You dont have javascript enabled! Please enable it!
এ ই দেশে তে জন্ম আ মা র

১. নিপীড়িত। শােষিত। হাজার হাজার গ্রাম।। নীরব । নিস্তব্ধ।। মানুষের কণ্ঠ রােধ করে দেয়া হয়েছে। তীক্ষ্ণ সঙ্গীন। রাইফেল। সবুট সন্ত্রাস।। শুধু মাত্র সিপাহসালার আইয়ুবের দম্ভোক্তি। অস্ত্রের আঘাতে অধিকার আন্দোলন স্তব্ধ করা হবে। বাঙালির অধিকার, বাঁচার অধিকার। ছ’ দফা। ছ’দফার বিরুদ্ধে অঘােষিত যুদ্ধ। সশস্ত্র সামরিক জান্তা আর নিরস্ত্র জনতার যুদ্ধ। অস্ত্রের ভাষা আর আপােষহীন বজ্রকণ্ঠ। একদিকে শেখ মুজিব। অন্যদিকে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব। একদিকে অস্ত্র । হুমকি। রক্তচক্ষু। সন্ত্রাস। ক্ষমতার দম্ভ। দাপট। অন্যদিকে আদর্শ। লড়াই। আপােষহীন লড়াকু জংগী ঐক্য। রাজপথ উত্তাল। বজ্রমুষ্টি। মিছিল। মুজিবের কণ্ঠে বাঙালি জাতিসত্তার জয়ধ্বনি। মহানায়ক মুজিব গ্রেফতার। এক ডজন মামলা। অত্যাচার। নিপীড়ন। জনতা পিছু হটে। আইয়ুব-মােনায়েম আন্দোলনের ভাটা দেখে উল্লসিত মুজিবকে শেষ করে দাও এইতাে সময়! গভর্নর মােনায়েম খানের গর্জন মুজিবকে ফাসিতে লটকাবাে।১.১ চারদিকে এমনি এক আপাত: অসহায় অবস্থার অন্ধকার। শেষ সূর্যেরদিনলিপির অন্তিম প্রার্থনা রাত্রির অন্ধকারে তলিয়ে আছে। সগর্তন জলপাই রঙের মিলিটারি ভ্যান ধীরে এসে দাড়ালাে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে। সঙ্গীন উঁচিয়ে সৈন্যরা নেমে আসে জেল গেটের সামনে। সারিবদ্ধ। প্রস্তুত। নিরাপত্তা আইনে বন্দি এক, নিঃসঙ্গ।। নিঃসঙ্গতা এক পলকহীন প্রহরীর মতাে লােহার গারদে লেপটে আছে। দিন যায়। রাত আসে। মাস। বছর। এমনি করে দুটো বছর চলে গেল। জেলার এল। অপ্রত্যাশিত। বলল বন্দি এই তােমার মুক্তি পরােয়ানা। বন্দি দেখল। ভাবলএত রাতে মুক্তির আদেশ! বন্দির চোখে অবিশ্বাসের কালাে ছায়া! মুক্তিপত্র হাতে জেল গেটে এসে দাঁড়ালেন— বিশাল বাংলার দীপ্যমান শ্যামল চেহারার শরীর ও আত্মার মানুষটি! সঙ্গীনধারী সৈন্যরা এসে চারপাশ তার ঘিরে দাঁড়ায়। অন্ধকার রাত। চারিদিকে শুধু ঝকঝকে সঙ্গীদের ঝিলিক। রাত জাগা ভয়ার্ত পাখির আর্তনাদ! তুমি আবার বন্দি হলে। চল আমাদের সাথে। কেন?

কোথায়? কতদূরে নিয়ে যাবে? কোন্ লৌহ প্রাচীরের অন্তরালে? —জবাব মেলে না। জলপাই রংয়ের গাড়ির সামনে জেল গেটের পথের মাঝে বন্দির ছােট্ট অনুরােধ এক মুহূর্ত সময় দাও আমায়। তারপর কারাগারের সামনে এক মুঠি ধূলি তুলে কপালে স্পর্শ করে। দুইহাত বাড়িয়ে দেয় বন্দি-মুজিব দেশ। জনতা। বিধাতার উদ্দেশ্যে এই দেশেতে জন্ম আমার। যেন এই দেশেতেই মরি।’ কারাগারের ফটক সশব্দ কান্নায় বন্ধ হলাে। মিলিটারি ভ্যান ছুটে চলে। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট। যবনিকা উঠল।মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র । ওকে ফাসি দাও। গুলি করাে। চক্রান্তের বাইরের রূপ আগরতলা মামলা। উদ্দেশ্য মুজিব-হত্যা। সেই থেকে আমরণ তার সামনে, পেছনে, এপাশে ওপাশে একটি বুলেট, এক ঝাঁক বুলেট মৃত্যুর ছায়া হয়ে তাড়া করে ফিরেছে বার বার।
১.২ বাঙালি ভাবল : একি জঘন্য ষড়যন্ত্র! বাঙালি দেখল : একি দুঃশাসন! বাঙালি বুঝল : শেখ মুজিব মানে বাঙালির অধিকার। বাংলার স্বাধীনতা। বাংলার মুক্তি। বাঙালির স্বপ্নে, চেতনায়, আঘাতে সংগ্রাম। আন্দোলনে। রক্ত বহ্নিতে শেখ মুজিব আর বাঙালি-বাংলাদেশ এক অবিভাজ্য অভিন্ন। মুজিব মানেই বাংলাদেশ। অত্যাচারিত মুজিব আর তার দুঃখিনী বাংলা! দেখে শুনে বুঝে বাঙালি গর্জে উঠল— দুঃশাসন হটাও। ছাত্র এল। এল শিক্ষক। জনতা। চাষি। মজুর মুটে সবাই এল—নেমে এল রাজপথ। হটাও আইয়ুব শাহী। কবর খোড়াে মােনায়েম খার। ঘেরাও করাে লাট ভবন। সেনা ছাউনি। ছিনিয়ে আনাে মুজিবকে। সকল রাজবন্দিদের। আইয়ুবের বড় সাধ ছিল— মােনায়েমের প্রতিজ্ঞা ছিল— মুজিবকে ফাসিতে, গুলিতে হত্যা করার। তাদের সাধ আর প্রতিজ্ঞা অপূর্ণ রইল। সংগ্রামী জনতা ছিনিয়ে আনলাে মুজিবকে। রক্ত দিয়ে। প্রাণ দিয়ে।  বড্ড বেশি ভালােবাসা দিয়ে! আগরতলা মামলা প্রত্যাহৃত হলাে। মুজিব বেরিয়ে এলেন স্বাপ্নিক সূর্যের প্রখরতা আর প্রগাঢ়তা নিয়ে। আইয়ুবের বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠলাে! মুজিব হত্যার প্রথম পরিকল্পনা ব্যর্থ হলাে।২.
