বঙ্গবন্ধু কেন বন্দীত্ববরণ করলেন, পাকিস্তানে বিচার প্রক্রিয়া কেমন ছিলো, তার জন্য কবর খোঁড়া, বন্দীদের দিয়ে তাকে হত্যাচেষ্টা, কেন ইয়াহিয়া তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হল, কিসের জন্য তিনি ভুট্টোর কাছে কৃতজ্ঞ, শহীদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ কীভাবে জানলেন, বাংলাদেশের পতাকা থেকে কেন মানচিত্র বাদ দিলেন, কিভাবে জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত হল, ৭ মার্চ কেন বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করলেন না, এমনকি তার ২৫ বছরের প্রিয় তামাক এরিন মোর কিভাবে কারাগারে পেয়েছেন, পাকিস্তানের কাছে সম্পদের বাটোয়ারা চাওয়া, দেশের গোল্ড রিজার্ভ শুরু করতে জনগণের কাছে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্নালংকার চাওয়া, “পাওয়ার করাপ্টস, অ্যাবসোলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলিউটলি” – এর থেকে কিভাবে বাঁচতে পারবেন বঙ্গবন্ধু, প্রিয় ব্যক্তিত্ব, জেল জীবনের সময়কাল, জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহুর্ত, পৃথিবীর মানুষের কাছে বার্তা ইত্যাদি অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এই সাক্ষাৎকারে। অবশ্যই পড়বেন।
ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের নেওয়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার | ১৮ জানুয়ারি ১৯৭২।
১৯৬৯-৭২ সময়ে আমেরিকায় ডেভিড ফ্রস্ট শো বিভিন্ন টেলিভিশন স্টেশন থেকে প্রচারিত হতো। ডেভিড ফ্রস্ট (পরবর্তীতে স্যার) তখন একই সঙ্গে লন্ডনে বিবিসিতে ও আমেরিকায় আকর্ষণীয় প্রোগ্রাম করতেন। ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিলে ডেভিড ফ্রস্ট ঢাকায় এসে তার সাক্ষাঙ্কার গ্রহণ করেন। ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক এক ঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠানে এই সাক্ষাৎকার আমেরিকায় অনেক টেলিভিশন স্টেশনে যথা WNEW নিউইয়র্ক বা WTTG ওয়াশিংটনে ১৮ জানুয়ারি প্রদর্শিত হয়। পুরো সাক্ষাৎকারটি ভারত সরকার প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস দ্বিতীয় খণ্ড সংকলনে আছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারটির পূর্ণ বিবরণ:
(ইংরেজি ডকুমেন্ট এবং ভিডিও লিঙ্ক নীচে দেখুন।)
ডেভিড ফ্রস্ট: সে রাতের কথা আপনি বলুন। সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন চলছিল আলোচনা এবং যখন সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই রাতের কথা বলুন। সেই ২৫শে মার্চ, রাত আটটা। আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। সেই বাড়িতেই পাকিস্তানি বাহিনী আপনাকে গ্রেপ্তার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু আপনি আপনার বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। আপনি গ্রেপ্তার হলেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গেলেন না এবং গ্রেপ্তারবরন করলেন? কেন এই সিদ্ধান্ত? তার কথা বলুন।
শেখ মুজিবুর রহমান: হ্যা, সে এক কাহিনী। তা বলা প্রয়োজন। সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কম্যান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুনো-না-বেরুনো নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানি বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগােপন করলে, ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে। এক হত্যাযজ্ঞ ওরা সমাধা করবে। আমি স্থির করলাম, আমি
মরি, তাও ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।
ফ্রস্ট: আপনি হয়ত কলকাতা চলে যেতে পারতেন।
শেখ মুজিব: আমি ইচ্ছা করলে যে-কোন জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার
দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব। মৃত্যুবরণ করব। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহবান ছিল, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোল।
ফ্রস্ট: আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ, এই ঘটনাই বিগত ন’মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি তো এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরবৎ।
শেখ মুজিব: আমি তা বলিনে। কিন্তু এ কথা সত্য, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি
আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। আমি তাদের জীবন রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিল। আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধা জননী ছিলেন, গ্রামের সে বাড়িও ধ্বংস করে দিল। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে তাদের চোখের সামনে সে। বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। বাবা-মার আর কোন আশ্রয় রইল না। ওরা সব কিছুই জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে। আমি একটি শক্তিশালী সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই। করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, হয়ত এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।
ফ্রস্ট: আপনাকে ওরা ঠিক কিভাবে গ্রেপ্তার করেছিল? তখন তো রাত ১.৩০ মি. ছিল? তাই নয় কি? তখন কি ঘটল?
শেখ মুজিব: ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল।
ফ্রস্ট: ওরা যখন এলো, তখন আপনি বাড়ির কোনখানটাতে ছিলেন?
শেখ মুজিব: এই যেটা দেখছেন, এটা আমার শোবার ঘর । আমি এই শোবার ঘরেই তখন বসেছিলাম। এদিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপরে এদিক ওদিক-সবদিক থেকে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। জানালার ওপর গুলি চালায়।
ফ্রস্ট: এগুলো সব তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, সব ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে
ছিলাম। একটা গুলি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছ’বছরের ছোট ছেলেটি বিছানার ওপর তখন শোয়া ছিল। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।
ফ্রস্ট: পাকিস্তান বাহিনী কোন দিক দিয়ে ঢুকেছিল?
শেখ মুজিব: সবদিক দিয়ে। ওরা এবার জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে সন্তান দুটি নিয়ে বসে থাকতে বলি। তারপর তার কাছ থেকে উঠে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি।
ফ্রস্ট: আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?
শেখ মুজিব: না, কোন শব্দ উচ্চারণের তখন অবস্থা নয়। আমি শুধু তাকে একটি বিদায় সম্ভাষণ জানিয়েছিলাম। আমি দুয়ার খুলে বাইরে বেরিয়ে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম, “তোমরা গুলি বন্ধ কর। আমি তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা গুলি করছ কেন? কি তোমরা চাও?” তখন চারদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলো, বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একটা অফিসার আমাকে ধরল। ওই অফিসারই বলল, “এই! ওকে মেরে ফেল না।”
ফ্রস্ট: একটা অফিসারই ওদের থামিয়েছিল?
