বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৭ই ডিসেম্বর, শুক্রবার, ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
গণতন্ত্রের অতন্দ্র সাধকের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হবে
অত্যন্ত গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ ও যথোপযুক্ত মর্যাদার সাথে গত পরশু বাংলাদেশের সর্বত্র গণতন্ত্রের অতন্দ্র সাধক ও বাংলার সংগ্রামী চেতনার দুরন্ত সূর্য সন্তান জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দশম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে। বিশেষ করে, রাজধানী ঢাকায় এমন স্মৃতি ব্যাথাবিজড়িত দিনটি পালনে বিশেষ পূণ্য গাম্ভীর্য্য পরিলক্ষিত হয়। রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্পীকার জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ সহ মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা পুরানো হাইকোর্টস্থ সোহরাওয়ার্দীর মাজারে গিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও পুষ্প-স্তবক অর্পণ করেন এবং ফাতেহা পাঠ করেন। উপমহাদেশের রাজনীতি অংগনে জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দী একজন ব্যতিক্রম ও প্রথম শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ছিলেন। এদিক থেকে তাকে অনায়াসেই যুগস্রষ্টাও বলা হতো।
তার দীর্ঘ কর্মময় জীবন সমগ্র বাঙ্গালীদের জন্য ছিল এক অমূল্য সম্পদ। তার দুর্বার, অবিরাম ও আপোষহীন সংগ্রাম ছিল শোষণ, ঔপনিবেশিক শাসন ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে এবং এ ক্ষেত্রে তিনি তার সম্পূর্ণ শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন দেশের জনসাধারণ ও আইনের বিচার থেকে। তার অটুট চারিত্রিক বলিষ্ঠতার মধ্যে একটি অন্যতম গুণ ছিল এই যে, সংকীর্ণ লোভ-লালসা তাকে কোনদিনও কাবু করতে পারেনি বরং তিনি যে কোন অবস্থাতেই অত্যন্ত দৃঢ় চিত্তে সব রকমের প্রভাবকেই বর্জন করেছেন।
তার আর একটি গুণ ছিল এই যে, তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছ ক্যানভাসের ওপর রাজনীতি করতেন বা করার পক্ষপাতী ছিলেন। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, রাজনৈতিক কারচুপী, রাজনৈতিক শঠতা এর সবই তিনি পরিষ্কার বর্জন করতেন এবং অন্যান্যকেও তিনি বর্জন করতে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন। দেশ বিভাগের সামান্য পূর্ববর্তী কালে তিনি যখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন তার ক্ষিপ্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফলে যে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির এক জঘন্যতম চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন জীবন লাভ করে তা আজো সবার স্মৃতির ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
জনাব সোহরাওয়ার্দীয আজীবনই রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে এক জঘণ্য ও ঘৃণ্য পদ্ধতি বলে এর বিরুদ্ধে চিরকালই সোচ্চার ছিলেন৷ বিরাট প্রগতিশীল অন্তরের অধিকারী মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আজ শুধু একটি নাম নয়, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জীবনে একটি উজ্জ্বল আদর্শ জ্যোতিষ্ক। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দীর্ঘকাল একই সঙ্গে বাংলার মানুষের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য আপোষহীন সংগ্রাম করে এসেছেন। এই উভয় নেতার চিন্তাধারার মধ্যে এতো সাদৃশ্য সচরাচর আর অন্য কোনো দু’জন মানুষের মধ্যে দেখা যায় না। বিশেষ করে, রাজনীতি যে মানুষের উপকারের জন্যই করতে হয়, ক্ষমতা দখলের বা গদির জন্য নয়— বঙ্গবন্ধু ও জনাব সোহরাওয়ার্দী এই উভয় নেতাই আজীবন ঠিক একই নীতি অনুসরণ করে এসেছেন।
জনাব সোহরাওয়ার্দী শুধুমাত্র রাজনীতিকই ছিলেন না। রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। তার অপূর্ব সংগঠনী ক্ষমতা অনুকরণ করে যে কেউই উন্নতির চরম শিখরে সমাসীন হতে পারে। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই সত্য, তবে তার আদর্শ ও নেতৃত্ব আজো আমাদের সবার মানসপটে দীপ্তকরোজ্জল হয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছেন যে, নেতার আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে পারলেই তার প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সফল হবে। তিনি যে শোষণহীন সমাজের এক গণতান্ত্রিক রূপরেখার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারই চরম বাস্তবায়ন করার মরণ প্রতিজ্ঞা আমরা নিয়েছি আমাদের সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের মাধ্যমে। গণতন্ত্রের স্বরূপ সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অটল থাকা এবং জাতীয়তাবাদে’র আদর্শে নিজেদেরকে অনুপ্রাণিত করার শিক্ষাই আমাদের আজকের দিনে গ্রহণ করতে হবে এবং এই হবে মরহুমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সর্বোত্তম পন্থা।
