This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ
১
তাজউদ্দীন আহমদ
ছাত্রজীবন
তাজউদ্দীন আহমদের বংশ পরিচয়
তাজউদ্দীন আহমদের পূর্ব পুরুষ মােগল সম্রাটদের কর্মকর্তা ছিলেন। তারা দিল্লি থেকে বাংলায় ধর্ম প্রচারের জন্য আগমন করেন এবং গফরগাঁও থানার নিগাইর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তার বসতবাড়ি খানবাড়ি হিসেবে পরিচিত। এ বংশের মােহাম্মদ ইব্রাহিম খান বিবাহ করে ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। দরদরিয়া হতে নিগুয়ারী দূরত্ব ৬ মাইল। কাপাসিয়া ও গফরগাঁও পাশাপাশি থানা, নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। ইব্রাহিম খান দরদরিয়ায় কৃষি জমি ও বনভূমির মালিক ছিলেন। তার পুত্র মােহাম্মদ ইয়াসিন খান। ইয়াসিন খানের পুত্র তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদের মাতার নাম মােসাম্মৎ মেহেরুন্নেসা খানম । ইয়াসিন খান ও মেহেরুন্নেসার ৪ পুত্র, ৬ কন্যা। চার পুত্র হলেন- ওয়াজিউদ্দীন, তাজউদ্দীন আহমদ, মফিজউদ্দীন আহমদ খান এবং আফসার উদ্দীন আহমদ খান। ভাইদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ওয়াজিউদ্দীন ও কনিষ্ঠ ভ্রাতা মফিজউদ্দীন মৃত। এখন একমাত্র আফসার উদ্দীন আহমেদ খান জীবিত। তাজউদ্দীন আহমদ বিখ্যাত খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি খান পদবি ব্যবহার করেননি।১
ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানা ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত। ঢাকা জেলার ৫টি থানা নিয়ে গাজীপুর মহকুমা সৃষ্টি এবং ১৯৮৪ সালে গাজীপুর মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়। গাজীপুর ঐতিহাসিক স্থান। বারভূঁইয়ার শ্রেষ্ঠ ভূঁইয়া ঈশা খাঁর রণক্ষেত্র ছিল গাজীপুরে। গাজীরা ছিলেন এ অঞ্চলের জমিদার, পরে ভাওয়ালের রাজা। ব্রিটিশ আমলের বিখ্যাত জমিদার ভাওয়ালের দ্বিতীয় কুমার ভাওয়াল সন্ন্যাসী নামে খ্যাত। এ অঞ্চলের অন্যতম সম্পদ গজারি বন। গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া থানা বানার ও শীতলক্ষ্যা নদী দ্বারা বিধৌত। বানার ও শীতলক্ষ্যা নদী পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর শাখা। ঢাকার উত্তর ও ময়মনসিংহ জেলা ব্ৰহ্মপুত্র নদের পলল দ্বারা গঠিত। তাজউদ্দীন আহমদের
পৃষ্ঠাঃ ১৭
জন্মভূমি বৃহত্তর ঢাকার গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ায়। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলে কার্পাস তুলা জন্মাত। তাই কার্পাস থেকে কাপাসিয়া থানার নামকরণ হয়েছে। বারভূঁইয়া-গাজীদের নামে গাজীপুর জেলা। তাজউদ্দীন আহমদ একই সাথে বৃহত্তর ঢাকা ও ময়মনসিংহের অধিবাসী। ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার নিগুয়ারী গ্রামে তাদের আদি বাসস্থান। নিগুয়ারী গ্রামের খাঁ পরিবারের ইব্রাহিম খান বিবাহ করে উনিশ শতকের শেষভাগে কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে আসেন। তাজউদ্দীন আহমদের দাদার পুরাতন বাড়ি নিগুয়ারী গ্রাম থেকে দরদারিয়া গ্রামের দূরত্ব ৬ মাইল। বানার নদীর উত্তর পাড়ে নিগুয়ারী এবং দক্ষিণ পাড়ে কাপাসিয়া। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা নদী বানার। বানার নদী কাওরাইদ ও শীতলক্ষ্যা নাম ধারণ করে নারায়ণগঞ্জ হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। কাপাসিয়া থানার উত্তর-পূর্ব দিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র প্রবাহিত । শীতলক্ষ্যা নদীর উত্তর পাড়ে দরদরিয়া এবং দক্ষিণ পাড়ে কাপাসিয়া উপজেলার সদর দপ্তর।
কাপাসিয়া উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন এবং ২৩১টি গ্রাম। শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে ৩টি এবং পূর্ব পাড়ে ৮টি ইউনিয়ন। কাপাসিয়ার বানার ও শীতলক্ষ্যা নদীর সাথে তাজউদ্দীনের সম্পর্ক শিশুকাল হতে। নদীতে সাঁতার কাটা, মাছধরা তার নেশা ছিল। নদীর পাড়ে গভীর গজারী বনের সাথে নিবিড় সম্পর্ক ছিল। কাপাসিয়ার বনের মালিক কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বন বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। সর্বপরি শিশুকাল থেকে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল।
তাজউদ্দীন আহমদের বংশ তালিকা
পূর্ব পুরুষ দিল্লির অধিবাসী
মােগল সম্রাটের কর্মকর্তা
ইসলাম প্রচারে বাংলায় আগমন
ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ের নিগুয়ারী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন
ইব্রাহিম খান
(জন্ম : গফরগায়ের নিগুয়ারী গ্রামে)
মুহাম্মদ ইয়াসিন খান
(জন্ম : কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে)
পৃষ্ঠাঃ ১৮
মুহাম্মদ ইয়াসিন খান
(জন্ম : কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে)
ওয়াজিউদ্দীন, তাজউদ্দীন আহমদ, মফিজ উদ্দীন, আফসার উদ্দীন, ৬ কন্যা
রিমি, রিপি, সিমি, এক পুত্র সােহেল তাজ
তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই বর্তমান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মাতার নাম মেহেরুন্নেসা খানম। তারা চার ভাই, ৫ বােন। তাজউদ্দীন আহমদের পিতা কৃষিভূমি ও বনের মালিক ছিলেন।
দরদরিয়া থেকে সেন্ট গ্রেগরীজ ১৯৩৫-১৯৪৪
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পূর্বে ১৯০৫ সাল বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ গঠিত হয়। পূর্ববঙ্গকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলন চলে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ১৯০৫ সালে অনুশীলন ও যুগান্তর নামে দু’টি সশস্ত্র বিপ্লবী দল সৃষ্টি হয়। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে । ছাত্র- যুবকরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে । কংগ্রেসে ও মুসলমান লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করে। ১৯১৯ সালে মওলানা মুহাম্মদ আলী শেরেবাংলার নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন ও ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয় । ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে অসহযােগ আন্দোলন বন্ধ হয় যায় । হিন্দু-মুসলমান মিলনের অগ্রদূত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৫ সালের ১২ জুন মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের চেষ্টা স্তিমিত হয়ে যায়। ১৯২৪ সালে এ কে ফজলুল হক বাংলার শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হয় । ১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ ও এ কে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি জয়লাভ করে। এ কে ফজলুল হক ১৯৩৭ সালের ৩ এপ্রিল বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৩৮ সালে তিনি জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের জন্য ফ্লাউড কমিশন নিয়ােগ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ১৯
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪১ সাল নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু কলকাতা থেকে পালিয়ে জার্মানি হয়ে জাপান গমন করেন । ১৯৪২ সালে তিনি রেঙ্গুনে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আজাদ-হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। বিশ শতকের প্রথম অর্ধের ঘটনাবলী দ্বারা তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্র জীবনে দারুণভাবে প্রভাবিত হন।
দরদরিয়া মক্তব
তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার ছিল রক্ষণশীল। তার পিতা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন। এ পরিবারের পূর্বপুরুষ ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য দিল্লি থেকে গফরগায়ে চলে আসেন। এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান হিসেবে তাজউদ্দীনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পিতার নিকট। পিতা বাড়িতে তাজউদ্দীনকে কুরআন শরিফ পড়াতেন। দরদরিয়া গ্রামে মক্ত ছিল। তিনি পুত্রকে শিশুকালে দরদরিয়া মক্তবে ভর্তি করে দেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি কুরআন শরিফের কয়েক পারা মুখস্থ করে ফেলেন। তাকে কুরআনে হাফেজ বলা হতাে।
ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়
১৯৩৪-১৯৩৭
তার মেধাশক্তি দেখে অনেকে তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পরামর্শ দেন। দরদরিয়া থেকে ২ মাইল দূরে ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ভর্তি হলেন। ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণী হতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন। এ জন্য তাকে জীবনের প্রথম পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাকে ১০ পয়সা মূল্যের দেড় পয়সার কালির দোয়াত এবং সাড়ে আট পয়সা মূল্যের একটি কলম পুরস্কার দেয়া হয়। এ সামান্য পুরস্কার তাকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করেছিল। তিনি সকল পরীক্ষায় প্রথম হতেন। এ বিদ্যালয় হতে তিনি ১৯৩৬ সালে তৃতীয় শ্রেণী সমাপ্ত করেন।
কাপাসিয়া এমই স্কুল ১৯৩৭-৩৮
তাজউদ্দীন আহমদ ৫ মাইল দূরে কাপাসিয়া মাইনর স্কুলে ১৯৩৭ সালে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। তখন তার বয়স ১৩ বছর । কাপাসিয়া জুনিয়র স্কুলে পড়ার সময় কাপাসিয়ায় ৩ জন শিক্ষক রাজবন্দীর সাথে সাক্ষাত ঘটে। ব্রিটিশ যুগে রাজবন্দীদের অনেক সময় থানায় অন্তরীণ রাখা হতাে। এ সময় ৩ জন রাজবন্দীকে কাপাসিয়া থানার কর্তৃত্বে রাখা হয়।
পৃষ্ঠাঃ ২০
কালিগঞ্জ নাগরী সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউট ১৯৩৯-৪০
কাপাসিয়ার সেই রাজবন্দীরা তাজউদ্দীনকে ভাল স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। ৩ রাজবন্দী তার মধ্যে অগ্নির সন্ধান পেয়েছিলেন। এ কারণে তারা তাকে ভাল স্কুলে যেতে বলেছিলেন। কালিগঞ্জ থানায় খ্রিস্টান মিশনারীগণ নাগরী সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। তাজউদ্দীন এ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে তিনি মাইন বৃত্তি পরীক্ষায় ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেন্ট নিকোলাস স্কুলে তার মেধা দেখে শিক্ষকগণ বিস্মিত হন। তিনি ক্লাসে প্রথম হতেন। শিক্ষকগণ তাকে ঢাকায় ভালাে স্কুলে ভর্তি হতে বলেন। তারা আরও বলেন যে, তিনি একদিন মন্ত্রী হবেন । ১৯৪০ সালে তাজউদ্দীন সপ্তম শ্রেণী পাস করে ঢাকায় মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
ঢাকা মুসলিম বয়েজ হাই ইংলিশ স্কুল ১৯৪১-১৯৪৩
নাগরী সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে তাজউদ্দীন পঞ্চম থেকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। শিক্ষকগণ তার মেধা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। ক্লাসে প্রথম হতেন । মাইনর ইংলিশ পরীক্ষায় তিনি ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন। শিক্ষকগণ তাকে ঢাকায় ভাল স্কুলে ভর্তির পরামর্শ দেন। ১৯৪১ সালে তিনি ঢাকা মুসলিম বয়েজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ডাফরিন মুসলিম হােস্টেলে থাকতেন। তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র মহম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের সাথে একই কক্ষে থাকতেন। হােস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন অম্বর আলী। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবদুর রহমান এবং অঙ্ক শিক্ষক ছিলেন শাহাবুদ্দিন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকার সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং চালু করে। তাজউদ্দীন আহমদ সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। এ কাজের জন্য প্রত্যেক রাতে সম্মানী পেতেন ৮ আনা। তিনি আজীবন বয়স্কাউট আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন।
সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুল ১৯৪৩-১৯৪৪
১৯৪৪ সালে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে মেট্রিকুলেশন পাস
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৩ সালে মুসলিম বয়েজ হাইস্কুল ত্যাগ করে ঢাকার প্রাচীনতম বিদ্যালয় সেন্ট গ্রেগরীজ হাই ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি ইংরেজীতে ৮০ নম্বর পেয়েছিলেন। সেন্ট গ্রেগরীজে ইংরেজীর বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন এস দাশগুপ্ত।
তাজউদ্দীন আহমদ পড়ার পাশাপাশি রাজনীতি করতেন। কলতাবাজারে
পৃষ্ঠাঃ ২১
মুসলিম লীগ অফিস ছিল। তিনি নিয়মিত মুসলিম লীগ অফিসে যেতেন। তিনি কোর্টে যেতে পছন্দ করতেন এবং কোর্টে উকিল ও জজদের মধ্যে আলোচনা শুনতেন। বন্ধুরা তার কোর্টে যাতায়াত দেখে জিজ্ঞেস করতেন- তুমি কি উকিল হবে? তাজউদ্দীন বলতেন তিনি উকিল হবেন।
ক্লাস নাইন থেকে তাজউদ্দীন রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। লেখাপড়া কম করতেন। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার মেধাশক্তি দেখে শিক্ষরগণ বিস্মিত হতেন। তার সতীর্থরা বলতেন- এরকম মেধাবী ছাত্র তারা আর দেখেনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ডামাডােলে তখন বিদ্যালয়ের পড়া বিঘ্নিত হতো। এতােসব প্রতিকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান দখল করেন। মেট্রিক পরীক্ষায় তার কৃতিত্ব ঢাকা শহরে আলােড়ন সৃষ্টি করে। সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে মুসলিম ছাত্র সংখ্যা খুবই কম ছিল। তার মধ্যে তাজউদ্দীনের কৃতিত্ব এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ঢাকা কলেজ ১৯৪৪-১৯৪৭
মেট্রিক পাস করে তাজউদ্দীন আহমদ ঐতিহ্যবাহী ঢাকা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তিনি সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ সম্মেলন, কৃষ্ণনগর ছাত্রলীগ সম্মেলন, ১৯৪৬ সালের নির্বাচন, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ- এসকল ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার পক্ষে নিয়মিত ক্লাস করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৬ সালে তার আইএ পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। কিন্তু তা দেয়া হয়নি। তিনি ঢাকা কলেজে নন-কলেজিয়েট হলেন। লেখাপড়ার প্রতি তার অমনােযােগিতা দেখে বলতেন- তুমিতাে পরীক্ষায় ভাল করবে না। তিনি বলতেন- তার ভাল করার প্রয়ােজন নেই।
মানুষের পাঠশালায়
গ্রামে পড়ার সময় হতে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পল্লী অঞ্চলের মানুষের একান্ত আপনজন- তাদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াতেন।
তাজউদ্দীন আহমদ বাল্যকাল থেকে সাহসী ছিলেন। দরদরিয়া গ্রামের আবদুর মজিদ বেপারি বলেন, তাজউদ্দীনসহ আমরা সকলে বাঘ শিকারী মনিরউদ্দিন বেপারির সাথে জঙ্গলে যাই। শিকারী গুলি করার সাথে সাথে বাঘ আমাদের দিকে দৌড়াচ্ছে। প্রাণের ভয়ে সকলে দৌড়ে পালায়। তাজউদ্দীন দৌড়ালেন না। আমাকেও দৌড়াতে দিলেন না। বললেন ভয় পেয়াে না, বাঘের বিরুদ্ধে লাঠি নিয়ে দাঁড়াও- এমন ছিল তার সাহস। নদীতে সে সময় কুমিরের
পৃষ্ঠাঃ ২২
উপদ্ৰপ ছিল, অথচ তাজউদ্দীন নদীতেই গােসল করতেন ।
তাজউদ্দীন বরাবরই রাজনীতি করতেন। তবে তিনি ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির চেয়ে সমাজসেবাই বেশি করতেন।
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মানবদরদী। তার গ্রামের এক বিধবা মহিলার দু’পায়ে মারাত্মক ঘা ছিল; যা ছোঁয়াচে রােগ। তার কাছে কেউ যেত না। তার পুত্র কাশেমও মায়ের কাছে আসত না। তাজউদ্দীন আহমদ এ মহিলাকে সেবা- শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তােলেন।
প্রাইমারি স্কুলের সহপাঠী দরদরিয়ার নাসের আলী মােড়ল বলেন, আমাদের স্কুলে হেঁটে যাবার পথে ৬টি খাল ছিল। তাজউদ্দীন সকলকে নিয়ে গজারি কাঠ দিয়ে সেগুলােতে সাঁকো তৈরি করেছেন। নায়েব আলী বলেন, নদীতে মাছ ধরাতেও তাজউদ্দীন ছিলেন পটু। সে সময় গ্রামে প্রতিবছর বসন্ত হতাে। তাজউদ্দীন রােগীদের সেবা করতেন। দরদরিয়া গ্রামের আলাউদ্দিন জানান, তাজউদ্দীন তাহের আলী ভিক্ষুককে গ্রামের সমাজে একঘরে অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। তিনি গ্রামের মহিম নাপিতকে শ্রদ্ধা করতেন। কারণ মহিম আতুড়ঘরে তার চুল কেটেছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ স্কুল-কলেজে পড়ার সাথে সাথে মানুষের পাঠশালা থেকে বাস্তব শিক্ষা গ্রহণ করেন- ভবিষ্যতে বড় কিছু করার জন্য। বনে আবৃত দরদরিয়া গ্রামে তার জন্ম। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তিনি মানুষের পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য চেষ্টা করেছেন। গরিব-অসহায় মানুষের প্রতি নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবর সলিমুল্লাহ এতিমখানায় ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন।
২৫-৮-১৯৪৭ তারিখের ডায়েরিতে লেখা আছে : “আপার ক্লাসের যাত্রীদের প্রবেশপথের কাছেই একজন বৃদ্ধা মাটিতে পড়ে ছিলেন। তার গায়ে কাপড় নেই। বৃদ্ধাটি মৃত্যুমুখে। মিটফোর্ড হাসপাতালে ফোন করে কোনাে সাড়া পাইনি।” তার চিকিৎসার জন্য সারা দিন তাজউদ্দীন ছােটাছুটি করেছেন। “কিন্তু আমলাতন্ত্রের কারণে সকাল ১০টা হতে ৫টা পর্যন্ত জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করল।”
এলাকায় মহামারী হলে রােগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। অনেককে চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠিয়েছেন। গ্রামের বয়ােজ্যেষ্ঠরা তাকে স্যার বা সাহেব বললে রাগ করতেন। তিনি তুই বা তুমি সম্বােধন আশা করতেন। গ্রামে তিনি পাটচাষী ও কৃষকদের নিয়ে চিন্তা করতেন- পাটচাষীরা কম দাম পাচ্ছেন ।
২৫-৩-১৯৫০ তারিখে লেখা ছিল : “মফিজউদ্দিন দফাদারের ছেলে
পৃষ্ঠাঃ ২৩
আজিজকে নিয়ে হাসান আসেন। আবদুল আজিজ বুলেটে আহত। যুক্তফ্রন্ট অফিস থেকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টেলিফোন করি এবং এম্বুলেন্সের সাহায্যে আজিজকে হাসপাতালে পাঠাই। আমি ১০ আউন্স রক্ত দেই।” আজিজের মৃত্যু হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য কি তার ভালোবাসা
২৫-৮-১৯৫১ তারিখে লেখা ছিল : “বাড়ি থেকে টুকু আসে । সে জানাল আফসু গত ৭/৮ দিন ধরে জ্বরে ভুগছে। এ খবর শুনে আমি খুব বিচিলিত হয়ে পড়লাম। আমি নিজে ওষুধের দোকানে গিয়ে ওষুধ কিনে সেগুলাে দিলাম।”
কাপাসিয়া থানায় গজারি বন। রাজেন্দ্রপুর বন বিভাগের অধীনে কাপাসিয়া বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এলাকার লােকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে নির্যাতন করত। তাজউদ্দীন আহমদ বন বিভাগের দুনীতিবাজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে অভিযােগ করতেন। অনেক সময় এলাকার লােকজন নির্যাতন থেকে মুক্তি পেত। এ কারণে কাপাসিয়া অঞ্চলে ছাত্রাবস্থায় খ্যাতি অর্জন করেন। বন কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে মামলা করে- তার পক্ষে উকিল ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, আতাউর রহমান খান। অন্যান্য আসামীসহ তাজউদ্দীন আহমদ মামলায় জামিনে ছিলেন। কিন্তু ১৯৫০ সালের ৭ জুলাই মহকুমা হাকিম তাদের জামিন বাতিল করে কারাগারে প্রেরণ করেন।
৭ জুলাই, ১৯৫০ শুক্রবার ডায়েরিতে লেখা আছে : “সকাল সাড়ে ১০ টায় এসডিও (এন) এর এজলাসে উপস্থিত হলাম। তিনি আমাদের জামিন বাতিল করে রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দিলেন।… দুপুর ১টার দিকে আমাদেরকে অন্যান্য সকলের সাথে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল হাজতে নিয়ে যায়।
শ্রীপুরের রেঞ্জার জামিন নাকচের আবেদন করেছেন…
ডা. করিম এবং তােয়াহা সাহেব বেলা ২টায় দুপুরের খাবার পাঠিয়েছেন।
৭-৭-১৯৫০ তারিখ দুপুর ১টা থেকে ১১-৭-১৯৫০ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল অভ্যন্তরে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।”২
এমনিভাবে তাজউদ্দীন আহমদ মানুষের পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। এ সকল বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার ভবিষ্যত জীবনের পাথেয় ছিল। মানুষের পাঠশালার শিক্ষা তাকে মহান করেছিল- হিংসা, বিদ্বেষ, দুনীতি, মিথ্যা ভাষণ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। অন্য নেতাদের থেকে তিনি ছিলেন আলাদা। তিনি ছিলেন তুলনাহীন। সাধারণত প্রাচ্যে তার মতাে নেতা বিরল- পাশ্চাত্য দেশে তার মতাে নেতা পাওয়া যায়।
লাহাের প্রস্তাব
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহােরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ সম্মেলনে বাংলার
পৃষ্ঠাঃ ২৪
প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক আসাম-বাংলা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। লাহাের প্রস্তাবের অংশবিশেষ নিম্নে উদ্ধৃত হলাে :
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অত্র অধিবেশনে এই মর্মে অত্যন্ত সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করছে যে, নিমােক্ত মৌলিক আদর্শসমূহকে ভিত্তি হিসেবে না ধরে অপর যে কোন নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর ও মুসলমানের জন্য গ্রহণযাগ্য বলে বিবেচিত হবে না। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা এদেশের কয়েক কোটি মুসলমান দাবি করছে যে, যেসব এলাকা একান্তভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ যেমন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল; প্রয়ােজন অনুয়ায়ী সীমানার রদবদল করে এ সকল এলাকাকে ভৌগােলিক দিক দিয়ে এককভাবে পুনর্গঠিত করা হােক। যাতে তার স্বাধীন ও স্বতন্ত্র স্টেটসের রূপ পরিগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট ইউনিটদ্বয় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা লাভ করতে পারে।”
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ লাহাের সম্মেলনে তার ভাষণে দ্বি-জাতি তত্ত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন :
“We maintain and hold that Muslims and Hindus are two major nations by any definition or test of a nation. We are a nation of hundred million, and what is more, we are a nation with our own distinctive culture and civilizalian, language and literature, art and architecture, names and nomenclature, sense of value and proportion, legal laws and moral codes, customs and calendar, history and traditions, aptitudes and ambitions, in short, we have our own distinctive outlook on life. By all canons of internatianal law we are a nation.”৩
জিন্নাহ বলেছেন, আমরা মনে করি যে কোন সংজ্ঞায় আমরা একটি জাতি। আমরা এক শ’ মিলিয়ন নিয়ে একটি জাতি। আমাদের স্বভাব, কৃষ্টি, ভাষা, সাহিত্য, নাম, পদবি, আইন, আচার, অনুষ্ঠান, ইতিহাস এবং ঐতিহ্য পৃথক । আন্তর্জাতিক যে কোন আইন অনুসারে আমরা একটি জাতি।
লাহাের প্রস্তাবের এবং জিন্নাহর উপরােক্ত প্রস্তাবের উত্তরে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন :
“If we accept the argument of Sree Jinnah the muslims of Bengal and we muslim of Panjab would become two distinct and separate nations”৪
আমরা যদি শ্ৰী জিন্নাহর যুক্তি গ্রহণ করি, তাহলে বাংলার মুসলমান এবং
পৃষ্ঠাঃ ২৫
পাঞ্জাবের মুসলমান পৃথক জাতি। জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ Two-nation theory দ্বি-জাতি তত্ত্ব রাজনীত ভারতের মুসলমানদের সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করে। হিন্দু পত্রিকাগুলো লাহাের প্রস্তাবকে পাকিস্তান প্রস্তাব আখ্যা দিয়ে কঠোর সমালোচনা করে। মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালে লাহার প্রস্তাবকে পাকিস্তান দাবি হিসেবে চিহ্নিত করে।
তাজউদ্দীন আহমদ স্কুল জীবনে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪০ সালে ঢাকায় এসে লাহাের প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি অবহিত হয়েছেন। ১৯৪০ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে হলওয়েল মুভমেন্ট তৎকালীন ছাত্রসমাজকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। তাজউদ্দীন আহমদের মতো রাজনৈতিক সচেতন স্কুলছাত্র তখন সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবন কথা শুনেছেন। সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪১ সালে কলকাতা থেকে পালিয়ে আফগানিস্তান, জার্মানি হয়ে জাপান গমনের রােমাঞ্চকর কাহিনী তরুণ সমাজকে আলােড়িত করেছিল।
তাজউদ্দীন সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। এ সময় ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। হােলি উৎসবকে কেন্দ্র করে শহর ও গ্রামে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। অশিক্ষিত মুসলমানদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তাদের জামিনের জন্য ঢাকায় Legal Defence কমিটি গঠন করা হয়। মামলা পরিচালনার ভার নেন রেজাই করিম, মুসলিম লীগ নেতা আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, ওয়াছির উদ্দিন, এ টি মােজহারুল হক প্রমুখ মুসলমান উকিলগণ। মােক্তারদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, হেমায়েত উদ্দিন, মােশতাক উদ্দিন। মামলা পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়ােজন। কাদের সরদার, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, কামরুদ্দীন আহমদকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গার অভিশাপ দেখেছেন। তাই সারাজীবন তিনি অসাম্প্রদায়িক ও দাঙ্গাবিরােধী ছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক গুরু কামরুদ্দিন আহমেদ চল্লিশের দশকের রাজনীতি সম্পর্কে লিখেছেন :
১৯৪২ সালের ইতিহাস বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের একটি নতুন রাজনৈতিক সচেতনতা ও সংগ্রামের ইতিহাস। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠিত হবার পরই মুসলিম ছাত্র সমাজ সরকারবিরােধী শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিল।
১৯৩৭ সাল ৩ এপ্রিল এ কে ফজলুল হক তার প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ নিয়ে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি নিজেও তার কৃষক পার্টি পরিত্যাগ করে মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৪১ সালে তিনি ওয়ার কাউন্সিলের সদস্য হলে
পৃষ্ঠাঃ ২৬
জিন্নাহর সঙ্গে মতবিরােধ হয় । তার মন্ত্রিসভা থেকে মুসলিম লীগ মন্ত্রীরা ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পদত্যাগ করে। ফজলুল হক শরৎ বসুর ফরওয়ার্ড ব্লক ও শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর হিন্দু মহাসভার সাথে প্রগতিশীল দল গঠন করে মন্ত্রিত্ব টিকিয়ে রাখেন। মুসলিম লীগের ৪০ জন বাদে সকল এমএলএ ফজলুল হকের সঙ্গে থেকে যায়। ১৯৪১ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি তার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করলেন। ফজলুল হকের বিজয়ে ঈর্ষান্বিত হয়ে জিন্নাহ বলেন :
I make a Christmas gift of Fazlul Huq to the Viceroy of India and a new year day presents of Nawab of Dacca to the governor of Bengal.
ভারতের ভাইসয়রকে আমি ফজলুল হককে ক্রিসমাস উপহার দিলাম এবং বাংলার গভর্নরকে ঢাকার নবাবকে নববর্ষের উপহার দিলাম ।
ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় আগমন করবেন। তাকে অর্ভ্যথনা জানানাের জন্য বেচারাম দেউড়ির খান সাহেব আবুল হাসনাত, সাতরওজার খান বাহাদুর ফজলুল করিম, শেফাউল মুলক হেকিম হাবিবুর রহমান এবং ঢাকার বাইশ পঞ্চায়েত ঢাকার রেলস্টেশনে সমবেত হন। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ নজীর ও বদরুদ্দীন সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ছাত্ররা নবাবকে কাল পতাকা উড়িয়ে বিরূপ অভ্যর্থনা জানান। অমনি অভ্যর্থনা কমিটির গুণ্ডাবাহিনী ছাত্রদের ওপর লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শহীদ নজীরের মাথা ফেটে যায়। কিন্তু তিনি নিশান ছাড়লেন না। অন্য ছাত্ররা পালিয়ে যায়। নবাব হাবিবুল্লাহ ছাত্রদের লক্ষ্য করে বলেন, তার বাবার তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ে কতকগুলাে দেহাতি ও ক্ষেতুয়া জোট করেছিল তাকে অপসারণ করার জন্য। ক্ষেতুয়া ও দেহাতি শব্দ দুটো গালি হিসেবে ব্যবহার করায় গ্রামের ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমউদ্দিন, আবুল হাশিম ছাত্রদের নিয়ে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা শুরু করেন। ছাত্রসমাজ পাকিস্তান দাবি করে। তারা দ্বি-জাতি তত্ত্বের অনুসারী হলাে। এ সময় নবম শ্রেণীর ছাত্র তাজউদ্দীন তৎকালীন ছাত্র রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন এবং কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল ছাত্র কংগ্রেস। কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্টের নাম ছিল ছাত্র ফেডারেশন। মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন পরিবর্তিত হয়ে ১৯৪২ সালে ছাত্রলীগ পুনর্গঠন করা হয়। মুসলিম বাংলার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যশােরের শামসুর রহমান ও ঢাকার মােহাম্মদ ওয়াসেক।
পৃষ্ঠাঃ ২৭
১৯৪২ সালে উপমহাদেশের ইতিহাসে কয়েকটি ঘটনা উলেখযোগ্য। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৪২ সালে জাপান রেঙ্গুন দখল করে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ-হিন্দ বাহিনী আসাম সীমান্ত দখল করেছে। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট মহাত্মা গান্ধী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দেন- ইংরেজ সরকার দমননীতি শুরু করে। হাজার হাজার কংগ্রেস নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়, অনেকে গুলিতে নিহত হয়। মেদিনীপুরের অবস্থা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন মাতঙ্গিনী হাজরা। সরকার মহাত্মা গান্ধী ও ককংগ্রেস নেতবৃন্দকে গ্রেফতার করে। মুসলিম লীগ ইংরেজ তােষণনীতি অনুসরণ করে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক কংগ্রেসের ভারত ছাড় আন্দোলন ও নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ইংরেজ সরকারের নির্দেশ সত্ত্বেও তিনি ভারত ছাড় আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেননি।
বাংলার মুসলমান রাজনীতি তখন ফজলুল হকের বিরুদ্ধে। শ্যাম-হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। অথচ হিন্দু সমাজের নেতা শ্যামা প্রসাদ মুসলমানের সাথে যৌথ মন্ত্রিসভা গঠন করে বাংলার মুসলমানদের জন্য অনেক কল্যাণমূলক কাজ করেন।
ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ কেবিনেট মন্ত্রী স্যার স্টাফোর্ডক্রিপস ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে ভারতে আগমন করেন। ক্রিপস কংগ্রেস ওমুসলিম লীগের সাথে আলােচনা করেন এবং আশ্বাস দেন যে যুদ্ধের পর ভারতকে ডােমিনিয়নের মর্যাদা দেয়া হবে। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দল ক্রিপসেরপ্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৪২ সালে বাংলায় কয়েকটি উপনির্বাচন হয়। ঢাকার উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী ছিলেন রেজায়ে করিম এবং ফজলুল হকের প্রার্থী ছিলেন নবাব পরিবারের অশিক্ষিত কালু মিয়া। ঢাকায় কালু মিয়ার পক্ষে বক্তৃতা দিতে এসে বলেন, ‘দেশের মাঝি আমিই আছি, আমার প্রয়ােজন মাল্লার । রেজায়ে করিমের ন্যায় একজন বুদ্ধিমান ও নামকরা উকিলকে আমি মাল্লা হিসেবে ব্যবহার করতে পারব না। মাল্লা হতে পারে কালু মিয়া- আমি মাঝি হিসেবে দেশের হাল ধরি। এই যদি আপনারা চান তবে কালু মিয়াকে ভােট দেন, আর যদি মনে করেন আপনাদের মাঝি বদলানাের প্রয়ােজন তবে রেজায়ে করিমকে ভােট দেন। আমি হাতের বৈঠা ছেড়ে আবার ওকালতি করব।’ এ নির্বাচনে কালু মিয়ার জয় হলাে,শেরে বাংলার ভক্ত রেজায়ে করিম একজন মূর্খ মানুষের নিকট পরাজিত হলেন।
১৯৪২ সালে বার্মা পতনের পর ইংরেজ সরকার পােড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে চাল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর
পৃষ্ঠাঃ ২৮
মাসে হঠাৎ চালের দাম মণপ্রতি ৪ টাকা থেকে ৮ টাকায় বৃদ্ধি পায়। দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শােনা যায়।
১৯৪১ সাল থেকে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছিল। গ্রামে গ্রামে শান্তি ফিরে এলেও ১৯৪২ সালের গুপ্তহত্যা সংগঠিত হয়। ছাত্রনেতা শহীদ নজীর শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু ছাত্রনেতাদের নিকট গমন করেন। তখন অতর্কিতে এক হিন্দু ছাত্র তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়। নজীর ১৯৪৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালেমৃত্যুবরণ করেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায় ।
১৯৪২-৪৩ সালে ভারত ছাড় আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। মেদিনীপুর জেলার তমলুকে মাতঙ্গিনী হাজরার নেতৃত্বে স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়। পুলিশের গুলিতে মাতঙ্গিনী মৃত্যুবরণ করেন। শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীকে মেদিনীপুর পরিদর্শন করতে দেয়া হলাে না। বঙ্গীয় আইন সভায় মেদিনীপুরে ইংরেজদের দমননীতির বিরুদ্ধে কঠোর সমালােচনা চলে। প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক মেদিনীপুরের ঘটনা তদন্তের আশ্বাস দেন। এজন্য গভর্নর হারবার্ট ফজলুল হকের নিকট কৈফিয়ত তলব করেন। উত্তরে ফজলুল হক বললেন, “I owe no explanation to you”, আমি আপনার নিকট কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। ব্রিটিশ সরকারকে তিনি বাঘের ন্যায় হুঙ্কার দিয়ে হুঁশিয়ার করেন এবং বলেন, বন্ধ করাে তােমাদের নির্যাতন, তুলে নাও পােড়ামাটি নীতি। ব্রিটিশ সরকার এ কে ফজলুল হককে বরখাস্ত করতে বদ্ধপরিকর। তাই তিনি ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এভাবে শেষ হয় এ কে ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা।
এ কে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা পতনের সংবাদে দিল্লীতে জিন্নাহ উল্লসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আর ফজলুল হকের নাম ভূ-ভারতে কেউ শুনবে না।’ মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের কারণে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার পতন হয়েছে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩ সালের ২৭ মার্চ পর্যন্ত তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এ সময় ভূমি সংস্কার, মহাজনী আইন ও প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের ফলে বাংলার চিরবঞ্চিত কৃষক সমাজের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল ।
১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করে। মন্ত্রিসভায় ১৩ জন মন্ত্রী, ১৩ জন পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ও ৪ জন হুইপ নিযুক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী হলেন খাজা নাজিমউদ্দিন। মন্ত্রিসভার শক্তিশালী মন্ত্রী ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী।
ছাত্র রাজনীতি
কাপাসিয়া মাইনর স্কুলে প্রাথমিক ছাত্রাবস্থাতেই তার হাতেখড়ি হয় রাজনীতিতে
পৃষ্ঠাঃ ২৯
নেহায়েত অলক্ষ্যে- সেটা ১৯৩৭ সালের কথা। তখন তিনি সবেমাত্র চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছেন। সে সময় তিনজন শিক্ষক রাজবন্দীকে কাপাসিয়া থানার কর্তৃত্বে রাখা হয়। তদনুসারে তিন রাজবন্দীকে রাখা হয়েছিল কাপাসিয়া থানার কতৃত্বে।
১৩ বছরের ফুটফুটে ও চটপটে তাজউদ্দীনকে দেখেই তাদের একজন কাছে ডেকে নিয়ে ঝটপট কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। তাজউদ্দীনের মতাে একটি গ্রাম্য ছেলের বিদ্যাবুদ্ধিতে তিনি সত্যিই অবাক হলেন। তারপর তারা তাকে ইতিহা, ভূগােল, যুদ্ধ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মনীষীদের জীবনী সম্পর্কিত প্রায় তিন কুড়ি বই পড়ালেন। তারপর শুরু হয় পরীক্ষা। তাজউদ্দীন সব বিষয়ে পাস করলেন। তবে রাজনীতিতে পেতেন বেশি নম্বর। তারা তাকে বললেন ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে। এই রাজবন্দীদের সংস্পর্শে এসেই তাজউদ্দীনের হাতেখড়ি হয় রাজনীতিতে। তারা তাজউদ্দীনকে আরও ভাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। অতঃপর তিনি কালিগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। কয়েক মাস পর তারা অন্তরীণ অবস্থার অবসান শেষে কোথায় চলে গেলেন তা তাজউদ্দীন আজও জানেন না। যাবার সময় তাজউদ্দীনের সাথে তাদের শেষ সাক্ষাতটুকুও হয়নি। কারণ তাজউদ্দীন তখন ভিন গায়ে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন। তবে তারা যাবার সময় তাজউদ্দীনের ঘরে রেখে গিয়েছিলেন একজোড়া গােলাপ। সে গােলাপ অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে। কিন্তু তাজউদ্দীন তার সুবাস এখনও পাচ্ছেন।
মুসলিম লীগ রাজনীতির সঙ্গে নিজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়েছিলেন ১৯৪৩ সালে আবুল হাশিম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর। এর আগে তিনি মুসলিম লীগকে মনে করতেন ব্রিটিশের পদলেহী খাজা-গজাদের একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানরূপে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্রিটিশবিরােধী কথা শুনতে পাই জনাব আবুল হাশিমের মুখে। তাই তিনি আকৃষ্ট হলেন মুসলিম লীগের প্রতি। তিনি আরও বলেন, “প্রথমে নারায়ণগঞ্জ এবং পরে ঢাকার পাকিস্তান ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় আবুল হাশিম মুসলিম লীগকে ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে আনার আহ্বান জানালেন। কেবল তখন মুসলিম লীগ রাজনীতির একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছিলাম। তাই জনাব শামসুল হকের নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে ইসলামপুরের একটি ছােট ঘরের ছাদে চালু করেছিলাম মুসলিম লীগ সংগঠনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা। আমার একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে এনে সাধারণ মানুষের
পৃষ্ঠাঃ ৩০
প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করা।” ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর পাকিস্তান হলাে, মুসলিম লীগ আবার খাজা-গজাদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। আর তাজউদ্দীন তার সাথে ছিন্ন করলেন সকল প্রকার সম্পর্ক।
“মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তাজউদ্দীন রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এ কথা ভাবলে মহা ভুল করা হবে। বস্তুত দেশ বিভাগের সময় থেকে ৪/৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে যত আন্দোলন হয়েছে তার প্রতিটির সাথে তাজউদ্দীন ছিলেন ওতপ্রােতভাবে জড়িত। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি যখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) গঠিত হয় তিনি ছিলেন তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে যে ক’জন নেতা জিন্নাহ সাহেবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাদের একজন।”
“শেখ মুজিবের সাথে তার প্রথম পরিচয় ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায়। প্রথম সাক্ষাতেই তাদের মধ্যে একটা ভাবের আদান-প্রদান হয়েছিল। অদ্যাবধি তাদের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক চলে আসছে।”
“ শেখ মুজিবের নেতৃত্ব সম্পর্কে তাজউদ্দীনের একটা বিরাট আস্থার ভাব প্রকাশ হয়ে গেল সেদিন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, শেখ সাহেবকে আগে ছাত্রাবস্থা থেকে জানি, চিনি। তাকে কোনদিন কোন প্রকারের পরাজয় বরণ করতে দেখিনি। বিশ্বাস করুন, তিনি এবারও জিতবেন।”৬
খাজা নাজিম-সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা
খাজা নাজিমউদ্দিন – প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী – খাদ্য, সিভিল, সাপ্লাই
তুলসীচন্দ্র গােস্বামী – অর্থ
তমিজউদ্দিন খান – শিক্ষা
বরদা প্রসন্ন পাইন – যাতায়াত, পূর্ত
সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেন – কৃষি ও পল্লী উন্নয়ন
তারাকান্ত মুখার্জী – রাজস্ব, ত্রাণ
নবাব মােশাররফ হােসেন – বিচার
খাজা শাহাবুদ্দিন – বাণিজ্য, শুল্ক ও শিল্প
পৃষ্ঠাঃ ৩১
প্রেম হরি বর্মণ – বন ও আবগারি
খান বাহাদুর জালালউদ্দিন আহমেদ – ব্যবস্থাপনা ও স্থানীয় সরকার
পুলিন বিহারী মল্লিক – তথ্য
যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল – সমবায় ও ঋণ সালিশী বোর্ড
ঢাকার মুসলিম লীগ নেতা খাজা শাহাবুদ্দিন মন্ত্রী নিযুক্ত হলে আহসান মঞ্জিলের রাজনীতিতে পতনের সঙ্কেত বেজে ওঠে। ফজলুর রহমান চীপ হুই। তিনি নবাব পরিবারের জামাতা। সৈয়দ আজিজুল্লাহর কন্যাকে বিয়ে করে তিনি এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি আত্মীয়তার সিঁড়ি বেয়ে মধ্যবিত্ত শেণীভুক্ত হলেন। তার পুত্র সালমান রহমান। ঢাকার নবাব পরিবার বাংলার মুসলিম রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করত, প্রত্যেক জেলায় তাদের এজেন্ট ছিল। যেমন বরিশালে খান বাহাদুর হেমায়েতউদ্দিন, আজিজ উদ্দিন, ময়মনসিংহে নুরুল আমীন, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, কুমিল্লায় আবিদুর রেজা চৌধুরী, ফরিদউদ্দিন, চচট্টগ্রামে নুর আহমদ, রফিউদ্দিন সিদ্দিকী, ফরিদপুরে ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া) নােয়াখালীতে রেজাউল হায়দার চৌধুরী। এমনিভাবে সারা বাংলায় তাদের এজেন্ট ছিল। আহসান মঞ্জিল তাদের মাধ্যমে মুসলিম লীগ রাজনীতি পরিচালনা করত। এ কে ফজলুল হক ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকার আহসান মঞ্জিলের সাথে সমন্বয় করে সরকার পরিচালনা করেছেন।
ঢাকার মুসলিম লীগ ফজলুর রহমানকে বাইরে রেখে মুসলিম লীগের সেক্রেটারি পদে নির্বাচিত করার পক্ষে ছিল। কিন্তু ফজলুর রহমানের সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সাথে সংঘাতে যাওয়ার যােগ্যতা ছিল না। তিনি এ পদ থেকে দূরে ছিলেন। তিনি সবসময় আহসান মঞ্জিলের ইঙ্গিতে রাজনীতি করতেন।
মুসলিম লীগ সরকারের বেসামরিক সরবরাহ মন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধকল্পে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তার প্রথম কাজ হলাে কলকাতা শহরে রেশনের ব্যবস্থা করা। দুর্ভিক্ষের সুযােগ নিয়ে কলকাতায় ঘুষ, দুর্নীতি চলছে। লক্ষ লক্ষ লােক দুর্ভিক্ষে মারা যাচ্ছে। এ কে ফজলুল হক দুর্ভিক্ষের জন্য খাজা নাজিমউদ্দিন-সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভাকে দায়ী করেন। তার নবযুগ পত্রিকা আবুল মনসুরের সম্পাদনায় মুসলিম লীগ সরকারকে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধে ব্যর্থতার জন্য সমালােচনা করছে। আবুল মনসুর মুসলিম লীগকে আক্রমণ করে ‘ফুড কনফারেন্স’ লেখেন। এ গ্রন্থে তিনি খাজা নাজিমউদ্দিনকে মহিষে বাংলা এবং সােহরাওয়ার্দীকে কুত্তায়ে বাংলায় ভূষিত
পৃষ্ঠাঃ ৩২
করেন। অন্যদিকে আজাদ পত্রিকা সরকারের পক্ষে লিখেছে। ১৯৪৩, বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তরে ৫০ লক্ষ লােক নিহত হয়। দুর্ভিক্ষের করুণ চিত্র এঁকে শিল্পী জয়নুল আবেদীন অমর হয়ে আছেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতাসহ বাংলার শহরে-গ্রামে মৃত্যুর মহােৎসব হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধে এগিয়ে আসেন। তাদের Denial Policy পােড়ামাটি নীতির কারণে বাংলা মন্বন্তর দেখা দেয়। পঞ্চাশের মন্বন্তরে-মানুষের অপমৃত্যু হয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি দেখেছেন কিভাবে মানুষ কুকুর-শিয়ালের মতাে মরে পথে-ঘাটে পড়ে আছে। দুর্ভিক্ষের হাহাকার তার অন্তরকে দারুণভাবে আঘাত হানে। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে তিনি গ্রামে ধর্মগােলা প্রতিষ্ঠা করেন। মৌসুমে ধান-চাল গুদামজাত করে আপকালে তা বণ্টন করা হতাে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ তাকে বাংলার রাজনীতি অনেক প্রবলভাবে আকর্ষণ করে মানুষ কেন মনুষ্য সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে না খেয়ে মৃত্যুবরণ করে- এর কি কোন প্রতিকার নেই। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশ স্বাধীন হলে, দেশ শাসনের অধিকার পেলে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করা সম্ভব হবে। ১৯৪৪ সালে চালের মণ ১০ টাকায় ওঠে। কামরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা শাহাবুদ্দিনের নিকট চাদার জন্য গেলে তিনি দিলেন দশ টাকা। মুসলিম লীগের সম্পাদক সৈয়দ আব্দুস সালিক দিলেন পাঁচ টাকা। সুতরাং শামসুল হককে একদল ছেলে নিয়ে কলকাতায় পাঠানাে হয়- কলকাতায় হাসান ইস্পাহানী দিলেন এক শ’ টাকা। পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী খিজির হায়াৎ খাঁ তেওয়ানা দেন এক হাজার টাকা। দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের প্রতি এ ছিল নবাব, খাজা ইস্পাহানীদের মনােবৃত্তি। মানবতার প্রতি এ চরম অবহেলা দেখে যুবনেতা কর্মীরা হতাশ হলাে।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক পদে আবুল হাশিম ১৯৪৩
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৩৮ সাল হতে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৪৩ সালে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করার পর গঠনতন্ত্র অনুসারে পার্টির সম্পাদক পদ ত্যাগ করতে হলাে। নতুন সম্পাদক নির্বাচিত হবে। মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আকরম খাঁ ও খাজা নাজিম উদ্দিন, সাতক্ষীরার আবুল কাশেমকে সমর্থন দেয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আজাদ বাংলার ছাত্র ও যুবসমাজ বর্ধমানের আবুল হাশিমকে সমর্থন করে। ১৯৪৩ সালের ৭ নভেম্বর কলকাতার মুসলিম লীগ সম্মেলনে আবুল হাশিম
পৃষ্ঠাঃ ৩৩
বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পরদিন আবুল হাশিম তার ভাষণে বলেন, মুসলিম লীগ তিন স্থানে বন্ধক রয়েছে। স্যার সলিমুল্লাহর সময় থেকে নেতৃত্ব বন্ধক আছে আহসান মঞ্জিলে। প্রচার বন্ধক রয়েছে দৈনিক আজাদের মালিকের কাছে। আর আর্থিক দিকে বন্ধক রয়েছে ইস্পাহানির নিকট। তিনি বলেন, এ বন্ধকসমূহ থেকে মুসলিম লীগকে মুক্ত করতে এবং বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তকে তার যােগ্য স্থানে বসাতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। এ উক্তির মধ্য দিয়ে তিনি ঘােষণা করেন তার গণমুখী রাজনৈতিক অভিপ্রায় এবং দক্ষিণপন্থী লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন-মওলানা আকরম খা চক্রের বিপরীতে তার অবস্থান।
আবুল হাশিম ১৯০০ সালে পশ্চিম বাংলার বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল কাশেম (১৮৭২-১৯৩৬) এবং মাতার নাম মােকাররমা খাতুন। আবুল হাশিম বিএ, বিএল পাস করে বর্ধমানে ওকালতি করতেন। ১৯৩৭ সালে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হয়ে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৪৩- ১৯৪৭ পর্যন্ত তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৬ সালে তিনি পুনরায় বর্ধমান থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তিনি খেলাফতে রব্বানী পার্টি গঠন করেন।
বিহারের গােরখপুর জেলার অধিবাসী ইসলামী চিন্তাবিদ মওলানা আজাদ ছােবহানী আবুল হাশিমের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরু ছিলেন। তার দর্শন ছিল রব্বানী- সৃষ্টিকর্তা-পালনবাদ। মওলানা ভাসানী আজাদ ছােবহানীর অনুসারী ছিলেন। মওলানা আজাদ ছােবহানী ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে আবুল হাশিমের সাথে বর্ধমানে দেখা করেন এবং তাকে মুসলিম লীগের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণের পরামর্শ দেন। তাকে বাংলার মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠার উপদেশ দেন।
মুসলিম লীগের অফিস ছিল কলকাতার ৩ ওয়েলেসলী ফাস্ট লেনে। আবুল হাশিম লীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বেগবান করার জন্য নিম্নলিখিত নীতিমালার ওপর জোর দেন:
১. ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবকে সামনে রেখে যৌক্তিকতা প্রচার, লাহাের প্রস্তাব যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না তা প্রচার করা।
২. মুসলিম লীগকে একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়া।
৩. মুসলিম লীগকে তৃণমূল পর্যায়ে নেয়ার জন্য যুব শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করা।
