You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৫ই জানুয়ারী, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ৩০শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আজ সংসদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে

আজ সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে। অধিবেশন তিন সপ্তাহকাল ধরে চলবে বলেও জানা গেছে। শীতকালীন এ অধিবেশনের উদ্বোধন করবেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্যে শোক প্রস্তাব পাঠ, কিছু অর্ডিন্যান্স ও বিল অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আইন ও সংসদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে যে, অধিবেশনে বেশ কিছু সংখ্যক বিল পেশ করা হবে এবং সেগুলোর মধ্যে—সরকার কর্তৃক প্রাথমিক স্কুল গ্রহণ সংক্রান্ত বিল, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানার চাকরী শর্ত সংক্রান্ত বিল, টিসিবি’র সংশোধনী বিল, রেলওয়ে বদলী বিল, রেডক্রস সমিতির সংশোধনী বিল, সাংবাদিক মজুরী বোর্ড, প্রেস কাউন্সিল গঠন সংক্রান্ত বিল অন্যতম। সংবাদে জানা গেছে যে, অধিবেশন শুরুর দ্বিতীয় দিনে বিল নিয়ে বিবেচনা করা হবে এবং ‍তৃতীয় দিন থেকে পরবর্তী পাঁচ দিন ধরে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর আলোচনা হবে। এবারের অধিবেশনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে বিষয়টি রয়েছে তা হলো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
১৯৭৪ সালের শুরুতে জাতীয় সংসদের এ অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষতঃ দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সন্ত্রাসী তৎপরতার প্রাক্কালে এ অধিবেশন অনুষ্ঠান অত্যন্ত অর্থবহ। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ হবে সংসদে। যার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন বিল রচিত হতে পারে। ইতিপূর্বে আমরা শুনেছিলাম আসন্ন অর্থাৎ বর্তমান সংসদ অধিবেশনে নাকি দেশের বিভিন্ন আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে আলোচনা হবে এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংশোধনীও গৃহীত হতে পারে। আমরা ইতিপূর্বে বহুবার সংসদের কাছে দেশের পুরাতন জীর্ণ আইন ও তার প্রয়োগের পুরাতন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে প্রশ্ন রেখেছিলাম। জাতীয় সংসদের নেতৃবৃন্দ দেশের আইন ও তার প্রয়োগের পুরাতন ব্যবস্থাদি সম্পর্কে একটা বাস্তব চিন্তা-ভাবনা করবেন বলে আমরা আশা রাখি। আমাদের আইন ব্যবস্থা এমনভাবে সমাজের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে যাতে আইনের প্রতি মানুষের সহযোগিতামূলক মনোভাব তো দূরের কথা, সাধারণ আইনের থেকে দূরে থাকাকেই নিরাপদ মনে করে। যেমন গ্রামদেশে কোনো মারাত্মক ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যক্তি সে ঘটনার সাক্ষী হয়ে আইনের প্রতিষ্ঠার জন্যে এগিয়ে আসতে রাজী হয়না। তাদের সহজ কথা থানা-পুলিশ কোর্টের ব্যাপার—ও অনেক ঝামেলা।
বস্তুতঃপক্ষে আমাদের দেশের বর্তমান ‘কোড অব ক্রিমিন্যাল ল’ অত্যন্ত ক্রুটিপূর্ণ এবং মান্ধাতার আমলের। এ কারণে এর পুনর্বিন্যাস আশু প্রয়োজন। আমাদের সংসদের এ অধিবেশনে এ সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা হওয়া আবশ্যক সংসদের এ অধিবেশন জাতিকে নতুন আশ্বাস ও দেশবাসীকে সরকারের প্রতি আস্থা অর্জনের সুযোগ দেবে বলে আমরা মনে করি।

হবে হচ্ছে নয়—হতে হবে

খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা করছেন যে, দেশব্যাপী খাদ্য সংগ্রহ অভিযানে জনগণের পক্ষ থেকে সন্তোষজনক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে এবং জনগণ এই সংগ্রহ অভিযানকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্যে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসছেন। অপরপক্ষে দেশের নানা স্থান থেকে বিশ্বস্ত সূত্রের বিভিন্ন সংবাদ সূত্র পত্রিকান্তরের মাধ্যমে জানাচ্ছেন যে, খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানে হতাশাব্যঞ্জক।
প্রকাশ থাকে যে, দেশে খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো চার লাখ টন। পরে চার লাখ টন থেকে তা বাড়িয়ে ছয় লাখ টন করা হয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে সংগ্রহ অভিযান সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী আরম্ভ হয়েছিল ১৫ই নভেম্বর। ২৯শে ডিসেম্বরের এক সাক্ষাৎকারে খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তখন পর্যন্ত দেশে ১৭ হাজার ৭১২ টন ধান সংগৃহীত হ’য়েছিল।
শস্যের মৌসুম হ’ল মাত্র দু’তিনটি মাস। তার দেড় মাসে চার লাখ টনের মধ্যে মাত্র ১৭ হাজার ৭১২ টন খাদ্য সংগৃহীত হয়েছে। তাহলে জনগণের সহায়তা ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহের অভিযানের এই কি নমুনা?
প্রসঙ্গক্রমে কয়েকটি অঞ্চলের লক্ষ্যমাত্রা ও সংগৃহীত শস্যের একটু বিবরণ দেওয়া যাক। গাইবান্ধার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সোয়া চার লক্ষ টন। ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত সেখানে ১২০০ মণ ধান আর ২০০ মণ চাউল সংগৃহীত হয়েছে বলে জানা গেছে। পাবনা সদর মহকুমার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮২ হাজার মণ। ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত সেখানে সংগ্রহের মাত্রা ছিল পাঁচশ মণ। হবিগঞ্জে সংগ্রহ করার কথা ১৫ লক্ষ মণ। গত বছরের শেষ নাগাদ সেখানে শস্য সংগৃহীত হয়েছিল ২০০ মণ। চুয়াডাঙ্গায় শস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৩ হাজার মণ। ডিসেম্বরের ২৭শে পর্যন্ত সেখানে সংগৃহীত হয়েছিল ৩৫০ মণ। সিলেট জেলায় মোট খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ লক্ষ মণ। ১২ই জানুয়ারী পর্যন্ত প্রায় দুই মাসে সেখানে ২ লক্ষ ৩০ হাজার মণ ধান ও ২১শ’ ৯২ মণ চাল সংগৃহীত হয়েছে। এমন ধরনের সংগ্রহ নমুনার খবর আসছে কুষ্টিয়া, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, ফেনী ও আরও অন্যান্য অঞ্চল থেকে।
এই সংগ্রহ অভিযান চলবে মার্চ মাস পর্যন্ত। তার মধ্যে দু’টি মাস অতিবাহিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যাদির মাধ্যমে শস্য সংগ্রহের যে সংবাদ আমরা পাচ্ছি, তা নিরতিশয় উদ্বেগজনক। অথচ মন্ত্রী মহোদয় বলছেন—সংগ্রহ অভিযান আশাব্যঞ্জক। কোন্ কথা বিশ্বাসযোগ্য?
তাছাড়া ১৯৭৪ সালের খাদ্য ঘাটতি ২০ লক্ষ টন বলে খাদ্যমন্ত্রী যে হিসাব দাখিল করেছিলেন, তারপর দেশে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নানাবিধ কারণে দেশের আমন শস্যের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে এবং কতিপয় মোনাফেক দুষ্কৃতিকারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় খাদ্যশস্য অবিরত সীমান্তের ওপারে পাচার হয়েই চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বভাবতঃই মনে প্রশ্ন জাগে যে, খাদ্য ঘাটতির হিসেবটা ঠিক তো?
তাহলে খাদ্যশস্য সংগ্রহের মূল যে দু’টি স্তম্ভ—এক হ’লো মোটামুটি নির্ভুল একটি হিসেব, দুই সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন। এই দু’টির কোনোটিই কি রক্ষিত হচ্ছে? আমাদের মনে এই প্রশ্নের অস্থিরতার প্রেক্ষিতে যদি এখনো খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতা ও মন্ত্রী মহোদয়ের সান্ত্বনা বাণী শুনতে হয় তাহলে সে বৈপরীত্যের প্রমাদ বই কি!
পরিশেষে বলতে হয়, শুধু কথায় কোনোদিন চিড়ে ভেজে না। তাই কথায় এবং কাজে আত্মীয়তা স্থাপন করতে হবে এবং এমন ভাবে কাজ করে যেতে হবে, যেন সমালোচনার অবকাশ না থাকে। শুধুমাত্র ‘সাড়া পাওয়া যাচ্ছে’ বলে আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগলে শেষ পর্যন্ত দুর্ভোগ পোহাতে হবে দেশের গরীব জনসাধারণ ও সরকারকেই। কাজেই ‘হবে হচ্ছে’ না হয়ে ‘হতে হবে’ এমন একটি মনোভাব নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। কারণ ফসলের মৌসুম শেষ হতে আর বেশী দিন দেরী নেই। এরপর কপাল চাপড়ালেও ধান-চাল সংগ্রহ করা যাবে না।

‘অপারেশন ভলকানো!’

কয়লা ধুলে নাকি ময়লা যায় না। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর শিরোমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এ কথা ষোল আনা প্রযোজ্য। একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির ললিত বাণী প্রচারের জন্যে ডঃ কিসিঞ্জার খোল করতাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন অন্যদিকে নেপথ্য রঙ্গমঞ্চে চলছে চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র। খাদ্য সরবরাহ বন্ধের হুমকি থেকে শুরু করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি লাগে তাহলে কি ভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো ক্ষেপণান্ত্রের সাহায্যে ধ্বংস করা হবে তারই ফিরিস্তি দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় সৌদী আরবের তেল এলাকা রাতারাতি কি ভাবে দখল করা যায় তারই নীলনকশা প্রণীত হয়েছে ইতিমধ্যে।
মার্কিন ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের চাঞ্চল্যকর তথ্য সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে লেবাননের সংবাদপত্র ‘আল-দায়ার’ এ। মার্কিন পরিকল্পনাটির নাম ‘অপারেশন ভলকানো’। পরিকল্পনাটি দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথমে ইসরাইলী ছত্রী বাহিনী ও যুদ্ধ জাহাজ এবং পরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সেনাবাহিনী প্রয়োগের ব্যবস্থা এই পরিকল্পনায় স্থান পায়। ‘আল-দায়ার’ জানান, এই পরিকল্পনার কাগজপত্র জনৈক আরব কূটনীতিক প্রতিনিধির হাতে পড়ে।
গত বুধবার লেবাননের ‘আল আনোয়ার’ও আরবদেশের তেলখনি এলাকা দখলে মার্কিন ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করেছেন। এই পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রে তেল সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে সৌদী আরবকে তিন ভাগে ভাগ করার চিন্তা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি চুক্তির ফলে জর্ডান কোনো অঞ্চল খোয়ালে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ এক ভাগ দেওয়া হবে জর্ডানের রাজা হোসেনকে।
‘আল-দায়ার’-এ প্রকাশ, ভলকানো পরিকল্পনার প্রথম পর্যায়ে আছে ইসরাইলী ছত্রী বাহিনী সৌদী আরবের তেলখনি এলাকাগুলোতে নামবে। ঠিক সেই সময়ে ইসরাইলী নৌবহর লোহিত সাগরের প্রবেশ পথে বাবেলমান্ডের প্রণালীতে ঢুকে পড়বে এবং আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের দ্বীপগুলোতে কমান্ডো বাহিনী নামিয়ে দেবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে আরব-ইসরাইলী বাহিনীর সংঘর্ষরোধের অজুহাত দেখিয়ে মার্কিন সপ্তম নৌবহর এই যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে। তারপর মার্কিন নৌবাহিনীর সেনারা তেলের খনি এলাকাগুলোর নিরাপত্তার ভার স্বহস্তে তুলে নেবে।
পরিকল্পনাটি একেবারে সুনিশ্চিত ছকে বাঁধা। এ যেন ঠিক ভিয়েতনামের যুদ্ধের আগুন জ্বালাবার মতোই অতি-পরিচিত ছক। একযুগ আগে টনকিন বদ্বীপের ঘটনাকে উপলক্ষ করেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভিয়েতনামের অন্যায় ও অসঙ্গত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সৌদী আরবের ব্যাপারেও ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সৌদী আরবের বাদশা ফয়সল তেল সরবরাহ বন্ধের হুমকি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই সৌদী আরবকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য এই মার্কিন পরিকল্পনার জন্ম।
পরিকল্পনা, ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত যাই-ই হোক না কেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে শেষ পর্যন্ত হালে পানি পাবেনা এটা সুনিশ্চিত। ইতিহাস সে কথাই বলে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যে খেসারত দিতে হয়েছে তারপর যদি আবার মধ্যপ্রাচ্যের অন্যায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে ‘অপারেশন ভলকানো’র ঠ্যালায় খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তৈলাস্ত্রের মাঝে ইতিমধ্যে সেই অবস্থারই সূচনা হয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!