হাট-বাজারের উন্নয়ন প্রসঙ্গে
সম্প্রতি সরকার প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। পরিকল্পনীয় গ্রাম্য হাট বাজার উন্নয়নের জন্যে বিশ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে শর্ত রয়েছে যে, হাট-বাজার থেকে আয়কৃত টাকার এক-তৃতীয়াংশও এই উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হবে। ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত একটি সংবাদ সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে আরো উল্লেখ করেছেন যে, দেশের প্রায় ছ’হাজার ছ-শ’ বড় বড় বাজারের পরিচালনার দায়িত্ব সরকার হাতে নেবেন। এবং তিন হাজার তিনশ বাজার ইউনিয়ন ও পৌরসভাকে পরিচালনা করতে হবে। রাজস্ব মন্ত্রী বাজার তৈরি ও সম্প্রসারণের ব্যাপারে সরকারি পরিকল্পনার কথাও ব্যক্ত করেছেন। তাতে বাজারের উন্নয়নের জন্যে বাজারসমূহ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে।
বাজারের মধ্যকার গলি-উপগলির উন্নয়ন, মাছের ও সব্জীর বাজারে চালা ঘরের ব্যবস্থা, টিউবওয়েল স্থাপন ও পাকা পায়খানারও ব্যবস্থা করা হবে। বাজারের সঙ্গে যে সকল রাস্তাঘাটের সংযোগ রয়েছে তার উন্নয়ন সাধনও করা হবে। দূর-দূরান্ত থেকে আগত ব্যবসায়ীদের জন্যে সরাই খানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত সরকারের রয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সরাইখানা নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে গেছে। পাকিস্তানী আমলে হাট-বাজার থেকে মাসে আয় হতো এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকারের নয়া বাজার নীতি ঘোষণার পর এবং বিভিন্ন প্রকার কর মওকুফ করার পরও গত বছরের এক মাসে আয় হয়েছে এক কোটি ছাব্বিশ লাখ টাকা। স্বভাবতই তাই অনুমেয় যে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে হাট-বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে হাট-বাজারের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সরকারের একটি আবশ্যকীয় কর্তব্য। এ ব্যাপারে সরকারী পদক্ষেপকে আমরা অভিনন্দিত করি। দেশের অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী হাট-বাজার আজ নানা প্রতিকূল কারণে বিনস্ট হয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেও অসংখ্য হাট-বাজার দখলদার বাহিনী ও তাদের দেশীয় দালালরা পুড়িয়ে ছারখারা করে দিয়ে গেছে।
তার পুনর্নির্মাণ করা আজ আবশ্যক। এতোকাল গ্রাম্য হাট-বাজারগুলোর প্রতি মোটেই লক্ষ্য দেয়া হয়নি। এতোকাল কোন বিশেষ অঞ্চলের মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই হাট বা বাজারের জন্ম হয়েছিল। যার দরুন কোন পরিকল্পনা বা উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বাজার গড়ে উঠছে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত রাস্তাঘাট-নদী-নালা বা নিরাপত্তা ইত্যাদির মতো আবশ্যকীয় বিষয়গুলোর বিবেচনা যে একান্ত প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রেই অতীতে তা করা হয়নি। অথচ বাজারের সঙ্গে নদী-নালার সংযোগ ও রাস্তাঘাটের সংযোগ একান্ত আবশ্যক। এবং বাজারের উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই ওগুলোরও উন্নয়ন করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে হাট বা বাজারের মধ্যকার ড্রেন ব্যবস্থার উন্নয়ন, পায়খানা প্রসাব খানার উন্নয়ন ইত্যাদিও অত্যাবশ্যক। মাছের বাজার বা মাংসের বাজারের মতো জায়গাগুলোর উন্নতি বা ঘেরাবস্থায় থাকা প্রয়োজন। পূর্বে গ্রাম অঞ্চলের প্রভাবশালী মানুষের খেয়াল-খুশি মতো হাট-বাজারের স্থান নির্বাচিত হতো।
এটা কোনমতেই আজ গ্রহণযোগ্য নয়। অঞ্চলের মানুষের সুযোগ-সুবিধা ও তৎসঙ্গে অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলেই তবে বাজারের বা হাটের স্থান নির্বাচিত হতে পারে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে প্রভাবশালী ব্যক্তির খেয়ালখুশির উর্ধে থেকে জনগণের সার্বিক সুবিধার্থে কাজ করতে হবে। গ্রাম অঞ্চলের হাট-বাজারে আজ নিরাপত্তার অভাব একটি বড় দিক। হাট বাজারে লুটের সংবাদও আজকাল বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকার নিরাপত্তার দিকটিও চিন্তা করবেন। হাট-বাজারের উন্নতি সাধন হলে দেশে অসংখ্য মানুষ উপকৃত হবে বলে আমরা মনে করি। সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে ইজারাদারদের কবল-মুক্ত করে যেন আমরা নতুন কোন শ্রেণীর হাতে হাট-বাজারের উপর দন্ডমুন্ডর ভার না দেই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক