You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

৩৩ তম ও ৩৪ তম দিবসে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন। যোগ্যতার ভিত্তিতে তাদের বিভিন্ন এ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হতো। তাদের গ্রুপ লিডার তালিকাভুক্ত করা হতো।
৩৫ তম দিবসে অনুষ্ঠিত হতো পাস আউট। উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণে যুবকদের যে বিষয়টির ওপর বেশি জোর দেয়া হতো তা হচ্ছে স্বাধীনতা লাভ করতে হলে আমাদের নিজেদেরই যুদ্ধ করতে হবে। কোনাে দেশ আমাদের স্বাধীনতা এনে দেবে না। যুদ্ধের পদ্ধতি হবে গেরিলা। কারণ আমাদের সম্পদ সীমিত।
মনোবলের দিক থেকে পাকিস্তানীদের চেয়ে শক্তিশালী হলেও অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা তাদের বেশি। কিন্তু আমাদের জনগণ যেহেতু এই যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত এবং তারাও যেহেতু যুদ্ধে আমাদের প্রদান সহায়ক, তাই গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেই সহজে শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব হবে।
শিবিরে তালিকাভুক্ত সবাই যুদ্ধ করার মানসিকতা নিয়ে এসেছে। কিন্তু যারা নিয়মিত এবং গেরিলা যােদ্ধা হওয়ার সুযােগ পেল না, তাদের যুদ্ধের অংশ হিসেবে বেছে না নেয়া হলে অসুবিধা হতে পারে। এক্ষেত্রে যারা প্রথম ধাপেও কৃতকার্য হয়নি তাদেরকে ভিত্তি ফেজের অন্তর্ভুক্ত করে যুদ্ধে তাদের অবদানকে সুসংহত করা যেতে পারে। তাদের কাজ হবে অনেকটা সহযােদ্ধার মতাে। তারা সশস্ত্র যােদ্ধাদের সরাসরি সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
যুব প্রশিক্ষণকালে ভিত্তি ফৌজের মূলনীতিগুলাে অনেক সময় প্রশিক্ষণার্থীদের পড়ানাে হতাে। মূলনীতির শুরুতে শ্লোগান হিসেবে উল্লেখ ছিল, “গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড় /শেখ মুজিবের অস্ত্র ধর।”
যুব শিবির পরিচালনা বাের্ডের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত এসব ক্যাম্পে অবস্থানকারীদের প্রশিক্ষণের জন্য সুন্দর এবং উপযােগী একটি কারিকুলাম তৈরি হয়। ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণার্থীদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হতাে।
মূলনীতির ব্যাখ্যা প্রদানকালে সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টিও ছিল। তাদেরকে বলা হতাে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে জয়ী হতে গেলে অর্থনৈতিক বিজয় অর্জনও অপরিহার্য। হানাদার বাহিনী যে উদ্দেশ্যে লুটতরাজ করছে সে উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করতে হলে নিজেদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখতে হবে। সরকার ও প্রশাসন আরেকটি বিষয় সম্পর্কে সচেতন ছিল, তা হচ্ছে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে নিজেদের সম্পূর্ণ সাহায্য-নির্ভর থাকা সম্ভব হবে না। এতে করে যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি মৌলিক চাহিদা পূরণের বিষয়টি কঠিন হয়ে পড়বে।
ভিত্তি ফৌজের মূলনীতিতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কেও বিশদ বলা
পৃষ্ঠাঃ ৪০১

ছিল । আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির সুবাদে হানাদার ও অধ্যুষিত এলাকাগুলােতে সাধারণ মানুষকে আবারও পশ্চিমা আমলাতন্ত্রের জালে আটকা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাঙালির নিয়ন্ত্রণে রাখা অপরিহার্য। সামগ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় প্রাথমিক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করবে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসন । এই প্রশাসন ব্যবস্থায়ও জনসম্পৃক্ততা থাকবে সর্বাধিক।
তৃণমূল পর্যায়ে সরকার ব্যবস্থা দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এ সময়ে স্থানীয় সরকার কাঠামাের প্রয়ােজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করা হয়। সেই উদ্দেশ্যেই ভিত্তি ফৌজের মূলনীতিতে স্থানীয় সরকার কাঠামোর মূল স্তর হিসেবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার কথা বলা হয় ।
প্রতিটি গ্রামে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৫-৭ জন সদস্য নিয়ে পঞ্চায়েত গঠন করার কথা বলা হয়। ভিত্তি ফৌজ পঞ্চায়েতের অধীনে কাজ করবে। পঞ্চায়েত নেতা নির্বাচিত হবে এমন আদর্শের ভিত্তিতে, যেখানে ভিত্তি ফৌজের যেকোনো সদস্য পঞ্চায়েত নেতার নির্দেশ পালনে মৃত্যুবরণেও দ্বিধা করবে না। ভিত্তি ফৌজ গঠনের পেছনে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রধানত কাজ করেছে। আর এর সূত্রপাত হয়েছে যুব প্রশিক্ষণ শিবিরগুলাে থেকেই।
যুব শিবিরগুলাে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য যেমন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশিকা ছিল তেমনি শিবিরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়টিও ছিল নির্দিষ্ট। এই ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনাও ছিল।
যুব শিবিরের নিরাপত্তা বিষয়ে পরিচালনা বাের্ডের একটি নির্দেশ ছিল নিম্নরূপ :
১. প্রশিক্ষণার্থী এবং শিবিরে কর্মরত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কেউ শিবিরে অবস্থান করতে পারবে না ।
২. শিবির প্রশাসক কিংবা শিবির প্রধানের লিখিত অনুমতি ছাড়া কোন প্রশিক্ষণার্থী শিবির থেকে বাইরে যেতে পারবে না।
৩. ক্যাম্প চীফ কিংবা ক্যাম্প এডমিনিস্ট্রেটর দাফতরিক প্রয়ােজনে বাইরে যাবেন, তবে কোনােমতেই একই সঙ্গে দু’জন শিবির ত্যাগ করবেন না।
৪. অননুমােদিত কোনাে অতিথিকে শিবিরে আসতে দেয়া হবে না, তবে ক্যাম্প চীফ কিংবা ক্যাম্প এডমিনিস্ট্রেটরের লিখিত অনুমতিসহ এবং যথােপযুক্ত প্রয়ােজন থাকলে দর্শনার্থী প্রবশে করতে পারবে।
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদর্শিত নীতিমালার বাইরে অন্য কোনাে বিষয় এখানে শিক্ষা দেয়া হবে না।
৬. যথােপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতিসাপেক্ষে যুব শিবিরে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
৪০২

৭. ট্রেনিং কো-অর্ডিনেটরের অনুমোদন ব্যতিরেকে ভিত্তি ফৌজ কিংবা যুব শিবিরের প্রশিক্ষণে ভর্তির সুযোগ থাকবে না।
৮. প্রশিক্ষনার্থীদের নাম ঠিকানা সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাদের কোথায় পাঠানো হচ্ছে এবং কি দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে তা অতি গোপনীয় বলে বিবেচিত।
৯. প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে গ্রুপ ডিসকাসনের সুযােগ থাকবে। আবার তাদের মধ্যে কোন গুপ্তচর আছে কি না তাও পরীক্ষা করে দেখা হবে। এ ধরনের কোন খবর পাওয়া গেলে তা অনতিবিলম্বে যুব প্রশিক্ষণ অধিদফতরকে অবহিত করতে হবে।
কোন দেশের মুক্তিযুদ্ধে যুব সমাজ অন্যতম ভূমিকা পালন করে। একটি দেশ পরিচালনার জন্য তাদের প্রস্তুতি নিতে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে এ দেশের যুব সমাজকে সে লক্ষ্যে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যেই যুব শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
সরকারের পক্ষে আমাকে এর সামগ্রিক দিক দেখার দায়িত্ব দেয়া হয়, যা ছিল আমার সচিব হিসেবে দায়িত্বভুক্ত কাজের অতিরিক্ত।
যুব শিবির পরিচালনা ছিল সরকারের যুদ্ধকালীন সুদূরপ্রসারী নীতির অন্যতম । এটি ছিল তণমূল পর্যায়ে সশস্ত্র যুদ্ধকে শক্তিশালী করার একটি প্রধান উপায়। কারণ এই কার্যক্রম এমন একটা ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, সশস্ত্র যােদ্ধা তৈরি করা, পাশাপাশি উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া, বেসামরিক সরকার পরিচালনা তথা দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ মানুষ এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থীর সকল সমস্যার সমাধানের একটি পথ নির্দেশিকা ছিল এখানে।
এমন সুন্দর একটি পরিকল্পনাও সহজভাবে কার্যকর হয়নি। সরকারকে অভ্যন্তর থেকেই প্রতিবন্ধকতার মুখােমুখি হতে হয়েছে। আর এক্ষেত্রে তাজউদ্দীন সাহেবের ধীরস্থির চিন্তা ও কৌশলের কারণে সকল ষড়যন্ত্র মােকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার গঠন নিয়ে প্রথম অবস্থায় কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তাজউদ্দীন সাহেবের সিদ্ধান্তকে স্বল্পসংখ্যক লােক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এমন অবস্থায় যে-কোনাে মুহূর্তেই অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, যাকে আমরা দলীয় কোন্দল বলে মনে করতে পারি।
এক্ষেত্রে আমরা শেখ ফজলুল হক মনির কথা বলতে পারি । তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এটা তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। অথচ
পৃষ্ঠাঃ ৪০৩

ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্ববাসী তাজউদ্দীন আহমদকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করেছেন। এটা ছিল রাজনৈতিক মতানৈক্য; যার গুরুত্ব সময় বিবেচ্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা এসেছিল ভিন্ন পথে, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
সরকারের অভ্যন্তরেই একটি গ্রুপ ছিল, যারা মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছিল। তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরবর্তী সময়ের সাধারণ মানুষও স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে।
যাই হােক, মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ বিষয়ে বলছিলাম। উল্লিখিত এই গ্রুপটি প্রশিক্ষণ বিষয়েও নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছিল, এর আলামত মুজিবনগরের সরকারসহ ভারতীয় কর্তৃপক্ষও দেখেছেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাঠিয়েছিলেন ড. ত্রিগুণা সেনকে। ত্রিগুণা সেনের ওপর মূলত দায়িত্ব ছিল অন্তর্কলহ দমিয়ে নেয়ার চেষ্টার পাশাপাশি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলােচনা। তিনি প্রথমে যান আগরতলা। সেখানে তিনি বেশকিছু প্রশিক্ষণ শিবির পরিদর্শন করেন সরেজমিনে দেখেন সামগ্রিক অবস্থা। এরপর কলকাতায় এসে দেখা করেন রাষ্ট্রদূত হােসেন আলীর সঙ্গে।
হােসেন আলীর সঙ্গে তার আলােচনা হয় প্রশিক্ষণ বিষয়ে। কিন্তু হোসেন আলী সাহেব প্রাসঙ্গিকভাবেই আমার কথা বলেন। কারণ ইতােমধ্যে প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনার কাজে আমি ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে পড়েছি এবং একই কারণে উত্তরবঙ্গে সফরও করছিলাম।
কলকাতায় ফিরে এসেই ত্রিগুণা সেনের বিষয়টি জানতে পারি । এও জানতে পারি, হােসেন আলী সাহেব এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য আমার কথা বলেছেন।
কলকাতায় এসে তাঁর কথা হয়। তিনি পরের দিন বিস্তারিত আলােচনার আহ্বান জানান। সময় এবং স্থান নির্ধারিত হয়। পরদিন সন্ধ্যায় ওখানকারখাদ্যমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আহমদের বাসায় দেখা হয় ত্রিগুণার সঙ্গে। ওখানেই আলােচনা হবে, এ বিষয়ে ইতােপূর্বে সিদ্ধান্ত হয় । ঐ সময় ফখরুদ্দিন সাহেবের বাসায় কর্নেল ওসমানী, কামরুজ্জামান এবং মাহবুব আলম চাষীকে দেখা গেল।
সেখানে প্রস্তাব করা হলাে, মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণের জন্য মােট তিনটি কেন্দ্র হবে। প্রতিটি কেন্দ্রে মাসে এক হাজার যুবক ট্রেনিং গ্রহণ করবে এবং আপাতত তিন মাসের একটি কর্মসূচী নেয়া হােক। তার অর্থ হচ্ছে তিন মাসে তিন হাজার করে মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে।
পৃষ্ঠাঃ ৪০৪

আসলে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত যুদ্ধকে অহেতুক দীর্ঘায়িত করতে সহায়তা করত। স্বাভাবিকভাবেই এ প্রস্তাবনার বিপক্ষে আমাকে অবস্থান নিতে হয়। সে কারণে মাহবুব আলম চাষী যথেষ্ট মনােক্ষুন্ন হলেন। এর প্রতিফলন ঘটল পরের দিন মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে। সেখানে আমার দ্বিমত পােষণ করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বলা হয়েছিল যে, সামরিক বিষয়ে একজন বেসামরিক কর্মকর্তার বলার এখতিয়ার আছে কি?
প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন মাহবুব আলম চাষী। এটা বােঝা গেছে ড. ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে তার সখ্য গড়ার প্রচেষ্টা দেখে। তার ইচ্ছা ছিল ত্রিগুণ্য সেনের মাধ্যমে তিনি মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণের দায়িত্বটি নিজের হাতে নিয়ে নেবেন যাতে করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে তারা তাদের পাক-মার্কিন আঁতাতের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ইচ্ছামতাে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
ফকরুদ্দিন আহমদ সাহেবের বাসায় যে আলােচনা হয়েছে, সে বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রী কে বিস্তারিত জানাই। এখানেও তাজউদ্দীন সাহেব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। এক্ষত্রে তার সিদ্ধান্তই সঠিক বলে প্রমাণিত হলাে। তিনি মাহবুব আলম চাষীকে প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে নিলেন।
অতঃপর তাজউদ্দীন সাহেব আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে বললেন যুব ক্যাম্প পিরচালনার সামগ্রিক দায়িত্ব নেয়ার জন্য। ইউসুফ আলী সাহেব জানালেন, বিষয়টি অস্ত্রশস্ত্র সংশ্লিষ্ট, তিনি এ বিষয়ে খুবই কম জানেন, সুতরাং বিকল্প কোনাে কিছু থাকলে ভালাে হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন যুব ক্যাম্প চেয়ারম্যান হবেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, তবে সচিব হিসেবে কাজ করতে হবে আমাকে, যা আমার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। আমার তখনকার অফিস ছিল রাষ্ট্রদূত হােসেন আলীর অফিসেরই একটি কক্ষে।
তার অফিস কক্ষের বিপরীত দরজাই ছিল আমার অফিস কক্ষের দরজা। অফিসে বসেই ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে আমাদের আলােচনা হলাে। প্রথম অবস্থায় তাকে কিছুটা অস্বাভাবিক বলে মনে হলেও পরবর্তী সময়ে তিনি আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন।
যুব ক্যাম্প প্রশিক্ষণ বিষয়ে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আরও কিছু ঘটনার কথা আলােচনায় আসতে পারে। ত্রিগুণা সেনের সঙ্গে আলােচনার কয়েক দিন পরের ঘটনা এটি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে বললেন, তার সঙ্গে যেতে হবে এক জায়গায়। সেখানে বিশেষ একজনের সঙ্গে কথা বলতে
পৃষ্ঠাঃ ৪০৫

হবে। প্রথমত কৌতুহল জাগলো! অবশ্য পরে অনুমান করতে পারলাম। বিষয়টি নিশ্চিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণই শুধু নয়, হয়তাে-বা গােপনীয়ও। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমি তার সফরসঙ্গী হলাম। আর বুঝতে বাকি রইলো না সফর কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর আগেই প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে নিয়ে যেতে হয়েছে।
আমরা ভারতীয় বিমানে করে গেলাম দিল্লী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত করা আমাদের উদ্দেশ্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আবাসিক দফতরে আমাদের দেখা করার আয়ােজন করা হয়েছে। ওখানে পাওয়া গেল ড. ত্রিগুণা সেনকে। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাত হলাে। ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলাে। এর একটি কারণ তাঁর সাদাসিধা চলুন দেখে মনে হচ্ছিল ছবিতে দেখা সেই ইন্দিরা যেন তিনি নন। একেবারেই সাধারণ তার বেশভূষা, কিন্তু চেহারায় স্পষ্টত ব্যক্তিত্বের ছাপ। তার সাধারণ মুখাবয়ব এবং বেশভূষার কারণেও মনে হচ্ছিল তিনি প্রকৃতই রাষ্ট্রনায়কোচিত পাণ্ডিত্যের অধিকারিনী।
প্রায় দুই ঘণ্টা ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একান্ত আলোচনা হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সহায়তাকারী হিসেবে আমি এবং ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তাকারী হিসেবে ছিলেন ড. ত্রিগুণা সেন।
আলােচনাকালে মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয় । ত্রিগুণা সেন তার অভিজ্ঞতাপ্রসূত পরামর্শ দেন। ইন্দিরা গান্ধীকে মুক্তিবাহিনীর অবয়ব ও কাঠামাে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। এই সময় স্পষ্টত অতীতের বিতর্কিত ধারণাকে পরিহার করে অধিক সংখ্যায় প্রশিক্ষণার্থরি ব্যবস্থার কথা বলা হয়। এও আলােচনায় আসে, দিল্লীর সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে কিছু বাস্তবভিত্তিক অসুবিধা আছে। যেহেতু কলকাতায় বাংলাদেশ সরকারের দাফতরিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তাই সেখানে একটি লিয়াজো অফিস স্থাপন করা অপরিহার্য। তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে আমাকে যুব প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ক্যাম্পগুলাের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। অবশ্য সচিব (সাধারণ প্রশাসন)-এর অতিরিক্ত হিসেবেই তা পালন করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাত্র ৬ মাস সময়ে এসব প্রশিক্ষণ শিবির থেকে এক লাখ তিন হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যা আমার জীবনের অন্যতম গর্বের স্মৃতি হিসেবে গণ্য করি ।”৪
পৃষ্ঠাঃ ৪০৬

১৭
পাকবাহিনীর গণহত্যা
প্রবাসী বাঙালীদের অবদান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হতে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা চালায় এবং ত্রিশ লাখ বাঙালী হত্যা করে। তারা দুই লাখ ৫০ হাজার নারী নির্যাতন করেন। তারা কয়েক লাখ বাড়িঘর পুড়ে ফেলে, জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে। রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পুল ধ্বংস করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল মক্তিযােদ্ধা, আওয়ামী লীগ ও হিন্দু সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করা। লাখ লাখ শহীদদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করা হলাে :১
শহীদ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ;
১. এমডি মশিউর রহমান এমএনএ, যশাের;
২. এমডি আমজাদ হােসেন এমএনএ, পাবনা;
৩. এমডি নাজমুল হক সরকার এমএনএ, রাজশাহী;
৪ ডা. জিকরুল হক এমপিএ, রংপুর;
৫. আমিন উদ্দিন এমপিএ, পাবনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকগণ
ড. জেসি দেব – দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জ্যোতিময় গুহঠাকুরতা – অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ৩০ মার্চ
আনােয়ার পাশা – অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ১৪ ডিসেম্বর
আতােয়ার রহমান খান খাদিম – অধ্যাপক, পদার্থ বিভাগ, ২৬ মার্চ
অনু দ্বৈপায়ন – অধ্যাপক, পদার্থ বিভাগ, ২৬ মার্চ
ড. আবুল খায়ের – অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ
এএনএম মনিরুজ্জামান – অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, ২৬ মার্চ
এসএএম ফয়জুল মহী – অধ্যাপক, ১৪ ডিসেম্বর
গিয়াসউদ্দিন আহমদ – অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ১৪ ডিসেম্বর
মুনির চৌধুরী – অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ১৪ ডিসেম্বর
পৃষ্ঠাঃ ৪০৭

ড. এমএ মুক্তাদির – সহযােগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী – অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ১৪ ডিসেম্বর
রাশিদুল হাসান – অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ১৪ ডিসেম্বর
ড. সরাফত আলী – অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ২৬ মার্চ
ড. সাদাত আলী – অধ্যাপক আইইআর
সন্তানচন্দ্র ভট্টাচার্য – অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ১৪ ডিসেম্বর
ড. সাদাত আলী – অধ্যাপক, গবেষণা ইনস্টিটিউট, ২৬ মার্চ
সিরাজুল হক খান – অধ্যাপক, গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৪ ডিসেম্বর
ফজলুর রহমান খান – অধ্যাপক, মৃত্তিকা বিভাগ
ড. মোহাম্মদ মর্তুজা – চিকিৎসক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ ডিসেম্বর
ড. আবুল কালাম আজাদ – অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার – সাংস্কৃতিক বিভাগ, ১৪ এপ্রিল
অধ্যাপক হাবিবুর রহমান – অঙ্ক বিভাগ, ১৫ এপ্রিল
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব
লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম – আগরতলা মামলার আসামী
আলতাফ মাহমুদ – একুশে গানের সুরকার
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত – সাবেক মন্ত্রী, ২৭ মার্চ
ললিত কুমার বল – সাবেক আইনসভার সদস্য, ৭ জুন
জহির রায়হান – সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকার, ৩০ জুলাই
সিরাজ উদ্দীন হােসেন – সাংবাদিক, ১০ ডিসেম্বর
শহীদ সাবের – সাংবাদিক, ২ এপ্রিল
নূতন চন্দ্র সিংহ – কুন্ডেশ্বরী ঔষধালয়, ১৩ মে
শহীদুল্লাহ কায়সার – সাংবাদিক, ১৪ ডিসেম্বর
নিজামউদ্দিন আহমদ – সাংবাদিক, বিবিসি, ১২ ডিসেম্বর
ডা. মােহাম্মদ ফজলে রাব্বি – অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ১৪ ডিসেম্বর
ডা, আবদুল আলিম চৌধুরী – অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ১৪ ডিসেম্বর
ডা. যােগেশচন্দ্র ঘােষ – সাধনা ঔষধালয়, ৪ এপ্রিল
রণদা প্রসাদ সাহা – দানবীর, মির্জাপুর, ২৯ জুলাই
কবি মেহেরুন্নেসা – মিরপুর, ঢাকা, ২৭ মার্চ
প্রফেসর সেলিনা পারভীন – সাংবাদিক, ১৩ ডিসেম্বর
আয়েশা – ধানমণ্ডি, ঢাকা, ১৬ ডিসেম্বর
পৃষ্ঠাঃ ৪০৮

এএনএম গােলাম মােস্তফা – সাংবাদিক
নুরুল আমিন সিএসপি – সাবেক জেলা প্রশাসক, বরিশাল, ২০ মে
শামসুল হক খান সিএসপি – ডিসি, কুমিল্লা, এপ্রিল
এ কে শামসুদ্দিন সিএসপি – এসডিও, সিরাজগঞ্জ
কাজী আজিজুল ইসলাম – এডিসি, বরিশাল, ৫ মে
মামুন মাহমুদ পিএপি – ডিআইজি, রাজশাহী
শাহ আবদুল মজিদ – এসপি, রাজশাহী
শামসুল হক পিএসপি – এসপি, চট্টগ্রাম
লেঃ কর্নেল জাহাঙ্গীর – কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, ৩০ মার্চ
লেঃ কর্নেল আনােয়ারুল ইসলাম কুমিল্লা- ক্যান্টনমেন্ট, ৩০ মার্চ
ডা. শামসুদ্দীন আহমদ – মেডিকেল কলেজ, ঢাকা, ১৩ ডিসেম্বর
কর্নেল ডা. এএস জিয়াউর রহমান – অধ্যক্ষ, সিলেট মেডিকেল কলেজ
সৈয়দ নজমুল হক – সাংবাদিক, ১১ ডিসেম্বর
ধীরেন্দ্রনাথ সরকার – আইনজীবী, রাজশাহী
আবদুল আহাদ – এডভােকেট, সুপ্রিমকোর্ট, ঢাকা, ১১ মে
জিতেন্দ্রলাল দত্ত – আইনজীবী, বরিশাল বার, ১৪ আগস্ট
মােহাম্মদ নাসির উদ্দিন – সিপিও, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম, ১১ মে
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকবাহিনী ৬৮ জন ডাক্তার ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৬ জন আইনজীবী, ৬৩৯ জন প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক, ২৭০ জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ৫৯ জন কলেজ শিক্ষক এবং ২০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে হত্যা করেছে।
শান্তি কমিটি
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যখন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সে সময় পর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার্থে শান্তি কমিটি গঠন করেন। তারা হলেন :২
সৈয়দ খাজা খয়েরউদ্দিন – আহবায়ক
মওলানা নুরুজ্জামান – প্রচার সম্পাদক
এডভােকেট একিউএম শফিকুল ইসলাম – কোষাধ্যক্ষ
এডভােকেট নুরুল হক – কোষাধ্যক্ষ
কমিটির সদস্যবৃন্দ
অধ্যাপক গােলাম আযম – আমীর, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলাম
মহম্মদ আলী – পিডিপি
পৃষ্ঠাঃ ৪০৯

আবদুল জব্বার খদ্দর
মওলানা সিদ্দিক আহমদ
আবুল কাশেম – মুসলিম লীগ
ইউসুফ আলী চৌধুরী মােহন মিয়া – পিডিপি
পীর মােহসিনউদ্দিন দুদু মিয়া – নেজামে ইসলাম
এএসএম সােলায়মান – কেএসপি
মেজর আফসার উদ্দিন
মওলানা সৈয়দ মােহাম্মদ মাসুম
আবদুল মতিন
ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন প্রমুখ ।
১১৬ নম্বর বড় মগবাজার, ঢাকা-২ শান্তি কমিটির অফিস ছিল।
পাকবাহিনীর দালালদের মধ্যে ছিলেন :
মতিউর রহমান নিজামী, আল বদর বাহিনী, পাকিস্তান প্রধান
আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, বদরবাহিনী, পূর্ব পাকিস্তান
চৌধুরী মঈনুদ্দিন
এটিএম আজাহার
বিশিষ্ট দালাল নেতৃবৃন্দ
নূরুল আলম – পিডিএম প্রধান
মহম্মদ আলী – পিডিএম
হামিদুল হক চৌধুরী – পিডিএম
ফজলুল কাদের চৌধুরী – মুসলিম লীগ
খান এ সবুর খান – মুসলিম লীগ
রাজিয়া ফয়েজ – মুসলিম লীগ
শাহ আজিজুর রহমান – মুসলিম লীগ
আবদুল মতিন – মুসলিম লীগ
ফরিদউদ্দিন আহমদ – নেজামে ইসলাম
ড, সাজ্জাদ হােসেন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুলমত আলী খান
ইউসুফ আলী চৌধুরী মােহন মিয়া প্রমুখ।
গণহত্যা ও যুদ্ধ অপরাধীর জন্য লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ ১৯৫ জন এবং লেঃ জেনারেল টিক্কা খান, লেঃ জেনারেল খাদেম হােসেন রাজা, মেজর জেনারেল রহিম
পৃষ্ঠাঃ ৪১০

গণহত্যার জন্য দায়ী। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিলেন লেঃ জেনারেল টিক্কা খান । সেনাবাহিনীর সাথে জামায়াতের আমীর প্রফেসর গােলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ প্রমুখ গণহত্যায় সহযােগিতা করেছেন ।
বাংলাদেশ মিশন
কলকাতায় পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলী ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন । তিনি পাকিস্তান দূতাবাসগুলোতে পাকিস্তানের জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি ও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কূটনীতির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি কলকাতায় বাংলাদেশের প্রথম মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
২৭ আগস্ট বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের ২৪ নম্বর কেমব্রিজ গার্ডেনে স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় মিশন উদ্বোধন করেন। লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারে এক বিরাট জনসভায় বাংলাদেশ মিশন খােলার ঘােষণা দেয়া হয়।যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালীদের নিয়ে গঠিত এ্যাকশন বাংলাদেশ- এক জনসভার আয়ােজন করে। এ জনসভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, লর্ড ব্রুকওয়ে, লেডি প্রিফোর্ড, ব্রটিশ পার্লামেন্টের সদস্য মিঃ টম ইউলিয়াম, বব এডওয়ার্ড প্রমুখ ভাষণ দেন। এ সভায় বাংলাদেশের মেয়েরা বাংলাদেশের মানচিত্র খণ্ডিত ললপাড় শাড়ি পরে যােগ দেয়। সভা শেষে মিছিল করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের নিকট স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি, জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিষয়ে সমর্থন দেয়ার আবেদন জানিয়ে স্মারকলিপি দেয়া হয়।
বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের প্রেক্ষিতে বিদেশে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত অধিকাংশ বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য স্বীকার করে।
বাঙালী কূটনীতিবিদ ও কর্মচারীদের তালিকা
কলকাতা
এম. হােসেন আলী, ডেপুটি হাইকমিশনার
আর, আই. চৌধুরী, প্রথম সচিব
আনােয়ারুল করিম চৌধুরী, তৃতীয় সচিব
কাজী নজরুল ইসলাম
এম. মাকসুদ আলী, সহকারী প্রেস এ্যাটাচি
জায়েদুর রহমান, অফিসার
পৃষ্ঠাঃ ৪১১

নয়াদিল্লী
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী
কে এম শাহাবুদ্দিন, দ্বিতীয় সচিব
আমজাদুল হক, সহকারী প্রেস এ্যাটাচি
নিউইয়র্ক
এ. এইচ মাহমুদ আলী, ডেপুটি কনসাল
এম, এ, করিম, উপস্থায়ী প্রতিনিধি
ওয়াশিংটন
এনায়েত করিম, মিনিস্টার
এস, এ. এম. এস. কিবরিয়া, রাজনৈতিক কাউন্সিলর
এ. এম. এ. মুহিত, অর্থনৈতিক কাউন্সিলর
এ. আর. এ. মুহিত, অর্থিৈতক কাউন্সিলর
এ. আর, মতিনউদ্দিন, শিক্ষা বিষয়ক কাউন্সিলর
সৈয়দ মােয়াজ্জেম আলী, তৃতীয় সচিব
এ. আর. চৌধুরী, একাউন্টস অফিসার
শেখ রুস্তম আলী, সহকারী তথ্য অফিসার
এ. এম. এস. আলম, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা
লন্ডন
মহিউদ্দিন আহমেদ, দ্বিতীয় সচিব
এ. লুৎফুল মতিন, পরিচালক (অর্থ)
রেজাউল করিম, কাউন্সিলর
আব্দুর রউফ, ডেপুটি ডাইরেক্টর
ফজলুল হক চৌধুরী, লেবার অ্যাটাচি
সুইজারল্যান্ড
ওয়ালিউর রহমান, দ্বিতীয় সচিব
ইরাক
এ. এফ. এম. আবুল ফাত্তাহ, রাষ্ট্রদূত
ফিলিপাইন
কে, কে, পন্নী, রাষ্ট্রদূত
জাপান
এ. রহিম, তৃতীয় সচিব
এ. মাসুদ, প্রেস এ্যাটাচি
পৃষ্ঠাঃ ৪১২

নেপাল
মােস্তাফিজুর রহমান, দ্বিতীয় সচিব
লাওস
এম, এ, জায়গীরদার, ততীয় সচিব
হংকং
মহিউদ্দিন আহমেদ, ট্রেড কমিশনার
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন খোলা হয়। ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর এ. এফ আবুল মুহিত পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার সাথে ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে বাঙালি কূটনীতিকগণ বাংলাদেশ মিশনে যােগ দেন। ৩০ আগস্ট দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস খোলা হয়। ৪ অক্টোবর দিল্লির পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালী কাউন্সিলর হুমায়ুন রশীদ চৌধরী পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিল্লি মিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমর্থন ও সহযােগিতা লাভের প্রচেষ্টা চালান। পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে বাঙালী কূটনীতিবিদদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য স্বীকার বিশ্ববিবেককে আলোড়িত করে। পত্রপত্রিকা ও টিভি নিউজে তাদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় । পাকিস্তান সরকার তাদের চাকরিচ্যুত করে এবং বেতন-ভাতা দেয়া বন্ধ করে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি কূটনীতিকগণ বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ প্রশ্নটি সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে। বাংলাদেশ সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে দলপতি করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধ দল জাতিসংঘে প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকার ইতিপূর্বে মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকীকে (এম. আর. সিদ্দিকী) আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করে। তিনি দূতাবাসের কর্মকর্তা ও নেতাদের নিয়ে কর্মসূচি প্রণয়ন শুরু করে দেন। ২৩ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্কে পৌছেন। হােটেল বেলফাস্ট প্লাজায় প্রতিনিধি দলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের সকল বাঙালি সদস্য একযােগে পদত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। তাদের নিয়ে ওয়াশিংটনে দূতাবাস স্থাপিত হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে
পৃষ্ঠাঃ ৪১৩

জাতিসংঘ বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এবং নিউইয়র্ক দূতাবাসের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলে ছিলেন ।
১. আব্দুস সামাদ আজাদ এমএনএ, সিলেট
২. মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী এমএনএ, চট্টগ্রাম
৩. সৈয়দ আব্দুল সুলতান এমএনএ, ময়মনসিংহ
৪. ড. মফিজ চৌধুরী এমএনএ, বগুড়া
৫. এডভােকেট সিরাজুল হক, এমএনএ, কুমিল্লা
৬. অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, সভাপতি ন্যাপ
৭. ফণী ভূষণ মজুমদার, এমপিএ, ফরিদপুর
৮. এডভােকেট ফকির শাহাবুদ্দিন এমপিএ, গাজীপুর
৯. ডা. আসাহাবুল হক, এমপিএ, চুয়াডাঙ্গা
১০. ড. আজিজুর রহমান মল্লিক, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১১. ড. রেহমান সােবহান, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১২. এএফএম আবুল ফতেহ, সাবেক রাষ্ট্রদূত
১৩. খুররম খান পন্নী, সাবেক রাষ্ট্রদূত
১৪. সৈয়দ আনােয়ারুল করিম, কূটনীতিবিদ
১৫. এএমএ মুহিত, কূটনীতিবিদ
১৬. এএইচ মাহমুদ আলী, কূটনীতিবিদ

জয় আমাদের সুনিশ্চিত : তাজউদ্দীন আহমদ
জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ
জুন ১৩, ১৯৭১ বাংলাদেশ বেতার থেকে প্রচারিত
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাইবােনেরা,
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একাদশ সপ্তাহ শেষ হয়েছে। এই সংগ্রামের মাধ্যমে আমাদের বীর নরনারী অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে স্বাধীনতা লাভের দুর্জয় সঙ্কল্প প্রকাশ করেছেন। নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর বিশ্বাসঘাতকতামূলক আক্রমণ চালিয়ে দ্রুত জয়লাভের ভরসা করেছিল শক্ররা, কিন্তু বীর মুক্তিসংগ্রামীরা তাদের সে কল্পনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বিপুলসংখ্যক শত্রু সৈন্য হতাহত হওয়ায় আমাদের প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের সাফল্য যেন প্রমাণিত হয়েছে তেমনি প্রমাণিত হয়েছে ইসলামাবাদের শাসকচক্রের মারাত্মক হিসেবের ভুল। তারা ভেবেছিল যে সর্বাত্মক ভীতি প্রদর্শন ও নির্বিচারে হত্যা করে বাংলাদেশকে পদানত রাখা যাবে। স্বাধীনতা
পৃষ্ঠাঃ ৪১৪

লাভে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জাতির সঙ্কল্প বিনাশের এ সব পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। দখলকারী শত্রুরা এক নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। তাদেরকে লেক ও রসদ আনতে হয় বিমানপথে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে। আমাদের মুক্তিফৌজ আবার প্রত্যহ আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। সৈন্য ও অস্ত্রবলে শত্রুরা কয়েকটি জেলা শহর ও ছাউনি এলাকা পুনর্দখল করেছে বটে। কিন্তু ধরনের যুদ্ধে এটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি নয় । শত্রুর যা লাভ হয়েছে তা আবার ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জনসাধারণের ক্রমাগত অসহযোগীতার ফলে। হানাদারদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রলােভন সত্তেও কোথাও কোন সামরিক শাসন ব্যবস্থার লক্ষণ নেই। কল-কারখানার চাকাও ঘােরেনি।
সর্বস্তরের মানুষের সামগ্রিক অসহযােগিতার ফলে হানাদারগণ যে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে তার থেকে উদ্ধার পাওয়া বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু তাদের সাহায্যের আবেদন কোন দেশে সাড়া জাগাতে পারেনি। তারা এখন বাজার থেকে উঠিয়ে নেবার নামে বিনিময় মূল্য না দিয়েই এক শ’ ও পাঁচ শ’ টাকার নােট জমা দিতে জনসাধারণকে বাধ্য করেছেন। এতে তাদের অর্থনৈতিক দেওলিয়াপনার স্বীকৃতিই যে শুধু মিলছে তা নয়, সাধারণ মানুষকে লুট করে ইসলামাবাদের শূন্য তহবিল পূরণের জঘন্য কারসাজিও প্রকাশ পাচ্ছে। কায়িক ও নৈতিক শক্তির তুলনায় শত্রুপক্ষ নিজেকে খুব বেশি জড়িয়ে ফেলেছে। এটাই নিঃসন্দেহে তার ধ্বংসের কারণ হবে। পশ্চিম থেকে পুবে এসে এই বিদেশী সৈন্য যা দখল করেছে, তা তারা আয়ত্তে রাখতে পারবে না । সুপরিকল্পিত হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে মানুষের শত্রু ও সভ্যতার শত্রু রূপে। তাদের আর জনসাধারণের মাঝে রয়েছে ঘৃণার সমুদ্রের ব্যবধান। এই কারণেই আমাদের গৃহীত গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণে শত্রুপক্ষের এত ক্ষতি হচ্ছে। শত্রুরা যেখানে যাচ্ছে সেখানেই তারা মারাত্মক নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। এর একটা কারণ এই যে, শত্রুর মনে ভয় ঢুকেছে। তারা ভয় পেয়েছে। কারণ তারা জানে যে তারা হারছে।
ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক সৈন্যবাহিনীকে বীরত্বের সঙ্গে বাধা দেবার জন্য বাংলাদেশের জনসাধারণকে আমি অভিনন্দন জানাই। তাদের সাহস ও আত্মত্যাগ পৃথিবীর সকল দেশের স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে এবং তাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। শত্রুপক্ষের সৈন্যবাহিনী সংখ্যায় বিপুল এবং উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে আদ্যপান্ত সজ্জিত। এ সত্তেও মুক্তিবাহিনী তাদেরকে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়েছে। সংগ্রামের নতুন স্তরে মুক্তিযােদ্ধারা আরও সুসংগঠিত হয়েছে এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যহ বহুসংখ্যক তরুণ সামরিক শিক্ষা নিতে এগিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৪১৫

আসছে। এরা একটা আদর্শের জন্য লড়াই করছে। নিজের দেশ শাসন করার অনস্বীকার্য অধিকার ও সম্মানের সঙ্গে নিজ বাসভূমে বেঁচে থাকার জন্য এরা লড়াই করছে, এরা লড়ছে দেশের মাটির জন্য, লড়ছে নিরপরাধ জনসাধারণকে হত্যার প্রতিশােধ নেয়ার জন্য। লড়ছে মা, বোনদের বেইজ্জতির প্রতিকারের জন্য। আর পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্যরা যুদ্ধ করছে ঔপনিবেশিক সুবিধা রক্ষার জন্য। একদিকে লুণ্ঠনের পাশবিক রূপ, অন্যদিকে একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের সর্বাত্বক আকাক্ষা। এই যুদ্ধে জয় যে আমাদের হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনায় সারা পৃথিবীর মর্মাহত মানুষের কাছে বাংলাদেশের জনসাধারণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের মারাত্মক ষড়যন্ত্রের পরিচয় উদঘাটিত হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে ব্যাপক গণহত্যার মাধ্যমে একটি জাতিকে ধ্বংস করা। সুপরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি, ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে ও পােড়ামাটি নীতি অবলম্বন করে বিপুলসংখ্যক বাঙালীকে ভারতে ঠেলে দেওয়া ও দুনিয়ার কাছে তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দেয়া। বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। বর্তমান অর্থনৈতিক ভিত্তি ধ্বংস করা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথরােধ করা। এ সবের উদ্দেশ্য হলো একটি, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক প্রভু ও পুঁজিপতিদের কাছে বাঙালীদেরকে সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও অর্থনৈকি দাসে পরিণত করা । উদ্দেশসিদ্ধির জন্য যেসব পন্থা তারা গ্রহণ করেছে তাকে বর্বরতা বললে যথেষ্ট বলা হয় না। পাশবিক বললেও পশুদের প্রতি অন্যায় করা হয়। তবে এসব উদ্দেশ্য ও পন্থা থেকে আমাদের শত্রুর প্রকৃতি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বােঝা যায়। পৃথিবীর মানুষ বুঝুন অন্য কোন কারণে নয়, বর্বর একনায়কত্বের বিরুদ্ধে আমরা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছি। মানব জাতির একটি বিরাট অংশ এ দেশের এক ন্যায্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করেছে। আমরা সেই দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছি।
পাকিস্তান বলতে যা বােঝাত সেখানে সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও বড় ব্যবসায়ীদের একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী যারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানী, এতকাল দেশের সংখ্যাগুরু পূর্বাঞ্চলকে শাসন করে এসেছে এক ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সর্বসম্মতভাবে যে রায় দিয়েছে তাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তারা তেইশ বছরের এই ঔপনিবেশিক দাসত্বের অবসান ঘটানাের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংখ্যালঘু শাসকচক্রের প্রতিনিধি ইয়াহিয়া ও ভুট্টো গত ডিসেম্বরে এই নির্বাচনী রায় মেনে নিতে কার্যত অস্বীকার করেন। আমাদের শাসনতান্ত্রিক দাবির জবাবে তারা কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতারণামূলক
পৃষ্ঠাঃ ৪১৬

আলোচনার চালাবার পরে সে আলোচনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি বা ব্যর্থতা ঘোষণার আগেই পঁচিশ মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিদ্রিত মানুষের ওপর ট্যাঙ্কের আক্রমণ চালালেন এর পরবর্তী ঘটনা ইতিহাসের অন্তর্গত। এখন আমরা জানি চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ বোঝাই সৈন্য আমদানি করার জন্য যতদিন সময়ের প্রয়োজন ছিল ততদিনই আলোচনা চলেছে। বাংলাদেশের চির নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণকে হত্যা করার অনেককাল পরে এই অত্যাচারের কৈফিয়ত হিসেবে বাঙালির হাতে অবাঙালী নিধনের কাহিনী উদ্ভাবন করা হয়।
ইয়াহিয়া ক্রমাগত অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরােধী মিথ্যা ভাষণের একটি হলাে শেখ মুজিব তাকে ঢাকায় গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। অথচ ঢাকায় তিনি সর্বক্ষণ তার জেনারেলদের নিরাপদ বেষ্টনির মধ্যে বাস করছিলেন । পঁচিশ মার্চ রাতে সামরিক বাহিনীর কাপুরােষিত আক্রমণে ছাত্র, শিক্ষক, বস্তিবাসী, শ্রমিক, রিক্সাওয়ালা এবং বাঙালী সৈন্য, পুলিশ, সীমান্ত রক্ষীদেরকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হয়। এখন বলা হচ্ছে শেখ মুজিবের লােকেরা ছাব্বিশ মার্চ সকালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দখল করার পরিকল্পনা করেছিল। সে পরিকল্পনায় বাধা দেবার জন্য এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু সমগ্র দেশবাসীর বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া যে সামরিক তৎপরতা চালিয়েছেন তাকে আগাম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা চলে না। এ সব মিথ্যা এতই অপটু যে তা দিয়ে পৃথিবীর কাছে প্রকৃত সত্য গােপন করা যায়নি, আর সে সত্য হচ্ছে এই যে, দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের আত্মশাসনের অধিকার অস্বীকার করাই হচ্ছে পশ্চিম-পাকিস্তানী সৈন্যদের প্ররােচনাহীন সামরিক তৎপরতার কারণে।
বাংলাদেশে আজ অশুভ শক্তির যে তাণ্ডব চলছে তাতে বৃহৎ শক্তিবর্গের দায়িত্ব অনস্বীকার্য। পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে এবং তাল ব্যবহারের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তা তারা পাকিস্তানের একনায়কত্ববাদী শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং পুঁজিবাদী হামলাতান্ত্রিক সামরিক চক্রের অভ্যুত্থানের সহায়তা করেছেন। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অধিকার ক্ষুন্ন করে তারা এই চক্রের পত্তন ও ফ্যাসিবাদী সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাদেরকে আগে উপলব্ধি করতে হবে যে, ইয়াহিয়া খানের হাতে আজ যে রক্ত লেগেছে তার দাগ তাদের হাতকেও স্পর্শ করেছে। আমেরিকার জনসাধারণও আজ বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের দেয়া অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের ফলেই বাংলাদেশে এই ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে পেরেছে।
বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের নামে আমার আবেদন, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তারা যেন রক্তপিপাসু সামরিক
পৃষ্ঠাঃ ৪১৭

অধিনায়কত্ববাদকে আর শক্তিশালী না করে তোলেন। তাদের কাছে আমার আবেদন, বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিক বাহিনী তুলে না নেয়া পর্যন্ত তারা যেন প্রত্যক্ষভাবে অথবা বিশ্বব্যাংক বিশ্ব অর্থ তহবিলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ সরকারের বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামাে সারিয়ে তোলার চেষ্টা না করেন। এ কথায় কারও যেন সন্দেহ না থাকে যে, ইসলামাবাদকে কোন রকম সাহায্য দেয়ার অর্থ পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সে শক্তি বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই শুধু ব্যবহৃত হবে। সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা চালিয়ে ও পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশকে জনশূন্য করার যে চক্রান্ত করেছে পাকিস্তান তার কয়েকটি দিক আছে। বাঙালি অবাঙালী বিরোধ সৃষ্টি করে তারা যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিল এখন ইচ্ছাকৃতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করে তারা তাই সিদ্ধি করতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশবাসী জানেন যে, আমাদের সংগ্রাম জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল মানুষের সংগ্রাম এবং আজ যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেশের পরিবেশ কলুষিত করার চেষ্টা করছে তারা শত্রুর চর ছাড়া আর কিছু নয়। শত্রুর এসব চরকে আমরা ক্ষমা করব না। সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় যেসব সমাজবিরােধী লুটতরাজ ও অত্যাচার-উৎপীড়ন চালাচ্ছে, তাদেরকে সমুচিত শাস্তি দেওয়া হবে।
লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকে ভারতের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তার অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পাকিস্তান সক্ষম হয়েছে। যে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধপীড়িত নির্মূল নরনারী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে তাদের ভরণপােষণের জন্য ভারত যা করছে তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিবৃতিতে বাংলাদেশের গণহত্যা ও পাশবিকত্বের প্রচণ্ড পরোক্ষ স্বীকৃতি রয়েছে। দুঃখের বিষয় এই বিলম্বিত আবেদন সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ অপ্রতুল, এর ওপর বর্ষাকাল আগত। মহামারীতে অবর্ণনীয় দুর্দশা হচ্ছে মানুষের। ভারত একাই এই সমস্যার ভার বহন করছে। অবশ্য বিশ্ব বিবেক যে নাড়া খেয়েছে তার পরিচয় সম্প্রতি পাওয়া যাচ্ছে। অত্যাচারিত হয়ে যারা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছে এবং দেশের অভ্যন্তরে যারা দুর্ভিক্ষে পীড়িত হচ্ছে তাদের জন্য আমরা সকল দেশের মানুষের কাছে সকল প্রকার সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছি। তবে এই সাহায্য সামগ্রী যাতে হানাদার সরকারের হাতে না পড়ে সে ব্যবস্থা তাদেরকে করতে হবে। নইলে এই সাহায্য সামগ্রী ব্যবহৃত হবে নিরপরাধ মানুষ হত্যার কাজে। আমি এ কথা সবাইকে জানাতে চাই যে, বাংলাদেশের শরণার্থীরা দেশে ফিরে আসতে উদগ্রীব। তাদের প্রত্যাবর্তনের সময় ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের তরুণেরা বিপুলসংখ্যায়
পৃষ্ঠাঃ ৪১৮

মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে । তারা জানে যে, স্বজনের দেশে ফিরিয়ে আনার এটাই একমাত্র উপায় ।বর্বর শক্তির জোরে যারা তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে তাদের মর্জির পর নির্ভর করে নয়। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে,পচিশ মার্চ থেকে বাংলাদেশে যে সকল নাগরিককে তাদের ঘরবাড়ি, জমি- জমা ও বিষয় সম্পত্তি থেকে বেআইনিভাবে উৎখাত করা হয়েছে, মুক্ত স্বদেশে তার সবই তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে।
বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের স্বীকৃতি দেবার জন্য আমরা পথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি । পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। আমাদের জনসাধারণ যে নির্যাতন ভোগ করছে, তার তুলনা পথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি নেই। কিন্তু শুধু সে জন্য নয়, আমাদের প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের জন্যই আমরা স্বীকৃতি দাবি করছি। আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে যে সমস্ত সরকার এখনও কোন স্থির মনােভাব গ্রহণ করেননি, যারা মাত্র মুখে এর প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এবং যারা এর বিরােধিতা করছেন তাদের সবাইকে আমি জানাতে চাই যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তিতে সে স্থান তার স্থায়ী হবে । মানব জাতির বৃহৎ এই অংশকে স্বীকৃতি না দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত? অথবা এসব রাষ্ট্রের স্বার্থে অনুকুল?
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের জন্য পৃথিবীর সকল দেশের কাছে আবার আমি অস্ত্র সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। যেসব মুসলিম ও আরব ভাইয়েরা এখনও বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা করে উঠতে পারেননি, তাদের কাছে আমার একটি বিশেষ নিবেদন আছে । ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশে ইসলামী ন্যায়নীতির জন্য যুদ্ধ করছে এ রকম ধারাণা তাদের পক্ষে এক দুর্ভাগ্যজনক ভ্রান্তি । জনসাধারণের ইচ্ছা ও মানব অধিকারকে বর্বরােচিতভাবে দমন করে তিনি ইসলামের দোহাই দিচ্ছেন। যে সংহতি নিজে ভেঙ্গেছেন শকুন দিয়ে মুসলমানের লাশ খাইয়ে, এখন তিনি ইসলামের নামে সেই সংহতি বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে আমাদের সংগ্রাম সম্পর্কে নীরবতার অর্থ ঔনিবেশিকতাবাদ ও বর্বরতার নিন্দা থেকে বিরত থাকা। আরবরা স্মরণ করে দেখুন, কিভাবে মুসলিম তুর্কীদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা মুক্তি সংগ্রাম করেছিলেন । পশ্চিম- পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই তারই অনুরূপ। যে পর্যন্ত না শত্রু শেষ হয় বা তারা দেশের মাটি থেকে সরে যায় ততদিন সংগ্রাম
পৃষ্ঠাঃ ৪১৯

চালিয়ে যেতে বাংলাদেশের মানুষ বদ্ধপরিকর।
ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহের সংগ্রামকে আমরা যেভাবে সমর্থন করেছি আমাদের সংগ্রামকেও সেভাবে সমর্থন করার জন্য আমরা তাদের কাছে আবেদন জানাই। বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আমাদের আবেদন দূরদৃষ্টির হিসাব ফেলে ন্যায় ও গণতন্ত্রের পক্ষ সমর্থনা করুন। দশ লক্ষ লােকের হত্যা ও পঞ্চাশ লক্ষ লোকের বিতাড়ন কোন সরকারের ঘরােয়া আমােদ বলে বিবেচিত হতে পারে না। আপনাদের দেওয়া সাহায্য যেন আর বাংলাদেশের শান্তিকামী স্বাধীনতাপ্রিয় গণতন্ত্রী মানুষের প্রতি কৃত অন্যায়কে আরও বাড়িয়ে না তোলে । বরং ইসলামাবাদের উন্মাদ শাসক চক্রের শুভবুদ্ধি জাগ্রত করার চেষ্টায় আপনাদের প্রভাব প্রয়ােগ করুন। বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা বিধান ও মুক্তি সাধনের ব্যবস্থা অবলম্বন করুন।
বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম দেশের পুষ্পপত্রের মতাে মাটি থেকে উদ্ভূত। যে অসহনীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করছিল সেই সম্পর্কের অবসান ঘটাবার জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা থেকেই এর উৎপওি।একে ভারতের প্ররোচনা বলে পাকিস্তান যে প্রচারণা চালাচ্ছে তা তার সুপরিচিত কৌশল। বাংলাদেশের সকল দাবি সম্পর্কেই এ রকম প্রচারণা হয়েছে, এতে আর কেউ কান দিচ্ছে না। এটা বলা দরকার যে, জাতিগত প্রয়ােজনের ভিত্তিতে আমাদের আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। কোনাে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত গােষ্ঠীর বিরুদ্ধেও এই আন্দোলন নয়। বাংলাদেশের যেসব নাগরিকের ভাষা বাংলা নয় তাদের কাছে আশা বরবাে যে, তারা যেন শত্রুর সঙ্গে হাত না মেলান অথবা নিজেদেরকে যেন হানাদার শাসক গােষ্ঠীর সগােত্র বিবেচনা না করেন। আমরা জানি অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে বিশেষ করে সিন্ধী, বালুচী ও পাঠান সৈন্যকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক লজ্জাজনক ও নিষ্ঠুর কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আমি তাদের কাছে আবেদন জানাই তারা যেন এ রকম অমানবিক কাজ করতে অস্বীকার করে সৈনিকের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখেন এবং অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাড়ান।
আমাদের মুক্তিফৌজ এখন শত্রুর মৃত্যুর ক্ষেত্রে প্রস্তুত করছে বাংলাদেশের জলায়, জঙ্গলে, নদীতে, পথে প্রান্তরে। রক্ত দিয়ে তারা আমাদের জাতিগত পরিচয়ের চিহ্ন অঙ্কন করেছে। যে নতুন রাষ্ট্রে আমাদের ভবিষ্যত নিহিত তার জন্য সংগ্রাম, করছে তারা। তাদের সাহস, আত্মােৎসর্গ ও কষ্ট স্বীকারের ক্ষমতা
পৃষ্ঠাঃ ৪২০

সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আদর্শস্বরূপ হয়ে রইবে। তাদের সাফল্য আসলে তাদের আত্মিক বলের জয়। এত কম উপকরণ নিয়ে এত নিষ্ঠুর শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে আর সংগ্রাম হয়নি। আমি তাদেরকে জানাতে চাই যে, সারা জাতির চিত্তে তারা বিরাজ করছে এবং প্রতিটি মানুষ তাদের সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করছে।
বীর দেশবাসী, এই সংগ্রামে আপনারা দুঃখ বরণ করেছেন, গৌরবও অনুভব করেছেন। এই দ্বৈত ধারায় আপনাদের বল বেড়েছে, শত্রুর শক্তি কমেছে। তার নৈতিক ও আর্থিক শক্তি বিনষ্ট। তার উপস্থিতি বিকৃত আমাদের কষ্টের কাল সংক্ষেপ করার জন্য একযােগে সকল ক্ষেত্রে শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে। রপ্তানি পণ্য, দ্রব্য যেন শত্রুর হাতে না পড়ে আপনাদেরকে তা দেখতে হবে। যেসব বিশ্বাসঘাতক শক্রর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে। যে মুক্তিফৌজ দেশের বাতাসকে কলুষমুক্ত করছে তার সঙ্গে একাত্মতা রক্ষা করতে হবে আমার আপনার এ সংগ্রামে সংগ্রামী সাথীদেরকে সাহায্য করুন। সাম্প্রদায়িক ও দলীয় সম্প্রীতির বিনাশে শত্রুর চরদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সতর্ক হোন এবং নিজেদের ন্যায্য লক্ষ্য ও অবশ্যম্ভাবী বিজয় সম্পর্কে আস্থা রাখুন। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।
শরণার্থী শিবির
পাকবাহিনী, শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের অত্যাচার এক কোটি শরণার্থী ভারতের পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও বিহারে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ৯১৮৮৫৩২ জন বাংলাদেশের নাগরিক ৯৩৫টি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করে।৩
শরণার্থীদের পরিসংখ্যান
রাজ্যের নাম আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা শরণার্থী সংখ্যা
পশ্চিমবঙ্গ ৬১৫ ৭৪৯৩৪৭৪
ত্রিপুরা রাজ্য ২৭৩ ১৪১৬৪৯১
মেঘালয় ১৭ ৬৬৭৯৮৬
আসাম ২৭ ৩১২৭১৩
বিহার ৩ ৮৬৪১
মােট ৩৯৫ ৯৮৯৯৩০৫
যুব অভ্যর্থনা শিবির
ভারতের সীমান্ত এলাকায় শতাধিক যুব অভ্যর্থনা শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়। যুব শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন একজন এমএনএ বা এমপিএ! প্রত্যেক ক্যাম্পে যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল। যুবকদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৪২১

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হতাে। জলপাইগুড়ি জেলার মূর্তি সেনানিবাসে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার জসি ও কর্নেল দাশের তওাবধানে ৪ সপ্তাহের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালী
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লন্ডন আমেরিকা, ভারত, জাপানসহ সকল দেশে বসবাসরত বাঙালীরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর গণহত্যার সংবাদ শুনে তারা প্রতিবাদ মিছিল করে এবং বিশ্ব জনমত গঠন করে। তারা অর্থ, অস্ত্র ও দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহ করে মুক্তিযােদ্ধা ও শরণার্থীদের সহায়তা করেছ। বিদেশী মিশনে চাকরিজীবী বাঙালীরা চাকরি বাসস্থান ত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লন্ডনে প্রকাশিত পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডন ছিলেন। তিনি জেনেভায় মানবাধিকার সম্মেলনে যােগ দেয়ার জন্য এসেছেন। ২৫ মার্চের ঘটনা শুনে তিনি ২৬ মার্চ লন্ডনে পৌছেন। তিনি প্রবাসী বাঙালীদের নেতা-সংগঠনের সাথে যােগাযােগ করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারকে বাংলাদেশে গণহত্যা সম্পর্কে অবহিত করেন। ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আহমদ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি নিয়ােগ করেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালীরা আবু সাঈদ চৌধুরীর সভাপতিতে বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি গঠন করে এবং সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ২৫ এপ্রিল ৫ সদস্যবিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন : আজিজুল হক ভূঁইয়া, কবীর চৌধুরী, মনােয়ার হােসেন, শেখ আবদুল মান্নান এবং শামসুর রহমান। স্টিয়ারিং কমিটির লন্ডন শাখা কমিটির সদস্য ছিলেন : গাউস খান- সভাপতি, মিনহাজউদ্দিন- সহসভাপতি, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন- সাধারণ সম্পাদক। লন্ডনে স্বাধীনতা সংগ্রামে আরও নেতৃত্ব দেন- ডা. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার, জাকারিয়া চৌধুরী, সুলতান শরীফ, শেখ মকসুদ আলী, ডা. শামসুদ্দিন প্রমুখ । লন্ডনের মহিলা সমিতি স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।৪

আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন
নিউইয়র্কে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দেন তারা লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরী সাথে সমন্বয় রেখে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। স্বাধীনতা আন্দোলন, বাংলাদেশ আন্দোলনকে আমেরিকায়
পৃষ্ঠাঃ ৪২২

অবস্থানরত বাঙালীদের মধ্যে ছিলেন : ফজলুর রহমান খান (এফআর খান), ড. খন্দকার আলী আলমগির এবং তার স্ত্রী ডা. রােকেয়া, কাজী শামসুদ্দিন আহমদ, প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, প্রমুখ । ডা, আলমগীর প্রথম আমেরিকায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তােলন করেন । মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে আমেরিকার বাঙালীরা লন্ডনে আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে আলােচনা করে আন্দোলন পরিচালনা করেন ।৫
দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্ক ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য এক অতি স্মরণীয় সঙ্গীত সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। জর্জ হারিসন, রবি শংকর, বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেন্টল, লিওন রাসেল, এরিথ ক্লাবটনসহ ৭৫ জন বিদেশী শিল্পীর সমন্বয়ে দি কনসার্ট ফর বাংলাদেশ কে উদ্যোক্তারা চব্বিশ লাখ চৌত্রিশ হাজার এক শ’ পঁচাশি, মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশ তহবিলে দান করেন।
জন বেজ লিখেছেন :
Bangladesh, Bangladesh Bangladesh
when the sun sinks in the west die a
million people of Bangladesh
জর্জ হ্যারিসন নিজের সুরে গেয়ে ওঠেন
My friend come to me
We get to release Bangladesh
Now please let your hand
Please the people of Bangladesh.
ইংল্যান্ডের তরুণ-তরুণীরা এ্যাকশন বাংলাদেশ’ গঠন করে অনেক অনুষ্ঠান করে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করে।
১৯৭১ সালের জুন মাসে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সােলায়মান করাচী থেকে ইয়াহিয়া খানের সরকারকে সমর্থন দেয়ার ফলে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এ সময় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদ সােহরাওয়ার্দী লন্ডন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে বিবৃতি দেন। রাশেদ সােহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলাদেশকে সমর্থন করায় মুক্তিযােদ্ধারা অনুপ্রাণিত হয়।৬
পৃষ্ঠাঃ ৪২৩

১৮
মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকা
চীন ও জাতিসংঘের ভূমিকা

ভারত
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তার সরকার ভারতের জনগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন ও ১৭ এপ্রিল সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়ােজনে ভারত সার্বিক সহযােগিতা করেছে। ভারত এক কোটি শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে জনগণ, শিক্ষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছে, আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। পরিশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ১৪ দিনের যুদ্ধে ভারত পাকিস্তানকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে।

সােভিয়েত রাশিয়া
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানের বর্বর হামলার প্রতিবাদে বহির্বিশ্বে প্রথম সােভিয়েত রাশিয়া এগিয়ে আসে। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগনি ইয়াহিয়া খানের নিকট লিখিত পত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিল্লীতে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে The Indo-Soviet Traty of Peace, Friendship and Co- operation, 9 August 1971 স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে ছিল দুই দেশের মধ্যে কোন দেশ তৃতীয় দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে একে অপরকে সাহায্য করবে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে দেয়া। সপ্তম নৌবহরকে প্রতিহত করার জন্য রাশিয়া নৌবহর প্রেরণ করে। বাধ্য হয়ে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর প্রত্যাহার করে নেয়।
সােভিয়েত রাশিয়া ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর ২ বার এবং ১২ ডিসেম্বর
পৃষ্ঠাঃ ৪২৪

তৃতীয়বার ভেটো প্রয়ােগ করে। চীন-আমেরিকার যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের পথে নিয়ে যায় ।
আমেরিকা
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে আমেরিকা প্রশাসন পাকিস্তানকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পরামর্শদাতা কিসিঞ্জার মুক্তিযুদ্ধকে নস্যাৎ করার ষড়ন্ত্র করতে থাকে। আমেরিকা বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে। অন্যদিকে আমেরিকার জনগণ, সিনেট ও কংগ্রেস সদস্যগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেন। সিনেট সদস্য এডওয়ার্ড কেনেড়ি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাহায্য করে এবং ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
চীন
১৯৭১ সালে চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রবল বিরােধিতা করে। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত চীনের শত্রু এবং পাকিস্তান চীনের মিত্র। এ কারণে চীন আরও মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে এবং পাকিস্তানে নগ্নভাবে সমর্থন দেন। ১৯৭১সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণ করার পর থেকে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে আসে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানকে সমর্থন করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট পত্র লিখেন। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে চীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাবিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করে। এ কারণে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বিজয় লাভের পর থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদে বাধা প্রদান করে।
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ
১৯৭১ সালে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল- জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী সদস্য পদ লাভ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। জাতিসংঘ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেনি। কিন্তু জাতিসংঘে সােভিয়েত ইউনিয়ন তিনবার ভেটো প্রয়ােগ করে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
বাংলাদেশে সংঘটিত ট্রাজেডির সংবাদ পেয়ে ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট পত্র লেখেন, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য প্রদানের প্রস্তাব পাঠান। তিনি প্রিন্স সদরউদ্দিনকে শরণার্থীদের জাতিসংঘের হাইকমিশনার নিয়ােগ করেন। ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণ করে। জন
পৃষ্ঠাঃ ৪২৫

কেলিকে ঢাকায় ইউএন রিলিফ হাইকমিশনারের প্রতিনিধি নিয়ােগ করা হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব সকল রাষ্ট্র ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি আহবান জানান। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর প্রিন্স সদরুদ্দিন জানান যে, ১১৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পেয়েছেন। এ ছাড়া কয়েক মিলিয়ন ডলার মূল্যের কাপড়, কম্বল ও খাদ্য সাহায্য পেয়েছেন। জাতিসংঘ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য অব্যাহত রাখে । স্বাধীনতার পর জাতিসংঘ বাংলাদেশে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করে।
নিরাপত্তা পরিষদের সাহায্য
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান আক্রমণ করে সাথে ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্র আক্রান্ত হওয়ার অভিযােগ করে জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের নিকট পত্র লেখে। মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। ৪ ডিসেম্বর ৮টি দেশের অনুরােধে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন বসে । নিরাপত্তা পরিষদ ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবের ওপর ভােট গ্রহণ করে। প্রস্তাবের পক্ষে ১১ ভােট, বিপক্ষে ২ ভোট সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পােল্যান্ড। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স ভােটদানে বিরত থাকে। সােভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রয়ােগের ফলে ৮ সদস্যের প্রস্তাব অকার্যকর হয়। ৬ ডিসেম্বর পুনরায় ৬ সদস্য দেশ যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে সভায় পেশ করলে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাবের পক্ষে ১ ভােট- বিপক্ষে ২ ভােট- সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পােল্যান্ড। সাধারণ পরিষদ ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ৮ সদসাের প্রস্তাব সাধারণ পরিষদে আলােচনা হয়। যুদ্ধ বিরতিতে সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রয়ােগ করলে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪ ভােট এবং বিপক্ষে ১১ ভােট এবং ১০টি দেশ ভােটদানে বিরত থাকে। একই দিনে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে প্রেরণ করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর মুলতবি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বের মতাে পক্ষে ১১, বিপক্ষে ২ ভােট- সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পােল্যান্ড। সােভিয়েতের ভেটো দানের ফলে যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। পর পর তিনবার ভেটো প্রয়ােগ করে সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঁচিয়ে রাখে। সেদিন যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার গৃহীত হলে মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ হয়ে যেত এবং ভারতকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হতাে। ভারতীয় সৈন্য চলে গেলে বাংলাদেশ ভিয়েতনাম বা বায়াফ্রা হয়ে যেত।
পৃষ্ঠাঃ ৪২৬

১৯
মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা
‘জয় আমাদের কজায় তাজউদ্দীন আহমদ
মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান
২৬ মার্চ থেকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রামের ৩টি স্বতন্ত্র ধারা সৃষ্টি হলাে। প্রথম ধাৱা ছিল আক্রান্ত বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর-এর সেনা ও অফিসারদের সমবায়ে গঠিত। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল বাঙালী সৈন্য ও অফিসার যে এতে যােগ দিয়েছিল তা নয়। অনেকে নিরস্ত্ৰকৃত হয়েছে। অনেকে বন্দী হয়ে থেকেছে। আবার অনেকে শেষ অবধি পাকিস্তানীদের পক্ষে সভায় থেকেছে। বিদ্রোহ ও প্রতিরােধ যুদ্ধে ইপিআরের অংশগ্রহণ বরং ছিল অনেক বেশি ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত। যেমন ছিল বাঙালী পুলিশদের ।
স্বাধীনতা সংগ্রামে দ্বিতীয় ধারার সমাবেশ ও গঠন প্রথম ধারার মতাে আকস্মিক কি ছিল না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আওয়ামী যুব সংগঠনের শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ এবং আবদুর রাজ্জাক সরাসরি কলকাতায় এসে পড়েন। তারা শেখ মুজিবের বিশেষ আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। ভারতে প্রবেশের পর থেকে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপারে এক স্বতন্ত্র গােষ্ঠীগত ভূমিকা গ্রহণ করেন । তারা RAW-এর পৃষ্ঠপােষকতায় বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে মুজিব বাহিনী গঠন করেন। মুজিব বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিভক্ত করতে উদ্যত হয়।
তৃতীয় ধারা আওয়ামী লীগ- স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলধারা। মূল ধারার প্রধান চালক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক- দু’দশকের অধিককাল বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী । ১৯৬৪ সাল থেকে দলীয় সকল কর্মসূচীর, নীতিমালার অন্যতম মুখ্য প্রণেতা। দলের সকল কর্মকাণ্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচারবিমুখ সংগঠক। অসহযােগ আন্দোলনের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের
পৃষ্ঠাঃ ৪২৭

পরেই ছিল তার স্থান।
১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কেসি সেনগুপ্তের সাথে আলােচনা করেন। দ্বিতীয়বার তাজউদ্দীন সেনগুপ্তের সাথে আলােচনা করে জানতে পারলেন আক্রান্ত হলে ভারত সরকার আশ্রয় ও সম্ভাব্য সহযােগিতা করবে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য ৩০ এপ্রিল দায়িত্ব দেয়া হয়। ৯ মে মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়, চার সপ্তাহ মেয়াদী ট্রেনিং। মে-জুন মাসে হতাশা ও বৃষ্টির মধ্যে প্রকৃত ট্রেনিং শুরু হলাে।
মঈদুল হাসান মূলধারা ‘৭১ গ্রন্থে লিখেছেন :
“মে মাসে এমনিতেই প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ মহলে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা শুরু হয়েছে। মন্ত্রিসভার অবশিষ্ট তিনজন সদস্য প্রধানমন্ত্রিত্নের পদ নিয়ে স্ব-স্ব দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় কম বেশি তৎপর। মন্ত্রিসভার বাইরেও তাজউদ্দীনবিরােধী প্রচারণায় উৎসমুখ একাধিক। শেখ মুজিবের গ্রেফতার হওয়ার কারণ থেকে শুরু করে স্বীকৃতিদানে ভারত সরকারের বিলম্ব পর্যন্ত অনেক অঘটনের জন্যই সরাসরি তাজউদ্দীনকে দায়ী করে এক প্রবল প্রচার আন্দোলন চলতে থাকে আওয়ামী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে।
২ জুন নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের সমন্বয়ে সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় পাঁচটি আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাউন্সিল গঠন করা হয়।
প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় প্রভাবমুক্ত সংস্থা হিসেবে গড়ে ওঠে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাঁচটি অসম্পূর্ণ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে ইপিআর বাহিনীর লােকজনদের একত্রিত করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (জুলাই থেকে নিয়মিত বাহিনী নামে পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১২ ও ১৩ মে কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে মাইদুল ইসলামের আলােচনা হয়। তার আগেরদিন তাজউদ্দীন দিল্লী থেকে এসেছেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি সােভিয়েত ইউনিয়নসহ সকল কমিউনিস্ট দেশকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান ও মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করার আহবান জানান।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব পিএন হাকসার, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা অধ্যাপক পিএন ধর, পররাষ্ট্র সচিব টিএন কল, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শদাতা জি পার্থ সারথি, পরিকল্পনামন্ত্রী সি সুব্রামনিয়ম এবং ডিপি ধর মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করে।
পৃষ্ঠাঃ ৪২৮

জুলাই মাসে ৩টি, সমবায়ে একটি ব্রিগেড এবং সেপ্টেম্বরে আরও ৩টি নতুন ব্যাটেলিয়ন সৃষ্টি করা হয়।
জুলাই মাসে মাসে মেঘালয়ের তুরা অঞ্চলে ১, ২ ও ‘৮ ইবি তিন ব্যাটেলিয়ন সমন্বয়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বপ ব্রিগেড গঠন করা হয়। মেজর খালেদ ৪ ইবি এবং শফিউল্লাহ ২ইবির দায়িত্বে ছিলেন।
মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ শুরু হয় দেরাদুনের অদূরে চকরাতায় । শেখ মনির দাবি ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধু কর্তৃক মনােনীত তাকেই সমগ্র বাহিনী গঠনের জন্য; কোন কারণে লীগ ব্যর্থ হলে বিকল্প নেতা হিসেবে তাদের সংগঠিত রাখা। কোন কারণে মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বামপন্থীদের হাতে নেতৃত্ব চলে যাবে।
১১ সেপ্টেম্বর এসএমএ এনায়েত হােসেন খানের সভাপতিত্বে সভা হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগের জন্য হাইকমান্ডকে অনুরােধ করা হয়।
১৬ সেপ্টেম্বর ডিপি ধর ৩ দিনের জন্য কলকাতায় আসেন। ডিপি ধর ১৮ ডিসেম্বর কলকাতায় আসেন, ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ পাবনার ডিসি নুরুল কাদের খানকে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিব হিসেবে নিয়ােগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি রূপকার। তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই নিয়ােগ আদেশ লেখেন। বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগ পর্যন্ত মন্ত্রী পরিষদের সভার অধিকাংশ সিদ্ধান্ত ও অন্যান্য রেকর্ড নিজ হাতে লিখতেন। প্রধানমন্ত্রী সকল কাজ বাংলায় করার নির্দেশ দেন।
সচিবালয়ের কাজ একই ভবনে করা সম্ভব ছিল না। তাই বিভিন্ন জায়গায় সচিবদের বসতে হয়েছে। তবে ৮ নম্বর থিয়েটার রােডেই বেশিরভাগ মন্ত্রণালয়ের কাজ হতাে। এখানে মন্ত্রিপরিষদ, প্রতিরক্ষা, সংস্থাপন, অর্থ, পরিকল্পনা, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের দপ্তর ছিল।
তথ্য, বেতার, আইন, মন্ত্রণালয়ের দপ্তর ছিল বাংলাদেশ মিশন ৯ সার্কাস এভিনিউতে । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছিল ৪৫ প্রিন্সেস স্ট্রিট, শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছিল ২২ সি লােয়ার সার্কুলার রােডে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা ভবনে।
৮ নম্বর থিয়েটার রােডের নিচতলায় বসতেন প্রধানমন্ত্রী। পাশেই ছিল তার শয়ন ও আহার কক্ষ। নিচতলায় প্রধান সেনাপতি, সংস্থাপন সচিব ও স্বাস্থ্য সচিব বসতেন। দ্বিতীয়তলায় ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, অর্থ সচিব, ইউসুফ আলী, ফণী ভূষণ মজুমদার প্রমুখের দপ্তর। মন্ত্রিপরিষদের
পৃষ্ঠাঃ ৪২৯

সভা দ্বিতীয়তলায় বসত।
সংস্থাপন সচিব মােহাম্মদ নুরুল কাদের বলেন ,
মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত সরকার কাঠামো ছিল বাস্তবমুখী এবং প্রকৃত অর্থে বেসামরিক প্রশাসনের প্রতিভূ। এটা সম্ভব হয়েছিল,প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রঙগাজনিত পদক্ষেপের কারণে।প্রকৃত অর্থে সিভিল সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে এ ধরনের পদক্ষেপ হতে, অনুকরণীয়। তিনি এমন একটা প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যেখানে , গণতান্ত্রিক রাজনীতি গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ হবে সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী। আবার আমলাতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তাকেও তিনি অবমূল্যায়ন করেননি । আমালারা জনগণের সেবক এবং জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এমন একটা ধারণা মুজিবনগর প্রশাসন দেখে সস্পষ্টভাবে বলা যায়। এই চিন্তা চেতনা থেকেই জোনাল কাউন্সিল গঠিত হয়।”

জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল
জোনাল কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে তাজউদ্দীন আহমদের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণের যে উদাহরণ তৈরি করেছেন তা আজও অনুকরণযোগ্য হতে পারে। প্রতিটি জোনাল কাউন্সিলরই ছিল একেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট। এর কার্যপরিধি লক্ষ্য করলে এই বক্তব্যের যথার্থতা লক্ষ্য করা যাবে। জনপ্রতিনিধিত্বশীল শক্তিশালী শাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলাই ছিল জোনাল কাউন্সিল গঠনের অন্যতম লক্ষ্য। এর বৈশিষ্ট্যগুলোকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখবঃ
১. ভারতে অবস্থানকারী প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে সরকারের প্রশাসনিক
নিয়ন্ত্রনে আনা।।
২. কেন্দ্রে ও মাঠ পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামাে গঠন।
৩. সেনাবাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের অধীনে ন্যস্ত করে গণআর্মির রূপ দেয়া
৪. প্রশাসনকে নিয়ম-
শৃঙ্খলায় আনা (এর পরিপূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছে
নিয়ােগ, পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, ডিসিপ্লিনারি এ্যাকশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে)।
পাশাপাশি যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সরকারের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় যাতে কোন রকম ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয় সেই ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছিল। প্রশাসন ক্ষেত্রে দক্ষ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছিল বলেই যুদ্ধ-পরবর্তী প্রশাসনিক কাঠামাে পুনর্গঠনে উল্লেখযােগ্য কোন জটিলতা সৃষ্টি হয়নি। আর এ একারণেই যুদ্ধ চলাকালেই নতুন একটি সরকারের সাথে বহির্বিশ্বের যােগাযােগ
পৃষ্ঠাঃ ৪৩০

স্থাপন করা সম্ভব হয়েছে আশানুরূপ। অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বিষয়টি অনেকাংশে প্রশাসনিক সুষ্ঠু পদক্ষেপের কারণে সম্ভব হয়েছে ।
২৪ জুন মন্ত্রি পরিষদের বৈঠকে প্রশাসনিক কাঠামাে সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা হয়। সিদ্ধান্ত হয় সারা দেশকে মােট ছয়টি প্রশাসনিক জোনে ভাগ করতে হবে।অবশ্য পরবর্তী সময়ে পর্ষায়ক্রমে এই জোনের সংখ্যা ১১টিতে উন্নীত হয়।
জোনের এডমিনিস্ট্রেটিভ ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে এক সরকারী বিজ্ঞপ্তি বলে জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলগুলো গঠিত হয় । জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ও তাদের অধীনস্থ এলাকা ছিল নিম্নরূপ :

এলাকা চেয়ারম্যান হেডকোয়ার্টার। প্রশাসনিক কর্মকর্তা
দক্ষিণ-পূর্ব জোন-১- নূরুল ইসলাম এমএনএ। সারলেন। এস এ সামাদ সিএসপি
দক্ষিণ-পূর্ব জোন-২-জহুর আহমদ চৌধুরী এমএনএ আগরতলা কাজী রকিবউদ্দিন সিএসপি
পূর্ব জোন-কর্নেল এম এ রৰ এমএনএ। ধর্মনগর। ডা, কে এ হাসান
উতল-পূর্ব কোন-১- দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ। ডাউকি এম এইচ চৌধুরী
উত্তর-পূর্ব জোন২-হামিদুর রহমান খান এমএনএ। কোরা এ এইচ চৌধুরী
উত্তর জোন- মতিউর রহমান এমএনএ কোচবিহার ফয়েজ উদ্দিন আহমদ ইপিসিএস
পশ্চিম জোন-১- আবদুর রহিম এমএনএ বালুরঘাট এম এ কাশেম ইপিসিএস
পশ্চিম জোন-২- আশরাফুল ইসলাম এমপি মালদহ জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া ইপিসিএস
দক্ষিণ-পশ্চিম জোন-১- এ রউফ চৌধুরী কৃঞনগর
দক্ষিণ-পশ্চিম জোন-২ -ফণী ভূষণ মজুমদার বনগাও। বিবি বিশ্বাস ইপিসিএস
দক্ষিণ জোন- আ, রব সেরনিয়াবাত এমএনএ বারাসত আবদুল মােমেন ইপিসিএস

এলাকাভিত্তিক জোনাল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা হয়। জোনের অন্তর্গত জেলার এমএনএ, এমপিএ নিজ নিজ এলাকার জোনের সদস্য ছিলেন। সদস্যগণ তাদের মধ্যে একজনকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন। প্রত্যেক জোনের প্রশাসক কর্মকর্তা জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের সদস্য সচিব ছিলেন। প্রত্যেকে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের নিজস্ব সচিবালয় ছিল।।
জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলের দায়িত্ব ;
১, মন্ত্রিপরিষদ গৃহীত সিদ্ধান্তগুলাে বাস্তবায়ন করা এবং রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরামর্শ ।
২. জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করা এবং সরকারের প্রয়ােজনীয় নির্দেশ পরামর্শ অবহিতকরণ ।
৩, বাংরাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ। স্থানীয়

পৃষ্ঠাঃ ৪৩১

এজেন্সি ও সংস্থাগুলাের সাথে এতদসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা।
৪. রিলিফ ক্যাম্পগুলাে পরিচালনা এবং দুষ্কৃতকারী থাকলে তা
৫. যুৱ শিবির পরিচালনাকল্পে তাদের সামগ্রিক সহায়তা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণ ।
৬. প্রতিটি জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল সেক্টর কমান্ডারদের কার্যক্রমে সমন্বয় করবে এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযোগ রক্ষা করবে
৭. মুক্ত এলাকায় জোনাল কাউন্সিল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করবে
৮. সদস্য সচিব চেয়ারম্যানের সাথে আলোচনা সভা আহবান করবেন প্রত্যেক জোনাল কাউন্সিলদের সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ৫টি করে সাব- কমিটি কাজ করেছে :
সাব-কমিটি
১. ফাইন্যান্সি সাব-কমিটি
২. রিলিফ সাব-কমিটি
৩. স্বাস্থ্য সাব-কমিটি
৪. পাবলিসিটি সাব-কমিটি
৫. এডুকেশন সাব-কমিটি
প্রত্যেক সাৰ-কমিটিতে এমএনএ, এমপিএ বা নেতৃবৃন্দ সদস্য থাকতে তারা নিজেরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবে। প্রত্যেক জোনে জোনাল হেলথ অফিসার শিক্ষা অফিসার, রিলিফ অফিসার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, তথ্য প্রভৃতি অফিসার ছিল |
জোনাল কাউন্সিলের গঠন প্রণালী, কার্যাবলী দেখে মনে হয় যে প্রত্যেক কাউন্সিল স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রশাসনিক ইউনিট ছিল না। কাউন্সিলে যেমন দক্ষ আমলাদের উপস্থিতি ছিল, আবার কাউন্সিলের নেতৃত্বে ছিলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রত্যেক কাউন্সিল ছিল গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রশাসনের জবাবদিহিতা ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে । তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালে আমালা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অপূর্ব সমন্বয় ভিত্তিক প্রশাসন কার্যকর ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে যা সম্ভব ছিল আজ তা সম্ভব নয় কেন?
যুব শিবির : জোনাল এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল যুব ক্যাম্প পরিচালনা করতে। যুৰ ক্যাম্প ছিল মুক্তিযােদ্ধার মূল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়- চারটি রাজ্যে ১০৬টি যুব ক্যাম্প।

পৃষ্ঠাঃ ৪৩২

ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশ ছিল কৃষকের সন্তান। অথচ তারা সীকৃতি পায়নি। যুব ক্যাম্পের অধিকাংশ দায়িত্বে ছিলেন একজন এমএনএ বা একজন এমপিএ।তাদের সাথে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্য; বাংলার সামরিক বাহিনি ও পুলিশ সদস্যরা প্রশিক্ষণ দিত।
যুব ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমএনএ/এমপিও
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য
নাম যুব ক্যাম্পের নাম
নুরুল ইসলাম মঞ্জুর এমএনএ – তাকি পুর ২৪ পরগনা
মােশাররফ হােসেন- হাফিস পুর
নুরুল ইসলাম এমপিএ- হাসনাবাদ ২৪ পরগনা
লেঃ মতিউর রহমান এমপি- তালিখোলা,চাপাবাড়িয়া
হাদিউজ্জামান এমপিএ- ঘোষপুর
মতিউর রহমান এমপিএ- রানাঘাট
আবুল হাশেম মােক্তার- মাঝদিয়া
আবদুর রব এমপিএ- কেচুডাঙা
আবদুর রউফ চৌধুরী- করিমপুর
শহীদউদ্দিন এমএনএ-বেতাই,মুর্শিদাবাদ
এ হাদী এসপিএ- লালগোলা,মুর্শিদাবাদ
ডা. মেজবাহুল হক এমপি-শেখপাড়া,পশ্চিম দিনাজপুর
ড, নইমুদ্দিন- ডালিমগাও
এসএম ইউসুফ এমপিএ-
শাহ মাহতাব এমপিএ -গঙ্গারাম
অধ্যাপক সাঈদ এমপি- কুরমাইল
আবদুর রহিম এমপি- কলকাতা কুমারগঞ
আজিজুর রহমান এমএনএ-মেলন
ডা, মাশরুল হক এমপিএ- তাপান
ফজলুল করিম এমপিএ- খোকরাবাড়ি
আবদুর রশীদ-
আফসার আলী আহমেদ এমএনএ-দেওয়ানগঞ্জ, জলপাইগুড়ি
এ মজিদ, তারা মিয়া- বাঘমারা, মেঘালয়
অধ্যক্ষ মতিউর রহমান- ডালু মেঘালয়
লতিফ সিদ্দিকী এমপি-মেহেন্দীগঞ্জ, মেঘালয়
পৃষ্ঠাঃ ৪৩৩

আবদুল মােমেন এডভােকেট- করিমগঞ্জ, আসাম, ত্রিপুরা
এম এ মান্নান-হারিণা
খায়রুদ্দিন মাহমুদ এমপিএ- হরিশামুখ
অধ্যাপক মােহাম্মদ হানিফ এমএনএ- রাজনগর
খাজা আহমদ এমএনএ- ছােট খলিস
জালালউদ্দিন আহমদ এমপি- কাঠালিয়া
ক্যাপ্টেন এম আলী- উদয়পুর
ক্যাপ্টেন আলম- মতিনগর
আমিরুল ইসলাম এমপি- কোনাবন
এম এ রশীদ এমপিএ- হাতিমারা
অধ্যাপক এ রউফ এমপিএ- বক্সনগর
মােঃ শামসুল হক এম পি এ- চারিপাড়া
আফজাল হােসেন এমপি- জয়নগর
ডি এ আব্বাস এম এন এ- নরসিংগড়
শরীফুদ্দিন এমপি-মােহনপুর
মােস্তফা শহীদ এমপিএ-খােয়াই
মানিক চৌধুরী এমএনএ-কৈলাশহর
এ রহিম এমএনএ-করিমগঞ্জ
ফজলুর রহমান এমএনএ-কংগ্রেস ভিলা
আলী আজম এমএনএ-গােমতী-১
সৈয়দ ইমদাদুল বারি এমপিএ-বিজনা
কাজী আকবর উদ্দিন আহমেদ এমপিএ – তিতাস
আফতাবউদ্দিন ভূইয়া এমএনএ – হাপানিয়া
জামালউদ্দিন আহমদ এমপিএ-ইছামতি
আমির হােসেন এমপিএ-গােমতী-২
আবুল বাশার- কলমনগর
তাইমুজ আলী এমপিএ-ধর্মনগর
আবদুল আলিম-করিমগঞ্জ

পৃষ্ঠাঃ ৪৩৪

যুব ক্যাম্পের কার্যক্রম
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। যুব ক্যাম্পের কার্যক্রম জনযুদ্ধের ভিওিতে গ্রহণ করা হয়। তাদের শ্লোগান ছিল- গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, শেখ মুজিবের অস্ত্র ধর। যুব শিবির বাের্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন যুব ক্যাম্পের অবস্থানকারী যুবকদের জন্য প্রশিক্ষণ কারিকুলাম তৈরি করা হয়। তাদের রাজনৈতিক, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হতাে। একই সাথে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হয়। যুব শিবির পরিচালনা ছিল সরকারের যুদ্ধকালীন সুদূরপ্রসারী নীতির অন্যতম। এটি ছিল তৃণমূল পর্যায়ে সশস্ত্র যুদ্ধকে শক্তিশালী করার একটি প্রধান উপায়। কারণ এই কার্যক্রম এমন একটা ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, সশস্ত্র যােদ্ধা তৈরি করা, পাশাপাশি উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া, বেসামরিক সরকার পরিচালনা তথা দেশের অভ্যন্তরে অবরুদ্ধ মানুষ এবং প্রায় এক কোটি শরণার্থীর সকল সমস্যা সমাধানে একটি পথ নির্দেশিকা ছিল এখানে। “এমন সুন্দর একটি পরিকল্পনাও সহজভাবে কার্যকর হয়নি। সরকারকে অভ্যন্তর থেকেই প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর এক্ষেত্রেও তাজউদ্দীন সাহেবের ধীর স্থির চিন্তা ও কৌশলের কারণে সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে । বাংলাদেশ সরকারে গঠন নিয়ে প্রথম অবস্থায় কিছুটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। তাজউদ্দীন সাহেবের সিদ্ধান্তকে স্বল্পসংখ্যক লোক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। এমন অবস্থায় যে কোন মুহূর্তেই অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। যাকে আমরা দলীয় কোন্দল বলে মনে করতে পারি।
এক্ষেত্রে আমরা শেখ ফজলুল হক মনির কথা বলতে পারি। তাজউদ্দীন সাহেব প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এটা তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ বিশ্ববাসী তাজউদ্দীন আহমদকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বীকার করেছেন। এটা ছিল রাজনৈতিক মতানৈক্য। যার গুরুত্ব সময়ে বিবেচ্য কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা এসেছিল ভিন্নপথে, যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
সরকারের অভ্যন্তরেই একটি গ্রুপ ছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্ন পথে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছিল তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে সাধারণ মানুষও এ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে।
খন্দকার মােশতাক আহমদ, মাহবুবুল আলম চাষী প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম থেকে ষড়যন্ত্র শুরু করে। প্রথমে মাহবুবুল আলম চাষী যুব শিবিরের দায়িত্ব
পৃষ্ঠাঃ ৪৩৫

পালন করত। অন্তর্কলহ নিসরনের লক্ষ্যে ইন্দিরা গান্ধী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. এিগুনা সেনকে প্রেরণ করেন। মাহবুবুল আলম চাষীর তিন মাসে তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণের কর্মসূচীর সাথে সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের দ্বিমত পোষণ করেন । নূরুল কাদের খান বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে অবহিত করেন। প্রধানমন্ত্রী মাহবুবুল আলম চাষীকে সরিয়ে অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যুব ক্যাম্প পরিচালনার জন্য চেয়ারম্যান নিযুক্ত এবং সচিব হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবেন নূরুল কাদের। সংস্থাপন সচিবের অফিস ছিল রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীর অফিসের একটি কক্ষে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গোপনে সচিব নুরুল কাদেরকে নিয়ে দিল্লী গমন করেন এবং ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। আলােচনায় ইন্দিরা গান্ধীকে সহায়তা করেন ড. ত্রিগুণা সেন এবং তাজউদ্দীনকে সহায়তা করেন নুরুল কাদের। মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ ও কাঠামাে নিয়ে আলােচনা হয়। তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে আমাকে যুব প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে প্রতিদিন ক্যাম্পগুলাের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাত্র ৬ মাস সময়ে এসব প্রশিক্ষণ শিবির থেকে এক লাখ তিন হাজার যুবককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যা আমার জীবনের অন্যতম গর্বের স্মৃতি হিসেবে গণ্য করি ।
মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উল্লেখযােগ্য দিক ছিল প্রশাসনিক দেশাত্মবােধের নিরিখে সাজানাে। যুদ্ধকালীন সরকার বিজয় -পরবর্তী সরকার পরিচালনাকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করা হয়েছে; সঙ্গত কারণে প্রশাসনিক সুবিন্যাসের বিষয়টি পরিকল্পনাভুক্ত হয়েছে। যুদ্ধকালীন সরকার কার্যএম পরিচালনার দিক নির্দেশনার পাশাপাশি স্বাধীনতা লাভের পর কোন পর্যায়ে কি পদক্ষেপ নিতে হবে তার একটা ছক তৈরি করা হয়। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানাের পদক্ষেপ নেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে সাথে সরকারকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এ জন্য স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত সরকার গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকারের উপস্থিতি বিষয়টি জড়িত। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। তিনি এমন একটি সরকার ব্যবস্থা গড়ে তােলেন যেখানে মন্ত্রী পার্লামেন্ট সদস্য এবং সিভিল সার্ভেন্টদের মধ্যে একটি সুসমন্বিত ব্যবস্থার উদাহরণ সৃষ্টি করেন।
মুজিবনগর সরকারের সমস্যা ছিল উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের অভাব । পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত বাঙালী ও পাকিস্তানী কর্মকর্তার সংখ্যা :

পৃষ্ঠাঃ ৪৩৬

পদ বাঙালী পশ্চিম পাকিস্তানী
সচিব/অতিরিক্ত সচি ১৪ ৮৬
যুগ্ম সচিব ৬ ৯৪
উপসচিব ১৮ ৮২
অন্যান্য। ২০ ৮০
অধিকাংশ বাঙালী কর্মকর্তা পশ্চিম পাকিস্তানে আটক ছিল । কোন সচিব বা অতিরিক্ত সচিব মুজিবনগর আসতে পারেনি। একমাত্র যুগ্ম সচিব ছিলেন খন্দকার আসাদুজ্জামান- অর্থ সচিব। উপসচিব পর্যায়ে কয়েকজন সিএসপি ও ইপিসিএস স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারে যােগ দিয়েছিলেন। অধিকাংশ সিএসপি ও ইপিসিএস কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার ও সহকারী সচিব পদমর্যাদার ছিলেন। কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের দিয়ে মুজিবনগর সরকারের শূন্যতা পূরণ করা হয়। যুদ্ধকালীন প্রশাসন সফল বলে প্রমাণিত হয়েছে। স্বাধীন দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার কাঠামাের প্রস্তাব প্রফেসর মােজাফফর আহমদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করেন। তার সুপারিশ পরবর্তীতে বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।
“বেসামরিক প্রশাসন পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য মন্ত্রিপরিষদ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে :
১৯টি জেলায় ডিসি ও এসপি নিয়ােগ করা হয়।
অবরুদ্ধ দু’অঞ্চলে যারা চাকরিরত ছিলেন তারা স্ব-স্ব পদে বহাল থাকবেন। তবে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ দিয়েছেন তারা স্ব-স্ব স্থানে যােগদান করবেন।
দ্রুত বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে
“ সেপ্টেম্বর মাস থেকেই তাজউদ্দীন সরকার চিন্তা করেন যে, যুদ্ধের গতিকে আরও তীব্র করতে হবে। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভের প্রচেষ্টা বেড়ে যায় তখন থেকে।
সরকারের এই অভিলাষের পেছনে বেশ কিছু যুক্তি কাজ করছিল। তাজউদ্দীন সাহেব যদি তখন সময় মতাে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হতেন তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চিত্র হয়তাে ভিন্নরকম হয়ে যেত। সরকার যুদ্ধকে তীব্রতর করে পাকিস্তানীদের মরণ আঘাত হানার পরিকল্পনা করেছিল নানা কারণে। প্রধান কাজ ছিল অধিকৃত এলাকায় গভর্নর ডা, এস এ মালার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার গঠন। কিন্তু পাকিস্তানের পুতুল সরকার বিশ্ব সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তান অধিকৃত এলাকায় বেসামরিক প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।
পৃষ্ঠাঃ ৪৩৭

পাকিস্তান সরকারের এজেন্টরা মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ও সচিব মাহবুবুল আলম চাষি বিপক্ষে কাজ করছিল। তাদের প্রস্তাব ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির শর্তে যুদ্ধ বিরতি ও আলোচনা চলবে। একই সাথে দু জন সেক্টর কমান্ডার উচ্চাভিলাষের বিষয়টি সরকার জানতে পারে। ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়নি। তবু ও সন্দেহ থেকে যায় । তাই মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত সমাপ্ত করতে হবে। যুদ্ধ বিলম্বিত হলে সমস্যা সষ্টি হবে। সরকারের তহবিল শেষ হয়ে আসছে। এক কোটি শরণার্থীর দুর্গতির শেষ নেই। দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী ও তার দোসর রাজাকার আলবদর-জামায়াত লাখ লাখ মানুষ হত্যা করছে, নারী নির্যাতন করছে। মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণপণ লড়ছে শত শত মুক্তিযােদ্ধা শহীদ ও আহত হচ্ছে। ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হতে থাকে। পাশাপাশি উত্তেজনা বাড়ছে। পাকবাহিনী ২৫ মার্চ বাঙালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, গণহত্যা শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিএ বাহিনি গঠন করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়। ৪ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা
করেন-
“আজকে বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এই যুদ্ধ আমার সরকার ও ভারতের জনগণের ওপর বিরাট দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে । ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। একই দিনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দান করেন।
৬ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সদ্য আগত রুহুল কুদ্সকে মহাসচিব নিয়ােগ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একজন রাজনীতিবিদ ও সংগঠকই ছিলেন না তিনি একজন সফল প্রশাসক ছিলেন। সরকার পরিচালনায় তিনি ধীশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। সরকারের অবকাঠামাে তিনি নিপুণভাবে সাজিয়েছেন। তিনি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে বিভক্ত করেন। তিনি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও ব্ণ্টন করেন।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির সচিবালয়
৮ নম্বর থিয়েটার রােড, কলকাতা
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম
আবদুস সামাদ আজাদ এমএনএ- উপদেষ্টা
মােহাম্মদ উল্লাহ এমএনএ- উপদেষ্টা
পৃষ্ঠাঃ ৪৩৮

সৈয়দ আবদুস সুলতান এমএনএ-উপদেষ্টা
কোরবান আলী এমএনএ-উপদেষ্টা
কাজী লুৎফুল হক ইপিসিএল- একান্ত সচিব
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর
তাজউদ্দীন আহমদ- প্রধানমন্ত্রী
সংস্থাপন,প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার, পরিকল্পনা
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ- উপদেষ্টা
মেজর নূরুল ইসলাম-এডিসি
ডা. ফারুক আজিম-একান্ত সচিব
আলী তারেক-তথ্য অফিসার
মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়
হােসেন তৌফিক ইমাম সিএসপি- মন্ত্রিপরিষদ সচিব
নূরুল কাদের খান সিএসপি- সচিব, সংস্থাপন
কামাল উদ্দিন আহমেদ- উপসচিব
ওয়ালিউল ইসলাম সিএসপি- উপসচিব
দীপক কুমার চৌধুরী ইপিসিএস- উপসচিব
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
৮ নম্বর থিয়েটার রােড
এম এ সামাদ সিএসপি-সচিব
আকবর আলী খান-উপসচিব
তথ্য ও বেতার
বাংলাদেশ মিশন
আবদুল মান্নান এমএনএ- উপদেষ্টা
আনােয়ারুল হক খান- সচিব
অর্থ মন্ত্রণালয়
৮ নম্বর থিয়েটার রােড, কলকাতা
এম মনসুর আলী- মন্ত্রী
খন্দকার আসাদুজ্জামান সিএসপি- সচিব
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
খন্দকার মােশতাক আহমদ- মন্ত্রী
পৃষ্ঠাঃ ৪৩৯

মাহবুব আলম চাষী পি এস ডি- সচিব
কামাল উদ্দিন সিদ্দকী সি এস পি-একান্ত সচিব
সরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
এ এইচ এম কামরুজ্জামান-মন্ত্রী
এম এ সালেক পি এইচ পি-সচিব
খসরুজ্জামান চৌধুরী সি এস পি-উপ সচিব
সাস্থ্য মন্ত্রণালয়
ডা. টি হোসেন-সচিব
কৃষি মন্ত্রণালয়
এ এইচ এম কামরুজ্জামান-মন্ত্রী
নুরুদ্দীন আহমদ- সচিব
দফতর সমূহ
এান ও পুনর্বাসন দফতর, কৃষি দফতর,প্রকৌশল দফতর, পরিকল্পনা কমিশন, বাণিজ্য বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা বোর্ড, এান ও পুনর্বাসন কমিটি, শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।
পাকিস্তানের প্রশাসন -১৯৭১
জেনারেল এ এম ইয়াহিয়া খান-প্রেসিডেন্ট প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং প্রধান সেনাপতি
জেনারেল আব্দুল হামিদ -চীফ অব আর্মি স্টাফ
লেঃ জেনারেল এম জি এস এম পীরজাদা-রাষ্ট্র পতির প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার
লেঃ জেনারেল গুলহাসান-চীফ অব জেনারেল স্টাফ
লেঃ জেনারেল টিক্কা খান-গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক পূর্ব পাকিস্তান
লেঃ জেনারেল এ একে নিয়াজি – কমান্ডার পূর্ব পাকিস্তান
মেজর জেনারেল গোলাম ওমর- সচিব জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগ
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী- পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বেসামরিক উপদেষ্টা
মেজর জেনারেল গোলাম জিলানী – গোয়েন্দা প্রধান
এয়ার মার্শাল রহিম খান- পাকিস্তান বিমান বাহিনি প্রধান

পৃষ্ঠাঃ ৪৪০

ডা., এ এম মালিক-গভর্নর, পূর্ব পাকিস্তান
(সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)
মােজাফফর হোসেন-চীফ সেক্রেটারি, পূর্ব পাকিস্তান
এম এ কে চৌধুরী-আইজিপি, পূর্ব পাকিস্তান
আগশাহী-জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি
মেজর জেনারেল এন এ এম রাজা-রাষ্ট্রদূত, আমেরিকা
এমএনএ-এমপিদের সদস্যপদ বাতিল
ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হত্যা, লুণ্ঠন ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে আওয়ামী লীগের ৭৯ জন এমএনএ ও ১৭৯ জন এমপিএ’র সদস্যপদ বাতিল করে। তাদের অবর্তমানে সামরিক আদালতে বিচার করে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে শস্তি প্রদান করে। তাদের শূন্য আসনে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও পিডিপির নেতাদের নির্বাচিত ঘােষণা করে। ঢাকা-৫ আসনে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের এমএনএ পদ বাতিল এবং তাকে শাস্তি প্রদান করা হয় ।
তাজউদ্দীন আহমদের প্রতিজ্ঞা
তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম হয়েছিল একটি দেশ, একটি জাতি প্রতিষ্ঠার জন্য। সে কারণে পারিবারিক বন্ধন তাকে দুর্বল করতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পরিবার থেকে বিদায় নেন । পাকবাহিনী ঢাকা শহর আক্রমণ করলে তিনি বারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে লালমাটিয়ায় রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং সেখানে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ছিলেন। ২৮ মার্চ তারা ঢাকা ত্যাগ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ২৮ মার্চ তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীনের নিকট চিরকুট লেখেন :
“আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়িয়েছি। কবে এর শেষ হবে জানি না। আট কোটি মানুষের সাথে মিশে যাও। যদি বেঁচে থাকি, তাহলে দেখা হবে।”
তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা, ৩ কন্যা ও এক পুত্র নিয়ে ঢাকা ও গ্রামে একটু আশ্রয়ের জন্য ঘুরেছেন। কোথাও আশ্রয় পেয়েছেন, আবার কোথাও আশ্রয় মেলেনি। এমনিভাবে তিনি মে মাস পর্যন্ত বিপদসঙ্কুল দিন কাটান। পরিশেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগরতলা পৌছেন। সেখান থেকে কলকাতায় এবং কোহিনূর ভবনে ওঠেন। তাজউদ্দীন আহমদ একটি রাতও স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সাথে কাটাননি। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন : “যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে ততদিন তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৪৪১

পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। তিনি বলতেন যুদ্ধরত অবস্থায় যােদ্ধারা যদি পরিবারবিহীন অবস্থায় থাকতে পারে, আমি সরকারের প্রধান হিসেবে তা পারব না কেন?” তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা আমীর-উল ইসলামের স্ত্রী জাহানারা আমীর নীলা গর্ভবতী অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে আত্মগােপন করে শেষে তার ভাই শামসুজ্জোহা এমএনএ ও মােস্তফা সারওয়ার খান আগরতলা হয়ে কলকাতায় যান। হাসপাতালে তিনি এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। কিন্তু সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। পুত্রের নাম রেখেছিলেন জয়।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানান।
১৯৭১ সালের ২৩ নবেম্বর তিনি মুক্তিযুদ্ধের সফলতা বর্ণনা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট পত্র দেন।

পাকিস্তান কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকবাহিনী গ্রেফতার করে এবং ৩১ মার্চ তাকে করাচী নিয়ে আসে। তাকে প্রথম ফয়সালাবাদ জেলে রাখা হয়। যুদ্ধ শুরু হলে তাকে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি জেলে স্থানান্তর করা হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার অভিযােগে সরকার ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সামরিক কোর্টে বিচার শুরু করে। সামরিক কোর্টের চেয়ারম্যান ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার। সদস্য ছিলেন দু’জন। সেনা অফিসার এবং পাঞ্জাবের একজন জেলা জজ। সরকার বঙ্গবন্ধুর পক্ষে এ কে ব্রোহীকে আইনজীবী নিয়ােগ করে।
১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তথাকথিত বিচারের সমালােচনা করেন এবং তার মুক্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, আমি সকল শক্তির প্রতি আহবান জানাচ্ছি যে, যাদের ইসলামাবাদের ওপর প্রভাব আছে তারা শেখ মুজিবের আশু মুক্তির সহায়তা করবেন।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বিচারের রায় হয়। বিচারে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। যুদ্ধ শেষ হলে বিচারের রায় কার্যকর হয়নি। বিশ্বের চাপে ইয়াহিয়া খান মৃত্যুদণ্ড দিতে সাহস পায়নি।
ড. কামাল হােসেনকে ঢাকায় বন্ধী করে পশ্চিম পাঞ্জাবের গৌরীপুর জেলে আটকে রাখে । তিনি ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাথে মুক্তি লাভ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৪৪২

মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা
রাজাকার মন্ত্রিসভা
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল লেঃ জেনারেল টিক্কা খান গভর্নর হাউজে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকীর নিকট পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। টিক্কা খান ঘােষণা করেছিলেন- I want land, not the people আমি ভূমি চাই- মানুষ নয়! ‘তার নির্দেশে লাখ লাখ বাঙালীকে হত্যা করা হয়। বিশ্ব জনমতের চাপে গণহত্যার নায়ক জেনারেল টিক্কা খানকে ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে বদলি করে। ১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ডা. এএম মালিক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি ২৪ সেপ্টেম্বর ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিরা হলেন : আবুল কাশেম, নওয়াজেশ আহমেদ। আব্বাস আলী খান (জামায়াত), মওলানা এ কে এম ইউসুফ (জামায়াত), ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, এএসএম সােলায়মান, মওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন আহমদ এবং অং সু প্রু।
জাতির উদ্দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ
(৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত)
প্রিয় দেশবাসী ও সগ্রামী সাথীবর্গ,
আপনাদের উদ্দেশে গতবার আমার বক্তব্য পেশ করার পরে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে গেছে। হানাদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের জনসাধারণের কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলাে এই যে, সামরিক শাসকচক্রের পশ্চিম পাকিস্তানী ক্ষমতা ভিত্তিতে ভাঙ্গন ধরেছে এবং বাংলাদেশে তাদের মুষ্টিমেয় নিরাপদ এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে এসেছে। তাদের অর্থনীতিকে বানচাল করার জন্য আমাদের দৃঢ়নীতি, জলে-স্থলে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের উজ্জ্বল সাফল্য এবং আমাদের প্রতিরােধের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গভীরতা শক্রর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটিকে নিশ্চিতরূপে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। এ সত্ত্বেও ধৈর্য ও সাহসের প্রয়ােজনীয়তার ওপরে আমি জোর দিতে চাই । শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবসানে দেশের পুনর্গঠনের জন্য এই গুণ দুটি অর্জন করা আজ আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক।
বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। এই ভারসাম্যের উপর ভরসা করে শত্রুপক্ষ যা লাভ করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সফল হতে পারেনি। এর নবতম প্রমাণ ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির যে বিস্ময়কর পরিচয় আমরা লাভ করেছি,
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৩

নিঃসন্দেহে আমরা তারই উপর নির্ভর করি। তবে যেসব মহলে আগে শুধু সতর্কতার মনােভাব দেখা দিয়েছিল, সেখান থেকে যখন সমর্থনের ইংগিত পাওয়া যায়, তখন আমাদের সন্তোষের কারণ ঘটে বৈ কি। .কোন কোন দেশের সরকার এখন অবশ্য নীতিবিবর্জিত ভূমিকা পালন করছে। যদিও সেসব দেশের জনসাধারণ আমাদের প্রতি দ্বিধাহীন সমর্থন জ্ঞাপন করছে। আমরা শুধু আশা করব যে, এই সব দেশের জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের অচিরণের এই অসঙ্গতি শিগগিরই দূর হবে।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লক্ষ্যে যে, বাংলাদেশের জনগনের জনগণের ধ্বংসসাধন সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং তারা যে জনগণকে ত্রাণসামগ্রী ঠিকমতাে পৌঁছে দেবে, সে কথা বিশ্বাস করার মত লোক পৃথিবীতে বেশি নেই। তবু বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যে সাহায্য দিয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে তা দখলীকৃত এলাকায় বিলি করার ব্যবস্থা সঙ্গত বিবেচনা করেছেন জাতিসংঘ। বিগত ঘূর্ণিঝড়ের পরে রিলিফের জন্য যে সব হেলিকপ্টার, জলযান ও অন্যান্য যানবাহন এসেছিল পাকিস্তান সরকার নির্বিকারচিত্তে সে সব ব্যবহার করেছে বাংলাদেশের মানুষের মানুষের বিরুদ্ধেই। দুর্গত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বহু সামগ্রী দখলদার সৈন্যদের প্রয়ােজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের সেবাদলে একদল যােগাযােগ বিশেষজ্ঞ এসেছেন উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে, এতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী রণকৌশলে যে সাহায্য হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় ত্রাণকার্যের মানবতাবাদী উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হবার ঘােরতর আশঙ্কা রয়েছে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে চান, তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণকার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়।
ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের প্রকাশ্য বর্বরতার পরিচয় আমরা পেয়েছি। মাঝে মাঝে আপােসের কতকগুলাে প্রস্তাবের মাধমে তার গােপন ছলনার পরিচয়ও আমরা পাচ্ছি। এইসব প্রস্তাব চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের আপােসহীন সঙ্কল্পকে দুর্বল করে দেওয়া। শত্রুপক্ষ আপােস চাইতে পারে দুটি কারণে : হয় সে দুর্বল, না হয় সে আমাদের জন্য ফাঁদ পেতেছে- যে ফাঁদ সম্পর্কে আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার কৌশল হলাে বাংলাদেশের বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করা। ঘৃণ্য টিক্কা খানের আসনে বেসামরিক ক্রীড়নক বসানাে এবং জনগণ থেকে
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৪

বিছিন্ন কয়েকজন ধিকৃত বাঙালীকে জাতিসংঘে প্রতিনিধিরূপে পাঠানাে- এ সবই তার ছদ্য আবরন।সে মিথ্যা আশা করে যে, এতে অব্যাহত সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশে গণহত্যা ও জনমত দলনের নিষ্ঠুর সত্যকে ঢাকা দেয়া যাবে।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কিছুসংখ্যক প্রতিনিধির আসন বাতিল করে আর কিছুসংখ্যকের আসন বজায় রেখে ইয়াহিয়া কাকে ধোকা দিতে চাইছেন? তিনি এমনতর ভান করছেন যে, যাদের আসন বাতিল হয়নি, তারা বুঝি তার চক্রান্তের সমর্থক জনসাধারণের সুস্পষ্ট অভিপ্রায়ই জাতির নির্বাচিত ক্ষমতার উৎস। তারা কোনাে ক্ষমতা দখলকারীর আজ্ঞাবাহী নন এবং তার উদ্ভাবিত ফন্দি-ফিকিরে তাদের কোনাে সম্পর্ক নেই। গত জুলাই মাসের সম্মেলনে এমএনএ ও এমপি এরা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা পুনরায় ঘােষণা করেন। জনপ্রতিনিধিদেরকে বিচার করার হাস্যকর প্রচেষ্টা কিংবা তাদের বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রয়াস – তাদের প্রতিজ্ঞা টলাতে পারবে না ।
বাংলাদেশের গণহত্যায় যে বিশ্ববাসী শিউরে উঠেছে, তারাই এখন লক্ষ্য করছে যে জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে কারারুদ্ধ করে সামরিক আদালতে গােপন বিচারের আয়ােজন হয়েছে এবং তার পক্ষ সমর্থনের জন্য খলনায়ক ইয়াহিয়া সন্দেহজনকভাবে আইনজ্ঞ চাপিয়ে দিয়েছেন। পথিবীর মানুষ তাই আবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানী শাসক চক্রের মিথ্যাভাষণে এবং তাদের কলঙ্ক মােচনের কলাকৌশলে কেউ প্রতারিত হবে না ।
বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রসঙ্গে আমি পৃথিবীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালােবাসা মেখে তাদের সুখের স্বপ্ন যিনি দেখেছিলেন দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দী জীবন যাপন করছেন। তার বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার ও জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সক্রিয় করে তােলার সর্বপ্রকার চেষ্টাই করেছে বাংলাদেশের সরকার ও জনসাধারণ। কিন্তু বর্বর চক্রের অন্ধ ঔদ্ধত্যের উপর এর তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। তবে দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। আর ইসলামাবাদের ওপর যে সব সরকারের কিছুমাত্র প্রভাব আছে, শেখ সাহেবের মুক্তি সাধনের জন্য তাদের কাছে আমি আবার আবেদন জানাই।
পাকিস্তান সরকারের কর্মরত কূটনীতিবিদেরা সম্প্রতি দলে দলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছেন। এতে আমাদের শক্তির
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৫

প্রমাণ ঘটেছে এবং অন্যান্য দেশের সরকারের পক্ষে আমাদেরকে স্বীকৃতি দানের আরেকটি কারণ যুক্ত হয়েছে। আসলে স্বীকৃতি লাভ হল মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত ও সফল পরিসমাপ্তির স্বরূপ সােপান। বর্বর শক্তির দ্বারা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ আজ অস্ত্র ধারণ করেছে। আমাদের জনসাধারণ যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছে বোধহয় আর কোনাে জাতির ভাগ্যে এমন ঘটেনি। সুতরাং যারা গণতন্ত্রের অনুসারী এবং আমাদের প্রতি মানবিক সহানুভূতিসম্পন্ন, তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক প্রত্যাশা করি।
পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নিষ্পেষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি আমাদের জীবনে আবার এক নিষ্ঠুর আঘাত হেনেছে। তা হলো সাম্প্রতিক বন্যার তাণ্ডবলীলা। বাৎসরিক দুঃখের বন্যায় বাংলাদেশের বহু অঞ্চল আজ প্লাবিত। এই প্লাবন পশ্চিম পাকিস্তানের মানবতাবিরােধী শােষণনীতির প্রতি এক সুস্পষ্ট অভিযােগ কেননা, এই শাসক গােষ্ঠীই বাংলাদেশ বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করেনি। এ কথা আজ পরিষ্কার যে, বাঙালীরা নিজেদের নিয়তি ভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান হবে না।
বাঙালীর দুঃখের ব্যাপকতা ও গভীরত্রা আজ মানবীয় পরিমাপ শক্তির বাইরে। তবু আমি বাংলার অজেয় প্রাণশক্তিতে বিশ্বাসী। তাই আমার দৃঢ় প্রত্যয় ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের উপরে বাংলার এই প্রাণশক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী।
পরিশেষে, যাদের সাহস আত্মোৎসর্গ ও সাফল্য সারা জাতিকে গৌরবে পূর্ণ করেছে এবং মহান ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত করেছে, সেই মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কামনা করি সকল শক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের। জনসাধারণ নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছে। এই ঐক্যই যেন আমাদের শক্তির চিরকালীন উৎস হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান
পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের সৈন্যসংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ।”
পাকসেনা বাহিনীর অবস্থান
সেক্টর
ঢাকা সেক্টর ৩৬ ডিভিশন, কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল
ঢাকা, ময়মনসিংহ জামসেদ
উত্তরবঙ্গ সেক্টর ১৬তম ডিভিশন, কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল।
দিনাজপুর, রংপুর নজর হােসেন শাহ
বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৬

যশাের সেক্টর নবম ডিভিশন, কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল
যশাের, কুষ্টিয়া, খুলনা এম এইচ আনসারী
বরিশাল, ফরিদপুর
সিলেট সেক্টর ১৪তম ডিভিশন, কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল
মজিদ কাজী
চাঁদপুর সেক্টর। ৩৯ ডিভিশন, কমান্ডিং অফিসার ডেপুটি সামরিক
আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল রহিম খাঁ
পাকিস্তান বিমান বাহিনী
এয়ার কমােডর এনাম আহমদ
১৪টি এফ ৮৫ স্যাবর জঙ্গী বিমান ৩টি ৩৩ ও ৩টি হেলিকপটার
ইস্টার্ন কমান্ডার ও সামরিক আইন প্রশাসক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল
আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী।

বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তি
সেনাবাহিনী – ৫৯০৮২
নৌবাহিনী – ৪১৩
বিমান বাহিনী – ১১৩১
বেসামরিক। – ৭৭২১
আধা সামরিক – ১২১৯২
মােট। – ৯১৫৪৯
রাজাকার বাহিনী – ৫০০০০
আলবদর – ১০০০০
আলশামস – ২৫
সশস্ত্র যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী বাঙালীদের ওপর আক্রমণ করে গণহত্যা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘােষণা করেন এবং দেশবাসীকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহবান জানান।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বেঙ্গল রেজিমেন্ট-ইবিআর ও ইপিআরদের অবস্থান চার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট- ঢাকা-গাজীপুরে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে। তারা ২৭ মার্চ বিদ্রোহ করে ।
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৭

এক নম্বর ইবিআর যশোর- অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে ।
তৃতীয় ইবিআর- রংপুর, বিভ্রান্ত বিদ্রোহ করতে ব্যার্থ
চতুর্থ ইবিআর- ব্রাহ্মণবাড়িয়া- মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ।
অষ্টম বেঙ্গল- চট্টগ্রাম- মেজর জিয়ার নেতৃত্বে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ। ২৭ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ করেননি।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টর ৪টি ব্যাটেলিয়ন পুর্ব বাংলায় ছিল। তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১০০০০। তারা ২৬ মার্চ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দেন যশোরের লেঃ কর্নেল জলিল এবং চট্টগ্রামের মেজর জিয়াউর রহমান।

মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্বে সাহসী ভূমিকা রেখেছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন বিভ্রান্ত তখন ইপিআর সরাসরি পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে।
১৯৭১ সালে ইপিআর বাহিনীর অবস্থান :
সেক্টর ৭
উইং ১৭
হেডকোয়ার্টার- পিলখানা, ঢাকা
১৩, ১৫, ১৬ নম্বর উইং ঢাকা হেডকোয়ার্টারে
১ নম্বর উইং কুমিল্লা
২ নম্বর উইং ময়মনসিংহ
৩ ও ১২ নম্বর উইং সিলেট
৩ নম্বর সেক্টর- যশাের
৫ নম্বর উইং ৪ নম্বরের সেক্টর রাজশাহী।
৬ নম্বর উইং চাপাইনবাবগঞ্জ
৭ নম্বর উইং নওগাঁ।
৫ নম্বর সেক্টর, ৮ নম্বর উইং দিনাজপুর
৯ নম্বর উইং ঠাকুরগাঁও
১০ নম্বর উইং রংপুর।
৬ নম্বর সেক্টর ১১, ১৪,১৭ নম্বর উইং চট্টগ্রাম
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৮

ইপিআরের সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। তাদের মধ্যে প্রায় ২০ ভাগ ছিল অবাঙালী।অফিসার দের মধ্যে অবাঙালি ছিল। ইপিআর বাহিনী ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে প্রথম ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ৮টা ৩০ মিনিটে বিদ্রোহ করে এবং পাকিস্তানি দের নিরস্ত্র করে। যশাের, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেটে তারা ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু করে। ইপিআর বাহিনী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার বার্তা পেয়ে তা সকল ইপিআর উইং ও সেক্টৱে জানিয়ে দেয়। তাই তারা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে সাহসী ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৭৬৯ জন ইপিআর শহীদ হয়েছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য ১৩৪ জন ইপিআর পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ এবং ল্যান্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ বীরশ্রেষ্ঠ পদকে ভূষিত হয়।
পুলিশ
পূর্ব বাংলায় পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার। ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকসেনাদের প্রতিহত করে অনেকে শহীদ হয়েছেন। পাকসেনারা রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস করে দেয়। পুলিশের মধ্যে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।অনেক আত্মসমর্পণ করে চাকরি করেছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে একজন ডিআইজি, ৩ জন এসপিসহ ৭৫১ জন পুলিশ শহীদ হয়েছেন।
আনসার
১৯৭১ সালে কয়েক হাজার আনসার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । ৩ জন জেলা ও ৩ জন মহকুমা এডজুটেন্টসহ ৪৭৭ জন আনসার মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার এক লাখ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করে। ইবিআর, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ৯ মাস পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি একজন দক্ষ প্রশাসকই ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাশালী সমরবিদ। প্রতিরক্ষা দপ্তর ও সেনাবাহিনীর দপ্তর ছিল ৮ নম্বর থিয়েটার রােড, কলকাতায়।
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী
সর্বাধিনায়ক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৯

প্রতিরক্ষামন্ত্রী : তাজউদ্দীন আহমদ
প্রধান সেনাপতি : কর্নেল এমএজি ওসমানী
চীফ অব স্টাফ : কর্নেল এমএ রব
ডেপুটি চীফ অব স্টাফ : গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার
১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের আলােচনার পর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। ভারতের জেনারেল রাজেন্দ্র সিং এবং সেনাপতি এমএজি ওসমানীর সাথে মতৈক্য অনুসারে মুক্তিবাহিনীতে লােক ভর্তি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৪ মে ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তি হয়। জুন মাসে ভারত সরকারের অনুমোদনের পর ১২৭টি যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্রে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রত্যেক ক্যাম্পে ৫০০ থেকে ২ হাজার মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং, মেজর সবানিয়াম, ক্যাপ্টেন ত্রিভুজ ব্যানার্জী প্রমুখ। তত্ত্বাবধানে ছিলেন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ড. ত্রিগুণা সেন, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী, সতীন্দ্রনাথ সিং বাংলাদেশেএসিসট্যান্ট কমিটির সদস্য মনুভাই বিমানী।
মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের জন্য হাজার হাজার যুবক প্রশিক্ষন নেন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণে সহযােগিতার জন্য সরকার প্রশিক্ষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড করা হয়। বাের্ডের দায়িত্বে ছিলেন প্রফেসর ইউসুফ আলী। তাকে সহায়তা করতেন কমান্ডার আরপিআর মীর্জা, বিমান বাহিনী অফিসার আহমেদ রেজা প্রমুখ। ৪৫ দিন প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধে প্রেরণ করা হয়।
১ হাজার এক শ’ অফিসার এবং ২৮ হাজার বাঙালী সৈন্য পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়ে। মাত্র ২০ জন অফিসার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন।
মুক্তিযোেদ্ধাদের সংখ্যা
নিয়মিত বাহিনী ২৫০০০
সেক্টর বাহিনী ১০০০০
গণবাহিনী (এফএফ) ৭০০০০
মুজিব বাহিনী ১০০০০
গেরিলা ১০০০০০
কাদেরিয়া বাহিনী ১৭০০০
স্বেচ্ছাসেবক ৭২৫০০
পৃষ্ঠাঃ ৪৫০

আফসার বাহিনী – ৪৫০০
হেমায়েত বাহিনী – ৫৫৫৮
স্কোপন্থী কমিউনিস্ট ন্যাপ – ২০০০০
পর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি – ১৫০০০
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট – ১০০০০
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি – ১০০০
১৯৭১সালে মক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ সরকার দুই ব্যাচে প্রথম ব্যাচ- ৬১ এবং
দ্বিতীয় ব্যাচে ৪৭ জন অফিসার কমিশনপ্রাপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টর
৩টি ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রথম
তৃতীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ৭ জুলাই জেড ফোর্স গঠন করা হয় । নবম,
দশম ও চতুর্থ নর্থ বেঙ্গল নিয়ে ৭ অক্টোবর খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে কে ফোর্স
গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে এস ফোর্স গঠিত হয়।
শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল
আহমেদের নেতৃত্বে ৬ হাজার ছাত্রলীগ কর্মী নিয়ে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয় ।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে
বিভক্ত করেন।প্রত্যেকটি সেক্টর সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়।

সেক্টর নম্বর অধিনায়ক এলাকা সৈন্য সংখ্যা সাব সেক্টর সংখ্যা
১ নম্বর মেজর রফিকুল ইসলাম চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ২০০০ ৬
২ নম্বর মেজর খালেদ মােশাররফ নােয়াখালী, কুমিল্লা ৬০০০ ৬
মেজর হায়দার
৩ নম্বর মেজর সফিউল্লাহ সিলেট, মৌলভীবাজার ৩০০০০ ৯
মেজর নুরুজ্জামান হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া

৪ নম্বর মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত সিলেট, পূর্ব-উত্তর অঞ্চল ৪০০০নিয়মিত ৬
৯০০০ গেরিলা

৫ নম্বর মেজর মীর শওকত সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল ১০০০০ ৬
আলী
৬ নম্বর উইং কমান্ডার এম কে রংপুর, ঠাকুরগাঁও ১১০০০ ৫
বাশার
৭ নম্বর ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া – ৮
কর্নেল নূরুজ্জামান

৮ নম্বর মেজর ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর ২০০০ নিয়মিত ৮

পৃষ্ঠাঃ ৪৫১

মেজর মঞ্জুর খুলনার একাংশ। ৮০০০ গেরিলা
৯ নম্বর মেজর এম এ জলিল খুলনা বরিশাল ২০০০ ৬
১০ নম্বর মেজর আবু তাহের ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল – ৮
১১ নভেম্বর থেকে স্কোয়াড্রন
লিডার হামিদুল্লাহ খান
এক নম্বর সেক্টরে চাদগাজী, হিয়াকুব, করুইয়া ছাগলনাইয়া সালিয়া দীঘি ও বেলােনিয়া যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের পরিচয় দেয়। বেলােনিয়া যুদ্ধে ৪ নবেম্বর ক্যাপ্টেন শামসুল ইসলাম শহীদ হন।
দুই নম্বর সেক্টরে বেলােনিয়া, মন্দাবাগ, সালদা নদীর যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে।
তিন নম্বর সেক্টরে তেলিয়াপাড়া ও আখাউড়া যুদ্ধে পাকবাহিনী বার বার পর্যুদস্ত হয়েছে।
চার নম্বর সেক্টরে মুক্তিযােদ্ধারা বিয়ানীবাজার, বড়লেখা ,জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী প্রাধান্য বজায় রাখে।
পাঁচ নম্বর সেক্টরে সুরমা নদী, ছাতক, রাধানগর, টেংরাটিলার যুদ্ধে পাকবাহিনী পর্যুদস্ত হয়।
ছয় নম্বর সেক্টরে পাটগ্রাম, নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র ছিল।
সাত নম্বর সেক্টরের প্রধান যুদ্ধ – ভােলাহাট, নবাবগঞ্জ, মহানন্দা নদী চাপাইনবাবগঞ্জ ।
আট নম্বর সেক্টরের প্রধান যুদ্ধ- বয়রা, ভােমরা, বেনাপােল।
নবম সেক্টরের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র- সুন্দরবন, টাকি, হিঙ্গলগঞ্জ, শমশেরনগর।
এগারাে নম্বর সেক্টরের বিখ্যাত যুদ্ধক্ষেত্র- কামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাট, হালুয়াঘাট প্রভৃতি। কামালপুর যুদ্ধে কর্নেল তাহের পাকসেনাদের গােলার আঘাতে একটি পা হারান। তিনি আহত হলে উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন।
মুজিব বাহিনীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অজান্তে এবং বিনা অনুমতিতে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে এমনি সময় ভারতের গােয়েন্দা সংস্থা RAW- Research and Analysis Wing বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে Bangladesh Liberation Force – BLF নামে একটি বাহিনী গঠন করে। এ বাহিনীর জনপ্রিয় নাম মুজিব বাহিনী।
পৃষ্ঠাঃ ৪৫২

মুজিব বাহিনির প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল উবান । মুজিব বাহিনীর নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি সিরাজুল আলম খান আব্দুর রাজ্জাক তােফায়েল আহমেদ। মুজিব বাহিনীকে জুন মাস থেকে দেরাদুনের সামরিক একাডেমিতে বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হয় । প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সেনাপতি এমএজি ওসমানী বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সাথে আলোচনা কৱেন। তারা এ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে আলােচনা করেন। মুজিব বাহিনী গঠন নিয়ে ছাত্রনেতাদের সাথে প্রধানমন্ত্রীর মতবিরােধ চরমে পৌছে। স্বাধীনতার পরও এ বিরােধ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করতে হয় ।৯
স্বাধীনতার পর মুজিব বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য বিভ্রান্ত হয়ে যায়। তারা জাসদের অধীনে গণবাহিনী গঠন করে ভ্রাতৃহত্যায় মেতে ওঠে।
পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে দেশবাসীর প্রতি বাংলাদেশ
সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাণী
নভেম্বর ১৮, ১৯৭১
আমাদের দেশে এবার ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলকৃত শত্রু সৈন্যের তাণ্ডব চলছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। মুক্ত এলাকায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে আছে শুধু স্বজন হারানাের শােক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সঙ্কল্প।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও আমার পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধা ও জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের যে আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি তা আমাদের জীবনে পুনর্ধতিষ্ঠিত হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করবাে। আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা আজ লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্তটিকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলে যেন নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়ােগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হােক আমাদের প্রার্থনা।” (নভেম্বর ১৮, ১৯৭১ বাংলাদেশ
বেতার থেকে প্রচারিত)।
জয় আমাদের কজায়।
নভেম্বর ২৩, ১৯৭১
জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব
পৃষ্ঠাঃ ৪৫৩

তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ
“দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবােনেরা,
গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের কাছে আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পর্যালোচনা করেছিলাম। তারপর আড়াই মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আমাদের সাফল্য এসেছে নানাদিক থেকে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সে কথা শএু মিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনী এখন যে কোনাে সময়ে যে কোনাে জায়গায় শএু কে আঘাত করতে পারে; এমনকি শক্রর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে। জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে মুক্তিবাহিনীর। নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্ত মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শত্রুমুক্ত। ক্রমেই অধিকতর এলাকায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য সামগ্রী ও মনােবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় ততই উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
এদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতকারীরা আজ দিশেহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নিজেদের ভবিষ্যত্ব সম্পর্কে সংশয় ও ভীতির উদ্রেক হয়েছে, তাদের মনে। বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙ্গনের মুখে । এখন তারা চায় ‘ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে । তারা আশা করে যে, এমন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যত্র নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গোপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপােষকরা হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না বরং এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পরিণামে তাদের আত্মবিকাশ সুনিশ্চিত হবে।
সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপূত হােক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই- আর তা হলাে পূর্ণ স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্ষক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিনই প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প আর সে স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি। দখলদার
পৃষ্ঠাঃ ৪৫৪

সেনাবাহিনীর বিনাশ অথবা সম্পূর্ণ অপসারণের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ । ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই এমনকি, এক বিশ্ব শক্তির সমর সম্ভার দিয়ে জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না।
এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কোনাে কোনাে পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তি লক্ষ্য খরার মত। মনে হয় মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশি। এটা শোচনীয়, কিন্তু ভারতকে অর্থ সাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোনাে রাষ্ট্র উত্থাপন করেন, তখন আমরা শিউরে না উঠে পারি না। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেয়া হয়েছে, পর্বতপ্রমাণ অবিচার ও অন্যায়কে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানী সন্ত্রাসের পর যারা ছিন্নমূল হয়েছেন, তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে হাতবদল করা হবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন। আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশি দেরি নেই।
ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশের তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইন সভার সদস্যরা অবগত নন এমন কি নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ লক্ষ বাঙালীকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য সংগ্রাহক পাঠিয়ে কি ফল তারা লাভ করতে চান জানি না। তবে এতে আমাদের সঙ্কল্পের কোন ব্যত্যয় হবে না। সে সঙ্কল্প হলাে দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে । কিন্তু তার জন্য আরও আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবন দানের প্রয়ােজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগত। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কি মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি, তার উপরে। শত্ৰুসংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশী দখলদারদের বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান
পৃষ্ঠাঃ ৪৫৫