শেখ মুজিব: হ্যা, ওই অফিসারটি থামিয়েছিল। ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে
নামাল। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের কুদো দিয়ে মারতে লাগল। অফিসারটা আমাকে ধরেছিল। তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নামাতে লাগল। আমি বললাম, “তোমরা আমাকে টানছ কেন? আমি তো যাচ্ছি।” আমি বললাম, “আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও।” ওরা একটু থামল। আমি ওপরে গিয়ে আমার তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী তখন দুটি ছেলেকে নিয়ে দাড়িয়েছিলেন। আমাকে কিছু কাপড়চোপড়সহ একটি ছোট স্যুটকেস দিলেন। তাই নিয়ে আমি নেমে এলাম। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছিল। আজ এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকে ওরা আমায় নিয়ে গেল।
ফ্রস্ট: আপনার ৩২ নং ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে সেদিন যখন আপনি বেরিয়ে এলেন,
তখন কি ভেবেছিলেন, আর কোনদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?
শেখ মুজিব: না, আমি তা কল্পনা করতে পারি নি। আমি ভেবেছি, এই-ই শেষ। কিন্তু
আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোন কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভাল। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোন হানি ঘটে।
ফ্রস্ট: শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন : “যে-মানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পার না। কথাটি কি এমনই ছিল না?
শেখ মুজিব: হ্যা, আমি তাই মনে করি। যে-মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস। আমি একজন মুসলমান। এবং একজন মুসলমান একবারই মাত্র মরে, দুবার নয়। আমি মানুষ। আমি মনুষ্যত্বকে ভালোবাসি। আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কিছু দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসেছে। সবকিছুকে বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সব কিছুকে তাদের জন্যে দিবার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ-ভালোবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।
ফ্রস্ট: পাকিস্তানি বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছুই লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মুজিব: হ্যা, আমার সব কিছুই ওরা লুট করেছে। আমার ঘরের বিছানাপত্র, আলমারি, কাপড়-চোপড়—সব কিছুই লুষ্ঠিত হয়েছে।
মি. ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ বাড়ির কোন কিছুই আজ নেই।
ফ্রস্ট: আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব জিনিস লুষ্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুণ্ঠন করেছে?
শেখ মুজিব: পাকিস্তানি ফৌজ আমার সবকিছুই লুণ্ঠন করেছে। কিন্তু এই বর্বর বাহিনী
আমার আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্য-সামগ্রী লুণ্ঠন করেছে, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল। আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরি ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।
ফ্রস্ট: তাই আবার সেই প্রশ্নটা আমাদের সামনে আসে—কেন ওরা সবকিছু লুণ্ঠন
করল?
শেখ মুজিব: এর কি জবাব দেব? আসলে ওরা মানুষ নয়। কতগুলো ঠগ, দস্য, উন্মাদ,
অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা ছেড়ে দিন। তা নিয়ে আমার কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ২ বছর-৫ বছরের শিশু, মেয়েরা—কেউ রেহাই পেল না। সব নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে দেখিয়েছি সব জ্বালিয়ে দেওয়া, পােড়াবাড়ি, বস্তি। একেবারে গরিব, না-খাওয়া মানুষ সব বাস করত এই বস্তিতে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে। আর সেইসব মানুষের উপর চারদিক থেকে মেশিনগান চালিয়ে হাজারে হাজারে হত্যা করা হয়েছে।
ফ্রস্ট: কি আশ্চর্য! আপনি বলছেন, ওদের ঘরে আগুন দিয়ে ঘর থেকে বার করে, খোলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব: হ্যা, এমনিভাবে গুলি করে তাদের হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: কোন মানুষকে মারল, তার কোন পরোয়া করল না?
শেখ মুজিব: না, তার বিন্দুমাত্র পরোয়া করে নি।
ফ্রস্টঃ কেবল হত্যার জন্য হত্যা—যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?
শেখ মুজিব: হ্যা, যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। ওরা ভেবেছে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ। তাই প্রত্যেককেই হত্যা করতে হবে।
ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখেন, মানুষ মানুষকে এমনিভাবে হত্যা করছে, তখন আপনার কি মনে হয়? আপনি কি মনে করেন, মানুষ আসলে ভালো? কিংবা মনে করেন মানুষ আসলেই খারাপ?
শেখ মুজিব: ভালো-মন্দ সর্বত্রই আছে। মনুষ্যত্ব আছে, এমন মানুষও আমি দেখেছি। কিন্তু আমি মনে করি, পশ্চিম পাকিস্তানের এই ফেীজ-এগুলো মানুষ নয়। এগুলো পশুরও অধম। মানুষের যে পাশবিক চরিত্র না থাকতে পারে, তা নয়। কিন্তু যে-মানুষ, সে পশুর অধম হয় কি প্রকারে? কিন্তু এই বাহিনী তো পশুরও অধম। কারণ, একটা পশু আক্রান্ত হলেই মাত্র আক্রমণ করে। তা নইলে নয়। পশু যদি মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তবু সে তাকে অত্যাচার করে না। কিন্তু এই বর্বরের দল আমার দেশবাসীকে কেবল হত্যা করে নি। দিনের পর দিন বন্দি মানুষকে অত্যাচার করেছে। ৫ দিন, ৭ দিন, ১৫ দিন। নির্মম অত্যাচার করেছে, আর হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট : পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সেই বিচার সম্পর্কে কিছু বলুন।
শেখ মুজিব: ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। তাতে পাঁচজন ছিল সামরিক
অফিসার। বাকি কয়েকজন বেসামরিক অফিসার।
ফ্রস্ট: আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আনল ওরা?
শেখ মুজিব: অভিযোগ—রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাদেশকে
স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র, আরও কত কী!
ফ্রস্ট: আপনার পক্ষে কোন আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন উপায়
ছিল?
শেখ মুজিব: সরকারের তরফ থেকে গােড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম অবস্থাটা এমনই যে, যুক্তির কোন দাম নেই; দেখলাম, এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র, তখন আমি কোর্টে নিজে দাড়িয়ে বললাম ; জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গােপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক কোন লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল । ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট, তাই নয়। তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসকও। এ বিচারের রায়কে অনুমােদনের কর্তা তিনি। এই আদালতকে গঠন করেছেন তিনি।
ফ্রস্ট: তার মানে, তার হাতেই ছিল সব?
