You dont have javascript enabled! Please enable it!

সেদিন যে ঘটনা ঘটেছিলো সেটিকে “Assassination” বা “গুপ্তহত্যা” শব্দটি দিয়ে প্রকাশ করলে কম হবে। সেটি ছিল তীব্র নিষ্ঠুরতা যা বর্ননার বাইরে। অফিসারদের ক্ষোভের কারণ যাই হোক না কেন, এধরনের কাজকে ন্যায্যতা দেয়া যায়না। যারা পরিচালনা করেছে তারা নরপশু। তাদেরকে বোঝানো হয় যে যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত থাকে তাহলে তাদের অস্তিত্ব থাকবেনা। এইধরনের মনস্তাত্বিক বিশ্বাসের কারণে তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। যদি তাদের টার্গেট শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু হয় তাহলে পরিবারের বাকি সদস্যদের কেন হত্যা করা হল? কারণ হয়ত খুনিচক্রের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ঘৃণা এতোটাই তৈরি করা হয়েছিলো যে পুরো পরিবারের উপর হত্যাকাণ্ড চালাতে তাদের হাত এতোটুকু কাঁপেনি।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার চ্যানেল অব কমান্ড একেবারে ভেঙ্গে পরে। অন্যভাবে বলা যায়, কমান্ড চ্যানেল শেষ হয়ে গিয়েছিলো। সেদিন আর্মি চিফকে বাইপাস করেই কিছু ঘটনা ঘটে। কর্নেল শাফায়াৎ জামিল ভালো করে জানতেন যে, স্টেশনে যদি চিফ না থাকে তাহলে আর্মিতে আর কেউ নেই যে তার উপর কর্তৃত্ব করতে পারে। যদিও ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল চিফ কর্তৃক বিদ্রোহীদের বাধা দেবার আদেশ না মেনে ডেপুটি চিফের কাছে আদেশের জন্য গিয়েছিল। (এটি তার নিজেরই স্টেটমেন্ট যা সে একটি ইন্টারভিউতে বলেছে। সেটি প্রফেসর আবু সাইদের ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বইতে ছাপা হয়েছে)। যে মুহুর্তে কর্নেল শাফায়াৎ জামিলকে তার চিফ আদেশ করেছে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য তখন ডেপুটি চিফের কাছে নির্দেশনার জন্য যাবার কোন অধিকার তার নেই। এটি চ্যানেল অব কমান্ড এর স্পষ্ট লঙ্ঘন।

চিফের কাছ থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা পাবার পরেও কেন কর্নেল শাফায়াৎ নির্দেশনা নিতে ডেপুটি চিফের শরণাপন্ন হয়েছিল? এটি তার নিজের বক্তব্যেই উল্লেখ আছে। অপরদিকে ডেপুটি চিফ তাকে সেদিন সজাগ থাকতে বলেছে। এর বাইরে কিছু বলেনি! সেই অবস্থায় কি এটাই সঠিক আদেশ হতে পারে? বিশেষ করে যখন দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে? এই আদেশের মাধ্যমে ডেপুটি আসলে কর্নেল শাফায়েতকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার চিফের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েও ডেপুটি চিফের শরণাপন্ন হয় এবং শেষ পর্যন্ত নিষ্ক্রিয় থাকার পথ বেছে নেয়। কেন তিনি নিষ্ক্রিয় থাকার পথ বেছে নিলেন? এটি কি কোন হুমকি ছিলো? নাকি বিদ্রোহীদের সাথে একতা প্রকাশ? শাফায়াৎ তার অবস্থান পরিষ্কার করেন নাই, তবে এটি বুঝতে এক্সপার্ট হবার প্রয়োজন নেই।

যখন এরকম একটি ঘটনা ঘটে সেটি জানবার অধিকার মানুষের থাকে। আমি এখানে কী করতে পেরেছিলাম আর কী করতে পারিনি তা লেখার চেষ্টা করব। মূল পর্বতে যাবার আগে পেছনের কিছু ইতিহাস তুলে এনে আলোচনা করা দরকার। এতে বিষয়টার সংযোগসূত্র পেতে সুবিধা হবে। এই বিষয়গুলো বেশ আগের। তাই দিন তারিখ কিছুটা হেরফের হতে পারে। তবে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত। কিছু কিছু ঘটনা স্মৃতি প্রায় গেঁথে আছে – তাই সেগুলো এখনো মুছে যায়নি। তবে যতদূর আমার মনে পরে আমি পাঠকের জন্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করব। সেসময় কিছু নোটও আমি সংরক্ষণ করেছি। আমার মতে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনায় গোয়েন্দা বাহিনীর পূর্ণ ব্যার্থতা ছিল। নীচে সেগুলো বেশ কিছু আলোচনা করছি।