ঘটানাের সংগ্রাম। আমাদের আজকের সংগ্রাম সে দিনই সার্থক হবে, যে দিন আমরা বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুত সমাজের যে ভবিষ্যত রূপ তখন বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করবেন সেখানে সকল সমানাধিকারের ভিওিতে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসের সকলে অংশগ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদারদ সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তাই করতে যাচ্ছি। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে আমরা চরম আঘাত হানবাে আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখােমুখি হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমার আহ্বান : মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন। যে সব সরকারি কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তারা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযােগ গ্রহন করুন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছেন, তাদেরকে আমি শেষ বারের মতাে বলতে চাই : বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন। অঅনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশী প্রভুদের পরিণতি একই হবে। আর তা হলাে গ্লানিকর মৃত্যু, হাজার হাজার মুক্তিসেনা আজ শত্রুকে ঘিরে রেখেছে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। সকলে প্রস্তুত থাকুন : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে চরম মুহূর্তে যেন সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুকে একযােগে চরম আঘাত করতে পারেন।
বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামকে যারা সাফল্যের বর্তমান স্তরে নিয়ে এসেছেন, সেই বীর শহীদ, অকুতােভয় যােদ্ধা ও সংগ্রামী জনগণকে আমি সালাম জানাই।”১০

পৃষ্ঠাঃ ৪৫৬

২০
পৃথিবী কাপানাে ১৩ দিনের যুদ্ধ
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পর লাখ লাখ বাঙালী ভারতে আশ্রয় নেয়। রাজ্য সরকারগুলাে কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ জানায়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহে উদ্ভূত পরিস্থিতি আলােচনার জন্য মন্ত্রিসভার বৈঠক আহবান করেন। সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহ অর্থমন্ত্রী ওয়াইবি চরণ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম উপস্থিত ছিলেন।সভায় প্রধান সেনাপতি জেনারেল শ্যাম মানেকশ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রধান সেনাপতিকে শরণার্থী আসা প্রতিহত করার জন্য তাকে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে বলেন। মানেকশ বলেন, তার অর্থ যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ হলেও অভিযান চলাতে হবে। শ্যাম মানেকশ বলেন, Prime Minister, I guarantee you 100 percent defeat। প্রধানমন্ত্রী এ মুহূর্তে আক্রমণ করলে শতকরা একশ’ ভাগ পরাজয় বরণ করতে হবে। কিন্তু তাকে সময় দিলে নিশ্চয় জয়লাভ করবেন- I guarantee you 100 percent success।১ জেনারেল মানেকশর মন্তব্য থেকে মনে হয় পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে তার ন্যুনতম তথ্য জানা ছিল না। এপ্রিল মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ অসংগঠিত ছিল। সেনাবাহিনী বিভিন্ন জেলা ও সীমান্তে প্রেরণ করা হয়েছে। ঢাকা ছিল অরক্ষিত। মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে ভারতীয় বাহিনী অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তাদের গতিরােধ করার ক্ষমতা পাকসেনাদের ছিল না। তাদের বিমান ও নৌবাহিনী ছিল খুবই দুর্বল। হয়ত জনবলের ক্ষতি হতাে; কিন্তু বেঁচে যেত লাখ লাখ বাঙালী।
জেনারেল মানেকশ ১৫ নবেম্বর পর্যন্ত সময় চাইলেন। সৈন্য মােতায়েন ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে কয়েক মাস সময় লাগবে।
পৃষ্ঠাঃ ৪৫৭

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান
নবেম্বর ১৯৭১

সেক্টর সেনাবাহিনী
উত্তর সেক্টর সেনাবাহিনীর অধিনায়ক
ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা। মেজর জেনারেল গুরবক্স সিংহ
সদর দপ্তর ; জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি

উত্তর-পশ্চিম সেক্টর ৩৩ কোর কমান্ডার মেজর জেনারেল তপন
রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, ৬ নম্বর মাউন্টেন ডিভিশন
রাজশাহী, পাবনা মেজর জেনারেল পিসি রেড্ডি
সদর দপ্তর : শিলিগুড়ি নবম মাউন্টেন ডিভিশন
মেজর জেনারেল লচমন সিংহ
পূর্ব সেক্টর ভারতীয় বাহিনির ৪র্থ কোর কমান্ডার
সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী, লেঃ জেনারেল সগত সিংহ
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম। ৮ম মাউন্টেন ডিভিশন
সদর দপ্তর : আগরতলা মেজর জেনারেল কৃঞ রায়
৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন
মেজর জেনারেল গঞ্জালেশ
২৩ নম্বর মাউন্টেন ডিভিশন
মেজর জেনারেল আর টি হিরা

পশ্চিম সেক্টর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২ নম্বর কোর কমান্ডার
কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর, লেঃ জেনারেল টি এন রায়না
খুলনা, বরিশাল। নবম ডিভিশন
সদর দপ্তর : কৃষ্ণনগর। মেজর জেনারেল দলবীর সিং
চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশন
অধিনায়ক মেজর জেনারেল মহিন্দর সিং
পূর্বাঞ্চল ১০১ কমিউনিকেশন জোন
সদর দপ্তর : আসামের গৌহাটি অধিনায়ক মেজর জেনারেল জি এম সিং
যুদ্ধে আহত হলে মেজর জেনারেল নগরা কমান্ডার নিযুক্ত হন।

পৃষ্ঠাঃ ৪৫৮

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর সমরনায়কগণ
ফিল্ড মার্শাল এম এইচ এফ জে মানেকশ- প্রধান সেনাপতি
মার্শাল পি সি লাল-বিমান বাহিনী প্রধান
এডমিরাল এমএস নন্ধা-নৌবাহিনী প্রধান
লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা-কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ড
ভাইস এডমিরাল এস কৃষ্ণা-পূর্বাঞ্চল নৌবাহিনী প্রধান।
মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব-চিফ অব স্টাফ ইস্টার্ন কমান্ড
মেজর জেনারেল গিলবার গৈল-ডাইরেক্টর, মিলিটারি অপারেশন
ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের কার্যালয় ছিল কলকাতার ফোর্ড উইলিয়াম দুর্গে।

ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা
সেনাবাহিনী-৮২৮০০০
বিমান বাহিনী-৯০০০০
নৌবাহিনী-৪০০০০
মুক্তিবাহিনীর অভিযান
১৯৭১সালের ৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিলিত হয়ে মিত্র বাহিনী গঠন করা হয়। মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা। ভারতীয় বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নিন্মরূপ ছিল ঃ
পশ্চিম সেক্টর : মুক্তিবাহিনীর ৮ম ও ৯ম সেক্টর
পশ্চিম-উত্তর সেক্টর : ৬ষ্ঠ ও ৭ম সেক্টর
পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল : ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ১১তম সেক্টর ।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত ও পাকিস্তান সামরিক শক্তির
তুলনামূলক সংখ্যা নিম্নে উল্লেখ করা হলাে :
বিবরণ পাকিস্তান ভারত
মােট সৈন্য (স্থল বাহিনী) ৩,৫০,০০০ ৮,২৮,০০০
সাঁজোয়া ডিভিশন। ২ ১
সাজোয়া ব্রিগেড। ১ –
পদাতিক ডিভিশন। ১২ ১৩
মাউন্ডেন ব্রিগেড। – ১০
প্যাটন ট্যাংক। ৪০০ –

পৃষ্ঠাঃ ৪৫৯

চীনা ট্যাংক ২০০ –
টি ৫৪-৫৫ রুশ ২৫০ ৪৫০
বিমান বাহিনীর লােকবল ১৫০০০ ৯০০০০
জঙ্গী বিমান ১৭০ ৬২৫
ক্যানবের বােমারু ১১ ৪০
বি – ৫৭ ১১ ৫০
মিগ-১৯ ৫ স্কোয়াড্রন –
মিগ-২১ – ১২০
এফ-৮৬ জঙ্গী বিমান ৭ স্কোয়াড্রন –
৩৩ মিরাজ ৮০ –
ন্যাট – ১৫০
এসইউ জঙ্গী বােমারু – ১৪০
নৌ সেনা ৯৫০০ ৪০০০০
ক্রুজার ১ ২
ডেস্ট্রয়ার ১ ৪
সাবমেরিন ৪ ৪
বিমানবাহী জাহাজ – ১

ভারতীয় বাহিনীর রণকৌশল
উত্তর-পশ্চিম সেক্টর : ভারতীয় ৩৩ নম্বর করপাস অধিনায়ক লেঃ জেনারেল তপন।
১. পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও দখল করে দিনাজপুর আক্রমণ করবে।
২. হিলি পলাশবাড়ী ও পরে রংপুর দখল।
৩. ফুলবাড়ী হয়ে পীরগঞ্জ ও গাইবান্ধা দখল।
দক্ষিণ-পশ্চিম সেক্টর : ২ নম্বর করপাস।
বনগাঁ, যশাের, কৃষ্ণনগর, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা।
নবম ডিভিশন- যশাের, খুলনা দখল
৪ নম্বর করপাস দখল করবে।
পূর্ব সেক্টর : সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম।
পৃষ্ঠাঃ ৪৬০

পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘােষণা
মিত্রবাহিনীর অভিযান
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন । এ সময় জেনারেল মানেকশ মেজর জেনারেল জ্যাকবের মাধ্যমে প্রধান মন্ত্রীকে অবগত করান যে, পাকিস্তান বিমান বাহিনী পশ্চিমাঞ্চলের বিমানবন্দর আক্রমণ করেছে। ইন্দিরা গান্ধী তাড়াতাড়ি রাজভবনে চলে যান।সে দিন সন্ধ্যায় তিনি দিল্লী ফিরে যান। জরুরী মন্ত্রিসভার বৈঠক আহবান করেন। সভায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় সেনাবাহিনী রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যে বাংলাদেশে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করার নির্দেশ প্রদান করে। ৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতীয় বাহিনি ও মুক্তিবাহিনী নিয়ে মিত্র বাহিনী গঠন করে। মিত্র বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হলেন পূর্বাঞ্চলের ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা। তিনি ৩ ডিসেম্বর রাতেই পূর্বাঞ্চল ও চাচিমাঞ্চলে বিমান হামলা পরিচালনা করেন।
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের ওপর পাকিস্তানী নগ্নহামলার প্রতিবাদ করেন। তারা মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার অঙ্গীকার করে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পত্র লিখেন।
বাংলাদেশের প্রথম স্বীকৃতি
৬ ডিসেম্বর ভারত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এ সংবাদে বাংলার জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধারা উৎফুল্ল হয়। ভারতের স্বীকৃতি প্রদানের সংবাদ শুনে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল ও ভারতের শরণার্থী শিবির এবং মুক্তিযােদ্ধারা আনন্দ মিছিল করে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়।
ডিসেম্বর ৮, ১৯৭১
সােনার বাংলাকে গড়তে হবে
জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী
তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ
“দেশবাসী সংগ্রামী ভাইবােনেরা,
পাকিস্তানী সমর নায়কেরা আজ সারা উপমহাদেশে এক সর্বনাশা যুদ্ধ ডেকে
পৃষ্ঠাঃ ৪৬১

এনেছে। বাংলাদেশে তাদের শাস্তি ও অপরাধের পরিণতি এই যে এ পথেই ঘটবে কয়েক মাস থেকেই তা বােঝা যাচ্ছিল।
একদিকে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের লজ্জাজনক বিপর্যয় এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসাধারণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি ভারতের আন্ত রিকতাপূর্ণ সমর্থন, এই পটভূমিকায় পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের বিপদ এসেছে একই শক্রর কাছ থেকে। এর ফলে দুই দেশের মানুষের সম্পর্কে নিবিড়তর হয়েছে। মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সৈনিকেরা এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে : উভয়ের মিলিত রক্তধারায় রঞ্জিত হচ্ছে আমাদের দেশের মাটি। ইতিহাস এই এই দ’দেশের মানুষের যে বন্ধুতের পথ নির্দেশ করেছে, এই রক্তধারায় সেই মৈত্রীর বন্ধন রচিত হলো।
ভারতের জনসাধারণ অনেক আগেই আমাদেরকে স্বীকার দিয়েছেন তাদের অন্তরে। এখন তাদের সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের পক্ষে এ এক বিজয়- বিজয় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, আর বিজয় তাদের মুক্তিবাহিনীর
স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের কুটনৈতিক স্বীকৃতি লাভ আর সম্ভব হলাে অগণিত শহীদের রক্তের বিনিময়ে, মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক তৎপরতা, অপূর্ব আত্মত্যাগ ও দুর্ভেদ্য ঐক্যের ফলে। এ বিজয় জনসাধারণেও বিজয়। বাংলাদেশের স্বীকৃতির বিষয়ে তাদের সর্বসম্মত অভিপ্রায় আজ বাস্তবে রূপায়িত হলাে।
স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদেরকে জগৎসভায় সর্বপ্রথম স্বাগত জানিয়েছে ভারত। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। এক কোটি ছিন্নমূল বাঙালীর পরিচর্যার ক্লেশ স্বীকার এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যুদ্ধের আপদ বহন আর মানবতা ও স্বাধীনতার আদর্শের প্রতি যে সুগভীর নিষ্ঠার পরিচয় ভারত দিয়েছে, তা বর্তমান কালের এক আশ্চর্য ঘটনারূপে বিবেচিত হবে। ভারতের এই দৃঢ়তাপূর্ণ সিদ্ধান্তে আমরা আনন্দিত। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের ভিত্তিমূলে এই ঐতিহাসিক অবদানের জন্য আমরা ভারতের জনসাধারণ, পার্লামেন্ট, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় বাঙালী জাতির অপরিসীম কৃতজ্ঞতাবােধ করছে। ভারতের এই স্বীকৃতি দান একটি মহৎ ঘটনা। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি হবে পরস্পরের জন্য মৈত্রী ও শ্রদ্ধাবােধ। বিপদের দিনে যুদ্ধের দুর্যোগের মধ্যে ভারতীয় জনসাধারণের সঙ্গে যে সম্পর্ক আমরা প্রতিষ্ঠিত করলাম, সম্পদে ও শান্তির কালে তা অক্ষুন্ন থাকবে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তা উভয়
পৃষ্ঠাঃ ৪৬২

জাতির স্থায়ী কল্যাণ সাধন করবে।
ভারতের পর ভুটান স্বীকৃতি দিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে। এর জন্য আমরা ভুটানের রাজা ও জনসাধারণের নিকট কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের মানুষের এই আনন্দের মুহূর্ত তবু মিলন হয়ে গেছে এক বিষাদের ছায়ায় | বাংলাদেশের স্বপ্ন যখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাস্তবে রূপান্তরিত হলাে, তখন সেই স্বপ্নের দুষ্টা, বাঙালী জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান শত্রুর কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন। দেশবাসীর নিকট অথবা দূরে যেখানেই থাকুন না কেন, বঙ্গবন্ধু সর্বদাই জাগরুক হয়ে রয়েছেন তাদের অন্তরে। যে চেতনা আমাদের অতীতকে রূপান্তরিত করেছে, তিনি সেই চেতনার প্রতীক। যে রূপকাহিনী ভবিষ্যতে আমাদের জাতিকে যােগাবে ভাব ও চিন্তা, তিনি সেই কাহিনীর অংশ। তবু এই মুহূর্তে তার অনুপস্থিতিতে আমরা সকলেই বেদনার্ত।
স্বাধীন বাংলাদেশের অত্যুদয়কে সকল প্রগতিশীল রাষ্ট্রেরই স্বাগত জানানাে উচিত। আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের আদর্শ হলাে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোট নিরপেক্ষতা এবং সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবোদের বিরােধিতা করা। আমরা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বিশ্বাসী। সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে ভারত ও ভুটানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করার জন্য আমি সকল রাষ্ট্রকে আহ্বান করছি।
পশ্চিম পাকিস্তান সরকার যে অমঙ্গলের সূচনা করেছে বাংলাদেশে পরিণামে তাই আজ তাকে ধ্বংস করতে চলেছে। এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি থেকে তার পৃষ্ঠপােষকরা তাকে বাঁচাতে চেয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে, কিন্তু সে প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের সংঘর্ষের মূল কারণ বিবেচনা না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব করেছে, তা মার্কিন সরকারের অন্ধতা ও বিকত বিচারবুদ্ধির পরিচায়ক। চীনও একই ধরনের বিচার বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়েছে। তাই নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রয়ােগ করায় সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বাংলাদেশের মানুষ কতজ্ঞ।
ইতিহাস আমাদেরকে যে দায়িত্বভার অর্পণ করেছে, এখন তা সম্পূর্ণ করতে হবে আমাদেরকেই। উনাত্ত যুদ্ধবাদীদের নেততাধীন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকে কবর দিতে হবে আমাদেরকেই। চারপাশে মৃত্যুর জালে জড়িয়ে পড়েছে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রশক্তির মিলিত আঘাতে শত্রু এখন পর্যদস্ত-পলায়নপর । বাংলাদেশে ভাইবােনেরা এখন সময় এসে গেছে- একযােগে শত্রুকে প্রবল আঘাত হানুন, এই শেষ আঘাতে তার সমাধি রচনা করুন, সকল সম্ভাব্য উপায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করুন। শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনের
পৃষ্ঠাঃ ৪৬৩

সঙ্গে সকল প্রকার সহযোগিতা করুন। ভবিষ্যতে যেন এ কথা না বলে যে চরম
আহবান যখন এল তখন কর্তব্যে আমাদের এুটি হয়েছে।
সকল শএু সৈন্য ও রাজাকারদের আমার আহ্বান- অস্ত্র ফেলে দিন আত্নসমর্পণ করুন। এই উপায়ে এখনও আপনারা আত্নরক্ষা করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সকল নাগরিক দের কাছে আমার আহবান কোন অবস্থাতেই নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না। মনে রাখবেন যে অপরাধীকে আইন মোতাবেক শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব আপনার সরকারের এবং সে দায়িত্ব সরকার পালন করবেন। ভাষার জন্য বা অন্ন রকম ভিন্নতার জন্য বাংলাদেশের একটি নাগরিক ও যদি বিপদগ্রস্ত হন তালে জানবেন তা হবে এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাঘাতকতা তা হবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা।
দীর্ঘদিন ধরে দখলদার সৈন্যবাহিনী যে পীড়ন চালিয়েছে তার ক্ষতিচিহ্ন বাংলাদেশের সর্বত্র দেখা যাবে। তবু আশ্বাস ও আনন্দের কথা এই যে-
হানাদারদের শেষ সময় এসে গেছে। বাংলাদেশের সমগ্র ভূখণ্ড শত্রুমুক্ত হতে চলেছে এবং দেশের গৃহহারা নিপীড়িত সন্তানেরা দুঃখ ও নির্বাসনের কাল কাটিয়ে স্বদেশ ফিরে অসতে যাচ্ছেন। যুদ্ধজয়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্তিকেও জয় করে আনতে হবে। নিষ্ঠুর যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের উপরে ‘সোনার বাংলার সৌধ নির্মান করতে হবে। পুনর্গঠন ও উন্নয়নের এই অনিন্দনীয়ক ও মহান কাজে অংশ নিতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি সন্তানকেই। বঙ্গবন্ধুর আরদ্ধ বিপ্লব সেই দিন শেষ হবে যে দিন গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আদর্শ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হবে। জয় বাংলা “।

পশ্চিমাঞ্চলের রনাঙগন
যশোর দুর্গের পতন
যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল
পশ্চিম অঞ্চলের মিত্র বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন লেঃ জেরোজা রায়। তার অধীনে ছিলেন মাউন্টেন ডিভিশন কমান্ডার মেজর জেনারেল এস বাবর ৯ম ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবীর সিং তাদের সাথে ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ৮ম সেক্টর কমান্ডার মেজর মনজুর ও ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল । যশোরের বয়রা ও চৌগাছা যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হয়। পাকবাহিনী দুভাগে বিভক্ত হয়ে পরে একটি নিয়ে মেজর জেনারেল আনসারী মাগুরা ও ফরিদপুরে চলে যায়। ব্রিগেডিয়ার হায়াত অপর দল নিয়ে খুলনা চলে যায়। পাকবাহিনী মিত্র বাহিনীর অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। তারা ৫
পৃষ্ঠাঃ ৪৬৪

ডিসেম্বর চৌগাছা দখল করে। ৬ ডিসেম্বর সকাল ৮টায় মিত্র বাহিনী যাশোর ক্যান্টনমেন্ট এ পৌছে এবং ৭ ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যে যশাের বাংলাদেশ সরকারের দখলে চলে আসে। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় । ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী এ এইচএম কামরুজ্জামান সহ মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে যশাের শহরে প্রবেশ করে । যশোর সেনানিবাসের পতনের সাথে পাকবাহিনী বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা পরিত্যাগ করে ঢাকায় পালিয়ে যায়।

মিত্র বাহিনীর বিজয়
১৯৭১ সালে ৭ ডিসেম্বর যশাের পতনের পর পাকসেনাদের মনােবল ভেঙ্গে যায় । তারা পিছু হটে যেতে থাকে। তাদের বিমান নেই । নৌবাহিনী নেই। অন্ত্র সীমিত। খাদ্যের অভাব। তাই পরিস্থিতি জানিয়ে গভর্নর ডা. মালেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে লেখেন-
৭ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় লেঃ জেনারেল নিয়াজী গভর্নর ডা. এএম মালিক কে পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। এ সময় মুখ্য সচিব মোজাফফর হােসেন এবং রাও ফরমান আলী উপস্থিত ছিলেন। একই দিন দুপুর ১২ টায় নিন্মের বার্তা গভর্নর প্রেসিডেন্টের নিকট প্রেরণ করেন—
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হতে
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, ।
“পূর্ব পাকিস্তানের সত্যিকার অবস্থান আপনাকে জানানাে প্রয়ােজন। আমি জেনারেল নিয়াজীর সাথে আলােচনা করেছি। তিনি বলেন যে, সেনাবাহিনী অনেক অসুবিধার মধ্যে প্রয়ােজনীয় সমরাস্ত্র এবং বিমান সমর্থন ব্যতীত এবং অনেক অসুবিধার মধ্যে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছে। বিদ্রোহীরা তাদের পিছন থেকে আঘাত হানছে। সমরাস্ত্র জনশক্তির ক্ষতি অনেক; এবং এ ক্ষতি পূরণ করা যাচ্ছে না। পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের সেক্টরের পতন হয়েছে। মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চলের পতন ঠেকানাে যাবে না। যশােরের ইতােমধ্যে পতন ঘটেছে। পাকিস্তানপন্থী দের জন্য এ এক বিরাট আঘাত। বেসামরিক প্রশাসন ভেঙ্গে পড়েছে। কারণ পরিবহনের অভাবে তারা অগ্রসর হতে পারছে না। খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের সাবরাহের অভাব। কারণ চট্টগ্রাম অথবা প্রদেশের অভ্যন্তরে চলাচল করতে পারছে না। এমনকি ৭ দিন পরে ঢাকায় খাদ্য পাওয়া যাবে না। জ্বালানি ও তেলের অতলে ঢাকার জীবন সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়বে। সেনাবাহিনী যে অঞ্চল ত্যাগ করছে সেখানে হাজার হাজার পাকিস্তানপন্থীকে বিদ্রোহীরা হত্যা
পৃষ্ঠাঃ ৪৬৫

করছে। লক্ষ লক্ষ অবাঙালী এবং অনুগত লােকেরা মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে। কোন মৌখিক সমবেদনা অথবা বিশ্বের শক্তিশালী দেশের দ্রব্য সাহায্যে কোন উপকার আসবে না। একমাত্র প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের দ্বারা উপকৃত হবে। কেউ যদি সাহায্য করতে চায় তা করতে হবে আগামী ৪৮ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। যদি কোন সাহায্য না আসে তা হলে আমি আপনাকে আলােচনা ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা এবং অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আলােচনার অনুরােধ করছি। যেখানে পরিণতি অবশ্যম্ভাবী সেক্ষেত্রে এত উৎসর্গ করার মূল্য কি? যদি সাহায্য আসে তবে আমরা যুদ্ধ করব- ফলাফল যাই হোক অবহিত করার অনুরােধ জানাচিছ।”
৭ ডিসেম্বর ৭.২৫ মিনিট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গভর্নরের বার্তার উত্তর দেন। প্রেসিডেন্ট গভর্নর ও পূর্বাঞ্চলের কমান্ডারকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি জানালেন যে, রাশিয়ার ভেটো সত্তেও যুদ্ধবিরতির চেষ্টা চলছে। একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল নিউইয়র্ক পাঠানাে হচ্ছে। প্রেসিডেন্টের বার্তা পূর্বাঞ্চলের অধিনায়কের মনােবল ভেঙ্গে দেয়।
৮ ডিসেম্বর গভর্নরের অনুরোধে মুখ্য সচিব ও সচিবগণ গভর্নর হউজে আশ্রয় নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পতন হয়েছে । মিত্রবাহিনী কুমিল্লাকে ঘিরে ফেলেছে। তারা চাদপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, “যুদ্ধ জয়ের সাথে শান্তি জয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। নিষ্ঠুর যুদ্ধের ধ্বংসস্তৃপের ওপর সােনার বাংলার ভিত্তি স্থাপন করতে হবে। পুনর্গঠন ও উন্নয়নে সকল ছেলেমেয়েকে অংশগ্রহণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু যে বিপ্লব শুরু করেছেন তার শেষ হবে বঙ্গবন্ধুর গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।” তাজউদ্দীন আহমেদ তার ভাষণে বলেন, “বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে, পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কোন পথ ছিল না।”
“পাকিস্তান এখন মৃত । পর্বত পরিমাণ মৃতদেহের নিচে তার কবর দেয়া হয়েছে। সেনাবাহিনী বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেছে এবং তা পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে অপ্রতিরােধ্য প্রাচীর সৃষ্টি করেছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যা করে ইয়াহিয়া খান নিজে জানেন যে, তিনি পাকিস্তানের কবর রচনা করেছেন। পরবর্তীতে তার আদেশে তার লাইসেন্সধারী খুনীরা জনগণের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তা একটি জাতির ঐক্য বজায় রাখার জন্য নয়। তা
পৃষ্ঠাঃ ৪৬৬

ছিল মানবতা বিবর্জিত জাতিগত ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার কাজ। পেশাজীবী সেনাবাহিনী নির্দেশ পেয়ে সেনাদের আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এবং শিকারী পশুর মতাে দেখা গেল তারা যে হত্যা ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ এবং ধ্বংসলীলায় নিমজ্জিত হয়েছে পড়ে তা সভ্যতার ইতিহাসে নেই। এ সকল কার্যাবলী প্রমাণ করে যে ইয়াহিয়া এবং তার সঙ্গীদের মনে দু’দেশের ধারণা গভীরভাবে অঙ্কুরিত হয়েছে । তাদের দেশের প্রতিএরুপ নিষ্ঠুরতা চালাতে পারত না। তাদের অবশ্য উপলব্ধি করতে হবে যে, পাকিস্তান মৃত- ইয়াহিয়া খান তাকে হত্যা করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। ৭৫ মিলিয়ন বাঙালীর আকাঙ্ক্ষা এবং সাহস তাকে রক্ষা করছে। তারা প্রত্যেক দিন তাদের রক্ত দিয়ে তাদের নব্য জাতীয়তার শিকড় দৃঢ় করছে। পৃথিবীর কোন শক্তি এ নতুন জাতিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ ছোট-বড় সকল শক্তিকে তাদের সভায় তাকে গ্রহণ করতে হবে।”

আমরা বাংলাদেশের বিষয়টি পৃথিবীর কাছে তুলে ধরলাম । কোন জাতির স্বীকৃতির জন্য আমাদের চেয়ে বেশি অধিকার নেই। কোন জনগােষ্ঠী এই অধিকারের জন্য এক কঠিন সংগ্রাম করেনি। জয় বাংলা ।”
৯ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী আখাউড়া হতে আশুগঞ্জের নিকট মেঘনা নদীর তীরে পেীছায়। পাকবাহিনী ভৈরব সেতুর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে মিত্রবাহিনীর মেঘনা নদী অতিক্রম বন্ধ করে দেয়। স্থানীয় জনগণ নদী পারাপার সহায়তা করে । ৯ ডিসেম্বর ৯.৩০ মিনিটে জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানের চীফ অব জেনারেল স্টাফের নিকট নিম্নোক্ত বার্তা পাঠান –
“সেনাবাহিনীর পুনঃ দল গঠন ও সমন্বয় করা সম্ভব নয়। কারণ শত্রুরা আকাশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কোন বিমানের সাহায্য বিগত দিনে সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। শত্রুবিমান সকল জেটি, ফেরি এবং নৌযান ধ্বংস করেছে। বিদ্রোহীরা সেতু ধ্বংস করেছে। অসম্ভব পরিশ্রম ও চাপের ফলে সেনাবাহিনী ক্লান্ত। তারা বিগত ২০ দিন ঘুমায়নি। অবস্থা দারুন ভয়াবহ, শত্রুর বিমান ঘাঁটি আক্রমণের অনুরােধ করছি। বিমানে সৈন্য পাঠিয়ে ঢাকাকে শক্তিশালী করুন।”
৯ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর প্রেসিডেন্টের নিকট নিম্নের বার্তা প্রেরণ করেন। বার্তাটি মুখ্য সচিব মুজাফফর হােসাইন এবং রাও ফরমান খসড়া প্রণয়ন করে এবং তাতে নিয়াজীর সম্মতি রয়েছে।
’Military situation desperate’. পশ্চিমে শত্রুরা ফরিদপুর অগ্রসর হচ্ছে। কুমিল্লা ও লাকসামে আমার সৈন্যকে অতিক্রম করে পূর্বাঞ্চলে মেঘনা নদী পর্যন্ত পথ রুদ্ধ করেছে। চাঁদপুরের পতন হয়েছে। ফলে সকল নদীপথে বন্ধ।
পৃষ্ঠাঃ ৪৬৭

হয়েছে। যদি বাইরের কোন সাহায্য না আসে তবে শত্রুরা শহরের (ঢাকা) উপকণ্ঠে পৌছে যাবে। ঢাকাস্থ জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধি প্রস্তাব করেছেন যে, জনগণের বিশেষ কার অবাঙালীদের জীবন রক্ষার জন্য ঢাকা শহরকে উন্মুক্ত শহর ঘোষণা করা যেতে পারে। আমিত এ প্রস্তাব গ্রহনে ইচ্ছুক…।”
একই দিন রাত ১১টায় প্রেসিডেন্ট গভর্নরকে জানালেন আপনার প্রেরিত বার্তা পেয়েছি এবং সম্পূর্ণভাবে বুঝেছি। আমার নিকট যে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন তার ওপর কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুমোদন দিচ্ছি। আমি আন্তর্জাতিকভাবে সকল ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু একে অন্য থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আপনার ন্যায়নীতির ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। আপনারা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন আমি তা অনুমােদন করব। আমি জেনারেল নিয়াজীকে একই সাথে আপনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি। আপনি যে সকল ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন সে সকল জ্ঞানহীন ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধের জন্য বিশেষ করে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।”
৯ ডিসেম্বর সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী ব্রেজনেভ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ৬ ডিসেম্বরের পত্রের উত্তর দেন। পত্রে তিনি জানান যুদ্ধবিরতি এবং ২৫ মার্চ যেখানে আলোচনা হয়েছে সেখান হতে শেখ মুজিবের আলােচনা পুনরায় শুরু করতে হবে। এখন আলােচনার অর্থ হলাে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। সুতরাং সম্মান রক্ষার জন্য কিসিঞ্জার পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতার নিশ্চয়তা চেয়েছেন। ভারতের রাষ্ট্রদূত পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতার নিশ্চয়তার প্রদান করেন।
খুলনা জেলার সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট ৭ ডিসেম্বর মুক্ত হয়। যশাের পতনের পর পাকবাহিনী খুলনায় আশ্রয় নেয় । ১৭ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াত তার বাহিনী নিয়ে মিত্রবাহিনীর দলবীর সিংহ ও মেজর জলিলের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১৪ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ফরিদপুর দখল করে এবং ১৫ ডিসেম্বর পদ্মা পাড়ি দিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতির সংবাদে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে পড়ে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ৮
পৃষ্ঠাঃ ৪৬৮

ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, ১০ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ভারতে ও বিদেশে সরকারের যে অর্থ জমা আছে তা বাংলাদেশ সরকারের নামে পরিবর্তন করতে হবে। মুজিবনগরের কর্মকর্তারা ২৫ মার্চের পুর্বের পদে যােগদান করবেন এবং দেশের ভেতরে যারা ছিলেন তাদের বিনা বিচারে শান্তি দেয়া হবে না।
উত্তর পশ্চিম সেক্টর।
দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী
ভারতীয় বাহিনীর ৭১ ব্রিগেড ৩ ডিসেম্বরের পূর্বে ঠাকুরগাঁও দখল করে। ভারতীয় বাহিনীর সাথে ৬ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধা দিনাজপুর দখলের লক্ষে আক্রমণ চালায়। তারা ১০ ডিসেম্বর গাইবান্ধা ও ১১ ডিসেম্বর হিলি দখল করে দিনাজপুর ও রংপুর বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।
উত্তর সেক্টর।
ময়মনসিংহ ও জামালপুরের পতন।
মিএ বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল গুরবক্সের নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী ও ১১ ডিসেম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা ১৯ ডিসেম্বর জামালপুর দখল করে। কাদের সিদ্দিকী মিত্র বাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসে। মেজর জেনারেল নাগরা ঢাকা দখলের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে থাকেন।
দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর।
সিলেটের পতন
ভারতীয় বাহিনীর ৮ ও ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের সাথে ৩, ৪, ৫ সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় অবস্থানরত পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র অভিযান চালায়। মিত্র বাহিনী ৪ ডিসেম্বর আশুগঞ্জ দখল করে। পাকবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার পথে ভৈরব ব্রিজ ধ্বংস করে। মিত্র বাহিনী নৌকায় মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
কুমিল্লা-ময়নামতি
মিত্র বাহিনী ৯ ডিসেম্বর কুমিল্লা শহর দখল করে। ১৬ ডিসেম্বর ময়নামতি সেনানিবাসে অবরুদ্ধ ৪ হাজার পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে।
কুমিল্লা-লাকসাম-চাঁদপুরের পতন
পূর্বাঞ্চলের পাকবাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল রহিম খান ৯ ডিসেম্বর গানবােট ও ফেরিতে তার বাহিনী নিয়ে মেঘনা নদী পথে ঢাকা যাওয়ার জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৪৬৯

চাঁদপুর ত্যাগ করে। এ সংবাদ পেয়ে ভারতীয় বিমান বাহিনি মেঘনা বক্ষে সকাল ৮টায় আক্রমণ শুরু করে। জেনারেল রহিমা গুরুতর আহত হন।তিনি নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা পৌঁছেন। তিনি হেলিকপ্টারে রেঙ্গুন পালিয়ে যান এবং সেখান থেকে বিমানে করাচী চলে যান। ১১ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল সগর সিং ঢাকা অভিযান শুরু করেন।
চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম
ভারতীয় বাহিনীর ৯৭ পদাতিক ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার আনন্দ স্বরুপ মিত্রবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম দখলের জন্য অভিযান চালায়। ৮ ডিসেম্বর তারা ফেনীর শুভপুর সেতু পেীছে। ১১ ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড দখল করে এবং ১৪ ডিসেম্বর কুমিল্লা দখল করে। ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আত্মসমর্পণ করে। ১৭ ডিসেম্বর মেজর রফিকুল ইসলাম তার বাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম প্রবেশ করেন ।

বিমান যুদ্ধ
১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকবাহিনি কে পর্যুদস্ত করেছিল। ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় ১৩টি বিমান বােমা নিক্ষেপ করে ঢাকা বিমানবন্দর ধ্বংস করে দেয়। ফলে পাকসেনারা তাদের বিমান আর ব্যাবহার করতে পারেনি। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর পরাজয়ের অন্যতম কারণ যুদ্ধকালে তাদের বিমান বাহিনী সহায়তা দিতে পারেনি। বিমান আক্রমণে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিমান আক্রমণ করে সফলতা অর্জন করেন।
নৌযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ ভিক্রান্ত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার যাত্রা করে । ভিক্রান্ত থেকে সিহক বিমান চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা, মংলা বরিশালে বােমা বর্ষণ করে পাকবাহিনীর নৌযান বিধ্বস্ত করে দেন।
পাকিস্তানী সাবমেরিন বিশাখাপট্টম যাত্রা করে। ভারতীয় নৌ বাহিনী ৪ ডিসেম্বর রাত ১২-৩০ মিনিটে ডেপথ চার্জ করে গাজী ধ্বংস করে দেয়। পাকিস্তানের গর্ব গাজী চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায় ।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় নৌ কমান্ডার সামন্তের নেতৃত্বে মংলা পৌছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পদ্মা-পলাশ বিজয়ের আনন্দে খুলনা শহরের দিকে এগিয়ে যায় । ভিক্রান্তের সি-হক বিমান পদ্মা ও পলাশ থেকে শত্রু গানবােট মনে করে হামলা চালায়। পদ্মা-পলাশ নদীতে ডুবে যায়। চীফ ইআরএ রুহুল আমিনসহ অনেকে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য রুহুল আমিনকে
পৃষ্ঠাঃ ৪৭০

বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেয়া হয়।
জেনারেল মানেকশার ‘আত্মসমর্পণের আহবান
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সকল রণক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করতে থাকে। তাদের বিমান ও নৌবাহিনী বিধ্বস্ত। তাদের আত্মসমর্পণ ব্যতীত বিকল্প নেই। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ভৱতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশা আকাশবাণী থেকে ইংরেজী, হিন্দী ও বাংলায় ,পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য প্রচার শুরু করেন। “হাতিয়ার ডাল দো, মিত্র বাহিনী আপনার সৈন্যদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আপনার বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস, আপনি অস্ত্র সমর্পণ করুন।” জেনারেল মানেকশা আত্মসমর্পণ করার জন্য বেসামরিক প্রধান মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নিকট বার্তা প্রেরণ করেন।

সপ্তম নৌবহর- Gun Boat Diplomacy
আমেরিকা ও রাশিয়ার নৌ কুটনীতি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ধ্বংস করার জন্য ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর হােয়াইট হাউজ বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের জন্য এক গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয় । ৯ ডিসেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেয়। সপ্তম নৌবহর প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল ,
• ভারতকে যুদ্ধ বিরতি মানতে বাধ্য করা;
• পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করা;
• মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মূলােৎপাটন করা;
• বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করে পাকিস্তানী শাসন পুনর্থতিষ্ঠা করা ।।
আমেরিকার টাস্কফোর্সের অপর নাম সপ্তম নৌবহর। সপ্তম নৌবহরের ৮টি জাহাজ এর মধ্যে দলপতি জাহাজের নাম এন্টারপ্রাইজ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর টাস্কফোর্স ভিয়েতনামের টনকিন উপসাগর থেকে যাত্রা করার নির্দেশ দেয়। ১০ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর মালাস্কা প্রণালীতে একত্রিত হবে। ১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করবে এবং ২০ ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে পৌছবে। ভারতের আন্দামান, নিকোবর কমিউনিকেশন সেক্টরে রাডার সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ ধরে ফেলে এবং সাথে সাথে ভারত সরকার সােভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়ে দেয়। সংবাদ পেয়েই রাশিয়ার ২০টি জাহাজের নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌছায় এবং অবস্থান নেয়। ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করার পূর্ব পর্যন্ত রাশিয়ার নৌবহর
পৃষ্ঠাঃ ৪৭১

বঙ্গোপসাগরে ছিল।
১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহরে বঙ্গোপসাগরের দিকে চলছে। কিন্তু হঠাৎ হােয়াইট হাউজের নির্দেশে সপ্তম নৌবহরে শ্রীলঙ্কার দিকে গতি পরিবর্তন করে। ১৫ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্ব কোণে সমুদ্রে এসে নােঙর করে। সপ্তম নৌবহরের হঠাৎ গতি পরিবর্তনের কারণ ছিল ভারত মহা সাগরে রাশিয়ার নৌবহরের উপস্থিতি। ততীয় মহাযুদ্ধ শুরু হতে পারে এ ভয়ে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর ফিরিয়ে নেয়। সমগ্র বঙ্গোপসাগরে মুক্ত ভারতের নৌবাহিনী বিমানবাহী জাহাজ ভিক্রান্ত এককভাবে বঙ্গোপসাগরে তৎপর ছিল। এভাবে আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে নৌ কূটনীতি Ganboat Diplomacy যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে। সেদিন যদি আমেরিকার নৌ কূটনীতি সফল হত তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিলম্বিত হতাে। আমাদের চিরদিন পাকিস্তানের কলােনি হয়ে থাকতে হতো। সােভিয়েত রাশিয়ার হস্তক্ষেপের ফলে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীরা জয়লাভ করে একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠায় সফল হয়েছে বাংলার জন্য সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে।
১০ ডিসেম্বর
হিলি সেক্টরে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। ভৈরব ব্রিজ ভেঙ্গে দেয়ার কারনে সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে মেঘনা নদী অতিক্রম করে নরসিংদী -রায়পুরায় অবতরণ করে। তারা ঢাকা আক্রমণ করবে। কিন্তু পাকিস্তানের ১৪ ডিসেম্বর অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার স্থানান্তর করা হয়। চারদিক থেকে ঢাকা শহর ঘিরে ফেলা হচ্ছে। ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান শ্যাম মানেকশী পাকসেনাদের আত্নসমর্পণ করার জন্য বার বার নির্দেশ দিচ্ছেন। ফলে তাদের মনােবল ভেঙ্গে পড়েছে
তেরাে দিনের যুদ্ধের সবচেয়ে আলােচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১০ ডিসেম্বর ঘটেছে। ঢাকার গভর্নর হাউসে গভর্নর ডাঃ এএম মালিক, চীফ সেক্রেটারিমোজাফফর হােসেন, বেসামরিক প্রধান রাও ফরমান আলী এবং জেনারেল নিয়াজী উপস্থিত। যুদ্ধের বিপর্যয়ের ওপর জেনারেল নিয়াজী সংক্ষেপে বিবরণ দিলেন। ফরমান আলী ও মােজাফফর হােসেন প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘে প্রেরণের জন্য পত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন এবং চারজনে তা অনুমােদন করে। বার্তাটি নিন্মে উদ্ধৃত হলাে৬– “যেহেতু চূড়ান্ত এবং দুর্ভাগ্যজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন সে কারণে আমি নিম্নের প্রস্তাব আপনার অনুমােদনের পর জাতিসংঘের মহাসচিব মিঃ পল মার্ক হেনরির নিকট প্রদান করব।
পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে একটি পূর্ণ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান
পৃষ্ঠাঃ ৪৭২

সেনাবাহিনীর কখনও ছিল না। যা হােক এমন অবস্থার সৃষ্টি হলাে যে, যার ফলে আতরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছিল। পাকিস্তান সরকারের সর্বদা ইচ্ছা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করা হবে সে কারণে আলােচনা অব্যাহত ছিল। ব্যাপক অসুবিধার মধ্যে সেনাবাহিনীর বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে এবং এখনও করছে। কিন্তু রক্তপাত এবং নীরিহ লোকের জীবনের ক্ষতি পরিহার করার জন্য আমি নিন্মের প্রস্তাব করছি-
(ক) যেহেতু রাজনৈতিক কারণে যুদ্ধ শুরু; সে জন্য রাজনৈতিকভাবে তার সমাপ্তি হতে হবে। যেহেতু আমাকে প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায়ন করেছে আমি পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আহ্বান করে ঢাকায় শান্তিপূর্ণভাবে সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হবে, এ প্রস্তাবের সাথে এ আমার কর্তব্য বলে মনে করি যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছানুসারে তারা তাদের ভূমি থেকে অবিলম্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারের দাবি জানাবে। সুতরাং আমি জাতিসংঘকে শান্তিপর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানাচ্ছি এবং অনুরােধ করছি-
এক. অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি;
দুই. সম্মানের সাথে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণ;
তিন, পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক যারা ফিরে যেতে ইচ্ছুক তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতে হবে ।
চার. ১৯৪৭ সাল হতে যারা বসতি স্থাপন করেছে তাদের নিরাপত্তা।
পাঁচ. পূর্ব পাকিস্তানে কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা না নেয়ার নিশ্চয়তা।
আমি এ প্রস্তাব করার সাথে পরিষ্কারভাবে বলতে চাই- এ হলাে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুনিশ্চিত প্রস্তাব। সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রশ্ন বিবেচনা করা হবে এবং সে প্রশ্ন আসে না। এ প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য না হলে সেনাবাহিনীর শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাবে।
জেনারেল নিয়াজীর সাথে আলােচনা করা হয়েছে এবং তিনি আপনার নির্দেশাধীন আছেন । অবিলম্বে অনুমতি প্রদানের জন্য অনুরােধ করছি।”
জাতিসংঘের প্রতিনিধ পল মার্ক হেনরি উপরােক্ত বার্তা পেয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট পাঠিয়ে দেন । মহাসচিব তার অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের
সকল সদস্যকে দেন। ইতােমধ্যে ইয়াহিয়া খানের সংশােধিত বার্তা নিউইয়র্ক
পৃষ্ঠাঃ ৪৭৩

পৌছে যায় । ইয়াহিয়া খান গভর্নর ডাঃ মালিকের প্রস্তাব অনুমোদন করেন নি। প্রেসিডেন্ট উক্ত বার্তা সংশোধন করে জাতিসংঘে প্রেরণের জন্য অনুমোদন প্রদান করেন—
“আপনি যে পরামর্শ দিয়েছেন এবং আমি যা অনুমােদন দিয়েছে তা আপনার খসড়া বার্তাটি ছাড়িয়ে গেছে। আপনি যখন ক্ষমতা হস্তান্তর, রাজনৈতিক সমাধান এবং পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানে সেনাবাহিনী প্রত্যাবর্তনের উল্লেখ করেছেন, তখন আপনি পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলেছেন। এর প্রকৃত অর্থ হল পাকিস্তানের স্বাধীনতা স্বীকার করা। আপনার এলাকার বর্তমান অবস্থার জন্য প্রয়ােজনে সীমিত ক্ষমতা প্রয়ােগ করে পূর্ব পাকিস্তানের সংঘর্ষ শেষ করতে হবে। সুতরাং একটি খসড়ার সুপারিশ করুন যা ইস্যু করার জন্য আপনাকে ক্ষমতা দেয়া হলাে।
আকাশ ও সমুদ্রপথে এবং বিরাট ভারতীয় বিরাট ভারতীয় বাহিনি পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলেছে। ফলে জনগণকে নির্যাতন এবং নীতি জ্ঞানহীন হত্যা পূর্ব পাকিস্তানে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট যে কোন পদক্ষেপ প্রহণের ক্ষমতা আমাকে অর্পণ করেছে। সুতরাং আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদিও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অসুবিধা সত্ত্বেও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে এবং তারা এখনও যুদ্ধ করতে পারে; তবু আর রক্তপাত, নির্দোষ মানুষের হত্যা পরিহার করার লক্ষ্যে আমি নিমােক্ত প্রস্তাব করছি-
• যুদ্ধ বন্ধের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি।
• ১৯৪৭ সাল হতে পূর্ব পাকিস্তানে যারা বসতি স্থাপন করেছেন তাদের
নিরাপত্তার নিশ্চয়তা;
• পূর্ব পাকিস্তানের কারও বিরুদ্ধে প্রতিশােধ না নেয়ার নিশ্চয়তা
• পূর্ব পাকিস্তানে সকল সৈন্যের নিরাপত্তা।
আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই এ হলাে যুদ্ধ বন্ধের জন্য নিশ্চিত প্রস্তাব এবং তাকে আত্মসমর্পণ হিসেবে মনে করা যাবে না এবং সে প্রশ্ন ওঠে না। এই কাঠামাের মধ্যে আপনি প্রয়ােজনীয় রদবদল করতে পারেন। ক্ষমতা হস্তান্তর ও রাজনৈতিক সমাধান জাতীয় পর্যায়ে আলােচিত হবে এবং তা করা হচ্ছে।”
গভর্নর কর্তৃক বার্তাটি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির আলােকে জাতিসংঘে প্রেরণ করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্টের কিছু করার ছিল না। রাও ফরমান আলী ৫ ডিসেম্বর থেকে বলে আসছে চীন প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করবে। কিন্তু চীন কোন প্রকারে উপমহাদেশের যুদ্ধ জড়িয়ে পড়বে না। তাদের ১৯৬২ সালের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের যুদ্ধবিরতির
পৃষ্ঠাঃ ৪৭৪

শর্তগুলো পাকিস্তানের জন্য সঠিক ছিল। যা হোক ১০ ডিসেম্বর গভর্নর বার্তা ও পরবর্তী সংশােধিত বার্তাটি কুটনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করেছে! বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও বিজয় ব্যাতীত কোন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করবে না । মুক্তিবাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করেছে- জয় তাদের সুনিশ্চিত। সুতরাং এখন প্রশ্ন হলাে পাক বাহিনি কখন আত্নসমর্পণ করবে? ঢাকা শহরে পাকবাহিনি প্রত্যেক রাতে কার্ফু দিচ্ছে -তার মধ্যে মুক্তি বাহিনীর অপারেশন চলছে।
এ সময় ঢাকা শহরে ৩০,৩৫০ জন পাকিস্তানী সৈন্য একত্রিত হয়েছিল।

১১ ডিসেম্বর
পদ্মা নদীর পশ্চিম ও দক্ষিণে ১১ ডিসেম্বর এবং মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ের পাকবাহিনি ঢাকা রক্ষার জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পলায়ন অবস্থায় মিত্র বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। ফলে ঢাকা শহরে পলায়নরত পাকসেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঢাকা রক্ষার জন্য শহরে তখন প্রায় ৩০ হাজার বিপর্যস্ত সৈন্য ছিল। তারা ভীত হয়ে পড়ে, কখন তাদের মুক্তিবাহিনী মেরে ফেলবে – এ চিন্তায় তারা প্রহর গুনছে।
১১ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী, রাও ফরমান আলী পিন্ডিতে চীফ অব স্টাফের নিকট নিমের সঙ্কেত প্রেরণ করেন।
“সকল সেক্টরে আমাদের সৈন্য প্রচণ্ড চাপের মুখে | দুর্গে তারা বিছিন্ন এবং শত্রু দ্বারা বেষ্টিত। শত্রুরা আকাশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, স্থানীয় জনসাধারণ এবং বিদ্রোহীরা আমাদের সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য বদ্ধপরিকর। সকল যাতায়াত ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন; শেষ সৈন্য শেষ গুলি – নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে গােলাবারুদ শেষ হলে অবস্থা রক্ষা করা যাবে না। নির্দেশের অপেক্ষায়।”
একই দিন বিকেলে ঢাকার ভাগ্য সম্পর্কে কটি সংক্ষিপ্ত বার্তা রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদরে প্রেরণ করা হয়-
“নরসিংদীর দক্ষিণে শত্রুদের প্রায় এক ব্রিগেড সৈন্য এবং টাঙ্গাইল অঞ্চলে এক ব্রিগেড সৈন্য হেলিকপ্টারে অবতরণ করেছে।”
হেলিকপ্টারে মিত্রবাহিনী অবতরণ করেছে এবং তারা ঢাকা অগ্রসর হচ্ছে এ সংবাদে ঢাকায় সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজী এবং মালিক মন্ত্রিসভা ভীত ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দিন ঢাকায় ভারতীয় বিমান বােমাবর্ষণ করছে। ১১ ডিসেম্বর হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের গেটে নিয়াজী সাংবাদিকদের
পৃষ্ঠাঃ ৪ ৭৫

জানালেন, “শত্রুরা তার মৃতদেহের ওপর দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করবে। তার এ কথায় কেন্দ্রীয় সরকার ব্রিত হয়ে পড়ে। ১১ ডিসেম্বর বেসামরিক কর্মকর্তাগণ গভর্নর ভবনে আশ্রয় নেয়।
১২ ডিসেম্বর
ভারতীয় নৌবাহিনী ভিক্রান্ত থেকে বিমান চট্টগ্রামের ওপর অবিরাম বোমাবর্ষণ করে। সিলেট শহরের চারদিক থেকে আক্রমণ চলছে সবচেয়ে সংকটময় ছিল ঢাকা দখল । মিত্রবাহিনী ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। ইতোমধ্যে অল ইন্ডিয়া রেডিও ভারতের জেনারেল মানেকশার বাণী প্রচার করে। পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর নিকট মানেকশার এক বাণীতে পাকিস্তান সেনাপ্রধান ও তার সৈন্যদের অস্ত্র সংবরণ করতে বলেন কারণ তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে।
দিল্লী, কলকাতা বেতার থেকে বার বার জেনারেল মানেকশার পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ প্রচার করা হয়। তার নির্দেশ ইংরেজি, হিন্দি ও বাংলার অনুবাদ করে প্রচার করা হয়। ৮ ডিসেম্বর আকাশবাণী থেকে বাংলা ও হিন্দিতে জেনারেল মানেকশার পাক সেনাদের উদ্দেশে তার প্রচার শুরু হয় এবং তা ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। বার্তায় বলা হয় হাতিয়ার ডাল দো’ মিত্রবাহিনী আপনার সৈন্যদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আপনার বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস। আপনি অস্ত্র সমর্পণ করুন। এ ঘােষণায় আরও বলা হয় – বিজয়ী সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণের কোন ঘােষণায় লজ্জা নেই। ১৪ ডিসেম্বর এ সম্পর্কে ছাপানাে প্রচারপত্র বিমান থেকে ছাউনিতে ফেলা হয় ।৮
১৩ ডিসেম্বর
মিত্রবাহিনী জামালপুর হয়ে টাঙ্গাইলে ভারতীয় ছত্রী সেনাদের সাথে মিলিত হয়। ইতােমধ্যে কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নাগরা তার অস্থায়ী হেডকোয়ার্টারসহ টাঙ্গাইলে পৌছেন। টাঙ্গাইলে টাইগার কাদের সিদ্দিকীর সাথে মিলিত হন। জেনারেল নাগরা ২ ব্রিগেড ঢাকা অভিমুখে প্রেরণ করেন। জয়দেবপরে পাকবাহিনী তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে ঢাকা চলে যায়। এ সময় পাক সেনারা তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। জেনারেল নিয়াজী ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিম্নের সিগন্যাল রাওয়ালপিন্ডিতে পাঠান ৯-
“সকল সেনা ছাউনি প্রচণ্ড চাপের মুখে। কোন সরবরাহ নেই; এমনকি অস্ত্রের শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। বিদ্রোহীরা ইতােমধ্যে শহর ঘিরে ফেলেছে। ভারতীয়রা অগ্রসর হচ্ছে। অবস্থা খুবই সঙ্কটময়। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিশ্রুতি (চীন) অনুসারে সাহায্য করতে হবে। শিলিগুড়ি নয় নেফায় আক্রমণ চালাতে
পৃষ্ঠাঃ ৪৭৬

হবে। শত্রুর বিমান ঘাটিকে ব্যস্ত রাখতে হবে।”
১২ তারিখে প্রথম গভর্নর হাউস থেকে কামানের শব্দ শােনা যায় । ১৩ তারিখে মনে হচ্ছে আরও সন্নিকটে এসেছে। পিলখানা, পুলিশ লাইন প্রভৃতি স্থানে ঘন ঘন বিমান হামলা চলছে। ঢাকায় ১১ ডিসেম্বর হতে ২৪ ঘণ্টার কারফিউ চলছে। মাঝে মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি । বিদ্যুৎ ও পানির সরবরাহ অনিয়মিত হচ্ছে। নতুন খাদ্য সরবরাহ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তাগণ শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। দু’দিন পর্বে রাও ফরমান প্রস্তাব করেছিলেন তারা বার্মার আকিয়াবে চলে যাবে এবং যুদ্ধবিরতির পরে চলে আসবে। কিন্তু বিমান বাহিনী প্রধান ইনামুল হক রাজি হননি। ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় মুখ্য সচিব মােজাফফর হােসেন, সচিব গিয়াসউদ্দিন, সুলতান মােহাম্মদ এবং এম কাইয়ুমের সাথে কথা বলেন। আশ্চর্য ব্যাপার কেন্দ্রীয় সরকার তখনও পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক খবর জানে না। তাদের কেউ পাট রপ্তানি, কেউ হিন্দুদের যানবাহন দখল করার নির্দেশ দেন, ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে রাও ফরমান আলী ইউএন রেডক্রস কমিশনের সাথে আলােচনা করেন হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেয়ার ব্যবস্থা করেন। তারা সকলে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চলে আসেন । ভারতীয় বিমান ১৩ ডিসেম্বর সকালে গভর্নর হাউসে বোমা বর্ষণ করে। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১২:৩০ মিনিটে গভর্নর পদত্যাগ করেন। কারণ জেনারেল ইয়াহিয়া তার কথা শুনছেন না।
১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা
পূর্বাঞ্চলে পাকবাহিনী সকল সেক্টরে ১৪ ডিসেম্বরের পূর্বে পরাজয় করণ করে- ঢাকা, সিলেট, খুলনা, রংপুর, ময়মনসিংহ প্রভৃতি শহরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এ মুহর্তে পাকিস্তানের সমর নায়ক, জামায়াত, আলবদর বাহিনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, তারা বাঙালী বুদ্ধিজীবী, চাকরিজীবী, রাজনীতিবিদদের হত্যা করবে যাতে মুজিবনগর সরকার ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নামের দেশটি পরিচালনা করতে না পারে। এই হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, জামায়াত নেতা অধ্যাপক গােলাম আযম ও মওলানা মতিয়ুর রহমান নিজামী। তারা তালিকা প্রণয়ন করে এবং আলবদর বাহিনীর তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের ১৪ তারিখ রাতে বাসায় বাসায় গিয়ে ধরে এনে হত্যা করে। তাদের লাশ মিরপুর ও রায়েব বাজারে ফেলে দেয়।
শহীদদের তালিকা নিম্নে দেয়া হলাে—
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ
পৃষ্ঠাঃ ৪৭৭

প্রখ্যাত সাহিত্যিক, নাট্যকার
অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ
ডাঃ মুহাম্মদ মুর্তজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চিকিৎসক
অধ্যাপক আনােয়ার পাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ
অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস বিভাগ
অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস বিভাগ
অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অধ্যাপক রাশিদুল হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
শহিদুল্লাহ কায়সার যুগ্ম সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ, বিশিষ্ট সাহিত্যিক
সিরাজউদ্দিন হােসেন বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক
ডা. ফজলে রাব্বী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
মুহাম্মদ ইয়াকুব মিয়া শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের একান্ত
সচিব ও আওয়ামী লীগ নেতা।

পাকিস্তান সামরিক সরকার উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের ১৪ ডিসেম্বর হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তাদের গভর্নর হাউসে এক বৈঠক আহ্বান করে। কিন্তুু ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হাউসে একটানা বােমাবর্ষণের ফলে সভা বাতিল হয়। সামরিক সরকার এমনকিভাবে হত্যার যে পরিকল্পনা করেছিল তা পরাজয়ের কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাতে জেনারেল নিয়াজীর বার্তার উওরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী চীফ অব স্টাফ নিমােক্ত উত্তর প্রেরণ করেন১০ –
“নিরাপত্তা পরিষদে আলােচনা চলছে, খুব সম্ভব যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত নেয়া পর্যন্ত প্রতিরােধ অব্যাহত রাখুন। পূর্বাঞ্চল কমান্ড গভীর সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে তা বুঝতে পেরেছি।” ঢাকার পতন অবশ্যম্ভাবী। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া যে উদ্দেশ্যে ভারত আক্রমণ করেছিল তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলে বিমান ও নৌবাহিনী পর্যুদস্ত। স্থলবাহিনী পিছু হটছে। পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এমনি সময় ১৩-১৪ ডিসেম্বর রাতে ইসলামাবাদ থেকে ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া জেনারেল নিয়াজীকে ফোনে বলেন যে, গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত পাঠানাে হচ্ছে। ১৪ ডিসেম্বর বিকেল ৩.৩০ মিনিটে ইয়াহিয়া খান নিন্মের সঙ্কেত প্ররণ করেন-
প্রেরক – প্রেসিডেন্ট
প্রাপক – গভর্নর এবং জেনারেল নিয়াজী।
পৃষ্ঠাঃ ৪৭৮

আপনারা সীমাহীন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছেন। জাতি আপনাদের জন্য গর্বিত এবং বিশ্ব আপনাদের প্রশংসা করা করছে। সমস্যা সমাধান একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়ার জন্য সাহায্যের পক্ষে যা যা করা দরকার তা আমি করছি।আপনারা যেখানে পৌছেন সেখানে আর প্রতিরােধ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় এবং কোন উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। প্রতিরােধ করলে মানুষের জীবননাশ ও ধ্বংস ডেকে আনবে। যুদ্ধ বন্ধের জন্য এখন আপনাদের সকল প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সেনাবাহিনী, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নাগরিক এবং সকল অনুগতদের জীবন রক্ষা করুন। অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের অবসান হােক। সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য লােকজন যারা সন্ত্রাসীদের হাতে শিকার হতে পারে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমি জাতিসংঘের নিকট প্রস্তাব রেখেছি যে, তারা যেন পূর্ব পাকিস্তানে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ, সেনাবাহিনী এবং যারা সন্ত্রাসীদের শিকার হতে পারে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করার জন্য ভারতকে অনুরােধ জানায়।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল নিয়াজীর সকল দম্ভ শেষ। তারা আত্মসমর্পণ করলেন। শেষ মুহূর্তে ও মুক্তিযুদ্ধকে স্বীকার করেননি। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করেন। গভর্নর টেলিফোনে জেনারেল নিয়াজীকে যুদ্ধ বন্ধের জন্য নির্দেশ দেন। পেপার টাইগার নিয়াজী তখনও তার গভর্নরকে বলেছেন -” I still had every intention of fighting on’- চালিয়ে যাওয়া আমার ইচ্ছা আছে।”
১৪ ডিসেম্বর বিকেলে গভর্নর হাউসে মন্ত্রিসভার বৈঠক চলছে। এমনি সময় ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স গভর্নর হাউসে কয়েকবার বিমান হামলা চালায় এবং ভবনের ক্ষতিসাধন করে। গভর্নর ডাঃ এএম মালিক ও তার পুতুল মন্ত্রিসভা তুরিত গতিতে ট্রেঞ্চে আশ্রয় নেয়। ঢাকার পাকিস্তান সরকারের শেষ চিহ্ন শেষ; ঢাকার প্রশাসন, সেনাবাহিনী সব শেষ। এখন আত্মসমর্পণ । গভর্নর বার বার ইয়াহিয়া খানের সাথে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ। ইয়াহিয়া ফোন ধরছেন না । তেমনিভাবে জেনারেল নিয়াজী বার বার চেষ্টা করে সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে জেনারেল হামিদ জেনারেল গুল হাসানের সাথে আলােচনা করতে পারছেন না।
১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লেঃ জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান শ্যাম মানেকশার নিকট বার্তা প্রেরণের জন্য ঢাকায় আমেরিকার কনসাল জেনারেল মি, হারবার্ট সিপব্যাকের নিকট যান এবং যুদ্ধবিরতির বার্তাটি দিল্লী
পৃষ্ঠাঃ ৪৭৯

পাঠাবার জন্য মি, সিপব্যাকের নিকট হস্তান্তর করেন। আমেরিকার কনসাল জেনারেল নিয়াজীর বার্তার একটি কপি ওয়াশিংটনে প্রেরণ করেন। নিয়াজির বার্তাটি ছিল—১১
“To bring to an end loss of further human lives and destruction we are willing to under honourable conditions :
A. Cease fire and stop all hostitities immediately in East
Pakistan.
B. Hand over peacefully administration of east Pakistan as
arranged by UN
C. The UN should ensure :
1. Safety and securities of all armed forces personnel of both military and para-military forces of Pakistan pending their return to West Pakistan.
2. Safety of all West Pakistan civilian and civil servant pending theur return to West Pakintan.
3. Satety of non-locals settled in East Pakistan since 1947
4. Guarantee of no reprisal against those who helped and served the government and cause of Pakiststan since March 1971.
এর একটি অনুলিপি রাও ফরমান গভর্নরের নিকট পৌছে দেন। নিয়াজী -তার সেনাবাহিনী, পাকিস্তানী নাগরিক, অবাঙালীদের নিরাপত্তা ও পশ্চিম পাকিস্তানি দের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের শর্তে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন।
সিপব্যাক নিয়াজীর বার্তাটি দিল্লী না পাঠিয়ে ওয়াশিংটন পাঠান। কিসিঞ্জার। পাকিস্তানকে আর একদিন অপেক্ষা করতে বলেন। জেনারেল শ্যাম মানেকশা নিয়াজীর বার্তাটি ১৫ ডিসেম্বর পেয়েছিলেন।
১৫ ডিসেম্বর
গভর্নর ডা. মালিক ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীর নিকট লিখলেন : গভর্নর হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের রেড ক্রিসেন্ট আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে (ICRC) অবস্থান করছিলেন। ১৫ ডিসেম্বর সকাল ১০.৩০ মিনিট রাওয়ালপিন্ডিতে সিওএস-এর নিকট জানতে চাইলেন যে, তিনি যে, প্রেসিডেন্টকে বার্তাটি পাঠিয়েছেন সে সম্পর্কে কোন উপদেশ আছে কি-না। জেনারেল আব্দুল হামিদ রাত ১১.৫০ মিনিটে নিয়াজীকে নিমােক্ত উপদেশ দেন।
পৃষ্ঠাঃ ৪৮০

জেনারেল হামিদ নিয়াজীকে ভারতের চীফ অব স্টাফের নির্দেশ অনুসারে বিরতি গ্রহণের উপদেশ দেন।হাসান জহির লিখেছেন, “ এদিন প্রত্যুষে (১৫ ডিসেম্বর) বিগত দিনের নির্দেশের ধারাবাহিকতা হিসেবে জিএইচকিউ (GHQ) পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক কে কাগজের টাকা, ট্রাভেলার্স চেক, ন্যাশনাল ব্যাংক ট্রেজারি চেক সিগন্যাল এবং কোড বই ধ্বংসের নির্দেশ দেন। ১৫ তারিখ রাতে স্টেট ব্যাংক খোলা হয় এবং নােটসমূহ পুড়িয়ে ফেলে। আসন্ন শক্রর দখলে যওয়ার পূর্বে পাকবাহিনি পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে। এ কাজ ছিল পােড়ামাটি নীতির অংশ বিশেষ আত্যসমর্পণের পর বাংলাদেশে এ কাজের বিরুদ্ধে ভীষণ সমালোচনা হয়েছিল। পাকবাহিনী যে কত জঘন্য ছিল তা স্টেট ব্যাংকের নােট পােড়ানাে থেকে জানা যায়। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে।
ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশা জেনারেল নিয়াজীর বার্তার উওর প্রেরণ করেন ১৬ ডিসেম্বর রাত ২৩.৩০ মিনিটে।
প্রাপক : লেঃ জেনারেল নিয়াজী।
প্রেরক : শ্যাম মানেকশা, ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান।
প্রথমত আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আপনার যুদ্ধবিরতির বার্ত আমি আজ ১৪.৩০টায় পেয়েছি।
দ্বিতীয় আমি জেনারেল ফরমান আলীর দুটো বার্তার মাধ্যমে পূর্বেই তাকে অবহিত করেছি যে, আমি নিশ্চয়তা প্রদান করছি (ক) বাংলাদেশে আপনার সেনাবাহিনী এবং আধা সামরিক বাহিনী যারা আমার নিকট আত্মসমর্পণ করবে তাদের সকলের নিরাপত্তা। (খ) বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু, পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক যেই হােক না কেন তাদের পূর্ণ নিশ্চয়তা প্রদান। যেহেতু আপনি যুদ্ধ বন্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, সে কারণে আপনি আপনার অধীনের সকল সৈন্যকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি এবং আমার সংগ্রামী সৈন্যদের নিকট যেখানে তারা অবস্থান করুন না কেন তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করবেন।
তৃতীয়, আমি আপনাকে পবিত্র নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারি যে, যে সকল ব্যক্তি আত্মসমর্পণ করবে তাদের একজন সৈন্যর যে মর্যাদা ও সম্মান প্রাপ্য তেমনি তারা সম্মান ও মর্যাদার ব্যবহার পাবে এবং জেনেভা চুক্তির ধারা মেনে চলতে বাধ্য থাকব। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আপনাদের আহত সৈন্যদের যথাযথ যত্ন নেয়া হবে এবং মৃতদের সঠিকভাবে কবর দেয়া হবে। যে যেখানে থেকে আসুক তাদের নিরাপত্তাহীনতার ভয়ের কোনাে কারণ নেই। আমার অধীনে যুদ্ধরত কোন বাহিনী প্রতিশােধ নিতে পারবে না।
পৃষ্ঠাঃ ৪৮১

চতুর্থত, আপনার নিকট থেকে এখনই খসড়া পেলে পুর্বাঞ্চলের ভারতীয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অারোর কে আপনার সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিমান ও স্থল বাহিনীর আক্রমণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করব। আমার বিশ্বাসের অংশ হিসেবে আজকের ১৭. ০০ টা থেকে ঢাকায় বিমান হামলা করার নির্দেশ দিয়েছি।
পঞ্চম, আমি মানব হত্যাকে ঘৃণা করি। সে কারণে আমি অাপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আপনার লােকদের হত্যার ইচ্ছা নেই। আমি যা বলেছি তা যদি আপনি না মানেন তাহলে তাদের কোন বিকল্প থাকবে না। ১৬ ডিসের ভারতীয় স্থানীয় সময় সকাল ০৯.০০ সেনাবাহিনী তীব্র বেগে আক্রমণ শুরু করব।
ষষ্ঠ, আলােচনা চূড়ান্ত করার জন্য আজ ১৫ ডিসেম্বর স্থানীয় সকল ১৭.০০ হতে বেতার সংযােগের ব্যবস্থা করেছি…” ১২
জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশা উওর পাকিস্তান সেনাবাহিনরি হেডকোয়ার্টারে পাঠান। ১৬ ই ডিসেম্বর সকাল ৩ টায় ভারতীয় সেনাপতির দেয়া শর্ত গ্রহণ করার নির্দেশ দেয় ।
এখানে একটি প্রশ্ন, রাও ফরমান আলী গভর্নর বা নিয়াজীকে না জানিয়ে কি করে মানেকশার সাথে যােগাযােগ করলেন! খুব সম্ভব তিনি রাওয়ালপিনডির সাথে গােপন যােগাযােগ রক্ষা করতেন। ১৫ ডিসেম্বর রাতে জেনারেল রহিম কে হেলিকপ্টারে বার্মা পাঠানাে হয়। তার সাথে ফরমান আলী যেতে চেয়েছিলেন। নিয়াজী তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলে তিনি থেকে যান ।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ নিয়ে আলােচনা চলছে। সােভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে ৪টি প্রস্তাব উত্থাপনের প্রস্তুতি চলছে। ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় নিরাপত্তা পরিষদে আলােচনা শুরু হয়। প্রথমে সিরিয়া, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়। তার বিরুদ্ধে সােভিয়েত রাশিয়া ভেটো প্রদান করলে তা নাকচ হয়ে যায়। ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী ভারতের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেন। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে নিউইয়র্ক সময় সকাল ৬টায় ঢাকায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে নিরাপত্তা পরিষদের ১৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণসিংহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধবিরতির একক সিদ্ধান্ত নিরাপত্তা পরিষদে পাঠ করে শােনান। এ
পৃষ্ঠাঃ ৪৮২

প্রস্তাবের ওপর ভােট গ্রহণ করা হয় করা হয় নি। ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর হাতে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে ৯টি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল তার মধ্যে দুটি প্রস্তাবে ভেটো দেয়া হয়। এছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে
জাতিসংঘের শেষ অংশগ্রহণ। এখানে সমাপ্ত হলাে বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কে আলােচনা। বাংলাদেশের আবির্ভাব কে জাতিসংঘ স্বীকৃতি প্রদান করে।

বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে আমেরিকা
রেডিওতে ঢাকায় ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজীর আত্মসমর্পণের সংবাদ প্রচারে পররাষ্ট্র সচিব টেলিফোন করেন। প্রেসিডেন্ট তাকে পরদিন সকালে দেখা করতে বলেন। ১৭ডিসেম্বর সকাল ৯টায় ইয়াহিয়া খান পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদের সাথে যুদ্ধবিরতি গ্রহণে সম্মত হন। কিন্তু তা হবে সাধারণ পরিষদের পরিষদের কাঠামাের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে সংবাদ এলাে পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড হেনরি কিসিঞ্জারের নিকট থেকে একটি সংবাদ নিয়ে এসেছেন। কিসিঞ্জার জানিয়েছেন যে, তিনি ব্রিটেনের নিকট থেকে জানতে পেরেছেন, ভারত তার প্রস্তাব ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত রাখবে এবং তারপর সােভিয়েত ইউনিয়ন সংযােজন পর্বের প্রস্তাবে এ রাতে নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করবেন। কেসিঞ্জারের ইয়াহিয়া খানকে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ভারতের প্রস্তাব গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন, অন্যথায় ভারত পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার অজুহাত পাবে এবং তারা তাদের মতাে প্রস্তাব জাতিসংঘে পেশ করার সুযােগ পাবে।
পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানকে কিসিঞ্জারের পরামর্শ গ্রহণের জন্য প্রচণ্ডভাবে চাপ দেন । তিনি বলেন, পাকিস্তানের সামনে ভয়ানক বিপদ । ভারত তার সকল বিমান বাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। তিনি তার বিমান অভিজ্ঞতা থেকে ধ্বংসের বিশেষজ্ঞ মতামত দিলেন যে, ভারত এক শ’ বিমান নিয়ে একসঙ্গে আক্রমণ করতে পারবে এবং পাকিস্তানের বিমান বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি কিছু বেঁচে যায় তা পুনরায় তুলে নেয়ার সময় ভারতের দ্বিতীয় আক্রমণে তা ভূমিতে ধ্বংস হয়ে যাবে । প্রেসিডেন্ট ক্ষীণকণ্ঠে সাড়া দিয়ে বলেন যে, আকাশেই যুদ্ধে বিজয় লাভ হয় না। আমেরিকার মতের ওপর ‘অনেক নির্ভর করে। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট ১৪ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিকট যে পত্র লিখেছেন তার উত্তরের অপেক্ষায় আছেন । ইয়াহিয়া সরাসরি ফারল্যান্ডকে জিজ্ঞেস করলেন,
আপনারা কি সত্যি সাহায্য করবেন, না আমি গভীর বিপদে পতিত হব ?
পৃষ্ঠাঃ ৪৮৩

তিনি একই সুরে আরও বলেন, আমি ঝুঁকিপূর্ণ পথে নিপতিত হতে পছন্দ করি না। অনেক অঙ্গীকার এবং আশা দেখানাে হয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি কােন বাস্তব সাহায্যের নতুনা দেখছি না। ফারল্যান্ড নিক্সনের অসুবিধার কথা তুলে ধরেন। ইয়াহিয়া খানকে সাহায্য করার অভিযোগে প্রেস নিক্সন কে কঠোর সমালােচনা করেছে। এখন নির্বাচনের সময়। ডেমােক্র্যাটিক পার্টি বাংলাদেশকে নির্বাচন ইস্যু করবে। নিক্সন যতদ্রুত সম্ভব সাহায্য প্রদান করবে। ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলে তার ভালোর দিকটি তুলে ধরেন-পূর্ব পাকিস্তানের বােঝা থেকে পশ্চিম পাকিস্তান মুক্ত হবে এবং পাকিস্তান হবে সমৃদ্ধিশালী দেশ। যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সাহায্য দেবে। ভারতের প্রস্তাব প্রত্যাহার করলে আমেরিকার প্রতিক্রিয়া নিন্মে ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন- Farland, I have a request. If you are not accepting the cease-fire, please let me know. I want to evacuate the Americans.
Yahya- why?
Garland. Pakistan is not to be a fit place to live in If india really starts this offensive.”১৩
ফারল্যান্ড ইয়াহিয়াকে বললেন, “আপনি যদি যুদ্ধবিরতি গ্রহণ না করেন আমাকে বলুন। আমি আমেরিকার নাগরিকদের স্থান ত্যাগ করাব। কারন ভারত যদি আক্রমণ করে তাহলে পাকিস্তানে বাস করার যােগ্য হবে না। তাই আমাকে সময়মতাে বলুন। আমি আমেরিকানদের নিয়ে যাব।” ফারল্যান্ড আমেরিকার মতামত জানালেন যে, ভারত চায় যে পাকিস্তান তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করুক। তাহলে তারা সর্বশক্তি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করতে পারবে ।
আমেরিকার রাষ্ট্রদূত চলে যাবার পর ইয়াহিয়া খান সুলতান মােহাম্মদকে যুদ্ধবিরতি গ্রহণের খসড়া প্রণয়ন করতে বলেন এবং জেনারেল হামিদ, লেঃ জেনারেল গুল হাসান এবং এয়ার মার্শাল রহিম খানকে ডেকে পাঠালেন। ফারল্যান্ডের সাথে তার যে আলােচনা হয়েছে তা তাদের অবহিত করেন। তারা তিন জনে ভারতের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণে সম্মত হন । অন্যদিকে সচিবালয়ে ইমার্জেন্সি কমিটি কয়েকটি শর্ত জুড়ে যুদ্ধবিরতি গ্রহণের পরামর্শ দেন। তারা বলেন, জাতিসংঘের ৭ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্তে আলােকে যুদ্ধবিরতি গৃহীত হবে এবং পূর্ব বাংলা থেকে ভারত ও পাকিস্তানীদের সৈন্য প্রত্যাহার করলে জাতিসংঘের শান্তিবাহিনী পূরণ করবে। এ সময় এমএম আহাম্মদ, তথ্য সচিব রােয়েদাদ খান, জেনারেল পীরজাদা, গােলাম ইসহাক খান উপস্থিত ছিলেন। ইয়াহিয়া খান
পৃষ্ঠাঃ ৪৮৪

পররাষ্ট্র সচিবকে খসড়া ভাষণটি সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করতে বলেন । রােয়েদ খান বলেন; যুদ্ধবিরতি জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে হচ্ছে না, হবে ভারতের প্রস্তাবে। ইয়াহিয়া খান এই বলে আলোচনা শেষ করেন যে, দায়িত্ব আমার। আমি অন্য কারও ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছি না। এটা ভাল হোক আমি এ করবইব। রােয়েদ খান বলেন এর ফলে জনগণ বিপক্ষে যেতে পারে। ইয়াহিয়া খান তার সভাৰসুলভ ভঙ্গিতে বলেন- জনগণকে প্রস্তুত থাকা উচিত ছিল। যদি তারা না থাকে তা আপনাদের সমস্যা। শব্দের কিছু পরিবর্তনের পর সকলে খসড়া ঘোষণা অনুমােদন করে। ১৭ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় পাকিস্তান সরকার যুদ্ধবিরতি গ্রহণের ঘােষণা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে। ২৩ বছর একত্রে থাকার পর পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হলাে।
কেন্দ্রীয় সরকারের জরুরি কমিটির সদস্য এমএম আহমেদ, গিয়াসউদ্দিন, গােলাম ইসহাক খান, কামরুল ইসলাম ;রােয়েদাদ খান, সুলতান মােহাম্মদ খান ১৫ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করে প্রস্তাব দেন যে, পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ চলবে। ইয়াহিয়া তাদের প্রস্তাবে সম্মত হন। বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর তিনি ১৫-১৬ ডিসেম্বর বেতার ভাষণ দেবেন। ভাষণ চূড়ান্ত করার পর তা প্রস্তাবিত প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনকে দেখাতে বলেন । পূর্ব পাকিস্তান হাউসে নূরুল আমিন ও মাহমুদ আলী অবস্থান করছিলেন। নুরুল আমিন ও মাহমুদ আলী মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী ছিলেন এবং তারা ইয়াহিয়া সরকারকে সমর্থন করে বাঙালী নিধনে সহযােগিতা করেন। খসড়া ভাষণ আলােচনার জন্য নূরুল আমিন, মাহমুদ আলী, তথ্য সচিব রােয়েদাদ খান রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করতে যান। নুরুল আমিন প্রেসিডেন্টকে উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘এত সস্তা মূল্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিক্রি করে দেয়া দেখার জন্য আমি বেঁচে আছি কি? প্রেসিডেন্ট বলেন, পাকিস্তানের জন্য আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। নূরুল আমিন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন আজই ঘােষণার জন্য দাবি তােলেন। ইয়াহিয়া আগামীকাল ঘােষণা করার নিশ্চয়তা দেন। ভাষণ উর্দু ও ইংরেজি অনুবাদ ১৫ ডিসেম্বর সকালে প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌছানাে হয়। প্রেসিডেন্ট সন্ধ্যা ৮.৩০ মিনিটে জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং জানান যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানে চলবে। তিনি বলেন, একটি যুদ্ধের বিপর্যয় দ্বারা যুদ্ধের সমাপ্ত বুঝায় না। ১৭ ডিসেম্বর রাত ৮টায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পশ্চিম পাকিস্তানে একক যুদ্ধবিরতি ঘােষণার মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৪৮৫

বাংলাদেশের অভ্যুদয়
১৬ ডিসেম্বর ঢাকার পতন
বাংলাদেশের বিজয়-পাকিস্তানের পরাজয়
যুদ্ধবিরতির শর্তাবলী সম্পর্কে প্রেসিডেন্টের নিকট থেকে নির্দেশের জন্য গভর্নর ডাঃ এএম মালিক এবং পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানী কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী অপেক্ষা করছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ১২টায় গভর্নর একটি উচ্চ পর্যায়ের জরুরি সভা আহ্বান করেন। সকাল ৯.৩০ মিনিটে ভাৱতীয় সিগন্যাল ইনটেলিজেন্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল পিসি ভাল্লা গভর্নর হাউসের সভার সংবাদ সিগনালে ধরে ফেলেন। লেঃ জেনারেল জ্যাকোব এই সংবাদটি শিলংয়ে অবস্থিত ইস্টার্ন এয়ার কমান্ডার এয়ার ভাইস মার্শাল দেশ্বরকে অবহিত করেন। গর্ভনর যাতে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন সে জন্য ভারতীয় বিমান গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) বােমাবর্ষণ শুরু করে। এ সময় সাংবাদিক জ্যাবিন ইয়ং জাতিসংঘের প্রতিনিধি কেলির সাথে দেখা করার জন্য গভর্নর হাউসে গিয়েছিলেন। গভর্নর ভীত হয়ে কেলিকে বলেন, আপনি কি মনে করেন আমাদের এখন ছেড়ে দেয়া উচিত? ডাঃ মালিক ইয়াহিয়া খানকে সম্বােধন করে পদত্যাগপত্র লেখেন। এ সময় গভর্নর হাউসে উপর্যপরি বিমানের বোমা হামলা চলছিল। তার মধ্যে তিনি জুতা খুলে অজু করে ট্রেঞ্চে নামাজ আদায় করেন। এ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের শেষ সরকারের গভর্নর- তিনি পরে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কেন্দ্র – হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে চলে যান।
১৫ ডিসেম্বর জেনারেল শ্যাম মানেকশা জেনারেল নিয়াজী প্রেরিত যুদ্ধবিরতির বার্তা পেলেন। মানেকশা নিয়াজীকে উত্তর প্রেরণ করেন। ১৫ ডিসেম্বর ১৭.০০ ঘণ্টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি পালন করতে উভয় পক্ষ সম্মত হয় । নিয়াজীর অনুরােধে যুদ্ধ বিরতির সময় ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় ।
১৫ ডিসেম্বর রাতে ১০১ কমিউনিকেশন বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল নাগরা, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী কালিয়াকৈর হয়ে নয়ারহাট-ঢাকা সড়ক ধরে দ্রুত এগিয়ে আসছিল। ঢাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে পাকবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার বাশার অস্থির; তিনি সংবাদ পেয়েছিলেন মুক্তিবাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করছে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি। সকাল ৬টায় নাগরা দেখলেন পাকিস্তানী সৈন্যরা গােলাবর্ষণ করছে না। নিয়াজী সকল সেনা ছাউনিতে যুদ্ধবিরতির বার্তা পাঠালেন। তুরাগ নদীর ওপারে গাবতলীতে পাকিস্ত
পৃষ্ঠাঃ ৪৮৬

।নী বাহিনী এবং পূর্ব পাড়ে মিএবাহিনী অবস্থান নিয়ে আছে। ভোর রাতে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। একটি জীপে মিত্রবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য জীপে মিরপুর সেতুর ওপরে যাওয়ার চেষ্টা করলে পাক বাহিনীর মেজর সালামতের নির্দেশে পাকবাহিনী গুলিবর্ষণ করলে জীপের ভিতরে একজন অফিসারসহ ৪ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। ভারতীয় সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণ করলে পাক বাহিনী পিছু হটে যায়।
জয়ের আনন্দ- জেনারেল নাগরা ও টাইগার সিদ্দিকী ঢাকা দখল করবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা গােলাবর্ষণ বন্ধ করেছে। নাগরা সিদ্ধান্ত নিলেন এই মুহুর্তে নিয়াজীর নিকট দূত পাঠাবেন। জীপের সামনে থাকবে বিরাট সাদা ফুাগ। দুইজন অফিসার তাদের নিকট নিয়াজীকে নিন্মের বার্তা পাঠালেন।
’প্রিয় আবদল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। ঘটনার পরিসমাপ্তি হয়েছে; আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি, আপনি আমার কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সেক্ষেত্রে আমরা আপনাদের কে দেখার দায়িত্ব গ্রহণ করব। শীঘ্রই আপনার প্রতিনিধি পাঠান ।
নাগরা তদার এডিসিকে বার্তাটি নিয়াজীর হাতে পৌছে দিতে বলেন। সাদা ফ্লাগ উড়িয়ে জীপটি ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়াটারে এসে পৌছল। সকাল ৯টায় বার্তাটি নিয়াজীর হাতে তুলে দেন। তখন সেখানে বসা ছিলেন নিয়াজী, মেজর জেনারেল জামসেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, রিয়ার এডমিরাল শরিফ। নিয়াজী বার্তাটি নীরবে পড়ে অন্যদের হাতে দেন। তখন সেখানে কবরের নিরবতা বিরাজ করছিল। মিত্রবাহিনীকে প্রতিহত করার মতাে সৈন্য জেনারেল নিয়াজীর ঢাকায় ছিল না। হয়তাে মিত্র বাহিনীকে কয়েক দিন ঠেকিয়ে রাখতে পারতেন; তাতে লােক ক্ষয় হতাে। জাতিসংঘ চেষ্টা করছে ভারত-রাশিয়াকে যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে । কিন্তু পাকবাহিনীর যেভাবে মনােবল ভেঙ্গে গিয়েছিল তাকে প্রতিহত করার শক্তি ছিল না। বিমান নেই, নৌবাহিনী নেই। তারা কয়েকটা শহরে জনবন্দী। তাদের আত্মসমর্পণ ব্যতীত তাদের পথ খােলা ছিল না। জেনারেল নিয়াজী ও তার যুদ্ধের সাথীরা ভাবলেন জেনারেল নাগরা সন্ধিচুক্তি সম্পর্কে আলােচনা করতে আসবেন । সিদ্ধান্ত হলাে তাকে অভ্যর্থনা দেয়া হবে । ঢাকার জিওসি মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামসেদ জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনার জন্য মিরপুর ব্রিজ যান। নাগরা সাদা ফ্ল্যাগ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। পাকিস্তানী এক মেজর নিয়াজীর আত্মসমর্পণের বার্তা প্রদান করেন। জেনারেল জামসেদ ব্রিজের পশ্চিম পাশে অপেক্ষা করছিলেন। জেনারেল নাগরা ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং ক্লার, কাদের সিদ্দিকী সাদা ফ্লাগে জীপে পশ্চিম পাড়ে এলেন। জেনারেল জামসেদ তাদের অভ্যর্থনা জানালেন । তখন সকাল সাড়ে দশটা; কুয়াশা কেটে
পৃষ্ঠাঃ ৪৮৭

গেছে। জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকীর ঢাকা প্রবেশের সাথে সাথে ঢাকার পতন ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলাে। তারা ৩৬ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে পৌছলে ইস্টার্ন আর্মির চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকের সবাইকে অভ্যর্থনা জানান। ইস্টার্ন কমান্ডারের কক্ষের অপারেশন ম্যাপ সরিয়ে কক্ষটি পরিষ্কার করা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর জেনারেল নিয়াজী কক্ষ ত্যাগ করে সকলের সাথে করমর্দন করে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠেন। জেনারেল নাগরা কাদের সিদ্দিকী কে নিয়াজির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। পরিচয়ের সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। জেনারেল নিয়াজী কাদের সিদ্দিকীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে কাদের সিদ্দিকী হাত না মিলিয়ে বললেন, যারা নারী ও শিশু হত্যা করেছে তাদের সঙ্গে করমর্দন করতে পারলাম না বলে আমি দুঃখিত। আমি আল্লাহর কাছে জবাবদিহির সম্মুখীন হতে চাই না”।১৪
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় কলকাতার থিয়েটার রোডে মুজিব নগর সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট খবর এলো ঢাকায় পাক বাহিনি আত্মসমর্পণে সম্মত হয়েছে। বিকেল ৩টায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্য করবেন প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী। কিন্তু তিনি যেন অস্বীকার করেন। তখন বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার অপেক্ষা করছে। ভারতীয় বাহিনী চাচেছ ওসমানী উপস্থিত থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ও সেনাপতি ওসমানীর সাথে আলোচনাকালে বিশিষ্ট সাংবাদিক চরমপত্র লেখক-পাঠক এম আর আখতার মুকুল উপস্থিত ছিলেন। পরে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ এয়ার কমােডর একে খন্দকারকে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রেরণ করেন। জেনারেল এমএজি ওসমানী কেন ‘ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যােগ দেননি- এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানীকে ঢাকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অনুরােধ জানান। ওসমানী ভয় পেলেন ঢাকা গেলে পাকসেনারা হয়তাে তাকে গুলি করে হত্যা করতে পারে। সে জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার জীবনের মূল্য খুব বেশি। আমি যেতে পারব না। পরবর্তী জীবনে জেনারেল ওসমানীকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, আমি একখানা বই লিখছি তাতে সব ঘটনাই পাবেন। জেনারেল ওসমানী অত্যন্ত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সব সময় পদমর্যাদার “ব্যাপারে সচেতন ছিলেন। তিনি যখন দেখলেন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধান
পৃষ্ঠাঃ ৪৮৮

সেনাপতি মানেকশা থাকবেন না; সুতরাং একটি স্বাধীন দেশের সেনাপতি হিসেবে তার চেয়ে নিচের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের অনুষ্ঠানে তার উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়।
এ ঘটনা সম্পর্কে লেঃ জেনারেল জেএফআর জ্যাকব তার লেখা
Surrender at Dacca’ গ্রন্থে লিখেছেন:
এমনি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারকে বলেন,….. ‘আজ বিকেল চারটায় রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান। সেখানে আপনাকেই মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। এটা আমার মান-ইজ্জতের প্রশ্ন। আপনার জন্য দমদম বিমানবন্দরে একটি হেলিকপ্টার তৈরি রয়েছে। আর একটা কথা- আমার জীপটা নিয়েই দমদম এয়ারপােটে চলে যান। প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র এ ফাইলটিতে রয়েছে। জীপে বসেই পড়ে নিতে পারবেন।
জেনারেল মানেকশা ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীর যুদ্ধ বার্তা পান। তিনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও নাগরিকদের নিশ্চয়তা প্রদান কালে নিয়াজী আত্মসমর্পণে সম্মত হন। ১৫ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় জেনারেল মানেকশা লেঃ জেনারেল জ্যাকবকে ঢাকায় ঐদিন বিকেলে আতসমর্পনের আয়োজনের জন্য অতিশীঘ্র ঢাকা যাওয়ার নির্দেশ দেন। জ্যাকব ইতিপূর্বে আসমর্পণ দলিলে খসড়া জেনারেল মানেকশার নিকট অনুমােদনের জন্য প্রেরণ করেছিলেন । জ্যাকব ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল অরােরাকে প্রধান সেনাপতির বার্তা জানালেন । নিয়াজী জ্যাকবকে দুপুরে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন । জ্যাকব কর্নেল সেহনাকে নির্দেশ দেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল ওসমানী ও একে খন্দকার যেন ঢাকার অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। জেনারেল জ্যাকব আত্মসমর্পণ দলিলের একটি খসড়া নিয়ে হেলিকপ্টারে যশাের হয়ে ঢাকা পৌঁছেন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ হেলিপাের্টে জ্যাকবকে অভ্যর্থনা জানান। জ্যাকব দুপুর একটায় সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে পৌছেন। কিছুক্ষণ পূর্বে নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী পৌছেন। জেনারেল নিয়াজী তার কক্ষে জেনারেল জ্যাকবকে অভ্যর্থনা জানান। আলােচনাকালে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল নিয়াজী, রাও ফরমান আলী মেজর জেনারেল জামসেদ, রিয়ার এডমিরাল শরীফ, এয়ার কমােডর ইনামুল হক, জেনারেল জ্যাকব যুদ্ধবিরতির খসড়ার কপি জেনারেল নিয়াজীকে দেখান । কর্নেল খারা আত্মসমর্পণ দলিলের খসড়া পাঠ করেন। রাও ফরমান সারেন্ডার এবং বাংলাদেশ শব্দের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে আপত্তি করেন । জ্যাকব পাকিস্তানী জেনারেলদের বুঝাতে সক্ষম হন।
পৃষ্ঠাঃ ৪৮৯

নিয়াজী দলিলটি জ্যাকবের হাতে ফিরিয়ে দেন। মনে হলো ইচ্ছা না থাকলে ও তার মৌন সম্মতি ছিল। জ্যাকব নিয়াজীকে বালেন আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত হবে। নিয়াজি বলেন অনুষ্ঠান তাদের অফিসে হতে পারে। জ্যাকব বলেন ,জেনারেল অরোরকে ভারত ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী গার্ড অব অনার প্রদান করলেন। গার্ড অব অনারের পর অরােরা এবং নিয়াজী সারেন্ডার ডকুমেন্টে স্বাক্ষর ‘করবেন।তারপর নিয়াজি ও তার তরবারি হস্তান্তর করবেন। নিয়াজী বলেন, তার তরবারি নেই তাহলে তিনি পিস্তল সমর্পণ করবেন নিয়াজীকে অত্যন্ত অখুশি মনে হলো। তিনি চুপ হয়ে যান। জেনারেল জ্যাকৰ একটি সাধারণ টেবিল সংগ্রহ করেন। তাকে অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট নির্দেশ দেননি। সাধারণভাবে তিনি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সকাল থেকে মুক্তিবাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করতে থাকে। জেনারেল নিয়াজী নিরাপত্তার জন্য অস্ত্র রাখার অনুমতি চাননি । তখনও ঢাকা শহরে ভারতীয় বাহিনী এসে পৌঁছায়নি। মুক্তিবাহিনী সারা শহরে এসে গেছে। সেক্টর কমান্ডার মেজর এটিএম হায়দার তার বাহিনী নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন। কাদের সিদ্দিকির বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধারা শহরে পৌঁছেছে। দুপুরে খাবারের পর বিকেল ৩টায় নিয়াজীর গাড়িতে জ্যাকব জেনারেল অরােরাকে অভ্যর্থনার জন্য বিমানবন্দরে রওনা দেন। পথে মুক্তিবাহিনী ও জনগন তাদের বাধা দেয়। নিয়াজীর ওপর জনগণ ক্রোধে ফেটে পড়ে।নিয়াজির নিরাপত্তা বিঘ্নিত। জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী বিমানবন্দরে অরোরার জন্য অপেক্ষা করছেন। কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনী নিয়ে জেনারেল নিয়া ঘিরে ফেলার চেষ্টা করেন। জ্যাকব বিপদ সঙ্কেত পেলেন। দলিলে স্বাক্ষরের জন্য নিয়াজীকে জীবিত থাকতে হবে। লেঃ জেনারেল জ্যাকব তার গ্রন্থে লিখেছেন-
‘I sensed trouble and asked the two paratroopers to shield Niazi I walked toward Siddiqui. It was imperative that Niazi should live to sign the instrument of surrender. I was afraid that Siddiqui may have come to shoot Niazi.”১৫
জেনারেল জ্যাকব মনে করলেন কাদের সিদ্দিকী জেনারেল নিয়াজীকে হত্যা করতে পারেন। তাই তাকে অবিলম্বে বিমানবন্দর ত্যাগ করার আদেশ দেন। কাদের সিদ্দিকী রাগান্বিত হয়ে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। বিকেল ৪-৩০ মিনিট ইস্টার্ন থিয়েটারের কমান্ডার এবং মিত্র বাহিনীর কমান্ডার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার মিত্রবাহিনীর এয়ার মার্শাল দেওয়ান, রিয়াল এডমিরাল কৃষ্ণ, লেঃ
পৃষ্ঠাঃ ৪৯০

জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা মিসেস অরােরা হেলিকপ্টার যোগে বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ক্ষতিগ্রস্ত বিমানবন্দরটি দ্রুত মেরামত করে অবতরণের উপযোগী করা হয়। বিমানবন্দরের টারমাকে ১৮টি জঙ্গী বিমান ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। জেনারেল জ্যাকব, জেনারেল নিয়াজী এবং এয়ার মার্শাল দেওয়ান এগিয়ে মিত্র বাহিনির প্রধান অরোরা কে অভ্যর্থনা জানান। এরপর গাড়ির বহর রমনা রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগিয়ে চলে। রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষ লোক উপস্থিত। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে কাদের সিদ্দিকীর কয়েক হাজার মুক্তিযােদ্ধা মিরপুর ব্রিজ হয়ে এবং ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার এটিএম হায়দার ও তার বাহিনী ডেমরা কমলাপুর দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। এটিএম হায়দার বেতার কেন্দ্র দখল করে। মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মতাে শশ্রুমণ্ডিত ছিল। বিজয় আনন্দে তারা আকাশে গুলি ছুড়ে মারে, সে কি আনন্দ । বাঙালী জাতির জীবনে এতবড় বিজয় ও আনন্দ আর আসেনি। পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে শুনে দশ লক্ষ লোক ৯ মাস ৯ দিন পর আবার রমনা রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যেখানে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীণতা ঘোষণা করেছিলেন সেখানে পাকিস্তানের পরিসমাপ্তি হবে। জেনারেল নিয়াজী ও তার ৯৩ হাজার দুর্ধর্ষ হত্যাকারী নির্যাতনকারী বর্বর সেনাবাহিনী মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করবে; লক্ষ লক্ষ বাঙালী তা দেখবে।
মিত্রবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা এবং পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান এবং সামরিক শাসক লেঃ জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজী রেসকোর্সে পৌছে গাড়ি থেকে নামলেন। পিছনের গাড়ি থেকে নামলেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার, কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী, ভারতীয় ১০১ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল নাগরা, ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব, ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং, ৯৫ মাউন্টেনের ব্রিগেডিয়ার এইচএম ক্লার, ভারতীয় সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের কর্নেল হেরা । তারা গাড়ি থেকে নেমে মিত্রবাহিনীর প্রধানের সারিতে দাঁড়ালেন। অন্য গাড়িগুলাে থেকে শান্ত্রী পরিবেষ্টিত অবস্থায় নামলেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জামসেদ, রিয়ার এডমিরাল শরীফ, ব্রিগেডিয়ার বাকের, এয়ার কমােডর ইনামুল হক। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে পাকিস্তানের ছােট একটি দল শিখ জেনারেল গান্ধর্ব নাগরার নেতৃত্বে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থার মধ্যে লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। তারপর জেনারেল অরােরা ও নিয়াজী গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর টেবিলের দিকে
পৃষ্ঠাঃ ৪৯১

এগিয়ে যান। জেনারেল অরােরা আত্মসমর্পণ দলিল টেবিলে রাখেন। জেনারেল নিয়াজী দলিল দেখলেন। কিন্তু কোনাে শব্দ করেননি। জেনারেল অরোরা প্রথমে মিত্রবাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। এবং তারপর জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ নিয়াজী দলিলে স্বাক্ষর করেন । স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণ দলিল নিচে উদ্ধৃত হলাে১৬—
ইংরেজি ভাষায় স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণ দলিলের বঙ্গানুবাদ
‘পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি বাংলাদেশে অবস্থিত সকল সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্ব রণাঙ্গণে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার নিকট আতসমর্পণ করতে সম্মত হন। পাকিস্তানের সকল স্থল, বিমান ও নৌবাহিনীর প্যারামিলিটারি এবং বেসামরিক সশস্ত্র সেনাবাহিনী এ আত্মসমর্পণের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ সকল সৈন্য তাদের অস্র পরিত্যাগ করবে এবং লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিংহের অধীনস্থ নিকটস্থ নিয়মিত বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করবে। এ দলিল স্বাক্ষরের সাথে সাথে পাকিস্তানের পূর্বাঞলীয় সেনাবাহিনী লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরােরার অধীনে চলে আসবে। নির্দেশ ভঙ্গ করলে তা আত্মসমর্পণের শর্ত ভঙ্গকরণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তা যুদ্ধ রীতি ও আইন অনুসারে বিচার করা হবে। যদি আত্মসমর্পণের শর্তের সম্পর্কে কোন সন্দেহ অথবা ব্যাখ্যার প্রয়ােজন দেখা দেয় তাহলে জগজিৎ সিং অরােরার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা নিশ্চিত আশ্বাস দেন, যে সকল সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে তাদের সঙ্গে জেনেভা কনভেনশনের বিধির অধীনে সেনাবাহিনীর প্রাপ্যতা অনুসারে পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে ব্যবহার করা হবে এবং পাকিস্তানের সৈন্য এবং প্যারামিলিটারি যারা আত্মসমর্পণ করছে তাদের নিরাপত্তা ও মঙ্গলের নিশ্চয়তা প্রদান করবে। লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরােরার অধীনে সেনাবাহিনী বিদেশী নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।’

জগজিৎ সিং অরােরা আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজি
লেঃ জেনারেল। লেঃ জেনারেল
পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় এবং সামরিক প্রশাসক জোন -খ এবং
বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয়
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সেনাপতি ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১
অরােরা যে দলিলে স্বাক্ষর করেছিল সেখানে সময়ের উল্লেখ ছিল (ভারতীয়
পৃষ্ঠাঃ ৪৯২

স্থানীয় সময়) বিকেল ৪.৩১ মিনিট (১৬.৩১ মিনিট) কিন্ত প্রকৃত সময় ছিল ৪.৫৫ মিনিট। নিয়াজী তার বেল্ট ও ব্যাজ দুটো খোলেন এবং ৩৬. বোরের রিভলবার অরােরার হাতে সমর্পণ করেন। তখন নিয়াজী নীরবে কাঁদছিলেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, জনতা নিয়াজীবিরােধী স্লোগান দিচ্ছে। সে কি অপূর্ব দৃশ্য। লক্ষ লক্ষ লােক জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনি দিচ্ছে অার নিয়াজি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের তীব্র ভাষায় গালাগাল করছে। তারা নিয়াজীকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায়। স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে মিত্রবাহিনী পাক সেনাদের পাহারা দিচ্ছে। সে দিন জনতা ও মুক্তিবাহিনী অতুলনীয় শৃঙ্খলার পরিচয় দেয়। বিদ্রোহী লক্ষ জনতা জেনারেল নিয়াজী ও পাকিস্তানী সেনাদের ছিনিয়ে নিয়ে যেতে পারত বারেসকোর্সে গুলি করে হত্যা করতে পারত। তারা বিশ্বাস করত খুনীদের বিচার হবে। মুক্তিবাহিনী আনন্দে আকাশে বৃষ্টির মতাে গুলিবর্ষণ করছে। এ পরিস্থিতিতে সিনিয়র ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাগণ নিয়াজীকে পাহারা দিয়ে গাড়িতে ওঠান। জেনারেল জ্যাকব তার গ্রন্থে লিখেছেন- ‘We are concerned about Niazi’s safety there being hardly any troops available at the Race Cource. We sensor officers escorted him to an Indian Army jeep. দলিলে স্বাক্ষরের পর ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল অরোরা তার দল নিয়ে হেলিকপ্টারে সন্ধ্যায় আগরতলা চলে যান। পাকিস্তানী জেনারেল নিয়াজি তার দল বাইরের অবস্থান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যান। মিত্র বাহিনি এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরের মাধ্যমে পূর্বঞ্চলে পূর্ বপাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলাে এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে এক রাষ্ট্রের জন্ম হলাে।
লেঃ জেনারেল এএকে নিয়াজী তার রচিত The Betrayal of East Pakistan গ্রন্থে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ সম্পর্কে লিখেছেন-
“জেনারেল মানেকশা আমাকে সংবাদ দেন যে, একটি ভারতীয় দল আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করার জন্য ঢাকা আসছে। …যা হােক হেলিকপ্টারে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব তার দল নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসেন। ভারতীয় দল যুদ্ধ বন্ধের শর্তাদি আলােচনা ও নির্ধারণ করার জন্য এসেছে। তারা আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া নিয়ে এসেছে। ভারতীয় দল আমাদের সাথে ঠগবাজি করেছে। তারা ভয় দেখালেন যে, তারা অনুগত নাগরিক এবং ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় গ্রহণকারী বেসামরিক কর্মকর্তাদের মুক্তিবাহিনীর নিকট হত্যা করার জন্য হস্তান্তর করবে। আত্মসমর্পণ দলিলে উল্লিখিত ভারত এবং
পৃষ্ঠাঃ ৪৯৪

বাংলাদেশের সেনাবাহিনী অন্তর্ভুক্ত করেন। আত্মসমর্পণের স্থান আত্মসমর্পণের পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই ; কিন্তু সে অবস্থায় মানতে বাধ্য হই। আমরা আত্মসমর্পণ অনষ্ঠানেরপ্রস্তাবে আপত্তি করি ; আমি এ রকম একটি অনুষ্ঠান আয়ােজনে অস্বীকৃতি জানাই ; কিন্তু আমাদের আলােচনা ব্যর্থ হয়ে যায় । ভারতীয়রা অটল ছিল। তারা অনুগত বাঙালীদের হত্যা করার ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। আমি যখন দলিলে স্বাক্ষর করি তখন আমার হাত কাপছিল ।দুঃখ আমার হৃদয় হতে চোখে এবং হতাশার অশ্রু বেয়ে পড়তে থাকে। আমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে আমার কোন পছন্দ অপছন্দ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচাবার জন্য অস্র পরিত্যাগ করার অাদেশ অামার ভাগ্য নিয়ন্ত্রন করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ – শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তারা ৯ মাসব্যাপী শুনে আসছে পাকবাহিনি বিদ্রোহী দের নির্মল করেছে। তারা পরাজয়ের সংবাদ শুনে হতবাক। তারা জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পরে। ইয়াহিয়া খানকে পদত্যাগ করতে হয়, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন।
Witness to Surrender গ্রন্থের লেখক সিদ্দিক সালিকের প্রশ্নের উত্তরে নিয়াজি বলেন ‘ কি কারণে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। ফল কি হবে- মৃত্যু ও ঢাকার নর্দমা রক্তের স্রোতে বন্ধ হয়ে যাবে । রাস্তায় লাশের স্তুপ হবে। কিন্তু শেষ পরিণতি একই হবে। ৯০ হাজার বিধবা এবং অর্ধ মিলিয়ন এতিমের মুখােমুখি হওয়ার চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে নিয়ে যাবে। উৎসর্গে কোন মূল্যায়নই হবে না। ফলাফল একই হবে।”১৭
জেনারেল নিয়াজীর অনুরােধে জেনারেল অরােরা আত্মরক্ষার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত অস্ত্র রাখার অনুমতি দেন। লক্ষাধিক মুক্তিযােদ্ধা বাংলাদেশের শহর, বন্দর ও গ্রামে সমবেত । তারা বীরের সংবর্ধনা পাচ্ছে।আবার অনেকে স্বজন হারিয়ে শােকাভিভূত। সারা বাংলায় বিজয় ও কান্নার রােল । অনেক মুক্তিযােদ্ধা বাবা, মা, ভাই-বােন হারিয়ে আত্মহারা । তাই অনেকে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছে। অবাঙালী বিহারী ও পাকিস্তানী সৈন্যদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল ভারতীয় বাহিনীর। প্রথম দিকে ভারতীয় সৈন্যের সংখ্যা কম ছিল। পরে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ১৯ ডিসেম্বর পাক সেনারা অস্ত্র পরিহার করে।
১৬ ডিসেম্বর ঢাকা স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধুর পরিবার তখনও গৃহবন্দী। ১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মেজর তারা তাদের মুক্ত করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বিহারী লােকজন বাঙালীদের হত্যা ও তাদের ওপর নিপীড়ন চালায়। তাই অনেক
পৃষ্ঠাঃ ৪৯৫

স্থানে বাঙালী মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উপর প্রতিশোধ নেয়। এ সময় অনেক বিহারী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়। ভারতীয় সৈন্যরা অৰাঙালী বিহারীদের রক্ষা করে। অবশ্য পাকবাহিনীর দালালীর অভিযােগে অনেক বিহারী কে হত্যা করা হয়। কোন কোন স্থানে বিহারীদের প্রতি প্রতিশােধের মাত্রা ছিল বেশি। বাংলাদেশ সরকার ২২ ডিসেম্বর শাসনভার গ্রহণ করার পর সকল প্রকার হত্যা নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। অপরাধীদের গ্রেফতার করার নির্দেশ দেয়া হয় । আইন নিজেদের হাতে তুলে না নেয়ার নির্দেশ কঠোরভাবে পালিত হয়।
২০ ডিসেম্বর সকালে লেঃ জেনারেল একে নিয়াজী মেজর জেনারেল ফরমান -এডমিরাল শরীফ, এয়ার কমোডর ইনামুল হক, ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দকি জনসংযােগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিককে যুদ্ধবন্দী হিসেবে ঢাকা থেকে কলকাতায় পাঠানাে হয়।ফোর্ট উইলিয়ামে আটক রাখা হয়। ঢাকার বাইরের সৈন্যদের সংগ্রহ করা খুব দুরূহ ছিল। ৩ দিনের মধ্যে সকল সৈন্যকে বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা সেনানিবাসে একত্রিত করা হয়। পরে মেজর জেনারেল নজর হােসেন মোহাম্মদ হােসেন আনসারী, কাজী মজিদ, মেজর জেনারেল জামসেদকে কলকাতায় পাঠানাে হয়। তারপর ৯০ হাজার সৈন্যকে পর্যায়ক্রমে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রেরণ করা হয় ।
ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন পরিচালনার জন্য ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে বেসামরিক সেল প্রতিষ্ঠা করে। ভারতীয় আইএএস পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তাকে নিয়ে বেসামরিক সেল গঠন করা হয়েছিল। তারা নিয়োগপএ নিয়ে বাংলাদেশে যােগদানের জন্য প্রস্তুত। এমনি সময় মুজিব নগর সরকার ঘােষণা করে যে, তাদের প্রয়ােজনীয় সিএসপি, ইপিসিএস ও অন্যান্য কর্মকর্তা রয়েছে এবং তাদের সচিবালয় ও বিভিন্ন জেলায় পদায়ন করা হয়েছে।সুতরাং ভারতীয় সিভিল অফিসারদের তাদের প্রয়ােজন নেই। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে সব সামরিক বিষয়ক নিয়ােগ অকার্যকর হয়ে পড়ে ।
বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানাে হয় যে, ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ লুটপাট করছে । এ অভিযােগ শুনে জেনারেল অরােরা ১৮ ডিসেম্বর জেনারেল জ্যাকোবকে নিয়ে ঢাকায় এসে বিষয়টি তদন্ত করে ফিরে আসেন। ঘটনা যদিও অনেকটা গুজব, তা সত্ত্বেও তিনি মানেকশাকে বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী অত্যন্ত সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে। তদের বিরুদ্ধে কোন নারী নির্যাতনের অভিযােগ পাওয়া যায়নি। বাংলার একটি শ্রেণী মিথ্যা অভিযােগ করতে থাকে। বিশেষ করে মেজর জলিলের সাথে সম্পদ লুটের বিষয় নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সংঘর্ষের কথা বলা হয়। কিন্তু তিনি এ রকম কোন সংঘর্ষে ভারতীয় বাহিনীর সাথে লিপ্ত হননি। এক কাল্পনিক
পৃষ্ঠাঃ ৪৯৬

কাহিনী সৃষ্টি করে বলা হয় যে, ভারতীয় বাহিনী যশোর, খুলনা থেকে মালামাল ও অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল। মেজর জলিল বাধা দিলে সংঘর্ষ হয়। প্রকৃত পক্ষে এ রকম কোন ঘটনা ঘটে নি। বাংলাদেশ সেনা আইন ভঙ্গ করলে জেনারেল এমএজি ওসমানীর নির্দেশে জলিলকে ১৯৭১ সালের ৩০ ডিসেম্বর বন্দী করা হয় এবং পরে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। মেজর জলিল ও কয়েকজন ছাত্রনেতার উদ্যোগে গঠিত সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তানের ক্ষয়ক্ষতি
যুদ্ধে পাকিস্তান ৫৭৫০ বর্গমাইল ভূমি হারায় । তারমধ্যে রাজস্থান সেক্টরে ৫০০০ বর্গমাইল, শিয়ালকোট সেক্টরে ৩৮৬ বর্গমাইল এবং উত্তর অঞ্চলে ৩৬৪ বর্গমাইল হারায়। পূর্ব পাকিস্তানে মিত্রবাহিনীর সাথে যুদ্ধে পাকিস্তানের ১১৫ জন অফিসার, ৩০ জন জুনিয়র অফিসার এবং ১১৮২ জন সৈন্য নিহত হয়। পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তানের ৭০ জন অফিসার, ৫৯ জন জুনিয়র অফিসার এবং ১৪৮২ জন সৈন্য নিহত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে পাকবাহিনী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতের হিসেবে ২৬ মার্চ হতে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনীর ৪৫০০ সৈন্য নিহত এবং ৪০০০ জন আহত হয়েছে। এরা সকলে মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। ৪ ডিসেম্বর হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২২১ জন নিহত হয় এবং ৪০০০ আহত হয়েছে। মােট ৬৭৬১ জন পাকবাহিনীর অফিসার ও সৈন্য নিহত হয়েছে।
এ যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর ১৪২১ জন নিহত, ৪০৫৮ জন আহত এবং ৫৬ জন নিখোঁজ হয়েছে।
পুর্ব রণাঙ্গনে মিত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধে পাকিস্তানের ১৮টি এফ ৮৬ বিমান, ৪১টি ট্যাঙ্ক, ৫০টি কামান, মর্টার, ১০৪টি রিকয়েললেস কামান এবং অনেক গানবােট ও নৌযান ধ্বংস হয়েছে। পাকবাহিনী ভারতীয় বাহিনীর ২৪টি ট্যাঙ্ক, ১৪টি বিমান ধ্বংস করেছে।
ইয়াহিয়া খানের বিদায়- ভুট্টোর ক্ষমতা গ্রহণ
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজীর আত্মসমর্পণের সাথে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানের সমাপ্ত হয়। পাকিস্তানের জনগণ পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য ইয়াহিয়া খান, জেনারেল নিয়াজী প্রমুখকে দায়ী করে সারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবল আন্দোলন শুরু হয়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৪৯৭

জনসাধারণ তাদের গাড়ি দেখলে পাথর ছোড়ে।তরুণ আর্মি অফিসাররা বিদ্রোহ করে এবং ইয়াহিয়া খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে। এ ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়ক ছিলেন চীফ অব স্টাফ লেঃ জেনারেল গুল হাসান বিমান বাহিনির প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম, জেনারেল পীরজাদা এবং টিক্কা খান।তারা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর সমর্থক। তারা অবিলম্বে ভুট্টো কে নিউইয়র্ক থেকে দেশে ফিরে আসার পরামর্শ দেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ১৮ – ২০ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতার লড়াই চলে। এ সময় জেনারেল গুল হাসান ক্ষমতাবান হয়ে দাড়ান। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা গুল হাসান নিজেই প্রেসিডেন্ট হবার স্বপ্ন দেখতেন। ওদিকে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় থাকতে চান।১৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট হাউসে সেনাবাহিনীর প্রধানগণ ও জরুরি কমিটির সদস্য দের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কেবিনেট সচিব গােলাম ইসহাক খান ভুট্টোকে দেশে ফিরে আসার পরামর্শ দেন। ভুট্টোকে অবিলম্বে দেশে আসতে বলা হয়। প্রেসিডেন্ট ১৮ ডিসেম্বর নতুন শাসনতন্ত্রের প্রধান বিষয়গুলাে সম্পর্কে ভাষণ দেবেন। জেনারেল গুল হাসান ইয়াহিয়া খানকে ভাষণ না দেয়ার পরামর্শ দেন। ইয়াহিয়া খানের ভাষন আর দেয়া হলাে না। জেনারেল গুল হাসান ও অন্যান্যের পরামর্শে ইয়াহিয়া খান ১৯ ডিসেম্বর রাতে পদত্যাগ করেন। ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশে ফিরে ঐদিন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ভুট্টো তার পাকিস্তান পিপলস পার্টির সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন।তার ক্ষমতা গ্রহণ সম্পর্কে জেনারেল নিয়াজী বলেন, ‘ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের স্থান দখল করেছেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে পুড়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের পােড়া ছাই থেকে তিনি তার ভাগ্য খুঁজে পেয়েছেন। ছাই থেকে তিনি মুকুট তুলে নিয়ে মাথায় পরেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে শাসন করা তার ভাগ্যে লেখা ছিল।
জেনারেল নিয়াজী আরও লিখেছেন- “প্রেসিডেন্টের অনুমতি ব্যতীত মেজর জেনারেল ফরমানের জাতিসংঘে বেআইনী বার্তা প্রেরণ, গভর্নরকে বা আমাকে না জানিয়ে তার আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং গ্রেট ব্রিটেনের প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাত এবং তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের, আমার অনুমতি না নিয়ে রাশিয়া এবং ভারতের প্রধান সেনাপতির সাক্ষাত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির পক্ষে এয়ার মার্শাল রহিম খানের প্রেসিডেন্ট ভবনের ওপর দিয়ে বিমান উড্ডয়ন- এ সকল কার্যাবলী ভুট্টোকে ক্ষমতাসীন করার পরিকল্পিত ক্যুর অংশবিশেষ।”১৮
পৃষ্ঠাঃ ৪৯৮

১৯-২০ ডিসেম্বর রাতে গভর্নর মালিক তার পরিবার, মন্ত্রীরা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বেসামরিক কর্মকর্তাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাহারায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর করা হয়। মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর প্রতিশােধ নিতে পারে- এ ভয়ে তাদের হােটেল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
নিয়াজীকেও তার সাথে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার পর ICIRC যুদ্ধবন্দীদের তালিকা প্রণয়ন করে এবং ১৯৭২ সালের জানুয়ারি হতে খুলনা থেকে বিশেষ ট্রেনে যুদ্ধবন্দীদের ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়। ১৯৭৪ সালে যুদ্ধবন্দীরা মুক্তি লাভ করে পাকিস্তানে ফিরে যায়।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ
ঢাকায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করলে ১৬ ডিসেম্বরেই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বিজয় লাভের প্রাক্কালে সােভিয়েত ইউনিয়ন, পােল্যান্ড ও অন্যান্য দেশকে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
জাতির উদ্দেশে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে প্রদত্ত গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ :
দেশবাসী সংগ্রামী ভাই বােনেরা,
বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রাম আজ সাফল্যের তােরণে উপনীত হয়েছে। গতকাল বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে সম্মিলিত ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খার নিযুক্ত খ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক হিসেবে এবং নিজের ক্ষমতাবলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী তার অধীনস্থ পাকিস্তানী স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী, আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীসহ বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন।
পঁচিশ মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের যে দুঃস্বপ্নের রাত শুরু হয়েছিল, এতদিনে তার অবসান হলাে। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের কর্তৃত্ব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলাে । এত অল্প সময়ে বােধহয় আর কোনাে জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হয়নি, স্বাধীনতার জন্য এত মূল্য বােধহয় আর কোন জাতি দেয়নি। আজকের বিজয় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়, ভারত- বাংলাদেশ মৈত্রীর বিজয়, সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের বিজয়।
আমরা যারা আজ স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি, আসুন,
পৃষ্ঠাঃ ৪৯৯

শ্রদ্ধাবনত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযােদ্ধাদের যারা নিজেদের নিজেদের উৎসর্গ করেছেন সকলের মঙ্গলের জন্য ।
পাকিস্তানের সামরিক চক্র চেয়েছিল বর্বর শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে দমন করে রাখতে। হানাদারেরা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে পঙ্গু করেছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, আমাদের জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে।
এই দুঃসময়ে আমাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভারত।আর তাই পাকিস্তানি সমরনায়কদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ভারতের উপর । বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে , ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে। পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানী আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। আর পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে সংগ্রাম করে তারা মাত্র বারাে দিনের যুদ্ধে দখলদার সেনাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপর্যয় এত দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হতে পারলো ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশার নেতৃত্ব এবং সম্মিলিত বাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিপুন রণকৌশলে। এই দুই সেনাপতির কাছে এবং ভারতের স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর কাছে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
আমাদের সাফল্যের এই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তিনি যেভাবে পথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সঙগত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যেভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, ইতিহাসে তার নজির নেই। আমাদের সংগ্রামের ফলে ভারতের জনসাধারণকে যে বিপুল ভার বহন করতে হয়েছে, সে বিষয়েও আমরা সচেতন। তাদের এই কষ্ট স্বীকার সার্থক হয়েছে। শরণার্থীরা এখন মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন।
আমাদের সংগ্রামের গতি দৃঢ়তাপূর্ণ সমর্থন দানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। পােল্যান্ড এবং অন্য যে সব দেশ আমাদের ন্যায় সংগ্রামকে সমর্থন করেছে, তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা এ কথাও ভুলিনি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামকে যথার্থরূপে তুলে ধরে এই সংগ্রাম সফল করতে সাহায্য করেছেন।
দেশবাসী ভাইবােনেরা
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু আমাদের সংগ্রাম শেষ
পৃষ্ঠাঃ ৫০০

হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনাে শত্রুর কারাগারে। পাকিস্তানি শাসকদেরকে আমি আহবান জানাচ্ছি, তারা শেষ মুহূর্তে অন্তত শুভবিদ্ধির পরিচয় দিন.। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন। এই দাবি মেনে নেয়ার সুফল সম্পর্কে পাকিস্তান কে অবহিত করাও তার বন্ধুদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এলো এক রক্তাপ্লুত ভূমিতে এবং ধ্বংসস্তুপের মধ্যে। জনগণের আশা ও আকাক্ষা অনুযায়ী এই দেশকে নতুন করে গড়ে তােলার দায়িত্ব এখন আমাদের সামনে। দেশের এত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযােগিতা ও সাহায্য কামনা করব। শুধু পুনর্নির্মাণ নয়- নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মসমর্পণের পরিচয় আমরা দিয়েছি, সেই ঐক্য ও ত্যাগের মনােভাব অটুট রাখতে হবে । তবেই নতুন গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় সেই নতুন আলাের পথে আজ আমরা যাত্রা করলাম।
জয়বাংলা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘােষণা
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় পার্লামেন্টে নিম্নোক্ত ঘােষণা প্রদান করেন—
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “আজ আমি একটি ঘােষণা দিচ্ছি ঢাকায় ১৬.৩১ ঘণ্টায় আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেঃ জেনারেল এ একে নিয়াজী আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষর করেছেন এবং ইস্টার্ন থিয়েটারের ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর কমান্ডার লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা আত্মসমর্পণের দলিল গ্রহণ করেছেন। ঢাকা এখন স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী।
এই ঐতিহাসিক ঘটনায় এই সংসদ ও সমগ্র জাতি আনন্দ উৎসবে মুখরিত। আমরা তাদের বিজয় মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা মুক্তিবাহিনীর সাহসী যুবক ও ছেলেদের তাদের দুঃসাহস ও আত্মত্যাগের জন্য অভিনন্দন জানাই। আমরা আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর জন্য গর্বিত। তারা তাদের গুণাবলী ও দক্ষতা প্রদর্শন করেছে। …আমাদের উদ্দেশ্য সীমাবদ্ধ ছিল- নিষ্ঠুর নির্যাতনের রাজত্ব থেকে তাদের দেশকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের সাহসী জনতা ও মুক্তিবাহিনীকে
পৃষ্ঠাঃ ৫০১

সাহায্য করা এবং আমাদের নিজস্ব ভূমিতে আগ্রাসন প্রতিহত করা। ভারতের সেনাবাহিনী প্রয়ােজনের চেয়ে বেশি সময় বাংলাদেশে অবস্থান করবেন না।
আমরা বিশ্বাস করি নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগনের মধ্যে সঠিক স্থান পাবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তি প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করবেন।
মাউন্টব্যাটেনের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হলাে
ল্যারি কলিন্স এবং ডমিনিক লা পিয়ার তাদের বিখ্যাত গ্রন্থ “Freedor at Midnight’ গ্রন্থে বাংলাদেশ সৃষ্টি সম্পর্কে অখণ্ড ভারতের সাবেক গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভবিষ্যত বাণীর উল্লেখ করেছেন- The traumatic experience of the 1971 Bangladesh war which released Louis Mountbatten’s prophecy that the union between the two halves of Pakistan would not last a quarter of a century…
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধের ফলে লুইস মাউন্টব্যাটেনের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের দুটি অংশ নিয়ে গঠিত দেশ এক শতকের এক-চতুর্থাংশ (২৫) বছর টিকে থাকবে না’ মূলত মাউন্টব্যাটেনের ভবিষ্যদ্বাণীর সময়ের এক বছর পূর্বেই পাকিস্তান ভেঙ্গে যায়। বাংলাদেশ পথিবীর বুকে আত্মপ্রকাশ করে। উল্লেখ্য, লুইস মাউন্টব্যাটেন অখণ্ড ভারতের গভর্নর জেনারেল থাকাকালে বৃহত্তর বাংলাকে ভাগ করতে চায়নি। তিনি চেয়েছিলেন যে, বৃহত্তর বাংলা ভারতের তৃতীয় স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। মাউন্টব্যাটেন ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাঙালী জাতির মহান নেতাদের স্বাধীন বাংলাদেশ
প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলাে
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জাতির মহান নেতাদের আজীবন লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলাে-
শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের লাহাের প্রস্তাব
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ শেরেবাংলা লাহােরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সম্মেলনে ভারতের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৫০২

হােসেন শহীদ সােহারওয়ার্দরি স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করেন। সাথে ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু ও আবুল হাশিম। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের স্বপ্ন আংশিক হলেও বাস্তবায়িত হয়েছে।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব বাংলা
১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাঙালী জাতি পশ্চিম পাকিস্তানকে শেষ বিদায় জানিয়েছে।
লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেনের এক দফা
লক্ষ লক্ষ শহীদের সাথে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রত্যুষে জয় বাংলা উউচ্চারণ করে পাকবাহিনীর বুলেটে নির্মমভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পিতার নির্মম মৃত্যু দেখে তার শিশুপুত্র চিরতরে বােবা ও পঙ্গু হলাে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য
১৯৭১ সালের যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষকে পাকিস্তা নের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি দেয়া- এ ছাড়া ভারতের কোন উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের বাংলাদেশের ভূমি দখল বা সম্পদ লুট করার ইচ্ছা ছিল না।
দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। এ ছিল সীমিত যুদ্ধ, সীমিত এলাকায়।
তৃতীয় বৈশিষ্ট্য, এ যুদ্ধের ফলে একটি নতুন দেশ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।।
চতুর্থত, পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতের একক যুদ্ধবিরতি ঘােষণা ছিল ঐতিহাসিক। ভারত ইচ্ছা করতে পশ্চিম পাকিস্তান দখল করে খণ্ড খণ্ড করতে পারত, তা না করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ায় তারা যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করে এবং তা পাকিস্তান গ্রহণ করে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপান ও জার্মানির আত্মসমর্পণের পর বিশ্বে ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণের মতাে কোন ঘটনা ঘটেনি। ১৪ দিনের যুদ্ধে ভারতের মাত্র ১০৪৭ সৈন্য নিহত, ৩০৪৭ জন আহত এবং ৮৯ জন নিখোঁজ ছিল। মুক্তিযুদ্ধবিরােধী শক্তি জামায়াত, মুসলিম লীগ বর্তমান বিএনপিসহ বামপন্থীদের অনেকে বলে থাকেন— ভারত নিজের স্বার্থে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তা পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে মুসলমান রাষ্ট্রকে দুর্বল করেছে। এসব দলের অনেকে বলেন তারা স্বাধীনতা চেয়েছে তবে
পৃষ্ঠাঃ ৫০৩

ভারতের মাধ্যমে নয়।কিন্তু ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব ছিল না।
পণ্ডিত জওহর লাল নেহরুর কন্যা শীমতী ইন্দিরা গান্ধী, বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তা তিনি সমর্থন করেছেন। তিনি বাঙালি দের গণহত্যা ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা দিয়েছেন। তিনি তার সেনাবাহিনী দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সম্মিলিত ভাবে যুদ্ধ করে পাক বাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশকে মুক্তি করেন । তিনি বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা। বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর সাথে ইন্দিরা গান্ধী কছিগিন ও পদগরনির চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন।

‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধীর মন্তব্য
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনা অফিসার মেজর জেনারেল লাছমান সিং তার Victory in Bangladesh এর গ্রন্থ রচনাকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এক পত্রে নিন্মের ৭টি প্রশ্ন করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৯ সালের ৭ জুন উল্লিখিত প্রশ্নের উত্তর দেন। নিন্মে প্রশ্ন ও উত্তরের বঙ্গানুবাদ উদৃত হলাে।
“প্রিয় জেনারেল সিং আমি আপনার ২৭ মে তারিখের পত্র পেয়েছি। নিন্মে আপনার পত্রের উত্তর দেয়া হলাে :
১. প্রশ্ন : আপনার (ইন্দিরা গান্ধী ) রাজনৈতিক এবং কৌশলগত উদ্দেশ্য কি ছিল?
উত্তর ; উদ্দেশ্য ছিল দশ মিলিয়ন উদ্বাস্তু নিরাপদে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানাে এবং আমাদের সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আমার মুল্যায়ন হলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে দেশাত্মবােধের চেতনা এত জাগ্রত হয়েছে যে, তারা মৃত্যুবরণ করবে কিন্তু আত্মসমর্পণ করবে না এবং এ চেতনার ফলে তারা অবশ্য স্বাধীনতা অর্জন করবে। দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ফলে আরও বেশি রক্তপাত হতাে এবং দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হতাে ।
সারা ভারতের জনগণ বিশেষ করে বাংলার জনগণের পূর্ব পাকিস্তানীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। এ ছাড়া পূর্ব সীমান্ত অথবা পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানী আক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমি যুদ্ধ পরিহার করতে চেয়েছিলাম এবং উদ্দেশ্য মনে রেখে আমি ইউরােপ এবং আমেরিকা ভ্রমণ করে পশ্চিমের দেশগুলাের সরকারকে আমাদের দ্বারপ্রান্তে, আমাদের সীমান্তের ভেতরে উপস্থিত
পৃষ্ঠাঃ ৫০৪