শেখ মুজিব: হ্যা, সে ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার ইচ্ছাই ইচ্ছা।
ফ্রস্ট: তার মানে, আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন?
শেখ মুজিব: তার তো কোন উপায় ছিল না। আমি তো বন্দি।
ফ্রস্ট: হ্যা, তা তো বটেই। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তো কোন উপায় ছিল না। ওরা
কি বিচার শেষ করে সরকারিভাবে কোন রায় তৈরি করেছিল?
শেখ মুজিব: ৪ঠা ডিসেম্বর (‘৭১) ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান সব বিচারক, যথা লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার—এদের সব রাওয়ালপিন্ডি ডেকে পাঠাল রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ঠিক করল, ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।
ফ্রস্টঃ আর তাই সেলের পাশে কবর খোঁড়া দেখে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন, ওরা ওখানেই আপনাকে কবর দেবে?
শেখ মুজিব: হ্যা, আমার সেলের পাশেই ওরা কবর খুঁড়ল। আমার চোখের সামনে।
ফ্রস্ট: আপনি নিজের চোখে তাই দেখলেন?
শেখ মুজিব: হ্যা, আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম, ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম, “আমি জানি, এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে। কোন পরোয়া নেই। আমি তৈরি আছি।”
ফ্রস্টঃ ওরা কী আপনাকে বলেছিল? “এ তো তোমার কবর?”
শেখ মুজিব: না, ওরা তা বলে নি।
ফ্রস্টঃ কী বলেছিল ওরা?
শেখ মুজিবঃ ওরা বলল, ‘না, না। তোমার কবর নয়। ধর যদি বোম্বিং হয়, তাহলে তুমি এখানে শেলটার নিতে পারবে।’
ফ্রস্টঃ সেই সময়ে আপনার মনের অনুভূতি কেমন ছিল? আপনি কি এই সারাটা সময়, ন’মাস নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করেছেন?
শেখ মুজিবঃ আমি জানতাম, যে-কোন দিন ওরা আমায় শেষ করে দিতে পারে। কারণ, ওরা অসভ্য বর্বর।
ফ্রস্ট: এমনই অবস্থায় আপনার কেমন করে কাটত? আপনি কি প্রার্থনা করতেন?
শেখ মুজিব: এমন অবস্থায় আমার নির্ভর ছিল আমার বিশ্বাস, আমার নীতি, আমার পৌনে আট কোটি মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস। তারা আমায় ভালোবেসেছে
ভাই-এর মতো, পিতার মতো। আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।
ফ্রস্ট: আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না, আপনার স্ত্রী-পুত্র পরিজনের কথা?
শেখ মুজিব: আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয়-স্বজনদের চাইতেও আমার ভালোবাসা আমার দেশের জন্য। আমার যা কিছু দুঃখ ভােগ, সে তো আমার দেশেরই জন্য। আপনি তো দেখেছেন, আমাকে তারা কি গভীরভাবে ভালোবাসে।
ফ্রন্ট: হ্যা, একথা আমি বুঝি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা। পারিবারিক চিন্তা পরের চিন্তা।
শেখ মুজিব: হ্যা, জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালোবাসা। আমি তো জানি, আমি অমর নই। আজ, কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রকেই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।
ফ্রস্টঃ কিন্তু ওরা তো আপনাকে কবর দিতে পারে নি। কে আপনাকে রক্ষা করেছিল সেদিন- আপনার ভবিতব্য থেকে।
শেখ মুজিব: আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে রক্ষা করেছেন।
ফ্রস্ট: আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি জেলার এক সময়ে সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল তখন আপনাকে স্থানান্তরে করেছিলো। একি যথার্থ?
শেখ মুজিব: ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল মনে হচ্ছিল, কতগুলো কয়েদীকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে-অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়ত-বা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটার সময়ে সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলোতে দুদিন যাবৎ রক্ষা করল। এ দুদিন আমার ওপর কোন সামরিক পাহারা ছিল দুদিন পরে এই অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়ত চার-পাঁচ কিংবা দু’দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ অজ্ঞাত ছিল না।
ফ্রস্ট: এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী হয়েছে, তাই ভাবছি।
শেখ মুজিব: আমিও জানিনে। ওদের ওপর কোন আঘাত হানতে ওরা পারবে বলে মনে হয় না। ওদের জন্য যথার্থ শুভকামনা রয়েছে।
ফ্রস্টঃ এমন কি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনো নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিব: হ্যা, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনীটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিল, “মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সব চাইতে বড় ভুল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাসি না দেওয়া।”
ফ্রস্টঃ ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল।
শেখ মুজিব: হ্যা, ভুট্টো একথা আমায় বলে তার পরে বলেছিল, “ইয়াহিয়ার দাবি ছিল,
ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে।” কিন্তু ভুট্টো তার এ প্রস্তাবে রাজি হয় নি।
ফ্রস্টঃ ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিব: হ্যা, বলেছিল।
ফ্রস্ট: কী বলেছিল ভুট্টো?
শেখ মুজিব: ভুট্টো, ইয়াহিয়াকে বলেছিল : “না, আমি তা হতে দিতে পারিনে। তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিকবাহিনীর লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক।” ভুট্টো একথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর নিকট আমি অবশ্যই এ জন্যে কৃতজ্ঞ।
ফ্রস্ট: শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঘটে, আপনি তা হলে তাকে কী বলবেন?
শেখ মুজিব: ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনি। তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই। তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দি করেছে। ভুট্টো তাকে নিয়ে এখন কী করবে? আপনার কী মনে হয়?
শেখ মুজিব: মি. ফ্রস্ট, আপনি জানেন, আমার বাংলাদেশে কী ঘটেছে? শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। অন্ততপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘরবাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তারপর সবকিছুকে ওরা লুট করেছে। খাদ্যের গুদামগুলিকে ওরা ধ্বংস করেছে।
ফ্রস্ট: নিহতদের সংখ্যা ৩০ লাখ, এ কথা আপনি সঠিকভাবে জানেন?
