৬
জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন
১৯৫৮-১৯৬৯
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম
১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও জেনারেল আইয়ুব খান গণতন্ত্র চায় না। তারা সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করবে। তাই তাদের অনুচরেরা পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হত্যা করে। প্রদেশে ও কেন্দ্রে সরকার অস্থিতিশীল করে সামরিক শাসনের ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নূনের মন্ত্রিসভা নিয়ে ইস্কান্দার মির্জা খেলা শুরু করেন। মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন নিয়ে ফিরােজ খান নূন ওয়াদা ভঙ্গ করেন। তাই ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর আওয়ামী লীগ মন্ত্রী জহিরুদ্দিন, দেলদার আহমদ, আদেল উদ্দিন, আবদুর রহমান খান, নূরুর রহমান খান পদ্যতাগ করেন।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ১০টায় ইস্কান্দার মির্জা বেতারে ভাষণ দেন এবং দেশে সামরিক আইন জারি করেন। তিনি পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য নিমােক্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন :
• ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিল;
• কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার বাতিল;
• কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়;
• সকল রাজনৈতিক দলকে বেআইনী ঘােষণা করা হয়;
• সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করা হয়।
প্রেসিডেন্ট প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানকে পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেন। ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সুলতান উদ্দিন আহমদের স্থলে আইজিপি জাকির হােসেনকে গভর্নর নিয়ােগ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর আখতার হােসেনের স্থলে কালাবাগের আমির আজমকে গভর্নর
পৃষ্ঠাঃ ২০২
নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন প্রশাসন নিযুক্ত করা হয় মেজর জেনারেল ওমরাও খানকে। জেনারেল আইয়ুব খান পল্টন ময়দানে এক সমাবেশে ভাষণ দেন এবং রাজনৈতিক নেতাদের সমালােচনা করেন। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ২৪ অক্টোবর আইয়ুব খানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তিনি ২৭ অক্টোবর শপথ নেন। ইতােমধ্যে আইয়ুব খানের সাথে মির্জার মতবিরােধ দেখা দেয়। মির্জা আইয়ুব খানকে সরিয়ে দেয়ার জন্য বিমান বাহিনীর সাথে ষড়যন্ত্র করেন। আইয়ুব খান এ সংবাদ পেয়ে জেনারেল আজম খান, কে এস শেখ, বারকি ও শের খানকে পাঠিয়ে ইস্কান্দার মির্জা ও তার স্ত্রী নাহিদ মির্জাকে বন্দী করে কোয়েটা পাঠিয়ে দেন। কোয়েটা থেকে তাদের লন্ডনে পাঠানাে হয়। ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক উভয় পদ গ্রহণ করেন। ২৭ অক্টোবর তিনি ১১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন।১
জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খান – প্রেসিডেন্ট-সিএমএলএ
লেঃ জেনারেল মুহাম্মদ আজম খান – পুনর্বাসন ও পূর্ত
লেঃ জেনারেল এ বারকি – স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ
মঞ্জুর কাদের – পররাষ্ট্র
বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম – আইন
লেঃ জেনারেল কে এম শেখ – স্বরাষ্ট্র
মােহাম্মদ শােয়েব – অর্থ
এফ এম খান – রেল ও যােগাযােগ
হাবিবুর রহমান – শিক্ষা ও তথ্য
হাফিজুর রহমান – খাদ্য ও কৃষি
এ কে খান – শিল্প ও সেচ
জুলফিকার আলী ভুট্টো – বাণিজ্য
সামরিক আইন জারি করে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা হয়নি। তবে সামরিক সরকারের কঠোর পর্যবেক্ষণে ছিলেন। তিনি গােপনে দলের কাজ চালিয়ে যান।২
তাজউদ্দীন আহমদের বিয়ে- ২৬ এপ্রিল ১৯৫৯
তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা কলেজের আরবি ও ফারসি ভাসার অধ্যাপক ছিলেন সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম। তার কন্যা সৈয়দা
পৃষ্ঠাঃ ২০৩
জোহরা খাতুন। ডাক নাম লিলি। শিক্ষক-কন্যা লিলির সাথে তাজউদ্দীনের পরিচয় ছিল। উভয় পরিবারের সম্মতিক্রমে ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল মোসাম্মত জোহরার সাথে তাজউদ্দীনের বিয়ে হয়। নব স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ১৮ নম্বর কারকুনবাড়ি লেনে বাস করতেন। ১৯৬২ সালে ধানমন্ডির বাসভবনে স্থায়ীভাব্দ বাস করতে থাকেন।
১৯৫৯ সারের ৬ আগস্ট প্রেসিডেন্ট- প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার নম্বর ১৩ বলে The Elective Bodies Disqualification Order- EBDO জারি করেন। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে একতরফা মিথ্যা অভিযােগ এনে তাদের ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত রাজনীতি ক্ষেত্রে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। ১৯৫৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের ৪৩ জনকে অযােগ্য ঘােষণা করা হয়। ১৯৫০ সালের ১৮ জুলাই তথাকথিত বিচারে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ১৯৬৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন নির্বাচনে প্রার্থী হতে অযােগ্য ঘােষণা করে। তিনি ৮৪ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ আড়াই হাজার সরকারী কর্মচারীকে স্ক্রীন আউট বা বরখাস্ত করেন।
মৌলিক গণতন্ত্র ১৯৫৯
১৯৫৯ সালের ২৫ অক্টোবর আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ জারি করেন। মৌলিক গণতন্ত্রের ৫টি স্তর ছিল- ইউনিয়ন, থানা, জেলা, বিভাগ ও প্রাদেশিক কাউন্সিল।
১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি উভয় অঞ্চলে মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার ও পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হয়। প্রত্যেক ইউনিয়নে ৯ জন নির্বাচিত ও ৪ জন মনােনীত সদস্য ছিল। তারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করত। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হ্যা ও না সূচক ভােট অনুষ্ঠিত হয়। সঙ্গত কারণে আইয়ুব খান আস্থাসূচক ভােট লাভ করেন।
১৯৬০ সালের ১৫ এপ্রিল জাকির হােসেনের স্থলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী লেঃ জেনারেল আজম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। তিনি ১৯৬২ সালের ১১ মে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন। তিনি পাঞ্জাবের অধিবাসী হয়েও মানব দরদী ও জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য বাঙালীদের আপনজন হতে পেরেছিলেন।
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর করাচীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সাথে পাকিস্তানের সিন্ধু নদের পানি চুক্তি সম্পাদিত হয়। আইয়ুব খানের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি অসংখ্য কমিশন গঠন করেন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আস্থা ভােট লাভ করে ১৯৬০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি
পৃষ্ঠাঃ ২০৪
বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে শাসনতন্ত্র কমিশন গঠন করেন। ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও চট্টগ্রামের ও.আর নিজাম কমিশন সদস্য ছিলেন। কমিশন ১৯৬২ সালের মে মাসে রিপাের্ট দাখিল করে। প্রশ্নোত্তর কাল ৫০.৬ ভাগ সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে মতামত প্রকাশ করে এবং ৪৭.৪ ভাগ প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির পক্ষে ছিল। কিন্তু আইয়ুব খান তার মন্ত্রিসভা দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়।
সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ৯টি মামলা দায়ের করে। হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তার মামলা পরিচালনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মুক্তিলাভ করেন।
দেশব্যাপী আইয়ুব খান প্রণীত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও সমালােচনা চলছে। এ সময় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। তাকে মুক্ত রেখে আইয়ুব খান শাসনতন্ত্র কার্যকর করা সম্ভব হবে না ভেবে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচী বাসভবন থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে করাচী জেলে অন্তরীণ রাখে। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল তিনি দেশদোহী ও পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। হােসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ধর্মঘট ও হরতাল পালন করে। ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা রাস্তায় মিছিল করে- সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। সর্বপ্রথম সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সরকার ৬ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করে। সারা দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হরতাল চলে। সামরিক সরকার শত শত আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার করে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, কোরবান আলী, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, ন্যাপের সৈয়দ আলতাফ হােসেন, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম প্রমুখকে বন্দী করা হয়। সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার ও বিচারপতি হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলতে থাকে। সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নতুন সংবিধান অনুসারে ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ ও ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। ভােটার হন ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী। সাধারণ জনগণের ভােটের অধিকার নেই। রাজনৈতিক দলগুলাে নির্বাচন বর্জন করে। তবে অনেক রাজনীতিবিদ ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে প্রার্থী হন।
পৃষ্ঠাঃ ২০৫
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ২৮ এপ্রিল পল্টন ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাকে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে দাফন করা হয়। গভর্নর আজম খান তার জানাজা ও দাফন অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
১৯৬৪ সালের ২৮ এপ্রিল ঢাকায় পরিষদের ১৬৭ এবং ৬ মে প্রাদেশিক আইনসভার ১৫৫টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ৯ মে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ জারি করেন এবং ৮ জুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। ১৯৬২ সালের ৮ জুন আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন। একই দিনে তমিজউদ্দিন স্পিকার, আবুল কাসেম ও আফজাল মিয়া ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালের ১৩ জুন আইয়ুব খান নিম্নোক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
মােহাম্মদ আলী – সিনিয়র মন্ত্রী ও পররাই
বিচারপতি মুহাম্মদ মুনির – আইন
আবদুল কাদির – অর্থ
আবদুল মােনায়েম খান – স্বাস্থ্য, শ্রম
হাবিবুল্লাহ খান – স্বরাষ্ট্র
ওয়াহেদুজ্জামান – বাণিজ্য
জুলফিকার আলী ভুট্টো – শিল্প ও প্রাকৃতিক গ্যাস
সবুর খান – যােগাযােগ
এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী – খাদ্য ও কৃষি
আবদুল ওয়াহেদ খান – তথ্য ও বেতার
এটিএম মােস্তফা – শিক্ষা
পরে জেড এ ভুট্টো পররাষ্ট্র, মুহাম্মদ শােয়েব অর্থ, আবদুল্লাহ জহিরুদ্দিন স্বাস্থ্য ও শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
নয় নেতার বিবৃতি
২৪ জুন, ১৯৬২
সামরিক আইন প্রত্যাহারের পর শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক নেতা ১৯৬২ সালের ১৮ জুন মুক্তি লাভ করেন। পূর্ব বাংলার জনগণ আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্র মেনে নেয়নি। ১৯৬২ সালের ২৪ জুন পূর্ব বাংলার ৯ জন নেতা এক যৌথ বিবৃতিতে সর্বজনীন ভােটাধিকার, নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আহবান জানান। নেতারা হলেন৩ :
নূরুল আমিন – মুসলিম লীগ
পৃষ্ঠাঃ ২০৬
আতাউর রহমান খান – আওয়ামী লীগ
শেখ মুজিবুর রহমান – আওয়ামী লীগ
আর হােসেন সরকার – কেএসপি
হামিদুল হক চৌধুরী – কেএসপি
মাহমুদ আলী – ন্যাপ
সৈয়দ আজিজুল হক – কেএসপি
মৌলানা পীর মুহসেন উদ্দিন আহমেদ দুদু মিয়া – নেজামে ইসলাম
নয় নেতার বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে ছাত্র ও জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। নয় নেতার বিবৃতির সমর্থনে ১৯৬২ সালের ৮ জুলাই ঢাকা পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ১৪ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি প্রণয়ন করেন।
১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট ৬ মাস ২০ দিন কারাবাসের পর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিমানে তিনি ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। লাখ লাখ জনতা প্রাণপ্রিয় নেতা সােহরাওয়ার্দীকে সংবর্ধনা জানায়।
১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্র সমাজ প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করে। ঢাকায় পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হয়।
ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট- এনডিএফ ১৯৬২
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মুক্তি লাভের পর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলােকে পুনরুজ্জীবিত না করে ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য আলােচনা করতে হবে। ১৯৬২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর লাহাের নেতাদের সাথে আলােচনা করে এনডিএফ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ১৯৬২ সালের ৪ অক্টোবর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সােহরাওয়ার্দীকে আহবায়ক করে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এডিএফ গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান এনডিএফ-এর আহবায়ক হলেন নূর আমিন। ১৯৬২ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকার পল্টন ময়দানে এনডিএফ-এর বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রায় ৫ লাখ লােকের সমাবেশ হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন নূরুল আমিন। সভায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ভাষণ দেন।
পৃষ্ঠাঃ ২০৭
পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক এনডিএফ কমিটি নিম্নলিখিত নেতাদের নিয়ে গঠিত হয়:৪
নাম দলের নাম পদবি
নূরুল আমিন মুসলিম লীগ আহবায়ক
আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগ সদস্য
আবুল মনসুর আহমেদ আওয়ামী লীগ সদস্য
শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সদস্য
আব্দুস সালাম খান আওয়ামী লীগ সদস্য
মওলানা তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগ সদস্য
খন্দকার মােশতাক আহমেদ আওয়ামী লীগ সদস্য
তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগ সদস্য
এম মনসুর আলী আওয়ামী লীগ সদস্য
এএইচএম কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগ সদস্য
আবু হােসেন সরকার কেএসপি সদস্য
হামিদুল হক চৌধুরী কেএসপি সদস্য
আবদুল লতিফ বিশ্বাস কেএসপি সদস্য
ইউসুফ আলী চৌধুরী কেএসপি সদস্য
সৈয়দ আজিজুল হক কেএসপি সদস্য
তােফাজ্জল আলী মুসলিম লীগ সদস্য
শাহ আজিজুর রহমান মুসলিম লীগ সদস্য
ফজলুর রহমান মুসলিম লীগ সদস্য
খাজা খয়ের উদ্দিন মুসলিম লীগ সদস্য
শফিকুল ইসলাম মুসলিম লীগ সদস্য
হাজী মােহাম্মদ দানেশ ন্যাপ সদস্য
মাহমুদ আলী ন্যাপ সদস্য
প্রফেসর মােজাফফর আহমেদ ন্যাপ সদস্য
মশিউর রহমান ন্যাপ সদস্য
মহিউদ্দিন আহমদ ন্যাপ সদস্য
অলি আহাদ ন্যাপ সদস্য
পীর দুদু মিয়া নেজামে ইসলাম সদস্য
মৌলভী ফরিদউদ্দিন আহমদ নেজামে ইসলাম সদস্য
পাশাপাশি জেলা, মহকুমা ও থানায় এনডিএফ কমিটি গঠন করা হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২০৮
আওয়ামী লীগে ২, মুসলিম লীগে ২, কেএসপি ২, ন্যাপ ২, নেজামে ইসলাম ১ জন সদস্য নিয়ে জেলা, মহকুমা, থানা কমিটি গঠিত হয়। সােহরাওয়ার্দী জাতীয় নেতাদের নিয়ে সারা বাংলায় জনসভা করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তার প্রত্যেকটি জনসভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কেএসপি দল পুনরুজ্জীবিত না করে এনডিএফ-এ যােগ দেয়। মুসলিম লীগের একাংশ খাজা নাজিমুদ্দিন নেতত্নে দল পুনরুজ্জীবিত করে। তবু তারা এনডিএফের সাথে কাজ করে।
তাজউদ্দীন আহমদ এনডিএফের প্রাদেশিক কমিটির প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করে যান। তিনি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র বিশ্বাস করতেন না। তিনি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যু ২৭ এপ্রিল ১৯৬২
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক মৃত্যুবরণ করেন। তাকে হাইকোর্টের মাজারে সমাহিত করা হয়। শেরে বাংলা তাজউদ্দীন আহমদের রাজনীতিক গুরু ছিলেন। মওলানা ভাসানীকে সরকার ঢাকায় অন্তরীণ রাখে। ১৯৬২ সালের ৩ নভেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দী করাচীতে হৃদরােগে আক্রান্ত হন। ১৯৬৩ সালের ১৯ মার্চ চিকিৎসার জন্য বৈরুত গমনকরেন। চিকিৎসার পর তিনি লন্ডনে পুত্রের সাথে অবস্থান করেন। তিনি দেশেআর ফিরে আসেননি।
আইয়ুব খানের রাজনৈতিক দল গঠন
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বলতেন, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল দেশেরঅধঃপতনের জন্য দায়ী। রাজনীতিকে ভর্ৎসনা করতেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করলেন। ১৯৬২ সালের ৪ ও ৫সেপ্টেম্বর করাচীতে মুসলিম লীগের কনভেনশন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানে আবুল হাশিম ও পশ্চিম পাকিস্তানে চৌধুরী খালেকুজ্জামান আইয়ুব খানের পক্ষে মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে সভাপতি করে কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। পরে আইয়ুব খান নিজে মুসলিম লীগের
পৃষ্ঠাঃ ২০৯
সভাপতি হন। ১৯৬২ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকায় মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন ডাকা হয়। খাজা নাজিমউদ্দিনকে সভাপতি করে কাউন্সিল মুসলিম লীগ গঠন করা হয়।
১৯৬৩ সালের ২৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতা মুহাম্মদ আলী ঢাকায় হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বগুড়ায় পারিবারিক গােরস্তানে কবর দেয়া হয়। ১৯০১ সালে তিনি বগুড়ায় জনগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৬ সালে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সদস্য ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু- ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩
১৯৬৪ সালের ৩ বা ৪ জানুয়ারি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানে ফিরে আসবেন। তাকে ঢাকা ও করাচীতে সংবর্ধনা প্রদানের জন্য এনডিএফ ও জনতা অপেক্ষা করছে। এমন সময় তিনি দেশবাসীকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে বৈরুতের হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সন্দেহ করা হয় যে, তাকে আইয়ুব খান হত্যা করিয়েছেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা ২ মিনিটেমৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। মৃত্যুকালে তার নিকট আত্মীয়স্বজন বা ডাক্তার কেউ ছিলেন না। উভয় অঞ্চলের জনতা তাদের প্রিয় নেতাকে হারিয়ে শােকাভিভূত হয়ে পড়ে। তার জামাতা শাহ আহম্মদ সােলায়মান, পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দী, মামাত বােন শায়েস্তা একরামুল্লাহ বৈরুত থেকে লাশ নিয়ে করাচী আসেন। করাচীরপ্যাটেল পার্কে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৬৩ সালের ৮ ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দীর লাশ নিয়ে পিআইএ বিমান ১৭টা ১৭ মিনিটে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। আকাশে বিমান দেখে লাখ লাখ মানুষ চিকার দিয়ে কেঁদে ওঠে। লাশের সঙ্গে করাচী থেকে আসেন বােন বেগম শায়েস্তা একরামুল্লাহ, কন্যা বেগম আখতার সােলায়মান, পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দী, নাতনি শাহিদা মুন্নী, তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, মাহমুদুল হক ওসমানী প্রমুখ। খােলা ট্রাকে লাশ বিমানবন্দর থেকে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে আসতে দু’ঘণ্টা সময় লাগে। লাশের ট্রাকে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, নূরুল আমিন, মওলানা তর্কবাগীশ, মহিউদ্দিন আহমদ, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ। রমনা রেসকোর্স ময়দানে বেলা ২টা ৩০ মিনিটে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ১০ লাখ লােক জানাজায় উপস্থিত ছিলেন। পীর দুদু মিয়া জানাজা পড়ান। তাকে শেরে বাংলা এ
পৃষ্ঠাঃ ২১০
কে ফজলুল হকের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুতে পাকিস্তানে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। ১৯৬৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর পল্টনে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “আমার নেতাকে হত্যা করা হয়েছেআ।” এ বক্তৃতার জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়।
হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার মেদেনিপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিচারপতি ব্যারিস্টার জাহির রহিম সোহরাওয়ার্দ, মাতার নাম খুজিস্তা আখতার বানু। সােহওয়ার্দী কলকাতা থেকে এনট্রান্, এফএ, বিএসসি ও এমএ পাস করেন। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯১১ সালে লন্ডন গমন করেন। তিনি অক্সফোর্ড থেকে বিসিএস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও ইংরেজীতে এমএ ও ব্যারিস্টারী পাস করে ১৯২০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি প্রথম কংগ্রেস ও পরে মসলিম লীগে যােগ দেন। তিনি ১৯২১ সাল হতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতা থেকে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও১৯৫৬-৫৭ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি এক কন্যা ও এক পুত্র রেখে যান।
শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর এনডিএফ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়।
১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে আওয়ামী লীগের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় মওলানা তর্কবাগীশকে সভাপতি ও শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্পাদক করে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করা হয়। আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, খন্দকারমােশতাক আহমদ প্রমুখ নেতারা আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের বিরােধী ছিলেন। তারা এনডিএফে থেকে যান।
আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি ১৯৬৪
১৯৬৪ সালের ৬ ও ৭ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।সভায় নিম্নলিখিত নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। সভাপতি- মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, সাধারণ সম্পাদক- শেখ মুজিবুর রহমান। কমিটির সহ-সভাপতি ও বিভাগীয় সম্পাদক ও সদস্য ছিলেন :
পৃষ্ঠাঃ ২১১
এডভােকেট আবদুস সালাম খান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শাহ আজিজুর রহমা, আবদুল মালেক উকিল, মােল্লা জালাল উদ্দিন, শেখ আবদুল আজি, এএইচএম কামারুজ্জামান, রফিক উদ্দিন ভূইয়া, ময়েজ উদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মমিন তালুকদার, আবদুল মান্নান, রওশন আলী, সোহরাব হোসেন, মাহমুদুল্লাহ, এবিএম নূরুল ইসলাম, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন আহমদ, আবদুর রহমান খান, আজিজুর রহমান, টি হােসেন, গাজী গোলাম মোস্তফা, সাদ আহমদ, এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ, নূরুল হক, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আমজাদ হােসেন, এমএ আজিজ, আমিনুল হক চৌধুরী, এ কে মুজিবুর রহমান।
আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করার পর নেতাকর্মীদের ওপর আইয়ুব খান ও মােনায়েম খানের নির্যাতন নেমে আসে। ১৯৬৪ সালের ১৫ মার্চ ১৯ মার্চ পর্যন্ত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়।
১৯৬৪ সালের ১১ মার্চ সকল রাজনৈতিক দল সমন্বয়ে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৬৪ সালের ১৮ ও ১৯ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় প্রাপ্ত বয়স্ক ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন দিবস পালন করা হয়। ১৯৬৪ সালের ১৮ মার্চ ভােটাধিকার দাবি দিবসের প্রথম দিনেই আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীন আহমদ ও কোরবান আলীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ন্যাপের অলি আহাদ ও আর আবদুস সামাদকে পুলিশ গ্রেফতার করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভােকেশন ১৯৬৪
মােনায়েম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হয়ে বাঙালীদের ওপর নির্যাতনশুরু করে। বিশেষ করে ছাত্র সমাজ তার সময় নিষ্ঠুরতার শিকার হয়। তিনি ছাত্ৰনীতি প্রতিহত করার জন্য সন্ত্রাসী ছাত্রদের নিয়ে এনএসএফ গঠন করান। এনএসএফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ কলুষিত করে। ১৯৬৪ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভােকেশন অনুষ্ঠিত হবে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন অঙ্গীকার করেছে ছাত্ররা স্বৈরাচারী গভর্নর মােনায়েম খানের নিকট হতে সনদ গ্রহণ করবে না। তারা কনভােকেশন ভণ্ডুল করবে। ছাত্রদের প্রতিবাদের মুখে গভর্নর মােনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে সনদ বিতরণে ব্যর্থ হন। তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে নিম্নোক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন।
ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণি ও আসমত আলী সিকদারের এমএ ডিগ্ৰী বাতিল করা হয় ।
পৃষ্ঠাঃ ২১২
কে এম ওবায়দুর রহমান, এ কে বদরুল হক, রাশেদ খান মেনন ও সওগাতুল আলম সগীরকে ৫ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কার করা হয়। হায়ান হোসেন, আনােয়ারুল হক চৌধুরী, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, আনােয়ার আলী, আলী হায়দার খান, শহীদুল হককে ৩ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
গিয়াস উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মনসুর উদ্দিন আহমদ, জাকি আহমদ, আবদুল করিম, সৈয়দ মতিউর রহমান, আবদুর রাজ্জাক মিয়া, সিরাজুল আলম খান, কাজী মোজাম্মেল ইসলাম, আতিকুর রহমান, হুমায়ুন কবীর, কামাল উদ্দিন সিকদার, ফেরদৌস আহমদ কোরেশীকে ২ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কার করা হয়।
ঢাকা হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে কোর্ট ছাত্রদের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বাতিল ঘােষণা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. হাইকোর্টে কোর্ট অবমাননা মামলায় জয়লাভ করে। ১৯৬৬ সালের ১৫ ফেরুয়ারি তার পক্ষে সাহসী বিচারপতি মাহবুব মাের্শেদ রায় প্রধান করেন। ঐদিন এনএসএফ ছাত্র গুণ্ডারা ড. মাহমুদ বেদম প্রহার করে। এ ঘটনায় বাঙালী সমাজ বিক্ষুব্ধ হয় এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও গভর্নর মােনায়েম খানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। এ সকল বর্বর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তাজউদ্দীন আহমদ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংকটকালে বিচারপতি মাহবুব মাের্শেদ দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে ন্যায়বিচারের ভিত্তি সুদৃঢ় করেন। বিচারপতি মাের্শেদ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ভাগিনা।৫
দাঙ্গা প্রতিরােধ ১৯৬৪
১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের মসজিদ থেকে হযরত বাল চুরি হওয়ায় ভারতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান এ সবুর ও গভর্নর মােনায়েম খানের ইঙ্গিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ, হত্যা, লুট শুরু হয়। ঢাকায় শতাধিক হিন্দু নিহত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করা হয়। বিরােধী দল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামে প্রচারপত্র বিলি করে। সরকার ১৯৬৪ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকা সদর দক্ষিণ মহকুমা হাকিমের কোর্টে হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া, জহুর হােসেন চৌধুরী, মাহমুদ আলী, মাহবুবুল হক, অলি আহাদ, কে এম ওবায়দুর রহমান, মাহবুবুল হক, ডা. আলীম আল রাজী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখের বিরুদ্ধে প্রেস আইনে গভর্নর মােনায়েম খানের নির্দেশে মামলা দায়ের
পৃষ্ঠাঃ ২১৩
করে। এ মামলা অনেকদিন চলে। ১৯৬৯ সালের ৫ এপ্রিল সরকার মামলা প্রত্যাহার করে।
১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠি হয়। পদাধিকারবলে মােনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। ছাত্ররা স্বৈরাচারী গভর্নরের নিকট থেকে সনদ গ্রহণ করবে না। সমাবর্তনের স্থান কার্জন হলে পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ৩১৩ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। গভর্নর মােনায়েম খান শেখ ফজলুল হক খান ও আসমত আলী সিকদারের এমএ ডিগ্ৰী বাতিল করে।
১৯৬৪ সালের ১ মে বিকেলে ধানমণ্ডির বাসভবন থেকে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে জননিরাপত্তা আইন ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪এ ধারায় গ্রেফতার করে। পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
১৯৬৪ সালের জুন মাসে সরকার ঘােষণা করে যে, ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কনভেনশন মুসলিম লীগ আইয়ুব খানকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী ঘােষণা করে।
১৯৬৪ সালের ৫ জুন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ১১ দফা গৃহীত হয়। ১১ দফা ছিল ৬ দফার ভিত্তিমূল।
১৯৬৪ সালের ২৬ জুলাই আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ সর্বদলীয় মাের্চা- কৰ্প (Combined Opposition Parties) গঠন করে এবং ৯ দফা কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়।৬
১৯৬৫ সালের নির্বাচন
১৯৬৪ সালের ২১ জুলাই খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসভবনে ৪টি দল নিয়ে কপ গঠন করা হয়। সভায় কপ-এর পক্ষে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ঘােষণা করা হয়। ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে উভয় পাকিস্তানের ৪০ হাজার করে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য নির্বাচিত হয়।
১৯৬৪ সালের ১৫ অক্টোবর মিস ফাতেমা জিন্নাহ ও পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আজম খান ঢাকায় আগমন করেন। শেখ মুজিব তাদের নিয়ে সকল জেলায় জনসভা করেন। ১৯৬৪ সালের ২৮ অক্টোবর নির্বাচনী সভায় আইয়ুব খান ঢাকা সফরে আসেন। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার ভােটের মধ্যে আইয়ুব খানের পক্ষে ২১ হাজার ১৩ ভােট ও ফাতেমা জিন্নার পক্ষে ১৮ হাজার ৪৩৪ ভােট পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব খান পেলেন ২৮ হাজার ৯৩৯ ভােট এবং
পৃষ্ঠাঃ ২১৪
এবং ফাতেমা জিন্নাহ পেলেন ১০ হাজার ২৫৭ ভােট। সরকার বিপুল অর্থ ব্যয় করে এবং প্রভাব খাটিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রভাবিত করে। আইয়ুব খানকে নির্বাচন কমিশনার জি মঈনুদ্দিন ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেন।
১৯৬৫ সালের ২১ মার্চ জাতীয় পরিষদ এবং ৫ মে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরােধী দল আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়।
পাক-ভারত যুদ্ধ- ১৯৬৫
পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করলে ভারত ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান আক্রমণ করে। ১৭ দিনের যুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান পর্যদস্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। ১৯৬৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর উভয় দেশ যুদ্ধ বিরতি মেনে নেয়। ১৯৬৬ সালের ১০ জুন রাশিয়ার তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাসখন্দ চুক্তির পরের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ২১৫
৭
৬ দফা আন্দোলন-১৯৬৬
তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেপ্তার
আওয়ামী লীগ বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৪৯ সালে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আওয়ামী লীগ সৃষ্টি। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬২ সালে গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলন, শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিল, ১৯৬৪ সালের আন্দোলন পেরিয়ে আওয়ামী লীগ ৬ দফার মাধ্যমে বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে। ৬ দফা প্রণয়নে তাজউদ্দীন আহমদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
বাঙালী জাতির মুক্তি সনদ ৬ দফা
পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, চিন্তা- চেতনার ভিত্তিতে ৬ দফা প্রণীত হয়েছিল। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে ৬ দফা রচিত হয়। ৬ দফা প্রণয়নে যারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন তারা হলেন :১
তাজউদ্দীন আহমদ সম্পাদক – আওয়ামী লীগ
ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরী – অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. নূরুল ইসলাম – অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. রেহমান সােবহান। – অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. খান সরওয়ার মাের্শেদ – অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬৬ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে। তারা দেখেছেন যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় ছিল। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। সুতরাং পাকিস্তানের সাথে একত্রে থাকা ভৌগােলিক ও রাজনৈতিকভাবে অসঙ্গত। ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে রক্ষা করতে পারে না। তাই আওয়ামী লীগ ৬ দফা প্রণয়ন করে বাঙালী জাতির মুক্তির জন্য।
পৃষ্ঠাঃ ২১৬
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহাের বিরােধী দলের জাতীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে। শেখ মজিবুর রহমান সম্মেলনে বাঙালীদের মুক্তির দাবি ৬ দফা পেশ করবেন। ১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, নুরুল ইসলাম চৌধুরীসহ লাহােরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর বাসভবনে ৫ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলা থেকে ২১ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬০০ জন সম্মেলনে যােগ দেন। কাউন্সিল মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজালের সভাপতিত্বে সম্মেলন শুরু হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি সাবজেক্ট কমিটি সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পেশ করেন।২
প্রস্তাব-১ শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে ও রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি :
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে এমন হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহাের প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির। সর্বজনীন ভােটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট হবে সার্বভৌম।
প্রস্তাব-২ শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে ও রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি :
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র দুটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে, যথা দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে রাষ্ট্রগুলাের ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
প্রস্তাব-৩ মুদ্রা ও অর্থ সম্পৰ্কীয় ক্ষমতা :
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দুটির যে কোনাে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে-
(ক) সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধ বিনিময়যােগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
(খ) সমগ্র দেশের জন্য কেবল একটি মুদ্রা চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্র ব্যবস্থা থাকতে হবে যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভের ব্যবস্থা করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আর্থিক বা অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
প্রস্তাব-৪ রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা :
ফেডারেশনের অঙ্গ রাষ্ট্রগুলাের কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তার প্রয়ােজনীয় ব্যয়
পৃষ্ঠাঃ ২১৭
নির্বাহের জন্য অঙ্গ রাষ্ট্রের রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গ রাষ্ট্রগুলাের সকল করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
প্রস্তাব-৫ বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বহিঃবাণিজ্যকে পৃথক হিসাব করতে হবে।
(খ) বহিঃবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গ রাষ্ট্রগুলোর এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোনাে হারে অঙ্গরাষ্ট্র মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গরাষ্ট্রগুলাের মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদির চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনাে বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলােকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যকে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রস্তাব-৬ আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা :
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলােকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
লাহাের, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬
শেখ মুজিবুর রহমান
সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
চৌধুরী মােহাম্মদ আলী তাৎক্ষণিকভাবে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন উত্থাপন করা হবে না। বৈঠকের আলােচ্য বিষয়- গণতন্ত্র উদ্ধার ও তাসখন্দ শান্তিচুক্তি। ১৯৬৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সংবাদপত্রে ৬ দফার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ছাপা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে ৬ দফা প্রকাশিত হয়। আওয়ামী লীগের আগামী কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় অনুমােদনের জন্য ৬ দফা পেশ করা হবে। ৬ দফা পুস্তিকাটি আওয়ামী লীগ কার্যালয় ৫১ পুরানা পল্টন থেকে প্রকাশিত ও প্রচার সম্পাদক আব্দুল মােমিন কর্তৃক প্রচারিত এবং গ্রোব প্রিন্টার্স থেকে মুদ্রিত। ৬ দফা পুস্তিকাটি ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম
পৃষ্ঠাঃ ২১৮
বিলি করা হয়। বেশির ভাগ প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ৬ দফার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। ৬ দফা জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি সাব কমিয়ির সভায় ৬ দফা নিয়ে রাজশাহীর মুজিবুর রহমান বিতর্ক সৃষ্টি করেন। আশঙ্কা করা হয় আওয়ামী লীগ আবার দ্বিধাবিভক্ত হবে।
১৯৬৬ সালের ১২ মার্চ রমনা গ্রীনে অনুগত মৌলিক গণতন্ত্রীদের সম্মেলনে আইয়ুব খান ৬ দফা প্রণয়নকারীদের পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মােনায়েম খান হুমকি দিলেন যে, ৬ দফার আন্দোলনকারীদের কঠোরহস্তে দমন করা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ মুজিবুর রহমান
সম্পাদক পদে তাজউদ্দীন আহমদ
১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৬ দফা অনুমােদিত হয়। তবে সিদ্ধান্ত হয় ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে অনুমােদন নিতে হবে। মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ৬ দফা প্রশ্নে দ্বিমত পােষণ করেন এবং কাউন্সিল অধিবেশন ত্যাগ হন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভার কাজ চালিয়ে যান। এডভােকেট আব্দুস সালাম ৬ দফার বিরােধী ছিলেন; কিন্তু তিনি ভাবলেন তাকে সভাপতি করা হবে- এ বিশ্বাসে তিনি ৬ দফার পক্ষে কথা বলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে মতিঝিল ইডেন হােটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। সেদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, কামরুজ্জামান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মিসেস আমেনা বেগম, আমজাদ হােসেন, শাহ আজিজুর রহমান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, আব্দুল মালেক উকিল, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, সাদ আহমেদ, আব্দুস সালাম খান, মতিউর রহমান। দ্বিমত সত্ত্বেও কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা দাবি অনুমােদিত হয়। সভায় পশ্চিম পাকিস্তানী আওয়ামী লীগ নেতা মিয়া মঞ্জুরুল হকসহ সকলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানান। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।৩
শেখ মুজিবুর রহমান – সভাপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – সহ-সভাপতি
আবদুস সালাম খান – সহ-সভাপতি
খন্দকার মােশতাক আহমদ – সহ-সভাপতি
পৃষ্ঠাঃ ২১৯
এম মনসুর আলী – সহ-সভাপতি
মজিবুর রহমান – সহ-সভাপতি
শাহ আজিজুর রহমান – সহ-সভাপতি
তাজউদ্দীন আহমদ – সাধারণ সম্পাদক
মিজানুর রহমান চৌধুরী – সাংগঠনিক সম্পাদক
জহুর আহমদ চৌধুরী – শ্রম সম্পাদক
ওবায়দুর রহমান – সমাজসেবা সম্পাদক
আবদুল মমিন – প্রচার সম্পাদক
আমেনা বেগম – মহিলা সম্পাদিকা
মাহমুদুল্লাহ – দপ্তর সম্পাদক
হাফেজ মুসা – কোষাধ্যক্ষ
এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ – সদস্য
এবিএম নূরুল ইসলাম চৌধুরী – সদস্য
আবদুর রহমান খান – সদস্য
এম এ রশিদ – সদস্য
রওশন আলী – সদস্য
মমিন উদ্দিন আহমদ – সদস্য
রহিম উদ্দিন আহমদ – সদস্য
সাদ আহমেদ – সদস্য
জালালউদ্দিন আহমদ – সদস্য
আমজাদ হােসেন – সদস্য
সােহরাব হােসেন – সদস্য
হােসেন মনসুর – সদস্য
অধ্যাপক ইউসুফ – সদস্য
আবদুল মালেক উকিল – সদস্য
নূরুল হক – সদস্য
বাহাউদ্দিন চৌধুরী – সদস্য
শামসুল হক – সদস্য
শেখ আবদুল আজিজ – সদস্য
আফজাল হােসেন – সদস্য
জাকিরুল হক – সদস্য
আবদুস সামাদ – সদস্য
পৃষ্ঠাঃ ২২০
আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ – সদস্য
মােল্লা জালাল উদ্দিন – সদস্য
১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ আমাদের বাচার দাবি- ৬ দফা গৃহীত হবার পর ঐদিন বিকেলে আওয়ামী লীগের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৬ দফা গৃহীত হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, বিভিন্ন জেলায় জনসভা করে ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। এদিকে মােনায়েম খান শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দিয়ে হয়রানি ও গ্রেফতার করতে থাকে।
শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ গ্রেফতার
১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের সর্ববৃহৎ জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ নেতৃবৃন্দ সভায় ভাষণ দেন। সভা রাত ৮টা পর্যন্ত চলে। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকায় পৌঁছেন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে গভীর রাতে পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যায়। ৮ মে রাতেই পুলিশ তাজউদ্দীন আহমদ, চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, পাবনার মনসুর আলী, ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভূইয়া, রাজশাহীর মজিবর রহমান প্রমুখ গ্রেফতার হন। ৯ মে দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ শিরােনাম ছিল- ‘আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী, মজিবর রহমান ও এমএ আজিজ কারা প্রাচীরের অন্তরালে’। নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা চলতে থাকে। তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া ও দৈনিক ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের ৬ দফা সমর্থনে এগিয়ে আসে। ১০ মে মানিক মিয়া দৈনিক ইত্তেফাকে মােসাফির নামে রাজনৈতিক মঞ্চ কলামে ৬ দফার সমর্থনে ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কলাম লিখেন।
তাজউদ্দীন আহমদের গ্রেফতার সম্পর্কে তার কন্যা সিমিন হােসেন রিমি লিখেছেন : “জুন মাস ১৯৬৬ সালের এক গভীর রাতে আম্মা অথবা আপার ডাকে ঘুম থেকে উঠি। তাকিয়ে দেখি ঘরে বাতি জ্বলছে। আব্রু বাইরে যাবার জন্য কাপড় পরে তৈরি। সবার চেহারা থমথমে। ঘুম ঘুম চোখে আব্বকে বিদায় জানাতে সবার সাথে বাইরে বের হয়ে দেখি রাইফেল হাতে পুলিশ সমস্ত বাড়ি ঘিরে রেখেছে। আব্দুকে একটা জীপে তুলে নিয়ে পুলিশের দল চলে গেল। আব্বু
পৃষ্ঠাঃ ২২১
মানুষের দুঃখ কষ্ট দূর করতে চান, সবাইকে ভালাে থাকতে দিতে চান, এই কারণে যেন কাজ না করতে পারেন তাই তাকে আটক রাখতে ওরা ধরে নিয়ে গেছে, আমি এটুকু খুব বুঝলাম।” লেখিকা তাজউদ্দীনের গ্ৰেযফতারের তারিখ জুন মাস বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি ৮ মে গ্রেফতার হয়েছিলেন৷ ঢাকা জেলে কিছুদিন রাখার পর তাজউদ্দীন আহমদকে ময়মনসিংহ কারাগারে প্রেরণ করা হয়।
৭ জুন পালন
৬ দফার সমর্থনে ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ হরতাল পালন করে। নারায়ণগঞ্জ ও তেজগাঁয়ে আন্দোলন জঙ্গিরূপ ধারণ করে। তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বেঙ্গল বেভারেজে চাকরিরত সিলেটের অধিবাসী মনু মিয়া পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন। তেজগাঁয়ের আজাদ এনামেল এ্যান্ড এ্যালুমিনিয়াম কারখানার নোয়াখালীর শ্রমিক আবুল হােসেনকে ইপিআর বুকে গুলি করে হত্যা করে। নারায়ণগঞ্জ রেল স্টেশনে ৬ জন শ্রমিক পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। হরতালে সরকারী হিসেবে ১১ জনের মৃত্যু হয়। সরকার সন্ধ্যায় কর্ফু জারি করে। ৭ জুনের হরতালে ব্যাপক গণসমর্থন দেখে সরকার আওয়ামী লীগের ওপর কঠোর নির্যাতন শুরু করে। নেতাকর্মীদের গ্রেফতার চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের মুখপত্র দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর গভর্নর মােনায়েম খান ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন পত্রিকার নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করে এবং সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করে। ২২ জুন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এমএনএ মিজানুর রহমান চৌধুরীকে তার চাঁদপুরের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। আওয়ামী লীগের সংগ্রামী প্রায় সকল নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়েছেন।
১৯৬৬ সালের ১৮ জুন আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভা থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টো পদত্যাগ করে পৃথক দল গঠন করেন।
পিডিএম ১৯৬৭
৬ দফাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ভাঙ্গনের সম্মুখীন হয়। দলের একটি অংশ এনডিএফ-এর সাথে যুক্ত ছিলেন। নূরুল আমিনের নেতৃত্বে এনডিএফ পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্টে- পিডিএম-এ যােগ দেয়। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল আতাউর রহমান খানের বাসভবনে কয়েকটি দলকে নিয়ে পিডিএম গঠিত হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২২২
পিডিএম-এর নেতৃবৃন্দ
নূরুল আমিন – জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ
হামিদুল হক চৌধুরী – জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ
আতাউর রহমান খান – জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ
মমতাজদৌলাতানা – পাকিস্তান মুসলিম লীগ
তােফাজ্জল আলী – পাকিস্তান মুসলিম লীগ
সৈয়দ খাজা খয়ের উদ্দিন – পাকিস্তান মুসলিম লীগ
মওলানা তােফায়েল মােহাম্মদ – জামায়াতে ইসলাম
মওলানা আবদুর রহিম – জামায়াতে ইসলাম
অধ্যাপক গােলাম আযম – জামায়াতে ইসলাম
নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান – পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
আবদুস সালাম খান – পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
গােলাম মােহাম্মদ খান – পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
চৌধুরী মােহাম্মদ আলী – পাকিস্তান নেজামে ইসলাম
মৌলানা ফরিদ আহম্মদ – পাকিস্তান নেজামে ইসলাম
এম আর খান – পাকিস্তান নেজামে ইসলাম
পিডিএম গঠন প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৬৬ সাল হতে কারাগারে বন্দী। তাদের অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আমেনা বেগম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও রাজশাহীর মজিবর রহমান দল ত্যাগ করে পৃথক আওয়ামী লীগ গঠন করেন। ১৯৬৭ সালের ২৩ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এডহক কমিটি গঠন করে। কমিটির নেতৃবৃন্দ ছিলেন :৫
মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ – পাবনা, সভাপতি
মশিউর রহমান – যশাের, সহসভাপতি
মুজিবুর রহমান মিয়া – রাজশাহী, সাধারণ সম্পাদক
নূরুল ইসলাম চৌধুরী – ঢাকা, কোষাধ্যক্ষ
আবদুস সালাম খান – ফরিদপুর, সদস্য
মিয়া আবদুর রশীদ – যশাের, সদস্য
আতাউর রহমান খান – কুমিল্লা, সদস্য
মতিউর রহমান – রংপুর, সদস্য
পৃষ্ঠাঃ ২২৩
রওশন আলী – যশাের, সদস্য
রহিমউদ্দিন আহমদ – দিনাজপুর, সদস্য
সা’দ আহমদ – কুমিল্লা, সদস্য
আবদুর রউফ – কুষ্টিয়া, সদস্য
এসডব্লিউ লকিতুল্লাহ – বরিশাল, সদস্য।
মমিন উদ্দিন চৌধুরী – খুলনা, সদস্য
আবদুল হাই – সিলেট, সদস্য
জালালউদ্দিন আহমদ – সিলেট, সদস্য
নূরুল হক – রংপুর, সদস্য
আহমদ আলী – কুমিল্লা, সদস্য
ডা. সুলতান আহমদ – কুমিল্লা, সদস্য
আবদুর রহমান চৌধুরী – দিনাজপুর, সদস্য
এম মনসুর আলী – পাবনা, সদস্য
বিএম ইলিয়াস – বগুড়া, সদস্য
জুলমত আলী – ময়মনসিংহ, সদস্য
উপরােক্ত কমিটির জবাবে ১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট নিম্নের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কমিটি (৬ দফা) গঠন করা হয় :
শেখ মজিবুর রহমান – সভাপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – সহসভাপতি
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী – সহসভাপতি
খন্দকার মােশতাক আহমদ – সহসভাপতি
তাজউদ্দীন আহমদ – সাধারণ সম্পাদক
মিজানুর রহমান চৌধুরী – সাংগঠনিক সম্পাদক
মিসেস আমেনা বেগম – সাংগঠনিক সম্পাদক
আমজাদ হােসেন – পাবনা, সদস্য
সােহরাব হােসেন – যশাের, সদস্য
হােসেন মনসুর – পাবনা, সদস্য
এবিএম নূরুল ইসলাম – ফরিদপুর, সদস্য
অধ্যাপক ইউসুফ আলী – দিনাজপুর, সদস্য
আবদুল মালেক উকিল – নােয়াখালী, সদস্য
নূরুল হক – নােয়াখালী, সদস্য
বাহাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী – বরিশাল, সদস্য
পৃষ্ঠাঃ ২২৪
শামসুল হক – ঢাকা, সদস্য
হাফেজ মুসা – ঢাকা, সদস্য
শেখ আবদুল আজিজ – খুলনা, সদস্য
জাকিরুল হক – চট্টগ্রাম, সদস্য
মহম্মদ উল্লাহ – নােয়াখালী, সদস্য
পিডিএম গঠন- ১৯৬৬
এনডিএফ দুর্বল হয়ে পড়ায় নেতারা পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট- পিডিএম গঠন করে। ৬ দফা বিরােধী আওয়ামী লীগ ও এনডিএফ ১৯৬৬ সালের ৩০ এপ্রিল আতাউর রহমান খানের বাসভবনে পিডিএম গঠন করে। পিডিএম-এর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হলেন নূরুল আমিন ও মাহমুদ আলী।
৬ দফা পন্থী আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির ২৩ জন সদস্যের মধ্যে ১৮ জন জেলে। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা আমেনা বেগম আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৬৬ সালের ১৯ আগস্ট পুরানা পল্টন অফিসে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পিডিএমপন্থী ১৪ জনকে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৪ জন হলেন : মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, আবদুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, মজিবর রহমান, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মতিউর রহমান, আবদুর রহমান, এম এ রশীদ, রওশন আলী, মােমিন উদ্দিন আহমদ, এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ, রহিমুদ্দিন আহমদ, সাদ আহমদ, জালাল উদ্দিন আহমদ। ১৯৬৭ সালের ২৩ আগস্ট পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি ও রাজশাহীর মজিবর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়।
আইয়ুব-মােনায়েম খান ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৩০০ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। জেলে শেখ মুজিবকে তিলে তিলে হত্যার জন্য তাকে একটি সেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখে।
১৯৬৭ সালের ২৪ জুন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঘােষণা করেন। পাকিস্তানের সংস্কৃতিক মূল্যবােধবিরােধী রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার করা যাবে না। গভর্নর মােনায়েম খান রবীন্দ্রসঙ্গীত রচনার নির্দেশ দেয়। ১৯৬৭ সালের ২৫ জুন ১৮ জন বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্পর্কে সরকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। বিবৃতিদাতাগণ ছিলেন ড. কুদরত-ই খােদা, ড. কাজী মােতাহার হােসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, শিল্পী জয়নুল আবেদীন, এস এ বারী, অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. খান সরওয়ার মাের্শেদ, সিকান্দার আবু জাফর,
পৃষ্ঠাঃ ২২৫
মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, কবি শামসুর রহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, ড. আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এ বিবৃতির বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ ১৯৬৭ সালের ২৯ জুন একদল ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীর দ্বারা এক বিবৃতি দেয়া হয়।
১৯৬৭ সালের ২ আগস্ট ছাত্র সমাজ রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে বন্দি মুক্তি দিবস পালন করে। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা মামলায় গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আটক রাখা হয়।
