঙ্গে মিল রেখে সে মােতাবেক আদালত বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের যথার্থতা নিরূপণের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এই বিধিগুলাে কেন্দ্রীয় সরকার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষকে কোনাে দলিল বা সেই দলিল প্রস্তুতকারী প্রেস ৫২(২) বিধির অধীনে বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেয়নি।
৪৭. এরকম ক্ষেত্রে বিবেচ্য প্রশ্নের সঠিক জবাব একটি বিষয় বিবেচনার উপর নির্ভর করে। তা হলাে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের যথার্থতা নিরূপণসংক্রান্ত অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফার বিধানাবলি কি অমান্যতার জন্য অসিদ্ধ হওয়ার পরিণতিমুক্ত এবং কেবল নির্দেশনামূলক; নাকি সেটা বাধ্যতামূলক এবং অমান্যতার জন্য তা বাতিল হওয়ার পরােক্ষ বিধান সংযােজিত রয়েছে? কোনাে সুনির্দিষ্ট বিধান
২৪৩
নির্দেশনামূলক নাকি বাধ্যতামূলক এই প্রশ্ন নিরূপণ করা অনেক ক্ষেত্রেই দুঃসাধ্য। আইন ও বিধান রচনার বৈশিষ্ট্যকে সব সময় নিশ্চিত সূচক হিসেবে ধরা যায় না এবং এই প্রশ্নটি নির্ধারণের জন্য কাজে আসতে পারে এমন সর্বজনীন নীতিও নেই। তবে সর্বজনীনভাবে গ্রহণযােগ্য মত হলাে, সংবিধিবদ্ধ আইন ব্যাখ্যা করার স্বীকৃত নীতিমালা এবং তার মাধ্যমে কোনাে বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী ছিল তা নিরূপণ করা আদালতের দায়িত্ব। কোনাে সুনির্দিষ্ট আইনি বিধান কেবল নির্দেশনামূলক নাকি বাধ্যতামূলক তা নির্ধারণের জন্য এমনকি কিছু গ্রন্থ প্রণেতা এবং উচ্চ আদালত নির্দেশনামালা ইঙ্গিত করেছেন এবং এজন্য মানদণ্ড প্রস্তাব করেছেন।
৪৮. ক্রফোর্ড (Crawford) তাঁর Statutory Construction গ্রন্থের ১০৪ পৃষ্ঠায় বলেছেন :
“A statute, or one or more of its provisions, may be either mandatory or directory. While usually in order to ascertain whether a statute is mandatory or directory, one must apply the rules relating to the construction of statutes; yet it may be stated, as a general rule, that those whose provisions relate to the essence of the thing to be performed or matters of substance, are mandatory, and those which do not relate to the essence and whose compliance is merely a matter of convenience rather than of Substance, are directory.”
একই লেখকের মতে,
“The basic text by which to determine whether that requirement is essential or not, is to consider the consequences of the failure to follow the statute. In this way the importance of the requirement will be revealed. If the requirement is revealed to be important, it may logically be assumed that the Legislature intended that it be met; if found to be unimportant, that it need not be met.”
৪৯. ম্যাক্সওয়েল (Maxwell) তাঁর Maxwell on interpretation of Statutes গ্রন্থে (১১তম সংস্করণ, ৩৬৪ পৃষ্ঠা) বিষয়টি এভাবে উপস্থাপন করেছেন :
“It has been said that no rule can be laid down for determining whether the command is to be considered as a mere direction or instruction involving no invalidating consequence in its disregard, or as imperative, with an implied nullification for disobedience, beyond the fundamental one that it depends on the scope and object of the enactment. It may, perhaps, be found generally correct to say that nullification is the natural and usual consequence of disobedience, but the question is in the main governed by considerations of convenience and justice, and, when that result would involve general inconvenience or injustice to innocent persons’ or advantage to those guilty of the neglect without promoting the real aim and object of the enactment, such an intention is not to be attributed to the legislature. The whole scope and purpose of the statute under consideration must be regarded.”
২৪৪
৫০. একই বিষয়ে 59 Corpus Juris (পৃষ্ঠা ১০৭৪)-এ বলা হয়েছে :
“Whether a statute is mandatory or directory depends on whether the thing directed to be done is of the essence of the thing required, or is a mere matter of form. Accordingly, when a particular provision of a statute relates to some immaterial matter, as to which compliance with the statute is a matter of convenience rather than substance, or where the directions of a statute are given merely with a view to the proper, orderly, and prompt conduct of business, it is generally regarded as directory, unless followed by words of absolute prohibition; and the same is true where no substantial rights depend on the statute, no injury can result from ignoring it, and the purpose of the legislature can be accomplished in a manner other than that prescribed, with substantially the ‘same results. But a provision relating to the essence of the things to be done, that is, to matters of substance, is mandatory…”.
৫১. Government of Assam v. Sahebulla AIR 1924 Cal IFB মামলায় যেমনটি liverpool Borough Bank v. . Turner, 1860 30 L.J. Ch. 379 মামলার লর্ড ক্যাম্পবেলকে উদ্ধৃত করা হয়েছে :
“I believe as far as any rule is concerned you cannot safely go further than that in each case. You must look to the subject matter, consider the importance of the provision that has been disregarded, and the relation of that provision to the general object intended to be secured by the Act, and, upon a review of the case in that aspect, decide whether the matter is what is called imperative or only directory.”
৫২. D. A. Koregaonkar v. . The State AIR 1958 Bom. 167 মামলায় এই সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে, কোনাে বিধান বাধ্যতামূলক নাকি নির্দেশনামূলক প্রকৃতির তা নির্ধারণ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে পরীক্ষা প্রয়ােগ করতে হবে তা হলাে কোনাে সুনির্দিষ্ট বিধান অমান্য করা হলে তা কোনাে অসুবিধা বা অবিচার সৃষ্টি করে কিনা সেটি বিবেচনা করা এবং যদি তা করে তাহলে বিধানটি অবশ্যমান্য এবং তা বাধ্যতামূলক প্রকৃতির মর্মে আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন।
৫৩. মামলায় একটি সুনির্দিষ্ট প্রভিশন বা বিধান বাধ্যতামূলক নাকি নির্দেশনামূলক তা নিষ্পত্তি করার ক্ষেত্রে | Ajit Kumar Sen v.. State of West Bengal, AIR 1954 Cal. 49 155 মামলায় জটিলতা দেখা দেয়। সেই জটিলতার কথা উল্লেখ করে বিজ্ঞ বিচারক বলেন :
“Broadly speaking, however, there are three fundamental tests which are often applied with remarkable success in the determination of this question. They are based on the consideration of the scope and object sometimes called the scheme and purpose of the enactment in question, on consideration of justice and balance of convenience and on a consideration of the nature of the
২৪৫
particular provision, namely, whether it affects the performance of a public duty or relates to a right, privilege or power in the former case the enactment is generally directory, in the latter mandatory.
৫৪. M. Noman v. D. I. T. 16 DLR 537 মামলায় এই আদালতের একটি ডিভিশন বেঞ্চে আমি সদস্য
ছিলাম। সেখানে শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদানকরী সংবিধিবদ্ধ বিধান কি কেবল নির্দেশনামূলক নাকি বাধ্যতামূলক এই প্রশ্নটির সমাধান করা হয়েছিল। Julius v Bishop, 5 AC 214 মামলায় হাউস অব লর্ডসের রায়সহ বেশ কয়েকটি বিচারিক সিদ্ধান্ত ও প্রামাণ্য সূত্র পর্যালােচনা করার পর আমি নিমােক্ত মতামত প্রকাশ করেছিলাম :
আইন-প্রণেতাদের উদ্দেশ্য আবিষ্কারের জন্য প্রযােজ্য পরীক্ষাগুলাে সাধারণত সংশ্লিষ্ট আইনের পরিধি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে প্রয়ােগ করা হয়। ন্যায়বিচার ও সুবিধা এই দুইয়ের মধ্যকার ভারসাম্যের ব্যাপারটি বিবেচনা করা হয় এবং আইনের বিধানে প্রদত্ত ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে কোনাে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে কিনা সেটিও বিবেচনা করা হয়। দায়িত্ব অর্পণ করা হলে দেখতে হবে সেই দায়িত্ব পালন না করলে তা আইনের বাস্তবায়নে কোনাে বাধা সৃষ্টি করে কিনা এবং তা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উপর কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই এমন ব্যক্তিদের জন্য কোনাে দুর্ভোগ, অসুবিধা, ক্ষতি বা অবিচারের কারণ হয় কিনা। যদি কর্তব্যের সাথে যুক্ত ক্ষমতা অনুশীলিত না হয় তবে সেক্ষেত্রে যদি আইনের কোনাে বিধান পালন করা না যায় বা তা যদি অন্যদের দুর্ভোগ, অসুবিধা, ক্ষতি বা অবিচারের কারণ হয়, তাহলে সেই বিধান অবশ্যই বাধ্যতামূলক বলে ঘােষণা করতে হবে।
৫৫. এসব মানদণ্ড এবং আইনি-ব্যাখ্যার স্বীকৃত নীতিমালা যা আমি নিমে যথার্থ ক্ষেত্রে উল্লেখ করবাে তার ভিত্তিতে দেখা যাক পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফায় উল্লিখিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের যথার্থতা নিরূপণসংক্রান্ত বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য কী ছিল। অন্য কথায়, এটা দেখতে হবে যে, উক্ত বিধান প্রণয়নে আইনপ্রণেতাগণের অভিপ্রায় ছিল কেবল নির্দেশনামূলক নাকি এই বিধানের লঙ্ঘন করে কত কর্মকাণ্ড বাতিলের পরােক্ষ উদ্দেশ্যসহ বাধ্যতামূলক।
৫৬. নিঃসন্দেহে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫ ও এর অধীনে প্রণীত বিধিমালা ভারত প্রতিরক্ষা আইন, ১৯৩৯ ও তার অধীনে প্রণীত বিধিমালার এখানে-সেখানে সামান্য রদবদলসহ আক্ষরিক পুনরুৎপাদন (verbatim re-production)। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার (iii) দফা ভারত প্রতিরক্ষা আইন, ১৯৩৯-এর ২ ধারার (৩) উপধারার (iii) দফার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রতীয়মান হয় যে, ভারত প্রতিরক্ষা আইন, ১৯৩৯-এর ২(৩) ধারার (iii) দফা-আদিতে যেভাবে প্রণীত হয়েছিল তাতে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বিধান রাখা হয়েছিল। সেই দফায় বা আইনের অন্য কোনাে জায়গায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারসংক্রান্ত বিধিমালা তৈরির ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ভারত প্রতিরক্ষা (তৃতীয় নংশােধনী) অধ্যাদেশ, ১৯৪৫ (১৯৪৫ সালের ৩৫ নম্বর অধ্যাদেশ)-এর মাধ্যমেই (iii) দফায় কেবল নিমােক্ত শব্দাবলি যুক্ত করার মাধ্যমে ভারত প্রতিরক্ষা আইন, ১৯৩৯ সালের ২(৩) ধারার (iii) দফায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের যথার্থতা নিরূপণসংক্রান্ত বিধান রাখা হয় : and for the adjudication of such forfeiture whether by a Court or by any other authority.
২৪৬
৫৭. কোনাে বিধি বা তার অধীনে জারিকৃত কোনাে আদেশ লঙ্ঘনের জন্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ কারাদণ্ড বা জরিমানার মতােই শাস্তি। কারণ পরিণামে ঐ শাস্তির মাধ্যমে সম্পত্তির অধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিতকরণ প্রতিপন্ন হয়। বস্তুত, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ পাকিস্তান দণ্ডবিধির ৫৩ ধারায় বিধৃত কয়েক ধরনের শাস্তির।
মধ্যে একটি।
৫৮. ভারত প্রতিরক্ষা বিধিমালা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এর কোনাে বিধি বা তার অধীনে জারিকৃত কোনাে আদেশের লজ্জনকে কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় শাস্তিতে দণ্ডনীয় করা হয়েছে এবং বিভিন্ন বিধি ও আদেশের লঙ্ঘনের জন্য ভারত প্রতিরক্ষা আইন, ১৯৩৯-এর ২(৩) ধারার (iii) দফায় প্রস্তাবিত সীমার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। আরাে প্রতীয়মান হয় যে, ওই আইনের ১৪ ধারার কল্যাণে এরকম লঙ্ঘনসমূহ সাধারণ ফৌজদারি আদালতে বিচার্য ছিল। ফলে, ভারত প্রতিরক্ষা বিধিমালার। প্রত্যেক লঙ্ন বা এর কোনাে বিধির অধীনে জারিকৃত আদেশের লঙ্ঘনের দায়ে কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় আদালত কর্তৃক এ বিষয়টি বিচার ও নির্ধারণের বিধান সেখানে ছিল। কিন্তু কোনাে বিধি বা তার অধীনে জারিকৃত আদেশের লঙ্ঘনের দায়ে কেন্দ্রীয় সরকার বা তার কর্তৃক হস্তান্তরিত ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে ভারত প্রতিরক্ষা আইন বা বিধিমালা কোথাও বিচারের বিধান নেই, যদিও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ একটি শাস্তি। এই আইন ও বিধিমালায় মারাত্মক গলদ ছিল এবং এর পরিণতি খুবই অন্যায্য এবং অবিচারমূলক যে, বিচারের বিধান না থাকায় কথিত লঙ্ঘনের জন্য সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের নির্বাহী আদেশ কার্যত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে কোনাে ফোরামে প্রতিকার পাওয়ার সুযােগ না দিয়ে সম্পত্তিতে তার স্বত্ব বিলুপ্তির শামিল। প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এই ত্রুটি দূর করার জন্য ১৯৪৫ সালে জারিকৃত ভারত প্রতিরক্ষা (তৃতীয় সংশােধনী) অধ্যাদেশ, ১৯৪৫-এর মাধ্যমে ৩(২) 3078779 (iii) 7271 “and for the adjudication of such forfeiture whether by a Court or by any other authority” কথাগুলাে যােগ করা হয়েছে। ফলে, সংসদ কর্তৃক প্রণীত ভারত প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৩৯-এর আদি ক্রটি দূর করার জন্য ১৯৪৫ সালের উক্ত সংশােধিত অধ্যাদেশ সুস্পষ্টভাবেই একটি প্রতিকারমূলক আইনি ব্যবস্থা। পরবর্তীকালে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারের বিধান প্রণয়ন করার অপরিহার্যতাই একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এটা নিছক কোনাে ধরন নয়, এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ন্যায়বিচারের স্বার্থে তথা জনগণের সুবিধা এবং জনগণের ন্যায়বিচার উন্নয়নের লক্ষ্যে করণীয় কোনাে কিছুর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি। ফলে, এটা বলা কি কোনােভাবেই যৌক্তিক হবে যে, আইন-প্রণেতাগণ সচেতনভাবে এবং নিজ স্বেচ্ছাধীনভাবে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ বিষয়ে বিচারের বিধান প্রবর্তন করেছেন- কেবল অনুমতিদায়ক বিধান হিসেবে, যা বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাক্ষমতা প্রয়ােগ করে ইচ্ছেমতাে মান্য বা উপেক্ষা করতে পারবে?
৫৯. Butler o. Fife Coal Company, 1912 Act 149 মামলায় লর্ড শ’ (Lord Shaw) বলেন:
“The commending principle in the construction of a statute passed to remedy the evils and to protect against the dangers which confront or threaten persons or classes of His Majesty’s subjects is that, consistently with the actual language age employed, the Act shall be interpreted in the sense favorable to making the remedy effective and protection secure. This principle is sound and undeniable.”
২৪৭
60. Rai Ram Taran Banerjee vs. Mrs. Hill AIR 1949 FC 135 মামলায় ভারতীয় ফেডারেল কোর্ট সিদ্ধান্ত দেন যে :
“The words of remedial statute must be construed so far as they reasonably admit so as to ensure that the relief contemplated by the statute shall not be denied to the persons intended to be relieved.”
61. Bengal Immunity Co. v. State of Bihar, AIR 1955 SC 664 মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যার নীতিমালাসংক্রান্ত প্লাইডন মামলায় নােবেল লর্ডের দেওয়া পর্যবেক্ষণ, যা লর্ড কোক কর্তৃক সমর্থিত তা উদ্ধৃত করেন। এটি এখানে উল্লেখ করা যথার্থ হবে :
“(22) It is a sound rule of construction of a statute firmly established in England as far back as 1584 when ‘Heydon’s case, (1584) 3 Co. Rep 7a (V) was decided that
… for the sure and true interpretation of all Statutes in general (be they penal or beneficial, restrictive or enlarging of the common law) four things are to be discerned and considered :
1st. What was the common law before the making of the Act,
2nd. What was the mischief and defect for which the common law did not provide,
3rd. What remedy the Parliament hath resolved and appointed to cure the disease of the Commonwealth, and
4th. The true reason of the remedy; and then the office of all the judges is always to make such construction as shall suppress the mischief, and advance the remedy, and to suppress subtle inventions and evasion for continuance of the mischief.”
62. Eastman Photographic Material Co, v. Comptroller General of Patents, Designs and Trademarks, 1898 AC 571 at page 576 (Earl of Halsbury) উক্ত নীতিমালাকেই নিমােক্ত শব্দভান্ডার দ্বারা পুনঃসমর্থন জ্ঞাপন করেন :
“My Lords it appears to me that to construe the Statute now in question, it is not only legitimate but highly convenient to refer both to the former Act and to the ascertained evils to which the former Act had given rise, and to the later Act which provided the remedy. These three things being compared, I cannot
doubt the conclusion.”
63. লর্ড Halsbury-এর উপরক্ত মতামত সম্প্রতি ফেডারেল কোর্ট Muhammad Haroon v. Crown 1951 3 DLR FC 408 (414-415) মামলা গ্রহণ করেছেন।
২৪৮
৬৪. প্রতীয়মান হয় যে, উপরােক্ত সর্বজনস্বীকৃত নীতিমালা ভারত প্রতিরক্ষা আইনের ২(৩) ধারার (iii) দফার বিধান সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারের সাথে যতটুকু সম্পর্কিত, তা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযােজ্য। এই নীতি প্রয়ােগ করে উপরােক্ত বিধানের একমাত্র যে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে তা হলাে, ১৯৪৫ সালের ৩৫ নম্বর অধ্যাদেশের সংশােধনীর মাধ্যমে আইনপ্রণেতাগণ বিষয়টির ন্যায়বিচারের স্বার্থে অপকার নিবারণ (suppress the mischief) এবং প্রতিকারকে বৃদ্ধি করতে চেয়েছেন।
৬৫. এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, ১৯৪৫ সালের ৩৫ নম্বর অধ্যাদেশ জারির পর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ভারত প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৩৯-এর সংশােধিত ২(৩) ধারার (iii) দফা মােতাবেক ১৯৪৫ সালের ১০ নভেম্বর ভারত প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৮১ বিধির (৩ডি) উপবিধি, অর্থাৎ বিধি-প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে একটি নতুন বিধি প্রণয়ন করেন, যেখানে কোনাে আদেশ লঙ্ঘনের জন্য জেলা কালেক্টর কর্তৃক কোনাে ধরনের জিনিসপত্র বাজেয়াপ্তের ক্ষেত্রে বিচারের বিধান রাখা হয়। এছাড়া, ১৯৪৫ সালের ৩৫ নম্বর অধ্যাদেশের সংশােধনীর পরে ভারত প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৮১ বিধি অনুযায়ী অনেকগুলাে নিয়ন্ত্রণ আদেশ জারি করা
হয়, যেখানে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে বিচারের বিধান রাখা হয়।
৬৬. এসব নিয়ন্ত্রণ আদেশের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার প্রয়ােজন নেই। তবে সেসব আদেশের কিছু অংশ
উদাহরণস্বরূপ নীচে দেওয়া হলাে :
আদেশের নাম
আদেশের নম্বর ও তারিখ
ভারতীয় গেজেটে প্রকাশের তারিখ
সালফিউরিক এসিড নিয়ন্ত্রণ আদেশ, ১৯৪৫
নম্বর- এস এস/১০১০, তারিখ ২৮.৯.৪৫ ৬.১০.১৯৪৫
ক্লোরিন নিয়ন্ত্রণ আদেশ, ১৯৪৫
নম্বর- এস এস/১৩৮, তারিখ ৩১.১০.১৯৪৫ ১০.১১.১৯৪৫
আজমির কটন ক্লথ নিয়ন্ত্রণ (রেশনিং) আদেশ, ১৯৪৫
নম্বর- সিওয়াইসি/১১৭, তারিখ ৩১.১০.১৯৪৫
১০.১১.১৯৪৫
মটর সাইকেল নিয়ন্ত্রণ আদেশ, ১৯৪৫
নম্বর- ৮ এলভিসি (৪২)৪৫, তারিখ ১.১২.১৯৪৫
১.১২.১৯৪৫
ড্রাগ কন্ট্রোল অর্ডার, ১৯৪৫
নম্বর- ১-ডিএম(১)/৪৫, তারিখ ৩.১২.১৯৪৫ ৩.১২.১৯৪৫ (অতিরিক্ত সংখ্যা)
ফলে, এটা পরিষ্কার যে, ১৯৪৫ সালে ভারত প্রতিরক্ষা আইনের ২(৩) ধারার (iii) দফায় প্রবর্তিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে বিচারের বিধান বস্তুত কার্যকর ছিল। যা এই ইঙ্গিত করে যে, এই বিধানের কঠোর প্রতিপালন আইনপ্রণেতাদের অভিপ্রায় হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।
৬৭. ইতােমধ্যে যেমনটি বলা হয়েছে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ ও সে অনুযায়ী প্রণীত বিধিমালা বস্তুত ভারত প্রতিরক্ষা আইন, ১৯৩৯ এবং তার অধীনে প্রণীত বিধিমালার আক্ষরিক পুনরুৎপাদন (verbatim
২৪৯
re-production)। যদি তা-ই হয়, তাহলে ভারত প্রতিরক্ষা আইনের ২(৩) ধারার (iii) দফা এবং তার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফার ব্যাখ্যাও একই হওয়া উচিত।
৬৮. কোনাে আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ ও বহির্গত বিষয়াবলি বিবেচনায় নেওয়া অনুমােদনীয়। সংশ্লিষ্ট আইনের ইতিহাস, একই বিষয়সংশ্লিষ্ট পূর্বতন আইনের পরিধি এবং বিচারিক সিদ্ধান্তসমূহ কোনাে আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সহায়ক গুরুত্বপূর্ণ বহির্গত বিষয়। অভ্যন্তরীণ সহায়ক বিষয়টি আইনের মূল পাঠ্যাংশেই থাকে। Henrietta O. Attorney General AIR 1930 PC 120 মামলায় লর্ড সাঙ্কে (Lord Sankey) পর্যবেক্ষণ দেন যে,
“In coming to a determination as to the meaning of a particular word in a particular Act of Parliament, it is permissible to consider two points, viz;
(i) The external evidence derived from extraneous circumstances such as previous legislation and decided cases,
(ii) Internal evidence derived from the Act itself.” এক আইনের ভাষার মাধ্যমে অন্য আইনের ব্যাখ্যা করা প্রসঙ্গে Maxwell on Interpretation of Statutes (Eleventh Edition, page 32) গ্রন্থে লর্ড ম্যান্সফিল্ডের (Lord Mansfield) নিমােক্ত বক্তব্য উল্লেখ করা হয় :
“Where there are different statutes in pari materia, though made at different times, or even expired and not referring to each other, they shall be taken and construed together, as one system and as explanatory of each other.”
Holine vs. Guy 1877 5 Ch. D. 901 মামলায় Jessel M. R. পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন যে:
“The Court is not to be oblivious and I have cited from the authorities to which I have referred to show that such is the case of the history of law and legislation. Although the Court is not at liberty to construe an act of Parliament by the motives which influenced the Legislature, yet when the history of law and legislation tells the Court, and prior judgment tells this present Court, what the object of the Legislature was, the Court is too see whether the terms of the section are such as fairly to carry out that object and no other, and to read the section with a view to finding out what it means, and not with a view to extending it to something that was not intended.”
৬৯. আইনটির ইতিহাস, তথা আইনের পূর্বতন অবস্থা আইনি-ব্যাখ্যার জন্য সহায়ক হতে পারে- এই যুক্তি Muhammad Haroon vs. Crocon, 1951 3 DLR FC 408 (122-124) মামলায় আমাদের ফেডারেল কোর্ট গ্রহণ করেছেন।
৭০. উপরােক্ত প্রতিষ্ঠিত নজিরসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে এটি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা যায় যে, ভারত প্রতিরক্ষা আইনের ২(৩) ধারার (iii) দফার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে বিচারসংক্রান্ত বিধানকে বাধ্যতামূলক প্রকৃতির
২৫০
প্রতিপন্ন করে মর্মে প্রদত্ত ব্যাখ্যা পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের সাদৃশ্যপূর্ণ ৩(৩) ধারার (iii) দফার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযােজ্য।
৭১. এখন আমরা পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ এবং তার অধীনে প্রণীত বিধিমালার মধ্যে নিহিত অভ্যন্তরীণ ইঙ্গিত বিবেচনা করবাে। অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারা শুরু হয় “The rules made under sub-section (1) may further provide etc.’এই কথাগুলাে দিয়ে। কোনাে সন্দেহ নেই যে, ৩(৩) ধারায় ব্যবহৃত সহায়ক ক্রিয়া ‘mayতার স্বাভাবিক অর্থ অনুযায়ী অনুমােদনমূলক বা সক্ষমতার শব্দ এবং এটি স্বেচ্ছাধীন। ক্ষমতার কথা সূচিত করে। কিন্তু may’, ‘it shall be lawful’ বা এরকম অনুমােদনমূলক ভাষ্যে প্রকাশিত আইন অপরিহার্যভাবেই অনুমােদনমূলক বা নির্দেশনামূলক নয়। ব্রিটিশ চার্চ ডিসিপ্লিন অ্যাক্ট-এর ৩ ধারায় উল্লিখিত ‘it shall be lawful’ শব্দগুচ্ছের অর্থ করতে গিয়ে Julius vs. Bishop Of Oxford 5 AC 214 মামলায় লর্ড চ্যান্সেলর পর্যবেক্ষণ দেন যে :
“The words ‘it shall be lawful’ are not equivocal. They are plain and unambiguous. They are words merely making that legal and possible which there would otherwise be no right or authority to do. They confer a faculty or power, and they do not of themselves do more than confer a faculty or power But there may be something in the nature of the thing empowered to be done, something in the object for which it is to be done, something in the conditions under which it is to be done, something in the title of the person or persons for whose benefit the power is to be exercised, which may couple the power with a duty, and make it the duty of the person in whom the power is reposed to exercise that power when called upon to do so.”
একই বিষয়ে বিশপ মামলায় প্রদত্ত অপরাপর মাননীয় বিচারপতিদের মতামত M. Notulen vs. D. I.T. 16 DLR 537 মামলায় আমি বিবেচনায় নিয়েছিলাম। সেখানে বিশপ মামলাসহ উচ্চ আদালতের বেশ কয়েকটি রায় পর্যালােচনা করতঃ আমি নােমান মামলায় মতামত দিয়েছিলাম যে, ‘may শব্দটি নির্বিচারে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বােঝায় না; shall শব্দ যেমন অপরিহার্যভাবে বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করে না। বরং আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্যই প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ করে। এটা প্রমাণ করার জন্য বেশি দূর যেতে হয় না। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (১) উপধারাতেই সাহায্যকারী ক্রিয়া ‘may’ ব্যবহার করে একই রকম অনুমােদনমূলক ভাষায় উপধারাটির বাধ্যতামূলক প্রকৃতি বােঝানাের জন্য উজ্জ্বল এক উদাহরণ। কারণ, এই উপধারায় প্রদত্ত আপাত অনুমােদনমূলক বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা অনুযায়ী যদি কেন্দ্রীয় সরকার বিধি প্রণয়ন না করে তাহলে অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। অন্যদিকে, shall’ শব্দটি যে অপরিহার্যভাবে বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করে তা পরিষ্কার হয় নােমান মামলায় দেওয়া একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে। এটি এখানে পুনরাবৃত্তি করা যায়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১১ ধারায় বলা হয়েছে : Parliament shall by law provide for the determination of the area of the Federal Capital …
আইন প্রণয়নের জন্য সংসদের উপর কোনাে চাপ থাকতে পারে না। কারণ আইন প্রণয়ন সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে এবং আইন প্রণয়নে তাদের সম্মতি অপরিহার্য। স্পষ্টতই এটা একটা সক্ষমতার বিধান। যদিও এই অনুচ্ছেদে ‘shall’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।।
২৫১
৭২. আমরা ইতােমধ্যে দেখেছি যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (১) উপধারার বিধান অনুমােদনমূলক ভাষায় প্রকাশ করা হলেও তা বাধ্যতামূলক। এখন দেখা যাক ৩ ধারার (৩) উপধারা কীভাবে শুরু হয়েছে “The rules made under sub-section (1) may further provide”প্রারম্ভিক এই কথাগুলাে স্পষ্ট ইঙ্গিত করে যে, (৩) উপধারার বিভিন্ন দফায় উল্লিখিত বিষয়াবলির জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করতে হবে ৩ ধারার উপধারা (১)-এর অধীনে। অন্য কথায়, (৩) উপধারায় উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা উপধারা (১) থেকে উদ্ভূত এবং এসব বিষয়ে প্রণীত বিধিমালা সেই উপধারার অধীনে প্রণীত অতিরিক্ত বিধিমালা বৈ আর কিছু নয়। যেখানে ৩ ধারার (১) উপধারা বাধ্যতামূলক হয় এবং (৩) উপধারায় বিধৃত অতিরিক্ত বিধানাবলিও (১) উপধারার অধীনে প্রণীত হতে হবে, তখন এটা বলা যেতে পারে যে, (১) উপধারার বিধানের মতাে (৩) উপধারার বিধানও বাধ্যতামূলক।
৩(৩) উপধারার (iii) দফা নিম্নরূপ :
3 (iii) The rules made under sub-section (1) may further provide for the seizure, detention and forfeiture, of any property in respect of which such contravention, attempt or abetment as is referred to in the preceding clause has been committed, and for the adjudication of such forfeiture whether by a Court or by any other authority;
লক্ষণীয় যে, এই দফায় ‘for the adjudication of such forfeiture whether by a Court or by other authority- এই কথাগুলাের ঠিক আগে ব্যবহৃত সংযােজক শব্দ ‘and’ কে ‘or’ হিসেবে। পড়া যাবে না। এর সহজ কারণ হলাে, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিকল্প হতে পারে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে এর অর্থ দাঁড়ায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের জন্য বিধি প্রণয়ন করা হলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারের জন্য আরেকটি বিধি প্রণয়ন অপরিহার্য। যদি এটা সঠিক আইনি অবস্থান না হয়, তাহলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারের বিধানটি উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে পড়ে এবং তা (1957 9 D L R (S C) 178 (Reference No.1 of 1957) মামলায় সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারকগণ কর্তৃক বিধৃত নিমােক্ত নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে :
‘সাংবিধানিক দলিলাদি ব্যাখ্যার আরেকটি মৌলনীতি হলাে, সংবিধানের প্রতিটি অংশ এবং প্রতিটি শব্দের কার্যকর পরিণতি দিতে হবে। কাজেই সাধারণ নীতি হিসেবে আদালতের উচিত হবে কোনাে বিধানকে অর্থহীন বা অকার্যকর করে তােলে এমন ব্যাখ্যা এড়িয়ে চলা এবং এমন ব্যাখ্যাকে সমর্থন করা যা কিছু শব্দকে অলস ও নিরর্থক না করে রেখে বরং প্রতিটি শব্দকে কার্যকর করে তােলে।
৭৩. এছাড়া, যদি কোনাে বিধিতে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিধান রাখা হয়, কিন্তু সেই সংক্রান্ত বিচারের বিধান রাখা না হয়, তবে এর পরিণতি হবে এই যে, সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জন্য কোনাে প্রতিকারের ব্যবস্থা না রেখে বিধি বা আদেশের কথিত লঙ্ঘনের জন্য নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সম্পত্তি হবে বাজেয়াপ্তযােগ্য। এটা হবে public justice-এর বিরুদ্ধ। উক্ত দফায় সুস্পষ্টভাবে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের জন্য বিচারের বিধান রাখার কথা থাকার পরেও তা প্রণয়ন না-করা এবং তার মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করার কোনাে যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকতে পারে কি? বিশপ মামলায় উদ্ধৃত Rex vs. Barloo 91 ER 516 মামলার রায়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় : যখন কোনাে আইনে ন্যায়বিচার বা জনকল্যাণের স্বার্থে কোনাে কিছু করার নির্দেশনা দেওয়া হয়, সেখানে may’ শব্দটি ‘shall’ শব্দের মতাে একই অর্থ বহন করে। এটা
২৫২
থেকে বর্তমান মামলায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে বিচারসংক্রান্ত বিধান রাখার বিষয়টি মেনে নেওয়ার প্রতি নির্দেশ করে।।
৭৪. ৫২(২) বিধির অধীনে যেখানে বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ দেওয়া হয়, সেই বিধির সাহায্য নেওয়া যাবে যদি কোনাে ব্যক্তি (১) উপবিধির অধীনে প্রণীত কোনাে আদেশ লঙ্ঘন করে। সেই আদেশ যার লঙ্নের জন্য ৫২(২) বিধির প্রতি নির্ভর করা হয় এবং সেই বিধির অধীনে বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ জারিসংক্রান্ত বিধি স্বয়ং বিচারের কথিত লজ্ঞান হিসেবে আবির্ভূত হয়। আদালতের এখতিয়ার অন্য কোনােভাবে সীমাবদ্ধ না থাকলে, বস্তুনিষ্ঠতা নিরূপণের দাবি রাখে এমন বিষয়াদি জুডিসিয়াল রিভিউর আওতাধীন হয়। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৬(১) ধারায় যদিও বলা হয়েছে, এই অধ্যাদেশের অধীনে কিংবা অধ্যাদেশের অধীনে প্রদত্ত কোনাে ক্ষমতা প্রয়ােগপূর্বক জারিকৃত আদেশ সম্পর্কে কোনাে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে
না। কোনাে আদেশ বস্তুনিষ্ঠ সন্তুষ্টির ভিত্তিতে প্রদান করা হলেও এই বিধান দৃশ্যত জুডিসিয়াল রিভিউকে আওতাবহির্ভূত করে। এই বিষয়ে আদালতের এখতিয়ার অধ্যাদেশের ১৪ ধারায় সংরক্ষিত দেখা যায়, যদিও সেই এখতিয়ার নিয়ন্ত্রিত প্রকৃতির (restricted nature)। ১৪ ধারাটি নিম্নরূপ :
14(1) Except as may be provided in this Ordinance or in any rule made thereunder or in any order made under any such rule by the Central Government or the Provincial Government or by an officer not below the rank of Collector empowered under sub-section (4) or sub-section (5) of section 3 to make such order, the ordinary criminal and civil Courts shall continue to exercise jurisdiction”.
(2) Any provision in any such rule or order as aforesaid to the effect that the decision of any authority, not being a Court shall be final or conclusive shall be a sufficient accepting provision within the meaning of sub-section (1).
১৪ ও ১৬ ধারা একসঙ্গে পড়লে এটি প্রতীয়মান হয় যে, এই অধ্যাদেশবলে বা তার অধীনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জারিকৃত কোনাে আদেশকে প্রশ্ন করার ব্যাপারে আদালতের এখতিয়ার ১৬ ধারায় বারিত হলেও ১৪ ধারা কেবল সেই অধ্যাদেশ কিংবা অধ্যাদেশের অধীনে প্রণীত কোনাে বিধি বা কোনাে বিধির অধীনে জারিকৃত আদেশ সম্পর্কে সাধারণ ফৌজদারি বা দেওয়ানি আদালতের এখতিয়ার প্রয়ােগ বহাল রেখেছে। অধ্যাদেশের অধীনে প্রণীত অধিকাংশ বিধিতে লঙ্ঘনের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। আদেশ লঙ্ঘনের অভিযােগে তল্লাশি, জব্দ, অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও বিচারের প্রক্রিয়া পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ১৮ ভাগে বিধৃত রয়েছে। ফলে, এটা পরিষ্কার যে, সাধারণ ফৌজদারি আদালত কেবল অধ্যাদেশের অধীনে প্রণীত বিধি ও আদেশের প্রত্যক্ষ বিধানাবলি অনুসারে এখতিয়ার প্রয়ােগ করতে পারবে এবং অপরাধীদের বিচার করতে পারবে। জারিকৃত আদেশ লঙ্নের জন্য আলােচ্য ৫২ বিধিতেও বিচারের বিধান রাখা হয়, কিন্তু ১৯(৯), ২৫(৪) ও ১৩০(৩) ধারার মতাে ফৌজদারি আদালত কর্তৃক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের বিচার করার বিধান রাখা হয়নি, এমনকি বিচারের বিধানই রাখা হয়নি। এর অর্থ হলাে, একদিকে ৫২(২) বিধির অধীনে বাজেয়াপ্তকরণ আদেশকে প্রশ্ন করার আদালতের এখতিয়ার অধ্যাদেশের ১৬ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয়, অন্যদিকে অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্তসংক্রান্ত বিচারের বিধান থাকার পরেও সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির জন্য কোনাে প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এরকম পরিস্থিতিতে, বস্তুনিষ্ঠতার ভিত্তিতে ৫২(২) বিধির অধীনে জারিকৃত বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ হবে চূড়ান্ত এবং
২৫৩
প্রশ্নাতীত। যদিও সেই বিধিতে বা অধ্যাদেশের ১৪ ধারার (২) উপধারা অনুযায়ী অন্য কোথাও এরকম আদেশের চূড়ান্ততা দেওয়া হয়নি। (উল্লেখযােগ্য যে, ১৩১(৭) ও ১৩৩(৬) বিধি হলাে অনুরূপ চূড়ান্ত অবস্থার উদাহারণ। এর ফলে এমন একটা দুর্বল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যেখানে ৫২(২) বিধি অনুযায়ী জারিকৃত নির্বাহী আদেশ, স্পষ্টভাবে চূড়ান্ত বলা না হলেও, কার্যত চূড়ান্ত এবং প্রশ্নাতীত হয়ে যাবে। এটা আইন-প্রণেতাদের উদ্দেশ্য হতে পারে না। তাছাড়া, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে বিচারের বিধান না থাকার ফলে বাজেয়াপ্তকরণের আদেশের চূড়ান্ততা (finality) কার্যত মনােকল্পিত সন্তুষ্টি ও বিচারমুখী
সন্তুষ্টির মধ্যে ব্যবধান দূর করবে, যা নির্বাহী কার্যক্রমের জুডিসিয়াল রিভিউর ক্ষেত্রে খুবই অত্যাবশ্যক।
৭৫. এটি একটি যুক্তিনির্ভর নীতি যে, আইনে ভিন্ন কিছু না থাকলে একই ব্যক্তি প্রসিকিউটর ও বিচারক হতে পারেন না। আদালত অবমাননার এখতিয়ার প্রয়ােগের ক্ষেত্রে এই নীতির ব্যতিক্রম দেখা যায়। যদি অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারা মােতাবেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের জন্য আদালত বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষের দ্বারা বিচারের বিধান না রাখা হয়, তাহলে ৫২(২) ধারার অধীনে বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ উপরােক্ত নীতির বিরােধী হবে।
৭৬. লর্ড কোকের বয়ানে ইতােমধ্যে বলা হয়েছে যে, বিচারকের পদে আসীন ব্যক্তি সবসময় এমন ব্যাখ্যা প্রদান করবেন যা অন্যায়কে দমন করবে এবং প্রতিকার বিধান করবে। কোনাে আইন ব্যাখ্যার এই সুসংহত নীতি Muhammad Haroon vs. Crown 1951 3 DLR 408 মামলায় আমাদের ফেডারেল। কোর্ট এভাবে পুনর্ব্যক্ত করেছেন :
“According to what was stated in Heydon’s case (1584) 3 Rep. 7(b); some four hundred years ago, by Lord Kenya in Turtle v. Hartwell (,1795) 8 T.R. 429, more than, one hundred fifty years ago, and by Cockburn, C.J. in Twycross v. Grant (1877) 2 C.P.D. 30, seventy years ago, it is the duty of a Judge to place such a construction on a statute as shall ‘suppress the mischief and advance the remedy.”
Woking Muslim Mission v. Crown (1956) 8 DLR (FC) 116 মামলায় পাকিস্তান ফেডারেল কোর্ট রায় দিয়েছেন যে :
“Though a Court of Law has nothing to do with the reasonableness or unreasonableness of a statutory provision, the reasonableness or otherwise of the interpretation is relevant to interpret what the Legislature has said, and in determining either the general object of the Legislature or the meaning of its language in any particular passage, it is obvious that the intention which appears to be most in accord with convenience, reason, justice and legal principles should, in all cases of doubtful significance, be presumed to be true one.” Maxwell on Interpretation of Statutes-(Eleventh Edition) গ্রন্থের ১৮৩ পৃষ্ঠায় একই নীতি বর্ণিত হয়েছে।
৭৭. ম্যাক্সওয়েল-এর গ্রন্থের ১৯৩ পৃষ্ঠায় পরবর্তী সেই নীতি বিবৃত হয়েছে এবং তা হলাে: যখনই আইনপ্রণেতাদের ভাষ্যের মধ্যে দু রকম ব্যাখ্যার সুযােগ থাকে এবং একরকম ব্যাখ্যা করা হলে তা
২৫৪
নিশ্চিতভাবে অবিচারের দিকে নিয়ে গড়ায়, তখন আদালত এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেবে। আইন-প্রণেতাদের উদ্দেশ্য এরকম হতে পারে না যদি না তাঁদের অভিপ্রায় স্পষ্ট শব্দে প্রতিভাত হয়।
৭৮. প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফায় সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারসংক্রান্ত বিধান যদি উপরােক্ত আইনি নীতিমালার আলােকে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে সেই বিধান প্রণয়ন করার পেছনে আইনপ্রণেতাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যের ব্যাপারে কোনাে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকবে না। কারণ নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের মাধ্যমে নাগরিকের প্রতি অবিচারের শাস্তির বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা কোনােভাবেই আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্য বলে ভাবা যাবে না। অন্যায়কে দমন এবং প্রতিকারের বিধান করা’র সেই বিধানকে অবশ্যপালনীয় হিসেবে ব্যাখ্যা করা যুক্তি ও ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যদি সেই বিধানকে কেবল অনুমতিদায়ক বা নির্দেশনামূলক হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, তাহলে সেটা কার্যত প্রতিকারকে অবদমন করবে এবং অন্যায় বৃদ্ধি করবে, যা শংকাজনক ফলাফল বয়ে আনবে এবং সেটি হবে সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুবিদিত আইনি নীতিমালার বিরােধী।
৭৯. Attorney-General of Canada Vs. Hollett Carey Ltd. (DLR 1952 PC 29) মামলায় এটি সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আরেকটি সর্বজনবিদিত সাধারণ নীতি হলাে, যেসব আইন জনগণের অধিকার সংকুচিত করে সেসব আইন কঠোর ব্যাখ্যা সাপেক্ষতার অধীন। ম্যাক্সওয়েলের (একাদশ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২৭৬) মতে,
“It is presumed, where the objects of the act do not obviously imply such an intention, that the Legislature does not desire to confiscate the property or to encroach upon the right of persons, and it is, therefore, expected that, if such be its intention, it will manifest it plainly if not in express words at least by clear implication and beyond reasonable doubt.”
৩(৩) ধারার (iii) দফার সুস্পষ্ট বিধানের আলােকে এটা পরিষ্কার হয় যে, বিচারের ব্যবস্থা রাখা ছাড়া সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা আইন-প্রণেতাদের উদ্দেশ্য ছিল না।
৮০. ১৯৪৫ সালের ৩৫ নম্বর আইন দ্বারা সংশােধিত ভারত প্রতিরক্ষা আইনবলে যােগ হলাে বহির্গত পরিস্থিতি এবং আইন-ব্যাখ্যার সুপ্রতিষ্ঠিত নীতিমালা এবং অন্যান্য আইনি নীতিমালা, বিশেষত এই বিধান অমান্য করলে যে মারাত্মক অবিচার বয়ে আনবে ইত্যাদির আলােকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফায় উপধারায় উল্লিখিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত সংক্রান্ত বিচারের বিধান বিবেচনার পর আমার কোনাে দ্বিধা নেই যে, উপরােক্ত অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফায় উপদফায় প্রদত্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা এর সঙ্গে দায়িত্বও অর্পিত হয়েছে, যা সুরক্ষিত রাখা ন্যায়বিচারের জন্য বাধ্যতামূলক। এর সমর্থনে আমি ক্রফোর্ডের Statutory Construction গ্রন্থের ৫৩০ পৃষ্ঠার থেকে উদ্ধৃতি দিয়েই তৃপ্ত হব :
“But if the public interest or private rights call for the exercise of the power vested in a public official, the language used, though permissive or directory in form, is in fact peremptory or mandatory, as a general rule.”
চূড়ান্ত বিচারে আমার মত হলাে, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে বিচারসংক্রান্ত পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফার বিধান বাধ্যতামূলক। কারণ, যখন কোনাে বিধি প্রণয়ন-ক্ষমতাবলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের জন্য বিধি প্রণয়ন করা হয়, তখন সেই বিধি কার্যকরী হওয়ার জন্য আদালত বা
২৫৫
অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সেই বাজেয়াপ্তকরণ সংক্রান্ত বিচারের বিধান রেখে আরেকটি বিধি প্রণয়ন করতে হয়।
৮১. পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারা, (২) উপধারার মতাে কেবলই ব্যাখ্যামূলক। তবে (১) উপধারার অধীনে প্রদত্ত সাধারণ বিধি প্রণয়ন ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণমূলক নয়। এই বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল Emperor o. Sibnath Banerjee, AIR 1945 PC 156 মামলায় প্রিভি কাউন্সিল প্রদত্ত রায় উদ্ধৃত করেন। উদ্ধৃত মামলায় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (১) ও (২) উপধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ভারত প্রতিরক্ষা আইনের (১) ও (২) উপধারার মধ্যে তুলনামূলক অবস্থান মূল্যায়ন করা হয় এবং প্রিভি কাউন্সিলের সম্মানিত লর্ডগণ (২) উপধারার শুরুর কথাগুলাে without prejudice to the generality of the powers conferred by sub-section (1) বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত দেন যে, ভারত প্রতিরক্ষা আইনের ২ ধারার (২) উপধারা ব্যাখ্যামূলক এবং এই উপধারার বিধানাবলি ২ ধারার (১) উপধারা নিয়ন্ত্রণমূলক নয়। এই মামলার রায় এখানে বিশেষ কোনাে কাজে আসবে না, কারণ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ভারত প্রতিরক্ষা আইনের ২ ধারার (৩) উপধারাটি প্রিভি কাউন্সিলের জুডিসিয়াল কমিটির বিবেচনার জন্য উত্থাপিতই হয়নি।
৮২. এটা পরিষ্কার যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার (২) ও (৩) উপধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থান সম্পর্কিত। উপধারা (২) শুরু হয়েছে এভাবে- ‘Without prejudice to the generality of the powers conferred by sub-section (1)’, যা (৩) উপধারার ক্ষেত্রে সেরকম নয়. যেটি শুরু হয়েছে 90168- “The Rules made under sub-section (1) may further provide” ug parec দিয়ে। ফলে, এই রায়ের আগের অংশে ইতিমধ্যে (৩) উপধারার ৩ ধারার (১) উপধারার অধীনে সাধারণ বিধি প্রণয়ন ক্ষমতার বিধিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে।
৮৩. ৩ ধারার (৩) উপধারা যে কেবল ব্যাখ্যামূলক নয়, তা আরাে বেশি পরিষ্কার হয়ে উঠে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থেকে যে, এই উপধারাতেই কারাদণ্ড, জরিমানা ও বাজেয়াপ্তকরণ সংক্রান্ত বিধান বিধৃত রয়েছে। মূল আইনে কর্তৃত্ব দেওয়া না থাকলে বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ বিধি প্রণয়ন করে শাস্তির বিধান করতে পারেন না। এটা আইন প্রণয়নের এই প্রতিষ্ঠিত নীতিমালার কারণেই হয়েছে যে, আইনসভা ছাড়া কোনাে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করা ও সেটার শাস্তির সুপারিশ করা যায় না। কিন্তু আইনসভা কেবল সাধারণ নীতি বা নির্দেশনা এবং সর্বোচ্চ শাস্তি বিধৃত করতে পারে। মূল আইনে প্রস্তাবিত সীমার মধ্যে শাস্তি নির্ধারণের কাজটা অধস্তন আইন-প্রণয়নকারী (the maker of subordinate legislation) কর্তৃপক্ষের উপর ছেড়ে দেয়। ৩ ধারার (৩) উপধারায় এই বিধানই রাখা হয়েছে। ফলে, (৩) উপধারায় শাস্তি সম্পর্কে এরকম বিধান থাকার পরে এটা বলা যায় না যে, তা কেবল (২) উপধারার মতাে (১) উপধারার অনুরূপ ‘ব্যাখ্যামূলক’। আরেকটা বিষয় থেকে এটা আরাে পরিষ্কার হবে যখন দেখা যাবে যে, (৩) উপধারায় বিধৃত শাস্তির সীমা অতিক্রম করে (১) উপধারার অধীনে প্রণীত কোনাে বিধি প্রণয়ন করা যাবে না। কারণ, এরকম ক্ষেত্রে আইনের মূল বিধানের আওতাবহির্ভূত হওয়ার কারণে বিধিটিই স্বয়ং এখতিয়ারবহির্ভূত হয়ে যাবে।
৮৪. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের পরবর্তী যুক্তি ছিল যে, ৩ ধারার (৩) উপধারা কেবল নির্দেশনামূলক। উপধারা(৩)-এর সকল বিধান নির্দেশনামূলক কিনা তা এখানে বিবেচ্য বিষয় নয়। কাজেই, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারসংক্রান্ত কেবল (iii) দফাই আমাদের জন্য এখানে প্রাসঙ্গিক। আইন-ব্যাখ্যার
২৫৬
অভ্যন্তরীণ ও বহির্গত সহায়ক সূত্রের সাহায্যে উপরােক্ত দফার সংশ্লিষ্ট বিধান সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা-পর্যালােচনার পর ইতিমধ্যে দেখা গেছে যে, ৩(৩) ধারার (iii) দফা মােতাবেক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিধান প্রণয়ন করলে, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারসংক্রান্ত বিধি-প্রণয়ন করাটাও। বাধ্যতামূলক। যদি এটা মেনেও নেওয়া হয় যে, উক্ত দফার বিধানটি কেবল নির্দেশনামূলক, তবু বিধি-প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের একটা অবহেলা রয়ে যায়। কারণ ৫২(২) বিধির অধীনে বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষমতাসংক্রান্ত উপরােক্ত বিধান এখন পর্যন্ত উল্লেখযােগ্য পরিমাণে মানা হয়নি। ম্যাক্সওয়েলের গ্রন্থে (একাদশ সংস্করণ, ৩৬৩ পৃষ্ঠা) বর্ণিত সাধারণ নিয়ম হলাে অনন্যসাপেক্ষ আইন অবশ্যই হুবহু প্রতিপালন করতে হবে। তবে কোনাে নির্দেশনামূলক আইন উল্লেখযােগ্যভাবে প্রতিপালন করলেই যথেষ্ট হবে। Punjab Co-operative Bank Ltd v. Income Tax Officer Lahore (AIR 1940, PC 230) মামলায় ভাইকাউন্ট মম (Viscount Maugham) এই নীতি উল্লেখ করেছেন। তবে বর্তমান মামলায়। বিধি-প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষ সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচারসংক্রান্ত বিধান উল্লেখযােগ্য মাত্রায় মানার বিষয়ে কিছুই করেনি। ৫২(২) বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে মনস্থ হওয়ার ক্ষেত্রে কাউকে নােটিশ দেওয়ার কোনাে বিধিই তাে প্রণীত হয়নি, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দেওয়া তাে বহু দূর। এটা সত্য যে, তর্কিত আদেশে দরখাস্তকারীকে তার প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের আদেশের বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের কাছে বক্তব্য পেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাজেয়াপ্ত করার পর বক্তব্য দেওয়ার সুযােগ দেওয়ার প্রচলিত রীতিটা আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের একটি অকারণ কাজ। এরকম বক্তব্য প্রদান কোনাে বিধি মেনে দেওয়া হয়নি। এই বক্তব্য প্রদান কোনাে অধিকারবলে তাঁকে দেওয়া হয়নি বলে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ না দিয়েই বাজেয়াপ্তকরণের আদেশদাতা সেই সুযােগ সরাসরি বাতিল করতে পারেন। Abul Ala Maududi cuse (1965) 17 DLR (SC) 208 at page 260 মামলায় মাননীয় বিচারপতি এস. এ. রহমান একই মতামত ব্যক্ত করেন : “to make a representation to the Government against the action taken under Act XIV of 1908, suffers from the infirmity that such a representation would not be based on a right and could be rejected summarily by the Government, on that basis.”
৮৫. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের রূপরেখা এরকম যে, যেসব ক্ষেত্রে বাজেয়াপ্তকরণের সিদ্ধান্ত উচ্চ পর্যায়ে হয় সেসব ক্ষেত্রে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের বিচার হয় না। এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল ৫২(২), ৫৫, ৯২(৩) ও ১৬২(৪) বিধির কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আমি এটাকে শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারছি না। নিঃসন্দেহে এসব বিধিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব বিধির অধীনে প্রদত্ত ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকার বা সরকারি কর্মচারীদের অনুকূলে হস্তান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা সব সময়ই থেকে যায়। প্রকৃতপক্ষে এসব বিধি মােতাবেক বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষমতা ইতােমধ্যে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখ-সম্বলিত (iii) (৪) ৬৫ নম্বর এস.আর.ও-র মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রাদেশিক সরকারকে দেওয়া হয়েছে। এরপর প্রাদেশিক সরকার চাইলে অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৫) উপধারা অনুযায়ী তাদের কর্মকর্তাদের সেই ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে, একটি আদেশ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের আদেশ হলেও গভর্নর নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং আদেশ জারি করার তার প্রয়ােজন থাকবে না। এটি জরুরি নয় যে, গভর্নরের নিজেরই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সরকারপক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনাে কর্মকর্তার কোনাে আদেশ সংবিধানের অধীনে গঠিত রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী সেটিও গভর্নরপ্রদত্ত আদেশ বলে গণ্য হবে। সুতরাং,
২৫৭
বাজেয়াপ্তকরণের সিদ্ধান্ত উচ্চ পর্যায়ে নেওয়া হলে বিচারের প্রয়ােজন নেই— এই এই যুক্তিতে আমি কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাই না।
৮৬. এই প্রসঙ্গে দরখাস্তকারীর বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব মাহমুদ আলী যুক্তি দেখান যে, দরখাস্তকারীকে কেবল প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের বিচার পাওয়ার আইনি প্রতিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়নি, তাঁকে ন্যাচারাল জাস্টিস (বিচারের প্রাকৃতিক বিধান) থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। বিজ্ঞ আইনজীবীর মতে, ন্যাচারাল জাস্টিস আইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিধায় দরখাস্তকারীকে অন্তত একবার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দেওয়া উচিত ছিল। নিজ বক্তব্যের সমর্থনে Chief Commissioner, Karachi o. Mrs. Dina Sohrab Katrak 1959 11 DLR SC 53, Messrs Faridsons Ltd. v Government of Pakistan 1961 13 DLR SC 237, Province of east Pakistan v. Nur Ahmed 1964 16 DLR SC 375, Tofazzal Hossain province of east Pakistan 1965 17 DLR 498 and Ridge v. Baldwin 1964 AC 40 মামলার পর্যবেক্ষণসমূহ উদ্ধৃত করে বিজ্ঞ আইনজীবী বলেন, বাজেয়াপ্তকরণের তর্কিত আদেশটি ন্যাচারাল জাস্টিসের বিধান লঙ্ঘন করেছে বিধায় তা বাতিল (void)।
৮৭. এর জবাবে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন যে, ন্যাচারাল জাস্টিস অপরিবর্তনীয় (inflexible) নয়। অত্যাবশ্যক জনস্বার্থ, প্রশাসনিক দক্ষতার বাস্তব কারণ, শান্তিশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থার স্বার্থে এই নীতির ব্যতিক্রম রয়েছে। এই যুক্তির সমর্থনে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল Abul A’la Maudoodi 17 DLR (SC) 209 মামলায় ২৩৭, ২৩৮, ২৩৯, ২৮৪ ও ২৮৯ পৃষ্ঠায় আমাদের সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞ বিচারকদের পর্যবেক্ষণের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু সেখানে বিজ্ঞ বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণে এরকম কোনাে নীতি ঘােষিত হয়নি যে, জরুরি অবস্থার সময় বিষয়মুখ নিরূপণ সাপেক্ষে নিবর্তনমূলক আটকের ক্ষেত্রে ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি স্থগিত থাকে। সেটা ছিল নিবর্তনমূলক মামলা। আর এখানে বিবেচ্য আদেশটি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। কারণ বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ জারি করা হয়েছিল ৫২(১) বিধির কথিত লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার পুরােটা জুড়েই নিবর্তনমূলক ও শাস্তিমূলক পদক্ষেপের মধ্যকার ব্যবধান বজায় রাখা হয়েছে। তাছাড়া অধ্যাদেশের ১৫ ধারা ও বিধিমালার ১৬০ বিধি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে অধ্যাদেশ ও বিধিমালা সচেষ্ট থেকেছে। তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণ আদেশটি যেহেতু বাস্তবতা/বিষয়মুখ নিরূপণের ভিত্তিতে গৃহীত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ, সেহেতু, এখানে ন্যাচারাল জাস্টিসের নীতি কঠোরভাবে প্রযােজ্য। প্রতীয়মান হয় যে, এই মামলায় ৫২(১)(খ) বিধি মােতাবেক ৭ জুন সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ জারি করা হয় এবং ৯ জুন ১৯৬৬ ও তার আগের কয়েকটি তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক’-এ কিছু মতামত, বিবৃতি ইত্যাদি প্রকাশের বিষয়ে তর্কিত আদেশটি জারি করা হয় ১৬ জুন ১৯৬৬ তারিখে। ফলে, তর্কিত আদেশটি জারি করার পূর্বে দরখাস্তকারীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দেওয়ার সময় ছিল। দরখাস্তকারীর কেবল একটি প্রেসের মালিকানা থাকাটাই নিরাপত্তা, শান্তি-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ইত্যাদির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে না, যদি না সেগুলাে ব্যবহার করার স্বাধীনতা তার থাকে। যদি দরখাস্তকারী ৫২(১)(খ) বিধির অধীনে প্রণীত নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ন করে থাকেন বা করার অবস্থায় থেকে থাকেন, তাহলে ১৯৮ সাধারণ বিধির অধীনে প্রেস বাজেয়াপ্ত করার এবং ব্যাপক ক্ষমতা নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ৫২(২) বিধি অনুযায়ী প্রেসের ডিক্লারেশন বাতিল করার ব্যাপক ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের ছিল। এসব কারণে এই মামলায় ন্যাচারাল জাস্টিসের নীতি প্রযােজ্য নয় মর্মে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি গ্রহণ করতে আমি অপারগ। যেহেতু, আমি ইতােমধ্যেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, বিচারের বিধানের অনুপস্থিতিতে বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ অকার্যকর, সেহেতু, যথাযথভাবে বলতে
২৫৮
গেলে আমার মনে হয়েছে, ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি প্রয়ােগের প্রশ্ন এখানে উঠেই না। যা হােক, যে কোনাে বিবেচনায় আমার মত হলাে তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ আইনত দোষণীয় এবং অকার্যকর।
বিচারপতি সালাহউদ্দীন আহমেদ
৮৮. একটি বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে আমি আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি সিদ্দিকীর প্রজ্ঞাপূর্ণ রায়ের সঙ্গে একমত পােষণ করছি। তার প্রস্তাবিত আদেশের সঙ্গেও আমি একমত। তবে তা ভিন্ন একটি কারণে। তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই এই অভিমতের সঙ্গে একমত হতে পারছি না যে, প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের অ্যাডজুডিকেশন সংক্রান্ত বিধান না রাখায় পকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার (এরপর থেকে শুধু বিধিমালা) ৫২(২) বিধি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ (এরপর থেকে শুধু ‘অধ্যাদেশ’)-এর এখতিয়ারবহির্ভূত। বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি সিদ্দিকী মামলার ঘটনা পর্যাপ্ত বর্ণনা করেছেন এবং আমি তা পুনরাবৃত্তি করার প্রয়ােজনীয়তা দেখি না। সুতরাং সরাসরি আদালতে উপস্থাপিত যুক্তিগুলাের দিকে চলে যাই।
৮৯. বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক-আলােচনা শুরু করার আগে মামলার ঘটনা ও আইন যথার্থভাবে অনুধাবনের জন্য কিছু বিষয় সামনে নিয়ে আসা যুক্তিযুক্ত।
৯০. মারাত্মক জরুরি পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেন এবং ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫ জারি করেন। জরুরি পরিস্থিতি এখনাে বিদ্যমান কিনা একমাত্র প্রেসিডেন্টই তা মূল্যায়ন ও নির্ধারণ করতে পারেন। ফলে, আইনের চোখে এখনাে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান এবং আমরা এ-ব্যাপারে আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না।
৯১. এটা মনে রাখা দরকার যে, পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক ও ভয়াবহ বলে বিবেচিত হয়েছিল যে, সংবিধান সংশােধনীর মাধ্যমে (৩০ (৯) ও (১) অনুচ্ছেদবলে) পাকিস্তানের সংবিধানে বিধৃত ১৯টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে ১১টি স্থগিত করতে হয়েছিল। এই ১১টি অধিকার গ্রেফতার ও আটকাদেশ থেকে সুরক্ষা, দাসপ্রথা ও বাধ্যতামূলক শ্রম নিষিদ্ধকরণ, চলাফেরার স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পেশার স্বাধীনতা, সম্পত্তির অধিকার, নাগরিকের সমতা এবং চাকরিতে বৈষম্য থেকে সুরক্ষা-সম্পর্কিত। সংবিধানের ৩০(১০) অনুচ্ছেদের অধীনে জারিকৃত এক আদেশে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেন যে, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৭ নম্বর মৌলিক অধিকারসমূহ এবং সেগুলাে প্রয়ােগ কিংবা সেগুলাে লঙ্ঘন হয়েছে কিনা তা নির্ধারণের প্রশ্নে আদালতে গৃহীত কার্যক্রম জরুরি অবস্থা কার্যকর থাকাকালীন স্থগিত থাকবে। এটা উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের অধীনে
হাইকোর্টের অন্য সকল অধিকার অবিঘ্নিত হয়।
৯২. উপরােক্ত প্রতিটি অধিকারই মৌলিক প্রাকৃতিক অধিকার এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ বা audi altering pattern নীতির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবু এটি বিবেচনা করা অনিবার্য যে, রাষ্ট্র ও তার জনগণের সামগ্রিক অস্তিত্বকে ভয়ানক বিপদাপন্ন করে তােলার সময়ে সর্বোচ্চ চাহিদা মােকাবিলা করতে গিয়ে এই অধিকারগুলােকে হিমঘরে পাঠানাে হয়েছিল কিনা। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ ও সে অনুযায়ী প্রণীত বিধিমালায় নির্বাহী বিভাগকে প্রদত্ত ক্ষমতা অবশ্যই খুব ব্যাপক ও অত্যন্ত কঠোর। তবে সেগুলাে অস্থায়ী। এটাই একমাত্র উদাহরণ নয় যে, সেক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগ এরকম ক্ষমতাপ্রাপ্ত। প্রাসঙ্গিক কিছু উদাহরণ। হিসেবে আমরা ইংল্যান্ড ও স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতের কথা বলতে পারি, যেখানে নির্বাহী বিভাগকে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল এবং এটার প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে কখনােই প্রশ্ন করা হয়নি। সুস্পষ্ট প্রয়ােজনীয়তার কারণে এবং মারাত্মক জাতীয় জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করার জন্য এটা প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে, কেবল
২৫৯
জরুরি অবস্থা পর্যন্তই তা টিকবে বিধায় জনগণ এটা মেনে নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই আমি তর্কিত আদেশের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের সামনে উপস্থাপিত বিভিন্ন যুক্তি-তর্ক নিয়ে আলােচনা করতে চাই।
৯৩. একটি যুক্তি দিয়ে শুরু করব যা আমার অনুভূতিকে নাড়া দিয়েছে। ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি, audi alteram pattern-র লঙ্ঘন করে আদেশটি জারি করা হয়েছে মর্মে দাবি করে তর্কিত আদেশটি অবৈধ দাবি করা হয়েছে। এটা স্বীকৃত যে, প্রেস বাজেয়াপ্ত করার আগে বা পরে কেন তর্কিত আদেশটি জারি করা হবে না সে মর্মে দরখাস্তকারীকে কারণ দর্শানাের সুযােগ দেওয়া হয়নি। এটা স্বীকৃত যে, যুক্তি দেওয়া হয় যে, অধ্যাদেশ দ্বারা বিধিটি সুনির্দিষ্টভাবে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সেটি অবশ্যই মানতে হবে। দাবি করা হয় যে, বিধিটি জরুরি অবস্থার সময়ে নিবর্তনমূলক ঘটনার ক্ষেত্রে শিথিল করা যেতে পারে, তবে শাস্তিমূলক ক্ষেত্রে কখনােই নয়। আরও দাবি যে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘটনায় বিধির শর্তাবলি অনুযায়ী অবশ্যই পূর্ব-শুনানির সুযােগ দিতে হবে এবং যতই জরুরি অবস্থা বা অত্যাবশ্যকতা থাকুক না কেন তা পরিহার করা যাবে না।
৯৪. জবাবে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন যে, বিধিটি অনমনীয়/অশিথিলযােগ্য এবং সাধারণ নীতির ব্যতিক্রম। তিনি যুক্তি দেন যে, জরুরি অবস্থায় জনগণের প্রয়ােজন, শান্তিশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা, নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক বাস্তবতায় বিধিটি শিথিল করা হয়েছে। তিনি দাবি করেন যে, বিধির শর্ত অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ-পরবর্তী শুনানির সুযােগ প্রদান বিধির পর্যাপ্ত প্রতিপালন বলে বিবেচিত হয়েছে। তিনি বলেন, তর্কিত আদেশেই আদেশের বিরুদ্ধে রিপ্রেজেন্টেশন করার সুযােগ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরাে বলেন, গুরুতর জরুরি অবস্থায় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় তাৎক্ষণিক ও অত্যাবশ্যক পদক্ষেপ জরুরি ছিল এবং এর ফলে, পূর্ব-শুনানির সুযােগ দেওয়া যায়নি।
৯৫. যার যার যুক্তির সমর্থনে আদালতে নজিররূপে উল্লেখ করা মামলাগুলাে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমি দেখতে পাই যে, Abul A’la Maududi (1965) 17 DLR SC 209 মামলায় বিচারপতি এস. এ. রহমানের যথাযথ সারসংক্ষেপ মতে, ন্যাচারাল জাস্টিস নীতিটি কেবল বিচারিক ও আধা-বিচারিক কার্যক্রমেই নয়, বরং প্রশাসনিক কার্যক্রমেও প্রযােজ্য, যদি না সংশ্লিষ্ট আইনে এর প্রয়ােগ বারিত করা হয় এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে ঘটনার বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সন্তুষ্টির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। (1966) 18 DLR SC 422 পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সুপ্রীম কোর্টের সাম্প্রতিক মামলায় পর্যবেক্ষণ হলাে :
“… This Court in the case of the University of Dacca vs. Zakir Ahmad [(1963) 2WR 947). It was observed therein that “whenever any person, or body of persons, is empowered to take decisions, after ex post facto investigation into facts which will result in consequences affecting the person, property or other rights of another person, then, in the absence of any express words in the enactment giving such power, excluding the application of the principles of natural justice the Courts of law are inclined generally to imply that the power so given is coupled with a duty to act in accordance with such principles of natural justice as may be applicable in the facts and circumstances of a given case.” This is the principle embodied in the maxim audi alteram partem and has been applied by this Court in other cases where orders passed by administrative tribunals or authorities, affecting the rights of citizens, in point
২৬০
of property, or other rights, had been passed, without giving an opportunity for defense to the person concerned. “No one can be condemned unheard”, is one of the settled principles of law, and such a principle will be read into the relevant law, unless its application is excluded by express words. A duty is cast on every administrative Tribunal to act fairly and justly and with due regard to the principles of natural justice, unless specifically exempted from such a limitation. Mere omission from the relevant law, of a provision for notice, would not affect this position.”
যাই হােক, আমার কাছে মনে হয়েছে, ন্যাচারাল জাস্টিস নীতির প্রয়ােগ নিয়ে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের অনেক সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও এই নীতির প্রয়ােগ ও শর্তাবলি এখনাে পরিবর্তনশীল অবস্থায় আছে এবং আমার মতে ন্যায়বিচারের স্বার্থে তা-ই সঠিক। এই অবস্থান আদালতের হাতকে অবাধ রাখে এবং ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি প্রয়ােগের ব্যাপ্তি ও প্রয়ােজনীয়তা নির্ধারণের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। ফলে, এই নীতির প্রয়ােগ সুনির্দিষ্ট মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। অ্যাটর্নি জেনারেল যেসব নজিরের উপর নির্ভর করেছেন সেসব থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় যে, দরখাস্তকারীর দাবি মতে এই নীতি কেবল দরখাস্তকারীর পক্ষে দাবিকৃত নিবর্তনমূলক ঘটনার বেলায়ই শিথিলযােগ্য নয়। ১৯৬১ ১৩ DLR SC ৪৭ মামলায় এই বিধি শিথিল করা হয়েছে এবং পদক্ষেপ-পরবর্তী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগকে যথেষ্ট প্রতিপালন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই মামলায় বিচারপতি কাইকাউস (Kaikaus J) পর্যবেক্ষণ দেন যে :
“With regard to the first ground it has been admitted on behalf of the respondents that the order had in fact been passed without notice, their plea being that notice was unnecessary. On a consideration of the relevant provisions of the Sind Rent Restriction Act it appears to us that the Rent Controller was not bound to issue any notice before making an order under section 15. It will be observed that the order has to be passed when the premises are vacant or are about to become vacant obviously, speedy action has to be taken before the premises are occupied and a notice to the landlord before the order is made is impracticable. The interests of the landlord have been sufficiently protected by the grant of a right of revision. It is to be noted that section 15 provides for the service of the order on the landlord. This is a strong indication of the fact that the omission to provide for a notice before the order is made is deliberate. The provision that the order should be served on the landlord also suggests that the Order is made behind the back of the landlord. Had the intention been that the order should be made only after an opportunity to the landlord to show cause there is no reason why this should not have been expressly provided. Reliance was placed on behalf of the appellant on Chief Commissioner Karachi and another vs. Mrs. Dina Sohrab Katrak (1), wherein it had been laid down that an order affecting the liberty or
২৬১
property of a person should not be passed without an opportunity of hearing. That case does not lay down at what particular stage the opportunity is to be granted. What is required is a reasonable opportunity of hearing and under the circumstances an opportunity granted at the stage of revision is quite reasonable. On account of the fact that speedy action has to be taken opportunity for hearing cannot be given in a case like the present at the time the order is made, and if it is granted at a later stage the principle of natural justice that no order-affecting a person shall be made without an opportunity of being heard is not contravened. In any case, the intention of the legislature is in the circumstances quite clear that no notice was inquired at the stage of making the order.”
৯৬. উপরােক্ত নীতিমালার আলােকে আমি এটি বিবেচনা করব যে, বর্তমান মামলায় এই নীতি কতটা প্রযােজ্য। আমার কাছে মনে হয়, ৫২(২) বিধির অধীনে গৃহীত পদক্ষেপ একটি সম্পূর্ণ নির্বাহী পদক্ষেপ এবং তা বিচারিক বা আধা-বিচারিক কার্যক্রমের মধ্যে পড়ে না। যদিও এটা ঘটনার বস্তুনিষ্ঠতা নিরূপণের উপর ভিত্তি করে করতে হয়। ৫২(২) বিধিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদত্ত ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রকৃতি বিবেচনাতেই এর উপর বিচারের দায়িত্ব অর্পিত হয় না। আসলে দরখাস্তকারীর একটি প্রধান অভিযােগ হলাে যে, এই উপবিধিতে বিচারসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়নি। তবে অধ্যাদেশে ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি সুস্পষ্টভাবে নাকচ করা হয়নি। আমাদের সামনে উপস্থাপিত অসংখ্য নজিরের মূল কথা হলাে, যে প্রকৃতির কার্যক্রমই হােক না কেন, তা ন্যায্য ও যথাযথ প্রক্রিয়ায় হতে হবে।
বর্তমান মামলার এই প্রেক্ষাপটে Ridge os. Baldoin. (1963) 2 W.R. at page 947 মামলায় লর্ড রিডের (Lord Reid) এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণটি মনে রাখতে হবে এবং তা হলাে :
S
“It seems to me to be a reasonable and almost inevitable inference from the circumstances in which Defense Regulations were made and from their subject matter that, at least in many cases, the intention must have been to exclude the principles of natural Justice. War time secrecy alone would often require that, and the need for speed and general pressure of work were other factors…..”