পৃষ্ঠাঃ ৩৪
৪. গণমুখী নীতিতে বিশ্বাসী কর্মী ও নেতা তৈরি করা।
৫. সর্বক্ষণিক লীগ কর্মীদের মাসিক ভাতা দেওয়া।
৬. লীগ মঞ্চ হতে ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সংস্কৃতি প্রচার।
তিনি প্রত্যেক জেলায় পার্টি হাউস, অফিস প্রতিষ্ঠা, সদস্য সংগ্রহের নির্দেশনা, সদস্য রসিদ ছাপিয়ে বিলি করেন। মুসলিম লীগ তরুণ কর্মীদের মধ্যে ছিলেন :
শামসুল হক – ময়মনসিংহ
কামরুদ্দীন আহমদ – ঢাকা
শেখ মুজিবুর রহমান – ফরিদপুর
ফজলুল কাদের চৌধুরী – চট্টগ্রাম
খন্দকার মােশতাক আহমেদ – কুমিল্লা
তাজউদ্দীন আহমদ – ঢাকা
শামসুদ্দিন আহম্মদ – মুন্সীগঞ্জ
মােহাম্মদ তােয়াহা – নােয়াখালী
শেখ আবদুল আজিজ – খুলনা
আবদুর রহমান চৌধুরী – বরিশাল
কাজী গােলাম মাহবুব – বরিশাল
শমসের আলী – বরিশাল
মহিউদ্দিন আহমদ – বরিশাল
কাজী বাহাউদ্দিন আহমদ – বরিশাল
নূরউদ্দিন আহমদ – বরিশাল
মােহাম্মদ সালেহ – বরিশাল
বিএম ইলিয়াস – বগুড়া
এ এইচ এম কামরুজ্জামান – রাজশাহী
আতাউর রহমান – রাজশাহী
নাজমুল করিম – কুমিল্লা
অলি আহাদ – ব্রাহ্মণবাড়িয়া
আবুল হাশিম ও সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বের ফলে বাংলা মুসলিম লীগে প্রগতিশীল ও উদার চিন্তার তরুণের সমাবেশ ঘটে। হােসেন শহীদ সােরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম প্রায় ৫০০ জনসভা করে মুসলিম লীগ গণসংগঠনে উন্নীত করেন। ১৯৪৪
পৃষ্ঠাঃ ৩৫
সালে মুসলিম লীগ শক্তিশালী রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। তাদের দল কমিউনিস্ট পার্টির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ১৯২৭ সালে মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল দু’হাজার। ১৯৩৮ সালে প্রায় ১ লাখ এবং ১৯৪৪ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ। ১৯৪৫ সালে সমগ্র ভারতে ২০ লাখ সদস্যদের মধ্যে বাংলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ লাখে। ১৯৪৪ সালের ২৪ মার্চ আবুল হাশিম মুসলিম লীগের খসড়া ঘােষণাপত্র তৈরি করেন এবং মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়।
তাজউদ্দীন আহমদের জীবন কাহিনী পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে তিনি কতটা আবুল হাশিম ও তার রাজনৈতিক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। আবুল হাশিমের ইসলামী দর্শন বাদ দিলে তিনি তার সম্পূর্ণ সাংগঠনিক কর্মসূচী অনুসরণ করেন। অবশ্য চল্লিশের দশকে তিনি ইসলামী চিন্তা-ভাবনা করতেন।
তাজউদ্দীন আহমদের সমকালীন ছাত্রদের স্মৃতিচারণ
ডা. এম এ করিম
আমার পরম বন্ধু ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে। এতদিন পরে আজ আর দিন-তারিখ মনে নেই। আছে শুধু স্মৃতিটুকু। দিনটি হয়তাে ছিল শনি অথবা রবিবার। ঢাকার মৌলভীবাজারে হাফিজুল্লাহ সকাল দশটার দিকে কামরুদ্দিন সাহেব তাজউদ্দীনকে নিয়ে এলেন একজন ছাত্রকে ইংরেজি পড়াবার জন্য। ছাত্র এলাে- ওর বাবা এলেন, সঙ্গে তার বড় ভাই। উৎসাহিত হয়ে আমিও গেলাম, তাজউদ্দীনের সঙ্গে কথা হলাে। ছাত্রকে পড়াবার জন্য কোনাে একদিন এসে টেস্ট নেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বলল, এখনই টেস্ট হয়ে যাক। ছাত্রকে ইংরেজি বই আনবার আদেশ করা হলে ছাত্র বই নিয়ে এলাে। তাজউদ্দীন ইংরেজি বই হাতে নিয়ে ক্ষণকাল দেরি না করে বইটি খুলে একটি গল্প পড়তে শুরু করল। তার পড়বার ভঙ্গিতে সবাই চমৎকৃত হলাে এবং সেদিন থেকে সেখানে তার পড়াবার স্থান আমার পাশের ঘরেই ঠিক হলো। আমি তখন মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এবং তাজউদ্দীন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। ও বাড়িতে আমি কিছুদিন আগে এসেছিলাম। তাই নিজেকে আমি বিশেষ বুদ্ধিমান বলেই মনে করতাম এবং আমি তাজউদ্দীনকে বেশ আদেশ-উপদেশ দিতাম এবং সেও আমার কথা খুশি মনেই মেনে নিত। সেই থেকে আমাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠল এবং সে বন্ধুত্ব গভীর হতে হতে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ ছিল।
পৃষ্ঠাঃ ৩৬
তাজউদ্দীনের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ার দরদরিয়ায় । নদী থেকে কিছু দূরে আম-কাঠাল বাঁশঝাড় ঘেরা একটি সুন্দর বাড়ি। তার বাবা ছিলেন বেশ সাদাসিধা, স্বল্পভাষী, বুদ্ধিমান, মিতব্যয়ী ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি। তাজউদ্দীনের প্রথম লেখাপড়া আরম্ভ হয় নাগরী মিশনারী স্কুলে। সেখান থেকে তার সর্বপ্রকার গুণের হাতেখড়ি হয়। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাজ নিজে করা, জীবে দয়া, আর্তের সেবা প্রভৃতি গুণের সমন্বয় ঘটে। মিশনারি স্কুল থেকে এসে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ হাই স্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। তার ভেতরে কতকগুলাে সদ্গুণ লক্ষণীয় ছিল। সেগুলাে হচ্ছে পরােপকার, আর্তের সেবা, দুস্থদের সাহায্য করা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সাদাসিধা জীবনযাপন ও মিতব্যয়িতা। তাদের গ্রামের লােকদের উপর যখন অন্যায় হতাে, সে তার প্রতিবাদ করতেন। তাদের এলাকায় একটি ফরেস্ট অফিস ছিল। সেখানকার অফিসাররা খুব দুর্নীতি করত। একবার তাজউদ্দীন তাদের এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মিথ্যা ডাকাতি মামলায় জড়িয়ে তাকে অনেক দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছিল। দেশের কেউ কেউ অসুস্থ হলে তার সেবা করে নিরাময় করতে না পারলে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসতেন ভালাে চিকিৎসার জন্য। দেশে কলেরা, বসন্ত- মহামারী দেখা দিলে সে ঢাকা থেকে স্যানিটারি অফিসারদের নিয়ে গিয়ে টিকা দান ও অক্লান্তভাবে রােগীদের সেবা করতেন। টিকাদান সম্বন্ধে একটি মজার ঘটনা আছে। তখন দেশের লােকদের মধ্যে টিকা ভীতি ছিল। এবং দেশে কবিরাজরা টিকাদানের বিরুদ্ধে ছিল। তাজউদ্দীনকে অনেক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই টিকা দেবার কাজ করতে হতাে। একবার বসন্তের টিকা দিতে গিয়ে তাকে অনেক বিপাকে পড়তে হয়েছিল। তিনি লােকজন নিয়ে যে গ্রামেই টিকা দিতে যান গ্রামবাসীরা পালিয়ে যায় । তাজউদ্দীন এর কারণ অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন যে, কবিরাজরা গ্রামবাসীদের মনে টিকা সম্বন্ধে নানা রকম ভয়ভীতি ঢুকিয়ে তাদের টিকা দিতে বিরত করত। কবিরাজরা রাতে দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে গিয়ে লােকদের বুঝিয়ে বলত যে, তারা নেচে-গেয়ে শীতলা দেবীকে তুষ্ট করছে এবং লাঠি দিয়ে মেরে বসন্ত রােগ তাড়াচ্ছে। কবিরাজদের কথা গ্রামবাসীরা না মানলে তারা সপরিবারে মারা পড়বে। তাজউদ্দীন এ কথা জানতে পেরে একদিন রাতের অন্ধকারে লােকদের নিয়ে রাস্তা পাহারা দিতে আরম্ভ করেন। গভীর রাতে দেখেন কয়েকজন লােক লাঠি হাতে যাচ্ছে এবং বলাবলি করছে : “ব্যাটা খুব নাকাল হয়েছে। এখন আর কেউ টিকা দিতে রাজি হচ্ছে না।” তাজউদ্দীন টর্চ জ্বালিয়ে তাদের পথরােধ করে জিজ্ঞাসা করেন, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?” উত্তরে তারা
পৃষ্ঠাঃ ৩৭
বলে, স্যার দেশে বসন্ত রােগের মহামারী তাই দল বেঁধে যাচ্ছি তাদের সেবা করতে। আমরা লােকদের বুঝাই যে তােমরা সবাই স্যারের কথা মতো টিকা নিও তাহলে আর বসন্ত হবে না।” তাজউদ্দীন বললেন, “আপনারা তো বেশ ভালো কাজই করছেন, কিন্তু আপনারা সবাই টিকা নিয়েছেন তাে?” লোকেরা বলল “আমরা এখনও টিকা নেইনি তবে কাল সকলেই নেব।” তাজউদ্দীন বললেন রাতে টিকা নিলে কোন ক্ষতি নেই, টিকার লােক আমার সঙ্গেই আছে আপনারা টিকা নিয়ে গ্রামবাসীদের দেখান যে, আপনারা টিকা নিয়েছেন, তাহলে সেটা দেখে সবাই টিকা নেবে।” তখন লােকগুলাে টিকা নিতে রাজি হলাে। তাজউদ্দীন তার লােকজনকে বললেন, “এদের সবাইকে টিকা দিন। তবে হাতে নয় কপালে। তাহলে অন্য লোকদের দেখতে সুবিধা হবে।” লােকজন তখন তাজউদ্দীনের কাছে মাপ চেয়ে বলল, “হুজুর আমাদের মাফ করেন। আমরা আজ থেকে সবাই টিকা নেব এবং গ্রামবাসীদের টিকা দিতে উৎসাহিত করব।” এই বলে তারা সবাই হাতে টিকা নিল। পরদিন তাজউদ্দীন কবিরাজের হাতের টিকা গ্রামবাসীদের দেখিয়ে তাদের টিকার ভয় দূর করল।
তাজউদ্দীন ছাত্রাবস্থায়ই অল্প পয়সায় দিন চালাতেন, এবং তার থেকেই উদ্বৃত্ত করে গরিব বিধবা মেয়েদের সাহায্য করতেন। সহায়সম্বলহীন মেয়েদের পিঠা তৈরি করে ব্যবসা করার জন্য অল্প টাকা ধার দিত। তারা সেই টাকায় পিঠা বানিয়ে বিক্রি করে কিছুটা সচ্ছল জীবনে ফিরে আসলে তার টাকা ফেরত দিতেন।৭
ম. ওয়াহিদুজ্জামান
তাজউদ্দীনের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৪১ সালে। সেই বছর আমি ঢাকা মুসলিম বয়েজ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে ভর্তি হই ক্লাস নাইনে। তাজউদ্দীন নাগরী সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন থেকে এসে এই স্কুলেই ক্লাস এইটে ভর্তি হয়। আমরা ডাফরিন মুসলিম হােস্টেলে একই রুমে থাকতাম।
পড়াশােনায় সে ছিল এক্সট্রাঅর্ডিনারিলি ব্রিলিয়ান্ট। তার ছিল প্রখর স্মরণশক্তি। তার যা পড়াশােনা সে তা ক্লাসেই পড়ে আসত। এর বাইরে তাকে আমি ক্লাসের বই নিয়ে খুব বেশি পড়তে দেখিনি। যেমন, সন্ধ্যায় রিডিং রুমে এক টেবিলেই আমরা দুজন পড়তে বসতাম । তাজউদ্দীন বই নিয়ে চার-পাঁচ মিনিট পড়ইে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু রাত দশটায় বেল না বাজা পর্যন্ত আমাদেরকে রিডিং রুমেই থাকত হতাে। আর পরীক্ষার সময় দেখা যেত প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে তাজউদ্দীন।
পৃষ্ঠাঃ ৩৮
অদ্ভুত রকমের মেধা ছিল তার। আমি আমার এই জীবনে এমন মেধাসম্পন্ন জ্ঞানী ছাত্র আর দেখিনি। একবারের বেশি কোন বই পড়তে হয়নি তার। শুধু।একবার চোখ বুলালেই বুঝে ফেলত সব।
স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক তাকে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। মনে আছে, ১৯৪১ সালের মার্চ মাসে আমাদের স্কুল থেকে আমরা আহসানউল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং দেখতে গেলাম (বর্তমান বুয়েট)। ফিরে আসার পর সুপারিনটেনডেন্ট স্যার বললেন, ‘তােমরা আজ যা দেখে এলে সেই বিষয়ে কিছু লিখে আমাকে দেখাও।’ আমরা সবাই ইংরেজিতে লিখলাম। তাজউদ্দীন ইংরেজিতে যা লিখল তা পড়ে স্যার বললেন, ইংরেজিতে এমএ পাস করে কোন শিক্ষকও এমন লিখতে পারবেন কি না ভাবতে হবে। আমরা সবাই তার এই লেখাটা পড়লাম।
আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের সাথে বাংলা, ইংরেজি, অংক, এ সমস্ত নানা বিষয় নিয়ে তাজউদ্দীনের তর্ক হতাে। শিক্ষকতা তার সম্পর্কে বলতেন, অদ্ভুত রকমের মেরিটরিয়াস ছেলে।
হােস্টেলে আমাদের সব কিছু ছিল আর্মির নিয়মের মতাে। নামাজ পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। নামাজ না পড়লে খাবার দেয়া হতাে না। সব কিছুতেই ছিল বেশ কড়াকড়ি। কিন্তু আমাদের প্রধান শিক্ষক এবং হােস্টেল সুপার একমাত্র তাজউদ্দীনকেই অনুমােদন দিতেন দিনে হােক রাতে হােক বাইরে যাবার । আমাদের হােস্টেল সুপার ছিলেন অম্বর আলি সাহেব। অত্যন্ত কড়া মানুষ। তিনি আমাদেরকে ইংরেজী পড়াতেন। তিনি তাজউদ্দীনকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। জ্ঞান-বুদ্ধি আচার-আচরণে তিনি তাজউদ্দীনকে এতটাই পছন্দ করতেন যে মাঝে মাঝে তাকে ইংরেজি সিনেমা দেখার জন্য অনুমতি দিতেন। ভাল ছবি এলে তিনি নিজেই তাজউদ্দীনকে ছবি দেখতে পাঠিয়ে দিতেন। ক্লাস নাইন থেকে তাজউদ্দীন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪২-৪৩ এর দিকে কলতা বাজারে মুসলিম লীগের অফিস ছিল। সে সেই অফিসে যেত । আমার আজও ভাবতে অবাক লাগে যে যখন মাত্র ক্লাস নাইনের ছাত্র, তখনই সে আমাদেরকে বলত, ‘জিন্নাহ সাহেব পাকিস্তানের কথা বলছেন, কিন্তু এই পাকিস্তান কোনদিনই ভায়াবল হবে না। কিছুতেই টিকবে না এই পাকিস্তান। তাজউদ্দীনের আর একটি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল, সে প্রায়ই জজ কোর্টে যেত। সেখানে বসে দুই পক্ষের আরগুমেন্ট শুনত। এটা ১৯৪২ সালের কথা।
জজ সাহেব যেদিন ডেপােজিমন পড়ে শােনাতেন, সেই দিন ফিরে এসে কখনও কখনও বিষয়টি আমাকে বলে বিশেষ কোন শব্দ বলত যে, জজ সাহেব
পৃষ্ঠাঃ ৩৯
যদি এই শব্দটা না ব্যাবহার করে ওই শব্দটা ব্যবহার করতেন তবে ভাল হতো। আমি তার এই কোর্টে যাওয়া-আসা দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যেতাম৷ একবার তাকে বললাম, ‘যা তুই ল ইয়ার হয়ে যা।’ সে বলেছিল, ‘হ্যা, আমি ল ইয়ারই হব।’
আগেই বলেছি, তাজউদ্দীনের এই বাইরে যাওয়া-আসায় স্কুল কোন সময়ই বাধা দেয়নি। আমরা যারা হােস্টেলে ছিলাম তাদের অনেকেরই আত্মীয়স্বজন হােস্টেলে আসতে দেখা করতে। তার মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ, এমএ-র ছাত্র । এই সমস্ত ছাত্রের সাথে এই স্কুল ছাত্র তাজউদ্দীন কথা বলত। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলােচনা করত। আমি কিন্তু কাউকেই তার যুক্তির কাছে পেরে উঠতে দেখিনি।
আমাদের স্কুল জীবনের এই সময়টাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এই সময়।তাজউদ্দীন সিভিল ডিফেন্সের ট্রেনিং নেয়। আমার আর এক বন্ধু বজলুল হাসান, সেও ট্রেনিং নিয়েছিল। পােশাক পরে সারারাত ডিউটি দিতে হতাে। সকালে ওরা ফিরত। তাজউদ্দীনদের সম্ভবত হােম গার্ড বলা হতাে। ওরা পারিশ্রমিক পেত। এ ছাড়াও তাজউদ্দীন বয়স্কাউট হিসেবে স্কাউট আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল।
তাজউদ্দীন ছিল ভীষণ স্ট্রেটফরােয়ার্ড। ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ভাল। কথাবার্তা যা বলবে সামনাসামনি। কিন্তু উচিত কথায় কাউকে সে ছাড়ত না। ১৯৪২ সালের শেষের দিকের একটি ঘটনার কথা বলি। তাজউদ্দীনসহ আমরা সবাই একসঙ্গে ফুটবল-ভলিবল খেলতাম নিয়মিত। আমাদের হােস্টেলের একটা টিম ছিল । একবার আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে হােস্টেলের টিমে খেললাম। স্কুলের টিমে ওই দিন আর খেলতে পারিনি, স্কুল টিম হেরে যায়। আমি ছিলাম টিম লিডার, আমার
হাতে চ্যাম্পিয়শিপ কাপ। আমাদের স্কুলের হেডমাস্টার আবদুর রহমান সাহেব অংক শিক্ষকের পরামর্শে আমাকে খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে বললেন, “তুমি যে স্কুলের টিমে খেল নাই, আমরা তাে বদদোয়া করব। শিক্ষকের কথা না শুনলে পরীক্ষায় কি ভাল হবে! এখনই তােমাদের চ্যাম্পিয়নশিপ কাপ সারেন্ডার করতে হবে।” আমার সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা, বদদোয়ার কথা শুনে আমি হেড স্যারের কাছে আমাদের কাপটা ফিরিয়ে দিলাম।
পরে তাজউদ্দীন আমার কাছ থেকে সব শুনে বলল, “এসব শিক্ষকের অনর্থক বদদোয়া কোন কাজে আসে না। এতে আরও ভাল হবে।” পরদিন তাজউদ্দীনকে অংক ক্লাসে অংক শিক্ষক শাহাবুদ্দিন সাহেব আমার প্রসঙ্গ তুলে অনেক কিছু বললেন। তাজউদ্দীন স্যারকে বােঝাবার চেষ্টা করল যে, হােস্টেলে আগে থেকেই
পৃষ্ঠাঃ ৪০
একটা খেলার টিম ছিলই, কিন্তু স্কুল থেকেও তাে বলা হয়নি তােমরা এই চ্যাম্পিয়নশিপে স্কুলের পক্ষে খেলবে। তাই হােস্টেলে টিমের তাে এখানে অন্যায় হয়নি। তাজউদ্দীন এমনও বলেছিল, “স্যার, হােস্টেল তাে মাত্র ত্রিশ-চল্লিশটা ছেলে, ওদেরকে দেখার কেউ নেই, কিন্তু স্কুলের তাে অনেক লােকজন আছে এবং কাপ নিয়ে নেয়া সঠিক হয়নি।” এই পর্যায়ে স্যার বললেন, “আমি প্রধান শিক্ষক হলে তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করতাম।” তাজউদ্দীন আর সহ্য না করতে না পেরে বলে ফেলে, “ এই জন্যই তাে আপনার মতাে লােক হেডমাস্টার হয়নি।” এরপর ভীষণ তর্কাতর্কি হলাে। তাজউদ্দীন ক্লাস টেনের শুরুতে স্কুল ছেড়ে দিল। হােস্টেল ছেড়ে কলতাবাজারে একটা মেসে উঠল। এই মেসের সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন কলেজিয়েট স্কুলের একজন শিক্ষক।
আমাদের হােস্টেলে সুপার অম্বর আলি সাহেব কিন্তু তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন এই হােস্টেলেই থাকতে, কারণ সেন্ট গ্রেগরীজের আর একটি ছেলেও এই হােস্টেলে ছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আর রাজি হয়নি । বলেছিল, “স্যার, আমি আর এখানে থাকবই না।”
তাজউদ্দীনের সাথে হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা হয়। সে আমাকে কলতাবাজারের মেসে নিয়ে যায় । আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী খবর তাের, কোথায় পড়ছিস?” সে বলল, “আমি সেন্ট গ্রেগরীজ হাই স্কুলে ভর্তি হয়েছি। সেখানে ব্রাদারের সাথে কথা বলেছিলাম, তিনি আমাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে বললেন। আমি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম ।” সেই সময় সেন্ট গ্রেগরীজের ইংরেজিতে বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন এস, দাশগুপ্ত। তিনি অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে খাতা দেখতেন। সেখানেও তাজউদ্দীন ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে ৮০ নম্বর পেয়েছিল।
ওর কলতাবাজার মেসে আমি দু’চারবার গিয়েছি। তখনও দেখেছি তার সেই একই চিন্তা, দেশ কেমন করে আরও উন্নত হবে, মানুষের কীভাবে আরও ভাল হবে, রাত-দিন শুধু এই সমস্ত পরিকল্পনা। তাজউদ্দীন সব সময় তার এই সমস্ত চিন্তাভাবনা নিয়ে বিভিন্ন মানুষে সাথে কথা বলত। একবার আমি তাকে বলেছিলাম, “এইসব চিন্তা কম করে ভাল করে লেখাপড়া করাে, পরীক্ষায় তাে ভাল করতে হবে।” সে বলেছিল, “পরীক্ষায় ভাল করার আমার দরকার নেই। পড়া যা বুঝি তাতেই হবে, কিন্তু দেশের জন্য কাজ আমাকে করতেই হবে।”
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর তাজউদ্দীনের সাথে আমার দীর্ঘদিন যােগাযােগ ছিল না। তাজউদ্দীন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২তম স্থান লাভ করে ।
পৃষ্ঠাঃ ৪১
১৯৫০ সালে ফজলুল হক হলে তার সাথে আমার আবার দেখা হয়। সেই সময় ইতিহাসের একজন প্রভাষক ছিলেন এস এম চৌধুরী ( যিনি পরবর্তীতে সিএসপি অফিসার এবং সচিব ছিলেন)। আমি তার রুমে থাকতাম। তিনি ম্যাটিকের খাতা দেখতেন। একদিন তিনি আমাকে বললেন একজন লোক ঠিক করে দিতে যে ওই খাতা দেখে দিতে পারবে। আমি তাজউদ্দীনের কাছে খাতাগুলাে নিয়ে গেলাম। তাজউদ্দীনের সাবসিডিয়ারি ছিল ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এম, এস, চৌধুরী তার সাবসিডিয়ারির শিক্ষক ছিলেন। যাই হোক, তাজউদ্দীন খাতাগুলাে দেখে ফিরিয়ে দিলে এম. এস. চৌধুরী অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর খাতা দেখার ধরন, মার্কিং, সমস্তই অত্যন্ত চমৎকার। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ছেলেটি কে? আমি তাজউদ্দীনের কথা বললাম। তখন তিনি বললেন, “হেড এগজামিনারও বলেছেন এই খাতা দেখেছে কে, চমৎকার হয়েছে। কোন একটা নম্বর এদিক-ওদিক হয়নি।”
স্কুলে তাজউদ্দীন যেমন দেখেছি সারাক্ষণ মানুষ আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকত, বিশ্ববিদ্যালয়েও তার একই অবস্থা। হয়ত দেখা গেল ছাত্ররা কোন একটা কিছু নিয়ে আন্দোলন করছে, ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে দরখাস্ত লিখতে হবে, এখন দরখাস্ত কে লিখে দিবে? লিখে দিচ্ছে তাজউদ্দীন। কী চমৎকার তার ভাষা, তার কী সুন্দর যুক্তি দিয়ে লিখত, সত্যিই তা ছিল অনন্য। তা ছাড়াও ছাত্র আন্দোলনের লিফলেট এবং অন্যান্য সমস্ত লেখা সে লিখে দিত। হল প্রভােস্টের কাছে কোন দাবি নিয়ে যাওয়া, সেখানেও মূল ভূমিকা ছিল তাজউদ্দীনের।
তাজউদ্দীন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভােটে জয়লাভ করে এমএলএ নির্বাচিত হয়। আমি তখন সরকারী চাকরি করি। আমার চাকরিস্থল নেত্রকোনা। আমি নেত্রকোনায় কাজে যােগ দেয়ার মাত্র ছয় মাসের মাথায় আমার নর্থ বেঙ্গলে বদলির আদেশ হলাে। আর সেই সময় আমি প্রচণ্ড অসুস্থ, মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে অপারেশন হবে আমার। আমি অনেক চেষ্টা করলাম, দরখাস্ত লিখলাম, কিন্তু আমার বদলির আদেশ বহাল রইল । আমি শেষে তাজউদ্দীনের কাছে গেলাম । তাজউদ্দীনের একটা ব্যাপার ছিল, কেউ কোন অন্যায় আবদার নিয়ে তার কাছে যেতে পারত না, সে যত আপন লােকই হােক না কেন। আবার যদি কোন কিছু যৌক্তিক হতাে, ন্যায্য হতাে, তবে একেবারে অপরিচিত হলেও সে চেষ্টা করত কাজটি করে দিতে। আমার শারীরিক অবস্থা দেখে তাজউদ্দীন বলল, “ঠিক আছে, আমি দেখছি।”
আতাউর রহমান সাহেব তখন চিফ মিনিস্টার। তাঁর রাজনৈতিক সচিব যিনি ছিলেন তিনি আমার বিষয়টি একটু শুনেই বলে দিলেন, কিছুই করা যাবে না।
পৃষ্ঠাঃ ৪২
তাজউদ্দীন আতাউর রহমান সাহেবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। আতাউর রহমান সাহেব অ্যাসেম্বলিতে ঢােকার সময় তাজউদ্দীন তাকে বলল, “আপনার সাথে আমার কথা আছে। এবং আপনি আমার কথা অর্ধেক শুনবেন, না পুরাে শুনবেন সেটা আগে বলে দিন।” আতাউর রহমান সাহেব তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, “বলাে তােমার কথা।” তাজউদ্দীন আমার বদলির বিষয়টি বলল এবং আমার বদলির আদেশ ওই দিনই বাতিল হয়ে গেল। তাজউদ্দীনের ব্যক্তিত্ব ছিল আকাশছোঁয়া।৮
আরহাম সিদ্দিকী
আমি সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে পড়তাম। তাজউদ্দীন সাহেবও সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে পড়তেন । সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে সেই সময় প্রায় ৯৫ ভাগ হিন্দু ছাত্র ছিল। যেমন আমাদের ক্লাসে ১২৩ জন ছাত্রের মধ্যে আমরা ৪ জন মাত্র ছিলাম মুসলমান ছাত্র। মুসলমান ছাত্ররা সেন্ট গ্রেগরীজ স্কুলে বেশি একটা পড়ত না। তাজউদ্দীন সাহেব খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। আমিও খুব ছাত্র ছিলাম। তিনি ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করে বেরিয়ে যান। আমি ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করি। সেই হিসেবে তাঁর সাথে আমার ব্যবধান তিন বছরের। স্কুলে থাকার সময়ে তিনি আমাকে প্রায়ই ডেকে নিতেন এবং লেখাপড়ায় উৎসাহ দিতেন। তখন আমাদের সম্পর্কটা দু’জনের পরিচয় জানা এবং কুশল বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল । তবে আমি জানতাম, তিনি তখন থেকেই রাজনীতি করেন। হিন্দু ছেলেরা ওই সময়টাতে খুব রাজনীতি করত। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে তিনি ম্যাট্রিক পাস করার আগে থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত, সে জন্য আমি তাকে খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতাম। তাঁর সম্পর্কে আরও শুনতাম যে, তিনি উচ্চ পর্যায়ের ছাত্রদের সঙ্গে রাজনীতি করেন।
তারপর কয়েক বছর তার সাথে হঠাৎ দু-একবার দেখা হওয়া ছাড়া আর কোন যােগাযােগ হয়নি। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ছি তখন তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেল । রাজনীতির জন্য তার ধারাবাহিক লেখাপড়ায় সাময়িক ছেদের কারণে আমরা দু’জন তখন সহপাঠী । এইভাবে আবার কিছু জানাশােনা এবং যােগাযােগ। অনার্স ফাইনালের পর আবার কয়েক বছর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন।৯
বাহাউদ্দিন চৌধুরী
চল্লিশের দশকটা আমাদের জাতীয় জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেননা, একদিকে যেমন মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালের যে প্রভাব সমস্ত দেশে ছড়িয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৪৩
পড়ছিল- দুর্ভিক্ষ, মহামারী ইত্যাদি- তেমনি ভারতবর্ষে একটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন সেই সময় খুব জোরদার হয়েছিল। এর ফলেই দেখা যায়, ১৯৪০ সালেই লাহাের প্রস্তাব পাস হয়েছিল । এই লাহাের প্রস্তাব বাঙালী মধ্যবিত্তদের খুব আন্দোলিত করেছিল।
তাজউদ্দীন সাহেব আমার সামান্য বড় হবেন। আমার স্কুল জীবন যখন প্রায় শেষ, শেষ সময় তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়, সেটা ১৯৪৬ সালের কথা। আমরা প্রধানত জনাব কামরুদ্দিনের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে যারা ছাত্র রাজনীতি এবং জাতীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম তার মধ্যে তাজউদ্দীন প্রধানতম একজন কর্মী ছিলেন। সেই সময় তিনি মুসলিম লীগের সর্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন এবং মাঝখানে আমার মনে হয় কিছুদিন লেখাপড়াও স্থগিত রেখেছিলেন রাজনীতির কারণেই। আমাদের মধ্যে তিনি খুব ভােকাল ছিলেন না, একটু ইনট্রোভার্ট টাইপের মানুষ ছিলেন। যার ফলে সেই সময় মঞ্চে তাকে খুব একটা দেখা না গেলেও আমাদের ভেতরে যে সমস্ত চিন্তা ও চেতনার জগত ছিল তাতে তাজউদ্দীন সবসময় প্রধানতম ভূমিকা পালন করেছেন। যেমন আমি বক্তা ছিলাম, বক্তৃতাতে আমাকে সবাই চিনত। অলি আহাদ সাহেবকে সবাই চিনতেন, বক্তৃতা দিতে পারতেন। তাজউদ্দীন সাহেব কখনও মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেয়া পছন্দ করতেন না। কিন্তু বিভিন্ন আলােচনা সভায় বা কর্মী সভায় তিনিই ছিলেন আমাদের কেন্দ্রবিন্দু। তখনকার ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে তিনি কিন্তু আমাদের চাইতে অনেক অগ্রসর চিন্তার লােক ছিলেন এবং অনেক বেশি পড়াশােনা করতেন ।
সেই সময় চল্লিশের দশকেই বলতে গেলে বাঙালী মধ্যবিত্ত মুসলমানদের একটা উত্থানের সময় যে কারণে আমরা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলাম। এই অংশের পাকিস্তান আন্দোলনের একটা ভিন্নরূপ ছিল, যেটা সারা ভারতবর্ষে ছিল না। সেটা হলাে এখানে লড়াইটা বলতে গেলে সাম্প্রদায়িক না হয়ে একটা শ্রেণী সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল এবং সেই আদিকালে তাজউদ্দীন আমাদের মধ্যে মার্কসিস্ট লিটারেচার সম্পর্কে সবচাইতে বেশি জ্ঞানী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন বইপত্র পড়তেন, বলতে গেলে আমাদের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। বাইরে তার ব্যাপক পরিচিতি না থাকলেও কর্মীদের মধ্যে তাঁর একটা শ্রদ্ধার স্থান ছিল এবং তিনি খুব শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। সেই সময়ে যে সমস্ত লেখালেখির কাজ হতাে, বিভিন্ন পুস্তিকা প্রকাশ করা হতাে, সেসব ক্ষেত্রে তাজউদ্দীন সর্বদা প্রধানতম ভূমিকা পালন করতেন। যেহেতু আমারও সেই সময় লেখার প্রতি একটা ঝোক ছিল, আমি কিছু লেখালেখি করতাম। কাজেই এসব
পৃষ্ঠাঃ ৪৪
লেখালেখির ক্ষেত্রে আমাকে তাঁর ঘনিষ্ঠতম সহযােগীর ভূমিকা পালন করতে হয়েছে।
তৎকালীন মুসলিম লীগের রাজনীতিতে একটা ফিউডাল এবং অ্যান্টি- ফিউডাল দ্বন্দ্ব ছিল। প্রধানত ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিমউদ্দিনের নেতৃত্বে যে দলটি ছিল তার বিরুদ্ধে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের নেতৃত্বে আর একটি গ্রুপ কাজ করেছিল। এবং আবুল হাশিম সাহেবের নেতৃত্বে ইসলামী সমাজতন্ত্র নামে একটা তথ্য বা তত্ত্ব তিনি প্রচার করার চেষ্টা করেছিলেন খােলাফায়ে রাশেদীনের কথা বলে। সেই সময়ে এ সম্পর্কিত বিভিন্ন পুস্তিকা রচনা করা হয়েছিল এবং এই পুস্তিকা রচনার ব্যাপারে তাজউদ্দীন খুব একটা বড় ভূমিকা পালন করেন। কামরুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমিও সহযােগীর ভূমিকা পালন করেছি।
পাকিস্তান হওয়ার পরে হয়ত মুসলিম লীগের অনেক বড় নেতাও চিন্তা করেননি যে পরবর্তীকালে পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থা কী হবে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কী হবে, রাষ্ট্রীয় কাঠামাে কী হবে- সেই সময়ে আমরা এসব চিন্তা করতাম। আমরা তখন কলেজে পড়ি কিন্তু আমরা কোন উপসংহারে আসতে পারিনি। আমাদের চিন্তার এই ক্ষুদ্র গােষ্ঠীর মধ্যমণি ছিলেন তাজউদ্দীন। আমরা মনে করতাম যে, যেভাবে মুসলিম লীগের নেতৃত্ব চলছে তাতে ভবিষ্যতে আমাদের যে সমাজ-কাঠামাে আসবে, তাতে আমাদের যে আকাক্ষা তা পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না- এই সন্দেহেই আমরা সবসময় দোদুল্যমান ছিলাম। পাকিস্তানের আন্দোলনের সময়েও আমরা ঠিক বাঙালী জাতীয়তাবাদ কথাটা হয়ত উচ্চারণ করিনি, কিন্তু আমাদের যে রাষ্ট্রীয় সীমানা, আমাদের যে আলাদা একটা সত্তা, পশ্চিমাদের চেয়ে আলাদা একটা সত্তা আছে, এটা কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে একটা অনুভূতির মতাে ছিল। এবং এর প্রবক্তাই বলা হােক বা এক্সপােনেন্ট, তা ছিলেন তাজউদ্দীন। এই বিষয়ে কামরুদ্দিন সাহেবেরও একটা ভূমিকা ছিল।১০
পৃষ্ঠাঃ ৪৫
২
পাকিস্তান আন্দোলন
ছাত্র রাজনীতি ১৯৪৩-৪৭
তাজউদ্দীন আহমদ দশম শ্রেণী হতে রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি একদিকে ছাত্রনেতা অন্যদিকে মুসলিম লীগের কর্মী ছিলেন।
ঢাকার মুসলিম যুবনেতাদের উদ্দেশ্য হলাে মুসলিম লীগকে আহসান মঞ্জিল থেকে মুক্ত করা। আবুল হাশিম এতে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী পিছন থেকে তাকে সমর্থন দেন। ঢাকায় আবুল হাশিমের অনুসারীদের মধ্যে ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শামসুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রমুখ। তারা আবুল হাশিমকে ঢাকায় আসার জন্য আমন্ত্রণ করেন। ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ঢাকা আসবেন প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়ােজন। কামরুদ্দিন আহমদ যুব ও ছাত্রনেতাদের নিয়ে ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ সম্পাদক সৈয়দ আবদুস সেলিমের সাথে আলােচনা করেন। তিনি বলেন, যেহেতু ঢাকা জেলা মুসলিম লীগকে জানানাে হয়নি, সুতরাং তাদের কোন দায়িত্ব নেই। ১৯৪৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি আবুল হাসিম নারায়ণগঞ্জ আসেন। সিদ্ধান্ত হলাে মুন্সীগঞ্জের শামসুদ্দিন লৌহজং স্টেশনে তিনি আবুল হাশিমকে অভ্যর্থনা জানাবেন। ৩ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলীর বাড়িতে সভা ডাকা হলাে। নারায়ণগঞ্জের আব্দুল আউয়াল, আলমাস আলী, শামসুজ্জোহা কর্মিসভার আয়ােজন করেন।
শামসুজ্জোহার পিতা খান সাহেব ওসমান আলী পাটের ব্যবসা করে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি চাষাঢ়া স্টেশনে বায়তুল আমান নামে সুন্দর বাড়ি নির্মাণ করেন। ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাড়ির নাম ছিল বায়তুল আমান। নবাবদের সাথে প্রতিযােগিতা করে চলতেন ওসমান আলী। মুসলিম লীগ বামপন্থীদের জন্য তার বাড়িতে অবারিত দ্বার। ওসমান আলী যুবলীগ নেতাদের সার্বিক সহযােগিতা করতেন। এ সময় শ্রীনগর হাসপাতালে ডাক্তার নন্দী ও তার স্ত্রী তাকে সহায়তা করতেন। তারা স্বামী-স্ত্রী কমিউনিস্ট কর্মী ছিলেন। আবুল হাশিমের সঙ্গে বিপ্লবী নেতা ও কবি বেনজির আহমদ ছিলেন।
পৃষ্ঠাঃ ৪৬
১৯৪৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিরাজউদ্দৌলা পার্কে এক জনসভায় আবুল হাশিম অপূর্ব বক্তৃতা করেন। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। তাজউদ্দীন আহমদসহ ছাত্র-যুবসমাজ আবুল হাশিমের বক্তৃতায় আকৃষ্ট হন। তিনি ইসলামকে ধর্ম হিসেবে না দেখে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির পথ হিসেবে ব্যাখ্যা করতেন। বাংলা ভাষার ওপর তার অসম্ভব দখল ছিল। তার উচ্চারণ বাচনভঙ্গি শ্রোতাদের মােহিত করে। তার ভাষণ ছিল অন্য নেতাদের থেকে আলাদা। মুসলিম ছাত্রসমাজের নিকট শিগগিরই তিনি জননেতা হয়ে ওঠেন। ঢাকা শহর মুসলিম লীগ সভাপতি ডাক্তার মইজুদ্দীনের বাসায় আবুল হাশিম থাকতেন। অনেক আলােচনার পর সিদ্ধান্ত হলাে খাজাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে একটি পার্টি হাউস এবং সর্বক্ষণিক কর্মীর প্রয়ােজন।
“আবুল হাশিম সাহেবের প্রেরণা পেয়ে পার্টি হাউস’ গঠন করা হলাে ১ এপ্রিল ১৯৪৪ সালে ঢাকায় ১৫০ নং চক মােগলটুলিতে। তিনতলা বাড়ি- নিচতলায় কাগজের দোকান হায়দার সাহেব বলে এক ভদ্রলােকের। দোতলায় আমাদের অফিস- তেতলায় সর্বক্ষণ কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা এবং কনফারেন্স ঘর। সর্বক্ষণের কর্মীরা হলেন চারজন- শামসুল হক, শামসুদ্দীন, তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ শওকত আলী। এদের খাবার-থাকার ব্যবস্থা ছাড়াও তাদের পার্টির কাজের জন্য যা খরচ হবে তার ব্যবস্থা করা। পার্ট-টাইম কর্মীদের মধ্যে ছিলেন- মােহাম্মদ তােহা, খন্দকার মােশতাক আহম্মদ, এ কে আর আহমদ, নইমুদ্দীন আহম্মদ এবং ডাক্তার এম এ করিমের ওপর ও যারা নানা কাজে বুদ্ধি- পরামর্শ দিয়েছেন তাদের মধ্যে নাম করা যায়- নজমুল করিম, মােহাম্মদ নূরুল ইসলাম চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র। বাড়িটা ছিল একজন হিন্দুর। ১৯৪১ সনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর থেকে এ বাড়িটা ছিল পরিত্যক্ত। ভদ্রলােক আমাদের ভাড়া দিতে পেরে খুশি হলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল রাজনীতি ও ইসলামের উপর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা পুস্তকসমূহ সংগ্রহ করা বিশেষ করে হযরত মােহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনীর বিভিন্ন দিক নিয়ে বিদেশীদের আলােচনা।”১
“এরপর মােহাম্মদ মহসিন-এর নিকট থেকে হুঁশিয়ার সাপ্তাহিক কাগজ কিনে নিয়ে তা বহুদিন পার্টি পত্রিকা হিসেবে পরিচালনা করার দায়িত্ব আমরা নিয়েছিলাম- এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য পেয়েছিলাম তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে। চিরদিনই সে নিজেকে পশ্চাতে রাখতে অভ্যস্ত ছিল বলে তার কর্মক্ষমতার কথা অনেকের নিকট জানা ছিল না। সে ছিল অনেকটা নির্বাক কর্মী। আমাকে বাদ দিলে সবচেয়ে বেশি কথা বলত শামসুল হক, মােহাম্মদ
পৃষ্ঠাঃ ৪৭
তােহা তারপর শামসুদ্দীন। কিন্তু আমাদের অফিসে অনর্গল কথা বলার ব্যাপারে আবুল হাসিম বা হাবিবুল্লাহ বাহার সাহেবদ্বয়ের সমকক্ষ কেউ ছিল না।”২
“১৯৪৪ সালের জুন মাসে স্যার নাজিমুদ্দীন ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী এলেন মােগলটুলি পার্টি হাউসে। অনেক আলােচনার পর স্থির হলাে যে, যেহেতু খাজা সাহাবুদ্দীন ও সৈয়দ আবদুস সেলিম, যথাক্রমে জেলা লীগের সভাপতি ও সম্পাদক কলকাতায় থাকেন সুতরাং ঢাকা জেলার জন্য ‘অর্গে-নাইজিং কমিটি প্রয়ােজন। নুরুল আমীন সাহেব প্রস্তাব করলেন রেজাই করিম হবেন চেয়ারম্যা, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিঞা) প্রস্তাব করলেন সম্পাদক হবেন আসাদুল্লাহ। কমিটিতে থাকলেন সুলতানউদ্দীন সাহেব, ডাক্তার ময়েজউদ্দীন, আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, খানবাহাদুর আওলাদ হুসেন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কমিটি হয়ে গেল। রেজাই করিম সাহেব বললেন যে, শামসুল হক, শামসুদ্দীন ও আমি কমিটিতে আলােচনায় অংশগ্রহণ করব পার্টি হাউসের প্রতিনিধি হিসেবে। আমাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হলাে যে, এমনিভাবে চাদা তুলে পার্টি অফিস চালানাে অসম্ভব সুতরাং প্রত্যেকটি ইউনিয়নের সকল সাবালক মুসলমানদের দু’আনার সদস্য করা হলে ইউনিয়ন লীগে দু’পয়সা, মহকুমা লীগের অফিসের জন্য দু’পয়সা। বাকি চার পয়সা জেলা লীগের জন্য। রেজাই করিম সাহেব বললেন যে, গ্রামের লােকেরা পয়সা দিয়ে মেম্বার হতে চাইবে না সুতরাং রশীদই ছাপাবার পয়সাটাই মারা যাবে। বিশেষ করে যুদ্ধের জন্য যেখানে কাগজ কিনতে হবে কালােবাজারে চারগুণ বেশি দামে ছাপাবার জন্যও খরচ হবে বিস্তর। কিন্তু আমরা জেদ করতে লাগলাম। আমি বললাম এটা না করলে মুসলিম লীগ নেতাদের পকেটেই থেকে যাবে। দেশের লােকের মধ্যে চেতনা আসবে না। কমিটির সদস্যদের মধ্যে একমাত্র আসাদুল্লাহ সাহেব ঢাকা সদর মহকুমার ভার নিতে রাজি হলেন। বাকি মহকুমাসমূহের ও উত্তর সদরের ভার পড়ল আমাদের পার্টি অফিসের ওপর। শামসুদ্দীন মুন্সীগঞ্জের ভার নিলেন- তাজউদ্দীন আহমদ ভার নিলেন উত্তর সদরের। মানিকগঞ্জের ভার পড়ল মহিউদ্দীন (রাজা মিঞা)-এর উপর, নারায়ণগঞ্জ শহরআলমাছ আলী আর শামসুজ্জোহার উপর, আর সেই মহকুমার ভার পডল আবদুল আওলাদের উপর আর ঢাকা শহরের ভার নিল ইয়ার মােহাম্মদ ও মােহাম্মদ শওকত আলী। এমনভাবে ব্যবস্থা করা হলাে যে, সব মহকুমারই আমাদের পার্টির লােকের হাতেই ভার পড়ল কারা ইউনিয়ন লীগের, শহর লীগের ও মহকুমা লীগের কর্মকর্তা হবে তা স্থির করতে একমাত্র ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা ছাড়া, পার্টি অফিসের এক গােপন সভায় আমাদের পার্টির লােকদের বলে দেয়া হলাে যে,
পৃষ্ঠাঃ ৪৮
তারা যেন এমন কৌশলে কাজ করে যাতে পুরনাে জেলা নেতা বা অর্গানাইজিং কমিটির কোন সদস্য এমন কোন সন্দেহ না করে যে, আমরা কেবল আমাদের লােকদেরই সদস্য করছি- বা ইউনিয়ন লীগ বা মহকুমা লীগ থেকে তাদের সবাইকে বাদ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর এও স্মরণ রাখতে হবে যে, মহকুমার কাউন্সিল সদস্য যেন সব আমাদের লােক হয়। মহকুমার কমিটিগুলােতে কেবল আমাদের সংখ্যাগুরু, সদস্য থাকলেই চলবে। আর আমাকে বা শামসুল হককে কাজের সাপ্তাহিক রিপাের্ট পাঠাতে হবে কিন্তু শামসুল হকের উপর যেহেতু ময়মনসিংহের সংগঠনের ভার ছিল, কলকাতার সঙ্গেও যােগাযােগ রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে বিভিন্ন জেলার সংগঠনের কাজে তাকে যেতে হতাে- তার পক্ষে রিপাের্টসমূহ পড়ার সময় হবে না। সুতরাং স্থির হলাে যে, পনেরাে দিন অন্তর আমাদের পার্টির যে আত্মআলােচনার সভা বসবে তাতে ঢাকা ও অন্যান্য জেলার সংগঠনের অগ্রগতির খবরাখবর আলােচনা করা হবে।”৩
তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র। লেখাপড়া বাদ দিয়ে তিনি ঢাকা উত্তর মহকুমা মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত করেন। ইউনিয়ন ও শাখা কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন করে মহকুমা কমিটি গঠন করেন। একই সাথে তিনি কামরুদ্দিন আহমদের দক্ষিণহস্ত হিসেবে সকল মহকুমার অগ্রগতি সমন্বয় করতেন। ১৯৪৪ সালে তিনি যে সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সংগঠনে সহায়তা করে।
খাজা শাহাবুদ্দিন বুঝতে পারলেন নতুন কমিটি হয়ত তাদের পক্ষে নাও থাকতে পারে। তিনি ১৯৪৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন এবং পার্টি অফিসে এসে আলােচনা করেন। ২০ সেপ্টেম্বর রেজায়ে করিমের ৩১ নম্বর দেওয়ান বাজারের বাড়িতে সভা আহ্বান করেন। সভায় সদস্য সংগ্রহের অর্থের হিসাব নেয়া হয়। খাজা শাহাবুদ্দিন নির্ভর করতেন মধ্যবিত্তের ওপর মধ্যবিত্ত সমাজ সুযােগসন্ধানী। সুযােগ পাবার আশায় তারা দলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করত। তাদের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা প্রবল ছিল। ঢাকার নেতা রেজায়ে করিম ও ফজলুর রহমানের মধ্যে কেউ একে অন্যকে নেতা মানতেন না। তারা কালু মিয়ার অধীনে সহসভাপতি হতেন। এ সময় ঢাকার মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে ছিলেন- আবদুস সেলিম, খান বাহাদুর আওলাদ হােসেন, আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, আসাদুল্লাহ, আব্দুল ওয়াসেক, সুলতান উদ্দিন, ফজলুর রহমান, রেজায়ে করিম। তারা সকলে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।
পৃষ্ঠাঃ ৪৯
১৯৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা
মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশন
“২৪ সেপ্টেম্বরের কাউন্সিল অধিবেশন ছিল বাংলার মধ্যবিত্ত সমাজে বাচা-মরার সংগ্রাম, ঢাকার আহসান মঞ্জিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বাংলার রাজনীতিকে আহসান মঞ্জিল থেকে মুক্ত করে গণসংগ্রামে পরিণত করার সংগ্রাম। প্রতিপক্ষ বহুকাল ধরে বাংলার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত। ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ কমিটি গঠন করার জন্য মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঢাকায় এলেন। তিনি আহসান মঞ্জিলের রাজনীতির প্রধান পরিচালক। তিনি নবাব সলিমুল্লাহর ভাগিনা। তিনি বাংলার রাজনীতিতে বেশি চতুর, ধূর্ত ও ধড়িবাজ রাজনীতিবিদ। “তাছাড়া তারাই সরকার যে কাউকে যে কোন পুরস্কার দিয়ে আমাদের এতদিনের সংগ্রামকে বানচাল করে দিতে পারে। বামপন্থী নেতারা কাউন্সিলরদের সাথে আলােচনা করে নির্বাচনের জয়লাভের পরিকল্পনা জানিয়ে দেন। কাউন্সিলরদের বলা হলাে তারা যেন ২৪ তারিখে আহসান মঞ্জিলে চলে আসেন।”৪
২৩ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে খান সাহেব ওসমান আলীর বাসভবনে বামপন্থীদের গােপন বৈঠক হলাে। বৈঠকে কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক ও শামসুদ্দিনকে কমিটি গঠন করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ গােপন খবর খাজা শাহাবুদ্দিন জানতে পেরে কূটকৌশল অবলম্বন করেন। তিনি তিন নেতাকে রেজায়ে করিমের মাধ্যমে তার বাসায় নিয়ে আসার ষড়যন্ত্র করেন। রেজায়ে করিম পার্টি হাউজে গিয়ে তার বাসায় দাওয়াতের অভিনয় করে কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক ও শামসুদ্দিন আহমদকে নিয়ে আসেন। পরে দেখা গেল তার বাসায় না নিয়ে খাজা শাহাবুদ্দিনের পরিবাগের বাসভবনে নিয়ে এসেছেন। এ সময় খাজা শাহাবুদ্দিনের বাসভবনে ডা. মইজুদ্দীন, সৈয়দ আবদুস সেলিম, ফজলুর রহমান, আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, খান বাহাদুর আওলাদ হােসেন উপস্থিত ছিলেন। খাজা শাহাবুদ্দিন, কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক ও শামসুদ্দিন আহমদকে অন্য কক্ষে নিয়ে আলােচনা শুরু করেন। তিনি বলেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে, তাদের ৩ জনের ওপর কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন তারা কাকে নিয়ে কমিটি করলেন। তখন ৩ জনেই বুঝতে পারলেন তাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে। বামপন্থী নেতারা যে জমিদারদের বিরুদ্ধে তা শাহাবুদ্দিন জানতেন। তিনি প্রস্তাব করলেন সৈয়দ আবদুস সেলিমকে (কালু) সভাপতি করা হােক। কালু মিয়া খাজা শাহাবুদ্দিনের খালাত ভাই এবং তার মা নবাব আহসানউল্লাহর মেয়ে। তিন নেতা বলেন, সৈয়দ
পৃষ্ঠাঃ ৫০
সেলিম কলকাতায় থাকেন। তিনি কি করে সভাপতি হবেন । রাত অনেক হয়েছে- তাদের জন্য পার্টি অফিস চিন্তিত থাকবে- এ অজুহাতে শামসুদ্দিনকে ছেড়ে দিতে বলেন। শাহাবুদ্দিন অনেক চিন্তা করে শামসুদ্দিনকে যেতে দেন। শাহাবুদ্দিন চীফ হুইপ ফজলুর রহমানকে সহসভাপতি করার প্রস্তাব দেন। তিনি সম্পাদক হিসেবে আসাদুল্লাহ ও অন্যান্য কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করেন। এ সময় জুরে শামসুল হক কাঁপছিলেন। কামরুদ্দিন ও শামসুল হকের বিদায়কালে তিনি একটি প্যানেলে সই করতে বাধ্য করেন। তারা সই না করলে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাউন্সিল বন্ধ করার হুমকি দেন। তারপর পাটি হাউজে তারা আসলেন । সকল কাউন্সিলরকে বলা হলাে : শামসুদ্দিন আহমদ যে প্যানেল উত্থাপন করবেন তা আমাদের প্যানেল। কামরুদ্দিন ও শামসুল হকের প্যানেল তাদের নয়- খাজা শাহাবুদ্দিনের। বামপন্থীরা এ.টি মােজহারুল হককে সভাপতি করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ প্রস্তাব পেশ করবেন শামসুদ্দিন আহমদ।
ঢাকা জেলা কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হলাে আহসান মঞ্জিলে । প্রথমে জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা শাহাবুদ্দিন এবং সম্পাদক সৈয়দ আবদুস সেলিম তাদের লিখিত ভাষণ পাঠ করেন। শাহাবুদ্দিন তার আসন ছেড়ে দিলেন নতুন সভাপতির জন্য। রেজায়ে করিমের নামও বলেন। শামসুল হক দাঁড়িয়ে রেজায়ে করিমের নাম সভাপতি পদে প্রস্তাব করেন। তৎক্ষণাৎ শামসুদ্দিন আহমেদ এ.টি মােজহারুল হকের নাম প্রস্তাব করেন। শামসুল হকের প্রস্তাবের ওপর ৩৫ ভােট আর শামসুদ্দিন আহমদের প্রস্তাবের ওপর ১৫০ ভােটের বেশি ভােট পড়ে। চীপ হুইপ ফজলুর রহমান চিৎকার করে শাহাবুদ্দিনকে বলেন- ‘We are betrayed- শাহাবুদ্দিন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খাজা শাহাবুদ্দিনের মনােনীত প্যানেল হেরে গেল। আর বামপন্থীদের প্রস্তাব বিপুল ভােটে গৃহীত হলাে। মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ করে আমরা মিছিল করে বেরিয়ে এলাম। আহসান মঞ্জিলের ঘর থেকে রাজনীতির বিদায় সমাপ্ত হলাে ১৯৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।”৫
১৯৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নতুন কমিটির বিজয়ের পিছনে ছাত্রনেতা কাউন্সিলর তাজউদ্দীন আহমদের অবদান স্মরণীয়। তিনি পার্টি হাউজে বসে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। এ বিজয় তার জীবনের প্রথম বিজয়। তিনি ১৯৪৪ সালে বিজয়ের পথ ধরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নতুন সভাপতি খান বাহাদুর আওলাদ হােসেনের বাসা থেকে কামরুদ্দিন আহমদ। আবুল হাশিমকে খবরটি দেয়া মাত্র তিনি বললেন, খােদাকে অশেষ ধন্যবাদ। তাদের ৩ জনকে কলকাতায় যেতে বলেন। তারা কলকাতায় যেয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৫১
দেখেন- অমৃতবাজারে বিরাট হেডলাইন- খাজা নাজিমউদ্দিনের পরাজয়। অন্যান্য পত্রিকায় লিখেছে, আহসান মঞ্জিলের নেতৃত্বের অবসান। কলকাতায় প্রগতিবাদী নেতাদের সঙ্গে কামরুদ্দিন, শামসুল হক ও শামসুদ্দিনের দেখা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দিন, নূরুদ্দিন, আব্দুল জলিল, মােয়াজ্জেম, শাহ আবদুল বারী, মাহাবুব, আনােয়ার, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল হাকিম, শফিকুল ইসলাম, সালেহ আহমদ, দবিরুল ইসলাম, আবদুল হাই, মাহবুবুল হক প্রমুখ। ফজলুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান ১৫০ নম্বর মােগলটুলি পার্টি হাউজের কর্মীদের মুণ্ডুপাত করতেন।
মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিল- ১৭ নভেম্বর ১৯৪৪
১৯৪৪ সালের ১৭ নভেম্বর কলকাতায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হবে। এ সভায় কর্মকর্তা নির্বাচিত হবে।
মুসলিম লীগে দক্ষিণপন্থী নেতাদের ভিড়। এ দলে ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন, মওলানা আকরম খাঁ, ফজলুর রহমান, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, সবুর খান, ডা. এম এ মালেক, খাজ শাহাবুদ্দিন, মওলানা আবদুল্লাহ হিল বাকী প্রমুখ। বামপন্থীদের দলে যে সকল যুবনেতা ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ফজলুল কাদের চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, নুরুদ্দিন, কেজি মাহবুব প্রমুখ। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দু’দলের উর্ধে থাকতে চেয়েছিলেন। ডা. এ এম মালেক দলের সম্পাদকের পদে ডানপন্থীদের প্রার্থী। যুবকর্মীরা এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান সাহসী ভূমিকা পালন করেন । ঢাকার কাউন্সিলর আবুল হাশিমের সমর্থক ছিলেন। কাউন্সিলরদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি পিতার নিষেধ সত্ত্বেও কলকাতা কাউন্সিল সম্মেলনে যােগদান করেন। এ ছিল কলকাতায় তার প্রথম সফর। এ সময় তাজউদ্দীনের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সাক্ষাত হয়। ১৯৪৪ সালের ১৫-১৭ নভেম্বর তাজউদ্দীন, শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয় । পরবর্তীকালে তাদের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। তিনি প্রায় বলতেন ১৯৪৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তার পরিচয়। বামপন্থীদের প্রার্থী ছিলেন আবুল হাশিম। ১৭ নভেম্বরের নির্বাচনের আবুল হাশিম পুনরায় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৮ নভেম্বরের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের তালিকা প্রকাশিত হয়। কামরুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ বিজয়ী বেশে তাদের দল নিয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। ইতােমধ্যে তার লেখাপড়া দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
ঢাকার প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম শেষ হওয়ার পর
পৃষ্ঠাঃ ৫২
শেখ মুজিবুর রহমানও তার জেলার প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃবৃন্দের যেমন ইউসুফ আলী চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান, আবদুস সালাম খান তাদের নেতৃত্বের অবসান ঘটাবার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করে। গােপালগঞ্জে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে শেখ মুজিবুর আহ্বান করেন। তার সঙ্গে আবদুস সালাম খানের নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। উভয় দলের লাঠিয়াল বাহিনী এসেছে। শেখ মুজিব তার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। বরিশাল ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী বাহাউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বামপন্থীদের উত্থান ঘটে। এমনিভাবে প্রায় সকল জেলায় যুবশক্তির জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা মুসলিম লীগের উদ্যোগে ঢাকার মনােহরদী থানার চালাকচরে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কৃষক সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, শামসুদ্দিন ও তাজউদ্দীন আহমদ। সৈয়দ আবদুস সেলিম সভা পণ্ড করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কৃষক সমিতির সভাপতি কমরেড অন্নদা পাল ও লীগ নেতা শামসুদ্দিন আহমেদের চেষ্টায় বিরুদ্ধবাদীরা মাঠ ত্যাগ করে। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আবুল হাশিম, হােসেন শহীদ সােরাওয়ার্দী, আবদুল্লাহ হেল বাকী প্রমুখ।
