You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ
এম এ ওয়াজেদ মিয়া

প্রথম পরিচ্ছেদ ১৯৬১-১৯৬২ সাল
১।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আমি বিশেষভাবে জেনেছি ১৯৫২ সালে। তখন আমি রংপুর সরকারী বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা শেষ করে পীরগঞ্জ উপজেলায় (তৎকালীন থানা) অবস্থিত উচ্চ বিদ্যালয়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় প্রথম তাঁর সম্পর্কে কিছু কিছু জানতে পারি। পীরগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেখানকার দুই যুবক যাঁরা তখন কলেজে পড়তেন, তাঁরা মাঝে মাঝে পীরগঞ্জ বেড়াতে এলে শেখ মুজিব সম্পর্কে কথা বলতেন। ঐ দু’জনের একজন কাজী আব্দুল হালিম আর অপরজন এম. মতিউর রহমান। পরবর্তীতে কাজী আব্দুল হালিম পীরগঞ্জ উপজেলার বহু বছর ন্যাপের সভাপতি ছিলেন এবং মতিউর রহমান পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত হন ও জুলাই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীপরিষদের সদস্য হন।
২। আমি ১৯৫২ সালের জুলাই মাসে রংপুর জিলা স্কুলে ভর্তি হই। বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে থাকতাম। রংপুর জেলায় জিলা স্কুল (Zilla School) ও রংপুর কারমাইকেল কলেজ ভবন দু’টি অত্যন্ত ভাবগম্ভীর ভবন ও শিক্ষার কেন্দ্রস্থল ছিল। আমাদের বিদ্যালয়টি প্রায় ষাট-সত্তর একর জমির মাঝখানে অবস্থিত। এর সামনে বাগান, তারপর দুটি ফুটবল ও একটি হকি খেলার মাঠ। এরপর প্রধান প্রবেশ পথ। মাঠটি চওড়া প্রায় আধা কিলোমিটার। আমাদের স্কুল গ্রাউন্ডের পূর্ব পাশে অবস্থিত সরকারী ট্রেজারী, পুলিশ সুপারিটেন্ডেটের দফতর, জেলা প্রশাসকের দফতর ও ফৌজদারী কোর্ট ভবন। ১৯৫২ সাল ছিল ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের বছর। কারমাইকেল কলেজের ছাত্ররাই বেশীরভাগ ঐ সময় আন্দোলনে জড়িত ছিলো। স্কুলগুলোতে, বিশেষ করে রংপুর (Zilla School)-এর ছাত্ররা রাজনীতির সঙ্গে বিশেষ জড়িত ছিলো না। কোনদিন হরতালও হয় নি। তবে দু’একদিন কিছু যুবককে দেখতাম বিদ্যালয়ের প্রধান গেটে হরতালের সময় দাঁড়িয়ে থাকতে, কিন্তু তাঁরা স্কুলে প্রবেশ করতেন না বলে লেখাপড়া বিঘ্নিত হত না।
৩। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরের দিকে একদিন লক্ষ্য করি ফৌজদারী কোর্ট থেকে পুলিশ একটি যুবককে হাতকড়া লাগিয়ে আমাদের স্কুল প্রাঙ্গণের পায়ে হাঁটার পথে জেলখানার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। রংপুর জেলখানা আমাদের বিদ্যালয় থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। কাছে গিয়ে দেখি এই যুবক পীরগঞ্জের সেই কাজী আব্দুল হালিম। দেখে আমার কান্না পেল এই ভেবে যে, স্বাধীন দেশে একটি কলেজের ছাত্রকে হাতকড়া লাগিয়ে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার রাস্তা হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, পুলিশ কি তাঁকে অন্তত রিক্সায় নিয়ে যেতে পারতো না? স্বাধীন দেশের একটি কলেজের ছাত্রের প্রতি এই অশোভন আচরণ দেখে আমি বিস্মিত হই। পরবর্তীতে তাঁর পীরগঞ্জের বাড়ীতে গেলে আমি এই ঘটনা তাঁকে প্রায়ই বলতাম। তিনি সেই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলতেন, “ছোট ভাই, এই অপমান তো কিছুই নয়। বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণের বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাংলার মানুষের ওপর আরও কত অপমান ও নির্যাতন নেমে আসবে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন।” তিনি ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে শেখ মুজিবের অবদান ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু বলতেন।
৪। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পাস করার পূর্ব পর্যন্ত রাজনীতি সম্পর্কে বিশেষ চিন্তা ভাবনা করিনি। ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর রাজশাহী সরকারী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই এবং দু’বছর পড়াশুনা করি। আমি ক্লাসে প্রথম হতাম বলে সহপাঠীরা আমাকে ভীষণ ভালবাসত আর শিক্ষকরা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। কলেজে রাজনীতি নিয়ে কোন কথাবার্তা শুনিনি এবং হরতালও হতে দেখি নি। তবে স্নাতক স্তরের ছাত্রছাত্রীরা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করত এবং কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ নির্বাচনে গ্রুপ অথবা দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হত। আমরা ইন্টারমেডিয়েট স্তরের ছেলেমেয়েরা একটি ডিবেটিং ক্লাব পরিচালনা করতাম এবং মাসে অন্তত দু’টি বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। একবারের নির্বাচনের কথা মনে পড়ে। ঐ সময় স্নাতক স্তরের যুবক আনোয়ার জাহিদ কলেজ সংসদের সহ-সভাপতি পদের প্রার্থী হিসেবে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তাঁর মাথায় ছিল রক্তমাখা ব্যান্ডেজ এবং তিনি তাঁর বক্তব্যে রাজনৈতিক বিষয় প্রসঙ্গে অনেক কথাবার্তা বললেন এবং শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ নেতাদের জাতীয় আন্দোলন ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অবদানের কথা উল্লেখ করলেন। এই আনোয়ার জাহিদ পরবর্তীতে একজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
৫। ১৯৫৮ সালে Intermediate Science কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে Physics-এর অনার্স ক্লাশে ভর্তি হই এবং তৎকালীন ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে স্থান পাই। তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতির কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহ ছিল না এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্র বা অন্য কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম না। স্মর্তব্য যে, ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা গ্রহণ করে সারা পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকান্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। শেখ মুজিবসহ অনেক রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছিল৷ কাজেই ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্তিমিত ছিল। ১৯৬০-এর শেষের দিকে শোনা যায় যে, জেনারেল আইয়ুব খান Basic Democracy নামে রাজনৈতিক পদ্ধতি চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঐ Basic Democracy-এর আওতায় কেবল ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য চেয়ারম্যানগণ রাষ্ট্রের কার্যনির্বাহী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। আইয়ুব খানের ঐ অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তুতির খবর শুনে আমার বিবেক প্রতিবাদ করে ওঠে এবং তার ফলে আমি ছাত্র রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। অতঃপর ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে শেখ মুজিবের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আমি ছাত্রলীগে যোগদান করি। ৬। তৎকালীন আইয়ুব খানের সামরিক সরকার ১৯৫৯ সালের অক্টোবর মাসের দিকে ছাত্র রাজনীতির অনুমতি প্রদান করে। যুগপৎ বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোর ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রদান করা হয়। তখন ফজলুল হক হলটি ছিল ছাত্র ইউনিয়নের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। ঢাকা হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল, ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক) ছিল ছাত্র ইউনিয়নের ঘাঁটি। এস এম হলটি ছিল জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। তখন বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের বেশ সমর্থক থাকলেও কোন হলেই তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল না। ১৯৬০-এর অক্টোবর মাসের দিকে ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যৌথভাবে নির্বাচন করার জল্পনা-কল্পনা চলছিলো। ঢাকা হল ও ইকবাল হলেও অনুরূপ চেষ্টা চালানো হয়েছিলো বলে আমি শুনেছিলাম। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন ফজলুল হক হলের একটি রুমে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের মধ্যে একটি যৌথ সভা আয়োজন করা হয় । ফজলুল হক মুসলিম হলের আমার বিশিষ্ট ও অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব আব্দুর রব উক্ত সভায় আমাকে উপস্থিত থাকতে বলে। আমি যথাসময়ে সভায় উপস্থিত হই এবং দেখি ছাত্রলীগের কিংবা ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতারা অনুপস্থিত। ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগের একজন বিশিষ্ট সমর্থক ও অর্থনীতির এম.এ ক্লাসের শেষ বর্ষের ছাত্র জনাব মীর্জা আজিজকে সভাপতি করে সভার কার্য যথাসময়ে শুরু হয়। ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে এম.এ শেষ বর্ষের এবং মীর্জা আজিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব এরশাদুল হক মোল্লা এবং ইংরেজী ৩য় বর্ষের ছাত্র ও আমার সমসাময়িক জনাব আনোয়ার আনসারী খান উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন। ছাত্র ফেডারেশনের বক্তারা সবায় জনাব হোসেন সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দর্শন ও আদর্শের প্রতি সমর্থন জানায়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমার সমসাময়িক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুর রব, জনাব ইসহাক তালুকদার ও সিরাজুল আলম খান এবং প্রথম বর্ষের আব্দুর রাজ্জাক শহিদুল হক মুন্সী উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন। এই সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশন যৌথভাবে ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এতদুদ্দেশ্যে এরশাদুল হক মোল্লাকে সভাপতি, আমাকে কোষাধ্যক্ষ এবং আব্দুর রবকে সেক্রেটারি করে একটি সাত সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচনী সাংগঠনিক ও প্রচারণা কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটিকে হলের নির্বাচনের প্রার্থীদের মনোনয়ন করার ক্ষমতাও প্রদান করা হয়। নির্বাচনী কমিটি জনাব মির্জা আজিজকে ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহ-সভাপতির প্রার্থী এবং আরও দশজনকে অন্যান্য পদের প্রার্থী মনোনীত করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ প্যানেল প্রস্তুত ও অনুমোদন করে। নির্বাচন প্রচার অভিযানে আইয়ুব খানের অগণতান্ত্রিক বেসিক ডেমোক্রেসির বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখা হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়। তখন পর্যন্ত শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার দেখা হয় নি। উক্ত ছাত্র নির্বাচনে একমাত্র ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ প্যানেল সম্পূর্ণভাবে বিজয়ী হয়।
৭। ১৯৬১ সালের জুলাই মাসের দিকে জেনারেল আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেটিক রাজনীতির রূপরেখা প্রকাশ করে। তখন আমার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব আব্দুর রব, জনাব ইসহাক তালুকদার, জনাব এনায়েতুর রহমান এবং আমি বিকেলে রমনা পার্কে বেড়াতে গিয়ে একান্ত জনশূণ্য জায়গায় বসে আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেটিক পদ্ধতির দোষত্রুটি, অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি এবং স্বৈরাচারী দিকগুলো নিয়ে আলাপ করতাম। একদিন সাব্যস্ত করা হয় যে, ফজলুল হক মুসলিম হলের পরবর্তী ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ এককভাবে ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্র ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এও সিদ্ধান্ত হয় যে, আমাকে সহ-সভাপতির এবং জনাব আব্দুর রবকে সাধারণ সম্পাদকের প্রার্থী হতে হবে। আমি প্রথম প্রথম এ ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করিনি। আমি পক্ষান্তরে ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের তৎকালীন সহ-সভাপতি মির্জা আজিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব এরশাদুল হক মোল্লাকে সহ-সভাপতির পদে মনোনয়ন দানের জন্য সুপারিশ করি। কিন্তু আমার উপরোল্লিখিত ছাত্রলীগের বন্ধুগণ আমার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধীতা করে। আমার প্রস্তাবের বিরোধিতার কারণ হিসেবে তারা আমাকে জানায় যে, জনাব এরশাদুল হক মোল্লা গোপনে তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংসদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারা আরো বলে যে, জনাব এরশাদুল হক মোল্লা আইয়ুব খানের প্রস্তাবিত বেসিক ডেমোক্রেটিক পদ্ধতির প্রতি সমর্থন জানাবে এবং জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবের রাজনীতির বিরুদ্ধে গোপনে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করবে। সুতরাং জনাব এরশাদুল হক মোল্লাকে সহ-সভাপতির প্রার্থী হিসেবে
Unicoded by Arbina Rahman
মনোনয়ন দিলে এবং সে ছাত্র নির্বাচনে জয়ী হলে ছাত্রলীগের বিশ্বাসযোগ্যতার চরম ক্ষতি হবে। এই বক্তব্য শোনার পর আমি আমার বন্ধুদের মতের সঙ্গে একমত হই।
৮। ইতোমধ্যে জনাব এরশাদুল হক মোল্লা এম. এ. পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন এবং ফজলুল হক মুসলিম হলের দোতলায় একতি সিংগেল কক্ষ তার নামে বরাদ্দ করা হয়। এ ছাড়াও মীর্জা আজিজ এরশাদুল হক মোল্লাকে ছাত্রাবাসের ১৯৬০-৬১ সালের বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশনার সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ছাত্রাবাসের নির্বাচনী অনুষ্ঠানের কয়েক মাস পূর্বেই জনাব এরশাদুল হক মোল্লা হলের বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে সমর্থ হন এবং হলের নতুন ছাত্রদের ও তাঁর বিশিষ্ট সমর্থকদের উক্ত ম্যাগাজিন বিতরণ করাও শুরু করেন। ফজলুল হক হলের নির্বাচনের ঘোষণা করার পর হলের ছাত্রলীগের একটি সভায় জনাব আবদুর রবকে সভাপতি এবং জনাব ইসহাক তালুকদারকে সেক্রিটারী করে একটি সাত সদস্যবিশিষ্ট নির্বাচনী সাংগঠনিক ও প্রচারণা কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত সভায় এও সিদ্ধান্ত হয় যে, আসন্ন ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমাকে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সহ-সভাপতির প্রার্থী হতে হবে। উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার দেখা বা আলাপ হয়নি। উক্ত নির্বাচনে ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্র ইউনিয়ন তিনটি পৃথক প্যানেল প্রদান করে। আল্লাহর রহমতে ছাত্রলীগ থেকে আমি সহ-সভাপতি, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জনাব নুরুল ইসলাম সাধারণ সম্পাদক ও আরো পাঁচজন ছাত্র সংসদের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হই। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, জনাব আবদুর রাজ্জাক ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মাত্র একজন ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্র ফেডারেশন এ্যাথলেটিক ও সহ-এ্যাথলেটিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে জনাব ইকবাল বাহার চৌধুরীসহ মোট তিনটি আসনে বিজয়ী হয়। DUCSU- এর প্রতিনিধি হিসেবে ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্রলীগের তিন জন বিজয়ী হন, যাঁদের অন্যতম ছিলেন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রসায়ন বিভাগের এম. এসসি. ক্লাশের জনাব এনায়েতুর রহমান, অপরপক্ষে ছাত্র ফেডারেশনের মাত্র একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। নির্বাচনের অব্যবহিত পরেই আমি জানতে পারি, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী জনাব এরশাদুল হক মোল্লা তাঁর হল কক্ষে চলে গেছেন এবং তাঁর সঙ্গে আনোয়ার আনসারী খান রয়েছেন। আমি তাড়াতাড়ি জনাব এরশাদুল হক মোল্লার কক্ষে চলে যাই এবং তাঁকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখি। আমি তাঁকে সবিনয়ে অনুরোধ করে ছাত্রদের সামনে নিয়ে আসি এবং আমার পাশে রেখে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিই। ভাষণে আমি বলি যে, ছাত্র নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন ও ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হওয়ার জন্য হলের ছাত্রদের ধন্যবাদ জানাই এবং হল সংসদের দায়িত্ব পালনে দল-শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতা কামনা করি এবং নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য হল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা জানাই। আমি আরও বলি যে, জনাব এরশাদুল হক মোল্লাকে আমি চিরদিন আমার শুভাকাংক্ষী হিসেবে দেখেছি এবং বড় ভাই বলে সম্বোধন করেছি। তিনি ভবিষ্যতেও আমার বড় ভাই হিসেবে থাকবেন এবং শ্রদ্ধা পাবেন। তিনি যে আমার দায়িত্ব পালনে বড় ভাই হিসেবে আন্তরিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করবেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। উক্ত সভার দুই তিন ঘণ্‌টা পর তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি এবং ঢাকা হলে ছাত্রলীগের বিজয়ী সহ-সভাপতি জনাব নাসিমুদ্দিন আমাদের হলে এসে আমাকে ও ছাত্রলীগের বিজয়ী অন্যান্যকে অভিনন্দন জানান। এরপর সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে ছাত্র ফেডারেশনের পূর্ণ প্যানেল বিজয়ী ও অন্যান্য ছাত্রকে নিয়ে তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আবুল হাসনাত আমার হলে আসেন। আমি আমার হলের ছাত্রদের নিকট পরিচয় করিয়ে দিই সলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংসদের নব নির্বাচিত সহ-সভাপতি জনাব খোরশেদ হামিদ ও তাঁর সহকর্মীদের এবং আমার হলের ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাঁদের অভিনন্দন জানাই ও সাফল্য কামনা করি। সেই যুগ বলে এই ঘটনা সম্ভব হয়েছিল, বর্তমান যুগে তা অকল্পনীয়।
৯। উল্লেখ্য যে, সে যুগে ছাত্র সংগঠনগুলো কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক-অনুসারী হলেও তারা ছাত্র নির্বাচনের সময় ছাত্র সদস্যদের নিকট হতে চাঁদা তুলে খরচ মেটাতো। ফজলুল হক মুসলিম হলের ছাত্রলীগের নির্বাচনের সময় নির্বাচন প্রচারাভিযান শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই ছাত্র ফেডারেশন ও ছাত্র ইউনিয়ন তাদের স্ব স্ব দলের নির্বাচনী ইশতেহার, প্রার্থীদের জীবন বৃত্তান্ত ছাপিয়ে হলের ছাত্রদের মধ্যে বিতরণ শুরু করে। অর্থের অভাবে আমরা ছাত্রলীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও প্রার্থীদের জীবন বৃত্তান্তের কপিগুলো সংগ্রহ করতে পারিনি। বেশী দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে একদিন সকাল বেলা আমি আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে আমাদের হাউস টিউটর, রসায়নের সহকারী অধ্যাপক জনাব নূরুল হক ভুইঞার নিকট যাই এবং আমাদের অবস্থার কথা বর্ণনা করে তাঁর নিকট ৩০০ টাকা ধার চাই। বিষয়টি নাজুক বিধায় তিনি আমাদের ৩০০ টাকা ব্যক্তিগত ধার দিলেন যেন আমরা বিষয়টি গোপন রাখি। এ সাহায্যের জন্য আমি তাঁর নিকট চিরকৃতজ্ঞ এবং যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো তখনই তা উল্লেখ করতাম। পরবর্তীতে আমি আমার ব্যক্তিগত বৃত্তির টাকা থেকে ঐ ঋণ পরিশোধ করি।
১০। হলগুলো নির্বাচন শেষে ডাকসুর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিডিউল ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, সে সময় ডাকসুর নির্বাচন হতো হলগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটের ভিত্তিতে। ডাকসুর সংসদ পরিষদের প্রতিনিধিদের মধ্যে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন জোট পেয়েছিল, একজন বাদে, সকল সদস্যের অর্ধেক এবং ছাত্র ফেডারেশন পেয়েছিলো অনুরূপ সংখ্যক প্রতিনিধি। রোকেয়া হল থেকে ছাত্রশক্তির একজন মহিলা ডাকসুর ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিল। ডাকসুর নির্বাচন উপলক্ষে তখন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের, কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের, কেন্দ্রীয় ছাত্র ফেডারশনের নেতাদের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলছিলো। আমাকে ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছিলো, কিন্তু আমি পড়াশুনা ও হলের কার্যক্রমে ব্যস্ততার কারণে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোন সভাতে যোগদান করতে পারতাম না। আমার হলের পক্ষ থেকে জনাব আবদুর রব ও আবদুর রাজ্জাক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রায় সব সভায় যোগদান করতো এবং সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ সম্পর্কে আমাকে সব সময় অবহিত করতো। ডাকসু নির্বাচনের তারিখের দু’দিন আগে আবদুর রব ও আবদুর রাজ্জাক আমাকে জানায় যে, শেখ মুজিবের পরামর্শ অনুযায়ী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে ডাকসু নির্বাচনে প্যানেল দেবে এবং আমার হলের জনাব এনায়েতুর রহমানকে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এবং ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জনাব রফিকুল ইসলামকে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। আমাকে বলা হয়েছিলো যে, আমি যেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সমসাময়িক ও বন্ধু জনাব মাহবুবুর রহমানকে (পরবর্তীকালে এরশাদ সরকারের মন্ত্রী) নিয়ে নির্বাচনের আগের দিন সকালে ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি জনাব আবুল হাসনাতের সঙ্গে আলাপ করতে যাই এবং তাঁদের সঙ্গে ছাত্রলীগের যৌথ প্যানেল দেয়া সম্ভব কি না তৎসম্পর্কে জনাব হাসনাতের সঠিক অবস্থান জেনে আসি। জনাব মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে এই প্রথম আমার পরিচয় হয়। পরের দিন সকাল দশটায় ভাইস চ্যান্সেলরের আবাসিক অফিসে ডাকসুর নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছিল। নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণার পর জানতে পারি যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্র-ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল এবং ফেডারেশন প্যানেল নির্বাচনে সমান সংখ্যক ভোট পাওয়ায় তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ মাহমুদ হোসেন সভাপতির (Casting) ভোট দিয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলের প্রার্থীদেরকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। রোকেয়া হলের ছাত্রশক্তি থেকে নির্বাচিত মহিলাটি সেদিন ভোট দিতে যাননি। তাই আজও কৌতূহল বোধ করি যে, যদি তিনি ঐ দিনে ভোট দিতেন তা হলে ফলাফলটা কেমন দাঁড়াতো!
১১। এরপর আমরা হলে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি এবং এটাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের গুরুত্বের ওপর একটি আলোচনা সভার আয়োজন করি। উক্ত সভার প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তাঁর প্রধান অতিধির ভাষণে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে তাঁর নিজের এবং শেখ মুজিবসহ অন্যান্য ছাত্রনেতার অবদানের কথা উল্লেখ করেন। অতঃপর বাংলা ভাষার মান ও উৎকর্ষের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যেমন স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজীর তুলনা করে তিনি অনেক কথা বলেন। এর কিছুকাল পর আমরা তৎকালীন ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে একটি সভার আয়োজন করি। উক্ত সভার প্রধান অতিথি ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। তিনি অসুস্থতার কারণে সভায় সময় মতো উপস্থিত হতে পারেন নি। সভায় বিভিন্ন বক্তা ফজলুল হক মুসলিম হলের অতীতের অনেক ঐতিহ্য ও উল্লেখযোগ্য ঘটনা বর্ণনা করেন এবং এই হলের নামকরণের কাহিনীও উল্লেখ করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় যে, ফজলুল হক মুসলিম হলের নাম শুধু ফজলুল হক হল রাখা হবে। সভার শেষের দিকে জনাব ফজলুল হক সাহেব আমাদের হলে এলে আমরা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে যাই এবং তাঁকে এই নতুন নামকরণের কথা জানাই। তিনি আমাদের নতুন নামকরণের প্রতি তাঁর পূর্ন সমর্থন জানান। জীবনে এই প্রথম শ্রদ্ধেয় এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে।
১২। ইতোমধ্যে জেনারেল আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেটিক পদ্ধতির বিস্তারিত বিবরণ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ঐ বছর একমাত্র ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগ হল সংসদের দায়িত্ব নিয়োজিত। ঢাকা হলের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ প্যানেলের ছাত্র কর্মকর্তারা হল সংসদের কার্য পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলো। জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল এবং তৎকালীন ইকবাল হলে ছিলো ছাত্র ইউনিয়নের প্রবল আধিপত্য। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছিলো ছাত্র ফেডারেশনের পূর্ণ আধিপত্য। জেনারেল আইয়ুব খান প্রদত্ত বেসিক ডেমোক্রেটিক পদ্ধতির পক্ষে সমর্থন নেয়ার জন্য যে গণভোট নেয়ার আয়োজন করার প্রস্তুতি চলছিলো তার বিরোধিতা করার জন্য ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। আমাদের হলেও এ ব্যপারে আলচোনা করার জন্য ঘন ঘন সভার আয়োজন চলছিলো। জনাব আবদুর রব, জনাব ইসহাক তালুকদার, জনাব এনায়েতুর রহমান, জনাব আবদুর রাজ্জাক, জনাব শহিদুল হক মুন্সী, এবং আমি স্বয়ং এ সমস্ত সভায় জোরালো বক্তব্য রাখতাম। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ মণির নেতৃত্বে আগামসি লেনে শাহ মোয়াজ্জেমের মেসে আলোচনা চলতো। আমিও মাঝে মধ্যে সেই আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতাম। আমি প্রতি সভায় যেতে পারতাম না। কারণ ঐ সময় আমাকে ফজলুল হক হলের বার্ষিক ডিনার ও পড়ালেখার জন্য ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।
১৩। আমার সময়ে ফজলুল হক হলের বার্ষিক ডিনারের তারিখ ধার্য করা ছিলো ৩১শে জানুয়ারী ১৯৬২ সাল। ঐ সময় ঢাকায় পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্টের অধিবেশন চলতে থাকার সুযোগে আমরা হলের প্রভোস্টের সম্মতিক্রমে পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জাস্টিস কর্নেলিয়াসকে উক্ত বার্ষিক ডিনার উৎসবে প্রধান অতিথি নির্বাচিত করেছিলাম। সেদিন রাত ৮টায় হলে প্রভোস্টের গাড়ী নিয়ে জাস্টিস কর্নেলিয়াসকে হলে আনার জন্য আমি ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় সার্কিট হাউসে যাই। হলে পৌঁছালে হলে প্রভোস্ট জনাব সফিউল্লা তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। যখন জাস্টিস কর্নেলিয়াসকে নিয়ে ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছিলাম তখন ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান আমাকে ডেকে বলে, “আজ বিকালের খবরের কাগজে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে করাচী জেলে নিয়ে যাওয়ার খবর বেরিয়েছে। সুতরাং ডিনারোত্তর বক্তৃতায় তোমাকে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখতে হবে।” সে আমাকে এও বলে যে, ঐদিন রাত ১২টায় ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতির অফিস কক্ষে ছাত্রলীগ হল ইউনিট- এর নেতৃস্থানীয় নেতাদের সভার আয়োজন করতে হবে এবং উক্ত সভায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি উপস্থিত থাকবেন। আমি ডিনারোত্তর বক্তৃতায় সামরিক শাসনের দোষত্রুটি এবং তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের প্রয়োজনীয়তা ও সার্বজনীন গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলনের কথা উল্লেখ করে বক্তব্য রাখি এবং কর্নেলিয়াসের কাছে এতদসম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত মতামত দেয়ার অনুরোধ জানাই। আমি শ্রদ্ধেয় জননেতা জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবীও জানাই। কিন্তু প্রধান অতিথি জাস্টিস কর্নেলিয়াস এ বিষয়ে কোন বক্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। সেদিন জাস্টিস কর্নেলিয়াসকে সার্কিট হাউসে পোঁছে দিয়ে হলে ফিরে এসে আমাকে ডিনারের কার্যাবলী শেষ করার জন্য সাড়ে এগারটা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। অতঃপর আমার হলের ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে রাত্রি ১২ টায় প্রস্তাবিত সভা আয়োজনের ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করি। সভা আয়োজনের ব্যাপারে সবাই একমত হয়।
১৪। ঐ দিন রাত সাড়ে বারটায় হল সংসদ সহ-সভাপতির অফিস কক্ষে মিলিত হই। জনাব শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের প্রস্তাব ও শেখ ফজলুল হক মনির সমর্থনে আমাকে ঐ সভায় সভাপতিত্ব করতে হয়। সভায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মনি ছাড়াও আবদুর রব, এনায়েতুর রহমান, ইসহাক তালুকদার, নূরজ্জামান, আবদুর রাজ্জাক ও শহিদুল হক মুন্সী উপস্থিত ছিলেন। প্রথম শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও তারপর ফজলুল হক মণি বক্তব্য রাখেন। তাঁরা দুজনেই সভায় বলেন যে, জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সামরিক শাসনের আওতায় গ্রেফতার ও অনির্দিষ্টকালের জন্য কারারুদ্ধ করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন থেকে সামরিক শাসন অবসানের লক্ষ্যে ছাত্র আন্দোলন শুরু করার জন্য ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীদের প্রতি শেখ মুজিব অনুরোধ জানিয়েছেন। সভায় উপস্থিত অন্যান্য ছাত্রনেতাও শেখ মুজিবের উক্ত প্রস্তাবের প্রতি জোর সমর্থন ব্যক্ত করে। সভার সভাপতি হিসেবে সর্বশেষে আমি ছাত্র আন্দোলন শুরু করার বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের অবস্থান ও মতামত সম্পর্কে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ মনির কাছ থেকে জানতে চাই। তাঁরা দুজনেই বলেন যে, তৎবিষয়ে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁদের ইতোপূর্বেই অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তাঁদের ধারনা, ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও কর্মীবৃন্দ আমাদের আন্দোলনকে সম্পূর্ন সমর্থন জানাবে এবং আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। কিন্তু ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকরা আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন নাও জানাতে পারে। তবে আমাদের আন্দোলনে হয়তো বাধা দেবে না। অতঃপর পরদিন সকাল থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট শুরু করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এতদ্‌উদ্দেশ্যে বিজ্ঞান অনুষদ, ফজলুল হক হল ও ঢাকা হল এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয় আবদুর রব, এনায়েতুর রহমান, ইসহাক তালুকদার, সিরাজুল আলম খান, নাসিম আহমেদ ও আমাকে। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মনি, ওবায়দুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক ও শহিদুল হক মুন্সীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিষয়টি অত্যন্ত গোপন রাখার জন্য সভায় উপস্থিত সবাইকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয়।
১৫। পরদিন সকাল থেকে পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট শুরু করি। ধর্মঘটটি হঠাৎ শুরু হওয়ায় কিছু কিছু ছাত্রকে আমরা অপ্রস্তুত দেখি, কিন্তু সকাল ১১টার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রছাত্রী ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে। বিজ্ঞান অনুষদের দায়িত্বে যাঁদের থাকার কথা ছিলো তাঁদের মধ্য থেকে একমাত্র ইসহাক তালুকদার ছাড়া অন্য কাউকেই আশেপাশে দেখলাম না। ইতিমধ্যেই পুলিশ বাহিনী ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের লোকজন ট্রাকে ট্রাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে আসে এবং বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে অবস্থান নেয়। বেলা প্রায় ১১টার দিকে E.P.R.T.C- এর একটি ফাঁকা বাস কার্জন হলের সম্মুখে আসে। বিপুল সংখ্যক ছাত্র ঐ বাসটিকে থামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। বাসে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে, কিন্তু কার্জন হলের সামনের রাস্তার দুই কোণে অবস্থানরত E.P.R. বাহিনীর জোয়ানগণ ও পুলিশ বাহিনীর লোকজন বিপুল সংখ্যাক ছাত্রের উপস্থিতি দেখে প্রজ্বলিত বাসটির নিটক আসতে ভয় পাচ্ছিলো বলে মনে হলো। প্রায় একটার দিকে দমকল বাহিনীর একটি গাড়ী অকুস্থলে উপস্থিত হয়। কিন্তু ইতোপূর্বেই বাসটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছিলো। এরপর ছাত্রদের উপস্থিতি আস্তে আস্তে কমতে থাকে। ঐ সুযোগে E.P.R. বাহিনীর কয়েকজন জোয়ান ও পুলিশ বাহিনীর কয়েকজন ব্যক্তি আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে রাস্তার দুই কোণ থেকে ভস্মীভূত বাসটির নিকট আসতে থাকে। উপস্থিত ছাত্ররা তাদের দিকে ইট-পাটকেল ছুঁড়তে থাকে এবং তাদেরকে গালিগালাজ করতে থাকে। এর অব্যবহিত পর ঠিক ঐ সময় পুলিশ বাহিনীর দিক থেকে কয়েকটি কাঁদানে গ্যাস কার্জন হলের সম্মুখস্থ চত্বরে নিক্ষেপ করা হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা, ছাত্ররা, কার্জন হলের পেছনে অবস্থান নিই। এইভাবে ছাত্র এবং ইপিআরের জোয়ান ও পুলিশ বাহিনীর ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ইটপাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি চলে। বিকেল প্রায় পাঁচটার দিকে অবস্থা কিছুতা প্রশমিত হলে ছাত্ররা তাদের স্ব স্ব হলে ফিরে যায়।
১৬। পরদিন থেকে আন্দোলন আস্তে আস্তে জোরদার হতে থাকে। উল্লেখ্য যে, জেনারেল আইয়ুব খান ঐ সময় কেবিনেট মিটিং পরিচালনা করার জন্য তাঁর মন্ত্রী পরিষদসহ ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল আজম খান। ছাত্র আন্দোলন আস্তে আস্তে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জোরদার হতে থাকে। আন্দোলন শুরু হওয়ার তৃতীয় দিনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বিকেল ৬টার দিকে আমার হলে এসে আমাকে বলেন, “ওয়াজেদ, তুমি তো জান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মধ্যে তুমিই একমাত্র ছাত্রলীগের নির্বাচিত সহ-সভাপতি এবং ফজলুল হক হলই হচ্ছে ছাত্রলীগের একমাত্র ঘাঁটি। মুজিব ভাই (ছাত্রলীগের সবাই ও আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই শেখ মুজিবকে ভাই বলে সম্বোধন করতো) তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তুমি আমার সঙ্গে চলো।” অতঃপর আমরা দুজনে রিক্সাযোগে ধানমণ্ডি রওয়ানা হই। তখন ধানমণ্ডির উত্তরাঞ্চলে বিশেষ কোন বাড়িঘর ছিলো না, সন্ধ্যায় শেয়াল ডাকতো। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডস্থ বাড়ীতে মুজিব ভাই আমাদের একটা ছোট্ট বসার ঘরে নিয়ে বলেন, “ওয়াজেদ, তুমি ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় তোমাকে মোবারকবাদ জানাই। ছাত্র আন্দোলন এখন চরম পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ মণি যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার হতে পারে। সুতরাং এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখবে।” এরপর আমরা চলে আসি। শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার জীবনে এই প্রথম সাক্ষাৎ ও আলাপ।
১৭। ঐ সময়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে একটি পূর্ব নির্ধারিত শিক্ষকদের সভায় ভাষণ দেয়ার জন্য পাকিস্তানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মঞ্জুর কাদের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আসেন। কিন্তু ছাত্ররা সেই সভা সম্পূর্ণভাবে পণ্ড করে দেয় এবং মঞ্জুর কাদেরকে চরমভাবে নাজেহাল করে। সরকারের শান্তি রক্ষাবাহিনী কোন প্রকারে মঞ্জুর কাদেরকে সভামঞ্চ থেকে বের করে নিচে নিতে থাকে। সিঁড়িতে নামার পথে জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, কাজী জাফর আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি প্রমুখ ছাত্র-নেতৃবৃন্দ মঞ্জুর কাদেরের গায়ে থুথু দেন। যা হোক, সরকারের শান্তি রক্ষাবাহিনী কোন প্রকারে অপমানে রাগান্বিত মঞ্জুর কাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে নিয়ে যান। ঐ দিন সন্ধ্যায় জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে সারা ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে বলে পাকিস্তান রেডিওতে বার বার ঘোষণা দেয়া হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এই ঘটনার পরের দিন সকাল বেলা পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও বেলুচ রেজিমেন্ট বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা হল, ফজুলুল হক হল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদুঘর সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও করে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ঢাকাস্থ I.B- এর একজন কর্মকর্তা সকালে আমার হলে আসেন এবং হলের সহ-সভাপতি হিসেবে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁর কাছে এলে তিনি বলেন যে, তিনি সরকারী নির্দেশে আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন। অতঃপর তিনি আমাকে হল সংসদের সহ-সভাপতির অফিস কক্ষে নিয়ে যান
Unicoded by – Ali Imran Jidny
উপস্থিত ছিলেন। সে সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পদের দায়িত্বে ছিলেন জেনারেল আজম খান। ছাত্র আন্দোলন আস্তে আস্তে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং জোরদার হতে থাকে। আন্দোলন শুরু হওয়ার তৃতীয় দিনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন বিকেল ৬টার দিকে আমার হলে এসে আমাকে বলেন, ওয়াজেদ, তুমি তো জানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর মধ্যে তুমিই একমাত্র ছাত্রলীগের নির্বাচিত সহ-সভাপতি এবং ফজলুল হক হলই একমাত্র ছাত্রলীগের ঘাঁটি। মুজিব ভাই (ছাত্রলীগের সবাই ও আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই শেখ মুজিবকে ভাই বলে সম্বোধন করতো) তোমার সঙ্গে দেখা করতে চান। তুমি আমার সঙ্গে আজই চলো। অতঃপর আমরা দুজন রিক্সাযোগে ধানমন্ডি রওয়ানা হই। তখন ধানমন্ডির উত্তরাঞ্চলে বিশেষ কোন বাড়িঘর ছিলো না, সন্ধ্যায় শেয়াল ডাকতো। ধানমন্ডি ৩২ নং রোডস্থ মুজিব ভাই আমাদের ছোট একটা ঘরে নিয়ে বলেন, ” ওয়াজেদ,
তুমি ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় তোমাকে মোবারকবাদ জানাই। ছাত্র আন্দোলন এখন চরম পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে। শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ মনি যে কোন মুহুর্তে গ্রেফতার হতে পারে। সুতরাং এখন থেকে তুমি আমার সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখবে।” এরপর আমরা চলে আসি। শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার জীবনে এই প্রথম সাক্ষৎ এবং আলাপ।
১৭ । ঐ সময়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে একটি পূর্ব নির্ধারিত শিক্ষকদের সভায় ভাষণ দেয়ার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মঞ্জুর কাদের বিশ্ববিদ্যালয় চ্ত্তরে আসেন। কিন্তু ছাত্ররা সেই সভা সম্পূর্ণভাবে পন্ড করে দেয় এবং মঞ্জুর কাদেরকে চরমভাবে নাজেহাল করে। সরকারের শান্তিরক্ষা বাহিনী কোন প্রকারে মঞ্জুর কাদেরকে সভামঞ্চ থেকে নিচে নিতে থাকে। সিঁড়িতে নামার পথে জিয়া উদ্দিন মাহমুদ, কাজী জাফর আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি প্রমুখ ছাত্র-নেতৃবৃন্দ মঞ্জুর কাদেরের গায়ে থুথু দেন। যা হোক, সরকারের শান্তিরক্ষা বাহিনী কোন প্রকারে অপমানে রাগান্বিত মঞ্জুর কাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় চ্ত্তর থেকে নিয়ে যায়। ঐ দিন সন্ধ্যায় জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে সারা ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করা হয়েছে বলে পাকিস্তান রেডিওতে বার বার ঘোষনা দেয়া হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। এই ঘটনার পরের দিন সকাল বেলা পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও বেলুচ রেজিমেন্ট বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা হল, ফজলুল হক হল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাদুঘর সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও করে। এখানে উল্লেখ টরা প্রয়োজন যে, আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ঢাকাস্থ I B একজন কর্মকর্তা সকালে আমার হলে আসেন এবং হলের সহ-সভাপতি হিসেবে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁর কাছে এলে তিনি বলেন যে, তাঁর নাম ইসরাইল। তিনি তাঁর পরিচয়পত্র আমাকে দেখান এবং বলেন যে, তিনি সরকারী নির্দেশে আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন। অতঃপর তিনি আমাকে হল সংসদের সহ-সভাপতির অফিস কক্ষে নিয়ে যান এবং আমার অনুমতিক্রমে আমার অফিস টেবিলের সমস্ত ড্রয়ার ও অফিস আলমারিতে রাখা সমস্ত কাগজপত্র তন্ন তন্ন করে নিরীক্ষা করেন। কোন কিছু না পেয়ে সন্তষ্ট হতে না পেরে তিনি হলের যে সিঙ্গেল রূমে আমি থাকতাম আমাকে সেখানে নিয়ে যান এবং চৌকি ও তোশকের নিচে ও আমার সমস্ত কাগজপত্র তন্ন তন্ন করে নিরীক্ষা করেন। কোন আপত্তিকর কাগজপত্র না পেয়ে তিনি আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, “বাঙালী জাগো” শিরোনামে কোন প্রচারপত্র আমি দেখেছি কি-না। পরে জানতে পারি যে, উক্ত প্রচারপত্র শেখ মুজিবের বাড়ী থেকে প্রচার করা হয়েছিলো।
১৮ । এখন ইতোপূর্বে উল্লেখিত হলগুলো ঘেরাওয়ের ঘটনায় ফিরে যাই। আমাদের ঢাকা হল, ফজলুল হক হল ও কার্জন হলের পু্রা চত্তর বিপুল সংখ্যক পাঞ্জাব রেজিমেন্টের জোয়ান সারাক্ষন ঘিরে রাখে। প্রথম দু’দিন হলের বাজার করার কোন কর্মচারীকেও হলের বাইরে যেতে দেয়নি। বহু কষ্ট ও চাতুরী করে রাতের অন্ধকারে চত্বরের লোহার রেলিং ডিঙিয়ে হলের কর্মচারীরা কোন রকমে বাজার থেকে খাবার জিনিসসত্র কিনে আনে। হল বন্ধের কারণে ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং কিছু সংখ্যক ছাত্র রাতের অন্ধকারে হল ছেড়ে চলে যাওয়ায় কোন রকমে তিনদিন কেটে যায়। অতঃপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও হল প্রভোস্টদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাগণ কেবল হলের বাবুর্চিদের বাজা্য করার অনুমতি দেন। ঢাকা হল ও ফজলুল হক হলের অবরোধের পঞ্চম দিনে সামরিক বাহিনীর লোকজন ঢাকা হলে ঢুকে বহু সংখ্যক ছাত্রকে গ্রেফতার করে ট্রাকে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে তাহের উদ্দিন ঠাকুরও ছিলেন। অবরোধের ষষ্ঠ দিনে সকাল বেলা সামরিক বাহিনীর লোকজন আস্তে আস্তে ফজলুল হক হলে প্রবেশ করে। প্রথম সারিতে ছিল বেলুচ রেজিমেন্টের লোকজন ও কর্মকর্তা এবং পেছনের সারিতে ছিলো পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অফিসার ও জোয়ানরা। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বেই আব্দুর রব, সিরিজুল আলম খান, ইসহাক তালুকদার, আতিয়ার রহমান, আব্দুর রাজ্জাক ও শহীদুল হক মুন্সীসহ অনেক ছাত্র নেতৃবৃন্দ রাতের অন্ধকারে হল ছেড়ে চলে যান। ছাত্র নেতৃবৃন্দের এনায়েতুর রহমান আমার কক্ষে এসে বলে হলের সহ-সভাপতি হিসেবে আমার কোনক্রমেই হল ছাড়া যাবে না। সে রসায়ন বিভাগের ল্যাবরেটরিতে লুকিয়ে থাকবে এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। অবরোধের ষষ্ঠ দিনে সামরিক বাহিনীর লোকজনরা সকাল ৮/৯ টার দিকে আমাদের হলে ঢোকে। তাদের সঙ্গে অসামরিক লোকজনও ছিলো। তারা হল গেটে এসে মাইকের মাধ্যমে উচ্চ স্বরে হলের ছাত্রদের হলের ভিতরের চত্বরে এসে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে আহ্বান জানায়। হলে তখন প্রায় ৬৫/৭০ জন ছাত্র উপস্থিত ছিলো। আমরা সবাই নীচে এসে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়াই এবূ প্রথমে আমি সারির সম্মুখ ভাগে অবস্থান নেই। কিন্তু ছাত্রদের বিশেষ অনুরোধে আমাকে সারির মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নিতে হয়। এরপর বেসামরিক বাহিনীর লোকজন প্রত্যেক ছাত্রের পরিচয়পত্র তাদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। তারা আমার সামনে সমস্ত ছাত্রকে ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে এসে আমার পরিচয়পত্র পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে নির্দেশ দেয়। আমার পেছনের অন্য ছাত্রদের যখন নীরিক্ষা হচ্ছিল তখন I
B বিভাগের সেই ইসরাইল আমার কাছে এসে আমাকে কানে কানে বলে, “স্যার আপনি ঘাবড়াবেন না। আপনার শেষ নামটি তালিকায় ভুল করে লেখা আছে। সুতরাং আপনাকে গ্রেফতার করতে পারবে না।” অন্য সমস্ত ছাত্রকে নীরিক্ষা করে ছেড়ে দিয়ে বেসামরিক বিভাগের একজন কর্মকর্তা আমার নিকটে আসে এবং আমার পরিচয়পত্র ও তার তালিকার দিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে আমাকে আমার কক্ষে চলে যেতে বলে। এরপর তারা হল ছেড়ে চলে যায়। এসমস্ত ঘটনার পরও ঢাকা হল, কার্জন হল, বিজ্ঞান অনুষদ ও ফজলুল হক হল আরও তিনদিন অবরোধ করে রাখা হয়েছিলো, কিন্তু তাদের তৎপরতা ছিল কিছুটা শিথিল। হল দুটোতে বেশি ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং পরিস্থিতি অনেকাংশে শান্ত হওয়ার অবরোধে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর আমরা জানতে পারি যে, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বহু নেতা এবং ছাত্রলীগের শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ মনিসহ অনেককে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
১৯ । কলেজগুলো ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র না থাকায় আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু এম. এ/ এম. এস. সি.’র অনেক ছাত্রই হলে ফিরে আসে। আব্দুর রব, ইসহাক তালুকদার, আব্দুর রাজ্জাক ও শহীদুল হক মুন্সীও হলে ফিরে আসে। একদিন সকালবেলা ফজলুল হক হলের প্রভোস্ট হলে এসে ডেকে বলেন, ” ওয়াজেদ তুমি তো মেধাবী ছাত্র। কিছুক্ষণ আগে I B-এর একজন কর্মকর্তা আমাকে টেলিফোন করে তুমি হলে উপস্থিত আছো কিনা সে সম্পর্কে জানতে চায়। সুতরাং, তুমি এখনই হলে থেকে অন্যত্র চলে যাও।।” আমি তৎক্ষণাৎ ইসহাক তালুকদারকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমান শেরাটন হোটেলের পাশে একটি ছাত্র মেসে চলে যাই। সেখানে তিনদিন থাকার পর আমরা দুজন হলে ফিরে আসি। আবার পরদিন হলের প্রভোস্ট এসে আমাকে একই খবর দেন। আমি তখন বাধ্য হয়ে আমার কাপড়চোপড় ও কিছু বইপত্র নিয়ে কয়েকদিনের জন্য পুরনো ঢাকায় এক ছাত্র মেসে আমার বন্ধু বাদলের কাছে আশ্রয় নিই। পরদিন সংবাদপত্রে দেখি সরকার ছাত্রলীগের মীর আমির হোসেন চৌধুরী (মীরু ভাই), আমাকে ও ছাত্র ইউনিয়নের দুই জনকে ঢাকার ডি. সি.- এর সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ করেছে। কয়েকদিন অপেক্ষা করার পর আমি ১৯৫৪ সালের মূখ্য মন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের সরকারের নিকট এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য যাই। উল্লেখ্য আবু হোসেন সরকার ১৯৫৪ সনের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন প্রচারাভিযানের সময় আমাদের দেশের বাড়ি পীরগঞ্জের ফতেপুরে গিয়েছিলেন। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর বেশ পরিচয় ছিলো। তিনি আমার বাবাকে জোতদারী সংক্রান্ত পরামর্শ দিতেন এবং কোর্টে মামলার উকিল হিসেবে থাকতেন। আমি তখন রংপুর জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম। তখন বাবা আমাকে একদিন তাঁর বাসায় নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরেও আমি বাবার মামলার কাগজপত্র দিতে কয়েকবার গিয়েছিলাম তাঁর বাসায়। জনাব আবু হোসেন সরকার আমাকে বলেন যে, আমি যদি ডি. সি. সাহেবের সাথে দেখা না করি তাহলে আমার Double offence হতে পারে। সুতরাং সামরিক শাসনের অধীনে আমার ডি. সি.- এর সঙ্গে দেখা করা ছাড়া উপায় নেই। এর কয়েকদিন পর আমি গোপনে ফজলুল হক হলের প্রভোস্টের নিকট বাদলকে জানতে পারি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ মাহমুদ হোসেন আমাকে অতিসত্বর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেছেন। পরেরদিন সন্ধ্যাবেলায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বলেন, “I. B.-এর অফিস থেকে ঘন ঘন তোমার অবস্থান সম্পর্কে আমার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে। সুতরাং আর দেরি না করে তুমি ডি. সি.- এর সঙ্গে দেখা করো।” উপায়ান্তর না দেখে আমি আমার প্রিয় শিক্ষক ডঃ আব্দুল মতিন চৌধুরীর অফিসে যাই। তিনি তৎক্ষণাৎ ছাত্র হিসেবে আমার ভূয়সি প্রশংসা করে একটি সুদীর্ঘ চিঠি টাইপ করে আমাকে দিয়ে বলেন, “তমি কালকে সকালেই ডি. সি.- এর সঙ্গে দেখা করো এবং এই চিঠিটি তাঁকে দিও। এ চিঠি পড়ে তিনি আমাকে গ্রেফতার নাও করতে পারেন।”
২০ । আমি পরদিন ডি. সি. তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমার বক্তব্য শুনে কিছুক্ষণে জন্য আমাকে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর কক্ষে অবস্থান করতে বলেন। ঘন্টা খানেক পরে তিনি আবার আমাকে ডেকে পাঠান। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি যে, ছাত্র ইউনিয়নের ওয়ালি আশরাফসহ আরো দুজন বেসামরিক কর্মকর্তা উক্ত কক্ষে বসে আছেন। ডি. সি. আমাকে ও ওয়ালি আশরাফকে বেসামরিক দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে চলে যেতে বলেন। ঐ দুজন কর্মকর্তা আমাদের দুজনকে একটা জীপে বেলা ১টার দিকে পুরানা পল্টনে তাদের একটা অফিসে নিয়ে বলেন যে, আমাদের দুজনকে সরকারি আদেশ বলে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাদেরকে কেন্দ্রীয় কারাগারে যেতে হবে। একথা শুনে আমি তাদেরকে বলবলা, ভাই আমাকে একটু ফজলুল হক হলেনিয়ে যান, যাতে আমি বইপত্র, কাপড়চোপড় নিয়ে জেলখানায় যেতে পারি।” তাদের একজন বলেন, আপনাকে এই পরিস্থিতিতে ফজলুল হক হলে নেয়া সম্ভব নয়। বরঞ্চ আপনি আপনার কোন বন্ধুর কাছে চিঠি লিখে যান, তিনি আপনার বইপত্র কাপড়চোপড় পৌঁছে দেবেন।” অতঃপর আমাদের দুজনকে বেলা ৪টার দিকে একটি জীপে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। জেলখানার অফিসে আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমাদের দুজনকে জেলখানার একটি পৃথক এলাকা যেখানে অনেক ছাত্রনেতা ও কর্মীকে রাখা হয়েছে, সেখানে রেখে আসা হয়। ঐ জায়গায় প্রবেশ করতেই শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ মনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন।
২১ । জেলখানার যে অংশে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন ছাত্রনেতা ও কর্মীদের আটক রাখা হয়েছিলো সেটি জেলগেট সংলগ্ন। ওখানে দুটি একতলা বিল্ডিং। একটার ফ্লোর দুই ফুট উঁচু
(Unicoded by Mahmood Hussain)
এবং লম্বা ঘর। অপর দক্ষিণমুখী বিল্ডিংটির ফ্লোর মাত্র নয় ইঞ্চি থেকে বার ইঞ্চি উঁচু । এ বিল্ডিংটির দুটো রুম কিন্তু প্রবেশদ্বার মাত্র একটিই । ঢোকবার দরজাটি লোহার রডের গ্রিলে তৈরী এবং জানালাগুলো পাল্লাবিহীন,মোটা মোটা রডের গ্রীল দিয়ে তৈরী। ওখানে ছিল একটি দেশীয় পায়খানা ও পেশাবখানা এবং গোসল করার জন্য খোলা আকাশের নীচে একটি খোলা চৌবাচ্চা । আমাদের ফ্লোরে ম্যাট্রেসে থাকতে দেওয়া হতো । কোন মশারি দেওয়া হতো না । আমার বেডটি পড়েছিল দরজার সঙ্গে । রাতে তালা বন্ধ করে দেয়ার পর বেয়নেটসহ রাইফেল নিয়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে পাহারা দিতো । রাত্রে পুলিশ বেয়নেটে আঘাত করতে পারে এই ভয়ে আমি দরজার দিকে মাথা না দিয়ে উল্টো দিকে মাথা রেখে শুতাম ।ঐ চত্বরে একটু খোলা জায়গা ছিলো যেখানে আমাদের ভলিবল খেলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো । এভাবে দশ দিন কেটে যায় । এগার দিনের মাথায় আমাকে জেল গেট থেকে খবর দেওয়া হয় যে, একজন আমার সাথে দেখা করতে জেল গেটে এসেছেন । আমি গিয়ে দেখি আমার হলের এম.এ. ক্লাশের ছাত্র শফিকুর রহমান (আঞ্জুমান), যার কাছে আমি গ্রেফতারের দিনে চিঠি দিয়ে এসেছিলাম, আমার কিছু বই, জামা-কাপড়, মশারি নিয়ে এসেছে । উল্লেখ্য যে, আঞ্জুমান আমার রংপুর জিলা স্কুলের সহপাঠী ছিলো এবং সে ছিলো ছাত্রলীগের একজন নীরব কর্মী । সে আমাকে বলে যে, আমার গ্রেফতারের খবর পেয়ে আমার বাবা রংপুর থেকে হলে এসেছিলেন এবং আমার রুমে দু’দিন থেকেছেন । ঐ সময় আঞ্জুমান তাকে বহু কান্নাকাটি করতে দেখেছে । সাক্ষাৎ শেষে ফেরার পথে দেখি ইতোমধ্যেই শেখ মুজিব তার পরিবারবর্গের সঙ্গে জেল গেটে আলাপ আলোচনা করছেন । I.B- এর লোক আমাকে শেখ মুজিবের পাশ কাটিয়ে অন্য দিক দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিলো । কিন্তু শেখ মুজিব ঐ কর্মকর্তাকে উপেক্ষা করে আমাকে বলেন, “ওয়াজেদ,এদিকে আস।” তিনি তার পরিবারবর্গকে বললেন, “এর নাম ওয়াজেদ,ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতি। ” এরপর তিনি তার পরিবারবর্গের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “এই তোমার ভাবী,আমার বড় মেয়ে হাসিনা, ছেলে কামাল, জামাল ও ছোট মেয়ে রেহানা । ” হাসিনার হাতে অনেকগুলো লিচু ছিল । তিনি বলেন, “মা হাসু, লিচুগুলো ওয়াজেদকে দিয়ে দাও। ” এরপর তিনি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ মণি, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মীর আমির হোসেন চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন ও অন্যদের সম্পর্কে আমার কাছ থেকে জেনে নিলেন । জেলের ভিতর ফিরে এসে সব কথা মোয়াজ্জেম ভাই, শেখ মণি ও অন্যদের কাছে বলি।
২২। এভাবে প্রায় চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ দিন কেটে যায় এবং লোক মারফত জানা যায় যে, ছাত্র আন্দোলন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো বন্ধ করে দেয়ায় প্রায় স্তিমিত হয়ে গেছে । এপ্রিল (১৯৬২)- এর গোড়ার দিকে একদিন সংবাদপত্রে দেখি যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে: জে: আজম খান পদত্যাগ করেছেন।এর পরের দিন থেকে আমাদের প্রতিদিন প্রায় চার পাঁচজনকে এক সঙ্গে জেল থেকে মুক্তি দেয়া শুরু হয় । প্রথম দলে ছিলো রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো এবং আরো কয়েকজন । তৃতীয় দফায় আমি আরও চার পাঁচজনের সঙ্গে মুক্তি পাই । জেল গেটে দেখি আব্দুর রব, ইসহাক তালুকদার, এনায়েতুর রহমান,আতিয়ার রহমান,আব্দুর রাজ্জাক ও ফজলুল হক হলের কিছু ছেলে ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । জেল গেট থেকে বেরিয়ে এলে সবাই আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনায় আলিঙ্গন করে । অতঃপর তাদের সঙ্গে আমরা হলে ফিরে আসি । সবার শেষে মুক্তি পান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ মণি, মীর আমির হোসেন চৌধুরী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও আরো দুজন । ফজলুল হক হলের আমরা অনেকে তাঁদেরকে জেল গেটে অভ্যর্থনা জানাই । কিন্তু তখনও শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।
২৩। ১৮ ই জুন(১৯৬২) সকাল বেলা আবদুর রাজ্জাক আমাকে বলে, “ওয়াজেদ ভাই, মুজিব ভাই আজ যে কোন সময় জেল থেকে মুক্তি পেতে পারেন।আপনাকে সময়মত জানাবো । ” আমি সেদিন বিকেল পর্যন্ত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবরেটরীতে কাজে ব্যস্ত ছিলাম । বিকেল পাঁচটার দিকে আমি হলের ক্যান্টিনে চা খেতে আসি । ক্যান্টিনে বসে যখন চা-নাস্তা খাচ্ছিলাম তখন দেখি একটি কালো গাড়ি এসে পুকুরের পাড়ে থামলো । শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ঐ গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন।আমাকে ডেকে তিনি বললেন, “ওয়াজেদ, তুমি জানতে না,মুজিব ভাইয়ের আজকে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিলো ?” আমি বললাম যে, রাজ্জাক এ ব্যাপারে আমাকে আভাস দিয়েছিলো কিন্তু সময় মত জানায় নি । শাহ মোয়াজ্জেম বলেন, “মুজিব ভাই তোমাকে জেল গেটে না দেখে আমাদের ওপর ভীষণ রাগ করেছিলেন এবং বাসায় ফিরে তিনি বলেছেন তোমাকে তাঁর বাসায় না নেওয়া পর্যন্ত তিনি বাড়ী থেকে বাইরে বেরুবেন না ।” শেখ মুজিব যে মাত্র দুই দিনের দেখা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে এত স্মরণ রেখেছেন এবং তাকে (আমাকে) এত স্নেহ করেন,এই ভেবে আমি তার প্রতি শ্রদ্ধায় অভিভূত হই । অতঃপর আমরা শেখ সাহেবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডস্থ বাসায় যাই।সেখানে শেখ সাহেব আমাকে স্নেহের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন । অতঃপর তিনি তখন পাশে দাঁড়ানো রংপুর জেলার পীরগঞ্জের (অর্থাৎ পীরগঞ্জ থানার) মতিউর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন । কিছুক্ষণ পর শেখ মুজিবসহ সদলবলে আমরা প্রথমে যাই শেরে বাংলার কবর জেয়ারত করতে।শেষে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে যে যার মত যার যার স্থানে চলে যাই । ১৯৬৭ সালে হাসিনার সঙ্গে বিয়ের পর এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসিনা বলে, “ঐ দিন আব্বা ফজলুল হক হলের সহ-সভাপতিকে আমাদের বাসায় না নিয়ে আসা পর্যন্ত শহীদ মিনারে যাবেন না বলেছিলেন।”
২৪। ইতোপূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়েছিলো এবং তখন রীতিমত ক্লাশ চলছিলো । পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে আমার সহপাঠীদের থিসিস গ্রুপের সবাই এম.এসসি.- এর থিসিসের কাজ শেষ করেছে । আমার সুপারভাইজার ড. হারুন-অর-রশীদ, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার চাকুরী পেয়ে তৎকালীন পাকিস্থান আণবিক শক্তি কমিশনের লাহোরস্থ গবেষণা কেন্দ্রে যোগদান করেছেন । তিনি আমাকে একটা চিঠিতে লিখে গিয়েছিলেন যে, আমি যেন আমার কাজটি আগের থিওরী ব্যবহার করে অথবা সম্প্রতি প্রকাশিত জনৈক জাপানী বৈজ্ঞানিকের ব্যবহৃত থিওরী অবলম্বন করে সম্পন্ন করি এবং ড. রফিক উল্লাহ আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবেন । আমি ড. রফিক উল্লাহর সঙ্গে আলাপ করে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম যে, পূর্বের থিওরী ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করলে বিভাগের হাতে চালানো ইলেকট্রিক মেশিন দিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে পারবো । উল্লিখিত জাপানী বৈজ্ঞানিকের থিওরী ব্যবহার করলে কম্পিউটারের সাহায্য নিতে হবে।দূর্ভাগ্য যে, তখন ঢাকায় কোন কম্পিউটার ছিলো না । অতঃপর ড. রফিকুল্লাহ আমাকে পুরোনো থিওরী ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত দেন।
২৫। ঐ সময় একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের আমতলায় পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে একটি মিটিং ডাকা হয়েছিলো । উক্ত সভায় শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, ওবায়দুর রহমান,আবদুর রব, সিরাজুল আলম খান, শহিদুল হক মুন্সী, আবুল হাসনাত, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল ক্লাশের পরীক্ষা অন্তত তিন মাস পেছানোর দাবির পক্ষে সমর্থন জানান।উক্ত সভায় আমি ছিলাম শেষ বক্তা । আমি বললাম যে,যদিও আমি ভাল ছাত্র তবুও জেলে কারারুদ্ধ থাকার কারণে তখন পরীক্ষা হলে হয়তো আমার পরীক্ষার ফলাফল ভাল হবে না । কিন্তু পরীক্ষা তিন মাস পিছিয়ে দিলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হবে ও ওলটপালট হবে । অধিকন্তু পরীক্ষা পেছানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছাত্রদের সাধারণ সভায় গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হবে না।বরঞ্চ পরীক্ষা পেছানোর দাবি করতে হলে তা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষা পেছানোর দাবির স্বপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় ভাইস চ্যান্সেলরের নিকট পেশ করতে হবে । আমার বক্তব্যের পর উক্ত সভায় পরীক্ষা পেছানোর ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।সপ্তাহখানেক পর জানতে পারি যে, পরীক্ষা পেছানোর দাবির সপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রছাত্রীদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে ভাইস চ্যান্সেলরের নিকট পেশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, উক্ত দাবিনামায় আমার স্বাক্ষর নেওয়া হয়নি । যা হোক, এর দুই দিন পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সকল পরীক্ষা চার মাসের জন্য পিছিয়ে দেয় । পরীক্ষা পেছানোর পর থেকে আমি প্রায়ই বলতাম, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের জন্য যা করেন, তা তাদের মঙ্গলের জন্যই করে থাকেন।”
২৬। ১৯৬২ সালের জুন মাসের শেষের দিকে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচীর জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা আসেন । শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাকে বিপুল সম্বর্ধনা দেয়া হয় । সেদিন বিমান বন্দরে এত লোক সমাগম হয়েছিলো যে, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে সরাসরি বিমান থেকে একটি ট্রাকে করে নিয়ে
Unicoded by – Mehedi Hasan Linkon
আসতে বাধ্য হয় । এরপর বিরাট মিছিল সহকারে তাকে দৈনিক ইত্তেফাকের মানিক মিয়ার কাকরাইলস্থ বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয় । ঢাকায় অবস্থানকালীন তিনি সেখানে ছিলেন । একদিন রাত্রিবেলা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও শেখ মনি আমার হলে এসে আমাকে জানান যে, পরদিন সোহরাওয়ারদী সাহেব ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সকাল দশটায় আলাপ আলোচনা করবেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন আমাকে এও বলেন, “মুজিব ভাই বিশেষভাবে বলছেন যে, তোমাকে অবশ্যই উক্ত সভায় উপস্থিত থাকতে হবে। “ পরদিন সকাল দশটায় মানিক মিয়ার কাকরাইলস্থ বাসভবনে যাই । এই প্রথম সোহরাওয়ারদী সাহেবের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয় । আওয়ামী লীগের একমাত্র শেখ মুজিব উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রায় তিন ঘণ্টা আলাপ আলোচনা চলে । সভায় বেশীর ভাগ বক্তব্য রাখেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ মনি, আবদুর রব, এনায়েতুর রহমান ও সিরাজুল আলম খান । আমিও কিছু বক্তব্য রেখেছিলাম। দুপুর দেড়টার দিকে আমরা ফিরে আসি ।
২৭। ইতমধ্যে সোহরাওয়ারদী সাহেব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। এই আলাপ আলোচনা প্রায় তিন চার দিন ধরে চলে । এই আলোচনার ফলশ্রুতিতে আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক সাসন প্রদ্ধতির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন পরিচালনার জন্য “ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফন্ট (NDF) নামের একটি ঐক্যজোট গঠনের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয় । ঐ ঐক্যজোটের মধ্যে তৎকালীন মুসলীম লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতা জনাব নুরুল আমিনও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এর পর চার দিন পর পল্টন ময়দানে উক্ত প্রস্তাবিত জোটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জনগনের কাছে পেশ করার জন্য একটি রাজনৈতিক জনসভার আয়োজনের ঘোষণা দেয়া হয় । উক্ত সভার দুই দিন পূর্বে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন শেখ মনি, আবদুর রব, এনায়েতুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, সহিদুল হক মুন্সী প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ আমাকে বলেন যে, “ওয়াজেদ তুমি কি জানো যে, (NDF) – এর উক্ত জনসভায় জনাব নুরুল আমিন সভাপতিত্ব করবেন বলে (NDF) নেতৃবৃন্দ সাব্যস্ত করেছেন । তুমি তো জানোই ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানোর আদেশ প্রদানকারী উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করলে তিনি রাজনৈতিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। সুতরাং (NDF) – এর এই সিদ্ধান্তকে অবশ্যই বাতিল করাতে হবে । তুমি তো জানোই মুজিব ভাই তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কাজেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তুমি এই কাজটি মুজিব ভাইকে দিয়ে করাতে পারবে ।
২৮। ঐ দিন বিকেল পাঁচটার দিকে ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগ নেতা ইসহাক তালুকদারকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মুজিবের বাসায় যাই। তিনি তখন বাইরে কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় । তিনি আমাদের তার গাড়ীতে বসালেন। তিনি ইসহাক তালুকদারকে সামনের সীটে আর আমাকে পেছনের সীটে তার পাশে বসালেন। নুরুল আমিনকে (NDF) এর সভায় সভাপতিত্ব করার ব্যাপারে ছাত্রলীগের আপত্তির কথা জানালে তিনি বলেন যে, উক্ত ব্যাপারে সিদ্ধান্তটি সোহরাওয়ারদী ও মওলানা ভাসানী সাহেবদের । তাই তার উক্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করার চেষ্টা ব্যর্থ হবে বলে তিনি আমাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন । অতঃপর তিনি তৎকালীন আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানী ভবনটি দেখিয়ে বলেন যে, সেখানে তিনি বসেন এবং চাকুরী করেন । পল্টন ময়দানের দিকে দেখিয়ে তিনি জানালেন যে, প্রস্তাবিত জনসভায় মঞ্চ তৈরি, মাইক্রোফোনের যোগাড়, সভার আয়োজন সম্পর্কিত যাবতীয় কাজকর্ম এবং সে ব্যাপারে টাকা পয়সা খরচের দায়িত্ব তার ওপর দেয়া হয়েছে । অতঃপর তিনি গুলিস্তান সিনেমা হলের পাশে আমাদের নামিয়ে দিলেন। ব্যাথ মনোরথ হয়ে আমরা হলে ফিরে আসি । উক্ত জনসভায় আমি উপস্থিত ছিলাম । নুরুল আমিন সভাপতিত্ব করেছিলেন । চার পাচ জন নেতার বক্তৃতার পর বক্তব্য রাখলেন শেখ মুজিব । তারপর মওলানা ভাসানী, সবশেষে সোহরাওয়ারদী সাহেব । সভাপতির বক্তব্যে নুরুল আমিন বলেন, “সূর্যাস্ত যাওয়ার শেষ প্রান্ত, আমারও জীবন সায়াণহ এসে গেছে ।“ অতঃপর উক্ত জনসভায় তাকে সভাপতিত্ব করার সম্মান ও জনগনের কাছে কিছু বলার সুযোগ দেয়ার জন্য তিনি নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর নিকট তার কৃতজ্ঞটা প্রকাশ করে তার বক্তব্য শেষ করেন । এ ঘটনার মধ্যে দিয়েই মুসলিম লীগের অতি পরিচিত শীর্ষ স্থানীয় নেতা জনাব নুরুল আমিন রাজনীতিতে সসম্মানে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হন ।
২৯। ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্ররা আইয়ুব খান সরকারের বিরুদ্ধে আর এক দফা আন্দোলন করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হামিদুর রহমানের নেতত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদে । ঐ আন্দোলন সংগঠিত করার পেছনেও শেখ মুজিবের সরবাধিক ভুমিকা ছিলো । ছাত্ররা সারা দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে ১৭ ই সেপ্টেম্বর (১৯৬২) তারিখে । এ দিন ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা স্বত্বেও রাস্তায় রাস্তায় ছাত্র জনতার মিছিল বের হয় । ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোরসহ দেশের অনান্য শহরে পুলিশ ও অনান্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘটিত সংঘর্ষে অনেকে আহত ও কয়েকজন নিহত হবার খবর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । উক্ত আন্দোলনের সময়ও ছাত্রসহ বহু লোককে গ্রেফতার করা হয় । উক্ত আন্দোলনেও আওয়ামীলীগের সমর্থক ছাত্রলীগ অগ্রণী ভুমিকা পালন করে ।
৩০। ইতোমধ্যে আমার এম. এস. সি ডিগ্রীর জন্য থিসিসের কাজ শেষ করি । তখনও আমাদের ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি। তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের বিজ্ঞাপন দেখে আমরা পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের কয়েকজন চাকুরীর জন্য আবেদন করি । ১৯৬২ সালের নভেম্বরের শেষের দিকে আমাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় । ঐ সাক্ষাৎকার বোর্ডের সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক ইন্নাস আলী । তার কাছ থেকে জানতে পারি যে, আমি সাক্ষাৎকারের ফলাফলে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম । ডিসেম্বরের শেষের দিকে চাকুরীর নিয়োগপত্র পাই এবং আমাকে উক্ত নিয়োগপত্রে ৩০ এপ্রিল (১৯৬৩) তারিখের মধ্যে তৎকালীন পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রে যোগাযোগ করতে বলা হয় । ঐ নিয়োগপত্র পেয়ে আমি দেশের বাড়িতে গিয়ে বাবা মার দোয়া নিয়ে ঢাকা ফিরে আসি ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৯৬৩-১৯৬৮ সাল
১। ১৯৬৩-এর ফেব্রুয়ারীর গোড়ার দিকে একদিন ঢাকা হল ক্যান্টিনে শেখ মণির সঙ্গে দেখা হলে আমি তাকে আমার চাকুরীর সংবাদটি জানাই। শেখ মণি বলে, “তুই তো লাহোর থেকে বিদেশে Ph.D করতে যাবি। আমার আত্মীয়ের বড় মেয়ে এখন নবম/দশম শ্রেণীতে পড়ে। তাকে বিয়ে করে সঙ্গে করে নিয়ে যা।“ আমি বললাম, “মণি, Ph.D সম্পন্ন করার আগে আমি বিয়ে করবো না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সুতরাং আমি তোমার অনুরোধ রাখতে পারছি না বলে দুঃখিত।“
২। সে সময় নিজের খরচে টিকেট কিনে লাহোরে যেতে বলা হয়েছিলো, কিন্তু আমার কাছে প্রয়োজনের তিন শত টাকা কম ছিল। আমি মতি ভাইয়ের বাসায় গিয়ে এ সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। আমার কথা শুনে মতিউর রহমান সাহেব আমাকে তিন শত টাকার চেক লিখে দেন। উক্ত ধার আমি ১৯৬৭ সালে ইংল্যান্ড হতে ফিরে পরিশোধ করতে চাইলে তিনি নেননি। আমি তাঁর কাছে এখন পর্যন্ত তিন শত টাকা ঋণী। আমি লাহোরে যাওয়ার পূর্বদিন মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমি পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনে চাকুরী পেয়েছি জেনে তিনি খুব খুশী হন এবং আমাকে মোবারকবাদ জানিয়ে জীবনে আমি যেন কামিয়াব হই তাঁর জন্য সর্বান্তকরণে দোয়া করেন। এরপর তাঁর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলি। পরের দিন, ৮ই এপ্রিল (১৯৬৩) বিকেলে PIA করে লাহোরের পথে রওনা হই।
৩। ঐদিন একই ফ্লাইটে আমার আরও তিনজন সহপাঠী ফরহাদ হাসান মোহাম্মদ ফয়সাল, শামসুজ্জামান মজুমদার ও অমল কৃষ্ণ দাসসহ আমরা লাহোর পৌছাই রাত ৮ টার দিকে। আমাদের জন্য লাহোরস্ত আণবিক শক্তি কেন্দ্র থেকে মাইল খানেক দক্ষিণে লাহোরে নব-নির্মিত স্টেডিয়ামের নীচে আণবিক শক্তি কমিশন কর্তৃক ভাড়াকৃত তৎকালীন অস্থায়ী বাসস্থানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়ে। তখন স্টেডিয়ামের আশেপাশে কোনো দোকানপাট ও বাড়িঘর ছিলো না। রাতে শেয়াল ডাকতো । শুধু মাঝে মধ্যে কয়েকজন এসে স্টেডিয়ামের
মাঠে পানি দিতো। পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের স্টেডিয়ামে ভাড়াকৃত আটটি ছোট ছোট কক্ষে আমরা চারজন বাঙ্গালী ছাড়া আর কেউ ছিলো না। আণবিক শক্তি কমিশন লাহোরের মডেল টাউনে একটি বিরাট দোতলা বাড়ি ভাড়া করে আণবিক শক্তি কেন্দ্রের আমাদের মতো জুনিয়র কর্মকর্তাদের থাকতে দিয়েছিলো। ঐ গেস্ট হাউজের চারজন বাঙ্গালী ছাড়া আর সবাই ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানী। লাহোরের তরুণ পশ্চিম পাকিস্তানী বিজ্ঞানীদের সকলেরই পারিবারিক বাসস্থান ছিলো এবং প্রায় প্রতিদিনই তারা রাতে বাসা থেকে খেয়ে আসতো। পাঞ্জাবী তরুণ বিজ্ঞানীদের নিম্নস্তরের একাডেমিক কেরিয়ার থাকা সত্ত্বেও বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাঠানোর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। কিছু দিন পর মডেল টাউনের গেস্ট হাউসের দু’টো রুম খালি হলে তা আমাদের চারজনের জন্য অবশেষে বরাদ্দ করা হয়। এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়।
৪। একদিন অফিসে হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের আমার পরবর্তী ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক আতিয়ার রহমানের কাছ থেকে টেলিফোন আসে। সে আমাকে জানায় যে, পাকিস্তান জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের সভায় যোগদান করার জন্য সে লাহোরে এসেছে এবং কয়েকদিন থাকবে। তাকে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আণবিক শক্তি কেন্দ্রের অফিসে আসতে বলি। আতিয়ার আমাকে জানায় যে, জেনারেল আজম খানের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছে এবং সে তাকে আমার লাহোরে অবস্থানের কথা জানিয়েছে। আতিয়ার আরো জানায় যে, পরদিন দুপুরে জেনারেল আজম খান আমাদের দুজনকে দাওয়াত দিয়েছেন।
৫। পরদিন আমরা দুজন দুপুর ১২টার দিকে লাহোরস্ত ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল আজম খানের বাসায় যাই। এক তরুণী সুন্দরী মেয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এবং তিনি নিজেকে আজম খানের মেয়ে বলে পরিচয় দিলেন। কিছুক্ষণ পর জেনারেল আজম খান ও তাঁর স্ত্রী বৈঠকখানায় এলেন। উল্লেখ্য, আমাদের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নর হাউসের সকল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ছাত্রাবাসের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহ-সভাপতিদের দাওয়াত দেয়া হতো। ঐ সুযোগে জেনারেল আজম খানের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরিচয়ের প্রথম দিনের আলাপের সময় জেনারেল আজম খান বলেছিলেন যে, তিনি খবর পেয়েছিলেন যে, আমি মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবেই ফজলুল হক হলের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম, ছাত্রনেতা বাঁ একটিভিস্ট হিসেবে নয়। যা হোক, সেদিন খাওয়ার সময় আতিয়ার ও আমাকে উদ্দেশ্য করে আজম খান বলেন, “আইয়ুব খান আমাকে এই বাড়ীতে কড়া পাহারায় অন্তরীণ রেখেছেন। শেখ মুজিবকে অবশ্যই বলবে তিনি যেন কোনো অবস্থাতেই আইয়ুব খানের সঙ্গে আপোষ না করেন। তাকে আমি গভীর শ্রদ্ধা করি ও তাঁর সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করি।“ অতঃপর জেনারেল আজম খান তাঁর মেয়েকে আমাদের লাহোর শহর ঘুরে দেখাতে বলেন। এর কয়েকমাস পর ফরহাদ হাসান মোহাম্মদ ফয়সাল, শামসুজ্জামান মজুমদার, অমল কৃষ্ণ দাস ও আমি একত্রে সেপ্টেম্বর-এর প্রথম সপ্তাহের দিকে যুক্তরাজ্যে উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।
৬। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পিরিয়াল কলেজে আমি পিএইচ.ডি. ডিগ্রীর প্রাথমিক স্তর হিসেবে “ডিপ্লোমা অব ইম্পিরিয়াল কলেজ (D.I.C)” কোর্স শুরু করি। উক্ত কোর্সে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জন ছাত্র ছিলো। এক বছর পর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলে আমি প্রথম চারজনের মধ্যে ছিলাম। উল্লেখ্য, আমাদের বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন পাকিস্তানের অধ্যাপক আবদুস সালাম। D.I.C-তে যারা ন্যূনতম ৭০% নম্বর পায় কেবল তাদেরকেই পিএইচ.ডি. ডিগ্রীর জন্য ভর্তির সুপারিশ করা হয়। অধ্যাপক সালাম ঐ বছর ইটালীর ট্রিয়েস্টে অবস্থিত “ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিকস (I.C.T.P)” –এর পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হওয়ায় এবং যুক্তরাজ্যের বাইরে কলোম্বো প্ল্যান ফেলোশীপ দেয়ার নিয়ম না থাকায় আমাকে ইংল্যান্ডের ডারহামস্থ অতি প্রসিদ্ধ এবং অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাচীন ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ই.জে.স্কয়ার্স-এর অধীনে পিএইচ.ডি. ডিগ্রী করার জন্য সাব্যস্ত করা হয়। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ ডারহাম কাউন্টির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের বহু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পড়াশুনা করতো। এ ছাড়াও সেখানকার কিছু কলকারখানায় বহু সংখ্যক পাকিস্তানী কর্মরত ছিলো। তখন ডারহামে আমরা মাত্র পাঁচজন বাঙ্গালি ছিলাম। পরের বছর ফজলুল হক হলের আমার সহপাঠী আবদুস সোবহান ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আমার এক বছরের জুনিয়র একজন ছাত্র ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।
ঐ সময়টা ছিল ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এ মাসের গোড়ার দিকে কাশ্মীরের শ্রীনগরস্থ প্রধান মসজিদে রক্ষিত রসূলুল্লাহ হযরত মোহাম্মদ (সাঃ)-এর চুল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হওয়ার খবর পাই। এই ঘটনার কয়েকদিন পর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে। যুদ্ধ প্রায় সতেরো দিন স্থায়ী ছিল। যুদ্ধ থামার পর লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় শেখ মুজিবের দেয়া একটি ইশতেহার দেখতে পাই। তিনি কাশ্মীর সমস্যা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করার জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনগণের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি এও অভিযোগ করেছিলেন যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ব্যবস্থা ও শক্তি দুর্বল রাখার কারণে যুদ্ধের সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা সাংঘাতিক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এই সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে সামরিক ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাঙালিদের নিয়োগ করার দাবিও তিনি জানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি পরিহার করার দাবিও জানিয়েছিলেন উক্ত ইশতেহারে।
(Unicoded by Kazi rakib)
৮। এর সপ্তাহখানেক পরে লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের তৎকালীন শিক্ষা কর্মকর্তা জনাব হাবিবুর রহমান ডারহামে প্রশিক্ষণরত পাকিস্তানী ছাত্রছাত্রী ও অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ডারহামস্থ পাকিস্তানী সমিতি এই উপলক্ষে একটি সভার আয়োজন করে। উক্ত সভায় জনাব হাবিবুর রহমান ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে আমাদের মতামত জানতে চান। প্রায় সবাই উক্ত যুদ্ধ শুরু করার জন্য ভারতকে দায়ী করে নিন্দা জ্ঞাপন করে। এরপর জনাব হাবিবুর রহমান তৎমর্মে পাকিস্তানী সমিতির ডারহাম শাখার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করার পরামর্শ দিলে আমি বলি যে, ঐ মুহূর্তে আমাদের এমন কিছু করা সমীচীন হবে না যা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে সহায়ক না হয়ে পাক-ভারতের মধ্যে বিরাজিত উত্তেজিত পরিস্থিতিকে আরো বেশি উত্তপ্ত করে তুলতে পারে। আমার বক্তব্য শেষ না হতেই পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যরা মারমুখী হয়ে আমাকে ঘেরাও করে আমার কথা প্রত্যাহার করার দাবি জানায়। তখন জনাব হাবিবুর রহমান সাহেবের হস্তক্ষেপে তারা নিবৃত্ত হয় এবং আমি কোন রকমে তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাই। যাহোক, পশ্চিম পাকিস্তানীরা, বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা যে একজন বাঙ্গালীর সামান্য মত পার্থক্যকেও সহ্য করতে পারতো না আমার অভিজ্ঞতার স্মৃতিপটে এই ঘটনা আর একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে সংযোজিত হলো।
৯। ১১ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) তারিখে শেখ মুজিব ৬ দফা ঘোষণা করে তার ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছে বলে ইংল্যান্ডের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় (পরিশিষ্ট-১ দ্রষ্টব্য)। শেখ মুজিবের ৬ দফার ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপনের জন্য পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি দীর্ঘ দিনের বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণ যে মূলত দায়ী তৎমর্মেও পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়। শেখ মুজিবের ৬-দফা দাবি প্রদানে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রশাসন যে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল তৎসম্পর্কেও কিছু কিছু সংবাদ পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়। ঐ সময় পাকিস্তান সমিতির বিভিন্ন সভায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। স্পষ্টতই বাঙ্গালীরা ৬-দফার সমর্থনে জোরালো যুক্তি পেশ করে। লক্ষণীয়, এই ঘটনার পর থেকে বাঙ্গালী ও পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবিদের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে তার অবনতি ঘটে।
১০। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৬-দফার দাবি ঘোষণার পর তার পক্ষে সমর্থন ও জনমত গড়ে তোলার লক্ষ্যে শেখ মুজিব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলায় রাজনৈতিক সফর ও সভাসমাবেশের কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ১৯৬৬ সালের ১৮ই মার্চ ঢাকায় “ইডেন হোটেল” প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে “আমাদের বাঁচার দাবি” শিরোনামে শেখ মুজিবের ৬-দফার দাবি পুস্তিকাকারে প্রকাশ করা হয়। এর ফলে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের মধ্যে অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য ও অনুপ্রেরণার সৃষ্টি হয়। উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে ৬-দফার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ব্যক্ত করে সমবেত কাউন্সিলরগণ শেখ মুজিবকে সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে আওয়ামী লীগের নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদ গঠন করেন। পক্ষান্তরে আইয়ুব খান বললেন, “অস্ত্রের ভাষায় ৬-দফার জবাব দেওয়া হবে।” আইয়ুব খান সরকারের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান বললেন, “আমি যতোদিন গভর্নর থাকবো ততোদিন শেখ মুজিবকে জেলেই পচতে হবে।”
১১। আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর সাধারণ জনগণের কাছে তাঁর ৬-দফা দাবির ব্যাখ্যা প্রদানের উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব সারা প্রদেশে রাজনৈতিক সফরে বের হন। একই সঙ্গে গভর্নর মোনেম খান শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে খুলনায় এক বিশাল জনসমাবেশে শেখ মুজিব তাঁর ৬-দফা দাবির পক্ষে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। উক্ত সভাশেষে ঢাকায় ফেরার পথে শেখ মুজিবকে “রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক” বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। যাহোক, তখন কোর্টে আপীল করলে তাঁকে জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। এরপরও শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক সভাসমাবেশের কর্মসূচী অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তিনি যখন যে জেলায় জনসমাবেশে ভাষণ দেন তখন সে জেলায় তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা দায়ের করে হুলিয়া জারি করা হয়। শেখ মুজিবের ৬-দফার রতি জনগণের বিপুল সমর্থন লক্ষ্য করে আইয়ুব খানের সরকার তাঁর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং অবশেষে তাঁকে ‘পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে’র আওতায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারারুদ্ধ করে ১৯৬৬ সালের ৮ই মে তারিখে। ঐ দিন বিকেলে শেখ মুজিব নারায়ণগঞ্জে স্মরণাতীতকালের এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে আইয়ুব খানের সরকার বিভিন্ন অভিযোগে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দায়ের করেছিল বারোটি মামলা। শেখ মুজিবকে ‘পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে’ অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক করার পর আইয়ুব খানের সরকার আওয়ামী লীগের আট শতাধিক নেতা ও কর্মীকে কারারুদ্ধ করে। এঁদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ, শ্রম সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক এডভোকেট এ. মোমিন, জুনিয়র সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ, অন্যতম সহ-সভাপতি ক্যাপ্টেন (অব.) এম. মনসুর আলী, সমাজসেবা সম্পাদক কে. এম. ওবায়দুর রহমান, দফতর সম্পাদক এডভোকেট মোহাম্মদুল্লাহ, ওয়ার্কিং কমিটি সদস্য মোল্লা জালালউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের আট শতাধিক নেতা ও কর্মীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারারুদ্ধ করেও আইয়ুব খানের সরকার ৬-দফার আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পারেনি। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬-দফা আন্দোলনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ৭ই জুনের সফল হরতাল। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৬ দফা বাস্তবায়ন ও কারারুদ্ধ নেতা ও কর্মীদের মুক্তির দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন সারাদেশে হরতাল আহবান করা হয়। ঐদিন দেশের বিভিন্ন শহরে ছাত্র, জনতা ও শ্রমিকের সঙ্গে পুলিশ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষ সংঘটিত হয় নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায়। এ সমস্ত সংঘর্ষে বহু লোক গ্রেফতার ও হতাহত হয়। একমাত্র নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকের সংঘটিত সংঘর্ষে ১০ জন শ্রমিক নিহত হয়।
১২।
আমার পিএইচ. ডি. পরীক্ষা শেষ হয় ১৯৬৭ সনের আগস্ট মাসে। মৌখিক পরীক্ষা শেষ হয় আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে। মৌখিক পরীক্ষা শেষে আমি বিভাগীয় কফি কক্ষে চলে যাই। এর কিছুক্ষণ পর বাইরের পরীক্ষকদ্বয়কে নিয়ে অধ্যাপক স্কয়ার্স কফি কক্ষে প্রবেশ করে আমাকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রী দেয়া হয়েছে বলে অভিনন্দন জানান। পরীক্ষার ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হবে তার জন্য আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। যা হোক, প্রফেসর স্কয়ার্সের অন্যান্য গুণের সঙ্গে এ ঘটনাটিও আমাকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় অভিভূত করে। আগস্ট মাসে আমার স্কলারশীপ শেষ হওয়ায় সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখে দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে লন্ডনে চলে যাই। লন্ডনে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করে ৮ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় লন্ডন ত্যাগ করি এবং ৯ই সেপ্টেম্বর করাচী পৌঁছাই। করাচীতে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট করি। অতঃপর আমাকে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদ থেকে উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার পদে পদোন্নতি দিয়ে ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রে পদস্থ করা হয়। আমি ১২ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় পৌঁছাই এবং পরদিন ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রে যোগদান করি। এরপর আনি ঢাকা কলেজের পাশে কলেজ স্ট্রীটের নীচতলায় দুই কক্ষ-বিশিষ্ট একটি বাসা ভাড়া নিই।