যখন কোনাে ব্যক্তি (১) উপবিধির অধীনে জারিকৃত কোনাে আদেশ লঙ্ঘন করে তখন ৫২(২) বিধি কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রেস বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা প্রদান করে। আদেশ লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রতিপক্ষের দাবি হলাে : ৫২(১)(বি) বিধি মােতাবেক দরখাস্তকারীর বিরুদ্ধে একের পর এক তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ জারি করে সেখানে উল্লিখিত বিষয়ে লেখা প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং বাজেয়াপ্তকরণের প্রতিটি আদেশ জারির আগেই লজ্ঞান করা হয়েছে। এটা যদি সত্য হয় তবে প্রতিপক্ষের জন্য সেসব বিষয়ে লেখা প্রকাশ বন্ধ করার একমাত্র অনুমােদিত উপায় ছিল দ্রুত ও কার্যকরভাবে দরখাস্তকারীকে সেই লেখাগুলাে প্রকাশ করা থেকে নিবৃত্ত করার জন্য ঐ প্রেস, যেখানে তুর্কিত লেখাসমূহ প্রকাশ করা হচ্ছে তা বাজেয়াপ্ত করা। উপবিধি (১)-এর অধীনে প্রদত্ত আদেশ
২৬২
লঙ্ঘনের জন্য বিধিমালায় দুটি প্রতিকারের বিধান বিধৃত করা হয়েছে। যেমন : ১. আদেশ লঙ্ঘন করে প্রকাশিত দলিলের প্রত্যেক কপি ও এসব দলিল প্রকাশনার কাজে ব্যবহৃত ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স। অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০’-এ সংজ্ঞায়িত প্রেস বাজেয়াপ্ত করা এবং ২. লঙ্ঘনকারী ব্যক্তিকে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা। কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কোন পরিস্থিতিতে কোন প্রতিকার প্রয়ােগ করা হবে তা সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গুরুতর জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় এরকম অবস্থা দাঁড়াতে পারে যে, রাষ্ট্র ও তার নাগরিকদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি আনতে পারে এমন কর্মকাণ্ড প্রতিরােধ করার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে এবং এক্ষেত্রে নির্বাহী সরকারই একমাত্র সর্বোৎকৃষ্ট নির্ধারক (best Judge)। এমনকি এরকম ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও তার নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার প্রধান ও গুরুতর দায়িত্বভার যার উপর সেই নির্বাহী বিভাগ যদি দ্রুতগতিতে এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন না হয়, তাহলে অধ্যাদেশ প্রণয়নের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। অধ্যাদেশের প্রস্তাবনাতেই বলা আছে যে, নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও কিছু অপরাধের বিচারের বিধান করার জন্য অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছে। ফলে, এসব পরিস্থিতির কারণেই নির্বাহী বিভাগের কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত করা হয়েছে। কিন্তু তা এতটা নয় যা কর্তৃপক্ষের অসদুদ্দেশ্য বা খামখেয়ালিপূর্ণ কাজকে অনুমােদন করে। ঠিক এই কারণেই যখন কোনাে বিষয়ে উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়, তখন তর্কিত কার্যক্রম বা আদেশটির কোনাে যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তি আছে কিনা সেটা আদালতকে পরীক্ষা করতে হয়। তবে এর মানে এটা নয় যে, আদালত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য নিজের মতামত পরিবর্তন করবেন।
আদালতের জন্য যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে উপস্থাপিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ সদুদ্দেশ্য এবং কিছুটা যৌক্তিকভাবে পরিচালিত হয়েছে কিনা, যদিও সেসব ঘটনার ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আদালত হয়তাে একইভাবে সিদ্ধান্ত নিতেন না। ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমার মনে হয়। আদালতের সামনে দুটি পথই খােলা থাকে। একটা উপায় হলাে DLR (1965) 17 DLR (SC) at page 242-243 মামলায় প্রধান বিচারপতি কর্নেলিয়াসের মতে তর্কিত আদেশটির জুডিসিয়াল রিভিউ করা যেত। তাতে তর্কিত আদেশে অন্তর্বর্তীকালীন হস্তক্ষেপ না করে আদালত নিজেই ঘটনা-পরবর্তী শুনানি পরিচালনা করবেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করবেন এবং এরপর দেখবেন যে, প্রেসটি বৈধভাবে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিনা। অন্য উপায় যা আমাদের দেশে বিচারিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অধিকতর পরিমাণে গ্রহণ করা হয়, তা হলাে তর্কিত আদেশটি চূড়ান্ত করার পূর্বশর্ত হিসেবে দরখাস্তকারীকে কমপক্ষে ঘটনা-পরবর্তী শুনানির (ex post facto) সুযােগ দেওয়া। আমার মতে, ৫২ বিধির (২) উপবিধিতে দ্রুত একতরফা পদক্ষেপের কথা মনস্থ করা হলেও দরখাস্তকারীর এই যুক্তিতে কিছুটা জোর আছে যে, তাকে ঘটনা-পরবর্তী শুনানির সুযােগ না দিয়ে বাজেয়াপ্তকরণের মতাে এতটা কঠোর ও পূর্ণাঙ্গ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত হয়নি। শুনানিকালে দরখাস্তকারীকে হয়তাে প্রেস হতে বিতাড়িত না করার ব্যাপারে রাজি করাতে পারতেন কিংবা প্রেস বাজেয়াপ্ত না করে দরখাস্তকারীকে (৩) উপবিধি অনুযায়ী বিচারের মুখােমুখি করতে পারতেন এবং এর মাধ্যমে বাজেয়াপ্তকরণের কারণে চাকরি হারানাে ৩০০ লােকের চাকরি বাঁচানাের ব্যাপারে রাজি করাতে পারতেন। হতে পারে বর্তমান মামলায় লঙ্ঘনের প্রশ্নটি আসলে res ipsa loquitur নীতিসংক্রান্ত। তথাপি, দরখাস্তকারীকে অন্তত তার কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করার এবং তাঁর বিরুদ্ধে কেন প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের মতাে কঠোর সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে না- সেই মর্মে কারণ দর্শানাের একটা সুযােগ দেওয়া উচিত ছিল। যেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার একটা যৌক্তিক সম্ভাবনা থাকে, সেক্ষেত্রে ঘটনা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী যতটা সম্ভব ন্যাচারাল জাস্টিস নীতির উপর আদালত গুরুত্ব আরােপ করবেন। আমার মতে,
২৬৩
বর্তমান মামলায় প্রতিপক্ষ যেন আবেদনকারীকে তার প্রেস কেন বাজেয়াপ্ত করা হবে না সে মর্মে ঘটনা-পরবর্তী কারণ দর্শানাের সুযােগ দেয় সেই ব্যাপারে আদালত জোর দিতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে বিচারিক সিদ্ধান্তের অত্যধিক গুরুত্ব এবং এই মামলায় জড়িত সাধারণ একটি বিষয়ে আমি উপরােক্ত (1965) 17 DLR (SC) 209 মামলায় প্রধান বিচারপতি কর্নেলিয়াসের অভিমত মেনে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী এবং সে অনুসারে তর্কিত আদেশটি জডিসিয়াল রিভিউ সাপেক্ষ করার পক্ষে মত দিচ্ছি। তবে বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমি মনে করি যে, প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযােগ দরখাস্তকারীর প্রাপ্য এবং সেটা না করা পর্যন্ত (1965) 17 DLR (SC) 209 মামলায় বিচারপতি কায়কাউসের ভাষায় তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ অন্তর্বর্তীকালীন বা সাময়িক আদেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে শুনানির পর চূড়ান্ত আদেশ জারি না করা পর্যন্ত তা কার্যকর থাকবে। দরখাস্তকারী তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারেন- তাঁকে কেবল এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। সম্ভব হলে তাঁকে খরচ দিতে হবে এবং মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতির সঙ্গে বাস্তবে যতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য ততটুকু পর্যাপ্ত সুযােগ দিতে হবে।
৯৭. সুতরাং, আমি বিনা খরচায় রুলটি চূড়ান্ত করছি এবং ঘােষণা করছি যে, তর্কিত আদেশটি আইনি কর্তবিহীনভাবে জারি করা হয়েছে এবং এর কোনাে আইনি কার্যকারিতা নেই এবং প্রতিপক্ষকে আরাে নির্দেশনা দিচ্ছি যে, দরখাস্তকারীকে তার প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করার প্রয়ােজনীয় সুযােগ দিতে হবে।
৯৮. দরখাস্তকারী এই যুক্তিতে ৫২(২) বিধির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন যে, অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফা অনুযায়ী বাজেয়াপ্ত সংক্রান্ত বিচারের বিধান রাখা হয়নি। এটা খুব জোরালােভাবে দাবি করা হয় যে, অধ্যাদেশের ৩(১) ধারার অধীনে বিধিমালা তৈরির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে উপধারা (২) ও (৩)-এর শর্তাধীন যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা এই নীতির উপর নির্ভর করে যে, কোনাে আইনের বিশেষ বিধান সাধারণ বিধানকে খর্ব করে। বিশপ মামলা 5 A.C.214-এর বিবর্তিত নজিরের উপর নির্ভর করে দাবি করা হয় যে, বিধি প্রণয়ন ক্ষমতার সঙ্গে তা প্রয়ােগের দায়িত্বও যুক্ত এবং ৩ ধারার (৩) উপধারার may’ বলতে must’ বােঝায় এবং সেজন্য, ৫২(২) বিধি অনুযায়ী প্রেস বাজেয়াপ্তকরণ অবশ্যই বিচারসাপেক্ষে হতে হবে। এটা দাবি করা হয় যে, বাজেয়াপ্তকরণ যেহেতু শাস্তিমূলক বিধান, সেহেতু, অধ্যাদেশ হতে উদ্ভূত কোনাে বিধি স্বতন্ত্রভাবে সেই শাস্তি ঘােষণা করতে পারে না। এই কারণেই অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারার (iii) দফায় সেইরূপ বিধান রাখা হয়েছে। যুক্তি দেওয়া হয় যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিচারের বিষয়টি ৫২(২) বিধিতে গুরুত্বসহকারে পড়তে হবে। বিপরীতে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এই যুক্তি দেখান যে, ৩ ধারার (১) উপধারা পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের অধীনে প্রণীত সকল বিধির মূল উৎস এবং (২) ও (৩) উপধারা তার ব্যাখ্যা। ও নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। তার যুক্তির সমর্থনে তিনি Shib Nath Banerjee, AIR 1945 PC160 মামলার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করেন। তিনি আরাে যুক্তি দেখান যে, বিধান প্রণয়নের জন্য ৩ ধারার (৩) উপধারা হলাে ক্ষমতার প্রকৃতি কী হবে তা বলে এবং কোনাে নির্দিষ্ট ঘটনা ও অবস্থার দাবি অনুসারে এটা করা সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছানির্ভর। তিনি দাবি করেন যে, অধ্যাদেশ একটি জরুরি আইন বিধায় এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য এর সবচেয়ে উদার ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়ােজন।
৯৯, ৩ ধারার (১) উপধারায় প্রদত্ত ক্ষমতার সাধারণতার (generality) উপর উপধারা (২) কোনাে সীমাবদ্ধতা আরােপ করেনি মর্মে প্রস্তাবের সমর্থনে প্রিভি কাউন্সিলের প্রদত্ত রায়ে একটি নজির আছে। তবে প্রিভি কাউন্সিলের এই মামলা এই বিষয়টি আলােকপাত করে যে, বিধিতে বর্ণিত শাস্তি অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারায়
২৬৪
কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদত্ত ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত, ৩(১) ধারা থেকে নয়। অথরিটি উক্ত অধ্যাদেশের ৩(৩) ধারা থেকে বিধিতে বিধৃত শাস্তিবিধানের বিষয়টি উদ্ভূত ধরে নিলেও এই প্রশ্নটি আসে যে, এই উপধারা এটাকে বাধ্যতামূলক করেছে কিনা এবং শাস্তি হিসেবে সুপারিশকৃত বাজেয়াপ্তকরণের প্রত্যেক ক্ষেত্রে বিচারের বিধান অবশ্যই থাকতে হবে কিনা তা বিবেচ্য বিষয়। ৩(৩) ধারা নিম্নরূপ :
(3) The rules made under sub-section (i) may further
(iii) provide for the seizure, detention and forfeiture of any property in respect of which such contravention, attempt or abetment as is referred to in the preceding clause has been committed, and for the adjudication of such forfeiture whether by a court or by any other authority;
বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আমি একমত যে, এখানে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুমােদনকারী প্রকৃতির (enabling nature)। এই পর্যায়ে আইন ব্যাখ্যার কিছু প্রাসঙ্গিক নীতিমালা স্মরণ করা যেতে পারে।।
১০০. আইন-ব্যাখ্যার স্বীকৃত নীতিমালা অনুযায়ী কোনাে আইন যেভাবে আছে সেভাবেই আমাদের তা বুঝতে হবে এবং কী হওয়া উচিত তা ধরে নিয়ে নয়। আরেকটি সহায়ক নীতি হলাে, আইনের বৈধতা দিে সচেষ্ট হওয়া। এটা মনে রাখা দরকার যে, সকল ব্যাখ্যার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলাে আইনপ্রণেতাদের প্রকৃত অভিপ্রায় খুঁজে বের করা, কেবল ব্যাখ্যার জন্য ব্যাখ্যা নয়। মাঝে মাঝে সেই অভিপ্রায় রে পুরাে আইনটি পাঠ করতে হয়। এসব নীতি মাথায় রেখে আমরা দেখবাে ৩(৩) (iii) ধারা কী অর্থ বহন করে। আমার মতে ৩(৩) ধারায় উল্লিখিত বিষয়াবলি-সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার যে বিধি প্রণয়ন করে তার একটি কাঠামাে সেখানে রয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে এই উপধারায় কেন্দ্রীয় সরকারকে ৩(১) ধারার অধীনে প্রণীত বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় সে-সংক্রান্ত কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়েছে। জব্দ, আটক ও বাজেয়াপ্তকরণের জন্য কোন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কোনাে সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিচারের বিধান থাকবে কিনা, তা সম্পূর্ণতই কেন্দ্রীয় সরকারের নিজস্ব বিচার-বিবেচনার বিষয় এবং (“and”) আমার মতে (৩) (iii) উপধারার দুটি বিপরীত পছন্দের একটি বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্য কোনাে ব্যাখ্যার মানে দাঁড়াবে, কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনাে সুনির্দিষ্ট সম্পত্তির জব্দ, আটক ও বাজেয়াপ্তকরণের যে কোনাে একটি করতে হবে কিংবা কোনােটিই নয়। অর্থাৎ, তারা শুধু জব্দ, শুধু আটক কিংবা শুধু forfeiture-এর বিধান রাখতে পারবে না। তাছাড়া, (৩) উপধারাকে এর প্রেক্ষাপটে পাঠ করে পরিষ্কার হয় যে, ‘and for the adjudication of such forfeiture whether by a Court or by any other authority- একটা আলাদা ক্ষমতা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে বিবেচনা অনুযায়ী সেরূপ বিধান রাখা কেন্দ্রীয় সরকারের স্বেচ্ছাক্ষমতাধীন। ৩ ধারার (৩) উপধারা যা প্রকৰি অনুমােদনকারী (enabling in nature) তা উপধারার ৯ নম্বর দফা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। ৯ দফায় বলা হয়- ‘provide for charging fees in respect of the grant or issue of any license, permit, certificate or other document for the purpose of the rules’ এটা বলা বোকামি হবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া ৬ বিধি, যা কোনাে ব্যক্তিকে কোনাে নিষিদ্ধ জায়গায় প্রবেশে বারিত করে তা এখতিয়ারবহির্ভূত, কারণ সেখানে ফি (fees) আরােপ করার বিধান নেই। আইন-প্রণেতাদের অভিপ্রায় যদি এমন হতাে যে, বাজেয়াপ্তকরণের বিচারের বিধান করা কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক তাহলে তারা তা যথাযথ ভাষায় সহজে করতে পারতেন। একই দফায় may’ শব্দটিকে ভিন্ন অর্থে— অর্থাৎ এর স্বাভাবিক অর্থে এবং এর বাধ্যবাধকতা অর্থে পাঠ করা
২৬৫
দুরূহ। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত আইনের ব্যাখ্যার সাধারণ নীতিমালাগুলাে মাথায় রাখলে এটা স্তম্ভিত করে দিতে পারে যে, প্রেস বাজেয়াপ্তসংক্রান্ত ৫২(২) বিধিতে বাজেয়াপ্তকরণ সংক্রান্ত বিচারের বিধান রাখা হয়নি। তবে মারাত্মক জাতীয় জরুরি অবস্থায় ব্যতিক্রমী ঘটনায় বিচারের বিধান করা ছাড়াও আইনসভা শাস্তি নির্ধারণ করতে পারে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সম্মুখে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে বিচার ছাড়াই শাস্তির বিধান রয়েছে- এমন আইনকে মেনে নেওয়া আমাদের জন্য খুব কঠিন না-ও হতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এমনকি ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি বাতিল বা সংকুচিত করার ক্ষমতা আইনসভার রয়েছে। যদি কেন্দ্রীয় সরকার ৫২(২) বিধিতে বাজেয়াপ্তকরণ সংক্রান্ত বিচারের বিধান রাখতাে তাহলে সেখানে দরখাস্তকারীকে কেন তার প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হবে না মর্মে কারণ দর্শানাের নােটিশ পাঠানাে এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রশ্ন আসতাে। কিন্তু যেখানে আপত্তিকর লেখাগুলাে দেখেই আদেশের লঙ্ঘন প্রকাশ পায় এবং আদালতের মতে প্রায় অপরাধ সংঘটনের মতাে বিষয়ে বিচারের বিধান না রাখা খুব গর্হিত মনে না-ও হতে পারে, অন্তত প্রাথমিকভাবে তা-ই মনে হয়। এই ধারণা নতুন বা অপরিচিত নয়। অনেক আইন রয়েছে যেখানে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে শাস্তির বিধান রয়েছে। এই মামলায় আরেকটি দিকও আছে। সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও আদেশকে জুডিসিয়াল রিভিউতে পাঠানাে এবং সেগুলােতে ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি প্রয়ােগ করার স্বভাবজাত প্রবণতার ব্যাপারেও আইনপ্রণেতারা সচেতন ছিলেন। তারা এরকম জুডিসিয়াল রিভিউ ও নজরদারিকে কেন্দ্রীয় সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনাে স্বেচ্ছাচারী বা অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সুরক্ষা হিসেবে বিবেচনা করে থাকতে পারেন।
১০১. Julius vs. Lord Bishop of Oxford (1879) 5 A.C.214 মামলায় বিধৃত নীতিমালা আবেদনকারীর
এই যুক্তির পক্ষে কোনাে সমর্থন জোগায় না যে, ৫২(২) বিধিতে বর্ণিত বাজেয়াপ্তকরণের বিষয়টি বিচারের (অ্যাডজুডিকেশনের) বিধান রাখতে কেন্দ্রীয় সরকার ৩(৩) (iii) ধারার অধীনে বাধ্য। এই প্রসঙ্গে লর্ড চ্যান্সেলর আর্ল কেয়ার্নস ২২৮ পৃষ্ঠায় নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন :
“I will only add that if I am right in holding that the bishop has, under the statute, a discretion as to proceeding or not proceeding, in the way in which the Appellant calls upon him to do, your Lordships have not as it seems to me, any occasion or indeed any right to examine into the manner in which, or he principles upon which, that discretion has been exercised. For the exercise of that discretion the bishop, and the bishop alone, is responsible, and it would, in my opinion, be inconsistent to hold that his discretion is an answer to the application for a mandamus, and at the same time on that application, to criticize the ground upon which that discretion has been exercised.”
এই পর্যায়ে এটা স্মরণযােগ্য যে, উল্লেখযােগ্য সংখ্যক মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখাকে যদি উপযুক্ত বিবেচিত হয়, সেক্ষেত্রে, আইনপ্রণেতাগণ ভয়াবহ জরুরি অবস্থার সময় স্বাভাবিক পরিস্থিতির মতাে প্রত্যেক বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে বিচারের বিধান রাখা জরুরি মর্মে বিবেচনা করবেন— এটা কল্পনা করা যায় না। তবে যা হােক, আদালত তার ঐতিহ্য অনুযায়ী কোনাে ব্যক্তির দেহ বা সম্পত্তির মৌলিক অধিকারের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাতের ব্যাপারে সজাগ থাকবে এবং বর্তমান ক্ষেত্রে সতর্কতার সঙ্গে তর্কিত আদেশটি বিবেচনা করে দেখবেন যে, এই পরিস্থিতিতে ন্যাচারাল জাস্টিস নীতির প্রয়ােগ স্থগিত
২৬৬
থাকতে পারে কিনা এবং থাকলে তা কতটুকু স্থগিত রাখা যায়। সুতরাং, আমি মনে করি না যে, ৫২(২) বিধি নিয়মবিরুদ্ধ।।
১০২. দরখাস্তকারীর দাবি মতে, ৫২ বিধিতে বিচারের বিধান ধরে পড়া যায় না। কারণ, উদাহরণস্বরূপ আপিলের বিধান ১৩১(৭) বিধিতে থাকলেও কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিধিতে বিচারের বিধান রাখেননি। ২৫(৪) বিধিতে আদালত কর্তৃক বাজেয়াপ্তকরণের কথা বলা হয়েছে। ৫৫(২) বিধিতে বিচার প্রক্রিয়ার বিধান না রেখে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্তকরণের বিধান রাখা হয়েছে। বিধিমালার রূপরেখা বিবেচনা করে এটা পরিষ্কার যে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেখানে বিচারের বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু যেখানে অধস্তন কর্তৃপক্ষকে বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেখানে কেবল বিচার নয়, বরং প্রাদেশিক সরকারের কাছে আপিলের বিধানও রাখা হয়েছে। আদেশ লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে আইনপ্রণেতাগণ ৫২(২) বিধিতে বিচারের বিধান রাখার কথা। ভেবেছেন মর্মে আরেকটি যে সম্পূরক যুক্তি দেওয়া হয়েছে তাতে কোনাে সারবত্তা নেই। কোনাে লঙ্ঘন হয়েছে কিনা তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এই উপবিধি কেন্দ্রীয় সরকারকে একমাত্র বিচারক বানিয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারকে (১) উপবিধি অনুযায়ী জারিকৃত নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন করে যেসব নিষিদ্ধ বিষয় প্রকাশ করা হয়েছে তা বন্ধ করতে দ্রুত ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে সক্ষম করা হয়েছে। সময় ও বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়ােজনে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হতে পারে এবং সেজন্য এই বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের স্বেচ্ছাক্ষমতার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে অধ্যাদেশের উদ্দেশ্য ব্যাহত করা ব্যতীত বিচার তাে দূরের কথা, পূর্ব-শুনানির সুযােগ দেওয়াও সম্ভব নয়। যে ৫ ও ২০৫ বিধির ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, সেগুলাে এক্ষেত্রে কোনােভাবেই দরখাস্তকারীর জন্য সহায়ক হয় না। ৫ বিধিতে বলা হয়েছে, নিজ বা অন্য কারাে বরাবর পাঠানাে নিজ বা অন্য কারাে সংক্রান্ত কোনাে বিধি বা তদনুযায়ী প্রণীত আদেশ কোনাে আইনি কর্তৃত্ব ছাড়া অমান্য করা হলে তা সেই ব্যক্তি কর্তৃক বিধি বা আদেশের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। ২০৫ বিধিতে বলা হয়েছে যে, কোনাে সরকারি কর্মকর্তার লিখিত রিপাের্ট ছাড়া কোনাে আদালত বা ট্রাইব্যুনাল কোনাে কথিত লঙ্ঘনের বিষয় আমলে নেবেন না। লঙ্ঘনের বিচারের ক্ষেত্রে এই বিধি প্রযােজ্য। সাধারণ সতর্কর্তা হিসেবে তর্কিত লঙ্ঘনের জন্যও এই দুটো বিধি কোনােভাবেই এই দাবিকে সমর্থন করে না যে, কোনাে বিধির অধীনে পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে লঙ্নের বিষয়টি সব সময় আদালত বা ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হতে হবে। ৬(৪) বিধি খেয়াল করলে দেখা যাবে এই যুক্তি কতটা অসার। এটা মনে করা উদ্ভট যে, যদি কোনাে ব্যক্তি ৬(১) বিধি লঙ্ঘন করতঃ কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমােদন ছাড়া কোনাে নিষিদ্ধ স্থানে প্রবেশ করে, তাহলে তাকে সেই স্থান থেকে সরানাের জন্য বিচার করা প্রয়ােজন। তবে, কোনাে লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বাজেয়াপ্তকরণ খামখেয়ালিপূর্ণ কিনা এবং যে নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে বলে অভিযােগ করা হচ্ছে তার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্কহীন কিনা তা বিচারিক আদালতের পরীক্ষাধীন। আপাতদৃষ্টে আদেশ পাওয়া গেলে লঙ্ঘন থাকলে আদালত তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়ে গিয়ে বিষয়টির বিস্তারিত দেখতে যাবে না। এটা বলার প্রয়ােজন নেই যে, যে কোনাে বাজেয়াপ্তকরণ অবশ্যই সদুদ্দেশ্যপ্রণােদিত হতে হবে। কারণ অসদুদ্দেশ্যপ্রণােদিত আদেশ আইনের চোখে আদেশ হিসেবে বিবেচিত হয় না। প্রতিপক্ষের দাখিলকৃত হলফনামা থেকে পরিষ্কার হয় যে, আওয়ামী লীগ কিছু কর্মসূচি যেভাবে পালন করতে চেয়েছে এবং তাদের আন্দোলন ক্রমশ আপত্তিকর কর্মকাণ্ড পরিণত হয়ে রাষ্ট্র ও তার জনগণের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে মর্মে তা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সরকার যে খুব তাড়াহুড়াে করে নয়, বরং বেশ সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়েছে তা এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে,
২৬৭
৫২(২) বিধি অনুসারে পরপর তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ এবং একের পর এক তা লঙ্ঘনের ফলেই সরকার দরখাস্তকারী ও তার প্রেসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছেন, তার আগে নয়।
১০৩. দরখাস্তকারী ৩ ধারার (৪) ও (৫) উপধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন এই যুক্তিতে যে, এগুলাে সংবিধানের ১৪৩ অনুচ্ছেদের সাথে সাংঘর্ষিক। খুব জোরালােভাবে যুক্তি উপস্থাপন করা হয় যে, এসব উপধারায় উল্লিখিত মতে প্রাদেশিক সরকারকে ক্ষমতা অর্পণ কেবল ১৪৩ (১) ও (২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলেই করা যাবে। যুক্তি দেওয়া হয় যে, স্বীকৃতভাবেই যেহেতু প্রাদেশিক সরকারের সম্মতি নেওয়া হয়নি এবং অধ্যাদেশ যেহেতু সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের অর্থ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের আইন’ নয়, সেহেতু পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের কাছে ক্ষমতা অর্পণ সংবিধানের লঙ্ঘন।
১০৪. জবাবে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দেখান যে, সাংবিধানিক দলিলপত্র ব্যাখ্যার নিয়ম অনুসারে এরকম দলিলাদির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ-সম্ভব বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে হবে। তিনি দাবি করেন যে, ১৪৩ অনুচ্ছেদ অনুমােদনকারী বিধান, নিষেধাজ্ঞামূলক বিধান নয় এবং ১৪৩(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্মতির অর্থ পূর্ব বা পরবর্তী সম্মতি নয়। আর বর্তমান মামলায় প্রাদেশিক সরকারের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই সম্মতি আদায় হয়েছে। তিনি আরাে যুক্তি দেখান যে, ৩০(৪) অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্টকে অধ্যাদেশের অধীনে এরকম অর্পণের (delegation) ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং তার ক্ষমতার উপর কোনাে প্রতিবন্ধকতা আরােপ করা হয়নি। তিনি বলেন, যদি অধ্যাদেশের অধীনে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অর্পণের ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের পূর্বসম্মতি সাপেক্ষে হয়, তাহলে তা সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জরুরি অবস্থা। মােকাবিলা করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল, আমার মতে অপ্রয়ােজনীয়ভাবে, salus populi suprema lex (জনকল্যাণই সর্বোচ্চ আইন) নীতির আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।
১০৫. ৩৪ অনুচ্ছেদের শর্তাধীনে প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং এই অধ্যাদেশের মান্যতা কেন্দ্রীয় সরকার প্রণীত আইনের সমান। (৮) উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইন প্রণয়নের এই ক্ষমতা কেবল কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের আইন-প্রণয়ন ক্ষমতা পর্যন্ত ব্যাপ্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের আইন-প্রণয়নের ক্ষমতা কেবল সংবিধানের ১৩১ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বিষয়াবলি পর্যন্ত নয়, বরং ১৪৩ (২) অনুচ্ছেদে বিবেচিত অন্যান্য বিষয়েও বিস্তৃত। ফলে, ৩০(৪)/৮) অনুচ্ছেদের অধীনে কোনাে অধ্যাদেশ যেটি করতে সক্ষম তা ১৪৩(২) অনুচ্ছেদের অধীনে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ করতে পারে। যেমন, প্রাদেশিক সরকার বা প্রাদেশিক সরকারের কোনাে কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের উপর ক্ষমতা অর্পণ ও দায়িত্ব আরােপ করতে পারে। ফলে, আমার সিদ্ধান্ত হলাে, কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অধ্যাদেশের ৩(৪) ধারা অনুযায়ী প্রাদেশিক সরকারের উপর ক্ষমতা অর্পণ ও দায়িত্ব আরােপ বৈধ ও যুক্তিসিদ্ধ। এছাড়া ১৪৩(১) অনুচ্ছেদের অধীনে প্রাদেশিক সরকারকে তার সম্মতিক্রমে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত কোনাে কার্যক্রম পরিচালনার ভার প্রদানের ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের রয়েছে। ১৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাহী কর্তৃত্ব অন্য সব বিষয় ছাড়াও ১৩১(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের যেখানে একক ক্ষমতা রয়েছে এমন সব বিষয় এবং ১৩১(২), (৩) বা (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কিছু আইন বাস্তবায়নের ক্ষমতা পর্যন্ত ব্যাপৃত। ১৩৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রদেশের নির্বাহী কর্তৃত্ব ১৩৫বি অনুচ্ছেদে উল্লিখিত কোনাে আইনের বাস্তবায়ন পর্যন্ত ক্ষেত্রে ব্যাপৃত নয়। সাংবিধানিক দলিলপত্র ব্যাখ্যার রীতি অনুযায়ী, ১৪৩(১) অনুচ্ছেদের সর্বোচ্চ-সম্ভব বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিতে হবে। ফলে, সম্মতির বিষয়টি কেবল। পূর্ব ও প্রকাশ্য সম্মতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। আমরা যদি সংবিধানের ৯৯, ১৪০(২) ও (৪) অনুচ্ছেদের ভাষ্যের দিকে নজর দিই তাহলে এই যুক্তির পক্ষে সমর্থন পাওয়া যাবে। যদি প্রাদেশিক
২৬৮
সরকারের সম্মতি পরবর্তীকালে দেওয়া হয় এবং ন্যস্ত কার্যের গ্রহণযােগ্যতার মাধ্যমে এটি অনুমিত হয়, তাহলে তা-ই যথেষ্ট। এছাড়া, আমার মতে, প্রাদেশিক সরকারকে এরকম ক্ষমতা অর্পণের জন্য ৩০ অনুচ্ছেদের অধীন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রদান পর্যাপ্ত। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের এই যুক্তির মধ্যে জোর আছে যে, যদি অধ্যাদেশের অধীনে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রাদেশিক সরকারকে ক্ষমতা অর্পণের ক্ষমতাকে’ প্রাদেশিক সরকারের সম্মতিসাপেক্ষ করা হয়, তাহলে সেই ক্ষমতা জরুরি অবস্থা মােকাবিলার জন্য যথেষ্ট হবে না এবং সেই ব্যাখ্যা অধ্যাদেশের কার্যকারিতা না বাড়িয়ে বরং তার প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে যা সমর্থন করা উচিত নয়। সুতরাং, আমি মনে করি, অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৪) উপধারা সংবিধানের আওতাভুক্ত এবং বৈধ। (৫) উপধারাও বৈধ, কারণ স্বয়ং অধ্যাদেশ অনুরূপ হস্তান্তরের ক্ষমতা দিয়েছে এবং ফলে delegatus non potest delegare বা হস্তান্তরিত ক্ষমতা পুনরায় অন্য কাউকে হস্তান্তর না করতে পারার নীতির লঙ্ঘন হয়নি।
১০৬. এই যুক্তি দেওয়া হয় যে, অধ্যাদেশের ১৫ ধারা মােতাবেক বিকল্প ও কম কঠোর প্রতিকার থাকলে ৫২(২) বিধি অনুযায়ী কোনাে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়। আমি মনে করি না, বর্তমান মামলার ঘটনা বিবেচনায় এই ধারার কোনাে প্রযােজ্যতা বা প্রাসঙ্গিকতা আছে। ৫২(১) বিধির অধীনে প্রণীত কোনাে আদেশ লঙ্ঘনের শাস্তির বিধান ৫২(২) ও (৩) বিধিতে করা হয়েছে। যে কোনাে একটি শাস্তি দেওয়া যায়। কোন শাস্তি প্রদান করা হবে এবং কোন সুনির্দিষ্ট ঘটনা বা পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে তা নির্ধারণ করা সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। অধ্যাদেশে কেন্দ্রীয় সরকারকে নিজস্ব বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃত বিচার-বিবেচনা পরিবর্তন করা আদালতের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কারণ সেটা তাহলে বিচার হবে না, হয়ে যাবে আইন প্রণয়ন। তাছাড়া, আবেদনকারীর বিরুদ্ধে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের অধীনে পদক্ষেপ নেওয়া যেত কিংবা ৫২(১)(ক) বিধির অধীনে সেন্সরশিপ আরােপ করা যেত- এই যুক্তি গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ, শেষেরটি শাস্তি নয় এবং প্রথমটি এক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। এটা এখন সর্বজনবিদিত যে, কোনাে সুনির্দিষ্ট ঘটনায় একাধিক আইন প্রযােজ্য হলে কোন আইনটি প্রয়ােগ করা হবে তা নির্ধারণ করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
১০৭. এই যুক্তিতেও কোনাে জোর নেই যে, ৫২(২) বিধি অনুযায়ী আপত্তিকর ডকুমেন্ট ও প্রেস দুটোই বাজেয়াপ্ত করতে হবে, না হয় কোনােটাই করা যাবে না।
১০৮. এই যুক্তিতেও আমি কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাই না যে, প্রেসের মালিক বা কিপারকে নােটিশ না পাঠিয়ে প্রেস বাজেয়াপ্ত করা যায় না। স্বীকৃত মর্মে নােটিশ দেওয়া হয়নি। দরখাস্তকারী দৈনিক ইত্তেফাক-এর সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশকের পাশাপাশি প্রেসের মালিক ও কিপার এবং এর ফলে উপরােক্ত নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশসমূহের ব্যাপারে তিনি জানতেন এবং তা লঙ্ঘনের পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাছাড়া, সরকারের কাছে ন্যায়বিচার দাবির নােটিশ (নােটিশ অব ডিমান্ড অব জাস্টিস) আকারে পাঠানাে বিবৃতিতে এটা উল্লেখ করা হয়নি। আমার মতে, দরখাস্তকারী প্রেসের মালিক ও কিপার হিসেবে কোনাে অন্যায়ের শিকার হননি। কারণ প্রেসের মালিক ও কিপার হিসেবে পাঠানাে না হলেও তিনি নােটিশটি পেয়েছেন। ১৮৯ (১) বিধিতে বিধৃত নােটিশ পাঠানাের প্রক্রিয়ায় বলা হয়েছে, (১) উপধারা মানতে ব্যর্থ হলে তা আদেশের বৈধতার উপর কোনাে প্রভাব ফেলে না।
১০৯. এই যুক্তিতে আমি কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাই না যে, আদেশ জারি করার শর্তগুলাে পূরণ হয়নি বিধায় প্রাদেশিক সরকার তর্কিত আদেশটি বৈধভাবে জারি করেননি। এই বক্তব্যের ভিত্তি হলাে, কেন্দ্রীয়
২৬৯
সরকারের ৬.৯.৬৫ তারিখের এস.আর.ও III (আর)/৬৫ নম্বর প্রজ্ঞাপন, যেখানে ৫১, ৫২, ৫৫ ও ৫৬ বিধির বিপরীতে বলা হয়েছে- “৪৬ বিধির জন্য উল্লিখিত একই শর্তাদি”। ৪৬ বিধিতে উল্লিখিত শর্তাবলি নিম্নরূপ :
1. The powers shall be exercised only when-
(a) no orders in this behalf have been made by the Central Government; and
(b) it is not possible to obtain immediate orders of the Central Government.
2. A report shall be made to the Central Government of any action taken by the
Provincial Government under this rule.
যুক্তি দেওয়া হয় যে, স্বীকৃতভাবেই ১ নম্বর শর্ত পূরণ করা হয়নি। এই বিষয়ে আমি ৫ মে, ১৯৬৬ তারিখে ঘােষিত স্পেশাল বেঞ্চ (১৯৬৬ সালের ১৫৮ ও ১৬০ নম্বর পিটিশন) মামলার রায়ে আমার প্রদত্ত পর্যবেক্ষণের পুনরাবৃত্তি করব। এই যুক্তি প্রদানের ক্ষেত্রে ৭ এপ্রিল ১৯৬৬ সালের এস.আর.ও ৪৩ (আর) ৬৬ নম্বর প্রজ্ঞাপনের পরবর্তী সংশােধনীর বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। কোনাে আইন আংশিক বাতিলের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নীতি এবং কোনাে দলিল প্রণেতার ক্ষেত্রে সর্বদা যে নীতি প্রযােজ্য হয়। সেগুলাে প্রয়ােগপূর্বক আমার অভিমত হলাে, ৭.৬.৬৬ তারিখের প্রজ্ঞাপন-প্রণেতা যিনি ৬.৯.৬৫ তারিখের প্রজ্ঞাপনটিও প্রণয়ন করেছিলেন, তার সুস্পষ্টভাবে অভিপ্রায় ছিল যে, ৭.৪.৬৬ তারিখের প্রজ্ঞাপনে উল্লিখিত ৪৬ বিধির পরিবর্তিত শর্তাদি অন্যান্যের মধ্যে ৫১, ৫২, ৫৫ ও ৫৬ বিধির জন্যও শর্তাদি হবে। অন্য কোনাে ব্যাখ্যার অর্থ দাঁড়াবে এই যে,৭.৪.৬৬ তারিখের প্রজ্ঞাপনে ৪৬ বিধির জন্য পরিবর্তিত শর্তাবলি পড়তে হবে, তবে ৬.৯.৬৫ তারিখের প্রজ্ঞাপনে ৪৬ বিধির বিপরীতে যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলাে ৫১, ৫২, ৫৫ ও ৫৬ বিধির ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে। এটাই যদি প্রজ্ঞাপনদাতার উদ্দেশ্য হতাে তাহলে ৪৬ বিধির জন্য শর্ত পরিবর্তন করতে গিয়ে তিনি এটাও বলে দিতেন যে, ৪৬ বিধির জন্য প্রযােজ্য মূল শর্তাবলি ৫১, ৫২, ৫৫ ও ৫৬ বিধির ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য হবে।
১১০. নিষেধাজ্ঞামূলক তিনটি আদেশের লঙ্ঘন হয়েছে কিনা- এই প্রশ্নে বলা যায় যে, তর্কিত লেখা/প্রবন্ধগুলাের কোন অনুচ্ছেদ বা বাক্য আদেশ লঙ্ন করেছে তা প্রতিপক্ষ না জানানাে পর্যন্ত। দরখাস্তকারী এই বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ। এটা বরং বেশ উদ্ভট মনােভাব। যা হােক, অনমনীয় মনােভাব বিবেচনায় এবং সময় বাঁচানাের জন্য এই বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেলকে আহ্বান করা হয় এবং দরখাস্তকারী কর্তৃক এটি তুলে ধরা হয়নি যে, এই প্রশ্নে কোর্টে উত্থাপিত যুক্তি ছিল যথেষ্ট। দরখাস্তকারী কোনাে যুক্তি দেননি- এটাই প্রথম প্রশ্নের জন্য একটা ভালাে জবাব। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল ইত্তেফাক-এর ৭, ২৫, ২৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের তিনটি সংখ্যা, ৯ ও ১২ জুনের দুটি সংখ্যায় প্রকাশিত আপত্তিকর নিবন্ধগুলাে একে একে আমাদের পড়ে শােনান। এর মধ্যে ১৩, ২৫ ও ২৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের ইত্তেফাক ৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযােগ করা হয়। ৯ জুন, ১৯৬৬ তারিখের সংখ্যা (মুসাফিরের রাজনৈতিক মঞ্চ) এবং ১২ জুন ১৯৬৬ তারিখের ইত্তেফাক ৭ এপ্রিল, ২ ও ৭ জুন ১৯৬৬ তারিখের তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশই লঙ্ঘন করেছে। ২৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের একটি সংখ্যা এবং ৯ জুন ১৯৬৬ তারিখের একটি সংখ্যা, যা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কার্যবিবরণী সংক্রান্ত প্রতিবেদন বলে মনে হয়, সেগুলাে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল উপেক্ষা করেছেন।
২৭০
১১১. আমি যেই আদেশ প্রদান করতে চাচ্ছি তাতে বিভিন্ন আপত্তিকর প্রবন্ধের ভেতরে গিয়ে তা তিনটি নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশের লঙ্ন করেছে কিনা তা বিচার করা যুক্তিযুক্ত মনে করি না। এটা দরখাস্তকারীর জন্য তার বক্তব্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে। এটা উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, কোনাে লঙ্ঘন হয়নি মর্মে সাধারণভাবে অস্বীকার করার বাইরে কোনাে নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশেরই লঙ্ঘন হয়নি এটা দেখানাের বিশেষ কোনাে চেষ্টা করেননি। এখানে উল্লেখ্য যে, নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশগুলাের একটি অর্থাৎ ৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশটি এই আদালতের উপরােক্ত স্পেশাল বেঞ্চে বিবেচনার জন্য এসেছে এবং রায় হয়েছে যে, আদেশটি বৈধ ছিল মর্মে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
১১২. ‘ন্যাচারাল জাস্টিস নীতির লঙ্ঘন হয়েছে বিধায় আমি বিনা খরচায় রুলটি চূড়ান্ত করছি এবং ঘােষণা করছি যে, নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করার তর্কিত আদেশটি আইনি কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে জারি করা হয়েছে এবং এর কোনাে আইনি কার্যকারিতা নেই।।
বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি এম. আর. খান রায়ে যেসব কারণ উল্লেখ করে রুলটি চূড়ান্ত করেছেন তার সাথে আমি একমত পােষণ করছি। তিনি তার রায়ে যা বলেছেন তার সাথে কোনাে কিছু যুক্ত করে আমি কোনাে ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারবাে বলে মনে করি না। তবে আমি জোর দিতে চাই যে, যদি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশে বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষকে বিচারের বিধান করতে না বলত এবং যা প্রতিপক্ষের দাবি মতে বাজেয়াপ্তকরণও একটা নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতাে, তারপরও আমি তর্কিত আদেশটিকে বাতিল ঘােষণা করতাম। কারণ দরখাস্তকারীর সম্পত্তির অধিকার হানি করার আদেশ জারি করার আগে বা পরে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এটা এজন্য যে, অধ্যাদেশ বা তদনুযায়ী প্রণীত বিধিমালার কোথাও আমি এরকম কিছু খুঁজে পাইনি যেখানে ন্যাচারাল জাস্টিস নীতির প্রয়ােগকে বর্জন করা হয়েছে। রুলের সমর্থনে অন্য যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে আমি বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকীর এই অভিমতের সাথে একমত এজন্য যে, এগুলাের কোনাে সারবত্তা নেই।
আমি কেবল পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৫ ধারার প্রভাব সম্পর্কে কিছু কথা যুক্ত করতে চাই। এই ধারায় বলা হয়েছে যে, অধ্যাদেশের অধীনে কার্যাধীন কোনাে ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তের স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা ও সম্পত্তির অধিকার উপভােগের ক্ষেত্রে জননিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করবে। নিঃসন্দেহে এই ধারায় একটা আইন প্রণয়ন-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা আরােপ করা হয়েছে। কোনাে আদেশ জারি করার প্রস্তাব করার ক্ষেত্রে নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে সর্বদা তা মনে রাখতে হবে। কিন্তু আমার মতে, সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে আদালতে প্রত্যেক নির্বাহী বাড়াবাড়ির কাজে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। কেবল তথ্যগত বা আইনগত অসদুদ্দেশ্যের প্রমাণ থাকলেই কোনাে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সীমা লঙ্ঘনকে জুডিসিয়াল রিভিউর আওতায় আনা যাবে এবং তখনই কর্তৃপক্ষের সম্পূর্ণ পদক্ষেপকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতাধীন করা যাবে। বিকল্প বা কম কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেও একইভাবে নির্বাহী বিভাগের লক্ষ্য অর্জন করা যেত। কিংবা এরকম পদক্ষেপ নিলে তা ১৫ ধারার শর্তাদির সঙ্গে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ হতাে- এসব যুক্তি অধ্যাদেশের অধীনে বা প্রদত্ত ক্ষমতার অধীনে গৃহীত নির্বাহী পদক্ষেপের বৈধতা নিরূপণ বিচারিক বিবেচনার বিষয় হতে পারে না। আমার মতে, এটা পরবর্তী ১৬ ধারা থেকে উদ্ভত, যাতে বলা হয়েছে কোনাে আদেশ চ্যালেঞ্জ করা যাবে না এবং এর মাধ্যমে চূড়ান্ত আদেশ দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশের ১৬ ধারা বিবেচনায় নিয়ে আমার মনে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, অসদুদ্দেশ্য বা কর্তৃপক্ষের
২৭১
অদক্ষতার প্রমাণ না থাকলে এরকম অভিযােগ কেবল ঊর্ধ্বতন নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কাছেই করা যায়, আদালতে নয়। বর্তমান মামলায় প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত কোনােভাবেই আদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সদুদ্দেশ্যপ্রণােদিত ক্ষমতাচর্চা করার অনুমানকে নাকচ করে না। যা হােক, বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি এম. আর. খান কর্তৃক রায়ে উল্লিখিত কারণসমূহের আলােকে আমার মতে রুলটি চূড়ান্ত হওয়া উচিত এবং তর্কিত আদেশটি আইনি কর্তৃত্ব ছাড়া পাস হয়েছে মর্মে ঘােষিত হােক।
বিচারপতি আবদুল্লাহ
এই দরখাস্তে দরখাস্তকারীর মালিকানাধীন ‘নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস’ বাজেয়াপ্তকরণের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এই প্রেস থেকে দরখাস্তকারী তাঁর ইত্তেফাক’ এবং ঢাকা টাইমস’ ও ‘পূর্বাণী নামের আরাে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ১ নম্বর প্রতিপক্ষ কর্তৃক জারিকৃত ১৬.৬.১৯৬৬ তারিখের ৯৮৫ পল II নম্বর আদেশে অভিযােগ করা হয় যে, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে খবর ও মতামত ছাপানাের বিষয়ে দরখাস্তকারীর প্রতি নিষেধাজ্ঞা প্রয়ােগ করে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৫২(১)(বি) বিধির অধীনে কিছু আদেশ জারি করা হয়েছে। অভিযােগ করা হয়, দরখাস্তকারী তার পত্রিকায় ১৬ জুন ১৯৬৬ সালের উক্ত আদেশের ‘ডি’ তফসিলে উল্লিখিত ৬টি খবর বা মতামত ছাপানাের মাধ্যমে উপরােক্ত আদেশসমূহ লঙ্ঘন করেছেন; ফলে ১ নম্বর প্রতিপক্ষ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৫২ বিধির (২) উপবিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে উক্ত ‘নিউ নেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করেছেন। দরখাস্তকারী যেসব আদেশ লঙ্ঘন করেছেন বলে অভিযােগ করা হয় সেগুলাে হলাে ৭.৪.১৯৬৬, ২.৬.১৯৬৬ ও ৭.৬.১৯৬৬ তারিখে জারিকৃত আদেশ। ১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল তারিখে ইত্তেফাক’-এর সম্পাদক হিসেবে দরখাস্তকারীর বিরুদ্ধে জারিকৃত আদেশে তাঁকে নিমােক্ত বিষয়ে কোনাে লেখা প্রকাশ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয় :
(i) Views, comments, statements and reports in any manner or from which may or are likely or intended to infringes the sovereignty of the State of Pakistan or undermine its integrity. (ii) Views, comments, statements and reports alleging exploitation of one part of the country for the benefit of any other part or for the benefit of any class or classes of persons.
(ii) Views, comments, statements and reports which in any manner or form
create or are likely or intended to create feelings of enmity or hatred between different classes of citizens.
(iv) Views, comments, statements and reports relating to students’ meetings, students’ grievances of various kinds and governmental measure in relation thereto.
১৯৬৬ সালের ২ জুন তারিখের দ্বিতীয় আদেশে দরখাস্তকারীকে “৭.৬.১৯৬৬ তারিখে আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রস্তাবিত প্রতিবাদ দিবস’ পালনসংক্রান্ত বা এই সম্পর্কিত সকল বিষয়ে খবর, মতামত, মন্তব্য,
বিবৃতি ও প্রতিবেদন প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
১১৫. ১৯৬৬ সালের ৭ জুন তারিখে জারিকৃত তৃতীয় আদেশে দরখাস্তকারী কর্তৃক “১৯৬৬ সালের ৭ জুন পূর্ব
পাকিস্তানে হরতাল ও প্রতিবাদ দিবস এবং এই ব্যাপারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসংক্রান্ত বা এই
২৭২
সম্পর্কিত কোনাে খবর, মতামত, মন্তব্য, বিবৃতি, প্রতিবেদন ও আলােকচিত্র প্রস্তুত বা প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয় |
১১৬. এসব নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন করে যা প্রকাশ করা হয়েছে তা ১৬.৬.১৯৬৬ তারিখের উক্ত আদেশের ‘ডি’ তফসিলে উল্লেখ ছিল, যা নিম্নরূপ :
(1) The news under the heading : গুলিবর্ষণের মুলতুবি প্রস্তাব অগ্রাহ্য (Adjournment motion on firing disallowed) in page 1 and 8 of the issue of 9th June, 1966
Dacca.
(2) The publication with the caption রাজনৈতিক মঞ্চ (The political forum) page 4 of the issue of the 9th June, 1966 Dacca.
(3) The news under the heading ৬ দফার বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি
(Phased programme of the Awami Leaguefor materialization of the six point
programme) in page 1 and 10 of the 12th June, 1966.
(4) The news under the heading 2017 Seat CPICTI orienta ag (No compromise on six point programme) of the issue of 13th April 1966.
(5) The news under the heading tegla BOR-a0cus fronton Galayalays Gayosong GETTIN (struggle will go on Declaration by leaders in the great gathering at Paltan) of the issue of 25th April, 1966 in page 1.
(6) The publication under the heading (Result of Red Tapism) of the issue on
27.4.1966, Dacca. The petitioner had moved this Court earlier challenging the vires of the first order dated 7th April, 1966 and his case was considered by a Special Bench of this Court in writ petition, No. 158 of 1966 of which Special Bench I was a member. In that case I had the misfortune of disagreeing with my learned Brothers Salahuddin, J. and Sayem, J. on an issue which was, in my opinion, vital. I had held that the order was without lawful authority on the ground that it had not fulfilled the condition imposed on the Provincial Government by the delegate of the Central Government and I have given my reasons in the judgment passed by me in that case. Although it is not necessary to repeat the reasoning, I would just indicate here briefly why I had held that the order was without lawful authority. Section 3 (4) of the Defense of Pakistan Ordinance (hereinafter referred to as the Ordinance) enables the Central Government to direct by order that any power or duty which by rules under sub-section (1) is conferred or Imposed upon the Central Government shall in such circumstances and under such conditions as may be specified in the direction be exercised or discharged by any Provincial Government or other officers or authorities.
২৭৩
১১৭. ক্ষমতাপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকার ৬.৯.১৯৬৫ তারিখের এস.আর.ও-৩১১১(আর) ৬৫ নম্বর উক্ত আদেশ দ্বারা এই নির্দেশনা দিয়েছেন যে, উপরােক্ত আদেশের ১ নম্বর কলামে সুনির্দিষ্টকৃত পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে সরকারকে প্রদত্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব ২ নম্বর কলামে উল্লিখিত পরিস্থিতি ও শর্তাদি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারের মাধ্যমে প্রদেশগুলােতে প্রয়ােগ ও পালিত হবে (অবধারেখা আমার দেওয়া)। ৪৬ বিধির বিপরীতে তফসিলের ২ নম্বর কলামে নিমােক্ত শর্তাদি দেওয়া হয় :
The powers shall be exercised only when
(a) No orders in this behalf have been made by the Central Government, and
(b) It is not possible to obtain immediate orders of the Central Government. 2. A report shall be made to the Central Government of any action taken by the Provincial Government under this Rule.
১১৮. ৫২ বিধির পাশাপাশি ৫১, ৫৫ ও বিধির বিপরীতে দ্বিতীয় কলামে লেখা আছে- “৪৬ বিধির বিপরীতে উল্লিখিত একই শর্ত”। উপরােক্ত আদেশটি ৭ এপ্রিল ১৯৬৬ তারিখের এস.আর.ও ৪৩ (আর)/৬৬ নম্বর আদেশ দ্বারা সংশােধন করা হয় :
“Against Rule 46, for the entries in column 2 the following shall be substituted namely, “A report shall be made to the Central Government of any action taken by the Provincial Government under this Rule”. There was no mention of Rule 52 in the amending order dated 7th April, 1966. I had held that in the schedule to the notification of 6th September, 1965 the delegation with regard to each Rule was really a separate order regarding each rule. I had held following the observations of Lord Esher in Re: Woods reported in (1882) 31 Chancery 607 at page 615, that on the 6th of September the delegation with regard to rule 52 must be taken to read that no order under the said rule 52 could be made by the Provincial Government without showing that it was not possible to obtain orders of the Central Government, I had held that these conditions had been embodied against rule 52 as if they had been actually watered with the pen or printed in it. The subsequent amendment therefore affected only rule 46 and did not affect rule 52. I had also relied on section 20 of the Central Clauses Act to apply the principles of interpretation with regard to legislation as being applicable also to orders under an act or regulation. As the Provincial Government did not take their stand on its being impossible to obtain immediate order of the Central Government I had hold that the order was ultra-vires the Provincial Government. I do not see any reason to modify my view now. On behalf of the petitioner Mr. Kasuri referred to my judgment and adopted the reasoning incorporated therein. The learned Attorney General relied on the judgment of my learned Brothers. No further argument
২৭৪
was advanced by either party before this Bench on this point. Therefore there has been no occasion for me to change my former view.”
১১৯. এরকম পরিস্থিতিতে আমি এই অভিমত না দিয়ে পারছি না যে, ৭ এপ্রিল ১৯৬৬, ২ জুন ১৯৬৬ ও ৭ জুন ১৯৬৬ তারিখের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশসমূহ প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতাবহির্ভূত এবং অবৈধ। আবেদনকারী কর্তৃক উপরােক্ত আদেশসমূহ লঙ্ঘন হলেও সেই কারণে তার অধিকার হরণ করা যাবে না। এই একটি যুক্তিতেই, আমার মতে, রুলটি অবশ্যই চূড়ান্ত করতে হবে।
১২০. দরখাস্তকারী আরাে বেশ কয়েকটি বিষয়/প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যা আমি শেষ করার আগে আলােচনা করতে চাই।
১২১. প্রথম যে বিষয়টি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলাে, বাজেয়াপ্তকরণ সংক্রান্ত বিচারের জন্য কোনাে বিধি প্রণয়ন করা হয়নি। অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারার প্রাসঙ্গিক অংশটুকু নিম্নরূপ :
3) The Rules made under section (1) may further
(i) ……
(ii) ….
(iii) provide for the seizure, detention and forfeiture of any property In respect of which such contravention, attempt or abetment as is referred to in the proceeding clause has been committed, and for the adjudication of such forfeiture whether By a Court or by any other authority. (অধােরেখা আমার দেওয়া). লক্ষণীয় যে, যেখানে জব্দ ও আটকের কথা বলা আছে সেখানে বিচারসংক্রান্ত কোনাে বিধান রাখা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে বিচারের বিধান করা হয়নি, কারণ তাহলে তা নিশ্চিতভাবে জব্দ ও আটকের উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করবে। কিন্তু বাজেয়াপ্তকরণের বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এই ধারাতেই বলা হয়েছে, আদালত কিংবা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিচারের জন্য বিধি প্রণয়ন করতে হবে। ৫২ বিধির (১) উপবিধির অধীনে জারিকৃত কোনাে আদেশ লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে (২) উপবিধিতে বাজেয়াপ্তকরণের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এখানে বাজেয়াপ্তকরণ সংক্রান্ত বিচারের কোনাে বিধান রাখা হয়নি। ফলে, বিধিটি তার উৎস অধ্যাদেশের ম্যান্ডেট বা বাধ্যবাধকতা পূরণ করেনি এবং এর ফলে তা এখতিয়ার-বহির্ভূত এবং এই বিধির অধীনে প্রণীত বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ আইনি কর্তৃত্ববিহীন। যুক্তি দেওয়া হয় যে, ৩ ধারার (৩) উপধারায় বলা হয়েছে, বিধি তৈরি করার বা না করার ক্ষমতা বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের রয়েছে মর্মে বিধিমালার বিধান থাকতে পারে। কিন্তু আমার মতে, যেহেতু, বিধিটি বাজেয়াপ্তকরণের জন্য করা হয়েছে, সেহেতু, সেখানে অবশ্যই বিচারের বিধান থাকতে হবে। সুযােগ রাখা হয়েছে বাজেয়াপ্তকরণের বিধান করার ক্ষেত্রে। অধ্যাদেশের বিধান অনুযায়ী একবার যদি বাজেয়াপ্তকরণের বিধি প্রণয়ন করা হয় তাহলে অবশ্যই বিচারসংক্রান্ত বিধিও প্রণয়ন করতে হবে। কেননা বিচারের পরেই বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
১২২. এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল প্রথমে যুক্তি দেন যে, এটা একটা জরুরি অবস্থাকালীন আইন এবং সেজন্য শান্তিকালীন আইনসংক্রান্ত আদালত যে ব্যাখ্যার নীতি প্রয়ােগ করেন তা এখানে প্রযােজ্য নয়। যে অভিপ্রায় সাধনের লক্ষ্যে আইন প্রণীত হয়েছে তার প্রতি অবশ্যই খেয়াল রেখে সেভাবেই আইনের বিধান ব্যাখ্যা করতে হবে। তিনি 1941 2 All.E. R. 338 লিভারসিজ মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের
২৭৫
উপর নির্ভর করেছেন। এটা সত্য যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের মতাে জরুরি অবস্থাকালীন আইনের বিধান উদারভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে, যেন আইনের উদ্দেশ্য সাধিত হয়। কিন্তু (একই রকম পরিস্থিতিতে লর্ড অ্যাটকিনের এই পর্যবেক্ষণ ছাড়াও যে,-“যুদ্ধ কিংবা শান্তি, সবসময় আইন একই ভাষায় কথা বলে’) আমি সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মধ্যে যিনি একটি প্রধান রায় দিয়েছেন সেই লর্ড ম্যাকমিলান প্রদত্ত পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করতে চাই। তিনি বলেছেন :
“Holding then, as I do, that the opening words of the regulation are open to interpretation, I now propose to seek what aid I can from the permissible sources of guidance. In the first place, it is important to have in mind that the regulation in question is a War measure. This is not to say that the courts ought to adopt in wartime canons of construction different from those which they follow in peace time. The fact that the Nation is at war is no justification for any relaxation of the vigilance of the Courts in seeing that the law is duly observed especially in a matter so fundamental as the liberty of the subject-rather the country.”
১২৩. সুতরাং, এটা বলা ঠিক হবে না যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত সংবিধিবদ্ধ আইন ব্যাখ্যার নীতিমালা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল, যাকে যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা বলা যেতে পারে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তির বিরুদ্ধে সবচেয়ে যৌক্তিক পয়েন্ট হচ্ছে, সার্বভৌম আইন ও অধস্তন আইনের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। যদি এটা মেনেও নেওয়া হয় যে, অধ্যাদেশের ৩ ধারা উদার ব্যাখ্যার দাবি রাখে, তদনুযায়ী প্রণীত বিধিমালার ক্ষেত্রে সেটা খাটে না। AIR 1943 Calcutta 489 মামলায় বিচারপতি সেনের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে Madhab Sen, AIR 1943 Allahabad 379 মামলায় সিদ্ধান্ত হয় যে, সার্বভৌম আইন ও অধস্তন আইনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আরাে বলা হয়, অধস্তন আইনসভা কেবল তার এখতিয়ারাধীন বিষয়সমূহে আইন প্রণয়ন করতে পারে এবং অধস্তন আইনসভা তার ক্ষমতার ছাড়িয়ে গেছে মর্মে আদালত ঘােষণা করতে পারেন। একই যুক্তিতে এটা সুস্পষ্ট যে, অধস্তন আইনসভাকে অবশ্যই সার্বভৌম আইনসভার বিধান মেনে চলতে হবে। বর্তমান মামলায় সংবিধানের ৩০(৪) অনুচ্ছেদের অধীনে প্রেসিডেন্ট সার্বভৌম আইনপ্রণেতা। তিনি ৩ ধারার (৩) উপধারায় প্রস্তাব করেছেন যে, কেবল বাজেয়াপ্তকরণের জন্য নয়, বরং অধ্যাদেশের ৩(১) ধারার অধীনে প্রণীত বিধির লজ্ঞানের ক্ষেত্রে আদালত বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাজেয়াপ্তকরণ বিষয়ে বিচারের জন্যও বিধি প্রণয়ন করতে হবে। তিনি ৩ ধারার (৩) উপধারার বিভিন্ন দফায় সুস্পষ্টভাবে এসব বিধির সীমা নির্দেশ করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার ৫২(১) বিধির অধীনে প্রণীত নিষেধাজ্ঞামূলক বিধির লঙ্ঘনের বিষয়ে, ৫২(২) বিধি প্রণয়ন করেছেন। সেই বিধিগুলাে অবশ্যই উপরােক্ত বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। আবেদনকারী এই প্রশ্নে সার্বভৌম আইনকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তিনি এটি মনে করেন যে, নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘনের জন্য বাজেয়াপ্তের বিষয়ে বিচারসংক্রান্ত বিধান রক্ষার ব্যাপারে মূল আইন তথা সার্বভৌম আইন যা একটি যুদ্ধকালীন অবস্থা সেটি যথেষ্ট যত্নশীল। অধস্তন আইন (Subordinate Legislation), অর্থাৎ ৫২ বিধি যা মূল আইন না মানায় তা অধস্তন আইনপ্রণেতা অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ববহির্ভূত।
১২৪. এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের পরবর্তী যুক্তি ছিল এই যে, অধ্যাদেশের ৩ ধারার (৩) উপধারা এবং
(২) উপধারা একই প্রকৃতির এবং তা কেবল ৩(১) উপধারায় কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদত্ত সাধারণ
২৭৬
ক্ষমতাবলে বিধিমালা প্রণয়ন হতে পারে, সেটির ব্যাখ্যা/চিত্রায়ন। এক্ষেত্রে তিনি Secretary of State vs. Shibnath Banerjee 1945 PC at page 156 মামলাটি উদ্ধৃত করেছেন। আমার মতে, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের এই যুক্তিও গ্রহণযােগ্য নয়। প্রথমত, (২) উপধারার মতাে “without prejudice to the powers under sub-section 1”- এই দায়মোচন অনুচ্ছেদের মাধ্যমে (৩) উপধারার অর্থের পরিধি কমিয়ে আনা হয়নি। আমার মতে, (৩) উপধারা হলাে (১) উপধারা অনুযায়ী প্রণীত বিধির লঙ্ঘনসংক্রান্ত বিধি তৈরির ক্ষেত্রে মূল আইন। বিধি প্রণয়নকারী কর্তৃপক্ষের কখনাে আইন বা তদনুযায়ী প্রণীত বিধিমালার লঙ্ঘনের জন্য বিধান প্রণয়নের স্বাধীন এখতিয়ার থাকে না। মূল আইন, যেটির অধীনে বিধিমালা প্রণীত হয়, সেখানে অবশ্যই আইন বা তদনুযায়ী প্রণীত বিধিমালার লঙ্ঘনসংক্রান্ত বিধান থাকতে হয়। তা না হলে Subordinate Legislator-কে Sovereign Legislator-এর মতাে একই ক্ষমতা দেওয়া হয়ে যাবে।
১২৫. দ্বিতীয়ত, এটি আমার কাছে মনে হয়েছে যে, ভারত প্রতিরক্ষা আইনের (২) ধারার (২) উপধারা সম্পর্কে প্রিভি কাউন্সিলের সিদ্ধান্তটি কেবল ব্যাখ্যামূলক, যা বর্তমান মামলায় প্রযােজ্য নয়। দেখা যায় যে, ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর অধ্যাদেশ জারি করার পর ৩০ অক্টোবর ১৯৬৬ তারিখে প্রেসিডেন্ট আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করেছেন যেখানে তিনি বিদ্যমান (২) উপধারায় ৪(ক) ও ১০(ক) দফা যুক্ত করেছেন এবং বিদ্যমান দফাগুলােতেও অনেক পরিবর্তন এনেছেন। যদি অধ্যাদেশের ৩ ধারার (২) উপধারা কেবল ব্যাখ্যামূলক হতাে তাহলে এসব সংশােধনীর কোনাে প্রয়ােজন হতাে না। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার ৩(১) ধারার অধীনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এসব নতুন বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করতে পারত। (v) দফার ব্যাখ্যা। থেকেও দেখা যায় যে, (২) উপধারার বিভিন্ন দফা প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সচেতনভাবে প্রণীত মূল আইন এবং ঐসব দফার ক্ষেত্রে বিধি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় সরকারের সীমাবদ্ধতা ছিল। আবেদনকারী কর্তৃক দায়েরকৃত পূর্বতন ১৫৮/৬৫ নম্বর রিট পিটিশনে একই বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল, যা এই আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ঐ বেঞ্চে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। তবে আমি সেই মামলায় কোনাে পর্যবেক্ষণ দেওয়া থেকে বিরত ছিলাম। আমি বলেছিলাম :
“In my opinion, these petitions can be disposed of on consideration of the main point raised by the petitioners, namely the orders made were without lawful authority. I regret that I have not been able to agree with the decision of m y learned brothers on this point”. As I had decided to dispose of the petition on the point that the powers exercised by the Provincial Government had not been exercised in accordance with the terms of the delegation. I had not
advertised to the other points raised by the petitioners.’
১২৬. আমার মতে, Shib Nath Banerjee মামলায় প্রিভি কাউন্সিলের রায় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ৩ ধারার বিধানাবলির ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা যাবে না। কারণ পরবর্তী সংশােধনী ও সংযােজনীর মাধ্যমে স্বয়ং আইনপ্রণেতা (২) উপধারার বিভিন্ন দফাকে সুনির্দিষ্ট বিষয় হিসেবে বিবেচিত করার ইঙ্গিত করেছেন, যার উপর বিধি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। (২) উপধারার বিভিন্ন দফা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিধি প্রণয়নের সময় অল্প বেশি হলেও যে কোনাে দোষত্রুটি সংশােধন করার বিষয়টি “without prejudice to the generality of Powers” – এই শব্দগুচ্ছ থেকে অবশ্যই ধরে নিতে হবে। তাছাড়া, (৩) উপধারা এরকম কোনাে ভাষ্য দ্বারা সীমিত নয়। উপরােক্ত কারণে আমার সিদ্ধান্ত
২৭৭
হলাে, বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ আইনি কর্তৃত্ববহির্ভূতভাবে দেওয়া হয়েছে, যেহেতু, বাজেয়াপ্তকরণ বিষয়ে বিচারের জন্য কোনাে বিধি প্রণয়ন করা হয়নি।
১২৭. দ্বিতীয় যে প্রসঙ্গে আমাকে আকৃষ্ট করেছে তা হলাে : যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় ৫২(২) বিধিতে উপরােক্ত আদেশসমূহ লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারকে প্রেস বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেক্ষেত্রে বিধির বাক্যকথন (wordings) থেকে দেখা যাবে, যেসব কাগজ/দলিলের মাধ্যমে উক্ত নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ লঙ্ঘন করা হয়েছে তার প্রতিটি কপি বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ ছাড়া প্রেস বাজেয়াপ্ত হতে পারে না। ৫২(২) বিধির সংশ্লিষ্ট অংশটুকু নিম্নরূপ :
“The Central Government may declare to be forfeited to it every copy of any document published or made in contravention of such order and any press as defined in the press and publications ordinance 1960, used in the making of such document”।এখানে সংযােজক হিসেবে and’ বসানাে হয়েছে যা সত্যিই সংযােজক এবং (১) উপবিধির অধীনে জারিকৃত আদেশ লঙ্ঘনের জন্য সরকার যে দুটি পদক্ষেপ নিতে পারে সেগুলাের মধ্যে তা অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক তৈরি করে। প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এই মামলায় এটা স্বীকৃত যে, প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। ফলে, আমার মতে, প্রেস বাজেয়াপ্তকরণ অবৈধ।
১২৮. তৃতীয় যে যুক্তি আমাকে আকৃষ্ট করেছে তা হলাে, বিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতার বাইরে গিয়ে আদেশটি জারি করা হয়েছে এবং আদেশের বাস্তবায়নও সেই আদেশের বাইরে করা হয়েছে। ৫২(২) বিধিতে বলা হয়েছে যে, আদেশ লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে এসব দলিল/কাগজ প্রস্তুতকারী প্রেস বাজেয়াপ্ত করতে হবে। আদেশে দেখা যায়, নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস, প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এর সংজ্ঞানুযায়ী একটি প্রেস। কিন্তু প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এর সংজ্ঞানুযায়ী এটি সেই প্রেস নয়। প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০-এ নিম্নোক্তভাবে প্রেস সংজ্ঞায়িত হয়েছে – “Press” includes a printing press and all machines, implements and plant and parts thereof and all materials used for multiplying documents.
সেহেতু, বিধিতে নির্দেশিত ‘প্রেস’ মানে ডকুমেন্ট প্রস্তুতকারী মেশিনপত্র’। এছাড়া রয়েছে ‘used in the making of such document.’ শীর্ষক নিষেধাত্মক দফা। ফলে, এটা সুস্পষ্ট যে, বিধিতে সরকারকে কেবল ডকুমেন্ট প্রস্তুত করার জন্য প্রকৃতপক্ষে ব্যবহৃত মেশিন বা মেশিনসমূহ বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। হলফনামায় বলা হয়েছে যে, ভবনটিতে সাতটি প্রেস মেশিন আছে যার মধ্যে কেবল ৪ নম্বর মেশিনটি ইত্তেফাক’ মুদ্রণের কাজে ব্যবহৃত হয়। জবাবি-হলফনামায় সরকার কেবল এটুকুই উল্লেখ করেছে যে, আপত্তিকর পত্রিকাটি মুদ্রণের কাজে কোনটি বা কতটি প্রেস মেশিন ব্যবহার করা হয়েছে তা অপ্রাসঙ্গিক এবং বিষয় হলাে ১ নম্বর রামকৃষ্ণ মিশন রােড, ঢাকাস্থ উক্ত আঙ্গিনার একটি সুনির্দিষ্ট কক্ষে কেবল একটি নিউ নেশন প্রেস’ রয়েছে এবং কোন মেশিন বা কতটি মেশিন আপত্তিকর পত্রিকা মদ ব্যবহৃত হয়েছিল তা নির্ধারণের প্রশ্ন উঠে না। এটা সংশ্লিষ্ট বিধির বিধানাবলির সুস্পষ্ট অপব্যাখ্যা। এক্ষেত্রে সরকার ‘প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশ ১৯৬০-এ যেভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে’ শব্দগুচ্ছকে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অধ্যাদেশের অধীনে ঘােষিত অর্থে পাঠ করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে বলে মনে হয়।
২৭৮
১২৯. আদেশটি কার্যকরণ প্রসঙ্গে দাবি করা হয়, কেবল ইত্তেফাক মুদ্রণের কাজে ব্যবহৃত মুদ্রণযন্ত্র জব্দ করা হয়েছে তা-ই নয়, ভবন, ভবনের অপরিহার্য অংশসমূহ, চেয়ার, টেবিল ও অন্যান্য অস্থাবর জিনিসপত্রও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এটা স্পষ্টতই ৫২ বিধির (২) উপবিধিতে প্রদত্ত ক্ষমতাবহির্ভূত কাজ। এই পরিস্থিতিতে আমার সিদ্ধান্ত হলাে বিধির অধীনে সরকারকে প্রদত্ত ক্ষমতার বাইরে গিয়ে বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ জারি করা হয়েছে এবং এই আদেশ কার্যকরের ক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ সেই আদেশে অরােপিত সীমা লঙ্ঘন করেছে।
১৩০. চতুর্থ যে বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে তা হলাে, প্রস্তাবিত বাজেয়াপ্তকরণ আদেশের বিরুদ্ধে দরখাস্তকারী কারণ দর্শানের সুযােগ পেতে অধিকারী ছিলেন। বারংবার আমাদের সুপ্রীম কোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, কোনাে নাগরিকের বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিকূল ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে তিনি অন্তত একটা শুনানি প্রাপ্য। সরকার কেবল বলেছে যে, ন্যাচারাল জাস্টিস নীতি অনমনীয় নীতি নয়। সরকার প্রেস বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়েছে মর্মে তারা কোনাে জরুরি অবস্থা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। আদেশ থেকেই এটা সুস্পষ্ট যে, ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাস থেকেই নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশের কথিত লঙ্ঘন হচ্ছিল। আমি এটা বুঝি না যে, সরকার যদি এতদিন অপেক্ষা করতে পারে তাহলে কেন প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হবে না তত্মর্মে প্রেসের মালিককে কারণ দর্শাতে বলেনি? এটি দাবি করা হয়েছে যে, প্রেস মালিক তথা দরখাস্তকারী প্রেস কনসাল্টেশন কমিটির সেক্রেটারি যেখানে মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, তথ্য সচিব ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা সদস্য। কিন্তু ওই সময়ে অনুষ্ঠিত কমিটির কোনাে বৈঠকেই দরখাস্তকারীকে কোনােভাবে সতর্ক করা হয়নি যে, তিনি যে আদেশসমূহ লঙ্ঘন করছেন সেগুলাের কারণে বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ উদ্ভূত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, আদেশেই তাঁর পক্ষে কথা বলার অধিকার রাখা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সুপ্রীম কোর্ট রায় দিয়েছেন যে, সরকার কর্তৃক কোনাে আদেশ জারি করার পর বক্তব্য প্রদানের অধিকার রাখা আর আদেশ জারি করার আগে কারণ দর্শানাের সুযােগ দেওয়া এক কথা নয়। Abul A’la Maududi (1965) 17 DLR (SC) 209 at Page 281 মামলায় বিচারপতি কায়কাউস পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে :
“The plea that as a representation can be made a provision for an opportunity for showing cause was not needed hardly deserves any serious consideration. The Government need not even look at the representation as there is no provision for it. But even if they were bound to look at the representation that could not be a substitute for an opportunity to show cause. Such an opportunity implies that a person should be informed of the grounds on which action is proposed to be taken against him, and he should be allowed to state his case and produce material before the tribunal in support of his case.”