মুসলিম ছাত্রলীগের নদীয়া জেলার কুষ্টিয়া সম্মেলন- ডিসেম্বর ১৯৪৪
১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম ছাত্রলীগের প্রাদেশিক সম্মেলন নদীয়া জেলার কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগ দু’ধারায় বিভক্ত- বামপন্থী ও ডানপন্থী। ডানপন্থী নেতাদের মধ্যে ছিলেন খাজা নাজিমউদ্দিন, মওলানা আকরম খা, খাজা শাহাবুদ্দীন প্রমুখ। বামপন্থী নেতাদের মধ্যে ছিলেন আবুল হাশিম। ডানপন্থী ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন শাসুল হুদা চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান, বাম দলের নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। নুরুদ্দিন, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। ঢাকা থেকে শামসুদ্দিন, শামসুল হক, তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়ার প্রাদেশিক কাউন্সিল অধিবেশনে যােগ দেন। দেশ বিভাগের আগে কুষ্টিয়া সম্মেলন ছিল ছাত্রলীগের শেষ অধিবেশন। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার শামসুল হুদা চৌধুরী ও নদীয়ার শাহ আজিজুর রহমান খাজাপন্থীদের ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী। আবুল হাশেম গ্রুপের প্রার্থী ছিলেন বরিশালের পিরােজপুর নিবাসী নুরুদ্দিন আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমান নুরুউদ্দিনকে সমর্থন দেন। বিদায়ী ছাত্রলীগ সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন এম এ ওয়াসেক ও আনােয়ার হােসেন। প্রার্থী নিয়ে উভয় দলের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। আবুল হাশেম ও শেখ মুজিবের প্রার্থী নুরুদ্দিনের দল হেরে যায়।
পৃষ্ঠাঃ ৫৩
সম্মেলনে শামসুল হুদা চৌধুরী সভাপতি ও শাহ আজিজুর রহমান সম্পাদক নির্বাচিত হন। ডানপন্থীদের বিজয় হলাে। কিন্তু ভেতরে বিরােধ রয়ে গেল। বামপন্থীদের নেতা ও সমর্থকগণ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে। তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্রলীগ পুনর্গঠনে সক্রিয় নেতা ছিলেন।
খাজা নাজিমউদ্দিনের মন্ত্রিসভার পতন
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৪ সালের বাংলায় বস্ত্রের অভাব দেখা দেয়। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলার গভর্নর হার্বার্ট মারা যান। তার স্থলে স্যার ফ্রেডারিক ব্যারােজ গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯৪৫ সালের ৮ মার্চ বাজেট অধিবেশন কৃষি খাতে টাকা মঞ্জুরি বিষয়ে ভােট গ্রহণ করা হয়। অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে নবাব হাবিবুল্লাহ ১০ জন সদস্য নিয়ে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। কংগ্রেস, কৃষক প্রজা পার্টি তখন বিরােধী দল । স্পীকার সৈয়দ নওশের আলী ভােট গ্রহণ করেন। মুসলিম লীগের পক্ষে ৯৭ এবং বিরােধী দলের পক্ষে ১০৬ ভােট পড়ে। খাজা নাজিমউদ্দিনের মন্ত্রিসভার পতন হয়। গভর্নর ব্যারােজ ১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্রের ৯২ ধারায় বাংলার শাসনভার নিজের হাতে নেন। ফজলুল হক বিরােধী দলের নেতা। কিন্তু তাকে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আহবান করা হলাে না।
১৯৪৪ সালে মহাত্মা গান্ধীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। গান্ধীর ও ভাইসরয়ের সাথে ভারতের ভবিষ্যত নিয়ে আলােচনা হয়। ওয়াভেল ছিলেন ভারত বিভাগের বিপক্ষে। তিনি অখণ্ড ভারতে হিন্দু-মুসলমানের সমাধান চেয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। জার্মানি পরাজিত হয়। হিটলার আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার দু’দিন পূর্বে ইভা ব্রাউনকে বিয়ে করেন। ১৯৪৫ সালের ৫ ও ৯ আগস্টে জাপানের হিরােশিমা এবং নাগাসাকি শহরে এটম বােমা নিক্ষেপ করা হয়। হাজার হাজার মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। রেঙ্গুন পতনের পর ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু টোকিও যাওয়ার পথে বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাপান আত্মসমর্পণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জয়লাভের পর ব্রিটিশ শ্রমিকদের সরকার প্রধানমন্ত্রী এটলী ভারতবাসীকে স্বাধীনতা প্রদানে বদ্ধপরিকর।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণে ভারতে কেন্দ্রীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। ভারত সরকার ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে
পৃষ্ঠাঃ ৫৪
কেন্দ্রীয় আইন সভা ও ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেন।
ব্রিটিশ সরকার আজাদ হিন্দ ফৌজে যােগদানকারী সেনা কর্মকর্তা কর্নেল শাহ নেওয়াজ, ক্যাপ্টেন রশিদ আলী প্রমুখকে শাস্তি প্রদান করে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ আইএএন রশিদ দিবস পালন করে। কলকতার অকটার লনিতে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ কাউন্সিল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বাের্ড গঠিত হয়। মুসলিম লীগ বামপন্থী গ্রুপ নাজিমউদ্দিন গ্রুপকে পরাজিত করে বিজয় লাভ করে। বাের্ডের ৯ জন সদস্যের মধ্যে ৫ জনকে কাউন্সিল নির্বাচিত করে।৬
পার্লামেন্টারি বাের্ডের সদস্য ছিলেন :
১. খাজা নাজিমউদ্দিন- পদাধিকারবলে- মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা।
২. মওলানা আকরম খাঁ-পদাধিকার বলে- মুসলিম লীগ সভাপতি।
৩. নুরুল আমিন- নিম্ন পরিষদের প্রতিনিধি।
৪. ফজলুর রহমান উচ্চ পরিষদের প্রতিনিধি।
৫. হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী- মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত।
৬, আবুল হাসিম- মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত।
৭. আহমদ হুসেন- মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত ।
৮. মােয়াজ্জেম হােসেন চৌধুরী লালমিয়া- মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত।
৯. আল্লামা রাগিব আহসান- মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক নির্বাচিত।
পার্লামেন্টারি বাের্ডে বামপন্থীদের বিজয় হলাে। এ বিজয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিশ্চিত হলাে। এ বিজয়ের পিছনে ছিল আব্দুল হাশিম ও বামপন্থী মুসলিম লীগের অবদান। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী উপদলীয় কোন্দলের ওপর থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার সমর্থক ছিল বামপন্থীরা। সুতরাং মুসলিম ডানপন্থীরা তাকে সমর্থন করত না।
১৯৪৫ সালের ১৬ নভেম্বর আবুল হাশিমের সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। পত্রিকার সম্পাদক আবুল হাশিম এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন কাজী ইদ্রিস। পত্রিকার মান ছিল উন্নত। তাই পাঠকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুসলিম লীগের প্রচার আজাদ পত্রিকার নিকট বন্ধক ছিল।
পৃষ্ঠাঃ ৫৫
আজাদ পত্রিকা থেকে মুসলিম লীগ শক্তি পায়। ১৯৪৬ সালে হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা প্রকাশ করলে প্রচারে মুসলিম লীগ আজাদ পত্রিকা থেকে পূর্ণ মুক্তি লাভ করে।
পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠনের পর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম বাংলা সফর করেন। তারা বিভিন্ন জেলায় পরিদর্শন করে নির্বাচনী অফিস প্রতিষ্ঠা প্রার্থী নির্বাচন ও বিজয়ের কৌশল উদ্ভাবন করেন। বাংলার ২৭টি জেলায় নির্বাচন অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং প্রত্যেক নির্বাচনী অফিসে সম্পাদক নিয়োগ হয়।
১৯৪৫-৪৬ সালে জেলা নির্বাচন অফিসের সম্পাদক ছিলেন:
১. কামরুদ্দিন আহমদ-ঢাকা
২. শেখ মুজিবুর রহমান-ফরিদপুর
৩. ফজলুল কাদের চৌধুরী-চট্টগ্রাম
৪. আব্দুর রহমান চৌধুরী- বরিশাল
৫. শামসুল হক-ময়মনসিংহ
৬. শেখ আব্দুল আজিজ-খুলনা
৭. খন্দকার মােশতাক আহমেদ-কুমিল্লা
৮. বিএম ইলিয়াস-বগুড়া
৯. কামরুল হাসান-রাজবাড়ী
১০. জহিরুল-কলকাতা
এভাবে ২৭ জেলায় ২৭ জন সম্পাদক নির্বাচিত করা হন।
প্রত্যেক মহকুমায় একজন ছাত্রনেতাকে সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে ঢাকা মহকুমার নির্বাচনী সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। এ সময় তিনি ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। সম্পাদক ছিলেন বরিশালের সুলতান হােসেন খান (বিচারপতি)।
১৯৪৫ সালের ১০ ও ১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় আইন সভার ১৩২টি আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রের ১৩২ সদস্যের মধ্যে ৩০ জন মুসলমান। এর মধ্যে ৬ আসন বাংলাদেশে। মুসলিম লীগের মনােনয়ন পেলেন :
১. আব্দুর রহমান সিদ্দিকী অবাঙালী-কলকাতা
২. স্যার হাসান সােহরাওয়ার্দী- পশ্চিম বাংলার কয়েকটি জেলা নিয়ে গঠিত কেন্দ্র।
৩. তমিজউদ্দিন খান-ঢাকা-ময়মনসিংহ
৪. রফিউদ্দিন সিদ্দিকী-চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নােয়াখালী
৫. আব্দুল হালিম শাহ- রংপুর, দিনাজপুর,
পৃষ্ঠাঃ ৫৬
৬. ইসমাইল খান চৌধুরী- বরিশাল, ফরিদপুর।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ৬টি আসনে প্রজা পার্টির প্রার্থী দেন । তাকে সহায়তা করে কংগ্রেস। এ সময় প্রজা পার্টির নেতা-কর্মীরা অনেকে মুসলিম লীগে যােগ দেয়। কৃষক প্রজা পাটি সম্পাদক কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন আহমেদ ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মুসলিম লীগে যােগ দেন। এ কে ফজলুল হক সংরক্ষিত কলকাতা আসনে জয়লাভ করে নিজের জনপ্রিয়তা বজায় রাখেন। কিন্তু তার দলের বিপর্যয় ঠেকাতে পারেননি। এ সময় পাকিস্তান দাবি এত প্রবল হয়ে পড়ে যে, মুসলিম সমাজ তার অবদানের কথা স্মরণে আনেনি।
১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর কেন্দ্রিয় আইন পরিষদের নির্বাচন
ঢাকা-ময়মনসিংহ নির্বাচনী কেন্দ্রের নির্বাচন পরিচালনার বেশি দায়িত্ব ঢাকা
মুসলিম লীগ পার্টি হাউজের ওপর অর্পিত হয় । ১৫০ নম্বর মােগলটুলি পার্টি হাউজের সর্বক্ষণিক কর্মী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি মুসলিম লীগের বিজয়ের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করেছেন।
মুসলিম লীগের তমিজউদ্দিন খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন ময়মনসিংহের দেলদুয়ারের জমিদার স্যার আব্দুল হালিম গজনবী। তার পক্ষে ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ। এ কে ফজলুল হক ঢাকার নবাব প্রার্থী আব্দুল হালিম গজনবী একযােগে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসছে না। নারায়ণগঞ্জের মুসলিম লীগ কর্মী আব্দুল আউয়াল, আলমাস ও শামসুজ্জোহা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তারা প্রায় জায়গায় প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। ময়মনসিংহের শামসুল হক, তমিজউদ্দিন খানকে সভা করে যাচ্ছেন। ঢাকা জেলায় কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রিয় নেতারা প্রচার চালিয়ে যান। ফরিদপুরে নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৫ সালের ১০ ও ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনে মুসলিম লীগ বাংলার ৬টি আসনসহ ভারতের ৩০টি আসনে বিজয় লাভ করে- কৃষক প্রজা পার্টি ও কংগ্রেস থেকে মুসলমান প্রার্থীরা জামায়াত হারায়। ১৯৪৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর কলকাতার অকটার গলি মনুমেন্টের পাদদেশে মুসলিম লীগ শুকরিয়া দিবস পালন করে। দলে দলে মুসলমানরা জরসভায় যােগ দেয়। খাজা নাজিমউদ্দিন, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আকরম খা, আব্দুল হাসিম সভায় ভাষণ দেন। মিছিলে সব শ্লোগান ছিল উর্দু ভাষায়- ‘লড়কে লেয়েংগে পাকিস্তান,’ ‘ছিনকে লেয়েঙ্গে পাকিস্তান’, ‘সিনামে গুলি লেয়েঙ্গে পাকিস্তান বালাংসে’। আর রাস্তার ছােকরারা বলছে- ‘কানমে বিড়ি, মুখে পান লড়কে লেয়েঙ্গে পাকিস্তান। এ
পৃষ্ঠাঃ ৫৭
সময় কামরুদ্দিন আহমদ কলকাতায় ছিলেন। তিনি কলকাতার মুসলিম সমাজের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি দেখে বলেছেন- “সমস্ত সমাজটা যেন পাগল হয়ে গেছে।” কামরুদ্দিন আহমেদ মুসলিম লীগের বঙ্গ বিজয়ে ভারত বিভাগের অশনিসংকেত দেখতে পেয়েছেন। পাকিস্তান দাবি মুসলমানের মধ্যে প্রবল আকার ধারণ করে। খাজা নাজিমউদ্দিন পার্লামেন্টারী বাের্ডে হেরে গেলেন। বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। ১৯৪৫-৪৬ সালের নির্বাচনে খাজা নাজিমউদ্দিন কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেননি। নির্বাচনের পর জিন্নাহ তাকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে লন্ডনে চলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাছাড়া ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তার দলীয় লােকদের বিজয়ে তার পার্লামেন্টারীদের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার আভাস পেয়ে স্বেচ্ছায় প্রবাস জীবন বেছে নিলেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক পার্লামেন্টারী বাের্ড ১১৯টি মুসলমান আসনে মনােনয়ন সম্পন্ন করেন। কিন্তু ২২ আসনে আপীল হলাে। আবুল মনসুর আহম, আব্দুল জব্বার সরদার প্রমুখ ২২ জন বাদ পরে। ফলে ১১৯ জনের মধ্যে ৫৭ জন খাজা নাজিমউদ্দিন গ্রুপের।
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ বাংলার নির্বাচন তদারকির জন্য জিন্নাহ এম, এ ইস্পাহানি, সৈয়দ মােয়াজ্জেমুদ্দিন, এ. ডব্লিউ, রাজ্জাককে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। ১৯৪৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাের্ড মুসলিম লীগ প্রার্থীদের মনােনয়নের কাজ শেষ করে। প্রাদেশিক বাের্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বাের্ডের প্রতিনিধি হিসেবে খালিকুজ্জামান চৌধুরী এবং হাসান ইমাম ১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় আসেন। তাঁরা ২২ জনের শুনানি গ্রহণ করেন। মুসলিম লীগ মনােনীত ১০ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন এইচ.এস সােহরাওয়ার্দী। তিনি চব্বিশ পরগনার মিউনিসিপ্যালিটি থেকে নির্বাচিত হন। কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তেমন ছিল না। শুনানিতে যাদের মনােনয়ন বাতিল হয়েছিল তাদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমেদ অন্যতম। তার স্থলে আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে মনােনয়ন দেয়া হয়। সাধারণ নির্বাচনের দিন ধার্য হলাে ১৯ মার্চ থেকে ২২ মার্চ।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কৃষক প্রজা সমিতির সাথে সাধারণ নির্বাচন করার প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাব ছিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের ও আইনসভার মােট মুসলিম আসনের শতকরা ৪০টি আসন কৃষক প্রজা পার্টিকে দেয়া হবে এবং তারা মুসলিম লীগের প্রার্থী বলে গণ্য হবেন। শহীদ সাহেব বুঝলেন যে, মুসলিম লীগের মনােনীত প্রার্থীদের মধ্যে শতকরা ৬০ জন অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি কৃষক প্রজা শ্রেণীর লােক থাকবে। কাজেই, কৃষক প্রজার স্বার্থ রক্ষিত হবে এবং বিনা
পৃষ্ঠাঃ ৫৮
ক্ষতিপরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে। প্রস্তাবটি কৃষক প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে সমিতির সভাপতি মওলানা আবদুল্লাহেল বাকী, আবুল মনসুর আহমেদ, নির্মল কুমার ঘােষ প্রমুখ গ্রহণ করলেও অধিকাংশ নেতা সােহরাওয়ার্দরি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৪৬ সালের ১২ জানুয়ারি গফরগায়ে মুসলিম লীগ সম্মেলন
১৯৪৬ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। বাংলার মানুষ তাকে দেখেনি। দু-একবার কলকাতায়, একবার সিরাজগঞ্জে এসেছেন। আসামের লীগ নেতাদের অনুরােধে ১৯৪৬ সালে নির্বাচনের পূর্বে রেলপথে আসাম যান। রেলস্টেশনে তাকে দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষের ভিড়- তাকে দেখবে কথা শুনবে। কিন্তু তিনি দরজা খােলেননি। ট্রেন যখন ময়মনসিংহ পৌছে তখন লক্ষাধিক মানুষ তাকে দেখতে চায়। শামসুল হক বক্তৃতা দিচ্ছেন জিন্নাহ মাত্র জানালা খুলে বলেন, ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ । সাথে সাথে জানালা বন্ধ করে শামসুল হককে বলেন, “Young men, you have lot of things to learn about mob. You have shown an indisciplined Bengali mob, let me expect in future disciplined people here.” “যুবকেরা তােমাদের জনতা সম্পর্কে আরাে অনেককিছু শিখতে হবে। তােমরা আমাকে এক উচ্ছল বাঙালি জনতাকে দেখাচ্ছ। আশা করি ভবিষ্যতে এখান শৃঙ্খল জনতা দেখাবে।” স্টেশনে জনতাদের জিন্নাহ উচ্ছল বলেছেল- কারণ তারা ট্রেনের গতিরােধ করে তাকে দেখতে চেয়েছিল । জিন্নাহ নির্বাচনী সফরে বাংলায় আসেন। তিনি লীগ সম্পাদক নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানকে বাংলায় প্রেরণ করেন। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্পাদক আব্দুল হাশিম তাকে ময়মনসিংহ জেলা সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার দায়িত্ব দেন।
গফরগাঁয়ের কৃষক নেতা মওলানা শামসুল হুদা- তার দলের নাম এমারত পার্টি। তিনি কৃষক প্রজা পার্টির প্রার্থী। অপরদিকে মুসলিম লীগের প্রার্থী হলেন গিয়াসউদ্দিন পাঠান। নির্বাচনকে উপলক্ষ করে ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগ সম্মেলন গফরগায়ে ১৯৪৬ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে এমারত পার্টি ও মুসলিম লীগের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় । মাওলানা শামসুল হুদার স্থানীয় প্রভাব প্রবল থাকায় মুসলিম লীগ তাদের সাথে পারছে না।
তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র। তার ১৯৪৬ সালে পরীক্ষা দেবার কথা। কিন্তু নির্বাচনকে সামনে রেখে তার পরীক্ষা দেয়া হলাে না । তিনি নির্বাচনে মুসলিম লীগকে জয়যুক্ত করার জন্য সর্বক্ষণ কাজ করেছেন। তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৫৯
সাহসী ও উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ নেতা ছিলেন। গফরগাঁয়ের সেদিনের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে কি ত্বরিতগতিতে তাজউদ্দীন আহমদ মােকাবেলা করেছেন তা দেখে কামরুদ্দিন আহমদ বিস্মিত হয়েছেন। তিনি মাওলানা শামসুল হুদার পাটির দাবির প্রতিধ্বনি দিয়ে তার দলের লােকদের শান্ত করেছিলেন। তাজউদ্দীন উপস্থিতি না হলে মাওলানার লােকদের হাতে তাদের লাঞ্ছিত হতে হতো। কামরুদ্দিন ও তাজউদ্দীনের আগে শামসুল হক ও বাহাউদ্দিন চৌধুরী এসেছিলেন। তারাও উভয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন।
১৯৪৬ সালের ১২ জানুয়ারি নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমউদ্দিন, আবুল হাশিম, মওলানা আজাদ ছােবহানী প্রমুখ নেতা গফরগাঁও পৌছেন। ময়মনসিংহের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট টিআইএম নুরুন্নবী প্রয়ােজনীয় পুলিশ বাহিনী নিয়ােগ করেন। নেতাদের আগমনের সাথে সাথে এমারত পার্টির লােকেরা ইট পাটকেল নিক্ষেপ এবং স্লোগান দিতে থাকে। খাজা নাজিমউদ্দিন ভয়ে কাঁপছেন। লিয়াকত আলী খানের মুখ ফ্যাকাশে। শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহসী পরুষ, তিনি ট্রেন থেকে প্রথম অবতরণ করেন। তারা মঞ্চে গেলেন। আবুল মনসুর আহমদ লীগের কথা না বলে কৃষক মুক্তি, জমিদারী উচ্ছেদের ভাষণ দিয়ে উন্মত্ত জনতাকে শান্ত করেন। নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, খাজান নাজিমউদ্দিন কার্যত উর্দুতে ভাষণ দেন- তা জনতা বুঝতে পারেনি। সােহরাওয়ার্দী দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা করেন। আবুল হাশিম সুন্দর বাংলায় মওলানাকে কঠোর সমালােচনা করে ভাষণ দেন। নেতারা ভাষণ সমাপ্ত করে সভা ত্যাগ করেন। এ আসনে মুসলিম লীগ প্রার্থী পরাজয় বরণ করেন। কিন্তু জামানত হারাননি। মওলানা শামসুল হুদা জয়লাভ করেন।
গফরগাঁও লীগ সম্মেলন সম্পর্কে কামরুদ্দিন আহমদ বলেন,৮
“দিল্লীতে ফিরে গিয়ে তিনি (জিন্নাহ) লিয়াকত আলী খানকে পাঠালেন বাংলার নির্বাচন তদারক করতে। আবুল হাসিম সাহেব বুদ্ধি করে তার জন্য সবচেয়ে বড় জেলা ময়মনসিংহে মুসলিম লীগ কনফারেন্স করে তাকে সেখানে সভাপতিত্ব করতে বললেন। আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের ওপর ভার পড়ল গফরগাঁয়ে কনফারেন্সের আয়ােজন করতে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনী কেন্দ্রে গিয়েছিলেন জিন্নাহ সাহেব, কিন্তু তিনি তার মাথা থেকে সােনার হ্যাটটি পর্যন্ত নামাতে অস্বীকার করলেন। ফলে ইব্রাহিম সাহেব ভােট পেলেন না। এবারও ময়মনসিংহে এক গিয়াসউদ্দীন পাঠান ছাড়া আর কেউ নবাবজাদাকে নিমন্ত্রণ করতে চাইলেন না। শামসুল হক ও আবুল মনসুর সাহেবে তাদের ভলান্টিয়ারদের নিয়ে গফরগাঁও গেলেন। কিন্তু তারা খুব বেশি এগােতে পারলেন না । আমাকে তার করলেন, ঢাকা থেকে খুব জাদরেল
পৃষ্ঠাঃ ৬০
সাহসী যারা খুনাখুনিতে ওস্তাদ এবং কাউকে ভয় করে না- এমনি কয়েক শত লােক নিয়ে গফরগাঁ যেতে। আমি ঢাকা শহরের মুসলিম লীগের নতুন নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা শহর সভাপতি কাজী মােহাম্মদ বশীর। সেক্রেটার, কলতাবাজারের হাবিবুর রহমান এবং ট্রেজারার ইয়ার মােহাম্মদ খান, শওকত আলী, ডাক্তার মেছবাহউদ্দীন প্রভূতি। তাদের পছন্দ করা দেড় শত ঢাকার ডাকসাইটে লােক নিয়ে আমি এবং তাজউদ্দীন রওনা হলাম। স্টেশনে এসে যা দেখলাম- তাতে আমার অন্তর কেঁপে উঠল। মস্ত বড় বড় রামদাও নিয়ে হাজার হাজার লােকের মিছিল। আমাদের ক্যাম্পে যাবার পথে, আমাদের দু’পাশে তারা রামদ, বর্শা উঁচু করে লাফাচ্ছে, আর চিৎকার করছে “এমারত পার্টি জিন্দাবাদ, মাওলানা শামসুল হুদা জিন্দাবাদ”। আমি কি যে করব কিছু ভেবে পাচ্ছিলাম না হঠাৎ দেখলাম তাজউদ্দীন সমানভাবে শ্লোগান দিচ্ছে ‘লাঙল যার জমি তার’, ‘জমিদার নিপাত যাও’, ‘জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করাে’ একবারও বলছে না ‘মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’ এ শ্লোগানে কাজ হলাে তাদের চিৎকার থেমে গেল এবং আমাদের স্লোগান শুনে তারা যেন অনেকটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
আমরা ক্যাম্পে পৌছে প্রথম দেখা পেলাম বাহাউদ্দীন চৌধুরীর সঙ্গে সে কোনরকম প্রাণে বেঁচে মশাখালী থেকে এসেছে। তার খবর অনুযায়ী শামসুল হককে মাওলানা ধরে নিয়ে গেছে। আজাদের রিপাের্টার আবু জাফর শামসুদ্দীনকে মেরেছে তার সাইকেল পানিতে ফেলে দিয়েছে- ইত্যাদি নানা রকমের খবর । আমার ঢাকার সাহসী বীরপুরুষরা সেখানে থাকতে রাজি নয়। তারা ছুরি মেরে অনেক মানুষ মেরেছে তাদের জীবনে, কিন্তু অতবড় রামদার সঙ্গে ছুরি চালানাে অসম্ভব ব্যাপার। পরের দিন তাদের ট্রেনে তুলে দিতেই হলাে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নুরন্নবী চৌধুরী-ময়মনসিংহের পুলিশ বাহিনী পর্যাপ্ত নয় বলে ঢাকা তার করেছেন- আরও বন্দুকধারী পুলিশের জন্য। কারণ তার ধারণা যে, নেতারা যেদিন আসবেন সেদিন একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটে যাবে।
নেতারা এলেন। নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, স্যার খাজা নাজিমুদ্দীন, শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা আজাদ সােবহানী, আবুল হাসিম। আমরা স্টেশনে গেছি বন্দুকধারী পুলিশ সমভিব্যাহারে তাদের আনতে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নূরুন্নবী সাহেব ও পুলিশ সুপার নিজেরা উপস্থিত। দূরে দেখা গেল যে, রামদার মিছিল আসছে- পুলিশ কর্ডন ভেদ করে কিছুসংখ্যক লােক প্ল্যাটফরমে চলে এসেছে। লিয়াকত আলী খানের ‘ভেলে’ (দেখাশােনা করার লােক) যেই মাত্র দরজা খুলছে অমনি এক পাথর এসে লাগল তার মুখে একটা দাঁত ভেঙ্গে রক্ত পড়তে লাগল। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে তারা দূরে সরে গেল
পৃষ্ঠাঃ ৬১
বন্দুকধারী পুলিশরা পজিশন নিয়ে রাইফেল তাক করে ফেলল। শহীদ সাহেব নেমে এলেন প্রথম, তারপর আবুল হাসিম সাহেব এরপর নাজউদ্দীন সাহেবের দেখা গেল বেটে-খাটো মােটা মানুষটির আচকানের নিচে টাইট চুড়িদার পাজামা। তার দু’হাঁটু এমনভাবে কাঁপছে যে, তিনি আর কিছুতেই নামতে পারছেন না। নুরুন্নবী সাহেব তাকে হাত ধরে নামালেন। তারপর নামল নবাবজাদা। মুখ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সভার প্যান্ডেল পর্যন্ত পুলিশ তাদের পৌছে দিয়ে গেল। প্যান্ডেলের চারপাশে বন্দুকধারী পুলিশ। ছেলেরা, ভলান্টিয়াররা খড়ের উপর শুয়ে আছে। তাদের খাবার-দাবারের তেমন ব্যবস্থা নেই। বক্তৃতা করলেন মিনিট দশেক খাজা নাজিমুদ্দীন, শহীদ সাহেব আধ ঘণ্টা। শহীদ সাহেব একটা কথা বললেন যে, শামসুল হক বা অন্য কারও যদি কোন ক্ষতি হয় তবে তার প্রতিশোধ মাওলানার ওপর উঠবেই- যখন তিনি পরিষদ সদস্য হয়ে কলকাতা যাবেন। আবুল হাসিম সাহেব তার বিরুদ্ধে বাংলায় বললেন যে, ‘আমি মাওলানা শামসুল হুদাকে তুলনা করব না মীর জাফরের সঙ্গে আমি তাকে তুলনা করব মােহাম্মদী বেগের সঙ্গে যে সেজদারত সিরাজ-উদ-দৌলাহকে হত্যা করেছিল। তারপর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন আবুল মনসুর আহমদ সাহেব। অনেক প্রস্তাবের মধ্যে একটা প্রস্তাব তিনি উত্থাপন করলেন, ‘বিনা খেসারতে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ’। ঐ পরিস্থিতি ওখানে কেউ “বিনা খেসারত” কথাটা নিয়ে কোন তর্ক উপস্থিত করেনি । কারণ ওটা প্রজা-আন্দোলনের পুরনাে শক্ত ঘাঁটি। নবাবজাদা বােধহয় কিছু বােঝেননি। তাড়াতাড়ি সভা শেষ করে শেষের ট্রেনে তারা নবাবজাদা ও খাজা সাহেব ময়মনসিংহ চলে যাবেন এ ছিল ব্যবস্থা। তারা খাস উর্দুতে বক্তৃতা করেছিলেন- যা মুসলিম লীগের লােকেরও কারও বােধগম্য হয়নি। ইংরেজিতে বললে হয়তাে অন্তত ছাত্ররা বুঝত।
আমাদের অধিবেশন শেষ হলাে। এখানে গিয়াসউদ্দীন পাঠানের টাকা বাজেয়াফত হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা হয়েছিল যদিও তা হয়নি। অধিবেশনের রাতেই শামসুল হক সুস্থ শরীরে ফিরে এলেন শুনলাম যে, তিনি মাওলানার সঙ্গে স্বেচ্ছায় বাহাস (ধর্মীয় বিতর্ক) করতে গিয়েছিলেন।
মওলানা শামসুল হুদার সংগঠন শক্তি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম । তার নিজস্ব একটি প্রেস ছিল। সেই ‘সেতারা প্রেস’ থেকে ট্রেডেল মেশিনে যে ছােট ছােট ছাপানাে বিজ্ঞপ্তি বেরােত তাই লােকে বিশ্বাস করে ফেলত। ধর্ম এবং প্রজা-আন্দোলনের মধ্যে এক অদ্ভুত সামঞ্জস্য এনে মানুষগুলােকে সংগঠিত করেছে যারা মরতে ভয় পায় না। আমি শরিয়তুল্লাহ বা মানুষগুলােকে সংগঠন করেছে যারা মরতে ভয় পায় না। আমি শরিয়তুল্লাহ বা দুদু মিঞার ফরায়েজী
পৃষ্ঠাঃ ৬২
আন্দোলন চোখে দেখিনি। কিন্তু এমারত পার্টির আমীর মাওলানা শামসুল হুদার ক্ষমতা দেখে মনে হলাে- সে গফরগায়ে যেটা করতে পেরেছে, সেটাই একটু বৃহৎ আকারে তিতুমির বা হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং তার ছেলে দুদু মিঞা করেছিলেন।”
১৯৪৬ সালের ১৯-২২ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা জেলার সকল আসন মুসলিম লীগ দখল করে। ফরিদপুরে শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইউসুফ হােসেন চৌধুরী মােহন মিয়াকে স্বেচ্ছাসেবক ও অর্থ দিয়ে সাহায্য না করে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। ফলে মােহন মিয়া পরাজিত হলেন। নির্বাচিত হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুদ্দিন চৌধুরী। এ কে ফজলুল হক এককভাবে ৩ আসনে অপরাজিত থেকে তার ব্যক্তিগত জয় টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হন। তার দলীয় প্রার্থী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল পিরােজপুর থেকে এবং খান সাহেব হাতেম আলী জমাদ্দার মঠবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগ ১১৯ টি আসনের মধ্যে শেরে বাংলা মাত্র ৫টি আসন লাভ করেন। মুসলিম লীগ ১১৪টি আসন দখল করে।
তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা জেলার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন। কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ ঢাকা জেলার মুসলিম লীগের নির্বাচন পরিচালনা করে সকল আসনে জয়লাভ করে।
ঢাকা জেলা থেকে নির্বাচিত মুসলিম লীগ এমএলএগণ- ১৯৪৬
ফকির আবদুল মান্নান, ঢাকা
আওলাদ হােসেন খান, মানিকগঞ্জ
ডা. এ এম মালেক, ঢাকা
মশিউদ্দিন আহমদ রাজা মিয়া, ঢাকা
আবু তৈয়ব মাজহারুল হক, ঢাকা
খাজা নাসরুল্লাহ, ঢাকা
ওসমান আলী, নারায়ণগঞ্জ
এম এ সেলিম, নারায়ণগঞ্জ
মওলা এমডি আবদুল আজিজ, মুন্সীগঞ্জ
আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, মুন্সীগঞ্জ
আব্দুল খালেক, ঢাকা
মিসেস আনওয়ারা খাতুন
ঢাকার হিন্দু আসনে ৮ জন নির্বাচিত হন। তাদের মধ্যে মহিলা সদস্য ছিলেন; আশালতা সেন। তাজউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী এলাকা ঢাকা উত্তর-
পৃষ্ঠাঃ ৬৩
কাপাসিয়া থেকে এমএলএ নির্বাচিত হলেন ফকির আব্দুল মান্নান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাকে হারিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচিত হন।
১৯৪৬ সালের ১৯-২২ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগ আশাতীত জয়লাভ করে। কংগ্রেসের হিন্দু আসনে একচেটিয়া জয়লাভ করে। কিন্তু মুসলিম আসনে কংগ্রেস বাংলায় কোন আসন পায়নি। ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ ৩০টির মধ্যে ৩০ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৫২৫ টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৪৬৪টি আসন লাভ করে।
প্রাদেশিক মুসলিম আসনের ফলাফল
প্রদেশ – মোট আসন – মুসলিম লীগ
বাংলা – ১১৯ – ১১৪
বিহার – ৪০ – ৩৪
উড়িষ্যা – ৪ – ৪
যুক্ত প্রদেশ- ৬৬ – ৫৫
পাঞ্জাব – ৮৬ – ৭৯
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ-৩৮-১৭
সিন্ধু – ৩৫ – ২৮
বোম্বে – ৩০ – ৩০
মধ্য প্রদেশ – ১৪ – ১৪
মাদ্রাজ – ২৯ – ২৯
১৯৪৬ সালের ২ এপ্রিল বাংলায় মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি অধিবেশনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সর্বসম্মতিক্রমে পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন।
গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক ব্যারােজ শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আহবান জানান। মুসলিম লীগ কংগ্রেসকে নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে চায় এবং এ জন্য আলােচনা চলতে থাকে।
সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়ের পর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ৭-৯ এপ্রিল দিল্লিতে এ্যাংলাে এরাবিক কলেজে মুসলিম লীগ লেজিসলেটরস কনভেনশন আহবান করেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান লাহাের প্রস্তাব সংশােধন করেন । লাহাের প্রস্তাবের একাধিক রাষ্ট্র States এর ‘S’ বাদ দিয়ে State অন্তর্ভুক্ত করেন। তারা লাহাের প্রস্তাবের States- কে টাইপের ভুল বলে সংশােধন করেন। ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবে কোন রাষ্ট্রের নাম ছিল না। কিন্তু দিল্লির কনভেনশনে পাকিস্তান শব্দ অন্তর্ভুক্ত করেন। দিল্লি
পৃষ্ঠাঃ ৬৪
কনভেনশনে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সুকৌশলে তার সংশােধিত প্রস্তাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল কনভেনশনে উত্থাপন করান।
প্রস্তাবটি ছিল নিম্নরূপ :
প্রস্তাব গ্রহণ করা হল যে,
১. ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বে বঙ্গদেশ ও আসাম এবং উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধু ও বেলুচিস্তান অঞ্চলসমূহ যা পাকিস্তান অঞ্চল নামে অভিহিত এবং যেখানে মুসলমানরা প্রধান সংখ্যাগুরু তাদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হােক এবং অবিলম্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কার্যকর করার নিমিত্তে দ্ব্যর্থহীন প্রতিশ্রুতি দেয়া হােক।
২. স্ব-স্ব সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের জনগণ কর্তৃক দুটি পৃথক সংবিধান রচনাকারী সংস্থা গঠন করা হােক।
৩. ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কর্তৃক লাহােরে গৃহীত প্রস্তাবানুসারে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হউক।
৪. কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে মুসলিম লীগের সহযােগিতা ও অংশগ্রহণের অপরিহার্য শর্ত হলাে- মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবির স্বীকৃতি ও অবিলম্বে তা বাস্তবায়ন।
আবুল হাশিম উপরােক্ত প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করে বলেন, লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সম্মেলনে এবং তা বাতিল বা সংশােধন করার ক্ষমতা লেজিসলেটরস কনভেনশনের নেই। তিনি বেআইনী প্রস্তাব প্রত্যাহারের অনুরােধ জানান। অন্য কোন সদস্য জিন্নাহর প্রস্তাবের বিরােধিতা করতে সাহস পায়নি। প্রস্তাব গৃহীত হয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে সমালােচনা করা হলাে। বাংলার যুবসমাজ আহত হলাে, তারা যে আশা নিয়ে মুসলিম লীগকে বিজয়ী করেছে তা ভেঙ্গে চুরমার হচ্ছে- সামনে আরও দুর্দিন আসছে- দিল্লি কনভেনশনে জিন্নাহ ভারত ভাগ করে এক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবি করেন।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের চেষ্টা সত্ত্বেও কংগ্রেসের সাথে যৌথ মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব হলাে না। কংগ্রেস ও গান্ধী প্রাদেশিক কংগ্রেসকে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় যােগ দিতে নিষেধ করেন। যৌথ মন্ত্রিসভা হলে হয়ত বঙ্গ বিভাগ ঠেকানাে যেত । ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠন করেন ।
পৃষ্ঠাঃ ৬৫
মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ
এইচ এস সােহরাওয়ার্দী- প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র
আহমেদ হােসেন – কৃষি
খান বাহাদুর আবুল গােফরান – বেসামরিক সিভিল সাপ্লাই
খান বাহাদুর মােয়াজ্জেম হােসেন – শিক্ষা
খান বাহাদুর মােহাম্মদ আলী – জনস্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার
খান বাহাদুর এএফএস আবদুর রহমান – সমবায় ও সেচ
শামসুদ্দিন আহমেদ – বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প
যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল – বিচার ও পূর্ত
দ্বারকানাথ মুখার্জী – অর্থ
নগেন্দ্র নারায়ণ রায়
তারকানাথ বাড়ৈ
ফজলুর রহমান
কেবিনেট মিশন-১৯৪৬
ভারতের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৬ সালের ২০ মার্চ ৩ সদস্যবিশিষ্ট কেবিনেট মিশন প্রেরণ করে। কেবিনেট মিশনের সদস্য ছিলেন ভারত-সচিব স্যার প্যাট্রিক লরেন্স, নৌ-বাহিনীর সচিব এবি আলেকজান্ডার এবং ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস। মিশন দু’মাসে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা করে ১৯৪৬ সালের ১৬ মে নিমােক্ত সুপারিশ পেশ করে :
১. ব্রিটিশ ভারত ও দেশীয় রাজ্যসমূহ সমন্বয়ে ভারতীয় ইউনিয়ন সংগঠিত হবে । কেন্দ্রের হাতে পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যােগাযােগ ।
২. অবশিষ্ট বিষয়সমূহ প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যের নিকট থাকবে ।।
৩. ভারতবর্ষকে তিনভাগে বিভক্ত করা হােক।
গ্রুপ-এ : মাদ্রাজ, বােম্বে, যুক্ত প্রদেশ, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উড়িষ্যা ।
১৬৭টি সাধারণ আসন ও ২০টি মুসলিম আসন।
গ্রুপ-বি : পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। ৯টি সাধারণ সদস্য, ২২টি মুসলিম আসন ও ৪টি শিখ আসন।
গ্রুপ-সি : বাংলাদেশ ও আসাম। সাধারণ আসন ৩৪ এবং মুসলিম আসন ৩৬।
২৪ মে, ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কেবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করে ।
পৃষ্ঠাঃ ৬৬
পাকিস্তান আন্দোলন
১৯৪৬ সালের ৬ জুন মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি কেবিনেট মিশন প্লান গ্রহণ করে।
ভারত কংগ্রেসের নতুন সভাপতি পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই হঠাৎ ঘােষণা করেন : We are entirely and absolutely free to determine- কেবিনেট মিশন প্লানকে পরিবর্তন বা সংশােধন করার ব্যাপারে আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন।
মুসলিম লীগ পণ্ডিত নেহরুর মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ১৯৪৬ সালের ২৭-২৯ জুলাই বােম্বে শহরে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করে। মুসলিম লীগ পর্বে যে কেবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করেছিল তা প্রত্যাখ্যান করে এবং পাকিস্তান দাবির প্রতি অঙ্গীকার করে প্রত্যক্ষ দিবস পালন ও ব্রিটিশ প্রদত্ত উপাধি ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
“সভায় উপস্থিত সকলে উপাধি প্রত্যাখ্যান শুরু করে। বাংলায় উপাধিধারী নেতা কম ছিল। ঢাকার নবাবজাদা নসরুল্লাহ মাইকে গিয়ে নবাবজাদা উপাধি বর্জন করলেন। মঞ্চ থেকে নেমে বসতেই আবুল হাশিম তাকে বললেন, হারামজাদা নসরুল্লাহ। তিনি খুব রেগে যান। তখন আবুল হাশিম বলেন, সলিমুল্লাহর ছেলে বলে তুমি নবাবজাদা- সেই নবাবজাদা তুমি অস্বীকার করেছ- তাহলে তুমি হারামজাদা। তার এ কথায় সকলে হেসে ওঠে।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন শুরু করেন। তিনি চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার আসামী ও বিপ্লবীদের মুক্তি দেন। তিনি জুন মাসে ঢাকা এলেন এবং নিজে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে দাঁড়িয়ে রাজবন্দীদের মুক্ত করে দেন। তিনি খাদ্য ও বস্ত্র সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে দুর্ভিক্ষের সুযােগ নিয়ে বাংলায় দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। ক্ষমতায় আসার পর অনেক নেতা-কর্মী পারমিট ব্যবসা শুরু করে দেয়। তাদের কর্মকাণ্ড দেখে কামরুদ্দীন আহমদ দুঃখ করে বলেন, কোথায় গেল আদর্শ, দেশসেবা ও পরােপকার। তিনি তার বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ গ্রন্থে লিখেছেন : “বাংলার মুসলমান পরিশ্রম করে ভাগ্য পরিবর্তন করতে শিখল না। ইতােপূর্বে শহীদ সাহেব বেসরকারী সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী থাকাকালীন একদল পরিষদ সদস্য পারমিট, লাইসেন্সের ব্যবসা করে হঠাৎ বড়লােক হয়ে গিয়েছিল। আমাদের দল সে কথা বলেই মুসলিম লীগ সংগঠন দখল করেছিল। আজ দেখা গেল মানুষ ‘লােভের দাস’ । সুযােগ পেলে প্রলােভনকে চরিতার্থ করার জন্যে সচেষ্ট হন না এমন লােকের অভাব দেখলাম যথেষ্ট। তারপর যা হবার তাই হলাে- সবাই কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে বেসরকারী
পৃষ্ঠাঃ ৬৭
সরবরাহ মন্ত্রী গােফরান সাহেবের বাসায় ও অফিসে ঘােরাঘুরি করতে লাগলেন আবুল মনসুর আহমদ সাহেব তার এক বইতে লিখেছিলেন যে , ‘ বাঙালির চরিত্র এমন যে, তারা বেহেস্তে গিয়েও পাচার ব্যবসা না করে পারবেন না। তাই বাঙালি যেখানে জন্মেছে সেখানে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দিতে। অবশ্যই তিনি যারা পারমিট লাইসেন্সের ব্যবসা করেছিলেন তাদের উদ্দেশ করেই উপরোক্ত মন্তব্য করেছিলেন। বাঙালী একবার ক্ষমতায় এলে টাকা করা ছাড়া আর কোন আদর্শ থাকে না। এর কারণ বােধ হয় শহীদ সাহেবের সময়ই মুসলমানদের জন্য এ সহজ ব্যবসাটির দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। আরও দেখলাম যে, অত সহজে টাকা করার ব্যবস্থা পেয়ে কেউ কষ্ট করে ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি হয়ে উঠল না। কোন কাজেই বােধ হয় বাঙালী ধরে রাখতে পারে না। নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্যে দীর্ঘ পথ না বেছে সবচেয়ে সহজ উপায় খুঁজতে থাকে এবং সেটাকে সমর্থনীয় বলে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট যুক্তির আশ্রয় নিতে পারেন।”৯
প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস- Direct Action Day ১৬ আগস্ট ১৯৪৬
১৯৪৬ সালের ৬ জুন মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করে । কারণ তাতে পাকিস্তানের স্বীকৃতি আছে। প্রথমে কংগ্রেস কেবিনেট মিশনের ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রুপ প্ল্যান গ্রহণ করেনি। তারা কনফেডারেশনে অংশগ্রহণ করতে চায়নি। তারা চায় শক্তিশালী ফেডারেশন। পরিশেষে তারা কেবিনেট মিশন প্ল্যান গ্রহণ করে এবং ১৯৪৬ সালের ৮ আগস্ট নেহরুর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। মুসলিম লীগ কংগ্রেসের অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিতে অস্বীকার করে এবং ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে পালনের ডাক দেয়। ১১ ও ১২ আগস্ট খাজা নাজিমউদ্দিন ও পাঞ্জাবের রাজা গজনফর আলী বক্তৃতা করে বলেন, তাদের সংগ্রাম ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে। তারা হিন্দুদের উত্তেজিত করে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী ১৬ আগস্ট ছুটির দিন ঘােষণা করে। কারণ অফিস আদালত ছুটি থাকলে দাঙ্গার ভয় থাকবে না। মুসলিম লীগ কলকাতা অকটার লেন মনুমেন্টের পাদদেশে সভা করছে। হাজার হাজার মুসলমান মিছিল সহকারে সভায় যােগ দেয়। ইতােমধ্যে শহরে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। সােহরাওয়ার্দী সভার সকলকে ফিরে যেতে বলেন। ১৬ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট দাঙ্গা চলে। সােহরাওয়াদী দাঙ্গা দমনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তিনি বারবার অনুরােধ করে সেনাবাহিনীর সাহায্য পাননি। ৫ দিনের দাঙ্গায় কলকাতায় চার হাজার লােক নিহত এবং কয়েক হাজার আহত হয়। কয়েক লক্ষ লােক কলকাতা ছেড়ে অন্য শহর বা গ্রামে চলে যায়। কলকাতায় দাঙ্গার সংবাদে ঢাকা ও নােয়াখালীতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।
পৃষ্ঠাঃ ৬৮
ঢাকায় মুসলিম লীগের বামপন্থী দল দাঙ্গা দমনে এগিয়ে আসে। ১৬ আগস্ট ১৮ আগস্ট ঢাকা শান্ত ছিল। ৩ নম্বর জনসন রােডের ফরওয়ার্ড ব্লকের অফিস ছিল। সেখানে ১৮ আগস্ট সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রীশ চ্যাটার্জি বীরেন পােদ্দার, জ্ঞান চক্রবর্তী, পংকজ ঘােষ, গিরিশ দাশ, অনীল রায়, তার স্ত্রী লীলা রায়, সমর গুহ এবং কামরুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ যুবনেতারা। কামরুদ্দিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. বেল এডিসি মনজুর মাের্শেদের সাথে দেখা করে শান্তি কমিটি গঠন করেন। সভাপতি শ্ৰীশ চ্যাটার্জী, সম্পাদক কামরুদ্দিন।
১৯ আগস্ট ঢাকা শহরে কয়েকজন নিহত হয়। ২৯ আগস্ট দাঙ্গা নোয়াখালীতে ছড়িয়ে পড়ে। পরে বিহারে দাঙ্গা মারাত্মক আকার ধারণ করে। মুসলিম লীগের সাপ্রদায়িক রাজনীতি এবং মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর একগুয়েমিতে কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হয়। মুসলিম লীগের উচিত ছিল অন্তর্বর্তী সরকারে যোগ দেয়া। তারা কার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম করল- সাধারণ মুসলিম লীগ নেতাকর্মীরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। একজন সচেতন মানবতাবাদী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। তিনি মুসলিম লীগ করলেও কখনও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি কামরুদ্দিনের নেততে গঠিত শান্তি কমিটি নিয়ে কাজ করেছেন।
ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করেন।
কলকাতা দাঙ্গার জন্য প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে দায়ী করে ১২ সেপ্টেম্বর কংগ্রেস তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর সােহরাওয়ার্দী আইনসভায় ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ২১ সেপ্টেম্বর অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ৮৫ ভােট এবং বিপক্ষে ১৩০ ভােট পড়ে। অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালের ১৪ নভেম্বর মহাত্মা গান্ধী নােয়াখালীর দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পৌছেন।
১৯৪৬ সালের ২৪ অক্টোবর মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যােগদান করে। মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগ হতে লিয়াকত আলী খান, আই আই চুন্দ্রিগড়, আবদুর রব নিশতার ও যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মন্ত্রিসভায় যােগ দেন । বাংলা থেকে একমাত্র যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল মন্ত্রিসভায় স্থান পান। অথচ ভারতের ১০ কোটি মুসলমানের ৪ কোটি শুধু বাংলায় বাস করে। জিন্নাহ প্রথম থেকে বাংলার মুসলমানদের প্রতি বৈরী ভাব পােষণ শুরু করেন।
বাংলার মুসলিম লীগকে প্রচার মাধ্যম আজাদ থেকে পূর্ণ মুক্ত করার জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৬৯
প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৪৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকার সম্পাদক হলেন বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ (১৮৯৮-১৯৭৯)। দৈনিক পত্রিকার সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হলেন তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া পত্রিকার ম্যানেজার ছিলেন নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী। পত্রিকায় একদল তরুন সাংবাদিক যােগ দেন। তারা হলেন মােহাম্মদ ওয়াজিউল্লাহ, মোহাম্মদ মােদাব্বের, খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, কে জি মােস্তফা, সিরাজ উদ্দীন হোসেন, রশিদ করিম, কবি আহসান হাবীব, রােকনুজ্জামান খান, মােহাম্মদ নাসির আলী, কবি গােলাম কুদ্দুস প্রমুখ। এ সকল তরুণ সাংবাদিক বিভাগােত্তরকালে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে লেখনীর মাধ্যমে উজ্জীবিত করেন।
১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় কাউন্সিল অধিবেশন
১৯৪৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ফজলুল হকের মুসলিম লীগে যােগদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। এ কে ফজলুল হক লীগে ফিরে এলে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। মওলানা আকরম খাঁ ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে মুসলিম লীগের সভাপতি পদে ইস্তফা দেন। ৩১ জানুয়ারি সভাপতি পদে এ কে ফজলুল হক ও আবুল হাশিম প্রার্থী হলেন। ১৯৪৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করা হয়। মুসলিম লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও দৈনিক ইত্তেহাদ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে আবুল হাশিম সােহরাওয়ার্দীর ওপর মনক্ষুন্ন ছিলেন। ঢাকা থেকে কাউন্সিলরদের নিয়ে কামরুদ্দিন আহমদ ও তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতা পৌছেন। তারা এসে দেখেন যুব জনমত শেরে বাংলার পক্ষে কাউন্সিল অধিবেশন সম্পর্কে কামরুদ্দিন আহমেদ বলেন :
“এদিকে ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি পদের জন্য প্রার্থী হন যদিও তখনও মাওলানা আকরম খার পদত্যাগপত্র সরকারীভাবে মুসলিম লীগের সম্পাদকের নিকট এসে পৌঁছায়নি। এর পরেই মাওলানা সাহেবের পদত্যাগপত্র আবুল হাশিম সাহেবের নিকট পৌছায় এবং আবুল হাশিম সাহেবও ঐ পদের জন্য প্রার্থী হন। আবুল হাশিম সাহেব সভাপতির ইস্তফাপত্র বিবেচনা ও পদত্যাগপত্র গৃহীত হলে সভাপতি নির্বাচনের জন্য ৯ ফেব্রুয়ারি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভা আহ্বান করেন। ফজলুল হক সাহেবে ছাত্রদের সমর্থন আদায় করার জন্য কলকাতায় একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও মুসলমান ছাত্রদের জন্য আরও
পৃষ্ঠাঃ ৭০
ছাত্রাবাস তৈরি করার পরিকল্পনা ছাত্রদের সম্মুখে পেশ করলেন। তার জন্য ইসলামিয়া কলেজের তৎকালীন উত্তর প্রদেশবাসী অধ্যক্ষ জুবেরী সাহেব ফজলুল হক সাহেবের পক্ষে নির্বাচনী অভিযান চালাতে থাকেন। অপরপক্ষে আবুল হাশিম সাহেবের পক্ষে যারা ছাত্রনেতা ছিলেন তাদের তাে বেশির ভাগ জুবেরী সাহেবের ছাত্র। ঢাকার কাউন্সিলরদের নিয়ে আমরা যখন কলকাতা পৌছলাম- তখনই আমার মনে হলো যে, যুব জনমত আমাদের বিপক্ষে। আমি আর শামসুল হক শহীদ সাহেবের বাসায় গেলাম রাতে, গিয়ে দেখি তার ওখান ফজলুর রহমান সাহেব রয়েছেন। আমরা শহীদ সাহেবকে বললাম যে, পরিস্থিতি এমন ঘােড়ালাে হয়ে গেছে অথচ কলকাতার কাউন্সিলররা আমাদের বললেন যে, আপনি এ ব্যাপারে কোন পক্ষই সমর্থন করতে চান না। সুতরাং কলকাতা কাউন্সিলররা নিরপেক্ষ থাকবে। তিনি উত্তর দেবার পূর্বেই ফজলুর রহমান সাহেব তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বললেন :
“Prime Minister has taken a very laudable attitude and he should not mix himself up with this politics of the monther- organization. Any one who would be elected would be welcomed by him and members of his cabinet.”