শুরু হয় মুজিব হত্যার দ্বিতীয় পর্যায়। সে এক গভীর চক্রান্তের নাটকীয় ইতিহাস নতুন ভাবে। নতুন কৌশলে। ঘটনার আবরণে—ঘনঘটার নেপথ্যে। উনসতুরের প্রচণ্ড গণঅভ্যুত্থানে জেনারেল আইয়ুব বিদায় নিল। এল জেনারেল ইয়াহিয়া। সামরিক শাসন জারী হলাে। ২৬শে মার্চ ১৯৬৯। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত ভাষণের মূল কথা হলাে-শাসনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযােগী পরিবেশ সৃষ্টি করা ও জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা।২.১ সেই উদ্দেশ্যে ১৯৭০ সনের ১লা জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির বাঁচার দাবী ছয় দফা নিয়ে সারা বাংলার এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তরে দুর্বার বেগে ছুটে চলেছেন। গ্রাম থেকে শহরে। গঞ্জে। নগরে। বন্দরে। ২.২ এমনি এক দিন… ১৯৭০ সাল। ২৬শে মার্চ। বঙ্গবন্ধু যাচ্ছেন মফঃস্বলে এক নির্বাচনী সমাবেশে বক্তৃতা করতে। গাড়ি চলছে খট খট আওয়াজ তুলে। গাড়ির পেছনের সিটে এক অবাঙালি সাংবাদিক উপবিষ্ট। তিনি করাচীর একটি পত্রিকার ঢাকাস্থ নির্বাচনী রিপাের্টার। চলতি কিছু ঘটনার কথা উত্থাপন করে তিনি শেখ মুজিবকে উস্কে দিলেন এবং সংগােপনে নিজের ক্যাসেট রেকর্ডারের বোতাম টিপে নিলেন। সে টেপকৃত বাণীর মধ্যে মূল কথা ছিল, এখানে আমি যা চাইবাে তাতে কেউ ‘না’ বলতে পারবে না। এমন কি ইয়াহিয়া খানও আমার দাবীকে উপেক্ষা করতে পারবেন না।২.৩ ১৯৭০ সালের ৩০শে মার্চ ইয়াহিয়া খান আইনগত কাঠামাে আদেশ (এল, এফ, ও) ঘােষণা করেন। ঐ আইনগত কাঠামাের আদেশে ভাবী শাসনতন্ত্রের মূল নীতিগুলাে কি হতে হবে তা নির্দেশ করে দেয়া হয়েছে। ইসলাম, জাতীয় সংহতি, জাতীয় স্বার্থ, অখণ্ডতা ইত্যাদির পাকাপােক্ত ব্যবস্থা রাখার সুস্পষ্ট বিধান এতে সন্নিবেশিত ছিল। শুধু তাই নয়, এল.এফ.ও-র ২৫ এবং ২৭ ধারায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ যাই গ্রহণ করুক না কেন—তা প্রেসিডেন্ট ভেটো দিয়ে বাতিল করে দেবার অধিকারী ছিলেন। ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে ব্যর্থ হলে জাতীয় পরিষদকে বাতিল করে দেয়া হবে। এল, এফ. ও-র মূল কথা ছিল, পাকিস্তানে ২৩ বছর ধরে চলে আসা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু রাখার; অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ পুঁজি, সামরিকবেসামরিক আমলাচক্র তাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখার অস্ত্র ।
২.৪ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেন। তিনি বাঙালিকে এসব চক্রান্তের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। এ সম্পর্কে সিদ্দিক সালিক বলেন-শেখ মুজিবের দাবীগুলাে কি ছিল? ইয়াহিয়া খানের গােয়েন্দা বাহিনীর সংগৃহীত আরেকটি টেপ থেকে সূত্রটি পাওয়া যায়। বিষয়টি লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক’ সম্পর্কিত। এটা ছিল। শাসনতন্ত্রের বহিরঙ্গ চিত্র। এই আদেশ বিখ্যাত ছয় দফা বাস্তবায়নের ব্যাপারে মুজিবের হাত বেঁধে ফেলল। এল, এফ, ওর উপর তিনি তার মতামত একান্ত নির্ভরতার সাথে বলেছিলেন তার সিনিয়র সহকর্মীদের কাছে। তিনি আঁচ করতে পারেননি যে, তার কথাগুলাে ইয়াহিয়া খানের জন্য টেপ হয়ে যাচ্ছে। রেকর্ডকৃত টেপে মুজিব বলেন— আমার লক্ষ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঐ এল, এফ, ও টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলবাে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে কে? যখন এই টেপ ইয়াহিয়া খানকে শােনানাে হলাে, তিনি বললেনঃ যদি মুজিব বিশ্বাসঘাতকতা করে। তা হলে আমিও তাকে দেখে নেবাে।২.৫ এখানে স্বভাবতই দুটি প্রশ্ন থেকে যায়— এক. বঙ্গবন্ধুর সিনিয়র সহযােগীদের মধ্যে এমন ব্যক্তি কে ছিলেন, যিনি পাক গােয়েন্দা বাহিনীর এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর গােপন কথা—পরামর্শ টেপ করে পাচার করেছিলেন? অন্য প্রশ্নটি হলাে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এহেন উদ্দেশ্য জ্ঞাত হবার পরেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান নির্বাচন অনুষ্ঠানে সম্মত ছিলেন কেন?