এর ফলে, আমার মতামত হলাে, যেহেতু ন্যাচারাল জাস্টিস নীতির’ শর্তানুযায়ী দরখাস্তকারীকে কারণ দর্শানাের সুযােগ না দিয়েই বাজেয়াপ্তকরণের আদেশটি জারি করা হয়েছে, সেহেতু তা দোষণীয়।
১৩১. সর্বশেষ যে বিষয়টি আমার সিদ্ধান্তের জন্য তুলে ধরা হয়েছে তা হলাে, প্রতিপক্ষের হলফনামার ৩২ অনুচ্ছেদের কথা হলাে সরকারের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশসমূহ লঙ্ঘন থেকে দরখাস্তকারীকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের অধীনে বাজেয়াপ্তের আদেশ জারি করা হয়েছে। যুক্তি দেখানাে হয়, প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০-এর বিধানাবলির মাধ্যমেই একই উদ্দেশ্য পূরণ করা
২৭৯
যেত এবং গৃহীত পদক্ষেপ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৫ ধারায় বারিত/নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬৬ সালের ২৪৭ নম্বর রিট পিটিশনে দরখাস্তকারীর পক্ষে অনুরূপ বিষয় উত্থাপিত হয়েছিল যা বর্তমান পিটিশনের সঙ্গে একসঙ্গে শ্রুত হয়েছিল। সেই পিটিশনে দরখাস্তকারীর এই যুক্তি গ্রহণ করেছি এবং সেই পিটিশনে আমার প্রদত্ত রায়ে কারণ উল্লেখ করেছি। সেই রায়ে প্রদত্ত কারণসমূহের ভিত্তিতে আমার সিদ্ধান্ত হলাে, বর্তমান মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে গৃহীত ব্যবস্থা/কার্যক্রম পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশের ১৫ ধারায় প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞা বিরােধী এবং সেই কারণে তা আইনি কর্তৃত্ববিহীন ছিল। এসব যুক্তিতে, রুলটি চূড়ান্ত করার এবং বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ আইনি কর্তৃত্ববহির্ভূত ছিল মর্মে ঘােষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
আদালতের আদেশ
আদালতের সর্বসম্মত মতামতের ভিত্তিতে ১৯৬৬ সালের ২৫০ নম্বর পিটিশনে জারিকৃত রুল চূড়ান্ত করা হলাে এবং ১৬.৬.১৯৬৬ তারিখের তর্কিত বাজেয়াপ্তকরণের আদেশ আইনি কর্তৃত্ববহির্ভূত ও আইনি কার্যকারিতাবিহীন মর্মে ঘােষণা করা হলাে এবং উক্ত আদেশটি প্রত্যাহার বা বাতিল করার জন্য প্রতিপক্ষদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হলাে।
এই পিটিশনের পক্ষগণ নিজেদের খরচ বহন করবে। বিজ্ঞ অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নমেন্ট প্লিডার জনাব টি এইচ খান সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আপিলের সার্টিফিকেট প্রার্থনা করেন। এই মামলায় সংবিধানের ব্যাখ্যার বিষয়ে উল্লেখযােগ্য আইনি প্রশ্ন জড়িত আছে বিধায় সার্টিফিকেট প্রদানের প্রার্থনা মঞ্জুর করা হলাে।
জনাব খান আরও প্রার্থনা করেন যে, আমাদের আদেশের কার্যকারিতা দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হােক, যাতে সরকার সুপ্রীম কোর্টে আপিল করতে পারে। দরখাস্তকারীর বিজ্ঞ আইনজীবী এর বিরােধিতা করেন। যেহেতু, এই মামলায় গুরুত্বপূর্ণ আইনি প্রশ্ন জড়িত রয়েছে, সেহেতু আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপক্ষকে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করার জন্য কিছু সময় দেওয়া উচিত। এই বিবেচনায় আমরা নির্দেশ দিচ্ছি যে, আমাদের প্রদত্ত আদেশ আজ থেকে দুই সপ্তাহের জন্য স্থগিত থাকবে।
২৮০
[৩]
বঙ্গবন্ধুকে বিনা বিচারে (নিবর্তনমূলক) আটক রাখার আদেশের বৈধতাসংক্রান্ত মামলা :
শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে রেজাউল মালিক বনাম পূর্ব পাকিস্তান সরকার (১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর ক্রিমিনাল বিবিধ এবং ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর ক্রিমিনাল বিবিধ মামলা)
রায়টির সারাংশ
ঘটনার (ফ্যাক্টস) সারসংক্ষেপ
১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর ফৌজদারি বিবিধ মামলা এবং ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর ফৌজদারি বিবিধ মামলা- এই দুটি মামলা এই এক রায়ের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। উভয় মামলার যুক্তি-তর্ক ও তথ্য-উপাত্ত সাদৃশ্যপূর্ণ। তবে দ্বিতীয় মামলায় (১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর ফৌজদারি বিবিধ) একটি অদ্ভুত বিষয় রয়েছে। তা হলােসর্বশেষ আটকাদেশ ও বর্তমান আটকাদেশ, যার মাধ্যমে বন্দিকে (ডেটি) আটক রাখা হয়েছে, এই দুটোর মধ্যকার ব্যবধানকাল। শেখ মুজিবুর রহমানকে যে পরিস্থিতিতে আটক করা হয়েছে তাতে নতুন কোনাে বেআইনি/আইনবহির্ভূত কাজ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলাটি ৮.৫.১৯৬৬ তারিখে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২(১) বিধির অধীনে জারিকৃত আটকাদেশ সম্পর্কিত, যা প্রথমে এই আদালতের একটি বিশেষ বেঞ্চ কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে সুপ্রীম কোর্টের সাম্প্রতিক মালিক গােলাম জিলানী ও অন্যান্য (১৯ ডিএলআর ১৯৬৭ এসসি ৪০৩) মামলায় গৃহীত/প্রদত্ত নীতিসমূহের ভিত্তিতে ১৪ জুন, ১৯৬৭ তারিখে সুপ্রীম কোর্ট এক অর্ডার অব রিমান্ড প্রদান করে মামলাটি পুনরায় বর্তমান বিশেষ বেঞ্চে প্রেরণ করেন।
আদালতের রায়
রায় লিখেছেন মাননীয় বিচারপতি বাকের। এই রায়ের সাথে সহমত পােষণ করেছেন মাননীয় বিচারপতি হাকিম। ভিন্নমত পােষণ করে রায় দিয়েছেন মাননীয় বিচারপতি আবদুল্লাহ।
২:১ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুপাতে রায় দেওয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে জারিকৃত আটকাদেশ বৈধ ছিল। তবে বিচারপতি আবদুল্লাহ ভিন্নমত পােষণসহ অসাধারণ বিকল্প ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে একটি মাইলফলক রায় প্রদান করেন। তিনি সিদ্ধান্ত দেন যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সরকারের জারি করা আটকাদেশ আইনের চোখে অবৈধ। সরকারপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ক্ষতিকর বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেন, যার মধ্যে ছয় দফা কর্মসূচি এবং এর সমর্থনে প্রদত্ত বক্তৃতাও ছিল। বিচারপতি আবদুল্লাহ তার রায়ে বলেন যে, ছয় দফা কর্মসূচি আইনের চোখে কোনাে অপরাধ নয়।
২৮১
একটি অদ্ভুত বিষয় রয়েছে। সেটা হলাে, সর্বশেষ আটকাদেশ ও বর্তমান আদেশ, যার মাধ্যমে বন্দিকে (ডেটি) আটক রাখা হয়েছে, এই দুটির মধ্যকার ব্যবধানকাল। তাকে যে পরিস্থিতিতে আটক করা হয়েছে তাতে নতুন কোনাে বেআইনি/আইনবহির্ভূত কাজ করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল।
২. ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলা, যা ২৯ মে, ১৯৬৭ তারিখ সম্বলিত সর্বশেষ আটকাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত। দুই আদেশের মধ্যকার উল্লিখিত ব্যবধানকালের প্রসঙ্গ এলেই কেবল সেই মামলাটি আলাদাভাবে অলােচনা করা হবে। দুটি মামলার মধ্যে মিল থাকা বিষয়গুলাে একসঙ্গেই আলােচনা করা হবে।
৩. ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলাটি ৮.৫.১৯৬৬ তারিখে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২(১) বিধির অধীনে জারিকৃত আটকাদেশ সম্পর্কিত, যা প্রথমে এই আদালতের একটি বিশেষ বেঞ্চ কর্তৃক নিষ্পত্তিকৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে সুপ্রীম কোর্টের সাম্প্রতিক Malik Ghulam Jilani and others. (1967)19 DLR (SC) 403 মামলায় গৃহীত নীতিসমূহের ভিত্তিতে ১৪ জুন, ১৯৬৭ তারিখে সুপ্রীম কোর্ট এক পুনঃশুনানির আদেশ প্রদান তথা অর্ডার অব রিমান্ড পাস করে মামলাটি পুনরায় বর্তমান বিশেষ বেঞ্চে প্রেরণ করেন।
৪. হাইকোর্টের ভুল এবং জিলানী মামলায় গৃহীত নীতিসমূহ যা বর্তমান বিশেষ বেঞ্চকে অনুসরণ করতে হবে, তা পুনঃশুনানির আদেশে বিস্তারিতভাবে বিধৃত হয়েছে নিমােক্ত ভাষায় :
“আটক (ডিটেনশন) করা হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২ বিধি অনুযায়ী। আটকাদেশে কোনাে কারণ (গ্রাউন্ড) উল্লেখ না থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে পেশ করা হলফনামার উপর ভিত্তি করে হাইকোর্ট এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে, আটককারী কর্তৃপক্ষের (ডিটেইনিং অথরিটি) সন্তুষ্টি একটি সাবজেক্টিভ বিষয়। ফলে, কর্তৃপক্ষই ফ্যাক্ট অর্থাৎ কোনাে সুনির্দিষ্ট নাগরিকের কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে কিনা সে বিষয়ে একমাত্র সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। “সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজ্ঞ বিচারকগণ এই মতও পােষণ করেন যে, আদালতের পক্ষে এর চেয়ে বেশি অনুসন্ধান করা (গাে বিহাইন্ড দ্য কোয়েশ্চন) হবে তার চিন্তাভাবনাকে একজন নির্বাহীর চিন্তা-ভাবনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার সমতুল্য, যদিও সকল তথ্য তার কাছে নেই এবং আইন তাকে অনুরূপ ক্ষমতাও প্রদান করেনি। “তাদের এই সিদ্ধান্ত Malik Gulam Jilani and others মামলায় এই আদালত [পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট] কর্তৃক গৃহীত নীতিসমূহের সাথে সাংঘর্ষিক। সেখানে বলা হয়েছিল যে, এমনকি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে জারিকৃত নির্বাহী বিভাগের আদেশও জুডিসিয়াল রিভিউর আওতামুক্ত নয়। আদালতকেই সন্তুষ্ট হতে হবে যে, আটককারী কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হতে পারে এরকম কোনাে কারণ বিদ্যমান রয়েছে কিনা এবং উক্ত কারণগুলাে যৌক্তিক ও আটকের ক্ষমতা প্রদানকারী আইনের আওতাভুক্ত কিনা…। সুতরাং, এটা সুস্পষ্ট যে, হাইকোর্ট পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক প্রণীত আইন/নীতি অনুযায়ী মামলাটি নিষ্পত্তি করেনি এবং উপরােক্ত মামলার [জিলানী মামলা] পর্যবেক্ষণের আলােকে আটকাদেশের (অর্ডার অব ডিটেনশন) বৈধতা নিরূপণের জন্য মামলাটি হাইকোর্টে ফেরত পাঠানাে উচিত। হাইকোর্টের উচিত ছিল তাদের সামনে উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ অনুযায়ী ডেপুটি কমিশনারের সন্তুষ্টির যৌক্তিকতা আছে কিনা তা বিবেচনা করা এবং সিদ্ধান্তে পৌছানাে।
২৮৩
“যেহেতু, আমরা পুনঃশুনানির জন্য মামলাটি হাইকোর্টে ফেরত পাঠাচ্ছি, ফলে আপিলকারীর পক্ষে উত্থাপিত অন্যান্য বিষয়ে আর কোনাে পর্যবেক্ষণ দিচ্ছি না। এমতাবস্থায়, আটকাদেশের বৈধতা পুনঃপরীক্ষার জন্য মামলাটি হাইকোর্টে ফেরত পাঠানাে হলাে।”
৫. সুতরাং, পুনঃশুনানির আদেশ অনুযায়ী আমাদের জিলানী মামলায় প্রদত্ত পর্যবেক্ষণের আলােকে আটকাদেশের বৈধতা পুনঃপরীক্ষা ও নিরূপণ করতে হবে এবং আপিলকারীর পক্ষে সুপ্রীম কোর্টে উত্থাপিত অন্যান্য বিষয়ও বিবেচনা করতে হবে।।
৬. এখানে উল্লেখ্য যে, অন্য যে একটিমাত্র বিষয়/কারণ সুপ্রীম কোর্টে গৃহীত হয়েছে এবং আমাদের সামনেও জোরালােভাবে উত্থাপন করা হয়েছে, তাহলাে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জারিকৃত জরুরি অবস্থার সঙ্গে তর্কিত (ইমপিউনড) আটকাদেশসমূহের সম্পৃক্ততা বা প্রাসঙ্গিকতা সুপ্রীম কোর্টে যে আকারে কারণগুলাে গৃহীত হয়েছে তা নীচের বিবরণীতে নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে :
“(১) বিশেষ বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকরা যখন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫-এর ১৫ ধারা যথাযথভাবে প্রয়ােগ না করে এই মত প্রদান করেন যে, আটককৃতের কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত তথ্যাবলি (ফ্যাক্টস) এবং আটককারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয় উত্থাপন করার ব্যাপারে আদালতের কিছুই করার নেই, তখন তাঁরা মারাত্মক আইনগত ভুল করেছেন।
“(২) পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আদেশ, ১৯৬৫-এর ১৫ ধারা অনুযায়ী জারিকৃত জরুরি অবস্থা এবং জরুরি অবস্থার অধীনে পাসকৃত আইনের অধীনে আটকের ডিটেনশন] জন্য আটককারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যাবলি ও কারণসমূহ যৌক্তিক কিনা আদালতের তা বিবেচনা করার এখতিয়ার রয়েছে। বিজ্ঞ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ আইনে প্রদত্ত সেই এখতিয়ার প্রয়ােগে ব্যর্থ হয়েছেন।”
৭. প্রতীয়মান হয় যে, সুপ্রীম কোর্টের নিকট যে অভিযােগ করা হয়েছিল তা হলাে, হাইকোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ যখন এই আলােচ্য তর্কিত [এলেজড] সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, “আটককৃতের কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত তথ্যাবলি এবং আটককারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত যে কারণসমূহ উত্থাপন করা হয়েছে সেই ব্যাপারে আদালতের কিছুই করার নেই”, তখন তাঁরা অধ্যাদেশের সংশ্লিষ্ট ধারাটির প্রতি নজর দেননি এবং তা বিবেচনাতেই নেননি [that section of the Ordinance was lost sight by the majority Judges of the High Court]
৮. আরও অভিযােগ ছিল এই যে, হাইকোর্ট আইনে প্রদত্ত এখতিয়ার প্রয়ােগে ব্যর্থ হয়েছেন। কারণ, উপরােক্ত ধারা অনুযায়ী আটককারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যাবলি ও কারণসমূহ জরুরি অবস্থার অধীনে যে উদ্দেশ্যে আটক করাকে যৌক্তিক প্রতিপন্ন করে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা দেখার এখতিয়ার ছিল।
উপরােক্ত বিষয়গুলােকে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে উপস্থাপন করা (ক্লামসিলি ড্রন) হয়েছে অথবা বিষয়টিকে যে বৃহত্তর পরিধিতে উপস্থাপন করা যেতে পারত সেটিকে সীমিত করা হয়েছে।
৯. এই বিষয়গুলাে পুনঃশুনানির আদেশের অধীন রায়ে বিচারপতি আবদুল্লাহর ভিন্নমত পােষণকারী রায়কে স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ-এর ১৫ ধারার আওতায় নিরাপত্তা অধ্যাদেশ পড়ে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা নয়।.
২৮৪
১০. পুনঃশুনানির আদেশে একবার উল্লেখ করা ব্যতীত এই ভিন্নমত প্রদানকারী রায় সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু এখানে জিলানী মামলা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অধ্যাদেশের ১৫ ধারার প্রসঙ্গ এসেছে এবং এর ১২, ২৮, ২৯ ও ৩৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে :
পৃষ্ঠা ১২. Malik Gulam Jilani and others মামলায় তার স্ত্রী আরও যে আরজি/বক্তব্য (প্লি) উত্থাপন করেছেন তা হলাে, ডিটেনশনের কারণে পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ-এর ১৫ ধারার বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই ধারায় শর্তারােপ করা হয়েছে যে, এই অধ্যাদেশের অধীনে গৃহীত পদক্ষেপ “এমন হতে হবে যাতে তা জননিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং সাধারণের জীবিকা ও সম্পত্তি ভােগের উপর যতটা সম্ভব কম হস্তক্ষেপ করা হয়।” (This section requires that actions taken as to “interfere with the ordinary avocations of life and enjoyment of property as little as may be consonant with the purpose of ensuring the public safety and interest and the defence of pakistan.”)।
পৃষ্ঠা ২৮. “৩২ বিধি কঠোর ও স্বেচ্ছাচারী (আরট্রিারি)- এই যুক্তিতে হাইকোর্ট কোনাে সারবত্তা খুঁজে পায়নি। কারণ, সেখানে আটকাদেশের কোনাে সুনির্দিষ্ট সময় বা কাল নির্ধারণ করা হয়নি। জরুরি অবস্থাকে আপাতদৃষ্টে (prima facie) স্বল্পকালীন বলে ধরে নিতে হয় এবং মনে রাখতে হবে। যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ-এর মতাে অস্থায়ী আইনের (temporary statute) অধীনে জারিকৃত আটকাদেশ জরুরি অবস্থা উঠিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতিলযােগ্য (co-terminus) এবং আইনটি বাতিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তামাদি হয়ে যাবে।”
পৃষ্ঠা ২৯. “হাইকোর্টের সামনে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল যে, অধ্যাদেশের ১৫ ধারায় সুপারিশ করা হয় যে, অধ্যাদেশ অনুযায়ী আটকাদেশ জারি করার সময় সাধারণের জীবিকা ও সম্পত্তি ভােগ-দখল ইত্যাদি ব্যাপারে হস্তক্ষেপ ন্যূনতম পর্যায়ে সীমিত রাখতে হবে। আরাে বলা হয় যে, আটককারী কর্তৃপক্ষ ৩২(১) বিধির (এফ) দফার অধীনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এই দফার মাধ্যমে। নাগরিকের চলাফেরা কিংবা ব্যবসা বা অন্য ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা (অ্যাসােসিয়েশন) কিংবা কোনাে মতের পক্ষে প্রচারণার জন্য খবর সরবরাহ করার উপর বিধিনিষেধ আরােপ করার বিধান রাখা হয়েছে। হাইকোর্টের জবাব ছিল যে, কোন দফার অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তা সিদ্ধান্ত নেবে আটককারী কর্তৃপক্ষ। আটকাদেশ জারি করার সময়ে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমার মনে হয় আরাে পূর্ণাঙ্গ উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল। মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনার পর বিষয়টি পরবর্তীকালে আরাে বিশ্লেষণ করা হবে।”
পৃষ্ঠা ৩৬. “এখানে এই বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই আপিলসমূহে যুক্তি-তর্ক চলাকালীন এটা উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আটকাদেশ জারি করার পূর্বে সম্মেলনে লাহাের সম্মেলন?] যােগদানকারী দুটি রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম যে কোনাে ধরনের প্রত্যক্ষ আন্দোলন (ডিরেক্ট অ্যাকশন) থেকে নিজেদের বিযুক্ত করেছে। ফলে, এরকম একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে, বাকি দুটি দলের নেতৃবৃন্দকে আটকে রাখার উদ্দেশ্যে এই আটকাদেশ। তা করতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ সুস্পষ্টভাবেই অধ্যাদেশের ১৫ ধারায় সুপারিশকৃত ন্যূনতম বিধিনিষেধের শর্ত অনুসরণ করেছে। কিন্তু, যুক্তি ছিল এই যে, যাদের আটক করা হয়েছে তাদের জন্য আটকাদেশটি
২৮৫
খারাপ ছিল। কারণ, তাদের সাধারণ কর্মকাণ্ড, যা থেকে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন, তা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এই যুক্তির কোনাে সারবত্তা নেই। তারা যেহেতু, ক্রুসেড-সম রাজনৈতিক প্রচারাভিযানে নিজেদের নিবেদিত করেছেন এবং এটা তাদের সাময়িক পেশায় পরিণত হয়েছে, সেহেতু তা অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় নির্বাহ করতে দেওয়া যায় না।”
১১. এসব পর্যবেক্ষণ একই বিষয়ে একই সময়ে বিদ্যমান দুটি আইনের মধ্যে কোনটি তুলনামূলকভাবে নমনীয় বা কঠোর তার ভিত্তিতে নয়, বরং তা হতে হবে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫-এর কাঠামাের মধ্যেই কম কঠোর পদক্ষেপের ভিত্তিতে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত মামলার পরিস্থিতি দাবি না করে ততক্ষণ পর্যন্ত ন্যূনতম হস্তক্ষেপ নীতি অনুযায়ী ৩২ বিধি প্রয়ােগ না করার ভিত্তিতে।
১২. প্রতীয়মান হয় যে, ১৫ ধারা ও পুনঃশুনানি আদেশের ভাষা একই সময়ে বিদ্যমান দুটি আইন ও পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫-এর মধ্যে বাছাই করার বিষয়টিকে নাকচ করে দেয়। অধ্যাদেশের ১৫ ধারা নিম্নরূপ :
“এই অধ্যাদেশের অধীনে পদক্ষেপ গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি সাধারণ জীবিকা ও সম্পত্তি ভােগের উপর যতটা সম্ভব কম হস্তক্ষেপ করবেন এবং তা যেন জননিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।” [“An authority or a person acting in pursuance of this Ordinance shall interfere with the ordinary avocations of life and enjoyment of property as little as may be consonant with the purpose of ensuring the public safety and interest and the defense of pakistan.”)
সুতরাং, প্রশ্নটি হলাে অধ্যাদেশের মধ্য থেকেই এটি বাছাই করা, এর বাইরে নয় এবং তা সংযতভাবে প্রয়ােগ করা।
১৩. ১৫ ধারা কেবল এই সুপারিশই করে যে, অধ্যাদেশের অধীনে আদেশ জারি করার সময় সাধারণ জীবিকা ও সম্পত্তি ভােগ-দখলের উপর হস্তক্ষেপ ন্যূনতম পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এই ধারা কেবল নাগরিকের সাধারণ জীবিকা ও সম্পত্তি ভােগ-দখলের উপর হস্তক্ষেপের বিষয়ে নির্বাহী বিভাগের প্রতি এই বিধিনিষেধ আরােপ করে। কিন্তু জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও দেশে শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখতে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের জন্য কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ (Preventive Detention) জারি করার ক্ষেত্রে নির্বাহী ক্ষমতার উপর কোনাে বাধানিষেধ আরােপ করেনি। আমাদের মতে, জুতসই ও যথার্থ ক্ষেত্রে ১৫ ধারার বিধান কোনােভাবেই পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩১(১) (খ) বিধির
অধীনে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে প্রভাবিত করে না।
১৪. বিষয়/কারণগুলাে যথাযথ ভাষায় উপস্থাপিত (হ্যাপিলি ওয়ার্ডেড) না হলেও, আমরা জনাব সালাম খানকে ঘােষিত জরুরি অবস্থার সঙ্গে উল্লিখিত ডিটেনশনকে সম্পর্কযুক্ত করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের সুযােগ দিয়েছি।
১৫. জনাব খান যুক্তি দিয়েছেন যে, তর্কিত আদেশে উল্লিখিত বিষয়াবলি, অর্থাৎ জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্য ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার জন্য ক্ষতিকর যেসব কারণে আবেদনকারীকে আটক রাখা হয়েছে তা জরুরি অবস্থা ঘােষণায় উল্লিখিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়।
২৮৬
১৬. সংবিধানের ১৩০ অনুচ্ছেদের প্রাসঙ্গিক অংশ নিম্নরূপ :
৩০(১) “যদি রাষ্ট্রপতি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, মারাত্মক জরুরি পরিস্থিতি বিদ্যমান।
(ক) যেখানে পাকিস্তান, কিংবা পাকিস্তানের কোনাে অংশ যুদ্ধ কিংবা বহিরাগত আক্রমণের হুমকির সম্মুখীন (কিংবা সম্মুখীন হওয়ার বিপদ আসন্ন); কিংবা যেখানে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন এমন অভ্যন্তরীণ গণ্ডগােল দ্বারা হুমকির সম্মুখীন যা প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতার বাইরে, তখন প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন …
(৪) জরুরি অবস্থা চলাকালীন (জাতীয় পরিষদ বাতিল কিংবা অধিবেশন চালু থাকুক না কেন)
প্রেসিডেন্ট যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, জরুরি পরিস্থিতি যা জরুরি অবস্থা ঘােষণার প্রেক্ষাপট তৈরি করে, তা মােকাবিলা করার জন্য তাৎক্ষণিক আইন প্রণয়ন জরুরি, তিনি এই ধারার শর্তাধীন থেকে জরুরি পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য তার কাছে প্রয়ােজনীয় বলে মনে হয় এরকম অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারেন এবং এরকম কোনাে অধ্যাদেশ এই ধারার শর্তাধীনে, কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ প্রণীত আইনের মতাে একই ক্ষমতাসম্পন্ন (ফোর্স) হবে।”
১৭. পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ, ১৯৬৫-এর প্রস্তাবনা নিম্নরূপ :
“নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা এবং কিছু সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের (প্রােভাইড ফর) জন্য অধ্যাদেশ।
যখন নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা এবং কিছু সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার জন্য সমীচীন মনে হয়;
এবং যখন সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুযায়ী জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এবং যখন প্রেসিডেন্ট এই মর্মে সন্তুষ্ট যে, অধ্যাদেশের বিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জরুরি অবস্থা মােকাবিলার জন্য তাৎক্ষণিক আইন প্রণয়ন প্রয়ােজন;
“সুতরাং, এখন সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদের (৪) দফা, রেড উইথ ১৩১ অনুচ্ছেদের (২) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতা এবং এ ব্যাপারে তাকে সক্ষম করে এমন সকল ক্ষমতা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট নিমােক্ত অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছেন।”
লক্ষ্য হলাে নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৯. অনুচ্ছেদ ১৩১ দফা (২)-এর কল্যাণে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও জননিরাপত্তা এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও জরুরি অবস্থার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেগুলাে জরুরি অবস্থার কারণে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ হতে হবে।
২০.পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা তৈরি হয়েছিল কিংবা তা জরুরি অবস্থা ঘােষণায় উল্লিখিত যুদ্ধের হুমকির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিল- হলফনামায় (এফিডেভিট-ইন অপজিশন) এটা উল্লেখ করা হয়নি। আবেদনকারীকে জননিরাপত্তা ইত্যাদির জন্য ক্ষতিকর কোনাে কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়ােগ করা
২৮৭
হয়েছে-কেবল এটা উল্লেখ করা হয়েছে বলেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে যায় না যে, অভিযােগসমূহ জরুরি অবস্থা ঘােষণাপত্রে উল্লিখিত বিষয়াবলি থেকে বিচ্ছিন্ন। যেসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে তার তীব্রতা হয়তাে এমন হতে পারে যে, সেটিকে প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধের হুমকির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা যেতাে। জরুরি অবস্থা এখনাে বহাল রয়েছে (দ্য ইমার্জেন্সি এজ প্রােক্লেইমড ইজ স্টিল অন)।
২১. এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় এসব কর্মকাণ্ড অধ্যাদেশের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত বিশেষ পদক্ষেপসমূহ প্রয়ােগের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে কিনা।
Emergency having been proclaimed whether for (a) or (b) or for both and the emergency having been in force, the President under sub-article (4) of article 30 of the Constitution is empowered to make any legislation for meeting the emergency.
২২. এসব কর্মকাণ্ড প্রাদেশিক তালিকার কিছু শব্দগুচ্ছ দ্বারা আওতাভুক্ত করা হয়েছে [simply because the activities are covered by certain phrases of the provincial list,…] এর মানে এটা দাঁড়ায় না যে, এসব কর্মকাণ্ড এমন মাত্রা লাভ করতে পারে না যা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষাকেই হুমকির সম্মুখীন করতে পারে। তাছাড়া, যুদ্ধের হুমকি কেবল জরুরি অবস্থা ঘােষণার উপলক্ষ্য মাত্র। কিন্তু যখন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩০(১), যা ‘ক’ ও ‘খ’ উভয় উপ-দফা অন্তর্ভুক্ত করে, তার অধীনে যখন জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হয়, তখন এটা বলা যাবে না যে, ঘােষণাটি শুধুমাত্র ‘ক’ উপ-দফার উদ্দেশ্যে এবং তা ‘খ’ উপ-দফার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। (ক) কিংবা (খ) কিংবা উভয় উপ-দফার জন্য জরুরি অবস্থা জারি হােক না কেন- ঐ জরুরি অবস্থা চলাকলে প্রেসিডেন্ট ৩০ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুযায়ী জরুরি অবস্থা মােকাবিলা করার জন্য প্রয়ােজনীয় যে কোনাে আইন প্রণয়নের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এরকম জরুরি অবস্থা মােকাবিলার জন্য প্রেসিডেন্ট ৩০(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যখন জরুরি অবস্থা জারি করেন, তখন এটা ধরে নেওয়া যাবে না যে, অধ্যাদেশ কেবল ৩০(১)(ক) অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পাস করা হয়েছে। উপ-দফা (৪) শুধু জরুরি পরিস্থিতি মােকাবিলায় সহযােগিতা করার জন্য প্রয়ােজনীয় যে কোনাে আইন প্রণয়নের ক্ষমতার কথা বলে। উদ্দেশ্য যা-ই হােক না কেন, একমাত্র পূর্ববর্তী শর্ত (কন্ডিশন প্রিসিডেন্ট) হলাে জরুরি পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকা। এই যদি অবস্থা হয় তখন বলা যায় না যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ কেবল যুদ্ধ কিংবা বহিরাগত আক্রমণের হুমকির মােকাবিলার | জন্য; তা অভ্যন্তরীণ গােলযােগ মােকাবিলার জন্য নয়। তবে সেক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিক হতে হবে। উপ-দফা (৪) অনুযায়ী প্রেসিডেন্টকে প্রদত্ত ক্ষমতা সাংবিধানিক ক্ষমতা এবং এর একমাত্র পূর্বশর্ত হলাে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকা। জরুরি অবস্থা চলাকালে প্রেসিডেন্ট জরুরি পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করেছেন।
২৩. ফলে, এই মতে পৌছানাে কঠিন যে, প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারির সময় কেবল ‘ক’ উপ-দফার কথা চিন্তা করেছেন, ‘খ’ উপ-দফার কথা নয়। কারণ, এরকম পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরীণ পরি হুমকি ও গােলযােগের সম্মুখীন হয়। ফলে, জরুরি অবস্থা অনুচ্ছেদ ৩০(১)-এর অধীনে জারি হয়েছে, কেবল ৩০(১)-এর (ক) উপ-দফা অনুযায়ী নয়। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদের (ক) ও (খ) দুই উপ-দফার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য।
২৮৮
এই দৃষ্টিকোণ থেকে আটককৃতের কর্মকাণ্ড ক্ষতিকর প্রতীয়মান হলে তা জরুরি অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় তা বলা যাবে না। এসব কর্মকাণ্ড ও অভিযােগ কোন মাত্রায় গেলে তা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করে? এবং তা নিরূপণ করবে কে?
২৪. জিলানী মামলার আগে অবস্থান এরকম ছিল যে, এটা এককভাবে নির্বাহী বিভাগের আওতাভুক্ত বিষয় (ডােমেইন)। প্রতীয়মান হয় যে, এমনকি জিলানী মামলার পরেও এই পয়েন্টে সন্তুষ্টির জায়গাটি নির্বাহী বিভাগের একক কর্তৃত্বাধীন বিষয়ই (ডােমেইন) রয়ে যাবে। একমাত্র পার্থক্য যেটা তৈরি হয়েছে তা হলাে, নির্বাহী বিভাগের সাবজেক্টিভ সন্তুষ্টিকে আদালতের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অধীন করা হয়েছে। এটা আদালতকে নির্বাহীর মনের জায়গায় নিজেকে স্থাপন করা হিসেবে প্রতিপন্ন হয় না। আদালত কেবল পরীক্ষা করবে, নির্বাহী বিভাগ যে অভিযােগ সম্পর্কে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে তা যথাযথ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত কিনা। সন্তুষ্টির উৎস পর্যালােচনা করার ক্ষেত্রেও আদালতের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ এই ক্ষমতা বিশেষ সুবিধার অধীন (There are also limitations on the Court’s power of review of the sources of the satisfaction by reason of this power having been made subject to privileges.)
২৫. বতর্মান মামলায়, পূর্বতন বিশেষ বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকগণ এই ক্ষেত্রে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা প্রয়ােগ কতটুকু যৌক্তিক তা নিরূপণ করার জন্য নিজেরা তথ্য-উপাত্ত (ম্যাটেরিয়ালস) বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু সম্ভবত সুপ্রীম কোর্ট ভেবেছে ‘নির্বাহী বিভাগের সাবজেক্টিভ সন্তুষ্টি নির্ণয় করার লক্ষ্যে বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ আরাে গভীরভাবে তথ্য-উপাত্ত (ম্যাটেরিয়ালস) অনুসন্ধান করবেন। (but probably the Supreme Court thought that but for the impression of the subjective satisfaction of the executive, the probe of the materials by the learned Judges would have been deeper.)। জিলানী মামলা তথ্য-উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিধিকে পরিপূর্ণ করেছে বলে মনে হয় এবং এই মামলাটিকে বিশেষ পদক্ষেপের চরম অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একমাত্র রক্ষাকবচ (সেফটি ভাল্ব) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জিলানী মামলার রায়ের প্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ রায়ের ২৬ ও ৩০ পৃষ্ঠায় রয়েছে :
পৃষ্ঠা ২৬. “বস্তুত, আদালতে গ্রেফতার ও আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে কর্তৃপক্ষ মৌখিক সাক্ষ্য বা অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত (ম্যাটেরিয়ালস) উত্থাপন করলেই, আদালত কর্তৃক জুডিসিয়াল রিভিউ আকৃষ্ট হয়ে যায়। তখন আদালত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারে না। হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকগণ লিভারসিজ মামলার উপর নির্ভর করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ৩২ বিধির অধীনে সন্তুষ্টি সাবজেক্টিভ এবং এর যৌক্তিকতা আদালতে নিরূপণ করা যায় না। তারা এই সিদ্ধান্তে পৌছানাের ক্ষেত্রে এমনকি নিজেদের রেকর্ডকৃত ও গৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণও বিবেচনা করেননি। সংবিধানের প্রাসঙ্গিক বিধানগুলাের যথাযথ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ এবং সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সম্পর্কে উপরােক্ত মতামত গ্রহণযােগ্য নয় বলেই মনে হয়। ফলে বর্তমান রায়ে সেই সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনা করা উচিত এই সিদ্ধান্তে পৌছানাের জন্য যে, ডেপুটি কমিশনার তার আটকাদেশের পক্ষে যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন তার যৌক্তিক অস্তিত্ব ছিল কিনা।
পৃষ্ঠা ৩০. “তথ্যগত অবস্থানের যথার্থ বিচার করতে হলে এসব মামলায় আটককারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উপস্থাপিত কারণ এবং দলিল আকারে উত্থাপিত (এভিডেন্স দেট হ্যাজ বিন লেড, ইন দ্য শেপ অব ডকুমেন্টস) সাক্ষ্য-প্রমাণ জুডিসিয়াল রিভিউর আওতায় নিয়ে আসা প্রয়ােজন।”
২৮৯
২৬. আটককারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উপস্থাপিত কারণ ও দলিলাদি জুডিসিয়াল রিভিউর অধীন হবে।।
২৭. জনাব আবদুস সালাম খান সুপ্রীম কোর্ট নির্দেশিত জুডিসিয়াল রিভিউর তাৎপর্য (ইমপ্লিকেশন) ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে প্রশ তােলেন।
২৮. বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, জুডিসিয়াল রিভিউর আওতা সীমাবদ্ধ, কারণ এখানে রিভিউটি আপিল আকারে হাজির হয় না (that the scope of Judicial Review is limited inasmuch as the review contemplated is not in the nature of an appeal.) তার মতে এটা নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে জনগণের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার একটা পদক্ষেপ মাত্র। জনাব সালাম খান এই বক্তব্য বিপরীতভাবে উপস্থাপন করেন এবং জোর প্রয়ােগ করেন যে, এই জুডিসিয়াল রিভিউ তথ্য-প্রমাণের যথার্থতা সম্পর্কে উভয় পক্ষের বিস্তৃত সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন ও দীর্ঘ যুক্তি-তর্কের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। (প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা জনাব সালাম খানকে অ্যাডভােকেট জেনারেল কর্তৃক পেশকৃত সম্পূরক-হলফনামায় উত্থাপিত বিষয়সমূহ এবং আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] তাঁর বক্তৃতাকারে আরাে যেসব তথ্য-প্রমাণ উন্মােচন করেছেন এবং অ্যাডভােকেট জেনারেল যেগুলাের জন্য বিশেষ সুবিধা (প্রিভিলেজ) দাবি করেননি, সেসব বিষয়ে মন্তব্য করার সুযােগ দিয়েছিলাম। কিছু সময়ের জন্য আমরা রুদ্ধদ্বার কক্ষে (ইন ক্যামেরা) বিচারকার্য পরিচালনা করেছি।
২৯. জনাব সালাম খান আমাদের বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল পেশকৃত সম্পূরক হলফনামার উত্তরে অতিরিক্ত বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলতে চান যে, ‘জুডিসিয়াল রিভিউ’ অভিব্যক্তিটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্যই হলাে উভয় পক্ষের পূর্ণাঙ্গ শুনানি।।
৩০. দেওয়ানি কার্যবিধির আলােকে রিভিউর পরিধি খুবই সীমিত এবং এখানে রিভিউর যে পরিধি কল্পনা করা হয়েছে (কনটেমপ্লেট) তা এতদিন পর্যন্ত অনুসৃত প্রক্রিয়ার আমূল পরিবর্তন বােঝায় না।।
৩১. সুপ্রীম কোর্ট ‘জুডিসিয়াল রিভিউ’ বলতে কী বুঝিয়েছেন তা নিমােক্ত লাইনগুলােয়, অর্থাৎ, ইতােমধ্যে উল্লিখিত সুপ্রীম কোর্টের রায়ের ২৬ পৃষ্ঠায় সুস্পষ্ট :
“বস্তুত, কর্তৃপক্ষ আদালতে গ্রেফতার ও আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে মৌখিক সাক্ষ্য বা অন্যান্য ম্যাটেরিয়ালস উত্থাপন করলেই তার প্রতি আদালত কর্তৃক জুডিসিয়াল রিভিউ আকৃষ্ট হয়ে
যায়, তখন আদালত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পারে না।”
৩২. সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে, উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত নির্বাহী বিভাগের দাবিকৃত সন্তুষ্টির যথার্থ ভিত্তি তৈরি করে কিনা তা সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করা আদালতেরই দায়িত্ব। আদালতের দায়িত্ব তথ্য-উপাত্তসমূহ বিচারিক মন, যা নির্বাহী দৃষ্টিভঙ্গি (আউটলুক) থেকে ভিন্ন, দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা; তর্কিত আদেশ জারিকারী ডেপুটি কমিশনারের সন্তুষ্টির যৌক্তিকতা নিরূপণের জন্য দৃশ্যত (প্রাইমা ফেসিয়ে) সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে কিনা তা নির্ণয় করা, বিচারের (ট্রায়াল) মতাে কঠোর অর্থে প্রমাণ্য আইনি সাক্ষ্য-প্রমাণ দাবি করা নয় (not to search for legal evidence produced under strict compliance of proof as in a trial)। কাজেই আদালতের দায়িত্ব সন্তুষ্টির যৌক্তিকতা পরীক্ষা করা, কোন সন্তুষ্টি নিষিদ্ধ এই অনুমানে তার যৌক্তিকতা নিরূপণ থেকে বিরত থাকা নয় (and not to refrain from considering the reasonableness of the satisfaction on the assumption that this is prohibited.)
২৯০
৩৩. এই অর্থে, নিঃসন্দেহে আদালতের পরিধি বিস্তৃত হয়েছে। এটা পুনঃশুনানি আদেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যেখানে বলা হয়েছে :
“আটক (ডিটেনশন) করা হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২ নম্বর বিধি অনুযায়ী এবং আটকাদেশে কোনাে কারণ উল্লেখ না থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে পেশ করা। হলফনামার উপর নির্ভর করে হাইকোর্ট এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, যেহেতু আটককারী কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি একটি সাবজেক্টিভ সন্তুষ্টি, ফলে ফ্যাক্ট অর্থাৎ কোনাে সুনির্দিষ্ট নাগরিকের কোনাে কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে দেশের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে কিনা তার একমাত্র নির্ণায়কও কর্তৃপক্ষ।”
৩৪. “এসব কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কিনা”- এই অংশটুকু হাইকোর্টের মূল রায় থেকে উদ্ধৃত। ফলে, পুনঃশুনানির আদেশ প্রদান মানে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে এটা নয় যে, আমরা কেবল এসব কর্মকাণ্ড থেকে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে মর্মে সন্তুষ্টিতে পৌঁছানাে যায় কিনা তা পরীক্ষা করবাে। এমনও নয় যে, এসব কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করলে আটকাদেশ বাতিল হয়ে যাবে। পুনঃশুনানি আদেশে যেটা বােঝানাে হয়েছে, তা হলাে আটককারী কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে এসব কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তবে সেটাই যথেষ্ট নয়। এসব কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কিনা এবং তা। যৌক্তিকভাবে প্রতীয়মান হয় কিনা তা আদালতকে পরীক্ষা করতে হবে। মনে হয়, জিলানী মামলায় এই সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়েছে যে, আলােচ্য কর্মকাণ্ড জনশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে গিয়েছে কিনা তার ভিত্তিতে অধ্যাদেশের ৩২ বিধি প্রযােজ্য হবে, পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার উপর কর্মকাণ্ডের কোনাে সম্পর্ক 6065 fpall oth foreco 12 [Jilani’s case it seems, held rule 32 of the Ordinance to be applicable on the basis that the activities went against public order, not on the basis that the activities had any bearing on security and defence of Pakistan.]
৩৫. বর্তমান মামলায় জনশঙ্খলা সমস্যার কথা উপস্থাপন করা হয়েছে। পুনঃশুনানি আদেশে যা বলা হয়েছে তার তাৎপর্য এই যে, ৩২ বিধির বিধান প্রযােজ্য কিনা তা দেখা, কারাে কর্মকাণ্ড আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে কিনা তা পরীক্ষা করা নয়। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার বিষয়টি কেবল প্রসঙ্গক্রমে এসেছে। হাইকোর্টের সামনে এই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে, এসব কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। পুনঃশুনানি আদেশে এটা বােঝানাে হয়নি যে, এসব কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য ক্ষতিকারক হলেই কেবল ৩২ বিধি প্রযােজ্য হবে। যেহেতু হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, একমাত্র নির্বাহী বিভাগই বলতে পারে কোনাে কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে স্পর্শ করে কিনা”। এসব কথা সেই রায় থেকে পুনঃশুনানি আদেশে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এর মানে এটা নয় যে, যদি কর্মকাণ্ডসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে, তা পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষাকে প্রভাবিত করেনি, বরং জনশৃঙ্খলা ও দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে, তাহলে আদেশটি অবৈধ হয়ে যাবে।
৩৬. ১৯৬৬ সালের বিবিধ ৬৪ নম্বর দরখাস্ত রক্ষণীয়/গ্রহণযােগ্য (মেইনটেবিলিটি) কিনা তা-ও আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, অধ্যাদেশের ৪, ১৪ ও ১৬ ধারার বিধান মতে (ইন ভিউ অব) ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯১ ধারার অধীন আবেদন গ্রহণযােগ্য
২৯১
(মেইনটেনেবল) নয়। এই ধারাগুলাে মনােযােগ দিয়ে পড়লে দেখা যায়, এই দাবি একেবারে সারহীন নয়। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটি আমাদের কাছে সুপ্রীম কোর্টের পুনঃশুনানি আদেশ হিসেবে এসেছে গােলাম জিলানী মামলায় গৃহীত নীতিসমূহ অনুযায়ী মামলাটি নিষ্পত্তি করার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ, কাজেই এই আদালতের সেই নির্দেশনা না মেনে উপায় থাকে না।
৩৭. একইভাবে উত্থাপিত এই রুলের অসারতা প্রশ্নে আমরা কোনাে সিদ্ধান্তে যেতে চাই না। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, ১৯৬৬ সালের ৬৬ নম্বর বিবিধ মামলার আটকাদেশের তিন মাস মেয়াদ বহু আগেই উত্তীর্ণ হওয়ায় রুলটিই ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে। তিনি তাঁর সাবমিশনে আরও বলেন যে, উপরােক্ত তিন মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরাে নয় মাসের আটকাদেশের মেয়াদ শেষ হয়। ৩.৮.১৯৬৬, ৮.১১.১৯৬৬ ও ২৫.১.১৯৬৭ তারিখের তিনটি পরপর আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে কোনাে আলাদা মামলা করা হয়নি। ইলেক্টোরাল কলেজ অ্যাক্ট-এর ৫৩ ধারা ও ন্যাশনাল অ্যান্ড প্রভিন্সিয়াল অ্যাসেম্বলি (ইলেকশন) অ্যাক্ট-এর ১০৬ ধারার প্রয়ােগের কারণে নির্বাচনে দাঁড়ানাের ব্যতিক্রমী অযােগ্যতার প্রশ্ন (দ্য কোয়েশ্চন অব সেভিং ডিসকোয়ালিফিকেশন) এই মামলায় আসে না। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল পেশ করেন যে, যেহেতু আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] বর্তমানে একটি নতুন আটকাদেশ অর্থাৎ, ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলাসংশ্লিষ্ট আটকাদেশের অধীনে আটক আছেন, যা আমাদের পরবর্তী রায়ের বিষয়বস্তু, বর্তমান ১৯৬৬ সালের বিবিধ ৬৪ নম্বর মামলার আদেশ বিবেচনা করা কেবল অ্যাকাডেমিক, প্রয়ােজনীয় নয়। এই প্রশ্নটি অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখলেও সুপ্রীম কোর্টের পুনঃশুনানি আদেশ দ্বারা বাঁধা থাকার কারণে আমরা এই বিষয়ের ভেতরে যেতে ব্রিতবােধ করছি।
৩৮. প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উল্লেখ করা যায় যে, জনাব সালাম খান ক্ষোভ জানিয়েছেন যে, বর্তমান মামলায় যে সম্পূরক হলফনামা (সাপ্লিমেন্টারি) পেশ করা হয়েছে, তা মূল হলফনামাকারী ডেপুটি কমিশনার না করে করেছেন প্রাদেশিক সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা।
৩৯. প্রাদেশিক সরকার এই মামলার একটি পক্ষ; মূল জবাবি-হলফনামা পেশ করেছেন (সাের্ন ইন) ডেপুটি কমিশনার, যিনি নিজে আটককারী কর্তৃপক্ষ। এর পরে যে বিস্তারিত জবাবি হলফনামা পেশ করা হয়েছে। তার মূল অংশ (নিউক্লিয়াস) এখানে বিধৃত করা হয়েছে [a nucleus has been given for the elaborate counter-affidavit that followed] এবং ডেপুটি কমিশনার যে ক্ষমতা প্রয়ােগ করেছেন তার অর্পণকারী (ডেলিগেট) পূর্ব পাকিস্তান সরকার- এসব বিষয় বিবেচনা করে আমরা এই যুক্তির মাঝে বিশেষ সারবত্তা খুঁজে পাইনি।
৪০. দুটি মামলায়ই সাধারণ আইনি বিষয়গুলাে আলােচিত হয়েছে এবং জবাব দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা আমাদের সামনে উপস্থাপিত মূল হলফনামা, জবাবি-হলফনামা (কাউন্টার) ও সম্পূরক হলফনামায় (সাপ্লিমেন্টারি) ও পক্ষদ্বয়ের জবাব (রিপ্লাইজ) পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার দিকে অগ্রসর হবাে। এখানে উল্লেখ্য যে, বিবাদিপক্ষে অ্যাডভােকেট জেনারেল কর্তৃক পেশকৃত সম্পূরক-হলফনামা দুটি, মামলার সঙ্গেই সম্পর্কিত।
৪১. দুটি পিটিশনের হলফনামাতেই বলা হয় যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি একজন আইন মান্যকারী নাগরিক এবং কখনােই কোনােভাবে পাকিস্তানের স্বার্থবিরােধী কোনাে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি [শেখ মুজিবুর রহমান] সাংবিধানিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী এবং সর্বদা জনগণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আসছেন। তিনি সম্প্রতি ছয় দফা কর্মসূচি
২৯২
প্রণয়ন করেছেন যা সারা দেশে প্রচার পেয়েছে এবং জনগণের কাছ থেকে বিপুল সমর্থন লাভ করেছে। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলের লক্ষ্য বর্তমান সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা।
৪২. এটা বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবি ক্ষমতাসীন দলকে বিক্ষুব্ধ করেছে এবং সেই কারণেই তার শুরু করা বৈধ আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেওয়ার অসৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে আটককৃত ব্যক্তিকে [শেখ মুজিবুর রহমানকে] অবৈধভাবে আটক করে রাখা হয়েছে।
৪৩. অন্যদিকে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার মূল জবাবি-হলফনামায় দাবি করেন যে, ছয় দফা দাবি আদায়ে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ও তাঁর দলের শুরু করা আন্দোলন কোনােভাবেই সাংবিধানিক ছিল না এবং আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ছয় দফা কর্মসূচির নামে জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিভ্রান্তি ও সংকীর্ণ চেতনা সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি বস্তুত মারাত্মকভাবে বিপজ্জনক কর্মকাণ্ড ও দিচ্ছেন যা দেশের স্বার্থের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ছাত্রদের মধ্যে গুজবভিত্তিক প্রচারণা (হুইসপারিং ক্যাম্পেইন) শুরু করেন এবং ঢাকা ও অন্যান্য জায়গায় জনসভায় বক্তৃতা করে বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা ছড়িয়েছেন এবং আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন। এভাবে তিনি জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখার বিপক্ষে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন এবং এগুলাে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২(১)(খ) বিধির অধীনে আটককারী কর্তৃপক্ষের নিকট ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত হিসেবে পরিগণিত হয়। ডেপুটি কমিশনার সকল তথ্য-উপাত্তসমূহ যত্নসহকারে বিশ্লেষণ করে পূর্ণ সন্তুষ্টির ভিত্তিতে তর্কিত আদেশটি দিয়েছেন।
৪৪. এটা অস্বীকার করা হয় যে, ছয় দফা দাবি আদায়ের সাংবিধানিক আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য আটকাদেশের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এটাও উল্লেখ করা হয় যে, আটকের শিকার ব্যক্তি তার ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের জন্য বেশ কয়েকবার গ্রেফতার হয়েছেন।
৪৫. ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলার মূল জবাবি-হলফনামায় আরও বলা হয় যে, ছয় দফা কর্মসূচি কেবল জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিভ্রান্তি ও সংকীর্ণ চেতনা সৃষ্টি করেছে তা নয়, বরং আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক শুরু করা এই আন্দোলনের ধরন ছিল সহিংস এবং তা জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। দাবি করা হয় যে, লক্ষ্যে পৌছানাের জন্য আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন তা সাংবিধানিক নয়। এই দাবির জবাবে আটককৃত পক্ষে যা বলা হয়, তার মূল কথা হলাে-এই আন্দোলন একটি সাংবিধানিক আন্দোলন এবং আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সংহতির জন্য ক্ষতিকর কোনাে কিছু করেননি।
৪৬. উপরােক্ত আলােচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সমালােচনার তীর ছয় দফা কর্মসূচির দিকে নয়, বরং তার সহিংস বাস্তবায়ন নিয়ে। ছয় দফা সাংবিধানিক কর্মসূচি কিনা তা এখানে বিচার্য নয়। এখানে যা নির্ধারণ করতে হবে তা হলাে- ছয় দফা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] কর্তৃক গৃহীত পদ্ধতি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ বিধির অর্থ অনুযায়ী আপত্তিজনক ও ক্ষতিকর কিনা।
৪৭. উপরােক্ত আলােচনা থেকে বােঝা যায়, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] সারা দেশজুড়ে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন এবং বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল কর্তৃক পেশকৃত সম্পূরক হলফনামায় দেখা যায়,
২৯৩
আটককৃতের [শেখ মুজিবুর রহমান] সঙ্গে বিদেশি দূতাবাসেরও যােগাযােগ ছিল। ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম, বরিশাল ও ফরিদপুরে বক্তৃতা করেছেন। ১৯৬৪ সালে তিনি এক সংবাদ বিবৃতিতে সরকারের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন যে, সরকার যদি দমনমূলক পদক্ষেপ বন্ধ না করে এবং গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে না দেয়, তাহলে জনগণ অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করতে পারে।
৪৮. আমরা সম্পূরক-হলফনামার এই অংশে প্রকাশিত আটককৃতের কর্মকাণ্ডকে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। কারণ
এগুলাে ১৯৬৪ সালসংক্রান্ত, যা বর্তমান আটকাদেশের বহু পূর্বেকার।
৪৯. সম্পূরক হলফনামার অনুচ্ছেদ ১২ থেকে আমরা আটককৃতের অতি সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের একটা চিত্র পাই।
৫০. এখানে দেখা যায়, যুদ্ধবিরতির এক সপ্তাহের মধ্যে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] সারা পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশজুড়ে বক্তৃতা করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের অনুভূতি এবং আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করতে শুরু করেন।
৫১. সম্পূরক হলফনামার ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, ৩০.৯.১৯৬৫ তারিখে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান। তার রাজনৈতিক বন্ধুদের সঙ্গে এক আলােচনার সময় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাজেটের অপর্যাপ্ততা নিয়ে সমালােচনা করেন এবং তিনি ভারতের আক্রমণের নিন্দা করে গৃহীত প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন, যদিও তা শেষ পর্যন্ত পাস হয়। জবাবে এই অভিযােগ মিথ্যা বলে অস্বীকার করা হয় এবং এই ব্যাপারে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল আমাদের সন্তুষ্ট করতে পারেননি।
৫২. অন্যদিকে, প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ভারতীয় আগ্রাসনের সমালােচনায় পিছিয়ে ছিলেন না। অনুচ্ছেদ ১৪-তে বলা হয়, ১৯৬৫ সালের অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ভারতের সঙ্গে ১৭ দিনের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অসহায়ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন এবং বলেছেন যদি পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপনের দাবি মেনে না নেওয়া হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন শুরু করবে এবং পাকিস্তানের পৃথককরণের পক্ষে প্রচারণা চালাবে। ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, ১৮.১.১৯৬৬ তারিখে আলফা ইস্যুরেন্স কোম্পানির অফিসে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠক করেন। সেখানে তিনি পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে কাণ্ডজ্ঞানহীন (সেন্সলেস) এক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং তাসখন্দে কাশ্মীরকে বিনিময় (বার্টার) করে এসেছে- এই মর্মে অপপ্রচারাভিযান (হুইসপার ক্যাম্পেইন) চালানাের পরামর্শ দেন ছাত্রদের। এটাও বলা হয় যে, তিনি ছাত্রদের তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলার পরামর্শও দেন, যাতে জরুরি অবস্থা উঠে গেলে তারা একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন।
৫৩. জরুরি অবস্থার পর আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। ফলে এসব অভিযােগ দুর্বল হয়ে যায়। তাছাড়া প্রতীয়মান হয় যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান প্রকাশ্যে তাসখন্দ চুক্তির সমালােচনা করেননি। ১৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ২০.১.১৯৬৬ তারিখে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের এক বৈঠকে বক্তৃতা করেন, যেখানে তিনি পুনরায় আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ান এবং বলেন যে, জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর সহিংসতা আসবে। এছাড়া তিনি করব্যবস্থা (লেভি সিস্টেম) তুলে নেওয়ার দাবি জানান এবং দাবি পূরণের জন্য সহিংস পন্থা অবলম্বনের প্রস্তাব করেন।
২৯৪
৫৪. এসব অভিযােগ অস্বীকার করা হয় এবং অ্যাডভােকেট জেনারেল ১৩-১৬ অনুচ্ছেদে বিধৃত বিষয়গুলাের | ব্যাপারে প্রিভিলেজ দাবি করায় আমরা সেসব ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারােপ করিনি।
৫৫. ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, ২১.১.১৯৬৬ তারিখে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] মিসেস গান্ধী কংগ্রেস সংসদীয় দলের প্রধান নির্বাচিত হওয়ায় তাঁকে অভিনন্দন জানান এবং ভারত পাকিস্তানে আগ্রাসনকারী হওয়া সত্ত্বেও মিসেস গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় তাঁকে স্বাগত জানান।
৫৬. আমরা এর মধ্যে গুরুতর কিছু খুঁজে পাইনি। ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, ৪.২.১৯৬৬ তারিখে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পৃথককরণ (সেপারেশন) ও পাকিস্তান থেকে আলাদা করতে চান মর্মে এক সংবাদ বিবৃতি প্রদান করেন।
৫৭. প্রতীয়মান হয় যে, তিনি এসব বিষয়ে বিস্তৃত কিছু বলেননি। তবে দাবি পূরণ না হলে বিচ্ছিন্নতার প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, ১০.২.১৯৬৬ তারিখে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] লাহােরে তাঁর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন এবং তিনি সংবাদ প্রতিনিধিদের বলেন যে, দেশের প্রতি ভালােবাসাই সংহতিকে টিকিয়ে রেখেছে।।
৫৮. এটা পুরােপুরি সাব্যস্ত করা যায়নি। ২০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, ১১.২.১৯৬৬ তারিখে লাহাের থেকে ফিরে আসার পর সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি ছয় দফা কর্মসূচির বিশদ তুলে ধরেন যা লাহাের সম্মেলনে আলােচিত হয়নি এবং এর পরিণতি হিসেবে তিনি দুটি সম্মেলন ও এর প্রস্তাবগুলাে থেকে সকল সংযােগ বিচ্ছিন্ন করেন।
৫৯. এখানেও ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি। ২১ অনুচ্ছেদে যা বলা হয় তার সার এই যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ২২.২.১৯৬৬ তারিখে ঢাকাস্থ আমেরিকান কনস্যুলেটে আমেরিকান জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়ােজিত এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে যােগদান করেন। আমরা এর মধ্যে গুরুতর কিছু খুঁজে পাইনি, বিশেষত এই কারণে যে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল এই অনুচ্ছেদের পেছনের ম্যাটেরিয়ালগুলাে প্রিভিলেজের মাধ্যমে কাভার করেছেন (particularly having regard to the fact that the learned Advocate-General has covered the materials behind this paragraph by privilege.) ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ২৫.২.১৯৬৬ তারিখে আটক ব্যক্তি চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির ময়দানে একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন, যেখানে তিনি এই দেশ পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক গত ১৮ বছর ধরে শােষণের শিকার হচ্ছে এই বক্তব্যের উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের নাগরিকদের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষের অনুভূতি ছড়িয়েছেন।
৬০. অন্য অনেক বক্তৃতার মতাে এই বক্তৃতাও ছিল খুবই আগুন ঝরানাে। ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ২৭.২.১৯৬৬ তারিখে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] নােয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। যেখানে তিনি আবারাে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন এই বলে যে, পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি আরাে বলেছেন, যদিও রাজস্বের বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে যায়, কিন্তু তা এই অংশের উন্নয়নে ব্যয় করা হয় না। তিনি আরাে বলেছেন, তিনি যদি তাঁর নীতির পক্ষে ২০,০০০ সমর্থক জোগাড় করতে পারেন তাহলে তিনি ছয় দফা দাবি আদায় করতে পারবেন। ২৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ২৭.২.১৯৬৬ তারিখে আটক ব্যক্তি মাইজদীতে অনুষ্ঠিত নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সম্মেলনে ভাষণ দেন। যেখানে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচ কোটি
২৯৫
জনগণ সবসময় অত্যাচারের শিকার হয়েছেন এবং তাদের ন্যায্য অর্থনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। উপরােক্ত ২১ অনুচ্ছেদে আনীত অভিযােগসমূহের ব্যাপারেও প্রিভিলেজ দাবি করা হয়েছে। আমরা সেগুলােকে তেমন গুরুত্ব দেইনি, যদিও সেসব বক্তৃতায় অসন্তোষ সৃষ্টির সুস্পষ্ট প্রবণতা রয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৫-এ ১০.৩.১৯৬৬ তারিখে ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের কথা বলা হয় যেখানে আটক ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর গত ১৮ বছরে যতটা শােষণ ও নিপীড়ন করেছে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ২০০ বছরেও ততটা হয়নি। তিনি দুই অংশের অসমতার কথা বলেন এবং আরাে বলেন যে, দেশের আয়ের মাত্র ১৪% পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়, বাকিটা ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। তিনি সম্ভাব্য পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য ২০,০০০ স্বেচ্ছাসেবী আহ্বান করেন।
৬১. এটা ছিল চরম অনলবর্ষী বক্তৃতা। খুবই উত্তেজক ও হুমকিস্বরূপ। ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ১৪.০৩.১৯৬৬ তারিখে তিনি সিলেটের এক জনসভায় অংশগ্রহণ করেন এবং উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের যে কোনাে আত্মত্যাগের বিনিময়ে ছয় দফা দাবি আদায়ের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ২০.৩.১৯৬৬ তারিখে ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামের এক জনসভায় বক্ততা করেন। এই ব্যাপারে কোনাে প্রিভিলেজ দাবি করা হয়নি। এই বক্তৃতার মূল বৈশিষ্ট্যগুলাে ছিল : “গত ১৮ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের জীবনরক্ত শুষে নেওয়া চলছে।” … “সব ট্যাক্স দুই প্রদেশ সংগ্রহ করবে”, … “আমরা বৈদেশিক মুদ্রার সত্তর শতাংশ উপার্জন করি যা আপনারা লুট করে নিচ্ছেন, আমরা জানি না টাকাগুলাে যায় কোথায়। এগুলাের ভাগ-বাটোয়ারা হওয়া উচিত”… “পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করার জন্য আমি বদনাম কুড়িয়েছি।”
৬২. একই সময়ে তিনি বলেন, তিনি বিচ্ছিন্নতার পক্ষে ওকালতি করেননি। “রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য ছাত্ররা জীবন দিয়েছে, কিন্তু আমাদের মান্য (ওবে) করতে হবে।” এটা উত্তেজনাকর। “১৭ দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান কেবল আল্লাহর দয়ায় রক্ষা পেয়েছে। এটা বরং আনুগত্যহীনতা সৃষ্টিকারী। “প্রেসিডেন্ট জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করেছেন”… “কোনাে জাতিই (বিশেষত তার দলকে লক্ষ করে) আত্মত্যাগ ছাড়া তার দাবি আদায় করতে পারেনি। তবে একই সময়ে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হতে হবে। এটা খুবই উত্তেজনাকর এবং সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক। পূর্ব পাকিস্তানের স্বর্ণের দর ১৫০/=, পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে ১২০/=। বাজারমূল্য পূর্ব পাকিস্তানে ৬/=, পশ্চিম পাকিস্তানে ২/=।” এটা ঘৃণা সৃষ্টি করে। “প্রেসিডেন্ট বাঙালিদের দাস বলেছেন”… “বিড়ি পূর্ব পাকিস্তানে আসতে পারবে না, পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে পারে”… “যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও, জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।” এটা সহিংসতা, রক্তপাত ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার পথে আহবান। “বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্লক করে দেওয়া হয়েছে”।
৬৩. এতে ছাত্রদের উত্তেজিত করার প্রবণতা রয়েছে। “জেল দিয়ে সাড়ে ৫ কোটি জনগণের দাবি দমন করা যাবে না। আত্মত্যাগ ও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।” এটা জনশৃঙ্খলা লঙ্ঘন করার আহ্বান। “যদি একজন। আওয়ামী লীগারের গায়ে হাত দেওয়া হয়, তাহলে আমরা জেল ভরে ফেলবাে।” বেশ আপত্তিকর। “গ্রামে বেরিয়ে পড়াে এবং মুক্তি আদায়ের চেষ্টা করাে”। কলস ফর নাে কমেন্ট। বক্তব্য শেষ হয় এই বলে যে, আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হতে হবে। এটা বরং নিজেদের কৌশলকে আড়াল করার জন্য চালাকি বলে মনে হয়। ক্ষতি যা করার তা করা হয়ে গেছে এবং ইতিমধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠে গেছে। ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ২৭.৩.১৯৬৬ তারিখে চট্টগ্রামেও একই ভাষায় বক্তৃতা করেছেন। ২৯ অনুচ্ছেদেও বলা হয় ১৭.৪.১৯৬৬ তারিখে তিনি পাবনায় একটি জনসভায় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রায় একই রকম বক্তৃতা করেন। ৩০ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ৯.৬.১৯৬৬ তারিখে তিনি রংপুরেও একই রকম বক্তৃতা করেন। ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ১১.৪.১৯৬৬ তারিখে
২৯৬
রাজশাহীতে একই ধরনের একটি জনসভায় বলেন, বাঙালিদের টাকায় ইসলামাবাদ ও পিন্ডিতে রাজধানী তৈরি করা হচ্ছে। ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ১৪.৪.১৯৬৬ তারিখে তিনি ফরিদপুরেও বক্তৃতা করেন। ৩৩ অনুচ্ছেদের ভাষ্য, ১২.৪.১৯৬৬ তারিখে তিনি খুলনায় এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। সেখানে তিনি বলেন, সরকার ৬০ লাখ কাশ্মীরীর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির সুরক্ষার জন্য কোনাে উদ্যোগ নিচ্ছে না। এমন দিন আসবে যখন জনগণ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। এই বক্তৃতাও উসকানিমূলক মনে হয়। ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়, আটক ব্যক্তি সানডে অবজার্ভার-এর বিশেষ প্রতিনিধি সিরিল ডানের কাছে বলেছেন যে, “পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান ছেড়ে যেতে চায়। পূর্ব পাকিস্তান কারাে উপনিবেশ হােক তা আমি পছন্দ করি না।” আমরা এর উপর বিশেষ নির্ভর করছি না, কারণ খবরটি অনির্ভরযােগ্য উৎস অর্থাৎ ২৬.৪.১৯৬৬ তারিখের অমৃতবাজার পত্রিকা থেকে এসেছে। ৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ২৯.৪.১৯৬৬ তারিখে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] কুমিল্লার এক জনসভায় একই রকম বক্তৃতা করেন।
৬৪. ৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়, ৮.৫.১৯৬৬ তারিখে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। যেখানে পুনরায় আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিষােদগার করেন এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করেন। আমরা ইতােমধ্যে আলােচিত ঢাকা স্টেডিয়ামের বক্তৃতার মতাে এই বক্তৃতাও অনুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছি। এই বক্তৃতা নিয়েও কোনাে প্রিভিলেজ দাবি করা হয়নি।
৬৫. ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বক্তৃতা দুটি শােনার সময় অন্যদের সঙ্গে আটককৃতের আইনজীবী সালাম খান উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই বলে সেগুলােকে আড়াল করার চেষ্টা করছিলেন যে, এগুলাে সরকারি নীতির বৈধ সমালােচনা। পুরাে বক্তৃতা একসঙ্গে পড়ে আমরা সেগুলাের নির্দোষিতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হতে পারিনি।
৬৬. আউটার স্টেডিয়ামের বক্তৃতার মতাে নারায়ণগঞ্জের এই বক্তৃতা খুবই উত্তেজক ও উসকানিমূলক। মূলকথাগুলাে ছিলাে : “বক্তৃতা দেওয়া কঠিন”… “আইয়ুব খান অসহনীয়”… “পশ্চিমে অবস্থিত সদর ও দপ্তরসমূহ”… “যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অসহায়ত্ব”… “আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে সবকিছু
দিয়েছি, বিনিময়ে তারা আমাদের নিপীড়ন করেছে।”
৬৭. এটা সুস্পষ্টভাবে অন্য অংশের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টিকারী এবং বেশ সমস্যাজনক। “ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ, গুলি।” এটা উত্তেজনাকর। এটা শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিনষ্ট করতে পারে। “রক্তপাত ছাড়া তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়নি।”… স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে কোনাে সােনা নেই”। এটা আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রতিফলন। “তােমরা আমাদের সঙ্গে গত ১৮ বছর ধরে বিশ্বাসঘাতকতা করে আসছাে।” লক্ষ রাখুন, এই ১৮ বছরে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান নিজে একজন মন্ত্রী ছিলেন। “তােমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারাে, সাড়ে ৫ কোটি মানুষকে নয়।” আরাে উত্তেজক। “পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শুষে নিলেও সে খবর ছাপা যাবে না।”…“আমরা মারা যাব, কিন্তু বাঙালিদের মরতে দেবাে না, তােমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি।” এখানে সহিংসতার ইঙ্গিত রয়েছে। কোনাে সন্দেহ নেই যে, বক্তৃতাগুলাে জনশৃঙ্খলার লঙ্ঘন।
৬৮. ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়, জরুরি অবস্থা চলাকালীন আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ভারতীয় দূতাবাসসহ বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, তিনি সহিংস ও অসাংবিধানিক পন্থায় ছয় দফা আদায় করবেন এবং মনে হয় বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি বক্তৃতার জন্য
২৯৭
তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি মামলা শুরু হয়েছে এবং দুটি মামলায় তিনি ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
৬৯. ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়, নথিতে রক্ষিত কাগজাদি ও আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] কর্তৃক ঢাকা জেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রদত্ত বক্তৃতা পরীক্ষা করে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, তিনি ক্ষতিকর উপায়ে রাষ্ট্রবিরােধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারেন এবং ৮.৫.১৯৬৬ তারিখে তিন মাসের আটকাদেশ জারি করেন। এরপর আটকাদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে সময়ে সময়ে আদেশ সংশােধন করেন। এরপর থেকে পুরাে পরিস্থিতি পর্যালােচনা করেন এবং ৩.৫.১৯৬৭ তারিখ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন আটকাদেশ দেন on which date on substantive order of conviction, no further order under the Defence of Pakistan Rules was made.
৭০. ৪০ অনুচ্ছেদে বলা হয়, সকল ম্যাটেরিয়ালস, সিচ্যুয়েশন রিপাের্ট ও ইনফরমেশন রিপাের্ট বিবেচনা করে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার ২৯.৫.১৯৬৭ তারিখে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আটককৃতকে জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্য ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ বিধি অনুযায়ী আটকাদেশ জারি POST SC311979, as his substantive order of detention was suspended by the granting of bail passed the said order for a period of three months which was served on the detenu on 1.6.1967. ৩৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদের এই অংশটুকু ১৯৬৭ সালের পরবর্তী বিবিধ মামলা নম্বর ১৬১-এর জন্য বিশেষ
তাৎপর্য বহন করে (স্পেশাল বিয়ারিং)।
৭১. উপরােক্ত বক্তৃতাসমূহ, বিশেষত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে প্রদত্ত বক্তৃতা দুটি, কেবল অতিমাত্রায় বিস্ফোরক নয়, জনশৃঙ্খলা ও দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি নষ্ট করার ইঙ্গিতবাহী। বক্তৃতায় কেবল দুই অংশের মধ্যে ঘৃণার অনুভূতিই সৃষ্টি করা হয়নি, বরং আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি সকল আনুগত্য অপসৃত করা হয়েছে।
৭২. সুতরাং, আটককৃতের বিভিন্ন বক্তৃতা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের সিদ্ধান্ত
হলাে এই যে, উপরের বিষয়গুলাে আটককারী কর্তৃপক্ষের জন্য ৮.৫.১৯৬৬ ও ২৯.৫.১৯৬৭ তারিখের তর্কিত আটকাদেশ জারি করার যৌক্তিক সন্তুষ্টির (reasonable satisfaction) যথার্থতা প্রদান করে। সুতরাং, ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলায় প্রদত্ত রুল খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে।
৭৩. ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্র পয়েন্ট বিবেচনায় যাওয়ার আগে এটা বলা প্রয়ােজন যে, জিলানীর মামলায় নবযুগ সৃষ্টিকারী রায় ঘােষিত হয় ১৯৬৭ সালের ১৭ মে। সেই রায় অনুসারে সদ্য নিষ্পত্তিকৃত ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলাটি সুপ্রীম কোর্টের ১৪.৬.১৯৬৭ তারিখের একটি রিমান্ড আদেশে হাইকোর্টে ফেরত পাঠানাে হয়।
৭৪. সদ্য নিষ্পত্তিকৃত ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলা পুনঃশুনানির জন্য প্রধান বিচারপতি কর্তৃক নতুন বিশেষ বেঞ্চ পুনর্গঠনের পূর্বে জনাব সালাম খান ২৯.৫.১৯৬৭ তারিখের আটকাদেশ, যার অধীনে আটককত ব্যক্তি [শেখ মুজিবর রহমান। বর্তমানে আটক রয়েছেন, তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এই রয়েছেন, তার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এই আদালতের এক ডিভিশন বেঞ্চে আরেকটি পিটিশন দাখিল করেন। সেই ডিভিশন বেঞ্চ ২৬.৬.১৯৬৭ তারিখে বর্তমান রুল জারি করেন।
২৯৮
৭৫. রুল জারি করার ক্ষেত্রে ডিভিশন বেঞ্চ এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছেন যে, বর্তমান আটকাদেশ ও পুরনাে আদেশমালার (চেইন অব অর্ডারস) মধ্যে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় বর্তমান তর্কিত আদেশ সম্পূর্ণভাবে নতুন আদেশ।
৭৬. দুটি বিবিধ মামলার সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয় ও ঘটনাগুলাে ইতােমধ্যে বিবেচনা করা হয়েছে এবং তা বন্দির বিরুদ্ধে গিয়েছে। তাই আমরা এই অংশে কেবল সুনির্দিষ্ট স্বতন্ত্র আইনি প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করবাে। তা হলাে : ২৯.৫.১৯৬৭ তারিখের বর্তমান আদেশ ও সর্বশেষ আদেশের মধ্যে ২৬ দিনের ব্যবধান অতিবাহিত হয়েছে। এবং পরিস্থিতি এরকম ছিল যে, বন্দির পক্ষে নতুন করে কোনাে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে যােগ দেওয়ার সুযােগ থাকে না। এই ব্যাপারটা বিবেচনা করে দেখতে হবে বর্তমান আদেশটি কতটুকু বৈধ।
৭৭. কী পরিস্থিতিতে বর্তমান আদেশ জারি করা হয়েছে তা পিটিশনের ১৪ ও ১৭ অনুচ্ছেদে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে। এখানে সেটির পুনরুল্লেখ করা যেতে পারে :
১৪. “বিধি অনুযায়ী ডিটেনশনের মেয়াদ বৃদ্ধিকারী সর্বশেষ আদেশ জারি করা হয়েছিলাে ১৯৬৭ সালের ২৫ জানুয়ারি, যা তাঁর কাছে পৌছানাে হয় ৪.২.৬৭ তারিখে। কিন্তু ২৫ জানুয়ারি ১৯৬৭ তারিখের আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ডিটেনশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে আরেকটি আদেশ আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান]-কে সার্ভ করা হয়।”
১৫. “এর মধ্যে ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আফসারউদ্দীন তার ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭ তারিখের রায় ও আদেশের মাধ্যমে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান]-কে বিধিমালার ৪৭ বিধির (৫) উপবিধির অধীনে একটি ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করেন এবং তার বিরুদ্ধে এক বছর তিন মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেন।”
১৬. “আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সেই আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকা দায়রা আদালতে আপিল করেন এবং জামিন আবেদন করেন। বিজ্ঞ দায়রা জজ আটককৃত ব্যক্তির আইনজীবী ও জামিনের বিরােধিতাকারী সরকারি আইনজীবীর বক্তব্য শুনানির পর ২৯ মে ১৯৬৭ তারিখের আদেশে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান]-কে জামিনে মুক্তি দেন।
১৭. “বিজ্ঞ দায়রা জজের আদেশানুসারে আটককৃত ব্যক্তির [শেখ মুজিবুর রহমান] এই জামিনের কথা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছে ১৯৬৭ সালের ১ জুন। জামিনাদেশ পাওয়ার পর মুক্তি দেওয়ার জন্য তাঁকে জেল গেটে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু এর মধ্যে বিধিমালার ৩২ বিধির (২) উপবিধির (খ) দফার অধীনে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার জনাব এম. কে. আনােয়ারের স্বাক্ষরিত ২৯ মে ১৯৬৭ তারিখসম্বলিত আটকাদেশ তাঁকে (ডেটিকে) ১.৬.৬৭ তারিখ সন্ধ্যা ৬.০০টায় জেলগেটে সার্ভ করা হয় এবং তাঁকে [শেখ মুজিবুর রহমানকে] সেখানে আটক করা হয়। এই আদেশের সত্যায়িত অনুলিপি (ট্র কপি) এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে এবং সংযুক্তি “সি” হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
৭৮. ডেপুটি কমিশনার জবাবে যে মূল জবাবি-হলফনামা পেশ করেছেন তা পিটিশনের ২১ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত হয়েছে। তা নিম্নরূপ :
২১. “পিটিশনের ১৪ অনুচ্ছেদে এই মর্মে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে যে, “কিন্তু ২৫ জানুয়ারি ১৯৬৭ তারিখের উপরােক্ত আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ডিটেনশনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে কোনাে আদেশ আটককৃত ব্যক্তিকে [শেখ মুজিবুর রহমান] সার্ভ করা হয়নি, তা সঠিক নয় এবং ফলে, তা এই
২৯৯
ডিপােনেন্ট অস্বীকার করেছেন : তার মতে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২(১)(খ) অনুযায়ী ৮.৫.৬৬ তারিখের প্রথম আটকাদেশ ডেটিকে [শেখ মুজিবুর রহমান] সার্ভ করা হয় ৯.৫.৬৬ তারিখে। এই আদেশ তিন মাসের হওয়ায় দ্বিতীয় আদেশ জারি করা হয় ৩.৮.৬৬ তারিখে যা ডেটির কাছে পৌছানাে হয় ৬.৮.৬৬ তারিখে। এই আদেশও তিন মাসের হওয়ায় ২.১১.৬৬ তারিখে দ্বিতীয় আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে তৃতীয় আদেশ জারি করা হয় যা ডেটির কাছে পৌছানাে হয়। ৫.১১.৬৬ তারিখে; পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা, ১৯৬৫-এর ৩২(১)(খ) অনুযায়ী চতুর্থ আদেশ জারি হয় ২৫.১.৬৭ তারিখে এবং আটককৃতকে তা জানানাে হয় ৪.২.৬৭ তারিখে। এই আদেশও মাত্র ৩ মাসের হওয়ায় ৩ মে ১৯৬৭ তারিখে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কথা ছিল। সর্বশেষ আদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২৭.৪.৬৭ তারিখে একটি ফৌজদারি মামলায় ডেটিন (আটককৃত ব্যক্তি) দোষী সাব্যস্ত হন এবং ১৫ মাসের সাধারণ কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। উপরােক্ত কনভিকশন অর্ডারের ভিত্তিতে ডেটি (আটককৃত ব্যক্তি) জেলে থাকেন এবং ১.৬.৬৭ তারিখে জামিনে মুক্তি পান। এই ডেপােনেন্ট এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, ডেটিকে জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখা এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার স্বার্থে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২(১)(খ) অনুযায়ী আদেশ জারি করা প্রয়ােজন এবং সেই অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ডেটিকে পৌঁছানাের দিন থেকে তিন মাসের আটকাদেশ জারি করেন যা ডেটিকে পৌছানাে হয় ১.৬.৬৭ তারিখে।”
৭৯, ইতিমধ্যে উল্লিখিত একই বিষয়ে পেশকৃত সম্পূরক হলফনামার ৩৯ ও ৪০ অনুচ্ছেদ এখানে আবার
উল্লেখ করা যায় :
৩৯. নথিতে রক্ষিত কাগজাদি ও আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] কর্তৃক ঢাকা জেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রদত্ত বক্তৃতা পরীক্ষা করে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ক্ষতিকর উপায়ে রাষ্ট্রবিরােধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারেন এবং ৮.৫.১৯৬৬ তারিখে তিন মাসের আটকাদেশ জারি করেন। এরপর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আদেশ পর্যালােচনা করেন। এরপর থেকে সময়ে সময়ে (টাইম টু টাইম) পুরাে পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে ৩.৫.১৯৬৭ তারিখ পর্যন্ত কন্টিনিউয়াস ডিটেনশনের আদেশ দেন on which date on substantive order of conviction, no further order under the Defence of Pakistan Rules was made.