১৩। একদিন আমি বিকেলে গুলিস্তান সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে যাই। সিনেমা হল থেকে বের হয়ে একটি ছেলেকে সান্ধ্য পত্রিকা হাতে শেখ মুজিবের জেলখানার গেটে বিচার শুরু হয়েছে বলে চিৎকার করতে শুনি। আমি পত্রিকাটি কিনে উদগ্রীব হয়ে সমস্ত বিষয় গভীরভাবে পড়লাম। ঐ সংবাদে আওয়ামী লীগের ১৫ নম্বর পুরানা পল্টনস্থ অফিসের ঠিকানা ছিল। অতঃপর আমি আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে মাত্র কয়েকজন ব্যক্তির এখানে সেখানে ঘোরাফেরা করতে দেখতে পাই। এর কিছুক্ষণ পরেই ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান, সৈয়দ মজহারুল হক বাকী ও গোলাম রসুল ময়না সেখানে আসে। আমাকে দেখে তারা তিনজনই বিস্ময়ে হতভম্ব হয়। যা হোক, আমি পিএইচ. ডি. ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরেছি শুনে তারা ভীষণ খুশি হয়। তারা আমাকে বলে যে, আমি আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে মারাত্মক ভুল করেছি, কারণ ঐ সময় কেন্দ্রীয় সরকারের ইঙ্গিতে এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খানের নির্দেশে শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোস্তাক আহমদ, জিল্লুর রহমান প্রমুখ নেতাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। তারা আমাকে আরো জানায় যে, আওয়ামী লীগের অন্যান্য
Unicoded by মোহাম্মদ ফেরদৌস ইউসুফ, কলেজছাত্র, রাঙামাটি।
নেতা ও কর্মীর ওপর বিভিন্নভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। অতএব তারা বলে যে, আমার কোনমতেই আওয়ামী লীগ অফিসে যাওয়া ঠিক হয়নি।
১৪। ঐ সময়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন সাহেব কারারুদ্ধ থাকায় জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে অফিসে কর্মরত ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আমাকে মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েই তোপখানা রোডস্থ একটি রেঁস্তোরায় নিয়ে যায়। তারা আমাকে জানায় যে, শেখ মুজিব কর্তৃক ঘোষিত ছয় দফার পক্ষে বিপুল জনসমর্থন দেখে সরকার ভীত হয়ে শেখ মুজিবসহ প্রায় সকল আওয়ামী লীগ নেতাকে কারারুদ্ধ করে সমস্ত দেশে ত্রাসের সৃষ্টি করছে। শেখ মুজিবের পরিবারবর্গের ওপরও বিভিন্ন প্রকারের হয়রানি ও নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তারা আমাকে জানায় যে, উক্ত পরিস্থিতির কারণে ছাত্রলীগ কিংবা আওয়ামী লীগ, এমন কি শেখ মুজিবের আত্মীয়স্বজনও সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে শেখ মুজিবের বাসায় প্রকাশ্যে যায় না। অতঃপর সিরাজুল আলম খান ও ময়নাকে নিয়ে আমি আমার বাসায় চলে আসি। বাসায় এলে সিরাজুল আলম খান আমাকে জানায় যে, ময়না ছোটখাট কন্ট্রাকটারী ও ইনডেন্টিং- এর কাজ করে। কিন্তু মোনেম খান সরকারের ইঙ্গিতে তার বিলগুলো কয়েকমাস ধরে আটকে রাখায় তারা তখন কপর্দহীন। এ কথা শুনে আমি বেদনাহত হই এবং তৎক্ষণাৎ ময়নার নামে একটি তিন শত টাকার চেক সই করে দিই। সেদিন সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে ছয় দফার বিষয়ে বিস্তারিত ও সুদীর্ঘ আলাপ-আলোচনা হয়। ওদের কাছ থেকে আরও জানতে পারি যে, ৬ দফার প্রতি দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন জানানো ও তৎমর্মে জোরালো ভাষায় নিবন্ধ লেখার জন্য দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক ও রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অঙ্গনে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ত্ব জনাব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে দীর্ঘ দিন যাবৎ কারারুদ্ধ রাখা হয়েছে এবং দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রকাশনা অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওরা রাত প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে আমার বাসা ত্যাগ করে। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু মানিক মিয়াকে (কাকাকে) অত্যন্ত সমীহ ও শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁকে “মানিক ভাই” বলে সম্বোধন করতেন।
১৫। এর পরের দিন আকস্মিকভাবে জনাব মতিউর রহমান আমাকে টেলিফোন করেন। তিনি আমাকে সাফল্যজনকভাবে বিদেশে পিএইচ. ডি. ডিগ্রী করে দেশে ফিরে আসার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে সেদিন দুপুরে তাঁর বাসায় খেতে বলেন। তিনি আমাকে তাঁর গুলশানস্থ বাসায় নিয়ে যান। তখন তাঁর বাসাটি ছিল একতলা। খাওয়া দাওয়ার পর মতি ভাই ও ভাবী আমার কাছে জানতে চান বিদেশে আমি বিয়ে শাদী করেছি কিনা। তখনও আমি অবিবাহিত রয়েছি জেনে তাঁরা জানতে চাইলেন আমি অতি তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো কিনা। আমি তাঁদেরকে জানাই যে, তিন মাসের মধ্যে আমি বিয়ের কাজটি সম্পন্ন করতে চাই। আমি তাঁদের জানাই যে, আগামী দুই একদিনের মধ্যেই আমি গ্রামের বাড়িতে যাবো। সেখান থেকে ফিরে আসার পর আমাকে পাত্রী দেখাতে পারলে আমি খুশী হবো। তাঁরা জানতে চাইলেন, আমার কি ধরনের পাত্রী পছন্দ। আমি জানাই, “প্রথমত পাত্রীকে কোনক্রমেই কোটিপতির কন্যা কিংবা আপস্টার্ট মেয়ে হওয়া চলবে না। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে হলে আমি খুশী হবো। মেয়েকে অবশ্যই সুরুচিসম্পন্না, অমায়িক ও সদাচার স্বভাবের হতে হবে।”
১৬। এর দু’দিন পর আমি রংপুরের পীরগঞ্জ থানার ফতেহপুর গ্রামে মায়ের দোয়া নিতে যাই। সেখানে ছয় দিন অবস্থান করার পর আমি ঢাকায় ফিরে আসি। এর দুদিন পর মতি ভাইয়ের কাছ থেকে আবার টেলিফোন পাই। তিনি ঐ দিনেই দুপুরে আমাকে তাঁরর বাসায় এক সঙ্গে খাওয়ার কথা বলেন এবং সেখানে আমার বিয়ের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা হবে বলে জানান। তিনি সেখানে আমাকে বলেন যে, আমি পাত্রীর যে বিবরণ দিয়েছি তেমন পাত্রী তাঁরা কোথাও খুঁজে পাননি। তারপর তিনি বলেন, “তুমি মুজিব ভাইয়ের মেয়ে হাসিনাকে দেখেছো? ও কয়েক দিন আগে আমাদের বাসায় এসেছিলো। আমার মনে হয় ওর সঙ্গে তোমাকে খুব মানাবে।” আমি বললাম যে, সেটাতো রাজনৈতিক সম্পর্ক, নিকট আত্মীয় বা রক্তের সম্পর্ক নয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের প্রায় সকলেই তো তাঁকে ভাই বলে সম্বোধন করে। আমি একটু চিন্তা করে হাসিমাকে দেখার সুযোগ দেয়ার লক্ষ্যে ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করি। এর দু’দিন পর আবার মতি ভাই আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। খাওয়ার পর তিনি ও ভাবী আমাকে জানান যে, ঐদিন সন্ধ্যে সাতটার সময় হাসিনা ও তার পরিবারের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক পরিচয় করার আয়োজন করা হয়েছে। অতঃপর মতি ভাইকে বলেন, “চল এখন মার্কেটে গিয়ে কিছু কেনাকাটা করে আসি।”
১৭। ভাবীসহ আমরা বায়তুল মোকাররম থেকে আমার পছন্দমত একটি আংটি নির্বাচন করি। আমার নিকট পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ভাবী এ আংটির মূল্য পরিশোধ করেন। এরপর আমরা তাঁদের গুলশানস্থ বাসায় ফিরে আসি। সন্ধ্যে সাতটার দিকে হাসিনার আম্মা, শেখ কামাল, শেখ শহিদ, মরুব্বী ধরনের এক ভদ্রলোক মতি ভাইয়ের বাসায় আসেন। শেখ শহিদ আমাকে আগে থেকেই চিনতো। তাঁদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার পর বিয়ের ব্যাপারে কিছু আলোচনা হয়। তখনও হাসিনা সেখানে আসেনি।
১৮। হাসিনার আম্মাকে খাবার টেবিলের আগ্রভাগে বসানো হয়, আমাকে তাঁর বিপরীত স্থানে। এর অল্প কিছুক্ষণ পরে হাসিনা খাবার ঘরে প্রবেশ করে বলে, “বা-বা, কিছুক্ষণ আগে কলেজের সংসদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করে মুক্ত হলাম।” এ কথাগুলো বলতে বলতে হাসিনা তার মার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আমার দিকে মুখোমুখি হওয়ার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি হাসিনা না?” হাসিনা বলে, “হ্যাঁ, আমি হাসিনা।” এ কথাটুকু বলেই খাবার ঘর ছেড়ে হাসিনা চলে যায়।
১৯। নাস্তার শেষে আমরা সবাই বসার ঘরে ফিরে যাই। এরপর আমাদের বিয়ে সম্পর্কে আবার আলাপ-আলোচনা হয়। বিয়ের প্রস্তাবে আমি সম্পূর্ণ সম্মতি জ্ঞাপন করি। তবে আমি তাঁদের জানাই যে, আমার মা, একমাত্র জীবিত মামা ও বড় দুলাভাইয়ের মতামত নিয়ে বিয়ের তারিখ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন হবে বলে মনে করি। হাসিনার আম্মা বলেন যে, তিনি বিষয়টি নিয়ে জেলগেটে শেখ সাহেবের সঙ্গে আলাপ করেছেন। তিনি আরও বলেন যে, হাসিনার আব্বা এ বিয়ের ব্যপারে ঐ দিনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বিশেষভাবে বলেছেন। অতঃপর কিছু এটাসেটা বলার পর তখনকার পরিস্থিতি এবং শেখ সাহেবের পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটি ঐদিন পাকাপাকি করতে সম্মত হই। এরপর আমি বলি যে, আমার বাবা বেঁচে নেই। ১৯৬৩ সালে লাহোরে কর্মরত থাকার সময় জুলাই মাসে হঠাৎ বাবার মৃত্যুর সংবাদ পাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ঐ সংবাদে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এলেও বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি। এর আগের দিন বাবাকে দাফন করা হয়েছিলো। অতএব বিয়েতে আমি বিশেষ কিছু দিতে পারবো না। দ্বিতীয়ত, তাঁদের কাছ থেকে আমার কোন কিছু দাবি বা প্রত্যাশাও নেই।
২০। এরপর হাসিনাকে বসার ঘরে নিয়ে আসা হয়। আমি হাসিনার হাতে আংটি পরিয়ে দেয়ার সময় লক্ষ্য করি আংটিটি তার আঙ্গুলের মাপের চেয়ে বেশ বড়। এরপর হাসিনার আম্মা আমার হাতে একটি আংটি পরিয়ে দিয়ে আমাদের জন্য দোয়া করেন। এর কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই চলে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ি। হাসিনার আম্মা তাঁদের গাড়ীতে আমি যাবো কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করেন। আমি কিছু ইতস্ততঃ করে তাঁদের সঙ্গে যেতে সম্মত হই। সেদিন শেখ কামাল গাড়ীটি চালাচ্ছিলো এবং তাদের বাসার নিকট পৌঁছার পূর্বে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয় তাদের বাসায় যেতে আমার আপত্তি আছে কিনা। আমি তাদের বাসা দেখার আগ্রহ সম্বরণ করতে না পেরে প্রস্তাবে রাজী হই। গাড়ীটি তাদের বাসার সামনে থামার পরপরই হাসিনা দ্রুত গাড়ী থেকে বের হয়ে বাড়ীর ওপর তলায় চলে যায়। আমরা বসার ঘরে গিয়ে বসি। বসার ঘড়টি প্রায় দৈর্ঘ্যে ২৫/৩০ ফুট, ডাইনিং-কাম ড্রয়িং রুম। ঘরটি অতি সাধারণ বসার ঘর। রাত প্রায় এগারটার দিকে ফজলুল হক মুন্সী নামের এক ড্রাইভারের মাধ্যমে আমাকে আমার কলেজ স্ট্রীটের ফ্লাটে পৌঁছে দেয়া হয়।
২১। এর একদিন পর মতি ভাই দুপুরে আমাকে জানান যে, ঐদিন সন্ধ্যেয় আমার বিয়ের আক্‌ত (রুসমত) সম্পন্ন করার আয়োজন করা হয়েছে। সেদিন দুপুরে মতি ভাই আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যান এবং খাওয়া-দাওয়ার পর আক্‌ত অনুষ্ঠান উপলক্ষে কিছু কেনাকাটা করার জন্য বাজারে নিয়ে যান। উল্লেখ্য, আক্‌ত অনুষ্ঠানের ব্যাপারটি যে কি তখন সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিলো না। যাহোক, প্রথমে আমাকে স্টেডিয়াম মার্কেটে নিয়ে একটি শাড়ীর দোকান থেকে আক্‌ত অনুষ্ঠান উপলক্ষে একটি শাড়ী নির্বাচন করতে বলা হয়। আমি লাল গোলাপী রংয়ের একটি শাড়ী নির্বাচন করি। এরপর আরো কিছু কাপড়-চোপড় ও প্রসাধনী দ্রব্য কিনি। দুর্ভাগ্যবশত আমার নিকট পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় ঐ সব দ্রব্যের মূল্য ভাবী পরিশোধ করেন। এরপর আমরা চলে যাই নিউ মার্কেটে। সেখানে একটি জুতোর দোকানে আমাকে একটি স্যুটকেস ও এক জোড়া স্যান্ডেল নির্বাচন করতে বলা হয়। আমি একটি মাঝারি আকারের ক্রিম রংয়ের নতুন ডিজাইনের স্যুটকেস নির্বাচন করি। হাসিনার পায়ের মাপ না জানা সত্ত্বেও আমাকে এক জোড়া স্যান্ডেলও নির্বাচন করতে হয়। এসবের মূল্যও ভাবী পরিশোধ করেন। এরপর তাঁরা আমাকে আমার বাসায় নামিয়ে দিয়ে আক্‌ত অনুষ্ঠানে রাত ৮টার দিকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানান। আমি তাড়াতাড়ি করে আমার বড় বোনের বড় ছেলের মামা শ্বশুর লতিফ ভাই (পরবর্তীতে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর বড় মেয়ের বিয়ে হয়) এবং ভাগ্নে বৌয়ের বড় ভাই আফজাল আহমেদ রানাকে টেলিফোনে এ সম্পর্কে জানিয়ে তাদেরকে রাত ৮টার আগে আমার বাসায় আসার জন্য অনুরোধ করি। রাত সাড়ে আটটার সময় মতি ভাই ও ভাবী এসে আমাদের শেখ সাহেবের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাসায় নিয়ে যান ।
২২। বসার ঘরে প্রবেশ করে দেখি আমাকে বসানোর জন্য আলাদা করে ডিভানে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশের চেয়ারগুলোতে একজন মাওলানাসহ মাত্র কয়েকজন মুরুব্বী গোছের ব্যক্তি বসেছিলেন। পরিচয় পর্বে জানতে পারি যে, তাঁদের একজন ছিলেন শেখ সাহেবের ছোট বোন জামাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সিনিয়র সেকশন অফিসার এ. টি. এম. সৈয়দ হোসেন এবং আরেকজন হাসিনার সম্পর্কে নানা। হাসিনারা তাঁকে তানু নানা বলে ডাকে। সেদিনেই বিয়ে পড়ানো ও কাবিন নামায় স্বাক্ষর করা হবে বলে আমাকে জানানো হয়। সে রাতটি ছিলো ১৭ই নভেম্বর ১৯৬৭ সাল শবে বরাতের রাত। সত্যি বলতে কি, আমি এ ব্যপারের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। আর বিষয়টির মর্মার্থ জানতাম না বলে আমি স্যুট পরে গিয়েছিলাম। এজন্য বিয়ে পড়ানোর কথা শোনার পর কিছু বাকবিতন্ডা হয়। শেষমেষ আমাকে একটি টুপী এনে দেয়ার অনুরোধ করি। এরপর কাবিননামায় স্বাক্ষর করি। উক্ত কাবিনপত্রে পঁচিশ হাজার টাকা বিয়ের দেন মোহরানা সাব্যস্ত করা হয়। অতঃপর দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে আক্‌ত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এর প্রায় এক ঘণ্টা পর বৌ দেখার জন্য আমাকে ওপর তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। হাসিনার ঘরে ঢোকার পূর্ব মুহূর্তে শেখ শহীদ আমার হাতে একটি তাজা বড় লাল গোলাপ দেয়। ঐ ঘরে খাটে বসেছিলো বৌ বেশে হাসিনা ও তার সমবয়সী এ. টি. এম. সৈয়দ হোসেন সাহেবের বড় মেয়ে শেলী ও ছোট বোন রেহানা। রেহানা আমাকে দেখেই বলে, “দুলা ভাই, খালি হাতে বৌ দেখতে এসেছেন। বৌ দেখতে দেব না।”
২৩। এর কিছুক্ষণ পর আমি নীচে চলে আসি। ঐ দিন আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসার সময় জানানো হয় যে, পরদিন বিকেল সাড়ে চারটায় জেল গেটে শেখ সাহেবের কাছে দোয়া নেয়ার জন্য যেতে হবে। জেল গেটের কাছেই আমাদের একটি কক্ষে বসানো হয়। তখন দেখি গোয়েন্দা বিভাগের সেই ইসরাইল সেখানে কর্তব্যরত। ইসরাইল আমাকে অভিনন্দন জানায়। এর একটু অর শেখ সাহেবকে উক্ত কক্ষে আনা হয়। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার জন্য দোয়া করেন। আমরা তাঁকে সালাম করি। আমাকে তিনি একটি রোলেক্স ঘড়ি পরিয়ে দেন। ঘড়ির গায়ে আটকে থাকা কাগজটি থেকে দেখতে পাই সেটির মূল্য ছিল বারো শত টাকা। উক্ত ঘড়িটি এবং আমাদের বিয়েতে হাসিনাকে দেয়া শাড়ী ও স্যুটকেস এখনো আমার কাছে রয়েছে। গত পাঁচ বছর যাবৎ ঘড়িটি আমি ব্যবহার না করে সযত্নে রেখে দিয়েছি। এরপর মিষ্টি বিতরণ করা হয়। এর একটু পর শেখ সাহেব আমাকে ইশারা দেন। ঐ ইঙ্গিতের মর্মার্থ বুঝতে পেরে আমি দরজার অতি কাছে দাঁড়ানো ইসরাইলের কাছে যাই এবং তাঁকে সামনের মাঠের এক কোণায় নিয়ে যাই। আমার ধারণা হয়েছিলো যে, গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তার অনুপস্থিতির সুযোগে শেখ সাহেব আমার শাশুড়ীর সঙ্গে কিছু গোপণ আলাপ করবেন। আমাদের সাক্ষাৎকার শেষে ৭টার দিকে আমরা সবাই শেখ সাহেবের বাসায় ফিরে আসি। বাসায় ফিরে শাশুড়ী আমাকে বলেন, “বাবা তুমি তো বুঝতেই পারছো, মুরুব্বী বলতে এ বাসায় কেউ নেই। কামাল এখনো ছোট। তাছাড়া কোন আত্মীয়-স্বজনও ভয়ে এ বাসায় বিশেষ একটা আসে না। তুমি আমার বড় ছেলের মতো। শেখ সাহেব অনুমতি দিয়েছেন যথাসম্ভব তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে।”
২৪। যাহোক, সেদিন রাতের খাবার শেষে আমি আমার বাসায় চলে আসি। এরপর থেকে শাশুড়ী আমাকে প্রতিদিন বিকেলে গাড়ী পাঠিয়ে তাঁদের বাসায় নিয়ে যেতেন। আমিও সেই সুযোগে হাসিনা ও শ্যালিকাদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টায় সময় কাটাতাম। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে এগারটার দিকে বাসায় ফিরতাম। এভাবে দিন দশেক কেটে যায়। একদিন হাসিনার সেই বান্ধবী ফুফাতো বোন শেলী আমাকে জোরপূর্বক ঐ রাতে ওদের বাসায় থাকতে বাধ্য করে। এরপর থেকে আমি প্রায় রাতেই শেখ সাহেবের বাসায় থাকতাম।
২৫।
একদিন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের করাচীস্থ প্রধান কার্যালয় থেকে ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ছয় সপ্তাহব্যাপী একটি কর্মশালায় যোগদান করার অফিস আদেশ পাই। ঐ কর্মশালা ডিসেম্বরের ৩য় সপ্তাহের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়ার কথা। সেখানে মুখ্য বক্তা হিসেবে বিশেষ কোর্স দেয়ার জন্য নির্বাচন করা হয়েছিলো আমেরিকার রচেষ্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জাপানী অধ্যাপক ওকুবকে। এই সংবাদে আমার শাশুড়ী ইসলামাবাদ যাওয়ার পূর্বে শেখ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন করেন। আমরা যথাসময়ে জেলখানায় যাই এবং পূর্বের সেই একই কক্ষে আমাদের বসানো হয়। গোয়েন্দা বিভাগের সেই একই ইসরাইল উপস্থিত ছিলো। সেদিন দেখলাম, শেখ সাহেবকে দু’জন লোক ধরে নিয়ে আসছে। তিনি জানান যে, প্রায় এক সপ্তাহ ধরে তিনি বাতের ব্যথায় ভুগছেন। আমাকে ইসলামাবাদে যেতে হবে শুনে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেন। সাক্ষাৎকার শেষে জেলে ফিরিয়ে নেয়ার মুহূর্তে তিনি ঐ দুই কর্মচারীকে বলেন যে, তিনি জামাইয়ের কাঁধে ভর করে গেট পর্যন্ত যাবেন। আমার কাঁধে ভর করে যাওয়ার এক পর্যায়ে তিনি আমার কানে ফিস ফিস করে বলেন, “ওয়াজেদ, তুমি ইসলামাবাদে গিয়ে তোমার সহকর্মীদের, বিশেষ করে পাঞ্জাবী সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ছয়-দফা সম্পর্কে তাদের প্রতিক্রিয়া জেনে নেবে। ব্যাটাদের এবার দেখিয়ে দেবো।“ এরপর তাঁকে জেল গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমরা সবাই ফিরে এলাম।
২৬। আমি নির্ধারিত তারিখে ইসলামাবাদে পৌঁছাই। ইসলামাবাদ বিমান বন্দর থেকে আমাকে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের একজন বাঙ্গালী প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত আমার বড় বোনের বড় ছেলে আবদুল কাইয়ুম সরকারের বাসায় নিয়ে যান। আমার ভাগ্নে বৌ তখন পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের আমার এম. এসসি. থিসিসের তৎকালীন সুপারভাইজার অধ্যাপক হারুন-অর-রশীদও ইসলামাবাদ বিশ্বিবিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। আমার ভাগ্নে ও অধ্যাপক হারুন এই দুইজন মাত্র বাঙ্গালী ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী পেয়েছিলেন। যথারীতি কর্মশালা শুরু হয়। এই সুযোগে আমার পাঞ্জাবী সহকর্মী এবং আমার লন্ডনস্থ ইম্পিরিয়াল কলেজে থাকাকালীন পরিচিত পাঞ্জাবী শিক্ষকদের সঙ্গে মেলামেশা করি। তাঁরা সবাই শেখ সাহেবের মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে জেনে বাহ্যত আমাকে অভিনন্দন জানায়। তারা চা বিরতি ও মধ্যাহ্ন ভোজের সময় আলাপ-আলোচনার মাঝে কখনো কখনো ছয় দফার প্রসঙ্গ টেনে আনে। এভাবে আমি ছয় দফার দাবির ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানীদের, বিশেষ করে পাঞ্জাবীদের প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব সম্পর্কে কিছু ধারণা লাভ করি।
২৭। ২০শে জানুয়ারী (১৯৬৮) রাতে ভাগ্নে আমাকে জানায় যে, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোক শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিশেষ আইনের আওতায় গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে বলে গোপণ সূত্র থেকে সে জানতে পেরেছে। এর পরদিন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী শিক্ষক ও ছাত্রবৃন্দের মাঝে বেশ গম্ভীর হয়ে চুপচাপ থাকা এবং আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করি।
২৮। আমি ২৫শে জানুয়ারী ঢাকায় ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। প্লেনে একটা ইংরেজী খবরের কাগজে শেখ সাহেব, তিনজন ঊর্ধ্‌বতন সি. এস. পি. কর্মকর্তাসহ মোট পঁয়ত্রিশ জন সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানতে পারি। ঢাকায় ধানমণ্ডির শ্বশুরের বাসায় দেখি যে, সবাই চুপচাপ ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একটু পরেই শাশুড়ী আমাকে নীচু স্বরে বলেন, “বাবা, গত ১৮ই জানুয়ারী গভীর রাতে তোমার শ্বশুরকে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে গেছে। গত সপ্তাহ থেকে বহু জায়গায় এবং বহু লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখনও পর্যন্ত তাঁকে কোথায় নেয়া হয়েছে, তিনি কি অবস্থায় আছেন সে সম্পর্কে কোন কিছুই জানতে পারিনি।“ একথা বলার সময় শাশুড়ীকে ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখলাম এবং তিনি কোনক্রমেই অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলেন না। এর পর এপ্রিল মাসে (১৯৬৮)- এর গোড়ার দিকে একদিন শাশুড়ী আমাকে জানান, “শেখ সাহেবসহ আরো ৩৪ জন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলায় জড়িয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ রাখা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের কোথায় কি অবস্থায় রাখা হয়েছে এখন পর্যন্তও কিছু জানতে পারিনি।“
২৯। এর মাস খানেক পর ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে একটি বিশেষ ভবনে তথাকথিত “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার” আনুষ্ঠানিক বিচারের আয়োজন করা হয়েছে বলে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পাওয়া যায়। এর প্রায় দুই সপ্তাহ পর একদিন সকাল বেলা সাদা পোশাক পরিহিত দুজন কর্মকর্তা বাসায় এসে আমাদের জানায় যে, সেদিন বিকেল তিনটায় শাশুড়ী ও তাঁর ছেলেমেয়েদের শেখ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সরকার অনুমতি দিয়েছেন। তাঁরা বিকেলে শাশুড়ীকে বাসায় এসে নিয়ে যাবেন বলে জানায়। উক্ত সাক্ষাৎকারের তালিকায় আমার নাম ছিলো না। শাশুড়ী, হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা ও শিশু রাসেলকে যথাসময়ে সাক্ষাৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এই ছিলো শেখ সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সদস্যদের “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়” গ্রেফতার হওয়ার পর প্রথম সাক্ষাৎ। এর দুই সপ্তাহ পর আবার সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়। ঐ সাক্ষাৎকারের তালিকায় শেখ সাহেবের পরিবারবর্গের সদস্যদের মধ্যে আমাকেও প্রথম অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এর পরবর্তীতে প্রতি সপ্তাহের সাক্ষাতের অনুমতির তালিকায় কেবল দুই সপ্তাহ পর পর আমার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হতো।
৩০। ১৯৬৮ সালের ১৯শে জুন তারিখে তথাকথিত “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়” শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, জনাব ফজলুল রহমান, শামসুর রহমান, রুহুল কুদ্দুসসহ আরো ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে উক্ত মামলা শুরু করা হয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক উপরিক্ত ৩৫ জনের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। সরকারের পক্ষ থেকে আইয়ুব খানের এককালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদেরকে প্রধান কৌসুলী করে উক্ত মামলা পরিচালনা করার জন্য একটি কৌসুলী ও পরামর্শদাতা কমিটি গঠণ করা হয়। শেখ মুজিবের সম্পর্কে মামা শ্বশুর পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের এডভোকেট জনাব সালাম খানকে আসামীদের পক্ষ থেকে প্রধান কৌসুলী নিয়োগ করা হয় এবং জনাব আতাউর রহমান খান, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, এডভোকেট কে. এস. নবী, ব্যারিস্টার কে. জেড. আলম, প্রমুখকে এডভোকেট আবদুস সালামের সহকারী নির্বাচিত করা হয়। এছাড়াও ডঃ কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, (তখনো তাঁরা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না) প্রমুখ ব্যক্তিগণ স্বেচ্ছায় এডভোকেট আবদুস সালামকে সহায়তা করেন। যথাসময়ে মামলা শুরু হয়। মামলার সময়ে পরিবার বা বাইরের কাউকে কোর্টে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। সরকার পক্ষ রাজসাক্ষী হিসেবে শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠ বোনের একমাত্র কন্যার স্বামী মীর আশরাফ উদ্দিনসহ দুই শতাধিক জন সাক্ষীর নাম ঘোষণা করে।
৩১। ৬ই আগস্ট (১৯৬৮) তারিখ বিকেলে অফিস থেকে হাসিনাদের বাসায় ফিরে দেখি হাসিনা বিছানায় কাঁথা মুড়ে শুয়ে আছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে হাসিনা জানায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস শেষে বাসায় আসার পর তার পেটে ভীষণ ব্যথা ও যন্ত্রণা হচ্ছে। ডাক্তার আনা হয়েছিলো, কিছু ওষুধপত্র খেতে দিয়েছেন যার ফলে ব্যথা একটু কমেছিলো। ডাক্তার বলেছেন যে, অ্যাপেনডিসাইটিস এমন ব্যথার কারণ হতে পারে। পরদিন এক্সরে করার পরামর্শ দিয়েছেন। এক্সরে রিপোর্ট দেখার পর ডাক্তার বলেন যে, অবিলম্বে অপারেশন করা ছাড়া উপায় নেই। এই সংবাদে আমার শাশুড়ী ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আমি শাশুড়ীকে দুশ্চিন্তার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “বাবা, কার সহায়তায় হাসপাতালে ভর্তি ও অপারেশন করাবো? গভর্নর মোনেম খান সরকারের চক্ষুশূল হওয়ার ভয়ে কেউ সম্মত হবে না বলে আমার ভয় করছে।“
৩২। অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পর ছাত্রলীগের আমিনুল হক বাদশা ডাঃ সার্জেন্ট আসিরুদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ দায়িত্ব নিতে সম্মত হন। অতঃপর ৮ই আগস্টে হাসিনাকে ঢাকা মেডিকেল কলজ হাসপাতালের একটি পুরাতন কেবিনে ভর্তি করা হয়। আমার শাশুড়ী আমাকে আণবিক শক্তি কেন্দ্রের অফিস কাছাকাছি হওয়ায় দিনে বেলায় মাঝে মধ্যে দেখে আসতে এবং রাতে কেবিনে থাকতে বলেন। শাশুড়ী দুপুরে ও রাতে হাসিনার জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। আমি রোজ অফিস সময়ের পর হাসপাতালে চলে যেতাম। হাসিনা কিছুটা সুস্থ্য হয়ে ওঠার পর ১৪ই আগস্ট অপারেশনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। সাফল্যের সঙ্গে অপারেশন সম্পন্ন হয়। অপারেশনের ঘণ্টাখানেক পর শাশুড়ী ও আমাকে পোস্ট অপারেশন কক্ষে হাসিনাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তখন আমাদের বলা হয় যে, তাকে প্যাথিডিন ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে, আমরা যেন তার সঙ্গে কথা না বলি। পানি থেকে সদ্য ধরা মাছ যেমন ছটফট করে, প্যাথিডিন ইনজেকশন দেয়া সত্ত্বেও হাসিনাকে বিছানায় তদ্রুপ ছটফট করতে দেখি। এ অবস্থা দেখে আমি কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়েছিলাম এবং শাশুড়ী অশ্রু সংবরণ করতে পারছিলেন না। পরদিন হাসিনাকে কেবিনে ফিরিয়ে আনা হয়। আস্তে আস্তে হাসিনা সুস্থ হয়ে ওঠে। একদিন হাসিনা আমাকে বলে, “তুমি জান কি এই কেবিনের চারটা কেবিনের উত্তরে কবি জসীম উদ্‌দীন সাহেব ভর্তি হয়েছেন? তিনি প্রায়ই আমার কেবিনে আমার কুশলাদি জানার জন্য আসেন এবং অনেক মজার গল্প শুনিয়ে যান।“ এ কথা শোনার পর আমি কবি জসীম উদ্‌দীনের কেবিনে যাই তাঁর কুশলাদি জানার জন্য। এর দু’দিন পর হাসিনাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।
৩৩। এর কিছুদিন পর হাসিনাকে ১৯৬৭ সালের ১৭ই নভেম্বরে আমাদের বিয়ের “আক্‌ত” অনুষ্ঠান অত তড়িঘড়ি করে কেন সম্পন্ন করা হয়েছিলো সে সম্পর্কে জানতে চাইলে সে আমাকে জানায়, “১৯৬৬ সালে আব্বা কর্তৃক ঘোষিত ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রতি বিপুল জনসমর্থন দেখে গভর্নর মোনেম খাঁর সরকার তখন দেশের বিভিন্ন শহরগঞ্জে আয়োজিত জনসভায় তিনি যাতে ভাষণ দিতে না পারেন সেজন্য তাঁকে পর পর বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করতে থাকে এবং পরিশেষে তাঁকে পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দী করে রাখে। এরপর পরিবারবর্গের ওপর শুরু করা হয় নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন। শেখ ফজলুল হক মণিকেও অনির্দিষ্টকালের জন্য কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। এহেন পরিস্থিতিতে আব্বা-আম্মা চিন্তিত হয়ে আমার তাড়াতাড়ি বিয়ে সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রথমে এক সি. এস. পি. (CSP)- এর সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব আসে। ঐ সময় গভর্নর মোনেম খান সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন যে, আমাকে তাঁদের কেউ বিয়ে করলে তাঁকে চাকুরী থেকে অপসারণ করা হতে পারে। এ কারণে ঐ ভদ্রলোকের পরিবারবর্গ এবং আত্মীয়-স্বজনও একটু ইতস্ততঃ করেছিলেন। তাছাড়া ভদ্রলোকের দাড়ি ছিল, যে কারণে ঐ প্রস্তাবে আমি বেশী খুশী ছিলাম না। অতঃপর ঐ বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়। আমার বিয়ে সম্পর্কিত দ্বিতীয় প্রস্তাব আসে বিদেশ থেকে চার্টারড একাউন্টে ডিগ্রী নিয়ে সদ্য দেশে ফেরত আসা এক ভদ্রলোকের পরিবারের কাছ থেকে। ভদ্রলোকটি আমার চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো হওয়ায় আমি ঐ বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হইনি। এরপর আসে তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের প্রস্তাব। তোমার উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশী হওয়ায় আমি বেশ কিছু চিন্তা করে এতে রাজী হলাম। তাছাড়া তুমি একজন পরমাণু বিজ্ঞানী জেনে মনে মনে আমি বেশ খুশীও হয়েছিলাম।”
৩৪। এদিকে “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার রাজসাক্ষীদের এক এক করে জেরা চলতে থাকে এবং কোর্টের ধারাবিবরণী বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ হতে থাকে। আইনজীবীদের খরচ বহনের অর্থ যোগানের পুরো দায়িত্ব আমার শাশুড়ীর ওপর এসে পড়ে। কারণ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী পরিষদে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, যেমন আতাউর রহমান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আমেনা বেগম, তাঁরা এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে গড়িমসি করেন।
৩৫। তখন শাশুড়ীর সংসারে অর্থ সংকট আমি লক্ষ করি। একদিন বিকেলে এককালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল আউয়াল শাশুড়ীর সঙ্গে আলাপ করতে আসেন। তখন জনাব আউয়াল আদমজী জুট মিলসের কেন্দ্রীয় অফিসে উচ্চ পদে কর্মরত ছিলেন। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি শাশুড়ীকে বলেন যে, শেখ কামালের জন্য আদমজী জুট মিলসের কেন্দ্রীয় অফিসে একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাঁকে অফিসে বিশেষ কিছু করতে হবে না। প্রতি মাসের বেতন হিসেবে সে দু’হাজার টাকা পাবে। ঐ সময় প্রধান কৌসুলী সালাম সাহেব তাঁর বকেয়া ফি পরিশোধ না করায় কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এই পরিস্থিতিতে শাশুড়ী ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার খরচের অর্থ সংগ্রহ করা লক্ষ্যে কুপন ছাপায়। ঐ বৎসরে শাশুড়ী তার সম্পর্কে ছোট ভাই, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়ণরত শেখ আকরাম হোসেন ও শেখ সাহেবের আপন ফুফাত ভাই জনাব মোমিনুল হক খোকার মাধ্যমে অতি কষ্টে ও গোপণে কিছু টাকা পয়সা সংগ্রহ করেন। এরপর সালাম সাহেবের বকেয়া ফি আংশিকভাবে পরিশোধ করা হয়। তারপর থেকে এডভোকেট সালাম সাহেব পুনরায় কোর্টে যাওয়া শুরু করেন।
৩৬। রাজসাক্ষীদের জেরার প্রকাশিত বিবরণী থেকে জনমনে ধারণা সৃষ্টি হতে থাকে যে, তথাকথিত “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলাটি আইয়ুব খান সরকার কর্তৃক সাজানো ও ভিত্তিহীন। বাঙ্গালী জনসাধারণ আস্তে আস্তে বুঝতে পারে যে, শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিয়ে তাঁর ৬- দফার আন্দোলন খতম করাই ছিলো আইয়ুব খান সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের একদিন বিকেলে শেখ সাহেবের সঙ্গে শাশুড়ীসহ দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, “বাবা ওয়াজেদ, জানি না মামলা কতদিন চলবে এবং এর থেকে আমি আদৌ মুক্তি পাবো কিনা। তুমি আর অপেক্ষা না করে হাসুকে (হাসিনাকে) আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে নাও।”
৩৭। এরপর তড়িঘড়ি করে কেবল আণবিক শক্তি কেন্দ্রের আমার সহকর্মীদের, আমার আত্মীয়-স্বজনদের এবং শেখ সাহেবের আত্মীয়-স্বজনদের মৌখিকভাবে দাওয়াত দিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৭ই নভেম্বর (১৯৬৮) অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার আমাদের পক্ষের সব কৌসুলীদের মৌখিকভাবে দাওয়াত দেয়া সত্ত্বেও একমাত্র এডভোকেট সালাম খান শেখ সাহেবের মামাশ্বশুর হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আমার আত্মীয়দের পক্ষ থেকে আমার একমাত্র মামা, বড় দুলাভাই ও বড় ভাই উক্ত অনুষ্ঠানে যোগদান করতে সমর্থ হন।
৩৮। অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমার পক্ষ থেকে কাপড়-চোপড় ছাড়া কোন অলংকার দেয়া সম্ভব হয়নি। ঐ অনুষ্ঠানে কোন আলোকসজ্জারও ব্যবস্থা করা হয়নি। শেখ সাহেবের আত্মীয়-স্বজনদের পক্ষ থেকে কিছু অলঙ্কার ও সামান্য উপহার দেয়া হয়েছিলো। অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়া পর্ব শেষের এক পর্যায়ে এডভোকেট সাহেব আমাকে ঘরের বাইরে নিয়ে বলেন, “ভাই, আমি তোমাকে বিশেষ কিছু দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত।“ এই বলে তিনি আমার পকেটে কিছু টাকা গুঁজে দেন। অনুষ্ঠান শেষে দেখি সালাম সাহেব আমাকে দশটি দশ টাকার নোট দিয়েছিলেন। পরদিন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান উপলক্ষে নিমোক্ত শিরোনামে সংবাদ পরিবেশিত হয়, “শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠা তনয়ার বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় নিরানন্দ ও আলোকসজ্জাবিহীন পরিবেশে।”
Unicoded by – Ali Imran Jidny