এবং বিপদ সঙ্কুল পরিস্থিতি বােঝাবার এবং বিবেক জাগ্রত করার চেষ্টা করেছি। পাকিস্তান আমাদের বিমানবন্দরগুলাে আক্রমণ করে আমার শেষ চেষ্টাকে কেড়ে নেয়।
২. প্রশ্ন : আমেরিকা চীন ও সােভিয়েত রাশিয়ার সম্ভাব্য ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
উত্তর : আমরা চীন ও ,পরোক্ষভাবে আমেরিকার হস্তক্ষেপ বাতিল করতে পারি। না। সােভিয়েত রাশিয়া আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল কিন্তু আমি মনে করি না যে তারা প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য করতে পারত।

৩. প্রশ্ন : আমাদের রাজনৈতিক কৌশল অথবা, যুদ্ধ পরিচালনার ওপর ইন্দো সােভিয়েত চুক্তির প্রভাব কি ছিল?
উত্তর : আমাদের কৌশল অথবা যুদ্ধ পরিচালনার ওপর এর কোন প্রভাব ছিল না। এ চুক্তি আমাদের নৈতিক মনােবল অটুট রেখেছে এবং নৈতিক সমর্থনের উৎস ছিল। এটা অবশ্য সান্ত্বনা ছিল যে, তারা আমাদের বিরুদ্ধে ছিল না।
৪. প্রশ্ন : জাতিসংঘ ও পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্রগুলাের চাপ কি পরিমাণ ছিল এবং সে সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া কি ছিল।
উত্তর : চাপের পরিমাণ করা কঠিন। তবে বেশ চাপ ছিল। অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ যারা গণতন্ত্রের জন্য চীৎকার করছিল। তারা পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের গনতান্ত্রিক মতামতের প্রতি অথবা পাকিস্তানের নির্বাচন এবং নির্দোষ জনগণকে হত্যার ব্যাপারে সামান্য শ্রদ্ধা বা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং আমেরিকার কোন কিছু গােপন না করে তারা ভারতকে তার অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য সব কিছু করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে সমর্থন পরিত্যাগ করতে বলেছিল, যদি তা আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে হলেও । জাতিসংঘের অধিকাংশই আমাদের বিরুদ্ধে এবং আমাদের বিব্রত করার জন্য তারা সবকিছু করেছে। আমি এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা না দেয়া পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের সেখানে তার খুব খারাপ সময় ছিল।
৫. প্রশ্ন : বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রবেশ সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন কি ছিল?
উত্তর : সপ্তম নৌবহন পাঠানাে ছিল আমাদের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ | সত্য কথা বলতে কি আমি এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করি না যে আমেরিকা আর বেশি কিছু করতে পারবে না।
৬. প্রশ্ন : উপমহাদেশের ভবিষ্যতে শান্তি ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় সিমলা চুক্তির প্রভাব কি ছিল?
পৃষ্ঠাঃ ৫০৫

উত্তর : সিমলা সম্মেলন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ যার ফলে ৩০ বছরের বরফ গলে গেল । ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘৃণ্য তিক্ততা এবং সংঘর্ষের মধ্যে বরফ জমে ছিল। ভারতের ঐতিহ্য হলাে বন্ধুত্ব ও শান্তি । কিন্তু তা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে নয়। তার পর যাত্রাপথ ছিল কঠোর। কিন্তু কুটনৈতিক ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও উন্নত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা কি করে ভিত্তি স্থাপন করেছে।
৭. প্রশ্ন : দু’বছরের বেশি যুদ্ধবন্দীদের আটকে রাখার কি ভূমিকা ও রাজনৈতিক লাভ ছিল?
উত্তর : মাটি অথবা মানুষের মধ্যে পছন্দ করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমি দখল করে রাখলে আমেরিকা এবং অন্যদের যারা পাকিস্তান কে সমর্থন করেছে তাদের হৈচৈ করতে আরও উৎসাহিত করবে।পাকিস্তানের বিরাট ভূখন্ড দখল করে রাখলে আমাদের অভিযুক্ত করা হবে। যেমন ছিল তেমন রেখে দিয়ে আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা প্রমাণ দিয়েছি দর কষাকষি ছাড়া যুদ্ধবন্দীকে আটকে রাখার কোন উপকারিতা নেই।
আপনার ঘনিষ্ঠ লছমান সিং
নতুন দিল্লী
স্বাঃ ইন্দিরা গান্ধী
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের কারণসমূহ
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণসমূহ হলো :
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, নৈতিক ও আন্তর্জাতিক।
• দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালীর প্রতি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য শুরু হয়। ভাষার প্রতি আঘাত এবং ১৯৫২ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবি করলে পুলিশ ছাত্রদের হত্যা করে।
• পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি না গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় শাসন চাপিয়ে দেয়।
• অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈষম্য উন্নয়ন থেকে পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা হয়। উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সাহায্য ও রপ্তানি পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নয়নে ব্যয়।
• ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন হতে জনগণের মধ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ।
– আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি না মেনে বাঙালীর ওপর নির্যাতন চলে।
পৃষ্ঠাঃ ৫০৬

বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা মামলার বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে উনসত্তরের গণআন্দোলন।
• ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালীদের বিরাট বিজয়- জনগণ ৬ দফা-এক দফা- স্বাধীনতার পক্ষে রায় দেয়।
• আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জয়লাভ করে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করা- প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ হতে অসহযোগ আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর পূর্ব বাংলার শাসনভার গ্রহণ ।
• ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী বাঙালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা পাকবাহিনীর আক্রমণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা।
• ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার বাণী চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার।
• ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন।
• ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনগণ নির্বাচিত পার্লামেন্টের নেতৃত্বে জনযুদ্ধ। বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম একটি নির্বাচিত পার্লামেন্টের নেতৃত্বে জনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
• পাকবাহিনীর গণহত্যা, নারী নির্যাতন এবং এক কোটি লােকের ভারতে আশ্রয় গ্রহণ বিশ্বের বিবেককে নাড়া দেয়। বিশ্ববাসী বাঙালীদের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন জানায়।
• ১৯৭১ সালের বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঁচার দাবি- অস্তিত্বের লড়াই- পাকিস্তানীরা ছিল লুণ্ঠনকারী, হত্যাকারী ও নারী নির্যাতনকারী। পাকসেনাদের নৈতিক মনােবল ছিল না- বাঙালীরা যুদ্ধ করেছে সত্য, ন্যায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
• ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান আর্মি ক্ষমতা দখল করে তারা সৈনিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে। তারা ক্ষমতালােভী, সম্পদ লুণ্ঠন ও ভােগ বিলাসে লিপ্ত হয়।
• মওলানা ভাসানী ভারতে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যান।
• ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার অদ্ভুত রণকৌশল- তিনি বাংলাদেশকে ১১টি
পৃষ্ঠাঃ ৫০৭

সেক্টরে বিভক্ত করেন এবং একই সাথে ১০টি আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে অপূর্ব সমন্বয় সাধন করে বিজয়ের পথে এগিয়ে যান।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অসম যুদ্ধ ছিল। পাকিস্তানের নিয়মিত সৈন্য ছিল মাত্র ৪৫০০। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ১৫০০০০ হাজার। এ ছাড়া ছিল জনতার সমর্থন।পাকবাহিনির কোন জনসমর্থন ছিল না।
পাকবাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। যে থেকে বিচিছন্ন ছিলেন। তার অস্ত্রের অভাব ছিল। জেনারেল নিয়াজি কেন্দ্র থেকে
বিচ্ছিন্ন ছিলেন ।তার অস্রের অভাব ছিল। পাকিস্তানের অস্র ছিল নিন্মমানের। তাদের বিমান ও নৌবাহিনী ছিল না।
আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ভাসানী, ন্যাপ মোজাফফর, জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের নিয়ে সর্বদলীয় সমন্বয় পরিষদ গঠন করে বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের পথে নিয়ে যায়।।
ভারত রাশিয়ার সক্রিয় সমর্থন ও সহযােগিতার কারণে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীদের জয়লাভ সম্ভব হয়েছে। আমেরিকা, চীন জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব সােভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। আমেরিকা সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে মুক্তিযুদ্ধ স্তব্ধ করতে চেয়েছিল- রাশিয়া তার নৌবাহিনী পাঠালে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর ত্যাগ করে চলে যায়।
পাকিস্তানের পরাজয়ের কারণ
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর পরাজয়ের কারণ নির্ণয়ের জন্য ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি নিয়ােগ করেন। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে-
‘আমাদের নিকট প্রতীয়মান হয় যে, একমাত্র সামরিক কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হয়নি। রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক, নৈতিক এবং সামরিক কারণে পাকবাহিনী পরাজিত হয়েছে।’ হামুদুর রহমানের রিপাের্টে পাকিস্তান জান্তার জন্য বা পাকবাহিনীর পরাজয়ের জন্য ১৯৭১ সালে এ বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, ব্যাপক দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, কাপুরুষতা, এমনকি জেনারেলদের মধ্যে চারিত্রিক স্থালনকে দায়ী করা হয়েছে। রিপাের্টে বলা হয়েছে ‘পরাজয়ের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে যখন
পৃষ্ঠাঃ ৫০৮

সশস্ত্র বাহিনী দেশের শাসনভার নেয়। …এ নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তারা রাজনৈতিক বৃত্তি শিখতে শুরু করে। ক্রমে তাদের মৌলিক দায়িত্ব সৈনিকবৃত্তি থেকে সরে যায় এবং নিজেদের জন্য সম্পদ ও সৌভাগ্য লুণ্ঠন শুরু করে।
কমিশন ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা দখলের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল হামিদ , পীরজাদা, খোদাদাদ খান, টিক্কা খান, ওমর প্রমুখের বিচারের সুপারিশ করেছিল। কমিশনের মতে নৈতিক পদস্খলনের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পেশাগত দক্ষতা হারিয়ে ফেলে। তারা সঠিক নির্দেশ প্রদানেও ব্যর্থ। এ জন্য তারা১৯৭১ সালে পরাজয় ও লজ্জাকর আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর প্রদান করেছিল।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণসমূহ হলাে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামরিক, নৈতিক ও আন্তর্জাতিক।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলার ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি আঘাত, অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। কেন্দ্রীয় সরকার বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসন থেকে বঞ্চিত করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী জাতীয়তাবাদ আন্দোলন সমগ্র বাঙালী জাতি- ছাত্র, জনতা, শ্রমিক, কষক বাঙালি সৈন্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ঐক্যবদ্ধ এবং সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধর রণকৌশল ছিল পাকিস্তানী যেনাবাহিনীর কৌশলের চেয়ে অনেক বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু একদিকে যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন— অন্যদিকে তিনি পাকবাহিনীর আক্রমণের পূর্বে যুদ্ধ ঘােষণা করেননি। এ ছিল বঙ্গবন্ধুর রণকৌশল। তিনি নাইজিরিয়া বায়াফ্রা প্রদেশের মতাে বিচ্ছিন্নতাবাদী না হয়ে আত্মরক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ ঘােষণা করেন। ২৫ মার্চ পাকবাহিনী হঠাৎ বাঙালীদের আক্রমণ করলে তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা ও সর্বাত্মক প্রতিরােধ ও যুদ্ধের আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু ৭ কোটি বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ করে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন। অন্যদিকে পাকবাহিনী স্থানীয় জনগণের কোন সমর্থন পায়নি। তারা লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করেছে, নারী নির্যাতন করেছে। কিছুসংখ্যক রাজাকার, আলবদর ব্যতীত সমগ্র জাতি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও যুদ্ধ শুরু করে । ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ না করে একমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে বাঙালীদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল। অন্যদিকে মুজিবনগর সরকার রাজনৈতিক ও সামরিক
পৃষ্ঠাঃ ৫০৯

শক্তির সফল সমন্বয় করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় গণহত্যা নারী নির্যাতন ও লুন্ঠনে নিয়ােজিত ছিল। তাদের ধারণা ছিল ভারত যুদ্ধে অংশ নেবে না।ভারত আক্রমণ করলে চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে এগিয়ে আসবে। কিন্তু তাদের সে আশা ব্যর্থ হয়ে যায়। মৌখিক আশ্বাস ব্যতীত পাকিস্তান আন্তর্জাতিক সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে মুজিবনগর সরকার ভারত, রাশিয়া সহ বিশ্বের সমর্থন অর্জনে সফল হয়। ভারত এক কোটি বাঙালীকে আশ্রয় প্রদান এক লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও যুদ্ধকালে সামরিক বাহিনী নিয়ে সহায়তা করেছে।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ৭ কোটি বাঙালী মৃত্যুপণ করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিল। অন্যদিকে পাকবাহিনী গণহত্যা, লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতনে নিয়োজিত ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা সত্য, ন্যায় ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। পাকবাহিনী বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করে একমাত্র মাটি চেয়েছিল।। টিক্কা, নিয়াজীর সপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাংলাদেশ পার্লামেন্টের নৃেতত্বে জনযুদ্ধ। অন্যদিকে পাকবাহিনী একটি বর্বর ও দস্যুবাহিনী হিসেবে কুখ্যাত ছিল।
১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধ ছিল অসম যুদ্ধ। মূলত পাকবাহিনীর যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল না। তাদের মাত্র ৪৫ হাজার নিয়মিত সৈন্য ছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের দশ ব্যাটালিয়ন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ মিলিয়ে নিয়মিত বাহিনী সীমান্তে দশটি সেক্টরে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। এক লক্ষ গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পাকবাহিনীকে শক্তিহীন ও দুর্বল করে ফেলে। পাকবাহিনীর মিত্র বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার মনােবল ছিল না তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী নিধন, বুদ্ধিজীবী হত্যা, নারী নির্যাতন। সুতরাং ভারতের সাথে যুদ্ধ যখন শুরু হলাে তখন তাদের প্রতিরােদের বা সম্মুখ যুদ্ধের সাহস ও শক্তি ছিল না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তানের তিন লক্ষ সৈন্যের প্রয়ােজন ছিল। সেক্ষেত্রে তাদের সামরিক ও আধা সামারিক বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৯৩ হজার।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল পাকবাহিনীর কয়েক গুণ বেশি। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের তিন ডিভিশন সৈন্য ছিল। অন্যদিকে ভারতের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৯ ডিভিশন। পাকিস্তানের পূর্ব বাংলায় মাত্র এক স্কোয়াড্রন বিমান এবং নৌবাহিনীর কয়েকটি গানবােট ছিল। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে পাক
পৃষ্ঠাঃ ৫১০

বিমান ও নৌশক্তি সম্পূর্ ণধ্বংস হয়ে যান। ফলে ৯৩ হাজার পাকবাহিনী সদস্য বাংলাদেশে বন্দী হয়ে পড়ে। তাদের আকশপথে, জলপথে পালাবার উপায় ছিল না। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে । আত্নসমর্পণ করা ব্যতীত তাদের বিকল্প ছিল না।
ভারত ও রাশিয়ায় সক্রিয় সহযােগিতার কারণে পাকিস্তান যুদ্ধে পরাজিত হতে বাধ্য হয়। মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেন। কিন্তু রাশিয়া নৌবহন প্রেরণ করলে আমেরিকার নৌবহর পিছু হটে যায়। পাকিস্তান-চীন আমেরিকার সাহায্যে পূর্ব বাংলায় যুদ্ধবিরতি ঘােষণা দিয়ে বাঙালিদের স্বাধীনতা অর্জন ব্যর্থ করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া ও পোল্যান্ডের ভেটোর ফলে তাদের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় এবং পাকিস্তান আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
পাকিস্তানি জেনারেলদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল । জেনারেল নিয়াজীর সাথে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট, প্রধান সেনাপতি ও অন্যান্য জেনারেলের মধ্যে সমন্বিত সম্পর্কের অভাব ছিল।
পাকিস্তানের পরাজয়ের অন্যতম কারণ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সমকক্ষ নেতা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানে ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদ একদিকে সমরবিশারদ অন্যদিকে কূটনীতিবিদ ছিলেন।
পাকিস্তানের সমরাস্ত্র ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের এবং অধিকাংশ অস্ত্র ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কালের। অন্যদিকে ভারতের অস্ত্র অত্যাধুনিক। তা ছাড়া সােভিয়েত রাশিয়া অস্ত্র দিয়ে ভারতকে সহায়তা করেছে। জেনারেল নিয়াজীর ভাষায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে যুদ্ধ করতে চাননি। তারা যুদ্ধের নামে একটি শাে করেছেন। কারণ নিয়াজীকে তারা অস্ত্র ও পরামর্শ দিয়ে কোন সহযােগিতা করেননি। তাকে পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার নামে তার মাধ্যমে যুদ্ধের মহড়া করেছেন।
একটি গণহত্যা ও নারী নির্যাতনকারী সেনাবাহিনী মুক্তিপাগল বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে জয়লাভ করতে পারে না। তাদের পরাজয় অনিবার্য ছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর বিজয় ছিল ঐতিহাসিক সত্য।
হাজার বছরব্যাপী বাঙালী জনগােষ্ঠী সংগ্রাম করেছিল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য। বাঙালী জাতি তাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে।
পৃষ্ঠাঃ ৫১১

২১
কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােড হতে
বঙ্গভবন
তাজউদ্দীন আহমদের স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন
১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, মন্ত্রী এম এ মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান কর্মকর্তাদের নিয়ে কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার ত্যাগ করেন এবং বিমানে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তাদের প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানানাে হয়। ঢাকায় পৌছেই, তাজউদ্দীন আহমদ ধানমনডি তে বেগম মুজিব ও পরিবারের সদস্যদের সাথে সাক্ষাত করেন ।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নির্দেশে ১৮ ডিসেম্বর সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খান ঢাকায় আগমন করেন। তিনি সচিবালয়ে কাজ কিভাবে শুরু করেছেন সে সম্পর্কে বলেন, “তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, নুরুল কাদের, ঢাকায় যাও। কেন বলছিলেন জানি না। হয়ত প্রসঙ্গক্রমেই বলা হয়েছিল। এরপর বললেন, এ কে খন্দকার সাহেব আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যাবেন। খন্দকার সাহেব ছিলেন ব্যারাকপুরে। ওখানে কমল সিদ্দিকীসহ বেশ ক’জন আহত মুক্তিযোদ্ধাকে দেখার জন্য গিয়েছিলেন। খন্দকার সাহেবকে যথারীতি খবর দেয়া হলাে। তিনি ঢাকায় গেলেন।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল ওসমানীর উপস্থিত না থাকা নিয়ে পরবর্তী সময় অনেক কথাই লেখা হয়েছে। এগুলাের মধ্যে অনেক অসত্য তথ্যও আছে। আসলে ঐ দিন তিনি কলকাতা ছিলেন না এবং তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করাও সম্ভব হয় নি। যে কারণে তাজউদ্দীন সাহেব সিদ্ধান্ত নেন এ কে খন্দকার সাহেব মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তক্রমেই খন্দকার সাহেব ঢাকায় এসে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে যােগ দেন এবং আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন।
যাই হােক, বেসামরিক প্রশাসন সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। তাজউদ্দীন সাহেব
পৃষ্ঠাঃ ৫১২

নির্দেশ দিলেন ঢাকায় যাওয়ার জন্য এবং ১৭ ডিসেম্বর যাওয়া যায় কি না সে বিষয়টি ও ভাবতে বললেন।
রুহুল কুদ্স সাহেব তখন সরকারের অস্থায়ী সেক্রেটারি জেনারেল স্বাভাবিকভাবেই এমন একটা গুরুত্বপর্ণ সন্ধিক্ষণে তার থাকার কথা। অন্তত সিনিয়র লােক হিসেবে এ প্রশ্নটা একে যায় । তাই রুহুল কুদুস সাহেবের সামনে এ প্রসঙ্গটি উত্থাপন করা হয়।
রুহুল কুদুস সাহেবকে অনেকটা অপ্রস্তুত মনে হলাে ঐ সময়। তিনিই বিষয়টির সুরাহা করেন। বলেন, “প্রবাসী সরকারের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমি এখনও সম্পূর্ণ অবহিত হতে পারি নি । তাই নুরুল কাদের এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন।”
বিজয় অর্জনের আনন্দ যে কি ঐ সময় প্রতিটি মানুষ অনুভব করেছে। এ ধরনের বিজয়ে শােকও থাকে। কারণ এ অর্জনের পেছনে অসংখ্য আত্মত্যাগ থাকে। তবে বাঙালীর বৃহত্তম অর্জনের জন্য যত বড় ত্যাগ বাঙালী জাতিকে স্বীকার করতে হয়েছে তা বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের আনন্দ প্রকাশে উল্লাসের আতিশয্য ছিল না। শােকমিশ্রিত আনন্দ হিসেবে তাকে অভিহিত করা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের মহান বীর তাজউদ্দীন আহমদের সংস্পর্শে আমরা যারা ছিলাম তাদের বেলায় তা ছিল প্রায় সর্বাংশে সত্য।
উল্লাসের কারণে কর্তব্যবিমুখ হওয়া ঐ সময় কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এ ক্ষেত্রে ও আমার ধারণা, তাজউদ্দীন সাহেব স্বল্প সময়ের প্রশাসনিক দক্ষতা দিয়ে তার সহকর্মীদের মধ্যে এমন একটি মানসিকতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আগেই বলা হয়েছে, বহু পূর্ব থেকেই প্রশাসনকে ঢাকায় স্থানান্তরসহ সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নেয়া হচ্ছিল। আর এ কারণেই ১৬ ডিসেম্বরই তাজউদ্দীন সাহেব বলতে পেরেছিলেন ১৭ ডিসেম্বর যেন আমি ঢাকায় চলে আসি। মুজিবনগরে যাতে কার্যক্রম পরিচালনায় কোন অসুবিধা না হয় সে জন্য কাগজপত্র বুঝিয়ে দিতে হবে। সে কাজটির জন্য আমাকে একদিন সময় নিতে হয়েছে। অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর আমাকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে হয়েছে দেশে ফেরার জন্য।
স্বাধীনতা যখন এলাে তখন মনে হচ্ছিল আমি যেন রণক্লান্ত এক যােদ্ধা। পা যেন সরতে চাইছে না। মনে হলাে যুদ্ধ শুরুর কথা। তাজউদ্দীন সাহেবকে ‘ বলেছিলাম, “স্যার, আপনার নির্দেশে আমি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ খরা ছেড়ে প্রশাসনিক কাজে নিয়ােজিত হয়েছি। আজকে অগ্রিম একটা আবেদন আপনার কাছে জানিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৫১৩

রাখছি, দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সেদিন তামি আর প্রশাসনে থাকবো কি না তা ঐ মুহুর্তে আমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। বিজয় অর্জনের দিন খুব করে ঐ দৃশ্যের কথা বার বার মনে হচ্ছিল। এক পর্যায়ে তাই আমি বলেই ফেলি স্যার, আপনার হয়তো মনে আছে, যুদ্ধের শুরুতে আমি আপনার কাছে একটি অগ্রিম আবেদন জানিয়েছিলাম ।
তাজউদ্দীন সাহেব ঐ সময় স্পষ্টভাবে বলেছিলেন নুরুল কাদের এটা নিশ্চিত সপ্তাহের মধ্যেই প্রশাসনিক সরকার ধাকায় স্থানান্তরিত হবে।দেশে আবারো কাজকর্ম সবই চলবে। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যকে সে কর্মধারায় সম্পৃক্ত করতে না পারলে যে আমাদের এ ত্যাগই অসার্থক হয়ে পড়বে। দেশে দীর্ঘস্থায়ী সুস্থ ও উন্নয়ন ধরা নিশ্চিত করতে হলে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে এবং তা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাজউদ্দীন সাহেবের এ বক্তব্য আমাকে আবারও অনুপ্রাণিত করে।
“১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রশাসনিক বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা প্রদান করলেন। সদ্য স্বাধীন দেশে যে সব সমস্যা দেখা দেবে এবং সরকারের সিদ্ধান্তগুলাে বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিভাবে সে সবের সমাধান হতে পারে, সে কথাও তিনি বললেন।
১৮ ডিসেম্বর ভােরবেলা আমাকে রওনা হতে হয় দেশের উদ্দেশে। ভারতীয় বিমানে করে আমার আসার ব্যবস্থা হলেও সরাসরি ঢাকা পৌছানোর কোন সুযােগ ছিল না। কারণ ঢাকা বিমানবন্দর বিমান অবতরণের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। তাই আগরতলা হয়ে ঢাকার পথে রওনা হতে হয়েছে।
আগরতলা থেকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে যখন রওনা হয়েছি তখন সকাল প্রায় আটটা। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন আমার সঙ্গে।
হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করার পরই পরম পাওয়ার স্বাদ অনুভব করলাম। মনে হলাে এ যেন জন্মজন্মান্তরের এক পরম প্রাপ্তি।
মুজিবনগরে বসে বিজয়ের সংবাদ শুনেছি, ইতিহাসের একেকটি অধ্যায় প্রত্যক্ষ করেছি এবং নিজেও সংযুক্ত হয়েছি যুদ্ধের একেকটি পর্যায়ে। সে আনন্দ যেন ম্লান হয়ে গেল স্বাধীন দেশের গাছপালা-মাটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে।
যে মুহূর্তে ঢাকা বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার অবতরণ করল তখন মনে হলাে, আমার মাটি আমাকে বুকে টেনে নিয়েছে। এ মাটির সন্তান আমি। মুক্ত ভূমির স্পর্শ পেয়ে আমি আনন্দিত। নিজের আবেগকে সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়লো। হেলিকপ্টার থেকে নেমে সঙ্গে সঙ্গে আমি বসে পড়ি। দু’হাতের মুঠোয় মাটি তুলে
পৃষ্ঠাঃ ৫১৪

নিই আবেগাপ্লুত হয়ে ছোয়াই কপালে । ঐ মুহূর্তে মনে হয়েছে আমার চেয়ে ধন্য আর কজন আছে পৃথিবীতে। আমি যে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। এ মাটি আমার, আমি এ মাটির সন্তান।
মুজিবনগর থেকে রওনা হওয়ার প্রাক্কালে ঢাকায় কোনাে যোগাযােগ করা সম্ভব হয় নি। সুতরাং আমাকে কেউ রিসিভ করবে এমন চিন্তাও করিনি। সত্যি বলতে কি আবেগ এতই গভীর ছিল যে, এসব চিন্তা করারও যেন সুযোগ ছিল না। সহযাত্রী ভারতীয় জেনারেল বললেন, তারা আমার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি তাদের সসম্মানেই জানাই তার প্রয়ােজন হবে না।
ঢাকা বিমানবন্দর টার্মিনালে প্রবেশকালেই দেখা গেল দু’জন কর্মকর্তা দাড়িয়ে আছেন। একজন ঢাকার তৎকালীন ডিসি আহমদ ফরিদ, অন্যজন ফারুক চৌধুরী। তাঁদের দেখে মনে হলাে তারা যেন প্রবাসী সরকারের প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মনে হলাে তারা যেন কিছুটা অস্বস্তিবােধ করছেন। কুশল বিনিময়ের পর ফারুক চৌধুরীর অস্বস্তি দূর হলাে। বিমানবন্দর থেকে তাদের সাথে নিয়েই চলে গেলাম সােজা শহীদ মিনারে।
বিধস্ত এ মিনার বাঙালীর স্বপ্নসাধকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। যখনই বাঙালী অত্যাচারিত হয়ে প্রতিবাদী হয়েছে তখনই গিয়েছে এ মিনারে। শপথ নিয়েছে শাণিত হওয়ার লক্ষ্যে। আবার জাতীয় বিজয় অর্জিত হওয়ার পর মানুষ ফুলে ফুলে ঢেকে দিয়েছে এ মিনারের পাদদেশ। এ মিনার বাঙালীর চেতনাকে বার বার। জাগ্রত করেছে। পথে আহমদ ফরিদ ও ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে আলােচনা হলাে। এক পর্যায়ে তারা আলাদা হয়ে গেলেন। সম্ভবত সচিবালয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই।
এরপর গেলাম বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে। এবার ভারতীয় কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা আমার সঙ্গী হলেন (তাঁদের নাম মনে নেই)।
বাড়িতে ঢােকার সময় আমার খেয়াল হলাে নিজ পরিধেয় বস্ত্রের দিকে । কি আশ্চর্য ব্যাপার আমার গায়ে পুরনাে একটি জাম্পার। ভারতীয় সেনাকর্তাদের জাম্পারের অনুরূপ। রং পর্যন্ত এক রকম। যাই হােক, বেগম মুজিব তখন বাড়িতেই ছিলেন। তার সঙ্গে শেখ হাসিনাসহ পরিবারের সদস্যদের কয়েকজনও ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশ অনুযায়ী বেগম মুজিবকে প্রবাসী সরকারের সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই। তাঁকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবর্গের অভিনন্দন পৌছে দিই। স্বল্প সময়ের মধ্যে বেগম মুজিবও তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রীবর্গের খবরাখবর নেন। তারপর সােজা চলে যাই সচিবালয়ে।”
করিডাের এ্যাপয়েনমেন্ট ও সচিবালয়ে অভ্যর্থনা
“সচিবালয়ে তেমন লােকজন ছিল না। দেশ স্বাধীন হয়েছে সবেমাত্র । এর
পৃষ্ঠাঃ ৫১৫

আগেই সচিবালয় প্রায় শূণ্য হয়ে গিয়েছিল।
নিরাপত্তার কারণে লােকজন তখন অফিসে আসেনি। বিশেষ করে যখন থেকে মিত্র বাহিনী বিমান হামলা চালায়, তখনই মূলত অফিস আদালত খালি হয়ে যায়।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহেই সরকারী কর্মচারী -কর্মকর্তারা ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন। যারা ঢাকায় ছিলেন তাদের প্রায় সবাই ডাক্তার মালিক মন্ত্রিসভা তথা পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বাস্তব ক্ষেত্রে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এ ছাড়া বিজয় দিবসেও নিরাপত্তাহীনতার কিছু লক্ষণ দেখা গেছে ঢাকায়। আত্মসমর্পণ করতে রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার সময়ও পাকিস্তানী বাহিনী বেশ কজন বাঙালীকে গুলি করে হত্যা করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনও ঢাকায় আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকে যদিও বেতার ঘােষণায় সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আহ্বান জানানাে হচ্ছিল, কিন্তু এই আহ্বান সংশ্লিষ্টদের সবার কাছে এত দ্রুত পৌছায় নি।
আবার যাদের কাছে পৌছেছে তারাও দ্রুত আসতে পারছে না। বিশেষ করে যারা ঢাকার বাইরে অবস্থান করছে তাদের পক্ষে ঢাকায় আসাটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কারণ প্রায় সমস্ত যােগাযােগ ব্যবস্থাই অচল হয়ে পড়েছিল।
এ ছাড়া অবাঙালী কর্মচারী ও কর্মকর্তারা তাে স্বাভাবিক কারণেই অনুপস্থিত ছিল। ফলে পুরাে সচিবালয়ে উপস্থিত কর্মচারী-কর্মকর্তার সংখ্যা সাকল্যে দু’শর মতাে ছিল।
দেখা হলাে এডিশনাল চীফ সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে নিজ কক্ষে তিনি কেমন একটা অস্বস্তিতে ভুগছিলেন। বােঝা যাচ্ছিল, আমার অবস্থান সম্পর্কে তিনি অস্বচ্ছ ছিলেন। তাঁর এই দ্বিধা কাটানাে আমার প্রথম দায়িত্ব বলে চিন্তা করলাম। তাঁর এই দ্বিধা সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম যখন দেখলাম তিনি সালামের জবাব দেয়ার পরও নিজ আসনে বসছেন না। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন পরােক্ষভাবে।।
তাঁর এই দ্বিধা কাটানাের জন্যই বললাম, স্যার, আপনি সম্ভবত দ্বিধান্বিত। আমার বক্তব্য শেখ হওয়ার আগেই তিনি বললেন, আমার জন্য কোনাে নির্দেশনা আছে কি?
তার এ ধরনের বক্তব্য আমাকে কিছুটা লজ্জায় পেলে দেয়। কারণ নুরুল ইসলাম সাহেব অনেক সিনিয়র মানুষ । তাই তাঁকে আশ্বস্ত করা হলাে, ‘স্যার আমি আপনাকে নির্দেশ দেবাে না। আপনিই আমাকে নির্দেশ দেবেন। তবে, প্রবাসী সরকারের প্রশাসনিক নীমিমালা বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন
পৃষ্ঠাঃ ৫১৬

আহমদ ও তার মন্ত্রী পরিষদ যে বার্তা আমার মাধ্যমে পাঠিয়েছেন তা আমি পৌছে দিয়ে চাই। প্রশাসনকে দ্রুত পরিচালিত করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে নির্দেশনা দিয়েছেন সে সম্পর্কে নুরুল ইসলাম সাহেবকে অবহিত করি।
তাঁকে প্রবাসী সরকারে চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে জানাই। প্রবাসী সরকার স্পষ্টতই মনে করছে সকল বাঙালীই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কেবল যারা স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি বাহিনি কে সহায়তা করেছে কিংবা তাদের সঙ্গে মিলে অত্যাচার- অবিচার চালিয়েছে তারাই অভিযুক্ত হবে। স্বাভাবিক কারণেই এদের সংখ্যা ছিল নগণ্য।
বিষয়টি নুরুল ইসলাম সাহেব পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলেন এবং মনে হলাে তিনিও তাই ভাবছিলেন। এর পরই তার কাছে অনুরােধ জানাই সচিবালয়ে উপস্থিত কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলােচনার ব্যাপারে। তিনি সাদরে তা গ্রহণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে একজনকে বলেন ব্যবস্থা করার জন্য । পোষ্ট অফিস ভবনের সামনে খোলা জায়গায় জমায়েত হলাে সবাই। সবার মধ্যেই দারুণ একটা কৌতূহল। আমরা যারা মুজিবনগরে ছিলাম তাদের অভিজ্ঞতা এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশবাসীর অভিজ্ঞতার মধ্যে বেশ কিছুটা পার্থক্য। ছিল।
অবরুদ্ধ থেকেও ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই দেশের স্বাধীনতা কামনা করেছেন। প্রবাসী সরকারকে প্রায় সবাই সমর্থনও করেছেন। সেই প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে আসা একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে সরকারের বক্তব্য জানবেন, সঙ্গত। কারণেই কৌতূহলটা ছিল বেশি।
তাদের কৌতূহল নিরসনের লক্ষ্যেই প্রবাসী সরকারের বক্তব্য তাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। সেদিন তাদের বলা হয়েছিল, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে। আপনারা মাননীয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে আপামর বাঙালী যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তারই ফলে আজকের এই স্বাধীনতা। মনে রাখতে হবে এ স্বাধীনতা লাভ আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের প্রথম ধাপ মাত্র। আমাদের এই প্রথম বিজয় অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের জন্য লাখ লাখ বাঙালীকে শহীদ হতে হয়েছে। সেই বীর শহীদদের আমরা সশ্রদ্ধ সালাম জানাই। শহীদদের পরিবারবর্গকে আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি।
পৃষ্ঠাঃ ৫১৭

একই সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব সবার প্রতি আহবান জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে মুক্তিপাগল সকল বাঙালী যেন অংশগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় পর্যায়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দেশকে গড়ে তোলা । কাজটি খুব সহজ নয়। তবে সরকার আশা করছে যে জাতি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করতে পারে সে জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে অবশ্যই দ্বিতীয় লক্ষ্য ও অর্জিত হবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাই সম্মিলিত প্রয়াস। সুতরাং বিজয়ের আনন্দে আমাদের কালক্ষেপণ করার সুযােগ নেই।
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও এখানে সভায় উথাপিত একটি প্রশ্ন উল্লেখ না করে পারছি না। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে একজন দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন স্যার আমাদের অফিস আওয়ার কি হবে?
আসলে এ ধরনের প্রশ্ন অন্তত ঐ মুহুর্তে শুনতে হবে এ রকম চিন্তা করার সুযােগ ছিল না। তাঁর এ প্রশ্নের জবাব দানকালে সম্ভবত আমার কণ্ঠ কিছুটা উত্তেজিত হয়েছিল। বলেছিলাম, যারা নামাজ পড়েন তাদের ফজরের নামাজ পড়ে অফিসে আসতে হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত কাজ শেষ না হবে কিংবা ক্লান্তিতে শরীর নুইয়ে না পড়বে ততক্ষণ কাজ করতে হবে। এটাই হবে অফিস আওয়ার।
এখানে বলে নেয়া ভালাে সবার শুরুতে এডিশনাল চীফ সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম সাহেব প্রারম্ভিক বক্তব্য রেখেছিলেন। উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, মুজিবনগর থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নুরুল কাদেরকে পাঠিয়েছেন। তিনি সরকারের বার্তা বহন করে এনেছেন এবং তা উপস্থাপন করবেন।
সভা শেষ করে আবারও নুরুল ইসলাম সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে সচিবালয়ে ফিরছি। বারান্দায় তখন লােকজনের ভিড়। প্রত্যেকেরই কৌতূহল আছে। মুজিবনগর সম্পর্কে সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে তারা জানতে উৎসাহী। একই সঙ্গে বেশ কিছু প্রশাসনিক অসুবিধাও তারা প্রত্যক্ষ করছিলেন। বিশেষ করে সরকারী দফতরগুলাের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই ছিলেন অনুপস্থিত। এর কয়েকটি কারণ আছে। যেমন কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিল অবাঙালী। তাঁরা স্বেচ্ছায় অনুপস্থিত ছিল কিংবা দেশত্যাগ করেছিল । আরেক শ্রেণীর ছিল যারা ঢাকার বাইরে অবস্থান করছিল। ঢাকার ভেতরে থেকেও কেউ কেউ আসতে পারেনি। শেষোক্তদের মধ্যে একটি অংশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল, আরেকটি ক্ষুদ্র অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি।
এসব কারণে প্রায় অফিসই কর্মকর্তাবিহীন হয়ে পড়ে। করিডােরে হাটতে
পৃষ্ঠাঃ ৫১৮

হাটতে এসব তথ্যও পাওয়া যাচ্ছিল। পাশাপাশি যতটা সম্ভব লোকজনকে বলতে হচ্ছিল যার যার কাজে দ্রুত যােগ দেয়ার জন্য। এমনি সময় একজন ভদ্রলোক এসে সালাম দিলেন। পরিচয় জিজ্ঞেস করার পর বললেন তিনি এ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল অফিসে চাকরি করেন। জানতে চাইলেন তিনি এখন কার নির্দেশ পালন করবেন। জিজ্ঞেস করলাম কেন-একাউন্ট্যান্ট জেনারেল নেই? জবাব ছিল-না। তাঁকে বলা হলাে, এরপর যিনি আছেন তিনিই একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দায়িত্ব পালন করবেন।যতদূর মনে পড়ে ঐ ব্যক্তি ছিলেন ক্রম অনুসারে তৃতীয় স্থানের কর্মকর্তা। সুতরাং তাকে বলতে হল আপনিই গিয়ে একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের দায়িত্ব পালন করুন। সঙ্গত কারণেই তিনি অফিস নির্দেশের কথা জানতে চাইবেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বলা হলাে যথাসময়ে তিনি অফিস অর্ডার পাবেন।
নুরুল ইসলাম সাহেবকে নিয়ে তার কক্ষে প্রবেশ করার পর তিনি তার কক্ষে কাজ করার জন্য আহ্বান জানালেন। এটা আসলে সম্ভব নয়। সবিনয়ে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। শেষ পর্যন্ত চীফ সেক্রেটারির খালি কক্ষে বসার জায়গা হলাে।
এ প্রসঙ্গে একজনের নাম স্মরণ করতে হয়। তার নাম আবদুল মজিদ । আমি প্রথম সচিবালয়ে প্রবেশের পরই তিনি এসে বললেন, স্যার আমি আপনার সঙ্গে কাজ করব। আবদুল মজিদকে অনেক আগে থেকেই চিনতাম। তিনি এক সময় আমার সঙ্গে কাজ করেছেন। আমি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রটোকল অফিসার থাকাকালে আবদুল মজিদ আমার স্টেনােগ্রাফার ছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই আবার সে পদে নিয়ােজিত হলেন। অনেকটা সেলফ এ্যাপয়েন্টমেন্টের মতাে।
তিনি অত্যন্ত অমায়িক লােক ছিলেন। আমার কাজের ধারা সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল । ঐ সময় তাকে পাওয়ার ফলে কাজের ক্ষেত্রেও বেশ সুবিধা হয়েছিল। তিনি আমার ব্যক্তিগত খোঁজখবরও রাখতেন। খাওয়া-দাওয়া-গােসল এসব ব্যাপারেও তাঁর আচরণ ছিল অভিভাবকসুলভ। আবার দাফতরিক বিষয়ে তিনি তার সীমানা সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণ সচেতন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রশাসন পুনরায় চালু করার ব্যাপারে তাঁর সহযােগিতা অবশ্যই স্বীকার্য।
করিডাের পর্যায়ে ঐ সময় বেশ কিছু নিয়ােগ হয়েছিল। সেসব ছিল মৌখিক । আবদুল মজিদ সাহেব এগুলাে যথাযথভাবে নােট করতেন এবং অফিস অর্ডার তৈরি করে নিয়ে আসতেন। তিনি কখনও কোন আবেদন জানাতেন না। সুপারিশও না। কিন্তু পরবর্তী সময়ের একটি ঘটনা মনে পড়ে। তিনি এসে বললেন, স্যার একাউন্ট্যান্ট জেনারেলকে সরিয়ে দিন।
পৃষ্ঠাঃ ৫১৯

কেন, কি হয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন দেখেন, যে একাউন্টেন্ট জেনারেলকে আপনি করিডােরে এ্যাপয়েনমেন্ট দিয়েছেন তিনি কি না আপনার বিলে অবজেকশন দিয়েছেন!
কথা বলার সময় তাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছিল। তিনি বলেন বেশ ক ’টা বিষয় তিনি উল্লেখ করেছেন, যেমন- আপনি পাবনার ডিসির চার্জ হান্ডওভার করেছেন, এর সপক্ষে কোনাে কাগজপত্র নেই। দ্বিতীয়ত, আপনি যে এস্টাব্লিশমেন্ট সেক্রেটারি হয়েছেন তার কোনাে নিয়ােগপত্র নেই এবং এখানে যে আপনি কাজে যােগ দিয়েছেন এর পক্ষেও কোনো কাগজপত্র নেই।
আবদুল মজিদকে বােঝালাম, এজি অফিস থেকে যে অবজেকশন দেয়া হয়েছে তা তাদের নিয়মানুযায়ী হয়েছে। আমি আবদুল মজিদ সাহেবকে আর ও বললাম : অবজেকশন মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করুন। বলে দিন পাবনা থেকে যাওয়ার সময় চার্জ হ্যান্ডওভার করার কোনাে সুযোগ ছিল না। দ্বিতীয়ত মুজিবনগরে আমার অ্যাপয়েনমেন্ট স্বাভাবিক সময় যেভাবে হয় তেমনি হয় না। আর তৃতীয়ত, যেহেতু এখন আমি সশরীরে কাজ করছি তাই কাজে যােগদানের ক্ষেত্রে কোনাে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আর একাউন্ট্যান্ট জেনারেলের এ কাজটি যে অবশ্যই সাহসী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং এ কারণে তার চাকরি খেতে হবে কেন? আসলে মজিদ সাহেব আবেগের কারণেই এটা বলেছিলেন।
যাই হােক আবারও ১৮ ডিসেম্বরের প্রসঙ্গে আসি । নরুল ইসলাম সাহেব শেষ পর্যন্ত আমাকে কাজ করার জন্য একটি রুম দিলেন।
এর পরদিন খবর পেলাম ভারত সরকারের কয়েকজন প্রতিনিধি ঢাকার ডিসির অফিসে গেছেন। প্রবাসী সরকারের অনুরােধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং যৌথ আলােচনার ভিত্তিতে ত্রাণ পরিচালনা ও পুনর্গঠন কাজে সহায়তা করা তাদের লক্ষ্য। কিন্তু ইতােমধ্যে ঢাকার ডিসি আহমদ ফরিদকে প্রত্যাহার করা প্রয়ােজন হয়ে পড়েছিল। সুতরাং সে জায়গায় নতুন লােক নিয়ােগ করতে হবে, নতুবা কাজের ব্যাঘাত ঘটবে প্রচণ্ড। তাই ঢাকার ডিসি হিসেবে মােকাম্মেল হককে নিয়ােগ দেয়া হলাে। এ নিয়ে পরবর্তী সময় আমাকে কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। যদিও নিয়ােগটি করা হয়েছিল প্রবাসী সরকারের নীতিমালা অনুসরণ করেই।
খুব সম্ভবত ১৯ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়। সেখানে বাঙালী কর্মচারী-কর্মকর্তাগণ একইভাবে প্রবাসী সরকারের নির্দেশনা সম্পর্কে জানতে চান। তাদের অফিসেও অনেক আসন শূন্য। সে শুন্য স্থান পূরণ হবে কিভাবে,
পৃষ্ঠাঃ ৫২০

কাজকর্ম চলবে কিভাবে সর্বোপরি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নাতি কি হবে এসব প্রশ্ন ছিল।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব সে সব বিষয়ে তাঁর দিকনির্দেশনা আগেই দিয়েছেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হলাে। এখানে জোর দিয়ে বলা হলাে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরও দেশ পরিচালনায় বিদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল অপরিহার্য। আর এ কাজটি করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের । বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার বিষয়টিই শুধু নয়, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়ও তখন খুব জরুরী কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তাই উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসনিক পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রবাসী সরকার একটি রূপরেখা তৈরি করে রেখেছে। তা বাস্তবায়নের যথাযথ সময় হচ্ছে এটি। প্রবাসী সরকারের নীতিমালার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন পুনর্গঠনের কার্যক্রম অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। এ কমিটিতে মাহবুব জামান ছিলেন। মহিউদ্দিন খান আলমগীরকে মেম্বার সেক্রেটারি করা হলাে। কথা হলাে তারা শিগগিরই প্রতিবেদন পেশ করবেন।
২৮ ডিসেম্বরে আরেকটি নিয়ােগের কথা মনে পড়ে। আর এটি ছিল প্রথম মৌলিক নির্দেশনা। বিমানবন্দর থেকে আসার পথে ফারুক চৌধুরীকে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছিল।
এস আর মির্জাকে বলা হলাে অতি দ্রুত বিমানবন্দরকে বিমান অবতরণ করার উপযােগী করার জন্য। কারণ শিগগির মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ দেশে প্রত্যাবর্তন করবেন। বিদেশি অনেকেই আসবেন; কিন্তু বিমানবন্দর ছিল সম্পূর্ণ অচল।
এদিকে বাংলাদেশ বেতার থেকে নিয়মিত প্রচার হচ্ছে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা যেন দ্রুত কর্মস্থলে যােগদান করেন। এ নির্দেশ ১৮ ডিসেম্বরই দিয়েছিলাম। সরকারের এ নির্দেশ প্রচারের পাশাপাশি যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। রাস্তাঘাট তাে বলতে গেলে অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। সড়ক ও জনপথের সেতুগুলাে ভাঙ্গা। এ অবস্থায় লােকজন আসবে কি করে।
বিকল্প হচ্ছে নৌপথ। কাইউম সাহেব ও কমােডর রশীদ সাহেবকে বলা হলাে। নৌ-যােগাযােগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য। যাতে সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাগণ কর্মস্থলে আসতে পারেন। বিআইডব্লিউটিএ এবং বিআইডব্লিউটিসিকে কার্যকর
পৃষ্ঠাঃ ৫২১

করা হলাে এভাবে। সঙ্গে সঙ্গে বেতারকে বলা হলো লঞ্চ স্টিমারগুলো কোথায় কখন থামবে, তা যেন ঘােষণা মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়।
খুব সম্ভবত ১৮ কিংবা ১৯ ডিসেম্বর হবে। দুপুরবেলা গভর্নর হাউজে গিয়েছিলাম। সচিবালয় থেকে রওনা হয়েছি, এমন সময় আলী আশরাফ নামের একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবেন? জবাব ছিল – বঙ্গভবন।
পর্ব চিন্তা ছাড়াই নামটা বলা হয়েছিল। একেবারেই নতুন নাম। সঙ্গত কারণেই সাংবাদিকের পরবর্তী প্রশ্ন আসে, বঙ্গভবন কোনটা? তাকে জানানোর পর তিনি অনুরােধ করলেন এ তথ্য যাতে অন্য কোনাে সাংবাদিককে না বলা হয়। তিনি এটি তাঁর পত্রিকায় পরের দিন প্রধান শিরােনাম করবেন। বঙ্গভবন নামটির এবাবেই উৎপত্তি হয় এবং আশরাফ সাহেবের মাধ্যমে তা পত্রিকায় প্রকাশের ব্যবস্থা হয়।
এখানে একটা বিষয় বলা জরুরি তা হচ্ছে, সরকারী কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সরকারের প্রতি আনুগত্য আছে কি না এ মর্মে একটি ঘোষণা চাওয়া হয়। আনুগত্য পত্র বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর একটি নির্দেশনা অবশ্যই উল্লেখ্য। তিনি বলেছিলেন, যে কোনাে কর্মচারী-কর্মকর্তা আনুগত্য প্রদানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবেন। এ কথাও সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রত্যেকের বিশ্বাস এবং আস্থাকে সম্মান জানাতে হবে। এবং কেউই যাতে এমন মনে করতে না পারেন যে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক আনুগত্য আদায় করা হয়েছে। ঐ সময় কিছু কর্মকর্তা আনুগত্য প্রকাশ করে নি। তাঁরা ছিল প্রায় সবাই অবাঙালী। দু’একজন বাঙালী ছিলেন, তারা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। এঁদের সংখ্যা ছিল খুবই কম।”২
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফারুক চৌধুরী মুজিবনগর সরকার ঢাকায় স্থানান্তর সম্পর্কে বলেন :৩
২২ ডিসেম্বর ১৯৭১। বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে কলকাতা থেকে আগত ভারতীয় বাহিনীর একটি প্লেন, অতি সাবধানে যেন ট্যাক্সি করে ধীরে ধীরে এসে থামল। ১৯৭১-এর শীতের সেই বিকেলে ঢাকা বিমানবন্দরের রানওয়ের অবস্থা, কিছুটা তার বাইশ বছর পরে, ১৯৯৩-এর অবিশ্যন্তি বারিধারায় ভেঙ্গে যাওয়া ঢাকার রাজপথের মতাে। রানওয়ের যেখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বােমাবর্ষণ সৃষ্ট নানান আকারের ছোট বড় ক্রেটার। ভারতীয় বায়ুসেনার সেই পাইলটটির অবস্থা যেন আজকার ঢাকার মোটর চালকের মতো । ডানে কেটে, অতিসন্তর্পণে সাবধানে আগে বাড়া।
বিমানটির দরজা ধীরে ধীরে খুলে গেল। শীতের পড়ন্ত রােদে বিমান থেকে
পৃষ্ঠাঃ ৫২২

একে একে অবতরণ করলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজামান, আব্দুস সামাদ আজাদ, আর তাদের সবার মাঝে খন্দকার মোস্তাক আহমদ। রাজা এলাে শহরে। ঘাতক এলাে শহরে। রক্তঝরা বিয়ােগান্ত একটি নাটকের মুখর এই সূচনায়। তার এক অবিশ্বাস্য পৈশাচিকতায়, রক্তভেজা হাতে, মন্ত্রী হলো ঘাতক আর সেই ঘাতকই হলাে রাজা। অবশ্য একদিনকার বাদশা। বিচিত্র এই দেশে। কিন্তু শীতের সেই সন্ধ্যায় বিমানবন্দরে উৎসবমুখর জনতা। মারল ভূষিত নেতৃবৃন্দ। আকাশ-বিদারী হর্ষধ্বনি। জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু!! এই মুখরতায়ও দিনের বিদায়ী রােদে বিমর্ষ যেন সেই সন্ধ্যা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নেই। এই বিয়ােগান্ত নাটকের উৎসবমুখর সেই অংকে মহানায়কের নেই দেখা। তিনি কারাগারে। অন্য দেশে ।
বিজয়ের পুরাে সাতদিন পরে, দেশের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অস্বাভাবিকভাবে বিলম্বিতই মনে হয়েছিল মন্ত্রিসভার সেই আগমন । মনে হয়েছিল বিজয়বাদনে যেন কিছুটা ছন্দপতনই ঘটেছে। ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর। রাজনৈতিক নেতৃত্ববিহীন রাজধানী ঢাকা। বিজয়ী এই দেশে।
কিন্তু পরাজিত দেশে তার দু’দিন আগেই, ২০ ডিসেম্বরে, রাওয়ালপিন্ডিতে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ নিয়েছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো । তার দেশবাসী শুনেছেন তার আবেগময় ভাষণ। ২০ ডিসেম্বরের সেই সন্ধ্যায়ই। এদেশের অনেকে শুনতে পেয়েছেন পরাজিতের প্রত্যয়। ভুট্টো বলেছেন, ভাঙ্গা টুকরাে, খুব ছােট ছােট টুকরােগুলাে আমাদের তুলে নিতে হবে, নতুন এক পাকিস্তান আমরা গড়বাে সমদ্ধিশালী উন্নয়নমুখী পাকিস্তান, শশাসণমুক্ত পাকিস্তান ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু শােষিত এই দেশের, বিজয়ী এই দেশের স্বাধীন এই দেশের নেতার তখনও কাটেননি কলকাতা থেকে ঢাকা আসার তাদের প্লেনের টিকেট। মনে পড়ে সেই সময়ে অনেক ঢাকাবাসীর ব্যক্ত হতাশার কথা।
এদিকে পরাজয়ের গ্লানিমাখা ভুট্টো ১৭ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক থেকে চলে গিয়েছেন প্লেনে, ফ্লোরিডার কি বিসকেনে। নিক্সন আর কিসিঞ্জারের দরবারে ধরনা দিতে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার প্রত্যাশা, সামরিক আর আর্থিক সাহায্য। তারপর ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্যান অ্যাম প্লেনে রওনা হয়েছেন রােমের পথে । রােম থেকে পিআইএর বিমানে ২০ ডিসেম্বর ভােরে তিনি পৌছেছেন ছােট হয়ে পড়া দেশে । সময় মূল্যবান। হারাবার সময় নেই হাতে।
ঢাকার ২২ ডিসেম্বরের প্রাণকেন্দ্র ঢাকার বঙ্গভবন। মন্ত্রিসভার সাথে কলকাতা থেকে দ্বিতীয়বারের মতাে ফিরে এসেছেন পররাষ্ট্র সচিব আবুল ফতেহ। ঢাকা ত্যাগের দু’দিন পরেই। তিনি বললেন, নতুন সরকারের আদেশ, আমি যেন
পৃষ্ঠাঃ ৫২৩

পররাষ্ট্র দফতরের মহাপরিচালক তাৎক্ষণিকভাবেই কার্যভার গ্রহণ করি। বঙ্গভবনের দোতলায় একটি কামরায় পররাষ্ট্র সচিব সাময়িকভাবে বাসা বাঁধলেন। সেই তলায়ই দুটি কামরায়, স্থাপিত হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতর।
মন্ত্রিসভা প্রত্যাবর্তনের সেদিনটির সকালে বঙ্গভবনে পররাষ্ট্র দপ্তরে বসে আমরা দু’জন। হুমায়ুন কবির আর আমি বিদেশী সাংবাদিকদের দেখাশোনার জন্য আমরা ইতিমধ্যেই ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে দপ্তর স্থাপন করি। দখলকারী বাহিনীর অত্যাচার আর আলবদরের হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে জ্ঞাত হওয়ার ঔৎসুক্য বিদেশী সাংবাদিকদের প্রচুর। ব্যস্ত তাই সেই অফিসের কর্মকর্তারা। বঙ্গভবনে সেদিন মন্ত্রিসভার আগমনের অধীর প্রতীক্ষায় আমরা। কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ব্যতিরেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডের যথার্থ সূচনা অসম্ভব। তবু বঙ্গভবনে বসে আমরা দুটি দায়িত্ব পালনের যথাসম্ভব চেষ্টা করছি। প্রথমটি হচ্ছে বিমানবন্দরে আমাদের কর্মকর্তাদের সাথে যােগাযােগ রেখে বিদেশি কূটনীতিক অবস্থানগুলাের বিশেষ করে চীন আর বর্মার কনসালেট দুটির নিরাপত্তা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর ঢাকার পুলিশের সহায়তায় নিশ্চিত করা। ঢাকার টেলিফোন ব্যবস্থা তখন চমক্কারভাবেই কাজ করেছিল। রিসিভার হাতে হ্যালো হ্যালাে বলে কাটাতে হয়নি উত্তেজনাভরা অনিশ্চিত কোনাে সময়। সেই সকালে হঠাৎ আবির্ভাব, কালাে থ্রি পিস স্যুট পরা, ব্রিফকেস হাতে, সুদর্শন এক ইংরেজ ভদ্রলােকের। যথাসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ালাম আমরা দু’জন। তাঁর নামাঙ্কিত কার্ড দুটো আমাদের হাতে দিয়ে করমর্দন করলেন তিনি। বসতে বললাম তাঁকে। স্বাধীনতাউত্তর সেই পরিবেশ কেন জানি তাঁর ডােরা কাটা কালাে থ্রি পিস স্যুটটি কিছু বেমানানই লাগছিল। গম্ভীর অক্সফোর্ড উচ্চারণে বললেন তিনি, কার্ডে দেখতেই পারছেন, আমি ব্রাডবেরি উইলকিনসন কোম্পানির প্রতিনিধি । অন্য অনেক কাজের মাঝে আমরা ব্যাংক নােটও ছাপি। নতুন স্বাধীন আপনারা। নিশ্চয়ই ব্যাংক নােটের প্রয়ােজন হবে।’
আমরা অবাক। নতুন দেশের মন্ত্রিসভার নেই দেখা । অথচ এসে হাজির ইংরেজ বণিক! আবার সেই বণিকের মানদণ্ড। বাদশা জাহাঙ্গীরের কাছে ব্যবসাজনিত সুবিধাদির আবেদনকারী বণিকেরই বংশধর হয়তাে। আমাদের দুজনের একজন হুমায়ুন হলেও আমিই জাহাঙ্গীর।
ঔৎসুক্য দমন করতে না পেরে প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা আপনি ঢাকা এসে পৌছলেন কি করে? বিদেশের সাথে আমাদের বেসামরিক কোনাে বিমান যােগাযােগ তখনাে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
পৃষ্ঠাঃ ৫২৪

তাতে কি হয়েছে? তাঁর উত্তর, আমি কলকাতা এসে বসেছিলাম । ঢাকা মুক্ত হলো। একজন ভারতীয় ব্রিগেডিয়ারের সাথে হলাে আমার পরিচয় আর বন্ধুত্ব। তারই সাহায্যে ভারতীয় বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে এসে পৌছেছি গতকাল । আপনারা কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন ব্যাংক নােটের ব্যাপারে?
আমরা হতভম্ব। কি বলি তাকে? ইংরেজের ব্যগ্রতায় প্রচণ্ড হাসি পেল আমাদের দুজনের। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ইংরেজের চিন্তা আমাদের ব্যাংক নোট ছাপাবার। হুমায়ন কবিরের মাথায় বুদ্ধি এলাে। বললেন, আপনার যাওয়া উচিত অর্থ মন্ত্রণালয়ে।’
উদগ্রীব ইংরেজ বণিক। এবার প্রশ্ন, “অর্থ মন্ত্রণালয় কোথায়? অর্থ সচিব কোথায়?
কলকাতা থেকে সদ্যপ্রত্যাগত অর্থসচিব আসাদুজ্জামানকে আমরা বঙ্গভবনে দেখেছি দু’একবার। তার এত ব্যস্ততার মাঝে ব্যাংক নােট ছাপাবার চিন্তা-ভাবনার অবকাশ তখনও হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া মন্ত্রিসভা তখন পর্যন্ত এসে পৌছায়নি ঢাকায়। ব্যাংক নােট ছাপাবার সিদ্ধান্তই বা নেবে কে?
তৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অবাস্তবই মনে হয়েছিল বিচক্ষণ সেই ইংরেজ ব্যবসায়ীটির সময় বিচার। কিন্তু ব্যবসায়ে অতিউদ্যমী ছিলেন সেই ইংরেজ বিক্রেতা। দুই শতাব্দী আগে নাকি তার কোম্পানি, উইলকিনসন, তরবারি তৈরি করতাে তরবারির সাম্রাজ্যবাদের সেই যুগে। এখন সেই কোম্পানিটিই ছাপছে ব্যাংক নােট অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের এই যুগে।
সেদিন সচিবালয়ে কারাে সাথে ইংরেজি ব্যবসায়ীটি কোন অর্থবহ আলােচনা করতে পেরেছিলেন কি না তা জানা নেই। তবে তার বেশ ক’মাস পরে, আমি তখন লন্ডনে আমাদের দূতাবাসের ডেপুটি হাইকমিশনার, শুনেছিলাম যে সেই কোম্পানি নাকি আমাদের প্রথম ব্যাংক নােটগুলাে ছাপার দায়িত্ব পেয়েছিল। সার্থক ব্যবসায়ী ছিলেন আমাদের নাম ভুলে যাওয়া সেই ইংরেজ ব্যবসায়ীটি। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথম বিদেশী অতিথি ছিলেন তিনি!
ঢাকার মন্ত্রিসভার আগমনের সাথে সাথেই বঙ্গভবন হয়ে উঠল প্রাণচঞ্চল সরকারের সব দফতর তখন যেন সেটাই। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাময়িকভাবে সেখানেই অবস্থান করছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরটিও তখন সেখানে। সেই বাসভবনটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী তখন ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা, গভর্নর মালেকের উপসচিব নুরুল ইসলাম অনু। তাঁর স্থাতেই তখন ছিল বঙ্গভবনের চাবিকাঠি। অর্থাৎ সরকার চালনার ব্যবস্থাদি করার দায়িত্ব। অনেক লােকের খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর
পৃষ্ঠাঃ ৫২৫

প্রধানমন্ত্রীর দফতর স্থাপনের আয়ােজন, মিটিং, লোকজনের আনাগোনা, যুদ্ধোত্তর ঢাকার অনিয়মতান্ত্রিক সেই সময়টিতে তার উপর বর্তালো গুরুদায়িত্ব। কিন্তু নুরুল ইসলাম অনু ছিলেন একাই একশাে। কনিষ্ঠ কর্মকর্তা তখন ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর স্বল্পপরিসর প্রশাসনিক শক্তিতে তিনি সেই দিনগুলোতে বহন করেছিলেন বিপুল দায়িত্ব, প্রদর্শন করেছিলেন অসাধারন কর্ম ক্ষমতা।
২২ ডিসেম্বরের সেই সন্ধ্যায় একটি ঘটনা মনে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গভবনে উপস্থিত প্রত্যেকটি কর্মকর্তা আর কর্মচারীর সাথে একে একে করেছিলেন দেখা। ভবনটি ঘুরে সবার সাথে করেছিলেন করমর্দন। তার সাথে সেটা ছিল আমাদের অনেকেরই প্রথম পরিচয়। তার ওই নেতৃত্ব সুলভ পদক্ষেপটির তাৎপর্য ছিল যথেষ্ট। বিজয় দিবসের সপ্তম দিনের সেই সন্ধ্যায় সরকারের কর্তৃত্বের প্রতিষ্ঠা। যুদ্ধোত্তর কর্কশ কোনাে উগ্রতার নয়, আমাদের কাছে তার স্বভাবসুলভ , ধীর, আর বিশ্বাস ভরা ব্যক্তিত্বের ওই প্রথম প্রকাশ। স্বল্পভাষী, জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, কর্মক্ষম এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমাদের অনেকের মনেই করেছিলেন গভীর রেখাপাত ।
সব মিলে একাত্তরের ২২ ডিসেম্বরের সেই দিনটি ছিল উত্তেজনা ভরা স্মরণীয় একটি দিন। স্বাধীনতাউত্তর ঢাকার বুকে প্রথমবারের মতাে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সেই দিনটি। তারপর থেকেই যেন ব্যক্তিবিশেষের জন্য সামগ্রিকভাবে ঘটনাবলি অবলােকন করার সম্ভাবনার হলাে শেষ। আমরা প্রত্যেকেই জড়িয়ে পড়লাম নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের আবর্তে।”
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক
১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ঢাকায় সচিবালয় কেবিনেট কক্ষে স্বাধীন দেশের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ বৈঠকে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত হয় :
১. বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান;
২. পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের নাম বাংলাদেশ ব্যাংক নামকরণ করা;
৩. জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে;
৪. মুজিবনগর মুক্তিযােদ্ধাদের একটি জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তা বাস্তবায়নের জন্য ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মিলিশিয়া বাের্ড গঠন করা হয়;
৫. সকল পাটকল রাষ্ট্রায়ত্ত করা;
৬. বিএনআর ও প্রেস ট্রাস্ট বিলুপ্ত করা হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৫২৬

২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় ৮ নম্বর থিয়েটার রােড হতে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ৮ নম্বর থিয়েটার রােড অফিস থেকে প্রবাসী সরকারের নথিপত্র বঙ্গভবন ও সচিবালয়ে চলে আসে। সরকারের সচিববৃন্দ, কর্মকর্তা, কর্মচারীগণ ঢাকায় চলে আসেন। ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়বেশে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। পরিতাপের বিষয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী সরকারের অধিকাংশ ঐতিহাসিক দলিলপত্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ধ্বংস করা হয়েছে।
২৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মন্ত্রিসভাকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। তাদের সমাবেশে তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দেন। ৫৫ মিনিটব্যাপী ভাষণে তিনি সরকারী কর্মচারীদের জাতি গঠন কাজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শােষণমুক্ত ন্যায় বিচার, শান্তি ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিনি ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভুটানের প্রশংসা করেন । তিনি বলেন, জাতি গঠনের কাজে শান্তির প্রয়ােজন এবং স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন । আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এখন দেশ থেকে সকল প্রকার শােষণ দূর করতে হবে।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সকল শ্রেণীর মানুষের সহযােগিতা কামনা করেন। শােষণ ও অত্যাচারমুক্ত একটি স্বাধীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শপথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মাত্র ১৪ দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশকে মুক্ত করে ফেলে। বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালী পারস্পরিক স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে চিরদিন ভারতের বন্ধু হয়ে থাকবে। তিনি দু’মাসের মধ্যে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য কর্মচারীদের সহযােগিতা কামনা করেন।
বর্বর দখলদার সৈন্যদের হাতে বাংলাদেশের যেসব মহিলা নানাভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে তাদের পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হবে। যে মুক্তিযােদ্ধারা স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন তাদের পরিবারবর্গের প্রতি সরকারের দায়িত্ব রয়েছে।
তিনি বলেন, যারা শত্রুসৈন্যের ইচ্ছাকৃতভাবে সহযােগিতা করেছে তাদের ক্ষমা করা হবে না। তাদের যুদ্ধবন্দী হিসেবে বিচার করা হবে। তিনি ঘােষণা করেন যে, সরকারী কোন প্রকার পাইকারি ব্যবস্থা নেবে না। তবে যে সমস্ত দালাল স্বাধীনতা সংগ্রামে বিঘ্ন সষ্টি করে এবং বাঙালী হত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহায়তা করেছে তাদের বিচার করা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৫২৭

তিনি আইন স্বহস্তে গ্রহণ না করার জন্য জনগণকে উপদেশ দেন । তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু এখনও পাকিস্তানের কারাগারে অন্তরীণ। বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙালি বা অবাঙালী সবাই এ দেশের সমমর্যাদার নাগরিক।
২৪ মার্চ থেকে মন্ত্রিগণ সচিবালয়ে তাদের কক্ষে নিয়মিত অফিস করা শুরু করেন ।
২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী বিকেলে বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনাকালে বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে চায় এবং এই নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দানের জন্য তিনি সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান। চীনের সাথে বাংলাদেশ সম্পর্কের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সবার সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চায় । তিনি আশা করেন বাংলাদেশের স্বার্থের ব্যাপার চীন নেতৃবৃন্দের মনােভার পরিবর্তন করতে চীনা জনগণের প্রতি আহবান জানান।
তিনি বলেন, দেশে খুব শিগগিরই শাসনতন্ত্র দেয়া হবে ।
ন্যাপ নেতা মােজাফফর আহমদ বাংলাদেশে একটি জাতীয় সরকার গঠনের পরামর্শ দেন। এ সম্পর্কে তাজউদ্দীন বলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হয়েছে। তিনি সকল দল মিলে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব সমর্থন করেননি।
২৮ ডিসেম্বর এক ভাষণে বলেন, “আওয়ামী লীগ অসাধ্য সাধন করিয়া বিশ্বের ইতিহাসে একটি অনন্য নজির স্থাপন করিয়াছে। যে বাঙালীরা বন্দুক ধরিতে জানিত না, তাহারা সুনিপুণভাবে স্বয়ংক্রিয় সমরাস্ত্র ব্যবহার করিতে শিখিয়াছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হইয়াই তরুণ ও যুব সমাজ প্রাণ বিসর্জন দিয়াছে। বঙ্গবন্ধু জানিয়া শুনিয়াই ঘরে ঘরে দুর্গ গড়িয়া তােলার আহবান জানাইয়াছিলেন।”…
তিনি বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের নিরস্ত্র করার কোনে প্রশ্নই ওঠে না। শহীদানের পরেই মুক্তিযােদ্ধাদের মর্যাদা।
১৯৭১ সালের ২৮ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন, ধর্ম ও ভাষা প্রভেদ সত্তেও দেশের সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সুবিধা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানে সরকার বদ্ধপরিকর।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গত নয় মাসে যেসব যুদ্ধবন্দী গণহত্যা ও অন্য অপরাধের জন্য দায়ী হবে তাদের বিচার করা হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যখনই চলে যেতে বলবে তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী দেশে ফিরে যাবে।
পৃষ্ঠাঃ ৫২৮

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মার্কিন সরকারের অনুসৃত নীতির ফলে সাহায্য প্রস্তাব প্রত্যাশা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের জনগণ ভিখারী নয়। কখনও সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হবার মতো কোনো সাহায্য প্রস্তাব বাংলাদেশের জনগণ গ্রহণ করবে না।
জাতির জনকের মুক্তির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক রেডক্রস, আন্তর্জাতিক বিচারক কমিশন ও মানবাধিকার পরিষদকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার অনুরােধ করেছে।
শহীদ মিনার সম্পর্কে বলেন, মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী শহীদ মিনার পুননির্মাণের কথা সরকার চিন্তা করছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শহীদ মিনার পুননির্মাণ করা হবে।
২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনী কর্তৃক নির্যাতিতদের দেখতে যান। তিনি হাসপাতালে তিন শতাধিক আহত ব্যক্তির সাথে দেখা করেন।
২৯ ডিসেম্বর খিলগাঁও আওয়ামী লীগ অফিস উদ্বোধনকালে বলেন, সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সমাজতন্ত্রী অর্থনীতি চালু করাই আওয়ামী লীগ সরকারের লক্ষ্য।
৩০ ডিসেম্বর তিনি মিটফোর্ড হাসপাতালে আহত মুক্তিযােদ্ধা ও বেসামরিক নাগরিকদের দেখতে যান।
৩১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী বলেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য বহু দেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর হমানের মুক্তির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।বঙ্গভবনের দরবার হল বােমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা মেরামত করেমন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
২৭ ডিসেম্বর শেখ আব্দুল আজিজ, ফণী ভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ এবং জহুর আহমদ চৌধুরীকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। ২৮ ডিসেম্বর অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। খন্দকার মােশতাক আহমদকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত প্রথম পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা :
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
তাজউদ্দীন আহমদ – প্রধানমন্ত্রী, সংস্থাপন, মন্ত্রিপরিষদ, প্রতিরক্ষা, তথ্য
পৃষ্ঠাঃ ৫২৯

খন্দকার মােশতাক আহমদ – বাণিজ্য
এএইচএম কামারুজ্জামান – স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ
আবদুস সামাদ আজাদ – পররাষ্ট্র
শেখ আবদুল আজিজ
ফণী ভূষণ মজুমদার
জহুর আহমদ চৌধুরী
অধ্যাপক ইউসুফ আলী
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ২৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদের কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত বাংলায় লেখার নির্দেশ দেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচ টি ইমাম কার্যবিবরণী বাংলায় লেখা শুরু করেন। রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, বিচারপতিদের শপথ বাক্য ইংরেজীতে। শপথবাক্য বাংলায় খসড়া করেন এইচটি ইমাম, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, নুরুল ইসলাম আনু, আকবর আলী খান। তারা যে শপথ বাক্য খসড়া করেছেন তা মন্ত্রিপরিষদ অনুমােদন করে। আজও সে শপথনায চলছে। ২৭ ডিসেম্বর বঙ্গভবনে নতুন মন্ত্রিগণ শপথ গ্রহণ করেন ।৪

তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন
তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন ৩ কন্যা, একমাত্র পুত্রসহ ১৯৭১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে একটি মালবাহী বিমানে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে পৌছেন। তারা সাতমসজিদ রােডের মুসা সাহেবের বাড়িতে ওঠেন। এ বাড়িতে তাজউদ্দীন আহমদের শ্যালক ভাড়া থাকেন। তাজউদ্দীন আহমদ ধানমণ্ডির বাসভবনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে ছিল। বাড়ির গাছপালা পাকসেনারা কেটে ফেলেছে। বাড়ি বসবাসের উপযােগী করার জন্য সংস্কার চলছে। তাজউদ্দীন আহমদ ৩৫ নম্বর হেয়ার রােডের সরকারী বাড়িতে থাকছেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি তার পরিবারের সদস্যরা হেয়ার রােডের বাড়িতে ওঠেন। বাড়িতে ফুলভর্তি। গঙ্গামালী একগুচ্ছ ফুল দিয়ে তাদের স্বাগত জানালেন।
১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের কাছে তাজউদ্দীন বলেন, গত ২৫ মার্চের পর ইয়াহিয়া সরকার কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে গৃহীত যে কোন ব্যবস্থা বাতিল করা হছে। বাস্তুত্যাগীদের সম্পত্তি নিলামে বিক্রি ও ফেরত সম্পর্কে বলেন, গত মে মাসে গৃহীত বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ ধরনের সম্পত্তি নিলাম বা বিক্রি বাতিল বলে ঘােষণা করা হয়। আজ প্রধানমন্ত্রী ঢাকা শহর সচক্ষে দেখার জন্য ঠাটারীবাজার, বনগ্রাম, ওয়ারি ও র্যাংকিন ষ্ট্রীট পরিদর্শন করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৫৩০

২ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদ নবগঠিত বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পুনর্গঠিত করার কাজে সর্বাত্মক সহযােগিতা দানের জন্য দেশের সাংবাদিক সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
২ জানুয়ারি একটি বৌদ্ধ প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মের ওপর ভিত্তি করে দেশে কোন রাজনৈতিক দল থাকবে না।
নবলব্ধ রাষ্ট্র বাংলাদেশ হবে একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশে প্রতিটি ধর্মের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। রাষ্ট্র কোন ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্মের নামে কাউকে শােষণ করতে দেয়া হবে না। ধর্মের ভিত্তিতে সমাজে কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থাকবে না। দেশের সাধারণ নির্বাচনে পরাজিত দলই শুধু সংখ্যালঘু হিসেবে অভিহিত হবে।
৩ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘােষণা করেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের সিদ্ধান্তের খবরে ৩ জানুয়ারি সােমবার রাত ১১টা ৫০ মিনিট তাজউদ্দীন আহমদ টেলিভিশনে এক ভাষণ দেন।
“……..আমরা জানতে পেরেছি, বিনা শর্তে বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বের চাপে ইসলামাবাদের একনায়ক সরকার মাথা নত
করতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর শােনার সাথে সাথে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছে। আজ শুধু একান্তভাবে প্রার্থনা করছি, আমাদের মহান নেতা আমাদের মাঝে ফিরে আসুন। রক্তস্নাত বাংলাদেশের মুখে হাসি ফুটে উঠুক। আসুন আমরা অযুত কণ্ঠে বলি, ‘জয় শেখ মুজিব, জয় বাংলা’।”
ছাত্রলীগের ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ
৪ জানুয়ারি ১৯৭২
১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউশনে ছাত্রলীগের ২৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি
তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে আর কোন ছলাকলা ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোকে
পৃষ্ঠাঃ ৫৩১

সাবধান করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে আসার জন্য সরকার সকল ব্যবস্থা করে রেখেছে। তাকে আনার ব্যাপারে যাতে মুহূর্ত বিলম্ব না হয় তার জন্য নয়া দিল্লিতে একটি আন্তর্জাতিক বিমান ভাড়া করে রাখা হয়েছে।
ছাত্রলীগের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা
স্বাধীনতাযুদ্ধে ছাত্রলীগের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির ওপর মরণঘাত হানা হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত ছাত্রসমাজ সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল। ছাত্রলীগই শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দিয়েছে। যারা কোনদিন ঘুঘু শিকারে অভ্যস্ত ছিল না তারা আজ স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিখে হানাদারদের তাড়িয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করেছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামাে ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে হচ্ছে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ, আমাদের অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে হলে অভান্তরীণ ও বহির্বিশ্বের শান্তি অপরিহার্য। বিশ্বের অশান্তি অভ্যন্তরীণ শান্তিকে বিঘ্নিত করতে পারে। তিনি রাষ্ট্র আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার আহবান জানান।
বৈদেশিক নীতি
বৈদেশিক নীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুস্মরণে আমাদের বৈদেশিক নীতি হবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি। বিশ্ব শান্তির স্বার্থে আমরা কোন যুদ্ধজোটে শরিক হব না।
আমরা দুনিয়ার সকল দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই।
তিনি বলেন, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য করেছে। সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের জনগণের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। এ ছাড়া আমাদের জয়ের মুখে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য আমেরিকা ও চীন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব এনেছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন তিন তিনবার ভেটো দিয়ে সে প্রচেষ্টা বন্ধ না করলে আমাদের দেশ আজ কঙ্গো, ভিয়েতনাম, মিসর বা কোরিয়ার মতাে বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্র হতো।
পৃষ্ঠাঃ ৫৩২

বৈদেশিক সাহায্য
দেশকে পুনর্গঠন এর জন্য আমাদের সাহায্যের দরকার আছে। কিন্তু সাহায্য নেয়ার সময় আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ভিক্ষুকের মতাে দান আমরা নেব না । আমরা অনাহারে মরে যেতে পারি, তবু স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেব না।
পুনর্বাসন
শত্রু সাথে আমাদের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু শরণার্থীদের পুনর্বাসন, শহীদ এবং যুদ্ধে আহত ও পঙ্গু যােদ্ধাদের পুনর্বাসন, গাজী হয়ে যারা বেঁচে আছেন তাদের কর্মসংস্থান ইত্যাদি গুরুতর সমস্যাগুলাের সমাধান করতে হবে। যুদ্ধ পরিস্থিতির মতো এগুলোর মােকাবিলায় সাহায্য করার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহবান জানান।
দালালদের বিচার
শত্রুর সাহায্য ও দালালী যারা করেছে আইনের মাধ্যমেই তাদের বিচার এবং অপরাধীদের অবশ্য সাজা ভােগ করতে হবে। কিন্তু দালালদের সাজা দেয়ার জন্য কেউ যেন আইনকে হাতে তুলে না দেয় এবং নিরীহ মানুষ যাতে জুলুমের শিকার না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য তিনি ছাত্র ও যুবকদের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন, স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে একটি লােকও যদি ভীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে কাল যাপন করে তাহলে আমাদের স্বাধীনতা নিরর্থক হয়ে দাড়াবে। আমাদের লক্ষ্য করতে হবে বাংলার প্রতিটি কৃষক যেন তার ক্ষেতের ফসল ভােগ করতে পারে, প্রতিটি কর্মচারী যেন তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত না হয়। আমাদের সমাজ থেকে দারিদ্রকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, সুন্দর কল্যাণময় সমাজ গড়ে তােলা বক্তৃতামঞ্চ থেকে উঠে আসে না। এ জন্য প্রয়ােজন কাজ করা।
জাতীয় পতাকা
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্রটি পরিবর্তন করা যায় কিনা তা চিন্তা করার জন্য দেশের ছাত্রসমাজের প্রতি আহবান জানান।
প্রধান সেনাপতি ও সেক্টর কমান্ডারদের সাথে প্রধানমন্ত্রী
১৯৭২ সালের ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারগণ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে একত্রিত হন। তাজউদ্দীন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর দঢ়প্রতিজ্ঞা, স্বদেশপ্রেম এবং দেশের লাখ লাখ
পৃষ্ঠাঃ ৫৩৩

মানুষের সংগ্রামের ফলেই এই ঐতিহাসিক বিজয় সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের অন্য কোন দেশ এত বেশি রক্তদান করেনি। এই বিপুল কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। নবােদ্ভুত জাতিকে ধর্মনিরপেক্ষতা গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তােলার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগের আহবান জানান। তার বাসায় বসে প্রদান সেনাপতি ও সেক্টর কমান্ডারগণ ছবি তােলেন। সে ছবি এখন বিভিন্ন গ্রন্থে দেখা যায়। এ ছবি মুজিবনগরে নয় ঢাকায় তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে তোলা ।
৬ জানুয়ারি ১৯৭২ সােভিয়েত মন্ত্রিপরিষদের চেয়ারম্যান আলেক্সি কসিরগিনের একটি শুভেচ্ছা বার্তা ঢাকার সােভিয়েত কনসাল জেনারেল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কাছে পৌছে দেন। তাজউদ্দীন পত্র পেয়ে গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কসিগিনকে উত্তর দেন।
জাতীয় মিলিশিয়া
মুক্তিযােদ্ধাদের জাতীয় উন্নয়নে আধভুক্ত ও পুনগঠনের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার ১১ সদস্যের সমন্বয়ে জাতীয় মিলিশিয়ার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাের্ড গঠন করেন। মিলিশিয়া বোর্ডের সদস্য ছিলেন :
তাজউদ্দীন আহমদ – সভাপতি
এএইচএম কামারুজ্জামান – স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
মনােরঞ্জন ধর
প্রফেসর মােজাফফর আহমদ
মণি সিং
তােফায়েল আহমেদ
আবদুর রাজ্জাক
রফিকউদ্দিন ভূইয়া
গাজী গােলাম মােস্তফা
ক্যাপ্টেন সুজাত আলী
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের যে উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তার রূপরেখা :
জাতীয় মিলিশিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণা
জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা নিম্নরূপ হবে :৪
পৃষ্ঠাঃ ৫৩৪

১. অনতিবিলম্বে একটি জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন হবে তালিকাভুক্ত হোক বা না হােক সকল মুক্তিযোদ্ধাকে এর আওতায় আনা হবে।
২. প্রত্যেক মহাকুমায় এলাকার গেরিলা বাহিনীর জন্য শিবির প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ সকল যুবকদের পুনর্গঠন কাজের জন্য প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
৩. মহকুমা ভিত্তিক শিবিরগুলাে সে এলাকার মিলন কেন্দ্র হবে ।
৪. ঊর্ধ্বপক্ষে ১১ জন সদস্য নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় বোর্ড গঠন করা হবে। সদস্যদের সরকার নিয়ােগ করবে।
৫. প্রত্যেক মহকুমা শহরে জাতীয় মিলিশিয়ার জন্য মহকুমা বাের্ড থাকবে- সদস্য সংখ্যা ১১ জন।
৬. প্রত্যেক শিবিরে অস্ত্র রাখার জন্য একটি অস্ত্রাগার থাকবে।
৭. এ সকল যুবকদের নিমের কাজের উপযােগী করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
(ক) যেন তারা দেশের রক্ষাব্যুহ হতে পারে।
(খ) যখন প্রয়ােজন হবে তারা যেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উপযুক্ত হতে পারে।
(গ) দেশের পুনর্গঠনে সরাসরি সহায়তা হয় এমন বিভিন্ন কাজের উপযােগী হবে।
৮. অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান, অপুষ্টি, খাদ্য এবং অপর্যাপ্ত বেতন ও ভাতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলারা কষ্টভােগ করেছে। সে কারণে তাদের খাদ্য, বাসস্থান ও ভাতার প্রতি নজর দেয়া হবে।
(সূত্র : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দেশ রক্ষা বিভাগ কর্তৃক প্রচারিত)
তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য গঠিত জাতীয় মিলিশিয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মুক্তিযােদ্ধারা পুনর্বাসিত হতাে এবং দেশ গঠনে অবদান রাখতে পারত। যারা লেখাপড়া সমাপ্ত করেছে তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করা হলেও অধিকাংশ মুক্তিযােদ্ধা বেকার জীবন যাপন করেছে। যারা চাকরি পেয়েছে তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযােদ্ধা যারা সেনাবাহিনী, প্রশাসন, পুলিশ প্রভৃতি বিভাগে যােগ দিয়েছে পরবর্তী সময়ে সামরিক সরকার এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তাদের চাকরিচ্যত করেছে এবং পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করেছে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে
পৃষ্ঠাঃ ৫৩৫

জাতীয় মিলিশিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। মিলিশিয়া ক্যাম্পগুলো ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চলছিল। তারপর সকল মিলিশিয়া ক্যাম্প বিলুপ্ত করা হয। ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়মিত খাবার পরিবেশন করা হত এবং প্রত্যেকটি মাসে ৭৫ টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। লেখক বরগুনা মহকুমা ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। মিলিশিয়া ক্যাম্প বিলুপ্ত করা সরকারের মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
৬ জানুয়ারি ১৯৭২ বিকেলে সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় জাতীয় মিলিশিয়া বাের্ডের সবা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জাতি ধর্ম বর্ণ দলমত নির্বিশেষে যারাই দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তাদের সবাইকে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীতে নেয়া হবে। সরকার তাদের আহার, বাসস্থান এবং ন্যূনতম বেতনের ব্যবস্থা করবে।
৭ জানুয়ারি ১৯৭২ আওয়ামী লীগের এক কর্মী সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, নুরুল আমিনের ভাষণ থেকে স্পষ্ট বােঝা যাচ্ছে পাকিস্তানকে বাঁচানোই সপ্তম নৌবহরের উদ্দেশ্য ছিল। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে তিনি যদি পাকিস্তানকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে চান তাহলে অবিলম্বে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার নিজের জনগণের সাথে ফেরত দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বন্ধুত্ব দিন দিন শক্তিশালী হবে। মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে যে সমর্থন ও সহানুভূতি আমরা পেয়েছি তা কখনও শােধ করা যাবে না। সােভিয়েত ইউনিয়ন এ অঞ্চলকে ভিয়েতনামে পরিণত হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা করেছে।সােভিয়েতের সময়ােচিত হুঁশিয়ারির কারণে সপ্তম নৌবহরের গতি স্তব্ধ হয়েছে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৩৬

২২
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিলাভ
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে আটক ছিলেন। ২৬ জানুয়ারি তাকে হেলিকপ্টারে মিয়ানওয়ালী থেকে রাওয়ালপিণ্ডির বিমান ঘাঁটির পাশে একটি ভবনে সেনা পাহারায় আটক রাখা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো তার সাথে ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর এবং ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি সাক্ষাত করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একত্রে থাকার প্রস্তাব দেন। বঙ্গবন্ধ উত্তরে জানান, তিনি তার জনগণের সাথে আলােচনা না করে কিছু বলতে পারবেন না। ড. কামাল হােসেনকে বঙ্গবন্ধুর বন্দিশালায় নিয়ে আসে। তারা একে অপরকে ধরে কান্নাকাটি করেন।১
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হােসেনকে জুলফিকার আলী ভুটো মুক্তি দেয়। তারা পিআইএ বিমানে লন্ডন যাবেন। সাথে ড. কামাল হােসেনের স্ত্রী, দু’কন্যা ছিলেন। তারা পাকিস্তানে ড. কামাল হােসেনেরশ্বশুরবাড়িতে গৃহবন্দী ছিলেন। ৮ জানুয়ারি ভােরে বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হােসেন লন্ডন পৌছেন। বঙ্গবন্ধুকে অতিথি ভবন- হােটেল ক্লালিজে রাখা হয়। প্রায় ৪শ’ সাংবাদিক জড়াে হয়েছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরােধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলিয়াম বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথের সাথে দেখা করেন।২
৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির সংবাদ পেয়ে তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ফলে পশ্চিম পাকিস্তানী সাম্রাজ্যবাদীদের ফাইনাল ডিফিট সূচিত হলাে। এ বিজয় সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়। এ বিজয় গণতন্ত্রের বিজয়। আর এ বিজয় বিশ্ব জনগণের বিজয়।
৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমদ টেলিফোনে কথা বলেন। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বিটিশ রয়াল এয়ারফোর্সের কমেট বিমানে বঙ্গবন্ধু
পৃষ্ঠাঃ ৫৩৭

দিল্লীর উদ্দেশে রওনা দেন। দিল্লী প্যারেডগ্রাউন্ডে তাকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয়। ভারতের প্রেসিডেন্ট ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে স্বাগত ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধু ভরতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও জনগণকে বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ১০ জানুয়ারি সাধারণ ছুটি ঘােষনা করেন।
১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারি বেলা ১টা ৪১ মিনিট বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিনায়ক, তৃতীয় বিশ্বের নিপীড়িত জনতার মুখপত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ ৯ মাস পর ঢাকায় অবতরণ করেন। লাখ লাখ মানুষ আনন্দ ধ্বনি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়। বিমানবন্দরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ, অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। বঙ্গবন্ধও তাজউদ্দীন আহমদকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। জনতার ঢল অতিক্রম করে রমনা রেসকোর্স ময়দানে আসতে বঙ্গবন্ধর ৪ ঘন্টা সময় লাগে।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লক্ষাধিক জনতার উপস্থিতিতে ভাষণ দেন। তিনি বললেন, ফাসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।৩
ভাষণরত অবস্থায় তিনি বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
জনসভার পর বঙ্গবন্ধু তার পিতামাতা, স্ত্রী, পুত্র-কন্যাদের সাথে ধানমন্ডির বাসভবনে মিলিত হন। দীর্ঘ ৯ মাস পরে প্রিয়জনদের সাথে দেখা। এক অভূতপূর্ব বেদনামিশ্রিত আনন্দ। বাংলার লাখ লাখ মানুষকে পাকবাহিনী হত্যা করেছে করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। চারদিকে ক্রন্দন রােল- বিধ্বস্ত বাংলাকে গড়ে তুলতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের সামরিক শাসনতন্ত্র অধ্যাদেশ জারি করেন-
যেহেতু ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে স্বাধীনতা ঘােষণা আদেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ শাসনের জন্য অস্থায়ী বিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং সেহেতু উক্ত ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতিকে সকল নির্বাহী, আইন প্রণয়নগত ক্ষমতা এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল এবং সেহেতু উক্ত ঘােষণাপত্রে বর্ণিত
পৃষ্ঠাঃ ৫৩৮

বেআইনি ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধের অবসান এখন ঘটেছে এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত আকাঙ্ক্ষা এই যে, বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকর করা হবে এবং যেহেতু উক্ত লক্ষ্য অনুযায়ী এক্ষেত্রে অবিলম্বে কতকগুলাে বিধান প্রদান করা প্রয়োজন।
সেহেতু এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র আদেশে এবং উক্ত আদেশে তাকে প্রদত্ত অন্যান্য ক্ষমতা অনুসারে রাষ্ট্রপতি নিমােক্ত আদেশ জারি করেছেন :
১. এ আদেশ বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২ নামে অভিহিত হবে….
২. বাংলাদেশ একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদের প্রধান থাকবেন;
৩. রাষ্ট্রপতি সকল দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রে যে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি অস্থায়ী সংবিধান আদেশে তা পরিবর্তন করে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি হতে ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত অস্থায়ী সংবিধান আদেশ কার্যকর ছিল। অস্থায়ী সংবিধানে বাংলাদেশ হাইকোর্ট গঠন, প্রধান বিচারপতিসহ কয়েকজন বিচারপতি নিয়ােগ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
১৯৭০-৭১ সালে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ৪৬৯ জন সদস্য- জাতীয় পরিষদের ১৬৯ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০= ৪৬৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত ছিল। তন্মধ্যে দালালী অভিযােগে অভিযুক্ত ও মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের বাদ দিয়ে ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। তাদের মধ্যে ৪০০ জন আওয়ামী লীগ, ১ জন ন্যাপ এবং ২ জন নির্দলীয় ছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতি সরকার প্রতিষ্ঠা করে। তিনি ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি মনােনীত হন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ
পৃষ্ঠাঃ ৫৩৯

মুজিবুর রহমান। নতুন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমদ, আবদুস সামাদ আজাদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, শেখ আবদুল আজিজ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জহুর আহমদ চৌধুরী, ফণীভূষণ মজুমদার, ড. কামাল হোসেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত।
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে বীরােচিত অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ গৃহহারা, সম্পদহারা, কৃষকদের বাঁচানোর জন্য ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত সুদসহ সকল বকেয়া খাজনা মওকুফ করা হয়। এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, জাতীয় পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে না, লাল সূর্য থাকবে। একই বৈঠকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রখ্যাত গান ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’-এর প্রথম দশটি চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হবে-
“আমার সােনার বাংলা
আমি তােমায় ভালােবাসি
চিরদিন তােমার আকাশ
তােমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তাের আমের বনের
ঘ্রাণে পাগল করে
মরি হায় হায়রে
ও মা অঘ্রাণে তাের ভরা ক্ষেতে
আমি কি দেখিছি মধুর হাসি।”
জাতীয় কুচকাওয়াজ সঙ্গীত হিসেবে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’ গানটি নির্বাচিত হয়। জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পশু বাঘ, এবং দোয়েলকে জাতীয় পাখি হিসেবে ঘােষণা করা হয়। বাংলা সনের পহেলা বৈশাখ ও ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন ঘােষণা করা হয়। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৭ জানুয়ারি মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র জমা দিতে বলেন। ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনীর ১৫ হাজার বীর মুক্তিযােদ্ধা এবং ৩১ জানুয়ারি মুজিববাহিনী অস্ত্র জমা দেয়।
পৃষ্ঠাঃ ৫৪০

ভারত-রাশিয়া সফর
১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের আহবানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় সফরে কলকাতা যান । কলকাতা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও লাখ লাখ জনতা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামী ভারতের সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও জনগণের সাহায্য ও সহযােগিতার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারত সরকার ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেয়। এত অল্প সময়ে কোনাে বিজয়ী সেনাবাহিনী দখলকৃত দেশ ত্যাগ করে না। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্ব ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিকতার কারণে। ১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত রাশিয়া গমন করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য তিনি সােভিয়েত সরকার ও জনগণের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানান।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং উভয় দেশের মধ্যে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তির কোনাে ধারা বাংলাদেশের স্বার্থবিরােধী ছিল না। বিরােধী দল বিশেষ করে বিএনপি চক্তির বিরােধিতা করত। কিন্তু ক্ষমতায় এসে বিএনপি চুক্তি বাতিল করেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে চুক্তি নবায়ন করেনি।
১৯৭২ সালের সংবিধান
দু’শ পঁচিশ বছরের পরাধীনতার পর লাখাে শহীদের রক্তে লেখা দলিলে বাঙালী জাতির প্রথম সংবিধান ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয়। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা- এ চারটি স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে রচিত হয় রক্তে লেখা সংবিধান। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচিত সকল এমএনএ ও এমপিএগণকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনকে সভাপতি করে ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট খসড়া সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে গণপরিষদ শাসনতন্ত্র পাস করে একই দিনে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের কথা ঘােষণা করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে গণপরিষদ বাতিল করে নতুন সংবিধান চালু করেন। শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল-
পৃষ্ঠাঃ ৫৪১

সংবিধানে ১১টি এবং ১৫৩টি অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত আছে। সংবিধানে ৪ টি মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র – শোষনহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ – জনগণ মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য খাদ্য, শিক্ষা আশ্রয়, বস্ত্র ও স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা প্রদান রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সংবিধানে নারী- পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ ও সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। নারী বা পুরুষ সমান অধিকার ভােগ করে।
সংবিধানে সর্বজনীন ভােটের অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র এবং এক কক্ষবিশিষ্ট বাংলাদেশের সংসদ। বাংলাদেশের সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার।
বাংলাদেশকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘােষণা করা হয় ।
সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন- বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।
সংসদীয় গণতন্ত্র- সর্বজনীন ভােটে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচিত হয়। এ ছাড়া মহিলাদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত আছে। পরে আসন সংখ্যা ৩০-এ উন্নীত করা হয়। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন নেতাকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী প্রধান এবং রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান। রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের ভােটে নির্বাচিত হন। তিনি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনা করে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিবছর পর সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৮ বছর বয়স্ক নারী-পুরুষ ভােট দিতে পারে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সংবিধানে অনেক মৌলিক পরিবর্তন করা হয়েছে। সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলে পরিচিত ছিল । কিন্তু জেনারেল জিয়া নাগরিকদের সংজ্ঞায় বাঙালীর পরিবর্তে বাংলাদেশী অন্তর্ভুক্ত করে শাসনতন্ত্রের মূলনীতি ও বাঙালীদের জাতীয় পরিচয় ও সংস্কৃতির মূলে কুঠারাঘাত করেন। সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদ সংশােধন করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ইসলাম ধর্ম এবং সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে সামাজিক ন্যায়বিচার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে বাংলাদেশকে একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদ ইসলামকে দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করেন। শাসনতন্ত্রের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে ধর্মভিত্তিক
পৃষ্ঠাঃ ৫৪২

রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরােধী ভূমিকার জন্য দলগুলোর রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আইনের সাহায্যে শাসনতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট ধারা বাতিল করে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী দলসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শাসনতান্ত্রিক অধিকার প্রদান করেন।
বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করা যাবে না- এ মর্মে প্রণীত ইনডেমনিটি আইন পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এভাবে ১৯৭২ সালে সংবিধানকে সামরিক সরকার পরিবর্তন করে পাকিস্তানী ভাবধারা প্রবর্তন করে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে বাঙালী ও বাংলাদেশী।
মন্ত্রিসভা নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে শপথ গ্রহণ করে। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের প্রতীক ছিল নৌকা। ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৫টি আসনে জয় লাভ করে।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নতুন সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের প্রতীক ছিল নৌকা। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৫টি আসনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার কাপাসিয়া-১৯০ ঢাকা-২০ আসন থেকে বিপুল ভােটে নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর্বে তাজউদ্দীনের আপন মামা, আওয়ামী লীগ নেতা ও সমাজকর্মী হেকিম মােল্লা নিহত হন দুষ্কৃতকারীদের হাতে। নির্বাচনের সময় তাজউদ্দীন কাপাসিয়া ডাকবাংলােতে এক রাত যাপন করেন। এসপি তাকে জিজ্ঞেস করেন। তার কি কাউকে সন্দেহ হয়। জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “আমার মামাকেই শুধু নয়, আরও অনেককেই জীবন উৎসর্গ করতে হতে পারে।
১৯৭৩
ঢাকা-২০ (কাপাসিয়া)
আওয়ামী লীগ প্রার্থী তাজউদ্দীন আহমদ- ৬২৭৬২
জাসদ- সুলতান উদ্দিন আহমদ – ৩৮৬৪
মােট ভােট – ১০৪৩৩৮
দেয় ভােট – ৬৬৬২৬
তিনি ভােট পেয়েছিলেন ৬২,৭৬২ ভােট এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছিল ৩৮৬৪ ভােট। এ নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদের মােট খরচ হয়েছিল ২৫০৯ টাকা । নিবাচনের এক মাসের মধ্যে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাচন কমিশনে দাখিল
পৃষ্ঠাঃ ৫৪৩

করেন। ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে ২১ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।
মন্ত্রিসভার সদস্যরা হলেন :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, সংস্থাপন, প্রতিরক্ষা, পরিকল্পনা
সৈয়দ নজরুল ইসলাম – শিল্প
তাজউদ্দীন আহমদ – অর্থ ও পাট
এম মনসুর আলী – যােগাযােগ
খন্দকার মােশতাক আহমদ – বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ
এএইচএম কামারুজ্জামান – বাণিজ্য
আবদুস সামাদ আজাদ – কৃষি
শেখ আব্দুল আজিজ – তথ্য ও বেতার
অধ্যাপক ইউসুফ আলী – শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া
জহুর আহমদ চৌধুরী – শ্রম ও সমাজকল্যাণ
ফণীভূষণ মজুমদার – খাদ্য
ড. কামাল হােসেন – পররাষ্ট্র
আব্দুল মালেক উকিল – স্বরাষ্ট্র
এম মতিউর রহমান – স্থানীয় সরকার, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন
মিজানুর রহমান চৌধুরী – ত্রাণ ও পুনর্বাসন
সােহরাব হােসেন – পূর্ত
আবদুল মান্নান – স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা
আবদুর রব সেরনিয়াবাত – ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার, বন, মৎস্য ও পশু পালন
জেনারেল মােঃ আতাউল গনি ওসমানী – নৌ পরিবহন, ডাক ও তার
ড. মফিজ চৌধুরী – বিজ্ঞান, কারিগরি ও আণবিক শক্তি
মনােরঞ্জন ধর – আইন ও সংসদবিষয়ক
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ ৭ জন শহীদ মুক্তিযােদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জনকে বীরউত্তম, ১৭৫ জনকে বীরবিক্রম, ৪২৬ জনকে বীরপ্রত্যক উপাধিতে ভূষিত করে। মন্ত্রিপরিষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিল করে ১৯৭৩ সালে নতুন আইন জারি করে।
ড. কুদরাত-এ খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন নিয়ােগ করা হয় এবং ১৯৭৫ সালে কমিশন রিপাের্ট দাখিল করে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৪৪

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন নিয়োগ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন ড. নুরুল ইসলাম এবং সদস্য ছিলেন ড. রেহমান সােবহান, ড. মোশাররফ হোসেন এবং আনিসুর রহমান। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ভিত্তিতে কমিশন ১৯৭৩-৭৮ সালের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা রচনা করে।
সিমলা চুক্তি ও বন্দী বিনিময়
১৯৭২ সালের ২৮ জুন হতে জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের সিমলায় এক বৈঠকে মিলিত হন এবং সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। চুক্তি অনুসারে পাকিস্তান ভারতের নিকট থেকে তার হারানাে ৬০০ বর্গমাইল ভূমি ফেরত পায়।
১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা ঘােষণা করা হয় এবং বিচারের জন্য সংসদে International Crimes (Tribunal) Bill পাস করা হয়। ১৯৭৩ সালের ১৬ এপ্রিল এক যুক্ত স্বাক্ষরে পাকিস্তানের নিকট প্রস্তাব পেশ করা হয়, চুক্তিতে ছিল ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীসহ বিহারী নাগরিকদের ফেরত পাঠাবে এবং অপরদিকে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফেরত পাঠাবে। ১৯৭৩ সালের ১৯ এপ্রিল হতে ব্যাপক প্রত্যাবাসন শুরু হয় এবং ১৯৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত চলে।
সংবিধানের প্রথম সংশােধনী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আইন
১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদ সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ সংশােধনী করে এবং মৌলিক অধিকারের ৩৫ ও ৪৪ ধারা প্রদত্ত অধিকার যুদ্ধাপরাধীদের জন্য প্রযােজ্য হবে না এবং তারা আটক আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আদালতের আশ্রয় নিতে পারবে না।
সংবিধানের দ্বিতীয় সংশােধনী ও জরুরী অবস্থা ঘােষণা
১৯৭২ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির বিশেষ জরুরী আইন ঘােষণার ক্ষমতা ছিল না। ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংবিধানের ২৫ ও ৩৩ ধারা সংশােধন করে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘােষণার ক্ষমতা প্রদান করা হয়।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু চীনের ভেটোর কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত হয়। অবশেষে ১৯৭৪ সালের
পৃষ্ঠাঃ ৫৪৫

১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন।৫
বিরােধী দলের ভূমিকা
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের যুব শক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে। তারা ছাত্র, যুবক ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংগঠিত হতে থাকে। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি হত্যা, ব্যাংক ডাকাতি শুরু করে। মওলানা ভাসানী ভারতবিরােধী রাজনীতি অনুসরণ করেন। সরকার রক্ষীবাহিনী গঠন করে সন্ত্রাস ও বিরােধী দল দমন করে। সরকারের বিরােধী দলের সাথে সংঘর্ষে না যেয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা উচিত ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ
দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। বন্যার কারণে ১৯৭৪ সালে ফসল ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং প্রায় ৪০ হাজার লােক না খেয়ে মৃত্যুবরণ করে।
জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সরকার ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলগুলাে নিয়ে দেশ পরিচালনা করতেন তাহলে তিনি অনেক ক্ষেত্রে সফল হতেন। সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মুজিবনগরে গঠিত জাতীয় সমন্বয় পরিষদকে নিয়ে দেশ শাসন করতেন তাহলে পরবর্তী ইতিহাস অন্যরকম হতাে।
বাকশাল গঠন ১৯৭৫
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকার গঠন না করে জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত ছিল। আওয়ামী লীগ দেশ শাসনে অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়নি। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দারিদ্র্য দেশের অগ্রগতি ব্যাহত করে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি শাসনতন্ত্রের চতুর্থ সংশােধনী করে গণতন্ত্রের
৫৪৬

পরিবর্তে একদলীয় শাসন ও রাষ্ট্রপতির সরকার প্রতিষ্ঠা করেন ।
বঙ্গবন্ধু বাকশাল কমিটি গঠন করেন এবং মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করে ৬১ জন গভর্নর নিয়ােগ করেন।
বাকশাল থেকে তাজউদ্দীন আহমদকে দূরে রাখা হলাে
তাজউদ্দীন আহমদ তার সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য খ্যাত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করেছিলেন। কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়া হয়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব তার নিকট ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদকে বাকশালের কোনাে পদে রাখা হয়নি। তিনি বাকশাল গঠনের সাথে একমত ছিলেন না। তিনি বাকশাল গঠনকে সময়ােচিত মনে করতেন না।
তাজউদ্দীন আহমদকে বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়ােগের প্রস্তাব
রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদকে তার বিশেষ সহকারী বা উপদেষ্টা করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির তৎকালীন এপিএস জেড আর ইকবাল লেখককে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু তাকে তাজউদ্দীন আহমদের জন্য বঙ্গবন্ধুর কক্ষের পাশের কক্ষে বসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হঠাৎ তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ােগ দান থেকে বিরত থাকেন। আওয়ামী যুবলীগের কয়েকজন নেতার চাপের মুখে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে বিশেষ উপদেষ্টা বা সহকারী পদে নিয়ােগ দেননি।
যুবনেতাদের কারণে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। দেশ ও জাতি তাজউদ্দীন আহমদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৪৭

২৩
তাজউদ্দীন আহমদের অর্থ ও পরিকল্পনা
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ
বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনর্গঠন
১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। তিনি পরিকল্পনা ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।
১২ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গভবনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ আমি সবচেয়ে বেশি সুখী লােক। আমি পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র চেয়েছিলাম, নেতা তা গ্রহণ করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৭০ দিন এ দায়িত্ব পালন করেন এবং গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করেন।
১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি কলকাতায় ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে যােগদানের জন্য অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে বলেন, “সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘকাল সংগ্রাম পরিচালনাকারী চীনা জনগণ এখন আমাদের সাফল্যজনক সংস্কারের বাস্তবতাকে স্বীকার করেন।” তিনি আশা প্রকাশ করেন।
২৭ জানুয়ারি ১৯৭২ তাজউদ্দীন আহমদ নয়াদিল্লীতে ঈদের নামাজ পড়েন। একই সাথে ভারতের কৃষিমন্ত্রী ফখরুদ্দিন আলী আহমদ ও শিল্প উন্নয়নমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী একই সাথে ঈদের নামাজ পড়েন। জনগণ তাজউদ্দীন আহমদকে জয় বাংলা, ইন্দিরা-মুজিব জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে স্বাগত জানায়। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন।
২৮ জানুয়ারি ১৯৭২ এক সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী বলেন, খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য আগামী ৫ মাসের মধ্যে ৫ লাখ টন খাদ্যশস্য আসবে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৪৮

গভর্নর হাউজে বাঙালী অফিসারদের হত্যার ষড়যন্ত্র
১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরীজ হাইস্কুলে আয়ােজিত এক সভায় তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, মুক্তি সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শাসকগােষ্ঠীর এই ষড়যন্ত্র ঢাকা পতনের আর একদিন বিলম্ব হলেই আমরা কোন বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক ব্যক্তি কে জীবিত পেতাম না। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৪ ডিসেম্বর আমি খবর পাই যে, ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় গভর্নর হাউজে বাঙ্গালী অফিসারদের এক সভা ডেকে সকলকেই হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তখনই আমি মিত্রবাহিনী কে অনুরােধ করি গভর্নর ভবনে বােমা বর্ষণ করে এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বানচাল করে দিতে। ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে গভর্নর ভবনে তাবেদার গভর্নর মালেকের মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক চলাকালে মিত্রবাহিনী সাহস ও বীরত্বের সাথে সেই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বানচাল করে দেয়।১
উল্লেখ্য, দখলদার বাহিনী সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুলের তিনজন শিক্ষক এবং দু’জন ছাত্রকে হত্যা করে। তাদের স্মরণে শােক সভা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ এই স্কুল হতে ১৯৪৪ সালে মেট্রিক পাস করেন।
১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সামরিক বিমান দুর্ঘটনা। বৈমানিকের মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলাে।
তাজউদ্দীন আহমদ তার শােক বাণীতে বলেন, “…তাদের অকাল মৃত্যুতে আমাদের নতুন রাষ্ট্রে অপূরণীয় ক্ষতি হলাে। আজ ঢাকা বিমানবন্দরে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় আমাদের ৫ জন বৈমানিকের অকাল মৃত্যুতে নতুন রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হলাে তা পূরণ হবার নয়। আমি নিহতদের পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সহানুভূতি জানাচ্ছি এবং নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।”
১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মন্ত্রীরা দলীয় পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
১০ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশ আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি পরিষদের সভায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এদেশের মানুষ কোনাে যুদ্ধজোটে যােগদানের বিরােধী।
২২ মার্চ ১৯৭২ তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনকালে বলেন, দালালদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দেয়া হবে।
২ এপ্রিল ১৯৭২
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রই চালু হবে, অন্য কিছু নয়
ঢাকা কারিগরি মিলনায়তনে সফররত ভিয়েতনামী শান্তি প্রতিনিধি দলের সংবর্ধনা
পৃষ্ঠাঃ ৫৪৯

সভায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়ােজন জাতীয় ঐক্য। অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা শোষনহীন সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েমে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।২
৭-৮ এপ্রিল ১৯৭২
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদের রিপোর্ট : ৩
ঢাকা, ৭-৮ এপ্রিল, ১৯৭২
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন, ১৯৭২ সাল
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
তাজউদ্দীন আহমদের রিপাের্ট
শ্রদ্ধেয় সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পরিষদের
সদস্য ও প্রতিনিধিবৃন্দ
স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্ত পরিবেশের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এই প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে আজ সর্বাগ্রে স্মরণ করি সেই অগণিত শহীদদের, যাদের চরম আত্মত্যাগে ফলে আজ আমরা স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করতে পেরেছি। সশস্ত্র বাহিনী ও গণবাহিনীর শহীদ সদস্যদের পাশাপাশি আজ স্মরণ করি জনাব মসিউর রহমান, আমজাদ হোসেন আমিনউদ্দিন আহমদ, ডাঃ জিকরুল হক, মাসুদুল হক চৌধুরী, মিলি চৌধরী ও আলাউদ্দিনের মতাে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদেরকে, যারা বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হয়েছেন। এই সঙ্গে স্মরণ করি জনাব আবদুর রবকে, স্বাধীনতার পরে এক দুর্ঘটনায় যাকে আমরা হারিয়েছি। এইসব আত্মত্যাগী পুরুষের অমলিন আদর্শ আওয়ামী লীগের কর্মীদেরকে চিরকাল দেশহিব্রতে অনুপ্রাণিত করবে।
১৯৭০ সালের জুন মাসের ৩ থেকে ৫ তারিখে যখন আমাদের বিগত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তখন আমাদের পশ্চাতে ছিল ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের ঐতিহ্যপূর্ণ স্মৃতি এবং সামনে ছিল দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। গত অধিবেশনে আমরা সেই সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একদিকে ৬ দফাভিত্তিক শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাবকে সামনে রেখে এবং অন্যদিকে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়ে। ইতিহাসের ধারায় আজ আমাদের তখনকার অনেক চিন্তা-ভাবনা ও ভয়-ভীতি সম্পূর্ণ অবান্তর হয়ে গেছে। আবার তখনকার
পৃষ্ঠাঃ ৫৫০

অনেক পরিকল্পনা আজ নতুন তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে দেখা দিয়েছে। আজ আমার রিপোর্ট ওই কাউন্সিল সভার পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের একটা বিবরণ দেওয়া কর্তব্য।
আওয়ামী লীগের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের যে সুদীর্ঘ ঐতিহ্য তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমরা বলেছিলাম, এই নির্বাচন হবে ৬ দফা সম্পর্কে একটা গণভােট। এই ঘোষণায় সামরিক চক্র কায়েমী স্বার্থবাদীরা এবং প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো ভয় পেয়েছিল। এইসব রাজনৈতিক দল জনসমর্থন ও নির্বাচনী প্রস্তুতির অভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দেবার দাবি জানিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, বাংলাদেশে বন্যা হবে এবং তার ফলে নির্বাচন হতে পারবে না। ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে দেশে যখন বন্যার সূচনা হয়, তখন এই দাবি জোরদার হলাে। আওয়ামী লীগ এই দাবি সমর্থন করেনি। কারণ, আমাদের এই আশঙ্কাও ছিল যে, কায়েমী স্বার্থবাদীরা কােন না কোন ছলে হয়তাে নির্বাচন এড়িয়ে যেতে চাইবে। সুতরাং রাজনৈতিক দলগুলাে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বললে তারা সেই সুযােগ লুফে নেবে। বন্যার পরে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলসমূহ সেই সুযোগের সৃষ্টি করল এবং ইয়াহিয়া খান তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নির্বাচন পিছিয়ে দিলেন ডিসেম্বরে।
নভেম্বর মাসে দেখা দিল ইতিহাসের সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের দশ লক্ষাধিক মানুষ সে দুর্যোগে প্রাণ দিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট চীন সফর শেষে ঢাকা হয়ে ইসলামাবাদে ফিরে গেলেন- অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর এই মর্মান্তিক দুরবস্থা সচক্ষে দেখার সময় করতে পারলেন না। পৃথিবীর দূর দেশ থেকে সাহায্য সামগ্রী এবং ত্রাণ বিতরণের জন্য হেলিকপ্টার এসে পৌছাল- অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টার বসে রইল, ইয়াহিয়ার মনােনীত প্রাদেশিক গভর্নরও তা চেয়ে পেলেন না। বাংলাদেশের মানুষের এই মরণ যন্ত্রণার মূহুর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের মর্মান্তিক ঔদাসীন্যে দেশবাসীর কাছে সরকারী বৈষম্য নীতির স্বরূপ নতুন করে উদঘাটিত হলাে। যে মােহ বহুদিন আগে থেকেই ভাঙতে শুরু হয়েছিল, এবারে তার আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
আবারাে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব উঠল, কিন্তু গণসমর্থনহীন দলগুলাের এই দাবির সুযােগ নিতে এবারে আর ইয়াহিয়া খান সাহস করলেন না। ডিসেম্বর মাসের ৭ ও ১৭ তারিখে শান্তিপূর্ণভাবে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলাে। বাতাবিধ্বস্ত অঞ্চলে নির্বাচন হলাে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারিতে হলাে জাতীয় পরিষদের উপনির্বাচন। এইসব নির্বাচনে ইয়াহিয়া
পৃষ্ঠাঃ ৫৫১

খান নিজেই যাকে অবাধ ও নিরপেক্ষ বলে বর্ণনা করেছিলেন – আওয়ামী লীগের বিজয় পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক বিস্ময়কর অধ্যায় রচনা করল।
আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের পরে দেশবাসী শেষবারের মতো আশা করলো যে কায়েমী স্বার্থবাদীদের খেলা এবার শেষ হবে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ঔপনিবেশিকতাবাদী মনোবৃত্তি পরিত্যাগ করে নির্বাচনের রায় মেনে নেবেন, ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে। জানুয়ারি মাসের মধ্যভাগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘পাকিস্তানের ভাবি প্রধানমন্ত্রী বলে আখ্যা দিলে জনমনে সে আশা দৃঢ়তর হয়।
জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক এবং পিপলস পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ৬ দফাভিত্তিক সংবিধান রচনা সম্পর্কে আলোচনা হয়। সংবিধান আলােচনায় উত্থাপিত হয়নি, বরং তারা শুধু ৬ দফার তাৎপর্য সম্পর্কে অবহিত হতে চেয়েছিলেন। অন্যপক্ষে সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৬ দফা সমর্থন করেছিলেন। ভোট চেয়েছিলেন পরিষদের বাইরে আগে সংবিধানের প্রশ্নে মীমাংসা হয়ে যাক, আর আমরা চেয়েছিলাম, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেই সংবিধান রচনার কাজে অগ্রসর হওয়া, প্রয়ােজনীয় আলাপ আলােচনা পরিষদ চলাকালেই হতে পারত।
এরই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৫ ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টকে অনুরােধ করেন। প্রেসিডেন্ট যখন সে দাবি উপেক্ষা করে ভুট্টোর পরামর্শ অনুযায়ী ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেন, তখন আমরা ক্ষুন্ন হলেও সে তারিখ মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ভুট্টো আকস্মিকভাবে পরিষদ বর্জনের হুমকি দিলেন। ভুট্টোর হুমকি এবং তারপক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল উমরের সক্রিয় কার্যকলাপ সত্ত্বেও, পিপলস পার্টি ও কাইয়ুম মুসলিম লীগের সদস্য ব্যতীত জাতীয় পরিষদের সকল পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যই হয় ঢাকার এসে গিয়েছিলেন নয়তাে নির্ধারিত সময়ে ঢাকায় আসবার জন্য টিকিট করেছিলেন। এমনকি কাইয়ুম লীগ ও পিপলস পার্টির বহু সদস্যই যথাসময়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভুট্টোর প্রতিরােধ ভেঙ্গে পড়তে পারে, এই ভয়েই ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রাখার ঘােষণা করেন।
সেই সময়ে সংবিধানের খসড়া রচনার কাজে আওয়ামী লীগ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ৩০ জন সদস্যবিশিষ্ট খসড়া প্রণয়ন কমিটি প্রভূত পরিশ্রম করেই কাজ করেছিল এবং ১ মার্চে পূর্বাণী হােটেলে কমিটি মিলিত হয়েছিল এ
পৃষ্ঠাঃ ৫৫২

বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। ঠিক সেই সময়েই প্রেসিডেন্টের ঘোষণার কথা আমরা জানতে পারি।
এই ঘােষণায় সারা বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় ও ধর্মঘট পালিত হয়। বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ তখন থেকেই স্বাধীনতার কথা ভাবতে আরম্ভ করে। বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তারখে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘটের আহ্বান জানান। কিন্তু সামরিকচক্র শান্তিভঙ্গের সকল ব্যবস্থা পরিপূর্ণ রূপে গ্রহণ করে। গভর্নরের পদ থেকে ভাইস অ্যাডমিরাল আহসানকে অপসারিত করা হয় এবং ২ ও ৩ মার্চ নিরস্ত্র জনতার উপর সামরিক বাহিনী গুলি বর্ষণ করে । ছাত্রলীগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহুত ঢাকার জনসভায় ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করেন।
এর পরবর্তী ঘটনা আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। এ রকম পরিপূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। শুধু যে সর্বশ্রেণীর মানুষ অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়েছিল তা নয়; প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধৱ নেতৃত্ব মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্দেশে দেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাকে সচল করে রেখেছিল। বিভিন্ন সময়ে মানুষ আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল পরামর্শ নেয়ার জন্য এবং পরামর্শ দেয়ার জন্য। বস্তুত আওয়ামী লীগই সে সময়ে একমাত্র বৈধ সরকার হিসেবে দেশের কর্ম-পরিচালনা করেছিল। সামরিক বাহিনীর দমন নীতি ও উত্তেজনা সৃষ্টির সকল প্রয়াস সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষ আশ্চর্য ঐক্য ও শৃঙ্খলার পরিচয় দিয়েছিল। এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধের মুখে ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চের বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগের প্রতি সকল দোষ আরােপ করেন এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের কথা ঘােষণা করেন। একই দিনে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুবকে অপসারণ করে কুখ্যাত টিক্কা খানকে গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতিদের অসহযােগের ফলে তিনি গভর্নর হিসেবে শপথ নিতে পারেননি।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য চারটি পূর্বশর্ত আরােপ করেন। তিনি ঘােষণা করেন : এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি দেশবাসীকে সেই বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সর্বত্র আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশবাসী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। অন্যদিকে ১ মার্চ থেকে অবাঙালী সামরিক অফিসারদের ও পশ্চিম
পৃষ্ঠাঃ ৫৫৩

পাকিস্তানী ধনীদের পরিবার-পরিজন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে এবং সামরিক ও বেসামরিক বিমানে সামরিক বাহিনীর লোকজন অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র বাংলাদেশে আমদানি করা হতে থাকে । এই পরিস্থিতিতে আপোষ – আলোচনার ছল করে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে পৌঁছেন। পরে তার আমন্ত্রণ ক্রমে ভুট্টো ও ঢাকায় আগমন করেন।
১৬ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় এই আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে বঙ্গবন্ধু এককভাবে ইয়াহিয়ার সঙ্গে মিলিত হন। দ্বিতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের উচ্চতম পর্যায়ের পাঁচজন নেতাসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া পক্ষের আলোচনা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিনজন বিশেষজ্ঞ কেন্দ্রীয় সরকারের তিনজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্টনের বিষয় আলাপ করেন। এসব আলােচনার ফলে যে সব বিষয়ে মতৈক্য স্থাপিত হয় তা হলাে :
১. ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের অনুসরনে প্রেসিডেন্টের ঘােষণাবলে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে নিয়ে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করা হবে।
২. জেনারেল ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকবেন ও কেন্দ্রীয় সরকার তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
৩. প্রদেশসমূহে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে ।
৪. জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যেরা প্রথমে পৃথকভাবে মিলিত হবেন, পরে পরিষদের পূর্ণ অর্থাৎ যুক্ত অধিবেশনে সংবিধানের চূড়ান্ত রূপদান করা হবে।
এই মতৈক্যের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত রূপদানের পথে আর কোন বাধা ছিল না। তাই ২৪ মার্চ সাংবাদিকদেরকে আমি বলেছিলাম যে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর আলােচনার মতাে কোন বিষয় নেই।
ইতােমধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের অনেকগুলাে ঘটনা ঘটে। জয়দেবপুরে ঘটনায় বহু ব্যক্তি হতাহত হয়। সরকারের বর্বর দমন নীতি সত্ত্বেও দেশবাসীর মনােবল অটুট থাকে এবং স্বাধীনতার দাবি প্রবলতর হাতে থাকে। এক্ষেত্রে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে বলিষ্ঠ। উন্নয়নশীল দেশমাত্রেই ছাত্র সমাজে রাজনৈতিক চেতনার ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশেও তার অন্যথা হয়নি। ইয়াহিয়ারসঙ্গে আলােচনার ফলাফল সম্পর্কে তারা প্রকাশ্যেই সন্দেহ প্রকাশ করে এবং স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিতে থাকে। ২৩ মার্চ তারিখে ছাত্র
পৃষ্ঠাঃ ৫৫৪

সংগ্রাম পরিষদ সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ইয়াহিয়া খানিক সময় প্রস্তুতি আমাদেরও অগোচর ছিল না। কিছু দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে যে গুরু দায়িত্ব আমাদের উপর অর্পিত হয়েছিল, তার ফলে আওয়ামী লীগকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়েছিল। সামরিক চক্র এই অবস্থায় নতুন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করে । চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বাঙালি কমান্ডিং অফিসারকে অপসারণ করে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক অফিসারকে তার দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় এবং সেইদিন সন্ধ্যায় ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে জোর করে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের কাজ শুরু হয়। অসহযােগ আন্দোলনের পূর্বঘােষিত নীতি অনুযায়ী নিরস্ত্র জনসাধারণের অস্ত্রশস্ত্র পরিবহনের পথ রোধ করলে সামরিক বাহিনী তাদের উপর ক্রমাগত গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে অসংখ্য লােক হতাহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২৭ মার্চ তারিখে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানায় ।
২৫ মার্চ তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান রচনার জন্য সরকারপক্ষ ও আমাদের মধ্যে চূড়ান্ত অধিবেশন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বিশ্বাসঘাতকতার এক অতুলনীয় ইতিহাস রচনা করে, কাউকে কিছু না জানিয়ে, আলােচনার সমাপ্তি ঘোষণা না করে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাতের বেলায় ঢাকা ত্যাগ করেন। তার পরেই পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী টিক্কা খানের ঘাতক সেনারা মধ্যরাতে ঢাকা শহরের বুকে হত্যার তাণ্ডবে মেতে ওঠে। তারই মধ্যে তারা গ্রেফতার করে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ২৬ মার্চ রাতের ভাষণে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘােষণা করেন।
কুর্মিটোলায় সেনানিবাসে, পিলখানায় ইপিআর সদর দফতরে ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে সশস্ত্র বাঙালীরা অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে আমৃত্যু যুদ্ধ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তি এলাকায় এবং সাধঅরণ মানুষের উপর বর্বর পাকসেনারা যখন ঝাপিয়ে পড়ে তখন তা প্রতিরােধ করার শক্তি ছিল না নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীদের। আওয়ামী লীগ নেতবৃন্দের পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রামে রত মেজর জিয়াউর রহমান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেন এবং বাংলাদেশ গণহত্যা রােধ করতে সারা পৃথিবীর সাহায্য কামনা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার কথা জানতে পেরে বাংলার মানুষ এক দুর্জয় প্রাতরােধ আন্দোলন গড়ে তুলল। সারা বাংলাদেশ সামরিক, আধা সামরিক ও বেসামরিক কর্মীরা অপূর্ব দক্ষতা, অপরিসীম সাহসিকতা ও অতুলনীয় ত্যাগের মনােভাব নিয়ে মাতভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে অগ্রসর হন। মাত্র তিন দিনে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ করতলগত করার যে পরিকল্পনা সামরিক সরকার করেছিল,
পৃষ্ঠাঃ ৫৫৫

প্রাণের বিনিময়ে বাংলার মানুষ তাকে সর্বাংশে ব্যর্থ করে দেয়।
১১ এপ্রিল তারিখে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের ঘােষণা প্রচার করি। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, আমাকে প্রধানমন্ত্রী এবং জনাব মনসুর আলি, খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও জনাব এএইচএম কামরুজ্জামানকে সদস্য হিসেবে নিয়ে মন্ত্রিমসভা গঠিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে বিভিন্ন সামরিক অফিসারকে এক এক অঞ্চলের ভার দেয়া হয়। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের ভার দেওয়া হয় মেজর (এখন কর্নেল) খালেদ মোশাররফকে। চট্টগ্রাম ও নােয়াখালী অঞ্চলের ভার মেজর (এখন কর্নেল) জিয়াউর রহমানকে, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের ভার মেজর (এখন কর্নেল) শফি উল্লাকে, কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চলের ভার মেজর ওসমানকে, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলের ভার মেজর জলিলকে, রাজশাহীর ভার মেজর আহমদকে, সৈয়দপুরের ভার মেজর নজরুল হককে ও রংপুরের ভার দেয়া হয় মেজর নওয়াজেশকে। ১৮ এপ্রিল সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিয়ােগ করা হয় জাতীয় পরিষদ সদস্য কর্নেল (এখন জেনারেল) এমএজি ওসমানীকে। ইতােমধ্যে বেসামরিক তরুণদের মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করে তাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও চূড়ান্ত করা হয়।
মন্ত্রিসভা গঠনের পর আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং আমাদের সগ্রামকে সমর্থন দানের জন্য পত্র প্রেরণ করি। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর বহু দেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে এই সম্মেলনে ঘােষণাপত্র প্রচারিত হয়। এই সম্মেলনের ফলে বিদেশী সাংবাদিকরা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বাস্তব ভিত্তির সঙ্গে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পাঠিয়ে সেইসব দেশের সরকার ও জনসাধারণের কাছে বাংলাদেশের বাস্তব সত্যকে তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনে কথা। এই সম্মেলনের প্রতিনিধিরা সর্বপ্রথম প্রকৃত পরিস্থিতি অবগত হন এবং এই সম্মেলনেই বাংলাদেশকে শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। জাতিসংঘেও অনুরূপ একটি প্রতিনিধিদল প্রেরিত হয় । প্রবাসী বাঙালীরাও বিদেশে খুব উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। সেখানে জনমত সৃষ্টি ও অর্থসংগ্রহ করে তারা বাংলাদেশের সংগ্রামকে শক্তিশালী করে তােলেন।
পৃষ্ঠাঃ ৫৫৬

আমাদের আহবানে বহুসংখ্যক সরকারী কর্মচারী অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে মুজিবনগরে গিয়ে পৌছেন। এদের মধ্যে অনেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে যোগদান করেন, কিন্তু আমাদের স্বল্প-সামর্থ্যের জন্য অনেককে চাকরি দেয়া সম্ভব হয়নি। অনেকে আবার চাকরি না করে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন।
দেশে মুক্তিসংগ্রামের শক্তি বৃদ্ধি হয় দ্রুতগতিতে এবং দৃঢ়ভাবে। কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত তরুণ ও ছাত্রসমাজ যে বিপুলসংখ্যায় এবং আত্মত্যাগের যে মনোভাব নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে, তা যে কোন জাতির মুক্তিসংগ্রামের পক্ষেই আদর্শ স্থানীয়। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানসমূহ, বিশেষত ছাত্রলীগ এবং শ্রমিক সংগঠন সমূহ বিশেষত শ্রমিক লীগের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযোদ্ধারা কেউই ব্যক্তিগতভাবে অসুবিধাকে গ্রাহ্য করেনি। আমি ও আমার সহকর্মীরা যখনই রণাঙ্গনে গিয়েছি, তখনই তাদের দৃঢ় প্রত্যয় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। হাসপাতলে আহত মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের কষ্টের কথা বলেনি, তাড়াতাড়ি যেন আবার যুদ্ধে যােগদানের অনুমতি পেতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে বলেছে। যারা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেননি, তারাও মুক্তিযােদ্ধাদের সর্বপ্রকার সক্রিয় সাহায্য করেছেন। অধিকৃত এলাকায় যারা বসবাস করতেন, তারাও চরম ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করেছেন নানাভাবে । জনসাধারণের মনােবল বৃদ্ধিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একটা বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল।
মে মাসে এই বেতার কেন্দ্রের জন্য একটা শক্তিশালী প্রেরণ যন্ত্র সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয়েছিল। এই বেতার কেন্দ্র সংগঠনে জনাব আবদুল মান্নানের অবদানের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়।
বাংলার এই প্রতিরােধের মুখে ইয়াহিয়া-চক্র তাদের কৌশল পাল্টে ফেলে । কুখ্যাত টিক্কা খানের বদলে একজন সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদকে তারা গভর্নর পদে নিয়ােগ করেন এবং বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ছল করতে চায়। বিশ্বমতকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সদস্যপদ বাতিল করে তারা তথাকথিত উপনির্বাচনের মাধ্যমে বশংবদ ব্যক্তিদেরকে নির্বাচিত করে। প্রদেশে একটি তাবেদার মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। বেসামরিক কর্তৃত্বে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার ভাওতা দিয়ে প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সংবিধান ঘােষণার জন্য ২৭ ডিসেম্বর তারিখ ধার্য করা হয় এবং বলা হয় যে, ডিসেম্বরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে। কিন্তু এই প্রয়াস যে কত শূন্যগর্ভ ছিল তার প্রমাণ তারাই দিয়েছে পদে পদে। অন্য পক্ষে মুক্তিযােদ্ধা।
ও সশস্ত্র বাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম, হয়, তাদের গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণে ঢাকায় এবং অন্যত্র পাকিস্তানী হানাদারদের মনােবল সম্পূর্ণ
পৃষ্ঠাঃ ৫৫৭