৪০. সব তথ্য-উপাত্ত, সিচ্যুয়েশন রিপাের্ট ও ইনফরমেশন রিপাের্ট বিবেচনা করে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার ২৯.৫.১৯৬৭ তারিখে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আটককৃতকে জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্য ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার স্বার্থে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধির ৩২ বিধি অনুযায়ী আটকাদেশ জারি করা প্রয়ােজন, as his substantive order of detention was suspended granting of bail passed the said order for a period of three months which was served on the detenu on 1.6.1967.
৮০. উপরােক্ত হলফনামা ও জবাবি-হলফনামাসমূহের বক্তব্য পরিষ্কার। জনাব সালাম খান যুক্তি দিয়েছেন যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] জেলে থাকায় নতুন ঘটনা ঘটার পরিস্থিতি ছিল না। এই ব্যাপারটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বর্তমান আদেশ অসদুদ্দেশ্যপ্রণােদিত (ম্যালাফাইড)। বিজ্ঞ
৩০০
অ্যাডভােকেট জেনারেল যুক্তি দেন যে, বর্তমান আদেশ সম্পূর্ণ বৈধ। তিনি Basanta Chandra Ghose os. Emperor AIR 32 1945 FC18 মামলার রায় উদ্ধৃত করেন।
৮১. তিনি ২১ পৃষ্ঠার লেফট হ্যান্ড টপ-এর লাইনগুলির উপর নির্ভর করেন। তা হলাে : “একইভাবে এই যুক্তিতেও কোনাে জোর নেই যে ইতােমধ্যে আটক থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আটকাদেশ জারি করা যাবে না।”
৮২. কোন প্রেক্ষাপটে এটা বলা হয়েছে তা দেখার জন্য পুরাে অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করা প্রয়ােজন। পুরাে অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ :
“এরপর ম্যাটার অব ল’ হিসেবে যুক্তি দেওয়া হয় যে, একবার ১৯ মার্চ ১৯৪২ তারিখের আদেশ বাতিল করা হলে নতুন আটকাদেশ জারি করার কোনাে ক্ষমতা নেই, যদি না নতুন কোনাে ম্যাটেরিয়াল থাকে। এই যুক্তি দেওয়া হয় যে, হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকগণ এটা অনুমান করার ক্ষেত্রে যৌক্তিক ছিলেন না যে, জুলাই ১৯৪৪ সালের আদেশ জারির সময় ফ্রেশ ম্যাটেরিয়ালস অবশ্যই বিদ্যমান থাকতে হবে। এই যুক্তির প্রথম অংশ আমাদের কাছে নিরর্থক মনে হয়। (1942) 1AllE.R. 373-এ কোর্ট অব আপিলের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায় যে, বৃহত্তর অর্থে এই অনুমিতি অসমর্থনযােগ্য। এটা হতে পারে যে, যেসব ক্ষেত্রে কোনাে ডিটেনশনের গ্রাউন্ডগুলাের বৈধতা কোর্টের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য উপস্থাপিত হয়, সেখানে কিছু কথিত গ্রাউন্ড ডিটেনশনকে সমর্থন করে- এরকম কোনাে রায় একই গ্রাউন্ডে আরও ডিটেনশনকে প্রতিরােধ করে। কিন্তু যেখানে আগেকার ডিটেনশন কেবল ফর্মাল গ্রাউন্ডে ত্রুটিযুক্ত মর্মে ঘােষিত হয়েছে, সেখানে পূর্বেকার গ্রাউন্ডগুলাের উপরই ভিত্তি করে যথার্থ আটকাদেশকে নাকচ করা যায় না, বিশেষত যখন এরকম ক্ষেত্রে গ্রাউন্ডগুলাের পর্যাপ্ততা আদালতে পরীক্ষাযােগ্য নয়। একইভাবে এই যুক্তিতেও কোনাে জোর নেই যে, ইতিমধ্যে ডিটেনশনে থাকা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনাে আটকাদেশ জারি করা যায় না। 22 Pat 252-তে পাটনা হাইকোর্টের রায়কে এরকম কোনাে সাধারণ আইনি অনুমিতির (জেনারেল প্রপােজিশন অব ল’) উপর ভিত্তি করে বােঝা যাবে না। বিজ্ঞ বিচারকগণ মামলার প্রেক্ষাপট থেকে এরকম একটি অনুমানে পৌছান যে, that the order in question was not one made in the bonafide exercise of the Governor’s power.”
৮৩. নিশ্চয়ই এসব পর্যবেক্ষণ এমন মামলাকে অন্তর্ভুক্ত করে যেখানে পূর্বেকার আদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রুটিযুক্ত। কিন্তু বর্তমান ক্ষেত্রে ঘটনা তা নয়। এখানে পুরনাে আদেশের মেয়াদ শেষ হয়েছে ৩ মে, ১৯৬৭ তারিখে। পরবর্তী আদেশ দেওয়া হয়েছে ২৯.৫.১৯৬৭ তারিখে ২৬ দিনের ব্যবধানের পর। আদেশটি আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান]-কে পৌছানাে হয় ১.৬.১৯৬৭ তারিখে। তার জামিন
হওয়া পর্যন্ত বর্তমান আদেশের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়নি।
৮৪. “বিশেষত এরকম ক্ষেত্রে যখন যুক্তিগুলাের যথার্থতা আদালতে পরীক্ষাযােগ্য নয়।”-এই লাইনগুলাে এই ইঙ্গিত করে যে, যদি যুক্তিগুলাের যথার্থতা আদালতে পরীক্ষা করা যেতাে, তাহলে অবস্থান ভিন্নরকম হতে পারতাে।
৮৫. উপরের লাইনগুলাে খুবই কাঠখােট্টা এবং টানটান। তবু সেগুলাে এই নীতি ইঙ্গিত করে যে, একটা ব্যবধানের পর দ্বিতীয় আদেশ হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ব্যবধানটা ছিল প্রায় ৪ মাসের।।
৮৬. আমাদের বর্তমান মামলায় আদেশটি জারি হয়েছে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] জামিনে মুক্তি পাবার পরপরই। তিনি যতদিন শাস্তিমূলক আটকাবস্থায় (পিউনিটিভ ডিটেনশনে) ছিলেন, ততদিন নতুন
৩০১
আটকাদেশের প্রশ্ন উঠেনি। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] মুক্তি পাবার পরই কেবল তার পূর্ব প্রবণতা ও গতিবিধির ধারা বিবেচনা করে নতুন আদেশের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়েছে।
৮৭. পুরনাে গতিবিধি বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ যৌক্তিকভাবে এর প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হতে পারেন, কারণ তখনাে জরুরি অবস্থা চলছিল। এক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণের ২৮(ক) পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করা যায় :
“পৃষ্ঠা ২৮. “৩২ বিধি কঠোর ও স্বেচ্ছাচারী (আরট্রিারি)-এই যুক্তিতে হাইকোর্ট কোনাে জোর খুঁজে পাচ্ছে না, কারণ সেখানে আটকাদেশের কোনাে সুনির্দিষ্ট সময় বা কাল নির্ধারণ করা হয়নি। জরুরি অবস্থাকে আপাতদৃষ্টে (prima facie) স্বল্পকালীন বলে ধরে নেওয়া হয় এবং মনে রাখতে হবে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ-এর মতাে অস্থায়ী আইনের অধীনে জারিকৃত আটকাদেশ জরুরি অবস্থা উঠিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতিলযােগ্য এবং আইনটি বাতিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তামাদি হয়ে যাবে।”
৮৮. জনাব সালাম খান Rameshwar Shaw vs District Magistrate, Burdwan & another, AIR 1964 SC 334 মামলার রায়ের উপর নির্ভর করেছেন বলে মনে হয়, যেখানে সিদ্ধান্ত হয় :
“এটা সুস্পষ্ট যে, কোনাে ব্যক্তিকে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য আটক (ডিটেনশন) করা প্রয়ােজন কোনাে কর্তৃপক্ষকে বৈধভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানাের ক্ষেত্রে এই মর্মে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, যদি ব্যক্তিটি আটক না থাকেন তাহলে তিনি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন and that inevitably postulates freedom of action to the said person at the relevant time. যদি কেউ ইতােমধ্যে জেলহাজতে থাকেন তাহলে এই অনুমান কীভাবে যৌক্তিক হতে পারে যে, তাকে আটক না করলে তিনি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারেন? কোনাে ব্যক্তিকে আটকাদেশ পৌছানাের সুনির্দিষ্ট সময়ে এটা পরিষ্কার থাকতে হবে যে, উক্ত ব্যক্তি আটক না থাকলে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন। এই বিবেচনাটা অনুপস্থিত থাকে যখন কর্তৃপক্ষ এমন একজন ব্যক্তিকে নিয়ে ডিল করছেন যিনি ইতােমধ্যে আটক (ডিটেনশন) রয়েছেন। সে কারণে কোনাে ব্যক্তিকে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাকে আটক করা প্রয়ােজন এই মর্মে সন্তুষ্টি Preventive Detention Act, 1950-এর ৩(১)(ক) ধারার অধীনে প্রদেয় আদেশের ভিত্তি এবং পিটিশনারের ক্ষেত্রে এই ভিত্তি ইতােমধ্যে অনুপস্থিত।”
৮৯. সেটা প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট-এর অধীনে মামলা এবং সেখানকার ঘটনাবলি থেকে দেখা যায়, ডেটিন (আটককৃত ব্যক্তি) ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি গ্রেফতার হন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩ তারিখে যখন তাকে আটকাদেশ পৌছানাে হয় তখনাে তিনি হাজতে। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিজ্ঞ বিচারকগণ তাকে মুক্তি দেন এই গ্রাউন্ডে যে, তাকে কোনাে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য আটক করা প্রয়ােজন এই মর্মে সন্তুষ্টি যা ৩(১)(ক) ধারার অধীনে আদেশের ভিত্তি তা সুস্পষ্টভাবে অনুপস্থিত। ৯০. প্রতীয়মান হয় যে, বিজ্ঞ বিচারকগণ এই পর্যবেক্ষণও দিয়েছেন যে, সেই মামলায় ৩(১)(ক) ধারা কর্তৃপক্ষকে কোনাে ব্যক্তি ডিটেনশন বা কারাগারে থাকলে তার বিরুদ্ধে আটকাদেশ জারি করা থেকে নিষেধ করে না, তা প্রত্যেক মামলার প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করে।।
৯১.. Mst. Nasim Fatima vs. Government of West Pakistan and others as reported in PLD 1967 Lahore 103 মামলার রায় দিতে গিয়ে স্পেশাল বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি এস. এ. মাহমুদ পর্যবেক্ষণ করেন যে :
৩০২
“৩২(১)(খ) বিধির উদ্দেশ্য হলাে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড ও কার্যক্রম প্রতিরােধ করা। সরকার বা কর্তৃপক্ষ যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে একজন মানুষ ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন তখনই কেবল ডিটেইন করার ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে হয়। সুতরাং, এরকম সব ক্ষেত্রেই যেখানে কোনাে ব্যক্তি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারেন বলে আশঙ্কা থাকে, তাহলে আটকাদেশ জারি হতে যতক্ষণ কর্তৃপক্ষ এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, সেই ব্যক্তির ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার আশঙ্ক রয়েছে। যদি এরকম হয় তাহলে এটা কেন সম্ভব নয় যে, কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন মুক্তি পেলে কোনাে ব্যক্তি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করতে পারেন, ফলে আটকাদেশ জারি করবেন? অবশ্যই, কোনাে ব্যক্তি যদি দীর্ঘ মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে তার বিরুদ্ধে আটকাদেশ জারি করার কোনাে যৌক্তিকতা থাকে না, কারণ তিনি কারাগারে থাকবেন এবং কোনাে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ করার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু কোনাে ব্যক্তি যখন মুক্তি পাওয়ার পথে তখন এ কথা কি বলা যাবে যে, তিনি ডিটেনশন বা কারাগারে থাকার কারণে তার কর্তৃক ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যায়? সেই ব্যক্তির ডিটেনশন বা স্বল্প সময়ের জন্য কারারবরণ থেকে এটা নিশ্চিতভাবেই কোনাে যৌক্তিক উপসংহার হতে পারে না। তবে যখন কোন ব্যক্তি বহু বছর ধরে ডিটেনশনে থাকেন তখন অবস্থা ভিন্নতর হবে। কারণ সেক্ষেত্রে পরিকল্পিত অপরাধ সংঘটন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার নীতি (locus poenitentiae) প্রযােজ্য হতে পারে এবং এটাও হতে পারে যে দীর্ঘ ডিটেনশন তার ক্ষতিকর। কর্মকাণ্ড সংঘটনের প্রবণতাকে কমিয়ে ফেলতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে যেখানে কাউকে স্বল্প সময়ের জন্য ডিটেনশনে রাখা হয়েছে এবং ডিটেনশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে, আমাদের মতে, তখন তাকে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য আরাে ডিটেনশন প্রয়ােজন কিনা তা বিবেচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা যথাযথ কর্তৃপক্ষের জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত।
কাউকে আটক করা প্রয়ােজন কিনা এই সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছানাের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ তার পূর্ববর্তী ইতিহাস, অতীত কর্মকাণ্ড, ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড- যাতে তার অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে- সে সম্পর্কে সাক্ষ্য-প্রমাণ ও ইঙ্গিত, যদি থাকে, এবং সব ধরনের পরিস্থিতি নিখুঁতভাবে বিবেচনা করবেন। বলে আশা করা হয়, যাতে কর্তৃপক্ষ এই মর্মে সন্তুষ্ট হতে পারেন যে, তাকে আরাে আটক রাখা প্রয়ােজন। যদি সততা ও যত্নের সঙ্গে মন প্রয়ােগ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, তাকে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য আটক রাখা প্রয়ােজন, তখন বিধি তাকে তার আটকাদেশ জারি করার ক্ষমতা প্রদান করে।”
৯২. আমরা উপরােক্ত মতামতের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত (respectful agreement) পােষণ করি এবং মনে হয় যে, প্রধান পরীক্ষা (প্রিন্সিপাল টেস্ট) হলাে মুক্ত হওয়ার পর আটক থাকা ব্যক্তির ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা, নতুন ঘটনা (ম্যাটেরিয়ালস) নয়।
ফলে, ১৯.৫.১৯৬৭ তারিখের আটকাদেশ, যা বর্তমান রুলের বিষয়বস্তু, তা বৈধ।
সাধারণ (কমন) আইনি বিষয় ও সাধারণ তথ্যাদি যেহেতু ডেটির বিরুদ্ধে গিয়েছে এবং দুই আদেশের মধ্যবর্তী ব্যবধান (ইন্টারভিনিং গ্যাপ) সম্পর্কিত গ্রাউন্ডে কোনাে সারবত্তা না থাকায় ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলায় প্রদত্ত রুলটিও খারিজ করে দেওয়া হচ্ছে।।
বিচারপতি আবদুল হাকিম
আমি একমত।
৩০৩
বিচারপতি আবদুল্লাহ
আমি দুঃখিত যে, আমার বিজ্ঞ ভ্রাতাদের মতাে আমি একই উপসংহারে পৌঁছতে পারিনি এবং সেজন্য আলাদা রায়ে আমার মতামত তুলে ধরছি। ৯৪. ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলা ও ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলা দুটি একই ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত এবং এই স্পেশাল বেঞ্চ কর্তৃক একই সঙ্গে শ্রুত হয়েছে। দুটি পিটিশনের প্রেক্ষাপট নিম্নরূপ :
৯৫. ঢাকার ডেপুটি কমিশনার কর্তৃক পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২ বিধি অনুযায়ী ৮.৫.৬৬ তারিখ জারিকৃত আদেশে আটককৃতকে ৯.৫.৬৬ তারিখে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার এই ৩২ বিধি অনুযায়ী অন্য অনেককেও গ্রেফতার করা হয়। অন্যদের সঙ্গে আটককৃত ব্যক্তি (ডেটিন) [শেখ মুজিবুর রহমান] ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯১ ধারা অনুযায়ী আবেদন দাখিল করেন। সেই আবদেনসমূহ, অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের ৬৩, ৬৪, ৬৫, ৬৬, ৬৯ ও ৭০ নম্বর বিবিধ মামলা এই কোর্টের একটি স্পেশাল বেঞ্চে একসঙ্গে শুনানি হয়, আমি যার একজন সদস্য ছিলাম। ১৯৬৬ সালের ২৪৭ ন রিট পিটিশনে উল্লিখিত গ্রাউন্ডস বিবেচনায় আমি রায় প্রদান করি যে, ৩২ বিধি অনুযায়ী জারিকৃত আটকাদেশ আইনি কর্তৃত্ববিহীন এবং সেই অনুযায়ী সকল মামলায় আই মেড দ্য রুল অ্যাবসলিউট। কিন্তু আমার সংখ্যাগরিষ্ঠ ভ্রাতাগণ ভিন্ন রায় প্রদান করেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে রুলটির নিষ্পত্তি হয়। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] বিশেষ অনুমতিক্রমে (উইথ স্পেশাল লিভ) সুপ্রীম কোর্টে আপিল করেন। সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞ বিচারকগণ রায় প্রদান করেন যে, ঢাকা হাইকোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজ্ঞ বিচারপতিগণ প্রদত্ত রায় সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক Malik Golam Jilani and others, 1967 19 DLR SC 403 মামলায় গৃহীত নীতিমালার বিরােধী। বিজ্ঞ বিচারকদের যে সুনির্দিষ্ট মতামত সুপ্রীম কোর্টের বিচারকদের মতামতের বিরােধী তা সুপ্রীম কোর্টের রায়ে উদ্ধৃত হয়েছে এবং তা হলাে: আটককারী কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টি ‘সাবজেক্টিভ সন্তুষ্টি এবং এটি কোনাে সুনির্দিষ্ট নাগরিকের কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কিনা তা বিচার করার একমাত্র নির্ণায়ক (সােল জাজ)। সুপ্রীম কোর্টের আপিলের রায়ে বলা হয়, Malik Golam Jilani and others মামলায় সুপ্রীম কোর্ট ঘােষণা দিয়েছেন যে, এমনকি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে জারিকৃত নির্বাহী আদেশও জুডিসিয়াল রিভিউর আওতামুক্ত নয়। আটককারী কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হতে পারেন। যে, এরকম যথাযথ গ্রাউন্ডের অস্তিত্ব রয়েছে যা যৌক্তিক এবং ডিটেনশনের ক্ষমতা প্রদানকারী আইনের আওতার অধীন কিনা আদালতই তা বিচার করবেন। এরকম মত প্রকাশ করে সুপ্রীম কোর্ট Malik Golam Jilani and others মামলায় সুপ্রীম কোর্ট প্রদত্ত রায় অনুসারে আটকাদেশ পুনঃনিরীক্ষা করার জন্য এই মামলা হাইকোর্টে ফেরত পাঠান। উল্লিখিত [রিমান্ড] আদেশে এই নির্দেশনা দেওয়া হয় যে, আদালতের কাছে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করে ডেপুটি কমিশনারের সন্তুষ্টির যৌক্তিকতা আছে কিনা হাইকোর্ট সে ব্যপারে বিবেচনা করে উপসংহারে পৌঁছতে পারেন এবং তা করা উচিত (ক্যান অ্যান্ড শুড)। সুপ্রীম কোর্টের কাছে আরাে কিছু বিষয়ও উত্থাপন করা হয়েছিলাে। সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টে পুনঃশুনানির জন্য ফেরত পাঠানাের সময় আপিলকারী কর্তৃক উত্থাপিত এসব বিষয়ে কোনাে পর্যবেক্ষণ দেননি এবং তা হাইকোর্ট কর্তৃক যথাসময়ে বিবেচনার জন্য রেখে দিয়েছেন।
৯৬. ৮.৫.১৯৬৬ তারিখে তিন মাসের জন্য আটকাদেশ জারি করা হলেও প্রতীয়মান হয় যে, ৩.৮.১৯৬৬, ২.১১.১৯৬৬ ও ২৫.১.১৯৬৭ তারিখের প্রত্যেক আদেশের মাধ্যমে তিন মাস করে আটকাদেশ চলমান
৩০৪
রাখা হয়েছে। ২৫.১.১৯৬৭ তারিখ জারিকৃত তিন মাসের আটকাদেশের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ৩ মে ১৯৬৭ তারিখে। আটককারী কর্তৃপক্ষের দাবি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২৭.৪.১৯৬৭ তারিখে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান একটি ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন এবং ১৫ মাসের সাধারণ (সিম্পল) কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] সেই কনভিকশন ও কারাদণ্ডের ভিত্তিতে কারাগারে ছিলেন এবং ১.৬.১৯৬৭ তারিখে ঢাকা জেলা জজের এক আদেশে জামিনে মুক্তি পাওয়ার নির্দেশ লাভ করেন। দাবি করা হয়, আটককৃতকে জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি এবং নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রবাদি ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার জন্য ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২(১)(ক) বিধির অধীনে একটি আদেশ জারি করা প্রয়ােজন মর্মে আটককারী কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়েছেন। সেই অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের ২৯ মে আটককৃতকে আদেশ পৌছানাের দিন থেকে আরাে তিন মাস আটক করার নির্দেশনা দিয়ে আরেকটি আদেশ জারি করা। হয় এবং ১.৬.১৯৬৭ তারিখে আটককৃতের কাছে ঐ আদেশ পৌছানাে হয়। এরপর আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] এই আদালতের দ্বারস্থ হন এবং আরেকটি রুল, অর্থাৎ ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলা অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালের এই ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলাটি সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক ফেরত পাঠানাে ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলার সঙ্গে শুনানির জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।
৯৭. সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এই আবেদনগুলাে বিবেচনার জন্য নেওয়া হলে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল পূর্বের রীতি অনুযায়ী আদালতের সামনে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করতে চান। [এই আদালত কর্তৃক] রায়ে যেমন বলা হয়েছে যে, আটককারী কর্তৃপক্ষের সাবজেক্টিভ সেটিসফেকশনের ভিত্তিতে জারিকৃত আটকাদেশের কারণ বিবেচনার সময় এই আদালত এমন কিছু রেকর্ড পরীক্ষা করেন যেগুলােতে আটককৃতকে জবাব দেওয়ার অনুমােদন দেওয়া হয়নি। এরপর আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আটককারী কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্ট হওয়ার মতাে এরকম কিছু তথ্য-উপাত্ত রয়েছে যা একতরফাভাবে পরীক্ষাযােগ্য (Unilateral Examination), যদিও এই প্রক্রিয়া আইন দ্বারা সমর্থিত নয়। যদি সরকার বিশেষ সুবিধা (প্রিভিলিজ) দাবি করেন এবং আদালত যদি মনে করেন সরকার সেই বিশেষ সুবিধা প্রাপ্য, তাহলে আদালত সেই বিষয়টি বিবেচনা করারই কোনাে অধিকার রাখেন না। যা হােক, এই রীতি গড়ে উঠেছে সরকারি আইন কর্মকর্তা ও আটককারী কর্তৃপক্ষের বদৌলতে, যারা আদালতের কাছে তাদের বিশ্বস্ততা (bonafides) প্রমাণ করার জন্য এরকম তথ্য-উপাত্ত আদালতের কাছে উপস্থাপন করেন কেবল আদালতের অবগতির জন্য, যদিও তারা আইনগতভাবে তা করতে বাধ্য নন। তথ্য-উপাত্তের এই ধরনের একতরফা পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর ভিত্তি করে বিচার করাই যেখানে আইনত যুক্তিসঙ্গত না-ও হতে পারে, আদালত সেখানে এই রীতি গ্রহণ করেছেন আটককৃতের স্বার্থে। (Although the adjudication itself based on such unilateral examination of documents might not be justified in law this practice was adopted by the Court in the interest of the Detenu himself.)
… কিন্তু মালিক জিলানী মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায়ে সুস্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয় যে, ৩২ বিধির অধীনে কর্তপক্ষের যে কোনাে পদক্ষেপ অধ্যাদেশের ৩(২) ধারার x দফায় বর্ণিত ক্ষম সম্পর্কযােগ্য অন্য সব পদক্ষেপের মতাে জুডিসিয়াল নিরীক্ষার অধীন। ব্যতিক্রম কেবল গােপন তথ্যের ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ সুবিধা দাবির অধিকার ও আদালতের রুদ্ধদ্বার বিচারের (proceedings in trial) ক্ষমতা। এরপরই এটা অনুভূত হয় যে, এরকম একতরফাভাবে কাগজপত্র (ডকুমেন্ট) পরীক্ষা-নিরীক্ষা যুক্তিসঙ্গত হবে না। রায়ে আটককারী কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপকে জুডিসিয়াল রিভিউর জন্য
৩০৫
উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। অনুভূত হয় যে, রাষ্ট্রের বিশেষ সুবিধা দাবি কিংবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রুদ্ধদ্বার/গােপন বিচারের অনুরােধের শর্তসাপেক্ষে আটককারী কর্তৃপক্ষের করা অভিযােগের জবাবে আটককৃতকে জবাব দেওয়ার অনুমােদন দেওয়া উচিত। এই অবস্থায় বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল আরেকটি হলফনামা পেশ করার প্রস্তাব করেন যেখানে আটককারী কর্তৃপক্ষ যেসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আটকাদেশ জারি করেছেন সেগুলাে বিধৃত হবে এবং আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ও তার আইনজীবীকে এর একটি কপি দেওয়া হবে এই শর্তে যে, আটককৃত ব্যক্তি ও তার। আইনজীবী এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করবেন যে, হলফনামায় উল্লিখিত বিষয়গুলাে গােপন থাকবে এবং এই সম্পূরক-হলফনামা ও জবাবি-হলফনামা (ইন রিপ্লাই) উপস্থাপনের সময় আদালত রুদ্ধদ্বার কক্ষে (ইন ক্যামেরা) কার্যক্রম পরিচালিত হবে। আদালত সেই অনুসারে প্রয়ােজনীয় নির্দেশনা দেন। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল যেসব বিষয়ের উপর আটককারী কর্তৃপক্ষ তাদের মনস্থির করেছিলেন সেগুলাে উন্মােচন করে একটি সম্পূরক হলফনামা পেশ করেন, যা ঘটনাক্রমে, অ্যাফার্ম করেন একজন সেকশন অফিসার। আটককৃতও এর জবাবে একটি হলফনামা (অ্যাফিডেভিট ইন রিপ্লাই) পেশ করেন। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল সাক্ষ্য আইন-এর ১২৩ ধারা অনুযায়ী পাবলিক পলিসির গ্রাউন্ডে সম্পূরক হলফনামার ৩-৫, ১৩-১৬, ২১-২৪ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ডকুমেন্টসের ব্যাপারে কেবল প্রিভিলেজ দাবি করেন। যদিও সম্পূরক-হলফনামার অন্যান্য অনুচ্ছেদে বিধৃত বিবরণের ব্যাপারে প্রিভিলেজ দাবি করা হয়নি, তবু যেহেতু বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল সম্পূরক হলফনামা ও জবাবি হলফনামা রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলােচনার প্রার্থনা করেছেন, সেহেতু এই দুই হলফনামায় উল্লিখিত বিষয়াবলি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা যথাযথ হবে না। কারণ, যেহেতু আমি মনে করি আমাদের রায় পাবলিক ডকুমেন্ট, সেহেতু সেসব বিষয় বিস্তারিত আলােচনা করা আটককারী কর্তৃপক্ষের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
৯৮. আমি এখন উপরােক্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আলােচ্য সম্পূরক হলফনামায় উপস্থাপিত বিষয়বস্তু (ম্যাটারস) আলােচনা করবাে। উপরােক্ত হলফনামার ২ নম্বর অনুচ্ছেদ আটককৃতের চরিত্র সম্পর্কে সাধারণ পর্যবেক্ষণ বিত করেছে। তাকে বর্ণনা করা হয় একজন বড় মাপের রাজনৈতিক আন্দোলনকারী। (অ্যাজিটেটর) হিসেবে, যিনি তাঁর লক্ষ্য অর্জনের জন্য সহিংস পন্থা অবলম্বন করার পক্ষে (সাজেস্টিং ও মিনস)। বলা হয়, তার বিধ্বংসী, ক্ষতিকর ও রাষ্ট্রবিরােধী কর্মকাণ্ডের জন্য তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে বেশ কয়েকবার জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ-এর অধীনে আটক (ডিটেইনড) হয়েছিলেন। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল এই অভিযােগ প্রমাণ করার জন্য কোনাে কাগজপত্র উপস্থাপন করতে পারেননি। অন্যদিকে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান তার জবাবি-হলফনামায় (ইন রিপ্লাই) দাবি করেন যে, তিনি কখনাে এমন কোনাে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি যেটাকে সহিংস বলা যাবে এবং তিনি পাকিস্তানের সার্বিক স্বার্থে সর্বদা শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পন্থার পক্ষালম্বন করেছেন (অ্যাডভােকেটেড)। তিনি দাবি করেন যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ (পলিটিক্যাল ভিক্টিমাইজেশন) হয়ে তাকে আটক করা হয়েছিল। আটককৃতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং পাকিস্তান অর্জনের সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ১৯৪৩ সাল থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৪৩ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন, ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং বিভিন্ন উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে এবং ১৯৪৭ সালে গণভােটের সময় সিলেটে কাজ করেছেন। দেশভাগের পর তাঁর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দাবি করা হয়, ১৯৫৪
৩০৬
সালে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের এবং ১৯৫৫ সালে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৪, ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে তিনি প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন।
৩ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত অভিযােগ, যা ১৯৬০ সালের একটি কথিত ঘটনা, যা আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন।
৪ নম্বর অনুচ্ছেদ ১৯৬৩ সালের একটি ঘটনা সম্পর্কিত এবং আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] তা অস্বীকার করেন। সেই তর্কিত (এজেড) ঘটনার জন্য আটককৃতের বিরুদ্ধে কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
৯৯. ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লিখিত অভিযােগ সম্পর্কে আটককৃতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে, স্বায়ত্তশাসন কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যও দাবি করা হয়েছে। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] দাবি করেন যে, তিনি ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানের জন্য প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে প্রচারণা চালান। বলা হয়, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] যে স্বায়ত্তশাসনের প্রচার করেন এবং করে এসেছেন তা হলাে দুই পক্ষের জন্য সমান সুবিধাদায়ী স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে একাত্ম (ইন্টিগ্রেটেড) ও শক্তিশালী পাকিস্তান।।
১০০. ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের অভিযােগ আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] অস্বীকার করেছেন এবং এই অভিযােগের সমর্থনে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] কর্তৃক সেরকম কোনাে উসকানি নেই। এখানে আটককৃত ব্যক্তি[শেখ মুজিবুর রহমান]। কর্তৃক ৩০.৪.৬৪ তারিখে প্রদত্ত একটি বক্তৃতার উল্লেখ করা হয়।
১০১. ৭ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত অভিযােগ আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন এবং দাবি করা হয়, তিনি কেবল ইঙ্গিত করেছেন যে, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া উচিত নয়। ১৭.৪.৬৪ তারিখের উপরােক্ত বক্তৃতার কোনাে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি, কেবল একটি গােপন প্রতিবেদন যা থেকে সম্পূরক-হলফনামায় উল্লিখিত অভিযােগের কোনাে সমর্থনসূচক কিছু পাওয়া যায়নি।
১০২. ৮ অনুচ্ছেদের অভিযােগ সম্পর্কে তিনি বলেন, তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরােধে সরকারের আরাে কঠোরতর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল স্বীকার
করেছেন যে, এটা সরকারি নীতির সমালােচনা।
১০৩. ৯ অনুচ্ছেদে বিধৃত অভিযােগ সম্পর্কে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] এরকম কোনাে বিবৃতির কথা অস্বীকার করেন এবং বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল প্রদত্ত বক্তব্য এই অনুচ্ছেদে বিধৃত অভিযােগকে সমর্থন করে না।
১০৪. ৩ থেকে ৯ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ঘটনাগুলাে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সময় বা কালের। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] পক্ষ থেকে যুক্তি উপস্থাপন করা হয় যে, এসব অনুচ্ছেদে উল্লিখিত কোনাে বক্তব্য বা কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ-এর অধীনে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দাবি করা হয় যে, এসব বক্তৃতা সরকারি নীতি ও কর্মকাণ্ডের ন্যায্য সমালােচনারই প্রতিফলন এবং এসব সমালােচনার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার অসমতা দূর করা, যা এমনকি সংবিধানেও স্বীকৃত হয়েছে। এটাও বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে, যখন আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান]
৩০৭
তর্কিত (এজেড) ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডগুলাে সংঘটন করছিলেন তখন জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ জারি ছিল। এটাও অবশ্যই বিবেচনা করা দরকার যে, সে সময় সরকার আটককৃতকে নিবৃত্তিমূলক আটকাদেশে আটক করেননি।।
সম্পূরক হলফনামা ও জবাবি হলফনামার (ইন রিপ্লাই) উপরােক্ত অনুচ্ছেদসমূহ বিশ্লেষণ করে এটা সুস্পষ্ট যে, আবেদনকারী একজন খ্যাতিমান রাজনৈতিক নেতা এবং বিরােধী দলের বিখ্যাত নেতা। এই প্রেক্ষাপটে দেখলে এবং সরকার কর্তৃক সংশ্লিষ্ট সময়ে আটককৃতের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ-এ প্রদত্ত ক্ষমতা ব্যবহার থেকে বিরত থাকার বিষয়টি বিবেচনা করলে এসব কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
১০৫. সম্পূরক-হলফনামার ১০ ও ১১ অনুচ্ছেদ আসলে সেসব ঘটনার বিবরণ, যা থেকে জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, ভারত কর্তৃক পাকিস্তান ভূখণ্ডে কোনাে প্ররােচনা ছাড়াই কাপুরুষােচিত আক্রমণের প্রেক্ষাপটে। ১০৬. ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়, যুদ্ধবিরতির এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানাে এবং সারা পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে জনসভায় বক্তৃতার মাধ্যমে আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও উসকানিমূলক মনােভাব সৃষ্টির মাধ্যমে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করতে শুরু করেন। কিন্তু আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] জবাবি হলফনামার (ইন রিপ্লাই) ১০ ও ১১ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, তিনি ও তাঁর দল যুদ্ধকালে সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে প্রথম বিবৃতিদানকারী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন এবং তাঁর বিবৃতি রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র থেকে কয়েক দিন ধরে সম্প্রচারিত হয়েছে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর দলের সব সদস্যের কাছে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছেন সরকারকে যুদ্ধ কর্মযজ্ঞে সহযােগিতা করার জন্য। এই বিজ্ঞপ্তি জবাবি হলফনামার (ইন রিপ্লাই) সংযুক্তি-ক আকারে সংযুক্ত করা হয়েছে।
১০৭. সম্পূরক-হলফনামার ১২ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন।।
১০৮. সম্পূরক-হলফনামার ১৩ অনুচ্ছেদের অভিযােগও আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন এবং বলেন, তিনিই দলের পক্ষ থেকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং সেই প্রস্তাব সংযুক্তি-খ আকারে যুক্ত করা হয়েছে। জবাবি হলফনামায় (ইন রিপ্লাই) প্রদত্ত বক্তব্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে প্রথম বিবৃতিদানকারী রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন এবং তাঁর বিবৃতি স্বয়ং রেডিও পাকিস্তান প্রচার করেছে। এই বক্তব্য অ্যাডভােকেট জেনারেল অস্বীকার করেননি। এর সঙ্গে সংযুক্তি ক ও খ-তে উল্লিখিত প্রস্তাবসমূহ থেকে ১৩ অনুচ্ছেদের অভিযােগকে মনগড়া বলে মনে হয়। ১০৯. ১৪ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অভিযােগ আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] অস্বীকার করেন এবং সম্পূরক হলফনামার পরবর্তী অনুচ্ছেদসমূহে নির্দেশিত তাঁর উন্মুক্ত বক্তৃতাসমূহ দৃষ্টে এটা প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয় যে, তিনি গােপনে এ ধরনের বিবৃতি প্রদান করেছেন।
১১০. ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অভিযােগ আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] অস্বীকার করেন এবং বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল কর্তৃক উপস্থাপিত কাগজপত্র অভিযােগকে কোনােভাবেই সমর্থন করে না। সবচেয়ে বড় কথা, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] প্রকাশ্যে তাসখন্দ চুক্তি সমর্থন করেছেন।
৩০৮
আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] প্রকাশ্যে তাসখন্দ চুক্তি সমর্থন করেছেন- এই বক্তব্যের সমর্থনে আটককৃতের আইনজীবী সম্পূরক-হলফনামার ২০ অনুচ্ছেদের বিবরণীর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যেখানে সরকার স্বয়ং স্বীকার করেছেন যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] লাহাের সম্মেলন ত্যাগ করেন এবং উক্ত সম্মেলন ও সেখানে গৃহীত প্রস্তাবসমূহের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি বলেন যে, আটককৃত ব্যক্তি প্রকাশ্যে তাসখন্দ চুক্তি সমর্থন করেছেন এবং তার সমর্থনে তিনি একটি প্রেস কাটিং হাজির করেন যেখানে বলা হয়, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] লাহাের সম্মেলনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে ঘােষণা করেন যে, তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে কোনাে প্রস্তাব গৃহীত হলে তিনি সম্মেলন ত্যাগ করবেন।।
১১১. ১৬ থেকে ৩৩ এবং ৩৫ ও ৩৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অভিযােগ সারা প্রদেশজুড়ে বিভিন্ন জনসভায় ছয় দফার সমর্থনে আটককৃত ব্যক্তি প্রদত্ত বক্তৃতার উপর ভিত্তি করে রচিত। আটককৃত [শেখ মুজিবুর রহমান] স্বীকার করেছেন যে, তিনি বক্তৃতাগুলাে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাঁর প্রণীত ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য কখনাে কোনাে সহিংস পন্থার প্রচার করেননি। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল আমাদের সামনে প্রাসঙ্গিক বক্তৃতাগুলাে হাজির করেছেন এবং আমি এগুলাের কোথাও সহিংসতার পক্ষে কোনাে উসকানি খুঁজে পাইনি। ছয় দফা’ তিনি [শেখ মুজিবুর রহমান] প্রণয়ন করেছেন।
১৯৬৬ সালের ৯৫ নম্বর বিবিধ মামলায় (Syed Fazlul Haque on behalf of the detenue Abdul Aziz vs. The Government of East Pakistan represented by Secretary, home Department & other) ছয় দফা কর্মসূচির বিচারিক মীমাংসা (অ্যাডজুডিকেশন) করা হয়েছে। আমার বিজ্ঞ ভ্রাতৃদ্বয় বিচারপতি বাকের ও বিচারপতি আবদুল হাকিম ছয় দফা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করায় কোনাে অপরাধ হয়নি বলে রায় দিয়েছেন (have held indulging in six points programme is no offence)। সেই মামলায় প্রতিবাদী পক্ষে দাখিলি হলফনামার ১৯ অনুচ্ছেদে সরকার যুক্তি দেখিয়েছেন যে,
“দরখাস্তের ২০ অনুচ্ছেদে বিধৃত বক্তব্য সঠিক নয়। বলা হয়েছে যে, জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংকীর্ণ মনােভাব সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত ক্ষতিকারক ছয় দফা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য আটককৃতকে বৈধভাবে আটক করা হয়েছে। আটককৃতের কর্মকাণ্ড জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার জন্য ক্ষতিকর।”
১১২. আমার বিজ্ঞ ভ্রাতৃদ্বয় জনাব আবদুস সালাম খানের এই যুক্তি গ্রহণ করেছেন যে, সুপ্রীম কোর্ট কিংবা হাইকোর্ট কোনাে আদালতই কখনাে ছয় দফা কর্মসূচিকে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড বলে বর্ণনা করেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে “ছয় দফা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড” হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে আটককারী কর্তৃপক্ষ সঠিক ছিল না। আমার বিজ্ঞ ভ্রাতৃদ্বয় “ছয় দফা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড” হিসেবে বিবেচনা করেন না এবং তারা এমনকি এই সিদ্ধান্তও দিয়েছেন যে, কেবল “ছয় দফা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করাই আটকের জন্য যথেষ্ট। আটককারী কর্তৃপক্ষ এরকম একটা ঘােরের মধ্যে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই মামলায় বিজ্ঞ ভ্রাতৃদ্বয় রুল অ্যাবসলিউট করেন।
১১৩. আরাে প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামী লীগ দেশে ক্রিয়াশীল একটি রাজনৈতিক দল। তারা ছয় দফা কর্মসূচিকে নিজেদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ছয় দফা কর্মসূচির মূল কথা (বেসিক আইডিয়া) হলাে ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী পাকিস্তানের উভয় অংশের জন্য সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া। স্বীকৃত মতেই সরকার কর্তৃক ছয় দফা কর্মসূচি বা দলের কর্মকাণ্ডকে পলিটিক্যাল পার্টিজ অ্যাক্ট-এর ৬
৩০৯
ধারা অনুযায়ী সুপ্রীম কোর্টের কাছে রেফার করার কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আটককৃত, যিনি এই দলের সভাপতি, তিনি ছয় দফা কর্মসূচিকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে গিয়ে ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন- এটা বলা যাবে না। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, এসব বক্তৃতা সংকীর্ণতা সৃষ্টি করছে। আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন যাতে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ ছাড়া (ইন্ডিপেন্ডেন্ট অব ওয়েস্ট পাকিস্তান) নিজের কর্মকাণ্ড (অ্যাফেয়ার্স) পরিচালনা করতে পারে। দাবি করা হয়, এভাবে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার (secession) পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন যা পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করবে (disintegretion of Pakistan)। আমি বক্তৃতাগুলাে মনােযােগ সহকারে পড়েছি এবং এরকম কোনাে ইঙ্গিত খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছি। প্রতীয়মান হয় যে, এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহও ছয় দফা কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করায় আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং সেই মােতাবেক পশ্চিম পাকিস্তানি ভ্রাতাদের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কথিত (এলিজড) যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে সেই ব্যাপারে বােঝানাের চেষ্টা করেছেন। তিনি আরাে উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠতার ছাড় দেওয়ার (conceding) মাধ্যমে জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে সমতার নীতি থেকে সরে এসেছে (conceding)। পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে ছাড় দেওয়ার আরাে কিছু নজির তুলে ধরেন। তিনি যুক্তি দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের উচিত প্রতিদান দেওয়া (reciprocate)। তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে প্রচারণা চালান এবং গত সেপ্টেম্বরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজনের তীব্রতার ওপর জোর দেন। পুরাে বক্তৃতার সারমর্ম ছিলাে পশ্চিম পাকিস্তানি বা সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানাে নয়, বরং সর্বশেষ যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের তীব্র প্রয়ােজনীয়তার কথা তুলে ধরা। এটা সত্য যে, ভাষা প্রায়শই জোরালাে (emphatic), তবে কোনাে একটি উদ্দেশ্যের (KR) প্রচারমূলক যে কোনাে রাজনৈতিক বক্তৃতায় যা হয় তার বেশি নয়। আমরা বক্তব্যগুলাের বিষয়ে বিস্তারিত যেতে চাই না, তবে এগুলাের ব্যাপারে সরকারের ব্যাখ্যা যৌক্তিক নয়। এবং এটা এই দাবিকেই সমর্থন করে যে, সরকার বক্তব্যগুলােকে এমনভাবে ব্যখ্যা করেছে যা ইঙ্গিত করে যে, সরকারের উদ্দেশ্য হলাে পলিটিক্যাল পার্টিজ অ্যাক্ট-এর অধীনে ব্যবস্থা না নিয়ে ছয় দফা কর্মসূচিকে বন্ধ করে দেওয়া।
১১৪. ৩৪ অনুচ্ছেদের অভিযােগ একটি বিদেশি পত্রিকার প্রতিনিধিকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকার সম্পর্কিত, যার ভিত্তি একটি বিদেশি পত্রিকা। এটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আরেকটি বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল উক্ত পত্রিকাটি উপস্থাপন করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিদেশি পত্রিকায় বিধৃত শিরােনাম ও প্রতিনিধির বক্তব্য প্রতিবেদনের প্রথম বিদেশি পত্রিকার সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। এবং এটা কোনােভাবেই ৩৪ অনুচ্ছেদে বিধৃত অভিযােগকে সমর্থন করে না।
১১৫. ৩৭ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে প্রিভিলেজ দাবি করা হয়েছে, কিন্তু আটককৃতের রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এই অভিযােগকে ভিত্তিহীন মনে হয়।
১১৬. ৩৮ অনুচ্ছেদে আটককৃতের বিরুদ্ধে চলমান থাকা ১২টি মামলার কথা উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল এসব মামলার একটা তালিকা উপস্থাপন করেছেন। এই তালিকা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ৫টি মামলা চালু হয়েছে ১৯৬৪ সালে। এই সব মামলা বিচারাধীন (সাবজুডিস) এবং আমি কোনাে মন্তব্য করতে চাই না। কেবল একটি কথা যে, এগুলাে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পূর্বেকার
৩১০
সময়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাকি ৭টি মামলার ৪টির কথা সম্পূরক-হলফনামার ২৬, ২৭, ২৯ ও ২২ অনুচ্ছেদে আলােচিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি করা হয় ২৭ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বক্তৃতার কারণে, যেখানে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৪৭(৫) বিধি অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করা হয় (কনভিকশন) এবং আটককৃতকে ১৫ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং ইতােমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, আপিলে ঢাকা জেলা ও দায়রা বিচারকের কাছ থেকে জামিনাদেশ লাভ করেন। যেহেতু, এসব মামলা বিচারাধীন, সেহেতু আমি এগুলাে সম্পর্কে কোনাে মন্তব্য করতে চাই না।
১১৭. সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয় যে, অনেকগুলাে মামলা দায়ের হওয়া প্রমাণ করে যে, আটককারী কর্তৃপক্ষ যৌক্তি ভাবেই এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] এমন একজন ব্যক্তি যিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালায় উল্লিখিত ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করছেন কিংবা করার আশঙ্কা রয়েছে। সেপ্টেম্বর যুদ্ধ-পরবর্তী ৭টি মামলার মধ্যে মাত্র একটি ঢাকায়, অর্থাৎ আটককারী কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারাধীন এলাকায় প্রদত্ত বক্তৃতাসংক্রান্ত। সেপ্টেম্বর যুদ্ধ-পরবর্তী অন্য সব বক্তৃতা, যেগুলাের কারণে সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের হয়েছে, সেগুলাে দেওয়া হয়েছিল প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায়, ঢাকার ডেপুটি কমিশনার যিনি আটককারী কর্তৃপক্ষ তার এখতিয়ারাধীন এলাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায়। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল কর্তৃক সরবরাহকৃত তালিকার দ্বিতীয় কলামে উল্লিখিত মামলার সারমর্মে যা বলা হয় তা নিম্নরূপ :
“এই মামলা ২০.৩.৬৬ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জনসভায় ক্ষতিকারক ভাষণ দেওয়ার জন্য। এই বক্তৃতায় ৬ দফা দাবি ব্যাখ্যা করা হয়, জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের কথিত প্রত্যাখ্যানের জন্য বর্তমান সরকারের সমালােচনা করা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের নাগরিকদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বৈরিতা ও ঘৃণার মনােভাব জাগিয়ে তােলা এবং জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক (অ্যালার্ম) সৃষ্টি করা।”
১১৮. উপরােক্ত বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] পাকিস্তানের নাগরিকদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বৈরিতা ও ঘৃণার মনােভাব জাগিয়ে তােলা এবং জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক (অ্যালার্ম) সৃষ্টি করতে চেয়েছেনএটা আটককারী কর্তৃপক্ষের অনুমান মাত্র। বক্তৃতায় ছয় দফা দাবি ব্যখ্যা করা হয়েছে এবং জনগণের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের কথিত লঙ্ঘনের জন্য বর্তমান সরকারের সমালােচনা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখান থেকে তারা এই অনুমান করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে কেবল একটা বক্তৃতার ভিত্তিতে কোনাে যুক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি এই মর্মে সন্তুষ্ট হতে পারেন না যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] কোনাে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করতে উদ্যত হয়েছেন কিংবা তাঁর কর্তৃক তা করার সম্ভাবনা রয়েছে।
১১৯. এই যুক্তি দেওয়া যায় যে, ১-৫ নম্বর মামলা, যার সবই ১৯৬৪ সালের পূর্বেকার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের করা হয়েছিল, সেগুলােও আটককারী কর্তৃপক্ষের সামনে ছিল। কারণ, সেগুলাে ঢাকা জেলাসংক্রান্ত। আমি ইতােমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, ৮.৫.৬৬ তারিখের পূর্বে আটককৃতের বিরুদ্ধে কোনাে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ (প্রিভেনটিভ ডিটেনশন) জারি করা হয়নি যা প্রমাণ করে যে, আটককারী কর্তৃপক্ষ তখন এসব কর্মকাণ্ডকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশের জন্য যথেষ্ট মনে করেননি।
১২০. বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল তার সম্পূরক-হলফনামায় সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি এরকম বাকি ৮টি মামলার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র আমাদের সামনে হাজির করেছেন। ১২টি মামলার মধ্যে ৫টি, ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৬৫ সালের পূর্বেকার সময়সংক্রান্ত। এর মধ্যে একটিতে খালাস (একুইটাল) ও
৩১১
একটিতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল কর্তৃক সরবরাহকৃত মামলার সারমর্ম অনুযায়ী বাকি মামলাগুলাে হয়েছে ২৬, ২৭, ২৯ ও ২৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বক্তৃতাসমূহের জন্য। আমি সেজন্য এসব মামলার রেকর্ড দেখিনি (লুক এট)। তার চেয়ে বড় কথা, রুদ্ধদ্বার কক্ষে শুনানি চলাকালে রেকর্ডসমূহ উপস্থাপন না করায় আটককৃতের জবাব শােনার সুযােগও আমাদের আর নেই।
১২১. আমাদের কাছে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তই সব। এসব তথ্য-উপাত্তের (ম্যাটেরিয়াল) নির্মোহ বিশ্লেষণ থেকে তিনটি সিদ্ধান্তে আসা যায়। প্রথমত, উপাদানসমূহ থেকে দেখা যায়, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা এবং বিরােধী রাজনৈতিক দলের সভাপতি। এই পদে পদাসীন হয়ে যখনই উপলক্ষ্য তৈরি হয়েছে তখনই তিনি সরকারি নীতির সমালােচনা করেছেন এবং সেপ্টেম্বর যুদ্ধের পর থেকে ছয় দফা কর্মসূচি’, যার লক্ষ্য প্রদেশের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, তার পক্ষে জনসমর্থন আদায়ের জন্য (মবিলাইজ) ব্যাপক প্রচারণা শুরু করেন। তাঁর বক্তৃতাগুলােতে সহিংসতার কোনাে উসকানি নেই। তাঁর প্রদত্ত কোনাে বক্তৃতার বশবর্তী হয়ে কেউ কোনাে সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছেন বলেও জানা যায় না। এসব পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটা বলা যায় না যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ডি.পি.আর-এ সংজ্ঞায়িত কোনাে ধরনের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করেছেন কিংবা করার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, ডি.পি.আর.-এর ৩২ বিধি অনুযায়ী ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের ৮.৫.৬৬ তারিখের আদেশ এবং ৩.৫.৬৭ তারিখ পর্যন্ত ডিটেনশন বর্ধিতকারী পরবর্তী আদেশসমূহ আইনি কর্তৃত্ববিহীন। দ্বিতীয়ত, এই সিদ্ধান্তে অবশ্যই আসতে হবে যে, বস্তুত আটককারী কর্তৃপক্ষ নিজেরা সন্তুষ্ট হতে পারেন এরকম কোনাে বিষয়বস্তু আমাদের সামনে হাজির করা হয়নি। পুনঃশুনানি আদেশে সুপ্রীম কোর্ট মত দিয়েছেন যে, আটকাদেশেই (অর্ডার অব ডিটেনশন) কোনাে কারণের উল্লেখ নেই। পুনঃশুনানির পরও এমনকি আটককারী কর্তৃপক্ষ কোনাে কারণ উপস্থাপন করেননি। আমাদের কাছে যা আছে তা হলাে ২৯ জুলাই, ১৯৬৭ তারিখসম্বলিত ঢাকাস্থ পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র বিভাগের একজন সেকশন অফিসার কর্তৃক পেশকৃত সম্পূরক-হলফনামায় উল্লিখিত তথ্য-উপাত্ত। সেকশন অফিসার কিংবা পূর্ব পাকিস্তান সরকার কেউই আটককারী কর্তৃপক্ষ নন। ফলে, আটককৃত ব্যক্তির [শেখ মুজিবুর রহমান] পক্ষ থেকে সঠিকভাবেই যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, আটককারী কর্তৃপক্ষ আমাদের সামনে এমন কোনাে তথ্য-উপাত্ত হাজির করেননি যা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, আটককারী কর্তৃপক্ষের আটকাদেশ জারি করার পক্ষে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। আমি মনে করি না যে, আটককারী কর্তৃপক্ষের কাছে এমন কোনাে তথ্য-উপাত্ত আছে যা এই আদেশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। মনে রাখা দরকার যে, তর্কিত আদেশটি জারি করা হয়েছে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা, ১৯৬৫-এর ৩২ বিধির (১) উপবিধির (খ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, যে ক্ষমতা, আদেশের বিবরণ অনুযায়ী, ১৩.৯.৬৫ তারিখসম্বলিত No. 115. poll. (11) নম্বর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ডেপুটি কমিশনারকে অর্পণ করা হয়েছে। ফলে, স্বয়ং ডেপুটি কমিশনারকেই তার সামনে থাকা তথ্য-উপাত্তের (ম্যাটেরিয়ালস) ভিত্তিতে সন্তুষ্ট হতে হবে। উক্ত প্রজ্ঞাপন দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান সরকার ৩২(১)(খ) বিধি অনুযায়ী আদেশ জারি করার ক্ষমতা অর্পণ করেছে, সরকারের সন্তুষ্টি অর্পণ করা হয় নি, কারণ তা করা যায় না। আদেশটি ডেপুটি কমিশনারের, সুতরাং, যৌক্তিক কারণের উপরে সন্তুষ্টি তারই হতে হবে। কিন্তু, আমি আগেই যেমন উল্লেখ করেছি যে, সুপ্রীম কোর্ট বলেছেন যে, আদেশে সন্তুষ্টির কোনাে কারণ দেখানাে হয়নি এবং এমনকি ফেরত পাঠানাের [রিমান্ড] পরেও আটকাদেশ জারি করার সময় কী কী কারণ তিনি বিবেচনা করেছেন। তার বিবরণ দিয়ে কোনাে হলফনামা পেশ করেননি ডেপুটি কমিশনার। সেকশন অফিসার কর্তৃক পেশকৃত সম্পূরক হলফনামা ১৯৬০ সাল থেকে ঘটনাবলি সম্পর্কিত এবং সারা প্রদেশজুড়ে সংঘটিত
৩১২
কর্মকাণ্ডকে আকৃষ্ট করে। এটা বলা হয়নি, কীভাবে একজন ডেপুটি কমিশনার, তিনি যখন ডেপুটি কমিশনার ছিলেন না, তখনকার এবং যখন ঘটনা ডেপুটি কমিশনারের এখতিয়ারাধীন এলাকার বাইরে সংঘটিত হয়েছে, এমন ঘটনাবলি (ম্যাটেরিয়ালস) বিবেচনা করে আদেশ জারি করতে পারেন।
এই গ্রাউন্ডে আমি ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলায় রুল অ্যাবসলিউট করলাম।
১২২. ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলার ক্ষেত্রেও আদেশটির ভাষা ৮ মে, ১৯৬৬ তারিখের আদেশের মতাে হুবহু একই। একমাত্র পার্থক্য হলাে ১৯৬৭ সালের ২৯ মে তারিখের আদেশটি জারি করেছেন ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এম. কে. আনােয়ার, যেখানে ৮.৫.১৯৬৬ তারিখের আদেশ জারি করেছেন ঢাকার তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার পি. এ. নাজির। বস্তুত, জনাব আনােয়ারের ক্ষেত্রে বলা যায়, তার কাছে এমন অন্য কোনাে তথ্য-উপাত্ত (ম্যাটেরিয়াল) ছিল না যা তাকে আটককৃতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করবে। নিশ্চিতভাবেই জনাব আনােয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন জনাব পি. এ. নাজিরের পর এবং এটা জানা কথা যে, ৮.৫.১৯৬৬ তারিখসম্বলিত পি. এ. নাজির কর্তৃক জারিকৃত আদেশের পর থেকে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ধারাবাহিকভাবে কারাগারে ছিলেন। জনাব আনােয়ার কর্তৃক পেশকৃত জবাবি-হলফনামায় (কাউন্টার-এফিডেভিট) কিংবা অ্যাডভােকেট জেনারেল কর্তৃক আদালতের কাছে কোথাও এই অভিযােগ করা হয়নি যে, জেলে আটক থাকাকালে পিটিশনার কোনাে ঘটনা ঘটিয়েছেন, যাতে কোনাে যুক্তিসম্পন্ন মানুষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন যে, তিনি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবেন। যদি সরকার কর্তৃক এই যুক্তি দেওয়া হয় যে, জনাব আনােয়ার তার অফিসিয়াল ক্ষমতাবলে এই পদে জনাব নাজিরের উত্তরাধিকারী হিসেবে জনাব নাজির যেসব তথ্য-উপাত্তের (ম্যাটেরিয়ালস) উপর ভিত্তি করে আদেশ জারি করেছেন একই তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে তিনিও আটকাদেশ জারি করতে পারেন, তবে প্রথমে সিদ্ধান্ত দেবাে যে, ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলায় যেমন রায় দিয়েছি, তেমনি বর্তমান ডেপুটি কমিশনার জনাব আনােয়ারের কাছে আটকাদেশ জারি করার পক্ষে যৌক্তিক গ্রাউন্ড আছে এরকম তথ্য-উপাত্ত অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত আমি সিদ্ধান্ত দেবাে যে, সন্তুষ্টি জনাব আনােয়ারের নিজের হতে হবে এবং আদেশ জারি করার ক্ষেত্রে তিনি তার পূর্বসরির সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করতে পারেন না। তিনি নিজে এই আদেশে বলেছেন। যে, তিনি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, তিনি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২ বিধির (১) উপবিধির (খ) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়ােগ করছেন যা ১৩.৯.১৯৬৫ তারিখসম্বলিত No. 115. poll. (11) নম্বর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তাকে অর্পণ করা হয়েছে। এই আদেশ থেকে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় যে, এটা জনাব আনােয়ার কর্তৃক তার উপর অর্পিত (ডেলিগেটেড) ক্ষমতাবলে স্বাধীনভাবে গৃহীত আদেশ। কিন্তু আমাদের সামনে এমন কোনাে তথ্য-উপাত্ত হাজির করা হয়নি যার উপর ভিত্তি করে জনাব আনােয়ার সন্তুষ্ট হতে পারেন এবং ফলে, তার আদেশ আইনি কর্তৃত্ববিহীন। এই বিবেচনায় আমি এই রুল তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করার আদেশ প্রদান করি (মেক রুল অ্যাবসলিউট)। মামলার এই অংশ অর্থাৎ যেসব তথ্য-উপত্তের উপর আটকাদেশ জারি করা হয়েছে সেগুলাের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করার আগে আমি পর্যবেক্ষণ দিতে চাই যে, জনাব পি. এ. নাজির কর্তৃক জারিকৃত ৮.৫.১৯৬৬ তারিখের প্রথম/মূল আটকাদেশ ছিল মাত্র তিন মাসের। জনাব নাজির পরবর্তী (সাকসেসিভ) আদেশের মাধ্যমে এই আদেশের মেয়াদ বর্ধিত করেছেন যা শেষ পর্যন্ত ৩.৫.১৯৬৭ তারিখে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়। সুতরাং, ৩.৫.১৯৬৭ তারিখে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে জারিকৃত প্রথম/মূল আটকাদেশ শেষ হয়।
৩১৩
এই প্রসঙ্গে জনাব আবদুস সালাম খান একটি যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে একের পর এক (সাকসেসিভ) আদেশের আইনগত ভিত্তি নেই। কিন্তু এর বিকল্প হলাে অনির্দিষ্টকালের জন্য আদেশ, যা আমার মতে, নাগরিকের জন্য অনিষ্টকর হবে। আমার মতে, অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকাদেশের চেয়ে মূল ডিটেনশনের সময় বা কাল পরপর (সাকসেসিভ) আদেশের মাধ্যমে বর্ধিত করা নাগরিকদের জন্য ভালাে। এই মত প্রকাশ করতে গিয়ে আমি এই যুক্তি সম্পর্কে অবগত নই যে, পূর্ববর্তী আটকাদেশকে বর্ধিতকারী কোনাে আদেশ জারি করার আগে আটককারী কর্তৃপক্ষ নতুন কোনাে তথ্য-উপাত্ত পেতে পারে না এই সাধারণ কারণে যে, তখন আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] কারাগারে ছিলেন। কিন্তু অধ্যাদেশ ও বিধিমালার ভাষা বলে যে, কর্তৃপক্ষ যদি তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করতে পারেন তাহলে তাদের আদেশ জারি করার ক্ষমতা রয়েছে। সুতরাং, এটা বলা যায় না যে, একের পর এক আদেশ (সাকসেসিভ) আইনত জারি করা যায় না।
১২৩. এটা সত্য যে, আটকাদেশ বৃদ্ধি করে একের পর এক আদেশ (সাকসেসিভ) জারি করার আগে পরিস্থিতি খুবই বিশ্বাসযােগ্য (কনভিন্সিং) হতে হবে। মূল আদেশে নিবৃত্তিমূলক আটকাদেশের মেয়াদ সম্পর্কে অনুমান ভুল হতে পারে কিংবা এরকম পরিস্থিতিতে সময় পরিবর্তিত হতে পারে যা প্রথম আদেশের সময় জানা ছিল না।
১২৪. এভাবেই প্রথম আদেশ যতই চলমান রাখা হােক না কেন, ১৯৬৭ সালের ৩ মে তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। এই বিবেচনায় ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলায় প্রদত্ত রুলটি অর্থহীন হয়ে যায়। কিন্তু যে কারণে মালিক জিলানীর মামলায় সুপ্রীম কোর্টে আপিল করা হয়েছে, সেই একই কারণে এই কোর্ট ১৯৬৬ সালের ৬৪ নম্বর বিবিধ মামলার রুলটি বিবেচনা করেছেন। জিলানী মামলায় আটককৃত ব্যক্তি ইতিমধ্যে মুক্তি পেয়ে যাওয়ার কারণে আপিল বিফলে যায়। ১৯৬৭ সালের ১৬১ নম্বর বিবিধ মামলার ব্যাপারে বলতে হয়, আমি যেমন বলেছি, এটা নতুন আটকাদেশ এবং আমি রুলটি নিয়ে আলােচনা করেছি এবং রুল তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করার আদেশ দেওয়ার (অ্যাবসলিউট) কারণও উল্লেখ করেছি।
১২৫. আমি এখন সুপ্রীম কোর্ট নির্দেশিত অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলােচনা করবাে। এক্ষেত্রে প্রথম যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আসে তা হলাে, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২ ধারা অনুযায়ী জারিকৃত আদেশ ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জারিকত জরুরি অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযােগ্য কিনা। ঠিক এই বিষয়েই সুপ্রীম কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়কে রদ ঘােষণা করেন (সেট অ্যাসাইড)। সুপ্রীম কোর্ট উদ্ধৃত করেছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়েছে যে, “কোনাে নির্দিষ্ট নাগরিকের কোনাে সুনির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষাকে প্রভাবিত করে কিনা তা নির্ধারিত হবে আটককারী কর্তৃপক্ষের সাবজেক্টিভ সেটিসফেকশনের উপর, যারা এটা নির্ধারণ করার একমাত্র নির্ণায়ক। ১৯৬৬ সালের ২৪৭ নম্বর রিট পিটিশন ও বর্তমান আবেদনকারী কর্তৃক সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের সামনে এই যুক্তি উপস্থাপন করা হয় যে, দরখাস্তকারী যেসব কারণে আটক হয়েছেন তার সঙ্গে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা প্রতিরক্ষার বিষয় সম্পর্কযােগ্য নয়। এসব ক্ষেত্রে প্রযােজ্য যথার্থ আইন হলাে প্রিভেনটিভ ডিটেনশন আইন, ১৯৫৮, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা নয়। এই যুক্তি বিশ্লেষণের সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ উপরােক্ত মন্তব্য করেন। সুপ্রীম কোর্ট ঘােষণা করেছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ এই মতও দিয়েছেন যে, আদালতের জন্য এই প্রশ্নের ভেতরে প্রবেশ (গাে বিহাইন্ড দ্য কোয়েশ্চন) করা আদালতের মনকে প্রয়ােজনীয় তথ্য ছাড়াই নির্বাহী মন দ্বারা প্রতিস্থাপন করা বলে প্রতিপন্ন হবে, যদিও আইনত তা করার অনুমােদন নেই। কিন্তু এসব মতামতকে মালিক গােলাম জিলানী ও অন্যান্য মামলায় সুপ্রীম কোর্ট গৃহীত
৩১৪
মতামতের বিপরীত বলে রায় প্রদান করেন। জিলানী মামলায় যেখানে এই মত দেওয়া হয়েছিল যে, এমনকি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে জারিকৃত নির্বাহী আদেশও জুডিসিয়াল রিভিউর আওতামুক্ত নয়। সুপ্রীম কোর্ট আপিল আদেশে বলেন যে, সুপ্রীম কোর্ট কেবল আটককারী কর্তৃপক্ষের সন্তুষ্টির জন্য যুক্তিসঙ্গত হেতু (গ্রাউন্ড) রয়েছে কিনা তা নয়, বরং সেই কারণসমূহ যুক্তিসঙ্গত এবং ডিটেনশনের ক্ষমতা প্রদানকারী আইনের পরিধিভুক্ত কিনা সেই মর্মে সন্তুষ্ট হবেন। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা প্রণীত হয়েছে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ অনুযায়ী। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছে নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করা এবং কিছু সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচারের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণের বিধান চালু করার জন্য। প্রস্তাবনায় যেমন বলা হয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রয়ােগকৃত ক্ষমতা সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদের ৪ দফায় এবং ১৩১ অনুচ্ছেদের ২ দফায়, দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনায় আরাে বলা হয়েছে যে, ৩০ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর দফার অধীনে ঘােষিত জরুরি অবস্থাসৃষ্ট পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য আইন প্রণয়নের আশু প্রয়ােজনীয়তা পূরণ করার জন্য এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
১২৬. জরুরি অবস্থা ঘােষণাপত্রের প্রস্তাবনা নিম্নরূপ :
“যেহেতু রাষ্ট্রপতি এই মর্মে সস্তুষ্ট হয়েছেন যে, পাকিস্তানে একটি ভয়াবহ জরুরি অবস্থা বিরাজ করছে, পাকিস্তান যুদ্ধের হুমকির আসন্ন বিপদের সম্মুখীন;
ফলে, এখন সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদের (১) দফায় প্রদত্ত ক্ষমতানুযায়ী রাষ্ট্রপতি সন্তুষ্ট হয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেন।”
সংবিধানের ৩০ (১) অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ :
৩০(১) “যদি রাষ্ট্রপতি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, মারাত্মক জরুরি পরিস্থিতি বিদ্যমান
(ক) যেখানে পাকিস্তান, কিংবা পাকিস্তানের কোনাে অংশ যুদ্ধ কিংবা বহিরাগত আক্রমণের হুমকির সম্মুখীন (কিংবা সম্মুখীন হওয়ার বিপদ আসন্ন); কিংবা
যেখানে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন এমন অভ্যন্তরীণ গণ্ডগােল দ্বারা হুমকির সম্মুখীন যা প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার বাইরে, তখন প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন।”
১২৭. সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদের বিধানের আলােকে জরুরি অবস্থা ঘােষণাপত্র পড়লে এটা সুস্পষ্ট যে, প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা ঘােষণা করেছেন, কারণ তিনি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, অনুচ্ছেদ ৩০(১)(ক) অনুযায়ী পরিস্থিতি এটাকে প্রয়ােজনীয় করে তুলেছিল। ঘােষণাপত্রের কোথাও সংি ৩০(১)(খ) অনুযায়ী প্রয়ােজনীয় পরিস্থিতির (কন্ডিশন রিকয়ার্ড) কথা উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তী বিধান অনুযায়ী জরুরি অবস্থা উদ্ভূত হয় যখন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দ্বারা হুমকির সম্মুখীন এবং এই বিশৃঙ্খলা এতটাই যে তা প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার বাইরে (বিয়ন্ড)। কেউই এটা দাবি করেনি যে, (ইট ইজ নােবডি’জ কেইস) ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জরুরি অবস্থা জারি করার পর পাকিস্তানের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন অভ্যন্তরীণ গােলযােগ দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে এবং তা এমন পর্যায়ের যা প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার আওতাবহির্ভূত। এরকম পরিস্থিতিতে অনুচ্ছেদ ৩০(৪) অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইনে যুদ্ধের হুমকির কারণে যে জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কেবল তার উল্লেখ থাকতে হবে।
৩১৫
অনুচ্ছেদ ৩০(৪) নিম্নরূপ :
৩০(৪) জরুরি অবস্থা চলাকালীন (জাতীয় পরিষদ তখন বাতিল কিংবা অধিবেশনে থাকুক না কেন) প্রেসিডেন্ট যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, জরুরি পরিস্থিতি যা জরুরি অবস্থা ঘােষণার প্রেক্ষাপট তৈরি করে, তা মােকাবিলা করার জন্য তাৎক্ষণিক (ইমিডিয়েট) আইন প্রণয়ন জরুরি, তিনি এই ধারার শর্তাধীন থেকে জরুরি পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য তার কাছে প্রয়ােজনীয় বলে মনে হয় এরকম অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করতে পারেন এবং এরকম কোনাে অধ্যাদেশ এই ধারার শর্তাধীনে, কেন্দ্রীয় আইন পরিষদ প্রণীত আইনের মতাে একই ক্ষমতা (ফোর্স) পাবে।”
১২৮. “প্রেসিডেন্ট এই মর্মে সন্তুষ্ট যে, জরুরি পরিস্থিতি যা জরুরি অবস্থা ঘােষণার প্রেক্ষাপট তৈরি করে, তা মােকাবিলা করার জন্য তাৎক্ষণিক (ইমিডিয়েট) আইন প্রণয়ন জরুরি”- এই বাক্যগুলাে সুস্পষ্টভাবে অনুচ্ছেদ ৩০(৪) অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের আইন প্রণয়ন ক্ষমতার পরিধি নির্দেশ করে।
১২৯. আমার মতে, আইনে যুদ্ধের হুমকিসংক্রান্ত কিছুর উল্লেখ থাকা দরকার ছিল এবং প্রস্তাবনায় উল্লিখিত বিশেষ পদক্ষেপকেও প্রেসিডেন্ট ঘােষিত জরুরি অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কযােগ্য করা উচিত ছিল। এটা আরাে সুস্পষ্ট হয় যখন দেখা যায় প্রেসিডেন্ট ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা জারি করছেন, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ ১৯৫৮ বাতিল করেননি, যা একই বিষয়বস্তু কাভার করে, কেবল ব্যতিক্রম বিধি ৩২৯(১)(ক)-এর অধীনে প্রদত্ত ক্ষমতা। ফলে, ৩২ বিধির অধীনে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণের আগে আটককারী কর্তৃপক্ষকে এই মর্মে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, আইন অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ ১৯৬৫-এর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য উক্ত ৩২ বিধি প্রয়ােগ করা প্রয়ােজন। সংক্ষেপে, ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডসমূহকে যুদ্ধ বা যুদ্ধের হুমকির সঙ্গে সম্পর্কযােগ্য দেখাতে হবে। অর্থাৎ, এসব কর্মকাণ্ডসমূহকে হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি কাজে বাধা কিংবা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য ক্ষতিকারক হতে হবে। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ ও পাকিস্তান জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ দুটি আইনেরই বিষয়বস্তু এক। কর্তৃপক্ষ উভয় আইনে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন, যেহেতু দুটি আইনই একই সময়ে বিদ্যমান। কোন আইন প্রয়ােগ করবেন তা বাছাই করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে বিবেচনা করতে হবে যে, যেসব কর্মকাণ্ড সংশােধন বা প্রতিরােধ করতে যাচ্ছেন তা আইনের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিনা। আটকাদেশ, সম্পূরক হলফনামা কিংবা বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল কর্তৃক পেশকৃত তথ্য-উপাত্তে এরকম কোনাে ইঙ্গিত নেই যে, আটকাদেশ জারি করা হচ্ছে কারণ আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] যুদ্ধপ্রস্তুতি বা পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ক্ষতিসাধন করছেন। ৬৪ নম্বর রিট পিটিশনে পেশকৃত জবাবি-হলফনামার (কাউন্টার-অ্যাফিডেভিট) ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “যখন কোনাে বিষয় দুটি আইনের আওতাভুক্ত থাকে, তখন কর্তৃপক্ষই সেরা বিচারক যে, তিনি কোন আইনের বিধান প্রয়ােগ করবেন, যা আইনে অনুমােদনযােগ্য।” কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট আমাদের এই আদেশ আটকাদেশের ক্ষমতা প্রদানকারী আইনের পরিধিভুক্ত কিনা তা খুঁজে বের করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে উপরােক্ত আদেশ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩২ বিধির অধীনে জারি করা যায় না। পাকিস্তান জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ ১৯৫৮ এক্ষেত্রে প্রযােজ্য এবং এমনকি কথিত কর্মকাণ্ডসমূহ ক্ষতিকারক বলে প্রতিপন্ন হলেও এই আইন যথেষ্ট। যদি এই আইন, অর্থাৎ পাকিস্তান জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ ১৯৫৮-এর অধীনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতাে, তাহলে আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান তার মামলা সেই অধ্যাদেশের ১৯(খ)-এর অধীনে গঠিত বাের্ডের কাছে পর্যালােচনা করার অধিকার পেতেন। ম্যাক্সওয়েলের Interpretation of Lab-এর একাদশ সংস্করণের ১১৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে :
৩১৬
“Where, as in a multitude of Acts, something is left to be done according to the discretion of the authority on whom the power of doing it is conferred, the discretion must be exercised honestly and in the spirit of the statute. “According to his discretion” means, it has been said, according to the rules of reasons and justice., not private opinion, according to law and not humor, it is to be, not arbitrary, vague and fanciful but legal and regular, to be exercised, not capriciously, but on judicial grounds and for substantial reasons. And it must be exercised within the limits to which an honest man competent to the discharge of his office ought to confine himself, that is within the limits and for the objects intended by the legislature.”