পৃষ্ঠাঃ ৩৭
৩৯। তখন গভর্নর মােনেম খান বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে অকল্পনীয় ত্রাসের অবস্থা সৃষ্টি করেছিলেন। যে সমস্ত ছাত্রাবাসে ছাত্র ফেডারেশনের প্রাধান্য ছিল সেগুলােতে নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছিলাে। সে সব হলে ছাত্র ফেডারেশনের গুণ্ডাদের সর্দারেরা হলের প্রভােস্টের অফিস থেকে ভয় দেখিয়ে অফিস টেলিফোন নিজ কক্ষে নিয়ে রেখেছিলাে। এই হলগুলাের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলাে ঢাকা হল ও সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। গুণ্ডার সর্দারদের কক্ষে রাতে মদ খাওয়া ও নারীদের নিয়ে অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলতাে। ঢাকা হলের ছাত্র গুন্ডাদের সর্দার ছিলাে খােকা নামের এক ছাত্র এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্র গুণ্ডাদের সর্দার ছিলাে “পাচপাণ্ডু” নামের একজন গুণ্ডা। ছাত্র ফেডারেশনের ছাত্র গুণ্ডাদের প্রধান ছিলাে স্বয়ং গভর্নর মােনেম খানের দুই ছেলে। এদের ভয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে চলাফেরা করতে ভয় পেতাে। ঐ বছর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে রংপুর জেলার আবদুর রউফ ও নােয়াখালী জেলার খালেদ মােহাম্মদ আলী। ডাকসুর সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছাত্রলীগের বরিশাল জেলার তােফায়েল আহমেদ এবং ছাত্র ফেডারেশনের নাজিম কামরান চৌধুরী। নভেম্বরের শেষের দিকে আমি হাসিনাকে নিয়ে ছাত্রলীগের আবদুর রউফ, খালেক মােহাম্মদ আলী ও তােফায়েল আহমদের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করি। প্রায় সাতদিন খোঁজাখুজির পর ঢাকা প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসের কক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফকে একজন বিদেশী নাগরিকের সঙ্গে আলাপরত অবস্থায় পাই। বিদেশী ভদ্রলােক চলে যাওয়ার পর আবদুর রউফকে জানাই যে, “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলাকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলন সংগঠন করার জন্য আমার শাশুড়ী তাদেরকে বিশেষ অনুরােধ করেছেন। আবদুর রউফ আমকে বলে, ওয়াজেদ তাই, এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মধ্যে অনেক আলােচনা হয়েছে, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথেও এ ব্যাপারে আলােচনা চলছে।”
৪০। তখন বিদেশে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে অধ্যয়ন ও কর্মরত বাঙ্গালী ছাত্র ও জনগণ শেখ মুজিবের ৬-দফার বাস্তবায়ন ও তার বিরুদ্ধে আনীত তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সােচ্চার হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনমূলক বিভিন্ন তৎপরতা চালায়। ডিসেম্বরের গােড়ার দিকে যুক্তরাজ্যে অধ্যয়ন ও কর্মরত এবং শেখ সাহেবের অনুরাগী ও ৬-দফার সমর্থক ছাত্ররা ও বাঙ্গালী জনসাধারণ চাঁদা সংগ্রহ করে বৃটিশ লেবার পার্টির তৎকালীন পার্লামেন্টের সদস্য ও প্রখ্যাত আইনজীবী স্যার টমাস উইলিয়ামস, কিউ. সি.-কে ঢাকায় পাঠান ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিবাদী পক্ষের কৌসুলীদের পরামর্শ ও সহায়তা প্রদানের জন্য। স্যার উইলিয়ামস কোর্টে উপস্থিত হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার রাজসাক্ষী ও সরকারী কৌসুলীদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে শেখ মুজিব ও অন্যান্য আসামীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগের অসারতা প্রমাণে অনেকাংশে সফল

পৃষ্ঠাঃ ৩৮
হন। উল্লেখ্য, প্রবাসী বাঙ্গালীরা স্যার টমাস ইউলিয়ামসের শুধু ফিসের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। ফলে তাঁর ঢাকায় অবস্থানের ব্যয় শাশুড়ীকে অতি কষ্টে মেটাতে হয়েছিলাে।
৪১। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি একদিন বিকেলে আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, তােফায়েল আহমদ ও আরও কয়েকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ক্যান্টিনে এক বৈঠকে মিলিত হই আওয়ামী লীগের ৬-দফা বাস্তবায়নের দাবি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার ব্যাপারে আলাপ-আলােচনার জন্য। উক্ত বৈঠক প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে চলে। তখন উপস্থিত ছাত্রনেতাদের মােটামুটি সবাই বলে যে, সফল ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য ছাত্র ইউনিয়নের উভয় সংগঠনকে সঙ্গে নিতে হবে। অতঃপর সে সময়ের প্রেক্ষাপট বিস্তারিতভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ছাত্র ইউনিয়নের উভয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ ও পরামর্শপূর্বক শেখ মুজিবের ৬-দফার বাস্তবায়ন ও তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি ছাড়াও শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণ, কৃষকশ্রমিকের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও আদায়, আপামর জনসাধারণের কল্যাণকর আর্থসামাজিক নীতি প্রবর্তন এবং জাতীয় স্বার্থের অনুকূল ও যুক্তিযুক্ত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের দাবি ব্যক্ত করে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করা হবে। এর দিন দশেক পর ছাত্রলীগের উল্লিখিত নেতৃবৃন্দ আমাকে জানায় যে, পূর্ব সিদ্ধান্ত মােতাবেক তারা ছাত্র ইউনিয়নের উভয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে একটি ১১-দফাসম্বলিত দাবিনামা প্রণয়ন করেছে। কিন্তু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি তৎসম্পর্কিত গঠিত কোর্টের অবমাননা করার সামিল হতে পারে বলে পিকিং (বেইজিং)-পন্থী ছাত্র ইউনিয়নের কতিপয় নেতা মন্তব্য করেছে। অতএব এ বিষয়ে উল্লিখিত ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আরও বিশদ আলাপের প্রয়ােজন রয়েছে বলে ছাত্রলীগের নেতারা আমাকে অবহিত করে। এ সমস্ত আলাপ-আলােচনায় সমাপ্ত হয় ১৯৬৮ সালে।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৯৬৯-১৯৭০ সাল

১। ছাত্রলীগ এবং তৎকালীন মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী উভয় ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের ৬-দফার বাস্তবায়ন ও তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহার, শিক্ষা ও ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান, কৃষক-শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও আদায়, জনকল্যাণমূলক আর্থ-সামাজিক নীতি প্রবর্তন, জাতীয় স্বার্থের অনুকূল ও যুক্তিযুক্ত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ, ইত্যাদি বিষয়ের দাবি উল্লেখপূর্বক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে ১১-দফার দাবিনামা এক ইশতেহারের মাধ্যমে সংবাদপত্রে প্রকাশ করে ৫ই জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে। একই সঙ্গে তারা সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ১১-দফার দাবিতে আন্দোলন করার আহ্বান জানায় ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও আপামর জনসাধারণের প্রতি। উক্ত ইশতেহারে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন ‘ডাকসু’-এর সহসভাপতি ও ছাত্রলীগের তােফায়েল আহমদ, সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্র ফেডারেশনের নাজিম কামরান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী, মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ও সাধারণ সম্পাদক সামসুদ্দোহা এবং পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি মােস্তফা জামাল হায়দার ও সহ-সম্পাদিকা দীপা দত্ত। উল্লেখ্য যে, ছাত্র ফেডারেশনের নাজিম কামরান চৌধুরী ‘ডাকসু’ -এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উক্ত যুক্ত ইশতেহারে স্বাক্ষর করলেও তখনও ছাত্র ফেডারেশন দলগতভাবে ছাত্রদের ১১-দফার প্রতি সমর্থন জানায় নি।
২। এদিকে ঢাকায় নেজামে ইসলামের বিশিষ্ট নেতা ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, এনডিএফ-এর বিশিষ্ট নেতা ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্য মন্ত্রী নূরুল আমিন, জামাতে ইসলামীর মিয়া মােহাম্মদ তােফায়েল, পিডিপি-এর নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এবং কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি ও পশ্চিম পাঞ্জাবের

পৃষ্ঠাঃ৪০
প্রাক্তন মুখ্য মন্ত্রী মিয়া মােমতাজ দৌলতানা, আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম দলসমূহের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করছিলেন আইয়ুব খানের বেসিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসনের অবসানের লক্ষ্যে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করতে। অবশেষে ৮ই জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে উপরিউক্ত ৮টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’–সংক্ষেপে (ডাক)-গঠন করা হয়। ১২ই জানুয়ারী (১৯৬৯) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ‘ডাক’-এর নেতৃবৃন্দের আহ্বান জানায় ছাত্রদের ১১-দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানানাের জন্য। কিন্তু ‘ডাক’-এর অনেক নেতা ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার প্রতি সমর্থন জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী। ঐ সময় একদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পথে আমি তৎকালীন ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)-এর সামনে অনেক ছাত্রের সমাবেশ দেখতে পাই। তৎক্ষণাৎ সেখানে গিয়ে সমবেত ছাত্রদের ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান, মােস্তফা মহসিন মন্টু, খায়রুল আলম খসরু প্রমুখ ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ‘ছাত্র , সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার প্রতি দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন জানানাের দাবি করতে দেখতে পাই। এক পর্যায়ে ছাত্ররা মিজানুর রহমান চৌধুরীকে লাঞ্ছিত করতে উদ্যত হয়। আমি তখন ছাত্রদের শান্ত করে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সেখান থেকে নিয়ে আসি।
৩। উপরিউক্ত ঘটনার পরদিন সকাল ৯টার দিকে আমি হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে ইকবাল হলে গিয়ে ছাত্রলীগের আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, তােফায়েল আহমদ ও সিরাজুল আলম খানকে একত্রে আলাপরত দেখতে পাই। তারা আমাদের জানায় যে, শেখ সাহেবের ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে কিনা তৎসম্পর্কে ছাত্র ইউনিয়নের উভয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সুনিশ্চিত হতে চায়। অতঃপর সাব্যস্ত হয় যে, ছাত্রলীগের আবদুর রউফ ও তােফায়েল আহমদ যৌথভাবে এক পত্রের মাধ্যমে উভয় ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের উল্লিখিত প্রশ্ন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার প্রতি ছাত্র-জনতা, বিশেষ করে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন, ৮ দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ১১-দফার প্রতি মনােভাব, তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ইত্যাদি বিষয়ে শেখ সাহেবকে অবহিত করবে। তখন উপরিউক্ত চিঠিটি লেখা হয় ইকবাল হলের পুকুরের পাড়ে বসে।
৪। সেদিন আবদুর রউফ ও তােফায়েল আহমদের যৌথ স্বাক্ষরিত চিঠিটি নিয়ে হাসিনা ও আমি ইকবাল হল থেকে সােজা ক্যান্টনমেন্টে শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই। শেখ সাহেব তখন তার সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অনেককে আটকে রাখা সামরিক মেসের তাঁর কক্ষের বারান্দায় বসেছিলেন। তার থেকে কিছু দূরে এক সামরিক কর্মকর্তা দাড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন। আমাদের দেখেই শেখ সাহেব উচ্চ স্বরে কর্তব্যরত সামরিক

কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে বলেন, “আমার মেয়ে ও জামাই এসেছে আমাকে কিছু বলার জন্য। আমি গেটে গিয়ে তাদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি।” উক্ত সামরিক কর্মকর্তা এ ব্যাপারে কিছু বলার আগেই শেখ সাহেব দ্রুত মেসের গেটের কাছে চলে আসেন। তখন হাসিনা ও আমি গেটের একটু ভেতরে প্রবেশ করি। শেখ সা
হেব ‘মা হাসু’ বলে হাসিনাকে জড়িয়ে ধরলে ঐ সুযোগে সে ছাত্র-নেতাদের চিঠিটি তাঁর গেঞ্জির নীচে গুঁজে দেয়। এ পরিস্থিতি দেখে ঐ সামরিক কর্মকর্তাও গেটের দিকে আসতে থাকেন। কিন্তু সেই সামরিক কর্মকর্তার গেটে পৌঁছার আগেই শেখ সাহেবকে ছাত্র-নেতাদের বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করি। তখন শেখ সাহেব আমাদের পরদিন একইভাবে ছাত্রলীগের আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী ও তোফায়েল আহমদকে ঐ সামরিক মেসের গেটের কাছে আসতে বলেন। এরপর পারিবারিক বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বলে আমরা সেখান থেকে চলে আসি।
৫. পরদিন সকাল ১০টায় হাসিনা ও আমি ছাত্রলীগের আবদুর রউফ,খালেদ মোহাম্মদ আলী ও তোফায়েল আহমদকে আমার গাড়ীতে ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের ঐ সামরিক মেসের গেটের কাছে নিয়ে যাই। শেখ সাহেব সেদিনও একই কৌশলে গেটের কাছে চলে আসেন। সেদিনও একই সামরিক কর্মকর্তা উক্ত মেসের বারান্দায় কর্তব্যরত ছিলেন। কিন্তু তিনি পূর্বে আমাদের দেখেছেন বলে তখন কোন উচ্চবাচ্য করেন নি। এই সুযোগে শেখ সাহেব গেটের একটু বাইরে এসে তিন ছাত্র-নেতাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “তোমাদের ১১-দফার দাবিকে আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে সমর্থন করি এবং তোমাদের নেতৃত্বের ওপর আমার গভীর বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোমাদের আন্দোলন ফলপ্রসূ হবে। তোমরা দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যাও। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।” ইত্যবসরে উক্ত সামরিক কর্মকর্তা সেখানে এসে পৌঁছায়। তখন শেখ সাহেব আগের মতই পারিবারিক বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বলে আমাদের বিদায় দিয়ে ঐ সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে মেসের ভেতর চলে যান।
৬. ১৭ই জানুয়ারী (১৯৬৯)ছিল ‘ডাক’ আহূত গণতন্ত্রের দাবিতে সারা দেশে মিছিল ও শোভাযাত্রা প্রদর্শনের কর্মসূচি। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরসহ বিশেষ বিশেষ জায়গায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এদিন তৎকালীন ডাকসু-এর সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বরের ‘বটতলা’য় একটি ছাত্রসভা আয়োজন করা হয়। সভাশেষে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের ওপর বেপরোয়াভাবে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করে। এমন কি পুলিশ ছাত্রীদের কমনরুমে ঢুকেও মেয়েদের বেদম প্রহার করে। আণবিক শক্তি কেন্দ্রের অফিস থেকে আমরা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করি। পুলিশের সঙ্গে এহেন সংঘর্ষের এক পর্যায়ে হাসিনা কয়েকজন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে পেছনের গেট দিয়ে আমাদের অফিসে প্রবেশ করে। তখন তাদের কারো পায়ে স্যান্ডেল ছিল না। কারণ পুলিশের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পালানোর সময় তারা তাদের পায়ের স্যান্ডেল ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিল। যাহোক, আমি তাড়াতাড়ি অতি কষ্টে গাড়ীতে অন্যান্য ছাত্রীকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়ে হাসিনাকে নিয়ে শেখ সাহেবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডস্থ বাসায় যাই।
৭. ১৭ই জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশের নির্মম হামলার ঘটনায় ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অতঃপর ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ পরদিন অর্থাৎ ১৮ জানুয়ারী (১৯৬৯) থেকে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালেরজন্য ধর্মঘটের কর্মসূচী ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ শেখ মুজিবের ৬-দফাসহ ছাত্রদের ১১ দফার দাবি আদায় এবং তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করে এবং তা সাফল্যমন্ডিত করার জন্য ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সকল স্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়।
৮. ১৮ই জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র আহ্বানে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এদিনও ঢাকায় হাজার হাজার ছাত্র ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের করে। পুলিশ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-মিছিলের ওপর বেপরোয়া কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ করে। রমনা ও গুলিস্তান এলাকায় পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপী সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা একটি ইপিআরটিসির ডবল ডেকার বাস অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করে। সেদিন ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২৫ জন ছাত্র গুরুতরভাবে আহত হয়। সন্ধ্যায় সরকার ইপিআর বাহিনী তলব করে। রাতে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী যৌথভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক) হল ও জিন্নাহ (বর্তমানে সূর্যসেন) হলে ব্যাপক অভিযান চালিয়ে ছাত্রদের মারধর করে এবং অনেককে গ্রেফতার করে।
৯. ২০শে জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র আহ্বানে প্রদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। এদিনও ঢাকায় ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের করে। শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো কলাভবনের (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগ) উল্টো দিকে অবস্থিত পেট্রোল পাম্পের নিকট জনৈক পুলিশ ইন্সপেক্টরের রিভলভারের গুলিতে প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান নিহত হয়। উক্ত ঘটনার পর হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আসাদুজ্জামানের লাশ দেখার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যায়। এক পর্যায়ে পুলিশের আইজির নেতৃত্বে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর লোকেরা ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে কয়েকবার হামলা চালায় আসাদুজ্জামানের লাশ দখলের জন্য। কিন্তু ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর তৎকালীন ডাকসু’র সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল চত্বরে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার এক শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। শোকসভা শেষে আসাদুজ্জামানের লাশ নিয়ে হাজার হাজার ছাত্র -জনতার শোক মিছিল ঢাকার কয়েকটি রাস্তা প্রদক্ষিণ করে।
১০. ২১শে জানুয়ারী (১৯৬৯)ছিল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান হত্যার প্রতিবাদে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ আহূত সারা দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল। এদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ঢাকায় লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার শোক মিছিল। দেশের অন্যান্য শহরেও ছাত্ররা মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঢাকার কয়েকটি ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর লোকেরা লাঠি চার্জ ও গুলি বর্ষণ করে। সেদিন ঢাকায় পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার এ সমস্ত সংঘর্ষের ঘটনার ২৯ জন আহত ও ৬৯ জন গ্রেফতার হয়। এদিন শহীদ আসাদুজ্জামানের লাশ তার নিজ গ্রামে দাফন করার সময় দশ হাজারেরও বেশী লোকের সমাগম হয়।
১১. ইত্যবসরে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র নেতৃত্বে গঠিত ও পরিচালিত ৬-দফার বাস্তবায়ন ও তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহারসহ ১১-দফার দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিতে ২৪ জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ঢাকায় আহ্বান করা হয় জাতীয় পরিষদের শীতকালীন অধিবেশন। ২২শে জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ঘোষণা করে ২৪শে জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে প্রদেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালনের কর্মসূচি। এরই প্রেক্ষাপটে গভর্নর মোনেম খানের নির্দেশে এদিন সারা ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২৪শে জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার আশেপাশে শিল্প এলাকার শ্রমিক ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ আহূত আন্দোলন কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ব্যক্ত করে ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। এদিন সকাল ১০টার দিকে কয়েক লাখ ছাত্র-শ্রমিক-জনতায় ভরে যায় ঢাকার সচিবালয় এলাকা, ডিআইটি ইউনিট ও মতিঝিল এলাকায় কয়েকটি রাস্তা। এগারটার দিকে প্রায় দশ হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতা পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর বাঁধা অগ্রাহ্য করে তৎকালীন আয়ুব-সমর্থক ট্রাস্টের পত্রিকা মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান (বর্তমান দৈনিক বাংলা) অফিসের লোহার গেট ও প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে এবং পত্রিকাদ্বয়ের বিভিন্ন কক্ষে অগ্নিসংযোগ করে। মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান অফিস ছাড়াও ঐ সমস্ত এলাকায় পার্কিং করা বহু সংখ্যক গাড়ীও অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত হয়। এ সমস্ত ঘটনার সময় পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করলে ঘটনাস্থলেই ৪ জন নিহত ও বহু আহত হয়। অন্যদিকে কয়েক হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতা আবদুল গনি রোডে আয়ুব খানের কনভেনশন মুসলীম লীগের দুজন এম.এন-এর বাসভবন এবং রমনা গেটের নিকটবর্তী তৎকালীন পাকিস্তান স্টেট গেস্ট হাউসে অগ্নিসংযোগ করে। উভয় স্থানেই পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে জনাকয়েক নিহত ও বহু আহত হয়। এদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানেও পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। সেদিন পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর গুলিতে ময়মনসিংহে ২ জন,চট্টগ্রামে ১ জন এবং খুলনায় ৩ জন নিহত হয়। এ সমস্ত সরকারী নির্যাতনমূলক ঘটনার প্রতিবাদে এদিন বিরোধী দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট করে। এদিন সন্ধ্যায় সরকার ঢাকায় সামরিক বাহিনী তলব এবং ৩৬ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন বলবত করে। এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আয়ুব খানের সরকারবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন গণ অভ্যুত্থানের রূপ পরিগ্রহ করে। আয়ুব-মোনেমবিরোধী গণআন্দোলনের এই পর্যায়ে ছাত্র ফেডারেশন দ্বিধাবিভক্ত হয় এবং উক্ত ছাত্র সংগঠনের তৎকালীন সভাপতি ইব্রাহীম খলিল, সাধারণ সম্পাদক ফকরুল ইসলাম মুন্সী, বিশিষ্ট নেতা মাহবুবুল হক দোলনসহ বহু নেতা ও কর্মী ছাত্রদের ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন প্রদানপূর্বক ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’ যোগদান করে।
১২. ২৪শে জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখের পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সকল শহর,বন্দর,গ্রাম ও গঞ্জে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলতে থাকে ৬-দফার বাস্তবায়ন ও তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা প্রত্যাহারের দাবিসহ ১১-দফার দাবিতে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক জনতার আন্দোলন। সর্বত্রই আন্দোলনরত কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার মুখে উচ্চারিত হয়, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, মানি না, মানবো না’, জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ মুজিবকে আনবো, ‘৬-দফা, ১১-দফা মানতে হবে’, ‘আয়ুব-মোনেমের গদিতে, আগুন জ্বালো এক সাথে’, ইত্যাদি শ্লোগান। ২৫শে জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ঢাকার সান্ধ্য আইন ভঙ্গের সময় সেনা বাহিনীর গুলিতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আবদুল লতিফসহ ২ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। এদিকে ময়মনসিংহে এক শোক মিছিলে পুলিশ লাঠি চার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। উক্ত ঘটনায় ৮৪ জন গ্রেফতার ও বহু আহত হয়৷ পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে এদিন বিকেলে গভর্নর মোনেম খানের নির্দেশে নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা এলাকাসমূহে বিকাল ৫টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার জন্য কারফিউ জারি করা হয়। প্রদেশের অন্যান্য শহরেও পুলিশ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। ২৫শে জানুয়ারী রাতে ঢাকায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ আরো ২৪ ঘন্টা বৃদ্ধি করা হয়।
১৩. ২৬শে জানুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রাস্তায় অবরোধ সৃষ্টি করতে শুরু করলে তখন টহলরত সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল তাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। উক্ত ঘটনায় ৪ জন নিহত হয়। এদিকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানে পুলিশ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর হামলা চালিয়ে ৮৫ জনকে গ্রেফতার করে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন আরো তীব্র আকার ধারণ করায় এদিন রাতে সরকার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা ও ময়মনসিংহ শহরসমূহে সান্ধ্য আইনের মেয়াদ আরো ৩৬ ঘন্টা বৃদ্ধি করে। ২৭ ও ২৮শে জানুয়ারী (১৯৬৯) প্রদেশের বিভিন্ন শহরে হরতাল, সান্ধ্য আইন ও সেনা বাহিনীর
Typed by- Samia Rahman
এবং সর্বোপরি ৬-দফা বাস্তবায়ন ও তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র ‘ মামলা প্রত্যাহারসহ তাদের ১১ দফা দাবি মেনে না নেয়া পর্যন্ত প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান না করার জন্য ৮-দলীয় ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’র নেতৃবৃন্দের প্রতি অনুরোধ জানায় ।
১৫। ৬ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এক সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় আসেন । ইতোপূর্বে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলো এদিনটিকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালনের জন্য । সেদিন ঢাকায় বিশ হাজারের ও অধিক ছাত্র-জনতা আইয়ুব খানকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে । যাহোক, এদিন সরকার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে সেনাবাহিনী ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করে । ৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আইয়ুব খানের সরকার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রকাশনা ও প্রেস বাজেয়াপ্ত করণ আদেশ প্রত্যাহার করে ।
১৬। ৯ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে ছিল ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র পুরানো পল্টনে আয়োজিত জনসভা । উক্ত সভায় সভাপতির ভাষণে ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা ও ডাকসু-এর তৎকালীন সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ বলেন, “তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, সকল রাজবন্দীর মুক্তিদান, আন্দোলনের সময় নিহতদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও সংঘটিত ঘটনা সম্পর্কে বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা এবং ছাত্র, রাজনৈতিক ও শ্রমিক নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে জারিকৃত হুলিয়া প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আইয়ুব খানের আহুত গোল টেবিল বৈঠকের প্রশ্নই বিবেচিত হতে পারে না ।” ১১ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে ‘শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি দিবস’ হিসেবে পালিত হয় সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র আহ্বানে । এদিনে ছাত্ররা ঢাকাসহ প্রদেশের সকল শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও সভা-সমাবেশের আয়োজন করে।
১৭। ফেব্রুয়ারীর ২য় সপ্তাহ থেকে সরকার প্রদেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে ছাত্র, শ্রমিক এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দেওয়া শুরু করে । ১২ ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান । সেদিন আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন এবং ছাত্রলীগ ও সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র অনেক নেতা ও কর্মী জেল গেটে গিয়ে জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় । অন্যদের সঙ্গে আমিও সেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে উপস্থিত ছিলাম । পরদিন অর্থাৎ ১৩ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান আওয়ামী লীগের ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ও খন্দকার মোশতাক আহমদ সহ ৬৫ জন ছাত্র, শ্রমিক, ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী ।
এদিনও আমি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে উপস্থিত ছিলাম উল্লিখিত নেতা ও কর্মীদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য ।
১৮। তখন আইয়ুব খান কিছু ছাত্র, শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে জেল থেকে
মুক্তি দিলেও ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহার করে শেখ সাহেবকে মুক্তি দিতে
অস্বীকৃতি জানান । তিনি বিভিন্ন প্রকারে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন
শেখ সাহেবকে ছাড়াই রাওয়ালপিন্ডিতে আহূত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের জন্য । কিন্তু
আওয়ামী লীগের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সদ্য কারামুক্ত
তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ দলের সভাপতি শেখ সাহেবকে
ছাড়া গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানান । অতঃপর আওয়ামী লীগের
নেতৃবৃন্দ ৮-দলীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’কে বাধ্য করেন শেখ মুজিবের মুক্তির
দাবি’তে ১৪ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে সারা দেশে সর্বাত্মক অর্ধ দিবস হরতাল
পালনের কর্মসূচী ঘোষণা করতে । ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’ আহুত ১৪ই ফেব্রুয়ারী
(১৯৬৯) তারিখের হরতালের কর্মসূচীর প্রতি একাত্মতা জানায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম
পরিষদ’ শ্রমিক সমাজ ও অন্যান্য সংগঠন । ১৪ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে হরতাল শেষে
তৎকালীন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল জনসভা । উক্ত জনসভায় ৮-দলীয়
‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’ -এর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, শেখ মুজিবের
অনুপস্থিতিতে রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খান আহূত গোল টেবিল বৈঠক অর্থবহ ও ফলপ্রসূ
হবে না।
১৯। ১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র আহ্বানে তথাকথিত ‘আগরতলা
ষড়যন্ত্র’ মামলা নিঃশর্ত প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে ঢাকাসহ দেশের সকল
শহরে হরতাল পালিত হয় । এদিন নারায়ণগঞ্জে গুলিতে একজন নিহত ও ছয় জন আহত
হয় । রাতে লোকমুখে জানা যায় যে, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট
জহুরুল হককে ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে আটক অবস্থায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে গুলি করে
হত্যা করা হয়েছে। এ সংবাদে সে রাতেই ঢাকায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাস্তায় রাস্তায়
মিছিল করে এই নৃশংস হত্যায় ক্ষোভ প্রকাশ করে । এদিকে সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যার
সংবাদে শাশুড়ী ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হন । ভীষণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণে শাশুড়ীসহ শেখ
সাহেবের ধানমন্ডির বাড়ীতে সে রাতে আমরা কেউ ঘুমোতে পারিনি ।
২০। পরদিন অর্থাৎ ১৬ই ফেব্রুয়ারী সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যার খবর সংবাদপত্রে
প্রকাশিত হলে প্রদেশের সর্বত্র শ্রমিক-ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে । এদিন সকালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক বিশাল ছাত্র-জনতার সমাবেশে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম
পরিষদের নেতৃবৃন্দ পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যার জন্য আইয়ুব খান ও
তাঁর সরকারের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করে । আইয়ুব খান সরকারের এহেন অমানবিক নীতির
প্রতিবাদ, সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত এবং তথাকথিত ‘আগরতলা
ষড়যন্ত্র’ মামলার প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ চলমান আন্দোলনকে আরও জোরদার করার জন্য শ্রমিক, ছাত্র ও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহবান জানায় । এদিন দুপুরে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সার্জেন্ট জহুরুল হকের জানাজায় শরিক হয় । বিকেলে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করে । এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা মোনেম সরকারের তিনজন মন্ত্রী এবং আইয়ুব খানের রাজনৈতিক দল কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রধানের বাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করে । বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ওপর একটি অংশ কনভেনশন মুসলিম লীগের অফিসে অগ্নিসংযোগে ভস্মীভূত করে । এ সমস্ত স্থানে পুলিশ গুলি চালালে ১ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয় । সন্ধ্যায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সরকার সেনাবাহিনী তলব করে এবং সারা ঢাকা শহরে ১২ ঘন্টার জন্য কারফিউ বলবৎ করে । রাতে তৎকালীন ‘রেডিও পাকিস্তানে’র খবরে বলা হয় যে, শেখ মুজিব যাতে রাওয়ালপিন্ডিতে আহূত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান করতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে ।
২১। ১৭ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে ৮ দলীয় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি’র তৎকালীন
পূর্ব পাকিস্তানের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ রাওয়ালপিন্ডি পৌছান । আওয়ামী লীগের তৎকালীন
ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ, অন্যতম
জুনিয়র সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান,
ময়েজদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দও সে সময় রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়েছিলেন । কিন্তু আওয়ামী
লীগের নেতৃবৃন্দ দলের সভাপতি শেখ মুজিবকে ছাড়া গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানে
অস্বীকৃতি জানান । এহেন পরিস্থিতিতে আইয়ুব খান প্রস্তাবিত গোল টেবিল বৈঠক ২৬শে
ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করেন । এদিন বিকালে খবর পাওয়া যায় যে, সন্ধ্যা সাড়ে
ছয়টায় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইবুন্যালের বিশেষ অধিবেশন আহবান করা হয়েছে ।
উক্ত কোর্টের সম্মতিক্রমে শেখ মুজিবকে প্যারোলে (সাময়িকভাবে মুক্তি দিয়ে)
রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিতব্য গোল টেবিল বৈঠকে নেয়ার জন্য । সেদিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে
আমি আমার গাড়ীতে শাশুড়ী, রেহানা, হাসিনা ও শেখ সাহেবের ফুফাতো ভাই মোমিনুল
হক খোকা কাকাকে সঙ্গে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত ট্রাইবুন্যাল কোর্ট অফিসের নিকটে
পৌছাই । ইতিপূর্বে কয়েক হাজার ছাত্র-জনতাও সেখানে সমবেত হয়েছিলো । এর একটু পর
শেখ সাহেবকে আটক রাখা সামরিক মেস হতে বেরিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী
পক্ষের প্রধান কেীসুলীর অন্যতম সহকারী ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম আমাদের গাড়ীর পাশ
দিয়ে কোর্টের দিকে যাচ্ছিলেন । তখন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে জিজ্ঞেস করলে তিনি
বলেন যে, শেখ সাহেব তাকে কোর্টে প্যারালে চেয়ে আবেদন পেশ করতে নির্দেশ দিয়েছেন ।
একথা শুনে শাশুড়ী মনে মনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন । যাহোক, কিছুক্ষণ পর কয়েকটি সামরিক
গাড়ীতে শেখ সাহেবসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের কোর্টে আনা হয় । এর প্রায় এক ঘন্টা পর
ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কোর্টের বাইরে এসে আমাদের অবহিত করেন যে, শেখ সাহেব
আদালতে বলেছেন যে, ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র ‘ মামলা নিঃশর্তে প্রত্যাহার করে সকলকে মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত তিনি গোল টেবিল বৈঠকে যাবেন না । ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম আমাদের আরও জানান যে, শেখ সাহেবের উক্ত বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কোর্টের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছে । এ সংবাদ জানার পর শাশুরী কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করেন । এরপরও সেখানে আরও পৌনে এক ঘন্টা অপেক্ষা করে আমরা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করি । আস্তে আস্তে ছাত্র-জনতাও ক্যান্টনমেন্ট এলাকা থেকে চলে যায় । উল্লেখ্য যে, সেদিন সন্ধ্যায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করলেও সেনাবাহিনী কোন বাড়াবাড়ি করেনি । ফলে সেদিন সেখানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি ।
২২। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ইইতোপূর্বে আইয়ুব খানের এক উপদেষ্টা ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগ নেতাদের নিকট এই মর্মে প্রস্তাব রাখেন যে, রাওয়ালপিন্ডিতে ১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে আহুত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানে সম্মত হলে শেখ মুজিবকে প্যারোলে (সাময়িকভাবে) মুক্তি দেয়া হবে। এই প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ নেতা ও ৬-দফা সমর্থক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় । দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, তৎকালীন দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী, আওয়ামী লীগের তৎকালীন অন্যতম সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ, বিশিষ্ট নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ শেখ সাহেবের আইয়ুব খানের প্রস্তাব মতো ‘প্যারোলে’ মুক্ত হয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে আহুত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের পক্ষে মত প্রকাশ ছাড়াও এ ব্যাপারে জোর ‘লবি’ করেন । তাদের বক্তব্য ছিলোঃ “হিমালয়ের বরফ যখন গলতে শুরু করেছে, তখন প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে। ” পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ও ময়েজদ্দিন আহমদ সহ তরুণ নেতৃত্ব এবং ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের শেখ সাহেবকে ‘প্যারোলে’ মুক্তির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
২৩। ১৫ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র ‘ মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হক সামরিক হেফাজতে সামরিক প্রহরীর গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনার পর আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার মূখ্য শ্লোগান ছিলঃ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, প্রত্যাহার করতে হবে’, ‘জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ মুজিবকে আনবো। ‘ একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার আন্দোলন জঙ্গী রূপ পরিগ্রহ করে । ১৮ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে রাজশাহীতে ছাত্র-জনতা ১৪৪ ধারা লংঘন করে মিছিল বের করে এবং সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে টহলরত সেনাবাহিনীর একটি গাড়ী ঘেরাও করে তার ওপর ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে । এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণ করে । এই ঘটনায় সে সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে দন্ডায়মান বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রোক্টর অধ্যাপক ডঃ শামসুজ্জোহা সহ দুইজন নিহত এবং
Unicoded By Mehedi Hasan Linkon