” আমি একটু অবাক হলাম। বললাম যে, যদি ফজলুল হক আজ মুসলিম লীগের সভাপতি হন তবে আগামীকাল তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন। শহীদ সাহেব কোন কথার মধ্যেই এলেন না। সুতরাং আমাদের আর কিছু করার থাকল না। ৯ তারিখে ছাত্ররা ভীষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগল মুসলিম ইনস্টিটিউটের সম্মুখে। রাস্তায় আবুল হাশিম সাহেবের উপর হামলার চেষ্টাও করল । মনে হলাে যেন লােহার রেলিং এবং গেট ভেঙ্গে বিক্ষোভকারীরা হলে ঢুকে পড়বে। ঠিক এ
সময় কোথা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব একাই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। আমি অবাক হলাম তার সাহস দেখ । অন্যান্য ছাত্রনেতা দোতলার সিঁড়ি ঘরে বসে বিক্ষোভ দেখছে। আমার ভয় হলাে যে, বিক্ষোভকারীরা শেষ পর্যন্ত গেট ভেঙ্গে ঢুকে পড়বে এবং সবাই ঝাপিয়ে পড়বে মুজিবুর রহমানের ওপর। যাক ইতিমধ্যে মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ডস সালারে- সুরা আই. আই. মােহাজের ও নায়েবে সালারে-সুরা জহিরুদ্দীন সাহেব তাদের গার্ডদের নিয়ে ঢুকে পড়ে পজিশন নিয়ে নিলেন। ভেতরেও গােলমালের আশঙ্কা দেখা দিত যদি এরই মধ্যে খবর পাওয়া না যেত যে, মাওলানা আকরম খাঁ সাহেবকে অনুরােধ করা হয়েছে তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করতে । বােঝা গেল সবটাই ছিল অভিনয়। প্রতিক্রিয়াশীল দলের ষড়যন্ত্র । বিশেষ করে খাজা
পৃষ্ঠাঃ ৭১
শাহাবুদ্দীনের একটি চাল। এক গুলিতে দুটো বাঘ শিকার। এ কে ফজলুল হক সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিভক্ত হলো বামপন্থী যুব সম্প্রদায়। ফজলুল হক সাহেব আবার বছর সাতেকের জন্য রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হলেন আর আবুল হাশিম সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। যেহেতু তিনি মনে করলেন যে- শহীদ সাহেব প্রথম থেকেই ষড়যন্ত্রের কথা জ্ঞাত ছিলেন এবং এ ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থাকলেও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তাই তিনি স্থির করলেন যে, তিনি আর মুসলিম লীগের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবেন না। আমরা তাকে বােঝাতে চেষ্টা করলাম যে, রাজনীতিতে অভিমানের স্থান নেই- অভিমান করে দূরে সরে গেলে সবাই কালক্রমে তাকে ভুলে যাবে, এমনকি তার বিগত তিন বছরে মুসলিম রাজনীতিতে যে দান তাও লােকে মনে রাখবে না। আমরা আরও বললাম যে, তার ঐ অভিমানের ফলে যে কেবল তারই ক্ষতি হবে তা নয়- শহীদ সাহেব হবেন খাজা পরিবারের পরবর্তী শিকার। আমরাও কতটা দাড়িয়ে থাকতে পারব তাও বলা যায় না। কিন্তু তিনি আমাদের কোন যুক্তিই মানলেন না এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি আকরম খাঁর নিকট একটি চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে বর্ধমান চলে গেলেন। আমরা ঢাকায় ফিরে এলাম নিরাশ হয়ে।”১০
আবুল হাশিম পরে উপলব্ধি করেন যে, তার মুসলিম লীগ সভাপতি পদে এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তার রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা-১৯৪৭
১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়াভেল ঘােষণা করেন, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে শাসন ক্ষমতা ভারতের নিকট অর্পণ করা হবে। লর্ড ওয়াভেলের নিকট ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ ছিল : ভারত বিভক্ত করে পাকিস্তান-ভারত দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করা এবং তাহলে হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বের অবসান হবে। লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে একমত হতে পারেননি। লর্ড ওয়াভেল বিশ্বাস করতেন ভারত বিভাগ হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান করবে না বরং আরও তীব্র হবে । বাধ্য হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের ২০ মার্চ পদত্যাগ করেন। ২১ মার্চ নতুন গভর্নর জেনারেল ব্রিটিশ রাজপরিবারের লর্ড লুইস মাউন্ট ব্যাটেন দায়িত্ব গ্রহণ করেন । তিনি ও তার স্ত্রী এডুইনা পণ্ডিত নেহরুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে আলােচনা করেন। তিনি ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান প্রস্তাব মেনে নেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭২
ইংরেজ সরকার পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করবে। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন বাংলা দাবি করেন। ১৯৪৭ সালের ২০ মে শরৎচন্দ্র বসুর বাসভবনে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শংকর বায়। সভায় আলােচনান্তে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসু । চুক্তির মূল বিষয় ছিল :
১. বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।
১ স্বাধীন বাংলার সংবিধানে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যার অনুপাতে আসন সংরক্ষণসহ যুক্ত নির্বাচনমণ্ডলী এবং বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে বঙ্গীয় আইনসভার নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে।
৩. সমানসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান সদস্যদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন হিন্দু।
৪. চাকরির ক্ষেত্রে সমতা রক্ষা করা হবে।
৫. ১৬ জন মুসলমান এবং ১৪ জন অমুসলমান নিয়ে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট অস্থায়ী সংবিধান রচনাকারী সংস্থা গঠন করবে।
প্রথমে গভর্নর জেনারেল মাউন্ট ব্যাটেন ও বাংলার গভর্নর বারােজ স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের সমর্থক ছিলেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সােহরাওয়ার্দীকে প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু ও কংগ্রেস স্বাধীন বাংলার ঘাের বিরােধিতা করেন। মহাত্মা গান্ধীও পরিশেষে শরৎচন্দ্র বসুকে বৃহত্তর বাংলার দাবি পরিহার করার পরামর্শ দেন। জিন্নাহ মাউন্ট ব্যাটেনকে বলেছিলেন: I shall be delighted, what is the use of Bengal without Calcutta. They had much better remain united and independent.”১১ তিনি স্বাধীন বাংলাকে স্বাগত জানালেন কারণ কলকাতা না পেলে বাংলাদেশের বাকি অংশ নিয়ে কি লাভ হবে ।
১৯৪৭ সালের ১৮ মে সােহরাওয়ার্দী ও কিরন শংকর রায় ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাত করেন। ভারত বিভাগের প্রস্তাব নিয়ে মাউন্ট ব্যাটেন ২১ মে লন্ডন পৌঁছেন। একই দিন জিন্নাহ ভারতের মধ্য দিয়ে একটা করিডর দাবি করলেন।
১৯৪৭ সালের ৩১ মে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বাহার মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করেন। সে সভাতে স্বাধীন বাংলার মৃত্যু হলাে ।
পৃষ্ঠাঃ ৭৩
মুসলিম লীগ বলতে থাকে সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মুসলিম লীগের পক্ষে কথা বলার অধিকার নেই। ১৯৪৭ সালের ২ জুন মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রে, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের নিকট ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিভাগ, পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব গ্রহণ করতে বলেন। নেহরু, জিন্নাহ ও সদার বলদেব সিং মাউন্ট ব্যাটেনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত হলাে : ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হবে। স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনার মৃত্যু হলো। ৫ জুন মুসলিম লীগ কাউন্সিল মাউন্ট ব্যাটেনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আবুল হাশিম ও হজরত মােহানী বক্তৃতা করতে চাইলে তাদের জিন্নাহ বক্তৃতার অনুমতি দেননি। ভােটে দিলে সকলে পক্ষে আল্লাহু আকবর বলে সম্মতি জানায়। বিপক্ষে আবুল হাশিম, ইফতেখার উদ্দীন ও ইসরত মােহানীসহ ৯ টি ভােট। বাংলা পৃথক প্রস্তাব পাস হয়ে গেল।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ঘােষণা অনুসারে সীমান্ত প্রদেশ ও আসামের সিলেটে গণভােট অনুষ্ঠিত হয়। সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই সিলেটে গণভােট অনুষ্ঠিত হয়। গণভােটে সিলেট পাকিস্তান রাষ্ট্রে যােগ দেয়।
পূর্ব বাংলার তফসিলী সম্প্রদায় যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে পাকিস্তানে যােগদানের সিদ্ধান্ত নেয় এবং পাকিস্তানের পক্ষে ভােট প্রদান করে।
এভাবে সােহরাওয়ার্দী-শরৎবসু-আবুল হাশিমের স্বাধীন বাংলার প্রস্তাবের অপমৃত্যু হলাে- কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের ফলে বাঙালী জাতি বিভক্ত হয় ধর্মের ভিত্তিতে। তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য অন্ধকারে নিপতিত হয়। জাতি হিসেবে তারা দিল্লি ও করাচীর নিকট বন্দী হলাে। পূর্ব বাংলার জনগণ ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। পশ্চিম বাংলা হয়ত চিরতরে দিল্লির কলােনিতে পরিণত হলাে।
ষড়যন্ত্রের এখানেই শেষ নয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। খাজা নাজিমউদ্দিন অর্থ দিয়ে মন্ত্রিত্বের লােভ দেখিয়ে আইনসভার সদস্যদের দলে নিয়ে আসেন। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদে পূর্ব বাংলার সদস্যদের ভােট গ্রহণ করা হয়। ১০৬-৩৫ ভােটে গৃহীত হয় যে, বাংলা বিভক্ত করা চলবে না- পশ্চিম বাংলার সদস্যদের ৫৮-২১ ভােটে বাংলা বিভাগের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। উভয় অংশের যুক্ত অধিবেশনে ১২৫-৯০ ভােটে বাংলা বিভাগের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হলাে। বাংলা বিভাগের প্রস্তাব গৃহীত হলে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সংবাদপত্রে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, “আশা-নিরাশার
পৃষ্ঠাঃ ৭৪
যন্ত্রণার ইতি হলাে অবশেষে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রের আদর্শের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।”১২
সোহরাওয়ার্দীর ভক্তগণ তাকে মন্ত্রিত্ব ও টাকা দিয়ে এমএনএদের দলে আসতে অনুরােধ করেন। সােহরাওয়ার্দী এ প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, টাকা দিয়ে নেতা হবার শখ তার নেই।
বামপন্থী নেতারা আবুল হাশিমকে নেতা নির্বাচনে সােহরাওয়ার্দীকে সমর্থন করার উপদেশ দেন। তিনি বলেন, আমার কিছু করার নেই। আমার নির্বাচনে শহীদ সাহেব যেমন নিরপেক্ষ ছিলেন তার নির্বাচনেও আমরা নিরপেক্ষতা বজায় রাখব। আমার মনে হয় আবুল হাশিম সাহেবের এ সিদ্ধান্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া মেনে নেননি- আর সেদিন থেকেই তাদের মধ্যে হাশিম সাহেবের সকল সম্পর্ক কেবল ছিন্ন হয়নি। শেষ পর্যন্ত তিক্ততায় পৌছেছিল ।
৫ আগস্ট নেতা নির্বাচন। সিলেটের ১৭ জন পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শামসুদ্দিন খাজা নাজিমউদ্দিনের দলে ভিড়লেন। সিলেট থেকে ৩ জন ও শামসুদ্দিনকে মন্ত্রী করা হবে। জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের নির্দেশে ৫ আগস্ট কেন্দ্রিয় লীগ নেতা আই আই চুন্দ্রিগড়ের সভাপতিত্বে নেতা নির্বাচন হয় । খাজা নাজিমউদ্দিন পেলেন ৭৫ ভােট এবং সােহরাওয়ার্দী পেলেন ৩৯ ভােট। কি বিচিত্র বাংলাদেশ! হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী তাকে বঞ্চিত করার জন্য ছিল এ ভােট পর্ব। ১৩ আগস্ট হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষকে এবং পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে দায়িত্ব অর্পণ করেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী ও আবুল হাশিম পশ্চিম বাংলায় থেকে যান।
দিল্লি মুসলিম লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে তাজউদ্দীন আহমদ
১৯৪৭ সালের ৫ জুন দিল্লিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার কাউন্সিলরদের সাথে তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লির অধিবেশনে যােগ দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। অধিবেশনে ভারত বিভাগ, বাংলা বিভাগ ও পাকিস্তান প্রস্তাব আলােচনা করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে ও স্বাধীন বৃহত্তর বাংলার সমর্থক ছিলেন।
এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লি হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জেয়ারত করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭৫
বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার নেতৃদ্বয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিচারপতি ব্যারিস্টার জাহিদুর রহিম সােহরাওয়ার্দী এবং মাতা খুজিস্তা আখতার বানু। সােহরাওয়াদী পরিবার উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম পরিবার। বাংলার মুসলিম জাগণের অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন সােহরাওয়ার্দীর নানা মওলানা ওবায়দুল্লাহ সােহরাওয়ার্দী (১৮৩৪-১৮৮৬)। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯০৭ সালে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে প্রবেশিকা, ১৯০৯ সালে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফএ এবং ১৯১১ সালে বিএসসি অনার্স পাস করেন। ১৯১৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আরবী ভাষায় এমএ পাস করে উচ্চ শিক্ষার জন্য লন্ডন গমন করেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি অনার্স, জুরিসপ্রুডেন্সে বিসিএস ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি ও ইংরেজী ভাষায় এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি গ্রেস ইন হতে বার এট ল পাস করে ১৯২০ সালে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি স্যার আবদুর রহিমের কন্যা নিয়াজ ফাতেমাকে বিয়ে করেন। ১৯২২ সালে নিয়াজ ফাতেমা এক পুত্র ও এক কন্যা রেখে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্র অক্সেফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাককালে ১৯৪০ সালে অকালে প্রাণত্যাগ করেন। কন্যা আখতার সুলায়মান ১৯৮২ সালে করাচিতে মৃত্যুবরণ করেন। সােহরাওয়ার্দীর রাশিয়ান স্ত্রীর গর্ভে পুত্র রাশেদ সােহরাওয়াদী লন্ডনে বাস করছেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯২১ সাল হতে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। তিনি প্রথমে শ্রমিক ও কংগ্রেস রাজনীতি করতেন। তিনি দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এ কে ফজলুল হকের সাথে বেঙ্গল প্যাক্ট চুক্তি করেন। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা করপােরেশনের মেয়র এবং সােহরাওয়ার্দী ডেপটি মেয়র নির্বাচিত হন। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন করপােরেশনের প্রধান নির্বাহী অফিসার। বেঙ্গল প্যাক্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে মিলন প্রতিষ্ঠা করা। ১৯২৫ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর হিন্দু-মুসলমানের মিলনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় ।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী ১৯৩৬ সালে মুসলিম লীগে যােগ দেন এবং ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইনসভার এমএলএ নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের স্ত্রী সভায় যােগ দেন। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ
পৃষ্ঠাঃ ৭৬
সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৪ সালে তার স্থলে আবুল হাশিম মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সাল হতে সােহরাওয়াদা-আবুল হাশিম মুসলিম লীগকে সুসংগঠিত করেন। ১৯৪৪ সালে ছাত্র তাজউদ্দীন আহমদ হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী আবুল হাশিম ও শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্পর্শে আসেন। তাদের প্রেরণায় তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবি করেন। তাদের বৃহত্তর বাংলার দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাংলা বিভক্ত হয়ে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় । ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তার উদ্যোগে পাকিস্তানে প্রথম বিরােধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। তার সুপারিশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। হােসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাজউদ্দীন আহমদকে আওয়ামী লীগ থেকে ঢাকার কাপাসিয়া আসনে মনােনয়ন দেন। বিপুল ভােটে তাজউদ্দীন আহমদ এমএলএ নির্বাচিত হন।
১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৩ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি বলেন, ” গণতন্ত্রই হচ্ছে প্রগতি ও বিবর্তনের একমাত্র নিশ্চিত পথ ।” তার সময় প্রথম জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার অধিবেশনে যুক্ত নির্বাচন বিল পাস হয়। ব্রিটিশ সরকার উপমহাদেশে ধর্মভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু করে। প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচন আইন পাস হয়। ১৯৫৬ সালের ১০ অক্টোবর জাতীয় পরিষদে দ্বিজাতি তত্তের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “ দেশ বিভাগ এবং ভৌগােলিক সান্নিধ্য বিশিষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলাে সমভাবে রাষ্ট্র গঠনের সমর্থনে মুসলমানেরা যে দ্বিজাতি তত্ত্বের মতবাদ তখন পেশ করেছিল, সে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে তার কার্যকারিতা মুসলমানদের জন্য নিঃশেষিত হয়েছে। পৃথক নির্বাচনে হিন্দু ভােটাররা তাদের এবং মুসলমান ভােটাররা তাদের সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে- এ পদ্ধতিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠতে পারে না। তাই বৃহত্তর জতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যুক্ত নির্বাচন প্রথার প্রবর্তন করেন। তার সময় পূর্ব পাকিস্তানে ও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এক ইউনিট ও প্যারিটি পদ্ধটি বাস্তবায়নের ফলে পূর্ব পাকিস্তান অধিক স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে
পৃষ্ঠাঃ ৭৭
সুযােগ-সুবিধা পায়। আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের পথ সহজতর হয়। সেনাবাহিনী ও বেসরকারী চাকরিতে বাঙালীরা অর্ধেক চাকরি পেতে থাক। ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গ যায়, সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভাত পতন হয়। ১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি হয়। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। তিনি জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেন, সংবিধান বাতিল করেন। ১৯৫৯ সালে মৌলিক গণতন্ত্র প্রথা চালু করেন এবং ১৯৬২ সালের ৩০ জানয়ারি হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। তার মুক্তির দাবিতে ছাত্র সমাজ প্রচণ্ড আন্দোলন করে। ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট তাকে মুক্তি দেয়া হয়। তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য ১৯৬২ সালের ৫ অক্টোবর ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-এনডিএফ প্রতিষ্ঠা করেন। বয়স্কদের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তিনি ১৯৬৩ সালের ৩ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। চিকিত্সার জন্য তিনি বৈরুত গমন করেন। ১৯৬০ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি বৈরুতের একটি হােটেলে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ৮ ডিসেম্বর ঢাকার শেরে বাংলার মাজারের পাশে দাফন করা হয়। সােহরাওয়ার্দীর তিরােধানের পর এনডিএফ দুর্বল হয়ে পরে। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করেন। তাদের নেতৃত্বে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ১৯৭১ সালে আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।
আবুল হাশিম
তাজউদ্দীন আহমদ তার রাজনৈতিক জীবনে তৎকালীন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। আবুল হাশিম মুসলিম লীগের প্রগতিশীল দলের নেতা, ইসলামের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিলেন ।
আবুল হাশিম ১৯০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার কাশিয়াড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবুল কাশেম এবং মাতা মােকাররমা খাতুন । পিতা আবুল কাশেম বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য এবং শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি শেরে বাংলা ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন।
আবুল হাশিম বর্ধমান থেকে ১৯২৩ সালে মেট্রিক, বর্ধমান কলেজ থেকে ১৯২৫ সালে আইএ, ১৯২৮ সালে বিএ এবং ১৯৩২ সালে কলকাতা
পৃষ্ঠাঃ ৭৮
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাস করেন। তিনি ১৯২৮ সালে শাহ সৈয়দ জিয়াউদ্দিনের কন্যা মাহমুদা আখতার মেহের বানুকে বিবাহ করেন।
১৯৩৭ সালে তিনি জিন্নাহর আহবানে মুসলিম লীগে যােগ দেন এবং বর্ধমান থেকে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তিনি লাহোরে মুসলিম লীগ সম্মেলনে যােগ দেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার উদ্যোগে ১৯৪৪ সালে ঢাকার মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কার্স ক্যাম্প অফিস স্থাপন । তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৪ সালের প্রতিষ্ঠাকাল হতে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সর্বক্ষণিক কর্মী ছিলেন।
১৯৪৬ সালে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শরৎ বসুর সাথে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবি করেন। ১৯৫০ সালে তিনি বর্ধমান ও কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি খেলাফতে রব্বানী পাটি গঠন এবং যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন।
আবুল হাশিম ১৯৬০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক এবং ১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। বাংলাদেশে আবুল হাশিমকে যথাযথ মর্যাদা দেয়া হয়নি। অথচ তিনি ছিলেন অনেক নেতার রাজনৈতিক গুরু। তাকে জুরাইনে ৬ অক্টোবর কবর দেয়া হয়। তার পুত্র বামপন্থী নেতা বদরউদ্দিন ওমর। আবুল হাশিম একজন বিখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও পণ্ডিত ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে The Creed of Islam, Intergration of Pakistan, In Retrospection প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
আসাম-বাংলা নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবক
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক
এ কে ফজলুল হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন । তার পিতা মুহাম্মদ ওয়াজেদ ও মাতা সৈয়েদুন্নেসা খাতুন । ফজলুল হক ১৮৮৯ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজ হতে ১৮৯১ সালে
পৃষ্ঠাঃ ৭৯
এফএ, ১৮৯৪ সালে বিএ অনার্স এবং ১৮৯৫ সালে অঙ্কে এমএ পাস করেন। ১৮৯৭ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএল পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সরকারী চাকরিতে যােগ দেন। ১৯১১ সালে সরকারী চাকরি ত্যাগ করে কলকাতা হাইকোর্টে যােগ দেন। ১৯১৩ সালে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালে তিনি বাংলার শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৩০ সালে তিনি লন্ডনে গােলটেবিল কনফারেন্সে যােগ দেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তিনি লাহাের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালে তার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা হাইকোর্ট মাজারের পিছনে সমাহিত করা হয়েছে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক গুরু। মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন । তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শদাতা ছিলেন মওলানা ভাসানী।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ শরাফত আলী খান এবং মাতার নাম মজিরন বিবি। তারা ৩ ভাই এক বােন। শিশুকালে হামিদ খান পিতা মাতা হারান। তার ডাকনাম ছিল চেগা মিয়া। শিশুকালে তার দিনগুলাে ছিল দুঃখকষ্টের। তিনি ধানগড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। স্থানীয় জমিদারের সাথে সংঘাত শুরু হয়। বাল্যকাল হতে তিনি কৃষক আন্দোলন শুরু করেন। তিনি পীর শাহ নাসিরউদ্দিনের সাথে আসামে চলে যান। আসামে বহিরাগত বাঙালীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হন। ১৯২৪ সালে তিনি আসামের ধুবড়ির ভাসানচরে কৃষক সম্মেলন আহবান করেন। সম্মেলনের পর জনগণ তাকে ভাসানী নামে ডাকতে থাকে। ১৯২৫ সাল হতে তিনি আসাম-বাংলায় ভাসানী নামে পরিচিতি লাভ করেন। তার নেতৃত্বে আসামে লাইন প্রথা বিলােপের আন্দোলন চলে। ভাসানী আসামে মুসলিম লীগ সভাপতি ছিলেন এবং
পৃষ্ঠাঃ ৮০
১৯৩৭ সালে তিনি আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি আসাম ও বাংলাকে নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে সিলেট রেফারেন্ডামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি সন্তোষে চলে আসেন। ১৯৪৮ সালে তিনি উপনির্বাচনে টাঙ্গাইল থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তাকে সভাপতি করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। ১৯৫৭ সালে তার নেতৃত্বে ন্যাপ গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি মৃত্যবরণ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৮১
৩
পাকিস্তানের রাজনীতি
বিরােধী দলের ভূমিকায় তাজউদ্দীন আহমদ
১৯৪৭ সালের জুন মাসে যেদিন স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল সেদিন আমরা ঢাকা এবং পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলার কর্মীরা আবুল হাসিম সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলাম। কারণ তিনি স্থিরই করেছিলেন যে, তিনি পাকিস্তানে আসবেন না। আমাদের অতঃপর করণীয় সে সম্বন্ধে আলােচনাকালে তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন যে, পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের একটা যুক্তফ্রন্ট সৃষ্টি করার মধ্য দিয়েই কেবল আমরা ফ্যাসিবাদী মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা ও আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে পারব। ঢাকায় ফিরে এসেই আমরা আমাদের পার্টির লােকদের আমার বাসায় ডাকি এবং সেখানে গণআজাদী লীগ (Peoples Freedom League) গঠন করা হয় এবং একটি ম্যানিফেস্টো তৈরি করে পার্টির কর্মীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকল কর্মীর দ্বারা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ‘কনভেনর’ নিযুক্ত করা হয়। যারা প্রথম কমিটিতে ছিলেন তারা হলেন- তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােহা, অলি আহাদ, তােসাদ্দক আহমদ এবং সৈয়দ মােহাম্মদ আলী প্রমুখ | শামসুল হক আবুল হাসিম সাহেবের সঙ্গে বর্ধমান চলে গেলেন। শামসুল হক তখন আল্লামা আজাদ সােবাহনী ও আবুল হাশিম সাহেবের সঙ্গে রবুবিয়াৎও রব্বানিয়াতের তত্ত্ববিষয়ক আলােচনায় অংশগ্রহণ করছেন। যার ফলে পরে পূর্ববঙ্গে এসে তার পুস্তক ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ইসলাম’ প্রকাশ করেন। তিনি গণ-আজাদী লীগের ম্যানিফেস্টোর সঙ্গে একমত হননি তাই আমাদের সঙ্গে যােগ দেননি। যার ফলে তার নিজস্ব কর্মী বন্ধুরাও আমাদের সঙ্গে যােগ দেননি। আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলাে। অর্থাৎ আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অর্থনৈতিক ভিত্তিতে পার্টি গড়ার চেষ্টা করেছিলাম পাকিস্তান হবার দু’মাস আগেই। গভর্নর জেনারেল মাউন্ট ব্যাটেনের ১৯৪৭ সালের ৩ জুনের ঘােষণার প্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি শেষ হলাে। ছাত্র ও যুব সমাজ হতাশ হয়ে পড়ে। তাদের নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ঢাকায়
পৃষ্ঠাঃ ৮২
আসবেন না। যুব সমাজ ভেঙ্গে পড়ে। তারা নেতাশূন্য হয়ে পড়ে। এ সময় কামরুদ্দিন আহমদ আবুল হাশিমের পরামর্শ চাইলেন । তিনি তাদের একটি দল গঠন করে মুসলিম লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার পরামর্শ দেন। কলকাতার মুসলিম ছাত্ররা সিরাজউদ্দৌলা হলে একত্রিত হয়ে একটি বিকল্প দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ঢাকার ছাত্র-যুবনেতাদের দল গঠনের অনুরােধ জানায়।
এমন সময় রাজশাহীর মাহবুবুল হকের মারফত নুরুদ্দীন সাহেবের একখানা চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন বামপন্থী যুবকদের একত্র করে একটি গণতান্ত্রিক যুব সংস্থা করার জন্য তারা কলকাতায় বসে এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন এবং আরও স্থির করেছেন যে, ঢাকায় সে কনফারেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। অথচ তখন সাহেবে আলম ঢাকার ভাড়াটিয়া গুণ্ডাদের নিয়ে আমাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। এমনকি শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেব নিরাপত্তার জন্য কাদের সর্দার সাহেবের একটি ঘরে বাস করছেন এবং সেখানে বসেই ওকালতি করছেন। তা সত্ত্বেও সৈয়দ সাহেবে আলম ট্রাকে করে একদিন হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়লেন। তাকে অপমান করার জন্য কারণ তিনি নাকি অনেক লােকের এক বৈঠকে জিন্নাহ সাহেবকে খরদজ্জালের সঙ্গে তুলনা করেছেন – কথাটা হয়ত সত্য কারণ ফজলুল হক সাহেব প্রায়ই ঐ রকম কথা বলতেন। উকিল লাইব্রেরিতে বসে একদিন বলেছিলেন : খর-দজ্জালের চেহারা কেমন হবে তা তােমরা জান?” তারপর তিনিই উত্তর দিলেন- ‘তার এক চোখ কানা- স্বর্গে এক পা আর মর্তো এক পা। নাম বলেননি তবে আমরা বুঝেছিলাম যে, জিন্নাহর মনােকল ব্যবহার আর তার পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানে দু’পায়ে দাড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত। এমনকি একবার পকেট থেকে আট শ’ টাকা হারিয়ে গেলে নােট খাতায় লিখে রাখলেন আট শ টাকা- জিন্নাহ ফান্ড । রিকশাওয়ালা হাইকোর্টে যাবার ভাড়া ঠিক করল বারো আনা- হাইকোর্টে পৌছিয়ে দিয়েই চাইল এক টাকা। তিনি দিলেন টাকাটা- বাড়ি এসে নােট করলেন- বারাে আনা রিকশা ভাড়া, চার আনা জিন্নাহ ফান্ড। একদিন হঠাৎ নােট বইটা আমার হাতে পড়ল- লঅনেক পৃষ্ঠায়ই দেখলাম তিনি প্রায়ই জিন্নাহ ফাণ্ডে চাঁদা দিয়েছেন । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম : ‘নানা, আপনি জিন্নাহকে গালি দেন অনবরত অথচ জিন্নাহ ফান্ডে চাদাও দেন দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি উত্তরে বললেন : “যে টাকার হিসেব মিলে না- যে টাকা লােকে আমাকে ঠকিয়ে নেয়, যে টাকা চুরি হয় সে তাে সবই জিন্নাহ ফান্ডেই যায়, নইলে যায় কোথায়। এই যে প্রতিটি ওকালতনামার ওপর “কায়েদে আজম রিলিফ ফান্ডে’ পয়সা দিয়ে যাচ্ছে তার হিসাব কি কোনদিন
পৃষ্ঠাঃ ৮৩
কোন কাগজে দেখেছ?’ তার কথার মধ্যে ব্যঙ্গ ও খেদ, দুটোই মিশ্রিত থাকত। তাই বলে যে মানুষটি স্যার সলিমুল্লাহর সঙ্গে কাজ করেছেন তাকেই সলিমুল্লাহর বােন আমিনা বিবির ছেলে গুণ্ডা দিয়ে অপমান করছে- আর মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন অন্তরে আনন্দ পাচ্ছেন- এ যেন দশ বছর আগে পটুয়াখালীর নির্বাচনে পরাজয়ের প্রতিশােধ।
নুরুদ্দীন সাহেবের চিঠি পাবার কয়েকদিন পরেই রাজশাহীর আতোয়ার রহমান এলেন ঢাকায় পরামর্শ করতে- সভার স্থান কেথায় হবে। কলকাতার কর্মীরা ধরে নিয়েছিলেন যে, আমরা জেলা বার-লাইব্রেরিতে করতে পারব৷ আমি তাঁকে, তােসাদ্দক আহমদ, সৈয়দ মােহাম্মদ আলী, তােহা সাহেব ও তাজউদ্দীন সাহেবের উপস্থিতিতে অবস্থাটা বিশ্লেষণ করলাম। একমাত্র স্থান আমি বললাম যেখানে গুণ্ডারা মারামারি করতে পারবে না সে হলাে আবুল হাসনাত সাহেবের বাড়ি, তার ‘লন’ প্রকাণ্ড নানা ফুলে-ফলে সাজানাে, সুতরাং তিনি রাজি হবেন কি না তাঁর সঙ্গে আলাপ না করে বলা যাবে না।
আমার যতদূর মনে পড়ে আমি ও শামসুল হক তার বাড়ি গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি বেশ সহজেই রাজি হলেন- কারণ বহু বছর পর্যন্ত তিনি ছিলেন মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস-চেয়ারম্যান- খাজা নাজিমুদ্দীনের তখন ইচ্ছা হয়েছে সৈয়দ সাহেবে আলমকে ভাইস-চেয়ারম্যান করবেন এবং সেটা হাসনাত সাহেবকে বলা হয়েছে। তিনি কোন তর্ক করেননি খাজা সাহেবের সঙ্গে, কিন্তু অন্তর তাঁর জলে যাচ্ছিল। সুতরাং আমাদের চেয়ে দেখলাম তিনিও কম ক্ষিপ্ত নন আহসান মঞ্জিলের প্রতি। তার একটু দুর্বলতা ছিল খাজা হাবিবুল্লাহর জন্য। কিন্তু তিনি অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হবার পরে আর সে দুর্বলতা রইল না। এভাবেই স্থান সম্বন্ধে আমরা অনেকটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌছলাম। এরপর ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে আমাদের পুরনাে পার্টি অফিসে এক বৈঠক বসে এবং একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। আমি ঐ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছিলাম যেহেতু এককালে ঐ পার্টি হাউসের নেতৃত্বের ভার আমার ওপর ছিল। যুবক বলতে কি বােঝাবে সে সম্বন্ধে আলােচনা করে ঠিক হলাে যে, যারা ত্রিশ বছর বয়স পেরােয়নি- তাদেরই ‘যুবক’ বলে চিহ্নিত করা হবে। অবশ্য তাদের মধ্যে যারা সাম্প্রদায়িকতার সমর্থক তাদের বাদ দেয়া হবে। ১৯৪৩ সালে আমার ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে- সুতরাং আমি কেবল তাদের সমর্থন করতে পারি, সাহায্য করতে পারি কিন্তু তাদের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে পারি না। স্থির হলাে অধিবেশন বসবে সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে আর তার প্রস্তুতি নেবার জন্য ভার নিলেন সর্বজনাব তােসাদ্দক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, অলী আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা ও আবদুল আউয়াল।
পৃষ্ঠাঃ ৮৪
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে প্রফেসর আবুল কাসেম তমদুন-মজলিস নামে একটি সংস্থা গঠন করেন। নূরুল হক ভূঞা সাহেব ঐ সংস্থার কনভেনর নিযুক্ত হন। সংস্থাটি ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রথম থেকেই ঐ সংগঠন বাংলা ভাষা সর্বত্র প্রচলন করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারা সভা, সিম্পােজিয়াম, পুস্তিকা প্রকাশ ও খবরের কাগজের মাধ্যমে তাদের আন্দোলন এগিয়ে নিতে চাইছিলেন। পরে তাদের ধারণা হয় যে, ছাত্র এবং রাজনীতিবিদদের সাহায্যের প্রয়ােজন আন্দোলনে সফলতা লাভ করার জন্য।
ঐ সময় শাহ আজিজুর রহমান সাহেবের নিখিলবঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল একমাত্র মুসলমান ছাত্র প্রতিষ্ঠান। শাহ আজিজুর রহমান সাহেব খাজা সাহেবদের দলে- সুতরাং শহীদ সাহেব ও আবুল হাশিম সাহেবের দলীয় ছাত্রনেতারা স্থির করেন যে, অন্য একটি ছাত্র সংগঠন করা প্রয়ােজন। বিভিন্ন জেলার কয়েকজন ছাত্রনেতা একত্র হয়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। নইমুদ্দীন সাহেব ঐ সংস্থার ‘কনভেনর’ হন এবং অলী আহাদ সাহেব শহর ছাত্রলীগের কনভেনর হন।
সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতা থেকে অনেক ছাত্র এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে থাকে এবং শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান এবং খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবদের নেতৃত্বে মােগলটুলী অফিসে ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ প্রতিষ্ঠিত হয়। শামসুল হক সাহেব ঐ ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কনভেনর হন। ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ সেসব যুবককে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় যারা শহীদ সাহেব অথবা আবুল হাসিম সাহেবের জন্য মুসলিম লীগে কাজ করেছেন তারা সবাই পুনরায় মুসলিম লীগ দখল করার প্রচেষ্টা চালাবার জন্যেই ঐ ‘ক্যাম্প’ গঠন করেছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা বােকা বনলাম- কারণ আবুল হাশিম সাহেবের শেষ উপদেশ ছিল- ১৯৪৭ সালের জুন মাসে যে বামপন্থীদের একতা গড়ে তুলতে হবে। তাই আমি ঢাকায় এসে গণ-আজাদী লীগ গঠন করি। যার ভিত্তি সেই লাহাের প্রস্তাব- পূর্ব পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং দুটো পাকিস্তান একত্র থাকতে হলে কি ভিত্তিতে থাকবে তা পরে নিরূপণ করবে দু’দেশের লােকেরা। তাই আমরা বললাম, বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা তারাই স্থির করবেন। আবার যদি কেন্দ্র গঠিত হয় তবে দু’দেশের রাষ্ট্রভাষাই কেন্দ্রের রাষ্ট্রভাষা হবে যেমন- বেলজিয়াম, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান হবার পরে যারা ঢাকা এলেন তাদের মধ্যে দেখলাম যত সত্বর সম্ভব ক্ষমতায় যাবার প্রচেষ্টাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আমার মনে হলাে ৬ সেপ্টেম্বর
পৃষ্ঠাঃ ৮৫
গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হবার পর বামপন্থী ঐক্যের প্রশ্নটাও যেন তার বিশেষত্ব হারাল। এরপর বাকি রইল যে- কারা কলকাতা যাবে পরের বছর দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার যুব-সম্মেলনে।১
নতুন দল গঠন প্রসঙ্গে কামরুদ্দিন আহমদ লিখেছেন : ঢাকা ফিরে এসেছি আমরা আমাদের পার্টির লােকদের আমার বাসায় ডাকি এবং সেখানে গণআজাদী লীগ (Peoples Freedom League) গঠন করা হয় এবং একটি মেনিফেস্টো তৈরি করে পার্টির কর্মীদের নিকট পাঠিয়ে দেয়া হয়। সকল কর্মীর দ্বারা নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আমাকে কনভেনর নিযুক্ত করা হয়। যারা প্রথম কমিটিতে ছিলেন তারা হলেন : তাজউদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােহা, অলি আহাদ , তোসাদ্দক আহমদ এবং সৈয়দ মােহাম্মদ আলী প্রমুখ ।…
আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো অর্থাৎ আমরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও অর্থনৈতিক ভিত্তিতে পার্টি গড়ার চেষ্টা করেছিলাম পাকিস্তান হবার দু’মাস আগেই।
শামসুল হক আবুল হাসিমের সাথে বর্ধমানে চলে যান। শামসুল হক তখন আল্লামা আজাদ সােহবাহনী ও আবুল হাশিমের সাথে রবুবিয়াত ও রব্বানিয়াতের আলােচনায় অংশগ্রহণ করছেন। তিনি গণআজাদী লীগে যােগ দেননি।
ঢাকা ও কলকাতার ছাত্র-যুবক একত্রিত হয়ে ১৯৪৭ সালেই যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৪৭ সালের জুলাই মাস থেকে লেখা ডায়েরিতে নতুন দল গঠনের যে তথ্য পাওয়া যায় তা নিয়ে আলােচিত হলাে।
১৯৪৭ সালের ১৪ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদ খাজা নাজিমউদ্দিন বিশেষ করে হাফিজুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে সমালােচনা লেখে তা দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য আরএমএস অফিসে (পােস্ট অফিস) পৌছেছেন।
ঢাকা শহর মুসলিম লীগ দু’দলে বিভক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে সমঝােতার জন্য ১৯৪৭ সালের ২২ জুলাই মুসলিম লীগ অফিসে শামসুল হক সভা আহবান করেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন- আতাউর রহমান খান, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, হাসমত, সেকান্দার মাস্টার, মহিউদ্দিন, আউয়াল, কামরুদ্দিন, তােয়াহা, আজিজ আহমেদ, মতিন চৌধুরী, হযরত আলী, ডাঃ নূরুর রহমান, এম এ রহিম, শামসুল হুদা।
২৩ জুলাই, ১৯৪৭
অলি আহাদ সন্ধ্য ৬টায় আজিজ সাহেব ও আমাকে কামরুদ্দিন সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। মি. তােয়াহা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরে মহিউদ্দিন
পৃষ্ঠাঃ ৮৬
এলেন। এরপর কামরুদ্দিন সাহেবকে ছেড়ে তােয়াহা সাহেব, অলি আহাদ ও আমি আমাদের মেনিফেস্টো সম্পর্কে আলাপ করলাম | ৩ আগস্ট বিভক্ত জেলার কর্মীদের একটা সভা ডাকা হবে। সিদ্ধান্ত হলাে মেনিফেস্টো গ্রহণ করতে হলে শামসুল হক সাহেবকে কাজের ধারা থেকে সরিয়ে রাখতে হবে।
৫ আগস্ট, ১৯৪৭
মেনিফেস্টো তৈরি সংক্রান্ত সভায় তাজউদ্দীন আহমদ লিখেছেন : সভায় উপস্থিত ছিলেন এম এ আশরাফ, নাজমুল করিম, তােয়াহা, তাসাদ্দক আজিজ আহমেদ, অলি আহাদ, বাহাউদ্দিন। মেনিফেস্টোতে দেখা যায়, মুসলিম লীগের ভেতরে একটি পার্টি হবে।
৫ আগস্টের ডায়েরিতে তাজউদ্দীন লিখেছেন : খাজা নাজিম উদ্দিন ৭৫-৩৯ ভোটে বেঙ্গল এসেমব্লি পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছেন।
৬ আগস্ট, ১৯৪৭
ঢাকা নগর মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন পরিকল্পনার জন্য নাজির লাইব্রেরীতে সভা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন হাবিবুর রহমান, তাসাদ্দুক, আজিজ আহমেদ, মহিউদ্দিন, ওয়াদুদ পাটোয়ারী, শামসুদ্দিন, আউয়াল, তাজউদ্দীন আহমদ।
৭ আগস্ট, ১৯৪৭
বেলা ২টায় কামরুদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়ে একটি মেসিফেস্টো টাইপ করলাম। তােয়াহা সাহেব, নূরুল ইসলাম চৌধুরী ও অন্যান্য পরামর্শ দিলেন আমাদের দলের নাম হােক- পাকিস্তান পিপলস ফ্রিডম লীগ। আমরা করলাম ইস্ট পাকিস্তান ইকোনমিক ফ্রিডম লীগ- পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক মুক্তি লীগ।
১২ আগস্ট, ১৯৪৭ মঙ্গলবার
১০-৮-৪৭ তারিখে করাচীতে পাকিস্তানের সাংবিধানিক এসেমব্লির প্রথম বৈঠক বসেছিল। যােগেন্দ্র মণ্ডল প্রেসিডেন্ট। জিন্নাহ স্থায়ী প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন।
১৩ আগস্ট ১৯৪৭
অভ্যর্থনা কমিটির বিধি নিষেধ সত্তেও ১৫ আগস্ট আমরা শােভাযাত্রা বের করব। শামসুল হুদা শােভাযাত্রা বের করার অনুমতির জন্য লীগ অফিসে আবেদন করলেন। পরে লীগ অফিসে এলেন।
…কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে সহস্র যােজন পার্থক্য। কংগ্রেস খুবই সাম্প্রদায়িক ।
পৃষ্ঠাঃ ৮৭
আগামী কালকের জন্য তােরণ নির্মাণ ও সাজানাে গোছানোর কাজ সারা শহরের মুসলিম এলাকার লােকজন দিনরাত ব্যস্ত রয়েছে। শোভাযাত্রা বের না করার ব্যাপারে নবাব ও কমিটির সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও লােকজন শোভাযাত্রার ব্যবস্থা করছে এবং ২৪ ঘন্টা আগে তারা শােভাযাত্রার সপক্ষে শেষ পর্যন্ত একটা প্যামপ্লেট বের করল।
আজ রাত ১২টায় ব্রিটিশ শাসনের অবসান হতে চলেছে। শুরু হতে যাচ্ছে ভারতীয়দের নিজ সরকারের শাসন।
আজ খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকা এসে পৌঁছেছেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলাে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হলেন কায়দে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন লিয়াকত আলী খান।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ – গভর্নর জেনারেল
লিয়াকত আলী খান – প্রধানমন্ত্রী
আই আই চুন্দ্রিগড় – বাণিজ্য, শিল্প
গােলাম মুহাম্মদ – অর্থ
রাজা গজনফর আলী খান – খাদ্য ও কৃষি
যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল – আইন, শ্রম ও পূর্ত
স্যার মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ – পররাষ্ট্র
ফজলুর রহমান – শিক্ষা
স্পিকার নির্বাচিত হলেন ফরিদপুরের তমিজউদ্দিন খান।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তানে খাজা নামিজউদ্দিন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
স্যার ফ্রেডারিক বােন – গভর্নর
খাজা নাজিমউদ্দিন – মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, পরিকল্পনা
নূরুল আমিন – বেসামরিক সরবরাহ, বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প
আবদুল হামিদ – শিক্ষা
সৈয়দ মুহাম্মদ আফজাল – কৃষি, সমবায় ও ত্রাণ
হামিদুল হক চৌধুরী – রাজস্ব, অর্থ
মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী – স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার
পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার স্পিকার নির্বাচিত হন আবদুল করিম।
পৃষ্ঠাঃ ৮৮
পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যসচিব নিযুক্ত হন আজিজ আহমদ এবং পুলিশের আইজি নিযুক্ত হন জাকির হােসেন।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির পাতা
১৫ আগস্ট, ১৯৪৭ শুক্রবার
স্বাধীনতা
সকাল ৮টায় কুমারটুলি বাইন্ডারের কাছ থেকে ৫ শত কফি কর্মসূচী নিলাম। সেগুলো নিয়ে কামরুদ্দিন সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি কার্জন হলে গেছেন গভর্নর ও তার কেবিনেটের অনুষ্ঠানে যােগ দিতে।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় কার্জন হলে প্রধান বিচারপতি এএমএস আকরমের কাছে খাজা নাজিমউদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং নূরুল আমিন ও হামিদুল হক চৌধুরী মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। গভর্নর হিসেবে শপথ নিয়েছেন ফেডারিক সি বােন।
সাড়ে ৩টা নাগাদ শােকযাত্রা শুরু হলাে। সামনে একটা গাড়িতে খাজা নাজিমউদ্দিন। মধ্যখানে নবাব (হাবিবুল্লাহ)…
সাড়ে ৪টার দিকে শােভাযাত্রা ভিক্টোরিয়া পার্কে পৌছল। খাজা নাজিমউদ্দিনের সভাপতিত্বে প্রথমে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং পরে কোরান তেলাওয়াতের মাধ্যমে সভা শুরু হল। হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ লােকসভায় যােগ দিয়েছে। অনেক লােক এসেছে গ্রাম থেকে। পরিবেশ খুবই পীড়াদায়ক। ব্যবস্থাপনা বাজে । লােকজন না বসে শুধু ছােটাছুটি করছে।
নবাব উদ্বোধনী ভাষণ দিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনকে সকল দাঙ্গার মামলা মিটিয়ে ফেলতে এবং সাজাপ্রাপ্ত সকল বন্দীদের মুক্তি দেবার অনুরােধ জানালেন। অনুষ্ঠানে বি, দাস গুপ্ত, বীরেন পােদ্দার, নিখিল দাশ, লীলা রায়, নগেন্দ্র রায়, মালেক, আলাউদ্দিন, আতাউর রহমান, শামসুল হুদা, শামসুল হক এবং শাহ আজিজুর রহমান বক্তৃতা করলেন।
সকালের আকাশ ছিল খুবই পরিষ্কার। নগরীর লােকজন নগর সজ্জার সুযােগ পেয়েছিল। বর্ষাকাল বলেই কাগজের বদলে পাতা দিয়ে অধিকাংশ গেট সাজানাে হয়েছে। হিন্দুরাও অনুষ্ঠানে যােগ দিয়েছে। পতাকা তুলেছে এবং শােভাযাত্রায় যােগ দিয়েছে। অনুষ্ঠান শান্তি ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয়েছে।…।
যেসব এলাকা সাজানাে হয়েছে তার মধ্যে আমি প্রথম দেখেছি বকশীবাজার। বাবুবাজার ব্রিজ থেকে মােগলটুলি পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে আলােকসজ্জা করা হয়েছে। গেটগুলাে দর্শনীয় । বিশেষ করে বাবুবাজার
পৃষ্ঠাঃ ৮৯
ক্রসিংয়েরটা। আহসান মঞ্জিলের চূড়া এবং আর একটি বাড়ির আলোকসজ্জা বিশেষ মনােযােগ আকর্ষণ করে। সারারাত আতশবাজি, ককটেল, হাতবোমা ফাটানাে হয়েছে।
হােটেল, মসজিদ, রেল স্টেশন, এমনকি খােলা মাঠে লােক ধরছে না। অনেকে রাতে ঘােরাঘুরি করছে।
শামসুল হক সাহেব শােভাযাত্রায় খাজা নাজিমউদ্দিনের গাড়ির পাশে ছিলেন। তিনি শােভাযাত্রার শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গেই ছিলেন ।
১৮ আগস্ট, ১৯৪৭
ঈদ-উল ফিতর।
পল্টন ময়দানে বিরাট জামায়াত। খাজা হাবিবুল্লাহ, খাজা নাজিমউদ্দিন নামাজে উপস্থিত।
সন্ধ্যায় এসএম হলে সঙ্গীতানুষ্ঠানে তাজউদ্দীন যােগ দেন। আব্বাসউদ্দিন ও সহশিল্পীরা গাইলেন।
২০ আগস্ট, ১৯৪৭
এ কে ফজলুল হক নিজের দল গঠনের জন্য কাদের সর্দারের সাথে হাত মিলিয়েছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের থাকার জায়গা নিয়ে অসুবিধা। তার মেস বেদখল হয়েছে। একটি বাড়ি বা লজিংয়ের চেষ্টা করছেন।
২৩ আগস্ট, ১৯৪৭
মুসলিম লীগ অফিসে কামরুদ্দিনের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে নেতা-কর্মীরা সভায় যােগ দেন।
২৫ আগস্ট, ১৯৪৭
আপার ক্লাসের প্রবেশ পথে এক উলঙ্গ বৃদ্ধা পড়ে আছে- মৃত্যুপথযাত্রী । মিটফোর্ড হাসপাতালে টেলিফোন করলাম- কেউ সাড়া দিল না। ওয়ালী খান দ্রুত হাসপাতালে গেলেন কর্তব্যরত চিকিৎসকগণ জানালেন তাদের করার কিছুই নেই। তারা রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে যােগাযােগ করতে বলেন। লীগ অফিসে গিয়ে এএসএমকে টেলিফোন করলাম। তিনি ব্যবস্থা করবেন বলে জানালেন … এভাবে একটি জীবনের ওপর সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম চলল।
কলকাতা থেকে আগত কর্মকর্তাদের যাতায়াতের জন্য একটা ট্রাকের ব্যবস্থা করলাম ।
পৃষ্ঠাঃ ৯০
২৬ আগস্ট, ১৯৪৭
মুসলিম লীগ ছেড়ে নতুন একটি দল আরম্ভ করায় খায়ের মিয়া আমাদের ওপর ক্রুদ্ধ । তােয়াহা সাহেবকে ৫০টি মেনিফেস্টো দিলাম । আগামী শনিবার থেকে তার পরীক্ষা। তার নােট টাইপ করতে স্টেশনে যাই।
৩০ আগস্ট, ১৯৪৭
আগামী কালের ছাত্র সম্পর্কে আলােচনার পর নগরীর জন্য অস্থায়ী কমিটি গঠনের এবং কমিটির নামে মুসলিম শব্দটা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। নতুন উদ্যোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আমি গােটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করলাম।
ছাত্রকলীগের নগর কমিটি গঠন করার জন্য এফএইচ হলে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সালেক গােলমাল করে। হাবিবুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন। মোয়াজ্জেম চৌধুরী, নঈমউদ্দিন, মতিউর রহমান, মােখলেস প্রমুখ ভাষণ দেন। হলের ছাত্রদের মারামারিতে জড়িয়ে পড়া একটা বােকার মতাে কাজ হয়েছে।
৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৭
হাসনাতের বাড়িতে তাসাদুকের সভাপতিত্বে যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ৫০০ প্রতিনিধি উপস্থিত। সাবজেক্ট কমিটি গঠন করা হলাে। ৭ সেপ্টেম্বর সভা পুনরায় শুরু হলাে। সভায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠিত হলাে। বিকেলে সিরাজউদ্দৌলা পার্কে সভা অনুষ্ঠিত হয়।
কামরুদ্দিনের বাসায় মুজিবের সাথে তাজউদ্দীন ও অলি আহাদের দেখা। গণতান্ত্রিক যুবলীগের সাংগঠনিক কমিটিতে থাকতে তাজউদ্দীন অস্বীকার করেন ।
৪ নভেম্বর ১৯৪৭
সন্ধ্যায় কামরুদ্দিন সাহেবের বাসায় সভা হলাে। শামসুল হক, আউয়াল, আলমাস, শামসুজ্জোহা, মহিউদ্দিন, নূরুল আলম, শওকত, আজিজ আহমদ সভায় উপস্থিত। সিদ্ধান্ত হয় অস্তিত্বের জন্যই ক্ষমতা ধরে রাখা উচিত। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় কলকাতা যেতে হবে ।
৮ নভেম্বর, ১৯৪৭
আজ সন্ধ্যায় নিমতলী রেল ক্রসিংয়ের কাছে একজন ভদ্রলােক আমার কাছে পলাশী ব্যারাক যাওয়ার পথ জানতে চায়। আমি কোন চিন্তা না করে তাড়াহুড়াের মধ্যে তাকে নীলক্ষেতের পথ দেখিয়ে দেই। আমার এই বেখেয়ালের জন্য ভদ্রলােককে কি পরিমাণ দুর্ভোগ যে পােহাতে হয়েছে তা জানি না।
পৃষ্ঠাঃ ৯১
৯ নভেম্বর, ১৯৪৭
বিকেলে সাইকেলযােগে রমনা এলাকায় ঘুরে বেড়ানাের সময় আমি আমার সাত বছর ঢাকা অবস্থানকালে আজ প্রথমবারের মতাে রেসকোর্স ময়দানে ঘােড়দৌড় দেখার সুযােগ পেলাম।
২৩ নভেম্বর, ১৯৪৭, রােববার
সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকা আসেন৷ খাজা নসরুল্লাহর বাড়িতে তিনি উঠেছেন।
২৪ নভেম্বর, ১৯৪৭
বিকেল ৩টায় এফএইচএম হল প্রাঙ্গণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ভাষণ দেন। দু’হাজার লােক উপস্থিত। প্রভােস্ট ড. এম হােসেন সভাপতিত্ব করলেন। খাজা নাজিমউদ্দিন, হামিদুল হক চৌধুরী, আনােয়ারা বেগমসহ অনেক এমএলএ উপস্থিত ছিলেন। সােহরাওয়ার্দী ভারত- পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সমস্যা সম্পর্কে ভাষণ দেন। সােহরাওয়ার্দীর ঢাকা আগমনের কারণে তাদের মধ্যে কিছুটা যন্ত্রণা ও ভীতির ছাপ দেখা গেল।
২৬ নভেম্বর, ১৯৪৭
কামরুদ্দিন সাহেবের বাসায় সিদ্ধান্ত হলাে- দলের সচিবালয় খুলতে হবে, যাতে থাকবে অফিস- কামরুদ্দিন, পাঠচক্র তােয়াহা, পরিসংখ্যান -অলি আহাদ, প্রচার- তাজউদ্দীন। তােয়াহা সাহেব ও অলি আহাদ একটা সেফার্ড কলম কিনে আমাকে দিলেন।
২৮ নভেম্বর, ১৯৪৭
এতিমখানার ছাত্রদের নিয়ে তাজউদ্দীনের ভাবনা । এতিমখানার প্রতি রাজনীতিবিদদের উদাসীনতা দেখে তিনি লিখেছেন- “আমাদের সব ভালাে ভাল কথা জনগণকে ধোকা দেওয়ার জন্য।”
১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ঢাকার রাজনীতিতে মুজিবের উপস্থিতি দেখা যায়। তার সাথে প্রায় দিন তাজউদ্দীনের সাথে কামরুদ্দিনের বাসায় দেখা হতো।
১৩ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
গুণ্ডাবাহিনী ছাত্রনেতা নঈমুদ্দিনকে আহত করেছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে দেখতে মুখ্য সচিব আজিজ আহমদ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এস রহমতউল্লাহ এসেছেন।
পৃষ্ঠাঃ ৯২
২১ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
খাদ্য নিয়ে বর্ধমান হাউজে সভা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ খাদ্যনীতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন।
৩০ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
কামরুদ্দিন আহমদের বাসায় জমিদারী বিলােপ কমিটির বৈঠক নিয়ে আলােচনা হয়।
১ জানুয়ারি, ১৯৪৮
কলেজ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষা দেয়ার আবেদন মঞ্জুর করে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেয়। তিনি পড়াশােনা শুরু করেন।
৪ জানুয়ারি, ১৯৪৮
উর্দু-বাংলা বিরােধের সূত্র ধরে বলিয়াদী প্রেস থেকে প্যামফ্রেট পুলিশ বাজেয়াফত করেছে এবং শােনা যাচ্ছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে।
বর্ধমান হাউজে তাজউদ্দীন আহমদসহ ছাত্র প্রতিনিধিরা মুখ্যমন্ত্রী নজিমউদ্দিন ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ খান দেখা করেন।
১৫ জানুয়ারি, ১৯৪৮
পল্টনের জনসভায় চুন্দ্রিগড়, সাত্তার, আবদুর রব নিস্তার, আকরম খাঁ যােগ দেন।
১৬ জানুয়ারি, ১৯৪৮
মহাত্মা গান্ধী দিল্লিতে হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য ১৩ জানুয়ারি থেকে অনশন করছেন । ১৫ জানুয়ারি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ প্রফুল্ল সেন পদত্যাগ করেন।
২৬ জানুয়ারি, ১৯৪৮
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে ড. মেঘনাথ সাহা বক্তৃতা দেন।
২৭ জানুয়ারি, ১৯৪৮
সলিমুল্লাহ কলেজে গিয়ে ৪০ টাকা ফি দিলেন।
৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮
ঠিক রাত ৮টার সময় জলিল আমায় বলল, গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমি এ কথা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু শাহজাহান সাহেব এ খবর ঠিক করে বললেন। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। প্রায় ৩ মিনিট
পৃষ্ঠাঃ ৯৩
আমার স্নায়ুগুলাে যেন বিরশ হয়ে রইল। খবরটা শুনে আমার কণ্ঠ থেকে কেবল একটা চিৎকার ধ্বনি বেরিয়ে এলাে।
মৃত্যু: আমি জীবনে এই প্রথম মৃত্যুর আঘাত পেলাম । মানুষের মৃত্যুর আঘাত । অথচ মানুষের মৃত্যুকে আমি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করি। আমার কাছে মৃত্যু একটা সাধারণ ব্যাপার, স্বাভাবিক নিয়ম। আমি কারোর মৃত্যুতে কোনদিন শােক প্রকাশ করিনি। আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কথা আমার এখনও মনে আছে। ১৯৪৪ সালে তার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম না। কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমার মনে কোন দুঃখবোধ জন্মেনি। তেমন দুঃখবােধের কোন কারণ আমি খুঁজে পাইনি।
আমার বাবার মৃত্যুর কথাও আমার মনে আছে। মাত্র এক বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে। বছরটা শেষ হতে আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। তার মৃত্যুর সময়ে আমি আমি কলকাতায় ছিলাম তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তার মৃত্যুতেও আমার মনের মধ্যে কোন দুঃখ জাগেনি। তার মৃত্যুতে কেবল কাধের ওপর পারিবারিক বোঝার ভারটা যেন জীবনে প্রথমবারের জন্য বােধ করলাম । আমার মনে আছে, বাবার মৃত্যুর খবর শােনার মাত্র ১৫ মিনিট পরই আমি ৪টা পরােটা এবং এক বাটি মাংস খেয়েছিলাম। আমার তাে এ কথাও মনে আছে, তার পরের রাতে যে বিছানাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। সেই বিছানাতে আমি গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হয়েছিলাম।
কিন্তু গান্ধীজির মৃত্যুতে আমি তেমনটি হতে পারছিনে কেন? আমি আমার মনের বিষাদকে দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম। অনিচ্ছা নিয়ে আমি রাত বারােটায় রাতের খাওয়া খেলাম। আমি ঘুমাতে চাইলাম। কিন্তু তবু তাে আমি ঘুমাতে পারলাম না ! জাগ্রত অবস্থাতে গান্ধীজি আমাকে আপ্লুত করে রাখলেন। স্নায়ু বিবশ হলাে। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন হলাম । কিন্তু সে তন্দ্রার মধ্যেও তাে গান্ধীজি আমাকে আপ্লুত করে রাখলেন।
আর বিগত দিনে এই আমিই তাে এই মহৎ আত্মার বিরুদ্ধে কত কথা বলেছি। বাক্য উচ্চারণ করেছি। অন্তরের বিশ্বাস থেকে নয়। রাজনীতি থেকে। কারণ মুসলিম লীগের শক্তিতাে কংগ্রেসের দুর্বলতায় এবং তাই মনে করেছি কংগ্রেসকে দুর্বল করার বড় উপায় হচ্ছে মহাত্মা গান্ধীকে অবনত করা। তাঁকে ক্ষুদ্র করা। কারণ এই বৃহৎ সংগঠনের তিনিই তাে আত্মস্বরূপ। এই হচ্ছে আমার বিগত দিনের এমন আচরণের একমাত্র ব্যাখ্যা।
৩১ জানুয়ারি, ১৯৪৮
ইউনিভার্সিটি চত্বরে শােকসভা হলাে। ড. এম হাসানের সভাপতিত্বে সভা
পৃষ্ঠাঃ ৯৪
শুরু হলাে। ড. এম হােসেন, ড. এমএস হােসেন, কাজী মােতাহার হােসেন, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, বিএ সিদ্দিকী ভাষণ দেয়। ঢাকায় খবরের কাগজ নিয়ে ভিড়- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর দিনের সংবাদপত্রের চাহিদা আর তার মূল্যের স্মৃতি তাজউদ্দীনের আছে।
ঢাকা শহরে হরতাল হয়েছে। ঢাকার জন্য এ দৃশ্য অভাবিত। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে শোক মিছিল বের হলাে। ৫টায় শ্রীশ চ্যাটার্জীর সভাপতিত্বে করােনেশন পার্কে শােকসভা এবং মৌন প্রার্থনা হলাে, কোন বক্তৃতা নয়।
৩১ জানুয়ারি ১৯৪৮
মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্য- নাজির লাইব্রেরীতে তাজউদ্দীন রেডিওতে ধারাবিবরণী শােনেন।
সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে মহাত্মার মরদেহকে বিড়লা ভবন থেকে শোভাযাত্রা করে আনা হলাে। সামরিক বাহিনীর অধিনায়কবৃন্দ ধার বহন করে। ভারত সরকার মহাত্মার শেষকৃত্যকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বলে ঘােষণা করেছে। ৪টা ২০ মিনিটে শবাধার যমুনার তীরে রাজঘাটে এসে পৌছে। ৪টা ৩০ মিনিটে দেহ চিতায় শায়িত করা হলাে। দেবদাস গান্ধী দেহের ওপর চন্দন কাঠ স্থাপন করেন। রামদাস চিতায় অগ্নি সংযােগ করলেন। ৫টার মধ্যে মহাত্মার দেহ ভস্মে রূপান্তরিত হয়ে গেল । মহাত্মার শিয়রে পণ্ডিত রামদাস শর্মা মন্ত্র পাঠ করলেন।
মহাতার চিতায় ১৫ মণ চন্দন কাঠ, ৪ মণ ঘি, ২ মণ সুগন্ধি, ১ মণ নারিকেল এবং ১৫ সের কর্পূরের সমাহার ঘটেছিল। সূর্য অস্তমিত হলাে এবং অস্তমিত হলাে মানবতার পথের দিশারী আলােকবর্তিকা। তাহলে কি অন্ধকার নেমে এলাে । আলাে এবং অন্ধকার । দিনের পরে তাে রাতের আগমন এবং দিনের আগমনে নিশির অপসারণ । মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তারপর তাে সূর্যের কিরণ। ক্ষীণ তনু নতুন চন্দ্র। কিন্তু তারপর তাে আনন্দময় পূর্ণ চন্দ্রের আবির্ভাব। হতাশার শেষ তাে আশাতে। সঙ্কটময় মুহূর্তে তাে তিরােহিত হয় বিস্তৃত অতীতে। অনিশ্চিত ভবিষ্যততাে বর্তমানের সৃষ্টিতে রূপায়িত হয়। জগত তাে থেমে থাকে না। অনির্বার তার এই চক্র। যে মানুষটির শােকে আজ আমরা মুহ্যমান, সে মানুষটি তাে অন্ধকারের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আলােতে পৌঁছেছিলেন। তাকেও তাে অন্ধকারে আলাের অন্বেষণে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। অথচ কি বিষয়। তিনি নিজেই তাে ছিলেন একটি আলােকবর্তিকা। আলােককে কি তুমি ধ্বংস করতে পারাে? আলাের কণিকা আমাদের কাছ থেকে বহুদূরে অবস্থিত হতে পারে। কিন্তু তাতে কি? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর মােহতাে একমাত্র দিকনির্ধারক। যুগ থেকে যুগে।
পৃষ্ঠাঃ ৯৫
তার চোখের ক্ষুদ্র কল্পনাটিও আমাদের পথের দিশা প্রদান করে। তাহলে বেদনা কেন? বহু যুগের এই ধ্রুবতারার কাছ থেকে আমরা নির্দেশ গ্রহণ করব। তার ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্ন ধরে আমরা অগ্রসর হব। তিনি শান্তি লাভ করুন। আমিন।
গান্ধী হত্যায় তাজউদ্দীন আহমদ এত শােকাহত হয়েছিলেন যে গােসল করেননি, ৪৮ ঘণ্টা কেশবিন্যাস করেননি। তার চুল আচরাবার বিলাস ছিল। তিনি তিনদিন ডায়েরি লেখেননি। ‘মহান সন্তান মহাত্মা গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যর ফলে আমার হৃদয়বিদারক অনুভূতির কারণে গত ৩ দিন ডায়েরি লেখা হয়নি।’২
শান্তি মিশন
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় ভারতে বিশেষ করে পাঞ্জাবে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবের প্রায় সকল শিখ ও হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করা হয় এবং পূর্ব পাঞ্জাবের মুসলমানদের ধ্বংস করা হয়। পাঞ্জাবের দাঙ্গায় ৫ লাখ আদম সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত ও পাকিস্তানে এক কোটি ৪০ লাখ লােক মাতৃভূমি ত্যাগ, এক লাখ যুবতী ধর্ষিত এবং অপহৃত হয় অথচ পাঞ্জাব সীমান্তে তখন ৫০ হজার সৈন্য ছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানের ব্রিগেডিয়ার (পরে জেনারেল) আইয়ুব খান। তারা হিন্দু-মুসলমানের জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটে। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গার কারণে অনেকে ভয় পেয়েছিলেন দেশ বিভাগের সাথে সাথে পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায় গণহত্যা শুরু হবে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী ও সােহরাওয়ার্দীর চেষ্টার ফলে উভয় বাংলায় দাঙ্গা হয়নি। এ জন্য গভর্নর জেনারেল মাউন্ট ব্যাটেন মাহাত্মা গান্ধী ও সােহরাওয়ার্দীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন| পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ- মােট ১ কোটি ৩০ লাখ হিন্দু ছিল। মুসলিম লীগ সরকার চেয়েছিল পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুদের একটি বিরাট অংশ ভারতে চলে যাক। তাই তারা সােহরাওয়ার্দীর শান্তি মিশন পছন্দ করত না। সরকার পূর্ব বাংলায় তার ঘন ঘন সফর পছন্দ করত। পরে পূর্ব বাংলায় তাঁর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি উগ্র জাতীয়তাবাদী নাথুরাম গডসে গুলি করে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে। মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু এবং সােহরাওয়ার্দীর ভারত ত্যাগ এরপর ভারতে দাঙ্গা বেশি করে দেখা দেয়।
পৃষ্ঠাঃ ৯৬
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দরি সাথে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ
তাজউদ্দীন আহমদ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মী ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদকে সােহরাওয়ার্দীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পাকিস্তান সষ্টির পর একদিন শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করতে যান। সােহরাওয়ার্দী তাকে চিনতেন না, তাই শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করলেন- Who is he? এ কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বের হয়ে যান। পরে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তাজউদ্দীন সম্পর্কে জানতে পারেন। তাজউদ্দীন আহমদ সােহাওয়ার্দীর প্রিয় হয়ে ওঠেন এবং তাকে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনয়ন দেন ।
আমলাতন্ত্রের উত্থান
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত খানের দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই তারা আমলানির্ভর হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ সরকার চৌধুরী মােহাম্মদ আলীকে পাকিস্তানের সেক্রেটারি জেনারেল নিযুক্ত করে। অর্থমন্ত্রী হলেন আমলা গোলাম মুহাম্মদ। গােলাম মুহাম্মদ সুচতুর ব্যক্তি ছিলেন। তিনি রাজনীতিবিদদের অনভিজ্ঞতার সুযােগ নিয়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র শুরু করেন । পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যসচিব হলেন আজিজ আহমেদ। তিনি মূলত প্রশাসন চালাতেন। খাজা নাজিমউদ্দিন ছিলেন কেন্দ্রের পুতুল। পদস্থ আমলাদের মধ্যে বাঙালিদের সংখ্যা নগণ্য। কেন্দ্রে বাঙালী কোন সচিব ছিল না। আমলাদের দ্বারা উচ্চশ্রেণীর লােকেরা উপকৃত হতাে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমলাতন্ত্রের কারণে পাকিস্তানে গণতন্ত্র সফল হয়নি। ইংরেজ সৃষ্ট আমলাতন্ত্র প্রথমে পাকিস্তানে এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছে।
পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের জন্ম
সেপ্টেম্বর ১৯৪৭
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগের পূর্বেই হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর বৃহৎ স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে যায় । অন্যদিকে ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট সুকৌশলে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর স্থলে খাজা নাজিমউদ্দিন আইনসভায় নেতা নির্বাচিত হন। ফলে সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সমর্থক ছাত্র-যুবক সম্প্রদায় হতাশ হয়ে পড়ে। তরুণ নেতা কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক ও তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার ১৫০নং
পৃষ্ঠাঃ ৯৭
মােগলটুলীতে যুব সম্মেলন আহবান করে। কফিলউদ্দিন চৌধুরী সভাপতি ও শামসুল হককে সম্পাদক নিয়ােগ করে অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। কেউ জায়গা দিতে রাজি না হওয়ায় ঢাকা মিউনিসিপালিটির ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের সাথে যুব নেতারা সাক্ষাৎ করেন। তিনি তার বেচারাম দেউড়ির বাসভবন হলে সম্মেলন অনুষ্ঠানে সম্মত হন। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর বেচারাম দেউড়িতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় তােসাদ্দক আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ইয়থ লীগ- পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। মওলানা আকরম খাঁ পরিচালিত মুসলিম লীগ ঢাকাবাসীদের নিয়ে যুব সম্মেলন পণ্ড করার চেষ্টা করে। যুবনেতাদের ভারতের চর, পাকিস্তান ধ্বংস করতএ চায়- এ অভিযােগ তুলে ঢাকাবাসীদের ক্ষেপিয়ে তােলে। সেদিন খান সাহেব আবুল হাসনাত যে সাহস ও সহযােগিতা দেখিয়েছেন তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।৩
গণআজাদী লীগ-১৯৪৭
১৯৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির ঘােষণা দেয়। ভারত ও বাংলা বিভাগ তাজউদ্দীন আহমদ মেনে নিতে পারেননি। কামরুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন, তােয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকদিন আলােচনার পর Peoples Freedom League- গণআজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কামরুদ্দিন আহমদকে আহবায়ক করে গণআজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। “লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কল্পনায় আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে একটি ভিন্ন রাষ্ট্র জ্ঞান করিয়াই পূর্বে পাকিস্তানভিত্তিক ঘােষণাপত্র জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছিলাম। যতটা ছিল সংকল্প, তাহার চাইতে বহুগুণ বেশি ছিল বাঙালী বিদ্বেষী কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আক্রোশ ও রাগের অভিব্যক্তি।” অলি আহাদ লিখেছেন, “দুঃখের বিষয়, গণআজাদী লীগ গণসংগঠনে পরিণত হইতে পারে নাই। ইহার কারণ, প্রথমত, আহবায়ক কামরুদ্দিন আহমদের কর্মবিমুখ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, কারাগারভীতি ও ত্যাগী মনােভাবের অভাব; দ্বিতীয়ত, সমগ্র দেশে উৎকট সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত আবহাওয়া; তৃতীয়ত, তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের কঠোর দমননীতি।”
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ঢাকা আগমন :
১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি অঙ্গনে মুসলিম লীগের
পৃষ্ঠাঃ ৯৮
স্বৈরশাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ সৃষ্টি হতে থাকে। কিন্তু প্রবীণ নেতাদের অবর্তমানে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে উঠতে পারছে না। এ কে ফজলুল হক বয়সের কারণে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম পশ্চিম বাংলায় অবস্থান করছেন। সােহরাওয়ার্দী দলের নেতারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় স্থান পাচ্ছেন না। তার দলের ডা আব্দুল মালেক, তফাজ্জল আলী, মহম্মদ আলী, আনােয়ারা বেগম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছাত্র- যুবকগণ নেতৃত্বের অপেক্ষায়। এমনি সময় আসামের মুসলিম লীগ সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকায় আগমন করেন এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। “উল্লেখ্য যে, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ইস্ট হাউজের দক্ষিণ দিকের মাঠে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বপ্রথন ভাষণ দান করেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন হলের আবাসিক ছাত্র আবদুর রহমান চৌধুরী। মওলানার তেজোদৃপ্ত ভাষণের মধ্য দিয়ে এ সভায়ই সরকারবিরােধী ছাত্র শক্তি ও জননেতাদের মধ্যে যােগসূত্রের সূচনা হয়।”৫
ছাত্র অসন্তোষ ১৯৪৭-৪৮
ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় অনেক সমস্যা দেখা দেয়। সচচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আবাসন। অফিস ও কর্মকর্তাদের বাসস্থানের তীব্র সঙ্কট শুরু হয়। নাজিমউদ্দিন সরকার সমর্থক শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। এ কারণে ছাত্রসমাজে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে নভেম্বর মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বর্তমান স্থান হতে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকা মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুলে কনডেঞ্জ এমবিবিএস কোর্স চালু এবং ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে ডিগ্রি কোর্স চালুর দাবিতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্র মিছিল ইডেন বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে। সচিবালয়ে কর্মচারীরাও ছাত্রদের সাথে যােগ দেয়। কর্মচারীরা পানি ও আবাসন সঙ্কটে ভুগছেন। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের দাবি শুনেন । ছাত্রদের প্রাথমিক বিজয় সূচিত হলাে। সােহরাওয়ার্দী গ্রুপের ছাত্রনেতা পিরােজপুরের নূরুদ্দিন আহমেদ কলকাতা থেকে আসতে পারেননি। কিন্তু তার দলের আবদুর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল মতিন চৌধুরী, মুহাম্মদ তােয়াহা, ঢাকা কলেজের ছাত্র তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন এগিয়ে চলে।
পৃষ্ঠাঃ ৯৯
সরকারী কর্মচারীদের বাসগৃহের অভাব থাকায় সরকার পলাশী ও নীলক্ষেতে ব্যারাক নির্মাণ করে দেয় । নীলক্ষেতে কর্মচারীরা ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পানির অভাবে অতিষ্ঠ হয়ে লােটা-বদনাসহ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে বিক্ষোভ মিছিলসহ উপস্থিত হয়। এভাবে সরকারবিরোধী মনোভাব সমাজে সৃষ্টি হতে থাকে।
অন্যদিকে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের সমালােচনায় মুখর। তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে নবাব সিরাজউদ্দোলা পার্কে জনসভা আহবান করেন। খাজা নাজিমউদ্দিনের লীগের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালিয়ে সভা পণ্ড করে দেয়।
তমদুন মজলিশ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭
পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনে উর্দুভাষীদের প্রাধান্য চলতে থাকে। প্রধান পদসমূহ অবাঙালীদের দখলে। শিক্ষিত বাঙালী সমাজ বাংলা ভাষার দাবিতে এগিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আবুল কাসেম ও রসায়নের অধ্যাপক নূরুল হক ভূইয়া ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ গঠন করেন।
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমুদ্দিন মজলিশের উদ্যোগে ঢাকায় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার। সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রকাশ্য দাবি জানানাে হয়।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন। করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হয়। প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তমুদ্দিন মজলিশের সম্পাদক অধ্যাপক আবুল কাশেমের সভাপতিত্বে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে ভাষার দাবিতে মিছিল হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন।
তমদ্দুন মজলিশের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের সুসম্পর্ক ছিল। তিনিও এ সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে যােগ দেন।
ছাত্রলীগের জন্ম
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা আন্দোলন ব্যর্থ হলে তার
পৃষ্ঠাঃ ১০০
ভক্ত একদল তরুণ ১৯৪৭ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের নবাব সিরাজউদ্দৌলা হলে গােপন সভায় মিলিত হয়ে পূর্ব বাংলায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, কেজি মােস্তফা, আখলাকুর রহমান, শহিদুল্লাহ কায়সার, কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিস প্রমুখ।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে ঢাকার মুসলিম লীগ নেতা কামরুদ্দিন আহমেদ গণআজাদী লীগ গঠন করেন। ১৯৪৭ সালের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান বিএ পাস করে ঢাকায় চলে আসেন এবং গণআজাদী লীগে যােগ দেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কলকাতার মুসলিম ছাত্র নেতৃবন্দ ১৪ আগস্টের পর ঢাকায় আসতে থাকে। তখন ছাত্রসমাজ খাজা নাজিমউদ্দিন গ্রুপ ও সোহরাওয়ার্দী গ্রুপে বিভক্ত ছিল। নেতাদের মধ্যে সােহরাওয়ার্দী দলে ছিলেন বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, ডাঃ এ এম মালিক, আনােয়ারা খাতুন, মওলানা তর্কবাগীশ, তােফাজ্জল আলী প্রমুখ। মুসলিম লীগ মুহাম্মদ আলীকে রাষ্ট্রদূত, ডাঃ এ এম মালিক ও টি. আলীকে মন্ত্রী করায় বিরােধী দল শক্তিশালী হতে পারেনি। এদিকে এ কে ফজলুল হক বিরােধী দলের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকার সিরাজউদ্দৌলা পার্কে এক জনসভা আহ্বান করে। কিন্তু খাজা নাজিমউদ্দিনের গুণ্ডা বাহিনী সভামঞ্চে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ কে ফজলুল হক কোনরকমে আত্মরক্ষা করে কাদের সর্দারের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহকর্মীদের উদ্যোগে বিরােধী দল সংগঠিত হতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকার বলিয়ানী হাউজে পূর্ব বংলা আইনসভার একটি উপদলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তারা মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কর্মসূচী গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু উপদলটি রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হয়।
কলকাতা থেকে আগত ছাত্রনেতাদের আশ্রয়স্থল ছিল ঢাকার ১৫০ নম্বর মােগলটুলির ভবনের দ্বিতল ও ত্রিতলে। মুসলিম লীগকে ঢাকার নবাবদের বৈঠকখানা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে টাঙ্গাইলের শামসুল হকের উদ্যোগে ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল ঢাকার ১৫০ নম্বর মােগলটুলিতে মুসলিম লীগ কর্ম শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে ছাত্রনেতাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর মুসলিম লীগ কর্মীশিবিরকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের প্রথম বিরােধী রাজনীতি সৃষ্টি হয়। ছাত্র ও যুব নেতাদের মধ্যে ছিলেন- নূরুদ্দিন আহমেদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, কাজী গােলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ। ১৯৪৭ সালে কামরুদ্দিন আহমেদ গণতান্ত্রিক
পৃষ্ঠাঃ ১০১
যুবলীগ গঠন করেন। শেখ মুজিব এ দলের অন্যতম নেতা ছিলেন। মুসলিম লীগ সরকার এ দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নিপীড়ন চালালে দলটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এ সময় কামরুদ্দিন আহমেদ পিপলস ফ্রিডম লীগ গঠন করেন। অধ্যাপক আবুল কাসেম গঠন করেন তমদ্দুন মজলিস।
নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সোহরাওয়ার্দী সমর্থক ছাত্ররা ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে। ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্যগণ ছিলেন :
নাম – এলাকা
নইমুদ্দিন আহমেদ – রাজশাহী
আব্দুর রহমান চৌধুরী – বরিশাল
শেখ মুজিবুর রহমান – ফরিদপুর
অলি আহাদ – কুমিল্লা
শেখ আব্দুল আজিজ – খুলনা
শামসুল হক – ঢাকা
খালেক নেওয়াজ – ময়মনসিংহ
আজিজ আহমেদ – নােয়াখালী
আবদুল মতিন – পাবনা
দবিরুল ইসলাম – দিনাজপুর
মফিজুর রহমান – রংপুর
সৈয়দ নূরুল আলম – ময়মনসিংহ
আব্দুল আজিজ – কুষ্টিয়া
আব্দুল কুদুস চৌধুরী – চট্টগ্রাম
নূরুল কবির – ঢাকা শহর
নতুন মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে শামসুল হক, নুরুদ্দিন আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গােলাম মাহবুব, আব্দুস সামাদ আজাদ প্রমুখ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৩ সালে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামকরণ করা হয়। মুসলিম লীগ সমর্থক দলের নাম ছিল নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ।
১৯৪৭ সালে ড. শহীদুল্লাহ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘােষণার দাবি জানান। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিস বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার পক্ষে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে।
পৃষ্ঠাঃ ১০২
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন বাংলা ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বলেন, “১৯৪৭ এর শেষের দিক থেকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। তার উদ্যোক্তা ছিলেন পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকের অখ্যাত সাধারণ সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীবৃন্দ । পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নতুন মুদ্রা ও মনিঅর্ডার ফরম ফরম এবং খাম ও পােস্টকার্ডে বাংলা না থাকায় বা অতি মামুলিভাবে থাকায় তারা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র প্রতিবাদ মিছিল বের করেন এবং বাংলাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান এবং এসব মিছিল ও প্রতিবাদসভাতেই সর্বপ্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি তােলেন। এসব ঘটে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন ছাত্র ও জনতার এক মিছিল সেক্রেটারিভ ভবনে গিয়ে তৎকালীন প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রীর কাছে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। শিক্ষামন্ত্রী জনাব মফিজউদ্দিন তাদের দাবিতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হন। শিক্ষামন্ত্রীর দস্তখত করার জন্য যে কলম দেওয়া হয়েছিল তা ছিল আমার।
এরপর মিছিল তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনের কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে তিনি আগেই নিজ কক্ষ ত্যাগ করে গাড়িতে চড়ে পালিয়ে যান।
‘৪৭-এ পূর্ব বাংলায় প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল দুটো : মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস । এর মধ্যে লীগের জনসমর্থন ছিল প্রায় সর্বাত্মক এবং কংগ্রেসের কম। কিন্তু এই কংগ্রেসই ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগী। অনেক রাজনৈতিক নেতা ভাষা-আন্দোলনের শুরুতে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু গাজীউল হক, যিনি আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিলেন, তিনি লিখেছেন :
‘মওলানা ভাসানীসহ যে ৪২ জন নেতা এই আন্দোলনের সপক্ষে ছিলেনতাঁদের মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রিত্ব এবং রাষ্ট্রদূতের পদ নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন।”৬
পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় মওলানা ভাসানী
১৯৪৬ সালের নির্বাচন হতে খাজা নাজিমউদ্দিন বিদায় নিয়ে লন্ডনে অবসর জীবন যাপন করেছিলেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বাংলার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা। খাজা নাজিমউদ্দিন ছিলেন জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের বিশ্বস্ত ও ইয়েসম্যান। ১৯৪৭ সালে খাজা নাজিমউদ্দিনকে বাংলার রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা হলাে এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তিনি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি আইনসভার সদস্য ছিলেন না; অথচ তিনি দলীয় নেতা
পৃষ্ঠাঃ ১০৩
ও মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে যদি সদস্য নয় এরূপ কেউ মন্ত্রী হন তবে তাকে ৬ মাসের মধ্যে আইনসভার সদস্য (এমএলএ) হতে হবে। মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরীও নির্বাচিত সদস্য ছিলেন না। টাঙ্গাইল দক্ষিণ আসন শূন্য হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন মুসলিম লীগের প্রার্থী হলেন। এদিকে মওলানা ভাসানী ১৯৪৭ সালের সেপ্টম্বর মাসে আসাম থেকে টাঙ্গাইলে এসে বসতি শুরু করেছেন। এ সময় তার প্রভাবে স্থানীয় জনগণও মুসলিম লীগ তাকে নমিনেশন না দিলেও তিনি প্রার্থী হবেন। খাজা নাজিমুদ্দিন ভীত হয়ে পড়েন। তিনি আর প্রার্থী হলেন না। তিনি ফরিদপুরের আহমদ আলী মৃধাকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য করে তার শূন্য আসনে প্রার্থী হলেন- সেখানেও স্থানীয় প্রতিরােধের মুখে তিনি প্রার্থী হলেন না। সেখানে হামিদুল হক চৌধরীকে প্রার্থী করেন। তিনি বিরােধিতার মুখে দাড়াতে পারেননি। টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর আসনের সদস্য ছিলেন প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান। তাঁকে সেকেন্ডারি স্কুল বাের্ডের চেয়ারম্যান নিয়ােগ করে তার শূন্য আসনে খাজা নাজিমউদ্দিন প্রার্থী হলেন। তাঁর বিরুদ্ধে একজন প্রার্থী ছিলেন। তার প্রার্থিতা রিটার্নিং অফিসার ত্রুটির কারণে বাতিল করে দিলেন। ফলে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খাজা নাজিমউদ্দিন ভুয়াপুর থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এলএমএ নির্বাচিত হন৷ মি.জিন্নাহর অনুরােধে মন্ত্রী ফজলুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন ছেড়ে দিলে হামিদুল হক চৌধুরী নির্বাচিত হন। এ জন্য জিন্নাহকে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ৬ মাস সময়সীমা বৃদ্ধি করেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাথে মুসলিম লীগ সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করে।খাজা নাজিমউদ্দিন আইনসভার সদস্য না হয়েও তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করা হলাে। অন্যদিকে এ কে ফজলুল হক ও হােসেন শহীদ সােহওয়াদকে ষড়যন্ত্র করে দূরে রাখা হয়।
টাঙ্গাইল দক্ষিণ আসনে বাধ্য হয়ে মুসলিম লীগ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নমিনেশন প্রদান করে। তিনি ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার এমএলএ (মেম্বার অব লেজিসলেটিভ এ্যাসেমবলি) নির্বাচিত হলেন। এ নির্বাচনে প্রমাণিত হলো মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার একজন উদীয়মান নেতা। তিনি শপথ গ্রহণ করে আইনসভায় যােগ দেন। তিনি প্রথম পূর্ব বাংলার আইনসভায় বাংলা ভাষায় ভাষণ প্রদানের দাবি করেন।৭
গণপরিষদে বেগম শায়েস্তা সােহরাওয়ার্দী- ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮
পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান গণপরিসদে একমাত্র নির্বাচিত মুসলিম মহিলা
পৃষ্ঠাঃ ১০৪
সদস্য ছিলেন বেগম শায়েস্তা সােহরাওয়ার্দী একরামুল্লাহ। তার পিতা ছিলেন হাসান সােহরাওয়ার্দী। তার স্বামী ছিলেন পাকিস্তান সরকারের সচিব একরামুল্লাহ। শায়েস্তা সােহরাওয়ার্দী ও তার মামাত ভাই হােসেন সােহরাওয়ার্দী একই সময় পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে এবং বাঙালিরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঞ্চিত হতে থাকে। এর প্রতিবাদে বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে এক ভাষণে বলেন : A feeling is growing among the Eastern Pakistanis that East Pakistan is being neglected and treated as a colony of West Pakista. – পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে একটি ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যদের গণপরিষদে যােগদানে যাতায়াতের অসুবিধা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে অজ্ঞ। তাই তিনি প্রস্তাব করেন যে, গণপরিষদ অধিবেশন বছরে অন্তত একবার ঢাকায় বসা প্রয়ােজন। শায়েস্তা সােহরাওয়ার্দী সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য ও অবহেলার কথা গণপরিষদে তুলে ধরেন। ১৯৫৬ সালে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন প্রথম ঢাকায় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়। ছাত্রলীগের সভাপতি সম্পাদকদের নাম নিম্নে দেয়া হলাে:
১৯৪৮ : জনাব নঈমুদ্দিন আহমদ- আহ্বায়ক
১৯৪৯-৫৩ : দবিরুল ইসলাম – সভাপতি
খালেক নেওয়াজ খান- সাধারণ সম্পাদক
১৯৫৩-৫৪ : কামরুজ্জামান – সভাপতি
এম. আবদুল ওয়াদুদ – সাধারণ সম্পাদক
১৯৫৪-৫৫: আবদুল মমিন তালুকদার – সভাপতি
এম. আবুদল ওয়াদুদ – সাধারণ সম্পাদক
১৯৫৫-৫৬-৫৭: আব্দুল মমিন তালুকদার- সভাপতি
আবদুল আউয়াল – সাধারণ সম্পাদক
পৃষ্ঠাঃ ১০৫
১৯৫৭-৬০ : রফিকুল্লাহ চৌধুরী- সভাপতি
১৯৫৭-৫৮ : কাজী আজহারুল ইসলাম- সাধারণ সম্পাদক
১৯৫৮-৫৯-৬০: শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন- সাধারণ সম্পাদক
১৯৬০-৬৩: শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন – সভাপতি
শেখ ফজলুল হক মনি – সাধারণ সম্পাদক
১৯৬৩-৬৫ : কে এম ওবায়দুর রহমান- সভে
সিরাজুল আলম খান- সাধারণ সম্পাদক
১৯৬৫-৬৬-৬৭: মােজাহারুল হক বাকী- সভাপতি
আবদুর রাজ্জাক – সাধারণ সম্পাদক
১৯৬৭-৬৮: খোরশেদ আহমেদ কোরেশী – সভাপতি
আব্দুর রাজ্জাক- সাধারণ সম্পাদক
১৯৬৮-৬৯ : আবদুর রউফ – সভাপতি
খালেদ মােহাম্মদ আলী – সাধারণ সম্পাদক
১৯৬৯-৭০ : তােফায়েল আহমেদ- সভাপতি
আ স ম আবদুর রব – সাধারণ সম্পাদক
১৯৭০-৭২ : নূরে আলম সিদ্দিকী – সভাপতি
শাজাহান সিরাজ – সাধারণ সম্পাদক
ঢাকা কলেজ হতে নবাব সলিমুল্লাহ কলেজ
১৯৪৮ সালে চতুর্থ স্থান পেয়ে আইএ পাস
১৯৪৪ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে তার আইএ পরীক্ষা দেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি ছাত্র ও মুসলিম লীগ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার আইএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। ১৯৪৭ সালেও তার পরীক্ষা দেয়া হয়নি। এ জন্য তার মায়ের বকুনি খেতে হয়েছে। মা ছেলের লেখাপড়া নিয়ে চিন্তিত। ছাত্রজীবনে পিতা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে। জনগণের পক্ষে তিনি দুর্নীতিবাজ বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মামলা করেছেন। রাজনীতি ও সাংসারিক কারণে তিনি কলেজে নিয়মিত পড়তে পারেননি। ফলে তিনি ঢাকা কলেজে নন-কলেজিয়েট
পৃষ্ঠাঃ ১০৬
হন এবং নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি পেতে ব্যর্থ হন। তখন বাধ্য হয়ে তাজউদ্দীন আহমদ নবাব সলিমুল্লাহ কলেজ হতে প্রাইভেট পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় সলিমুল্লাহ কলেজের অধ্যক্ষের সাথে দেখা করেন। অধ্যক্ষ তাকে প্রাইভেট আইএ পরীক্ষা দেয়ার অনুমতি দেন।
১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইএ পরীক্ষা দেন এব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তিনি চতুর্থ স্থান দখল করে প্রথম বিভাগে ইন্টারমেডিয়েট আর্টস- আইএ পরীক্ষা পাস করেন।
পৃষ্ঠাঃ ১০৭
৪
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন ১৯৪৮-৫৯
ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮
পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্তকরণের প্রস্তাব
২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮
পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাঙালীদের মধ্যে প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি পরিষদে উত্থাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি গণপরিষদের ২৯ নম্বর বিধির ১৫ উপবিধিতে উর্দু ও ইংরেজী ভাষার সাথে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্তির জন্য সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন :
MR. President, Sir, I make :
That is sub-rul (1) of rule 29, after the word ‘English’ in line 2, the words or Bengalee be isserted’.