২.৬ এর পেছনে ষড়যন্ত্রমূলক কৌশল কাজ করেছিল। ঐ সময়ে যে চক্রটি পাকিস্তানের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের সিদ্ধান্ত নিতেন তাদের ভেতরে ছিলেনজেনারেল ইয়াহিয়া খান, চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ জেনারেল পীরজাদা, চিফ অব দি জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান, ন্যাশন্যাল সিকিউরিটি কমিটির প্রধান মেজর জেনারেল উমর, ইন্টার সার্ভিস ইনটেলিজেন্সের ডিরেক্টর জেনারেল আকবর খান এবং  বেসামরিক দুইজন হলেন সিভিল ইনটেলিজেন্স ব্যুরাের ডিরেক্টর রিজভী ও প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, আমলা এম, এম, আহমদ। এ ছাড়াও লে. জেনারেল আতিকুর রহমান, লে. জেনারেল রাখমান গুল, এয়ার মার্শাল রহীম খান, ভাইস এ্যাডমিরাল মুজাফফর হাসান প্রমুখ ছিলেন আরেক চক্রে। সামরিক বেসামরিক এই আমলা চক্র বুঝেছিল পুরনাে কায়দায় ক্ষমতাআপাতত কুক্ষিগত রাখা যাচ্ছে না। সামরিক বাহিনীর এ সব জঙ্গী জেনারেলদের মাথায় এও ঢােকানাে হয় যে, নির্বাচন দিলে কেউ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। বিভিন্ন দল বিভিন্ন মত নিয়ে আসবে, ১২০ দিনে শাসনতন্ত্র তৈরি হবে না।
অতএব আসল ক্ষমতা করায়ত্ত থাকবে এ সব চক্রের হাতেই। ২.৭ এর সঙ্গে তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সামরিক-বেসামরিক গােয়েন্দা বাহিনী প্রদত্ত সম্ভাব্য নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে রিপাের্ট বিবেচনা করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও সামরিক জান্তার একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল যে, দেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে কোনাে রাজনৈতিক দল বা গ্রুপই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। সামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর গােড়ার দিকের রিপাের্ট ছিল যে, আওয়ামী লীগ ২০টি, কাইয়ুম মুসলিম লীগ ৭০টি, দৌলতানা ৪০টি, ভুট্টো ২০টি, এবং ওয়ালী খানের ন্যাপ ৩৫টি আসন পাবে।১০ ১৯৭০ সালের অক্টোবরের গােড়ার দিকে ইয়াহিয়া সরকারের বেসামরিক গােয়েন্দাগিরির দায়িত্বে নিয়ােজিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সরদার আব্দুর রব নিশতার ভেবেছিলেন যে, জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্দিষ্ট আসনের ৬০% ভাগ পর্যন্ত পেতে পারে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বে গােয়েন্দা বিভাগের কর্মচারীগণ নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ধারণা করেছিলেন, আওয়ামী লীগ ৮০, কাইয়ুম মুসলিম লীগ ৭০, দৌলতানা ৪০, ওয়ালী খানের ন্যাপ ৩৫, ভুট্টোর পি.পি.পি. ২৫।১২ তদানীন্তন যােগাযােগ মন্ত্রী ও বেসামরিক শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ড. জি, ডব্লিউ চৌধুরী ১৯৭০ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর লন্ডনস্থ পাকিস্তান সােসাইটিতে প্রদত্ত ভাষণ ও প্রশ্নের উত্তর দান কালে বলেছিলেন ঃ পূর্ব পাকিস্তান থেকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের আবির্ভাবের সম্ভাবনা নেই।২.৮ নির্বাচনের পূর্বে ইসলাম পছন্দ১৪ দলগুলাের স্বপক্ষে পাকিস্তানী বেতার থেকে প্রচার করা হয়েছিল।১৫
শুধু তাই নয়, বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, সামরিক সরকার পূর্ব বাংলায় শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীকে কাজে লাগানাের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হয়েছিল ১৬ কিন্তু সামরিক জান্তার সর্বপ্রকার গণনা ও ধারণা এবং প্রদত্ত রিপাের্ট ভুল প্রমাণিত হলাে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বমােট ৩১৩ সদস্য সংখ্যা বিশিষ্ট আসনে আওয়ামী লীগ এককভাবে ১৬৭টি আসন লাভে সমর্থ হয়।১৭২.১০ আওয়ামী লীগের এই বিজয় ছিল ঐতিহাসিক। প্রদত্ত ভােটের ৭২.৫৭ভাগ আওয়ামী লীগ লাভ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালির এই বিজয়কে পাক শাসক চক্র কোনাে সময়েই মেনে নিতে পারেনি। আওয়ামী লীগের এই ঐতিহাসিক বিজয়কে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে নির্বাচনী ফলাফলের উপর পর্যালােচনা করার জন্য ঐদিনই জেনারেল হেড কোয়াটার্সে কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।১৯ ১৯৭০ সনের ২৭শে নভেম্বর ঢাকার গভর্নর ভবনের সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেন : যদি নির্বাচনের পর তারা (রাজনৈতিক দল) আইনগত কাঠামাে আদেশকে অস্বীকার করে তাহলে আমি ধরে নেব যে তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেনি। সামরিক আইন আছে এবং থাকবে।২০ এ সব থেকে বােঝা যায়, নির্বাচনের পূর্বেই জেনারেল ইয়াহিয়া ও সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত ছিল না এবং নির্বাচনী ফলাফল দেখে তারা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ক্ষমতা ছাড়া যাবে না। নির্বাচনী ফলাফল দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা জেনারেলদের ইয়াহিয়া খান এই বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমঝােতায় না আসলে ক্ষমতা হস্তান্তরতাে নয়ই বরং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যে কোনাে অজুহাতে বন্ধ রাখবেন।২২ শুধু তাই নয়, ছয় দফা বাংলার জনগণের। এই ম্যান্ডেট- এর সঙ্গে আপােষ নয়” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের এই দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ও মনােভাব সম্পর্কে তখন ঢাকায় অবস্থানরত জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন আমাদের উপর এ সব ব্লক বাস্টারদের শাসনকরতে দেয়া হবে না।২৩ ২.১১ সামরিক জান্তার এই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও চক্রান্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
চক্রান্ত ও ঘটনাসমূহ দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়। ইয়াহিয়া খান ও সামরিক চক্র চেয়েছিলেন শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে উৎখাত করতে ও এই লক্ষ্যে ভুট্টোকে দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ লাগিয়ে অধিবেশন স্থগিত ও সামরিক শাসন অব্যাহত রাখতে। আর ভুট্টো চেয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজসে তার ক্ষমতা প্রাপ্তির পথকে প্রশস্ত করতে। ২.১২। এ সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানে তদানীন্তন দখলদার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লে.জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী তার জবানবন্দিতে বলেছেন “আমি জানিনা যে, বেসামরিক সরকার গঠনের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানেরচিন্তা-ভাবনা কি ছিল? তবে এটা সত্য যে, তার চার পার্শ্বে যে সব ক্ষমতালিন্দু লােক জড়াে হয়েছিল, তারা এর বিরােধিতা করেছিল। তারা আশংকা করেছিল যে, এতে করে তাদের ইজারদারী খতম হয়ে যাবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তারা মিঃ ভুট্টোকে ক্ষমতায় বসানাের পরিকল্পনা সফল করতে পারবে না। জেনারেল ইয়াকুবের অযােগ্যতা ও নিষ্ক্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে শেখ মুজিব সামরিক সরকারের বিকল্প একটি সরকার গঠন করে ফেলেন। এই কারণেই বাঙালিরা সেনাবাহিনীর মােকবিলা করার জন্য ময়দানে নেমে আসার সাহস পায়। এরপর জেনারেল টিক্কা খান তার দুই জন ঘনিষ্ঠ সহযােগীর পরামর্শে যে নিঠুর পন্থায় শক্তি প্রয়ােগ করেন, তা বাঙালিদেরকে বহু দূরে ঠেলে দেয় এবং সেখান থেকে তাদের ফিরে আসা আর সম্ভবপর ছিল না। ফলে স্বভাবতই তারা পশ্চিম পাকিস্তানের শত্রু বনে যায়। এটা ছিল একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ফসল যারা এই ঘৃণ্য অপকর্মের হােতা,তারা ছিল ভুট্টোর সঙ্গে গােপন চক্রান্তে লিপ্ত। এর একটি মৌখিক প্রমাণ এই যে, ক্ষমতা লাভের পর ভুট্টো এদেরকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করেন।”২৪ ৩. জাতীয় পরিষদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করায় পাক জেনারেলদের সঙ্গে আঁতাত করে ভুট্টো গােলমাল শুরু করেন। ১৯৭০ সনের ২০শে ডিসেম্বর তিনি ঘােষণা করেন যে, তার দলকে বাদ দিয়ে শাসনতন্ত্র রচনা ও কেন্দ্রে সরকার গঠন হতে পারে না। তিনি বলেন ক্ষমতায় যাবার জন্য তিনি আরাে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে রাজী নন।
তিনি বলেন, ক্ষমতার ভাপ তাকে দিতেই হবে—কেননা পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ।২৫ পাকিস্তানের রাজনৈতিক গগনে ষড়যন্ত্রের এই ভয়াবহ অবস্থার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অত্যন্ত ধীরস্থির, সৌম্য এবং বিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণে ও বক্তব্যে বাঙালি জাতিকে আরাে দৃঢ় সুসংগঠিত করার কাজে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিসমূহের সম্মিলিত এই সকল কূট ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রয়াসকে তিনি দুঃসাহসিক সেনানায়কের মতাে পরাভূত করে চললেন। বাঙালি জাতির মানস প্রস্তুতিকে স্বাধীনতার সর্বশেষ চেতনার স্তরে উন্নীত করার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সামরিক জান্তা ও ভুট্টোর এ সব কার্যকলাপ ও বক্তব্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে সচেতন ও সংঘবদ্ধ করেন। শাসক গােষ্ঠীকে সাবধান করে দিয়ে তিনি বললেন, “রক্তচক্ষু দেখাইয়া বাঙালিকে স্তব্ধ করা যাবে না।”২৬ ৩.১ ফৌজী চক্র ও ভুট্টো চক্র পরিবেশকে আরাে উত্তপ্ত ও যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ৩০শে জানুয়ারি ভারতীয় বিমান সংস্থার একটি ফোকার ফ্রেন্ডশিপ বিমান ছিনতাই করে লাহােরে নামায়। ৩১শে জানুয়ারি ভুট্টো ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে ছিনতাইকারীদের অভিনন্দন জানান এবং ছিনতাইকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দানের দাবী জানান।২৭ ভারতের পুনঃ পুনঃ দাবী সত্ত্বেও ২রা ফেব্রুয়ারি ডিনামাইট দিয়ে বিমানটি উড়িয়ে দেয় তারা। ফলে ভারত ৩রা ফেব্রুয়ারি থেকে তার আকাশ সীমানার উপর দিয়ে পাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়।২৮। বিমান ছিনতাই-এর ঘটনার প্রেক্ষাপটে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৫ই ফেব্রুয়ারি বললেন দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ।
এই অজুহাতে ব্যাপক হারে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ও অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশে আনা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু এই ঘটনাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানাের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে হুশিয়ারী করে দিয়ে বলেন, এই ঘটনাকে সরকার ও পি,পি,পি ক্ষমতা কুক্ষীগত রাখার গুঢ় চক্রান্ত সফল চরার জন্য ব্যবহার করছে। ৩.২ বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতির দৃঢ়তার মুখে ১৩ই ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন যে ৩রা মার্চ তারিখে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভুট্রা পেশােয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ভারতের শক্রতা ও ছয়দফা না মানার ফলে ঢাকায় তাদের অবস্থা ডবল জিম্মির শামিল। সে জন্য তার দাবী ছয়দফা আপােষ করতে হবে।। ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি বললেন, পরিষদ ‘কসাই খানা হবে।৩২ ১৮ই ফেব্রুয়ারি তিনি বললেন, পাকিস্তানে তিনটি শক্তি-কেন্দ্র রয়েছেআওয়ামী লীগ, পি.পি.পি ও সামরিক বাহিনী। এখন আওয়ামী লীগকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কি একা যাবে, না অন্যদের সঙ্গে সমঝােতায় আসবে।৩৩। ২১ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির অজুহাতে তার বেসামরিক মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেন। প্রদেশসমূহের সামরিক গভর্নর ও জেনারেলদের সঙ্গে সভা করেন। এরপর হতেই সমগ্র প্রদেশকে সেনাবাহিনীর পুনঃ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত গৃহীতহয়।৩.৩ ১৬ই ফেব্রুয়ারি ভুট্টো করাচীতে প্রেসিডেন্ট ভবনে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভুট্টো দাবী করলেন, হয় পরিষদ অধিবেশনপিছিয়ে দিতে হবে নয় ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময়সীমা তুলে নিতে হবে।
তার দুইদিন পর লাহােরের জনসভায় ভুট্টো ঘােষণা করলেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের প্রতিবাদে তার দল খাইবারপাস থেকে করাচী পর্যন্ত হরতাল পালন করবে এবং তিনি হুমকি প্রদান করেন এই বলে যে তার দলের কোনাে সদস্য পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত থাকলে তাকে হত্যা করা হবে। ভুট্টোর এই হুমকি সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৩৬ জন পরিষদ সদস্য অধিবেশনে যােগদানের জন্য টিকেট ক্রয় করেন।৭ শুধু তাই নয়, কাইয়ুম মুসলীম লীগের ও পি.পি.পির সদস্যগণ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঢাকায় আসার জন্য প্রস্তুতি নেয়। পাকিস্তানের ন্যাশন্যাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠবন্ধু মেঃ জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যের অধিবেশনে যােগদান না করার জন্য চাপ প্রদান করতে থাকে। ৩.৪ ২৮শে ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লে. জে. এস,জি, এম পীরজাদা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আহসানকে টেলিফোনে বললেন ৩রা মার্চের আহুত পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করা হয়েছে। পীরজাদার ইচ্ছানুসারে সন্ধ্যা সাতটায় গভর্নর হাউসে ভাইস অ্যাডমিরাল এস, এম, আহসান শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার কথা অবহিত করালেন। আশ্চর্যের বিষয়, মুজিব কোনাে উদ্বেগই প্রকাশ করলেন না বরং যুক্তি সহকারে বললেন মার্চ-এ অধিবেশন পুনঃ আহবান করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এপ্রিল হলে বড় অসুবিধা হবে এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য পরিষদ স্থগিত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ঐ দিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া রাওয়ালপিন্ডিতে জানানাে হয় এবং বলা হয় এই ঘােষণায় যেন পার্লামেন্ট বসবার নতুন তারিখ থাকে। এর জবাবে রাওয়ালপিন্ডি ঠাণ্ডাভাবে শুধু বলে পাঠায় ইয়াের মেসেজ ফুললী আন্ডারস্টুড’। এক গভীর ষড়যন্ত্রের আবর্তে সেদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবর্তিত হয়েছিল তারই প্রমাণ—প্রেসিডেন্টের ১লা মার্চের ভাষণ।৩৯।
সিদ্দিক সালিক লিখেছেন পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার সম্পর্কে শেখ মুজিব পূর্বেই অবগত ছিলেন বলে তিনি তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য বেশ সময় পেয়েছিলেন। ঘােষণার আধা ঘণ্টার মধ্যে ক্রুদ্ধ জনতা বাশের লাঠি, লােহার রড এবং আপত্তিকর শ্লোগানে রাস্তায় নেমে আসে। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলার প্যান্ডেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়।৩.৫ শেখ মুজিব এ পরিস্থিতিতে হােটেল পূর্বানীতে আয়ােজিত জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন উই ক্যান নট লেট ইট গাে আনচ্যালেঞ্জড। তিনি ২রা মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল এবং ৩রা মার্চ সারা বাংলাদেশে হরতাল আহ্বান করেন এবং সরকারকে চিন্তা করার জন্য তিন দিনের সময় প্রদান করে বঙ্গবন্ধু বলেন আগামী ৭ই মার্চে জনসভায় তিনি তার পরবর্তী কর্মসূচী ঘােষণা করবেন। এ প্রসঙ্গে সিদ্দিক সালিক লিখেছেন : জনগণের সামনে কঠিন মনােভাব দেখানাের পর শেখ মুজিব গভর্মেন্ট হাউসে এসে বললেন এখনাে সময় আছে যদি অধিবেশন বসার নতুন তারিখ প্রদান করা হয় তবে জনগণের ক্রোধ প্রশমিত করা যাবে। তার পরে হলে ‘ইট উইল বি টু লেট”। ঢাকায় মুখ্য সামরিক কর্মকর্তাগণ এ লক্ষ্যে চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতুত্তরে শেষ রাতে জেনারেল পীরজাদা জেনারেল ইয়াকুবকে অ্যাডমিরাল আহসানের নিকট থেকে ক্ষমতা অধিগ্রহণের কথা ফোনে জানালেন।” ৩.৬ এরপর শেখ মুজিব ষড়যন্ত্র বিষয়ক কথিত ধারণায় বদ্ধমূল হলেন। এ প্রসঙ্গে আসগর খানের বক্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত এক আলােচনায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কিরূপ নেবে এবং অচলাবস্থার অবসান কিভাবে সম্ভব? উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত সহজ। ইয়াহিয়া খান প্রথম ঢাকা আসবেন, এম, এম আহমদ (প্লানিং কমিশনের প্রধান) তাকে অনুসরণ করবেন। ভুট্টো আসবেন তারপর। ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযানের আদেশ দেবেন এবং তারপরই পাকিস্তানের শেষ। বঙ্গবন্ধু চলতি খেলার সকল দরজা বন্ধ করে অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং সেট আউট আপন দ্য ওয়ার পাথ।৪৩৪.