শেখ মুজিব: আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। এখনো আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে
আসিনি। সংখ্যা হয়ত একেও ছাড়িয়ে যাবে। ত্রিশ লাখের কম তো নয়ই।
ফ্রস্ট: কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড তো নিরর্থক। মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করা।
শেখ মুজিব: হ্যা, কাদের ওরা হত্যা করেছে? একেবারে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে। গ্রামের মানুষকে, যে-গ্রামের মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়ত কিছু জানত না, সে-গ্রামে পাকিস্তানি ফেীজ ঢুকে পাখি মারার মতো গুলি করে এই মানুষকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: আমার মনেও প্রশ্ন, আহা! কেন এমন হলো?
শেখ মুজিব: না, আমিও জানিনে। আমিও বুঝিনে। এ রকম পৃথিবীতে আর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
ফ্রস্টঃ আর এ তো ছিল মুসলমানের হাতেই মুসলমানের হত্যা?
শেখ মুজিব: ওরা নিজেরা নিজেদের মুসলমান বলে। অথচ ওরা হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের। আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ত্রাণ শিবিরে এখনো অনেকে রয়েছে। এদের স্বামী, পিতা-সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মা আর বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। পুত্রের সামনে মাকে ধর্ষণ করেছে। আপনি চিন্তা করুন। আমি এ কথা চিন্তা করে চোখের অশ্রুকে রোধ করতে পারিনে। এরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কিভাবে? এরা তো পশুরও অধম। মনে করুন, আমার বন্ধু মশিউর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন তিনি। আমাদের সরকারের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাকে নির্যাতন করে করে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ দিন ধরে তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। প্রথমে তার এক হাত কেটেছে। তারপর তার আর একটা হাত কেটেছে। তারপরে তার একটা কান কেটেছে। তারপর পা কেটেছে। ২৪ দিনব্যাপী চলেছে এমন নির্যাতন (শেখ মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন), কিন্তু এ তো একটা কাহিনী। আমাদের কত নেতা আর কর্মীকে, বুদ্ধিজীবী আর সরকারি কর্মচারীকে, জেলখানায় আটক করে সেখান থেকে নিয়ে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী আমি ইতিহাসে কোথাও শুনি নি। একটা পশু, একটা বাঘও তো মানুষকে হত্যা করলে এমনভাবে হত্যা করে না।
ফ্রস্ট: ওরা কী চেয়েছিল?
শেখ মুজিব: ওরা চেয়েছিল, আমাদের এই বাংলাদেশকে একেবারে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনি তো জানেন, মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙালি পুলিশ বাহিনীর লোককে, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙালি শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বাঙালি ডাক্তার, যুবক, ছাত্র—সবাইকে হত্যা করেছে।
ফ্রস্ট: আমি শুনেছি, যুদ্ধের শেষ অবস্থাতেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ জন বুদ্ধিজীবীকে
হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব: হ্যাঁ, সারেন্ডারের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৩০ নয়, ৩০০
মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, মেডিক্যাল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে বাড়ির মধ্যে আটক করেছে। আর তারপর বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এই সব মানুষকে হত্যা করেছে।
ফস্ট: তার মানে, কারফিউ জারি করে সকল খবরাখবর বন্ধ করে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিব : হ্যাঁ, তাই করেছে।
ফ্রস্ট: শেখ সাহেব, আপনার কী মনে হয়? ইয়াহিয়া খান কি দুর্বল চরিত্রের লোক, যাকে অন্য লোক খারাপ করেছে, না, সে নিজেই একটা দুস্তরতম খারাপ লোক?
শেখ মুজিব: আমি মনে করি, ও নিজেই একটা নরাধম। ও একটা সাংঘাতিক লোক। ইয়াহিয়া খান যখন প্রেসিডেন্ট, তখন আমি জনসাধারণের নেতা হিসেবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময়েই দেখেছি।…
ফ্রস্ট: তিনি কি তখন আপনাকে বিভ্রান্ত করেন নি?
শেখ মুজিব: আমাকে বিভ্রান্ত করতে তিনি পারেন নি। তিনি কি করতে যাচ্ছেন আমি
বুঝেছিলাম, কিন্তু আমিও আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এবং সে-আঘাত তখন তিনি পেয়েছেন।
ফ্রস্ট: কিসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আপনি?
শেখ মুজিব: পাল্টা আঘাত হানার এবং সে পাল্টা আঘাত তিনি পেয়েছেন।
ফ্রস্টঃ বন্দি হওয়ার পর আপনি কি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন? একবারের জন্যেও?
শেখ মুজিব: না। সে তো মানুষ নামের অযোগ্য।
ফ্রস্ট: মি, ভুট্টোর জন্যে এখন সঠিক কাজ কী হবে আপনি মনে করেন?
শেখ মুজিব: আমি মনে করি, ইয়াহিয়ার পূর্ণাঙ্গ এবং প্রকাশ্য বিচার হওয়া উচিত।
ফ্রন্ট: ইয়াহিয়া এখন গৃহবন্দি। আপনি কি মনে করেন মি. ভুট্টো সেটা করবেন?
শেখ মুজিব: করা উচিত।
ফ্রস্ট: মি. ভুট্টো সম্পর্কে আপনি এখন কী ভাবেন? আপনি কি ভাবেন যে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কিংবা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কখনো স্বাধীন ঢাকা সফর করবেন? তিনি কি কখনো এখানে কথা বলতে আসবেন?
শেখ মুজিব: আমি জানিনা। কিন্তু তিনি প্রথমে এখন এই বাস্তবতাকে স্বীকার করুন যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। তার এটাও জানা উচিত যে, বাংলা তার ভূখণ্ড—এ চিৎকার করে লাভ নেই। বাংলা তা নয়। কারণ, কোন কেজো উদ্দেশ্যে তারা যদি একক পাকিস্তান দাবি করে, তখনও আপনি জানেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা আমার রয়েছে, এবং আমি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দাবি করতে পারতাম, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তান হতো আমার ভূখণ্ড। তারা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাহলে আমি দাবি করতে পারি যে, আমার দলই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমি একটি সভা ডেকে গােটা দেশকে বাংলাদেশ ঘোষণা করতে পারি এবং তাদেরকে বলতে পারি যে, পশ্চিম পাকিস্তান আমার ভূখণ্ড। তুমি, ভুট্টো, বেরিয়ে যাও, আমি গভর্নর নিয়োগ করছি। এটা আমার ভূখণ্ড, তুমি বিদায় নাও, অন্যথায় আমি মিত্রবাহিনীসহ আমার সেনাবাহিনী পাঠাব পশ্চিম পাকিস্তান দখল করার জন্যে। এসব ঝামেলা আমি চাই না। ভূখণ্ডের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার নেই। পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে মি. ভুট্টো সুখী থাকুন। বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে আমি সুখী থাকতে চাই এবং বাংলাদেশ এখন একটি সার্বভৌম স্বাধীন দেশ।
ফ্রস্ট: বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের কতজন আজ ক্ষুধার্ত, দুর্ভিক্ষের অবস্থায় রয়েছে?
শেখ মুজিবঃ আমি মনে করি, শতকরা পঁচাত্তর ভাগ মানুষ ক্ষুধার্ত।
ফ্রস্ট: পঁচাত্তর ভাগ?
শেখ মুজিব: হঁ্যা, কারণ, তারা সবকিছু ধ্বংস করেছে। নিজেদের ভাণ্ডার থেকে খাওয়া দাওয়ার সামর্থ্য আমাদের রয়েছে, সেই ভাণ্ডারও লুট হয়েছে। মানুষের অর্থ লুট হয়েছে। আমার মনে হয়, এই অংশ ৭৫% নয়, ৮৫%। ৮৫% মানুষ অত্যন্ত কষ্টে রয়েছে। আমার জনগণ অত্যন্ত ভালো এবং শান্তিপ্রিয়। আমার ওপর তাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে, আমি তাদের জন্য কোন কিছু ব্যবস্থা করব-সে- অপেক্ষা তারা করছে। আমি খুবই আনন্দিত যে, স্বীকৃতি দেওয়ার পর ভারত আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছে, যাতে আমার ব্যবস্থাগুলো সচল হয়। যোগাযোগব্যবস্থা পুনঃস্থাপিত হওয়া উচিত, কারণ, আত্মসমর্পণ করার আগে পাকিস্তানিরা আমার রেলওয়েকে ধ্বংস করে দেয়, বৃহত্তম ব্রিজগুলো, তেলের ট্যাংক, শিল্পগুলো, মানুষের পক্ষে যা কিছু ধ্বংস করা সম্ভব, তা তারা করেছে।
ফ্রস্টঃ একটি নতুন দেশের প্রথম সপ্তাহে আপনার কত কিছু যে করার রয়েছে – যেমন আপনি একটি পতাকা এবং জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করেছেন।
শেখ মুজিব: হ্যা। ওই পতাকাটি অনেকদিন ব্যবহার করা হয়েছে, শুধু একটি ছোট পরিবর্তন এখন করা হয়েছে। আগে থেকে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে জাতীয় সংগীতটিও, কিন্তু আমি সরকারি স্বীকৃতি দিতে চাইছিলাম এবং এখন আমি তা দিয়েছি। জাতীয় পতাকায় আমি একটি ছোট পরিবর্তন করছি, কারণ, এতে ইতঃপূর্বে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র ছিল। কোন দেশ জাতীয় পতাকায় তার ভূখণ্ডের মানচিত্র দিতে পারে না।
ফ্রস্ট: কেন এমনটা?
শেখ মুজিব: পৃথিবীর কোথাও তা হয় নি। আমরা পতাকায় আমাদের ভূখণ্ডের মানচিত্র রাখতে চাই না। আমি যা করেছি এবং আমাদের জনগণও গ্রহণ করেছে, তা হচ্ছে উদীয়মান সূর্যটি রেখে ভূখণ্ডের মানচিত্রটি বাদ দিয়ে দেওয়া।
ফ্রস্ট: আর জাতীয় সংগীতটি কার রচিত?
শেখ মুজিব: এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি পুরনো গান।
ফ্রস্ট: ইংরেজিতে এর বক্তব্যটি কি?
শেখ মুজিব: ইংরেজি ভাষায় নিলে বক্তব্য হচ্ছে, “আমি আমার সোনার বাংলাকে ভালোবাসি।” এভাবে এটি শুরু হয়, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।”
ফ্রস্টঃ আর এটি এমন একটি গান যা বাংলাদেশে দীর্ঘকাল গাওয়া হয়েছে?
শেখ মুজিব: দীর্ঘকাল। ৭ মার্চ তারিখে যখন রেসকোর্স ময়দানে আমাদের শেষ সভাটি
করেছিলাম—যেখানে ১০ লক্ষ লোক উপস্থিত ছিল, এবং তারা স্বাধীন বাংলা শ্লোগানগুলো দিচ্ছিল, আর যখন ছেলেরা গানটি গাইতে শুরু করল, আমরা ১০ লাখ লোক দাড়িয়ে এ-গানকে অভিবাদন জানিয়েছিলাম। বলা যায়, আমাদের বর্তমান জাতীয় সংগীত আমরা তখনই গ্রহণ করেছিলাম।
ফ্রস্ট: আপনার কি মনে হয় যে, রেসকোর্সে ৭ মার্চ তারিখেই আপনার স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করা ভালো ছিল?
শেখ মুজিব: আমি জানতাম কী ঘটতে যাচ্ছে এবং সে সভায় আমি ঘোষণা করেছিলাম যে, এবারে আমাদের সংগ্রাম মুক্তির, স্বাধীনতার।
ফ্রস্ট: আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণা করছি, তাহলে কী ঘটত?
শেখ মুজিব: সেদিন আমি তা করতে চাই নি, বিশেষত এ-কারণে যে, তাহলে তাদের
পৃথিবীকে এটা বলতে দেওয়া হয়ে যেত যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে এবং এখন আমাদের আঘাত করা ছাড়া বিকল্প নেই। আমি চেয়েছিলাম তারা প্রথমে আঘাত করুক এবং প্রতিরোধ করার জন্যে আমার জনগণ প্রস্তুত ছিল।
ফ্রস্ট: কিন্তু আপনি এটা শুরু করতে চান নি?
শেখ মুজিব: না, আমি চেয়েছিলাম তারা শুরু করুক।
ফ্রন্ট: ব্রিটেন কখন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে বলে আপনি মনে করেন?
শেখ মুজিব: যে কোন সময়। আমি ব্রিটিশ জনগণকে জানি।
ফ্রস্ট: লন্ডনে মি, হিথের সঙ্গে আপনার আলোচনা হয়েছে?