১১৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে :
“So construed as to meet all attempts to abuse them, either by exercising them in cases not intended by the statute, or by refusing to exercise them the occasion for their exercise has arisen.
Though the act done was ostensibly in execution of the statutory power and within its letter, it would nevertheless be held not to come within the power if done otherwise than honestly and in the spirit of the enactment.”
১৩০. এখানে যদি ধরে নেওয়াও হয় যে, কর্তপক্ষ কোন আইন প্রয়ােগ করবেন তা বাছাই করার ক্ষেত্রে তাদের স্বেচ্ছাক্ষমতা (ডিসক্রিশন) ব্যবহার করেছেন, তাহলেও কর্তৃপক্ষের অপেক্ষাকৃত কম কঠোর পদক্ষেপ অর্থাৎ জননিরাপত্তা অধ্যাদেশ-এর আশ্রয় নেওয়া উচিত ছিল। পাকিস্তান নিরাপত্তা অধ্যাদেশ-এর ১৫ ধারায়ও আমি এই নীতিমালার সমর্থন পাই, যেখানে প্রেসিডেন্ট বলে দিয়েছেন যে, সাধারণ জীবিকাপ্রবাহ (ভােকেশন) যতটা কম সম্ভব হস্তক্ষেপ করা। সাধারণভাবে, যদি আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলেও জননিরাপত্তা অধ্যাদেশই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি ইতােমধ্যে ১৯৬৬ সালের ২৪৭ নম্বর রিট পিটিশনে একই মত প্রকাশ করেছি। এই মামলায়ও একই গ্রাউন্ডে প্রথম বিশেষ বেঞ্চে আমি রুল তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করার (অ্যাবসলিউট) আদেশ দিয়েছি। আমার পূর্বতন মতের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনাে কারণ দেখি না। এবং এই প্রসঙ্গে আমি সিদ্ধান্ত দিতে চাই যে, দুটি মামলাতেই আটকাদেশ আইনি কর্তৃত্ববিহীনভাবে জারি
করা হয়েছে।
১৩১. বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, আমাদের সামনে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করছেন। তবে দুটি মামলাতেই আটকাদেশে তা উন্মােচিত হয় না। উক্ত আদেশে বলা হয়েছে যে, “আটককৃত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] জননিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, দেশে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখা ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্যসামগ্রী ও সেবা সরবরাহ বজায় রাখার পক্ষে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন ও করার আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং, আমি বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেলের যুক্তির কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাই না। তিনি কিছু বক্তৃতার কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে, এগুলাে সরকারের
৩১৭
বিরুদ্ধে ঘৃণার মনােভাব ছড়িয়েছে। কিন্তু সরকারের কর্মকাণ্ডের কোন ধরনের সমালােচনা সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানাে বলে প্রতিপন্ন হবে তা ১৭ ডিএলআর ৪৯৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ঢাকা টাইমস-এর avant (Tofazzal Hossain … Petitioner, Motahar Hossain Siddique Petitioner vs. Province of East Pakistan and other Respondents) বিস্তারিতভাবে আলােচিত হয়েছে। সেখানে বিশেষ বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারক কী করলে তা আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানাে বলে প্রতিপন্ন হয় তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। মাননীয় বিচারকগণ আরাে বলেছেন যে, “it is an accepted principle that while construing offending publication, the same should be considered as a whole in fair, free and liberal spirit, without laying stress or emphasis on strong or irritating words used here and there, the matter should be viewed in its proper perspective, along with the surrounding circumstances.” 43 দৃষ্টিভঙ্গির আলােকে উপরােক্ত বক্তৃতার চরণসমূহ বিশ্লেষণ করলে সেখানে আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের
বিরুদ্ধে কোনাে ধরনের ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ানাে বলে ধরা যাবে না।
১৩২. বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল সর্বশেষ যুক্তি দিয়েছেন যে, অধ্যাদেশের ১৬ ধারা পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ বা বিধিমালার অধীনে জারিকৃত কোনাে আদেশের বৈধতা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে আদালতের ক্ষমতায় আইনগত বাধা (বার) সৃষ্টি করে। প্রিভি কাউন্সিলের কাছে একই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল Emperor Vs Vimlabai Deshpande, AIR 1946 PC page 123 মামলায়। সরকারের পক্ষের আইনজীবী মি. ম্যাককেনা ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯৩৯-এর ১৬ ধারার (১) উপধারার উপর নির্ভর করেছেন, যেখানে বলা হয়েছে, “এই আইন কর্তৃক বা অধীনে প্রদত্ত কোনাে ক্ষমতার বলে জারিকৃত কোনাে আদেশ কোনাে আদালতের সন্দেহের আওতায় পড়বে না।” প্রিভি কাউন্সিলের বিজ্ঞ বিচারপতিগণ রায় প্রদান করেন যে, যদি পুলিশ বা প্রাদেশিক সরকারের কোনাে আদেশ অবৈধ হয় তাহলে তা আইনে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জারি করা হয়নি বলে ধরে নেওয়া হবে। আমি সম্মানের সঙ্গে প্রিভি কাউন্সিলের এই আইনি নীতিমালা (ডিক্টাম) অনুসরণ করে রায় প্রদান করছি যে, অবৈধভাবে জারিকৃত আটকাদেশসমূহ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ বা বিধিমালার অধীনে জারি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় না।
এই প্রেক্ষাপটে এবং উপরােক্ত কারণসমূহের আলােকে আমি দুটি মামলাতেই তাৎক্ষণিকভাবে রুল কার্যকর করার (অ্যাবসলিউট) আদেশ প্রদান করছি এবং আটককৃতকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি।
৩১৮
[৪]
‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ প্রচারপত্র সম্পর্কিত মামলা: শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র (১৯৬৪ সালের ৩০৩ নম্বর ক্রিমিনাল রিভিশন)
রায়টির সারাংশ
ঘটনার সারসংক্ষেপ
এই রিভিশন মামলাটি ঢাকা (উত্তর) মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন ১৯৬৪ সালের ৩৬ নম্বর জি.আর. মামলাটি বাতিলের (quash) জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক-এর বিধান অনুযায়ী উদ্ভূত হয়ে ঢাকা হাইকোর্টে দায়ের করা হয়।
১৯৬৪ সালের ২১ জানুয়ারি দাঙ্গা চলাকালীন আবেদনকারী চারজন (আহ্বায়ক শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, সিরাজুদ্দীন (সাংবাদিক) এবং শহীদুল্লা কায়সার) দাঙ্গা প্রতিরােধে যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিতে গাড়িযােগে সাভার যাচ্ছিলেন। চার আবেদনকারী দুটি গাড়িতে ছিলেন এবং তাঁদের পেছনে থাকা আরেকটি জিপে ছিলেন দুই অভিযুক্ত নুরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম। তাঁদের সাভার অভিমুখে গমনকালে গভর্নরের গাড়ি সাভার থেকে ফিরছিলাে এবং তাঁদের অতিক্রম করে যায়। জিপ থেকে এক বান্ডিল প্রচারপত্র গভর্নরের গাড়ির দিকে ছুড়ে মারা হলে তা গাড়ির জানালায় আঘাত হানে। গভর্নরের বহরে উপস্থিত ঢাকার ডেপুটি কমিশনার জিপের আরােহী উল্লিখিত দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেন এবং তাদের ব্যবহৃত জিপ থেকে পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শীর্ষক অবৈধ প্রচারপত্র উদ্ধার করেন, যেগুলাে তারা বিতরণ করছিলেন মর্মে অভিযােগ করা হয়।
জিডিতে উল্লেখ করা হয় যে, গ্রেফতারকত দুজন স্বীকার করেন যে, তারা দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটির’ কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত কমিটির আহ্বায়ক। শাহ আজিজুর রহমান কমিটির কন্ট্রোলার এবং ডন-এর প্রতিবেদক সিরাজুদ্দীন, সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার ও প্রেস ক্লাবের আলী আকসাদ কমিটির সম্পাদকমণ্ডলী। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যাদেশ, ১৯৬০ এবং পাকিস্তান দণ্ডবিধির ৩৩৬ ও ৩৫২ ধারা লঙ্ঘনের অভিযােগে মামলা (১৯৬৪ সালের ৩৬ নম্বর জি.আর. মামলা) দায়ের করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগপত্র দাখিল করা হয়। আসামিগণ ৫৬১ক ধারা মােতাবেক উক্ত মামলা বাতিলের (quash) আবেদন জানিয়ে এই রিভিশন পিটিশন দায়ের করেন।
আদালতের রায়
আদালত এই মামলা বাতিলের (quash) উপযুক্ত নয় মর্মে রায় প্রদান করেন এবং রুলটি খারিজ করে দেন।
৩১৯
রায়টির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ
পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট
শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য
•••••• পিটিশনার
বনাম রাষ্ট্র
••• রেসপনডেন্ট
(১৯৬৪ সালের ৩০৩ নম্বর ক্রিমিনাল রিভিশন04)
রায় প্রদানের তারিখ
৭ মে ১৯৬৫
বিচারপতিবৃন্দ
বিচারপতি এ. কে. এম. বাকের ও
বিচারপতি আবদুস সােবহান চৌধুরী
পিটিশনার পক্ষে আইনজীবী
এস. আর. পাল
এস, এস, হালদার
রেসপনডেন্ট পক্ষে আইনজীবী
মাকসুমুল হাকিম, অ্যাডভােকেট জেনারেল
রায়
বিচারপতি এ. কে. এম. বাকের
১. এই রিভিশন মামলাটি ঢাকা (উত্তর) মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন ১৯৬৪ সালের ৩৬ নম্বর
জি.আর. মামলাটি বাতিলের (quash) জন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক-এর বিধান অনুযায়ী আনীত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত হয়েছে। পটভূমি বােঝার জন্য ঘটনার সংক্ষিপ্তসার হচ্ছে, ১৯৬৪ সালের ২১ জানুয়ারি দাঙ্গা চলাকালীন আবেদনকারী চারজন দাঙ্গা প্রতিরােধে যথাসাধ্য ব্যবস্থা নিতে গাড়িযােগে সাভার যাচ্ছিলেন। চার আবেদনকারী দুটি গাড়িতে ছিলেন এবং তাঁদের পেছনে থাকা আরেকটি জিপে
——————————————————————
04. Sk. Mujibur Rahman vs. State. PLD 1967 Dacca 484.
৩২০
ছিলেন দুই অভিযুক্ত নুরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলাম। তাঁদের সাভার অভিমুখে গমনকালে গভর্নরের গাড়ি সাভার থেকে ফিরছিল এবং তাঁদের অতিক্রম করে যায়। জিপ থেকে এক বান্ডিল প্রচারপত্র গভর্নরের গাড়ির দিকে ছুড়ে মারা হলে তা গাড়ির জানালায় আঘাত হানে। গভর্নরের বহরে উপস্থিত ঢাকার ডেপুটি কমিশনার জিপের আরােহী উল্লিখিত দুই অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেন এবং তাঁদের ব্যবহৃত জিপ থেকে পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শীর্ষক অবৈধ প্রচারপত্র উদ্ধার করেন, যেগুলাে তারা বিতরণ করছিলেন মর্মে অভিযােগ করা হয়।
২.পরবর্তীকালে, সংযুক্তি ‘ক’ আকারে বিদ্যমান সাধারণ ডায়েরি, সংযুক্তি ‘খ’ আকারে বিদ্যমান এজাহার, সংযুক্তি ‘গ’ আকারে বিদ্যমান অভিযােগপত্র এবং সংযুক্তি ‘ঘ’ আকারে বিদ্যমান “অভিযােগনামা” অত্র আবেদনের সাথে দাখিল করা হয়।
৩.মামলা বাতিলের সমর্থনে উপস্থাপিত যুক্তি হচ্ছে, বর্ণিত তথ্যের ভিত্তিতে অবৈধ প্রচারপত্র বিলি কিংবা গভর্নরের গাড়িতে প্রচারপত্রের বান্ডিল নিক্ষেপ সংক্রান্ত বিষয়ে আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে না। বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে যে বিষয়গুলাের উপর তা হচ্ছে, জিপে আরােহীদের সঙ্গে আবেদনকারীদের কোনােরূপ সম্পর্ক নেই। অপরাধ যদি ঘটেও থাকে তাতে জিডি, এজাহার বা অভিযােগপত্র, সেখানে আবেদনকারীদের কোনােরূপ সম্পৃক্ততা নির্দেশ করে না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায়, এই মামলা চলতে দেওয়াটা হবে বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি অপব্যবহার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য গঠিত অভিযােগ বাতিল (quash) করাই বাঞ্ছনীয়।
৪. আবেদনকারী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব এস. আর. পাল আরাে বলেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের (প্রসিকিউশন) উদ্দেশ্যই হলাে ক্ষমতাসীন দলের বিরােধী পক্ষভুক্ত আবেদনকারীদের হয়রানি করা। রাষ্ট্রপক্ষের অনুসৃত প্রক্রিয়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নয়, বরং বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহারমাত্র।
৫. তিনি M.S. Kharbuja 0. State PLD 1965 SC 287 মামলার রায়ে প্রধান বিচারপতি কর্নেলিয়াসের নিমােক্ত পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করেছেন :
“অন্যদিকে আদালতের এই পর্যবেক্ষণের সাথে একমত হওয়া যায় যে, যেসব মামলায় আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়ােগ করা হয়েছে সেসব মামলার প্রেক্ষাপট অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে এটা নির্ধারণের জন্য যে- ‘বিচারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে নাকি ‘বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার হচ্ছে?
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কোনাে বিচারিক কার্যক্রম বাতিল করার প্রয়ােজন হলে দেখাতে হবে যে, যদি বিচারিক কার্যক্রমটি চালিয়ে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হতাে তাহলে তা ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করতাে বা অন্যভাবে বলতে গেলে উক্ত বিচারিক কার্যক্রমের মাধ্যমে মূলত অবিচারই করা হতাে কিংবা তার মাধ্যমে অবিচারকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হতাে।
বিচারিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অপব্যবহার’ কী- সেটা বােঝাবার জন্য এটা দেখানাে জরুরি যে, বিচারিক কার্যক্রমটি আইনের মূল উদ্দেশ্যের এমন বিকৃতি সাধন করে যা নিরপরাধ পক্ষের হয়রানির কারণ হবে, বিলম্বের সৃষ্টি করবে; অথবা দেখাতে হবে যে, বিচারিক-কর্তৃপক্ষ এমন এক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েছে যা ন্যায়বিচারে কোনাে অগ্রগতি সাধন তাে করবেই না, বরং বিকৃত ফলাফলের জন্ম দেবে।” পক্ষান্তরে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেলও একই অংশের উপর নির্ভর করেছেন।
৩২১
৬. উক্ত পর্যবেক্ষণের শেষাংশের উপর নির্ভর করে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জেনারেল বলেন, কোনাে বিচারিক কার্যক্রম কেবল তখনই বাতিলযােগ্য হয়ে ওঠে, যখন তা চলমান থাকলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হবে মর্মে অভিমতে পৌছানাে যায় এবং তার জন্য কার্যক্রমটিতে বিকৃতির অনুসন্ধান জরুরি। তাঁর বক্তব্যের সারাংশ হলাে, উদ্ধত অংশটুক এ মামলা বাতিল প্রসঙ্গে সহায়ক তাে নয়ই, বরং নিরেট অন্তরায় হিসেবে হাজির। হয়েছে। তাছাড়া ওই মামলায় সুপ্রীম কোর্ট বাতিল (quash) মঞ্জুরও করেননি।
৭.উদ্ধৃত পর্যবেক্ষণ মােতাবেক, অপব্যবহার দ্বারা আইনের মূল উদ্দেশ্যের বিকৃতিসাধন ঘটে। কোনাে উচ্চ আদালত, বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার রােধ, কিংবা অন্য প্রকারে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নিমিত্তে, তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতাবলে একটি অপরাধকে বিলম্ব বা এ জাতীয় কারণে ফৌজদারি আইনের আওতা-বহির্ভূত গণ্য করাকে কতটুকু উপযুক্ত মনে করবেন, তা-ই ওই মামলায় মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছিল। আমাদের মামলায় বিচার্য হচ্ছে আনীত অভিযােগের আলােকে আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে কিনা। রাষ্ট্রপক্ষের অভিযােগ সত্য ধরে নিলেও, আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে যদি অপরাধ প্রতিষ্ঠিত না হয়, কিংবা অপরাধ প্রতিষ্ঠা সত্ত্বেও, যদি তাতে কোনাে প্রকার সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকে, সেক্ষেত্রে বাতিলকরণ যথােপযুক্ত হবে।
৮.এখনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের সুযােগ থাকায় মামলার বর্তমান পর্যায়ে বলা যাচ্ছে না, অভিযােগের সমর্থনে প্রমাণাদি অনুপস্থিত।
৯.আবার অভিযােগের ধরন থেকে হতে বলা যাচ্ছে না কোনাে অপরাধই সংঘটিত হয়নি। অপরাধের ঘটনা অস্বীকার করা হয়নি। মূলত অস্বীকার করা হয়েছে অপরাধের সঙ্গে আবেদনকারীদের সম্পৃক্ততা।
১০. নথিপত্র পরীক্ষণে আমাদের অভিমত হচ্ছে, অভিযােগ সত্য হলে কিছুটা অপরাধ সংঘটিত হয়। তাছাড়া আবেদনকারীদের অন্যায় আচরণ কোনােভাবেই অনুমিত হয় না, অভিযােগ সে রকমও নয়।
১১. মৌলিক প্রশ্নটা হচ্ছে অপরাধের সঙ্গে আবেদনকারীগণের সম্পৃক্ততা। অভিযােগ থেকে আপাতদৃষ্টে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যাদেশ, ১৯৬০ এবং পাকিস্তান দণ্ডবিধির ৩৩৬ ও ৩৫২ ধারার লঙ্ঘন সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
১২. আবেদনের বর্ণনা মােতাবেক অভিযুক্ত নুরুল ইসলাম ও সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলার কিঞ্চিৎ যথার্থতা রয়েছে। প্রশ্ন হলাে এইরূপ যথার্থতা চার আবেদনকারী সম্বন্ধেও বিদ্যমান কিনা।।
১৩. নথিপত্র পর্যালােচনায় দেখতে পাই, একেবারে শুরু থেকেই জিডি এন্ট্রিতে, গুরুত্ব তার যা-ই হােক না কেন, আবেদনকারীদের নাম রয়েছে। সংযুক্তি ‘ক’-তে জিডি এন্ট্রির শেষ ভাগে নিম্নোক্ত বিবরণ বিদ্যমান :
“অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা বলেছেন যে, ১৫.১.৬৪ তারিখ থেকে তারা দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটির’ কর্মী হিসেবে কাজ করছেন। শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত কমিটির আহ্বায়ক। শাহ আজিজুর রহমান তার নিয়ন্ত্রক এবং ডন-এর প্রতিবেদক সিরাজুদ্দীন, সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার ও প্রেস ক্লাবের আলী আকসাদ হচ্ছেন সম্পাদকমণ্ডলী। কমিটির অফিস ৩৩, তােপখানা রােড, ঢাকায় অবস্থিত। কোন প্রেস থেকে প্রচারপত্রগুলাে ছাপানাে হয়েছে তা জ্ঞাত থাকার কথা গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা অস্বীকার করেছেন। তারা বলেছেন, তারা সেগুলাে জিপে পেয়েছেন এবং উপযুক্ত জায়গাভেদে বিতরণ করেছেন। এ থেকে আমার মনে হয়েছে তারা সত্য গােপন করছেন।”
৩২২
দুঃখজনকভাবে জিডি এন্ট্রির এই অংশটুকু আবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। এখানেই আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার মূলসূত্র (nucleus) প্রােথিত রয়েছে। জনাব পাল যুক্তি দেখান যে, এ বর্ণনা পুলিশের নিকট প্রদত্ত বক্তব্য এবং এ কারণে গ্রহণযােগ্য নয়।
১৪. এটা কতটুকু গ্রহণযােগ্য তা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার মূল উৎস সেখানেই
নিহিত।
১৫. তিনটি গাড়ি একই বহরে থাকা প্রসঙ্গে এজাহারেও বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অংশটুকু নিম্নরূপ :
“আমি এসআই এফ. হক, সাভার থানার ওসি, নিজেই অভিযােগকারী হয়ে এই মর্মে এজাহার দাখিল করছি যে, ২১.১.৬৪ তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ঢাকার ডেপুটি কমিশনার ও অন্যান্য কর্মকর্তাসহ সাভার থেকে প্রত্যাবর্তনকালে সর্বজনাব শেখ মুজিবুর রহমান, অ্যাডভােকেট শাহ আজিজুর রহমান, অ্যাডভােকেট শামসুল আলম এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গকে বহনকৃত দুটো কারের পেছনে একই বহরে অভিযুক্ত নুরুল ইসলাম, পিতা- সেকান্দার গাজী, ধাদ্দার, থানা-হাজীগঞ্জ, জেলা-কুমিল্লা, বর্তমান ঠিকানা ২২/৫ শান্তিনগর, ঢাকা এবং অভিযুক্ত সাইফুল ইসলাম, পিতা-নেয়ামুদ্দীন আহমেদ, বালিয়াকান্দা, থানা-দেবহাটা, জেলা-খুলনা, বর্তমান ঠিকানা-৩৩, তােপখানা রােড, ঢাকা- উল্টো দিকে দ্রুতগতিতে যাচ্ছিলেন। পথে “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও” শীর্ষক মুদ্রণালয়ের নামবিহীন বাংলা প্রচারপত্রের একটি গােটানাে বান্ডিল গভর্নরের গাড়ির দিকে ছুড়ে দেওয়া হলে তা গাড়ির কাচে আঘাত করে। ঢাকার ডেপুটি কমিশনার দুইটি জিপে পুলিশসহ গাড়ি বহরটিকে ধাওয়া করেন এবং সাভার থানা থেকে আগত সড়ক ও আরিচা সড়কের সংযােগস্থলে তাদের গতিরােধ করেন। তল্লাশি করে দেখা যায়, অভিযুক্ত দুজন একটি জিপে বিপুল পরিমাণে উলিখিত অবৈধ প্রচারপত্র বহন করছিলেন। জনাব শেখ মজিবর রহমান, জনাব শাহ আজিজর ও অন্যরাসহ একই দলের সদস্য হিসেবে তারা সাভারের দিকে যাচ্ছিলেন।”
১৬. এজাহারে তিনটি গাড়ি একসঙ্গে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং অভিযােগ করা হয়েছে যে, জিপে অবস্থানরত অভিযুক্ত দুজন জনাব শেখ মুজিবুর রহমান, জনাব শাহ আজিজুর রহমান ও অন্যান্য ব্যক্তিসহ একই দলের সদস্য হিসেবে একসঙ্গে সাভার যাচ্ছিলেন। অভিযােগপত্রেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, জীবন বিপন্ন করার জন্য যে ইবিএ ৩৩৮৩ নম্বর জিপ থেকে প্রচারপত্রের একটি গােটানাে বান্ডিল বেপরােয়াভাবে গভর্নরের গাড়ির দিকে নিক্ষেপ করে জানালায় আঘাত হানা হয়, তাতে দুইজন অভিযুক্ত আরােহী ছিলেন এবং তাঁরা কলাম নম্বর ২-এর ১ ও ৩ নম্বর অভিযুক্তকে বহনকারী দুটি গাড়ির পেছনে সাভার যাচ্ছিলেন। ঢাকার ডেপুটি কমিশনার গাড়িবহরটিকে ধাওয়া করেন ও সাভার-আরিচা রােডের সংযােগস্থলে তাদের পথরােধ করেন। তল্লাশির পর এই বহরের অন্তর্ভুক্ত জিপগাড়িতে পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শিরােনামের মুদ্রণালয়ের নামবিহীন কিছু অবৈধ প্রচারপত্র পাওয়া যায়।
১৭. তদন্তকালে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের মালিকানাধীন জিপগাড়িটি জব্দ করা হয় এবং তার ড্রাইভার মনসুর আলীকে গ্রেফতার করা হয়। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এসব অবৈধ প্রচারপত্র বহন ও বিলি করার জন্য গাড়িটি দিয়েছিলেন। সংযুক্তি ‘গ’ অভিযােগপত্রে বলা হয়েছে :
“তদন্তে ২ ও ৩ নম্বর কলামে উল্লিখিত সকল অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যাদেশ, ১৯৬০-এর ৫৫(২) ধারাসহ ৫৫(১) ধারা এবং পাকিস্তান দণ্ডবিধির ৩৪ ধারার অভিযােগ প্রাথমিকভাবে (prima facie) এবং ৩ নম্বর কলামের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান দণ্ডবিধির
৩২৩
৩২৬/৩৫২ ধারা মােতাবেক পৃথক অভিযােগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আমি আদালতে তাদের বিচারের জন্য মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যাদেশ, ১৯৬০-এর ৫৫(১)(২) ধারাসহ পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১০৯, ৩৩৬/৩৫২/৩৪ ধারায় অভিযােগপত্র নম্বর ১৪, তারিখ ২৬.০১.৬৪ দাখিল করি।
(স্বাক্ষরিত) (Sd.) এফ. হক,
এসআই এবং ওসি, সাভার থানা (S.I.O.C. Savar P.S.)
১৬.৩.৬৪”
১৮. অভিযােগপত্রের উপরােক্ত অংশে দৃশ্যত ভুলক্রমে উপস্থাপিত তারিখ ২৬.১.৬৪-এর সূত্রে জনাব পাল অপর একটি অভিযােগপত্রের প্রসঙ্গ টেনেছেন, যদিও নথিপত্রে তার কোনাে হদিস আমরা পাইনি। ভুলটা মূলত অভিযােগপত্র “তিনি দাখিল করেছেন” সংক্রান্ত। সুতরাং একমাত্র অভিযােগপত্র এটাই, যার নম্বর ১৪ এবং তারিখ ১৬.৩.৬৪, ভুলবশত সেটা হয়ে গেছে ২৬.১.৬৪।
১৯. আনীত অভিযােগ থেকে দেখা যায়, অভিযােগ গঠন করা হয়েছে অবৈধ প্রচারপত্র বিতরণ এবং দণ্ডবিধির ৩৩৬ ও ৩৫২ ধারাসহ ৩৪ ধারায় বর্ণিত অপরাধের জন্য। ২০. কাজেই আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে মামলার কোনাে ভিত্তি নেই, নথি পর্যালােচনায় এরূপ বলা যাচ্ছে না।
২০.অবশ্য এখনাে পর্যন্ত সেগুলাে বেশ নগণ্যই। প্রকৃতপক্ষে অভিযােগের সত্যতা নির্ণীত হবে সা আলােকে এবং সেটা বিচারিক আদালতের বিবেচ্য বিষয়। উপরােক্ত পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এই মামলা বাতিলের (quash) উপযুক্ত নয়। মামলার গুণাগুণ সম্পর্কে আমরা কোনাে মন্তব্য করছি না। এমতাবস্থায় রুলটি খারিজ করা হলাে। এই মামলার নথিপত্র দ্রুত প্রেরণের আদেশ দেওয়া হলাে।
বিচারপতি আবদুস সােবহান চৌধুরী
আমি একমত।
৩২৪
[৫]
পল্টন ময়দানে ২৯ মার্চ ১৯৬৪ তারিখের বক্তৃতা সম্পর্কিত মামলা : শেখ মুজিবুর রহমান বনাম রাষ্ট্র (১৯৬৪ সালের ১৫৯ নম্বর ক্রিমিনাল বিবিধ মামলা)
রায়টির সারাংশ
ঘটনার সারসংক্ষেপ
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৪ সালের ২৯ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলায় একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন :
“… ঢাকা ও বাংলার অন্যান্য জায়গায় সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, কিছুদিন আগে ইকবাল হলে লাইট বন্ধ করে ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করা হয়েছিল। আপনারা শুনেছেন লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডা ছাত্রদের মারধর করেছিল … ছাত্রদের উপর নির্যাতন চালানাে হচ্ছে, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, হাজতে রাখা হচ্ছে, তাদের জামিন দেওয়া হচ্ছে না…আমরা ট্যাক্স দিই, কিন্তু আমাদের ভােট দেওয়ার অধিকার নেই। এরকম দিন আসবে যখন জনগণ বলতে বাধ্য হবে, আমাদের ভােট নেই, আমরা ট্যাক্স দেবাে না। আমাদেরকে আমাদের অধিকার দিতেই হবে। এজন্যই আপনাদের আমেরিকার ইতিহাস দেখতে বলি- নাে রিপ্রেজেন্টেশন, নাে ট্যাক্সেশন।… এরকম দিন আসবে যখন জনগণ বলতে বাধ্য হবে যদি আমাদের ভােটের অধিকার না দেওয়া হয়, তাহলে তােমাদের ট্যাক্স আদায়েরও কোনাে অধিকার নাই।… পূর্ব পাকিস্তানকে শুষে খাওয়া বন্ধ করাে। তা না হলে বাংলার জাগ্রত জনতা দেখিয়ে দেবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে কীভাবে রুখে দাঁড়াতে হয়।”
এই বক্তৃতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় ১৯৬৪ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার পুলিশ সুপার সৈয়দ মান্নান বখশ ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার জনাব এম. বি. আলমের আদালতে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা অনুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করেন। অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার নালিশি দরখাস্তটির ভিত্তিতে ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বরের এক আদেশের মাধ্যমে অভিযােগটি আমলে নেন এবং ১৯৬৪ সালের ২০ নভেম্বর হাজিরার তারিখ নির্ধারণ করে আবেদনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করেন। একই তারিখে আবেদনকারী তার ডিফেন্স প্রস্তুত করার জন্য দীর্ঘ মুলতুবির আবেদন করেন। কিন্তু উক্ত অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার আবেদনকারীর প্রার্থনা অগ্রাহ্য করে এক আদেশের মাধ্যমে ১৯৬৪ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেন।
১৯৬৪ সালের ৩ ডিসেম্বর এই মামলায় আবেদনকারীর আইনজীবী অ্যাডভােকেট আবদুস সালাম খান হাইকোর্টে অন্য মামলায় ব্যস্ত থাকায় আবেদনকারী শুনানি মুলতুবির আবেদন করেন। কিন্তু অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার আবেদনটি নামঞ্জুর করেন। একই আদালতে আবেদনকারীর বিরুদ্ধে অপর একটি মামলা বিচারাধীন ছিল। সেই মামলায়ও তিনি শেখ মুজিবকে তার ডিফেন্স প্রস্তুত করার অনুমােদন দেননি এবং আবেদনকারীর আপত্তি সত্ত্বেও প্রসিকিউশন পক্ষের অগ্রহণযােগ্য (ইনএডমিসিবল) সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনকারী আশঙ্কা করেন যে, এই অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের কাছে তিনি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার পাবেন না। আবেদনকারী মামলাটি ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ধারা অনুযায়ী বাতিল (quash) কিংবা এর বিকল্প হিসেবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২৬ ধারা অনুযায়ী এই আদালত থেকে যথাযথ এখতিয়ারসম্পন্ন অন্য কোনাে মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি বদলির আবেদন করেন এবং সেই মর্মে রুল প্রাপ্ত হন। আদালতের রায় : আদালত রুলটি খারিজ করে দেন।
৩২৫
রায়টির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ
পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট
শেখ মুজিবুর রহমান
…… পিটিশনার
বনাম
রাষ্ট্র
•••••• রেসপনডেন্ট
(১৯৬৪ সালের ১৫৯ নম্বর ক্রিমিনাল বিবিধ মামলা05 )
রায় প্রদানের তারিখ : ২৫ মার্চ ১৯৬৫
বিচারপতিবৃন্দ
বিচারপতি এ. কে. এম. বাকের ও
বিচারপতি এ. সােবহান চৌধুরী
পিটিশনার পক্ষে আইনজীবী
এস.আর. পাল,
এস. এস. হালদার ও
বি. বি. রায় চৌধুরী
রেসপনডেন্ট আইনজীবী
আবদুল হাকিম, ডেপুটি লিগ্যাল রিমেমব্রালার ও
এ. টি. এম. মাসুদ
রায়
বিচারপতি বাকের
এই মামলায় ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার জনাব এম. বি আলমের আদালতে বিচারাধীন ১৯৬৪ সালের ক্রিমিনাল মামলা নম্বর ২ কেন বাতিল (quash) করা হবে না কিংবা ঐ আদালত থেকে যথাযথ এখতিয়ারসম্পন্ন অন্য কোনাে মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে কেন বদলি করা হবে না- সে মর্মে ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানাের রুল জারি করা হয়।
…………………………………………………………….
05. Sheikh Mujibur Rahman 0s. State. 16 PLR 1966 Dacca 151. (১৯৬৪ সালের ২৯ মার্চ পল্টন ময়দানে বক্তৃতার জন্য মামলা)
৩২৬
আবেদন মােতাবেক মামলার প্রেক্ষাপট এরকম : ১৯৬৪ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার পুলিশ সুপার জনাব সৈয়দ মান্নান বখৃশ প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে ঢাকার অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার জনাব এম. বি. আলমের আদালতে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় এই মর্মে একটি অভিযােগ দাখিল করেন যে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অত্র মামলার আবেদনকারী ১৯৬৪ সালের ২৯ মার্চ তারিখে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলায় একটি বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন, যার অনুবাদ নিম্নরূপ :
“ঢাকা ও বাংলার অন্যান্য জায়গায় সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, কিছুদিন আগে ইকবাল হলে বাতি নিভিয়ে ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করা হয়েছে। আপনারা শুনেছেন যে, গুন্ডা দিয়ে ছাত্রদের মারধর করা হয়েছে,…ছাত্রদের নির্যাতন করা হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে, হাজতে রাখা হচ্ছে, জামিন দেওয়া হচ্ছে না…আমরা ট্যাক্স দিই, কিন্তু আমাদের ভােট দেওয়ার অধিকার নেই। এরকম দিন আসবে যখন লােকে বলতে বাধ্য হবে, আমাদের ভােট নেই, আমরা ট্যাক্স দেবাে না। আমাদেরকে আমাদের অধিকার অবশ্যই দিতে হবে। এজন্যই আপনাদের আমেরিকার ইতিহাস দেখতে বলি- নাে রিপ্রেজেন্টেশন, নাে ট্যাক্সেশন। ব্রিটিশ সরকারের অবস্থা কীরকম হয়েছিল? এমন দিন আসতে পারে যখন জনগণ বলতে বাধ্য হবে যদি আমাদের ভােটের অধিকার না দেওয়া হয়, তাহলে তােমাদের ট্যাক্স আদায়েরও কোনাে অধিকার নাই।…পূর্ব পাকিস্তানকে শুষে খাওয়া বন্ধ করাে। তা না হলে বাংলার জাগ্রত জনতা দেখিয়ে দেবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেমন করে রুখে দাঁড়াতে হয়।”
নালিশি দরখাস্তটির ভিত্তিতে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার ১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর তারিখের আদেশমূলে অভিযােগটি আমলে নেন এবং ১৯৬৪ সালের ২০ নভেম্বর তারিখ আবেদনকারীর উপস্থিতির জন্য ধার্য করে আবেদনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করেন।
উক্ত পরােয়ানা তামিলান্তে গ্রেফতারকৃত এবং জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত আবেদনকারী জামিনের শর্ত মােতাবেক উপরােক্ত ধার্য তারিখ অর্থাৎ ১৯৬৪ সালের ২০ নভেম্বর অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের আদালতে হাজির হন।
সেদিন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রস্তুতির জন্য দীর্ঘ মুলতুবির প্রার্থনা করলেও অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার তা অগ্রাহ্য করে একই তারিখের এক আদেশবলে ১৯৬৪ সালের ৩ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করেন।
১৯৬৪ সালের ৩ ডিসেম্বর এই মামলায় আবেদনকারীর আইনজীবী অ্যাডভােকেট আবদুস সালাম খান হাইকোর্টে ব্যস্ত থাকায় আবেদনকারী মুলতুবি প্রার্থনা করলে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার তা খারিজ করে দেন। নালিশি দরখাস্তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাক্ষীদের অনেকেই উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যক্তি, যারা অভিযােগকারী দ্বারা প্রভাবিত।
এই মামলার পূর্বেও দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় আবেদনকারীর বিরুদ্ধে অপর একটি মামলা ১৯৬৪ সালের ক্রিমিনাল বিবিধ মামলা নম্বর ১ক হিসেবে একই অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের আদালতে বিচারাধীন ছিল। এতে উল্লেখ করা হয় যে, যেহেতু ঐ মামলায় তিনি আবেদনকারীকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সুযােগ প্রদান করেননি, প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের অগ্রহণযােগ্য বিষয়সমূহকে স্বীকৃতি দেন এবং আবেদনকারীর আপত্তি সত্ত্বেও সরকারি সাক্ষীর অগ্রহণযােগ্য সাক্ষ্য গ্রহণ করেন, সেহেতু আবেদনকারী আশঙ্কা করেন যে, এই অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের কাছে তিনি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার পাবেন না। ফলে, তিনি ঐ মামলা উক্ত কমিশনারের আদালত থেকে বদলি করার নিমিত্তে হাইকোর্টে আবেদন করেন এবং ১৯৬৪ সালের ৭৩ নম্বর বিবিধ মামলায় একটি রুল প্রাপ্ত হন যা এখনাে বিচারাধীন।
৩২৭
উপরােক্ত পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের নিকট স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার প্রাপ্তিতে আবেদনকারীর আশঙ্কা থাকায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৫২৬ ধারার বিধান অনুসারে মামলাটি বদলির জন্য হাইকোর্টের শরণাপন্ন (move) হওয়ার নিমিত্তে তিনি ১৯৬৪ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখে এই অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার বরাবর মামলার কার্যক্রম মুলতুবি করার জন্য একটি আবেদন দায়ের করেন।
আবেদনকারী হাইকোর্টে আবেদন করার জন্য এক মাস সময় প্রার্থনা করলেও অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার ৩ ডিসেম্বর ১৯৬৪ তারিখের আদেশে ২০০ টাকা মুচলেকায় কেবল ২১ ডিসেম্বর ১৯৬৪ পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করেন।
নিবেদন মােতাবেক আবেদনকারী কর্তৃক প্রদত্ত এবং নালিশি দরখাস্তে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত উক্ত বক্তৃতার সারাংশে দণ্ডবিধির ১২৪ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলার কোনাে উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং এর ফলে মামলাটি বাতিল (quash) করা যথার্থ।
দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারার অধীনে দায়েরকৃত মামলাটি বাতিল কিংবা এই অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের আদালত থেকে যথাযথ এখতিয়ারসম্পন্ন কোনাে মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে বদলি হচ্ছে প্রার্থিত প্রতিকার।
আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী জনাব এস. আর. পালের মূল যুক্তি ছিল, বর্তমান সংবিধানের আলােকে দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারা আর গ্রহণযােগ্য নয়, এটা রহিত হয়ে গেছে, অভিযুক্ত বক্তৃতার দীর্ঘ উদ্ধৃতাংশ কোনােভাবেই দণ্ডবিধির ১২৪ ধারাকে আকৃষ্ট করে না। জনাব পাল তার যুক্তির সমর্থনে Maulvi Farid Ahmad v. Government of West Pakistan(1) (1) P.L.D. 1965 Lah.(W.P.) 135.,(আংশিকভাবে রিপাের্টেড) মামলার রায়ের কথা উল্লেখ করেন।
তিনি সুনির্দিষ্টভাবে উপরােক্ত মামলার ১৪৩ পৃষ্ঠার কয়েকটি লাইন নির্দেশপূর্বক নিবেদন করেন, এর চেয়ে অনেক বেশি জ্বালাময়ী বক্তৃতাও আটকের জন্য যথেষ্ট কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। সেই বক্তৃতার সারাংশ করা হয়েছে এইরূপ (রিপাের্টের ১৪৩ পৃষ্ঠায়) :
“অভিযােগসমূহের সারসংক্ষেপ হচ্ছে যে, আবেদনকারী তার বক্তৃতায় নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ায় পুলিশবাহিনীর সমালােচনা করেন। তিনি বলেন, গণদুর্ভোগ ও হায়দ্রাবাদে বন্যা-আক্রান্ত মানুষের কষ্ট উপেক্ষা করে পেশােয়ারে প্রেসিডেন্টের পার্টিতে ৫০,০০০ রুপি ব্যয় করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার নিন্দা জানিয়ে তিনি অভিযােগ করেন, প্রেসিডেন্টের হাত মজবুত করা হচ্ছে এবং তার হাত ধ্বংস হােক’ বলে জনগণকে উসকানি দেন। বক্তৃতার ঐ অংশটুকুর কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে তিনি অভিযােগ করেন যে, পারমিট ইত্যাদির মাধ্যমে অসাধু উপায়ে জাতীয় পরিষদের সদস্যদের কিনে নেওয়া হয়েছে, প্রশাসন হয়ে গেছে দুর্নীতিগ্রস্ত, জনগণের প্রতি বর্তমান সরকারের কোনাে দরদ নেই, আর যেসব লােক আগে রণজিৎ সিং ও ব্রিটিশদের সমর্থন করেছিল, সরকার তাদেরই সমর্থনপুষ্ট। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল হওয়ারও সমালােচনা করেন তিনি এবং তাকে নানাবিধ উপাধি দেন। আরেকটি অভিযােগে তার উক্তি নিম্নরূপ : “ছােটবেলায় আমরা স্পিরিট অব ইসলাম পড়তাম, সামরিক শাসন আসার পর থেকে সেটা অ্যালকোহল অব ইসলামে পরিণত হয়েছে। এর মানে হলাে কিছুদিন পর ব্যাভিচার করে তারা সেটাকে বলবে ইসলামি ব্যাভিচার। অ্যাসেম্বলিতে একজন নারী আমাদের জন্য ফতােয়া জারি করেছেন। ইমাম আবু হানিফার পরিবর্তে বেগম জি. এ. খান আমাদের মুফতিতে পরিণত হয়েছেন। রুহ্-এ-ইসলাম হয়ে গেছে।
শরাব-এ-ইসলাম। সেটা একটি রিট পিটিশন ছিল এবং সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদের আলােকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল নিম্নরূপ :
“কোনাে ব্যক্তির হ্যাবিয়াস কর্পাস পিটিশনের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ অধিকার এবং সকল বেআইনি কারারােধের বিরুদ্ধে একটি সাংবিধানিক প্রতিকার। এটা সংবিধানে উল্লিখিত অন্যতম মৌলিক
৩২৮
অধিকারসমূহের একটি। এই অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে কোনাে সীমাবদ্ধতা না থাকায় কোনাে অধস্তন আইন দ্বারা প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষ বিধি-নিষেধ আরােপের মাধ্যমে এই অধিকার প্রয়ােগে সীমাবদ্ধতা আরােপ করা যায় না। পাকিস্তান সংবিধানের (১৯৬২) ২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, আইনের সুরক্ষা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং আইনসঙ্গত না হলে বিশেষত জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য ক্ষতিকর কোনাে পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। কোনাে ব্যক্তির গ্রেফতার আইনসঙ্গত না হলে, ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার, যা তার একটি মৌলিক অধিকার, তা পুনরুদ্ধারের জন্য তৎক্ষণাৎ হাইকোর্টের এখতিয়ার প্রার্থনা করতে না পারার কোনাে কারণ থাকতে পারে না। যখন কোনাে ব্যক্তিকে আটক করা হয় এবং তিনি অভিযােগ করেন যে, তা অসাংবিধানিক ও সংবিধান প্রদত্ত সুরক্ষার লঙ্ঘন কিংবা রাষ্ট্রীয় আইনি বিধানের আওতাবহির্ভূত, তখন তিনি পাকিস্তান সংবিধানের (১৯৬২) ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের এখতিয়ার প্রয়ােগ এবং তৎক্ষণাৎ মুক্তি পাওয়ার প্রার্থনা করতে পারেন। West Pakistan Maintenance of Public Order Ordinance, 1960-এর ৩ ধারার বিধান অনুসারে জারিকৃত কোনাে আটকাদেশ কেবল দুই মাসের জন্য হলে তা অ্যাডভাইজরি বাের্ডের কাছে পাঠানাের প্রয়ােজন নেই। সুতরাং, এই যুক্তি দেওয়া যাবে না যে, অ্যাডভাইজরি বাের্ডের কাছে পাঠানাের আগে আটককৃত ব্যক্তির হেবিয়াস কর্পাস রিট দায়ের করার অধিকার নেই।”
এটাও প্রতীয়মান হয় যে, এই সিদ্ধান্তটি প্রধানত West Pakistan Maintenance of public Order Ordinance, 1960-এর ৩ ধারার অনুবলে জারিকৃত আটকাদেশের যথার্থতা বা যৌক্তিকতা নির্ধারণের সাথে। সম্পর্কিত এবং এখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, যদিও আটককারী কর্তৃপক্ষের আটকাদেশ জারির যথার্থতা বা সন্তুষ্টির কারণ সম্পর্কে প্রশ্ন তােলা যাবে না, তথাপি আদালত যে কারণসমূহ আটকাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তা আটককারী কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করার মতাে কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে পারেন এবং আদালত এই মর্মে অভিমত দেন যে, বক্তৃতার অভিযুক্ত অংশগুলাে আটককারী কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করার মতাে ছিল না।
বক্তৃতাটিকে নির্বাচনী প্রচারণার পটভূমি হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তার মাধ্যমে শান্তিভঙ্গ ঘটানাের মতাে সহিংসতা উসকে দেওয়া হয়নি।
বিষয়টিকে কোনােভাবেই দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়নি।
উপরােক্ত বক্তৃতাংশের সঙ্গে বর্তমান মামলায় তর্কিত বক্তৃতার তুলনা করলে দেখা যায়, বর্তমান বক্তৃতার কথাগুলাে বেশি ক্ষতিকর নয় বটে, তারপরও এখানে দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারার সুনির্দিষ্ট অপরাধ কিংবা অন্য কোনাে অপরাধের জন্য প্রসিকিউশন উত্থাপন করেছে। দণ্ডবিধির অধ্যাদেশের অধীনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার মানদণ্ডসমূহ একই রকম না-ও হতে পারে। অধ্যাদেশের অধীনে আটকের ক্ষেত্রে প্রশ্নটি ছিল আদেশের বৈধতাসংক্রান্ত। এখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কেবল পাকিস্তান দণ্ডবিধির একটি সংজ্ঞাবাচক ধারায় বর্ণিত (substantive section) অথবা অন্য কোনাে অপরাধের জন্য বিচার করা হচ্ছে। মামলার এই অস্পষ্ট পর্যায়ে এই একই প্রকৃতির বক্তৃতার উপর ভিত্তি করে মামলাটি বাতিল (quash) করার জন্য আনীত প্রার্থনা পাবলিক সেফটি অর্ডিন্যান্সকে আকৃষ্ট করার মতাে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে না।
আমরা পিএলডি-র ১৯৬৫ সালের মার্চ সংখ্যায় প্রকাশিত ১৪৫ পৃষ্ঠায় এই রায়ের বাকি অংশ রিপাের্টেড হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। পুরাে রায় সতর্কতার সাথে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আমাদের অভিমত হলাে, দণ্ডবিধির ১২৪ ধারা অনুযায়ী দায়েরকৃত এই মামলা প্রার্থিত মতে বাতিল (quash) করার ক্ষেত্রে রায়টি জনাব পালকে কোনাে সুবিধা প্রদান করেনি। বিচারকার্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বিধায় আমরা এই বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।
৩২৯
বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সারের বক্তব্য মতে আবেদনের অন্যান্য উপাদানে আমরা কিছু অনিয়মের সন্ধান পাই। প্রথমত, একই পিটিশনে একই সময়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ও ৫২৬ উভয় ধারায় প্রতিকার চাওয়া হয়েছে। এটা বেশ অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতীয়মান হয়।
দ্বিতীয় অনিয়ম হলাে, মামলা বদলির বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে যথাযথ নােটিশ প্রদান করা হয়নি। এটা প্রতীয়মান হয় যে, ২১ ডিসেম্বর ১৯৬৪ তারিখে নােটিশ প্রদান করা হয় এবং ঐ দিনই পিটিশন শুনানি করা হয়।
এটা সত্য যে, অপরপক্ষকে না শুনে কেবল গুণাগুণের ভিত্তিতে ঐ পিটিশনটি নিষ্পত্তি করা যায় না। তবে স্বীকৃত বিধান হচ্ছে, বদলির আবেদন শুনানি করার কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা পূর্বে রাষ্ট্রপক্ষকে নােটিশ দিতে হবে।
পিটিশনে এটাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি যে, কী বাতিল (quash) করতে হবে? তা কি প্রাথমিক আদেশ, অর্থাৎ গ্রেফতারি পরােয়ানা এবং মামলা প্রস্তুতকরণ কিনা বা নালিশটি কিনা? নালিশ বাতিল (quash) করা যায় না । আবেদনটি অস্পষ্ট এবং কোনােভাবেই সুনির্দিষ্ট নয়।
আমরা অর্ডার শিটে চারটি আদেশ দেখতে পাই : প্রথম আদেশটি ছিল ৬ নভেম্বর ১৯৬৪ তারিখের, যেখানে দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারার অভিযােগের ভিত্তিতে গ্রেফতারি পরােয়ানা জারি করা হয়। দ্বিতীয় আদেশ ছিল ২০ নভেম্বর ১৯৬৪ তারিখের, যেখানে দেখা যায় আসামি হাজির হয়েছেন এবং প্রসিকিউশন সাক্ষীদের প্রতি সমন জারি করার জন্য ১৯৬৪ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখটি নির্ধারণ করা হয়েছে। ১৯৬৪ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখের আদেশ এবং ১৯৬৪ সালের ২১ ডিসেম্বর তারিখের আদেশে পরিলক্ষিত হয় যে, আসামিপক্ষে সময়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬৪ তারিখ পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করা হয়।
এরকম পরিস্থিতিতে এটা বােঝা খুবই কঠিন, ঠিক কী বাতিল করতে হবে। তাছাড়া, দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারার অভিযােগ প্রতিষ্ঠিত হােক বা না হােক- এ পর্যায়ে মামলাটি বাতিল করা সমীচীন নয়। কারণ এখানে একই প্রকৃতির অপর কোনাে অভিযােগ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এক্ষেত্রে স্বীকৃত বিধান হলাে- বাতিলের মাধ্যমে কোনাে মামলায় হস্তক্ষেপ করা সমীচীন নয়, যদি না মামলাটি একবারেই ভিত্তিহীন কিংবা মামলার বিষয় পুরােপুরি দেওয়ানি দায়সংক্রান্ত কিংবা মামলাটি দেখে অযৌক্তিক বলে প্রতীয়মান হয়।
মামলার কার্যধারা তখনই বাতিল করা যায় যখন কোনাে প্রকার অপরাধই প্রকাশিত হয় না বা যখন মামলাটি দেখে প্রতীয়মান হয় প্রসিকিউশন অভিযােগ প্রমাণে ব্যর্থ হতে বাধ্য কিংবা যখন একই রকমভাবে অন্য কোনাে 2011 Bontott DITO ANCPO 19 1968 Hariram Onkar and others v. Mt. Radha, w/o. Jairam Kunhar A.I. R. 1943 Nag. 327 মামলার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করা হয়েছে।
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ দুর্বল- কেবল এর ভিত্তিতে কোনাে মামলা বাতিল করা যায় না। Nandlal and another v. Emperor, 34 Cr. L. J. 82. মামলায় এরকম রায়ই দেওয়া হয়েছিল।
জনাব পাল অভিযােগ দায়ের প্রসঙ্গেও অভিযােগ উত্থাপন করেন। বক্তৃতা দেওয়া হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ২৯ মার্চ এবং অভিযােগ দায়ের হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ৫ নভেম্বর।
Muhammad Rafi Parvey v. The State, P. L. D. 1960 Lah. (W.P.) মামলার রায়ে দেখা যায় যে, বিলম্বে অভিযােগ দায়ের কোনাে কারণ হতে পারে না, যখন সেটা ঘটে অনুমােদন এবং আইনি মতামত গ্রহণের জন্য। এই মামলায় নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ পরিলক্ষিত হয়েছে :
আদালতে দীর্ঘকাল মামলা বিলম্বকরণ নিঃসন্দেহে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫৬১ক ধারা অনুযায়ী বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার হিসেবে বিবেচিত হবে, যদি তা ঘটে আদালত কর্তৃক অপ্রয়ােজনীয় মুলতুবি আদেশ জারি করার মাধ্যমে, যেখানে অভিযুক্তকে দীর্ঘ কাল হয়রানির শিকার হতে হয়। এরকম
৩৩০
অপ্রয়ােজনীয় মুলতুবির কারণে বিচারিক কার্যপ্রক্রিয়ার অপব্যবহার ঘটে। কিন্তু আইনি অনুমােদন গ্রহণ কিংবা তদন্ত শেষ না হওয়ায় মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হওয়া ভিন্ন বিষয়। এই ধরনের বিলম্ব দ্বারা মামলা দায়ের বাধাগ্রস্ত হলে ফৌজদারি মামলায় তামাদি আইনের প্রয়ােগ দেখা যাবে। হাইকোর্ট নিজস্ব ক্ষমতাবলে ফৌজদারি অপরাধে অভিযােগ দায়ের করার ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট সময় বা কাল সীমিত করে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারেন।
এই মামলায় দেখা যাচ্ছে, মামলার অনুমােদন দেওয়া হয়েছে ১৯৬৪ সালের ২৪ অক্টোবর এবং পরবর্তীকালে অভিযােগ দায়ের করা হয়েছে এর ১২ দিন পর, যা কোনাে অযৌক্তিক বিলম্ব নয়।
এখানে ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্বার কর্তৃক উদ্ধৃত আরেকটি রায় উল্লেখ করা প্রয়ােজন- Jana Syed Muhammad Razi v. Maulana Shabihul Rahman Hasnain and another, P.L.D. 1961 Kar. (W.P.) 220, যেখানে নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় : যদি নথিতে এরকম কিছু থাকে যার মাধ্যমে প্রতীয়মান হয় যে, নালিশে উল্লিখিত অভিযােগসমূহ যখন কোনাে ধরনের অপরাধ প্রকাশ করে না কিংবা মামলায় গৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে কোনাে অপরাধ প্রতিষ্ঠিত হয় না, তখনই ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ৫৬১ক ধারার অধীনে কোনাে ফৌজদারি মামলা বাতিল করা যায়। সেক্ষেত্রে বিচারিক কার্যপ্রক্রিয়ার অপব্যবহার হয়েছে বলা যাবে। কিন্তু নালিশে উল্লিখিত অভিযােগসমূহ প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান হলে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পরীক্ষণীয় নালিশ-বর্ণিত অভিযােগের জবাব দেওয়ার জন্য নিম্ন আদালত অভিযুক্তকে কেবল সমন জারি করলে ৫৬১ক ধারার অধীনে আবেদন অপরিপক্ক বলে বিবেচিত হবে। অভিযােগকারীকে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনের সুযােগ না দিয়ে একটি আপাত যুক্তিযুক্ত নালিশ হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিলের মাধ্যমে উপেক্ষা করা হলে আদালতের কার্যক্রমের অপব্যবহার ঘটবে।
এই প্রসঙ্গে জনাব পাল যুক্তি দিয়েছেন যে, এই মামলায় অন্য কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করার কিছু নেই এবং বক্তৃতাটিই সব।
কিন্তু এই মামলায় এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, নালিশে উল্লিখিত অভিযােগসমূহ প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান একটি মামলার জানান দেয়।
এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্বার Syed Azizuddin v. Bashir Ahmad and two others, P.L.D. 1964 Kar. (W.P.) 102 মামলা উদ্ধৃত করেছেন। এই মামলায় অভিযােগটি দেওয়ানি বিচারকের কাছে ফেরত যায় এবং এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, আবেদনকারীর উচিত ছিল অপেক্ষা করা এবং দায়রা আদালত বা হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশনের মাধ্যমে আশ্রয় গ্রহণ করা। এই রায়ের মাধ্যমে ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সার এই বিষয়ে গুরুত্বারােপ করতে চেয়েছেন যে, যেখানে রিভিশনের বিধান প্রযােজ্য হয়, সেখানে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক। ধারা প্রয়ােগ করা যায় না। তিনি এই মামলায় Muhammad Samiullah Khan v. The State, P.L.D. 1963 S.C.237 মামলায় সুপ্রীম কোর্টের রায় উদ্ধৃত করেন যেখানে সুপ্রীম কোর্ট নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ দেন :
“ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ৫৬১ক ধারার এখতিয়ার একটি বিশেষ প্রকৃতির এখতিয়ার। যেখানে অন্য কোনাে প্রতিকার নেই- এমন বিশেষ ক্ষেত্রেই কেবল এটা প্রয়ােগ করা যায়। এর পরিধি সীমিত এবং ফৌজদারি কার্যবিধিতে অন্য কোনাে প্রত্যক্ষ প্রতিকারের বিধান থাকলে এটা প্রয়ােগ করা যাবে না। এই ধারার অধীনে হাইকোর্ট অন্তর্নিহিত এখতিয়ার প্রয়ােগের ক্ষেত্রে কখনােই আপিল আদালত হিসেবে ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না; তেমনি দণ্ডাদেশ বাড়াতে পারেন না, এমনকি দণ্ডাদেশের পুনর্বিবেচনাও করতে পারেন না। এই ধারার বিধান বিচারিক প্রক্রিয়ার অপব্যবহার রােধ করে। এই ধারায় হাইকোর্টের এখতিয়ার, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৫ ধারা, তৎসহ ৪৩৯ ধারার অধীন হাইকোর্টকে অধস্তন আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোনাে সিদ্ধান্ত, দণ্ডাদেশ বা আদেশের শুদ্ধতা, বৈধতা ও যথার্থতা পরীক্ষা করার যে ক্ষমতা
৩৩১
বা এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে, তার মতাে বিস্তৃত নয়। কেবল ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৯ ধারার অধীনেই এরকম বিস্তৃত এখতিয়ার প্রয়ােগ করা যাবে। এই দুই ধারার অধীনে এখতিয়ারের পরিধি এক নয়। ৪৩৯ ধারার অধীনে হাইকোর্টের রিভিশনাল এখতিয়ার বেশ ব্যাপক এবং কেবল আইনসংক্রান্ত ত্রুটির (errors of law) মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। রিভিশনাল এখতিয়ার প্রয়ােগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট যথাযথ ক্ষেত্রে তথ্যগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন, যেমন- অধস্তন আদালত মামলা প্রমাণের দায় ভুলভাবে নির্ধারণ করেছে বা সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়নে সঠিক নীতি প্রয়ােগ করেনি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনাে সাক্ষ্য বিবেচনা করেনি। এ কাজগুলাে ৫৬১ক ধারার অধীনে হাইকোর্ট করতে পারেন না। এই দুই এখতিয়ার তাই মৌলিকভাবেই আলাদা। প্রকৃতপক্ষে, আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার বিধান এমন একটি বিধান যার বলে বিচারিক অপব্যবহার কিংবা নিশ্চিত অবিচার সংশােধন করা যায়, কিন্তু যেখানে কোনাে মামলা বিবেচনার ক্ষেত্রে এই কার্যবিধিতে নিয়মসিদ্ধ স্পষ্ট বিধান আছে সেখানে এটা প্রয়ােগ করা যাবে না।”
এরকম পরিস্থিতিতে আমরা বাতিল (quash) করার কোনাে যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না।
আবেদনে মামলা-বদলি অংশের গুণাগুণ প্রসঙ্গে আসা যাক। বিকল্প হিসেবে জনাব পাল মামলাটি অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের আদালত থেকে যথাযথ এখতিয়ারসম্পন্ন কোনাে মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে স্থানান্তরের প্রার্থনা করেছেন।
সংক্ষিপ্ত অর্ডার শিট দৃষ্টে প্রার্থিত কালব্যাপী সময় আবেদন নামঞ্জুর ভিন্ন আর কোনাে পক্ষপাত ম্যাজিস্ট্রেটের তরফে পরিলক্ষিত হয় না।
আবেদনে এই আদালতে অপেক্ষমাণ অপর একটি ট্রান্সফার পিটিশনের কথা উল্লেখ আছে। ঐ বিষয়টি পর্যালােচনায় প্রতীয়মান হয় যে, ঐ ক্ষেত্রে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ক ধারার অধীনে আরেকটি পৃথক পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল। তাছাড়া, আগে যেমনটা বলা হয়েছে, ট্রান্সফার পিটিশনের শুনানি করা হয় ১৯৬৪ সালের ২১ ডিসেম্বর, যেটি ছিল প্রকৃতপক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মঞ্জুরকৃত শেষ দিন এবং তা করা হয়েছে সরকারকে যথাযথ নােটিশ না দিয়ে।
তাছাড়া আরও প্রতীয়মান হয় যে, মামলার গুরুত্বের কারণে অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনারের কাছে পাঠানাে হয়েছিল।
এই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন নির্বাসন এবং বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সার উল্লেখ করেছেন, এই অপরাধের বিচার ফৌজদারি কার্যবিধির তফসিল ২ অনুযায়ী কেবল দায়রা আদালত, সিটি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট সম্পন্ন করতে পারেন।
এরকম পরিস্থিতিতে আমরা মনে করি না যে, যথাযথ এখতিয়ারসম্পন্ন মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বদলির মাধ্যমে কোনাে কার্যকর উদ্দেশ্য সাধিত হবে।
ফলে, রুলটি খারিজ করা হলাে এবং স্থগিতাদেশ বাতিল করা হলাে।
যেহেতু এই মামলায় দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারাকে সংবিধানে সুরক্ষিত ৯ নম্বর মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন হিসেবে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা জড়িত রয়েছে, সেহেতু সংবিধানের ৫৮(২)(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সার্টিফিকেট মঞ্জুর করা হলাে।
বিচারপতি এ. সােবহান চৌধুরী
আমি একমত।
৩৩২
[৬]
পল্টন ময়দানে ২০ মার্চ ১৯৬৬ তারিখের বক্তৃতা সম্পর্কিত মামলা : শেখ মুজিবুর রহমান বনাম রাষ্ট্র (১৯৬৭ সালের ৭৬০ নম্বর ক্রিমিনাল রিভিশন)
রায়টির সারাংশ
ঘটনার (ফ্যাক্টস) সারসংক্ষেপ
২০.৩.৬৬ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ভাষণ প্রদান করেন। প্রায় ১৫,০০০ হাজার লােক এই জনসভায় অংশগ্রহণ করেন। রমনা পুলিশ স্টেশন, ঢাকা-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বক্তৃতাটিকে ক্ষতিকর বিবেচনা করে ১৭.৪.৬৬ তারিখে একটি এজাহার দায়ের করেন, যেখানে তিনি অভিযােগ করেন যে, উক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে অভিযুক্ত-আবেদনকারী (শেখ মুজিব) পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা-এর ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (এ) (ঐ) ও (ঘ) দফার বিধানাবলি লঙ্ঘন করেছেন এবং তার মাধ্যমে ৪৭ বিধির (৫) উপবিধির অধীনে শাস্তিযােগ্য অপরাধ করেছেন। স্থানীয় পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে এবং তদন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর অভিযুক্ত-আবেদনকারীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭ বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলগেটে দেশরক্ষা আইনের ৪৭(৫) বিধি মােতাবেক শেখ মুজিবকে ১৫ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৭ নভেম্বর ১৯৬৭ মঙ্গলবার ঢাকার অতিরিক্ত দায়রা জজ কায়সার আলী শেখ মুজিবের দণ্ডাদেশ বহাল রাখেন, তবে ন্যায়বিচারের খাতিরে ১৫ মাসের বদলে ৮ মাসের দণ্ডাদেশ প্রদান। করেন। শেখ মুজিব দণ্ডাদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন এবং রুল অর্জন করেন।
আদালতের রায়
আদালত রায়ে দোষীসাব্যস্তকরণ (কনভিকশন) আদেশ বাতিল করেন এবং শেখ মুজিবকে অভিযােগ থেকে অব্যাহতি দেন। রায়ে বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা সম্পর্কে তার মতামত পেশ করেছেন, যা সংবিধান অনুযায়ী তার অধিকারের মধ্যে পড়ে। তিনি বক্তৃতার কোথাও কোথাও আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার করেছেন যা হয়তাে অস্বস্তিকর ছিল, কিন্তু তা কোনােভাবেই বিধিমালার ৪১(৬) বিধি অনুযায়ী ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের আওতায় পড়ে না। তিনি বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন তাঁর দলের ছয় দফা কর্মসূচি প্রসারের অংশ হিসেবে। সুতরাং, এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই যে, তিনি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তৃতার কোনাে কোনাে অনুচ্ছেদে কিছু অনুদার মন্তব্য করেছেন এবং কোথাও কোথাও কঠোর ও দুঃখজনক ভাষা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু বক্তৃতার অন্যান্য অংশের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে তার একটা কৈফিয়তও পাওয়া যাবে। আইন অনুমােদিত সীমার মধ্যে বিরােধীদলীয় কার্যক্রম এবং কিছুটা চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সরকারের জন্য যতই অস্বস্তিকর হােক না কেন- কেবল এজন্য বক্তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনাে যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
৩৩৩
রায়টির পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ
পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট
(ফৌজদারি রিভিশন অধিক্ষেত্র)
শেখ মুজিবুর রহমান
••••••••• পিটিশনার
বনাম
রাষ্ট্র
•••••••••• রেসপনডেন্ট
(১৯৬৭ সালের ৭৬০ নম্বর ক্রিমিনাল রিভিশন07)
রায় প্রদানের তারিখ : ০৬.০৫.১৯৬৯
বিচারপতি
বিচারপতি আবদুল হাকিম
পিটিশনার পক্ষের আইনজীবী
সিরাজুল হক,
আবুল হােসেন,
এম. এ. মান্নান,
সিদ্দিকুর রহমান হাজরা,
এইচ. কে. আবদুল হাই এবং
তাজউদ্দীন আহমদ
রেসপনডেন্ট পক্ষের আইনজীবী
এ. টি. এম. মাসুদ, ডেপুটি লিগ্যাল রিমেমব্রান্সর
রায়
বিচারপতি আবদুল হাকিম
১. পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা, ১৯৬৫ (এরপর থেকে বিধিমালা’ হিসেবে উল্লিখিত হবে)-এর ৪৭(৫) বিধির সাথে পঠিত ৪১(৬) বিধির অধীনে প্রদত্ত দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে দরখাস্তকারী এই রুল প্রাপ্ত হন।
……………………………………………………………..
07. Sheikh Mujibur Rahman Vs. The State. 21 DLR (1969) 810.পল্টন ময়দান বক্তৃতা মামলা, ২০ মার্চ ১৯৬৬, (১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বক্তৃতার জন্য মামলা)
৩৩৪
২. সংক্ষিপ্ত ঘটনা হলাে: ২০.৩.৬৬ তারিখে দরখাস্তকারী জনাব শেখ মুজিবুর রহমান আউটার স্টেডিয়ামে যা সাধারণভাবে পল্টন ময়দান হিসেবে পরিচিত- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়ােজিত এক জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন। প্রায় ১৫,০০০ হাজার লােক এই জনসভায় অংশগ্রহণ করেন। রমনা পুলিশ স্টেশন, ঢাকা-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বক্তৃতাটিকে ক্ষতিকর বিবেচনা করে ১৭.৪.৬৬ তারিখে একটি এজাহার দায়ের করে এই অভিযােগ করেন যে, উক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে অভিযুক্ত-দরখাস্তকারী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (জি), (এইচ) ও (এন) দফার বিধানাবলি লঙ্ঘন করেছেন এবং তার মাধ্যমে ৪৭ বিধির (৫) উপবিধির অধীনে শাস্তিযােগ্য অপরাধ করেছেন। স্থানীয় পুলিশ ঘটনার তদন্ত করে এবং তদন্তসম্পন্ন হওয়ার পর অভিযুক্ত-দরখাস্তকারীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এরপর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৪৭ বিধির (৫) উপবিধির অধীনে আনা অভিযােগের বিচারের জন্য তাকে ঢাকার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আহমদের আদালতে হাজির করা হয়।
৩.আনীত অভিযােগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত ব্যক্তি [শেখ মুজিবুর রহমান] দাবি করেন যে, তিনি ৪১(৬) বিধির আওতায় পড়ে এমন কোনাে অপরাধ করেননি। তিনি দাবি করেন যে, তাঁর বক্তৃতায় আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ বা অসন্তোষ জাগিয়ে তােলা, পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও শত্রুতার মনােভাব সৃষ্টি করা, জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বা দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে জনগণের আচরণ ও মনােভাবকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নীতিমালার বস্তুনিষ্ঠ সমালােচনা করেছেন এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ এবং দুই অংশের জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ভ্রাতৃত্ববােধ সমুন্নত রাখা এবং দুই অংশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণের জন্য পর্যাপ্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন।
৪. সরকারপক্ষে ১৩ জন সাক্ষীকে পরীক্ষা করা হয় এবং আসামিপক্ষে কোনাে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়নি। আদালতে কিছু দলিলাদিও উপস্থাপন করা হয়। বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষ্য-প্রমাণ ও নথিতে থাকা তথ্যাদি বিচার করার পর অভিযুক্ত-দরখাস্তকারীকে উপরােক্ত বিধিমালার ৪৭(৫) বিধির সাথে পঠিত ৪১(৬) বিধির অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ১৫ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। আপিলে ঢাক বিজ্ঞ অতিরিক্ত দায়রা জজ, তৃতীয় আদালত, দণ্ডাদেশ ১৫ মাস থেকে কমিয়ে ৮ মাস করেন। সংক্ষুব্ধ দরখাস্তকারী [শেখ মুজিবুর রহমান] বর্তমান আদালতের শরণাপন্ন হন এবং উক্ত দোষীসাব্যস্তকরণের যথার্থতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তােলেন।
৫. মামলার শুনানির একেবারে শুরুতেই বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সার উল্লেখ করেন যে, প্রাদেশিক সরকার ২০.৩.৬৯ তারিখের 2P-17/69/274-Jud (IV) নম্বর স্মারকের অধীনে দরখাস্তকারীর [শেখ মুজিবুর রহমান] শাস্তির মেয়াদ উল্লেখযােগ্য পরিমাণ মওকুফ করে ইতােমধ্যে যে মেয়াদ সাজা খেটেছেন সেই পর্যন্ত কমিয়ে এনেছেন এবং সরকার কর্তৃক এই দণ্ড লাঘব হয়েছে বিধায় রিভিশনাল এখতিয়ার প্রয়ােগ করে ঘটনার গভীরে প্রবেশ করা এবং অধস্তন দুই আদালতের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করা হাইকোর্টের উচিত হবে না।
৬. অন্যদিকে দরখাস্তকারীর [শেখ মুজিবুর রহমান] আইনজীবী দাবি করেন যে, শাস্তি লাঘবের আদেশ জারির অনেক আগেই দণ্ডাদেশ চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল বিধায় এই আদালত ব্যাপারটির গভীরে প্রবেশ করতে পারেন এবং উপরােক্ত বিধিমালার ৪১(৬) বিধির অর্থানুযায়ী উক্ত বক্তৃতার মাধ্যমে কোনাে অপরাধ
৩৩৫
সংঘটিত হয়েছে কিনা তা দেখতে পারেন। তিনি বলতে চান যে, উপরােক্ত বক্তৃতাটি আইনের সীমার মধ্যেই করা হয়েছে এবং বক্তৃতার উপাদান বিধিমালার ৪১(৬) বিধির অধীনে কোনাে অপরাধ সংঘটন করে না। সুতরাং, ৪৭(৫) বিধির অধীনে অভিযুক্ত-দরখাস্তকারীকে দোষীসাব্যস্তকরণ অবৈধ এবং দণ্ড লাঘবের মাধ্যমে সেই অবৈধতা সারানাে যায় না। এই মামলায় যে বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে তা নিতান্ত আইনি প্রশ্ন হওয়ায় দণ্ডাদেশ কমানাের আদেশ আদালতকে সেই বিষয়টি বিবেচনা করা থেকে বিরত রাখতে পারে না এবং এই আদালত দোষীসাব্যস্তকরণের বৈধতার প্রশ্নটি নিরূপণ করতে সক্ষম।
৭. এই বিষয়ে নথিতে বিস্তর সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, অভিযুক্ত দরখাস্তকারী [শেখ মুজিবুর রহমান] ২০.৩.৬৬ তারিখে ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করেছেন। বক্তৃতাটি বাংলায় দেওয়া হয়, সরকারি রিপাের্টারগণ তা রেকর্ড করেন। দরখাস্তকারী শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা লিপিবদ্ধকারী ৩, ৪ ও ৫ নম্বর প্রসিকিউশন সাক্ষী তাদের রেকর্ডকৃত বক্তৃতাটির শর্টহ্যান্ড নােটের সত্যতা প্রতিপন্ন করেছেন। ৩, ৪ ও ৫ নম্বর প্রসিউকিশন সাক্ষী কর্তৃক রেকর্ডকৃত উক্ত শর্টহ্যান্ড নােটগুলাে ৬ নম্বর প্রসিকিউশন সাক্ষী প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যয়ন করেছেন। ২, ৮, ৯, ১০, ১১ ও ১২ নম্বর প্রসিউকিশন সাক্ষী জনসভায় উপস্থিত ছিলেন; বক্তৃতাটি শুনেছেন এবং সবাই সমভাবে উল্লেখ করেছেন যে, অভিযুক্ত-দরখাস্তকারী [শেখ মুজিবুর রহমান] সেদিন বাংলায় খুবই অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এটাও তারা অস্বীকার করেননি যে, তর্কিত বক্তৃতাটি অভিযুক্ত দরখাস্তকারীই প্রদান করেছেন।
৮. উভয় অধস্তন আদালতই তাদের রায়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করেছেন এবং এই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, অভিযুক্ত-দরখাস্তকারী প্রকৃতপক্ষেই প্রসিকিউশনের অভিযােগকৃত জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে অধস্তন দুই আদালতের সিদ্ধান্তের বিপরীত মতামত দেওয়ার কোনাে কারণ নেই।
৯. ২০.৩.৬৬ তারিখে ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত জনসভায় দরখাস্তকারী শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত বক্তৃতা নিম্ন আদালত ইংরেজিতে অনুবাদ করলে উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ তা সংশােধন করেন, যা নিম্নরূপ :
(১) বন্ধুরা, বাতাস এবং ঝড়ের কারণে আপনারা আজ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন, পরীক্ষা এবং সংকটের/দুর্দশার মধ্য দিয়েই মানুষের দাবি সুরক্ষিত হয়। এখন কোনাে আবেগ দেখানাে বা জ্বালাময়ী বক্তব্য দেওয়ার সময় না। আজ এটি পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ কোটি মানুষের বাঁচার প্রশ্ন। বন্ধুরা, হঠাৎ করেই রাষ্ট্রপতি সাহেব শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। ছয় দফায় এমন কী আছে যে সকলেই একসাথে এটির উপর আঘাত হানছে? আপনারা সহজেই বুঝতে পেরেছেন যে, আঠারাে বছর ধরে জনগণ শােষিত হচ্ছে। আবার সেই শােষকেরা মাঠে নেমেছে। আমার কারাে সাথে কোনাে ব্যক্তিগত বিরােধ নেই। আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন ৬ দফায় কী আছে।।
(২) দফাগুলাের মধ্যে একটি হলাে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই যে আইয়ুব সাহেব রাগান্বিত হবেন। দ্বিতীয় দফাটি হচ্ছে, যে করসমূহ এতদিন কেন্দ্র থেকে আদায় করা হয়েছে, সেগুলাে যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আদায় করবে। আঠারাে বছর ধরে সমস্ত সম্পদের ক্ষেত্রে এ শােষণ চলছে। আমরা জানতে চাই কী পরিমাণ অর্থ আপনারা খরচ করেছেন এবং কী পরিমাণ অর্থ আমরা খরচ করেছি। আমরা বৈদেশিক লেনদেনের ৭০ শতাংশ উপার্জন করি।
৩৩৬
গত ১৮ বছর ধরে আমাদের জনগণকে শােষণ করা হচ্ছে। আমরা জানি না কীভাবে এবং কোথায় এ অর্থ খরচ করা হয়েছে। সুতরাং, আমি বলছি যে, পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানকে দেওয়া উচিত এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানকে দেওয়া উচিত। এই সম্মিলিত অর্থ থেকে যে পরিমাণ অর্থ কেন্দ্রের প্রয়ােজন, তা আমরা দিব।
ভাইয়েরা, আজকে পূর্ব পাকিস্তান একটি বাজারে পরিণত হয়েছে। আমার বক্তব্যের মূল কথা হচ্ছে যে, বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই পূর্ব পাকিস্তান অর্জন করেছে। প্রত্যেক প্রদেশের বাণিজ্যিক প্রতিনিধি পাঠানাের বিধান অস্ট্রেলিয়ার সংবিধানে রয়েছে। আইয়ুব সাহেব প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছেন। যখনই আমি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কিছু চেয়েছি, আমি তার কাছ থেকে বিশ্বাসঘাতক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীর অপবাদ ছাড়া কিছুই পাই নাই। ফজলুল হক জেলে ছিলেন, সােহরাওয়ার্দীকেও জেলে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাংলার যুবকদের জীবন দিতে হয়েছে। তবে আমাদের দাবি মানতে হয়েছে। আমার প্রিয় বন্ধুরা, তাই আমি বলছি, কেন আপনারা বিক্ষুব্ধ হচ্ছেন? ঠিক আছে, বসুন। পাকিস্তান রাশিয়ার চেয়ে দুর্বল নয়, যেই রাশিয়াকে আমেরিকাও মাঝেমধ্যে ভয় পায়। ইউক্রেন এবং বাইলাে-রাশিয়া নামে রাশিয়ায় দুইটি প্রদেশ আছে। তারা যদি ইচ্ছা করে তবে তাদের অধিকার আছে জাতিসংঘে নিজেদের প্রতিনিধি পাঠানাের। আমরা কি বলতে পারি যে রাশিয়া এ কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে ?