পৃষ্ঠাঃ ৫০
কয়েকজন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এরপর ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ জঙ্গী আকার ধারণ করলে অপরাহ্ন ২-৩০ মিনিট হতে সরকার রাজশাহী শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে। রাজশাহীর উক্ত ঘটনার সংবাদ রাতে ঢাকায় পৌছায়। এ সংবাদে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ঢাকা নগরীতে সান্ধ্য আইনের কঠিন নিষেধাজ্ঞা এবং টহলদার সেনাবাহিনীর সকল প্রতিরােধ ছিন্নভিন্ন করে আকস্মিক জলােচ্ছ্বাসের মতাে রাস্তায় রাস্তায় বের হয় এবং শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গগনবিদারী আওয়াজ তােলে। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে ঢাকায় পরদিন সকাল ৭টা হতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইনের বিরতির যে ঘােষণা ইতােপূর্বে দেয়া হয়েছিলাে তা অকস্মাৎ প্রত্যাহার করা হয় এবং কোনরূপ বিরতি ছাড়াই তা পরবর্তী ২৪ ঘন্টার জন্য বলবৎ রাখা হয়। সে রাতে ঢাকায় সেনাবাহিনীর গুলিতে ১ জন নিহত ও ২৭ জন আহত হয়।
২৪। ১৯শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজন প্রাণ হারায় এবং বহু আহত হয়। এদিন নােয়াখালীর সেনবাগে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত ও বহু আহত হয়। এদিন কুষ্টিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। এদিন এখানে সেনাবাহিনীর গুলিতে ১ জন নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। এদিন দিনাজপুরে পুলিশের গুলিতে ৬ জন আহত হয়। এদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র বাহিনী ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি বর্ষণ করলে ৪ জন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়। ২০শে ফেব্রুয়ারী অধ্যাপক ড: শামসুজ্জোহার হত্যার প্রতিবাদে ও তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে সারা দেশের শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে। এদিন রাতে ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয় পরদিন ভাষা আন্দোলনের শহীদ দিবসের কারণে।
২৫। ২১শে ফেব্রুয়ারী তারিখের প্রথম প্রহর থেকেই ঢাকায় ছাত্র-জনতা দলে দলে শহীদ মিনারে যায় ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে। প্রতিটি ছাত্রজনতার মিছিলে সেদিন মুখ্য শ্লোগান ছিলঃ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হবে’, “জেলের তালা ভাঙ্গবাে, শেখ মুজিবকে আনবাে”। এদিনেও দেশের বিভিন্ন শহরে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল অব্যাহত ছিলাে। পাবনার সুজানগরে পুলিশ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করলে ২ জন নিহত ও বহু আহত হয়। বরিশালে ছাত্র-জনতা একটি পুলিশ ফড়ি আক্রমণ করলে পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত ও বহু আহত হয়। রংপুরে ইপিআর বাহিনীর গুলিতে ৩ জন আহত হয়। এদিন খুলনায় পুলিশ ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চালালে ৮ জন নিহত ও বহু আহত হয়। এই ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সেখানে আইয়ুব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা ও তৎকালীন মন্ত্রী সবুর খানের বাড়ীতে অগ্নিসংযােগ করে। এরপর কর্তৃপক্ষ সেখানে সেনাবাহিনী তলব করে এবং ৪২ ঘন্টার জন্য কারফিউ বলবৎ করে।

পৃষ্ঠাঃ ৫১
২৬। ২২শে ফেব্রুয়ারী তারিখে তৎকালীন পাকিস্তান রেডিও থেকে ১টার সংবাদে বলা হয় যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বাতিল করেছেন এবং শেখ মুজিবসহ উক্ত মামলার অন্যান্য অভিযুক্তদের নিঃশর্তে মুক্তি দেয়া হয়েছে। সে সময় আমি অফিসে ছিলাম। এ সংবাদ শুনে আমি তৎক্ষণাৎ শেখ সাহেবের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (বর্তমানে ১১ নম্বর) রােডস্থ বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ধানমন্ডির লেক সার্কাসের নিকট পৌছে দেখি যে, মিরপুর রােডের এই অংশসহ সারা ৩২ নম্বর রােড হাজার হাজার লােকে ভরে গেছে। তখন আমি আমার গাড়ীটি মিরপুর রােডের একটি বাড়ীতে রেখে অতি কষ্টে শেখ সাহেবের বাড়ীতে পৌছাই। বাড়ীর ভেতরেও কয়েক হাজার লােক সমবেত হয়েছিলাে। যাহােক, আমি অতি কষ্টে বাড়ীর ওপর তলায় যাই। হাসিনা ইতােপূর্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেখানে পৌছেছিলাে। শেখ সাহেবকে মুক্ত দেখে পরিবারের আমাদের সকলের চোখ আনন্দ-বেদনার অশ্রুতে ভরে ওঠে। ইত্যবসরে শেখ সাহেবের বােনেরা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সেখানে আসেন। তাঁরা সবাই শেখ সাহেবকে মুক্ত দেখে আনন্দ-বেদনার কান্নায় ফেটে পড়েন। এদিকে বাইরে ললাকের সমাগম ক্রমাগত বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে বাড়ীর সিড়ির দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। এহেন অবস্থা দেখে আমি শাশুড়ীকে বলি, “শেখ সাহেবকে এক নজর দেখার জন্য জনগণ ব্যাকুল হয়ে আছে। সুতরাং তাঁকে জনগণের মাঝে যেতে দেয়াই সমীচীন হবে।” অতঃপর শেখ সাহেবকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার মিছিলের সঙ্গে একটি ট্রাকে শহীদ মিনারের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৭। ২৩শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) রােববার বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়ােজন করা হয়েছিলাে শেখ মুজিবের গণসম্বর্ধনা। সভার মঞ্চটি তৈরী করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের সামনের রাস্তা থেকে রেসকোর্স ময়দানের একটু ভেতরে। উক্ত গণসম্বর্ধনায় কয়েক লাখ লােকের সমাগম হয়েছিলাে। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করে ছাত্রলীগের বিশিষ্ট নেতা ও তৎকালীন ডাকসু—এর সহ-সভাপতি তােফায়েল আহমদ। উক্ত সভায় বক্তৃতা করেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মােহাম্মদ আলী, মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ এবং ছাত্র ফেডারেশনের ১১ দফা সমর্থক গ্রুপের মাহবুবুল হক দোলন। এই গণসম্বর্ধনায় সভাপতির ভাষণে তােফায়েল আহমদ বিপুল করতালির মধ্যে পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে শেখ সাহেবকে ‘বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করার কথা ঘােষণা করে। উক্ত গণসম্বর্ধনা সভায় শেখ সাহেব প্রায় ৫০ মিনিট ভাষণ দেন। মুক্তি লাভের পর এটাই ছিলাে শেখ সাহেবের প্রথম জনসভায় ভাষণ। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিভিন্ন দাবি দাওয়ায় প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে সেদিন শেখ সাহেব

পৃষ্ঠাঃ ৫২
বলেন, “আপনারা নিশ্চিত থাকুন। আমি যদি এদেশের মুক্তি আনতে ও জনগণের দাবি আদায় করতে না পারি, তবে আন্দোলন করে আবার কারাগারে চলে যাবাে।… বাংলার মাটিকে আমি ভালােবাসি আর বাংলার মাটিও আমাকে ভালােবাসে। ১১-দফা জিন্দাবাদ।”
২৮। ২৩শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখের গণসম্বর্ধনার সমাবেশ থেকে বঙ্গবন্ধু সােজা চলে যান ঢাকায় সে সময় অবস্থানরত মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ও তাঁর দোয়া নিতে। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু তার বাড়ীতে ফেরেন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে তখন ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ তাঁর আগমনের অপেক্ষায় ছিলাে। বাড়ীতে ফিরেই বঙ্গবন্ধু ছাত্র নেতাদের সঙ্গে মিলিত হন রাওয়ালপিন্ডিতে ২৬শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে অনুষ্ঠিতব্য গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানের ব্যাপারে আলাপ-পরামর্শ করার জন্য। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাে শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, তােফায়েল আহমদ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফার দাবি আলােচনা করতে সম্মত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিতব্য গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করা যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন হবে না বলে ছাত্র নেতাদের সকলেই ঐকমত্য পােষণ করেন। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন। যে, মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার এ ব্যাপারে আলাপ হয়েছে। যদিও মাওলানা ভাসানী গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানের ঘাের বিরােধী তবে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস যে, ভাসানী সাহেব উক্ত বৈঠকে যােগদান না করলেও তিনি যে ঐ সময় রাওয়ালপিন্ডিতে উপস্থিত থাকবেন সে ব্যাপারে তাঁর কোন সন্দেহ নেই। বঙ্গবন্ধু ছাত্র নেতাদের আরও বলেন যে, গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করে তিনি তাঁর ৬-দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১-দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ের সমাধানের লক্ষ্যে উক্ত বৈঠকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখবেন। আইয়ুব খান এবং তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তার প্রস্তাব মেনে না নিলে তিনি উক্ত গােল টেবিল বৈঠক থেকে ওয়াক আউট করবেন। বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য রাখার পরেও ছাত্রনেতারা তাঁর গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করার তীব্র বিরােধিতা করে। এই পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু সে ব্যাপারে আমার মতামত জানতে চান। তখন আমি সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত বক্তব্য পুনরুল্লেখ করে বলি যে, তিনি গােল টেবিল বৈঠকে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে স্থির করেছেন তাতে ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলন বিঘ্নিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু উপস্থিত ছাত্রনেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “Thats right। আমি গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করার সিদ্ধান্ত নিলাম।”
২৯। পরদিন অর্থাৎ ২৪শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে বঙ্গবন্ধু নয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে সঙ্গে নিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। সে সময় আওয়ামী শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে নেন।

পৃষ্ঠাঃ ৫৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড: মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, ড: সারওয়ার মাের্শেদ, ড: আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ড: কামাল হােসেন প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের। ২৬শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে গােল টেবিল বৈঠক শুরু হয়। পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও ভাসানী ন্যাপ গােল টেবিল বৈঠক বর্জন করে। এই দুটি রাজনৈতিক দল ছাড়া দেশের অন্যান্য দলের শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এয়ার মার্শাল (অবঃ) আসগর খান ও বিচারপতি মাের্শেদও গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করেন। ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখ সকালে গােল টেবিল বৈঠক ১০ই মার্চ (১৯৬৯) তারিখ পর্যন্ত মুলতবি ঘােষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধ, ঐ দিনই ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন।
৩০। ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) রাতে বঙ্গবন্ধু হাসিনা ও আমাকেসহ পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি মাঝারি লঞ্চে গােপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন সেখানে বসবাসরত তার আব্বা-আম্মার সঙ্গে সাক্ষাৎ ও দোয়া নেয়ার জন্য। পরদিন সকালে লঞ্চটি গােপালগঞ্জ শহরে পৌছালে কয়েক হাজার লােক সেখানে সমবেত হয় বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য। এর ঘন্টা খানেক পর আমরা টুঙ্গীপাড়ায় পৌছাই। সেখানেও কয়েক হাজার লােক বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য সমবেত হয়েছিলাে। হাসিনার সঙ্গে ১৯৬৭ সালে বিয়ের পর বঙ্গবন্ধুর গ্রামের বাড়ীতে এই আমার প্রথম গমন। সে সময় বঙ্গবন্ধুর আবার বসবাসের ঘরটি ছিলাে চার কক্ষবিশিষ্ট মাঝারি আয়তনের ঢেউ টিনে তৈরী ঘর। বঙ্গবন্ধু আগে যে কক্ষে বসবাস করতেন সেই কক্ষে হাসিনা ও আমাকে থাকতে দেয়া হয়। ৩রা মার্চ (১৯৬৯) তারিখে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অনুসারী শিল্পপতি ইউসুফ হারুন একটি হেলিকপ্টারে টুঙ্গী পাড়ায় আসেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপ করার জন্য। সেদিন ইউসুফ হারুন সাহেব প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করেন। ৬ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু আমাদের সকলকে সঙ্গে নিয়ে একই লঞ্চে ঢাকায় ফেরেন।
৩১। ৯ই মার্চ (১৯৬৯) বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম. মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমদ, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞকে সঙ্গে নিয়ে ১০ই মার্চ (১৯৬৯) তারিখ। রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিতব্য গােল টেবিল বৈঠক যােগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। সে সময় মাওলানা ভাসানীও রাওয়ালপিন্ডি গমন করেন। কিন্তু তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে পৃথক জোট গঠন করে গােল টেবিল বৈঠকে যােগদান করা থেকে বিরত থাকেন। ১০ই মার্চের গােল টেবিল বৈঠকের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু তেজদীপ্ত কণ্ঠে ৬-দফা ও ১১-দফার ভিত্তিতে তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও

পৃষ্ঠাঃ ৫৪
অন্যান্য বিষয়ের নিষ্পত্তির দাবি জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু আইয়ুব খান এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দ তার প্রস্তাব মেনে না নেয়ায় বঙ্গবন্ধু ১৩ই মার্চ তারিখে গােল টেবিল বৈঠক হতে ওয়াক আউট করেন। তিনি একই সঙ্গে ৮-দলীয় ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কচ্ছেদের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তের ফলে গােল টেবিল বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তবুও ১৩ই মার্চ আইয়ুব খান সভাপতির ভাষণ দেন এবং উক্ত ভাষণে তিনি প্রাপ্ত বয়স্কের ভােটাধিকারভিত্তিক প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। যাহােক, ১৪ই মার্চ (১৯৬৯) তারিখে বঙ্গবন্ধু তার প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। গােল টেবিল বৈঠকে তিনি যে অবস্থান নিয়েছিলেন তার সমর্থনে, বিশেষ করে তার নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস ও আশা প্রকাশের জন্য সেদিন বিপুল ছাত্র-জনতা বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার তেজগাও বিমান বন্দরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়।
৩২। ১৫ই মার্চ আইয়ুব খান শিল্পপতি ইউসুফ হারুনকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ২১শে মার্চ (১৯৬৯) তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনেম খানকে সরিয়ে আইয়ুব খান তার স্থলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড: এম. এন. হুদাকে নিয়ােগ করেন। ড: এম. এন. হদা নতুন গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ২৩শে মার্চ তারিখে। তিনি মাত্র তিন দিন গভর্নরের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ২৫শে মার্চ (১৯৬৯) প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন। অতঃপর সারা দেশে সামরিক আইন জারি করে তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ জেনারেল ইয়াহিয়া খান একাধারে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সামরিক আইন জারির সঙ্গে সঙ্গেই সারা দেশে সর্বপ্রকার সভা, মিছিল, শােভাযাত্রা, ধর্মঘট, হরতাল এবং রাজনৈতিক তৎপরতা ও কর্মকান্ড অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। রাতে জাতির উদ্দেশ্যে এক রেডিও ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন, “প্রাপ্ত বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করাই আমার লক্ষ্য।” অতঃপর ড: এম. এন. হুদার স্থলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী প্রধান (GOC) মেজর জেনারেল মােজাফফর উদ্দিনকে একই সঙ্গে আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর নিয়ােগ করা হয়।
৩৩। উল্লিখিত ঘটনার অনেক আগেই ইটালীর টিয়েস্টে অবস্থিত আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক পাকিস্তানের প্রফেসর আবদুস সালাম (যিনি তখন পাকিস্তান সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন) আমাকে ছয় বছরের জন্য তার প্রতিষ্ঠানে এসােসিয়েটশীপ প্রদান করেন। উক্ত এসােসিয়েটশীপের অধীনে প্রতি বছর অন্তর ছয় বছরে তিন মাসের জন্য তিনবার উক্ত কেন্দ্রে কাজ করার ব্যবস্থা ছিলাে। অধ্যাপক সালাম আমাকে সে বছরের মার্চ এপ্রিলের দিকে তিন মাসের জন্য ঐ কেন্দ্রে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ২৫শে মার্চ সামরিক শাসন

পৃষ্ঠাঃ ৫৫
জারি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু আমাকে হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এমন কি তিনি হাসিনার জন্য বিমান ভাড়া দেবেন বলেও আমাকে জানান। পরদিন আমি হাসিনার পাসপাের্টের কাগজপত্র সংগ্রহ করি। বঙ্গবন্ধু পরদিন আমাকে পাসপাের্ট বিভাগের তার পরিচিত ডেপুটি ডাইরেক্টর জনাব বাহাউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে হাসিনার পাসপাের্ট ইস্যু করার ব্যাপারে গােপনে দেখা করতে বলেন। আমি যথাসময়ে জনাব বাহাউদ্দিনের অফিসে গিয়ে তাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। তিনি পাসপাের্ট সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে আমাকে পাসপাের্ট বিভাগের মহাপরিচালকের স্বাক্ষর নেয়ার জন্য তাঁর অফিস কক্ষে নিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই পাসপাের্টে স্বাক্ষর করেন। ব্যাপারটি বেশী জানাজানি হয়ে গেলে সামরিক কর্তৃপক্ষ হাসিনাকে পাসপাের্ট নাও দিতে পারে এই আশঙ্কায় কাজটি গােপনে এবং তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করিয়ে নিতে হয়েছিলাে।
৩৪। ১৯৬৯ সালের ১২ই এপ্রিল আমি হাসিনাকে নিয়ে ইটালী পৌছাই। এদিন হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে ঐ কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক আবদুস সালামের (F. R. S) সঙ্গে দেখা করি। অধ্যাপক সালাম হাসিনার কাছে বঙ্গবন্ধুর কুশলাদি জেনে নেন। এর মাস খানেক পর প্রফেসর সালাম একদিন তার অফিসের পরিচালকের গাড়ীতে করে আমাদেরকে ইটালীর সীমান্ত থেকে ৫০-৬০ কিলােমিটার দূরে যুগােশ্লোভিয়ার বিখ্যাত ইস্তনিয়ার পর্বতগুহা দেখিয়ে আনেন। জুন মাসে অধ্যাপক সালামের অনুমােদনক্রমে হাসিনাকে নিয়ে সুইডেনের সৃন্ড-এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যােগদান করি। কনফারেন্স লবিতে একদিন আমার ইম্পিরিয়াল কলেজের এককালীন শিক্ষক ও সেখানকার তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক P. T. Mathiews—এর সঙ্গে হাসিনার পরিচয় করিয়ে দিই। অধ্যাপক Mathiews বঙ্গবন্ধুর কন্যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে জেনে ভীষণ খুশী হন এবং তিনি হাসিনার লম্বা ঘন চুল দেখে তার প্রশংসা করেন। কনফারেন্স শেষে ইটালীতে ফিরে যাই।
৩৫। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি বঙ্গবন্ধুর টেলিগ্রামে আমরা জানতে পারি যে, তিনি লন্ডন যাওয়ার পথে ইটালীর ট্রিয়েষ্টে আমাদের সঙ্গে কয়েকদিন অবসর যাপন করবেন। সে মােতাবেক আমরা আমাদের বাসার পাশেই একটি কটেজে বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা করে রাখি। এর দুদিন পরে আবার টেলিগ্রামে আমাদের জানানাে হয় যে, তিনি ট্রিযেষ্টে আসার প্রােগ্রাম বাতিল করেছেন। তিনি ২৬শে অক্টোবর লন্ডনে পৌছাবেন বলেও আমাদের জানানাে হয় এবং আমাদেরকে লন্ডনে যেতে বলা হয়। আমরা তদনুসারে প্রস্তুত হই। আমি লন্ডনে আমার বন্ধু, এককালীন ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আবুল হাসনাতকে আমাদের লন্ডনে যাওয়া সম্পর্কে অবহিত করি। আমরা ১৮ই অক্টোবর লন্ডনে পৌছাই। হিথরাে বিমানবন্দরে আমার বন্ধু আবুল হাসনাত আমাদের অভ্যর্থনা জানান। তিনি আমাদের জন্য তার বাসার কাছাকাছি একটি ছােট হােটেলে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। পরদিন সকাল ৯টায় আমার

পৃষ্ঠাঃ ৫৬
টেলিফোন আসে। টেলিফোন করেছিলেন সুলতান শরীফ। তিনি জানান যে, তিনি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমসাময়িক এবং ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলেন। সেদিনই সুলতান শরীফ হােটেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাকে দেখে আমার স্বরণ হয় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় তাকে আমি অনেকবার দেখেছি। পরদিন সুলতান শরীফ আমাদের তার গাড়ীতে করে লন্ডনস্থ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি গউস খান ও বিশিষ্ট কর্মী জনাব মিনহাজ উদ্দিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এছাড়াও সুলতান শরীফ লন্ডনস্থ আইন বিষয়ে অধ্যয়নরত বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনের সময় লন্ডনে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জাকারিয়া চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করে দেন।
৩৬। ২৬শে অক্টোবর খুব সকালে সুলতান শরীফ আবুল হাসনাতসহ আমাদেরকে হিথরাে বিমান বন্দরে নিয়ে যান। বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগের ও লন্ডনে অধ্যয়ন, কর্মরত ও অবস্থানরত কয়েক শত বাঙ্গালী বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন গওস খান, মহিবুর রহমান, তােদ্দক আহমেদ, মিনহাজ উদ্দিন, বি. এইচ. তালুকদার, তৈয়বুর রহমান, জাকারিয়া চৌধুরী, ন্যাপ (ভাসানী)-এর নেতা জনাব মশিউর রহমানের (যাদু মিয়া) ছেলে শফিকুল গণি স্বপন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার প্রমুখ। যথাসময়ে বঙ্গবন্ধু হিথরাে বিমানবন্দরে পৌছান। ব্রিটিশ সরকারের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে সােজা অভ্যর্থনা স্থানে নিয়ে আসেন। উপস্থিত সবাই তাকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করে অভ্যর্থনা জানান। তিনি হাসিনা ও আমাকে আদর করেন। অভ্যর্থনা শেষে বঙ্গবন্ধু ও আমাদের জন্য লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রীটে মাউন্ট রয়েল হােটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর কক্ষে তাঁর অনুগত ও বিশ্বস্ত সাংবাদিক নজমুল হকের থাকার বন্দোবস্ত করা হয়। উল্লেখ্য যে, নজমুল হককে ১৯৭১ সনের পশ্চিম পাকিস্তানে অজ্ঞাত স্থানে গােপনে অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার সাক্ষী হিসেবে নেয়া হয়েছিলাে। তৎকালীন সরকারের গােয়েন্দা বিভাগের লােক, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ১৯৭১, রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম” তা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু ঐ ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন এই মর্মে এক ইশতেহারে স্বাক্ষর করতে নজমুল হকের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলাে। এ ঘটনা ঘটেছিলাে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে। উক্ত ইশতেহারে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানালে তারা তাকে হুশিয়ার করিয়ে তৎবিষয়ে চিন্তা করার জন্য এক মাস সময় দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলাে। অত্যন্ত মর্মান্তিক যে, ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর স্বাধীনতার বিপক্ষের পাক হানাদার বাহিনীর দোসরদের এক দলের লােকেরা অন্যান্য বাঙালী বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাকেও হাজারীবাগে নিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

৩৭। বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছার পর অধ্যাপক সালাম ( যিনি তখন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা ছিলেন) আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর একটি সাক্ষাতের আয়োজন করতে অনুরোধ করেন। নির্ধারিত তারিখে অধ্যাপক সালাম আমাদের হোটেলে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক আলাপ করেন। ইতিপূর্বে আমি ইংল্যান্ডের ওয়ারিংটনস্থ ডারেসবেরি নিউক্লিয়ার ল্যাবলেটরিতে এক বছর পোষ্ট-ডক্টরাল কাজ করার জন্য নিয়োগপত্র পেয়েছিলাম। আলোচনার শেষ পর্যায়ে আমি ১৯৭০ সালের জন্য ওয়ারিংটন শহরের নিকট অবস্থিত নিউক্লিয়ার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে আমার পোষ্ট ডক্টরাল রিসার্চ কাজ করার প্রস্তাব গ্রহণ করার প্রসঙ্গ ওঠালে অধ্যাপক সালাম তাতে সম্মতি জানান। বঙ্গবন্ধু একটু চিন্তা করে প্রস্তাবে রাজি হন।
৩৮। লন্ডনের এক বিশাল সিনেমা হলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ম্যানচেষ্টার, লিভারপুলসহ কয়েকটি শহরে তাকে বাঙালিরা সম্বর্ধনা জানায়। বার্মিংহামে বঙ্গবন্ধুর জন্য শেষ গণসম্বর্নার আয়োজন করা হয়েছিলো। এর আগের দিন সংবাদ পাওয়া যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের নারায়ণগঞ্জস্থ আদমজী জুট মিলসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, রংপুর প্রভৃতি শহরে বাঙালি বিহারী দাঙ্গা বাঁধানো হয়েছে। এই সংবাদ পেয়ে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই বার্মিংহামে যাওয়া বাতিল করে তিনি হাসিনাকে সঙ্গে করে নভেম্বরের ৭ তারিখে ঢাকার পথে রওনা দেন। দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, পার্বতীপুর, সৈয়দপুর, রংপুর প্রভৃতি দাঙ্গা উপদ্রুত শহর পরিদর্শন করেন। এরপর এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু বলেন, “পুরোনো খেলার সঙ্গে আমরা পরিচিত। এ খেলা খেলবেন না। এর পরিণতি ভালো হবে না। বাঙ্গালী জাতির দাবি ষড়যন্ত্রমূলক পন্থায় নস্যাৎ করতে চেষ্টা করবেন না। আমরা জানি শাসক-গোষ্ঠী কি চান। আইয়ুব খান এমনতর খেলার পরিণতিতে বিদায় নিয়েছেন। সুতরাং টালবাহানা না করে ( সাধারণ) নির্বাচন দিয়ে দিন। আমরা নির্বাচন, গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে চিরকাল অপেক্ষা করতেই থাকবো এমনতর ভাবা উচিত হবে না।“
৩৯। ২৮শে নভেম্বর (১৯৬৯) তারিখে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিল সহ প্রদেশগুলোর জনসংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধিত্বের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। একই সঙ্গে তিনি জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ৫ই অক্টোবর (১৯৭০) তারিখে অনুষ্ঠিত এবং ১৯৭০ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা, সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা প্রভৃতির অনুমতি দেয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। উক্ত ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, “১৯৭০ সালের ৫ই অক্টোবর ‘এক মানুষ এক ভোট’ এই নীতির ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের ফলে যে জাতীয় পরিষদ গঠিত হবে, চার মাসের মধ্যেই সেই পরিষদ পাকিস্তানের জন্য নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে।“
৪০। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অঞ্চলের নাম ছিলো “পূর্ব বাংলা”। ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার নতুন নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় তাঁর মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম এ দেশের নাম “ বাংলাদেশ” হবে বলে ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “আর পূর্ব পাকিস্তান নয়, আর পূর্ব বাংলা নয়। শেরে বাংলা ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে জনগণের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করছি, আজ থেকে বাঙালি জাতির এই আবাসভূমির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।“
১৮ই ডিসেম্বর (১৯৬৯) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের দাবিতে সর্বদলীয় ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মিছিল বের করা হয়।
৪১। ১৯৭০ সালের ৬ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু ও এ.এইচ. এম. কামরুজ্জামান পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৭ই মার্চ (১৯৭০) তারিখ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের সময় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনও অনুষ্ঠানের দাবি জানান। তিনি আরও বলেন, “৬-দফা বাস্তবায়ন ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। ‘ইসলাম বিপন্ন কথাটা’ যারা বলেন তাদের ‘রাজনৈতিক ধাপ্পাবাজ’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।।“ এই জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ শেষ করেন ‘জয় বাংলা’ বলে। এই প্রথম উচ্চারিত হয় ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতা বিপুল উল্লাস ধ্বনি ও করতালির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘’জয় বাংলা’ শ্লোগানকে স্বাগত জানায়। সেদিন ছাত্র-জনতার মুখ্য শ্লোগান ছিলঃ ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’, ‘জেগেছে জেগেছে , বাঙ্গালি জেগেছে’, ইত্যাদি। তখন আমি ওয়ারিংটন শহরের নিকট অবস্থিত নিউক্লিয়ার রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ছিলাম। এরপর পাঁচ মাস কেটে যায়। হাসিনার চিঠিতে বঙ্গবন্ধু ও সবার কুশলাদি এবং পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারতাম।
৪২। ১৯৭০ সালের আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি লন্ডন থেকে সুলতান শরীফ আমাকে জানান যে, ঐ সময়ে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ার ফলে লন্ডন থেকে ছাত্র ইউনিয়নের এ.টি.এম ওয়ালী আশরাফ কতৃক প্রকাশিত “জনমত” পত্রিকায় আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে বলে বিরাট হেড লাইনে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে এই আশঙ্কায় সুলতান শরীফ আমাকে অবিলম্বে লন্ডনে যেতে বলেন। আমি পরদিন লন্ডনে সুলতান শরীফের বাসায় উঠি। আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের নেতা গউস খান ও মিনহাজ উদ্দিন সাহেবদের সঙ্গে দেখা করে ঐ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করি। তাদের দু’জনকে সবিনয়ে যে কোনোভাবে নির্বাচন এড়ানোর জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করি। দুঃখের বিষয়, মিনহাজ উদ্দিন সাহেব নমনীয় হলেও গউস খান সাহেব তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাসায় ফিরে আসার পর রাত ১০ টার দিকে একটা ভাল আইডিয়া মনে আসে। সুলতান শরীফকে সে ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে বললাম। লন্ডন আওয়ামী লীগে ঐক্যের, বিশেষ করে ১৯৭০ সালের তৎকালীন পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান কতৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের এবং ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমার প্রস্তাবের সঙ্গে সুলতান শরীফ ঐক্যমত্য ব্যক্ত করেন। এরপর গউস খানের বিরোধী গ্রুপের নেতা মিনহাজ উদ্দিন ও বি. এইচ. তালুকদার সাহেবদেরকে ঐ বিষয়ে টেলিফোনে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। তাদেরকে পরদিন অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাধারণ ও নির্বাচনী সভায় এ ব্যাপারে প্রস্তুত থাকার জন্য অনুরোধ করি।
৪৩। পরদিন যথাক্রমে সুলতান শরীফের সঙ্গে সভাস্থলে উপস্থিত হই এবং সেখানে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর থেকে আগত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করি। আরও দেখি “জনমত”-এর সম্পাদক এ.টি.এম ওয়ালী আশরাফ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সেখানে ইতিপূর্বেই উপস্থিত হয়েছেন। সাধারণ সভা গউস খানের সভাপতিত্বে যথাসময়ে শুরু হয় এবং শান্তিপূর্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে শেষ হয়। লাঞ্চের পর নির্বাচণি অনুষ্ঠানের জন্য নেতৃবৃন্দ সভাকক্ষে সমবেত হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে বি.এইচ. তালুকদার উপস্থিত সকলের নিকট প্রস্তাব করেন যে, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ জামাতা হিসেবে আমাকে যেন নির্বাচনী অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। গউস খান একটু বিরত হন। কারণ সভা তাঁর সভাপতিত্বে হওয়ার কথা ছিলো। আমার নাম প্রস্তাবিত হওয়ায় সবাই সম্মতি জ্ঞাপন করেন। আমার সভাপতিত্বে নির্বাচনী সভা শুরু হয়। আমি সংক্ষিপ্ত ভাষণে আমার ওপর আস্থা ও গুরু দায়িত্ব অর্পণ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী অনুষ্ঠান শুরু করি। সর্বসম্মতিক্রমে এক ব্যতিক্রমধর্মী পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান পরিচালনা করার ঘোষণা প্রদান করি। উপস্থিত আওয়ামী লীগের সদস্যদের নিকট থেকে, আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটির জন্য প্রার্থী মনোনয়ন নেয়ার জন্য প্রস্তাব আহ্বান করি। এরপর এক এক করে যুগ্ম-সম্পাদক, সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, সভাপতিসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও সদস্যদের পদে নির্বাচনেচ্ছুক প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদান করার প্রস্তাব করি। সমস্ত পদে মনোনয়ন প্রাপ্তির পর যেহেতু সদস্য পদের সংখ্যার চেয়ে বেশী প্রস্তাব এসেছে সেহেতু প্রস্তাবিত প্রার্থীদের মধ্য হতে কেউ মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে চাইলে তা করার জন্য প্রায় দশ মিনিট সময় দেয়া হয়। মজার ব্যাপার যে, এক এক করে অতিরিক্ত প্রার্থীরা তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। একই পন্থায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদের প্রস্তাবিত
(Unicoded by Kazi rajib)
(পেইজ 61 থেকে 63 টাইপ করা সম্ভব হয়নি। আলাদা পোস্টে মূল বই দেখুন।)
চতুর্থ পরিচ্ছেদ ১৯৭১ সাল ১। ৩রা জানুয়ারি (১৯৭১) তারিখে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে একটি জনসভা আহ্বান করেন। ঐ জনসভায় নৌকা আকৃতির একটি বিশাল মঞ্চ বর্তমান শিশু পার্কের স্থানে তৈরি করা হয়েছিল। জনসভার প্রারম্ভে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের আওয়ামী লীগের আদর্শ, পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও সংস্কৃতি বিশেষ করে ছয় দফার দাবীর ব্যাপারে আপোষহীন ও অটল থাকার জন্য শপথ গ্রহণ করান। এর কিছুদিন পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অডিটোরিয়ামে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের থানা, মহকুমা, জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দু’দিনব্যাপী একটি সভার আয়োজন করা হয়। সভার সমাপনী উপলক্ষে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিলো। অনুষ্ঠানের শেষাংশে সমবেত কন্ঠে ডি. এল. রায়ের “ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” ও রবী ঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গান দুটি পরিবেশন করা হয়। সেদিন রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে গম্ভীর হয়ে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেশটা যদি কোনদিন স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে কবিগুরুর- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি- গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করো।” ঐ সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেনারেল পীরজাদাকে সঙ্গে করে ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর কয়েক দফা আলাপ- আলোচনা হয়। ১৮ই জানুয়ারী ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি অচীরেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ত্যাগ করবেন বলে আভাস দেন। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সাংবাদিকদের আর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করুন। তিনিই তো ভাবী প্রধানমন্ত্রী।” ২। ইয়াহিয়া খান ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর পশ্চিম পাকিস্তানের ‘পাকিস্থান পিপলস পার্টি- এর চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন এবং পর পর দু’দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চারটি বৈঠকে আলাপ-আলোচনা করেন। এরপর ৩০শে জানুয়ারী লাহোরের উদ্দেশ্যের রওনা হওয়ার প্রাক্কালে ঢাকা তেজগাঁ বিমানবন্দরে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধানের রুপরেখা সম্পর্কে শেখ সাহেবের সঙ্গে আমার চারটি বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমি তাঁকে স্পষ্ট বলে দয়েছি যে, ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করা হলে পাকিস্তান টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। সুতরাং ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান করার চেষ্টা করা হলে আমার দল তার বিরোধিতা করবে। ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করা হলে আমার দল যে কোন উপায়ে সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করবে। ভূট্টো সাহেব লাহোর বিমানবন্দরে পৌঁছে সেখানেও সাংবাদিকদের একই কথা বলেন। ঐদিন একটা ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে লাহোরে নেয়া হয়েছিলো। ভূট্টা ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন এবং তাদের খুব প্রশংসা করেন। এর এক-দুই দিন পরে ছিনতাইকারীরা বিমানটি জ্বালিয়ে দেয়। ভারত সরকার এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে এবং প্রতিশোধ হিসেবে ভারতের উপর দিয়ে পাকিস্তানী বিমান চলাচল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। ফলে পাকিস্তানী বিমানের জন্য শ্রীলঙ্কার কলম্বো হয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে হয়। ৩। ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষনা দেন। ইয়াহিয়ার এ ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সন্তোষ প্রকাশ করেন। কিন্তু জনাব ভুট্টো বললেন অন্য কথা। ১৫ই ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো বললেন, “মুজিব ৬ দফার প্রশ্নে আপোষ না করলে তাঁর দল ৩রা মার্চের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করবে না।” ভুট্টোর সংগে হাত মেলালেন কনভেনশন মুসলিম লীগের খান আব্দুল কায়উম খান। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ভুট্টো এক জনসভায় বলে বসলেন, “ঢাকা পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য কসাইখানা হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সদস্য প্রস্তাবিত অধিবেশনে যাবার চেষ্টা করলে তার পা ভেঙে দেয়া হবে।” ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ সপ্তাহের প্রথম দিকে পত্রিকায় নিম্নোক্ত শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়ঃ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনাব ভুট্টোর সঙ্গে সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় তাঁর জমিদারী অঞ্চলের বনে পাখি শিকারে গেছেন।” ২৮শে ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার আবেদন জানান। এরপর ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে জাতির উদ্দেশে্য ভাষনে ঘোষণা দেন যে, অনিবার্য কারণবশত জাতীয় ঐক্য ও সংহতির স্বার্থে ঢাকায় ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিল করা হয়েছে। ঐ ঘোষণার সপ্তাহ দুয়েক আগে থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ঢাকাস্থ হোটেল পূর্বাণীতে পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া তৈরীতে দিনরাত ব্যাস্ত ছিলেন। ১লা মার্চ যথারীতি বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে সকাল ৯টায় হোটেল পূর্বাণীতে গিয়েছিলেন। দুপুর ১২টার দিকে ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিলের সংবাদ তাঁরা পান। এই ঘোষনা শোনা মাত্রই সারা ঢাকায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অধিবেশন বাতিলের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। ঐ সময়ের ঢাকা স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ বিশাল খোলা মাঠটি ছাত্র-জনতায় ভরে যায়। জনতা বঙ্গবন্ধুকে তাদের সঙ্গে এসে যোগদান করার অনুরোধ জানালে তিনি হোটেল পূর্বাণীতে সমবেত সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে জনতার সামনে হাজির হন। উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত ভাষনে বঙ্গবন্ধু বলেন, “গত দুই সপ্তাহ ধরে আমি ও আমার দলীয় নেতৃবৃন্দ প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদে পেশ করার লক্ষ্যে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত ছিলাম। জতীয় ঐক্য ও নিরাপত্তা সংহত রেখেও কি ব্যবস্থার মাধ্যমে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন করা যায় তার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপায় আমারা নির্ধারণ করেছি। কিছুক্ষণ আগে প্রস্তাবিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করার ঘোষণা আমাদের প্রচেষ্টাকে বানচাল করার গভীর ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি বলে মনে করি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সকল বাঙালি এই ষড়যন্ত্রকে জীবন দিয়ে হলেও
প্রতিহত করবে।” তিনি ছাত্র-জনতাকে ইয়াহিয়া খানের ঘোষনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। উপরন্তু বঙ্গবন্ধু ২রা মার্চ ঢাকাতে , পরদিন সারাদেশে হরতাল এবং ৭ই মার্চ রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার কথা ঘোষণা করেন। ৩রা মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এডমিরাল আহ্সানকে পদচ্যুত করে তার স্থলে জেনারেল ইয়াকুব খানকে সাময়িকভাবে দায়িত্ব দেন। এরপরেও মার্চের ৪ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত একনাগাড়ে তিনদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৪। ক্রমেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইপিআর ও পুলিশের গুলিতে অনেক ছাত্র-জনতা মৃত্যুবরণ করেন। ৪ঠা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করে একই সঙ্গে তাঁর নিকট পূর্ব পাকিস্তানের Zonal Martial Law Administrator- এর ক্ষমতাও অর্পণ করেন। টিক্কা খান ঢাকায় পৌঁছেন ৫ই মার্চ। তাঁর শপথ গ্রহণ করার কথা ছিলো ৬ই মার্চ। কিন্তু গনআন্দোলনের তীব্রতা ও আওয়ামী লীগের প্রতি জনগণের পূর্ণ সমর্থন লক্ষ্য করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিক টিক্কা খানকে গভর্নর পদে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান। ৪ঠা মার্চ রেডিও- টেলিভিশনে ঘোষণা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৫ই মার্চ বিকেল ৫টায় জাতীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। ঐ দিন বিকেল ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমেদ ও ডঃ কামাল হোসেন সাহেবদের সঙ্গে তাঁর বেডরুমে বসে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন। আমিও সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম। এমনি সময় ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলবেন বলে তৎকালীন ঢাকাস্থ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াকুব খান বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করে তাঁকে অপেক্ষা করতে বলেন। টেলিফোন পাবার পর বঙ্গবন্ধু “কিছু শুনতে পাচ্ছি না, কিছু শুনতে পাচ্ছি না” বলে ইয়াহিয়া খানকে আবার টেলিফোন করতে বলেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন যে, পুনরায় টেলিফোন এলে আমি যেন ইয়াকুব খানকে এই বলে ব্যাস্ত রাখি যে, তিনি তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করছেন। এর কিছুক্ষণ পর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে পুনরায় টেলিফোন আসলে আমি তা রিসিভ করে কিছুক্ষণ তাঁকে ব্যাস্ত রেখে বঙ্গবন্ধুকে রিসিভারটি দিই। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানকে বলেন যে, তিনি যেন বিগত কয়েকদিন আন্দোলন চলাকালে যে সমস্ত ছাত্র-জনতা ইপিআর ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন, তার জন্য তাঁর আন্তরিক দুঃখ এবং শহীদদের পরিবারবর্গের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রকাশ করে সে সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠন করেন। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানকে আরো বলেন যে, তিনি যেন এই মর্মে একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন যে, ঢাকা এসে তিনি জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত আওয়ামী লীগ দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে সমস্যাদির সমাধানের লক্ষ্যে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করবেন। ৫। সে সময় হাসিনা ও আমি বঙ্গবন্ধুর বাসাতেই থাকতাম। বঙ্গবন্ধু আমাদের সবাইকে নির্দেশ দেন যে, আমারা যেন ৫ই মার্চে ইয়াহিয়া খানের ভাষন টেপ করে রাখি। ৫ই মার্চ বিকেলে বঙ্গবন্ধু নিজেও একটি ট্রানজিস্টর নিয়ে শয়ন কক্ষের দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকলেন। ভাষনে ইয়াহিয়া খান বললেন যে, তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের একগুঁয়েমীর জন্য প্রস্তাবিত ৩রা মার্চে অনুষ্ঠিতব্য পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি আরো বলেন যে, ১০ই মার্চ ঢাকায় গোলটেবিল সম্মেলন আয়োজন করে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তিনি পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলের দলের দলের নেতৃস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করবেন। । । উপরন্তু ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় ২৫শে মার্চ নির্ধারণ করেন। ভাষণ শোনার সর বাড়ীর সবাই আমারা নিশ্চুপ হয়ে যাই। ঘন্টাখানেক পর বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী মোহাম্মদ হানিফকে আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও ডঃ কামাল হোসেনকে জরুরী তাঁর বাসায় আসার জন্য সংবাদ দিতে বলেন। নেতৃবৃন্দদের আসার পর বঙ্গবন্ধু তাদেরকে নিয়ে লাইব্রেরী রুমে প্রায় এক ঘন্টা আলাপ-আলোচনা করেন। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান ও আমি- এই তিনজন মিলে উদ্ভুত পরিস্থিতি সম্পর্কে ছাত্রদের মতামত তাঁদেরকে জানাই। আলোচনা শেষে, ইয়াহিয়া খানের ভাষনের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি ইশতেহার প্রদান করা হয়। উক্ত ইশতেহারটি ছিল ইংরেজিতে এবং তাজউদ্দিন আহমেদ এটি ডঃ কামাল হোসেনের সহায়তায় তৈরি করেছিলেন। এর শেষাংশে বলা হয়েছিলো, “শহীদের রক্তে রঞ্জিত রাস্তার রক্ত এখনো শুকোয়নি। শহীদদের রক্ত পদদলিত করে ১০ই মার্চ তারিখে প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ যোগদান করতে পারে না।”
৬। ৭ই মার্চ সকালে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আওয়ামী লীগের বহু নেতৃস্থানীয় ও ছাত্র নেতৃবৃন্দে ভরে যায়। উপস্থিত সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন দেশে পরিণত করার ব্যাপারে আলোচনা করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন সাহেবদের সঙ্গে লাইব্রেরী রুমে দ্বার রুদ্ধ করে আলাপে বসেন। সুদীর্ঘ আলোচনার পর লাইব্রেরী কক্ষ থেকে বসার ঘরে অপেক্ষারত আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তাঁরা ঐক্যমত্যে পৌছেছেন এবং ঐদিন বিকেল সাড়ে চার ঘটিকায় রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিতব্য সভায় দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করে একটি চার দফার ঘোষণা দেয়া হবে। অতঃপর বঙ্গবন্ধু তৎমর্মে জনাব কামরুজ্জামান, জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ডঃ কামাল হোসেনকে নির্দেশ দিয়ে গোসল ও দুপুরের আহারের জন্য বাড়ীর ওপরের তলায় চলে যান। আহার শেষে বঙ্গবন্ধু যখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সে সময় এক ফাঁকে এসে ডঃ কামাল হোসেন তাঁকে প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্রের খসড়াটি দেখিয়ে নেন। ততক্ষনে আওয়ামী লীগের অপর পাঁচ নেতা নিজ নিজ বাসায় দুপুরের আহারের জন্য চলে গিয়েছিলেন। ডঃ কামাল হোসেন উপরোল্লিখিত ঘোষনাপত্রটি টাইপ করিয়ে নেয়ার জন্য নিচে চলে গেলে বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন আমি যেন ঐ ঘোষণাপত্রটির টাইপড্ (চুড়ান্ত) কপিটি সেটির অনুমোদিত মূল খসড়াটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি। ঘোষনাপত্রের খসড়াটি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী মোহাম্মদ হানিফকে টাইপ করার নির্দেশ দিয়ে ডঃ কামাল হোসেন আহারের জন্য তাঁর বাসায় চলে যান। ৭। বিকেল তিনটার দিকে প্রথম আসেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং আর একটু পরেই ডঃ কামাল হোসেন। আমি তখন ঘোষণাপত্রটির চুড়ান্ত কপিটি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক অনুমোদিত খসড়া কপিটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখছিলাম। এক পর্যায়ে খন্দকার মোশতাক কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, ইশতেহারে স্বাধীনতা ঘোষণার কথা উল্লেখ করা হয়েছে কিনা। তিনি বলেন যে, সামরিক শাসনের ক্ষমতাবলে জারীকৃত আইনগত কাঠামো (Legal Framework Order- LFO)- এর অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকায় বসে পাকিস্তানের অখণ্ডতা লংঘন সংক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার ব্যাপারটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং এই ব্যাপারটা ইশতেহারে লেখা হয়নি। আমি ইশতেহার পড়ে দেখলাম যে, তাতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর যে সমস্ত আলাপ হয়েছে এবং ১লা মার্চ হতে গনআন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে সমস্ত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে এবং বিরাজমান পরিস্থিতি ও ছাত্র-জনতার দাবি উল্লেখ পূর্বক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতা হিসেবে চারটি দাবি উপস্থাপিত করেছেন। উক্ত ইশতেহারে ইয়াহিয়া খানের নিকট দাবি করা হয়: (১) সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, (২) ১লা মার্চ হতে আন্দোলনে যে সমস্ত ভাইবোনকে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে সেব্যাপারে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, (৩) সামরিক আইন অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং (৪) অবিলম্বে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দলের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ৮। এ সময়েই বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে আয়োজিত জনসভায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আমাদের কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁর সঙ্গে আরওদশ-পনেরজন ছাত্র ও আওয়ামী লীগ নেতা প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি সভা মঞ্চে পৌছার পূর্বেই সভামঞ্চের চারদিকে উপস্থিত দেশী-বিদেশী সাংবাদিকবৃন্দের মধ্যে এই ইশতেহারের কপি বিতরণ করবে।” এই কথা বলে তিনি দোতলায় চলে যান। প্রায় আধ ঘন্টা পর সাড়ে চারটার দিকে বঙ্গবন্ধু সভায় যাওয়ার জন্য আয়োজন করতে বলেন। হাসিনা, রেহানা, এ. টি. এম. সৈয়দ হোসেন সাহেবের বড় মেয়ে শেলী ও শেখ শহীদের বোন জেলী আমার গাড়ীতে উঠে বলে যে, তাদেরকেও রেসকোর্সের জনসভায় নিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু একটি ট্রাকে ওঠেন। উক্ত ট্রাকে ছিলেন সিটি আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফা, শেখ ফজলুল হক মনি, ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি আবদুর রউফ ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ডাকসুর প্রাক্তন সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমেদ , নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। মোস্তফা মোহসীন মন্টু, কামরুল আলম খসরু, মহিউদ্দিন, আ. স. ম. আব্দুর রব ও শাহ্জাহান সিরাজসহ আরো কিছু সংখ্যক আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা আর একটি ট্রাকে ছিলেন। নিরাপত্তার জন্য গাজী গোলাম মোস্তফা ড্রাইভারকে ৩২ নম্বর সড়কের পশ্চিম দিক দিয়ে যেতে বলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুসারী অন্যান্য যানগুলো চলে যাওয়ার পর আমি হাসিনা ও শ্যালিকাদের নিয়ে মিরপুর রোড দিয়ে যাত্রা করি। সিএসআইআর- এর মোড়ে পৌঁছে সায়েন্স ল্যাবরেটরি রোড ও আশেপাশের রাস্তাগুলোয় রেসকোর্সে অভিগামী ছাত্র-জনতার মিছিলে পরিপূর্ণ থাকায় নিউ মার্কেট, ইডেন কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে হাইকোর্ট এলাকা ঘুরে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের কাছাকাছি যাই। সেখানে পৌছে দেখি রেসকোর্স লাখ লাখ লোকে পরিপূর্ণ এবং প্রায় সবার হাতে লাঠিসোটা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রাঙ্গণ ছিলো রায়ট পুলিশে ভর্তি।
৯। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে নৌকা আকৃতির সভামঞ্চটি স্থাপন করা হয়েছিলো বর্তমান শিশু পার্কের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে। হাসিনার অনুরোধে আমি বহু কষ্টে সভামঞ্চের কাছাকাছি গাড়ি নিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু তখনো সভামঞ্চে এসে পৌছাননি। এর প্রায় পনের মিনিট পর বঙ্গবন্ধু সদলবলে সেখানে পৌছান এবং মঞ্চে উঠে সবাইকে অভিবাদন জানান। হাসিনা আমাকে বলে, ” বিভিন্ন সংবাদপত্রে লিখেছে, আব্বার আজকের সম্পূর্ণ বক্তৃতা রেডিওর মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে।” সে আমাকে গাড়ির রেডিও অন করতে বলে। রেডিওতে তখন বার বার এই মর্মে ঘোষণা দেয়া হচ্ছিলো, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রেডিও নিস্তব্ধ হয়ে যায়। যা হোক, বঙ্গবন্ধু প্রায় আধ ঘন্টা ধরে বক্তৃতা করেন এবং শেষ প্রান্তে বলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।” এই কথার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতা লাঠিসোটা ঠোকাঠুকি করে বিজয় উল্লাসে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা বলে শ্লোগান দিলে উপস্থিত জনতা জয় বাংলা শ্লোগান তুলে প্রত্যুত্তর দেন। বঙ্গবন্ধু আবার জয় বাংলা বললে জনতা জয় বাংলা ধ্বনিতে চারিদিক মুখরিত করে তোলে। “খোদা হাফেজ” বলে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন। সভা শেষে আমি হাসিনা ও শ্যালিকাদের নিয়ে একই রাস্তায় ৩২ নম্বরে ফিরে আসি। বঙ্গবন্ধু প্রায় আধঘন্টা পর বহু লোকজনসহ বাসায় ফিরে আসেন।
১০। সেদিন রাত ৮টার দিকে রেডিও পাকিস্তানের ঢাকাস্থ কেন্দ্রের প্রায় সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৩২ নম্বরের বাসায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে আসেন। তাঁদের নেতৃবৃন্দের অন্যতম ছিলেন জনপ্রিয় বাংলা সংবাদ পাঠক ও ছাত্র ফেডারেশনের ইকবাল বাহার চৌধুরী। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে জানান যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন সত্ত্বেও ঢাকায় অবস্থিত সেনা বাহিনীর হাঈ কমান্ডের নির্দেশে সেদিন বক্তৃতা সরাসরি সম্প্রচার করতে না দেয়ায় তাঁরা প্রতিবাদ স্বরুপ ৭ই মার্চ রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রদত্ত তাঁর সম্পূর্ণ ভাষণ পুনঃপ্রচার করার অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত ঢাকাস্থ রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারী অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ও অফিসে উপস্থিত না হওয়ায় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঐ রাত থেকে পরদিন রাত পর্যন্ত ঢাকাস্থ রেডিও পাকিস্তানের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ ছিলো। ৯ই মার্চ সকাল ৮টায় হঠাৎ পাকিস্তান রেডিওর ঢাকা কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয় যে, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু যে ভাষন দিয়েছিলেন তা হুবহু সকাল ৯টায় প্রচার করা হবে। আমি ৯ তারিখ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে গাড়ীর রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি সম্পূর্ণ শুনেছিলাম (পরিশিষ্ট- ২ দ্রষ্টব্য)
Unicoded by 64-70 Mahmood Hussain
১১। ৭ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু, হাসিনা, শেখ কামাল, শেখ জামাল, রেহানা, রাসেল, শেখ শহীদ, শাশুড়ী ও আমাকে নিয়ে খাওয়ার সময় গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমার যা বলার ছিলো আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোন মুহূর্তে গ্রেফতার বা হত্যা করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু’বেলা আমার সঙ্গে একত্রে খাবে।“ সেদিন থেকে এ নিয়ম আমরা ২৫শে মার্চ দুপুর পর্যন্ত পালন করেছি। কেবল ২৫শে মার্চ রাতে ব্যাতিক্রম ঘটে। সে রাতে বঙ্গবন্ধু রাত এগারোটা পর্যন্ত বাড়ির নীচতলায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগ ও অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনায় ব্যাস্ত ছিলেন। ফলে শাশুড়ী বাদে আমরা সবাই খেয়ে নিয়েছিলাম।
১২।৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে তার নির্দেশে শুরু হয় পাকিস্থান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন। তারপর থেকে তিনি কার্যত গোটা পূর্ব পাকিস্থানের শাসনভার গ্রহণ করেন। ৮ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্থানের ঢাকাসহ সকল শহর-গঞ্জে সরকারী অফিস আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন্ধ করে দেয়। কেবল অত্যাবশ্যকীয় সেবাদানমূলক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, পানি-বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, মিউনিসিপালিটি, মেডিকেল ক্লিনিক খোলা রাখা হয়। লক্ষণীয় ছিলো যে, জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্থানের শাসনভার গ্রহণ করায় সরকারের পুলিশ বাহিনী ও EPR-এর বাঙালী সদস্যবৃন্দের অনেকে পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিলেন। সে সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, আইনজীবী ও পেশজীবী প্রতিষ্ঠানের সদস্যবৃন্দ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর লোকজন, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র সংগঠন বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে জয় বাংলা ধ্বনি তুলে তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি আকুন্ঠ ও স্বার্থহীন সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশ করতে থাকে।
১৩। ৯ মার্চ বিকেলে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দানকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেনঃ “… প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও তাই বলি, অনেক হয়েছে আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নেই। লা কুম দ্বীনকুম ওয়ালইয়া দ্বীন (তোমার ধর্ম তোমার, আমার ধর্ম আমার)- এর নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করিয়া লও। মুজিবের নির্দেশমত আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোন কিছু করা না হইলে আমি শেখ মুজিবর রহমানের সহিত হাত মিলাইয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল আন্দোলন শুরু করিবো। খামাকা কেহ মুজিবকে অবিশ্বাস করিবেন না। মুজিবকে আমি ভালো করিয়া চিনি…।“
১৪। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ সকালে তার উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে ঢাকায় পৌঁছান এবং কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ঢাকাস্থ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাউজ (বর্তমানে সুগন্ধা)-এ অবস্থান করেন। ১৬ মার্চ সকালে কোন পরামর্শদাতা ছাড়াই ইয়াহিয়া-মুজিব প্রথম দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ও তার পরামর্শদাতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সামরিক ও বেসামরিক পরামর্শদাতাদের সুদীর্ঘ বৈঠক হয়।আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ.এইস.এম.কামরুজ্জামান, খন্দকার মোশতাক, ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন। ১৮ই মার্চ সকাল ও বিকেলে দুই দফা আলোচনা হয়। সেদিন উল্লিখিত নেতৃবৃন্দ ছাড়াও আরো কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। ১৯শে মার্চ জয়দেবপুরে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হলে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সরকার সেখানে কারফিউ জারি করে। বঙ্গবন্ধু এর তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং পরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দীর্ঘ দেড় ঘন্টা এ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর তিনজন পরামর্শদাতাদের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের পরামর্শদাতাদের পৃথক বৈঠক হয়। আওয়ামী লীগের এই তিনজন ছিলেন সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম,তাজউদ্দিন আহমদ ও ডঃ কামাল হোসেন। ২০শে মার্চ বঙ্ঘবন্ধু সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ.এইস.এম.কামরুজ্জামান,ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক ও ডঃ কামাল হোসেনকে নিয়ে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর পরামর্শদাতাদের সঙ্গে চতুর্থ দফা বৈঠক করেন।