ভেঙ্গে পড়ে। এই হৃত মনােবল সৈন্যরাই পরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হয়ে বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে।
মুক্তিসংগ্রামের কালে আমাদের রাজনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হলে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘােষণা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, কমরেড মণি সিংহ ও ভবেশচন্দ্র নন্দী। হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার উদ্দেশ্যে ব্যাপক জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার জন্য ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকারের এক পরামর্শদাতা কমিটি গঠন করা হয়। ভবেশ নন্দী ছাড়া পূর্বোক্ত নেতারা এই কমিটির সদস্য ছিলেন; কংগ্রেসের পক্ষ থেকে কমিটিতে থাকেন মনোরঞ্জন ধর। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্তিসংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে এই কমিটির অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এবং দেশপ্রেমিক দলগুলাের মধ্যে সহযােগিতার এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়।
আওয়ামী লীগের নিজস্ব উদ্যোগের মধ্যে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা প্রকাশ খুব উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এই পত্রিকা জনমনে তুমুল সাড়া জাগিয়েছিল।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশের কথা ও এখানে বলা যেতে পারে। জুলাই মাসের ৫ ও ৬ তারিখে আওয়ামী লীগের কার্যকরী সমিতির সভা ও আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উভয় সভাতেই মুক্তিসংগ্রামের কর্মসূচি সমর্থন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করা হয়। আমাদের সাংগঠনিক গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মন্ত্রিসভার সদস্যদের দলীয় কর্মকর্তার পদ ত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু কার্যকরী সমিতি দেশের সঙ্কটজনক অবস্থায় এই বিধির ব্যতিক্রম করে আমাদেরকে সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করে যেতে অনুরােধ করে। ২০-২১ ও ২৭-২৮ অক্টোবরে আবার আওয়ামী লীগের কার্যকরী সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় আমরা মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পরিকল্পনার আভাস দান করি এবং এই সভা তা সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করে।
এইখানে আমি আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সদস্যদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। এ কথা সুবিদিত যে, ২৫ মার্চের রাত থেকে ইয়াহিয়া খানের রক্তলােলুপ সৈন্যরা আওয়ামী লীগের সকল শ্রেণীর কর্মীকে হন্যের মতাে খুঁজে বেড়িয়েছে, তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করেছে, তাদের পরিবার-পরিজনকে অত্যাচার ও সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত করেছে। দখলদার সেনাদের এই অভিযানে শহীদ কয়েকজন
পৃষ্ঠাঃ ৫৫৮

বিশিষ্ট আওয়ামীলীগ নেতা ও কর্মীর কথা আগে বলেছি; আরও অনেকে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হয়েছেন । এ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ কর্মী, নেতা ও পরিষদ সদস্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েনি। নিজেদের জীবন বিপন্ন করেও তারা মুক্তিসংগ্রামের প্রত্যেকটি পর্যায়ে জনসাধারণ ও সরকারের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করে নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করেছেন। এরা প্রত্যেকেই ছিলেন অপরাজেয় শক্তির উৎস স্বরূপ বেসামরিক প্রশাসনের জন্য সারা বাংলাদেশকে ১১টি অঞ্চলে যখন ভাগ করা হয় তখন এইসব কর্মী ও সদস্যরা আঞ্চলিক কমিটির সদস্য হিসেবে সরকারি কর্মচারীদের মাধ্যমে বিভিন্ন মুক্তাঞ্চলে প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছেন। মুক্তিসংগ্রামের কালে তাদের জন্যই আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক প্রসার ঘটেছে এবং শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে। শুধু মুষ্টিমেয় সদস্য জাতির সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে হানাদার পক্ষে যোগ দেয়। আজ তারা জাতির কাছে অপরাধী হিসেবে বিচার অপেক্ষা করছে।
মুক্তিসংগ্রামের কালে আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতার জন্য বিশেষভাবে আমাদের অস্থায়ী সভাপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামের অবদান স্মরণীয় । আমাদের সহসভাপতি জনাব মনসুর আলী ও জনাব খন্দকার মােশতাক আহমদ, সাবেক নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এএইচএম কামরুজ্জামান এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা যে নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা উল্লেখযােগ্য।
এ সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধের সকল স্তরে আমরা সব সময়ে যার অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি তিনি আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আমরা পৃথিবীর সকল দেশের সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি এবং বিভিন্ন দেশে জনমত গঠনের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করেছি। ইয়াহিয়া খান তার বিচারের স্পর্ধা প্রকাশ করলে বাংলার মানুষ প্রতিবাদে গর্জন করে ওঠে। সরকারের পক্ষ থেকে তার বিচার-প্রহসনের প্রতিবাদে যেমন বিবৃতি, প্রচারপত্র ও পােস্টার প্রচারিত হয়, তেমনি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিবৃতি, প্রচারপত্র ও পােস্টার ছাড়াও জনসভা এবং বিভিন্ন দূতাবাসে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রতিবাদলিপি প্রেরিত হয়। তবে একথা আমাদেরকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে যে, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সবচেয়ে সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন।
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের কঠিন সময়ে আমরা সবচেয়ে বেশি সাহায্য লাভ করেছি ভারত থেকে। এক কোটি শরণার্থীর অন্ন ও আবাসের সংস্থান করে ভারত আমাদেরকে গভীর কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছে। তারচেয়েও বড় কথা, শ্ৰীমতী
পৃষ্ঠাঃ ৫৫৯

ইন্দিরা গান্ধী ও তার সরকার যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যেভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নৈতিক ও উপকরণগত সাহায্য যুগিয়েছেন তার তুলনা হয় না। এই জন্যই পাকিস্তান সমরনায়কদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ভারতের উপর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলিতভাবে রক্ত দান করে বীর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাত্র বারাে দিনের যুদ্ধে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে। তার আগেই ভারত সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
বাংলাদেশ গণহত্যা বন্ধের জন্য এবং বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধানের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন ২ এপ্রিলেই পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। ৯ আগস্ট ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পরে বাংলাদেশের বিষয়ে সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে সােভিয়েত ইউনিয়নই সর্বাগ্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন।
জার্মানি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, পােল্যান্ড ও চেকোস্লোভাকিয়া প্রভৃতি সমাজতন্ত্রী দেশ জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কানাডা, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের ভূমিকাও আমাদের অনুকূলে ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে আমাদেরকে নিরাশ করে। আর দুর্ভাগ্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন হানাদার পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে সমর্থন করে এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সসর্বশেষ স্তরে জাতিসংঘে চীনের কার্যকলাপ এবং বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর প্রেরণ- এই দুই দেশের মুক্তিসংগ্রাম বিরােধী ভূমিকার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি।
তবে সরকারী মতামত নির্বিশেষে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের সংবাদপত্র ও অপরাপর প্রচার মাধ্যমের ভূমিকা বাংলাদেশের সংগ্রামের অনুকূল ছিল। এসব দেশের বুদ্ধিজীবী, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষও আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সমর্থন করেছিলেন।
সারা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষের সেই শুভেচ্ছাকে সার্থক করে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বরে । কিন্তু এর পূর্ব মুহূর্তে সামরিক চক্রের সাহায্যকারী ফ্যাসিস্ট বদর বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হন বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা। স্বাধীনতার পরে সামরিক চক্রের সহযােগীরা নানাভাবে লােক হত্যা।ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে রত থাকে। ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সদস্যরা ঢাকায় এসে পৌঁছেন এবং নতুন করে প্রশাসন পরিচালনার কাজে আত্মনিয়ােগ
পৃষ্ঠাঃ ৫৬০

করেন। এরপরের মন্ত্রিসভাও সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু তখনও আমাদের আরব্ধ। কাজ সমাপ্ত হয়নি- বঙ্গবন্ধু তখনও শত্রুর কারাগারে বন্দী ।
সারা দেশবাসীর এবং বিশ্ব বিবেকের দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্ত হন। লন্ডন হয়ে তিনি তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারিতে। ১২ তারিখে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠিত হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি রূপে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ গ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির অধিবেশন হয়। মন্ত্রীদের আওয়ামী লীগের কর্মকর্তা না থাকার সিদ্ধান্ত করা হয়। এই সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠন করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়।
বন্ধুগণ,
ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এখন আমরা তা সংহত করতে চলেছি। বাংলাদেশ আজ নানা সমস্যার ভারে জর্জরিত। এক কোটি শরণার্থরি পুনর্বাসন, দেশের মধ্যে প্রায় দু’কোটি উদ্ধাস্তু মানুষের অন্ন এবং বাসস্থানের সংস্থান, বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন, যােগাযােগ ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস-এর প্রত্যেকটিই দুরূহ অথচ জরুরি কর্তব্য। খাদ্যের ঘাটতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে মানুষের হাতে অর্থ এনে দিতে পারলেও সেই অর্থ দিয়ে জীবনের উপকরণ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই ঊর্ধ্বগতি রােধ করার উপায় হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধি করা। অবশ্য সেই সঙ্গে কালােবাজারি ও মজুতদারি বন্ধ করতে হবে। আইন- শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস । আইনের শাসন যত দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, ততই আমরা গণতন্ত্রকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে পারব। এই আইনের শাসনের নতুন ভিত্তি রচিত হতে যাচ্ছে আমাদের সংবিধানে।
বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন আমাদের দায়িত্ব, সে কথা বলেছি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, আমরা পুরনাে অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাকেই সচল করতে চলেছি। অর্থনৈতিক জীবনের নবরূপায়ণে আমরা বদ্ধপকির। আওয়ামী লীগের বিঘােষিত নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাই ঘােষণা করেছেন যে, সমাজতন্ত্রই আমাদের লক্ষ্য। আর এই সমাজতন্ত্র কোন লােক দেখানাের ব্যাপার হবে না, এ হবে সত্যিকার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র । ব্যাংক, বীমা, পাটশিল্প, বস্ত্রশিল্প, চিনি শিল্প এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের বৃহত্তর অংশের জাতীয়করণ এই
পৃষ্ঠাঃ ৫৬১

বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দিকেই দৃঢ় পদক্ষেপ। আমরা আশা করব যে, কৃষিযোগ্য জমি ও শহরের সম্পত্তির মালিকানার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হবে এবং বেতনের ক্ষেত্রে এখনকার বিরাট বৈষম্য দূর হবে। আওয়ামীলীগ কল্যাণকর শ্রম নীতির পক্ষপাতী এবং শিক্ষার ভিত্তিতে বিস্তৃত ও গণমুখী করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা বিশ্বাস করি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও অস্বাস্থ্যের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সার্থক হবে, আমরা নতুন সমাজ গঠন করতে সক্ষম হবো।
পৃথিবীর কোন দেশই আজ নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো নয়। সুতরাং নানা দেশের সাহায্য ও সহযােগিতা আমাদের প্রয়ােজন। বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের সহায়তায় আমরা পুনর্বাসন ও খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে অনেক দুর অগ্রসর হয়েছি। পাকিস্তান থেকে সকল বাঙালীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা আমরা কামনা করেছি। কিন্তু আমাদের প্রয়ােজন যতই তীব্র হোক না, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন করতে পারে, এমন কোন সাহায্য আমরা গ্রহণ করব না। গােষ্ঠী নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করতে এবং যুদ্ধজোটের বাইরে থাকতে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আজ আমরা সেই প্রতিশ্রুতি পালন করতে যাচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সকল মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও তীব্র সংগ্রাম গড়ে তুলব।
আমাদের আজকের সংগ্রাম তাই অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই সংগ্রামে সঠিক নেতৃত্বদানের গুরুদায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগের উপর অর্পিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে দায়িত্ব পালনে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ যােগ্যতার পরিচয় দেবে। নিজেদের বহু কর্মী ও নেতাকে আমার হারিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক সংগঠনকে আজ নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযােগ রেখে যে নিমতম পর্যায় থেকে আওয়ামী
লীগের সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে ওঠে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। মানুষের কাছে আমাদের বিঘােষিত নীতি ও কার্যক্রম ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব ও জনমত গঠনের দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগ কর্মী মাত্রকে গ্রহণ করতে হবে। দেশের পুনর্গঠনে যেন আমরা প্রত্যেকেই মানুষের সেবার মনােভাব নিয়ে কাজে অগ্রসর হতে পারি, সেটাই আজকের বড় প্রার্থনা । দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সহনশীলতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কেননা, সহনশীলতা ছাড়া গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হতে পারে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেন সমাজ জীবনে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, আওয়ামী লীগের কর্মীদেরকে তা দেখতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৬২

দেশ প্রেমিক সকল রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির কাছেও আমার আবেদন, অর্থনৈতিক মুক্তি, সাম্রাজ্যবাদী প্রভাব -প্রতিরােধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের আপনারা নিজের দায়িত্ব পালন করুন।
অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে দেশবাসী প্রমাণ করেছে, বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য কিভাবে তারা ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারেন। দেশের মানুষের এই কল্যাণ বৃদ্ধিকে সঠিক পথে পরিচালিত করে বাংলাদেশকে আমরা সত্যিকার সোনার বাংলায় রূপান্তর করতে পারব। এই আশার বাণী উচ্চারণ করে আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। “৪
১৬ এপ্রিল ১৯৭২
ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হাত গােটাও
আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি পরিষদের সভাপতি অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন , মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ভিয়েতনাম থেকে এখনও সরে যাওয়ার সময় আছে, তারা যদি তা না করে তাহলে তাদের পতন অনিবার্য।
ত্রৈলােক্য মহারাজের চিতাভস্ম বিসর্জন অনুষ্ঠান
চিতাভস্ম বিসর্জনপূর্ব অনুষ্ঠানের সভাপতি তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাধ্যমে মহারাজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে এবং তার স্বপ্নকে আরও ফলপ্রসূ করার জন্য এদেশে শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২৭ এপ্রিল ১৯৭২
শেরেবাংলার আদর্শ বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্রের অবসান ঘটাতে হবে। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, শেরেবাংলা সারা জীবন বাঙালী হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। আমাদের জাতীয়তাবাদের যে আদর্শ শেরেবাংলা আজীবন সে আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। শেরে বাংলার দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে টিএসসিতে ফজলুল হক ছাত্র সংসদ কর্তৃক আয়ােজিত আলােচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। সভায় সভাপতিত্ব করেন ফজলুল হক হলের প্রভােস্ট আফম বজলুল করিম।
২৭ এপ্রিল ১৯৭২
ঢাকা মােক্তার বার কর্তৃক আয়ােজিত নবী-দিবসে অর্থমন্ত্রী বলেন, নবীর অনুকরণেই শান্তি সম্ভব।
১৪ মে ১৯৭২
জাতি গঠনের মূলে প্রাথমিক শিক্ষকদের দান অনস্বীকার্য
১৩ ও ১৪ মে দু’দিনব্যাপী সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়ােজিত জাতীয় সম্মেলনে
পৃষ্ঠাঃ ৫৬৩

সমাপ্তি দিবসে প্রধান অতিথির ভাষণে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে ১ লাখ ১৭ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের অধিকার কেউ আর খর্ব করতে পারবে না।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে আসেন। যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বাংলাদেশের অর্থ, পরিকল্পনা ও পাটমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। সে সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টর ছিল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত । তখন সরকারী কোষাগার খালি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য। যুদ্ধকালে ভারত সরকার বাংলাদেশকে পাঁচ মিলিয়ন ডলার প্রদান করে এবং তা তাদের বােম্বের রিজার্ভ ব্যাংকে জমা ছিল। পাকিস্তান সরকার রপ্তানি আয়ের সম্পূর্ণ অংশ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। বেশিরভাগ শিল্প-বাণিজ্যের মালিক পাকিস্তানীরা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। কাচামালের অভাব। ব্যবস্থাপনার অভাবে ব্যাংক, বীমা, শিল্পখাত অচল। তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। শােষণহীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা ছিল তার লক্ষ্য। অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করার জন্য তিনি পরনির্ভরশীল হতে চাননি। তাই তিনি আমেরিকা বা অন্য দেশের শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণ করতে চাননি। এ কারণে অনেকে সমালােচনা করেন যে, তাজউদ্দীন মার্কিনবিরােধী ছিলেন। পূর্ব বাংলার ১০ টি ব্যাংকের মধ্যে ৮টির মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীরা। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা নিয়ােগ করার জন্য নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ করা হলাে। সুপারিশকৃতদের মধ্যে ছিল পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট নুরুল আমিনের পুত্র আনােয়ারুল আমিন। বঙ্গবন্ধু তাকে বাদ দেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন উদার মনের মানুষ । স্বাধীনতার পর তিনি কে মুক্তিযােদ্ধা, কে নয়- এ ধারণা নিয়ে তিনি প্রশাসন পরিচালনা করেননি। তার নিকট অফিসারদের পরিচয় ছিল তাদের যােগ্যতা ও সততা। তিনি মুজিবনগর ও ভেতরের অফিসারদের মধ্যে কোনাে বিভাজন করেননি। তার অর্থ সচিব ছিলেন সাবেক সিএসপি মতিউল ইসলাম। মতিউল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তাকে খুব পছন্দ করতেন এ দক্ষ অফিসারের সাথে তিনি কখনও দ্বিমত পােষণ করেননি। তাজউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানী দালালদের
পৃষ্ঠাঃ ৫৬৪

একাউন্ট জব্দ করেননি। পাকবাহিনীর নিয়ােগকৃত গভর্নর ড. এম এ মালেকের ব্যাংকের টাকা উন্মুক্ত করতে আপত্তি করেন। তার মামলা পরিচালনার জন্য অর্থ ছাড়া করেছেন। তাজউদ্দিনের মানবিক মূল্যবােধ ছিল সীমাহীন। তার মধ্যে প্রতিহিংসার ছিল না। পাকিস্তানী দালাল বলে তিনি তার প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন না । আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
রাষ্ট্রপতির আদেশে (PO 16) ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ ব্যাংকগুলাের হাবিব ব্যাংক, ইউনাইটেড ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, স্টান্ডার্ড, মুসলিম কমার্শিয়াল, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল, ইস্টার্ন ব্যাংক করপােরেশন প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্ত করে ৬ টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হলাে। ব্যাংকগুলাে হলাে : সােনালী, রূপালী, জনতা, অগ্রণী, পূবালী ও উত্তরা ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাকিস্তান স্টেট ব্যাংকের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, শিল্প ঋণ সংস্থা পুনর্গঠনে তাজউদ্দীন আহমদ অপূর্ব মেধার পরিচয় দেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একজন সাহসী যোদ্ধার পরিচয় দেন। আমি (লেখক) অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে ৮ বছর চাকরি করেছি। আমি তাজউদ্দীন আহমদ এর প্রশংসা শুনেছি। সকলে বলত যে তাজউদ্দীন আহমদের মতাে দক্ষ অর্থমন্ত্রী আর মন্ত্রণালয়ে আসেনি। মূলত তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের মুদ্রা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন। যুদ্ধকালে পাক সরকার হঠাৎ পাঁচ শ’ টাকার নােট অচল ঘােষণা করে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিল। যুদ্ধকালীন সময় বাংলাদেশের নিজস্ব মুদ্রা ছিল না। স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন আহমদ বিভিন্ন মানের মুদ্রা ও নােট ছাপানাের ব্যবস্থা করেন। তার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। তিনি মুদ্রা ও নােটের ডিজাইন সংশােধন করতেন। মুদ্রায় ‘টা’ শব্দটি তার অঙ্কিত । মুদ্রা ছাপা নিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চলে। যুদ্ধকালে ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে ৬০/৭০ টাকার এক টাকার নােট ছাপাতে দেয়া এবং তা স্বাধীনতার পর বাজারে ছাড়া হয়। গুজব ছড়ানাে হলাে যে, ভারত অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপিয়ে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করছে। পরে এক টাকার নােট বাজার থেকে প্রত্যাহার করা হলাে। দেখা গেল যে টাকা ছাড়া হয়েছে তার চেয়ে কম জমা পড়েছে। তাজউদ্দীন বাজার থেকে পাকিস্তানী মুদ্রা ও কাগজের নােট প্রত্যাহার করেন। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের মুদ্রার মান বৃদ্ধি পায়।
পৃষ্ঠাঃ ৫৬৫

বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ১৯৭২-৭৩
বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন। বাজেটে রাজস্ব খাতে উদ্বৃত্ত ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। উদ্বৃত্ত নিয়ে তিনি ৫০১ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়ন করেন- উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসনের কর্মসূচি সামনে রেখে। উন্নয়ন বাজেটের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৩১৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
রাজস্ব বাজেট
আয় – ২৮৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা
ব্যয় – ২১৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা
রাজস্ব খাতে উদ্বৃত্ত – ৬৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা
উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন বাজেট
মোট বরাদ্দ – ৫০১ কোটি টাকা
৩১৮ কোটি ৩০ লাখ বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প
১৮২ কোটি ৭০ লাখ পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন
অর্থমন্ত্রী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হতে ১৯৭২ সালের জুন পর্যন্ত বাজেট পেশ করেন। বাজেটে নতুন করারােপ করা হয়নি। বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ হবে ১১৩ কোটি টাকা, বাকি ১০৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ থেকে ঋণ সংগ্রহ করা হবে।
১৯৭২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ যুক্তরাজ্যে জনতা ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন করেন।
২৪ সেপ্টেম্বর তিনি নির্বাচিত সুধীমণ্ডলীর সম্মানে ভাষণ দেন। অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের জন্য যে কাজ করেছে সে জন্য তিনি যুক্তরাজ্যকে ধন্যবাদ জানান।
২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ তাজউদ্দীন আহমদ কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রী সম্মেলনে ভাষণ দেন।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭২, ওয়াশিংটন : ২৯ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় ভাষণ দেন। তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে উদার মনােভাব নিয়ে সাহায্য দানের আহবান জানান। ৯ অক্টোবর অর্থমন্ত্রী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ৩টি বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করেন। বাজেটের আয়-ব্যয় নিমে দেয়া হলাে :
পৃষ্ঠাঃ ৫৬৬

অর্থবছর – বাজেটের আকার – রাজস্ব আয় – বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি
১৯৭২-৭৩ ৭৮৬ কোটি ২১৮.১৫ ৫০১ কোটি
১৯৭৩-৭৪ ৯৯৫ কোটি ৫৫৯.৩৭ ৫২৫ কোটি
১৯৭৪-৭৫ ১০৮৪.৩৭ ৪৫৯.৩৭ ৫২৫ কোটি

১৯৭৪ সালে বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন:
“Last year, when I presented the Budget, I had stated that in order to reach the goal of socialist transformation of society, people from all walks of life shall have to make all-out efforts at all levels, but our endeavours have not been as pervasive as it should have been. It is my sacred duty to apprise the people of the actual condition of our economy, so that everyone may appreciate the problems and contribute his mite for building up a socialistic and democratic society. I believe without people’s whole-hearted co-operation and active participation. Our economic and social goals cannot be achieved.”
“Although the financial year 1973-74 did ont register the desired rate of growth, nevertheless. It has been a period of experience with realities. Some soul searching is needed today, because mere slogans and speeches cannot bring socialism, eliminate corruption and achieve economic development. There is a crying need for honesty, hardwork and discipline at all levels; for the people cannot be deceived for all times by palliatives. I believe, we need a total commitment of the leadership, manpower and all other resources for the overall development of the country.”
“Keeping in view the performance shortfall of this year, the Development Programme that we propose to undertake next year, is the minimum for meeting the requirements of the long- term growth of the economy. If we fail to accomplish this programme, then it will not be possible for us to break through the vicious circle of poverty and to attain the objectives of the hard-earned freedom.”
“To avoid the possibility of such a disaster, the national
পৃষ্ঠাঃ ৫৬৭

resources, human as well as material, shall have to be developed, we will have to ceaselessly respond to the challenge of increasing output in a realistic and planned manner. For increasing the national product, today, we need a firm and a-never failing adherence to production and financial discipline, We should realise that in the absence of a disciplined an organised system and without mutual understanding and co-operation between the labour and the management and their complete dedication to the cause of increasing productivity, no development can take place. It is my firm belief that the people who have achieved freedom after tremendous sacrifices cannot be misled or taken-off from the road to the cherished goals by narrow self-seeking and unrealistic pursuits . we hope, the difficulties of this year will be overcome, and in the coming year, the nation will demonstrate a greater sense of realism and will fully mobilise itself for an all-out, honest and determined drive for development. Joy Bangla.”
“গত বছর বাজেট পেশ করার সময় আমি বলেছিলাম, সমাজের সমাজতান্ত্রিক পরিবর্তন রূপ দেয়ার লক্ষ্যে জীবনের সকল স্তরের জনগণকে সকল ক্ষেত্রে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা ততটা সফল হয়নি। আমাদের অর্থনীতির বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা আমার পবিত্র দায়িত্ব। তাহলে প্রত্যেক সমস্যা উপলব্ধি এবং সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন তাদের শক্তি দিয়ে অবদান রাখতে পারবে। আমি বিশ্বাস করি, জনগণের সম্পূর্ণ আন্তরিক সহযােগিতা এবং বাস্তব অংশগ্রহণ ব্যতীত আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।
যদিও ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির হার অর্জিত হয়নি তবুও এটা ছিল বাস্তবতার সাথে অভিজ্ঞতার আজ আত্মজিজ্ঞাসার প্রয়ােজন। কারণ একমাত্র স্লোগান এবং বক্তৃতা দিয়ে সমাজতন্ত্র আনা যায় না, দুর্নীতি দূর করা যায় না এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করা যায় না। সর্বস্তরে সততা, কঠোর শ্রম এবং শৃঙ্খলার প্রচণ্ড প্রয়ােজন। কারণ সব সময়ের জন্য জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বঞ্চিত করা যায় না আমি বিশ্বাস করি। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নেতৃত্ব, জনশক্তি এবং অন্যান্য সম্পদের সম্পূর্ণ আমাদের অঙ্গীকারের প্রয়ােজন।
এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ঘাটতি মনে রেখে এবারের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নের নূ্যনতম প্রয়ােজন মেটানাের জন্য আগামী বছরের কর্মসূচি
পৃষ্ঠাঃ ৫৬৮

প্রস্তাব করব। আমরা যদি এ কর্মসচী বাস্তবায়নে ব্যর্থ হই তাহলে দারিদ্রের দুষ্ট চক্র থেকে মুক্তি পাবো না। কষ্টে অর্জিত স্বাধীনতার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে না ।
এরূপ সম্ভাব্য দুর্যোগ পরিহার করার জন্য জাতীয় মানব এবং প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নত করতে হবে। বাস্তব এবং পরিকল্পিতভাবে বর্ধিত উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ আমাদের অবিরামভাবে মােকাবিলা করতে হবে। জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আজ আমাদের উৎপাদন ও আর্থিক শৃখলার প্রতি দৃঢ় এবং অব্যর্থ ভক্তি থাকতে হবে। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, একটি সুশৃংখল এবং সংগঠিত পদ্ধতির অনুপস্থিতি এবং শ্রমিক এবং ব্যবস্থাপনার মধ্যে পারস্পরিক উপলব্ধি এবং সহযােগিতা এবং উৎপাদন বৃদ্ধির প্রতি সম্পূর্ণ উৎসর্গ ব্যতীত কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। মার দৃঢ় বিশ্বাস যে, জনগণ এত বড় উৎসর্গের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে সঙ্কীর্ণ, আত্মকেন্দ্রিক এবং অবাস্তব অনুসরণ দ্বারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হতে বিপদগামী বা প্রত্যাহার করা যাবে না। আমরা আশা করি, এ বছরের সমস্যাসমূহ অতিক্রম করা হবে এবং আগামী বছরে জাতি অধিক বাস্তবতার উপলব্ধি প্রদর্শন করবে এবং উন্নয়নের জন্য সার্বিক সৎ এবং দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নিয়ে অভিযান চালাতে হবে।
জয় বাংলা।”
বলা হতাে, তাজউদ্দীন আহমদ পশ্চিমা দেশগুলাের সাহায্য ও সহযােগিতা নেয়া পছন্দ করতেন না। অর্থসচিব মতিউল ইসলাম বলেন, “এটা কিন্তু আমি শুনেছি অথচ অর্থসচিব হিসেবে আমি কিন্তু কোনদিনও তার এই মনােভাবের কোন ইঙ্গিত পাইনি। তিনি খুব প্রাগমেটিক ছিলেন। আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে ভীষণ সজাগ ছিলেন। এবং সেই সাথে সুচিন্তিত বাস্তবসম্মত কর্মপদ্ধতির মানুষ ছিলেন। তিনি বুঝতেন পশ্চিমের সাহায্য ছাড়া আমাদের চলবে না। সাহায্য আমাদের নিতেই হবে।… পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য যে ঋণ গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে তাজউদ্দীনের নীতি ছিল “আমরা পাকিস্তান সরকারের একমাত্র সে সমস্ত দায়িত্বই নেব যা সে সময়ে পূর্ব পাকিস্তানীদের অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য আনা হয়েছিল বা ব্যবহার করা হয়েছে। এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাজউদ্দীন আহমদ কতখানি বাস্তববাদী ছিলেন। একজন পরিপক্ব দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদের যা করা উচিত ছিল তিনি তাই করেছেন।
বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফের সদস্যপদ লাভ
পশ্চিমা দেশগুলাের নিকট তাজউদ্দীন আহমদ মস্কোপন্থী ও আমেরিকা বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত ছিল । বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা মুক্তিযুদ্ধকালে
পৃষ্ঠাঃ ৫৬৯

আমেরিকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। ম্যাকনামারা বাংলাদেশে এলে তাজউদ্দীন আহমদ তাকে গ্রহণ করতে বিমানবন্দরে যাননি। আর একবার দিল্লীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ম্যাকনামানারপাশাপাশি বসলেও তাজউদ্দীন তার সাথে কথা বলেননি। এমনই পরিস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে অর্থসচিব বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ এর সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেন। আবেদনের নিয়ম হল প্রথমে আইএমএফের সদস্য হতে হয় এবং তার পর বিশ্বব্যাংকের । তাজউদ্দিনের মেধা ও অর্থনীতিতে পাণ্ডিতের নিকট পাশ্চাত্য দেশগুলাে হার মেনেছে। ১৯৭২ সালের জুলাই -আগস্ট। নিয়ম হলাে অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের ও আইওএমএফের গভর্নর এবং অর্থসচিব বিকল্প গভর্নর হবেন। বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের ১৩ জুন আইএমএফের সদস্যপদ লাভ করে। পক্ষে ৮৮ ভােট, বিপক্ষে ১ (সুদান) এবং ভোটদানে বিরত থাকে ২৬টি দেশ।
বঙ্গবন্ধু পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলামকে বিশ্বব্যাংকের গভর্নর এবং তাজউদ্দীনকে আইএমএফের গভর্নরের জন্য সুপারিশ করেন। ১৯৭২ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হয় । তাজউদ্দীন এডিবির গভর্নর এবং অর্থসচিব বিকল্প গভর্নর নির্বাচিত হন।
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অর্থসচিব মতিউল ইসলাম বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় ওয়াশিংটন গমন করেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারার সাথে অর্থমন্ত্রীর চমৎকার এবং সফল আলােচনা হয়। অর্থমন্ত্রী যে বিদেশী সাহায্য নিতে চায় না ম্যাকনামারার এ ধারণা দূর হয়। তিনি তাজউদ্দীন আহমদের ভূয়ষী প্রশংসা করেন। তাজউদ্দীনের সাথে আলােচনার পর বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য প্রদান করে। ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০০ মিলিয়ন ডলারে পৌছে। অথচ ‘৭২-এর জানুয়ারি মাসে রিজার্ভ শূন্য ছিল । ব্যাংকের রিজার্ভ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সুদৃঢ় হতে থাকে। লােকে যে বলত তাজউদ্দীন সাহেব পশ্চিমের ঋণ নিতে চাইতেন না এটা বােধ হয় ঠিক নয়। তার যেটা মূল ভাবনা ছিল তাহলাে শর্তযুক্ত ঋণ আমরা নেব না। সহজ ঋণ নিতে পারি।
১৯৭৪ সালের জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের বিশেষ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ওয়াশিংটনে আসেন। সাথে ছিল নতুন অর্থসচিব কফিল উদ্দিন মাহমুদ। ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী। আলােচনা শেষে তাজউদ্দীন
পৃষ্ঠাঃ ৫৭০

আমেরিকা সরকারের সাথে বাংলাদেশে খাদ্য সাহায্য নিয়ে আলােচনা করেন। এবার একই রকম সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশ কিউবায় নিকট পাট রপ্তানি করেছে। আমেরিকার সাহায্যের অন্যতম শর্ত ছিল কোন রাষ্ট্র কিউবার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করলে আমেরিকা সে রাষ্ট্রকে সাহায্য দেবে না। তাজউদ্দীন আহমদ যুক্তরাষ্ট্রকে খাদ্য সাহায্যের জন্য জোরালাে প্রস্তাব রাখেন।
তাজউদ্দীন আহমদ ওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন এবং দ্বিতীয়বার ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সভায় যোগ দেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাউদ্দীন আহমদ দেশ-বিদেশে দাতাগােষ্ঠীর সাথে অনেক সভা করেন।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলন হবে ম্যানিলায়। অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিব মতিউল ইসলাম, ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী থাই বিমানে ম্যানিলা যাবেন। হঠাৎ খবর এলাে ঢাকা থেকে থাই ফ্লাইট বাতিল । তখন তাদের বলা হল দিলী-ব্যাঙ্কক হয়ে ম্যানিলা যাওয়া যাবে। তাজউদ্দীন দুই কর্মকর্তাকে নিয়ে বিকেলে দিল্লি পৌছেন। ডিপি ধর তাদের অভ্যর্থনা জানান। পরের দিন ৫ টায় প্যানঅ্যাম বিমানের ফ্লাইট। তারা ভিআইপি রুমে বসে আছেন। ভারতীয় প্রটোকল অফিসার জানায় যে, সময় হলে তিনি জানাবেন। কিন্তু যখন জানাল তখন পেনের কাছাকাছি গিয়ে দেখা গেল প্লেনের সিড়িটা নিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে প্রটোকল অফিসার বলেন, না ও কিছু না। প্লেন চলছে দেখে অফিসারের মাথায় হাত। তখন গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে প্যানঅ্যামের অফিসারের কাছে গিয়ে বলল । প্লেন কীভাবে যাচ্ছে? ভিআইপি যাত্রীরা রয়ে গেছে। প্যানঅ্যাম অফিসার বলে, ভিআইপিদের অনেকবার ডাকা হয়েছে, কেউ আসেনি তাই প্লেন যাচ্ছে। অফিসার কন্ট্রোল টাওয়ারে ফোন করে প্লেন থামতে বলে। মালগাড়ির সিড়ি দিয়ে মন্ত্রী ও তার সহযাত্রীরা উঠল, কিন্তু দরজা বন্ধ। প্লেন থেকে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। টোকা দেয়ায় দরজা খুলে যায়। তারা ভেতরে ঢুকে পড়েন। প্রটোকল অফিসারের দায়িত্বহীনতার ফলে অর্থমন্ত্রীর জীবনহানির আশঙ্কা ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে শেষ সফর
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সর্বশেষ ওয়াশিংটন সফর ছিল ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। এবারে বাংলাদেশের সমস্যা ছিল কঠিন আকারের। বাংলাদেশে তখন দুর্ভিক্ষ চলছে, আমদানি-রপ্তানির অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। ওয়াশিংটনের পথে তাজউদ্দীন আহমদ সােভিয়েত রাশিয়া সফর করে আসেন। ম্যাকনামারার চেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংক প্রয়ােজনীয় অর্থ ও খাদ্য যােগাতে ব্যর্থ হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৫৭১

এ সময় তাজউদ্দীন আহমদকে বিমর্ষ দেখা যেত। দেশে দুর্ভিক্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে ছিল তার সর্বক্ষণিক চিন্তা।
১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আসেন কিন্তু তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আসেননি। এটা ছিল দুঃখজনক। একজন বিশ্বনেতাকে আমেরিকার সম্মান জানায়নি। তাজউদ্দীনও বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন । তিনি আক্ষেপ করেছেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম বাংলা ভাষায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন। দেশে ফেরার পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদ কূটনীতিক আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে বলেছিলেন, এটাই তার শেষ সফর। তাহলে তিনি কি জানতেন দেশে ফেরার সাথে সাথে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। তাজউদ্দীন আহমদ চারবার আমেরিকা সফর করেন।
১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদ অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলামকে চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যান করে বাংলাদেশ প্রানিং কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের সদস্য ছিলেন ড. রেহমান সোবহান, ড. আনিসুর রহমান ও ড. মােশাররফ হােসেন। তাজউদ্দীন আহমদ পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে কমিশনের কার্যাবলী তত্ত্বাবধায়ন করতেন এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন। প্লানিং কমিশন বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী (১৯৭৩-৮০) পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।
১. আয় বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ;
২. জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার শতকরা ৩ থেকে ২.৮ ভাগ করা;
৩. জাতীয় আয় ৫.৫ ভাগে বৃদ্ধি;
৪. ৪১ লক্ষ লােকের কর্মসংস্থান;
৫. দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীলকরণ ।
পরিকল্পনায় ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪৪৫৫ কোটি টাকা। বৈদেশিক সাহায্য নির্ধারণ করা হয় ১৭৫৭ কোটি টাকা। মােট ব্যয়ের ৪০ ভাগ আসবে বিদেশ থেকে। কৃষি ও শিক্ষা খাতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়।৬
দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল। ১৯৭২ সালে ২৪ লাখ ও ১৯৭৩ সালে ১৪ লাখ টন খাদ্য আমদানি করা হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে ৯৭ লাখ ধান ও গম উৎপন্ন হয়। তাজউদ্দীন আহমদ পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে ৬৬ লাখ বেল পাট উৎপন্ন হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৫৭২

তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী থাকাকালে সংসদে ১৯৭১-৭২, ১৯৭২-৭৩, ১৯৭৩-৭৪ ও ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাজেট পেশ করেন। তার অর্থনীতি ছিল- আয় বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করা।
তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ায় শিল্পক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। তাই তিনি পাট, বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করেন। পাটশিল্প পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশন ও বস্ত্রশিল্প পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মিলগুলাে পুনরায় চালু করেন ।
তাজউদ্দীন আহমদ কালজয়ী অর্থনীতিবিদ ছিলেন। তিনি আর্থিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সােনালী, জনতা, অগ্রণী, পূবালী, উত্তরা ও রূপালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে অর্থনীতি পুনর্ধতিষ্ঠা করায় তাজউদ্দীন আহমদ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতাে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭২-৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
• ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট গঠন করা হয় ।
• ১৯ জানুয়ারি এমআর সিদ্দিকী, শামসুল হক, মতিয়ুর রহমানকে মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়।
• ২১ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়।
• ২৪ জানুয়ারি পাকবাহিনীর দালালদের বিচার করার জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।
• ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সকল ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ ঘােষণা দেয়া হয়।
• ৭ এপ্রিল ১৯৭২ এমএজি ওসমানী সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
• ১৯৭২ সালে ১ মে স্পিকার শাহ আবদুল হামিদ মৃত্যুবরণ করেন এবং তার স্থলে মােহাম্মদ উল্লাহ স্পিকার নিযুক্ত হন।
• ১৯৭২ সালের ১৭ জুন বাংলাদেশ আইএমএফের সদস্যপদ লাভ করে ।
• ১৯৭২ সালের ২২ অক্টোবর এক হিসাবে দেখা যায়, পাকিস্তানী শিল্পপতিরা ৭৮৫ কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যায়।
• ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদ শাসনতন্ত্র অনুমােদন করে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৭৩

• ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর আওয়ামী যুবলীগ গঠন করা হয়।
• ১৯৭২ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য মন্ত্রী নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে শপথ গ্রহণ করেন ।
• ১৯৭৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করে।
• ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৩শ’ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮০ আসন লাভ করে। তাজউদ্দীন আহমদ কাপাসিয়া থেকে এমপি নির্বাচিত হন।
• ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদসহ ১৪ সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে।
• ২৪ এপ্রিল সরকার ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের ঘোষণা দেয়। নূরুল আমিন, গােলাম আযম প্রমুখের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।
• ১৭ মে ত্রাণমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী পদত্যাগ করেন।
• ১৯৭৩ সালের ৩ জুন সরকার ঘােষণা দেয় যে, প্রাথমিক শিক্ষকরা ১ জুলাই থেকে সরকারী কর্মচারী হবেন এবং সরকারি বেতন -ভাতা পাবেন।
• ৬ জুন কর্নেল সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
• ১০ জুলাই ১৯৭৩, সরকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ১০ কি জাতীয় বেতন স্কেল ঘােষণা করে। বর্ধিত হারে তারা বেতন-ভাতা পেতে থাকেন।
• ১৩ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ৭৮ অনুমােদন করে।
• সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৫৫৯৪ জন শিক্ষককে ১৯৭৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে সরকারী কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
• ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু দালালদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেন। এ আদেশে ৩৬৪০০ দালাল মুক্তি পায়।
• ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন।
১৯৭৪
• ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৫৭৪

২০ জানুয়ারি এএইচএম কামারুজ্জামান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
• ২৪ জানুয়ারি মােহাম্মদ উল্লাহ রঞ্জিপতি এবং মালেক উকিল স্পিকার নির্বাচিত হন।
• ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ বিশেষ আইন ১৯৭৪ পাস করে।
• সরকার বাংলাদেশে কুমিল্লায় প্রথম মিলিটারি একাডেমী প্রতিষ্ঠা করে।
• ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু একাডেমী উদ্বোধন করেন। এ সময় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কুমিল্লা সেনানিবাসের জিওসি ছিলেন।
• ৫ এপ্রিল ১৯৭৪ দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে ছাত্রলীগের ৭নেত নিহত হন।
• ৯ এপ্রিল দিল্লীতে পাকিস্তান- ভারত- বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানে বন্দী বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে আনার বিনিময় ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে মুক্তি দিতে বাংলাদেশ সরকার সম্মত হয়।
• ৭ জুন শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট পেশ করে।
• ১১ জুন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট এমএ হান্নান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়।
• ১৯৭৩-৭৪ সালে বাংলাদেশে ১১৮২২ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়।
• ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই ৬ জন মন্ত্রী ও ৩ জন প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করেন।
• ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে।
• ১৯৭৪ সালের বন্যায় শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ৬ সেপ্টেম্বর হতে দেশে ৪৩০০টি লঙ্গরখানা শুরু । দুর্ভিক্ষে ২৭ হাজার লােকের মৃত্যু হয়।
• ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর আমেরিকার পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সফর করেন।
• ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর শাসনতন্ত্রের তৃতীয় সংশােধনী পাস হয়।
• সর্বহারা দল ও জাসদের গণবাহিনী আওয়ামী লীগের ৫ জন সংসদ সদস্য ও কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে হত্যা করে। সংসদ সদস্যগণ হলেন : মঈনুদ্দিন (যশাের), আবদুর খালেক (নেত্রকোনা), মােতাহার হােসেন (ভােলা) ও সগীর (মঠবাড়িয়া)।
১৯৭৫
• বাংলাদেশ ব্যাংক ৪ জানুয়ারি ১৯৭৫ জানায় যে, দেশে ৩৮৭ হাজার ৭৩ লাখ ৭২ হাজার টাকার নােট চালু ছিল।
পৃষ্ঠাঃ ৫৭৫

• ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী পাশ হয়। বঙ্গবন্ধু, রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি এবং এম মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
• ২১ মে ফারাক্কা বাঁধ উদ্বোধন।
• ১৯ জুন ৬০টি জেলা ঘােষণা।
• ১৬ জুলাই ৬০ জন গভর্নর নিয়ােগ।
• ৩ আগস্ট জেলা বাকশাল গঠন।
• ৮ আগস্ট আবু সাঈদ চৌধুরী মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
• ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার নিহত হয়।
• ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়।
পাট
পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আমার মনে হয় , তাজউদ্দীন আহমদ নিজে পছন্দ করে পাট মন্ত্রণালয় নিয়েছেন। তার লেখা ডায়েরিতে দেখা যায়, তিনি ছাত্র জীবনে পাটচাষী ও পাটের ন্যায্য মূল্য নিয়ে চিন্তা করতেন। পাট চাষীরা পাটের ন্যায্য মূল্য পায় না। অথচ পাকিস্তানি পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করে। আর বাংলার পাটচাষীরা নিষ্পেষিত ও বঞ্চিত। তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। পাট উৎপাদনে যে ব্যয় হয় তা কাঁচা পাট বিক্রি করে তা পাওয়া যায় না। তেমনিভাবে পাটকলের শ্রমিকরা উপযুক্ত বেতন পায় না। পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা ২৩ বছর ধরে সােনালী আঁশের একচেটিয়া ব্যবসা করেছে। স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীন আহমদ পাটচাষী ও শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
তিনি পাটশিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পাটকল সংস্থা-বিজেএমসি প্রতিষ্ঠা করেন। বিজেএমসির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় পাটকলগুলাের উৎপাদন বৃদ্ধি পেতে থাকে।
পাট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৭৩ সালে দাঁড়ায় ৬৬ লাখ ২৫ হাজার বেল। ১৯৭২-৭৩ সালে পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন ছিল ৪ লাখ ৪৬ হাজার টন। ১৯৭২-৭৩ সালে পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে ১৪০ কোটি টাকা আয় হয়। পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য ৩৮০টি পাট ক্রয় কেন্দ্র খােলা হয়। ৮ লাখ ৫৫ হাজার বেল পাট রপ্তানি হয়। পাট উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশ জারি করা হয়। পাটচাষীদের ন্যায্যমূল্য প্রদানের
পৃষ্ঠাঃ ৫৭৬

লক্ষ্যে পাটমন্ত্রীর উদ্যোগে বাংলাদেশ পাট করপােরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয় । সরকার ১৯৭২ সালে জুট ব্যবস্থা জাতীয়করণ করে।
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ব্যাংক ব্যবস্থা জাতীয়করণ করেন। তিনি নিজে রাষ্ট্রীয়করণ অধ্যাদেশের খসড়া প্রণয়ন করেন। তিনি প্রাথমিক অবস্থায় প্রত্যেক ইউনিয়নে ভ্রাম্যমাণ ব্যাংকিংয়ের ব্যাংকিংয়ের সুযােগ সৃষ্টি করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ১৮৬ টি শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তার সময় জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি পায়। মন্ত্রীর উদ্যোগে। ১৯৭৩ সালের মধ্যে পাকিস্তানী নােট বাজার থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার এবং তার পরিবর্তে বাংলাদেশের নতুন নোটের প্রচলন করা হয়। বাংলাদেশে নতুন ৫, ১০ ও ২৫ পয়সার মুদ্রা চালু হয়।
তাজউদ্দীন আহমদ একজন ভালো শিল্পী ছিলেন। বাংলাদেশের মুদ্রায় অদ্ভিত ‘৳’ বর্ণটি তার আঁকা।
২ জুন ১৯৭৩
সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ভারত থেকে সর্বমােট ৪২১ কোটি ৫৯ লাখ ৫০ হাজার টাকার নােট ছাপিয়ে আনা হয়েছে। তার মধ্যে ১২০ কোটি ৭২ লাখ ৫শ’ টাকার নােট বাজারে ছাড়াই হয়নি।
ভারতে বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপানাে নিয়ে কঠোর সমালােচনা হয়। এমনকি এমনও বলা হয়েছে যে, ভারত বাজারে জাল নােট ছেড়েছে। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য অর্থমন্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন।
অর্থমন্ত্রী এক পর্যায়ে বলেন, ‘মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ভারতের সাথে কোনাে গােপন চুক্তি করে বলে যদি কোন প্রমাণ করতে পারেন তবে আমি সাথে সাথে পদত্যাগ তাে করবই, এমনকি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতেও রাজি আছি।’
১৪ জুন ১৯৭৩
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আজ জাতীয় সংসদে ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। ২৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকার নয়া কর ও কর বৃদ্ধির প্রস্তাব, ৩৭৪ কোটি ৭২ লাখ টাকার উদ্বৃত্ত বাজেট, ৫২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার উন্নয়ন কর্মসূচি।।
রাজস্ব খাতে আয় – ৩৭৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা
রাজস্ব খাতে ব্যয় – ২৯৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা
রাজস্ব উদ্বৃত্ত – ৭৯ কোটি ২ লাখ টাকা
পৃষ্ঠাঃ ৫৭৭

উন্নয়ন বাজেট – ৫২৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা
৩৫২ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবে।
ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৫৯৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ১৯৭২-৭৩ সালে পাট রফতানি লক্ষমাত্রা ৩০ লাখ বেল। ইতিমধ্যে ২৮ লাখ বেল পাট রপ্তানি করা হয়েছে।
১৯৭২-৭৩ সালে জাতীয় আয় ৪২৯০ কোটি টাকা।
১৯৭৩ সালের ২৫ জুলাই তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, পার্টির সর্বনিম্ন দাম মণপ্রতি ৫০ টাকা ধার্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৭২-৭৩ সালে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে মোট ২৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক সম্মেলন, নাইরােবি
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩
নাইরোবীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ধনীদের দেশসমূহ হতে সত্যিকার সম্পদ আরও অধিক পরিমাণে গরিব দেশসমুহে সরবরাহের জন্য জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, ধনী ও দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে বিভেদ দূর করার জন্য দূরদৃষ্টি ও অভিজ্ঞান আবশ্যক। ১ অক্টোবর সম্মেলনে তিনি আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাঠামাে সংস্কারের সুপারিশ করেন। তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার সাথে সাক্ষাত করেন।
১৯৭৩ সালের ৩০ নবেম্বর বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের দালালদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেন। যারা গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযােগে জড়িত তাদের ক্ষমা করা হবে না। ৩৬৪০০ দালাল মুক্তিলাভ করে ।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩ বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণে আয়ােজিত বিজয় দিবসের আলােচনাসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলার মানুষের মৌলিক সমস্যা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থার দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত । আমরা যদি এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই তবে ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে আমাদের নাম থাকবে। তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ :
জানুয়ারি ১৬, ১৯৭৪ বুধবার : দৈনিক ইত্তেফাক
সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হইলে ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে আমাদের নাম লেখা হইবে : (জাতীয় দিবস উপলক্ষে গত ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭৩ বাংলা একাডেমী
পৃষ্ঠাঃ ৫৭৮

প্রাঙ্গণে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের সংক্ষিপ্ত বিবরণ)।
মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছে তারা অমর, তারা চিরদিন বাংলার মাটিতে বেঁচে থাকবেন। কারণ তাদের কথা রক্ত দিয়ে লেখা হয়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অধ্যায়ে। তারা মরে প্রমাণ করে গেছেন, বিশ্বাস ও আদর্শের জন্য, ভবিষ্যৎ বাংলার মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য, সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, কল্যাণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তারা অকাতরে হাসিমুখে বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে মুক্তি সংগ্রামের প্রয়ােজনীয় উপাদান সরবরাহ করেছেন। তারা চিরঞ্জয়ী।
বাংলার মানুষের মৌলিক সমস্যা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থার দায়িত্ব আমাদের ওপর ন্যস্ত। আমরা যদি এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হই, তবে ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়ে আমাদের নাম থাকবে। দেশ গড়ার নামে জনতাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে দেশ গড়তে উপদেশ দিলে কিছুই হবে না। কি করতে হবে তা আমাদের জানতে হবে। পরিকল্পিত উপায়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং যে যেখানে আছেন, সেখানে তার কর্তব্য পুরােপুরি পালন করতে হবে।
সবাইকে নিজ নিজ ঘর থেকে দুনীতি উচ্ছেদ অভিযান শুরু করতে হবে। ব্যক্তিজীবনে পূর্বাপর সংহতি বজায় রাখতে হবে। অন্যথায় দুর্নীতির উচ্ছেদ হবে না এবং বাংলাদেশ থেকে দুনীতি কখনও যাবে না। উপর থেকে আদর্শ-অনুশাসন করে দেখাতে হবে। তাহলে কমীরা উৎসাহ ও প্রেরণা পাবে। উপরে বসে দুর্নীতি করে আদর্শবান নাগরিক হবার উপদেশ প্রদান করা উপহাসমাত্র। এতে জাতির দুর্ভোগ বাড়বে বই কমবে না।
সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হতে পারে এমন সব মৌলিক অধিকার রহিত করা প্রয়ােজন। সংবিধানে এর ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ভবিষ্যত সংসদে আইন প্রণয়নকারীদের ওপর এ ব্যাপারটি নির্ভর করবে। যার পয়সা আছে, সে উচ্চ আদালতে মামলা করে মৌলিক অধিকার ক্রয় করতে পারে। যার পয়সা নেই, তার সেই অধিকারও নেই।
প্রথমত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ১৯ লক্ষ লােকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে। ধরুন, ৫টি পাটকল স্থাপন করতে হবে বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য এবং পাঁচসালা সফল করার জন্য। কিন্তু পাটকলের জমি সংগ্রহ করতে গিয়ে পয়সাওয়ালা এবং প্রভাবশালী লােকদের নিকট থেকে বাধা আসবে। সে বাধা সম্পত্তি রাখার মৌলিক অধিকারের প্রতিবন্ধকতা, তারা মামলা করবে। ধরুন, সরকার যদিও জিতে যাবে, পরিণামে তবুও পাঁচসালার দু’বছর অতীত হয়ে যাবে
পৃষ্ঠাঃ ৫৭৯

ইতােমধ্যেই, অতএব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে যাবে।
তাই ব্যক্তিমালিকানায় সম্পত্তি রাখার মৌলিক অধিকার দেশের বৃহত্তর অগ্রগতির স্বার্থে রহিত হওয়া প্রয়ােজন। সংবিধানের টায় রয়েছে। মৌলিক অধিকার নিয়ে আজকে যারা বাক-বিতণ্ডা করছেন তাদের আসল কথা বাকস্বাধীনতা নয়, তারা চান ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার অধিকার। যার ফলে আপনার সম্পত্তি কিভাবে হলাে, কিভাবে বৃদ্ধি পেল এটা কি হাইজ্যাক করে হলো না ডাকাতি করে হলাে, লুটপাট করে হলাে তার হিসাব নিকাশ করা বা প্রশ্ন করা যাবে না।
শিক্ষা প্রসঙ্গ : গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা আমি চাই না। জনকল্যাণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। যে শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের অগ্রগতির প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক অনুশীলনপ্রাপ্ত কমার যােগান দেবে সে ব্যবস্থাই আমার কাম্য। পরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থা চাই। যেখানে দেশের অগ্রগতির সর্বস্তরের সবরকম কর্মী পাওয়া যাবে। কোন দিক শূন্য থাকবে না।
সংস্কৃতি : সংস্কৃতির আবেদন বিশ্বজনীন। এর সীমারেখা টানা ঠিক হবে না । সংস্কৃতি চির প্রবহমান। সত্য ও সুন্দরের সাধনাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি কোনকালে কোন অবস্থায়ই বর্জনীয় নয়, সবকালেই গ্রহণীয়।
প্রমাণ করতে পারলে ফাসি কাষ্ঠে ঝুলতে প্রস্তুত : আমি চ্যালেঞ্জ করছি, যদি কেউ কোন প্রমাণ করতে পারেন যে, আমার প্রধানমন্ত্রিত্বকালীন সময়ে ভারতের সঙ্গে কোন প্রকার গােপনীয় বা প্রকাশ্যে চুক্তি করেছি তবে আমি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে প্রস্তুত রয়েছি। ২৩ নবেম্বর ইয়হিয়া খান ঘােষণা করেন যে, ১০ দিনের মধ্যে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য প্রদান বন্ধ না করে তবে পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করবে। এই ঘােষণার পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানান এই হামলা বন্ধ করার জন্য। কিন্তু কিছুই হয়নি এবং ঠিকই দশ দিন পর ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণ শুরু করে। ফলে ভারতের স্বাধীনতা বিপন্ন হয় এবং আমরাও তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত। তাই উভয়ের স্বাধীনতার চরম শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যৌথভাবে কি করে মােকাবিলা করা যায়, তাই নিয়ে আমরা আলােচনা শুরু করি এবং একদিন রাতে সবার অলক্ষ্যে মুজিবনগর থেকে আমি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব উধাও হয়ে যাই। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে রাতে দীর্ঘ আলােচনার পর আমাদের সিদ্ধান্ত ভারতকে জানিয়ে দেই যে, আমরা তার সম্মিলিত শক্রর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সগ্রাম করতে প্রস্তুত, তবে
পৃষ্ঠাঃ ৫৮০

তা হবে আমাদের শর্তানুযায়ী। শর্তগুলাে হলো : ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করবে, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের সম্মিলিত সৈন্য বাহিনীর সাথে (গণফৌজ ও ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট তৎকালীন ই.পি.আর, আনসার, মুজাহিদ যার সম্মিলিত নাম ছিল মুক্তিবাহিনী) Supporting Forec বা সহায়ক বাহিনী হিসেবে আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে। এটাই ছিল ভারতের সাথে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সেই রাতের বৈঠকের কার্যবিবরণী । এটাকে আপনারা যে কোন নামে অভিহিত করতে পারেন। আমাদের আপত্তি নেই। এই প্রস্তাবের মূল কপি এখনও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে।
বিপ্লবের নিম্নচাপ থেকে সময় থাকতে সাবধান হতে হবে : জলভাগে বায়ুর গতি ও চাপ পরিবর্তনের ফলে যে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়, সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বায়ুর গতি ও চাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না এলে যে ঘূর্ণিঝড় ও গাের্কির সৃষ্টি হয়, তাতে প্রলয়ঙ্কারী জলােচ্ছাস এবং হারিকেন মানব ও প্রাকৃতিক জীবনে ডেকে আনে এক চরম বিপর্যয়। যার ফলে সব স্বাভাবিক অবস্থা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে রূপ নেয় এক ধ্বংসলীলার। তেমনি আমরা যদি দেশের মানুষকে প্রয়ােজনীয় খাদ্য ও বস্ত্র সরবরাহ করতে ব্যর্থ হই বা তাদের প্রয়ােজন মেটাতে না পারি, তবে আমাদের দেশেও বিপ্লবের নিম্নচাপ সৃষ্টি হবে এবং যদি সময় থাকতে মানুষের কল্যাণ প্রচেষ্টায় আমরা ব্রতী না হই, তাহলে নিম্নচাপের ফলে।
অবশ্যম্ভাবী বিপ্লবের গতিধারায় আমরা শুধু ভেবেই যাব না, ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যয়েও নিক্ষিপ্ত হব। অতএব সময় থাকতে আমাদের সাবধান হওয়া উচিত।
অতি-বিপ্লবীরা সামজের কোন উপকারে আসে না। তারা শুধু জনসাধারণকে নির্যাতন করতেই সক্ষম। পশ্চিম বাংলায় অতি-বিপ্লবীরা বহু মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু সার্বিক জনগণের কোন উপকার হয়নি ।
বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গ : বুদ্ধিজীবীরা তাদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সর্বদাই সচেতন এবং আমি বিশ্বাস করি তাদেরকে নতুন করে দায়িত্ব দেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। কারণ জাতীয় প্রয়ােজন এবং ক্রান্তিলগ্নে বুদ্ধিজীবীরা সর্বদাই সঠিক দায়িত্ব অতীতেও পালন করে এসেছেন। বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও করবেন, এই দৃঢ় বিশ্বাস আমার রয়েছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা দেশের সত্যিকার সমস্যা তুলে ধরবেন এবং সমাধানের ইঙ্গিত প্রদর্শন করবেন, এটাই কামনা করি। অন্ধভাবে আমাদের শুধু প্রশংসা করলেই চলবে না।
বঙ্গবন্ধু যেন রেলগাড়ি লাইনের ওপর স্থাপন করতে পারেন : বঙ্গবন্ধুর কাছে
পৃষ্ঠাঃ ৫৮১

খুব বেশি কিছু আশা করবেন না। শুধু এইটুক দোয়া করবেন যে, বঙ্গবন্ধু যেন লাইনচ্যুত রেলগাড়িটি লাইনের ওপর সঠিকভাবে স্থাপন করে যেতে পারেন। কারণ অগ্রগতির প্রতীকস্বরূপ এই গাড়িটি লাইনের অবস্থান করলে যেকোন ইঞ্জিন বিলম্বে হলেও সেটি গন্তব্যস্থানে পৌছাতে সক্ষম হবে। অন্যথায় রেলগাড়িটি যদি লাইনচ্যুত থেকে যায়, তা হলে দ্বিগুণ শক্তি সম্পন্ন ইঞ্জিন দিয়েও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে না।
সার্বভৌমত্ব : দেশের সার্বভৌমত্ব নির্ভর করে দেশের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর। এই জন্য আমাদের উৎপাদন বাড়াতে হবে, সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে এবং সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতেই হবে। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে শতকরা ১০০ ভাগ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা অসুবিধা হবে। কারণ বিদেশ থেকে যখন সাহায্য হিসেবে গম আসে, তখন দলিলপত্রের কোথাও কোন শর্ত লেখা থাকে না। কিন্তু গমের সাথে সাথেই বিদেশী প্রভাবও দেশে প্রবেশ করে। পরনির্ভরশীল যে কোন দেশের সার্বভৌমত্ব এমনিভাবে ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রশাসনযন্ত্র ছাড়া অন্য কোনাে রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি কোনরূপ অস্ত্র রাখতে পারবেন না। সরকারী দলের কাছে অস্ত্র থাকলে আত্মরক্ষার জন্য বিরােধী দলও অস্ত্র রাখতে চাইবে। ফলে দেশে অশান্তি সৃষ্টি হবে। এমন কি ভয়াবহ পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে। কোন আওয়ামী লীগারের হাতে বেআইনী অস্ত্র থাকলে তাকেও গ্রেফতার করতে হবে, নতুবা বক্তৃতা-বিবৃতিতে ভাল কথা শুনিয়ে শুনিয়ে দেশে শান্তি তথা আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে না। পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করতে হবে, জনগণের আস্থা অর্জনে সাহায্য করতে হবে।
তাই, আসুন প্রতিজ্ঞা করি, শহীদদের স্মৃতি স্মরণ করে, আমার পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে, যারা আমাদের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত, চলুন আজ আমরা শপথ গ্রহণ করি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমাজবাদী বাংলাদেশ গড়ে তােলার। দেশের ৮০ ভাগ ভুখা-নাঙ্গা মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন প্রচেষ্টায় আমাদের সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে। তবেই আমরা সুখী সমৃদ্ধিশালী শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ এবং স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারব। আমরা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব এবং বিশ্ব শান্তিতে অবদান রাখব, বিশ্বের সব মুক্তি সংগ্রামীদের পাশে থাকব ও বিশ্ব শান্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের রুখে দাঁড়াব।
পৃষ্ঠাঃ ৫৮২

রোমে অনুষ্টিত আইএমএফ কমিটির সভায় যােগদান
১৬-১৯ জানুয়ারি
রুমে অনুষ্ঠিত আইএমএফ-এর ২০ জনের কমিটির সভায় তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বিশ্বের মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ এ বছর জুলাই মাসে চূড়ান্ত হবে।
১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পদত্যাগ করেন। তার স্থলে এএইচএম কামারুজ্জামান সভাপতি নির্বাচিত হন।
২৪ জুলাই স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আবদুল মালেক উকিল স্পিকার নির্বাচিত হন।
১৯ ফেব্রুয়ারি খন্দকার মােশতাক আহমদকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়।
পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ ফেব্রুয়ারী লাহােরে অনুষ্ঠিত ইসলামী কনফারেন্সে যােগ দেন।
২৪ মার্চ ১৯৭৪
তাজউদ্দীন আহমদ ‘সত্য ও ন্যায়বিচার’কে সমুন্নত রাখা এবং জনগণকে আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য সরকারী কর্মচারীদের কাজ করে যাওয়ার আহবান জানান। তিনি কাপাসিয়া থানার ইউনিয়ন পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্যদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন ।
১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লীতে পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। আটক বাঙালীদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিতে হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুজিনগর সরকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যােগদান করেন ।
১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে আয়ােজিত অনুষ্ঠানে
তাজউদ্দীন আহমদ যে বক্তৃতা দেন তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ৭
হতাশা নয়, লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে; মুজিবনগরে বিপ্লবী সরকারের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত : গতকাল ছিল ধ্রুব-নক্ষত্রের দীপ্তিতে জ্যোতিষ্মন একটি দিন ১৭ এপ্রিল, যেদিন বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত জেলা কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার এক অখ্যাত গ্রাম বৈদ্যনাথতলার নিভৃত আম্রকুঞ্জে শপথ নিয়েছিল জনাব তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার।
পৃষ্ঠাঃ ৫৮৩

সেই আশ্চর্য ইতিহাসের দিনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার ঘোষণা করেছিল মৃত্যুর প্রহর গোনা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কানে স্বাধীনতার বরাভয়। ১৯৭১ সালের সেই আশ্চর্য ইতিহাসের দিনে বাঙালি জাতির সেই বিস্ময়কর অভ্যুদয়ের দিনে বিপ্লবী সরকারের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিল শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে বাংলার তরুণ সূর্যসেনা। গতকাল সেই একই আম্রকুঞ্জা অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে জাতিকে নতুন সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বলেছেন, আর হতাশা নয় আসুন স্বাধীনতাযুদ্ধের অগ্নিসংযোগ দিনগুলোতে যে শপথ নিয়ে আমরা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, আজ সেই একই শপথ নিয়ে আমরা আবার নতুন সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য একটি সমাজ গড়ে তোলার জন্য। গতকাল মুজিবনগরে এই অনুষ্ঠানে ভাষণ দানকালে অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, দেশ আজ যে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে তা সমাধানের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলাে সমাধানের জন্য সমস্যাগুলােকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বেছে নিয়ে সর্বশ্রেণীর জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পর্যায়ক্রমে সেগুলোর সমাধান করা। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য প্রতিটি নাগরিককেই স্থির সংকল্প নিয়ে নিস্বার্থভাবে কাজ করে যেতে হবে। তিনি বলেন, রক্তাক্ত বিপ্লবের মাঝে নিয়ে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে সেই বাংলাদেশ আজ না না সমস্যায় পরিবেষ্টিত, কিন্তু তাতে হতাশ হয়ে যাবার কোন কারণ নেই। স্বাধীনতাযুদ্ধে যে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড গুড়াে হয়ে গেছে, স্বাধীনতার মাত্র ২৪ মাস পরে সে দেশের রাতারাতি একটা বিরাট পরিবর্তন আশা করা ঠিক সঙ্গত নয়। আসলে যেটা লক্ষ্য করা দরকার তা হলাে দেশ তার অভীষ্ট লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হচ্ছে কি-না। তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি নাগরিক নিঃস্বার্থভাবে তার দায়িত্ব পালন করে, যদি আমরা আমাদের শিল্পকারখানা আর ক্ষেত-খামারগুলোর উৎপাদন বাড়াতে পারি তবেই । জনাব তাজউদ্দীন আহমদ দেশের কৃষক শ্রেণীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, গত দু’বছরে দেশের কৃষকরা খাদ্য ঘাটতি বারাে লাখ টন কমিয়ে এনেছে। তিনি জনগণকে দেশের কৃষক সমাজের দৃষ্টান্ত অনুসরণের আহ্বান জানান।
১৯৭৩-৭৪ সালের ২ জুন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ২ হাজার ২৪০টি ভিন্ন বেতন স্কেলকে ১০টি গ্রেডের ভেতর আনা হয়েছে। নতুন বেতন স্কেল ১ জুলাই থেকে শতকরা ৭৫ ভাগ কার্যকর করা হবে, বাকি ২৫ ভাগ আগামী বছর থেকে কার্যকর হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৮৪

অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ওয়াশিংটনে আইএমএফ বৈঠকে যোগদানের জন্য ৮ জুন ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি বলেন, স্পেশাল ড্রইং রাইডার এর মাধ্যমে ঋণদানযোগ্য অর্থ বর্তমান সীমিত সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা ছাড়াও আরও কিছু দেশের মুদ্রার সাথে মানসম্পন্ন হওয়া উচিত। ১২ জুন তিনি মার্কিন সংস্থার প্রশাসক মি. এস এর সাথে বৈঠকে মিলিত হন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা বাংলাদেশকে 15 কোটি ডলার ঋণ দেবে বলে আশা করা যায়।
অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের পুরনো ঋণের ৮৪ ভাগ মওকুফের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
১৯৭৪ সালের ১৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭৪-৭৫ সালের বাজেট উত্থাপন করেন। তিনি ৪৭০ কোটি ২৩ লাখ টাকার রাজস্ব ও ৫২৫ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট পেশ করেন। তিনি বলেন, উন্নয়ন বাজেটে ৩৯৪ কোটি টাকা সাহায্য লাভের সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন, আগামী বছর ১৭ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি থাকবে।
১৯৭৪ সালের ২৩ জুন তাজউদ্দীন আহমদ মিরপুর চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গালের উদ্বোধন করেন।
১৯৭৪ সালের ৮ আগস্ট ৰাগদাদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৯৭৪ সালের ১২ আগস্ট জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সম্মেলনে যােগদান করেন। তিনি কয়েকটি আরব দেশ পরিদর্শন করেন। তার সাথে ছিলেন অর্থসচিব কফিলউদ্দিন মাহমুদ।
১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দেন।
১৯৭৪ সালের ১৩ অক্টোবর বিদেশ থেকে দেশে ফিরে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিক সম্মেলনে তাজউদ্দীন আহমদ যে বক্তব্য প্রদান করেন তা নিয়ে উদ্ধৃত হলো :
“খাদ্য সঙ্কটকে রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। নিরন্ন মানুষকে বাঁচাতে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসুন : অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বর্তমানে জাতীয় দূর্যোগকালে উট পাখির মতাে বালিতে মাথা গুজে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। অবিলম্বে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে জাতীয়ভাবে খাদ্য সঙ্কটের বাস্তব সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি গতকাল ঢাকা বিমানবন্দরে এই অভিমত ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, সকল দল ও মতের নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে
পৃষ্ঠাঃ ৫৮৫

বর্তমান খাদ্য সঙ্কট মােকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর প্রন্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুরোধ করবেন । তিনি তার বক্তব্য দ্বারা কোনাে সর্বদলীয় বা জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেছেন যে, সে প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বর্তমান সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। ক’দিন আগের উপনির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, খাদ্য সমস্যাকে অবশ্যই রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। একথা মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র বক্তৃতা, বিবৃতি, স্লোগান দিয়ে সংকটের সমাধান হবে না। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫৬ সালের সর্বদলীয় খাদ্য কমিটির কথা উল্লেখ করেন।
অর্থমন্ত্রী আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, মানুষ না খেয়ে মরছে – কি অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর অবসান ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, মাটি আর মানুষ নিয়ে দেশ- বাংলাদেশ এখন সার্বভৌম, তার মাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলে কাকে নিয়ে রাজনীতি, কার জন্যই বা রাজনীত। মানুষ যখন মরে যাচ্ছে তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা যায় না। এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের ব্যক্তি নির্বিশেষে ছাঁটাই করা দরকার। এমন কি আমি যদি হই আমাকেও বাদ দেয়া উচিত। মােটকথা যে কোন মূল্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতাে বর্তমান সঙ্কট মােকাবেলা করে মানুষ বাঁচাতে হবে।
জনৈক সাংবাদিক বর্তমান গণঐক্য জোটের পরিপ্রেক্ষিতে তার দলমত নির্বিশেষে খাদ্য সঙ্কট মােকাবেলার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাবি করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি গণঐক্য জোটকে আরাে ব্যাপকভিত্তিক (ব্রড বেজড) করার কথা বলেছি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি মনে করি কিছুসংখ্যক (মাইক্রোস্কপিক মাইনরিটি) লােক যারা বিদেশের এজেন্ট, তারা ছাড়া এ দেশের সকল মানুষ দেশপ্রেমিক। তাছাড়া বিরােধী দল করলেই মানুষ অ-দেশপ্রেমিক হয় না ।
দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, কেউ অভিজাত বিপণী কেন্দ্রে মার্কেটিং করবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে এ অবস্থা চলতে দেয়া যেতে পারে না। তিনি আরও বলেন, যারা আজ না খেয়ে ধুকে ধুকে পথে-ঘাটে পড়ছে-মরছে, তারা আমাদের মানবতাবােধের প্রতি বিদ্রুপ করে বিদায় নিচ্ছে। তিনি জানান যে, বিদেশ সফরকালে তিনি বিদেশী সংবাদপত্রে বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যুর সচিত্র খবর পাঠ করে ব্যথিত হয়েছেন। লন্ডনে ব্রিটিশ টেলিভিশনে তিনি বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যু এবং এরই পাশাপাশি একশ্রেণীর মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার দুই বিপরীত মর্মান্তিক ছবি দেখেছেন। তিনি দেখেছেন ঢাকার রাজপথে না খেয়ে মরে যাওয়া মানুষের লাশ আর তারই পাশাপাশি নাইট ক্লাবে একশ্রেণীর মানুষ বেআইনীভাবে আমদানিকৃত
পৃষ্ঠাঃ ৫৮৬

দামি বিদেশি মদ এবং আস্ত মুরগি খাচেছ। তিনি জানান যে, লন্ডনে বসে নিজ দেশের দুই বিপরীত ও অমানবিক দৃশ্য দেখে তিনি মর্মাহত ও লজ্জিত হয়েছেন ।
তিনি দুঃখ করে বলেন দেশের মানুষ যখন মানুষ যখন না খেতে পেয়ে মরছে, তখন কালো টাকার মালিকরা তাদের সম্পদ আরও বাড়ানাের জন্য অবৈধ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি সকল অধঃপতন ও দুর্নীতির মূল কারণ । আমরা স্থায়ীভাবে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হতে পারি না। আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। সেই সম্পদ আহরণ করে গণমানুষের মধ্যে সুষম বণ্টনের মাধ্যমে আমাদের সুষম জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার কাজ করে যেতে হবে। যদিও অনেক আগ থেকেই আমাদের তা করা উচিত ছিল।
অর্থমন্ত্রী দেশের বিত্তবান লােকদের কৃছু সাধনের জন্যও আহবান জানান। তিনি বলেন, যাদের নাই তাদেরকে কৃচ্ছ্র সাধনের কথা বলে মরতে বলতে পারি না। আমরা সবাই সহানুভূতিশীল হলে এ পরিস্থিতির বেদনা কিছুটা প্রশমিত হতো।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, সরকারী দলই হােক আর বিরােধী দলই হােক- কারাে হাতে অস্ত্র থাকা উচিত নয়। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও উপদলের মধ্যে অনাস্থার মনােভাব সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা কেন সরকারের ভালমন্দ তুলে ধরছেন না? কেন বাস্তব অবস্থা তুলে না ধরে জনগণকে শুধু আশার বাণীই শােনাচ্ছেন? অমুক দেশ থেকে চাল আসছে, গম আসছে, সাহায্য পাওয়া যাবে- এইটুকু লিখলেই চলবে না। কিভাবে উৎপাদন বাড়ানাে যেতে পারে, কিভাবে সকল মানুষকে একত্রিত করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে তার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
পরিশেষে তিনি বলেন যে, একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তােলার ব্যাপারে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।”৮
২৩ অক্টোবর ১৯৭৪, আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি সংস্থার উদ্যোগে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসেরের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়। অনুষ্ঠানে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলাের মধ্যে সংহতি আবশ্যক।
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর অর্থ ও পাটমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পদত্যাগ করেন।
১৯৭৪ সালের আগস্ট মাস হতে চরম খাদ্যাভাব দেখা দেয় । দুর্ভিক্ষে ২৭
পৃষ্ঠাঃ ৫৮৭

হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে।
১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তির আলােকে ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর সংবিধানে তৃতীয় সংশােধনী আনা হয়।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী অনুমোদন করা হয়। চতুর্থ সংশােধনীতে একদলীয় শাসন ও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং এম মনসুর আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল- উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি দমন।
তিনি ১৬ জুলাই ৬১ জন গভর্নর নিয়ােগ করেন।
ইতিহাসের পাতা থেকে
১৯৭২ সালের ৭ জুন পালন উপলক্ষে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ৭ জুন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মােড় পরিবর্তন।
তিনি বলেন, পয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর আইয়ুব খান আসলেন ঢাকা। জনাব নুরুল আমিন উদ্যোগ নিলেন তার সাথে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতাদের সাক্ষাত ঘটানাের। আমাদের সাথে আইয়ুব খানের সে সাক্ষাতকার হয়েও ছিল। কিন্তু এর আগে আমরা তৎকালীন স্থানীয় সমস্যাসহ পাকিস্তানির রাজনৈতিক পটভূমিকায় তৈরি করি একটি দাবিনামা। তাতে ছিল তেরােটি দফা (১৩টি দফা)। নুরুল আমিন সাহেবকেও তার একটি কপি আমরা দিয়েছি। কিন্তু তিনি সে কপির দফাগুলাে দেখেই চমকে উঠলেন। বললেন, তাহলে তাে আর আলােচনাই হতে পারে না আইয়ুব খানের সাথে । আমরা অনড় রইলাম। তবুও সাক্ষাতকার হলাে। সম্ভবত নুরুল আমিন সাহেব তার কপিটা আইয়ুব খানকে দিয়েছিলেন।
তারপর আসল ১৯৬৬ সাল। লাহােরে বসল সর্বদলীয় কনফারেন্স। এর উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য ছিল সব বিরােধী জড়াে করিয়ে তাসখন্দ ঘােষণার বিরুদ্ধে কিছু আদায় করে নেয়া। আমরাও সে সম্মেলনে আমন্ত্রণ পেলাম । যাবার আগে শেখ সাহেব বললেন, লাহাের কনফারেন্সের জন্য বাঙালীদের পক্ষ থেকে কিছু তৈরি করে নিতে। আমরা তখন সেই ১৩ দফার স্থানীয় কিছু বাদ দিয়ে তৈরি করলাম এক দাবিনামা । তাতে অনেক উপদফা বাদ দিয়ে মােট দাবি হলো ৬টি।
পৃষ্ঠাঃ ৫৮৮

তাই নিয়ে আমরা লাহোরে, তা পেশ করা হলো সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে। কিন্তু সাবজেক্ট কমিটি আমাদের দাবিনামা দিলেন নাকচ করে। পরদিন প্রতিবাদে আমরা বর্জন করলাম সর্বদলীয় সম্মেলন।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, দাবিনাময় যে ৬টি দফা ছিল তার ওপর আমরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সম্মেলন বর্জনের পরদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে ব্যানার হেডিংয়ে বের হলো শেখ সাহেবের ৬ দফা। অথচ সে সময়ে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে (ডিপিআর) কোন সম্মেলনের খবর প্রকাশ করা ছিল নিষিদ্ধ । তবুও ৬ দফার সংবাদ বের হলো খবরের কাগজে। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদের অপবাদ দিয়ে লেখা হলাে সম্পাদকীয় । ৬ দফা দাবি ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র।
সে বছর মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বসল আওয়ামী লীগের বার্ষিক কাউন্সিল সভা। আমরা ৬ দফাকে অন্তর্ভুক্ত কলাম আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে। মার্চের কাউন্সিল অধিবেশনের তৃতীয় ও শেষ দিনে ২০ মার্চ পল্টনে হলাে আমাদের বিরাট জনসভা। শেখ সাহেব ব্যাখ্যা দিলেন ৬ দফা কর্মসচির। শুরু হলো ৬ দফা আন্দোলন। শেখ সাহেব সফর করলেন সারা বাংলা। সভা করে আমরা প্রচার শুরু করলাম ৬ দফার।
কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হলাে আইয়ুব শাহীর মরণছােবল। নেমে আসাতে লাগল নির্যাতনের স্টিমরােলার। শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় জনসভার পর দায়ের করা হলাে মামলা। জামিন নাকচ করে বার বার তাকে করা হলাে গ্রেফতার। সর্বশেষে ১৯৬৬ সালের ৮ মে তাকে গ্রেফতার করে নেয়া হলাে সেন্ট্রাল জেলে। তার সাথে গ্রেফতার হলেন জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী, খন্দকার মুশতাক আহমদ, জনাব নুরুল ইসলাম, রাজশাহীর মুজিবর রহমান ও আমি (তাজউদ্দীন)। তারপর ধীরে ধীরে গ্রেফতার হতে লাগলেন আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা।
শেখ সাহেব ও আওয়ামী লীগের ওপর এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল বাঙালী জাতি । বজ্রকণ্ঠে তার দাবি জানালেন তাদের প্রিয় নেতার মুক্তির । কিছু টনক নড়ল স্বৈরতন্ত্রী শাসকদের। অবশেষ ৭ জুন ডাক দেয়া হলাে সারা দেশব্যাপী পূর্ণ হরতালের। হরতাল পালিত হলাে বাংলাদেশের শহরে-বন্দরে, হাটে-গঞ্জে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, গায়ে পাঠশালায় । কলের চাকা সেদিন ঘােরেনি। ওঠেনি চিমনির ধোঁয়া । বাজেনি কারখানার ভেঁপু। গাড়ির চাকা বন্ধ । সারা দেশব্যাপী বিক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল স্রোত। বন্যার বেগে তারা নেমে আসলেন রাজপথে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৮৯

অপরদিকে স্বৈরাচারী আইয়ুব-মােনেম খান জারি করলেন ১৪৪ ধারা। তলব করা হলাে সেনাবাহিনী। কিন্তু বিপ্লবী জনতা কোন বাধাই মানলো না। বজ্রমুষ্ঠি তুলে বেরিয়ে আসলেন রাজপথে । বিপ্লবের লাল ঝান্ডা উড়িয়ে শ্রমিকরা নেমে পড়লেন পথেঘাটে। শুরু হলাে গুলি। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ। শহীদ হলেন এগারােজন সংগ্রামী বীর। আহত হলেন শত শত।
কিন্তু এই নজিরবিহীন নির্যাতনেও ৬ দফার আন্দোলন এগিয়ে চলল, শাসকগােষ্ঠী হয়ে পড়লেন ক্ষেপা কুকুরের মত। তারা সাজালেন মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। শেখ সাহেবকে করা হলাে মামলার এক নম্বর আসামি। কিন্তু তাও টেকেনি। জনতার রুদ্ররােষে তা ভেসে গেল। শেখ সাহেবকে সম্মানে মুক্ত করে দেওয়া হলো। তারপর নির্বাচন। সবশেষে শুরু হলো স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জনাব তাজউদ্দীন বললেন, ৭ জুনকে এক অর্থে বলা যায় ৬ দফার দিবস। এই দিনে ৬ দফার দাবিতে বাঙালী রক্ত দিতে শুরু করে। স্বাধিকারের এই আন্দোলনই ধাপে ধাপে রক্ত নদী পেরিয়ে স্বাধীনতাযযুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়েছে। কাজেই বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রমে ৭ জুন অমর। অবিস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক দিন ৭ জুন।
জুন ৮, বৃহস্পতিবার : দৈনিক বাংলা
বাংলাদেশের ধনতন্ত্রের সমাধি হবে : অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জগন্নাথ কলেজের এস আর হল ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে এক বক্তৃতায় বলেন, আমরা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বদ্ধপরিকর। ধনতান্ত্রিক দেশে এবং সমাজতান্ত্রিক দেশের বন্ধুত্বের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণকে অবশ্যই পার্থক্য নির্দেশ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তা না হলে সাহায্যের ছদ্মবেশে সাম্রাজ্যবাদের বিষ আমাদের দেশে প্রবেশ করবে।
মন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন যে, সাম্রাজ্যবাদীদের সাহায্য শর্ত যে কোন দেশের পক্ষেই ক্ষতিকর । অর্থমন্ত্রী বলেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ইউরােপের জনগণকে শােষণ করার জন্য তথাকথিত মার্শাল পরিকল্পনা প্রণয়ন, ন্যাটো ও অন্যান্য নিরাপত্তা চুক্তি চালু করে। তিনি বলেন যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সােভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরােপের দেশগুলাের ২ কোটি ৪০ লাখ লােক নিহত হয়েছিল, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী সাহায্য ছাড়াই এই সব দেশ পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে প্রভূত উন্নতি করেছে। তিনি যুব সমপ্রদায়, আওয়ামী লীগ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে স্বাবলম্বী হওয়ার অভিযান চালাতে আহ্বান জানান। মন্ত্রী আরও বলেন যে, তাদের রাস্তায় নেমে আসতে হবে এবং দরিদ্র মানুষের নিকট ত্রাণসামগ্রী।
পৃষ্ঠাঃ ৫৯০

পৌছে দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশ চিরদিনের জন্য ধনতন্ত্রের সমাধি হয়ে গেছে এবং ভবিষ্যতেও ধনতন্ত্র এবং সম্রাজ্যবাদের বিকাশের কোন সুযোগ থাকবে না। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের দালালরা সরকারের সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচিকে নস্যাৎ করার জন্য চেষ্টা করছে। এসব চক্রান্তের মূলোচ্ছেদ করার জন্য তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চারটি আদর্শকে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফর্মুলা হিসেবে চালু করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে কোনাে আদর্শই কোনো দেশে অপরিবর্তিতভাবে প্রয়ােগ করা যায় না।
একটি দেশের পরিবেশানুযায়ী এর পরিবর্তন হয়। তিনি বলেন যে, শুধু সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে কোন দল হবে না। যুবকদের মানসিক গঠনের বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। কৃষক-শ্রমিকরাজ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি তাদের আত্মোৎসর্গ করতে আহ্বান জানান। বাসস গত মঙ্গলবার এই খবর পরিবেশন করে।
জুলাই ১৩, ১৯৭২ বৃহস্পতিবার : দৈনিক পূর্বদেশ
পাটের চাহিদা কমেনি, উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে : নারায়ণগঞ্জ, ১২ জুলাই (এনা) : কৃত্রিম বিকল্পের মুখে বিশ্বের বাজারে পাটের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে বলে পাকিস্তানি আমলে যে প্রচারণা চালানাে হতাে অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ তাকে প্রতারণা ও দুরভিসন্ধিমূলক বলে আখ্যায়িত করেছেন। আজ সকালে এখানে অনুষ্ঠিত এক সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দানকালে মন্ত্রী বলেন যে, সমস্ত চ্যালেঞ্জ ও হুমকির মুখেও পাটের প্রয়ােজনীয়তা স্থায়ী হতে বাধ্য এবং ক্রমেই নতুন নতুন কাজে পাটের ব্যবহার চলবে।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ জানান যে, চলতি বছর দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানাের পর বাংলাদেশের হাতে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ বেল রপ্তানিযােগ্য পাট থাকবে। এর মধ্যে ভারত একাই তার চাহিদা পূরণের জন্য ২০ লাখ বেল পাট নেবে। তিনি বলেন, বাকি পাট বিশ্বের অন্যান্য দেশের চাহিদা মেটানাের জন্য যথেষ্ট | বাংলাদেশের উচ্চমানের পাটের চাহিদা আন্তর্জাতিক বাজারে খুবই বেশি। তিনি ঘােষণা করেন, কৃষকরা যাতে পাটের ন্যায্য মূল্য পান এবং পাট শ্রমিকরা যাতে লাভ করেন, সুবিচার পান, সে জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার দৃঢ় সঙ্কল্পবদ্ধ। তিনি বলেন, পাকিস্তানি আমলে পাট উৎপাদনকারী ও পাট শ্রমিকরা ঘােষিত হতেন এবং পারে গুরুতৃকে খাটো করে দেখা হতাে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৯১

অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন দেশে যে সরকার ক্ষমতায় রয়েছে তারা দেশের সম্পদ দিয়ে দেশের কল্যাণ সাধন এবং জনগণের জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, পাটই বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ এবং উৎপাদন বৃদ্ধি না পেলে দেশবাসীর ভাগ্যোন্নয়নের কোন আশা নেই। তাই তিনি সকলের কাছে উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান জানান । দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, অতি অল্পসংখ্যক যুবক সমাজ বিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে সমগ্র ছাত্রসমাজ ও মুক্তি সংগ্রামীদের মুখে কলঙ্ক লেপন করেছে। এতদপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার সমাজ দেহ থেকে এই সব দুষ্টক্ষত সম্পূর্ণ নির্মূল করতে যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। সভা শেষে অর্থমন্ত্রী শুভ পাট ক্রয়ের সূচনা করেন। তিনি প্রতিমণ কাঁচা পাটের মূল্য বাবদ ৫১ টাকা ২৫ পয়সা প্রদান করেন। এরপর তিনি জুট বিলিং ও প্রসেসিংয়ের বিভিন্ন শাখা ঘুরে দেখেন।
সেপ্টেম্বর ৬, ১৯৭২ বুধবার : দৈনিক ইত্তেফাক
লেখাপাড়ার সাথে সাথে ছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠন করিতে হইবে
ধামরাই, ৪ সেপ্টেম্বর : সম্প্রতি অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ধামরাই মহাবিদ্যালয়ের উদ্বোধন করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, লেখাপড়ার সাথে সাথে ছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠন করিতে হইবে। তিনি বলেন, বর্তমান তরুণ সমাজের নিকট দেশ অনেক কিছু আশা করে। মন্ত্রী মহােদয় বলেন, বর্তমানে দেশের অভ্যন্তরে এক শ্রেণীর সমাজবিরােধী লােক পণ্য দ্রব্যের কালােবাজারি ও দ্রব্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করিতেছে। তিনি ইহাদের দমন করিবার জন্য তরুণদের প্রকৃত ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। জনাব তাজউদ্দীন সভায় দেশী-বিদেশী সমস্ত প্রকার চক্রান্তকে নস্যাৎ করিয়া দেশ গঠনের কাজে ছাত্র-ছাত্রীদের আত্ম- নিয়ােগের আহ্বান জানান। উক্ত ছাত্র সভায় মন্ত্রী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চীনের ভেটোতে শুধু বিস্মিত নয় দুঃখিত হইয়াছেন বলিয়া উল্লেখ করেন। মন্ত্রী মহােদয় কলেজের জন্য সরকারের সম্ভাব্য সবরকমের সাহায্যের আশ্বাস করেন।
সেপ্টেম্বর ১১, ১৯৭২ সােমবার : দৈনিক পূর্বদেশ
চীন স্বীকৃতি দিক আর নাই দিক কিছু আসে যায় না : অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, এই উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ জাতিসংঘে যেতে চেয়েছিল। পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের বাস্তবতা স্বীকার করে নেয় তা হলে এই উত্তপ্ত হাওয়া দূর হয়ে এখানে শান্ত হাওয়া বিরাজ করবে।
পৃষ্ঠাঃ ৫৯২

আমরা যুদ্ধের প্রতিশোধ চাই না, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই । সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শত্রু ও বন্ধু সেজে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
তিনি বলেন, চীন উপরে বসে এবং আমেরিকা তলে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই দুই দেশের পথ পৃথক হলেও উদ্দেশ্য তাদের এক, চীন ভেটো দিয়েছে, আমেরিকা ভেটো দেয়নি। তারা উভয়েই বাংলাদেশে একটুখানি ঠাই চায় ।
জনাব তাজউদ্দীন রাষ্ট্রীয় নীতিতে বিশ্বাসী সকল রাজনৈতিক দলকে দেশের উন্নতিকল্পে জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার আহ্বান জানান। আদমজীতে শ্রমিক দাঙ্গার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তিনি কল-কারখানা ও ক্ষেতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দেশের সকল শ্রমিক ও কৃষকের প্রতি আহ্বান জানান।
ছাত্রদেরকে পড়ালেখার প্রতি মনােযােগী হবার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যে সকল ছাত্র নকল করে পরীক্ষা পাস করে পরবর্তী কালে তারাই দুর্নীতিবাজ আমলায় পরিণত হয়। তিনি ছাত্রসমাজকে সমাজতন্ত্রের কারিগর হিসেবে গড়ে উঠার আহ্বান জানান। দেশের রাজনৈতিক কাঠামাে গণতান্ত্রিক আর অর্থনৈতিক কাঠামাে সমাজতান্ত্রিক বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চীনের ভেটো প্রয়ােগের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, চীন বা কোন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল কি দিল না তাতে বাংলাদেশের কিছু যায় আসে না। আকাশে সূর্য উঠলে যদি কেউ তা না দেখে তবে তাকে অন্ধ বলেই ধরে নিতে হবে।
সেপ্টেম্বর ২৫, ১৯৭২ সােমবার : দৈনিক বাংলা
কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রী সম্মেলনে তাজউদ্দীন; উন্নয়নশীল দেশের
স্বার্থরক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে
লন্ডন, ২৪ সেপ্টেম্বর (বাসস) : বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনা দফতরের মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বৃহস্পতিবার এখানে বলেন যে, আগামী বছর ব্রিটেন ইউরােপীয় সাধারণ বাজারে অন্তর্ভুক্ত হলে কমনওয়েলথের উন্নয়নগামী দেশগুলাের বাণিজ্য ও আর্থিক স্বার্থরক্ষার প্রয়ােজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরােপ করতে হবে ।
তিনি এখানে কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রী সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে বক্তৃতাকালে এ কথা বলেন। ভাসমান পাউন্ড স্টার্লিং ও বর্তমান অর্থ সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সমস্যাবলীর কথা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, সে সকল দেশের অর্থ ব্যবস্থা স্টার্লিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং
পৃষ্ঠাঃ ৫৯৩

যে সব দেশ পাউন্ড স্টালিংকে গচ্ছিত মুদ্রার রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে তাদের স্বার্থ পুরােপুরি রক্ষা করতে হবে।
দৈনিক ইত্তেফাক, সেপ্টেম্বর ২৫, ১৯৭২ সোমবার
জনগণকে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে
লন্ডন, ২৪ সেপ্টেম্বর : লন্ডনে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রী সম্মেলন শেষে জনাব তাজউদ্দীন এনা প্রতিনিধিকে বলেন যে, বাংলাদেশের জনগণকে নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে।
দৈনিক বাংলা, সেপ্টেম্বর ৩০, ১৯৭২ শনিবার
বিশ্বব্যাংকের সভায় তাজউদ্দীনের হুশিয়ারি; ধনী ও দরিদ্র দেশের বৈষম্য
বিশ্বশান্তির প্রতি হুমকিস্বরূপ : ওয়াশিংটন
২৯ সেপ্টেম্বর (রয়টার/এনা) : গতকাল এখানে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও বিশ্ববাংকের বার্ষিক সভায় বক্তৃতাকালে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে উদার মনোভাব নিয়ে সাহায্য দানের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বিশ্বের ধনী ও গরিব দেশসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য যে রকম ব্যাপকভাবে বেড়ে চলেছে তাতে বিশ্ব শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে, বিশ্ব শান্তির পক্ষে এ বৈষম্য এক মারাত্মক হুমকি রূপে এগিয়ে আসছে।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ অভিযােগ করেন যে, বিশ্বের ধনশালী দেশগুলো সহযােগিতার লক্ষ্য সঙ্কুচিত করছে এবং যেটুকু সাহায্যদান করছে তাও শর্ত সাপেক্ষে সাহায্য।
সাম্প্রতিক ভাসমান পাউন্ড স্টার্লিং পরিস্থিতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধনশালী দেশসমূহের দায় পরিশােধ বা ব্যালেন্স অব পেমেন্ট গরিব দেশসমূহের ভাগ্য তথা অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। গরিব দেশসমূহের অর্থনীতির উপর ধনী দেশের বা দেশসমূহের প্রতিক্রিয়া মারাত্মকভাবে দেখা দিয়ে থাকে। তিনি বলেন, গত ২৫ বছরে বিশ্ব যে কেবল ধনী ও দরিদ্র দেশসমূহের মধ্যে বিভক্ত হয়ে গেছে তা নয় বরং বিভক্ত দুই গ্রুপের দেশগুলাের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও দেখা দিয়েছে দুঃখজনকভাবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ বাড়েনি এবং গরিব দেশগুলাের জাতীয় উৎপাদনের লক্ষ্য হ্রাস পেয়েছে। তিনি বলেন, বৈদেশিক সাহায্য প্রকল্পের মধ্যেই সীমিত রয়েছে।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ অভিযােগ করেন যে, কিছু দেশ এমন কঠিন শর্ত
পৃষ্ঠাঃ ৫৯৪

ও স্বল্পমেয়াদী ঋণ দেয় যার সঙ্গে ব্যক্তিগত রফতানিকারকদের দেয়া ঋণের কোন তফাৎ নেই। এসব ঋণ নিয়ে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশসমূহের কোন কাজ হয় না অনুন্নত ও দরিদ্র দেশসমূহের প্রয়ােজন সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ । তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলাে বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে তাদের শর্তাবলী আরাে সহজ করবে।
তিনি বলেন, ট্যারিফ, কোটা ও অভ্যন্তরীণ বিধিনিষেধের মাধ্যমে উন্নত দেশসমূহের অনুন্নত ও গরিব দেশগুলাের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন যে, ধনী দেশগুলাে দরিদ্র ও অনুন্নত দেশসমূহের কৃষিপণ্য ও শিল্পপণ্যের ওপর সংরক্ষণ নীতি আরােপ করে আসছে।
সেপ্টেম্বর ৩০, ১৯৭২ শনিবার : দৈনিক পূর্বদেশ
উন্নয়ন স্বয়ম্ভরতাই আমাদের লক্ষ্য : ওয়াশিংটন, ২৯ সেপ্টেম্বর (এনা) : বাংলাদেশের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গতকাল এখানে বলেন যে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতাই তার দেশের লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন যে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বৈদেশিক সাহায্য পরিত্যাগ করবে। এখানে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহিলের বার্ষিক সম্মেলনে বকৃতা প্রসঙ্গে তিনি এই মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, জনাব তাজউদ্দীন আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলেরও অন্যতম গভর্নর। জনাব তাজউদ্দীন আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত বৈদেশিক সাহায্য পরিত্যাগের সঙ্কল্প নিয়েই আমরা এখন এটা প্রার্থনা করছি। বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বয়ম্ভর হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
জনাব তাজউদ্দীন বলেন যে, বাংলাদেশের সামাজিক অবয়বে মৌল পরিবর্তনের ধারা বইছে। গণতান্ত্রিক কাঠামাের উপর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তােলাই বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরকারি খাতের ভূমিকাকে প্রধান্য দেয়াই আমাদের উদ্দেশ্য।
জনাব তাজউদ্দীন বলেন যে, তার দেশ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমাজে পূর্ণও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য প্রতীক্ষা করছে। তিনি তার দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি গড়ে তােলার জন্য সাহায্য কামনা করেন।
জনাব তাজউদ্দীন এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, ধনী ও গরিব দেশগুলাের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান বিশ্ব শান্তির পক্ষে হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তিনি ধনী দেশগুলাের বিরুদ্ধে সংরক্ষণবাদ, অর্থ সাহায্য হাস ও শর্তযুক্ত সাহায্য দিনের অভিযােগ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৫৯৫

ডিসেম্বর ৬, ১৯৭২ বুধবার : দৈনিক বাংলা
রুশ-ভারত সহযােগিতা চুক্তিই ছিল ভিত্তি : মুজিবনগরে তখন নতুন প্রস্তুতির পালা। উত্তপ্ত হৃদয়ে সুস্পষ্ট ঘােষণা। চল, ঢাকা চল। এ শুধু স্লোগান নয়। যেন সাগরের আহ্বান। সেই আহ্বানের প্রতিধ্বনি ওঠে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে ।
বিপ্লবী বাংলাদেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের মাত্র কিছুদিন আগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের জনৈক এমপিকে বলেছিলেন, আগামী ডিসেম্বরেই ঢাকায় দেখা হবে। কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও বাস্তব পরিস্থিতির উপলব্ধি থেকেই তার পক্ষে সেদিন এ মন্তব্য করা সম্ভব হয়েছিল।
পর এক বছরের মাথায় স্বাধীন মুক্ত রাজধানীর বুকে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ দৈনিক বাংলার প্রতিনিধিকে বলেন, ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট সম্পাদিত ঐতিহাসিক ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তিই ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাকে স্বীকৃতি দানের প্রথম ভিত্তি। এটি ছিল বর্তমান বিশ্বের কুটনীতির ক্ষেত্রে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর অসাধারণ সাফল্য।
সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অনুরোধ জানিয়ে ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর প্রথম শ্ৰীমতী ইন্দিরাকে চিঠি লিখি। এরপর ২৩ নভেম্বর আর একখানা চিঠি দেই। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে ঘোষিত যুদ্ধের ঠিক আগের দিন ২ ডিসেম্বর ও পরের দিন ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। ৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ভারতীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের কথা ঘােষণা করার পর শ্রীমতী ইন্দিরা আমাকে একখানা আনুষ্ঠানিক চিঠি দেন। ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেল সােয়া তিনটায় মুজিবনগরে সে চিঠি আমার হাতে এসে পৌঁছে।
শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন : অর্থমন্ত্রী বলেন, সমাজতান্ত্রিক ধরনের সমাজের চাহিদা পূরণের উপযােগী করে সমগ্র শিক্ষা পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করা হবে। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাবার জন্য যে সব অশুভ শক্তি পায়তারা করছে তাদেরকে মন্ত্রী সতর্ক করে দেন।
আটক বাঙালীদের ফেরত দিতেই হবে : অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, প্রেসিডেন্ট ভুট্টো যা খুশি বলুন না কেন, তাকে পাকিস্তানে আটক চার লাখ বাঙালীকে ফেরত দিতেই হবে। তিনি ভুট্টোকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়ার জন্য আবার উপদেশ দেন।
তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে চীনের ভেটো প্রয়ােগে দুঃখ
পৃষ্ঠাঃ ৫৯৬

প্রকাশ করেন। তিনি আশা করেন, চীনের মহান জনগণ ও নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবেন।
ডিসেম্বর ১৩, ১৯৭২ বুধবার : দৈনিক বাংলা।
স্বাধীনতার বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে বিশেষ সাক্ষাতকারে তাজউদ্দীন
জাতিকে সঠিক পথ দেখানাের দায়িত্ব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলাের
সটাফ রিপোর্টার : জনাব তাজভপান আহমদ বলেছেন, বর্তমান বাস্তব পরিস্থিতিতে আপন লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য জাতিকে একটি সঠিক চলার পথ ধরিয়ে দেয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলােকেই পালন করতে হবে।
স্বাধীনতার বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে সাংবাদিকদের সাথে এক বিশেষ সাক্ষাতকারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গতাকল মঙ্গলবার এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন ।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ারই সাহায্য নিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতান্ত্রিক দেশের সাহায্যে কোন সমাজতান্ত্রিক দেশকে সত্যিকারভাবে গড়ে তােলা যায় না।
তিনি বলেন, ভিয়েতনামে মার খাওয়ার পর আমেরিকা যেন বাংলাদেশে নতুন ঘাঁটি গড়তে না পারে সেদিকে সকলকে সজাগ ও হুশিয়ার থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সংবিধানে সমাজতন্ত্রে অগ্রসর হওয়ার পথ বন্ধ হয়নি, বরং সে পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য কতকগুলাে সঠিক পথ-নির্দেশ রয়েছে। উনিশ শতকের ধারণা নিয়ে আজকের দিনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এ গণতন্ত্রে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী জনগণের অবশ্যই সমর্থন থাকতে হবে।
মুজিবনগরস্থ বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বীর যুবসমাজের প্রভাবকে কখনােই অস্বীকার করা যাবে না। এই যুবশক্তিকে দেশ গড়ার কাজে নিয়ােজিত করার একটি পরিকল্পনা প্রণীত হচ্ছে। নির্বাচনের পর সরকার সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার পর এই যুব শক্তিকে সফলভাবে দেশ গড়ার কাজে আমরা নিয়ােজিত করতে পারিনি বলেই যুবসমাজ কিছুটা বিপথগামী হয়ে পড়েছে। তাদের কাছে অর্থ ও সম্পদ উপার্জন নয়, অন্যের কাছ থেকে তা কেড়ে নেবার অশুভ প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এটা জাতির জন্য খুবই ক্ষতিকর।
পৃষ্ঠাঃ ৫৯৭

জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আপাতদষ্টিতে মনে হলেও দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে হতাশ হবার কিছু নেই। সংবিধান চালু হলেই দেশে স্থিতিশীলতা আসবে।
সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন দৃঢ়তার সাথে বলেন, আমাদের দেশে ‘মুসলিম বাংলা’ আন্দোলন কোনদিনই কার্যকর হবে না। তবে এর বিপদ সম্পর্কে সকলকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। পাকিস্তান আমলে ইসলামের নামে সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দেয়া হতো। এখন মুসলিম বাংলার নামে তারিখ নতুন কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। একে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর আলোকপাত করতে অনুরোধ জানানাে হলে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সমকালীন ইতিহাস রচনা ও তা প্রকাশ করা খুবই কঠিন। কারণ তাতে জীবিত ব্যক্তিদের সংঘর্ষ হতে পারে। এতে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, জাতীয় স্বার্থে মিথ্যা কথা বলব না, সত্য গোপন করতে পারি। তিনি বলেন, ‘৭১ সালের ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সম্ভাব্য গেরিলা যুদ্ধের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। ২৫ মার্চে ইয়াহিয়া বাহিনীর আক্রমণের পূর্বে কয়েকদিনে কমপক্ষে চল্লিশটি দেশের রাষ্ট্রদূত আমার সাথে সাক্ষাত করেন। আমি আগে থেকেই বাংলাদেশ সম্বন্ধে আমেরিকা সরকারের মনােভাব জানতাম। ২৭ মার্চ ফরিদপুরে সম্ভবত ইমামউদ্দিন সাহেবের বাড়িতে বেলা দুটোর দিকে বেতারে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা প্রথম শুনি। এ ঘােষণার সাথে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন যােগাযােগ ছিল না।
তাজউদ্দীন আহমদ আরাে বলেন, ইয়াহিয়া খান ই.পি.আর., ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বেসামরিক প্রশাসনের ওপর আঘাত করে প্রথমেই মারাত্মক ভুল করে। সাধারণত এসব মুহূর্তে কোন ঔপনিবেশিক শক্তি তার ঘনিষ্ঠতর প্রতিবেশী শক্তিকে আঘাত করে না। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মার্চের অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে গােটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া বাহিনী সেই ঐক্যবদ্ধ গােটা জাতিকে সামগ্রিকভাবে আঘাত করে ভুল করে । মূলত ঐ রাতেই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের প্রথম বিজয় সূচিত হয় ।
তিনি বলেন, বেসামরিক প্রশাসনকে আঘাত করার ফলেই আমাদের পক্ষে আত্মগােপন করে মুজিব নগরে একত্র হওয়া সম্ভব হয়েছিল। এমনকি ২৫ মার্চের আগে ইয়াহিয়া খানের সামরিক উপদেষ্টা লে, জে, পীরজাদার কাছে প্রেরিত লে.
জে, টিক্কা খানের গােপন বার্তাটিও আমার হাতে আসে। আমি তা বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়েছি ।
পৃষ্ঠাঃ ৫৯৮

তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আগে কখনাে ভাবিনি যে, আমার মত সাধারণ কর্মীর ওপর ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব পড়বে। দেশবাসীও সম্ভবত তা পূর্বে কখনো ভাবেনি। আসলে নেতৃত্ব হচ্ছে জনগণের মনের আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। গণতন্ত্রের পথে কিংবা কোন যুদ্ধ জোটে যাব না- এই মনোভাব নিয়েই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করি। স্বাধীনতা সংগ্রামে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি বিরাট পদক্ষেপ।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান তার বন্ধুদের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির বহু চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ও আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য বহুভাবে চেষ্টা করেছিল। সংগ্রামের এক পর্যায়ে আমেরিকা প্রশ্ন তােলে- ‘স্বাধীনতা চাও না, মুজিবকে চাও । এক উত্তরে আমি বলেছিলাম, স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকও চাই। স্বাধীনতা এলেই মুজিবকে পেতে পারি। কারণ আমি জানতাম আদর্শের মধ্যেই শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই স্বাধীনতা সংগ্রাম জোরদার হবে। আর এর দ্বারাই বঙ্গবন্ধুকে বাচিয়ে রাখা সম্ভব হলেও হতে পারে। বঙ্গবন্ধুর সাথে ২৭ বছর রাজনীতি করেছি, তাকে আমি গভীরভাবে জানি। তিনি বলেন, কৌশলগত হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে যুদ্ধে চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। মওলানা ভাসানীর মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য চীনের নেতৃবৃন্দের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, মওলানা ভাসানী এখন অনেক উল্টাপাল্টা কথা প্রচার করছেন।
ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭২ শনিবার : দৈনিক পূর্বদেশ
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমি কখনাে নিরাশ হই না : স্টাফ রিপাের্টার ॥
বাংলাদেশের ভবিষ্যত চিন্তা করে আমি কখনাে নিরাশ হই না। স্বাধীনতা লাভের পর গত এক বছরে এ দেশের সমস্যা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে তা প্রকট হয়েছে। বিপ্লবের পর সব দেশেই এটা হয়েই থাকে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের উত্তরণে এসব সমস্যার বেশিরভাগই তখন সমাধান হয়ে যায়। সে জন্যই আমি নিরাশ হই না।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকালে বিপ্লবী সরকারের সুযােগ্য প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক ঘরােয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তার মতে, দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণীর মানুষকে দেশ গঠনের দায়িত্বে এগিয়ে আসা উচিত। কিন্তু এটা হচ্ছে না দেখে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তার অনুযােগ বাংলাদেশের বিরােধী দলগুলাে সরকারের ভুলক্রটিকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনেই তাদের রাজনীতিকে সীমিত রেখেছেন। অথচ আমরা দীর্ঘ ২৩ বছর বিরােধী দলের ভূমিকা পালন করেছিলাম
পৃষ্ঠাঃ ৫৯৯

এর আগে। কিন্তু কখনই কারাে বিরুদ্ধে অশালীন কথাবার্তা কিংবা কাল্পনিক অভিযােগ করিনি। এছাড়া আমরা বিরােধী দল করলেও দেশের যে কোনো দুর্যোগ বা দুঃসময়ে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সেবায় আমাদের সামান্য সম্পদ দিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়তাম। তিনি বলেন, লােককে উস্কানি দেয়া খুব সহজ। কিন্তু তাদের সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া খুবই কঠিন কাজ। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন যে, বিরোধী দলগুলাে তাদের ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করছেন না বলে তার বিশ্বাস করার কারণ ঘটেছে, গত এক বছরে তাদের ভূমিকা অবলােকন করে। তিনি বলেন, এ দেশের জনগণের কল্যাণের স্বার্থেই প্রতিটি বাঙালীকে তা সে সরকারি দলের হােক বা বিরােধী দলেরই হােক একই সঙ্গে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে যেতে হবে।
যুবশক্তি : দেশ গঠনে যুবশক্তির ভূমিকাও অগ্রগণ্য হওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে বিপ্লবােত্তর যুব শক্তিকে সদ্ব্যবহার করা যায়নি একথা সত্য এবং এ কথা স্বীকার করে নিতে কারও কাপর্ণও দেখানো উচিত নয়। তাদের দেশ গঠনে উদ্বুদ্ধ করার যথােপযুক্ত ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, তবে আমি দেশের বর্তমান অবস্থায় আদৌ নিরুৎসাহিত নই। সংবিধান প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন যে, বর্তমান অবস্থায় এই সংবিধানের চাইতে আর কোনো উন্নত সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভবপর ছিল না। তিনি বলেন, দেশের ভাবি নেতৃবৃন্দ এবং সংসদই দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যাবতীয় স্বার্থকে রক্ষা করবে। আর দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে জনগণের সমকালীন ধ্যান-ধারণাই কাজ করে যাবে।
আমেরিকা প্রসঙ্গে : মন্ত্রী বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশকে তার বিশ্ব রাজনীতির দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। এই চেষ্টা সে করবেই। কেননা ভিয়েতনাম থেকে তাকে হাত গুটাতে হবে। আর সে জন্যই চাইবে বাংলাদেশে থাবা বিস্তার করতে।
তিনি বলেন, একমাত্র জনগণের মিলিত চেষ্টা আর তাদের সদা সতর্কতাই যুক্তরাষ্ট্রের এ অপচেষ্টাকে রােধ করতে পারবে, নইলে নয়। জনগণের মধ্যকর সব রকমের বিভেদ ভুলে গিয়ে এ নিয়ে এখন থেকেই সজাগ হতে হবে।
তিনি দেশবাসীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরােধ জানিয়ে বলেছেন, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি রচনা করার জন্যে আমাদের সবাইকে পরিশ্রম করে যেতে হবে। সাহায্যের নামে আমরা কারও যাতে লেজুড় হয়ে না যাই সে জন্যও সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়ােজন। তিনি বলেন, মুক্তি সংগ্রাম চলার সময়েও এ ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত সতর্ক ছিলাম এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা সে সময়ে আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ৬০০

পররাষ্ট্রনীতিতে যে লক্ষ ঘােষণা করেছিলাম তাতে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন জানিয়েছিল। আমরা স্পষ্টতই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, ভবিষ্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্র কখনই বৃহৎ শক্তিবর্গের লেজুর হবে না বা কারও সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না। এমনকি কখনো সংগতিপূর্ণ হয়েও না।
একাত্তরের এপ্রিলে বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আবদুস সামাদকে জনাব ‘আজাদ’ ছদ্মনামে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সেই সম্মেলনে যােগ দেয়ার জন্য আমি তাকে পাঠাই। তিনি সেই সম্মেলনে আমাদের যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা উপস্থিত সবারই দষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশের পক্ষে জোরালাে যুক্তি দেখিয়ে আমি অনেকগুলো চিঠি দিয়েছিলাম- বাইরের কোন দেশ থেকে সেগুলাে পােস্ট করার জন্য। কিন্তু সেদিন অনেক দেশই সে সব চিঠি পােস্ট করতে পর্যন্ত দেয়নি। সেই সম্মেলনে পূর্ব-জার্মান প্রতিনিধি জনাব সামাদের অসুবিধা জানতে পেরে সরাসরি তাকে তার দেশে গিয়ে ঐ চিঠি পােস্ট করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল।
জনাব তাজউদ্দীন বললেন, বাঙালীর সেই দুর্দিনে একমাত্র পূর্ব-জার্মানিই আমাদের এই সুযােগটুকু দিয়েছিল এবং সে জন্য আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, চীনের কর্মকর্তাদের কাছেও আমাদের বক্তব্য পেশ করা হয়েছিল। প্রবীণ জননেতা মওলানা ভাসানীকে দিয়ে আমি বেশ ক’টি তারবার্তা পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু চীন কর্তৃপক্ষ তার কোন জবাব দেয়ারই প্রয়ােজন বােধ করেননি।
নগণ্য কর্মী হিসেবে : সেদিনের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা সংগ্রামের ন’মাসের স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে দেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনায় যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা বাংলাদেশ ও এ দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বার্থেই নিয়েছিলাম। বাঙালীর আশা-আকাক্ষা আর বাঁচা-মরার প্রশ্নকে সেদিন সবচেয়ে উঁচুতে স্থান দিয়েই আমি কাজ করে গিয়েছি। আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এবং একজন খাটি বাঙালী হিসেবে আমার দায়িত্ব সাফল্যের সঙ্গে পালন করতে পারায় আমি খুশি। তবে সামগ্রিক সাফল্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই । আমরা যা করেছি তা তারই নির্দেশিত পথ। কাজেই সাংগঠনিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে আমাদের আশা-আকাক্ষার বাস্তবায়ন ঘটুক আমরা সেটই চাইব।
বিপ্লব একদিনে হয়নি : জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, বাংলাদেশের
পৃষ্ঠাঃ ৬০১

এই বিপ্লব কোন একদিনের ঘটনা নয়। এর জন্য আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বাঙালী জাতিকে ধীরে ধীরে বিপ্লবের দিকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে এবং এভাবেই তাদের মানসিক প্রস্তুতি ঘটিয়েছে। এরপর ২৫ মার্চ রাতে জেনারেরল ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সমগ্র বাঙালী জাতি তার প্রতিরােধে ঐক্যবদ্ধ শপথ নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হামলা শুরু হবার পর ঢাকা থেকে পালিয়ে আমি জীবননগরেপৌঁছাই। সঙ্গে ছিল ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম।
মানুষের চেতনা আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে সুযােগ দিয়েছিল: তিনি বলেন পালিয়ে যাবার পথে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা লাভের যে চেতনার উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেয়ার পথে অনিবার্য সুযােগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টঙ্গি নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলাে : একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।’
সেদিন ঐ সীমান্তেই মেজর ওসমানের সঙ্গে আমার দেখা। তার কমান্ডে একটি ব্যাটালিয়ন তখন। কিন্তু হাতে সেই সেকেলে রাইফেল। এর বিপরীতে পাকিস্তানী খান সেনাদের হাতে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিপুল সম্ভার। সেদিন মেজর ওসমানের বাহিনীর কাছে একটি লাইট মেশিনগানও ছিল না। যা হােক এপ্রিলের মধ্যেই আমি কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সংগ্রহ করি এবং সেগুলাে মেজর ওসামনের হাতে দিয়ে দিই যা দিয়ে তিনি ঐ সীমান্তে পাক বাহিনীর অগ্রগতি রােধ করেন এবং তাদের হাত থেকে আরও বহু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দখল করেন।
এরপর ১০ এপ্রিল আমি স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করি এবং ঐদিনই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘােষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। ১১ এপ্রিল মুক্তিসংগ্রামের পরিচালনার জন্য আমি বিভিন্ন সেক্টরের নাম ঘােষণা করে সেক্টর কমান্ডারও নিয়ােগ করি ।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী চুয়াডাঙ্গায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিই ১৪ এপ্রিল। এ খবরটা পত্রিকার আগাম প্রকাশ হয়ে পড়ায় বর্বর পাকিস্তানীরা পরের দিনই চুয়াডাঙ্গায় নির্বিচার বােমা বর্ষণ শুরু করে। ফলে সেখানে বহু লােক হতাহত হয়। এই বােমা বর্ষণের জন্য সেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের চুয়াডাঙ্গা শহর ছাড়তে হয়েছিল। এরপর আমরা মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা নামক স্থানকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মনােনীত করে এর নাম দিই ‘মুজিব নগর’ । এরপর ১ এপ্রিল কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করি। সেই সঙ্গে শুরু হয়
পৃষ্ঠাঃ ৬০২

মুক্তিবাহিনীতে লােক নিয়ােগ । তিনি জানান, নিয়মিত, অনিয়মিত, আনসার, পুলিশ, যুবক, তরুণ মিলিয়ে মুক্তি বাহিনীর মেটি সদস্য সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১ হাজার।
আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন যুদ্ধ করতে হয়েছিল, তেমনি কূটনৈতিক ফ্রন্টেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল। আমাদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ করার লক্ষ্য ছিল নভেম্বর মাস। কেননা আমি জানতাম, বাংলাদেশে বর্ষাকাল শেষ হওয়ার পর পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পরাস্ত করতে না পারলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সফলকাম হবে না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাও আসবে না। এ ছাড়া আরও বুঝেছিলাম যে, ঐ সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে না যাওয়া হলে মার্কিনীরা তার সুযােগ নেবে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধকে নিয়ে আসবে বাংলার মাটিতে। কেননা, আমেরিকাকে ভিয়েতনাম থেকে সরতেই হবে। আর এ সম্পর্কে আমরা খুবই হুশিয়ার ছিলাম।
মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সােমবার : দৈনিক ইত্তেফাক
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের দুঃখের অবসান হয় না : নিজস্ব সংবাদদাতা, শৈলকুপা, যশাের, ৭ মার্চ : ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমেই মানুষের দুঃখের অবসান হয় না। তার জন্য প্রয়ােজন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আর এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য খেতে-খামারে, কলে-কারখানায় একতাবদ্ধ হইয়া কঠোর পরিশ্রম করার প্রয়ােজন।’ গত ৪ মার্চ শৈলকুপায় বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের একশত চারতম শাখা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দানকালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ উপরােক্ত মন্তব্য করেন।
মন্ত্রী আরও বলেন, দেশ বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত এবং একমাত্র দেশের জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন ত্যাগের মনােভাব লইয়া সকলকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করিয়া যাইবার আহ্বান জানান। তিনি কৃষকদের উদ্দেশে বলেন, সুখী- সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়িয়া তুলিতে হইলে আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হইতে হইবে ।
মন্ত্রী দুর্নীতিবাজ, কালােবাজারি, চোরাচালানি প্রভৃতি সমাজবিরােধী শ্রেণীর উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করিয়া বলেন, তাহাদের ক্ষমা করা হইবে না। এই সমস্ত সমাজবিরােধীদের উৎখাতের জন্য সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষকে সক্রিয় সহযােগিতা করার ও গণ-প্রতিরােধ গড়িয়া তুলিবার জন্য তিনি আহ্বান জানান।৯
পৃষ্ঠাঃ ৬০৩

তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তার বিরুদ্ধে অনেক গুজব ছড়ানো হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ম্যানসেরু মিয়া। তিনি একবার চট্টগ্রাম বন্দরে যান ম্যানসেরু মিয়া মামলা তদারকের জন্য; কিন্তু তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হলাে যে, তিনি ম্যানসেরু মিয়াকে মুক্ত করার জন্য চট্টগ্রাম এসেছেন। তৎকালীন কাস্টম কলেক্টর আব্দুল লতিফের লেখা ‘কিংবদন্তী মহানায়ক ম্যানসেরু মিয়া ‘ গ্রন্থের অংশবিশেষ নিম্নে দেয়া হলাে :
‘…অথচ দুঃখজনক ব্যাপার এই যে, জনাব তাজউদ্দিনের সরেজমিনে পরিদর্শন স্বার্থান্ধ মহল সন্দেহের বাকা চোখে দেখেছে। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তখন অনেক গুজব ছড়ানাে হতাে- পাকিস্তানী দখলদার সময়ের কায়দায়। এ দেশকে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অস্থিতিশীল করার মানসে এবং দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত কিছু লােক ব্যক্তিগতভাবে তার বিরুদ্ধে লেগেছিল বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বাংলাদেশ পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন সার্বভৌম সত্তায় আবির্ভাব লাভ করার ফলে পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে যাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে তারা এ জন্য জনাব তাজউদ্দীনকেই প্রধানত দায়ী করত। আক্রোশটা তার ওপরেই বেশি। তাই এ কুচক্রী ঘূণ্য মহল থেকে রটনা করা হলাে যে, জনাব তাজউদ্দীন ‘ম্যানসেরুমিয়া’ কেসের আটক পণ্য ছেড়ে দেবার জন্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন। কি জঘন্য নােংরা প্রচারণা, কত বড় নির্জলা মিথ্যা ও নিষ্ঠুর অপপ্রচার। এ ধরনের কথা কানে এলে অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর বােধ করেছি। কেননা অখণ্ডনীয় স্বীকৃত সত্য এই যে, তিনি সেই মুহূর্তে সেখানে এলেন বলেই আমরা ধন্য হলাম, গৌরবান্বিত হলাম, মর্যাদাসিক্ত হলাম, উদ্বুদ্ধ হলাম, দিনরাত্রির নিরলস পরিশ্রমে অসাধ্য সাধনে ব্রতী হলাম। তারই ফলশ্রুতি ‘ম্যানসেরু মিয়া’ কিংবদন্তি ।
এরূপ ঘােরতর অসত্য প্রচারণ্য এবং ভিত্তিহীন গুজবের পরিণতিতেই হয়তাে আমাকে একদা এক তদন্ত সেলের মুখােমুখি হতে হয়েছিল। সেটা ১৯৭৫ সালের শেষের দিককার ঘটনা। দেশের রাজনৈতিক আকাশে তখন দুর্যোগের ঘনঘটা। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তখন ইদানীং সভ্যজগতের ইতিহাসে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞটি ঘটে গেছে। জনাব তাজউদ্দীন তখন অন্যান্য নেতাদের সাথে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নির্মম নিয়তি ও নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রের শিকার হিসেবে বন্দী। এরই মধ্যে একদিন জাতীয় রাজস্ব বাের্ডের সদস্য জনাব ওয়ালিউল ইসলাম আমায় ডেকে পাঠালেন। আমি তখন সবেমাত্র বাের্ডে বদলি হয়ে এসেছি। তিনি জানালেন যে, এক তদন্ত সেলে আমায় হাজির
পৃষ্ঠাঃ ৬০৪

হতে বলা হয়েছে। যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলাম। সেখানে যে সব প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তাতে আর এক বিস্ময় বিমূঢ় হবার পালা।
তদন্ত কর্মকর্তার কাছে একটি অভিযোগের তদন্ত ভার অর্পিত হয়েছে। অভিযােগটি হলাে, আমি নাকি জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে ম্যানসেরু মিয়া কেসে চট্টগ্রামে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাই এবং তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করে তার ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আটক পণ্য ছেড়ে দেবার নির্দেশ প্রদান করেন । জনাব তাজউদ্দিনের নির্মল নিষ্কলুষ চরিত্রে কালিমা লেপন করে তাঁকে অপমানিত এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অপবাদ দিয়ে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যেই যে এটা করা হয়েছিল তাতে কোনাে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। অভিযােগটি যে কোনােভাকে দাড় করিয়ে তাকে দণ্ড প্রদান করা যে এর লক্ষ্য ছিল সেটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু এর চাইতে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযােগ আর কী হতে পারে? যার সরেজমিন পদার্পণে কেসটির সামগ্রিক পরিস্থিতি পাল্টে যায়, যার কারণে এটি মনেসেরু মিয়া কিংবদন্তির মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়, যার নির্দেশে বিশেষ তদন্তের মাধ্যমে এটি একটি অসাধারণ কেসের প্রেক্ষিত রচনা করে, যার উপস্থিতির জন্য স্থানীয় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করে কেসটি ধরে রাখা সম্ভব হয় সেই তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বানােয়াট, উদ্ভট ও অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত অভিযােগ উত্থাপন।
আমি ব্যাখ্যা করলাম, প্রথমত, একমত অর্থমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করে যেকে নিয়ে আসা সহকারী কালেক্টরের মতাে একজন সামান্য সরকারী কর্মকর্তার পক্ষে কোনাে ক্রমেই সম্ভবপর নয়। এটি সরকারী কর্মকর্তা আচরণ বিধির পরিপন্থী এবং প্রটোকল বহির্ভূত। তাই তার সাথে আমার সরাসরি যােগাযােগ করার কোনাে সুযােগ ছিল না। তবে তার উপস্থিতি তীব্রভাবে কাম্য ছিল। যে কারণে অর্থ সচিব উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং সংকট নিরসনে তার হস্তক্ষেপ কামনা করায় অত্যন্ত কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তিনি আসতে সম্মত হন বলে জানতে পারি। দ্বিতীয়ত, একজন অর্থমন্ত্রী চাইলে সে রাতেই একটি টেলিফোনের মৌখিক নির্দেশই যথেষ্ট ছিল। অকুস্থল পরিদর্শনে এসে জনাব তাজউদ্দীনের যতাে একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ জনসমক্ষে এরূপ নির্দেশ দিতে পারেন না, তা যে কোন সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষও বুঝতে সক্ষম। তাই যেটা রটনা করা হয়েছে সেটা কিছু দুষ্ট লােকের উদ্ভট কল্পনাপ্রসূত প্রচারণা, যা সরকারের গৃহীত দৃঢ় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে যায় এবং চোরাচালানী পক্ষকে শক্তিশালী করে তােলে। উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে একটা বিভ্রান্তির ধুম্রজাল সৃষ্টি করে আসল ব্যাপারটা
পৃষ্ঠাঃ ৬০৫

ধামাচাপা দিয়ে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়াই এ হীন চক্রান্তের পেছনে কার্যকর ছিল বলে মনে হয়। সেই লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায়ই যে এরূপ কুরুচিপূর্ণ এবং দুরভিসন্ধিমূলক মিথ্যা গুজবটি প্রচারিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। এবং তৃতীয়ত, জনাব তাজউদ্দীনের সরেজমিন পরিদর্শন না হলে কেসটি বর্তমান গুরুত্ব ও পরিণতি লাভে ব্যর্থ হতাে, যার ফলে এ কেসে নেপথ্য নায়কদের জড়িত থাকার সত্য উদঘাটিত হতাে কিনা সন্দেহ।
এসব প্রতিষ্ঠিত ধ্রুব সত্যের আলােকে অভিযােগটির অসারতা প্রমাণিত হয়। তদন্তকারী অফিসার তাঁর স্বকীয় বুদ্ধিমত্তায় বিষয়টি সম্যক বুঝতে সক্ষম হন বলে মনে হয়। কেননা তারপর ব্যাপারটি নিয়ে আর কোন টানাহেচড়া করা হয়নি। ১০
ভারতের সাথে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের গােপন চুক্তি প্রসঙ্গে
অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে অভিযােগ করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার সরকার ভারতের সাথে নিম্নের সাতটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন :
১. ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা| হবে, যথা রক্ষীবাহিনী।
২. ভারত হতে সমরােপকরণ ক্রয় করতে হবে।
৩. ভারতের পরামর্শে বাংলাদেশের বহিঃবাণিজ্য কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে।
৪. বাংলাদেশের বার্ষিক ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সাথে ভারতের পরিকল্পনার সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
৫. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতীয় পররাষ্ট্র নীতির অনুরূপ হতে হবে।
৬. ভারত-বাংলাদেশের চুক্তিগুলাে ভারতের সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাবে না।
৭. পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোনাে সময় যে কোন সংখ্যক সৈন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং বাধাদানকারী শক্তিকে ভেঙ্গে অগ্রসর হতে পারবে।
স্বাধীনতার পর কয়েকটি রাজনৈতিক দল মিথ্যা প্রচার করে যে, আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সাথে গােপন চুক্তি করেছে তারা ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসকে ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা দখল দিবস হিসেবে পালন করত। তারা
পৃষ্ঠাঃ ৬০৬

অভিযােগ করেছে যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ সকল চুক্তি করেছে। তাজউদ্দীন আহমদ প্রকাশ্যে এ সকল অভিযােগ অস্বীকার করে বলেছেন- এ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে তিনি ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে রাজি আছেন । তাজউদ্দীন আহমদের সতীর্থ এবং এক সময়ের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর অলি আহাদ তার রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে গুজবের ওপর ভিত্তি করে মিথ্যা কথা লিখেছেন। তার অভিযোগের সপক্ষে কোন তথ্য নেই।
পৃষ্ঠাঃ ৬০৭

২৪
আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী
অধিবেশনে প্রদত্ত তাজউদ্দীন আহমর শেষ ভাষণ
২০ জানুয়ারি ১৯৭৪
বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু দলীয় নেতাদের চাপে পদত্যাগ করতে পারেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, মন্ত্রীত্ব ও দলীয় দায়িত্ব পালন সঠিক নয়। তিনি জাতির পিতা। সুতরাং জাতির পিতা একটি বিশেষ দলের প্রধান হতে পারেন না। তাই তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি কাউন্সিল অধিবেশন। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, একই সাথে মন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক থাকবেন না।
১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে। এএইচএম কামরুজ্জামান সভাপতি এবং জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তাজউদ্দীন আহমদ দীর্ঘ ১০ বছর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি দলকে তৃণমূল থেকে সুসংগঠিত করেন এবং দলকে নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তিনি চিরদিনের জন্য দল থেকে বিদায় নেন।
১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি শেষ ভাষণ দেন। তার দেয়া ভাষণ উদ্ধৃত হলাে :
“দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নবগঠিত সর্বোচ্চ পরিষদের সভায় এই সর্বপ্রথম আমরা সমবেত হয়েছি। আগে আমরা যে সম্মেলন করতাম তখনকার পটভূমিতে তার কার্যক্রম ছিল ভিন্ন ধরনের। স্বাধীনতার পর আমাদের দলীয় সংগঠনের এই সর্বোচ্চ পরিষদ কার্যক্রম ভিন্নরূপে হবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু আজকের এই সম্মেলনে শ্রদ্ধেয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে আমাদের দলের দষ্টিভঙ্গিতে এবং সরকারের পক্ষে
পৃষ্ঠাঃ ৬০৮