(৩) আমি আইয়ুব সাহেবকে একটি প্রশ্ন করতে চাই। আপনি কি ১৭ দিন যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানে আসতে পেরেছেন? আপনার সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী কি সেখানে পাঠানাে হয়েছে? কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকা সত্ত্বেও, একমাত্র আল্লাহর রহমত পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচিয়েছে। আপনারা লাহাের সীমান্তকে রক্ষা করতে পারেননি কোথায় দিল্লি? আমি আইয়ুব সাহেবকে একটি প্রশ্ন করতে চাই, তবে কীভাবে জোর করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন সেই প্রশ্ন না। আমি আইয়ুব সাহেবের কাছে নিবেদন করতে চাই যে, ৫৬ শতাংশ জনগণ পূর্ব পাকিস্তানি হওয়া সত্ত্বেও আপনি একের পর এক করাচি, রাওয়ালপিন্ডি এবং ইসলামাবাদে রাজধানী স্থাপন করেছেন। প্রতিরক্ষা পরিষেবার সদর দপ্তরগুলাে করাচি, পেশওয়ার এবং রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত। পূর্ব পাকিস্তানে কতগুলাে ভাঙা বিমান ছিল? পূর্ব পাকিস্তানে কী ছিল; এটা জানলে আপনি আশ্চর্যান্বিত হয়ে যাবেন। বাংলায় কেবল আর্মির ডিভিশন ছিল। সেখানে কেবল অল্প কিছু বিমান এবং যুদ্ধজাহাজ ছিল। আপনি কি পূর্ববাংলায় এসেছিলেন?
(৪) বন্ধুরা, বৃষ্টি শুরু হয়েছে কিন্তু দয়া করে আপনারা উঠে যাবেন না। ত্যাগ এবং বারবার চেষ্টা ছাড়া কোনাে জাতিই তাদের দাবি-দাওয়া আদায় করতে পারে না। শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে ছয় দফার দাবিগুলাে আদায় করা হবে। আপনাদেরকে আমার বলার অনেক কিছু ছিল। প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি কেন্দ্রের হাতেই থাকবে। প্রতিরক্ষার দায়িত্ব যেই কর্তৃপক্ষের উপর থাকে তারা শক্তিশালী হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানিদের নিয়ে গঠিত ইপিআর এবং রেঞ্জার্স অফ ওয়েস্ট পাকিস্তানের মতাে একটি আঞ্চলিক সেনাবাহিনী থাকা উচিত। উভয় প্রদেশেই আঞ্চলিক সেনাবাহিনী থাকা উচিত। বাংলা একত্রকরণের দাবি করায় আপনি সােহরাওয়ার্দীর সমালােচনা করেছেন। কিন্তু আমাদের দাবি ছিল সম্পূর্ণ বাংলা এবং
৩৩৭
আসাম। আপনি তখন ইংরেজদের স্যালুট করতেন। সুতরাং, যদি সােহরাওয়ার্দী এমন কিছু চেয়ে থাকেন তিনি কোনাে ভুল করেননি এবং আপনার কোনাে কারণ নেই তাকে সমালােচনা করার। আপনি তখন একজন লেফটেন্যান্ট মাত্র। সােহরাওয়ার্দী এখন মৃত। সুতরাং, এই গল্পটি পুনরাবৃত্তি করা অসার। আপনি ফজলুল হককে গ্রেফতার করেছেন। আজ আইয়ুব একা চিন্তিত নন। চৌধুরী মােহাম্মদ আলী এসেছিলেন। তিনি ছিলেন বাঙালিদের দুর্ভোগের মূল কারণ। বাংলার জন্য তার অনুভূতি রয়েছে, এমন ভনিতাও তিনি করেন। মওদুদী এসেছেন, আমি তাকে প্রশ্ন করতে চাই গত আঠারাে বছর ধরে যে অর্থ পূর্ব পাকিস্তান থেকে নেওয়া হয়েছে, তা তিনি ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত কি না।।
(৫) আঠারাে বছর ধরে দাবি-দাওয়া আপনাদের সামনে পেশ করা হয়েছে, কিন্তু আপনারা কখনােই আমাদের সুযােগ-সুবিধার প্রতি নজর দেননি। আমরা পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছি এবং আমরা পাকিস্তানকে ভালােবাসি। আমি আপনাদের অনুরােধ করছি, দয়া করে আপনারা পাকিস্তান বিভাজনের কারণ হবেন না। |
(৬) মুদ্রার বিষয়টিও ছয় দফায় রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে স্বর্ণের মূল্য ১৫০ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে স্বর্ণের মূল্য ১২০ টাকা। এর উপর কাস্টমস চার্জ রয়েছে। যে দ্রব্যটি পূর্ব পাকিস্তানে ৫ টাকায় বিক্রি হয়, সেটি পশ্চিম পাকিস্তানে ২ টাকায় বিক্রি হয়। আমি জানতে চাই এর কারণ কী? এবং পূর্ব পাকিস্তানে অনেক বড় শিল্পপতিরা আছেন যারা তাদের আয় নিয়ে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। এই অর্থপাচার বন্ধ করতেই হবে।
ভাইয়েরা, আমরা বহু দিন ধরে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসছি। ১৯৪৯ সালে আমি যখন এই দাবি তুলেছিলাম, তখন আমাকে আড়াই বছর জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। আমি যখন ছয় দফার কথা বলছি তখন আমি স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার কথা বলছি। অন্যথায় বাংলা বাঁচবে না। মিষ্টি কথায় আমাদের পেট ভরবে না। ১৭ দিনের যুদ্ধের সময়ে আপনি এখানে আসতে পারেননি। নিজেদের শক্তির উপর আমাদের নির্ভর করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে নাগরিক ভারতের দখল সহ্য করবে না। রাষ্ট্রপতি আমাদের বলেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার উপর নির্ভরশীল। আমি বলব যে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পূর্ব পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল। তারা দুটো সুবিধা ভােগ করে আসছে। ৬২% অর্থ খরচ করা হয় কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এবং ৩২% অর্থ খরচ করা হয় প্রশাসনের জন্য। আমরা কতটুকু পাই? আমরা ৫৬ শতাংশ মানুষ, আপনারা ৪৪। এটা কি ন্যায়বিচার? আমি নিশ্চিত যে যদি কেন্দ্রীয় রাজধানী, সশস্ত্র বাহিনীর ৩ সদর দপ্তর, সব বিদেশি মিশন, স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে থাকত, তাহলে আমরা আঠারাে বছর ধরে যে দাবি-দাওয়া করছি, তার চেয়ে আপনাদের দাবি-দাওয়া অনেক বেশি হতাে। যদি বিমান বাহিনীর সদর দপ্তর এখানে অবস্থিত হতাে, যদি নৌবাহিনীর সদর দপ্তর চিটাগংয়ে থাকত এবং যদি সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর কুর্মিটোলায় থাকত, যদি এত পরিমাণ অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে খরচ করা হতাে, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা ৬ দফার বেশি দাবি তুলত।
(৭) একটা রাষ্ট্র চালানাের জন্য ৫টি জিনিস প্রয়ােজনীয়। রাজধানী, কেন্দ্রীয় প্রশাসন এবং আর্থিক সম্পদ, সমস্ত কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। সামরিক সদর দপ্তরও পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। মূলধন গঠনও পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। আমরা একটা বাজার ছাড়া কিছুই না। আমরা বাজার হতে চাই না, আমরা পাকিস্তানের নাগরিক হতে চাই। পূর্ব পাকিস্তানের একটি জিনিস
৩৩৮
আছে, তা হলাে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রদেশের কার্যসমূহ পরিচালনা করা। আইয়ুব সাহেব সামরিক আইন প্রচারের পরে আমাদের একটি সংবিধান দিয়েছেন। বাংলায় এর অবস্থান কী? আমি পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের প্রতি নিবেদন করছি আমাদের দুর্ভোগ অনুধাবনের জন্য। আমরা বৈদেশিক মুদ্রার ৭০% আয় করি। আমরা পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চাই। আমি আপনাদের সাথে এ আয় ভাগ করার বিষয়ে বিদ্বেষ পােষণ করছি না। আমরা আপনাদেরকে এ আয়ের একটি অংশ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার অংশ কত আমি জানতে চাই। আমাদের দুর্দশার কথা আপনারা শুনবেন না? দয়া করে মনে রাখবেন, কেন্দ্রে কিংবা আইয়ুব সাহেবের হাতে সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করে পাকিস্তান শক্তিশালী হবে না।
(৮) পাকিস্তানকে শক্তিশালী করতে হলে, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান, উভয়কেই শক্তিশালী করতে হবে। পাকিস্তানকে শক্তিশালী করতে হলে, পূর্ব পাকিস্তানকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে। সমস্ত ক্ষমতার ভান্ডার হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের দুর্দিনে আপনারা আমাদের পাশে দাঁড়াননি।
(৯) বক্তব্য দেওয়ার সময় রাষ্ট্রের প্রধানের সংযত হওয়া উচিত। তিনি আমাদের গালি দিয়ে বলেন যে, আমরা নাকি জাতি হিসাবে দাস ছিলাম। কীভাবে তার এত সাহস হয়? (বৃষ্টি শুরু হওয়ায় দর্শকের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়)। আমি আপনাদের বলব যে আমাদের শােষণ করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে বিড়ি পাতার প্রবেশ নিষিদ্ধ, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এগুলাে ঢুকতে পারে। আপনারা শুনে থাকবেন যে আমাদের চোরাচালানকারী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে স্বর্ণ আনা যায় না। কিন্তু যুদ্ধের সময় খেম কেরান শহরে ৪০ হাজার বস্তা গম পাওয়া গিয়েছে। এগুলাে কি তাহলে আরব সাগর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে?
(১০) যদি আপনারা ৬ দফা সমর্থন করে থাকেন, তাহলে সংগ্রামের জন্য এবং জেলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। যদি আপনারা প্রস্তুত থাকেন, তবে হাত তুলুন এবং আইয়ুব খানকে দেখান।
(১১) বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি জানি, আইয়ব সাহেব বলেছেন তিনি আমাদের। করে দিবেন এবং অত্যাচার করবেন।
(১২) আমি জানি তিনি আমাদের জেলে ঢােকাবেন, কিন্তু জেলে ঢুকিয়ে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের দাবি দমন করা যাবে না। সুতরাং ভাইয়েরা, ত্যাগ এবং সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হন।
(১৩) আমি বলছি যে আওয়ামী লীগের কোনাে কর্মীকে যদি স্পর্শ করা হয়, তাহলে আমরা পূর্ববাংলার সমস্ত কারাগার ভর্তি করে ফেলব। সে আমাদের অত্যাচার করবে। আমার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা আছে। কিন্তু মৃত্যু আল্লাহর হাতে। যদি আমার মৃত্যু ঘটানাের ক্ষমতা আইয়ুব খানের থাকত, তাহলে সামরিক আইনের শাসনের সময় তিনি তা করতে পারতেন। তাই আপনারা গ্রামে চলে যান, আমাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি নিন। এ শােষণ বন্ধ করতে হবে। জনগণের মুক্তি অর্জন করতে হবে। এ ৬ দফা পাকিস্তানের জনগণের ম্যাগনা কার্টা।
(১৪) আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়গুলি উল্লেখ করি। ভােগ্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কী আছে?
(১৫) আমাদের সর্বোচ্চ শােষণ করা হয়েছে। আমরা অনেক চিন্তা করে প্রােগ্রামগুলাে নিয়ে এগিয়েছি। আমি আপনাদের আবার ডাকবাে, যদি সরকার অনুমতি দেয়। আমি আমার সহকর্মীদের অনুরােধ করবাে শান্তিপূর্ণভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে নেওয়ার জন্য। আপনারা ভিজে গিয়েছেন এবং এমতাবস্থায় সভা চালিয়ে যাওয়া অসুবিধাজনক হবে। সভা বন্ধ করা হলাে।
৩৩৯
(১০). বক্তৃতাটি নিঃসন্দেহে দীর্ঘ। অভিযােগ গঠন থেকে দেখা যায়, সরকার বক্তৃতার ১৫টি ভিন্ন ভিন্ন অংশকে আপত্তিকর বিবেচনা করে সেগুলাে বিচারে ন্যস্ত করেছে। যে অংশগুলাের ব্যাপারে আপত্তি তােলা হয়েছে তা আমি রেখাঙ্কিত করেছি। প্রসিকিউশনের মতে, নিম্নরেখাঙ্কিত অংশগুলাে উপরােক্ত বিধিমালার ৪১ বিধির (ই) (জি) (এইচ) ও (এন) দফার অধীনে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে।
(১১) বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ, ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখেছেন যে, অভিযুক্তের [শেখ। মুজিবুর রহমান] বক্তৃতা ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (ই) (জি) (এইচ) ও (এন) দফা লঙ্ঘন করেছে এবং প্রসিকিউশনের অভিযােগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি সেই মােতাবেক সিদ্ধান্ত দেন যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি বক্তৃতার মাধ্যমে আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি এবং অসন্তোষের মনােভাব জাগিয়ে তােলা এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণার মনােভাব উসকে দেওয়া, জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক জাগিয়ে তােলা এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমনভাবে জনগণের কর্মকাণ্ড ও মনােভাবকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন।
(১২) আপিল-আদালত বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পােষণ করেননি। বিজ্ঞ বিচারক কেবল এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, বক্তৃতাটি আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষের মনােভাব সৃষ্টি করার মতাে ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানি শ্রোতাদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা-উভয় দিক নিয়ে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করার মতাে ছিল। ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (জি) দফার অধীনে আনীত অভিযােগের ব্যাপারে গৃহীত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তিনি বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করেন। এবং পর্যবেক্ষণ দেন যে, বক্তৃতাটি বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণার মনােভাব উসকে দেওয়ার মতাে মর্মে বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। এছাড়া তিনি তাঁর রায়ে ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (এন) দফার উপাদান নিয়েও কিছু বলেননি এবং সেজন্য বক্তৃতাটি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ব্যাপারে জনগণের কর্মকাণ্ড ও মনােভাবকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছিল- এই অভিমতের সঙ্গেও দ্বিমত পােষণ করেছেন। (এন) দফার ব্যাপারে দরখাস্তকারীর আইনজীবী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী উভয়ই দাবি করেন যে, মামলার ঘটনা বিবেচনায় ওই দফা কোনােভাবে প্রযােজ্য নয়, কারণ উক্ত বক্তৃতার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বা যুদ্ধ কার্যকরভাবে পরিচালনার কোনাে সম্পর্ক নেই।
আমি নিজেও (এন) দফার উপাদানসমূহ যত্নসহকারে পরীক্ষা করেছি এবং আমার মনে হয়েছে এটা যথার্থভাবেই দেখানাে হয়েছে যে, তর্কিত বক্তৃতাটি উক্ত ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (এন) দফাকে কোনােভাবেই আকৃষ্ট করে না। ফলে, বিজ্ঞ বিচারকের পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে কেবল দুটি বিষয় বিবেচনার বাকি থাকে এবং সেগুলাে হলাে (ই) ও (এইচ) দফা। আমার জন্য বিবেচ্য প্রশ্ন হলাে তর্কিত
আদেশটি ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (ই) ও (এইচ) দফার বিধানাবলি লঙ্ঘন করে কিনা।
(১৩). শুরুতেই এটা উল্লেখ করা উচিত যে, এজাহারে প্রসিকিউশন ৪১(৬) বিধির (ই) দফা লঙ্ঘনের ব্যাপারে কোনাে অভিযােগ করেনি। ঘটনার এক মাস পরে দায়েরকৃত এজাহারে এরকম কোনাে অভিযােগ ছিল না যে, বক্তৃতায় ঘৃণা, বিদ্বেষ সৃষ্টি করা ও পাকিস্তানে আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ উসকে দেওয়ার কোনাে উদ্দেশ্য ছিল। (ই) দফার অভিযােগটি পরবর্তীকালে বিচার চলাকালে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযােগ গঠনের সময় যােগ করা হয়। এজাহারে (ই) দফার উল্লেখ না থাকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং ব্যাখ্যাবিহীন এই গুরুতর বিষয় অনুল্লেখের বিষয়ে আদালত বিচারিক গােচরে নিতে পারে না। মনে হয়, প্রসিকিউশন শুরুতে (ই) দফার প্রযােজ্যতার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না এবং সে কারণেই দ্বিতীয় বার চিন্তা করে পরবর্তীকালে তা যােগ করেছে।
৩৪০
১৪. যা হােক, যেহেতু দুই অধস্তন আদালতই অভিযুক্ত-দরখাস্তকারীকে [শেখ মুজিবুর রহমান] (ই) ও (এইচ) দফা লঙ্ঘনের জন্য দোষী-সাব্যস্ত করেছেন, সেহেতু আমাকে দেখতে হবে প্রসিকিউশন এই দুই দফা অনুযায়ী অভিযােগ কতটা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (ই) ও (এইচ) দফা নিম্নরূপ :
(৬) ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড’ বলতে এমন কোনাে কর্মকাণ্ডকে বােঝায় যার অভিপ্রায় নিম্নরূপ হয় কিংবা যা নিমােক্ত পরিস্থিতির কারণ হতে পারে –
(ই) ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করা, কিংবা পাকিস্তানে আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জাগিয়ে তােলা;
(এইচ) জনগণ বা জনগণের কোনাে একটি অংশের মনে ভয় আতঙ্ক সৃষ্টি করা।
(ই) দফায় ব্যবহৃত “ঘৃণা”, “বিদ্বেষ” ও “অসন্তোষ” শব্দসমূহ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং কোন প্রেক্ষাপটে তা ব্যবহার করা হচ্ছে সেই অনুযায়ী বিশেষ ব্যাখ্যার অবকাশ থাকে। এসব শব্দ কোনাে সংবিধিবদ্ধ বইয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি, কিন্তু বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে আদালত কর্তৃক স্পষ্ট হয়েছে। আমরা এসব শব্দের সবচেয়ে নতুন ব্যাখ্যা ও অর্থ খুঁজে পাই Tofazzal Hossain vs. Province of East Pakistan and ors. (1) 17 DLR 498 মামলায়।
১৫. “ঘৃণা” হলাে দীর্ঘ দিনের জমানাে তিক্ত বিতৃষ্ণা ও অপছন্দের অনুভূতি, যার সঙ্গে সাধারণত যােগ হয় আঘাত, ধ্বংস বা পরিত্রাণের (to injure, destroy or get rid of its object) আকাক্ষা; অন্যকে নীচ, হীন ও অযােগ্য হিসেবে দেখাকে “বিদ্বেষ” হিসেবে অভিহিত করা হয়। “অসন্তোষ” শব্দের অর্থ ও আওতাভুক্ত হলাে- আনুগত্যহীনতা এবং শত্রুতা ও ঘৃণার খারাপ মনােভাব।
১৬. (এইচ) দফায় ব্যবহৃত ভয় ও আতঙ্ক’ শব্দসমূহ খুবই সরল-অর্থবােধক এবং কোনাে ব্যাখ্যার প্রয়ােজন নেই। এক্ষেত্রে একমাত্র বিচার্য হলাে কোনাে কাজের মাধ্যমে কোনাে যুক্তিবােধসম্পন্ন মানুষ ভীত বা আতঙ্কগ্রস্ত হবেন কিনা। অভিযুক্ত-দরখাস্তকারীর উদ্ধৃত বক্তব্যকে উপরােক্ত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে।
১৭. আগেই বলা হয়েছে, অধস্তন আপিল-আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হননি যে, বক্তৃতাটি আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যপূর্ণ ছিল। আদালত কেবল এই মত দিয়েছেন যে, বক্তৃতাটি সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষের মনােভাব জাগিয়ে তুলতে পারে এবং তা পূর্ব পাকিস্তানিদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। কাজেই এটা দেখা দরকার যে, উপরে উদ্ধৃত বক্তৃতা ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (ই) ও (এইচ) দফার অধীনে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষের মনােভাব জাগিয়ে তুলেছে কিনা এবং তা পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে কিনা।
১৮. আমি ইতােমধ্যেই উল্লেখ করেছি যে, সরকার বক্তৃতার বিভিন্ন অংশ থেকে মাত্র ১৫টি বিষয়কে আপত্তিকর বিবেচনা করেছে এবং সেগুলাে অভিযােগে উল্লেখ করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার অধীনে অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তা উপস্থাপন করা হয়েছিল। আগেই বলেছি, সেই ১৫টি অংশ উল্লেখ করা হয়েছে।
দরখাস্তকারী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব সিরাজুল হক এই যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে, অভিযােগে উল্লিখিত ১৫টি অংশের একটিও ৪১ বিধির অর্থাধীনে ক্ষতিকর কাজ সংঘটন করে না। তিনি দাবি করেন
৩৪১
যে, অভিযুক্ত-দরখাস্তকারী [শেখ মুজিবুর রহমান] তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক তত্ত্ব, অর্থাৎ, পাকিস্তানের সংহতি বজায় রাখা ও দুই অংশের মধ্যে বৈষম্যের কারণসমূহ দূর করার লক্ষ্যে প্রণীত আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির প্রসারের লক্ষ্যে বক্তৃতাটি দিয়েছেন এবং সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির সমালােচনার ক্ষেত্রে বক্তা আইনের সীমার মধ্যে ছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, উপরােক্ত সকল অনুচ্ছেদকে প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এর কৈফিয়ত পাওয়া যাবে এবং সেখানে আপত্তিকর কিছু পাওয়া যাবে না। পুরাে বক্তৃতাটি একসঙ্গে পড়লে তা ৪১ বিধির অর্থানুযায়ী কোনাে ক্ষতিকর কর্ম সংঘটন করে না এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ৪৭ বিধির অধীনে কোনাে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উঠে না। উপরােক্ত প্রশ্নে বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সার অকপটে স্বীকার করেছেন যে, ৭, ১২ ও ১৩ নম্বর অংশ ব্যতীত অন্য অনুচ্ছেদগুলাে ব্যাখ্যাসাধ্য এবং সেসব অনুচ্ছেদের ব্যাপারে আপত্তি করার কিছু নেই। তবে তিনি জোরালােভাবে দাবি করেছেন যে, উপরােক্ত অভিযােগপত্রে ১৫টি অংশের মধ্যে ৭, ১২ ও ১৩ নম্বর অংশ আপত্তিজনক। কারণ, প্রথমটিতে পাকিস্তানের বিভিন্ন শ্রেণির নাগরিকের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণার মনােভাব সৃষ্টি করার প্রবণতা রয়েছে; দ্বিতীয়টিতে জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা এবং পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে উসকানি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে।
১৯. বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সার যেহেতু ৭, ১২ ও ১৩ নম্বর অংশ বাদে অন্য অনুচ্ছেদগুলাে ৪১ বিধির অর্থ অনুযায়ী আপত্তিজনক নয় বলে স্বীকার করেছেন, সুতরাং সেগুলাের ব্যাপারে বিস্তারিত আলােচনায় যাওয়ার প্রয়ােজন নেই। উদ্ধৃত অনুচ্ছেদগুলাে নিজেই কথা বলবে। এই পর্যায়ে আমি সহজেই বলতে পারি যে, সেই অনুচ্ছেদগুলাে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিবেচনা করলে ব্যাখ্যাসাধ্য এবং বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্বার যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে, সেসব অনুচ্ছেদের ব্যাপারে আপত্তি করার কিছু নেই। এবার আমরা আপত্তিজনক, অর্থাৎ ৭, ১২, ১৩ নম্বর অংশের দিকে মনােযােগ দিতে পারি। এই তিনটি অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ :
Paragraph 7: “The capital, The Central Administration and financial resources are all in the hands of West Pakistan. The Military Headquarters are also in the band of West Pakistan. The capital formation is also in the hand of West Pakistan. You are nothing but a Bazar. We do not want to be Bizarre but want to be the citizens of Pakistan. East Pakistan has one thing, that is to conduct the affair of the State through elected representatives. Ayub Saheb has given us a constitution after promulgation of Martial law. What is the position of Bengal in it?
Paragraphs 12 and 13: “So brothers, get ready for sacrifice and be prepared for struggle. I [শেখ মুজিবুর রহমান] say that if any Awami League Worker is touched then we shall fill up all the jails of East Bengal. He will oppress us. There are 5 cases against me. But death is in the hand of Allah. If it was in the power of Ayub Khan to kill me then he could have done it during the Martial law regime. So, I tell you to go out into the village, get ready for struggle in order to realize our demands. The oppression must be stopped. The people’s salvation must be achieved.
২০. মামলাটির ফলাফল নির্ভর করছে উপরােল্লিখিত ৭, ১২ ও ১৩ নম্বর অংশের সারমর্ম ও অর্থ প্রকাশের | উপর। এই অনুচ্ছেদগুলাে ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (ই) ও (এইচ) দফায় সংজ্ঞায়িত ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের
৩৪২
আওতায় পড়ে কিনা সেই প্রশ্নে যাওয়ার আগে অনুচ্ছেদসমূহের প্রকৃত সারমর্ম ও অর্থ এবং বক্তার উদ্দেশ্য নিরূপণ করার জন্য বক্তৃতাটি অখণ্ডভাবে পড়া উচিত। এটা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত যে, কোনাে বক্তৃতা বা লেখার ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য পুরাে বক্তৃতা বা লেখাটিকে অখণ্ডভাবে বিবেচনা করা উচিত। কোনাে সুনির্দিষ্ট বক্তৃতা বা লেখা ক্ষতিকর কিনা তা নির্ধারণ করার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে এরকম অনেক মামলায় একই রকম সিদ্ধান্ত এসেছে যে, এরকম প্রতিটি মামলায় আদালতের উচিত বক্তৃতা বা লেখাটিকে অখণ্ডভাবে এবং ন্যায্য, স্বাধীন ও উদার মানসিকতা দিয়ে বিবেচনা করা; এখানে-সেখানে ব্যবহৃত কোনাে বিচ্ছিন্ন শব্দ, শব্দগুচ্ছ বা অনুচ্ছেদের উপর অতিরিক্ত জোর না দিয়ে কোন প্রেক্ষাপট, পরিপ্রেক্ষিত ও পরিস্থিতিতে বক্তৃতাটি দেওয়া হয়েছে কিংবা লেখাটি রচিত হয়েছে তার আলােকে বিবেচনা করা। এটাকে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধের আওতায় আনার জন্য কেবল কোনাে কোনাে জায়গায় কঠোর শব্দ বা শব্দগুচ্ছের প্রয়ােগই যথেষ্ট নয়। এই প্রসঙ্গে তফাজ্জল হােসেন বনাম পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশ, ১৭ পিএলডি ৪৯৮ মামলার উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে এই আদালতের একটি স্পেশাল বেঞ্চ বক্তৃতার ঘটনা বিবেচনা করেছে।
২১. উপরােক্ত নীতিমালা এবং কোন ঘটনা, পরিপ্রেক্ষিত ও পরিস্থিতিতে বক্তা উক্ত বক্তৃতা প্রদান করেছেন তার আলােকে ৭, ১২, ও ১৩ নম্বর অনুচ্ছেদের প্রভাব বিচার করতে হবে।
২২. উপরে উদ্ধৃত ৭ অনুচ্ছেদের বিষয়বস্তু যদি বিচ্ছিন্নভাবে ও আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয় তাহলে এরকম একটা ধারণা হতে পারে যে, বক্তা [শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সকল প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রাধান্য সম্পর্কে কিছু বলতে চেয়েছেন এবং এর মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণের প্রতি এক ধরনের শত্রুতা ও ঘৃণার অনুভূতি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। কিন্তু যদি এই অনুচ্ছেদটি প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এবং বক্তৃতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অন্যান্য অংশের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যায় তাহলে দেখা যাবে, সেখানে ব্যবহৃত শব্দ, শব্দগুচ্ছ ও বাক্য এতটা কঠোর বা আপত্তিজনক নয় যা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি কোনাে খারাপ মনােভাব ও ঘৃণার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। উক্ত অনুচ্ছেদে যে আবেগ প্রকাশিত হয়েছে, তা যদি “We want to live as citizens of Pakistan. I do not grudge your sharing it. We are ready to give you a share out of it. But I want to know how much my share is? Will you not listen to our tale of miseries?”- অনুচ্ছেদটির সঙ্গে মিলিয়ে বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে বক্তা প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের বিরুদ্ধে খারাপ অনুভূতি বা ঘৃণা সৃষ্টি করতে চাননি। তিনি কেবল শ্রোতামণ্ডলী ও পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যমান দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে বলেছেন। কাজে কাজেই অনুচ্ছেদটিকে ৪১(৬) বিধির অর্থাধীনে অনিষ্টকর হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না এবং এর ব্যাপারে কোনাে আপত্তি তােলা যায় না। অধস্তন আপিল-আদালতও উক্ত বিধির (৬) উপবিধির (জি) দফার অধীনে বক্তৃতাটিকে ক্ষতিকর বিবেচনা করেননি। একইভাবে ১২ ও ১৩ অনুচ্ছেদ একসঙ্গে মিলিয়ে পড়লে এবং এই দুটি অনুচ্ছেদকে আলাদা ও বিচ্ছিন্নভাবে বিবেচনা করলে কারাে কাছে মনে হতে পারে যে, বক্তা [শেখ মুজিবুর রহমান] এসব কথার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই দুই অনুচ্ছেদকে স্বতন্ত্রভাবে বিবেচনা করলে হয়তাে মনে হবে, বক্তা জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে উসকে দিতে চেয়েছেন এবং একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যদি অনুচ্ছেদ দুটিকে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিবেচনা করা হয় এবং পরবর্তী “I request my co-workers to carry on the struggle peacefully”
৩৪৩
লাইনগুলাের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া হয়, তাহলে দেখা যাবে বক্তা আদতে জনগণকে উসকে দেননি, বরং জনগণকে কেবল তাদের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং দাবি পূরণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহবান জানিয়েছেন। যদিও বক্তা এসব লাইনে কিছু উসকানিমূলক শব্দ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু পরক্ষণেই শ্রোতাদের শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন।
এসব বিবেচনায় আমার পক্ষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন যে, বক্তা প্রকৃতপক্ষেই কোনাে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন কিংবা উক্ত ৪১ বিধির (৬) উপবিধির (এইচ) দফা অনুযায়ী জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন।
২৩. “অসন্তোষ” শব্দটি আগেই ব্যখ্যা করা হয়েছে। এটা আনুগত্যহীনতা এবং শত্রুতা ও ঘৃণার মন্দ মনােভাবকে ইঙ্গিত করে। ৭, ১২ ও ১৩ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত বক্তৃতাংশের উপর বিজ্ঞ ডেপুটি লিগ্যাল রিমেম্ৰান্সার অধিক জোর প্রয়ােগ করেছেন। উপরােক্ত আলােচনার ভিত্তিতে বলা যায়, এসব অনুচ্ছেদ আনুগত্যহীনতা কিংবা আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে শত্রুতা ও ঘৃণার মন্দ মনােভাব বােঝায় না। এসব অনুচ্ছেদে ব্যবহৃত শব্দাবলি এরকম কিছু প্রকাশ করে না যে, বক্তা প্রকৃতপক্ষে অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা উভয় দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানিদের মনে কোনাে ভয় বা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছেন।
২৪. অভিযােগে উল্লিখিত এছাড়া অন্যান্য অনুচ্ছেদগুলাের ব্যাপারে আমি আগেই বলেছি যে, সেসব অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যাসাধ্য এবং সেগুলাের বিষয়ে কোনাে আপত্তি তােলা যায় না। এটা সত্য, বক্তা কোনাে কোনাে জায়গায় কিছু কঠোর ও অপ্রত্যাশিত শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেসব শব্দ প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায় যে, সেসব শব্দ ও শব্দগুচ্ছের কঠোরতা বক্তৃতার অন্যান্য অনুচ্ছেদের মাধ্যমে উল্লেখযােগ্য পরিমাণে লাঘব হয়। কিছু বক্তব্য এবং কিছু শব্দ ও শব্দগুচ্ছের ব্যবহার দুঃখজনক হলেও এটা বলা যাবে না যে, সেগুলাে শ্রোতাদের মনে দীর্ঘস্থায়ী কোনাে প্রভাব বিস্তার করেছে যাতে সরকারের প্রতি ঘৃণা অসন্তোষের মনােভাব জাগিয়ে তুলতে পারে।
২৫. সরকারি নীতিমালায় পরিবর্তন আনার জন্য আইনসঙ্গত উপায়ে সমালােচনা করা একটি স্বীকৃত নাগরিক অধিকার। প্রত্যেক নাগরিকেরই দেশের কল্যাণের জন্য স্বাস্থ্যকর উপায়ে সরকারি নীতিমালার সমালােচনার অধিকার রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে যে, সমালােচনার অধিকারের একটা সীমা রয়েছে। সেটা হলাে, সমালােচনা অবশ্যই সরকারের নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না এবং আনুগত্যহীনতার মনােভাবকে উৎসাহিত করবে না। সমালােচনার উদ্দেশ্য যতই মহৎ হােক না কেন, তা অবশ্যই আইনি সীমা অতিক্রম করবে না। নিঃসন্দেহে সরকারের নীতিমালার গঠনমূলক সমালােচনার অধিকার রয়েছে, তবে সেই অধিকার মানে লাইসেন্স বুঝলে চলবে না। বক্তব্য ও লেখার ক্ষেত্রে অবশ্যই সবসময় সতর্ক থাকতে হবে এবং আইনে বর্ণিত শর্তের অধীন হতে হবে।
২৬. কোনাে আক্রমণাত্মক বক্তৃতা বা লেখনীর কোনাে অংশ আইনের আওতার মধ্যে পড়লেও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী বিবেচনা করে যদি সেটি ব্যাখ্যাসাধ্য না হয়, তবে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যে মামলা করা যাবে, সে সম্পর্কিত নজির রয়েছে। এই প্রসঙ্গে A.I.R. 1931 Lahore 283 Ges A.I.R. 1948 Lahore 6-এ প্রকাশিত মামলা দুটির উল্লেখ করা যেতে পারে।
২৭. যদি কোনাে বক্তৃতা বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত বিচ্ছিন্ন শব্দ, শব্দগুচ্ছ বা অনুচ্ছেদের আলােকে না পড়ে অখণ্ডভাবে পড়া হয়, তাহলে এটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় না যে এটা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সরকারের
৩৪৪
প্রতি আনুগত্যহীনতা বা শ্রোতাদের মনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চেয়েছে, তাহলে সেক্ষেত্রে আবেদনকারী খালাস হওয়ার যােগ্য। যদি কোনাে বক্তৃতা আইনি সীমার শেষ রেখায় গিয়েও পড়ে, তাহলেও ফলাফল একই হবে। এই প্রসঙ্গে ১৭ ডিএলআর ৪৯৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত রায়ের ৫/৯ পৃষ্ঠায় বিচারপতি সাত্তারের পর্যবেক্ষণ উল্লেখযােগ্য।
২৮. দেশদ্রোহিতার উপাদানসমূহ কী কিংবা কোনাে কাজ পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার একই বিধানের আওতার মধ্যে পড়ে কিনা তা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, সময়ের ব্যবধানে দেশদ্রোহিতার ধারণা পরিবর্তিত হয়। এই পর্যবেক্ষণ ধারাবাহিকভাবে বহুসংখ্যক মামলায় দেওয়া হয়েছে এবং আমার মতে, এটা বিবর্তনের বিষয়। P.L.D. 1950 Lahore 420, 1953 S.C.A 152 and 17 D.L.R. 498-এ প্রকাশিত মামলাগুলাে এই প্রস্তাবের সমর্থন জোগায়।।
২৯. দরখাস্তকারীর বক্তৃতা এই প্রেক্ষাপটেই বিবেচনা করতে হবে। বক্তা [শেখ মুজিবুর রহমান] একটি রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ আওয়ামী লীগের সভাপতি। দলটি ছয় দফা কর্মসূচি প্রচারের জন্য সারা দেশব্যাপী একটি আন্দোলন হাতে নিয়েছে। এই সংগঠনের গৃহীত ছয় দফা কর্মসূচি সরকার নিষিদ্ধ করেনি কিংবা তা অবৈধ ঘােষণা করা হয়নি। একটি দলের সভাপতি হিসেবে বক্তা তাঁর কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়া এবং তার মতামত প্রচার করার অধিকার রাখেন। সাংবিধানিক বিধি-বিধান বিবেচনা করলে ছয় দফা কর্মসূচির সমর্থনে কথা বলা এবং দেশের কল্যাণের জন্য সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালােচনা করার অধিকার তার রয়েছে। এই মামলায় বক্তা ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানের একটি জনসভায় বক্তৃতা করেছেন এবং সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রবর্তন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ, কেন্দ্রীয় রাজস্ব প্রদেশগুলােতে বিতরণ, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনির্ভরশীলতা ইত্যাদি দাবি জানিয়েছেন।
তাঁর জোরালাে বক্তৃতায় তিনি অন্যান্য বিষয়েও কথা বলেছেন এবং বিভিন্ন সরকারি নীতির সমালােচনা করেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার সমালােচনাও করেছেন এবং কিছু বড় ব্যবসায়ীর নিন্দা করেছেন। নিঃসন্দেহে ছয় দফা কর্মসূচি সম্বন্ধে শ্রোতাদের মনে দাগ কাটার জন্য এবং শস্তা হাততালি পাওয়ার জন্য বক্তা সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালােচনার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও উদ্ধত শব্দ ব্যবহার করেছেন। তিনি বেশ কিছু সহিংস শব্দও উচ্চারণ করেছেন এবং মনে হয় উত্তেজনার এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে কোথাও কোথাও তার বক্তব্যের খেই ধরাও কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমাকে বলতে হচ্ছে যে, বক্তৃতাটি ছিল অসার ও দায়িত্বজ্ঞানহীন, যা এই পর্যায়ের একজন নেতার কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে, এই বক্তৃতায় এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে যা তেতাে লাগলেও তথ্যগতভাবে সঠিক এবং তা অপ্রীতিকর সত্য।
৩০. আদালতের কর্তব্য হলাে বক্তব্যটি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৪১(৬) বিধির বিধানাবলি লজ্ঞান করেছে কিনা তা নিরূপণ করা। এই কাজ দুরূহ। বক্তৃতাটি ছােট হলে কাজটি সহজ হয়। কিন্তু বক্তৃতাটি দীর্ঘ এবং সচেতনভাবে প্রদত্ত হলে কাজটি কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এক বা দুই বাক্যে কোনাে আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়া হলে সেখানে ব্যবহৃত শব্দের প্রকৃত সারমর্ম ও অর্থ খুঁজে বের করা সহজ হয়। কিন্তু বক্তৃতাটি দীর্ঘ হলে এবং পুরাে বক্তৃতাটি অখণ্ডভাবে পাঠের মাধ্যমে তার সারমর্ম ও তাৎপর্য নিরূপণ করতে হলে, তখন কাজটি আর সহজ থাকে না। কোনাে সচেতন সৃষ্টিকর্মের [বক্তৃতা] ক্রটি নির্দেশ করা আরাে দুরূহ, যেখানে বক্তা তার বক্তৃতায় বেশ কিছু কটু কথা নিক্ষেপ করেন, আবার এর মধ্যেই যােগ রেন কিছু স্তুতিবাক্য। এই ক্ষেত্রে আদালতকে খুব সাবধানতার সঙ্গে একটা ন্যায্য, স্বাধীন ও উদার মন।
৩৪৫
নিয়ে বিচার করতে হবে। তবে প্রতিটি মামলার ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি সেই মামলার তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী নির্ণীত হতে হবে।
৩১. Niharendu Dutt Majumdar vs. Emperor, AIR 1942 (E.C) 22 মামলায় আপিলকারী নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার একটি আপত্তিকর বক্তৃতা দিয়েছেন এবং ভারত প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৩৪ বিধি অনুযায়ী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এই ৩৪ বিধি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৪১ বিধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই মামলায় ভারতের ফেডারেল কোর্টের পর্যবেক্ষণ নিম্নরূপ :
আপিলকারীর অভিযােগ হলাে, বক্তব্য থেকে আমরা যা উদ্ধার করতে পারি, সরকার কোনাে পদক্ষেপই নেননি কিংবা পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেননি, কারণ তারা অযােগ্য ছিলেন এবং এজন্য নয় যে, তারা কোনাে না কোনাে কারণে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উৎসাহিত করতে চেয়েছেন। নিজের মতামত উপস্থাপন করতে গিয়ে আপিলকারী বেশ সহিংস ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং নিজেকে উত্তেজনার এতটাই তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, কোথাও কোথাও তাঁর বক্তৃতার খেই ধরাও কঠিন হয়ে পড়ছিল। আমরা এরকম পর্যবেক্ষণ না দিয়ে পারছি না যে, বক্তৃতাটি ছিল অসার এবং দায়িত্বহীন আচরণ, যা বঙ্গীয় আইনসভার একজন সদস্যের কাছ থেকে প্রত্যাশিত নয়। কিন্তু আমাদের মতে, এই বক্তৃতাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা আখ্যা দেওয়া হবে এটিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। একটি
৩২. ইংরেজি প্রবাদ আছে- hard words break no bones [গালিতে কারাে হাড় ভাঙে না]। যুক্তিবােধসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে ঘৃণ্য নােংরা গালিগালাজ মনে হবে। এরকম বক্তৃতা যতই কঠোর ও আক্ষরিকভাবে মানহানিকর হােক না কেন- কমন ল বিচারব্যবস্থায় বহুকাল আগে থেকেই এরকম বক্তৃতাকে মামলাযােগ্য গণ্য করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এমনকি কোনাে সরকারের বিরুদ্ধে গালিগালাজপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করা হলেও তা অপরিহার্যভাবে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক হয়ে উঠে না এবং এমন কিছু শব্দ ও শব্দগুচ্ছ রয়েছে, যেগুলাে বহুকাল আগেই বুলিসর্বস্বদের ব্যবসায়িক পুঁজিতে পরিণত হওয়ায় আসল অর্থই প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। আমাদের আলােচ্য বক্তৃতা এরকম শব্দ বা শব্দগুচ্ছ দিয়ে পরিপূর্ণ। এরকম কিছু শব্দ আমাদের মাথায় ঘুরছে, সেগুলাে উল্লেখ করতে দ্বিধা করছি কেবল এই কারণে যে, আমরা সেসব ভিত্তিহীন ও অসার শব্দের সরবরাহ আর বাড়াতে চাই না। কিন্তু বক্তৃতাটি অখণ্ডভাবে পড়ে আমরা বলতে পারি না যে শ্রোতারা ‘শেইম, শেইম’ বলে চিৎকার করছিলেন, তবু এই বক্তৃতাটি সে সময় বাংলা বা ভারতের অন্য কোথাও সরকার উৎখাত করার জন্য সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে প্ররােচনামূলক ছিল বলে মনে করি না। আপিলকারী সরকারব্যবস্থা নিয়ে তার মতামত পেশ করেছেন তা সত্য, কিন্তু তা করার অধিকার তার রয়েছে এবং এই প্রসঙ্গে তাঁর উল্লিখিত সূত্রসমূহ আমরা বলতে পারি যে, both common place and in common form এবং তা ভারত সরকারের জন্য এক মুহুর্তের অস্বস্তির কারণও হতে পারে না। তার অধিকতর সহিংস বিস্ফোরক মন্তব্যসমূহ ছিল তৎকালীন বঙ্গীয় মন্ত্রিসভা এবং বাংলার গভর্নরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে। কিন্তু আমরা মনে করি না যে, তাঁর বক্তৃতার চিন্তা-কাঠামাে যা-ই হােক না কেন, তিনি মন্তব্য বা সমালােচনার আইনি সীমা লঙ্ন করেছেন।
৩৩. Malik Nasrullah Khan Aziz VS. Crown, PLD 195) Lah, 420 মামলায় আবেদনকারী মালিক নসরুল্লাহ খান আজিজ দ্বি-সাপ্তাহিক কউসার পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন এবং Press (Emergency powers) Act 1931-এর ৪(১) ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। এই ৪(১) ধারার বিধানাবলি পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার ৪১ বিধির বিধানাবলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। লাহাের হাইকোর্টের একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মামলার বিষয়বস্তু বিবেচনা করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যেযা হােক-
সরকারের পক্ষ থেকে আপত্তি তােলা হয়েছে এরকম কিছু অনুচ্ছেদকে ক্ষমতাসীন মহলের সাংবিধানিক অবস্থান কিংবা মওদুদী ও তার সহচরদের কারাগারে আটকে রাখার মতাে কোনাে সুনির্দিষ্ট
৩৪৬
পদক্ষেপের সমালােচনার বেশি কিছু নয়। আবেদনকারীর বিজ্ঞ আইনজীবীর এই যুক্তিতে বেশ জোর আছে। লেখক হয়তাে সংযত ভাষা ব্যবহার করেননি এবং অতিরঞ্জিত ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে ন্যায্য সমালােচনার সীমা লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু বুলিসর্বস্বদের ব্যবসার পুঁজিতে পরিণত হওয়া এবং ফলত অতি ব্যবহারের কারণে ধার হারিয়ে ফেলা অলঙ্কারসর্বস্ব অসার বুলি বা মতামত আইনে মামলাযােগ্য বলে চিহ্নিত হতে পারে না। আমি এই ব্যাপারে একমত যে, ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮ ও ৯ অনুচ্ছেদ এই কাতারেই পড়ে এবং ১৯৩১ সালের ওই আইনের ৪(১)(ডি) ধারার আওতাধীন হয় না। এই অনুচ্ছেদগুলাের সারমর্ম হলাে যে, মওদুদী ও তার সহচরদের অন্যায়ভাবে কারাবন্দি করা হয়েছে এবং তাদের মুক্তি দেওয়া উচিত। যদি ক্ষমতাসীনরা ব্যবস্থার পরিবর্তন না করেন, তাহলে জাতি তার স্বাধীনভাবে বাছাইকৃত নিজস্ব প্রতিনিধিদের দ্বারা ক্ষমতাদণ্ড গ্রহণ করবে। এটা কোনাে ব্যাপার নয় যে, ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের বলে বিদ্যমান সাংবিধানিক বিধি-বিধান দ্বারা সরকার গঠিত হয়েছে এবং পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তক নতন সংবিধান জারি করা পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত থাকা উচিত। লেখকের ব্যবহৃত কিছু মতামত রুচিসম্মত না-ও হতে পারে। যা হােক, এরকম প্রবাদ রয়েছে যে, গালি কারাে হাড় ভাঙ্গে না। এসব অনুচ্ছেদ সতর্কতার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে আমার মত এই যে, এসব অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে আইনের ৭ ধারার (৩) উপধারা অনুযায়ী জারিকৃত কোনাে আদেশ জারি করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি হতে পারে না।
৩৪. পুনরায় Reazuddin Ahmed on behalf of the detenue Abdul Momen vs. Deputy Commissioner of Dacca and others 21 DLR 169 মামলায় আটককৃত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মােমেন সিলেটে একই ধরনের একটি বক্তৃতা করেছেন। এই আদালতের একটি ডিভিশন বেঞ্চ মামলার সব দিক বিবেচনা করে পর্যবেক্ষণ দেন যেআমরা মনে করি না যে-
এই বক্তৃতা আটককারী কর্তৃপক্ষের এটা ভাবার কোনাে যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি করে যে, আটককৃত কোনােভাবে তর্কিত আটকাদেশে উল্লিখিত ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড করেছেন কিংবা করতে পারতেন। এটা সত্য যে, দেশের প্রশাসনে আধিপত্যশীল পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি অবন্ধুসুলভ মনােভাবের একটা চাপা স্বর ছিল। কিন্তু আমাদের মতে, পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতি এরকম অবন্ধুসুলভ মনােভাবের ইঙ্গিত থেকে কোনাে মানুষ এরকম চিন্তা করতে পারেন না যে, আটককৃত তর্কিত আটকাদেশে উল্লিখিত বিষয়সমূহের জন্য ক্ষতিকর উপায়ে কোনাে কাজ করেছেন বা করতে পারতেন।
আটককৃত ব্যক্তি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য পূরণের অংশ হিসেবে কোনাে ধরনের সহিংসতা কিংবা অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের উল্লেখ না করে কোনাে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মতামত পেশ করা থেকে এরকম মনে করার কোনাে যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি হয় না যে, আটককৃত তর্কিত আদেশে বর্ণিত বিভিন্ন বিষয়ের জন্য সম্ভাব্য হুমকি। রাষ্ট্র ও সরকার’ দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা, দ্বিতীয়টির প্রতি হুমকি অপরিহার্যভাবে প্রথমটির জন্য হুমকি না-ও হতে পারে। এটা সত্য যে, বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড সমকালে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলােকে বিচার করা হয়েছে। এমনটি অ্যাডভােকেট জেনারেল আমাদের সামনে এরকম কোনাে পরিস্থিতি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন যা আটককৃতের বক্তব্যকে অর্থপূর্ণ এবং ভয়ানক পরিণতির আশঙ্কা-পরিপূর্ণ করে তােলে। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের আইন বিরােধীদলীয় কর্মকাণ্ড এবং কিছু চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনাে মতামত রিকারের জন্য যতােই বিস্বাদ বা তেতাে হােক না কেন, আমার মতে, তা বক্তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার মতাে বিশেষ আইনে মামলাযােগ্য ঘটনা হতে পারে না; যদি না এসব মতামতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করা, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা কিংবা আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জাগিয়ে তােলা কিংবা জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার প্রবণতা থাকে।
৩৪৭
৩৫. উপরােক্ত মামলাসমূহে বিধৃত নীতিমালার মাপকাঠিতে বর্তমান মামলার তথ্যাদি বিশ্লেষণ এবং তর্কিত বক্তৃতাটি অখণ্ডভাবে বিবেচনা করে এবং অভিযােগে উল্লিখিত আপত্তিকর অংশগুলাে পড়ে আমার পক্ষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন যে, বক্তৃতাটি যেই ভাবনা-প্রসূতই হােক না কেন, তা মতামত বা সমালােচনার আইনি সীমা অতিক্রম করেছে কিংবা আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ উসকে দেওয়া কিংবা অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা- উভয় দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানিদের মেনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যপূর্ণ ছিল। বক্তা [শেখ মুজিবুর রহমান] সরকারের বিভিন্ন নীতিমালা সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশ করেছেন, যা করার অধিকার তার রয়েছে। কোথাও কোথাও তার সহিংস বিস্ফোরক মন্তব্য অস্বস্তিকর হতে পারে, কিন্তু তা ৪১(৬) বিধির অধীনে কোনাে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড সংঘটন করে না। পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলাে দ্বারা বক্তৃতার আপত্তিকর অংশ তার হুল হারিয়ে ফেলে। বক্তৃতাটি যেহেতু সরকারের প্রতি অসন্তোষ সৃষ্টি করা এবং জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি এবং দেশে কোনাে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ছাড়াই দলের প্রস্তাবিত ছয় দফা কর্মসূচির প্রসারের। লক্ষ্যে করা হয়েছে, ফলে এটা মনে করার কোনাে কারণ নেই যে, আবেদনকারী ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। বক্তা হয়তাে সংযত ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারেননি, হয়তাে অতিরঞ্জিত ভাষা ব্যবহার করে ন্যায্য সমালােচনার সীমা কিছুটা ছাড়িয়ে গেছেন, কিন্তু কেবল অলঙ্কারসর্বস্ব অসার কথামালা বা মতামত, যা বুলিসর্বস্বদের ব্যবসায়ের পুঁজিতে পরিণত হয়েছে এবং যা পরবর্তী শব্দ ও শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে তার হুল হারিয়েছে, তা মামলাযােগ্য বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া যায় না।
৩৬. আমি আগেই বলেছি যে, দীর্ঘ বক্তৃতার কোনাে কোনাে অনুচ্ছেদে বক্তা কিছু অনুদার মন্তব্য করেছেন এবং কিছু কঠোর ও দুঃখজনক শব্দ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু বক্তৃতার অন্যান্য অংশের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে ও বিবেচনা করলে সেই মন্তব্য ও শব্দগুলাে কৈফিয়ত দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায় এবং প্রকৃত অর্থে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালা ১৯৬৫-এর অধীনে ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের আইন বিরােধীদলীয় কর্মকাণ্ড এবং চিন্তা ও মত প্রকাশে বাধা সৃষ্টি না করে ততক্ষণ পর্যন্ত নিছক মত প্রকাশ সরকারের জন্য যতই বিস্বাদ বা তেতাে হােক না কেন, আমার মতে, তা বক্তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালার অধীনে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়ার মতাে ঘটনা হতে পারে না, যদি না এসব মতামতে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করা, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা কিংবা আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ জাগিয়ে তােলা কিংবা জনগণের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার প্রবণতা থাকে।
৩৭. উপরে বর্ণিত যুক্তিসমূহের আলােকে বক্তৃতাটিকে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধিমালায় সংজ্ঞায়িত ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডের আওতায় ফেলা কঠিন। অতএব, আমি দোষীসাব্যস্তকরণের আদেশ বহাল রাখতে অপারগ। ফলত, দোষীসাব্যস্তকরণের আদেশ বাতিল করা হলাে এবং অভিযুক্ত-দরখাস্তকারীকে [শেখ মুজিবুর রহমান] খালাস দেওয়া হলাে।
জারিকৃত রুলটি চূড়ান্ত করা হলাে।
৩৪৮
ইতিহাসের কলঙ্ক ও কলঙ্কমােচনের দায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট08
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল, শুক্রবার। সুবেহ সাদেকের সময়। ঠিক সেই মুহূর্তে পাশবিক সশস্ত্র ঘাতকেরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে আক্রমণ করে। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে তার শিশুপুত্র রাসেল, বেগম মুজিবসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঘাতকচক্র রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশ বেতার’ দখল করে। সেখান থেকেই ঘাতকরা বেতারযন্ত্রে সদম্ভ প্রচারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যার দায়-দায়িত্ব বিশ্ববাসীর কাছে স্বীকার করে। এমন বর্বরতা বিশ্বে নজিরবিহীন।
এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের পরিণামে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে এক নিকষ আঁধার। যে মানুষটি বাংলার মানুষকে ভালােবেসেছেন, বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য, স্বাধিকারের জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন, সেই শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে কতিপয় বিশ্বাসঘাতক সপরিবারে হত্যা করে! রক্তাক্ত হয় মানবতা ও সভ্যতা। বিশ্বাসঘাতক খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ঐ দিনই রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। এরপর ২০ আগস্ট, ১৯৭৫ সামরিক আইন জারি করেন, সংবিধান বহাল রেখেই। ঐ সামরিক আইনের কার্যকারিতা দেওয়া হয় ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ থেকে। শর্ত ছিল সংবিধান কার্যকর থাকবে সামরিক আইনের ঘােষণা, সামরিক বিধি ও আদেশসমূহ সাপেক্ষে। এভাবে সংবিধানকে সামরিক আইন, সামরিক আদেশ ও বিধির অধীন করা হয়।
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ দখলদার রাষ্ট্রপতি মােশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৫’ জারি করেন। ঐ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’-এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ ঐ দিন সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি প্রদান করা হয়। শুরু হয় এক কালাে অধ্যায়ের। ঐ ‘কালাে অধ্যাদেশে’ উল্লেখ করা হয় যে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ ঐ সকল হত্যা এবং হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার লক্ষ্যে যে সকল পরিকল্পনা, পদক্ষেপ বা সক্রিয় কার্য গ্রহণ এবং সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টসহ কোনাে আদালত বা ট্রাইব্যুনালে কোনাে আইনি পদক্ষেপ বা অন্য কোনাে কার্যধারা গ্রহণ করা যাবে না। ঐ অধ্যাদেশে আরাে উল্লেখ করা হয়, রাষ্ট্রপতি কিংবা তাঁর পক্ষে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কর্তৃক ঘটনাসমূহে জড়িত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণকে দায়মুক্তি প্রদান করবেন। এ মর্মে প্রদত্ত সার্টিফিকেটটি পর্যাপ্ত সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এভাবে হত্যাকারীদের করা হয় দায়মুক্ত ও পুনর্বাসিত।
ঐ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা সম্পর্কে কোনাে মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ সামরিক শাসনকাল ও প্রতিকূল অবস্থার কারণে অনেকগুলাে বছর
……………………………………………………………….