সৈন্যদের কাজ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা চিফের থাকতে হয়। বিশেষ করে সেইসব বিষয় যেগুলো দেশ ও চাকরীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। এসব তথ্য পেতে হলে চিফকে কিছু এজেন্সির শরণাপন্ন হতে হয় যারা তাকে এই তথ্যগুলো দেবার দায়িত্বে থাকে। ১৫ আগস্ট ‘৭৫ এর ব্যাপারে সেসব এজেন্সি থেকে চিফকে কোন তথ্য দেয়া হয়নি। এই এজেন্সিগুলো চিফের কাছে ছিলো না। সেটি দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী জানতো। কেন সেগুলো চিফের কাছে ছিলোনা নীচে তা আলোচনা করছি। আমি সেগুলো পেতে চেষ্টা করেছি কিন্তু ডিফেন্স মিনিস্ট্রি – বিশেষ করে ডিফেন্স মিনিস্টারের থেকে যতোটুকু সহযোগিতা পাবার কথা সেটি না পাওয়ায় আমি সেগুলো পাইনি।

সেটি ছিলো ১৯৭৫ এর জুন মাসের দিকে। MI Dte (মিলিটারি ইন্টিলিজেন্স ডাইরেক্ট্রেট) এর ঢাকা ডিটাচমেন্টের FIU মারফত কুমিল্লা গ্যারিসনের একজন NCO (Non-Commissioned Officer) থেকে একটি গোপনীয় ডকুমেন্ট পাওয়া যায়। এতে সেনা অভ্যুত্থানের ব্যাপারে কিছু মেজেস পাওয়া যায়। এটি হঠাত করে হাতে আসে এবং এর পেছনে ইন্টিলিজেন্সের কোন প্রচেষ্টা নেই। এমন সময়ে এটি প্রকাশিত হয় যখন প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জ্যামাইকার কিংস্টনে CHOGM (Commonwealth Heads of Government Meeting) এর মিটিং এ অংশ নেবার জন্য দেশের বাইরে ছিলেন। যে লিফলেট প্রচার হচ্ছিলো তাতে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের নির্দিস্ট কিছু বিষয় উল্লেখিত ছিলো। সংক্ষেপে যার অর্থ হচ্ছে সরকার আর্মির সাথে ন্যায়সঙ্গত কাজ করছেনা। এর কারণ ছিলো রক্ষীবাহিনী দিয়ে আর্মিকে রিপ্লেস (প্রতিস্থাপন) করার প্রক্রিয়া। আমি তথ্য পেয়েছিলাম যে যারা এগুলো করছে তাদের র‍্যাংক NCO এর উপরে নয় এবং এর পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে জাসদ। তবে নেতৃত্বের লেভেল যাই হোক না কেন এটি ছিলো একটি অশুভ সংকেত।

সেসময় আর্মি পুরোদমে তার কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। এবং এধরনের বিষয় ঠেকাতে যে পরিমাণ কাউন্টার ইন্টিলিজেন্সের দরকার হয় তাও ছিলোনা। প্রকৃতপক্ষে পুরো সেনাবাহিনী তখন একটি এড হক অর্গানাইজেশনের মত কাজ করছিলো। যখন আমরা প্রথম DFI (Directorate of Forces Intelligence) করলাম তখন আমাদের ইচ্ছা ছিলো এটি আর্মি হেডকোয়ার্টারের নিয়ন্ত্রণে থাকুক। (যেহেতু ফোর্সের সংখ্যা অনেক)। এবং এর ফলে তিন বাহিনী প্রধানরাই ইন্টিলিজেন্স কাভারের আওতায় আসবে। তাই শুরু থেকেই DFI এর কার্যালয় আর্মি হেড কোয়ার্টারের ভেতরেই ছিলো। এটি করা হয়েছিলো যাতে তিনটি বাহিনী সার্ভিস পায়। এটাও নিশ্চিত হয় যে তিন বাহিনী প্রধানগন তাদের সৈনিকদের কার্যক্রম সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারেন। সেই থেকে DFI যেসব গোয়েন্দা তথ্য পেত সেগুলো তাদের ডিজির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চিফদের কমিউনিকেট করা হত। এবং এরপর যদি প্রয়োজন হয় তবে সেটি প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো হবে। সেটি চিফ অথবা ডিজি এদের যে কেউ জানাতে পারে।

১৯৭৩ এর শেষ পর্যন্ত এই নিয়মেই চলেছে। কিন্তু ১৯৭৪ সালে রিপ্যাট্রিয়েশনের পর একটি সময় আসলো যখন DFI এর কার্যালয় আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে নিয়ে যাওয়া হল। তখন থেকে ডিজি কর্তৃক চিফদের কাছে রিপোর্ট করার নিয়মটা বদলে যায়। সেই থেকে ডিজি সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে রিপোর্ট করতে থাকেন। এবং এখানে চিফদের বাইপাস করা হচ্ছে। সার্ভিস চিফরা এভাবে অক্ষম হয়ে গেলেন। যেহেতু সেসময় থেকে ডিজি ইচ্ছাকৃতভাবে বা নিজের সামর্থ্যহীনতার কারণে চিফদের কাছে রিপোর্ট করছিলেন না। এই সময় থেকেই সমস্যার শুরু।

Source: 15th August A National Tragedy Major Gen K M Safiullah BU PSC

খন্দকার মোশতাকের মিত্ররা কেন একত্রিত ছিলো?(Opens in a new browser tab)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!