১৫। ইতোমধ্যে পশ্চিম পাকিস্থানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত অন্যান্য দলের ৩৫ জন নেতা ঢাকায় এসে পৌঁছান। এঁদের অন্যতম ছিলেন ন্যাপের সভাপতি খান মোহাম্মদ ওয়ালী খান। ১১ই মার্চ বিকেলে ওয়ালী খান বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডস্থ বাড়ীতে আসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি বাড়ীর ওপরতলার বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষের পাশে বাসার মুক্ত স্থানে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সুদীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেন। ওয়ালী খানকে জীবনে এই প্রথম দেখি। শাহ মোয়াজ্জেমের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ব্যারিস্টার এ,আর, ইউসুফের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন জেনে তিনি ১২ই মার্চ সকাল ৯টার দিকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা সম্পর্কে তাঁর মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “আপনাকে এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে—হয় N.D.F- এর ৯ দফার ভিত্তিতে সমাধানে পৌঁছাতে হবে নতুবা বর্তমান আন্দোলন ও গণদাবির প্রেক্ষিতে এক দফার ঘোষণা দিতে হবে। এছাড়া আপনার আর কোন বিকল্প নাই।“ ঐদিন মুসলিম লীগের নেতা খান আবদুস সবুর খানও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন সন্ধ্যে ৭টার দিকে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে প্রায় এক ঘন্টা আলাপ-পরামর্শ করেন। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু সবুর খানকে “ভাইজান” বলে সম্বোধন করতেন। মুসলিম লীগের বিশিষ্ট নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথেও বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীর বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে আন্দোলন প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেন। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীকে “হুজুর” বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেট মনি সিং এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রফেসর মোজাফফর আহমেদ সাহেবের সঙ্গে পরিস্থিতি সম্পর্কে সুদীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেন। কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রধান মিয়া মমতাজ দৌলত খানেরও সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আলাপ-আলোচনা করেছিলেন।
১৬। অসহযোগ আন্দোলন শুরুর পর একদিন রাতে খাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, “ওয়াজেদ, যে কোন মুহূর্তে সামরিক বাহিনী আমার বাড়ী আক্রমন করতে পারে।তুমি হাসিনা, রেহানা ও জেলীকে নিরাপদে রাখার জন্য জরুরী ভিত্তিতে একটি বাসা ভাড়া করো এবং ওদের নিয়ে চলে যাও। প্রয়োজনবোধে আমি তোমার বাসায় গোপনে আশ্রয় নেবো। একটু বড় বাড়ী নিও, আমি ভাড়া দেবো।“ এর দু’দিন পরো বঙ্গবন্ধু একই কথা পুনরায় বলেন। দ্বিতীয়বার একই কথা বলার পর আমি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে হাসিনাকে নিয়ে সুবিধাজনক বাসার খোঁজ করতে থাকি।প্রথমে ধানমন্ডির (পুরাতন) ২৮ নম্বর (নতুন ১৫ নম্বর) সড়কে একটি দোতলা বাড়ি দেখি।বাড়িটি উন্নতমানের এবং প্রতি ফ্ল্যাট তিন হাজার টাকার কম ভাড়া দেবেনা বলে বাড়িওয়ালা আমাদের জানান। অত্যান্ত বেশী ভাড়া এবং বাড়ীটি বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর কাছাকাছি হওয়ায় হাসিনা ঐ বাড়ীটি নিতে সম্মত হলো না। এরপর হাতিরপুলে তৎকালীন ঢাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পুরাতন ফুলবাড়ীয়া ষ্টেশনে যাওয়ার রেল লাইনের পশ্চিমে অবস্থিত ১২ নম্বর ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে একই কম্পাউন্ডের ভেতরে তিনটি বাড়ীর মধ্যে একটি দোতলা বাড়ী খালি দেখতে পাই। এ বাড়ীর মালিক ছিলেন আমার রাজশাহী সরকারী কলেজের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ডঃ আব্দুল্লা আলমুতি শরফুদ্দিনের শ্বশুর খান বাহাদুর আবদুল হাকিম সাহেবের। ফ্ল্যাটটিতে দু’টো বেড্রুম, ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুম এবং দু’টো বাথ্রুম।বাসাটি হাসিনার পছন্দ হয়। এর ভাড়া ছিলো কম, পাঁচ শত টাকা। বঙ্গবন্ধু এ বাড়ীতে এসে প্রয়োজনে আত্মগোপন করে থাকতে পারবেন ভেবে হাসিনার সম্মতিক্রমে পাঁচ শত টাকা অগ্রিম দিই। ১৪ মার্চ সকালে ঠেলাগাড়িতে শাশুড়ীর দেয়া আসবাবপত্র নিয়ে ঐ ফ্ল্যাটে রেখে আসি। কিন্তু পরদিন সেখানে যাওয়ার পর নিঃসঙ্গবোধ করার কারনে ফ্ল্যাটটি ঠিকমত রং করা হয়নি এই অজুহাতে হাসিনা আমাকে তৎক্ষণাৎ ৩২ আসবাবপত্রসহ ফিরে আসতে বাধ্য করে। পরদিন সাত মসজিদ রোডের ওপর ধানমন্ডির (পুরাতন) ১৫ নম্বার রোডস্থ ৯নতুন ৮/এ-১৭৭ নম্বর) বাড়ীর নীচতলা নয় শত টাকায় ভাড়া নিই। ১৭ মার্চ সকালে ঐ বাড়ির ড্রয়িং রুমে আসবাবপত্র রেখে আসি।
১৭। ১৮ মার্চ সকালে সংবাদপত্রে ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে একটি সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, শেখ মুজিবসহ আওয়ামীলীগের অনেক নেতা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট দেশের রাজনৈতিক সমস্যাদি এবং বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করেছেন এবং সকলের গ্রহণযোগ্য ও সন্তোষজনক সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভব বলে তিনি আশাবাদী। এই খবর দেখে হাসিনা ধানমন্ডির ১৫
(Unicoded by 71-73 Fahim Al Mamun)

নম্বর রোডস্ত ভাড়াকৃত বাড়ীর ফ্লাটে যেতে ইতস্তত করছিলেন। ফলে ধানমন্ডির ১৫ নম্বরের ঐ বাসায় ওঠার আয়োজন সাময়িকভাবে স্থগিত করতে হয়।
১৮।২১শে মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো তার দলীয় নেতা ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে করে ঢাকায় এসে কড়া নিরাপত্তায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান হোটেল শেরাটন) এ অবস্থান করেন । ঐ দিনই তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দুই ঘন্টা গোপন শলাপরামর্শ করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে অপেক্ষমান জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের গতি কোনভাবেই মন্তর করা যাবে না। ২২শে মার্চ বঙ্গবন্ধু এক প্রেস বিবৃতিতে বললেন,” লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকারে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে-প্রতিরোধ দুর্গ। আমাদের দাবি ন্যায় সঙ্গত। তাই সাফল্য আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।”
১৯।২২শে মার্চ ইয়াহিয়া খান,শেখ মুজিব ও ভূট্টোর মধ্যে এক বৈঠক হয়। এ বৈঠক খুব একটা ফলপ্রসূ হয়েছিল বলে মনে হল না। ঐ দিনেই সরকার পক্ষ থেকে এক ঘোষণায় বলা হয় যে,পাকিস্তান উভয় অঞ্চলের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আরো বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কারণে ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্ব সিদ্ধান্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল করা হয়েছে। সরকারের এই ঘোষণার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন আরো দৃঢ় করার লক্ষ্যে ২৬শে মার্চ থেকে সারা দেশব্যাপী “অবরোধ আন্দোলন” শুরু করার প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানালেন।
২০। ঐ সময় আবাস পাওয়া গিয়েছিল যে, ইয়াহিয়া খান কোন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান করতে আন্তরিক ছিলেন না৷ আলোচনার অজুহাত দেখিয়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আন্দোলনরত জনতার বিরুদ্ধে কঠোর সামরিক ব্যবস্তা গ্রহণ করার জন্য বিমানে ও জাহাজে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার সৈন্য ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভারী অস্রশস্র আনা হচ্ছিলো। একদিন সংবাদপত্রে দেখা যায়, পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ সামরিক জাহাজ “সোয়াত” কয়েক হাজার সৈন্য ও অস্রশস্র সহ কয়েক দিনের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছাবে। এই সংবাদে চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত কর্মচারীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে, কোন অবস্তাতেই তারা “সোয়াত” কে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করতে দেবে না। আন্দোলনের এহেন অবস্তায় ২৩শে মার্চ সকাল দশটায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। আমি সেখানে পৌছাই নয়টার দিকে। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বাজিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন ছাত্রলীগের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী,আব্দুল কুদ্দুস মাখন,আ.স.ম আব্দুর রব,ও শাহজাহান সিরাজ। লক্ষণীয় যে গাঢ় সবুজ কাপড়ের মাঝখানে লাল– গোলাকার বলয়ের ভিতর সোনালী রং এ অঙ্কিত বাংলাদেশের মানচিত্র সহ তৈরী করা হয়েছিল ঐ পতাকাটি। সভাশেষে এই চার নেতা একটি বিশাল মিছিল সহকারে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুকে পতাকাটি অর্পণ করে এবং মিছিলে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের একটি বিশেষ দল সামরিক কায়দায় তাকে অভিবাদন জানায়। ঐ দিনই ছাত্র-জনতা প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট ও হাইকোর্ট সহ বাড়ী বাড়ী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে।
২১। ঐ দিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে শাশুড়ী বঙ্গবন্ধুকে বললেন, “এতদিন ধরে যে আলাপ -আলোচনা করলে, তার ফলাফল কি হলো কিছু তো বলছো না। তবে বলে রাখি তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর, তবে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী তাদের সুবিধামত যেকোন সময়ে তোমাকে হত্যা করবে,অন্যদিকে এদেশের জনগণ ও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে৷ একথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শ্বাশুড়িকে বললেন, ” আলোচনা এখনো চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভন না। ” এই পর্যায়ে শাশুড়ী রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপর তলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারাদিন শুয়ে থাকলেন,কারো সঙ্গে কথাও বললেন না।
২২। ২৩ শে মার্চ সকালে ও বিকালে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার প্রেক্ষাপটে আওয়ামীলীগ ও সামরিক জান্তার উপদেষ্টাদের মধ্যে দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ ও ড.কামাল হোসেন আওয়ামীলীগের পক্ষে এবং এম.এম আহমদ, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ.আর.কর্ণেলিয়াস লেঃ জেনারেল পীরজাদা, ও কর্ণেল হাসান (গোয়েন্দা বিভাগ) সামরিক জান্তার পক্ষে বৈঠকগুলোতে উপস্তিত ছিলেন৷ সেদিন খান আব্দুল্লাহ, কাইয়ুম খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পৃথকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সন্ধ্যে সাতটার দিকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাসায় দেখা করে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও আনুগত্য প্রকাশ করেন। ঐদিন রাতে রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের ” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি সঙ্গীত প্রচারিত হলো।
২৩। ২৪ শে মার্চ সকাল ও বিকেলে আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ ও ডঃ কামাল হোসেন প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের সঙ্গে দুই দফা আলোচনা করলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা ছিলেন এম.এম.আহমদ,বিচারপতি কর্ণেলিয়াস লেঃ জেনারেল পীরজাদা এবং কর্ণেল হাসান। সাংবাদিকদের নিকট তাজউদ্দীন আহমদ শুধু বললেন, “প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মধ্যে যে সব কথা বার্তা হয়েছে, তারই আলোকে বিস্তারিত আলোচনার সিদ্ধান্তে পৌছানোর লক্ষ্যে এসব বৈঠক।”

২৪। ২৫ শে মার্চ সকালে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার পার্টির জে.এ রহিম ও মোস্তফা খানকে সহ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেন। ঐদিন আওয়ামীলীগের সঙ্গে সামরিক জান্তার কারও আলোচনা হয়নি। বঙ্গবন্ধু, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ,ক্যাপ্টেন এম এ মনসুর আলী,সৈয়দ নজরুল ইসলাম,ড. কামাল হোসেন ও গাজী গোলাম মোস্তফাকে নিয়ে নিয়ে প্রায় সারাক্ষণ নিচের লাইব্রেরী রুমে বসেছিলেন৷ সেদিন সবার চোখে মুখে ছিল উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার ছাপ। মাঝে মাঝে বঙ্গবন্ধু অন্যান্য ছাত্র ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এক এক করে বিদায় দেন। রহস্যের ব্যাপার সেদিন খন্দকার মোশতাক আহমদকে কখনো দেখা যায়নি। বিকেল তিনটার দিকে শেখ ফজলুল হক মণি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার শয়নকক্ষে আলাপ করেন। এর কিছুক্ষণ পর লন্ডনস্থ আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা জাকারিয়া চৌধুরী বাসায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোপনে আলাপ করেন। আলাপ শেষে প্রথমে শেখ মণি তার পরিবারের সকলকে নিয়ে সে রাতে টুঙ্গিপাড়া চলে যাবে বলে সে সকলের কাছ থেকে বিদায় নেয়। জাকারিয়া চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় আমাকে জানান যে তিনি ঐ রাতেই বর্ডার পার হয়ে লন্ডন চলে যাবেন।
২৫। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যে সাতটার আগেই একে একে আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গদলের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তার নির্দেশ নিয়ে চলে যান। সন্ধ্যায় আসে ছাত্রনেতৃবৃন্দ। রাত আটটায় এইচ.এম.কামরুজ্জামান,ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম পুনরায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করেন। সে সময় আমি হাসিনাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে অস্থির হয়ে পায়চারী করছিলাম৷ রাত যতই বাড়তে থাকে ততোই চারদিকে লোকজন ও যানবাহন চলাচল কমতে থাকে। চারদিক থমথমে অবস্তা লক্ষ্য করে আমি সঙ্কিত হই। যা হোক ব্যস্ততার কারণে বঙ্গবন্ধুর রাতে খাবার খেতে দেরী হবে এই ভেবে শাশুড়ী বাদে আমরা সবাই পূর্বের নিয়ম ভঙ্গ করে সাড়ে ন,টার সময় আমরা খেয়ে নিই৷ অতঃপর শেখ কামাল সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোথায় যেন চলে যায়।
২৬। রাত ১১টার দিকেও বঙ্গবন্ধু ওপরে আসছেন না দেখে হাসিনা আমাকে বলে “আব্বা সারা বিকেল কিছুই খাননি। চলো আমরা দুজন নিচে গিয়ে আব্বাকে নিয়ে আসি।আমরা নিচে নামার সময় দেখি সিড়ির গোড়ায় দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেষ কথা বলছেন সিরাজুল আলম খান,আ.স.ম আব্দুর রব,ও শাহজাহান সিরাজকে। তাদের সঙ্গে কথা শেষ করে বঙ্গবন্ধু হাসিনাকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলেন, মা তোকে আমি সারাদিন দেখিনি।” এসময় বঙ্গবন্ধুর চোখ দুটি ছিল টকটকে লাল। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে নীচ থেকে কাজের লোকদের একজন উপরে এসে জানান যে ঝন্টু নামের এক যুবক বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে চান৷ বঙ্গবন্ধু বললেন ওর কথাই তো আমি ভাবছি। ওয়াজেদ তুমি ওকে উপড়ে নিয়ে এসো। ঝন্টু নামক ঐ যুবকটি নিজেকে লন্ডনস্ত আওয়ামীলীগের নেতা জাকারিয়া চৌধুরীর ছোট ভাই বলে পরিচয় দিলেন। কিন্তু তাকে আমি চিনি না বলে বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী
[Unicoded by Sultan Jamil Ahmed Jibon ]

ছাত্র লীগের মহিউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ওপরে যাই। বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “মুজিব ভাই, পাকিস্তান আর্মিরা আপনাকে মারতে আসছে, আপনি এক্ষুণি বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। তারা ট্যাঙ্ক, কামান ও ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইতিপূর্বেই ঢাকা শহরে প্রবেশ করার জন্যে তৈরী হয়েছে।“ তারা আর কি পরিকল্পনা করেছে বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলে তিনি জানান যে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স, ইপিআর বাহিনীর পিলখনাস্থ সদর দফতরে সশস্ত্র আক্রমণ চালাবে এবং সারা ঢাকায় রাস্তায় যাদেরকে পাবে, তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালাবে এবং রেডিও স্টেশন, টেলিভিশন কেন্দ্র, টেলিকমিউনিকেশন কেন্দ্র ও ঢাকার ফুড গোডাউন বল প্রয়োগ করে পুনর্দখল করবে। তখন বঙ্গবন্ধু আমা কে চিৎকার করে ডেকে হাসিনা, রেহানা ও জেলীকে নিয়ে আমাদের ভাড়াকৃত ফ্ল্যাটে চলে যেতে বলেন। এ খবর শোনার পর আমি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়াহিয়া খান এখন কোথায়?” তিনি বললেন, “আমি বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়েছি যে, ইয়াহিয়া খান বিকেল পাচটার দিকে বেইলী রোডের রাস্ট্রপতি ভবন ছেড়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন।“ অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে জেজ্ঞেস করলাম যে, তিনি কোথায় যাবেন। এবং কামাল, জামালকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবো কিনা। বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমার এখন অন্যত্র চলে যাওয়ার কোন উপায় নেই। তাই তারা আমাকে মারতে চাইলে এ বাসাতেই মারতে হবে। কামাল অন্যত্র চলে গেছে। জামাল ওর মাকে ছেড়ে থাকতে পারে না, সে আমাদের সঙ্গে থাকবে।“ এ কথা শোনার পর হাসিনা, রেহানা ও জেলী বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

২৭। “ওরা পরে যাবে”, শাশুড়ী এ কথা বলায় আমি তড়িঘড়ি করে মাত্র একটি স্যুটকেস নিয়ে গাড়ি চালিয়ে রওনা দিই, কিন্তু গেইটে পৌঁছে দেখি চারদিকে থমথমে অবস্থা এবং বেশ কিছু অপরিচিত লোক বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে ও লেকের ধারে টহল দিচ্ছে। আমি আমার নতুন ভাড়া বাড়ীতে পৌছাই বারটার দিকে। সেখানে দেখতে পাই অনেক বাঙ্গালী ছাত্র জনতা সাত মসজিদ রোডে বিরাট গর্ত তৈরী করছে যাতে পাকিস্তান আর্মির লোকেরা সহজে মোহাম্মদপুরের দিকে যেতে না পারে। বাসায় ঢুকে বিছানার চাদর দিয়ে জানালায় পর্দা লাগিয়ে ফ্লোরে শোয়ার ব্যবস্থা করি। এর মিনিট বিশেক পর হাসিনা, রেহানা, জেলী ও যে যুবকটি ইতোপূর্বে অনেক বছর যাবত বঙ্গবন্ধুর বাসায় নানান কাজকর্মের দেখাশুনা করতো সেই ওয়াহিদুর রহমান পাগলাকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গাড়ীতে সেখানে পৌছায়। কিছুক্ষণের মধ্যে চারদিক, বিশেষ করে ইপিআর- এর পিলখানাস্থ হেড কোয়ার্টারের দিকে গোলাগুলি ও কামানের আওয়াজ শুনতে পাই। হাসিনাদের মাঝের রুমে শোয়ার ব্যবস্থা করে আমি ফ্লাটের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে পাশের রুমে শুয়ে থাকি। রাইফেলের গুলি আমাদের বাসায় পড়তে শুরু করলে দু’টো রুমের মাঝখানে ড্রেসিং রুমের ভেতর হারিকেন জ্বেলে বসে থাকি। কিছুক্ষণ পর আর্মির কয়েকটি গাড়ী বাসার পাশের রাস্তা হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে চলে যায়। রাত ২টার দিকে আমাদের ফ্ল্যাটের কলিং বেল কয়েকবার বাজানো হয়। কিন্তু আর্মির লোক হতে পারে এই ভেবে আমি সাড়া দিলাম না। ভোর পাঁচটার দিকে মাইকে উর্দু ও জড়তাপূর্ণ বাংলায় রাস্তায় রাস্তায় ঘোষণা দেয়া হয়, “সারা ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়েছে। ঘরের বাইরে আসা সম্পূর্নভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ বাইরে এলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হবে। যাদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাবে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে।“

২৮। ২৫শে মার্চ রাতে সুযোগের অভাবে ঐ ফ্ল্যাটে নাস্তা কিংবা খাবারের জন্যে কোন ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিলো না। যাহোক, ঐ রাতে পাগলা বুদ্ধি করে যে কিছু চাল, ডাল, লবণ, পেঁয়াজ, মরিচ, ও রান্নার তেল এনেছিলো সেই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। ২৬শে মার্চ বিকেলের দিকে কামালের এক বন্ধু গোপনে অনেক বাড়ীর দেয়াল টপকিয়ে এসে আমাদের জানায় যে, পাকিস্তানী আর্মি রাত একটার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে প্রবেশ করে তাঁকে, তাঁর সহকর্মী জনাব গোলাম মোরশেদ, কাজের লোক আজিজ, ফরিদ, বাবুর্চি নিয়াজ ও শিশু রাসেলকে দেখাশোনার জন্য নিয়োজিত আজিজুন নেছা (বুড়ী)- কে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। গোলাম মোর্শেদকে রাইফেলের বাট দিয়ে আহত করে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে গেছে। শাশুড়ী, জামাল ও রাসেল বাসায় আছে। কামাল অন্যত্র তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে আছে। ঐ যুবকটি আরও জানায় যে, তথাকথিত “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলার ২ নম্বর আসামী অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় ২৫শে মার্চ রাত বারটার পর পরই অতর্কিতে হামলা চালিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর লোকজন তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাঁর লাশ ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গেছে। এ কথা শুনে পাগলা তৎক্ষণাৎ কারফিউ উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর বাসার উদ্দেশ্যে চলে যায়।

২৯। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তান রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর আলোচনার ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ দায়ী করে সারা পূর্ব পাকিস্তানের পুনঃসামরিক শাসন জারি করেন। ঐ ভাষণে শক্তি প্রয়োগের আদেশ প্রদান এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ দলকে বেআইনি ঘোষণা করার কথাও উল্লেখ করা হয়। ২৭শে মার্চ ভোর সকালে রেডিও ও মাইকে বার বার ঘোষণা করা হয় যে, ঐ দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হবে এবং সকল সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত দফতর ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যেতে হবে। পরে জানতে পারি যে, পাকিস্তান সৈন্যরা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ শহীদ মিনার বিধ্বস্ত করেছে। ইকবাল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক) হলে ৫০-৬০ জন ছাত্রসহ হলের নিম্নশ্রেণীর কর্মচারীদের গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। জগন্নাথ হলে শতাধিক ছাত্রকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। ২৬ তারিখে দিনের বেলায় ঐ সমস্ত নিহত ছাত্রদের দেহগুলো হলের সামনের মাঠে কাঠের মত স্তূপীকৃত করে রাখা অবস্থায় দেখা গিয়েছিলো। রাতে মৃতদেহগুলোকে কবর দেয়ার জন্য কয়েকজন ছাত্রকে দিয়ে বৃহৎ গর্ত খোড়ানো হয়। পরে তাদেরকেও গুলি করে হত্যাকরেছিলো পাকিস্তানি সৈন্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের চত্বরে একটি ক্যান্টিন চালাতেন সর্বজনপরিচিত ‘মধু দা’ তাঁর দু’কন্যা, এক পুত্র ও স্ত্রী সহ তাকেও গুলি করে হত্যা করেছিলো পাকিস্তানি সৈন্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবনগুলোয় ঢুকে অধ্যাপক ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেবসহ ১১ জন অধ্যাপক ও প্রভাষককেও পাকিস্তানি সৈন্যরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলো ২৫শে মার্চের মধ্যরাতের পর। দৈনিক ইত্তেফাকের অফিসসহ সব কিছু জ্বালিয়ে দিয়েছিলো।

৩০। ২৭শে মার্চ সকাল সাড়ে আটটার দিকে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি যে পাকিস্তান আর্মির ডজনখানেক জোয়ান দু’টো জীপে ঐ বাসার গেটে মোতায়েন রয়েছে। গেটের কাছেই গ্যারাজে ছিল আমার গাড়ী। গাড়ীর গ্লাসে তখনও লাগানো রয়েছিলো বাংলাদেশের পতাকা ও জয় বাংলা সম্বলিত নানান পোষ্টার। যাহোক, উপস্থিত সৈন্যদের অনুমতি নিয়ে গ্যারাজে ঢুকে দরজা কিছুটা বন্ধ রেখে ভেজা রুমাল দিয়ে কোন রকমে পোস্টারগুলো তুলে ফেলি। অতঃপর গাড়ী বের করে হাসিনাদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশের বাসায় যাই। সেখানে জানতে পাই যে, শাশুড়ী জামাল ও রাসেলকে নিয়ে ২৬শে মার্চ রাতে ঐ বাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ঐ সকালে আমাদের সেখানে পৌঁছার কিছুক্ষণ আগে মোমিনুল হক খোকা তাঁদেরকে নিয়ে আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে চলে গেছেন। এ কথা শুনে আমরা তাদের খোজে আমাদের বাসার দিকে চলে যাই। পথে আমার বাসার নিকট অপর একটি বাসার দোতলা থেকে রাসেল চিৎকার করে আমাদেরকে ডাক দেয়। ঐ ফ্ল্যাটে থাকতেন বঙ্গবন্ধুর সুহৃদ ক্যাপ্টেন কিউ. বি. এম. রহমান বাশার। সেখানে শাশুড়ীকে কিছুটা অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় দেখতে পাই। তাঁকে ফ্লোরে শোয়ানো হয়েছিলো এবং তিনি “বাবা, আর্মিরা কামাল-জামালকে মেরে ফেলেছে” বলে প্রলাপ করছিলেন। এরপর আমি হাসিনাদের সেখানে রেখে আশ্রয়ের খোজ নিতে আমার বন্ধু ও সহকর্মী ডঃ মোজাম্মেলের খিলগাওস্থ বাসায় যাই। ডঃ মোজাম্মেল ওর আব্বা-আম্মার সঙ্গে থাকতেন। ডঃ মোজাম্মেল এর ছোট বোন-জামাই ও আমার সহকর্মী ডঃ ফয়জুর রহমানও ঐ বাসায় থাকতেন। ডঃ ফয়জুর রহমান তাঁর রুমটি আমাদের জন্য দেয়ার কথা জানান। সেখান থেকে ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, আমি হাসিনা ও জেলীকে নিয়ে ডঃ মোজাম্মেলের আব্বার বাসায় সাময়িকভাবে আশ্রয় নেবো, আর খোকা কাকা শাশুড়ী, জামাল, রেহানা ও রাসেলকে নিয়ে ওয়ারীতে তাঁর শ্বশুরের বাসায় আশ্রয় নেবেন।

৩১। খিলগাওয়ে যাবার পথে দেখি যে, পাকিস্তান আর্মি রাজারবাগস্থ পুলিশ ব্যারাক সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়েছে। বিল্ডিংগুলো মর্টার ও কামানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। যাহোক, এদিক-সেদিক ঘুরে টহলরত আর্মির দৃষ্টি এড়িয়ে কারফিউ পুনরায় বলবৎ হওয়ার পূর্বেই আমরা ডঃ মোজাম্মেলের বাসায় পৌছাই। এর কিছুক্ষণ পর ডঃ মোজাম্মেলের ছোট বোন আমাদের জানায় যে, ঢাকাস্থ সামরিক বাহিনীর কন্ট্রোল রুম থেকে ২৫শে মার্চ রাতে আক্রমণকারী সেনা ইউনিটগুলোকে অয়ারলেসে যে সমস্ত নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেগুলো সে রেকর্ড করে রেখেছে। সে আরও জানায় যে, ২৬শে মার্চ দুপুরে কোন এক বেতার কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে যে, চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনসাধারণের সশস্ত্র লড়াই হচ্ছে। ঐ সংবাদ প্রচারের পর পরবর্তীতে আরও সংবাদ দেয়ার কথা জানিয়ে বেতার প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।
৩২। পরবর্তীতে জানা যায় যে, চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব এম. এ. হান্নান ২৬শে মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাসম্বলিত বাণীর বরাত দিয়ে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণ প্রচার করেন। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭-৪০ মিনিটে এই বেতার কেন্দ্রের স্বল্পকালীন অনুষ্ঠান পুনরায় শুরু হয়। এই অনুষ্ঠানেই বঙ্গবন্ধুর প্রেরিত স্বাধীনতার বাণীর বাংলা অনুবাদ পাঠ করেন অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। বাণীটির বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপঃ
“সম্ভবত এটাই আমার শেষ নির্দেশ। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বিদেশী শত্রু সৈন্য বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে রাতের অন্ধকারে। ঢাকায় তারা ঘুমন্ত লোককে হত্যা করছে। এই বর্বর আক্রমণ এবং অবাধ গণহত্যার কথা বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিন। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের কাছে আমার নির্দেশ, আপনারা যেখানেই থাকুন না কেন এবং আপনাদের হাতে যা’ই থাকুক তাই নিয়ে দখলদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়াই করুন। বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যকে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত আপনাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।“
৩৩। যা হোক, ২৭শে মার্চ সন্ধ্যায় ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ঘোষণায় বার বার বলা হচ্ছিলো যে, মেজর জিয়া ভাষণ দেবেন। এর কিছুক্ষণ পর শোনা গেলো,
“স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। দেশের সর্বত্র আমরা পাকিস্তানি হানাদারদের পর্যুদস্ত করে চলেছি। ইনশাআল্লাহ আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশকে আমরা শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হবো। জয় বাংলা।“
৩৪। এরপর বেতার কেন্দ্রটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। পরদিন অর্থাৎ ২৮শে মার্চ সকাল প্রায় দশটার দিকে ঐ বেতার কেন্দ্রটি থেকে মেজর জিয়া বলেন যে, ক্যাপ্টেন ভূঞার নেতৃত্বে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানরত জাহাজে আক্রমণ চালিয়ে জাহাজটি দখল করা হয়েছে এবং চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় লড়াই অব্যাহত রয়েছে। মেজর জিয়া জনগণকে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে সমবেত হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেখানে উপস্থিত হয়ে একটি বিশেষ ঘোষণা দেবেন। এই সংবাদ শুনে হাসিনা বলে, ‘আব্বার ২৫শে মার্চ রাতেই বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়ে আত্মগোপন করার
(Unicoded by Kazi rajib)
কথা ছিল এবং তাঁর জন্য পুরচুলাও এনে রাখা হয়েছিলো। পরবর্তীতে জিঞ্জিরায় তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর একত্রে চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু বাইরে বেরুনোর কোন সুযোগ না পেলে যাতে ইপিআর এর অয়্যারলেসের মাধ্যমে ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাৎ ২৬শে মার্চ ০০.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ সভাপতি জহুর আহমেদ চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হান্নান সাহেবকে বার্তা পাঠানো যায় তাঁর জন্য আব্বা ব্যবস্থা করেছিলেন। ওরা বোধ হয় জানে না যে, আব্বাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।“
৩৫। পরবর্তীকালে জেনেছি যে, বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি ছিল টেপকৃত। ঢাকার বলধা গার্ডেন থেকে ঐ টেপকৃত বার্তাটি সম্প্রচারের পর ইপিআর এর ঐ বীর সদস্যটি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোনে যোগাযোগ করে পরবর্তী নির্দেশ জানতে চান। তখন বঙ্গবন্ধু জনাব গোলাম মোর্শেদের মাধ্যমে ইপিআর এর ঐ সদস্যটিকে সম্প্রচার যন্ত্রটি বলধা গার্ডেনের পুকুরে ফেলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ উক্ত স্থান পরিত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। উক্ত কথোপকথনের সময়ই একজন কর্নেলের নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে প্রবেশ করে এবং গোলাম মোর্শেদের মাথায় রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে। তিনি ঐ আঘাতে সংজ্ঞা হারান। তাঁকে সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেই অন্যায়ের সঙ্গে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এম. এ. হান্নান সাহেবকে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন সেটা ছিলো নিম্নরূপঃ
“ পাকিস্থানী সেনাবাহিনী অতর্কিত পিলখানার ইপিআর ঘাটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমন করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোষ নাই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এই সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।“
৩৬। ২৮ ও ২৯শে মার্চের বিভিন্ন সময়ে বেতারে মেজর জিয়া সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দাবি করে জনগণের প্রতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। ৩০শে মার্চ সকাল ৮টার দিকে মেজর জিয়া উক্ত বেতারে বলেন, “অনিবার্য কারণবশত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লালদীঘি ময়দানে উপস্থিত হতে পারেন নি। এজন্য আমি মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করছি।“ জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষণা প্রকল্প থেকে প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে তাঁর যে ইংরেজী ঘোষণাটি লিপিবদ্ধ আছে সেটি বঙ্গানুবাদসহ হুবহু উদ্ধৃত করা হলোঃ
“ The Government of the sovereign state of Bangladesh, on behalf of our Great Leader, the Supreme Commander of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, we hereby proclaim the independence of Bangladesh, and that the Government headed by Sheikh Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representatives of the seventy five million people of Bangladesh, and the Government headed by him is the ony legitimate Government of the people of the Independent Sovereign State of Bangladesh, which is legalty and constitutionally formed and is worthy of being recognized by all the Government of the World. I, therefore, appeal, on behalf of our Great Leader Sheikh Mujibur Rahman, to the Governments of all the democratic countries of the world, specially the big powers and the neighbouring countries to recognize the legal Government of Bangladesh and take immediate measures for stopping the awful genocide that has been carried on by the army of occupation from Pakistan…
…The guiding principle of the new state will be, first neutrality, second peace and third friendship to all enmity to none. May Allah help us. Joy Bangla.”
এর বাংলা অনুবাদ হচ্ছেঃ
সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র, আমাদের মহান নেতা বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে আমরা এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং ঘোষণা করছি যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই সরকার গঠিত হজ্যেছে। এতদ্বারা আরো ঘোষণা করা হচ্ছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কতৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের একমাত্র নেতা এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনগণের একমাত্র বৈধ সরকার। আমি আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, বিশেষ করে বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং প্রতিবেশী দেশসমুহের কাছে বাংলাদেশের বৈধ সরকারকে স্বীকৃতি দান এবং পাকিস্তানের দখলদার সামরিক বাহিনী কতৃক সংগঠিত ভয়াবহ গণহত্যাকে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি। নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হবে প্রথমত নিরপেক্ষতা, দ্বিতীয়ত শান্তি এবং তৃতীয়ত সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বৈরিতা নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। জয় বাংলা।“
৩৭। উপরিউক্ত ঘোষণার পর ঐ বেতার কেন্দ্র হতে আর কোন অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়নি। এর পরের দিন হতে ঢাকা থেকে প্রতিদিন ঘন ঘন সামরিক বাহিনীর বহু হেলিকপ্টার, বিমান বাহিনীর প্লেন ও সামরিক অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য বহনকারী প্লেনকে চিটাগং এর দিকে উড়ে যেতে দেখি। এ ছাড়াও রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স থেকে প্রাণে বেঁচে যে সমস্ত পুলিশ বাহিনীর লোকজন আমার বন্ধুর আব্বার বাসার আশেপাশের বাড়িগুলোয় আত্মগোপন করেছিলেন তারাও এক এক করে অতি গোপনে নিঃস্বাবস্থায় সামনের ঝিলের মধ্য দিয়ে গ্রামের দিকে চলে যায়। আমাদের এলাকায় আত্মগোপন করে থাকা পুলিশ বাহিনীর লোকদের কাছ থেকে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে রাজারবাগস্থ পুলিশ বাহিনীর ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে সংঘটিত সশস্ত্র লড়াইয়ের আরও বিস্তারিত বিবরণ পাই। রাজারবাগস্থ পুলিশ বাহিনীর লোকজনকে সে রাতে সেনাবাহিনীর দল কী মির্মম, নৃশংস ও নির্বিচারে হত্যা করেছিলো তাঁর বিবরণ পাই ঐ সমস্ত আত্মগোপন করা পুলিশদের কাছ থেকে। ঐ সময় আল্লাহর নিকট কায়মনে প্রার্থনা করি যে, চিটাগাংয়ের মেজর জিয়াউর রহমান ও তাঁর সহকর্মীদেরসহ অন্যান্য যারা তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছিলেন তাদের যেন কোন ক্ষতি না হয় এবং তারা যেন দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজয়ী হন।
৩৮। ১লা এপ্রিল হতে খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার গোলচক্করে ঢোকার প্রধান পথের কাছে ডঃ এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, উর্ধবতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আণবিক শক্তি কেন্দ্র, ঢাকা, এই নামে একটি বাড়ীর ফ্লাট ভাড়া নেয়া হয়। শাশুড়ী, হাসিনা, জামাল, রেহানা, রাসেল, জেলী, খোকা কাকা, তাঁর স্ত্রী, দুই সন্তান ও আমি ঐ ফ্লাটে গিয়ে উঠি। ঐ ফ্লাট থেকে দেখতাম যে, রাস্তায় আর্মি মাঝে মাঝে টহল ও বিভিন্ন ঘোষণা দিতো। পাঁচ-ছয় দিন পর বাড়ীওয়ালী শাশুড়ীকে ভাড়া ফেরত দিয়ে বলেন, “ আপনাদের পরিচয় জানাজানি হয়ে গেছে। আল্লাহর দোহাই, আপনারা দয়া করে এই বাড়ী ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে যান। তা না হলে পাকিস্তানি আর্মি আমাদের বাড়ীটি ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেবে।“ ঐ বাসায় থাকার সময় একদিন কামাল এসে কান্নাজড়িত কন্ঠে আমার শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, আমি আজ রাতে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, তোমরা আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করো।“ উপায়ন্তর না দেখে বেগম বদরুনন্নেসার স্বামী নূরুউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের তাঁর মগবাজারের চৌরাস্তার নিকট প্রধান সড়কে অবস্থিত বাড়ীর নীচ তলায় থাকতে দেন। ঐ বাসায় থাকার সময় একদিন পত্র-পত্রিকায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দুইজন কর্মকর্তা প্রহরারত অবস্থায় করাচী বিমান বন্দরের লাউঞ্জে তোলা বঙ্গবন্ধুর ফটো সরকারের নির্দেশনায় প্রকাশ করা হয় । এই প্রথম জানতে পাওয়া যায় যে, বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিম পাকিস্তানে নেয়া হয়েছে।
৩৯। তখন প্রায়ই বৃষ্টি হতো। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় কিছু সংখ্যক অচেনা পশ্চিম পাকিস্তানি লোককে সেখানে ঘোরাফেরা করতে দেখা যেতো। কোন কোন রাতে পাকিস্থান আর্মির ট্রাক
(Unicoded by kazi rajib)

পৃষ্ঠাঃ ৮৪
বাড়ীটির সামনে এসে থামতাে। এতে শাশুড়ী ঘুমাতে পারতেন না বলে তিনি আমাকে ঐ এলাকার ভেতরের দিকে একটি দোতলা বাড়ির ওপরতলা ভাড়া নিতে বলেন। বেশী ভেতরে বাসা খালি না পেয়ে ঐ বাসার কাছাকাছি একটি বাড়ীর দোতলার ফ্ল্যাট ভাড়া নিই। সেখানে সপ্তাহ দুয়েক কেটে যায়। সেখান থেকে আমরা পাকিস্তান আর্মিকে বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে দিতে দেখতাম। লােকজনের কান্নাকাটি শুনতে পেতাম। রাতে শেয়াল-কুকুর কান্নার সুরে ডাকতাে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী এসে আমাদের জানায় যে, ১০ই এপ্রিল জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ বঙ্গবন্ধুর নামে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন (পরিশিষ্ট-৩ দ্রষ্টব্য) এবং ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের নিকট এক আমকাননে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দিন আহমদ সাহেবকে প্রধান মন্ত্রী, এ. এইচ, এম, কামরুজ্জামান সাহেবকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম, মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী এবং খন্দকার মােশতাক আহমদকে পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয়েছে। দেশকে সশস্ত্র সংগ্রামের। মাধ্যমে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে মুক্তি বাহিনী গঠন করে কর্নেল এম. এ. জি. ওসমানীকে তার প্রধান নিয়ােগ করা হয়েছে। যে স্থানে (ভবেরপাড়া) আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন গণপ্রজান্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠনের ঘোেষণা দেয়া হয় সে স্থানের নাম ‘মুজিব নগর’ রাখা হয়েছে।
৪০। উপরিউক্ত খবর পাবার দিন কিছুদিন পর ১২ই মে (১৯৭১) বিকেল দুটোর পর বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় এক পশ্চিম পাকিস্তানী দোতলায় উঠে আসলে আমি তার সঙ্গে দেখা করার জন্য বারান্দায় যাই। ভদ্রলােক নিজেকে মেজর হােসেন, পাকিস্তান আর্মির লােক বলে পরিচয় দিয়ে বলেন, এই বাসায় শেখ মুজিবের পরিবার আছে। আমি সরকারী নির্দেশে আপনাদের গ্রেফতার করতে এসেছি।” গ্রেফতারি পরােয়ানা আছে কিনা জানতে চাইলে মেজর হােসেন বলেন যে, তিনি পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এমন এক বিভাগের কর্মকর্তা যাঁদের বিনা সরকারী পরােয়ানায় যে কোন ব্যক্তিকে যে কোন অবস্থায় গ্রেফতার করার ক্ষমতা রয়েছে। তিনি সেখানে বসে অয়্যারলেসে সংবাদ পাঠিয়ে আরাে একটি সশস্ত্র সৈন্যসহ জীপ ও আর্মি ট্রাক নিয়ে আসেন। প্রায় সন্ধ্যার দিকে কড়া পাহারায় সেনাবহরটি আমাদের তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে ধানমন্ডির দিকে নিতে থাকে। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) বহিঃগমন গেটের পেছনে সাংবাদিক গােলাম রসুল মল্লিককে (বর্তমানে ENA-এর Chief) আমাকে লক্ষ্য করে হাত নাড়তে দেখি। অতঃপর আমাদের ধানমন্ডির (পুরাতন) ১৮ নম্বর নতুন ৯/এ) সড়কের ২৬ নম্বর বাড়ীতে ঢুকিয়ে আমাদের বাড়ীর বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে এবং ১৫/২০ জন সশস্ত্র সৈন্যকে পাহারায় রেখে মেজর হােসেন চলে যান। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শাশুড়ী অস্বস্তিবােধ করতে করতে এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ কথা পাহারারত আর্মির।

পৃষ্ঠাঃ ৮৫
কমান্ডারকে জানালে সে আমাকে গাড়ী নিয়ে তাকে সঙ্গে করে ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়ের দিকে যেতে বলে। পথে সে আমাকে জানায় যে, উক্ত বিদ্যালয়টিকে ধানমন্ডি এলাকার সামরিক হেড কোয়র্টার্সে পরিণত করা হয়েছে এবং সেখান থেকে সে ক্যান্টনমেন্টস্থ আর্মি হেড কোয়াটার্সের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আমার শাশুড়ীর অসুস্থতার খবর অবহিত করবে। সে ভেতরে চলে যাবার পর পাঁচ-ছয়জন সামরিক বাহিনীর লােক আমার গাড়ীটিকে ঘিরে রেখে। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “তূহ শেখ মুজিব্কা বড় লাড়কা শেখ কামাল হাে?” উত্তরে আমি বলি যে, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল নই। আমি শেখ মুজিবের দামাল, ড: ওয়াজেদ এবং পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। অতঃপর বাসায় ফিরে আসি। ইতিপূর্বে কারফিউ বলবৎ হয়েছিলাে। আশেপাশে কোন দোকান-পাট না থাকায় আমাদেরকে সে রাত অনাহারে কাটাতে হলাে। রাতে হাসিনা আমাকে জানায় যে, সেদিন দুপুর ১টার দিকে ছাত্রলীগের তিন জন যুবক মগবাজারস্থ বাসায় এসেছিলাে আমাদের ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করার জন্য।
৪১। পরদিন সামরিক বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা একজন নার্সসহ শাশুড়ীর শারীরিক অবস্থা দেখার জন্য ঐ বাড়ীতে আসেন। তাঁর রক্তচাপ পরীক্ষা করে আমাদের বলা হয় যে, তিনি ভাল আছেন। তাঁর কোনাে চিকিৎসার দরকার নেই, এ কথা বলে সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা নার্সকে নিয়ে চলে যান। এরপর শাশুড়ীর জন্য আর কোনরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়নি।
৪২। অন্তরীণ করার চতুর্থ দিনে মেজর হােসেন আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। শাশুড়ী মেজর হােসেনকে হাসিনার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার কারণে তাকে নিয়ে আমার বাইরে যাওয়ার অনুমতি চান ও খােকা কাকার বাচ্চাদের চিকিৎসা ও লেখাপড়ার অজুহাত দেখিয়ে তাদেরকেও বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার অনুরােধ জানান। মেজর হােসেন এ পর্যায়ে আমাকে জানান যে, সরকার আমাদের তত্ত্বাবধান করবে। তখন শাশুড়ি বলেন, “আমার জামাইয়ের অফিসের বেতন দিলেই চলবে, আমাদের সরকারী টাকা পয়সার দরকার নেই।” তখন মেজর হােসেন শর্ত দেন যে, আমি নিয়মিত অফিসে গেলে বেতন দেয়া হবে। এরপর মেজর হােসেন সেখানে পাহারারত সৈন্যদের কমান্ডারকে ডেকে বলেন, “ড: ওয়াজেদ ও তার স্ত্রী এবং মােমিনুল হক তার বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে যেতে পারবে, অন্যদের গেটের বাইরে যেতে দেবে না।”
৪৩। এর দুই-তিন দিন পর মেজর হােসেন আবার এসে আমাকে আলাদাভাবে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এক পর্যায়ে আমি তাঁকে লাহােরস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রে ১৯৬৩ সালে প্রশিক্ষণ থাকার সময়কাল থেকে পরিচিত পশ্চিম পাকিস্তানী বিজ্ঞানী ড: নিজাম উদ্দিনের কথা বলি। ড: নিজাম উদ্দিনের ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রে প্রায় দুই বছর কর্মরত থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, হৃদ্যতা, তাঁর বাসায়

পৃষ্ঠাঃ ৮৬
আমার যাতায়াত, আমাদের বিয়েতে তাঁর উপস্থিতি ইত্যাদি বিষয়েও মেজর হােসেনকে অবহিত করি। মেজর হােসেনও ড: নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হওয়া ও পরবর্তীতে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার কথা আমাকে জানান। এরপর থেকে মেজর হােসেন আমার সঙ্গে অনেকটা মার্জিত ও খােলাখুলি ব্যবহার ও কথাবার্তা বলতেন। যাহােক, পরের দিন থেকে অবশ্যই অফিসে নিয়মিত যাবার জন্য তিনি আমাকে নির্দেশ দেন। ঐ বাসায় কোন আসবাবপত্র কিংবা ফ্যান ছিল না। এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবেন কিনা একথা মেজর হােসেনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাঁর অপারকতা প্রকাশ করে বলেন যে, আমাদেরকে ঐ অবস্থাতেই থাকতে হবে। ফলে, পাকিস্তান সামরিক জান্তার হাতে বন্দীদশাকালে আমাদের সবাইকে ঘরের মেঝেতে ঘুমােতে হয়।
৪৪। পরদিন অফিসে এসে দেখি যে, আমার কক্ষের সমস্ত বই ও নথিপত্র তছনছ করে তন্নতন্ন করে তল্লাশি করা হয়েছে। সহকর্মীদের কাছে জানতে পারি যে, তৎকালীন আণবিক শক্তি কেন্দ্রের পরিচালক ড: এম. শমশের আলীর নির্দেশে এসব করা হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য সহকর্মীদের ক্ষেত্রেও ড: শমশের আলী এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমি অবশ্য ড: শমশের আলীকে এ ব্যাপারে কোন কিছু বলিনি। এ সময় অফিসের অন্যান্য সহকর্মীর কাছে জানতে পারি যে, মার্চ মাসের শেষের দিকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী NAP (ভাসানী)-এর সভাপতি ও বয়ােজ্যেষ্ঠ জননেতা মওলানা ভাসানীর টাংগাইলের সন্তোষের বাড়ীঘর ও বিষয় সম্পত্তি জ্বালিয়ে ধ্বংস করে, তবে তিনি তার আগেই পরিবারবর্গসহ অন্যত্র পালিয়ে আত্মগােপন করেছিলেন।
৪৫। ২৫শে মে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জানতে পারি যে, মুজিব নগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের হাজার হাজার ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জনগণকে চাঙ্গা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গান ও দেশাত্মবােধক গান বাজিয়ে শােনানাে হতাে। স্বাধীন বাংলা বেতারের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিলাে এম. আর. আখতার মুকুল কর্তৃক রচিত ও পঠিত “চরমপত্র”। আমরা ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে জয় বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতাম। ঐ “জয় বাংলা বেতার”-এ জানানাে হয়েছিলাে যে, NAP (মােজাফফর)-এর সভাপতি প্রফেসর মােজাফফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং এবং NAP (ভাসানী)-এর সভাপতি ও দেশের অন্যতম অবিসংবাদিত নেতা মওলানা ভাসানী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। মওলানা ভাসানীকে মুজিব নগরে গঠিত সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমটির চেয়ারম্যানও নির্বাচিত করা হয়েছিলাে।
৪৬। জুন মাসের প্রথম দিকে হাসিনাকে স্ত্রীরােগ চিকিৎসক (Gynaecologist) ডা: এম. এ. ওয়াদুদের ক্লিনিকে নিয়ে যাই। ডা: ওয়াদুদের স্ত্রী ডা: সুফিয়া ওয়াদুদও স্ত্রীরােগ