থেকে আমরা যে অভিজ্ঞতা পেয়েছি, তার আলােকে একটি রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করতে বলেছেন। যার ফলে দলের নেতা ও কর্মী ভাইয়েরা আমাদের কাছ থেকে রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে মােটামুটি একটা ধারণা নিতে পারেন। এ ছাড়াও আপনাদের নিজেদের ও প্রত্যেকের একটি ধারণা রয়েছে এবং আপনারা অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে এই সম্মেলনে এসেছেন। যে সব প্রশ্নের সম্মুখীন আপনারা হয়েছেন আপনাদের দৈনন্দিন কাজে, গ্রামে-গঞ্জে, পথে-প্রান্তরে। তেমনিভাবে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে। আগামী দিনে যারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা হবেন তাদের কাছে আমার অনুরােধ ভবিষ্যতে যখন কাউন্সিল মিটিং হবে, তখন যেন আরো দীর্ঘ সময় দিয়ে সমস্ত নেতা-কর্মরি সুস্পষ্ট ধারণা সৃষ্টির জন্য তাদের সমস্ত প্রশ্নের আলােচনার সুযেগি কাউন্সিলে থাকে, আপনারা অবশ্যই সেই ব্যবস্থা করবেন। আগামীর যারা কর্মকর্তা হবেন, যাদের কাধে এই দলের গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হবে তাদের কাছে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলর হিসেবে আমার অনুরােধ কমপক্ষে পাঁচ দিন যাতে আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলের নেতারা আলােচনার সুযােগ পান তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আগে সযােগ কম ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের অনেক নেতার সুযােগ এবং সৌভাগ্য হয়েছে বিদেশে বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে জাতীয় রাজনৈতিক দল কিভাবে কাজ পরিচালনা করেন, কিভাবে তাদের বার্ষিক সম্মেলনগুলাে হয় তা দেখবার। আমরা সেই সমস্ত কার্যক্রম থেকে আমাদের জন্য প্রয়ােজনীয় বা উপযােগী কিছু ভাল ভাল বিষয় গ্রহণ করতে পারি যা থেকে আমাদের দল এবং এর নেতা কর্মীরা উপকৃত হতে পারেন । আপনাদের মনে যে সব কথা ছিল, তা হয়ত পরিষ্কারভাবে বিশদভাবে ব্যাখা করার সুযােগ আজকে এই অল্প সময়ে নাও হতে পারে। তবে আমি একজন আওয়ামী লীগের ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে একটি ব্যাপার এই দলের জন্মলগ্ন হতে আজ পর্যন্ত দেখে এসেছি যে উপরের নেতৃত্ব থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ের সবার মধ্যে মতামতের একটা মােটামুটি ঐক্য থাকে। তাই আমরা আশা করব আলােচনা পর্যাপ্ত না হলেও আমাদের যারা যারা আলােচনা করেছেন বা করবেন তারা অনেকে পরিমাণে আমাদের আপামর নেতৃত্বের এবং কর্মীবৃন্দের মনােভাব ব্যক্ত করতে পারবেন।
অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আমাকে কিছু বলতে বলেছেন। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে রাষ্ট্র পরিচালনায় দলের ভূমিকা দেশের অর্থনৈতিক উত্থান-পতন, অবনতি-উন্নতি, উৎকর্ষ-অপকর্ষের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ দেশের
পৃষ্ঠাঃ ৬০৯

রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের জনপ্রিয়তা ও স্থিতিশীলতা এবং যে দলের তারা প্রতিনিধি অর্থাৎ শাসক- সে দলের উত্থান-পতন, অপ্রিয়তা, উৎকর্ষ অপকর্ষ নির্ভর করে সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর।
আজকে বাংলাদেশের প্রত্যেকটি আওয়ামী লীগ কর্মী এবং নেতা; যে যেখানেই রয়েছেন তাদের কাছে গোপন করার বিষয় এটা নয় যে, আমরা একটি অর্থনৈতিক দুর্গতির মধ্যে রয়েছি। দুর্গতি যে আজকেই সৃষ্টি হয়েছে একথা বললে যেমন ভুল হবে, আবার স্বাধীনতার পর এই দু’বছরের মধ্যে যেখানে সেখানে আপনাদের দৃষ্টিতে, দেশের মানুষের দৃষ্টিতে, অবনতি হওয়া উচিত ছিল না অথচ হয়েছে-সেগুলােও যদি আপনাদের কাছ থেকে আমরা গোপন করে যায় তাও সঠিক হবে না, এই কথাটা আমি বলে রাখতে চাই। আমরা মাঝে মাঝে যখন বাইরে যাই প্রশ্নের সম্মুখীন হই। এই অতি সম্প্রতি নেত্রকোনায় আমি নিজে গিয়ে এসেছি। রাত দেড়টা পর্যন্ত স্থানীয় কর্মী এবং নেতা ভাইদের সাথে কথা বলেছি। তারা যে প্রশ্নগুলাে আমাকে করেছিলেন, আমার মনে হয় বাংলাদেশের যারা এখানে উপস্থিত তারাও তেমনি ধরনের প্রশ্নই করবেন। তারা আমার কাছ থেকে মােটামুটি একটি কথাই জানতে চেয়েছিল, তাদের সামনে যে প্রশ্ন গুলো আসছে তার সঠিক জবাব কি হবে? একজন যদি এরকম জবাব দেয় দ্বিতীয়জন দেয় অন্যরকম, তাহলে প্রশ্নের সমাধান না হয়ে বিভ্রান্তির পরিমাণও আরও বাড়ে। তাই আমি আজকে আবেদন করব যারা ভবিষ্যত কর্মকর্তা হবেন, এই কাউন্সিল যাদেরকে নির্বাচিত করবেন, তারা দলের কার্যক্রম তাকে স্বচছ রাখবেন। সেই কার্যক্রম ৩ ধরনের থাকে, প্রথমটি স্বল্পমেয়াদি অর্থাৎ Short Term দ্বিতীয়টি মধ্যমেয়াদী অর্থাৎ Middle Term এবং তৃতীয়টি হলাে দীর্ঘমেয়াদী অর্থাৎ Long Term.
এই Short Term প্রােগ্রাম নিয়েই অসুবিধা। LongTerm প্রােগ্রামটা একটা মােটামুটি ব্যাখা দিয়ে ছেড়ে দিলে বেশ কিছুদিন এমনকি বছরের পর বছর চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু Short Term প্রােগ্রামের পরিবর্তন হয় অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে। আর তখনই প্রয়ােজন হয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের। এই নেতৃত্বের কাজ তখন এই যে গতি পরিবর্তন হওয়ার ফলে নতুন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার সঠিক ব্যাখা দেওয়া এবং সেই পরিস্থিতি মােকাবেলার পন্থাটি পরিষ্কারভাবে কর্মী সাধারণকে জানিয়ে দেওয়া, সংগঠনকে জানিয়ে দেওয়া। যাতে করে কেন্দ্র থেকে শুরু করে আমদের গ্রাম পর্যন্ত একইভাবে দলের সমস্ত কর্মীদের সাথে আমাদের সবার চিন্তাভাবনার সমন্বয় থাকে। অর্থাৎ দল হিসেবে বলতে গেলে আওয়ামী লীগের নেতা কিংবা নেতত্ন যা ভাবছেন, যে সমাধান
পৃষ্ঠাঃ ৬১০

চিন্তা করেছেন, সমস্যাকে যে আলােকে দেখছে, সেটা যেন গ্রাম পর্যন্ত কর্মী ভাইয়েরা সেই আলোকে দেখেন, সেইভাবে ভাবেন, সেইভাবে ব্যাখা করেন এবং সেই ভাবে সমাধানের কথা চিন্তা করেন। কাজেই সেই ব্যবস্থাটাই অনাগত যে নেতৃত্ব তারা যেন করেন, তাদের কাছে আমার এই বক্তব্যটি রেখে গেলাম ।
সরকার হিসেবে আমরা যে কাজ করি সেই কাজের ভাল এবং মন্দের ফল প্রত্যক্ষভাবে ভোগ করতে হয় আমাদের দলকেই আর দলকে অবহিত রাখতে হয় সেই জন্য। সরকার কি করতে যাচ্ছে, সরকারের কাজ এবং কাজের পথে সব সময় যে সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়গুলাে থাকে তার সাথে দলীয় যে নীতি এর একটা পরিষ্কার যোগাযোগ থাকা দরকার। কারণ, দলীয় নীতি সাধারণত সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম থাকে না- broad principle থাকে যেখানে। আর সরকার যে ব্যাপারগুলো থাকে সেখানে কার্যকর করতে গেলে, সমসাময়িকভাবে দলীয় কর্মী বা নেতৃত্বের কাছে অনেক সময় মনে হবে যে এটা বােধহয় বিচ্যুতি । সেই বিচ্যুতিটা কোন করা প্রয়ােজন, সেটাও দলের কাছে সুস্পষ্ট হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। বর্তমানে আমাদের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব এবং কর্মেিদর মধ্যে একটা ধারণা রয়েছে যে সরকারের সাথে সংগঠনের যেন খুব একটা বেশি সংযােগ নেই। এই ধারণা টার কারণ কি? তা আমি বিশ্লেষণ করতে যাচ্ছি না। কিন্তু ধারণাটা যে রয়েছে এটা আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী এবং এই দলের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের একজন মন্ত্রী হিসেবে বুঝেছি। সেখানেই গিয়েছি এই ধারণাটা যেন অনুভব করছি।
কাজেই আমি আবার নিবেদন করব ভবিষ্যত নেতৃত্বের কাছে সংগঠন এবং সরকারের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যে নির্বাহী কমিটি হবে (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি) সেই ওয়ার্কিং কমিটিও গতানুগতিক নিয়মে না বসে ভবিষ্যতে কিছু সময় নিয়ে বসবেন। বিভাগীয় মন্ত্রীদের বক্তব্য, তাদের বিরুদ্ধে বা তাদের সম্পর্কে দলীয় নেতা-কর্মীরা বলবেন, সবসময় বিরুদ্ধে বলবেন এটা আমি চিন্তা করব না। আপনারা যখন আমাদের বিরােধিতা করেন তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এবং আমার সমস্ত সহকর্মীবৃন্দরা ব্যক্তিগতভাবে এটাই ভাবেন যে, এটা কারও।বিরুদ্ধে নয়। বিরুদ্ধ মনােভাবের লােকেরা যে কথাগুলাে ভাবে তাই আপনারা প্রকাশ করেন। সে ক্ষেত্রে আমাদের কর্তব্য হবে আপনাদের বক্তব্যগুলাে পরিষ্কারভাবে শােনা এবং সময় নিয়ে শােনা। সময় অত অপর্যাপ্ত হওয়া উচিত হবে না। দেশে সমস্যা থাকবেই। আমরা যদি মনে করি যে সমস্যা আছে অতএব বেশি লম্বা মিটিং করা যাবে না, এটা ঠিক নয় বলে আমি মনে করি। সমস্যা
পৃষ্ঠাঃ ৬১১

থাকেবেই, প্রতিদিন সমস্যা প্রবলতা যে বাড়বে তা তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। ঘাত-সংঘাত না থাকলে মানুষের সমাজের কোন বিকাশ হতে পারে না, কাজেই সংঘাত থাকবেই। সেই সংঘাত যে রূপ ধারণ করুক না কেন তার মধ্যে দিয়েই আমাদের যেতে হবে। আমরা ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধুর কাছে জাতির পিতা হিসেবে, মন্ত্রিসভার নেতা হিসেবে আবেদন করব এবং ভবিষ্যতে যে ওয়ার্কিং কমিটি হতে যাচ্ছে তাদের কাছেও আমার আবেদন থাকল- যারা এই সদস্য হবেন তারা একটু দীর্ঘসময় বসে মন্ত্রীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে যে সব কথা বিভিন্ন নেতা-কর্মীরা শােনেন তাদের নিজের মনে যে প্রশ্ন তা পরিষ্কারভাবে, বিশদভাবে বিশ্লেষণ ও আলােচনা করবেন। সেখানে মন্ত্রীদের বক্তব্য, সর্বোপরি আমাদের সর্বময় নেতা বঙ্গবন্ধুর কি বক্তব্য সেটাও শােনা প্রয়োজন হবে। সেজন্য যে সময়টুকু দরকার সেটুকু দেবার জন্য তৈরি থাকতে হবে। আর মাঝে মাঝে জেলা কমিটির সম্পাদক, সভাপতি মাসে হােক ছয় মাসে হোক একত্রে বসলে জেলা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা যারা ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার নন তারাও সরাসরি তাদের প্রয়ােজনীয় বক্তব্য শুনে যেটা তাদের জন্য গ্রহণযােগ্য হয় সেটা গ্রহণ করবেন। যেটা গ্রহণযােগ্য নয় সেটাও আলাপ আলােচনার মাধ্যমে একটা সুষ্ঠু মতামতের ভিত্তিতে আমরা একমত হবার চেষ্টা করব। সেই মতটাকেও আমরা দলের সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত পৌছে দেব।
বর্তমানে আমি যে জিনিসটা লক্ষ্য করছি- খােলাখুলি বলছি, আমাকে একটু মাফ করবেন। চার বছর হয়তাে পুলিশ টুলিশ দিয়ে আমরা ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করতে পারব। গত মার্চ মাসে ইলেকশন হয়েছে। বর্তমানে যাদেরকে নিয়ে আমরা বিব্রত বােধ করছি, নাম বেশি বলতে চাই না। এক সময় ওরা আমাদের মধ্যেই ছিল। খুব বেশি দিনের কথা নয়, ওরা তখন আমাদের চাইতে ভাল কথা বলত এবং তখন সাময়িকভাবে অনেকে মনে করত ওরাই বােধহয় আসল কথা বলছে ।
ওরাও একসময় বলেছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া দরকার। এই মন্ত্রী-টন্ত্রীরা খুব বেশি সুবিধার নয়। তাদের আসল মতলব ছিল বঙ্গবন্ধুকে আস্তে আস্তে একা করে ফেলা- যেটা আমাদের শ্রদ্ধেয় সৈয়দ নজরুল সাহেব বললেন, একা করে একটু বিচ্ছিন্ন করে দেয়া- একা লােককে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া খুব সহজ। তাদের মতলব কি ছিল? এ রকমই একটা কিছু ছিল বোধহয়। তবে বঙ্গবন্ধু তার জীবনে অনেক দেখেছেন। সৈয়দ সাহেব যে নামগুলাে বলছেন তাদের এবং বাড়ির কাছের অন্যদেরও তিনি দেখেছেন।
এক আল্লাহ, এক কোরআন ছিল মুসলমানদের মধ্যে মুসলিম লীগের একটা
পৃষ্ঠাঃ ৬১২

প্ররােচনা। এর বিরুদ্ধে কোন চিন্তা বা কথা বলা যেত না এমন কি মনে মনে চিন্তা করাও যেত না- সেটাও দেখেছি, বঙ্গবন্ধুও দেখেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লিয়াকত আলী খানকে দেখেছি, তারপর গােলাম মুহম্মদ । গােলাম মুহম্মদকে আমাদের ছোট ভাই বােনেরা দেখেন নাই। লােকটি একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারত না। কিছু বােঝা যেত না। একটা অপদার্থ, একটা অর্থব লােক, সেই লোকটারও কি ক্ষমতা আপনারা না দেখলে বুঝতে পারতেন না, ঐটাও দেখলাম। ইস্কান্দার মির্জার কি ধরনের ক্ষমতা সেটাও দেখলাম। তারপর আইয়ুব খাঁ এল। এই সময়ে রীতিমতাে আমদের সংশয় দেখা দিয়েছিল, যে লােক দশ বছর ক্ষমতায় টিকে গেছে, একটা মানুষের জীবনে আর বা চা-ই কি? যদিও আর পাঁচ সাত বছর যেতে পারে তবে কাজ হয়ে গেল। সেও দেখলাম। তারপরে ইয়াহিয়া খান এলেন, তাকে দেখলাম। ফলে বঙ্গবন্ধু এসব দেখে তাদের মতলবটা বুঝে গেছেন। ঐ যে একা করবার একটা বুদ্ধি। ঐটা উনি নেননি। তাকে একা করে সব ধাক্কা কখন বঙ্গবন্ধুর দিকে- তখন তাে সৈয়দ সাহেবকেও ধাক্কা মারা লাগে না, মােশতাক সাহেবকেও মারা লাগে না। বঙ্গবন্ধুকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেই হয়। এই রকম অবস্থা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। যাই হােক আজকে সেই সমস্ত ধকল কাটিয়ে আমরা এখনও টিকে রয়েছি।
এখন কতকগুলাে বির্তক আসে। বির্তক যে আসে সেই কথাটা আপনারা অনেক বলেছেন এবং আমিও নিজেও কিছু কানাঘুষা শুনেছি বিভিন্ন জায়গায় যে, গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র না সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র । অথবা গণতন্ত্রের জন্য সমাজতন্ত্র না সমাজতন্ত্রের জন্য গণতন্ত্র। এ কথাটাও কিন্তু একটা দেখা দিয়েছে। আলােচনা হচ্ছে গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য, নির্ভেজাল সংসদীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য, প্রয়ােজন হলে আমরা সমাজতন্ত্র ছাঁটাই করব কিনা। অথবা সমাজতন্ত্রকে নির্ভেজাল সমাজতন্ত্র করবার জন্য গণতন্ত্রকে প্রয়ােজনবােধে ছাটাই করব কিনা, এই প্রশ্নটা কিন্তু রয়েছে। তবে আমাদের অবস্থার প্রেক্ষিতে লক্ষ্য অনুসারে গণতন্ত্র সংসদীয় থাকবে। এখন এই সমস্ত প্রশ্ন কিন্তু শুধু মনে মনে না, কাগজপত্রে বেশ প্রচার হয়েছে। কাজেই আমরা যে সমাজ ব্যবস্থায় যাচ্ছি, মূল কথা হল সমাজের রাজনৈতিক স্বাধীনতা চাই? রাজনৈতিক স্বাধীনতা চাই এই জন্য যে আমরা বাইরের হস্তক্ষেপ বা বাইরের প্রভাব মুক্ত আমাদের নিজেদের অর্থনীতির গড়ে তুলব এবং একটা সুখী, সুন্দর সমাজ আমাদের পরিকল্পনা অনুসারে গড়ে তুলব। সেই সমাজ গড়ার কাজে কোন কিছু যেন আমাদের অন্তরায় সৃষ্টি করতে না পারে সেই জন্য আগে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রটা হাতে নিতে হয় সেটার নামই রাজনৈতিক স্বাধীনতা। সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা বাঙালীরা পেয়েছি তার পিছনে
পৃষ্ঠাঃ ৬১৩

রয়েছে একটা বিরাট ইতিহাস। আপনারা জানেন, সে সব শুনেছেন। আমাদের জেনারেল সেক্রেটারি তার রিপাের্টেও বলেছেন, এর আগেও বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের কোন নেতা বা কর্মী আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানেন না এই কথাটা আমার জন্য চিন্তা করাটাও অন্যায় ।
কাজেই এই যে ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন থেকে আওয়ামী লীগ যে অধিকার আদায়ের আন্দোলন করছে সেই আন্দোলনই ধাপে ধাপে প্রকটতর হয়ে ১৯৭১সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে স্বাধীনতার আকার ধারণ করেছে। এই রাজনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ কেন করলাম? কেন বাঙালী উদ্বুদ্ধ হলাে। স্বাধীনতা যুদ্ধ অনেক দেশেই হয় এবং দেখা যায় স্বাধীনতা যুদ্ধ জনসাধারণের মধ্যে একটা ঐক্য আনা যায় । যেটাকে National Liberation বলা হয়। National liberation Struggle এ মানুষ সাধারণত ঐক্যবদ্ধ হয়। একটা অর্থনৈতিক লক্ষ্য নির্দিষ্ট না থাকলেও মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমন ধরুন পাকিস্তানের সময় হয়েছিল এবং অন্যান্য দেশে হয়। কেন হয়? National Liberation হয় সাধারণত বিদেশীদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অথবা বিদেশী প্রভাবের বিরুদ্ধে অথবা উভয়ের বিরুদ্ধে।
দেশে বিভিন্ন শ্রেণীর যে সমস্ত লােক থাকে সেই প্রত্যেক শ্ৰেণী মনে করে বিদেশীরা থাকলে, বিদেশী শাসন থাকলে আমার ক্ষেত্রে আমি বড় হতে পারি না, আরও বিকাশ সাধন করতে পারি না। তাই যে উঠতি পুঁজিপতি সেভাবে পাকিস্তানী, ইস্পাহানী, আদমজী, বাওয়ানী, করিম এদের জন্য আমি তার উপরে উঠতে পারছি না। তাদের একটা প্রতিযােগিতা থাকে। আবার ধরুন শ্রমিক এবং মালিকদের মধ্যে থাকে যে, এই মালিক বেটাদের শােষণের জন্য আমি আমার মেহনতের দাম পাচ্ছি না। আমি খেয়ে বাঁচতে পারছি না। এমনিভাবে প্রত্যেকে তার সমস্যাকে নিজের নিজের মতাে দেখে। কেউ ভাবে যে, আমি একজন ভাল শিক্ষক। অন্য দেশে শিক্ষকের মর্যাদা আছে, আমার দেশে তা নেই। ঐ বিদেশীটার কারণে বােধহয় নেই। এই বিদেশীটা চলে গেলে হয়তাে আমার মর্যাদা বাড়বে। ছাত্র মনে করে আমার লেখাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে- আমি যদি স্বাধীন হই এবং এই বিদেশীটা যদি চলে যায়। সাথে সাথে অবচেতন মনে পকেটমারও মনে করে যে, এই বিদেশীগুলাে থাকার জন্যই আমি পকেট মেরে মাত্র পাই এক টাকা, পাঁচ আনা। ধরা পড়ে যাই, কিল-গুতাে খাই, তারপরও তিনবার জেল খাটতে হয়, নাম বদলাইয়া কামে নামতে হয়। বােধহয় জাতার স্বাধীনতা হলে-এটা কিন্তু সে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে না তবে এইটুকু বােঝে যে, জাতীয় স্বাধীনতা হলে আমার উন্নতি হবে। পকেটমারের উন্নতি কি?
পৃষ্ঠাঃ ৬১৪

পকেটমারের উন্নতি যদি পকেট মারা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন কাজের সংস্থান হতে পারে তবে তো ভাল কথা। কিন্তু অবচেতন মনে সেটা থাকে না। মনে করে আমারও ভালো হবে। ভালো যে কি হবে সেটার সুস্পষ্ট ধারণা কারও থাকে না। তারা মনে করে স্বাধীনতা হবার সাথে সাথে পকেটে হাত দিলে আমি অনেক পয়সা পাবো । আথবা পকেটে হাত দিয়ে ধরা পড়লে আমার জেল-টেল হবে না। এই রকম একটা চিন্তাধারা থাকে National Stuggle-এর সময় । National Liberation শেষ হয়ে গেলে তখন প্রত্যেকে যার যার চিন্তা অনুসারে সেই স্বাধীনতা ভােগ করতে চায়।
আজকের আমাদের সমাজে সেই ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কিনা, আমি বলতে চাই না, তবে আপনারা একটু চিন্তা করে দেখবেন। কারণ আপনাদের একটা কথা বলি, আমাদের প্রগতিশীল নেতাদের দুই একজনকে আমি দেখেছি তাদের সামনে বক্তৃতা করেও বলেছি, মনে মনে রাগ করেছে, কিন্তু বলতে পারে নাই। আমিও বলেছি, দেখি মারধর কর কি হয়! এটা দেখেছি ১৯৭১-এর নয় মাসে। আমি কবুতর কেমন করে জবাই করে এটা দেখতে পারতাম না। তারপর মানুষ মারার জন্য ১৯৭১ সালে নিজে সংগঠন করেছি। কাজেই এখন আমার ভয়-ডর নাই, মেরে ফেললে গেলাম। কিন্তু মারবার আগে একবার দেখে যাব এটাও ঠিক। সামনেই বলছি, এই গাড়িটা চালাও এটা কি তােমার বাপের ছিল? তােমার কিনবার মতাে কি পয়সা হয়েছে? ব্লু বুকটা তাে ঠিক করে নিয়েছ। ব্লু বুক কিন্তু বদলিয়ে ঠিক করে নিয়েছে; বহু গাড়িওয়ালা আছে- এই অবস্থা।
আরও উদাহরণ আছে, যেমন বাড়ি, একটা বাড়িতে থাকে। এটা সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ করে নেয়নি। সে বাড়ির কিছুই করেনি, দেখেন দিব্যি দখল করে আছে। দুই একজন সম্পর্কে জানা যায় এ রকম, তারা কোন দলের কি? অন্তত তারা যে কোন ভাল দলের নয় তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। দুই- তিনটা বাড়ি দখল করে রেখেছে। নিজে একটায় থাকে আর তিনটা ভাড়া দেয়। ছাড়ে না কেউ, এমনও আছে। এটা কেন হল? এটা আমার মনে হয়, এই যে স্বাধীনতার আগে মনে মনে তাদের ধারণা ছিল যে স্বাধীনতা হলে পরে, আমি সব করতে পারব। এই রকম একটা ধারণা তাদের মধ্যে হয়ে গেছে।
মাফ করবেন আমাকে, আমি খােলাখুলিই বলব। আমার শ্রমিক ভাইয়েরা, স্বাধীনতার আগে তাদেরকে সুস্পষ্ট ধারণা বােধহয় আমরা দিতে পারি নাই। বঙ্গবন্ধুকে বলছি না। আমরা যারা তার সহযােগী ছিলাম তারা এর দায়িত্ব নিচ্ছি। বােধহয় তাদেরকে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারি নাই যে সমাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কি? কলকারখানার জাতীয়করণের অর্থ কি? আমি সকলের কথা বলছি না, ভাল-মন্দ
পৃষ্ঠাঃ ৬১৫

সব জায়গায় আছে। আমার শ্রমিক নেতা ভায়েরা বােধহয় কথাটা ভুল বুঝে ছিল যে স্বাধীনতা পেলে সমাজতন্ত্র হবে। সেই সমাজতন্ত্রে কল-কারখানার মালিকানাটা ঐ দশ টাকার শেয়ারদের কাছ থেকে ঐ শ্রমিকদের দিয়ে দেওয়া হবে এবং শ্রমিকদের দিয়ে দিলে তারা তাে আর ম্যানেজ করতে পারবে না, তখন শ্রমিক নেতা হিসেবে আমি ম্যানেজ করব। এই রকম বোধহয় একটা ধারণা ছিল।
কিন্তু এটা সমাজতন্ত্রের গুণ নয়। এটা সমাজতন্ত্রের ধারণা নয়। সমাজতন্ত্রে জাতীয়করণ যেটা করা হয় সেটা সমাজের নিয়ন্ত্রণে আসে। সমাজের মালিকানায় আসে। কোন গােষ্ঠী বিশেষের বা শ্রেণীবিশেষের হাতে আসে না। যা হোক এই ধারণা থেকেই স্বাধীনতার পর অপকর্মটি হয়েছে, আমাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। স্বাধীনতার পর কিছুদিন বেশ ভালই ছিল, বিশ্বাস করুন, একাত্তরে নিলাম করে করে পাকিস্তানীরা আমার যে সব জিনিস বিক্রি করেছিল তারও কিছু আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেরত পেয়েছিলাম, স্বাধীনতার দশ পনেরাে দিনের মধ্যে তারপরে দশ, পনেরাে, বিশ দিন এক মাস পরে এমন একটা অবস্থা হয়ে গেল যে ফেরত দেওয়া দূরের কথা, পারলে আপনার ঘড়িটা খুলে নিয়ে যায়। এই রকম অবস্থা হয়ে গেল, এটা কেন হলাে?
সেই সম্পর্কে আমার নিবেদন, ভবিষ্যত নেতৃত্বে যারা আসছেন তাদের। কাছে, নেতত্ব আমাদের দিতে হবে। এই তরুণদেরকে দুষ্কৃতকারী বলে দোষ দিলে চলবে না। ভাল মানুষও দুষ্কৃতকারী হয়ে যায়। যদি ভাল ছেলেদেরকে বিশেষ করে তরুণ সমাজকে কাজ দিতে না পারেন। বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন। ৯ মাসের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনারা দেখেছেন এই তরুণরা কিভাবে সংগ্রাম করেছে। তাদের পাশের ভাইটি প্রাণ দিয়েছে, সামনের ভাইটি পঙ্গু হয়ে শেরেবাংলা নগরে পড়ে আছে, একটা গুলি এদিক সেদিক হলে আজ যারা
সশরীরে ভাল আছেন তারও মারা যেতেন। মৃত্যুর জন্য তারা তৈরি ছিলেন। নয় মাসে যুদ্ধ শেষ না হয়ে যদি নয় বছর লাগত এই তরুণরা সংগ্রাম করত, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আজকে তারা যদি বিপথে গিয়ে থাকে তবে কেন গেল? আমাদের তা চিন্তা করে দেখতে হবে। আমার ভায়েরা দুই একটি কথা না বলে পারছি না। তরুণ সমাজ অদম্য শক্তির অধিকারী, এই শক্তিকে যদি সুষ্ঠু পথে পরি চালনা করা না যায়, তা হলে সেই শক্তিটা যদি বিপথে যায় বা উদ্দেশ্যবিহীন, লক্ষ্যবিহীন হয়ে যায় তবে অবস্থা মারাত্মক হয়ে দাঁড়ায়।
একটা গল্প বলি, এক লােকের খায়েশ হয়েছে, যা খুশি তাই সে করতেএ পারবে। এ রকম একটা শক্তি তার দরকার। তখন সে বহু খুঁজেটুজে এক পীরের
পৃষ্ঠাঃ ৬১৬

কাছে গেছে। পীরকে বলছে আমি এমন একটা ক্ষমতা চাই যার ফলে আমার যা ইচ্ছা হবে তাই যেন করতে পারি। পীর বলছে জিনিসটা বেশি ভাল হবে না। লোকটা বলে, না তবুও শিখান। তারপর পীর একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে, পরিষ্কার ঘরে খালি মাটিতে বসে ৪০ দিন সেই মন্ত্র জপ করতে হবে। জপ করার পর এক দৈত্য আসবে। সেই দেত্যকে তুমি যা বলবে মুহুর্তে সে তা করে দেবে। অবশেষে সেইমত মন্ত্র জপ করার পর ঐ দৈত্য এসে হাজির হয়েছে। এদিকে পীর কিন্তু বলেছিল দৈতের শর্ত হলাে, যদি তাকে কাজ দিতে না পারাে তবে সে তোমার ঘাড় মটকাবে। অতঃপর দৈত্য যখন এসে হাজির হয়েছে তখন কি বলবে, তাড়াতাড়ি সে বলে যে, আমার জন্য সাততলা বাড়ি বানিয়ে দাও। সাথে সাথে দৈত্য বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে। তখন বলে যে, একটা পুকুর কেটে দাও, সে তাই কেটে দিয়েছে। বলে যে, একটা শহর বানিয়ে দাও, তাই দিয়েছে, উপস্থিত বুদ্ধিতে। পরিকল্পনা টরিকল্পনা নাই। উপস্থিত বুদ্ধিমতাে যা মনে এসেছে, যা মুখে এসেছে তা বলেছে- তারপর আর মনেও আসে না। তখন দৈত্য হাজির হয়েছে তার ঘাড় মটকাবে, তখন সে দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৌড়, দৈত্য ধরে ধরে অবস্থা। এমন সময় পীর ধ্যান করে দেখতে পেল যে শিষ্য মহাবিপদে। তাড়াতাড়ি পীর শিষ্যকে পুনরায় উপদেশ দিলেন এবং বললেন যে, তােমার বাড়িতে যে কুকুরটা আছে দৈত্যকে সেখানে নিয়ে যাও এবং দৈত্যকে বলাে তােমাকে কিছু ঘি যােগাড় করে দিতে। উপদেশ মতাে লােকটি দৈত্যকে সেই নির্দেশ দিল, দৈত্যটি কুকুরের কাছে গেল এবং ঘি যােগাড় করে দিল। এবার পীর তার শিষ্যকে চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করলেন। বললেন, শিষ্য এবার দৈত্যকে ঘি দিয়ে তােমার কুকুরের লেজ সােজা করতে বলাে, অতঃপর দৈত্য কুকুরের লেজ সােজা করতে লেগে গেল। সে যতবার লেজ সােজা করে ততবার তা বাঁকা হয়ে যায়। অতএব কাজটি অনন্ত। এ কাজ শেষ হবার নয়। দৈত্যকে কাজ দেওয়া গেল শিষ্যের মাথা বেঁচে গেল । পীর নিশ্চিত হলেন। তেমনিভাবে আমাদের যুব শক্তিকে কাজ দিতে হবে। অন্যথায় তারা আমাদের ঘাড় মটকাবে। এটা তাে খুবই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে সমাজতন্ত্রের নামে আমাদের দেশে ব্যবসা চলছে। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা থাকার ফলে এটা হচ্ছে। আজকে সমাজতন্ত্রের ঘােরবিরােধী, ধরে নেন বিদেশী রাষ্ট্রে চর, ধনতন্ত্রের চর, তার পক্ষে সমাজতন্ত্রের বিরােধিতা করে সামনে আসা সম্ভব না। সমাজতন্ত্রের নামেই আসতে হয়। কাজেই আজকে সমাজতন্ত্রের ঘােরবিরােধী, বিদেশী রাষ্ট্রের চর, ধনতন্ত্রের চর, তাদের পয়সা খাওয়া লােক, তারাও দেখছে বাংলার মানুষের মনােভাব এমন- এটার বিরুদ্ধে বললে মানুষ পছন্দ করবে না। কাজেই পছন্দ করার দরুন তার মুখেও সমাজন্ত্রের
পৃষ্ঠাঃ ৬১৭

স্লোগান। শুধু সমাজতন্ত্রের শ্লোগান না, বঙ্গবন্ধুর থেকেও বেশি স্লোগান দিয়ে দেয় তারা। মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি হয়েছে। এটা কি রকম? যেমন আমাদের সদরঘাটে কোন পকেটমার ধরা পড়লে সে কোন রকমে মাথা ফস্কে দৌড় দেয় আর বলে, পকেটমার! পকেটমার! কারণ যাতে অন্য কোন লোক বুঝতে না পারে যে সে পকেটমার। আজকে CIA-এর দালাল যারা তারাও বলে CIA, CIA, CIA, তখন আপনার বুঝতে পারেন না কেননা আসল CIA এই অবস্থা যে আজকের কিছু কিছু চলবে না এ কথা বলা চলে না। কাজেই এ থেকে আমাদের সতর্ক হতে হবে। এখন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা বলতে গেলে বলবেন যে, ধান বানতে শিবের গীত কেন গাইলেন? কেন সুষ্ঠু অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করা যায় ন, যদি সামাজিক পরিস্থিতি একটা মোটামুটি স্থিতিশীল না থাকে এবং সামাজিক পরিস্থিতি যদি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ করার উপযােগী না হয়। আজকে স্বাধীনতার সাথে সাথে আমাদের অর্থনৈতিক কাজেরও উপযােগিতা বিনষ্ট হয়েছে। আগে যা ছিল তা থেকেও বেশি বিনষ্ট হয়েছে। কেণ হলাে তা আমি এই স্বল্পপরিসর সময়ে আলােচনা করতে চাই না। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব নিশ্চয়ই সেই সুযােগ আপনাদের দেবেন। আমি একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে এই সুযােগে দাবি করব, শুধু কেন্দ্রে বসে নয় আমরা জেলায় জেলায় যাব, সেই কর্মসূচী নিতে হবে, সেই কর্মসূচী নিলে চলবে না। আমরা মন্ত্রী নামের যে জীবগুলাে আছি তাদের দুর্ভাগ্যের কথা শােনেন। আমাদের মনে করা হয় যে মন্ত্রী হওয়া মানে ফাইল করা। মন্ত্রী হওয়া মানে কিছু তদবির টদবিরের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এটা যে মােটেও একটা স্বাধীন, উন্নয়নকামী প্রগতিশীল রাষ্ট্রের কর্তব্য নয় সেই কথাটি সকলকে বােঝাতে হবে। আজকে আমাদের যারা বুঝতে না পারবে তাদের বােঝাবার দায়িত্ব আপনাদের, আমাদের , সকলের।
আজকের মন্ত্রীদের কাছে তারা যে সমস্ত কাজ নিয়ে যায় সেই কাজটি কিন্তু থানা পর্যায়েই হয়ে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু মাঝে মধ্যে বলেন যে “আমাকে তাে তােমরা দারােগা বানাইয়া ছাড়ছ”! কোন থানায় কি হবে সেটাও বঙ্গবন্ধুর কাছে। যদি হােম মিনিস্টার বলেন যে, আমি একটু শুনি, জবাব আসে না, না আপনার সাথে কি কথা বলল, আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছে যাব। একেবারে সরাসরি । সংগঠনের ব্যাপারেও দেখেছি। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যে সমস্যা জেলার করা উচিত, থানার করা উচিত সেখানে না যেয়ে সােজা কেন্দ্রে। তাও জেনারেল সেক্রেটারি না, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি না সােজা গণভবনে! তারা হয়ত বঙ্গবন্ধুর দর্শন লাভের আশায় সেখানে যায়, কিন্তু তাতে দেশের বড় ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যায়।
পৃষ্ঠাঃ ৬১৮

কাজেউ এই জিনিসগুলাে আমাদের একটু চিন্তা করা দরকার। সেইগুলো চিন্তা করতে হলে সাথে সাথে আবার একটা প্রশ্ন এসে যায়। স্থানীয় যে সমস্যা, সেই স্থানীয় সমস্যা গুলো বিবেচনা কিভাবে করা যাবে? তারও তাে একটা সুরাহা হওয়া দরকার। কোন জায়গায় গেলে এই সমস্যা কথাটা বলা যাবে এর প্রতিকারের একটা নির্দেশ পাওয়া যাবে সেটাও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কাছে আমার দাবি ভবিষ্যতে তারা যেন সেই ব্যবস্থা করেন। আমাদের কর্মীদের, আমাদের স্থানীয় নেতাদের যে স্থানের অসুবিধাগুলাে রয়েছে সেই অসুবিধা বলার মত ফোরামের দরকার। সেই ফোরাম আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। সেই ফোরামের মাধ্যমে প্রয়ােজন হলে সরকারের সাথে যােগাযােগ করতে হবে। তা না হলে শুধু যদি কর্মীদের উপদেশ দেই যে, আপনারা আমাদের কাছে আসবেন না তাতেই সমস্যা সমাধান হবে না।
এবার আমি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আসছি। কলকারখানার কি অবস্থা হয়েছে তা খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চিটাগাং এবং সেখানে যে অল্পবিস্তর শিল্প আছে সে সব যারা দেখেছেন তাদেরকে কি বুঝিয়ে বলার দরকার আছে? মােটেই না, কারণ অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রত্যেকে আমরা স্বাধীন। কারও কাজ করার দরকার নাই। ব্যবসা বাণিজ্যের কথা বলতে গেলে একটা কথা এসে যায়। গতকালেও এই কথাটি হয়েছে এবং আগে পরে সবসময় এই কথাটি হয়, সেটা হলাে লাইসেন্সের কথা। সংমিশ্রিত অর্থনীতির কারণে কিছু পারমিট-লাইসেন্সের ব্যবস্থা যখন এখনও আছে তখন একজনকে না একজনকে এটা করতে হবে, যতদিন পর্যন্ত পারমিট প্রথা উঠিয়ে দেওয়া না যায়। এই ক্ষেত্রে এটা কমিয়ে আনার জন্য টিসিবি নামক যন্ত্রটির হাতে কিছু ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন টিসিবি জিনিসটা কি? সেখানে আমাদের যে কর্মচারীরা রয়েছে এই প্রসঙ্গে বলি ভাইয়েরা একটা কথা নির্লিপ্তভাবে মনে করতে হবে দোষক্রটি যদি কারও থাকে সমষ্টিগতভাবে যদি দোষী হয়, সমষ্টিগতভাবে নিশ্চয়ই তাদেরকে আমাদের ধরতে হবে। প্রতিকার করতে হবে। প্রয়ােজনবােধে তাদেরকে বিতাড়িত করতে হবে কিন্তু ঢালাওভাবে যদি আমরা বলি, ঢালাওভাবে বললে কাজের সুবিধা হয়। আর সরকারী কর্মচারী কারা? এখানে যারা আছেন, জিজ্ঞাসা করে দেখুন নিজেদের মনকে, কোন না কোন সরকারী কর্মচারী হয় আপনার ছেলে, না হয় আপনার বড় ভাই, না হয় ছােট ভাই, না হয় মামা, না হয় ভাগিনা, না হয় চাচা, না হয় ফুফা, হয় খালু।
আজকে বাংলাদেশ ছােট দেশ, জনসংখ্যা অনেক বেশি। আজকে আমি আপনাদের নাম উল্লেখ না করেই বলছি, একজন দারােগাকে আমি জানি
পৃষ্ঠাঃ ৬১৯

স্বাধীনতার সময় মানুষ হত্যা করিয়েছে। কিন্তু সেই দারােগাড় চাকরি ডিসমিস করা গেল না। কেন গেল না? সেই দারােগার পক্ষে আমাদের অনেকেই ছিলেন। মাফ করবেন, আমি মন্ত্রী যে, মন্ত্রীদের বাঁচাচ্ছি, তাও না। মন্ত্রীত্বের বাইরে যারা উচ্চপদস্থ নেতৃত্বে আছে তারা Protection দিয়ে রেখেছে। একটা নয়, এরকম বহু ঘটনা আপনাদেরকে দেখাতে পারি। কিন্তু এখানে আমরা অনেক লোক বসে আছি, সময়ও নাই, তবুও আপনাদেরকে কয়েকটি ঘটনা একটা একটা করে দেখাই যে, এই এই অফিসার এই এই কাজ করেছিল। হাকিম হুকুম দিয়েছিল, খবর দাও, কান ধরে নিয়ে এসেছিল। সেই অফিসার আমাদের কারোর না কারোর আত্মীয়স্বজন। একজন সাজা দিতে চাইলে, পাঁচজন তার বিরোধিতা করে। আমি নিজে দুই এক জায়গায় গিয়ে দেখেছি। তার মধ্যে এক জায়গার কথা বলি, আমাদের এক অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এল। অভিযােগের জন্য যখনই পাঁচজন নেতাকে নিয়ে হুকুম দিলাম (এসডিও না ডিসিকে তা পরিষ্কার করে বলছি না, কারণ যারা যা জানেন তারা বুঝে যাবেন) এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দুই ঘণ্টা পরেই আর দশজন এসে বলছে যার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন তার মতো ভালো মানুষ হয় না। ও আওয়ামী লীগের সাংঘাতিক উপকার করে, এখন বলুন কি করবেন?
আমি যখন গত বছর একসময় রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ গিয়েছিলাম । সেখানে আমাকে কয়েকজন বলেছিলেন, সে আমাদেরই কর্মী ছিল, তারা লাইসেন্স টাইসেন্স নিয়ে দু’পয়সা বানিয়ে এখন অন্য রাজনৈতিক দলের আশ্রয় নিয়েছে। নামটা আমি বললাম না। তাদের কথা অত প্রচার করতে চাই না। আর এমন অনেক জায়গায় আছে, দিনে আওয়ামী লীগ করে রাতে অন্য দলের সাথে যােগ দেই। এই বর্ণ চোরাদেরকে আপনাদের ঠিক করতে হবে। এটা যদি করা যায় তবে অসম্ভব, কিছু করা যাবে না। মনে রাখবেন একটা দেশ চালাতে হলে তার সরকার কোনদিনই EFFECTIVE হবে না যদি না, তার পেছনে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান থাকে। আপনার নিজের দলের ভেতরে স্থানীয়ভাবে যদি কোন্দল থাকে, তবে বিপর্যয় আপনারা নিজেরা ভােগ করেন, কিন্তু আমরাও সেই সাথে কম শাস্তি ভােগ করি না। আমার আওয়ামী লীগ যদি দুর্বল হয়ে যায় আমি মন্ত্রী, এই পতাকাটি উড়িয়ে যাই, বিভিন্ন ঘটনায় আমি লজ্জাবােধ করলে এই পতাকাটি হয়ত একটা টিটকারি হয়ে যাবে । টিটকারি হবে তখন যখন আমার আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে। যখন আওয়ামী লীগ দুর্বল হবে না, তখন কেউ টিটকারি দিতে সাহস পাবে না। যদি কোন ব্যক্তিবিশেষকে, কোন মন্ত্রীকে আপনাদের অপছন্দ থাকে, আপনারা বঙ্গবন্ধুর কাছে আসুন, আপনাদের
পৃষ্ঠাঃ ৬২০

সংগঠনের কাছে আসুন, এসে বলুন তার সম্বন্ধে । সেই মন্ত্রী কোন উত্তরাধিকার সূত্রে পৌত্রপৌত্রাদির ওয়ারিশক্রমে ভােগদখলের জন্য মন্ত্রিত্বে আসেনি। তাকে সরিয়ে দেবার অধিকার আপনাদের আছে। কিন্তু প্রকাশ্যে তাকে মন্ত্রিও রাখবেন আবার গালিগালাজও দেবেন তাহলে পরিণামে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে লিফলেট বের হয়। যে অমুক তাে চোরা? আওয়ামী লীগের লোকেরাই বলছে। ওমুক Permit Hunter আওয়ামী লীগারাই বলছে।
আর রিকিফ কমিটি। এই রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে আমার খুব ভাল ভাল কর্মী দোষের ভাগী হয়েছে, কিন্তু সবাই দোষী ছিল না। কিছু কিছু দোষী ছিল হয়ত, সব দোষী ছিল না। আমি জানি বিভিন্ন গ্রামে আমার কর্মী যারা আছেন আপনারা যদি টাকা দিয়ে থাকেন, এক টাকার সাথে আরও চার আনা তার নিজের পকেট থেকে খরচ হয়। আমাদের বাংলার একটা চরিত্রের কথাও চিন্তা করতে হবে। বাংলা সমস্যাসঙ্কুল দেশ। এখানে আমি হলফ করে বলতে পারি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমি বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় একাটি জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নিয়ে ঘােষণা করব যে পাঁচ হাজার টাকা এক গ্রামের লােকজনের মধ্যে বিতরণ করা হবে। সেই টাকা সবচাইতে ভাল কর্মীটির হাতে দেবেন। সেই কর্মী এর সাথে আরও পাঁচ হাজার টাকা যােগ দিয়ে মােট দশ হাজার টাকা যদি খরচ করে তারপরও কিছু কিছু লােক বলবে যে, টাকা পয়সা ‘বাটা হলদি’ এটা হাতের মধ্যে পড়লে কি কিছু লাগে নাই। এই হলাে বাংলাদেশের চরিত্র।
আপনি নিজের পয়সা খরচ করে দশটা গরু জবাই করে অথবা ৫০ খাসি জবাই করে একটা মেজবানি (দাওয়াত) খাওয়ান। লােকজন মেজবানি খাওয়ার পরে বাড়ি যাবে আর রাস্তায় রাস্তায় গল্প করবে। একজন আর একজনকে জিজ্ঞাসা করবে যে কি, কেমন খেলে? ৫ জন বলবে, খুব খেলাম, ভালই হয়েছে। অন্যজন বলবে, না, ওই তরকারিটায় একটু পােড়া পােড়া গন্ধ লেগেছে। আর একজন বলবে আরে শালার নিয়তই ভাল ছিল না, ভাল হবে কেমনে? যিনি খাওয়ালেন, হাজার হাজার টাকা খরচা করলেন, তিনি রাধেনও নাই, বাবুর্চিও তিনি না, সব দিয়ে দিলেন তারপরও কিছু লােক বলবে ওর নিয়ত ভাল ছিল না তাই একটু পােড়া লেগে গেছে, তরকারিটা একটু গন্ধ হয়ে গেছে। কাজেই এই স্বভাব আমাদের আছে, এই স্বভাবটা ভুললে চলবে না। এই স্বভাব পরিবর্তনের দায়িত্ব আপনাদের সকলের সেই সাথে আমাদেরও একইভাবে।
আজকে যারা রিলিফ কমিটির কথা বলছেন, কি ছিল আপনার গ্রাম পর্যস্ত? গ্রাম পর্যন্ত সংগঠনটা কোথায় ছিল স্বাধীনতার পরে, একটু ভেবে দেখুনতাে! এই
পৃষ্ঠাঃ ৬২১

এমসিএ আর রিলিফ কমিটি ছাড়া অন্য কোন সরকারী সংগঠন তখন ছিল না। তারাই কাজ করছেন, সাধ্যানুযায়ী কাজ করছেন। আমি মনে করি এমনিভাবে দলের জন্য উৎসর্গীকৃত মনােভাবাপন্ন আমাদের অনেক কর্মীকে তৈরি করতে হবে। যেটা সত্যি সেটা করতে হবে। তাতে যদি অপ্রিয়তা আসে পাঁচ বছর যদি নির্বাচনে জয়লাভ করতে না পারি, তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা মুসলিম লীগ নই যে , ইলেকশনে হেরে গেলে বিরােধী দলে না বসে ঐ দল ছেড়ে দিয়ে নতুন দল বানাব। একদল ভেঙ্গে পাচ দল বানাব। গণতন্ত্রের মূল কথা হল আমি যদি জনগণকে সাথে নিতে না পারি, আমার দোষের জন্যই হোক বা জনগণের ভুল বােঝার জন্যই হােক, যে জন্যই হােক, যদি সাথে নিতে না পারি জনগণ আমাকে যদি না চায় তবে আমি নির্দ্বিধায় বিরােধী দলে বসব। অর্থাৎ হাতের দিকে বসে যাওয়া এবং জনসমর্থন যারা পাবে তাদেরকে ডান হাতের দিকে বসতে দেওয়া। এটা হলাে গণন্ত্রের একটি মূল কথা, যে গণতন্ত্রকে আমরা সংবিধানে রেখেছি। কাজেই আজকে আমাদের এই নীতিগুলােকে মনে রাখতে হবে। যেটা আজ কোনভাবেই আমরা মনে রাখতে চাই না।
অর্থনীতির কথা যদি বলেন, আমাদের অনেক দুর্যোগ ছিল। অনেক অভাব আছে। বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব চিরকালই ছিল। সবসময় আমদানি হতো। বাংলাদেশে কাপড়ের অভাব চিরকাল ছিল। আপনারা বলবেন কাপড়ের অভাব ছিল এটা আপনি কি বলেন, এতদিন তাে আমরা অভাব বােধ করিনি। আমি দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখাচ্ছি। দু’এটা কথার বেশি বলতে পারব না। পরে দরকার হয় সেমিনার করেন। আমি আওয়ামী লীগকেও পরামর্শ দেব। কালচারাল সেক্রেটারি যিনি হবেন, দেশের অর্থনৈতিক ইস্যুর উপর সপ্তাহে না হলে পনেরাে দিনে একটা সেমিনার করবেন বিভিন্ন BURNING PROBLREM-এর ওপর। যে সমস্যা নিয়ে আলােচনা হবে সেখানে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। মাঝে মাঝে একাধিক মন্ত্রীও থাকবেন, এটা করতে হবে।
প্রথমেই ধরুন উপনিবেশ কাকে বলে, উপনিবেশ জিনিস কি? উপনিবেশের সােজা কথা হলাে, একটা বিদেশী শাসন, যে শাসন শুধু সামাজ্যবাদী কায়দায় শাসন করেই ক্ষান্ত নয়, যারা নিজের দেশে FINISHED PRODUCTS তৈরি করার জন্য উপনিবেশের কাঁচামাল নিয়ে যাবে। উপনিবেশে সংগৃহীত মূলধন নিয়ে যাবে। এই হলাে উপনিবেশের মল চরিত্র। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান যখন একত্রে ছিল তখন বাংলাদেশকে তারা বাজার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এই বক্তৃতা শুধু বঙ্গবন্ধু না আপনারা সকলেই করেছেন। দু’বছরের মধ্যে সেটা য কেউ ভুলে গিয়ে থাকেন তবে নিশ্চয়ই আপনার দায়িত্ব তাকে স্মরণ করিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৬২২

দেওয়া। একটা উদাহরণ দিচ্ছি- পাকিস্তান যখন হয়েছিল ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সাল সেদিন পূর্ব বাংলায় আজকের বাংলাদেশে কাপড় ও সুতাকলের সংখ্যা ছিল আট। পাকিস্তানের ২৪ বছরের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান শুধু কাপড় ও সুতায় স্বয়ংসম্পূর্ণই হয় নাই তাদের সুতার বাজার বাবুরহাট, মাধবদি, শাহাজাদপুর বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ঐ মমিননগর থেকে শুরু করে সারা বাংলাদেশে আমার তাঁতি ভাইদের সুতা আসত পাকিস্তান থেকে, তারা এখানে বাজার করছিল। সুতার কল এখানে কল এখানে হয় নাই। ১৯৪৭-এ পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল মাত্র দু’টি সতা ও কাপড়ের কল-ভাওয়ালপুরে একটা আর একটা করাচি এলাকায়। দুটোই ছিল ওদের আর তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে আপনার জায়গায় বাজার বানিয়েছে। বাজার বানাবার ফলে পাকিস্তানে যে কাপড় আপনার এখানে আসত, আপনার চাহিদা, তার জন্য আপনাকে কিছু কিছু সুতা দিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে দেয় নাই। আজকে পাকিস্তানের সাথে আমার যুদ্ধ করে স্বাধীনতা লাভ করেছি বিভিন্ন হয়ে গেছি।
ইংরেজের সাথে ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান আপােসে যেভাবে বিচ্ছিন্ন হয়েছে আমরা সেইভাবে বিচ্ছিন্ন হয় নাই। আপােসে বিচ্ছিন্ন হলে ঐ ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান যেমন করেছিল সেই সময়ে বিলাতের জিনিসপত্র কিছু কিছু আনত যতদিন তারা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। আর পাকিস্তানের সাথে আমাদের স্বাধীনতাটা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, যুদ্ধের মাধ্যমে। পাকিস্তানের সঙ্গে আজও আমাদের কোনরকম সম্পর্ক নেই। কাজেই পাকিস্তান থেকে হঠাৎ করে যদি কাপড়ের সাপ্লাইটা বন্ধ হয়ে যায় আপনার কি অবস্থা হতে পারে? আর একটা কথা চিন্তা করে দেখুন, লুঙ্গি এবং শাড়ি এই উপমহাদেশের কিছু লােক ছাড়া এমন কি ভারতেরও সকলে পরে না। পশ্চিম বাংলা এবং সীমান্তবর্তী এলাকাগুলােতে পরে, পাকিস্তানের কেউ পরে না, আপনার জন্য বানাত। বাজারের জন্য বানাত।
এখন যদি জাপান থেকে আপনি শাড়ি কিনতে চান, পাবেন না। আমেরিকা থেকে যদি শাড়ি কিনতে চান, পাবেন না, পাবেন স্কার্ট-গাউন। এখন এই পরিস্থিতিতে এই যে বিরাট gap, এই gap পূরণ করতে ভারত থেকে কাপড় আনা হয়েছে। তাতে ভারতের বিরুদ্ধে সে কি সমালােচনা! ভারত থেকে ৯ হাত শাড়ি এনেছে, সাড়ে নয় নয় হাত শাড়ি এনেছে, এটা ভারতের দোষ। আমি বলি ভারত কি আপনাকে এই শাড়িটা জোর করে দিয়েছে? না আপনি দেখে শুনে পছন্দ করে এনেছেন। আপনারা পছন্দ করে এনেছেন। আর ৯ হাত শাড়ি যদি আসে, বাংলার গ্রামের মেয়েরা ফ্রক পরে না। শাড়ি পরে। ঐ ছােট মেয়েদের কি
পৃষ্ঠাঃ ৬২৩

৯ হাত শাড়ি লাগে না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, বাংলার তাঁতে যে কাপড় -শাড়িগুলো তৈরি হয় তা শহরের মহিলাদের জন্য না। ভদ্র মহিলাদের শাড়ি ১১ হাত বা ১২ হাত হয়। আরও এক দেড় হাত দিয়ে ব্লাউজ হয়। আজকে ভারত থেকে আমদানি করা সাড়ে ৯ হাত শাড়ি- যেটা গরিবের জন্য, সেটা যদি আপনারা কিনতে যান, কিংবা কেউ কিনলে বা ভদ্রমহিলা কিনলে তার কাছে তো খাটোই হবে। খাটো হলে তিনি যেহেতু vocal শহরে থাকেন উন্নত মানের মহিলা আর খবরের কাগজের লােকেরা আশপাশেই আছে বলে দিলেন যে, শাড়ি ছোট। কত ছােট, কি বিধান, কি শানে নজুল কিছুই বললেন না। এই নিয়ে আরম্ভ হয়ে গেল একটা রব যে, সমস্ত দোষ ভারতবর্ষের। এখন বলি আমার সুতা বিতরনের সত্য বিতরণ কমিটি করেছি। তারপর সমবায় করেছি। কত রকম EXPERIMENT যে করেছি। আচ্ছা এই কমিটিগুলােতে কারা কারা ছিল বলুন ত দেখি, ও তাে কি কোন ফেরেস্তা টেরেস্তা ছিল, না ভাবতের লোক ছিল, নাকি আমেরিকান লােক ছিল, না রাশিয়ার লােক ছিল, নাকি আমাদের লোকজনও ছিল?
সকলেই বলে চোর, চোর, চোর। তবে চুরি করে কে, কে তারা? আমি তো এই পর্যন্ত শুনলাম না বিগত দু’বছরে যে, কোন কর্মী এসে খাস করে বলেছে যে, আমার চাচা ঐ রিলিফের চাল চুরি করেছে। এমন তাে কেউ বলেনি । ঐ পল্টন ময়দানে বক্তৃতা করে দুর্নীতি ধরে ফেলতে হবে আর ধরা পড়লে বাড়িতে এসে বলে তাজউদ্দীন ভাই আমার খালু ধরা পড়েছে, ওরে ছেড়ে দেন। আমি বলি যে, তুমি না বক্তৃতা করে এলে? উত্তর দেয় বক্তৃতা করেছি সংগঠনের জন্য, আমার খালুরে বাঁচান, এই হলাে বাংলদেশের অবস্থা। কোথায় সামাজিক বয়কট? দুর্নীতি যারা করে তাঁদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট করতে হবে। সরকারের ব্যর্থতা আপনারা একশতবার বলেন- সরকারের দায়িত্ব যখন নিয়েছি, বঙ্গবন্ধু যখন নিয়েছেন, জাতির পিতা যখন হয়েছেন তখন ভালােমন্দ সব ছেলের কথাই শুনতে। হবে। খারাপ ছেলে, ভাল ছেলে সব ছেলের আবদারই শুনতে হবে। ঐ দত্তের কথাও শুনতে হবে। আমরা এড়ালেও বঙ্গবন্ধু এড়াতে পারবেন না। যা বলছিলাম, যারা সমালােচনা করে, তাদেরকে মেহেরবানী করে আমার ভাই-বােনেরা আপনারা জিজ্ঞাসা করবেন, সরকার না হয় জেল দেয় না, কিন্তু একজন ধরিয়ে দেয় তাে আর একজন টেলিফোন করে বের করে নেয় কেন? এটার কি করা?
এই হচ্ছে এক জ্বালা। কাজেই সরকার না হয় করে, অন্যায় করে, দুর্নীতি করে। না করলেও দোষ আসবে, করলে তাে কথাই নেই। সামাজিক প্রতিবিধানটা তাে দেশের মানুষ করতে পারে। আপনারা জিজ্ঞাসা সমালােচকদেরকে যে, তাদের গ্রামে রিলিফ কমিটির মাল কে চুরি করে? এটা কি
পৃষ্ঠাঃ ৬২৪

বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জানা সম্ভব, নাকি যারা শহরে থাকে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব? একটা গ্রামে যে আমার কর্মী আছে তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ঐ গ্রামের দুর্নীতিবাজটিকে তা জানিয়েও দিতে পারি? অন্তত খালু যদি হয় খালাকে, মামা যদি হয় তবে মামীকে বলে দিতে পারি যে, যারা দুনীতি করবে তার বউয়েরা কেউ ভাত দেবে না অন্তত এইটুকু করতে পারি। এমন ধরনের কিছু কি করেছি? আমাদের পক্ষ থেকে আমরা কি ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছি তা আমাদের মনকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। পাটি ভবিষ্যতে যাতে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেন, তার আবেদন আজ আমরা সকলে রাখাছ। পুনতি বন্ধ করতে হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের নির্দেশ দিতে হবে পার্টিকেই। পার্টি শুধু Theoretically সরকারের ঊর্ধ্বে হলে চলবে না, বাস্তবে হতে হবে।
এখন আসুন, মিল কারখানার ব্যাপারে। মিল কারখানায় যারা শ্রমিকনেতা তারা কারা? আমি আপনাদেরকে বলছি কারও বিরুদ্ধে আমার কোন ঈর্ষা নেই। আমাকে মাফ করবেন। মাফ করতে পারলে ভাল। না পারলে আমার বিরুদ্ধে অভিসম্পাত দিন আমার কোন আপত্তি নেই। মিল, কারখানার শ্রমিকনেতা কারা? বিশ্বাস করুন কয়েক সময় মনে মনে অনেক চিন্তা করেছি যে, আজকে যেয়ে আমাদের বিরােধী দলের কোন নেতাকে ধরব জব্দ করবার জন্য। কিন্তু যখন ধরতে গেছি, ধরে দেখি আমাদের চেনাশােনা মানুষ। এই যে জিনিসটা আরম্ভ করব হয়েছে এটা বন্ধ করতে আমিও আপনাদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের কাছে দাবি করব, বঙ্গবন্ধুর কাছে দাবি করব। বিনা দাবিতে তিনি সবসময় করেন, তার পরেও যে আমাদের শ্রমিক নেতৃত্ব, এই নেতৃত্বকে যদি সুষ্ঠু করা না যায় তবে বাংলার অর্থনীতি চলবে না। চলতে পারে না।
আমি একটা নমুনা দেই আপানাদেরকে। বন্দরে জাহাজ ভিড়েছে, খাদ্য নামাতে হবে, ‘৭২ সালের প্রথম দিকের কথা বলছি। UNROD প্রধান আমার
কাছে গেছেন। নিশ্চয় বঙ্গবন্ধুর কাছেও গেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, “মি. মিনিস্টার, তােমার দেশে ব্যাপারটা কি? খাদ্য বােঝাই জাহাজ এসেছে, তােমার মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে অথচ শ্রমিকরা কাজ করেন না। হাজিরা দেখিয়ে চলে যায়।” এখানে আমাদের শ্রমিক নেতাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমি শ্রমিক নেতৃত্বে মানুষের পরিবর্তনের কথা বলছি না, আজ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। যদি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে না পারেন তবে এদেশের অর্থনীতি চলবে না। আমাদের দেশের অবস্থা ভাবতে হবে, আমি যদি ভেবে থাকি আমার দেশের অবস্থা সবচেয়ে ভাল এটা ঠিক কথা নয়। আমাদের মতাে দেশের অবস্থা ঔপনিবেশিক শাসন শােষণে যা হয়, সেই নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
পৃষ্ঠাঃ ৬২৫

রেলওয়ে ওয়াগনের অভাব, বার্জ, ফ্ল্যাটের অভাব, চালনার জেটি নেই। যারা জানেন তাদের বলছি না। যারা না জানেন তাদের বলছি- ANCHORAGE জাহাজ থাকে পানিতে, বার্তা দিয়ে মাল উঠাতে নামাতে হয়, আর রেলি নিয়ে গেলেও ক্রেন দিয়ে সরাসরি জাহাজে ওঠানাে যায় না। আপনাকে আবার বার্জে বহন করে নিয়ে গিয়ে জাহাজে ওঠাতে হয়। ভরবার বেলায় ও তাই, খালাস করবার বেলায়ও তাই। চিটাগাং বন্দরে Capacity কত? আপনার প্রয়োজন কত? মাল আসছে। মাল যাচ্ছে। বন্দরের ক্যাপাসিটি নেই, আজকে ইচ্ছে করলেই রাতারাতি Capacity বাড়াতে পারেন না। আমাদের ছড়িয়ে যাকেই বসান অবস্থা একই থাকবে। তার অর্থ এই নয় যে, আমাদেরকেই রাখতে হবে। পছন্দ না হলে সরিয়ে দিন। আমাদের বদলাবার অধিকার আপনাদের আছে। বঙ্গবন্ধুকে বলেন এই ২০ জন মন্ত্রী যাদের আপনি রেখেছেন এদেরকে বরখাস্ত করুন। বরখাস্তের পরও এরা দেশে থাকলে যদি অসুবিধা হয়, তবে নির্বাসনে দিন। দিয়ে আর এক সেট লােক নিন। দেখবেন একই সমস্যা। এই ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সুস্পষ্ট নিদের্শনা এবং ভূমিকার কথা ভাবতে হবে। আজকে ট্রাকের ভাড়া কত? ট্রাক কি বঙ্গবন্ধু চালায় না সৈয়দ নজরুল ইসলাম চালায়? ট্রাকের মালিক কে? চিটাগাং থেকে ৭ টনি যে ট্রাক স্বাধীনতার পরেও ৪৫০-৫০০ টাকায় ঢাকায় আসত এখন সেটার ভাড়া ৩০০০, ৩২০০, ৩৫০০ পর্যন্ত ওঠে। ৭ টন মাল থাকে এক ট্রাকে। দামটা কত পড়ে একবার চিন্তা করুন।
এখন আসুন তেল সঙ্কটে। তবে এই সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী হবে। তেলের অভাব নেই তবে দামের সঙ্কট চলবে। দাম বেড়ে গেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুন্নত দেশের পক্ষে আমরা তেল রপ্তানিকারক দেশের সাথে কথা বলে এসেছি। তবে তারা যে তেলের দাম বাড়িয়েছে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, তারা খুব অন্যায় করেছে। কেন তেলের দাম বাড়বে না? গমের দাম কত? স্বাধীনতার পর যে গম প্রতিটন কিনেছি ৭৭ ডলারে সেই গম জুলাই-আগস্টে ৮১ ডলারে আর আজ সেখানে ২৪২ ডলার। স্বাধীনতার পর পর প্রতিমণে Subsidy দিতে হয়েছে ২২ টাকা ২৫ টাকা। অর্থাৎ ৫০ টাকায় কিনে ২৫ টাকায় খাই। এই ২৫ টাকা দেয় কে? বাকি টাকা দেবেন আপনারা জনসাধারণ, আজকে ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে আমরা এই সব করেছি। ৭৭ ডলার থেকে শুরু করে আজকের কোটেশন হলাে ২৪২ ডলার, কেমন করে আপনি সস্তায় খাওয়াবেন? কোথা থেকে খাওয়াবেন? মনে রাখবেন শুধু আপনার দেশের সমস্যা এটা নয় এটা সারা দুনিয়ার সমস্যা। শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলাে খাদ্য বেশি উৎপাদন করে না। ফিনিশেদ
পৃষ্ঠাঃ ৬২৬

goods উৎপাদন করে বিনিময়ে খাদ্য ক্রয় করে থাকে। তবে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশি। সাধারণ মানুষের আয় রুজি বেশি। আমাদের মতো অবস্থা তাদের নয় । আমাদের অবস্থা একবার ভেবে দেখুন। আজকে ২৭২ ডলার এক টন গমের দাম। যেটা ৭৭/৮১ ডলার কিনেছি।
আর এক সমস্যা শুনবেন? তেলের দাম বাড়ার ফলে আজ পর্যন্ত জাহাজই ঠিক করতে পারিনি। তেলের দাম বাড়ার আগের কিছু কথা বলি। গত জুলাই মাসে (১৯৭২) ২৮০০০০ টন গম আমেরিকা থেকে কিনেছি তার সবগুলো এখনো এসে পৌঁছেনি। মাত্র ১৯ হাজার টন এসেছে। এই অসুবিধায় বঙ্গবন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে অনুরােধ করায় সেখান থেকে আমাদেরকে ২ লক্ষ টন গম ধার দিয়েছিল। এই প্রকাশ্য সভায় বলতে পারি এটা বােধ হয় আর ফেরত নাও দিতে হতে পারে। এদিকে মুহিতের সঙ্গে আলােচনা করেছি। গত অক্টোবরের কিছুদিন আগেও যেখানে পার টন জাহাজ ভাড়া ছিল ৩৯ ডলার ৩৫ সেন্ট, খাজনা থেকে বাজনা কত দেখেন, নভেম্বরে সেই ভাড়া ৪৯ ডলার ৪২ সেন্ট এবং ডিসেম্বরে ৭৪ ডলার চেয়েছে। আমি বলেছি ঠিক আছে, ৭৪ ডলারে নিয়ে নাও। বর্তমানে ৭৪ ডলারে কেউ আসে না, ফলে ৭৪ ডলারেও জাহাজ ব্যবস্থা করতে পারি নাই। জাহাজ কোম্পানিরা তেলের বাড়তি দামের জন্য জাহাজ কমিয়ে দিয়েছে। কোম্পানিগুলাে হচ্ছে ধনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের জন্য তাদের তেমন আসে যায় না। তারা তেল খরচ কমবার জন্য ৫০ টা জাহাজ না চালিয়ে যদি ২৫ টা চালায় আর ভাড়াটা দ্বিগুণ করে দেয় তবে তাতেই তাদের লাভ। এই কাজটা তারা করছে।
আজকে আসুন দেখি তেলের দাম বাড়ার পরে কি অবস্থা দাঁড়ায়। ‘৭২ সালে অপরিশােধিত তেল কিনেছি ১ ডলার ৭২ সেন্ট পার ব্যারেল। ১ ব্যারেল তেল আনার জন্য জাহাজ ভাড়া ছিল ২ ডলার ৭৫ সেন্ট। বর্তমানে ১ ব্যারেলের দাম কমপক্ষে ১১ ডলার, আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, পরশু আমি সে আলােচনা করে এসেছি, সেখানে জানা গেল ১৬ ডলারের কম কোন রিফাইনারী থেকে অপরিশােধিত তেল পাওয়া যাচ্ছে না। আমি বলেছি এই ১৬ ডলারই যেন কিনে ফেলে, না হলে তাও পাওয়া যাবে না। কারণ এই তেল দিয়ে পাওয়ার পাম্প চালাতে হবে সেই Crude-এর কোরােসিন দিয়ে গ্রামবাংলার কুপি বাতি জ্বালাতে হবে। সেই ডিজেল দিয়ে কলকারখানা চালাতে হবে। বিভিন্ন এলাকার ১৬/১৭টি পাটকল, অন্যান্য শিল্প, বিদ্যুৎ সরবরাহ সব চালাতে হবে।
এবার তাকাই আমাদের মানব সম্পদের দিকে। আমাদের সবচাইতে বড় সৌভাগ্য আমাদের প্রচুর মানব সম্পদ রয়েছে। এই মানব সম্পদকে কাজে
পৃষ্ঠাঃ ৬২৭

লাগিয়ে সত্যিকার সম্পদে রূপান্তরিত করতে প্রচুর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমি আবার বলছি আমাদের সেমিনার করতে হবে, সেখানে একটা একটা করে প্রশ্ন করে যে সেটা বুঝি আলােচনা করে সমাধান খুঁজতে হবে। এই সেদিন ইংলান্ডের Black Poll-এ Labour-র সম্মেলন হলো। সৌভাগ্যবশত আমি সেখানে ছিলাম। ৭ দিনব্যাপী সম্মেলন, Space pollution এর ওপর আলােচনা হলাে। বিরাট বিরাট Physicist P.hd -রা বক্তৃতা করেছেন। আমি মনে মনে ভাবলাম যদি আমার দেশে এই আলােচনা হত তবে আমিও দু কথা বলবার জন্য যেতাম। অথচ ঐ Space Pollution-এর ব্যাপারটাই আমি বুঝি না। যে যেটা বুঝি সে সেই বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করলে ভালো হয় বেশি। একজনের পক্ষে সব জানা সম্ভব না।
এখন আইন শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতিটার যদি উন্নতি না হয় কিভাবে কাজ করবেন? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে যারা আছেন এ ব্যাপারে কিভাবে সরকার এবং দলের সমন্বয় করবেন তারা তা ভেবে দেখবেন। এই ভাবে দেখাটাকে আমি অত্যন্ত জরুরী বলে মনে করি।
এটি আমার ব্যক্তিগত অভিমত, এটা দলের বা সরকারের নয় অস্ত্রের খেলা বন্ধ করা দরকার। আমি সামান্য যেটুকু লেখাপড়া করেছি তা থেকে বলতে পারি Establishment এর বাইরে অর্থাৎ সরকার যন্ত্রের বাইরে যদি অস্ত্র থাকে তবে অস্ত্রের প্রতিযােগিতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। পুলিশ হলাে মৌলিক প্রতিষ্ঠান। সব তন্ত্রে পুলিশ হলাে মুখ্য ব্যবস্থা (মিলিটারিকে কথায় কথায় Civilian-এ আনা ঠিক হবে না।) যেখানে আইন ভঙ্গ হলে মানুষ পুলিশের কাছে যায়। সেই পুলিশের প্রতি আস্থা জন্মাতে হবে। আস্থা জন্মাবার দুটো উপায়, এক পলিশ প্রতিষ্ঠানকে সুন্দরভাবে ঢেলে সাজানাে। এক দিনে সম্ভব হবে এ কথা বলছি না । কিছুটা সময় সাপেক্ষ। দ্বিতীয়ত প্রত্যেকটা কর্মী কি আপনারা ব্যক্তিগতভাবে সবাই চেনেন? বাংলার আপামর সাড়ে সাত কোটি লােকের মাঝে সবগুলাে কর্মীকে ব্যক্তিগতভাবে চেনা সম্ভব নয়। স্থানীয় কর্মীটিকে স্থানীয় নেতা বা নেতৃত্ব চেনেন। আজকে যদি সরকারের মন্ত্রী মালেক উকিল নিজে উপস্থিত থেকে ঘেরাও দিয়ে ৫ জনকে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্রসহ ধরেন আর পরক্ষণেই আমি একজন তাজউদ্দীন একজন আওয়ামী লীগ নেতা গিয়ে যদি মালেক সাহেবকে বলি যে, মালেক সাহেব মি. এক্স অত্যন্ত ভাল আওয়ামী লীগ কর্মী আমি জানি, আমি তার দায়িত্ব নিচ্ছি তখন তার অবস্থা কি দাঁড়ায়? আজকে যদি কারও হাতে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র না থাকত আর বঙ্গবন্ধু যদি হুকুম দিয়ে দিতেন পুলিশকে যে-ধর, অস্ত্রজমা দাও পুলিশের কাছে বিনা লাইসেন্সে অস্ত্র যদি আমার দলের লোকের
পৃষ্ঠাঃ ৬২৮

কাছেও থাকে, রেহাই নেই, তবে পরিস্থিতি ভিন্ন হতাে। অনেক বর্ণচোরা লােক আওয়ামী লীগে বিভিন্ন কৌশলে আসছে আওয়ামী লীগ কর্মী নাম দিয়ে। আপনাদের এটা বন্ধ করতে হবে। পরিবেশ সৃষ্টি না হলে কাজ করবেন কি ভাবে ।
অর্থনীতির কথা বললামই না, Economic Activity মানে কি? ব্যবসা বাণিজ্য চলবে, Commerce Trade চলবে, হাটবাজার চলবে। ব্যবসা বাণিজ্য করলে এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত করবে, সদাই করবে, মাথায় করে জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। আর খারদ্দার টাকা নিয়ে যাবে হাটে-বাজারে। ৯ লক্ষ টাকা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মালেক সাহেবের কাছ থেকে আনসার ভাড়া করেছি পাট ক্রয় কেন্দ্রগুলাে পাহারা দেবার জন্য। যাতে টাকা লুট করে নিয়ে না যায় । ৫ মাসের জন্য এরা পাহারা দেবে। একটা রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। আজকাল রাইফেল কিছু না। অটোমেটিক অস্ত্রের কাছে রাইফেল কিছু না। ফড়িয়ারা যায় না পাট কিনতে। ২০ মণ পাট কিনতে ১০০০ টাকা লাগে, কে তাকে নিশ্চয়তা দেবে যে তার পয়সা নিয়ে যাবে না।
দুষ্কৃতকারীর একমাত্র পরিচয় সে দৃষ্কৃতকারী। সে যে দলেরই হােক। আমরা অনেক সময় বিরােধী দলের উপর চাপিয়ে দেই। এতে দুটা সর্বনাশ হয়। সে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে যায়। রাজনৈতিক শ্লোগান তার পক্ষে যাবার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। সে যতটা শক্তিশালী নয় কিন্তু জনগণের সামনে শক্তিশালী প্রমাণ হয়। ইংরেজ আমলেও দেখেছি, পােস্ট মাস্টার হত্যা মামলায় এটা রাজনৈতিক ডাকাতি ছিল। ফণীদারা তখন এই কাজ করতেন (বর্তমানে তিনি খাদ্য মন্ত্রী)। সেই মামলায় ইংরেজরা অনুশীলন পার্টির নামই উচ্চারণ করে নাই। অনুশীলন পার্টির নাম উচ্চারণ করলে সে রাজনৈতিক protection পেয়ে যেত। এতে জনগণের সহানুভূতি পেয়ে যেত। তবে তারা কি করল? ঐ ডাকাতির সাথে খুন, ৩৯৬ ধারা দিয়ে ফাঁসি দিয়ে দেয়া। পকেটমারের জন্য পকেট মারের আইনে সােপর্দ করেন। সে যদি শ্রদ্ধেয় নেতা হয় নেতা হিসাবে তার ব্যবস্থা নিন নাম উচ্চারণের দরকার হয় না। তেমনিভাবে ভাল মা যারা তার দুই সন্তান যদি ঝগড়া করে তবে নিজের সন্তানের বিচার তিনি করেন। তেমনি আশা করি এবং বঙ্গবন্ধুও আশা করেন যে আমাদের মধ্যেও যদি কেউ অন্যায় করে তবে তার শাস্তি হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। কারণ তা না হলে পার্টির মুখে কালিমা লেপন করা হয়, তাতে ক্ষতি হয়। বঙ্গবন্ধুর যে ভাবমূর্তি তার ক্ষতি হয়। কাজেই সেই দিকে দৃষ্টি রেখে গােপনে বা প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা উন্নতি করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির যদি উন্নতি না হয় তবে অর্থনৈতিক activity হতে পারে না।
আজকে আমার তরুণ ভাইয়েরা আপনাদের কাছে আমার একটা আবেদন।
পৃষ্ঠাঃ ৬২৯

আপনারা যে বিপুল শক্তির অধিকারী সেই শক্তিকে সুসংহত করুন। যুদ্ধের সময় যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করেছিলেন আজকে সেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। অতএব আর কোন লক্ষ্য নেই এই ধারণা থাকার কোন কারণ নেই। আপনাদের পরিষ্কার লক্ষ্য রয়েছে। আপনাদের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যে উত্তরণ করবেন। উত্তরণ করবেন বলছি এই জন্য যে আজকেই সমাজতন্ত্র করার মত অবস্থা পরিবেশ, কর্মী বাহিনী, মনােভাব, সবচেয়ে বড় কথা হল সারা জাতির মনােভাব নেই। শুধু কম থাকলে চলবে না, যদি সমস্ত জাতির প্রচেষ্টা না থাকে। সেখানে বিভিন্ন মতের লােক তলে তলে অন্য কথা বলে তা নয়।
আমরা যখন আওয়ামী লীগ সংগঠন করেছি, তখন মােমেন খাঁকে যারা পাঁচহাজার টাকা চাঁদা দিয়েছে তারাও চুপি চুপি বঙ্গবন্ধুকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিয়ে গেছে। এই জন্য যে, যখন সরকারের পরিবর্তন হবে তখন তারা ওই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। সব মানুষের সমান অধিকার বা সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য এই যােগাযােগ নয়, নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য এটা তারা করেছে । আজকে তারা বসে নাই। পাট বর্তমানে কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে রপ্তানি হয়। এখন যারা পাট ব্যবসায় আছেন তারা বাঙালী, আমি চিনি তাদের। বঙ্গবন্ধু ও অনেককেই চিনেন। তারা গােপনে পাকিস্তানীদের চেয়ে বেশি শক্রতা করছে। তারা টাকা পাউন্ডে, ইয়েনে, ডয়েস মার্কে পরিবর্তন করে টোকিওতে, বৈরুত সহ বিভিন্ন জায়গায় রাখে। তারা বর্তমানে সুইজারল্যান্ডে টাকা রাখে না, কারণ সেখানে টাকা রাখলে উল্টো শতকরা ৩/- হারে সুদ দিতে হয়। আমাদের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করার পেছনে এই এরা কাজ করছে।
যুবকদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলে যাই, কলেজে যারা প্রবেশ করে তারাই তাে হয়ে যায়। কৈশাের ছেড়ে যৌবনে পা দেয়, তার জন্য কি ব্যবস্থা? ঢাকা শহরের কথা ধরুন। বর্তমানে ঢাকা শহরের লােকসংখ্যা কত? বঙ্গবন্ধুর মতে ২০ লক্ষ, তা হলে আরও ভাল ।
আগের লােকসংখ্যা জন্য ঢাকায় যে স্কুল কলেজ ছিল, যে ব্যায়ামাগার ছিল বর্তমানে তা কি বাড়ছে না কমছে? মতিঝিল, দিলকুশা এলাকায় GP.O হয়েছে। ঐ পুরাে এলাকাতাে খালি ছিল। ছােট বেলায় আমরা ওখানে খেলাধুলা করেছি। এক একটা স্কুলের জন্য এক একটা খেলার মাঠ ছিল । কলেজগুলােরও নিজস্ব মাঠ ছিল। আর বর্তমানে লােক বেড়েছে সন্তান সন্ততি বেড়েছে। খালি জায়গায় ইমারত হয়েছে বাড়িঘর হয়েছে। মানুষের তুলনায় যেখানে মাঠঘাট বাড়ার কথা সেখানে কমে গেছে। বাড়ির জায়গাটা নিয়েই রাস্তার কিনারা ঘেঁষে দেওয়াল দেন! রাস্তাটা সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। দুটো গাড়ি চলাচল করতে পারে না। যে বেশ
পৃষ্ঠাঃ ৬৩০

প্রভাবশালী তার গাড়ি আগে যায়। আর যে কম প্রভাবশালী কার গাড়ি দাড়িয়ে থাকে। এই অবস্থা। এটা এক বছরে হয়নি। গত ২৫ বছর হয়েছে। আগে কলেজগুলোতে যে বিল্ডিং রুম ছিল সেখানে ৫০ জন বসার স্থান ছিল, এখনও ৫০ জনেরই স্থান আছে। অথচ ছাত্রসংখ্যা পঞ্চাশের জায়গায় এক হাজার হয়েছে।
যুবকদের পড়াশােনার সাথে সাথে মন ও মননশীলতার বিকাশের সুযােগ করে দিতে হবে| পাঠাগারের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে । খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি ঢাকা শহরের কথা বলছি, সাথে সাথে সমস্ত জেলা ও মহকুমা সদর দপ্তর এবং অন্যান্য ঘনবসতি এলাকায় পাঠাগার ও খেলার মাঠ গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু আপনি হুকুম দিয়ে দিন ঢাকায় ১ মাইল লম্বা আধ মাইল প্রশস্ত একটা জায়গা নিয়ে ছেলেদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দিন। নিষ্কলুষ আনন্দ লাভের সুযােগ করে দিন। তা না হলে এরা ফুটপাথে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে বেড়ালে সাধারণত কি হতে পারে? চিন্তা করে দেখুন। হাত শুধু পকেটেই যাবে না। নানান দিকে যাবে। কাজেই যুবকদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন ভবিষ্যত সােনার বাংলার যুবক হিসেবে তারা গড়ে ওঠে।
এখানাে আমি রিকশাওয়ালা ও হুমায়ুন খালেদের সােনার বাংলার গল্পটা বলি। একদিন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির সভায় যােগদানে জন্য জনাব হুমাযয়ুন খালেদ সংসদ ভবনে যাচ্ছিলেন। তিনি রিকশা দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে এক কথা দু’কথায় রিকশাওয়ালার সঙ্গে তার আলাপ জমে ওঠে। একসময় খালেদ নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন। ফলে সে সঙ্কোচ করছিল। কিন্তু খালেদ সহজভাবে কথা বলতে অনুরােধ করায় সে মন খুলে কথা বলতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে বলে যে, সাব, খাইটা-খুইটা কি করবেন? সােনার বাংলা তাে অইয়া গেছে। জনাব খালেদ প্রশ্ন রাখলেন, কি করে সােনার বাংলা হলাে ভাই? আমরা তাে চেষ্টা করছি। কিন্তু হলাে কোথায়? উত্তরে রিকশাচালক জবাব দেয় ক্যান ছার। দেশে জিনিসপত্র তাে সােনার দামে বিক্রি হইতাছে!
জনাব খালেদ এখানে উপস্থিত আছেন (জনাব খালেদ নিজেও বক্তব্যের প্রতি সম্মতি জানিয়ে নিজের উপস্থিতি ঘােষণা করেন)।
সত্যিকারের সােনার বাংলা হতে হলে এই যুবক, কিশাের ও শিশুদের সম্পূর্ণ সুযােগ দিতে হবে। আমার বয়সে ৩টা পতাকায় সালাম করলাম Union Jack, অর্ধ চন্দ্র তারকা, এখন বাংলাদেশের সূর্য। কাজেই আমাকে দিয়ে আপনি কতটুকু আশা করতে পারেন। আমার মজ্জায় ঢুকে গেছে অনেক জিনিস। বের করা সম্ভব নাও হতে পারে। মধ্যবিত্তকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, মস্তিষ্ক, দেহ, মনের বিকাশের
পৃষ্ঠাঃ ৬৩১

সুযােগ দিতে হবে। আমি বিশ্বাস করি এবং আপনারাও বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্ভবনা একটুও কম নয়। নিরাশ হবার কোন কারণ নাই। আপাতত আমরা যেটা দেখছি সেটা বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতেই হবে। এই বিভ্রান্তি কাটিয়ে ওঠার দায়িত্ব আজকে যে আওয়ামী লীগের পরিষদ গঠিত হবে তাকে নিতে হবে। আমাদের মূলনীতি অনুসরণ করে কাজ করে যেতে হবে। বর্তমানে সামপ্রদায়িকতাসহ কিছু কিছু ব্যাপারে বিভ্রান্তমূলক প্রচার হচ্ছে। যেমন গত এপ্রিল মাসে খাদ্য বোঝাই জাহাজ গ্রহণ করতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। যেখানে শুনে এলাম সােভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের দেশে নৌ ঘাঁটি করছে। এই যে প্রচারের উদ্দেশ্য কি? বাংলাদেশে কারও ঘঁটি হবে না। এমন কি যুদ্ধের দিনে সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে, ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্ৰীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখনই হবে, যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না। ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী আমাদের সাথে এসেছিল। সেই দিন, শুনে রাখুন আমার বন্ধুরা, কোন গােপন চুক্তি ভারতের সাথে হয় নাই। একটাই চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি প্রকাশ্যে এবং কিছুটা লিখিত, কিছুটা অলিখিত। সেই নয় মাসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আমি যুক্তভাবে সই করেছিলাম। সে আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে সহায়তা বাহিনী Supporting হিসেবে তোমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এবং যেদিন আমরা মনে করব আমাদের দেশে আর তােমাদের থাকার দরকার না সেই দিন তােমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে যে দিন বঙ্গবন্ধু শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন যে, ৩০ মার্চের মধ্যে তোমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে তখনই মিসেস গান্ধী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।
আজকে বিভ্রান্তির জন্য বলা হয় যে রক্ষী বাহিনীও নাকি ভারতীয় সৈন্যকে পােশাকের ন্যায় তৈরি করা হয়েছে। আমার ভাইয়েরা আপনাদের কাছে একটা কথা বলা দরকার। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব এবং আমরা Cabinet Colleague যারা ছিলাম সকলে এবং বাইরেও যারা নেতৃত্বে ছিলেন।তারাও রক্ষী বাহিনীর পােশাক নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। যা বলছিলাম রক্ষী বাহিনীর।পােশাকের একটা ইতিহাস আছে। আমাদের তখন কোথায় কাপড় ছিল? লুঙ্গি পরে তাে আর ডিউটি করা যায় না। একাত্তরে লুঙ্গি পরে আমার যােদ্ধারা যুদ্ধ করেছে। নিজে দেখেছি যশাের নবগ্রাম যেদিন মুক্ত হয় আমি সেদিন রণাঙ্গনে উপস্থিত ছিলাম। চোখের সামনে দেখেছি আমাদের ছেলেদের হাতে পােটলা আর এক হাতে রাইফেল। লুঙ্গি পরে, খালি গায়ে, গেঞ্জিও গায়ে নেই, জামাও
পৃষ্ঠাঃ ৬৩২

অনেকের গায়ে ছিল না। আমাদের সেই সমস্ত মুক্তিযােদ্ধা ভাইদের পােশাক দেওয়ার জন্য, এক লক্ষ Uniform দিতে ভারত সরকারকে আমাদের তখনকার মন্ত্রীপরিষদ অনুরোধ করেছিল। এদিকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। আর সেই পোশাকের চালান আমাদের কাছে এসে পৌছেছে দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে। মুক্তিযােদ্ধদের জন্য তৈরি পােশাকগুলােই রক্ষী বাহিনীকে দেয়া হয়েছে। মোল্লা জালাল উদ্দিন সাহেব বিহারে গিয়ে সেই এক লক্ষ বুট আর কাপড় জামা নিয়ে এসেছেন। এখন এদিকে বলা হচ্ছে ঐ পােশাকে বঙ্গবন্ধু ভারতীয় বাহিনী আনবেন। বঙ্গবন্ধুকে আঘাত দেওয়া হয় এই জন্য যে তাকে এক জায়গায় কাত করতে পারলে বাকিগুলো কিছুই না, এমনিতেই কাত হয়ে যাবে।
আর একটা কথা আপনাদের কাছে বলে রাখি। আমি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব ইন্দিরা গান্ধীর কাছে যে চিঠিপত্র লিখেছিলাম সেই চিঠিপত্রের কপি আমি ড. কামাল হােসেনের কাছে দিয়েছি। একে চুক্তি বলেন, চিঠি বলেন, দেশ বিক্রি করা বলেন যাই বলেন এটা প্রকাশ্যে হয়েছে, গােপনে না। পরবর্তীতে যে চুক্তি হয়েছে সেটাও প্রকাশ্য চুক্তি। ১২টি ধারা আছে তার মধ্যে। যেটা বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী সই করেছেন ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালে। এটা গােপন টোপন না। পার্লামেন্টে ড. কামাল হােসেন, সালাউদ্দিন সাহেবের প্রশ্নের উত্তরে এই চুক্তির এক লাইন এক লাইন করে পড়ে শুনিয়েছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় অনেক কথাই আমরা বলি সেগুলাে যদি জাতীয় খবরের কাগজে পুরােপুরি উঠত তবে বিভ্রান্তি অনেক কম হতাে। খবরের কাগজগুলাে বিরােধী দলের যত কথা প্রকাশ করেন আমাদের কথাও একটু যদি সেইভাবে প্রকাশ করেন তবে ভাল হয়। আমি এই কথাটি এই জন্য বলছি যে, সেদিন পার্লামেন্টে এই চুক্তির ওপর যে বক্তব্য ছিল তা বেশি ভাল করে প্রকাশ হয়নি। আরও একটি নমুনা দেই আমি আপনাদের পার্লামেন্টে অর্থমন্ত্রী হিসাবে বাজেট আলােচনা শেষ দিনে তিন ঘণ্টা সমাপনী বক্তৃতা করলাম। জাতীয় খবরের কাগজ তা থেকে এক লাইনও দেয়নি ।…”
(অসমাপ্ত, এর পরের অংশ পাওয়া যায়নি)।১

২৫
মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ
২৬ অক্টোবর ১৯৭৪
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভুল
সােভিয়েত রাশিয়ার লেনিন, স্টালিন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত জওহের লাল নেহরুর মতাে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয়-বরণীয়।
মুক্তিদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদকে বঙ্গবন্ধুর নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য খন্দকার মােশতাক আহমদ ও যুবলীগের ইয়ংটার্ক স্বাধীনতা পরই সক্রিয় হয়ে ওঠে। দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিলেন। রামচন্দ্রের অনুপস্থিতিতে ভরত রাজ্য শাসন করেছেন তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুর অন্তরীণকালে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সেটা তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করতে হলো- এ ছিল বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভুল। তাজউদ্দীন আহমদের অনুপস্থিতিতে বঙ্গভবন অরক্ষিত হয়ে পরে এবং এ সুযােগে খন্দকার মােশতাক আহমদের মাধ্যমে খুনী চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানপন্থী সরকার দেশ শাসন করে। গণতন্ত্র নেই- জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভূলের মূল্য জাতিকে আজও দিতে হচ্ছে।
২৬ অক্টোবর শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে অর্থমগ্রী তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন । প্রধানমন্ত্ৰী জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগের অনুরােধ জানালে তিনি সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি মুহাম্মদ উল্লাহ তাজউদ্দীনের পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ ২৬ অক্টোবর ১০টা ১২ মিনিটে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। সকাল ১০টায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দেয়া
পৃষ্ঠাঃ ৬৩৪

হয়। বেলা ১১টায় মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকের অব্যবহিত পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করতে বলেন। পদত্যাগের সময় তিনি অর্থ, বন, মৎস্য উন্নয়ন ও পশু পালন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
পদত্যাগ করেই তাজউদ্দীন আহমদ ফোনে তার স্ত্রীকে জানিয়ে দেন। তিনি দুপুর ১টার কিছু পরে বাসায় ফিরে আসেন। এসেই পিয়ন আমির হােসেনকে বললেন ছাদ থেকে পতাকা নামাতে। মিসেস জোহরা তাজউদ্দীন এগিয়ে এসে তাজউদ্দীনকে স্বাগত জানান। তাজউদ্দীন আহমদ ১২টা ২২ মিনিটে পদত্যাগপত্রে সই করেন। তাজউদ্দীনের পদত্যাগের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় বাসায় লোকারণ্য। মন্ত্রিসভার একমাত্র ড. কামাল হােসেন বাসায় দেখা করতে আসেন।
পৃষ্ঠাঃ ৬৩৫

সাংবাদিকরা পদত্যাগের কারণ জানতে চাইলে প্রশ্ন এড়িয়ে যান।
তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগের দিন সরকারের বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থাকে সতর্ক করে রাখা হয়। তারা তাজউদ্দীনের বাসভবনে নজর রাখে।
তাজউদ্দীন আহমদ সংসদে যান এবং দ্বিতীয় সারিতে বসেন। তার আসনে বসেন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত। পরে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে এম মনসুর আলী তাজউদ্দীনের আসনে বসতেন।
তাজউদ্দীনের ধানমণ্ডির বাড়িতে ভাড়াটে ছিল, তাদের বিদায় দিতে সময় লাগে। ৩৫ নম্বর হেয়ার রােডের সকল আসবাবপত্র বুঝিয়ে দিয়ে ২৮ নবেম্বর নিজের বাসভবনে চলে যান।
একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদের সাথে কথা বলছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ‘মুজিব ভাই, দেশটা যেদিকে যাচ্ছে তাতে আপনি, আমি, আমরা কেউ বাঁচব না। সব শেষ হয়ে যাবে, দেশটা ভেসে যাবে।
আগামী দিনে বাংলাদেশের কি হবে তা তাজউদ্দীন আহমদ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯৭০-৭৫ সালে আমি বরগুনার এসডিও। বরগুনার এসপি
পৃষ্ঠাঃ ৬৩৬

আসমত আলী সিকদার ধানমণ্ডির বাসায় তাজউদ্দীন আহমদের সাথে দেখা করেন। তিনি দেখতে পেলেন তাজউদ্দীন আহমদ ঘরের মেঝেতে ঝাড় দিচ্ছেন। কথায় কথায় আসমত আলী জিজ্ঞেস করলেন, তাজউদ্দীন ভাই, এখন কী হবে? উত্তরে তাজউদ্দীন বলেন, কি আর হবে, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হবে, আমরাও শেষ হব।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর আমার তাজউদ্দীন আহমদের কথাগুলাে মনে হলাে। তিনি ভবিষ্যতকে দেখেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা রিমি লিখেছেন, “আব্বু বলতেন, একটা কষ্ট আমার মনে রয়েই গেল। যে মুজিব ভাইকে আমি তিলতিল করে আমার মনে ধারণ করেছিলাম, যাকে আমি কোনদিন নিজ থেকে আলাদা করে ভাবতে পারিনি, সেই মুজিব ভাই একটা দিনের জন্য আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন না, তাজউদ্দীন ১৯৭১ -এ আমি যখন ছিলাম না তােমরা তখন কি করলে? একবারও বললেন না, তাজউদ্দীন তুমি বল, আমি ১৯৭১ এর কথা শুনব।” ৩
তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগের পর তার বাসভবনে আইবির লােকজন ঘোরাঘুরি করে তাজউদ্দীনের ওপর নজর রাখত। তাজউদ্দীন আহমদের ভাই মফিজউদ্দিন আহমদ গুরুতর অসুস্থ। তাকে চিকিৎসার জন্য তিনি তাকে মস্কো নিয়ে যাবেন। সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত আঁদ্রে পপভের সাথে যােগাযােগ করেন। রাষ্ট্রদূত জানালেন দেশের বাইরে যাবার ভিসা নিতে হলে তার রাষ্ট্রপতির অনুমতির প্রয়ােজন।
তাজউদ্দীন বলেন, যে দেশ আমার হাতে স্বাধীন হলাে সে দেশ থেকে আমি কাজে বিদেশে যাব আর আমাকে নিতে হবে অনুমতি! আমি যাব না। আমি বিশ্বাসঘাতক হয়ে বেঁচে থাকতে চাই না।
তাজউদ্দীনের পদত্যাগের পর তার গাড়ি ছিল না। তার দুই কন্যা রিকশা বা অন্যের গাড়িতে বেইলী রােডের ভিকারুননিসা স্কুলে যেত।
বঙ্গবন্ধুকে যে কথা বলা হলাে না
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের কথা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কোনদিন বলার সুযােগ পেলেন না। আর বঙ্গবন্ধু কোন কথা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চাননি। তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের সবচেয়ে আপেক্ষ ছিল- বঙ্গবন্ধু কোনদিন জানতে চাননি যে, তিনি কি করে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। এ ব্যাপারে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একান্ত সাক্ষাতকালে তাজউদ্দীন আহমদ মঈদুল হাসানকে তার আপেক্ষপের কথা বলেছিলেন। মঈদুল হাসান তার মূলধারায় লিখেছেন :৪
পৃষ্ঠাঃ ৬৩৭

“এরপর অবশিষ্ট মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন ছিল সরকারের নেতৃত্ব পুননির্ধারনের। ১১ জানুয়ারি (১৯৭২) সকালে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন প্রথম এ বিষয়ে একান্ত আলাপে প্রবৃত্ত হন। এতদিন শেখ মুজিব ছিলেন রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী। পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কোন কার্যকরী ক্ষমতা নেই। সরকার পরিচালনায় সর্বপ্রধান ভূমিকা শেখ মুজিব পালন করেন, তাই ছিল অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের ঐকান্তিক কামনা। তাদের এই ইচ্ছার কথা উভয় নেতাই অবগত ছিলেন। কাজেই সরকার পরিচালনার মূল দায়িত্ব শেখ মুজিবের কাছে হস্তান্তরিত করার বিষয়টি স্বল্প আলোচনার মাধ্যমেই স্থির হয়।
বাইরে অপেক্ষমাণ অসংখ্য দর্শনার্থীর অধৈর্য ভিড়। সকাল দশটায় আহূত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যােগদানের তাড়া। ফলে দু’জনের আলােচনা আর এগুতে পারেনি। তাজউদ্দীন জানান, তার আরও কিছু জরুরী কথা বলার ছিল- মুক্তিযুদ্ধের এই সাড়ে ন’মাসে কোথায় কি ঘটেছে, কিন্তু তখন এসব কিছুর আলােচনার সময় ছিল না। পরেও কখনও সে সুযােগ তাজউদ্দীনের ঘটে ওঠেনি। তাজউদ্দীন আহমদের বড় ভাই ওয়াজউদ্দিন ১৯৪৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ওয়াজউদ্দিনের পুত্র দলিল উদ্দিনকে আপন ছেলের মতাে মানুষ করেন। তিনি একজন প্রকৌশলী ছিলেন। তাজউদ্দীনের ভাইয়ের মৃত্যু সময় তাদের বাবা জীবিত ছিলেন। পিতার জীবিতকালে পুত্রের মৃত্যু হলে তার ছেলেমেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পায় না। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ ভাইয়ের ছেলেকে সম্পত্তি ভাগ করে দেন।
তাজউদ্দীন খুব অতিথিবৎসল ছিলেন। তার বাসায় যারা আসতেন তাদের তিনি আপ্যায়ন করতেন।
১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ আইন প্রণয়ন করে । তাজউদ্দীন এ আইনের বিরােধিতা করেন। এ কারণে বিশেষ আইন বাস্তবায়নে বিলম্বিত হয়েছিল ।
প্রশাসনিক দক্ষতায় তাজউদ্দীনের সমতুল্য মুজিব কেবিনেটে কেউ ছিলেন না।
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি
হওয়া দেশের ইতিহাসের বড় ট্র্যাজেডি
২০০৫ সালের ২৩ জুলাই জাতীয় জাদুঘরের বেগম সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে তাজউদ্দীন আহমদের ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে প্রশ্নোত্তর সভায় আলােচনা করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৬৩৮

অধ্যাপক কামাল হােসেন, অধ্যাপক খান সরওয়ার মােরশেদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম, মুজিবনগরের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম, তাজউদ্দীন আহমদের অর্থসচিব কফিল উদ্দীন মাহমুদ, সেক্টর কমান্ডার লেঃ আবু ওসমান চৌধুরী, তাজউদ্দীনের একান্ত সচিব ড. ফারুক আজিজ খান, আবু সাঈদ, মতিয়ুর রহমান। তারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি বড় ট্রাজেডি। যারা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছিল তারাই এ দূরত্ব সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। দু নেতার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিতে আঘাত করতে চেয়েছে।
অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ বলেন, তাজউদ্দীন আহমদ একটি ধারালাে প্রশ্ন হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক জীবনে উপস্থিত। তার ব্যক্তিত, দূরদৃষ্ট, ধীশক্তি, কঠিন পরিশ্রম আর ব্যক্তি জীবনে ত্যাগ ছিল অতুলনীয়।
হােসেন বলেন, পাকিস্তানে বন্দী থাককালে ১৯৭১ সালের ২৮
ড. কামাল হােসেন বলেন, পাকিস্তানে বন্দী থাকাকালে ১৯৭১ সালের ২৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর সাথে কারাগারে প্রথম সাক্ষাৎ। বঙ্গবন্ধু আমাকে দেখেই বললেন, দেখেছ, আমি জানতাম সে পারবে। পাকিস্তান থেকে লন্ডনে পৌছে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বললেন, দেখেছ, আমি জানতাম সে পারবে। পাকিস্তান থেকে লন্ডনে পৌছে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বললেন, তাজউদ্দীনকে ফোন কর। তার সাথে কথা বলার পর আমি সংবাদ সম্মেলন করব। অথচ মােশতাক আমাকে বলেছে, তাজউদ্দীন চাইনি বঙ্গবন্ধু ও আপনি ফিরে আসুন। এভাবেই ষড়যন্ত্রকারী রাষ্ট্রের অস্তিত্বে আঘাত করতে চেয়েছে।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম শর্ত ছিল আমাদের যুদ্ধ আমরাই করব। অনেক শর্ত মেনেই ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের সাথে যৌথ কমান্ড গঠনে সম্মতি দেন। এটাই ছিল ভারত-বাংলাদেশ প্রথম আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক। এর প্রথম শর্ত ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ও বাংলাদেশ সরকার বলা মাত্র ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, শুরু থেকেই কিছু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে বিরােধ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। বেগম মুজিবের কাছেও তারা তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বলেছেন। শেষ পর্যন্ত তারই সফল হলেন।
লে. কমান্ডার অব, আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীন আহমদ প্রবাসী সরকার গঠন না করলে আমরা মুক্তিযােদ্ধা না হয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত হতাম। জিয়াউর রহমান একটি কাউন্সিল গঠন করে নিজে তার প্রধান হতে চেয়েছিলেন। তাকে ব্রিগেড গঠনের দায়িত্ব
পৃষ্ঠাঃ ৬৩৯

দেয়া হলেও তিনি ফোর্স গঠন করেছেন নিজের নামে। এসব কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওসমানী তাকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ তাকে বাধা দিয়ে আরও দুটি ফোর্স গঠনের নির্দেশ দেন।
হােসেন তৌফিক ইমাম বলেন, মােশতাকের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমরা অনেকেই কিছুটা জানতাম। তিনি পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিলেন। এটি জানার পরই তার পরিবর্তে আর আবু সাঈদ চৌধুরীকে নিউইয়র্কে পাঠানাে হয়েছিল।
আবু সাঈদ বলেন, নিয়মানুবর্তিতা ও স্মৃতিশক্তিতে তাজউদ্দীন আহমদ অসাধারণ ছিলেন। তার সেন্স অব জাজমেন্ট ছিল প্রখর। তাকে হারিয়ে বাংলাদেশ হতদরিদ্র হয়েছে।
স্বাধীনতার পর একদল কুচক্রী তাজউদ্দীন আহমদের চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য জঘন্য মিথ্যা প্রচার চালায়। আওয়ামী লীগের মধ্যেও একটি গোষ্ঠী তাজউদ্দীন আহমদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মিথ্যা প্রচারেও বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করত।
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কুখ্যাত কালােবাজারী ম্যানসেরু মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযােগ উদঘাটন করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শন করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু কুচক্রী মহল গুজব ছড়ালাে যে, তিনি ম্যানসেরু মিয়ার আটককৃত মালামাল ছেড়ে দিতে বলেছেন। তাজউদ্দীন মন্ত্রী থাকাকালে তার বিরুদ্ধে অভিযােগ আনা হয়। তিনি কারাগারে বন্দী ও তাকে নির্মমভাবে হত্যার পর তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয় এবং তদন্তে অভিযােগ প্রমাণিত হয়নি। কাস্টমস কালেক্টর আবদুল লতিফ সিকদার ম্যানসেরু মিয়ার ওপর গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি বলছেন, “তাই এই কুচক্রী ঘৃণ্য মহল থেকে রটনা করা হলাে যে, জনাব তাজউদ্দীন ম্যানসেরু মিয়া কেসের আটক পণ্য ছেড়ে দেবার জন্য চট্টগ্রাম সফর করছেন। কি জঘন্য নােংরা প্রচার, কত বড় নির্লজ্জ মিথ্যা ও নিষ্ঠুর অপপ্রচার। এ ধরনের কথা কানে এলে অসহ্য যন্ত্রণা কাতর বােধ করেছি। কেননা অখণ্ডনীয় স্বীকৃত সত্য এই যে, তিনি সেই মুহূর্তে সেখানে এলেন বলেই ম্যানসেরু মিয়া কিংবদন্তি।”৫
পদত্যাগ সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদ
দৈনিক ইত্তেফাক : ২৭ অক্টোবর ১৯৭৪
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ : প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান পদত্যাগ করিতে বলায় অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গতকাল (শনিবার)
পৃষ্ঠাঃ ৬৪০

মন্ত্রীসভা হতে পদত্যাগ করিয়াছেন। অর্থমন্ত্রীর এই পদত্যাগের কথা গতকাল ঢাকায় সরকারিভাবে ঘােষণা করা হয়।
বাসস, এনা, বিপিআই এই খবর দিয়া জানায় যে, রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদউল্লাহ জনাব তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিয়াছেন ।
পদত্যাগের খবর প্রচারিত হওয়ার পর জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সহিত তাহার বাসভবনে যোগাযোগ করা হইলে তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশেই তিনি পদত্যাগ করিয়াছেন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে এ ব্যাপারে তিনি কোনাে বিতর্কের সৃষ্টি করিতে চাহেন না।
তাজউদ্দীন আহমদ বেলা ১০টা ২২ মিনিটে পদত্যাগপত্র পেশ করেন । সকাল ১০টায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের বৈঠক বাতিল করিয়া দেওয়া হয় ।
বেলা ১টায় মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকের অব্যবহিত পর প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করিতে নির্দেশ দিলে তিনি পদত্যাগপত্র পেশ করেন।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীনতা সংগ্রামকালে বাংলাদেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানী জিন্দানখানা হইতে মুক্তি লাভ ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করিলে জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়। পদত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত তিনি অর্থ, বন, মৎস্য উন্নয়ন এবং পশুপালন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করিতেছিলেন।
দৈনিক পূর্বদেশ : ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৪ রবিবার
তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ : স্টাফ রিপাের্টার : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে অর্থ দফতরের মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গতকাল শনিবার পদত্যাগ করেছেন। সরকারীভাবে এ কথা ঘােষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি জনাব মুহাম্মদউল্লাহ গতকাল শনিবার জনাব আহমদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন।
দৈনিক ইত্তেফাক : ৪ঠা অগ্রহায়ণ, ১৪৮১ বাংলা
প্রেস গ্যালারি হইতে : হাসান শাহরিয়ার : শীত এখনও জাঁকিয়ে বসে নাই বটে, কিন্তু জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন ঠিকই বসিয়াছে। তবে এই অধিবেশন আপাতত স্বল্পকালীন। মেয়াদ বড়জোর ৪/৫ দিন । তারপর এই অধিবেশন মুলতবি হইয়া যাইবে। জানুয়ারি শীতের মাস। পৌষ এবং মাঘের গ্রন্থি জানুয়ারি । তখন আবার শীতকালীন অধিবেশনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হইবে।
পৃষ্ঠাঃ ৬৪১

এই অধিবেশনের একটি নতুন ঘটনা হইলাে সাবেক অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের পেছনের সারিতে আসন গ্রহণ। বাংলাদেশের সংসদের পর্ববর্তী সব কয়টি অধিবেশনে জনাব তাজউদ্দীনের জন্য যে আসনটি সংরক্ষিত ছিল তিনি সে আসনে বসেন নাই। তাজউদ্দীন সােজা আসিয়া দ্বিতীয় সারিতে মনােরঞ্জন ধরের আসনে উপবেশন করেন। জনাব সেরনিয়াবাত আসিয়া প্রথমে তাজউদ্দীন সাহেবের আসনে বসেন, পরে জনাব মনসুর আলী সংসদ কক্ষে প্রবেশ করিলে তিনি সেই আসনটি ছাড়িয়া দেন। জনাব মনসুর আলী তাজউদ্দীন সাহেবের আসনে বসেন। আর মি. মনােরঞ্জন ধর নতুন আসন গ্রহণ করেন।
দৈনিক বাংলা : ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৪
মন্ত্রিসভা থেকে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বিদায় : অর্থমনী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং তার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে।
এনা বাসস ও বিপিআই পরিবেশিত এই খবরে বলা হয়, শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। সরকারীভাবে একথা ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদউল্লাহ জনাব তাজউদ্দীনের পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করেছেন।
এনার খবরে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই জনাব তাজউদ্দীনকে পদত্যাগের অনুরােধ জানানাের সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।
দৈনিক সংবাদ : ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৪
জাতির স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাজউদ্দীনের পদত্যাগ : প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গতকাল (শনিবার) মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন।
রাষ্ট্রপতি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। সরকারী ঘােষণার বরাত দিয়ে বাসস এ খবর দিয়েছে।
এনা পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে।
দৈনিক বাংলার বাণী : ২৭ অক্টোবর, ১৯৭৪
মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় : স্টাফ রিপাের্টার ॥ মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় । প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ গতকাল (শনিবার) দুপুরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদউল্লাহ তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৬৪২

বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বার্থের খাতিরে অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানাের আগে মন্ত্রিসভার কয়েখজন সিনিয়র সদস্যের সাথে মিলিত হন।
জানা গেছে, জনাব তাজউদ্দীন পদত্যাগ করার পর সরাসরি তার হেয়ার রােডস্থ সরকারী বাসভবনে চলে যান। বিকেলে প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব শামসুল হক ও মোল্লা জালালুদ্দিন আহমদসহ অনেকেই তার সাথে দেখা করেন।
স্মরণযােগ্য যে, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বন্দী শিবির থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসার পর দেশে সমুদয় গণতন্ত্র পত্তন এবং তার মন্ত্রিসভায় জনাব তাজউদ্দীন অর্থ ও পরিকল্পনা দফতরের দায়িত্ব লাভ করেন কিন্তু পরে তাকে পরিকল্পনা দফতর থেকে ভারমুক্ত করা হয়।
১৯৭৩ সালের ১০ মার্চ গঠিত মন্ত্রিসভায় জনাব তাজউদ্দীনকে অর্থ ও পাট দফতরের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু ডিসেম্বরে পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তার কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হয়। চলতি বছরের জুলাই মাসে অর্থ ছাড়া তাকে মৎস্য ও পশুপালন দফতরের কর্তব্যভার দেয়া হয়।
তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ সম্পর্কে সাবেক রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান খান বলেন,৬ ‘৭২-এর শেষভাগে তাজউদ্দীনের সাথে আমার কথা হয়েছিল। আমাকে বলল, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে পছন্দ করছেন না। সেটা আমি কিছুটা বুঝতে পারছি।’ আমি বললাম, কোন অন্যায় করেছ?’ তাজউদ্দীন বলল, না। আমার মনে হয তিনি আমার প্রতি ঈর্ষা বােধ করেন। আমি তাজউদ্দীনকে বললাম, “ঈর্ষা হবে কেন? ঈর্ষার কোন কারণ তাে নেই।’
তবে কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘তাজউদ্দীন উচ্চাকাঙ্ক্ষী।’ তখন আমি বলেছিলাম, সে তাে ভাল কথা। অ্যামবিশন প্রত্যেকের মনে থাকা উচিত। তবে তাজউদ্দীনকে নিয়ে তােমার আশঙ্কার তাে কোন কারণ নেই। তার যদি উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে তবে দুই নম্বর আসনটির জন্য, এক নম্বরের জন্য নয়। কারণ প্রত্যেক আওয়ামী লীগার জানে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরেই তাদের থাকতে হবে। শেখ মুজিব সরে গেলে তাদের কোন লাভ নেই। সমাজে তাদের কোন দাম নেই। কাজেই সে এক নম্বর হচ্ছে না। বাকি যারা আছে কাছাকাছি, যাদেরকে ধরে নেয়া হয় যে প্রথম সারিতে আছে, বঙ্গবন্ধুর ঠিক পরেই তাদের মধ্যে কিছু রেষারেষি তাে থাকবেই। আর এদের মধ্যে সে তাজউদ্দীন যদি এমন দাবি করে যে তার স্থান উঁচুতে থাকবে তাতে তােমার আপত্তি কী? তােমার আসন নিয়ে তাে সে কিছু করছে না। সব কথা শুনে শেখ সাহেব বললেন, ‘না, সে অ্যামবিশাস্।’
এই কথাগুলাে বলে তাজউদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঈর্ষার অন্য কোন
পৃষ্ঠাঃ ৬৪৩

কারণ আছে নাকি? তাজউদ্দীন বলল, “মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপার নিয়ে আছে। এই যে মুক্তিযুদ্ধ হলাে, বঙ্গবন্ধুও জানেন, সবাই জানে এবং অন্য অনেকেই মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে জানেন যে, পুরাে মুক্তিযুদ্ধ আমি চালিয়েছি। সেই জন্যই ঈর্ষা করেন আমাকে।’
আমি তখন বললাম, ‘শেখ সাহেবের তাে ঈর্ষা করার কোন কারন নেই। এই স্বাধিকার অর্জনের আন্দোলন হােক বা ভাষা আন্দোলন বা অন্য যে কোন আন্দোলন- সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন না। বেশির ভাগ সময় তিনি ছিলেন কারাগারে। কিন্তু সবকিছুর কৃতিত্ব তিনি একাই পেয়েছেন। অন্য কারও নামে তাে কৃতিত্ব দেয়া হয় না, সব শেখ সাহেবের নামে দেয়া হয়। অন্য কারও আওয়ামী লীগের লােকজন বেশি করে বলতেন যে তাঁর নেতৃত্বে, তার নির্দেশনায় আমরা সব করেছি। সব কৃতিত্ব তাকে দেয়া হচ্ছে। তিনি তো জানেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শারীরিকভাবে হাজির ছিলেন না, কিন্তু সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তো তিনি পেয়েছেন। এই ক্ষেত্রেও তাে সবাই এক কথা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলাে। সুতরাং তাঁর কৃতিত্ব তিনি পেয়েই যাচ্ছেন, কে আসলে কাজটি করেছিল সেটা নিয়ে তাে তার মাথা ঘামাবার প্রয়ােজন নেই।’
তাজউদ্দীন বলল, “দেখুন অন্য আন্দোলনের সঙ্গে এখানে একটা বড় গুণগত পার্থক্য রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ তাে শুধু আন্দোলন নয়, একটা ইতিহাসের বিষয়বস্তু হয়ে গেল । একটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেল, সংগ্রাম করে স্বাধীন হলাে এবং তিনি সেখানে উপস্থিত নেই। এটা বােধ হয় একটু গায়ে বাধছে, খারাপ লাগছে। তিনি জানেন আমি তাঁর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব দিয়েছি, সেই জন্যই হয়ত তিনি আমার উপর ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছেন।’
একদিকে তাজউদ্দীন যেটা বলল, শেখ সাহেব তার সম্পর্কে কী মনে করছেন, অন্যদিকে বিশেষ কিছু লােকজন এবং শেখ সাহেবের কিছু আত্মীয়স্বজনও প্রীত ছিলেন না তাজউদ্দীনের প্রতি। এই সবকিছু মিলিয়েই হয়ত তিনি ঝড়ের পূর্বাভাস হিসেবে আমাকে শুনিয়ে রেখেছিলেন যে, তাজউদ্দীন অ্যামবিশাস। কারণ তাজউদ্দীন যেমন জানত শেখ সাহেবের সাথে আমার সুন্দর সম্পর্কের কথা, তেমনি শেখ সাহেবও জানতেন আমার সঙ্গে তাজউদ্দীনের সম্পর্ক ভাল।
তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা থেকে চলে যাবার বেশ কিছুদিন পর আমি ঢাকায় এসেছিলাম। তখনও শেখ সাহেবের সাথে কথা হয়েছে। তিনি নাম উচ্চারণ না করে বললেন, ‘দেখ, যার উপর এত নির্ভর করতাম, বন্ধু, সে-ই এখন বড় শত্রু
পৃষ্ঠাঃ ৬৪৪

হয়ে দাঁড়াল, আমি কি বুঝি না!’ আমি বললাম, কার কথা বলছ? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কেন, তাজউদ্দীন।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী শত্রুতা করলো তোমার সাথে? তিনি জবাব দিলেন না। তখন বললাম, তােমার কাছে না বলে তো সে মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নেয়নি?’ তখন শেখ সাহেব বললেন, ‘না এটা তো অনেক পরে, কিন্তু আগে থেকে তাে সে শত্রুতা শুরু করেছে।’
মনে হল কেউ কোন কথা লাগিয়েছে। এ কথা হয়ত কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না যে বঙ্গবন্ধু কানকথা শুনতেন খুব বেশি । আমার মনে হয়েছে যে কোন ব্যাপারে শেখ সাহেব তাজউদ্দীনের ওপর নির্ভর করতে পারতেন। যেখানেই কোনো অসুবিধা হচ্ছে দলের বা আন্দোলনের, তখন তাজউদ্দীনকে দেখেছি এসে সামলে নিতে পারত। আমি অনুভব করেছি তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভায় না থাকার ফলে বাংলাদেশ সরকারের অনেক অসুবিধা হবে।
তারপর ‘৭৫-এর ৭ আগস্ট আমি বাংলাদেশের হাই কমিশনার হিসেবে দিল্লিতে গেলাম। দিল্লীর বাংলাদেশ দূতাবাসে ডিফেন্স এ্যাডভাইজার ছিলেন বিগ্রেডিয়ার মঞ্জুর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল এবং ‘৮১ সালে নিহত)। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পর মঞ্জুর বললেন, ‘আমি তাে রাজনীতি করি না, সৈনিক হিসেবে বাইরে থেকেই যতটা দেখেছি, তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে যখন শেখ সাহেবের মনােমালিন্য শুরু হলাে এবং তাজউদ্দীন সাহেব মন্ত্রিসভা থেকে চলে গেলেন তখনই বুঝলাম শেষ মুজিবুর রহমান সাহেবের ডেজ আর নাম্বার, তিনি আর বেশিদিন টিকে থাকতে পারবেন না, এখন তার উপর যদি কোন আক্রমণ আসে তবে তাকে বাচাবার আর কেউ থাকবে না। একজনই তাকে বাঁচাতে পারতেন তিনি তাজউদ্দীন, কিন্তু তিনি চলে গেলেন। আমি মঞ্জুরের মতাে ততটা ভাবিনি। বুঝেছিলাম তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভায় না থাকাতে বেশ কিছু সমস্যা হবে।”
মঞ্জুর তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে আর একটি কথা বলেছিলেন যে, “’৭১-এ মুক্তিযােদ্ধা অনেকেই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধও করেছেন অনেকেই। আমাদের বিভিন্ন নেতা যারা গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানত কাজ তাে করেছেন তাজউদ্দীন সাহেব। তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি দেখেছি, তিনি একটা বুশ শার্ট পরে সারাদিন কাজ করতেন, রাতে সবাই চলে যাবার পর সেটি নিজের হাতে কেচে শুকাতে দিতেন। পরদিন সকালে আবার সেই বুশ শার্ট গায়ে দিয়ে বিভিন্ন লােকজন, কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ-আলােচনা করছেন, নানারকম কাজকর্ম করছেন। এ রকমভাবে কাজ তাে আর কেউ করেননি। বাংলাদেশের প্রতি তাজউদ্দীন সাহেবের যে আনুগত্য এবং যে আগ্রহ ছিল তা প্রশ্নাতীত।”
পৃষ্ঠাঃ ৬৪৫

পদত্যাগ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন : “কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের তিন বছর পুরতে না পড়তেই ইতিহাস কেন ঘুরে গেল? বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে কেন ভুল বােঝাবুঝি দেখা দিল? একজন কেন আরেকজনের কাছ থেকে দূরে সরে গেলেন? আর এই জুটি ভাঙ্গার ফলে দেশের কি সর্বনাশ হলাে? এই প্রশ্নগুলোর জবাব যদি তুলে ধরা না হয়, তাহলে অতীতের ভুল শােধরানাে যাবে না। ইতিহাসে তার আসর নির্মাতাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি বিলম্বিত হবে। দেশকেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলধারায় সহসা ফিরিয়ে নেয়া যাবে না।
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি। আমাদের মধ্যে পারস্পরিক একটা গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক ছিল। এটা অনেকেরই জানা ছিল না। বঙ্গবন্ধু জানতেন, আমি তাজউদ্দীনকে গভীর শ্রদ্ধা করতাম। তাজউদ্দীনের ছিল আমার প্রতি গভীর স্নেহ। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর, বন্ধু ও সহকর্মীর তাজউদ্দিনের সঙ্গে সামান্য মতান্তর হলেও আমাকে ডেকে পাঠাতেন। বলতেন, তুমি একটু তাজউদ্দীনের সঙ্গে কথা বলাে। মনে হয়, আমার ওপর কোনো কারণে রাগ করেছেন। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর ওপর রাগ করতেন না। কোন কারণে দুজনের মতানৈক্য হলে তিনি বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে নীরব হয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধু ভাবতেন, তাজউদ্দীন তাঁর ওপর রাগ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কোনাে সিদ্ধান্ত তার নিজের জন্য, দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে বুঝতে পারলে তাজউদ্দীন প্রতিবাদ জানাতেন না, শুধু অভ্যাসমাফিক হাতের নখ খুটতে খুটতে বলতেন, লিডার এখন সম্ভবত এই সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক নয়। বঙ্গবন্ধু তার কথা শুনলে তিনি খুশি হতেন। না শুনলে আর বাধা দিতেন না। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুর সরকারের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে আমেরিকা সফরে গিয়ে কি বলেছেন, তাঁর উড়াে খবর- বানানাে খবর নিয়ে মন্ত্রিসভার ভেতরে তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা যখন বঙ্গবন্ধুর কান ভারি করলেন এবং বঙ্গবন্ধু তাঁকে পদত্যাগের নির্দেশ দিলেন, সেদিন বিনা বাক্যব্যায়ে তিনি পদত্যাগপত্র সই করেছেন এবং বাসায় ফিরে গিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছেন, দায়মুক্ত হয়ে এলাম।
অর্থমন্ত্রীর পদে তাজউদ্দীন ভাই ইস্তফা দিয়েছেন শুনে আমার মনে কিছুটা গ্লানিবােধ দেখা দিয়েছিল। কারণ, পদত্যাগ করার কিছুকাল আগে তিনি আমার কাছে তাঁর আত্মীয়, সে সময়ের সংসদ সদস্য ও ঢাকার পাইওনিয়ার প্রেসের মালিক মােহাইমেন সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন, আমাকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। গিয়ে দেখি, তিনি ড্রয়িংরুমে ভাবলেশহীন মুখে বসে আছেন।
পৃষ্ঠাঃ ৬৪৬

বললাম, তাজউদ্দীন ভাই, ডেকেছেন কেন?
তিনি আমাকে বসতে বললেন। আমি বসতেই নিরুত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, একটা পরামর্শের জন্য ডেকেছি। আমি এখন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে চাই । আপনি কি বলেন? সবিস্ময়ে বলেছি, হঠাৎ পদত্যাগ করতে কেন চান? মতানৈক্য তাে সব গণতান্ত্রিক সরকারেই হয়।
সে জন্য নয়।
তাহলে?
আমার মনে হয়, আমি লিডারের আস্থা হারিয়েছি। হয় আমার শত্রুদের কান কথা শুনে অথবা অন্য যে কোন কারণে হােক, তিনি আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমাদের সম্পর্কের ভিত্তিটাই ছিল পরস্পরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের জন্যই অনেক বড় বড় বিপদেও আমরা একজন আরেকজনকে ছাড়িনি। তার অনুপস্থিতিতেই সাহস করে অনেক সময়ে বড় সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। কিন্তু এখন মনে হয়, আমাদের সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার এই ভিত্তিটা আর নেই। তিনি আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারছেন না। এই অবস্থায় আমার পক্ষে কি তার মন্ত্রিসভার সদস্য থাকা উচিত? না থাকা সম্ভব? আমি তার যুক্তিটাকে সেদিন মেনে নেইনি। ভেবেছি, বঙ্গবন্ধুকে তিনিভুল বুঝেছেন। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয়ই তাকে অবিশ্বাস করেন না। কোনাে ব্যাপারে মতানৈক্যটাকেই তিনি অবিশ্বাস বলে ভাবছেন। এটা দুই বন্ধুর মান-অভিমানের পালা। দ’দিন গেলে আপনা থেকেই চলে যাবে। অথবা বঙ্গবন্ধু আমাকে কিংবা আর কাউকে ডেকে বলবেন, দেখ তাে তাজউদ্দীন আমার ওপর রাগ করেছে কি না।
এই ভাবনাচিন্তা থেকেই তাজউদ্দীন ভাইকে সেদিন বলেছিলাম, আপনি এখন পদত্যাগ করবেন না। এই ভুল বােঝাবুঝি থাকবে না। এই সময়েই আপনাকে বঙ্গবন্ধুর বেশি দরকার। আপনি অপেক্ষা করুন।
তাজউদ্দীন পদত্যাগ করেননি। এরপর তিন মাস না ঘুরতেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন পদত্যাগ করতে হলাে, তখন খবরটা শুনে গ্লানিবােধ করেছি। তাজউদ্দীন আহমদ যখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, তখন যদি করতেন, তাহলে বরখাস্ত হওয়ার মতাে এই অবস্থাটা তাকে মেনে নিতে হতাে না। আমি তাঁর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম ক্ষমা চাওয়ার জন্য। কিন্তু আশ্চর্য মানুষ তাজউদ্দীন। হেসে বললেন, তখন আপনার পরামর্শটাই ঠিক ছিল। পদত্যাগ করলে লিডারকে বােঝানাে হতাে, মন্ত্রিসভার ভেতরে বসে আর চক্রান্ত করতে পারছি না বলে সরে গেছি। এখন লিডারের নির্দেশেই আমি সরেছি। সব
পৃষ্ঠাঃ ৬৪৭

দায়দায়িত্ব তার।
বললাম, এখন কি করবেন? নতুন দল গড়বেন? আপনি ডাক দিলে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতাকর্মী আপনার কাছে চলে আসবেন।
তাজউদ্দীন বললেন, পাগল হয়েছেন, আমি করব শেখ মুজিবের রাজনীতির বিরােধিতা? এ তাে আমার আত্মহত্যার শামিল। লিডারের এখন অনেক শত্রু বন্ধু সেজে চারপাশে জুটেছে। আমি অপেক্ষা করব। দেখি, বাইরে বসেই থাকে রক্ষা করার কোনাে উপায় উদ্ভাবন করতে পারি কি-না। শেখ মুজিব ধ্বংস হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে যাবে।
তাজউদ্দীনের ড্রয়িং রুমে রাখা ছিল বঙ্গবন্ধুর লাইফ সাইজ এটা পোর্ট্রেট। সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর চারপাশে তার শত্রুরা শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তাঁকে ভুল বােঝাচ্ছে। তিনি তা বুঝতে পারছেন না। লিডারের ওপর আমার কোনাে রাগ নেই। কেবল দুঃখ কি জানেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা দেশে ফিরে এসেছি মুজিবনগর থেকে। তিনি ফিরে এসেছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। কি ফিরে এসে তািন একবারও আমার কাছে জানতেও চাননি, তাঁর দশ মাসের অনুপস্থিতিতে আমরা মুজিবনগরে কি করেছি, মুজিবনগরে কি হয়েছে? তিনি সবই অন্যের মুখে শুনলেন, আর সেই শােনা কথার উপরেই তিনি তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভিত তৈরি করলেন। এবারও হয়েছে সেই একই ব্যাপার। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আমি আমেরিকায় গিয়ে কি বলেছি, তিনি তা আমার কাছে একবারও জানতে চাননি, শুধু অন্যের কথা, খবরের কাগজের উদ্দেশ্যমূলক রটনা শুনেই আমাকে বিচার করে বসলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কেন তাকে নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু বললেন না?
তাজউদ্দীন ম্লান হাসলেন, বললেন তিনি শুনতে না চাইলে তাকে শােনানাে মুশকিল। তাছাড়া আমার এক মুখের কথা, অন্যদিকে দশ মুখের কথা। তিনি কোনটা বেশি বিশ্বাস করতেন? গাফফার, আপনি খন্দকার মােশতাক আহমদকে চেনেন। প্রকাশ্য রাজনীতিতে তিনি সুবােধ বালক সেজে থাকেন। কিন্তু কান কথার গােপন রাজনীতিতে তিনি মারাত্মক খেলােয়াড়। লিডারের পরিবারের অধিকাংশ লােককে তিনি বশ করে ফেলেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের দিনটির কথা এবার বলি। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যভাগ। আমি লন্ডন থেকে ঢাকায় গিয়েছিলাম মাসখানেকের জন্য। তখন ফিরে আসার উদ্যোগ নিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছেন মাত্র কয়েক মাস হয়। ঢাকার আকাশে বাতাসে নানারকম গুজবের
পৃষ্ঠাঃ ৬৪৮