ময়মনসিংহ জেলে তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদকে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে থেকে সরকার দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ স্বৈরাচারী সরকার তাজউদ্দীন আহমদকে ভয় পেত। তাজউদ্দীন তার প্রখর বুদ্ধি, কৌশল প্রয়ােগ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকারবিরােধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করবে। তাই তাকে ঢাকা জেল থেকে ময়মনসিংহ জেলে স্থানান্তর করা হলাে।
তাজউদ্দীন আহমদের গ্রেফতারের পর তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি জীবন-মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসেন। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদের মেয়েরা খুবই ছােট। তার বােনের মেয়ে আনার বাসায় থাকে। জোহরা তাজউদ্দীনের অবর্তমানে আনার সংসারের দায়িত্ব পালন করে। ময়মনসিংহ কারাগারে তাজউদ্দীনকে দেখতে মাসে দু’বার তার স্ত্রী ও শিশু কন্যারা আসত। রিমি শিশুকালে ময়মনসিংহে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন :
“আব্বুকে ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সত্যিকার অর্থে আব্বুর সাথে আমার পরিচয় এই কারাগারে। সেই ভাের অন্ধকার থাকতে আমাদের ছুটতে হতাে তখনকার সেই ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনের দিকে। মাসে দু’বার আব্বুর সাথে ময়মনসিংহ কারাগারে গিয়ে দেখা করার সুযােগ ছিল।…।
আব্বু কারাগার থেকে মাসে একবার হলেও চিঠি লিখতেন। রিপি সব সময় উত্তর দিত। আমি তখনও ভালাে করে লিখতে জানি না। তাই বানান করে পড়েই আনন্দ পেতাম।…
আমরা কারাগারে আব্বুর সাথে দেখা করতে গেলে ময়মনসিংহে আব্বুর এক বন্ধুর বাড়িতে উঠতাম। দোতলা বাড়ির সামনে বড় রাস্তার ওপারে দেখা যেত ব্রহ্মপুত্র নদী।… আব্বুর সাথে দেখা করার নির্ধারিত সময় থাকত বিকেলের দিকটাতেই। তাই অনেক সময় সন্ধ্যায় ঢাকায় ফেরার ট্রেন ধরা যেত না। রাতে
পৃষ্ঠাঃ ২২৬
আমরা এখানে থেকে যেতাম।
ময়মনসিংহ কারাগারে একবার অবাক করা এক মজার ঘটনা হলাে। আব্বুর সাথে দেখা করতে গেছি। প্রতিবারের মতাে জেলার সাহেব রিপি আর আমাকে ডেকে কথা বলেন। তারপর আব্বু ভেতর থেকে এলে আব্বুর অনুমতি নিয়ে আমাদের দুই বােনকে নিয়ে দুজন সেপাইসহ ভিতরের দিকে রওনা হলেন। কারাগারের ভেতর ঢােকার মূল ফটকের তালা খুলে দেয়া হলাে । অজানা বিস্ময় নিয়ে আমরা দুই বােন ভেতরে ঢুকলাম। ঝকঝকে তকতকে সাজানাে চারদিক। বড় বড় গাছ। কিন্তু মাটিতে একটা পাতাও নেই। বাইরে থেকে দেখা উঁচু প্রাচীরের ভেতরের দিকটা একেবারেই অন্যরকম। অনেকটা পথ হেঁটে আমরা এসে দাঁড়ালাম একটা বড় লম্বা টিনের চালের ঘরের সামনে। ঘরের ভেতরে হাসপাতালের ওয়ার্ডের মতাে দুই দিকে অনেকগুলাে লােহার খাট পেতে রাখা। লোহার গরাদের দরজার বা পাশের প্রথম খাটটি আব্বুর। ঘরের মাঝখানে ধবধবে সাদা লাল ঝুটির একটি কাকাতুয়া পাখি বসে চ্যা চ্যা করছে। আমাদের দু’জনের সমস্ত নজর পাখিটার দিকে। কেউ একজন বললেন পাখিটা সম্ভবত কারাগারের ভেতরে পাওয়া গেছে। … আমাদের দু’জনকে দেখতে চারদিকে লােক জমে গেছে। এর কাছ থেকে ওর কাছে, সেখান থেকে আর একজনের কোলে । এইভাবে ফুলে ফুলে ভরা এক বাগানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। জানলাম আব্বুর নিজ হাতে তৈরি এ বাগান।
১৯ আগস্ট আমার জন্মদিনের তারিখ । ১৯৬৮ সালের এই দিনের তিনদিন পর আমরা আব্বুর সাথে দেখা করতে গেছি। ওয়েটিং রুমের মােটা লােহার গরাদ ধরে রিপি আর আমি দাঁড়িয়ে আছি। দেখি আব্বু আমাদের হাতে টিনের কোটায় ছােট একটি গাছ। ওয়েটিং রুমে ঢুকে আমার সামনে গাছটি দিয়ে বললেন, ‘আমার রিমির জন্মদিনের জন্য এটা আব্বুর দেয়া উপহার।’ এটি একটি ডালিম গাছ। আমি কত যত্ন করে সাবধানে গাছটি ঢাকায় নিয়ে এলাম।…
‘৬৯ সালের শেষ দিকে সরকারী আদেশে আব্বুকে ময়মনসিংহ কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত করা হলাে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাথে এই আমার প্রথম পরিচয়।
…এই বছরেরই অক্টোবর মাসে আমার নানির শরীরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। আম্মা নানিকে মগবাজার থেকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলেন। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আম্মার আবেদনের জবাবে জানানাে হলাে আব্বু নানিকে দেখতে প্যারােলে মুক্ত হয়ে এক ঘণ্টার জন্য বাসায় আসতে পারবেন। বিকেল থেকেই বাসায় লােক আসতে শুরু করল। ঢাকায় উপস্থিত আওয়ামী লীগের
পৃষ্ঠাঃ ২২৭
নেতৃস্থানীয় কয়েকজন এসে অপেক্ষা করতে থাকলেন। আব্বু আসার আগে পুরো বাড়িটা পুলিশ ঘিরে ফেলল। নানিকে দেখার পাশাপাশি আব্বু দলীয় লােকজনদের সাথে কথা বলে নিলেন। তারপর ফিরে গেলেন। নানীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানাে হলাে। নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ দুপুরে নানি মারা গেলেন।
….১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে আব্বু কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বাসায় ফিরলেন। আব্বুর মুক্তি পাওয়াটা এতটাই আকস্মিক ছিল যে, আগে থেকে জানানাে হয়নি।” সাড়ে তিন বছর পর তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তি পেলেন ।৬
পৃষ্ঠাঃ ২২৮
৮
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা
আগরতলা মামলার ফলে বাঙালী জাতির জাগরণ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তা শীর্ষে পৌছে। ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনীর একদল বাঙালী কর্মকর্তা বাংলাদেশকে সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি-বিএলএ নামে গােপন সংগঠন গড়ে তােলেন। তাদের নেতা ছিলেন লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন। বিএলএ’র কার্যক্রম চলতে থাকে। বাঙালী সেনাবাহিনীর গােপন তথ্য সরকার জানতে পেরে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর থেকে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার শুরু করে। তাদের বিরুদ্ধে। অভিযােগ ছিল যে, তারা ভারতের আগরতলায় ভারতের প্রতিনিধিদের সাথে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে একটি প্রেসনােট আকারে প্রকাশিত হয়। ২ জন সিএসপি কর্মকর্তাসহ ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আর একটি প্রেসনােট প্রকাশ করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামী করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচিছন্ন করার অভিযােগ আনা হয়। পূর্বে এক নম্বর আসামী ছিলেন লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামী করা হয়।
আগরতলা মামলার আসামীগণ :
১. শেখ মুজিবুর রহমান, পিতা শেখ লুৎফর রহমান টুঙ্গিপাড়া, গােপালগঞ্জ, ফরিদপুর। ৬৬৭ নম্বর ধানমণ্ডি, রােড ৩২, ঢাকা।
২. লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন, পিতা মৌলভী মােফাজ্জল আলী, ডুমুরতলা, পিরােজপুর, বরিশাল।
৩. স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ঘটমাঝি, মাদারীপুর, ফরিদপুর।
৪. এল এস সুলতান উদ্দিন আহমদ, উত্তর খামার, কাপাসিয়া, ঢাকা।
পৃষ্ঠাঃ ২২৯
৫. এলএসসিডি নূর মােহাম্মদ, কুমার বার্ড, লৌহজং, ঢাকা।
৬ আহম্মদ ফজলুর রহমান সিএসপি, কচিসার, দেবীদ্বার, কুমিল্লা।
৭. এফ সার্জেন্ট মাহফুজুল্লাহ, মুরাদপুর, বেগমগঞ্জ, নােয়াখালী।
৮. কর্পোরাল আবুল বাশার মােহাম্মদ আব্দুস সামাদ, মিঠাখালী, মঠবাড়িয়া, বরিশাল।
৯. হাবিলদার দলিল উদ্দিন, গ্রাম, শ্যামপুর, থানা, বাকেরগঞ্জ , বরিশাল।
১০. রুহুল কুদুস সিএসপি, গ্রাম-পচারাসি, থানা-সাতক্ষীরা,খুলনা৷
১১. ফ্লাইট সার্জেন্ট মােহাম্মদ ফজলুল হক, গ্রাম-শায়েস্তাবাদ, কোতোয়ালি, বরিশাল।
১২. ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, হাবিলাশ দ্বীপ, থানা- পটিয়া, চট্টগ্রাম।
১৩. বিধানকৃষ্ণ সেন, সারুয়াবলা, থানা- বােয়ালখালি, চট্টগ্রাম।
১৪, সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক, বরষার চর, মতলব, কুমিল্লা।
১৫. হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবুর রহমান, গােপালপুর, থানা-নবীনগর, কুমিল্লা।
১৬, ফ্লাইট সার্জেন্ট মােহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, গ্রাম-বাঞ্ছারামপুর, থানা দাউদকান্দি, কুমিল্লা
১৭. সার্জেন্ট জহিরুল হক, গ্রাম- সােনাপুর, থানা-সুধারাম, নােয়াখালী।
১৮. এজি মােহাম্মদ খুরশীদ, সাবের কটেজ, কোতােয়ালি, ফরিদপুর।
১৯. খান এম শামসুর রহমান সিএসপি, গ্রাম-লালুবাড়ি, থানা-মানিকগঞ্জ, ঢাকা।
২০. পিজেও রিসালদার একেএম শামসুল হক এসি, গ্রাম- পোতাল, থানা- মানিকগঞ্জ, ঢাকা।
২১. হাবিলদার আজিজুল হক, গ্রাম-কবিয়া, থানা- গৌরনদী, বরিশাল।
২২. এসপি মাহফুজুল বারী, গ্রাম-চরলক্ষ্মী, থানা- ফেনী, নােয়াখালী।
২৩. সার্জেন্ট শামসুল হক, গ্রাম- নৈরাজপুর, থানা- ফেনী, নােয়াখালী।
২৪. মেজর শামসুল আলম, খাজে দেওয়ান, সেকেন্ড লেন, ঢাকা।
২৫. ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আব্দুল মােতালিব, গ্রাম-দরুদ বাইরতি, থানা-পূর্বধরা, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ।
২৬. ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী মিয়া, গ্রাম-চাকদা, থানা-নড়িয়া, ফদিরপুর।
২৭. ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা, পশ্চিম বগুড়া রােড, বরিশাল।
২৮. ক্যাপ্টেন এএন নুরুজ্জামান, গ্রাম-সাইদাবাদ, থানা-রায়পুরা, ঢাকা।
২৯. সার্জেন্ট আবদুল জলিল, গ্রাম-সারিয়াবাদ, নারায়ণপুর, ঢাকা।
পৃষ্ঠাঃ ২৩০
৩০. মােহাম্মদ মাহবুবুদ্দিন চৌধুরী, গ্রাম-পাইয়াস, সিলেট।
৩১. ফার্স্ট লেঃ এএসএম রহমান, গ্রাম-মাকরাইল, লােহাগড়া, যশাের।
৩২. সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, গ্রাম-শ্রীপুর, ভাণ্ডারিয়া, বরিশাল।
৩৩. মোহাম্মদ আলী রেজা, গ্রাম-লহিরী, থানা- কোতােয়ালী, কুষ্টিয়া।
৩৪. ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমেদ, গ্রাম-বাশিয়া, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ।
৩৫. ফার্স্ট লেঃ আবদুর রউফ, পাকিস্তান হাউজ, ভৈরব, ময়মনসিংহ।
১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট ফৌজদারী আইন সংশােধন- বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ১৯৬৮ বলে আগরতলার আসামীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি এস এ রহমানের নেতৃত্বে বিচারপতি মজিবুর রহমান খান, বিচারপতি মাকসুদুল হাকিমকে নিয়ে একটি বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। কুর্মিটোলা সেনানিবাসে শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যের বিচার শুরু হয়।
১৯৬৮ সালের ২০ জুন আগরতলা মামলার শুনানি শুরু হয়। সরকার পক্ষে প্রধান কৌশলী ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও লাহাের হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী মঞ্জুর কাদের, পূর্ব পাকিস্তান থেকে টিএইচ খান সরকারের পক্ষের উকিল ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান কৌসুলী ছিলেন আবদুস সালাম খান। ইংল্যান্ডের রানীর কৌসুলি টমাস উইলিয়াম শেখ মুজিবুর রহমানের কৌসুলি নিযুক্ত হন। ২০ জুন হতে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে ২০৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২ জানুয়ারি সওয়াল-জবাব শুরু হবে। আসামীদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযােগ- তারা ভারতের সহযােগিতায় সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করবে এবং এ লক্ষ্যে তারা ভারতের আগরতলায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের সাথে ষড়যন্ত্র করেছিল। এ জন্য মামলার নাম দেয়া হয় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। মামলার জবানবন্দী ও জেরা ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। আসামী পক্ষ আগরতলা মামলাকে মিথ্যা মামলা বলে অভিহিত করে। শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আসামীর মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু হয়। সারা বাংলায় শ্লোগান চলছে- জেলের তালা ভাংবাে, শেখ মুজিবকে আনব।
১৯৫৮ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ৬ দফা আন্দোলন ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবির প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হতে থাকে।
একই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে ।
পৃষ্ঠাঃ ২৩১
তাসখন্দ চুক্তির ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। জেড এ ভুট্টো পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু করে। আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালের ১৩ নবেম্বর পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৮ সালের ৮ ডিসেম্বর সমগ্র পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়।
এ সময় মওলানা ভাসানী আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ন্যাপ বিভক্ত হয়ে পরে, পিকিংপন্থী ন্যাপের সভাপতি মওলানা ভাসানী মস্কোপন্থী ন্যাপের সভাপতি ওয়ালি খান। পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ।
ডাক-DAC
১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি একনায়কতন্ত্রের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৮ দফার ভিত্তিতে বিরােধী দলগুলাে Democratic Action Committee- DAC গঠন করে। ডাকের ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করে নিম্নলিখিত দলগুলাে:
আমির হােসেন- ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ন্যাপ
চৌধুরী মােহাম্মদ আলী – সভাপতি, নেজামে ইসলাম পার্টি
মুফতি মাহমুদ – জামায়াতে ওলামায়ে ইসলাম
মমতাজ মােহাম্মদ খান দৌলতানা – সভাপতি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ
নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান – সভাপতি, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
নূরুল আমিন – সভাপতি, এনডিএফ
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
তােফায়েল মিয়া – ভারপ্রাপ্ত আমির, জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান
এই ঘােষণার সাথে দেশের সর্বত্র ডাক-এর কর্মসূচী সংবর্ধিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৯ জানুয়ারি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করবে না।২
ছাত্র সগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন-১৯৬৯
১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে ছাত্রলীগ জয়লাভ করে। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও এনএমএফ-এর একাংশ ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ১১ দফার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে।
পৃষ্ঠাঃ ২৩২
আবদুর রউফ – সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ
সাইফুদ্দীন আহমেদ – সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো)
মোস্তফা জামাল হায়দার – সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং)
খালেদ মোহাম্মদ আলী – সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগ
মাহবুব উল্লাহ – সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং)
মাহবুবুল হক দোলন – সভাপতি, এনএসএফ
তোফায়েল আহমেদ – সহ-সভাপতি, ডাকসু
নাজিম কামরান – সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক হলেন ডাকসুর ভিপি তােফায়েল আহমদ। আওয়ামী লীগের ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্রদের ১১ দফা রচিত হয়।৩
আসাদের মৃত্যু
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয় । সভা শেষে মিছিল করে রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। পুলিশ-ইপিআর ছাত্রদের উপর আক্রমণ চালায় এবং বেলা ১টা ৫৫ মিনিটে পুলিশের গুলিতে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজের ছাত্র- ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এএম আসাদুজ্জামান (২৫) নিহত হন। আসাদের হত্যাকাণ্ডের ফলে বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে। ২১ জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়।
১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি হরতাল চলাকালে মিছিলে গুলি করে পুলিশ ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণীর কিশাের মতিউর রহমান মল্লিককে হত্যা করে। পুলিশের গুলিতে মকবুল, রুস্তম আলী ও আরও অনেকে নিহত হন। ঐ দিন রাতে সরকার কার্ফু জারি করে। মতিউর রহমানকে হত্যার সাথে দেশে গণবিপ্লব শুরু হয়ে যায়। ২৫ জানুয়ারি হতে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে হরতাল চলতে থাকে। পুলিশ-ইপিআর অনেককে গুলি করে হত্যা করে। পশ্চিম পাকিস্তানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী, লাহাের, পেশােয়ার, কোয়েটা সকল শহরে আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য সেনাবাহিনী ও পুলিশ গুলিবর্ষণ করে অনেককে হত্যা করে। পরিশেষে আইয়ুব খান রণে ভঙ্গ দেন। ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঘােষণা করলেন শীঘ্রই তিনি আলােচনায় বসবেন। তিনি ১৭ ফেব্রুয়ারি গােলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি সরকার দৈনিক ইত্তেফাকের ছাপাখানা বাজেয়াপ্তের আদেশ প্রত্যাহার
পৃষ্ঠাঃ ২৩৩
করে। ৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতা-রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার গেটে সমবেত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। মনে হলাে তারা জেলগেট ভেঙ্গে ফেলবে। এ মুহূর্তে কারা-কর্তৃপক্ষের অনুরােধে তাজউদ্দীন আহমদ ও অলি আহাদ জেলগেটে উপস্থিত হয়ে জনতাকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান। মিছিলকারীরা শান্তভাবে চলে যায়।
তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিলাভ
১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান লাহােরে গােলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। আওয়ামী লীগ বৈঠকে যােগদান করবে না। পিডিপি নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ঢাকা এসে সকল দলের সাথে আলােচনা করছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদককে জেলে রেখে আলােচনা সম্ভব নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত হলাে- সরাসরি না বলে বলা হোক সম্পাদককে মুক্তি দেয়া হােক। শেখ মুজিবের সম্মতি নিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম নবাবজাদা নসরুল্লাহর সাথে তাজউদ্দীনের মুক্তির বিষয় আলাপ করেন নবাবজাদার চেষ্টায় তাজউদ্দীন আহমদ পরদিন মুক্তি লাভ করেন। কর্নেল নাসের ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সেনানিবাসে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে গােলটেবিল বৈঠক নিয়ে আলােচনা হলাে এবং কৌশল নির্ধারণ করা হয়।
১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সরকার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, জাতীয় লীগের অলি আহাদ, ন্যাপের সিরাজুল হােসেন খান, এডভােকেট মুজিবুর রহমান, ওবায়দুর রহমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে হঠাৎ মুক্তি লাভ করেন। তাজউদ্দীন মুক্তি লাভ করে তার সুটকেস নিয়ে একটি বেবিটেক্সিতে তার ধানমণ্ডির বাসভবনে উপস্থিত হয়ে বাসার সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেলেন। মুহূর্তের মধ্যে তাজউদ্দীনের বাসভবনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ছাত্রনেতারা ফুলের মালা নিয়ে উপস্থিত । তিনি সকলের সাথে কুশল বিনিময় করেন।
১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বিকেলে পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, তােফায়েল আহমদ, আমেনা বেগম ন্যাপের মােজাফফর আহমদ প্রমুখ ভাষণ দেন। সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আগরতলা মামলার প্রত্যাহারের দাবি করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি জেড এ ভুট্টোকে
পৃষ্ঠাঃ ২৩৪
মুক্তি দেয়া হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে ভুট্টো স্বীকৃতি লাভ করেন। শেখ মুজিব বাঙালীদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।
মুক্তি লাভের পর তাজউদ্দীন আহমদ গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নব উদ্যোগে আইয়ুব-মােনায়েম খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে।৪
সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু
১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাবিলদার মঞ্জুর উপরের নির্দেশে টয়লেটে যাবার সময় হঠাৎ আগরতলা মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে গুলিবর্ষণ করে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু হলো। ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৬ ফেব্রুয়ারী সার্জেন্ট জহুরের জানাজা বায়তুল মােকাররমে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর লাখাে জনতা মিছিল করে তাকে আজিমপুরে সমাধিস্থ করে। সার্জেন্ট জহুরের মৃত্যুর সাথে আইয়ুব খানের রাজত্ব শেষ হয়ে যায়।
ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যু
১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯
১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী হরতাল চলাকালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে গুলি করে হত্যা করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে ড. জোহার করুণ মৃত্যু হয়। ড. জোহার হত্যা সংবাদে সারা দেশে কার্ফু ভঙ্গ করে জনতা রাস্তায় প্রতিবাদ জানায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। গ্রামে গ্রামে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার ভেঙ্গে পড়ে- ডাক ও ছাত্র সংগ্রাম কমিটি দেশ পরিচালনা করছে।
আগরতলা মামলা প্রত্যাহার
১৯৬৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি গােলটেবিল বৈঠক বসার কথা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া বৈঠক অর্থহীন। সরকার শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি দিতে চায়। শেখ মুজিবুর রহমান প্যারােলে রাউন্ড টেবিল বৈঠকে যােগদান করবেন না। তিনি মুক্ত মানুষ হিসেবে গােলটেবিল বৈঠকে যােগ দেবেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৩৫
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন, আবদুল মান্নান, ময়েজউদ্দিন, শামসুল হক, মােস্তফা সারওয়ার পিডি গমন করে- পাকিস্তানের আইনমন্ত্রীর সাথে আলাপ হলাে। সরকার শেখ মুজিবকে মুক্ত মানুষ হিসেবে যােগ দিতে দেবে না। আলােচনা ভেঙ্গে যাচ্ছে। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আমরা আলােচনা ভেঙ্গে না দিয়ে আমরা প্যারেলের প্রস্তাব নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট যাই। সকল ঝুঁকি নিয়ে তাজউদ্দীন ঢাকায় চলে আসেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জেলখানায় দেখা করেন। শেখ মুজিব ঘােষণা দিলেন। তিনি প্যারােলে গােলটেবিল বৈঠকে যাবেন না। এদিকে একদল প্রচার করছে তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে প্যারােলে গােলটেবিল বৈঠকে নিতে চায়। তাজউদ্দীন সব সময় প্যারােলে মুক্তিরবিরােধী ছিলেন। তাজউদ্দীনের লক্ষ্য ছিল আলােচনা বিলম্ব করা এবং আইয়ুববিরােধী আন্দোলন চলতে থাক। আইয়ুব খান দ্রুত দুর্বল হচ্ছে। এদিকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর গুলিতে সার্জেন্ট জহুরুল হক নিহত হন। লাহােরের গােলটেবিল বৈঠক ভেঙ্গে যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন অবশ্যম্ভাবী। তাই বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে সদ্য মুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান করা হয়। বঙ্গবন্ধু লাহাের বৈঠকে যাবেন। ইসলামাবাদ যাওয়ার আগে যে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি, সম্পূর্ণ ব্রিফিং, এটা তাজউদ্দীন সাহেবই বঙ্গবন্ধুকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বললেন।
আর একদিকে আমরা কোন ফাঁদে না পড়ে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থটা কীভাবে সংরক্ষিত হয় এই বিষয়টিতেই অবস্থান করছিলাম। এই ব্যাপারে নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু, কিন্তু বিষয়টি পরিচালনার মূল দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দীন সাহেব।”
ঈদের কারণে বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়। ঈদের পর পুনরায় বৈঠক বসবে। ঢাকায় তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় ঘন ঘন বৈঠক চলছে- বৈঠকের জন্য কাগজপত্র তৈরি করার জন্য। এ সভায় যােগ দিতেন বঙ্গবন্ধু, ড. কামাল হােসেন, ড. নূরুল ইসলাম, রেহমান সােবহান, ড. সরওয়ার মাের্শেদ, রুহুল কুদ্স, শামসুর রহমান খান প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু জেলখানাতে বসেও তার বিশ্বস্ত এবং যােগ্য লােক হিসেবে যার কথা মনে করতেন তিনি তাজউদ্দীন। সে জন্য জেল থেকে তাজউদ্দীনকে বের করা তার প্রাথমিক দায়িত্ব- তাকে দিয়েই গােলটেবিলের সব কাজ করানাে হয়। তাজউদ্দীনের ওপর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ততা ২৫ মার্চ পর্যন্ত অটুট ছিল। কিন্তু দেশের দুর্ভাগ্য, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর
পৃষ্ঠাঃ ২৩৬
দুই নেতার মধ্যে আলাপ-আলােচনার পদ্ধতি আর কার্যকর ছিল না।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হঠাৎ ঘােষণা করলেন, আগরতলা মামলা তুলে নেয়া হয়েছে এবং সকল বন্দীর মুক্তি দেয়া হলাে। শুরু হলাে বিজয় মিছিল। ২২ফেব্রুয়ারি বিকেলে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল আসামী মুক্তি লাভ করে। সারা বাংলায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আইয়ুব আরও ঘােষণা করলেন- তিনি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা প্রদান করে। জনতার পক্ষ থেকে ডাকসুর ভিপি তােফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করেন।৫
লাহাের গােলটেবিল বৈঠক
১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিণ্ডিতে গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিম্নলিখিত নেতৃবৃন্দকে আহবান করা হয় :
শেখ মুজিবুর রহমান – আওয়ামী লীগ
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – আওয়ামী লীগ
মমতাজ মােহাম্মদ দৌলতানা – পাকিস্তান মুসলিম লীগ
খাজা খয়েরউদ্দিন – পাকিস্তান মুসলিম লীগ
নূরুল আমিন – এনডিএফ
হামিদুল হক চৌধুরী – এনডিএফ
নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান – পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
আবদুস সালাম খান- পাকিস্তান ৮ দফা
চৌধুরী মােহাম্মদ আলী – নেজামে ইসলাম
মৌলভী ফরিদ আহমদ – নেজামে ইসলাম
মওলানা আবুল আলা মওদুদী – জামায়াতে ইসলাম
অধ্যাপক গােলাম আযম – জামায়াতে ইসলামী
ওয়ালী খান – ন্যাপ
অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ – ন্যাপ
মুফতি মাহমুদ – জমিয়াতুল উলেমায়ে ইসলাম
পীর মােহসেন উদ্দিন দুদু মিয়া – জমিয়াতুল উলেমায়ে ইসলাম
মওলানা ভাসানী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্বেই গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানে অস্বীকৃতি জানান।
পৃষ্ঠাঃ ২৩৭
গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ৯ জনপ্রতিনিধি নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি লাহােরের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। তার সাথে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মােমেন, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, এম এ আজিজ, ময়েজউদ্দিন ও মতিউর রহমান।
১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ১০টা ৩০ মিনিটে রাওয়ালপিণ্ডিতে অবস্থিতপ্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউজে গােলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ডাক-এর ১৬ জন, প্রেসিডেন্টের পক্ষে ১৫ নির্দলীয় এবং নির্দলীয় ২ জনসহ মােট ৩৩ জন বৈঠকে যােগ দেন। প্রেসিডেন্টের উদ্বোধনী ভাষণের পর আলােচনা ১০ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে , ১১ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণ দেন।
গােল টেবিল বৈঠকে উত্থাপিত দাবির মধ্যে ছিল :
• ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা;
• সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভােটে গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট নির্বাচন;
• কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন;
• পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন;
• আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ।
আলােচনা ১০ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত চলে। আইয়ুব খান তার ভাষণে
দু’টি দাবি মেনে নেন- ১. প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন, ২. দেশে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা চালুকরণ। যে দুটো বিষয় মতৈক্যে পৌছেছে তা তিনি সংসদের অনুমােদনের জন্য প্রেরণ করবেন। ডাক আইয়ুব খানের ভাষণের প্রশংসা করে। আওয়ামী লীগ ও ওয়ালি ন্যাপ আইয়ুব খানের প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। ডাক স্বায়ত্তশাসন সমর্থন না করায় শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে সম্পর্ক ছেদ করেন। ১৩ মার্চ আইয়ুব খান শেখ মুজিবকে নৈশভােজে আহবান করেন। তিনি আইয়ুব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের নতুন গভর্নর নিয়ােগের পরামর্শ দেন। আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানের সুপারিশে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মির্জা নূরুল হুদা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ইউসুফ আব্দুল্লাহকে গভর্নর নিয়ােগ করেন। অত্যাচারী গভর্নর মােনায়েম খান বিদায় নিলেন। ড. এমএন হুদা ২২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৩৮
আইয়ুব খানের বিদায়
শেখ মুজিবুর রহমান তার দলের ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন গ্রহণ না করায় গােলটেবিল বৈঠক (RTC)-এর ফলাফল শূন্য হয়। আইয়ুব খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করতে চান কিন্তু শেখ মুজিব আইয়ুব খানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ৬ দফার দাবিতে অটল থাকেন। দেশব্যাপী আন্দোলন চলছে। ১৯৬৯ সালের ২০ মার্চ মন্ত্রিসভা ও আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এদিকে প্রধান সেনাপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্র চলছে- তিনি আইয়ুব খানকে ক্ষমতাচ্যুত করবেন।
আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাত ৮টায় জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে বলেন, ‘এ আমার শেষ ভাষণ’ । আইয়ুব খান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে দেশের শাসনভার অর্পণ করেন এবং তাকে প্রধান সামরিক শাসক (CMLA) নিয়ােগ করেন। ইয়াহিয়া খান শাসনতন্ত্র বাতিল, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার ও আইনসভা বাতিল করেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গভর্নর ড. এমএন হুদার স্থলে এডমিরাল এসএম আহসানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও লেঃ জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেন। দেশে আইনশৃঙ্খলা ফিরে আসে। দশ বছর স্বৈরশাসনের পর আইয়ুব খানকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বিদায় নিতে হয়। তিনি প্রেসিডেন্ট বাসভবনে ৩ মাস থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও তার সাথীরা আইয়ুব খানকে তিন দিনের মধ্যে বাসভবন ছাড়তে বাধ্য করেন।৬
তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার মৃত্যু
১৯৬৯ সালের ৩১ মে রাত ১২টা ৪০ মিনিটে রাওয়ালপিন্ডির এক হােটেলে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে জাতি শােকাভিভূত হয়ে পড়ে। সংগ্রামী সাংবাদিক মানিক মিয়াকে আজিমপুরে সমাহিত করা হয়।
তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া বরিশালের ভাণ্ডারিয়ায় ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি বিএম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তিনি চল্লিশের দশকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন এবং কলকাতা গমন করেন। তিনি সােহরাওয়ার্দীর স্নেহধন্য ছিলেন। তিনি প্রথমে দৈনিক ইত্তেফাকের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। ১৯৪৯ সালে তার সম্পাদনায় ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২৩৯
দৈনিক ইত্তেফাক ও মানিক মিয়া ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাণ। দৈনিক ইত্তেফাকবাঙালীর স্বায়ত্তশাসনের কথা ঘরে ঘরে পৌছে দেয়।
প্রদেশব্যাপী জনসংযোগ
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ সামরিক আইন জারি ও আইয়ুব- মোনায়েম খানের বিদায়ের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ জনসংযোগে বিভিন্ন জেলায় গমন করেন। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেম সম্পর্কে কটাক্ষ কিরেন। এ প্রেক্ষিতে ১৯৬৯ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের উক্তির প্রতিবাদ জানান। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ ৬ দফাকে সামনে রেখে গণসংযোগ অব্যাহত রাখেন।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ৪ আগস্ট সাত সদসবিশিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। তারা হলেন :
ডা. এম এ মালেক – স্বাস্থ্য ও শ্রম
সরদার আবদুর রশীদ খান – স্বরাষ্ট্র
এ কে এম হাফিজউদ্দিন – শিল্প
নবাব মােজাফফর আলী কিজিলবাগ – অর্থ
শামসুল হক – শিক্ষা
মেঃ জেনারেল নবাবজাদা শের আলী খান – তথ্য ও বেতার
আহসানুল হক – বাণিজ্য
১৯৬৯ সালের ১৫ আগস্ট এডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং এয়ার মার্শাল নূর খানকে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করা হয়।
তাজউদ্দীন আহমদের মাতার মৃত্যু
১৯৬৯ সালে তাজউদ্দীনকে দলীয় কাজ ও গণসংযােগে প্রায়ই ঢাকার বাইরে থাকতে হতাে। তার অসুস্থ বৃদ্ধ মাতা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। দেশের কাজে মায়ের সংবাদ সব সময় রাখতে পারতেন না। ১৯৬৯ সালের ১৮ আগস্ট তার মাতা মেহেরুন্নেসা বেগম কাপাসিয়ার দরদরিয়ার বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ রাজনৈতিক কাজে ঢাকার বাইরে ছিলেন। ঐদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে স্নেহময়ী মায়ের মৃত্যুসংবাদ শুনতে পান। তিনি বােনের মেয়ে আনার
পৃষ্ঠাঃ ২৪০
ও বড় মেয়ে রিপিকে নিয়ে ছুটলেন দরদরিয়ায়। সেদিন ঝড়-বৃষ্টি শ্রীপুর রেলস্টেশন থেকে দরদরিয়ার ৫ মাইল লাল কাদামাটির পথ- মাঝে শীতলক্ষ্যা নদী। মাটির ৫ মাইল পথ ও শীতলক্ষ্যা পার হয়ে তাজউদ্দীনের বাড়ি পৌছতে গভীর রাত হয়। পরের দিন বৃষ্টির মধ্যে নিজ হাতে মায়ের কবর দিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনিমায়ের দেখা পেলেন না। দেশের ডাকে তাজউদ্দীন নিজকে উৎসর্গ করেছেন। তিনি পিতার মৃত্যুও দেখতে পারেননি। পিতার নিষেধ সত্ত্বেও ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে যােগ দেন। ১৯৪৬ সালে পিতা ও ১৯৬৯ সালে মাকে হারালেন । তার বড় ভাই ও এক বােনের মৃত্যু হয়েছে। প্রিয়জন হারানাের বেদনা ভুলে তিনি দেশমাতৃকার সেবক হলেন।
১৯৬৯ সালের ১৬ নবেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ১৯৭০ সালের এপ্রিলের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের সমাপ্তির তারিখ ঘােষণার দাবি জানানাে হয়।
বাংলাদেশ নাম ঘােষণা
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। ঐদিন বিকেলে সােহরাওয়ার্দীর মাজারে আলােচনাসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন- আজ হতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশ নামকরণ এক ঐতিহাসিক ঘটনা।৭
১৯৬৯ সালের ৭ ডিসেম্বর দুর্নীতির অভিযােগে ইয়াহিয়া খান ৩০৩ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেন।
সাধারণ নির্বাচন ঘােষণা
প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। তিনি এক ইউনিট বাতিল করেন এবং এক ব্যক্তি এক ভােট নীতি গ্রহণ করেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চূড়ান্ত ভােটার তালিকা প্রণয়নের নির্দেশ দেন।
১৯৭০ সালে তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র সন্তান লাভ
১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি সােমবার দুপুরে তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজউদ্দীন পুত্র সন্তান লাভ করেন। সন্তান জন্মের সময় তাজউদ্দীন, তার কন্যা,
পৃষ্ঠাঃ ২৪১
আতীয়স্বজন উপস্থিত ছিলেন। সকলে আনন্দিত। বঙ্গবন্ধু পুত্রের জন্মের সংবাদ শুনে টুকরি বোঝাই মিষ্টি নিয়ে আসেন। তাজউদ্দীনের শ্বশুর ও বড় মেয়ে রিপি পুত্রের নাম রাখেন সােহেল। তিনি সােহেল তাজ নামে পরিচিত।
১৯৭০ সালের ২০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ময়দানে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। অনুষ্ঠানে ১৯৭০-১৯৭১ সালের ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন- নূরে আলম সিদ্দিকী ও শাজাহান সিরাজ। ১৯৭০ সালের ১৭ মে নির্বাচনে ১৯৭০-৭১ সালের ডাকসুর ভিপি – জিএস নির্বাচিত হলেন- আসম আবদুর রব এবং আবদুল কুদুস মাখন।
পৃষ্ঠাঃ ২৪২
৯
১৯৭০ সালের নির্বাচন
অসহযােগ আন্দোলন
১৯৭০ সালের ১৮ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আইনগত কাঠামাে- Legal Frame Work Order- LFO ঘােষণা করেন। ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ এলএফও জারি করা হয়। তাতে বলা হয়-১
শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হবে ইসলামী আদর্শ রক্ষা করা, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচন হবে, পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র হবে, পাকিস্তান ফেডারেল সরকার হবে, প্রদেশগুলাের স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
পাকিস্তানের প্রদেশের মধ্যে জাতীয় পরিষদের আসন এভাবে বণ্টন করা হয়:
পূর্ব পাকিস্তান – ১৬৯
সাধারণ – ১৬২
মহিলা – ৭
পশ্চিম পাকিস্তান – ১৪৪
সাধারণ – ১৩৮
মহিলা – ৬
প্রাদেশিক পরিষদ
পূর্ব পাকিস্তান – ৩০০
১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদ ও ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে।
তাজউদ্দীন আহমদ পুনরায় আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত
আওয়ামী লীগ কমিটি-১৯৭০
১৯৭০ সালের ৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন মতিঝিলের ইডেন হােটেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয়। ১১৩৮ জন কাউন্সিলর সম্মেলনে যােগ দেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৪৩
১৯৭০ সালের ৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কমিটি গঠিত হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান – সভাপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – সহ-সভাপতি
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী – সহ-সভাপতি
খন্দকার মােশতাক আহমদ – সহ-সভাপতি
তাজউদ্দীন আহমদ – সাধারণ সম্পাদক
মিজানুর রহমান চৌধুরী – সাংগঠনিক সম্পাদক
আবদুল মােমিন – প্রচার সম্পাদক
মােহাম্মদ উল্লাহ – দপ্তর সম্পাদক
জহুর আহমদ চৌধুরী – শ্ৰম সম্পাদক
বেগম বদরুন্নেসা – সমাজসেবা ও সংস্কৃতি
মােহাম্মদ মােহসিন মিয়া – কোষাধ্যক্ষ
৬ জুন হােটেল ইডেনে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ৬ জুন অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়।
১৯৭০ সালের ৮ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ১৯৭০ সালের নির্বাচনের রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করে।
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ – নৌকা
পিপলস পার্টি – তরবারি
পিডিপি – ছাতা
ন্যাপ (ভাসানী) – ধানের শীষ
ন্যাপ (ওয়ালি) – কুঁড়েঘর
জামায়াতে ইসলাম – দাঁড়িপাল্লা
কনভেনশন মুসলিম লীগ – বাইসাইকেল
কাইয়ুম মুসলিম লীগ – বাঘ
কাউন্সিল মুসলিম লীগ – হারিকেন
পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগ – লাঙ্গল
১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতার- টেলিভিশনে নির্বাচন উপলক্ষে ভাষণ দেন। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য তিনি নিন্মলিখিত কর্মসূচী পেশ করেন:
• ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান
পৃষ্ঠাঃ ২৪৪
• বাঙালীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে
• শাসনতান্ত্রিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠ্য
• ভূমি সংস্কার- ২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমি খাজনা মাফ
• যমুনা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার ওপর সেতু নির্মাণ
• ফারাক্কা বাধ সমস্যার সমাধান
১৯৭০ সালের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নে তাজউদ্দীন আহমদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর প্রাকৃতিক দুর্যোগ
১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস উপকূল দিয়ে বয়ে যায়। এ ঝড়ে ভােলা, পটুয়াখালী, নােয়াখালী ও চট্টগ্রামে ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়। লাখ লাখ গবাদিপশু মারা যায়। জনগণের কাচাবাড়ি ও সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে ছুটে গেলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদ ও মওলানা ভাসানী। কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলায় বাঙালীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।
ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করলেন ক্ষতিগ্রস্ত ৩০ আসনের নির্বাচন ১৯৭১ সালের ১৭ জানয়ারি অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে।
১৯৭০ সালে নির্বাচন
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। প্রত্যেক নির্বাচনী কেন্দ্রে একাধিক প্রার্থী। আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যৌথ নির্বাচন করবে না। এককভাবে নির্বাচন করবে। পার্লামেন্টারি বাের্ডের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং সদস্য সচিব তাজউদ্দীন আহমদ। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে শত শত প্রার্থী তাদের সাক্ষাতকার স্থানীয় গ্রহণযোগ্যতা, দলের প্রতি আনুগত্য ও অবদান বিবেচনা করে তাজউদ্দীন আহমদ প্রার্থী বাছাই করতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনের প্রতি নির্ভরশীল ছিলেন। প্রার্থী নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন । তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি, জেলা কমিটি, থানা কমিটিকে সমভাবে গুরুত্ব দিতেন। তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। দলের মধ্যে তিনি গণতন্ত্রের চর্চা করে নির্বাচনে বিজয়ের পথ সুগম করেন। আওয়ামী
পৃষ্ঠাঃ ২৪৫
লীগের প্রার্থী নির্বাচন সমাপ্ত করে জনগণকে অবহিত করেন।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের জেলাভিত্তিক আসন বণ্টন
জেলার নাম জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা প্রাদেশিক পরিষদের আসন সংখ্যা
রংপুর ১২ ২২
দিনাজপুর ৬ ১০
বগুড়া ৫ ৯
রাজশাহী ৯ ১৭
পাবনা ৬ ১২
কুষ্টিয়া ৪ ৮
যশোর ৮ ১৩
খুলনা ৮ ১৪
বাকেরগঞ্জ ১০ ১৮
পটুয়াখালী ৩ ৭
টাঙ্গাইল ৫ ৯
ময়মনসিংহ ১৮ ৩২
ফরিদপুর ১০ ১৯
ঢাকা ১৬ ৩০
সিলেট ১১ ২১
কুমিল্লা ১৪ ২৬
নােয়াখালী ৮ ১৪
চট্টগ্রাম ৯ ১৮
পার্বত্য চট্টগ্রাম ১ ২
মহিলা ৭ —
মােট ১৬৯ ৩০০
তাজউদ্দীন আহমদকে জাতীয় পরিষদের এনই-১০৮ ঢাকা-৫ আসনে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন দেয়া হয়। ঢাকা জেলার সদর উত্তর মহকুমার কাপাসিয়া থানা ও কালিগঞ্জ থানা নিয়ে জাতীয় পরিষদের ঢাকা-৫ আসন গঠিত ছিল । তাজউদ্দীন আহমদকে নিজ নির্বাচনী এলাকার ব্যতীত বাংলাদেশের সকল কেন্দ্রের সাথে যােগাযােগ রাখতে হয়েছে।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়। নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচিত হন।
পৃষ্ঠাঃ ২৪৬
১৯৭০ সালে তাজউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী ফলাফল
ঢাকা-৫ জাতীয় পরিষদ
এলাকা : কালিগঞ্জ-কাপাসিয়া
মােট ভােট- ১৯১০৮২
মােট দেয় ভােট – ১১১৬১৭
আওয়ামী লীগ – প্রার্থী তাজউদ্দীন আহমদ – ৯৭২৬৮
জামায়াতে ইসলামী – অধ্যাপক ইউসুফ আলী – ১০৬৬৫
ন্যাপ- আহমেদুল কবির – ৮২৮৪
আওয়ামী লীগ সারাদেশে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে বিজয় লাভ করে। আওয়ামী লীগ ২টি আসন হারায়- চট্টগ্রামে নান্দাইলে পিডিএস প্রার্থী নুরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান ভিত্তিক ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল:২
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ -১৬৭
পাকিস্তান পিপলস পার্টি – ৮৮
কাইয়ুম মুসলিম লীগ – ৯
কাউন্সিল মুসলিম লীগ – ৭
কনভেনশন মুসলিম লীগ – ২
ন্যাপ (ওয়ারি) – ৭
জামায়াতে ইসলামী – ১
মারকাজ জমিয়তউল ইসলাম
থানভি গ্রুপি – ১৪
নির্দলীয় – ১৪
মােট – ৩১৪
প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসনে জয়লাভ করে। পিডিপি ২, নেজামে ইসলাম ১, জামায়াতে ইসলাম ১, ন্যাপ ওয়ালি ১, স্বতন্ত্র ৭টি আসন পায়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগে যােগ দেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৪৭
১৯৭১ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি
১৯৭০ সালের নির্বাচনের বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের দায়িত্ব-কর্তব্য বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলার রাজনীতিকে সুচারুরূপে পরিচালিত করেন। প্রত্যেকটি পদক্ষেপ তিনি ধীর স্থিরভাবে গ্রহণ করেন। তাই দলের কর্মসূচীর সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সমর্থ হন।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদের শপথ অনুষ্ঠিত হয়। তারা সকলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অঙ্গীকার করেন। আওয়ামী লীগের শপথ অনুষ্ঠানকে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং বাঙালীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
নির্বাচনের পর ১৯৭১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন এবং ১২ ও ১৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনায় বসেন। আলােচনাকালে শেখ মুজিব ৬ দফা ব্যাখ্যা করেন।
পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা পৌঁছেন এবং হােটেল শেরাটনে ওঠেন। ২৭, ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি শেখ মুজিব-ভুট্টো আলােচনা চলে। আলােচনায় তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান সহায়ক হিসেবে কাজ করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টকে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে সংসদ অধিবেশন আহবানের দাবি জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘােষণা করলেন- ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘােষণা করলেন তার দলের যে সকল সদস্য অধিবেশনে যােগ দেবেন তাদের পা ভেঙ্গে দেয়া হবে।
১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী দলের এমএন ও এমপিএদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্টারি দলের নেতা ও উপনেতা নির্বাচিত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রফেসর ইউসুফ আলী দলের দলের চীফ হুইপ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ও আবদুস সালাম হুইপ নির্বাচিত হলেন। প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হলেন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী।
পৃষ্ঠাঃ ২৪৮
মার্চ ১৯৭১
১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেলা ১টা পাঁচ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হঠাৎ ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বানীতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন । সংসদ স্থগিতের সংবাদ শুনে তিনি ২ মার্চ ঢাকায় অর্ধদিবস এবং ৩ মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় হরতাল ঘােষণা করেন এবং ৭ মার্চের জনসভায় তিনি চুড়ান্ত কর্মসূচী দেবেন বলে জানান।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ অনুসারে কাজ করতে অস্বীকার করলে গভর্নর আহসানকে বদলি করে তার স্থলে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেঃ জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব আলীকে গভর্নরের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। সেনাবাহিনী ২ মার্চ ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্রলীগ নেতা ফারুক ইকবালকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ছাত্রলীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ছাত্রনেতা আসম রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২ মার্চ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ৯ জনকে ঢাকায় গুলি করে হত্যা করে। পল্টন ময়দানে তাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে ৩ মার্চ বিকেলে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় শেষ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। ৩ মার্চ সেনাবাহিনী ১৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ৩ মার্চ ইকবাল হলের নামকরণ করা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল।
১৯৭১ সালের ৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট ১০ মার্চ ঢাকায় সর্বদলীয় সম্মেলন আহবান করেন। ৪ মার্চ আওয়ামী লীগের নির্দেশে রেডিও পাকিস্তানকে বাংলাদেশ বেতার এবং পাকিস্তান টেলিভিশনের নাম বাংলাদেশ টেলিভিশন রাখা হয়। পাকিস্তান জিন্দাবাদের পরিবর্তে জয় বাংলা বলা হয় । ৪ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ৪ মার্চ পর্যন্ত সেনাবাহিনী ৩০০ জন বাঙালীকে হত্যা করে।
৫ মার্চ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। ৫ মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ১৮৮ জনকে হত্যা করে। টঙ্গীতে ৫ জনকে হত্যা করে। ৫ মার্চ মওলানা ভাসানী ও তাজউদ্দীন আহমদ গণহত্যার নিন্দা করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশন আহবান করেন।
৬ মার্চ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলে। ৬ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় লীগের জনসভায় জাতীয় লীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। ইয়াহিয়া খান লেঃ জেনারেল টিক্কা
পৃষ্ঠাঃ ২৪৯
খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। ৭ মার্চ প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অস্বীকার করেন।
৭ মার্চের ভাষণ
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ৭ মার্চের ভাষণের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাষণ ইতিপূর্বে কোন নেতা দিয়েছেন বলে জানা নেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তেমনিভাবে ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের নিকট অমর হয়ে থাকবে।
৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে সভার আয়ােজন চলছে। সকলে আশা করছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। ৬ মার্চ টিক্কা খান ঢাকায় পৌঁছলে তাকে শপথ পড়ানাে হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন সেনাবাহিনী দিয়ে সভা স্তব্ধ করে দেয়া হবে; তা কিন্তু তাতে আন্দোলন থামবে না। তাই সামরিক বাহিনী সভা বন্ধ করতে সাহস পায়নি।
আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কি ভাষণ দেবেন তা নিয়ে আলােচনা হয়। বিশেষজ্ঞরা তার ভাষণ লিখে দেন। বামপন্থী ও ছাত্রলীগের চরমপন্থীরা স্বাধীনতা ঘােষণা দেয়ার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকেচাপ দিচ্ছিলেন। ৭ মার্চ দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা করেন। বঙ্গবন্ধুর জ্বর ছিল । তিনি গভীর চিন্তা করছেন তিনি কী বলবেন। তাঁর দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনীতির আলােকে নিজের চিন্তা থেকে তিনি ৭ মার্চের ভাষণ প্রদান করেন। ৭ কোটি মানুষের নেতা তিনি। তাদের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে জাতির সংকটকালে তিনি যে ভাষণ দেবেন তা জাতিকে আগামী দিনে সঠিক পথ দেখাবে।
৭ মার্চ সকাল হতে ঢাকা ও দূর-দূরান্ত থেকে জনতার স্রোত রমনা রেসকোর্সে মিলিত হয়। জনতার হাতে লাঠি, মাঝির হাতে বৈঠা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ৭ মার্চের জনসভায় পিতার ভাষণ শুনতে যান। দশ লক্ষেরও বেশি জনতা ময়দানে সমবেত হয়েছে । সকল এমএনএ, এমপিএ ও ছাত্রনেতা মঞ্চে উপবিষ্ট। বঙ্গবন্ধু জনসভায় বেলা ২টায় ভাষণ দেবেন। কিন্তু তিনি ২.৪৫ মিনিটের পূর্বে পৌছতে পারেননি। তিনি ১৮ মিনিটে নিমােক্ত ভাষণ দেন :৫
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৯৭১ রেসকোর্সে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ভাষণ :
পৃষ্ঠাঃ ২৫০
“ ভাইয়েরা আমার!
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায় বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
কি অন্যায় করেছিলাম! নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভােট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবাে। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বছর পর্যন্ত আমাদের গােলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে, ৭ জুন আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার দায়িত্বভার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলাে। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরােধ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন প্রথম সপ্তাহের মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবাে। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলােচনা করবাে, এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।
জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলােচনা করলেন, বলে গেলেন যে, আলােচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলােচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম : আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করি। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে
পৃষ্ঠাঃ ২৫১
আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ এক তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেয়া হলাে । ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন আমি বললাম যে আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। পয়ত্রিশ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হলাে। দোষ দেয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলাে আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পর এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন, জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাে । তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাে।
কি পেলাম আমরা? যে আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙালিলা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে। কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি না-কি স্বীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তাে অনেক আগেই বলেছি, কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গােপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার!
পচিশ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি দশ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর দিয়ে, পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যােগদান করতে পারে না। এসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত
পৃষ্ঠাঃ ২৫২
সামরিক বাহিনীর লােকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাছারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অনান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলাের হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘােড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু, সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দফতরগুলাে- ওয়াপদা, কোন কিছু চলবে না। ১৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয় আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লােককে হত্যা করা হয় তোমাদের উপর আমার অনুরােধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলে। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে।
আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব। তােমরা আমার ভাই তােমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তােমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করাে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। আর যে সমস্ত লােক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগ থেকে যতদূর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতাল যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যােগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌছিয়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি- আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলাে। কেউ দেবে না । শােনেন- মনে রাখবেন শত্রুবাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-ননবাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শােনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে
পৃষ্ঠাঃ ২৫৩
যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমার নিউজ না দেয়, কোন বাঙালী টেলিভিশনে যাবেন না, দুই ঘন্টা ব্যাংক খােলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশেত সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালীরা বুঝেশুনে কাজ করবেন।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তােলে এবং তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক৷ মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেয় তা বিশ্বের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত এমন ভাষণ দেয়নি। তার ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে একটি জাতি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। রমনা রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ লােকের উপস্থিতিতে ৭ মার্চ বিকেলে তিনি ১৮ মিনিটের ভাষণ দেন- ভাষণে তিনি বলেন-
আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায় বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লােককে হত্যা করা হয়, তােমাদের ওপর আমার অনুরােধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলার করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে।
মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ও ইনশাল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার। সংগ্রাম। জয় বাংলা।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সংসদ অধিবেশন ডেকেছেন- বঙ্গবন্ধু সংসদে যােগদানের পূর্বে কয়েকটি দাবি মেনে নেয়ার শর্ত দেন :
পৃষ্ঠাঃ ২৫৪
* সামরিক আইন প্রত্যাহার
* সামরিক বাহিনী ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে
* হত্যার তদন্ত করতে হবে
* জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
৮ মার্চ
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রধান ৮ মার্চ থেকে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘােষণা করে।
* যতক্ষণ জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করবে ততক্ষণ অহিংস ও অসহযােগ আন্দোলন চলবে;
* কর প্রদান বন্ধ ।
* সকল অফিস হরতাল পালন করবে;
* সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে;
* রেডিও-টিভি ও সংবাদপত্র অসহযােগ আন্দোলনের সংবাদ পরিবেশন করবে;
* কোন ব্যাংক পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ প্রেরণ করবে না;
* আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রত্যেকটি মহল্লা/গ্রামে, ইউনিয়ন, থানা, জেলায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে;
* ব্যাংক দুঘণ্টা খােলা থাকবে- কর্মচারীদের বেতন প্রদান করবে;
৭ মার্চের ভাষণের পর শেখ মুজিব প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুকুটহীন রাজা হলেন। বেসামরিক প্রশাসন তার নির্দেশে চলছে। আর সকল নির্দেশ নেপথ্যে দিচ্ছেন তাজউদ্দীন আহমদ।
৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ৩ মার্চ থেকে তাদের প্রধান কার্যালয় জহুরুল হক হলে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
৯ মার্চ
ন্যাপ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকার পল্টন ময়দানে ঘােষণা করেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আগামী ২৫ মার্চের মধ্যে এ দাবি মেনে না নিলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে এক হয়ে ১৯৫২ সালের মতাে বাঙালীর স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন।৪
৯ মার্চ জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগের সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ প্রস্তাব অনুমােদন করা হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২৫৫
১০ মার্চ
ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে ‘ক’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেন।
১১ মার্চ
ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ও তার দল কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
১২ মার্চ
অসহযােগ আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে। হাজার হাজার ছাত্র- যুবক সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।
১৩ মার্চ
শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন যে, তিনি ইয়াহিয়া খানের সাথে ঢাকায় আলােচনা করতে সম্মত।
কেন্দ্রীয় সরকারের বাঙালী তথ্য সচিব সৈয়দ আহমদকে বদলি করে তার স্থলে একজন পশ্চিম পাকিস্তানীকে নিয়ােগ দেয়া হয়। সচিব সৈয়দ আহমদের নির্দেশে ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারিত হয়েছিল ।
১৪ মার্চ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার স্বহস্তে গ্রহণ করেন।
১৫ মার্চ
৩৫টি বিধি
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের শাসন কার্য পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি প্রণয়ন করেন এবং বঙ্গবন্ধু তা অনুমােদন করেন।
১৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন প্রণীত নিমের ৩৫টি বিধি ঘােষণা করেন :৫
১. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট, সরকারী ও আধাসরকারী অফিসসমূহ, হাইকোর্ট ও দেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। তবে অতিপ্রয়ােজনীয় ও আন্দোলনের স্বার্থে নির্দিষ্ট অফিস, দপ্তর ও সংস্থা হরতালের আওতাবহির্ভূত থাকবে।
২. বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৩. আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ডেপুটি কমিশনার, সাব ডিভিশনাল অফিসার, আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটির সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়ন কর্মসূচীসহ দায়িত্ব পালন করবে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে।
বন্দরসমূহ’- অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল অব্যাহত থাকবে। তবে সৈন্যদের
পৃষ্ঠাঃ ২৫৬
সহযােগিতা করবে না। বন্দরের কাজ চলবে।
৫. মাল আমদানি – আমদানিকৃত সকল মালামাল খালাস করতে হবে। সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে জমা হবে না।
৬. রেল চলবে- তবে সৈন্য চলাচল বা তাদের রসদ বহন করতে পারবে না।
৭. সড়ক পরিবহন- ইপিআরটিসির বাস চলাচল করবে।
৮. অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের কাজ চলবে ।
৯. ডাক ও টেলিগ্রাফ বাংলাদেশের মধ্যে কাজ করবে বিদেশে মেল সার্ভিস ও টেলিগ্রাফ করা যেতে পারে।
১০. টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে।
১১. টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র এগুলাে চালু থাকবে এবং জনগণের আন্দোলনের সংবাদ প্রচার করতে হবে।
১২. হাসপাতালসমূহ চালু থাকবে।
১৩. বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
১৪. পানি, গ্যাস সরবরাহ চালু থাকবে।
১৫. কয়লা সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
১৬. খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। খাদ্য আমদানি চালু থাকবে।
১৭. কৃষি তৎপরতা ধান ও পাটের বীজ, সার ও কীটনাশক ওষুধ সরবরাহ ও বণ্টন অব্যাহত থাকবে। পাওয়ার পাম্প ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ চালু থাকবে। কৃষি ব্যাংকের কাজ চালু থাকবে।।
১৮. বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণের কাজ অব্যাহত থাকবে ।
১৯. উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ চলবে।
২০. সাহায্য ও পুনর্বাসন— ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজসহ পুনর্বাসনের কাজ চলতে থাকবে।
২১. ইপিআইডিসি, ইস্টার্ন রিফাইনারি ও সকল কারখানার কাজ চলবে ।
২২. সকল সরকারী ও আধা সরকারী সংস্থার কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন নিয়মিতভাবে প্রদান করতে হবে।
২৩. পেনশন নিয়মিতভাবে সরকারী-বেসরকারী অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের দেয়া হবে।
২৪. এজি ও ট্রেজারি বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক কর্মচারী কাজ চালিয়ে যাবে ।
২৫, ব্যাংক সকাল ৯টা হতে ১২টা পর্যন্ত ব্যাংকিং কাজ করবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে লেনদেন চলবে না। বিদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য
পৃষ্ঠাঃ ২৫৭
চলবে। ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হবে।
২৬. স্টেট ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের মতােই কাজ করবে।
২৭. আমদানি ও রপ্তানি কন্ট্রোলার- আমদানি-রফতানি নিশ্চিত করবে এবং কাজ চালিয়ে যাবে।
২৮. ট্রাভেল এজেন্ট ও বিদেশী এয়ারলাইন্স চালু থাকবে।
২৯. ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থা চালু থাকবে।
৩০. পৌরসভার কাজ চালু থাকবে।
৩১. ভূমি রাজস্ব আদায় বন্ধ থাকবে। লবণ ও তামাক কর আদায় হবে না। আয়কর বন্ধ থাকবে— এ ছাড়া প্রাদেশিক কর আদায় হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের একাউন্টে জমা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর আবগারি শুল্ক কর, বিক্রয় কর আদয় করে কেন্দ্রীয় সরকারের খাতে জমা না দিয়ে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল বা ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপােরেশনে জমা দিতে হবে।
৩২. পাকিস্তান বীমা কর্পোরেশন, পােস্টাল লাইফ ইস্যুরেন্স চাল থাকবে।
৩৩. সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সেবাদান নিয়মিতভাবে চলবে।
৩৪. সকল বাড়ির ওপর কালাে পতাকা উড়বে।
৩৫. সংগ্রাম পরিষদগুলাে সর্বস্তরে তাদের কাজ চালু রাখবে এবং এসব নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে যাবে।
নির্দেশাবলী অনুসারে প্রয়ােজনীয় জনসেবামূলক অফিস চালু থাকবে যেমন— হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস প্রভৃতি। সকল সরকারি -বেসরকারি দপ্তর, হাইকোর্টসহ অন্যান্য কোর্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তাজউদ্দীন আহমদ ১৫ মার্চ এক বিবৃতিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। বাংলাদেশ সংকট আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে বিশেষ স্থান দখল করে। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও বিভিন্ন বিদেশী পত্রিকা বাঙালীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।
১৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলােচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সদলবলে ১৫ মার্চ ঢাকা পৌঁছেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে আলােচনা করেন।
১৬ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক
সকাল ১০টায় শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ,
পৃষ্ঠাঃ ২৫৮
এএইচএম কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হােসেনকে প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। তিনি এককভাবে ইয়াহিয়া খানের সাথে ১৫ মিনিট আলোচনা করে সঙ্গীদের নিয়ে চলে আসেন।
১৭ মার্চ
কোন সাহায্য ছাড়া ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনা চলে। বিকেলে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথেপ্রেসিডেন্টের দলের সাথে আলােচনা চলে।
১৮ মার্চ-১৯ মার্চ
ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনা চলে। বিকেলে আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রেসিডেন্টের দলের সাথে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
জয়দেবপুরে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু- ১৯ মার্চ
জয়দেবপুরে ভাওয়ালের রাজবাড়িতে এক ব্যাটালিয়ন বেঙ্গল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল। বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য পাকসেনারা জয়দেবপুর আসে। এ সংবাদ শুনে জয়দেবপুরের মুক্তিযােদ্ধা সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়। তখন পাকবাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে ২০ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং ১৬ জন আহত হয়।
২০ মার্চ
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ণ আলােচনা হয়। উভয় পক্ষের সাহায্যকারীরা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রস্তাব ছিল- প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার করবেন। রাষ্ট্রপতির সাহায্যকারী বিচারপতি কর্নেলিয়াস জানান, ক্ষমতা হস্তান্তর ও সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় সংসদের অনুমতি ও শূন্যতা পূরণের জন্য আইনের প্রয়ােজন হবে। তাজউদ্দীন আহমদ এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দ্বিমত পােষণ করেন। আওয়ামী লীগের আরও প্রস্তাব ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যরা একটি কমিটি গঠন করে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা তাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। তারপর দু’কমিটির প্রস্তাব সংসদে পেশ করা হবে ।
২১ মার্চ
২১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের এক অনির্ধারিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারা কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার থাকবে না – প্রেসিডেন্ট তার উপদেষ্টাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করতে পারেন। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে সম্পূর্ণ ক্ষমতা প্রাদেশিক আইনসভার থাকবে ।
পৃষ্ঠাঃ ২৫৯
২১ মার্চ জেড এ ভুট্টো দল নিয়ে ঢাকা পৌছালে তাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রাখা হয়। ইয়াহিয়া খানের সাথে ভুট্টার আলোচনা চলে।
১৯ মার্চ ডেপুটি চীফ কমান্ডার জেনারেল আবদুল হামিদ ঢাকায় পৌছেন এবং সকল জেনারেলের সাথে গােপন বৈঠক করেন। তিনি ২১ মার্চ চট্টগ্রাম পরিদর্শন করেন। তিনি বাঙালীদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। অন্যদিকে পিআই বিমানে প্রত্যেক দিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসছে। ইয়াহিয়া খান একদিকে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করছেন। অন্যদিকে বাঙালীদের হত্যার নীলনকশা অনুসারে পরিকল্পনা করছেন।
২২ মার্চ
প্রেসিডেন্ট ও তার দল অধ্যাদেশের একটি খসড়া বিকেলে তাজউদ্দীন আহমদ ও ভুট্টোকে প্রদান করে। পিপলস পাটি সংসদের অনুমোদন ব্যতীত অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহারের বিরােধিতা করেন।
২৩ মার্চ প্রতিরােধ দিবস- একটি নতুন পতাকার জন্ম
আওয়ামী লীগ ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস পালন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে তার ধানমণ্ডির বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
২৩ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলােচনা চলে। প্রেসিডেন্টের দল একটি খসড়া তৈরি করেছে- আওয়ামী লীগ তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ২৬ পৃষ্ঠার খসড়া প্রণয়ন করে। উভয় খসড়া নিয়ে আলােচনা হয় ।
আওয়ামী লীগের খসড়ার প্রধান দাবি ছিল-
• ৬ দফার ভিত্তিতে ঘােষণা এবং ১৯৬২ সালের সংবিধান সংশােধন
• সামরিক আইন প্রত্যাহার
• পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের নিকট থাকবে
• পূর্ব পাকিস্তান কর আদায় করবে এবং পৃথক রিজার্ভ থাকবে
• দুটো কনভেনশন বসবে এবং দু’অঞ্চলের জন্য পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে।
প্রেসিডেন্টের দল আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের বিরােধিতা করে ।
২৪ মার্চ
২৪ মার্চ প্রেসিডেন্টের দল ও আওয়ামী লীগের সাথে আলােচনা হয়। এ সভায় আওয়ামী লীগ তাদের খসড়া সংশােধন করে পেশ করে। সংশােধনীতে ছিল সরকার হবে কনফেডারেশন পদ্ধতি ফেডারেশন পদ্ধতি নয়। প্রেসিডেন্টের
পৃষ্ঠাঃ ২৬০
দল আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের বিরােধিতা করে। প্রেসিডেন্টের খসড়া ছিল ফেডারেল পদ্ধতির সরকার। আওয়ামী লীগ কনেলিয়াসের প্রস্তাব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগ ও প্রেসিডেন্টের দল ফল চূড়ান্ত করার জন্য আলোচনায় বসবে কিনা সে সম্পর্কে দ্বিমত রয়েছে।
২৪ মার্চের সভার পর তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে বিবৃতিতে বলেছেন যে, তাদের আর কিছু বলার নেই এবং আর কোন আলােচনারও প্রয়ােজন নেই।
২৫ মার্চ ৪ টায় পরবর্তী সভা বসার কথা ছিল কিন্তু ২৪ মার্চ সভা শেষে জেনারেল পীরজাদা প্রেসিডেন্টের একটি আদেশ নিয়ে আসেন এবং তাতে বলা হয় আওয়ামী লীগ যদি তার দেয়া ফর্মুলা গ্রহণ না করে তাহলে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার বিগ্রেডিয়ার এম আর মজুমদারকে জেনারেল টিক্কা খান এবং জেনারেল মির্জা খান ঢাকায় নিয়ে আসেন।
২৫ মার্চ প্রাক্তন সেনাবাহিনী, আনসার, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক, কর্নেল এমএজি ওসমানী, ব্রিগেডিয়ার আবদুর, মেজর জেনারেল আবদুর মজিদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য অঙ্গীকার করেন। ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী ১১০ জনকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সাথে আওয়ামী লীগের কোন আলােচনা হয়নি। তার দলের সদস্যরা ঢাকা ত্যাগ করে। পাকবাহিনী বাঙালীদের আক্রমণ করার জন্য অপারেশন সার্চ লাইট পরিকল্পনা করে। প্রেসিডেন্ট অপারেশন সার্চ লাইট অনুমােদন করে গােপনে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন। উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার ইয়াহিয়া খানকে বিমানে আরােহণ করতে দেখেন। তিনি সম্মেলনে এ সংবাদ বঙ্গবন্ধুকে জানান।
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সাথে তার বাসভবনে দেখা করতে থাকেন। তারা বঙ্গবন্ধুকে বাসভবন ত্যাগ করার জন্য অনুরােধ জানায়। কিন্তু তিনি কোনক্রমে বাসভবনে ত্যাগ করতে রাজি হননি।৬
পৃষ্ঠাঃ ২৬১
১০
২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণ
বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা
বাঙালী জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক লাহাের প্রস্তাবে ভারতের পূর্বাঞ্চলের আসাম -বাংলা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের সােহরাওয়াদী-আবুল হাশিম-শরৎচন্দ্র বসুর বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পথ অতিক্রম করে বাঙালী জাতি ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানীরা বাঙালীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না৷ তাই তিনি ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনের পর তাজউদ্দীনের সাথে আলােচনা করে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তিনি একটি রাজনৈতিক, আর একটি সামরিক কমিটি গঠন করেন।
রাজনৈতিক কমিটি
এই কমিটি হাইকমান্ড নামে পরিচিত ছিল। এ কমিটিতে ছিলেন :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান -রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক
তাজউদ্দীন আহমদ – নির্বাহী প্রধান, প্রতিরক্ষা
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – আইন ও সংগ্রাম পরিষদ
এম মনসুর আলী – অর্থ
এএইচএম কামরুজ্জামান – পররাষ্ট্র
খন্দকার মােশতাক আহমদ – সমন্বয়কারী
ড. কামাল হােসেন – উপদেষ্টা
প্রফেসর রেহমান সােবহান – উপদেষ্টা
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম – উপদেষ্টা
পৃষ্ঠাঃ ২৬২
সামরিক কমিটি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – সর্বাধিনায়ক
তাজউদ্দীন আহমদ – প্রতিরক্ষা
কর্নেল এমএজি ওসমানী – প্রধান সেনাপতি
মেঃ জেনারেল মজিদ – প্রাক্তন সৈনিক দল গঠন
লেঃ কর্নেল এমআর চৌধুরী – ফিল্ড কমান্ডার
মেজর খালেদ মােশাররফ – অপারেশন কমান্ডার
অপারেশন সার্চ লাইট ও গণহত্যা
১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান একদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মিথ্যা অভিনয় করছেন; অন্যদিকে জেনারেলদের নিয়ে বাঙালীর ওপর আক্রমণ করার ষড়যন্ত্র করেন। তার নির্দেশে ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ মেজর জেনারেল খাদিম রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশন ব্লিজ (BLITZ) পরিবর্তন করে অপারেশন সার্চ লাইট তৈরি করেন । ২০ মার্চ ফ্লাগ হাউজের সভায় জেনারেল হামিদ এবং লেঃ জেনারেল টিক্কা খান অপারেশন সার্চ লাইট অনুমােদন করেন।১
অপারেশন সার্চ লাইটের দুটো হেডকোয়ার্টার ছিল- ব্রিগেডিয়ার আরবারের অধীনে ৫৭ ব্রিগেডসহ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অপারেশন-১ ঢাকা। প্রদেশের অবশিষ্ট এলাকার দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম। সমগ্র অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন লেঃ জেনারেল টিক্কা খান।
অপারেশনের দায়িত্ব এলাকা
২২ বেলুচ পিলখানায় ৫০০০ ইপিআর নিরস্ত্র করা;
৩২ পাঞ্জাব রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ১০ হাজার পুলিশকে নিরস্ত্র করা;
২২ বেলুচ ও ৩২ পাঞ্জাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল
ধ্বংস করা;
১০৭ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর, পুলিশ নিরস্ত্র করা;
২৫ বেলুচ, ২৪ ফিল্ড
রেজিমেন্ট-যশাের
২৫ পাঞ্জাব-রাজশাহী ইপিআর, পুলিশ নিরস্ত্র করা;
২৩ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার সৈয়দপুর;
পৃষ্ঠাঃ ২৬৩
২৯ ক্যাটাগরি-রংপুর, সৈয়দপুর ইস্ট বেঙ্গল ও ইপিআর নিরস্ত্র করা;
৪৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট-কুমিল্লা ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর নিরস্ত্র করা,
২০ বালুচ, ৩১ পাঞ্জাব ইবিআর, ৮ ইস্ট গেল, ইপিআর পুলিশ নিরস্ত্র করা;
২৪ ফন্টিয়ারস- চট্টগ্রাম
নিমােক্ত রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ ছিল :
১. শেখ মুজিবুর রহমান
২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম
৩. তাজউদ্দীন আহমদ
৪. কর্নেল এমএজি ওসমানী
৫, সিরাজুল আলম খান
৬. আবদুল মান্নান
৭. আতাউর রহমান খান
৮. অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ
৯. অলি আহাদ
১০. মতিয়া চৌধুরী
১১. ব্যারিস্টার মওদুদ
১২. ফয়েজুল হক
১৩. তােফায়েল আহমদ
১৪. নূর-এ-আলম সিদ্দিক
১৫. আবদুর রউফ
১৫. আবদুল কুদুস মাখন ও অন্যান্য
রাত ১১টায় তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হােসেন, ব্যারিস্টার আমীর- উল-ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাত করে তাকে নিরাপদ স্থানে যেতে বলেন। কিন্তু তিনি বলেন, তাকে না পেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহর ধ্বংস করবে। তাদের নিরাপদ স্থানে থেকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং জনগণকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে এবং জেনারেল টিক্কা
পৃষ্ঠাঃ ২৬৪
খানের নেতৃত্বে পাকবাহিনী বাঙালীদের আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে। পাকবাহিনীর আক্রমণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত ১২ টা ৩০ মিনিটে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।
Declaration of War of Independence
Pak Army suddenly attacked EPR base at Pilkhana, Rajarbag Police Line and killing citizens stop street battle are going on in every street of Dhaka-Chittagong stop I appeal to the nations of the world for help stop our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland stop I apeal and order you all in the name of almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country stop ask Police. FPR Bengal regiment and Ansar to standby you and to fight stop no compromise stop Victory is ours stop drive out the last enemy from the holy soil of motherland stop convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom stop niay Allah bless you stop Joy Bangla stop-Sheikh Mujibur Rahman stop২
“পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আলাহর নামে আপনাদের কাছে আমাদের আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান । আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপােস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লােকদের কাছে এ সংবাদ পৌছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।”
একই রাতে বঙ্গবন্ধু আরও একটি স্বাধীনতার ঘােষণা বার্তা ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। দ্বিতীয় বার্তাটি নিম্নে উদ্ধৃত হলাে—
“This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to to resist the army
পৃষ্ঠাঃ ২৬৫
of occupation to the last. Your fight must go on untill the last solidier of Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and dinal Victory is achieved.”৩
” এ আমার শেষ বাণী। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তােমরা যে যেখানে থাকো; তােমাদের কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীর প্রতিরােধ করাে। বাংলাদেশ হতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শেষ ব্যক্তিকে না তাড়ানাে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।”
কয়েক মিনিটের মধ্যে আর্মির গাড়ি বাসভবন ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রবল গুলিবর্ষণের মধ্যে শেখ মুজিব নিচে চলে আসেন এবং গুলি বন্ধ করতে বলেন। সৈন্যরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে এক কর্নেল তাকে রক্ষা করেন। তিনি উপরে গিয়ে প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র নেন এবং স্ত্রী-পুত্রদের নিকট থেকে রাত ১.৩০ মিনিটে বিদায় নেন। শেখ মুজিব মুখে কথা বলেননি। কিন্তু মনে মনে সিংহের মতাে গর্জন করেছিলেন। পাক সেনারা তাঁকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট চলে যায়। বঙ্গবন্ধুর বিদায়ের পর বেগম ফজিলাতুন্নেসা শেখ জামাল, শেখ রাসেলকে নিয়ে পাশের বাসায় আশ্রয় নেন। তারপর পাক সেনারা বাসায় প্রবেশ করে মালামাল লুট করে।
শেখ মুজিব কিভাবে গ্রেফতার হলেন সে সম্পর্কে পাকিস্তানী মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে লিখেছেন :
“When the first shot had been fired the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through and wave length close to that of official Pakistan Radio. In what must have been, and sounded like a pre-recorded message. The Sheikh proclaimed East Pakistan the Peoples Republic of Bangladesh.”৪
যখন প্রথম গুলিবর্ষণ করা হয় তখন রেডিও পাকিস্তানে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবের কষ্ঠ শােনা যায়। মনে হলাে পূর্বে রেকর্ডকৃত বাণী । শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘােষণা করছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের ঢাকা ত্যাগ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১টায় তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হােসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম বহঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে শেষ সাক্ষাত করেন। বঙ্গবন্ধু তাদের নিরাপদ স্থানে থেকে প্রতিরােধ করার নির্দেশ দেন। তিনি বাসভবন ছেড়ে যাবেন না। তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হােসেন
পৃষ্ঠাঃ ২৬৬
ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তারা নিজ নিজ বাসভবনে থাকবেন না। পরের দিন তারা নিরাপদ স্থানে চলে যাবেন। তাজউদ্দীন আহমদ বাসায় ফিরে আসেন। কিছুক্ষণ পর কামাল হােসেন ও আমীর-উল-ইসলাম তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে আসেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাজউদ্দীন একটি শার্ট এবং একটি রাইফেল নিয়ে তাদের সাথে চলে যান। স্ত্রী জোহরাকে বললেন, “তােমরা যা করবে করাে। আমি চলে গেলাম।” তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম হয়েছে একটি জাতিকে স্বাধীন করার জন্য। তাই পারিবারিক বন্ধন তাকে দুর্বল করতে পারেনি- তিনি স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সাত কোটি জনতার সাথে রেখে গেলেন। ঢাকার এক বাসায় তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম আশ্রয় নেন। কথা ছিল পরের দিন সকালে ড কামান হোসেন তাদের সাথে মিলিত হবেন। কিন্তু তিনি আটকে যান এবং পরে সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে।
তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে পাকসেনাদের আক্রমণ
তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ঢাকায় আটকা পড়ে যান। পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যা চলে সারাদিন। তাজউদ্দীন আহমদ বাসা ত্যাগ করার কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনী তার বাসা আক্রমণ করে। বাড়ির সামনে আসার আগেই জোহরা তাজউদ্দীন দোতলায় অবাঙালী পরিবারের সাথে আশ্রয় নেন। তারা তাজউদ্দীন আহমদকে না পেয়ে তার স্ত্রীর খােজ করে। উপরে পাকবাহিনী উঠে যায় এবং ভাড়াটিয়া অবাঙালী আতিয়া বেগম ও জোহরা তাজউদ্দীনকে স্টেনগান তাক করে এবং জিজ্ঞেস করে মিসেস তাজউদ্দীন কে উপস্থিত বুদ্ধিতে জোহরা তাজউদ্দীন ধরা পড়েননি। পাকসেনারা তাজউদ্দীন আহমদের ৩ আত্মীয়কে ধরে নিয়ে যায় এবং ঘরের জানালা ভাংচুর করে। তাজউদ্দীন আহমদের দোতলার ভাড়াটে আজিজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বােমা তৈরির কাজ করছিলেন। ২৬ মার্চ ভােরে বােমা ফেটে প্রচণ্ড শব্দ হয়। মিসেস তাজউদ্দীন সাথে সাথে ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু তারা ভয় পেয়ে যায়- ২৭ মার্চ জোহরা তাজউদ্দীন তার শিশুপুত্র ও মেয়েদের নিয়ে আশ্রয়ের জন্য ঘুরছেন- কেউ আশ্রয় দিতে সাহস পায়নি। ধানমণ্ডির ১৩ নম্বর রােডের এক গৃহস্বামী তাদের বাসা থেকে বের করে দেন। এক বছরের পুত্র সােহেল ও ৫ বছরের মেয়েকে বুকে নিয়ে ২৭ মার্চ সারা রাত ইটের পাঁজার ফাকে কাটান । পরের দিন অন্য জায়গায় আশ্রয় নেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৬৭
১১
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন
তাজউদ্দীন আহমদের ভারত গমন
“ছেলেমেয়ে নিয়ে তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও।
কবে দেখা হবে জানি না… মুক্তির পর”
-তাজউদ্দীন আহমদ
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলােচনা
তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ভারত গমনের লক্ষ্যে ২৭ মার্চ সকালে কার্ফু তুলে নেয়ার সাথে সাথে ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা পদ্মা নদী পার হয়ে মাগুরা হয়ে ২৮ মার্চ ঝিনাইদহ পৌছেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী, সিএসপি ও মেজর ওসমান চৌধুরীর সহায়তায় ২৮ মার্চ রাতে মেহেরপুর দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন। বিএসএফের আঞ্চলিক প্রধান গােলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এমএনএকে সংবর্ধনা জানান। বিএসএফ প্রধান ছিলেন রুস্তামজী। কলকাতায় গােলক মজুমদার ও রুস্তামজীর সাথে তাজউদ্দীনের বৈঠক হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল- ইসলাম ভারত সরকারের প্রতিনিধি জেনারেল নরেন্দ্র সিংহের সাথে ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ কলকাতায় সাক্ষাত করেন। গােলক মজুমদার ও বিএসএফ-এর মহাপরিচালক রুস্তামজী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। বিএসএফ-এর মহাপরিচালক কে এফ রুস্তামজী ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠজন। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিনিধি স্বরাজ চট্টোপাধ্যায় তাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলাম দিল্লীতে রুস্তামজী ও গােলক মজুমদারের সাথে দেখা করেন। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে জিজ্ঞেস করলেন- শেখ মুজিব কেমন আছেন। তিনি কি বেঁচে আছেন? উত্তরে
পৃষ্ঠাঃ ২৬৮
তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন ২৫ মার্চের পর তার সাথে দেখা হয়নি। আশ্রয় , খাদ্য ও অস্ত্র প্রয়ােজন।” ৫ এপ্রিল পুনরায় তিনি ইন্দিরা গান্ধির সাথে আলােচনা করেন এবং নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়: ১
১. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ভারতে অবস্থানের অনুমতি দেয়া হয়,
২. সরকার পরিচালনায় সহায়তা প্রদান;
৩. মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা;
৪. বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়;
৫. বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা;
৬. আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্যদের সাথে যােগাযােগের জন্য একটি বিমান প্রদান;
৭. মুক্তিযােদ্ধাদের সংবাদ প্রচারের জন্য একটি বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা;
৮. মুক্তিযােদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ।
স্বাধীনতা ঘােষণাপত্র
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রেহমান সােবহান ও ড. আমিনুর রহমান দিল্লীতে ছিলেন। তারা ২৫ মার্চের পর ঢাকা ত্যাগ করে ভারতে চলে আসেন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল-ইসলাম কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম একই স্থানে থাকতেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণার আলােকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ খসড়া দেখে তা অনুমােদন করেন। তারা পরামর্শ করে খসড়া ঘােষণা কলকাতা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরীকে দেখান। তিনি কোন পরিবর্তন না করে খসড়ার সাথে একমত পােষণ করেন।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনার পর তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এসপিদের সাথে এক অধিবেশনে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং তাজউদ্দীন আহমদ এমএনকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়ােগ করা হয় । এম মনসুর
পৃষ্ঠাঃ ২৬৯
আলী, খন্দকার মােশতাক আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামানকে মন্ত্রীসভার সদস্য নিয়ােগ করা হয়। ১১ এপ্রিল কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিয়ােগ করা হয়।
দিল্লিতে অবস্থানকালে তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ রেকর্ড করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল রাত ১০টায় জলপাইগুড়ির শিলিগুড়ির এক জঙ্গল থেকে তার রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করা হয়। ১১ এপ্রিল উক্ত ভাষণ কলকাতা ও স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়। ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার সংবাদে বাঙালী আনন্দ উৎসব করে। দিশেহারা পর্যুদস্তবাঙালী জাতি তাজউদ্দীনের ভাষণে উজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত হয়। পূর্ণ উদ্যমে তারা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ বেতার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা গঠনের ঘােষণা দেন। ১১ এপ্রিলের ভাষণ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলাে :২
বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশ্যে : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে
গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী
তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ
(স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে এপ্রিল ১১, ১৯৭১ তারিখে প্রচারিত)
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাই-বােনেরা
“বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের যারা বাংলাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালীর মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলােলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নব-হত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরােধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন । আপনার সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম । পশ্চিম-পাকিস্তানী হানাদা দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে
আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল।
পৃষ্ঠাঃ ২৭০
প্রত্যেকদিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে। বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে।
আপনাদের অদম্য সাহস ও মনােবল, যা দিয়ে আপনারা রুখে দাড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুদের বিরুদ্ধে, তার মধ্য দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্ৰাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালি জাতি জন্ম নিল । পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধুবাৎসল্যে, মায়া ও হাসিকান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্য্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লী বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম, যুদ্ধ রণডঙ্কা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজ?
আমাদের মানবিক মূল্যবােধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি যে, আমরা তিতুমীর-সূর্যসেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্য যেমন আমরা জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশী শত্রু-সৈন্যদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনােবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হােক না কেন, পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়তাে কিছুদিনের জন্য হলেও পিছিয়ে যেত । আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বােমারু বিমানের মােকাবেলা করেছেন এবং আপনাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়ে রুখে দাড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তারা বাইরের জগতকে জানাচ্ছেন।
আজ প্রতিরােধ আন্দোলনের কথা গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌছে গেছে।
হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর বীর বাঙালী যােদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরােভাগে রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যােগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্র ও গোলা-বারুদ দিয়ে বাংলার এ মুক্তিবাহিনীকে শক্রদের মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সাগরপারের বাঙালী ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদেরকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৭১
সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মোশাররফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সঙ্গে মোকাবেলা করেছেন এবং শত্রু সেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী শিগগিরই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সঙ্কল্প গ্রহণ করেছেন।
চট্টগ্রাম ও নােয়াখালী অঞ্চল সমর পরিচালনার ভার পরেছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরােধ ব্যূহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাইবােনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুকে মােকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরােধ স্ট্যালিনগ্রাদের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরােধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নােয়াখালী জেলাকে মুক্ত এলাকা বলে ঘােষণা করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মেজর শফিউল্লাহর ওপর। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতিমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযােগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছােট ছােট শিবিরগুলােকে সমূলে নিপাত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ইপিআরের বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশাের জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা এখন যশাের ক্যান্টনমেন্ট ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের ওপর ভার দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশাল- পটুয়াখালী।
উত্তরবঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীক শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে ও মেজর নওয়াজেশ রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ অবরােধ করে বিব্ৰত করে তুলেছেন। দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়া জেলাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া জেলার বাড়ি অংশ এখন মুক্ত।
স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ভবিষ্যতে আরও নতুন
পৃষ্ঠাঃ ২৭২
সাফল্যের দিশারী প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিচ্ছে তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর একই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শত্রুর কেড়ে নেয়া হাতিয়ার । এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি বেতার কেন্দ্র গড়ে তােলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়।
আপাতত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ -পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায়। পূর্বাঞ্চলের সরকারী কাজ পরিচালনার জন্য সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে।
আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কুটনীতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তারা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যারা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে নিষেধ উচিয়ে দাড়িয়েছে তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেন।
আমরা যদিও বিদেশ থেকে পাঠানাে ত্রাণ-সামগ্রীর জন্য কৃতজ্ঞ, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের দিনে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ত্রাণের বাণী বয়ে আনতে পারে উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত হাতিয়ার, যা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারে এবং রক্ষা করতে পারে তারও তার প্রিয় পরিজনের জান, মাল আর সম্ভ্রম।
বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রগারের আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙালীর কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার এক পৈশাচিক উন্মত্ততায় মত্ত। আমরা সেইসব শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয় । এ সমস্ত অস্ত্র দেয়া হয়েছিল বিদেশী শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য বাংলার নিস্পাপ শিশুদেরকে ও নিরপরাধ নর-নারীকে নির্বিচারে হত্যা করার জন্য নিশ্চয়ই এ অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের কৃষক- শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে যে অস্ত্র
পৃষ্ঠাঃ ২৭৩
কেনা হয়েছে এবং যাদের টাকায় ইয়াহিয়া খানের এই দদস্যুবাহিনী পুষ্ট, আজ তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা অস্ত্র সরবরাহকারী শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, শুধু অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলেই চলবে না, যে অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সে অস্ত্র দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস বন্ধ করতে হবে।
পৃথিবীর জনমতকে উপেক্ষা করে আজও ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুরা বাংলাদেশের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা সমস্ত দেধের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি এবং যারা জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এসেছেন ও নিজেদের দেশেও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তারা আমাদের এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবে না, এ বিশ্বাস আমারা রাখি।
বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে- হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানবজাতির শাশ্বত অধিকার। বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্য যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্য নয়। পথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিবারগােষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার।
আমাদের বাঙালী ভাইয়েরা, আপনারা পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে থাকুন না কেন, আজকে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে আমাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিন, যাতে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা অতি সত্বর সে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার মাতভূমিকে রক্ষা করবার কাজে।
ইতােমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাদের হাতে আজও আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি তাদের আহ্বান জানাচ্ছি, যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিন । আমাদের স্থির বিশ্বাস যে, শিগগিরই আপনাদের হাতে আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারব। ইতােমধ্যে প্রত্যেকে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নেয়ার জন্য নিকটবর্তী সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যােগাযােগ করুন। যাদের হাতে
পৃষ্ঠাঃ ২৭৪
আধুনিক অস্ত্র নেই তাদেরও এই জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে। শত্রুর ছত্রী ও গুপ্তবাহিনীকে অকেজো করে দেবার কাজে আপনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখ সমরে কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরও নানাভাবে আপনার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে হয়রান ও কাবু করতে পারেন। নদীপথে শত্রু যাতে না আসতে পারে তাত সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা আপনাকেই গ্রহণ করতে হবে ও সবদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। নদী পথে সমস্ত ফেরি, লঞ্চ ও ফ্ল্যাট অকেজো করে দিতে হবে। এ সমস্ত দায়ত্ব পালন করার জন্য স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছােট ছােট দলে সংগঠিত হতে হবে। এর জন্য আপনার এলাকার সমর পরিচালকের সাথে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে যােগাযােগ করতে হবে এবং তার আদেশ ও নির্দেশ মেনে চলতে হবে।
যুদ্ধে অংশ নেয়া ছাড়াও বাংলাদেশকে সব দিক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্বকেও অবহেলা করলে চলবে না। শাসনকার্যে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বাঙালী অফিসারদের মধ্যে যারা এখনও আমাদের সাথে যােগ দিতে পারেননি তারা যে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা তাদের মুক্ত এলাকা চলে আসতে আহবান জানাচ্ছি। অনুরূপভাবে আমরা আহবান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, সংবাদপত্রসেবী, বেতার শিল্পী গায়ক ও চারুশিল্পীদের, তারা যেন আনবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ- তার জন্য বহু পারদর্শীর প্রয়ােজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়ােগ করবার সুযােগ পাবেন। আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে বাংলাদেশের এই সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে শামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক প্রতিরােধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরাচরিত রাজনৈতিক গণ্ডির ঊর্ধ্বে রাখবার জন্যে আমরা আবেদন জানাচ্ছি।
হানাদার শত্রুবাহিনীর সাথে কোন প্রকার সহযােগিতা করা বা সংস্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোন মীর জাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রু সৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গাের থেকে গাত্রোত্থান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘূণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যদি এই সুযােগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাংলাদেশের স্বার্থবিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশবাসীর রােষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ২৭৫
দেশের ওপর এটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। হয়তাে কোথাও নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা যেতে পারে।
আমাদের উচিত হবে যতদূর সম্ভব ব্যয়সঙ্কোচন করা এবং জিনিসপত্র কম ব্যবহার করা। দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিশেষ অনুরোধ তারা যেন মজুতদারি ও কালােবাজারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জিনিসপত্রের দাম যাতে সাধারণ লােকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে না যায় তার দিকে দৃষ্টি রাখেন। এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহের কারন নেই। আপনারা ইতােমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমর সজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নিচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালীর ভবিষ্যৎ আশা ভরসা। আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালীরা তারা বুটের নিচে নিষ্পষণ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা তাদের মারমুখী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি এবং তাদেরকে যে প্রতিনিয়ত হটিয়ে দিচ্ছি এতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ- ঢাকার সাথে আজ তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। উড়ােজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ওদের জ্বালানি সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে। ইয়াহিয়ার উড়ােজাহাজ আর বেশিদিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝখানে আজকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে মতাে। বাংলাদেশের আকাশে শিগগিরই ঝড়ের মাতন শুরু হচ্ছে। ওরা জানে ওরা হানাদার । ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের দ্রুকুটি ও ঘৃণা। ওরা ভীত, ওরা সন্ত্রস্ত, মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরােয়ানা নিয়ে হাজির । তাই ওরা উন্মাদের মতাে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে।
পৃথিবী আজ সজাগ হয়েছে। পৃথিবীর এই অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানুষ যেখানে ওরা এ ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। বিশ্বের মানুষ আজ আর ইসলামাবাদ সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মিথ্যা যুক্তি আর অজুহাত স্বীকার করে নিতে রাজি নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার এই অন্যায় ও অমানবিক যুদ্ধ আর ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন। অপরপক্ষে যে সমস্ত সাংবাদিক আমাদের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন
পৃষ্ঠাঃ ২৭৬
করছেন তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের এই বীর প্রতিরােধ যুদ্ধের খবর আর বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া সরকারের ধ্বংস ও তাণ্ডবলীলার চাক্ষুস প্রমাণ।
ইতােমধ্যে সােভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাগেদর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সােভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করবার আহ্বান জানিয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে । যে সমস্ত পাকিস্তানী বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানি সংগ্রহ করছিল, তাদেরকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ।
যদিও কোন কোন দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন, তবু এ কথা এখন দিব্যলােকের মতাে সত্য হয়ে গেছে যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেবার ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগনিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাঙালী ভাইদের বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরােধ জানিয়েছি। পথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশের সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি।
আমাদের যে সমস্ত ভাইবােন শক্রকবলিত শহরগুলােকে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাদেরকে আমরা এক মুহুর্তের জন্য ভুলতে পারি না। যারা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাদের জন্য রইল আমাদের আমন্ত্রণ। যাদের পক্ষে নেহাতই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে শহীদ ভাইবােনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইনশাল্লাহ, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব-
পৃষ্ঠাঃ ২৭৭
পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সঙ্কল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়ত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে গেলে চলবে না যে এ গণযুদ্ধ এবং সত্যিকারেএ অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে, এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানষের যুদ্ধ, খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্নপ্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীনবাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসু হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শােষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়ােজিত হােক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালী ভাইবােনের সম্মিলিত মনােবল ও অসীম শক্তি। যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, গণমানসের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তর লেখা হােক ‘জয় বাংলা’, ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’।”
জাতির এই সঙ্কটময় মুহূর্তে তাজউদ্দীন আহমদ জাতিকে নতুন প্রাণ দিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ সময়ােচিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে তথাকথিত স্বাধীনতার ঘােষক কোথায় ভেসে যেতেন। তাজউদ্দীন আহমদ নিশ্চয়ই ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয় তা শােনেননি। অবশ্য পরে তিনি তার ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত হন এবং তাকে প্রশংসা করেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে আগরতলা রওনা দেন। ১১ এপ্রিল ময়মনসিংহ সীমান্ত থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এমএনএকে নিয়ে আগরতলা পৌছেন। ১১ এপ্রিল আগরতলা সার্কিট হাউজে এমএনএ ও এমপিদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কর্নেল এমএজি ওসমানী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, আবদুস সামাদ আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকার গঠনসহ যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা অনুমােদিত হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২৭৮
আগরতলায় সংসদীয় দলের প্রথম সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমমূহ:
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল রাতে আগরতলা সার্কিট হাউজে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১. বাংলাদেশ সরকারের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হবে।
২. সংসদীয় পদ্ধতির সরকার। রাষ্ট্রপ্রধান হবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
৩. ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করা হয়।
৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সনদ ১০ এপ্রিল ১৯৭১।
৫. অধ্যাপক ইউসুফ আলী মন্ত্রিসভাকে শপথ পাঠ করাবেন।
৬. ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল আইন বলবতকরণ আদেশ জারি আইনে পরিণত করা।
৭. ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ অনুমোদন।
৮. মুক্তিফৌজকে মুক্তিবাহিনী নামকরণ ।
৯. ৫ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে আলােচ্য বিষয়সমূহ অনুমােদন।
১০. কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়ােগের অনুমােদন।
১১. বাংলাদেশের রাজধানীর নামকরণ মুজিবনগর।
১২. বাংলাদেশকে ৫টি সেক্টরে বিভক্ত করা ও মুক্তিযুদ্ধে নিয়ােজিত কমান্ডার নিয়ােগ।
১৩. ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে মন্ত্রিপরিষদের সাক্ষাত করার সুপারিশ।
১৪. একটি সমর পরিষদ গঠনের অনুমােদন।।
১৫. বিদেশে জনমত সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি প্রেরণ।
১৬. অস্ত্র কেনার জন্য দেশ-বিদেশে প্রচেষ্টা চালানাে।
১৭. যুদ্ধের অস্ত্র, বস্ত্র ও রসদ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মাধ্যমে গেরিলাদের মধ্যে সরবরাহ করা হবে ।
১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘােষণা বাংলাদেশ বেতার থেকে ঘােষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়। কিন্তু ১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়ায় স্থান ও তারিখ পরিবর্তন করতে হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২৭৯
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন প্রসঙ্গে ভারতের বিএসএফ- এর মহাপরিচালক কে এফ রস্তামজী, উপমহাপরিচালক গােলক মজুমদার এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের ভাষ্য
কে এফ রুস্তামজী
আমি কে এফ, রুস্তামর্জী। আমার বর্তমান বয়স ৮২ বছর। আমি আইপি ক্যাডারের একজন পুলিশ কর্মকর্তা। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। ১৯৭১ সনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক ছিলাম।