08. এই অধ্যায়টি রচিত হয়েছে মাননীয় বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম কর্তৃক লিখিত একটি প্রবন্ধের ভিত্তিতে।
৩৫৩
জাতি বিচারহীনতার গ্লানি বহন করে রক্তাক্ত হয়। সামরিক শাসন ও জারিকৃত কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স দেশে বিচারহীনতার ও দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে লালন করে।
দীর্ঘদিন পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে ২ অক্টোবর, ১৯৯৬ তারিখে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের হত্যাসংক্রান্ত ধানমন্ডি থানার মামলা নম্বর ১০(১০) ১৯৯৬ দায়ের করা হয়। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভােটে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ বাতিল করে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬’ (আইন নম্বর-২১/১৯৯৬) পাস করা হয়। এই আইন ১৪ নভেম্বর, ১৯৯৬ তারিখে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সার্বভৌম সংসদে এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার সকল বাধা দূর হয়।
ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬’-এ উল্লেখ করা হয় যে : “এই আইন বলবৎ হবার পূর্বে যে কোনাে সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের অধীনে কৃত কোনাে কার্য, গৃহীত কোনাে ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনাে সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ অথবা অর্জিত কোনাে অধিকার বা সুযােগ-সুবিধা, অথবা সরকার বা কোনাে কর্তৃপক্ষের জন্য সৃষ্ট কোনাে দায়-দায়িত্ব, যদি থাকে সেক্ষেত্রে জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট, ১৮৯৭-এর ধারা ৬-এর বিধানাবলি প্রযােজ্য হবে না এবং উক্তরূপ কৃত কার্য, গৃহীত ব্যবস্থা, প্রদত্ত সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ বা অর্জিত অধিকার বা সুযােগ-সুবিধা বা সৃষ্ট দায়-দায়িত্ব উপ-ধারা (১) দ্বারা উক্ত অধ্যাদেশ রহিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে এইরূপে অকার্যকর, বাতিল ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে যেন উক্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয় নাই এবং উক্ত অধ্যাদেশের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না ও নাই।”
এরপর ধানমন্ডি থানায় দায়েরকৃত মামলা নম্বর ১০(১০) ১৯৯৬ সূত্রে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হলে গ্রেফতারকৃত আসামি কর্নেল (বরখাস্তকত) শাহরিয়ার কবির এবং আসামি কর্নেল (বরখাস্তকত) সৈয়দ ফারুক রহমানের পক্ষে তার মা মিসেস মাহমুদা বেগম ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ এবং বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং জেল হত্যাসংক্রান্ত মামলা দুটির কার্যক্রম চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে পৃথক পৃথকভাবে দুটি রিট পিটিশন দায়ের করে। উভয় রিট পিটিশনের একত্রে শুনানি হয়।
আদালতের সামনে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবীর মূল বক্তব্য ছিল :
১. ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত অনুচ্ছেদ ৩ক’ এবং ১৮’-এর সাথে সাংঘর্ষিক;
২. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ আইনটিকে যেহেতু সংবিধানে পঞ্চম সংশােধনী দ্বারা অনুমােদন, সুরক্ষিত ও সংরক্ষণ করা হয়েছে, সেহেতু, সাধারণ কোনাে আইন পাসের মাধ্যমে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা উপরােক্ত আইনটি বাতিল করা বেআইনি ও ক্ষমতাবহির্ভুত এবং ঐ আইন বাতিল করতে হলে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের দ্বারা সংবিধান সংশােধন করা আবশ্যক।
৩. যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে সাধারণ একটি আইন দ্বারা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি বাতিল আইনসঙ্গত হয়েছে, তথাপিও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, যা সংবিধানের অংশ হিসেবে বিবেচিত, তদ্বারা রিট আবেদনকারীরা যে দায়মুক্তির অধিকার অর্জন করেছে, তা কোনােভাবেই হরণ করা সংবিধানসম্মত নয়। এক্ষেত্রে জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ধারা ৬-অনুযায়ী বাতিলকৃত আইন দ্বারা আবেদনকারীরা দায়মুক্তির যে অধিকার প্রাপ্ত হয়েছে তা কোনােভাবেই ক্ষুন্ন করা যাবে না;
৪. সংবিধান যেহেতু ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সুরক্ষা দিয়েছে, সেহেতু, আসামিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের হতে পারে না; সুতরাং ফৌজদারি মামলার কার্যধারা বাতিলযােগ্য।
৩৫৪
এখানে উল্লেখ করা সঙ্গত হবে যে, সংবিধানে পঞ্চম সংশােধনীর (বর্তমানে বাতিল ও অস্তিত্বহীন) মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে দুটি অনুচ্ছেদ অর্থাৎ ‘ক’ এবং ‘১৮’ সংযােজন করা হয়। অনুচ্ছেদ ৩ক(১) ও (২)-এ উল্লেখ করা হয় যে, ২০ আগস্ট ১৯৭৫-এ ঘােষিত সামরিক আইনসংক্রান্ত ঘােষণা, ৮ নভেম্বর ১৯৭৫ এবং ২৯ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ঘােষণাসমূহ এবং ঐ ঘােষণাসমূহের সকল সংযােজন, সংশােধন ও পরিবর্তন, সকল সামরিক বিধি, আদেশ এবং প্রণীত আইনসমূহ যা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এবং উল্লিখিত ঘােষণা বাতিল এবং সামরিক আইন বাতিল-এর মধ্যবর্তী সময়ে প্রণীত হয়েছিল তা বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং দেশের কোনাে আদালত কিংবা ট্রাইব্যুনালে এসবের বৈধতা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
উল্লিখিত সময়ে বা কালে রাষ্ট্রপতি বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক কর্তৃক জারিকৃত আদেশ, আইনসমূহ বা কৃত অন্যান্য কার্যধারা এবং সামরিক আইনের ঘােষণা, বিধি বা উপরােক্ত আদেশসমূহে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে অপর কোনাে ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত আদেশ বা দণ্ডাদেশ বা অন্যান্য সকল প্রয়ােগকৃত ক্ষমতা বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং কোনাে আদালত বা ট্রাইব্যুনালে এ সংক্রান্তে কোনােরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
অনুচ্ছেদ ‘১৮’-এ উল্লিখিত সময়ে প্রণীত সামরিক ঘােষণাসমূহ এবং এর সংযােজন, বিয়ােজন, পরিবর্তন এবং ঐ সকল ঘােষণা, বিধি ও আদেশের ক্ষমতাবলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কৃত সকল আদেশ, কর্ম, দণ্ডাদেশকে অনুমােদন’ (ratification) এবং সমর্থন দিয়ে উপরােক্ত বিষয়সমূহের বৈধতা নিয়ে কোনাে আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনাে কর্তৃপক্ষের নিকট কোনাে অজুহাতেই কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না মর্মে বিধান করা হয়।
হাইকোর্ট বিভাগ উপরােক্ত সাংবিধানিক ও আইনি বিষয়গুলি নিষ্পত্তির জন্য তৎকালীন বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল কে. এস. নবী এবং ছয়জন অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য শ্রবণ করেন। ছয়জন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে চারজন সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, রফিকুল হক, কামাল হােসেন, এম. আমীর-উল ইসলাম এবং তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল কে. এস. নবীর বক্তব্য ছিল প্রায় এক ও অভিন্ন। তাঁদের বক্তব্য ছিল :
১. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স ছিল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সমতা), ৩১ (আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার), ৩২ (জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ), ৪৬ (দায়মুক্তি বিধানের ক্ষমতা) এবং ৪৭ (আইনের হেফাজতের বিধান)-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সামঞ্জস্যহীন এবং অকার্যকর একটি আইন;
২. অকার্যকর একটি আইন কখনই সংবিধানের অংশ হতে পারে না এবং একটি অকার্যকর আইন কারাে অনুকূলে কোনাে অধিকার বা স্বার্থ (vested right) সৃষ্টি করতে পারে না;
৩. কোনাে খুনিকে কখনও দায়মুক্তি দেওয়া যায় না; এবং
৪. একজন রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরা দায়মুক্তি পেতে পারে না।
অ্যামিকাস কিউরি এম. নুরুল্লাহর বক্তব্য ছিল : “ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কোনাে সামরিক ঘােষণা, রেগুলেশন বা আদেশ ছিল না। এটা ছিল একটি সাধারণ আইন, যা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জারি করেছিলেন। ঐ অধ্যাদেশ যখন জারি করা হয় তখন সামরিক আইনের পাশাপাশি সংবিধান বহাল ছিল। এ অধ্যাদেশ সংবিধানের কোনাে অংশ ছিল না বা হতে পারে না এবং এটি একটি সাধারণ আইন হিসেবে জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভােটে ঐ অধ্যাদেশ বাতিল করে পাসকৃত ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ একটি বৈধ ও সংবিধানসম্মত আইন।”
অপর অ্যামিকাস কিউরি খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ তার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে যে প্রস্তাব পাস করা হয়েছিল তা আদালতে উপস্থাপন করে রিট
৩৫৫
আবেদনকারীদের আইনজীবীর সাথে সুর মিলিয়ে আদালতে বলেন, একটি বিশেষ প্রেক্ষাপটে ঐ অধ্যাদেশটি জারি হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীর ফলে ঐ আইনটি সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, যা শুধু সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই পারেন পরিবর্তন বা বাতিল করতে, সাধারণ কোনাে আইন দ্বারা বা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা ঐ আইন বাতিল করা যাবে না।
সংশ্লিষ্ট পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী ও বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরিগণের বক্তব্য, আইন ও সংবিধান এবং প্রতিষ্ঠিত নীতি বিশ্লেষণে হাইকোর্ট বিভাগ সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে,
১. ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ একটি বৈধ আইন এবং এটা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়;
২. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ (অধ্যাদেশ নম্বর ৫০/১৯৭৫) একটি অকার্যকর আইন, কেননা এটা সংবিধানের সঙ্গে বেমানান সামঞ্জস্যহীন ছিল;
৩. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ যেহেতু সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল এবং ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ সংবিধানের কোনাে বিধানকেই লংঘন বা বিক্ষুব্ধ করেনি, সেহেতু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ধানমন্ডি থানা মামলা নম্বর ১০(১০) ১৯৯৬ এবং জেলহত্যা মামলা লালবাগ থানার মামলা নম্বর ১১(১১) ১৯৭৫ বেআইনি বা ক্ষমতাবহির্ভূত মর্মে প্রার্থিত ঘােষণার কোনাে আইনি সুযােগ নেই; উপরন্তু জেলহত্যা মামলা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের আওতাবহির্ভূত ছিল; |
৪. পাঁচজন বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি ও বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য : “ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ আইনটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ একটি বৈধ আইন;” সঠিক ও আইনসম্মত।
ফলে রিট দুটি খারিজ হয়। তবে হাইকোর্ট বিভাগ রিট আবেদনকারীদের আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৩-এর বিধান অনুসারে আপিল বিভাগে আপিল দায়েরের জন্য সার্টিফিকেট প্রদান করেন।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়ােজন, হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে বিস্তারিত আলােচনা শেষে সিদ্ধান্তের অংশে এসে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫’-কে ‘অকার্যকর একটি আইন হিসেবে’ অভিমত ব্যক্ত করলেও রায়ের গর্ভে এই আইনটিকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) অনুযায়ী প্রণীত একটি বৈধ সাধারণ আইন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাইকোর্ট বিভাগ আরাে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, “যেহেতু খােন্দকার মােশতাক। আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে, সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নয়, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জারি করেছিলেন, সেহেতু, এটি একটি সাধারণ আইন”; সুতরাং, এই আইন সংশােধন বা বাতিলের জন্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ অনুসরণ অর্থাৎ সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সমর্থনে সংবিধান সংশােধনের কোনাে প্রয়ােজন নাই এবং সাধারণ আইন দ্বারা সংসদে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তা বাতিল করা বৈধ। হাইকোর্ট বিভাগ রায়ে আরাে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যেহেতু একটি অকার্যকর আইন হিসেবে ঘােষিত হয়েছে, সুতরাং জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্টের ধারা ৬-এর বিধান অনুযায়ী রিট আবেদনকারীরা কোনাে সুবিধা কেউ পাবে না- অর্জিত বা প্রাপ্ত অধিকারের’ অজুহাতে। (বি.এল.ডি. পৃষ্ঠা-১১৩, অনুচ্ছেদ-৬৪ ও ৮৭)।
আরাে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, এ মামলার শুনানিতে রিট আবেদনকারীদের বিজ্ঞ আইনজীবীর জোরালাে বক্তব্য ছিল যে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ একটি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে। ঐ বিপ্লবের ফলে সরকার পরিবর্তন হয় এবং একটি নতুন সরকার গঠিত হয়েছিল। সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে চতুর্থ তফসিলে অনুচ্ছেদ ‘ক’ ও ‘১৮ সংযােজনের মাধ্যমে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এবং ৯ এপ্রিল ১৯৭৯-এর মধ্যবর্তী সময়ের সকল কর্ম ও কার্যকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এ কার্যসমূহকে কোনাে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার আদৌ কোনাে সুযােগ নেই। প্রত্যুত্তরে তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল কে. এস. নবীর বক্তব্য ছিল যে, ১৫
৩৫৬
আগস্টের ঘটনা কোনাে বিপ্লব ছিল না; সশস্ত্র বাহিনীর একটি গ্রুপ অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে পরিকল্পিতভাবে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবন আক্রমণ করে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেছে। এটা রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারবর্গকে খুনের একটি ঘটনা। অস্ত্রধারীদের সহায়তায় খােন্দকার মােশতাক আহমেদ অবৈধ ও বেআইনিভাবে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেছিলেন। তার সব কর্মকাণ্ড অবৈধ ও অসাংবিধানিক এবং আইনের দৃষ্টিতে অকার্যকর। সুতরাং, খােন্দকার মােশতাক কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আইনের দৃষ্টিতে অস্তিত্বহীন, অকার্যকর, অসাংবিধানিক এবং আসামিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলতে কোনাে বাধা নেই।।
হাইকোর্ট বিভাগ, দুই বিজ্ঞ আইনজীবীর উপরােক্ত পরস্পরবিরােধী বক্তব্যকে ‘আবেগতাড়িত বক্তব্য (emotional contentions)’ মর্মে অভিমত দেন। হাইকোর্ট বিভাগের অভিমত ছিল, যেহেতু সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনী দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভােটে অনুমােদিত ও গৃহীত হয়েছিল, সুতরাং এটা সংবিধানের অংশ ও বৈধ। হাইকোর্ট বিভাগ এটাকে ‘অতীত ও সমাপ্ত (past and close) বিষয় উল্লেখ করে পঞ্চম সংশােধনীর বিষয়ে ভিন্ন কোনাে মতামত দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
প্রাসঙ্গিকভাবে আরাে উল্লেখ করা সঙ্গত হবে যে, পঞ্চম সংশােধনীর বিষয়ে উপরােক্ত মামলাসমূহে উক্ত সংশােধনীকে বৈধ মর্মে গ্রহণ করে রায় প্রদান করলেও এর প্রায় দশ বছর পর (২৯.০৮.২০০৫) মাননীয় বিচারপতি জনাব এ. বি. এম. খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ ‘ইটালিয়ান মার্বেল ওয়ার্কস্ লি: বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলায় সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীকে অবৈধ, বেআইনি ও অকার্যকর মর্মে ঘােষণা করেন, যা আপিল বিভাগও বহাল রাখেন।
হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারীদের দায়েরকৃত আপিলসমূহ আপিল বিভাগেও খারিজ হয়। তবে হাইকোর্ট বিভাগ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫ অকার্যকর একটি আইন হিসেবে’ পাঁচজন অ্যামিকাস কিউরি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের সাথে একমত পােষণ করে যে অভিমত দিয়েছিলেন তাকে আপিল বিভাগ ‘অযাচিত’ (uncalled for) হিসেবে আখ্যায়িত করেন- তা সমর্থনযােগ্য নয় বলে অভিমত দিয়েছেন।
আপিল বিভাগের অভিমত ছিল- ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫’র আইনটিতে ‘অতি জাদুকরী (extra magic)’ কোনাে বিষয় ছিল না। রাষ্ট্রপতি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) অনুসারে ঐ আইন জারি করেছিলেন। সংসদে কোনাে অধ্যাদেশ অনুমােদন দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, তা সংবিধানের অংশে পরিণত হবে। সুতরাং, সাধারণ আইন হিসেবে বিবেচিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বা পরিবর্তন অপর একটি সাধারণ আইন দ্বারা হতেই পারে; অতএব ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬’ একটি বৈধ আইন।
ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ একটি বৈধ আইন হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগ থেকে ঘােষিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার তদন্ত ও বিচার দ্রুতগতি লাভ করে। মােট ২০ জন আসামির বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ১২০বি/৩০২/৩৪ এবং ২০১ ধারায় অভিযােগ গঠন করা হয়।
চার্জ গঠনের পর একজন আসামি, মিসেস জোবাইদা রশিদ হাইকোর্টে রিভিশন দায়ের করে মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ঢাকার বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ কাজী গােলাম রসূল ০৮.১১.১৯৯৮ তারিখের রায় প্রদান করেন। ঐতিহাসিক এই রায় ও আদেশে ১৯ জন আসামির মধ্যে ১৫ জন আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে সকলকে ‘মত্যদণ্ড প্রদান করে খালাস প্রদান করেন।
কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারা ৩৭৪ অনুযায়ী বিচারিক আদালত প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ড’ আদেশ অনুমােদনের জন্য হাইকোর্ট বিভাগে রেফারেন্স প্রেরণ করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগের উল্লেখযােগ্য সংখ্যক জ্যেষ্ঠ বিচারপতিগণ এই ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে বিব্রতবােধ করেন। তাদের এমন অপ্রত্যাশিত মানসিকতা কিছুটা হলেও সর্বোচ্চ
৩৫৭
আদালতের ভাবমূর্তিতে কলঙ্ক-তিলক এঁকেছিল। অবশেষে মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ রুহুল আমিন ও মাননীয় বিচারপতি জনাব এ. বি. এম. খায়রুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে এই ডেথ রেফারেন্সের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানি শেষে বেঞ্চের একজন মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ রুহুল আমিন ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন এবং একজন আসামির দণ্ডাদেশ পরিবর্তন এবং পাঁচজনকে অভিযােগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে খালাস প্রদান করেন। কিন্তু বেঞ্চের অপর মাননীয় বিচারপতি জনাব এ. বি. এম. খায়রুল হক ১৫ জন আসামিরই মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে তা অনুমােদন করেন। এর ফলে সঙ্গত কারণে ডেথ রেফারেন্সটি তৃতীয় একটি বেঞ্চে প্রেরণ করা হয়। তৃতীয় বেঞ্চের বিচারক হিসেবে মাননীয় বিচারপতি জনাব ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশের সাজা বহাল রেখে ৩ জনকে খালাস প্রদান করেন।
এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে কারাগারে আটক দণ্ডিত পাঁচজন পৃথক পৃথকভাবে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে ‘লিভ পিটিশন দাখিল করলে আপিল বিভাগে লিভ’ মঞ্জুর হয়। আপিল বিভাগ দণ্ডিতদের পক্ষে উপস্থাপিত পাঁচটি আইনি বিষয় বিবেচনার জন্য লিভ মঞ্জুর করে। আইনি বিষয়গুলাে ছিল :
“১. হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চের দুজন বিচারক ভিন্নমত পােষণ করে পৃথক পৃথক রায় প্রদান করায় তৃতীয় বিচারক পূর্ণাঙ্গভাবে অর্থাৎ সকল সাজাপ্রাপ্তের বিষয়ে ডেথ রেফারেন্সটির শুনানি গ্রহণ না করে শুধু ছয়জন সাজাপ্রাপ্তের রেফারেন্স শুনানি করে আইনগত ভুল করেছে
২. দীর্ঘ বিলম্বে অর্থাৎ ২১ বছর পর রাষ্ট্রপক্ষ অসৎ উদ্দেশ্যে ও পরিকল্পিতভাবে মনগড়া গল্প তৈরি করে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে’– কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগ এই বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দিয়ে চরম ভুল করেছে;
৩. ‘সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেনা বিদ্রোহের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিহত হয়েছেন’- এটা সাধারণ বা প্রচলিত কোনাে খুন নয়; সুতরাং প্রচলিত আদালতে এ খুনের বিচার এখতিয়ারবহির্ভূত ও বিচার কার্যক্রমকে কলুষিত (vitiated) করেছে;
৪. রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত সাক্ষ্যসমূহ প্রমাণ করে না যে, হত্যাকে সংঘটিত করার জন্য কোনাে ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, বরং সামরিক বিদ্রোহ হয়েছিল মুজিব সরকারকে পরিবর্তনের জন্য; ৫. রাষ্ট্রপক্ষ দণ্ডিত আপিলকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য আদালতে উপস্থাপনে এটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে, তারা পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারায় কোনাে অপরাধ সংঘটিত করেছে এবং সে কারণে হাইকোর্ট বিভাগ আপিলকারীদের দণ্ড ও সাজা বহাল রেখে মারাত্মক ভুল এবং আইনের অপপ্রয়ােগ করেছে।”
এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠন করলে আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের শেষ ধাপ থমকে যায়। আপিল শুনানির জন্য আপিল বিভাগে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক বিচারক নিয়ােগ না দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিচারক সংকট তৈরি করে রাখা হয়। বিশেষভাবে নিযুক্ত আইনজীবী বর্তমান আইনমন্ত্রী জনাব আনিসুল হককে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
অবশেষে দীর্ঘ আট বছর পর ২০০৯ সালে আবারাে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলে পিল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়ােগের মাধ্যমে আপিল শুনানি সম্ভব হয়। আপিল বিভাগ সংশ্লিষ্ট পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের বক্তব্য শােনার পর দণ্ডিত আপিলকারীদের পক্ষে উত্থাপিত আইনগত প্রশ্নসম সিদ্ধান্ত ও অভিমতসমূহ প্রদান করে আপিলসমূহ খারিজ করে দেন :
“১. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারা ৩৭৪ ও ৪২৯ অনুসারে তৃতীয় বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারক সম্পূর্ণ এখতিয়ার রাখেন যে, তিনি বিরােধপূর্ণ কোন বিষয়ের উপর শুনানি করবেন’; সুতরাং তৃতীয়
৩৫৮
বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারক হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকগণ যে ছয়জন আসামির বিষয়ে দ্বিমত পােষণ করেছেন শুধু তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কোনাে ভুল করেননি;
২. বিজ্ঞ দায়রা জজ এবং হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ দীর্ঘ বিলম্বে এজাহার দায়ের সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যাখ্যা ও সাক্ষ্য পর্যালােচনায় যে সিদ্ধান্ত একযােগে দিয়েছেন তাতে হস্তক্ষেপ করার কোনাে সুযােগ নেই; শুধু বিলম্বে এজাহার দায়েরের কারণে প্রসিকিউশন অর্থাৎ রাষ্ট্রপক্ষের অভিযােগ অবিশ্বাস করার কোনাে সুযােগ নেই; বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনা ও পরিস্থিতির কারণে এজাহার দায়েরে বিলম্ব হতেই পারে;
৩. আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ধারা ৫৯(২) অনুসারে ঐ আইনের অধীনে খুনের ঘটনা বিচার তখনই হবে যদি অপরাধীরা কর্মে সক্রিয় (এক্টিভ সার্ভিস)’ থাকে; কিন্তু আসামিরা আর্মি অ্যাক্টের ধারা ৮(১) অনুসারে কর্মে সক্রিয় (এক্টিভ সার্ভিস) ছিল না বিধায় প্রচলিত ফৌজদারি আদালতে তাদের বিচারে কোনাে বাধা ছিল না; দ্বিতীয়ত, যদি এটা ধরেও নেওয়া হয় যে, আর্মি অ্যাক্টের ধারা ৮(২) অনুসারে এটা একটা ‘দেওয়ানি অপরাধ’ (সিভিল অফেন্স) তথাপি ঐ আইনের ধারা ৯৪ অনুসারে প্রচলিত আদালতে বিচারে কোনাে বাধা নেই;
৪. আদালতে উপস্থাপিত সাক্ষ্য পর্যালােচনায় এ সিদ্ধান্তে আসার কোনাে সুযােগ নেই যে, সেনা বিদ্রোহের কারণেই বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও অপর তিনজন নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল; এটা ‘সেনা বিদ্রোহ সংঘটিত করার জন্য কোনাে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ছিল না, বরং ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রটি ছিল বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দকে হত্যা করার জন্য;
৫. হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ উপস্থাপিত সাক্ষ্য বিবেচনায় বিশ্বাস করেছেন যে, রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগসমূহ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে সক্ষম হয়েছে; অপরদিকে দণ্ডিত আপিলকারীগণ এটা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে যে, হাইকোর্ট বিভাগ সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণে ও বিবেচনায় ‘গুরুতর কোনাে ভুল’ বা ‘অবিচার করেছেন, যাতে ন্যায়বিচার বিঘ্নিত ও আইনের অপপ্রয়ােগ হয়েছে;
৬. দণ্ডিত আপিলকারীগণ আদালতের সামনে এমন কোনাে বিশেষ বিষয়’ বা ‘প্রেক্ষাপট’ উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়নি যার ভিত্তিতে তাদের মৃত্যুদণ্ডের সাজা হ্রাস করা যেতে পারে এবং সে কারণে দায়রা আদালত কর্তৃক প্রদত্ত মৃত্যুদণ্ডের সাজা যা ডেথ রেফারেন্সে হাইকোর্ট বিভাগ অনুমােদন দিয়েছে তাতে হস্তক্ষেপ করার কোনাে সুযােগ নেই।”
‘বিলম্ব কোনাে অপরাধীর বিচারে কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে না’- এই আইনি নীতিটি আবারও স্বীকৃতি পায়। বিচার চাইবার অধিকার সাংবিধানিক ও সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃত অধিকারকে স্বৈরাচারী কোনাে অধ্যাদেশ দ্বারা রুদ্ধ করা যায় না।
আপিল বিভাগের রায়ের পরপরই কারাগারে থাকা দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচজনের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয় ২৮ জানুয়ারি, ২০১০-এ। সাম্প্রতিক সময়ে আরাে একজন দণ্ডিতকে গ্রেফতার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। এর ফলে জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে; অবসান হয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও গ্লানির। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্ট বিলম্বে হলেও জাতির জনকের হত্যার বিচারে অর্পিত সংবিধানিক ও আইনি দায়িত্ব, বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও পালনে সক্ষম হয়েছে।
৩৫৯
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট
হাইকোর্ট বিভাগ
শাহরিয়ার রশিদ খান বনাম বাংলাদেশ
রিট পিটিশন নং-৫৩২১/১৯৯৬
মিসেস মাহমুদা রহমান বনাম বাংলাদেশ
রিট পিটিশন নং-৫৩১৩/১৯৯৬
রায়ের তারিখ : ২৮ জানুয়ারি ১৯৯৭
বিচারপতিবৃন্দ
বিচারপতি মােঃ মােজাম্মেল হক
বিচারপতি মােঃ আবদুল মতিন
পিটিশনার পক্ষে আইনজীবী
অ্যাডভােকেট মােহাম্মদ কোরবান আলী,
অ্যাডভােকেট জাহাঙ্গীর আলম খান (উভয় রিট পিটিশনে)।
রেসপনডেন্ট পক্ষে আইনজীবী
কে. এস. নবী, অ্যাটর্নি জেনারেল,
আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া,
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল কাইসারউদ্দিন আহমেদ,
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল
বজলুর রহমান ছানা, অ্যাসিসটেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল
অ্যামিকাস কিউরিয়াবৃন্দ
সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ,
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদ,
সিনিয়র অ্যাডভােকেট কামাল হােসেন,
সিনিয়র অ্যাডভােকেট রফিক-উল হক,
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এম. নুরুল্লাহ,
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এম. আমীর-উল ইসলাম,
সিনিয়র অ্যাডভােকেট
৩৬৬
রায়
বিচারপতি মােঃ মােজাম্মেল হক :
যেহেতু, উভয় রিট পিটিশনে (নং-৫৩২১/১৯৯৬ এবং ৫৩১৩/১৯৯৬) ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট-এর সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, সেহেতু, দুটো মামলা একসঙ্গে শুনানি করা হয়েছে এবং বর্তমান রায়ের মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করা হলাে।
২. কেন ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট অবৈধ, বেআইনি, সংবিধান-বহির্ভূত এবং কোন আইনগত কার্যকারিতাবিহীন বলে ঘােষণা করা হবে না; এবং কেন ২-১০-৯৬ তারিখে ধানমণ্ডি থানায় দায়েরকৃত মামলাটি (নং-১০(১০)/১৯৯৬) এবং ৪-১১-৭৫ তারিখে লালবাগ থানায় দায়েরকৃত মামলাটি (নং-১১(১১)/৭৫ অবৈধ, বেআইনি এবং বাতিল বলে ঘােষণা করা হবে না মর্মে রেসপনডেন্টগণের প্রতি কারণ দর্শানাের জন্য রুলগুলাে ইস্যু করা হয়।
৩. ৫৩২১/১৯৯৬ নং রিট পিটিশনে কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাহরিয়ার রশিদ খান পিটিশনার। তাকে ধানমণ্ডি থানা মামলা (নং-১০(১০)/১৯৯৬ তারিখ ২-১০-৯৬) এবং লালবাগ থানা মামলা (নং-১১(১১)/৭৫ তারিখ ৪-১১-৭৫) এই দুটি মামলায় আসামি করা হয়েছে। তার দায়েরকৃত এই রিট পিটিশনে ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্টকে এবং উপরােক্ত দুইটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।
৪. ৫৩১৩/১৯৯৬ নং রিট পিটিশনে মিসেস মাহমুদা রহমান হলেন পিটিশনার। তিনি কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক রহমানের মাতা। এই রিট পিটিশনে ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট এবং ধানমন্ডি থানায় দায়েরকৃত মামলাটির (নং-১০(১০)/১৯৯৬) বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। পিটিশনে বর্ণনা করা হয়েছে যে, আসামি কর্নেল ফারুক রহমান কাস্টডিতে রয়েছে। তার দরখাস্তকারী-মাতা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন জেল থেকে আসামি কর্নেল ফারুক রহমানের স্বাক্ষরিত ওকালতনামা পেতে, কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। যেহেতু, মা হয়েও তার পুত্রের (জেলে থাকা অবস্থায়) কাছ থেকে ওকালতনামা সংগ্রহ করতে পারেননি, সেহেতু ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট এবং বর্ণিত ক্রিমিনাল প্রসিডিংস এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তার পুত্রের পক্ষে বর্তমান রিট পিটিশনটি দায়ের করার কোনও বিকল্প ছিল না।
৫. এই প্রসঙ্গে ঘটনার সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করা প্রয়ােজন। ১৯৭৫ সালের সংবিধান (চতুর্থ সংশােধনী) আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধান সংশােধন করা হয় এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫-এর সকালে একদল সেনাসদস্য কু্য সংগঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্যদের হত্যা করে। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এই সেনা সদস্যরা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মন্ত্রীপরিষদের সদস্য খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে রাষ্ট্রপতি পদে বসায়। খােন্দকার মােশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে সরকারের ক্ষমতায় বসেন ১৫-৮-৭৫ তারিখে এবং ২০ই আগস্ট ১৯৭৫-এ সামরিক শাসন জারি করেন যা সারাদেশে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে কার্যকর বলে ঘােষণা করা হয়। ২০ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে জারিকৃত প্রােক্লেমেশন দ্বারা খােন্দকার মােশতাক আহমেদ সারাদেশে সামরিক শাসন জারি করলেও এই শর্তে বাংলাদেশের সংবিধান বহাল রাখা হয় যে, Martial Law Proclamation, Martial Law Regulation 978 Martial Law Orders সাপেক্ষে বাংলাদেশ সংবিধান কার্যকর থাকবে। ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ খােন্দকার মােশতাক আহমেদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন যা ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০ নামে পরিচিত।
৩৬৭
১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্যদের হত্যার জন্য দায়ী সকল ব্যক্তিকে এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তি প্রদান করা হয় এবং ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং সামরিক শাসন জারির সঙ্গে জড়িত কতিপয় কার্যাবলি অথবা এই প্রসঙ্গে সংঘটিত কোনও কার্য অথবা কোনও পরিকল্পনা কার্যকর করার প্রস্তুতি, অথবা প্রয়ােজনীয় কোনও পদক্ষেপ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কোনও আইনগত অথবা অন্য কোনও ধরনের কর্যক্রম গ্রহণ করাকে নিষিদ্ধ করা হয়।
৬. ২রা নভেম্বর ১৯৭৫ (৩-১১-৭৫) দিবাগত রাতে চার জাতীয় নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। তারা হলেন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কামরুজ্জামান। এই জেলহত্যার সূত্রে জেল কর্তৃপক্ষ লালবাগ থানায় প্রাথমিক তথ্য বিবরণী দাখিল করে যা লালবাগ থানা মামলা নং-১১(১১)/১৯৭৫ হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। উক্ত মামলাটি লালবাগ থানায় অমীমাংসিত অবস্থায় পড়ে থাকে এবং এ বিষয়ে পরবর্তী কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ১৯৯৬ সালের ২রা অক্টোবর রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যগণ এবং অন্যান্যদের হত্যা সম্পর্কিত একটি প্রাথমিক তথ্য বিবরণী ধানমন্ডি থানায় দাখিল করা হয় (ধানমন্ডি থানার মামলা নং-১০(১০)/১৯৯৬)। কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাহরিয়ার রশিদ খানসহ অন্যান্যদের উপরােক্ত দুইটি ফৌজদারি মামলায় আসামি করা হয় এবং কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফারুক রহমানসহ অন্যান্যদেরকে ধানমন্ডি থানার মামলাটিতে (মামলা নং-১০(১০)/১৯৯৬) আসামি করা হয়।
৭. সংসদ যেহেতু, ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করা প্রয়ােজন মনে করেছে, সেহেতু, ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট প্রণয়ন করা করেছে। রহিতকরণ আইনটি ১৪-১১-৯৬ তারিখে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়। উক্ত ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ এর ধারা (১)(২) নিম্নরূপ :
“2(1) The Indemnity Ordinance, 1975 (L of 1975 যাহা XLX of 1975 নম্বরে মুদ্রিত) অতঃপর উক্ত Ordinance বলিয়া উল্লেখিত, এতদ্বারা রহিত করা হইল।
(২) এই আইন বলবৎ হইবার পূর্বে যে কোন সময় উক্ত Ordinance এর অধীনকৃত কোন কার্য, গৃহীত কোন ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ অথবা অর্জিত কোন অধিকার বা সুযােগ-সুবিধা অথবা সরকার বা কোন কর্তৃপক্ষের জন্য সৃষ্ট কোন দায়-দায়িত্ব, যদি থাকে এর ক্ষেত্রে জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট, ১৮৮৭ (X of 1887) এর ৬নং ধারার বিধানাবলী প্রযােজ্য হইবে না এবং উক্তরূপ কৃতকার্য, গৃহীত ব্যবস্থা প্রদত্ত সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ বা অর্জিত অধিকার বা সুযােগ সুবিধা বা সৃষ্ট দায়-দায়িত্ব উপ-ধারা (১) দ্বারা উক্ত Ordinance রহিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে এইরূপে অকার্যকর বাতিল ও বিলুপ্ত হইয়া যাইবে যেন উক্ত Ordinance জারি করা হয় নাই এবং উক্ত Ordinance এর কোন অস্তিত্ব ছিল না ও নাই।”
৮. ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং ২১ এবং উপরােক্ত দুইটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে বর্তমান রিট পিটিশন দুইটি আনীত হয়েছে। পিটিশনাররা পরবর্তীতে অত্র আদালত থেকে বর্তমান রুল দুইটি লাভ করেছেন।
৯. এই দুইটি মামলায় পিটিশনারগণ অনেকগুলাে অভিযােগ উত্থাপন করেছেন যেগুলাে রেসপন্ডেন্টগণ হলফনামা (অ্যাফিডেভিট ইন অপজিশন) দাখিল করার মাধ্যমে অস্বীকার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রত্তোত্তর হলফনামাও (অ্যাফিডেভিট ইন রিপ্লাই) দাখিল করা হয়েছে। বর্তমান মামলায় ঐসব ঘটনাবলি
৩৬৮
বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার আবশ্যকতা নেই এই কারণে যে, এখানে দুইটি রিট আবেদনেই প্রধানত ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট ১৯৯৬ এর সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে যে, এই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ একটি বৈধ আইন কি না এবং উপরােক্ত দুইটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা সাংবিধানিকভাবে বারিত কি না।
১০. জনাব কে.এস. নবী, বাংলাদেশের বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল, রিট পিটিশন দুটির বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত প্রাথমিক আপত্তিসমূহ উত্থাপন করেছেন :
(ক) বর্তমান রিট পিটিশনগুলাে দাখিল করার জন্য পিটিশনারদের কোনও আইনগত অধিকার (Locus-Standi) নেই।
(খ) এর আগেও উভয় আসামি কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাহরিয়ার রশিদ খান এবং কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফারুক রহমানের পক্ষে দুইটি রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল (পিটিশন নং-৪২৯৭/১৯৯৬ এবং ৪৩৩৪/১৯৯৬)। কিন্তু ঐ দুটি রিট পিটিশনের পিটিশনারদের লােকাস স্ট্যান্ডির অভাবে সংক্ষিপ্ত শুনানির পর আদালত কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কেননা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড এর অধীনে। পিটিশনারদের বিকল্প প্রতিকার পাওয়ার পথ খােলা ছিল। সেহেতু, বর্তমান রিট পিটিশন দুইটি রক্ষণীয় নয়। তিনি আরাে বলেন যে, ঐ দুইটি রিট পিটিশনে প্রদত্ত আদেশের বিরুদ্ধে পিটিশনারগণ আপীল বিভাগেও গিয়েছিল এবং আপিল দায়ের করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লিভ পিটিশনগুলাে শুনানির সময় পিটিশনারদের অ্যাডভােকেট বর্নিত আপিল দুইটি আপীল বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে নেন। সেহেতু, বর্তমান রিট পিটিশনগুলােও চলতে পারে না।
(গ) বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে তাদের আটকাদেশকে (Detention) চ্যালেঞ্জ করে বর্তমান দুই আসামির পক্ষে অতীতে আরাে দুইটি রিট পিটিশন দাখিল করা হয়েছিল। উক্ত রিট পিটিশন দুইটিতে উভয় রুল অ্যাবসলিউট করা হয়েছিল এবং তাদের মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে আটকাদেশকে চ্যালেঞ্জ করে দাখিলকৃত ঐ রিট আবেদনগুলােতে, প্রকৃতপক্ষে, পিটিশনারগণ আটকাদেশের কারণসমূহ অস্বীকার করেননি। যেহেতু, প্রকৃতপক্ষে তাদের আটকাদেশের কারণসমূহ স্বীকৃত সেহেতু, বর্তমান রিট পিটিশন দুইটি রক্ষণীয় নয়।
১১. পিটিশনারদের পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব মােঃ কোরবান আলী নিবেদন করেন যে, বর্তমান রিট পিটিশনে (নং-৫৩২১/১৯৯৬) শাহরিয়ার রশিদ খান নিজেই পিটিশনার। তিনি কারাগারে থেকে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করেছেন এবং এই রিট আবেদনটি দাখিল করেছেন। কেবল আদালতের অনুমতিতে তার স্ত্রী কর্তৃক হলফনামায় শপথ করা হয়েছে। রিট পিটিশন নং-৫১৩/১৯৯৩ এ মিসেস মাহমুদা রহমান আসামি ফারুক রহমানের মাতা। তিনি এই রিট পিটিশনের পিটিশনার। পিটিশনে তিনি এই অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন যে, তার পুত্র কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফারুক রহমান ১৩-৮-৯৬ তারিখ থেকে কারাগারে আটক আছেন। তিনি তার পুত্র কর্তৃক জেল থেকে ওকালতনামা সম্পাদন করানাের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ওকালতনামা সম্পাদন করার অনুমােদন প্রদান করা হয়নি। যেহেতু, আসামি ফারুক রহমানকে রিট পিটিশন দায়েরের জন্য ওকালতনামা সম্পদানে অনুমতি দেয়া হয়নি সেহেতু, তার মাতা তার পুত্রের পক্ষে পিটিশনার হিসেবে এই রিট পিটিশনটি দাখিল করেছেন। জনাব কোরবান আলী আরাে নিবেদন করেছেন যে, পিটিশনার মিসেস মাহমুদা রহমান তার পুত্রের পক্ষে ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১ এবং পুত্রের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ফৌজদারি কার্যক্রম এর
৩৬৯
বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। সেহেতু, জনাব কোরবান আলী নিবেদন করেছেন যে, উভয় রিট পিটিশন বর্তমান আকারে রক্ষণীয়।
১২. বর্তমান দুটি রিট পিটিশনে (নং-৪২৯৭/১৯৯৬ এবং ৪৩৩৪/১৯৯৬) যথাক্রমে শাহরিয়ার রশিদ খানের স্ত্রী এবং ফারুক রহমানের মাতা দুই আসামির (যারা কারাগারে আছেন) আটকাদেশকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, কিন্তু তারা তাদের আবেদনের প্রার্থিত প্রতিকার অংশে উপরােক্ত দুইটি ফৌজদারি কার্যক্রমের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাদের দাবি হলাে উক্ত দুইটি ফৌজদারি কার্যক্রম কোনােরূপ আইনগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে দায়ের করা হয়েছে, সেহেতু, এগুলাের কোনরূপ আইনগত বলবৎযােগ্যতা নেই বলে। হাইকোর্টের ঘােষণা করা উচিত। এই আদালত সংক্ষিপ্ত শুনানির ভিত্তিতে এই রিট পিটিশন দুইটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই যুক্তিতে যে, সংবিধানের ১০২(২)(খ) (অ) নং অনুচ্ছেদ প্রয়ােগে বর্ণিত ফৌজদারি কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না, কেননা ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড এর অধীনে কার্যক্রম বাতিলের বিকল্প প্রতিকার ছিল। উপরন্তু, উভয় পিটিশনার প্রকৃতপক্ষে আইনত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ছিলেন না এবং এ কারণে সংক্ষিপ্ত শুনানির মাধ্যমে রিট পিটিশন দুইটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। কিন্তু, বর্তমান দুইটি রিট পিটিশনের বিষয়বস্তুতে ভিন্নতা রয়েছে। এখানে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ এবং উপরােক্ত দুইটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করার আইনগত বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। সেহেতু, আমাদের অভিমত এই যে, পূর্বের দুইটি রিট পিটিশন বর্তমান রিট পিটিশনগুলাে দায়ের করার ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধক হতে পারে না। পূর্ববর্তী দুইটি রিট পিটিশনের মামলার কারণ (cause of action) বর্তমান দুইটি রিট পিটিশনে উত্থাপিত মামলার কারণ থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক। দুইজন ডেটি এর আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে রিট পিটিশন দুইটি বর্তমান দুই আসামির পক্ষে দায়ের করা হয়েছিল। শুনানি শেষে এই আদালত উভয় রুল অ্যাবসলিউট করেছিলেন এবং ডেটিনদের মুক্তি দেয়ার নির্দশ দিয়েছিলেন, যদি তারা অন্য কোনও মামলা সূত্রে আটক না থাকে। উপরে বর্ণিত মতানুসারে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, বর্তমান রিট পিটিশন দুইটি রক্ষণীয় এবং সেহেতু, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল কর্তৃক উত্থাপিত প্রাথমিক আপত্তিসমূহ গ্রহণ করা যায় না।
১৩. বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব কোরবান আলী উভয় রিট পিটিশনে পিটিশনারদের পক্ষে নিমােক্ত যুক্তিসমূহ উত্থাপন করেছেন :
(ক) ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট (নং-২১/১৯৯৬) সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক এবং ১৮নং অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।
(খ) যেহেতু, ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত (protected and saved), সেহেতু, তা কেবল সংসদ সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে তা বাতিল বা রহিত হতে পারে না। উপরন্তু, এরূপ একটি অর্ডিন্যান্স বাতিল বা রহিত করার নিমিত্ত সাংবিধানিক সংশােধনীর জন্য সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়ােজন, কিন্তু ১৯৯৬ সালের এই আইনটি বেআইনিভাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে পাস করা হয়েছে।
(গ) এমনকি যদি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমেও এটি বাতিল করা হয়, তারপরও এর কার্যকারিতা, ফলাফল, অর্জিত সুবিধা, পরিণতি এবং আইনি অধিকার (effect, consequence, benefit, result and legal right) যা আসামিরা অর্জন করেছে সেগুলােও বহাল থাকবে। কেননা তা
৩৭০
সাংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক এবং ১৮ নং অনুচ্ছেদের এবং জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ৬নং ধারার অধীনে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত। এই সুরক্ষা থেকে উদ্ভূত এরূপ কার্যকারিতা, ফলাফল, অর্জিত সুবিধা, পরিণতি এবং আইনি অধিকার যা উপরােক্ত ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স হতে উৎসরিত হয়েছে তা সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক এবং ১৮ নং অনুচ্ছেদ সংশােধন ছাড়া হরণ করা যাবে না
(ঘ) ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট (নং-২১/১৯৯৬) একটি colourable legislation ছাড়া আর কিছুই নয়, কেননা, যে কাজ (সংবিধান সংশােধন ছাড়া) প্রত্যক্ষভাবে করা যায় না, এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্যই অপ্রত্যক্ষভাবে অর্জন করা হয়েছে।
(ঙ) যেহেতু, ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে সংবিধানের অধীনে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে, তাই আসামিদের বিরুদ্ধে তর্কিত দুইটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা যাবে না। কারণ এই দুইটি ফৌজদারি মামলার আসামিরা সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।
১৪. জনাব কোরবান আলী নিবেদন করেন যে, ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫-এ যা ঘটেছে তা একটি বিপ্লব ছাড়া কিছুই নয়। বিপ্লবের মাধ্যমে তদানীন্তন সরকার পরিবর্তিত হয় এবং নতুন সরকার ক্ষমতা দখল করে। বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ায় খােন্দকার মােশতাক আহমেদ দেশের শাসন ক্ষমতায় আসেন। এসব কার্যক্রম পরবর্তীতে প্রক্লেমেশন নং-১/১৯৭৭ এর অনুচ্ছেদ ৩ক এবং সংবিধানের (পঞ্চম সংশােধনী) আইন নং-১/১৯৭৯ এর মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ১৮ এর অধীনে সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত (protected and saved) হয়েছে। তিনি বলেন যে, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ এর মধ্যে যা করা হয়েছে। সেগুলােকে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক এবং ১৮নং অনুচ্ছেদের অধীনে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। সেই কারণে উক্ত সময়ের মধ্যে সরকার কর্তৃক যা করা হয়েছে সে সম্পর্কে কোনােভাবেই কোনও প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। জনাব কোরবান আলী আরও বলেন যে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ কর্তৃক ২০ই আগস্ট ১৯৭৫ এ সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয় যা ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে কার্যকর হয় এবং যা ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ তারিখে প্রত্যাহার করা হয়। তাই উক্ত সময়ের মধ্যে যা করা হয়েছে সেসব বিষয়কে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এই প্রসঙ্গে তিনি State os. Dosso, 11DLR (SC) 1 মামলাটি উদ্ধৃত করেন।
১৫. জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল রেসপন্ডেটগণের পক্ষে হাজির হয়ে নিবেদন করেন যে, ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ এ যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তা কোন বিপ্লব ছিল না, বরং তা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একদল সেনাসদস্য দ্বারা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন আক্রমণপূর্বক তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্যের ও অন্যান্যদের হত্যা করার ঘটনা, যাদের মধ্যে দশ বছর বয়সী এক শিশুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এটি রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। খােন্দকার মােশতাক আহমেদ একদল সেনাসদস্যের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করে। এর মাধ্যমে খােন্দকার মােশতাক বেআইনি এবং অসাংবিধানিকভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষণা করেন এবং দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তাই, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ একজন দখলদার এবং বেআইনি শাসক ছিলেন। এ কারণে খােন্দকার মােশতাকের শাসন এবং শাসনকাল ছিল সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক। খােন্দকার মােশতাক আহমেদের মতাে একজন ক্ষমতা দখলকারীর কার্যকলাপ সংবিধানের অধীনে সুরক্ষা পেতে পারে না। তাই, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ কর্তৃক জারি করা ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের কোনও আইনগত অস্তিত্ব নেই এবং এই কারণে উল্লিখিত দুইজন আসামি
৩৭১
ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ফৌজদারি কার্যক্রম বা মামলা সাংবিধানিকভাবে বারিত নয় (cannot be called to be constitutionally barred.)।
১৬. বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব কোরবান আলী এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল কে. এস. নবীর উপরােক্ত আবেগতাড়িত বক্তব্যসমূহ গ্রহণ করা কঠিন। কারণ এই মামলায় আমাদেরকে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ সময়কালে বিদ্যমান শাসনকালের সাংবিধানিক বৈধতাকে বিবেচনা এবং বিচার করার জন্য আহ্বান করা হয়নি। উভয়পক্ষে উপস্থিত বিজ্ঞ অ্যাডভােকেটগণ আবেগতাড়িত বলে প্রতিভাত হয়েছেন। উপযুক্ত সময়কালে বহুসংখ্যক সামরিক আইন ফরমান জারি করা হয়েছে, সামরিক আইন বিধিমালা প্রণীত হয়েছে, সামরিক আইন বিধিসমূহ এবং আদেশসমূহ পাস করা হয়েছে এবং প্রশাসন চালানাের জন্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বহুসংখ্যক সাধারণ আইন যেমন, অধ্যাদেশ, বিধিসমূহ, বিধিমালা, উপ-আইন (Ordinance, Rules, Regulations, bys laws) ইত্যাদি পাশ করা হয়েছে। কেবল এগুলােই নয়, সামরিক আইন জারি করার মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সংবিধানের বহু বিধানাবলি সংশােধন অথবা বাতিল করা হয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত, ৬ই এপ্রিল ১৯৭৯ তারিখে সংসদ কর্তৃক সংবিধানের (পঞ্চম সংশােধনী) আইন পাশের মাধ্যমে ঐ সময়ে জারি করা সামরিক আইন বিধিমালা, সামরিক আইন আদেশসমূহ এবং অন্যান্য আইনসমূহকে সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছে। যেহেতু, সংবিধানের (পঞ্চম সংশােধনী) আইন সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ করা হয়েছে এবং যেহেতু, তা সংবিধানের একটি অংশ হিসেবে সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়েছে, সেহেতু, আমরা অতীতে নিস্পত্তি ও সম্পন্ন হয়ে যাওয়া (past and closed issue) বিষয়গুলােকে আবার উন্মােচন করে সংবিধানের (পঞ্চম সংশােধনী) আইন, ১৯৭৯ এর সাংবিধানিক বৈধতা যাচাই করার অবস্থায় নেই। একটি বিদ্যমান এবং চলমান আইন হিসেবে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি দেশের আইনের বইয়ে (Statute book) এতদিন অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৪ই নভেম্বর ১৯৯৬ তারিখে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ পাশের মাধ্যমে উক্ত অর্ডিন্যান্সটি বাতিল করা হয়। যেহেতু, বর্তমান রিট পিটিশন দুটিতে ১৯৯৬ সালের এই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট-এর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, সেহেতু, আমাদের এটি বিবেচনা করতে হবে যে, ১৪ই নভেম্বর, ১৯৯৬-তে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ হিসেবে যে আইনটি পাশ করা হয়েছে তা কেমন আইন এবং ঐ একই সময়ে অর্থাৎ ১৪ই নভেম্বর ১৯৯৬ তারিখে সংবিধানের অবস্থান কী ছিল। আমরা মনে করি যে, আমরা বর্তমান রিট দুইটিতে এর বাইরে যেতে পারি না।
১৭. জনাব কোরবান আলী সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ক এবং ১৮ এবং একইসঙ্গে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের উদ্ধৃতি প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এবং সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ক এবং ১৮ হলাে নিম্নরূপ :
“GOVERNMENT OF THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH
MINISTRY OF LAW, PARLIAMENTARY AFFAIRS AND JUSTICE.
(Law and Parliamentary Affairs Division)
NOTIFICATION
৩৭২
Dacca, the 26th September, 1975
No. 692. Pub: The following Ordinance made by the President of the People’s Republic of Bangladesh, on the 26th September, 1975, is hereby published for general information:
THE INDEMNITY ORDINANCE, 1975
Ordinance No. L of 1975
AN ORDINANCE
To restrict the taking of any legal or other proceedings in respect of certain acts or things done in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitating, the historical change and the proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975.
WHEREAS it is expedient to restrict the taking of any legal or other proceedings in respect of certain acts or things done in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitating, the historical change and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975;
AND WHEREAS Parliament is not in session and the President is satisfied that circumstances exist which render immediate action necessary;
NOW, THEREFORE, in pursuance of the Proclamation of the 20th August, 1975, and in exercise of the powers conferred by clause (1) of article 93 of the Constitution of the People’s Republic of Bangladesh, the President is pleased to make and promulgate the following ordinance:
1. Short title. -This Ordinance may be called the Indemnity Ordinance, 1975.
2. Restrictions on the taking of any legal or other proceedings against persons in respect of certain acts and things-(1) Notwithstanding anything contained in any law, including a law relating to any defense service, for the time being in, force, no suit, prosecution or other proceedings, legal or disciplinary, shall lie, or be taken, in, before or by any Court, including the Supreme Court and Court Martial, or other authority against any person, including a person who is or has, at any time, been subject to any law relating to any defense service, for or on account of or in respect of any act, matter or thing done or step taken by such person in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step towards, the change of Government of
৩৭৩
the People’s Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975.
(2) For the purposes of this section, a certificate by the President, or a person authorized by him in this behalf, that any act, matter or thing was done or step taken by any person mentioned in the certificate in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step towards, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975, shall be sufficient evidence of such act, matter or thing having been done or step having been taken in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step towards, the change of such Government and the Proclamation of Martial Law on that morning.
KHONDAKER MOSHTAQUE AHMED
President
M. H. RAHMAN
Secretary
Dacca 26th September, 1975
President
সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে প্যারাগ্রাফ ৩(১) এবং ২ এবং ১৮ হলাে নিম্নরূপ :
3A (1) The Proclamations of the 20th August, 1975, and 8th November, 1975, and the Third Proclamation of the 29th November, 1976, and all other Proclamations and Orders amending or supplementing them, hereinafter in this paragraph collectively referred to as the said Proclamations and all Martial Law Regulations, Martial Law Orders and all other laws made during the period between the 15th day of August, 1975 and the date of revocation of the said Proclamations and the withdrawal of Martial Law (both days inclusive), hereinafter in this paragraph referred to as the said period, shall be deemed to have been validly made and shall not be called in question in or before any Court or Tribunal on any ground whatsoever.
(2) All orders made, acts and things done, and actions and proceedings taken, or purported to have been made, done or taken, by the President or the Law Administrator or by any other person or authority during the said period, in exercise of purported exercise of the powers derived from any of the said
৩৭৪
Proclamation or any Martial Law Regulation or Martial Law Order or any other law, or in execution of or in compliance with any order made or sentence passed by any Court or authority in the exercise or purported exercise of such powers, shall be deemed to have been validly made, done or taken and shall not be called in question in or before any Court, or Tribunal on any ground whatsoever.
“18. All Proclamations, Proclamation Orders, Martial Law Regulations, Martial Law Orders and other laws made during the period between the 15th August, 1975, and the 9th April, 1979 (both days inclusive), all amendments, additions, modifications, substitutions and omissions made in this Constitution during the said period by any such Proclamation, all orders made, acts and things done, and actions and proceedings taken, or purported to have been made, done or taken, by any person or authority during the said period in exercise of the powers derived or purported to have been derived from any such Proclamation, Martial Law Regulation, Martial Law Order or any other law, or in execution of or in compliance with any order made or sentence passed by any court, tribunal or authority in the exercise or purported exercise of such powers, are hereby ratified and confirmed and are declared to have been validly made, done or taken and shall not be called in question in or before any Court, tribunal or authority on any ground whatsoever.
১৮. আইনের উপরােক্ত বিধানাবলির উপর নির্ভর করে জনাব কোরবান আলী নিবেদন করেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স (নং-৫০) ১৯৭৫ জারি করা হয়েছিল ২৬-৯-৭৫ তারিখে এবং যেহেতু, তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সংরক্ষিত হয়েছে, সেহেতু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ক ও ১৮-এর সংশােধন না করে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বিলােপ করা যাবে না। যেহেতু, এই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ক এবং ১৮-এর অধীন প্রদত্ত সুরক্ষাকে লঙ্ঘন করে, সেহেতু, এই আইনটি (১৯৯৬ সালের) সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং এই কারণে আইনটি বাতিল (Struck down) যােগ্য। জনাব কোরবান আলী এই বিকল্প যুক্তি দেন যে, এমনকি যদি সাধারণ আইনের মাধ্যমেও ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স (নং-৫০)/১৯৭৫ কে সংশােধন কিংবা বিলােপ করা হয়, তথাপিও ইতােমধ্যে এই আইনের অধীনে প্রদত্ত বিষয়গুলাে অর্থাৎ এর কার্যকরতা, পরিণতি, সুবিধা, ফলাফল এবং আইনগত অধিকার যেগুলাে এই অর্ডিন্যান্স থেকে উদ্ভূত হয়েছে। সেগুলাের কার্যকর সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক এ ১৮নং প্যারাগ্রাফ এবং জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ৬নং ধারার বিধান অনুযায়ী বহাল থাকবে। যারা ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এ সংঘটিত ঘটনায় অংশ নিয়েছিল, তারা ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এর কার্যকরতা, পরিণাম, সুবিধা, ফলাফল এবং আইনগত অধিকারের দাবি করতে পারে, সেহেতু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ক এবং ১৮-এর সংশােধনী না করে সাধারণ আইনের মাধ্যমে তা কেড়ে নেয়া যাবে না। তিনি নিবেদন করেন যে, ১৯৭৫ সালের অর্ডিন্যান্সটি বাতিল হয়ে যেতে পারে, কিন্তু এর ফলাফল বিদ্যমান থাকবে এবং যেহেতু, বর্তমান দুইটি রিট পিটিশনের দুইজন আসামির অনুকূলে অর্জিত অধিকার ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে উদ্ভূত।
৩৭৫
উপরােক্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের (নং-৫০/১৯৭৫) অধীনে, সেহেতু, তা কোনও সাধারণ আইন অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট (নং-২১/১৯৯৬) এর মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া যাবে না। ১৯. তিনি আরাে বলেন যে, জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ৬নং ধারাটি যা সংবিধানেই সন্নিবেশিত তদনুসারে
১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ হতে কার্যকর হওয়া আসামিদের অর্জিত অধিকার কোনােভাবেই কেড়ে নেওয়া যাবে না। তাই, উপরােক্ত ফৌজদারি মামলার আসামিরা সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত এবং তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুইটি ফৌজদারি কার্যক্রম সাংবিধানিকভাবেই বারিত।
২০. জনাব কোরবান আলী আরাে নিবেদন করেন যে, ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট একটি Colourable Legislation ছাড়া আর কিছুই নয়। যেহেতু, সংবিধান সংশােধন ছাড়া বা সরাসরি ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি বিলােপ করা যায় না, সেহেতু পরােক্ষভাবে একটি সাধারণ আইন এর মাধ্যমে তা করা হয়েছে। অর্থাৎ, ১৯৯৬ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট পাশ করার নামে প্রকৃতপক্ষে সংবিধানের বিধানের সংশােধন করা হয়েছে। তাই এরূপ একটি Colourable Legislation সংবিধানের লঙ্ঘন (ultra vires).
২১. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেছেন যে, সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) অ্যাক্ট, ১৯৭৯ এর মাধ্যমে
সামরিক আইন প্রক্লেমেশেন, মার্শাল ল’ রেগুলেশন, মার্শাল ল’ অর্ডারস এবং অন্যান্য সকল আইন’ যেগুলাে ১৫-৮-৭৫ থেকে ৯-৪-৭৯ এই সময়কালের মধ্যে প্রণীত হয়েছে তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ দ্বারা সুরক্ষিত ও সংরক্ষিত করা হয়েছিল। ২০ আগস্ট ১৯৭৫ এর একটি সামরিক ফরমানবলে ১৫ই আগস্ট থেকে কার্যকরতা দিয়ে সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল। উক্ত ফরমানের (ঙ) নং প্যারাগ্রাফটি নিম্নরূপ :
“এই ফরমান এবং এর অধীনে আমার প্রণীত অন্যান্য সামরিক আইন বিধিমালা এবং আদেশ সমূহ এবং অন্যান্য আদেশ সমূহ সাপেক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান বলবৎ থাকবে।”
২২. এটি নিবেদন করা হয়েছে যে, যদিও সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল, তা সত্ত্বেও তখনও সামরিক আইন প্রক্লেমেশনস, বিধিমালা এবং আদেশের বিধানাবলির সাপেক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান বহাল ছিল মর্মে বলা হয়েছিল। খােন্দকার মােশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩ বিধি (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল, কারণ তখন সংসদের কোনও অধিবেশন ছিল না। খােন্দকার মােশতাক আহমেদ সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে উক্ত আইনটি জারি করেননি, অথবা উক্ত আইনটি কোনও সামরিক আইন ফরমান অথবা কোনও বিধি অথবা কোনও আদেশ ছিল না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন। যেহেতু, সংবিধান বলবৎ ছিল, সেহেতু, এই আদালতের এটি বিবেচনা করে দেখতে হবে যে, উক্ত অর্ডিন্যান্সটি সংবিধানের বিধান মােতাবেক জারি করা হয়েছিল কি না। ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটিকে সংবিধানের অংশ বা অঙ্গে পরিণত করা হয়নি। যদি উক্ত অর্ডিন্যান্সটি সংবিধানের কোনও বিধানকে লঙ্ঘন করে তখন এটি সংবিধানের পরিপন্থী (ultra vires) হবে। যদি কোন আইন সংবিধান-পরিপন্থী (ultra vires) হিসেবে পরিগণিত হয়, তবে তা সংবিধানের অধীনে সুরক্ষিত হতে পারে না; কেননা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল এমন একটি আইন অন্য কোনও আইন দ্বারা বা আইনের অধীনে সুরক্ষা পেতে পারে না।
৩৭৬
২৩. এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধানের ৯৩(১) নং অনুচ্ছেদটির উদ্ধৃতি প্রদান করেন যা নিম্নরূপ :
“সংসদ ভাঙ্গিয়া যাওয়ার অবস্থার অথবা উহার অধিবেশনকাল ব্যতীত কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনীয় পরিস্থিতি বিদ্যমান রহিয়াছে বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি উক্ত পরিস্থিতিতে যে রূপ প্রয়ােজনীয় বলিয়া মনে করিবেন, সেইরূপ অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করিতে পারিবেন এবং জারি হইবার সময় গৃহীত অনুরূপ প্রণীত অধ্যাদেশ সংসদের আইনের ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন হইবে।”
এর সঙ্গে তিনি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(২) এর ২৬(২) এর উদ্ধৃতিও প্রদান করেন :
৭(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্যকোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, তা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।
২৬(২) রাষ্ট্র এই অংশের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করিবে না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হইলে তাহা এই অংশের কোন বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
২৪. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, কিন্তু এরূপ অধ্যাদেশ জারি করার তারিখ থেকেই তা কার্যকর হয়। বর্তমান মামলাসমূহে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ১৫-৮-১৯৭৫ তারিখে কিন্তু অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে ২৬-৯-১৯৭৫ তারিখে। ঘটনা পরবর্তী সময়ে জারিকৃত ঐরূপ একটি অধ্যাদেশকে ১৫-৮-৭৫ তারিখ থেকে ভূতাপেক্ষ (Retrospective) কার্যকারিতা দেওয়া যায় না। অধ্যাদেশ জারি হওয়ার তারিখ অর্থাৎ ২৬-৯-৭৫ তারিখ থেকে এটি বলবৎ হয়নি। যেহেতু, ১৬-৮-১৯৭৫ তারিখে এটি কার্যকর ছিলনা এবং যেহেতু, এটির ভূতাপেক্ষ (Retrospective) কার্যকারিতা প্রদান করা হয়েছে, সেহেতু, এটি সংবিধানের ৯৩(১)নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় এটি বাতিল। তিনি আরাে নিবেদন করেন যে, ১৯৭৫ সালের অর্ডিন্যান্স নং-৫০ এ এমন কিছু বিধৃত করা হয়েছে যা সংসদও প্রণয়ন করতে পারে না এবং সেই কারণেও এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১)(ক) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
২৫. ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধানের ৩১, ৩২, ৪৬ নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক (ultra moires)। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭ নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ নিম্নরূপ :
“আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোন স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।”
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩২ নিম্নরূপ :
“আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।”
২৬. জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন যে, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ ৩১ ও ৩২ হচ্ছে আমাদের সংবিধানে সুরক্ষিত মৌলিক মানবাধিকার। তাই, জীবন ও দেহের সুরক্ষার অধিকার যা মৌলিক অধিকারের অধীনে সংরক্ষিত
৩৭৭
হয়েছে তা আইনানুযায়ী ব্যতীত কেড়ে নেওয়া যায় না। ১৫-৮-১৯৭৫ এর নির্মম দিনে একদল সেনাসদস্য কর্তৃক তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্যদের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এর পেছনে কোনও আইনের অনুমােদন ছিল না। আমাদের সাধারণ আইন, যেমন পেনাল কোড অথবা সেনা আইন (Army Act) এবং অন্য আইনের অধীনে আইনানুযায়ী বিচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির জীবন কেড়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর সকালে সেনাসদস্যগণ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যগণসহ এবং অন্যান্যদের হত্যা করা হয় যা কোনও আইনের দ্বারা অনুমােদিত ছিল না। যদি কোনও ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির জীবন কেড়ে নেয়, তাহলে অবশ্যই দেশে বিদ্যমান আইন মােতাবেক তার বিচার হবে। ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোনােরূপ আইনগত কার্যক্রম গ্রহণের পথে বিধিনিষেধ (restriction) আরােপ করেছে। যদিও তারা হত্যার অপরাধ সংঘটিত করেছে, তথাপি দেশের সাধারণ আইনের অধীনে বিচারের সম্মুখীন হওয়া থেকে তাদের দায়মুক্তি প্রদান করা হয়েছে। যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫-এর বিধান দ্বারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সেনাসদস্য ও অন্যান্যদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, অথচ সাধারণ প্রচলিত আইনেও এসব অপরাধের বিচার করা বাধ্যতামূলক, তাই এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কেননা, কোনও ধরনের আইনি অনুমােদন ব্যতিরেকেই রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিল এবং ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এর মাধ্যমে হত্যাকারীদের সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। যদিও এতগুলাে মানুষকে হত্যার জন্য দেশের সাধারণ আইনের অধীনেই হত্যাকারীদের বিচার হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল, তথাপি এই অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে হত্যাকারীদের দেশের আইনের অধীনে বিচারের সম্মুখীন হওয়া থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সেহেতু, প্রকৃতপক্ষে এই অর্ডিন্যান্স সংবিধানের ৩১ ও ৩২ নং অনুচ্ছেদের বিধানকে লঙ্ঘন ও ক্ষুন্ন করে এবং ফলে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধায় ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি বাতিল।
২৭. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধানের ৪৬ নং অনুচ্ছেদের উদ্ধৃতি প্রদান করেন যা নিম্নরূপ :
“এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলীতে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রয়ােজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে কোন অঞ্চলে আইন শৃঙ্খলা-রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়ােজনে কোন কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ওই অঞ্চলে প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ, দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্যকোন কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন।”
২৮. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধানের উপরােক্ত অনুচ্ছেদ ৪৬ এর আওতার মধ্যে পড়ে না। যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের ৪৬ নং অনুচ্ছেদের বিধানাবলির পরিপন্থী, সেহেতু, পুরাে অর্ডিন্যান্সটি সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires), কেননা উক্ত অধ্যাদেশ সংবিধানের ৪৬ নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেহেতু এটি ছিল আদিতে বাতিল (ooid-ab-initio) যেহেতু, খােদ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং শুরু থেকেই বাতিল (ooid ab-initio), সেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নিজে অথবা এর ফলাফল, পরিণতি, কার্যকরতা, সুবিধা অথবা কথিত ন্যস্ত অধিকার সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক এবং ১৮নং অনুচ্ছেদের অধীনে সুরক্ষিত ছিল বলে দাবি করা যায় না।
২৯. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের পরবর্তী বক্তব্য এই যে, ২০-৮-৭৫ তারিখে সামরিক আইন জারি সত্ত্বেও এর পাশাপাশি সংবিধান প্রচলিত ছিল এবং যখন ২৬-৯-৭৫ তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫
৩৭৮
জারি করা হয়েছিল তখন সংসদ অধিবেশনে ছিল না। খােদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটির দিকে লক্ষ্য করলে এটি নির্জলা (এক্স ফেইসি) প্রতীয়মান হয় যে, এটি খােন্দকার মােশতাক আহমেদ কর্তৃক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংবিধানের অধীনে জারি করা হয়েছিল, কোনও সামরিক আইন ফরমান অথবা বিধিমালা অথবা আদেশ কিংবা সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কোনও আদেশের অধীনে নয়।
৩০. জনাব কোরবান আলী বলেন যে, অধ্যাদেশ কিংবা আইন পরবর্তীতে সংশােধনীর মাধ্যমে বাতিল করা যেতে পারে, কিন্তু এর পরিণাম, ফলাফল, সুবিধা কিংবা অন্যান্য অধিকার যা এর মাধ্যমে উদ্ভূত তা জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ৬নং ধারার অধীনে সংরক্ষিত হবে। বর্তমান মামলায় এগুলাে উক্ত আইনের ৬নং ধারা এবং সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সুরক্ষা পাবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(২) এর অধীনে এই সংবিধানের বিধানাবলির ক্ষেত্রে জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট প্রযােজ্য।
কিন্তু জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং শুরু থেকেই তা বাতিল (ooid ab-initio) সেহেতু, তা স্বয়ং সংবিধান কর্তৃক সংরক্ষিত হতে পারে না, কেননা আলােচিত আইনটি তার নিজের বিধানাবলিকে ক্ষুন্ন করে। কেবল অর্ডিন্যান্সটি নয়, এমনকি কোনও অধিকার, সুবিধা, লাভ, পরিণতি কিংবা ফলাফল যা উক্ত অর্ডিন্যান্স এর অধীনে অর্জিত তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সুরক্ষা পেতে পারে না এই কারণে যে, একটি বাতিল আইন কোনও ফলাফল, পরিণাম, সুবিধা কিংবা, কোনও ব্যক্তির বরাবরে আইনগত বা ন্যস্ত অধিকার সৃষ্টি করতে পারে না। একটি বাতিল আইন তার জন্মলগ্ন থেকেই অস্তিত্বহীন এবং যদি একটি আইন বাতিল হয়, তবে এটি কখনাে একজন ব্যক্তির অনুকূলে, যার জন্য একটি প্রণীত হয়েছে, কোনও অধিকার বা লাভ বা সুবিধা সৃষ্টি করতে পারে না। একটি বাতিল আইন কোনও আইন হিসেবে আইনের বইতে (Statute book) বা সংবিধানে বহাল থাকতে পারে না।
৩১. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করা হয়েছিল ঐসব ব্যক্তিগণ যারা সামরিক বাহিনীভুক্ত ছিল তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য কোনও শৃঙ্খলামূলক এবং অন্যান্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিধানের বিরুদ্ধে। একদল সেনাসদস্য রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্যদের ১৫-৮-১৯৭৫ তারিখে হত্যা করেছিল। যেহেতু, তারা হত্যার অপরাধ সংঘটিত করেছিল এবং তারা আর্মি অ্যাক্ট (The Army Act) এর অধীনে অভিযুক্ত এবং বিচারে। সম্মুখীন হওয়ার যােগ্য ছিল, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ আর্মি অ্যাক্টের বিধানাবলিকে ক্ষুন্ন করে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬২তে সামরিক ব্যক্তিগণের অপরাধের জন্য শাস্তির কথা বিধৃত রয়েছে, কিন্তু ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স দেশের প্রচলিত আইনের অধীনে ঐসব সামরিক ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন হওয়া থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে। এই কারণে ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি সংবিধানের ৬২ নং অনুচ্ছেদের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। কেননা, উক্ত অর্ডিন্যান্স জারি করার মাধ্যমে সংবিধানের ৬২ নং অনুচ্ছেদটিকে অর্থহীনতায় পর্যবসিত করা হয়েছে।
৩২. তিনি আরও নিবেদন করেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এর ধারা ২(১) এর বিধানাবলি প্রণীত হয়েছে ঐসব ব্যক্তিদের রক্ষা করার জন্য যারা হত্যার অপরাধ সংঘটিত করেছিল এবং এটি বলা হয় যে, ঐসব ঘটনা ঘটানাে হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের জন্য। সেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছিল ঐসব ব্যক্তিদের জন্য যারা অপরাধ সংঘটিত করার মাধ্যমে সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন এনেছিল। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সরকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের শিকার অন্যান্য ব্যক্তিগণ যারা ১৫-৮-৭৫ তারিখে নিহত হন তারা সরকারের কোনও অংশ ছিলেন না। বরং তারা সাধারণ
৩৭৯
নাগরিক ছিলেন। ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন করা এবং সেই কারণে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্যান্য ব্যক্তিগণ, যাদেরকে ওই দিন সেনাসদস্যরা হত্যা করেছিল তা কোনােভাবেই সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিংবা সংশ্লিষ্ট ছিল না। এ কারণে, যারা আদৌ সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের হত্যার জন্য ঐসব ব্যক্তিদের বিচারের ক্ষেত্রে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স কোনও অধিকার দিতে পারে না। আজ পর্যন্ত পিটিশনারগণ উপরােক্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এর ধারা ২(২) এর অধীনে বর্ণিত রাষ্ট্রপতি কিংবা অন্য কোনও অনুমােদিত ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত কোনও দায়মুক্তি-সার্টিফিকেট (Certificate of immunity) আদালতের সম্মুখে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সেহেতু, এরূপ একটি অর্ডিন্যান্স-এর উদ্দেশ্যে বা অভিপ্রায়সংবিধানের বিধানাবলির পরিপন্থি।
৩৩. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৯ উদ্ধৃত করেছেন। এখানে বলা হয়েছে যে, সংবিধানের
বিধানাবলি সাপেক্ষে সকল আইন অব্যাহতভাবে কার্যকর থাকবে, কিন্তু এগুলাে সংবিধানের অধীনে একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সংশােধন কিংবা বাতিল করা যাবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০ অনুসারে সংবিধানের অন্যান্য বিধানাবলিতে যাই বলা থাকুক না কেন সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের বর্ণিত অস্থায়ী এবং অন্তর্বর্তীকালীন বিধানাবলি বলবৎযােগ্য হবে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) উদ্ধৃত করেছেন যা নিম্নরূপ :
(৭) “উক্ত ফরমানসমূহ বাতিল এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের অব্যবহিত পূর্বে বলবৎ সকল আইন, উক্ত ফরমানসমূহ বাতিল এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারকারী ফরমান সাপেক্ষে, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিবর্তিত, সংশােধিত বা রহিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহতভাবে বলবৎ থাকবে।”
৩৪. যেহেতু ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, দেশের একটি সাধারণ আইন ছিল, তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) এর বিধানাবলি অনুসারে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯ মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছে। সংসদ প্রচলিত যে-কোনও আইনকে সংসদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে অথবা এমনকি একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংশােধন কিংবা বাতিল করার ক্ষমতার অধিকারী। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অনুচ্ছেদ ১৪৯ এবং প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) এর বিধানাবলি বিবেচনায় সংসদ যে কোন আইনের সংশােধন কিংবা বাতিল করার জন্য যথাযথভাবে ক্ষমতাবান এবং সেই কারণে, এই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ প্রণয়নের মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ বাতিল করা হয়েছে। সেহেতু, সংবিধানের কোনও বিধান লঙ্তি হয়নি।
৩৫. জনাব কোরবান আলী বলেন যে, যেহেতু, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ ২৬-৯-৭৫ তারিখে প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং যেহেতু, এই আইনটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সংরক্ষিত, তাই তা সাধারণ আইন (Legislation) এর মাধ্যমে বাতিল হতে পারে না। এটি অবশ্যই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এর অধীনে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় করতে হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল এই যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে নিবেদন করেন যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ ও ১৪৯ অথবা চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭)-এ এই মর্মে কোনও বিধান নেই যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের একটি অংশ এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২-এর বিধান উক্ত অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫-এর সংশােধন কিংবা বাতিলের জন্য অনুসরণ করতে হবে। তাছাড়া, ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে অন্যান্য আইনসমূহের একটি হিসেবে গণ্য করতে হবে, যা ১৫-৮-৭৫ এবং ৯-৪-৭৯ তারিখের মধ্যে প্রণীত হয়েছে এবং সাধারণ আইন হিসেবে সুরক্ষিত হয়েছে।
৩৮০
৩৬. আরাে নিবেদন করা হয় যে, সন্দেহ নেই যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ আদালতের এখতিয়ারের উপর বিধিনিষেধ আরােপ করেছে। আদালত দেখতে পারে, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ এই সময়কালের মধ্যে যেসব আইন করা হয়েছে সেগুলাের বৈধতা কতটুকু। বিধিনিষেধমূলক বিধান (barring clause) থাকা সত্ত্বেও আদালত এটি দেখতে পারে যে, আদালতের এখতিয়ার কতটুকু এবং কি পরিমাণ বারিত করা হয়েছে। আইন দ্বারা আদালতের এখতিয়ার বারিত করা হলেও এই আদালত এটি দেখতে পারে যে, আদালতের এখতিয়ার আইনগতভাবে বারিত করা হয়েছে কি না অথবা এখতিয়ার কতটুকু বারিত করা হয়েছে। সেহেতু, বর্তমান মামলায় এই আদালত বিবেচনা করতে পারে যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ এর সম্পর্কিত ক্ষেত্রে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্টের এখতিয়ার কতখানি খর্ব করা হয়েছে। যে-কোনও প্রচলিত আইন সংবিধানের সঙ্গে কতটুকু সাংঘর্ষিক (Constitutional Vires) তা পরীক্ষা করে দেখার যে ক্ষমতা এই আদালতের রয়েছে সেটি কোনােভাবেই খর্ব করা যেতে পারে না।।