পৃষ্ঠাঃ ৮৭
চিকিৎসক ছিলেন। তাঁরা সদয় হয়ে হাসিনাকে ভালভাবে পরীক্ষা করে প্রতি সপ্তাহে ক্লিনিকে আসতে বলেন। তাঁরা হাসিনাকে চেক আপ করার জন্য টাকা-পয়সা নিতেন না। জুন মাসের প্রথম থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান ও সরকারী ইলেকট্রিক সাব-স্টেশন, পুলিশ ফাঁড়ি, ইত্যাদি স্থানে আক্রমণ জোরদার করতে থাকে। জুন মাসের শেষের দিকে এই আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করে। যখনই বাইরে গােলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যেতাে, প্রহরারত সুবেদার মেজর স্টেনগান হাতে “ডক্টর সাব, ডক্টর সাব” বলতে বলতে আমার রুমে ঢুকতাে। সে সময়ে তারা আমাদেরকে নানাভাবে হয়রানি ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতাে। বাড়ীর ছাদে উঠে লাফালাফি করতাে এবং লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমােতে দিতাে না। রাইফেলের মাথায় বেয়নেট লাগিয়ে কক্ষের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতাে।
৪৭। জুলাই মাসের মাঝামাঝি হাসিনাকে ডা: ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঐ সময় আমার শাশুড়ী যাতে হাসপাতালে হাসিনার সঙ্গে থাকার কিংবা দেখা করতে পারেন তার অনুমতি নেয়ার জন্য মেজর হােসেনের অফিসে ফোন করি। মেজর হােসেনের পরিবর্তে মেজর ইকবাল নামক এক সামরিক কর্মকর্তা বাসায় এসে আমার শাশুড়ীকে রূঢ় ভাষায় বলেন, “আপনি তাে নার্স নন যে, হাসপাতালের কেবিনে আপনার মেয়ের সঙ্গে থাকা বা দেখাশুনা করার প্রয়ােজন রয়েছে।” এহেন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর ছােট বােন, এ. টি. এম. সৈয়দ হােসেনের স্ত্রী লিলি ফুফু, হাসিনার সঙ্গে কেবিনে সারাক্ষণ থাকতেন। আমিও মাঝে মাঝে থাকতাম। ২৭শে জুলাই রাত ৮টার দিকে নির্ধারিত সময়ের ৬ সপ্তাহ পূর্বে আমাদের প্রথম সন্তানের (ছেলে) জন্ম হয়। এরপর থেকে কিছু কিছু আত্মীয়-স্বজন বাচ্চা দেখতে আসতে শুরু করেন।
৪৮। একদিন খাবার নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে হাসিনা ও লিলি ফুফুকে ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় দেখতে পাই। তারা আমাকে জানায় যে, আমার সেখানে পৌছার ঘন্টাখানেক আগে বিহারীদের মতাে দেখতে এক লােক কেবিনে ঢুকে উপস্থিত সবার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং লিলি ফুফু বাদে অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনকে ভয় দেখিয়ে রুম থেকে বের করে দেয়। সেদিন থেকে আমি কেবিনে প্রতি রাতে থাকতাম। পরদিন সেই বিহারী চেহারাধারী স্বাস্থ্যবান লােকটিকে কেবিনের সামনে দেখতে পেয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করি। সে নিজেকে পাকিস্তান আর্মির একজন সদস্য বলে স্বীকার করে বলে যে, সরকারী নির্দেশ রয়েছে যে, উক্ত কেবিনে একজনের বেশি সেবিকা থাকতে পারবে না। সেদিন বাসায় ফিরে এসেও সকলকে ভীতসন্ত্রস্ত দেখি। শাশুড়ী আস্তে আস্তে বলেন যে, আগের রাতে হাবিলদার আকস্মিকভাবে স্টেনগান নিয়ে তাঁর কক্ষে ঢুকে বলেছিলাে, “আপনারা জয় বাংলা রেডিও শােনেন। এটা বন্ধ না করলে জামালকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে ঘরের সিলিং-এ পা বেঁধে ঝুলিয়ে পিটিয়ে তার পিঠের চামড়া ওঠানাে হবে।”

পৃষ্ঠাঃ ৮৮
৪৯। ইতিমধ্যে খবর পাওয়া যায় যে, আর্মিরা টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর আব্বার বাড়ী সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং সেখানে চারজন লােককে হত্যা করা হয়েছে। এতে হাসিনার দাদা-দাদি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁদেরকে ঢাকায় এনে বঙ্গবন্ধুর বড় বােনের মেয়ে জামাই (মীর আশরাফুদ্দীন) মাখন দুলাভাইয়ের আরামবাগস্থ বাসায় রাখা হয়েছে। এই খবর পাওয়ার পর হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার দিন আমি সরকারী বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে আরামবাগে গিয়ে দাদা-দাদিকে বাচ্চা দেখিয়ে তাঁদের দোয়া নিয়ে হাসিনাকে অন্তরীণ রাখা বাসায় নিয়ে আসি।
৫০। পরদিন সকাল বেলা দেখি যে, শাশুড়ী, হাসিনা ও রেহানা চিন্তিত হয়ে বাচ্চার পেটে তেল মালিশ করছেন। শাশুড়ী জানালেন যে, সারা রাত চেষ্টা করেও তাঁরা বাচ্চাকে পায়খানা করাতে পারেননি। সুতরাং ডাক্তারের চিকিৎসা ছাড়া বাচ্চাকে বাঁচানাে যাবে না। আমি তৎক্ষণাৎ ডা: ওয়াদুদকে ঘটনা জানিয়ে আমাদের বাসায় আসতে সবিশেষ অনুরােধ করি। তিনি একটু ভেবে তাঁর এ্যাসিসটেন্টকে নিয়ে যেতে বললেন। ডাক্তার নিয়ে বাসায় পৌছালে তাঁকে ভেতরে যেতে প্রহরীরা বাধা দেয়। বাচ্চার কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তাদেরকে দায়ী করা হবে, এ কথা বলার পর তারা ডাক্তারকে ভেতরে যেতে দেয়। বহু কষ্টে বাচ্চাকে পায়খানা করানাে হলাে। আল্লাহর রহমতে এ বিপদ থেকে আমাদের ছেলে বেঁচে যায়।
৫১। উপরােক্ত ঘটনার পরের দিন রাত সাড়ে আটটার দিকে হাসিনার অবিরাম রক্ত ক্ষরণ শুরু হলে ডাক্তার ডাকার প্রয়ােজন হয়। আমি ডাক্তার আনতে যেতে চাইলে হাবিলদার জোরপূর্বক স্টেনগানসহ আমার সঙ্গে যায়। অধিকন্তু পর্যাপ্ত গুলি ও সাবমেশিনগান নিয়ে সুসজ্জিত একজন জোয়ানকেও সে সঙ্গে নেয়। ডা: ওয়াদুদ তখন হাসপাতালে কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বৃত্তান্ত শােনার পর তিনি আমার সঙ্গে আসতে চাইলে হাবিলদার আপত্তি করে। অতঃপর তিনি ওষুধের ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। রাত তখন প্রায় পৌনে দশটা, কারফিউ শুরু হওয়ার মাত্র পনের মিনিট বাকি। দোকান-পাট সব বন্ধ করা হয়েছিলাে। সৌভাগ্য যে, ল্যাবরেটরী রােডে তখনও একটি ওষুধের দোকান খােলা ছিলাে। দোকানের ঝাঁপ প্রায় বন্ধ করে ভেতরে কয়েকজন “জয় বাংলা বেতার শুনছিলাে। যাহােক, তাড়াতাড়ি ওষুধ নিয়ে নিরাপদে বাসায় ফিরি। এরপর হাসিনা ও আমাদের ছেলে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে।
৫২। একদিন ছেলের গায়ে তেল মাখতে মাখতে শাশুড়ী ছেলের নাম কি হবে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করছিলেন। হাসিনা তখন বলে, “আহ্বা আমকে বলেছিলেন, ছেলে হলে জয় বাংলার “জয়” আর মেয়ে হলে “জয়া” নাম রাখতে।” শাশুড়ী ছেলেকে কোলে তুলে বলেন, “সত্যিই এ আমার জয়। আমার কোন ভাই নেই, জয় আমার সত্যিই ভাই। তাই মুজিব নামের সঙ্গে মিলিয়ে আসল নাম রাখলাম সজীব।” এই নাম শােনার পর উর্ধ্বতন কমান্ডাররা আমাকে জিজ্ঞেস করতাে, “জয় নাম কিসলিয়ে রাখা?” আমি তাদের বােঝাই যে, নাতিকে পেয়ে শাড়ী খুব খুশী হয়েছেন। যেহেতু “জয়” মানে আনন্দ তাই শাশুড়ী “জয়”

পৃষ্ঠাঃ ৮৯
রেখেছেন। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ তীব্র আকার ধারণ করলে মাঝে মাঝে তারা আমাকে কটাক্ষ করে বলতাে, “পশ্চিম পাকিস্তানমে এক নমরুদকে পাকড়াও করকে রাখা হয়, লেকিন এধার এক কাফের পয়দা হয়।”
৫৩। ৫ই আগস্ট সকাল ৯টার দিকে দেখি যে, শেখ জামাল একটি ছােট চাকু নিয়ে গেটের সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলছে। এতে সৈন্যরা ভুল বুঝতে পারে ভেবে আমি জামালকে ডেকে ছুরিটি নিয়ে নিই। যেহেতু রাতে সৈন্যদের মানসিক নির্যাতনে ঘুমােতে পারতাম না, সুতরাং এর পর আমি ঘুমােতে যাই। আধ ঘন্টা পর হাসিনা আমাকে জানায় যে, জামালকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই সংবাদ শুনে আমি চুপচাপ সৈন্যদের অবস্থান স্থান গ্যারেজ ও তৎসংলগ্ন ঘরগুলাে খুঁজে দেখি জামালকে সৈন্যরা কোথাও লুকিয়ে রেখে অত্যাচার করছে কিনা। ঘটনাটি আমার অফিসে না পৌছানাে পর্যন্ত গােপন রাখার পরামর্শ দিয়ে আমি গাড়ী নিয়ে অফিসে যাই। অফিসে পৌছেই আমি মেজর হােসেনের সঙ্গে ফোনে যােগাযােগ করার চেষ্টা করি। তাঁকে না পেয়ে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার রাও ফরমান আলীর অফিসে ফোন করি। রাও ফরমান আলী ঐ সময় কিছুদিনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় তাঁর অফিস থেকে আমাদের ব্যাপারে ব্রিগেডিয়ার কাদির দায়িত্বে রয়েছেন একথা জানিয়ে আমাকে ব্রিগেডিয়ার কাদিরের অফিসে যােগাযােগ করতে বলা হয়। ব্রিগেডিয়ার কাদিরের অফিসটি ছিলাে শেরে বাংলা নগরে। সে সময় সেখানকার বাড়ীগুলােকে পাকিস্তান আর্মির ট্রানজিট ক্যাম্পে পরিণত করা হয়েছিলাে। বিকেল পাঁচটার দিকে ব্রিগেডিয়ার কাদিরের অফিসে পৌছাই। তিনি অফিসে না থাকায় তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আমাকে ওয়েটিং রুমে বসান। এরপর পাঁচ ছয়জন পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর গােয়েন্দা বিভাগের লােক আমাকে ঘিরে বসে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। ঘন্টাখানেক এ অবস্থায় কাটানাের পরও ব্রিগেডিয়ার কাদির না আসায় তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর কাছে জামালের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি খুলে বলে তার পরামর্শ চাইলাম। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি টিক্কা খানের ব্যক্তিগত সেক্রেটারীর সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করে আমাকে গভর্নর হাউসে গিয়ে ব্যাপারটি তাঁকে জানাতে বললেন।
৫৪। তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমি তাড়াতাড়ি অফিসে এসে একজন নিরাপত্তা প্রহরীকে সঙ্গে নিয়ে গভর্নর হাউসে গেলাম। টিক্কা খানের ব্যক্তিগত সেক্রেটারীকে ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলার পর তিনি আমাদেরকে অন্তরীণ রাখা বাসার পাশের বাসায় টেলিফোন করে আমাদের বাসায় প্রহরারত সৈন্যদের কমান্ডারের সঙ্গে কথা বললেন। ঘটনাটির পর সে কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে তৎসম্পর্কেও তিনি বিস্তারিত জেনে নিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে বাসায় ফিরে যেতে বললেন এই বলে যে, পরদিন ঐ বাসার ঘটনাটির ব্যাপারে যথাবিহিত তদন্ত করা হবে। ধানমন্ডির ঐ বাসার কাছে ফিরে দেখি যে, বাসা অন্ধকার ও নিস্তব্ধ। বাসার গেইটে পৌছালে একজন সৈন্য আমাকে বন্দুক তাক করে গাড়ী বারান্দায় না গিয়ে

পৃষ্ঠাঃ ৯০
গ্যারাজে অবস্থানরত সৈন্যদের কমান্ডারের নিকট যাবার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা করে। শাশুড়ী ও হাসিনা তখন অন্ধকার বাড়ীর সামনের বারান্দায় বসেছিলেন। হাসিনা চীৎকার করে আমার উদ্দেশ্যে জানায় যে, এর কিছুক্ষণ আগে খােকা কাকাকে তারা গ্যারেজে ডেকে নিয়ে নানা ভাবে ভীতি প্রদর্শন করেছে। সুতরাং কোন অবস্থাতেই গ্যারেজে না গিয়ে হাসিনা আমাকে সােজা গাড়ী বারান্দায় যেতে বলে। হাসিনার পরামর্শ মােতাবেক আমি তখন গাড়ী বারান্দার দিকে যাবার জন্য গাড়ীটিকে ঘুরিয়ে নিয়েই ত্বরিত গতিতে বাসার বারান্দার দরজার নিকট পৌছাই। ঠিক ঐ মুহূর্তে বাড়ীর গেইটে কর্তব্যরত একজন সৈনিক গুলি ছোঁড়ে। ঐ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রহরারত সৈনিকেরা বাসার ভেতর ঘরের চারদিক ঘেরাও করে এবং ওদের কমান্ডার উচ্চঃস্বরে আমাকে ঘর থেকে বের হয়ে তার নিকট যেতে বলে। আমি তাকে আমার কক্ষে আসতে বলি। অনেক বাক-বিতন্ডার পর সে বাড়ীর বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে একজন রাইফেলধারী সৈনিকসহ নিজে একটি স্টেনগান হাতে আমার ঘরে প্রবেশ করে আমাকে সরাসরি বলে যে, তার দৃঢ় বিশ্বাস আমি গাড়ীর পেছনের বুটের ভেতর লুকিয়ে জামালকে বাড়ীর বাইরে নিয়েছি। আমি আমার সন্তানের মাথায় হাত রেখে আল্লাহর নামে কসম করে বলি যে, জামালের নিখোঁজ হবার বিষয়ে আমি কোন কিছু জানি না। এ কথা শােনার পর হাবিলদারটি একটু শান্ত হয়ে আমাকে বলে, “আজকের মত ঠিক আছে। তবে পরের দিনের মধ্যে জামালকে খোঁজ করে উক্ত বাসায় ফেরত আনতেই হবে।”
৫৫। পরদিন সকালে অফিসে এসেই ব্রিগেডিয়ার কাদিরের দফতরে ফোন করে তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের অনুমতি নিই। পরে সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে জামালের নিখোঁজ হওয়ার ও তৎপরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে তাকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। তিনি নিজেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের লােক বলে পরিচয় দিলেন। তাকে মার্জিত ও নম প্রকৃতির বলে মনে হলাে। ঘটনাটির জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “আমার নিজের ছেলে নিখোঁজ হলে আমি নিশ্চই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতাম। অতএব আপনার শাশুড়ীর উক্ত ঘটনায় যে মানসিক অবস্থা হয়েছে তা আমি সহজেই অনুভব করতে পারি।” এ প্রসঙ্গে গত কয়েকদিন আগে শেরে বাংলা নগরের ফার্মগেইটে এক গভীর রাতে যে ঘটনা ঘটেছিলাে তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বললেন, “সেখানে দশ-বারাে জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রহরারত ছিল। অতর্কিতে মুক্তিবাহিনীর লােকেরা সশস্ত্র আক্রমণ করে তাদের সকলকে মেরে ফেলে সেখান থেকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে পাকিস্তান টিকবে না। আমার অবশ্য বিশেষ কোন চিন্তা নেই, কারণ প্লেনে করে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে নিরাপদে চলে যাবাে।” অতঃপর তিনি বলেন যে, একটা সংবাদ তিনি সরকারী গােপনীয় সভায় জানতে পেরেছেন, যা শুনে আমার শাশুড়ী অন্তত কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারেন। তিনি বললেন, “আপনি আপনার শাশুড়ীকে বলবেন যে তাঁর বড় ছেলে, শেখ কামাল কলকাতায় নিরাপদে আছে।”

অতঃপর জামালের নিখোঁজ হওয়া ও তৎপরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে যথাযথভাবে অনুসন্ধান করার ব্যবস্থা যাতে গ্রহণ করা হয় সে ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করার আশ্বাস জানিয়ে তিনি আমাকে বিদায় দিলেন। ৫৬। এর একদিন পর সামরিক বাহিনীর দু’জন কর্মকর্তা ধানমণ্ডির ১৮ নম্বরস্থ বাসায় এসে বাসাটি বিশেষভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ভেতরের সমস্ত ফুলের গাছ ও নারকেল গাছের ডালপালা কাটিয়ে সাফ করিয়ে নেন। পরদিন সেই হাবিলদারকে ঐ বাসা থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। এর প্রায় সপ্তাহখানেক পর সামরিক বাহিনীর একজন উর্ধ্বতন কর্মকতা, কর্নেল লতিফ মেজর হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় এসে জামালের নিখোঁজ হওয়া এবং তৎপূর্ববর্তী ও পরবর্তী ঘটনা সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিতভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এক পর্যায়ে সেই হাবিলদারকে সেখানে হাজির করে আমাদের সামনে তাকেও ঐ বিষয়ে জেরা করা হয়।পরিশেষে, কর্নেল লতিফ উপস্থিত সকলকে জানান যে, শেখ জামালের নিখোঁজ হওয়া বা বাসা থেকে পালিয়ে যাবার ব্যাপারে আমার কোন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিলো না। এর পর থেকে তারা সৈন্য সংখ্যা এক কম্পানি থেকে দুই কম্পানিতে বৃদ্ধি করে৷ একজন পাঞ্জাবি হাবিলদারের অধীনে এক কম্পানি ও অপর একজন পাঠান হাবিলদারের অধীনে আর এক কম্পানি সৈন্য উক্ত বাড়িতে প্রহরার উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। বাড়ীর ছাদে বালির বস্তা দিয়ে নির্মিত বাঙ্কারে ভারী মেশিনগান ও গাড়ী গ্যারাজের ছাদে মাঝারি ক্ষমতাসম্পন্ন মেশিনগান স্থাপন করা হয়। সবার তত্ত্বাবধানে ছিলেন একজন সুবেদার মেজর। ৫৭। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা তাড়াতাড়ি শেষ করে আগস্ট মাসের মধ্যেই তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিলো তৎমর্মে একটি বিদেশী পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিলো। ৩রা আগস্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান টেলিভিশনের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করা হবে। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ রয়েছে।” ৯ই আগস্ট এক সরকারী প্রেসনোটে ঘোষণা করা হয়, “আগামী ১১ আগস্ট থেকে গোপনে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে।” ৩১শে আগস্ট জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব আগা শাহী জানান, “আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে এই বিচার সমাপ্ত হবে।” এ সমস্ত সংবাদ পাবার পর শ্বাশুড়ীসহ আমরা সবাই দারুণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। এর কয়েকদিন পর শেখ জামালের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠিতে জানতে পারা যায় যে, সে ঐ বাড়ীতে প্রহরারত দু’জন যুবক সৈন্যের সহযোগিতায় বাড়ীর সীমানাপ্রাচীর ডিঙ্গিয়ে পালিয়েছিলো এবং ইতোমধ্যে সে তার কয়েকজন বন্ধুর সাথে ঢাকা ত্যাগ করেছে। ৫৮। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর, বাঙালি জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ ও পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের কর্মকর্তা ও সদস্যদের সশস্ত্র হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুধু ঢাকাতেই

পৃষ্ঠাঃ ৯২
সীমাবদ্ধ ছিলাে না, তারা চট্টগ্রামস্থ সেনানিবাসেও সেনাবাহিনীর বহু বাঙালী কর্মকর্তা ও সদস্যদের হত্যাসহ পূর্ব পাকিস্তানের জেলা শহরগুলােতে অবস্থিত বিভিন্ন সেনানিবাসের অনেক বাঙালী কর্মকর্তা ও সদস্যদেরও হত্যা করে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, জয়দেবপুর, বগুড়া, রংপুর, কুষ্টিয়া, যশাের, বরিশাল, প্রভৃতি সেনানিবাসের বাঙালী সামরিক কর্মকর্তা ও সদস্যগণ তাঁদের প্রাণ রক্ষার্থে পশ্চিম পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা ও আত্মরক্ষামূলক আক্রমণ চালাতে চালাতে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েন। ঐ সমস্ত শহরের ছাত্র-জনসাধারণ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (NAP) ও কমিউনিস্ট পার্টির স্বাধীনতার সপক্ষের নেতাদের নেতৃত্বে সেখানের সেনানিবাসগুলাে ঘেরাও করে রাখে এবং বাঙালী সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাহায্য-সহযােগিতা করে। বেশ কয়েকটি সেনানিবাস যেমন, বরিশাল, কুষ্টিয়া, সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার সংবাদও ঢাকায় পৌছায়।
৫৯। পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নিজেদেরকে নতুন করে সংগঠিত করে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সারা পূর্ব বাংলায় নির্বিচার ও বর্বরােচিত গণহত্যা” চালায়। শহর, বন্দর ও গ্রামে-গঞ্জে বাঙালী জনগণের বাড়ীতে অগ্নিসংযোেগ, ধ্বংস, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হত্যায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের লেলিয়ে দেয় তাদের কর্মকর্তারা। ঢাকার মােহাম্মদপুর ও মীরপুর, সৈয়দপুর, পাকশী ও চট্টগ্রামে বসবাসরত অবাঙালীরাও প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে পাকিস্তান সামরিক জান্তার বাঙালী নিধন পরিকল্পনায় যােগ দেয়। এর ফলে ঢাকা, চিটাগাং ও খুলনা শহরসহ দেশের সকল শহর থেকে জনগণ প্রাণ রক্ষায় ছুটে যায় প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জে। মে মাসের মাঝামাঝি থেকে কিছু বাঙালী গুণ্ডাপাণ্ডা ও অবাঙালী লােকদের নিয়ে পাকিস্তান সামরিক জান্তার সরাসরি মদদে মুসলিম লীগের কতিপয় নেতা ও কর্মী তথাকথিত ‘শান্তি কমিটি গঠন করে এবং জামায়াতে ইসলামী ও নেজামের ইসলামের নেতারা গড়ে তােলে, “রাজাকার, আল বদর” ও “আল শামস” নামে তিনটি কুখ্যাত বাহিনী। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা এদের নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযােগিতা ছাড়াও এরা শহর, গ্রাম ও গঞ্জে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সমর্থকদের বাড়ীঘরে অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ ও নারী ধর্ষণ এবং হত্যা করতাে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সৈন্যদের এই অমানবিক অত্যাচার, নির্যাতন ও জীবন নাশের ভয়ে হাজার হাজার পূর্ব বাংলার নর-নারী ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলােয় আশ্রয় গ্রহণ করে এবং যারা নানা কারণে চলে যায়নি তারা কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে দিনরাত ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতাে। আগস্ট মাসে ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এক পরিসংখ্যান অনুসারে তখন ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী) শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলাে ৯৮ লাখ ১১ হাজার ৩ শত ৫ জনে। এর মধ্যে পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, বিহার,

পৃষ্ঠাঃ ৯৩
মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের মােট ৮২৫টি উদ্বাস্তু শিবিরে ৬৭ লাখ ৯৭ হাজার ২ শত ৪৫ জনের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাে ভারত সরকার। বাকি ৩১ লাখ ২ হাজার ৬০ জন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাে।
৬০। স্বাধীন বাংলাদেশ মুজিব নগর সরকারের অনুমােদনে মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী পাকিস্তানী হানাদার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সমগ্র রণাঙ্গনকে ১১টা সেক্টরে ভাগ করে ১১ জন সেক্টর কমাণ্ডার নিয়ােগ করেন। ১ নম্বর সেক্টর ছিলাে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনী নদী পর্যন্ত অঞ্চলকে নিয়ে এবং এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর মােহাম্মদ রফিক। নােয়াখালী জেলা, কুমিল্লা জেলার আখাউড়া ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত ও ফরিদপুর জেলার অংশ বিশেষ ছিলাে ২ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত এবং এর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর খালেদ মােশাররফ ও মেজর এম. টি. হায়দারের ওপর। ৩ নম্বর সেক্টর ছিলাে সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা জেলার অংশ বিশেষ, কিশােরগঞ্জ মহকুমা ও ভৈরব-আখাউড়া রেল লাইনের পূর্ব দিকের কুমিল্লা জেলার বাকি অংশ নিয়ে এবং এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ ও মেজর নূরুজ্জামান। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল, পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি রােড পর্যন্ত অঞ্চল ছিলাে ৪ নম্বর সেক্টরের অধীন এবং এর দায়িত্ব অর্পণ করা হয় মেজর সি.আর.দত্তের ওপর। ৫ নম্বর সেক্টর গঠন করা হয় সিলেট জেলার পশ্চিমাঞ্চল ও ডাউকিময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত পর্যন্ত অঞ্চলকে নিয়ে এবং এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী। ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে রাখা হয় দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরাঞ্চল ছাড়া সমগ্র রংপুর জেলা এবং এর দায়িত্ব ছিলাে উইং কমাণ্ডার এম. বাশারের ওপর। রাজশাহী, পাবনা, ঠাকুরগাঁও মহকুমা ছাড়া দিনাজপুর ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরাঞ্চল ছাড়া সমগ্র বগুড়া অঞ্চলকে ৭ নম্বর সেক্টরের অধীনে রাখা হয় এবং এর দায়িত্ব দেয়া হয় মেজর কাজী নূরুজ্জামানকে। ৮ নম্বর সেক্টর গঠন করা হয় কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর জেলার অধিকাংশ ও খুলনার উত্তরাঞ্চল নিয়ে এবং এর দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও মেজর এম. এ. মঞ্জুর। খুলনা জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার অঞ্চলকে নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টর গঠন করা হয় এবং এর দায়িত্ব অর্পণ করা হয় মেজর এম. এ. জলিলের ওপর। হেড কোয়ার্টার্সের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এক সুসংগঠিত কমাণ্ড বাহিনীর উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয় ১০ নম্র সেক্টরের। এই কমাণ্ড বাহিনীর দায়িত্ব ছিলাে অভ্যন্তরীণ নদীপথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করা। দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ নদীপথ ছাড়াও এঁরা চট্টগ্রাম এলাকাতেও তৎপর ছিলেন। কিশােরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা ও ব্রহ্মপুত্র (যমুনা নদীর উভয় তীরবর্তী এলাকা ছিলাে ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে এবং এর দায়িত্ব ছিলাে মেজর আবু তাহের ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম. হামিদুল্লাহর ওপর।

পৃষ্ঠাঃ ৯৪
৬১। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দস মাখন, আ. স. ম. আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের সমবেত নেতৃত্বে পৃথকভাবে গঠন করা হয় মুজিব বাহিনী”। এই বাহিনীর সদস্যদের পৃথকভাবে ট্রেনিং দেয়া হয় এবং এরা কখনাে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে একত্রে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু এদের দায়িত্ব ও কর্মকাণ্ড ছিলাে মুক্তিবাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। “মুজিব বাহিনী” ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে এককালে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও তৎকালীন টাঙ্গাইলের ছাত্র যুবক কাদের সিদ্দিকী তার একক নেতৃত্বে গড়ে তােলেন “কাদেরিয়া মুক্তি বাহিনী।” এই বাহিনীর সদস্যগণ দেশের ভেতর থেকেই কাদের সিদ্দিকীর তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং গ্রহণ করেন। দেশের অভ্যন্তরে যমুনা নদীর পূর্ব তীরাঞ্চল, টাঙ্গাইল জেলা ও ময়মনসিংহের পশ্চিমাঞ্চলসমূহে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করে টাঙ্গাইল জেলা ও ময়মনসিংহ জেলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ পাহাড়ী এলাকা মুক্ত করে এঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী যখন ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনী সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর নিকট ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে আত্মসমর্পণে সম্মত হয়, সে সময় কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মৃত্যুর বুকি থাকা সত্ত্বেও বীরদর্পে সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেছিলেন।
৬২। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের রণাঙ্গনের উত্তর-পূর্বাংশের যেসব জায়গার নাম উচ্চারিত হতাে সেগুলাে হচ্ছেঃ টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন জায়গা, আখাউড়া, দুলাই, শ্রীমঙ্গল, শমশের নগর, কুলাউড়া, জুরি, আটগ্রাম, লাতু, রাধানগর, ছাতক আর সুনামগঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নয় মাসকাল এসব এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনীর মধ্যে কত যে সশস্ত্র লড়াই হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তাই বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব এলাকায় যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিশেষ উল্লেখযােগ্য। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমাণ্ডের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ও শক্তিশালী ১৪তম ডিভিশনকে এই এলাকায় মােতায়েন করা হয়েছিলাে। কুমিল্লার নিকটবর্তী সালদা নদী থেকে শুরু করে উত্তরে সমগ্র সিলেট জেলা এই ডিভিশনের দায়িত্বে ছিলাে। এই ১৪তম ডিভিশনের প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল আবদুল মজিদ কাজী।
৬৩। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকসনের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রভাবশালী উপদেষ্টা ছিলেন ড: হেনরী কিসিঞ্জার। জুলাই-এ ড: কিসিঞ্জারের (পাকিস্তানের) ইসলামাবাদ সফর পাকিস্তানের সামরিক জান্তার) পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বক্ষণিক অবস্থানকে নিশ্চয়তার মাত্রায় নিয়ে এসেছিলাে। ইসলামাবাদ থেকে সারা

পৃষ্ঠাঃ ৯৫
বিশ্বকে বিস্মিত করে হঠাৎ করে পিকিং সফরে গিয়েছিলেন ড: কিসিঞ্জার। এরপর আগস্ট মাসে দিল্লী এসেছিলেন ড: কিসিঞ্জার। ইসলামাবাদে তাকে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা দেয়া হয়েছিলাে ঠিক তার উল্টো ঘটনাটি ঘটেছে ভারতের নয়াদিল্লীতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বৈঠকটি ছিলাে একেবারে আন্তরিকতাহীন ও অত্যন্ত শীতল। ভারতে এসে (পূর্ব পাকিস্তানীদের আশ্রয়ের জন্য নির্মিত) উদ্বাস্তু শিবিরগুলাে ড: কিসিঞ্জার একটিবারের জন্যও দেখতে চাননি। ইন্দিরা গান্ধীর তিনজন অতি কাছের উপদেষ্টা ছিলেন পি. এন. হাকসার, টি. এন. কাউল ও ডি. পি. ধর। এরা তিনজনেই ছিলেন নেহেরু পরিবারের মত কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ। প্রখর মেধা, প্রজ্ঞা ও ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনজনই। পি.এন.হাকার ছিলেন প্রধান মন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি এবং টি. এন. কাউল ও ডি.পি, ধর ছিলেন প্রধান মন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা। ডি. পি. ধরের ওপর সর্বোচ্চ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলাদেশের উদ্বাস্তু ও মুজিব নগর সরকারের সঙ্গে যােগাযোেগ রাখার। মার্কিন সরকারের ভারতবিরােধী মনােভাব, ড: কিসিঞ্জারের জুলাই মাসের আকস্মিক পিকিং সফর এবং পাকিস্তান সামরিক জান্তার ভারত ধ্বংসের শ্লোগান প্রচারের মাধ্যমে পাকিস্তানী জনগণকে উত্তেজিত করে তােলার প্রচেষ্টা এবং পাক-ভারত যুদ্ধ বাঁধানাের প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার ৯ই আগস্ট ২০ বছর মেয়াদী ইন্দো-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে। ঐ চুক্তির মাধ্যমে ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়ন পরস্পরের কাছে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় যে, যে কোন বৈদেশিক শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে তারা পরস্পরকে সর্বপ্রকার সাহায্য করবে।
৬৪। ৮ই আগষ্ট ভারতের প্রধান মন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তার সরকারের পক্ষ থেকে প্রেরিত এক বাণীতে বিশ্বের সকল দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের প্রতি শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি জানিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টির আহবান জানান। ১৭ই আগস্ট জেনেভাস্থ আন্তর্জাতিক আইন সমিতির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট তারবার্তায় শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি করা হয়। ২০শে আগস্ট হেলসিংকি থেকে বিশ্ব শান্তি পরিষদ শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে ১৩ই সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সমিতির এক বৈঠকে বৃটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ আর্থার বটমলী তার ভাষণ দানকালে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি করেন। তিনি বলেন, “এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে একমাত্র শেখ মুজিবের সাথেই আলােচনা ফলপ্রসূ হতে পারে।” ৪ঠা নভেম্বর বৃটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনে বৃটিশ শ্রমিক দলীয় প্রভাবশালী নেতা মিঃ পিটার শাের হুশিয়ার করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘বৃটিশ সরকার যেভাবে আবার পাকিস্তানকে সাহায্য দান শুরু করার পায়তারা করছে তার পরিণাম শুভ হবে না। পাকিস্তানে এখন আসলে প্রয়ােজন হচ্ছে একটা

পৃষ্ঠাঃ ৯৬
রাজনৈতিক সমাধান। আর এ ধরনের সমাধান পূর্ব বাংলার জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য হতে হবে।”
৬৫। ১লা সেপ্টেম্বরে লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিয়ােগ করেন লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে এবং গভর্নরের পদে মুসলিম লীগের ডা: এ.এম. মালেককে। ডা: মালেক ৩রা সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি যখন গভর্নরের শপথ গ্রহণ করেন সে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কনভেনশন মুসলিম লীগের সাবেক গভর্নর মােনেম খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগের চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী ও খুলনার খান আব্দুস সবুর খান। ডাক্তার মালেকের বয়স ছিল ৭৪ বছর এবং তিনি পূর্বে চক্ষু চিকিৎসা ছাড়াও মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষতাবে জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান সামরিক জান্তার ডা: মালেককে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিয়ােগ করার উদ্দেশ্য ছিল মূলত দু’টি। প্রথমত তথাকথিত ক্ষমা প্রদর্শনের প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত এলাকায় অভ্যর্থনা ক্যাম্পের আয়ােজন করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী) বাঙালীদের দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত ১৯৭০ সালের নির্বাচনের বাহানা করে দক্ষিণপন্থী ও ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে আসন বন্টন করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেমরির কিছু আসনে লােক দেখানাে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা। সে পরিকল্পনা মােতাবেক পাকিস্তান সামরিক জান্তা ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালীর প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন এবং তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত আনার জন্য পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় তথাকথিত অভ্যর্থনা ক্যাম্প স্থাপন করার কথা ঘােষণা করে। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক জান্তার সে প্রচেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ২১শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুস সাত্তার নির্বাচন সম্পর্কিত এক সংশােধনী জারির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে ৭৮টা জাতীয় পরিষদের এবং ১০৫টা প্রাদেশিক পরিষদের আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান যথাক্রমে ১২ই ও ২৩শে ডিসেম্বরে সম্পন্ন করার ঘােষণা দেন। ১০ই নভেম্বর পর্যন্ত ১০৮টি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সদস্যদের নাম ঘােষণা করা হয়েছিল।
৬৬। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণের অব্যবহিত পর ডা: মালেক কাউন্সিলিস্ট ও কনভেনশনিস্ট উভয় মুসলিম লীগ, ধর্মীয় রাজনৈতিক দলসমূহ (যেমন, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম) ও আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী গ্রুপের পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর কড়া পাহারায় আলাপ-আলােচনা শুরু করেন। ঠিক ঐ সময় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে বসবাসরত এক পশ্চিম পাকিস্তানী ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিবাহিতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একমাত্র কন্যা বেগম আখতার সােলায়মান ঢাকায়

পৃষ্ঠাঃ ৯৭
এসে আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী গ্রুপের কিছু সংখ্যক নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে মামা এডভােকেট আবদুস সালাম খান ও সােহরাওয়ার্দীর দীর্ঘকালের অনুসারী ও সহকর্মী এডভােকেট জহিরুদ্দিন। ঠিক ঐ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিকসন ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের দুদিকেই জাতিসংঘ সৈন্য মােতায়েন করার সুপারিশ করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিকসন পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চেয়ে আর একটু নীচের স্তরের বাঙালী নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করারও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। এরই প্রেক্ষাপটে মুজিব নগর সরকারের অজান্তে একটা বিশেষ মহল বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দানের শর্তে আওয়ামী লীগের ৬ দফার ভিত্তিতে একটা কনফেডারেশনের আওতায় পাকিস্তানের (উভয় অংশ) ভৌগােলিক সীমারেখা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিরতির জন্যে প্রচেষ্টা শুরু করেছিলাে। এমন কি এই উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর কয়েকটা ক্যাম্পে প্রচারপত্র পর্যন্ত বিলি করেছিলাে ঐ গ্রুপের লােকেরা। উল্লেখ্য যে, ইরানের পরলােকগত শাহের মধ্যস্থতায় তেহরানে উভয় পক্ষের মধ্যে ঐ প্রস্তাবিত বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিলাে। যুগােশ্লাভিয়ার প্রয়াত নেতা মার্শাল টিটো সিবিএস টেলিভিশন সাক্ষাৎকারেও ঐ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন। ঐ সময় বিশেষ সূত্রে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, আওয়ামী লীগের তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও কয়েকজন উর্ধ্বতন আমলাকে নিয়ে খন্দকার মােশতাক আহমদ ঐ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অতি গােপনে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। পশ্চিমা রাজনৈতিক মহল ছাড়াও প্রভাবশালী পত্র-পত্রিকাগুলাে বার বার তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক জান্তাকে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আলােচনায় বসার জন্যে আহ্বান জানিয়েছিলাে। পাকিস্তান সামরিক জান্তার উদ্দেশ্যে তৎঅর্মে কয়েকটি বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্যের অংশ বিশেষ নিম্নে দেয়া হলাে।
৬৭। নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২২শে সপ্টেম্বর (১৯৭১) তারিখের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় … (পাক-ভারত উপমহাদেশে শরণার্থী পুনর্বাসন ও শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘকে সক্রিয় কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর আন্তর্জাতিকভাবে এমন মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে কারারুদ্ধ শেখ মুজিবুর রহমানকে পুনর্বাসিত করা সম্ভব হয়। জাতিসংঘ যদি নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে পাকিস্তানে একটা রাজনৈতিক সুরাহার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে, তাহলেই কেবল পাক-ভারতের বিস্ফোরণমূখী সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সম্ভব হবে এবং নিরীহ ও ভুখা বাংলাদেশের মানুষদের বাঁচানাে যাবে।” ৩০শে সেপ্টেম্বর (১৯৭১) ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টার পত্রিকায় প্রখ্যাত সাংবাদিক ক্রুশবি নেইস লিখলেন, ‘বর্তমানের এই জটিল ও ভয়াবহ পরিস্থিতিতে একজন মাত্র ব্যক্তি রয়েছেন, যিনি কোন রকমে গ্রহণযােগ্য একটা সমাধান করতে পারেন। তিনি হচ্ছেন সম্প্রতি

পৃষ্ঠাঃ ৯৮
বেআইনী ঘােষিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে তাঁর পার্টি (পাকিস্তান) জাতীয় পরিষদে (নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভে সক্ষম হয়েছে। ২৫শে মার্চ সামরিক এ্যাকশন নেয়ার পর থেকে শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে রয়েছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে গােপনে একটা মিলিটারী কোর্টে তাঁর বিচার হয়েছে। এ বিচারের সর্বোচ্চ সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এই শাস্তি এখনও ঘােষণা করা হয়নি। শেখ মুজিবই হচ্ছেন একমাত্র বাঙালী নেতা যাঁর ইজ্জত ও ব্যক্তিগত বিপুল সমর্থন রয়েছে এবং তিনিই দেশকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে অন্য কোন সমাধান এখন তাঁর পক্ষে মানিয়ে নেয়া খুবই মুশকিল হবে। অন্যদিকে এটা খুবই আনন্দজনক হবে যদি পাকিস্তান সরকার একটু বিবেকসম্পন্ন হয়ে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবকে উক্ত অভিযােগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় বসে। এই বাঙালী নেতাকে বিচারে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি দিয়ে (আলােচনার সমস্ত পথ। বন্ধ করে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত পাকিস্তানে সাহায্য দান অব্যাহত রাখায় সীমাবদ্ধ প্রভাব ব্যবহারের যে সুযােগ রয়েছে, চূড়ান্ত বিপর্যয়ের আগেই তার। সবটুকু ব্যবহারের সময় এসেছে।” ২৫শে অক্টোবর (১৯৭১) কেনিয়ার সানডে পােস্ট পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলার (নির্বাচিত) নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন করতে পারে, তাহলে পাকিস্তান আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হবে এবং (তার) অস্তিত্ব বিপন্নের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া ছাড়াও অন্যান্য দেশকে নানা অসুবিধার হাত থেকে রক্ষা করবে। মার্কিন সাংবাদিক জোসেফ ক্রাফট ওয়াশিংটন পােষ্টে ২৫শে নভেম্বর এক নিবন্ধে লিখেন, “এখন এ কথা পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে যে, যখন গত মার্চ মাসে পূর্ব বাংলায় সামরিক শাসন পুনর্বার চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানী শাসকচক্র যতটুকু চিবুতে পারে তার চেয়ে বেশি মুখ-গহবরে গ্রহণ করেছিল। যদিও বহু লােককে হত্যা করা হয়েছে এবং লাখ লাখ আদম সন্তানকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে, তবুও পাকিস্তানী সৈন্যরা পূর্ব বাংলার পূর্ণ কর্তৃত্ব করায়ত্ত করতে পারেনি। উপরন্তু বাঙালীদের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করেও পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ বাঙালীদের স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন কতকগুলাে সহজ শর্ত খুঁজে বেড়াচ্ছেন যা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে গেলানাে যাবে।”
৬৮। ৭ই মার্চ পাকিস্তান সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আহূত অসহযােগ আন্দোলনের শুরুতেই জনগণ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত শিল্প কলকারখানা বন্ধ করে দেয়। ২৫শে মার্চ সামরিক শাসন পুনর্বার জারি ও নির্যাতন-হত্যার ভয়ভীতি প্রদর্শন সত্ত্বেও পাকিস্তান সামরিক জান্তা পূর্ব বাংলার শিল্পকারখানাগুলােকে সম্পূর্ণ চালু করতে সক্ষম হয়নি। যদিও কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিসে আসতেন, কিন্তু সেটাও ছিল দায়সারা ও লােক

পৃষ্ঠাঃ ৯৯
দেখাননা। অফিসে এসে কোন কাজকর্ম না করে তাঁরা বেশির ভাগ সময় কাটাতেন বাঙালীদের ওপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, নারী ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের খবরাখবর বিনিময়ের ব্যাপারে এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিদেশী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মন্তব্য ও সংবাদ জানার জন্য। এ ছাড়াও মুক্তিযােদ্ধাদের দেয়ার জন্য ঝুঁকি সত্ত্বেও অর্থ সগ্রহে তাঁরা অনেক পরিশ্রম করতেন। ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রের প্রকৌশলী এ. এস. এম. এনামুল হক ও উধ্বতন বিজ্ঞানী ড: এম. মােজাম্মেল হােসেন। যৌথভাবে এ উদ্দেশ্যে আমাদের অনেকে কাছ থেকে প্রতি মাসে অর্থ সগ্রহ করে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে পৌছিয়ে দিতেন।
৬৯। সেপ্টেম্বর মাসের গােড়ার দিক থেকে ঢাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি ও সশস্ত্র তৎপরতা বাড়তে থাকে। পুরানাে ঢাকার বিভিন্ন স্থানসহ, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা অঞ্চল, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, হাজারীবাগ, গ্রীন রােড, তৎকালীন ঢাকাস্থ পাকিস্তান রেডিও স্টেশন, শাহবাগ ও ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলদ্বয়ের পশ্চিম পাশের এলাকা, পীলখানা, প্রভৃতি জায়গায় প্রায় প্রতি রাতে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর টহলদারদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালাতাে। এভাবে ঢাকা ও তার আশেপাশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টলেশনও নিষ্ক্রিয় করে দিতে পেরেছিলাে মুক্তিযােদ্ধারা। ঢাকায় অবস্থানরত প্রায় লােকজনই স্বেচ্ছায় আশ্রয়, খাবারদাবার ও সাহায্য করতে এই সমস্ত মুক্তিযােদ্ধাদেরকে। ঢাকাস্থ অনেক যুবকযুবতীও গােপনে ট্রেনিং নিতাে সেসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধার কাছ থেকে। সে সমস্ত মুক্তিযােদ্ধার কতিপয় সদস্য ২৩শে অক্টোবরের সন্ধ্যায় আইয়ুব খান কর্তৃক নিযুক্ত পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর মােনেম খানের বনানীস্থ বাসভবনে ঢুকে বসার ঘরে তাঁকে তাঁর মুসলীম লীগের কয়েকজন সহকর্মীদের সঙ্গে আলােচনারত অবস্থায় গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম হয়।
৭০। ১৯৭১ সালে বেশ সময় নিয়েই বর্ষা চলছিলাে। বৃষ্টি একেবারে চলে যেতে যেতে শেষ হয় প্রায় অক্টোবরের মাঝামাঝি। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধ থেমে থাকেনি। যুদ্ধ চলছিলাে পুরাে বর্ষা জুড়েই। বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই ক্রমাগত মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসছিলাে। এ রকম অবস্থায় ঢাকাস্থ কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ডের ব্যারাক থেকে সে সময় আর্মি টুপগুলােকে ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাবার কথা বলে সীমান্তে চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। ভারত অবশ্য তখনও পাকিস্তান সীমান্তে তার সৈন্য সমাবেশ ঘটায়নি। সে সময়ে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জেনারেল (১৯৭১ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর ফিল্ড মার্শাল) স্যাম মানেকশ। পাকিস্তানী সৈন্য সীমান্তে এগুনাের ১১ দিন পর ১৩ই অক্টোবর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সীমান্তে তাঁদের সৈন্য সমাবেশ শুরু করেন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে দু’দল দু’দলের দিকে নিশানা তা, করলল—এদিকে পাকিস্তানী সৈন্য, অপরদিকে ভারতীয়রা। এ ব্যাপারটি প্রথম ঘটে ২৪শে অক্টোবর (১৯৭১)। সেই সময়ই ইন্দিরা গান্ধী ভাবলেন যে, বিশ্ব জনমতকে ঐ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করার সময় এসেছে। বিষয়টির

পৃষ্ঠাঃ ১০০
একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি তিনি চেয়েছিলেন। শেখ মুজিবের (নিঃশর্ত মুক্তি, উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরে যাবে আর সর্বোপরি বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ হবে—এগুলাে কোন শর্ত সাপেক্ষে আলােচনার বিষয় নয়, বরঞ্চ তিনি বলেছিলেন, “এর বাইরের বিষয়গুলােই আলােচনায় আসতে পারে।” এই কথা নিয়েই মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ভ্রমণে বেরুলেন ইউরােপ ও আমেরিকায়। তিনি তাঁর ভ্রমণে বিভিন্ন স্থানে বললেন, “পূর্ব পাকিস্তানে যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানাে হচ্ছে, মানবেতিহাসে এমন কলঙ্কজনক অধ্যায় আর দেখা যায়নি। সৎ উদ্দেশ্য থাকলে এ সমস্যার সমাধান যে অসম্ভব তা নয়। তবে ভারতের একার পক্ষে এটা সত্যিই অসম্ভব। কেননা শরণার্থীদেরকে তাে আর ফিরিয়ে দেয়া যায় না।”
৭১। এই সময় প্রায় আড়াই সপ্তাহ ধরে ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেস, ভিয়েনা, লন্ডন, অক্সফোর্ড, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, প্যারিস ও বন ঘুরলেন। উদ্বাস্তুদের জন্য অনেক প্রতিশ্রুতি এবং অর্থ সাহায্যও পেলেন, কিন্তু পেলেন না কোন সমাধান। ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিকসন মিসেস ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছিলেন, “ইয়াহিয়া খান তাঁকে পাক-ভারত সীমান্ত থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতএব আপনার উচিত হবে সমগ্র পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী অপসারণ করা।” জবাবে ইন্দিরা গান্ধী অত্যন্ত শান্তভাবে প্রেসিডেন্ট নিকসনকে জানিয়েছিলেন, “ইয়াহিয়া খানকে তাঁর সমস্ত সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তান থেকেই সরিয়ে নিতে হবে, এর আগে কোন কথা নয়।” ১৪ই নভেম্বর নয়া দিল্লী ফিরে ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে যদি অগত্যা সামরিক অভিযান চালাতেই হয় তাহলে আমরা তা করবাে। আশা করছি চুড়ান্ত ক্রাইসিসে ভারত এ মাসের শেষে কিংবা আগামী মাসের শুরুতে পৌছে যাবে; আর তখনই চালানাে হবে চূড়ান্ত সামরিক অভিযান।”
৭২। ইন্দিরা গান্ধী যখন বিদেশ ভ্রমণে ছিলেন সে সময় ইয়াহিয়া খান ভারতকে অবাক করে দিয়ে বললেন, “ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। পূর্ব পাকিস্তানে সব কিছুই স্বাভাবিক চলছে। যেটুকু অসুবিধা তার জন্য দায়ী একমাত্র ভারত। ভারতের ছত্রছায়াতেই দুষ্কৃতকারীরা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সৃষ্টি করছে বিশৃংখলা ও অশান্ত পরিবেশ।” ঐ সময় বিশ্ব জনগণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের নূরুল আমিনকে প্রধান মন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি (PPP)-এর চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী ও ধর্মীয় দলের নেতাদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক মন্ত্রিসভা নিয়ােগ করা হয়। অতঃপর ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চীনে পাঠালেন চীনের সঙ্গে একটা সামরিক সহযােগিতা চুক্তি সম্পন্ন করা যায় কিনা সে বিষয়ে আলাপ করার জন্য। সে সময় কোন চুক্তিতে চীন অস্বীকৃতি জানালেও পাকিস্তানে ফিরে এসে ভুট্টো

পৃষ্ঠাঃ ১০১
বললেন, “পাকিস্তানকে যে কোন ধরনের সাহায্য দেবার জন্য চীন সব সময় প্রস্তুত। অতএব ভারতের এ ব্যাপারে ধারণা থাকা উচিত।”
৭৩। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে একদিন বাসায় কাজের ছেলে ফরিদকে অনুপস্থিত দেখে হাসিনাকে তার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। হাসিনা জানায় যে, আগের দিন বিকেলে সে তাকে পাঠিয়েছিলাে জয়ের জন্য কিছু ওষুধপত্র কিনে আনতে। এরপর সে আর ফেরেনি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে ফরিদ ফিরে আসে। তখন তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে শীর্ণ এবং শুকিয়ে কাঠের মত হয়েছিলাে। ফরিদ জানায় যে, ঐ দিন ওষুধ নিয়ে সে যখন আমাদের বাসায় ফিরছিলাে তখন ধানমন্ডি গার্লস স্কুলের আর্মি ক্যাম্পের নিকটস্থ একটি খালি বাড়ীতে তাকে নিয়ে গিয়ে এবং তার হাত-পা বেঁধে আমাদের বাসায় প্রহরারত সুবেদার মেজর তাকে ভীষণ মারধর করায় সে গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাে। তার বাঁচার কথা ছিলাে না। মারধর করে ছেড়ে দিলেও তারা তাকে আমাদের বাসায় না ফেরার জন্য হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলাে। অতঃপর সুস্থ হয়ে সে মুক্তি বাহিনীতে যােগ দিয়েছিলাে। অস্ত্রশস্ত্র ও মালামাল বহনের কাজে সে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করেছিলাে।
৭৪। অক্টোবরের শেষের দিকে দাদা ও দাদি আম্মা (বঙ্গবন্ধুর আব্বা ও আম্মা) ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁদেরকে অধ্যাপক ডা: নূরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে পি. জি. (IPGMR) হাসপাতালে (পূর্বে শাহবাগ হােটেল) ভর্তি করা হয়। সামরিক কর্তৃপক্ষ শাশুড়ীকে অনুমতি না দেয়ায় বঙ্গবন্ধুর সবচে’ ছােট বােন (জনাব এ.টি.এম. সৈয়দ হােসেনের স্ত্রী) দিনরাত হাসপাতালে থেকে দাদা ও দাদি আম্মার সেবা-শুশ্রুষা করতেন। হাসিনা ও আমি রােজ বিকেলে তাঁদেরকে দেখতে যেতাম। লক্ষ্য করি যে, আর্মির গােয়েন্দা বিভাগের সশস্ত্র লােকজন কৌশলে দাদা-দাদিদেরকে যে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন দেখতে যেতেন তাঁদের পরিচয় ও যাতায়াত জেনে নিতে এবং তাঁদের গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতাে। ঐ সময় ঢাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রায় প্রতিরাতেই ধানমন্ডির আশেপাশে গােলাগুলির আওয়াজ শােনা গেলেই আমাদের বাসার প্রহরীদের দায়িত্বে নিয়ােজিত সুবেদার মেজর ডক্টর সাব, ডক্টর সাব” বলতে বলতে আমাকে আমার কক্ষের দরজা খুলতে বাধ্য করতাে এবং স্টেনগান হাতে কক্ষে প্রবেশ করতাে। তাছাড়াও রাতে আমার জানালার পাশেই বেয়নেট লাগানাে বন্দুকসহ প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকতাে। এর ফলে প্রায় কোন রাতেই আমি ঘুমােত পারতাম না।
৭৫। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় ঢাকায় সামরিক বাহিনীর লােকজনদের যুদ্ধ-প্রস্তুত অবস্থায় চলাফেরা করতে দেখা যায়। ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রােডস্থ আমাদের অন্তরীণ রাখা ঐ বাড়ীতে কর্তব্যরত পাকিস্তানী সৈন্যরাও ঐ সময় যুদ্ধ-প্রস্তুত অবস্থা গ্রহণ করে বাড়ীর এখানে সেখানে ট্রেঞ্চ খোঁড়া শুরু করে। ইন্দিরা গান্ধী আমার ফুফী-শাশুড়ী হয়” এই বলেও অনেক সময় তারা আমার উদ্দেশ্যে ব্যঙ্গোক্তি করে আমাকে বিব্রত করতাে। এছাড়া প্রায়