বিএসএফ-এর মহাপরিদর্শক গােলক মজুমদার জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং জনাব আমীর-উল ইসলামকে কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে নিয়ে আসেন। আমি দিল্লী থেকে এসে পৌছে এই বিমানবন্দরেই তাদের অঅভ্যর্থনা জানাই। সেখানেই তাঁদের সাথে আমার প্রথম দেখা। তাদের দুজনকেই খুব পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। কারণ বহু অসুবিধার মধ্য দিয়ে তাঁদের অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল এবং সাথে নিজস্ব কিছুই ছিল না।
‘৭১ সালের ৩১ মার্চ রাতে কলকাতার ‘আসাম ভবনে’ জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং জনাব আমীর-উল ইসলাম আমার অতিথি হিসেবে ছিলেন। এর পরের কয়েক দিনও আমরা সর্বক্ষণ একসাথে ছিলাম এবং দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেছি। তারা তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি, চট্টগ্রামের বিদ্রোহ এবং চট্টগ্রাম বেতার থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী আর্মি হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তাঁদের বর্ণনায় পূর্ব পাকিস্তানের ভয়াবহ নৃশংসতার পরিষ্কার চিত্র ফুটে ওঠে। প্রথম দিন থেকেই আমি এবং তাজউদ্দীন আহমদ একে অপরের বন্ধু হয়ে পড়ি। তাঁর দেশপ্রেম, প্রতিজ্ঞা এবং ভারতের ওপর বিশ্বাসের জন্য আমি তার প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। জনাব তাজউদ্দীনের যে জিনিসটি আমাকে সবচাইতে প্রথম মুগ্ধ করে সেটি হলাে তাঁর নিষ্ঠা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের সম্পূর্ণ উৎসর্গকৃত একটি মন।
তিনি ঢাকার রাজনীতি, তাঁর দলের দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা নিয়ে আলােচনা করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার জন্য কী কী সাহায্য প্রয়ােজন তা নিয়েও বিস্তারিত আলােচনা হয়। তাঁর সাথে আমার আলোচনার বিষয়বস্তু আমি দিল্লীকে অবহিত করেছিলাম এবং সেই সঙ্গে তাঁর ওপর আমার গভীর বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের কথাও জানিয়েছিলাম। আমরা যারা বিএসএফে ছিলাম তাদের সাথে শুরু থেকেই জনাব তাজউদ্দীন একটা দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তােলেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৮০
তিনি ছিলেন আগাগােড়া একজন সৎ মানুষ। তার স্বভাবসুলভ বিনয়ের মাঝে সততার আগুন জ্বলজ্বল করত। স্বাধীনতা যে আসবেই এ বিষয়ে তিনি ছিলেন স্থির বিশ্বাসী। জনগণের অ্যুত্থান এতই শক্তিশালী যে, কোন সামরিক স্বৈরাচারের পক্ষেই তা উপলব্ধি বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না- তার এই আত্মবিশ্বাস আমাকে সবচাইতে বেশি নাড়া দিয়েছিল। দিল্লীর সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ভারত ও বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সাহায্যের ঘােষণা অবশ্যই দেবে, এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম।
আমার মনে আছে,মিসেস গান্ধীর সাথে আলোচনার পর জনাব তাজউদ্দীন সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। দিল্লীতে তাঁর এই আলােচনা, ব্যক্তিগত উপস্থিতি, যোগাযাগের একটা কুটনৈতিক গুরুত্ব ছিল। দেশের প্রতি ওঁর নিষ্ঠা ও গভীর আগ্রহ ভারতীয় নেতাদের মনে এমন একটা ছাপ রেখেছিল যা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্ণ সহযােগিতা প্রাপ্তিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
বাংলাদেশ সরকার গঠনে জনাব তাজউদ্দীন প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতায় তাঁর কার্যালয় স্থাপন করেন এবং সেখানে সমবেত সামরিক এবং সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে নিয়মিত আলােচনা-বৈঠক করতেন। এমন লােক প্রচুর আছেন যারা তার কাছে সামান্য মতপার্থক্যের বিষয় নিয়েও হাজির হয়েছেন এবং ফিরেছেন সম্পূর্ণ সন্তুষ্টি নিয়ে। কেননা তিনি সমস্যাগুলাে বুঝতেন এবং যৌক্তিক সমাধান দিতে পারতেন। মুক্তিসংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে এই বিষয়টির গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। আসলে তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন যারা গণতান্ত্রিকভাবে মতভেদ দূর করতে চান। জনাব তাজউদ্দীন ছিলেন নিজ আদর্শের জন্য শহীদ হতে প্রস্তুত। এমন একজন নির্মল চরিত্রের সৎ রাজনীতিবিদ। বিভিন্ন সময়ে মিসেস গান্ধীর সাথে জনাব তাজউদ্দীন ও তার সংগ্রাম নিয়ে আমার আলােচনা হয়েছে। আমি প্রতিবারই লক্ষ্য করেছি যে, জনাব তাজউদ্দীনের ওপর মিসেস গান্ধীর ছিল গভীর বিশ্বাস।
১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর তিনি যখন প্রবাস থেকে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাচ্ছেন তখন কলকাতা বিমানবন্দরে আবেগঘন বিদায় মুহূর্তে আমি তাকে বলেছিলাম, আশা করি বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব চিরদিন বজায় থাকবে। তিনি দুই সার্বভৌম দেশের মর্যাদায় বন্ধুত্ব অক্ষুন্ন থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। এতে আমার মনে আশা জেগেছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা আমাদের দুই দেশের সমস্যা নিয়ে ভাববেন এবং বন্ধুত্ব দৃঢ় হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর যখনই আমি বিমানে আসাম বা ত্রিপুরার
পৃষ্ঠাঃ ২৮১
পথে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে যেতাম, আমি তাকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠাতাম। তিনিও সাথে সাথেই আমার সে বার্তার জবাব দিতেন।
তাজউদ্দীন যে দিন মৃত্যুবরণ করলেন সেই দিনটি আমার জীবনের অঅন্যতম শােকাবহ দুঃখের দিন।” [৫.১.১৯৯৮]
কে এফ রুস্তামজী ২০০৪ সালের ২২ অক্টোবর মুম্বাই শহরে মৃত্যুবরণ করেন।৩
গোলক মজুমদার
“তখন পূর্ব পাকিস্তান মানে রাজনীতির এক উত্তাল তরঙ্গের দেশ। নির্বাচনে সব কটি প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানাে সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভুট্টো সাহেবের পরামর্শে আওয়ামী লীগকে সমগ্র পাকিস্তানের বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মেনে নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করতে লাগলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং তারই কোনাে সহকর্মীকে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের কল্পনার অতীত। তাই শুরু হলো নানা রকম টালবাহানা এবং নির্বাচনী রায়কে এড়িয়ে যাওয়ার কূট অভিসন্ধি। সমস্ত আলাপ-আলােচনায় শেখ মুজিব এবং তাঁর সহযােগীদের একটিমাত্র দাবি- নির্বাচনী রায়কে কার্যকর করতে হবে।
পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী নেতৃবৃন্দকে এবং সমস্তবাঙালী জনসাধারণকে বরাবরই অত্যন্ত অবজ্ঞার চোখে দেখেছেন। বাঙালী জনসমাজ তাদের অত্যাচারে জর্জরিত। বাণিজ্য, শিল্প, অর্থনীতি, শাসন-ব্যবস্থা, সব ক্ষেত্রেই বাঙালীরা বঞ্চিত। এমনকি বাংলা ভাষার ওপর তারা চালায় আক্রমণ, বাঙালী সংস্কৃতি তাদের চক্ষুশূল। রবীন্দ্রসাহিত্য ও সঙ্গীতের কণ্ঠরােধেও তাদের নিত্যনতুন প্রচেষ্টা। শেখ সাহেবের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত দাবি তাদের কাছে অন্যায় এবং অসহনীয় মনে হলাে। বাঙালীরাও জানিয়ে দিলেন, দাবি না মানলে তাদের পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিদায় নিতে হবে। ভুট্টো সাহেব ঢাকা থেকে নিঃশব্দে নিষ্ক্রান্ত হলেন ইয়াহিয়া খানও। যাওয়ার সময়ে নির্দেশ দিয়ে গেলেন দুর্বিনীত, বাঙালীদের শায়েস্তা করতে। শুরু হয়ে গেল পশ্চিমা সশস্ত্রবাহিনীর তাণ্ডব। রাজধানী ঢাকায়, জেলা ও মহকুমা শহরে, রেল স্টেশনে, বন্দর ও বিমানঘাঁটিতে, এমনকি গ্রামে-গঞ্জে সন্ত্রস্ত, বিহ্বল বাঙালী বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল হিংস্র লালসার সেনাবাহিনী-শাসক সম্প্রদায় এবং তাদের সাহায্যপুষ্ট অবাঙালী আনসার ও মুজাহিদ দল। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেন। ইপিআর, আনসার, পুলিশ বাহিনীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাল । শেখ সাহেবের পূর্বঘােষিত নির্দেশে তখন সমস্ত পূর্ব
পৃষ্ঠাঃ ২৮২
পাকিস্তানে সবকিছু বন্ধ: দেশব্যাপী হরতাল এবং জনজীবন অচল। ভারতের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের এই অভূতপূর্ব ঘনাবলির ওপর তীছ দৃষ্টি রাখছিল সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর কর্মীরা এবং অন্যান্য কয়েকটি সংস্থা। গণবিক্ষোভ ও সন্ত্রাসের ঢেউ সীমান্ত ছাড়িয়ে পড়তে পারে বলেই এই সতর্কতা।
১৯৭১ এর ৩১ মার্চ। খবর এল আওয়ামী লীগের প্রথম সারির কোনো নেতা, হয়তো বা শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং, কুষ্টিয়ার মেহেরপুর অঞ্চলে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। শোনামাত্র তার সঙ্গে কথা বলতে রওনা হয়ে গেলাম। সন্ধ্যায় উপস্থিত হলান নদীয়া জেলার টুঙ্গি সীমান্ত চৌকিতে। সঙ্গী কর্নেল চক্রবর্তীর চেষ্টায় মহকুমা শাসক তৌফিক এবং পুলিশ অধিনায়ক মাহবুবের সঙ্গে সাক্ষাত হলো। তারা জানালেন শেখ সাহেবকে দেখা যায়নি তবে অন্য দু’জন নেতা ওখানে আত্মগােপন করতে এসেছেন এবং মুসলিম লীগ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদের প্রাণে বাঁচা কঠিন । অনেক অনুরােধ ও আশ্বাসে তারা ওই দুই নেতার সঙ্গে আমাকে সাক্ষাত করালেন। একজন হলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার সঙ্গীর নাম আমীর-উল ইসলাম। তাদের পরনে ছিল ময়লা গেঞ্জি ও লুঙ্গি। অনাহারে-অর্ধাহারে শরীর দুর্বল, কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। তাজউদ্দীন আহমদ জানালেন, সামরিক বাহিনীর চরম আঘাতের ঠিক আগে শেখ মুজিব ও তার সঙ্গে কথা বলে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। কথা ছিল শেখ মুজিবও তাঁর সঙ্গে আসবেন। কিন্তু পূর্বনির্ধারিত স্থানে ও সময়ে তার দেখা মেলেনি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরে যখন সেনাবাহিনী পথে-ঘাটে বেরিয়ে পড়ল তখন বাধ্য হয়ে তাকে ও আমীর-উল ইসলামকে হাটা শুরু করতে হয় । শেখ সাহেবের কোনাে খবর তিনি আর পাননি এবং তার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, দেশে প্রতি পদক্ষেপে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিপদ সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অবহিত। কিন্তু ভারতে আশ্রয় নিতে তিনি বিব্রত বােধ করেন। সার্বিক অবস্থার বিশদ পর্যালােচনা করে যখন তাকে বােঝানাে গেল যে, পূর্ব পাকিস্তানে থাকা তার পক্ষে নিরাপদ নয়, যােগ্য নেতার অভাবে গণবিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যাবে এবং তিনি এলে ভারত কোনােভাবেই তি হবে না, তখন তিনি স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে যান। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি ফিরে আসেন এবং আমাদের সঙ্গে কলকাতা রওনা হন। পথে কিছু আনসার ও মুসলিম লীগ সদস্য অন্ধকারে তাঁকে আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সতর্কতার ফলে ওদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দমদম বিমানবন্দরে সেই রাতেই সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অধিনায়ক কে এফ রুস্তামজি এসে পৌঁছলে তাজউদ্দীন ও আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে রুস্তামজি সাহেবের পাজামা-
পৃষ্ঠাঃ ২৮৩
পাঞ্জাবি পরে প্রায় শেষ রাতে তারা সামান্য আহার করেন।
এই সময়ে তাজউদ্দীন সাহেব জানালেন, পূর্ব বাংলায় বাংলায় স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বিলাস-ব্যসন, খানাপিনা পরিত্যাগ করার সঙ্কল্প নিয়েছেন৷ তারপর আরম্ভ হলাে কথাবার্তা। অত্যন্ত সরল সহজ ভাষায় তাজউদ্দীন সাহেব পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলেন এবং জানালেন, বাঙালীর জাতীয় জীবন পর্যুদস্ত করতে ইয়াহিয়া, টিক্কা ও ভুট্টো চক্র বদ্ধপরিকর। পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রে পূর্ব বাংলার অবস্থান এবং কুটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব তাঁর ব্যাখ্যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। সকালের দিকে তারা বিশ্রাম করতে গেলেন। ইতােমধ্যে রুস্তমজি সাহেব দিল্লীর সঙ্গে কথা বললেন, এবং স্থির হলাে তাদের সেখানে যেতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করবেন। পরের দিন দফায় দফায় রুস্তামজি সাহেব তাদের সঙ্গে কথা বললেন। মােটামটি স্থির করলেন পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলে রাখা হবে বাংলাদেশ, পতাকা হবে সবুজ জমিনে সোনালী রেখায় চিত্রিত বাংলাদেশের মানচিত্রসহ লাল সূর্য, জাতীয় সঙ্গীত হবে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি’ এবং সরকার হবে ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্র। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের মূল লেখাগুলাে তাজউদ্দীন আহমদ ঠিক করে দিলে, আমীর-উল ইসলাম এবং প্রখ্যাত ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী তাঁর সহকর্মীদের সাহায্যে ঘােষণাপত্র রচনার কাজে হাত দেন।
সেদিন ছিল শহরে হরতাল। বিশেষ অনুরােধে দোকান খুলিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব ও আমীর-উল ইসলামের জন্য জামা-কাপড়, স্যুটকেস এবং জুতা-মােজা প্রভৃতি নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রী কেনা হয়। ওষুধপত্রের বিকল্প ব্যবস্থা করা হয়- যেহেতু তাঁর অভ্যস্ত ওষুধ ভারতে অচল। তাজউদ্দীন সাহেবের ইচ্ছামতাে তাঁকে টুঙ্গি সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি সহকর্মীদের জন্য কিছু নির্দেশ পাঠান এবং ভারতের মনােভাব সম্বন্ধে অবহিত করেন। কলকাতা ফিরেই দিল্লী যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়। মধ্যরাতে বিশেষ বিমানে তাঁদের নিয়ে যাত্রা করি। শ্রান্তিতে তাঁরা সেই বিশাল বিমানের মেঝেতে শুয়ে পড়েন এবং ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যান। রাত আড়াইটার সময় যখন পালাম বিমানবন্দরে পৌছাই তখন অন্যান্য সমস্ত বিমানের জন্য বিমানবন্দর বন্ধ ছিল নিরাপত্তার স্বার্থে। বিশেষ মােটরযােগে বিদেশী গােয়েন্দাদের তীক্ষ দৃষ্টি এড়িয়ে অনেক ঘােরাপথে তাদের গুপ্ত বাসস্থানে নিয়ে আসা হয়। পরের দিন তাজউদ্দীন আহমদের প্রকৃত পরিচয় এবং আওয়ামী লীগে তাঁর প্রতিপত্তি যাচাই করার উদ্দেশ্যে ইতােমধ্যেই যাঁরা দিল্লী এসে পৌছেছিলেন এমন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যক্তিবর্গকে তাজউদ্দীন
পৃষ্ঠাঃ ২৮৪
সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়ে আসা হয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায়। তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে এদের প্রথম দর্শন এবং কথাবার্তায় দিল্লীর কর্তারা নিশ্চিত হন যে, শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠতম সহযােগী তাজউদ্দীন সাহেব এবং তার অনুপস্থিতিতে লীগের নেতৃত্ব গ্রহণে সক্ষম এবং এর অধিকারী একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ৷ তারপর তিনি বিদেশ সচিব, রাজ্যসচিব, দেশরক্ষা সচিব, বহু সংস্থার প্রধানবন্দ, প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও উপদেষ্টা এবং অবশেষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করেন এবং তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনের কথা বুঝিয়ে বলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনায় স্থির হয় আওয়ামী লীগের প্রধানদের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সরকার গঠন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য এবং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব নিয়ােগ এবং স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র ও জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নামকরণ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সুযোগমতাে ওই দেশেরই কোনাে স্থানে প্রকাশ্য সভায় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ, সরকার গঠন, মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম ঘােষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য যুব শক্তিকে যােগদান করতে আহ্বান প্রভৃতি অনুষ্ঠানও প্রচারের আয়ােজন সম্পন্ন করতে হবে। প্রথম থেকেই তাজউদ্দীন সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি করতে থাকেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, যথাসময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঠিকই দেওয়া হবে, আশ্রয়দান বস্তুত স্বীকৃতি দান। ইতিমধ্যে আমি কলকাতা ফিরে তাদের থাকার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা সেরে ফেলি এবং টেলিফোনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি জেলার সঙ্গে প্রয়ােজনীয় যােগাযােগের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করি।
দিল্লী থেকে ফিরে তাজউদ্দীন সাহেব যুবনেতাদের সহযােগিতায় মুক্তিবাহিনী গঠন করেন, এবং ভারত সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে তাদের জন্য কয়েকটি সামরিক শিক্ষার ও অভিযানের ঘাটি স্থাপন করান। সামরিক বাহিনী এবং ইপিআরে দলত্যাগী অফিসারবৃন্দ এসব ঘাটির ভার নেন। এরই মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে তাদের ভারতে আসার যথাসম্ভব বন্দোবস্ত করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক, কামরুজ্জামান প্রমুখ তাজউদ্দীন আহমদের সহায়তায় ভারতে অবস্থান নেন। অনেক এমএনএ এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরও সমাগম হয়। এদিকে ত্রিপুরার পথে কর্নেল ওসামনী এবং ধুবডির পথে মওলানা ভাসানী এসে পড়েন। আবদুস সামাদ আজাদ, মণি সিংহ, অধ্যাপক ইউসুফ
পৃষ্ঠাঃ ২৮৫
আলী, আইনবিদ নূরুল আলম প্রমুখকে প্রায়ই দেখা যেত। ইতোমধ্যে সকল এমএনএ-কে উদ্বুদ্ধ করে তাজউদ্দীন সাহেব সর্বসম্মতিক্রমে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র, মন্ত্রিসভার সদস্য, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকা প্রভৃতি যাবতীয় বিষয় অনুমােদন করিয়ে নিলে মুজিবনগরের আমবাগানে শত শত দেশবাসীর সামনে এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের সামনে বাংলাদেশ জাতীয় সরকার শপথ গ্রহণ করে। কয়েক দিনের মধ্যেই তাজউদ্দীনের নির্দেশে কলকাতার পাকিস্তানী ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলী তার আনুগত্য পরিবর্তন করেন এবং তাকে দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। কত সূক্ষ্মতার সঙ্গে ধীরস্থিরভাবে তাজউদ্দীন সাহেবকে এসব ব্যাপরে অগ্রসর হতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়। প্রবাসে গঠিত সরকার চালাতে যে অর্থের প্রয়োজন তার ব্যবস্থাও তিনি করেন। প্রবাসী বাংলাদেশীরা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলে সেই অর্থ সরাসরি সরকারের তহবিলে জমা পড়ার ব্যবস্থাও তিনি করেন। পাকিস্তানী রাজকোষের টাকাও তার চেষ্টায় ঠিকমতাে আসতে থাকে। বিদেশি মন্ত্রী ও নেতবৃন্দের সঙ্গে তিনি প্রায়ই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সাক্ষাৎ করতেন এবং অনেক সময়েই তাকে হাসিমুখে প্রাণ বিপন্ন করেও এগিয়ে যেতে দেখা যেত। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের চাপ তার ওপর প্রবল হলেও তিনি চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি, কেননা তিনি নিশ্চিত জানতেন অধিকসংখ্যক মন্ত্রী অধিকসংখ্যক সমস্যারই সৃষ্টি করবে। সকলেই আপন আপন স্বার্থ সিদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে। ভারতের প্রতি তার বন্ধুত্বের মনােভাব বিষিয়ে দিতে অনেকেই সচেষ্ট ছিলেন। কেন আরও অর্থ সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না, কেন আরও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আসছে না, কেন ভারত প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করছে না?- এদের প্রশ্ন করা হয়েছে। এক কোটি শরণার্থীর ভার আমাদের গরিব দেশের পক্ষে কি ভয়ানক তা তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারতেন; আর আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে যে কোনাে রকমের অসাবধানতা বা অপ্রাসঙ্গিক দ্রুততার ফল কত মারাত্মক হতে পারে, তাও তাঁর অজানা ছিল না। তিনি ছিলেন সহনশীলতার প্রতিমূর্তি। তাঁর দৃষ্টি ছিল স্বচ্ছ, স্থির লক্ষ্যে তিনি ছিলেন অটল, অনড়। একবার তাঁকে বলা হয়, তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কোনাে হদিস যদি তিনি দিতে পারেন তাহলে তাদের আনবার চেষ্টা করা যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তর দেন, বাংলাদেশের সকল পরিবারের যে ভাগ্য তার পরিবার সেই ভাগ্যেরই অংশীদার হবে, তাদের জন্য কোনাে বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়ােজন নেই। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বাংলাদেশ প্রকৃত স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সহজ ও সরলভাবে দিন কাটাবেন, গার্হস্থ্য জীবন পরিহার করবেন। শেষ দিন পর্যন্ত তার
পৃষ্ঠাঃ ২৮৬
প্রতিজ্ঞা তিন অক্ষরে পালন করেন। তার পরিবার এক সময়ে কলকাতায় এসে পৌছেছে বটে তবে তিনি কোনােদিন তাদের দেখতে যাননি। একদিন তার পুত্র অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাচার আশা খুঁব কম। ঘোরের মধ্যে বাবাকে ডাকছে। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন বাবাকে আনিয়ে নিতে। প্রতিজ্ঞায় অটল তাজউদ্দীন সাহেব যেতে অস্বীকার করলেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে ডেকে পাঠানাে হলাে। অনেক বুঝিয়ে বলার পর তিনি যেতে রাজি হলেন। পুত্রের শিয়রে মিনিট পাঁচেক দাড়িয়ে নীরব প্রার্থনার পর নিশব্দে ফিরে এলেন৷ বিধাতার অসীম করুণা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বের ভার ন্যস্ত হয়েছিল এমন একজন নির্ভীক ও নিঃস্বার্থ বীরের হাতে! কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্রমাগত গােপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এবং বিদেশী শক্তির সঙ্গে সহযােগিতা করে হীন স্বার্থ হাসিলের জন্য তৎপর ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব তার সহজ ও সরল যুক্তি সর্বক্ষণিক তৎপরতার জোরে তাদের ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কয়েকজন যুবনেতা বিক্ষুব্ধ হয়ে মক্তিবাহিনীর প্রতিযােগী আর এক মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং কিছু দিশেহারা আমলার সাহায্যে অধিকতর অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র যােগাড়ে সমর্থ হন। তাদের একজন তাজউদ্দীন সাহেবের প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে পিস্তল হাতে অতর্কিতে তার ঘরে ঢুকে পড়েন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার পায়ে লুটিয়ে পড়েন। তাজউদ্দীন সাহেব তাকে ক্ষমা করে নিজের বিশ্বস্ত অনুরাগী করে তুলতে সমর্থ হন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন নিঃসঙ্গ সেনানায়ক। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং কর্নেল ওসমানী সাধারণত তাকে সমর্থন করতেন, তবে যুদ্ধে কেউ তাঁর মতাে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন বলে মনে হয়নি। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি সকরেই প্রখর দৃষ্টি ছিল, শুধুমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ব্যক্তিত্বে ব্যতিক্রম। তার স্বতন্ত্র এক নীতিবােধ তাকে অনন্য মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এমনকি মওলানা ভাসানী পর্যন্ত বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগের মধ্যে মানুষের মতাে মানুষ ওই তাজউদ্দীন।”
এদিকে আওয়ামী লীগের ভেতরের এক অংশ বাইরের কোনাে কোনাে শক্তির সহেযাগিতায় প্রবল চেষ্টা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগের প্রতিপত্তি খর্ব করে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের। তাজউদ্দীন সাহেব এই চেষ্টার তীব্র বিরােধিতা করেন। ভাসানী সাহেব তাকে সমর্থন জানান এই বলে যে, “বাংলাদেশের জনগণ যাদের একজনকেও নির্বাচিত করেনি তারা কোন দাবিতে মন্ত্রীর পদ অধিকার করবে।” শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধীর চেষ্টায় এই অভিসন্ধির অবসান ঘটে, তিনি তাজউদ্দীন সাহেবের যুক্তিতে সায় দেন। শুভবুদ্ধির জয় হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২৮৭
বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর যেদিন মন্ত্রীরা ঢাকায় ফিরে যান, সেদিন রুস্তমজি সাহেবের সঙ্গে দমদম বিমানবন্দরে যাই তাদের বিদায় জানাতে। নানা কথার পর রুস্তমজি সাহেব বলেন, ‘আমরা আশা করব ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর বন্ধন চিরদিন অটুট থাকবে।’ সঙ্গে সঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেব জবাব দেন, হঁ্যা স্বাধীন বাংলাদেশের ওপর যদি কােন চাপ সৃষ্টি না করা হয়, বাংলাদেশের কাজকর্মে কোনাে প্রভাব বিস্তার না করা হয়, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশ ও স্বাধীন ভারতের মৈত্রী চিরকাল অক্ষুন্ন থাকবে।’ যে রুস্তমজীর চেষ্টায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ এবং যার সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্ক, স্বদেশের স্বার্থে তাকেও স্পষ্ট ভাষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে দৃঢ় মনােভাব জানাতে তাজউদ্দীন সাহেব মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করলেন না। অথচ বাংলাদেশে প্রচার করা হলাে তিনি ভারতের দালাল। মিথ্যা কি চিরদিন সত্যে কণ্ঠরোধ করে রাখবে? যখন স্বাধীনতা-সংগ্রামের শেষ কোথায় অনুমান করা যাচ্ছে না, সেই রকম একদিন কথা প্রসঙ্গে তাজউদ্দীন সাহেব বলেছিলেন, ” নববর্ষ ঢাকাতে উদযাপন করব।” নববর্ষের দিন ঢাকা সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘরে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি কেক, মিষ্টি, চা খাইয়ে আমাকে এবং আমার কন্যা জয়ন্তীকে আপ্যায়ন করেন। আমাকে সেই আগের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁর কোমল স্নেহার্ক ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করে। আমার দুই কন্যার বিবাহে তাঁর পরিবারের সাহচর্য আমি লাভ করি। জীবনে যখন চরম আঘাত আসে, ঈশ্বর আমার পত্মীকে চরণে স্থান দেন, তখনও তাজউদ্দীন সাহেব ছুটে এসে সমবেদনা জানিয়ে যান। এ তাঁর মহত্ত্বেরই পরিচয়।
তাজউদ্দীন সাহেব মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। প্রধান শক্তিগুলাে তাঁকে নানা প্রলােভন দেখিয়েছে। সামরিক বাহিনীও তার ইঙ্গিতের প্রতীক্ষা করতে থাকে। কিন্তু তার সুস্পষ্ট উত্তর ছিল, “শেখ সাহেবের নেতৃত্বে যে কোনাে পরিবর্তনের প্রয়াসে তিনি মুক্ত হতে প্রস্তুত, তাকে বাদ দিয়ে কোনাে পরিবর্তনের কথা তিনি চিন্তা করতে পারেন না। সমস্ত প্রলােভন তিনি হেলায় প্রত্যাখ্যান করেন। এর জন্য চরম মূল্য দিতেও তাঁর দ্বিধা ছিল না।
মনে হয়, তাঁর নীতিবােধ ও নেতৃত্বকে মর্যাদা দেওয়ার ক্ষমতা তখন বাংলাদেশের ছিল না। গভীর মানবিকতা, উজ্জ্বল আদর্শবাদ, নিপুণ কর্মপ্রণালী, মূল্যবােধের সাহায্য, অকপট আচরণ, সারল্য ও সহনশীলতা তাঁর নির্লোভ নিরাসক্ত হৃদয়কে এক অপূর্ব মহিমায় ভাস্বর করে তুলেছিল। তাঁর প্রতিভা ও চরিত্ৰগরিমার দীপ্তিতে যারা ম্লান হয়ে পড়েছেন তারাই ঈর্ষা ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু প্রভাতসূর্যের আলাের মতােই সত্য দিক-
পৃষ্ঠাঃ ২৮৮
দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত কুয়াশা, সকল অন্ধকার দূর করে দেবে। দেশবাসীও এই দেশভক্ত সন্তানকে যােগ্য আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে স্মরণের অমরতায়।৪
ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা
ব্যারিস্টার আমি -উল-ইসলাম ১৯৭০ সালে কুষ্টিয়া থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমএমএ। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন সম্পর্কে তার লেখা নিম্নে উদ্ধৃত হলাে :
পয়লা মার্চ থেকে বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার সময় আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সাথে এক প্রকার কথাবার্তা হয় না বললেই চলে। আমার শ্বশুর, আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, খান সাহেব এম, ওসমানী ১৯ মার্চ ইন্তেকাল করেন। স্ত্রী তখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পিতৃহারা স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেওয়ার সময়ও আমার হয়ে ওঠেনি।
এ অবস্থায়ই ২৫ মার্চ ঘরে প্রবেশ করেই লীলাকে আমি বললাম, আমাকে চলে যেতে হবে। সে শুধু জানতে চাইলাে আমার কাছে টাকা আছে কিনা পকেটে ২/১০ টাকা থাকতে পারে। আমার পরনে পাজামা, গায়ে পাঞ্জাবি আর পায়ে স্যান্ডেল। ভালাে থাক- এ কথা বলেই স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। দেয়াল টপকে বাসা থেকে বের হয়ে ড. কামাল হােসেনের বাসায় আসি। তিনি প্রস্তুত ছিলেন। দুজনে একত্রে চলি এবার বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে।
সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আত্মগােপন করার পরামর্শ দিই। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন, আমি যদি আত্মগােপন করি তাহলে আমাকে না পেয়ে পাকিস্তানীরা দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলবে। কাজেই আমি আত্মগােপন করব না। তিনি আমাদের পরামর্শ না শুনে বরং আমাদেরকেই তাড়াতাড়ি সরে পড়ার নির্দেশ দিলেন।
নেতার নির্দেশ মােতাবেক আমি ড. কামাল হােসেনকে সঙ্গে নিয়ে সরে পড়ার উদ্দেশ্যে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসায় চলে যাই। বাসায় গিয়ে তাজউদ্দীন ভাইকে বের হবার সংবাদ জানাই। সংবাদ পেয়ে নেতা বের হয়ে আসেন রণসাজে সজ্জিত হয়ে। দেখে মনে হলাে, নেতা আজ রণাঙ্গনে সেনাপতি। পরনে লুঙ্গি ও গায়ে পাঞ্জাবি। কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলানাে আছে। আর তাঁর ঘাড়ে একটি রাইফেল । তার এই বেশ দেখে আমি বললাম, শিকারে যাচ্ছেন নাকি? তাজউদ্দীন ভাই গত বেশ কিছুদিন যাবত আমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের কথা বলছিলেন। তিনিই ইতিমধ্যে রাইফেল ট্রেনিং নিয়েছেন। আরহাম সিদ্দিকী নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে
পৃষ্ঠাঃ ২৮৯
তাজউদ্দীন ভাই একটি রাইফেল সংগ্রহ করেন যা নিয়ে তিনি বাড়ি হতে বের হন। কিন্তু রাইফেলটি শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে রাখা সম্ভব হয়নি। এটি রাস্তায় কর্মীদের কাছে রেখে যাওয়া হয়।
তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসা থেকে বের হবার পর ড. কামাল হোসেন একটু অন্যত্র যান। তিনি আর আমাদের সাথে একত্র হতে পারেননি। পরে গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী থাকেন। আমাদের ছেড়ে না যাওয়ার জন্য আমি অবশ্য তাঁকে বার বার অনুরােধ করেছিলাম। কিন্তু আমার অনুরোধ না শুনে তিনি এক বন্ধুর বাসায় যান। সেখান থেকে তার আর আসা হলো না। তাজউদ্দীন সাহেবের বাসা থেকে বের হয়ে আমরা গোলাগুলির কারণে আটকা পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যে দুজন খুবই গােপনে এক বাসায় আশ্রয় নেই। পরে ২৭ মার্চ আমরা ঢাকা ত্যাগ করে অচেনা পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। বহু নদী, নালা, খাল, বিল, পাড়ি দিয়ে পায়ে হেঁটে কোথাও বা একটু আধটু গাড়িতে করে অমানুষিক কষ্ট করে আমরা দু’জন চুয়াডাঙ্গা গিয়ে উঠি। সেখানে রাজনৈতিক নেতাও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েকটি বৈঠক করি। তারপর সেখান থেকে তওফিক এলাহী ও এসপি মাহবুব-এর চেষ্টায় আমরা ভারতের মাটিতে পৌছি। সীমান্তের ওপারে যাওয়ার পর গােলক মজুমদারের সহযােগিতায় আমরা কলকাতা হয়ে দিল্লী পৌছি। দিল্লী পৌছার পর গােলক মজুমদার ও রুস্তমজী ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। ৪ এপ্রিল তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সাক্ষাতের সময় তাঁদের কোনাে সহযােগী ছিলেন না। সাক্ষাতের সময় উপস্থিত না থাকলেও আলােচনার সব বিষয়ই আমার জানা ছিল। কারণ সাক্ষাতে যাওয়ার আগে তাজউদ্দীন ভাই আমার সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা ধরে সম্ভাব্য আলােচ্যসূচি নিয়ে আলােচনা করেন।
মিসেস গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তাজউদ্দীন ভাই আমাকে সবকিছু জানান। মিসেস গান্ধী বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। তাজউদ্দীন ভাইয়ের গাড়ি পৌছে যাওয়ার পর তাঁকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী স্টাডি রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস গান্ধী প্রথম প্রশ্ন করেন, ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট?’ এই প্রশ্ন সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত ছিলাম । এ প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তার স্থান থেকে আমাদেরকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি নেতত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। ২৫ মার্চের পর তাঁর সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ হয়নি।’ উক্ত সাক্ষাতে তাজউদ্দীন ভাই আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু
পৃষ্ঠাঃ ২৯০
হয়েছে। যে কোনাে মূল্যে এই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।’ তিনি বলেন, পাকিস্তান আমাদের আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাতে পারে। যে কোনাে মূল্যে পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।’ তাজউদ্দীন ভাই বলেন, আমাদের অস্ত্র এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রয়ােজন। প্রয়ােজন বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ও খাদ্য। মাতৃভূমির স্বাধীনতার যুদ্ধে তাজউদ্দীন ভাই ভারত সরকারের সার্বিক সহযােগিতা কামনা করেন । তিনি জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোট নিরপেক্ষ; সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলার মানুষের সংগ্রাম মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই।’
একটি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে উপলব্ধি করি । কেননা ভারত সরকারের সাথে একটি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের কথা বলা উচিৎ। এদিকে সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে চাপ আসতে থাকে । সরকার গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন ভাইকে খুবই চিন্তিত দেখতে পাই। অস্ফুট স্বরে তিনি বলে ফেললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে কি বিপদে ফেলে গেলেন।’ আমি বিরক্তির সাথে জানতে চাইলাম সরকার গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন ভাই দ্বিধাগ্রস্ত কেন? জবাবে তাজউদ্দীন ভাই বলেন, ‘আপনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জানেন না। সরকার গঠন করার প্রয়ােজনীয়তা বুঝি । জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই তা প্রয়ােজন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য নেতাদের অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন করে নাজক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। আমার সরল মনে দেশের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তখন সরকার গঠনের প্রয়ােজনীয়তা প্রথম ও প্রধান কর্তব্য বলে মনে হলাে। তাজউদ্দীন ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কাকে নিয়ে সরকার গঠন করা হবে। আমি স্বাভাবিক উত্তর দিলাম, বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করে রেখে গেছেন। আমি বললাম যে, ৫ জন নিয়ে বঙ্গবন্ধু হাইকমান্ড গঠন করেছিলেন। এই ৫ জনকে নিয়েই সরকার গঠন করা হবে। দলীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধু, সাধারণ সম্পাদক আর তিনজন সহ-সভাপতি নিয়ে এই হাইকমান্ড পূর্বেই গঠিত হয়েছিল। তাজউদ্দীন ভাই পুনরায় প্রশ্ন করেন, প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? দ্বিধা না করে এবারও জবাব দিলাম, ২৫ মার্চের পর থেকে আজ পর্যন্ত যিনি প্রধান দায়িত্ব পালন করছেন। তাজউদ্দীন ভাই অনেকক্ষণ ভাবলেন। আমার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা কোনভাবেই তিনি নাকচ করতে পারলেন না। তিনি এত বেশি কেন ভাবছিলেন তার উত্তর পেতে আমার অনকে সময় লেগেছিল।
তাজউদ্দীন ভাই নিষ্ঠাবান ও সংগ্রামী পুরুষ ছিলেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দল ও দেশের স্বার্থে তিনি কাজ করতেন । নিজে বেশির ভাগ কাজ করেও তিনি
পৃষ্ঠা’ ২৯১
কোনাে দিন কৃতিত্বের দাবি করতেন না। সকলক কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে তিনি নিজেকে সর্বদাই দূর রাখার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি যখন বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেয়ার জন্য তার প্রস্তাব করি তখন এই প্রস্তাব মেনে নিতে তার খুবই কষ্ট হয়েছিল। এই দায়িত্বের গুরুভার সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। এ অবস্থায় তিনি আবার আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কথা স্মরণ করেন। তাঁরা কে কোথায়, কি অবস্থায় আছেন, এ নিয়ে তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত ছিলেন। পত্রিকাতে ইতিমধ্যে অনেকের মৃত্যু সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। অবশ্য পত্রিকাতে প্রকাশিত নিহতদের তালিকায় তাজউদ্দীন ভাই এবং আমার নামও ছিল। নিহতদের তালিকায় আমাদের দুজনের নাম দেখে ভেবেছিলাম আমাদের নেতারাও হয়তাে জীবিত রয়েছেন। আমাদের আরও চিন্তা হলো বঙ্গবন্ধুকে সরকারের প্রধান করা হলে আমাদের আন্দোলনের ব্যাপারে কি প্রতিক্রিয়া হবে। অথবা তার জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কারণ দেখা দিবে কি না। এ নিয়ে দু’জনে অনেক রাত পর্যন্ত আলােচনা করি। পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দিই আবার খণ্ডন করি। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, ফলাফল যাই হোক, বঙ্গবন্ধুকে সরকারের রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করতে হবে! তাজউদ্দীন ভাই বললেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছি। আমার মনে হয় চাপের মাধ্যমে পাক-সরকার বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কোনাে বিবৃতি দেওয়াতে সমর্থ হবে না।’ আমরা যেহেতু একটি যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম এবং বঙ্গবন্ধু তখন শক্রর কারাগারে বন্দী, কাজেই সে সময় আমাদের অনকে কিছু ভাবতে হয়েছিল। তবে ভাবাভাবির বেশি সময় ছিল না। কেননা আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া অপরিহার্য ছিল। একটা সরকার গঠন ছাড়া কাজ এগােনাে যাচ্ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সিপাহসালার শত্রুর হাতে বন্দী। আবার তাকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে কল্পনাও করা যায় না। তারপর কথা উঠল, দেশের নাম কি হবে। আমি বললাম, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ | নামটি তাজউদ্দীন ভাইয়ের পছন্দ হলাে। নামটি ঠিক করার সময় আমাদের মাথায় গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কথা মনে হচ্ছিল। এ সময় সরকারী কাগজপত্রে ব্যবহারের জন্য একটি মনােগ্রাম ঠিক করা দরকার। মনােগ্রামটি আমাদেরই ঠিক করতে হলাে। বর্তমান বাংলাদেশের যে মনােগ্রাম সরকারী কাগজপত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা আমার হাতে আঁকা । চারপাশে গােলাকৃতি লালের মাঝখানে সােনালি রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র। মনােগ্রাম দেখে তাজউদ্দীন ভাই পছন্দ করলেন। শুধু তাই নয়, সাথে সাথে তিনি অনুমােদনও করলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এটা তাঁর প্রথম সরকারী অনুমােদন।
এই দিন সন্ধ্যার পর রেহমান সােবহান ও ড. আনিসুর রহমান আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ২৯২
দেখা করতে এলেন। রেহমান সােবহান এর আগে একবার দেখা করে গেছেন। এ সময় ড. আনিসুর রহমান নিজ চোখে দেখা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাক বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেন। সারাদিন আমি তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা তৈরি করছি। রেহমান সােবহান বক্তৃতা খসড়া বচনায় আমাকে সাহায্য করেন৷ সেদিনই জানতে পারি ড. কামাল হােসেন গ্রেফতার হয়েছেন। রেহমান সোবহান জানান তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করবেন। রাজনৈতিক খসড়া তৈরিতে তাজউদ্দীন ভাই খুবই দক্ষ । কোনাে একটি খসড়া করা হলে পরে তিনি মনযােগ দিয়ে শুনতেন, মাথা নাড়তেন, কোনাে কোনাে স্থানে থেমে নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে বলতেন| প্রয়ােজনবােধে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতেন৷ এমনভাবে চুড়ান্ত বক্তব্য তেরি হতাে। আমাদের দুজনের মন ও চিন্তা যেন তখন একই ধারায় কাজ করছিল।
আমাদের হাতের লেখা খুব ভালাে নয়। তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করতে হবে। আমি একটি টেপরেকর্ডারের ব্যবস্থা করি। তিনি সমস্ত বক্তৃতা নিজের হাতে লিখে নিলেন। চট্টোপাধ্যায় তার নিজের হাতে আরও একটি কপি করে নেন। তাজউদ্দীন ভাই দ্বিতীয় বারের মতাে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন । ইন্দিরা গান্ধী তাকে জানান, বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অবশ্য এই খবর পাকিস্তান সরকার তখনও সরকারীভাবে প্রকাশ করেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাজউদ্দীন ভাই বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের নবগঠিত সরকার ভারতের মাটিতে অবস্থান করতে পারবে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, তাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ এবং শরণার্থীদের আশ্রয় এখানে থেকে ব্যবস্থা করা যাবে। মক্তিযুদ্ধের খবরাখবর প্রচারের একটি বেতার স্টেশন স্থাপনের বিষয়েও আলােচনা হয় । এদিকে আমাদের নেতারা কে কোথায় আছেন, সে খবর আমরা তখনও জানি না। তাদের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য একটি ছােট বিমানের ব্যবস্থা করা হলাে। স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য ভারত সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে আমাদের সাথে দেন। ঐ জেনারেলে নাম নগেন্দ্র সিংহ। তার বয়স ৬০-এর উর্ধ্বে। তিনি সামরিক ব্যাপারে আমাদের পরামর্শ দেবেন। জেনারেল সিংহ মনেপ্রাণে একজন খাটি সৈনিক। ব্যক্তিগত জীবনে খুবই ধর্মপ্রাণ । তাছাড়া মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ। আমাদের সংগ্রামের প্রতি তিনি আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধাশীল। দিল্লীতে বসেই তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা টেপ করা হয় । বক্তৃতার পূর্বে আমার কণ্ঠ থেকে ঘােষণা প্রচারিত হয়, এখন তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন।’ এরপর তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা শুরু করেন। আমরা
পৃষ্ঠাঃ ২৯৩
বিমানে করে আবার কলকাতা ফিরে এলাম। এখানে এসে জানলাম মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান ভাই এসেছেন। তাদের কথা শুনে কিছটা স্বস্তি পেলাম। খবর নিয়ে জানলাম কলকাতায় গাজা পার্কের কাছে একটা বাড়িতে কামরুজ্জামান ভাই থাকেন। শেখ ফজলুল হক মনি ঐ বাড়িতে আছেন। পরে আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ ও সিরাজুল আলম খান এই বাড়িতে ঘাটি করেন।
আমি ও তাজউদ্দীন ভাই কামরুজ্জামান ভাইয়ের কাছে দেখা করতে গেলাম। আমরা তাঁর কাছে এ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করি । কামরুজ্জামান ভাইয়ের মনে একটা ভিত্তিহীন কথা ঢুকানাে হয়েছে যে, আমরা তড়িঘড়ি করে দিল্লি গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছি, নেতাদের জন্য অপেক্ষা করা উতিত ছিল।
শেখ মনি আমাকে অন্য একটি ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে এটা বােঝালেন যে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁদের বিলম্বে সাক্ষাত হওয়ার কারণ হলাে, তাঁরা একটি শক্তিশালী গ্রুপ এবং তাদের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ত্রীর পূর্ব থেকেই যােগাযােগ রয়েছে।
আমাদের সরকার গঠনের ব্যাপারে সন্তুষ্ট নন এমন কয়েকজন a. এমপিএ, এমএনএ ও আওয়ামী লীগ নেতা কলকাতায় এসেছেন প্রিন্সেস স্ট্রীটের এমএসএলএ হােস্টেলে ওঁরা উঠেছেন। একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, আমাদের মাঝে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন গ্রুপে নেতৃত্ব নিয়ে আলাপ-আলােচনা চলছে। ইতিমধ্যে কামরুজ্জামান ভাইকে নিয়ে কপিতয় এমপিএ ও দলীয় নেতা প্রিন্সেস স্ট্রীটে একটি বৈঠক করেছেন। আর এতে ভালােভাবে সুর মিলিয়েছেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তাজউদ্দীন ভাই আমাকে ডেকে বললেন, আপনাকে আগেই বলেছিলাম, এই দল দিয়ে কি স্বাধীনতা যুদ্ধ হবে? আমাদের নেতাদের বিভিন্নমুখী বৈঠকে তাজউদ্দীন ভাই ও আমি বিশেষভাবে বিব্রত বােধ করছি। কামরুজ্জামান ভাই খুবই সুবিবেচক মানুষ। তিনি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বললেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রােডে আমাদের বৈঠক বসল । উপস্থিত বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে ছিলেন কামরুজ্জামান, মিজান চৌধুরী, শেখ মনি, তােফায়েল ও আরাে অনেকে। শেখ মনি তার বক্তৃতায় বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী। মন্ত্রী মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময় । সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে! তাজউদ্দীন ভাই ও আমি ছাড়া বৈঠকের উপস্থিত প্রায় সকলে শেখ মনির বক্তব্য সমর্থন করেন। তাজউদ্দীন ভাই যেহেতু নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, তার পক্ষে পাল্টা জবাব দেয়া সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হলাে। উপস্থিত সেছেন প্রিন্সেস স্ট্রীটের স বঝতে পারলাম, আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ২৯৪
শয় সকলেরই ধারণা ছিল আমি ও তাজউদ্দীন ভাই আগেভাগে দিল্লী গিয়েছি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। আমি তাদের দিল্লী যাওয়ার সমর্থনে ও শেখ মনির বক্তব্যের বিপক্ষে কয়েকটি যুক্তি পেশ করি। আমার প্রথম যুক্তি ছিল, কারা বেঁচে আছেন এবং কাকে কোথায় পাওয়া যাবে, তার জন্য অপেক্ষা করার সময় তখন ছিল না। দ্বিতীয় যুক্তি হলাে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলেছেন। দলের সভাপতির অনুপস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদকের কথা বলার এখতিয়ার তার রয়েছে। তাছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রাথমিক আলােচনা হয়েছে মাত্র। ভবিষ্যতে আরও আলােচনা হবে। তখন দলের অন্য নেতারা অংশগ্রহণ করতে সময় পাবেন । তৃতীয়ত, আমরা বঙ্গবন্ধুর নিয়ােজিত হাইকমান্ড নিয়ে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীসভা গঠনের পরিকল্পনা করেছি মাত্র। আমি আরও বললাম, বাংলাদেশ বারাে ভূঁইয়ার দেশ। বিরাট বিপ্লবী কাউন্সিল গড়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয় । আমাদের অবশ্যই আইনগত সরকার দরকার। কেননা আইনগত সরকার ছাড়া কোন বিদেশি রাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করবে না।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযােগ খুব কমই হয়েছে। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার অধিকার একটি আন্তর্জাতিক নীতি। যে কোনাে জনগােষ্ঠীর তাদের নির্বাচিত সরকার দ্বারা শাসিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের সে গনতান্ত্রিক অধিকার অবমাননা করেছে। তাই আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে। অথচ এতদিন হরণ করা হয়েছে, জনগণের সে অধিকার। শেখ মনির প্রস্তাবিত বিপ্লবী কাউন্সিল যদি বিভিন্ন মতাবলম্বীরা দুইটি, পাচটি বা সাতটি গঠন করে, তাহলে জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধারা একটিরও আদেশ মেনে চলবে না। কোন কাউন্সিলের সাথে, বিদেশের কোন সরকার সহযােগিতা করবেন? এই ক্ষেত্রে একাধিক কাউন্সিল গঠন কি ঠিক? সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই হচ্ছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আজ সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে অন্য কোনাে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হলে জনগণের মৌলিক অধিকারকে অবমাননা করা হবে। সেটা নিশ্চয়ই আমাদের উদ্দেশ্য হবে না। আমার বক্তব্যের পর মিজান চৌধুরী ও শেখ মনি ছাড়া উপস্থিত প্রায় সকলে তাদের পূর্বের মনােভাব পরিবর্তন করে। কামরুজ্জামান ভাই আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন, শেখ মনির কথানুযায়ী বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা যায় কিনা। আমি তাকে বললাম, তা করা হলে যুদ্ধ বিপন্ন হবে। তিনি আমার কথার আর কোনাে প্রতিবাদ করলেন না। আমি তাকে বলি, তার সাথে দেখা করে আমি বিস্তারিত সব কিছু বলব । সভার শেষ পর্যায়ে তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা দেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৯৫
উপস্থিত সকলে সরকার গঠন করার ব্যাপারে তাঁর বক্তব মেনে নেন।
১০ এপ্রিল বিভিন্ন অঞ্চল সফরের জন্য আমাদের বের হবার কথা রয়েছে। একটি ছােট বিমানের ব্যবস্থা করা হলাে। বিমানটি খুব নিচ দিয়ে উড়তে পারে। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের দলীয় নেতাদের সাথে যোগাযোগ করাই এই সফরের উদ্দেশ্য। মনসুর ভাই, কামরুজ্জামান ভাই ও তোফায়েল আহমদ একই বিমানে আমাদের সাথে যাবেন। পরদিন খুব ভোরে গাজা পার্কের বাড়িতে কামরুজ্জামান ভাইয়ের সাথে দেখা করে বিস্তারিত সব কিছু অবহিত করি। তার সাথে বলতে গেলে আমার আত্মিক যােগাযােগ ছিল। তিনি প্রাণখোলা সহজ-সরল মানুষ। দুজনে একান্তে প্রায় আধ ঘণ্টা আলোচনা করি আলোচনার মাধ্যমে তার মনের জমাট বাধা মান-অভিমান দূরীভূত হয়ে গেল। বিপ্লবী পরিষদ গঠনের জন্য যুবকদের প্রস্তাব যে অযৌক্তিক ও অবাস্তব এবং এরা যে যুদ্ধের সহায়ক হবে না, তাও তিনি মেনে নেন। তাজউদ্দীন ভাইয়ের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে তার আর কোনাে আপত্তি রইল না। আমাদের সাথে বিমানে আগরতলা যাত্রার জন্য কামরুজ্জামান ভাইকে বললাম । তিনি বললেন যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোনাে আপত্তি নেই। তবে তিনি খবর পেয়েছেন তার পরিবার পরিজন কলকাতার পথে স্বদেশ ত্যাগ করেছেন, এই পরিস্থিতিতে তার এখানে থাকা প্রয়ােজন। আমি খুশি মনে বিদায় নিই।
১০ এপ্রিল। বিমানে আমাদের আগরতলা রওয়ানা হওয়ার কথা। তাজউদ্দীন ভাই, মনসুর ভাই, শেখ মনি, তােফায়েল আহমদ ও আমি লর্ড সিনহা রােড থেকে সােজা বিমানবন্দরে যাই। অন্যদের মধ্যে মি. নগেন্দ্র সিংহ আমাদের সঙ্গী হলেন। বিমানটি খুবই ছােট। এতে বসার ৫/৬টি আসন ছিল । খুব নিচ দিয়ে বিমান উড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে তৈরি অব্যবহৃত বিমান বন্দরগুলোর কয়েকটিতে আমরা নামি। এগুলাে বাংলাদেশের সীমান্তের কাছাকাছি। একটি বিমানবন্দরে আমরা দুপুরে খাবার খাই। বিএসএফের মাধ্যমে খবর দেওয়া হলাে কোনাে আওয়ামী লীগ নেতার খোঁজ খবর পেলে তাঁকে পরবর্তী কোনাে বিমানবন্দরে তৈরি রাখতে।
উত্তরবঙ্গ তথা রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা অঞ্চলের কোনাে নেতার খোজ পাওয়া গেল না। এদের বেশির ভাগ কলকাতা চলে গেছেন। কিছুক্ষণ পর আরা বাগবোড়া বিমানবন্দরে নামি । সেখান থেকে জীপে করে শিলিগুড়ি যাই। শহর থেকে অনেক ভেতরে সীমান্তের খুব কাছাকাছি একটি বাংলােতে উঠলাম। গােলক মজুমদার এখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী এখানে কোনাে একটি জঙ্গল থেকে গােপন বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দীন
পৃষ্ঠাঃ ২৯৬
ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারিত হবে। এ সময় তােফায়েল আহমদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মনি বলেন, তোফায়েল আহমদের কলকাতা যাওয়া দরকার। শেখ মনি কিছু নির্দেশ দিয়ে তােফায়েল আহমদকে কলকাতা পাঠিয়ে দিলেন। মনসুর ভাইয়ের জ্বর এসে গেছে। তিনি শুয়ে আছেন, আমি তার পাশে বসে আছি। তার সাথে আমার সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে তার সাথে আলাপ করলাম। তিনি মত দিলেন তাজউদ্দীন ভাই প্রধানমন্ত্রী হলেন তিনি কোন আপত্তি করবেন না। এরপর মনসুর ভাই ও কামরুজ্জামান ভাই প্রধানমন্ত্রী পদের ব্যাপারে আর কোনাে প্রশ্ন তােলেননি। পঁচজন নেতার মধ্যে তিন জনের সাথে আলাপের পর আমার খুব বিশ্বাস হয়েছিল যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে কোনাে আপত্তি করবেন না। তা ছাড়া তাকে উপরাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। এখন বাকি খন্দকার মোশতাক আহমদ। তিনি আপত্তি করতে পারেন। তবু চারজন এক থাকলে মােশতাক ভাইকেও রাজি করানাে যাবে। এখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন ভাইয়ের প্রথম বক্তৃতা প্রচার করার পালা। তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতা প্রচারের জন্য অনুমতি দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড করা বক্তৃতার ক্যাসেটগুলাে মজুমদারের কাছে দেয়া হলো। শেখ মনি তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে আলাপ করতে চাইলেন। বাইরের ঘরের বিএসএফের আঞ্চলিক কর্মকর্তার সাথে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা ও শত্রুদের তৎপরতা নিয়ে আলােচনা করলাম।
শেখ মনির সাথে কথাবার্তা শেষে তাজউদ্দীন ভাই আমাকে ডাকেন। তিনি জানান শেখ মনি সরকার গঠনের ব্যাপারে রাজি নন, আগরতলা দিয়ে দলীয় এমপিএ, এমএনএ ও নেতাকর্মীদের সাথে বৈঠক শেষে শেখ মনি সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। আর এটা করা না হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। আমি সরকার গঠনের পক্ষে পুনরায় যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে বিলম্ব হলে সঙ্কট আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তাে নতুন কিছু নয়। মনসুর ভাই তাজউদ্দীন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মােশতাক আহমদের তখনও দেখা নেই। তারা কোথায় আছেন সে খবর এখনও আসেনি।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সরকার গঠনে বিলম্ব হলে তাও নস্যাৎ হতে পারে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে আমরা ভারত সরকারকে ধারণা দিয়েছি তাতে বিলম্ব হলে আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ২৯৭
নেতৃত্ব সম্পর্কে তারা সন্দেহ পোষণ করবেন। আমাদের মধ্যে যে এত কোন্দল রয়েছে কোনাে অবস্থাতেই তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া উতিত নয়। ভারত সরকার জানে যে, আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচারিত হবে। আমার এসব কথা শেখ মনি মানতে রাজি হননি। বেশি করে বুঝাতে চাইলে শেখ মনি জানান, তারা বঙ্গবন্ধু থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারও প্রশ্ন তােলা উচিত নয়। এ সময়েতাজউদ্দীন ভাই আমাকে বলেন, আমি যেন গােলক মজুমদারকে জানিয়ে দেই যে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা আজ প্রচার করা হবে না, এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাঁকে যথাসময়ে জানানো হবে। এ কথা শুনে গােলক মজুমদার যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন বিলম্ব করা কি ঠিক হবে? তিনি বলেন, যে মুহূর্তে সব কিছু ঠিকঠাক সে মুহূর্তে সেটা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে, সেটা আমরা ভেবে দেখিছি কিনা। ইতিমধ্যে রেকর্ড করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে ( জঙ্গলে) পৌছে গেছে। আমি গােলক মজুমদারকে বললাম, ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন তাহলে প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটি মাত্রও সিদ্ধান্ত আমি এভাবে নিয়েছিলাম। এইদিন ছিল দশই এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দীন ভাই ও শেখ মনি আছেন। রাত তখন সাড়ে নটা। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত মুহর্ত এলাে। প্রথমে আমার কণ্ঠ ভেসে আসলাে। ঘোষণায় আমি বলেছিলাম, ‘এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হচ্ছে। সারা বিশ্ববাসী শুনল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার বক্তৃত। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের তিনজনের কারও মুখে কোনাে কথা নেই। আমি শুধু বললাম, গােলক মজুমদার শেষ পর্যন্ত বক্ততা প্রচার বন্ধ করতে পারেনি। মনসুর ভাই রুই মাছ খেয়ে আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা শুনতে পাননি। পরে একক সিদ্ধান্তে বক্তৃতা প্রচারের জন্য তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে ক্ষমা ও শাস্তি প্রার্থনা করি। তিনি বলেছিলেন যে, সে সময়ে আমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। সেদিন বক্তৃতা প্রচার না করলে বিবাদ আরও বৃদ্ধি পেত। শেখ মনি তাজউদ্দীন ভাইকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যাপারে তিনি আগরতলা গিয়ে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু আগরতলার পথে শেখ মনি ভারত সীমান্তের কাছাকাছি কসবাতে সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের বাড়িতে যান। তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তৃতা প্রচারের পরে অনেক রাতে কর্নেল (অব) নূরুজ্জামান ও আবদুর রউফ (রংপুর) আসেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে আলােচনা করি। উত্তরবঙ্গে কয়েকটা সেক্টর রয়েছে। একটা সেক্টরের দায়িত্বে রয়েছেন কর্নেল জামান। তাঁরা জানান, গেরিলা কায়দায়
পৃষ্ঠাঃ ২৯৮
আকস্মিক হামলায় শক্রদের পর্যুদস্ত করা হচ্ছে।
আমি বাঙালীদের উপর হামলা না করার পরামর্শ দিলাম । অবাঙালী বিহারিদের ওপর জনগণ ক্ষুব্ধ। রংপুর, সৈয়দপুরে বেশ কিছু বিহারি রয়েছে। অবশ্য কোন কোন স্থানে এদের উপর হামলা হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা হামলা বন্ধ করার চেষ্টা করছেন। অবস্থাটা অনকেটা শান্ত হয়ে গেছে। আলোচনা করতে করতে রাত প্রায় ভাের হয়ে গেল । ভােরের দিকে তারা দুজন চলে গেলেন। তাদের অনেক কাজ । এক মুহূর্ত সময় নেই। যোদ্ধারা তাদের নির্দেশের অপেক্ষা করছে। সরকার গঠনে তারা আনন্দ প্রকাশ করলেন।
পরদিন ১১ এপ্রিল সকালে নাস্তা করে আমরা বিমানে উঠি। আগের রাতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর থেকেই শেখ মনি চুপ রয়েছেন। বক্তৃতার কথা শুনে মনসুর ভাই উৎফুল্ল । বাতে বিশ্রামের পর মনসুর ভাই কিছুটা সুস্থ হন। যুদ্ধের সময়ে শেষ পর্যন্ত মনসুর ভাই অবিশ্রান্তভাবে কাজ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কের অবসান হওয়ায় মনসুর ভাই যেন বেশি খুশি।
খুব নিচ দিয়ে আমাদের ছােট বিমান উড়ছে। দু’দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ছােট ছোট বিমানবন্দরে নেমে আমরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজ খবর নিচ্ছি। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বিশেষভাৱে খোঁজ রাখার জন্য ময়মনসিংহ সিমান্তে আমরা খবর দিয়ে রেখেছিলাম। বিএসএফের স্থানীয় অফিসার জানান, ঢালু পাহাড়ের নিচে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নান রয়েছেন। একথা শুনে আমরা ইউরেকা বলে আনন্দে লাফিয়ে উঠি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর তাঁরা দু’জন আসলেন। নজরুল ভাই প্রথমে জীপ থেকে নামেন। আমরা সহকারী হুইপ আবদুল মান্নানকে দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে জানলাম ১৫ মার্চের পর থেকে মান্নান ভাই খুব কষ্ট করে দিন কাটিয়েছেন। পাক বাহিনীর ভয়ে তিনি দুদিন পায়খানায় পালিয়েছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে সড়ক পথে হেঁটে ময়মনসিংহ এসেছেন। তিনি একবারে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার গ্রামের বাড়িতে ছিলেন । আমাদের খবর পেয়ে নজরুল ভাই ও তার ভাই যথেষ্ট উৎসাহিত হন। নজরুল ভাইকে ডেকে নিয়ে তাজউদ্দীন ভাই একান্তে কথা বলেন। ঘথ কয়েকদিনের ঘটনাবলী তাকে অবহিত করা হয়। আমরা বাইরে বসে আছি। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাজউদ্দীন ভাইকে মােবারকবাদ জানান। এই দৃশ্য দেখে আমরা সকলেই উফুন্ন হই। আমরা আবার বিমানে উঠি। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল আগরতলা । আমরা বিমানে আসন গ্রহণ করি। সামনের আসনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর ভাই। নজরুল ভাই বিমানে বসে ঢাকা থেকে পলায়নের কাহিনী বর্ণনা করেন । তিনি ডাঃ
পৃষ্ঠাঃ ২৯৯
আলীম চৌধুরীর ছােট ভাইয়ের বাসায় থাকেন। তিনি ছিলেন নজরুল ভাইয়ের আত্মীয়। সেই বাসা থেকে পরচুলা পরে ও মেয়েদের কাপড় পরিধান করে গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। মনসুর ভাই এ কথা নিয়ে এমন ঠাট্টা করলেন যে, বিমানে কেউ না হেসে থাকতে পারলেন না। আমাদের আগরতলা পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আগরতলায় অনেক নেতা বাসে পৌছেছেন। কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা হলাে। তার চেহারায় উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতাে। গোঁফ তিনি কেটে ফেলেছেন। প্রথমে তাকে চিনতেই পারছিলাম না। আমার নিজের দাড়িও কেটে ফেলেছি । দুজনেই দুজনকে দেখে খুব হাসলাম।
আগের রাতে খন্দকার মােশতাক এসেছেন। ডা, টি হোসেন তাকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছেন। এমআর সিদ্দিকী কয়েকদিন পূর্বে আগরতলা য় এসেছেন। চট্টগ্রাম থেকে জহুর আহমদ চৌধুরী এবং সিলেট থেকে আবদুস সামাদও এসে গেছেন। তাছাড়া সেখানে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং মাহবুব আলম চাষীও ছিলেন৷ আগরতলা সার্কিট হাউস পুরােটা আমাদের দখলে। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিংহ ভিন্ন একটি ঘরে অবস্থান করছেন। ওসমানী যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অস্ত্রের তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন। ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানাে হলাে। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন। রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দ বৈঠক বসেন। খন্দকার মােশতাক খুবই মনােক্ষণ। নাটকীয়ভাবে তিনি বলেন, আমরা যেন তাকে মক্কায় পাঠিয়ে দিই৷ আর মুত্যকালে তাঁর লাশ যেন বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি ডা. টি হােসেনের মাধ্যমে মােশতাক সাহেবের মনােভাব জানতে চাইলাম। মােশতাক ও টি হােসেনের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। দুজনেই এক জেলার লােক, পারিবারিক পর্যায়েও তাঁদের সম্পর্ক খুবই মধুর। তিনিই তাঁকে নিয়ে এসেছেন আগরতলায় টি হােসেনের সাথে আলাপ করে জানলাম মােশতাক সাহেব প্রধানমন্ত্রীর পদের প্রত্যাশী। সিনিয়র হিসেবে এই পদ তারই প্রাপ্য বলে তিনি জানিয়েছেন। সারারাত শলাপরামর্শ হলাে অন্দ্রিায় ও দীর্ঘ আলােচনায় আমি খুবই ক্লান্তি অনুভব করি। এক পর্যায়ে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মােশতাক মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হলেন। তবে একটা শর্ত হলাে, তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে হবে। তাজউদ্দীন ভাই এ কথা আমাকে জানান। সবাই এতে রাজি হলেন। কেননা একটা সমঝােতার জন্য এই ব্যবস্থাটা একেবারে খারাপ নয়। অবশ্য শেষে খন্দকার মােশতাক এর মন্ত্রিসভায় যােগদানের বিষয়টির সুরাহা হলাে। একজন হেসে আলহামদুলিল্লাহ বললেন। সকলে জহুর ভাইকে মােনাজাত করতে
পৃষ্ঠাঃ ৩০০
অনুরোধ করলেন। কয়েকদিন পূর্বে পবিত্র হজ পালন করে এসেছেন। তাঁর মাথায় তখনও মক্কা শরীফের টুপি। তিনি আধঘণ্টা ধরে আবেগপ্রবণভাবে মোনাজাত পরিচালনা করেন। তার মােনাজাতে বঙ্গবন্ধুর কথা পাক দস্যুদের অত্যাচারের কথা স্বজন হারানো দেশবাসীসহ শরণার্থীদের কথা এলাে। সে এক অদ্ভুত অপূর্ব দৃশ্য। অনেকের চোখে পানি এসে গেল। এই মােনাজাতের মাধ্যমে আমরা অগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা নিলাম।
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে আগরতলার বৈঠককেই আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে । তাজউদ্দীন ভাই ও আমার প্রচেষ্টায় যে সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, বেঠকে সবগুলাের অনমােদন দেয়া হয়।
এদিকে ওসমানী ও নগেন্দ্র সিংহ এক বৈঠকে যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন । বৈঠকের এক পর্যায়ে আমিও অংশ নেই। এর পূর্বে যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে দিল্লী কলকাতাসহ দেশের বাইরে ভেতরে সীমাবদ্ধ আলোচনা হয়েছে। সব ক’টিকে আমি গভীরভাবে জড়িত ছিলাম। যুদ্ধের প্রকৃতি, ব্যাপ্তি, সামরিক ও সামাজিক দিকগুলো যথাসম্ভব বিস্তারিতভাবে বোঝার চেষ্টা করা হয়।
১৩ এপ্রিল ছোট বিমানে কলকাতা ফিরে গেলাম। মন্ত্রিসভার সদস্য ছাড়াও আবদুস সামাদ আজাদ ও কলে ওসমানা কলকাতা আসেন। বাংলাদেশ থাকে ভারতে পৌঁছার ব্যাপারে আমরা দুটি প্রবেশ পথ ঠিক করি। এর একটি হচ্ছে আগরতলা। এই পথে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নােয়াখালী ও সিলেটের লােকজন প্রবেশ করবে। অন্যান্য জেলার লােকজনদের জন্য প্রবেশ পথ করা হয় কলকাতা। পরে অবশ্য সিলেটের জন্য উডিকিং, ময়মনসিংহের জন্য তােরা পাহাড়, রংপুরের জন্য ভুরুঙ্গামারী, দিনাজপুরের জন্য শিলিগুড়ি, বরিশালের জন্য টাকি, এ রকম বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রবেশপথ ঠিক করা হয়। মন্ত্রিসভার আনুষ্ঠানিক শপথের জন্য ১৪ এপ্রিল দিনটি নির্ধারণ করা হয় । শপথের জন্য আমরা প্রথমে চুয়াডাঙ্গার কথা চিন্তা করি । কিন্ত ১৩ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী দখল করে নেয়। পাক দস্যুরা সেখানে বিমান থেকে বােমাবর্ষণ করে। আমরা চুয়াডাঙ্গায় রাজধানী করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা গােপন থাকেনি। চুয়াডাঙ্গার কথা বাদ দিয়ে আমাদের নতুন স্থানের কথা চিন্তা করতে হলাে।
এই নিয়ে গােলক মজুমদারের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলােচনা হয় । এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, যেখানেই আমরা অনুষ্ঠান করি না কেন, পাকবাহিনীর বিমান হামলার বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৩০১
শেষ পর্যন্ত মানচিত্র দেখে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলাকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। মন্ত্রিসভার শপথের স্থানের নাম আমি, তাজউদ্দীন ভাই, গোলক মজুমদার এবং বিএসএফের চট্টোপাধ্যায় জানতাম। ইতিমধ্যে দ্রুত কতগুলো কাজ করার প্রয়ােজন দেখা দিল। অনুষ্ঠান সূচী নির্ধারণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার খসড়া রচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে বিশ্বের কাছে নবজাত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আবেদন জানাতে হবে। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দেন তার কপি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় করা হয়েছিল । ইংরেজি কপি বিদেশী সাংবাদিকদের দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় কাজ হলাে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা। আমি আর তাজউদ্দীন ভাই যে ঘরে থাকতাম, সে ঘরের ভোটো একটি স্থানে টেবিল ল্যাম্পের আলােতে লেখার কাজ করি। আমার কোন বই নেই, নেই অন্য কোনাে দেশের স্বাধীনতার কপি।
আমেরিকার ইন্ডিপেনডেন্স বিল অনেক দিন আগে পড়েছিলাম। সেই অরিজিনাল দলিল চোখের সামনে ভাসছে। আর সেই বড় বড় হাতের স্বাক্ষরগুলাে। কিন্তু ভাষা বা বক্তব্য কিছুই মনে নেই। তবে বেশি কিছু মনে করার চেষ্টা করলাম না। শুধু মনে করলাম, কি পটভূমিতে আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার রয়েছে। এমনি চিন্তা করে ঘােষণাপত্রের একটা খসড়া তৈরি করলাম। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের খসড়া রচনার পর তাজউদ্দীন ভাইকে দেখালাম। তিনি পছন্দ করলেন। আমি বললাম আমরা সকলে এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ । এই দলিলে খসড়াটি কোনাে এক বিজ্ঞ আইনজীবীকে দেখাতে পারলে ভালাে হতাে। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে কাকে আর দেখাবেন, যদি সম্ভব হয়, কাউকে দেখিয়ে নিন। ইতােমধ্যে কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবীরা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন । এঁদের মধ্যে সুব্রত রায় চৌধুরীর নাম আমি শুনেছি। রায় চৌধুরীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে। আমি তাঁর লেখা কিছু নিবন্ধ পড়ছি বলে মনে হলাে। বিএসএফের মাধ্যমে রায় চৌধুরীর ঠিকানা জেনে নিলাম। টেলিফোনে তার সাথে যােগাযােগ করি। বললাম তার সাথে দেখা করতে চাই। তিনি রাজি হলেন। বালিগঞ্জে তাঁর বাসা। সুব্রত রায় চৌধুরীর বাসায় পৌছে তাকে আমার প্রণীত ঘােষণাপত্রের খসড়াটি দেখালাম। খসড়াটি দেখে তিনি বললেন একটি কমা বা সেমিকোলন বদলানােরও কোনাে প্রয়ােজন নেই। তিনি বললেন, বাংলাদেশে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার যে আইনানুগ অধিকার, তা মানবাধিকারের একটি অংশ। এই কথা স্বাধীনতার সনদে ফুটে উঠেছে। তিনি জানান, তিনি এর ওপর একটা বই লিখছেন। এই ঘােষণাপত্রের একটা কপি
পৃষ্ঠাঃ ৩০২
তাকে দেওয়ার জন্য তিনি অনুরােধ করলেন। এরপর ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ওপর বই লেখা শুরু করেন। তাঁর রচিত বইটির নাম হচ্ছে ‘জেনেসিস অব বাংলাদেশ’। ইউরােপে ও আমেরিকার বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এ বই পড়ানো হচ্ছে।
এটা সুব্রত চৌধুরীর সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি বড় ভাইয়ের মতাে সময়ে অসময়ে সাহায্য করেছেন । আমার জন্য তার দুয়ার সর্বদাই ছিল খোলা।
এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটি তৈরি করা হচ্ছে। জানা গেল প্রধান সেনাপতি ওসমানীর সামরিক পােশাক নেই। কিন্তু শপথ অনুষ্ঠানের জন্য তার সামরিক পোশাক দরকার। বিএসএফকে ওসমানীর জন্য একসেট সামরিক পোশাক দিতে বললাম। তাদের স্টকে ওসমানীর গায়ের কোনাে পােশাক পাওয়া গেল না। সেই রাতে কাপড় কিনে দর্জি ডেকে তার জন্য পােশাক তৈরি করা হলো। শপথ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের হাজির করার ভার ছিল আমার ও আবদুল মান্নানের ওপর। ১৬ এপ্রিল আমরা দু জনে কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। এই প্রথম বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে দু জন প্রতিনিধি বিদেশী সাংবাদিকদের সাথে মিলিত হই। সমস্ত প্রেসক্লাব লােকে লােকারণ্য, তিল ধারণেরও ঠাই নেই৷ সার্চ লাইটের মতাে অসংখ্য চোখ আমাদের দিকে নিবদ্ধ। ক্লাবের সেক্রেটারি উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাদেরকে অনুরোধ জানাই আমাদের উপস্থিতির কথা গােপন রাখতে হবে। এরপর বললাম, আমরা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি বার্তা নিয়ে এসেছি। সমবেত সাংবাদিকদের পরদিন ১৭ এপ্রিল কাকডাকা ভােরে এই প্রেসক্লাবে হাজির হতে অনুরােধ জানাই। বললাম তখন তাদেরকে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি বিশেষ বার্তা দেয়া হবে। তাদের কেউ কেউ আরও কিছু প্রশ্ন করতে চাইলেন। আমরা তখন উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করি। এতে তারা কেউ কেউ হতাশও হন। সাংবাদিকদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে বলেও জানালাম । আওয়ামী লীগের এমপিএ এবং এমএনএ ও নেতাদের খবর পাঠিয়ে দিই রাত বারােটার মধ্যে লর্ড সিনহা রােডে সমবেত হওয়ার জন্য। বিএসএফের চট্টোপাধ্যায়কে বলি আমাদের জন্য ১০০টি গাড়ির ব্যবস্থা করতে। এর ৫০টা থাকবে প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের বহন করার জন্য অবশিষ্ট ৫০টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাংলাদেশ সীমান্তে পৌছানাে হবে। রাত বারােটা থেকে নেতাদের আমি গাড়িতে তুলে দিই। বলে দেয়া হলাে সকাল বেলা আমরা একত্রিত হব । গাড়ির চালক নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেবেন।
পৃষ্ঠাঃ ৩০৩
সাইকোস্টাইল করা স্বাধীনতা সনদের কপিগুলাে গুছিয়ে নিলাম। হাতে লেখা কিছু সংশােধনী রয়েছে। কয়েক জনকে এগুলাে সংশােধন করার জন্য দিই।
১৭ এপ্রিল আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন৷ স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকারের মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের দিন । সারা রাত ঘুম হয়নি। ভােরের দিকে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান এবংওসমানী সাহেব একটি গাড়িতে রওনা হয়ে যান। আমি ও আবদুল মান্নাম ভোরের দিকে পূর্ব কর্মসূচি অনুযায়ী কলকাতা প্রেসক্লাবে যাই। সেই ভােরেও ক্লাবে লোক ধরেনু৷ ক্লাবের বাইরেও অনেক লােক দাঁড়িয়ে ছিল। আমি সাংবাদিকদের বিনীতভাবে বললাম, আমি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের জন্য একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। তাঁদের জানালাম স্বাধীন বাংলার মাটিতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করবেন। আপনারা সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কেউ কেউ জানতে চাইলেন কিভাবে যাবেন, কোথায় যাবেন। আমি পুনরায় বলি আমি আপনাদের সাথে রয়েছি পথ দেখিয়ে দেব। আমাদের গাড়িগুলাে তখন প্রেস ক্লাবের সামনে। উৎসাহিত সাংবাদিকরা গাড়িতে ওঠেন। তাঁদের অনেকের কাধে ক্যামেরা, ৫০/৬০টা গাড়ি যােগে রওনা হলাম গন্তব্যস্থলের দিকে । আমি ও আবদুল মান্নান দু’জনে দুই গাড়িতে। আমার গাড়িতে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক ছিলেন৷ পথে তাদের সাথে কথা হলাে।
শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত স্থান আম্রকাননে পৌছতে ১১টা বেজে গেল। অনুষ্ঠানের আয়ােজন প্রায় শেষ। মাহবুব ও তওফিক এলাহী ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। আগেই ঠিক করা হয়েছিল যে, চিপ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার সনদ পাঠ করবেন। এদিকে হানাদার বাহিনীর চাপের মুখে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটতে হয়েছে । সম্মুখ সমরে জয়ী হওয়া মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব নয়। নির্দেশ সত্ত্বেও দেশমাতৃকার মুক্তিপাগল যােদ্ধারা বাংকার ছেড়ে আসতে রাজি হচ্ছিল না। মাহবুব ও তওফিক তাঁদের সৈন্যসহ পাক হানাদার বাহিনীর দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা সুকৌশলে পিছু হটে আসেন। মনােবল ঠিক রেখে পশ্চাদপসরণ একটি কঠিন কাজ। ক্লান্ত-শ্রান্ত মুক্তিযােদ্ধারা বাঙ্কার থেকে উঠে আসে। ওদের চোখে-মুখে বিশ্বাসের দীপ্তি বিদ্যমান ছিল। কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু হলাে। একটি ছােট মঞ্চে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, ওসমানী, আবদুল মান্নান ও আমি অনুষ্ঠান পরিচালনা করি।
পৃষ্ঠাঃ ৩০৪
ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেন। একজন সাংবাদিকর প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাৎক্ষণিকভাবে এই স্থানের ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল প্রবাসে গঠিত প্রথম বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী।
সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রধান প্রশ্ন ছিল, সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোথায়? জবাবে বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে৷ তার সাথে আমাদের চিন্তার মিল রয়েছে। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দী। কিন্তু আমরা তা বলতে চাইনি। পাকবাহিনী বলুক এটাই আমরা চাচ্ছিলাম। কারণ আমার যদি বলি বঙ্গবন্ধু পাক শিবিরে বন্দী আর তারা তা অস্বীকার করে , তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। আর আমরা যদি বলি তিঞ্জ দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তখন হানাদাররা বলে বসবেন তিনি বন্দী আছেন। আম বাগানের অনুষ্ঠানে ভরদুপুরে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার লােক জমায়েত হয়। হাজারো কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিল ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ইত্যাদি স্লোগান। আমার কাজ ছিল দ্রুত অনুষ্ঠান শেষ করে সাংবাদিকদের ফেরত পাঠানাে। দুপুরের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সাংবাদিকদের গাড়িযােগে ফেরত পাঠনাে হলাে। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ফেরেন সন্ধ্যায়। অনুষ্ঠানের পর কলকাতা গিয়ে সাংবাদিকরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই সংবাদ পরিবেশন করেন।
শপথ অনুষ্ঠানের পর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। সরকারের যােগ্য এবং দক্ষ নেতৃত্বের জন্য বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতেও মাত্র নয় মাসের মধ্যেই বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে ঐ সরকার, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।”৫
পৃষ্ঠাঃ ৩০৫
১২
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ
১৭ এপ্রিল ১৯৭১
তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কলকাতা থেকে মেহেরপুরের এসডিও, এমপি ডা. আসাবুল হক, সেক্টর কমান্ডারআবু ওসমান চৌধুরীর সথে যােগযােগ করে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। কুষ্টিয়া থেকে নির্বাচিত এমএনএ, এমপি, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযােদ্ধাসহ অনেকে অনুষ্ঠান আয়ােজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেশী-বিদেশী সাংবাদিকসহ এক শ’ যানবাহনে ১৭ এপ্রিল সকাল ১১টায় মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে পৌছেন। টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান এমএনএ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানে কোরান তেলাওয়াত, জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাংলা আমি তোমায় ভালােবাসি’ পরিবেশন করা হয়। অতঃপর অধ্যাপক ইউসুফ আলী ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘােষণাপত্র পাঠ করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
মুজিবনগর, তারিখ : ১০ এপ্রিল, ১৯৭১, শনিবার, ২৭ চৈত্র, ১৩৭৭
যেহেতু ১৯৭০ সনের ৭ ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে
এবং
যেহেতু এই নির্বাচনের বাংলাদেশের জনগণ তাদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন
এবং
যেহেতু আহূত এ পরিষদ স্বেচ্ছাচার ও বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়
এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে
পৃষ্ঠাঃ ৩০৬
বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলােচনাকালে পাকিস্তান কতৃপক্ষ ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক একটি যুদ্ধ ঘােষণা করেন
এবং
যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।
এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছে এবং এখনও বাংলাদেশের অসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নজিরবিহীন নির্যাতন চালাইতেছে
এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে
এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাঁহাদের কার্যকরী কৰ্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে
সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচন প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন, সেই ম্যান্ডেট মােতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।
সেইহেতু
আমরা বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা পূর্বাহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন করিতেছি।
এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না
পৃষ্ঠাঃ ৩০৭
হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র প্রধান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সব প্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়ন ও ক্ষমতার অধিকারী।
রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষমতা থাকিবে। তাঁহার গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও উহার অধিবেশন মুলতবি ঘােষণার ক্ষমতা থাকিবে। উহা দ্বারা বাংলাদেশের জনসাধারনের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হইবেন।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছে যে, কোনাে কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যােগদান করিতে না পারেন অথবা অক্ষম হন, তাহা হইলে তাহার কর্তব্য ও প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মােতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব কর্তব্য বৰ্তাইয়াছে উহা যথাযথভাবে আমরা পালন করিব।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘােষণা ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলিয়া গণ্য হবে।
আমরা আরাে সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতেছে যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য আমরা অধ্যাপক এম ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ- রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করিলাম ।১
স্বাক্ষর
এম ইউসুফ আলী
বাংলাদেশ গণপরিষদের পক্ষ থেকে
আইনের অব্যাহত কার্যকরণ আদেশ মুজিবনগর-
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
“আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে স্বাধীনতার ঘােষণার দ্বারা ক্ষমতাবান হয়ে এতদ্বারা আদেশ করছি। যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বে যে সকল আইন কার্যকর ছিল তা কার্যকর
পৃষ্ঠাঃ ৩০৮
থাকবে। তবে জনগণের ইচ্ছা অনুসারে গঠিত সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ সৃষ্টির কারনে যে আইন পরিবর্তন প্রয়ােজন তা করতে হবে। বেসামরিক, সামরিক, বিচার বিভাগ এবং কূটনীতিবিদগণ যারা বাংলাদেশের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেছেন, তারা সকল দপ্তরের চাকরির যে সকল শর্তাধীনে চাকরি করতেন সেভাবে তারা চাকরিরত থাকবেন৷ জেলা জজ, ম্যাজিস্ট্রেট, দূতাবাসের প্রতিনিধিগণ তাদের এলাকার সরকারী কর্মকর্তাদের শপথের আয়োজন করবেন।
এ আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে কার্যকর হবে।”২
স্বাক্ষর সৈয়দ নজরুল ইসলাম
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ পড়ান। অনুষ্ঠানে ৫০ জনের বেশি বিদেশি সাংবাদিক ও ফটোসাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিসভাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ পিএসপি। স্থানীয় আনসার, পুলিশ ও ইপিআর কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। শপথ অনুষ্ঠানের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি ভাষণ দেন৷ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদের নেতৃত্বে সাংবিধানিক সরকার পৃথিবীর ইতিহাসে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের রাজধানীর নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। মুজিবনগর সরকার গঠনের ফলে বিশ্ববাসী বাঙালীর স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন ও সহযােগিতায় এগিয়ে আসে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে মুজিবনগর সরকার গঠন এক যুগান্তকারী ঘটনা।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। নিম্নের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সরকার গঠন করা হয় ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – রাষ্ট্রপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
তাজউদ্দীন আহমদ – প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা, সংস্থাপন
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী – অর্থ
খন্দকার মােশতাক আহমদ – পররাষ্ট্র
এএইচএম কামারুজ্জামান – স্বরাষ্ট্র
কর্নেল এমএজি ওসমানী – প্রধান সেনাপতি
শপথ অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৭
পৃষ্ঠাঃ ৩০৯
এপ্রিল প্রেসে এক বিবৃতি দেন। তিনি ভাষণে বলেন :
এপ্রিল ১৭, ১৯৭১
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ:
আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাবার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।
আমি কি বলবার আগে প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সংবাদপত্রসেবী ও নিউজ এজেন্সির প্রতিনিধিদেরকে যে, তারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আগাগােড়া সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন এবং সত্য কথা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। যদিও ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে এবং তার সেই দস্যুবাহিনী বিদেশী সাংবাদিকদেরকে ভেতরে আসতে দেয়নি, যারা ভেতরে ছিলেন তাদেরকেও জবরদস্তি করে ২৫ তারিখ রাতেই বের করে দিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে আরও ধন্যবাদ দিচ্ছি, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই জন্য যে, আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম সেই সংগ্রাম কোন অবস্থাতেই যাতে ব্যাহত না হয় এবং কোন অবস্থাতেই সে সংগ্রামকে ভুল ব্যাখ্যা না দেয়া হয় সে জন্য আপনারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। সঠিক পথ দেখিয়েছেন।
আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আবেদন জানাব ভবিষ্যতেও আপনারা দয়া করে চেষ্টা করবেন যাতে সঠিক সংবাদ পরিবেশিত হয়, যাতে কোন দুষ্কৃতকারী বা কোন শত্রু বা এজেন্ট ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের আন্দোলনের কোন রকম ভুল ব্যাখ্যা করতে না পারে, ভুল বােঝাতে না পারে। সেই সাথে আমি আপনাদেরকে আরও অনুরােধ জানাব আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে হ্যান্ডআউট যাবে সেটাকেই বাংলাদেশ সরকারের সঠিক ভাষ্য বলে ধরে নেবেন, সেটাকেই ভিত্তি হিসেবে ধরে নেবেন। আর আমি আপনাদের আরও একটি অনুরােধ জানাব জানি না কিভাবে সেটা সম্ভব হবে, আমাদের বাংলাদেশের মাটি থেকে আপনারা কিভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন, কিভাবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে লিয়াজোঁ করতে পারেন সেই ব্যাপারে আপনারা চিন্তা করে দেখবেন এবং সেই ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শআমরা অত্যন্ত সাদরে, আনন্দের সাথে গ্রহণ করব।
পৃষ্ঠাঃ ৩১০
এখন আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমার আমার ভাষ্য তুলে ধরব।
“বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের ঔপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধীকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোন বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে। কিভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।
জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ৬ দফার আলােকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ৬ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে মােট ১৬৭টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনী বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামী লীগ মােট শতকরা আশিটি ভোট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ।
স্বভাবতই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন এক আশাময় দিন ।কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জনগণই বিশ্বাস করেছিলেন যে, এবার ৬ দফার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযােগ্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু এবং পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ৬ দফাকে এড়িয়ে গিয়েছিল। কাজেই ৬ দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার জন্য জনগণের কাছে এই দরে জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল ৬ দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ৬ দফার আলােকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ‘৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল।
আশা করা গিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাে আলােচনায় বসবে। এমনি আলােচনার প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সব
পৃষ্ঠাঃ ৩১১
সময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে, যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে জাগ্রত রাখার জন্য গােপনীয় সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্বর জাতীয় পরিষদ আহ্বানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রনয়নের কাজে লেগে গেলে এবং এ ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও তারা পরীক্ষা করে দেখল।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলােচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ‘৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ৬ দফা ভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলেন এবং ফল কি হতে পারে তারও নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে, ৬ দফায় সাংঘাতিক আপত্তিজনক কিছুই তিনি খুজে পাননি। তবে পাকিস্তান পিপলস পাটির সাথে একটি সমঝোতায় আসার ওপর তিনি জোর দিলেন।
পরবর্তী আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পাটি এবং আওয়ামী লীগের সাথে ঢাকায় ২৭ জানুয়ারি ‘৭১। জনাব ভুট্টো এবং তার দল আওয়ামী লীগের সাথে গঠনতন্ত্রের ওপর আলােচনার জন্য এ সময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন।
ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামাে সম্পর্কে কোনাে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেননি। বরং তিনি এবং তার দল ৬ দফার বাস্তব ফল কি হতে পারে সে সম্পর্কে আলােচনার প্রতিই অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না সূচক, এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোনাে তৈরি বক্তব্যও ছিল না, সেহেতু এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপােস ফর্মুলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দুয়ার সব সময়ই খােলা ছিল। এই আলােচনা বৈঠক থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোন পর্যায় থেকে আপােস ফর্মুলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোনাে বক্তব্য ছিল না।
| এখানে একটি কথা আরও পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার যে, আওয়ালী লীগের সাথে আলােচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোন আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা
পৃষ্ঠাঃ ৩১২
দিয়ে গেলেন যে, আলােচনার জন্য সব দরজাই খােলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানেত অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলােচনার পর পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরাে অধিক ফলপ্রসূ আলােচনায় বসবেন, অথবা জাতীয় পরিষদেও তারা ভিন্ন আলােচনায় বসার জন্য অনেক সুযােগ পাবেন।
পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত করে যে, শেখ মুজিবের দাবি মােতাবেক ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতােই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সমস্ত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যােগদান থেকে বিরত রাখা। এ কাজে ভুট্টোর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর লেঃ জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের ওপর পরিষদের অধিবেশনে যােগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ সত্ত্বেও পিপিপি ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য বিমানের পূর্ববাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, পিপিপির বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোনাে কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘােষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য। শুধু তাই নয়, জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব- বাংলার গভর্নর আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনে মধ্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালীদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারি জান্তার হাতে তুলে দেয়া হলাে।
এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোনক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণরায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র স্থান যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকর
পৃষ্ঠাঃ ৩১৩
করতে পারত এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারত। এটাকে বানচাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমিতার উৎস না করে একটা ‘ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করার।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূতভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এক পাকিস্তানের কাঠামো বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহবান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালী শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা এক বাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন।
শেষ মুজিব এতদসত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানে জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩ মার্চ অসহযােগ কর্মসূচির আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মােকাবেলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনও তিনি আশা করছিলেন যে, সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২ ও ৩ মার্চ ঠাণ্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শেখ সাহেবের অসহযােগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযােগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযােগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরী অসহযােগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ সহযােগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণপ্রশাসন বিভাগের কর্মচারীগণ কাজে যােগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারীগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যােগদান থেকে বিরত থেকে তারা ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লােকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন
পৃষ্ঠাঃ ৩১৪
শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্টভাবে ঘােষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারও নির্দেশ মেনে চলবেন না ।
এ অবস্থায় মুখােমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃকপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলীর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল৷ বাংলাদেশের কোনাে আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যে আদর্শ স্থাপন করেছিল তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলাে। কেননা তার ঐদিনের প্ররােচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের ওপর। অথচ যিনি ছিলেন সঙ্কটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকার সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ । লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানাে হলাে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনােভাবের পরিচয়।
কিন্তু ইতােমধ্যেই মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এ সত্ত্বেও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদের যােগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানাের জন্য ইয়াহিয়াকে দেয়া হয় তার শেষ সুযােগ।
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া
পৃষ্ঠাঃ ৩১৫
এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা । এটা আজ পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেয়া হয়েছিল।
১ মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়ােজিত ট্যাঙ্কগুলাে ফেরত আনা হয়। ১ মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানী কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লােকদের পরিবার পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হতে থাকে।
১ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পিআইয়ের কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পােশাকে সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের বাংলাদেশে আনা হলাে। সি ১৩০ পরিবহন বিমানগুলাের সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্তুপীকৃত করা হয়।
হিসাব নিয়ে জানা গেছে, ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে প্রয়ােজনীয় সাজসরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমানবন্দর এলাকায় আর্টিলারি ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন নির্গমনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এসজি কমান্ডো গ্রুপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যেসব কুকাণ্ড ঘটে এরাই সেগুলাে সংঘটন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্য স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এ সবের উদ্দেশ্য।
প্রতারণা বা ভণ্ডামির এই স্ট্রাটেজি গােপন করার অংশ হিসেবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলােচনায় আপােসমূলক মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন । ১৬ মার্চ আলােচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলােচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে। জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনােভাব কি? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, এ ব্যাপারে তাদের তেমন কোনাে আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে, ৪ দফা শর্ত পূরণের ভিত্তিতে
পৃষ্ঠাঃ ৩১৬
উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।
আলোচনা কালে যেসব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলাে হলাে :
১. মার্সাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটি বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
২. প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
৩. ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।
৪. জাতীয় পরিষদ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।
আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনােনয়নের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজই বলেছিলেন যে, ৬ দফা হলাে বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্নয়ের এক নির্ভরযােগ্য নীলনকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়ােগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানী এমএনএদের পৃথকভাবে বসে ৬ দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলােপের আলােকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তােলার সুযােগ অবশ্যই দিতে হবে।
শেখ মজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তা হলাে অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন। এক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মােটামুটি তার আলােকেই কেন্দ্র বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে। অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এমএম আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-আলােচনায় তিনি স্পষ্টভাবে এ কথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬ দফা কার্যকর করার প্রশ্নে দুর্লভ কোন সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না।
আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে তিনটি সংশােধনী পেশ করেছিলেন তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথাও কোন শব্দ বসবে তা নিয়ে। ২৪ মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশােধনীগুলাে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চুড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া
পৃষ্ঠাঃ ৩১৭
ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোন বাধাই ছিল না।
এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে হয়, কোন পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস ইঙ্গিতেও এমন কোনাে কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
গণহত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোছুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল তিনিও সেভাবে একটা ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তাই অনুমােদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইয়াহিয়া ঘুণাক্ষরেও এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার৷ ইয়াহিয়া যদি আভাস ইঙ্গিতেও এ কথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করত না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলোচনা বানচাল করতে দেয়া যায় না। তা ছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোন সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।
২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে এমএম আহমদ তার সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চুড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোনাে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং এমএম আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫ মার্চ করাচি চলে গেলেন।
২৫ মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে ‘পজিশন’ গ্রহণ করতে থাকে । মধ্যরাত নাগাদ ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হলাে গণহত্যার এক পূর্ব নির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোন চরমপত্র । অথবা মেশিনগান, আর্টিলারি
পৃষ্ঠাঃ ৩১৮
সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ যখন মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারি করা হয়নি কোন কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লে. জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লােক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুণ্ডে, প্রতিটি অলিগলি ও আনাচে -কানাচে চলতে লাগল নির্বিচারে গুলি । সামরিক বাহিনীর বাহিনীর লোকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযােগের মুখে অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যে সব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করল তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হয় মেশিনগানের গুলিতে।
আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ইপিআর বীরের মতাে লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোন প্রতিরোধ দিতে পারল না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযােগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শিগগিরই তা প্রকাশ করব। মানুব সভ্যতার ইতিহাসে যে সব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে স্নান করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালী হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জানানাে হলাে এর কৈফিয়ত। এই বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পরবিরােধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ- আলােচনা চালাচ্ছিলেন সে দলের লােকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘােষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ-আলােচনায় কোনাে সঙ্গতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘােষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অবাধ মত প্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না। তার বক্তব্য থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলাে যে, ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন জঙ্গি আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর।
পৃষ্ঠাঃ ৩১৯
পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব-পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উতিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোন মতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বৰ্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই৷ উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদারি সৈনিকরা লঙ্ঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারি পশুর মতাে। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এ সব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রাের্থিত হয়ে গেছে। যদি না হতাে তাহলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানের বিয়ােগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালীর রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়ি হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পােড়ামাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হলাে আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলােকে ধূলিসাৎ করা, যাতে একটি জাতি হিসেবে কোনােদিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি ।
ইতােমধ্যে এ লক্ষ্যপথে সেনাবাহিনী অনেকদূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শােষণ করেছে, তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসেবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে পড়ল।
বেলসেন এবং অসউহজের পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উটপাখির নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে, এতদ্বারা তারা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তাহলে তারা ভুল
পৃষ্ঠাঃ ৩২০
করেছেন। কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মোহমুক্ত।
তাদের বােঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত ও ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশের আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অজেয় মনােবল ও সাহসের মাধমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোন জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক বা কাল হােক দুনিয়ার ছােট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন রাষ্ট্রকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।
সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবাে। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সে জন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাব । প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভস্ম ও ধ্বংসস্তুপের ওপর একটা নতুন দেশ গড়ে তােলা। এ একটা দুরূহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এ ছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ একটা ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে।
আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধাবিপত্তি টিকতে পারে না।
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছােট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনােভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ৩২১
সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারও তাঁবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।
আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ওবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর কাছে আকুল আবেদন, আর কালবিলম্ব করবেন না, এই মুহর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন।
বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারেন না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।”৩
প্রধানমন্ত্রী তার ১১ এপ্রিলের ভাষণে বাংলাদেশকে নিমােক্ত অঞ্চলে সেক্টর কমান্ডার নিয়ােগ করেন ।
চট্টগ্রাম, নােয়াখালী – মেজর জিয়াউর রহমান
সিলেট, কুমিল্লা – মেজর খালেদ মােশাররফ
ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল – মেজর সফিউল্লাহ
কুষ্টিয়া, যশাের – মেজর আবু ওসমান চৌধুরী
রাজশাহী – মেজর আহমদ
দিনাজপুর, রংপুর – মেজর নজমুল হক
পাবনা, বগুড়া – মেজর নওয়াজেশ
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সর্বপ্রথম পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের পুনর্গঠিত করেন।
১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কর্নেল অব. এমএজি ওসমানী এমএনএকে Commander-in-Chief প্রধান সেনাপতি নিয়ােগ করেন। তিনি বাংলাদেশকে চারটি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডার নিয়ােগ করেন।
মেজর খালেদ মােশাররফ : সিলেট-কুমিল্লা।
মেজর জিয়াউর রহমান : চট্টগ্রাম-নােয়াখালী
পৃষ্ঠাঃ ৩২২
মেজর সফিউল্লাহ : ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল
মেজর এমএ ওসমান চৌধুরী : দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল
মুক্তিযােদ্ধাদের পুনর্গঠিত করে প্রধামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি প্রথমেই কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনারকে সরকারের পক্ষে নিয়ে আসেন। তার অনুরােধে ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার এম সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন । তার দপ্তরের ৫ জন অফিসার এবং ৭ জন বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশে সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেন। পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার অফিস বাংলাদেশ সরকার দখল করে নেয়। এ অফিস বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
২০ এপ্রিল দিল্লীস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনার অফিসার কেএস শাহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ লন্ডনে অবস্থানরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধি নিয়ােগ করেন।
স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনগণের প্রতি
বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশাবলী
হানাদার পাকিস্তানী পশুশক্তিকে বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে হটিয়ে দেবার ও বাঙালীকে শােষণমুক্ত করে একটি নতুন সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তােলার দৃপ্ত শপথ ও ব্রত নিয়ে বাঙালীর প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নেতৃত্বে গত ১২ এপ্রিল রাতে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার থেকে বাংলাদেশ সরকার ঘােষণা করা হয়েছে। এ ঘােষণার পর থেকে মুক্তি সংগ্রাম ঠিক পূর্বের মতােই এক সুস্পষ্ট গতিতে চলছে। প্রতিটি বাঙালী আজ নিজ নিজ ঘরে প্রতিরােধের দুর্গ গড়ে সঙ্কল্প দৃঢ় থেকে আরও দৃঢ়তর করতে তুলছে।
জনযুদ্ধের আশু সাফল্য অর্জনের উদ্দেশে সরকার সম্প্রতি কতকগুলাে নির্দেশ জারি করেছে।
নির্দেশাবলী
১. প্রতি শহর, গ্রাম, মহল্লায় একজন অধিনায়ক নির্বাচিত করে সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা রক্ষা, অসহযােগ, প্রতিরােধ ও দুর্বার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৩২৩
২. নিজ নিজ এলাকায় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদা মিটাবার জন্য খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও উৎপাদন বাড়াতে হতে।
৩. চুরি, ডাকাতি, কালােবাজারী ইত্যাদি সমাজবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪. দৈনন্দিন জীবনে সংযম ও কৃচ্ছ্র চালিয়ে যেতে হবে বিলাসিতা ত্যাগ করে জাতির বৃহত্তর কল্যাণে পারস্পরিক দৃঢ়তার হাতকে দৃঢ়তর করতে হবে।
৫ শত্রুকে চিনতে হবে- দেশদ্রোহীকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার সাথে মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতিরােধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে।
৭. গ্রাম, শহর, মহল্লায় নেতা নির্বাচন করে যােগাযােগ ও পণ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা করবে। উপরের স্তরে শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবে প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের হাতে।
৮, মুক্ত এলাকায় সরকারী-আধা সরকারী কর্মচারীরা প্রতিনিধিদের নির্দেশে কাজ করবে। শত্রুকবলিত এলাকায় নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
৯. সকল সামরিক, আধা সামরিক, কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত বাঙালী কর্মচারীরা নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যােগ দেবেন এবং কোন অবস্থাতে শক্রর সহযােগিতা করবেন না।
১০. যােগাযােগ ব্যবস্থা, বিশেষভাবে নৌ-চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা শত্রুর সাথে সহযােগিতা করবেন না।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ মুজিব
স্মরণ করুণ “আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- অতীতের চাইতে ভবিষ্যত নিশ্চয় সুখকর, বিশ্বাস রাখুন, আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী ।”৪
বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীর প্রতি নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী জারি করে-
• পাক সরকার ও দখলদার বাহিনীকে কোন প্রকার সহযােগিতা করা চলবে না। সকল প্রকার খাজনা, শুল্ক পাক সরকারকে দেয়া চলবে না।
• আঠারাে থেকে ত্রিশ বছরের যুবকরা অবিলম্বে মুক্তিফৌজের অধিনায়ক বা প্রতিনিধির সাথে যােগাযােগ স্থাপন করবেন।
• পাটের পরিবর্তে আউস ধান চাষ করতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৩২৪
•গণধিকৃত দখলদার নিঃশেষ করতে হবে । সংগ্রামবিরােধী গােয়েন্দাদের নির্মূল করা প্রত্যেকটি বাঙালীর কর্তব্য।
•মুক্তি ফৌজের সাথে সর্বপ্রকার সহযােগিতা এবং দখলদার বাহিনীর প্রতিপদে বাধা দিতে হবে।
• সকল সরকারি- বেসরকারি কর্মচারীদের পাক সরকারের অধীনে কাজে যােগ না দিয়ে স্বাধীন না দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে মুক্তি সংগ্রামের কাজে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
-স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রচার দপ্তর থেকে প্রচারিত।
২৯ মে তাজউদ্দীন আহমদ বেতার ভাষণে বলেন, “আমরা পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম এবং এ লক্ষ্যে আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। আমরা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইয়াহিয়ার নির্লজ্জ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর জন্য স্বাধীনতা ঘােষণা ব্যতীত আমাদের অন্য কোনাে উপায় ছিল না। এ সময় ইয়াহিয়া খানের দূত মীমাংসার জন্য প্রস্তাব দেয়। আমেরিকাও যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায় যে, “বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র কোন প্রকার সমঝোতার সম্ভাবনা বাতিল করেছে। পাকিস্তানের সাথে আলােচনার কোন প্রশ্নই ওঠে না।”
২ জুন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ জয় বাংলা পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে আলােচনাকালে বলেন, “বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। পাকিস্তানের কাঠামােতে কোনাে আপােস মীমাংসার প্রশ্ন উঠতে পারে না।”
১৯৭১ সালের ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধের জনগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ১৮ দফা নির্দেশাবলী জারি করেন ।
১৯৭১ সালের ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধকালে জনগণের পালনীয় ১৮ দফা নির্দেশ :
১৯৭১ সালের ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালে জনগণের পালনীয় ১৮ দফা নির্দেশ জারি করেন-
১. জনগণের চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে কোনাে সন্দেহ নেই- গুজবে কান দেবেন না।
২. যুদ্ধে অগ্রসর হওয়া বা পিছুহটা একরকম গুরুত্বপূর্ণ। এক স্থানে যুদ্ধ
পৃষ্ঠাঃ ৩২৫
পরিত্যাগ করে অন্যস্থানে যুদ্ধ করা সম্পর্কে জনগণের ভুল বুঝা উচিত নয়।
৩. ধর্ম, দল ও শ্রেণী নির্বিশেষে জনগণ বাঙালী হিসেবে ঐক্যবদ্ধ।
৪. সকল পদের বাঙালী কর্মচারিগণ শত্রুর সাথে কোন সহযোগিতা করবে না। শত্রু দখলকৃত এলাকার কর্মচারিগণ জননেতার পরামর্শে কাজ করবেন।
৫. সরকারী-বেসরকারী কর্মচারিগণ যারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন তারা বাংলাদেশ সরকারের কর্মচারী হিসেবে গণ্য হবেন এবং তারা বাংলাদেশের সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করবে।
৬. সামরিক, আধাসামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সিপাহিরা অবিলম্বে নিকটবর্তী মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে যোগ দেবেন এবং কোন অবস্থায় শত্রুর সহযােগিতা করবেন না।
৭. রাজস্ব আদায়ের একমাত্র ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের, অন্য কারো ক্ষমতা নেই। যারা শত্রুদের রাজস্ব দেবে তারা শত্রু হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তাদের শাস্তি প্রদান করা হবে।
৮. যানবাহনের কর্মচারী শত্রুদের সহযােগিতা করবে না। যানবাহন নিয়ে তারা শত্রু দখলীয় এলাকা পরিত্যাগ করবে।
৯. খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহের প্রতি সতর্ক থাকবেন।
১০. জনগণকে অধিক খাদ্য ফলাতে হবে।
১১. বিদেশী খাদ্যদ্রব্যের ওপর নির্ভর করা আত্মহত্যার সমতুল্য ।
১২. স্থানীয় উৎপাদিত দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।
১৩. কালােবাজারী মুনাফাকারী মজুদদার এবং চোর । এ জাতীয় সংকটকালে তারা এক নম্বর শত্রু। তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে এবং প্রয়ােজনে শাস্তি দিতে হবে।
১৪. বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে হুশিয়ার থাকতে হবে। তারা ধর্মের নামে ঐক্যবদ্ধ দেশের নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের এজেন্ট।
১৫. ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক জাতীয় পরিষদের সদস্যদের গণপরিষদের সদস্য বা এমপি এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের এমএলএ হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে।
১৬. জয় বাংলা পত্রিকায় ইতিমধ্যে ঘােষণা দেয়া হয়েছিল যে দলের এমপি এবং এমএলএ নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা
পৃষ্ঠাঃ ৩২৬
প্রদান করবেন। নিজ এলাকায় থাকা সম্ভব না হলে নিকটবর্তী মুক্তিযােদ্ধা ইউনিটে যোগ দিয়ে যুদ্ধের তত্ত্বাবধান করবে।
৭. যে সকল এমপিএ এমএনএ সীমান্ত অতিক্রম করেছেন তারা দলের নির্দেশনা অনুসারে কাজ করবেন।
১৮. যারা সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তু শিবিরে আছে তাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, এ হলাে অস্থায়ী ব্যবস্থা, তারা স্থায়ী বসবাসের জন্য আসেনি।
সকল সম্পদ সুষ্ঠ বণ্টনের জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়ােগ করা হয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে ১৯৭১ সালের
এপ্রিল মাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত
তাজউদ্দীন আহমদ একজন প্রতিভাশালী রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক ও সমর বিশারদ ছিলেন । সাচিবিক কাজে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। মুক্তার মতাে ছিল তার হাতের লেখা। তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। মন্ত্রিসভার কার্যবিবরণী তিনি স্বহস্তে লিখতেন এবং এবং পরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষর করতেন।
১৯৭১ সালের এপ্রিলে মন্ত্রিসভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ :৫
প্রথম সভা
১২ এপ্রিল, ১৯৭১
(তাজউদ্দীন আহমদের স্বহস্তে লেখা ইংরেজীর অনুবাদ)
আলােচ্যসূচী
১. সরকারের দপ্তর
২. সচিবালয় প্রতিষ্ঠা
৩. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
৪. পুলিশের মহাপরিদর্শক
১. প্রতিরক্ষা যুদ্ধ যুদ্ধের সরবরাহ, স্বরাষ্ট্র
২. পররাষ্ট্র
৩. অর্থ
৪. খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং বেসামরিক সরবরাহ
৫. বাণিজ্য ও শিল্প