৩৭. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন যে, যদি একটি আইন সংবিধান পরিপন্থি (ultra vires) হয় এবং শুরু থেকেই তা বাতিল (ooid ab-initio) হয়, তবে একটি বাতিল আইনের বৈধতা যাচাই করার জন্য আদালতের এখতিয়ার কখনাে বারিত হয় না। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল ল’ লেক্সিকন (Laco Lexicon) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বাতিল এবং পরিপন্থি (void and ultra vires) শব্দগুলাের বিভিন্ন অর্থ তুলে। Co-operative Society vs. Chief Commissioner of Manipur, AIR 1969 (Moni) 84 haritat উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন যে, বাতিল বলতে বুঝায় একটি রায় যেটি ত্রুটিপূর্ণ এবং যার কোনও আইনগত বলবৎযােগ্যতা অথবা কার্যকরতা নেই। তিনি আরও বলেন যে, বাতিল বলতে বুঝায় যেটি প্রাথমিক উদ্ভব থেকেই অস্তিত্বহীন এবং এটির স্বীকৃতির বিরুদ্ধে একটি নিষেধ। বস্তুত এবং কার্যত রহিতকৃত কোনও আইন এবং বাতিল ঘােষিত কোনও আইনের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। উভয়ক্ষেত্রেই আইনটি (Act) তার কার্যকারিতা হারায়। তিনি State of Bombay os. Hornan Shantilal, AIR 1952 (Bon), 16 মামলাটির উপর নির্ভর করেন। বাতিল’ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে এটি বুঝানাের জন্য যে, এরূপ একটি আইন এটির শুরু থেকেই বাতিল। এমনকি আইন বিষয়ক লেখালেখিতেও (Juristic writing) বাতিল এবং বহির্ভূত (ultra vires) অভিব্যক্তি ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। শব্দটির সংকীর্ণ অর্থে যা বাতিল তা কেবলমাত্র nullity এবং সমান্তরাল (Collateral) কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এটির কখনাে অস্তিত্ব ছিলনা বলে অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। শুরু থেকেই বাতিল (ooid ab-initio) একটি অভিব্যক্তি যা প্রায়শই আদালত ব্যবহার করে থাকে। ultra vires অভিব্যক্তিটি সংকীর্ণ অর্থে একটি এখতিয়ারের অনুপস্থিতি বুঝানাের সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ততার অনুপস্থিতিও বুঝায়। বাতিল শব্দটি সকল ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে সংকীর্ণ অর্থে নন-এস্ট (non est) এবং সমান্তরাল কার্যবিবরণীতে (Collateral Proceedings) উপেক্ষা করা যায় মর্মে Madliocoan Pallai os. State of Kerala, AIR 1966 (Kera) 212 মামলায় মন্তব্য করা হয়েছে। Ub. Chowdhury Moinuddin vs. Deputy Director, Military Land and Cantonment AIR 1956 | (All) 684 মামলায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, যেখানে একটি আইন বাতিল সেখানে আইনের দৃষ্টিতে এর কোনও অস্তিত্ব নেই এবং, সেই কারণে এটি একটি বাতিল আইন এবং সার্বিকভাবেই এটিকে| অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। আরও বলা হয়েছিল যে, একটি অসাংবিধানিক আইন কোনও আইন নয়; এটি কোনও অধিকার প্রদান করে না; এটি কোনও সুরক্ষা দেয় না ও কোনও দপ্তর সৃষ্টি করে না; এটি একটি বেআইনি অভিপ্রেত ঘটনা যা অকার্যকর যেন এটি কখনাে পাশ করা হয়নি। চুক্তি যা আইনগত কর্পোরেশন। অথবা কোম্পানিসমূহ কর্তৃক গৃহীত হয়েছে যেগুলাে আইন (Statute) কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতার বাইরে অথবা
৩৮১
যা সংঘ-স্মারক (Memorandum of Association) কর্তৃক প্রত্যাহার করা হয়েছে তা ultra oires এবং বাতিল এবং সকল বা যে কোনও সদস্যের অনুমােদন এটিকে বৈধ করতে পারবে না। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল P Janardhan Shetty vs. Union of India, AIR 1970 (Mysore) 171 clos উদ্ধৃত করেছেন।
৩৯. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং শুরু থেকেই বাতিল (0oid ab-initio), সেহেতু, এরূপ একটি বাতিল আইন (statute) সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সংরক্ষিত হতে পারে না। তিনি আরাে বলেন যে, যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং শুরু থেকেই বাতিল (ooid ab-initio); সেহেতু, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্যদের হত্যাকারীদের অনুকূলে এটি কোনও আইনগত কিংবা vested অধিকার, সুবিধা এবং আইনগত পরিণতি সৃষ্টি করেনি। যেহেতু, বর্তমান আইন (Act) অর্থাৎ ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ বাতিল ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কে রহিত করেছে এবং এর সকল কার্যকরতা, পরিণাম, এবং ফলাফল undone করেছে, সেহেতু, এই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ একটি বাতিল অর্ডিন্যান্স এর বিলােপ সাধনের মাধ্যমে সংবিধানের কোনও বিধানকে ক্ষুন্ন বা লঙ্ঘন করেনি। এটি একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি যে, একটি বাতিল আইন যা কোনও ব্যক্তির জন্য এটি প্রণীত সেটি তার অনুকূলে কখনাে কোনও অধিকার বা দায়দায়িত্ব সৃষ্টি করতে পারে না। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের সারাংশ এই যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ৩১, ৩২, ৪৬, ৬২, এবং ৯৩(১)(ক) এর বিধানাবলির বহির্ভূত (ultra vires) এবং ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬, একটি বৈধ আইন যা সংবিধানের কোনও বিধানকে লঙ্ঘন করেনি।
৪০. বার-এর ছয়জন সিনিয়র বিজ্ঞ সদস্যকে এই আদালত কর্তৃক আদালতকে এমিকাস কিউরি হিসেবে সহায়তা করার জন্য অনুরােধ করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে জনাব সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, বাংলাদেশের প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রখ্যাত সুপরিচিত আইনজ্ঞ বলেন যে, সংবিধানের ৪৬ নং অনুচ্ছেদ এর অধীনে খুবই সীমিত আকারে ইনডেমনিটি দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ এর আওতায় আসে না, সেহেতু, এটি অবৈধ এবং বাতিল (nullity and void) এবং এটি করা হয়েছিল বা পাশ করা হয়েছিল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ এর বিধানাবলিকে লঙ্ঘন করে। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানে বিধৃত ২৭ নং মৌলিক অধিকারকেও ক্ষুন্ন করেছে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ :
“সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী।”
৪১. তিনি বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ একটি বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। কারণ যারা দেশের রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করলাে তাদের বিচার করা গেলাে না, যদিও তারা খুনী। কিন্তু একই সময়ে অন্যান্য খুনীরা দেশের সাধারণ আইনের অধীনে হত্যা সংঘটিত করার পর বিচারের সম্মুখীন হয়। যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে এই কারণে যে, কেউ হত্যা সংঘটনের জন্য বিচারের সম্মুখীন হবে না কিন্তু অন্যান্যরা একই কার্য সংঘটনের জন্য বিচারের সম্মুখীন হবে এবং সেই কারণে, এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭ কে লঙ্ঘন করে। সংবিধানের কোনও বিধানকে সংসদ লঙ্ঘন করতে পারে না। সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) আইন, ১৯৭৯ এর মাধ্যমে সংবিধানের আওতা ৯-৮-৭৯ তারিখ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৯ এবং চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭)
৩৮২
এর অধীনে কর্তৃপক্ষ এখনাে যে কোনও আইন সংশােধন কিংবা বাতিল করতে পারে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫২(২) এবং চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৮) এর বিধানাবলি এই লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছে যে, জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট সংবিধানের সাথে প্রযােজ্য হবে এবং জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর বিধানাবলির অধীনে ব্যক্ত আইনের মাধ্যমে সংসদ কোন অর্পিত অধিকার (vested right) ভবিতব্যভাবে এবং ভূতাপেক্ষভাবে (prospectively and retrospectively) কেড়ে নিতে পারে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৯ এবং চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) এর বিধানাবলির অধীনে সংসদ বা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ এখনাে যে-কোনও বিদ্যমান এবং প্রচলিত আইনকে সংশােধন এবং বাতিল করতে পারে। ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ পাশ করার জন্য সংসদ উপযুক্ত যা কোনােভাবেই সংবিধানের কোনও বিধানকে ক্ষুন্ন করে না।
৪২. জনাব সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ আরাে বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ একটি পদ্ধতিসংক্রান্ত | আইন (procedural law) এবং এরূপ একটি আইন, কোনও অর্পিত অধিকার সৃষ্টি করতে পারে না। সংসদ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট অভিব্যক্তির মাধ্যমে অথবা এমনকি অত্যাবশ্যকীয় প্রায়ােগিকতার মাধ্যমে এরূপ একটি পদ্ধতিগত আইনের কার্যকর এবং ফলাফল পরবর্তীতে কেড়ে নেয়া যেতে পারে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫ এর ধারা ২ এর মতে ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫ এ সংঘটিত কতিপয় কার্য অথবা ঘটনার সূত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যে-কোনও আইনগত অথবা অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছে। অর্ডিন্যান্সটি কতিপয় বিধিনিষেধ আরােপ করে, কিন্তু এটি সার্বিকভাবে নিষেধ (prohibition) নয়। উপরন্তু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এর ধারা ২(২) মতে, রাষ্ট্রপতি কিংবা তার পক্ষে অনুমােদিত অন্য যে কোনও ব্যক্তি কর্তৃক সার্টিফিকেট দেওয়া যেতে পারে এবং তা এরূপ কাজের জন্য উপযুক্ত সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি বলে না যে, কথিত সার্টিফিকেট একটি চূড়ান্ত সাক্ষ্য হবে। যেহেত, কতিপয় কর্মের বিচারের উপর বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছিল এবং যেহেতু, উক্ত সার্টিফিকেট যথেষ্ট সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যায়, তিনি বলেন যে, সেহেতু, তারপরও আদালত কর্তৃক অপরাধীদের বিচার করার সুযােগ ছিল, এমনকি উক্ত অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ বাতিল না করেও কারণ অপরাধীদের বিচার করার জন্য কোন পুরােপুরি নিষেধাজ্ঞা ছিল না এবং উক্ত সার্টিফিকেট এরূপ একটি অপরাধের জন্য চূড়ান্ত সাক্ষ্য হতে পারে না। সুনির্দিষ্ট ভাষার মাধ্যমে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ তথাকথিত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এর সকল কার্যকরতা এবং পরিণতিকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সেই কারণে, এই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ কে চ্যালেঞ্জ করার কোনও সুযােগ নেই। সংসদের এই আইন (Act of Parliament) সংবিধানের কোনও বিধান লঙ্ন করে না। বরং যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এরূপ একটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করার ক্ষমতা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ নং-৩ক(৭) এর অধীনে নির্দেশিত হয়েছে এবং সেই কারণে, অসাংবিধানিকতার অজুহাতে এটিকে চ্যালেঞ্জ করার কোনও সুযােগ নেই।
৪৩. বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি জনাব রফিক-উল হক, আরেকজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রখ্যাত আইন বিশেষজ্ঞ বর্তমান রিট পিটিশনগুলাের বিষয় সম্পর্কে তার মতামত তুলে ধরেন। তিনি নিবেদন করেন যে, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ একটি বৈধ প্রকৃতির আইন (Legislation) এবং এটি সংবিধানের কোনও বিধানকে লঙ্ঘন করে না। তিনি নিবেদন করেন যে, সাক্ষ্য আইন একটি পদ্ধতিগত আইন এবং এরূপ একটি পদ্ধতিগত আইনের কার্যকরতা আইনের ব্যক্ত বিধানের মাধ্যমে কেড়ে নেয়া যায়। এরূপ একটি পদ্ধতিগত আইন একজন ব্যক্তির উপর কোন ন্যস্ত অধিকার আরােপ করে না। তিনি
৩৮৩
Tikarao vs. Hiralal, AIR 1940 (Pat), 385 (FB) মামলাটির উদ্ধৃতি প্রদান করে বলেন যে, পদ্ধতিগত আইনের ক্ষেত্রে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা আরােপ করা যেতে পারে। তিনি ম্যাক্সওয়েল এর Interpretation of Statutes, 12th Edition, 222 Gi Ges Brinda’s Interpretation of Statutes, 7th Edition, 890 বইটিও উদ্ধৃত করে বলেন যে, এরূপ পদ্ধতিগত আইনের কার্যকরতা কেড়ে নেয়া যেতে পারে পরবর্তীকালীন কোনও আইনের ব্যক্ত ভাষার মাধ্যমে এবং এরূপ পদ্ধতিগত আইন কোনও ন্যস্ত আইনগত অধিকার সৃষ্টি করে না। তিনি Bhyth vs. Blyth and Pugh, 1965 (2) AER, 817 মামলাটিও উদ্ধৃত করেছেন যেখানে পদ্ধতিগত আইনকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
৪৪. জনাব রফিক-উল হক আরাে নিবেদন করেন যে, ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট পাস করা হয়েছে ১৫ই আগস্টে যে ব্যক্তিরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (crime against humanity) সংঘটিত করেছে তাদের বিচার করা এবং শাস্তি দেওয়ার পথের প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য। এরূপ একটি আইনকে চ্যালেঞ্জ করার অর্থ যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে তাদের বিচার এবং শাস্তি প্রদানকে বাধাগ্রস্ত করা। সেহেতু, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭ক(২) অনুসারে বর্তমান রিট পিটিশনগুলাে রক্ষণীয় নয়। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও যে ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ এর (৩) দফায় বর্ণিত কোন আইন প্রযােজ্য হয় সেই ক্ষেত্রে এই সংবিধানের অধীনে কোন প্রতিকারের জন্য সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করিবার কোন অধিকার সেই ব্যক্তির থাকিবে না।” তিনি আরাে বলেন যে, অনুচ্ছেদ ৪৭(ক) (১) এ এই বিধান রয়েছে যে, অনুচ্ছেদ ৪১, অনুচ্ছেদ ৩৫ এর দফা (১) ও (৩) এবং অনুচ্ছেদ ৪৪ এ নিশ্চিতকৃত অধিকার সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে না যার ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৪৭ প্রযােজ্য হবে। অনুচ্ছেদ ৪৭ (৩) এ বর্ণিত হয়েছে, “এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতা বিরােধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারিতে সােপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান সংবলিত কোনও আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থি, এই কারণে বাতিল বা বেআইনি বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনাে বাতিল বা বেআইনি হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না।” যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ একটি আইন হিসেবে যা প্রকৃতপক্ষে, খুনীদেরকে তাদের দ্বারা সংগঠিত মানবতাবিরােধী অপরাধের (crime against humanity) জন্য বিচারের সম্মুখীন হওয়া থেকে দায়মুক্তি দিয়েছে, এই আইন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৭(৩) এর বিধানাবলির পরিপন্থি (ultra vires)।
৪৫. অ্যামিকাস কিউরি এবং সুপরিচিত আইন বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হােসেন বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ এর অধীনে অনুমােদিত ছিল না এবং সেহেতু এটি ছিল ঐ অনুচ্ছেদের ultra vires। তিনি আরও বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কে কোনও ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দেয়া যেতে পারে না, কারণ উক্ত আইনটি ১৫-৮-১৯৭৫ এ কার্যকর ছিল না। যে ব্যক্তি ১৫.৮.১৯৭৫ এ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিসহ অন্যান্যদের জীবন কেড়ে নিয়েছিল তাকে দায়মুক্তি দেয়ার জন্য কোনও আইন প্রণীত হতে পারে না। ঐরূপ একটি অর্ডিন্যান্স সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৭, ৩১ এবং ৩২ এর বহির্ভূত। যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধান বহির্ভূত এবং যেহেতু, এটি সংবিধানের বিধান অনুসারে কোনও আইন ছিল না, সেহেতু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এরকম একটি বাতিল আইনকে সুরক্ষা প্রদান করতে পারে না। মানুষ হত্যার জন্য দায়ি হত্যাকারীদের বিচার এবং শাস্তি প্রদান করা যাবে না এমনকি তারা রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার অপরাধ সংঘটিত
৩৮৪
করলেও, এরকম কোনাে আইন প্রণীত হতে পারে না। ঐরূপ একটি আইন স্বয়ং সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ নং মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন যা সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires).।
৪৬. ড. কামাল হােসেন তার বক্তব্যের উপসংহারে বলেন যে, নিমােক্ত কারণে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের দৃষ্টিতে কোনাে আইন নয়। আইনটি সংবিধান পরিপন্থি হওয়ার কারণে এটি শুরু থেকেই বাতিল (ooid ab-initio)। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬নং অনুচ্ছেদের শর্তের বাইরে কোনও ইনডেমনিটি আইন থাকতে পারে না। ইনডেমনিটির ধারণাটি খুবই সীমিত, এমনকি যুদ্ধকালীন সময়েও। সংবিধানে চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) এবং অনুচ্ছেদ ১৪৯ এ কোনও আইন অথবা অধ্যাদেশ সংশােধন এবং বাতিল সংক্রান্ত বিধান রয়েছে এবং সেই কারণে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ বাতিল অথবা সংবিধান বহির্ভূত (void ultra vires the Constitution) বলে ঘােষণার কোনও প্রশ্নের আদৌ উদ্ভব ঘটে না। তিনি আরও বলেন যে, ডসাে মামলায় (Dosso’s case 11 DLR (S.C.) 1) প্রদত্ত অভিমত প্রকৃতপক্ষে আসমা জিলানী (Asma Jilani vs. Government of Punjab, PLD 1972 (SC) 139) মামলায় প্রদত্ত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাতিল ঘােষিত হয়েছে।
৪৭. অ্যামিকাস কিউরি এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন প্রখ্যাত জুরিস্ট জনাব এম. নুরুল্লাহ শুরুতেই বলেন যে, বর্তমান মামলাগুলােতে আমাদের প্রথমে বিবেচনা করতে হবে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ একটি বৈধ প্রকৃতির আইন কি না। তিনি নিবেদন করেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কোন মার্শাল ল’ প্রক্লেমেশেন অথবা কোনও মার্শাল ল’ রেগুলেশন বা মার্শাল ল’ অর্ডার ছিল না। বরং অর্ডিন্যান্সটি থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে এটি একটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা হয়েছিল। অর্ডিন্যান্সটি থেকেই এটি প্রতীয়মান হয় যে, এটি সংসদের অন্যান্য আইন ও অধ্যাদেশের মতােই একটি সাধারণ (সিভিল) প্রকৃতির আইন। তিনি আরও বলেন যে, অর্ডিন্যান্স থেকেই এটি দেখা যায় যে, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে এটি জারি করেছিলেন এবং তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে এতে স্বাক্ষর করেন। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক এটি জারি করা হয়েছিল কেননা তখন সংসদ অধিবেশনে ছিল না। তখন বাংলাদেশেন সংবিধান সামরিক আইন প্রক্লেমেশন (সামরিক আইন ফরমান, বিধি, আদেশ সাপেক্ষে) এর পাশাপাশি চলছিল এবং যেহেতু, এই আইনটি কোনও মার্শাল ল প্রক্লেমেশন বা রেগুলেশন বা কোনও অর্ডার ছিল না সেহেতু, দেশের অন্যান্য সাধারণ আইনের মতাে জারি হওয়ার তারিখ হতে এটি প্রচলিত ছিল। তাই যখন এই ইনডেমনিটি
৭৫ জারি করা হয়েছিল, তখন বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬, ৩১, ৩২, ২৭, ৬২ এবং ৯৩(১)(ক) কে লঙ্ঘন করা হয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে, প্রচলিত যে-কোনও আইনকে সংশােধন বা বাতিল করার ক্ষমতা সংসদের রয়েছে, যখন তা করার প্রয়ােজন হয়। যেহেতু, ইনডেমনিটি অি একটি প্রচলিত আইন হিসেবে বিদ্যমান ছিল এবং যেহেতু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক এবং ১৮ নং প্যারাগ্রাফ এটিকে অন্যান্য আইন এবং অধ্যাদেশের মতাে বর্তমান এবং প্রচলিত আইন হিসেবে গণ্য করেছে, তাই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এর অধীনে এরূপ একটি প্রচলিত অধ্যাদেশ বা আইনকে সংসদ সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংশােধন বা বাতিল করা যেতে পারে; এজন্য সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আবশ্যকতা নেই।
৪৮. জনাব এম. নুরুল্লাহ আরাে বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ ছিল সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এবং শুরু থেকেই বাতিল (void-ab-initio)। তাই তা একটি প্রচলিত এবং বিদ্যমান আইনের পরীক্ষার দাবি রাখতে পারে না। এরূপ একটি বাতিল আইন সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮
৩৮৫
এর অধীনে সুরক্ষিত হতে পারে না এবং এটি ধরে নেওয়া উচিত হবে যে, সংবিধানের দৃষ্টিতে এরূপ কোন আইনের অস্তিত্ব নেই। এটির জন্মই হয়েছিল মৃত অবস্থায় এবং এর কোনও আইনগত অস্তিত্ব ছিল না।
৪৯. তিনি আরাে বলেন যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর মাধ্যমে আদালতের এখতিয়ারকেও খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি এই যে, কোনাে বিধান দ্বারা যদি আদালতের এখতিয়ার খর্ব করাও হয়, তথাপিও আদালত পরীক্ষা করে দেখতে পারেন প্রকৃতপক্ষে এখতিয়ার খর্ব করা হয়েছে কি না এবং খর্ব করার বিধিটি কতখানি বিস্তৃত। সেহেতু, যদি কোনও আইন বাতিল ও সংবিধান বহির্ভুত হয়; তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২ এর অধীনে হাইকোর্ট বিভাগের এটি পরীক্ষা করার এক্তিয়ার রয়েছে, এমনকি সামরিক আইনের ফরমান অথবা বিধি ইত্যাদির মাধ্যমে আদালতের এই এখতিয়ার খর্ব করা হলেও কোরাম নন জুডিস অথবা অসৎউদ্দেশ্য প্রণােদিত (Malafide) হওয়া ইত্যাদি প্রশ্নে আদালত তার এখতিয়ার প্রয়ােগ করতে পারেন। এই প্রসঙ্গে তিনি Khondker Ehteshan uddin Ahmed Iqbal vs. Bangladesh, 33 DLR (AD), 1541; Helal Uddin Ahmed Swapan vs. Bangladesh, 45 DLR (AD) 1; Jamil Hoq and others vs. Bangladesh, 34 DLR (AD) 125; Khondker Moshtagne Ahmed vs. Bangladesh, 34 DLR (AD) 222 মামলাগুলাের উদ্ধৃতি প্রদান করেন। জনাব এম. নুরুল্লাহ উপসংহারে বলেন যে, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ একটি বৈধ প্রকতির আইন (legislation) এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) হওয়ার কারণে বাতিল। এরূপ একটি বাতিল আইন কখনাে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সুরক্ষিত হতে পারে না। যেহেতু, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫ বাতিল ছিল, অত্র আদালত এরূপ একটি আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিবেচনা করার জন্য উপযুক্ত। উপরন্তু সংসদের এরূপ একটি বাতিল আইনের রহিত (repeal) করার কর্তৃত্ব রয়েছে।
৫০. আরেকজন বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি এবং প্রখ্যাত জুরিস্ট জনাব এম. আমীর-উল ইসলাম বলেন যে, সাংবিধানিক প্রাধান্য এবং আইনের শাসন আমাদের সংবিধানের আবশ্যিক নীতি (Guiding Principle)। তিনি বলেন যে, কেবল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ এর অধীনে ইনডেমনিটি মঞ্জুর করা যেতে পারে কতিপয় ব্যক্তির প্রতি যেমনটি এই ৪৬ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে এবং এর বাইরে নয়। অনুচ্ছেদ ৪৬ সংবিধানের একটি ব্যতিক্রমী বিধান। এর দুইটি অংশ রয়েছে, একটি তাত্ত্বিক অংশ (substantive) এবং অন্যটি পদ্ধতিগত অংশ (Procedural)। স্পষ্টত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ এর আওতার মধ্যে পড়ে না। তিনি আরাে বলেন যে, কেবল সংসদই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ অনুসারে একজন ব্যক্তিকে দায়মুক্তি প্রদানের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারে, কিন্তু তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে হতে পারে না। এজন্য ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, যেহেতু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ এর আওতায় করা হয়নি, সেহেতু, এটিকে আইনের দৃষ্টিতে একটি অর্ডিন্যান্স বলা যেতে পারে না। কারণ এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ লঙ্ঘন করেছে। উপরন্তু, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের ২৭, ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদও লঙ্ঘন করেছে, এবং সেই কারণে, তা শুরু থেকেই বাতিল (ooid ab-initio)। আরাে নিবেদন করা হয় যে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন সামরিক কুর (coup d’etat) সহায়তায়, কোনও বিপ্লবের মাধ্যমে নয় কিংবা কোনও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় নয়। কতিপয় সামরিক ব্যক্তিদের সহায়তায় তিনি দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনি একজন ডিফ্যাক্টো অসাংবিধানিক শাসক ছাড়া আরাে কিছু ছিলেন না। যেহেতু, তিনি অসাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা
৩৮৬
দখল করেছিলেন, তাই তাকে আইনের কোনও উৎস অথবা আইন প্রণেতা বলা যাবে না এবং তার কর্তৃক যদি কোনও আইন প্রণীত হয়ে থাকে তবে তাকে সংবিধানের দৃষ্টিতে আইন বলা যেতে পারে না। ডিফ্যাক্টো একনায়ক (De facto dictator) আইনের কোনও উৎস হতে পারে না।
৫১. তিনি আরাে বলেন যে, ১৯৭৫ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি ১৯৭৯ সালে সংসদ গঠিত হওয়ার পর সংসদে পেশ করা হয়নি, তাই এটি সংসদের অধিবেশন বসার তারিখ থেকে ৩০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর এর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। খুনীদের দায়মুক্তি দানের জন্য সংসদ কর্তৃক কোনও আইন পাশ করা হয়নি এবং সেই কারণে, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। তাই, এটি বলা যাবে না যে, এটি একটি বিদ্যমান আইন ছিল। তিনি আরও বলেন যে, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এবং ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ সময়ের মধ্যে সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) অ্যাক্ট সহ যাই ঘটে থাকুক না কেনাে সেগুলাের কোনও legal force ছিল না। পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক উসাে মামলার প্রতিষ্ঠিত নীতি প্রকৃতপক্ষে পরর্তীতে Asrna Jilani মামলায় প্রদত্ত সিদ্ধান্তে বাতিল করে দেয়া হয়েছে। তিনি আরাে বলেন যে, Asrna Jilani মামলায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে অবৈধ ক্ষমতা দখলদার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল এবং এজন্য দেশ শাসন করার কোনও আইনগত কর্তৃত্ব তার ছিল না। একইভাবে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদও একজন অবৈধ ক্ষমতা দখলদার হওয়ার কারণে দেশের শাসন চালানাের কোনও আইনগত দাবি বা অধিকার তার ছিল না।
৫২. ড. কামাল হােসেন এবং জনাব আমীর-উল ইসলাম উভয়েই Asina Jilani মামলার উপর বেশ জোর প্রদান করেছেন। আমরা সতর্কতার সঙ্গে Asina Jilani মামলার রায় পড়ে দেখেছি এবং আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের বিচারকগণ সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক ডসাে মামলায় প্রদত্ত রায়কে বাতিল (overruled) করেন। উপরন্তু, বিজ্ঞ বিচারকগণ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসন আমলকে নিন্দা জানিয়ে তাকে একজন অবৈধ ক্ষমতা দখলদার হিসেবে তুলে ধরেন। পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট ঘােষণা করেন যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জারিকৃত সামরিক আইন ছিল বেআইনি এবং তার কর্তৃক ক্ষমতা দখল ছিল সম্পূর্ণরূপে অসাংবিধানিক। অবশ্য, ইয়াহিয়া খান কর্তৃক সম্পাদিত আইনগত এবং প্রশাসনিক কার্যকলাপকে স্টেট নেসেসিটি নীতির (doctrine of State necessity) আওতায় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
৫৩. পূর্বেই বলেছি যে, আমরা বর্তমান মামলাগুলােয় ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ সময়কালের অধ্যায়কে পুন-উন্মুক্ত করার মতাে অবস্থায় নেই। ফলে, এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে আমরা অপারগতা প্রকাশ করছি। কিন্তু এটি বলা যায় যে, যদি জনাব এম আমীর-উল ইসলামের যুক্তি গৃহীত হয়, তাহলে দেশের সর্বত্র সম্পূর্ণ সাংবিধানিক সংকট এবং আইনগত শূন্যতা সৃষ্টি হবে যা দেশকে কোথাও নেবে না। আমরা, এই আদালতের বিচারকরা নিয়ােগকালে সংবিধানকে রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা দানের শপথ নিয়েছি। উপরন্তু, বর্তমান মামলা দুটিতে Rules এর আওতা সীমিত এবং আমরা সেই Rules এর বাইরে যেতে পারি না।
৫৪. জনাব আমীর-উল ইসলাম আরাে বলেন যে, ১৯৭৭ সালের প্রক্লেমেশন নং-১ এর মাধ্যমে প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং সংবিধানের (পঞ্চম সংশােধনী) আইন, ১৯৭৯ এর মাধ্যমে প্যারাগ্রাফ ১৮ সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে সংযুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন যে, এরূপ প্যারাগ্রাফগুলাের এরূপ সংযুক্তি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর বিধানের পরিপন্থি। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২ সংবিধান প্রণীত হয়েছিল। চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফগুলাে ঐদিন অর্থাৎ ১৬-১২-৭২ তারিখে অনুচ্ছেদ ১৫০ এর অধীনে অন্তর্বর্তীকালীন এবং অস্থায়ী
৩৮৭
বিধান হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছিল। অনুচ্ছেদ ১৫০-এ এমন কোনও বিধান নেই যাতে করে ভবিষ্যতে একই ধরনের প্যারাগ্রাফ সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে সংযুক্ত করা যেতে পারে, এবং তা ১৬-১২-৭২ তারিখের অন্য প্যারাগ্রাফগুলাের মতাে সুরক্ষা পেতে পারে। যেহেতু, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০ এরূপ কোনও বিধান প্রণয়নের কথা বলেনি সেহেতু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অতিরিক্ত প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এর আওতাবহির্ভূত ছিল যা পরবর্তীতে সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মত হচ্ছে যে, এটি বলা যায় না যে, উক্ত প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ সংবিধান বহির্ভূত (ultra vires) এই কারণে যে, এগুলাে সংবিধানের সংশােধনী এবং বর্তমানে এগুলাে সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
৫৫. জনাব আমীর-উল ইসলাম আরাে বলেন যে, যদি কোনও বাতিল আইন বিদ্যমান থাকে, তখন এই বাতিল আইনকে রহিত করার জন্য দুইটি পথ রয়েছে। উপযুক্ত আদালত কর্তৃক আইনটিকে বাতিল ঘােষণা করা যেতে পারে অথবা সংসদ প্রণীত ঘােষণামূলক আইন (declaratory statute) জারির মাধ্যমে এটি রহিত করা যেতে পারে। বর্তমান ক্ষেত্রে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ শুরু থেকেই বাতিল (ooid ab-initio) প্রকৃতির একটি আইন হওয়া সত্ত্বেও সে মর্মে কোনও ঘােষণার জন্য এটি কখনাে আদালতের সম্মুখে আসেনি এবং এজন্য এটি বিদ্যমান একটি আইন হিসেবে আইনের বইতে (Statute book) ছিল। সংসদ তার প্রজ্ঞাবলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, এটি একটি বাতিল আইন এবং সেই কারণে সংসদ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং- ৫০/১৯৭৫ কে রহিত করে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং-২১/১৯৯৬ পাশ করেছে। তাই, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ এর বৈধতাকে কোনােভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় না।
৫৬. আরেকজন বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি দেশের একজন প্রখ্যাত জুরিস্ট জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদ। শুরুতে বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ যেটিকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হয়েছে সেটি একটি চরম কালাে আইন এবং এটি সকল মানবাধিকার এবং সংবিধানের বিধানাবলির বিরুদ্ধে গিয়ে পাশ করা হয়েছিল। তিনি বলেন যে, তার সভাপতিত্বে ২-৪-১৯৮৯ তারিখে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আইনজীবী সম্মেলন অনুষ্ঠিত্ব হয়। ঐ সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্যদের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। এরূপ একটি অমানবিক এবং নৃশংস হত্যাকাণ্ড মনাবাধিকারের কোনও মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে পারে না।
৫৭. তিনি বলেন যে, স্বাভাবিক সময়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারি হতে পারে। জনাব খােন্দকার মােশতাক আহমেদ কিছু সামরিক ব্যক্তির সহায়তায় ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫-এ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে বাংলাদেশের স্ব-ঘােষিত রাষ্ট্রপতি করেন এবং তিনি ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ হতে কার্যকরতা দিয়ে ২০-৮-৭৫ তারিখে সারা দেশে সামরিক আইন জারি করেন। ১৯৭৫ সালের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করা হয়েছিল ২৬-৯-৭৫ তারিখে, এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। এটি এমন হতে পারে যে, স্ব-ঘােষিত রাষ্ট্রপতি খােন্দকার মােশতাক আহমেদ বাংলাদেশে সামরিক লােকদের কর্তৃক ট্যাঙ্ক এবং অস্ত্র দ্বারা বঙ্গভবনে পরিবেষ্টিত ছিলেন এবং খুনীদের রক্ষা করার জন্য তাকে ওই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সামরিক আইন বিদ্যমান ছিল এবং পাশাপাশি সামরিক আইনের শর্তাধীনে সংবিধানও প্রচলিত ছিল। তিনি বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ এর আওতায় আসেনা এবং সেহেতু, এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬ক লঙ্ঘন। করেছে, তাই এটি উক্ত অনুচ্ছেদ বহির্ভূত (ultra vires)। এই যুক্তি দেয়া যেতে পারে যে, যদি আইনটি স্বাভাবিক অবস্থায় জারি করা হতাে। কিন্তু ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর
৩৮৮
রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনীদের দ্বারা বল প্রয়ােগের মাধ্যমে একটি অস্বাভাবিক অবস্থায়। সেহেতু, এটি ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা উচিত।
৫৮. তিনি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এর প্রস্তাবনা উদ্ধৃত করে বলেন যে, প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রপতি সামরিক আইন ফরমানকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে প্রদত্ত তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করে উপরােক্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেছিলেন। তিনি বলেন যে, এতে লক্ষ্য করা যায় যে, তিনি উভয় উৎস থেকেই ক্ষমতা ধারণ করেছিলেন, সামরিক আইন ফরমানের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান হতে। রাষ্ট্রপতি হওয়ায় তিনি ছিলেন সামরিক আইন জারি, বিধিমালা এবং আদেশসমূহ প্রণয়ন করার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এবং একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ সংবিধানের অধীনে তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারতেন। বিচারাধীন অধ্যাদেশটিকে রাষ্ট্রপতি খােন্দকার মােশতাক আহমেদের একটি আইন হিসেবে বিবেচনা করা উচিত কারণ তিনি তা সামরিক আইন ফরমানের অধীনে একজন প্রশাসকের ক্ষমতার অধীনে তা জারি করেছিলেন। সেই কারণে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬-এর বিধান। সত্ত্বেও এটি বৈধ প্রকৃতির একটি আইন। যেহেতু, অধ্যাদেশ আকারে ঐরূপ একটি সংবিধানের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সুরক্ষিত এবং হেফাজত করা হয়েছে, তাই এটি একটি বৈধ আইন এবং সংবিধানের অংশ মনে করা সঙ্গত হবে।
৫৯. লক্ষ্যণীয় যে, এখানে জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমাদ কর্তৃক পূর্বে ব্যক্ত মতামত থেকে কিছুটা | বিচ্যুতি ঘটেছে। অস্বাভাবিক অবস্থা যা সেই সময় বিরাজমান ছিল, তখন তিনি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কে একটি বৈধ আইন (legislation) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন যে, এরূপ একটি আইন সামরিক আইন ফরমানের অধীনে কিংবা সংবিধানের অধীনে জারি করা অনুমােদিত নয়, কিন্তু তিনি এটিকে একটি চুক্তিমূলক আইন (Contractual legislation) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যা প্রাসঙ্গিক সময়ে আইন প্রণয়নের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত হয়েছিল। সেই কারণে এটিকে একটি বৈধ আইন হিসেবে বিবেচনা করা সঙ্গত যা শেষ পর্যন্ত সংবিধানের অধীনে এটি সংরক্ষণ, নিশ্চিতকৃত এবং অনুমােদনের মাধ্যমে সংবিধানের অংশ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি এবং অন্যান্যদের খুনীরা যদি খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে বলপূর্বক বাধ্য করে এরূপ একটি আইন প্রণয়ন করিয়ে থাকে, তবে এটি চরমভাবে অসৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত (Malafide) যেটি সংবিধান কর্তৃক সংরক্ষিত হতে পারে না। উপরন্তু, সামরিক আইন ফরমান, বিধিমালা বা আদেশসমূহে অথবা সংবিধানে এরূপ চুক্তিমূলক আইনের (Contractual legislation) কোনাে তত্ত্ব ছিল না। সেহেতু, আইন প্রণয়নের কথিত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে এরূপ একটি আইন জারি ছিল তার সম্পূর্ণ এক্তিয়ার বহির্ভূত। সংবিধান কর্তৃক কিংবা কোনও সামরিক আইন ফরমান, প্রবিধান অথবা আদেশ কর্তৃক এরূপ একটি চুক্তিভিত্তিক আইন (Contractual legislation) প্রণয়ন করার কোনাে অনুমােদন নেই। তিনি সর্বোচ্চ আইন প্রণেতা হতে পারেন, কিন্তু তাকে অবশ্যই তৎকালীন সময়ে প্রচলিত আইনের আওতাধীনে কাজ করতে হবে। যদি তা না করা হয়ে থাকে, তবে তা হবে সম্পূর্ণরূপে এক্তিয়ার বহির্ভূত। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ থেকে সুস্পষ্টরূপে (এক্স ফেইসি) প্রতীয়মান হয় যে, এটি প্রণীত হয়েছিল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে তার ক্ষমতাবলে; যেহেতু, তখন সংসদের অধিবেশন ছিল না। জনাব খােন্দকার এর নতুন তত্ত্ব অনুসারে স্বাভাবিক সময়ে কিংবা অস্বাভাবিক সময়ে, সংবিধানে কিংবা সামরিক আইন ফরমান, বিধি বা আদেশে চুক্তিভিত্তিক আইনের (Contractual Legislation) কোনাে আইনগত অস্তিত্ব নেই। সেই কারণে, জনাব খােন্দকার কর্তৃক প্রদত্ত এই নতুন তত্ত্ব গ্রহণযােগ্য নয়।
৩৮৯
৬০. এখন, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ তে সন্নিবেশিত দুইটি শব্দ অন্যান্য আইন (“other laws”) আমাদের বিবেচনা করতে হবে। চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক (১) বর্ণিত মতে, “law includes Ordinances, Rules, regulations, bye-laws, orders, notifications and other instruments having the force of law.” ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক অথবা ১৮তে সুনির্দিষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি, বরং এটি “অন্যান্য আইন” (other laws) এর শ্রেণিভুক্ত ছিল। সকল অন্যান্য আইন’ (other laws) যেগুলাে ১৫-৮-৭৫ থেকে ৯-৪-৭৯ সময়কালে প্রণীত তা চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে অনুমােদিত, সুরক্ষিত, এবং নিশ্চিতকৃত হয়েছিল জনাব খােন্দকার-এর মতে, যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৫ ফরমান নং-১/১৯৭৭ দ্বারা এবং পরবর্তীতে সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) আইন, ১৯৭৯ দ্বারা অনুমােদিত, সুরক্ষিত, সমর্থিত এবং নিশ্চিতকৃত হয়েছিল, চতুর্থ তফসিলের যথাক্রমে প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে, তাই অধ্যাদেশটি সংবিধানের একটি অংশ ছিল। যদি জনাব খােন্দকারের উপরােক্ত অভিমত গ্রহণ করা হয়, তখন সকল ‘অন্যান্য আইন’ (other laws) যেমন, অধ্যাদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, আদেশ, বিজ্ঞপ্তি এবং অন্যান্য দলিলাদি যেগুলাের আইনের বলবৎযােগ্যতা রয়েছে তা ১৫-৮-৭৫ থেকে ১-৪-৭৯ এই সময়ের মধ্যে প্রণীত হয়েছিল সেগুলাে সংবিধানের অংশ হিসেবে গণ্য করা উচিত এবং এমনকি উপযুক্ত অন্যান্য আইন’ (other laws) এর দাড়ি এবং সেমিকোলন সংশােধনের জন্য ও সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আবশ্যক হবে। আমরা বলছি যে, ঐরূপ অযৌক্তিক ব্যাখ্যা স্বয়ং সংবিধানে যেমন উল্লেখিত নেই তেমনি সামরিক আইন ফরমান, বিধি অথবা আদেশ যা ৯-৪-৭৯ থেকে ১৫-৪-৭৫ সময়কালে বলবৎ ছিল সেখানেও ছিল না। এরূপ ব্যাখ্যা (proposition) আইনগত সংকট এবং সাংবিধানিক শূন্যতার পানে নিয়ে যাবে।
৬১. এ বিষয়ে কোনাে বিতর্ক নেই যে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েম এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান এই তিনজনই ছিলেন দেশের ডিফ্যাক্টো শাসক, কেননা তারা সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত হননি। ১৫-৮-৭৫ থেকে ৯-৪-৭৯ সময়কালে রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্রকে সচল রাখার জন্য তারা বহু অধ্যাদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি, আদেশ ইত্যাদি প্রণয়ন করেছেন। যখন ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসে এবং গণতন্ত্র ফিরে আসে, তখন উপরােক্ত সময়কালের তিন ডিফ্যাক্টো শাসকের প্রণীত সকল আইনকে নিরাপদ সুরক্ষিত, অনুমােদিত এবং নিশ্চিত করার আবশ্যকতা দেখা দেয়, অন্যথায় দেশ একটি সাংবিধানিক সংকট এবং আইনগত শূন্যতায় পতিত হতাে এবং এই কারণে অন্যান্য আইন’ সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সুরক্ষিত, অনুমােদিত এবং নিশ্চিতকৃত করা হয়। সুতরাং, অন্যান্য আইন’ (other laws) যেগুলাে চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ তে সন্নিবেশিত হয়েছে তা সংবিধানের অংশ করা হয়নি, বরং সেগুলাে দেশের প্রচলিত এবং সাধারণ আইন হিসেবে সুরক্ষিত এবং বিদ্যমান ছিল।
৬২. বিকল্প হিসেবে তিনি নিবেদন করেছেন যে, এমনকি যদি এটি অনুমান করা হয় যে, এরূপ একটি অধ্যাদেশ জারি করার সময়ে কর্তৃপক্ষের কিছু আইনগত ত্রুটি অথবা ঘাটতি ছিল, কিন্তু প্রক্লেমেশেন নং-১/১৯৭৭ যেটির মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে প্যারাগ্রাফ তক সংযুক্ত করা হয়, এর পর এটি একটি বৈধ প্রকৃতির আইনে পরিণত হয় এই কারণে যে, সংবিধান সংশােধনীর মাধ্যমে তা সুরক্ষিত হয়েছিল। পূর্বে যতই আইনগত অক্ষমতা থাকুক না কেন তা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর দ্বারা শুদ্ধকরণ হয়েছে। তিনি আরাে বলেন যে, ৬-৪-৭৯ তারিখে সংসদ সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) অ্যাক্ট পাশ করে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে এবং এভাবে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯
৩৯০
সময়ের মধ্যে জারিকৃত আইনসহ সকল কিছুকে সুরক্ষিত করা হয়েছিল। এভাবে চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ সংযুক্ত করা হয় যা উপরােক্ত সময়কালে প্রণীত অন্যান্য আইনগুলাে অনুমােদন এবং নিশ্চিত করেছিল। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এ বর্ণিত মতে এই সময়কালের মধ্যে যে সমস্ত আইন প্রণীত হয়েছে তা বৈধভাবে প্রণীত হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে এবং যে-কোনও কারণেই হােক না কেন এগুলাে সম্পর্কে কোনও আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। সেই কারণে, আইনের দৃষ্টিতে এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ প্রক্লেমেশন নং- ১/১৯৭৭ এবং সংবিধান (পঞ্চম সংশােধনী) আইন, ১৯৭৯ দ্বারা সংবিধান সংশােধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এ বর্ণিত মতে সুরক্ষিত ছিল। এই বিষয়ে জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদ বলেন যে, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, এর উৎসগত অবৈধ প্রকৃতি থাকা সত্ত্বেও, এটিকে বৈধ করে নেওয়া হয় এবং এটি সংবিধানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সেই কারণে, এটি সংশােধন কিংবা রহিত করা যেতে পারে কেবল সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এর অধীনে সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে। যেহেতু, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ পাশ করা হয়েছে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে, এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর বিধান লঙ্ঘন করেছে এবং সেই কারণে, এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এর বিধানের পরিপন্থি। এইভাবে জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদের বক্তব্য পিটিশনারদের পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব কোরবান আলীকে সমর্থন করে।
৬৩. ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের প্রস্তাবনায় বলা হয় যে, ২০ আগস্ট ১৯৭৫ এর প্রক্লেমেশনবলে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩ বিধি (১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়ােগের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ প্রণয়ন এবং জারি করতে পারেন। এর উপর নির্ভর করে জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদ এবং জনাব কোরবান আলী উভয়েই বলেন যে, রাষ্ট্রপতি একই সঙ্গে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ হিসেবে এবং সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতা প্রয়ােগ করেছেন এবং যেহেতু, এই অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষেত্রে তিনি উভয় ক্ষমতা প্রয়ােগ করেছেন, সেহেতু, এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু আমাদের নিকট এটি প্রতীয়মান হয় যে, প্রথম বাক্যটি হলাে, ২০ আগস্ট ১৯৭৫ এর প্রক্লেমেশনের অনুসারে ডিফ্যাক্টো শাসক খােন্দকার মােশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কার্য করার ক্ষমতার উৎস দেখান এবং পরবর্তী বাক্যে প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে তিনি প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়ােগ করেছিলেন। এটি ইতােমধ্যেই বর্ণিত হয়েছে যে, সামরিক আইনের সঙ্গে বাংলাদেশ সংবিধান পাশাপাশি প্রচলিত ছিল। যেহেতু, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি কিংবা দেশের একজন সাংবিধানিক প্রধান ছিলেন না এবং যেহেতু, তিনি কতিপয় সেনা সদস্যের সহায়তায় জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং ২০ আগস্ট ১৯৭৫-এ সামরিক আইন জারি করেন এবং নিজেকে স্ব-নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করেন; সেহেতু, তিনি তার শাসনকালে সকল আইন প্রণয়নে নিজেকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে প্রদর্শন করেছেন। এই কারণের প্রেক্ষিতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ এর প্রস্তাবনার প্রথম বাক্যে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার কার্যাবলি সাধনের ক্ষমতার উৎস প্রকাশ করেছেন এবং এর পরবর্তী বাক্য দ্বারা তিনি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়ােগ করেছেন। উপরন্তু, প্রস্তাবনায় এটি বর্ণিত হয় যে, যখন সংসদ অধিবেশন থাকে না তখন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে অধ্যাদেশ জারি করাটা পূর্বশর্ত।
৬৪. তাই, এটি প্রতীয়মান হয় যে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে অধ্যাদেশ হিসেবে জারিকৃত এই আইনটি একটি সাধারণ আইন (Ordinary Civil Legislation) ছিল। উপরন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে,
৩৯১
এটি জারি করা হয়েছিল আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে। এর শিরােনামে বলা হয়েছে | যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ তারিখে বর্ণিত অর্ডিন্যান্সটি করা হয়েছে। অধ্যাদেশটির নিচে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার স্বাক্ষর প্রদান করেন। এটি সত্য যে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখল এবং সামরিক আইন জারি করার পর নিজেকে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘােষণা করেননি। বরং তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষনা করেছিলেন এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি তার সাংবিধানিক এবং আইনগত কার্যাবলি সম্পাদন করেন এবং একই সময়ে তিনি সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবেও তার কার্যাবলি সম্পাদন করেন। এমনকি তখন উপযুক্ত আইনটি হতে পরিষ্কারভাবে পরিলক্ষিত হয় যে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেন, কিন্তু তিনি এই অর্ডিন্যান্স জারি করার সময় সামরিক আইন কর্তপক্ষ হিসেবে তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করেননি। সেহেতু, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স একটি স্বাভাবিক সাধারণ আইন (Ordinary simple Civil Legislation) এবং সেই কারণে তা সাধারণ আইনের মাধ্যমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এর পদ্ধতি অনুসরণ ছাড়াই সংশােধন কিংবা বাতিল করা যেতে পারে।
৬৫. এই প্রসঙ্গে এটি উল্লেখ করা যায় যে, সামরিক আইনের সময়কালে জারি করা অধ্যাদেশ সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর সাধারণ আইন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। Manoranjan Mukherjee vs. Election Commission, 41 DLR 484 মামলায় অত্র আদালতে একটি ডিভিশন বেঞ্চ (মােস্তফা কামাল এবং এম এ চৌধুরী বিচারপতিদ্বয়) এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, নভেম্বর ১৯৮৬তে সামরিক আইন প্রত্যাহার করার পর বিচারাধীন অধ্যাদেশটিকে (স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ, ১৯৮৩) একটি সাধারণ আইন হিসেবে দেখতে হবে এবং যখন এটি কোনও ফৌজদারি অপরাধ এবং দোষী সাব্যস্তকরণ প্রসঙ্গে কোনাে কিছু বলে তখন এটি নিশ্চিতভাবে দেশের সাধারণ আইনে বর্ণিত সাধারণ অপরাধ প্রসঙ্গে বলা হয় এবং তা সাধারণ আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ অথবা বিশেষ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক একটি সাধারণ ফৌজদারি আদালত দ্বারা সম্পাদিত বিচার এবং দোষী সাব্যস্তকরণকে বুঝায়।
৬৬. মাননীয় বিচারকগণ আরও পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, এটি সুপ্রতিষ্ঠিত যে, সামরিক আইন দেশের সাংবিধানিক পদ্ধতির কোনও একটি অংশ নয়। এটি একটি সংবিধান-বহির্ভূত (extra-constitutional) অবস্থা। এটি একটি সংক্ষিপ্ত মেয়াদের অস্থায়ী আয়ােজন। এটি কেবলমাত্র অন্তর্বর্তীকালীন প্রয়ােজন সাধন করে থাকে। যখন এটি পরিত্যাজ্য হয়, এটি স্বভাবতই এর যাবতীয় অতীত কার্যকলাপকে আইনগত করে নেয় দায়মুক্তি পাওয়ার জন্য, এই সুকৌশলে স্বীকৃতিসহ যে, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় এর হস্তক্ষেপ ছিল একটি বিচ্যুতি (aberration) এবং তা উপেক্ষা (condoned) করা আবশ্যক। কিন্তু যখন প্রত্যাহারকৃত হয় তখন সামরিক আইন অযােগ্যতার বিচারে প্রত্যাহারকৃত হয় না। এটি ভালাে যতক্ষণ পর্যন্ত তা টিকে থাকে। কিন্তু এর প্রস্থানের পর এটি আর দেশের সাধারণ আইনের আস্থা পায় না। আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে মাননীয় বিচারপতিদের উপরােক্ত মতামতের সঙ্গে ঐকমত্য পােষণ করছি এবং এই সিদ্ধান্ত নেই যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ অন্যান্য আইনের সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রচলিত আইন হিসেবে বিদ্যমান ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করার পর, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮এ বর্ণিত অন্যান্য আইনসমূহ’ এর অভিব্যক্তির আওতাধীনে সুরক্ষিত এবং সংরক্ষিত এবং এটি এই আদালতের জুডিশিয়াল রিভিউ সাপেক্ষে, যখন এটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
৩৯২
৬৭. জনাব কোরবান আলী এবং জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমদ এর মতানুসারে, এই অর্ডিন্যান্স সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর মাধ্যমে সংবিধানের অংশ হিসেবে প্রণীত হয়েছিল। কিন্তু এটি প্রতীয়মান হয় যে, চতুর্থ তফসিলে কিংবা সংবিধানের অন্য কোনও বিধান মতে এমনটি বর্ণিত হয়নি যে, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধানের একটি অংশ হিসেবে উচিত। উপরন্তু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর মাধ্যমে এটি অন্যান্য আইনসমূহ’ এর শ্রেণিতে প্রচলিত আইন হিসেবে সংরক্ষিত এবং বিদ্যমান ছিল যা ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ই এপ্রিল ১৯৭৯ এই সময়কালের মধ্যে জারি করা হয়েছিল। যেহেতু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে একটি সাধারণ প্রকৃতির আইন হিসেবে এটি সংরক্ষিত, সুরক্ষিত এবং প্রচলিত ছিল, সেহেতু, তা সংসদ সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সংশােধন বা রহিত করা যেতে পারে। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) এ এই মর্মে স্পষ্ট বিধান রয়েছে যে, ১৫-৮-৭৫ থেকে ৯-৪-৭৯ সময়কালের মধ্যকার সময়কালে প্রণীত সকল আইন সুরক্ষিত ছিল, কিন্তু তা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংশােধিত, পরিবর্তিত এবং রহিত করা যেতে পারে। এর অর্থ, একটি আইনকে রহিত করার জন্য সংসদ হচ্ছে প্রকৃত কর্তৃপক্ষ। সংবিধানের চতুর্থ তফসিল কিংবা অন্য কোনও বিধানের কোথাও এটি বর্ণিত ছিল না যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে প্রচলিত এবং সংরক্ষিত আইনের প্রয়ােজনীয় সংশােধন কিংবা পরিবর্তন কিংবা রহিত করার জন্য সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অত্যাবশ্যক হবে। যেহেতু, এরূপ কোনও বিধান ছিল না, সেহেতু, আমরা এরূপ একটি বিধান আমদানি করতে পারি না এবং সেই কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংসদ সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সংশােধন কিংবা পরিবর্তন কিংবা রহিত করা যেতে পারে মর্মে এবং এজন্য সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আবশ্যকতা ছিল না। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একই সঙ্গে অন্য পাঁচজন বিজ্ঞ এমিকাস কিউরি তাঁদের এই মত প্রকাশ করেছেন যে, এই ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ সংসদ সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে আইনগতভাবেই পাশ করা হয়েছে এবং এরূপ একটি আইন পাশ করার জন্য, সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আদৌ কোনও প্রয়ােজনীয় ছিল না।
৬৮. প্রতিপক্ষীয় হলফনামায় (Affidavit-in-Opposition), উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এটি
দেখান যে, ১২টি অধ্যাদেশ যা ১৫-৮-৭৫ থেকে ৯-৪-৭৯ সময়কালের মধ্যে পাশ করা হয়েছিল, বি সেগুলাে পরবর্তীতে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে অ্যাক্ট অব পার্লামেন্ট দ্বারা এবং এমনকি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমেও রহিত করা হয়েছে। জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল আরাে একটি উদাহরণ দিয়ে দেখান যে, সুপ্রীম কোর্ট এবং হাইকোর্ট বিচারক (বেতন ভাতা এবং সুবিধাদি) অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬ (LXV ১৯৭৬) রহিত করা হয়েছিল সুপ্রীম কোর্ট বিচারক (বেতন ভাতা এবং সুবিধাদি) অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮, (অধ্যাদেশ নং-XI, ১৯৭৮) এর মাধ্যমে। এই অর্ডিন্যান্স নং-XI, ১৯৭৮ পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে সময় সময় সংশােধন করা হয়েছে। তাই, এই সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সংরক্ষিত এবং অনুমােদিত অন্যান্য আইনসমূহ সংশােধন অথবা রহিত করার জন্য সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আবশ্যক এই বক্তব্যের কোনও আইনগত ভিত্তি নেই।
৬৯. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং পাঁচজন বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরি (Amicus Curiae) এই মত প্রকাশ করেন যে, যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের বিধি বহির্ভূত (ultra vires) হওয়ার কারণে বাতিল, তাই এটি শুরু থেকেই বাতিল (Void ab-initio) এবং সংবিধানের দৃষ্টিতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স,
৩৯৩
১৯৭৫ এর মতাে কোনও আইন বিদ্যমান ছিল না। তারা আরও বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জন্ম থেকেই মৃত এবং এর জন্মলগ্ন থেকেই এর কোনও আইনগত অস্তিত্ব ছিল না। যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধানের বিধি বহির্ভূত (ultra vires) হওয়ার কারণে বাতিল; সেহেতু, এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এ বর্ণিত অন্যান্য আইনসমূহ’ এর একটি হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। যেহেত, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স শুরু থেকেই বাতিল (ooid ab-initio) সেহেতু, ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ এর কোনও আইনগত অস্তিত্ব ছিল না এবং সেই কারণে, সংবিধানের কোনও অংশ নয় কিংবা এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে বর্ণিত অন্যান্য আইনসমূহ’ এর অধীনে প্রচলিত কোনও আইন হতে পারে না। সেহেতু, আমাদের কাছে এটি প্রতীয়মান হয় যে, একটি বাতিল আইন যদিও তা বাতিল বলে আদালত কর্তৃক ঘােষিত হয়নি তা দীর্ঘদিন পর আইনগতভাবেই সংসদ কর্তৃক রহিত করা হয়েছে এবং সেই কারণে, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ পাশ করার ক্ষেত্রে বেআইনি কিংবা অসাংবিধানিক কিছু ঘটেনি।
৭০. এখতিয়ার খর্ব (ouster of jurisdiction) সম্পর্কে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট কর্তৃক উত্থাপিত যুক্তিতে এর্টি বর্ণিত হয়েছে যে, এমনকি যদি সামরিক আইনের ফরমানে কিংবা প্রবিধানে এরূপ কোনও খর্ব করার বিধান (ouster clause) থাকে তথাপিও আমাদের আপীল বিভাগ অনেক মামলায় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এই আদালত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২ এর অধীনে এটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য উপযুক্ত যে, প্ৰকতই এখতিয়ার খর্ব করা হয়েছিল কি না বা হয়নি এবং এরূপ খর্ব করার বিধির বিস্তৃতি এবং আওতা কতটুকু তা বিচার করে দেখার। যেহেত, বর্তমান মামলায় ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, সংবিধানের বিধি বহির্ভূত (ultra vires) হওয়ার কারণে শুরু থেকেই তা বাতিল (ooid-ab-initio); সেহেতু এই আদালতের এখতিয়ার রয়েছে এরূপ একটি আইনের সাংবিধানিকতার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার।
৭১. এই প্রসঙ্গে নিমােক্ত মামলাগুলাের উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে :
“Secretary of State vs. Mask & Co. 44 CWN (PC) 709, Anisminic Ltd. vs. Foreign Compensation, (1969)(I) AER 208, Khandkar Ehteshamuddin Iqbal vs. Bangladesh 36 DLR (AD) 154, Khondaker Moshtaque Ahmed vs. Bangladesh 34 DLR (AD) 222, Jamil Hoq vs. Bangladesh 34 DLR (AD) 125, Bangladesh vs. Md Salimullah, 35 DLR (AD) 1 and Anwar Hossain vs. Government of Bangladesh, 41 DLR (AD) 165. 92 g0y68 William Marbury vs. James Madison, 63110 US Supreme Court Reports (1803), Laco Edition 135
এ প্রতিবেদিত হয়েছে যা সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক জুডিসিয়াল রিভিউ (judicial review) এর অধিকারের একটি স্বীকৃতি হিসেবে বারংবার বার এর পক্ষ হতে উদ্ধৃত হয়েছে। উপরােক্ত মামলায় আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টের রায় যা প্রধান বিচারপতি মার্শাল কর্তৃক লিখিত হয়েছে তা আইনগত যৌক্তিকতা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা (dexterity) উভয় ক্ষেত্রেই একটি প্রধানতম নির্দেশক (masterpiece)। রায়টি বহুপূর্বের যা ১৮০৩ সালে জুডিসিয়াল রিভিউ এর নীতি এবং এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা প্রয়ােগের বিষয়টি বর্ণিত হয়েছিল যা নিম্নোক্ত প্রশংসনীয় ভাষায় :
“Thus, the particular phraseology of the Constitution of the United States confirms and strengthens the principle, supposed to be essential to all written Constitutions, that a law repugnant to the Constitution is void and that Courts, as well as other departments, are bound by that instrument.”
৩৯৪
৭২. জনাব অ্যাটর্নি জেনারেল তার বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে Miss Benazir Bhutto os. Federation of
Pakistan, PLD (1988) (SC) 416 মামলায় প্রদত্ত বিখ্যাত রায়টির উদ্ধৃতি প্রদান করেন। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের এগারজন বিচারক এগারদিন ধরে মামলাটি শ্রবণ করেন এবং এরপর এই বিশাল রায়টি প্রদান করেন। পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের উপযুক্ত রায় হতে আমরা বর্তমান মামলাটিতে স্বাভাবিক সমর্থন (Substantial Support) পেতে পারি। সামরিক আইনের সময়কালে Political Parties Act of 1962 এ কতিপয় সংশােধনী আনয়ন করা যায় যেখানে রাজনৈতিক দলগুলাের জন্য বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশনের বিষয়টি বর্ণিত হয়। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত এরূপ সংশােধনীকে এবং শেষ পর্যন্ত যা সংবিধানের অধীনে সংরক্ষিত, সন্নিবেশিত, অনুমােদিত এবং নিশ্চিতকৃত হয়েছিল তাকে চ্যালেঞ্জ করে, বেনজির ভুট্টো সুপ্রীম কোর্টে মামলা দায়ের করেন; এর ভিত্তিতে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট উপরােক্ত রায় প্রদান করেন এবং এই মর্মে ঘােষণার মাধ্যমে যে, The Political Parties Act, 1962 এর ধারা ৩-ই সম্পূর্ণরূপে বাতিল।
পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিগণ এই রায়ে মত প্রকাশ করেন যে, সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপের বৈধতা যদিও বারিত তথাপিও তাকে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে এবং তাদের কার্যকলাপ জুডিসিয়াল রিভিউ (judicial review) এর শর্তাধীন। আদালতের এখতিয়ার খর্ব করে এমন কোনও আইনের প্রণয়ন, বলবকরণ, বৈধকরণ এবং নিশ্চিতকরণ সংবিধানের অধীনে নিশ্চিতকৃত মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া অথবা প্রবর্তন করা অথবা পুনঃস্থাপন করা কোনটির ক্ষেত্রেই কার্যকর হবে না। সংবিধানের সংশােধনের মাধ্যমে নিশ্চিতকরণ এবং বৈধতা প্রদান, যদিও সীমিত, তথাপিও জুডিসিয়াল রিভিউ (judicial review) এর শর্তাধীন, যদি তা মৌলিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করে। মহামান্য বিচারকগণের সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ :
“But it does claim and has always claimed that it has the right to interpret the Constitution and to say as to what a particular provision of the Constitution means or does not mean, even if that particular provision is a provision seeking to oust the jurisdiction of this Court. This is a right which it acquires not dehors the Constitution but by virtue of the fact that it is a superior Court set up by the Constitution itself as a result of the System of Division of power. It is not necessary for this purpose to invoke any divine or supernatural right but this judicial power is inherent in the Court itself. It flows from the fact that it is a Constitutional Court and it can only be taken away by abolishing the Court itself.”
“The Court is left with no jurisdiction to strike off the laws without, in any way, affecting the judicial power to interpret the constitutional provision, which can not be denied so long as the Court exists. Here I would add the admirable words of Chief Justice Hughes of the Supreme Court of the United States of America;- “We are under a Constitution, but the Constitution is what the Judges say it is….” (Columbia Law Review, Volume 49, page 201.”
৩৯৫
এই প্রসঙ্গে আমরা প্রধান বিচারপতি মার্শাল-এর বিখ্যাত উক্তিটির যথার্থই উদ্ধৃতি দিতে পারি যা নিম্নরূপ :
“Every branch of Government i.e. executive as well as legislature has the right to look to the Constitution to find its meaning, but the ultimate authority to say what the law is, is the Court and it is for the Court to say whether the executive or the legislature has overstepped its bounds.”
৭৩. সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২ এর অধীনে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের এক্তিয়ার খর্ব সম্পর্কিত প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে Khandaker Moshtaque Ahmed os. Bangladesh 34 DLR (AD) 222 মামলার রায়ে, যেখানে এমিকাস কিউরি (Amicus Curiae) জনাব খােন্দকার নিজেই হাজির হয়েছিলেন। উক্ত রায়ে আমাদের আপীল বিভাগ সামরিক আইনের প্রবিধানের অধীনে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের। সামগ্রিক বিচার অসৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হওয়ায় তা বাতিল এবং এক্তিয়ার বহির্ভূত মর্মে ঘােষণা করে। সেহেতু, উপযুক্ত রায় হতে এটি আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, এমনকি কোনও কাজ বা ঘটনা যা সংঘটিত হয়েছে অথবা কোনও বিচার যা করা হয়েছে সামরিক আইনের ফরমান, প্রবিধান অথবা আদেশের অধীনে, তাকে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২ এর অধীনে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে যদি তা এক্তিয়ার ব্যতিরেকে প্রণীত হয়ে থাকে, তবে তা কোরাম নন জুডিস বা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত।
৭৪. জনাব রফিক-উল হক আমাদের সমীপে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের মূল সংবিধানের অনুলিপি পেশ করেছেন। তিনি বলেন যে, কেবল যখন সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২-এর অধীনে সংবিধান সংশােধন প্রয়ােজন তখন তা সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে করা অত্যাবশ্যক, কিন্তু ধারণ আইনের ক্ষেত্রে, কোনও আইনের সংশােধন অথবা সংযুক্তি অথবা রহিতকরণ সর্বদাই সংসদ সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে করা যেতে পারে। এটি হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত আইন। যদি সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১৪২ ব্যতীত এটি বর্ণিত হতাে যে, একটি নির্দিষ্ট আইন সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সংশােধিত কিংবা রহিত হওয়া উচিত, তখন এবং সে-ক্ষেত্রে এরূপ একটি আইনকে সংশােধন কিংবা রহিত করার জন্য সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নটি আসবে। তিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনুচ্ছে ৪৭(২)-এর শর্ত উদ্ধৃত করে বলেন যে, উক্ত অনুচ্ছেদে কিছু নির্দিষ্ট আইনের জন্য এটি বর্ণিত ছিল যে, এরূপ আইনের সংশােধন কিংবা রহিত করণ সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে করতে হতাে। এটি ব্যতীত, অন্য সকল সাধারণ সংশােধনী অথবা রহিতকরণগুলাে যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২-এর আওতায় আসে না, তা সংসদের সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতাতেই সংশােধন, সংযুক্তি, পরিবর্তন অথবা রহিত করার জন্য যথার্থই উপযুক্ত। সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) এ আইনের পরিবর্তন, সংযুক্তি অথবা রহিতকরণ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে এবং যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, সাধারণ দেওয়ানি প্রকৃতির আইন হিসেবে সংরক্ষিত এবং সন্নিবেশিত হয়েছিল সেহেতু, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ এর মাধ্যমে এটি আইনগত এবং সঠিকভাবেই রহিত করা হয়েছে। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে কেবল যখন এমন কোনও আইনের সংশােধন কিংবা রহিত করা আবশ্যক হয় যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এর আওতাধীনে আসে।
৭৫. এর উত্তরে, বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব কোরবান আলী বলেন যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করা হয়েছিল সামরিক আইন বলবৎ থাকার সময়ে এবং যেহেতু, এটি প্রণীত হয়েছে অতি সাংবিধানিক কার্যকারিতার প্রেক্ষাপটে, সেহেতু, এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে
৩৯৬
সংরক্ষিত হয়েছে এবং সেই কারণে, সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এটিকে রহিত করার জন্য আবশ্যক। আমরা জনাব কোরবান আলীর উপরি-উক্ত বক্তব্যের উত্তর আমাদের উপরােক্ত আলােচনায় প্রদান করেছি এবং নতুন কোন ব্যাখ্যা প্রদান আবশ্যক নয়।
৭৬. জনাব কোরবান আলী আরাে নিবেদন করেছেন যে, ১৯৭৫ সালের Act I বলে Emergency Powers Act পাস করা হয়েছিল। জরুরি অবস্থা আদেশে মৌলিক অধিকার স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল। উপরােক্ত জরুরি অবস্থা ক্ষমতা অধ্যাদেশ, ১৯৭৫ বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি করা হয়েছিল যা পরবর্তীতে সংসদের আইনে পরিণত হয়। জরুরি অবস্থার ফরমান ২৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭৪ এ জারি করা হয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪২ এর বিধি (১) এর অধীনে প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ২৮ই ডিসেম্বর ১৯৭৪ এ একটি আদেশ জারি করা হয় এবং ঐ আদেশের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি আদালতের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার বলবৎ করাকে স্থগিত করেন এবং এই জরুরি অবস্থা ২৭-১১-৭৯ তারিখে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তিনি বলেন যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স ২৬-৯-৭৫ তারিখে জারি করা হয়েছিল এবং যেহেতু, প্রাসঙ্গিক সময়ে আদালতের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার বলবৎ করা স্থগিতকৃত অবস্থায় ছিল সেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, সংবিধানের মৌলিক অধিকার বিধি বহির্ভূতভাবে প্রণীত হয়নি। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে জনাব কোরবান আলীর উপরােক্ত মতামত গ্রহণ করা কষ্টকর যে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আদালতের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার বলবৎ করা স্থগিত ছিল এবং পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এরূপ জরুরি অবস্থা জারি এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হতে এটি বুঝায় না যে, একটি আইন অথবা অধ্যাদেশ সংবিধানের বিধিবহির্ভূত হিসেবে ঘােষণা করা যেতে পারে না। এটি কেবল আদালতের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার বলবৎ করাকে নির্ধারিত সময়ের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল এবং এর বেশি কিছু নয়। তাই, আমরা জনাব কোরবান আলীর উপরােক্ত মতামতের মাঝে কোনও সারবত্তা লক্ষ্য করি না।
৭৭. এটি নিবেদন করা হয় যে, সরকার পরিবর্তন করার জন্য ১৫-৮-১৯৭৫ তারিখের উপযুক্ত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। জনাব কোরবান আলীর নিকট একটি প্রশ্ন রাখা হয়েছিল যে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সরকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, কিন্তু অন্যান্য ব্যক্তিগণ যাদেরকে ১৫-৮-১৯৭৫ তারিখে কিছু ব্যক্তি কর্তৃক হত্যা করা হয়েছিল তারা কোনােভাবেই সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না এবং সেই কারণে কেন রাষ্ট্রপতি ব্যতীত অন্যান্য ব্যক্তিদের খুনীরা এর জন্য দায়ী হবেন না? জনাব কোরবান আলী বলেন যে, ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা একটি বিপ্লব যা সামরিক কু এর মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছিল এবং ঐরূপ আর্মি কু্য সংঘটনের সময় এটি নির্ধারণ করা যেত না যে, কে কাকে হত্যা করেছিল। সেই কারণে অন্য ব্যক্তিগণকে প্রাসঙ্গিক। সময়ের ঘটনা সংঘটন হতে পৃথক করা যেতে পারে না। এরূপ একটি ব্যাখ্যা চূড়ান্তভাবে দুর্ভাগ্যজনক এবং
সেই কারণে তা গ্রহণ করা যেতে পারে না।
৭৮. তিনি আরাে বলেন যে, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ একটি এক্স পােস্ট ফ্যাক্টো (Ex-post facto) আইন যার মাধ্যমে ভূতাপেক্ষভাবে সুবিধা অথবা অধিকার প্রদান করা যেতে পারে, কিন্তু ভূতাপেক্ষভাবে কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করার জন্য কোন বিধান করা যেতে পারে না যা ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করার সময়ে কোনাে শাস্তি ছিল না। এক্স পােস্ট ফ্যাক্টো আইনের মাধ্যমে যেসব ব্যক্তি ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের উপর ন্যস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া যেতে পারে না। এক্স পােস্ট ফ্যাক্টো আইনের (legislation) এই তত্ত্ব বর্তমান মামলায় চলতে পারে না, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সংবিধান বিধিবহির্ভূত হওয়ার কারণে তা বাতিল বলে
৩৯৭
প্রতীয়মান হয়। AIR 1956 (All) ৬৮৪ এ প্রতিবেদিত রায়ের সিদ্ধান্তের সাথে ঐকমত্য হয়ে আমরাও সিদ্ধান্তে আসি যে, অসাংবিধানিক আইন কোনও আইন নয় : এটি কোনও অধিকার প্রদান করে না; এটি কোনও দায়িত্ব আরােপ করে না; এটি কোনও নিরাপত্তা প্রদান করে না; এটি কোনও প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে ; আইনগত বিবেচনায় এটি এইভাবে অকার্যকর যেন এটি কখনাে পাস হয়নি।
৭৯. আদালত জনাব কোরবান আলীর নিকট এই মর্মে আরেকটি প্রশ্ন রাখে যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বলবৎ হয় ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ তারিখে যা কি না ১৫-৮-৭৫ তারিখে সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং অন্যান্যদের খুনিদের কথিত মতে রক্ষা করে। কিন্তু জেল হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল ৩-১১-৭৫ তারিখে। প্রার্থনা অংশে ধানমণ্ডি থানার মামলা নং-১০(১০)/১৯৯৬ এবং লালবাগ থানার মামলা নং-১১(১১)/১৯৭৫ হতে উদ্ভূত দুইটি ফৌজদারি মামলার কার্যক্রমের বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু জেল হত্যার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে ৩-১১-৭৫ তারিখে এবং যেহেতু, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কেবলমাত্র ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সেহেতু, কীভাবে তা (জেল হত্যার ঘটনা) ২৬-৯-৭৫ তারিখের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের দ্বারা সুরক্ষিত হতে পারে?
৮০. উত্তরে জনাব কোরবান আলী বলেন যে, ৮-১১-৭৫ তারিখের দ্বিতীয় ফরমান জারি করার মাধ্যমে ৩-১১-৭৫ তারিখের ঘটনাকে আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি আরও বলেন ৩-১১-৭৫ তারিখের এই জেল হত্যার ঘটনাটি ছিল ১৫-৮-৭৫ তারিখের ঘটনার প্রেক্ষিতে একটি পরিণতি এবং সেই কারণে এটি ৮-১১-৭৫ দ্বিতীয় ফরমানের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি আরাে বলেন যে, ৩-১১-৭৫ তারিখের এই জেল হত্যার ঘটনা কেবল ১৫-৮-৭৫ তারিখের ঘটনার পরিণতিই নয় বরং তা একই ষড়যন্ত্রের (transaction) অংশ হিসেবে পরিগণিত হওয়া উচিত। এটি একটি অযৌক্তিক proposition, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যে, ৮-১১-৭৫ তারিখের এই দ্বিতীয় ফরমান ৩-১১-৭৫ তারিখে জেলে চার জাতীয় নেতাদের যারা খুন করে তাদের কোনও প্রকার দায়মুক্তি সংক্রান্ত কিংবা দায়মুক্তি প্রদান করেনি। হত্যা ঘটনা সম্পর্কে অন্য কোনও দায়মুক্তি আদেশ বা প্রবিধান প্রণীত হয়নি। এই চিন্তা করা অযৌক্তিক যে, ৩-১১-৭৫ তারিখের ঘটনা একই ঘটনা (same transaction) যা ১৫-৮-৭৫ তারিখে সংঘটিত হয়েছে তার একটি অংশ। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কেবল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা সম্পর্কিত এবং তা ৩-১১-৭৫ তারিখের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। জনাব কোরবান আলী নিস্ফলভাবে ৩-১১-৭৫ তারিখের ঘটনাকে ১৫-৮-৭৫ তারিখের একই ঘটনার (same transaction) একটি অংশ হিসেবে গণ্য করে তার মত প্রকাশ করেছেন। তাই আমাদের মত হচ্ছে যে, ৩-১১-৭৫ তারিখের জেল হত্যাকারীদের দায়মুক্তি প্রদান সম্পর্কিত কোনও আইন নেই। ২৬-৯-৭৫ তারিখের এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ কেবল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনা সম্পর্কিত এবং এটা কোনােভাবেই ৩-১১-৭৫ তারিখে জেলে সংঘটিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না।
৮১. Stroud’s Judicial Dictionary, Volume 1 এবং Volume 3 এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দীন আহমেদ approval, ratification এবং confirmation শব্দগুলাের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তার মতে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ৩ক প্যারাগ্রাফ সংযুক্ত করে ১৫-৮-৭৫ তারিখ হতে ৯-৪-৭৯ তারিখ সময়ের মধ্যে প্রণীত অন্যান্য আইন’ বৈধভাবে প্রণীত হয়েছিল বলে ধরে নেয়া হয়েছিল। জনাব খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন যে, প্যারাগ্রাফ ১৮ সংযুক্ত করে “অন্যান্য আইন” (“other laws”) সংসদ সদস্যদের দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠায় অনুসমর্থিত এবং নিশ্চিতকত করা হয়েছিল এবং সেই কারণে এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫, অন্যান্য আইন’ প্রকৃতির হওয়ায় সেটিকে
৩৯৮
সংবিধানের অংশ হিসেবে করা হয়েছিল যা সংশােধন কিংবা রহিত করা যেতে পারে কেবল সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে। আমরা ইতােমধ্যে এই বিষয়ে আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি। এ বিষয়ে পুনরায় আলােচনার আদৌ আবশ্যকতা নেই।
৮২. উভয়পক্ষের বিজ্ঞ অ্যাডভােকেটদের নিবেদন এবং বিজ্ঞ অ্যামিকাস কিউরিদের প্রদত্ত মতামত বিবেচনা করে, আমাদের কাছে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ দ্বারা আদালতের এক্তিয়ার খর্ব করার বিষয়টি এমনভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে যে, ১৫-৮-৭৫ তারিখ হতে ৯-৪-৭৯ তারিখ পর্যন্ত সময়কালে যা কিছু সংঘটিত হয়েছিল বা করা হয়েছিল তা নিয়ে কোনও আদালত কিংবা ট্রাইব্যুনালে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। কিন্তু আমরা সন্তুষ্টির সাথে বলছি যে, উভয় পক্ষের বিজ্ঞ কৌসুলীগণ এবং সকল অ্যামিকাস কিউরি ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদের এই মূল্যবান মত প্রকাশ করেছেন। যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ নং ৩ক এবং ১৮ এর barring clause থাকা সত্ত্বেও এই আদালতের স্বেচ্ছাধীন এখতিয়ার (Inherent jurisdiction) রয়েছে উপরােক্ত সময়কালের মধ্যে পাসকৃত যে-কোনও আইনের সাংবিধানিক বৈধতা পর্যবেক্ষণ করা এবং বিবেচনা করে দেখা, যখন এটি দেখা যায় যে, এক্তিয়ার ব্যতিরেকে, কোরাম নন জুডিস অথবা অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে (without jurisdiction, coram non judice বা malafide) তা প্রণীত হয়েছে।
৮৩. এই প্রসঙ্গে ইতােমধ্যেই 33 DLR (AD) 154, 45 DLR (AD) 1 এবং 34 DLR (AD) 222 এবং 125
এ বর্ণিত রায়গুলাের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। আমরা এটি পর্যবেক্ষণ করে গর্বিত যে, বেশ কিছু বিখ্যাত রায়ের মাধ্যমে আমাদের আপীল বিভাগ ইতিমধ্যেই এই নীতি প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, কোনও আইনে খর্ব করার বিধি (ouster clause) থাকা সত্ত্বেও, সাংবিধানিক এক্তিয়ার এর অধীনে বিচার বিভাগীয় নিরীক্ষণ এবং রিভিউ (judicial scrutiny and review) করার কর্তৃত্ব এই আদালতের রয়েছে, যদি আইনটি এক্তিয়ার ব্যতিরেকে, কোরাম নন-জুডিস অথবা অসউদ্দেশ্য প্রণােদিতভাবে পাস করা হয়ে থাকে অথবা কাজটি করা হয়ে থাকে। যদি কোনও আইন পাস করা হয়ে থাকে অথবা সংবিধানের কোন সংশােধনী করা হয়ে থাকে এমনকি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে, তথাপিও এই আদালত এটিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে, যদি এটি পরিলক্ষিত হয় যে, আইনটি অথবা সংশােধনীটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তিকে (fundamental structure of the constitution) ক্ষুন্ন করেছে। আপীল বিভাগ কর্তৃক এই বিষয়টিই বিস্তারিতভাবে বিবেচিত হয়েছে সংবিধানের অষ্টম সংশােধনী মামলা হিসেবে পরিচিত মামলায় প্রদত্ত fanto JIC (Constitution (8th Amendment) Case, BLD (A.D.) 1989, Special Issue.
৮৪. বর্তমান মামলা দুটিতে বিবেচনার প্রধান বিষয় এই যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ কে রহিত করে প্রণীত ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬ সংবিধান পরিপন্থি কি না। পিটিশনারদের মতে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধানের একটি অংশ যা সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে সুরক্ষিত এবং সংরক্ষিত হয়েছে এবং রহিতকরণ Act যা হচ্ছে, ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং ২১/১৯৯৬ সংবিধানের তফসিলটির প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এবং অনুচ্ছেদ ১৪২ কে ক্ষুন্ন করেছে এই কারণে যে, উক্ত আইন নং-২১/১৯৯৬ সংসদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে পাশ করা হয়েছে। পিটিশনারদের উপরােক্ত মতামত গ্রহণ করা কঠিন। আমাদের কাছে এটি প্রতীয়মান হয় যে, অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ একটি সাধারণ আইন (legislation) ছিল যা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খােন্দকার মােশতাক আহমেদ কর্তৃক সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৩(১) এর অধীনে জারি করা হয়েছিল। এটি সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের উভয় প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ তে অন্যান্য আইন’ এর
৩৯৯
প্রকৃতিতে বর্ণিত পূর্বক সংরক্ষিত এবং নিরাপদকৃত হয়েছে। তাই, আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ সংবিধানের কোন অংশ নয়, বরং এটি চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এ “অন্যান্য আইন” এর প্রকৃতিতে সংরক্ষিত এবং নিরাপদকৃত একটি সাধারণ আইন। উপরন্তু, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক(৭) এবং অনুচ্ছেদ ১৪৯ অনুসারে আমরা সিদ্ধান্তে আসি যে, এই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ আইনগতভাবেই সংসদ সদস্যদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে রহিত করা হয়েছে, এই কারণে ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট, ১৯৯৬, চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ অথবা অনুচ্ছেদ ১৪২ অথবা সংবিধানের অন্য কোনও বিধানকে ক্ষুন্ন করেনি।
৮৫. ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ সম্পর্কে রেসপন্ডেন্টগণ দুই ধরণের যুক্তির অবতারণা করেছেন। প্রথমত, ২০ আগস্ট ১৯৭৫-এ সামরিক আইনের ফরমানের সঙ্গে সংবিধানও বলবৎ ছিল এবং যখন ২৬-৯-১৯৭৫ তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ জারি করা হয়, তখন তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬, ২৭, ৩১, ৩২, ৬২ এবং ৯৩(১)(র) কে লঙ্ঘন করেছিল এবং সেই কারণে, এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(২) এবং ২৬(২) এর অধীনে বাতিল ছিল। দ্বিতীয়ত সামরিক আইন প্রত্যাহারের পূর্বে বা তা প্রত্যাহারের সাথে সাথে কোনও সময়ই ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫, চতুর্থ তফসিলের প্যারাগ্রাফ ৩ক এবং ১৮ এর অধীনে বিদ্যমান আইন হিসেবে অন্যান্য আইন’ এর প্রকৃতি হিসেবে সুরক্ষিত এবং সংরক্ষিত হয়েছিল তা বিচার বিভাগীয় নিরীক্ষণের (to judicial scrutiny) জন্য আনা হয়নি। সেহেতু, ১৯৭৫ এর অর্ডিন্যান্স নং-৫০ সংবিধানের পরিপন্থি এবং তা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৬, ২৭, ৩১, ৩২, ৬২ এবং ৯৩(১)(র) কে লঙ্ঘন করায়, এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(২) এবং ২৬(২) এর অধীনে বাতিল। উপরি-উক্ত বিবেচনার পর আমরা সিদ্ধান্তে আসি যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধানের বিধি বহির্ভূত (ultra vires) এবং সেই কারণে এটি সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(২) এবং ২৬(২) এর অধীনে বাতিল। যেহেতু, আমরা এই আর্ডন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ কে বাতিল বলে ঘােষণা করছি সেহেতু সংবিধানের দৃষ্টিতে ২৬-৯-৭৫ তারিখে জারি হওয়ার সময় এর কোনও আইনগত অস্তিত্ব ছিল না এবং বর্তমানেও নেই।
৮৬. যেহেতু, অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(২) এবং ২৬(২) এর অধীনে বাতিল বলে ঘােষিত হলাে, সেহেতু, এটি যেসব ব্যক্তিগণের জন্য এটি প্রণীত হয়েছিল তাদের অনুকূলে কোনও সুবিধা, পরিণতি, ফলাফল অথবা আইনগত অথবা ন্যস্ত অধিকার সৃষ্টি করবে না এবং সেই কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ধারা ৬ ঐসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয় যারা উক্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ হতে উদ্ভূত কোনও সুবিধা অথবা আইনগত অধিকার দাবি করে।
৮৭. যেহেতু ইনডেমনিটি (রহিতকরণ) অ্যাক্ট নং ২১/১৯৯৬, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ কে রহিত করেছে এবং যেহেতু, পিটিশনারগণ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং ৫০/১৯৭৫ এর বিধানাবলির উপর নির্ভর করে দুইটি ফৌজদারি মামলা যথা : ধানমণ্ডি থানা মামলা নং ১০(১০)/১৯৯৬ এবং লালবাগ থানা মামলা নং-১১(১১)/১৯৭৫ দায়ের করা বাতিল, বেআইনি এবং এক্তিয়ার বহির্ভূত হিসেবে ঘােষণা করার প্রার্থনা জানান, সেহেতু, আমাদেরকে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ এর সাংবিধানিক বৈধতা পর্যবে করে দেখার আবশ্যকতা ছিল। সংবিধান এবং আইনের বিধানাবলির যথাযথ বিবেচনার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, উপরি-উক্ত দুইটি ফৌজদারি কার্যক্রম বেআইনি, বাতিল এবং এক্তিয়ার ব্যতিরেকে করা হয়েছে মর্মে ঘােষণা করার জন্য পিটিশনারদের প্রার্থনা গ্রহণযােগ্য হতে পারে না, কারণ স্বয়ং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০/১৯৭৫ সংবিধান পরিপন্থি হওয়ার কারণে তা বাতিল।
৪০০