সামরিক সরকারকে উৎখাত করাে—শুরু হলাে অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন। সমগ্র বাঙালি জাতি শেখ মুজিবের ইঙ্গিতে, আদেশে এবং নির্দেশে উদ্বেলিত ও একতাবদ্ধ হলাে। ২রা মার্চের রাতে কার্য জারী করা হলাে। সেনাবাহিনীকে পথে নামানাে হলাে। সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষে ঐ রাতে ছয় ব্যক্তি নিহত হন। ৪.১ পরের দিন এই নিহত ব্যক্তিদের সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু অনলবর্ষী বক্তৃতা করেন এবং এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সকল স্তরের জনগণকে এবং সরকারি কর্মচারীদের ‘অবৈধ সরকার’-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার এবংনির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে স্বীকৃতির আহবান জানান। ঐ দিন এ রকম বিবৃতি মার্শাল ল হেডকোয়াটারে পৌছলে জেনারেল ইয়াকুব রাত সাড়ে এগারাে হতে চল্লিশ মিনিট ধরে শেখ সাহেবকে উক্ত বিবৃতি তুলে নেয়া বা সুর নরম করার জন্য বহুভাবে অনুরােধ করেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের অনুরােধ অগ্রাহ্য করেন।
এ প্রেক্ষিতে জেনারেল ইয়াকুব মিনি ওয়ার কাউন্সিল ডাকলেন এবং প্রদেশের সর্বত্র সেনাবাহিনীকে সতর্ক রাখার নির্দেশ দিলেন।৪৫ ৪.২ দেশের অবস্থা দ্রুত পরিবর্তনের দিকে এগুতে থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, কুমিল্লা, যশােহর, সিলেট, রংপুর প্রত্যেক জায়গায় সেনাবাহিনীর সাথে জনতার সংঘর্ষ চলতে থাকে। অবস্থা পরিদৃষ্টে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১০ তারিখে গােল টেবিল বৈঠক ডাকার কথা ঘােষণা করলে মুজিব তা প্রত্যাখান করে বললেন ঃ এটি একটি নিষ্ঠুর তামাশা।৪৬। ৪.৩
৩রা মার্চ বহু হতাহত হয়। মুজিব বললেন ঃ সেনাবাহিনী তুলে নিতে হবে। আইন-শৃঙ্খলার দায়িত্ব আমার। সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হলাে। প্রকৃত প্রস্তাবে শেখ মুজিব দেশের কর্তৃত্ব গ্রহণ করলেন। আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী রাজধানীর সর্বত্র চেকপােস্ট বসায় এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তুলে নেয়। ৪.৪ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দনে লাখাে জনতার ভীড়। মুজিব আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করবেন। ৬ই মার্চ রাত। চিন্তামগ্ন মুজিব। দেশ। জাতি। ভবিষ্যৎ। টেলিফোন বেজে উঠল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কথা বললেন। অনুরােধ জানালেন হঠাৎ কিছু না করার। বললেন ? আপনার আশা-আকাঙ্খা আর জনগণের প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকারকে পুরােপুরি সম্মান করা হবে—যা ছয় দফার চেয়ে বেশি। ৪.৫
৬ই মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ২৫শে মার্চ অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘােষণা দেন। ৪.৬ ৭ই মার্চ সকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।জি ডাব্লুউ চৌধুরী ফারল্যান্ড মুজিবের সাক্ষাৎকার সম্পর্কে বলেন, ফারল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি তুলে ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী (স্বাধীনতা) এই খেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে শেখ মুজিবকে কোনাে প্রকার সাহায্য না পাবার কথা পরিষ্কার করে বলেন। ৪.৭ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এদের কারাে কথা শুনলেন না।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতার কথা তিনি ঘােষণা করলেন। সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের রূপরেখা তিনি ৭ই মার্চের ঐ জনসভায় ঘোেষণা করলেন। বললেন ঃ আমি হুকুম দিতে না পারলেও তােমরা যুদ্ধ করবে। আর গােলামী নয়—স্বাধীনতা। মুক্তির সংগ্রামে সবাই এগিয়ে আসাে।৪৯ ৪.৮ জেনারেল ইয়াকুবকে সরিয়ে টিক্কা খান এল, কিন্তু শপথ নিতে পারল না। হাইকোর্টের বিচারকগণ অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়েছেন। টিক্কা খান গভর্নর হতে পারল না। ৫. এমনি অবস্থায় ১৫ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন তিনি বাংলাদেশের বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব নিচ্ছেন এবং বেসামরিক জনজীবন পরিচালনার জন্য ৩১টি নির্দেশ জারী করেন। তিনি সেনাবাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার জন্য সংগ্রামী জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। ৫.১ একই সাথে তিন প্রাক্তন সেনাবাহিনী, ছাত্র বিগ্রেড সংগঠিত করেন এবং কর্ণেল (অবঃ) ওসমানীকে ডিফ্যাক্টো কমান্ডার ইন চীফ নিযুক্ত করেন। মুজিবের নির্দেশে কর্নেল (অবঃ) ওসমানী পুলিশ, ইপিআর, ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করতে থাকেন।৫০ ৬.