৬. স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার
৭. যােগযােগ
৮. তথ্য
পৃষ্ঠাঃ ৩২৭
৯. পূর্ত
১৩ এপ্রিল, ১৯৭১
সভার বিষয় ছিল :
১. সাহায্য
ক, সামরিক
খ, বেসামরিক জনগণের খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ
গ, অর্থ
ঘ, নােট ছাপানাে
২. রাজনৈতিক
জনগণের মধ্যে নেতৃত্বের শূন্যতা- আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের অবিলম্বে পূরণ করতে হবে।
৩. সামরিক সংগঠন
ক. নিয়মিত সামরিক বাহিনী
খ. কর্মীবাহিনীকে উদ্বুদ্ধকরণ, ৫টি ক্যাম্প স্থাপন। প্রশিক্ষক নিয়োগ এবং উপকরণ সরবরাহ।
১৪ এপ্রিল, ১৯৭১
১. মন্ত্রিপরিষদ সদস্য অথবা মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি ব্যতীত কোন ব্যক্তি ভারত সরকার, কোন রাজ্য সরকার অথবা কোন বিদেশী সরকার অথবা কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বা সংবাদ মাধ্যমের সাথে যােগাযােগ করবেন না এবং ভারতে অবস্থানরত কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি পরিচয় গােপন করে চলবেন।
২. ক্যাবিনেট কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলে কোন আওয়ামী লীগ নেতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধি বা অন্য কোন ব্যক্তি বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করবেন না।
৩. সরকার কর্তৃক নতুন নােট অথবা মুদ্রা না ছাড়া পর্যন্ত দ্বৈত মুদ্রা ব্যবস্থা চালু থাকবে। বাংলাদেশে মুদ্রা তৈরি ও ছাপার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সাথে পুরনাে পাকিস্তানী নােটের ওপর বাংলাদেশের ছাপ দেওয়া হবে ।
৪. সাবেক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে।
————–
৯. নেতৃত্বদানের প্রশিক্ষণ ও নির্দেশাবলী দিতে হবে।
(স্বাক্ষর সৈয়দ নজরুল ইসলাম)
পৃষ্ঠাঃ ৩২৮
১৫ এপ্রিল, ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রীর কাজের তালিকা :
১. বেসামরিক কর্মকর্তা ও পুলিশের সাথে যােগাযোগ স্থাপন।
২. নতুন দিল্লীর সাথে রাজনৈতিক যোগাযােগ রক্ষা করা।
৩. পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে যোগাযােগ রক্ষা রাখা।
৪. আইনগত স্থান, সচিবালয় গঠন, সহকারীবৃন্দ।
১২. হােসেন আলীর সাথে সংযােগ করতে হবে। ১৮ এপ্রিল সাক্ষাতকার।
১৬ এপ্রিল, ১৯৭১
শপথ অনুষ্ঠানের আগেরদিনের নােট
১. মালেক উকিল
২. বক্তব্য পাঠ
৩. পােশাক
৪. নিরাপত্তা ব্যবস্থা আমাদের নিজস্ব
৫. অনুষ্ঠান যেন সাজানাে মনে না হয়- সাংবাদিকদের সাথে যােগাযােগ ।
১৭ এপ্রিল, ১৯৭১
সরকারী ট্রেজারি থেকে দ্রুত অর্থ সংগ্রহের নিরাপদ স্থানে আনা।
১. বিভিন্ন সরকারী ট্রেজারি থেকে
২. যুদ্ধরত বাহিনীর বেতন
৩, বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন
এ দেশের অভ্যন্তরে বেসামরিক জনগণের জন্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ- লবণ, তেল, চাল, দিয়াশলাই।
৫. সরবরাহ লাইন সংস্কার ।
৬. ভারত থেকে ১০ কোটি রুপীর ব্যবস্থা।
৭. কুটনৈতিক আলােচনা- ড. এ আর মান্নান, এ কে খান, ড. এম মাের্শেদ, ড. এ করিম, মাহবুব আলম ।
৮. এক লাখ রুপীর একটি ইমপ্রেস্ট ফান্ড- জরুরী ভিত্তিতে সচিবালয় স্থাপনের জন্য।
১৮ এপ্রিল, ১৯৭১
মন্ত্রণালয় বণ্টন
তাজউদ্দীন আহমদ
প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা, তথ্য, বেতার ও যােগাযােগ, অর্থনৈতিক বিষয়,
পৃষ্ঠাঃ ৩২৯
পরিকল্পনা উন্নয়ন, শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ। যেসব বিষয়ের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদের অন্য কোন সদস্যকে প্রদান করা হয়নি।
খন্দকার মােশতাক আহমদ – পররাষ্ট্র বিষয়ক, আইন ও সংসদ
এম মনসুর আলী – অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য শিল্প, পরিবহন।
এএইচএম কামরুজ্জামান – স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষি।
একটি ত্রাণ কমিটি গঠন
ত্রাণমন্ত্রী – চেয়ারম্যান
অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী – সদস্য সচিব
আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী – সদস্য
এ সামাদ – সদস্য
সােহরাব হােসেন – সদস্য
২৩ এপ্রিল, ১৯৭১
মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত
১. এমএ সামাদ এমএনএকে মন্ত্রিপরিষদের রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে।
২. এ মান্নান এমএনএকে জনসংযােগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য নিযুক্ত করা হয়।
৩. আমীর-উল-ইসলাম এমএনএকে পূর্বাঞ্চলীয় উপদেষ্টা নিয়ােগ করা হয়েছে।
২৯ এপ্রিল, ১৯৭১
১. বাংলাদেশে টাকার আমানত আদায় করে তা স্থানীয় মুদ্রায় অবিলম্বে বিনিময় করতে হবে।
২. শান্তি আলােচনায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মি. সামাদকে নির্বাচিত করা হলাে।
৬. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল নির্বাচিত সদস্য ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যগণ প্রত্যেকে মাসিক ১৫০ টাকা হারে ভরণপােষণের জন্য পাবে।
১১. কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি পদে নিয়ােগ অনুমােদন করা হলাে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৩০
১২. লেঃ কর্নেল আব্দুর রবকে বাংলাদেশ বাহিনীর চীফ অব স্টাফ হিসেবে নিয়ােগ অনুমােদন করা হলাে।
(স্বাক্ষর- সৈয়দ নজরুল ইসলাম)
২ মে, ১৯৭১
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ড. টি হােসেনকে স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়৷
১৬ মে, ১৯৭১
১. দিল্লী সফরের ওপর প্রতিবেদন।
৪. ইতােমধ্যে যুদ্ধে শহীদ যােদ্ধা ও ভবিষ্যতে যারা শহীদ হতে পারেন তাদের পরিবার/পােষ্যদের দেখাশােনার দায়িত বাংলাদেশ সরকারের।
২৪ মে, ১৯৭১
ক. পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে নিয়ে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ- Zonal administrative Councial ব্যবস্থা অনুমােদন করা হয়। পরিষদ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করবে এবং আঞ্চলিক প্রশাসক পরিষদের সদস্য সচিব হিসেবে কাজ করবেন ।
খ. প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ তহবিল
১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম – অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
২. তাজউদ্দীন আহমদ – প্রধানমন্ত্রী
৩. খন্দকার মােশতাক আহমদ – পররাষ্ট্রমন্ত্রী
৪. ফণী ভূষণ মজুমদার – এমপিএ
৫. এম আর সিদ্দিকী – এমএনএ
১৭ জুলাই, ১৯৭১
২. ১০ থেকে ১৫ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের সভার প্রেক্ষিতে প্রধান সেনাপতি প্রতিবেদন পেশ করবেন।
৩. বেতার প্রচার ।
৪. আঞ্চলিক প্রশাসন কাঠামাে। ৮টি অঞ্চল অনুমােদন করা হয় ।
১৮ জুলাই, ১৯৭১
ক. অর্থনৈতিক বিষয়ক প্রফেসর রেহমান সােবহানকে বিশেষ দূত নিয়ােগ করা হলাে।
খ. এম আর সিদ্দিকী যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ দূত।
পৃষ্ঠাঃ ৩৩১
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান অফিস ছিল কলকাতা পার্ক সার্কাসে এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিস ছিল পার্ক সার্কাস সােহরাওয়ার্দী ভবনে৷
বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বে নেতৃবৃন্দ :
এমএ মান্নান এমএনএ – তথ্য ও বেতা কেন্দ্র
অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ – মুক্তিবাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্প
জহুর আহমদ চৌধুরী এমএনএ – রাজনৈতিক
বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী সিভিল সার্ভিস ও অন্যান্য ক্যাডার থেকে মুজিবনগরে আগত কর্মকর্তাদের নিয়ে সচিবালয় গঠন করেন।
এইচ টি ইমাম সিএসপি – মন্ত্রী পরিষদ সচিব
নূরুল কাদের খান সিএসপি – সংস্থাপন ও যুব শিবির সচিব
খন্দকার আসাদুজ্জামান খান সিএসপি – অর্থ সচিব
এম এ সামাদ সিএসপি – প্রতিরক্ষা সচিব
মাহবুব আলম চাষী পিএসএস – পররাষ্ট্র সচিব
১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিশ্বের সকল দেশের নিকট মুজিবনগর সরকার পত্র প্রেরণ করে।
২৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের প্রতি অস্ত্র সাহায্য ও স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অনুরােধ জানান। তিনি বিদেশে বসবাসরত সকল বাঙালীকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের আবেদন জানান ।
বাংলাদেশ সরকার ঘােষণা করে যে, সকল এমএনএ ও এমপিওগণ এমসিএ হিসেবে পরিচিত হবেন।
পৃষ্ঠাঃ ৩৩২
১৩
রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী
সেক্টর ও আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ১১-১৭ জুলাই কলকাতাস্থ ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন আহবান করেন। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শক্তিশালী করার জন্য সেক্টরগুলাে সুসংগঠিত করা হয়।১
সেক্টর এবং কমান্ডারগণ
আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা ও বেসামরিক শাসন পরিচালনার জন্য ১১টি আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন করে।
সেক্টরের নাম এলাকা সেক্টর প্রধানের নাম
সেক্টর – ১ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম মেজর জিয়াউর রহমান
নােয়াখালীর একাংশ পরে মেজর রফিকুল ইসলাম
সেক্টর-২ নােয়াখালী, কুমিল্লা, ফরিদপুর মেজর খালেদ মােশাররফ
ও ঢাকার একাংশ।
সেক্টর-৩ কুমিল্লা, ঢাকা ও সিলেটের একাংশ মেজর কাজী শফিউল্লাহ
সেক্টর-৪ সিলেট, হবিগঞ্জ মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত
সেক্টর-৫ উত্তর সিলেট মেজর মীর শওকত আলী
সেক্টর-৬ রংপুর, দিনাজপুরের একাংশ উইং কমান্ডার এম.কে বাশার
সেক্টর-৭ দিনাজপুরের একাংশ কর্নেল নূরুজ্জামান
রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৩
সেক্টর-৮ কুষ্টিয়া, যশাের, খুলনার একাংশ মেজর আবু ওসমান চেীধুরী
পরে মেজর এম মঞ্জুর
সেক্টর-৯ খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী মেজর এমএ জলিল
ফরিদপুরের একাংশ
সেক্টর-১০ সমগ্র বাংলাদেশের নদী নৌবাহিনীর নৌ কমান্ডাে
বন্দর ও সমুদ্র উপকূল
সেক্টর-১১ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল মেজর এম এ তাহের,
উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ
প্রত্যেক সেক্টরকে সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ড অফিসার, লেঃ আথবা ক্যাপ্টেন। পুনরায় সাব-সেক্টর বেইজ বা থানায় বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক থানা/বেইজে একজন নন- কমিশন্ড কর্মকর্তাকে কমান্ডার নিয়ােগ করা হয়। মুক্তিবাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত ছিল – নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী। নিয়মিত বাহিনী সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে এবং গেরিলা বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ১১-১৭ জুলাই কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সেক্টরগুলাে পুনর্গঠিত হয়। এ সম্মেলনে কর্নেল এম এ রব এমএনএ চীফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিয়ােগ করা হয়।
কর্নেল রবের দপ্তর আগরতলায় অবস্থিত ছিল। তিনি পূর্বাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতেন।
আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিল
১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিম জোন এবং দক্ষিণ-পশ্চিম জোন বিভক্ত করে আরাে দুটি জোনাল কাউন্সিল বৃদ্ধি করেন। পশ্চিম জোন-১, ২ এবং দক্ষিণ- পশ্চিম জোন-১, ২।
প্রধানমন্ত্রী জোনাল কাউন্সিলের উপকমিটি গঠন করে।২
ত্রাণ উপদেষ্টা
স্বাস্থ্য উপকমিটি
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৪
প্রচার উপকমিটি
শিক্ষা উপকমিটি
১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদ ৯টি প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করেন।
জোন প্রধান কার্যালয় এলাকা
দক্ষিণ-পূর্ব জোন-১ সাবরুন, ত্রিপুরা চট্টগ্রাম, ফেনী, পার্বত্য চট্টগ্রাম
দক্ষিণ-পূর্ব জোন-২ আগরতলা ঢাকা, কুমিল্লা, নােয়াখালী
পূর্ব জোন ধর্মসাগর হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার
উত্তর-পূর্ব জোন-১ ডাউকি সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ,
ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল
উত্তর-পূর্ব জোন-২ — রংপুর
পশ্চিম জোন কালুরঘাট দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী
দক্ষিণ-পশ্চিম জোন-১ কৃষ্ণনগর পাবনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশাের
দক্ষিণ-পশ্চিম জোন-২ বারাসাত বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা
প্রত্যেক জোনে একটি আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। অঞ্চলের সকল এমএনএ ও এসপিগণ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন এবং তারা তাদের একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। জোনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাউন্সিলের সদস্য সচিব ছিলেন। জোনাল কাউন্সিলের সচিবালয় ছিল।
আঞ্চলিক কাউন্সিলের কার্যাবলী :
১. মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন
২. উদ্বাস্তুদের আশ্রয় ও ত্রাণ কাজ পরিচালনা করা
৩. যুব শিবিরকে সহায়তা করা
৪. সেক্টর কমান্ডারদের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করা
৫. মুক্ত এলাকায় প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা।
আঞ্চলিক কাউন্সিল
অঞ্চল এলাকা চেয়ারম্যানের নাম
পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল-১ চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফেনী নূরুল ইসলাম চৌধুরী এমএনএ
পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল-২ নােয়াখালী, ঢাকা, কুমিল্লা জহুর আহমদ চৌধুরী
পূর্ব অঞ্চল হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার কর্নেল এমএ রব এমএনএ
উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-১ সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৫
উত্তর অঞ্চল রংপুর মতিউর রহমান এমএনএ
উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-২ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল শামসুর রহমান খান এমএনএ
পশ্চিম অঞ্চল-১ দিনাজপুর, বগুড়া আবদুর রহিম এমএনএ
পশ্চিম অঞ্চল-২ রাজশাহী আশরাফুল ইসলাম এমপি
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল-১ কুষ্টিয়া, পাবনা আবদুর রউফ চৌধুরী এমপিও
দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল-২ যশাের, ফরিদপুর ফণী ভূষণ মজুমদার এমপিও
দক্ষিণ অঞ্চল খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী আবদুর রব সেরনিয়াবাত
মৃত্যুর মুখােমুখি তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১১টার পর তাজউদ্দীন আহমদ তার পরিবার বাসায় রেখে লালমাটিয়া রেলওয়ের সাবেক চীফ ইঞ্জিনিয়ার আবদুল গফুরের বাসায় চলে যান। তার যাত্রার সাথে সাথে পাকবাহিনী তার বাসায় এসে পড়ে। মিসেস জোহরা তাজউদ্দীন লিলি সেনাবাহিনীকে দূরে দেখেই মিমি ও সোহেলকে দোতলায় অবাঙালী পরিবারের বাসায় আশ্রয় নেন। তাদের বড় মেয়ে রিপি, রিনি খালার বাসায় ছিল। তাজউদ্দীনের বাড়ির দোতলায় পাকসেনারা ঢুকে পড়ে এবং জোহরা তাজউদ্দীন ও আতিয়া বেগমের বুকে স্টেনগান ধরে জিজ্ঞেস করে মিসেস তাজউদ্দীনকে। আতিয়া বেগম বলেন, আমরা তাজউদ্দীনের ভাড়াটে। সেনাবাহিনী খোঁজাখুঁজি করে চলে যায়। অথচ ঘরেই ছিল বােমা তৈরি কাগজ ও বারুদ। অল্পের জন্য বেঁচে যান মিসেস জোহরা তাজউদ্দীন। মিসেস তাজউদ্দীন আতিয়া বেগের বাসা ত্যাগ করে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ২৭ মার্চ কার্ফু তুলে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের শ্যালক মিসেস তাজউদ্দীনকে নিয়ে একটু আশ্রয়ের জন্য ঘােরাঘুরি করেন। কিন্তু কোথাও আশ্রয় পেলেন না। রাতে ১৩ নম্বর রােডে এক বাড়িতে আশ্রয় নন। কিন্তু বাড়ির মালিক বাসায় অনেক আত্মীয়স্বজন আছে এ অজুহাতে পাশের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা বলেন। জোহরা তাজউদ্দীন তার এক বছর তিন মাসের পুত্র সােহেল ও ৫ বছরের শিশুকন্যা মিলিকে নিয়ে গভীর রাতে বাসা ত্যাগ করেন। একটা জিনিস আনার কথা বলে তাদের রাস্তায় দাঁড় করে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। জোহরা তাজউদ্দীন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। চারদিকে গােলাগুলি, কার্ফু চলছে। পাশেই ইটের স্তুপ ছিল। তিনি শিশু ছেলেমেয়ে নিয়ে ইটের পাঁজায় রাত কাটালেন। তারপর তাজউদ্দীন আহমদের ভাড়াটে আজিজ মিয়ার ভাই আফতাবউদ্দিনের সাথে দেখা।
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৬
তাজউদ্দীনের বড় দু’মেয়ে রায়েরবাজারের বাসা থেকে তার শ্যালকের বাসায় নিতে আসেন। কিন্তু তিনি বরিশাল যাচ্ছেন। তাই দু’বোন তাদের ফুফাত বোন আনারেএ বাসায় আশ্রয় নেন। ৩০ মার্চ সকালে রিমি ও রিপি তাদের ছােট মামার বাসায় যান এবং তাদের মায়ের দেখা হয়। তারা আফতাবউদ্দিনের কাছে তার গ্রামের বাড়ি কালিগঞ্জের জামালপুরে যাচ্ছেন। তারা কাচপুর থেকে লঞ্চে আফতাবউদ্দিনের গ্রামের বাড়ি যান। কিন্তু রাতে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে, তাজউদ্দীনের স্ত্রী এখানে এসেছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের গ্রামের বাড়ি দরদরিয়া যাবেন।
নৌকাযােগে তারা বিকেল চারটায় দরদরিয়া পৌছেন। তাজউদ্দীনের মেজভাই মফিজউদ্দিন তাদের পেয়ে খুশি হলেন। ১০ এপ্রিল তারা রেডিওতে তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ শুনলেন৷ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। সকলে খুশি। ১৯ এপ্রিল শুনতে পেলেন ঢাকা শহরে মিসেস তাজউদ্দীনকে পাকবাহিনী খুজছে। শহর থেকে তাদের কাজের ছেলে হাসান এসেছে। তার কাছে ঢাকার কথা শোনে। ২৭ এপ্রিল পাকবাহিনী শ্রীপুর আক্রমণ করেছে। তাদের দরদরিয়ায় থাকা নিরাপদ নয়। গভীর রাতে তারা নােকায় গ্রাম ত্যাগ করে নদীতে তারা একটি লঞ্চে উঠে ডেমরা পৌছান। সেখান থেকে হাসানের শ্বশুরবাড়ি জোরপুর গ্রামে ওঠেন। থাকা হলো না। পাশেই বিহারীদের বাসা। সেখান থেকে তারা বাসাবােয় রুবির বাপের বাসায় ওঠেন। পরে মিসেস জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের এমএনএ আবদুল হামিদের শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেন। সেখানে হামিদ মিয়া নেই। তিনি বানরী গ্রামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীর বাড়িতে আছেন। পরের দিন একটি ছােট লঞ্চে তারা বানরী গ্রামে রওনা দেন। চালক নেই আবু ও রুহুল আমিন চালাচ্ছে। উন্মত্ত পদ্মায় ঝড় শুরু হয়েছে। লঞ্চ একটি চরে আটকে যায়। অনেক কষ্টে লঞ্চ নিয়ে সন্ধ্যায় বানরী গ্রামে পৌছেন।
৯ মে আবার খবর ছড়িয়ে পড়ে যে তাজউদ্দীনের পরিবার এ গ্রামে আছে। আগামীকাল আর্মি আসবে। পরের দিন সকালে ছােট লঞ্চে পথে সিরাজদিখানে আর্মির গােলাগুলির সম্মুখীন হন। সিরাজদিখানে রাত কাটালেন। এদিকে বানারী গ্রাম পুড়ে ফেলেছে এবং যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল তাকে পশুরা হত্যা করেছে। দুপুরে আবার শুনতে পেলেন আর্মি আসছে। হামিদ মিয়া ও মিসেস তাজউদ্দীন বাড়ি ত্যাগ করে নৌকায় গভীর রাতে গুইয়াগাইছা গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। খালি মাটিতে শুয়ে রাত কাটায় মেয়েরা। হামিদ মিয়ার স্ত্রীর আচরণ ভাল ছিল না। ১৭ মে এক নৌকায় জোহরা তাজউদ্দীন ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকা রওনা দেন। সদরঘাট টার্মিনালে আর্মি তল্লাশি চালায়। মিসেস তাজউদ্দীন তাড়াতাড়ি
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৭
প্রথমে রিকশা ও পরে ধানমণ্ডির ১৩ নম্বর রােডে তার ভাইয়ের বাসায় ওঠেন। তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় আর্মিরা তার শ্বশুরকে থাকতে দিয়েছে। তাকে সেনাবাহিনী বলত, আপনি সৈয়দ- অথচ মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন একজন হিন্দুর নিকট। তার নাম তাে তাজউদ্দীন নয়- ত্যাজারাম। তাজউদ্দীন আহমদের ভাড়াটে আজিজ মিয়াকে আর্মিরা ধরে নিয়েছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বোমা তৈরি করতেন। তার স্ত্রী ছিলেন অবাঙালী- আতিয়া বেগম৷ তিনি তার মায়ের বাড়ি গেছেন। তাজউদ্দীনের বাসা থেকে তার ৫ আত্মীয় ধরে নিয়ে সেনানিবাসে চরম নির্যাতন চালায়। সেপ্টেম্বর মাসে তারা মুক্তি পান।
হাসান ঠিক করেছেন জোহরা তাজউদ্দীন ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিমানে যশাের যাবেন। এ সংবাদ আমি জানতে পারে। জোহরা তাজউদ্দীনের ভাইয়ের এক বন্ধু এক ব্রিগেডিয়ার এ সংবাদ জানান। তারা যশাের গেলে গ্রেফতার হবেন। যশাের যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হলাে।
শ্রীপুরের রহমত আলী মিসেস তাজউদ্দীন ও ছেলেমেয়েদের খোজ করেছেন। রহমত আলী আগরতলা থেকে কলকাতায় তাজউদ্দীনের সাথে দেখা করেন। তাকে তার পরিবার সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেন। তিনি আরও বলেন যদি তারা বেঁচে থাকে জানতে ভাল লাগবে। আর মরে গিয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের মাঝে সন্তানদের খুঁজে পাবেন। রহমত আলী ১৯৫১ সালে শ্রীপুর হাইস্কুলে তাজউদ্দীন আহমদের ছাত্র। তাকে খোজ নিতে বলেছেন। তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। ২১ মে রহমত আলী তাজউদ্দীনের পরিবারকে নিয়ে ডেমরা রওনা দেন। তারা কাচপুর পৌছে নদী পার হয়ে বৈদ্যের বাজার গেলেন। সেখান থেকে লঞ্চে কুমিল্লার রামচন্দ্রপুর গ্রামে পৌছেন। মিসেস তাজউদ্দীন বােরখা পরা। সর জায়গায় আর্মির তল্লাশি চলে। গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটছেন । এমনি সময় তেজগাও থানার শিরু দারােগা দৌড়ে এসে তার পরিচয় দেন। তাজউদ্দীন আহমেদের বাসায় প্রায়ই শিরু দারােগা আসতেন। তাই তিনি সকলকে চেনে। তারা আওয়ামী লীগ এমএনএর বাড়ি পৌঁছেন। রাতেই খবর আসে আগামীকাল এ গ্রামে আর্মি আসবে। রাতেই নৌকা যাত্রা। শিরু দারােগা সড়কের পুলের নিকট নিয়ে আসে। সকলকে পাট ক্ষেতে নামতে হবে। পানি পাড়ি দিয়ে আবার ডিঙ্গি নৌকায় উঠে পুলের নিচ দিয়ে যেতে হবে। আর্মিরা দেখলে গুলি করে হত্যা করবে। পাশেই ছিল মৃতদেহ। তিন দলে বিভক্ত হয়ে পথপ্রদর্শকের সাথে জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ পুল অতিক্রম করে আবার পায়ে হেঁটে এক বাড়িতে পৌঁছেন।
আবার নৌকায় সিদলা গ্রামে পৌঁছেন। সাথে শিরু দারােগা ও রহমত আলী। শিরু দারােগা বিদায় নিলেন। সামনে সীমান্ত রেললাইন । পায়ে হেঁটে যেতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৮
খুব দ্রুত সকলে রেললাইন পার হলেন। বাংলাদেশ ত্যাগ করে শরণার্থী হয়ে আগরতলায় এলেন। জোহরা তাজউদ্দীন সীমান্ত পার হওয়ার সময় স্বদেশের দুমুঠো মাটি নিয়ে এসেছেন। তারা বক্সনগর পৌছলেন। বন বিভাগের ডাক বাংলোয় তারা ওঠেন। তারপর জীপে আগরতলা সার্কিট হাউজে পৌছেন। এ সময় নারায়ণগঞ্জের এমএনএ শামসুজ্জোহার সাথে দেখা হয়।
২৭ মে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার প্লেনে কলকাতায় পৌছেন। ট্যাক্সিতে তারা পার্ক সার্কাস বাংলাদেশ মিশনে পেীছেন। বাড়ির গেস্ট হাউজে তারা থাকেন গভীর রাতে তাজউদ্দীন পরিবারের সদস্যদের দেখতে আসেন। শুধু বললেন ভালভাবে থেক। ৫ মিনিট থেকে চলে গেলেন। তার মধ্যে কোন উচ্ছ্বাস বা আবেগ নেই- যার ওপর মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব তিনি তাে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন না।
২৯ মে পার্ক স্ট্রীটের কোহিনূর ম্যানসনের একটি ফ্ল্যাটে তারা বসবাস শুরু করেন৷ মওলানা ভাসানী একই ভবনে থাকেন। ভাসানী তাজউদ্দীনের স্ত্রী ও মেয়েদের সাথে আলােচনা করতেন এবং বলতেন, তাজউদ্দীন আমার যােগ্য ছেলে, ওর প্রতি আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট | এ ভবনে এক সপ্তাহ থাকার পর তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার সিআইডি রােডের ৮তলা ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হয় । একই ভবনে আরও ৩ মন্ত্রী থাকেন। মন্ত্রীরা বাসায় আসেন এবং খাওয়া দাওয়া করেন৷ কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ আসেন না। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন- দেশ স্বাধীন না হলে তিনি দাম্পত্য জীবন যাপন করবেন না। তিনি তার প্রতিজ্ঞা রেখেছেন। তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টা কাজ করতেন।
পরে জানা যায়, তেজগাঁও থানার যে শিরু দারােগা তাজউদ্দীনের পরিবারকে সীমান্ত পার করে দেন। তাকে এবং তার পুত্রকে স্ত্রীর সামনে গুলি করে পাকসেনারা হত্যা করে। ভারতে আসার পথে তাদের হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় ওয়ারলেস অফিসের যুবক অপারেটরকে। সেখানে মিসেস তাজউদ্দীন কয়েক ঘণ্টা ছিলেন।
ঢাকায় তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প। বাসায় তার শ্বশুর সৈয়দ সিরাজুল হক থাকেন। তিনি আরবি-ফার্সি ভাষায় পণ্ডিত। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।
ঢাকায় বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, রেহানা গৃহবন্দী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৫ মার্চ রাত দেড়টায় পাকসেনারা তাকে বন্দী
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৯
করে নিয়ে যায়। আদমজী স্কুলে দু’দিন রাখার পর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দী করে রাখে। পাক সেনারা ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রমণে সময় বেগম মুজিব, দুপুত্র, দুকন্যা নিয়ে পাশের বাসায় আশ্রয় নেন। শেখ কামাল রাতেই পালিয়ে যান। বেগম মুজিব কিছুদিন ঢাকায় পালিয়ে থাকেন। পরে চৌধুরীপাড়া থেকে তাদের গ্রেফতার করে ধানমন্ডির ১৮ নম্বর একটি বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়। বেগম মুজিবের সাথে ছিলেন দু’কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। বাসায় জামাতা ড. ওয়াজেদ মিয়া ও বঙ্গবন্ধুর ফুফাত ভাই মােমিনুল হক খোকা থাকতেন। গহবন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। শেখ হাসিনা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই পুত্র সন্তান লাভ করেন। পুত্রের নাম রাখা হয় জয়। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেগম মুজিব পুত্র-কন্যাসহ বন্দী ছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে
আগস্ট ১৯৭১
সকল সদস্য উপস্থিত।
৯-৮-১৯৭১
১. যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের পােষ্যদের ত্রাণ মন্ত্রণালয় অর্থ সাহায্য করবে- ৫,০০,০০০ টাকা ত্রাণমন্ত্রী
২. শিল্পী-শিক্ষক প্রমুখকে সাহায্য প্রদান ২,৫০,০০০ টাকা।
১৩-৮-১৯৭১
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে সাপ্তাহিক সচিব সভা অনুষ্ঠিত।
২৩-৮-১৯৭১
মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রধান সেনাপতি মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতা পেশ করেন।
নবগঠিত ৪ অঞ্চলের দৈনন্দিন ব্যয় অনুমােদন করা হয়।
কবি নজরুল ইসলামকে মাসিক ভাতা ৩৫০ টাকা মঞ্জুর করা হয়।
৪-৯-১৯৭১
আবদুল খালেককে স্বরাষ্ট্র সচিব ও ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ নিয়ােগ করা হয়।
৬-৯-১৯৭১
ড. এ আর মল্লিককে শিক্ষা উপদেষ্টা নিয়ােগ করা হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৩৪০
২০.৯.১৯৭১
মন্ত্রিপরিষদ
বিদ্যমান পশ্চিম-দক্ষিণ অঞ্চল ভেঙ্গে পশ্চিম অঞ্চল-১, পশ্চিম অঞ্চল -২।, দক্ষিণ- পশ্চিম অঞ্চল-১, দক্ষিণ -পশ্চিম অঞ্চল-২ নামে পুনর্গঠন করা হয়।
৬-১২-১৯৭১
বহুল কুদুসকে বাংলাদেশ সরকারের মহাসচিব নিয়ােগ করা হয় ।৩
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি
সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ বহু আকাক্ষিত জাতীয় ঐক্য এনে দেয়। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ভারত-রাশিয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সর্বদলীয় ঐক্য স্থাপনের বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, ৮ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ, মওলানা ভাসানী, মনোরঞ্জন ধর, মনি সিংহ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ একটি গোপন স্থানে মিলিত হবেন। সভায় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সিদ্ধান্তগুলাে সকল মিশন অফিসে পাঠানাে হয়। সভায় আট সদস্যবিশিষ্ট এক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা প্রদানের জন্য ৫টি রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ হয়। দলগুলাে হলাে :
১. আওয়ামী লীগ
২. ন্যাপ- মােজাফফর
৩. কমিউনিস্ট পার্টি
৪. ন্যাপ ভাসানী
৫. ন্যাশনাল কংগ্রেস।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন :
১. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ভাসানী-ন্যাপ
২. মনি সিংহ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি
৩. তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধানমন্ত্রী
৪. খন্দকার মােশতাক আহমদ, মন্ত্রী
৫. মনােরঞ্জন ধর, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস
৬. প্রফেসর মােজাফফর আহমদ, ন্যাপ-মােজাফফর
৭. আওয়ামী লীগের আরও ২ জন সদস্য
প্রধানমন্ত্রী কমিটির সভা আহবান ও পরিচালনা করবেন। ১৯৭১ সালের ৮
পৃষ্ঠাঃ ৩৪১
ও ৯ সেপ্টেম্বর মুজিবনগরে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনের ক্ষোভ প্রকাশ, বিচার বন্ধ করার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল শক্তির প্রতি আহবান।
২. বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন।
৩. বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান।
৪. মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়ার নেয়ার জন্য ভারত সহ সকল বিশ্বশক্তির প্রতি আহবান।
৫. মুক্তিযােদ্ধাদের অভিনন্দন।
৬ শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে ভারত সরকার ও জনগণকে অভিনন্দন জ্ঞাপন।
৭. রাজনৈতিক সমাধান বলতে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছুই গ্রহণযোগ্য না বলে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করা হয়।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের ফলে দেশে ও আন্তর্জাতিক জগতে মুক্তিসংগ্রামের গ্রহণযােগ্যতা শক্তিশালী হয়। সকল মহল অত্যন্ত আনন্দিত হয়। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্ব মুক্তিযুদ্ধ উজ্জীবিত করে। সকল দলের মধ্যে সমন্বয় হওয়ায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধী শক্তি নিস্তেজ হয়। প্রথম থেকে খন্দকার মােশতাক আহমদ প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করতে চেয়েছিলেন। তিনি সর্বদা তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। মওলানা ভাসানী মুজিবনগর সরকারের সাথে যুক্ত হওওয়ায় তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থান সুদৃঢ় হয়। তিনি প্রায়ই মওলানা ভাসানীর সাথে পরামর্শ করতেন। তার উপদেশ গ্রহণ করতেন। বাম দলগুলাে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিত্ব দাবি করত। ভাসানী তাদের এ দাবি পরিত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র, কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়া), পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়ন, পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন – বাংলাদেশের আটটি বামপন্থী দল মুজিবনগরে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে ঐক্যজোট গঠন করে। এ দলগুলােকে অষ্টম বলা হয়। মওলানা ভাসানীকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হলেও তিনি কখনও তাদের সভায় যােগ দেননি। কমিটির পক্ষে মেনন-রনাের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাদেরকে উপদেষ্টা কমিটিতে নেয়ার দাবি করে। তাজউদ্দীন
পৃষ্ঠাঃ ৩৪২
আহমদ তাদের প্রতি সহানুভূতি ছিলেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ তাদের দাবি গ্রহণ করেনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘জয় বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন
সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর কাছে একটি অতি প্রিয় নাম : স্বাধীন সার্বভৌ বাংলার প্রথম তাজউদ্দীন আহমদ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর কাছে আজ একটি অতি প্রিয় নাম।
বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ ২৭ বছরের একনিষ্ঠ সহকর্মী তাজউদ্দীন। বিশ্ব ইতিহাস, ভুগোল ও রাজনীতি সম্পর্কে তিনি লেখাপড়া করেছেন প্রচুর । বিশ্ব ইতিহাসের বা বিশ্ব রাজনীতির যে কোনাে ঘটনা সাল তারিখ দিয়ে তিনি মুহুর্তের মধ্যে আপনাকে বলে দিতে পারবেন, অথবা বিশ্ব মানচিত্রের যে কোনাে স্থানের অবস্থিতি তিনি সাথে সাথে বলে দিতে পারবেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল, মধ্যপ্রাচ্যে আরব- ইসরাইল সংঘাত এবং ভিয়েতনাম ও আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাসই যেন তার নখদর্পনে।
তাই বোধহয় এ সমস্ত ইতিহাসের আলােকেই সেদিন তিনি জোর করেই বলেছিলেন, আমরা কামিয়াব হবই। এ কথা বলার সময় যেন তার চোখেমুখে যেন একটা আত্মপ্রত্যয়ের দ্যুতি খেলে গেল।
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে তার জন্ম হয়। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান। তবে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দেয়া তার ভাগ্যে বড় একটা জোটেনি।
তাই বলে তিনি কোনােদিন পরীক্ষায় খারাপ করেছেন এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। তিনি এমই স্কলারশিপ পরীক্ষায় জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। আর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। অর্থনীতি শাস্ত্রে অনার্সসহ তিনি বিএ পাস করেন এবং জেলে থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে আইনের ডিগ্রী লাভ করেন।…
রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ
সৈনিক বেশে
“রংপুর জেলার মুক্তাঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এসেছিলেন মুক্তিবাহিনীরই একজন সেনানী হিসেবে। সেদিন ছিল ১০ অক্টোবর। বঙ্গবন্ধুর মহান জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ বাংলার বীর
৩৪৩
মুক্তিযােদ্ধাদের অসমসাহসিক রণনৈপুণ্য এবং বিজয়ের অগ্রাভিযানকে প্রধানমন্ত্রী নির্যাতিত বিশ্বের জাগ্রত জনমানবের এক নতুন উজ্জ্বল ইতিহাস বলে উল্লেখ করেন। তিনি পূর্বদিন বাংলার ইতিহাসে স্মরণীয় ঘটনা স্বাধীন বাংলার একদল সৈনিক অফিসার ক্যাডেট হিসেবে কমিশন লাভ অনুষ্ঠানে যোগদানের পর মুক্তাঞ্চলের এই সফরে বের হন।
প্রথমে তিনি মুক্তাঞ্চলে বুড়িমারীতে শিক্ষা সমাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত দুর্জয় সেনানীদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী আলাপ-আলােচনার পর বুড়িমারী স্কুলগৃহে প্রধানমন্ত্রী ও তার সাথে আগত অতিথিদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলাে। হঠাৎ উইং কমান্ডার বাশারকে ডেকে প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন- “আমাদের যােদ্ধারা খেয়েছে? উত্তর এলো- ওরা মাটির মধ্যে খেতে বসেছে। একটি মুহূর্ত মাত্র। দেখলাম প্রধানমন্ত্রী আস্তে করে উঠে চলে গেছেন। সমস্ত জিনিসটাই বুঝতে পারলাম যখন বাইরে এসে দেখি একটি টিনের থালায় খাবার হাতে নিয়ে অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধার সাথে বসে প্রধানমন্ত্রী পরম তৃপ্তির সাথে আহার করে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দুই পাশে উপবিষ্ট দু’জন মুক্তিযােদ্ধা সঙ্কোচ ও জড়তায় খাবার কথা ভুলে অবাক নেতা নেত্রে চেয়ে ছিল। নিজের থালা থেকে দুটি মাংসের টুকরা ওদের হাতে তুলে দিয়ে স্নিগ্ধ হাসিমুখে প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে বললেন- ‘বাংলার সাড়ে সাত কোটি নর-নারীরপ্রত্যেকেই আজ মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তি ও স্বাধীনতার এই যুদ্ধে আমি, তুমি, সে আর তিনি সবাই সমান।’
দেশব্যাপী এই সর্বাত্মক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কারও জন্যই বিশ্রামের কোনাে অবকাশ নেই। তাই আহার শেষ হওয়া মাত্র নেতার নির্দেশে আবার আমরা সকলেই প্রস্তুত হলাম। এগিয়ে চললাম মুক্তাঞ্চলের একের পর এক গ্রাম পেরিয়ে বড়খাতা অঞ্চলের রণাঙ্গনে। আসন্ন শীতের আহ্বান মৃদুমন্দ শীতল বাতাস আর তার সাথে মুক্তিসেনাদের মর্টার আর রাইফেলের আওয়াজ কানে আসতে শুরু করায় রােমাঞ্চিত আমরা বড়খাতা রণক্ষেত্রে পৌছলাম সন্ধ্যার কিছু আগে। সমস্ত এলাকায় অসংখ্য বাংকার তৈরি করে অতন্দ্র প্রহরীর মতাে মেশিনগান আর রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। সৈনিক বেশে সজ্জিত প্রধানমন্ত্রী আমাদের পেছনে রেখে এগিয়ে গেলেন।
হঠাৎ চোখে পড়ল একদল গ্রামবাসী সারিবদ্ধভাবে বাঁশের সাথে বড় বড় হাঁড়ি ঝুলিয়ে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তােমরা কোথায় যাচ্ছাে ভাই?’ ওরা বলল, ‘আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলে উঠলেন, ‘ধন্য আমার প্রিয় দেশবাসী
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৪
তারপর তিনি আমাদের বাঙ্কারের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বাঙ্কারে বাঙ্কারে
আনন্দাশ্রু বিসর্জন করতে করতে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন এক এক করে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদেরকে। হঠাৎ একটি ১২/১৩ বছরের কিশােরকে হাতে অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তের জন্য প্রধানমন্ত্রী হতবাক। ওরা গালে ছোট্ট করে একটি আদর করে জিজ্ঞেস করলেন- ‘এই খোকা তোমার বয়স কত? ‘স্যার, আঠারাে’ বুঝলাম ছেলেটি মিথ্যে বলল । ঠাট্টা করে প্রধানমন্ত্রী বললেন ‘তুমি ফিরে যাও তােমার যুদ্ধের দরকার নেই।’ অপলক নেত্রে চেয়ে দেখলাম- কিশােরটির দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। আকুতি জানিয়ে বলল, ‘আমাকে বাদ দেবেন না স্যার, এগিয়ে চলার পথে আমি পিছু হটতে শিখিনি’। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কেউ তােমায় বাদ দেবে না ভাই।’ পরে সেক্টর কমান্ডার জানালেন, ঐ বাচ্চা ছেলেটি পরপর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে সাফল্য নিয়ে ফিরে এসেছে।
রণক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অনির্ধারিত আগমনে সেনাবাহিনীর মাঝে দেখা দিল এক অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য। হঠাৎ একসঙ্গে গর্জে উঠল মুজিব ব্যাটারি, চার্জে বাংলা বাহিনীর কামান আর মর্টার। অব্যর্থ তাদের লক্ষ্য। চোখে দুরবিন লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রী সচক্ষে দেখলেন মাত্র ৪০০ গজ দূরে শত্রুবাঙ্কারে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হানাদার পশুদের।
ইতােমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আগমন বার্তা পৌঁছে গেছে মুক্তাঞ্চলের জনগণের মাঝে। তাই ফেরার পথে দেখলাম শত শত নরনারী পথিপার্শ্বে দাঁড়িয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে অভিনন্দন জানালাে প্রধানমন্ত্রীকে। পথের মােড়ে মােড়ে দাঁড়িয়ে ওদের সঙ্গে কথা বললেন, প্রধানমন্ত্রী। ওদেরকে তিনি শােনালেন আসন্ন বিজয়ের বাণী।
জয় আমাদের কব্জায়
পাটগ্রামে যখন পৌছলাম তখন রাত্রি প্রায় ৮টা। দূর থেকে ভেসে এলাে সহস্র সহস্র জনতার কণ্ঠনিঃসৃত বলিষ্ঠ স্লোগান। পাটগ্রাম হাইস্কুল প্রাঙ্গণে ওরা সমবেত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে স্বাধীনতার যুদ্ধের কথা শুনতে। বীর জনতার সে ডাক প্রধানমন্ত্রীর সকল ক্লান্তিকে কেড়ে নিয়ে গেল। তিনি ছুটে গেলেন জনতার মাঝখানে।
আবেগবিহ্বল কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন- ভায়েরা আমার সুদীর্ঘ ২৪ বছর
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৫
ধরে উপনিবেশবাদী শাসক চক্রের হাতে শােষিত, লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত সাড়ে সাত কোটি বাঙালী নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চেয়েছিল তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, আর তাই তারা বাংলাদেশের শতকরা সাড়ে ৯৮ টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ভােট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। তারা স্বপ্ন দেখেছিল একটি শােষণহীন সমাজব্যবস্থার। কিন্তু অত্যন্ত পৈশাচিকভাবে ইতিহাসের এই নজিরবিহীন গণরায়কে বানচাল করে দিয়ে বাংলার আবালবৃদ্ধবণিতার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হানাদার পশ্চিমা পশুর দল সারা বাংলাদেশব্যাপী এক অশ্রুতপূর্ব গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে বিগত ২৫ মার্চ থেকে।
একদিকে নিহত, লাঞ্ছিত ও লুষ্ঠিত মানবাত্মার আর্তনাদে বিমর্ষ বাংলা আর একদিকে আঘাতে প্রত্যাঘাত হেনে মাতৃভূমিকে শত্রু কবলমুক্ত করার দুর্জয় শপথে বলীয়ান বীর মুক্তিযােদ্ধাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার বেদীতটে মহান নেতার আদর্শে নবজন্ম লাভ করেছে বাঙালী জাতি । সারাদিন রণাঙ্গন দেখে এলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কিশাের, যুবক, প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ নর- নারী আজ অস্ত্র ধারণ করেছে হানাদার পশুদের মােকাবেলা করতে । এ যুদ্ধ আমাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধ। জয় আমাদের হবেই। আপনারা মুক্তাঞ্চলের অধিবাসীরা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করুন। মনে রাখবেন বাংলার প্রতিটি মানুষই আজ একজন মুক্তিযােদ্ধা। মাতৃভূমি থেকে শেষ হানাদার শত্রুকে খতম অথবা বিতাড়িত না করা পর্যন্ত এ যুদ্ধ আমাদের চালাতে হবে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বললেন, বাংলার মানুষের নয়নমণি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে আমরা আবার আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনবই। বিক্ষুব্ধ গর্জনে সমগ্র এলাকাকে থরথর করে কাঁপিয়ে দিয়ে ওরা আওয়াজ তুলল ‘জয় বঙ্গবন্ধু, জয় শেখ মুজিব’।
সভাশেষে আঞ্চলিক আওয়ামী লীগ নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে ডেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থাকে জনগণের স্বার্থে গড়ে তােলার কাজে সহযােগিতা করতে । বুড়িমারি ক্যাম্পে ফিরেছিলাম রাত্রি প্রায় ১২টায়। পরদিন সকালে তেঁতুলিয়ার পথে রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু ভাের বেলায় পাটগ্রাম থেকে খবর এলাে ওখানকার যুব সম্প্রদায় একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে অভিনন্দন জানাতে। তাই আবার চললাম পাটগ্রামের পথে । পথের দু’ধারে সহস্র সহস্র মুক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত নর-নারী, চোখেমুখে তাদের প্রভাত সূর্যের আলােকরশ্মির স্বর্ণচ্ছটা, চিত্ত ওদের হর্ষোৎফুল্ল আর কণ্ঠ ওদের ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে সােচ্চার।
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৬
একের পর এক পাটগ্রাম পোস্ট অফিস, থানা, বালিকা বিদ্যালয় ও আওয়ামী লীগ শাখা অফিস পরিদর্শন করে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান কক্ষে (পাটগ্রাম সদর দফতর) প্রবেশ করলেন। ওরা গেয়ে উঠল- ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি’- তারপর পরিবেশন করল বাংলাদেশের গণহত্যা ও আজকের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপরে রচিত একটি ছােট নাটিকা । ওদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়ােজনীয়তার কথা।
ফিফেন্স লাইনে
তারপর এগিয়ে চললাম ভুরুঙ্গামারি ও ফুলবাড়ি রণক্ষেত্রে । পথিমধ্যে এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। প্রধানমন্ত্রী ও আমাদের গাড়ির সামনে আর পশ্চাতে একটি জীপে চড়ে আসছিল আমাদের চলচ্চিত্র ও স্টিল ক্যামেরাম্যান আসিফ ও আলম । হঠাৎ ওদের জীপখানি রাস্তার ওপর থেকে স্কিড করে উল্টে গিয়ে খালের মধ্যে পড়ল। মুহূর্তের জন্য আমরা হতভম্ব হয়ে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে ছুটে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম খালের মধ্য থেকে ভেজাদেহে বেরিয়ে এসে ফটোগ্রাফার আলম চিৎকার করে উঠল আমরা সবাই ভালাে আছি। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে আলম, আসিক ও গাড়ির ডাইভারকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললেন। দু’হাত তুলে খােদার দরবারে জানালেন অশেষ কৃতজ্ঞতা। ওদেরকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে আবার এগিয়ে চললাম। ভুরুঙ্গামারি অঞ্চলে পৌছলাম সন্ধ্যার কিছু আগে। শত সহস্র যােদ্ধা ও গ্রামবাসী আমাদের অভিনন্দন জানালাে । মুক্তিযােদ্ধাদের সামনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের ডিফেন্স ক্যাম্প পরিদর্শনে বের হন। আমাদের ডিফেন্স লাইন থেকে মাত্র দু’মাইল দূরে রণসজ্জায় হানাদার পশুর দল। স্থানীয় নেতবর্গ ও সেনাপতিদের সকল অনুরােধ উপরোধ উপেক্ষা করেও বিপদ মাথায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে গেলেন।
সামনে পড়ল একটি খরস্রোতা নদী। সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান বললেন নদীর ওপারে আমাদের ডিফেন্স লাইন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, চলুন, আমি ওদেরকে দেখতে চাই। নদী পার হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিল। একটি মাত্র কলাগাছের তৈরি ভেলা ছাড়া সে মুহুর্তে সেখানে আর কিছুই ছিল না। দেখলাম প্রধানমন্ত্রী সােজা গিয়ে ভেলায় চড়ে বসলেন। অনুসরণ করে এগিয়ে গেলেন অন্যেরা । ভেলা ভেসে চলল । হঠাৎ মাঝ নদীতে গিয়ে স্রোতের কাছে পরাভূত হলাে ভেলার গতি। কিছুতেই আর এগােনাে সম্ভব নয়। কিন্তু ওকি? ওপার থেকে দুজন বলিষ্ঠ মুক্তিসেনা তাদের হাতের স্টেনগান দু’টি অন্য সাথীদের হাতে দিয়ে ঝাঁপিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৭
পড়ল । স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে ওরা ভেলাটিকে টেনে ওপারে নিয়ে গেল।
বাঙ্কারে বাঙ্কারে ঘুরে ঘুরে প্রতিটি সৈনিকের সাথে ব্যক্তিগতভাবে মিলিত হয়ে অনেক রাতে ফিরে আসলেন প্রধানমন্ত্রী কর্তব্য পালনের প্রশান্তি মুখে নিয়ে। খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের প্রত্যেকেই ঘুমাতে গেলেন৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে দেখলাম গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মাধক্ষ, আওয়ামী লীগ নেতবৃন্দ ও গ্রামবাসীর সাথে অভাব অভিযােগ ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলাপ-আলােচনা করতে।
শােষণহীন সমাজ গড়াই
১২ অক্টোবর। প্রত্যুষে উঠেই আবার আমরা সদলবলে তেঁতুলিয়ার পথে রওনা হলাম। সারাদিন পথ চলে তেঁতুলিয়ার মুক্তাঞ্চলে গিয়ে পৌছালাম প্রায় বিকেল ৩-৩০ মিনিটে। মধ্যাহ্নভােজন শেষ করেই যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। নেতার আগমনে আনন্দে উফুল্ল মুক্তিযােদ্ধারা চতুর্দিক থেকে ছুটে এসে যুদ্ধক্ষেত্রেই নেতাকে দিল সামরিক গার্ড অব অনার। ওদেরকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বললেন- ভায়েরা আমার, আগেরবার আমি যখন এসেছিলাম তখন আপনারা অনেক পেছনে ছিলেন। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তেঁতুলিয়া, ভজনপুর ও কোটগাছিসহ প্রায় সাড়ে ৬ শত বর্গমাইল এলাকা মুক্ত করে দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো আপনাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনন্দে আমার বুক ভরে উঠেছে। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোনাে শক্তিই আর আমাদের এ অগ্রযাত্রাকে রােধ করতে পারবে না। প্রতিটি শত্রু সেনাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আমাদের বহু সাধের ধর্মনিরপেক্ষ ও শােষণহীন সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারবােই এ বিশ্বাস আমার আছে। কঠিন আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপনারা এগিয়ে চলুন। জয় আমাদের হবেই।
বক্তৃতা শেষে সৈনিকরা তাদের বাঙ্কারে ফিরে গেল । প্রধানমন্ত্রী ওদের অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে। দেখলাম একটি গ্রাম্য দুর্গম স্থানের মাঝখানে ওদের প্রধান বাঙ্কার । বর্ষার জলে বাঙ্কার ভরে গেছে। আর তার মধ্যে কোমর জলে দাঁড়িয়ে প্রহরারত আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধারা। এক মুহূর্তে উপলব্ধি করলাম মাতৃভূমিকে হানাদারদের কবলমুক্ত রাখার শপথে বলীয়ান ঐ বঙ্গ-শার্দুলেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে তাচ্ছিল্য করে কর্তব্য পালনে রত।
ট্রেনিং ক্যাম্পে
পরদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী একটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শন করলেন। সেখানে প্রায় তিন সহস্রাধিক মুক্তিসেনা শিক্ষা গ্রহণ করছে। ওদেরকে শেখানাে হচ্ছে
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৮
অটোমেটিক মেশিনগান বা বাইফেল চালনা, মর্টার শেলিং, গ্রেনেড চার্জ ও ডিনামাইট বিস্ফোরণের আধুনিকতম পদ্ধতি ও গেরিলা কার্যক্রম । প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী ওদের পাশে পাশে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী দেখলেন কত ধৈর্য সহকারে ও মনযোগ দিয়ে ওরা শিখছে। টার্গেট করে মেশিনগানের ৫টি করে গুলি চালালাে ২০ শিক্ষার্থী। হতবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম গড় হিসেবে প্রত্যেকেরই ৫টির মধ্যে চারটি গুলিই টার্গেটে আঘাত করেছে! প্রশ্ন করে জানলাম, ওরা মাত্র এক সপ্তাহ আগে মেশিনগান হাতে দিয়েছে। গর্বে বুক ভরে উঠল। শুধু মনে হলাে জন্মভূমি মা ওদেরকে গড়ে তুলছে তার নিজের মতাে করে, কারণ ওরা মুক্তিসেনার দল । চেয়ে দেখলাম ওদের মধ্যে প্রত্যেকেই ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়স্ক কিশাের অথবা যুবক। ওদের সকলকে সমবেত করে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন- তোমরা আজ সকলেই দেশমাতৃকার আজাদী রক্ষার যে মহান সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে তার জন্যে তােমরা আমার অভিনন্দন গ্রহণ কর। সকল প্রকার রাজনৈতিক স্বার্থ বা আদর্শের উর্ধ্বে তােমরা আজ এক একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিসেনা। আজ থেকে তােমাদের আদর্শ মাত্র একটি মহান নেতা শেখ মুজিবের বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর একটি মাত্র শপথ-বিদেশী শত্রু কবলমুক্ত স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিরক্ষার প্রশ্নে আত্মােৎসর্গ করা । তােমরাই আমার দেশের ভবিষ্যত।
অপরাহ্নে সদলবলে প্রধানমন্ত্রী গেলেন মুক্তিযুদ্ধে আহত সৈনিকদের একটি হাসপাতাল পরিদর্শনে। সারা বিকেল ধরে এক এক করে প্রতিটি আহত সৈনিককে বুকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসজল চোখে প্রধানমন্ত্রী শােনালেন তাদের সান্তনার বাণী। ওদের ঘরবাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে লিয়াজো অফিসারকে বললেন যােগাযােগ করতে, নির্দেশ দিলেন ওদের জন্য স্থায়ী ব্যবস্থা করতে। প্রধানমন্ত্রীর চোখ অশ্রুসিক্ত কিন্তু আহত ও ঐ মুক্তিসেনাদের চোখেমুখে দেখলাম বারুদের বিস্ফোরণের প্রতিজ্ঞা। হাসপাতালের ডাক্তাররা অভিযােগ করলেন ওরা চিকিৎসা গ্রহণে কালক্ষেপণ করতে চায় না, ওরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যেতে চায়।
যা চাই, দিতে পারবেন
হাসপাতালের বিছানায় বসে অপলক নেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ছিল একজন সৈনিক। হানাদার পশুদের একটি মর্টার শেল ওর দু’টি হাতকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘বল তুমি কি চাও?’ ধীর শান্ত অথচ ইস্পাত কঠিন কণ্ঠে ও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘পারবেন আমি যা চাই তা আমাকে দিতে।’ প্রধানমন্ত্রী নির্বাক। ও বলল, ‘স্যার, হৃদয়ের জ্বালা
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৯
আমার থামেনি, আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে চাই। প্লাস্টিক সার্জারি করে আমার হাত দুটিকে ভালাে করে দিন। কয়েক মুহর্তের জন্য আমরা সকলে স্থবির হয়ে গেলাম- মন ডেকে বলল, যে মাটি এমন বীর সন্তানকে জন্ম দিয়েছে সে মাটিতে হানাদার পশুদের কোনাে স্থান নেই।
হাসপাতালের বিছানায় দুটি চেনামুখ দেখে আমরা সবাই চমকে উঠলাম। প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তােমাদেরকে তাে আমরা গত পরশু দিন বড়খাতা রণাঙ্গনে দেখে এলাম, কিন্তু আজ তােমরা এখনে আসলে কিভাবে? ওরা হাসিমাখা মুখে বলল, এখানে কেমন করে এসেছি তা আমাদের মনে নেই কিন্তু এ কথা স্পষ্ট মনে আছে যে সেদিন আপনাকে আমাদের মাঝে পেয়ে যে অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলাম তারই ভিত্তিতে সেদিন রাতে আমরা অগ্রসর হই। সারারাত যুদ্ধ করে হারাদারদের ২৪/২৫ জনকে খতম করে আমরা আরও ৪/৫ বর্গমাইল এলাকা দখল করে ওদেরকে বিতাড়িত করেছিলাম। আমাদের একজন বীর সঙ্গী বুলেটবিদ্ধ হয়ে মারা যায় আর আমরা দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমাদের জ্ঞান ফেরে, তখন আমরা এই হাসপাতালে
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের পক্ষ থেকে এম.আর আখতার কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।”৪
পৃষ্ঠাঃ ৩৫০
১৪
ভারতে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী
১৯৭১ সালের জানুয়ারি হতে ২৫ মার্চ পর্যন্ত মাওলানা ভাসানী সারা বাংলাদেশে জনসভা করে জনগণকে সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ২৫ মার্চ তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে অবস্থান করছিলেন। ৩ এপ্রিল রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনো মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ৪ এপ্রিল পাকবাহিনী সন্তোষে তার বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং এলাকার অনেককে হত্যা করে। পাক সেনারা তাকে খোঁজে এবং এলাকার মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করে ‘কাফের ভাসানী কোথায়’। নানা কৌশলে পাকবাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে কোষা নৌকায় ১০ এপ্রিল তিনি সরাজগঞ্জ পৌছেন। সিরাজগঞ্জের মােজাফফর ন্যাপ সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও মােরাদুজ্জামানসহ তিনি ১৫ এপ্রিল সীমান্ত পেরিয়ে আসামের গোয়ালপাড়া জেলার শিশুমারীতে আশ্রয় নন এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। মন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ভাসানীর আগমন সম্পর্কে অবহিত করেন। ভাসানী স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য কামনা করেন। ১৭ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সাথীসহ বিমানে আসাম থেকে কলকাতা পৌছেন। তারা কলকাতা পার্ক সার্কাসের পাক স্ট্রীটের কোহিনুর প্যালেসের পঞ্চম তলায় ফ্ল্যাটে অবস্থান করেন। একই ভবনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার বাস করতেন। তাজউদ্দীন আহমেদ স্বয়ং থাকতেন থিয়েটার রােডে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ে। তাজউদ্দীন অঙ্গীকার করেছেলিন দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাম্পত্য জীনযাপন করবেন না। কোহিনূর ম্যানসনে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সাথে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারতে ভাসানীর আগমন, সংবাদপত্রে ভারতের সাহায্য কামনা করে বিবৃতি মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশালী করে।
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ভাসানী চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ, প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি জানান। ভারত সরকার তার এই সমস্ত
পৃষ্ঠাঃ ৩৫১
চিঠিপত্র-তারবার্তা যথাস্থানে পাঠাবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন। পত্রপত্রিকাতেও এসব সংবাদ আসে ফলাও করে। যেমন ‘আর অস্ত্র দিবেন না।’ ‘মওলানা ভাসানীর নিক্সনকে চিঠি’ শিরােনামে আনন্দবাজারের সংবাদ এ রকম:
‘চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই শুধু নয় প্রেসিডেন্ট নিক্সনকেও মওলানা ভাসানী এক ব্যক্তিগত বার্তা পাঠিয়েছেন।
আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কাছে মওলানা ভাসানীর আবেদন: চীনের ও আপনাদের দেয়া সামরিকসম্ভার দিয়ে স্বৈরাচারী একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া ‘বাংলাদেশে’ লক্ষ লক্ষ নিরীহ নর-নারী-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করছে। আপনি অবিলম্বে পাকিস্তানকে নতুন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করুন। আপনার দেওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যাতে তারা বাঙালীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করতে পারে তার ব্যবস্থা করুন। ‘বাংলাদেশ’ প্রজাতন্ত্র অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন। তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করুন।
বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার বিদেশী সাংবাদিকদের যাতে বাংলাদেশের ভেতর পরিভ্রমণ করে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা বাংলাদেশে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, গুণ্ডামি, গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের প্রকৃতি ও বহর স্বচক্ষে দেখে বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের মর্মন্তুদ কাহিনী প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারেন আপনি তার ব্যবস্থা করলে আমি বাধিত হবে।”১
মাও সেতুঙকে তিনি লেখেন:
প্রেসিডেন্ট মাও সেতুঙ, পিকিং, চীন :
“সমাজতন্ত্রের আদর্শ হচ্ছে অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা।একনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক চক্রের বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর যে বর্বর অত্যাচার চলিতেছে তা থেকে তাদের বাঁচাবার জন্য আমি আপনার নিকট আবেদন করছি। আপনার সরকারের সরবরাহ করা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে ইয়াহিয়ার সামরিক গভর্নমেন্ট নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে বাংলাদেশের নিরপরাধ, নিরস্ত্র, অসহায়, কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের সাহায্যে সামরিক চক্র বাংলাদেশের অত্যাচারিত জনগণের উপর পশুর মতাে যে বীভৎস আক্রমণ চালিয়েছে, আপনার সরকার যদি তার প্রতিবাদ না করে তবে বিশ্ববাসীর এই ধারণাই হবে যে, আপনি অত্যাচারিত জনগণের বন্ধু নন।
বাংলাদেশের নিরপরাধ জনগণের উপর সামরিকচক্র যে নির্যাতন চালিয়েছে তার তুলনা আপনার দেশে চিয়াং কাইশেকের, রাশিয়ার জারের এবং স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসনকালেও পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি দুর্ভাগা
পৃষ্ঠাঃ ৩৫২
বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে যে বর্বরতা ও নৃশংসতা চলছে তার প্রচণ্ডতা ও প্রকৃতির সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র বিবরণ বিভিন্ন ভারতীয় সূত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। যে কোন দেশের, এমনকি ইয়াহিয়া সরকারের বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকরা যদি সরজমিনে সব কিছু দেখে যান, তাহলে বিশ্ববাসী বর্বরতার যথার্থ চিত্র ও যথার্থ প্রকৃতি এবং আমার অভিযোগের সত্যতা জানতে পারেন।
আপনি ভালােভাবেই জানেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকারের পিছনে যে প্রকাশ্য জনসমর্থন রয়েছে, কম্বােডিয়ার সিহানুক সরকারের পিছনেও ততখানি সমর্থন নেই। তাই আপনার নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরােধ, বাংলাদেশের স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে আপনি সমর্থন করুন, স্বীকৃতি দিন ও সর্বপ্রকারের সাহায্য করুন।
পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এবং পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আমাকে ৩১ বছর কারাবাস করতে হয়েছে। বর্তমানে আমি ৮৯ বছরের বৃদ্ধ। আমার এই বয়সে ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈন্যরা আমার সামান্য বাসগৃহ পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত আমার মূল্যবান বইগুলিও তারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাড়িতে আগুন লাগাবার পর আমার পরিবারবর্গের ভাগ্যে কী ঘটেছে আমি জানি না।
ইতি
মওলানা ভাসানী।”
২৫ এপ্রিল সােভিয়েত নেতাদের নিকট ধন্যবাদ জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করেন এবং তা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়: ২