শেখ মুজিব: মি, হিথের সঙ্গে কথা হয়, মি. উইলসনের সঙ্গে কথা হয়, এবং আলোচনায়
আমি খুশি।
ফ্রস্ট: এবং আপনি ব্রিটিশ তামাক সেবন করেন?
শেখ মুজিব: হ্যা, দীর্ঘকাল যাবৎ।
ফ্রস্ট: এটা কোন্ তামাক?
শেখ মুজিব: এরিন মাের।
ফ্রস্টঃ আপনি এটা পছন্দ করেন?
শেখ মুজিবঃ পছন্দ করি। প্রায় চৌদ্দ বছর আমি এ-তামাক সেবন করছি। এমন কি
জেলেও আমি তাদের বলেছিলাম যে, এই তামাকটিই আমাকে দিতে হবে। দয়া করে তারা তা দিয়েছিলেন।
ফ্রস্ট: নির্জন কারাকক্ষেও?
শেখ মুজিব : (হাসতে হাসতে) আমি তার জন্যে অন্তত তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।
ফ্রস্ট: এটা একটি ক্ষুধার্ত নগরী, কিন্তু সুখী। আপনি কি জানেন আপনার কত টাকা
প্রয়োজন?
শেখ মুজিব: এ-মুহূর্তে আমি বলতে পারব না। আমি কিছু বলতে পারব না। এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তারা ব্যাংক নোটগুলোও পুড়িয়ে দিয়ে যায়। ব্যাংকের টাকা নিয়ে নেয়। এবং আত্মসমর্পণের আগে পুড়িয়ে দেয়।
ফ্রস্টঃ এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্য টাকাও আছে, আগেও যেটা ছিল, যা পশ্চিম পাকিস্তানে রয়েছে। শেখ মুজিব ; সেখানে কিছু নেই। আমি আমার জনগণকে তাদের যা কিছু আছে, সোনা, দিতে বলছি। তারা তা দেবে।
ফ্রস্টঃ তারা সোনা দেবে এবং আপনার সোনার রিজার্ভ গঠন হবে।
শেখ মুজিব: এখন আমার এই একটিই বিকল্প রয়েছে। আগামীকাল কিংবা তার পরদিন আমি জনগণের কাছে আবেদন জানাব। আপনাদের যা আছে, তা থেকে কিছু গহনা দিন। সরকারি ব্যাংকে ওগুলো জমা রাখুন। যাতে আমি একটি রিজার্ভ গঠন করতে পারি। কিন্তু, তাদের কিছুই নেই। দোকান লুট হয়েছে, সোনার দোকান। এর বেশি কিছু আপনাকে বলতে পারছি না।
ফ্রস্ট: কিন্তু, কোথেকে মানুষ আপনাকে সোনা দেবে?
শেখ মুজিব: সামান্য যা আছে, তা থেকে।
ফ্রস্টঃ পশ্চিম পাকিস্তানে যা রিজার্ভ রয়েছে, তার কোনোটিই আর কখনো আপনি দেখতে পাবেন?
শেখ মুজিবঃ আপনি জানেন, বিশ্বের কাছে তাদের একটি অঙ্গীকার রয়েছে। তারা ২,০০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, বাংলাদেশে যার সামান্যই তারা ব্যয় করেছে। পাকিস্তান তো রয়ে যাচ্ছে। আমরা আর পাকিস্তানি বাংলাদেশ নয়। আমার কোন দায়িত্ব নেই। তারা যা ঋণ নিয়েছিল, তারা তা শোধ করুক। তাদের অর্থনীতি দেখুন। ২,০০০ কোটি টাকা ঋণ শোধ, এবং সেখানে তাদের শিল্পের কোন বাজার নেই—তারা কি দাঁড়াবে? তাদের মারাত্মক বেকারত্ব থাকবে।
ফ্রস্ট: সবাই বলছে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার বিশাল ক্ষমতা আপনার রয়েছে। ওই পুরনো কথাটিও রয়েছে, পাওয়ার করাপ্টস, অ্যাবসোলিউট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলিউটলি। ক্ষমতা আপনাকে নষ্ট করার সম্ভাবনা থেকে আপনি কিভাবে বাঁচবেন?
শেখ মুজিব: আপনি জানেন যে, ইয়াহিয়া খানের মতো কোন ব্যক্তি যদি দুর্ঘটনাক্রমে
ক্ষমতায় আসেন, তিনি নষ্ট হতে পারেন। কিন্তু কেউ যদি—একটি প্রক্রিয়ার সংগ্রাম, দুঃখকষ্ট, লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আসেন, তাকে আপনি যত ক্ষমতাই দিন, তিনি নষ্ট হবেন না। আমার দল এবং আমার ক্ষেত্রে, আমার সব নেতাই জেল খেটেছে, ঘরবাড়ি হারিয়েছে, অনেকে পরিবার-পরিজন হারিয়েছে। ২৪ বছর পর তারা ক্ষমতা পেয়েছে। তারা চূড়ান্ত ক্ষমতা পেলেও, নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ, ইয়াহিয়া খান এবং তার সঙ্গীদের থেকে ভিন্নভাবে তারা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছে। ইয়াহিয়ারা ক্ষমতায় আসে বন্দুক এবং পশুশক্তির মাধ্যমে। আমার লোকগুলো বন্দুক নয়, একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে-একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, ত্যাগ স্বীকার করে তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে, কারণ, তাদের দেশ এবং মানুষের জন্যে তাদের ভালবাসা রয়েছে। আমার নেতা এবং দলীয় কর্মীদের ওপর আমার আস্থা রয়েছে।
ফ্রস্ট: আমাদের আজকের এই আলাপে আপনি নেতা এবং নেতৃত্বের কথা তুলেছেন। যথার্থ নেতৃত্বের আপনি কি সংজ্ঞা দেবেন?
শেখ মুজিৰ : আমি বলব, যথার্থ নেততু আসে সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কেউ আকস্মিকভাবে, একদিনে নেতা হতে পারে না। তাকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাকে মানুষের মঙ্গলের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। নেতার আদর্শ থাকতে হবে, নীতি থাকতে হবে। এই সৰ গুণ যার থাকে, সে-ই মাত্র নেতা হতে পারে।
ফ্রস্ট: ইতিহাসের কোন্ নেতাদের আপনি স্মরণ করেন, তাদের প্রশংসা করেন?