Sir, in moving this the montion that stands in my name is can assure the house that I do so not in a sprit of narrow provincialsm, but, Sir, in the spirit that this motion receives the fullest consideration at the hands of the members. I know, Sir, that Bengalee is a provincial language, but so far our State is concerned, it is the language of the majority of the people of the State. So although it is a provincial language but as it is a language of the majority of the people of the state and it stands on a differant footing therefore. Out of six crores and ninety lakhs of people inhabiting this state, 4 crores and 40 lakhs of the people speak the Bengalee language. So, Sir, what should be the state language of the state? The state language of state should be the language which is used by the majority of the people of the state and for that, Sir, I consider that Bangalee language is a
পৃষ্ঠাঃ ১০৮
lingua franca our state.
I know, Sir, I voice the sentiment of the vast millons of our state. I want to let the house know the feeling of the vastest millions of our state. The common man of the state numbering four crores and forty lakhs find that the proceeding of this assembly which is unknown to them. Then, Sir English has got an honoured place because of the international character.
But, Sir, if English can have an honoured place in rule 29 that the proceedings of the asembly should be condcted in Urdu or English why Benglee, which is spoken by four crores forty lakhs of people shoud not have an honoured place. Sir, in rule 29 of the procedure rules. So, Sir, I know I am voicing the sentiments of the vast millions of our state and therefore Bengalee should not be treated as a provincial language. It should be treated as the language of the State and therefore, Sir, I suggest that after the word ‘English’, the Words ‘Bengalee be inserted in rule… ১
মহামান্য সভাপতি, আমি প্রস্তাব করছি :
২৯ নম্বর বিধির ১ নম্বর উপবিধির দ্বিতীয় পঙক্তিতে ইংরেজী শব্দের পর “অথবা ‘বাংলা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হবে।
মহামান্য, আমার নামে যে প্রস্তাব আছে তা পেশ করে আমি সংসদকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমি সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতার প্রেরণায় তা করছি না; আমি তা করছি কারণ এ প্রস্তাব সদস্যের পূর্ণ বিবেচনা লাভ করেছে।
মহােদয়, আমি জানি যে, বাংলা প্রাদেশিক ভাষা, কিন্তু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ ভাষা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা। সুতরাং যদিও এ হলাে প্রাদেশিক ভাষা, কিন্তু যেহেতু এ ভাষা দেশের বৃহৎ জনগােষ্ঠীর ভাষা এবং সুতরাং এ ভাষার স্বতন্ত্র অবস্থান রয়েছে। এ রাষ্ট্রের ৬ কোটি ৯০ লাখ লােকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ লােক বাংলা ভাষায় কথা বলে। সুতরং মহােদয়, দেশের রাষ্ট্রভাষা কি হবে? দেশের রাষ্ট্রভাষা সে ভাষাই হবে যে ভাষা রাষ্ট্রের অধিকাংশ লােক ব্যবহার করে। সুতরাং আমি মনে করি বাংলা ভাষা রাষ্ট্রের লিঙ্গুয়া ফ্যাংকা- রাষ্ট্রভাষা।
পৃষ্ঠাঃ ১০৯
মহােদয়, আমি জানি রাষ্ট্রের অধিকাংশ লােকের আকাঙ্ক্ষা আমার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে আমি দেশের বিরাট জনগােষ্ঠীর ইচ্ছা আমি সংসদকে অবহিত করছি।..
দেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ সাধারণ লােক দেখতে পায় যে তাদের মায়েরতুল্য পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালী যে ভাষায় লেখা হয় সে ভাষা তাদের নিকট অপরিচিত। মহােদয়, ২৯ নম্বর বিধিতে ইংরেজী ভাষার সম্মানজনক অবস্থান আছে। মহোদয়, আমি জানি আন্তর্জাতিক কারণে ইংরেজী ভাষার সম্মানিত অবস্থান।
মহােদয়, ইংরেজী ভাষার যদি ২৯ নম্বর বিধিতে সম্মানিত স্থান থাকে এবং ইংরেজী বা উর্দু ভাষায় যদি সংসদ পরিচালিত হতে পারে তাহলে ৪ কোটি ৪০ লাখ লােকের বাংলা ভাষা কেন ২৯ নম্বর বিধিতে মর্যাদার স্থানে থাকবে না। সুতরাং মহােদয়, আমি জানি যে, আমি আমাদের দেশের বিরাট জনগােষ্ঠীর মনের কথা বলছি এবং এ কারণে বাংলা ভাষাকে প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গণ্য করা উচিত। সুতরাং মহোদয় বিধি ২৯ নম্বরে ইংরেজি শব্দের পরে ‘বাংলা অন্তর্ভুক্ত করার’ সুপারিশ করছি।’
তিনি তাঁর ভাষণে আরও বলেন যে, মানি অর্ডার ফরম ও স্ট্যাম্পের ভাষা হলাে উর্দু ও ইংরেজি। অধিকাংশ মানুষের ভাষা বাংলার স্থান সেখানে নেই। রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু লােকেরা তা পড়তে পারে না এবং তারা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি প্রেমহরি বর্মা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাব সমর্থন করে গণপরিষদের ভাষণ দেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করে বলেন : ‘The object of this amendment is to take away from the mussalmans that unitifying force that brings them together.”
‘এ সংশােধনী উদ্দেশ্য হলাে পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। এর উদ্দেশ্য হলাে মুসলমানদের মধ্যে বন্ধনের শক্তি ছিনিয়ে নেয়া। প্রধানমন্ত্রী উর্দুর পক্ষে কথা বলেন। পূর্ব বাংলা প্রতিনিধি খাজা নাজিমউদ্দিন, তমিজউদ্দন খান প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, শিরিস চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সংশােধনী প্রস্তাবের পক্ষ সমর্থন করেন । লক্ষণীয়, বাংলার কোন মুসলমান প্রতিনিধি সেদিন বাংলা ভাষার পক্ষে গণপরিষদের ভাষণ দিতে সাহস পায়নি।
পৃষ্ঠাঃ ১১০
গণপরিষদের ২৯ নম্বর বিধিতে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এ সংবাদ পূর্ব বাংলায় পৌছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ জানায় এবং ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা দিবস পালন করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবকে এডভােকেট ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে পাক সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা শহরে তার বাসভবনে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পাকিস্তান গণপরিষদের কার্যাবলীর মাধ্যম ছিল উর্দু ও ইংরেজী । বাংলা নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। গণপরিষদের সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলা ভাষাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী, খাজা নাজিমউদ্দিন প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মুসলিম লীগ সরকারের বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণে অস্বীকৃতি প্রদানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করে এবং সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দ হলেন :
গণআজাদী লীগ – ২ জন
তমদ্দুন মজলিস – ২ জন
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল – ২ জন
ছাত্রলীগ- ২ জন
কামরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে সলিমুল্লাহ হলে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, মুহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, আবুল কাসেম, রণেশ দাশগুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখ। সভায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয় । ১১ মার্চ সকালে সচিবালয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ছাত্রসমাজ পিকেটিং শুরু করে। তারা সচিবালয় কর্মচারীদের হরতালে যােগদানের আহ্বান জানায়। পুলিশ শেখ মুজিব, তােয়াহা, অলি আহাদ, সর্দার ফজলুল করিমসহ প্রায় তিন শ ছাত্রকে গ্রেফতার করে। পুলিশ ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এ কে ফজলুল হক একদল আইনজীবীকে নিয়ে হাইকোর্ট থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ জানায়। পুলিশ শেরেবাংলাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। তিনি দীর্ঘদিন পায়ের আঘাতে ভুগছিলেন। ছাত্রদের গ্রেফতার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবাদ সভা ও হরতাল পালিত হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারের ভাষ্য হলাে :
পৃষ্ঠাঃ ১১১
১১ই মার্চ কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক অমুসলমানদের দোকন বন্ধ ছিল এবং ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও পাকিস্তানকে খর্ব করা , এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সমগ্র আন্দোলনের একটআ সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা দেয়ার প্রচেষ্টা সহজেই লক্ষণীয়। এই প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক ‘নওবেলালের’ ঢাকাস্থ প্রতিনিধি প্রেরিত একটি চিঠিতে বলা হয় :৩
“১১ই মার্চের এতবড় ঘটনার পর পূর্ববঙ্গ সরকার যে প্রেসনোট বাহির করেন তাহা পড়িলেই বুঝা যায় প্রকৃত সংবাদকে ব্ল্যাক আউট করার জন্য সরকার চেষ্টা করিয়াছেন। প্রেসনােটে বলা হয় মাত্র কতিপয় বিভেদ সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রের দুশমন এই ধর্মঘটে যােগ দিয়েছিল। শহরের সমগ্র মুসলিম এলাকা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করিতে অস্বীকার করে অর্থাৎ সরকারের মতে মুষ্টিমেয় কম্যুনিস্ট এবং কপিতয় হিন্দু ধর্মঘটে অংশ নিয়েছিল। অথচ কে না জানে ধর্মঘটকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য ঢাকার প্রত্যেকটি মুসলমান ছাত্র পুলিশের গুলি, বেয়নেট ও লাঠির সম্মুখে বুক পাতিয়া দিয়াছিল। অথচ সরকারের মতে মুসলমানরা এই আন্দোলনে যোগ দেয় নাই। প্রচারণার কি অপূর্ব নমুনা!”
পাকিস্তানের গবর্নর জেনারেল কায়দে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯ মার্চ ঢাকা সফরে আসবেন। তাই পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের সাথে রাষ্ট্রভাষার বিরােধ মিটিয়ে ফেলতে চান। ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী ও সংগ্রাম কমিটির সাথে নিম্নলিখিত ৮ দফার ভিত্তিতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় :
সর্বসম্মত চুক্তিটির বিবরণ নিম্নরূপ :
১. ২৯শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৮, হইতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদিগকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে তাহাদিগকে অবিলম্বে মুক্তি দান করা হইবে ।
২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযােগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।
৩. ১৯৪৮-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারী আলােচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেইদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে ।
৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজী উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলােতে
পৃষ্ঠাঃ ১১২
অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দান করা হইবে।
৫. আন্দোলনে যাহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের কাহারও বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।
৬. সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।
৭. ২৯ শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।
৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলােচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।
২৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান, তােয়াহা, অলি আহাদসহ সকল ছাত্রদের মুক্ত দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ বিকালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার বােন ফাতেমা জিন্নাহকে নিয়ে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তাঁকে বিরাট সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। তিনি ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে তিনি বলেন- Urdu and Urdu shall be the only state language of Pakistan. উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্রলীগের ছাত্র নেতৃবৃন্দ জিন্নার ঘােষণার প্রতিবাদ করে বলেন- No, No। ছাত্রলীগ-সরকারী ও বিরােধী উভয় দল জিন্নাহর সাথে দেখা করে। বিরােধী ছাত্রলীগ জিন্নাহর নিকট বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি জানান। ২৪ মার্চ সমাবর্তন উপলক্ষে জিন্নাহ কার্জন হলে ভাষণ দেন। তিনি পুনরায় ঘােষণা করেন- একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ মওলানা ভাসানী প্রাদেশিক আইনসভায় বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখার দাবি জানায়। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করারও প্রস্তাব করেন।
প্রাদেশিক আইনসভায় মওলানা ভাসানীর
বাংলায় ভাষণ- মার্চ ১৯৪৮
১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসবেন। একদিকে ভাষা আন্দোলন ও অন্যদিকে জিন্নাহর ঢাকায় প্রথম আগমন- এ নিয়ে ঢাকাসহ আইনসভায় উত্তপ্ত পরিবেশ । আইনসভায় বাজেট পেশ করা হয়েছে। কিন্তু আইনসভায় প্রধান আলােচ্য হয়ে দাঁড়ায় বাংলা ভাষার প্রশ্ন। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ আইনসভা বসে। স্পিকার ছিলেন আবদুল করিম। অধিবেশনে ভাষার
পৃষ্ঠাঃ ১১৩
প্রশ্নে আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন- ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাহমুদ আলী, আনোয়ারা খাতুন, মনােরঞ্জন ধর প্রমুখ। তাঁরা ১১ মার্চ তারিখে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি ও আইন পরিষদের বাইরে ছাত্রদের মিছিল সম্পর্কে জানতে চান। এ পর্যায়ে এ কে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে লক্ষ্য করে বলেন , The leader of the house must go outside just now. He must go, must go, must go- পরিষদের নেতা অধিবেশনের বাইরে যাওয়া উচিত। তাঁকে অবশ্য, অবশ্য যেতে হবে। এ কে ফজলুল হক খাজা নাজিমউদ্দিনকে হুকুম দিলেন, সংসদের বাইরে ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ চলছে তা তিনি নিজে দেখে আসুক, তার ভাষনে স্পিকার আপত্তি করেন। ১১ মার্চ এ কে ফজলুল হক নিজে পুলিশের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পুলিশ মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছে। এ কারণে বৃদ্ধ জননেতা রাগান্বিত ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ মওলানা ভাসানী ভাষার প্রশ্ন উত্থাপন করে আইনসভায় ইংরেজী ভাষায় আলােচনা না করে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেবার দাবি জানিয়ে বলেন-
“Point of Information Regarding Language Question (17th March, 1948).
Moulana Abdul Hamid Khan : জনাব সদর সাহেব, এখানে যারা সদস্য আছেন তারা সকলেই স্বীকার করবেন যে এটা বাংলা ভাষা-ভাষীদের দেশ এই Assembly-র যিনি সদর তিনিও নিশ্চয়ই বাংলাতেই বলবেন। আপনি কি বলেন আমরা তাে কিছুই বুঝিতে পারি না, আপনি যা বলেন তার সহিত সদস্যদের Discussion-এর কোন সংস্রব থাকতে পারে না। আপনি যদি বাংলায় Ruling না দেন তা হলে আমরা আপনার আলােচনায় শরিক হব কি করে, আমি আশা করি আপনি Ruling দেবেন যেন সবাই বাংলাতে বলেন এবং আপনিও বাংলাতে Ruling দেবেন।
Mr. Speaker : মাননীয় মেম্বর যা বলছেন সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এখন পর্যন্ত এই Assembly-তে ঠিক হয় নাই যে কোন ভাষায় এই Assembly-র কাজ হবে, তা নির্ভর করে এই Assembly-র সদস্যদের সিদ্ধান্তের ওপর। এখনও এই রূপ কোন সিদ্ধান্ত এই Assembly-তে হয় নাই, যে পর্যন্ত এই রূপ কোন সিদ্ধান্ত না হয় সে পর্যন্ত যিনি যে ভাষা জানেন তিনি সেই ভাষায় বলবেন, এটা Ruling-এর বিষয় নয়।
Moulana Abdul Hamid Khan ; আপনি কোন ভাষায় বলবেন? সদর
পৃষ্ঠাঃ ১১৪
সাহেব, আমি আশা করি ইংরেজী বর্জন করে বাংলা ভাষাতেই যাতে সকলে বলেন তার ব্যবস্থা করবেন।
Moulana Abdul Hamid Khan: জনাব সদর সাহেব, দীর্ঘদিন যাবত সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের শাসন ও শােষণ হতে মুক্তি লাভ করে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ আশা করেছিল যে, স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে, স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করবে, তাদের হারানাে গৌরব ফিরে পাবে, তারা অর্থনৈতি, সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নতি লাভে সক্ষম হবে কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় বড় আফসােসের বিষয় যে, এই হাউসে জনাব অর্থ সচিব যে বাজেয়াত পেশ করেছেন তা তিনি জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবে করেননি। গভর্নর জেনারেল মনােনীত মেম্বার হিসেবে করেছেন। স্বাধীন দেশে, স্বাধীন পাকিস্তানে স্পেশাল পাওয়ারের মন্ত্রী দ্বারা বাজেট পেশ হবে তা আমরা কখনও আশা করিনি। জেনসাধারণের মনের কথা, মনের দুঃখ ও বেদনা বুঝবার তার শক্তি নাই। কারণ জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর আদৌ কোন সংস্রব নাই। বিংশ শতাব্দীর এই গণতান্ত্রিক যুগে এই স্বাধীন দেশে গভর্নর জেনারেল স্পেশাল পাওয়ার ব্যবহার করবেন এটা আমাদের ধারণার অতীত।”
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে
২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮
নঈমদ্দিন ও অলি আহাদের সাথে বাংলা ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তান গণপরিষদের ভূমিকা নিয়ে আলােচনা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ তমদ্দুন মজলিস অফিসে যান। অধ্যাপক কাসেম, ইনসান, ওয়াহেদ চৌধুরী, অলি আহাদ ও অন্যরা উপস্থিত। গণপরিষদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ঘােষণা সম্পর্কে আলােচনা হয়।
১ মার্চ ১৯৪৮
সলিমুল্লাহ কলেজে যান এবং ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণ করেন।
২ মার্চ ১৯৪৮
নঈমউদ্দিনের অনুরােধে তাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য একটি প্যামপ্লেট খসড়া করেন। সন্ধ্যা ৭টায় এফএইচএম হলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কামরুদ্দিন আহমদ সভায় সভাপতিত্ব করেন। শামসুল হক, শামসুদ্দিন, সর্দার ফজলুল করিম, তােয়াহা, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, নাঈমউদ্দিন, অধ্যাপক কাসেম, লিলি খান, আনােয়ারা খাতুন, তফাজ্জল আলী, এটিএম হক, আলী আহম্মদ, মহিউদ্দিন, ওয়াদুদ, শওকত,
পৃষ্ঠাঃ ১১৫
আউয়াল, মাহবুব, নূরুল আলম, শহীদুল্লাহ, অজিত রায়, ওয়াহেদ চৌধুর, তাজউদ্দীন আহমদসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
৩ মার্চ ১৯৪৮
নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় যুব সম্মেলন সম্পর্কে সভা হয়, সভায় উপস্থিত ছিলেন আলমাস, আউয়াল, শামসুজ্জোহা, শামসুল হক, আজিজ আহম, নুরুল আলম, হযরত আলী, মহিউদ্দিন, শওকত, কামরুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন প্রমুখ।
১১ মার্চ ১৯৪৮, বৃহস্পতিবার
সকাল ৭টায় সাধারণ ধর্মঘটের পক্ষে কাজ করতে বেরিয়ে প্রথমে গেলাম এফএইচএস হলে। তােয়াহা সাহেব এবং আমি একসঙ্গে কাজ করছি। রমনা পােস্ট অফিসের কাছে তােয়াহা সাহেব ও অন্য কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। আমি গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হলাম। একটু পরে তােয়াহা সাহেবকে পুলিশ ছেড়ে দিল।
১২টায় পিকেটিং বন্ধ হলে ১টায় নাঈমুদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা হয়।
বেলা ২টায় সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হলে পুলিশ হাইকোর্ট গেটের কাছে বাধা দিল। আমরা উত্তর গেটের দিকে রওনা হলাম। তখনই পুলিশ লাঠিচার্জ করল । তােয়াহা সাহেবকে মারাত্মক মারধর করল। অন্যরাও মার খেল। কোথাও যেতে পারলাম না। সাড়ে ৩টায় সভার পর সবাই চলে গেল।
মুজিব, শামসুল হক, মাহবুব, অলি আহাদ, শওকত, আনসার ও অন্যান্য ৫৯ জনকে আটক করে জেলহাজতে রাখা হয়েছে। ১৪ জন আহত হয়ে হাসপাতালে। সেন্ট্রাল জেলে, কোতােয়ালি ও সূত্রাপুর থানা এবং হাসপাতালে তাদের সঙ্গে দেখা করলাম।
পুলিশের নির্যাতন ও ভাড়াটে গুণ্ডাদের গুণ্ডামি সত্ত্বেও আজকের ধর্মঘট চমৎকার সফল হলাে।
১২ মার্চ ১৯৪৮
তাজউদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রভাষা উপকমিশনের সভায় যােগ দেন।
১৪ মার্চ ১৯৪৮
তাজউদ্দীন মুসলিম লীগ নেতা তফাজ্জল আলীর সাথে দেখা করেন। কর্মীরা এমএলএদের সাথে দেখা করেছে। তােয়াহা ও তাজউদ্দীন আহমদের চাপে আগামীকাল সাধারণ ধর্মঘট ডাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে। এমএলএরা খাজা নামিউদ্দিনের সাথে সমঝােতার চেষ্টা করছে।
পৃষ্ঠাঃ ১১৬
তাজউদ্দীন একদল কর্মী নিয়ে দিলকুশায় গেল । মুহাম্মদ আলী ও অন্যান্যরা ব্যক্তিগত স্বার্থে আপোস না করার প্রতিশ্রুতি দিল। বিকেলে দলের সভায় আপােসের শর্ত নিয়ে আলােচান হলাে। বর্ধমান হাউজে ছাত্রদের বিক্ষোভ চলে। খাজা নাজিমউদ্দিন বিরােধী সদস্যদের গণপরিষদের ব্যাপারে ছাড় দিতে চান।
১৫ মার্চ ১৯৪৮
তাজউদ্দীন আহমদ ও তােয়াহা প্রথমে এফএইচএম হলের কর্মীদের একত্রিত করেন। তারপর তাজউদ্দীন রমনা পােস্ট অফিস থেকে নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক এলাকায় পিকেটিংয়ের কাজ দেখলেন। ডা, করিম অ্যাম্বুলেন্স ও কর্মীবাহিনী নিয়ে কাজ শুরু করছেন। সেখান থেকে জগন্নাথ হােস্টেল, আগামসি লেন দেখা যায় এবং কর্মীদের বের করেন।
সচিবালয় এবং রমনা এলাকার অন্যান্য অফিসে বাঙালী অফিসাররা পূর্ণ ধর্মঘট করলেন। ১১টায় রেলওয়ে কর্মীরা ধর্মঘটে যােগ দেন।
খাজা নাজিমউদ্দিন সংগ্রাম কমিটির সাথে তার বাসভবনে সাক্ষাত করেন এবং তিনি সংগ্রাম কমিটির শর্ত মেনে নিলেন। তাকে স্বীকার করতে হলাে যে, বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রের শত্রু নয়। ৮ দফা চুক্তি হলাে।
বিপুলসংখ্যক পিকেটারকে গ্রেফতার করা হলাে এবং দুপুর ১২টায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গেটে পুলিশ কাদানে গ্যাস ব্যবহার করে।
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সভার পর এসেম্বলি ভবনের সামনে একটা বিরাট বিক্ষোভ মিছিল চলে। তাজউদ্দীন আহমদ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চত্বরে অবস্থান নেন।
ছাত্ররা খাজা নাজিমউদ্দিনের সাথে কোন শর্তে সমঝােতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
২৬ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ঘােষণা করতে হলাে।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংগ্রাম কমিটির চুক্তি অনুসারে সন্ধ্যার পর সকল বন্দিকে ছেড়ে দেয়া হয়।
১৬ মার্চ ১৯৪৮
৮টায় এফএইচ হলে সংগ্রাম কমিটি গতকাল মুখ্যমন্ত্রীর সাথে গৃহীত শর্তাদির কিছু সংশােধন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রঙ্গণে বেলা দেড়টায় সভা শুরু হলাে। শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সভা শেষে এসেম্বলি হাউস অভিমুখে মিছিল করে এবং সন্ধ্যা
পৃষ্ঠাঃ ১১৭
পর্যন্ত অবস্থান করে। সন্ধ্যায় পুলিশ লাঠিচার্জ করে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে। ১৯ জন মারাত্মক আহত হয়। বলিয়াদী ভবনে এমএলএদের সভা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ঘটনা বর্ণনা করেন। ১৭ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ প্রদর্শন হবে- ধর্মঘট হবে না।
১৭ মার্চ ১৯৪৮
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভায় তাজউদ্দীন আহমদ যোগ দেন। সভাপতিত্ব করেন নঈমউদ্দিন আহমদ। কায়দে আযমের ঢাকা আগমন উপলক্ষে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে।
১৯ মার্চ ১৯৪৮, শুক্রবার
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নহ আজ বিমানে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তাকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তার পাশে হাজার হাজার মানুষ। তাজউদ্দীন আহমদ হেয়ার রোডে অবস্থান নেন। অনেক তােরণ নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বৃষ্টি সব ভণ্ডুল করে দেয়। জিন্নাহ মুখ্য সচিবের বাসায় থাকেন। কায়দে আযমের সম্মানে শহর সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। সর্বত্র আলােকসজ্জা করা হয়েছে। পুলিশী নির্যাতনে ছাত্ররা নিস্পৃহ স্লোগান তােলার উচ্ছাস দেখা যায়নি।
২১ মার্চ, রােববার
রমনা রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর জনসভা।
বিকেল সাড়ে ৪টায় রেসকোর্স ময়দানে কায়দে আযমের জনসভায় গেলাম।। কায়দে আযম এলাে সােয়া ৫টায়। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি নবাবের বক্ততার পর কায়দে আযম পৌনে ৬টায় তার বক্তৃতা শুরু করল। পৌনে ৭টা পর্যন্ত একঘন্টা বক্তৃতা করলেন। তিনি মন্ত্রিসভা ও মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচার চালান এবং সাম্প্রতিক ভাষা আন্দোলনের নিন্দা করলেন। তিনি ঘােষণা করলেন যে, উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা। পূর্ব বাংলার সরকারী ভাষা বাংলা হবে কিনা সে ব্যাপারে চূড়ান্তরূপে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন। ছাত্রদেরকে সাবধান করে দিলেন এবং প্রায় সরাসরি তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। কায়দে আযমের ভাষণ এ প্রদেশের সবাইকে আহত করেছে। প্রত্যেকেই নিদারুণ বিরক্ত। তিনি দলের ওপর উঠবেন সে আশাই করেছিল।
২৪ মার্চ ১৯৪৮, বুধবার
ছাত্রলীগের ব্যাপারে আলােচনার জন্য আবদুর রহমান চৌধুরীকে নিয়ে তােয়াহা সাহেব বিকেল সাড়ে ৫টায় কায়দে আযমের সাথে দেখা করেন। শাই
পৃষ্ঠাঃ ১১৮
আজিজের উপস্থিতিতে তাদের আলােচনা প্রায় ঘণ্টাধিককাল স্থায়ী হয়। কায়দে আযম ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের ব্যাপারে একমত হলেন এবং একটা গঠনতন্ত্র তৈরি করে নতুন করে শুরু করতে বলেন। তিনি অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্ট লীগকে বিলুপ্ত ঘােষণা করেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কায়দে আযম রাষ্ট্রভাষা কমিটিকে একটা সাক্ষাতকার দিলেন। আমরা তার সামনে একটি স্মারকলিপি দিলাম। কিন্তু কায়েদে আযম আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে দিলেন না। তিনি উর্দুর পক্ষে তার নিজস্ব তার নিজস্ব মতামত দিতে লাগলেন যা চরমভাবে যুক্তিহীন। তিনি আমাদেরকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন যে, আমরা যেন উর্দুকে আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করি। তিনি যা বললেন, “তােমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত উর্দু। আমরা হয়ত কিছুটা হলেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে পারতাম, যদি না শামসুল হক সাহেব তাকে উত্তেজিত করতেন। সােয়া সাতটা পর্যন্ত আলােচনা হলাে। কায়দে আযম অনেক ঘটনা অস্বীকার করলেন। হয় এসব ব্যাপারে তিনি জানতেন না, না হয় ইচ্ছাকৃতভাবেই তিনি এটা করছেন।
২৫ মার্চ ১৯৪৮
গত রাতে এ কে ফজলুল হক সাহেবকে খাজা নাজিমউদ্দিনের গুণ্ডারা মারধর করতে গিয়েছিল। আমরা সবাই ভয়ের মধ্যে আছি।
২৯ মার্চ ১৯৪৮
অলি আহাদ, নঈমউদ্দিন ও তাজউদ্দীন ভারতের সমস্যা বিশ্লেষণ করলেন। আদৌ স্বাধীনতা পাওয়া যায়নি। তাজউদ্দীনের এ মন্তব্য অলি আহাদ মানতে চাইলেন না।
১৫ এপ্রিল ১৯৪৮
ইস্ট পাকিস্তান ফ্রীডম লীগের সভা হলাে। সভার সিদ্ধান্তসমূহ :
১. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে দলের কোন সম্পর্ক নেই।
২. অবিলম্বে পাঠচক্র শুরু করা।৫
ঢাকার আহসান মঞ্জিলের যে পতন ১৯৪৪ সালে হয়েছিল তা আবার খাজা নাজিমউদ্দিন পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। তবে পূর্বের প্রতিপত্তি ফিরে আসেনি। খাজা নাজিমউদ্দিন মুখ্যমন্ত্রী হলেও খাজা সাহাবুদ্দিন ঢাকায় আর আসেননি। ফজলুর রহমান যা চায়নি তা পেয়ে মহাখুশি। তিনি কেন্দ্রের মন্ত্রী হলেন। নবাবের পুত্র ক্যাপ্টেন খাজা আসকারীকে মুখ্যমন্ত্রীর এডিসি করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালের জুন মাসে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেলে ঢাকায়
পৃষ্ঠাঃ ১১৯
বামপন্থী যুবনেতারা কামরুদ্দিনের নেতৃত্বে গণআজাদী লীগ Peoples Freedom League গঠন করে। তাজউদ্দীন নতুন দলের মেনুফেস্টোর খসড়া প্রণয়ন করেন। যুবকরা ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করে। এ কে ফজলুল হক ঢাকায় ফিরে এসে হাইকোর্টে ওকালতি করছেন। তিনি বাসা পাচ্ছেন না। কাদের সর্দারের বাড়িতে থাকেন। মাঝে মাঝে গুণ্ডারা তার বাড়ি আক্রমণ করে, সভা পণ্ড করে দেয়। নবাব সলিমুল্লাহর বােন আমিনার ছেলে সৈয়দ আলম গুণ্ডা দিয়ে ফজলুল হককে অপমান করেছে।
কলকাতা থেকে নূরুদ্দিন কামরুদ্দিনের পত্র দিয়ে যুবকদের একত্রিত করে একটি সংগঠন করতে বলেন। নূরুদ্দিনের পত্রের পর রাজশাহীর আতোয়ার রহমান ঢাকায় কামরুদ্দিন আহমদের সাথে দেখা করেন এবং যুবলীগ গঠন করার প্রস্তাব দেন। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান আবুল হাসনাতের বাড়িতে ১৯৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের ভার ছিল তােসাদ্দক আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, তােয়াহা, আবদুল আউয়াল। ১৯৪৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়- আহবায়ক ছিলেন তােসাদ্দক আহমদ।
ঢাকায় অনুশীলন পার্টির নেতা প্রতুল গাঙ্গুলী RSPI- বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পার্টি গঠন করেন। তার মৃত্যুর পর অমর ব্যানার্জী ও নেপাল নাগ আরএসপিআইর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। নারায়ণগঞ্জের মিল শ্রমিকদের মধ্যে তাদের আন্দোলন সংগঠিত ছিল। কামরুদ্দিন আহমদের সংগ্রাম ছিল আহসান মঞ্জিলের ধ্বংস। তিনি পুরােপুরি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তার মনে হলাে,আহসান মঞ্জিলের সাথে সংগ্রাম করতে হলে, শ্রমিকদের সংগঠিত করতে হবে। তিনি ডা. এএম মালিকের সাথে শ্রমিক আন্দোলন শুরু করেন। তিনি গণআজাদী লীগ ও গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠনে পূর্বের মতাে সময় দিতে পারছেন না। তিনি শ্রমিক আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যান। গণআজাদী লীগ ও যুবলীগ অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ও মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী আইনসভার সদস্য ছিলেন না। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে তাদের ৬ মাসের মধ্যে সদস্য হতে হবে। টাঙ্গাইলের দক্ষিণ এলাকা শূন্য হলে তিনি প্রার্থী হলেন।
জনগণের চাপে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইল থেকে প্রার্থী হন। ভয়ে নাজিমউদ্দিন তার নাম প্রত্যাহার করেন। মওলানা ভাসানী ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমএলএ নির্বাচিত হলেন।
১৯৪৮ সালের ১৭ মার্চ মওলানা ভাসানী বাংলা ভাষায় আইনসভায় ভাষণ
পৃষ্ঠাঃ ১২০
দেন। তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এদিকে খাজা নাজিমউদ্দিন তার সদস্যপদ বাতিল করার ষড়যন্ত্র করছে- মওলানা ভাসানী সরকারের ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর এমএলএ থেকে পদত্যাগ করেন। এর মধ্যে সরকার ভাসানীর সদস্যপদ বাতিল করে।
১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তান গণপরিষদে সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায়বিচার করার আহবান জানান। ১৯৪৮ সালের ৩ জুন স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য সােহরাওয়ার্দী ঢাকায় আসেন কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন তাকে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করেন।
১৯৪৮ সালের ১৪ জুলাই ঢাকায় পুলিশ বাহিনী বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করে। খাজা নাজিমউদ্দিনের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জিওসি মেজর জেনারেল আইয়ুব খান সেনাবাহিনী দিয়ে লালবাগে পুলিশের ওপর আক্রমণ করে অনেক পুলিশ হত্যা করে।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর করাচীতে দেহত্যাগ করেন। তার স্থলে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেন নুরুল আমিন। তারা সদস্যদের ভােটে নির্বাচিত হননি। পাকিস্তানে পূর্ণ গণতন্ত্র ভঙ্গ করল মুসলিম লীগ সরকার।
১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও তার স্ত্রী রানা লিয়াকত আলী পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। ২৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে লিয়াকত আলী খানকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ডাকসু তার নিকট বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সমিতির নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় বিশেষ করে উত্তর বাংলায় তেভাগা আন্দোলন চলে। মুসলিম সরকার কমিউনিস্টপার্টিকে বেআইনী ঘােষণা করে এবং বিরােধী দল দমনের জন্য ১৯৪৮ সালের জননিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ধর্মঘট-১৯৪৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীরা তাদের বেতন বৃদ্ধির দবিতে ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ ধর্মঘট আহবান করে। তাদের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ৫ মার্চ থেকে ছাত্র ধর্মঘট আহবান করে। ১১ মার্চ সরকার বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করে। মুসলিম লীগের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৯ মার্চ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এর
পৃষ্ঠাঃ ১২১
প্রতিবাদে ছাত্রলীগ ১৭ এপ্রিল প্রদেশব্যাপী হরতাল আহবান করে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন। প্রায় সকলে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি লাভ করেন। একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমান মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যায় আদেশের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়া ত্যাগ করেন।
১৯৪৯ সালে চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের আন্দোলনকালে তাজউদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি অনার্সের ছাত্র এবং ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
১৯৪৯ সালের ২৯ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কাউন্সিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ধর্মঘটে সমর্থনে আআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযােগে নিম্নের ২৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করে। তাদের মধ্যে ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার করে, ১৫ জনকে বহিষ্কার, ৫ জনকে ১৫ টাকা জরিমানা এবং ১ জনকে ১০ টাকা জরিমানা করা হয়।৬
৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কারাদেশ প্রাপ্ত ছাত্ররা হলো:
১. দবিরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ
২. আবদুল হামিদ চৌধুরী, এমএ, ছাত্র
৩. অলি আহাদ, বি.কম ছাত্র
৪. আব্দুল মান্নান, বিএ
৫. উমাপতি মিত্র, এমএসসি
৬. সমীর কুমার বসু, এমএ
হল হতে বহিষ্কার
১. আবদুর রহমান চৌধুরী, ভিপি, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
২. মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদ
৩. দেওয়ান মাহবুব আলী
৪. আবদুল মতিন
৫. অধ্যাপক মতিন খান চৌধুরী
৬. আবদুর রশীদ ভূইয়া
৭. হেমায়েত উদ্দিন আহমদ
৮. আবদুল মতিন খান
৯. নূরুল ইসলাম চৌধুরী
১০. সৈয়দ জামাল কাদেরী
পৃষ্ঠাঃ ১২২
১১. আবদুস সামাদ, এম,কম ছাত্র
১২. সিদ্দিক আলী এমএ
১৩, আবদুল বাকী, বিএ ছাত্র
১৪. জে পাত্রবিশ, এমএসসি ছাত্র
১৫. অরবিন্দু বসু, ভিপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ।
১৫ টাকা জরিমানা
১. শেখ মুজিবুর রহমান, আইন ছাত্র
২. কল্যাণ দাশগুপ্ত, এমএ, জিএস, ঢাকসু
৩. নঈমদ্দিন আহমদ এমএ, ল ছাত্র, আহবায়ক মুসলিম ছাত্রলীগ
৪. মিস নাদেরা বেগম, এমএ
৫. আবদুল ওয়াদুদ বিএ
১০ টাকা জরিমানা
১. মিস লুলু বিলকিস বানু, আইন ছাত্র
গণপরিষদে সােহরাওয়ার্দীর সদস্যপদ বাতিল-১৯৪৯
গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমউদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান গণপরিষদে তার সদস্যপদ বাতিল করে। ১৯৪৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সরকার পাকিস্তানের নির্বাচন বিধি সংশােধন করে বলেন, যে সকল সদস্য পাকিস্তানে কমপক্ষে ৬ মাস বাস করেনি, গণপরিষদে তাদের সদস্যপদ বাতিল হবে।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ গণপরিষদে সােহরাওয়ার্দীর সদস্যপদ শূন্য ঘােষণা করা হয়। অথচ সােহরাওয়ার্দী ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ চিরতরে কলকাতা ত্যাগ করে করাচী চলে আসেন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাজিম- লিয়াকত সােহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের গণতন্ত্র চর্চা থেকে বঞ্চিত করেন।
টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন- ১৯৪৯
টাঙ্গাইল দক্ষিণ নির্বাচনী কেন্দ্রে মওলানা ভাসানীর শূন্য আসনে ১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ঢাকার মুসলিম লীগের ১৪০ নম্বর মােগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের শামসুল হক ও মুসলিম লীগের খুররম খান পন্নীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের কর্মিবাহিনী শামসুল হকের নির্বাচনী প্রচার চালায়। শামসুল হকের নির্বাচন পরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদ অপূর্ব
পৃষ্ঠাঃ ১২৩
কর্মদক্ষতার পরিচয় দেয়। নির্বাচনে বিপুল ভােটে শামসুল হক নির্বাচিত হন।টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের পরাজয়ের পর মুসলিম লীগ আর কোন উপনির্বাচন সাহস পায়নি।
আওয়ামী লীগ সৃষ্টি- ২৩ জুন ১৯৪৯
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মামলা উপলক্ষে ঢাকায় আসতেন এবং একটি বিরােধী দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মওলানা ভাসানীর সাথে আলোচনা করেন। সােহরাওয়ার্দীর অনুগত যুব কর্মীরা ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার স্বামীবাগে কাজী মুহাম্মদ বশীর হুমায়ুনের রােজ গার্ডেনের বাসভবনে সম্মেলন আহবান করেন। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হলাে। সভায় এ কে ফজলুল হক উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনে ৪৯ সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী পরিষদ গঠিত হয়।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী – সভাপতি
আতাউর রহমান খান – সহসভাপতি
আলী আহমদ খান – সহসভাপতি
আলী আমজাদ খান – সহসভাপতি
সাখাওয়াত হােসেন – সহসভাপতি
আবদুস সালাম খান – সহসভাপতি
শামসুল হক – সাধারণ সম্পাদক
শেখ মুজিবুর রহমান – যুগ্ম সম্পাদক
খন্দকার মােশতাক আহমদ – যুগ্ম সম্পাদক
এ কে এম রফিকুল ইসলাম- সহসম্পাদক
ইয়ার মুহাম্মদ খান – কোষাধ্যক্ষ
১২ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয় :
১. পাকিস্তান একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ও জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হবে। সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হবে জনগণ।
২. রাষ্ট্রে দুটি আঞ্চলিক ইউনিট থাকবে- পূর্ব ও পশ্চিম।
৩. অঞ্চলগুলাে লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভােগ করবে।
৪. জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল নাগরিক সমান অধিকার ভােগ করবে ।
৫. শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে।
পৃষ্ঠাঃ ১২৪
৬. প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সকল নাগরিকের যােগদানের অধিকার থাকবে।
৭. মৌলিক মানবিক অধিকার দেয়া হবে- কাউকে বিনা বিচারে আটক করা যাবে না।
৮. বিনা খেসারতে জমিদারী ও সকল মধ্যস্বত্ব বিলােপ করা হবে।
৯. সকল জমি জাতীয়করণ করা হবে।
১০. সকল নাগরিক যােগ্যতানুসারে বৃত্তি অবলম্বনের অধিকার থাকবে।
১১. সরকারী ব্যক্তিরা কোন বিশেষ সুবিধা ভােগ করবে না।
১২. সরকারী কর্মচারীরা সমালােচনার অধীন হবেন, আইনের চোখে তাদের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করা হবে না।
হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মওলানা ভাসানীকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচন করেন। ১৯৫০ সালে সােহরাওয়ার্দী নিজকে আহবায়ক করে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। তার সুপারিশে মওলানা আবদুল হামিদ খানকে আওয়ামী লীগের সভাপতি, শামসুল হককে সম্পাদক এবং শেখ মুজিবর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত এবং পাকিস্তান গণপরিষদে তার সদস্যপদ বাতিল করে। এ সকল কারণে পূর্ব বাংলায় তিনি সরাসরি দল গঠনে অংশগ্রহণ না করে তিনি মওলানা ভাসানীকে সভাপতি পদে মনােনয়ন করেন। অনেকের ধারণা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। মূলত হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তার ‘Memoirs’ গ্রন্থে আওয়ামী লীগ গঠন সম্পর্কে লিখেছেন- “After coming to West Pakistan I decided to organise a political party to be called the Awami Muslim League, a suggestion I has already made to serveral my friends. Its doors would be open to all Muslim Pakistan Nationals so that once more we could have a mass Muslim organisation like the old Muslim League of Jinnah. Liaquat Ali Khan reacted by calling me a traitor, an agent of India and various other opporbrious names unworthy of himself and threatened to ‘crush all opposition under his heel”…
পৃষ্ঠাঃ ১২৫
In East Pakistan the Awami Muslim League found ready acceptance for, after all, the Muslims of East Pakistan knew me very well; I had worked in Bengal for more than a generation and spent twelve agonizing years among them in organising the Muslim League. The Awami Muslim League obviously had no members in the Constituent Assembly; this had been created in 1949 and was just a field opposition. The first contest create in 1951 when the general elections for the provincial ( Awami Muslim League) with the Nawab of Mamdot had created which called the Jinnah Awami Muslim League…
In East Bengal the Awami League was making great strides. I had nominated Moulana Bhasani as Predident of the Bengal Awami League. I had met him in Sirajgonj as long as 1931 when I was distributing relief to people suffering from the devastation of Floods in North Bengal. He was powerful speaker, a real demagogue and his speeches and similies has mass appeal. The Awami League was organised from the bottom with Union, Thana, Subdivision, District and Provincial Committees along the lines on which I had organised the Muslim League which in most places became the Awami League with all its members, lock, stock and barrel. ৭
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর আত্মকথায় দেখা যায় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তিনি মওলানা ভাসানীকে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নিয়ােগ করেন। ১৯৫০ সালে সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। ১৯৫১ সালে পাঞ্জাবে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য মামদোতের নওয়াব জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ পুনরুজ্জীবিত করে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠন করেন। তিনি দলের সভাপতি ছিলেন এবং এ পদে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন। মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সাল হতে ১৯৫৭ সালের ২০ মার্চ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্ত হলেন। মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিব সারা পূর্ব বাংলা সফর করেন, আওয়ামী লীগের জেলা ও মহকুমা কমিটি গঠন করেন। পূর্ব বাংলায় সােহরাওয়ার্দীর গতিবিধি তখনও ‘নিয়ন্ত্রিত এবং তিনি সরাসরি দল গঠনে
পৃষ্ঠাঃ ১২৬
এগিয়ে আসতে পারেননি। তাঁর নেতাকর্মীরা নতুন দল গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯-১৯৫৪
ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, সংবাদ, দি মর্নিং নিউজ, করাচি থেক প্রকাশিত দি ডন প্রভৃতি পত্রিকা মুসলিম সরকারপন্থী ছিল । বিরােধী দলের কোনো পত্রিকা ছিল না। আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকা বার লাইবেরীতে এক সভায় মওলানা ভাসানী একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব করলে চার শ’ টাকা চাদা পাওয়া যায়। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চাদা সংগ্রহ করে। আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ পত্রিকা প্রকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নামে পত্রিকার ডিক্লারেশন নেয়া হয়। পত্রিকার সম্পাদক হলেন খন্দকার আবদুর হামিদ এবং ম্যানেজার হলেন নারায়ণগঞ্জের শামসুদ্দিন আহমদ। কোনাে প্রেস পত্রিকা ছাপাতে রাজী হয়নি। পরিশেষে প্যারামাউন্ট প্রেস ছাপাতে রাজি হয়। ইয়ার মুহাম্মদ খানকে ইত্তেফাকের প্রকাশক ও মুদ্রাকর এবং মওলানা ভাসানীকে প্রতিষ্ঠাতা করা হয়। কলকাতা থেকে এ সময় দৈনিক ইত্তেহাদের সুপারিনটেন্ডেন্ট তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশে ঢাকা চলে আসেন। তার পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট আসগর হােসেন এমএলএ-এর ঢাকার ৭৭ নম্বর মালিটোলার বাসভবনে অবস্থিত ছাপাখানা থেকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক প্রকাশিত হয়। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া এবং প্রকাশক ইয়ার মুহাম্মদ খান। মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ে পত্রিকা কোনাে প্রেস ছাপাতে রাজি হয় না। কিছুকাল পরে ঢাকার কলতাবাজার করিম প্রিন্টিং থেকে ছাপা হয়। পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ঢাকার ৯ নম্বর হাটখােলা রােডে অবস্থিত প্যারামাউন্ট প্রেস থেকে মুদ্রিত ও ৯৪ নম্বর নবাবপুর আওয়ামী লীগ অফিস থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী নিজ অর্থে ইত্তেফাক পত্রিকার জন্য প্রেস ও টিকাটুলির বর্তমান ইত্তেফাক ভবনের জমি ক্রয় করেন। পত্রিকার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক ইত্তেফাককে দৈনিক করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৫৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক ইত্তেফাক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পত্রিকার
পৃষ্ঠাঃ ১২৭
প্রিন্টার্স এবং পাবলিশার্স ছিলেন ইয়ার মুহাম্মদ খান এবং প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ছাপা হত। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতে থাকে। তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া এবং এ কে ফজলুল হকের ভাগিনা আজিজুল হক নান্না মিয়ার সহায়তায় দৈনিক ইত্তেফাকের মালিকানা পরিবর্তন করে নিজে ১৯৫৪ সালের ২০ মার্চ পত্রিকার প্রিন্টার্স ও পাবলিশার্স হন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা অলি আহাদ বলেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের নির্দেশে সিলেট নিবাসী ঢাকা জেলা ম্যাজিস্টেট ইয়াহিয়া চৌধুরী গভীর রাতে ১৯৫৪ সালের ১৪ মে ইয়ার মুহাম্মদ খানের স্থলে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রিন্টার্স ও পাবলিশার্স করেন।
ইয়ার মুহাম্মদ খান ও মওলানা ভাসানীর অজ্ঞাতে দৈনিক ইত্তেফাকের প্রিন্টার্স ও পাবলিশার্সের নাম বাতিল করে তফাজ্জল হােসেনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মওলানা ভাসানীর নাম পৃষ্ঠপােষক হিসেবে ছাপা হয়। আওয়ামী লীগের বৃহত্তর স্বার্থে ইয়ার মুহাম্মদ খান ও ভাসানী পত্রিকার মালিকানা নিয়ে মামলা করেননি। তবে দলের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র সমলােচনা চলে। তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া বরিশালের অধিবাসী, তিনি সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া ও এ কে ফলুল হককে দিয়ে মালিকানা পরিবর্তন করেন। উল্লেখ্য, এ কে ফজলুল হক তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এ কাজ করেছেন তার ভাগিনা সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়ার চাপে পত্রিকার প্রকৃত মালিক আওয়ামী লীগ। খুব সম্ভব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী মালিকানা পরিবর্তনে তার সম্মতি ছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ পত্রিকার মালিকানা নিয়ে বিতর্কে যায়নি।
১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এই অধিবেশনে দবিরুল ইসলামকে সভাপতি এবং খালেক নেওয়াজকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
১৯৪৯ সালের শেষে পূর্ব বাংলায় চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১৯৪৯ সালের ১৬ অক্টোবর ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভুখা মিছিল বের হয়। মিছিল থেকে পুলিশ ভাসানী ও শামসুল হককে গ্রেফতার করে। জেলখানায় মুসলিম লীগ সরকার বন্দীদের প্রতি অমানুষিক নির্যাতন করত। ঢাকা জেলে নির্যাতনের ফলে ১৯৪৯ সালের ৯ ডিসেম্বর কমিউনিস্ট নেতা শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়।
১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর হতে ৩১ ডিসেম্বর তাজউদ্দীনের ৩ মাসের ডায়েরিতে তেমন উল্লেখযােগ্য ঘটনা নেই।
পৃষ্ঠাঃ ১২৮
১৮ নভেম্বর ১৯৪৯
জমিদারী উচ্ছেদ বিল বিবেচনার জন্য পূর্ব বাংলা আইনসভা ১৪ নভেম্বর বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হয়।
আম্বালা জেলে ১৫ নভেম্বর মহাত্মা গান্ধী হত্যার আসামী নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপতের ফাসি হয়।
২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৯
তাজউদ্দীন আহমদ কাপাসিয়ার নারায়ণপুর প্রাইমারী স্কুল প্রাঙ্গণে সভা করেন এবং সেখানে একটি এমই স্কুল চালু করার জন্য কমিটি গঠিত হয়।
রাজেন্দ্রপুর বন বিভাগের কর্মচরীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ অভিযোগ করে।
৩১ ডিসেম্বর ১৯৪৯
তিনি ডায়েরিতে লিখেছেন, তাদের এলাকার লােকজনের অবস্থা দু’মাস আগের তুলনায় ভাল। ধান মণপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা, চাল ১৭ থেকে ১৯ টাকা মণ পাট ১৪ থেকে ২৮ টাকা মণ। কাপড়ের দাম কমছে।
রাজশাহী জেলহত্যা ১৯৫০