পৃষ্ঠাঃ১০২
সাড়ে আট মাস দুর্বিষহ অবস্থায় থাকার ফলে আমিও কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ি। এহেন পরিস্থিতিতে দাদা ও দাদিশাশুড়ীদেরকে দেখাশুনা এবং নিজের শারীরিক পরীক্ষা (Checkup) ও চিকিৎসার জন্য আমি পি.জি. হাসপাতালে ভর্তি হই নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে।
৭৬। আমি হাসপাতালে ভর্তি হবার কয়েকদিন পর একদিন হঠাৎ সন্ধ্যে ছয়টার দিকে সমগ্র ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সন্ধ্যে ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। ঐ দিন ছাত্র ফেডারেশনের ১৯৬১-৬২ সময়কালের এককালীন সভাপতি ও আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত তাঁর কতিপয় আত্মীয়কে হাসপাতালে দেখতে এসে সংবাদ পেয়ে আমার কেবিনে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন বিকেল পৌনে ছয়টায়। আকস্মিক ও হঠাৎ করে কারফিউ বলবৎ করার ঘােষণা শুনে তিনিও স্তম্ভিত ও চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বাসায় ফেরার উপায় না পেয়ে সে রাত তিনি আমার কেবিনে থাকেন। সেদিন পি.জিহাসপাতালের অতি নিকটবর্তী এলাকাসহ সারা ঢাকায় গােলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় এবং আমরা দু’জন প্রায় সারাটি রাত কথাবার্তা ও আলাপ-আলােচনা করে কাটাই। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলােচনার এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত বলেন, “পাকিস্তানী সামরিক জান্তার শেখ মুজিবের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর না করা মারাত্মক ভুল হয়েছে। তা না করে শেখ সাহেবকে গ্রেফতার, সারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর নির্যাতন, অত্যাচার ও পূর্ব পাকিস্তানী সৈন্যদের অন্যান্য কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের অখণ্ড তাকে এখন বিনষ্টের দ্বারপ্রান্তে এনেছে। পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অত্যাসন্ন, যার পরিণতি হবে অতি ভয়াবহ। পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ঘটনাকে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আর কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না।”
৭৭। ২৩শে নভেম্বর পাকিস্তান জরুরী অবস্থা ঘােষণা করে। এরপর ২৫শে নভেম্বর এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করলেন, “আগামী দশ দিনের মধ্যে আমি নাও থাকতে পারি। আমি রণক্ষেত্রে একটা যুদ্ধ পরিচালনা করবাে।”
৭৮। ৩রা নভেম্বর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সংক্ষিপ্ত সফরে কলকাতায় আসেন। ঐ দিন বিকেলে কলকাতার গড়ের মাঠে একটি জনসভারও আয়ােজন করা হয়েছিলাে। কলকাতার বক্তৃতা-মঞ্চেই ইন্দিরা গান্ধী জানতে পারেন যে, পাকিস্তানী বিমান বাহিনী পশ্চিম ভারতের বেশ কয়েকটি বিমান ঘাঁটিতে আকস্মিকভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। তৎক্ষণাৎ ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ভাষণ শেষ করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে এ সংবাদ ঘােষণা করা হয়। AIR-তে এও বলা হয় যে, ১৯৬৭ সালে ইসরাইল যেমন অতর্কিতে মিসরের বিমানক্ষেত্রগুলােতে আক্রমণ চালিয়েছিলাে, ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলােতে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর আক্রমণও ছিল তেমনি। পশ্চিম ফন্টে, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, অমৃতসর, ফিরােজপুর, চন্দ্রিগড়, ফরিদকোট, পাঠানকোট, সাদেক, ওক, জোধপুর ও উত্তরলাই, আম্বালা, এমন কি দিল্লীর সন্নিকটে

পৃষ্ঠাঃ ১০৩
আগ্রার বিমান ক্ষেত্র এবং পূর্ব ফ্রন্টের আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী আক্রমণ চালায়। বেশির ভাগ আক্রমণ ছিলাে স্বল্প সময়ের। কেবল অমৃতসরেই সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়েছিলাে পাকিস্তান বিমান বাহিনী। প্রথম আঘাতটি হানা হয় বিকেল ভারতীয় সময় ৫-৪৭ মিনিটে ফরাসী তৈরী মিরেজ এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী এফ-৮৬ স্যাবর জেট বিমান দিয়ে। প্রায় এর সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানী স্থল বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করে, বিশেষত পশ্চিম ফন্টে পুনচ সীমান্ত এলাকা এবং যুদ্ধবিরতি এলাকা কাশ্মীরের সীমান্ত এলাকায়।
৭৯। ঐদিন রাত ১০-৩০টায় ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতা থেকে দিল্লী পৌঁছান। ততক্ষণে সারা দিল্লী শহরে যুদ্ধকালীন ব্ল্যাক-আউট বলবৎ করা হয়েছিলাে। সরকারের প্রতি সকল বিরােধী দলই সমর্থন জানিয়েছিলাে ইতােমধ্যেই। রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি সারা ভারতে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেন। এ রকম সঙ্কটজনক অবস্থার প্রেক্ষিতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন রাত ১২.২০মিনিটে। ঐ অল ইন্ডিয়া রেডিওর ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শত্রুরা আমাদের বিমানক্ষেত্রসহ সীমান্তের সবগুলাে প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ রকম সমূহ বিপদের মধ্যেও তারত যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। গত মার্চ মাস থেকেই আমরা একটা ব্যাপক বিপদগ্রস্ত (পূর্ব পাকিস্তানের) জনগণকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। তাঁদের দোষ ছিলাে যে, তাঁরা গণতন্ত্রের পক্ষে ভােট দিয়েছিলেন। তাঁদের সমস্যা আমাদেরকে ছুয়েছে—ভাবিয়েছেও বটে। চেষ্টা করেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এ সমস্যা সমাধানের। কিন্তু বিশ্বসভা মূল সমস্যাগুলােকে পাশ কাটিয়ে বাইরের দিকটা সামান্য আলােচনায় এনেছে মাত্র। ফলে স্বাভাবিক নিয়মেই অবস্থার অবনতি ঘটেছে। শৌর্যবান মুক্তিযােদ্ধারা জীবনকে যুদ্ধে বাজি রেখে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এক অসীম উন্মাদনায়। আমরা তাঁদের সম্মান করি। আজ এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ হিসাবেও আত্মপ্রকাশ করলাে। এর দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে আমার ওপর, আমার সরকারের ওপর এবং সর্বোপরি ভারতের সমস্ত জনগণের ওপর। যুদ্ধের তাণ্ডব থেকে আমাদের আর পেছনে ফেরার কোন উপায় নেই। আমাদের দেশপ্রেমিক মানবতাবাদী যােদ্ধা জওয়ানরা দেশের প্রতিরক্ষার জন্য এগিয়ে চলেছে। সারা ভারতে ঘােষণা করা হয়েছে জরুরী অবস্থা এবং এর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।”
৮০। ৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৭১) মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দু’জনের যুগ্ম দস্তখতে চিঠি লেখা হয়েছিলাে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে। চিঠির মূল বক্তব্য ছিলাে, স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানের দাবি। ৬ই ডিসেম্বর (১৯৭১) ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে মুজিবনগর সরকারের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে একটা চিঠি পাঠান। অতঃপর ভারতীয়

পৃষ্ঠাঃ ১০৪
সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার অধীনে ভারতীয় পূর্ব ফ্রন্টের সামরিক বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী বাহিনী” গঠনের ঘােষণা দেয়া হয়। ৭ই ডিসেম্বর ভুটান সরকারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদানের প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করে।
৮১। ইতিমধ্যে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার লােকজন এবং বিদেশী সাংবাদিক ও নাগরিকগণ নিরাপত্তার জন্য হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অবস্থার আরও অবনতি হওয়ায় আন্তর্জাতিক রেডক্রস সংস্থা উক্ত হােটেল চত্বরকে নিরপেক্ষ এলাকা ঘােষণা করে। ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর পক্ষে বিমান বাহিনী ঢাকায় আক্রমণ শুরু করে ৬ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতের বারটার দিকে। ৭ই ডিসেম্বর সকাল থেকে প্রায় সারা দিন চলে ওদের ও পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর মধ্যে তুমুল আকাশ লড়াই। ঢাকায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্বল্প সংখ্যক যুদ্ধজাহাজগুলাের প্রায় সবগুলাে সেদিন বিধ্বস্ত হয়। সেদিনের লড়াইয়ে মিত্র বাহিনীর কয়েকটি যুদ্ধজাহাজকেও বিধ্বস্ত হতে দেখা যায়। ঢাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ীর ছাদে উঠে লােকজন ঐ লড়াই প্রত্যক্ষ করে। লােকমুখে শােনা গিয়েছিলাে যে, মিত্রবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের অনেক পাইলট ছিলেন মুক্তিবাহিনীর বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা, যার ফলে তাঁদের লক্ষ্যস্থলগুলাে অতি পরিচিত ছিলাে। পরের দিন সকালে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর মাত্র দু’টো যুদ্ধজাহাজকে আকাশে উড়ে ঢাকার বাইরে যেতে দেখা যায়। ঐ যুদ্ধজাহাজ দুটোকে মিত্র বাহিনীর যুদ্ধজাহাজ বিধ্বস্ত করেছিলাে বলে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে দাবী করা হয়েছিলাে। এরপর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আর কোন যুদ্ধজাহাজকে আক্রমণরত মিত্র বাহিনীর যুদ্ধজাহাজের মােকাবেলা করতে দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই ডিসেম্বর তৎকালীন সােভিয়েত কমুনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারী ও USSR-এর প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভ পােল্যান্ডের ওয়ারশ নগরীতে অনুষ্ঠিত পােলিশ কমুনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে বক্তৃতা দানকালে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দ্ব্যর্থহীনভাবে যে রায় দিয়েছে সেই রায় এবং তথাকার জনগণের মৌলিক অধিকারকে “রক্তাক্ত” পদ্ধতিতে দমন করার প্রচেষ্টা ও লাখ লাখ শরণার্থীর মর্মন্তুদ ঘটনার পরিণতি হচ্ছে এই যুদ্ধ।”
৮২। ৮ই ডিসেম্বর হতে পাকিস্তান ইস্টার্ন কম্যান্ড আকাশযুদ্ধে শক্তি হারিয়ে ফেলায় ভারতীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলাে প্রতি দিনরাত ঢাকা ও এর আশেপাশের সামরিক লক্ষ্যস্থলের ওপর একরকম নির্বিঘ্নে আক্রমণ চালাতে থাকে। বিমান বাহিনীর সাহায্য না পাওয়ায় বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানী সৈন্যদের যে দশা হবার কথা ঠিক তাই ঘটতে থাকে। ৭ই ডিসেম্বর রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার ও অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিদেশী প্রচার মাধ্যমগুলাে, যেমন অস্ট্রেলিয়ান বেতার কেন্দ্র (ABC), বৃটিশ ব্রডকাষ্টিং কর্পোরেশন (BBC) -এর প্রচার কেন্দ্র, ভয়েস অব আমেরিকা (voA)-এর প্রচার কেন্দ্র হতে পাকিস্তানীদের।
১৯৭১ সাল।

পৃষ্ঠাঃ ১০৫
যশাের ক্যান্টনমেন্টের পতনের খবর শুনতে পাওয়া যায়। এরপর থেকে দিবারাত্রি শুধু পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে পরাজয়ের খবর আসা অব্যাহত থাকে। ১০ই ডিসেম্বর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পরাজিত পাকিস্তানী বাহিনীর সৈন্যদেরকে ঢাকায় আসতে দেখা যায়। রণাঙ্গনে পর্যদস্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের সদস্যরা পি.জি. হাসপাতালে এসে আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে প্রায় সমস্ত রােগী হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। ১২ই ডিসেম্বরের মধ্যে পি.জি. হাসপাতাল ঐ সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্যে ভরে যাওয়ায় তার পরিচালক অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, কয়েকজন ডাক্তার, নার্স, বঙ্গবন্ধুর অশীতিপর আব্বা-আম্মা ও তাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ছােট বােন এবং আমি ছাড়া আর অন্য কোন রােগী হাসপাতালে ছিলাে না বলে জানা যায়। এ দিকে পাকিস্তানের অনুরােধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশন শুরু হয়। ঐ অধিবেশনে পাকিস্তানী দলের নেতৃত্বে ছিলেন ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নিয়ােজিত কেন্দ্রীয় বেসামরিক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইতােপূর্বে ৯ই ডিসেম্বর মার্কিন সরকার জাপানী দ্বীপপুঞ্জে তার ওকিনওয়া নৌঘাঁটি থেকে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানাের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। পারমাণবিক ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ঐ বিশাল নৌবহরে ছিলাে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’, জলে-স্থলে আক্রমণে সক্ষম যুদ্ধজাহাজ “ত্রিপপালী” ইত্যাদি। ১৩ই ডিসেম্বর ঐ নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করার সংবাদ বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়। ইতােপূর্বে ভারত ও পাকিস্তানী বাহিনীদ্বয়ের অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবী জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন সরকারের পক্ষে পর পর পেশকৃত দুটো প্রস্তাব পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে পাস হলেও সােভিয়েট ইউনিয়নের ভেটো প্রদানে সেগুলাে অকৃতকার্য হয়ে যায়।
৮৩। ১৩ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে একটি হেলিকপ্টারে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর লােকেরা (বর্তমানে বাংলা মােটর্স ও সােনারগাঁও হােটেলের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত একটি এতিমখানার ওপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বােমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে এতিমখানাটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায় এবং সেখানে তখন অবস্থানরত ৫০-৬০ জন এতিম সন্তান মৃত্যুবরণ করে। একটি পৃথক বােমার আঘাতে এতিমখানার সামনে এয়ারপাের্ট রােডেও একটি বিরাট গর্ত হয়েছিলাে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার এ জাতীয় ঘটনা ঘটানাের উদ্দেশ্য ছিলাে বিশ্ববাসীকে এই বলে বিভ্রান্ত করা যে, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিমান বেপরােয়াভাবে সিভিলিয়ান (অসামরিক) এলাকার জনবসতির ওপর বিমান আক্রমণ চালাচ্ছিল। এরপর ১৪ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে নিউইয়র্ক সময়) নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে (পাক-ভারত উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে অবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহার করে আন্তর্জাতিক সীমানায় ফিরে নেয়ার দাবিতে যে

পৃষ্ঠাঃ ১০৬
শেষ প্রস্তাব পাস হয়েছিলাে তাও সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক ভেটো প্রদানে বাতিল হয়ে যায়।
৮৪। ১৩ই ডিসেম্বর সকালে ঢাকাস্থ পাকিস্তান রেডিওর অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করার কিছুক্ষণ পর বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে মুজিবনগর সরকার ও তার কর্মকর্তাদের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত ঢাকার রেডিও থেকে অনুষ্ঠান প্রচার সম্পূর্ণ বন্ধ ছিলাে। ১৪ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটার দিকে তিনটি ভারতীয় বিমান একযােগে গভর্নর হাউসে রকেট নিক্ষেপ করে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে। বিমান হামলা বন্ধ হবার পর গভর্নর আবদুল মােতালেব মালেক, তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ এবং পশ্চিম পাকিস্তানী বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সৃষ্ট “নিরপেক্ষ এলাকা” হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে হােটেল শেরাটন)-এ আশ্রয় নেন। বি.বি.সি., এ.বি.সি, ভােয়া, প্রভৃতি বেতারে বলা হয় যে, “নিরপেক্ষ এলাকায় প্রবেশের সময় তাঁদের প্রত্যেকেই রেডক্রসের কাছে লিখিতভাবে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ করতে হয়েছিলাে। গভর্নর ডা: মালেকের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চীফ সেক্রেটারী মােজাফফের হােসেন, পুলিশের আইজি, ঢাকা বিভাগের কমিশনার, প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়ােজিত পশ্চিম পাকিস্তানী সেক্রেটারীরা ছাড়াও কয়েকজন ভি.আই.পি. ছিলেন। ঐ দিনেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নির্দেশে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক (বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক) থেকে সমস্ত টাকা-পয়সা, স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা লুণ্ঠন এবং ব্যাংক চত্বরে বস্তায় বস্তায় কাগজের নােট পােড়ানাের খবর পাওয়া যায়। এ ছাড়াও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সহযােগিতায় তার দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর লােকেরা সরকারী বাস ডিপােগুলাের বাসগুলাে ধ্বংস এবং সেগুলাের যন্ত্রপাতি লুণ্ঠন করা ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি, রেকর্ডপত্র ইত্যাদি বিনষ্ট করে।
৮৫। ১৫ই ডিসেম্বর সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দু’টো ভারতীয় বিমান সারা ঢাকায় লিফলেট ফেলে। ভারতীয় আর্মী চীফ-অব-স্টাফ ও মিত্র বাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশ-এর নামে প্রচারিত উক্ত লিফলেটে পূর্ব পাকিস্তানের পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের উদ্দেশে বলা হয়েছিল, “অবিলম্বে আমার অগ্রগামী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে আপনাদের সৈন্য বাহিনী এবং অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তা বিধান করা হবে। ••• এরপরও যদি আমার আবেদন মােতাবেক আপনারা পুরাে সামরিক বাহিনীসহ আত্মসমর্পণ না করেন, তাহলে ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ৯টার পর আমি মিত্রবাহিনীকে পূর্ণোদ্যমে আঘাত হানার নির্দেশ দিতে বাধ্য হবাে।” উর্দু ও ইংরেজীতে জেনারেল মানেকশ-এর এই আহ্বান বাংলাদেশের সর্বত্র বিমানযােগে বিতরণ করা হয়েছিলাে। ঐ তারিখে সন্ধ্যা থেকে অল ইন্ডিয়া রেডিও (AIR) থেকেও জেনারেল মানেকশ’র কণ্ঠে টেপকৃত উক্ত আহ্বান কিছুক্ষণ পর পর প্রচার করা হয়েছিলাে। উক্ত আহবানে আরও বলা হয়েছিলাে,

পৃষ্ঠাঃ ১০৭
“পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে আত্মসমর্পণের সুযােগ দেয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় ১৫ তারিখ বিকেল ৬টা থেকে ১৬ তারিখ সকাল ৯টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান হামলা বন্ধ রাখা হবে।”
৮৬। ১৬ই ডিসেম্বর ভাের ছটায় পি.জি. হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক নূরুল ইসলাম আমার কেবিনে এসে গম্ভীরভাবে বললেন, “ড: ওয়াজেদ, ভারতীয় বিমান বাহিনী আজ ৯টার পর ক্যান্টনমেন্টের ওপর কার্পেট বােম্বিং করলে পি.জি. হাসপাতালও আক্রান্ত হতে পারে। অতএব আমার পরিবারবর্গসহ আপনি আপনার দাদা-শশুর, দাদী-শাশুড়ী ও ফুফুকে বাসায় নিয়ে যান। যদিও এম্বুলেন্সে পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই, তবুও এর জন্য চেষ্টা করে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।” অতঃপর ১৬ই ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে আমি অধ্যাপক নূরুল ইসলাম সাহেবের আম্মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ, দাদা, দাদী ও ফুফু-আম্মাকে নিয়ে একটি এম্বুলেন্সে হাসপাতাল ত্যাগ করি। তখন সারা ঢাকায় কারফিউ বলবৎ ছিলাে এবং পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সৈন্যরা অস্ত্রহাতে এদিক ওদিক পালাচ্ছিলাে। যাহােক, নিরাপদে অধ্যাপক নূরুল ইসলাম সাহেবের পরিবারবর্গকে তাঁর সেন্ট্রাল রােডস্থ বাসায় এবং দাদা-দাদী, ফুফু-আম্মাকে সােবহানবাগে তাঁর সরকারী ফ্ল্যাটে রেখে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর রােডস্থ বাসার পশ্চিম পাশের বাড়ীর দোতলায় এ. কে. এম. মােশাররফ হােসেন (পরবর্তীতে BCIC-এর দীর্ঘকালীন চেয়ারম্যান ও তৎপরবর্তীকালে এরশাদ সরকারের বাণিজ্য সচিব)-এর ফ্ল্যাটে আমি আশ্রয় নিই। সেখানে পৌছে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রচারিত ঘােষণায় শুনি যে, ঢাকায় পাকিস্তান সামরিক জান্তার আত্মসমর্পণের সময়সীমা ঐদিন বিকেল ৩টা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।
৮৭। এদিকে দুপুর থেকে ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা এসে ঢাকা নগরীতে প্রবেশ করতে শুরু করে। ঐ সময় জানতে পারি যে, ১৫ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতেই মুক্তিবাহিনী ও কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে “কাদেরিয়া বাহিনী”-এর সহায়তায় ভারতীয় ১০১ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রধান মেজর জেনারেল গার্শ্বব্য নাগরা তাঁর এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য ও সহকর্মী এবং কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনীর কিছু সদস্যদের নিয়ে কালিয়াকৈর হয়ে ঢাকা-মানিকগঞ্জ সড়ক পথে মীরপুর ব্রিজের উত্তর পাশে আমিনবাজারে এসে পৌছেছিলেন। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে ঐ ব্রিজের দক্ষিণ পাশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে কিছু সংঘর্ষ হবার পর বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ডের পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল জমশেদ মীরপুর ব্রিজের কাছে গিয়ে মেজর জেনারেল গার্শ্বব্য ও তাঁর দুইজন উচ্চপদস্থ সহকর্মী এবং কাদের সিদ্দিকীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাদেরকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পাকিস্তান ইস্টার্ন কম্যান্ডের হেড কোয়ারটার্স নিয়ে যান।
৮৮। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ২টার দিকে তিনটি ভারতীয় সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকব তার কয়েকজন

পৃষ্ঠাঃ ১০৮
উচ্চপদস্থ সহকর্মীদের নিয়ে ঢাকা পৌছান। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ৮-১০টি সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ভারতীয় ইস্টার্ন সেক্টরের সামরিক বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ কম্যান্ডের সর্বাধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা তার উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক সহকর্মী এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকারকে নিয়ে ঢাকা পৌছান। পাকিস্তান ইস্টার্ন সামরিক কম্যান্ডের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান আয়ােজন করা হয় ব্রেসকোর্স (বর্তমানে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান)-এর সেই স্থানে যেখানে মাত্র ৯ মাস ৯ দিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ (১৯৭১) তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ১৬ই ডিসেম্বর সকালের দিকে ঢাকার পথঘাট ছিলাে প্রায় জনশূন্য। কিন্তু বেলা তিনটার দিকে সেখানে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হাজার হাজার লােক পরাজিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান দেখতে জমায়েত হয়। তখন চারদিকে শুধু গগনবিদারী জয় বাংলা” শ্লোগান। ১৬ই ডিসেম্বর (১৯৭১) বিকেল ঠিক ৪টা ১৯ মিনিটের সময় পাকিস্তান সরকার ও তার সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কম্যান্ডের পক্ষে লেঃ জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী ভারত-মুক্তিবাহিনীর যৌথ কম্যান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করলেন (পরিশিষ্ট-৪ দ্রষ্টব্য)। হাজার হাজার জনতা ও শতাধিক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক এই অনুষ্ঠান অবলােকন করেন। ঢাকা নগরীর প্রতিটি বাড়ীতে তখন গাঢ় সবুজের ওপর লাল বলয়ের মধ্যে সােনালী রং-এর বাংলাদেশের মানচিত্রসম্বলিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিলাে।
৮৯। এদিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পরাজয়ে বিক্ষুব্ধ ও বিচলিত চৈনিক প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই সখেদে বলেন, “ঢাকার পতন ভারতের বিজয়ের পথে আগতির প্রমাণ নয়, বরং এশীয় উপমহাদেশে এক অন্তহীন যুদ্ধের সূচনামাত্র।” ১৭ই ডিসেম্বর পিকিং (বর্তমানে বেইজিং)-এ চৌ-এন-লাই আরও বলেন, “ভারতই পাকিস্তানের ঘাড়ে তথাকথিত বাংলাদেশের ক্রীড়নক সরকারকে চাপিয়ে দিয়েছে।”
৯০। ১৬ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেলাে। পশ্চাদপসারণরত পাকিস্তানী সৈন্যরা ১৩ই ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়ীয়াতে বেশ কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। শহরের উপকণ্ঠে এসব আইনজীবী, চিকিৎসক ও শিক্ষকদের লাশ পাওয়া যায়। রাজশাহীতেও অনুরূপ হত্যাযজ্ঞ চালানাে হয়েছে। ঢাকায় ১৩ ও ১৪ই ডিসেম্বর রাতে কারফিউ-এর মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ী বাড়ী হামলা চালিয়ে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তালিকার অন্তর্ভুক্ত অনেক বুদ্ধিজীবীকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকার মােহাম্মদপুর পশ্চিম প্রান্তের ইটখােলা ও মীরপুরের উত্তরের কবরস্থানের পাশে ৫০-৬০ জনের লাশ পাওয়া যায়। এদের অনেককে এক সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে ডােবার পাশে রেখে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিলাে,

পৃষ্ঠাঃ ১০১
আবার কাউকে কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সেসব বুদ্ধিজীবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, সাংবাদিক, কবিসাহিত্যিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী-ইঞ্জিনিয়ার, সরকারী কর্মচারীসহ সব ধরনের পেশার ব্যক্তিবর্গ। উল্লেখ্য, মােহাম্মদপুর ও মিরপুর আবাসিক এলাকা দুটো ছিলাে মূলত অবাঙ্গালী অধ্যুষিত অঞ্চল।
৯১। ১৬ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে (নিউইয়র্ক সময়) জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন, … সম্ভবত নিরাপত্তা পরিষদে এটাই হচ্ছে আমার শেষ বক্তৃতা। যদি নিরাপত্তা পরিষদ মনে করে থাকে যে, আমি আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত ব্যাপারটা বৈধ করার জন্য এতে অংশ গ্রহণ করবাে, তাহলে এটুকু বলতে পারি যে, কোন অবস্থাতেই আমি তা করবাে না। আমি নিরাপত্তা পরিষদ থেকে আত্মসমর্পণের দলিল গ্রহণ করব না। আমি একটা (সামরিক) আগ্রাসনকে বৈধ করার অংশীদার হবাে না। কেন গত তিন-চার দিন ধরে নিরাপত্তা পরিষদ বিধি মােতাবেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব কলাে? এটার অর্থ কি এই নয় যে, ঢাকার পতনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছিল। কেন আমি নিরাপত্তা পরিষদে সময় নষ্ট করবাে? ••• আমি এই মুহূর্তে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে) ওয়াক আউট করলাম।” অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন বিদেশী রেডিওতে বলা হয়েছিলাে যে, ওয়াক আউট করার পূর্ব মুহূর্তে ভুট্টো সাহেব ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত নিরাপত্তা পরিষদে পেশকৃত সর্বশেষ প্রস্তাবের কপি ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করেছিলেন। যাহােক, ১৭ই ডিসেম্বর ভারত সরকার একতরফাভাবে ভারত-পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টেও যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করে।
৯২। ১৬ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লােক মারফত খবর নিয়ে জানতে পারি যে, তখনও ধানমন্ডীর (পুরাতন) ১৮ ন (নতুন ৯/এ নম্বর) রােডস্থ ২৬ নম্বর বাড়ীটিতে পাকিস্তানী আর্মির সৈন্যরা প্রহরারত রয়েছে। কিন্তু শাড়ী, হাসিনা, রেহানা, রাসেল, জয় ও অন্যরা কি অবস্থায় রয়েছে সে সম্পর্কে কেউই সঠিক তথ্য দিতে পারলাে না। পরের দিন অর্থাৎ ১৭ই ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর (পুরাতন) ৩২ নম্বর (নতুন ১১ নম্বর) ব্লোডস্থ বাড়ীর পশ্চিম পাশের বাসার (শরায়ে খাম) ডা: এ. সামাদ খান চৌধুরী, তার মেজো ছেলে, এ, আহাদ খান চৌধুরী (আহাদ) এবং এ. কে. এম. মােশাররফ হােসেনসহ আমি একটি গাড়ীতে করে ধানমন্ডী বালিকা বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশের রাস্তা (পুরাতন) ২০ নম্বর নতুন ১২/এ ন) হয়ে ১৮ নম্বর রাস্তায় প্রবেশ করে ধীরে ধীরে ঐ বাড়ীটির দিকে আসর হই। বাড়ীটির কাছে পৌছানাে মাত্রই সেখানকার একজন সৈন্য গাড়ীটির দিকে বন্দুক তাক করে আমাদেরকে থামতে আদেশ করে। তখন বিপদের বুকি সত্ত্বেও আমি গাড়ী থেকে বেরিয়ে দু’হাত উচু করে দাঁড়ালে হয়তাে আমাকে চিনতে পেরে—সে আমাদের গাড়ীটিকে বাড়ীটির গেইটের দিকে নিতে বলে। সেখানে পৌছে বাড়ীটির ভেতরে লােকজনের কোন সাড়াশব্দ না

পৃষ্ঠাঃ ১১০
পেয়ে সেখানে অবস্থানরত দু’জন সৈন্যকে একটু পরে আবার আসব” বলে আমরা দ্রুত সেখান থেকে চলে আসি। এরপর আমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেল (বর্তমানে হােটেল শেরাটন)-এ গিয়ে সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি।
৯৩। ধানমন্ডীর ১৮ নম্বর রােডের ঐ বাড়ীটি রােড নম্বর (পুরাতন) ২০ (নতুন ১২/এ ন) থেকে চারটি বাড়ীর পশ্চিমে এবং ধানমন্ডীর (পুরাতন) ১৩ নম্বর (নতুন ৯ নম্বর) রােড থেকে দু’টি বাড়ীর পূর্বে অবস্থিত। ১৮ই ডিসেম্বর সকাল ৮টার দিকে আমি হাঁটতে হাঁটতে ঐ বাড়ীর পশ্চিমের রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে ১৮ নম্বর রাস্তার দিকে পৌছালে সেখানে বঙ্গবন্ধুর সেই সহকর্মী ও সহকারী গােলাম মােরশেদ সাহেবকে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন অবস্থায় বাড়ীটির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখতে পাই। তিনি দীর্ঘ ন’মাস কারারুদ্ধ থাকার পর মাত্র কয়েকদিন আগে মুক্তি পেয়েছেন, আমাকে একথা ক’টি জানিয়েই বললেন, “একটু সাবধানে থাকুন। ঐ বাড়ীতে ভারতীয় বাহিনীর এক কম্পানী সৈন্য নিয়ে মেজর তারা সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে আত্মসমর্পণ করানাের চেষ্টা করছেন। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণে রাজি করিয়ে দুটো গাড়ীতে তাদের দ্রুত নেয়ার মুহূর্তে আমরা দু’জন সেখানে গিয়ে পৌছাই। ততক্ষণে অনেক লােকজন সেখানে গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের অপদস্ত করা শুরু করে। মেজর তারার অনুরােধে জনতা কিছুটা শান্ত হয়। যে দুজন পাকিস্তানী সৈন্যের সহায়অয় শেখ জামাল ঐ বাড়ী থেকে আগস্ট মাসে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তাদের যেন কোন শাস্তি দেয়া না হয় তার জন্য আমার শাশুড়ী মেজর তারাকে বিশেষ করে অনুরােধ করেন।
৯৪। পাকিস্তানী সৈন্যদের সেখান থেকে নিয়ে যাবার পর মেজর তারার সঙ্গে বাড়ীর সবার কথাবার্তা বলার সময় জানতে পারি যে, ১৬ই ডিসেম্বর রাতে ছাত্র লীগের কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা একটি জীপে করে ঐ বাড়ীর সামনে পৌঁছানাে মাত্রই ঐ বাড়ীর ছাদ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিলাে। ১৭ই ডিসেম্বর রাতে পৃথকভাবে দু’জন ব্যক্তি গাড়ীতে ঐ বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় বাড়ীর ছাদের ওপর থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা মেশিনগানের গুলিতে তাদেরকে হত্যা করেছিলাে। তাদের গাড়ীর সামনের বাতি অনেকক্ষণ ধরে জ্বালানাে অবস্থায় ছিলাে। তারপর পাকিস্তান সেনা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য সেখানে এসে গাড়ী দু’টো নিয়ে গিয়েছিলাে। সে দু’রাত বাড়ীর সবাই দুশ্চিন্তায় একটুও ঘুমােয়নি।
৯৫। ১৯শে ডিসেম্বর আমাদেরকে জানানাে হয় যে, ঐদিন বিকেলে লেঃ জেনারেল অরােরা ধানমন্ডীর ঐ ১৮ নম্বর বাসায় আমাদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারের জন্য আসবেন। তাকে বসাবার মতাে মানসম্মত চেয়ার-টেবিল না থাকার কারণে আমার শাশুড়ী এই প্রস্তাবে একটু বিব্রতবােধ প্রলেও রাজি হলেন। অতঃপর বিকেল ৫টার দিকে

পৃষ্ঠাঃ ১১১
লেঃ জেনারেল অরােরা তার কয়েকজন সহকর্মীদের নিয়ে আমাদের বাসায় আসেন। সাক্ষাৎকারটি ছিলাে নিতান্তই সৌজন্যমূলক। তিনি আমাদের কুশলাদি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। এক পর্যায়ে আমার শাশুড়ী ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তারার নেতৃত্বে একটি ইউনিট পাকিস্তানী সৈন্যদের কবল থেকে তাঁর পরিবারবর্গসহ তাকে নিরাপদে মুক্ত করার জন্য জেনারেল অরােরা এবং তাঁর মাধ্যমে ভারতীয় সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। প্রায় আধ ঘন্টা পর জেনারেল অরােরা আমাদের থেকে বিদায় নেন।
৯৬। ১৯শে ডিসেম্বর কামাল ও জামাল যুদ্ধফ্রন্ট থেকে ঐ বাসায় ফিরে আসে। তাদের পরনে ছিল সামরিক পােশাক। শেখ কামাল মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানীর এ.ডি.সি. নিযুক্ত হয়েছিল এবং শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলাে। প্রায় সাড়ে নয় মাস পর পরিবারের সবাই অক্ষত অবস্থায় একত্রে হওয়ার খুশিতে তখন সবার চোখ ভরে ওঠে আনন্দাশ্রুতে। ২০শে ডিসেম্বর যুদ্ধফ্রন্ট থেকে ফিরে এসে ঐ বাসায় আশ্রয় নেয় শেখ ফজলুল হক মণি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও শেখ মারুফ। শেখ শহীদও যুদ্ধফ্রন্ট থেকে ফিরে এসে আমাদের দেখতে আসে। এরপর এক এক করে ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খান, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদুস মাখন, আ. স. ম. আবদুর রব ও শাহজাহান সিরাজও আমার শাশুড়ীসহ সেখানে সকলের সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
৯৭। ২২শে ডিসেম্বর একটি ভারতীয় বিমানে করে মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অবঃ) মনসুর আলী ও পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ ঢাকা পৌছান এবং বিমান বন্দর থেকে তারা সরাসরি ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রােডস্থ ঐ বাসায় আসেন আমার শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে। তখন সকলের চোখই ছিলাে আনন্দাশ্রুতে স্না। এরপর এক এক করে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাও আমার শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা করতে আসেন।
৯৮। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণ, নিরাপরাধ নরনারীদের হত্যা ও বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার-নির্যাতনমূলক অপরাধের অভিযােগে রাজাকার, আলবদর প্রভৃতি পাকিস্তান আর্মির সহযােগী বাহিনীর বহু সদস্য ও তাদের রাজনৈতিক মদদদানকারী নেতাদের গ্রেফতার করে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানের ক্যাম্পে আটক করে রাখে। ঢাকায় অন্যান্য ক্যাম্পের মধ্যে প্রধান ক্যাম্পটি ছিলাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক) হলে। মুসলিম লীগের সবুর খানসহ জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি ও মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার সহযােগিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলাের অনেক নেতাকেও সেখানে আটক রাখা হয়েছিলাে।

পৃষ্ঠাঃ ১১২
ইকবাল হল ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আ.স.ম. আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ।
৯৯। মুজিবনগর সরকারকে তখন সদ্য স্বাধীন শেক্রমুক্ত বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেই দেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করাসহ ঐ সমস্ত আটককৃত অভিযুক্ত ব্যক্তির ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হতে হয়। তাছাড়া একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশু রাষ্ট্রের আইন শৃঙক্ষলা রক্ষার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামাে গঠন, ইত্যাদি সমস্যার মােকাবিলায় তাঁদের সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। উপরন্তু আত্মসমর্পণকারী পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা নিরূপণ করার দায়িত্বও তাঁদের নিতে হয়। এ সময় পাকিস্তান বাহিনীর কর্মকর্তা ও সাধারণ সৈন্যদের সংখ্যা ছিলাে ৯১,৫৪৯ জন। বাংলাদেশে নিরাপত্তার অভাব বিবেচনায় এদের ভারতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তে আরও বলা হয়েছিলাে যে, ঐ সমস্ত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় ঢাকায় আবার ফেরত আনা হবে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এসব যুদ্ধবন্দীকে ভারতে পাঠানাে শুরু হয়। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে রাজিত পাকিস্তানী সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে লেঃ জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল জমসেদ, রিয়ার অ্যাডমিরাল শরীফ, এয়ার কমোেডাের ইমামুল হক প্রমুখকে। হেলিকপ্টারযােগে কলকাতায় নিয়ে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন হেড কোয়াটার্স ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে রাখা হয়। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য ব্যক্তির ভারতে স্থানান্তর ১৯৭২ সালের ১৮ই জানুয়ারীর মধ্যে সম্পন্ন হয়।
১০০। উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হওয়ার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের রুদ্ররােষ থেকে আত্মরক্ষার স্বার্থে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নিজেদের কৌশল পুনঃনির্ধারণপূর্বক জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে যুগপৎ সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভুট্টোর জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের সভা বর্জন করে ইসলামাবাদে ফেরার অব্যবহিত পর। এর পর পরই এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতাকে গ্রাহ্য করে সদম্ভে বলেন, “সমর শক্তির জোরে একটা পরিণতিকে চাপিয়ে দেয়া যায় কিন্তু তা চিরস্থায়ী হয় না। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য অংশ।” অতঃপর ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য চীন, যুক্তরাষ্ট্র, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানান।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৯৭২ সাল
১। ‘মুজিব নগর’ থেকে স্বদেশে ফিরেই বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান এবং অর্থ বিষয়ক মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অবস্থান নিলেন বঙ্গভবন (পাকিস্তান আমলে গভর্নর হাউস)-এ। অপরদিকে পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ গিয়ে উঠেন তাঁর আগামসি লেনস্থ নিজস্ব বাসায়। এর কয়েকদিন পর, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ তর মন্ত্রীসভায় রদবদল ও সম্প্রসারণ করেন। তিনি খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন এবং তাঁর স্থলে আওয়ামী লীগের আব্দুস সামাদ আজাদকে নতুন পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী নিয়োগ করেন। ২। তাজউদ্দিন আহমদের খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র বিষয়ক দায়িত্ব থেকে সরানোর কারণ কিছুটা ছিল তাঁদের দুজনের পরস্পর বিপরীতমুখী মতাদর্শ ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্নে ব্যক্তিগত সংঘাত। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সময় শেখ মুজিব এবং খন্দকার মোশতাক একই সঙ্গে দলের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে দলের কাউন্সিল সভায় শেখ মুজিবের উদ্যোগে দলটিকে ধর্মনিরপেক্ষ করার উদ্দেশ্যে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পরিবর্তিত নামকরণ করা হয় “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ”। দলের উক্ত কাউন্সিল সভার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আব্দুস সালাম খান ও অন্যান্য অল্পসংখ্যক সদস্যসহ খন্দকার মোশতাক আহমদ দল থেকে বেরিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে তিনি অবশ্য আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন এবং সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। যতই দিন যেতে থাকে ততই আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের নেতৃত্ব প্রশ্নাতীত হয়ে দাঁড়ায়। খন্দকার মোশতাকের বিরোধিতা তখন পরিচালিত হয় তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে। কিন্তু উপরোক্ত কারণ ছাড়াও খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করার কারণ
(Unicoded by – মোহাম্মদ ফেরদৌস ইউসুফ। )

পৃষ্ঠাঃ ১১৪
ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে মন্ত্রী পরিষদের সিদ্ধান্ত লংঘন করে কলকাতায় তাঁর স্বাধীনতা বিরােধী গােপন চক্রান্তমূলক বিভিন্ন ভূমিকা ও তৎপরতা। তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামে অবিচল এবং সমাজতন্ত্রী শিবিরের, বিশেষতঃ (তৎকালীন) সােভিয়েট ইউনিয়ন ও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। অপরদিকে খন্দকার মােশতাক আহমদের টান ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে এবং তিনি চেয়েছিলেন কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে আপােষ করে পাকিস্তান অটুট রাখতে। শুধু তাই নয়, এই আপােষ ফরমূলা নিয়ে কলকাতায় মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন প্রতিনিধির সঙ্গে খন্দকার মােশতাকের আলােচনাও হয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব মাহবুবুল আলম চাষী ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যােগাযােগ ও আপােষ আলােচনা শুরু করতে। ঐ গােপন বার্তাটি ধরা পড়েছিল এবং তারপরই বাংলাদেশ সরকার খন্দকার মােশতাককে জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে পাঠাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করে। তাঁর পরিবর্তে তখন লন্ডনে অবস্থানরত এবং সেখানে স্বাধীনতার পক্ষের আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা করে জাতিসংঘে পাঠানাে হয়েছিল। সুতরাং খন্দকার মােশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হতে সরানাের পূর্বে এসব ঘটনার কথা তাজউদ্দিন আহমদের মনে ক্রিয়াশীল থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল।
৩। মন্ত্রিসভার উপরােল্লিখিত রদবদলের কয়েকদিন পর সুলতান শরিফ আমাকে জানান। যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হারিয়ে ক্রুদ্ধ খন্দকার মােশতাক তাজউদ্দিনের মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে অসুস্থতার ভান করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের জেলখানায় কি অবস্থায় আছেন এবং আদৌও জীবিত আছেন কি
সেসম্পর্কে কারও কোন তথ্য জানা ছিল না। তদুপরি, তখন পর্যন্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে সাংগঠনিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য বিধি-ব্যবস্থা সুসংগঠিত করা সম্ভব না হওয়া, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী এবং অন্যান্য দল ও গ্রুপের সশস্ত্র সদস্যদের ভিন্ন ভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী নেতৃত্বের অধীনে অবস্থান, যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করলেও পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতি, স্বাধীনতা বিরােধী ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক গঠিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনীর সদস্য ও নেতাদের মুক্ত বিচরণ ইত্যাদির কারণে দেশে এক অস্বস্তিকর ও অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছিল। এহেন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে অনৈক্য ও কোন্দলের খবর প্রকাশ পেলে তার পরিণতিতে সদ্য অর্জিত স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে এই আশংকায় আমি তৎক্ষণাৎ সুলতান শরিফকে সঙ্গে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবকে দেখতে যাই। আমাকে পেয়ে আমার সঙ্গে একান্তে আলাপ করার জন্যে খন্দকার

মোশতাক আহমদ সাহেব তখন সুলতান শরিফসহ সেখানে উপস্থিত অন্যান্য সকলকে
কেবিনের বাইরে পাঠিয়ে দেন । কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি তাকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে
তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্যে অনুরোধ করি । খন্দকার মোশতাক আহমদ
সাহেব প্রথমে অনমনীয় ভাব দেখালেও শেষমেষ আমার প্রস্তাবে রাজি হন এই শর্তে যে,
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে আসার পর তাঁকে পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া না হলেও, মন্ত্রী পরিষদে যথাযোগ্য জ্যেষ্ঠতাসহ অর্থ কিংবা শিল্প ও
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করার জন্যে আমি বঙ্গবন্ধুর নিকট তদবির করবো । এর
পরদিন খন্দকার মোশতাক আহমদ তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন ।
৪। এদিকে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের অন্যান্য অংগদলসমূহ এবং মুজিব বাহিনীর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ৭ই মার্চ ( ১৯৭২ ) তারিখে রেসকোর্স ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান )–এ এক জনসভার ঘোষণা দেয়া হয় । ঐ সময় কয়েকটি বিশেষ মহল থেকে এই মর্মে প্রচারণা ছড়ানো হয় যে, তাজউদ্দিন আহমদ সাহেব বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তরিক নন । এই সংবাদ শোনার পরদিন সকালে আমি বঙ্গভবনে গিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে এবিষয়ে অবহিত করি । আমরা তখনও ধানমন্ডির সেই ১৮ নম্বর রোডের বাসায় থাকতাম । সেদিন বিকেলে তাজউদ্দিন আহমদ সাহেব আমাদের বাসায় আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে তখন পর্যন্ত তিনি যে সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেসম্পর্কে শাশুড়ীকে অবহিত করেন । এর পরদিন ঐ বাসায় একটি টেলিফোন সংযোগ দেয়া হয় ।
৫। ঐ সময় বিশ্বের প্রায় সব জায়গা থেকেই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্যে পাকিস্তানের প্রতি দাবী জানানো হয় । জাতিসংঘের মহাসচিব, ইউরোপের প্রায় অর্ধেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণ, এমনকি আন্তর্জাতিক আইনজীবী সমিতিও ইসলামাবাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্যে আবেদন জানান । অনেকগুলো মুসলিম দেশের সঙ্গে তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্যে পাকিস্তান সরকারের কাছে অনুরোধ জানান । সোভিয়েট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এও বলা হয়েছিল যে, শেখ মুজিবের যদি কিছু ঘটে যায় তাহলে তার সমস্ত দায়দায়িত্ব পাকিস্তানকে গ্রহণ করতে হবে এবং তার ফলাফল কখনোই ভালো হবে না । এরপরেও আরও কিছুদিন অতিবাহিত হয় । অবশেষে ৩রা জানুয়ারী ( ১৯৭২ ) তারিখে করাচীর এক জনসভায় জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন ।
৬। ৮ই জানুয়ারী ( ১৯৭২ ) বিবিসি-এর সকালের সংবাদে বলা হয় যে, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ৭ই জানুয়ারী দিবাগত রাতে একটি চার্টার্ড বিমানে করে লন্ডনের পথে পাঠিয়ে দিয়েছে । এই খবর আনন্দের হলেও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই তখনও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারেনি । বিবিসি-এর পরবর্তী সংবাদে বলা হয় যে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে উক্ত বিমানটি ঐদিন সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে লন্ডনের হিথরো বিমান বন্দরে পৌছেছে । লন্ডন বিমান বন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে বৃটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিসের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এবং লন্ডনের হোটেল ক্লারিজে তার জন্যে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে । এই খবর প্রচার হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাছের ও পরিবারবর্গ, চার বোন ও তাদের পরিবারবর্গ এবং ঢাকায় অবস্থানরত অন্যান্য নিকট আত্মীয়-স্বজন আমাদের ধানমন্ডির ঐ ১৮ নম্বর রোডের বাসায় ছুটে আসেন । তখন সকলের দু’চোখ ভরে উঠেছিল আনন্দাশ্রুতে । ঐ দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় । প্রথমে কথা বলেন আমার শাশুড়ী । এরপর বঙ্গবন্ধু এক এক করে বাসায় উপস্থিত সকলের সঙ্গে কথা বলেন । ঐ দিন সন্ধ্যেয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দেখা করেন ।
৭। পরদিন, অর্থাৎ ৯ই জানুয়ারী ( ১৯৭২ ) সকালে শাশুড়ী বলেন যে, আমি যেন তাজউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর ১০ই জানুয়ারী তারিখে দেশে ফেরার সময়সূচী সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি । তাই সকাল ১০টার দিকে সুলতান শরিফকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে তাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে এবিষয়ে আলাপ করতে যাই । তাজউদ্দিন সাহেব তখন বঙ্গভবনের দোতলার কোণাস্থ খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের ময়জুদ্দিন আহমেদ, গাজী গোলাম মোস্তফা এবং আরও দু’জন নেতার সঙ্গে আলাপ করছিলেন । আমাদের দেখে তাজউদ্দিন সাহেব আওয়ামী লীগ নেতাদের বিদায় জানিয়ে পাশের ড্রইং রুমে আমাদের নিয়ে বসেন । শাশুড়ীর কথা তাঁকে জানালে তাজউদ্দিন সাহেব বলেন যে, তিনি দুপুরের দিকে আমাদের বাসায় গিয়ে শাশুড়ীর সঙ্গে আলাপ করে বঙ্গবন্ধুর ফেরার সময়সূচী চূড়ান্ত করবেন ।
৮। ঐ দিন তাজউদ্দিন সাহেব শাশুড়ীর সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্যে আমাদের বাসায় আসেন ১টার দিকে । তাজউদ্দিন সাহেব শাশুড়ীকে জানান যে, ইতিপূর্বে লন্ডন ও দিল্লীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার ব্যাপারে একটি সময়সূচী তৈরী করা হয়েছে । ঐ সময়সূচী অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু একটি বিশেষ বৃটিশ বিমানে ৯ই জানুয়ারী রাতে লন্ডন ত্যাগ করবেন এবং পরদিন দুপুরের দিকে দিল্লী পৌঁছাবেন । দিল্লীতে ঘটাখানেকের জন্যে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে কোলকাতা পৌছে সেখানে এক ঘন্টা যাত্রাবিরতি করে বিকেল ৪টার দিকে ঢাকা পৌঁছাবেন । ঢাকায় পৌছানোর পর বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান )-এ জনসভায় ভাষণ দেবেন । ঐ দিন কলকাতাতেও যাত্রাবিরতি করলে ঢাকায় রেসকোর্সের সভাস্থলে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে, এই ভেবে শাশুড়ী তাজউদ্দিন সাহেবকে কলকাতার কর্মসূচী বাতিল করার পরামর্শ দেন । দ্বিতীয়তঃ দিল্লীতে বিমান পরিবর্তন করলে বৃটেনের জনগণ মনঃক্ষুন্ন হতে পারেন সে কারণে এই বৃটিশ বিমানেই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসা সমীচীন হবে বলে শাশুড়ী মন্তব্য করেন । এ কথা শোনার পর তাজউদ্দিন সাহেব দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ডি.পি. ধরকে টেলিফোন করে শাশুড়ীর মতামত তাকে অবহিত করেন । অতঃপর সাব্যস্ত হয় যে, লন্ডন থেকে ঢাকা ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু শুধু দিল্লীতে এক ঘন্টার জন্য যাত্রাবিরতি করে একই বিমানে দিল্লী থেকে সোজা ঢাকা আসবেন ।
৯। ১০ই জানুয়ারী ( ১৯৭২ ) দুপুরের দিকে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমান ‘কমেট’ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করে । দিল্লীর লাখো জনতা, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ, সেনাবাহিনীর তিন প্রধান, শীর্ষস্থানীয় নেতা ও বৈদেশিক কূটনৈতিকবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জানান । সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ অসুস্থতার জন্যে দিল্লীতে ছিলেন না । তিনি বঙ্গবন্ধুকে এ যুগের সবচাইতে বড় অহিংস গান্ধীবাদী নেতা বলে আখ্যায়িত করে তার জন্যে শুভেচ্ছা বার্তাসহ ফুলের মালা পাঠিয়েছিলেন পালাম বিমান বন্দরে । অভ্যর্থনা পর্ব শেষে, সেখানে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু । বিমান বন্দরে সমবেত হাজার হাজার মানুষের সুবিধার্থে সেখানে মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের প্রতি ভারতের সর্বাত্মক সমর্থনের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তারা বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়েছিলেন । রণাঙ্গনে ভারতের হাজার হাজার সৈন্য প্রাণ দিয়েছে, হাজার হাজার সৈন্য আহত হয়ে জীবনের অনেক কিছু হারিয়েছে ।” ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তিনি বহু দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন এবং অনেক দেশের নেতাদের টেলিগ্রামের মাধ্যমে অনুরোধ করেছেন আমার মুক্তির জন্যে পাকিস্তান সামরিক জান্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে ।” বাংলাদেশ ও ভারতের আদর্শগত মিলের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ।” তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তানীরা যখন আমাকে আমার জনগণের মাঝ থেকে ( বন্দী করে ) নিয়ে যায়, অনেক কেঁদেছিল তারা । আমার বন্দিত্বের সময় সেই কেদে ওঠা মানুষগুলো ঝাপিয়ে পড়েছিল জীবনযুদ্ধে । আর আমি যখন দেশে ফিরে যাচ্ছি তখন তারা বিজয়ী । লক্ষ লক্ষ বিজয়ী মুখের হাসির মাঝে আমি ফিরে যাচ্ছি । এক জীবনব্যাপী বন্দিত্ব থেকে আমি ফিরে যাচ্ছি মুক্ত, স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশে । সামনে যে ব্যাপক কাজ পড়ে রয়েছে সেখানে আমার জনগণের সঙ্গে তা সম্পন্ন করবার সংকল্প নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার দেশে- বাংলাদেশে । সামনে যে পথ আমরা রচনা করবো তা হবে শান্তির এবং প্রগতির পথ । কারো জন্যে কোন ঘৃণা বুকে নিয়ে আমি ফিরছি না । মিথ্যার ওপরে সত্যের জয়, অশুচিতার উপরে শুচিতার জয়, অন্যায়ের
(Unicoded by Mehedi Hasan linkon)