শেখ মুজিব: অনেকেই স্মরণীয়। বর্তমানের নেতাদের কথা বলছিনে। …
ফ্রস্ট: না, বর্তমানের নয়। কিন্তু ইতিহাসের কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
শেখ মুজিব: আমি আব্রাহাম লিংকনকে স্মরণ করি। স্মরণ করি মাও সে-তুঙ, লেনিন,
চার্চিলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট জন কেনেডিকেও আমি শ্রদ্ধা করতাম। …
ফ্রস্ট: প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের সাথে কী আপনার সাক্ষাৎ হয়েছিল?
শেখ মুজিবঃ আমার সাথে ওর সাক্ষাৎ হয় নি, কিন্তু আমি তাঁর বই পড়েছি। আমি তাকে পছন্দ করি।
ফ্রস্ট: মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
শেখ মুজিব: মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, সোহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, কামাল আতাতুর্ক—এঁদের জন্যে আমার মনে গভীর শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে। আমি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেতা ড. সুকর্নকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতাম। এই সকল নেতাই তো সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নেতা হয়েছিলেন।
ফ্রস্ট: আজ এই মুহূর্তে অতীতের দিকে তাকিয়ে আপনি কোন্ দিনটিকে আপনার জীবনের সবচাইতে সুখের দিন বলে গণ্য করবেন? কোন মুহূর্তটি আপনাকে সবচাইতে সুখী করেছিল?
শেখ মুজিব: আমি যেদিন শুনলাম, আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দিনটিই ছিল
আমার জীবনের সবচাইতে সুখের দিন।
ফ্রস্ট: আপনার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন?
শেখ মুজিব: সমগ্র জীবনের সব চাইতে সুখের দিন।
ফ্রন্ট: এমন দিনের স্বপ্ন আপনি কবে থেকে দেখতে শুরু করেন?
শেখ মুজিব: বহুদিন যাবৎ আমি এই স্বপ্ন দেখে আসছি।
ফ্রন্ট: স্বাধীনতার সংগ্রামে আপনি কবে প্রথম কারাগারে যান?
শেখ মুজিব: আমার জেল গমন শুরু হয়, বোধ হয়, সেই ১৯৪৮ সালে। আমি তারপরে ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাই এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। ১৯৫৪ সালে আমি একজন মন্ত্রী হই। আবার ১৯৫৪ সালেই গ্রেপ্তার হই এবং ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। আবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান আমাকে জেলে পাঠায় এবং তখন পাঁচ বছর অন্তরীণ থাকি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ নানা মামলায় আমাকে সরকার পক্ষ বিচার করেছে। ১৯৬৬ সালে আবার আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৩ বছর যাবৎ আটক রাখা হয়। তারপর আবার ইয়াহিয়া খান গ্রেপ্তার করে। এমন দীর্ঘ সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগতভাবেই আমার নয়। আমার বহু সহকর্মীর জীবনেরই এই ইতিহাস।
ফ্রস্ট: এবং যখন আপনি গত নয় মাসের মুক্তিসংগ্রামে আপনার কোন-কোন সহকর্মীর জীবনে কী ঘটেছে তা জানতে পান …
শেখ মুজিব: আমার ৩০ লক্ষ লোককে তারা মেরে ফেলেছে, এটা যখন জানলাম, সেটাই
ছিল আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা খারাপ সময়।
ফ্রস্ট: (ছবি দেখিয়ে) এগুলো এমন ছবি যা আমরা কখনো ভুলব না। এগুলো সেই
ছবি যা গােটা পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আপনি যখন এ-ছবিগুলো প্রথমে দেখলেন …
শেখ মুজিব: আপনি আমাকে এগুলো না দেখালেই পারতেন, আমি আবেগপ্রবণ হয়ে
পড়ি। (কাদছেন)
ফ্রস্ট: নিশ্চয় আপনি আবেগপ্রবণ হবেন। এই ছবিগুলো যখন আপনি প্রথমে দেখেন, কী বলেছিলেন তখন আপনি?
শেখ মুজিব: আমি কী বলতে পারতাম? বলার কোন কথা ছিল না আমার। আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। এখনও আমার চোখে পানি আসে। পাক সেনারা নির্দোষ বালক, বালিকা, নির্দোষ মানুষকে ক্ষমাহীনভাবে মেরেছিল। তারা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, আমার মানুষকে ধর্ষণ করে—আমার বোনদের মায়েদের। সেটা ছিল আমার জীবনের সর্বাধিক খারাপ সময় এবং আমি একজন শক্ত মানুষ। সম্ভবত কেউ আমার চোখে পানি দেখে নি, কিন্তু এখন পানি আসছে এবং আমি আটকাতে পারছিনে।
ফ্রস্ট: বিগত মাসগুলোতে আপনার মানুষের জন্যে আপনি কতবার কেঁদেছেন?
শেখ মুজিব: বহুবার।
ফ্রস্ট: যখন আপনি শুনেছেন কী করা হয়েছে?