১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জে সাওতাল বিদ্রোহ দেখা দেয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ছিলেন ইলা মিত্র। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি বিদ্রোহী সাঁওতালদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। নাচোল থানা সহকারী দারােগ তফিজউদ্দিনসহ ৩ জন পুলিশ নিহত হয়।
পুলিশ ইলা মিত্রকে চাপাইনবাবগঞ্জ মহকুমার রােহনপুর স্টেশনে গ্রেফতার করে। ইলা মিত্রকে রাজশাহী জেলে আটক করে এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম এ মজিদের নির্দেশে পুলিশ ইলা মিত্রের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় পাশবিক অত্যাচার চালায়। তিনি দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তিনি কলকাতায় চলে যান। ২০০২ সালে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৮-৫০ সালে মুসলিম লীগ সরকার শত শত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কৃষক নেতাকে গ্রেফতার করে। জেল নির্যাতনের প্রতিবাদে বন্দীরা প্রতিবাদ জানায়। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলে খাপড়া ওয়ার্ডে রাজবন্দীদের ওপর পুলিশ গুলি করে ৭ জনকে হত্যা করে। নিহতরা হলেন ; কৃষক নেতা হানিফ শেখ, আনােয়ার হােসেন, সুখেন ভট্টাচার্য, দেলােয়ার, সুধীন ধর, বিজন সেন ও কম্প রামসিং। রাজশাহী জেলহত্যা বাংলার রাজনীতিকে ভীষণভাবে আলােড়িত করে।
১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ঢাকা জেলে আটক
পৃষ্ঠাঃ ১২৯
রাখা হয়। ১৯৫০ সালের ১৯ মার্চ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে সভাপতি ও সিন্ধু প্রদেশের মাহমুদুল হক ওসমানীকে সম্পাদক করে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
_ ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে ময়মনসিংহে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন হয়। পরে ঢাকায় মুকুল সিনেমা হলে মুসলিম লীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মারামারি হয়। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন হামিদুল হক চৌধুরী ও মহিউদ্দিন আহমদকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার মহিউদ্দিনকে গ্রেফতার করে। জেলে তার বিরাট পরিবর্তন ঘটে। পরে তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে যােগ দেন।
১৯৫০ সালের দাঙ্গা
১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর হত্যা ও ১৯৪৯ সালে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কলকাতা ত্যাগের ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শান্তির অবনতি ঘটে। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা ও বিহারে দাঙ্গা শুরু হয় এবং হাজার হাজার মুসলমান বিহার ও পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরিতে দেখা যায়, ১৯৫০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় দাঙ্গা শুরু হয়। তাজউদ্দীন বেলা ১টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নবাবপুর, সদরঘাট, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলী, ইংলিশ রােড প্রভৃতি এলাকা ঘুরে হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেন। শরণার্থী ও অবাঙালী পুলিশ দাঙ্গায় উৎসাহ যােগাচ্ছে। তবে স্থানীয় জনগণ উদাসীন। ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং সন্ধ্যা-সকাল কাফু চলছে।
১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০
শান্তি রক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কোন আগ্রহ দেখা গেল না।
১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের এক যৌথ সভা হলাে। কাজী মােতাহার হােসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ড. শহীদুল্লাহ, ড, নূরুল হুদা, নাজমুল করিম, এ কে এম মাহমুদ, কিবরিয়া, আউয়াল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০
দাঙ্গা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কাপাসিয়ার কয়েকটি পরিবারের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। তাজউদ্দীন গ্রামে সভা করেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
পৃষ্ঠাঃ ১৩০
প্রথমবারের মতাে পূর্ব বাংলা মারাত্মক শরণার্থী সমস্যার সম্মুখীন হলাে। এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়েরএক বিরাট অংশ দেশ ত্যাগ করছে।
শরশ্চন্দ্র বসু ২২ ফেরুয়ারি পরলােক গমন করেন। তার মৃত্যুর সাথে আরএসপি শেষ হয়ে যায়।
৫ মার্চ ১৯৫০
ইরানের শাহ ঢাকায় আগমন করেন।
১৮ মার্চ ১৯৫০
পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের সমস্যা দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এসেছেন। বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামাে সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। অফিসারা নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থের জন্য পাকিস্তানের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে পারে। বন বিভাগ এমনি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
২৭ মার্চ ১৯৫০
মুসলিম লীগ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রভৃতি দলের সাথে পার্টির (গণআজাদী লীগ) অবস্থান কি হবে সে বিষয় আলােচনা হলাে। দলের অবস্থান অন্যান্য দল থেকে আলাদা হবে।
৩১ মার্চ ১৯৫০
মার্চ মাসে প্রদেশে দাঙ্গা হয়নি তবে হিন্দুরা পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
১৯৫০ সালে বর্ধমানে দাঙ্গার পর আবুল হাশিম সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
৪ এপ্রিল ১৯৫০
আবুল হাশিমের সাথে তাজউদ্দীনের সাক্ষাত হয়।
৮ এপ্রিল ১৯৫০
হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দিল্লী গমন করেন। তিনি ৮ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরুর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
৯ এপ্রিল ১৯৫০
তাজউদ্দীন রূপমহলে শাপমুক্তি ছবি দেখেন।
১০ এপ্রিল ১৯৫০
ডাকসু পরিবেশিত শেষ রক্ষা নাটক দেখেন।
পৃষ্ঠাঃ ১৩১
১২ এপ্রিল ১৯৫০
ডাকসু পরিবেশিত ওথেলাে নাটক দেখেন।
২১ এপ্রিল ১৯৫০
তাজউদ্দীন দরদরিয়ার বাড়িতে সমিতির মজুদ থেকে ধান বণ্টন করেন।
২৩ মে ১৯৫০
তােয়াহা সাহেবের বাবা ঢাকায় তার যােগীনগরের বাসায় মারা যান।
২৫ মে ১৯৫০
অপারেশনের জটিলতায় ভারতের সাবেক ভাইসরয় ওয়াভেন লন্ডনে পরলােকগমন করেন।
১৭ জুন ১৯৫০
হল অফিসে প্রমােশন লিস্টে (বিএ অনার্স ক্লাসে) তাজউদ্দীন তার নাম দেখে আনন্দিত হন।
২৭ জুন ১৯৫০
তাজউদ্দীন এসডিও নর্থ-এর কোর্টে আত্মসমর্পণ করেন এবং জামিন লাভ করেন।
৭ জুলাই ১৯৫০
এসডিও নর্থ জামিন বাতিল করে তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্যকে ঢাকা জেলে নিয়ে যায়। দুপুর ১টা থেকে ১১-৭-১৯৫০ তারিখ সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত জেল হাজতে ছিলেন।
১৩ জুলাই ১৯৫০
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বিমানে ঢাকা আসেন। ২৭-৭-১৯৫০ তারিখে তিনি কর্মী সম্মেলনে যােগ দেবেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও তার কর্মীরা সম্মেলনে যােগ দেবেন না।
২৩ জুলাই ১৯৫০
বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. হুদার সাথে তৃতীয় বর্ষের ক্লাস নিয়ে আলােচনা।
৩১ জুলাই ১৯৫০
গত দু’মাস ধরে কোরীয় যুদ্ধের ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রবণতা।
৬ আগস্ট ১৯৫০
আসামের মুখ্যমন্ত্রী জিএন বাৰ্দালই পরলােকগমন করেন।
পৃষ্ঠাঃ ১৩২
৭ আগস্ট ১৯৫০
জগন্নাথ কলেজে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্র স্মৃতি বার্ষিকী অনুষ্ঠানে যােগদান।
১৫ আগস্ট ১৯৫০
সাইকেলে শহর ঘুরে দেখেন। সাধারণ জনগণের মধ্যে উদ্দীপনার বেশ ঘাটত। কর্মকর্তাদের প্রাধান্য।
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫০
আহসান উল্লাহ হলে বিতর্কে তাজউদ্দীন অংশগ্রহণ করেন। বিষয় ছিল- Armed Intervenion of UNO in Korea is a Step to World Peace। ড. হালিম সভাপতিত্ব করেন।
মূল নীতি
২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০
মৌলিক নীতি নির্ধারণী কমিটির উপস্থাপিত খসড়া সংবিধান প্রথমবার প্রকাশিত হলাে।
১৩ অক্টোবর ১৯৫০
আরমানিটোলা ময়দানে সভা। আতাউর রহমান সভাপতি, হাফিজুর রহমান, শামসুদ্দিন, খয়রাত হােসেন রফিক, ওয়াদুদ, শামসুল হুদা, কামরুদ্দিন বক্তব্য রাখেন।
৪ নভেম্বর ১৯৫০
কামরুদ্দিন আহমদ সরকারের মূল নীতির বিপরীতে খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন এবং এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে সহায়তা করেন।
৪ নভেম্বর ১৯৫০
ঢাকা বার লাইব্রেরিতে মূলনীতির ওপর গ্র্যান্ড কনভেনশন শুরু হয়। মূলনীতি সম্মেলন শুরু।
৫ নভেম্বর ১৯৫০
সংবিধান সম্পর্কিত সম্মেলনে যােগ দেন। এ কে ফজলুল হক ১০টায় ভাষণ দেন। শামসুল হক, রফিক ও মানিক ধারালাে আলােচনা করেন।
১২ নভেম্বর ১৯৫০
আরমানিটোলা ময়দানে সভা। এডভােকেট আফতাব উদ্দিন সভাপতিত্ব করেন। বক্তা ছিলেন মওলানা এ জব্বার, এম এ রহিম, অলি আহমদ এমএলএ, খয়রাত হােসেন ও ওয়াদুদ। সভায় ৫০০০ লােক হয়েছিল।
পৃষ্ঠাঃ ১৩৩
১৬ নভেম্বর ১৯৫০
ছাত্রদের ধমর্ঘট। মূলনীতি নির্ধারণী কমিটির রিপাের্টের বিরুদ্ধে প্রতিবা।
২১ নভেম্বর ১৯৫০
একটি রাজনৈতিক দল শুরু করার প্রয়ােজনীয়তা প্রকাশ করেন,
৮ ডিসেম্বর ১৯৫০
জীবনে প্রথম টেনিস খেলেন।
১০ ডিসেম্বর ১৯৫০
বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে শারীরিক যােগ্যতা বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ নেন। ৩ টি বিষয়ে অংশ নেন।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৫০
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বােম্বের বিড়লা ভবনে মারা যান।
১৭ ডিসেম্বর ১৯৫০
ড. হুদার অফিসে ৫টা পর্যন্ত পড়েন।
২৪ ডিসেম্বর ১৯৫০
আরমানিটোলা মাঠে কায়দে আযমের জন্ম দিবস উপলক্ষে বিশাল সমাবেশ। মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাথে লিয়াকত আলী খানের যােগসাজশের কথা বলেন। তিনি কনসেনব্লি ও লিয়াকত আলী খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করেন। সভায় প্রায় ২৫ হাজার লােক উপস্থিত ছিল ।
২৫ ডিসেম্বর ১৯৫০
পুরানা পল্টন ময়দানে কায়দে আযমের অনুষ্ঠানে লিয়াকত আলী খান ভাষণ দেন। প্রায় ৪০ হাজার লােক উপস্থিত ছিল। ।
২৬ ডিসেম্বর ১৯৫০
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান করাচী গমন করেন।
৩১ ডিসেম্বর ১৯৫০
৪ ও ৫ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কনভেনশনে গৃহীত খসড়া মূলনীতিগুলাের ওপর তাজউদ্দীন ব্যাখ্যামূলক নােট তৈরি করেন। শামসুর রহমান জনসন সহায়তা করেন।৮
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবন
১৯৪৮ সালে সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে আইএ পাস করে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা
পৃষ্ঠাঃ ১৩৪
বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে বিএ অনার্সে ভর্তি হন। তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। তিনি ফুল-টাইম রাজনীতিবিদ এবং পার্ট-টাইম ছাত্র ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে তিনি রাজনীতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ও ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা কাজে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে দাঙ্গা প্রতিরােধ ও ১৯৫১ সালে যুবলীগ গঠন প্রক্রিয়ায় তাজউদ্দীন একজন উদ্যোক্তা ছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদের সাবসিডিয়ারি ছিল ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ১৯৫১ সালে তাজউদ্দীন আহমদ বিএ অনার্স পরীক্ষা দেয়ার কথা। কিন্তু তিনি পরীক্ষা না দিয়ে স্থানীয় জনগণের অনুরােধে কাপাসিয়া হাইস্কুলের শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। প্রায় এক বছর এ স্কুলের শিক্ষকতা করেন। তিনি একজন আদর্শ ও দক্ষ শিক্ষক ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাবসিডিয়ারি শিক্ষক এমএস চৌধুরীর অনুরোধে ম্যাট্রিকের খাতা দেখেন। তার খাতা দেখার মান, ধরন দেখে তার শিক্ষক ও বাের্ড প্রশংসা করেছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকালে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন।
১৯৫২ ও ১৯৫৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র রাষ্ট্রনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তার পরীক্ষার প্রস্তুতি ভাল ছিল না। ১৯৫৩ সালে তিনি অর্থনীতিতে বিএ অনার্স পাস করেন। একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে অর্থনীতি পরীক্ষায় তার ভাল করার কথা ছিল। কিন্তু বিএ অনার্স পরীক্ষায় আশানুরূপ ছিল না।
১৯৫৩ সালে বিএ অনার্স পাস করে এমএ পড়তেন। এ সময় নির্বাচনের প্রচণ্ড হাওয়া। ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কয়েকজন ছাত্রনেতাকে মনােনয়ন দেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, শামসুল হক (ঢাকা) এবং খালেক নেওয়াজ। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হওয়ায় তাজউদ্দীন আহমদের এমএ পরীক্ষা দেয়া হয়নি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি ক্লাসে ভর্তি হন। এলএলবি তিনি অনেক পরে পাস করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি জেলে বসে এলএলবি পাস করেন। তিনি এমএলএ নির্বাচিত হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবি ক্লাস করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিতে না পারলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে সফলতা এনে দিয়েছে। তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকালীন ছাত্রদের স্মৃতিচারণ:
মুজাফফর আলী
১৯৫০ সালে অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।
পৃষ্ঠাঃ ১৩৫
ফজলুল হক হলে আমার রুম বরাদ্দ হলাে। সিট পেয়ে দেখি তাজউদ্দীন সাহেবও সেই রুমে সিট পেয়েছেন। এখানেই আমাদের প্রথম পরিচয়। কুশল বিনিময়ে জানা গেল আমরা দু’জনেই প্রথম বর্ষ অর্থনীতিতে ভর্তি হয়েছি। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। মানুষ হিসেবে তাকে আমার খুব বেশি ভাল লাগতো। তিনি রাজনীতি নিয়ে ভীষণ রকম ব্যস্ত থাকতেন। প্রায় দিনই ডাইনিং হলের খাওয়া-দাওয়া যখন শেষের পথে তখন এসে তিনি রাতের খাবার খেতেন। আমিও অনেক সময় তার জন্য বসে থাকতাম, তাজউদ্দীন ভাই এলে একসঙ্গে খাব। আমি আবার টিউশনি করতাম। অত্যন্ত সংগ্রাম করে আমি লেখাপড়া করছি। এটা তিনি জানতেন এবং সে কারণেই আমাকে পছন্দ করতেন। ডাইনিং হলে খেয়ে আমি রুমে ফিরে আসতাম আর তিনি হলের ভেতরে লনের মধ্যে বসে বন্ধুদের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং অন্যান্য নানা ধরনের আলাপ- আলোচনা করতেন। রাজনীতি এবং মানুষের জন্য তার করার চেষ্টা, এটাই যেন ছিল তা জীবনের ধ্যানধারণা।
১৯৫৪ সালে এম এ ফাইনাল পড়ছি দুজনেই। হঠাৎ একদিন রাতে তাজউদ্দীন ভাই এসে বললেন, “মুজাফফর ভাই, আমার তাে আর পড়াশোনা হচ্ছে না। সােহরাওয়ার্দী সাহেব আমাকে মনােনয়ন দিয়েছেন। কাপাসিয়া থেকে নির্বাচনে ফকির আব্দুল মান্নান সাহেবের বিরুদ্ধে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে।” ফকির আব্দুল মান্নান তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক।
তারপর তিনি নির্বাচনের প্রচারণায় নেমে গেলেন। সেই সময়ে আমি মাঝে মাঝে বলতাম, “আপনার এলাকায় যাব।” তিনি বলতেন, “অবশ্যই যাবেন। কিন্তু লেখাপড়া ঠিক রাখবেন, নােট করবেন। এখন যদিও আমি নির্বাচনে নেমে গেছি, নির্বাচনের পর তাে লেখাপড়া করতে হবে। তখন আপনার নােটিংগুলাে আমার কাজে লাগবে।”
আমার মনে হয় অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার সময়টার কথা, কী তীক্ষ মেধা ছিল তাঁর- আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম। কারণ সারা দিন ঘুরেছেন বাইরে বাইরে, ।
পরীক্ষার ঠিক আগে রাত ন’টার মধ্যে খাবার খেয়ে আমাকে বলতেন, “কাল যে পেপারের পরীক্ষা, সেই পেপারটা পড়া হােক।” আমরা দুজনে আগে থেকে নােট তৈরি করে রাখতাম। আমি বলতাম, “দু’জন এক সাথে পড়ব কীভাবে?” তিনি বলতেন, “চলেন পাশাপাশি বসি।” আমি পড়তাম, তিনি শুনতেন, মাঝে মাঝে দুই এক জায়গায় জিজ্ঞাসা করে দেখে নিতেন। এইভাবে রাত বারােটা-একটা পর্যন্ত আমাদের পড়াশােনা হতাে। আমি ভাবতাম পরীক্ষার আগের দিনের সামান্য
পৃষ্ঠাঃ ১৩৬
এই পড়ায় তিনি কি পাস করবেন? কিন্তু পরীক্ষার ফল যখন বের হলো তখন আশ্চর্য হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় আমার ছিল না। তাজউদ্দীন সাহেব খুব সাধারণভাবে চলতেন। কিন্তু কাপড়চোপড় ভীষণ পরিষ্কার থাকত।
তিনি ধর্ম নিয়ে আলাপ করেছেন বিভিন্ন সময়ে, কিন্তু ধর্মীয় যে গোড়ামি সেটা তিনি পছন্দ করতেন না। ধর্ম নিয়ে মৌলভী-মােল্লারা যে ভণ্ডামি করে তিনি তার ঘােরবিরােধী ছিলেন। সচেতন মুসলমান হিসেবে ইসলাম ধর্মকে তিনি অত্যন্ত মর্যাদা দিতেন। কিন্তু এই ধর্মটাকে নিয়ে এ দেশের মৌলভী-মােল্লারা মানুষকে নানাভাবে ধোঁকা দেয়, মিথ্যা কথা বলে। যেমন, কেউ যদি একবার হজে যায়, তার সমস্ত জীবনের গুনাহ মাফ হয়ে গেল। এমনকি অনেকে হজ থেকে এসে আবার নানারকম অন্যায় কাজে জড়িয়ে যায়। হয়ত তারা মনে করে সমস্ত পাপই ধুয়েমুছে এসেছি। এই ধরনের কথাবার্তা তিনি মাঝে মাঝে বলতেন।
তার সাথে চার বছর থাকতে থাকতে আমার মন-মানসিকতায় অনেক পরিবর্তন হয়েছিল। গরিবের জন্য তাজউদ্দীন সাহেবের খুব দরদ ছিল । তার রাজনীতি করার একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল যে, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই দুর্বল, কাজেই এদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানাের জন্য কাজ করতে হবে। এই যে অফুরন্ত লােকসংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের, তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উনয়নের জন্য খুব চিন্তা-ভাবনা করতেন। আমাকে বলতেন, “ভাই, অর্থনীতি নিয়েছি এই জন্য যে, অর্থনীতি না বুঝলে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি করব কীভাবে! রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা করতে গেলে প্রথমে অর্থনীতিটা আমাকে বুঝতে হবে।”
তাজউদ্দীন সাহেব জানতেন আমার সহায়সম্বলহীন জীবন-সংগ্রামের কথা । তাজউদ্দীন ভাই ছাড়া আর কারাে কাছে বলতাম না এসব। ড. এম এন হুদা তখন আমাদের হলের প্রােভােস্ট। তাজউদ্দীন সাহেব তার কাছে গিয়ে আমার দুরবস্থার কথা বললেন এবং আমার জন্য কিছু সহযােগিতা করতে তাকে অনুরােধ করলেন । তাজউদ্দীন ভাই আমাকে বললেন, “আপনি প্রােভােস্টের সাথে দেখা করেন।” আমি তার কথামতাে প্রােভােস্টের কাছে গেলাম। তিনি আমার ডাইনিং হলের চার্জ মওকুফ করে দিলেন। তাজউদ্দীন সাহেবের চেষ্টায় আমার ডাইনিং চার্জ ফ্রি হয়ে গেল।
বি. করিম আমাদের হাউস টিউটর ছিলেন। বি. করিম সাহেব তাজউদ্দীন সাহেবকে খুব পছন্দ করতেন। আমি দেখতাম তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ-আলােচনা করতেন। ড. এম. এন হুদার সাথেও তার সুন্দর সম্পর্ক ছিল। যেহেতু তাজউদ্দীন ভাই ছাত্রনেতাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়
পৃষ্ঠাঃ ১৩৭
ছিলেন, তাই তাঁকে ছাড়া বাইরে অথবা হলের ভেতরে কোন দলীয় সভা বা ঘরােয়া মিটিং হতাে না।
আবুল মাল আবদুল মুহিত
১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন অনষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন ছিল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে সকল বিরােধী দলের ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনী লড়াই। যুক্তফ্রন্ট গঠনে ছাত্রদের অবদান ছিল বিনিশ্চায়ক। সােহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও শেরে বাংলাকে একত্রে বসিয়ে এই কাজটি সম্পন্ন করে ছাত্রদের এবং তরুণ রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দের চাপে। ছাত্ররা এর আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের যুক্তফ্রন্ট বানিয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচনে লড়েছে। ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও লবণ-সঙ্কট সরকারবিরোধী জোট গঠনে ছাত্রদের সংহত করে।
১৯৫২ সালে সলিমুল্লাহ হলের নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম ছাত্রলীগের বিপরীতে গড়ে ওঠে ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’। ছাত্রলীগের সমর্থক গােষ্ঠী থেকে সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মনােনয়ন পান যথাক্রমে শামসুল হক (পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত) এবং মােহাম্মদ বদরুজ্জামান (পরবর্তী সময়ে বিচারপতি)। বাম গােষ্ঠীর (তখনও সম্ভবত ছাত্র ইউনিয়ন সংগঠিত হতে পারেনি) প্রার্থী ছিলেন ক্রীড়া সম্পাদকের জন্য সিরাজুল হােসেন খান এবং যুগ্ম সম্পাদকের জন্য আমি । ফজলুল হক হলেও এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ বিরােধী দল হয় এবং সেখানে জিল্লুর রহমান (পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী) সম্ভবত স্পিকার নির্বাচিত হন।
১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভায় বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা নির্বাচিত হন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি মুসলিম লীগের সম্পাদক মরহুম ফকির আবদুল মান্নানকে পরাজিত করে খ্যাতি অর্জন করেন। আমাদের সহসভাপতি মােহাম্মদ শামসুল হকও নির্বাচিত হন। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে পরাজিত করে বিখ্যাত হয়ে যান খালেক নেওয়াজ। তাজউদ্দীন সাহেব প্রথম থেকেই ধীরস্থির চিন্তাশীল ছাত্রনেতা এবং সচেতন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবি ছাত্র। তাঁকে একজন জ্ঞানী ও অতি অমায়িক ব্যক্তি হিসেবে তার বন্ধুরা সম্মান করতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। তবে আমার অগ্রজসম মরহুম হেলাল উদ্দিন চৌধুরীর মুখে তাজউদ্দীনের সুনামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। তারা সম্ভবত কিছুদিন ফজলুল হক হলের এক কামরায় বাস করতেন। তাজউদ্দীনের প্রজ্ঞা, সততা এবং নিষ্ঠার কথা শুনতাম, বেং বিশ্বাস করতাম যে, তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মী ও রাজনৈতিক সংগঠক। সে যুগে ছাত্রনেতারা জাতীয়।
পৃষ্ঠাঃ ১৩৮
রাজনীতিতে অংশ নিলে আর ছাত্র রাজনীতি করতেন না। তাই এই নেতবৃন্দের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ রহিত হয়।১০
পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ১৯৫১
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাঙ্গার পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ভারতে চলে যান। তিনি তার তফসিলী সমপ্রদায়কে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হন। প্রধানমন্ত্রী নীতি নির্ধারণে তাকে ডাকেন না। তার নেতৃত্বে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়। সিলেটে রেফারেন্ডামে তারা পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দেয়। ১৯৫০ সালে গ্রামে গ্রামে নমঃশূদ্রদের ওপর আক্রমণ হলে তারা দলে দলে ভারতে চলে যায়। তারাই পশ্চিম বাংলা ও আসামে পাট চাষ করে ভারতকে পাট উৎপাদনে সাবলম্বী করে। ভারত বাংলাদেশ হতে পাট ক্রয় মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। বরিশালের যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের স্থলে শ্রমিক নেতা ডা. এএম মালিককে কেন্দ্রের শ্রমমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। পাকিস্তান তফসিলী সম্প্রদায়ের ওপর বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়। আজও তারা বাংলাদেশে নিগমহীত হচ্ছে। অথচ ১৯৪৭ সালে তারা কংগ্রেস ও বর্ণ হিন্দুদের পরিত্যাগ করে মুসলিম লীগকে সমর্থন দেয়। তাদের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করা হলাে।
১৯৫০ সালের ১৪ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সােহরাওয়ার্দীকে উদ্দেশ করে বলেন, Indian dog let loose to destroy Pakistan- পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ভারতের লেলায়িত কুকুর। বিরােধী দলকে বললেন- শের কুচল দেঙ্গে মাথা ভেঙ্গে দেব।
১৯৫০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এডজুটেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। তিনি কয়েকজন সিনিয়রকে অতিক্রম করে খাজা নাজিমউদ্দিন ও প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার চেষ্টায় সি- ইন-সি পদ লাভ করেন। শুরু হলাে পাকিস্তানে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং গণতন্ত্র নিয়ে খেলা। ১৯৫১ সালের ১৭ জানুয়ারি আইয়ুব খান প্রধান সেনাপতি জেনারেল গ্রেসির কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জেনারেল গ্রেসি লন্ডনে চলে যান।
১৯৫০ সালে গণআজাদী লীগ-People Freedom League-কে সিভিল লিবারর্টিজ লীগে পরিণত করা হয়। দলের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক কর্মীদেরআইনী সহায়তা দেয়া এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য জনমত গঠন করা । Civil Liberties League-এর কর্মীদের মধ্যে ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ, তােয়াহা প্রমুখ।
১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ভবিষ্যতে
পৃষ্ঠাঃ ১৩৯
শাসনতন্ত্রের ভিত্তি হিসেবে মূলনীতি প্রকাশ করলে বাঙালীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে পরে। মূলনীতি কমিটির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন করার জন্য Committy of action for Democratic Constitution গঠন করা হয়। এ্যাকশন কমিটির নেতৃবৃন্দ ছিলেন আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন আহমদ-আহবায়ক, সাখাওয়াত হোসেন, সাংবাদিক আবদুস সালাম খান, অলি আহাদ, তাজউদদীন আহমদ প্রমুখ। কমিটি অব এ্যাকশন বা সংগ্রাম কমিটির আহবানে ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নবেম্বর ঢাকা বার লাইব্রেরিতে Grand National Convention অনুষ্ঠিত হয়। সারা দেশ থেকে প্রায় ৫০০ প্রতিনিধি সম্মেলনে যােগ দেন। আতাউর রহমান খান সভায় সভাপতিত্ব করেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলল হক সভায় ভাষণ দেন এবং বলেন, তাকে আঙ্গুর রস পান করিয়ে মূলনীতিতে সাক্ষর নেয়। তিনি গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। সভায় মূলনীতি কমিটির সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করা হয়।
১৯৫১ সালের ২০ জানুয়ারি সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে পুনরায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫০ সালের ৪ ও ৫ নবেম্বর প্রণীত খসড়া মূলনীতি সংশােধন করা হয়। এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ অবদান রাখেন। কাউন্সিল ফর ডেমােক্রেটিক ফেডারেশন ১৯৫১ সালের ২০ জানুয়ারির সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সাব-কমিটির গৃহীত প্রস্তাবাবলীর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানায় এবং লাহাের প্রস্তাবানুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘােষণার দাবি জানায়।
পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের দাবি
১৯৫১ সালের মার্চ মাসে পাঞ্জাবে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাঞ্জাবের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মিয়া ইফতেখার উদ্দিনের আওয়ামী লীগের সাথে তার আওয়ামী মুসলিম লীগ একত্রিত করে জিন্নাহ মুসলিম লীগ গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। বিরােধী কয়েকটি আসন লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু খাজা নাজিমউদ্দিন ও নূরুল আমিন পরাজয়ের ভয়ে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন দিচ্ছে না। তারা বিরােধী দলের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে। আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব পাকিস্তানে আশু নির্বাচন দাবি করে।
যুবলীগ গঠন- ১৯৫১
পূর্ব পাকিস্তানের যুব সম্প্রদায়কে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে নিখিল ভারত মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি মাহমুদ নূরুল হুদা ও বাংলা মুসলিম
পৃষ্ঠাঃ ১৪০
ছাত্রলীগের সাবেক সম্পাদক আনােয়ার হােসেন এক যুবকর্মী সভায় সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে যুব সম্মেলন আহবানের লক্ষ্যে একটি শক্তিশালী অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেন। ঢাকায় ২৭ ও ২৮ মার্চ সম্মেলন আহবান করা হয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন লীগ সরকার ঢাকায় যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে দেয়নি এবং ১৪৪ ধারা জারি করে। নেতৃবৃন্দ কৌশল অবলম্বন করে বুড়িগঙ্গা নদীতে নৌকায় সম্মেলন করে। কারণ নদীতে ১৪৪ ধারা প্রযােজ্য নয়। ১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয়। কমিটির কর্মকর্তাবৃন্দ :
মাহমুদ আলী – সভাপতি
খাজা আহমদ – সহসভাপতি
ইয়ার মােহাম্মদ খান – সহসভাপতি
শামসুজ্জোহা – সহসভাপতি
আবদুল মজিদ – সহসভাপতি।
মিসেস দৌলতুন্নেসা – সহসভাপতি
অলি আহাদ – সাধারণ সম্পাদক
আবদুল মতিন – যুগ্ম সম্পাদক
রুহুল আমিন – যুগ্ম সম্পাদক
তসদ্দিক আহমদ চৌধুরী – কোষাধ্যক্ষ
মুহাম্মদ নূরুল হুদা – সদস্য
মােহাম্মদ তােয়াহা – সদস্য
আবদুস সামাদ – সদস্য
কেজি মােস্তফা – সদস্য
এম এ অদুদ – সদস্য
তাজউদ্দীন আহমদ – সদস্য
আবদুল গাফফার চৌধুরী – সদস্য
যুবলীগ গঠনে তাজউদ্দীন আহমদ সক্রিয় ছিলেন।
পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা
আইয়ুব খান প্রধান সেনাপতি হয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও জেনারেল আইয়ুব খান মুসলিম লীগ সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্র মামলা করেন। মামলার আসামী ছিলেন জেনারেল আকবর খান, বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন জানজুয়া, মেজর ইসহাক, ক্যাপ্টেন নিয়াজ মুহাম্মদ, পাকিস্তান টাইমস পত্রিকার সম্পাদক কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ,
পৃষ্ঠাঃ ১৪১
কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক সাজ্জাদ জহির, কমরেড মুহাম্মদ হােসেন আতা প্রমখ। যড়যন্ত্রের উৎস ছিল পিন্ডি। এ কারণে পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা বলা হয়ে থাকে। হায়দ্রাবাদ জেলে মামলার বিচার শুরু হয়। আসামী পক্ষে ছিলেন হোসেন শহীদ সােহরাওয়াদী- তিনি জেনারেল আইয়ুব খানকে কয়েক ঘণ্টা জেরা করেন। এ কারণে আইয়ুব খান ১৯৬২ সালে সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে প্রতিশোধ নেয়। আসামীরা ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায়।
নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের হত্যা
১৬ অক্টোবর, ১৯৫১
পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলার পর গভর্নর জেনারেল গােলাম মুহাম্মদ, সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও জেনারেল আইয়ুব খান প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির এক জনসভায় ভাষণদানকালে আততায়ীর গুলিতে লিয়াকত আলী খান নিহত হন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি উচ্চারণ করলেন- আল্লাহ পাকিস্তানকে হেফাজত কর । নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান ভারতের যুক্ত প্রদেশে ১৮৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তার মৃত্যুর সাথে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের শেষ চিহ্ন মুছে যায়। ১৯ অক্টোবর খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন। তার স্থলে গভর্নর জেনারেল হলেন অর্থমন্ত্রী ধূর্ত গােলাম মােহাম্মদ। খাজা নাজিমউদ্দিন নামেমাত্র প্রধানমন্ত্রী। তাকে পুতুল হিসেবে ব্যবহার করে পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদের ওপর শােষণ চালানাে হয় এবং দু’অঞ্চলের বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলায় তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম লবণ সঙ্কট সৃষ্টি করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে লবণ পূর্ব বাংলায় রপ্তানি করে মুনাফা অর্জন করা। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে ১৬ টাকা সের দরে লবণ বিক্রি হয়। ১৬ টাকা লবণের সের হওয়ায় মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পায়। আওয়ামী মুসলিম লীগ মুসলিম লীগের স্বৈরশাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।।
১৯৫১ সালের ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় যুবলীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৫২-৫৩ সালের কমিটি গঠন করা হয়।
মাহমুদ আলী – সভাপতি
মির্জা গােলাম হাফিজ – সহ-সভাপতি
খাজা আহমদ – সহ-সভাপতি
পৃষ্ঠাঃ ১৪২
মােহাম্মদ তােয়াহা – সহ-সভাপতি
ইয়ার মােহাম্মদ – সহ-সভাপতি
শামসুজ্জোহা – সহ-সভাপতি
অলি আহাদ – সাধারণ সম্পাদক
মুহাম্মদ সুলতান – যুগ্ম সম্পাদক
ইমাদুল্লাহ – যুগ্ম সম্পাদক
মাহবুব জামাল জাহেদী – কোষাধ্যক্ষ
কমিটির সদস্যগণ :
আবদুল হালিম, আবদুল মতিন, এবিএম মূসা, মাহমুদ নূরুল হুদা, আনোয়ারুল হোসেন, এসএ বারী এটি, সালাউদ্দিন, আবদুল ওয়াদুদ, শফি খান, আলী আশরাফ, আবদুর রহমান সিদ্দিকী, মােতাহার হােসেন, নুরুর রহমান, জিয়াউল হক, মতিউর রহমান, মফিজুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল কাদের ও প্রাণেশ সমাদ্দার।
১৯৫২ সাল- ভাষা আন্দোলন
১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগ আয়ােজিত জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঘােষণা করলেন- উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। খাজা
নাজিমউদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চের চুক্তির কথা ভুলে গেছেন। সেদিন তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে । নাজিমউদ্দিনের ঘােষণায় ঢাকার ছাত্রসমাজ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ২৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ছাত্ররা প্রতিবাদ করে এবং ১৯৫২ সালের ৩১ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নিমােক্ত সদস্যদের নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় :
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সভাপতি
সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ
আবুল হাশিম, খেলাফতে রব্বানী পার্টি
অধ্যাপক আবুল কাশেম, তমুদ্দিন মজলিশ
আতাউর রহমান খান, আওয়ামী মুসলিম লীগ
আবদুল আউয়াল, আওয়ামী মুসলিম লীগ, নারায়ণগঞ্জ
পৃষ্ঠাঃ ১৪৩
কামরুদ্দিন আহমদ, সভাপতি, লেবার ফেডারেশন
খয়রাত হােসেন এমএলএ, সদস্য, পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ
আনােয়ারা খাতুন এমএলএ, সদস্য পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ
আবদুল গফুর, সম্পাদক, সাপ্তাহিক সৈনিক
আলমাস আলী, আওয়ামী মুসলিম লীগ, নারায়ণগঞ্জ
সৈয়দ আবদুর রহিম, সভাপতি, রিকশা ইউনিয়ন
মােহাম্মদ তােয়াহা, সহ-সভাপতি, যুবলীগ
অলি আহাদ, সাধারণ সম্পাদক, যুবলীগ।
শামসুল হক চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
খালেক নেওয়াজ খান, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ
কাজী গােলাম মাহবুব, আহবায়ক, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
মির্জা গােলাম হাফিজ, সিভিল লিবার্টি কমিটি
মজিবুল হক, ভিপি, সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদ
হেদায়েত হােসেন চৌধুরী, সাঃ সম্পাদক, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদ
শামসুল আলম, ভিপি, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদ
আনােয়ারুল হক খান, জিএস, ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্র সংসদ
গােলাম মাওলা, ভিপি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদ
সৈয়দ নূরুল আলম, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
মােহাম্মদ নূরুল হুদা, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ
শওকত আলী, পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবির, ১৫০ মােগলটুলী, ঢাকা
আবদুল মতিন, আহবায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
আখতার উদ্দিন আহমদ, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও কাজী গােলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ২৮ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব বাংলায় ধর্মঘট, মিছিল ও জনসভা আহবান করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববঙ্গ আইনপরিষদের বাজেট অধিবেশন। ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট আহবান করে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও কর্মপরিচালনায় তাজউদ্দীন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কমরউদ্দিন আহমেদ বলেন,
“১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পূর্ববঙ্গে এসেই তার সততা ও সাধুতার খােলস খুলে ফেললেন। ২৬ জানুয়ারি তারিখে
পৃষ্ঠাঃ ১৪৪
পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগ আয়ােজিত এক জনসভায় পরিষ্কার ঘােষণা করলেন যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালে এই খাজা নাজিমুদ্দিনই ওয়াদা করেছিলেন যে, বাংলা ও উর্দু দুটো ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য পরিষদ থেকে গণপরিষদে প্রস্তাব পাঠাবেন।
ঐ বক্তৃতার পরই শহরে যেন আগুন জ্বলে উঠল । মওলানা আবদুল হামিদ খান সাহেব ঢাকা মোক্তার লাইব্রেরিতে মুসলিম লীগ ছাড়া সকল পার্টিকে, সকল সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানকে , সকল ট্রেড ইউনিয়নকে ডেকে পাঠালেন। ঢাকায় যে রকম সংঘ ছিল সেদিন আমি দেখেছিলাম। ১৯৫২ সাল, ১৯৪৮ সাল নয়। এবার আর হিন্দু কে, কমিউনিস্ট কে, কংগ্রেস এ নিয়ে কথা উঠল না। এবারে সকল বাঙালি যেন এক হয়ে দাড়াল। এবার আর আহসান মঞ্জিল বা তাদের খয়ের খা উচ্চ মধ্যবিত্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়- এবারকার আন্দোলন বাংলার সকল স্তরের সমুদয় মানুষের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এবারের সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্ব নেই, দীর্ঘদিন ধরে ধাপে ধাপে অগ্রসর হবার প্রয়ােজন নেই। এবারকার সংগ্রাম যেন আগুনের শিখার মতাে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল। সভায় মওলানা ভাসানী বক্তৃতা করলেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান থেকে এক একজন প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক বসবে ১৫০ নং মােগলটুলী অফিসে ৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে। সে সভায় কমিটি অব এ্যাকশনের কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হবে বলে ঘােষণা করেন মওলানা সাহেব। ওটাই আমারও ইচ্ছে ছিল- কারণ শ তিনেক লােকের মধ্যে কোন আন্দোলনের ব্যাপার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলােচনা করা বােকামি। এমনিই মওলানা সাহেব কঠোর ভাষায় বক্তৃতা করেছেন । ৭ তারিখে মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, কে জি মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ছােট একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন খেলাফতে রব্বানী পার্টির আবুল হাসিম সাহেব, আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে সভাপতি ছাড়া এলেন শামসুল হক সাহেব ও আতাউর রহমান সাহেব; যুবলীগের মােহাম্মদ তােহা ও অলী আহাদ সাহেব, ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমি আর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য মতিন, কে জি মুস্তাফা প্রভৃতি। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষে কে জি মাহবুব ছাড়াও তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, মােল্লা জালালউদ্দীন। প্রস্তাব গ্রহণ করা হলাে যে, ২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট পালন করা হবে। তার জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য কর্মীদের ওপর নির্দেশ দেয়া হলাে।
এদিকে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব তার নিজস্ব সংগ্রামের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এগিয়ে যাচ্ছিলেন এবং ফলে দীর্ঘদিন কারাজীবন যাপন করছিলেন তাই আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ১৪৫
সংবিধান সংক্রান্ত আন্দোলনে বা ১৯৫২ সালের ভাষা আআন্দোলনে তাকে প্রত্যক্ষভাবে পাইনি। তবে তার পরোক্ষ প্রভাব আমরা অনুভব করেছি।”
৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠা কন্যা দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথ ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহন করেন।
১৯৫২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কাপাসিয়া থানার শ্রীপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। তিনি ঢাকা থেকে গিয়ে শিক্ষকতা করতেন।
৬ ফেব্রুয়ারি কমিশরি অফিসে (১৫০ মোগলটুল) মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সংগ্রাম পরিষদের সভা হয় এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি অর্থ সংগ্রহের জন্য পতাকা দিবস পালন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিন ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। উদ্ভূত পরিস্থিতি আলোচনা করার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা ৭টায় ৯৪ নবাবপুর আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দেয়। রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন- এম এ মতিন, গাজীউল হক, শামসুল আলম, এস এ বারী এটি, এম আর আখতার মুকুল, হাবিবুর রহমান শেলী প্রমুখ। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের স্কুল কলেজের ছাত্ররআ বিশ্ববিদ্যলয় আমতলায় সমবেত হয়। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রছাত্রীরআ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেয়। আবদুস সামাদ আজাদ ৫ জন ৫ জন করে দশজনে প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পরামর্শ দেন। প্রথম মেয়েদের দলটি অগ্রসর হয়, তারপর ছেলেরা। শত শত ছাত্রছাত্রী এগিয়ে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও মুখ্য সচিব আজিজ আহমদ ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পুলিশকে নির্দেশ দেন। তখন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরাইশী, সিটি এসপি মাসুদ উপস্থিত। আইনসভার অধিবেশন ৩টায় শুরু হবে। বেলা ৩টায় মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলের সামনে সমবেত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান এমএ ক্লাসের ছাত্র জব্বার গুলিবিদ্ধ হন, তার মাথার খুলি উড়ে যায়। তারপর রফিক, বরকত মেডিক্যাল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ছাত্র হত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার জনতা মেডিকেল কলেজে ছুটে আসে। এ কে ফজলুল হক ও সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া বিকেলে মেডিকেল কলেজে আসেন ।
তাজউদ্দীন আহমেদ শ্রীপুর ছিলেন । ২১ ফেব্রুয়ারি সকালের ট্রেনে ঢাকা
পৃষ্ঠাঃ ১৪৬
এসে মিছিলে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি ট্রেন ধরতে পারেননি। বিকেলের ট্রেনে ঢাকা আসেন এবং ট্রেন থেকে নেমে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। কিন্তু কোন ছাত্র সমাবেশ দেখতে না পেয়ে শিক্ষা ভবনে যান। ডা. করিম ও তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ দেখতে যান। কিন্তু লাশ দেখতে ব্যর্থ হন। তখন তিনি নবাবপুর আওয়ামী লীগ অফিসে যান।
২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে যান। তিনি ফজলুল হক হল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা মেডিকেল কলেজে সমবেত হয়। কিন্তু লাশ নেই- রাতের অন্ধকারে পুলিশ লাশ ছিনিয়ে নিয়ে আজিমপুরে দাফন করে। মেডিকেল কলেজে গায়েবী জানাজা ও শােকসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের নিকট পুলিশের গুলিতে ১৯ জন নিহত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিকেল কলেজ হেস্টেলের সামনে যেখানে যেখানে ছাত্রদের হত্যা করা হয় সেখানে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। পলিশ শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। ২৩ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
সকল জেলা ও মহকুমা সদরে আন্দোলন চলতে থাকে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। ঢাকায় ২৪ ফেব্রুয়ারী থেকে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। শত শত ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে পুলিশ গ্রেফত করে। শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদকে ২২ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর থেকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫২ সালের ৭ মার্চ আতাউর রহমানকে আহবায়ক করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বার লাইব্রেী হলে ৫০০ ভাষা সৈনিকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন। মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতনের কারণে ১০ হাজার দেশপ্রেমিক কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মী বাংলা ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। তাদের দেশ ত্যাগের ফলে পূর্ব বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। শত শত হাইস্কুল বন্ধ হয়ে যায় ।
২৭ মার্চ ১৯৫২
তাজউদ্দীন আহমদ, মাহমুদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, এমাদুল্লাহ, সুলতান আলােচনা করে একটি দল গঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন।
পৃষ্ঠাঃ ১৪৭
২২ জুলাই ১৯৫২
ইমাদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা। একদিকে তিনি বরিশাল কোর্টে চাকরি করেন অন্যদিকে তিনি এলএলবির ছাত্র।
২৩ আগস্ট ১৯৫২
প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নূরুল আমিন সভাপতি ও ফকির আব্দুল মান্নান মুসলিম লীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। হামিদুল হক চৌধুরী ও মহিউদ্দিন আহমদকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৫২
মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন, মানিক মিয়া, মােহাম্মদ ইলিয়াস, সৈয়দ আহমদ বিশ্বশান্তি সম্মেলনে পিকিং গমন করেন।
১১ অক্টোবর, ১৯৫২
খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১০ নভেম্বর, ১৯৫২
তাজউদ্দীন আহমদ শ্রীপুর হাইস্কুল থেকে বিদায় নেন। তিনি শ্রীপুর স্কুলে এক বছর ৩ মাস ছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি কিশাের মেডিকেলে যােগ দেন।
২০ নভেম্বর, ১৯৫২
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকায় ভাষণ দেন।
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৭ সাল থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। জাতীয় ইতিহাসে তাজউদ্দীননের ডায়েরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার লেখার ওপর ভিত্তি করে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে। সরদার ফজলুল করিম ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাজউদ্দীনের ডায়েরি প্রসঙ্গে মূল্যায়ন করে লিখেছেন নিম্নে তা উদ্ধৃত হলাে :
সরদার ফজলুল করিম
বদরুদ্দীন উমর এবং বশীর আল হেলাল, এদের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনে যারাই যে ভূমিকা রেখেছেন, ‘৪৮ কিংবা তারও পূর্বের ‘৪৭ থেকে, তার নিশ্চয়ই উল্লেখ আছে। কিন্তু ‘তাজউদ্দীন আহমদ’ নামে কোনাে আলােচনা কিংবা গ্রন্থ রচনা আজ পর্যন্ত রাজনীতি-সচেতন কোনাে কর্মী কিংবা সাহিত্যিক রচনা
পৃষ্ঠাঃ ১৪৮
করেছেন বলে আমার জানা নেই।
পুরো তাজউদ্দীন আহমদ আজ আমাদের চোখের সামনে। জন্ম থেকে মত্যু পর্যন্ত ১৯২৫ থেকে ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে সশস্ত্র হন্তাদের হাতে অপর সাথীদের সঙ্গে নিহত জনাব তাজউদ্দীন আহমদ।
জনাব বদরুদ্দীন উমর জনাব তাজউদ্দীনের কাছ থেকে তার ডায়েরি সংগ্রহ প্রসঙ্গে ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ : কতিপয় দলিল প্রথম খণ্ডে লিখেছেন, ‘১৯৬৬ সাল থেকে দলিলপত্র সংগ্রহের সময় এ কাজে যারা আমাকে সব থেকে বেশি সাহায্য করেছিলেন নিজেদের সংগ্রহ থেকে দিয়ে বা অন্যদের থেকে সংগ্রহ করার ব্যাপার, তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুদ্দীন আহমদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, আবদুর রশীদ খানের নাম সব থেকে উল্লেখযােগ্য।’
তাজউদ্দীন আহমদের নিজের লেখা ডায়েরির সব আজ আর কোথাও পাওয়া যাবে না। ইতিহাসের দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি রেখে যে যুবক অপার নিষ্ঠার সঙ্গে ১৯৪৭ কিংবা তারও পূর্ব থেকে তার জীবনের প্রতিটি দিনের ঘটনা- দুর্ঘটন, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, জিজ্ঞাসা, সুহৃদ-অসুহৃদদের সঙ্গে সাক্ষাত-সংঘর্ষ সম্পর্কে দ্রুত কিন্তু অনবদ্য হাতে ইংরেজীতে নিজের দিনলিপি লিখে চলেছিলেন ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত, তার সামান্য পরিমাণই হয়তাে বদরুদ্দীন উমর উদ্ধার করে পাঠক সাধারণের সামনে প্রকাশ করতে পেরেছেন।
উমর লিখেছেন : ‘সাংগঠনিক ঘােষণাপত্র, গঠনতন্ত্র, প্রস্তাব, ভাষণ, ইশতেহার, সার্কুলার ইত্যাদি ছাড়াও এই সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হলাে তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির কিছু অংশ । তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনের ডায়েরি নিয়মিত রেখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপের সময়ে তিনি কথায় কথায় তার এই ডায়েরির উল্লেখ করেন। কিন্তু সেই সঙ্গে বলেন যে, তার কোনাে গুরুত্ব নেই। আমি তৎক্ষণাৎ ডায়েরিগুলাে দেখতে চাইলে তিনি সেগুলাে আমাকে দেন। আমি কিছু কিছু পাতা উল্টিয়ে বুঝতে পারি যে, তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ঠিকমতাে লেখার ক্ষেত্রে তাঁর ডায়েরি খুব সাহায্য করবে। সেই অনুযায়ী আমি সেগুলাে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে যাই এবং পরে ১৯৪৬ সাল এবং ১৯৫৩ থেকে ‘৫৬ সালের ডায়েরি তাঁকে ফেরত দিয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত নিজের কাছে রাখি। তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে ডায়েরিগুলাে ছিল, সেগুলাে ১৯৭১ সালে সামরিক বাহিনীর হামলার সময় বিনষ্ট হয়।’
বদরুদ্দীন উমরের রক্ষিত এবং ‘৮৪ সালে প্রকাশিত ডায়েরির ফটোকপি পাঠ করে পাঠক মাত্রেরই মন জনাব তাজউদ্দীনের বিনষ্ট ডায়েরি না পাওয়ার
পৃষ্ঠাঃ ১৪৯
ক্ষতির ক্ষোভে পূর্ণ হয়ে উঠবে।
তবু এই প্রকাশিত ডায়েরিরও বিস্তারিত আলােচনা এখনও হয়নি। জনাব তাজউদ্দীনের প্রকাশিত ডায়েরির অংশটিতে চোখ দিলে তার রাজনৈতিক চেতনার এবং বয়সের চাইতেও তাঁর শিক্ষা এবং বােধের উন্নতমানের পরিচয় আমরা লাভ করি। কী ঈর্ষণীয় নিষ্ঠা!