১৫ই মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকা আসেন। মুজিব পূর্বেই এই ‘অতিথিকে বিড়ম্বনা হতে বাঁচানাের জন্য ফার্মগেটের চেক পয়েন্ট তুলে নেন। প্রকাশ্যে জনতার সামনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশের একজন অতিথি হিসেবে তিনি স্বাগত জানান।৬.১ ১৬ই তারিখে মুজিব ইয়াহিয়া একান্ত আলােচনা এবং ১৭ই মার্চ আনুষ্ঠানিক পূর্ণাঙ্গ আলােচনা শুরু হয়। ঐদিন সন্ধ্যায় জেনারেল টিক্কা খানকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বললেন ঃ মুজিব সঠিক আচরণ করছে না। তুমি তৈরি হও। শুরু হয়ে যায় সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি। মেজর জেনারেল ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল খাদিম রাজা ১৮ই মার্চ ‘অপারেশন সার্চ লাইট চুড়ান্ত করে। ২০শে মার্চ জেনারেল হামিদ ও লেঃ জেঃ টিক্কা খান প্ল্যানটি অনুমােদন করে।৫২ ৬.২ এদিকে মুজিব অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রদেশগুলােতে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব পেশ করে। এমন অবস্থায় ভুট্টো এল ২১শে মার্চ। মুজিবের প্রস্তাব ভুট্টো প্রত্যাখ্যান করলাে। ২৪শে মার্চ বঙ্গবন্ধু নতুন প্রস্তাব পেশ করেন যা হলাে শাসনতান্ত্রিকভাবে পাকিস্তানকে বিভক্ত করা ।৫৩।৬.৩
২৩শে মার্চ বাংলার স্বাধীনতার পতাকা ঢাকায় সর্বত্র শােভিত হলাে। মুজিবের বাড়িতে, গাড়িতে পতাকা উড়ল । ভুট্টো-ইয়াহিয়া ২৪ শে মার্চ বৈঠকে পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষায় আর্মি একশনের বিষয়ে একমত হলেন, কিন্তু মুখে বলতে থাকেন আলোচনা চলছে। তাজুদ্দিন বললেন ঃ আমাদের আর কিছু বলার নাই। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত মেহমানগণ বিশেষ বিমান ব্যবস্থায় চলে যেতে থাকে। ৭. মেঃ জেনারেল ফরমান ও মেঃ জেনারেল খাদিম দুটি হেলিকপ্টারে ঢাকার বাইরে বিগ্রেড কমান্ডারদের নিকট এ্যাকশনের জন্য নির্দেশ পাঠাতে থাকেন। ৭.১ সন্ধ্যা সাতটায় রহস্যজনক ও প্রচণ্ড গােপনীয়তায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন যা সাথে সাথে উইং কমান্ডার এ, কে, খন্দকার বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন। দিনের আলাে নিভে এল। শুরু হলাে নিকষ কালাে বিভীষিকাময় রাত।৭.২ সন্ধ্যা সাতটায় ইয়াহিয়া খান পূর্ব নির্ধারিত ভাষণ না দিয়ে চলে যাবার সংবাদে শেখ মুজিব নেতাদের বললেনঃ তােমরা আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ঘােষণা করলেন বাংলার স্বাধীনতা। ৭.৩ যখন প্রথম গুলির শব্দ হলাে, তখন পাকিস্তান রেডিওর ওয়েভ লেন্থের পাশে শেখ মুজিবের ক্ষীণ কণ্ঠ ভেসে এল মনে হলাে এটি পূর্ব রেকর্ড কৃত। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রূপে ঘােষণা। করেন।৭.৪ ঘােষণায় বঙ্গবন্ধু বললেনঃ “পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত পিলখানার ইপিআর ঘাটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লােকদের হত্যা করছে। ঢাকা চট্টগ্রামের রাস্তায় যুদ্ধ চলছে।
আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য শক্রদের সাথে যুদ্ধ করছে। সর্ব শক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্ত বিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গলরেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনাে আপােষ নাই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লােকদের এ সংবাদ পেীছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’৭.৫ লে, ক, জেড এ খান এবং কোম্পানি কমান্ডার মেজর বেলাল পঞ্চাশ জন। কমান্ডাে সৈন্যকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। গােলাগুলির ভেতর বঙ্গবন্ধু বেরিয়ে এলেন। বললেন, “থামাও গুলি। কি চাও তােমরা?” তাকে গ্রেফতার করে সেকেন্ড ক্যাপিটালে (শেরেবাংলা নগর) নিয়ে যাওয়া হলাে।
পর দিন তাকে ফ্লাগ স্টাফ হাউসে রাখা হলাে এবং তিন দিন পর ঐখান থেকে সরাসরি করাচী পাঠিয়ে দেয়া হলাে ।৫৫৭.৬ ২৬শে মার্চ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভাষণ দিলেন। বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযােগ আন্দোলন ছিল দেশদ্রোহিতামূলক। সে এবং তার দল তিন সপ্তাহব্যাপী আইনানুগ কর্তৃপক্ষকে অস্বীকার করেছে। তারা পাকিস্তানী পতাকা ও জাতির পিতার ছবির অবমাননা করে এবং সমান্তরাল (বিকল্প) সরকার পরিচালনা করেছে। তারা গণ্ডগোল, সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। সে যে ঘােষণাসমূহের প্রস্তাব করেছিল তা ছিল শুধুমাত্র ফাঁদ। তার জানা ছিল সামরিক আইন। প্রত্যাহার করা হলে এগুলাে শুধুমাত্র কাগুজে ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে, প্রকৃতপক্ষে তখন সে পূর্ণভাবে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করত। তার ঔদ্ধত্য, একগুয়েমিতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন উপলব্ধির আচরণ একটি শর্তই পূরণ করে আর তা হলাে ঐ ব্যক্তি (মুজিব) ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু। এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানকে সার্বিকভাবে পাকিস্তান হতে পৃথক করতে চায়। এই অপরাধ ‘উইল নট গাে আনপানিশড়।৬৮. বঙ্গোপসাগরের লােনা জলে ঝড়ো হাওয়া। বাংলার আকাশে ঘন কালাে মেঘ—শ্যামল হৃদয় রক্তে লাল। পদ্মা যমুনার সবুজ প্রান্তর ছড়িয়ে দুইহাজার কিলােমিটার দূরে লায়ালপুরের এক নির্জন নিঃসঙ্গ সেলে বন্দি শেখ মুজিব। ৮.১ ৩রা আগস্ট, ১৯৭১। পাকিস্তান টেলিভিশন কেন্দ্রে জেনারেল ইয়াহিয়ার ছবি-সাক্ষাঙ্কার প্রচারিত হলাে। ইয়াহিয়া খান বললেন, শেখ মুজিবের বিচার হবে—কেননা তিনি পূর্বপাকিস্তানকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। সে দেশদ্রোহী ও প্রকাশ্য বিদ্রোহী।৮.২ ৯ই আগস্ট, ১৯৭১। সরকারি প্রেসনােটে বলা হলাে, শেখ মুজিবকে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। কেননা সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে। প্রেসনােটে আরাে বলা হলাে, বিচার ১১ই আগস্ট শুরু হবে, বিচার ক্যামেরায় হবে এবং কার্যধারা গােপন থাকবে। ৮.৩ ১০ই আগস্ট, ১৯৭১।
জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল-এর বিবৃতির জবাবে পাকিস্তান সরকার পাল্টা এক বিবৃতিতে বললেন ঃ শেখ মুজিবের বিচার পাকিস্তানী সীমানার বাইরে প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। ৮.৪ ৩০ আগস্ট, ১৯৭১। পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা শাহী জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টকে জানান যে, আগামী দুই সপ্তাহের ভেতর শেখ মুজিবের বিচার সমাপ্ত হবে। ৮.৫ ৩১শে আগস্ট, ১৯৭১। বন থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে৫৭ বলা হয়, অবশ্যই শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেয়া হবে। বিশেষ সামরিক আদালতে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শফি ইতিমধ্যে জ্ঞাত হয়েছেন যে, শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়া হবে। । ৮.৬
১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।প্যারিসের লা ফিগারাে পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বললেন, মুজিব পাকিস্তানের শত্রু। ৮.৭ ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর থেকে জারীকৃত এক প্রেসনােটে বলা হয় যে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার জন্য বিশেষ সামরিক আদালতে আগস্ট ১১ তারিখ থেকে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়েছে। আসামী শেখ মুজিবের পক্ষে রাষ্ট্র এ.কে, ব্রোহীকে আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। এ পর্যন্ত বিশ জনের সাক্ষ্য গৃহীত হয়েছে। বিচার কার্য চলছে। যথাসময়ে জনসাধারণকে মামলার অগ্রগতি অবগত করানাে হবে। ৮.৮ ২০শে অক্টোবর, ১৯৭১। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ফ্রান্সের ল ম্যান্ড পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, যেখানে রাষ্ট্রের সংহতি বিপন্ন হবার হুমকির প্রশ্ন জড়িত সেখানে। বিচার কার্য এভাবে পরিচালনা অস্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, আমি একজন (মুজিব) বিদ্রোহীর সঙ্গে কথা বলতে পারি না।৮.৯ ৮ই নভেম্বর, ১৯৭১।
নিউজ উইক পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বলেন, শেখ মুজিব স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত করে। আমার নিকট বিদ্রোহীদের দমন ব্যতীত অন্য কোনাে বিকল্প নেই। তার সঙ্গে কিভাবে আমি কথা বলতে পারি যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা ও সেনাবাহিনীর অনুগত্য বিপন্ন করার। অভিযােগ রয়েছে। আমি প্রথমে তাকে গুলি করে তারপর বিচার করছি।। আমি তাকে ছাড়তে পারি না। ৮.১০
১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।ন্যাশনাল প্রেস ট্রাস্টের উর্দু পত্রিকা ইমরােজ-এর বরাত দিয়ে লাহাের থেকে রয়টার জানায় যে, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযােগের তদন্ত সমাপ্ত হয়েছে এবং তা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট শীঘ্রই পেশ করা হচ্ছে। ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১। করাচী হতে এ. এফ. পির সংবাদদাতা তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে জানায় যে শেখ মুজিবের বিচার এখনাে চলছে। লায়ালপুরে শেখ মুজিবের যেখানে বিচার কার্য চলছে সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গত মাস থেকে আরাে কঠোর ও জোরদার করা হয়েছে। ১৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১। ইউ.পি. আই ইসলামাবাদ থেকে জানায় যে সরকারি মুখপাত্র বলেছে যে বিচার কার্য সমাপ্ত হয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত রায় প্রদত্ত হয়নি। মুখপাত্র আরাে বলেছে যে শীঘ্র রায় ঘােষিত হবে অথবা এ মাসের শেষ পর্যায়েওতা হতে পারে। ৮.১৩।২২শে ডিসেম্বর, ১৯৭১। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় শেখ মুজিবুর রহমানকে কারগার হতেসরিয়ে একটি গৃহে আটক করা হয়েছে। ৮.১৪ ২৫শে মার্চের রাতে গ্রেফতার হওয়া থেকে শুরু করে ইয়াহিয়া খানের তথাকথিতবিচার সম্পর্কে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকারটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য।৫৮ ডেভিড ফ্রস্ট : ওরা ঠিক কখন আপনাকে গ্রেফতার করে? সময়টা কি রাত দেড়টা? শেখ মুজিব : ঘটনার সূত্রপাত মেশিনগানের বৃষ্টি দিয়ে।
আমার বাড়িরচারিদিকে অবিরাম আগ্নেয় বৃষ্টি … ফ্রস্ট ; পাক বাহিনী যখন আপনার বাড়িতে পৌঁছে তখন আপনি কোথায়ছিলেন?শেখ মুজিব : আমি শােবার ঘরে বসেছিলাম। চারদিক থেকে অগ্নিবৃষ্টি হতেথাকে। আগুনের ফুলকির মতাে জানালা দিয়ে গুলি ঢুকে ঘরেরএক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যায়। ফ্র: তাহলেতেতাহলেতাে ঘরের সব কিছুই বিনষ্ট হয়? শেখ মুজিব : তাতাে স্বাভাবিক। আমি আমার পরিবারের সাথে ছিলাম। হঠাৎএকটা বুলেট এসে আমার শােবার ঘরে ঢােকে …; পাকিস্তান বাহিনী কোন পথে এখানে ঢোকে। শেখ মুজিব : এমনিতাে সারা বাড়ি ঘিরে রেখেছিল। তারপর ঘরের জানালালক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ চলছিল। এই অবস্থায় আমি আমার স্ত্রীকে সন্তানদের কাছে থাকতে বলি এবং এদের রেখে ঐ ঘরপরিত্যাগ করি। ফ্রন্ট ; আসার পথে আপনার স্ত্রী কি আপনাকে কিছু বলেছিলেন? শেখ মুজিব : না। ঘটনার অকস্মিকতায় সে হতবাক। আমি শুধু তাকে বিদায়চুম্বন দেই। তারপর কপাটের অর্গল খুলে বের হয়ে এসে গুলি থামাতে বলি, “আমি এখানে, তােমরা গুলি বন্ধ কর। আমি জানতে চাই কিসের জন্য এবং কেনই বা গােলাগুলি করছ?” আমার কথা তাদের কানে যেতেই আরাে বিপুল উদ্যোগে অগ্নিবান নিক্ষেপ হতে থাকে এবং কয়েক জন এসে আমাকে ঘিরে ফেলে। আমার উপর বেয়নেট ধরে। একজন অফিসার আমাকে চেপে ধরে বলেন, “একে মেরাে না”।মাত্র একজন অফিসার। শেখ মুজিব : মাত্র একজন। আমার পিঠে এবং সামনে উভয় দিকে অস্ত্র দিয়েগুতােতে থাকে এবং তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী এদিক ওদিক ঠেলে নিয়ে যেতে থাকে। অফিসারটি আমাকে ধরে রেখেছিল, তবু তারা আমাকে বিশ্রীভাবে নিচের দিকে ঠেলেছিল।
