ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এইসকল আর্মি অফিসারদের উপর যে অন্যায় করা হল সেটি ছিলো সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। পরবর্তিতে মেজর ডালিমকে নিশ্চিতভাবেই বঙ্গবন্ধু-বিরোধী শক্তিরা রিক্রুট করেছে – এবং তারপর ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঘটনায় তাকে কাজে লাগিয়েছে। মেজর ডালিমই রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতনের খবর প্রচার করে। সেদিন সকালে কর্নেল শাফায়াতকে নির্দেশ দিয়েছিলাম যেন তাদের বাধা দেয়া হয়। কিন্তু সে মেজর ডালিমকেও ক্যান্টনমেন্টে ঢুকতে বাধা দেয়নি। কর্নেল শাফায়াৎ সম্ভবত মেজর ডালিম কর্তৃক রেডিওতে বঙ্গবন্ধু সরকারের পতনের সংবাদ প্রচারের বিষয়ে অবাক হননি। হতে পারে কর্নেল শাফায়াৎ তার (ডালিমের) প্রতি সহমর্মী ছিলো। একারণেই তার প্রতি কোন একশন নেয়নি। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর ঘটনার পাশাপাশি মেজর ডালিম তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করে। এমনকি কোন রকম বাধা ছাড়াই সে আমার অফিসে তার সৈন্য নিয়ে প্রবেশ করে।
আমার জানা মতে, যাদের উপর আমি নির্ভর করি তারাই নিজেদের স্বার্থপরতার কারণে আমাকে ব্যার্থতায় পর্যবসিত করে। যেকারন আমি কথাটা বললাম তা হল, ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াৎ জামিল – যার আমার একমাত্র শক্তি হবার কথা – সে আমার সাপোর্টে এতোটুকু এগিয়ে আসেনি। অন্যদিকে সে আমার আদেশ অমান্য করেছে। যখন আমি তাকে আদেশ দিলাম বিদ্রোহী সৈন্যদের বাধা দিতে – সে সেটা মানেনি। আমার আদেশ না মেনে সে ডেপুটি চিফের শরণাপন্ন হয়েছে অর্ডারের জন্য। এটা চ্যানেল অব কমান্ডের সম্পূর্ণ বরখেলাপ। আরেকজন হলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ CGS, তার উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিলো। কিন্তু সেও এমন আচরণ করেছে যা তার থেকে আশা করিনি। পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করার পরিবর্তে সে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ দুপুরে বিদ্রোহী সৈন্যদের জন্য ট্যাংক এম্যুনিশন ইস্যু করেছে। আমার নলেজ ছাড়াই সে ট্যাংক রেজিমেন্টকে এম্যুনিশন ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিভাবে আমি তাকে বিশ্বাস করি? এরপর থেকে আমি একা হয়ে গেলাম। খন্দকার মোশতাক আমার এই দুর্বলতাকে কাজে লাগাল। সে আমাকে অন্যান্য অফিসার ও বাহিনীর অন্যান্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলো। বঙ্গভবনে আমাকে একরকম আটকে রাখা হল – প্রায় ৭২ ঘণ্টা।
আমার আদেশ মাফিক বিদ্রোহীদের থামানোর পরিবর্তে কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নিলো না। বিদ্রোহী অফিসাররা (মেজর ডালিম ও মেজর রশিদ) কোন রকম বাধা ছাড়াই ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। এর কারণ হতে পারে যে, সম্ভবত সে তাদের সাথেই আছে। অথবা সে অন্য কারো আদেশ মেনে চলছে যারা বিদ্রোহীদের প্রতি সহমর্মী। এটা সত্য যে বিদ্রোহী অফিসারদের প্রতি সৈন্যদের সহমর্মীতা ছিলো। কিন্তু তারা যে কাজটি করেছে নিশ্চতভাবেই তা কোনরকম সহমর্মীতা পাবার যোগ্য নয়। কর্নেল শাফায়াৎ যদি আমার আদেশ পাবার পরপর সেই মোতাবেক কাজ করত তবে এই বিদ্রোহী সৈন্যদের মোকাবিলা করা যেত – এমনকি পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়াটা ঠেকানো যেত। যখন আমি ৪৬ ব্রিগেড এরিয়াতে গেলাম, আমি দেখলাম যে সৈন্যদের মুভ করা হয়নি। তাদের বিপরীতে কোন সৈন্যই আমি যোগাড় করতে পারলাম না। উপরে উল্লেখিত কারণগুলোর জন্য আর্মিতে সৃষ্ট ক্ষোভের ব্যাপারটা অনুধাবন করা যায়। কিছু অফিসারদের প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে সেটিও তাদের সরকার বিরোধী হবার অন্যতম কারণ।
খন্দকার মোশতাককে বোঝানো হল, যতক্ষণ আমি চিফ অব স্টাফ আছি ততোক্ষণ তার প্রেসিডেন্সি নিরাপদ নয়। তাকে যেভাবে সতর্ক করা হয়, হয়ত তারা ভুল কিছু বলেনি। প্রকৃতপক্ষে আমি চেষ্টা করছিলাম বঙ্গভবন থেকে আর্মার ও আর্টিলারি ইউনিটকে ব্যারাকে নিতে এবং সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে। যদি সেই যাত্রায় সফল হতাম, তাহলে আমি তাকে আইনের মুখোমুখি করতে পারতাম। তার শক্তি ছিলো আর্মার, আর্টিলারি ইউনিট এবং বিদ্রোহী অফিসাররা। অন্যদিকে আমার শক্তি ছিলো ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ঢাকা ব্রিগেড কমান্ড এর সৈন্য ও বাকি অফিসারগণ। নিজেদের টিকে থাকার জন্যই খন্দকার মোশতাকের মিত্ররা একত্রিত ছিলো। অন্যদিকে আমার মিত্ররা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর সকাল থেকেই বিপথগামী ছিলো। বিশেষ করে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ড। সে জেনে বা না জেনে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সকাল থেকে বিদ্রোহীদের সমর্থন করে। ক্যান্টনমেন্টে মেজর রশিদ ও মেজর ডালিমের কোনরকম বাধা ছাড়াই অবাধ চলাফেরা এটার সত্যতা প্রমাণ করে। যেভাবেই হোক না কেন, তারা একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সবচেয়ে কালো একটি দিন হিসেবে পুরো জাতির কাছে বিবেচিত হবে।
Source: 15th August: A national Tragedy – K M Safiullah
Translated by Dr Razibul Bari