প্রকাশিত ডায়েরির শুরু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই: ১৩.০৭.৪৭ থেকে। মাঝে মাঝে কোনাে কোনাে দিনের ফাক ঘটলেও বেশিরভাগ দিনলিপি ধারাবাহিকভাবে লিখিত হয়েছে। এর পরিমাণ ১৬০ পৃষ্ঠা, এবং দিন হিসেবে ২১৮ দিনের ডায়েরি। প্রতিদিন যুবক রাজনৈতিক কর্মী তাজউদ্দীন আহমদ দিনের জীবনী সম্পন্ন করে নিজের মেসে কিংবা কোনাে সাথীর আশ্রয়ে ঘুমাতে যাবার পূর্বে দৈহিক ক্লান্তির বিন্দুমাত্র পরােয়া না করে অতিক্রান্ত দিনটির সারসংক্ষেপ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। ডায়েরির শিরিদেশে তারিখের উল্লেখের পরে নিজের পড়াশােনার কথা ইঙ্গিতে উল্লেখ করতে গিয়ে প্রতিদিনই হয়তাে লিখেছেন: ‘স্টাডি : নাে’ কিংবা রে শরৎ বাবুজ পল্লীসমাজ ফ্রম নাইট থারটি টু টুয়েলভ।
নাইট অর্থাৎ সাড়ে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত শরৎ বাবুর পল্লীসমাজ পাঠ। প্রায় প্রতিদিনের ডায়েরির তলদেশে দিনের আবহাওয়ার উল্লেখ আছে। অনেক সময়ে বাক্যহীন ইঙ্গিতে; ‘ওয়েদার : ক্লাউডস সিনস এ্যাবাউট ওয়ান পি.এম. । ড্রপস অফ রেইন ফল ওয়ান ফোর্থ অব নাইট সিনস ইভিনিং। একটা থেকেই আকাশ মেঘে ভরা; রাতের প্রথম দিকে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল । বিকেল থেকেই এমন। কিংবা ‘ওয়েদার: সাডেন এ্যাপিয়ারেন্স অব স্প্রিং হিট, ইন্টারাপটেড বাই এ বিট ইনফ্রিজ ইন কোলড… পারহ্যাপস লাস্ট বাইট বিফোর ডেথ : বসন্তের গরমের হঠাৎ আগমন; কেবল ২৩.২.৫২ থেকে ঠাণ্ডার কিছু বৃদ্ধি । হয়তাে বা মরণের আগে শেষ কামড়।’
যে কোনাে ব্যক্তির দিনলিপি তার অন্তর্দর্শনের ক্ষেত্রে যারপরনাই মূল্যবান। রাজনৈতিক যুবক তাজউদ্দীন আহমদের এমন নিষ্ঠার সঙ্গে রচিত দলিলে মূল্য বর্ণনার অতীত। দিনলিপি রচনা যেন তাঁর দুরারােধ্য স্বভাব এবং নিত্যদিনের সমাপনী কর্মে পরিণত হয়েছিল। কেবল যে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাদের হামলায় বিনষ্ট করেছে এই অতুলনীয় রাজনৈতিক প্রজ্ঞাময় কর্মী এবং নেতার ৫৩ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত রক্ষিত ডায়েরি তাই নয়। পাকিস্তান হানাদারদের বাংলাদেশী উত্তরসূরিরা নির্মমভাবে যেমন হত্যা করেছে রাজবন্দী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার অপর তিন রাজবন্দী সাথীদের ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে কারাগারের মধ্যে, তেমনি তারা নিশ্চয়ই ধ্বংস করেছে ‘৭১-এর পরবর্তীকালের
পৃষ্ঠাঃ ১৫০
তাঁর দিনপঞ্জি।
আবার যদি এমন হয় যে, বাংলাদেশের এমন হানাদাররা তাজউদ্দীন সাহেবের সমগ্র রচনাকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়নি, তাঁর বন্ধু বান্ধব, আত্মীয়- স্বজন, পরিবার- পরিজনদের কাছে যদি তাজউদ্দীন আহমদের কিছু মাত্র স্মারক আজও রক্ষিত এবং অক্ষত থেকে থাকে, তবে বর্তমানের সচেতন গবেষক ও রাজনৈতিক কর্মীদের কর্তব্য হচ্ছে তাকে উদ্ধার করে জাতির সামনে প্রকাশ করা এবং তাকে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরনের জন্য জাতীয় জাদুঘরে রক্ষা করার ব্যবস্থা কর।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদের ২১.২.৫২ তথা ‘৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখের দিনলিপিটার বাংলা অনুবাদ নিচে তুলে দেয়া হলাে।
“ঢাকা : ২১.২.৫২
‘ঘুম থেকে ওঠা ৫.৩০ মিনিট। স্কুলে গমন : ১০-৩০ থেকে ১১-৪৫। সকালে পুকুরে গােসল করার সময়ে আমার বালিশের নিচ থেকে রফিক আমার টাকা পয়সা নিয়ে গেছে। নওসিয়ার সাহায্যে ব্যাগ এবং ১৪৭ টাকা আট আনা তার কাছ থেকে উদ্ধার করা গেছে। কিন্তু গণ্ডগােলে ঢাকা আসার সকালের ট্রেন ফেল করেছি। ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম, ১২-১৪ মিনিটে ট্রেনে। এফ করিম এবং ডাক্তার আহসান উদ্দিন আমার সঙ্গে একই কামরায় এলেন । রাজেন্দ্রপুরে হাসান মােড়ল গাড়িতে উঠল। তার সঙ্গে স্কুলের বিষয়ে এবং ১৪.২.৫২ তারিখের ম্যানেজিং কমিটির মিটিং সম্পর্কে আলাপ করলাম। ইউনিভারসিটির কাছে ট্রেনটা থেমে যাওয়াতে আমি আর এফ করিম ট্রেন থেকে ওখানে নেমে পড়লাম ।
‘দেখলাম সমগ্র ইউনিভারটিসি এলাকায় বিরাট এক জনজমায়েত ঘটেছে। লােকে তখন মেডিকেল কলেজ এবং এ্যাসেম্বলি এলাকায় পুলিশের ছােড়া কাঁদানে গ্যাসের কথা বলছিল।
ইউনিভারসিটির কাছে মিনিট বিশেক অপেক্ষা করে ডিপিআই অফিসে যাওয়া। মুসলিম এডুকেশন ফান্ডের গ্রান্ট যে ডিল করে সেই সহকারীর সঙ্গে সাক্ষাত। তার কাছে খবর পাওয়া গেল, আমাদের স্কুলের জন্য ১২০০ টাকা মঞ্জুর করা হয়েছে এবং এডিপিআইর অফিস এ খবর ১৩.২.৫২ তারিখে পেয়েছে।
‘গভর্নমেন্ট গার্মেন্টস সহকারী মিঃ মহিউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাত। তিনি বললেন, এক সপ্তাহের মধ্যে মেমাে পাঠাবেন। প্রায় তিনটার দিকে সেখান থেকে ফিরে আসা।
পৃষ্ঠাঃ ১৫১
‘ইডেন বিল্ডিংয়ের সেকেন্ড গেটে আকবর আলী বেপারিকে দেখলাম। সে বলল, বিরানি বাজারের তারক সাহার ঘর দোকান সে কিনবে এবং এ টাকার জন্য সে জমি বিক্রি করবে। একটা বাসে জড়ে এসডিও (নর্থ)- এর কোর্টে ৩- ৩০ মিনিটে আসা। ৪-৫ মিনেটে তার খাস কামরায় সাক্ষাত এবং তার সঙ্গে স্কুলের ২৪.২.৫২ তারিখে এমসি মিটিং সম্পর্কে আলাপ। হেড মাস্টারের ব্যাপার সম্পর্কে তিনি আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করলেন। তিনি ৩.৩.৫২ তারিখে এমসির মিটিং দিতে বললেন। তখন তিনি শ্রীপুরে থাকবেন। আমার অনুরােধে তিনি শ্রীপুরের একজন উদ্বাস্তু মিস্ত্রির রিলিফের আবেদন মঞ্জুর করলেন! ৪-২৫ মিনিট তাঁর চেম্বার ত্যাগ।… কোর্টের রেস্টুরেন্টে নাস্তা খাওয়া। প্রায় ৫টার দিকে কোনাে এলাকা থেকে আসা।… ‘কামরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তাঁর বাসায় সাক্ষাত এবং দেরি না করে তাঁকে সাথে করে ৯৪ নং নওয়াবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে আসা। প্রায় ৫ মিনিট অপেক্ষা করে ক্যাম্ব্রিজ ফার্মেসিতে এলাম । জহির ভাই এসএম জহির উদ্দিন এবং আমাদের চা খাওয়ালেন।
‘ডাক্তার করিম এবং আমি মেডিকেল কলেজ এলাম এবং পুলিশের গুলিতে নিহত লাশ ও আহতদের দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। ডাক্তার করিম চলে গেলেন। কিন্ত আমি মেডিকেল কলেজের হােস্টেলের ব্যারাকে ঘােরাফেরা করে ১১টায় যােগীনগর ফিরলাম।
রাতের খাবারের পরে ১২-৩০ পর্যন্ত ভাবির সঙ্গে কথা বললাম। বিছানায় গেলাম ১টায় ।
‘আবহাওয়া : মােটামুটি স্বাভাবিক। ঠাণ্ডা কম।
‘দিনের খাবার হয়নি।
‘রাত সাড়ে তিনটার দিকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী আমাদের বাসা ঘিরে ফেলল এবং যুবলীগ অফিসে তল্লাশি চালালাে। তারা আপত্তিকর কিছু পেল না। যুবলীগ অফিসের পাশের ঘর থেকে আমি সরে পড়লাম । পুলিশ টের পায়নি। ৪টার দিকে পুলিশের প্রত্যাগমন । এর পরে আর ঘুমালাম না।
‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়েছে। গতকাল ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। মাসের জন্য ১৪৪ ধারা । আজ বিকেলে এ্যাসেম্বলি। অধিবেশন শুরু। ধর্মঘটে ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিল। তারা চাইছিল এ্যাসেম্বলির দিকে এগুতে যেন অধিবেশনের এমএলএরা তাদের আওয়াজ শুনতে পায়। প্রথমে এ্যারেস্ট শুরু হলাে। তারপরে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। মেডিকেল কলেজ হােস্টেলে গুলিবর্ষণ। বুলেটে
পৃষ্ঠাঃ ১৫২
ঐ জায়গাতেই ৪ জন নিহত । অনেকে বলেছে পুলিশ কয়েকটা লাশ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারীভাবে বলা হচ্ছে ১০-১১ জনের মৃত্যু ঘটেছে।’১১
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।
তআজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি সম্বন্ধে আমি প্রথমে জানতে পারি বদরুদ্দীন উমরের পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি বই থেকে। এই বিক্ষাত গবেষণা গ্রন্থ রচনার বিস্তর তথ্য জনাব উমর পেয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা স্বীকার করেছেন। ১৯৪৭-৪৮ সালের ডায়েরির প্রায় সােয়া নয় মাসের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এই বই, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি : ১৯৪৭-৪৮। প্রকাশকের কথায় সিমিন হােসেন রিমি জানাচ্ছেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি যেন প্রকাশিত হয়, এই অনুরােধ ছিল সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের। শুধু তাই নয়, আমি বলব দাবি ছিল । এই দাবি দু’কারণে। এক, একাত্তরের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কর্ণধার, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক সেনাপতি এই অসাধারণ মানুষটিকে আমরা যথেষ্ট জানি বলে দাবি করতে পারি না। সুতরাং তাঁর সম্বন্ধে জানার যতগুলাে পথ খােলা আছে, আমরা সে সবের সন্ধান পেতে চাই। দুই, পাকিস্তান অন্তর্গত পূর্ব পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে বহির্গত বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবনেতিহাস বিষয়ে আমাদের কৌতূহল আজো অপরিতৃপ্ত । যতই দিন যাচ্ছে, কৌতূহল বাড়ছে। সে সব উন্নত দেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা বিকশিত, সে সব দেশের রাজনীতিকরাও এই চর্চার মধ্যে আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত সমাজের ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি তারাও তাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার কথা লেখেন । সামগ্রিক ইতিহাস রচনায় এও এক মূল্যবান পরিপূরক কাজ। এদেশে দুর্ভাগ্যবশত এ কাজটা হয় না। কালি-কলমের সঙ্গে আমাদের রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক ক্ষীণ। তাজউদ্দীন আহমদের ব্যতিক্রম। তাঁর বাইশ-তেইশ বছরের এই ইংরেজী দিনলিপিই সাক্ষ্য দিচ্ছে, তিনি নিয়মিত পড়েছেন এবং নিয়মিত লিখেছেন। প্রমাণ দিচ্ছে, একজন অতিব্যস্ত রাজনীতিক হিসেবে তাঁর যে, বহির্জীবন, তাকে সমৃদ্ধ করেছিল, তার অন্তর্মুখীনতা, তার অন্তৰ্জীবন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বহির্জীবনের অতিব্যস্ততায় রাজনৈতিক কর্মী ও রাজনৈতিক নেতাদের অন্তৰ্জীবন পরিণত হয় একটি ক্ষীণপ্রবাহিনী ধারায়। তার নাব্য, তার স্রোতের বেগ হারিয়ে যায়। এর ফলে আমরা এক্ষেত্রে বাঙালীরা বঞ্চিত হয়েছি। আমাদের রাজনীতির জগতের প্রথম সারির নেতাদের কলম থেকে আমরা যা পাবার আশা করছিলাম, তা অতি সামান্যই পেয়েছি। এর ফলে এমন ধারণার জন্ম হতে পারে
পৃষ্ঠাঃ ১৫৩
যে, রাজনীতির সঙ্গে মননের কোনাে সম্পর্ক নেই। এদিক দিয়েও তাজউদ্দীন আহমদ একজন ব্যতিক্রমী পুরুষ। এই মেধাবী ছাত্রের রাজনীতিও যে মেধাবী ছিল, প্রথমাবধি তার সংবাদ আমরা পাচ্ছি তার এই যুবা বয়সের ডায়েরিতে।
এই নয় মাসের ডায়েরি, স্পষ্টই বােঝা যায়, তাজউদ্দীন রেখেছিলেন একান্ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। ভবিষ্যতের পাঠক বা গবেষকদের জন্য নয়। এগুলো নিয়ে তার কি চূড়ান্ত ভাবনা ছিল, তিনি শেষ বয়সের অবসরে এগুলোর সাহায্যে তাঁর সারা জীবনের রাজনীতির আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত লিখে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন কি না, কিছুই আমরা জানি না। বাইশ বছরের যুবক নিজেকে এই সময়ে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কল্পনা করে থাকলেও ডায়েরিতে তার কোনাে সমর্থন মেলে না। এখানে আছে শুধু তার সারাদিনের ব্যস্ততার সংবা। কিন্তু এর মধ্যেই ধরা পড়ে নানা বৈশিষ্ট্য। সকাল থেকে শুরু করে রাতে শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত তিনি কি করেছেন, কোথায় গিয়েছেন, কাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কখন ও কোথায় কি উপলক্ষে, কোথায় গিয়েছেন, কি খেয়েছেন, কে খাওয়াল, এসব খুঁটিনাটি তথ্যে ঠাসা তাঁর দিনলিপি। মনে হবে একজন অত্যন্ত বাস্তববাদী, গদ্য মনের মানুষ। কিন্তু এই ভুল ভেঙ্গে যায়, দিনলিপির শেষ দিকে এসে : প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে এই অংশে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন দিনের আবহাওয়ার সংবাদ ! এলােমেলােভাবে পাতা ওল্টানাের মধ্য দিয়ে পেয়ে যাই বিভিন্ন দিনের এসব সংবাদ।
: গত ৪ দিন যাবত গুড়িগুড়ি বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
: সারা দিন মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি।
: সারা দিন অবিরাম মুষলধারে বৃষ্টি! দুপুরে আধা ঘণ্টার মতাে বিরতি দিয়ে আবার কেঁপে বৃষ্টি এলাে। চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত।
: আজ সারাদিন বৃষ্টি হয়নি।
: দুপুর ১২টায় আধা ঘণ্টার জন্য বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর থেকে আকাশ পরিষ্কার ।
: সারাদিন ঝকঝকে রােদ। রাত ৯টায় আকাশে মেঘ জমল। এক-দু ফোটা বৃষ্টি পড়ল । এটাকে বৃষ্টি বলা যাবে না।
: দিনের আকাশ পরিষ্কার ও উজ্জ্বল। রাতের আকাশ উজ্জ্বল ও ছােট বড় তারায় ভরা। উজ্জ্বল সকাল।
: দিনের প্রথম ভাগ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও গুমােট, কিন্তু বৃষ্টি ছিল না। দ্বিতীয় ভাগ অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল।
: সকাল সাড়ে ১০টায় এক খণ্ড ভাসমান মেঘ থেকে আকস্মিক বৃষ্টি এলাে
পৃষ্ঠাঃ ১৫৪
সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ভালােই বৃষ্টি হলাে।
সেপ্টেম্বর-মার্চ পর্বের ডায়েরিতে বৃষ্টির উল্লেখ থাকবেনা তেমন। এটাই স্বাভাবি। কিন্তু ‘আবহাওয়া স্বাভাবিক’ এই সাদামাটা সংবাদ পরিবেশনেও ক্লান্তি নেই ডায়েরি-লেখকের।
এই আবহাওয়া- সংবাদ এটা আবশ্যিকতার রূপ নিয়েছে ডায়েরিতে। একই সঙ্গে থাকছে প্রতিটি ঘটনার সময়ের উল্লেখ । উদাহরণ স্বরূপ-
‘২ ফেব্রুয়ারি ‘৪৮, সােমবার। সকাল ৮টায় মফিজউদ্দীনকে ঘুম থেকে তুলে স্টেশনে গেলাম। সাড়ে ৮টায় স্টেশন থেকে ফিরলাম। হযরত আলী ও আবুল খায়েরের সঙ্গে দেখা হয়। ওদের সঙ্গে এফএই হলে গেলাম। পথে আবুল খায়েরের সঙ্গে তাজমহল ব্যাংক নিয়ে কথা হলাে। ১০টায় মেসে ফিরলাম। বেলা ১১টায় কমরেড ব্যাংকে ১৬২০ টাকা জমা দিলাম ।
‘লীগ অফিস হয়ে বেলা ২টায় তাজমহল ব্যাংকে গিয়ে সেখানে চা খেলাম। ৩ টায় ভিক্টোরিয়া পার্কের সভায় যােগ দিলাম । ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত জনাব ফজলুর রহমান বক্তৃতা করলেন। মাওলানা আকরম খাঁ সভাপতিত্ব করলেন। বাজে সামপ্রদায়িক বক্তৃতা। প্রসঙ্গ কাশ্মীর ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
‘৫টায় কোর্টে বসিরউদ্দিনের সঙ্গে দেখা হলাে। ৬টায় টাইম হলে এলাম। আগামীকাল আবার যেতে হবে।
‘সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ডা. করিমের সঙ্গে দেখা করে সাড়ে ৭টায় ফিরলাম। সাড়ে ১০টায় ঘুমাতে গেলাম।
‘আবহাওয়া ভ্যাপসা ও উষ্ণ। আকাশ মেঘহীন।’
এক ধরনের দৈনন্দিনতায় পরিপূর্ণ এই দিনলিপিতে ছড়িয়ে থাকা ইশারাগুলােকে একত্র করা গেলে একজন ব্যস্ত যুবকের প্রতিকৃতি তৈরি করা যাবে। যুবকটির ব্যস্ততা মূলত রাজনৈতিক। ১৯৪৭-৪৮ সালের ঢাকা শহরের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কারা ছিলেন, যাদের সঙ্গে যুবক তাজউদ্দীনের বিভিন্ন মাত্রার যােগাযােগ হয়েছে। আমরা জেনে যাই এই ডায়েরি থেকে। মনে হয় সমবয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যােগাযােগ হয়েছে অলি আহাদের সঙ্গে। আর জ্যেষ্ঠদের মধ্যে কামরুদ্দিন আহমদের সঙ্গে। এরপর যাদের সঙ্গে তার বেশি যােগাযােগ তাঁরা হলেন মােহাম্মদ তােয়াহা, নাঈমউদ্দিন ও শামসুল হক। যােগাযােগের এই বৃত্তান্ত থেকে কিছু সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব। এ ম্যান ইজ নৌন বাই দ্য কোম্পানি হি কিপস। ভবিষ্যতের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যেটুকু উল্লেখ দেখতে পাচ্ছি তাতে মনে হয়, সম্পর্ক তখনও দানা বাঁধেনি। তুলনায় টাঙ্গাইলের শামসুল হক বেশি সক্রিয় ও দৃশ্যমান। শামসুল হকের মতিগতি সম্বন্ধে তাজউদ্দীনকে
পৃষ্ঠাঃ ১৫৫
কিছুটা সতর্ক ও সন্দেহপরায়ণ মনে হয়।
ডায়েরিতে ধৃত সময়কালের মুখ্য ঐতিহাসিক ঘটনা ১৪ আগস্টে উপমহাদেশের স্বাধীনতা লাভ ও বিশ্ব মানচিত্রে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ওই সময়ের ঢাকা শহরের রাজনৈতিক আবহাওয়ার খবর পাওয়া যায় ডায়েরিতে। মিছিল, আলােকসজ্জা, জনসভা, জনপথে উচ্চল মানুষের ভিড়, ট্রেনে যাত্রীর ভিড়। চাপা আম্প্রদায়িক উদ্বেগ, স্বাধীনতার কয়েকদিন পরে ১৮ আগস্টে পল্টনে ঈদের জামাত, যেখানে উপস্থিত ছিলেন খাজা আfনাজিমদ্দিন ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, সন্ধ্যায় এসএম হলে সঙ্গীতানুষ্ঠান (অনুষ্ঠান দেরিতে শুরু হলাে। রাত ৯টায় আব্বাসউদ্দিন ও সহশিল্পীরা গাইলেন। গানের বাছাই তেমন ভালাে হয়নি)। চলমান ঘটনার ধারার অনেক কিছুই আছে। তবে উল্লেখযােগ্য এর কঠোর তথ্যধর্মিতা, এর বাঙালী-চরিত্রে দুর্লভ উত্তাপহীনতা।
তাজউদ্দীন চরিত্রের এই আপাত উত্তাপহীনতার বর্ম যে দুর্ভেদ্য ছিল না, তার ঘােষণা নিয়ে দেখা দেয় এই সময়ের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত একদিনের দিনলিপি।
৩০ জানুয়ারি নয়াদিল্লির বিরলা ভবনে আততায়ীর গুলিতে মহাত্মা গান্ধীর মুত্য সংবাদ সেই দিনই রাত ৮টার সময় পান তাজউদ্দীন। কতটা বিচলিত হয়েছিলেন তিনি এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে, তার স্বাক্ষর আছে ওইদিনের দীর্ঘ লেখায়, সেখান থেকে একটা অংশ-
‘আমার কাছে মৃত্যু একটা সাধারণ ব্যাপার, স্বাভাবিক ব্যাপার । আমি কারুর মৃত্যুতে কোনােদিন শােক প্রকাশ করিনি। আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কথা আমার এখনাে স্মরণ আছে। ১৯৪৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর জন্য আমার মনে কোনাে দুঃখবােধ জাগেনি। তেমন দুঃখবােধের কোনাে কারণ আমি খুঁজে পাইনি।
‘আমার বাবার মৃত্যুর কথাও আমার মনে আছে। মাত্র এক বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে। বছরটা শেষ হতে আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি কলকাতায় ছিলাম- তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তাঁর মৃত্যুতেও আমার মনের মধ্যে কোনাে দুঃখবােধ জাগেনি। তাঁর মৃত্যুতে কেবল কাঁধের ওপর পারিবারিক বােঝার ভারটা যেন জীবনে প্রথম বারের জন্য বােধ করলাম।
‘আমার মনে আছে, বাবার মৃত্যুল খবর শােনার মাত্র ১৫ মিনিট পরই আমি ৪টা পরটা এবং এক বাটি মাংস খেয়েছিলাম। আমার তাে এ কথা মনে আছে, তার পরের রাতে, যে বিছানাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেই বিছনাতেই আমি গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হয়েছিলাম।
পৃষ্ঠাঃ ১৫৬
‘কিন্তু গান্ধীজির মৃত্যুতে আমি তেমনটি হতে পারছিনে কেন? আমি আমার মনের বিষাদকে দুর্বলতা ভেবে ঝেড়ে ফেলতে চাইলাম। অনিচ্ছা নিয়ে আমি রাত বারোটায় রাতের খাওয়া খেলাম । আমি ঘুমাতে চাইলাম । কিন্তু তবু তাে আমি ঘুমাতে পারলাম না । জাগ্রত অবস্থাতে গান্ধীজী আমাকে আপ্লুত করে রাখলেন…।’
আমরা বিস্মিত হই অপ্রত্যাশিত এই আবেগের উচ্চারণে, কিন্তু আমাদের একটা ভুলও ভেঙ্গে যায়। আবেগ দমনের কঠিন বিষয়ই চর্চা করছিলেন যুবক তাজউদ্দীন। এমনও হতে পারে, আবেগের সঞ্চয় একটু বেশি ছিল বলেই এই সচেতন সংযম।
ডায়েরির পাতায় পাতায় অসংখ্য মানুষের ভিড়। তাদের কেউ কেউ আমাদের চেনা মানুষ। তবে অধিকাংশই অচেনা। এই অচেনা মানুষগুলাে যে অপাঙক্তেয় ছিল না, এই সাধারণ মানুষের ভিড়েই তিনি সহজ ও স্বচ্ছন্দ ছিলেন, আর এদের নিয়েই তিনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিভাবে যেন সেই সংবাদটাও আমরা পেয়ে যাই- নয় মাসের এই ডায়েরি থেকে।
ডায়েরি ১৯৪৭-৪৮ তাজউদ্দীন নামের মানুষটিকে খুব কাছে থেকে দেখিয়ে দেয়- এক সজীব, কর্মচঞ্চল, সজাগ, সন্ধিৎসু ও আত্মবিশ্বাসী যুবক। প্রতিটি প্রহর মূল্যবান ছিল তার জীবনে। আর তাঁর নিজের ও কামরুদ্দিন আহমদের বিকল ঘড়িটি সচল করা ও দোকান থেকে উদ্ধার করা খুবই জরুরী ছিল তার জন্য কারণ ঘড়ির ঘূর্ণায়মান কাটার সঙ্গেই ছুটছিলেন তিনিও, ধাবমান সময়ের সঙ্গে।”১২
তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্র জীবন থেকে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। তার লেখা ডায়েরি ১৯৪৭-৪৮ এবং ১৯৪৯-৫০ সালে দু’খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক খণ্ড ডায়েরি অপ্রকাশিত রয়েছে। কয়েকটি ডায়েরি হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ডায়েরি জেলখানা থেকে নিখোঁজ। তার লেখা ডায়েরি জাতীয় সম্পদ এবং ইতিহাসের উপাদান হয়ে আছে। অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি সম্পর্কে বলেন, “জনাব তাজউদ্দীন আহমদের উজ্জ্বল, মনােহর ইংরেজী হস্তাক্ষরে লেখা ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলাে এবং তার চিন্তার দিকে চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাই : তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের সমকালীন সাথীদের অন্যতম সেই ব্যক্তি যিনি ইতিহাসের পথকে সচেতনভাবে অনুসরণ করেছেন, যিনি ইতিহাসের সঙ্গে গেছেন। ইতিহাস তাকে টেনে নেয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ নির্বোধ ছিলেন না। তাজউদ্দীন আহমদ বুদ্ধিমান ছিলেন।”
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে শক্তিশালী করে। ভাষা আন্দোলন বাঙালীর চেতনাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়।
পৃষ্ঠাঃ ১৫৭
তারা চরমভাবে উপলব্ধি করল- পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলা পৃথক সত্তা। বাঙালীদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য স্বাতন্ত্র্য। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বাংলাকে শোষণ করে শ্মশানে পরিণত করেছে। তারা মাতৃভাষার ওপর আঘাত হেনেছে। তারা বাংলা ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে তাদের স্মৃতি অমর, শহীদদের রক্ত বৃথা যাবে না।
১৯৫২ সালের শহীদের স্মরণে গান, কবিতা, প্রবন্ধ রচিত হলো৷ বরিশালের আবদুল লতিফ লিখলেন- ‘ওরা আমার মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’ বরিশালের আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখলেন সাড়া জাগানো একুশের গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি।’ আবদুল গাফফার চৌধুরীর একুশে ফেব্রুয়ারি গানের প্রথম সুরকার আব্দুল লতিফ। ১৯৫৩ সালে তার সুর দেয়া গানটি প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়। ১৯৫৭ সাল হতে আলতাফ মাহমুদের একুশের গান জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখন যে একুশের গান প্রচলিত আছে তা আলতাফ মাহমুদের সুর দেয়া গান। একুশের গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদকে ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী হত্যা করে।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কমিউনিস্ট পার্টি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ছাত্র ফেডারেশন ও বামপন্থী ছাত্ররা একত্রিত হয়ে ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করে। ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মুহাম্মদ সুলতান ও মুহাম্মদ ইলিয়াস ।
১৯৫১ সালে যুবলীগ ও ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ফলে একটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল গঠনের পটভূমি সৃষ্টি হয়। ১৯৫৩ সালের ১৭ জানুয়ারি গণতন্ত্রী দল গঠিত হয়। গণতন্ত্রী দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন দিনাজপুরের হাজী মােহাম্মদ দানেশ এবং সম্পাদক হলেন যুবলীগ সভাপতি মাহমুদ আলী। বরিশালের মহিউদ্দিন আহমদ গণতন্ত্রী দলের সহসভাপতি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে আবুল হাশিম খেলাফতে রব্বানী পার্টি গঠন করেন।
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ব্যাপকভাবে পালিত হয়। এ বছর প্রকাশিত হলাে হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, পূর্ব বাংলায় খাদ্য সঙ্কট, মুসলিম সরকারের বাঙালীদের প্রতি শােষণ ও বৈষম্য সৃষ্টির কারণে মুসলিম লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। গভর্নর জেনারেল গােলাম মুহাম্মদ, প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান ও আমেরিকায় পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আলী আমেরিকার সাথে গােপন অস্ত্র চুক্তি করে । গোলাম মুহাম্মদ যখন দেখলেন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের পূর্ব
পৃষ্ঠাঃ ১৫৮
বাংলায় কোন জনপ্রিয়তা নেই তখন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল তিনি খাজা নাজিমউদ্দিনের মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেন। গভর্নর জেনারেল তার ঘোষনায় বলেন: I have been driven to the conclusion that the cabinet of Khaja Nazimuddin has proved entirely inadequate to grapple with the difficulties facing the country. In the emergency, which has arisen I have felt incumbent upon my asking the cabinet to relinquish office so that a new cabinet, better filled to discharge its obligation towards Pakistan, may be formed. আমি এ সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, খাজা নাজিমউদ্দিনের মন্ত্রিসভা দেশের সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমি তার মন্ত্রিসভাকে দায়িত্ব ত্যাগ করতে বলেছি এবং একটি অধিক দক্ষ মন্ত্রিসভা গঠন করব। ১৩
ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। খাজা নাজিমউদ্দিনকে বেআইনীভাবে পদচ্যুত করলে পূর্ব বাংলায় আনন্দের বন্যায় বয়ে যায় । আহসান মঞ্জিলের কবর তৈরি হলাে । দেশ রাজনৈতিক মুক্তি পায়, মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের পথ খুলে গেল।
১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন।
১৯৫৩ সালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হলাে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে পরিণত হয়। ১৯৫৩ সালে কাউন্সিল অধিবেশনে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামকরণ করা হয়। এম কামরুজ্জামানকে সভাপতি ও এম আবদুল ওয়াদুদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৯৫৩-৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কমিটি গঠন করা হয়।
আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি
১৯৫৩ সালে ঢাকা মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভায় নিম্নলিখিত নেতৃবৃন্দ কার্যনির্বাহী কমিটিতে নির্বাচিত হলাে :
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী – সভাপতি
আতাউর রহমান খান – সহ-সভাপতি
আবুল মনসুর আহমদ – সহ-সভাপতি
আবদুস সালাম খান – সহ-সভাপতি
পৃষ্ঠাঃ ১৫৯
খয়রাত হােসেন – সহ-সভাপতি
শেখ মুজিবুর রহমান – সাধারণ সম্পাদক
কোরবান আলী – সাংগঠনিক সম্পাদক
আবদুর রহমান – প্রচার সম্পাদক
পরে অলি আহাদ
মােহাম্মদ উল্লাহ – অফিস সম্পাদক
ইয়ার মােহাম্মদ খান – কোষাধ্যক্ষ
ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য
নাম জেলা
মুজিবুর রহমান রাজশাহী
শামসুল হক রাজধানী
মশিউর রহমান যশোর
আবদুল মালেক যশোর
ডা মজহারউদ্দিন আহমদ রংপুর
রহিমউদ্দিন আহমদ দিনাজপুর
মজিবর রহমান বগুড়া
ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী পাবনা
সৈয়দ আকবর আলী পাবনা
জহুর আহমদ চৌধুরী চট্টগ্রাম
আবদুল আজিজ চট্টগ্রাম
আবদুর রহমান খান কুমিল্লা
আবদুল বারী কুলিল্লা
জসিমউদ্দিন আহমদ সিলেট
সিরাজ উদ্দীন আহমদ নোয়াখালী
এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ বরিশাল
আবদুল মালেক খান বরিশাল
আচমত আলী খান ফরিদপুর
খােদাবক্স টাঙ্গাইল
আকবর হােসেন আখন্দ বগুড়া
আবদুল হাই যশোর
আবদুল আজিজ খুলনা
পৃষ্ঠাঃ ১৬০
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এটর্নি জেনারেল পদত্যাগ করে তার পুরাতন কৃষক পার্টি পুনরুজ্জীবিত করেন। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই কে এম দাস লেনের বাসভবনে কৃষক-শ্রমিক পার্টি কেএসপি গঠন করেন। কেএসপির সভাপতি ও সেক্রেটারি হলেন এ কে ফজলুল হক ও আবদুল লতিফ বিশ্বাস। দলের অন্যান্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, ইউসুফ আলী চৌধুরী, মােহন মিয়া, আবদুল ওহাব খান, বিডি হাবিবুল্লাহ, সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া প্রমুখ। ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুসলিম লীগের সাবেক সম্পাদক আবুল হাশিম গঠন করেন খেলাফতে রব্বানী পার্টি। ১৯৫৩ সালের শেষে কিশােরগঞ্জের মওলানা আতাহার গঠন করেন নেজামে ইসলাম পার্টি।
১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সম্পাদক শামসুল হককে গ্রেফতার ও তার ওরব লীগ সরকার মানসিক নির্যাতন চালায়। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার স্থলে ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা।
১৯৫৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী, সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া এবং প্রকাশক ছিলেন ইয়ার মােহাম্মদ খান। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর চেষ্টা, আর্থিক সহায়তা ও আওয়ামী লীগের উদ্যোগে দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠা লাভ করে ।
পৃষ্ঠাঃ ১৬১
৫
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন
বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইনসভায়
যুক্তফ্রন্ট গঠন- ৪ ডিসেম্বর ১৯৫৩
১৯৫৩ সালে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করতে হলে জাতীয় ঐক্যের প্রয়ােজন। ছাত্র-জনতার দাবি ‘হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী এক হও এক হও। ছাত্র-যুবকদের চাপে অনেক আলােচনার পর ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর শুক্রবার ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। কৃষক শ্রমিক পার্টির পক্ষে এ কে ফজলুল হক, আওয়ামী মুসলিম লীগের পক্ষে মওলানা ভাসানী একুশ দফায় স্বাক্ষর করেন এবং তাদের যুক্ত ঘােষণা ১৯৫৩ সালের ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়।
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঘােষিত ঐতিহাসিক ২১ দফা :
১, ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুসারে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।
২. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩. সকল নিরাপত্তা ও নিবর্তনমূলক আটক আইন বাতিল, বিনা বিচারে সকল বন্দীকে মুক্তি এবং রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের উন্মুক্ত আদালতে বিচার করা,
৪. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে,
৫. বিনা খেসারতে জমিদারী ও জমিতে সকল খাজনাভােগী স্বার্থ বিলােপ করা হবে, উদ্বৃত্ত জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন, খাজনা হ্রাস এবং খাজনা আদায়ের সার্টিফিকেট প্রথা বিলােপ করা হবে।
৬. সমবায় কৃষি খামার ব্যবস্থা প্রবর্তন, সরকারী সাহায্যে কুটিরশিল্পের পূর্ণ বিকাশ সাধন করা হবে।
৭. পূর্ববঙ্গকে শিল্পায়িত, কৃষককে আধুনিক যুগােপযােগী করে শিল্পে ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হবে।
পৃষ্ঠাঃ ১৬২
৮. সেচ ব্যবস্থা উন্নত করা হবে, দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
৯. পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, পাট উৎপাদনের জন্য ন্যায্যমূল্য আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে।
১০. পূর্ব বঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, মুসলিম লীগ আমলে লবণ অব্যস্থার জন্য দায়ী অপরাধিদের শাস্তি দান করা হবে।
১১. অবিলম্বে মােহাজেরদের পুনর্বাসন করা হবে।
১২. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করা হবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে।
১৩. সরকারী-বেসরকারী বিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্যের অবসান, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার প্রবর্তন করা হবে।
১৪. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কালা-কানুন বিলােপ করা হবে, শিক্ষাকে জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য করা হবে, ছাত্রদের অল্প খরচে আবাসের ব্যবস্থা করা হবে।
১৫. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি নির্মূল করা হবে।
১৬ প্রশাসন ব্যবস্থার ব্যয় হ্রাস করতে হবে, মন্ত্রীরা তাদের মাসিক বেতন এক হাজার টাকার বেশি গ্রহণ করবেন না।
১৭. মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হবে।
১৮. ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ ও তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দান করা হবে।
১৯. ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটির দিন বলে ঘােষণা করা হবে।
২০. পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভা কোনক্রমে আইন পরিষদের আয়ু বৃদ্ধি করবে না এবং স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচনের উদ্দেশ্যে সাধারণ নির্বাচনের ৬ মাস পূর্বে পদত্যাগ করবেন।
২১. আইন পরিষদে আসনশূন্য হলে ৩ মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের মাধ্যমে শূন্যতা পূরণ করতে হবে। পর পর ৩টি উপনির্বাচনে মন্ত্রিসভার মনােনীত প্রার্থীরা পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
২১ দফা ছিল পূর্ব বাংলার সাড়ে চার কোটি বাঙালীর মুক্তি সনদ। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি ছিল ২১ দফার প্রধান
পৃষ্ঠাঃ ১৬৩
বৈশিষ্ট্য। ২১ দফা বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে বাঙালীরা ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। যুক্তফ্রন্টের সভাপতি হলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী , পার্লামেন্ট বোর্ডের সদস্য ছিলেন এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, সােহরাওয়ার্দী। প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব ছিল সােহরাওয়াদরি ওপর। তিনি ২০ জন নেতা নিয়ে একটি সিলেকশন বাের্ড গঠন করেন। যুক্তফ্রন্টের অফিস ছিল সদরঘাটের ৫৪ নম্বর সিমসন বোর্ড। যুক্তফ্রন্টের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ। যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র ছিল দৈনিক ইত্তেফাক। এ ছাড়া ডেইলি পাকিস্তান অবজারভার, মিল্লাত মুসলিম লীগবিরােধী ভূমিকা পালন করে। মুসলিম লীগের ছিল দৈনিক আজাদ এবং মর্নিং নিউজ। এ কে ফজলুল হক, সােহরাওয়ার্দী ও ভাসানী সারা পূর্ব বাংলায় জনসভা করে গণবিপ্লব সৃষ্টি করেন। যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা, মুসলিম লীগের প্রতীক হারিকেন। নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী দল ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি যুক্তফ্রন্টের সাথে যুক্ত হয়। মােট আসন ৩০৯টি। তার মধ্যে ৭২ টি হিন্দু তফসিলী। ২৩৭টি মুসলিম আসন। ১৯৫৪ সালের ৭-১২ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী যুবনেতা। তিনি ঢাকা সদর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও যুবলীগ নেতা ছিলেন। হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও নির্বাচনী বাের্ড তাজউদ্দীন আহমদকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী নির্বাচন করে। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনীতিতে বিএ অনার্স পাস করেন। তিনি ১৯৫৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলএলবিতে ভর্তি হয়ে নিয়মিত ক্লাস করতেন।
জাতীয় তিন নেতা উল্কার বেগে সারা বাংলায় নির্বাচনী প্রচার অভিযান শুরু করেন। ১৯৫৪ সালের ৮ জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী ভাষণ দেন। নির্বাচনী প্রচার শেষে ১১ মার্চ সােহরাওয়ার্দী ঢাকায় যুক্তফ্রন্টের অফিসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, মুসলিম লীগ ৯টির বেশি আসন পাবে না।
এ কে ফজলুল হক পিরােজপুর থেকে, শেখ মুজিবুর রহমান গােপালগঞ্জ আসনে, তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার কাপাসিয়া থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সােহরাওয়ার্দী ও ভাসানী প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রার্থী হলেন না।
তাজউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী এলাকা ছিল ঢাকা সদর উত্তর-পূর্ব-কাপাসিয়া থানা। ১৯৫৪ সালের ৭ থেকে ১২ মার্চ তারিখে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পৃষ্ঠাঃ ১৬৪
মােট ৩০৯টি আসন নিমরূপভাবে বরাদ্দ ছিল :
মুসলিম – ২২৮
সাধারণ আসন হিন্দু – ৩০
সিডিউল কাস্ট – ৩৬
বৌদ্ধ – ২
খ্রিস্টান – ১
মুসলিম মহিলা – ৯
হিন্দু মহিলা – ১
সিডিউল কাস্ট – ২
মােট – ৩০৯
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করে। নির্বাচনের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ :
মুসলিম আসন
যুক্তফ্রন্ট – ২০৬
মুসলিম লীগ – ৯
খেলাফতে রব্বানী পার্টি – ১
স্বতন্ত্র – ১২
মােট – ২২৮
সাধারণ আসন
পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস – ১৫
মাইনরিটি ইউনাইটেড ফ্রন্ট – ১০
স্বতন্ত্র – ৫
মােট – ৩০
সিডিউল কাস্ট
সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন – ১৮
পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস – ১০
মাইনরিটি ইউনাইটেড ফ্রন্ট – ২
স্বতন্ত্র – ৬
মােট – ৩৬
খ্রিস্টান – ১
পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস – ১
মুসলিম মহিলা যুক্তফ্রন্ট – ৯
পৃষ্ঠাঃ ১৬৫
সাধারণ মহিলা আসন
কংগ্রেস – ১
সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন – ২
২৩৭টি আসনের মধ্যে ২২৮টি আসনে যুক্তফ্রন্ট জয় লাভ করে। ৯ টি আসন মুসলিম লীগ পায়।
যুক্তফ্রন্টের ২২৮ আসনের মধ্যে :
আওয়ামী লীগ – ১৪৩
কৃষক শ্রমিক পার্টি – ৪৮
নেজামে ইসলাম – ২২
গণতন্ত্রী দল – ১৩
খেলাফতে রব্বানী – ২
খেলাফতে রব্বানী পার্টির সভাপতি প্রখ্যাত বাগ্মী রাজনীতিদি আবুল হাশিমকে কৌশলে পরাজিত করা হয়। যুক্তফ্রন্টের নেতারা তার বিজয়ের ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না। এক কালের তুখােড় রাজনীতিবিদের জীবনের সমাপ্তি ঘটলাে।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে আইনসভার সদস্য
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রচারে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আতাউর রহমান খান তাজউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী এলাকা-কাপাসিয়া গমন করেন। মওলানা ভাসানী কাপাসিয়া সফরে যাওয়ার বর্ণনা তাজউদ্দীনের কন্যাকে খুব মজা করে বলেন, “১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী তাজউদ্দীনের এলাকা কাপাসিয়ায় তিনি মস্ত হাতির পিঠে চড়ে গিয়েছিলেন। সেই হাতিটা ছিল তাজউদ্দীনের ছােট বােনের শ্বশুরবাড়ির। হাতির পিঠে চড়ে গহীন গজারি বনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তার মনে হয়েছিল কি জানি বাবা আবার বাঘের হাতে পড়েন কিনা।”১
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫৪ সালের ৯-১০ মার্চ নির্বাচনে বিপুল ভােটে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুল মান্নানকে পরাজিত করে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
তাজউদ্দীন আহমদের প্রাপ্ত ভােট
নির্বাচনী এলাকা প্রদত্ত ভােট দল প্রাপ্ত ভােট দলীয় প্রার্থী
ঢাকা সদর ২৫০১১ যুক্তফ্রন্ট ১৯০৩৯ তাজউদ্দীন আহমদ
উত্তর-পূর্ব মুসলিম লীগ ৫৯৭২ ফকির আবদুল মান্নান
পৃষ্ঠাঃ ১৬৬
১৯৫৪ সালের ১৮ মার্চ তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচনী এলাকার ভােট গণনা করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯০৩৯ ভােট পেয়ে নির্বাচিত হন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা এবং যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী। তার বিরুদ্ধে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সম্পাদক এডভােকেট ফকির আবদুল মান্নান। তিনি মাত্র ৫৯৭২ ভোট পেয়েছিলেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাজউদ্দীন পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার এমএলএ নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগের সেক্রেটারি তার নিকয় ধবাশায়ী হলেন। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন পরাজিত হলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজের নিকট। শেখ মুজিবুর রহমান ৩৭ বছর বয়সে মুসলিম লীগের ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়াকে পরাজিত করে গোপালগঞ্জ থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন।
১৮ মার্চ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হলে তাজউদ্দীন আহমদকে শোভাযাত্রা করে যুক্তফ্রন্ট অফিস হতে নবাবপুর আওয়ামী লীগ অফিস, এফএইচ হল ও সলিমুল্লাহ হল পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে। বিজয়ের দিনেও তাজউদ্দীন আহমদ আইনের ক্লাস করেছেন।
১৯৫৪ সালের ২৯ মার্চ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নবনির্বাচিত এমএলএদের সম্মানে ঢাকার আলুরবাজারে লিবার্টি ক্লাবে ভােজ দেন।
১৯৫৪ সালের ১ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানীকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। ড. নূরুল হুদা সভায় সভাপতিত্ব করেন।
১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল সরকারীভাবে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীর একজন ব্যতীত সকলে যুক্তফ্রন্টে যােগ দেয়। স্বতন্ত্র প্রার্থী চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগে যােগদান করেন। ১০ জনের কমে আইনসভায় বিরােধী দল গঠন করা যায় না। মুসলিম লীগ আইনসভায় ১০ জনের কমে বিরােধী দল গঠন করতে সমর্থ হয়। যুক্তফ্রন্টের শক্তি ছিল ২৯৯ জন সদস্য।
এ কে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা
১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ অফিসে ১২০ জন এমএলএ সভা হয় এবং সােহরাওয়ার্দী ভাষণ দেন। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে পার্লামেন্টারি দলের সভা হয়। সভায় এ কে ফজলুল হক সর্বসম্মতিক্রমে প্রাদেশিক আইনসভার নেতা নির্বাচিত হন। এ সময় সিদ্ধান্ত হয় যে, এ কে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার নেতা হবেন এবং কেন্দ্রে নেতৃত্ব করবেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। সন্ধ্যায় ফজলুল হকের বাসভবনে নৈশ
পৃষ্ঠাঃ ১৬৭
ভােজ দেয়া হয়। ৪ এপ্রিল পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় । পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামান এ কে ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহবান জানান। সােহরাওয়ার্দীর সাথে মতদ্বৈততার কারণে ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল চার সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তরুণ মন্ত্রী নিয়ে এ কে ফজলুল হক ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মধ্যে মতদ্বৈততা দেখা দেয়। এ কে ফজলুল হক তার ভাগিনা সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়াকে মন্ত্রী নিয়োগের প্রস্তাব করলে হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদরি নাম প্রস্তাব করে। এ কে ফজলুল হক সােহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবে রাজী হলেন না। তিনি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ১৯৬৪ সালের ৩ এপ্রিল ৩ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তারা হলেন
এ কে ফজলুল হক – মুখ্যমন্ত্রী
আবু হােসেন সরকার
মৌলভী আফসার উদ্দিন চৌধুরী
সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া।
অবশেষে শেরে বাংলা, সােহরাওয়ার্দী, ভাসানী মতৈক্যে পৌছে যুক্তফ্রন্টের সদস্য নিয়ে ১৫ মে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
মন্ত্রিসভার সদস্যগণ :
এ কে ফজলুল হক – মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন
আবু হােসেন সরকার – অর্থ
আতাউর রহমান কান – বেসামরিক সরবরাহ
আবুল মনসুর আহমেদ – জনস্বাস্থ্য
কফিল উদ্দিন চৌধুরী – বিচার ও আইন
সৈয়দ আজিজুল হক – শিক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন
আব্দুস সালাম খান – শিল্প ও শ্রম
শেখ মুজিবুর রহমান – কৃষিঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন
আব্দুল লতিফ বিশ্বাস – রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার
আশরাফ আলী চৌধুরী – সড়ক ও গৃহ নির্মাণ
হাশিম উদ্দিন আহমেদ – স্বাস্থ্য ও কারা
ইউসুফ আলী চৌধুরী – কৃষি, বন ও পাট
মােয়াজ্জেম উদ্দিন হােসেন – জমিদারী অধিগ্রহণ
মুসলিম লীগ সরকার ও অবাঙালীরা যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা যুক্তফ্রন্টকে হেয় করার জন্য চন্দ্রঘােনা পেপার মিল ও নারায়ণগঞ্জ আদমজী জুট মিলে বাঙালী-অবাঙালী দাঙ্গা বাধায়। ১৫ মে আদমজী জুট মিলে
পৃষ্ঠাঃ ১৬৮
দাঙ্গায় ১৫শ’ নিরপরাধ শ্রমিক নিহত হয়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ২১ দফা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
২৩ এপ্রিল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, আবু হােসেন সরকার সৈয়দ আজিজুল হক, আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, মােহন মিয়া, তফাজ্জল হোসেন করাচী গমন করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তারা পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। কেন্দ্রের মুসলিম লীগ সরকার শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিক।
নউইয়র্ক টাইম পত্রিকার সংবাদদাতা কালাহান এক নিবন্ধে লিখেন ; ফজলুল হক বলেছেন, পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা হবে তার প্রথম কাজ। কেন্দ্রীয় সরকার ফজলুল হককে বিচ্ছিন্নতাবাদী, দেশদ্রোহী বলে ১৯৫৪ সালের ৩১ মে গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয় এবং ৯২(ক) ধারা জারি করে পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন প্রবর্তন করেন। গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামানের স্থলে কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করে। চিফ সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইসহাকের পরিবর্তে এনএম খানকে পূর্ব বাংলার চিফ সেক্রেটারি নিয়ােগ করা হয়। ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর হয়ে যুক্তফ্রন্টের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। প্রায় ৩ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩০ জন এমএলএকে গ্রেফতার করা হয়। মওলানা ভাসানী এ সময় ইউরােপ সফরে ছিলেন। ইস্কান্দার মির্জা ঘােষণা করলেন- ভাসানী দেশে আসলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে।
৫ জুন তাজউদ্দীন আহমদ ও ইয়ার মােহাম্মদ খান মিন্টো রােড থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে যান। জেলগেট থেকে পুলিশ ইয়ার মােহাম্মদ খানকে গ্রেফতার করে। তাজউদ্দীন কৌশলে জেলগেট ত্যাগ করেন।
জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যােগদানের জন্য মওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালের ২৫ মে করাচী ত্যাগ করেন। তার সফরসঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, জমিরউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ এবং সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ। মওলানা ভাসানী স্টকহােমে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যােগ দেন।
যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অধিক পরিশ্রমের ফলে শরীর ভেঙ্গে পড়া হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৫৪ সালের ৭ জুন ইউরােপের জুরিখ গমন করেন। জাতীয়
পৃষ্ঠাঃ ১৬৯
দু’নেতা ইউরােপে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রায়গৃহবন্দ। এ অবস্থায় বাঙালী নেতাশূন্য হয়ে পড়ে । একযােগে চলছে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জার স্বৈরশাসন ও নির্যাতন।
১৯৫৪ সালে গণপরিষদের সম্মতি না নিয়ে গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আলী, জেনারেল আইয়ুব খান আমেরিকার সাথে সামরিক চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৯৫৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় South-East Asia Treaty Organisation ( SEATO)- সিয়াটো গঠন করা হয়। সিয়াটোর সদস্য ছিল আমেরিকা, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, বৃটেন, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও পাকিস্তান।
তাজউদ্দীন আহমদ ও অলি আহাদের নিকট মওলানা ভাসানীর পত্র
প্রিয় অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্য সাহেবান,
অদ্য আমি ময়মনসিংহ হইতে নালিতাবাড়ী মিটিংয়ে খােদা করেন রওনা হইব। তথা হইতে আগামীকল্য ফিরিব। পরশু জ্বর উঠিয়াছিল গতকল্য জ্বর আসে নাই। আল্লা ভরসা তােমরা আগামী ওয়ার্কিং কমিটিতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টিকে নির্দেশ দিবে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সুপারিশ করতঃ প্রস্তাব আনয়ন করে বিশেষ জরুরী কাজ জানিবে। অপজিশন হইতে প্রস্তাব আসিবে আমাদের পক্ষ হইতে প্রস্তাবের নােটিস না দিলে বা আনয়ন না করিলে জনসাধারণের নিকট মুখ দেখানাে যাইবে না। অপজিশনের প্রস্তাবে বাধ্য হইয়া ভােট দিতে হইবে, বিশেষ জরুরী কাজ মনে করিতে প্রত্যেক মেম্বারকে আমার পক্ষ হইতে অনুরােধ করিবে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে নাজিমউদ্দিন সাহেব প্রস্তাব আনিয়া পূর্ব-পাক এসেম্বলিতে পাস করাইয়াছিল। নুরুল আমিন মন্ত্রিসভা পূর্বপাকের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করিয়া প্রস্তাব পাস করাইয়াছিলেন। এই সময় এবং আগামী নির্বাচনের পূর্বে জরুরী প্রস্তাব পাস না করাইলে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেহায়েত ভুল হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের লিডারের নিকটও অনুরােধ জানাইবে, উভয় পাকিস্তানের সংহতি কায়েম করিবার জন্য পাটি মিটিংয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করিতে। কাগমারী মাওলানা মােহাম্মদ আলী কলেজ খােলার পারমিশন চাহিয়া সত্তর দরখাস্ত ইউনিভার্সিটি বরাবর দিবে এবং অল্প দিনের মধ্যে যাহাতে অনুমতি পাওয়া যায় তাহার ব্যবস্থা অবশ্যই করিবে। কলেজের জন্য বিভিন্ন সাবজেক্টে পড়াইতে উপযুক্ত ও
পৃষ্ঠাঃ ১৭০
আদর্শবাদী ৬ জন প্রফেসর সংগ্রহ করিতে তােমরা সকলে চেষ্টা করিবে। ভুলিয়া যাইও না। আমার দোয়া ও সালাম জানিও। আমার শরীর খুব দুর্বল। তাই মিটিংয়ে উপস্থিত হইতে পারিব না। ২
আবদুল হামিদ খান
অলি আহাদ, তাজউদ্দীন
৫৬ নং সিম্পসন রােড, আওয়ামী লীগ অফিস
কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে পদচ্যুত করে পর্ব পাকিস্তানে গবর্নর শাসন প্রবর্তন করে এবং মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে গবর্নর নিয়ােগ করে। তখন আত্মগােপনে থাকাকালে তাজউদ্দীন আহমদ ছদ্মনামে অলি আহাদের নিকট পত্র লেখেন:৩
My Dear Rahmat,
Received yours this morning. I am really very sorry and plead guilty for not replying to your earlier note. But you may rest assured that we take interest in your thought, we have not been able as yet to do anything tangible for you. At my request Mr. A R Khan talked to the chief seceretary about your case and at his won accord. Mr. Khan very often goes to the chief seceretary and speaks for the political prisoners in general and the Awami Leaguers in particular. He takes much intetest in you and Mr. Toha. I was shown a letter of yours by Mr. Kamaruddin , and your suggetion regarding the attitude of Awami League in respect of Nezam-e-Islam and Krishak Sramik parties has been brough to the notice of Mr. A. R. Khan who appreciated your view point in view of the grim realities. You might have noticed the latest composition of the Flood Relief Committee. We have done our best to see that undesirable elements do not get predominance, but at the same time the solidarity of the U.F. party must not be at a jeopardy, and at least from outside no rift in the U.F Party can be detected by interested quarters, both innocent well wishars and the zealous cavillers. Even your bad friends (I do’nt use ‘enemy’) feel the need of your presence in these days of great cataclysm.
পৃষ্ঠাঃ ১৭১
It transpires from the talk of Mr: A. R Khan and the authorities of the present East Bengal Gove will take a lenient view in respect of the Awami Leaguers. But they will tighten their grip over the people belonging to other organisstion, nameli, P.S.U.Y.L. and G Dal whom they take wrongly to be the fellow. travellers of the communists. To your surprise you will learn that the Govt. think that P.SU is the recruiting organ, the Y. L. is the elementary training phase and the G. Dal is the parliamentary front of the Communist Party. This is the analysis of the Home Depertment.
Mr. Toha Awami leaguer, but belongs to Y. L. also. Yar Mohd. Khan also falls into the same category. Therefore it is our common view that you should wait for sometime more till the eminent govt. officials are convinced that there are more things in the heaven and earth than are reported by their over zealous promotion hunting worthless I. B. repotters. We hope better sense will soon dawn on the Govt. I realize your difficulvbut we are destined or we rather chose, to travel through the thorny path. No sufferings of patriots have ever gone in vain, and undaunted spirit and unadulterated patriotism always guide the lovers of humanity as a beacon light towards the cherished goal. No amout of afflictions can deter them from the path of truth.
Moulana Sb. writes letters and like you always proposes to rush headlong into the open without caring for the consequences. But Mr. Suhrawardy puts his rein, and advises him not to come before Mr. Suhrawardy gets here in Pakistan, We discussed about you and are of opinion that you also should await Mr. Suhrawardy’s arrival. he had undergone a three operation a fortnight or so ago. He is recovering fast. I saw a letter to messrs A.R. Khan and Kamruddin each written by him recently. Please be at rest and wait a bit further you had always been a tower of strenght and we are quite confident that you will be able to bear up all sufferings and parivations
পৃষ্ঠাঃ ১৭২
mainfully and never give way to despair.
your sincerely
Sd/-
Tarique (Tajuddin)
p. s: No question of surrender at this stage can at all arise
Sd/-
Tarique (Tajuddin)
প্রিয় রহমত (অলি আহাদ)
সকালে তােমার পত্র পেলাম। আমি খুবই দুঃখিত। তােমার পূর্বের পত্রের উত্তর না দিতে পেরে আমি অপরাধ স্বীকার করছি। কিন্তু তুমি নিশ্চিত থাকতে পার যে, তোমার চিন্তাভাবনার সাথে আমরা সচেতন। আমরা তােমার ব্যাপারে বাস্তবে কিছু করতে পারিনি। আমার অনুরােধে মি. এ আর খান (আতাউর রহমান খান) তোমার মামলার বিষয়ে চীফ সেক্রেটারীর সাথে কথা বলেছেন। মি, খান নিজেই অনেকবার চীফ সেক্রেটারীর সাথে কথা বলেছেন। তিনি রাজবন্দী, বিশেষ করে আওয়ামী লীগারদের মুক্তি নিয়ে আলােচনা করেছেন। তিনি তােমার ও তােয়াহার ব্যপারে খুবই উদ্যোগী। কামরুদ্দিন সাব তােমার লেখা এককানি পত্র দেখিয়েছেন। নেজামে ইসলাম ও কৃষক শ্রমিক পার্টির সম্পাদক আওয়ামী লীগের মতামত সম্পর্কে তােমার সুপারিশ এ আর খানকে অবহিত করা হয়েছে। বাস্তবতার নিরীক্ষে তিনি তােমার মতামতের প্রশংসা করেছেন। তুমি হয়ত বন্যা ত্রাণ কমিটির গঠন দেখেছ। আমরা চেষ্টা করছি যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিরা প্রাধান্য না পায়। একই সাথে যুক্তফ্রন্ট যাতে ধ্বংস না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তফ্রন্টে যে বিভেদ আছে তা যেন স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের নির্দোষ শুভাকাক্ষীবৃন্দের অথবা ঈর্ষাপরায়ণ শত্রুরা জানতে না পারে। এমনকি তােমার খারাপ বন্ধুরা (শক্র ব্যবহার করলাম না) আজকের দুর্যোগময় মুহূর্তে তােমার উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। ।
পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও এ আর খানের আলােচনা থেকে মনে হয় সরকার আওয়ামী লীগারদের ব্যাপারে সদয় হবে। কিন্তু অন্য দলগুলাে PSYL এবং জি দলের ব্যাপারে সরকার কঠোর হবে। সত্য হােক আর মিথ্যা হােক সরকার তাদের কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী বলে মনে করে।
তুমি জেনে নিশ্চিত হবে যে, সরকার মনে করে পিএসইউ (ছাত্র ইউনিয়ন) হলাে তাদের রিক্রুিটিং সংগঠন। ওয়াইএল যুবলীগ হলাে প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ পর্ব এবং ডিএল গণতন্ত্র হলাে কমিউনিস্ট পার্টির সংসদীয় শাখা- এ হলাে স্বরাষ্ট্র
পৃষ্ঠাঃ ১৭৩
মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণ ।
তােহা আওয়ামী লীগ কিন্তু যুবলীগের সদস্য। ইয়ার মোহাম্মদ খান একই দলের। সুতরাং আমাদের সকলের মত হলাে, তােমাকে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে যে পর্যন্ত না সরকারের বিশেষ কর্মকর্তা উপলব্ধি করতে পারেন যে, তাদের অপদার্থ পদোন্নতি লােভ আইবির প্রতিবেদনকারীরা যে তথ্য দেয় তারচেয়ে বেশি তথ্য পৃথিবী ও স্বর্গে আছে। আমরা আশা করি যে, সরকারের বােধদোয় হবে। আমি তােমার অসুবিধা বুঝতে পারছি। কিন্তু ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত আমরা আমাদের কণ্টকাকীর্ণ পথে চলতে হচ্ছে। দেশ প্রেমিকদের দুঃখ কষ্ট বৃথা যায় না। তাদের দুঃসাহসী প্রেরণা এবং অকৃত্রিম দেশপ্রেম মানব প্রেমিকদের পথ প্রদর্শন করে যেমন তেমন সঠিক গন্তব্যে পৌঁছার জন্য দিকনির্দেশ করে। সত্যের পথ থেকে কোন নির্যাতন তাদের বাধা দিতে পারে না।
মৌলানা সাব তােমার মতাে ফলাফল চিন্তা না করে প্রকাশ্যে চলতে চায়৷ কিন্তু সােহরাওয়াদী নিষেধ করেন। তিনি পাকিস্তানে ফিরে না আসা পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসবে না। আমরা তােমার বিষয় আলােচনা করছি এবং সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, সােহরাওয়ার্দী না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এক পক্ষকাল পূর্বে তার অপারেশন হয়েছে। তিনি দ্রুত আরােগ্য লাভ করছেন। সম্প্রতি তিনি এ আর খান ও কামরুদ্দিনের নিকট পত্র লিখেছেন। অনুগ্রহ করে বিশ্রাম নেও এবং অপেক্ষা কর। তুমি সব সময় অত্যন্ত সাহসী ছিলা। আমরা পূর্ণ বিশ্বাসী যে তুমি সকল কষ্ট সহ্য করতে পারবে এবং হতাশার নিকট আত্মসমর্পণ করবে না।
তােমার বিশ্বস্ত
তারেক (তাজউদ্দীন)
পুনশ্চ : এ মুহূর্তে আত্মসমর্পণের প্রশ্ন ওঠে না।
১৯৫৪ সালের ২০-২২ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১০ ধারা বিলুপ্ত করে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাস করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আলী। গণপরিষদের অনুমােদনের জন্য বিল উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আলী যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। জরুরি বার্তা পেয়ে গভর্নর জেনারেল দিশে ফিরে আসেন। ২৩ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল গণপরিষদ ভেঙ্গে দেন। ২৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীকে গভর্নর জেনারেল করাচী নিয়ে আসেন। তাকে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেন। তিনি মিনিস্ট্রি অব ট্যালেন্ট (Ministry of Talent) গঠন করেন।
মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন :
পৃষ্ঠাঃ ১৭৪
মুহাম্মদ আলী, প্রধানমন্ত্রী
জেনারেল আইয়ুব খান
মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা
ডাঃ খান সাহেব
এস এইচ ইস্পাহানী
মুহাম্মদ শােয়েব
চৌধুরী মুহাম্মদ আলী
মীর গােলাম আলী তালপুর
এ মন্ত্রিসভাকে জিনিয়াস বা রত্ন মন্ত্রীসভা বলা হতো। পরে এ মন্ত্রীসভায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী যােগ দেন।
গােলাম মুহাম্মদ কর্তৃক বেআইনীভাবে গণপরিষদ বাতিলের বিরুদ্ধে স্পিকার তমিজউদ্দিন খান সিন্ধু হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। গােলাম মুহাম্মদ পাকিস্তানের যড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৯২(ক) ধারা তুলে নেন। তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আলােচনার জন্য তিনি ১৯৫৪ সালের ১৪ নবেম্বর ঢাকা আগমন করেন। তাকে এ কে ফজলুল হক ও আতাউর রহমান উভয়ে মাল্যদানের প্রতিযােগিতা করেন। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গনের সূচনা হলাে।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৫৪ সালের ৮ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে করাচী পৌছেন। গভর্নর জেনারেল গােলাম মুহাম্মদের সাথে আলোচনা হলাে। তিনি সােহরাওয়ার্দীকে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অনুরােধ জানান। ১৮ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। গােলাম মুহাম্মদ সােহরাওয়ার্দীকে জিজ্ঞেস না করে আবু হােসেন সরকারকে কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। ফজলুল হক ও সােহরাওয়ার্দী গােলাম মুহাম্মদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। আতাউর রহমান ও এ কে ফজলুল হক উভয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দাবি করে ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পক্ষে-বিপক্ষে ভােট হলাে এ কে ফজলুল হক ১৯৯ ভােট এবং আতাউর রহমান পেলেন ১০৫ ভােট। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে গেল। আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসে।
সিন্ধু হাইকোর্টে ১৯৫৪ সালের ৭ নভেম্বর গভর্নর জেনারেলের গণপরিষদ বাতিলের আদেশ অবৈধ ঘােষণা করে। ১৯৫৫ সালের ২১ মার্চ ফেডারেল কোর্ট সিন্ধু হাইকোর্টের রায়কে নাকচ করে গভর্নর জেনারেলের আদেশকে বৈধ ঘােষণা করে। তবে ফেডারের কোর্ট অবিলম্বে একটি সংবিধান প্রণয়ন সংস্থা গঠনেরআদেশ দেন। ১৯৫৫ জালের ১৫ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল সংবিধান কনভেনশন
পৃষ্ঠাঃ ১৭৫
আদেশ জারি করেন। সােহরাওয়ার্দী কনভেনশন মেনে নেয়। এ কে ফজলুল হক ও তার দল কনভেনশনের ঘাের বিরােধিতা করে। ১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০ এপ্রিল গভর্নর হাউসে আওয়ামী লীগের সভা বসে। কনভেনশন গ্রহণের জন্য মওলানা ভাসানী সম্মতির প্রয়োজ। ভাসানী ১৯৫৪ সালের ৫ জানুয়ারি লন্ডন থেকে এসে কলকাতা টাওয়ার হোটেলে অবস্থান করেছিলেন । সােহরাওয়ার্দী ২৫ এপ্রিল কলকাতা থেকে ভাসানীকে নিয়ে আসেন ১৬ এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভায় সােহরাওয়ার্দী ২১ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করলে ভাসানী কনভেনশন মেনে নেন৷ ২৬ এপ্রিল সােহরাওয়ার্দী, ভাসানীসহ ৫০টি মুসলিম আসন মনােনয়নপত্র দাখিল করেন৷ কিন্তু ফেডারেল কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে কনভেনশন বাতিল হয়ে যায়।
১৯৫৫ সালের ৩ এপ্রিল ফেডারেল কোর্ট রায় দেন যে, অধ্যাদেশ বলে সংবিধান জারি করা যাবে না। গণপরিষদ একমাত্র সংবিধান রচনা করতে পারে।
১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল এক আদেশ বলে সংবিধান কনভেনশন গঠন করেন এবং ১০ মে কনভেনশন বসার ঘােষণা করেন। ১৯৫৫ সালের ১০ মে প্যাটেলের মামলায় রায় দান করে এবং ফেডারেল কোর্ট গণপরিষদ গঠনের নির্দেশ দেয়। তদনুসারে গভর্নর জেনারেল ১৯৫৫ সালের ২০ মে ৮০ সদস্যবিশিষ্ট গণপরিষদ গঠনের আদেশ জারি করে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৩১ মুসলিম এবং ৯ জন হিন্দু সদস্য হবেন।
এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে কেএসপি, নেজামে ইসলাম, গণতন্ত্রী দল ও সালাম খানের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি উপদল যুক্তফ্রন্টে থেকে যায়। ফলে আওয়ামী লীগের সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ১০৪ জনে।
১৯৫৫ সালের ৩১ মে পশ্চিম পাকিস্তানের মারি শহরে সংখ্যা সাম্যের ভিত্তিতে গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভােটার ছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ। নির্বাচনের ফল নিমরূপ ছিল :
কেএসপি- ১০
নেজামে ইসলাম- ২
আওয়ামী মুসলিম লীগ- ২
গণতন্ত্রী দল- ২
যুক্তফ্রন্ট- ১৬
আওয়ামী লীগ- ১৩
মুসলিম লীগ – ১
স্বতন্ত্র- ১
পৃষ্ঠাঃ ১৭৬
জাতীয় কংগ্রেস -৪
তফসিলী ফেডারেশন -৩
ইউনাইটেড প্রােগ্রেসিফ পাটি -২
মোট – ৫০ জন
আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ :
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী
আতাউর রহমান খান
শেখ মুজিবুর রহমান
আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ
আবুল মনসুর আহমেদ
জহির উদ্দিন
নূরুর রহমান
দেলদার আহমেদ
আব্দুর রহমান খান
মােজাফফর আহমেদ
মােসলেম আলী মিয়া
আবদুল খালেক
সর্দার ফজলুল করিম
আওয়ামী মুসলিম লীগ : সৈয়দ মেসবাহ উদ্দিন, আদেল উদ্দিন
গণতন্ত্রী পার্টি : মাহমুদ আলী, আবদুল করিম।
কেএসপি: এ কে ফজলুল হক, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, আবদুল লতিফ বিশ্বাস, নূরুল হক চৌধুরী, আবদুল ওহাব খান, লুৎফর রহমান খান, আবদুল আলিম, আবদুস সাত্তার, মাহফুজুল হক।
১৯৫৫ সালের ৩ জুন ৯২(ক) ধারা তুলে নিলে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা কার্যকর হয়। এ কে ফজলুল হক পদত্যাগ করেন। অস্থায়ী গভর্নর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আবু হােসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেন। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হােসেন সরকার ৬ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রীরা হলেন: আবু হােসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক, আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, আবদুস সালাম খান, শামসুদ্দিন আহমদ।
পৃষ্ঠাঃ ১৭৭
মারি চুক্তি
১৯৫৫ সালের ৭-১৪ জুলাই মারিতে গণপরিষদের বৈঠকে হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ৫ দফার মারি চুক্তি সম্পাদিত হয়।
১, পশ্চিম পাকিস্তান এক ইউনিট
২. পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
৩. দুই অঞ্চলের মধ্যে সকল ব্যাপারে সংখ্যাসাম্য
৪, বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা
৫. যুক্ত নির্বাচন
গভর্নর জেনারেল গােলাম মুহাম্মদ অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯৫৫ সালের ১৬ আগস্ট ইস্কান্দার মির্জা অস্থায়ী গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট প্রাদেশিক পরিষদের সভায় কেএসপির আবদুল হাকিম স্পিকারের এবং শাহেদ আলী ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন। কেন্দ্রে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু ইস্কান্দার মির্জার লষড়যন্ত্রের ফলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন না।
১৯৫৫ সালের ১০ আগস্ট চৌধুরী মুহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্ট নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
মন্ত্রিসভার সদস্যগণ :
চৌধুরী মুহাম্মদ আলী -প্রধানমন্ত্রী
এ কে ফজলুল হক – স্বরাষ্ট্র
এইচআই রহমতুল্লাহ – বাণিজ্য, শিল্প
ড. আবিদ হােসেন – কাশ্মীর
কামিনী কুমার দত্ত – স্বাস্থ্য
পীর আলী মুহাম্মদ রশীদ – তথ্য ও বেতার
আবদুল লতিফ বিশ্বাস – খাদ্য ও কৃষি
সৈয়দ আমজাদ আলী -অর্থ
এস আর কায়ানী – যােগাযােগ
আবদুস সাত্তার – শিক্ষা
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বিরােধী দলের নেতা হলেন। ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট গণপরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচিত হলেন আবদুল ওহাব খান ও মি. গিবন। স্পিকার আবদুল ওহাব খানের জন্ম বরিশালে। তিনি বরিশাল বারে আইন ব্যবসা করতেন।
পৃষ্ঠাঃ ১৭৮
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে তাজউদ্দীন আহমদ
১৯৫৫ সালের ২১,২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকায় আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের নাম পরিবর্তন হয়ে আওয়ামী লীগ করা হয়। মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলকে সাম্প্রদায়িক মুক্ত করে ধর্মনিরপেক্ষ দল করা হয়। আওয়ামী লীগকে সাম্প্রদায়িক মুক্ত করতে তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্র-যুব সমাজকে নিয়ে জোর প্রচেষ্টা চালান। তিনি ছাত্র জীবন থেকে সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী ছিলেন। তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেন। ঢাকা জেলা কমিটি থেকে ১৯৫৫ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এ সময় তার। বয়স মাত্র ৩৯ বছর। তার রাজনৈতিক জীবন জেলা থেকে প্রদেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। তার কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হলাে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের পথ উন্মুক্ত হলাে। তার মেধা, সততা ও কর্মসাধনা যৌবনের প্রথম পর্বে বিকশিত হলাে।
বিগত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন ও ওয়ার্কিং কমিটির সভাগুলােতে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন মধ্যমণি। সভার কার্যবিবরণী ও রিপাের্ট লেখায় তিনি ছাত্রজীবন হতে দক্ষ ছিলেন। তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণসম্পাদক ছিলেন। তার কর্মক্ষমতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাকে সােহরাওয়ার্দী ও ভাসানী খুব স্নেহ করতেন। তারা তাজউদ্দীনের মেধা ও ধীশক্তি দেখে মােহিত হন। তাই তাকে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের মনােনয়ন ও ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০ মে দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমদ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।
আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক দলে উন্নীত
১৯৫৫ সালের ২৩ অক্টোবর কাউন্সিল অধিবেশনে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলকে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দলে রূপান্তরিত করা হয়। দলকে গণতান্ত্রয়নে তাজউদ্দীন আহমদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি এমএলএ ছিলেন।
১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর সদরঘাটে অবস্থিত রূপমহল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন
পৃষ্ঠাঃ) ১৭৯
মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলের নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।
১৯৫৫-৫৬ সালে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ কমিটি:
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী- সভাপতি
আতাউর রহমান খান -সহসভাপতি
আবুল মনসুর আহমদ- সহসভাপতি
খয়রাত হােসেন – সহসভাপতি
শেখ মুজিবুর রহমান – সাধারণ সম্পাদক
অলি আহাদ – যুগ্ম সম্পাদক
অধ্যাপক আবদুল হাই – প্রচার
আবদুস সামাদ – শ্রম
তাজউদ্দীন আহমদ – সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ
মিসেস সেলিনা বানু – মহিলা ।
মােহাম্মদ উল্লাহ – দপ্তর সম্পাদক
ইয়ার মুহাম্মদ খান – কোষাধ্যক্ষ
কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন- জহুর আহমেদ চৌধুরী, আবদুল আজিজ, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন, আবদুল জব্বার খদ্দর, আবদুল রাবী, রফিকউদ্দিন ভূইয়া, হাতেম আলী খান, আবদুল হামিদ চৌধুরী, সৈয়দ আকবর আলী, শেখ আবদুল আজিজ, মমিন উদ্দিন আহমদ, মশিউর রহমান, সাদ আহমদ, কাজী গােলাম মাহবুব, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমজাদ হােসেন, ডা. মজহার উদ্দিন, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, রমিজউদ্দিন আহমদ, আমিনুল হক চৌধুরী, আকবর হােসেন আখন্দ, দবিরউদ্দিন আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, পীর হাবিবুর রহমান, কামরুদ্দিন আহমদ।
১৯৫৫ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪ প্রদেশ নিয়ে এক ইউনিট বিল পাস হয় এবং ১৪ অক্টোবর পশ্চিম পাকিস্তানকে এফ ইউনিট ঘােষণা করা হয়। নবগঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হলেন মুশতাক আহমেদ গুলমানী এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন ডা. খান সাহেব।
পাকিস্তান গণপরিষদ ১৯৫৫ সালে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নে এ কে ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট করাচীতে অনুষ্ঠিত পার্লামেন্টের অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের
পৃষ্ঠাঃ ১৮০
নাম বাংলা রাখার প্রস্তাব করেন। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ খসড়া শাসনতন্ত্র পাস করে। শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন অন্তর্ভুক্ত না করায় আওয়ামী লীগ শাসনতন্ত্র পাসের বিরােধিতা করে। স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে মওলানা ভাসান, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ অনঢ় ছিলেন। কিন্তু হােসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুরােধে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র মেনে নেয়।
১৯৫৬ সালের ৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর দেন এবং ৯ মার্চ তিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ শাসনতন্ত্র কার্যকর হয়। ২৪ মার্চ এ কে ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি পূর্ব বাংলার প্রথম বাঙালী গভর্নর।
পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশ নিয়ে এক ইউনিট গঠন করা হলাে। নবাব গুরমানি পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর এবং ডা, খান মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
১৯৫৬ সালের সংবিধানের বিরােধিতা
১৯৫৫-৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের সংবিধানে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের অঙ্গিকার না থাকায় পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ সংবিধানের বিরােধিতা করে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ মিলিত হয়ে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। মওলানা ভাসানী ও অলি আহাদকে পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কমিটি ১৯৫৬ সালের ২৯ জানুয়ারি প্রতিরােধ দিবস পালন কর। ৮ হতে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সমগ্র দেশে সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সপ্তাহ পালিত হয়। করাচি থেকেশেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের ১৬ মার্চ দাবি দিবস পালনের জন্য ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অলি আহাদকে নির্দেশ দেন। ১৬ মার্চ বিকেলে সর্বদলীয় জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। মােহাজের নেতা মওলানা রাগিব হাসান সভা আহবান করেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতাদের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, তিনি ছিলেন বিভাগপূর্বকালে সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম দলের অন্যতম নেতা। চুক্তি হলাে ৪টার মধ্যে মােজাহের সভা শেষ হবে। সভা শেষ না করে মােহাজের সম্প্রদায় সর্বদলীয় মঞ্চ আক্রমণ করে সভা ভেঙ্গে দেয়। এমনি সময় শেখ মুজিবুর রহমান সভায় উপস্থিত হলাে। তিনি নিজে বাঁশ নিয়ে হাঙ্গামাকারীদের দমন করে মঞ্চ তৈরি করে সভার কাজ সমাপ্ত করেন। এ হলাে অসীম সাহসী শেখ মুজিব। যথারীতি সভা হলাে পূর্ব বাংলার জনগণ সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দাবি উপেক্ষা করে পাকিস্তান
পৃষ্ঠাঃ ১৮১
মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, কংগ্রেস, সেডুল কাস্ট/ফেডারেশন, গণতন্ত্রী দলের সমর্থনে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান পাস হয়ে যায়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ প্রতিবাদে গণপরিষদ হল থেকে ওয়াকআউট করে। আওয়ামী লীগ সদস্যগণ শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর করবেন না। সােহরাওয়াদী ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ। পরে তার অনুরােধে শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল সদস্য শাসনতন্ত্রে স্বাক্ষর করেন। কথ
ছিল হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রে মুসলিম লীগের চৌধুরী মহম্মদ আলী সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হলেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এদিন হতে সংবিধান কার্যকর হবে। ১৯৫৬ সালের ১৭ মার্চ ঢাকার ৪৫ সিম্পসন রােডে সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনতান্ত্রিক কর্মপরিষদের সভায় প্রজাতন্ত্র দিবসের কর্মসচীতে যােগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এ সিদ্ধান্তে বিচলতি হয়ে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহাদকে তাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠান ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করার নির্দেশ দেন। পরিশেষে সকল দল ২৩ মার্চ প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করে।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ
মে ১৯-২০, ১৯৫৬
১. বৈদেশিক
বৈদেশিক রাজনৈতিক সম্বন্ধ নির্ধারণ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উপর বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের লেজুড় হিসাবে না থেকে আমরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির অনুসারী এবং আমরা বিশ্বাস করি কেবলমাত্র এই নীতি পাকিস্তাকে পৃথিবীর বুকে সমৃদ্ধিশালী ও শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি পাকিস্তানের সুষ্ঠু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির পরিপন্থী। বিভিন্ন সামরিক চুক্তি বিশেষত বাগদাদ চুক্তিতে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান মুসলিম জাহানের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সহানুভূতি হারিয়েছে। অতএব, এই কাউন্সিল এই প্রকারের সকল সামরিক চুক্তির তীব্র নিন্দা ও বিরােধিতা করছে।
২. খাদ্য সঙ্কট ও বন্যা
পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণকে বাঁচাবার জন্য মওলানা ভাসানী নিজের জীবন বিপন্ন করে অনশন ধর্মঘট করেন এবং তার দাবি হােসেন শহীদ
পৃষ্ঠাঃ ১৮২
সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নেয়।
এই সভা মওলানা ভাসানী ও সােহরাওয়ার্দীকে অভিনন্দন জানায়।
জনগণ দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষার জন্য সরকারের নিকট দাবি করছে :
ক. পূর্ব পাকিস্তানকে দুর্ভিক্ষ এলাকা ঘোষণা করা হােক;
খ. বিমান, সমুদ্র ও স্থলপথে খাদ্য আনয়নের ব্যবস্থা করা হােক;
গ. পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হােক এবং গরিবদের মধ্যে বিনামূল্যে চাল বিতরণ করা হােক;
ঘ. বর্তমানে চাল ৪৫ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে- চালের মণ ১৫ টাকা ও ধানের দাম ৮ টাকায় ধার্য করা হােক;
ঙ. ভাসানীর অনশনের ফলে কেন্দ্রীয় সরকার ৫৫ কোটি টাকা প্রদান করেছে, তার দ্বারা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৩. ফরিদপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল আজিজ ও পুলিশ জেলার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছে, তার বিচার বিভাগীয়তদন্তের দাবি করা হয়।
৪. বর্তমানে এম আর চালু আছে। রেশনিং পদ্ধতি এবিসি ক্লাস ঠিক করাআছে এবং মাত্র এ ক্লাসকে খাদ্য দেয়া হয়। এ পদ্ধতিতে সকলে পায় না। তাই ইউনিয়ন ফুড কমিটির অধীনে গ্রাম ও মহল্লা ফুড কমিটি গঠন করে অগ্রাধিকার তালিকা করে খাদ্য সরবরাহ করা হােক।
৫. আওয়ামী লীগ প্রত্যেক জেলা, মহকুমা ও ইউনিয়নে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ কমিটি গঠন করবে।
৬. প্রতিবছর বন্যায় উত্তরবঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই যাতায়াতের ব্যবস্থার জন্য সান্তাহারে একটি বিমানঘাঁটি নির্মাণ করা হােক।
৭. বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়।
যুক্ত নির্বাচন দাবি
যুক্ত নির্বাচন সুপারিশ এবং ২১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রে প্রয়ােজনীয় সংশােধনের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপ দেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে সরকারী দলকে আবেদন করা হয়।
এক ইউনিট
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রদেশগুলাের সাধারণ যে এক ইউনিট গঠন করেছে তার তীব্র প্রতিবাদ করছে।
পৃষ্ঠাঃ ১৮৩
যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় তাহলে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে এক ইউনিট আইন পুনর্বিবেচনা করবে।
উপনির্বাচন
২১ দফায় বলা হয়েছে যে কোন নির্বাচনী এলাকায় সদস্যপদ শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। মন্ত্রিসভা এক বছরের অধিক গঠিত হয়েছে, কিন্তু সরকার ৭টি শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান করেনি। এই সভা উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করার দাবি করছে।
রাজবন্দী
সরকারের প্রতি অবিলম্বে রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি এবং গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হােক।
রাজশাহী জেলে হাঙ্গামা
“পূর্ববঙ্গের তৎকালীন কুখ্যাত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন সরকারের আমলে প্রদেশের বিভিন্ন জেলে শত শত নিরাপত্তা বন্দী আটক ছিলেন। এ সকল বন্দীদের নিমস্তরের সাধারণ কয়েদীর সমপর্যায়ভুক্ত করে রাখা হয়। বন্দীগণ রাজবন্দীর মর্যাদার দাবিতে এক শ’ দিন অনশন পালন করেন। ১৯৫০ সালে সংগ্রামরত অবস্থায় রাজশাহী জেলে একটি কক্ষে ৩০ জন বন্দীর ওপর হঠাৎ পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে ৭ জনকে হত্যা করে। দেশবাসী বিচার ও তদন্তের দাবিতে আন্দোলন চালায়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত হয়নি। এই সভা উক্ত গুলি চালানাের নিরপেক্ষ বেসরকারী তদন্তের দাবি করছে।”
সাংগঠনিক
পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে আওয়ামী লীগের সদস্যগণকে (গণপরিষদ ও জাতীয় পরিষদের) এই সভা আন্তরিক অভিনন্দন জানচ্ছে।
আওয়ামী লীগ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তির সমর্থন লাভের চেষ্টা করবে। মানকি শরিফের পীরের নেতৃত্বে গঠিত সীমান্ত আওয়ামী লীগকে সােহরাওয়ার্দী যে না-মঞ্জুর করে তা পুনর্বিবেচনা করার জন্য তাকে অনুরােধ করা হয়।
শ্রমিক
শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করতে হবে ও ইউনিয়নের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ১৮৪
মােহাজের
মোহাজের সমস্যা সমাধানের জন্য স্থায়ী সমাধান করতে হবে।
সমবায় বিভাগ
গ্রাম্য সমবায় ঋণদান সমিতিসমূহ লিকুউডেশনে দিয়ে ঋণসালিশী বাের্ডের নির্ধারিত কিস্তিবন্দীগুলি, সুদ মাফ অমান্য করে সকল বকেয়া এককালীন আদায় করা হচ্ছে এবং সার্টিফিকেট ও নিলামের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। পরপর দুর্ভিক্ষ আজন্মা ও বন্যার কারণে কৃষকদের আর্থিক দুর্গতি চরমে উঠেছে। এই সভা সমবায়ী খাতকগণের যাবতীয় ঋণ মওকুফ করার দাবি করছে।
২১ ফেব্রুয়ারি ছুটি
বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্থান লাভ করেছে। সরকার ২১ ফেরুয়ারিকে সরকারী ছুটি ঘােষণা করে শহীদদের আত্মার প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন করেছে। তাই এই কাউন্সিল সভা দাবি করছি যে, ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটিকে অবিলম্বে সরকারী ছুটির স্থলে সাধারণ ছুটি ঘােষণা করা হােক এবং শহীদ পরিবারের ক্ষতিপূরণ দেয়া হােক।
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা
পাকিস্তান সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পর্যালােচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হােক।
[পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ এবং প্রচার সম্পাদক আবদুল হাই কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা হতে সংকলিত]
পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সঙ্কট
১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। এমনি পরিস্থিতিতে ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০ মে ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আলােচনা হয়। সােহরাওয়াদী নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ১৯৫৩ সালের মার্কিন বিরােধী সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। খাদ্য সঙ্কট তীব্র হতে থাকে। ১৯৫৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ভুখা মিছিল বের হয়। পুলিশ মিছিলে গুলি বর্ষণ করে ৪ জনকে হত্যা করে। মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার সংকটের মুখােমুখি। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা।পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে ৩০ আগস্টের মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদ আহবানের নির্দেশ দেন।
পৃষ্ঠাঃ ১৮৫
প্রাদেশিক পরিষদে আবু হােসেন সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট গভর্নরের নিকট তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। গণতন্ত্রী দল, কংগ্রেস এবং তফসিলী সদস্যগণ যুক্তফ্রন্ট ত্যাগ করে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়ায় আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রিসভার পতন হয় ।
১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
আতাউর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে ২১ দফা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে মুসলিম লীগ সরকারের জননিরাপত্তা আইন বাতিল ঘােষণা করেন এবং নিরাপত্তা বন্দিদের মুক্তির আদেশ দেন। ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এসে ৫৯ জন রাজবন্দির মুক্তি দেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বন্দী মুক্তির নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।
খাদ্য সংকট মােকাবিলার জন্য গভনর এ কে ফজলুল হক সেনাবাহিনী তলব করেন। সকল জেলায় সেনাবাহিনী খাদ্য বণ্টন তদারকি শুরু করে। খাদ্য ক্রয়ের জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৬ সালের ৭ মে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। কেন্দ্রে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা বরাদ্দে বিলম্ব করে। ইতিমধ্যে ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানেরপ্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করে পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সমস্যাসমাধানে এগিয়ে আসেন। তখন খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন খুলনার আওয়ামী লীগ নেতা চিরকুমার দেলদার আহমদ এমএনএ। অর্থমন্ত্রী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈয়দ আমজাদ আলী। খাদ্যমন্ত্রী দেলদার আহমদ খাদ্যশস্য ক্রয়ের জন্য অর্থমন্ত্রীর নিকট ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এত টাকা বরাদ্দের জন্য বিলম্ব করছে। দেলদার আহমেদ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেন । মন্ত্রিপরিষদের সভা চলছে। প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী পূর্ব পাকিস্তানের জন্য খাদ্যশস্য ক্রয়ের বরাদ্দের উল্লেখ করে বলেন, Mr. Amjad Ali, Do you think that the people of East Pakistan will die of starvation and I shall remain Prime Minister of Pakistan-৪’ জনাব আমজাদ, আপনি কি মনে করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করবে আর আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকব?” এ ঘটনা সাবেক মন্ত্রী দেলদার আহমদ লেখককে বলেছেন। মন্ত্রী পরিষদের সভায় লজ্জিত হয়ে অর্থমন্ত্রী পূর্ব
পৃষ্ঠাঃ ১৮৬
পাকিস্তানকে খাদ্য ক্রয়ের জন্য অর্থ বরাদ্দের করেন। পূর্ব পাকিস্তান খাদ্য ক্রয়ের প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে যায়। এ সময় আতাউর রহমান খান পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী- আওয়ামী লীগ সরকার দক্ষতার সাথে অতি দ্রুত খাদ্যশস্য সমস্যার সমাধান করে।১৯৫৬ সালে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করে সােহরাওয়ার্দী খ্যাতি অর্জন করেন এবং দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।
১৯৫৬ সালে তাজউদ্দীন আহমদ আইনসভার এমএলএ। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক। তিনি দলের নীতি নির্ধারণ ও খাদ্যশস্য বণ্টনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ঢাকা জেলা ও কাপাসিয়ায় খাদ্যাভাব দূর করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন।
কেন্দ্রে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভার পতন
কেন্দ্রে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্র চলতে থাকে তিনি প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে সীমান্তের ডাক্তার খান সাহেবের দ্বারা রিপাবলিকান পার্টি গঠন করান। মুসলিম লীগের সদস্যগণ তাদের দল পরিত্যাগ করে রিপাবলিকান দলে যােগ দেন। এ পরিস্থিতিতে চৌধুরী মােহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ ত্যাগ করা ছাড়া উপায় ছিল না। তিনি ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন। তিনি আদর্শবাদী ছিলেন। মুসলিম লীগ নেতাদের বিতর্কিত চরিত্র থেকে নেজামে ইসলাম পার্টিতে যােগ দেন।
পর্ব পাকিস্তান আইন সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান ১৯৫৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভা গঠন করেন ।
মন্ত্রিসভার সদস্যগণ :
আতাউর রহমান খান – মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, পরিকল্পনা
আবুল মনসুর আহমদ – শিক্ষা
কফিল উদ্দিন চৌধুরী – যােগাযােগ, পূর্ত ও সেচ
শেখ মুজিবুর রহমান – বাণিজ্য, শিল্প, শ্রম ও দুর্নীতি
মাহমুদ আলী – রাজস্ব বিভাগ ও জেল
মশিউর রহমান – জনসংযােগ ও স্থানীয় সরকার
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত – স্বাস্থ্য
মনােরঞ্জন ধর – অর্থ ও সংখ্যালঘু
খয়রাত হােসেন – কৃষি ও পশু
আবদুর রহমান – সমবায়, ঋণ, কৃষি ও বাজার
পৃষ্ঠাঃ ১৮৭
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী – বিচার ও সংসদীয় বিভাগ
শরচ্চন্দ্র মজুমদার – আবগারী, মৎস্য ও লবণ
গৌরচন্দ্র বালা – বন বিভাগ
প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের ফলে মুসলিম লীগ বিভক্ত হয়ে পরে এবং রিপাবলিকান দল গঠিত হয়। ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ আলী চৌধুরী পদত্যাগ করেন।
বিরােধী দলের নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১০ জনের ৫ জন ছিলেন বাঙালী।
সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার সদস্যগণ :
১২-৯-১৯৫৬ থেকে ১৮-১০-১৯৫৭
হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী – প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা, দেশীয়
মালিক ফিরােজ খান নুন – পররাষ্ট্র
আবুল মনসুর আহমেদ- বাণিজ্য ও শিল্প
সৈয়দ আমজাদ আলী – অর্থ
এস এ খালেক – শ্রম ও পূর্ত
মীর গােলাম আলী তালুকদার – স্বরাষ্ট্র
সরদার আমীর আযম খান – আইন, তথ্য ও বেতার
মিয়া জাফর শাহ – যােগাযােগ
জহিরুদ্দিন – শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
প্রতিমন্ত্রী
রসরাজ মণ্ডল – অর্থ
হাজী মওলা বক্স সুমরাে – পুনর্বাসন
আবদুল আলিম – অর্থ
নুরুর রহমান – বাণিজ্য
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের পরিবর্তে যুক্ত নির্বাচন গৃহীত হয় এবং অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তার চেষ্টায় পাকিস্তানে সংখ্যা সাম্য নীতি গৃহীত হয়। ফলে সেনাবাহিনী, চাকরি, ব্যবসা, শিল্পে পূর্ব পাকিস্তান অর্ধেক ভাগ পেতে থাকে। তিনি ক্রগ মিশন নিয়ােগ করে ওয়াপদা প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। এ সময় পূর্ব পাকিস্তান উন্নয়নে এগিয়ে যায়। পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান পাঁচ ভাগের এক ভাগ পেত- সংখ্যা সাম্য প্রবর্তন করা হলে কেন্দ্রিয় চাকরি ও সেনাবাহিনীতে পূর্ব বাংলা অর্ধেক অংশ লাভ করে।
পৃষ্ঠাঃ ১৮৮
উপনির্বাচন ১৯৫৬-৫৭
১০ ডিসেম্বর ১৯৫৬
মুসলিম লীগ আমলে ১৯৪৭-৫৪ সালে ৩০টি শূন্য আসনে নির্বাচ অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় অন্তর্ভুক্ত ছিল ৯০ দিনের মধ্যে উপনির্বাচন দিতে হবে। ৭টি আসন শূন্য। সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী ৭ জনকে মনােনয়ন দেন। উপনির্বাচন পরিচালনার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ ও ইয়ার মুহাম্মদ খানকে নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দরি খাদ্য সমস্যা সমাধানে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এটি আসনের মধ্যে একমাত্র ভােলার আসনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। ৬টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয় লাভ করে। এমনকি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের শূন্য আসনে পিরােজপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়নাল আবেদীন জয়লাভ করে । ১৯৫৬ সালের ১০ ডিসেম্বর উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী উপনির্বাচন উপলক্ষে বরিশাল আগমন করেন। পিরােজপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। পিরােজপুর সরকারী সােহরাওয়ার্দী কলেজ নির্বাচনী অঙ্গীকারের ফল ।
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে ন্যাপ সৃষ্টি হয়। এ সময় উপনির্বাচনে ন্যাপের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের নিকট পরাজিত হয় ।
কাগমারী সম্মেলন ১৯৫৭
আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলেছিলেন।
কাগমারী সম্মেলনের পর পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সাথে মওলানা ভাসানীর দ্বিমত সৃষ্টি হয়। মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে ইস্তফা দেন। আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি থেকে ৯ জন সদস্য পদত্যাগ করেন। তারা হলেন ইয়ার মােহাম্মদ খান, আবদুল হাই, আবদুস সালাম, সেলিনা বানু, দবির উদ্দিন আহমেদ, হাবিবুর রহমান, হাতেম আলী খান, অধ্যাপক আহসাব উদ্দিন আহমদ ও আকবর হােসেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
পৃষ্ঠাঃ ১৮৯
১৯৫৭ সালের ৩১ মে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি পদত্যাগ করে দলের সাংগঠনিক কাজে আত্মত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ছিল মন্ত্রীরা একই সাথে দলের পদ ও মন্ত্রীর পদ দখল করতে পারবে না। দলের ধারণা ছিল শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করবেন না। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান সঠিক সিদ্ধান্ত নেন এবং মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান ও গুলিস্তান সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
শেখ মজিবুর রহমান ও অলি আহাদের মধ্যে সম্পর্কের ভাঙন
অলি আহাদ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এমনকি পারিবারিক ব্যাপারে অনেক সময় শেখ মুজিবুর রহমান অলি আহাদের ওপর নির্ভর করতেন। শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে অলি আহাদের পরামর্শ চাইতেন। ১৯৫৬ সাল হতে তাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর প্রধান কারণ হলাে অলি আহাদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করতে চান।
১৯৫৫ সালের আওয়ামী লীগের সংশােধিত গঠনতন্ত্রের ৬০ ধারায় উল্লেখ আছে যে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি, সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য বিভাগীয় সম্পাদক মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলে সংগঠনের পদ হতে পদত্যাগ করতে হবে। এ ধারা অনুসারে মন্ত্রী আতাউর রহমান খা, আবুল মনসুর আহমদ ও খয়রাত হােসেন ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে সহসভাপতির পদত্যাগ করেন। একই সময় শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন।
ওয়ার্কিং কমিটির সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি। সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুজিব তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তিনি মন্ত্রিত্ব হতে পদত্যাগ করে প্রমাণ করলেন মন্ত্রিত্বের চেয়ে দল বড়। সেদিন মন্ত্রিত্ব ছেড়ে তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। অলি আহাদ আশাহত হলেন এবং আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাপে যােগ দন। অলি আহাদ তার গ্রন্থে শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কঠোর সমালােচনা করেছেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বাড়ি নির্মাণ নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যার ঘটনাকে বিপ্লবী পরিবর্তন ও খুনীদের সূর্য সন্তান বলেছেন। বঙ্গবন্ধু মহান হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। অলি আহাদ তার গ্রন্থে সংকীর্ণতার পরিচয় দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক বিষয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। আওয়ামী লীগের এই শূন্যতা পূরণ করলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদ
পৃষ্ঠাঃ ১৯০
দলের সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে ছিলেন। শেখ মুজিব- তাজউদ্দীন জুট আন্দোলনের প্রত্যেকটি স্তর পেরিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নিকটাত্মীয় মমিনুল হক খোকা বলেন:
“একদিন মিঞাভাই শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন, ‘চলতাে আমার সাথে একটু নারায়নগঞ্জের দিকে।’ মিঞাভাইকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে হামিদুল হক চৌধুরীর ভাগিনা রহিম চৌধুরীর আয়রন রডের এক বিশাল কারখানার কাছে এসে পৌছাই। সেখানে দেখি এক ভদ্রলােক চেয়ারে বসে কি কাজ করছেন। তার কাছে গিয়ে শেখ মুজিব বললেন, ‘ হয়েছে, নে চল গাড়িতে উঠ। ভদ্রলােক বললেন, ‘আমি কাজ করছি তো। আর আপনি কি করে জানলেন আমি এখানেই?’ শেখ মুজিব বললেন, ‘আর কথা বলতে হবে না, চল আমি লিলির কাছ থেকে শুনেই এসেছি। তারপর ওই ভদ্রলােককে নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। এই ভদ্রলােক আর কেউ নন, স্বাধীনতা যুদ্ধে সেই নয় মাস যিনি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, নরপশুদের বুলেট যাকে পরে রেহাই দেয়নি, তিনি সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় চার জাতীয় নেতার অন্যতম তাজউদ্দীন আহমদ এবং লিলি হচ্ছেন তার তখনকার ভাবী স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। মিঞাভাই তাজউদ্দীনকে এসে অলি আহাদের স্থলাভিষিক্ত করেন। পরের ইতিহাস সবারই কম বেশি জানা। আজও একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না- শহীদ তাজউদ্দীনের যথার্থ মূল্যায়ন কি এই স্বাধীন দেশে কখনাে হবে না?”
১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং পরে তিনি ন্যাপে যােগ দেন। তাজউদ্দীন আহমদ অলি আহাদের শুন্যতা পূরণ করে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতকে শক্তিশালী করেন।
অলি আহাদের বিদায়- তাজউদ্দীন আহমদের উত্থান
অলি আহাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তার সহপাঠী ছিলেন আবদুল হাই, তাজউদ্দীন আহমদ, জিল্লুর রহমান প্রমুখ। অলি আহাদ ১৫ নম্বর মােগলটুলি মুসলিম লীগ কর্মী শিবির কার্যালয়ে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিমের সাথে পরিচিত হন। কর্মী শিবিরে নিবেদিত কর্মী শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী প্রমুখের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারপর অলি আহাদ মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন। তিনি আইএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকম-এ ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও কারাবন্দী হন। ১৯৫১ সালে তিনি
পৃষ্ঠাঃ ১৯১
যুবলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানী অলি আহাদের মেধা ও দক্ষতায় মুগ্ধ ছিলেন। তারা ১৯৫৩ সালের ২১ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়া গমন করেন এবং অলি আহাদকে আওয়ামী লীগে যােগ দেয়ার অনুরোধ জানান৷ অলি আহাদ যুবলীগ ত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যােগ দেন। ১৯৫৪ সালের ১ এপ্রিল তাকে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক এবং ১৯৫৫ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে অলি আহাদ দ্বিমত পােষণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ওয়ার্কিং কমিটি ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ তাকে বহিষ্কার করে। আলি আহাদ সামরিক চুক্তি বিরোধী ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি দাবি করেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী সামরিক চুক্তি সমর্থন করতেন।৫
আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন
কাগমারী সম্মেলনের পর আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। যুগ্ম সম্পাদক অলি আহাদ পররাষ্ট্র নীতি, স্বায়ত্তশাসন ও মন্ত্রীদের দুর্নীতি নিয়্র সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে মতদ্বৈততা সৃষ্টি হয়। অলি আহাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ বিবেচনার জন্য ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ আওয়ামী লীগের সদর দপ্তর ৫৬ সিম্পসন রােডে ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবুল মনসুর আহমেদ। সভায় অলি আহাদ পাক- মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং মন্ত্রীদের দুর্নীতির প্রশ্নে অটল থাকেন। সভায় সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদকে সম্পাদকের পদ হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। অলি আহাদের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন না করে তাকে বহিষ্কার করা হলাে। ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে সভায় ৩০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। ৩০ জনের মধ্যে ১৪ জন প্রস্তাবের পক্ষে এবং ৯ জন বিপক্ষে ভােট দেয়। ৯ জন প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করেন। তারা হলেন :
ইয়ার মােহাম্মদ খান এমএলএ – কোষাধ্যক্ষ
আবদুল হাই – প্রচার সম্পাদক
আবদুস সামাদ এমএলএ – শ্ৰম সম্পাদক
সেলিনা বানু এমএলএ – মহিলা সম্পাদিকা
দবির উদ্দিন আহমদ এমএলএ – সদস্য
হাবিবুর রহমান এমএলএ – সদস্য
পৃষ্ঠাঃ ১৯২
হাতেম আলী খান এমএলএ – সদস্য
অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ- সদস্য
আকবর হােসেন এমএলএ, বগুড়া – সদস্য
১৯৫৭ সালের ২১ মে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পদত্যাগী ওয়ার্কিং কমিটির ৯ সদস্যের পদত্যাগপত্র গৃহতি হয় । ৩ জুন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নিম্নের নেতাদের কো-অপ্ট করা হয়:
জসিম উদ্দিন আহমদ – সভাপতি, সিলেট আওয়ামী লীগ
আমজাদ হােসেন – ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পাবনা আওয়ামী লীগ
মজিবর রহমান – সভাপতি, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ
দেওয়ান মহিউদ্দিন আহমদ- বগুড়া
রওশন আলী – সম্পাদক, যশাের আওয়ামী লীগ
শামসুল হক – ঢাকা
আজিজ আহমদ – নােয়াখালী
মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ – পাবনা
একই সভায় নিম্নলিখিত কর্মকর্তা নিয়ােগ করা হয়:
আবদুল হামিদ চৌধুরী – সাংগঠনিক সম্পাদক
জহুর আহমদ চৌধুরী – শ্রম সম্পাদক
অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমান – প্রচার সম্পাদক
মিসেস মেহেরুন্নেসা খাতুন – মহিলা সম্পাদিকা
১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন
১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান (পিকচার প্যালেস) ও গুলিস্তান সিনেমা হলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে ভাষণ দেয়ার পরপর মওলানা ভাসানী সভা ত্যাগ করেন। সভায় সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি বিপুল ভােটে গৃহীত হয়। মওলানা ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের সমর্থনে ভােট পরেছে মাত্র কয়েকটি।
১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগের ভাঙন চূড়ান্ত হয়ে গেল । মূল দল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে থেকে যায়। আর একটি দল আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করে। প্রেসিডেন্ট
পৃষ্ঠাঃ ১৯৩
ইস্কান্দার মির্জা ষড়যন্ত্র করে শক্তিশালী আওয়ামী লীগকে দ্বিধাবিত করতে সফল হয়। ইতােমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে মুসলিম লীগ ভেঙ্গে রিপাবলিকান দল গঠিত হয়েছে। দলের ভাঙ্গনের মুখে তাজউদ্দীন আহমদ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়া সমুন্নত রাখেন।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন
পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৫৭ সালের ২৬ জুলাই পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপ গঠিত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ও ওসমানীকে সম্পাদক করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ গঠিত হলাে। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও মাহমুদ আলীকে সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ গঠন করা হয়। আবদুল গাফফার খানকে সভাপতি ও মাহমুদ আলী কাসুরীকে সম্পাদক করে পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপ গঠন করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ নেতাদের মধ্যে ছিলেন হাজী মুহাম্মদ দানেশ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, মহিউদ্দিন আহমদ, মাহমুদ আলী, মােহাম্মদ তােয়াহা অলি আহাদ, পীর হাবিবুর রহমান, ব্যারিস্টার শওকত আলী, দেওয়ান মাহবুব আলী, খন্দকার মুহাম্মদ ইলিয়াস, ইয়ার মুহাম্মদ খান, এসএ বারি এটি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, আতাউর রহমান, মশিউর রহমান, আবদুল মতিন, আবদুল হক প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ কেন ভাঙল- তকালীন আওয়ামী লীগ নেতা ও লেখক আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন- “ন্যাপ গঠনে প্রেসিডেন্ট মির্জার হাত ছিল। এতেআমার কোন সন্দেহ নেই…।” বামপন্থী নেতাকর্মী বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী দল, ও যুব লীগের নেতা কর্মীরা ন্যাপে যােগ দেন। যুবলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপের সহযােগী সংগঠন ছিল।৬
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পদত্যাগ
আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন ও রিপাবলিকান দলের ষড়যন্ত্রের কারণে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৫৭ সালের ১০ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। গণতন্ত্রের বিদায়- ষড়যন্ত্রের বিজয় হয়। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পদত্যাগের ফলে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা গণতন্ত্রকে হত্যা করে সামরিক শাসনের দ্বার খুলে দেয়।
পৃষ্ঠাঃ ১৯৪
১৯৫৭ সালের ১২ অক্টোবর মুসলিম লীগ ও কেএসপি আইআই চন্দ্রিগড়ের নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন করে। ১৯৫৭ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী আইআই চন্দ্রিগড় পদত্যাগ করেন।
১৯৫৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রিপাবলিকান দলের নেতা পাঞ্জাবের ফিরোজ খান নূন পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। আওয়ামী লীগ ও কেএসপি রিপাবলিকান দলকে সমর্থন দেয়। নির্বাচন কমিশনার ঘােষণা করে যে, ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
১৯৫৭ সালের ১৬ ডিসেম্বরে গঠিত ফিরােজ খান নূনের মন্ত্রিসভায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিলেন:
হামিদুল হক চৌধুরী – কেএসপি
রমিজউদ্দিন আহমদ – কেএসপি
মাহফুজুল হক – কেএসপি
দেলদার আহমদ – আওয়ামী লীগ
জহিরউদ্দিন – আওয়ামী লীগ
নূরুর রহমান – ন্যাপ
কামিনী কুমার দত্ত – কংগ্রেস
বসন্ত কুমার দাশ – কংগ্রেস
আবদুল আলিম – রিপাবলিকান
আঞ্চলিক বৈষম্য
দেশ বিভাগের পর হতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি করে যে বিদেশী মুদ্রা অর্জন করা হয় তা পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প প্রতিষ্ঠায় বিনিয়ােগ করা হয়। বৈদেশিক সাহায্যের ৯০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হতাে। কেন্দ্রীয় চাকরি ও সেনাবাহিনীর ৯০ ভাগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী নাগরিক। ১৯৫২ সালে কেন্দ্রীয় সচিবালয় ৯৩ জন সচিবের মধ্যে সকলে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী । কেন্দ্রে একজন যুগ্ম সচিব ও ৪ জন উপসচিব ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে ৪২ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানী এবং ২ হাজার ১শ’ জন ছিল বাঙালী। বেতন হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানিরা পেত ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং বাঙালীরা পেত ৬৫ লাখ টাকা। তাজউদ্দীন আহমদ আঞ্চলিক বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আঞ্চলিক বৈষম্য আওয়ামী লীগের ভেতরে ও জনগণকে অবহিত করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
পৃষ্ঠাঃ ১৯৫
করেন। তার রাজনৈতিক প্রশ্ন ছিল পূর্ব বাংলা গরিব কেন? ১৯৫৬ সালে সেনাবাহিনীতে উভয় অঞ্চলের অফিসারের সংখ্যা ছিল নিম্নরুপ:
পদবি পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান
জেনারেল ১ –
লেঃ জেনারেল ৩ –
মেজর জেনারেল ২০ ১
ব্রিগেডিয়ার ৩৫ ০
কর্নেল ৫০ ০
লেঃ কর্নেল ১৯৮ ২
মেজর ৪৯৩ ১০
নৌবাহিনীর অফিসার ৬৯৩ ০
বিমান বাহিনীর অফিসার ৬৪০ ৬০
প্রতিরক্ষা খাতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে ব্যয় হয় ৪৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা, পূর্ব বাংলায় মাত্র ১০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। উভয় অঞ্চলে বৈষম্য দূর করার জন্য ১৯৫৬-৫৭ সালে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর সংখ্যা সাম্য নীতির ফলে সেনাবাহিনী ও কেন্দ্রে বাঙালীর প্রবেশের সুযােগ পায়। সেনাবাহিনীতে বাঙালী যুবকরা যােগদান করায় তাদের মধ্যে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার স্বপ্ন সষ্টি হয়। তারাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাঙালী সেনারা বিদ্রোহ করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
স্বায়ত্তশাসন দাবি
বরিশালের মঠবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত এমএলএ মহিউদ্দিন আহমেদ পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আওয়ামী লীগ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং প্রস্তাব আইনসভায় গৃহীত হয়। তাজউদ্দীন আহমদ লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং প্রস্তাবের পক্ষে ভােট প্রদান করেন।
১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান ও গুলিস্তান সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্র নীতির ওপর ভােট গ্রহণ করা হয়। সােহরাওয়ার্দীর পক্ষে ভােট এবং মওলানা ভাসানীর পক্ষে মাত্র ৩৫ ভােট পরে। ১৯৫৭ সালের
পৃষ্ঠাঃ ১৯৬
১৪ জুন পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় হােসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন- পূর্ব পাকিস্তান শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন লাভ করেছে। সোহরাওয়ার্দীর পররাষ্ট্র নীতি ও স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত ঘােষণা আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে এবং ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হয় ।
তাজউদ্দীন আহমদের যুক্তরাষ্ট্র সফর ১৯৫৮
১৯৫৮ সালে তাজউদ্দীন আহমদ এমএলএ শুভেচ্ছা সফরে আমেরিকা গমন করেন৷ এ সময় তিনি পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও প্রশাসন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। আমেরিকা থেকে ফেরার সময় তিনি একটি রেডিও ক্রয় করেন। ৮ বছর
হন। আমেরিকা থেকে ফেরার সময় তিনি একটি রেডিও পর রেডিওটি বাসা থেকে চুরি হয়ে যায়।
ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর মৃত্যু
যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে গেল- আওয়ামী লীগ ও কেএসপির বিরােধ চরমে। পূর্ব পাকিস্তানে ঘন ঘন মন্ত্রিসভার পতন ও গঠন চলতে থাকে। কখনও কেএসপির নেতা আবু হােসেন সরকার মুখ্যমন্ত্রী এবং কখনও আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ স্পিকার আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়েছে। ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছে। কেএসপি তাকে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করতে দেবে না। ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আইনসভায় সংঘর্ষ হয়। শাহেদ আলী গুরুতরভাবে আহত হন। ২৫ সেপ্টেম্বর শাহেদ আলী মৃত্যুবরণ করেন।
আবুল মনসুর আহমেদ তার রাজনীতি পঞ্চাশ বছর’ গ্রন্থে লিখেছেন: “আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করতে গিয়ে শাহেদ আলী নিহত হইলেন অপজিশনের ঢিল পাটকেলে। অথচ পূর্ব বাংলার দুশমনরা তখনও বলিলেন এবং আজও বলেন আওয়ামী লীগই শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে। কোন পাপে এ মিথ্যা তহমত। শাহেদ আলী ছিলেন অত্যন্ত সাদাসিধা লােক। তার উপর এমনি হামলা। বিচার হলে অনেক নেতার প্রকৃত চেহারা বের হতাে।” শাহেদ আলী ছিলেন আওয়ামী লীগের লােক। সুতরাং আওয়ামী লীগ সদস্যরা তাকে হত্যা করতে পারে না। সেদিন আইনসভায় মােহন মিয়া, কুমিল্লার নুরুররহমান প্রমুখ সদস্যগণ খুব উত্তেজিত ছিলেন। অনেকের ধারণা কেএসপির সদস্য
নুরুর রহমানের আঘাতে শাহেদ আলী আহত হয়েছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার দুঃখজনক ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন বিরােধী
দলের নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী লিখেছেন :
১৯৭
In East Pakistan a shameful incident had happend within the precincts of the legislature. The Deputy speaker was so severely assaulted with chairs and other missiles by certain members that he was led away bleeding and with internal injuries from which he subsequently succumbed. When General Iskander Mirza appointed Fazlul Huq as his Interior Minister in 1955 he adopted Huq’s KSP as his own, pampered and flattered it, met its members secretly, and utilized it to suit his own ends…
I happened to be in Dhaka at the time and tried but failed to get in touch with the President, who was in Karachi, although the Ideaders of the KSP were able to get him on the telephone easily. I got in touch with the Prime Minister, also in Karachi, who said that Article 193 could not even be considered and that the challenge to violence had to be aced; otherwise there would be an end to all civilized democratic Govermment…
This was a most unfortunate event as the Deputy Speaker succumbed to his injuries. I am regretfully constrained to state that whether President Iskander Mirza did or did not visualize the occurrence in its entirety, the opposition party would never have dared to act so brutally and savagely, so fearlessly and without restraint, if it had not felt that it had the backing of the President. It is believed that he desired deliberately to create some situation in East Pakistan which might-supply him with arguments for the ultimate abrogation of the constitution, which he had already decided on some time ago and for which he had made all arrangements.
“পূর্ব পাকিস্তানে আইনসভার ভিতরে লজ্জাজনক দুর্ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়। কয়েকজন সদস্য চেয়ার ও লাঠি নিক্ষেপ করে ডেপুটি স্পিকারকে সাংঘাতিক আঘাত করে। তাঁর অভ্যন্তরীণ আঘাত থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল এবং এর ফলে মৃত্যুবরণ করেন। যখন ১৯৫৫ সালে ইস্কান্দার মির্জা ফজলুল হককে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ােগ করেন তখন থেকে তিনি হকের কেএসপিকে দত্তক করে নেন- প্রশ্রয় দিতেন, তােষামােদ করতেন এবং সদস্যদের সাথে গােপনে সাক্ষাত করতেন
পৃষ্ঠাঃ ১৯৮
এবং তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তাদের ব্যবহার করতেন….
এ সময় আমি ঢাকা ছিলাম এবং করাচীতে অবস্থানরত প্রেসিডেন্টকে ধরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। যদিও কেএসপি নেতাগণ টেলিফোনে তাকে সহজে পেত। আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে করাচীতে কথা বলি। কিন্তু তিনি বলেন যে, ১৯৩ ধারার কথা চিন্তাই করা যায় না এবং সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে হবে নতুবা সকল সভ্য গণতান্ত্রিক সরকারের সমাপ্তি হবে।… এটা ছিল সবচেয়ে দুর্ভাজ্যজনক ঘটনা যে ডেপুটি স্পিকার যে আঘাত পেয়েছিলেন তাতেই মৃত্যুবরণ করেন।
আমি দঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সম্পূর্ণ ঘটনা যা ঘটতে যাচ্ছে তা উপলব্ধি করুক বা না করুক, তবে বিরােধী দল প্রেসিডেন্টের সমর্থন না পেলে এমন নির্দয় বর্বরদের ন্যায় ভয়-ভীতি ও কোন বাধা ছাড়া এ কাজ করতে সাহস পেত না। এটা বিশ্বাসযােগ্য যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানে কতকগুলাে অবস্থার সৃষ্টি করেন। তিনি ইতিপূর্বে এরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সে জন্য তিনি সকল আয়ােজন করেছিলেন।”
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পূর্ববঙ্গ আইনসভার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এবং কেএসপিকে দায়ী করেছেন। এ কে ফজলুল হক তখন রাজনীতি থেকে অবসর জীবনযাপন করছেন এবং এ ঘটনার সাথে আদৌ সম্পর্কিত ছিলেন না। এ সকল ঘটনায় তিনি আহত হয়েছেন। মওলানা ভাসানী ও ন্যাপ আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। ভাসানীও আইনসভার ঘটনায় মর্মাহত হয়েছেন। ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রথমবারের জাতীয় পরিষদে প্রত্যক্ষ ভােটে সদস্য নির্বাচিত হবে। এ মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় ডেপুটি স্পিকারকে হত্যা করে ইসকান্দার মির্জা ও জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্র তৈরি করেন।
যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গন
১৯৫৫ সালের ৩ জুন গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৯২(ক) ধারা প্রত্যাহার করে। আওয়ামী লীগ এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব করে হেরে যায়। আইনসভায় ফজলুল হকের সমর্থন বেশি। আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট ত্যাগ করে। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হােসেন সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। যুক্তফ্রন্টে মতবিরােধ চরম আকার ধারণ করে। যুক্তফ্রন্টের সমর্থনে ১৯৫৫ সালের ১০ আগস্ট মুসলিম লীগ কেন্দ্রে মন্ত্রিসভা গঠন করে। মন্ত্রিসভায় চৌধুরী মােহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী ও এ কে
পৃষ্ঠাঃ ১৯৯
ফজলুল হক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ ফজলুল হক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। ১৯৫৬ সালের ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভুখা মিছিল করে। মিছিলে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন প্রাণ হারায়। কংগ্রেস, তফসিলী ও গণতন্ত্রী দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করায় যুক্তফ্রন্টের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন সরকার ১৯৫৬ সালের ৩০ আগস্ট আবু হােসেন সরকারে মন্ত্রিসভার পতন হয়। ১৯৫৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান মন্ত্রীসভা গঠন করেন। কেন্দ্রে যুক্তফ্রন্ট ও মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার পতন হলো। প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলী পদত্যাগ করলে হােসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা কেন্দ্রে ও প্রদেশে রাজনীতি নিয়ে খেলা শুরু করেন। তিনি পাকিস্তানে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেন। নতুন দল গঠন, মন্ত্রিসভায় ভাঙ্গন- এ ছিল ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের ফল। পূর্ব পাকিস্তানে ন্যাপ, কংগ্রেস ও তফসিলী এমএলএগণ একবার আওয়ামী লীগ আবার কেএসপিকে সমর্থন দিয়ে মন্ত্রিসভার ভাঙ্গা-গড়ার ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রে ১৯৫৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার পতন হয়। পূর্ব পাকিস্তানে আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় গভর্নর এ কে ফজলুল হক ১৯৫৮ সালের ৩০ মার্চ আতাউর রহমানকে পদচ্যুত করেন এবং আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আহবান জানান। আওয়ামী লীগ ক্ষিপ্ত হয়ে ৩১ মার্চ গভর্নর এ কে ফজলুল হককে অপসারণ করে এবং তাদের দলীয় রাষ্ট্রদূত সুলতান আহমদকে গভর্নর নিয়ােগ করে। আতাউর রহমান মুখ্যমন্ত্রী হলেন। কিন্তু ১৯৫৮ সালের ১৮ জুন অনাস্থা প্রদান করলে আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভার পতন হয়। এমনিভাবে আওয়ামী লীগ ও কেএসপির মধ্যে চরম বিরােধ চলতে থাকে। ১৯ জুন আবু হােসেন সরকার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু ২২ জুন অনাস্থা ভােটে তার মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ২৫ জুন ১৯৩(ক) ধারায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসন জারি হয়। ১৯৫৮ সালের ২৯ আগস্ট আতাউর রহমান পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কেএসপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ঐক্যের চেষ্টা চলে। কিন্তু কয়েকজন নেতার একগুঁয়েমির জন্য সমঝােতা ভেঙ্গে যায়। পরিশেষে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় আওয়ামী লীগ ও কেএসপির বিরােধ চরমে পৌঁছে। ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী – মারাত্মকভাবে আহত হন এবং ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ
পৃষ্ঠাঃ ২০০
হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে আইনসভা পরিচালনা করছিলেন। কেএসপি তাকে আঘাত করে। আঘাতের কারণে তার মৃত্যু হয়। এ সকল ষড়যন্ত্রের পিছনে ছিলেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা। তিনি দেশে সামরিক আইন জারি, গণতন্ত্র হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করছিলেন।
যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গায় তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা কি ছিল সে সম্পর্কে তার কোন মন্তব্য জানা যায়নি। তবে সঙ্গত কারণেই বলা যায় যে, তিনি মূল দলের সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিলেন। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনকে নিয়ে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেন।
পৃষ্ঠাঃ ২০১