শেখ মুজিব: হ্যা। যতবার আমি এটা স্মরণ করি, আমার চোখে পানি আসে এবং এখনও আসছে। আপনি যখন এই ছবিগুলো দেখালেন, আমি আর এখন কথা বলতে পারছিনে। পাঁচ মাস, এক বছর কিংবা দুবছর বয়সের একটি শিশুকে একজন মানুষ কিভাবে হত্যা করতে পারে? নারীদের, কৃষকদের—যাদের খাবারটুকু পর্যন্ত নেই—কীভাবে হত্যা করতে পারে? আমার বন্ধু, আমি এটা ভাবতে পারি না। বাস্তবেই এটা একটি দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা। ফ্যাসিস্ট জার্মানির যুদ্ধাপরাধীদের এই পৃথিবী দেখেছিল এবং তাদের জন্যে নুরেমবার্গ বিচারের আয়োজন করেছিল। আমি মনে করি জাতিসংঘ কর্তৃক এই লোকগুলোর এবার বিচার হওয়া উচিত। পৃথিবীকে এগুলো দেখার, তদন্ত এবং বিচারের সুযোগ দিতে আমার কোন আপত্তি নেই। বিচার নয়, পথিবীর সামনে তদন্ত এবং প্রদর্শন। আমি সবসময় ক্ষমা এবং ভুলে যাওয়ায় বিশ্বাস করি। কিন্তু ক্ষমা করা এবং ভুলে যাওয়া এখন আমার পক্ষে অসম্ভব, কারণ, এগুলো ঠাণ্ডা মাথার এবং পরিকল্পিত ধরনের হত্যা, আমার মানুষের ওপর গণহত্যা। আপনি কি মনে করেন কোন মানুষ এগুলো মেনে নিতে পারে? এই লোকগুলোকে শাস্তি দিতেই হবে। এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন নেই। আমি এখন কথা বলতে পারছি না। আপনি কেন আমাকে এই ফটোগুলো দেখালেন? আমি এটা ভাবতে পারি না। বিশ্বাস করুন, এই বিশেষ ব্যাপারটাতে আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।
ফ্রস্ট আমি মনে করি, আমিও তা-ই হয়েছিলাম এবং আমি মনে করি আরো অনেক
মানুষও তা-ই হবেন।
শেখ মুজিব: অভিভূত! যখন আপনি বহু স্থানে শত-শত, হাজার হাজার মৃত মানুষ
দেখবেন। তারা একটি খন্দ খুঁড়েছে, হাজার হাজার মানুষকে মেরে তার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছে। কেউ-কেউ মারাও যায় নি এমন কি। তাদেরকেও ছুঁড়ে ফেলেছে এবং তারা সেখানে কাতরাতে-কাতরাতে মরেছে। (কণ্ঠস্বর উচুতে উঠছে) মানব জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে বড় বিপর্যয় কি আপনি শুনেছেন? আমার মানুষকে নিয়ে আর কেউ রাজনীতি করুক, এটা আমি চাই না। মানবতার স্বার্থে আমার দুর্ভাগা মানুষকে, যারা এখনও কষ্ট পাচ্ছে, তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে আমি তাদের নিকট আবেদন জানাচ্ছি। আমার কোন উচ্চাকাক্ষা নেই, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। আমি এটা গ্রহণ করতে পারি নি। একজন প্রধানমন্ত্রী কী পায়, যা আমি আমার মানুষের কাছ থেকে পাই নি? গতকাল আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম, আহত মানুষকে দেখলাম—যারা হাত ও পা হারিয়েছে, কিন্তু তারা আমাকে বলল, “আমাদের সৰ গেছে, তাতে কোন দুঃখ নেই, কিন্তু, আপনি তো ফিরে এসেছেন। এটাই আমাদের তৃপ্তি। আমরা খুশি।” আপনি কি ভালোবাসা-স্নেহকে হত্যা করতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রিত্ব, রাষ্ট্রপতিত্ব আমার কাছে কোন অর্থ রাখে না। আমি আমার মানুষের স্নেহ, ভালোবাসা পেয়েছি। আমি তা-ই নিয়ে মরতে চাই, আর বেশি কিছু চাই না।
আমি খুশি। আমার জনগণ এখন স্বাধীন, তারা নিজেদের উন্নতি করতে পারবে। একটি স্বাধীন দেশে বাস করতে পারবে। আমি কৃতজ্ঞ, সত্যই আমি। ভারতীয় জনগণ এবং মিসেস গান্ধীর নিকট কৃতজ্ঞ। যেভাবে তারা আমার এক কোটি লোককে সাহায্য করেছে। যারা ভারতে চলে গিয়েছিল, ভারতের মানুষ তাদের খাবার, আশ্রয়, বাসস্থান দিয়েছে। পৃথিবীর ৮০টি দেশে জনসংখ্যা ১ কোটির কম; কিন্তু আমার ১ কোটি লোককে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয় এবং আপনি জানেন কীরকম দুঃখ-কষ্ট ছিল। আমি তাদের পুনর্বাসিত করতে চাই, মানবিক অনুভূতি যাদের রয়েছে, এজন্যে তাদের। প্রত্যেকের কাছ থেকে আমি সাহায্য চাই। আমি চাই বিশ্ব এগিয়ে আসুক। কারো প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই। আমি ইতোমধ্যেই আমার পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেছি-সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়। আমি আমার দেশকে রক্ষা করতে চাই, আমার জনগণকে বাঁচাতে, তাদের খাবার, কাপড়, বাড়ি, শিক্ষা, চাকরি দিতে চাই। শোষণ থেকে মুক্ত একটি সমাজ আমি চাই, অন্য কিছু নয়।
ফ্রস্ট: মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, পৃথিবীর মানুষের জন্যে কী বাণী আমি আপনার কাছ
থেকে বহন করে নিয়ে যেতে পারি?
শেখ মুজিবঃ আমার একমাত্র প্রার্থনা—বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে অগ্রসর হয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য স্বদেশবাসীর পাশে এসে বিশ্বের মানুষ দাঁড়াক। আমার দেশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্যে যেমন দুঃখ ভােগ করেছে, এমন আত্মত্যাগ পৃথিবীর খুব কম দেশের মানুষকেই করতে হয়েছে। মিস্টার ফ্রস্ট, আপনাকে আমি আমার একজন বন্ধু বলে গণ্য করি। আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আসুন। নিজের চোখে দেখুন। আপনি নিজের চোখে অনেক দৃশ্য দেখেছেন। আরো দেখুন । আপনি আমার এই বাণী বহন করুন—সকলের জন্যেই আমার শুভেচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি, আমার দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে এসে বিশ্ব দাড়াবে। আপনি আমার দেশের বন্ধু। আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।
ডেভিড ফ্রস্ট: জয় বাংলা! আমিও বিশ্বাস করি, বিশ্ববাসী আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।
আপনাদের পাশে এসে আমাদের দাঁড়াতে হবে। নয় তো ঈশ্বর আমাদের কোনদিন ক্ষমা করবেন না।
ভাষান্তর : কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (সূত্র : বাংলাদেশ ডকুমেন্টস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬১৪-৬২৭) এবং আবদুল মতিন সম্পাদিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়, র্যাডিকাল এশিয়া পাবলিকেশান্স, ঢাকা।
ইংরেজি ভার্সন
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2020/02/david-frost-and-mujib-interview-english-text.pdf” title=”david frost and mujib interview english text”]
ভিডিও লিঙ্ক
David Frost interviews Sheikh Mujib | বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার ডেভিড ফ্রস্ট (ভিডিও)