“অসহায় মানুষের উপর ইয়াহিয়া খানের ফৌজের বর্বরােচিত অত্যাচার বন্ধের জন্য জাতীয় আওয়ামী দলের নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সােভিয়েত রাশিয়াকে আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ জানিয়েছেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পদগনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, মওলানা ভাসানী তাকে স্বাগত জানিয়ে শনিবার একটি বিবৃতিতে বলেন, শুধু ঐ কথাতেই সব হলাে না, অবিলম্বে বসে একটি কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
ন্যাপের (ভাসানী) সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া সীমান্ত পেরিয়ে কলকাতা এসেছেন এবং টাওয়ার হােটেলে অবস্থান করছেন। তিনি মওলানা ভাসানীর সাথে সাক্ষাতপ্রার্থী। ভাসানী যাদু মিয়ার সাথে দেখা করছেন না। তিনি তার ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলামকে বললেন, ওরা আমার হিন্দুস্তানে আসার বিরােধী। তারা চায় ভাসানী দেশে থাকুক। তারা ভাসানীকে চীনে নিয়ে যেতে চায়। চীনা দূতাবাসের লােকজন তাকে চীনে নেয়ার জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৩
তিনবার দেখা করেছিল। ২৪ মে যাদু মিয়া পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান এবং পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলান। পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যাসেলের ৫ম তলায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন ছেলেমেয়ে দের নিয়ে থাকতেন৷ এ ভবনে ভাসানীর সাথে তাজউদ্দীনের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা নিয়ে একত্রে আলােচনা হয়। ভাসানী তাকে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মে ভাসানী সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। ২১ এপ্রিল তিনি জাতিসংঘ, চীন ও অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য চেয়ে আবেদন জানান। ২৪ জুন ভাসানীর বিবৃতি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়।
মওলানা ভাসানী চীনের প্রেসিডেন্ট মাও সেতুংকে পত্র লেখেন। পাকবাহিনীর বাংলাদেশে যে নির্যাচন করছে তা তাকে অবহিত করেন। ২৫ এপ্রিল সােভিয়েত নেতাদের কাছে ধন্যবাদ জানিয়ে পত্র লেখেন। ১৯৭১ সালের ৩০ ও ৩১ মে কলকাতার বেলেঘাটায় প্রবাসী বামপন্থীদের দু’দিন ব্যাপী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বরদা চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ১ জুন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডা. সাইফ-উদ-দাহার, ডা, মারুফ হোসেন, কাজী জাফর আহমদ, দেবেন সিকদার, আবুল বাশার, অমল সেন, নজরুল ইসলাম , শান্তি ঘােষ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনাে, মােস্তফা জামাল হায়দার, নাসিম আলী প্রমুখ। সমন্বয় কমিটি মুক্তি সংগ্রামে করণীয় কর্তব্যগুলো জানিয়ে দেয়।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষে কোহিনূর প্যালেসে মওলানা ভাসানীর কক্ষে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মণি সিংহ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ, শ্রী মনােরঞ্জন ধর উপস্থিত ছিলেন।
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চারটি প্রগতিশীল দলের প্রতিনিধি নিয়ে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী এবং সদস্য ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, আওয়ামী লীগ, কমরেড মণি সিংহ, কমিউনিস্ট পার্টি, শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর, কংগ্রেস, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ ন্যাপ (মাে)। ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করার পর মুজিবনগর সরকার আওয়ামী লীগের একাংশের তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ষড়যন্ত্র থেকে বেঁচে যায়।
মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নিম্নের সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় :
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে ক্ষোভ প্রকাশ, বিচার বন্ধ
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৪
করার জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল শক্তির প্রতি আহবান।
২. বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা প্রকাশ জ্ঞাপন ।
৩. বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদান।
৪. মুক্তুযুদ্ধের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য ভারতসহ সারা বিশ্ব শক্তির প্রতি আহবান।
৫. মক্তিযােদ্ধাদের অভিনন্দন।
৬ শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে ভারত সরকার ও জনগণকে অভিনন্দন জ্ঞাপন।
৭. রাজনৈতিক সমাধান বলতে পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্যকিছুই গ্রহণযােগ্য নয় বলে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করা ।
অষ্টবামের উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্তির দাবি মন্ত্রিপরিষদ অনুমােদন করেনি। মুজিবনগর ৮টি বামপন্থী দল নিয়ে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি নামে ঐক্যজোট গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যভুক্ত দলগুলাে হলাে :
১. কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি
২. পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি
৩. কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র
৪. পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এমএল— আবদুল হক
৫. বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি হাতিয়া গ্রুপ
৬. পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়ন
৭. ভাসানী ন্যাপ
৮. পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন
এ দলগুলাের সম্মিলিত নামই অষ্টম।
মওলানা ভাসানী ছিলেন অষ্টবাম নিয়ে গঠিত কমিটির সভাপতি। অষ্টবামের পক্ষে রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনাের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সরকারের কলকাতাস্থ থিয়েটার রােডের কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সাক্ষাত করে। সমন্বয় কমিটির প্রতিনিধিদের উপদেষ্টা পরিষদের নেয়ার দাবি জানানাে হয় ।
মওলানা ভাসানী কলকাতায় কিছুদিন থাকার পর আসামে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । পশ্চিমবঙ্গ হতে আসামের পথে তিনি কুচবিহারের পুন্ডিবাড়িতে অবস্থান করেন। এখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দিল্লীর অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অবমেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আরােগ্য লাভের পর তাকে দেরাদুনের শৈলবাসে পাঠানাে হয়। এখানে সুন্দর সার্কিট হাউজে তার ব্যক্তিগত সচিব
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৫
সাইফুল ইসলাম ও মােরাদুজ্জামানকে নিয়ে অনেক দিন বাস করেন।
কলকাতায় উপদেষ্টা পরিষদের সভা হবে। ভাসানীকে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার অনুরােধ পাঠিয়েছে। ভাসানী গেলেন না কারণ অনেক বিষয়ে সরকারের সাথে দ্বিমত পােষণ করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মওলানা ভাসানীকে ঈদের উপহার পাঠালেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সাথে তিনি দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তার সফদার জং রােডের কার্যালয়ে কক্ষের দরজায় এসে দু’হাত জোড় করে নমস্কার সম্বােধনে মওলানা ভাসানীকে অভ্যর্থনা জানালেন। ভাসানী ইন্দিরাকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ জানান। ইন্দিরা উত্তরে বলেন, সময় হলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।
মওলানা ভাসানী আসামে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য আসামের ধুবড়ি গ্রামে ৫ একর জমি বরাদ্দ ও চারটি টিনের ঘর নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পত্র লেখেন। দেরাদুনে এসে মওলানা ভাসানী চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর কাছে নিমের বার্তা প্রেরণ করেন :
‘সমাজতন্ত্রের উদ্দেশ্য হলাে শােষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর দ্বারা নির্যাতিত বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি জনগনকে রক্ষার জন্য আপনাকে অনুরােধ করছি। আপনাদের সরকারের দেয়া আধুনিক অস্ত্র দিয়ে ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার নির্দয়ভাবে বাংলাদেশের নির্দোষী, নিরস্ত্র, অসহায় কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, নারী ও শিশুদের হত্যা করছে। সামরিক সরকার বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের প্রতি ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে তা যদি আপনার সরকার প্রতিবাদ না করে তাহলে বিশ্ব মনে করবে যে, আপনি নির্যাতিত মানুষের বন্ধু নন।’
মওলানা ভাসানী জাতিসংঘে প্রেরিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতা আবু সাঈদ চৌধুরীকে পত্র লেখেন : ‘… এখন একমাত্র দফা একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, অন্যথায় মৃত্যুবরণ। ইহা ব্যতীত অন্য কোন রাজনৈতিক মীমাংসা বা আপােস নহে। হিন্দুস্তান নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতিত শরণার্থীদের সাহায্য করিতেছে। চিরকাল বাঙালীরা তা স্মরণ রাখিবে।’
১৯৭১ সালের ৩ অক্টোবর দেরাদুন হতে মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এক ঐতিহাসিক পত্র লেখেন। পত্রে তিনি বলেছেন : ‘আমি পুনরায় ওয়াদা দিচ্ছি আওয়ামী লীগ যতক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়বে আমি তাদের সমর্থন দিয়ে যাব।’ তিনি আরও বলেছেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন এবং ভারতের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৬
করার লক্ষ্যে আমি আমার সংগ্রাম অক্ষুন্ন রাখব।’
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট থেকে পত্রের উত্তর পেয়ে ভাসানী ১৯৭১ সালের ২১ অক্টোবর পুনরায় ইন্দিরা গান্ধীকে পত্র লেখেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরও একটি তারবার্তা প্রেরণ করেন। তারবার্তায় তিনি বলেন : ‘ আমার ২৪ বছরের সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বলছে পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য অন্য কোনাে রাজনৈতিক সমাধান মুক্তি দিতে পারবে না। হয় স্বাধীনতা-নয় মৃত্যু।
মওলানা ভাসানী একস্থানে বেশিদিন থাকতেন না। তিনি রানীক্ষেতে কিছুদিন অবস্থান করেন। তিনি রানীক্ষেত থেকে দেরাদুনে গমন করেন। দেরাদুন থেকে বিমানে কলকাতা এলেন। হাজরা স্ট্রিটের বাসভবনে উপদেষ্টা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হলাে। তিনি কলকাতা থেকে আসামের চরভাসানে যান। আসাম থেকে তিনি পুনরায় দেরাদুনে গমন করেন। তিনি দিল্লিতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট পব মেডিকেল সায়েন্স সংলগ্ন হাসপাতালে ভর্তি হলেন । সুস্থ হয়ে তিনি হাসপাতাল ত্যাগ করে দিল্লীর যমুনা নদীর তীরে এক বাংলােতে ওঠেন। তার পৃষ্ঠপােষকতায় তার ছেলে নাসের ভাসানী ‘গণমুক্তি’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন৷
১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি কলকাতায় শিয়ালদহ রেল স্টেশনের নিকিট টাওয়ার হােটেলে চীনপন্থী বাম দলগুলাে এক প্রাথমিক সভা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। সভায় মওলানা ভাসানীর নেতত্বে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয় এবং একটি খসড়া কর্মসূচী অনুমােদন করা হয়। এ সভায় ভাসানী ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তার সাথে ন্যাপের তরুণ নেতা কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের মতদ্বৈততা দেখা দেয়। কলকাতা অবস্থানকালে মওলানা ভাসানী মশিউর রহমানকে একবারও সাক্ষাতকার দেননি। ২৪ মে মশিউর রহমান হঠাৎ টাওয়ার ভবন থেকে পালিয়ে যান। পরদিন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে এসেছিল। তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান সামরিক সরকারের নিকট ‘সারেন্ডার’ করেন। এ বিতর্কিত ব্যক্তি পরবর্তীকালে তার দলবল নিয়ে বিএনপিতে যােগ দেন ও জিয়া মন্ত্রিসভার সিনিয়র মন্ত্রী নিযুক্ত হন। চীন সমর্থক বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা বেলেঘাটার একটি স্কুল ভবনে ৩০ মে কমরেড বরদা চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে এক সম্মেলনে মিলিত হন। এ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে সমন্বয় কমিটির পক্ষে রাশেদ খান মেনন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট এক স্মারকলিপি পেশ করে মুক্তিযুদ্ধে শর্তহীন সমর্থন জানান। উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী মুক্তি
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৭
সংগ্রামে সমন্বয় কমিটির সভার আলােচনায় একবারও যোগ দেননি।
আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সেক্ষেত্রে চীনপন্থী দলগুলাের মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠনের প্রয়ােজনীয়তা ছিল না৷ এ কারণে ভাসানী কোনােদিন এ কমিটির সভাপতি হিসেবে কাজ করেননি। অনেকে বলে থাকেন মওলানা ভাসানীকে ভারত সরকার গৃহবন্দী করে রেখেছিল। কিন্তি এ অভিযােগ আদৌ সত্য নয়। কিছু পাকিস্তানী চর পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ে। তারা নেতাদের হত্যা করতে পারে। এ আশঙ্কায় মওলানা ভাসানীসহ বিশিষ্ট নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। আসামের ভাসানীরচরে যাওয়া পথে কুচবিহারের পুন্ডিবাড়িতে একবার ভাসানী অসুস্থ হয়ে পড়েন। সুচিকিৎসার জন্য ভাসানীকে বিমানযোগে দিল্লীতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুটা সুস্থ হলে তিনি ভারতেত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কোনপ্রকার সহায়তাকারী ব্যতীত দেড় ঘন্টা আলােচনা করেন। এরপর পূর্ণ সুস্থতার জন্য মওলানা ভাসানীকে দেরাদুনের শৈলাবাসে পাঠানাে হয়। এ সময় সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য মুজিবনগর সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা হয়। তাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মওলানা ভাসানীকে কলকাতায় আসার জন্য জরুরী অনুরােধ জানান। মওলানা ভাসানী কলকাতা চলে আসেন এবং হাজরা স্ট্রিটে ওঠেন। তিনি কয়েক দফা বিভিন্ন দলের সাথে বৈঠকে বসেন। মােজাফফর ন্যাপ, কংগ্রেস মন্ত্রিসভায় যােগদানের জন্য চাপ দেয়। বর্ষীয়ান নেতা ভাসানী এ সকল দলের নেতৃবৃন্দের কঠোর সমালােচনা করে বলেন যে, তারা বিগত নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। তাদের মন্ত্রিসভায় যােগদানের বৈধতা নেই। তিনি মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন ও সহযােগিতার আহ্বান জানান। এই বৈঠকে ভাসানীর প্রস্তাব অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার নীতিনির্ধারণ সংক্রান্ত একটি সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে চারটি প্রগতিশীল দলের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গঠন করা হয় ।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী – সভাপতি – ভাসানী ন্যাপ
তাজউদ্দীন আহমেদ – সদস্য – আওয়ামী লীগ
খন্দকার মােশতাক আহমেদ – সদস্য – আওয়ামী লীগ।
কমরেড মণি সিংহ – সদস্য – কমিউনিস্ট পার্টি
শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর – সদস্য – কংগ্রেস
অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ – সদস্য – ন্যাপ (মােজাফফর)
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৮
প্রতি তাদের ঘােষিত সমর্থন সক্রিয় করে তােলেন। শেখ মুজিবের অবর্তমানে মওলানা ভাসানীর এউ সাহসী ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ সভার বৈঠক আহবান ও পরিচালনা করবেন। সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের ফলে মুজিবনগর সরকার ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা পায়। খন্দকার মােশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি উপদল তাজউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ও সঙ্কট সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সুষ্ঠু ভাবে মুজিবনগর সরকার পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন।
উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পর মওলানা ভাসানী আসামের ভাসানীর চরে তার মুরিদদের সাথে দেখা করতে যান। এ ছিল ভাসানীর আসামে শেষ সফর। আসাম সফরের পর মওলানা ভাসানী পুনরায় দেরাদুনের শৈত্যনিবাসে গমন করেন৷ এবং ৭ সপ্তাহকাল অবস্থানকালে এখান থেকে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সেতুঙের নিকট তারবার্তা প্রেরণ করেন। তিনি তারবার্তায় মাও সেতুংকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করার অনুরোধ জানান৷ মাও সেতুং এর নিকট প্রেরিত তারবার্তা দেশ-বিদেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৪ জুন মওলানা ভাসানী স্বাক্ষরিত একটি লিখিত ভাষণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। তিনি বিবৃতিতে বলেন, “… মানবতার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা চীন জালেম সরকারকে স্বাধীন বাংলায় টিকাইয়া রাখার অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য প্রদান করিলে ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাহাদিগকে একদিন আসামী হইয়া দাড়াইতে হইবে। তাই আমি দুনিয়ার সকল দেশের শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ ও সরকারের নিকট আবেদন করি ইয়াহিয়া সরকারের এই ধরনের মানবতাবিরােধী অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন ও প্রতিরােধ গড়িয়া তুলুন।”
“প্রসঙ্গত আমি উল্লেখ করিতে চাই বাংলার স্বাধীনতার দাবিকে নস্যাৎ করিবার ষড়যন্ত্র যতই গভীর হােক না কেন, তাহা ব্যর্থ হইবেই। মীমাংসার ধােকাবাজিতে জীবনের সকল সম্পদ হারাইয়া, নারীর ইজ্জত, ঘরবাড়ি হারাইয়া, দেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া এবং দশ লক্ষ অমূল্য প্রাণ দান করিয়া স্বাধীন বাংলার সংগ্রামী জনসাধারণ আর কিছুই গ্রহণ করিবে না। তাহাদের একমাত্র পথ পূর্ণ স্বাধীনতা, না হয় মৃত্যু। মাঝখানে অবস্থান গ্রহণের কোনাে সুযােগ নাই। পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে নস্যাৎ করিয়া গোঁজামিল দিবার জন্য যে কোনাে দল এহিয়া খানের সহিত হাত মিলাইবে, তাহাদের অবস্থা গণবিরােধী মুসলিম লীগের চাইতেও ধিকৃত হইবে৷ তাহাদের রাজনৈতিক মৃত্যু কেহ রােধ করিতে পারিবে না।”৪
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৯
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে যােগদানের জন্য মওলানা ভাসানী মুজিবনগর আগমন করেন৷ এবারের বৈঠকে মওলানা ভাসানীর ছবিসহ সর্বদলীয় কমিটির ছবি সরকারি- বেসরকারিভাবে দেশে-বিদেশে প্রচারিত হয়। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় মওলানা ভাসানী সকল সময়ই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন। বৈঠকের পর ভাসানী পুনরায় দেরাদুনে চলে আসেন৷ তিনি আবার অসুস্থ হলে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মওলানা ভাসানীকে ঈদ উপহার পাঠিয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তিনি দেখা করলেন। প্রধানমন্ত্রী তার সফদর জং রােডের কার্যালয়ে কক্ষের দরজায় এসে দু’হাত জোর নমস্কারে মওলানা ভাসানীকে অভ্যর্থনা জানালেন। ভাসানী তাঁকে সালাম জানালেন। তিনি উর্দু ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনা করেন। আলােচনাকালে তিনি বলেন, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর সাথে পরিচয় ছিল। এলাহাবাদ আনন্দ ভবনে তিনি গেছেন এবং ইন্দিরাকে ছােট দেখেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার সরকারের সাহায্যের জন্য শুকরিয়া জানালেন। বিশেষ করে তাকে মেহমানদারি করার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান।
মওলানা ভাসানী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশকে স্বীকতি প্রদানের অনুরোধ জানান। ইন্দিরা উত্তরে বলেন, সময় হলে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে।
ভারত সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর মাওলানা ভাসানীর সাথে আলােচনা করতে চান। বিশেষ কারণে ডিপি ধর আসেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মি. নাগ্রানী মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি প্রথমে তার ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলামের সাথে আলােচনা করেন। নাগ্ৰানী স্বাধীন বাংলাদেশের সীমারেখা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। পরে তিনি ভাসানীর সাথে আলােচনা করেন। আলােচনার এক পর্যায়ে ভাসানী বলেন, …..আমি ১৯৫৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলাম। বলেছিলাম পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের ভিত্তিতেই আমি প্রথমে স্নােগান তুলেছিলাম স্বাধীন পূর্ববঙ্গের। পূর্ববঙ্গের সীমারেখা আপনারা জানেন, আমরাও জানি।
প্রকৃতপক্ষে ভারতের ভয় ছিল, ভাসানী ও মুজিবনগর সরকার আসাম ও পশ্চিম বাংলা দাবি করতে পারে । ১৯৪৬-৪৭ সালে তিনি আসামকে পূর্ব পাকিস্তানভুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেন। সে জন্য ভারতের ভয় ছিল যে। আসামের ওপর মওলানার কোন দাবি আছে কি-না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
পৃষ্ঠাঃ ৩৬০
প্রথম থেকে সরকারের পতাকা বাংলাদেশ মানচিত্র অঙ্কিত করে যুদ্ধ শুরু করে। সুতরাং মানচিত্র সম্পর্কে কোন ভুল বােঝাবুঝি থাকতে পারে না।
মওলানা ভাসানী আসামে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য আসামের ধুবড়ীর গ্রামে ৫ একর জমি বরাদ্ধ ও চার খানা টিনের ঘর নির্মাণের জন্য এক পত্র লেখেন । ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে পত্রটি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট প্রেরণ করা হয়। ভাসানীর নিজ হাতে লেখা চিঠি তুলে ধরা হলো:
“প্রিয় শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী,
প্রধানমন্ত্রী
আমার আন্তরিক আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানিবেন। আমার পত্রের উত্তর মি. কাউলের মেসেজে বিস্তারিত অবগত হইয়া যারপরনাই খুশি হইলাম।
আমার বাল্যজীবনের আদর্শ ৮৯ বছর যাবত অটুট রাখিয়াছিলাম। স্বৈরাচার ইয়াহিয়া সরকারের অমানুষিক অত্যাচারে উহা লঙ্ঘন করিতে হইল। বর্তমানের রাজনীতিবিদ কংগ্রেসের কর্মীদিগকে যে যাহাই বলুক কিন্তু তাহাদের মতাে বিলাসিতাশূণ্য জীবনযাপন ও নির্মল চরিত্র অনেকেরই নাই । আমি চিরদিন সাধারণ গৃহে সাধারণভাবে নির্জন পল্লীতে থাকিয়া দেশের সেবা করিয়াছি। কিন্তু এবারই তাহার ব্যতিক্রম হইল। গত ৭ মাসি শহরে প্যালেসেস সার্কিট হাউসে বাস- আহারাদি, বিলাসপূর্ণ। তাই আমার মৃত্যুকাল পর্যন্ত যাহাতে বাল্যজীবনের আদর্শ হাল থাকে তাহারই জন্য ৫ একর জমি ও সাধারণ ধরনের ৪ খানা ঘরের ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ীর গ্রামে। তাই আমার বৃদ্ধা স্বীর আশা তাহার শেষ দাফন ধুবড়ীর কোন গ্রামে হয়। আমার শেষ সংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভারতের সহিত কনফেডারেশন। এই তিন কাজের সাধন ইনশাল্লাহ আমার জীবিতকালে দেখার প্রবল ইচ্ছা অন্তরে পােষণ করি।
বাধা যতই আসুক, আমর আন্তরিক আশা ও বিশ্বাস আপনাদের আশীর্বাদে অবশ্যই পূর্ণ হইবে । আমার আন্তরিক আশীর্বাদ আপনার আদর্শানুযায়ী সমাজতন্ত্র শুধু ভারতে নহে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হইবে। যখন দরকার মনে করেন দিল্লীতে ডাকাইলেই হাজির হইব।
আপনার বিশ্বস্ত
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী”
এ প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলাম বলেন :
“মওলানা সাহেবের নিজ হাতে লেখা এই খসড়া বার বার পড়লাম। এই মুহূর্তে মওলানা ভাসানীকে রহস্যময় মনে হলাে। রানীক্ষেতে তিনি নিজ হাতে এই
পৃষ্ঠাঃ ৩৬১
ধরনের আর একটি খসড়া দাঁড় করিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন অনুবাদ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠিয়ে দিতে। আসামেও আমাকে দিয়ে এ ধরনের একটা খসড়া দাঁড় করিয়েছিলেন। রানীক্ষেত ও আসামের খসড়ায় তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, তাকে আসামে থাকতে দিলে তিনি আসাম ও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না এবং ভারত সরকারকে তার খরচ বহন করতে হবে না। অবশ্য এ দুটো চিঠিতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশনের কথা উল্লেখ করেছিলেন।”
দেরাদুনে এসে মওলানা সাহেব চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল বরাবর বেশ ক’টি টেলিগ্রাফ পাঠিয়েছিলেন।
মওলানা ভাসানী চীনের মাও সেতুঙের নিকট নিমের বার্তা প্রেরণ করেন৷:
Idelogy of Socialism is to fight against oppression. Appeal to you to save seven and half crores oppressed people of Bangladesh from the atrocities commiting by the military junta of Yahiya Khan. Yahya’s military government, by help of modern war weapons supplied by your government are mercilessly and brutally slaying the innocent unarmed, helpless peasants, labourers, students, inteligentsia, women, children of Bangladesh. If your government dont protest this brutal atrocites commited on oppressed masses of Bangladesh by the military Janta the world may think that you are not the friends of oppressed people.
তিনি জাতিসংঘে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রেরিত ডেলিগেশন নেতা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লিখলেন :
“প্রিয় আবু সাঈদ চৌধুরী
আমার আন্তরিক দোয়া ও ভালবাসা আপনার সকলে গ্রহণ করিবেন। আমার শেষ জীবনের শেষ কাজ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠাকল্পে যতদূর পারি ক্ষুদ্র শক্তিতে কাজ করিতেছি। হিন্দুস্তান সরকার আমাকে কারাগারে বা অন্তরীণ রাখিয়াছে ইহা মােটেই সত্য নহে আমি যখন যেখানে থাকি খুব গােপনে অবস্থান করি। প্রকাশ্য ঘােরাফেরা বা সাক্ষাত করা আমার পক্ষে এই অবস্থায় মােটেই সম্ভব নহে।
পাকিস্তান হওয়ার প্রাক্কালে যখন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলের অস্থায়ী সরকার গঠন হয় তখনই আমি মুসলিম লীগের সকল প্রকার কর্মের প্রতি বিশ্বাস হারাই। কারণ চুন্দ্রিগড়, রাজা গজনফর আলী, নবাবজাদা লিয়াকত আলী নেহরুর সহকারী মন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু বাংলা আসামের খ্যাতনামা একে ফজলুল
পৃষ্ঠাঃ ৩৬২
হক, শহীদ, স্যার সাদুল্লা, আব্দুল মতিন চৌধুরী প্রভৃতিকে গ্রহণ না করিয়া একমাত্র যোগেন মন্ডলকে শূদ্র শ্রেণীর হিন্দু হইতে মন্ত্রিপদে নেওয়া হয়। পশ্চিমা শোষক শ্রেণীর জঘন্য কার্যাবলী ও পূর্ব বাংলার প্রতি হীন মনােভাব পুরােপুরি কলোনি করিয়া রাখার ষড়যন্ত্র ভালভাবেই অবগত হইয়াই আমি ১৯৪৮ সালে লীগের সহিত সংস্রব পরিত্যাগ করি এবং আওয়ামী লীগের জন্ম দিয়া প্রকাশ্য সংগ্রামে লিপ্ত হই। বাংলা প্রতিষ্ঠা হইবেই। মুক্তিকামী গেরিলাদের জয় অবধারিত। ১৯৫৪ সালের ২১ দফা নস্যাৎ আর প্রযুক্ত নহে। এখন একমাত্র দফা ১ টি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, অন্যথায় মৃত্যুবরণ | ইহা ব্যতীত অন্য কোন রাজনৈতিক মীমাংসা বা আপােস নহে । হিন্দুস্তান নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা ও নির্যাতিত শরণার্থীদের যাহা করিতেছে চিরকাল বাঙালীরা স্মরণ রাখিবে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী”
১৯৭১ সালের ৩ অক্টোবর মওলানা ভাসানী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এক ঐতিহাসিক পত্র লেখেন :
আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নিকট হতে :
ক্যাম্প – দেরাদুন
বরাবর
মিসেস ইন্দিরা গান্ধী,
প্রধানমন্ত্রী,
ভারত সরকার,
নতুন দিল্লী।
তারিখ ৩ অক্টোবর ১৯৭১
সম্মানীয়া মহােদয়া,
আপনার জন্য আমার অশেষ ভালবাসা ও আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন। পুনরায় আপনার অমূল্য সময় হতে কয়েক মিনিট অপচয় করার কারণে আশা করি আপনি নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
আপনার সরকার সাধ্যমতাে উত্তর চিকিৎসা করা সত্ত্বেও পুরােনাে জ্বালাটা অনুভব করছি কয় মাস পেরিয়ে গেছে আমি আমার স্ত্রী এবং নাতনিদের কোন সংবাদ জানি না। তাদের কোন প্রকার খবরাখবর না জানায় আমার বেদনাদায়ক অনুভব আপনি বুঝতে পারছেন— এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।
বাংলাদেশের প্রথম কাতারের নেতারা যারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করছেন তাদেরও সততা সম্পর্কে আল্লাহই জানেন। আমি পুনরায় ওয়াদা দিচ্ছি আওয়ামী
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৩
লীগ যতক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়বে আমি তাদের সমর্থন দিয়ে যাব।
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যখন আমি কলকাতায় ছিলাম তখন কপিতয় আওয়ামী লীগ নেতা আপনার বরাবরে একটি লেখা টাইপ করে নিয়ে এসেছিলেন। যে, অসুস্থতার দরুন আমি আপনার সাথে দেখা করতে সক্ষম হব না। চিঠির পুঙ্খানুপুঙ্খ না পড়ে কেবলমাত্র বিশ্বাসে তাতে সই দিয়েছিলাম। ওর পেছনে কি মতলব আছে আমি তা জানি না। তারা ওয়াদা করেছিলেন যে, ঐ চিঠির কপি আমাকে দেবেন। কিন্তু তারা কথা রক্ষা করেননি। আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি ১১ বছর যাবত আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলাম এবং স্বাধীনতাউত্তরকালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে ৮ বছর যাবত তার সভাপতি ছিলাম। এবং আমি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এই পদে গত ১২ বছর যাবত কাজ করে যাচ্ছি। দীর্ঘদিন এই রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতির কাজে আমার পরিচালনায় কম হলেও ১৬ জন সেক্রেটারি কাজ করছেন। কিন্তু আমি গ্রামেই বাস করি। ফলে জরুরী রাজনৈতিক চাহিদা মােকাবেলা করার জন্য আমার সাদা প্যাডে বহু সই তাদেরকে দিয়েছি। এসব আমি ভালােভাবে উপলব্ধি করছি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে আমার সরল বিশ্বাসের বহু মওকা গ্রহণ করেছে৷ ফলে আমার রাজনৈতিক সহযােগিতার উপর আমার বিশ্বাস চটে গেছে। এই কারণে আমার মানবিক বেদনার জন্যই এই সব অবান্তর কথা আপনাকে লিখছি।
বিশ্বশান্তি, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি এবং আল্লায় বিশ্বাসীসহ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপনার মহৎ সংগ্রাম আপনি অব্যাহত রাখবেন বলে আমি আশা ও বিশ্বাস করি। এবং আমি খােলামনে আপনার প্রতি সকল বিশ্বাসের স্বীকারােক্তি করছি। যদি কোন বিষয়ে আমি আপনার সাথে দ্বিমত পােষণ করি তবে ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাথে সাক্ষাত করে সেই পয়েন্ট আলােচনা করব।
আপনার মূল্যবান উপদেশ ব্যতীত আমি কোন সিদ্ধান্ত নেব না কোন কাজ করব না৷ যদি আমার বিরুদ্ধে আপনার কাছে কোন রিপাের্ট পেশ হয়ে থাকে তবে বিশ্বাস করুন আমি জীবনে কাউকে ঠকাইনি। এবং শেষ জীবনেও ঠকাব না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমি সক্রিয়ভাবে কাজের সাথে জড়িত আছি । আপনি যদি আমাকে সক্রিয়ভাবে কাজের সাথে জড়িত রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন তবে আমি সুখী ও আনন্দিত হব। বৃদ্ধ বয়সের জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে অবহেলা করবেন না। যদি কাজ করার এই আজীবন অভ্যাস হতে দূরে রাখা হয় তবে আশঙ্কা করছি তা আমার স্বাস্থাের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৪
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য কিছুদিন পূর্বে মি. ডিপি ধরের নিকিট কিছু লেখা পাঠিয়ে তা ইংরেজি, বাংলায়, চীনা, আরবি, উর্দু, ফরাসি, রাশিয়ান, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় ছাপিয়ে এ সকল দেশে বিতরণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম। অনুরােধ মােতাবেক কাজ হলে আমি সুখি হবাে। রমজান মাসে আমি পশ্চিমবঙ্গ অথবা অসামের কোন স্থানে থাকতে চাই। পবিত্র মাস শেষ আমি আবার এখানে ফিরে আসতে চাই।
আমি আপনাকে এই নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন এবং ভারতের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন করার লক্ষ্যে আমি আমার সংগ্রাম অক্ষুন্ন রাখব।
এই বুড়াে বয়সে স্ত্রী ও নাতনিদেরকে নিয়ে আসামের ধুবড়ি মহকুমার যে কোন স্থানে বাস করার জন্য যদি আপনি পাঁচ একর জমিসহ ক’টি টিনের ঘরের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে এই বদান্যতার জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব। আসামের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমি কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করব না । আপনার এবং আসাম সরকারের নিকট আমি এই প্রতিষ্ঠা করছি। ছয় মাস যাবত আমার থাকা, খাওয়া, পরার জন্য আপনার উপর নির্ভরশীলতার দরুন অত্যন্ত লজ্জাবোধ করছি। যদি ধুবড়ী থাকতে আমাকে অনুমতি দেয়া হয় তাহলে সরকারী তহবিল হতে আমার জন্য অর্থ খরচের দরকার পড়বে না। যেই আমাকে প্রো চাইনিজ বলে আপনার কাছে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা করুন, ইনশাল্লাহ আমি ভারত ও আপনার অবাধ্য হবাে না ।
সর্বাধিক সম্মান সহকারে,
আপনার বিশ্বস্ত
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী”
ভাসানীর লেখা পত্রখানা তার ব্যক্তিগত সচিব ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ করেন।
ভারতে থাকাকালে গুজব ছিল মওলানা ভাসানী ভারতে বন্দী ছিলেন। লন্ডন থেকে ফজলুল হক, মিসেস বারবারা হক এবং দেবী প্রসাদ ভারতে এসে ভাসানীর সাথে সাক্ষাত করতে ব্যর্থ হন। এ কারণে তারা ভাসানীর মুক্তি দাবি করেছিলেন । ভাসানী নিজে বলেছেন তিনি মুক্ত। নিরাপত্তার কারণে তার যাতায়াত নিয়ন্ত্রিত ছিল। তিনি বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন এবং নিয়মিত বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিতেন ।
ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি দিল্লির যমুনা নদীর তীরে বাংলােতে ছিলেন। দেশে ফেরা পর্যন্ত তিনি এ বাংলােতেই থাকতেন। ১৯৭২ সালে ২২
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৫
জানুয়ারি তিনি আসাম হয়ে টাঙ্গাইলে পৌছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বামপন্থীদের অবস্থান
ন্যাপ ভাসানী : মুজিবনগর সরকার সমর্থক তবে মুক্তি সংগ্রাম কমিটি গঠন করে আলাদাভাবে যুদ্ধের পরিকল্পনা গ্রহণ করে ।
কমিউনিস্ট পার্টি : মুজিবনগর সরকারের সমর্থক
ন্যাপ মােজাফফর : মুজিবনগর সরকারের সমর্থক
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
(এমএল তােয়াহা): বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ।
শ্রমিক আন্দোলন (সিরাজ সিকদার) : মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তবে বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযােদ্ধাদের ভারতের দালাল বলে আখ্যায়িত করে।
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি ( এমএল আব্দুল হক) : মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই। তারা অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ( এমএল মতিন) : মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধাচরণ।
কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি ( জাফর-মেনন, রনাে) : মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তবে পৃথকভাবে যুদ্ধ করে।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ( দেবেন-বাশার-আফতাব) : মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে
কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র (অমল সেন-নজরুল) : মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে
বামপন্থী দলের মধ্যে মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি মুজিবনগর সরকারকে সমর্থন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। শেষে তারা অনেক মুক্তিযােদ্ধাদের ভারতের দালাল আখ্যা দিয়ে ভিতর থেকে পৃথকভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বিরােধিতা করেছে। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৬
১৫
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কার্যাবলী
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রপরিষদ, সংস্থাপন, প্রতিরক্ষা, তথ্য, বেতার, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদের সভার আলোচ্যসূচী কার্যবিবরণী নিজ হাতে লিখতেন। পরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম তা টাইপ করে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর গ্রহণ করতেন। তাজউদ্দীন আহমদ একজন মেধাসম্পন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, সােভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্টালিন, ফ্রান্সের জেনারেল দা গলে এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যুদ্ধ পরিচালনায় যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনিভাবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ অপূর্ব প্রশাসনিক, সমরবিশারদ ও কূটনীতিবিদ হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের দখল থেকে মুক্ত করা। কিন্তু যুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে শক্তিশালী প্রশাসন প্রয়ােজন। এ কারণে তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিরক্ষা ও সংস্থাপন নিজ হাতে রেখেছিলেন। তার পরই প্রয়ােজন প্রচার- তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও তিনি ছিলেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বেতার অনন্য ভূমিকা পালন করেছিল ।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভিত্তি ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার ভিত্তিতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল নির্বাচিত পার্লামেন্ট কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণা অনুমােদন এবং আইনের ধারাবাহিকতা আদেশ এর বলে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর
প্রধান উপদেষ্টা – ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এমএনএ
এডিসি – মেজর নূরুল ইসলাম শিশু
ব্যক্তিগত সচিব – ডা. ফারুক আজম
তথ্য অফিসার – আলী তারিক
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৭
বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন বিভাগের কার্যক্রম শুরু হলো। সাবেক প্রাদেশিক সরকারের সাধারণ প্রশাসক Service and general Administrative Department (SGA)- এর অনুকরণে General Administrative Department (GA) নামকরণ করা হলো। সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খান পাবনার ডিসি ছিলেন। তার নেতৃত্বে পাবনার মুক্তিযোদ্ধারা দু’সপ্তাহ পাকবাহিনীকে প্রতিহত করে। তিনি ১৬ এপ্রিল নদীয়ার কৃষ্ণনগর পৌছেন। তিনি মুজিবনগর শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ১৮ এপ্রিল মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন হয়। প্রধানমন্ত্রী সংস্থাপন ও সাধারণ ও প্রশাসন নিজের অধীনে রাখেন। কলকাতার থিয়েটার রােডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণী) যে বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী থাকতেন সেখানে সরকারের প্রধান কার্যালয় ছিল । প্রধানমন্ত্রীর নুরুল কাদের খানকে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব নিযুক্ত করা হয। তিনি মন্ত্রিপরিষদ, সংস্থাপনসহ অনেক দপ্তরের কাজ শুরু করেন। তার সাথে ছিলেন উপসচিব ওয়ালিউল ইসলাম, মাগুরা এসডিও; উপসচিব কামাল উদ্দিন এসডিও, নাটোর এবং ৭ জন সহকারী সচিব ছিলেন। যুদ্ধকালীন সময় রুলস অব বিজনেস সব সময় মেনে চলা সম্ভব হতাে না ।১
মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাদের সংখ্যা ছিল নিম্নরূপ :
সিএসপি ১৪ জন
পিএফএস ২০ জন
পিএসপি ২ জন
ইপিসিএস ৬২ জন
অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ৫১ জন
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর মধ্যে চট্টগ্রাম ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম প্রথম বিদ্রোহ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। অন্যদিকে মেজর জিয়াউর রহমান কোনাে প্রতিরােধ না করে চট্টগ্রাম থেকে ১৫ মাইল দূরে ২৬ ও ২৭ মার্চ পটিয়ায় নিরাপদ স্থানে ছিলেন। ক্যাপ্টেন রফিকের বীরত্বের কথা সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ অবহিত না থাকায় তিনি মেজর জিয়াউর রহমানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে যােদ্ধাদের বাড়িয়ে প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল কর্নেল এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিয়ােগ করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল মেজর জিয়াউর
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৮
রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর ওসমান, মেজর আহমদকে সেক্টর কমান্ডার নিয়ােগ করেন। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদ কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি (Commander in Chief) নিয়ােগ অনুমােদন করেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুর বরকে বাংলাদেশ বাহিনীর চীফ অব স্টাফ নিয়ােগ অনুমোদন করা হয। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ নিয়ােগ করা হয়।
১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট সিলেটের ডিসি আব্দুস সামাদকে প্রতিরক্ষা সচিব নিয়োগ করা হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছিলেন হবিগঞ্জের এসডিও আকবর আলী খান সিএসপি ।২
নৌবাহিনী
প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের নৌবাহিনী ছিল না। কোন উচ্চপদস্থ বাঙালী নৌ কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়নি। লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকসেনারা হত্যা করে। তার শূন্যস্থান পূরণ হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত ফরিদপুর নিবাসী এ জে মােহাম্মদ খুরশীদের নেতৃত্বে নবম সেক্টরের অধীনে দুটো আটককৃত লঞ্চ গানবােটে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ জুন নবম সেক্টরে বঙ্গবন্ধু স্কোয়াড নামে নৌবাহিনী উদ্বোধন করেন মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান।
১৯৭১ সালের ২৫ মে বিভিন্ন যুব শিবির থেকে বাছাই করে ৫শ’ জনকে ভর্তি করে নৌবাহিনী গঠন করা হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার সামন্তের।
তত্ত্বাবধানে পশ্চিম বাংলার হলদিয়া এবং পলাশীর ভাগীরথী নদীর তীরে নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি দল ফ্রান্সে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। তাদের মধ্যে ১৩ জন বাঙালী ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর গণহত্যার সংবাদে তাদের ৯ জন পালিয়ে ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নেয়। তারা ১০ এপ্রিল ভারতে পৌছেন। ১৯৭১ সালের ১৩ মে ভাগীরথীর তীরে আম্রকাননে বাংলাদেশ সরকারের নৌ কমান্ডাে গঠিত হয়। তখন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিল ১২০ জন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান নৌবাহিনী উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ নৌ কমান্ডাে সংখ্যা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল প্রভৃতি স্থানে অপারেশন জ্যাকপট চালিয়ে অনেক পাকিস্তানী ও বিদেশী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৯
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অফিসাররা ২৫ মার্চ থেকে ঢাকা সেনানিবাসে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তারা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে চান। তারা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদেরকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের মতিনগর মেজর খালেদ মােশাররফের সাথে দেখা করেন। কাদেরের নিকট সংবাদ পেয়ে ঢাকা থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার, উইং কমান্ডার এম কে বাসার, ফ্লাইট লেঃ সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লেঃ বদরুল আলম, ফ্লাইট লেঃ ইকবাল, ফ্লাইট লেঃ লিয়াকত, ফাইট লেঃ সদরুদ্দিন, স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল আলম প্রমুখ মতিনগরে যোগ দেন। এ সকল কর্মকর্তা বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। অবশ্য উইং কমান্ডার বাশারসহ দু’একজন স্থলবাহিনীতে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি পরামর্শ করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন করার ঘােষণা নেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব এবং বিমান বাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল দেওয়ানের সাথে বিমান বাহিনী গঠন সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে আসামের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হয়। বিমান বাহিনীর প্রশাসন ও অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ।
তথ্য মন্ত্রণালয়
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৯ এপ্রিল মন্ত্রিপরিষদের সভায় আবদুল মান্নান এমএনএকে সভাপতি করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামের রেডিওর কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিল্পী ও কুশলীরা বাংলাদেশ বেতারে যােগদান করে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে এমএ হান্নানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র চালু হয়। এ বেতার থেকে এম এ হান্নান প্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা পাঠ করেন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন বেলাল মােহাম্মদ। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ৩০ মার্চ পর্যন্ত চালু ছিল। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল থেকে রামগড় ও পরে আগরতলা থেকে বাংলাদেশ বেতার চালু ছিল।৩
১৯৭১ সালের ২৫ মে বালিগঞ্জের সার্কুলার রােডে একটি দোতলা বাড়িতে বাংলাদেশ সরকারের বেতার কেন্দ্র চালু হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর
পৃষ্ঠাঃ ৩৭০
ভাষণ এ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতাে। তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের পরিচালনায় ছিলেন:
আনোয়ারুল হক খান (এএইচ খান) – সচিব
শিল্পী কামরুল হাসান – পরিচালক, ডিজাইন
এম আর আখতার মুকুল – পরিচালক, তথ্য বিভাগ
আবদুল জব্বার খান – পরিচালক, চলচ্চিত্র বিভাগ
সিরাজুল ইসলাম – বিএ প্রযােজক
সমর দাশ – সংগীত পরিচালক
কামাল লোহানী – বার্তা বিভাগ
বেগম পারভীন হোসেন – প্রকৌশল বিভাগ
সৈয়দ হাসান ইমাম – ……
বহিপ্রচার বিভাগ
তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এমএনএ – উপদেষ্টা
আমিনুল হক বাদশা
বেতার বাংলার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শামসুল হুদা চৌধুরী, আশফাকুর রহমান, মেসবাহউদ্দিন আহমদ, বেল্লাল হােসেন, টিএইচ সিকদার, তাহের সুলতান, মােস্তফা আনােয়ার, ইংরেজি প্রােগ্রামে ছিলেন আলমগীর কবির, আলী যাকের।
বেতার কেন্দ্র থেকে যে সকল শিল্পীর গান প্রচারিত হতাে তারা হলেন- সমর দাশ, মলয় ঘােষ, হরলাল রায়, আবদুল জব্বার, অতিজ রায়, আপেল মাহমুদ, রথীন্দনাথ রায়, সনজীদা খাতুন, কল্যাণী ঘােষ, কাদেরী কিবরিয়া, সুবল দাশ, শেফালী ঘােষ, লাকি আখন্দ, স্বপ্না রায়, মালা খান, ফকির আলমগীর, তপন ভট্টাচার্য এবং আরও অনেকে। বাংলাদেশের শিল্পীদের সমন্বয়ে গঠিত বিক্ষুব্ধ বাংলা শিল্পীগােষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন স্থানে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছে মুক্তিযুদ্ধের জন্য।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনেক জনপ্রিয় গানের মধ্যে ছিল :
১. জয় বাংলা, বাংলার জয়।
কথা : গাজী মাজহারুল আনােয়ার
২. আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি
কথা : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৩. কারার ঐ লৌহ কপাট
পৃষ্ঠা: ৩৭১
কথা : কাজী নজরুল ইসলাম
৪. জনতার সংগ্রাম চলবেই
কথা : সিকান্দার আবু জাফর
৫. সােনা সােনা লােকে বলে সােনা
কথা : আবদুল লতিফ, শিল্পী : শাহনাজ রহমতুল্লাহ
৬. সালাম সালাম হাজার সালাম
কথা : ফজলে খােদা, শিল্পী : আবদুল জব্বার
৭. শােন একটি মুজিবরের থেকে
কথা : গৌরি প্রসন্ন মজুমদার, শিল্পী : অংশুমান রায়
৮. একটি ফুলকে বাঁচাবাে বলে
কথা : গােবিন্দ্র হালদার, শিল্পী : আপেল মাহমুদ
৯. এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
কথা : গােবিন্দ হালদার, শিল্পী : স্বপ্না রায়
১০. পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
কথা : গােবিন্দ হালদার, সুর : সমর দাশ
১১. আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে
কথা : আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুর : আলতাফ মাহমুদ
পত্রপত্রিকা
বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র জয় বাংলা পত্রিকা ১৯৭১ সালের ১১ মে আত্মপ্রকাশ করে। পত্রিকার দায়িত্বে ছিলেন আবদুল মান্নান এমএনএ।
জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদনায় ছিলেন :
আবদুল মান্নান এমএনএ – প্রকাশক
(ছদ্মনাম আহমেদ রফিক)
মুহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী – উপদেষ্টা
অধ্যক্ষ মুহাম্মদ খালেদ – উপদেষ্টা
জিল্লুর রহমান – উপদেষ্টা
আবদুল গাফফার চৌধুরী – উপদেষ্টা
আসাদ চৌধুরী – সম্পাদক
আসাদ চৌধুরী – সহকারী সম্পাদক
আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী – সহকারী সম্পাদক
গাজীউল হক – লেখক, ফিচার বিভাগ
পৃষ্ঠাঃ ৩৭২
বঙ্গবাণী, স্বদেশ বাংলাদেশ, রণাঙ্গন, স্বাধীন বাংলা, সােনার বাংলা, বিপ্লবী বাংলাদেশ, সাপ্তাহিক বাংলা, দাবানল, বাংলার মুখ প্রভৃতি পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ নিয়ে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হতো।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার মােস্তাক আহমদ। পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন মাহবুবুল আলম পিএসএস, উপসচিব ছিলেন কামালউদ্দিন সিদ্দিকী। কলকাতার সার্কাস এভিনিউস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনার অফিস। ১৮ এপ্রিল ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করেন ডেপুটি হাইকমিশনার অফিস বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসে রূপান্তরিত হয়। মূলত বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় মিশন অফিসে অবস্থিত ছিল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে কাজ করতো ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিএন হাফসার, পররাষ্ট্র বিষয় নীতি নির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডিপি ধর, বাংলাদেশ বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শরণ সিং এবং জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন সমর সেন। কলকাতায় ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের আবাসিক অফিস ছিল। তার প্রধান ছিলেন এ কে রায় এবং সহকারী কর্মকর্তা ছিলেন মিস অরুন্ধতী। বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক বিষয় দেখার জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন আনােয়ারুল করিম চৌধুরী। বিদেশের পাকিস্তান দুতাবাসে কর্মরত বাঙালী কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠা করেন।
দূতাবাস কর্মকর্তাদের নাম :
কর্মকর্তা দেশ
মুহাম্মদ হােসেন আলী ভারত, ৯ সার্কুলার এভিনিউ, কলকাতা
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী নতুন দিল্লী
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন, বাংলাদেশ দূতাবাস ২৪ প্রেস ব্রিজ গার্ডেনস
এ রাজ্জাক স্টকহােম, সুইডেন
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৩
এম এ করিম – নিউইয়র্ক
এম আর সিদ্দিকী – ওয়াশিংটন
মহিউদ্দিন আহমেদ – হংকং
কে কে পন্নী – ম্যানিলা, ফিলিপাইন
ওয়ালিউর রহমান – বার্ন, সুইজারল্যান্ড
এস এম মাসুদ – টোকিও
এএম মুস্তাফিজুর রহমান – কাঠমন্ডু
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তা:
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী – বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি
আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ – অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির উপদেষ্ট
ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এমএনএ – প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা
এম আর সিদ্দিকী এমএনএ – আমেরিকায় নিযুক্ত প্রতিনিধি
ফকির সাহাবুদ্দিন – দলনেতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রেরিত প্রতিনিধিদল
শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন এমপি – ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
শাহ এএমএস কিবরিয়া – কাউন্সিলর, আমেরিকা
এএমএ মুহিদ – অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, যুক্তরাষ্ট্র
এনায়েত করিম – মিনিস্টার, যুক্তরাষ্ট্র
এম আনােয়ারুল করিম – প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক
এম রেজাউল করিম – প্রথম সচিব, লন্ডন
এএইচ মাহমুদ আলী – ভাইস কনসাল, নিউইয়র্ক
এএফএম আবুল ফতেহ – রাষ্ট্রদূত, বিশেষ দায়িত্বে
খুররম খান পন্নী – রাষ্ট্রদূত, বিশেষ দায়িত্বে
আবদুর মােমিন – রাষ্ট্রদূত, বিশেষ দায়িত্বে
পররাষ্ট্রমন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমদ গােপনে কলকাতাস্থ আমেরিকান কনসালের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে সমঝােতার চেষ্টা চালায়। তার সাথে ছিলেন মাহবুবুল আলম চাষী। তাদের ষড়যন্ত্র প্রকাশ পাওয়ায় তাজউদ্দীন আহমদপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান কার্যাবলী পরিচালনা করতেন। তিনি খন্দকার মােশতাক আহমদকে জাতিসংঘে প্রেরিত প্রতিনিধি দলের নেতা থেকে বাদ দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে দলনেতা নিয়ােজিত করেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রেরিত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল-১৯৭১
১. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, দলনেতা, জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৪
২. এমএ সামাদ এমএনএ, বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা
৩. অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, ন্যাপ নেতা
৪. ফণীভূষণ মজুমদার, এমপিএ
৫. সিরাজুল হক এমএনএ
৬. সৈয়দ আবদুস সুলতান এমএনএ
৭. ফকির শাহাবুদ্দিন আহমদ এমপিএ
৮. ড. মফিজ চৌধুরী, এমএনএ
৯. ডা. আসহাবুল হক এমপি
১০. ড. এ আর মল্লিক, ভিসি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১১. অধ্যাপক রেহমান সােবহান, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পূর্ব ইউরােপের রাষ্ট্রদূত
১২. এম আর সিদ্দিকী এমএনএ
১৩. কে কে পন্নী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত
১৪. এ এম এ করিম, উপস্থায়ী প্রতিনিধি, জাতিসংঘ
১৫. এএমএ মুহিত, বাংলাদেশ মিশনের কাউন্সিলর, আমেরিকা
১৬. এএফ এম আবুল ফতেহ, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা
১৭. আবুল হাসান মাহমুদ আলী, ভাইস কাউন্সিলর, বাংলাদেশ মিশন, আমেরিকা। দলপতির সুপারিশে অতিরিক্ত সদস্য নিয়ােগ।
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন এএইচএম কামরুজ্জামান। সচিব ও আইজি পুলিশ ছিলেন আবদুল খালেক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লােকবল :
এম এ খালেক – সচিব
খসরুজ্জামান চৌধুরী (এস কে চৌধুরী) – উপসচিব
এসডিও, কিশােরগঞ্জ
ডিএসডি – ৫ জন
পুলিশের ব্যাচের নমুনা নৌকা প্রতীক অনুমােদিত হয়। ২০০৪ সালে বিএনপি সরকার পুলিশের নৌকা প্রতীক বাতিল করে দেয়। নৌকার ডিজাইন করেন শিল্পী কামরুল হাসান।
ত্রাণ বিভাগ
জে জি ভৌমিক রিলিক কমিশনার ছিলেন। এ বিভাগের উপসচিব ছিলেন মামুনুর রশীদ সিএসপি।
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৫
অর্থ মন্ত্রণালয়
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এম মনসুর আলীকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন আসাদুজ্জামান।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলী
১. বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব
২. আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন
৩. রাজস্ব ও শুল্ক আদায়
৪. মুদ্রা প্রস্তুত ও ছাপানাের ব্যবস্থা
পরিকল্পনা সেল
পরিকল্পনা কমিশন গঠন
ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরী চেয়ারম্যান
ড. খান সারওয়ার মাের্শেদ
ড. মুশাররফ হােসেন
ড. স্বদেশ বাস
ড. আনিসুজ্জামান
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর হতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। আওয়ামী লীগের একটি প্রভাবশালী অংশ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে না। তারা খন্দকার মােশতাক আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করতে চায়- এএইচএম কামরুজ্জামানও প্রধানমন্ত্রীর পদের প্রার্থী। তাজউদ্দীন আহমদের সামনে বিরাট সঙ্কট। তিনি ধৈর্য ও কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মােকাবেলা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নৌকার হাল ধরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেন। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের শেষ দেখা হয়। তখন বঙ্গবন্ধু তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলেন তিনি যথাসময় নির্দেশ পাঠাবেন। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হলে তার পক্ষে নির্দেশ দেয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা দেন।
তাজউদ্দীন আহমদ ৩০ মার্চ সীমান্ত অতিক্রম করেন। এ সময় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা তার সাথে ছিলেন না। তাই তিনি ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। সংগ্রামের সেই গােড়ার দিকেই
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৬
তাজউদ্দিন আহমেদ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পাকিস্তানের আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলাদেশকে মুক্ত করার একমাত্র পথ সশস্ত্র সংগ্রাম এবং এ জন্য প্রয়ােজন ভারতের সাহায্য ও সহযােগিতা। এ জন্য প্রয়ােজন সরকার গঠন যা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। গ্রহণযোগ্য হতে হলে নির্বাচিত এমএনএ ও এমপিএদের সমর্থন অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে সরকার গঠন ও শপথ অনুষ্ঠানের পূর্বে। বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান আইজি গােলক মজুমদার, বিএসএফের অধিনায়ক ডিজি রুস্তমজীর সহায়তায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এমএনএ ১৯৭১ সালের এপ্রিলের ৪ ও ৫ তারিখে দিলীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করে সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারত সরকার শরণার্থীদের আশ্রয়, ভারতে সরকারের অফিস স্থাপন ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদানে সম্মত হয়। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন তাজউদ্দীন আহমদ।
দিল্লি থেকে ফিরে এসে তিনি এমএনএ ও এমপিদের সাথে বৈঠক করেন। এমএনএ ও এমপিএদের অনেকে ভারতের আগরতলায় আশ্রয় নেয় । ৯ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদ ছুটে গেলেন আগরতলায়। খন্দকার মােশতাক আহমদ ও শেখ ফজলুল হক মনির প্রবল বিরােধিতার সম্মুখীন হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। শেখ মনি বিপ্লবী সরকার চান এবং মােশতাক প্রধানমন্ত্রী হতে চান।