ছড়াছড়ি। আমার নিশ্চিত ধারণা, মারাত্মক কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আমি তাকে আমার মনের আশঙ্কার কথা জানালাম, বললাম- চারদিকে ষড়যন্ত্রের গন্ধ । মনে হয়, সাংঘাতিক কিছু ঘটানাের চেষ্টা চলছে। তাজউদ্দীন বললেন, আমি এখন কি করতে পারি?
তাজউদ্দীন তখন মন্ত্রী নন। বাকশালের পলিটব্যুরােতেও তার স্থান হয়নি। বাড়িতে বসে রাজনৈতিক ডায়েরি লেখেন। আমার কথা শুনে বললেন, আমি এখন কি করতে পারি? সহসা তাকে একটি কথাই মাত্র বলতে পেরেছিলাম, দেশে কোন বিকল্প নেতা, বিকল্প গণতান্ত্রিক বিরােধী দল নেই। এই শূন্যতা ভয়াবহ। বঙ্গবন্ধুর কিছু হলে হলে এই শূন্যতা পূরণ করার সুযােগ কে বা কারা নেবে বুঝতে পারছেন না? আপনি একাত্তর সালের মতাে আবার দাঁড়ান। এবার নতুন রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করুন। এই শূন্যতা পূরণ করুন।
তাজউদ্দীন আহমদ মাথা দোলালেন, তা হয় না গাফফার। রাজনৈতিক শূন্যতা রাতারাতি পূরণ করা যায় না। তাছাড়া দেশে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কোনাে সুযােগও রাখা হয়নি। আমি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিয়ে তার বিরুদ্ধে কোনাে দল করতে পারব না। যদি তা চাইতাম, তাহলে তো অনেক আগে জাসদ যখন গঠিত হয়, তখন তাদের ডাকে জাসদেরই নেতা হতে পারতাম।
তাহলে আপনি এখন কি করবেন?
অপেক্ষা করব । লিডারের ভুল ভাঙ্গার সময় আসবে । তিনি শত্রু-মিত্র চিনতে পারবেন। আমাকে তার দরকার হবেই। তখন আবার একযােগে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে নামতে হবে। যুদ্ধে জয়ী হলে আমরা বাচব, নইলে সবাই মরব। এখন শুধু প্রার্থনা করছি, সময় থাকতে যেন লিডারের ভুলটা ভাঙ্গে।
তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে কয়েকদিন পর লন্ডনে ফিরে এসেছি। এরপর এক মাসও কাটেনি। পনেরােই আগস্ট ভােররাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। তারপর দু’মাস না যেতেই জেলে বন্দী অবস্থাতেই হত্যা করা হলাে তাজউদ্দীনকে। যারা তাঁকে বঙ্গবন্ধুর কাছ ছাড়া করেছিলেন, নানা রটনায় অবিশ্বাসের পাত্র করে তুলেছিলেন, সেই ব্রুটাসের দলকে দেখা গেল বঙ্গবন্ধুর রক্ত মাড়িয়ে বঙ্গভবনে পা রাখতে। ক্ষমতার মসনদে গিয়ে বসতে। আর তাজউদ্দীন (ও তিন জাতীয় নেতা) মধ্যরাতে বর্বর ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন, নেতা (মুজিব ভাই), আমি তােমারই লােক ছিলাম, জীবনে এবং এখনও মরণেও।
চীনের মাও-চৌ জুটির মতাে বাংলাদেশে মুজিব-তাজউদ্দীন নেতৃত্বের জুটিতে কেউ যদি চির ধরাতে না পারত, তাহলে পঁচাত্তরের পনেরােই আগস্ট এত সহসা,
পৃষ্ঠাঃ ৬৪৯

এত সহজে ঘটানাে কি সম্ভব হতাে? ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা প্রশ্নটি বিবেচনা করে দেখুন।”৭
বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে বিরােধের কথা কতটা সত্য?
আবদুল গাফফার চৌধুরী
লন্ডনে বােমা হামলা, তজ্জনিত অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ সবকিছু মিলে তেইশে জুলাই তারিখটির কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সাধারণত আমি ভুলি না। এ বছর তারিখটির কথা মনে পড়লাে দুদিন পর। অর্থাৎ পঁচিশে জুলাই সোমবার। মনে পড়তেই ঢাকায় বন্ধুবর মােনায়েম সরকারকে টেলিফোন করলাম। তিনি জানালেন, ২৩ জুলাই স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের ৮০তম জন্মবার্ষিকী তাজউদ্দীন স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে উদযাপিত হয়েছে। প্রধান দৈনিক পত্রিকাগুলােতে অনেকেই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে
করে লিখেছেন। নিজের স্মরণশক্তিকে ধিক্কার দিলাম। এই দিন ঢাক
সভায় শারীরিকভাবে হাজির থাকতে না পারি, সংবাদপত্রের পাতায় আমার উপস্থিতি প্রয়ােজন ছিল।
স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নায়ক তাজউদ্দীন। কিন্তু তাকে তার প্রাপ্য আসনটি দেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। আর তাজউদ্দীন আহমদকে নীরব উপেক্ষায় চেষ্টা হচ্ছে জনমানসের বিস্মৃতির পর্দায় ঠেলে দেওয়ার। এই খেলা ইতিহাসের অনেক নায়ককে নিয়েই হয়েছে। সুভাষ বসু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানে পালিয়ে গিয়ে তাদের সহায়তায় ভারত স্বাধীন করার চেষ্টা করেছিলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন। সে জন্য অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এবং একই মনােভাবের আরও অনেক ব্যক্তি তাকে ‘তােজোর কুকুর’ (তােজো ছিলেন জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) আখ্যা দিয়ে স্বাধীনতা-সংগ্রামী হিসেবে তাকে অস্বীকার করেছিল। সেই সুভাষ চন্দ্রের বিরাট ছবি এখন জাতীয় বীর হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট সরকারই রাজ্য বিধানসভার দেয়ালে স্থান দিয়েছে।
চীনে সানইয়াত সেনকে নিয়েও একই খেলা চলেছিল। কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখল করার পর সানইয়াত সেনকে ‘বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল নেতা আখ্যা দিয়ে তার নাম নয়াচীনের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। সেই চেষ্টা সফল হয়নি। বিস্মৃতির পর্দা ঠেলে সান আবার জনমানসে উঠে এসেছেন জাতীয় বীর হিসেবে। কমিউসিন্ট শাসকেরাও তাকে সেই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। মাও
পৃষ্ঠাঃ ৬৫০

জে দং জীবিত থাকতেই সানইয়াত সেনের বিধবা স্ত্রীকে সরকারীভাবে সম্মান দেখানাে হয়।
আমার বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলার ইতিহাসের দ্বিতীয় মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদ ও একদিন বিস্মৃতির পর্দার আড়ালে তাকে সরিয়ে রাখার সকল অপচেষ্টা ব্যর্থ করে জনমানসে তার প্রাপ্য আসনটিতে উঠে আসবেন। আসবেন কি তিনি উঠে আসতে শুরু করেছেন। বনানীর গােরস্তানে তাকে আরও দুজন জাতীয় মাটির কবরে শুইয়ে দিয়ে যারা ভেবেছিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই তারা চিরদিনের জন্য মাটিচাপা দিচ্ছে, তাদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে সেই মাটি চাপা দেওয়া ইতিহাস আবার খবর ফুড়ে মাথা তুলে দাড়াতে যাচ্ছে। ইতিহাস তার বীর নায়কদের নিজেই আবার জীবনদান করে। আর খলনায়কদের সকল শক্তিও দর্প চূর্ণ করে চিরদিনের জন্য আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেয়।
তাজউদ্দীন আহমদকে চিনি আমার কলেজ জীবন থেকে। ভালাে করে পরিচয় হয় তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী এবং আওয়ামী লীগের প্রধান সারির নেতাদের মধ্যে চলে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে সবচাইতে কঠিন পরীক্ষা এসেছিল, যকন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আইয়ুবের শাসনামলে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ঘটানাের জন্য তিনি পদক্ষেপ নেন। এ সময় আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, মশিউর রহমান, জহিরুদ্দিন প্রমুখ অধিকাংশ প্রবীণ নেতা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরে দাঁড়ান।
এ সময় আওয়ামী লীগের ভাঙ্গা দুর্গ খাড়া রাখা এবং প্রবীণ নেতাদের বিরােধিতা থেকে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখার জন্য যেসব সাহসী তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেন, তাদের মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সকলের অগ্রগামী। ছয় দফা আন্দোলনের সময় যখন বঙ্গবন্ধু অধিকাংশ সহকর্মীসহ বন্দী, তখন এই প্রবীণ নেতারাই, এমনকি বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় সালাম খান পর্যন্ত আওয়ামী লীগের পিঠে ছুরিকাঘাতের চেষ্টা করেন। তারা ঘােষণা দেন, বঙ্গবন্ধুকে তারা আওয়ামী রীগ থেকে বহিষ্কার করেছেন এবং পাল্টা আওয়ামী লীগ গঠন করেন। এই আওয়ামী লীগ পরিচিত হয়েছিল পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ নামে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন এই সময় নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। তিনিও ঢাকার পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগের দলে ভিড়ে যান। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদ জেলে বসে তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ গ্রহণে রাজি করান। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, কেবল কিছু তরুণ নেতা দ্বারা গঠিত আওয়ামী লীগ টিকবে না।
পৃষ্ঠাঃ ৬৫১

প্রবীণ নেতাদের পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগই টিকে যাবে। কিন্তু ছয় দফার আন্দোলন ও আটষট্টি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কায় প্রবীণ নেতাদের আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ ধসে পড়ে এবং বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে দাঁড়ান। তাজউদ্দীন আহমদও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুজিব ও তাজউদ্দীন নাম দুটি অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়।
ছয় দফা প্রণয়নে বঙ্গবন্ধুকে সবচাইতে বেশি সাহস ও শক্তি যুগিয়েছেন তাজউদ্দীন। এ সময় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও সমর্থকই এই ভেবে ভয় পেয়েছিলেন যে, ছয় দফা দাবি উত্থাপন করা হলে আইয়ুব সরকার একে বিচ্ছিন্নতাবাদের দাবি আখ্যা দেবে এবং প্রচণ্ড দমননীতি চালাবে। তারা বঙ্গবন্ধুকে এই দাবি উত্থাপন থেকে নিবৃত্ত রাখারও চেষ্টা করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদকে এ সময় দেখেছি ছয় দফার দাবি প্রকাশ্যে উত্থাপনে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থনও সাহস জোগাতে। তিনিই প্রস্তাবগুলােকে নাম দেন বাংলার মুক্তি সনদ, ম্যাগনাকার্টা’।
সম্ভবত তখনকার বাঙালী বুদ্ধিজীবী সমাজ বিশেষ করে রহমান সোবহান, ড. মােশাররফ হােসেন প্রমুখ অর্থনীতিবিদকে তিনিই ছয় দফার পক্ষে টেনে আনেন এবং রেহমান সােহান ছ’দফার অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান। রাজনৈতিক ফ্রন্টে এই গ্রুপেরই ড. কামাল হােসেন ও তার স্ত্রী মিলে ‘ফোরাম’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেন। পত্রিকাটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল ছয় দফা দাবির একটি প্রধান বাহন।
ঢাকায় আওয়ামী লীগের অফিস তখন ছিল ১৫ পুরানা পল্টনে। বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন একই কক্ষে বসতেন। পাশের কক্ষে বসতেন মােহাম্মদ উল্লা চৌধুরী । তিনি তখন সম্ভবত অফিসটির চার্জে ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথমে সংসদের স্পিকার, পরে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। পুরানা পল্টনের অফিসে গেলেই দেখতাম, বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ একই কক্ষে বসে আছেন এবং রাজনৈতিক বিষয়ে আলােচনায় প্রায়ই তারা মগ্ন থাকতেন। তাজউদ্দীন আহমদের ওপর বঙ্গবন্ধুর ছিল অগাধ আস্থা এবং তার পরামর্শের উপরেও তিনি নির্ভর করতেন। ছয় দফার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনকার একটি ঘটনা মনে আছে।।জুলফিকার আলী ভুট্টো হঠাৎ বঙ্গবন্ধুকে চ্যালেঞ্জ জানালেন, ছয় দফার প্রশ্নে তিনি ঢাকার কোনাে জনসভায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রকাশ্যে বিতর্কে নামতে চান এবং ছয় দফা যে অবাস্তব এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ এ কথাটা প্রমাণ করবেন। বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করলেন। অনেকেই তাকে ভুট্টোর সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের ভয় ছিল, ভুট্টোর মতাে অক্সফোর্ড
পৃষ্ঠা ৬৫২

পড়ুয়া, ইংরেজিতে তুখোড় বাগ্নীর সঙ্গে শেখ মুজিব তর্কে পেরে উঠবেন কি না! একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ‘তর্ক ভাষা দিয়ে হয় না, হয় যুক্তি দিয়ে। যুক্তি আমাদের পক্ষে।
পল্টনের মাঠের জনসমাবেশে এই তর্কযুদ্ধ হবে ঠিক হয়েছিল । ঢাকায় হৈরৈ কান্ড। মুজিব – ভুট্টো তর্কযুদ্ধ দেখার জন্য মফস্বল থেকে হাজার হাজার লােক ঢাকায় ছুটে এসেছিল। যেদিন বিকেলে তর্কযুদ্ধ হবে সেদিন সকালেও জানা গেল ভুট্টো সভায় আসবেন। তিনি ঢাকাতেই ছিলেন। আমি কয়েকজন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি তখন বেজায় ব্যস্ত। ভুট্টো তর্ক যুদ্ধে নেমে বঙ্গবন্ধুকে কী সব প্রশ্ন করতে পারেন এবং তার কী জবাব হতে পারে। অগুনতি বই ঘেঁটে তার নােট নিচ্ছিলেন। আমাদের দেখে দুই আঙুলে ভি চিহ্ন দেখিয়ে বললেন, ‘জয় আমাদের অনিবার্য।
বঙ্গবন্ধু যখন পল্টনের সভায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন খবর ছড়িয়ে পড়ল, জুলফিকার আলী ভুট্টো কাউকে কিছু না জানিয়ে ঢাকা এয়ারপাের্টে গিয়ে এই দপরেই লাহাের চলে গেছেন। তাজউদ্দীন ভাই সাংবাদিকদের ডেকে বললেন, ‘ভুট্টো আমাদের কিছু না জানিয়ে পালিয়ে গেছেন। এটা মুজিব-ভুট্টো যুদ্ধের ড্র নয়; মুজিবের ভিকটোরি। আমার তখন একটি সান্ধ্য দৈনিক ছিল, নাম ‘আওয়াজ’ তাতে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বক্তব্যের উদ্ধৃতিসহ প্রথম পৃষ্ঠার খবরের ব্যানার হেডিং করেছিলাম, ‘ভুট্টোর পলায়ন’।
ছয় দফা আন্দোলনের আগে থেকেই আওয়ামী লীগে ডান প্রতিক্রিয়াশীল অংশকে কোণঠাসা করে (পরে তাদের অধিকাংশই দল থেকে বেরিয়ে যান) একটি প্রােগ্রেসিভ লেফট গ্রুপ গড়ে উঠতে পেরেছিল এবং যে লেফট গ্রুপের সমথৃনে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘােষণা করে আন্দোলনে নামতে পেরেছিলেন, তার অন্যতম।রূপকার তাজউদ্দনি ভাই। দেশের বাম রাজনীতি ও আওয়ামী রীগের মধ্যে তিনি ছিলেন সেতুবন্ধের মতাে। আজ আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি প্রগতিশীল ও শক্তিশালী লেফট গ্রুপের অনুপস্থিতির জন্যই আন্দোলনে নামতে আওয়ামী লীগের এই ঢিলেমি অবস্থা। শেখ হাসিনার দুর্ভাগ্য এই যে, তার চারপাশে অনেক মােশতাক আছে। তাজউদ্দীন একজনও নেই।
বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন ভাই যখন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং কলকাতায় অবস্থান করছেন, তখন একদিন তিনি তার থিয়েটার রােডের বাসায় আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমিও তখন কলকাতায়। কমরেড মণি সিংহের সঙ্গেও সেদিন তার বৈঠক ছিল। আমি যখন প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে ঢুকি, তখন মণি সিংহ বেরিয়ে আসছেন। তাদের বৈঠক
পৃষ্ঠাঃ ৬৫৩

সেদিনের মতাে শেষ। পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পর তাজুদ্দিন ভাই সরাসরি বললেন, দেখুন গাফফার, পাকিস্তানের মিলিটারি জান্তা প্রচার করছে, আমি ভারতের তাঁবেদার। বাংলাদেশকে একটা তাঁবেদার রাষ্ট্র বানাতে চাই। ওরা জানে না, বাংলাদেশের মানুষ অন্য দেশের তাঁবেদার হওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে না, অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে না। তাবেদার হতে হলে তাে পাকিস্তানের তাঁবেদারি করাই আমাদের জন্য সহজ ছিল। এত কষ্ট, এত রক্তক্ষয়ের কী দরকার ছিল? তাজউদ্দীন ভাই আরও বলেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে চল্লিশ বছর বসবাস করে আমরা বুঝতে পেরেছি, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিশ্র সংস্কৃতি ও মিশ্র ধর্মের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে পারে, তবে বাঙালিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে, অন্য কোনােভাবে নয়। বঙ্গবন্ধু এই সত্যটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই যুদ্ধে নেমেছেন এবং আমরা তার অনুসারী হয়েছি। এখন তিনি আমাদের মধ্যে অনুপস্থিত। পাকিস্তানের জেলে আসেন। আমরা তার হয়ে লড়াই চালাচ্ছি। রামায়ণের সেই গল্পটা জানেন তাে, রাম এর বদলে তার ছোট ভাই ভরতকে সিংহাসন দেওয়া হলে তিনি রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখে নিচে বসে রাজত্ব চালাতেন।
আমিও বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তার পতাকা বহনের দায়িত্ব পেয়েছি মাত্র। তিনি ফিরে এলে তার পতাকা তার হাতে দিয়ে আমার দায়িত্ব-মুক্তি । তিনি যতদিন ফিরে না আসেন, কোন চক্রান্তের কাছেই আমি মাথা নত করব না।’
বঙ্গবন্ধুর প্রতি এতই যেখানে তাজউদ্দীন ভাইয়ের আনুগত্য ও নিষ্ঠা, সেখানে তিনি তার নেতার প্রতি কি আনুগত্যহীনতা দেখাতে পারেন অথবা চক্রান্ত করতে পারেন? অবশ্যই পারেন না। চক্রান্ত করেছিলেন খােন্দকার মােশতাক। সেই মুজিবনগরে থাকতেই তার চক্রান্তের শুরু। অথচ বঙ্গবন্ধুর কাছে তাজউদ্দীন আহমদকে অবিশ্বস্ত প্রমাণ করার জন্য তার চেষ্টার অন্ত ছিল না। এ কাজে তাকে যে সহায়তা যুগিয়েছেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বােস্টার, মাহবুব আলম চাষী, এআর মল্লিক প্রমুখ তার অনেক প্রমাণ পরে পাওয়া গেছে। মল্লিক তাে পরে অর্থমন্ত্রীই হয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের সহায়তায় বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে ক্ষমতায় বসতে চান এ কথা বঙ্গবন্ধু কখনােই বিশ্বাস করেননি, তা আমি হলফ করে বলতে পারি । কারণ, এই সময়টাতে আমি দুই নেতারই খুব ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ছিলাম। ভারতের এক দারুণ সঙ্কটের সময়ে নেহরু যেমন তার সবচাইতে বিশ্বস্ত বন্ধু কৃষ্ণমেননকে আমেরিকার প্রচণ্ড চাপের মুখে প্রতিরক্ষমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুও তেমনি একই চাপের মুখে তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে সাময়িকভাবে আত্মরক্ষা
পৃষ্ঠাঃ ৬৫৪

করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এই সময় একটি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন ভাই ওয়াশিংটন ও টোকিও সফরে যাওয়ার পথে দিল্লীতে যান এবং দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন হাইকমিশনার ড. এআর মল্লিকের বাসায় নৈশ ভোজ সারেন। এই সময় ঘরােয়া আলাপ-আলােচনাকালে তাজউদ্দীন ভাই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ সরল বিশ্বাসে ড. মল্লিককে ব্যক্তিগতভাবে যেসব কথা বলেছিলেন, সেগুলােকেই দুমড়েমুচড়ে, বিকৃত করে ড. মল্লিক বঙ্গবন্ধুকে জানান। এরপর ওয়াশিংটনে এবং টোকিওতে প্রদত্ত তাজউদ্দীনের বক্তৃতা টুয়িস্ট করে বঙ্গবন্ধুকে জানানাে হয়। এ কাজটি করে মোস্তাক গং।
আমার জানা মতে, বঙ্গবন্ধু অর্থমন্ত্রী পদ থেকে তাজউদ্দীন ভাইকে পদত্যাগের কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার ওয়াশিংটন ও টোকিও সফরের আগেই। কেবল তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু একই সময় তাজউদ্দীন ভাই দিলেন ওয়াশিংটন ও টোকিওতে তার বিতর্কিত বক্ততা। এই বক্তৃতার বিকৃত রিপাের্ট বঙ্গবন্ধুকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছিল বলে আমার মনে হয় না। হয়তাে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ দেশে ফিরেই। পদত্যাগ করার ব্যাপারটা কাকতালীয় হয়ে গেল, অর্থাৎ সকলে ধরে নিলেন, বিদেশে অর্থমন্ত্রী যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন বলে রটানাে হয়েছে, সেটাই তার কাল হয়েছে। এটাই এখন প্রচলিত বিশ্বাস। তবে তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগের পর পরই ঢাকার ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কার্টুন ছাপা হয়েছিল। কার্টুনটির প্রতিপাদ্য ছিল মার্কিন চাপে তাজউদ্দীন আহমদকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরানাে হয়েছে। আমারও এটাই ধারণা।
আমার এই ধারণা পােষণের পেছনে একটি কারণ আছে। তাজউদ্দীন ভাইয়ের পদত্যাগ করার বেশ কিছুদিন পর গণভবনের একটি কক্ষে যখন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি, তখন তাজউদ্দীন ভাই এসে হাজির হন। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমার উপস্থিতিতেই বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছেন, “তাজউদ্দীন, তুমি আমাকে ভুল বুঝ না। তুমি আমার পাশ থেকে সরে যেও না। আমার কাছে রিপাের্ট আছে দেশে খাদ্যশস্যের ফলন এবার ভাল হয়নি। অকাল বন্যার আশঙ্কা আছে। যদি তা হয় এবং ফসল নষ্ট করে তাহলে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারবে না। জরুরী মার্কিন খাদ্য সাহায্যের দরকার হবেই । তুমি নিশ্চয়ই আমার চালটা বুঝতে পারছ। সাময়িকভাবে তােমাকে সরিয়ে আমেরিকার খাদ্য সাহায্য পেতে চাই । কারণ তুমি তাদের কাছে চক্ষুশূল।’
পৃষ্ঠাঃ ৬৫৫

তাজউদ্দীন ভাই বলেছেন, আপনার পাশ থেকে সরে যাব এটা আপনাকে কে বললাে? আমি মন্ত্রিত্ব থেকে সরে গেছি। আপনার পাশ থেকে সরবো কেন? সরতে চাইলে তাে জাসদের সভাপতি হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতাম না। আমি আপনার দুর্দিনে পাশে ছিলাম, সুদিনেও আছি। আবার দুদিন যদি আসে, তখনও থাকব।
বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন ভাইকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বলেছেন, তাজউদ্দীন, আমাকে একটু সময় দাও, আমাকে একটু সামলে উঠতে দাও। আগের মত আমরা আবার এক হয়ে কাজ করব। তােমার বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্র হয়েছে তার খবর আমি রাখি। তােমার বিরুদ্ধে যে প্রচালনা চালানাে হচ্ছে তাও আমার কানে নেওয়া হয়েছে। আমি তা বিশ্বাস করি না।
এসব আমার নিজের কানে শােনা কথা, নিজের চোখে দেখা ঘটনা। তখনই নিজের ডায়েরিতে দিন তারিখসহ লিখে রেখেছিলেন বলে এই লেখায় তা উল্লেখ করতে পেরেছি। এ ছাড়া আমার কাছে আর কোনাে প্রমাণপত্র নেই। পরে যখন ঢাকায় রাজনীতির অঙ্গনে মুজিব-তাজউদ্দীনের বিরােধের পল্লবিত গুজব শুনেছি, তখন তা বিশ্বাস করতে পারিনি। অবশ্য মুজিব-তাজউদ্দীন বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা দুই তরফেরই কিছু লােকজন করেছিলেন সে কথা সত্য। দু’জনের কাউকেই তারা টলাতে পারেননি। তবে এসব কথাবার্তা শুনে বঙ্গবন্ধু কখনও তাজউদ্দীন ভাই সম্পর্কে এবং তাজউদ্দীন ভাই হয়তাে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রাজনীতিতে দু’বন্ধুর মধ্যেও এটা হয়। এসব কথা একশ্রেণীর সুযােগসন্ধানী লােক ভালপালা ছড়িয়ে প্রচার করেছে এবং দুই নেতার হিতৈষী সেজে দু’জনেরই কানভারি করার চেষ্টা করেছে। এই কাজে পেছন থেকে ইন্ধন জোগানাের জন্য নারদ মুনির মতাে মােশতাক গংতাে ছিলই।
বাকশাল গঠনের সময় বঙ্গবন্ধু আবার তাজউদ্দীন ভাইকে কাছে টানার চেষ্টা করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল হােন। এই প্রস্তাব দিয়ে মনােরঞ্জন ধরকে পাঠিয়েছিলেন তার কাছে। মােনায়েম সরকারের কাছে শুনেছি, প্রস্তাবটা ভেবে দেখার জন্য তাজউদ্দীন ভাই সময় চেয়েছিলেন। সহসা রাজি হননি। এর পরের ঘটনা শুনেছি আবদুস সামাদ আজাদের কাছে। মনােরঞ্জন ধর ব্যর্থ হওয়ায় বঙ্গবন্ধু এবার সামাদ ভাইকে পাঠিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের কাছে। তিনি তিনটা শর্ত দিয়েছিলেন। এই শর্ত তিনটা কি তা আমি জানতে পারিনি। আবদুস সামাদ আজাদকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের কাছে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। কিন্তু তার তিনটি শর্তের কথা প্রকাশে রাজি হননি।
পৃষ্ঠাঃ ৬৫৬

বঙ্গবন্ধু আরেকবার ডাকলে তাজউদ্দীন ভাই হয়তাে বাকশালের সম্পাদক হতে রাজি হতেন। কিন্তু ততদিনে অর্থাৎ মনােরঞ্জন ধর ও সামাদ আজাদের মিশন ব্যর্থ হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু হয়তাে জিল্লুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করার ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। তাজউদ্দীন ভাই যে বঙ্গবন্ধুর ডাকের অপেক্ষা করছিলেন তা বােঝা যায় একটি ঘটনায়। ‘দৈনিক সংবাদের’ বর্তমান সম্পাদক বজলুর রহমানকে তাজউদ্দীন ভাই একদিন তার বাসায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন গল্প করার জন্য। আলাপের এক ফাকে বজলুর রহমানকে তিনি বলেছেন, ‘কই সামাদ আজাদ সাহেব তাে আর এলেন না। বজলুর রহমান তখন সামাদ আজাদের দ্বৈতগিরির কথা জানতে পারেন। এই ঘটনাটাও আমি মােনায়েম সরকারের কাছ থেকে জেনেছি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং বাংলার তাজউদ্দীন দুজনেই আজ নেই। স্বাধীনতার উষালগ্নে এই দুই নেতা যদি কিয়ৎকালের জন্যও পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন না হতেন, তাহলে বাংলার ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতে পারত। স্বাধীনতার শত্রুরা তাই চেয়েছে এই দুই নেতার মৈত্রী ও মিলন যেন অক্ষণ না থাকে। তাদের এই অপচেষ্টা সকল হয়নি। কিন্তু গুজব, বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দুই নেতাকে তারা পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরাতে সক্ষম হয়েছিল । এর পেছনে বিদেশী ষড়যন্ত্রও কাজ করেছে। মুজিব-তাজউদ্দীনের মনােমালিন্য ও বিরােধ সম্পর্কে আজ যত তত্ত্ব ও তথ্যই প্রচার করা হােক না কেন, বঙ্গবন্ধুর পর একই ঘাতক চক্রের হাতে জীবন দিয়ে তাজউদ্দীন ভাই প্রমাণ রেখে গেছেন। তাদের রাজনীতি ছিল অভিন্ন এবং একই লক্ষ্যে তারা আত্মদান করে গেছেন।”৯
অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে মূল্যায়ন
ড. নুরুল ইসলাম খান, ডেপুটি চেয়ারম্যান, প্লানিং কমিশন
সত্যি কথা বলতে তাে আমি রাজনীতিবিদ নই, তাই তার স্ট্রেট ফরােয়ার্ড বক্তব্যে আমার কাজ করতে সুবিধাই হতাে। তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের দেশের প্রচলিত ধারার রাজনীতিবিদদের মতাে ছিলেন না, খুবই স্ট্রেট ফরােয়ার্ড ছিলেন। রাজনীতিতে অনেক সময় হয়ত সত্যি কথা বলতে নেই। ডিপ্লোম্যাসি করে কথা বলে সবাই। কিন্তু আমি দেখেছি তাজউদ্দীন সাহেব সবসময় একেবারে সােজা কথা বলতেন।
তাজউদ্দীন সাহেব খুব দুঃখ করে বলতেন, ‘বঙ্গবন্ধু কোন দিনও আমার কাছ থেকে শােনেননি কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ হলাে, কীভাবে কী করলাম।’ বলতেন, ‘আমি যে একটা মানুষ আছি, কোন দিনও ডেকে বলতেন না, আচ্ছা বল দেখি
পৃষ্ঠাঃ ৬৫৭

তাজউদ্দীন, কী হয়েছিল সেই ‘৭১-এ। আমাকে সেই সম্পর্কে সমস্ত খুলে বল, একদিনে না হয় কয়েক দিনে বল। কীভাবে সেখানে তুমি গেলে, কিভাবে কাজ করলে, আমাকে বল।’ এটা বােধ হয় তাদের মান- অভিমানের কোন ব্যাপার ছিল।
দেশ স্বাধীন হবার কয়েক মাসের মধ্যেই বুঝতে পারছিলাম এই দুজনের সম্পর্কটা যেন টেন্সড় এবং আমি মনে করি তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে শত্রুতা করে কেউ বােধ হয় বঙ্গবন্ধুকে কান-কথা বলত । কিন্তু আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে, তাজউদ্দীন সাহেব সম্পূর্ণভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্য নিবেদিত ছিলেন এবং অকৃত্রিম ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য তাঁর ভালবাসা। এর মধ্যে কোন ফাঁক ছিল না। আমার কাছে কোন দিনই মনে হয়নি তিনি বঙ্গবন্ধুর সবচাইতে ভালোটা চাচ্ছেন না। তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর ভালটাই সবসময় চাইতেন। বঙ্গবন্ধুর বিন্দু মাত্র ক্ষতি বা খারাপ তিনি চাচ্ছেন এটা আমার কোন দিনই মনে হয়নি। তার কার্যকলাপেও দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর ভাল চেয়েই বিশ্বাস করে হয়তো তিনি কিছু বলেছেন, কিন্তু কেউ হয়ত উল্টো কথা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে বুঝিয়ে এসেছেন। সেই সময়ের সমস্ত ঘটনা দেখে আমার যেটুকু ধারণা, শেখ মণি তাজউদ্দীন সাহেবের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এই বিষয়ে আমি প্রমাণ করতে পারব না, কারণ আমার সাথে শেখ মণির কোন সম্পর্ক ছিল না, সে আদৌ কি বলেছে কি না তাও জানি না, কিন্তু এটা আমার একটা ধারণা, হয়ত আমার ভুলও হতে পারে যে, কান-কথা বলায় মােশতাকের চাইতে শেখ মণির ভূমিকা বেশি ছিল। এ ছাড়াও অন্য কেউ কোন মন্ত্রীও থাকতে পারেন। ‘৭৩-এর শুরু থেকে এই টেনশনটা শুরু হয় যে, তাজউদ্দীন সাহেব মনে করতেন প্রায় সময়ই আর তার কথা শােনা হয় না। বঙ্গবন্ধুর যেন তাঁর প্রতি আগ্রহ কম। এই ভুল বােঝাবুঝিতে তাদের কী হলাে তা তাে আমরা দেখেছি, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা হলাে সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডি। আমার মনে আছে, যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এলেন- ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তারিখে, সে দিনের সেই বিশাল জনসমুদ্রে তাঁর সাথে আমি সরাসরি দেখা করতে পারিনি। তাই ১২ তারিখে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে আমি ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রােডের যে বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেগম মুজিব ছিলেন সে বাড়িতে গেলাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হলে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তিনি বললেন, ‘আগামীকাল সকাল দশটার সময় আসেন। আপনার সাথে জরুরী কথা আছে। আমি পরদিন সকাল দশটায় গিয়ে দেখি তাজউদ্দীন সাহেব, নজরুল
পৃষ্ঠাঃ ৬৫৮

সাহেব সহ ৩-৪ জন মন্ত্রী সেখানে আছেন। এ ছাড়া অন্যান্য মানুষ তো আছেনই। বঙ্গবন্ধু তার বেডরুমে বসে বিভিন্নজনকে বিভিন্ন পদে নিয়ােগ দিচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশ সরকার গঠন করছেন। আমাকে দেখেই বললেন, ‘প্রফেসর সাহেব, বসেন। আপনি আজ থেকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। প্ল্যানিং কমিশনের কী কার্যক্রম হবে কে মেম্বার হবে এই সব লিখে পরশুদিন সেক্রেটারীয়েটে নিয়ে আসেন। এক কথায় বঙ্গবন্ধু প্ল্যানিং কমিশনের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, একটু পরেই বঙ্গবন্ধু মতিউল ইসলামকে ডাকলেন। তারপর তাজউদ্দীন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তাজউদ্দিন , মতিউল ইসলাম তােমার অর্থ সচিব। ও খুব ভাল মানুষ । আমি চিনি তাকে, তোমার খুব ভাল হবে। তাজউদ্দীন সাহেব হ্যা বলে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তার সাথে আলাপ করা হয়নি, কিছুই বলা হয়নি, হঠাৎ করেই এই নিয়োগ দেয়া হলাে। বেচারা তাজউদ্দীন সহেব জানতেন না যে এই মানুষটি কে!
তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতাে। আমরা অনেক কথাবার্তা বলতাম। আমি বুঝতাম তিনি এই বিষয়টি কোন দিনও ভােলেননি। এ ছাড়াও আর একটি বিষয় ছিল, মতিউল ইসলাম সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধু সরাসরি যোগাযােগ রাখতেন- যা তাজউদ্দীন সাহেবের মতাে সিনিয়র এবং গুরুতপূর্ণ মন্ত্রীর পক্ষে মেনে নেওয়াটা খুবই সহজ ছিল না। আমি বুঝতাম হি ইজ ভেরি আনহ্যাপি , কিন্তু তিনি কোন দিনই পরিষ্কার করে কিছু বলেননি বা এই বিষয়ে অভিযােগ আকারেও কিছু বলতেন না। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাজউদ্দীন সাহেবের প্রশ্নাতীত এবং অতুলনীয় ভালবাসা ছিল, যে কারণে বুঝতে পারতাম বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রচণ্ড অভিমান ছিল তাঁর। তিনি কিন্তু এই ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও মতিউল ইসলামকে কোন রকম দোষারােপ বা তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ করেননি। তাঁর অভিমানটা ছিল বঙ্গবন্ধুর উপর। তাজউদ্দীন সাহেব মনে করতেন, বঙ্গবন্ধুর উচিত মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে সরাসরি সচিবের সাথে দেখা করার বিষয়টিকেও উৎসাহিত না করা।
তাজউদ্দীন সাহেব আসলেই যে একজন ব্যতিক্রমধর্মী মানুষ ছিলেন তার একটি উদাহরণ দেই। মতিউর ইসলাম সাহেব অনেক সময় বিভিন্ন ইস্যুতে তার নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতেন যা আমাদের মতামতের চাইতে ভিন্ন হতাে। হি ওয়াজ অ্যা প্রাইভেট সেক্টর ম্যান, আর আমরা সমাজতন্ত্র করতে চাচ্ছি, কাজেই মৌলিক পার্থক্য ছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব দ্বিমত হলেও সব সময় আগ্রহ সহকারে মতিউল ইসলামের মতামত শুনতেন, জিজ্ঞাসা করতেন। মতামত
পৃষ্ঠাঃ ৬৫৯

প্রকাশের ক্ষেত্রে কখনই তাঁকে বাধা দিতেন না, রাগ করতেন না, বা এমন ধরনের কোন আচরণই করতেন না। মতিউল ইসলাম সাহেব অত্যন্ত সৎ এবং ভালো মানুষ। তিনি কারও বিরুদ্ধে অগােচরে কোন কথা বলতেন না। যা বলতেন সরাসরি, এই গুণটি ছিল তাঁর। আমি দেখেছি এসব কারণেই তাজউদ্দিন সাহেব তাঁকে কিছুদিনের মধ্যেই পছন্দ করতে শুরু করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরােধী তৎপরতায় জোরালাে সমর্থন এবং ভূমিকার কারণে তাজউদ্দীন সাহেব আমেরিকার প্রাত ভয়ানকভাবে সন্দিহান ছিলেন। তার এই আচরণ খুবই স্বাভাবিক, কারণ আমরা প্রাণপণে স্বাধীনতা সংগ্রাম করছি আর ওই দিকে আমেরিকা আমাদের বিরুদ্ধে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে দিল। তারা আমাদের যুদ্ধকে সবােটাজ করার জন্য খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে গোপন যােগাযােগ করেছে। এসব সন্দেহ থেকেই তিনি বলেছিলেন, আমরা আমেরিকার সাহায্য নেব না। তার মনােভাবটা অত্যন্ত কঠোর ছিল আমেরিকার ব্যাপারে, কিন্তু তিনি যখন রাষ্ট্র চালাতে গেলেন, আমি মনে করি তখন তিনি দেখলেন বাংলাদেশের ভবিষ্যত আর আমার (তার) ব্যক্তিগত অনভূতি তো এক জিনিস নয়। মানবিক অনুভূতি দিয়ে রাষ্ট্র চালানাে যায় না। কাজেই তিনি ভাবনা- চিন্তা রেকনলাইন করেছিলেন। এখানেই তাজউদ্দীন ছিলেন অন্য সবার চাইতে আলাদা, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী মানুষ। ভীষণ প্র্যাগম্যাটিক ছিলেন তিনি।
ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা বলি। আমরা তখনও বিশ্বব্যাংকের সদসা হইনি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা ভারতে এসেছেন। সেখান থেকে খবর এল তিনি ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় আসবেন। এদিকে তাজউদ্দীন সাহেব তখন দিল্লীতে গিয়েছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে দু’জনেরই যখন একই জায়গায় আছেন তখন নিশ্চয়ই দেখা-সাক্ষাত হবে।
কিন্তু পরে আমার কিছু পরিচিত ভারতীয়দের কাছ থেকে খবর পেলাম দু’জনের দেখা হয়নি। ম্যাকনামারা দেখা করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব বলেছেন, আমি এখন ব্যস্ত। দিল্লীতে একটি সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শাে হয়, সেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশিষ্ট অতিথিদের জন্য অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন। সেখানে ম্যাকনামারা এবং তাজউদ্দীন সাহেবের আসন ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয়েছিল যেন তারা পাশাপাশি বসতে পারেন। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব তাঁর সাথে তাে কথা বলেনইনি, এমনকি ঘুরেও তাকাননি।
এদিকে আমি তাে ঢাকা থেকে জানতে পারছি না যে ওঁদের দুজনের দেখা
পৃষ্ঠাঃ ৬৬০

হচ্ছে না। তাই ভাবছি ব্যাপার কী? সরাসরি বিশ্বব্যাংক ম্যাকনামার খবর পাঠাচ্ছে যে, তিনি আসবেন, কিন্তু অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে কোন খবর আসছে না। অথচ তিনি সেখানে উপস্থিত খবর পাঠাচ্ছেন না, আমি বেশ উদ্বিগ্ন যেহেতু আমাকে সমস্ত কিছু ম্যানেজ করতে হবে।
‘ম্যাকনামারা যে দিন ঢাকায় আসবেন তার আগের দিন তাজউদ্দীন সাহেব দিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরলেন। দুপুরে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমি একসাথে বললাম ম্যাকনারাকে রিসিভ করবে, মিটিং কার কার সাথে হবে, ডিনার লাঞ্চ কোথায় হবে ইত্যাদি বিষয়গুলাে আলােচনা করে ঠিক করার জন্য। ম্যাকনামারা আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন, সেই সূত্রে তিনি আমার সাথেও প্রাইভেট লাঞ্চ খেতে চান এমন খবর পাঠিয়েছিলেন। তাই এই প্রস্তাবসহ আমি মোটামুটি ভাবে তৈরি করা প্রােগ্রাম সম্বন্ধে এক করে বিস্তারিত বললাম। আমি বললাম, ম্যাকনামারাকে রিসিভ করবেন বঙ্গবন্ধু।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাজউদ্দীন, তুমি কি বলাে? তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘মুজিব ভাই, আপনার এয়ারপাের্ট যাবার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি বললাম, ‘আপনি আপত্তি করছেন, কিন্তু অন্য অনেক জায়গায় তো এমনই হয়।’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, অন্য জায়গায় যা হয় এখানে সেটা চলবে না, চীফ প্রটোকল যাবে। আমি বললাম, “বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট যখন পাকিস্তানে যেতেন তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিংবা যিনি পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান থাকতেন তিনি যেতেন। আর আপনি চীফ অব প্রটোকল পাঠিয়ে দেবেন?’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পাবে। আপনিও যাবেন না। বঙ্গবন্ধু সব শুনছিলেন। বললেন, ঠিক আছে, তাজউদ্দীন যা বলছে তাই করেন।’ তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার সম্পর্কটা খুব সুন্দর ছিল। তাই আমি ঠাট্টা করে বললাম, ঠিক আছে, রিসিভ করতে না হয় গেলাম না। কিন্তু লাঞ্চ খেতে দেবেন, না তাও দেবেন না?’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘না, আপনি লাঞ্চ খেতে পারবেন না। কেন ম্যাকনামারা আপনাকে গােপনে লাঞ্চ দেবে? সবাই মিলে একটা পার্টি হতে পারে।’
পরদিন ম্যাকনামারা এলেন। প্রথম মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন সাহেব, ম্যাকনামারা এবং আমি। প্রাথমিক আলােচনার পর বিস্তারিত আলােচনার জন্য ম্যাকনামারা, তাজউদ্দীন সাহেব এবং যখন বসলাম তখন ম্যাকনামারা জানতে চাইলেন বাংলাদেশের জন্য কোথায় কী ধরনের সাহায্য দরকার ।
তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘আমাদের যা দরকার তা আপনি দিতে পারবেন কিনা আমার সন্দেহ আছে।’ ম্যাকনামারা বললেন, ‘মিস্টার মিনিস্টার, আপনি
পৃষ্ঠাঃ ৫৬১

বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে। তখন তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘মিস্টার ম্যাকনামারা, আমার গরু এবং দড়ি দরকার। যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, চাষীরা এদিক সেদিক পালিয়ে গেছে, তখন গরু হারিয়ে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষী ফিরেছে কিন্তু গরু নাই, তাই চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার চাহিদা হলাে গরু। ম্যাকনামারার চোখ-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “আর আমাদের সমস্ত দড়ি তাে পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে, এখন গরু পেলে গরু বাধতে দড়ি প্রয়ােজন। গরু এবং দড়ি প্রয়োজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না।’
আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমি একবার জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই, এদিকে ওদিকে তাকাই, তারপর বললাম, আমাদের এই প্রয়োজনের পাশাপাশি আরও অন্যান্য প্রয়ােজনও আছে।’ এই বলে কোনভাবি মিটিং শেষ করলাম। মিটিং শেষে আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বললাম, আপনি এমন কেন বললেন?’ তিনি বললেন, “কেন, গরু ছাড়া কি চাষ হয়?’ মহা চটেছিলেন। বললেন, ‘এই লােকটি তাে আমেরিকার ডিফেন্স সেক্রেটারি ছিলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে আমেরিকা। আমাদের স্যাবেটাজ করেছে। শেষ পর্যন্ত সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছে আমাদেরকে ধ্বংস করে দিতে। আমি যুক্তি দিলাম, ‘সপ্তম নৌবহর মার্কিন সরকার পাঠিয়েছিল, সে পাঠায় নাই। যাই হােক, ম্যাকনামারার মুখ লাল হলাে বটে কিন্তু পরে ফলাফল ভাল হয়েছিল।
আজ আমি এই ঘটনা বলছি মুক্তিযুদ্ধের ২৭ বছর পর। জানি না সে দিন হয়ত তাজউদ্দীন সাহেবের জায়গায় আমি আমি থাকলেও একই রকম ভাবতাম, কারণ আমরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করছি আর ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলতে সবরকম সহযােগিতা করছে। আসলে তাজউদ্দীন সাহেব সাংঘাতিক দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। তিনি বুঝতেন আমরা বড় দেশকে কিছু করতে পারব না। সেই ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু আমাদের আত্মসম্মানবােধ আছে, আমরা কারও দয়া চাই না, এই জিনিসটি তিনি বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, আর কোন উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। পরবর্তীতে আমি দেখেছি, তাঁর সাথে বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন মিটিংয়ে আমি গেছি, দেশের স্বার্থে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ। তাজউদ্দীন সাহেব অত্যন্ত নির্ভুলভাবে খুব অল্প কথায় সমস্ত বিষয় তুলে আনতে পারতেন। তার এই বিশেষত্বটি ছিল। আমি আগেই বলেছি, তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন এবং রাজনীতিবিদরা সাধারণত যে ধরনের কথাবার্তা বলেন তিনি তেমন বলতেন না। তার এই পরিষ্কার এবং স্ট্রেট কথার ফলে সবাই তার প্রতি আকৃষ্ট হতেন এবং
পৃষ্ঠাঃ ৬৬২

বাংলাদেশ পক্ষে সহজেই বিষয়গুলােকে নিয়ে আসা সম্ভব হতাে।
এটা ঠিক, শুধু ম্যাকনামারাই নয়, যে কোন বিদেশী যারাই তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কথা বলেছেন তারা প্রত্যেকে তার সম্পর্কে অগাধ শ্রদ্ধা পােষণ করছেন। তার ক্যাপাসিটি সম্পর্কে কারও কোন সন্দেহ ছিল না। আর একটা জিনিস ছিল তার, যেখানে কোন ভুল হচ্ছে তিনি সেই ভুলটা স্বীকার করতেন। বুঝতে পারতেন সঙ্গে সঙ্গে।
আর একটি কথা, তাজউদ্দীন ভারতঘেঁষা কিছু লােকের এমন একটি প্রচারণা ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ পক্ষপাতহীন একজন মানুষ। যুদ্ধের পর প্রথম ছয় মাসে আমি দেখেছি মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ভূমিকার কারণেই হয়ত তার মনােভাব আমেরিকা বিরোধী, কিন্তু তার পরেই তিনি সম্পূর্ণ প্রগিম্যাটিক। ভারতকে খাতির করব, রাশিয়াকে খাতির করব, রাশিয়াকে খাতির করব, আমেরিকানদেরকে খাতির করব না – এই মনােভাব তার কোন দিনই ছিল না। তার মনােভাব ছিল, যুদ্ধের সময় কার সাহায্য নিয়েছি, কার সাহায্য পাইনি, বা এমন সাহায্য দেশের স্বার্থে সবাই নেয় তার মানে এই নয় যে, সাহায্যের বদলে ওরা যা বলবে আমরা তাই করবো, এটি হবে না। তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে এই ভারতঘেঁষা কথাটি যারা বলেছে তারা সম্পূর্ণ বাজে কথা বলেছে। তিনি কোন দিনই কারও প্রতি নতজানু ছিলেন না। তার কোন রকম দুর্বলতা ছিল না। কোন দেশের প্রতি তাঁর যা কিছু দুর্বলতা ছিল তা ছিল তার নিজের দেশ বাংলাদেশের জন্য। তিনি ছিলেন প্রো-বাংলাদেশ। আমি তার সাথে কাজ করতে গিয়ে এমন প্রমাণ পাইনি যে তিনি ভারতের সাথে খাতির করে সমঝােতা করেছেন। আমি প্রায় ৩ বছর তার সাথে কাজ করেছি, আমার অভিজ্ঞতায় এটি নেই যে, ভারত আমার বন্ধু দেশ, কাজেই ছেড়ে দাও। অথবা ভারতের সাথে আলােচনার সময় শক্ত না থেকে নরম থাকতে হবে। এমন তিনি কখনই করেননি বা বলেননি।
তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবােধ ছিল। ভারত যুদ্ধের দিনে আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য করেছে, সেই জন্য তিনি কৃতজ্ঞ। কিন্তু দেশের স্বার্থে পাট বিক্রি করতে হবে, ফার্টিলাইজার লাগবে- এমন সব কথাবার্তার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা ভারতীয়দের সাথে ঝগড়া পর্যন্ত করেছি। তাজউদ্দীন সাহেব কোনদিন নরম হতে বলেননি।
আমরা একবার ভারতে গেলাম একটা ডেলিগেশন নিয়ে, আর এদিকে এনায়েত উল্লাহ খান হলিডেতে হেডলাইন দিয়ে লিখে ফেললেন, বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশন গেছে ভারতের আশীর্বাদ নিয়ে আসতে এবং প্ল্যান তৈরি করার আগে দিকনির্দেশনা নিতে। এই কথাগুলাে ছিল সম্পূর্ণ জঘন্য ও মিথ্যা অপপ্রচার ।
পৃষ্ঠাঃ ৬৬৩

আমাদের মনােভাব ছিল, আমরা স্বাধীন দেশ, কথাবার্তা- আলোচনায় আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলব। আমাদের দেশের স্বার্থের বিষয়ে কোন খাতির নেই। যেমন পাট নিয়ে আলােচনার সময় আমরা সরাসরি ভারতকে বলেছি, তোমাদের পাট উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। তােমাদের খরচ বেশি, তোমরা উৎপাদন কেন করছ? আমরা তােমাদের কাছে পাট বিক্রি করব। আমি রীতিমত ফাইট করেছি ওদের সাথে। আগে ভারত কিছু কিছু পাট উৎপাদন করত, বাকিটা নিত বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে। কিন্তু পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান পরবর্তীতে ভারতে পাট বিক্রি বন্ধ করে দেবার ফলে ভারত বেশ জোরোশােরে পাট উৎপাদন শুরু করে। আমরা চেয়েছিলাম ওরা বাড়তি পাট উৎপাদন বন্ধ করে আবার আগের মতাে আমাদের কাছ থেকে পাট ক্রয় করুক। তাজউদ্দীন সাহেবের কথা ছিল বিপদে সাহায্য করেছে ভাল কথা, আমরা বন্ধু থাকবো, কিন্তু তাই বলে আমার দেশের স্বার্থের ক্ষতি হয় এমন কোনো সুবিধা আমি তোমাকে দেব না। আর একটি ঘটনা, দেশ স্বাধীন হবার পর আমেরিকান কনসাল জেনারেল ঢাকায় রয়ে গেছেন, কিন্তু তার কূটনৈতিক স্টেটাস নেই- কারণ ওর দেশে তো আমাদেরকে স্বীকার করে না। তাজউদ্দীন সাহেবের জায়গায় অন্য কেউ হলে বলত, চলে যাও, তুমি এখানে কী করছ? কিন্তু দেশের স্বার্থে তাজউদ্দীন সাহেব তাকে কিছু করলেন না, বরঞ্চ তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করলেন। পরবর্তীতে তাঁকে সম্পূর্ণ কূটনৈতিক মর্যাদা দেয়া হয় । আমি এ কথাটি এজন্য বলছি, তখন তাে সাংঘাতিক আমেরিকা বিরােধী মনােভাব ছিল মানুষের।
‘৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট (দক্ষিণ এশিয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত) পিটার কারগিল ঢাকায় এলেন। তখনও বিশ্বব্যাংকের কোন প্রতিনিধি ঢাকায় ছিল না। আমরা কারগিলকে বুঝলাম, বাংলাদেশের এই অবস্থায় তােমরা এমন একজন প্রতিনিধি দাও যিনি কোন বড় দেশের মানুষ হবেন না এবং যাকে নিরপেক্ষ ভাবা যাবে। নরওয়েজিয়ান ইয়ুস্ট ফালান্ড আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু ছিলেন, আমি তার কথা বললাম। কারগিল বললেন, দেখি কী করা যায়। এরপর নরওয়েতে ফালান্ডের ইন্টারভিউ নেয়ার পর আমাদেরকে জানানাে হলাে ব্যাংক ফালান্ডকে তাদের প্রতিনিধি করতে রাজি আছে। আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে সমস্ত বিষয়গুলাে বললাম। ফালান্ড ঢাকায় এলেন। আমাদের সাথে বিশ্বব্যাংকের তিনিই ছিলেন যােগাযােগের মাধ্যম। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তার অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হি স্টার্টেড ফাইটিং ফর বাংলাদেশ রাদার দ্যান ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ইন্টারেস্টস। বাংলাদেশের জন্য তাঁর গভীর সহানুভূতি ছিল। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তাঁর এত ভাল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছিল যে,
পৃষ্ঠাঃ ৬৬৪

বাংলাদেশ থেকে চলে যাবার পরও তিনি তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করেছেন, যোগাযোগ রেখেছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেবের একটা ব্যাপার ছিল, তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মানুষকে হ্যান্ডল করতে পারতেন । যেহেতু তিনি অসম্ভব রকমের বুদ্ধিমান , শিক্ষিত এবং যােগ্য মানুষ ছিলেন তাই তার জন্য খুব সহজ ছিল বিদেশীদের হ্যান্ডল করা। তার মত দক্ষ মানুষ বাংলাদেশে খুব কমই ছিল।
বন্ধু হিসেবে তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত, অসম্ভব রকমের ভাল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সিম্পল এবং ভীষণ ভদ্র। নিজেকে জাহির করা, যে কোন ধরনের শো অফ করা এ সবের মধ্যে তিনি কখনওই ছিলেন না। অত্যন্ত ভাল একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
মনে আছে ‘৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রথমবার বিশ্ব্যাংকের মিটিংয়ে যােগ দিতে আমরা ওয়াশিংটন গেলাম। তখন তাে আমাদের টাকাপয়সা খুব কম ছিল। তার মধ্য দিয়েই সব কিছু ব্যবস্থা করতে হতো। তাজউদ্দীন সাহেব নিজেও কোন রকম আড়ম্বর পছন্দ করতেন না। একদিন আমাকে বললেন, ‘ভাই, চলুন কোথাও হাটতে যাই।’ হাটতে হাটতে বললেন, ‘চলুন, সস্তায় কোথাও খাব।’ আমি একটা সস্তা রেস্তরায় তাকে নিয়ে গেলাম। তারপর তাে বিশ্বের আরও অনেক দেশে গিয়েছি, পাশাপাশি থেকেছি। তিনি সব সময় একই রকম সিম্পল।
মনে আছে, একবার ক্যাবিনেট মিটিং শেষ করে তাজউদ্দীন সাহেব এবং আমি হেঁটে আমাদের বিল্ডিংয়ে ফিরছিলাম। আমার অফিসকক্ষ নিচতলায় আর তার অফিস কক্ষ ঠিক আমার উপরে। এদিকে প্রত্যেক বিল্ডিংয়ের গেটের সামনের দিকে পুলিশ থাকত। পুলিশ তাজউদ্দীন সাহেবকে ঢুকতে দিল না, বলল, ‘আপনার আইডেনটিটি কার্ড দেখান। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “আরে ভাই কর কী, আমাদের অর্থমন্ত্রী!’ পুলিশ বেচারা ‘সরি’ বলতে বলতে অস্থির। তাজউদ্দীন সাহেবের কোন ক্ৰক্ষেপ নেই, তিনি একটু হেসে আবার আমার সাথে কথা বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলেন।
আমি এই বিষয়টির উল্লেখ করলাম এ কারণে যে, তাঁর মত একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী অথচ কী স্বাভাবিক আচরণ তাঁর। অন্য যে কোন মন্ত্রী হলে তাঁর সাথে নিরাপত্তা অফিসার থাকত, একান্ত সচিবসহ আরও দু’চারজন মানুষ থাকত এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব একেবারেই সাধারণভাবে চলতেন।
আমার মনে আছে, তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে শেষের দিনগুলােতে যখন
পৃষ্ঠাঃ ৬৬৫

দেখা হতাে তখন তাঁকে অসম্ভব রকমের হতাশ মনে হতাে। গভীর দুঃখের সাথে বলতেন, “আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু। তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই করতে পারছি না। দেশের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ কিছু না করতে পারার কষ্টে তাঁর মনটা যেন হাহাকার করত। আমি তাঁকে অনেক কিছু বলে বােঝাবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু তাকে মনে হতাে হি ওয়াজ ভেরি হার্ট। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল সেটাই ছিল তাজউদ্দিনের মর্মপীড়ায় কারণ।
তাজউদ্দীন সাহেব বলতেন, কীভাবে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য ফ্যাক্টরদের সুবিধা দিচ্ছে, যার ফলে এমন কিছু লােক টেক ওয়ার করছে যাদের দিয়ে দেশের মঙ্গল হতে পারে না।
সেই সময় আসলে কমবেশি আমরা অনেকেই এই বিষয়গুলো অনুভব করতাম, বুঝতে পারতাম। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব যেহেতু দেশের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন, তিনি বুঝতে পরতেন অনেক বেশি। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে আমাকে ক্যাবিনেটের বহু মিটিংয়ে যোগ দিতে হয়েছে। ‘৭২-এর দিকে দেখতাম তাজউদ্দীন সাহেবের জ্ঞান এবং আন্তরিকতাপূর্ণ সুন্দর একটা প্রভাব ছিল। তিনি সাংঘাতিক প্রভাবশালী মন্ত্রী। কিন্তু ‘৭৩ থেকে লক্ষ্য করতাম সব কিছু যেন অন্য রকম হতে শুরু করেছে। ঠিক যেভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়ােজন তেমনিভাবে যেন অনেক কিছুই করতে পারা যাচেছ না। শেষের দিকে তাে আমি নিজেই আগ্রহ হারিয়ে ৭৫-এর জানুয়ারিতে বিদেশে চলে গেলাম।
যে দিন তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করবেন সে দিন তিনি নিচতলায় আমার রুমে বসে গল্প করছিলেন। তাঁর মধ্যে কোন রকম পরিবর্তন দেখিনি। প্রতিদিনেরমতােই স্বাভাবিক ছিলেন তিনি। তাঁর একান্ত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী যখন তাকে ডেকে নিয়ে গেল তখনও আমি বুঝতে পারিনি একটু পরে কী হতে যাচ্ছে। তিনি কিছুদিন ধরে প্রায়ই বলতেন, ‘আমি থাকব না, আমি যাচ্ছি। কিন্তু ঠিক সে দিনই তিনি চলে যাবেন এই বিষয়ে কিছুই বলেননি।
তাজউদ্দীন সাহেবের পদত্যাগের বেশ কিছুদিন পর আমি তার সাথে দেখা করতে ধানমণ্ডির বাসায় গিয়েছিলাম। অনেক কথার ফাঁকে তিনি বললেন, ‘এসেছেন তাে আমার কাছে, কিন্তু বাইরে থেকে পাহারা দিচ্ছে। খাতায় আপনার নাম লেখা হয়েছে।’ আমার মনে আছে, আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম ‘তাজাউদ্দিন সাহেব আমার বন্ধু মানুষ, আমি কিন্তু তাঁর বাসায় যাই, দেখা করি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি কেন বলছেন এই কথা?’ আমি বললাম, না আবার কে কখন
পৃষ্ঠাঃ ৬৬৬

আপনার কাছে কী রিপাের্ট করে , তাই আগেই বলে রাখছি। বঙ্গবন্ধু হেসে ফেললেন।
তাজউদ্দীন সাহেব দেশ নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমি তাকে কথায় কথায় বলেছিলাম, ‘দেশটার কী হবে, কীভাবে উদ্ধার হবে! তার উত্তর ছিল, আমার তো কিছু বলার নেই। আমি তাে ছেড়েই দিয়েছি। তারা এখন দেখুক, করাক যা করার করুক।’
শেষের দিকে তাে তিনি এমনও বলতেন যে, সরকার তাকে বিনা দোষে জেলেটেলেও ঢােকাতে পারে। আমি ভাবতাম তিনি রাগ করে, অভিমান করে এসব কথা বলছেন। তাই বলতাম, ‘এসব বাজে কথা কিছুই করবে না।’ তাজউদ্দিন সাহেব হাসতেন।
আজ চিন্তা করি, সত্যিই তিনি ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমী মানুষ। সরকারে রইলেন না, সােজা বাড়ি চলে গেলেন। আমাদের দেশগুলােতে যেমন হয় দল ত্যাগ, দল বদল, নতুন দল গঠন এসব তার চরিত্রেই ছিল না। নিজের দলের প্রতি তার ভালবাসা ছিল যেমন গভীর তেমনি এটাও সত্যি, বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর বিশ্বস্ত তা ছিল কল্পনাতীত।
আমি আগেও উল্লেখ করেছি, বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল তার পরিণাম ছিল বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডি। আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হতাে যদি এই দুজনের মধ্যে মনােমালিন্য, দূরত্ব বা বিচ্ছেদ না ঘটত। এই দুজন ছিলেন পারফেক্ট কম্বিনেশন। এমন যদি হতাে, দুজন মিলে কাজ করতেন, আলােচনা করতেন, সিদ্ধান্ত নিতেন তবে নিঃসন্দেহে আজকের বাংলাদেশ দীর্ঘ সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার চেতনার বাংলাদেশ হতাে। কিন্তু এই দেশের দুর্ভাগ্য, দু’জনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হলাে, তাজউদ্দীন সাহেব চলে গেলেন, দেশের সর্বনাশ আরম্ভ হলাে।”১০
মতিউল ইসলাম, অর্থ সচিব
তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা এক ঝলকের। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের তিন তারিখে আমি শেখ সাহেবের সাথে তাঁর ৩২ নম্বর রােডের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে উপস্থিত সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে তাজউদ্দীন সাহেব এবং অন্য নেতৃবৃন্দ ছিলেন।
এরপর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। তার পরদিন ১৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ
পৃষ্ঠাঃ ৬৬৭

থেকে জরুরী বার্তা পেয়ে আমি তার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি জানালেন, আমাকে অর্থ সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারির সেই এক ঝলকের দেখা ছাড়া আমার আর কোন যােগাযােগ, পরিচয় কিছুই ছিল না এবং প্রধানমন্ত্রী যখন আমাকে এই নিযুক্তির কথা বললেন তখন আমার মনে হলো, তিনি এই বিষয়ে তার অর্থমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে হয়ত সময় পাননি।
আমার প্রশাসনিক কাজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, মন্ত্রীর নিবিড় সহযোগিতা, সক্রিয় সমর্থন, বিশ্বাস এবং আস্থা যদি তাঁর সচিবের উপর না থাকে তবে কোন সচিবই ফলপ্রসূভাবে কাজ করতে পারেন না। আমার এই ধারণার পেছনে আরো জোরালােভাবে হয়ত কাজ করেছিল একটা নতুন দেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি। সেই সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সেক্টর ছিল সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত। অর্থনৈতিক সেক্টরকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে প্রতি মুহূর্তে দ্রুত এবং কার্যকর প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের প্রয়ােজনীয়তার কথা আমার চিন্তায় বিশেষভাবে ছিল।
তখন সরকারি কোষাগার খালি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শুন্য (বাংলাদেশ সরকারের নামে ভারত সরকার যে পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলার তাদের বম্বে রিজার্ভ ব্যাংকে জমা রেখেছে এটি বাদ দিয়ে)। পাকিস্তান সরকার ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত এই অংশের (বাংলাদেশের) রপ্তানি আয়ের সম্পূর্ণ অংশ সরিয়ে নিয়েছিল।
আমদানি-নির্ভর নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করা, শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাঁচামালের অভাব দেখা দেয়ার আগেই এর ব্যবস্থা করা, তারপর সরকার চালাবার যাবতীয় খরচ, নতুন মন্ত্রণালয় এবং শাখা, বিদেশে দূতাবাস খােলা, ১ জুলাই ১৯৭২ থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট তৈরি করার প্রস্তুতি ইত্যাদি বিষয়গু তখন দিগন্তবিস্তৃত হয়েছিল। এই অবস্থায় আমি অর্থ সচিব হিসেবে কাজে যােগ দেবার আগেই অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দেখা করতে ১৭ জানুয়ারি তাঁর হেয়ার রােডের বাড়িতে গেলাম।
সেখানে তখন তাঁর দেখা পাওয়ার জন্য বহুসংখ্যক দর্শনার্থী অপেক্ষা করেছিলেন। আমি আমার পরিচয় দিয়ে কিছু জরুরী সমস্যা সম্পর্কে তার মতামত এবং নির্দেশনার কথা বললাম। আমরা আলােচনা শুরু করতেই একজন মহিলা বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে সেই ঘরে এসে বললেন, রাজাকার ভেবে ভুলক্রমে মুক্তিযােদ্ধারা তাঁর স্বামীকে ধরে নিয়ে গেছেন- তাজউদ্দীন সাহেব যেন তার স্বামীকে বাঁচান, উদ্ধার করে দেন। তাজউদ্দীন সাহেব সেই মুহূর্তে আইজি
পৃষ্ঠাঃ ৬৬৮

পুলিশকে ফোন করলেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে উদ্ধারের নির্দেশ দিলেন। এই পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলােচনা করা যায় না । অফিসেই দেখা করব ভেবে আমি চলে এলাম।
এরপর থেকে প্রায় ’বছর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার কাজ করবার সুযোগ হয়েছিল। তার কাজের ধরন সম্পর্কে প্রথমেই যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমার নজরে পড়েছিল তা হচ্ছে, যদিও তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন পরিপূর্ণভাবে একজন রাজনীতিবিদ কিন্তু প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয় যখন সামনে আসত তখন তিনি নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে পারতেন।
মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি অংশ নিয়েছেন অথবা দেশের ভেতরে থেকেছেন এই যে দুটো ভাগ এই বিষয়ে তাজউদান সাহেবের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। এই দুই ভাগের মধ্যে তিনি কখনই বিভেদ সৃষ্টি করতে চাননি এবং আমি শুনেছি তাজউদ্দিন সাহেব ২২ ডিসেম্বর ‘৭১-এ ঢাকায় ফিরেই ২৩ তারিখে সচিবালয়ে সর্বস্তরের কর্মচারীদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আগে আপনারা পাকিস্তানের জন্য কাজ করেছেন, এখন থেকে বাংলাদেশ সরকারের জন্য কাজ করবেন। এখন আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করব।’ তিনি কোন সময় এমন কোন মনােভাব দেখাননি যাতে কোন বিভেদ সৃষ্টি হয়। তবে এটা ঠিক, যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, ঢাকাতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ পদেই ছিলেন। যেমন সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল কুদুস, সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের খান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব হােসেন তওফিক ইমাম এবং এম এ সামাদ, খন্দকার আসাদুজ্জামান, পুলিশের আইজি খালেক। আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় সরকারে কাজ করেছে বলে কাউকে পদোন্নতি দেয়া বা বিশেষ সুবিধা দেয়া- এ জাতীয় কোন কাজের জন্য বা এ জাতীয় কোন কথা তিনি কখনও বলেননি।
যেমন একটি উদাহরণ দেই : এক ভদ্রলােক ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টস অফিসার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারে যােগ দিয়েছিলেন এবং সরকারের চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার ছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পর দেশে ফিরে তিনি বললেন, তাঁকে অ্যাকাউনটেন্ট জেনারেলের পদ দিতে হবে। আমি বললাম, “দুঃখিত, এই পদের জন্য যেমন যােগ্যতার প্রয়ােজন সে অনুযায়ী এই পদে আপনাকে নিয়ােগ দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত বহাল রইল।
তাজউদ্দীন সাহেব কোনদিনও কিন্তু এই সমস্ত বিষয়ে আমাদেরকে কিছু করার জন্য অনুরােধ করতেন না। এমন বলতেন না যে, এই লােক প্রবাসে
পৃষ্ঠাঃ ৬৬৯

আমাদের সরকারে ছিল, একে একটু দেখবেন। অর্থাৎ তিনি কোনদিনই এদেশের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাননি। তার সাথে আমার দু বছরের কাজের সময়ে একটিমাত্র ঘটনা ছাড়া আর কোন উদাহরণ নেই। ঘটনাটি ছিল বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়ােগ সংক্রান্ত। এই পদে নিয়োগ দেবার জন্য আমি ফাইল নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি সম্পূর্ণ ফাইলটি পড়লেন। আমার সুপারিশ দেখে বললেন, এই অফিসার পাকিস্তানিদের সহযােগী ছিলেন কিনা সেটি কি আমি খোজ নিয়ে দেখেছি? আমি সাথে সাথে বললাম, আমার সুপারিশ এই ব্যক্তির যােগ্যতা ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে তৈরি এবং আমি মনে করি এই কাজের জন্য এই ব্যক্তি উপযুক্ত। আর তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কে খোঁজ রাখা আমার আয়ত্তের বাইরে। তবে এ বিষয়ে জানা যদি প্রয়ােজনীয় হয় তা অর্থমন্ত্রী করতে পারেন। এই কথার পর তাজউদ্দীন সাহেব আর কিছু না বলে সেই নিয়ােগপত্র অনুমােদন করে দিলেন।
এই ঘটনার আগেও আমরা ৬টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করেছি। কিন্তু কখনই তিনি সেই বিষয়ে কিছু বলেননি। কোন প্রশ্নই তোলেননি যে তার অতীত কি ছিল। পরবর্তীকালে সমস্ত ব্যাংকগুলাের জেনারেল ম্যানেজার পদে নিয়ােগ দেবার আগে প্রধানমন্ত্রী বললেন, এই কেসগুলাে যেন তার কাছে পাঠানাে হয়। সাধারণভাবে এই নিয়ােগগুলাে যদিও আমাদেরই করবার কথা, কিন্তু যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বললেন তার কাছে পাঠাতে, তাই অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে সেই কেসগুলাে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানাে হলাে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং আমি মিলে যে সুপারিশগুলাে করেছিলাম তাজউদ্দীন সাহেব তার কোন কিছুই রদবদল করলেন না। তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইলগুলাে পাঠিয়ে দিলেন।
ওই পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, ‘আমি সব অনুমােদন করেছি, শুধু একটি ছাড়া।
আমি বললাম, ‘কোনটি, স্যার?
প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তােমরা সুপারিশ করেছ, কিন্তু অনুমােদন দেয়া বােধ হয় ঠিক হবে না- এটি নূরুল আমিন সাহেবের ছেলে আনােয়ারুল আমিনের বিষয়টি।’ তাজউদ্দীন সাহেব কিন্তু আনওয়ারুল আমিনকে চিনতেন এবং জানতেন যে তিনি নুরুল আমিন সাহেবের ছেলে । নূরুল আমিন সাহেব তখন পাকিস্তানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব কোন সময়ই এসব ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতেন না বা তুলতেও চাননি। তারপর হাফিজুল ইসলাম ছিলেন ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের জিএম। তিনি শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলায় রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ হবার পর
পৃষ্ঠাঃ ৬৭০

পাকিস্তানের ব্যাংকগুলাে যখন বাংলাদেশের ব্যাংক হলাে তখন সেই হাফিজুল ইসলাম ও স্বাভাবিকভাবেই ওই ব্যাংকের জিএম হলেন। শেখ সাহেব ফিরে আসবার পর ওই লোককে চাকরি থেকে সরিয়ে দিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব জানতেন ওই লোকের কথা, কিন্তু কিছু বলেননি বা নাক গলাননি, অর্থাৎ তাজউদ্দীন সাহেবের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা রকমের ।
আর একটি ঘটনার কথা মনে আছে : নূরুল কাদের খান তখন সংস্থাপন মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট যারা পাকিস্তানি খেতাব পেয়েছিলেন- সেতারে পাকিস্তান, সেতারে কায়দে আযম প্রভৃতি – তাদের সবাইকে এক দিনের নােটিসে চাকরি থেকে সরিয়ে দেয়া হলাে। প্রধানমন্ত্রী ফাইলে সই করে দিলেন এবং নূরুল কাদের অর্ডার ইস্যু করে দিলেন। এই তালিকায় বেশ অনেক সিনিয়র অফিসার ছিলেন, যেমন ওয়ালিউল ইসলাম, ওয়াজেদ আলী খান । এই অর্ডারটি তাজউদ্দীন সাহেব দেখেছিলেন খবরের কাগজে । আমি অফিসে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি দেখেছেন এই অর্ডারটি?’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, দেখেছেন এবং এর ফলে তিনি বিচলিত বোধ করছেন। গতরাতে এই বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ‘এটা আপনি কী করেছেন এবং কেন করেছেন?
প্রধানমন্ত্রী জ্ঞানী মানুষ, তিনি বললেন, “দেখ আমি করে ফেলেছি এখন এটাকে কোন পদ্ধতিতে না পেলে তাে উঠিয়ে নেয়া যায় না। তখন তাজউদ্দীন সাহেব বলেছেন, “ঠিক আছে, চাকরি থেকে যাদেরকে বাদ দেয়া হয়েছে তাদের প্রত্যেককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিয়ে কেসগুলােকে আবার পর্যালােচনা করার ব্যবস্থা নেয়া হােক। একটা কমিটি গঠন করা হােক, সেখানে অভিযুক্ত সবাই তার কেস নিয়ে যাবে। সেই কমিটি যদি বলে, এরা পাকিস্তানিদের সহায়তাকারী অথবা প্রতি বছরের মতাে চাকরি জীবনের কৃতিত্বের ফলস্বরূপ তারা খেতাব পেয়েছেন, তবে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ কেউ দোষী হলে শাস্তি পাবে। এরপর ড. কামাল হােসেকে নিয়ে এক সদস্যের কমিটি হলে তার কাছে চাকরিচ্যুত সবাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযােগ খণ্ডনের সুযােগ পেলেন। এক এক করে সবার সাথে কথা বলে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেই রিপাের্ট ড. কামাল হােসেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে সবাই চাকরিতে পুনর্বহাল হয়েছিলেন।
তাজউদ্দীন সাহেব কখনই অফিসারের পরিচয়ের দিকটি বড় করে দেখতেন না। যােগ্যতার বিষয়টিই ছিল তার মূল বিবেচনা। যােগ্যতা আছে আসুন, নয়ত না। আবার যদি সত্যিই কেউ অন্যায় করে থাকে তবে তার আইন অনুযায়ী বিচার
পৃষ্ঠাঃ ৬৭১

হবে। আমি বলতে চাইছি, উনি অত্যন্ত উদার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন মানুষ ছিলেন।
সেই সময় পাকিস্তানের সাথে সহায়তাকারী অনেকেই কারাগারে বন্দি ছিলেন। তখন আমাদের একটা অর্ডার ছিল, যারা কারাগারে আছেন তাদের একাউন্টগুলাে আমরা ফ্রিজ করিনি, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বেশি তারা ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন না। ডা. মালেক ভাই আমার পূর্ব পরিচিত ছিল, আমার কাছে এসে বলল, ডা. মালেকের কেসটা তো করতে যাচ্ছে, সে কারণে বিশ হাজার টাকার দরকার। আমি সাথে সাথে তাকে একটা দরখাস্ত লিখতে বললাম এবং টাকা তুলবার অনুমতি দিয়ে দিলাম কাউকে কিছু না জিজ্ঞাসা করে। পরে সে দিনই বিকেলের দিকে বা পরদিন আমি তাজউদ্দিন সাহেব কে বিষয়টি বললাম। তিনি শুনে বললেন, ‘ভাল করেছেন, দিয়ে দিয়েছেন, ঠিক আছে।’ যে বিষয়গুলাে স্বাভাবিক নিয়মে হয়ে যাবার কথা সেসব বিষয় নিয়ে আসলে তিনি মাথা ঘামাতেন না। আর তার মধ্যে এই জিনিস ছিল না যে অমুক আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা পাকিস্তানিদের সহায়তাকারী, তাই আমি তাকে নাজেহাল করব, অসুবিধা সৃষ্টি করব- এই ধরনের মনােবৃত্তি তার ছিল না। আর একটি ঘটনা, আখতারউদ্দিন নামে আমার এক সহপাঠী যিনি ডা. মালেকের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী ছিলেন, তিনিও তখন জেলে। একদিন তার স্ত্রী আমার বাসায় এসে কাঁদতে কাঁদতে জানাল, আখতারউদ্দিন খুবই অসুস্থ, তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে হাসপাতালে নিতে হবে। আমি সাথে সাথে স্বরাষ্ট্র সচিব এবং স্বাস্থ্য সচিবকে অফিসিয়ালি ঘটনাটি লিখে জরুরী ব্যবস্থা নিতে নােট পাঠালাম। এবং পরদিনই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলাে। আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে বিষয়টি বলেছি। তিনি বলেছেন, ‘ঠিক আছে, এতে অসুবিধা কী, এগুলাে তাে মানবিক ব্যাপার। আসলে তাজউদ্দীন সাহেব অন্য কাউকে কষ্ট দেয়া বা অসুবিধা সৃষ্টি করার বিষয়গুলােকে কখনই উৎসাহ দিতেন না।
তাছাড়া আমি আমার কথা বলতে পারি, তাজউদ্দীন সাহেব তাঁর অফিসারদেরকে, বিশেষভাবে আমাকে, কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
তাজউদ্দীন সাহেব চমক্কার বাংলা লিখতেন এবং তাঁর হাতের লেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। এদিকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সচিবালয়ের সমস্ত ফাইলপত্র বাংলায় লিখতে হবে। এর ফলে আমার খুব অসুবিধা হলাে। কারণ আমার বাংলা লেখা মােটেও ভাল না, আর সবচাইতে বড় সমস্যা ছিল, আমার চিন্তাটাকে সুস্পষ্ট এবং জোরালােভাবে বাংলায় লিখতে গেলে প্রয়ােজনীয় সঠিক শব্দের জন্য আমার অনেক সময় লেগে যেত। এ কারণে বিভিন্ন কেস ফাইলপত্র দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে
পৃষ্ঠাঃ ৬৭২

আমি প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর কাছে আমার নােটগুলাে ইংরেজিতে লিখবার জন্য অনুমতি চেয়েছিলাম। এবং খুব দ্রুতই আমি এই অনুমতিও পেয়েছিলাম । তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আমি প্রায় দুবছর কাজ করেছি। এই সময়টিতে আমি সব সময় ইংরেজিতে নােট লিখলাম, অর্থমন্ত্রী লিখতেন বাংলায় ।
তাজউদ্দীন সাহেব এক অর্থে শিল্পীও ছিলেন। তিনি গভীর উৎসাহের সাথে খেটে সেই সময়ে ছাপা হওয়া কাগজের মুদ্রার প্রতিটি ডিজাইনকে আরাে উন্নত করেছিলেন। বাংলাদেশের টাকার ‘৳’ প্রতীকটি তার নিজ হাতের কাজ।
অনেকেই বলে, তাজউদ্দীন সাহেব পশ্চিমা দেশগুলাের সাহায্য বা সহযোগিতা চান নি বা নেয়া পছন্দ করতেন না। এটা কিন্তু আমি শুনেছি। অথচ অর্থ সচিব হিসেবে আমি কিন্তু কোনদিনও তার এই মনােভাবের কোন ইঙ্গিত পাইনি। তিনি খুব প্রাগম্যাটিক ছিলেন | আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে ভীষণ সজাগ ছিলেন এবং সেই সাথে সুচিন্তিত বাস্তবসম্মত কর্মপদ্ধতিরও মানুষ ছিলেন। তিনি বুঝতেন পশ্চিমের সাহায্য ছাড়া আমাদের চলবে না, সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। একটি বিষয়ে তিনি পাকিস্তান সরকারের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে আমার সুপারিশ নিয়েছিলেন। যেমন একটি ঘটনার কথা বলি : জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল প্রতিনিধি যিনি এখানে ছিলেন, উমবিখট তার নাম। সুইস নাগরিক। তিনি রিলিফের তদারকি করতেন। তিনি একই সঙ্গে সম্ভবত সুইস কোম্পানি সিবা-গেইগীরও প্রতিনিধি ছিলেন। আমি অর্থ সচিব হিসেবে যােগ দেয়ার দিন সাতেক পর একদিন তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে ডাকলেন। গিয়ে দেখি দু’জন বিদেশী ভদ্রলােক বসা। তিনি তাদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এঁরা সিবা-গেইগী থেকে এসেছেন। সিগা-গেইগী আমাদেরকে কীটনাশক দিয়েছিল, অর্থাৎ সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানকে। পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে বিতরণের জন্য এখানে ওই কীটনাশক এসেছিল বাকিতে। এখন এরা এসেছেন বাংলাদেশ সরকারের কাছে, যাতে করে সরকার সেই কীটনাশকের টাকা শােধ দেয়ার দায়িত্ব নেয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমরা পাকিস্তান সরকারের দায়িত্ব নেব কি নেব না।’ আমি তখন বললাম, দেখুন, এটা পলিসি ম্যাটার। তবে যদি কেউ সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে কোন কিছু দেয় সেটা পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্যই ছিল। অর্থাৎ আমাদের জন্যই দেয়া হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে আমরা এই দায়িত্ব নিতে পারি।’ তিনি বিষয়টি মেনে নিলেন এবং বললেন, ‘আমরা পাকিস্তনি সরকারের একমাত্র সেই সমস্ত দায়িত্বই নেব যা সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের অথাৎ বাংলাদেশের জন্য আনা হয়েছিল বা ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঘটনা থেকেই বােঝা যায় তাজউদ্দীন সাহেব কতখানি প্র্যাগম্যাটিক ছিলেন। তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৬৭৩

বলতে পারতেন, আমরা পাকিস্তানের দায়িত্ব নেব না। আমরা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেয়েছি, আমরা কেন পাকিস্তানের দায়িত্ব নেব। কিন্তু তিনি তা বলেননি কিংবা সেই মনােভাব দেখাননি। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে যা হওয়া উচিত তিনি তাই করেছেন। একজন পরিপক্ব দায়িত্বশীল রাজনীবিদদের যা করা উচিত তিনি তাই করেছেন।
তারপর বিশ্বব্যাংকের সদস্যপদ পাবার বিষয়টি। বিশ্ব ব্যাংক প্রধান বাংলাদেশে এলেন খুব স্বল্প সময়ের জন্য। অর্থমন্ত্রী আমাকে নির্দেশ দিলেন আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সদস্য পদ নেয়ার জন্য তৈরি হতে। আমি মােটামুটিভাবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলাম । সদস্য পদে আবেদনের নিয়ম হলাে, প্রথম আইএমএফ-এর সদস্য হতে হয়, তারপর বিশ্বব্যাংকের। এই কাজে তাজউদ্দীন সাহেব তাঁর জ্ঞান, মেধা, সহযোগিতা দিয়ে সব সময় সহায়তা দিয়েছেন। এবং এই বিষয়ে তিনি তাে বেশ আগ্রহী ছিলেন বলেই মনে হয়েছে। জুলাই-আগস্টের দিকে আমরা সদস্য হলাম। সদস্য হবার পর নিয়ম হলাে সাধারণভাবে অর্থমন্ত্রী হবেন বাংলাদেশের গভর্নর। অর্থ সচিব বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হবেন বিকল্প গভর্নর। এই বিষয় আমার জানা ছিল, তাই আমি মন্ত্রীর কাছে ফাইল পাঠালাম যে আপনি আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের গভর্নর হবেন, অর্থ সচিব হবেন বিশ্বব্যাংকের বিকল্প গভর্নর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হবেন আইএমএফ-এর বিকল্প গভর্নর। অর্থমন্ত্রী ফাইল সই করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এদিকে প্রফেসর ড. নুরুল ইসলাম সাহেবের বােধ হয় ইচ্ছা ছিল তিনি কোন একটির গভর্নর হবেন। তখন ঠিক হলাে অর্থমন্ত্রী হবেন আইএমএফ-এর গভর্নর আর ডেপুটি চিফ প্ল্যানিং কমিশন ড. নূরুল ইসলাম হবেন বিশ্বব্যাংকের গভর্নর। তারপর আমরা এশিয়ান। ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সদস্য হলাম, সেখানে তাজউদ্দীন সাহেব গভর্নর এবং আমি বিকল্প গভর্নর।
আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের সদস্য পদ লাভের পর বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যােগ দিতে সেপ্টেম্বর মাসে আমরা ওয়াশিংটনে গেলাম । বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সাথে আমাদের অর্থমন্ত্রীর প্রথম যে মিটিং হলাে সেটি অত্যন্ত চমৎকার এবং অত্যন্ত সফল হয়েছিল। ব্যাংক প্রেসিডেন্ট ম্যাকনামারাকে মনে হলাে অত্যন্ত খুশি। কারণ বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী পশ্চিমের সাহায্য নিতে চান না, বিশ্বব্যাংকের প্রতি তাঁর বিরূপ মনােভাব এমন ধরনের ভুল ধারণা ম্যাকনামারাকে দেয়া হয়েছিল আগে থেকেই। তাই তাজউদ্দীন সাহেবের খােলাখুলি, সুচিন্তিত এবং বাস্তবসম্মত মতামত ও আলােচনায় ম্যাকনামারা বিস্মিত এবং আনন্দিত
পৃষ্ঠাঃ ৬৭৪

হয়েছিলেন, এটা আমাদের কারােরই দৃষ্টি এড়ায়নি। ম্যাকনামারার চেহারা, অভিব্যক্তিতেই ফুটে উঠেছিল তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তার আলােচনা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। এমনকি মিটিং শেষ হবার পর আমরা ম্যাকনামারার অন্যান্য সহযোগীদের কাছ থেকে শুনেছি যে, অর্থমন্ত্রীর সাথে কথা বলে এবং মিটিং থেকে যে ফলাফল বেরিয়ে এসেছে তাতে বিশ্বব্যাংক প্রধান অত্যন্ত সন্তুষ্ট।
ওই সময়ে আমরা ওয়াশিংটনে থাকতে একটা প্রশ্ন উঠল, আইএমএফ থেকে আমরা বিশেষ আর্থিক সুবিধা নেব কিনা। এই সুবিধাটা ছিল এমন, যদি কোন নতুন দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে অসুবিধা বা ঘাটতি দেখা দেয় তবে সেই ঘাটতি পুষিয়ে নিতে আইএমএফ-এর এই টাকাটা ব্যবহার করা যাবে। এটা হলাে ‘৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কথা যখন আমরা বিশ্বব্যাংকের সাথে কথা বলছি। এদিকে ‘৭২ এর জানুয়ারিতে আমাদের সরকারি কোষাগার ছিল ফাঁকা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য। কিন্তু ‘৭২-এর সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গিয়ে দাঁড়ায় শূন্য থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে। আন্তর্জাতিক বাজার অনুযায়ী আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার এই রিজার্ভকে সন্তোষজনক এবং উপযুক্ত বলে ধারণা করা হতাে। আমরা প্রাথমিক সমস্যা কাটিয়ে ভাল অবস্থানে আছি, তাই এই অবস্থায় আইএমএফ-এর ঋণ নেব কি নেব না এই সমস্ত চিন্তাভাবনা যখন চলছে তখন আইএমএফ থেকে বলল, তোমরাই একমাত্র ব্যতিক্রমী দেশ যারা ঋণ নিতে চাচ্ছ না। এই পর্যায়ে সমস্ত বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, সম্পূর্ণ শর্তহীনভাবে এই ঋণ আমরা নেব।
লােকে যে বলত তাজউদ্দীন সাহেব পশ্চিমের ঋণ নিতে চাইতেন না এটা বােধ হয় ঠিক নয়। তার যেটা মূল ভাবনা ছিল যে, শর্তযুক্ত ঋণ আমরা নেব না। সহজ ঋণ নিতে পারি।
তাজউদ্দীন সাহেবকে খুব ঘনিষ্ঠভাবে লক্ষ্য করার সুযােগ হয়েছিল আমার। তার ছিল একটি অতি মহৎ হৃদয়। তবে তিনি মাঝে মাঝে খুব রেগে যেতেন। আমি তাকে বুঝতে পারতাম বলেই রাগের সেই মুহূর্তে ধৈর্য ধারণ করতাম, চুপ থাকতাম। কারণ এই সময়টুকু পার হলেই তিনি আবার সেই যুক্তির মানুষ। এমনকি নিজের কোন কাজে ভুল হলে সাথে সাথে সেটা সংশােধন করে নেয়ার মত মন ছিল তাঁর।
যেমন ব্যাংকের একজন এমডির অভিযােগের ভিত্তিতে তাজউদ্দীন সাহেব এক অফিসারকে সাসপেন্ড করার জন্য অর্ডার লিখে ফাইলটি আমার কাছে দিলেন। আমি অর্থমন্ত্রীর এই মতের সাথে একমত ছিলাম না। তাই রাগের মুহূর্তে
পৃষ্ঠাঃ ৬৭৫

আর কিছু না বলে ফাইলটি নিয়ে প্রায় দুই সপ্তাহের জন্য আমার কাছে এসেছে দিলাম। তারপর একদিন বুঝিয়ে বলতেই তিনি অর্ডারটি সংশোধন করে দিলেন। আমি আদেশটি পালন করিনি এই জন্য যে আমি জানতাম তার মনটি কেমন। উত্তেজিত হয়েই তিনি সাসপেন্ডের আদেশ দিয়েছেন। আমি যদি তাজউদ্দীন সাহেবের লেখা অর্ডারের ফাইলটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাই তবে তিনি সাথে সাথে সই করে দেবেন। কিন্তু তা করা ভুল হতাে এবং তাজউদ্দীন সাহেব নিজেই পরে আক্ষেপ করতেন। তাই আমি ফাইলটি ধরে রাখার দায়িত্ব এবং ঝুঁকি নিয়েছিলাম। আমার এখনও মনে আছে, দুই সপ্তাহ পর যখন আমি সাসপেন্ডের বিষয়টি বুঝিয়ে বলে ফাইলটি তার কাছে দিলাম তখন তিনি পরিষ্কার বাংলায় লিখলেন : অর্থ সচিব কি মনে করেন যে আমি অন্যায় আদেশ দিয়েছিলাম? শুধু এটুকু লিখেই তিনি তাঁর আদেশটি ফিরিয়ে নিলেন। এখানে আমার কাছে তার বড় মনের পরিচয়টিই ফুটে উঠেছিল। তিনি একটি আদেশ করেছেন যেটা ঠিক নয় এবং সেটি সংশােধনে তার কোন কার্পণ্য ছিল না।
তবে কিছু কিছু বিষয়ে তিনি ভাষণ শক্ত ছিলেন। হয়ত আমি সুপারিশ করেছি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও সুপারিশ করেছেন, কিন্তু তিনি মানেননি। একটি ঘটনা আমার মনে আছে। বাংলাদেশ হয়ে যাবার পর একটি অর্ডার হয়েছিল – সিভিল সার্ভেন্টরা মাসে ৫০০ টাকার বেশি পাবে না। পরে এটাকে এক হাজার, পরবর্তীতে দুই হাজার টাকা করা হয়। এই সময়ে আমি অর্থ সচিব হিসেবে কাজে যােগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালের ফাইলগুলাে দেখছিলাম। সেখানে দেখলাম একটি ফাইলে ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত লেখা আছে, যে টাকাটা অফিসারদের কম বেতন দিয়ে সরকারের তহবিলে জমা পড়ছে সেই টাকা সাময়িকভাবে ধার নেয়া হচ্ছে এবং এর পরিবর্তে সবাইকে সেভিংস সার্টিফিকেট দেয়া হবে, যা সবাই একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর জমা দিয়ে নগদ টাকা তুলে নিতে পারবেন। এই সিদ্ধান্তই ছিল ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেই সিদ্ধান্তে তাজউদ্দীন সাহেবের সই করা ছিল। আমি সেই ফাইল দেখলাম এবং আমার কাছে মনে হলাে এটা খুবই যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এই ফাইলের ভিত্তিতে একটি অর্ডার ইস্যু করে দিলাম, যাদের বেতন কাটা হয়েছিল তারা এই-এইভাবে টাকাটা ফেরত দিতে পারে।
এই অর্ডারটি ইস্যুর কয়েকদিন পরেই একদিন ক্যাবিনেট মিটিং হচ্ছে, মিটিংয়ে রুহুল কুদুস সাহেব, তওফিক ইমাম এবং আমি ছিলাম। তাজউদ্দীন সাহেব এই প্রসঙ্গ তুললেন এবং বললেন, এটা কেন করা হলাে। আরাে বললেন, এসব কর্মকাণ্ড আমাদের স্বাধীনতার মনােভাব, সরকারের আদর্শ নষ্ট করে দিচ্ছে।
পৃষ্ঠাঃ ৬৭৬

এটা আমাদের পলিসি যে আমরা টাকা কাটবো কিন্তু টাকা দেবো না। সেখানে কিভাবে ব্যুরোক্রেসি সিদ্ধান্ত দেয় যে টাকাটা কোন উপায়ে ফেরত দেয়া হবে? ব্যুরোক্রেসি বলে আসলে তিনি আমাকে বোঝাচ্ছিলেন কিন্তু নাম নিচ্ছিলেন না। আমি তো জানি আমি কিসের ভিত্তিতে অর্ডারটি ইস্যু করেছি, আর তো কেউ জানেও না। তাই তখন আমি আস্তে করে ক্যাবিনেট রুম ছেড়ে আমার রুমে গিয়ে ফাইলটি নিয়ে এলাম। ফাইলটা খুলে আমি প্রধানমন্ত্রীর সামনে দিলাম। সেটা পরে তিনি বললেন, ‘আরে তাজউদীন, এই তো তোমার অর্ডার তাে আছে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘অর্ডার থাকলে ওটা ভুল। বর্তমান অবস্থায় আমি এর সাথে একমত না। এটা বাতিল করতে হবে। অর্ডারটি বাতিল হলে। এই ক্ষেত্রে দেখলাম তিনি কিছুতেই কোন কথা মানলেন না। অন্যান্য বিষয়ে দ্বিমত হলে তাকে যুক্তি দিয়ে বললে বোঝান যেত, কিন্তু এই বিষয়ে কিছুতেই মানলেন না। বললেন, এই অর্ডার দেয়াটা ভুল হয়েছিল। হতে পারে সেই সময়ে বর্তমানের অবস্থাটি ঠিক বােঝা যায়নি। তাই অর্ডারটি বাতিল করতেই হবে। এই যে অর্ডারটি বাতিল হলাে, আমি অর্ডারটি ইস্যু করেছিলাম তাজদ্দীন সাহেবের সাথে কোনরকম পরামর্শ না করে, কি আমার সাথে এ কারণে কোন মনোমালিন্য বা অসঙ্গত ব্যবহার কিছুই কিন্তু তাজউদান সাহেব করেননি। তিনি একদম স্বাভাবিক ছিলেন, যেন কোন কিছুই ঘটেনি।
শেখ সাহেবের সাথে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে লক্ষ করতাম, সবসময় তাজউদ্দীন সাহেব তাকে পূর্ণ সমর্থন দিতেন। শেখ সাহেব যদি বলতেন কোন কিছু করতে হবে, সেটা তাজউদ্দীন সাহেব যেভাবেই হােক অবশ্যই করতেন । এটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে বলছি রাজনৈতিক বিষয় আমি জানি না।
যেমন, প্রধানমন্ত্রী কনজিউমার্স করপােরেশন তে চাইলেন প্রতি থানায় এমনকি আরাে নিচু স্তরেও কনজিউমার্স করপােরেশন করবেন। সেখানে সরকারি দোকান হবে এবং সেই দোকানে সরকার জিনিস বিক্রি করবে সস্তায়। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, ‘স্যার, সমস্ত দেশে লাখ লাখ দোকান আছে। সেখানে সরকারি একটা দোকান কিছুই করতে পারবে না। বরঞ্চ এতে মারাত্মক বেশি রকমের প্রশাসনিক খরচ হবে। করতে চান আপনি একটি পাইলট স্কীম করেন, সমস্ত জেলা শহরগুলােতে। যদি এটা সফল হয় তবে সাব-ডিভিশনে, তারপর থানায়। একবারে থানায় গেলে তাে আপনাকে বিরাট খরচের যােগান দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, না এটা আমার প্রস্তাব। আমি এটা করতে চাই। তাজউদ্দীন সাহেব কিন্তু আমাকে সমর্থন করলেন না। তিনি বললেন, ‘নেতা যখন
পৃষ্ঠাঃ ৬৭৭

বলছেন তখন আমাদের করতেই হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে পূর্ণ সমর্থন দিলেন। পরবর্তীতে অবশ্য এই প্রকল্পটি ফলপ্রসূ হয়নি।
তাজউদ্দীন সাহেবের আর একটি গুণ ছিল। ক্যাবিনেট মিটিংয়ে ক্যাবিনেট পেপারগুলাে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমিই উপস্থাপন করতাম। এবং এই মিটিংয়ে তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে আমার মতামত বলবার সুযোগ দিতেন। এমনকি আমার মতামত তার প্রস্তাবের বিপক্ষে হলেও তিনি বলতেন, ‘আপনি আপনার কথা বলেন। কারণ তিনি আবার অর্থমন্ত্রী ছাড়াও পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। কতকগুলাে প্রস্তাব হয়ত এসেছে পরিকল্পনা কমিশন থেকে। তখন তিনি সমর্থন দিচ্ছেন অথবা সংশােধন করছেন বা অনুমােদন করছেন পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে। কিন্তু অর্থ সচিব হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি থেকে আমি মনে করেছি ঠিক হয়নি বা ঠিক হবে যে বিষয়গুলাে, সেটা আমি সব সময় সময় বলেছি। তাজউদ্দীন সাহেব কোনদিনই বলতেন না, কেন আপনি বলছেন উল্টো কথা, এটা আমার প্রস্তাব – বা এই জাতীয় কথা। বরং অন্য দু’চারজন মন্ত্রী বলেছেন, আপনি কেন বলেন এইসব কথা? আমি জবাব দিয়েছি, আপনারা তাজউদ্দীন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, আমি এখানে কথা বলবার জন্য অনুমতি নিয়েছি। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনােভাব এবং দৃষ্টিভঙ্গিটা জানানাে তাে আমাদের দায়িত্ব। তারপর ক্যাবিনেট কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা নেবে। এই সমস্ত কারণের জন্যই বলছি, আমি সত্যি খুব আনন্দের সাথে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে দু’বছর কাজ করেছিল। আমি সত্যি মনে করি তিনি ম্যান উইদ আ গােল্ডেন হাট- একজন সুবর্ণ হৃদয়ের মানুষ।
শেখ সাহেবের সাথে শেষের দিকে তাজউদ্দীন সাহেবের যে সম্পর্কে চিড়। ধরল সেটা সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক। এই দুজনের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পেছনে আমি সেই সমস্ত লােকদের দায়ী করব যারা সব সময় এই দুই পক্ষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। এই সমস্ত লােকেরা সব সময় শেখ সাহেবকে বলত এক কথা আর অন্যদিকে বলত অন্য কথা। আর একই মানুষ সম্পর্কে বারবার একই কথা বলতে থাকলে হয়ত সেসব কথা বিশ্বাসও করতে শুরু করে দেয় মানুষ ।
তাজউদ্দীন সাহেব পদত্যাগ করবার পর আমি ওয়াশিংটন থেকে ঢাকায় এলাম। শেখ সাহেবের সাথে আগে থেকেই আমার সুন্দর সম্পর্ক ছিল। সে কারণেই আমি সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে তাঁর ৩২ নম্বরের বাড়িতে গেলাম। সেখান থেকেই সােজা তাজউদ্দীন সাহেবের বাড়িতে এলাম। তাজউদ্দীন সাহেবের বাড়িতে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক লােকজন ছিল। এর মধ্যে তিনি আমাকে
পৃষ্ঠাঃ ৬৭৮

খুব খুশি হলেন এবং ভেতরে নিয়ে বসালেন। অনেক কথা হলো। সব শেষে আমি বললাম, ‘স্যার, আমি তাে জানি প্রধানমন্ত্রী আপনার নেতা এবং আপনি তাকে কত সম্মান করেন । আপনি তাকে সবসময় সমর্থন দিয়েছেন, কোন সময়ই আপনি তার মতের বিরুদ্ধে যাননি। এখন আপনাদের দুজনের মধ্যে এই যে দূরত্ব, তা কি কোনক্রমে দূর করা যায় না? কোনভাবে জোড়া দেয়া কি একদমই সম্ভব না? ‘আমি আর কিছু বললাম না, চলে এলাম। বুঝলাম মতপার্থক্যটা এত বেশি যে ওখানে আর তিনি সমঝােতা করতে রাজি নন।
এই মতপার্থক্যটা বােধ হয় বাকশাল থেকেই হয়েছে। আমি তাে বিদেশে চলে গেলাম ‘৭৩ এর অক্টোবর মাসে। এর আগে অবশ্য দুই একটি বিষয় বুঝতে পারতাম কিছু কিছু। যেমন দু’একটি অর্ডার তিনি পছন্দ করেননি। তিনি বলছেন না মুখে, কিন্তু আমি আন্দাজ করতে পেরেছি তিনি প্রধানমন্ত্রীর অর্ডারটি পছন্দ করছেন না। একটি উদাহরণ দিচ্ছি, স্বাধীনতার পরপরই তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা মুজিবনগরে ছিলেন আমরা তাদেরকে একটা কিংবা দুটো ইনক্রিমেন্ট দেব । আমি সেইভাবে লিখে ফাইল তৈরি করলাম। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এটা প্রত্যখ্যিান করলেন। বললেন, না, আমার টাকাপয়সা নেই, আমি দেব না।
অর্থমন্ত্রী বলছেন, অর্থ সচিব বলছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বলছেন, না, আমি দেব না। আশ্চর্যের বিষয়, এক বছর পর অর্থমন্ত্রীকে, অর্থ মন্ত্রণালয়কে না জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ সেই একই অর্ডারটি ইস্যু করলেন। এটা তাজউদ্দীন সাহেব পছন্দ করলেন না। তার মনের ভাবটা এমন ছিল যে, এই অর্ডারটি কার্যকর করতে এক বছর আগে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়েছিলাম, তখন সবকিছু আমাদের অনুকূলে ছিল এবং আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পারতাম। আর এই এক বছরে সব কিছু তাে অন্যরকম হয়ে গেছে। এখন কে মুজিবনগর, কে কোথায়, সব এলােমেলাে। অথচ তিনি এক বছর পর অর্ডারটি দিলেন, আমাদেরকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলেন না। যাই হােক, আদেশটি কার্যকর করা হলাে। তখন দেখলাম তাজউদ্দীন সাহেব মনঃক্ষুন্ন হয়েছেন। কষ্ট পেয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রী তাকে জিজ্ঞাসা না করে অর্ডারটি দিয়ে দিলেন।
আর একটি অর্ডার প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন- যারা পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে গিয়েছিল তাদের যে পােষ্য বাংলাদেশে ছিল তাদেরকে টাকা দিতে হবে। এই বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে পরামর্শ করেননি। পরে আমি অর্থ সচিব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আপত্তি করেছিলাম যে এটা বােদ হয় ঠিক হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বললেন, আমি আদেশ দিয়েছি, তােমরা কার্যকর করাে।
পৃষ্ঠাঃ ৬৭৯

এটাও এইভাবে অর্থমন্ত্রীকে না জানিয়ে করাটি তাজউদ্দীন সাহেব পছন্দ করেননি। তাজউদ্দীন সাহেব অবশ্য চাইতেন না বাইরে এসব জিনিস প্রকাশ পাক। তাই মুখে কিছু বলতেন না, কিন্তু আমি পরিষ্কার বুঝতে পারতাম তিনি এইভাবে কাজ করাটা পছন্দ করছেন না। আজ বলছি, আমার কারণে যেন প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর মধ্যে কোন ভুল বোঝাবুঝি না হয় আমি সব সময় সেই চেষ্টাই করেছি। এবং শেষ পর্যন্ত আমি আমার এই চেষ্টা বজায় রাখতে পেরেছিলাম।
আর একটি কথা- গুজব ছিল, তাজউদ্দীন সাহেব ভারত ঘেষা, সম্ভব হলে তিনি দেশ বিক্রি করে দিচ্ছেন। আসলে কিন্তু এই গুজবের কোন ভিত্তি ছিল না। একটি ঘটনার কথা বলি। বাংলাদেশ থেকে বিদেশের যে কোন দেশে যেতে হলে পি ফর্ম প্রথা চালু ছিল। একমাত্র ভারত ভ্রমণের জন্য এই পি ফর্মের দরকার ছিল না। আমি একবার সিদ্ধান্ত নিলাম, ভারতও তাে বিদেশী দেশ, তাই ভারত ভ্রমণের জন্যও পি ফর্ম চালু করা যায়। আমি সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে নির্দেশ দিলাম প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে।
আমি ঠিক পুরােপুরি ধারণা করতে পারিনি এর ফলে যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে তা বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে কী প্রভাব ফেলবে। এই ঘটনাটি খুব দ্রুত অর্থমন্ত্রীর নজরে এলাে। তিনি আমাকে তার প্রতিক্রিয়া জানালেন এভাবে : ইসলাম সাহেব, এই অর্ডার ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তীক্ষ ছুরির মতাে আঘাত করবে। সময় খুবই অপরিপক্ব, অবিলম্বে এই অর্ডারটি বাতিল করতে হবে। অর্ডারটি সাথে সাথে বাতিল হলাে । একমাত্র এই ঘটনা ছাড়া তিনি আর কখনই ভারত সম্পর্কে কিছু বলেননি। আর এই অর্ডারটি ইস্যু করার আগে আসলে আমারই উচিত ছিল অর্থমন্ত্রীর সাথে আলােচনা করা, যা আমি করিনি। পরবর্তীতে কয়েক মাস পর ভারত ভ্রমণের জন্য যখন আবার পি ফর্ম প্রথা চালু হলাে তখন অর্থমন্ত্রীও কোন রকম আপত্তি জানালেন না বা ভারতের দিক দিয়েও কোন প্রতিবাদ বা আপত্তি আসেনি।
‘৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমি কলকাতা গেলাম । সেখানে ভারতের মিন্ট মাস্টার এল আমার সাথে দেখা করতে যে, আমরা তাদের মিন্ট-এ (টাকশাল) মুদ্রা ছাপব কিনা। এই বিষয়ে আলােচনায় আমি তাকে না করে দিলাম। কারণ আরাে কয়েকটি দেশের সাথে আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। ফিরে এসে তাজউদ্দীন সাহেবকে বিষয়টি জানালাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে। তিনি বললেন না যে, ইন্ডিয়া থেকেই করতে হবে বা কেন ইন্ডিয়া থেকে করবেন না। পরবর্তীতে আমরা পূর্ব জার্মানি থেকে কয়েন তৈরি করলাম।
পৃষ্ঠাঃ ৬৮০

স্বাধীনতার পর আস্তে আস্তে পাকিস্তানি মুদ্রা বাজার থেকে তুলে নেয়া হলো। নোট ছাপাবার ব্যাপারেও তাজউদ্দীন সাহেব কোনদিনও কোন দেশের পক্ষে সুপারিশ করেননি। আমরা টেন্ডার কল করতাম, সবচাইতে কম দর যারা দিত তাদেরকেই কাজ করতে দেয়া হতাে। বেশিরভাগ সময় ইংল্যান্ডের একটি কোম্পানি ছিল, ওরাই সর্বনিম্ন দরে কাজটি পেত। এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগে বা সেই সময় পাকিস্তান তাদের এক টাকার নােট বাজেয়াপ্ত করে উঠিয়ে নেবে শোনা যাচ্ছিল । বাংলাদেশ সরকার তখন ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে এক টাকার নােটে ৬০/৭০ কোটি টাকা ছাপাতে দিয়েছিলেন । সেই টাকার নােট আমরা পেলাম বাংলাদেশ হবার কয়েক মাস পর।
আমরা তখন সিদ্ধান্ত নিলাম বাংলাদেশী নােটটি আমরা আস্তে আস্তে ছাড়ব। এই নােটটিতে মুক্তিযুদ্ধকালের অর্থ সচিব খন্দকার আসাদুজ্জামান এর স্বাক্ষর মুদ্রিত ছিল। আমরা দুই মাস সময় দিলাম পাকিস্তানি নােট তুলে নেবার জন্য। এর কিছুদিনের মধ্যেই বাজার প্রচণ্ড গুজব শুরু হলাে, ভারতের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে এক টাকার নােট ছাপানাে হয়েছে আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য। ভারত ডুপ্লিকেট নােট ছাড়ছে বাজারে এবং কোটি কোটি টাকা সরিয়ে নিচ্ছে। এটা এখনই বন্ধ করতে হবে। খবরের কাগজেও এই ধরনের কথাবার্তা উঠতে শুরু করল। একদিন একটি কাগজে একই নম্বরের দুটো নােট পাশাপাশি ছাপল। তাজউদ্দীন সাহেব কাগজটি আমাকে দেখালেন। আমি বললাম, “দেখুন, একই নােটের ছবি দু’বার ছাপালে তাে নম্বর একই উঠবে। তিনি তখন বললেন, ‘এই বিষয়ে কী করা যায়?’ আমি বললাম, ‘আপনি দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এই বিষয়টি নিয়ে যেহেতু আপনার ব্রিতকর অবস্থা হচ্ছে তাই আমরা ভারতে ছাপানাে এই টাকাটা উঠিয়ে নেব। ইতােমধ্যে লন্ডন থেকে এক টাকার নােট ছাপা হয়ে এসেছে, তাই আমরা অর্ডার ইস্যু করে দিলাম, নতুন নােট ছাড়া হবে এবং আগামী দু’মাস সময়ে ভারতে ছাপানাে নােট তুলে নেয়া হবে। যেই মাত্র
এই অর্ডারটি ইস্যু করা হলাে অমনি আবার বাজারে হইচই যে, এই তাে দু’মাস সময় দেয়া হলাে, এই দু’মাসেই ভারত থেকে কোটি কোটি টাকা চলে আসবে। ওখানে এক টাকার নােট প্রিন্ট তাে হচ্ছেই! আরাে কত কী কথাবার্তা। আমি এই গুজবে তেমন একটা গুরুত্ব দিচ্ছিলাম না, কারণ আমি তাে জানি এসব কথা সত্য নয়।
কিন্তু এইসব গুজব, কথাবার্তা এমন অবস্থায় এল যে তাজউদ্দীন সাহেব একটা বিবৃতি দিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের জানা আছে আমরা কত কোটি টাকার এক টাকার নােট বাজারে ছেড়েছি। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি
পৃষ্ঠাঃ ৬৮১

সম্পূর্ণ টাকা বাজার থেকে তুলে নেবার পর যদি এক টাকাও বেশি আমরা পাই, তবে আমি পদত্যাগ করব। এই বিবৃতি তিনি সংসদে দিলেন, না বাইরে দিলেন সেটা আমার ঠিক খেয়াল নেই। যাই হােক, এই বিবৃতির পর সব দিক ঠান্ডা হলাে।
এদিকে যখন আর মাত্র দিন দশেক বাকি আছে দু’মাসের তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডাকলেন। বললেন, ‘বর্ডার এলাকা থেকে আমার কাছে কর্মীরা আসছে, তারা বলছে কোটি কোটি টাকার নােট নাকি ইন্ডিয়া থেকে বর্ডার দিয়ে ভেতরে আসছে। এটা তাে এখনই বন্ধ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল খুবই আন্তরিক। তাই আমি বলেই ফেললাম, ‘স্যার, যারা আপনাকে এইসব বলছে তাদেরকে আপনি জিজ্ঞাসা করেন তারা কি তাদের জীবনে এক টাকার নােটে এক কোটি টাকা দেখেছে? কারণ স্যার, আমার চাকরি জীবনের এক সময়ে আমি মুন্সীগঞ্জে ট্রেজারি অফিসার ছিলাম। সেখানে আমাদের একটি স্ট্রংরুম ছিল, বাক্সভর্তি টাকা থাকতো ১, ৫, ১০, ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। স্ট্রংরুমটি যে পরিমাণ বড় ছিল তাতে ও কিন্তু ৪০/৫০ লক্ষ টাকার বেশি জায়গা হতাে না। স্ট্যাক করে টাকা রাখা হতো, স্ট্যাক করে টাকা রাখা হতাে, স্ট্যাক ধরে টাকা গুনতে হতাে, টাকা গুনে শেষ করা যেত না। মুন্সীগঞ্জের সাব ট্রেজারির সিলিং ছিল ৪০/৫০ লক্ষ টাকা। সেখানে সব ধরনের নােট ছিল, কিন্তু তাতেও স্ট্রংরুমে গাদাগাদি অবস্থা ছিল। আর আপনি বলছেন ওরা বলছে এক টাকার নােট আসছে কোটি কোটি টাকার। তাই, স্যার, আমি বলছি ওরা কি জীবনে দেখেছে এক টাকার নােটে কোটি টাকা?
প্রধানমন্ত্রী বললেন, তুমি কী বল?
আমি বললাম, “আমরা যা করেছি তা সঠিক। আর দশ দিন বাকি আছে। সময়কে এগিয়ে যেতে দিন।’
তারপর দশ দিন শেষ হলাে। বাংলাদেশ ব্যাংক জমা হওয়া টাকার হিসাব দিল। সেখানে মােট ছাপানাে টাকার চাইতে জমা পড়েছে কম টাকা। তাজউদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে অভিযােগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলাে। আমি এই ক্ষেত্রে একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি, অন্য যে কেউ হলে হয়ত হুজুগে কান দিত বা নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখাত। কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব একদম শান্ত ছিলেন, ভীষণ শান্ত। কোন সময় কোন উচ্চবাচ্য করেননি। আমি আমার সম্পূর্ণ সমর্থন তাঁকে দিয়েছি।
এদিকে এই সময়টায় ভারতের পার্লামেন্টে বাংলাদেশের এই নােট ছাপানাে
পৃষ্ঠাঃ ৬৮২

নিয়ে প্রশ্ন উঠে যে, ব্যাপারটা কী, আমরা নােট ছাপিয়ে কি অন্যায় করেছি, ইত্যাদি।
ওই সময়টাতেই আমি দিল্লি গেলাম অর্থ সচিবদের একটা বৈঠকে। ভারতের অর্থ সচিব এম জি কাউল আমার কাছে জানতে চাইলেন এই বিষয়ের ব্যাপারে। আমি তাকে বিষয়টি জানালাম। সেই সাথে এটার যে সমাধান বা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে তাও বললাম। এই ঘটনাগুলাে যে সম্পূর্ণই হুজুগ ছিল সে সম্পর্কে ভারতের অর্থ সচিব একই মত প্রকাশ করলেন।
আর একটি হাস্যকর মজার ঘটনা, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বার্ষিক মিটিং হবে ম্যানিলায়। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেব, আমি এবং অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী সেই বৈঠকে যােগ দেব। ঢাকা থেকে থাই এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে ব্যাঙ্কক, সেখান থেকে আমাদের ম্যানিলা যাবার কথা। আমরা রওনা দেবার একদিন আগে হঠাৎ করে থাই জানাল ওদের সেই ফ্লাইটটি বাতিল হয়ে গেছে । এদিকে সেই সময় তাে ব্যাঙ্ককে যাবার আর কোন ফ্লাইট নেই, কী করা যাবে? থাই এয়ারলাইন্স বলল, ঠিক আছে আপনারা দিল্লি যান, সেখান থেকে প্যানঅ্যামের ফ্লাইটে ব্যাঙ্কক যেতে পারবেন। সেখান থেকে ফিলিপিন এয়ারে ম্যানিলা।
যেহেতু এই মিটিংয়ে যােগ দিতেই হবে তাই আমরা দিল্লি গেলাম। বিকেলে আমরা দিল্লি পৌছলাম। ডি.পি, ধর এয়ারপাের্টে আমাদের রিসিভ করলেন। রাতটা ভারত সরকারের অতিথি হিসেবে হােটেলে থাকতে হবে, ভাের পাঁচটায় ফ্লাইট। রাত চারটায় হােটেলের রুমে ফোন বাজল। ভারতের প্রটোকল অফিসার জানাল, ‘আপনারা ঘুমিয়ে থাকুন, ফ্লাইটটা যেতে দেরি হবে। আমরা পরে আপনাদেরকে সময়টা জানাব।’ সময় অনুযায়ী আমরা তৈরি হয়ে এয়ারপাের্টে গেলাম। ভিআইপি রুমে বসে আছি। আমাদের কেউ ডাকেটাকে না অনেকক্ষণ, এমন সময় দেখলাম মাঝবয়সী প্রটোকল অফিসারকে। তাকে জিজ্ঞাসা করতেই বলে, ‘অসুবিধা নেই, প্লেনের সময় হলেই ডাকব। আরাে কিছুক্ষণ পর ভিআইপি রুম থেকে অনেকটা পথ গাড়ি দিয়ে প্লেনের কাছাকাছি গিয়ে দেখি, প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, এমন কি সিড়িটাও সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখন আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “সিড়িটা তাে নিয়ে যাচ্ছে!’ প্রটোকল অফিসার বলে, ‘না, ওটা কিছু না। আমরা বললাম, “প্লেন তাে চলছে! তখন অফিসারটির মাথায় হাত। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে প্যানঅ্যামের অফিসারের কাছে গিয়ে বলল, ‘প্লেন কিভাবে যাচ্ছে? আমাদের ভিআইপি যাত্রীরা রয়ে গেছে!
অফিসারটি বলে, আমরা বারবার ডেকেছি, কেউ আসেনি, তাই প্লেন চলে
পৃষ্ঠাঃ ৬৮৩

যাচ্ছে।’ প্রটোকল অফিসার বলে, “জানেন, কারা আছেন যাত্রী হিসেবে? বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিব। প্লেনকে অবশ্যই থামাতে হবে। এটা খুবই জরুরি।’
তখন অফিসার বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে কন্ট্রোল টাওয়ারে বলল, ভিআইপি যাত্রীরা রয়ে গেছেন, তাঁদের মালপত্রও চলে গেছে, এখন তাতের নিতে হবে। কন্ট্রোল টাওয়ার থকে বলল, আমাদের গাড়ি যেন প্লেনকে পেছন থেকে অনুসরণ করে, টেকঅফের ঠিক আগ মুহূর্তে প্লেন থামবে। প্লেন তো থামল, কিন্তু উঠব কীভাবে, এত উঁচু ৭৪৭ প্লেন, সিঁড়ি তাে নিয়ে গেছে। এবার আনল মাল তোলার লিফট। তিনজন মিলে কোন রকমে দাঁড়ানাে গেল। নিচ থেকে হাতল ঘুরিয়ে আমাদেরকে উপরে তােলা হচ্ছে। নিচে দেখতে পাচ্ছি আমাদের হাইকমিশনার মল্লিক সাহেব এবং অন্যরা দাঁড়ানাে। তারা ছােট হয়ে আসছেন। ৭৪৭ এর ইঞ্জিনের সামনে দিয়ে যেতেই গরম বাতাস, সে যে কি অবস্থা। যাই হোক দরজার সামনে পৌছে দরজায় টোকা দিতে বলা হয়েছিল। টোকা দিতেই যেই ভেতর থেকে দরজা খুলতে গেল আমরা দেখলাম দরজা তাে বাইরে খুলবে, সেই ধাক্কায় আমরা নিচে পড়ে যাব। ওরা বিষয়টি বুঝতে পেরে লিফটটা একটু নিচে নামাল। দরজা খােলা হলে আমাদের তিনজনকে টেনে টেনে ভেতরে ঢােকানাে হলো। নিচে দাঁড়ানাে সবাই আমাদের অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে কাহিল।
তাজউদ্দীন সাহেব কথা বলতে পছন্দ করতেন। কথা বলতে শুরু করলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোন বিরতি ছাড়াই কথা চালিয়ে যেতে পারতেন। কাজ না থাকলে আমরাও বসে শুনতাম তার সেইসব নানা ধরনের কথা । মনে আছে, একবার আমরা দুজন দিল্লি গেলাম। এয়ারপাের্ট ছেড়ে খানিকটা পথ এগিয়ে যেতেই একটা বাড়ি দেখিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দিল্লিতে এলে এই বাড়িতেই আমার থাকা হতাে। একবার মিসেস গান্ধী নিজে এসে এই বাড়িতে দেখা করে গেছেন।’
একবার কিন্তু তাজউদ্দীন সাহেব মনের দুঃখেই হােক আর যে কারণেই হােক, বললেন, ‘আমরা কি ভুলই করলাম নাকি! স্বাধীনতার পর উচিত ছিল বেশ কিছু অপরাধীকে মেরে ফেলা। তা হলে হয়ত আমরা অনেক ভাল থাকতাম।
বিজয় লাভের পর সপ্তাহের সাত দিনই আমাদের কাজ করতে হতাে। কয়েক মাস পর সাপ্তাহিক ছুটি দেয়া হয়। মনে আছে, একবার বাজেটের সময় সকালবেলা অফিসে গিয়েছি, ফিরেছি পরদিন ভােরে আজানের সময়।
তাজউদ্দীন সাহেব যখন আমাকে সরকারের নীতি জানালেন যে, ব্যাংকগুলাে জাতীয়করণ করা হবে এবং এই বিষয়ে কাগজপত্র তৈরি করতে কিছু নির্দেশনা
পৃষ্ঠাঃ ৬৮৪

দিলেন তখন আমরা কয়েকদিন খেটে সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করে নিয়ে এলাম। সে সময়ে দেশের দুটি ব্যাংক ছিল : ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপােরেশন আর ইস্টার্ন মার্কেনটাইল ব্যাংক। আর বাকি সব ছিল পাকিস্তান ব্যাংক। যেমন হাবিব ব্যাংক, ইউনাইটেড ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক , এমন প্রায় দশটা ব্যাংক। বড় ছিল চারটা : ইউনাইটেড ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক আর ন্যাশনাল ব্যাংক। বাকিগুলাে ছিল এক- দুই শাখার। আমরা তখন চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম যে ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন আর ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক এই নামেই আলাদা দুটি ব্যাংক রাখা যায়। আর যে বাকি দশটা ব্যাংক ছিল সেগুলােকে এক সাথে করে ছয়টা ব্যাংক করা যায়। আমি ব্যাংকগুলাের নাম দিয়েছিলাম ইংরেজিতে নাম- পিপলস ব্যাংক এমন ধরনের সব নাম। এই প্রস্তাব ক্যাবিনেটে যাবার পরে একমাত্র বদলে গেল ব্যাংকের নামগুলাে, আর বাদবাকি প্রস্তাব ঠিকই রইল । তাজউদ্দীন সাহেব দিয়েছিলেন কয়েকটি নাম। দিনাজপুরের ইউসুফ আলী সাহেবও বললেন একটি নাম। এইভাবে সেখানেই ব্যাংকের নামগুলাে ঠিক হলাে ।
এই মিটিংটা হলাে ২৩ মার্চ। ২৬ মার্চ ব্যাংকগুলাে জাতীয়করণ করা হয় । তখন আমি অর্থমন্ত্রীকে বললাম, ‘স্যার, এখন ব্যাংকগুলাের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পদে নিয়ােগ দেয়া হবে এবং এই জন্য যাদের নামের সুপারিশ করৰ আমি চাই না এই সুপারিশের কেসটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাক। কারণ প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের এখতিয়ার আছে, সেই অনুযায়ী এতে রাজনৈতিক লােকজনের জড়িয়ে পড়বার সম্ভাবনা থাকবে। কারণ চারদিক দিয়ে লােকজন কিছু না কিছু স্বার্থের জন্য ব্যস্ত । ব্যাংক ভাল বুঝবে এমন লােকেরই এই মুহূর্তে প্রয়ােজন। আপনিও স্যার এর মধ্যে আসবেন না, আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইল গেলে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি যদি দেরি করেন বা অন্য কোন কিছু- কিন্তু হাতে কোনভাবেই সময় নেই। যেহেতু ব্যাংক জাতীয়করণ করা হয়েছে, আইন অনুযায়ী ২৬ তারিখেই সব নিয়ােগ দিতে হবে । আর ব্যাংকের উপর যদি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয় তবে সমস্ত বাংলাদেশের সমস্যা হবে।’ তাজউদ্দীন সাহেব আমার কথা মেনে নিলেন। আমি তখন ছয়টা ব্যাংকে ছয়জনকে নিয়ােগ দিলাম। এই ছয়জনকে আমি খুব ভালভাবেই জানতাম। যারা সবচাইতে ভাল কাজ করতে পারবেন তাদেরকেই কাজ দেব, এই চিন্তাই আমার মাথায় ছিল । যিনি পারবেন তাকে কাজ দেব না, এর মধ্যে কোন সমঝােতা নেই। আমি নিয়ােগপত্রে সই করে দিলাম। কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রীর কাছে রিপাের্ট গেল (অবশ্যই যারা এই পদের জন্য আগ্রহী ছিলেন হয়ত তাঁদের কাছ থেকেই) যে, মতিউল ইসলাম
পৃষ্ঠাঃ ৬৮৫

সাহেব সব নিজে করেছে, আপনাকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করেনি।
তাজউদ্দীন সাহেবের সই আমি ইচ্ছা করেই রাখিনি, কারণ তাহলে তাকে আটকাবে, তুমি কেন আমাকে দেখালে না? সাধারণ নিয়ম তাই। সে কারণেই তাজউদ্দীন সাহেব রাজি হওয়াতেই আমি সই করে দিয়েছি। তাজউদ্দীন সাহেবের কাছেও অভিযােগ এসেছে। রুলস অব বিজনেসকে তােয়াক্কা না করে মতিউল ইসলাম সমস্ত ব্যাংকের এমডিদেরকে নিয়ােগ করেছে। তাজউদ্দীন সাহেবের উত্তর ছিল, “আচ্ছা, মতিউল ইসলাম সাহেব এমন কাজ করল, কিন্তু ব্যাংকগুলো তো চলছে ভালই। আমি তাকে ডেকে বলে দেব। আমি অবশ্যই বিষয়টি জানতে চাইব।’
প্রধানমন্ত্রীও আমাকে ডাকলেন, তুমি কী এটা করেছ?
বললাম, জি, স্যার।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘কেন করেছ?
বললাম, স্যার আমি দুঃখিত, ভুল করেছি। আমি খুব তাড়াতাডিতে ছিলাম, কোন সময়ই ছিল না আপনার সাথে আলাপের। কারণ ২৩ মার্চ ব্যাংকের বিষয়ে ক্যাবিনেটে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমাকে দুই দিনের মধ্যে সমস্ত কিছু করতে হয়েছে, না হলে ২৬ তারিখে কিছুতেই সব কাজ শেষ করা যেত না। মারাত্মক সমস্যা দেখা দিত। স্যার, আমি সত্যিই দুঃখিত। আপনি যদি মনে করেন কাউকে বদলাবেন, বদলে দিন।’
প্রধানমন্ত্রী বললেন, না আমি বদলাতে চাচ্ছি না, কিন্তু এর পরে আর যেন এমন না হয়।’
তাজউদ্দীন সাহেবের একটা ব্যাপার ছিল তা হলাে, তিনি আমাকে ভীষণ বিশ্বাস করতেন। শুরু থেকেই বিশ্বাস করতেন। আমি অর্থ সচিব হিবে যােগ দেয়ার অল্প কিছুদিন পরেই পূর্বপরিচিতি মাহবুব আনাম (আবুল মনসুর সাহেবের ছেলে) একদিন আমার বাসায় প্রায় দৌড়ে এসে বলল, “স্যার, তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের বাসায় এসেছিলেন, তিনি আপনার ভীষণ প্রশংসা করলেন। বললেন, আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত অফিসার, আমি এই কথা বলতেই ছুটে এসেছি।’ এই কথা শুনে আমার ভীষণ ভাল লাগল যে তাজউদ্দীন সাহেব ভাবেন আমি একজন ভাল অফিসার এবং তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন। তাজউদ্দীন সাহেবের কাছ থেকে এটি আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক পুরস্কারপ্রাপ্তি। আমার প্রতি তাজউদ্দীন সাহেবের এমন মনােভাবই আমি সবসময় দেখেছি। তবে মানুষজন অনবরত এত মিথ্যা কথা বলত যে, মাঝেমধ্যে তিনি রেগে যেতেন। কিন্তু যেহেতু আমি তাকে বুঝতাম তাই চুপ করে থাকতাম, কিছু বলতাম না। পরে যখন বােঝা
পৃষ্ঠাঃ ৬৮৬

যেত উনি ঠান্ডা হয়েছেন তখন আমি আস্তে আস্তে বলতাম বিষয়টি। তিনি সব সময় আমার কথা শুনতেন।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন সাহেব শেষবার যখন বিশ্বব্যাংকের মিটিংয়ে যোগ দিতে ওয়াশিংটনে গেলেন, আমি তখন বিশ্বব্যাংকে কাজ করছি।
প্রায় এক বছর পর তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তার হােটেল রুমে আমার দেখা। অন্যান্য কথার মধ্যে হঠাৎ তিনি বললেন, যে ঢাকাতে আমি ছেড়ে এসেছি সেখানে আমার কিছু ভাল বন্ধু রেখে আসা উচিত ছিল । আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি একটু পরেই তার থেকে যা শুনলাম তা ছিল আমার কাছে অবিশ্বাস্য।
সেটা হলাে, একবার কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন উপলক্ষে লন্ডনে থাকাকালীন সময়ে জনতা ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়রুল কবির সাহেব আমাকে বললেন, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালীদের টাকা-পয়সা দেশে পাঠাবার ক্ষেত্রে সমস্যা এবং সম্ভাবনার উপর একটা পরীক্ষামূলক কাজ করতে জনতা ব্যাংককে অনুমতি দেবার জন্য। কারণ এই টাকা বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ভাল একটি উৎস হবে। একই সাথে তিনি এই কাজটি সম্পাদনের জন্য আইসিবি-এর প্রধান মমতাজ ইকবালের নাম প্রস্তাব করলেন। আমি জানতাম মমতাজ ইকবাল সেই সময় তার স্ত্রীর চিকিৎসার ব্যপারে লন্ডনে ছিলেন। এই প্রস্তাবের পক্ষে অর্থমন্ত্রীর সম্মতিসাপেক্ষে তাকে আমি আমার সম্মতি জানালাম।
কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন শেষে প্যানঅ্যাম-এর ফ্লাইটে ওয়াশিংটন যাবার জন্য আমরা যখন লন্ডন এয়ারপাের্টের পিকক লাউঞ্জে বসে আছি সেই সময় খায়রুল কবির সাহেব সেই রেমিটেন্সের বিষয়ে কাজটির জন্য ইকবালের নিয়ােগের একটি দরখাস্ত নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, অর্থমন্ত্রীর মৌখিক সম্মতি তিনি নিয়েছেন। এই কথা শুনে আমি সব সময়ের মতাে দরখাস্তটির মার্জিনের একপাশে লিখলাম : অর্থমন্ত্রীর সাথে আলােচনাসাপেক্ষে তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মমতাজ ইকবালের এই কাজের জন্য পাঁচ শ পাউন্ড মঞ্জুর করা হলাে। প্লেনে বসে আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি তার সম্মতি জানিয়েছিলেন।
ঘটনাটি এই পর্যন্তই। এরপর আমি বিশ্বব্যাংকের যােগ দেয়ার পর ঢাকায় দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রধান আমার সই করা ইকবালের দরখাস্তের সেই কাগজটি অর্থমন্ত্রীর কাছে নিয়ে এসে বলেছেন, ইকবাল আমার বন্ধু, তাঁকে সুবিধা দেয়ার উদ্দেশ্যে আমি এই দরখাস্তে মন্ত্রীর নামে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছি। এই নিয়ােগের
পৃষ্ঠাঃ ৬৮৭

বিষয়ে মন্ত্রীর সাথে আমার কোন আলােচনাও হয়নি এবং তিনি কোন সম্মতিও দেননি। তাই মন্ত্রীর অনুমতি পেলে তিনি আমার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। এইটুকু শুনে আমি হতভম্বের মতাে তাজউদ্দীন সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলাম, এরপর তিনি কী করলেন সেটা জানতে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তিনি দুনীতি দমন বিভাগের প্রধানকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছেন এবং বলেছেন, এই মুহূর্তে যদি এই বিষয়টি বন্ধ করে না দেয়া হয় তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলে ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে তাঁকে সাসপেন্ড করাবেন।
তাজউদ্দীন সাহেবের একটি ফোন কল যে দুর্নীতি দমন বিভাগের প্রধান চাকরির জীবনের অবসান ঘটাতে পারত এতে আমার কোন সন্দেহই ছিল না। কিন্তু তিনি হয়ত বুঝতে পারেননি তাজউদ্দীন সাহেবের মহানুবতার কাছে তিনি ঋণী হয়ে রইলেন।
তাজউদ্দীন সাহেব আমার মন্ত্রী ছিলেন, এ কারণে সেই রাতে এই ঘটনা শােনার পর বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। তাজউদ্দীন সাহেবের চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মানবিক গুণাবলী ছিল অতুলনীয়। তিনি সত্যিই ছিলেন একজন সুবৰ্ণ হৃদয়ের মানুষ। চিরদিন তাঁর জন্য আমার শ্রদ্ধা জমা থাকবে।
কফিলউদ্দিন মাহমুদ, অর্থ সচিব
এবার তিনি আমাকে বললেন, “শােনেন, এই ভদ্রলােক আমার কাছাকাছি থাকতেন। ২৫ মার্চ রাতে আমি তাে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম, কিন্তু বাড়িতে আমার স্ত্রী, ছােট মেয়ে আর কোলের বাচ্চাটা ছিল। সেই রাতে আমার স্ত্রী ভাড়াটিয়া সেজে আর্মির হাত থেকে বেঁচে যান। পরদিন ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেয়ার টপকে বাড়ি ছেড়ে বাচ্চা দুটো নিয়ে দুই দিন এদিক সেদিক পালিয়ে থেকে এক পর্যায়ে এই দ্রলােকের বাড়িতে যান। সেই সময় ভদ্রলােক বাড়ির বাইরে ছিলেন। তাঁর গিন্নি আমার স্ত্রীকে বাড়ির ভেতরে একটা কামরায় জায়গা দেন। কিন্তু বাসায় ফিরে আমার স্ত্রীর উপস্থিতির সংবাদ শুনে তিনি এই বিষয়টি মােটেও পছন্দ করলেন না। তিনি বিপদ টেনে আনা হয়েছে’ এমন মন্তব্য করতে লাগলেন। আমার স্ত্রী পাশের ঘর থেকে তাঁদের সমস্ত কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ভদ্রলােক আমার স্ত্রীর কাছে এসে বললেন যে, ‘আমার বাড়ি তাে আপনাদের বাড়ির পাশেই। খোজখবর করলে ওরা নিশ্চয় আমার বাড়িতেও আসবে এবং সেটা খুব নিরাপদ হবে না। আমি বরং আপনাকে পাশের একটা নিরাপদ জায়গায় রেখে আসি।’ এই কথা বলে তিনি আমার স্ত্রীকে বাইরে ডেকে নিলেন। তখন আমার স্ত্রীর কোলে দুধের ছেলে। রাস্তায় অল্প
পৃষ্ঠাঃ ৬৮৮

কিছুদূর গিয়ে ওই ভদ্রলোক বললেন, আপিন একটু দাড়ান ।। আমি বাসায় চাবি ফেলে এসেছি, চাবিটা নিয়ে এক মিনিটের মধ্যেই আসছি।’ ভদ্রলোক সেই যে বাড়িতে গেলেন এবং গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন, তারপর তিনি আর ফিরলেন না । আমার স্ত্রী ১০/১৫ মিনিট অপেক্ষা করলেন রাস্তার ওপর। তারপর বুঝলেন যে, ভদ্রলোক থাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন। আমার স্ত্রী নিরুপায় হয়ে মেয়েটা আর কোলের বাচ্চাকে নিয়ে কাছে কোন একটা ইটের পাজা ছিল, সে পাজর পেছনে লুকিয়ে রইলেন। বাইরে তখন কারফিউ । তারপর রাত যখন অনেক গভীর হলাে তখন ওখান থেকে চুপি চুপি আর একজন পরিচিত কারও বাড়িতে গেলেন, সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বন্ধুদের সহায়তায় অনেক পরে ভারতে চলে যান।’
তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আপনি যার কথা সুপারিশ করেছেন তিনি সেই ভদ্রলোক। একদিকে তাে আমার জানা আছে কী ধরনের চরিত্রের লােক তিনি আবার অন্যদিকে কাগজকলমে নথিপত্রে তার যে ইতিহাস আছে তা দেখে মনে হয় আপনার সুপারিশ ঠিকই আছে। এই নিয়ে আমি কদিন থেকে ভাবছি। তাে কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না। আমাকে বললেন, আপনি কি বলেন? আমি বললাম, ‘আপনি এই ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে যে রকম জড়িত সেখানে আমার পক্ষে কোন রকমের মন্তব্য করা সঙ্গত এবং সমীচীনবলে আমি মনে করি না। আপনি যেটা ভাল মনে করেন, সেই সিদ্ধান্ত আপনি নিন এবং আমার তরফ থেকে কোন রকমের আপত্তি থাকবে না। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, ‘আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার একান্তই আমার। সরকারী ব্যাপারে তার পেছনের চাকরির যে ইতিহাস আছে সেগুলাে বিচার-বিবেচনা করে যদি সে উপযুক্ত বিবেচিত হয় তাহলে সে পাবে, যদি উপযুক্ত না হয় তাহলে সে পাবে না। আমার ব্যক্তিগত ধারণা কী, সে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে কী করেছে না করেছে- এই জিনিসটা আমার এখানে আনা হয়ত ন্যায়সঙ্গত হবে না। এই কথা বলে তিনি আমার সেই প্রস্তাবের বদৌলতেই তার পদোন্নতির সুপারিশটা অনুমােদন করে দিলেন ।
এটা দেখে আমি বাস্তবিকই আশ্চর্য হলাম। যেখানে তার স্ত্রী, শিশুসন্তান অত্যন্ত বড় বিপদের মুখে পড়তে পারত এই ভদ্রলােকের কাজের জন্য এই কথাটাও তিনি তুলে গিয়ে তাঁর পদোন্নতিটা অনুমােদন করে দিলেন। এটা আমার কাছে অত্যন্ত আশ্চর্য বিষয় বলে মনে হলাে। আমার মনে হলাে, আমরা গল্পে- ইতিহাসে অত্যন্ত মহৎ এবং মহান লােকদের যে সমল্ক উদাহরণ পড়ি, এটা তারই একটা। ব্যক্তিগত সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, ধে, প্রতিশোধ- এগুলাের ঊর্ধ্বে উঠে নৈর্ব্যক্তিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার যে ক্ষমতা, এটা সেই ক্ষমতা। আমি সেই মুহূর্তে
পৃষ্ঠাঃ ৬৮৯

আমার নিজের মনে স্বীকার করে নিলাম যে, আমার নিজের ক্ষেত্রে যদি এটা হতাে, ঘৃণা, প্রতিহিংসা ইত্যাদির উর্ধ্বে উঠে এই রকম সিদ্ধান্ত আমি হয়তো নিতে পারতাম না। এই একটা জিনিস আমাকে চিরদিন অভিভূত করবে এবং আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে থাকবে।
আমি বহুদিন সরকারি চাকরি করেছি এবং উচ্চপদস্থ মানুষের সাথে কাজ করেছি, কিন্তু ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আমি কারও দেখেছি বলে এত দীর্ঘ কর্মজীবনে আমার মনে পড়ে না। এই কথাটি এখনও যখন মনে পড়ে, আমার দুই চোখ পানিতে ভরে ওঠে। এটি একটি বড় ঘটনা, কিন্তু ছােটখাটো ঘটনাতেও আমি তার এই মানসিকতাটা দেখিছি। সবকিছুর উর্ধ্বে, ঠিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে যা হওয়া দরকার ছিল, তাই তিনি করেছেন। এবং এটা তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও আনতে চেষ্টা করেছেন।
আমি আগেই বলেছি, আমি সরকারি কর্মচারী ছিলাম, এবং তিনি আমাকে রাজনীতিতে কখনই জড়াতে চাইতেন না। আর আমি নিজেও এই ব্যাপারে নিজেকে জড়াতে চাইতাম না। কিন্তু তবুও তার রাজনৈতিক জীবনের ছিটেফোঁটা আমি সবসময়ই পেতাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মাহমুদ সাহেব, আমি এটাই দেখাতে চাই যে, একজন সৎ রাজনৈতিক কর্মী কোন রকমের অন্যায় বা কোন রকমের দুর্নীতি বা কোন রকমের স্বজনপ্রীতি তােষণবাদ এইগুলো না করে শুধুমাত্র নিজের কাজ, নিজের চরিত্র এবং নিজের জনসংযােগের মাধ্যমে রাজনীতিতে সার্থক হতে পারে- আমি এই জিনিসটা দেখাতে চাই। আমার এই নির্বাচন বা রাজনীতির পদ দখল করতে টাকাপয়সা খরচ করার কোন প্রয়ােজন নেই। আর আমার সেই প্রবৃত্তিও নেই। আমি কোন রকমের কোন অসাধ আচরণ অবলম্বন করতে চাই না। আমি নিজের দেশের লােকের জন্য নিজের হয়ে খেটে, নিজের চারিত্রিক সততা দিয়ে, নিজের জনসংযােগ বলে নির্বাচিত হয়ে খেটে, নিজের চারিত্রিক সততা দিয়ে, নিজের জনসংযােগ বলে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারি কি না এটাই আমি দেখতে চাই এবং নিজের কাছে প্রমাণ করতে চাই।’
তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কাজ করে সরাসরিভাবে না হলেও তাঁর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে কিছু জানবার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। তাজউদ্দীন সাহেব মনেপ্রাণে চাইতেন দেশের সমস্ত মানুষের যেন উন্নতি হয়। অর্থনৈতিক ব্যাপারে তিনি মানুষের সমতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি চাইতেন, বাংলাদেশটা যেন সীমিত কিছু লােক, কয়েকটি পরিবার বা ক্ষুদ্র সীমিত স্বার্থের কুক্ষিগত না হয়। কারণ এই পথে যারা ধনী তারা নিতান্তই শােষণ করবে, এদের হাতে দরিদ্র ও শােষিতদের কোন ন্যায়সঙ্গত দাবি পূরণ হবে না।
পৃষ্ঠাঃ ৬৯০

পাকিস্তানের ২৪ বছরের অভিজ্ঞতার ফলেই হােক বা অন্য যে কারণেই হােক, এই ধারণাটি তার মনে দৃঢ় ভাবে ছিল । ছোট শিল্প বা মাঝারি শিল্প ব্যক্তির হাতে থাকবে এবং সেখানে তারা তাদের অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে। এতে বােধ হয় তার কোন আপত্তি ছিল না।
স্বাধীনতার পর বড় শিল্পগুলােকে রাষ্ট্রায়ত্তরা হয়েছিল। তিনি মনে করতেন রাষ্ট্রায়ত্ত করবার পর যে একটা সঠিক ব্যবস্থাপনা দরকার, শিক্ষিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও নিবিড় ভাবে কাজ করবার মতাে কর্মীবাহিনী দরকার, সেটা সেই সময় বাংলাদেশে ছিল না। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে যে সমস্যা এবং বিপত্তি দেখা দেয় সেগুলো তার সামনে সবসময় এসেছে এবং এই নিয়ে পরে তিনি বেশ চিন্তিতও ছিলেন। তবে তিনি মনে করতেন হয়ত এর একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে এবং ঘোষিত নীতি অনুযায়ী আমাদের অর্থনেতিক অগ্রগতি সম্ভবপর হবে।
তাজউদ্দীন সাহেব যেহেতু চাইতেন দেশের সম্পদ যেন মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে বন্দী না হয়ে যায়, সেই জন্যই তিনি চাইতেন সমাজের নিচের দিকের মানুষেরা স্বাবলম্বী এবং স্বাধীন হােক। মধ্যবিত্ত যারা তারা যেন সমাজের সমস্ত কিছুতে প্রাধান্য পায়। দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হােক। তাজউদ্দীন সাহেব ধারণা করতেন, আমরা হয়ত খুব বেশি ধনী হতে পারব না, কিন্তু আমরা যদি নিজেরা পরিশ্রমী হই, সৎভাবে জীবন যাপন করি এবং আমাদের আর্থিক দিকগুলাের যদি আমরাই ঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করি তাহলে খুব ধনী দেশ না হলেও মানসম্মানের সঙ্গে আমরা একটা দায়িত্ববান জাতি হিসেবে বেঁচে থাকতে পারব এবং সেদিকেই আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত। সত্যিকার অর্থেই তাজউদ্দীন সাহেব একজন দেশভক্ত মানুষ ছিলেন।
২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ আমি অফিসে কাজ করছি, তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে ইন্টারকমে ডেকে বললেন, ‘আমার রুমে আসেন। আমি গেলাম।’ এর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল । যখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, শেখ সাহেবের সঙ্গে তিনি আর থাকতে পারবেন না, এমন অবস্থায় একদিন বললেন যে, আমি আমার পদত্যাগপত্রটা দাখিলই করে দেই। কারণ আমি দেখছি বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার আর থাকা সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের দু’জনের মত এখন দ্বিমুখী, একটার সাথে আর একটার কোন সমন্বয় বা সামঞ্জস্যের কোন সম্ভাবনা আমি আপাতত দেখছি না।’ আমি তাকে বলেছিলাম, ‘দেখুন না, এমনও তাে হতে পারে যে, শেখ সাহেব আপনার যে মত আছে সেটা আবার চিন্তা করে দেখতে পারেন। আপনারা দু’জন এ দেশের স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের জন্য এত বছর ধরে এত আত্মত্যাগ করলেন, এত কাজ করলেন, এত স্বার্থত্যাগ করলেন, এখন দু’জন দু’দিকে
পৃষ্ঠাঃ ৬৯১

যাবেন, এটা দেশও তো ভালভাবে মানবে বলে মনে হয় না।’ সেই সময় তিনি তার পদত্যাগপত্রটি বােধ হয় দেননি।
সেদিন আমি যখন তার রুমে গেলাম তিনি আমাকে একটা চিঠি দিলেন, সেই চিঠিতে বােধ হয় এই রকমই কথা ছিল যে শেখ সাহেবের পক্ষে তাজউদ্দীন সাহেবকে আর মন্ত্রিসভায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি প্রথম একটু হাসলেন। হেসে বললেন, ‘এমন যে হবে আমার জানাই ছিল, বরং আপনি কিন্তু নিষেধ করছিলেন। আমি চুপ করে গেলাম, আর কি বলব। তার চোখে পানি এল। আমারও একই অবস্থা।
তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আমি বহুদিন কাজ করিনি, হয়ত দেড়-দু’বছর কাজ করেছি। কিন্তু এই সময়টুকুতেই আমরা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি এবং আমি মনে করি তাঁর সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ সেটা বােধ হয় একজন মন্ত্রী এবং একজন সচিবের যে প্রকৃত সম্বন্ধ হওয়া উচিত সে সম্বন্ধটাই ছিল। যখনই কোন ইস্যু আসত, তখনই আমি আমার যা বক্তব্য সচিব হিসেবে সেটা নির্ভয়ে অকপটে প্রকাশ করতে পারতাম। সেই মত তাজউদ্দীন সাহেবের পছন্দ হোক বা না হােক তিনি আমাকে সরাসরি নাকচ করে দিতেন না। তিনি আমাকে ডাকতেন, ডেকে তিনি যে ভিন্নমত পােষণ করেন তার সপক্ষে যত রকমের যুক্তি, যত রকমের আরগুমেন্ট, উদাহরণ, সব তিনি আমার সামনে তুলে ধরতেন। এবং আমিও আমার যা বক্তব্য তার সপক্ষে যত যুক্তি সব পেশ করতাম। এবং এর ফলে হয়ত আমি তার মত মেনে নিয়েছি অথবা তিনি আমার কথায় সায় দিয়েছেন। এবং সেটাই শেষ পর্যন্ত আমাদের মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত হিসেবে চালু হয়েছে ।
তাজউদ্দীন সাহেবের পদত্যাগের পর আমি মাঝে মাঝে তার কাছে যেতাম। তিনি দু-একবার বলতেন, এখন তাে সরকারী কর্মচারীদের মধ্য থেকে কেউ আসে না, আপনি কেন আসেন।’ আমি বলতাম যে, আমি তাে আপনার কাছে অর্থ সচিব হিসেবে আসিনি। আপনি তাজউদ্দীন, আমি কফিল উদ্দিন মাহমুদ। আমি সেই হিসেবে আসি। আপনাকে আমার ভাল লাগে, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, সেই জন্য আমি আসি। যদি আমি আপনার কাছে না আসি তবে আমি নিজের কাছে নিজে ছােট হয়ে যাব। যার কাছ থেকে আমি সবসময়ই সুবিবেচনা পেয়েছি তিনি যেহেতু আজকে ক্ষমতায় নেই তাই আমি তার সাথে গ্লানিকর বলে মনে করি। কিন্তু তার পরও তিনি আমাকে বলতেন, অনেকেই আমার কাছে আসতে ভয় পায়, আপনি এখানে না এলেই বােধ হয় ভাল। এখন যে দিনকাল পড়েছে, আপনি এলে শুধু অসুবিধা হবে, নানা বিপদ-বিপত্তিতে পড়বেন।
পৃষ্ঠাঃ ৬৯২

আমি বলতাম, সেটা আমার উপরই ছেড়ে দিন । যদি আমার কোন বিপদ হয় সেটা আমি বুঝব।’ এরপরেও আমি করেকবার গিয়েছি। কিন্তু দেখতাম আমাকে দেখলে তিনিই বেশ বিব্রতবোধ করেন। একদিন বললেন, ‘দেখেন না, আমার দুয়ারের সামনে লােকজন দাড়িয়ে আছে, কে আসে কে যায় তারা সমস্ত খোঁজ খবর রাখে, তাই আপনি কেন শুধু শুধুই ঝামেলায় পড়তে যাবেন?’ আমি তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে গেলে তিনি ব্রিত বােধ করবেন এই চিন্তায় আমি আস্তে আস্তে যাওয়াটা কমিয়ে দিলাম ।
আজ এত বছর হয়ে গেছে, এখনও তার স্মৃতি আমার মানে জাগরূক। এই সমাজে তাজউদ্দীন আহমদের মতাে অনন্য চরিত্র অতীতেও ছিল বলল, আর বর্তমানে তা আরও বেশি বিরল হয়ে গেছে। এখনও “আমি নামাজ পড়ে তার জন্য আল্লহর কাছে দোয়া করি : হে আল্লাহ, তুমি তাকে পরপারে শান্তি দিয়ে দিও, তার দোষত্রুটি যদি কিছু থাকে মাফ করে দিও।১২
পৃষ্ঠাঃ ৬৯৩

২৬
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও
তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে আমেরিকা, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে। ভারত-রাশিয়া প্রবল সমর্থন ও সহযোগিতার ফলে তাদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী জাতি জয়লাভ করে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ ১৩৬তম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশকে পাকিস্তান কোনদিন মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালের মুসলিম লীগ ও জামায়াত নেতা নাগরিকত্ব হারিয়ে পাকিস্তান, লন্ডন ও আরবে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
১৯৭৪ সালে আমেরিকা খাদ্যভর্তি জাহাজ বাংলাদেশে না পাঠিয়ে তা প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে দেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। বন্যার কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। চালের সের ১০ টাকায় বৃদ্ধি পায়। খাদ্যের অভাবে কয়েক হাজার লােক মৃত্যবরণ করে। সরকার ১৯৭৫ সালে খাদ্যাভাব কাটিয়ে ওঠে এবং চালের মূল্য স্বাভাবিক হয়ে আসে।
দেশের ভিতরে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য কয়েকটি তথাকথিত বিপ্লবী দলের সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সৃষ্টি বাংলাদেশের জন্য এক কলঙ্কময় অধ্যায়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। এ দলের দার্শনিক ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খান। তার সাথে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমেদ। মুজিবনগর সরকারের অজ্ঞাতে তারা মুজিব বাহিনী গঠন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে না এলে ক্ষমতা দখল এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। তারা বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। তাদের সাথে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরােধ ছিল। তাজউদ্দীন আহমেদ মুক্তিবাহিনীর অধীনে আর একটি বাহিনী চাননি। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলেও তারা সকলে অস্ত্র জমা দেয়নি।
পৃষ্ঠাঃ ৬৯৪

সিরাজুল আলম খান, ছাত্রনেতা আ স ম রব, শাজাহান সিরাজকে নিয়ে আলাদা রাজনৈতিক দল গঠন করেন । ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে মেজর এম এ জলিল কে সভাপতি ও আ স ম বুবকে সম্পাদক করে জাসদ সৃষ্টি করা হয়। ছাত্রলীগের সংগ্রামী নেতাকর্মী বিপথগামী হয়ে ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে জাসদ ছাত্রলীগ গঠন করে । তাদের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। সমাজতন্ত্রের মােহে ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হলে আওয়ামী লীগ দুর্বল হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমান ছাত্রলীগের ভাঙ্গন ঠেকাতে পারেননি । শেখ মনি, তোফায়েল আহমেদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের নায়ক তোফায়েল আহমেদকে রাজনৈতিক সচিব নিয়োগ করেন । অন্যদিকে শেখ ফজলুল হক মনি যুবলীগ গঠন করে সমাজতন্ত্র কায়েমের কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে তথ্য মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। কোন পূর্ণ মন্ত্রী না থাকায় তাহের উদ্দিন ঠাকুর তথ্য মন্ত্রণালয় এককভাবে পরিচালনা করতেন। কিছুদিন পর এম কোরবান আলীকে তথ্যমন্ত্রীর নিযুক্ত করা হলে তাহের উদ্দিন ঠাকুর অসন্তুষ্ট হয়ে ষড়যন্ত্র পথে অগ্রসর হন। যে গ্রামবাংলা ছিল বঙ্গবন্ধুর অতিপ্রিয়- দাপ্তরিক কাজ করতে গিয়ে তিনি জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। বিভিন্ন থানা ও গ্রামাঞ্চলে তার যাতায়াত সীমিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িক শক্তি, জাসদ, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা দল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অপপ্রচার চালাতে থাকে। জাসদ, চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, সিরাজ সিকদারের দল গ্রামবাংলায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি করে। তারা ব্যাংক ডাকাতি, পাটের গুদামে আগুন, পুলিশ ফাঁড়ি লুট করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু যখন দেশ গড়ার কাজে দিনরাত কাজ করছেন তখন তারা তার সরকারের বিরুদ্ধে অঘােষিত যুদ্ধ শুরু করে। উত্তরবাংলার আত্রাইকে তারা মুক্ত অঞ্চল ঘােষণা করে। আব্দুল হক, আব্দুল মতিন শ্রেণীশত্রু খতমে নেমে পড়ে। সরকার দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে রক্ষী বাহিনী গঠন করে। তাদের প্রশিক্ষণ ছিল স্বল্পমেয়াদী। তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। তাদের হাতে বিরােধী দলের নেতাকর্মী লাঞ্ছিত হয়েছে। অপপ্রচার করা হতাে যে, বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী বাদ দিয়ে রক্ষীবাহিনী দিয়ে দেশ চালাবে। রক্ষীবাহিনীর মধ্যে ভারতীয় সৈন্য আছে। রক্ষীবাহিনীকে বেশি সুযােগ দেয়া হয়। রক্ষীবাহিনী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি হয়।
একটি চক্র তাজউদ্দীন আহমেদ ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। আমেরিকা অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে পছন্দ করত না। আমরিকা
পৃষ্ঠাঃ ৬৯৫

বিশেষ করে আমেরিকার বিদেশ সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের হস্তক্ষেপের কারণে তাজউদ্দীন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। দুঃসময়ের কাণ্ডারী তাজউদ্দীনের বিদায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য অপূরনীয় ক্ষতি। আওয়ামী লীগের আর এক প্রভাবশালী নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে পদত্যাগ করতে হলাে। তাজউদ্দীন আহমদকে সরিয়েও আমেরিকার ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ সরকারের পতনের জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি Bottomless Basket আখ্যা দেন। বাংলাদেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মি. বােস্টার সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী সেনা অফিসার, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়। সাহসী সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ঢাকা আসেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের আভাস পান। তিনি ঢাকায় এক সাংবাদিকদের বাসায় খন্দকার মােশতাক আহমদ ও আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মি, বােস্টারকে আলােচনারত দেখেন। আমেরিকা অতি দূর থেকে ষড়যন্ত্র পরিচালনা করে। তেমনিভাবে সেনাবাহিনীর বিপথগামী মেজররা উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার সাথে যােগাযোগ রেখে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে ।
বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী এনে ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। তিনি দেশের আইনের অবনতি, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি দেখে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার রক্ষ্যে একটি দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-বাকশাল গঠন করেন। সকল রাজনৈতিক দল বাকশালকে স্বাগত জানায়। সর্বশ্রেণীর মানুষ বাকশালে যােগ দিতে থাকে। হাজী মােহাম্মদ দানেশ, আতাউর রহমান খান বাকশালে যােগ দেন। এমনকি ৫০০ সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে বাকশালে যােগদানের আবেদন করে। মওলানা ভাসানী ১৯৭২ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালােচনা করে এবং ভারতবিরােধী প্রচার চালিয়ে দেশে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে। তিনিও বাকশাল ঘােষণাকে স্বাগত জানান। দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রামে গ্রামে সমবায়ের ভিত্তিতে চাষ প্রবর্তন করা হবে- ভূমির মালিক এক ভাগ, শ্রমিক এক ভাগ এবং সরকার উপকরণ প্রদানের জন্য এক ভাগ পাবে। বঙ্গবন্ধুর তেভাগা কর্মসূচি জনগণের মধ্যে আলােড়ন সৃষ্টি করে। তিনি বাংলাদেশকে ৬০টি জেলায় বিভক্ত করেন। প্রত্যেক জেলায় একজন গভর্নর নিয়ােগ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাকশাল পদ্ধতি শুরু হবে। বাকশাল পদ্ধতি চালু হলে বঙ্গবন্ধুর হাত শক্তিশালী হতাে। ষড়যন্ত্রকারীরা দেখল যে, যদি বাকশাল পদ্ধতি চালু হয়
পৃষ্ঠাঃ ৬৯৬

তাহলে শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে না। তাই তারা অতি দ্রুত বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাকশাল ছিল সময়ােপযােগী কর্মসূচি। বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করলেন যে, সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে জনগণের মুক্তি আসবে না, কারণ শিক্ষিত সমাজ দুর্নীতিবাজ। যে নেতা আজীবন সংগ্রাম করেছেন গণতন্ত্রের জন্য তিনি কেন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করলেন। তিনি দেশের বিরাজমান অবস্থা দেখে হতাশ হয়ে বাকশাল করেছেন । সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে জাসদ, চৈনিকপন্থী কমিউনিস্ট দল, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা দল সমাজ ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে -আইনের শাসন ধ্বংস করছে, চুরি-ডাকাতি, নারী নির্যাতন চলছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করেছে। জাসদ ও সর্বহারা দল হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে জাসদের কর্মী নিহত হয়েছে। জাসদ এ দেশের হাজার হাজার ছাত্র-যুবককে বিপথগামী করে ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়ােগ করে। সাম্প্রদায়িক দল রাজাকার দালাল শ্রেণী জাসদকে শক্তিশালী করে। জাসদ যে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যার হত্যার পর তাদের সে স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। জাসদের অশুভ রাজনীতির ফলে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত করতে সাহসী হয়। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের জঙ্গী দলটি জাসদে যাওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ শক্তিহীন হয়ে পড়ে। জাসদ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘাতে লাভবান হলাে ষড়যন্ত্রকারীরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপথগামী ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে। সেনাবাহিনী ও উচ্চ পর্যায়ের অফিসাররা দর্শকের ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রপতি নিহত সেনাবাহিনী নীরব। তাদের ভূমিকা ছিল দেশপ্রেমহীন, সংবিধানের প্রতি অশ্রদ্ধা জাতির জনক অসহায় অবস্থায় নিহত হলেন। ইতিহাস এ বিশ্বাসঘাতকদের কোন দিন ক্ষমা করবে না। বঙ্গবন্ধু জাতির জনক থাকবেন। তাকে হত্যা করেও ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না।১
পনেরােই আগস্ট ১৯৭৫
দেশে চলমান পরিস্থিতি এবং দরিদ্র জনসাধারণের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তায় পরিবর্তন আনে। ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ শাসনতন্ত্রের চতুর্থ সংশােধনী অনুমােদন করে দেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি ও একদলীয় শাসন প্রবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু দেশ থেকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষতা, দুর্নীতি দূরীকরণ ও শােষনমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ১৭
পৃষ্ঠাঃ ৬৯৭

.

জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি এম. মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় তিনি দ্বিতীয় বিপ্লব ঘােষণা করলেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল- দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্নীতি দমন, জসংখ্যা। নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ সমবায় প্রতিষ্ঠা। এ লক্ষ্যে তিনি সকল প্রশাসনের সংস্কারের আশ্বাস দেন। সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করেন। প্রত্যেক জেলায় গভর্নর নিয়ােগ করা হয় এবং তারা জেলার প্রশাসনিক প্রধান। তার বৈপ্লবিক নেতৃত্বে দেশ উন্নতির পথে চলতে থাকে। খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। খাদ্যের মূল্য ১৯৭৪ সালের মূল্যের স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন। তিনি যখন প্রশাসনকে তৃণমূল পর্যায়ে এনে জনগণকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছেন তখন জাতির শত্রুরা দেশ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল।
স্বাধীনতার শত্রুরা ও কিছু ক্ষমতালিন্দু সামরিক কর্মকর্তা উপলদ্ধি করে যে, যদি বাকশাল কায়েম হয় তাহলে শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে না। তাদের বিশ্বাস ছিল নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তার দলকে পরাজিত করা যাবে না। খন্দকার মােশতাক আহমেদ এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমর্থনে ঘাতক দল গােপনে জাতির জনককে হত্যার ষড়যন্ত্র করে।
ছাত্রলীগ ও মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অংশ অতি দ্রুত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। তারা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করে। কর্নেল আবু তাহের, মেজর এম. এ. জলিল, আ. স. ম. আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) নেতা ছিলেন। জাসদ সৃষ্টি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে একটি ঐতিহাসিক ভুল। একদা তারা ছিল আওয়ামী লীগের শক্তি। সমাজতন্ত্রের নামে তারা ছাত্র, যুবক, শ্রমিক এবং সেনাবাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের আকৃষ্ট করে। মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরােধীরা মুক্তিযােদ্ধাদের বিভক্তির সুযােগ গ্রহণ করে। সিআইএ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সর্বপ্রকার সহায়তা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তুতি চলছে। উপাচার্য আব্দুল মতিন চৌধুরী তার প্রাক্তন ছাত্রকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য ব্যাপক আয়ােজন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালও অনুষ্ঠান আয়ােজনে সারা রাত সতীর্থদের সাথে ব্যস্ত ছিলেন। উপাচার্য আব্দুল মতিন চৌধুরী শেখ হাসিনাকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৬৯৮

বলেছিলেন। কিন্তু তিনি জার্মানি যাবেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। ২৯ জুলাই শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ২
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত কয়েকজন মেজর আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা খােন্দকার মোশতাক ও ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সাথে আলােচনা করেন। এ ব্যাপারে এন্থনি মাসকারেনহাস ও কর্নেল ফারুকের সাথে কথােপকথন নিম্নে উদ্ধৃত হল: ৩
Farook recalled: The First and obvious choice was General Zia because at least till then he was not tarnished. Till then he was the only one in whom I had a little bit of faith. A lot of Junior officers who were thinking of what should be done to stop the rot used to say: “Let’s find out from General Zia what we should do”. But nobody dared to approach him. Farook decided to have a try.
He had known the General, who was ten years his senior since the later had been his instructor in the Pakistan Military Academy. Zia was a popular figure in the Bangladesh army, with an impressive reputation. He had been commissioned in the 2nd Punjab in 1965 before transferring to the 1st East Bengal Regiment. Later he spent five years with military intelligence. Regiment to the Bengal Regiment in 1966. Zia did a three-month stint with the British Army on the Rhine. In 1971 he gained considerable fame as the man who announced the independence of Bangladesh over Chittagong Radio after the Pakistan army cracked down on the Bengalis. Later, his war-lime service as commander of “Z Force’ added to his reputation. After the liberation of Bangladesh, promotions came rapidly; Full colonel in February, 1972, Brigandier in mid-1973, Major General in October of the same year.
”At that time I had a stong respect and affection of General Zia’ Farook said, ‘I hoped to interest him in taking over the leadership of the country with the backing of the army.’
After much effort Farook managed to get an interview with
পৃষ্ঠাঃ ৬৯৯

General Zia on 20 March, 1975 was a Thursday na wen he reported to General zia;s bungalow at 7.30 pm he found Col. Moin, the Adjutant General, about to leave.
Farook said he broached the subject of his mission very cautiously. ‘I was meeting the Deputy Chief of Army Staff and a Major General. If I Bluntly told him that I wanted to overthrow the President of the country straightaway like that there was a very good chance that he would have errested me with his own guards, there and then, and put me in jail. I had to go about it in a round-about way.’
Farook continued : ‘Actually we came around to it by discussing the corruption and everything that was going wrong. I said the country required a change. Zia said “Yes, yes. Let’s go outside and talk” and then he took me on the lawn
As we walked on the lawn I told him that we were professional soldiers who served the country and not an individual. The army and the civil government, everydody, was going down the drain. We have to have a change. We the iunier officers, have already worked it out. We want your support and your leadership.’
According to Farook, General Zia’s answer was: ‘I am sorry I would not like to get involved in anything like this. If you want to do something you junior officers should do it yourself. Leave me out of it’.
Curiosly the Deputy Chief-of-Staff of the Bangladesh army, when informed about the impending muting, did not lift a little finger to protect the legally appointed President of the country. Though General Zia did not fall in with the Plot he also did not arrest Farook. Instead he quietly turned a blind eye to the plotting while taking steps to secure himself. According to Farook Zia instructed his ADC that the major Should on no account be allowed to see him again. In July, 1976, while doing a TV programme in London on the killing of Sheikh Mujib I confronted Zia with what Farook had daid. Zia did not deny it-nor did he confirm it, Instead he
পৃষ্ঠাঃ ৭০০

put off giving me an answer and when I persisted did his best to keep me out of the country for many years.”
ফারুক স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমাদের প্রথম এবং স্পষ্ট পছন্দের ছিলেন জেনারেল জিয়া, কারণ তখন পর্যন্ত তার কোন দুর্নাম ছিল না। তখন পর্যন্ত তার ওপর আমার কিছুটা আস্থা ছিল। এ অবস্থা প্রতিরােধ করার জন্য অনেক অফিসার চিন্তা করতেন। তারা বলতেন, আমাদের কি করা উচিত তা আমরা জিয়ার নিকট জিজ্ঞেস করি। কিন্তু তার নিকট যেতে সাহস পায়নি। আমি চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। “
অনেক চেষ্টার পর ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ আমি জেনারেল জিয়ার সাথে সাক্ষাতের অনুমতি লাভ করি। দিনটি ছিল মঙ্গলবার । তিনি রাত ৭-৩০ মিনিটে জিয়ার বাংলাতে উপস্থিত হন এবং এডজুট্যান্ট জেনারেল কর্নেল মঈনকে বিদায় নিতে দেখলেন।
ফারুক বলেন যে, তিনি অতি সন্তর্পণে তার আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন। “আমি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান এবং একজন জেনারেলের সাথে দেখা করছি। আমি যদি সরাসরি বলি যে, দেশের প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করতে চাই। এ রকম বললে তৎক্ষণাৎ তিনি তার রক্ষী দিয়ে আমাকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণের সম্ভাবনা ছিল। আমাকে এ ব্যাপারে ঘুরেফিরে কথা উত্থাপন করতে হয়েছিল।
ফারুক বলে বলেছেন, আমার প্রকৃতপক্ষে দেশের দুর্নীতি এবং সবকিছু যে খারাপের দিকে যাচ্ছে তা আলােচনা করে এ সিদ্ধান্তে এসেছিলাম। আমি বললাম দেশের একটা পরিবর্তন প্রয়ােজন। জিয়া উত্তরে বলেন, “হ্যা, হ্যা, চল আমরা বাইরে যাই এবং কথা বলি। পরে তিনি আমাকে মাঠে নিয়ে যান।”
জিয়া তার ফারুকের ১০ বছরের জ্যেষ্ঠ। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে তার শিক্ষক ছিলেন এবং তখন থেকে তিনি জিয়াকে চিনতেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে জিয়া খুব জনপ্রিয় ছিলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হওয়ার পূর্বে তিনি ১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় পাঞ্জাবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি মিলিটারির গােয়েন্দা বিভাগে ৫ বছর ছিলেন…।।
ফারুক বলেন, সে সময় জেনারেল জিয়ার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল। আমার আশা ছিল যে, সেনাবাহিনীর সহায়তায় দেশের নেতৃত্ব গ্রহণে তাকে আগ্রহী করতে পারব।
“আমরা হাঁটতে হাঁটতে তাকে বললাম যে, আমরা পেশাজীবী সৈনিক, আমরা দেশের সেবা করি, ব্যক্তিকে নয়। সেনাবাহিনী এবং বেসামরিক
পৃষ্ঠাঃ ৭০১

সরকারসহ সকলে নিমস্তারে চলে যাচ্ছে। আমাদের অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা জুনিয়র অফিসাররা ইতিমধ্যে একটি পন্থা বের করেছি। আমরা আপনার সমর্থন ও নেতৃত্ব চাচ্ছি।
ফারক বলছেন, জেনারেল জিয়ার উত্তর ছিল : “আমি দুঃখিত, আমি এ রকম কোনকিছুর সাথে জড়িত হতে চাই না। তােমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু করতে চাও, তােমরা নিজেরা কর। আমাকে বাদ দাও।”
আশ্চর্যের বিষয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফকে যখন অন্যান্য সেনা বিদ্রোহ বা ক্যু সম্পর্কে অবহিত করা হলাে, তিনি দেশের বৈধ নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে রক্ষার জন্য কোনকিছুই করলেন না। যদিও জেনারেল জিয়া ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হলেন না, কিন্তু তিনি ফারুককে গ্রেফতারও করলেন না। বরং তিনি ষড়যন্ত্রের প্রতি চোখ বুজে থাকলেন। অন্যদিকে, নিজেকে নিরাপদ রাখার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফারুকের ভাষ্য অনুসারে, জিয়া তার এডিসিকে আদেশ করলেন যে, কোন অবস্থায় যেন মেজরকে (ফারুক)। তার সাথে দেখা করার অনুমতি না দেয়।
১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে শেখ মুজিবের হত্যা নিয়ে টেলিভিশন প্রােগ্রাম করা উপলক্ষে ফারুক যা বলেছে সে কথা নিয়ে আমি জিয়ার সম্মুখীন হলাম। জিয়া তা অস্বীকার করল না, অথবা তা স্বীকারও করেননি। তার পরিবর্তে তিনি আমাকে কোন উত্তর দিলেন না। আমি যখন জিদ ধরলাম তখন তিনি অনেক বছর পর্যন্ত আমাকে দেশে (বাংলাদেশে) প্রবেশ করতে দেননি।
কর্মরত সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা ও তাদের অধীনস্থ সৈন্য ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়। ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে আজানের সময় মেজর ফারুক, মেজর খন্দকার আব্দুর রশীদ, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা, মেজর মুহিউদ্দিন ল্যান্সার ও আর্টিলারির একদল সৈন্য নিয়ে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে আক্রমণ করে। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনে না থেকে নিজস্ব ভবনে বাস করতেন। তিনি বঙ্গভবনে বাস করলে খুনিরা এত সহজে বাসায় প্রবেশ করতে পারত না। বাড়িতে অল্পসংখ্যক রক্ষী ছিল। তাদের সাথে প্রথমে গুলি বিনিময় হলে একজন পুলিশ অফিসার নিহত হয়। গােলাগুলির শব্দ শুনে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের সদস্যগণ ঘুম থেকে উঠে যান। বঙ্গবন্ধু প্রথমে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, সামরিক সচিব কর্নেল জামিলকে ঘটনা অবহিত করেন। কর্নেল জামিল বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে ছুটে যান। শেখ কামাল নিচতলায় নেমে আসেন। মেজর বজলুল হুদার গুলিতে তিনি লুটিয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ কামালের মৃত্যু
পৃষ্ঠাঃ ৭০২

সংবাদ পেয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে এসে মেজরদের ধমক দিলে তারা পিছিয়ে যায় । এই মুহূর্তে মেজর নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে স্টেনগান দিয়ে পরপর অনেকগুলাে গুলি করে। মেজর বজলুল হুদাও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। গুলি বুকের ভিতর দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। তিনি সিড়িতে লুটিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় মেজর আজিজ পাশা ও রিসালদার মােসলেম উদ্দিন উপরে উঠে যায় এবং বেগম মুজিব, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা, শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রােজী, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের শিশুপুত্র রাসেলকে ধরে ফেলে। ভয়ে রাসেল অনুরােধ জানায় যে, তাকে না মেয়ে যেন তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়। খুনিরা শিশু রাসেলকেও নির্মমভাবে হত্যা করে।
খুনিরা মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাসভবনে আক্রমণ করে। মেজর ডালিমের দল সকাল ৫.১৩ মিনিটে মিন্টো রোডস্থ সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুর নিকট ফোন করে বলেন তার বাড়ি দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। তখন শেখ মুজিবও তাকে জানান যে, দুষ্কৃতকারীরা তার বাসভবনও আক্রমণ করেছে। খুনিরা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের কক্ষে প্রবেশ করে। সকলকে ঘর থেকে বের করে লাইন করে বাইরে দাড় করায়। তার পর মেজর রাশেদ চৌধুরী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে গুলি করে। তার কোলে তখন ৫ বছরের নাতি সুকান্ত বাবু। সেরনিয়াবাত ও বাবু একই সাথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। খুনিরা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ১১ বছরের শিশুপুত্র আরিফ, ১০ বছরের কন্যা বেবী রব সেরনিয়াবাত এবং ভ্রাতুস্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাতকে হত্যা করে। খুনিরা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ২ কন্যা, স্ত্রী আমিনা এবং পুত্রবধূ সাহানাকে গুলি করে গুরুতর আহত করে। খুনিদের বাসভবনে প্রবেশ করতে দেখে মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ছাদে উঠে যান এবং আত্মগােপন করে থাকেন। খুনিরা বাসভবন ত্যাগ করার পরে হাসনাত আহতদের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করে পালিয়ে যান। খুনিরা চেয়েছিল হাসনাতকে হত্যা করতে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় বােন আমেনাকে বিয়ে করেন। তাদের জ্যেষ্ঠ কন্যা আরজুকে বিয়ে দিয়েছিলেন যুবলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনির সাথে। একই সময়ে খুনিরা ফজলুল হক মনির বাসভবন আক্রমণ করে। শেখ ফজলুল হক মনিকে লক্ষ্য করে রিসালদার মােসলেমউদ্দিন গুলি করে। এমনি সময় তার স্ত্রী মিসেস আরজুমনি (২৬) তার স্বামীকে রক্ষার জন্য তার সামনে দাঁড়ান। শেষ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী একই সাথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় আরজুমনি ৭ মাসের
পৃষ্ঠাঃ ৭০৩

গর্ভবতী ছিলেন। শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ বােন আছিয়া বেগমের জ্যেষ্ঠ পুত্র। শেখ মনি যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাকশালের সম্পাদক ছিলেন। শেখ মনি খালাত বােন আরজুকে বিয়ে করেন। দু’শিশুপুত্র রেখে পিতা- মাতা নিহত হন।
খুনীরা যখন জঘন্য হত্যাযজ্ঞে নিয়ােজিত তখন মেজর রশীদ বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের বাসবভনে যান এবং তাকে মিগ বিমান নিয়ে তৈরি থাকার জন্য বলেন। লিয়াকত সাহসের সাথে বলেন যে, বিমানবাহিনীর প্রধানের আদেশ ব্যতীত তিনি কোন কাজ করতে পারবেন না। শেখ মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার ষড়যন্ত্রে বিমান ও নৌবাহিনীর কেউ অংশগ্রহণ করেননি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে তারা ভেঙ্গে পড়েন। নবম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার ঢাকায়। নবম ডিভিশনের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল হত্যার ঘটনা শুনে মর্মাহত ও রাগান্বিত হন। তিনি জেনারেল শফিউল্লাহর সাথে কথা বলে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসভবনে গমন করেন এবং জিয়াকে দাড়ি কামাতে দেখেন। তাকে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সংবাদ দেন। তাদের মধ্যে যে আলােচনা হয়েছে তা এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের লেখা গ্রন্থ ‘বাংলাদেশ- লিগ্যাসি অব ব্লাড’ থেকে উদ্ধৃত হলাে-৪
“After Rashid left, Shafat Jamil received another telephone call from General Shafiullal, who was crying as he informaed him that Sheikh Mujib had been killed. The Army Chief appeared to have broken down completely and failed to give the Dhaka Brigade commander instructions to quell the mutiny. So quickly throwing on his uniform, Shafat Jamil walked over to General Zia’s house. He found him shaving. After recounting Rashid’s visit and the telephone calls from General Shafiullah, Shafat Jamil told Zia : The President has been killed, Sir. What are your orders.?”
Zia, he recalled, was quite calm, evidently aware of what had happened. Zia answered : if the President is no longer there, then the Vice President is there. Go to your headquarters and wait there.’
Zia clearly was not going to be pushed into any hasty action. Sheikh Mujib was dead. The situation was extremely fluid and unclear. So General Zia, like the other senior officers as Farook had suspected, decided to wait and see.”
পৃষ্ঠাঃ ৭০৪

রশিদ চলে যাবার পর শাফায়াত জামিল জেনারেল শফিউল্লাহর কাছ থেকে আর একটি ফোন পেলেন। তাকে শেখ মুজিবের হত্যার সংবাদ জানালেন, শফিউল্লাহ চিৎকার দিয়ে কাঁদছিলেন। সেনাপ্রধান সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লেন এবং বিদ্রোহ দমন করার জন্য ঢাকা ব্রিগেডকে নির্দেশ প্রদানে ব্যর্থ হলেন। সুতরাং ইউনিফর্ম পড়ে শাফায়াত জামিল হেঁটে জেনারেল জিয়ার বাসভবনে গেলেন। তিনি থাকে দাড়ি কামাতে দেখলেন। তার বাসগৃহে রশিদের আগমন এবং জেনারেল শফিউল্লাহর সাথে টেলিফোনে আলাপ পর্যালােচনা করে শাফায়াত জামিল জিয়াকে বললেন, স্যার, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছে। স্যার, আপনার নির্দেশ কি”?
জিয়া অত্যন্ত শান্ত ছিলেন। অবশ্য কি ঘটেছে সে সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। একথা বলেছেন শাফায়াত জামিল। জিয়া উত্তর দিলেন ‘যদি প্রেসিডেন্ট না থেকে থাকেন, ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন। হেডকোয়াটারে চলে যাও এবং অপেক্ষা করাে।”
এটা পরিষ্কার যে, জিয়া তাৎক্ষণিক কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না। শেখ মুজিব মৃত। পরিস্থিতি অত্যন্ত টলটলায়মান এবং অনিশ্চিত। ফারুক যেমন সন্দেহ করেছিলেন তেমনিভাবে অন্যান্য সিনিয়র অফিসারদের ন্যায় অপেক্ষা কর এবং দেখ’ নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাগণ সকলেই গভীর শােকে আচ্ছন্ন ছিলেন। তারা চিন্তা করতেন যে, বঙ্গবন্ধু এখন মৃত, বাধা দিলে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে এবং অনেক রক্তপাত হবে। মেজর ডালিম দ্রুত বেতার কেন্দ্রে চলে যায় এবং ঘােষণা করে স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে।
সকাল ৭.৩০ মিনিটে মেজর রশীদ খন্দকার মােশতাকের বাসভবনে গমন করে এবং তাকে নিয়ে রেডিও অফিসে যায়। সেনাবাহিনীর তিন প্রধানকেও রেডিও অফিসে উপস্থিত করা হয়। খন্দকার মােশতাক রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন এবং সকল ১১.১৫ মিনিটে রেডিওতে ভাষণ দেন। শাসনতন্ত্র ভঙ্গ করে খুনিরা তাকে রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করে। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। একমাত্র ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এইইচএম কামরুজ্জামান খুনিদের মন্ত্রিসভায় যােগদানে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করা হয়। জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনী প্রধান হতে পদচ্যুত করে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান নিয়ােগ করা হয়। বিমানবাহিনীর প্রধান এ আর খন্দকারকে পদচ্যুত করে তার স্থলে বিদেশে কর্মরত এম জি
পৃষ্ঠাঃ ৭০৫

তােয়াবকে বিমানবাহিনী প্রধান নিয়ােগ করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার ফলে যারা সরাসরি লাভবান হয়েছেন তাদের প্রত্যক্ষ সমর্থন ব্যতীত মেজরদের পক্ষে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ঘটানাে সম্ভব হতাে না।
দেশী বিদেশী ষড়যন্ত্রের ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একদল সেনা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, তার ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনির বাসভবন আক্রমণ করে। তারা নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ১৬ জনকে হত্যা করে ।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহতরা হলেন :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (৫৫)- রাষ্ট্রপতি
বেগম ফজিলাতুননেছা (৪৫)- স্ত্রী
শেখ নাসের (৪৭)- ভাই
শেখ কামাল (২৭)- পুত্র
শেখ জামাল (২১)- পুত্র
শেখ রাসেল (১০)- পুত্র
সুলতানা কামাল (২২)- কামালের স্ত্রী
রােজী জামাল (১৮)- জামালের স্ত্রী
আবদুর রব সেরনিয়াবাত (৫৪)- ভগ্নিপতি
শেখ ফজলুল হক মনি (৩৬)- ভাগ্নে
আরজু মনি (২৬)- শেখ মনির স্ত্রী
নুরুন্নেসা বেবী (১৩) সেরনিয়াবাতের কন্যা
আরিফ (১২)- সেরনিয়াবাতের পুত্র
সুকান্ত বাবু (৫) সেরনিয়াবাতের নাতি
শহীদ সেরনিয়াবাত (৩৫)- আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভ্রাতুস্পুত্র
আবদুল নঈম খান রিন্টু (২০)- আত্মীয়
কর্নেল জামিল উদ্দিন (৪২)
বঙ্গবন্ধুর লাশ ১৬ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করা হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতে বনানী কবরস্থানে গণকবর দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু পরিবারের হত্যাকারী
লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুকুর রহমান
লেঃ কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ
পৃষ্ঠাঃ ৭০৬

লেঃ কর্নেল শাহরিয়র রশীদ খান
মেজর বজলুল হুদা
লেঃ কর্নেল এ কে এম মহিউদ্দিন
লেঃ কর্নেল এস এইচ এস বি নূর চৌধুরী
লেঃ কর্নেল শরিফুল হক ডালিম
লেঃ কর্নেল এ এস রাশেদ চৌধুরী
লেঃ কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা
ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ
রিসালদার মােসলেম উদ্দিন
ক্যাপ্টেন অনারারী আবদুল ওহাব জোয়ারদার
মেজর আহমদ শরফুল হাসান
ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম
ক্যাপ্টেন অনারারী নাজমুল হােসেন আনসারী
দফাদার মারফত আলী
ক্যাপ্টেন এম মােস্তফা আহমেদ
রিসালদার সৈয়দ সারওয়ার হােসেন
এসিস্ট্যান্ট ল্যান্স দফাদার আবুল হাশেম মৃধা
ষড়যন্ত্রকারী
খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী এবং আরও কয়েকজন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার বিচার
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মােশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অধ্যাধেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার নিষিদ্ধ করে। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনী করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করেন। দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ১৯৯৭ সালে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করে। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর জেলা জজ কাজী গােলাম রসুল বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ঘােষণা করেন। বিচারে ১৫ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীরা হলাে :
১. লে. কর্নেল ফারুকুর রহমান
২. লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান
পৃষ্ঠাঃ ৭০৭

.

৩. লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি)
৪. লে. কর্নেল আবদুর রশীদ
৫. মেজর বজলুল হুদা
৬. লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম
৭. মেজর শরিফুল হােসেন ওরফে শরফুল হােসেন
৮, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী
৯. লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার)
১০. এসএইচএমবি নূর চৌধুরী
১১. লে. কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা
১২, ক্যাপ্টেন মােঃ কিসমত হাসেম
১৩, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার
১৪. ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ
১৫. রিসালদার মােসলেম উদ্দিন
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামীদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়নি। সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গােপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্যগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়েরা বেগম। তিনি ছাত্র জীবনে রাজনীতিতে যােগ দেন। তিনি ১৯৪২ সালে গােপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। তিনি মুসলিম ছাত্র লীগ ও মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে তিনি বিএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং একাধিকবার কারাবরণ করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বন্দী ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে গোপালগঞ্জ হতে এমএলএ নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ৬ দফা ঘােষণা করেন। ১৯৬৮ সালে তাকে আসামী করে আগরতলা মামলার বিচার শুরু হয়। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের ফলে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা দেন এবং তাকে পাকিস্তান সরকার গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তান জেলে আটক রাখে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী
পৃষ্ঠাঃ ৭০৮

করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অত্যুদয় হয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি সপরিবারে নিহত হন।
পৃষ্ঠাঃ ৭০৯

২৭
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাজউদ্দীন আহমদ নিহত
৩ নবেম্বর ১৯৭৫
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকালে গােলাগুলির শব্দ শুনে তাজউদ্দীন আহমদ কয়েক জায়গায় ফোন করে কোন সাড়া পেলেন না। তখন তিনি রেডিও খুলে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ জানতে পারেন। এ সময় তাজউদ্দীন আহমদের অবস্থা সম্পর্কে তার কন্যা রিমি লিখেছেন : আব্বু রেডিও অন করতেই মেজর ডালিমের কণ্ঠ শুনি। মুজিব কাকু নেই! বুকের ভেতর তছনছ করে যেন গুড়িয়ে দিল । এ সংবাদে কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাইকে বাকহীন করে দিল । বিষন্ন গলায় আব্বু বলে উঠলেন- মুজিব ভাই জেনেও গেলেন না কে তার বন্ধু ছিল আর কে শত্রু। মৃত্যুর আগে তিনি যদি সময় পেয়ে থাকেন ভাবনার তবে হয়ত তিনি ভেবেছেন তাজউদ্দীন তাকে হত্যা করাল। আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম তবে কারও ক্ষমতা ছিল না মুজিব ভাইয়ের শরীরে বিন্দুমাত্র ছোয়া দেয়। মুজিব ভাই বন্ধু চিনলেন না।
আব্বর মনের তীব্র কষ্টের উচ্চারণ শুনে মনে হলাে মুজিব কাকুর ঘাতক দেশের ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই বুঝেছিল মুজিব কাকু আব্বু এক সাথে থাকলে ওদের চক্রান্ত বাস্তবায়িত হবে না। তাই নানা উপায়ে তারা আব্বুকে মুজিব কাকুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আব্বু যদি সরকারের মন্ত্রী থাকতেন তবে নিশ্চয়ই তিনি বিভিন্ন যােগাযােগ রিপাের্টের মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রের খোঁজ পেয়ে যেতেন। কিন্তু সে সময়ে আব্দুর এ সুযােগ একেবারেই ছিল না। শুধু দূর থেকে অবলােকন করা ছাড়া।
আব্বুকে আমি চিন্তিত দেখেছি, উত্তষ্ঠিত দেখেছি। কিন্তু এমন বিষন্ন চেহরায় কোনদিনও দেখিনি।
মিসেস তাজউদ্দীন ও আত্মীয়স্বজনরা তাজউদ্দীন আহমদকে বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু গেলেন না। অবশ্য তিনি বলেছেন, জীবনে তিনি বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু গেলেন না। অবশ্য তিনি বলেছেন, জীবনে তিনি বাসা থেকে না গিয়ে ভুল করেছেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও বাসার সকলে জানতে পারলাে বঙ্গবন্ধুর বাসায় কেউ জীবিত নেই। কিছুক্ষণ পরে সেনাবাহিনী তাজউদ্দীন
পৃষ্ঠাঃ ৭১০

আহমদের বাসভবন ঘিরে ফেলে। ক্যাপ্টেন শহর বাসায় এসে তাজউদ্দীন আহমদের সাথে দেখা করে বলে, আপনারা কেউ বাইরে যেতে পারবেন না এবং বাইরে থেকে কেউ ভেতরে আসবে না। তার পর টেলিফোন লাইন কেটে দেয়, নিচ তলায় কন্ট্রোল রুম করে এবং ছাদে এন্টি এয়ার ক্রাফটগান বসায়। তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন, বলুন আমরা গৃহবন্দী।
খন্দকার মােশতাক আহমদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন এ সংবাদ রেডিওতে শুনে তাজউদ্দীন নিজে থেকে বলে উঠলাে, মুজিব ভাই জেনেও যেতে পারলেন না কে তার বন্ধু ছিল, আর কে তার শত্রু ছিল…।
১৫ আগস্ট গভীর রাতে মেজর ডালিম বাসায় প্রবেশ করে বলেন, আপনার নিরাপত্তার জন্যই এ ব্যবস্থা, সব ঠিকঠাক আছে তাে?
তাজউজ্জীন ধমক দিয়ে বলেন, ‘তুমি নিজ চোখে দেখতে এসেছ আমাকে সত্যি বন্দী করা গেছে কিনা। সত্যি আমি বন্দী হয়েছি কিনা।’ ডালিম মিসেস জোহরা তাজউদ্দীনের সাথে দেখা করলেন। ডালিমের আগমনের উদ্দেশ্য ছিল তাজউদ্দীনকে সচক্ষে দেখে যাওয়া।
১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট আর্মি জীপ বাসার সামনে এলাে। তারা তাদের সাথে তাজউদ্দীন আহমদকে যেতে বলেন। তাজউদ্দীন স্ত্রী, কন্যা, পুত্রের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। সিড়ি দিয়ে নামার সময় তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, কবে ছাড়বে। উত্তরে তাজউদ্দীন বললেন, Take it forever- ধরে নাও চিরজীবনের জন্য যাচ্ছি। তিনি হাসিমুখে জীপে উঠলেন। তাকে এবং অন্যান্য নেতাদের জেলে বন্দী করে রাখা হয়েছে। পরের দিন খবরের কাগজে বেরুল দুর্নীতির অভিযােগে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
দৈনিক ইত্তেফাক, ২৪ আগস্ট ১৯৭৫
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযােগে সাবেক
উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জন গ্রেফতার
“দুর্নীতি, সমাজবিরােধী তৎপরতা, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তি হস্তগত করার অভিযােগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব কোরবান আলী, আবদুস সামাদ আজাদ এবং কয়েকজন এমপিসহ মােট ২৬ জনকে গতকাল (শনিবার) গ্রেফতার করা হইয়াছে।”
এক মাস পরে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার ঢাকা জেলে দেখার অনুমতি
পৃষ্ঠাঃ ৭১১

পায়। স্ত্রী মেয়েদের সাথে দেখা হলে বলেন, তারা এতদিন আসেনি কেন? তারা বলেন, বাসায় আর্মি কি করে আসবে। তাজউদ্দীনকে মিথ্যা বলা হয়েছে। বাসায় আর্মি নেই। তখনই তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃপক্ষকে ফোন করে রাগারাগি করলেন- তারা কেন মিথ্যা বলেছে। পরদিন সশস্ত্র পাহারা উঠে যায়। প্রত্যেক সপ্তাহে একবার দেখা করা যেত। খন্দকার মােশতাক আহমদ আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিদের সভা আহবান করেছেন ১৬ অক্টোবর। তাজউদ্দীন আহমদ বলছিলেন, কোন এমপি যেন সভায় না যায়। রিমি সংসদ ভবনে যেয়ে তাজউদ্দীন আহমদের আহবান পৌঁছে দেন।
জোহরা তাজউদ্দীন তার স্বামীকে মুক্ত করার জন্য হাইকোর্টে রিট করার চেষ্টা করছেন। এমনি সময় অক্টোবরের মাঝামাঝি এক মেজরের নেতৃত্বে একটি আর্মির দল বাড়িতে আসে এবং ভবনের ছবি তুলতে থাকে। মেজর মিসেস জোহরা তাজউদ্দীনকে জিজ্ঞাসা শুরু করেন। মেজর বলেন, আপনার বড় ছেলে যে আমেরিকা পড়ে তাকে ডাকুন। মিসেস জোহরা সােহেলকে দেখিয়ে দেন। তারপর অফিসার বাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন।
জোহরা তাজউদ্দীন বলেন, তাদের ভবন ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়নি। ১৯৬১-৬২ সালে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। অফিসার ক্ষমা চেয়ে বিদায় নেন এবং বলেন এ ফাইল আগের সরকারের তৈরি।
চট্টগ্রামের ম্যানসেরু মিয়া মামলার সাথে তাজউদ্দীনকে জড়ানাের চেষ্টা ছিল এই ফাইলে। চট্টগ্রাম কাস্টম অফিসে গিয়ে তদন্ত করে দেখা হয়েছে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অফিসের অভিযােগ ভিত্তিহীন।
তাজউদ্দীন কন্যা রিমি বলেছেন :
এদিকে এক রাতে আমি স্বপ্নে দেখলাম মুজিব কাকু আমার বাসায় এসেছেন। মুজিব কাকু আমাকে বলছেন, রিমি তােমার আব্বু আর বেশি দিন বাঁচবে না, তাজউদ্দীন মারা যাবে।
স্বপ্ন দেখার পর জোহরা তাজউদ্দীন এবং রিমি জেলে তাজউদ্দীনের সাথে দেখা করতে যান।
তাজউদ্দীন এসেই বলেন, ‘আমাদের আর বাঁচিয়ে রাখা হবে না।’
আম্মাকে বললেন, লিলি, আমি আমার এই জীবনে কোনদিন সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করিনি। ১৫ আগস্ট বাসা থেকে বের না হওয়াটাই আমার জীবনের মারাত্মক ভুল ছিল।
জেলে একবার তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপ্নে দেখেছিলেন। তিনি বলছেন, তুমি চলে এসাে।
পৃষ্ঠাঃ ৭১২

১৯৭৫ সালের ১ নবেম্বর মিসেস জোহরার সাথে তাজউদ্দীনের শেষ দেখা । তিনি বলেন, আজ রাতে ডায়েরির শেষ পাতা লেখা হবে, সেই সাথে শেষ হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা। তিনি বলছিলেন, আর বােধহয় বাঁচব না।
জোহরা তাজউদ্দীন বিষন্ন মনে তাদের সাতমসজিদ রােডের বাসায় ফিরে আসেন। স্বামীর সাথে এই তার শেষ দেখা।
জেলহত্যা ৩ নবেম্বর ১৯৭৫
বাইরের প্রতিকূল পরিবেশ রাষ্ট্রপতির ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। টেলিফোন বাজছে। উচ্চস্বরে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। সংবাদ নিয়ে লোকজন আসছে এবং যাচ্ছে। রশীদ নিজে বাইরের সংবাদ নিচ্ছে এবং সৈন্যদের ওপর নজর দিচ্ছে। চারটার পরে তিনি টেপরেকর্ডের সাক্ষাতের আলােকে তিনি বলছেন, “টেলিফোনের মাঝে টেলিফোন বেজে উঠে। আমি টেলিফোন উঠালে একলােককে বলতে শুনি আমি ডিআইজি বলছি, আমি মহামান্য প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে চাই।”
রশিদ মােশতাককে টেলিফোন দিলেন। রশীদ বলছেন, “প্রেসিডেন্ট লােকটি কি বলছেন তা কিছুক্ষণ ধরে শুনছেন। পরে তিনি শান্তভাবে বলেন এবং আরও শুনলেন। পরে আমি তাকে কয়েকবার বলতে শুনি- ‘হ্যা, হ্যা, হ্যা। তিনি কি বলছেন তা আমি পরিষ্কারভাবে বুঝিনি, তবে এটা বুঝলাম তিনি সম্মতি (OK) দিচ্ছেন।
রশীদ অর্ধেক সত্য বলছেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, দু’মাস পূর্বে একটি বিকল্প পরিকল্পনা করেছিলেন। তা হলাে যদি মােশতাককে হত্যা করা হয় অথবা পাল্টা ক্যু হয় তাহলে জেলে আটক চার নেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ সরকারের পুনর্বহাল বন্ধ করতে হবে। এ পরিকল্পনা স্বাভাবিকভাবে বাস্তবায়িত হবে। তখন ৩ নভেম্বর সকালে বিকল্প মােশতাক সরকারের সংকটকালে এ বিকল্প পরিকল্পনা শুরু হলাে।
খালেদের পাল্টা ক্যু শুরু হলে পূর্বের পরিকল্পনা অনুসারে নায়েক রিসালদার মােসলেম উদ্দিনের নেতৃত্বে বিদ্রোহী টিমকে সােজা জেলখানায় পাঠান হলাে। তারা ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। সশস্ত্র লােক দেখে জেলার অস্বীকার করেন। তকাতর্কি শুরু হলে বিষয়টি মীমাংসার জন্য কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজিকে বাসা থেকে ডেকে আনা হয়। পরে কি তথ্য উদঘাটিত হয়েছিল তা খালেদ মােশাররফ এবং শাফায়াত জামিল কর্তৃক প্রেরিত ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হকের
পৃষ্ঠাঃ ৭১৩

১৯৭৫ সালের ৪ মে তাদের সাথে সাক্ষাতকার নেয়া থেকে জানা যায়। এ সকল রেকর্ডে দেখা যায় রশীদ এবং ফারুক মােসলেমউদ্দিন ও তার লোকদের পাঠিয়েছিলেন এবং তারা তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানকে তাদের নিকট হস্তান্তর করতে বলেন। এ কথা শুনে ডিআইজি (জেল) রাগান্বিত হন এবং তাদের প্রস্তাবে অস্বীকার করেন। কারণ এ ছিল কারা আইনের পরিপন্থী। মােসলেউদ্দিন রশীদের নিকট বঙ্গভবনে ফোন করতে চায়। টেলিফোন করলে রশীদ জেলের ডিআইজিকে মােসলেউদ্দিন যা চায় তা করার অনুমতি দিতে বলে। এ সকল নির্দেশ সত্ত্বেও ডিআইজি তা বাস্তবায়নে অস্বীকার করেন। সিনিয়রদের সাথে আলােচনা করে বঙ্গভবনে টেলিফোন করে প্রেসিডেন্ট মােশতাকের সাথে কথা বলতে যান। মােশতাক রশীদের নির্দেশ পরীক্ষা করে তদনুসারে মােসলেউদ্দিনকে জেলে এবং সেলে প্রবেশ করতে অনুমতি দেয়া হয়।
তাজউদ্দীন এবং নজরুল ইসলাম এক সেলে এবং মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামান পাশের সেলে ছিলেন। তাদের সকলকে তাজউদ্দীনের সেলে আনা হয় এবং অত্যন্ত কাছ থেকে অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। তিনজনের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়। তাজউদ্দীনের পেটে ও পায়ে গুলি লাগে। সম্ভবত আস্তে আস্তের রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছিল। পাশের সেলের ভীত বন্দীরা পরে তার পরিবারকে বলেছিল যে, তার কাতরানি তারা শুনেছে এবং তিনি পানি পানি করছিলেন। মােসলেউদ্দিন এবং তার দল যাবার পূর্বে সেলে তালা দিয়আএরশিযায়।
এ সকল অসহায় মানুষের বর্বর হত্যাকাণ্ডের সাথে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যা সমতুল্য জঘন্য ঘটনা। তবুও প্রত্যেক বছর বাংলাদেশের শহীদদের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। কিন্তু জেলের চার নেতা জাতির নিকট বিভ্রান্তিকর অবস্থায় আছে। তাদের স্মরণ করা হয় না। একমাত্র ব্যক্তিগতভাবে নির্দিষ্ট কিছু লােক ব্যতীত।
জেলহত্যা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তি আছে- কে করেছে? কি কার? এবং কেন? জনশ্রুতি আছে যে, তাদের বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ সত্য নয় । দাপ্তরিক রেকর্ডে দেখা যায়, অতি কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। শহীদ পরিবার তা পরীক্ষা করেছে। কিছু লেখক বলে থাকেন যে, জেলে বসে তাজউদ্দীন এবং তার সাথীরা খালেদ মােশাররফ ও দলের সাথে ৩ নভেম্বর ক্যুর পরিকল্পনা করেছিলেন। জেলের অবস্থা ও বাইরে বিরূপ পরিবেশ প্রমাণ করে যে, তাদের কুর সাথে পরিকল্পনা করা অসম্ভব। তা ছাড়া লেখকরা দু’মাস পূর্বে মােশতাক, রশীদ এবং ফারুকের জেলে চার নেতা হত্যার বিকল্প পরিকল্পনা
পৃষ্ঠাঃ ৭১৪

সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না।
The Unifinished Revolation গ্রন্থে লিফসুজ উল্লেখ করেছেন যে, ভারতীয় হাইকমিশনারকে তাজউদ্দীনের ক্যু সম্পর্কে লেখা পত্র ঢাকার রয়টারের সাংবাদিক আতিকুল আলমের নিকট ছিল। আলম সরাসরি অস্বীকার করেন যে, তার নিকট কোন পত্র নেই এবং এ কথা কেউ শােনেনি । আমি মনে করি আতিকুল আলম লিফসুজ ও অন্যদের সাথে ভিন্ন কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বস্ত লোক নন। তাকে ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পাকবাহিনীর দালাল অভিযোগে জেলে দিয়েছিল। মাত্র ৬ মাস পূর্বে তিনি মুক্তি লাভ করেন । তিনি তার পক্ষে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য সিনিয়র কর্মকর্তাদের তালিকা দিয়েছিলেন । তারা সকল বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। বিখ্যাত চিন্তাবিদ জিল্লুর রহমান খান তার লেখা Leadership Crisis in Bangladesh গ্রন্থে একটি বিবরণ দিয়েছেন । সবচেয়ে ক্ষতিকারক প্রচার ছিল যে, খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে যে ক্যু হয়েছিল তা ছিল মুজিবপন্থী। জেলে আটক মুজিবের চার ঘনিষ্ঠ সহচর ক্যু সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং তারা নায়ক হিসেবে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।” এ হলাে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি। জেলের এবং সরকারী নথি, নিরপেক্ষ সাক্ষী খালেদের ভুক্ত দল এবং তাজউদ্দীনের পরিবার ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন।৩
তাজউদ্দীন ১৯৭৫ সালের ২২ আগস্ট গ্রেফতার হন এবং তারপর কয়েক সপ্তাহ ধরে তার পরিবার গৃহবন্দী ছিলেন। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত তাকে কোন দর্শনার্থীর সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। ৫ জন জেল কর্মকর্তা ও কয়েক জন ইনটেলিজেন্সের লােকের সামনে তার স্ত্রীকে আধা ঘণ্টার জন্য দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়। নিহত হবার ৩৬ ঘণ্টা পূর্বে ১ নভেম্বর মিসেস তাজউদ্দীনকে দ্বিতীয়বার বা শেষবার ২০ মিনিটের জন্য দেখা করতে দেয়া হয়। দর্শনের সময় সিভিল ড্রেসে মিলিটারিসহ ৪ জন কর্মকর্তার উপস্থিতিতে দর্শন দেয়া হয়। তিনি বলেন, তাজউদ্দীনকে খুব বিষন্ন দেখেছেন। তিনি ডায়েরি লিখতেন এবং সেদিন শেষ ৫৬০ পৃষ্ঠা সমাপ্ত করেছেন। মিসেস তাজউদ্দীন তার স্বামীকে বলেন, তিনি মৃত্যু-স্বপ্ন দেখেছেন।
শেষ সাক্ষাতে তিনি তাকে (স্ত্রীকে) বলেছেন, “অবস্থা খুবই খারাপ এবং আমার মনে হয় আমাদের জীবিত এ স্থান থেকে যেতে দেয়া হবে না।”
এই দুটি সাক্ষাত ব্যতীত বাইরের জগতের সাথে তাজউদ্দীনের কোন যােগাযােগ ছিল না।
তাকে যে কর্মকর্তা সর্বশেষ দেখেছেন তিনিও একমত পােষণ করে বলেন, তাকে খুব বিষন্ন দেখা গিয়েছিল এবং নিশ্চয়ই জেল থেকে নায়ক হিসেবে বেরিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৭১৫ ।

আসার আশা করছেন না।
একটি সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্ঘাটিত হতাে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের ৩ জন বিচারক নিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। জেনারেল জিয়ার সাড়ে পাঁচ বছরের শাসন আমলে কমিশনকে কাজ করতে দেয়া হয়নি। এর কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। কমিশন নীরবে শুকিয়ে গেল । এ বিয়ােগান্ত ঘটনা জিয়ার স্মৃতিকে লজ্জিত করবে।… এবং বাংলাদেশ রক্তের ঋণে চলতে থাকবে।
জেলহত্যা সম্পর্কে বিখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনী মাসকারেনহাস তার লেখা Bangladesh- A Legacy of Blood গ্রন্থে লিখেছেন:৪
“প্রায় সকাল ১০টা (৩ নভেম্বর) বঙ্গভবনে একটি টেলিফোন আসে যা মেজরদের এবং মােশতাককে খালেদ মােশাররফ ও শাফায়াত জামিলের সৈন্যদের সাথে সমঝােতা গ্রহণের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছিল। সে সময় বঙ্গভবনে অবস্থানরত প্রতিরক্ষা স্টাফ প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান আমাকে ঘটনার বর্ণনা দেন।
জেনারেল খলিল বলেন, ‘আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু পুলিশের মহাপরিদর্শক নুরুল ইসলাম আমাকে ফোন করে রাতে জেলে তাজউদ্দীন এবং অন্যদের হত্যাকাণ্ডের সংবাদ দেয়। এ সংবাদে আমি ভীত হয়ে পড়ি। তখনই রাষ্ট্রপতির সচিব চাষী (মাহবুবুল আলম চাষী) নিকট যাই এবং তাকে ঘটনা বলি- যাতে তিনি মােশতাককে সংবাদ দেন। চাষী তখনই প্রেসিডেন্টের কক্ষে যায়। তিনি এক মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে ভীত কণ্ঠে বলেন, তিনি জানেন।
জেনারেল খলিল বলেন, তিনি উপলব্ধি করেছেন যে, মােশতাক জেলহত্যায় জড়িত। এ ঘটনা তাকে আঘাত করেছে। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তিনি তাকে এবং মেজরদের রক্ষার জন্য কিছু করবেন না। অজানা কারণের জন্য জেনারেল সেদিনের জেলহত্যা সম্পর্কে অন্যকে কিছু বলেননি। এ কারণে ৩৬ ঘণ্টার পর ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেন। কারণ তার নীরবতা মেজরদের পলায়নের সুযােগ করে দেয়।
মােশতাক এবং রশিদ যে সেদিন সকালে মােশতাকের কক্ষে ছিলেন তারাও জেনারেল খলিলের নীরব থাকার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কিছু জানেন না। তারা যা জানত তা হলাে এ লােমহর্ষক ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এ সংবাদ শহরে প্রচারিত হলে তারা উত্তেজিত জনতার সম্মুখীন হবে। তারপর তাদের সিদ্ধান্তের উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন হতে থাকে। তারা এখন যুদ্ধ চায় না। তারা জনতার রুদ্ররােষ থেকে পরিত্রাণ চায় ।
পৃষ্ঠাঃ ৭১৬

তখন পর্যন্ত রশীদ শক্ত ছিলেন এবং তার চারপাশের লােকদের বলতেন তিনি মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাবেন। এখন তিনি বলছেন তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেছেন এবং তারা গৃহয়দ্ধে লিপ্ত হবেন না। তারা প্রস্তাব করে যে, দুজন মেজরকে তাদের পরিবারসহ দেশত্যাগ করার অনুমতি দিতে হবে। একদল যারা ফারুকের সাথে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ট্যাঙ্কের সাথে আছে তারা দেশত্যাগ করবে না। ফারুক যুদ্ধ করবে। কিন্তু বঙ্গভবন থেকে রশিদের নির্দেশ কখনও আসেনি।
মেজরদের দেশত্যাগের মােশতাকের প্রস্তাব খালিদ মােশাররফ এবং শাফায়াত জামিল গ্রহণ করেন। মেজরদের দেশত্যাগ ও অন্যন্য যারা যেতে চায় তাদের যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতার দায়িত্ব এয়ার ভাইস মার্শাল তােয়াব এবং বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এক পর্যায়ে মােশতাক নিজে মেজরদের সাথে দেশত্যাগ করার জন্য জিদ ধরেন। কিন্তু খালেদ মােশাররফ এ কথা শুনতে রাজি নয়। পরিশেষে শেখ মুজিবের হত্যার সাথে জড়িত ডালিম, নূর, হুদা, পাশা এবং শাহরিয়ার সহ দলের ১৭ জন ফারুক এবং রশীদের সাথে দেশ ত্যাগ করে।
বিদায়কালে বঙ্গভবনে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ল্যান্সার এবং আর্টিলারির কয়েকজন প্রকাশ্যে কান্না করে, তারা চিৎকার করে বলছে আমাদের ছেড়ে যাবেন না, তাহলে ওরা আমাদের হত্যা করবে। ফারুক তাদের আশ্বাস দেন যে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নেয়া হবে না। কিন্তু ভয় থেকে যায়। চারদিন পরের সিপাহী বিদ্রোহের এ ছিল প্রধান কারণ।
“হঠাৎ দরজায় চীৎকারে তাদের আলােচনা বাধাগ্রস্ত হলাে। কর্নেল শাফায়াত জামিল হাতে লাঠি ও স্টেনগানসহ ৫ জন অফিসার নিয়ে কেবিনেট কক্ষে প্রবেশ করেন। এর ফলে তুমুল হট্টগােল সৃষ্টি হলাে। মন্ত্রীরা তাদের চেয়ার ছেড়ে পালাতে ছিল। এক পর্যায়ে মােশতাক মেঝেতে শুয়ে পড়ে। তার মাথায় এক যুবক মেজর স্টেনগান ধরে আছে। জেনারেল ওসমানী রক্ষা করতে যায় এবং অফিসারদের বলেন, খােদার ওয়াস্তে কিছু করাে না, এ হলাে পাগলামি। তােমরা দেশকে ধ্বংস করবে।
শাফায়াত জামিল খন্দকার মােশতাকের পদত্যাগ দাবি করেন। প্রেসিডেন্টকে লক্ষ্য করে বলেন, “তুমি খুনী। তুমি জাতির পিতাকে হত্যা করেছ – তুমি জেলে চার নেতাকে হত্যা করেছে। তুমি অবৈধ দখলকারী। তােমার সরকার অবৈধ । ক্ষমতায় থাকার তােমার কোন অধিকার নেই। এখনই পদত্যাগ করুন। জেনারেল খলিলের দিকে তাকিয়ে ঢাকা ব্রিগেডের অধিনায়ক তাকে জেলহত্যা গােপন রাখার জন্য তাকে বলেন, আপনি বন্দী।
পৃষ্ঠাঃ ৭১৭

১৯৭৫ সালের ২ নবেম্বর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের
বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বেআইনীভঅবে নিযুক্ত খন্দকার মোশতাক আহমদ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের নিরাপত্তা প্রদান করে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ গেজেটে ইনডেনমিটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। তিনি খুনীদের মেজর থেকে লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত, খুনীদের সূর্যসন্তান আখ্যায়িত করার ফলে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। সেনাবাহিনীর চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার জন্য ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফসহ সেনা কর্মকর্তারা চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অনুরােধ জানান। জিয়া কৌশলে তাদের প্রস্তাবে রাজি হননি। তার সাথে ছিল খুনীদের গােপন আঁতাত।
১৯৭৫ সালের ২ নবেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল নূরুজ্জামান, কর্নেল আবদুল গাফফার, মেজর ইকবাল, মেজর সানির, মেজর হাফিজ, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত প্রমুখ ১৯৭৫ সালের ২ নবেম্বর ক্যু করেন।
খন্দকার মােশতাক আহমদের নির্দেশে খুনীরা ৩ নবেম্বর রাতে কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সংবাদ পেয়ে খালেদ মােশাররফ খন্দকার মােশতাক আহমদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। তার স্থলে বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। খুনীরা বিশেষ বিমানে ব্যাঙ্কক পালিয়ে যায় । ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে মেজর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। জিয়াউর রহমান পদত্যাগ করে গৃহবন্দী থাকেন। খালেদ মােশাররফ ছিলেন মানবদরদী। তিনি রক্তপাত চাননি। বঙ্গভবনে আলােচনা চলছে। এ সুযােগে জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের ও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ৭ নবেম্বর তথাকথিত সিপাহী বিপ্লব শুরু হলাে। উচ্ছল সেনাদের নির্দেশিত হয়ে মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ, কর্নেল এটিএম হায়দার, কর্নেল কে এন হুদাকে শেরে বাংলানগরে নির্মমভাবে হত্যা করে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে বিচারের নামে জাসদ ও গণবাহিনীর নেতা কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে । সকল ষড়যন্ত্রের নায়ক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন। কর্নেল মতিউর রহমান তার হত্যাকারী। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যার নেপথ্য নায়ক। তাই তিনি ব্রত নিয়ে জিয়াকে গুলি করে হত্যা করেন।৫
পৃষ্ঠাঃ ৭১৮

কিভাবে জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হলো
আইজি প্রিজন ও ডিআইজি প্রিজন কে এ আউয়ালকে রাত তিনটায় বঙ্গভবনের নির্দেশে জেলে আসতে হয়। বঙ্গভবনের নির্দেশে তরাে রিসালদার মােসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ, এলাভ আকুল হাশেম মৃধাকে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশীদের নির্দেশে জেলে প্রবেশ করাতে দেন। তারা ৩ নবেম্বর ভোর ৪টায় জেলগেটে স্বাক্ষর করে প্রবেশ করে। তারা এসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামানকে একটি কক্ষে জড় করার কথা জানিয়ে বলে তারা তাদের গুলি করবে। ভীত সন্ত্রস্ত আইজি, ডিআইজি রাষ্ট্রপতি খন্দকার মােশতাক আহমদের সাথে কথা বলতে চান। মেজর রশিদ তাকে ফোনে খন্দকার মোশতার সাথে থা বলিয়ে দেয়। তার পর আইজি প্রিজনের প্রতিবাদ জানাতে দেয়া হয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ তাড়াতাড়ি ওজু করে নামাজ পড়ে নেন। অন্য ৩ নেতা নামাজ পড়েন। ৪ জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে গুলি করা হয়। শােনা যায়, তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম গুলিতে মরেননি, পরে তাকে পুনরায় গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। খুনীরা ৪টা ৪৫ মিনিটে জেলগেট ত্যাগ করে। তারপর ৫টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে জেলে এসে নেতাদের মৃত্যু হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করে চলে যায়।
৪ নবেম্বর রাতে তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ পুলিশ প্রহরায় তাদের বাসায় পৌছে দেয়া হয়। ৫ নবেম্বর ভােরে এম মনসুর আলী ও কামারুজ্জামানের লাশ তাদের আত্মীয়রা পুলিশ পাহারায় নিয়ে যায় । কামারুজ্জামানের লাশ হেলিকপ্টারে রাজশাহী নিয়ে কবর দেয়া হয়। অপর তিন জাতীয় নেতার লাশ বনানী গােরস্তানে সমাহিত করা হয়।
তাজউদ্দীনের কন্যা রিমির স্মৃতিচারণ
এদিকে একরাতে আমি স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম মুজিব কাকু আমাদের বাসায় এসেছেন।
মুজিব কাকু আমাকে বলছেন : রিমি তােমার আব্বু আর বেশিদিন বাঁচবে না, তাজউদ্দীন মারা যাবে।
আমি বললাম : মুজিব কাকু, আব্বু কেন মারা যাবে?
মুজিব কাকু বললেন : দুটো কারণে তােমার আব্বু মারা যাবে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম : সেই কারণ দুটো কি?
মুজিব কাকু বললেন : তুমি বড় হও। নিশ্চয়ই তুমি বুঝবে কি কারণ।
মুজিব কাকু চলে গেলেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭১৯

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে আম্মাকে স্বপ্নের কথা বললাম। আম্মাও আব্বুকে নিয়ে নানারকম ভয়ের স্বপ্ন দেখছিলেন। এই স্বপ্ন দেখার পররই আব্বুর সাথে দেখা করতে গেলাম। আব্বুর জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
আব্বু ভেতরে ঢুকেই বললেন : আমাদেরকে আর বাঁচিয়ে রাখবেন না।
১৬ তারিখের সেই সভার কথা উল্লেখ করে বললেন : আমরা আর বেশিদিন বাঁচব না।
আম্মাকে বললেন : লিলি, আমি আমার এই জীবনে কোনােদিন সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করিনি। ১৫ আগস্ট বাসা থেকে বের না হওয়াটাই আমার জীবনের মারাত্মক ভুল ছিল।
এক নব্য নেতার স্বনির্ভর আন্দোলনের নামে খন্দকার মােশতাককে সংবর্ধনা দেয়ার প্রসঙ্গ তুলে আব্বু আক্ষেপ করে বললেন : এদেরকে কোথা থেকে এনেছিলাম আর জাতির এই দুর্দিনে এরা করলটা কি!
বিভিন্ন কথার ফাঁকে এক সময় বললেন : আমি মুজিব ভাইকে স্বপ্নে দেখেছি। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, তাজউদ্দীন, সেই ১৯৪৪ সাল থেকে তোমার সাথে পরিচয়। তারপর তেকে আমরা দু’জন এক সাথে ছিলাম। এখন তােমাকে ছাড়া আমার আর ভালাে লাগে না। তুমি চলে এসাে।
আব্বুর সাথে এটাই আমার শেষ দেখা ছিল। একটা মৃত্যু যে খুব কাছাকাছি। তা কেমন যেন বুঝতে পারছিলাম। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এবং নবেম্বরের ১ তারিখে আইনজীবীদের সাথে নিয়ে আম্মা একাই আব্বুর সাথে দেখা করতে গিয়েছেন। হাইকোর্টে আব্লু রিট পিটিশন ৫ তারিখে উঠবার কথা। নভেম্বরের ১ তারিখ শনিবার আম্মা আব্বুর জন্য সাথে খাবারও নিয়ে গেলেন।
সন্ধ্যায় আম্মা বাসায় ফিরলেন। আম্মার মুখ তখন অস্বাভাবিক করুণ। আম্মা বারবার বলছিলেন, কিছু ভালাে লাগছে না। বাসার ফেরার আগে উদভ্রান্তের মতাে আম্মা ঢাকা-টঙ্গী রাস্তায় ঘুরেছেন অনেকক্ষণ।
আমাদের বললেন : তােমাদের আব্বুকে আজ অন্যরকম লাগছিল। বার বার সে কালাে বর্ডার দেয়া লাল ডায়েরির কথা বলছিল । বলছিল, আজ রাতে ডায়েরির শেষ পাতা লেখা হবে, সেই সাথে শেষ হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা। বলছিল- ‘আর বােধহয় বাঁচব না।’
আম্মা বললেন ; আজ জেল কর্তপক্ষ খুব রুক্ষ ব্যবহার করেছে। জেলের মূল গেটের ভেতরে-বাইরে মনে হচ্ছিল যেন সাদা পােশাকে বিশেষ কোনাে সংস্থার অতিরিক্ত লােকজন।
পৃষ্ঠাঃ ৭২০

আব্বুর সাথে আম্মাকে কথা বলতে সময় দিয়েছে মাত্র ১৫/২০ মিনিট ।
২ তারিখ রোববার রাতে আমি আম্মার ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। আম্মা মাটিতে বিছানা করে শুয়েছেন। আমি সােহেলকে নিয়ে খাটে। সমস্ত রাত একটুও ঘুম এলো না। আম্মাও জেগে ছিলেন। একটু পর পর জিজ্ঞাসা করছিলেন আমি ঘুমিয়েছি কি না। আব্বু খাটের পাশে কাঠের একটা হ্যান্সার মতাে ছিল। সেখানে আব্বুর শার্ট, বেল্ট ঝোলানো থাকতো। আব্বুকে বাসা থেকে নিয়ে যাবার দিন থেকে সেখানে নীলের উপর সাদা চেক চেক একটা হাফ শার্ট ঝোলানো ছিল। আম্মুর ডাকে অথবা এমনিতেই হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে আমার যেন মনে হচ্ছিল আব্বু এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আকাশে জঙ্গি বিমানের প্রচণ্ড শব্দে আর শুয়ে থাকা গেল না। ৩ তারিখে সমস্তটা দিন বিভিন্ন মানুষের নানারকম জল্পনা-কল্পনা শুনেই কাটল । ঢাকা তখন গুজবের শহর। কেউ বলছেন আব্বু এবং অন্যদেরকে সরকার গঠন করতে জেল থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছে। কেউ বলছে বঙ্গভবনে মিটিং চলছে।
৪ তারিখ মঙ্গলবার সকালে গুজব অন্যরকম। সবাই কেমন যেন ভয় ভয় চেহারা। কেউ একজন বললেন, জেলখানায় পরশু রাতে পাগলা ঘন্টা বেজে ছে, গুলির শব্দ শােনা গেছে।
সমস্ত দিন পাগলের মতাে উর্ধতন মহল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ১৯ নম্বর রােডের একটি বাসা থেকে নয়তাে সামনের বাসা থেকে ফোন করেছি। পরিচয় দিয়েছে আমি তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে, কিন্তু অনেকেই ফোন ধরেনি, যারা ধরেছে তারা এড়িয়ে গেছে কোনাে না কোনােভাবে ।
রিপি আর আমি একবার ছুটছি মফিজ কাকুর বাসায়, আর একবার আসছি আমাদের বাসায়, বেলা তখন কত হবে- হয়তাে ৪টা। আমি আর রিপি মফিজ কাকুর বাসায় গিয়েছি।
একটু পরেই তিন-চার জন মহিলা এসে ঢুকলেন। একজন নিজেকে পরিচয় দিলেন তিনি খালেদ মােশারফের মা। আমার ছােট ফুফুর ছেলে ঢাকা কলেজের ছাত্র বাবুল ভাইও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁকেই পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁরা।
হঠাৎ বাবুল ভাইয়ের গােঙ্গনির শব্দে আমরা ছুটে গেলাম সেই ঘরে। বাবুল ভাই এক একবার চোখ মেলেন আর মামা বলে ঘাড় কাত করেন। বুঝে ফেললাম তার মামা- আমার আব্বু আর নেই। তবুও বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় ছুটে চলে এলাম বাসায়। এখানে তখন অন্য দশ্য। কত যে মানুষ এখানে! সবার
পৃষ্ঠাঃ ৭২১

মুখের দিকে তাকাই, দেখি অন্য কথা বলে কিনা কেউ । কিন্তু না, গুজব ছাড়া কেউ কিছুই জানে না। প্রিয় মানুষটির সঠিক খবর শুনতেই সবাই ছুটে এসেছে এখানে।
ভর সন্ধ্যায় আব্বুর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধু করুণ চেহারা নিয়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই গেটের পাশে দাড়ানাে আমি তাদের পেছনে পেছনে ছুটে এলাম দোতলায়। আম্মা মলিন মুখে বারান্দার একটি চেয়ারে বসা ছিলেন। করিম কাকু (ডা. এমএ করিম) কান্না জড়ানাে গলায় তার ছােটবেলার বন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ দিলেন।
আমাকে মনে হলাে প্রাণহীন পাথর- কোনাে টু শব্দটি নেই। আমি দৌড়ে চলে এলাম নিচে। কোনাে ভাবনা তখন আমার মধ্যে কাজ করছে না। সিড়ির গােড়ায় দেখি মালেকা খালা আরাে কয়েকজনের সাথে দাড়িয়ে আছেন। আমি শুনছি তারা বলছেন, শহীদ মিনারে অথবা জেল গেটে যাবেন, লাশ নিয়ে আসবেন। আমি আর দাড়াতে পারিনি। আস্তে আস্তে গেট খুলে হেঁটে হেঁটে ১৯ নম্বরের ভেতর দিয়ে মফিজ কাকুর বাসায় গিয়ে উঠলাম।
আমার শরীরে যেন কোনাে শক্তি নেই। দেয়াল সামনে রেখে খাটের একটা কোনায় বসেছি আমি। সবার কথা কানে আসছে আমার। শুনছি বাসার সামনে অগণিত মানুষ। রাত গভীর হলে যখন একটু ভিড় কমবে তখনই আব্বুকে জেল গেট থেকে পুলিশ পাহারায় নিয়ে আসা হবে। বাসায় পুলিশের পাহারা বসেছে। শুনলাম, রাত ১২টা ২৫ মিনিটে আমার আল্লু মৃতদেহ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।
একজন মহান মুক্তিযােদ্ধার জীবনের এমন করুণ পরিণতি কেন হলাে সেই প্রশ্নগুলাে একে একে সাজাতে শুরু করেছি আমি। মনে পড়ল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সেই সব ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কথা।
ষড়যন্ত্র আসলে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করে দেবার চেষ্টায়। তাজউদ্দীন ছিলেন মনেপ্রাণে জাতীয়তাবাদী একজন মানুষ, যার কাছে দেশের মুক্তির চাইতে বড় আর কিছু ছিল না। সম্ভব ছিল না তাজউদ্দীনকে দিয়ে অন্যায়, অন্যায্য বাঁকা কিছু করানাে। তাই ষড়যন্ত্র শুধু একমুখী ছিল না, ছিল বিভিন্নমুখী, আর ভিন্ন ভিন্ন কায়দায়।
যুদ্ধকালীন মাত্র চার জনের মন্ত্রিসভার ভেতরেই খন্দকার মােশতাক সেই যুদ্ধের সময়েই চেষ্টা করেছেন পাকিস্তানের সাথে আপােস-রফায় এসে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ধ্বংস করে দিতে। এই ষড়যন্ত্রের জাল ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত। আন্তর্জাতিক।চক্রান্তের সাথে খন্দকার মােশতাকের ছিল সরাসরি যােগাযােগ। কিন্তু দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের কাছে এই ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে যায়। এক অশুভ চক্রান্ত থেকে মুক্তি পায়
পৃষ্ঠাঃ ৭২২

স্বাধীনতাকামী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের আরও যে সমস্ত স্পর্শকাতর প্রতিবন্ধকতা ছিল তার সমস্তকে তাজউদ্দীন অতিক্রম করতে পেরেছিলেন বলেই বাঙালীর কাক্ষিত বিজয় আসে।
কিন্তু এই স্বাধীন দেশে নিজেদেরই ভেতরে ঘাপটি মেরে অপেক্ষমাণ সুযোগ সন্ধানী অপরাধীদের উপযুক্ত কোনাে বিচার হলো না। কেউ মন্ত্রীই রইলেন, কেউ উচ্চপদে আসীন হলেন, ক্ষমতার সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভােগ করতে থাকলেন কেউ। সেই সাথে যােগ হলো ঘাতকেরা।
বাংলাদেশ যেন মাথা তুলে দাড়াতে না পারে সে কারণে এদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যই ছিল মুজিব কাকুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাজউদ্দীনকে এক কোণে সরিয়ে দেয়া। এই প্রচেষ্টা শুরু হয় মুজিব কাকু পাকিস্তানের কারাগার থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর। একাত্তরের তাজউদ্দীন এদের কাছে শুধুমাত্র মানুষ তাজউদ্দীন ছিলেন না, তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বলতম প্রতীক, যিনি এই দেশের মানুষের হাতে তুলে দিতে পেরেছিলেন বিজয় পতাকা। তাই একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতা মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিলেন স্বাধীনতা লাভের মাত্র ২ বছর ১০ মাসের মাথায়।
নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় গড়ে ওঠা বিশ্বস্ত আর সত্যবাদী তাজউদ্দীন ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্নকে বুকে নিয়ে, সমস্ত অপমানকে সহ্য করে নীরবে রইলেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আর স্বয়ং খন্দকার মােশতাক এদের একাত্তরের ব্যর্থ চক্রান্তের চরম প্রতিশােধ নিল।
বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় প্রতিভা তাজউদ্দীন আর তার তিন সাথীকে রাতের অন্ধকারে কাপুরুষের মতাে ঘুম থেকে ডেকে তুলে সরকারী হেফাজতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতর গুলি করে হত্যা করলাে। খন্দকার মােশতাকের নির্দেশে হত্যাকারীরা স্থাপন করলাে বিশ্বের নৃশংসতম বর্বরতার নজির।
যে প্রাণের উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনায় প্রতিদিনের মুক্তিযুদ্ধ প্রাণ পেত আমি সেই মুক্তিযােদ্ধার নিপ্রাণ মৃতদেহ এক নজর দেখবার শক্তি কিভাবে অর্জন করবাে? রাত কি তাের আমি জানি না, আমার হাত টেনে ধরে মেজ কাকি বললেন- রিমি, তােমার চোখমুখ বড় বেশি লাল হয়ে আছে, একটু পানি দাও।
আমি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে পানির ঝাপটা দিলাম। চোখে আমার পানি নেই, জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে চোখ। কলের পানি গড়িয়ে পড়ছে আমার কাপড়ে । কাকিই আমাকে ধরে ধরে আবার ঘরে আনলেন। রিপি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। আম্মার সাথে গত সন্ধ্যার পর থেকে আর দেখা নেই। একার আমরা আব্বুর কাছে যাবাে, আমাদের ৪টা বাসা পরেই লাল ফুফুর বাসা। কার সাথে কার সাথে যেন
পৃষ্ঠাঃ ৭২৩

তার বাসার সামনে দেখা হলাে। বলল, আমাকে এইমাত্র এখানে নিয়ে এসেছে। ভেতরে গেলাম।
আম্মার সেই পাথরমূর্তি। বললেন : যাও, তােমার আব্বুর কাছে যাও। আমি সমস্ত রাত পাশে বসে কপালে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছি।
তখন ও দিনের আলাে ফোটেনি, কিন্তু বাসার সামনে প্রচণ্ড ভিড়। মানুষ সারিবদ্ধভাবে এক এক করে ভেতরে ঢুকছে আবার বেরিয়ে আসছে নীরবে। ছােটবেলায় যে ঘরটায় দেখতাম ভরা থাকত আব্বুর বইপত্রে, যে ঘরটায় আব্বু লেখালেখি করতেন, আজ সেই শূন্য ঘরে দুঃখের প্রদীপে নিজেকে আলোকিত করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন আব্বু।
উত্তর দিকের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকতেই সেকেন্ডের মধ্যে মনে পড়ে গেল ‘৭৩-এর সেই স্বপ্নের কথা। স্বপ্নও কি কোনদিন এমন সত্যি হয়! ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হলাে আব্বুর কোলাে। সামনে আনার আপা বা অন্য কেউ দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর কাঁধেই মাথা রাখলাম।
হাইয়ের বাবা আব্বুর মুখ থেকে চাদর সরালেন। আমি আব্বুকে দেখলাম – মনে হলাে ঘুমিয়ে আছেন। ডাক দিলেই স্বভাবসুলভ মুচকি হাসি দিয়ে জেগে উঠবেন।
হাইয়ের বাবা গােসলের গরম পানির ব্যবস্থা করতে উপরে এলেন। চুলায় বড় হাঁড়িতে পানি বসানাে হলাে। সেই চুলার আগুন দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আমিই জ্বালালাম।
আব্বুর অতি আদরের ছােট বাগানের এক কোনায় যেখানে তাকে গােসল করানাে হবে, একমাত্র ভাই সােহেলকে নিয়ে সেখানে গিয়ে আব্বুর ডান পায়ের গােড়ালিতে দেখলাম বুলেটের রক্তাক্ত ক্ষত। গােসলের পর শুনলাম উরুতে আরও একটি ক্ষত ছিল। অনেক ভিড়ের মাঝে কেউ একজন বলেছিলেন, পােস্টমর্টেম রিপাের্টে নাকি লেখা আছে, বুলেটবিদ্ধ হবার ফলে রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় আব্বুর।
এরই মধ্যে শুনলাম মনসুর কাকুর মৃতদেহ আমাদের বাসার পেছন দিকে ১৯ নম্বর রােডে তাঁদের এক আত্মীয়ের বাসায় রাখা আছে। শেষবারের মতাে তাঁকে দেখতে, তাকে আমার শেষ শ্রদ্ধা জানাতে একা একাই হেঁটে আমাদের বাসার সামনের উপচেপড়া ভিড় ঠেলে সে বাড়িতে গেলাম। মনসুর কাকুর বা চোখটা খােলা, রক্তজবার মতাে লাল। সম্ভবত গুলি ছাড়াও পেটে বেয়নেট চার্জ করা হয়েছিল। তাই পেটের দিকের সাদা কাফনের কাপড়টা রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। খােলা চোখটা দেখে মনে হলাে যেন প্রশ্নবােধক চিহ্ন এঁকে গেছেন এই দেশের কাছে। মনটা কুঁকড়ে গেল। ধীরে ধীরে ফিরে এলাম।
পৃষ্ঠাঃ ৭২৪

বাসায় ফিরে দেখলাম কয়েকটি বিদেশী দূতাবাস থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছে আব্বুকে।
এদিকে ছাত্রদের দাবি সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক পাশে জাতীয় নেতাদের কবর দিতে হবে। টিএসসির উল্টো দিকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে পুকুরটা আছে তার পাশেই নাকি তিন নেতার জন্য কবর খোড়া হয়েছে। এই কথা ছড়িয়ে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সামরিক বাহিনীর লােকজন চলে এলাে, তারা ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাইল আব্বুকে।
ওরা আব্বুকে বনানীতে কবর দিতে নিয়ে যাবে। তখনও জানাজা হয়নি। সমস্ত মানুষ এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করল। বাইরে শ্লোগান, পুলিশের লাঠিপেটা। কেউ কেউ সাময়িক গ্রেফতার। শেষ পর্যন্ত আমাদের বাসার সামনে আর নিজ হাতে লাগানো আম গাছের ছায়ায় আব্বুর জানাজা হলাে। তারপর আব্বুকে নিয়ে সবাই চলে গেল, আন্ধু মিশে গেলেন বাংলাদেশের মানচিত্রে ।
নিপুণ কারিগরের মতাে যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে এই বিশ্বাসে যে মানুষটি মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জীবনপণ করে কাজ করেছিলেন, তিনি সত্যিই জীবনকে উৎসর্গ করলেন তার প্রিয় মাতৃভূমিকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাড় করবার স্বপ্নকে আমাদের সবার সামনে রেখে।
আমার কাছে আব্বু ছিলেন স্বপ্নের রাজপুত্র। আকাশের তারার মাঝে তাঁকে আমি খুঁজতাম। আমার মনে হতে লাগল আকাশের জ্বলজ্বলে তারার কোনাে একটির রূপ ধারণ করে আশীর্বাদের দুই হাত বাড়িয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন বাংলাদেশের দিকে। মনে হতে লাগল যেন তারা ভরা আকাশের জ্বলজ্বলে তারাটি আরও শক্তিশালী দ্যুতি হয়ে ফিরে আসবে এই মাটিতে। ফিরে তিনি আসবেনই। তার রেখে যাওয়া কর্মের মধ্য দিয়েই তিনি ফিরে আসবেন, বার বার।৬
অন্তরীণ অবস্থা থেকে আটক এবং জেলহত্যার পর
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট
দৈনিক ইত্তেফাক : আগস্ট ২৪, ১৯৭৫
দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারে অভিযােগে সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ ২৬ জন গ্রেফতার: দুনীতি, সমাজবিরােধী তৎপরতা, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ ও সম্পত্তি হস্তগত করার অভিযােগে সামরিক আইনের বিধিমালার আওতায় সাবেক সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, সাবেক উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব কোরবান আলী, জনাব আবদুস সামাদ আজাদ
পৃষ্ঠাঃ ৭২৫

এবং কয়েকজন এমপিসহ মােট ২৬ জনকে গতকাল (শনিবার) গ্রেফতার করা হইয়াছে।
দৈনিক ইত্তেফাক : নভেম্বর ৫, ১৯৭৫, বুধবার
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, কামরুল তাজউদ্দীন নিহত। (ইত্তেফাক রিপাের্ট) : সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী, সাবেক অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী জনাব এএইচএম কামরুজ্জামান গত রবিবার মধ্যরাত্রে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিহত হইয়াছেন (ইন্নালিল্লাহি…. রাজেউন)।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর জেল সূত্র হইতে এই সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। তাঁহাদের লাশ গতরাত্রে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করা হয়। ইহার পর গতকাল রাত্রি পৌনে দুইটার সময় আত্মীয় স্বজনদের নিকট তাঁহাদের লাশ ফিরাইয়া দেওয়া হয়।
এই সংবাদ ছড়াইয়া পড়ার পর তাহাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী ও গুণগ্রাহীরা তাঁহাদের বাসভবনে সমবেত হয়।
প্রসঙ্গত, উল্লেখযােগ্য যে, গত ১৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর তাঁহাদিগকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়।
চার. জেল হত্যাকাণ্ডের পর তকালীন আইজি প্রিজনস ও ডিআইজি প্রিজন যে প্রতিবেদন তৈরি করেন তা দীর্ঘ ২১ বছর ধামাচাপা থাকার পর উদ্ধার করা হয়। এর ওপরে পত্রিকায় প্রকাশিত রিপাের্ট।
দৈনিক ভােরের কাগজ : ২৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৬
জেল হত্যার প্রামাণ্য দলিল উদ্ধার : মাঈনুল আলম : ২১ বছর পর জেল হত্যার সকল সত্য উদঘাটিত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে অসহায় নিরস্ত্র অবস্থায় নিহত চার জাতীয় নেতা হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামান ও ডিআইজি প্রিজন আবদুল আউয়ালের প্রতিবেদন এবং নিহত নেতাদের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। তথ্য প্রমাণেও এটা এখন পরিষ্কার খন্দকার মােশতাক আহমদ ও আত্মস্বীকৃত খুনী কর্নেল রশীদ চক্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বসে ক্ষমতা অপব্যবহার করে আইন-কানুনের তােয়াক্কা না করে এই জঘন্য কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছিল। তাদের নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন মােসলেমের নেতৃত্বে কালাে পােশাকধারী ৫ জনের একটি ঘাতক দল এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়।
পৃষ্ঠাঃ ৭২৬

জেলে নিহত চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান হত্যার পর ৫ নভেম্বর ‘৭৫ আইজি প্রিজন স্বরাষ্ট্রসচিবকে ও ডিআইজি পিছনের কাছে যে মিজানুর রহমান চার মৃতদেহের যে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তা গত ২১ বছর ধরে চাপা পড়েছিল। গত ১৩ সেপ্টেম্বর আইজি প্রিজননের কক্ষে রক্ষিত আলমিরার ফাইলের স্তুপ থেকে ভারপ্রাপ্ত আইজি প্রিজনস লিয়াকত আলী খান এ ফাইলটি উদ্ধার করে কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছে দেন। এ ফাইল ধরেই এখন সিআইডি তদন্ত করেছে। আর এ ফাইল থেকেই জেল হত্যার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। আইজি প্রিজনস ও ডিআইজি প্রিজন এবং নিহতদের লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন আজকের ভােরের কাগজ-এ পৃথক পৃথকভাবে ছাপা হলো। তৎকালীন আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান তার প্রতিবেদনে বলেছেন, মোসলেম কারাগারে এসে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে । বিষয়টি সেখানে উপস্থিত ডিআইজি প্রিজন, জেলারসহ সকলকে হতভম্ব করে দেয়। অবশেষে আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামান রাষ্ট্রপতি খন্দকার মােশতাককে বলেন, ক্যাপ্টেন বন্দীদের হত্যা করতে চাচ্ছে। এর জবাবে মােশতাক তাকে বলেন, “সে যা বলছে তাই। আইজি প্রিজনস প্রতিবেদনে বলেন, ক্যাপ্টেন ও তার দলকে ক্রোধান্বিত দেখাচ্ছিল এবং সে কারণে কেউ তার নির্দেশ অমান্য করার সাহস দেখায়নি। মােসলেমের দল গুলি করে চার নেতাকে ফেলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর নায়েক এ. আলীর নেতৃত্বে আরেকটি দল গুলিবিদ্ধদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে কারাগারে ঢােকে। এ দলটি তখনও যারা আহত হয়ে কাতরাচ্ছিলেন তাদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে।
ডিআইজি প্রিজন কে.এ আউয়াল তাঁর প্রতিবেদনে বলেন, ক্যাপ্টেন মােসলেম তাদের জানিয়েছিল, সে মাত্র তিন মিনিটে শেখ মুজিবকে শেষ করেছিল । আউয়াল বলেন, নায়েক এ. আলীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলটি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর দেহে বেয়নেট চার্জ করেছিল।
মােশতাক বললেন, আপনি রশিদের নির্দেশ পালন করুন : আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামানের বক্তব্য : ১৯৭৫-এর নবেম্বরে জেলহত্যা সম্পর্কে তৎকালীন আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামান ঘটনার একদিন পর ৪ নভেম্বর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের বরাবর নিজের একটি বিবৃতিসহ তখন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্তব্যরত ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন কে. আবদুল আউয়ালের রিপাের্ট পাঠান। আইজি প্রিজনস নুরুজ্জামানের বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ এখানে
পৃষ্ঠাঃ ৭২৭

দেওয়া হলাে :
১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর রাত ৩টায় আমি বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের একটি ফোন পাই। তিনি আমার কাছে জানতে চান, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কোন সমস্যা আছে নাকি। আমি জানালাম, ঠিক এই মুহূর্তের অবস্থা আমার জানা নাই। এরপর তিনি আমাকে জানালেন, কয়েকজন বন্দিকে জোর করে নিয়ে যেতে কয়েকজন সেনা সদস্য জেল গেটে যেতে পারে, আমি যেন জেল গার্ডদের সতর্ক করে দেই। সে অনুযায়ী আমি সেন্ট্রাল জেলে ফোন করি এবং জেল গেটে দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ডারকে মেসেসটি জেলারকে পৌছে দিতে বলি যাতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
৩/৪ মিনিট পর বঙ্গভবন থেকে আরেকজন আর্মি অফিসারের ফোন পাই। তিনি জানতে চান আমি ইতােমধ্যেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গার্ডদের সতর্ক করে দিয়েছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সচক্ষে দেখার জন্য জেলগেটে চলে যেতে বলেন। আমি তখন সেন্ট্রাল জেলের ডিআইজি প্রিজনকে ফোন করি। খবরটি জানিয়ে আমি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে জেলগেটে চলে যেতে বলি। দেরি না করে আমিও জেলগেটে চলে যাই এবং ইতােমধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া জেলারকে আবার গার্ডদের সতর্ক করে দিতে বলি। এরই মধ্যে ডিআইজিও জেলগেটে পৌছেন। বঙ্গভবন থেকে পাওয়া খবরটি আমি আবার তাঁকে জানাই।
এর পরপরই মেজর রশিদের আরেকটি ফোন পাই। তিনি আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যে জনৈক ক্যাপ্টেন মােসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১. জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ২. জনাব মনসুর আলী ৩. জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৪. জনাব কামরুজ্জামান- এ ৪ জন বন্দীকে যেন তাকে দেখানাে হয়।
এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোন প্রেসিডেন্টকে দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪ জন সেনা সদস্যসহ কালাে পােশাক পরা ক্যাপ্টেন মােসলেম জেলগেটে পৌছান। ডিআইজি প্রিজনের অফিস কক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, পূর্বোল্লিখিত বন্দীদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাঁকে নিয়ে যেতে । আমি তাঁকে বলি, বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন। উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে
পৃষ্ঠাঃ ৭২৮

আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে এবং ডিআইজি প্রিজন ফোনে প্রেসিডেন্টের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিকিন্তু ব্যর্থ হই। সে সময় জেলারের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের আরেকটি কল আসে। আমি ফোনটি ধরলে মেজর রশিদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মোসলেম সেখানে পৌছেছেন কিনা। আমি আমি ইতিবাচক জবাব দেই এবং তাকে বলি, কী ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন মেজর রশিদ আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে ক্যাপ্টেনের বন্দীদের গুলি করার ইচ্ছার কথা জানাই। প্রেসিডেন্ট জবাব দেন, সে যা বলছে তাই হবে। তখন আমরা আরও উত্তেজিত হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন মোসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলারও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাকে সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যেখানে উপরোল্লিখিত বন্দীদের রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মতো লাগছিল এবং আমাদের কারও তাদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিল না। তার নির্দেশ অনুযায়ী পূর্বোল্লিখিত ৪ জনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়। সেখানে জেলার তাদের শনাক্ত করেন । ক্যাপ্টেন মােসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দীদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ. আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করে ।
স্বা: এন. জামান, মহা-কারা পরিদর্শক, ৫-১১-৭৫
৪ সশস্ত্র কর্মকর্তা নিয়ে ভীতিকর ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন মােসলেম এলেন : ডিআইজি প্রিজন আউয়ালের রিপাের্ট : কাগজ প্রতিবেদক : ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যার পর তখন কর্তব্যরত ডিআইজি প্রিজন আবদুল আউয়াল আইজি প্রিজনস বরাবর ঘটনার বিবরণ সংবলিত যে বিস্তারিত রিপাের্ট পেশ করেন তার পূর্ণ বিবরণ এখানে দেওয়া হলাে।
আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, গত ২ নভেম্বর ‘৭৫ দিবাগত রাত ৩ ঘটিকায় আমি আমার বাসভবনে অবস্থানকালে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে আমাকে জেলগেটে যাওয়ার নির্দেশ সংবলিত একটি মেসেজ পাই । তিনি আরও জানান, বঙ্গভবন থেকে প্রাপ্ত নির্দেশের ভিত্তিতে তিনি নিজের জেলগেটে অভিমুখে রওনা দিচ্ছেন। আমাকে আরও বলা হয়, এই মর্মে রিপাের্ট পাওয়া গেছে যে, কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা জেলগেটে আসতে পারেন এবং জোরপূবক কয়েকজন বন্দীকে নিয়ে যেতে পারেন। মুহূর্তমাত্র ব্যয় না করে আমি
পৃষ্ঠাঃ ৭২৯

জেলগেটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম এবং রাত ৩টা ২০ মিনিট নাগাদ সেখানে পৌছলাম। গিয়ে দেখি জেলগেটে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং জেলার আগে থেকেই উপস্থিত। অতঃপর আমি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিস কক্ষে গেলাম। একটু পরেই জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল একটি টেলিফোন কল রিসিভ করলেন, আমাকে বলা হলাে তা বঙ্গভবন থেকে এসেছে। এখানে বলা যেতে পারে, এই টেলিফোন সংলাপে ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা পােষণ করেছিলেন। স্পষ্টতই তার অনুরোধ মেনে নেওয়া হয়েছিল। কেননা আমি তাকে ‘স্যার’ সম্বােধন করতে এবং সালাম দিতে শুনলাম। টেলিফোনে আলাপ সেরে ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন যে, তাকে বলা হয়েছে কয়েকজন সশস্ত্র গার্ড নিয়ে ক্যাপ্টেন মােসলেম জেলে আসবেন এবং তাকে ভেতরে নিয়ে যেতে হবে। তিনি (ক্যাপ্টেন মােসলেম) যা করতে চান তাকে তা করতে দিতে হবে এবং বন্দী তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এএইচএম কামরুজ্জামান কারা তাকে তা চিনিয়ে দিতে হবে। ইতােমধ্যে ইন্সপেক্টর জেনারেল বঙ্গভবন থেকে আর একটি টেলিফোন মেসেজ রিসিভ করলেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন যে, তাকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল সব গার্ডকে ঠিকমতাে সতর্ক করা হয়েছে কিনা। তিনি ‘হ্যা’ বােধক উত্তর দিলেন এবং অতঃপর কর্মকর্তাসহ অন্যান্য স্টাফকে খুবই সতর্ক ও অতন্দ্র থাকার নির্দেশ দিলেন। ইন্সপেক্টর জেনারেলের এই নির্দেশ পালন করা হলাে। এর কিছুক্ষণ পর স্টেনগান, এসএলআর প্রভৃতিতে সুসজ্জিত ৪ জন সশস্ত্র কর্মকর্তা সহযােগে ভীতিকর ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন মােসলেম আমার অফিস কক্ষে এলেন এবং জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনিই নূরুজ্জামান কিনা। জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল ‘হ্যা’ বােধক উত্তর দিলেন। এরপর তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে তাড়াতাড়ি করতে বললেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করতে হবে? আমাদের ভয়ানক আতঙ্কিত করে তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বললেন, তার কাছে পূর্বে যে কয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি তাদের গুলি করবেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন যে, তিনি পূর্বে এ জাতীয় কোনাে নির্দেশ পাননি এবং তাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। আমার অফিসের টেলিফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েকবার যােগাযােগ করার চেষ্টা করা হলাে কিন্তু যােগাযােগ করা গেল না। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জানানাে হলাে যে, জেলারের অফিসের টেলিফোন সেটে তার নামে বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন এসেছে। ইন্সপেক্টর জেনারেল টেলিফোন ধরার জন্য রওনা দিলেন। আমি তাকে অনুসরণ করলাম। পেছন
পৃষ্ঠাঃ ৭৩০

পেছন চলল সামরিক কর্মকর্তারা। টেলিফোনে কথা বলার সময় ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন এবং তার অনুরোধ রাখা হলো বলে স্পষ্ট মনে হলো । ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বলতে শুনলাম, ক্যাপ্টেন মোসলেম তাদের গুলি করবেন বলে বলেছেন। এরপর ইন্সপেক্টর জেনারেল টেলিফোন রেখে দিলেন এবং তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন মোসলেম তখন বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আমাদের তক্ষুনি পূর্বোক্ত বন্দীরা যেখানে আটক রয়েছে সেখানে যাওয়ার হুকুম দিলেন । নির্দেশমাফিক সামরিক ককর্মকর্তাদের নিয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল রওনা দিলেন। আমি জেলার এবং অন্যান্য নির্বাহী স্টাফও সংগে চললাম। পথিমধ্যে আমি প্রেসিডেন্টের সংগে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানালাম। ক্যাপ্টেন হুমকির সুরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ভয় পাচ্ছেন? আমি বললাম, ভয়ের প্রশ্ন আসছে না, আমার ৩২ বছরের চাকরি জীবনে আমি এ জাতীয় ঘটনার কথা শুনিনি। তিনি ক্রোধান্বিত হলেন এবং একজন সামরিক কর্মকর্তা (সেপাই) আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে চলে যেতে বললেন। এতে ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন, না, উনি থাকবেন। আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়া চোখে ক্যাপ্টেন আমার দিকে তাকালেন। ইতােমধ্যে ক্যাপ্টেন মােসলেমের নির্দেশে জেলার এবং অন্যান্য কয়েকজন নির্বাহী স্টাফ মিলে তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অন্যান্য বন্দীদের থেকে আলাদা করলেন। তাদেরকে একটা ওয়ার্ডে জড়াে করা হলাে এবং ঐ ওয়ার্ডের অন্যান্য সদস্যকে সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হলাে।
ইতােমধ্যে ক্যাপ্টেন এ জাতীয় বিলম্বে বেশ ক’বার বিরক্তি প্রকাশ করে বলছিলেন, শেখ মুজিবকে খতম করতে তার মাত্র ৩ মিনিট সময় লেগেছিল। যখন তাদের জানানাে হলাে ৪ বন্দীকে একটি কক্ষে আনা হয়েছে, ক্যাপ্টেন মােসলেম আর তাঁর দল তৎক্ষণাৎ সেই রুমের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। যে ওয়ার্ডে উক্ত বন্দীদের আটক রাখা হয়েছে সেখান থেকে ৪০ গজ দূরে আমি আর জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল দাঁড়িয়ে রইলাম। অচিরেই আমাদের কানে গুলি করার ভয়াবহ শব্দ ভেসে এলাে। তারা ফিরে এলেন আর তড়িঘড়ি জেলগেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরা তাদের অনুসরণ করলাম। রেকর্ড অনুসারে ক্যাপ্টেন মােসলেম আর তার দল জেলগেটে ঢুকেছে ভাের ৪টা এবং জেলগেট ছেড়ে গেছে ভাের ৪টা ৩৫ মিনিটে। এরপর ভাের ৫টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ. আলীর নেতৃত্বে সশস্ত্র কর্মকর্তাদের আর একটি দল এলাে এবং গুলি করার জায়গাটি পরিদর্শন করে ভিকটিমদের মৃত্যু সম্বন্ধে
পৃষ্ঠাঃ ৭৩১

নিশ্চিত হতে চাইলাে। তাদের নির্দেশও পালন করা হলাে। যেহেতু আমি সেই সময় আমার অফিস কক্ষে ফজরের নামাজ পড়ছিলাম আমি এই দলটিকে স্বচক্ষে দেখিনি। নামাজ শেষ করে আমি জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে এ তথ্য পেলাম। তিনি তখনও তার অফিস কক্ষে ছিলেন। দলটি তাদের পরিদর্শন শেষে ৫টা ৩৫ মিনিটে জেল ছেড়ে চলে যায় । আমি পরে জানতে পারি এই দলটি মনসুর আলী এবং নজরুল ইসলামের দেহে বেয়নেট দিয়ে আঘাতও করে ।
জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল ভাের ৫টা ৪৫ মিনিটে জেল ত্যাগ করেন এবং আমি সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে আমার অফিস কক্ষ ত্যাগ করি। আমি আবার অফিসে ফিরে আসি সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে। অফিসে এসে আমি জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে টেলিফোন করি এবং মৃতদেহগুলাে সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করতে তাকে অনুরােধ করি। তিনি আমাকে মেজর রশিদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে অনুরােধ করেন। আমি তাকে অনুরােধ করি যাতে তিনি নিজেই মেজরের সঙ্গে যােগাযােগ করেন, কিন্তু তিনি কাজটা আমাকেই করতে অনুরােধ করেন। আমি কিছুটা সময় অপেক্ষা করি।।
বিশেষত আমার কিছু মন্তব্যের কারণে আমি ক্যাপ্টেন মােসলেমের ভয়ানক বিরাগভাজন হয়েছি বলে সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগ করতে আমার খানিকটা ভয় ভয়ই লাগছিল। সকাল ১০টার দিকে আমি তর কর্নেল রশিদের সঙ্গে ফোনে যােগাযােগ করলাম এবং মৃতদেহগুলাে কী করে সরানাে হবে জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে পুরােপুরি নীরব থাকতে বললেন এবং মৃতদেহগুলাে যেভাবে রয়েছে সেখানেই রাখার নির্দেশ দিলেন। আমি এ কথা ইন্সপেক্টর জেনারেলকে অবগত করলাম।
ঐদিন দুপুর ২টার দিকে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের অফিসে গিয়ে এ ঘটনায় আমাদের কি কি করণীয় তা পর্যালােচনা করলাম। খানিকক্ষণ আলােচনার পর আমরা বিষয়টা সম্পর্কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবকে রিপাের্ট করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বিকেল ৩টার দিকে আমি এবং ইন্সপেক্টর জেনারেল সচিবের দপ্তরে গেলাম। ইন্সপেক্টর জেনারেল পুরাে ঘটনাটি সচিবকে জানালেন।
মৃতদেহগুলাে সরানাের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনােরকম নির্দেশের অভাবে যেখানে হত্যা করা হয়েছে লাশগুলাে ৪ নভেম্বর ‘৭৫ সন্ধ্যাবেলা পর্যন্ত সেখানে সেভাবেই পড়ে রইলাে। ৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের তরফ থেকে নির্দেশ পাওয়া গেল। অচিরেই লাশগুলাের
পৃষ্ঠাঃ ৭৩২

সুরতহাল সম্পর্কিত রিপাের্ট তৈরি করার ব্যবস্থা করা হলো। সচিব মহোদয়ের সদয় হয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ মেডিকেল কর্তৃপক্ষ এবং ম্যাজিস্ট্রেটকে তাদের করণীয় পদক্ষেপগুলাে গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিহতদের পরিবার যাতে লাশগুলো ফেরত পেতে পারে এ ব্যাপারে তিনি পুলিশ কর্তৃপক্ষকে সবরকম সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে লাশ দাফনের ব্যাপারে সাহায্য করারও নির্দেশ ছিল। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সহায়তা দিয়েছে এবং ম্যাজিস্ট্রেট ও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করেছে। পুলিশের ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ এডিসি (জেনারেল) এবং বিপুল সংখ্যক উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা ঐ দিন রাত ১১টা পর্যন্ত জেলে অবস্থান করেছে। ৪নবেম্বর রাতে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের লাশ জেলগেটে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয় এবং প্রয়োজনীয় পুলিশ প্রহরায় পুলিশের ট্রাকে করে তাদের বাসায় লাশ পৌঁছে দেয়া হয়। কামরুজ্জামান এবং মনসুর আলীর লাশ ৫ নভেম্বর ভােরে তাদের আত্মীয়-স্বজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাদের আত্মীয়স্বজনরা যেভাবে চেয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষ সেভাবেই প্রহরা এবং গাড়ি দিয়ে লাশ বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে।
স্বা: কে.এ. আউয়াল, ডিআইজি প্রিজন
ঢাকা বিভাগ, কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা। ৫-১১-৭৫

সুরতহাল রিপাের্ট
দৈনিক ভােরের কাগজ, ২৫ নভেম্বর ১৯৯৬
চার জাতীয় নেতার লাশের সুরতহাল : কাগজ প্রতিবেদক : ১৯৭৫-এর নভেম্বরের রােমহর্ষক জেলহত্যা সম্পর্কে ৫ নভেম্বর তৎকালীন আইজি প্রিজনস নূরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যে রিপাের্ট পাঠান তার সঙ্গে নিহত ৪ জাতীয় নেতার লাশের সুরতহাল রিপাের্ট ছিল। ঐ দলিল থেকে ৪ নেতার সুরতহাল রিপাের্টের পূর্ণ বিবরণ এখানে দেওয়া হলাে :
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
আমি খন্দকার মিজানুর রহমান, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা সদর (উঃ) কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইডি সাহেবের ৪-১১-৭৫ইং লিখিত ১/ডিআইজি/1(৪) চিঠি মূলে জানিতে পারিয়া আমি ৪-১১-৭৫ ইং তাং ১৮-০০টার সময় কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হইয়া জেলার সাহেব-এর শনাক্তমতে এবং পার্শ্ব লিখিত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আমি মৃত সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের সুরতহাল
পৃষ্ঠাঃ ৭৩৩

প্রস্তুত করিলাম । মৃতদেহ কেন্দ্রীয় কারাগারের নূতন জেলার পূর্ব পার্শ্বের ১নং কোঠায় বারান্দার একটি কাঠের চৌকিতে উত্তর শিয়রে শায়িত অবস্থায় দেখিতে পাইলাম। তাঁহার মৃতদেহ সাদা ডােরাকাটা চাদরে আবৃত।
তাহার শরীর উলট-পালট করিয়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করিয়া বুকের ডান পার্শ্বে ৬টি বেয়নেটের রক্তাক্ত জখম আছে বলিয়া মনে হয়। শরীরের অন্যান্য স্থানেও বুলেটের জখম আছে বলিয়া মনে হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৩ তারিখের সকাল আনুমানিক ৪-৩০মিঃ সময় মৃত্যু সংঘটিত হয়। মৃতদেহ পচিয়া যাইতেছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য অবিলম্বে জরুরি ভিত্তিতে পর্যাপ্ত আলাের ব্যবস্থা করিয়া ময়না তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া গেল। স্বাক্ষর/মি. রহমান, ৪-১১-‘৭৫ইং
মৃতদেহটা জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের বলিয়া শনাক্ত করিলাম। স্বাঃ আমিনুর রহমান ৪-১১-৭৫।
আমাদের সামনে সুরতহাল করা গেল। স্বাঃ আঃ ওয়াহিদ মৃধ, সােবেদার স্বাঃ মােঃ ইছহাক মিয়া, ৪-১১-৭৫ইং।
সত্যায়িত, স্বাক্ষর অস্পষ্ট, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ, ঢাকা ।৭

তাজউদ্দীন আহমেদ
আমি মােঃ আজমল চৌধুরী, ১ম শ্রেণীর হাকিম, ঢাকা সদর (দঃ) মহকুমার কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি সাহেবের ৪/১১/৭৫ তারিখ লিখিত ১/ডিআইজি/১/(৪) নং চিঠি মূলে জানিতে পারিয়া অদ্য ৪/১১/৭৫ তারিখে ১৭- ৪৫ মিঃ কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হইয়া জেলার সাহেবের শনাক্ত মতে এবং পার্শলিখিত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের মৃতদেহের সুরতহাল প্রস্তুত করিলাম।
মৃতদেহ কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন জেলের পূর্ব পার্শ্বের ১নং কোঠার বারান্দায় একটি চৌকির উপর উত্তর শিয়রে শায়িত অবস্থায় দেখিতে পাই।
তাহার মৃতদেহ একটি সাদা চাদর দিয়া আবৃত আছে। তাঁহার শরীর ওলট- পালট করিয়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখমের চিহ্ন দেখা গেল। জখমগুলাে বুলেটের বলিয়া মনে হয়।
কারাগার কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন দেখিলাম । মৃত্যুর সময় ৩-১১-৭৫ তারিখ সকাল আনুমানিক ৪-৩০ ঘটিকার সময় বলিয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। আজ রাত ৭টা ঘটিকার সময় মৃতদেহ পচিয়া যাইতেছে বলিয়া মনে হইতেছে। সেহেতু
পৃষ্ঠাঃ ৭৩৪

এখানেই জরুরী ভিত্তিতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করিয়া কারাগারের ভেতরে ময়না, তদন্তের ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া গেল।
র জন্য নির্দেশ দেওয়া গেল ।
স্বাক্ষর/- মােঃ আ. চেীধুরী, ৪-১১-৭৫ ইং।
মৃতদেহটা জনাব তাজউদ্দীন সাহেবের বলিয়া শনাক্ত করিলাম। স্বাঃ আমিনুর রহমান, ৪-১১-৭৫।
আমাদের সামনে সুরতহাল করা গেল । স্বাঃ আঃ ওয়াহিদ মৃধা, সুবেদার
স্বাঃ মােঃ ইছহাক মিয়া, ৪-১১-৭৫ ইং।
সত্যায়িত, স্বাঃ অস্পষ্ট, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ, ঢাকা।৮

এম. মনসুর আলী
আমি মোঃ আজমল চৌধুরী প্রথম শ্রেণীর হাকিম, ঢাকা সদর (দঃ) মহাকুমা কেন্দ্রিয় কারাগারের ডিআইজি সাহেবের ৪/১১/৭৫ তারিখের লিখিত ১/ডিআইজি/১(৪) চিঠি মূলে জানিতে পারিয়া অদ্য ৪/১১/৭৫ তারিখে বেলা ১৮ টার সময় কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হইয়া জেলার সাহেবের শনাক্ত মতে এবং পার্শলিখিত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আমি মৃত মনসুর আলীর মৃতদেহের সুরতহাল প্রস্তুত করিলাম।
মৃতদেহ কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন জেলের পূর্ব পার্শ্বের ১নং কোঠার বারান্দার একটি চৌকিতে উত্তর শিয়রে শায়িত অবস্থায় একটি কালাে চাদর দ্বারা আবৃত অবস্থায় পাইলাম। শরীর ওলট-পালট করিয়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখমের চিহ্ন দেখা যায়। জখম বুলেটের বলিয়া মনে হয়। বাম পায়ের উরুতে, বুকে বড় রকমের জখম পরিলক্ষিত হয়। জেল কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন দেখিলাম । মৃত্যুর সময় ৪-১১-৭৫ তারিখে আনুমানিক ভাের ৪-৩০ ঘটিকার সময় বলিয়া বলা হইয়াছে। মৃতদেহ পচিয়া যাইতেছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য অবিলম্বে জরুরী ভিত্তিতে পর্যাপ্ত আলাের ব্যবস্থা করিয়া কারাগারের ভেতরে ময়না তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া হলাে।
স্বাক্ষর/- মােঃ আ. চৌধুরী ৪-১১-৭৫ ইং।
মৃতদেহটি জনাব মনসুর আলীর বলিয়া শনাক্ত করিলাম। স্বাঃ আমিনুর রহমান ৪-১১-৭৫ইং।
আমাদের সামনে সুরতহাল করা গেল। স্বাঃ আঃ ওয়াহিদ মৃধা, সুবেদার ৪-১১-৭৫ইং। স্বাঃ মােঃ ইছহাক মিয়া, ৪-১১-৭৫ ইং।
সত্যায়িত, স্বাঃ অস্পষ্ট, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ, ঢাকা।৯
পৃষ্ঠাঃ ৭৩৫

এএইচএম কামরুজ্জামান
আমি মােঃ আজমল চৌধুরী, ১ম শ্রেণীর হাকিম, ঢাকা সদর (দঃ) মহাকুমা কেন্দ্রীয় কারাগারে ডিআইজি সাহেবের ৪/১১/৭৫ তারিখের লিখিত ১/ডিআইজি/১(৪) চিঠির মূলে জানিতে পারিয়া অদ্য ইং ৪/১১/৭৫ তারিখ ১৭-৪৫ মিঃ কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হইয়া জেলার সাহেবের শনাক্ত মতে এবং পার্শ্বলিখিত সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আমি মৃত কামরুজ্জামান সাহেবের মৃতদেহের সুরতহাল প্রস্তুত করিলাম।
মৃতদেহ কেন্দ্রীয় কারাগারের নতুন জেলের পূর্ব পার্শ্বের ১নং কোঠার বারান্দায় একটি চৌকিতে উত্তর শিয়রে একটি সাদা চাদরে আবৃত ছিল । তাঁহার শরীর ওলট-পালট করিয়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখমের চিহ্ন দেখা গেল। বিশেষ করিয়া ডান দিকের পাঁজরের এবং ডান হাতের কনুইতে বড় ক্ষত চিহ্ন পরিলক্ষিত হইল । কারগার কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন দেখিলাম। মৃত্যুর সময় ৩-১১-৭৫ তারিখের সকাল আনুমানিক ৪-৩০ মিঃ সময় বলিয়া উল্লেখ আছে। মৃতদেহ পচিয়া যাইতেছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য অবিলম্বে জরুরী ভিত্তিতে পর্যাপ্ত আলাের ব্যবস্থা করিয়া ময়না তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া গেল।
স্বাক্ষর/- মােঃ আ, চৌধুরী, ৪-১১-৭৫ইং
মৃতদেহ জনাব এ.এইচ.এম, কামরুজ্জামান সাহেবের বলিয়া শনাক্ত করিলাম।
স্বাঃ আমিনুর রহমান, ৪-১১-৭৫ইং।
আমাদের সামনে সুরতহাল করা গেল। স্বাঃ আঃ ওয়াহিদ মৃধা। সােবেদার ৪-১১-৭৫ ইং । স্বাঃ মােঃ ইছহাক মিয়া, ৪-১১-৭৫।
সত্যায়িত, স্বাঃ অস্পষ্ট, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বিচার বিভাগ, ঢাকা ।১০

কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত জাতীয় চার নেতার পরিচিতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
১৯২৫-১৯৭৫
স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশােরগঞ্জ জেলার যশােদল ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের সাহেববাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ আবদুর রইস এবং মাতার নাম নুরুন্নেসা খাতুন রূপা। তিনি গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে কিশােরগঞ্জ শহরে আজিমুদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পিতা
পৃষ্ঠাঃ ৭৩৬

সরকারী চাকরি উপলক্ষে ময়মনসিংহ শহরে বাস করতেন । ১৯৩৯ সালে নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং ১৯৪১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ময়মনসিংহ আনন্দ মােহন কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্সে ভর্তি হন। ছাত্র জীবনে তিনি ক্রিকেট ও টেনিস খেলতেন এবং নাটক করতেন। সাহিত্যের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ অনার্স এবং ১৯৪৭ সালে এমএ পাস করেন । তিনি আইনের ছাত্র ছিলেন। অবশ্য আইন পাস করেন ১৯৫৩ সালে। ১৯৪৭-৪৮ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ভিপি নির্বাচিত হন। এ সময় ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি আনন্দ মােহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি গ্রহণ করেন । ১৯৪৯ সালে তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে ইনকাম ট্যাক্সের অফিসার পদে নিয়ােগ লাভ করেন। কিন্তু তার চাকরি ভাল লাগেনি। পিতার অমতে চাকরি ত্যাগ করে পুনরায় ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে আইন পাস করে ময়মনসিং বার-এ যােগ দেন। ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নির্বাচিত হলেন । ১৯৬৬ সালে ৬ দফার দাবিতে আন্দোলন কালে পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমেদকে গ্রেফতার করে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে ৬ দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৭০ সালে ৭ ডিসেম্বর তিনি পাকিস্তান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর বর্বর আক্রমণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা দেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে তিনি উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর মন্ত্রিপরিষদ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি তিনি সংসদে উপনেতা ও শিল্পমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতক দল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে
পৃষ্ঠাঃ ৭৩৭

সপরিবারে হত্যা করে। খুনীরা তাকে খন্দকার মােশতাক আহমদের অবৈধ সরকারে যােগদানের জন্য চাপ প্রয়ােগ করে। বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে তিনি ক্ষমতায় যাননি। তারা তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখে। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান হয়। জাতীয় চারনেতা আবার ক্ষমতায় আসতে পারে- এ ভয়ে খুনীরা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর প্রত্যুষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে বনানী গােরস্তানে দাফন করা হয়।

তাজউদ্দীন আহমদ
১৯২৫-১৯৭৫
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই বৃহত্তর ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মােহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মাতার নাম মেহেরুন্নেসা। তিনি গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক ও মধ্য ইংরেজি স্কুলে পড়া সমাপ্ত করে ঢাকা সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক, ১৯৪৮ সালে আইএ এবং ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ অনার্স পাস করেন। তিনি স্কুল জীবন থেকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বিভাগপূর্বকালে মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৪৯ সালে মুসলিম আওয়ামী লীগে যােগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৬-৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি জেলে বন্দী ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনা করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ কালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাকে বনানী গােরস্তানে সমাধিস্থ করা হয়।

এম মনসুর আলী
১৯১৯-১৯৭৫
মুক্তিযুদ্ধকালীন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী এম মনসুর আলী ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে পাবনা জেলার তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহমুকার কাজীপুর
পৃষ্ঠাঃ ৭৩৮

থানার কুড়িপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হরফ আলী এবং মাতা বেগম রওশন আরা। কাজীপুর গান্ধাইল স্কুলে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় । ১৯৩৭ সালে সিরাজগঞ্জ শহরের বিএল হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন । তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৩৯ সালে আইএ পাস করে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হন। তিনি ১৯৪২ সালে বিএ অনার্স ১৯৪৩ সালে এমএ পাস করেন। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে প্রথম বিভাগে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি পাবনা জেলা শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ছাত্র জীবন থেকে তিনি রাজনীতি সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি মুসলিম লীগে যােগ দেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে (পিএনজি) যােগ দেন এবং ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। এ কারণে তিনি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী নামে পরিচিত।
১৯৫১ সালে এম মনসুর আলী আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগ দেন। ১৯৫৪ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ-কাজীপুর আসন থেকে যুক্তফ্রন্ট থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য, আইন ও রাজস্ব মন্ত্রী নিযুক্ত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তিনি স্বায়ত্তশাসন ও ৬ দফা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার যােগাযােগ মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাকে মন্ত্রিসভায় যােগদানের জন্য চাপ দেওয়া হয়। তিনি খুনীদের মন্ত্রিসভায় যােগদান করতে অস্বীকার করলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তাকে অন্য তিন জাতীয় নেতার সাথে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

এএইচএম কামরুজ্জামান
১৯২৩-১৯৭৫
বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামারুজ্জামান ১৯২৩ সালের ২৬ জুন রাজশাহীর নাটোর মহকুমার বাগাতিপাড়ার মালঞ্চ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বিসান রাজশাহী শহরের কাদিরগঞ্জে। তিনি রাজশাহী ও
পৃষ্ঠাঃ ৭৩৯

চট্টগ্রামে স্কুল শিক্ষা সমাপ্ত করে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে আইএ-তে ভর্তি হন এবং অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেন। তিনি রাজশাহী আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাস করে রাজশাহী জজ কোটে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ছাত্র জীননে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৪২ সালে তিনি রাজশাহী মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান এবং ১৯৫৭ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের এমএনএ নির্বাচিত হন। তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭০ সালে তিনি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি দলের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্র ও ত্রাণমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ত্রাণ, পুনর্বাসন ও বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পদত্যাগ করলে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে তিনি নিহত হন। তাকে রাজশাহীতে পারিবারিক গােরস্তানে দাফন করা হয়।

জেলহত্যা মামলার রায়
জেলহত্যা মামলা তদন্ত ও বিচার ১৯৯৭-২০০১ সালে শুরু হলেও বিভিন্ন অজুহাতে বিচার বিলম্বিত হয়। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে সাক্ষ্যদান সমাপ্ত হলে আবারও বিলম্বের ধারাবাহিকতা চলে। ঢাকা জেলা জজ মতিউর রহমান নাজিমউদ্দিন রােডে একটি ভবনে বিচার কাজ সমাপ্ত করেন। খুনীচক্রের ষড়যন্ত্র ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ঢাকা জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মুক্ত করবে। কয়েকবার রায়ের তারিখ পরিবর্তন করা হয়। অনেকে সন্দেহ করেন যে, রায় পরিবর্তন করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক নেতাদের খালাস দেয়া হয়েছে। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর জেলহত্যা মামলার রায় ঘােষণা করা হয় । ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১২ জনের যাবজ্জীবন এবং ৫ জনকে খালাস দেয়া হয় ।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা : রিসালদার মােসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ, এলডি আবুল হাশেম মৃধা।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা : লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুকুর রহমান, লেঃ কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ, লেঃ কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ, মেজর বজলুল হুদা, লেঃ কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লেঃ কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ, লেঃ কর্নেল এম এইচ এস বি নূর চৌধুরী, লেঃ
পৃষ্ঠাঃ ৭৪০

কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর শরিফুল হােসেন, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেন এবং ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম।
খালাসপ্রাপ্তরা : তাহের উদ্দিন ঠাকুর- সাবেক প্রতিমন্ত্রী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন – সাবেক প্রতিমন্ত্রী, কে এম ওবায়দুর রহমান- সাবেক প্রতিমন্ত্রী, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর – সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবং মেজর সামসুজ্জোহা ।
কারাগারে নিহত জাতীয় চারনেতার হত্যা মামলার রায় তাদের পরিবারের সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি। তাদের অভিযােগ, কোর্ট স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারেনি। সরকারী প্রভাবে আসামীদের সঠিক শাস্তি দেয়া হয়। শহীদ পরিবার উচ্চ আদালতে আপীল করেছে।

বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা হত্যার পর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার পর খন্দকার মােশতাক আহমদ ক্ষমতা দখল করে এবং তাজউদ্দীন আহমদসহ চারনেতার হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। তিনি সামরিক আইন জারি করে গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের নির্বাসন দেন। ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীর দ্বারা সংবিধানের মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসন দেন। বাঙালী জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ইসলাম ধর্ম সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমাজতন্ত্র বাতিল করা হয়। গণতন্ত্রের পরিবর্তে দেশে ২১ বছর সামরিক শাসন চলে।
তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন শােষণহীন সমাজ গড়তে । তার আদর্শ- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ নির্বাসিত। মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ শক্তিশালী হচ্ছে। তারা বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের হত্যা করছে। গণতন্ত্রের চর্চা নেই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ৭৪১

২৮
মানুষ ও নেতা
ব্যক্তিগত জীবন
তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালীর রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ নেতা। দুঃখের বিষয় বিশেষ কারণে তার নেতৃত্বের অসাধারণ গুরুত্ব দেশবাসীর কাছে প্রচারিত ও প্রতিভাত হয়নি। লিখিত ইতিহাস ও এতটা পক্ষপাতদুষ্ট হচ্ছে যে তাতে তার নেতৃত্বের পরিচয় ফুটে উঠছে না। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। কারণ তিনি সেই নেতাদের একজন যাদের নেতৃত্বের অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা থেকে গ্রহণের প্রয়ােজন এ জাতির জীবনে চিরকাল থাকবে।
এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সাধারণত যে লঘুচিত্ততা, ভাবালতা, আবেগ সর্বস্বতা, অদূরদর্শিতা, অস্থিরচিত্ততা, ভাওতা প্রবণতা, ক্ষমতালিপ্সা, বাকপ্রিয়তা ও দুনীতিপ্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে তা ছিল না। তিনি ছিলেন স্থির ও দূরদর্শী। কিশােরকাল থেকেই তিনি চিন্তাশীল ও কর্তব্যপরায়ণ, উন্নতর নৈতিক চেতনার অধিকারী ছিলেন। ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক জীবনে কথার মূল্য বা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলতেন, আর ছােট ছােট কাজের মধ্য দিয়ে সমাজ সচেতনতা ও স্বদেশ প্রীতির পরিচয় দিয়েছেন। আবেগ তার মধ্যে ছিল, কিন্তু আবেগের চালিকাশক্তি হিসেবে ছিল বিবেক ও বুদ্ধি। এসব বাঙালী চরিত্রের নয়, ইউরােপীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।১
তাজউদ্দীন আহমেদ বক্তৃতাপ্রিয় নেতা ছিলেন না। বাগ্মিতায় তিনি পারদর্শী ছিলেন না। তিনি জনসভায় বাগিতা প্রদর্শন না করে কেবল কাজের কথাই বলতেন। জনগণের প্রতি তার ছিল আন্তরিক ভালােবাসা এবং তিনি নিজের অস্তিত্বকে জনগণের অস্তিত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য রূপে যুক্ত বলে অনুভব করতেন।
তাজউদ্দীন আহমদ স্বভাবগতভাবেই আদর্শ সন্ধিৎসু, আদর্শনিষ্ঠ এবং জনগণের কল্যাণে আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত কর্মসূচি বাস্তবায়নে আত্মনিবেদিত নেতা ছিলেন। অন্তরের তাগিদে তিনি দেশবাসীর মুক্তির লক্ষ্যে রাজনীতিতে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৭৪২

ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন ক্ষমতা উপভােগ করার জন্য নয়। সমাজ ও জাতিকে নিয়ে তার আকাঙ্ক্ষাকে সফল করার আন্তরিক তাগিদে। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন । লক্ষ্য অর্জনের প্রয়ােজনে, দায়িত্ব পালনের জন্য স্বদেশী রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন ও সমাজ গঠন ছিল তার লক্ষ্য। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৬ দফা প্রণয়ন ও প্রচারকার্যে এবং আন্দোলন পরিচালনায় শেখ মুজিবুর রহমানের সহকর্মী হিসেবে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তা তার বিস্ময়কর সংগঠননিষ্ঠা, সামর্থ ও যোগ্যতা প্রমাণ করে। তাকে ছাড়া ৬ দফা আন্দোলন উন্নততর চরিত্র লাভ করত না। আদর্শগত দিক দিয়ে শেখ মুজিবের ঝোক ছিল আমেরিকার প্রতি আর তাজউদ্দীনের ঝোক ছিল মস্কোর প্রতি। তাজউদ্দীন জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তাজউদ্দীন ঐতিহাসিক বাস্তবতা বুঝতেন এবং সে কারণে তিনি শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত থেকেছেন। কোন বিকল্প প্রবনতার পরিচয় দেননি।
মজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের ঘােষিত আদর্শ ছিল গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, আর সে সরকারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। যে ঘােষণার ভিত্তিতে তখন রাষ্ট্র পরিচালিত হতাে তা ছিল রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি সরকার। তখন রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির অভিপ্রায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রীকেই উদ্যোগ নিয়ে সবকিছু করতে হয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২৬ সালের ২৩ জুলাই, মৃত্যু ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর। মাত্র ৪৯ বছর ৩ মাস ১০ দিন বয়সে তাকে হত্যা করা হয়। ৪৬ বছর বয়সে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ মহৎ গুণের অধিকারী ছিলেন। হিংসা-বিদ্বেষ তার মধ্যে ছিল না। তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তিনি শ্রমের মর্যাদা দিতেন। তিনি অবসর সময় বই পড়ে বা নিজের কাজ করে সময় কাটাতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়। ৩ নবেম্বর নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পূর্বে তার জেল জীবন সম্পর্কে তৎকালীন জেলার আমিনুর রহমান বলেন :
“তাজউদ্দীন সাহেব খুব লেখাপড়া করতেন। জেলের লাইব্রেরী থেকে আমরা তাকে বই-পুস্তক দিতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে তার বাগান করার খুব শখ ছিল। দুইবার তিনি আমাকে দিয়ে ধানমণ্ডি থেকে গােবর সার আনিয়েছিলেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭৪৩

আমি তাজউদ্দীন সাহেবের বাসার ঠিকানায় এসে গােবর নিয়ে গেছি। তাজউদ্দীন সাহেব করতেন না এমন কোন কাজ ছিল না। মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না হতাে। তিনি রান্নার জন্য প্রায় রােজ লাকড়ি কাটতেন। নিজের কাপড় নিজে ধুয়ে ফেলতেন। নিজ হাতে দড়ি টাঙিয়ে কাপড় শুকাতেন। তাজউদ্দীন সাহেব যে কাপড় ধুয়ে মেলতেন তা অত্যন্ত সুন্দরভাবে টাঙানাে থাকত, কোন কোণা ঝুলত না। তারপর কিভাবে বেঞ্চ বানাতে হয় তা শেখান, গাছ লাগান সব করতেন। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। বিশেষ করে মনে পরে ওনার দাঁতগুলাে খুব চমৎকার ঝকঝকে সুন্দর ছিল। পরবর্তীতে এই হত্যাকাণ্ডের বহু বছর পর আমি যখন ডিআইজি হয়ে আবার এই ঢাকা জেলে গেলাম, তখন দেখেছি ওনার হাতে লাগানাে তিনটা গাছ ছিল। তার মধ্যে একটা জবা ফুলের গাছ। মৌসুমী ফুলের মধ্যে ডালিয়াসহ বহু গাছ তিনি লাগিয়েছিলেন সেই সময়টাতে। আর তাজউদ্দীন সাহেব তাে খুব রিজার্ভ কথাবার্তার মানুষ ছিলেন। আলফালতু কথা একদম বলতেন না। আমরা লাইব্রেরীর ক্যাটালগ ওনাকে দিতাম, তিনি তাতে মার্ক করে দিতেন। নজরুল সাহেবও বই পড়তেন।”
তাজউদ্দীন আহমেদ কত বড় মহৎ গুণের অধিকারী ছিলেন তা জানা যায় মুজিবনগর সরকারের প্রথম সচিব মুহাম্মদ নূরুল কাদের খানের লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন :
“এদিকে ১০-১১ ডিসেম্বরের মধ্যে অধিকাংশ থানায় বাংলাদেশ সরকারে প্রশাসন চালু হয়ে যায়। ফলে সংস্থাপন বিভাগের সচিব হিসেবে আমাকে প্রচর পরিশ্রম করতে হয়। এ কথা সত্য, অস্বাভাবিক কাজের চাপ এবং প্রচণ্ড উত্তেজনার পরও তখন মনে হয়নি যে আমি ক্লান্ত। বার বার উচ্চারিত বলে মনে হলেও আমাকে এ কথা বলতেই হবে আমার এই প্রাণশক্তি যুগিয়েছেন স্বয়ং তাজউদ্দীন আহমদ। একটা সরকার পরিচালনাকারী অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও অত্যন্ত ধীরস্থির মানসিকতাসহ এই মহান ব্যক্তি একের পর এক এগিয়ে গেছেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমি কাজ করেছি। তাজউদ্দীন আহমদ এমন একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যার তলনা বােধহয় তাজউদ্দীন আহমদ ছাড়া আর কারও হয় না।
ঘুম থেকে উঠে তার কাজের যাত্রা হতাে প্রতিদিন। বেঁচে থাকার প্রয়ােজনে যেটুকু ঘুম দরকার সেটুকুই তিনি বরাদ্দ করেছিলেন নিজের জন্য। সে রকম ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এসে নিশ্চয়ই কেউ কাজে ক্লান্তিবােধ করতে পারে না।। তাজউদ্দীন আহমদের কাছাকাছি থাকার সুবাদে আমি অন্তত তাই অনুভব করেছি। আমি কি ভুলত পারব সে দৃশ্যের কথা- একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের
পৃষ্ঠাঃ ৭৪৪

পরিধেয় একমাত্র শার্ট ধুচ্ছেন বাথরুমে । বাংলা সাবান ঘষে ঘষে শার্ট পরিস্কার করছেন আর ডিটেকশন দিচ্ছেন বাথরুমের দরজায় মোড়ায় বসা বাংলাদেশ সরকারের প্রথম নিয়োজিত সচিবকে। অবিশ্বাস্য দৃশ্যপটে যিনিই অংশ নেয়ার সুযোগ পান তার পক্ষে কাজে ক্লান্তি না আসাই স্বাভাবিক। এমনও হয়েছে রাত দুটো পর্যন্ত কাজ শেষে ঘুমাতে গেছেন। পরের দিন সকালবেলা সাতটা না বাজতেই আবার দেখা গেছে তাকে টেবিলে।
তার মেধা সম্পর্কে যুদ্ধের আগেও শুনেছি। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পর্কেও কিছু কিছু জেনেছি, কিন্তু একজন মানুষ যে কতটা পরিশ্রম করতে পারে তা দেখেছি যুদ্ধকালে তার সান্নিধ্য পাওয়ার পর।
সরকারী দায়িত্ব পালনে তাজউদ্দীন আহমদ কঠোর নিয়ম মেনে চলতেন। স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়প্রীতি, উলঙ্গ দলীয়করণের উর্ধে উঠে তিনি দেশ সেবা করেছেন। সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের খান একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন। প্রথম ব্যাচের অফিসার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পত্র শেখ কামাল। শেখ কামাল প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসে স্যালুট দিয়ে ব্যক্তিগত খবরাখবর জানতে চান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বললেন, পেশাগত আচরণ প্রত্যাশা করি। শেখ কামাল আবার স্যালুট করে, স্যার দুঃখিত বলে নিজ অবস্থানে চলে যান। অনুষ্ঠান শেষে লেঃ শেখ কামালকে ডেকে বুকে নিয়ে বাচ্চা শিশুর মতাে হু হু করে কেঁদেছিলেন।”৩
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ স্মরণে প্রাবন্ধিক, দার্শনিক ও সমাজচিন্তাবিদ সরদার ফজলুল করিম লিখেছেন :
“তাজউদ্দীন আহমদ আমার মনের এক স্মরণীয় মানুষ। এমন মানুষ জীবনে আমি কম পেয়েছি। তার নানা কারণ। অথচ তাজউদ্দীন আহমদের জন্য যেমন ১৯২৫ সালে আমার জন্মও সেই ১৯২৫ সালে।… তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমার যে পরিচয় না ঘটেছে তা নয়। আমার স্মৃতি রােমন্থনের একটি পাতায় দেখেছি ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে কোন একটি ধর্মঘট পালনকালে বর্তমান পােস্ট অফিসের গা ঘেঁষে যেখানে রমনা পােস্ট অফিস ছিল সেই পােস্ট অফিসের পাশে দাড়িয়ে ধর্মঘটের সাফল্যের জন্য যে পিকেটিংয়ের লাইনে আমরা দাড়িয়েছিলাম তাতে যেমন ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ তেমনি তার হাত ধরে দাড়িয়েছিলাম আমিও…।
তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব ছিলেন আকৈশাের এবং আজীবন রাজনৈতিক বােধসম্পন্ন অসামপ্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন মানুষ। আজকের এই শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের
পৃষ্ঠাঃ ৭৪৫

পাতায় স্থানের সীমাবদ্ধতার জন্য স্মৃতির বিন্দু বা টুকরাে স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে এবং ডুবে যাচ্ছে তা লিপিবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তবুও তার দু-একটি বলার আবেগকেও আমি রােধ করতে পারছিনে। তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি যথার্থরূপে আবিষ্কার করি তার শাহাদাত বরণের পরে তার অনবদ্য সুন্দর হস্তাক্ষরে ইংরেজীতে রচিত সংখ্যাহীন দিনলিপি দেখতে পাওয়ার সময়।…”৪
মহাত্মা গান্ধী যেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন (১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারী) সেদিন ২৩ বছরের যুবক তাজউদ্দীন তার নিজের হাতে ইংরেজী ভাষায় যে দিনলিপি তৈরি করেছিলেন তা পরবর্তীকালে তার প্রকাশিত ডায়েরিতে অক্ষত হয়ে রয়েছে।
তাজউদ্দীন সাহেবের সেদিনের ডায়েরি পাঠ করে আমি অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলাম ‘সমগ্র ভারত উপমহাদেশে গান্ধীজীর মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় ২৩ বছরের যুবক তাজউদ্দীনের ডায়েরি ছিল একেবারে তুলনাহীন।
আমার একটি স্মৃতিকথা, কিংবা তার কোন মৃত্যু দিবসের স্মৃতি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ইংরেজী বাক্য ব্যবহার করে আমি বলেছিলাম- Tajuddin Ahmed has yet to be discovered তাজউদ্দীনকে জানতে আমাদের এখনও বাকি আছে।”৫
সর্দার ফজলুল করিম তার প্রকাশিত দিনলিপি আবক্ষের অন্তর্গত ৩১-১২-৭৪ তারিখের দিনলিপির শিরােনাম ছিল- মূক তাজউদ্দীন। সেই লিপিটির শুরুতে লিখেছিলেন- “প্রায় দুমাস আগে ঘটনা হিসাবে এসেছে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পদত্যাগ। ঢাকার কানকথা বলে যে তাকে নাকি পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। ঘটনাটি যখন ঘটে (২৬ অক্টোবর) তখন এটা একটা বড় ঘটনা বলে মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল হয়ত তাজউদ্দীন সাহেবের কিছু বক্তব্য থাকবে। কিন্তু দেখা গেল, তিনি কিছু বললেন না। বস্তুত কয়েকদিন যদিও দু-একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় তিনি গৃহবন্দী বলে খবর ছাপাল, তবু বর্তমানে তিনি কি অবস্থায় তাই আন্দাজ করা মুশকিল। সমাজে-নামাজে বিবরণে-বিবৃতিতে কোথাও আর তার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এটি বাংলাদেশের পটভূমিতেও বিশেষ বিস্ময়ের ব্যাপার।”
তাজউদ্দীন আহমদের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র সম্পর্কে ড. আনিসুজ্জামান বলেন :৬
“তাজউদ্দীন আহমদের ব্যক্তিত্বের বিরলতা ও প্রতিভার অনন্যসাধারণতা তারাই বিশেষ করে উপলব্ধি করেছেন যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযােগ পেয়েছেন। আমার সেই সৌভাগ্য ঘটেছিল। ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমি যখন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে আইএ ক্লাসের প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগে
পৃষ্ঠাঃ ৭৪৬

যােগ দিই এবং অচিরে এর অফিস-সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করি। যুবলীগের সভাপতি তখন মাহমুদ আলী , সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ। তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং কার্যনির্বাহী সমিতির সদস্য। ইমদাদুল্লাহ ও মােহাম্মদ সুলতান যুগ্ম সম্পাদক, দেওয়ান মাহবুব আলী বোধহয় কোষাধক্ষ্য, মােহাম্মদ তােয়াহা একজন সহ-সভাপতি। তাজউদ্দীনের মতো এরাও কেউ আর এখন নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাজউদ্দীন আহমদ অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে বিএ পাস করেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে। মেধাবী ছাত্র ছিলেন; তবে রাজনীতির আকর্ষণে আর এমএ পড়েননি। তখনকার দিনে রাজনীতি আর ওকালতির মধ্যে অনেকেই একটা সম্পর্ক খুঁজে পেতেন । তাজউদ্দীনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হয়েছিলেন, তবে এলএলবি পাস করেছিলেন বহু পরে, তখন আমিই বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র লেকচারার হয়ে গেছি।
যে কোনাে বিষয়কে ধীরস্থিরভাবে তীক্ষ্ণ ধী’র সঙ্গে বিচার করার ক্ষমতা তার ছিল। স্বভাবতই এ রকম বিশ্লেষণ করতে সময় নিতেন। তবু সকলে খুব মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনতেন। তিনি জনসভার ভালাে বক্তা ছিলেন না, বাগ্নিতা তার সহজাত ছিল না, আবেগপ্রবণতাও তার পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না। ঘরোয়া সভায় তার বক্তব্য খুব আকর্ষণীয় হতাে। ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার অবদানের কথা সুবিদিত। তাঁর সে সময়কার দিনলিপি এখন ইতিহাসের অমূল্য উপকরণ।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একজন নেতা হিসেবে তাকে আমি দেখেছি। সেবারেই বােধহয় তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট থেকে প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য হয়েছিলেন। প্রদেশে ৯২(ক) ধারা জারি হলে আবার জেলে যান। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে বছর খানেক কারাবাস করেন। তারপর ১৯৬৪ ও ১৯৬৬তে আবার গ্রেফতার হন। শেষবার বন্দীত্ব থেকে মুক্ত হন ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে ছাত্রলীগের, যুবলীগের ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে তিনি ১৯৬৬ তে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
সংগঠনের বাইরে তাজউদ্দীনের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতাে পাটুয়াটুলিতে তাঁর বন্ধু এমএ মােহাইমেনের পাইওনিয়ার প্রেসে। তাছাড়া বামপন্থী রাজনীতিবিদ ডা. এমএ করিমের মালিকানাধীন নবাবপুরের কিশাের মেডিকেল হল ছিল ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত তাজউদ্দীনের একটা আড্ডার জায়গা। হাতে সময় থাকলে সন্ধ্যায় এখানে আসতেন। তখন অনেকেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এখানে
পৃষ্ঠাঃ ৭৪৭

আসতেন। আমি তখন ঠাটারি বাজারে থাকতাম । বাড়ির কাছাকাছি বলে এখানে প্রায়ই আসতাম। যুবলীগ আমলের পরিচয় এখানেই ঘনিষ্ঠ হয়। নীলক্ষেতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের আসে এবং কলাভবনে আমার অফিস কক্ষেও তিনি একাধিকবার এসেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতির প্রতি আমার পক্ষপাতের কথা তিনি জানতেন। এ সত্ত্বেও সম্ভবপর হলে তার লিখিত বক্তৃতা বা দলীয় ঘােষণাপত্রের খসড়া তিনি আমাকে একবার দেখিয়ে নিতেন। এ ধরনের কাজের সময়ে দু’একবার তাঁর বন্ধু আবদুল মমিন সঙ্গে ছিলেন। রাজনৈতিক দলিল তৈরি করার ক্ষেত্রে আমার সামর্থ্যকে তিনি বোধ হয় একটু বাড়িয়ে দেখতেন।
ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায়ই তাজউদ্দীনের অধিকার ছিল অসামান্য। শব্দ ও প্রতিশব্দের অর্থ ও ব্যঞ্জনা সম্পর্কে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। বাংলার শিক্ষক হয়েও আমি একটা বানান ভুল লিখেছিলাম, তিনি শুধরে দিয়েছিলেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর জনসমক্ষে তাজউদ্দীনের গুরুত্ব বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ১৯৭১ সালের অসহযােগ আন্দোলনের সময়ে তিনিই হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধুর পরে দ্বিতীয় নেতা। অসহযােগ সংক্রান্ত নির্দেশাবলী প্রণয়নে, সাংগঠনিক আয়ােজনে, আবার সংবিধান রচনার প্রশ্নে- সব ক্ষেত্রেই তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। ২৫ মার্চের সেই কালরাতের পরে তিনি কি অবস্থায় দেশত্যাগ করেন এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে সে দেশে বাংলাদেশ সরকারের কার্য পরিচালনার ব্যবস্থা করেন, তা এখন সুবিদিত। পরবর্তী নয় মাস মূলত তার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় । মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের পশ্চাতে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কৌশলগত চিন্তা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দূরদর্শিতার ভূমিকা ছিল খুব বড় ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। দলের ভেতর থেকে তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রতি একাধিকবার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সমর্থন লাভ করে তিনি এই বিরােধিতার মােকাবেলা করেন। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে আপােষের চেষ্টা করেন, তাজউদ্দীন তাকেও ব্যর্থ করতে সমর্থ হন। জাতিসংঘে প্রেরিত বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে তিনি মােশতাককে অন্তর্ভুক্ত করেননি এবং মােশতাকের প্রিয়পাত্র মাহবুবুল আলম চাষীকে সরিয়ে আবুল ফতেহকে শেষকালে পররাষ্ট্র সচিব নিয়ােগ করেছিলেন। মােশতাকের জন্য তাজউদ্দীনকে কখনও ক্ষমা করেননি।
মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়টা তাজউদ্দীন নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৭৪৮

থাকেন। থিয়েটার রোডের যে বাড়িটায় ছিল বাংলাদেশ সচিবালয়, তাতে একটা ছোট ঘরে তার অফিস ছিল। পেছনের বড় ঘরটায় তিনি থাকতেন। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ ও আমি ওই ঘরে বসে তার অনেক বক্তৃতা তৈরি করেছি। তিনি বলতে চান, সে কথাটা আগে তার সঙ্গে আলােচনা হতো। তারপর মুরশিদ সাহেব নয় আমি খসড়া তৈরি করতাম। তাজউদ্দীন সে সম্পর্কে মন্তব্য করার পর একজন সেটার চূড়ান্ত চড়ান্ত রূপ দিতাম এবং অন্যজন বাংলা অথবা ইংরেজি অনুবাদ করতাম। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না বলে তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা তিনি সম্পূর্ণ পালন করেছিলেন। নিজের হাতে তাঁকে কাপড় ধুতে দেখেছি। এক সকালে গিয়ে দেখি, দু’চোখ লাল, চুল উসকো- খুসকো। কি হয়েছে, জানতে চাওয়ায় বললেন, ‘রাতে ঝড়বৃষ্টির সময়ে বাতাসের বেগে জানালা খুলে গিয়েছিল। বন্ধ করতে গিয়ে ঝাড়বৃষ্টির প্রবণতা লক্ষ করলেন। তখন মনে হলাে, শরণার্থী শিবিরে দেশের মানুষের কি দুর্দশা হচ্ছে। অন্যদিকে দৃঢ় চিত্ততা। বাংলাদেশের নিরীহ মানুষর লাশের স্তুপের নিচে পাকিস্তান মরে গেছে। এ ধারণা থেকে এক চুলও নড়েননি তিনি। পাকিস্তানী সামরিক সরকার যখন বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার প্রহসন করল, তখন তিনি মোটেই চিন্তিত হননি। দেশের মধ্যে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচন হবে শুনে আমরা অনেকে খুব উকণ্ঠিত হয়েছিলাম। তিনি খুব প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘ওরা যত ইচ্ছা ইলেকশন করুক। অ্যাসেম্বলি বসতে দেব না।’
অল্প বয়সে সমাজতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি, তবে ঠিক কমিউনিজমের প্রতি নয় । অন্তত জীবনের শেষ দশ বছরে তাঁর ঝোঁকটা ছিল বড় পাবলিক সেক্টরের দিকে, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রীয় সেবার দিকে। এমনিতেই তিনি বিশ্বাস করতেন, বিদেশী সাহায্য দেশকে পরনির্ভরশীল করে তােলে, তার উপরে রাষ্ট্রীয় নীতিতে হস্তক্ষেপ করে। শর্তহীন সাহায্য বলে কিছু হতে পারে। তিনি তা মনে করতেন না। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কাছ থেকে আমরা যে সাহায্য নিচ্ছি, তার জন্য ভারতকেও কিছু ছাড় দিতে হবে, এ কথাও তিনি ভাবতেন। মুক্তিযুদ্ধবিরােধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের ভাবনাটা তারকাছে একেবারেই গ্রহণযােগ্য ছিল না। দেশে ফিরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এ কথা তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন। তারা যখন জানতে চেয়েছিলেন যে, বাইরের সাহায্য ছাড়া আমাদের চলবে কি করে, তাজউদ্দীন বলেছিলেন, ‘আমরা দারিদ্র্য ভাগ করে চলবাে।’
পৃষ্ঠাঃ ৭৪৯

তাজউদ্দীন এ ধারণার সঙ্গে রাজনীতিবিদ ও প্রশাসকদের অনেকের ধ্যানধারণা মেলেনি। দেশ ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে অনেক সময়ে তিনি নৈতিক সঙ্কটে পড়েন। স্বাধীনতা লাভের পর তাঁর কাছে একটি সরকারী ফাইল আসে; তাকে জরুরী ভিত্তিতে সার আমদানির প্রস্তাব ছিল। সার আমদানি করা সত্যিই জরুরী ছিল। তবে ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে, হাতে এখন সময় এতাে কম যে, আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকার সুযােগ নেই, আগে সরবরাহ করেছে এমন এক বিদেশী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সার কেনা হােক। তিনি বললেন, সার কেনার কথা এতদিনে মনে পড়ল কেন? এ প্রস্তাব মেনে নিলে দুনীতিকে উৎসাতি করা হবে, না মানলে সারের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হবে। আমি যা-ই করি, তা অন্যায় হবে।’
সবচেয়ে দুঃখের কথা, কিছু চক্রান্তকারী বঙ্গবন্ধু আর তার মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল । তারা সফলও হয়েছিল। ক্ষতিটা হয় দেশের তাজউদ্দীন মন্ত্রিসভা ছেড়ে ছিলেন। তবে যারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করল, তারা তাঁকে ছাড়ল না। বস্তুত, খন্দকার মােশতাক ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার আর সব সদস্যকেই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলাে।
তাজউদ্দীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন ৪৬ বছর বয়সে, নিহত হন ৫০ বছর বয়সে। তাকেও আমাদের অনেক কিছু দেবার ছিল। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর তাজউদ্দীনের যে পরিণতি হয়, তা কি তার প্রাপ্য ছিল? এই হত্যার কি বিচার হবে না? তাঁর নিকট আমাদের যে ঋণ, তা কি আমরা ভুলে যাব? তাকে কি এখনও আমাদের কিছু দেবার নেই? তার যথােচিত প্রাপ্য কবে তাকে দেবে?”
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার সর্বশেষ মােলাকাত দোসরা অথবা তেসরা আগস্ট মধ্যরাতে ১৯৭৫ সালে। পরদিন আমি ম্যানিলা ফিরে যাই। ইতিমধ্যে দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, দলের ১১৫ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘােষিত হয়েছে এবং গবর্নর নিয়ােগ করে জেলা প্রশাসককে নতুন ধাচে সাজানাের ব্যবস্থা হয়েছে। তার সঙ্গে আলােচনায় সব সময়ই দেশের সমস্যা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এবারে দু-একটি অন্য ধরনের কথা হলাে। তিনি দুঃখ করলেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের অভিজ্ঞতা কখনও বলতে পারেননি। তার নিজেরও অভিমান হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছেন। তিনি অভিমান করেছিলেন যে, ‘মুজিব ভাই’ তার কাছ থেকে জানতে চাননি। বাকশাল ও দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবেও তিনি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭৫০

তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা, বিচক্ষণতা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও দূরদর্শিতার নিদর্শন সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর ও তৎকালীন রাজনীতি গ্রন্থে তাজউদ্দীন আহমদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে সমীচীন । তাজউদ্দীনের ডায়েরিতে শুধু সমকালীন ইতিহাসই ছিল না। ছিল একটি নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদের মনমানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। তাজউদ্দীন ছিলেন ইতিহাস-সচেতন, চিন্তাভাবনায় ধীর-স্থির ও স্বচ্ছ, কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত পরিপাটি ও সুশৃঙ্খল, ঘটনা বিশ্লেষণে অসাধারণ বিচক্ষণ, বিশ্বাসে একনিষ্ঠ, আচরণে অকৃত্রিম ও আকর্ষণীয় এবং পরিকল্পনায় প্রয়ােগবাদী ও দূরদর্শী। তাজউদ্দীনের ধীশক্তি ও মেধার আরও পরিচয় মেলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচয়িতা মইদুল হাসানের মূলধারা ‘৭১ গ্রন্থে। একটি প্রতিরোধকে সর্বজনীন রূপদানে এবং ধাপে ধাপে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যের পথে নিয়ে যেতে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। যুদ্ধে বিজয়ের পর দেশ গঠনের রূপরেখা প্রণয়নে তিনি ব্রতী হন যুদ্ধের শেষ অধ্যায়ে পৌছবার আগেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ে তার সুন্দর হাতে লেখা অনেক নোট ও নির্দেশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযােগ আমার হয় তার শাহাদতের প্রায় অর্ধযুগ পরে। তার যুক্তি ও বিচার আমার কাছে মনে হয়েছে সত্য ও ন্যায়শ্রিত। সমকালীন চাপের মুখে নতি স্বীকার না করে ধীর মস্তিষ্কে নিতান্ত বিষয়মুখী বিচারে, নিজস্ব অভিরুচি বা সংস্কারের উর্ধ্বে উঠে, ন্যায় ও যুক্তিকে সমুন্নত করতে তিনি সর্বদা সচেষ্ট ও সজাগ থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যা বােঝা যায় তার মূর্ত প্রতীক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, পরমতসহিষ্ণু, জনস্বার্থে নিবেদিত, ন্যায়বিচারে আস্থাশীল, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও সমতায় ব্রতী, মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা, শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার দিশারি, প্রচারবিমুখ এবং কাজকর্মে মৌমাছির মতাে ব্যস্ত- এই ছিলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক তাজউদ্দীন আহমদ।
তাজউদ্দীন আহমদ স্মারক বক্তৃতায় বিশিষ্ট গবেষক-অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন : “স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সহস্র বছরের সংগ্রামের যন্ত্রণার ফসল। অনেক বীর সংগঠকের শ্রমে, ঘামে, রক্তে জড়াজড়ি করে আছে বাংলাদেশের পতাকা। এদের অন্যতম হলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ধাত্রীর ভূমিকা পালনকারী এ জাতীয় বীরের জীবন, তার সমাজ, তার উন্নয়ন ভাবনা আজকের দিনের নিরাশা জাতিকে ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে দিতে পারে। বিস্মরণের গ্লানি মুছে ফেলে আবার শিরদাড়া খাড়া করে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা দিতে পারে জাতিকে। উন্নয়নের জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৭৫১

মানুষকে আশাবাদী করতে পারে। নিঃসন্দেহে তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও ভাবনার ওপর আলােকপাত করা মানেই অন্যান্য জাতীয় বীর সংগঠকতদের উপেক্ষা করা নয়। তাদের কর্মময় জীবন নিয়েও সত্ন গবেষণা অপরিহার্য ।”
উনিশ শতক ছিল বাঙালী সমাজে নবজাগরণের যুগ। রাজা রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, খ্রিস্টান মিশনারিরা পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির যে মশাল প্রজ্বলিত করেছিল তার পথ ধরে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সমাজ সংস্কারকালে সমাজের কুপ্রথা- সতীদাহসহ অনেক প্রথা দূর করে। তবে কলকাতাকেন্দ্রিক উনিশ শতকের নবজাগরণ থেকে বাংলার মুসলমান সমাজ বিচ্ছিন্ন ছিল। মুসলিম সমাজে শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসেন নবাব আবদুল লতিফ, স্যার সৈয়দ আমীর আলী, স্যার সলিমুল্লাহ, এ কে ফজলুল হক, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী প্রমুখ। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে নবচেতনার সৃষ্টি হয়। বঙ্গভঙ্গ রদ হলে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে পরে। নিজ সম্প্রদায়ের দাবি আদায়ের জন্য স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯০৬ সালে ঢাকায় নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হয়। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। অতঃপর ঢাকাকে কেন্দ্র করে সচেতন অসাম্প্রদায়িক গােষ্ঠী গড়ে ওঠে। তবে ঢাকা কেন্দ্রিক সমাজ কলকাতার নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতাকেন্দ্রিক নেতৃত্ব ঢাকাসহ পূর্ব বাংলা প্রভাবিত করত। পূর্ব বাংলার অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিকাশের নেতৃত্বে ছিলেন এ.কে ফজলুল হক। উভয় বাংলায় তার নেতৃত্ব ছিল শক্তিশালী। বাংলার মুসলিম যুব সমাজ বেশি প্রভাবিত হয়েছে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের প্রগতিশীল নেতৃত্ব দ্বারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের অনুসারী।
উপমহাদেশের ইতিহাসে উনিশ শতক ছিল শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আবির্ভাবের যুগ। এ শতকে জন্মগ্রহণ করেছেন- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এ.কে ফজলুল হক, সি আর দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মওলানা মুহাম্মদ আলী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ। ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার আন্দোলনে তারা নেতৃত্ব দেন। উনিশ শতকে ব্রিটিশবিরােধী যে সংগ্রাম শুরু হয় তার ধারাবাহিকতা এগিয়ে নেয়ার কর্মীবাহিনী সৃষ্টি হয়েছে বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে।।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে এদেশে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি হয়। ধর্মীয়
পৃষ্ঠাঃ ৭৫২

চেতনার ভিত্তিতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান দাবি করে চল্লিশের দশকের মুসলিম ছাত্রনেতারা পাকিস্তান দাবির স্বপক্ষে ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ গ রাজনীতিতে জড়িত। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টিকে তিনি স্বাগত জানাননি তিনি মনেপ্রাণে ভারত বিভক্তি চাননি। তিনি বিশ্বাস করতেন ভারত বিভক্তি হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে স্থায়ী শান্তি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না । ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত ভাগ ও পরবর্তীকালে লাখ লাখ হিন্দু-মুসলমান-শিখ স্বাধীনতার বেদীমূলে নিহত হয়েছে- আজও দাঙ্গা চলছে।
বাংলার মুসলমান যুব সম্প্রদায়ের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বঙ্গভূমি। তাদের সে আশা বঙ্গ বিভাগের ফলে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। তাই দেখা দেয় ১৯৪৭ সালের ৩ জুন বাংলা বিভক্তি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ঢাকায় কামরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বের তাজউজ্জীন আহমদ, অলি আহাদ, মুহাম্মদ তােয়াহা, শামসুল হক প্রমুখ নতুন দল গণআজাদী লীগ গঠন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে ছাত্র ও যুব গােষ্ঠীর মোহভঙ্গ হয়। তাদের অন্যতম ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। তাজউদ্দীন আহমদ তার বন্ধু ও সতীর্থরাই ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে আন্দোলেন নেতৃত্ব দেন। “বলতে দ্বিধা নেই তাজউদ্দীন ও তার সতীর্থদের মধ্য থেকে ভাষা আন্দোলনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসা নেতৃত্ব শেষ অব্দি উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৪৮-৫২-এর পরে বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে শুভ সূচনা হয় তার সকল উত্তরণ ঘটে একাত্তরে। এই উত্তরণের পেছনে। তাজউদ্দীনের সাংগঠনিক অবদান অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।”
তাজউদ্দীন আহমদের পারিবারিক জীবন
তাজউদ্দীন আহমদ একজন আদর্শ স্বামী, একজন আদর্শ পিতা এবং একজন আদর্শ মানুষ ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সংসারের দায়িত্ব পালন করতেন। তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২৬ সালে। তার পিতা মৌলভী ইয়াসিন খান ১৯৪৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তখন তিনি কলেজ ছাত্র। লেখাপড়ার চেয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। মাত্র ২০ বছর বয়সে পিতাকে হারালেন। তার বড়ভাই ওয়াজিউদ্দিন খান ১৯৪৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তরুণ বয়সে তাজউদ্দীনকে সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। পরিবারের আয়ের অন্যতম উৎস ছিল বন সম্পদ। বন মালিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনি দুর্নীতিবাজ বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কৃষকদের নিয়ে সংগ্রাম করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা লড়েছেন। বন কর্মকর্তারা তাজউদ্দীন আহমদকে মিথ্যা মামলায় জড়িত করেন। তারা ষড়যন্ত্র করে
পৃষ্ঠাঃ ৭৫৩

তাজউদ্দীনের জামিন বাতিল করে তাকে হাজতে প্রেরণ করেন। দু’দিনের মধ্যে জামিনে মুক্তি লাভ করেন। তার আইনজীবী ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আতিউর রহমান খান। এ সময় ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, মুহাম্মদ তােয়াহা, মুহাম্মদ অলি আহমদ, পুরনাে ঢাকার শওকত আলী, মােহসিন, ডা. করিম প্রমুখ। ছাত্র জীবন থেকে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সংগ্রামী।
বন বিভাগের নির্যাতন থেকে মুক্তি আন্দোলনের নেতা হিসেবে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সমাজের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে তিনি পরিবারের প্রতি সঠিক দায়িত্ব পালন করেছেন। ছােট ভাইবােনদের লেখাপড়ার প্রতি তিনি সচেতন ছিলেন। বােনদের উচ্চশিক্ষা দিতে পারেননি। কিন্তু বিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করেছেন, ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত পরিবারে বিয়ে দিয়েছেন। ছােট ভাই আফসার উদ্দিন ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাসের পর তাজউদ্দীনের সাথে ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আফসার উদ্দিন তার ভাইয়ের সাথে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ও এলএলবি ডিগ্রী লাভ করে বারে যােগ দেন। তাজউদ্দীন ভাইয়ের ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন এবং বােনের মেয়ে আনারকে ঢাকার বাসায় রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে সুপাত্রে বিয়ে দিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারের সদস্যগণ সততা ও ভাল মানুষ হিসেবে খ্যত। তার ছােট ভাই আফসার উদ্দিন উপজেলা চেয়ারম্যান ও ১৯৯৬ সালে কাপাসিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ নিজের বিয়ের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। তিনি জনগণের সেবক ছিলেন। সংসার জীবনের প্রতি উদাসীন ছিলেন। ১৯৫৮ সালে বিয়ের পূর্বে তাজউদ্দীন আহমদ কোনাে মেয়ের সাথে প্রেম করেছেন এরকম কোনাে ঘটনা নেই। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা কলেজের তার শিক্ষক সৈয়দ সিরাজুল হকের কন্যা সৈয়দা জোহরা খাতুনকে বিয়ে করেন। জোহরা খাতুনের ডাক নাম লিলি। তাজউদ্দীন তার স্ত্রীকে লিলি বলে ডাকতেন। সৈয়দ সিরাজুল হক ঢাকা কলেজে আরবীর শিক্ষক ছিলেন। তিনি পশ্চিম বাংলার অধিবাসী ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সিরাজুল হকের নিকট আরবী ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের কয়েক পারা সুরা মুখস্থ ছিল। তিনি জের যবর ছাড়া কোরান পড়তে পারতেন।
পিতা ও বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাজউদ্দীন আহমদকে সংসার পরিচালনা করতে হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিশ্রমী। পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে তিনি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সংসারের ব্যয়ভার বহন করেন। তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৭৫৪

নােয়াখালীর রহিম উল্লাহ চৌধুরীর শিল্প প্রতিষ্ঠান ও লঞ্চ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তিনি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কয়েক বছর চৌধুরী কোম্পানিতে দায়িত্ব পালন করেন। চোধুরা কোম্পানিতে তার সহকর্মী ছিলেন কষক-শ্রমিক পার্টির নেতা, শেরে বাংলার বিশেষ সহকারী এবং বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ আজিজুল হক শাহজাহান । তিনি তাজউদ্দীন আহমদ এর ভক্ত ও গুণগ্রাহী।
তাজউদ্দীন আহমদ একজন সুপুরুষ ছিলেন। তিনি লম্বায় ছিলেন ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি। তার গায়ের রং ছিল খুব ফর্সা। তার পূর্ব পুরুষ ছিল রাজস্থান ও দিল্লীর অধিবাসী। সােহেল তাজ ২০০১ সালে পিতার কাপাসিয়া আসন হতে জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন। তাজউদ্দীনের মাতা মেহেরুন্নেসা বেগম একজন আদর্শ গৃহিনী ছিলেন। ছেলের লেখাপড়ার প্রতি তিনি বিশেষ যতবান ছিলেন। তাজউদ্দীন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পরীক্ষায় অনিয়মিত ছিলেন। মায়ের বারবার নির্দেশে তাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। অনার্স পরীক্ষা ঠিক সময়ে না দেওয়ায় তার মা খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। মায়ের কারণে তাকে ১৯৫৩ সালে অর্থনীতিতে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। তার পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল ১৯৫১ সালে। ১৯৫৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তার এমএ পড়া আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তার স্নেহময়ী মা ১৯৬৯ সালের ১৮ আগস্ট দরদরিয়া গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। মায়ের মৃত্যু খবর শুনে তাজউদ্দীন আহমদ দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে ৫ মাইল কাদাপথ ও শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিয়ে মায়ের দাফন সম্পন্ন করেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার পর আওয়ামী লীগ নেতাশূন্য হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের দুর্দিনে জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তাকে দলের আহবায়ক করা হয়। ১৯৯৬ সালে তিনি মেহেরপুর থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অল্প ভােটে তিনি হেরে যান। তাকে ষড়যন্ত্র করে হারানাে হয়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
তাজউদ্দীনের ৩ কন্যা বিবাহিতা। মেঝ মেয়ে সিমিন হােসেন রিমি একজন সুলেখিকা। তিনি পিতার স্মৃতিকে ধরে রেখেছেন। তার লেখা ‘আমার ছােটবেলা-১৯৭১’ এবং ‘বাবা তাজউদ্দীন আহমদ’ তথ্যপূর্ণ গ্রন্থ। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আলােকের অনন্তধারা’ গ্রন্থে তাজউদ্দীনের কর্মময় জীবন আলােচিত হয়েছে। তার সহপাঠী, সহকর্মী ও বন্ধুরা তাজউদ্দীন সম্পর্কে প্রবন্ধ লেখে তাকে স্মরণীয় করে রেখেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদ পরিবারের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। দিনে তিনি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাসায় ফিরে আবার লেখা ও পড়া।
পৃষ্ঠাঃ ৭৫৫

তার সাতমসজিদ সড়কের বাসায় অনেক বইয়ের সমাহার ছিল। তিনি বিশ্ব রাজনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি বিষয়ে বই পড়তেন। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী তাকে পলাতক দেখিয়ে তার অনুপস্থিতিতে কারাদণ্ড প্রদান করে এবং তার বাসভবনের বইপুস্তকসহ মালামাল নিলামে বিক্রি করে দেয়। তার লেখা মূল্যবান ডায়েরিসমূহ লুট হয়ে যায়। তার বাসভবনে পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল।
১৯৫৪ সালে এমএলএ নির্বাচিত হলে সরকার তাকে ধানমণ্ডির সাতমসজিদ সড়কে জমি প্রদান করে। হাউজ বিল্ডিং ফিন্যান্স করপােরেশন হতে ঋণ গ্রহণ করে ১৯৬১-৬২ সালে ৪ তলা ভবন নির্মাণ করেন। ঘরভাড়া দিয়ে তার সংসার চলত। তার বাসভবনের ঠিকানা ৭৫১, সাতমসজিদ সড়ক, মােহাম্মদপর, ঢাকা। এর পূর্বে তিনি পুরনাে ঢাকার ১৭ নম্বর কারকুনবাড়ি লেনে ভাড়া থাকতেন। ১৮ নম্বর কারকুনবাড়িতে বাস করতেন তার রাজনৈতিক বন্ধু ইয়ার মােহাম্মদ খান।
তিনি ঢাকা কলেজের আরবি, ফারসি ও উর্দুর অধ্যাপক সৈয়দ সিরাজুল হকের কন্যা সৈয়দা জোহরাকে বিয়ে করেন। তার ডাক নাম লিলি । তাজউদ্দীন আহমদ তার স্ত্রীকে লিলি বলেই সম্বােধন করতেন। তাজউদ্দীন ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের ৩ কন্যা, এক পুত্র। কারকুনবাড়ি লেনে প্রথম কন্যা রিপির জন্ম ১৯৬০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় কন্যা রিমি ১৯৬১ সালের ১৯ আগস্ট কারকুনবাড়ি লেনে জন্মগ্রহণ করেন। তৃতীয় কন্যা সিমি ১৯৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর এবং তাদের একমাত্র পুত্র তানজিম আহমদ ১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি ধানমণ্ডির বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের মে-জুন মাসে কিছুদিন কলকাতার পার্ক স্ট্রীটে কোহিনুর ম্যানসনে মওলানা ভাসানী ও তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার বাস করতেন। মওলানা ভাসানী তাজউদ্দীনের কন্যাদের কাছে পিতার প্রশংসা করতে গিয়ে বলেন, তাজউদ্দীন আমার যােগ্য ছেলে, ওর প্রতি আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট।
আরও কত কথা বলেন, সেই ছাত্র জীবনের কথা, রাজনীতির প্রতি একাগ্রতা আর নিষ্ঠার কথা। রাজনীতি, দেশ আর মানুষ- এই তিন যে কিভাবে তাজউদ্দীনের রক্তে মিশে আছে গর্ব করে সে কথা বলেন। আওয়ামী লীগ গঠনে তার পাশাপাশি থেকে সে সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তরুণ তাজউদ্দীনের অবদানের কথা আনন্দের সাথে প্রকাশ করেন।
তাজউদ্দীন আহমদ কাপাসিয়াসহ গাজীপুর জেলায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও এলাকার জনগণ তাকে ভুলেনি। তার জনপ্রিয়তার কারণে তার ছােট ভাই আফসার উদ্দিন খান, পুত্র সােহেল তাজ এবং কন্যা সিমিন হােসেন রিমি জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেছেন। ১৯৯১
পৃষ্ঠাঃ ৭৫৬

সালের নির্বাচনে জোহরা তাজউদ্দীনকে বিএনপি কৌশলে পরাজিত করে।
২০০১ সালে তাজউদ্দীন আহমদের পুত্র সােহেল তাজ বিপুল ভােটে জয়লাভ করেন। কিন্তু নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কাপাসিয়াসহ গাজীপুরে হত্যা, নির্যাতন, লুট চালায়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তানজীম আহমেদ সোহেল তাজ কাপাসিয়া থেকে এমপি নির্বাচিত হন। তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয়। পরে তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আমেরিকায় বসবাস করছেন। ১৯৭৫ সালের পর জোহরা তাজউদ্দীন আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকা নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর তিনি ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘৮০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে বনানী তার স্বামীর কবরে দাফন করা হয় ।

মুক্তিযুদ্ধের কর্ণধার
তাজউদ্দীন আহমদ একজন রাজনৈতিক-কূটনীতিবিদ ছিলেন। এ সম্পর্কে মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, “উপমহাদেশে, তথা বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে, যারা তাদের অবদানের জন্য রাজনৈতিক মহাকাশে নক্ষত্রের মতাে নিজ জ্যোতিতে জ্বল জ্বল করবেন, বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ তাঁদেরই অন্যতম। অন্যান্য অনেক নেতার সাথে তার কিছু সাযুজ্য থাকলেও মৌলিক কিছু পার্থক্যও বিদ্যমান। ইতিহাস পর্যালােচনায় দেখা যায়, Politicians are divided into two classes : demagogues and political diplomats. গতানুগতিক রাজনীতিতে political demagogues-এর অভাব নেই, কিন্তু political diplomat-এর জন্ম হয় কালেভদ্রে। তাজউদ্দীন আহমদ একাধারে political diplomat তিনি political demagogue হওয়ার রাজনৈতিক শিক্ষা পেয়েছিলেন তৎকালীন প্রবীণ রাজনীতিবিদের কাছ থেকে, কিন্তু political demagogue না হয়ে political diplomat হয়েছেন নিজস্ব মেধায়। আজকের বাংলাদেশ অন্যদের সঙ্গে বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের মুক্তিযুদ্ধকালীন নয় মাসের অমানুষিক পরিশ্রমের প্রত্যক্ষ ফসল।৯
বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুলাই গাজীপুরের কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সরেজমিন তথ্য সংগ্রহের সময়ে মফিজউদ্দিন মুন্সির মাধ্যমে জানা যায়, তাজউদ্দীন আহমদ গ্রাম্য টোলে, মক্তবে, ভুলেশ্বর প্রাইমারী স্কুলে এবং তরগাঁও প্রাইমারী স্কুলে পাঠ নিয়ে শেষে কাপাসিয়া মাইনর স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপরে নাগরী ক্রিশ্চিয়ান মিশনারি স্কুল, পরে ঢাকার মুসলিম বয়েজ স্কুল এবং সব শেষে সেন্ট গ্রেগরিজ
পৃষ্ঠাঃ ৭৫৭

ইংরেজি স্কুল থেকে তিনি মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান অধিকার করে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে তিনি তাঁর মেধার মৌলিকত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ভর্তি হলেন Oxford of the East নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও তিনি ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র ।
তাজউদ্দীন সম্পর্কে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘রাজনীতি ও শিক্ষা তার হাত ধরে চলেছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী বলেছেন : শেখ মুজিব যদি হন বাংলাদেশের স্থপতি, তাহলে তাজউদ্দীন এর কারিগর।’
পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর তথা রাজনীতিবিদদের নজর থাকত তাজউদ্দীনের উপর। এটা পরিষ্কার বােঝা গিয়েছিল কথায়। ভুট্টো বলেছিলেন : This Tajuddin, I tell you, will be our main problem. ভুট্টো একবার সরাসরি বলেছিলেন- Never care Shaikh Mujib, but only care Taiuddin. ভুট্টো তাজউদ্দীনের সঙ্কল্পনিষ্ঠ আর diplomatic leadership প্রকৃতভাবেই অনুধাবন করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গতাজ এ দু’জন ছিলেন একই বৃত্তের দুটি কুসুম। একজন ছিলেন সিদ্ধান্তদাতা, অন্যজন ছিলেন বাস্তবায়নকারী। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ‘৭১ তারিখে দিলেন স্বাধীনতার ঘােষণা, কিন্তু ২৫ মার্চ ‘৭১ তারিখে তিনি হয়ে গেলেন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী। তখন যুদ্ধকালীন পুরাে নয় মাস যুদ্ধে বিজয়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়ােজন ছিল Political Diplomacy maintain করা। Actually it was very hard to maintain, because it was not a diplomacy of an independent country, but to make the nation
independent, to create a new state, a new map and a new flag, the symbol of sovereignty, atheinct Tajuddin was the great and apposite player in the political diplomatic field.”১০
স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে খন্দকার মােশতাক যখন স্বায়ত্তশাসনের বদলে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা বলে এক দুরভিসন্ধি নিয়ে এগােচ্ছিলেন, ঠিক তখনই বঙ্গতাজ ঘােষণা করলেন, একটি মানুষের দুটি চোখই যেমন প্রয়ােজন,আজ বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা, বাঙালীর জন্য দুটোই সমান প্রয়ােজন। ব্যর্থ হয়ে গেল মােশতাকের গােপন চক্রান্ত, ব্যর্থ হলাে বিশ্ববিখ্যাত কুটনীতিবিদ হেনরি কিসিঞ্জারের ষড়যন্ত্র । জয় হলাে বাঙালীর, দেশ হলাে হানাদারমুক্ত স্বাধীন। নতুন এক পতাকা আর ভূগােলে এক টুকরাে ভূমি চিহ্নিত হলাে ‘বাংলাদেশ’ নামে।
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন নির্ভেজাল বাঙালী জাতীয়তাবাদী।
পৃষ্ঠাঃ ৭৫৮

১৯৭১ সালে কূটনীতিবিদ জে এন দীক্ষিত বলেছিলেন, ‘তাজউদ্দীন ছিলেন সেই মানুষ যার সৎসাহস ছিল ভারতে বসেই এ কথা বলার- আপনারা যত বড় দেশের নেতাই হােন না কেন, আমাদের দেশের জনগণের এবং সরকারের ব্যাপারে যা সিদ্ধান্ত নেবার তা আমরাই নেব।’
আজ তিনি নেই। মােশতাক আহমদের চক্রান্তের শিকার হয়ে জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডে তিনিও নির্জন কারাকক্ষে নৃশংসভাবে নিহত হন। কিন্তু এখানেও তিনি রেখে গেলেন ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত- জীবন থাকা বা যাওয়া কোনাে ব্যাপার নয়, ব্যাপার হলো বাঙ্গালী ও আদর্শের প্রশ্নে কোন আপোষ নেই। আজ বঙ্গবন্ধু নেই, তাজউদ্দীনও নেই, আছে তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ পৃথিবীতে যতদিন থাকবে, যত দিন এ দেশে বাঙালী থাকবে, তত দিন থাকবেন বঙ্গবন্ধু, ততদিন থাকবেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ, প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়ে।”
১৯৪৭ সালে তাজউদ্দীন আহমদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তার ডায়েরির পাতায় তিনি লিখেছেন : “আজ রাত ১২টায় বৃটিশ রাজত্বের অবসান হচ্ছে এবং ভারতের নিজস্ব সরকারের শুরু হবে। ” তিনি পাকিস্তানের কথা বা জিন্নাহর কথা লেখেননি । বােঝা যাচ্ছে তিনি পাকিস্তান- এ পাকিস্তান চাননি। তিনি পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীকার অর্জনের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালে গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে আগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত ২১ দফার কর্মসূচী নিয়ে ১৯৫৪ সালে তিনি আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন ৬ দফার অন্যতম প্রণেতা। বঙ্গবন্ধু তাকে নিয়ে ৬ দফা আন্দোলন শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে গ্রেফতার হয়ে ৩ বছর কারান্তরালে ছিলেন। উনসত্তরে গণআন্দোলনে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরিচালনা করে তিনি সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চের সংসদ অধিবেশন স্থগিত করেছেন। শুরু হলাে অসহযােগ আন্দোলন- বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবান জানালেন। অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে সকল কর্মসূচি তিনি প্রণয়ন করেন। একজন বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞ পেশাজীবীর মতাে তিনি দেশ পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি প্রণয়ন করেন। বঙ্গবন্ধু দেশ শাসনের ভার স্বহস্তে গ্রহণ করলেন পাকিস্তানিদের বিদায় ঘণ্টা বেজেছে- একমাত্র সেনানিবাসে পাকিস্তানী পতাকা উড়ছে- সর্বত্র বাংলাদেশের পতাকা- সমগ্র জাতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ১ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে প্রহসনমূলক বৈঠক করছেন- তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর প্রধান সাহায্যকারী- তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি,
পৃষ্ঠাঃ ৭৫৯

আপােসহীন যুক্তিতর্কে পাকিস্তানী সামরিক-বেসামরিক বিশেষজ্ঞ দল ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পরে। ৬ দফা ও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে তিনি ছিলেন আপোষহীন – তার আলােচনার গতি ছিল এক দফা- স্বাধীনতা এবং নামে মাত্র কনফেডারেশন। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাজউদ্দীন আহমদকে দেখলে ইয়াহিয়া খান শঙ্কিত হত। পাকিস্থানিদের মূল আলােচনা ভেঙ্গে যায়। ২৫ মার্চ পাকসেনা বাঙালীদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিয়ে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। স্ত্রীকে না বলে বাড়ির কেয়ারটেকার হাইয়ের বাবা আব্দুল বারিক খানকে বলে গেলেন- ‘আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা রইল আপনি তাদের দেখবেন। আর তাদের এখনি বলবেন না আমি কোথায় যাচ্ছি।’ পরে পথে কুড়িয়ে পাওয়া একটি সিগারেটের প্যাকেটে স্ত্রীর উদ্দেশে লিখেছিলেন- ছেলেমেয়ে নিয়ে মিশে যেও সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে । কবে দেখা হবে জানি না- মুক্তির পরে। ‘ যুদ্ধকালে জীবনে ঝুঁকি নিয়ে তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে কলকাতায় পৌছে – কিন্তু তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন- স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সাথে জীবন যাপন করবেন না। তিনি এ পণ পালন করলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সাধারণ মুক্তিযােদ্ধারা যখন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যুদ্ধ করতে পারে তখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি কেন পরিবারের সাথে বাস করবেন।
একান্ত সাক্ষাতকারে ড. রেহমান সােবহান বলেছেন, অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে আলােচনার কৌশল নির্মাণের সময় আমরা পেশাজীবীরা (সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ) তাজউদ্দীনের সাথে প্রায়ই মতবিনিময় করতাম। সে সময় লক্ষ্য করেছি, সংবিধান, আইন এবং অর্থনীতির সব জটিল বিষয়ে তার অন্তর দৃষ্টি ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা কোন অংশেই বিশেষজ্ঞদের চেয়ে কম ছিল না।
একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন যে, তার পেশাগত জীবনে সারা বিশ্বে যেসব নেতৃত্নের সংস্পর্শে এসেছেন তাদের তুলনায় তাজউদ্দীনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা অনেক বেশি ধারালাে।
মুজিবনগরের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, তাজউদ্দীন আহমদই একমাত্র নেতা যার কাছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার জীবনের পরম সাধনা। গভীর এক অন্তদৃষ্টি দিয়ে এবং অঙ্গীকারসহ তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তার সে নেতৃত্ব ছিল সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ এবং অতুলনীয়।
তাজউদ্দীন আহমদ যােদ্ধা বেশে রণাঙ্গন পরিদর্শন করতেন। উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহিত করা। একবার তিনি সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের ও কয়েকজন সঙ্গীসহ পাটগ্রাম এলাকা পরিদর্শন করেন। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে
পৃষ্ঠাঃ ৭৬০

মুক্তিযোদ্ধাদের বাঙ্কার দেখেন। বাঙ্কারে এক কিশাের রাইভেল হাতে দাড়িয়ে ছিল। প্রধানমন্ত্রী বিস্মিত হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি যুদ্ধ করতে এসেছ- কিশোর সাহসের সাথে জবাব দেয়, আসিব না? আমার ভাইকে মেরেছে, তাদের আমি ছেড়ে দেবো নাকি? প্রধানমন্ত্রী কিশোরটিকে নিয়ে পাশের ক্যাম্পে গেলেন । ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী আসার খবর পেয়ে পাকসেনারা শেলিং শুরু করে।
কি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এরপর ঘটে গেল । একটি গােলা আঘাত হানলাে একটি বাঙ্কারে। এ বাঙ্কারটি খানিক আগে প্রধানমন্ত্রী পরিদর্শন করে এসেছেন। এই বাঙ্কারের কাছে কিশােরটি ছিল । কিশােরটি বাঙ্কার ছেড়ে আসার পর যে ৩ জন যোদ্ধা সেখানে ছিল তারা সকলে শহীদ হয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদ অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন।
– তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সিপাহসালার ছিলেন। তিনি একদিকে প্রধানমন্ত্রী এবং একই সাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। তিনি তার অপূর্ব মেধা দিয়ে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করেন। বিজয় লাভের কৃতিত্বের দাবিদার ভারত-রাশিয়া- সর্বোপরি তাজউদ্দীন আহমদের রণ নৈপুণ্য । তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করেছেন। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রকে ১১ টি সেক্টর ও ১০টি আঞ্চলিক কাউন্সিলে বিভক্ত করে দুর্জয় মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলেন। ১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। তিনি নিয়মিত বাহিনীর সাথে জনগণকে সম্পৃক্ত করে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করেছিলেন। তিনি ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিকরূপ দিয়েছিলেন। তিনি শক্তিশালী প্রবাসী সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেন। প্রশাসনে সাবেক সিএসপি, পিএফএস, ইপিসিএস ও অন্যান্য ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি ৫টি রাজনৈতিক দল নিয়ে জাতীয় সমন্বয় পরিষদ গঠন করে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করেন। তিনি প্রবাসী বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
তাজউদ্দীন আহমদ তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বেতার ও প্রচার বিভাগ দ্বিতীয় বাহিনী হিসেবে যুদ্ধ করেছে। ১৯৭১ সালে তাজউদ্দীন আহমদের রণকুটনীতি ও যুদ্ধ পরিচালনা দেখে মওলানা ভাসানী বলতেন তাজউদ্দীন আহমদ না হলে দেশ স্বাধীন হতাে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধান নায়ক ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
পৃষ্ঠাঃ ৭৬১

অর্থনৈতিক উন্নয়ন
তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে। কৃষি ফসল ছাড়া তাদের আয়ের উৎস ছিল রাজেন্দ্রপুরের বন। তিনি বেড়ে উঠেছেন বাঙালীর হাজার বছরের গ্রামীণ অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে। সেই স্কুল জীবন থেকে তার ভাবনা ছিল গ্রামের গরিব চাষীরা। তার ডায়েরিতে গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা- ধান, চাল ও পাটের মূল্য লেখা আছে- চালের দাম বৃদ্ধি পেলে হতদরিদ্র মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। আবার পাটের মণ ১০ টাকা হলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা থাকে না। তাই দেখা যায়, তিনি পাটমন্ত্রী হয়ে চাষীদের পাটের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করেছেন- দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পাট ব্যবসা ও পাটকলগুলাে জাতীয়করণ করেছেন- শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করেছেন।
কলেজ পড়ুয়া তাজউদ্দীন ১৯৪৭ সালের ইকোনমিক লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা করেছেন। তার নিকট পাকিস্তান নয়- জনগণের আর্থিক মুক্তিই বড় ছিল। তাই দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেও তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি একটি পৃথক দল করতে চেয়েছিলেন।
বাম রাজনীতিবিদগণ ভূমি জাতীয়করণে বিশ্বাসী। তাজউদ্দীনের ভাবনা ছিল ভিন্ন:
Mass movement difficult in Bengal because all are agriculturists and more or less interested in owning land- therefore nationalization of land not easy- Islamic law is another great disadvantage to this end. “বাংলায় গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। কারণ সকলে কৃষক, কমবেশি ভূমির মালিক হতে আগ্রহী সুতরাং ভূমি জাতীয়করণ সহজ নয়। এ সম্পর্কে অন্য একটি বিশাল অসুবিধা হলাে ইসলামী আইন।” তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন বাস্তবধর্মী বামপন্থী রাজনীতিবিদ।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে দেশী বিদেশী সম্পদের প্রয়ােজন। জাতীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি করে বিনিয়ােগ বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যদিকে নতুন করারােপ করে জনগণের দুর্দশা তিনি বৃদ্ধি করতে চাননি। উন্নয়নের ঘাটতি পূরণের জন্য তিনি বিদেশী সাহায্য সমর্থন করেছেন। তবে তিনি শর্তহীন ঋণের পক্ষপাতী ছিলেন। অনেকের ধারণা, তাজউদ্দীন আহমদ আমেরিকা থেকে সাহায্য গ্রহণে বিরােধী ছিলেন। এ কারণে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জার তাজউদ্দীনবিরােধী ছিলেন। তিনি হয়ত বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় দিতে বলেছেন। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাজউদ্দীনকে পদত্যাগ করতে বলেছেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭৬২

তবে তাজউদ্দীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশ থেকে শর্তযুক্ত ঋণ গ্রহণের প্রতিবাদ করতেন। মালয়েশিয়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে এডিবি বৈঠকে তার বক্তৃতায় বলেন : Excellencies! how many time do I need to repeat that Bangladesh needs only soft loons? Why do you want me to be on my nees every time. বাংলাদেশ উন্নয়নে তিনি বৈদেশিক লোন চান- তা হতে হবে সহজ শর্ত। তিনি নতজানু হতে চাননি। মাছ ১৫ মিনিটের ভাষণে এডিবি বাংলাদেশকে শতহীন ঋণ প্রদান করে। এডিবি সভার বৈঠকে ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদের উন্নয়ন চিন্তা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। একইভাবে মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে তিনি কথা বলেছেন। মার্কিন এইড প্রশাসক ড্যানিয়েল পার্কারের সাথে আলােচনাকালে তিনি বলেছেন :
“আমি আরো পিএল-৪৮০ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের ডানিয়েল পার্কারের সাথে আলোচনা করেছি। কিউবার সাথে আমাদের বাণিজ্য বিষয়টি তিনি উত্থাপন করেছেন । তিনি বলেছেন। পিএল-৪’৮০ এর অধীনে বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে । আমি বলেছি, আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কারণ কিউবাকে আমরা স্বীকতি দিয়েছি। তারা কিছু পাটজাত দ্রব্য চেয়েছে এবং আমাদের উদ্বৃত্ত আছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন পরিবর্তন হয়েছে। আমি পরামর্শ দিয়েছি যে বর্তমান চিন্তাভাবনা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আইন পরিবর্তন করতে হবে।”

সমাজসেবী
তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম হয়েছিল একটি জাতিকে মুক্ত করার জন্য। তিনি তার সম্পূর্ণ সত্তাকে বিলীন করে দিয়েছেন সমাজ ও মানুষের জন্য। মানবপ্রেম তার সহজাত। মানুষ মানুষের জন্য এ ছিল তার জীবন দর্শন। তার জীবন দর্শনের শিক্ষা পেয়েছিলেন গ্রামীণ অসহায়, নিপীড়িত মানুষের কাছ থেকে। তাদের দুঃখে।সুখে তার প্রাণ কেঁদেছে অসহায় মানুষদের উদ্ধার না করা পর্যন্ত তিনি শান্তি পেতেন না। মহামারী ও সংক্রামক রােগের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছেন স্কুল জীবন থেকে। ভুলেশ্বর গ্রামে মহামারী দেখা দিলে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে রােগীর সেবা করেছেন। আর্তের সেবা ছিল তার আদর্শ।
১৯৫৪ সালে তিনি এমএলএ। তার গ্রামের সাইফুদ্দির পুত্র আবদুল আজিজ (১৪) বন্দুকের গুলিতে আহত হলাে। এক শিকারীর গুলি এসে ছেলেটিকে আঘাত করে। ছেলেটি ঢাকায় তাজউদ্দীনের নিকট আনা হয়। তিনি এ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং ১০ আউন্স রক্ত দেন। ছেলের মৃত্যু খবর শুনে ভ্রান্তের মতাে হাসপাতালে ছুটে যান এবং পােস্টমর্টেম করে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭৬৩

এ মৃত্যু তাকে গভীরভাবে আহত করে। এমনিভাবে তিনি রােগীদের সেবা করতেন। ঢাকা ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে এক মুমুষু বৃদ্ধের অবস্থা দেখে সারাদিন চেষ্টা করেন তাকে হাসপাতালে পাঠাবার জন্য।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষে বাংলায় লক্ষাধিক লােক নিহত হয়েছে। তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামবাসীকে ভবিষ্যত দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষার জন্য ধর্মগােলা প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি ধান-চাল সংগ্রহ করে খাদ্যাভাবের সময় ধর্মগােলা থেকে খাদ্য বিতরণ করতেন।
তিনি নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য গ্রামের মেয়েদের উৎসাহিত করতেন। তিনি বােনের মেয়ে আনারকে ঢাকায় নিজ বাসায় এনে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন এবং শিক্ষিত করে ভালাে বিয়ে দেন।
প্রশাসক
একজন দক্ষ প্রশাসক হতে হলে তাকে ভালাে সংগঠক হতে হবে। তিনি একাধারে প্রতিভাবান সংগঠক ও শাসক ছিলেন। তিনি একজন অতুলনীয় প্রশাসক ছিলেন। তার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৭১ সালে অসহযােগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালে । জন্মগতভাবে তিনি সর্বগুণান্বিত প্রশাসক ছিলেন। তিনি ৩৫টি বিধি জারি করে ১৯৭১ সালে তঙ্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার বঙ্গবন্ধুর হাতে অর্পণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পরিবারকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে রেখে ভারতে চলে যান এবং ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। দলের মধ্যে বাধা অতিক্রম করে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। যুদ্ধের প্রধান দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি প্রতিরক্ষা এবং অপরটি তথ্য ও প্রচার । দুটো বিষয় নিজ হাতে রেখে। প্রবাসী সরকারকে শক্তিশালী করেন। তিনি বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ও ১০টি আঞ্চলে বিভক্ত করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করেন। সামরিক ও বেসামরিক নেতৃত্নের সমন্বয় করে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন।
পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ভারত এককভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। তিনি বাংলাদেশ বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী নিয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করেন। একজন বেসামরিক ব্যক্তি হয়ে যুদ্ধ পরিচালনায় তিনি ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ও রাশিয়ার স্টালিনের মতাে রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করেন।
তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। দপ্তর পরিচালনা পাঠ তিনি শিখেছিলেন
পৃষ্ঠাঃ ৭৬৪

ছাত্র অবস্থায়। ১৯৪৭ সাল হতে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত যে সকল বিরোধী দল গঠন করা হয়েছে সে সকল দলের ইস্তেহার, আদর্শ, উদ্দেশ্যের খসড়া প্রণয়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর দলকে তিনি সঠিক নির্দেশনা দেন। স্বায়ত্তশাসিল, ও দক, পরিশেষে এক দফা- স্বাধীন- এভাবে ধাপে ধাপে দলকে বঙ্গবন্ধুর সাথে নিয়ে যান। তিনি দলের ভেতর থেকে বঙ্গবন্ধু কে প্রতিষ্ঠা করেন।
পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি সুষ্ঠুভাবে মন্ত্রিপরিষদ পরিচালনা করেন। মন্ত্রী পরিষদের আলোচ্যসূচি আলােচনা ও সিদ্ধান্ত নিজ হাতে লিখতেন। তার চিন্তাশক্তি সাবেক সিএসপি ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের বিমােহিত করেছে। ভারতের ঝানু আমলা ডিপি ধর, পিএন হাকসার তাজউদ্দীন আহমদের ভূয়সী প্রশংসা করতেন।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তিনি প্রশাসনকে গড়ে তোলেন । প্রত্যেক জেলায় ডিসি, এসপি এস এবং মন্ত্রণালয়ে কর্মকর্তাদের নিয়ােগ দেন।
প্রশাসনে তিনি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তার বাসভবন পাকবাহিনা আক্রমণ করে এবং তার বাসায় পাকসেনারা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে। তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে পাশের এক বাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু ঐ ব্যক্তি তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের নামে রাস্তায় রেখে পালিয়ে যায়। তার স্ত্রী ছেলেমেয়ে ইটের স্কুপের মধ্যে সারা রাত কাটায়। ঐ ব্যক্তির পদোন্নতির নথি তাজউদ্দীনের নিকট এলে তার পদোন্নতি তিনি দিয়ে দেন। তিনি বললেন, ‘ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বিবেচনায় না এনে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেবেন। পদোন্নতির প্রস্তাব অনুমােদিত হলাে। অর্থসচিব কফিলউদ্দিন মাহমুদ হতবাক হয়ে গেলেন। প্রশাসনকে নিজস্ব গতিতে কাজ করতে দেবার তার অঙ্গীকারের আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে।
আতিউর রহমান বলেন, “যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করার পর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তার সহকর্মীদের সাথে নিয়ে যেভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতার পুনরুজ্জীবন, কলেকারখানায় শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংযােগ স্থাপন এবং নির্বাচনী অঙ্গীকারের সাথে সঙ্গতি রেখে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন তাতে সার্বিক পরিস্থিতির বিস্ময়কর উন্নতি ঘটে। বিদেশীদের চোখেও এ পরিবর্তন ধরা পড়ে।
২২ ডিসেম্বর ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর বিমানবন্দরে এবং ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা সচিবালয়ের সমস্ত অফিসার ও কর্মচারীদের সমাবেশে তিনি ঘােষণা করেন,
পৃষ্ঠাঃ ৭৬৫

সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মরিপেক্ষতা- এই তিন মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে দেশকে গড়ে তােলা হবে। সচিবালয়ের বক্তৃতায় সরকারী প্রস্তাবের সর্বাত্মক সহযােগিতায় প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা সংগ্রাম করেছিলেন আইনের শাসন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সকল ধরনের শােষণ ও বৈষম্য চিরতরে বন্ধ করার জন্য এবং একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এদেশের সকল মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব।
“তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি সবল জাতি গঠনের জন্য যে বহুদলীয় ঐক্যের কাঠামাে গঠন, দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরে জন্য সকল মুক্তিযােদ্ধা তথা তরুণ সমাজকে একত্রিত ও উদ্দীপ্ত করার আয়ােজন এবং সাহায্যের আবরণে দেশকে আশ্রিত পুঁজিবাদের দিকে নিয়ে যাবার সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রয়াস প্রতিহত করার জন্য সাহায্যনির্ভরশীলতা সীমিতকরণের যেসব নীতিমালা তৈরি করেছিলেন তা অচিরেই পরিত্যক্ত হয়। নির্মীয়মান বহুদলীয় জাতীয় ঐক্য কাঠামাের পরিবর্তে। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ দলীয় শাসন প্রবর্তন, আর্থ-সামাজিক মৌল রূপান্তরের প্রধান শক্তি হিসেবে মুক্তিযােদ্ধাদের সমন্বয়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিবর্তে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রের স্বার্থে মুক্তিযােদ্ধারা কেবল অনুগত অংশের সমন্বয়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য সরাসরি মার্কিনী সাহায্য গ্রহণের নীতি মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গৃহীত হয়। নতুন নেতৃত্নের নিজস্ব প্রয়ােজনে ও উপলব্ধি অনুযায়ী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকাশ ও ব্যবহার চলল এগিয়ে। সে ইতিবৃত্ত অন্য এক সময়ের, অন্য এক রাজনৈতিক পর্বের ।”১১
তাজউদ্দীন আহমদ একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। মুজিবনগর সরকার পরিচালনা ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার সফলতার অন্যতম কারণ হলাে আমলাতন্ত্রের আন্তরিক সহযােগিতা। তারা মহান দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাজউদ্দীন আহমদের সাথে কাজ করেছেন। অফিসের সাধারণ কর্মচারী হতে সচিব- সকলে তাকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসতেন । আমলাদের সাথে সাধারণত রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে বন্ধুত্বপূর্ণ থাকে না। তারা মন্ত্রীদের সমালােচনা করে থাকে। কিন্তু তাজউদ্দীন ছিলেন ব্যতিক্রম। তার সাথে যারা কাজ করেছেণ তারা সকলে প্রশংসা করতে। তার সচিবদের মধ্যে মুজিবনগরের মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম, সংস্থাপন সচিব মােহাম্মদ নুরুল কাদের খান, অর্থসচিব মতিউল ইসলাম, কফিলউদ্দিন মাহমুদ এবং রাষ্ট্রদূত আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলাম প্রমুখ তাজউদ্দীন আহমদের উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন। তার ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী
পৃষ্ঠাঃ ৭৬৬

তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে লিখেছেন : “বাংলার এই কৃতি সন্তানের সাথে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। চার্চিলের ভাষায় বলতে গেলে, That was my finest hour. তাজউদ্দীন আহমদের সাথে আমার কাজ করার দিনগুলো ছিল সব চেয়ে অনুপম দিন।
অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী
বাংলাদেশে স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরও তাজউদ্দীন আহমদের স্থান। তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী। তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ বাঙালি চরিত্রের অধিকারী ছিলেন না। বাঙালী জাতির বিরুদ্ধে অভিযােগ, তারা মিথ্যাবাদী, পরশ্রীকাতর, দাঙ্গাবাজ, আত্মবিস্মৃত, কর্মবিমুখ এবং চুরি- কাতি তাদের পেশা। আমি সাধারণ বাঙালী জনগােষ্ঠীর কথা বলছি না। কিন্তু যারা সমাজে নেতৃস্থানীয় তারা প্রায় সকলে দুর্নীতিগ্রস্থ।
তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সকল লােভ, মােহ ও সম্পদ আহরণের উর্ধে । দুর্নীতি তাকে কোনােদিন স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি কালো টাকার নির্বাচন করেননি, সাধারণ মানুষ তার নির্বাচন করেছেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তার খরচ হয়েছিল মাত্র ২ হাজার ৬শ’ টাকা। বাংলাদেশে কোন প্রার্থী এত কম টাকায় নির্বাচন করেছেন তার উদাহরণ নেই।
শঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, ব্যক্তিত্ব, ভতা- এসব বড় মাপের মানুষের থাকবার কথা। কিg সব মানুষের মধ্যে এই সূচকগুলাে অনেক সময়ই খুঁজে পাওয়া যায় না। তাজউদ্দীন আহমদ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল তার জীবনাদর্শ। ছাত্র জীবনে তিনি একবার মাত্র দেরি করে টিউশন ফি জমা দেবার জন্য জরিমানা দিয়েছেন। এ ঘটনা তার ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছেন অনুতাপের সাথে ।
তাজউদ্দীন আহমদের মানবিক গুণগুলাে ছিল বেশ স্পর্শকাতর। মাকে তিনি দারুণ শ্রদ্ধা করতেন, শত কাজের মাঝেও মার কাছে বসতেন। গল্প করতেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন অতিথি বৎসল। ছাত্র জীবনেও তার কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি। হালকাভাবে একবার তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, গত সাড়ে ৪ মাসের মধ্যে আজই প্রথম একা ঘুমাতে হবে, কেননা আজ কোন মেহমান নেই।
তাজউদ্দীন আহমদ মানুষকে ছােট বড় করে দেখতেন না। তার সাতমসজিদ রােডের বাসায় দেখাশােনা করতেন হাইয়ের বাবা আবদুল বারিক খা। তাকে তান সব সময় আপনি বলে সম্বােধন করতেন। ছাত্র জীবন থেকেই গ্রামবাসীদের সুখে দুঃখে তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। তিনি যখন দরদারিয়া গ্রামে যেতেন তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৭৬৭

বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রামবাসীদের সুখ দুঃখের খবর নিতেন।
মানুষের দুঃখে তাজউদ্দীনের প্রাণ কাঁদত। দেশে বন্যার খবর শুনে তিনি রাতে ঘুমাতে পারতেন না। তার মহান হৃদয়ের পরিচয় পাওয়া যায় গেসুর বাবাকে সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়াতে। গেসুর বাবার জমি নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। তাজউদ্দীনের পিতা উক্ত নিলাম ক্রয় করেন। তাজউদ্দীন গেসুর বাবার সব জমি ফেরত দিলেন অকাতরে।
শিক্ষকদের তিনি সব সময় সম্মান দেখাতেন। তার বাল্যশিক্ষক মফিজউদ্দিন আগরতলা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। তাজউদ্দীন জায়নামাজ ও ওজুর বদনা নিয়ে তার সাথে দেখা করেন।
তাজউদ্দীন গ্রামের মানুষকে আপন করে নিয়েছিলেন। কারাগারে তার হত্যার সংবাদ গ্রামে এসে পৌছলে বিষাদের ছায়া নেমে আসে। মানুষ খাওয়া-দাওয়া ভুলে যায় । হাটবাজার খােলেনি। এমন সােনার মানুষ আর তারা পাবে না।

জাতীয় নেতা
বাংলাদেশের আপামর জনগণের মহান নেতা চারজন- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, এ কে ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিবিসির ২০০৪ সালের জরিপে তারা শ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে স্বীকৃত । চার মহান নেতার সারিতে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি পঞ্চম স্থান পেতে পারেন- তিনি হলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মহান জাতীয় চার নেতা বাঙালী জাতীয়তাদের স্রষ্টা। কিন্তু মাঠে যুদ্ধ করে তাজউদ্দীন আহমদ বাঙালী জাতির স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশের পঞ্চম মহান জাতীয় নেতা হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
একজন জাতীয় নেতার দায়িত্ব যে তার ভাবনায় ও কর্মে সমগ্র জাতির চিন্তা ও আকাক্ষা প্রতিফলন ঘটানাে এই সত্য তাজউদ্দীন সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে দেশের মর্যাদা সম্পর্কে ছিলেন পুরােপুরি সচেতন। ব্যক্তি, গােষ্ঠী, এলাকা, সম্প্রদায়, দলমত এসবের উর্ধে উঠে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়ােগ করতে পেরেছিলেন।
জাতীয় নেতা হিসেবে দলের চাইতে তার কাছে রাষ্ট্র ও জাতির পাওনা ছিল অনেক বেশি। তিনি যথাসম্ভব তা পূরণের চেষ্টা করেছেন। তার মন্ত্রীকালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর কক্ষে কখনও মােসাহেবদের আড্ডা বসেনি। দলীয় রাজনীতির ছোঁয়া লাগেনি। তিনি নীরবে, নিরলসভাবে, অনুচর ও মােসাহেব পরিবেষ্টিত না হয়েই কাজ করে যেতেন।
পৃষ্ঠাঃ ৭৬৮

কাপাসিয়া থেকে তার গ্রাম দরদরিয়ায় যেতে পাকা রাস্তা ছিল না। বর্ষাকালে রাস্তা কর্দমাক্ত হয়ে যেত। গ্রামের লোকেরা তার কথা বললে তিনি বলতেন, ‘দেখ, মেহমান এলে বাড়ির লােকেরা মেহমানকে খাইয়ে দাইয়ে বা বাকি থাকে তাই খায়। আমি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী, সারা দেশের পরিস্থিতি অপরিবর্তনীয় রেখে নিজ এলাকার উন্নতি হবে স্বার্থপরের কাজ। এতে তোমাদেরও বদনাম হবে।’ তা সত্বেও তার জনপ্রিয়তা ছিল সুদৃঢ়। তার প্রমাণ, তার ছোট ভাই আফসার উদ্দিন একবার উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ১৯৯৩ সালে এমপি নির্বাচিত হন রাজনীতি যখন দুর্বৃত্তের দখলে তখন গাজীপুর জেলায় তাজউদ্দীনের আদর্শ আজ জীবন্ত । চারটি আসনে আওয়ামী লীগের বিজয় হয়েছিল- একটি আসন বিরোধী পক্ষ ছিনিয়ে নিয়েছিল।
একজন জাতীয় নেতা জাতীয় ঐক্যের জন্য কাজ করে যাবেন এটিই স্বাভাবিক। আর সদ্য স্বাধীন ও উন্নয়নকামী দেশের উন্নয়নের জন্য তার প্রয়োজনীয়তাও অসীম। তাজউদ্দীন আহমদ তা সম্যক উপলব্ধি করেছিলেন এবং সে লক্ষ্যে সামাজিক সমঝােতা গড়ে তুলতেও প্রয়াসী হন। নানামুখী চাপ সত্তেও জাতীয় মিলিশিয়া গঠন করেন। আর এর পরিচালনার জন্য ২ জানুয়ারি ১৯৭২ সকল রাজনৈতিক দল থেকে একজন করে সদস্য নিয়ে গঠিত হয় জাতীয় মিলিশিয়া নিয়ন্ত্রণ বাের্ড পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য ও সমঝােতা বাড়ানাের জন্য দলীয় কর্মী, নেতা ও সমর্থকদের কাছেও আকুল আবেদন জানান।
আমাদের আজকের সংগ্রাম- অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম- দেশের পুনর্গঠনে যেন আমরা প্রত্যেকেই মানুষের সেবার মনােভাব নিয়ে কাজে অগ্রসর হতে পারি। সেটাই আজকের বড় প্রার্থনা। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সহনশীলতার নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। কেননা, সহনশীলতা ছাড়া গণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি জাতি গঠনের জন্য সর্বদলীয় ঐক্য কাঠামাে, জাতীয় সমঝােতার লক্ষ্যে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়েছিলেন।
এই আপােসহীন, ক্ষুরধার মুক্তিকামী নেতাকে তার বিদেশী শত্রুরাও ভয় করত। ভুট্টো একবার তার সহচরকে বলেছিলেন, “আলােচনা বৈঠকে তার মুজিবের পেছনে ফাইল বগলে চপচাপ যে নটোরিয়াস লােকটি বসে থাকে তাকে
পৃষ্ঠা ৭৬৯

কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন আই টেল ইউ, উইল বি ইওর মেইন প্রব্লেম।…. হি ইজ ভেরি থরাে। শেখের যােগ্য লেফটেন্যান্ট আছে দেখছি।”
তাজউদ্দীন ছিলেন মনেপ্রাণে গুণতান্ত্রিক। তিনি শক্তিশালী নিয়মতান্ত্রিক বিরােধী দলের প্রত্যাশা করতেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নে আপােস করতে চাননি। সংবাদপত্র প্রশংসনের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে দুর্ভিক্ষের মতাে অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে সাহায্য করবে, ক্ষমতার অপব্যবহার রােধে সহায়তা করবে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। একই সঙ্গে ছিলেন নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী এবং অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
১৯৭৫ সালের জুন মাসে ৬ তারিখে বঙ্গবন্ধু একটি মাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে বাকশাল গঠন করেন এবং বাকশাল বাদে অন্য সব দল নিষিদ্ধ ঘােষিত হয়। গণতন্ত্র পূজারী তাজউদ্দীন আহমদ বাকশালের কোন কমিটিতেই ছিলেন না। তিনি তার বন্ধু ও নিকটজনের কাছে এর ভয়াবহ পরিণতির কথা বললেও ক্ষেত্রে, অভিমানে সুখ-দুঃখের দীর্ঘদিনের সাথে শেখ মুজিবকে কিছু বলেননি। তাজউদ্দীন তার নেতার দৃঢ় সঙ্কল্প সম্বন্ধে ছিলেন সম্যক অবহিত এবং বন্ধুর প্রতি আনুগত্যও ছিল প্রশ্নাতীত । তিনি মনে করতেন এ পদক্ষেপ জাতীয় ঐক্যজোট গঠনে বিরােধিতা করবে। এ সময় কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহের সাথে প্রথমবারের মতাে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় করে তিনি বলেছিলেন :
“মণিদা একজন মানুষের ইচ্ছার সুযােগ নিয়ে এই সর্বনেশে পথ কেন বেছে নিলেন। আপনি জানেন, আমরা জনগণকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচন ও যুদ্ধ করেছি। আপনাদের দল নিঃশেষ করে দেয়ার মানে দুর্দিনে দেশে এক দুর্বিপাকে পড়বে। দ্বিতীয় কোন দেশপ্রেমিক শক্তি অবশিষ্ট থাকবে না। দেশ প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে গিয়ে পড়বে।”
বাঙালী আত্মবিস্মৃত জাতি। তারা ইতিহাস সচেতন নয়। আর ইতিহাসের উপাত্ত হলাে সাধারণ মানুষ। এই বাঙালীরা ১৯৫২ সাল, ১৯৫৪ সাল, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এবং ১৯৭১ সালে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭১ সালের সাথে তারা বীর জাতির পরিচয় দিয়েছে। অতীতে বাঙালীরা দেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের লড়াইয়ে এত রক্ত দেয়নি। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৪ সালে ছাত্র জীবনে আইনসভার সদস্য হয়েছেন, ৬ দফা আন্দোলনে দীর্ঘদিন কারাবরণ করেছেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে বাংলার ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জয় বাংলা পত্রিকায় তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছিল :১২
পৃষ্ঠাঃ ৭৭০

“স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর কাছে আজ একটি অতি প্রিয় নাম ।
বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ ২৭ বছরের একনিষ্ঠ সহকর্মা তাজউদ্দীন । বিশ্ব ইতিহাস, ভূগোল ওরাজনীতি সম্পর্কে তিনি লেখাপড়া করেছেন প্রচুর। বিশ্ব ইতিহাসের বা বিশ্ব রাজনীতিকে যে কোন ঘটনা সাল তারিখ দিয়ে তিনি মুহর্তের মধ্যে আপনাকে বলে দিতে পারবেন অথবা বিশ্ব মানচিত্রের যে কোন স্থানের অবস্থিতি তিনি সাথে সাথে বলে দিতে পারবেন । আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, চীনের কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল, মধ্যপ্রাচ্যের আরব-ইসরাইল সংঘাত এবং ভিয়েতনাম ও আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাস যেন তার নখদর্পণে ।
তাই বােধ হয় এ সমস্ত ইতিহাসের আলােকেই সেদিন জোর করেই বলেছিলেন, আমরা কামিয়াব হবই। এ কথা বলার সময় যেন তার চোখে মুখে একটা আত্মপ্রত্যয়ের দ্যুতি খেলে গেল।
আজ থেকে ৪৫ বছর আগে ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে তার জন্ম। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান। তবে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দেয়া তার ভাগ্যে বড় একটা জোটেনি।
তাই বলে তিনি কোনদিন পরীক্ষায় খারাপ করেছেন এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। তিনি এমই স্কলারশিপ পরীক্ষায় জেলার প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আর মেট্রিক পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান এবং ইন্টারমিডিয়েট প্ৰীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন । অর্থনীতি শাস্ত্রে অনার্সসহ তিনি বিএ পাস করে এবং জেলে আটক থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে আইনের ডিগ্রি লাভ করেন।”
জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন সৎ ও পরিশ্রমী রাজনীতিক ছিলেন। মিথ্যা আশ্বাস, রিলিফপ্রীতি, গােষ্ঠীপ্রীতি, স্বজনপ্রীতির উর্ধে এক আপােসহীন মুক্তিকামী নেতা তাজউদ্দীন। শত্রুরাও তার মেধাকে ভয় করত। আজীবন গণতান্ত্রিক তাজউদ্দীন বহুদলীয় রাজনীতির ক্ষেত্র সঙ্কোচনে উদ্বিগ্ন। সংবাদপত্রে স্বাধীনতা ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী তাজউদ্দীন বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়নে ব্যথিত হয়েছে। শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, কর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, ব্যক্তিত্ব পরিকল্পনা সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকার জন্য আকুতি- এসব গুণাবলির জন্য একজন বড় মাপের মানুষ হিসেবে তাজউদ্দীনের গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাবে।
মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিপরীক্ষার পাস করা তাজউদ্দীন আহমদের স্বপ্ন ছিল একটি সবল জাতি গঠনের। সে জাতির মূলে থাকবে বহুদলীয় ঐক্যের কাঠামাে গঠন, দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সকল মুক্তিযােদ্ধা তথা তরুণ সমাজকে একত্রিত ও উদ্দীপ্ত করার আয়ােজন এবং সাহায্যের আবরণে
পৃষ্ঠাঃ ৭৭১

দেশকে আশ্রিত পুঁজিবাদের দিকে নিয়ে যাবার সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রয়াস প্রতিহত করার জন্য সাহায্য নির্ভর সীমিতকরণ।
কিন্তু তাজউদ্দীনের সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে দেশবাসীর মনােজগতে, বিশেষ করে তরুণদের দীর্ঘদিন ধরে গরীব দুঃখী মানুষদের পাশে থেকে দারিদ্র্যের মুখােমুখি হবার অভিজ্ঞতার কারণে, পরিবর্তনের জন্য যে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল তা বাস্তবে রূপায়ণ না করতে পারার গ্লানি তাজউদ্দীনকে মর্মাহত করেছে।
কিন্তু কেন তাজউদ্দীনের স্বপ্ন রূপায়ণ সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দের অনৈক্য, রাজনৈতিক মতবিরােধ, মুজিব-তাজউদ্দীন সম্পূরক নেতৃত্বে অবনতি দেশকে বিপর্যয়ের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ক্ষমতা থেকে তাজউদ্দীন আহমদের বিদায় বাংলাদেশের জন্য অশুভ সংকেত তৃতীয় শক্তি লাভ হলাে। অতিবিপ্লবীরা মাঠে এলাে- তারা জেনারেল জিয়াউর রহমানের কূটবুদ্ধির নিকট পরাজিত হলাে। ডানপন্থীদের উত্থান হলাে। ক্ষমতার অধিকারী হলেন সামরিক শাসক-জিয়া-এরশাদ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নেয় বাংলাদেশ থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ধ্বংসের মুখে। এ জন্য দায়ী ইতিহাস চেতনার দৈন্য। বিশ্বব্যাপী চলছে নতুন ইতিহাস চর্চা- সে ইতিহাসের মূলে রয়েছে মানুষ। প্রবহমান সময়ের আঙ্গিকে মানবগােষ্ঠীর বেঁচে থাকার সংগ্রামই সে ইতিহাসের মূল উপজীব্য। হতাশার বেড়াজাল থেকে ছিড়ে, অসহায়ত্ব ও অনিশ্চয়তা অতিক্রম করে মানুষের সক্ষমতার ক্ষেত্রে বিকাশের নামই উন্নয়ন। মানুষের নিজের জীবনের ওপর অধিকার অর্জনের আরেক নাম উন্নয়ন।
নেতা হবেন সৃষ্টিশীল। সৃষ্টিশীল মানুষ পারে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষকে সংঘবদ্ধ করে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করতে। তারা সমাজের কাঠামাে পরিবর্তন করে স্বউন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সে জন্য প্রয়ােজন পুরনাে কাঠামাে ভেঙে নতুন কাঠামাে তৈরির সংগ্রামের সূচনা করতে হয় তৃণমূল থেকে। এ কাজের গুরুত্ব সব দেশের নেতৃত্ব উপলদ্ধি করতে পারবে না। যার মূল্য দিতে হয় পুরাে জাতিকে। আজকের বাংলাদেশের এ তমসা আমাদের নেতৃত্বের দীর্ঘদিনের ব্যর্থতা।
শিক্ষা গ্রহণের মতাে গুণাবলিসম্পন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ।
তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হােসেন রিমি তার পিতা সম্পর্কে লিখেছেন : “আমার মনে হতাে নিয়মতান্ত্রিক সুস্থ সুন্দর রাজনীতিতে বিশ্বাসী
পৃষ্ঠাঃ ৭৭২

আব্দু এক বুক কষ্ট নিয়ে ভেতরে ভেতরে গুমরে মরতেন। আর ধৈর্য ছিল সত্যি অবাক করার মতাে। কত মানুষ যে কতভাবে আল্লুকে এভাবে নিশ্চুপ না থেকে কিছু একটা করার জন্য অনুরােধ করতেন, তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু মুজিব কাকুর প্রতি ইস্পাত কঠিন বিশ্বস্ততায় হয়তবা জগতের একমাত্র নিদর্শন হয়ে অল্প কথায় সব এড়িয়ে যেতেন। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, মনেপ্রাণে দেশপ্রেমীক আব্বু কোনদিনই চাইতেন না তাকে জড়িয়ে এমন কোন বিতর্কের সৃষ্টি হোক যা থেকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কোন ক্ষতি হয়।
আব্বু বলতেন, তাজউদ্দীন ক্ষণিকের হাততালি আর হবার জন্য রাজনীতি করেনি। আজ থেকে ৫০ বছর ১০০ বছর কি তারও বেশি সময় পার যদি এ দেশের মানুষ বুঝতে পারে তাজউদ্দীন তার জন্মভূমিকে ভালােবেসে শুধুমাত্র মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করে গেছেন, তখনই তিনি সার্থক হবেন।”১৩
তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে মােঃ আনিসুর রহমান লিখেছেন : “একাত্তরে যখন দেশের অগণিত মানুষের সঙ্গে আমিও ভারতে ছিটকে গিয়েছিলাম, তখন একদিন দিল্লীতে ড, অশােক মিত্রের বাসায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্ট ডিপি ধর এবং পিএন হাকসার সাথে দেখা হলে তারা তাজউদ্দীন আহমদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “তােমাদের এই নেতার প্রজ্ঞা, দক্ষতা ও স্টেটসম্যানশিপ দেখে আমরা শ্রদ্ধাবনত।’
তাজউদ্দীন তার এই অসাধারণ গুণাবলী দিয়ে বাংলাদেশের আত্মঅধিকার ও পরে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান করেন। রাজনৈতিক পার্টিতে প্রথমে কর্মী ছিলেন ও পরে এর সাংগঠনিক হাল ধরেছিলেন এবং একাত্তরের একটা জটিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মধ্যে জাতির মুক্তিযুদ্ধে সফল রাজনৈতিক নেতৃত্বদান করেন। এ জাতির ইতিহাসে, তথা বাঙালীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাজউদ্দীনের এই অবদান অদ্বিতীয় এবং অতিস্মরণীয়।
আত্মপ্রচারবিমুখ সদা কর্মধ্যানে মগ্ন এই অসাধারণ দেশসেবক মানুষটির জীবন সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত অল্পই লিপিবদ্ধ হয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমদ আহমদ আমাদের ইতিহাসের এক ভাস্বর ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিতে তিনি মেধা, শ্রম, সততা, গণমনস্কতা এবং আদর্শবাদের প্রতীক। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে তার অবিস্মরণীয় সফল ভূমিকা ও অবদান। তার আরও একটি বড় অবদান, যা পরিণামে তার মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। তাহলাে ১৯৭১-এর দুর্যোগময় দিনে বাংলার বীর সন্তানরা যখন শত্রুর কবল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্যে অকাতরে রক্ত দিচ্ছিল তখন প্রবাসী সরকারের
পৃষ্ঠাঃ ৭৭৩

অন্যতম সদস্য খন্দকার মােশতাক আহমদের বাংলাদেশবিরােধী অন্তর্ঘাত প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করা। তাজউদ্দীন আহমদের প্রিয় নেতা, স্বাধীনতা মন্ত্রের উদ্গাতা এবং স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি তার আনুগত্য কিংবদন্তির মতাে। তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর নামে ন’মাসের যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে এ দুজনের মধ্যে বিচ্ছেদ আমাদের ইতিহাসের একটি অন্ধকারময় ঘটনা। এ অন্ধকার আরও গাঢ় হয়, যখন বঙ্গবন্ধু নিজ বাসভবনে মােশতাক নিয়ােজিত খুনীদের দ্বারা উনিশ শ’ পঁচাত্তরের আগস্ট মাসে সপরিবারে নিহত হন এবং অল্প কয়েকদিন পর যুদ্ধকালীন তিনজন প্রধান সহকর্মীসহ তাজউদ্দীন আহমদ জেলেনস্বাধীনতাবিরােধীদের হাতে প্রাণ দেন।
জীবন এবং মৃত্যুতে মহীয়ান, স্বাধীনতা ও ত্যাগের গৌরবপৃষ্ঠ, মানবিক উদার এবং স্বচ্ছ দৃষ্টির অধিকারী, শােষণহীন সমাজের স্বপ্ন দ্বারা প্রাণিত এ রাষ্ট্রনায়কের জীবন যে কোন মানদণ্ডে তাৎপর্যপূর্ণ। এ মানুষটির হয়ে ওঠার নিশ্চয়ই একটা বিস্তৃত ইতিহাস আছে এবং কতখানি কৌতুহলােদ্দীপক এবং চিত্তাকর্ষক তা তার সম্প্রতি প্রকাশিত প্রথম জীবনের ডায়েরীগুলােতে আংশিকভাবে প্রতিফলিত।
তাজউদ্দীন আহমদের শান্তিকালীন ভাবনা, যুদ্ধকালীন চিন্তা, পুনর্গঠন এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা দেশের মানুষের প্রতি তার অগাধ আস্থা তার একটা মূল নির্ধারক প্রত্যয় ছিল । মানুষের সংগ্রামী চেতনা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিত এবং যখন তিনি তা দেখতে পেতেন তাকে প্রাণভরে অভিনন্দিত করতেন।
তাজউদ্দীনের আস্থা ছিল স্বাধীনতা জয়, স্বাধীনতা রক্ষা এবং দেশের উন্নয়নে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিতে। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধের সময় তার প্রথম আবেদন এবং বিশ্বাসের উচ্চারণ ছিল বাংলাদেশের মানুষের প্রতিভ।
একইভাবে গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের, বিশেষ করে সমাজতন্ত্রের কথা তিনি বলতেন মানুষের জন্যে তার স্বাভাবিক অনুভূতি বা Instinct দিয়ে চালিত হয়ে। ঐতিহাসিক কারণে নানা যােগ-বিয়ােগ করেও তার এ Instinct ছিল যথার্থ। |
তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে কঠিন মানদণ্ড দিয়ে বিচার করতেন। তার আত্মসমালােচনা নির্মম। তাঁর অবলােকন দূরদর্শী। প্রথমে তার আত্মসমালােচনার কথাই ধরা যাক : ‘নিজে কৃছু সাধন না করে অপরকে কৃচ্ছ্রতা সাধন করার উপদেশ দেয়া যায় না। জাতির অগ্রগতির জন্যে কিছু না করা চরম।বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। দোষী ব্যক্তি পিতা-পুত্র, নেতা-শ্রমিক সঙ্গী হলেও তাকে ক্ষমা করা চলবে না। তিনজন মন্ত্রী ছাড়া কারো মন্ত্রিত্বের পুরনাে অভিজ্ঞতা
পৃষ্ঠাঃ ৭৭৪

নেই ঠিক তেমনি অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারীর জাতীয়ভিত্তিক দায়িত্ব পালনের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। মাত্র আড়াই বছরে দেশের সীমাহন সমস্যা দূর করা যায়নি এবং এর জন্য যে লােক তৈরির প্রয়ােজন ছিল তাও সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি; ব্রিটিশ ও পাকিস্তানীদের দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন আমলে যে প্রশাসনযন্ত ব্যবহার করা হয়েছিল তা বর্তমানে দেশ পরিচালনার যােগ্য নয়, দুর্নাম অর্জনের আগেই আওয়ামী লীগের মৃত্যুকে স্বাগত জানাব।
সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, বিরােধী রাজনীতি এবং জাতীয় ঐক্য সম্পর্কে তাজউদ্দীনের কিছু কথা এ মুহূর্তে বিস্ময়করভাবে প্রমাণিত ;
“আমরা ২৩ বছর বিরােধী দলের ভূমিকা পালন করেছিলাম কিন্তু কখনও কারও বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলিনি কিংবা কাল্পনিক অভিযােগ আনিনি। বিরােধী দল বিকল্প সরকার সহনশীলতা এবং পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাবােধ গণতন্ত্রের অপরিহার্য বিধান, মানুষকে যারা কষ্ট দেয়, তাদের মধ্যে হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, আসুন সরকার ও বিরােধী দল মিলে তাদের চিহ্নিত করি এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের হতাশা দূর করি। মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক মানুষের জন্য বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়নি।”
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দীনের আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন :
“দেশত্যাগ করে ট্রেনিং নিয়ে যারা যুদ্ধ করেছে, যারা অধিকৃত এলাকা থেকে ট্রেনিং নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে সংগ্রামে এবং অধিকৃত এলাকার যে কোটি কোটি বাঙালী সাহায্য ও সহযােগিতার মাধ্যমে পরােক্ষভাবে সংগ্রাম করেছে, তাদের সবাই মুক্তিযােদ্ধা।” এ যথা সময়ে উচ্চারিত একটি রাষ্ট্রনায়কোচিত কথা।
যিনি ছিলেন এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরােধা ব্যক্তিত্ব, যিনি আজীবন জনগণের কল্যাণ নিয়ে ভেবেছেন, যে মানুষটি বাঙালী জাতির সুখী স্বাধীন জীবন গড়ার সংগ্রামে পরমভাবে নিবেদিত ছিলেন, সেই প্রচারবিমুখ, ত্যাগী ও কৃতী দেশপ্রেমিক মানুষটিকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল।স্বাধীনতাবিরােধী ঘাতকের দল।
মৃত্যু তাজউদ্দীনকে মহিমান্বিত করে। নতুন রূপে উদ্ভাসিত হলেন তিনি। তার রেখে যাওয়া কর্ম আর ভাবনা আলােক দ্যুতি ছড়ায় এদেশের আকাশে বাতাসে, বাঙালী জাতি তথা বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে চির অক্ষয় লেখা থাকবে তার অবদান।
তাজউদ্দীন আহমদ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা
পৃষ্ঠাঃ ৭৭৫

করেছেন। তিনি মনে-প্রাণে সেকুলার ছিলেন । ধর্মকে আশ্রয় করে তিনি রাজনীতি করেননি। অন্যদিকে আলেম সমাজ বা ধর্মকে আঘাত দিয়ে কোন বক্তব্য দেননি। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বেতার হতে কুরআন, গীতা ও বাইবেল পাঠ হত। যুদ্ধের মধ্যে তিনি ঈদের নামাজ পড়েছেন। তিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাশী ছিলেন। তিনি পীর-আউলিয়াদের ভক্ত ছিলেন। ১৯৪৭ ও ১৯৭৪ সালে তিনি দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জেয়ারত করেন।
তিনি স্বচ্ছতা ও সততায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তা দৈনন্দিন জীবন চর্চা করতেন। তিনি জাতীয় নির্বাচনে সকল নিয়ম, বিধি মেনে চলতেন। নির্বাচনী অধিকাংশ প্রার্থী নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে দাখিল করবে না। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের হিসাব বিবরণী এক মাসের মধ্যে দাখিল করেন। নির্বাচনে তার মােট ব্যয় হয়েছিল দুই হাজার পাঁচ শত টাকা। ৭ মার্চ বিাচন সম্পন্ন হয়েছে এবং তিনি ১৩ এপ্রিল ১৯৭৩ তারিখে নির্ধারিত ফরমে নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন দাখিল করেন।
তিনি স্বহস্তে লিখিত আয়কর হিসাব কর অফিসে জমা দিতেন। তার আয়ের উৎস ছিল ধানমণ্ডির সাতমসজিদ রােডের চারতলা ভবনের ভাড়া। তিনি নিজে ভাড়ার রসিদ দিতেন। ভবনের সাধারণ সংস্কারের জন্য তার নিজের যন্ত্রপাতি।ছিল। বাসায় ফুলের গাছ ও অন্য গাছ লাগিয়ে যত্ন নিতেন।
তিনি নিয়মিত বই পড়তেন এবং ডায়েরি লিখতেন। প্রধানমন্ত্রী থাককালে তিনি সভার কার্যবিবরণী নিজ হাতে লিখতেন। তার হাতের লেখা ছিল মুক্তার মতাে। ইংরেজী ও বাংলা লেখায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তিনি কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের ওপর বই পড়তেন। মার্কস ও লেনিন এবং অন্য মনীষীদের লেখা গ্রন্থ চর্চা করতেন। তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন না- সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর মূল রাজনীতি হতে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়।
মানুষ সকল সমালােচনার উর্ধ্বে উঠতে পারে না। কোনাে না কোনাে ত্রুটি তার মধ্যে থেকে যায়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদের জীবন, শিশুকাল হতে মৃত্যু পর্যন্ত পর্যালােচনা করে দেখা যায়- Tajuddin Ahmed was a complete man. তিনি একজন সম্পূর্ণ মানুষ ছিলেন। সততা, ন্যায়, মানবতার সাধক- এ মহান নেতা বাঙালী জাতির অপূর্ব সৃষ্টি। হাজার বছর ধরে পদ্মা, যমুনা ও মেঘনা পাড়ের মানুষ তাকে স্মরণ ও অনুকরণ করবে- শােষণহীন এক সুখী বাঙালী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।
পৃষ্ঠাঃ ৭৭৬

তথ্য সূত্র

ছাত্রজীবন
১. এ্যাডভােকেট আফসার উদ্দিন আহমদ খান, সাবেক এমপি, প্রতিমন্ত্রী; প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ।
২. তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫০-১৯৫২
৩. মুহমাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহােরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ অধিবেশনের ভাষণ।
৪ কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২
৫. Stanely Wolpert, Jinnah of Pakistan
৬. তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতকার, প্রকাশিত জয় বাংলা পত্রিকা, ১৯৭১
৭. ডা. এম এ করিম, তাজউদ্দীন আহমদের বন্ধু
৮. ম. ওয়াহিদুজ্জামান, ছাত্র জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু
৯. আরহাম সিদ্দিকী, সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের বন্ধু
১০. বাহাউদ্দিন চৌধুরী, সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলের বন্ধু


ছাত্র রাজনীতি ১৯৪৩-৪৭
১. কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, পৃষ্ঠা ২৬
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৯
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪০
৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৭
৭. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬২
৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৬২-৬৫
৯. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭০
১০. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮০-৮২
১১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৮৩
১২. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, পৃষ্ঠা ১২১-১৫৪
পৃষ্ঠাঃ ৭৭৭


পাকিস্তানের রাজনীতি
১. কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, পৃষ্ঠা ৯৯-১০১
২. তাজউদ্দীন আহমদ এর ডায়েরি ১৯৪৭-৪৮
৩. কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, পৃষ্ঠা ১০০
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭
৫. অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, পৃষ্ঠা ৩০
৬. গাজীউল হক, ভাষা আন্দোলন
৭. সিরাজ উদদীন আহমেদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, পৃষ্ঠা ৬৯-৭০
৮. শায়েস্তা সােহরাওয়াদী, Proceedings of Pakistan Constituent Assembly, February 1948


পাকিস্তান আন্দোলন
১. তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪
৩. সাপ্তাহিক নওবেলাল, মার্চ ১৯৪৮
৪. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৪
৫. তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-৪৮
৬. অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫,পষ্ঠা ৬৫-৬৭
4. Memoirs of Hossain Shaheed Suhrawardy, Page 112-114
৮. তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৯-৫২
৯. মুজাফফর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ- আলােকের অনন্তধারা, পৃষ্ঠা ৩৪২
১০. আবুল মাল আবদুল মুহিত, আলােকের অনন্তধারা, পৃষ্ঠা ৯৯-১১৮
১১. বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, পৃষ্ঠা ১৫০
১২. অধ্যাপক সর্দার ফজলুল করিম, তাজউদ্দীন আহমদ- মানুষ ও নেতা, পৃষ্ঠা ১
১৩. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, মানুষ ও নেতা, পৃষ্ঠা ৬৩-৬৬
১৪. কামরুদ্দিন আহমদ, বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, পৃষ্ঠা ১৭৪


১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন
১. সিমিন হােসেন রিমি আলােকের অনন্তধারা, পৃষ্ঠা ২১
২. অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, পৃষ্ঠা ৫৫৯
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮৫-৫৯০
৪. সাক্ষাতকার, প্রয়াত দেলদার আহমদ (খুলনা), পাকিস্তানের সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ১৯৫৬-৫৭
পৃষ্ঠাঃ ৭৭৮

৫. অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, পৃষ্ঠা ২২৫-২৩৫
৬. আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর
৭. Memoirs of Hosain Shaheed Suhrawardy, Page 126
4. Memoirs of Hose


জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন
১. সিরাজ উদদীন আহমেল, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, পৃষ্ঠা ৩৫৮
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৫৮-৪৫৯
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৮৬-৩৮৭
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯৮-৪০৩
৫ সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৭৮-১৮৫
৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮০-১৮৫


৬ দফা আন্দোল ১৯৬৬
১. সিরাজ উদ্দীন আহমদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ১৮-১৮৯
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯০-১৮১
৩, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯১-১৯৩
৪. সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ ও বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ, পৃষ্ঠা ২৮-২৯
৫. অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, পৃষ্ঠা ৩২৪-৩৩০
৬. সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ ও বাবা তাজউদ্দীন আহমেদ, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬


ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
১. সিরাজ উদ্দীন আহমদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ২১৭-২২৪
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৪-২৩৫
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২০৫-২৪২
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪০
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪৬
৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫৪-২৫৭
৭. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৬২-২৬৩


১৯৭০ সালের নির্বাচন
১. L.F.O 1970 published on 30 March 1970
পৃষ্ঠাঃ ৭৭৯

২. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ২৭-৭৯
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩১১-৩১৪
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩১৭
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩১৯-৩২০
৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৩২-৩৩৪

১০
২৫ মার্চ পাকবাহিনীর আক্রমণ-বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা
১. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৩১১-৩৩৪
২. মযহারুল ইসলাম, শেখ মুজিব, পৃষ্ঠা ৮০৮-৮০৯
৩. তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১
8. Siddiq Salik, Witness to Surrender, Page 75-76

১১
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন
১. ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, সাক্ষাতকার
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড
৩. সিমিন হােসেন রিমি, তাজউদ্দীন আহমদ, আলােকের অনন্তধারা, পৃষ্ঠা ২০১-২০৪
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৩-২৪২
৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, ১৫তম খণ্ড

১২
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড
২. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫-৬
৩. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৪-১০৯
৪. প্রাগুক্ত
৫. প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এর ডায়েরি

১৩
রণাঙ্গনে প্রধানমন্ত্রী
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড
২. প্রাগুক্ত, তৃতীয় খণ্ড
পৃষ্ঠাঃ ৭৮০

৩. তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৭১
৪ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রকাশিত প্রচার পুস্তিকা

১৪
ভারতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
১ সৈয়দ মকসুদ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, পৃষ্ঠা ৪৬১-৪৪২
২. সিরাজ উদদীন আহমেদ, মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, পৃষ্ঠা ৩৫২-৩৫৩
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬৪
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬৪
৫. সাইফুল ইসলাম, স্বাধীনতা-ভাসানী-ভারত, পৃষ্ঠা ১৯৯৭-২১০

১৫
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কার্যাবলী
১. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড ও পঞ্চম খণ্ড
২. প্রাগুক্ত
৩. বেলাল মােহাম্মদ, স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র, পৃষ্ঠা ২১-২৪
৪. মােহাম্মদ নুরুল কাদের, আমার একাত্তর

১৬
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও তার মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলী
১. তাজউদ্দীন আহমদ এর ডায়েরি ১৯৭১
২. এইচটি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১, পৃষ্ঠা ৬১-১০৫
৩. বেলাল মােহাম্মদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, পৃষ্ঠা ১০০-১২৫
৪. মােহাম্মদ নুরুল কাদের, আমার একাত্তর

১৭
পাকবাহিনীর গণহত্যা
১. সিরাজ উদদীন আহমেদ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা ৩২২-৩৪৭
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬১-৩৬৫
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮৫-২৮৭
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬৬-৩৬৮
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭২-৩৭৩
৬. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭৪-৩৭৫
পৃষ্ঠাঃ ৭৮১

১৮
মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা, চীন ও জাতিসংঘের ভূমিকা
১. তাজউদ্দীন আহমেদ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা ৩৮৫-৩৮৮
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৮৮-৩৯১
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯১-৩১৩
৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯৪-৪৯৫
৫. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৬৮-৪৯৪

১৯
অগ্রযাত্রা
১. মইদূল হাসান, মূলধারা ‘৭১, পৃষ্ঠা ২৬
২. মােহাম্মদ নুরুল কাদের
৩. প্রাগুক্ত
৪. মােহাম্মদ নুরুল কাদের, আমার একাত্তর
৫. নুরুল কাদের, আমার একাত্তর
৬. তাজউদ্দীন আহমদ এর লেখা চিরকুট
৭. Lt. General AAK Niazi, The Betrayal of East Pakistan, Page 46-62
৮. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০
১. মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, পৃষ্ঠা ৭৭-৮০
১০. তাজউদ্দীন আহমদ এর ভাষণ, ২৩ নভেম্বর ১৯৭১

২০
পৃথিবী কাঁপানাে ১৩ দিনের যুদ্ধ- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
১. Lt. General JFR Jacobe, Surrender at Dacca, Page 182
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ড
৩. তাজউদ্দীন আহমদের বেতার ভাষণ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
8. Hasan Zaheer, The Separation of East Pakistan, Page 377-378.
৫. Ibidi, Page 379-380
6. Ibidi, Page 385
৭. Ibidi, Page 385-390)
৮. lbidi, Page 401
৯. Ibidi, Page 405
১০. Ibidi, Page 405
পৃষ্ঠাঃ ৭৮২

১১. Ibidi, Page 406
১২. Lt. General AAK Niazi, The Separation of East Pakistan, Page 190-191
১৩, Hassan Zaheer , The Separation of East Pakistan, Page 422
১৪. Lt. General JFR Jacobe, Surrender at Dacca, Page 146-148
১৫. Tbidi, Page 145-146
১৬. bidi, Page 176
১৭. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, পৃষ্ঠা ৫২৮
১৮. Lt. General AAK Niazi, The seperation of East Pakistan, page 210
১৯. Major General Lachhman Singh, Victory in Bangladesh, Page 295-298

২০
কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােড হতে বঙ্গভবন
১. মােহাম্মদ নুরুল কাদের, আমার একাত্তর, পষ্ঠা
২. মাহবুব করিম সম্পাদিত, তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও মানুষ, পৃষ্ঠা ৬৭-৭০।
৪. সাক্ষাতকার, এইচটি ইমাম, মন্ত্রিপরিষদ সচিব। মহিউদ্দিন খান আলমগীর, সচিব ও সাবেক মন্ত্রী।
৫. মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, পৃষ্ঠা ২৫৫-২৬৬

২২
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি লাভ
১. Stanley Wolpert, Zulfi Bhutto of Pakistan, Page 178
২. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৫০২-৫০৫
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৫-৫০৭
৪. বাংলাদেশের সংবিধান ১৯৭২
৫. সিরাজ উদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৫৫৮-৫৬৪

২৩
তাজউদ্দীন আহমদের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ
১. তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ- সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল, ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২
২. তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ, ২ এপ্রিল ১৯৭২
৩. তাজউদ্দীন আহমদ, কাউন্সিল অধিবেশনের রিপাের্ট ১৯৭২
৭৮৩

৪. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা
৫. তাজউদ্দীন আহমদ, বাজেট বক্তৃতা, ১৯৭৪-৭৫
৬. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-৮০
৭. তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতা, ১৭ এপ্রিল ১৯৭৪, মুজিবনগর
৮. তাজউদ্দীন আহমদ, সাংবাদিক সম্মেলন ১৩ অক্টোবর ১৯৭৪
৯. তাজউদ্দীন আহমদ এর ভাষণ, ৭ মার্চ ১৯৭৪
১০. আবদুল লতিফ সিকদার, কিংবদন্তীর মহানায়ক ম্যানসেরু মিয়া, পৃষ্ঠা ৪০-৪৩

২৪
আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে তাজউদ্দীন আহমদের শেষ ভাষণ, ২০ জানুয়ারি ১৯৭৪
১. সিমিন হােসেন রিমি সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদ ইতিহাসের পাতা থেকে, পৃষ্ঠা ৩৯০-৪১৩।

২৫
মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ, ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪
১. সিমিন হােসেন রিমি, পৃষ্ঠা ১৪৫-১৪৬
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫১
৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫২
৪. মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, পৃষ্ঠা ২৬৫-২৬৬
৫. আবদুল লতিফ সিকদার, ম্যানসেরু মিয়া, পৃষ্ঠা ৪০-৫০
৬. সিমিন হােসেন রিমি সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদ আলােকের অনন্তধারা, পৃষ্ঠা ৩৫৩-৩৭০
৭. মাহবুব করিম সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও মানুষ, পৃষ্ঠা ৫৫-৬০
৮. আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা প্রবন্ধ
৯. প্রাগুক্ত
১০. তাজউদ্দীন আহমদ- আলােকের অনন্তধারা, পৃষ্ঠা ২৫৩-২৬৮
১১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৯-১১৮
১২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৬৯-২৯২
১৩. প্রাগুপ্ত, পৃষ্ঠা ১৭৯-২০০

২৬
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ড
১. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা ৫৭২
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭৩
পৃষ্ঠাঃ ৭৮৪

৩. Anthony Mascarenhas, Bangladesh – A Lagecy of Blood, Page 53-55

২৭
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাজউদ্দীন আহমদ নিহত, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫
১. সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৫৭
২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬১-১৬২
৩. জিল্লুর রহমান খান, Leadership Crisis in Bangladesh
৪. Another Mascarenhas, Bangladesh- A Legacy of Blood, ,page 101-102
৫. Ibidi, Page 154-180
৬. সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৭
৭. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২০১-২০২
৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২০২
৯. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২০৩
১০. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২০৩-২০৪

২৮
তাজউদ্দীন আহমদ মানুষ ও নেতা
১.তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও মানুষ, সম্পাদনায় মাহবুব করিম, পৃষ্ঠা ৩৪-৪৯
২. সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৯০
৩. মােহাম্মদ নুরুল কাদের, আমার একাত্তর
৪. মাহবুব করিম সম্পাদিত তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও মানুষ, পৃষ্ঠা ৫০-৫৪
৫. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৫০-৫৪
৬. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৩০-৩৩
৭. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৭৪-৭৭
৮. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৭৯
৯. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ১০৪-১০৭
১০. প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ১০৪-১০৬
১১. মঈদুল হাসান, মূলধারা ‘৭১, পৃষ্ঠা ২৬৬
১২. জয় বাংলা পত্রিকা ১৯৭১
১৩. সিমিন হােসেন রিমি, আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, পৃষ্ঠা ১৫২
পৃষ্ঠাঃ ৭৮৫

—X—

Previous