আমি তখন তাদের বলি, এভাবে ঠেলবে না, একটু দাঁড়াও, আমি আমার পাইপটি নিয়ে আসি। পাইপ আর তামাক আমার খুব প্রিয় প্রয়ােজনীয়। আমার স্ত্রীর কাছে থেকে ওগুলাে আনার অনুমতি দাও। আমাকে ওরা উপরে যেতে দেয়। আমার স্ত্রীকে বাচ্চা দুটোর সাথে দাঁড়ানাে অবস্থায় চোখে পড়ে। ওরা আমাকে পাইপ আর একটা ছােট স্যুটকেস এনে দেয়। আমি নিঃশব্দে আসি। আমার দৃষ্টিসীমার চারদিকেজুড়ে ছিল একরাশ আগুনের লেলিহান শিখা, উষ্ণ লাভার মতাে। ফ্রন্ট : আপনিতাে তাদের চোখে অপরাধী; আপনার বিচার কিভাবে করাহয়? শেখ মুজিব : আমার বিচারের জন্য পাঁচ জন সামরিক অফিসারের সাথে সবঅসামরিক অফিসার মিলে আমার বিরুদ্ধে সামরিক আইনেরব্যবস্থা নিতে চেয়েছিল।ফ্রন্ট: আপনার বিরুদ্ধে তাদের অভিযোেগ? শেখ মুজিব : রাজদ্রোহের। পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধঘােষণা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে১২টা অভিযােগ। তার মধ্যে ছয়টার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ফ্রস্ট আপনি কি আত্মপক্ষ সমর্থন করেছিলেন? শেখ মুজিব : বিচারের বাণী যেখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদে সেখানে আত্মপক্ষসমর্থনের সুযােগ দেয়ার মানে ভাওতার আশ্রয় নেয়া। পাকিস্তান সরকার যেখানে আমার বিচার করতে বদ্ধপরিকর সেখানে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ কোথায়? কোর্টে নেয়ার পর আমি কোর্টের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একজন আইনজ্ঞ নিয়ােগের অনুমতি প্রার্থনা করি। কেননা আমি একজন অসামরিক ব্যক্তি। একজন অসামরিক ব্যক্তির বিচার সামরিক আদালতে কখনও হতে পারে না, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান ইয়াহিয়া খান শুধুমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান নন, প্রধান সামরিক আইন শাসকও। কাজেই সামরিক আদালত ডাকার ক্ষমতা একমাত্র তারই। তাছাড়া সবাইজানে বিচারের নামে একটা প্রহসন চলছিল। : তাহলে কি আপনার বিচারে শাস্তির সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ছিল ইয়াহিয়া খানের।
শেখ মুজিব : হ্যা, তিনি ছিলেন সিদ্ধান্তদাতা। ফ্রস্ট : তারা কি যথাযথ রায় দিতে সক্ষম হয়েছিল? শেখ মুজিব : ডিসেম্বর মাসে চারদিন কোর্ট মুলতবী ঘােষণা করে ইয়াহিয়া খানসব বিচারক, লেঃ কর্ণেল, ব্রিগেডিয়ার সবাইকে নিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে বিচারের রায় কি হবে সে সম্বন্ধে তার মতামত ব্যক্ত করেন। সর্বসম্মতিক্রমেআমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফ্রস্ট : আপনি কি তখন আপনার পাশের সেলে আপনার কবর আবিষ্কার করেন? শেখ মুজিব : হ্যা আমার সেলের খুব কাছেই আমার কবর খোঁড়া হয়।কবরটাকে স্বচোখে দেখেছি। ফ্রস্ট ; ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার জন্য নিতে আসে তখনজেল প্রশাসক আপনাকে লুকিয়ে রেখেছিলেন বলে আমি খবরেরকাগজে পড়েছি। তথ্যটা কি সঠিক? শেখ মুজিব : ইয়াহিয়া খানের সাগরেদরা জেলের ভেতর একটা তুলকালামকাণ্ড বাঁধিয়ে ফেলেছিলেন। কিছু কয়েদিকে আমার বিরুদ্ধেক্ষেপিয়ে তােলা হয়েছিল। খুব ভােরে আমাকে আক্রমণ করে। হত্যা করার একটি পরিকল্পনা আঁটা হয়েছিল, কিন্তু জেলের একজন অফিসার আমার প্রতি বেশ সদয় ছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের জেলে আসার দিনক্ষণ সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখতেন। একদিন রাত ৩টার সময় তিনি আমাকে কারাগারের বাইরে নিয়ে এসে তার বাংলােয় আমাকে মিলিটারি পাহারা ছাড়াই লুকিয়ে রাখেন। দুই দিন পর আমাকে ঐ বাংলাে থেকে সরিয়ে রাখেন। সেখানে তিনি আমাকে চার-পাঁচ কিংবা ছয় দিন লুকিয়ে রাখেন। কেউ আমার অবস্থান জানতাে না। জেলের কয়েক জন গরিবঅফিসার শুধু আমার সন্ধান জানতাে। : ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে ভুমার হাতে তুলে দেন তখন তিনিআপনাকে আবার ফাসি দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন—এটা কি সত্য?
শেখ মুজিব : নির্ভেজাল সত্য। এ প্রসঙ্গে মিঃ ভুট্টো আমাকে একটা মজার গল্পবলেছিলেন। ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় ইয়াহিয়া খান মিঃ ভুয়োকে বলেছিলেন, “শেখ মুজিবকে হত্যা না করে আমি একটি বিরাট ভুল করে ফেলেছি।”ফ্রন্ট: ইয়াহিয়া খান কি ঠিক এ কথাই বলেছিলেন? শেখ মুজিব : হ্যা, ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে বলেছিলেন ঃ ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে মুজিবকে হত্যার অনুমতি দিন। তিনি আরাে বলেছিলেন ঃ দিন তারিখ পিছিয়ে দিন, ক্ষতি নেই। কিন্তু দয়া করে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দিন। কিন্তু ভুঠোমত দেননি। প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করেছেন। : এর জবাবে ভুট্টো কি বলেছিলেন তা কি তিনি আপনাকে বলেছিলেন? শেখ মুজিব : হ্যা, ভুট্টো বলেছিলেন, তিনি তা পারেন না, কারণ এর প্রতিক্রিয়াসুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। এক লক্ষ বিশ হাজার সৈন্য এবং বেসামরিক ব্যক্তি তখন বাংলাদেশে বন্দি, বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কজায় তারা দিন কাটাচ্ছে। এ ছাড়া পাঁচ থেকে দশ লক্ষ অবাঙালির অবস্থান বাংলাদেশে। এ অবস্থায় শেখ মুজিবকে যদি হত্যা করা হয় এবং আমি যদি ক্ষমতা দখল করি তাহলে বাংলাদেশ থেকে একজন পাকিস্তানীও পশ্চিম পাকিস্তানে আর কোনােদিন ফিরে আসতে পারবে না। এরা ফেরৎ না এলে পশ্চিম পাকিস্তানে মারাত্মকপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং আমার অবস্থাও শােচনীয় হবে। মৃত্যুর কালাে গহবর থেকে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন… মুজিব হত্যার দ্বিতীয় পর্যায় ব্যর্থ হলাে।    

সূত্রঃ ফ্যাক্টস্ এন্ড ডকুমেন্টস্  বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড  অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!