১০ এপিল তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ঘােষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। রাজধানী কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা- মুজিবনগর। নিরাপত্তার কারণে রাজধানীর অফিস কলকাতা ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে স্থানান্তর করা হয় । এখান থেকে ৯ মাস বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম ছিলেন খন্দকার
মােশতাক আহমদ। তিনি ছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর পদ তারই প্রাপ্য। অন্যদিকে কামারুজ্জামান ছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদের একমাত্র দাবিদার। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর ভাগিনা বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনিই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিবেন । এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অবিচল ও অচঞ্চল।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৬৪ সাল হতে আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচীর
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৭
অন্যতম মুখ্য প্রণেতা। বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে ৬ দফা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ দেন। মূলধারা ১৯৭১ গ্রন্থের প্রণেতা মাইদুল হাসান বলেছেন, তাজউদ্দিন ছিলেন দলের সকল মূল কর্মকাণ্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচারবিমুখ সংগঠক। একাত্তরের মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মুজিবের পরই ছিল সম্ভবত তার স্থান।
১৯৭১ সালের ৫-৬ জুলাই পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়িতে আওয়ামী লীগের দলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ দাবি করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে সুদৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করায় বিরােধীরা পিছু হটে যায়। সভায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটিই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকবে। এ সিদ্ধান্তের পর কামারুজ্জামান তার দাবি থেকে সরে দাঁড়ায় এবং আন্তরিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। কিন্তু খন্দকার মােশতাক ও শেখ মনি মনেপ্রাণে তাজউদ্দীনকে মেনে নেয়নি। তার পরিণতি দেখা যায় তাজউদ্দীন আহমদের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ ও ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে।
শেখ মনির ক্ষমতার উৎস ছিল ভারতীয় ‘র’ (RAW) নামক গোয়েন্দা সংস্থা। ‘র’-এর প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল ইসলাম খান ও তােফায়েল আহমেদ মুজিববাহিনী গঠন করেন। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি না নিয়ে মুজিববাহিনী সৃষ্টি হয়। মুজিববাহিনী বাংলাদেশ সরকার ও সেক্টর কমান্ডারদের নির্দেশ মানত না। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। জেনারেল ওসমানী মন্ত্রিসভায় মুজিববাহিনী প্রশ্নটি তােলেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও মুজিববাহিনী সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত সরকারের নিকট থেকে কোনাে সহযােগিতা পাননি। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কেবিনেট সচিব এইচটি ইমাম লিখেছেন, “আমার উপস্থিতিতেই কর্নেল ওসমানী কয়েকবার অব্যাহতি চেয়েছেন মুজিববাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় । অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করতেন। আরেকটি ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। সেটা অক্টোবর মাসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পূর্ব রণাঙ্গন পরিদর্শনে গিয়ে আগরতলা সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। শেখ মণি এবং তার কয়েকজন সহযােগী অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে থাকেন। সকলেই বেশ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। যৌথ কমান্ড গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু হতেই এই বিশৃঙ্খলা থেকে পরিত্রাণ
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৮
পাওয়া যায়। সেটা সেপটেম্বরের প্রথম দিতেই। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে মি. ডিপি ধরকে নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান (মন্ত্রীর মর্যাদায়) নিয়ােগের ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে সময় অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্ভবত ‘র’ তখন থেকে মুজিববাহিনীর রাশ টেনে ধরে। এরপর কর্নেল ওসমানীর জন্য, বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে বড় কোনো অসুবিধা হয়েছে বলে আমার জানা নেই ।”৪
ভারত-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থীরা ভারতের দক্ষিণপন্থী ও আমেরিকার সাথে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা মুক্তিযুদ্ধে সর্বদলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বাধার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত করলে রাশিয়া ব্লকের সমর্থন পাওয়া যেত না। চীন আমেরিকা পাকিস্তানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সেই পাকিস্তানের সাথে মােশতাক-কিসিঞ্জার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। মুক্তিযুদ্ধে জয় লাভ করার জন্য সর্বদলায় সমর্থন প্রয়ােজন ছিল। এটা যেমন তাজউদ্দিন আহমদ উপলব্ধি করেন এবং সে কারণে তিনি জাতীয় ঐকমত্য সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন। এ ছিল তাজউদ্দীন আহমদের কূটনীতি ও রাষ্ট্রচিন্তার বিরাট বিজয়। তিনি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করেছেন। সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হলে আওয়ামী লীগের ভেতরে তাজউদ্দীনবিরােধী গ্রুপ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। উপদলীয় কোন্দলের নেতা খন্দকার মােশতাক আহমদকে তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতাহীন করে রাখেন। নামে মােশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু তাকে বহির্বিশ্বের সাথে কোনাে কাজ করার সুযােগ দেয়া হয়নি।
মুজিবনগর
৮ নম্বর থিয়েটার রােড, কলকাতা
বাংলাদেশের রাজধানীর নাম মুজিবনগর। মুজিবনগরের স্থায়ী কার্যালয় কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােড, বর্তমান নাম শেক্সপিয়ার সরণি । এ ভবনটি বিএসএফের পুরনাে ভবন ছিল। চারদিকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। পিছনে পুরাতন ভবন। বড় বড় ঘর। দালানে ঢুকেই প্রশস্ত বারান্দা, সামনে মাঠ। বড় দালানের চারদিকে ছােট ছােট কয়েকটি দালান। থিয়েটার রােডের এ ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন। কক্ষ সংলগ্ন বাথরুম ছিল। ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এ ভবনের দোতলায় বসতেন। দোতলায় আরও বসতেন খুলনার এম মােহসিন
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৯
এমএনএ ও আওয়ামী লীগ দপ্তর সম্পাদক মুহাম্মদ উল্লাহ ও টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান এমএনএ। অর্থ সচিব ছিলেন খন্দকার আসাদুজ্জামান।
প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব ছিলেন ড. ফারুক আজিজ খান। প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রীর সাথে যারা কঠোর পরিশ্রম করতেন তারা হলেন : ময়েজউদ্দিন আহমদ এমএমএ, ফকির সাহাবুদ্দিন, মােহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম এসপিএ, আরহাম সিদ্দিকী এবং শামসুল হক এমএনএ। তারা ছিলেন ঢাকার আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মী। শামসুল হক সলিমুল্লাহ হলের ভিপি ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি পাটমন্ত্রী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি সচিব ছিলেন মেজর নুরুল ইসলাম এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা ছিলেন তারেক। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য সচিব ছিলেন সিলেটের ডিসি আবদুস সামাদ। সংস্থাপন সচিব ছিলেন নূরুল কাদের খান সিএসপি। তিনি পাবনার ডিসি ছিলেন। তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। ১৭ এপ্রিল থেকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সাথে ছিলেন।
প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে অফিস করতেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও ওসমানী উভয়ে ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাস করতেন।
৮ নম্বর থিয়েটার রােডে আরও বসতেন ডাঃ টি হােসেন- স্বাস্থ্য সচিব, এমএ খালেক- স্বরাষ্ট্র সচিব, আব্দুস সামাদ- প্রতিরক্ষা সচিব, নূরুদ্দিন আহমেদ, কৃষি সচিব, ভৌমিক- ত্রাণ কমিশনার। অর্থ সচিব ছিলেন যুগ্ম সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান সিএসপি । অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ খন্দকার মােশতাক বসতেন সার্কাস এভিনিউর বাংলাদেশ মিশনে। এখানে ডেপুটি হাইককিশনার এম হােসেন আলীর অফিস ছিল। এখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিস ছিল ।
কলকাতার সিআইটি এভিনিউর আশু বাবুর বাড়িতে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান তাদের পরিবার নিয়ে বাস করতেন। একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারের সাথে বাস করতেন না। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দাম্পত্য জীবন যাপন করবেন না। তার পরিবার সিআইটি ভবনে বাস করত।
আগরতলা
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােড। এখানে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় অবস্থিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতির অফিস ৮ নম্বর থিয়েটার রােড ভবনে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দ্বিতীয় বৃহত্তম
পৃষ্ঠাঃ ৩৮০
কেন্দ্র ছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজধানী আগরতলায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, ঢাকা প্রভৃতি জেলার নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিযোদ্ধারা আগরতলায় সমবেত হয়। চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরী এমএমএ, এম আর সিদ্দিকী এমএনএ, প্রফেসর নূরুল ইসলাম এমএনএ, মোশাররফ হোসেন এমপিএ, এম এ হান্নান, কুমিল্লার কাজী জহিরুল কাইয়ুম এমএনএ, অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর এমএনএ, মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজী, নারায়ণগঞ্জের এমএনএ শামসুদ্দোহা প্রমুখসহ অনেক নেতা আগরতলায় আশ্রয় নেন।
এপ্রিল মাসেই জহুর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আগরতলায় কর্নেল চৌমুহনীতে বাংলাদেশ সরকারের অফিস চালু হয়। আগরতলা অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসক মাহবুব আলম চাষী। তিনি পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। চাকরি ত্যাগ করে তিনি চট্টগ্রামে পল্লী উন্নয়নে আত্মনিয়ােগ করেন। প্রশাসনে আরও ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক এইচটি ইমাম, সিলেটের জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও কাজী রফিকউদ্দিন, হবিগঞ্জের এসডিও আকবর আলী। আগরতলায় সেনাবাহিনী অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, মেজর শওকত আলী প্রমুখ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর রব এমএনএ-এর দপ্তর ছিল আগরতলায়। তিনি সেক্টর ১, ২, ৩, ৪ ও ৫ নিয়ন্ত্রণ করতেন আগতলা থেকে।
মাহবুবুল আলম চাষী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্ত হলেন, এএইচটি ইমাম সিএসপিকে আগতলা অঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসক নিয়ােগ করা হয়। মে মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আগরতলায় সফরে আসেন। রাজ ভবনে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সাক্ষাত প্রদান করেন। বাংলদেশ দলে ছিলেন এডভােকেট সিরাজুল ইসলাম এমএনএ, কাজী জহিরুল কাইয়ুম এমএনএ, প্রফেসর নূরুল ইসলাম, ড. এ আর মল্লিক, প্রফেসর আলী আহমদ। ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ছিলেন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী নন্দিনী সৎপতি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় প্রমুখ। ইন্দিরা গান্ধী সরেজমিনে মুক্তিযুদ্ধ ও শরণার্থীদের দেখতে এসেছেন। তিনি সকল প্রকার সহায়তার আশ্বাস দেন ।
১৯৭১ সালের জুন মাসে হােসেন তৌফিক ইমাম এইচটি ইমামকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়ােগ করা হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৩৮১
১৬
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও
তার মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলী
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বিপ্লবী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহান নেতা। তার রাষ্ট্রচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল বাংলার ইতিহাসে অতুলনীয়। অষ্টম শতকের গোপাল হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তার সমকক্ষ যােদ্ধা জন্মগ্রহণ করেনি। তিনি একটি অসংগঠিত যুদ্ধরত জাতিকে সুসংগঠিত করে বিশাল মুক্তিবাহিনী গঠন করে বিজয় অর্জন করেন। বিশ্বের ইতিহাসে রণবীর স্টালিন, চার্চিল, দ্য গলে, কামাল পাশা প্রমুখের সাথে তুলনীয়। মুক্তিযুদ্ধে সফলতার পিছনে ছিল তার সুবিন্যস্ত প্রশাসনে দক্ষতা। রাজনীতিবিদগণ সাধারণত আমলানির্ভরশীল হয়ে থাকেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। আমলরা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। তিনি যে একজন প্রতিভাশালী নেতা, যােদ্ধা ও শাসক ছিলেন তা দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে প্রমাণ করেছেন। তার জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় হলাে মুক্তিযুদ্ধে ৯ মাস।
জাতির কঠিনতম সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ শক্ত করে হাল না ধরলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন ও দুর্জয় সাহসের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হতাে, মুক্তিযুদ্ধ বিলম্বিত হতাে, জাতির ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতাে। মূলত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসন পরিচালনা শুরু করেন এবং ২৫ মার্চ পর্যন্ত তার প্রণীত নির্দেশ অনুসারে প্রশাসন চলে। পাকিস্তানী শাসন প্রকৃতপক্ষে ৭ মার্চ থেকে সমাপ্ত হয়েছিল। অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে তিনি তার অপূর্ব প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম তাজউদ্দীন আহমদের কর্মদক্ষতা দেখে লিখেছেন, “সত্যি কথা বলতে কি, শহীদ তাজউদ্দীনের মতাে খাঁটি দেশপ্রেমিক এবং সৎ ব্যক্তিত্ব খুব একটা দেখেছি বলে মনে হয় তি বড় মাপের নেতা হয়েও কী সহজ, সরল মানুষ ছিলেন তিনি।”
পৃষ্ঠাঃ ৩৮২
তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্রজীবন থেকে অপূর্ব প্রতিভার পরিচয় দেন । ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই ঢাকা জেলার কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বাদশ স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আইএ পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে অনার্স ও ল পাশ করেন। তিনি রাজনীতির সাথে প্রচণ্ডভাবে জড়িত থাকায় নিয়মিত লেখাপড়া করতে পারেননি। তিনি নিয়মিত পড়লে বিএ, এমএতে প্রথম শ্রেণী বা পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। দেশ ও জাতির সেবায় ছাত্রজীবনেই উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মাত্র ২৮ বছর বয়সে কাপাসিয়া থেকে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ৬ দফা প্রণয়নে অন্যতম রূপকার। ১৯৭০ সালে তিনি কাপাসিয়া এবং কালিগঞ্জ থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনাকালে পাকবাহিনী ২৫ মার্চ বাঙালির ওপর আক্রমণ করে। তিনি ভারতে পালিয়ে এসে এপ্রিলের ১০ তারিখে। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিমােক্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মন্ত্রণালয়
প্রতিরক্ষা -আবদুস সামাদ
তথ্য ও বেতার – আনােয়ারুল হক খান
সংস্থাপন – নূরুল কাদের খান
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি সরকারের সার্বিক বিষয় নিয়ে চিন্তা- ভাবনা করতেন । সরকারের কাজকর্ম সুশৃঙ্খল করতে তিনি মন্ত্রিপরিষদ সভায় আলােচনার জন্য বহু বিষয় এজেন্ডা ঠিক করতেন। আলােচ্যসূচি তিনি নিজ হাতে ডায়েরিতে লিখতেন। প্রধানমন্ত্রীর স্বহস্তে লেখা ডায়েরির বঙ্গানুবাদ :১
১৩ এপ্রিল ১৯৭১
১। সরকার গঠন
২। সচিবালয় গঠন
৩। মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
১। প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ, অস্ত্র সরবরাহ
২। পররাষ্ট্র
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৩
৩। অর্থ
৪। খাদ্য, ত্রাণ
৫। শিল্প বাণিজ্য
৬। স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার
৭। যােগাযােগ
৮। তথ্য
৯। পূর্ত, সড়ক
১। সহায়তা প্রয়ােজন
ক. সামরিক
খ. জনগণের নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য সরবরাহ
গ. অর্থ
ঘ. টাকা ছাপানাে
২। রাজনৈতিক-
রাজনৈতিক শূন্যতা আওয়ামী লীগ নেতা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পূরণ করতে হবে।
৩। সামরিক সংগঠন
ক. নিয়মিত বাহিনী
খ. প্রশিক্ষণ
কর্নেল ওসমানীর অবস্থান
মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চিন্তাপ্রসূত নােট। যুদ্ধ পরিচালনায় তিনি যে ধীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা তার নােট থেকে জানা যায়।
৯/৮/১৯৭১ তরিখে তার নােটে লেখা আছে-
১. যুব শিবির, ২. আঞ্চলিক প্রশাসন ও কাউন্সিল, ৩. প্রশিক্ষণ, গেরিলাদের সমস্যা, ৪. স্নায়ুযুদ্ধ, ৫. তথ্য, ৬. প্রতিরক্ষা, ৭. বাসস্থান।
মন্ত্রিপরিষদ সভার আলােচনা ও সিদ্ধান্ত নিজহস্তে লিখতেন এবং ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর দিতেন। কেবিনেট সচিব দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি তাজউদ্দীন আহমদের দেয়া নােট টাইপ করে তার স্বাক্ষর নিতেন। আমরা জানি মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তসমূহ সচিব বা অন্য কর্মকর্তা লিখে থাকেন এবং সভাপতি স্বাক্ষর দেন। কিন্তু মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের ৯ মাসে মন্ত্রিসভার আলােচনা ও সিদ্ধান্তসমূহ তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন অথবা তার দেয়া ডিকটেশন টাইপ করা হতাে।
প্রধানমন্ত্রীর উপযুক্ত সিদ্ধান্তে এবং ছােট ছােট নােট থেকে বুঝা যায় যে, তিনি কত বিচক্ষণ ছিলেন। প্রকৃত অর্থে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কর্ণধার ছিলেন। দেশ
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৪
পরিচালনায় তার প্রজ্ঞার পরিচয় মুক্তিযুদ্ধকালীন তার প্রদত্ত ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে কয়েকটি সেক্টরের উল্লেখ করেন এবং কয়েকজন কমান্ডার নিয়ােগ করেন।
১. সিলেট – কুমিল্লা অঞ্চল : সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ
২. চট্টগ্রাম – নােয়াখালী অঞ্চল : মেজর জিয়াউর রহমান
৩. ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল : মেজর সফিউল্লাহ
এ কমান্ডার একত্রে মিলিত হয়েছিল এবং যুদ্ধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন।
৪. দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল : যশাের-কুমিল্লা- মেজর ওসমান চৌধুরী
৫. উত্তর বাংলা – কমান্ডার মেজর আহমেদ।
তাজউদ্দীন আহমদ জন্মগতভাবে একজন বীরসেনানী। এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ শুরু করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করে কমান্ডার নিয়ােগ করেন। তার রণকৌশল ছিল বিশ্বের যে কোনাে সেনাপতির চেয়ে উন্নত। তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুক্তিফৌজ সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। প্রতিরক্ষা ছিল তার এক নম্বর এজেন্ডা। তার দূরদর্শিতা ছিল সুদূরপ্রসারী।
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামাে নিম্নরূপ ছিল :২
সশস্ত্র বাহিনীর সদর দপ্তর
৮ নম্বর থিয়েটার রােড, কলকাতা
প্রধান সেনাপতি কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানী
চিফ অব স্টাফ লে. কর্নেল (অব.) আবদুর রব, পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত
ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার- অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন ।
১৯৭১ সালের জুন মাসে মুক্তিবাহিনীর অঞ্চলভিত্তিক অবস্থান :
পার্বত্য চট্টগ্রাম – ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ইপিআর ও অন্যান্য।
চট্টগ্রাম-ফেনী – মেজর জিয়াউর রহমান, অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
কুমিল্লা – মেজর খালেদ মােশাররফ, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
সিলেট পূর্ব ও ময়মনসিংহ – মেজর সফিউল্লাহ, দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৫
সিলেট উত্তর – মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, ইপিআর
রংপুর – ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন, ইপিআর
দিনাজপুর – মেজর নাজমুল হক
সৈয়দপুর – ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেন, ৩ ইবিআর
রাজশাহী – ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ইপিআর
কুষ্টিয়া-যশাের – মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, ইপিআর, প্রথমে ইবিআর
খুলনা-বরিশাল – মেজর এম এ জলিল
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে জুন মাসে বৈঠকে যুদ্ধ পরিস্থিতি সার্বিক বিশ্লেষণ করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীন সেক্টর গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান সেনাপতিকে নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ১১ জুলাই কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় মুক্তিবাহিনীর সেনা কর্মকর্তাদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সভাপতিত্ব করেন। সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান গৃহীত হয়।
১. বাংলাদেশের যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা এবং কমান্ডার নিয়ােগ।
২. মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে পূর্বাঞ্চলে তিনটি ব্রিগেড গঠন। ‘এস’ ফোর্স- সফিউল্লাহ, জেড ফোর্স- মেজর জিয়াউর রহমান, ‘কে’ ফোর্স মেজর খালেদ মােশাররফ।
৩. প্রধান সেনাপতির অধীনে একজন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ কর্নেল আবদুর এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চীফ নিয়ােগ করা হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করতেন। পরিদর্শনকালে তিনি একবার মৃত্যুর মুখােমুখি হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, মুক্তিযােদ্ধারা যদি তাদের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যুদ্ধ করতে পারে তাহলে তিনি পারবেন না কেন। যুদ্ধের নয় মাস তিনি পারিবারিক জীবন যাপন করেননি। তার পরিবার কলকাতাতেই ছিল। এমনকি ঈদের দিন পরিবারের সাথে দেখা না করে যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে কাটিয়েছেন। এত বড় যােদ্ধা, এত বড় নেতা বিশ্বে বিরল।
মুজিববাহিনী গঠন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কর্নেল ওসমানী যুদ্ধকালে একাধিকবার পদত্যাগ করেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় তার অনুরােধে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৬
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আগস্ট মাসে নৌ কমান্ডাে ও নভেম্বর মাসে বিমান বাহিনী গঠন করা হয়। বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার।
মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত পর্যায়ে ২১ নভেম্বর তার উদ্যোগে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। সমগ্র যুদ্ধ এলাকাকে চারটি যুদ্ধাঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। মুজিব বাহিনী ১০ সেক্টর ও ৩টি ব্রিগেডকে ৪টি অঞ্চলের যৌথ কমান্ডে একত্রিত করা হয় যৌথ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন লে. জে. জগজিৎ সিং অরােরা। যৌথবাহিনী ৩ নভেম্বর থেকে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধ করে ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে।
তথ্য মন্ত্রণালয়
যুদ্ধ পরিচালনা ও জয়লাভের জন্য প্রচার বিভাগ দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করে। মুক্তিবাহিনীর পরেই দ্বিতীয় শক্তি ছিল বাংলাদেশ বেতার। ৯ মাস ধরে বাংলাদেশ বেতার বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহিত করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা পাঠ করেন । ৩০ মার্চ পাকবাহিনীর বােমার আঘাতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায়। তারপর অনিয়মিতভাবে রামগড় ও আগরতলা থেকে দুর্বল একটি কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ বেতারের কাজ চলে।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে। ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ সভায় আবদুল মান্নান এমএনএকে সভাপতি করে ৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয় কলকাতার বালু হককাক লেনে জয়বাংলা পত্রিকা অফিসে। তাজউদ্দীন আহমদের উদ্যোগে যুদ্ধের খবর সংগ্রহ ও প্রচারের জন্য আবদুল মান্নানকে সম্পাদক করে জয়বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মে কলকাতা থেকে জয়বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার শুরু হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের বেতার কেন্দ্র একটি অধিদপ্তর হিসেবে পরিচালিত হতাে।
তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামাে নিম্নরূপ ছিল : ৩
১. তাজউদ্দীন আহমদ – মন্ত্রী
২. এম এ মান্নান এমএনএ – উপদেষ্টা
৩. আনােয়ারুল হক খান – সচিব
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৭
৪. কামরুল হাসান – পরিচালক
৫. এস আর আখতার মুকুল – পরিচালক তথ্য
৬. আবদুল জব্বার খান – পরিচালক, চলচ্চিত্র বিভাগ
৭. আবদুল গাফফার চৌধুরী – সম্পাদক, জয়বাংলা
একজন দক্ষ শাসকের অন্যতম গুণ হলাে যােগ্য ব্যক্তিকে সচিব পদে নিয়োগ প্রদান। তাজউদ্দীন আহমদ প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় উপযুক্ত লোক নিয়োগ করে সুচারুরূপে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
বাংলাদেশ বেতারে একদল বিখ্যাত শব্দসৈনিক সমবেত হয়ে হাজার হাজার সঙ্গীত পরিবেশন করে যুদ্ধরত জাতিকে উজ্জীবিত রেখেছেন।
মন্ত্রিপরিষদ ও সংস্থাপন
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘােষণাপত্র (Proclamation of Independence) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ম্যাগনাকার্টা। স্বাধীন সরকারের প্রাথমিক পর্যায় থেকে মন্ত্রিপরিষদ ও সংস্থাপনের যাত্রা শুরু হয়। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) এবং পূর্ব পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (ইপিসিএ) ও অন্যান্য বিভাগে কর্মরত বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ সরকার গঠনের সাথে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এ সকল কর্মকর্তাদের নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ, সংস্থাপন ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। এ সকল কর্মকর্তা দক্ষতার সাথে নতুন সরকার পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধকে শক্তিশাল করেন।
তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিম্নলিখিত মন্ত্রণালয়/বিভাগ সংগঠিত করা হয়েছিল :
১. প্রতিরক্ষা
২. পররাষ্ট্র
৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য
৪. স্বরাষ্ট্র
৫. স্বাস্থ্য
৬. তথ্য ও বেতার
৭. ত্রাণ ও পুনর্বাসন
৮. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
৯, স্বাধীন প্রশাসন বিভাগ
১০. সংসদ বিষয়ক
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৮
১১. কৃষি বিভাগ
১২. প্রকৌশল বিভাগ।
মুজিবনগর সরকারের শক্তিশালী প্রশাসন গঠনে যাদের অবদান রয়েছে তাদের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো :
১. খন্দকার আসাদুজ্জামান সিএসপি – সচিব, অর্থ
(যুগ সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়)
২. নুরুল কাদের খান সিএসপি – সচিব, সংস্থাপন
(পাবনার ডিসি)
৩. মাহবুবুল আলম চাষী পিএসএফ – সচিব, পররাষ্ট্র
৪. এইচটি ইমাম সিএসপি – মন্ত্রিপরিষদ সচিব
(ডিসি, পার্বত্য চট্টগ্রাম)
৫. এম এ সামাদ সিএসপি (ডিসি, সিলেট) – সচিব, প্রতিরক্ষা
৬. আবদুল খালেক পিএসপি – সচিব, স্বরাষ্ট্র; ডিজি, পুলিশ
৭. আনােয়ারুল হক খান – সচিব, তথ্য
৮. নুরুদ্দীন আহমেদ – সচিব, কৃষি
(প্রধান বন সংরক্ষক)
৯. আবদুল হান্নান চৌধুরী – সচিব, আইন
(জেলা জজ, দিনাজপুর)
১০. ডাঃ টি হােসেন – সচিব, স্বাস্থ্য
১১. এমদাদ আলী – প্রধান প্রকৌশলী
১২. জয় গােবিন্দ ভৌমিক – ত্রাণ কমিশনার
১৩. ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ গণহত্যা ও স্নায়ুযুদ্ধ সেল
রুহুল কুদ্দুস সিএসপি – মহাসচিব (৮ ডিসেম্বর হতে)
(আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত)
প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণাধীন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ
৮ নম্বর থিয়েটার রােড
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ – প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার, পরিকল্পনা
প্রধান উপদেষ্টা – ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ
একান্ত সচিব – ফারুক আজিম
এডিসি – মেজর নূরুল ইসলাম
তথ্য অফিসার – আলী তারেক
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৯
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
এম এ সামাদ – সচিব
আকবর আলী খান – সিএসপি উপসচিব
মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
হােসেন তৌফিক ইমাম সিএসপি – মন্ত্রিপরিষদ সচিব
নূরুল কাদের খান সিএসপি – সচিব, সংস্থাপন
কামাল উদ্দিন আহমেদ ইপিসিএস – উপসচিব
ওয়ালিউল ইসলাম সিএসপি – উপসচিব
তওফিক এলাহী চৌধুরী সিএসপি – উপসচিব
দীপক কুমার চৌধুরী ইপিসিএস – সহকারী সচিব
মতিয়র রহমান ইপিসিএস – সহকারী সচিব
এম এ আউয়াল ইপিসিএস – সহকারী সচিব
ধীরাজ কুমার নাথ – সহকারী সচিব
শাহ মতিউর রহমান – সহকারী সচিব
এমএইচ সিদ্দিকী – সহকারী সচিব
কেএল সিদ্দিকী – ইঞ্জিনিয়ার ট্রান্সফোর্ট
আল আমীন চৌধুরী – সহ-সচিব
আবু তালেব – সহ-সচিব
হেদায়েত উল্লাহ – সহ-সচিব
অজিত কুমার ভাদুড়ী – সহ-সচিব
বজলুর রহমান – সহ-সচিব
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায়
তাজউদ্দীন আহমদ
সংস্থাপন মােহাম্মদ নূরুল কাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে তার গ্রন্থ ‘আমারএকাত্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন : “পরদিন তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত সময়ে দেখা করার জন্য যাই। তার সঙ্গে আলাপের সময় আবারও দেখা গেল কি ধীরস্থিরভাবে তার বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্তগুলাে প্রকাশ পাচ্ছে। তার কথায় যৌক্তিকতার কারণে অনেক ক্ষোভও সহজে মিটে যায়। তিনি বলেন, দেখুন হাজার হাজার মানুষ দেশ ছেড়ে চলে এসেছে এবং আসছে। দেশের অভ্যন্তরের ঘটনা সম্পর্কে আপনি নিজেও জানেন। শুধু পশ্চিম সীমান্ত নয় আগরতলাসহ সীমান্তের প্রায়
পৃষ্ঠাঃ ৩৯০
সবদিক দিয়েই আমাদের লােকজন প্রবেশ করছে। এই পরিস্থিতিতে জেনেশুনে অস্ত্র ছাড়া আপনাকে অভ্যন্তরে পাঠাই কিভাবে?
সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য যে সংগঠিত কার্যক্রম প্রয়ােজন সে ব্যাপারেও ওই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত দেয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যদিও ইতােমধ্যে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া সূচনা হয়েছে। বিশেষ করে ১০ এপ্রিলের ঘােষণা, ১১ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদের বেতার ভাষণ, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ ইত্যাদি ঘটনা সেই ভিত রচনা করেছে।
কিন্তু এসব ঘোষণা এবং সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে দাপ্তরিক ব্যবস্থা তা তখনও শুরু হয়নি। বিষয়টি সরকারের উর্ধ্বতন হলে গুরুত্বসহ আলােচিত হয়েছে।
এর কারণও আছে। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী সহায়তা পাওয়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই একমাত্র উদাহরণ নয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এক্ষেত্রে বিশ্বের দু’একটি মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে। যেমন নরোদম সিহানুককে সহযােগিতা করার জন্য চীনের সৈন্যরা তাদের হয়ে যুদ্ধ করেনি ইরানের আয়াতউল্লাহ খােমেনির হয়ে ফ্রান্সের সৈন্যরা যুদ্ধ করেনি। কিংবা ইরানের ১ কোটি লােকও ফ্রান্সে যায়নি। বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি লোক সরকারের সঙ্গে ভারতে অবস্থান করে। এই এক কোটি মানুষের নিরাপত্তা খাদ্য, বস্ত্র, বাস্থান ও চিকিৎসার বিষয়ে প্রবাসী সরকারকে চিন্তা করতে হচ্ছে। দেশে অবস্থানকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সরকারকেই ভাবতে হচ্ছে। যদিও সরকার নিজেই প্রবাসী।
এরপর যে বিষয়টি উল্লেখযােগ্য, তা হচ্ছে হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধার বিষয়টি। এখানেও ব্যতিক্রম স্পষ্টতর। বিশ্বের আর কোন মুক্তিযুদ্ধেই মিত্রশক্তির সৈন্য সহায়তা তথা যৌথবাহিনী গঠনের উদাহরণ নেই।
প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর ভরণপােষণের জন্য বিদেশী সাহায্য প্রয়ােজন। সরকারের দাফতরিক কাঠামাে ব্যতিরেকে এই সাহায্য গ্রহণ ও যথাযথ বিতরণ সম্ভব নয়। প্রতিদিন হাজার হাজার যুবক দেশত্যাগ করছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। তাদের উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে যােদ্ধা হিসেবে তেরির বিষয়টির জন্যও প্রশাসনিক সরকারের বিকল্প নেই।
সরকারীভাবে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যেমন মন্ত্রিপরিষদের সভার সিদ্ধান্তের রেকর্ড গ্রহণ ও সংরক্ষণ, কার্যবিবরণী তৈরি, সরকারী যােগাযােগ, আদেশ-নির্দেশ জারি ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লােকবল প্রয়ােজন। কিন্তু এই লােকবল নিয়ােগ ও তাদের পরিচালনা করতে হলেও
পৃষ্ঠাঃ ৩৯১
প্রশাসনিক সরকার প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। প্রশাসনিক সরকার গঠনের বিষয়টি সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা জরুরী ছিল আরেকটি বিষয় আলোচনা করলে বোঝা যেতে পারে। হাজার হাজার গেরিলা ও নিয়মিত যোদ্ধা নিয়োগ ও তাদের রসদ থেকে শুরু করে যুদ্ধসামগ্রীর সবটাই সরকারের করতে হয়েছে। যদি প্রশাসনিক সরকার গঠিত না হতাে তাহলে মুক্তিবাহিনীর এই সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা সম্ভব হতাে না।
সেক্টর কমান্ডারগণ যদি নিজ নিজ সেক্টরকে নিজ প্রশাসনিক আওতাভুক্ত বলেই মনে করতেন আর এবাবে যদি কেন্দ্রীয় কমান্ডের বাইরে নিজেরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন, তাহলে সামগ্রিক অর্থে যুদ্ধজয়ের ব্যাপরটি সিন্দেহমুক্ত হতো না। সমন্বিত পরিচালনার অনুপস্থিতিতে হয়তাে কোন কোন সেক্টর কমান্ডার নিজ এলাকার অংশবিশেষ শত্রুমুক্ত করতে সমর্থ হতেন, সেক্ষেত্রে শত্রু বাহিনীও দীর্ঘ বিরতি কিংবা পশ্চাদগমন স্থায়ী করত না। ফলে জয়-পরাজয় এরকম একটা ধারাবাহিক অবস্থা চলতে থাকত। সামগ্রিক বিজয়লাভ সহজতর হতো না ।
তাজউদ্দীন সাহেবকে তখন মনে হলাে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চিত্ত এসব আলােচনা করছেন। সকল প্রয়ােজনীয়তাকে যে তিনি স্বীকার করেন এবং একটা পরিকল্পনাও গ্রহণ করে রেখেছেন তা অনুমান করতে পারছিলাম । যদিও তিনি এসব উল্লেখ করতেও দ্বিধা করেননি। বললেন, “দেখুন, সবাই বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, প্রশাসনের লােকজন তাদের কেউ কলকাতা, কেউ শিলিগুড়ি কিংবা আগরতলায়। আমরা যারা আছি তাদের তাে চাল নেই, চুলােও নেই। এই অবস্থায় প্রশাসনিক সরকার গঠন করা সহজ বিষয় নয়। “
তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যে উষ্ঠা ছিল। তিনি যখন ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন, তখনই অনুধাবন করেছিলেন প্রশাসনিক সরকারের কথা। এটা অস্তিত্বের প্রয়ােজনেই।
তাঁর এই ভাবনার প্রতিফলন ঘটে তারই বক্তব্য থেকে। তিনি জানতে চান, কিভাবে এই কার্যক্রম সম্পন্ন হতে পারে। তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই বললাম, একটা নিউক্লিয়াস গঠন করা দরকার। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তির বিকল্প নেই। সেই ব্যক্তিই কর্মতালিকা প্রণয়নসহ প্রাথমিক কাজগুলাে সম্পন্ন করবেন।
তাজউদ্দীন সাহেবের কাছ থেকে এরপর জানলাম, এসব বিষয় নিয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সভাতেও বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। এমন কি শুরুতে প্রথম দায়িত্ব যিনি পাবেন সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমার ধারণা হলাে, আমার চেয়ে সিনিয়র কেউ হয়তাে সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি হবেন। আর তাছাড়া।
পৃষ্ঠাঃ ৩৯২
তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতাও এত গভীর ছিল না যে, আমি তেমন একটি গুরু দায়িত্ব পাওয়ার ব্যাপারে আমি চিন্তা করতে পারি।
তাজউদ্দীন সাহেব এই এই গুরুদায়িত্ব পালনের জন্য আমাকেই পছন্দ করেন। স্বাভাবিক কারণেই আমি তার কাছে জানতে চাই, কেবিনেট আমাকে দিয়ে কিভাবে কাজ করাতে চায়, অর্থাৎ আমাকে কি কি কাজ করতে হবে এ বিষয়ে যদি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতেন কিংবা আমার নিয়ােগে কি কি শর্ত আছে তাও যদি বলেন। তাজউদ্দীন সাহেব স্বভাবসুলভ গম্ভীরতা নিয়েই বললেন, শর্ত তাে অবশ্যই আছে। আপনাকে এমন একটি সরকার কাঠামাে গঠন করতে হবে, যে সরকার এই যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ধারণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হবে এবং শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উজ্জীবিত সক্ষম হবে।
আমি জানতে চাইলাম, মন্ত্রিপরিষদে আমার পদবি নিয়ে কোন আলােচনা হয়েছে কি না। স্মিত হেসে তিনি বললেন, কেন, আপনার পদবি তাে আপনি নিজেই নিশ্চিত করেছেন। আপনি একজন মুক্তিযােদ্ধা, এটাই কি আপনার বড় পরিচয় নয়?
কিছুক্ষণ বিরতির পর তিনি বললেন, আপনাকে যখন সরকার গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তখন সরকারের সর্বোচ্চ পদ প্রশাসনের সচিব হিসেবেই নিয়ােগ করা হচ্ছে। অতএব, আপনি সচিব পদ ধারণ করবেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব হিসেবে নিয়ােগ ঘােষণা করে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানালেন।
এর পরই তাজউদ্দীন সাহেব নিয়ােগ আদেশের একটি খসড়া তৈরি করে আনতে বলেন। খসড়াটি টাইপ করা হলাে। টাইপ করলেন আবদুর রশিদ। তিনি ছিলেন তৎকালীন ওয়াপদার একজন কর্মচারী। হিসাবরক্ষক হিসেবে কাজ করলেও তিনি টাইপও করতে জানতেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনায় নিজেকে জড়ানাের ইচ্ছায় আমাকে বললেন, স্যার, আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। আবদুর রশিদ অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে নিয়ােগ আদেশটি টাইপ করে হাতে দিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব এই নিয়ােগ আদেশে সই করতে অসম্মতি জানালেন । বললেন, বাংলায় লিখতে হবে। অতঃপর নিজেই লিখে নিলেন নিয়ােগ আদেশ, খুবই সুন্দর হাতের লেখা। এখানে উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ সভার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য রেকর্ড তিনি নিজ হাতে লিখতেন।
এই আদেশবলে আমাকে সচিব (সাধারণ প্রশাসন) হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। এখান থেকেই বাংলাদেশ সরকারের দাফতরিক কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু । আমাদের তখন বসার জায়গা, টাইপরাইটার, নথি, কাগজ-কলম ইত্যাদি কিছুই
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৩
ছিল না। এর আগে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ ন
তাজউদ্দীন আহমদ (তার হাতে ছিল কেবিনেট, প্রতিরক্ষা, পরিকল্পনা, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়), পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমেদ (আইন ও সংসদ বিষয়ক) এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামরুজ্জামান (ত্রাণ ও পুনর্বাসন, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়) দায়িত্ব লাভ করেন। অতএব তাদের দায়িত্বের পরিধি বিবেচনা করে স্বভাবতই প্রথম যে কাজটির প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়েছে, তা হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরকারের একটি সঠিক প্রশাসনিক রূপরেখা তৈরি করা।
সঙ্গত কারণেই মন্ত্রণালয়গুলাের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রথমেই সংস্থাপন বিভাগ সৃষ্টি করতে হলাে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল লােক নিয়োগের ক্ষেত্রে। কারণ সরকারী লােকজনের মধ্যে অনেকেই ভারতে আসেননি। যারা এসেছেন তারাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন বিভিন্ন জায়গায়। তাদের খুঁজে বের করতে খানিকটা সময়ও চলে যায়।
রূপরেখা তৈরি করার সময় এবং সচিবালয়ে কর্মকাণ্ড শুরু করার সময় প্রয়ােজনের কথা বিবেচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ কোন মন্ত্রণালয়ের লোক নিয়োগ আগে করা হবে তা নির্ধারিত হয়েছে সেভাবেই।
সাধারণ প্রশাসন/সংস্থাপন বিভাগে বিভিন্ন সময় নিয়ােগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন এম নুরুল কাদের- সচিব (প্রাক্তন সিএপি এবং পাবনার ডেপুটি কমিশনার), কামাল আহমেদ উপসচিব (প্রাক্তন ইপিসিএস এবং নাটোরের এসডিও), ওয়ালিউল ইসলাম- উপসচিব (প্রাক্তন সিএসপি মাগুরার এসডিও), দীপক কুমার চৌধুরী- সহসচিব, অজিত কুমার ভাদুড়ী – সহসচিব (পুলিশ অফিসার), নরেশচন্দ্র রায়- সহসচিব, মতিউর রহমান- সহসচিব (প্রাক্তন ইপিসিএস), মাে. হেদায়েত উল্লাহ- সহসচিব (প্রাক্তন ইপিসিএস), আল আমীন চৌধুরী- সহসচিব, শাহ মতিউর রহমান- সহসচিব (প্রাক্তন ইপিসিএস), কামাল সিদ্দিকী- ইঞ্জিনিয়ার (ট্রান্সপাের্ট অফিসার) প্রমুখ ।
মেহেরপুরের এসডিও প্রাক্তন সিএসপি তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী, মেহেরপুরের এসডিপিও, প্রাক্তন সিএসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ এবং কামাল সিদ্দিকীকেও সংস্থাপন বিভাগে নিয়ােগ দেয়া হয়। কিন্তু তারা সরকারে যােগ দেননি। তাঁরা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন। সশস্ত্র সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণ করে তাঁরা প্রত্যেকেই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
এক সময় মনসুর আলী সাহেব আমাকে ডাকলেন । কথা হলাে দেশ থেকে পাওয়া টাকা-পয়সা নিয়ে। সরকার ও যুদ্ধ পরিচালনা, অসংখ্য শরণার্থীর থাকা- খাওয়া, চিকিৎসা ব্যয়সহ সামগ্রিক ব্যয় নির্বাহের জন্য অর্থের বিকল্প নেই।
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৪
জনবলের পর পরই অর্থ বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হচ্ছে। বিশেষ করে দেশ থেকে প্রাপ্ত টাকা-পয়সাগুলোর হিসাবনিকাশ বিহিত করার জন্য ট্রেজারি প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মনসুর আলী সাহেব সেই প্রয়ােজনের কথা বিবেচনা করে দ্রুত একজন ট্রেজারি অফিসার নিয়ােগের কথা বললেন।
মাখন চন্দ্র মাঝির কথা বললাম । আমি পাবনায় জেলা প্রশাসক থাকাকালে মাখন চন্দ্র মাঝি সেখানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। পাবনায় সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হলে তিনি অংশ নেন। পরে যখন আমরা পাবনা ছেড়ে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর এবং সবশেষ কলকাতা আসি তখন তিনিও ছিলেন সঙ্গে। কথাবার্তা শেষে মনসুর আলী সাহেব মাখন চন্দ্র মাঝিকে ট্রেজারি অফিসার হিসেবে নিয়ােগের সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি হলেন বাংলাদেশের প্রথম ট্রেজারি অফিসার। মনসুর আলী সাহেব বসতেন ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। কিন্তু ট্রেজারি অফিস স্থাপিত হলাে পার্ক সার্কাসে। হোল্ডিং নম্বর ছিল ৯ নম্বর। দোতলা ভবনের পেছনের একটি কক্ষে মাখন চন্দ্র মাঝির অফিস হলাে। ঐ একই ভবনে হােসেন আলী এবং আমারও বসার জায়গা ছিল।
মাখন সম্পর্কে মজার একটি ঘটনা মনে পড়ছে। সম্ভবত জুন মাসের ঘটনা এটি। যথারীতি সংশ্লিষ্ট দুই এমএনএ মােহাম্মদ উল্লাহ (পরে রাষ্ট্রপতি) এবং মোহাম্মদ মহসীন একদিন এসে মাখনের ব্যাপারে অভিযােগ উত্থাপন করলেন।
তারা বললেন, মাখন আদব-কায়দা জানে না, সব সময় চিৎকার করে কথা বলে। যথারীতি খোজ নেয়া হলাে, জানা গেল এটা তার ইচ্ছাকৃত নয়। কারণ ছােটকাল থেকে তাকে জোরে কথা বলতে হয়েছে মার সঙ্গে, তার মা কানে কম শুনতেন বলে । সেই থেকে এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
মজিবনগরে এই মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের মধ্যে মনসুর আলী সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য নেতৃবৃন্দের তুলনায় ঘনিষ্ঠততর ছিল। আমি পাবনায় থাকাকালে তিনি আমার বাসায়ও গিয়েছেন। এ কথা আগেও উল্লেখ করেছি, তবে যে-কোনাে কারণেই হােক, তাঁর সঙ্গে আমার সেই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলাে কর্মক্ষেত্রে কাছাকাছি হওয়ার সুবাদে। তিনিও সম্ভবত আমাকে যথেষ্ট বিশ্বস্ত বলেমনে করতেন। যেজন্য অনেক বিষয়ে তিনি আমার সঙ্গে খােলামেলা আলাপ করতেন। তিনি আমার কাজের চাপ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। কাজের চাপ কমিয়েআনার বিষয়ে তিনি সচেষ্ট ছিলেন। এমনই একদিন তিনি বললেন অর্থ সচিব নিয়ােগের ব্যাপারে। ঐ সময় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান কলকাতায় এসেছেন। মনসুর আলী সাহেবকে প্রস্তাব করলাম আসাদুজ্জামানকে
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৫
অর্থ সচিব হিসেবে নিয়ােগ দেয়ার ব্যাপারে। তাকে জানালাম, খন্দকার আসাদুজ্জামান একজন অভিজ্ঞ লােক। তাঁকে অর্থ সচিব করলে ভালাে হয়। তিনি রাজি হলেন। তবে বললেন, আমিও যেন প্রয়ােজনীয় সহযােগিতা করি।
সঙ্গতভাবেই আমি মনসুর আলী সাহেবকে আমার সম্মতির কথা জানাই এবং খন্দকার আসাদুজ্জামানও অর্থ সচিব হিসেবে যােগদান করেন। তাকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সচিব সংখ্যা হলাে দু’জন।
খন্দকার আসাদুজ্জামান সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আগেও কয়েকজন কর্মকর্তা এই মন্ত্রণালয়ে যােগ দিয়েছিলেন। সচিব ছাড়াও অন্য যারা বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা হলেন : সাদাত হােসেন একান্ত সচিব (প্রাক্তন সিএসপি, যশােরের সহকারী কমিশনার), মাখন চন্দ্র মাঝি- সহসচিব ( প্রাক্তন ইপিসিএস), নেফাউর রহমান- সহসচিব, ক্ষিতীশ চন্দ্র কুণ্ড- সহসচিব, এ কে এম হেফাতুল্লাহ- সহসচিব এবং আলী করিম- সহসচিব।
এ এইচ এম কামরুজ্জামানের অধীনস্থ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অন্য কর্মকর্তা হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে যােগদান করেন যথাক্রমে নুরুদ্দিন আহমদ -সচিব, মহিদুল ইসলাম- উপ-পরিচালক, এনএম সরকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা; মােজাম্মেল হােসেন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তা হিসেবে যােগদান করেন আবদুল খালেক (প্রাক্তন পিএসপি)- সচিব। তিনি আইজিপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অন্য কর্মকর্তাগণ হলেন : খসরুজ্জামান চৌধুরী- উপসচিব (প্রাক্তন সিএসপি, এসডিও); এস কে চৌধুরী (প্রাক্তন পিএসপি) ওএসডি; সৈয়দ মাহবুব রশিদ- সহকারী সচিব; জ্ঞানরঞ্জন সাহা- সহকারী সচিব (প্রাক্তন ইপিসিএস); চৌধুরী এম এ গাফফার- স্টাফ অফিসার (পুলিশ অফিসার, পাবনা); ডিএন ব্যাপারি- স্টাফ অফিসার (প্রাক্তন ইপিসিএস); রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী- পিআরও ।
এছাড়া নিম্নলিখিত আনসার কর্মকর্তাগণও স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ে যােগদান করেন। তাঁরা হলেন : শরিফুল হক- জেলা আনসার অফিসার, সৈয়দ হাবিবুল বারী- মহকুমা আনসার অফিসার, রশীদ বখত মজুমদার- জেলা আনসার অফিসার, শামসুর রহমান- আনসার অফিসার, আকরাম হােসেন, তবিবুর রহমান, এ কে হুমায়ুন, কে জি কাদের, আবুল বাশার, আবুল কাশেম, আবদুল হান্নান, আলী আকবর এবং মােঃ জহিরুদ্দিন।
অন্য মন্ত্রণালয়ে তখনও সচিব নিয়ােগ হয়নি। উপসচিব কিংবা সহকারী সচিব নিয়ােগ করে জরুরী কাজ চালানাে হচ্ছিল। তবে এখানে একটা বিষয় বলা দরকার, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের কার্যক্রম পরিচালনায় সকল কর্মকর্তাই
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৬
ছিলেন আন্তরিক। ফলে যেসব মন্ত্রণালয়ে তখনও সচিব নিয়ােগ হয়নি সেসব মন্ত্রণালয়ের কাজেও যতটা অসুবিধা হওয়ার কথা ততােটা হয়নি। কারণ দায়িত্বের পরিধি বিবেচনা করে সিনিয়র কর্মকর্তা জুনিয়রের কাজ করবেন না, এমন চিন্তা তখন ছিল না। প্রত্যেকেই চিন্তা করতেন দেশের কথা, স্বাধীনতার কথা। লক্ষ্য ছিল একটাই- স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুষ্ঠু কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের হাতে এর দায়িত্ব ছিল । এপ্রিল মাসেই মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী এমএনএ নিয়োজিত ছিলেন। মুজিবনগর প্রশাসনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল যুদ্ধ পরিচালনায় দাফতরিক সহায়তা প্রদান করা। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে অবস্থানকারী যােদ্ধাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে কর্নেল এমএ রব এমএনএ প্রথমে উপদেষ্টা নিয়ােজিত হন। পরে তিনি চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োজিত হয়েছিলেন । ডেপুটি চীফ অব স্টাফ ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। এডিসি ছিলেন লে. নূর। সিলেটের ডেপুটি কমিশনার ও সাবেক সিএসপি পরবর্তী সময়ে এম এ সামাদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ ভাগ লাভ করেন। এছাড়া অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে আকবর আলী খান- উপসচিব (প্রাক্তন সিএসপি ও এসডিও হবিগঞ্জ); এস এ ইমাম- উপসচিব; নুরুল ইসলাম চৌধুরী – সহসচিব, এম এইচ সিদ্দিকী- সহসচিব এবং মােস্তফা আল্লামা পিআরও হিসেবে নিয়ােজিত হন।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রায় এক কোটি শরণার্থীর খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান সমস্যা ছিল প্রকট। দেশত্যাগী এই বিপুল জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ত্রাণ সাহায্য লাভের চেষ্টা ও বিতরণসহ প্রয়ােজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা ঐ সময়ের জন্য সরকারের অন্যতম কাজ। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন এ এইচ এম কামরুজ্জামান । এ এইচ এম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও কৃষি মন্ত্রণালয়েরও মন্ত্রী ছিলেন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়কে প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রয়ােজনীয়তার কথা বিবেচনা করে। ত্রাণ মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য কোনাে সচিব নিয়ােগ করা হয়নি। এই অবস্থা শেষ অবধি ছিল। তবে একজন ত্রাণ কমিশনার ছিলেন। ত্রাণ কমিশনার হিসেবে কাজ করছিলেন জে জি ভৌমিক।
অগ্রাধিকার বিবেচনায় এরপরই তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় গুরুত্বপূর্ণ বলে
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৭
বিবেচিত হয়। তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত এমএনএ আবদুল মান্নান। আনোয়ারুল হক সচিব হিসেবে নিয়ােজিত হন। এ ছাড়াও বিভিন্ন পদে যারা নিয়োজিত ছিলেন তারা হলেন : কামরুল হাসান পরিচালক, আবদুল জাব্বার খান পরিচালক এম আর আখতার মুকুল পরিচালক, বহিপ্রচার বিভাগে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এমএনএ এবং আমিনুল হক বাদশা ওএসডি।
রুহুল কুদুস সাহেবকে সরকারের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল নিয়োগ করা হয় বিজয় অর্জনের অল্প কদিন আগে। একাত্তরের প্রায় পুরোটা সময় তিনি দেশের অভ্যন্তরে ছিলেন। যে-কোন কারণেই হােক তার পক্ষে মুজিবনগর গিয়ে সরকারে যােগ দেয়া সম্ভব হয়নি। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি সপরিবারে রওনা হন ভারতের উদ্দেশে। কিন্তু আসাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে তিনি বন্দী হয়ে পড়েন।
মুজিবনগরে এই খবর পৌছানাের পর অনেকেরই মন খারাপ হয়ে পড়ে। এর একটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে রুহুল কুদ্দুস সাহেবের দীর্ঘ যােগসূত্র আছে। যেমন- ছয় দফা প্রণয়নকালে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বলে শ্রুতি আছে। সম্ভবত একই কারণে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামীও করা হয়েছিল। রুহুল কুদ্স সাহেবকে সসম্মানে মুজিবনগরে নিয়ে আসার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাও কাজ করেছে। তাঁরই নির্দেশে আমাকে যেতে হয়েছে শিলং। শিলংয়ে চীফ সেক্রেটারির সঙ্গে যােগাযােগ করে তাঁকে মুক্ত করে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় ৬ ডিসেম্বর। অবশ্য ইতোমধ্যে ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িয়ে পড়ে।
৬ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত হয়, রুহুল কুদুস সাহেবকে সরকারের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিয়ােগ করা হবে। সিদ্ধান্তটি ছিল এর রকম-
It was decided that for the time being an Acting Secretary General to the Government would be appointed and this appointment would be on a purely temporary basis. The cabinet was pleased to select Mr. Ruhul Quddus for this purpose and decided to apoint him to the post with immediate affect.
Sd/
Acting President
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৮
এই সিদ্ধান্তের কপি সংশিষ্ট বিভিন্ন দফতরে পাঠানাে হয়। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল অফিসের ব্যবস্থা করার জন্য আমাকে বলা হয়েছিল।
রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল পদে নিয়ােগের বিষয়টি নিয়ে পর্যালােচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন সাহেবও কথা বলেছেন। রুহুল কুদ্দুস সাহেব যুদ্ধের দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ অঞ্চলে থাকার পরও তার স্বাধীনতার প্রতি আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি ছিল না। এমন প্রশ্ন কেউ তোলেওনি তবে অসুবিধা দেখা দিয়েছিল তাকে নিয়ােগ করার ব্যাপারে। মুজিবনগরে কর্মরত সকল সচিবই ছিলেন তার চেয়ে জুনিয়র। এ ক্ষেত্রে তাকে সচিব পদে নিয়োগে স্বাভাবিক কারণেই অসুবিধা দেখা দিয়েছিল। আবার পাকিস্তান সরকারের যেমন প্রতিটি প্রদেশে একজন করে মুখ্য সচিব আছে তেমনি মুখ্যসচিব নিয়ােগেরও কোনাে সুযােগ ছিল না। কারণ বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক তার কোন প্রদেশ নেই। ফলে মুখ্য সচিব হিসেবেও নিয়ােগ করা সম্ভব নয়। অনেক চিন্তাভাবনা করে তাই সেক্রেটারি জেনারেলের একটা পােস্ট তৈরি তাঁকে সেই পদে নিয়ােগ করা হয়।
প্রশাসনিক সরকারের দফতরগুলাে একই ভবনে রাখা সম্ভব ছিল না পরিবেশ পরিস্থিতির কারণ। সচিবদের তাই বিভিন্ন জায়গায় বসে অফিস করতে হয়েছে। তবে ৮ নম্বর থিয়েটার রােডেই বেশির ভাগ মন্ত্রণালয়ের কাজ হতাে । এখানে কেবিনেট ও বেসামরিক প্রশাসনিক দফতর, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, উপ-রাষ্ট্রপতির সচিবালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দফতর ছিল ।
আইন মন্ত্রণালয়ের দফতর ছিল বাংলাদেশ মিশন ৯ সার্কাস এভিনিউতে। এখানে আরও ছিল তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দফতর ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা ভবনে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল ৪৫ প্রিন্সেস স্ট্রিট, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছিল ২২/সি লােয়ার সার্কুলার রােডে।
এখানে একটি বিষয় আবারও উল্লেখ করা প্রয়ােজন, মুজিবনগর প্রশাসনে নিয়ােজিত কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন সময় নিয়ােগ লাভ করেন। সরকার গঠনের শুরুতে কর্মকর্তাদের অনেকেই বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন। অনেকেই দেশত্যাগের সুযােগ- সুবিধা পেয়েছেন দেরিতে। ফলে প্রশাসনিক সরকার গঠন প্রক্রিয়াও দীর্ঘসূত্রতা লক্ষ্য করা যায়। প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় প্রয়ােজনীয় লােকবল কোন সময়ই ছিল না। যে কারণে প্রায় প্রত্যেককেই নিজ দায়িত্ব ছাড়াও অতিরিক্ত অনেক কাজ করতে হয়েছে।
মুজিবনগর প্রশাসনে কর্মরতদের প্রত্যেককেই এমন কাজও করতে হয়েছে,
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৯
যা হয়তাে নির্দিষ্ট পদের কর্মকর্তার করার কথা নয়। এমনও দেখা গেছে যে, একজন সচিব হয়তাে নিজেই এমন ফাইল ওয়ার্ক করছেন যা করার কথা একজন নিম্নমান সহকারীর। ঐ সময় এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল যে, কাজ করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। আর এ কারণেই সরকারের পক্ষে গোটা যুদ্ধকে বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীনে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বলেই মুক্তিযুদ্ধ ছিল সামগ্রিক বিবেচনায় জনযুদ্ধ।
এখানে সরকারের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা অপরিহার্য। সরকার প্রধান তাজউদ্দীন আহমদের তীক্ষ্ণ চিন্তার ফলে যুদ্ধ পরিচালনা এবং নিয়মিত বাহিনীসহ সকল মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা বেসামরিক সরকারের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল ।
যুব ক্যাম্পের কার্যক্রম
যুব ক্যাম্পের কার্যক্রম, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই জনযুদ্ধ ছিল। আর এই জনযুদ্ধ চালানোর জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তার প্রতিটিতেই গণতান্ত্রিক ধারা স্পষ্টত দৃশ্যমান ছিল। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সম্ভাবনার বিষয়টিও সরকারের চিন্তায় ছিল। যুব ক্যাম্পের কার্যক্রম থেকে তা প্রমাণিত হয়। যদি কোনাে কারণে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে অন্তত নতুন প্রজন্মকেও যাতে আদর্শভিত্তিক যােদ্ধা হিসেবে তৈরি করা যায়, সেই ধারণাও সরকার পােষণ করতাে। পাশাপাশি যুদ্ধকালীন জরুরী এবং দ্রুত প্রয়ােজন মেটানাের জন্য যােদ্ধা তৈরির বিষয়টিও অগ্রগণ্য ছিল।
যুব শিবির পরিচালনা বাের্ডের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত এসব ক্যাম্পে অবস্থানকারীদের প্রশিক্ষণের জন্য সুন্দর এবং উপযােগী একটি কারিকুলাম তৈরি হয়। ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হতাে।
প্রথম পর্যায়ে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে নাম রেজিস্ট্রেশন করাতে হয়। সেখানে ৩৫ দিনের একটি রুটিন মেনে চলতে হতাে। যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় দিন রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও আগতদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করা হতাে। তৃতীয় দিন থেকে ১৬শ’ দিন পর্যন্ত তালিকাভুক্ত যুবকদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতাে। ১৭শ’ দিন থেকে দু’দিন আরেকটি গ্রুপ করা হতাে তালিকাভুক্তদের মধ্য থেকে। প্রথম দাপে যারা সাফল্য লাভ করতাে তাদেরকে আর্মড ফোর্সে যােগ দেয়ার সুযােগ দেয়া হতাে। বাকি যারা থাকত তাদের আবারও উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হতাে। তাদেরকে বাছাই করা হতাে ভিত্তি ফৌজ হিসেবে।
পৃষ্ঠাঃ ৪০০