পৃষ্ঠাঃ ১১৮
বিরুদ্ধে ন্যায়ের জয় এবং সর্বোপরি অশুভ ও অসত্যের ওপরে সার্বজনীন সত্যের বিজয়ের প্রেক্ষাপটেই আমি ফিরে যাচ্ছি আমার নিজের দেশে রক্তস্নাত ও শুচিতায় উদ্ভাসিত স্বাধীন বাংলাদেশে। পরিশেষে, ভারতের জনগণ ও সরকারকে পুনরায় ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “ভারত হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। কৃতজ্ঞতার কোন ভাষা আমার নেই।”
১০। ১০ই জানুয়ারী (১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর শুভাগমনের খবর শুনে সারা ঢাকার মানুষ আনন্দ ও উচ্ছ্বাস-উল্লাসে ফেটে পড়ে। সকালে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে পড়ে। দলে দলে কিশাের, যুবক ও বৃদ্ধ, ফেষ্টুন, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ” সম্বলিত ব্যানারসহ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে রেসকোর্স ও তেজগাঁও বিমান বন্দরের দিকে আসতে থাকে। দুপুরের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের সমাগমে সারা রেসকোর্স ময়দান ভরে যায়। রেসকোর্স ময়দান থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সারা রাস্তা হয়ে যায় ললাকে লােকারণ্য। বিমান বন্দরের ভেতরেও হাজার হাজার লােক অবস্থান নেয়। এত জনতার সমাবেশ ইতিপূর্বে কখনও ঘটেনি। মুশকিলে পড়লেন পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর লােকেরা। ইতিমধ্যে একটা গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল যে, বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্সে আসবার পথে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হতে পারে। একে যথেষ্ট গুরুত্ব দেবারও দরকার ছিল, কেন না রাজাকার, আলবদর, আলশামস্-এর ধর্মোন্মত্ত পাকিস্তানী বহু এজেন্ট তখনাে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নিরাপত্তা বিভাগের পরামর্শ ছিল বঙ্গবন্ধুকে আর্মাড় কারে অথবা সম্ভব হলে ট্যাংকে করে এয়ারপোের্ট থেকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসার জন্যে। ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা দ্রুত মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে, এ দায়িত্ব নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে তাদেরই বেশী। অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে আলােচনা করে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার সমস্ত দায়িত্ব তারা নিল। এয়ারপাের্ট থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত পুরাে রুটেই তারা অবস্থান নিল। বিভিন্নভাবে অবস্থান নিয়েছিল তাঁরা। গুরুত্বপূর্ণ, কম গুরুত্বপূর্ণ নির্বিশেষে সবগুলাে জায়গাতে গিয়ে এবং জনতার সঙ্গে মিশে তাঁরা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল।
১১। বিকেল ৩টায় বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ (সাদা কমেট) বিমানটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেজগাঁও বিমান বন্দরে অবতরণ করে। এরপর সেখানে সমবেত লাখ লাখ জনতা আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাঁরা শােকরানা জানায় মহান আল্লাহ তালার দরবারে। বিমান বন্দরের ভেতরেও ছিল হাজার হাজার মানুষ। বিমান থেকে অবতরণের সিড়ির মুখে কোন রকমে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণ। তােফায়েল আহমদ, শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদুস মাখন, আ.স.ম. আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ এক এক করে বিমানে উঠে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে তাঁকে মাল্যভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুসহ প্রত্যেকে ফুপিয়ে কেঁদেছিলেন। এয়ারপোের্ট থেকে একটি ডজ ট্রাকে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে নেয়ার

পৃষ্ঠাঃ ১১৯
ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও ছাত্রনেতাসহ প্রায় বিশ-পঁচিশ জন ট্রাকের উপর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ছিলেন। হৃদয়ের গভীর থেকে মানুষের চওড়া গলায় তালে তালে ভেসে আসতে থাকে শুভাশীষ ধ্বনি, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, জয় বাংলা।” লােকের প্রচণ্ড ভিড়ে গাড়ীটি অতি মন্থর গতিতে রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগােয়। তেজগাঁও বিমান বন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত এতটুকু রাস্তা অতিক্রম করতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় লেগে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ঐ ট্রাকটি রেসকোর্স ময়দানের জনসভাস্থলে পৌছায় পৌনে পাঁচটার দিকে। বঙ্গবন্ধুর গলায় তখন এত ফুলের মালা যে তাঁকে আর দেখাই যাচ্ছিল না।
১২। ব্রেসকোর্সে পৌছতেই বঙ্গবন্ধু দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেলেন। ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা বুহ্যের মতাে করে তাঁকে বেষ্টনীতে নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সভা মঞ্চে উঠে তােফায়েল আহমদ বললেন, “ভাইসব, বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি আপনাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্যে দয়া করে প্রত্যেকে বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আপনার আশেপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনীর হাত যে কোন জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে। কড়া নজর রাখবেন।” এর একটু পরেই মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। উত্তেজনায় সবার নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগলাে। পুরাে রেসকোর্স ময়দান রা মানুষগুলাে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, সামনে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই দেখছেন। উত্তেজনায় উদ্বেল আনন্দধ্বনি ক্রমশঃই বেড়ে চললাে। ঐ অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে রইলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু বললেন, “১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এই ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলাদেশের মানুষ সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন। আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই এই ঐক্য বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙ্গালীও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে।” অতঃপর বঙ্গবন্ধু ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আজ সােনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশয়হারা। তাঁরা নিঃসঙ্কল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি বাংলাদেশের এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসতে অনুরােধ করছি। আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। যুদ্ধ চলাকালে রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে গেছে, শত শত সড়ক-পুল, রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার স্কুল-কলেজ, কল-কারখানা, দোকান-পাট হানাদার পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর লােকেরা ধ্বংস করে দিয়েছে। অফিস, ব্যাংক

পৃষ্ঠাঃ ১২০
ট্রেজারীগুলাে লুট করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জেলখানায় তাঁর বন্দীদশা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আপনারা জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশে আমার জন্যে কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করবাে না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলবাে, আমি বাঙ্গালী, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।”
১৩। এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইয়েরা, আপনাদের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নাই। আমি কামনা করি আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী আমাদের লাখ লাখ লােককে হত্যা করেছে, লাখ লাখ মা-বােনদের মর্যাদাহানি করেছে, আমাদের গ্রামগুলাে বিধ্বস্ত করেছে। তবুও আপনাদের প্রতি আমার কোন আক্রোশ নাই।” বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় নীতি কি হবে তা ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরেই এর স্থান। মুসলিম সংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের স্থান তৃতীয় এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে, আমাদের নারীদের বে-ইজ্জত করেছে। ইসলাম ধর্মের অবমাননা আমরা চাই না। আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে। যার যা ধর্ম তা স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পালন করবে।” দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত আলাপের কথা উল্লেখ করে অতঃপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে আমি দিল্লীতে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলাে নিয়ে আলাপ করেছি। আমি যখনই চাইবাে, ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তাঁর সৈন্যবাহিনী তখনই প্রত্যাহার করে নেবেন। ইতিমধ্যেই ভারতীয় সৈন্যের একটা বিরাট অংশ বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে দেয়া হয়েছে।”
১৪। এরপর মুক্তিযুদ্ধে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “প্রায় এক কোটি মানুষ- যাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং বাকী যারা দেশে রয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা সবাই অনেক দুঃখ-কষ্ট ভােগ করেছেন। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, সেই বীর মুক্তিবাহিনী, ছাত্রকৃষক-শ্রমিক সমাজ, বাংলার হিন্দু-মুসলমান, ইপিআর, বেংগল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী ও নাম না জানা লাখ লাখ নর-নারী তাঁদের সবাইকে আমার সালাম জানাই। আপনাদের মুজিব ভাই আহবান জানিয়েছিলেন আর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে

পৃষ্ঠাঃ ১২১
এনেছেন”। বক্তৃতার এই পর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “রেখেছে বাঙ্গালী করে মানুষ করােনি” উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধু বললেন, “এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালী পুড়ে সােনার মানুষ হয়ে উঠেছে। কবিগুরুর খেদোক্তির জবাবে আপনারা প্রমাণ করেছেন যে, বাঙ্গালী বীরের জাতি। পৃথিবীর কোন শক্তিই আমাদের পদানত করতে পারবে না।”
১৫। দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করার সংকল্প ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকেরা করে না। কাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না, করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন খাদ্য পায়, বস্ত্র পায়, বাসস্থান পায়, শিক্ষার সুযােগ পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।” অতঃপর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্তি পাবার পূর্বে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর যে আলাপ হয়েছিল তার প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধু বলেন, পাকিস্তানের কারাগার থেকে আমি যখন মুক্ত হই, তখন জনাব ভুট্টো আমাকে অনুরােধ করেছিলেন, সম্ভব হলে আমি যেন দু’দেশের মধ্যে একটা (লুস কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে) শিথিল সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আমার জনসাধারণের নিকট ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবাে না। এখন আমি বলতে চাই, জনাব ভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে শান্তিতে থাকুন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায়, তাহলে এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে শেখ মুজিব সর্বপ্রথম প্রাণ দেবে।” পরিশেষে, জাতিসংঘ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতাদের প্রতি অনুরােধ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে নির্বিচার গণহত্যা করেছে, তার অনুসন্ধান ও ব্যাপকতা নির্ধারণের জন্যে আমি জাতিসংঘের নিকট একটা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করার আবেদন জানাচ্ছি। আমি বিশ্বের সকল মুক্ত দেশকে অনুরােধ জানাই, আপনারা অবিলম্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে সীকৃতি দিন এবং সত্বর বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্য করে নেয়ার জন্যে সাহায্য করুন। জয় বাংলা।”
১৬। রেসকোর্স ময়দানের জনসভা শেষে, সদলবলে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মাজার জেয়ারত ও সেখানে পুষ্পস্তবক এবং শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বঙ্গবন্ধু আমাদের ধানমন্ডির (পুরাতন) ১৮ নম্বর নতুন ৯/এ নম্বর) বাসায় আসেন সাড়ে ছয়টার দিকে। ইতিপূর্বে তাঁর আব্বা-আম্মা, ভাই-বােন ও তাঁদের ছেলে-মেয়েরা এবং তার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ঐ বাসায় এসে সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এক এক করে তাঁকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই সারাক্ষণ কাঁদছিলেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এরপর ঐ বাসায় শাশুড়ী ও আমার শয়নকক্ষের মাঝখানের ড্রেসিং রুমে বঙ্গবন্ধু, শেখ ফজলুল হক মণি,

পৃষ্ঠাঃ ১২২
সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ এবং আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় বসেন। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ছাত্রনেতারা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোলকাতায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মােজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী), কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের ভূমিকা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করেন। তাঁরা মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন এলাকার দায়িত্বে নিয়ােজিত সেক্টর কমান্ডারদের মতাদর্শ ও ভূমিকা সম্পর্কেও বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। সবশেষে, ঐ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর কি কি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়ােজন তৎসম্পর্কে তাঁরা তাঁকে পরামর্শ দেন। ঐ সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তারার অধীনস্থ জোয়ানরা ঐ বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন উক্ত চার ছাত্রনেতার সঙ্গে আলাপ করছিলেন তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অনেক ছাত্র-যুবক ঐ বাড়ীর ছাদে উঠে পটকা ও অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনন্দ উল্লাস প্রছিল। এ ছাড়াও সারা ধানমন্ডী ও ঢাকা শহরের অন্যান্য এলাকাতেও মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য ছাত্র-যুবকেরা পটকা ও অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে জমােচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিল। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বাড়ীর ছাদের গােলাগুলি বন্ধ করার আদেশ করলেন। একই সঙ্গে অন্যান্য এলাকায়ও সর্বপ্রকার গােলাগুলি অবিলম্বে বন্ধ করার জন্যে তিনি ছাত্রনেতাদের প্রতিও নির্দেশ দিলেন।
১৭। চার ছাত্রনেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলাপ শেষ হয় রাত প্রায় ৯টার দিকে। ততক্ষণে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার জন্যে ঐ বাসায় ডিউটি দিতে আসেন বাংলাদেশ পুলিশের ১৫-২০ জন সদস্য। তাঁরা ঐ বাড়ীর সামনের বাড়ীর চত্বরে অবস্থান নেয়া শুরু করেন। ধানমন্ডীর (পুরাতন) ১৮ নম্বর রােডস্থ ২৩ নম্বর দোতলা বাড়ীটি শাশুড়ী ভাড়া নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত পাকিস্তান সরকার নিয়েছে ঐমর্মে ৪ঠা জানুয়ারী (১৯৭২) তারিখে জুলফিকার আলীর ঘােষণা শােনার পর। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর (পুরাতন) ৩২ নম্বর (নতুন ১১ নম্বর) ব্লোডস্থ বাড়ীটির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লােকেরা ২৫শে মার্চ (১৯৭১) রাতে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। ঐ বাড়ীটিকে পুনরায় বাসােপযােগী করে নিতে প্রচুর অর্থ ও সময়ের প্রয়ােজন হবে সে বিষয় চিন্তায় রেখে শাশুড়ী ধানমন্ডীর ১৮ নম্বর ব্রোডস্থ এই বাড়ীটি ভাড়া নিয়েছিলেন। রাত ৯টার দিকে ঐ বাড়ীটিতে আসবাবপত্র নেয়া হচ্ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর তারা তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু মেজর তারাকে বললেন, ‘আমি এখন নিজের দেশে ফিরেছি। আমার দেশে আমার নিরাপত্তার জন্যে আপনাদের দুশ্চিন্তা করার প্রয়ােজন নেই। রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে আপনাদের লােকজন নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়েছেন। এখন তাঁদের বিশ্রামের প্রয়ােজন। অতএব এক্ষণি আপনি আপনাদের লােকজনদের এই বাড়ীর ডিউটি থেকে প্রত্যাহার করে নিন। প্রথমে মেজর তারা এটাসেটা বলে একটু আপত্তি করেছিলেন বটে কিন্তু বঙ্গবন্ধু পুনরায় একই উক্তি করায় তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর বাহিনীর জোয়ানদের সেখান থেকে প্রত্যাহার করে নেন।

১৮. ১১ মার্চ (১৯৭২) সকালে খাওয়ার টেবিলে বঙ্গবন্ধু একা নাস্তা খাচ্ছিলেন। শ্বাশুড়ি সেখানে ছিলেন না। আমিও নাস্তা খাওয়ার জন্য তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। বঙ্গবন্ধুকে একান্তে পেয়ে গত রাতের চার ছাত্রনেতার সঙ্গে তাঁর আলাপের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললাম “বিরাজিত পরিস্থিতির কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত এবং তা বলবত না হওয়া পর্যন্ত আপনার হাতে যুগপৎ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব রাখা সমীচীন হবে। উপরন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও আপনার হাতে রাখা দরকার।” আমার কথাগুলো শেষ না হতেই বঙ্গবন্ধু কিছুটা রাগান্বিত হয়ে আমাকে বললেন, “বাবা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তুমি কোলকাতায় ছিলে না। কাজেই তুমি বর্তমানের রাজনীতির রহস্য বুঝবে না। আমরা সুদীর্ঘকাল সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করেছি। সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় আমরা অংগীকারাবদ্ধ। ১৯৭০-এর নির্বাচনেও জনগণ এর জন্যে বিপুল ম্যানডেট দিয়ে আমাদেরকে নির্বাচিত করেছেন। তুমি তোমার বিজ্ঞানের কাজ কর। রাজনীতি নিয়ে এখন তোমার মাথা ঘামানোর কোন দরকার নেই।” তাঁর এই বক্তব্য শোনার পর আমি আর কিছু বলার সাহস করি নি। অতঃপর বঙ্গবন্ধু শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গভবনে চলে যান।
১৯. সেদিন টেলিভিশনে রাত ৮ টার সংবাদে বলা হয় যে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করার লক্ষ্যে একটি অস্থায়ী শাসনতান্ত্রিক আদেশ জারি করা হয়েছে৷ পরদিন,অর্থাৎ ১২ই জানুয়ারী (১৯৭২) তারিখে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি পদের ইস্তফা দেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে মন্ত্রিপরিষদে ব্যাপক রদবদল ঘটান। আওয়ামী লীগের অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে নিয়োগ করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রী, জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক মন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে যোগাযোগ বিষয়ক মন্ত্রী, জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদকে সেচ ও পানি সম্পদ বিষয়ক মন্ত্রী, জনাব এ.এইচ.এম কামরুজ্জামানকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রী, জনাব আব্দুল মালেক উকিলকে স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী এবং ডঃ কামাল হোসেইনকে আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী। একই তারিখে বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমদকে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিষয়ক সচিব এবং পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে নির্বাচিত ছাত্রলীগের এককালীন সভাপতি এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনাব রফিকউল্লাহ চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারী নিয়োগ করেন। পরের দিন রফিকউল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে বলেন যে, চাকরিতে জ্যেষ্ঠতার বিবেচনায় তাঁকে ওই পদে নিয়োগ করা যায় না। যাহোক, এর কিছুদিন পর তাঁর পদমর্যাদা প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারী হিসেবে পুনঃনির্ধারণ করা হয়। ১২ই জানুয়ারী পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ার সরকারদ্বয় এবং ১৩ই জানুয়ারী ঘানার সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
২০. ১৪ই জানুয়ারী (১৯৭২) তারিখে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দেশে গণতান্ত্রিক পথে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা করেন। উক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি আরো বলেন যে, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাদেশের নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করা হবে এবং অতি শিগগির তদুদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হবে৷ খসড়া সংবিধানে বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্যে প্রস্তাবিত গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান করার ব্যাপারে প্রয়োজনের চাইতে এক মুহুর্তও বিলম্ব করা ঠিক হবে না বলে বঙ্গবন্ধু তাঁর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। পরিশেষে তিনি ঘোষণা করেন যে রাষ্ট্রীয় নীতির মূল ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারী দিল্লিতে এমনকি রেসকোর্স ময়দানের জনসভার ভাষণেও এ তিন নীতিকেই রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সুতরাং ১৪ই জানুয়ারীর সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ‘জাতীয়তাবাদ’-এর নীতিকে রাষ্ট্রীয় মূল নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
২১. ১৫ই জানুয়ারী (১৯৭২) তারিখে এক সরকারী আদেশে দেশের সর্বত্র মদ, জুয়া, হাউজি, ঘোড়দৌড়ে জুয়া খেলার ব্যবসা ইত্যাদি অনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে রমনার রেসকোর্স (ঘোড়দৌড়) ময়দানকে একটি বিশেষ উদ্যানে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে এর নতুন নামকরণ করা হয় “সোহরাওয়ার্দী উদ্যান”। ১৬ই জানুয়ারী নেপাল সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। দেশে যাতে আইনসিদ্ধ বাহিনী ছাড়া অন্য কারো নিকট অস্ত্র-শস্ত্র না থাকে সেজন্যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত মুক্তিবাহিনী,মুজিব বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের অস্ত্র শস্ত্র এবং বিশেষ করে যে কোন অবৈধ অস্ত্র-শস্ত্র দশদিনের ভেতর যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট জমা দেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয় ১৭ই জানুয়ারী। ২০শে জানুয়ারী যুগোস্লাভিয়ার সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২২শে জানুয়ারী বাংলাদেশ সরকার অবৈধ অস্ত্র-শস্ত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা ৩১শে জানুয়ারী পর্যন্ত বর্ধিত করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানী বাহিনীকে যারা গণহত্যা, লুন্ঠন, নারী মর্যাদাহানির কাজে সহযোগিতা ও সহায়তা করেছিল তাদের বিচার করার উদ্দেশ্যে দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ (১৯৭২) জারি করা হয় ২৪শে জানুয়ারী। একই দিনে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ” কাদেরিয়া বাহিনী”-এর সদস্যরা টাঙ্গাইলে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে তাদের যাবতীয় অস্ত্র-শস্ত্র জমা দেয়। ২৫শে জানুয়ারী (তৎকালীন) সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চেকোশ্লোভাকিয়ার সরকারদ্বয় বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২৯শে জানুয়ারী সরকার ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ৩০শে জানুয়ারী পল্টন ময়দানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা তাদের অস্ত্র-শস্ত্র জমা দেয়। সর্বশেষ, ৩১শে জানুয়ারী পল্টনস্থ স্টেডিয়ামে আয়োজিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে অস্ত্র-শস্ত্র জমা দেয় মুজিব বাহিনীর সদস্যরা।
২২. মুক্তিযুদ্ধ শেষে ভারত থেকে দেশে ফেরার পথে ২১শে জানুয়ারী (১৯৭২) তারিখে আসামের ফরিদগঞ্জে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী বললেন, “মিসেস গান্ধীর মত দয়ালু মানুষ হয় না। বাংলাদেশের জনগণ এই মহিয়সী নেত্রীর এবং ভারতের জনগণের সহানুভূতির কথা কোনদিন বিস্মৃত হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।” অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে ৭ই জানুয়ারী মুক্তি দেওয়ার সময় জনাব ভুট্টো পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে (কনফেডারেশনের মত) একটা শিথিল সম্পর্ক রাখার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তার প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানী বললেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে কিছু একটা যোগসূত্র রাখার জন্য ভূট্টো সাহেব শেখ মুজিবকে অনুরোধ করেছেন। আমি তাঁকে (জনাব ভূট্টোকে) বলে দিতে চাই, এটা শুধু আজকের জন্যেই অসম্ভব ব্যাপার নয়, অনাগত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটা অসম্ভব ব্যাপার থাকবে। বাঙ্গালীরা পাকিস্তানীদের বর্বরতার কাহিনী কোনদিনই ভুলতে পারবে না।”
২৩. জানুয়ারী (১৯৭২)-এর শেষ সপ্তাহে একদিন আমার বন্ধু ডঃ ইসহাক তালুকদার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আমার ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রের অফিসে আসে। তাকে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। কুশলাদি বিনিময়ের পর অত্যন্ত বেদনাহত হৃদয়ে সে আমাকে জানায় যে, আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাশুকুর রহমান আর ইহজগতে নেই। উল্লেখ্য যে, মাশুকুর রহমান টোজো পদার্থ বিজ্ঞান ও অংক শাস্ত্রে ডাবল অনার্সসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠি ছিল। মাশুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের অনাবাসিক ছাত্র এবং ছাত্র ইউনিয়নের একজন বিশিষ্ট সদস্য ও কর্মী ছিল। এম. এস. সিতে আমরা থিসিস গ্রুপে একই সঙ্গে পড়তাম। ১৯৬১ সালে ফজলুল হক হলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সময় আমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সহ-সভাপতির প্রার্থী হওয়ায় সে এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল। হল ছাত্রদের মধ্যে আমার বিরুদ্ধে সরাসরি ক্যানভাস করা দৃষ্টিকটু হবে বিবেচনায় সে তার দল (ছাত্র ইউনিয়ন)-এর সহ-সভাপতি পদপার্থীর পক্ষে মুখে কিছু না বলে “সৈয়দ আহমদকে ভোট দিন” সম্বলিত পোস্টার পিঠে লাগিয়ে সারাদিন হল চত্বরে ঘোরাফেরা করে ক্যানভাস করত৷ নির্বাচনী প্রচারণা শেষে প্রতি রাতে অবশ্য মাশুক আমার গেস্ট হিসেবে হলে আমার সঙ্গে খেতো। পরবর্তীতে সে লন্ডন থেকে এ্যাকচিউএ্যারী অংক শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি করে ১৯৭০ সালে দেশে ফিরে তৎকালীন ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানীতে উচ্চ পদে চাকরী পেয়ে উক্ত কোম্পানির চিটাগাং অফিসে পদস্থ হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি অসহযোগ আন্দোলনের সময় সে অফিসের গাড়ী নিয়ে ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর বাসায় আমার সঙ্গে দেখা করে৷ মাশুকের এক ছোট ভাই ও বোন ছিল। ওদের আব্বা হাবিবুর রহমান ছিলেন যশোরের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত এডভোকেট। মাশুকের আম্মা মারা যান যখন ওর বয়স হয়েছিল মাত্র সাত বছর। বঙ্গবন্ধু ওদের আব্বাকে ভালোভাবে জানতেন। ঐ সময়ের অসহযোগ আন্দোলন কোন দিকে মোড় নিতে পারে তৎসম্পর্কে পরিস্থিতি যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে মাশুক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে আমি তার ব্যবস্থা করি। সাক্ষাতের সময় বঙ্গবন্ধু ওর আম্মা ও ভাই-বোনদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন এবং ওকে খুব আদর করেন। ১৮ই মার্চ মাশুক ওর আম্মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা করতে যশোরে গিয়েছিল। ২৫শে মার্চ (১৯৭১) রাতে পাকিস্তান আর্মীর লোকেরা ওদের বাসা থেকে ওকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে ভীষণ মারধর করে। আসলে পাকিস্তানি আর্মীরা ওদের বাসায় আক্রমণ করেছিল ওর ছোট ভাই খালেদুর রহমান টিটোকে গ্রেফতার করার জন্যে। কারণ টিটো তখন নক্সালপন্থী কর্মকান্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল বলে তাদের কাছে তথ্য ছিল। যাহোক, পরদিন মাশুককে তারা ছেড়ে দেয় এই শর্তে যে, সে ওর ছোট ভাইকে আর্মীর নিকট সোপর্দ করবে। ছাড়া পেয়ে মাশুক ভারতে পালিয়ে গিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। একদিন অপর চারজন সঙ্গী নিয়ে মাশুক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটির ওপর গেরিলা তৎপরতা চালিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরছিল। পথে এক জঙ্গলে ঘুমিয়ে থাকার সময় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর দালাল রাজাকারের লোকেরা পাকিস্তানি আর্মীকে ওদের অবস্থানের কথা জানালে আর্মীর এক দল ওদের ঘেরাও করে অতর্কিত আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনাদের ঐ আক্রমণে মাশুকসহ তিনজন মৃত্যুবরণ করে, ওদের মাত্র একজন কোনরকমে পালিয়ে বেঁচে যায়।
২৪. ঐ দিন ডঃ ইসহাক তালুকদার আমাকে আরো জানায় যে, কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের দলসহ পিকিং (বর্তমান বেইজিং)-পন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও কর্মীদের নিধন করা হবে বলে মুজিব বাহিনীর কর্মীরা হুমকি দিয়েছে। যার ফলে সম্ভাব্য হানাহানি ও রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে ঐ দলগুলোর নেতা ও কর্মীরা লুকিয়ে থাকছেন। তার এ তথ্য আমার বিশ্বাস করা প্রায় অসম্ভব ছিল, কারণ কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের মত নেতারা অতীতে অনেক রাজনৈতিক ও দাবি আদায়ের ইস্যুতে বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি সমর্থন ও সহায়তা করেছিলেন। দ্বিতীয়তঃ সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁরাও লড়েছিল। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশে স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। যা হোক, আমি ডঃ ইসহাক তালুকদারকে জানাই যে, কাজী জাফর, রাশেদ খান মেনন ও হায়দার আকবর খান রনো যেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে তাঁকে অবহিত করেন। অতঃপর ডঃ ইসহাক তালুকদার চলে যায়। এর দু’দিন পরের ঘটনা। আমি তখনো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডির (পুরাতন) ১৮ নম্বর (নতুন ৯/এ) রোডস্থ ২৩ নম্বর ভাড়াকৃত বাসায় থাকতাম। ঐ দিন সকালে অফিসে যাওয়ার জন্যে গাড়ী চালিয়ে ঐ বাসা থেকে বের হচ্ছিলাম। গেটে দেখি যে, অন্যান্য দর্শনার্থীর সঙ্গে কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেনন রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমি তৎক্ষণাৎ গাড়ী থেকে নেমে ওঁদের কাছে যাই। ওঁরা দুজন আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন যে, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি তাঁদের নীচে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করার জন্যে উপর তলায় চলে যাই। বঙ্গবন্ধু তখন ফজলুল হক মণির সঙ্গে তাঁর শয়ন কক্ষে আলাপ করছিলেন। কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননের কথা বলার পর বঙ্গবন্ধু আমাকে তৎক্ষণাৎ তাঁদের উক্ত কক্ষে নিয়ে আসতে বললেন। আমি কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননকে সেখানে নিয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু তাঁদের দু’জনকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধু তাঁদের বললেন, “তোমরা অতীতেও আমাকে বহু রাজনৈতিক ইস্যুতে সমর্থন ও সহায়তা করেছো। মুক্তিযুদ্ধেও তোমরা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছো। সদ্য মুক্ত স্বাধীন দেশ এখন সর্বদিক দিয়ে বিধ্বস্ত। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা এবং সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতাকে সুসংহত করার কাজে তোমাদের সমর্থন ও সহযোগিতা আমার একান্ত প্রয়োজন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এ ব্যাপারে তোমরা সবাই আমাকে সর্বপ্রকারে সমর্থন ও সহায়তা করবে। তাছাড়া তোমরা তো এদেশেরই সন্তান, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তোমাদেরও লক্ষ্য। দেশপ্রেমিক নেতা হিসেবে এ ব্যাপারে তোমরা তোমাদের নৈতিক দায়িত্ব এড়াতে পারো না।” এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাদের গোপনীয় আলাপ রয়েছে বলে জানালে আমি তাঁদের সেখানে রেখে অফিসে চলে যাই।
২৫. দীর্ঘ নয়মাস যুদ্ধে সবদিক দিয়ে বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করা ছিল একটি অপরিসীম কঠিন দায়িত্ব। এর আগে বাংলাদেশ পাকিস্তানের একটি অংশ থাকায় এ দেশের প্রায় প্রতি সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনার প্রধান কার্যালয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত এবং সেখানে থেকে নিয়ন্ত্রিত। সারা দেশের রাস্তা-ঘাট, সেতু-বন্দর, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, কল-কারখানা, কয়েক কোটি পরিবারের বাড়ী-ঘর, যুদ্ধ ও পাকিস্তানি সেনা ও তাদের দোসর-দালাল, রাজাকার, আলবদর, আল শামস ও অন্যান্য বাহিনীর অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের তান্ডবলীলায় হয়েছিল বিধ্বস্ত। প্রায় এক কোটি বাংলাদেশের লোক বাড়ী-ঘর, ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর-দালালদের হাতে অত্যাচারিত, নির্যাতিত এবং সর্বোপরি নিহত হওয়া থেকে বাঁচার জন্যে। সরকারী গাড়ী-বাস-ট্রাক, ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি, জাহাজ, হেলিকপ্টার, বেসামরিক বিমান, স্টীমার বিশেষ করে নদী পারাপারের জাহাজ প্রভৃতির সব কিছুই বিধ্বস্ত করেছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর-দালাল বাহিনীর লোকেরা। ব্যাংকে গচ্ছিত প্রায় সম্পূর্ণ নগদ টাকা-পয়সা, স্বর্ণ-রৌপ্য পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত ব্যাংক ও কার্যালয়ে
(Unicoded by – Samia Rahman)

পৃষ্ঠাঃ ১২৮
স্থানান্তরিত করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানী লােকেরা ৩রা ডিসেম্বর (১৯৭১) তারিখে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক পূর্বেই। ব্যাংকে রক্ষিত অবশিষ্ট টাকা। পয়সা, স্বর্ণ-রৌপ্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লােকেরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল ১৬ই ডিসেম্বর (১৯৭১) তারিখে আত্মসমর্পণের পূর্ব মুহূর্তে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন গােডাউন থেকে প্রায় তিরিশ লাখ টন খাদ্যশস্য পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করেছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা। অগ্নিসংযােগে ভস্মিভূত করেছিল অনেক খাদ্য গুদাম। পশ্চিম পাকিস্তানে পাচারকৃত বিরাট অংক ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যান্যভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ন্যূনতম তৎকালীন মুদ্রামানের এক হাজার কোটি টাকা। ঢাকায় কর্মরত আরড (UNROD)-এর হিসেব অনুসারে এই পরিসংখ্যাণ তখন সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়েছিল। তৎকালীন সরকারের হিসেবে জাতীয় পুনর্গঠনের জন্যে তখন অবিলম্বে প্রয়ােজন ছিল প্রায় পঁচাশি কোটি ডলার।
২৬। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে তখন বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্ব হয় বিভিন্ন কার্যক্রম ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমেঃ (১) প্রায় তিন কোটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে পুনর্বাসিত করা; (২) পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া প্রায় পাঁচ লাখ সামরিক-বেসামরিক বাঙ্গালীকে দেশে ফেরত আনা ও পুনর্বাসন করা; (৩) বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও ব্যবস্থাপনা গঠন করে সেগুলাের কর্মকান্ডে দেশপ্রেমিক, অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ােগ করা; (৪) দেশে আইন শৃংঙ্খলা ও দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে কাজে নিবেদিত বিভিন্ন বেসামরিক, সামরিক ও অন্যান্য আইনসিদ্ধ সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা; (৫) দেশে সাংবিধানিক শাসন কায়েম ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়ন ও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের আয়ােজন করা ও দেশের বিভিন্ন সমস্যা মােকাবিলায় প্রয়ােজনীয় আইন বলবৎ করা; (৬) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর-দালাল, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও অন্যান্য সংগঠনের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশে গণহত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ ও ধ্বংসাত্মক কাজে নিজেরা সংগঠিত করা বা এ জাতীয় কাজে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে সহযােগিতা ও সাহায্য করার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা; (৭) স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বীকৃতি অর্জন করা ও বিভিন্ন আঞ্চলিক ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য লাভ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালানাে এবং (৮) পাকিস্তানের নিকট হতে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ এবং স্বাধীনতাপূর্ব সময়কালে বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদ আদায় করা। বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফিরে এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেই এ সমস্ত ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই বিষয়গুলাে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা ও সাধনায় সদাজাগ্রত ছিল।

পৃষ্ঠাঃ ১২১
২৭। ১লা ফেব্রুয়ারী (১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর সরকার পাকিস্তান আমলে বিশেষ করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন আমলে তঘমাপ্রাপ্ত ৫৩ জন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে চাকুরী হতে বরখাস্ত করে। প্রশাসনকে পাকিস্তানী দোসর-দালালদের কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এটা ছিল প্রথম পদক্ষেপ। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সকল সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলােকে বিলাস সামগ্রী বর্জন করার নির্দেশে দেওয়া হয় ২রা ফেব্রুয়ারী। একই দিনে বঙ্গবন্ধু সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলাের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি আহবান জানান তাঁদের প্রাপ্য বেতনের দশ শতাংশ সরকারের নিকট প্রত্যার্পন করার জন্যে। বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বানে সংশ্লিষ্ট সবাই সাড়া দেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী বৃটেন ও ফ্রান্সসহ আটটি দেশের সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৫ই ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল গঠন করে উক্ত তহবিলে মুক্ত হস্তে নগদ অর্থ, শিশু খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য যে কোন সামগ্রী দান করার জন্যে দেশের বিত্তবান জনগণ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ ও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি অনুরােধ জানান। একই সঙ্গে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি বৈরিতা নয়” বঙ্গবন্ধু সরকারের এই মূল সূত্রের ভিত্তিতেই দেশে দেশে চলতে থাকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় ও বন্ধুত্বের অন্বেষা।
২৮। জাতীয় পুনর্গঠনের প্রয়ােজনে ব্যাপক কর্মব্যস্ততা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ভারত সরকারের আমন্ত্রণে কোলকাতা সফরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে ১০ই জানুয়ারী (১৯৭২) তারিখে স্বদেশে ফেরার পথে ভারতের দিল্পী ছাড়াও কোলকাতায়ও বঙ্গবন্ধুর জন্য সংবর্ধনার আয়ােজন করা হয়েছিল। কিন্তু সময়াভাবে তখন সেখানে তার পক্ষে যাত্রাবিরতি করা সম্ভব ছিল না। যাহােক, দেশে ফেরার পর প্রথম সুযােগে বঙ্গবন্ধু ৬ই ফেব্রুয়ারী মাত্র এক দিনের সফরে কোলকাতায় গমন করেন। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্যে লাখ লাখ লােক বিমান বন্দর ও শহর থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত সারা রাস্তায় সমবেত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দমদম বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। কোলকাতার বিগ্রেড প্যারেড গ্রাউন্ডে স্মরণাতীতকালের এক বিরাট জনসমাবেশে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা ও সাহায্য প্রদান করায় ভারতীয় সরকার এবং জনগণের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের অভূদয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “কবি গুরু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছে বাঙ্গালী করে মানুষ করােনি। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকলে দেখতে পেতেন যে বাঙ্গালী মানুষ হয়েছে।” বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালােবাসা দিয়ে যাবাে তাই।” জনসভা শেষে, রাজভবনে ইন্দিরা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে প্রথম সুযােগে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য

পৃষ্ঠাঃ ১৩০
প্রত্যাহারের বিষয়টি উত্থাপন করেন। একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী উক্ত বিষয়ে এ পর্যায়ে বলেন, “বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি তাে এখনও পর্যন্ত নাজুক রয়েছে। পুরাে সিচুয়েশন’ বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়? অবশ্য আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই করা হবে।” যাহােক, এতদবিষয়ে আরও একটু বিস্তারিত আলাপের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ই মার্চ (১৯৭২) তারিখ থেকে ২৫শে মার্চ তারিখের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়া হবে। ৭ই ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত দুই প্রধানমন্ত্রীর এক যুক্ত ইশতাহারে গণ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, জোটনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ এবং সর্বপ্রকার বর্ণবাদ ও উপনিবেশিকতার বিরােধিতার নীতির আলােকে দুই দেশের জনগণের আশাআকাঙক্ষার বাস্তব রূপদানের সংকল্প এবং এই লক্ষ্যে দুই দেশের সরকার ও জনগণের মধ্যে শান্তিকামী, সৎপ্রতিবেশীসূলভ সর্বপ্রকার সম্ভাব্য সহযােগিতা বৃদ্ধির অঙ্গীকার ঘােষণা করা হয়। এরপর ৯ই ফেব্রুয়ারী কিউবা, ১০ই ফেব্রুয়ারী জাপান এবং ১৪ই ফেব্রুয়ারী কানাডা বাংলাদেশকে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।
২৯। ১৪ই ফেব্রুয়ারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা এডওয়ার্ড কেনেডী এক ব্যক্তিগত শুভেচ্ছা সফরে বাংলাদেশে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাঁকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানানাে হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বর্বরােচিত কার্যকলাপে ও গণহত্যার তীব্র নিন্দা করায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ক হয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে জাতীয় শহীদ দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “শােষণমুক্ত সােনার বাংলা কায়েমই আমাদের লক্ষ্য।” একই ভাষণে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে নিখোঁজ ও শহীদানের পরিবারবর্গের জন্যে তাঁর সরকারের সাহায্যদানের সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করেন। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছিল অনতিবিলম্বে সেখানে আটকেপড়া পাঁচ লক্ষ বাঙ্গালীকে বাংলাদেশে এবং এখানে আটকাপড়া পাঁচ লক্ষাধিক পাকিস্তানী অেবাঙ্গালী) নাগরিকদের পাকিস্তানে ফেরতের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে। ১৭ই ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ সরকারের উক্ত লােক বিনিময়ের প্রস্তাব নাকচ করে সেদেশে অবস্থিত বাঙ্গালীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রাখার কথা ঘােষণা করে। এরই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানে বাঙ্গালীদের আটকের প্রশ্নে উদ্বেগ প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের নিকট এক জরুরী তারবার্তা প্রেরণ করেন ২৩শে ফেব্রুয়ারী (১৯৭২) তারিখে। ২৫শে ফেব্রুয়ারী ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার সরকারদ্বয় বাংলাদেশকে একটি স্বন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৩০। ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নতুন ১১ নম্বর) রােডস্থ বাড়ীর মেরামত কাজ সম্পন্ন হলে তিনি তাঁর পরিবারবর্গসহ ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রােডস্থ

পৃষ্ঠাঃ ১৩১
ভাড়াকৃত বাড়ী ছেড়ে দিয়ে তাঁর নিজের বাড়ীতে চলে যান। আমি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডস্থ ৩ নম্বর বাড়ীর উপর তলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিই এবং হাসিনা ও আমাদের সন্তান জয়কে নিয়ে সেখানে চলে যাই। এই বাড়ীটির মালিক এক আধা-সরকারী দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জনাব আইনুল হক। এই পরিবার হাসিনাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। বেগম আইনুল হক হাসিনাদের দুরসম্পর্কের খালা হন। উক্ত বাড়ীটি মীরপুর সড়ক থেকে দ্বিতীয় বাড়ী এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়ী এই বাড়ীটির দু’টো বাড়ীর পশ্চিমে অবস্থিত। এরপর ১লা মার্চ (১৯৭২) তারিখে (তৎকালীন) সােভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের আমন্ত্রণে বঙ্গবন্ধু পাঁচদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে মস্কো গমন করেন। মস্কো বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানানাে হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকার প্রধান ব্রেজনেভসহ সােভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও বিষয়াদি নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলােচনা করেন। ৩রা মার্চ তারিখে স্বাক্ষরিত হয় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি। একই তারিখে স্বাক্ষরিত হয় “মুজিব কোসিগিন” যুক্ত ঘােষণা। এই ঘােষণায় বাংলাদেশের পুনর্বাসন তৎপরতায় সােভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য-সহায়তার প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা হয়। দুই দেশের প্রধান মন্ত্রীদ্বয় ঐক্যমত প্রকাশ করেন যে, বাইরের কোন প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের পাস্পরিক আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্যাবলীর সমাধান হওয়া উচিত।” উল্লেখ্য, শ্রীলংকার সুরকার ৪ঠা মার্চ তারিখে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৩১। (তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নে ছয়দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ৬ই মার্চ তারিখে। ঐ তারিখে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর)কে পুনর্গঠিত করে বাংলাদেশ রাইফেলস্ (বিডিআর) গঠন করা হয়। ইতিপূর্বে (২১ ফেব্রুয়ারী) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী ও কাদেরিয়া বাহিনী থেকে কয়েক হাজার সদস্য নির্বাচন করে একটি বিধিবদ্ধ জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। মস্কো থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিডিআর এবং রক্ষীবাহিনীকে একীভূত করার। কারণ এই দুই বাহিনীর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্ব প্রায় একই ধরনের। কিন্তু ঐ ইস্যুকে কেন্দ্র করে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গােড়ার দিকে এই দুই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গােলাগুলি শুরু হয় পিলখানার চত্বরে। এদের সংঘর্ষ এমন পর্যায়ে পৌছায় যে ওদের গােলাগুলি বন্ধ করানাের জন্যে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং নিজে পিলখানায় যেতে বাধ্য হন। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে বিডিআর-এর বাইরে অপর একটি পৃথক প্যারামিলিটারী সত্তা হিসেবে বহাল রাখার পক্ষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইত্যবসরে, ১০ মার্চ সােয়াজিল্যান্ড, ১১ই মার্চ গ্রীস এবং ১৩ই মার্চ সুইজারল্যান্ডের সরকারগুলাে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

পৃষ্ঠাঃ ১৩২
৩২। ১৫ই মার্চ (১৯৭২) তারিখ থেকে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্যদের আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। ১৭ই মার্চ বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় আসেন। ঐ দিনটি ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫৩তম জন্মদিন। ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধীকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানানাে হয়। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে (পুরাতন রেসকোর্স ময়দান) আয়ােজিত এক বিশাল জনসমাবেশে ভাষণদানকালে শ্রীমতি ইন্দিরা ও বঙ্গবন্ধু একইভাবে ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিবেশী দেশ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার নিবিড় বন্ধুত্ব ও সহযােগিতার সম্পর্ক অধিকতর উন্নত করার লক্ষ্যে অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘােষণা করেন। উক্ত সমাবেশে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আরও বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং জনগণের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।” ১৮ই মার্চ সকাল দশটার দিকে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারবর্গ নিয়ে বঙ্গভবনে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক অনানুষ্ঠানিক সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ঐ সাক্ষাতের সময় আমাদের নয় মাসের শিশু জয়কে সঙ্গে নিয়ে হাসিনা ও আমি উপস্থিত ছিলাম। ঐ দিন বিকেলে ইন্দিরা গান্ধীকে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং সন্ধ্যায় মুজিব-ইন্দিরা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৯শে মার্চ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু স্ব স্ব দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি পঁচিশ বছর মেয়াদী শান্তি, সহযােগিতা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন (পরিশিষ্ট-৫ দ্রষ্টব্য)। একই দিনে স্বাক্ষরিত হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর যুক্ত ঘােষণা। অতঃপর ঐ দিনই শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন।
৩৩। ২৩শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশের গণ-পরিষদের সদস্যপদ বাতিল সংক্রান্ত একটি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করা হয়। ২৬শে মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হয়। ঐ তারিখে দেশের ব্যাংক-ইসুরেন্স কোম্পানী, পাট, বস্ত্র, চিনিকলসহ বৃহৎ ও ভারী শিল্প জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির মালিকদের খাজনা প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া, ভূমি প্রশাসন ব্যবস্থার সংস্কার করে ব্যক্তি মালিকানায় জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া এবং হাটবাজার, নদী-জলা প্রভৃতির ইজারাদারী প্রথা বিলােপ করার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও ঘােষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে আহত ও পংগু মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য ও পুনর্বাসনের জন্যে মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠন করে কিছুসংখ্যক কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও লাভজনক ব্যবসায়িক সংস্থাকে উক্ত ট্রাষ্টের দায়িত্বে ন্যস্ত করার কথাও ঘােষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লাঞ্ছিত ও ছিন্নমূল বীরাঙ্গনাদের জন্যেও অনুরূপ কল্যাণ ট্রাষ্ট গঠন করার কথাও ঘােষণা করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য তহবিল থেকে তাঁদের পরিবার-পরিজনকে এককালীন সাহায্য মঞ্জরীর কথাও বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘােষণা করে।

পৃষ্ঠাঃ ১৩৩
৩৪। অনেক টালবাহানার পর ১৯৭২ সালের ৪ঠা এপ্রিলে বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার স্বীকৃতি দেয়। ৬ই এপ্রিল দুর্নীতির অভিযােগে ১৬ জন গণপরিষদ সদস্য (এমসিএ)-কে আওয়ামী লীগ হতে বহিস্কৃত করা হয়। ৬ই এপ্রিল গ্যাবনের সরকার বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ৮ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশে পৃথক সামরিক স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী গঠন করার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় অধ্যাদেশ জারি করে। একই তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। উক্ত অধিবেশনে প্রস্তাবাকারে গৃহীত সর্বসম্মত অনুরােধে ‘বৃহত্তর দলীয় ও জাতীয় স্বার্থে বঙ্গবন্ধু সাময়িকভাবে দলীয় প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে সম্মত হন। ৯ই এপ্রিল দুর্নীতির অভিযােগে আরও ৭ জন গণপরিষদ-সদস্যকে আওয়ামী লীগ হতে বহিস্কৃত করা হয়।
৩৫। ১০ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। অতঃপর গণপরিষদের অনুমােদনক্রমে বাংলাদেশের সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের জন্যে আইনমন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেনের নেতৃত্বে একটি ১৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ১২ই এপ্রিল আওয়ামী লীগের আরও আটজন নেতা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ঐদিনই বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার দফতর পুনর্বণ্টন করেন। ১৪ই এপ্রিল শােষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের অংগীকারের মাধ্যমে দেশের সর্বত্র বাংলা নববর্ষ পালিত হয়। ১৪ই এপ্রিল তারিখে মালাগাছির সরকার বাংলাদেশকে একটি সন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৬ই এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘােড়দৌড়ে জুয়াখেলা নিষিদ্ধ করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। ১৭ই এপ্রিল যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে মেহেরপুরের মুজিব নগরে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। ১৮ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ কমনওয়েলথ-এর সদস্যপদ লাভ করে। এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সরকার কমনওয়েলথ সংস্থা থেকে তার দেশের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নেয়। ২১শে এপ্রিল সিয়েরা লিওন এবং ২৫শে এপ্রিল লাওসের সরকারদ্বয় বাংলাদেশকে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৬শে এপ্রিল তারিখে হাট-বাজারের ইজারা প্রথা বিলােপ করে একটি সরকারী অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ২৬শে এপ্রিল তারিখে লাইবেরিয়ার সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৯শে এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধু ভিয়েতনাম থেকে বিদেশী সৈন্য অপসারণের জন্যে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলাের প্রতি আহবান জানান।
৩৬। ১লা মে রক্তরাঙা মহান মে দিবস হিসেবে উদযাপিত হয় যথাযথ মর্যাদায়। এই প্রথম বাংলাদেশে মে দিবসে সাধারণ ছুটি প্রদান করা হয়। শ্রমিক শ্রেণীর স্বাধীকার আদায়ের প্রতীক এই দিনে একটি শ্রমিক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শ্রমিকদের জন্যে এককালীন এডহক অর্থ সাহায্যদানের কথা ঘােষণা করেন। ৪ঠা মে আটক বাঙ্গালীদের পাকিস্তানের জিন্দাখানা
পৃষ্ঠাঃ ১৩৪

থেকে ফেরত আনার দাবীতে সমগ্র ঢাকা শহরে জনতার বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শিত হয়। ৮ই মে তারিখে সারাদেশে এই প্রথম যথাযথ মর্যাদায়, পরম শ্রদ্ধা ও আনন্দ-উৎসবের মধ্যদিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন (২৫শে বৈশাখ) পালিত হয়। এই দিন সকাল দশটার দিকে অফিসে যাওয়ার আগে আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাই। হাসিনা ইতােপূর্বেই শিশু জয়কে নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলাে। বাসার দোতালায় পৌছে হাসিনার মত বয়সী একজন সুন্দরী ভদ্র মহিলাকে আমার শাশুড়ীসহ সেখানে উপস্থিত সকল মহিলার কপালে টিপ লাগাতে দেখলাম। হাসিনা আমাকে ঐ মহিলাটির সঙ্গে পরিচয় করে দিয়ে বলে যে, তাঁর বাড়ী ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশে। তিনি লন্ডনে লেখাপড়ার সঙ্গে ছােটখাটো চাকুরী করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক সংগঠনের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্যে কষ্ট-পরিশ্রম করেছেন। হাসিনা আরও বলে যে, তিনি একটু পরেই সেখান থেকে তৎকালীন বাংলাদেশ বেতার (রেডিও) ভবনে যাবেন। যেহেতু আণবিক শক্তি কেন্দ্রের অফিসে বেতার ভবনের পাশ দিয়েই যেতে হয়, সুতরাং আমার গাড়ীতে যাওয়ার জন্যে হাসিনা ঐ ভদ্র মহিলাকে পরামর্শ দেয়। যা হােক, সেদিন অফিসে যাওয়ার সময় আমি ঐ মহিলাকে ঢাকা বেতার (রেডিও) অফিসে পৌছে দেই। পথে ঐ মহিলা আমাকে আরও অনেক কাহিনী বলেছিলেন। এরপর ঐ মহিলাটির সঙ্গে আমার কোন বােগাযােগ বা সাক্ষাৎ হয় নি।
৩৭। ঐ দিন রাতে হাসিনা আমাকে জানায় যে, কর্নেল (ঐ সময়ের পদমর্যাদা) জিয়াউর রহমান সাহেবের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পারিবারিক কিছু সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করার জন্যে ইতােপূর্বে বেশ কয়েকদিন বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসেছিলেন। হাসিনা আমাকে আরও জানায় যে, ১৯৭১-এর মে মাসে বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়াউর রহমান সাহেব লােক মারফত চিঠি লিখে ভারতে তাঁর (জিয়া সাহেবের) নিকট চলে যাওয়ার অনুরােধ জানানাে সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ভারতে যাননি বলে জিয়া সাহেব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাছাড়া ১৯৭১-এর জুলাই মাসে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দুই সন্তানসহ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার খবর শুনে জিয়া সাহেব শুধু দুঃশ্চিন্তাগ্রস্তই হননি, মনে মনে ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। এসব ঘটনার কারণে ঐ সময়ে কর্নেল জিয়াউর রহমান সাহেব ও তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে মনােমালিন্য চলছিল। হাসিনা আমাকে আরও জানায় যে, এই পারিবারিক মনােমালিন্যের সমস্যা নিরসনে সাহায্য করার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে ঐ সময় অনেক অনুরােধ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। খুশীর বিষয় যে, এর অল্প কিছুকাল পর বেগম জিয়ার পারিবারিক সমস্যার অবসান হয়েছিল।
৩৮। ৯ই মে সারদার পুলিশ বাহিনীর এক শিক্ষা সমাপনী উৎসবে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু জনগণের সেবায় নিঃস্বার্থভাবে দায়িত্ব পালনের জন্যে পুলিশ বাহিনীর সকল সদস্য ও কর্মকর্তার প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। ১০ই মে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ১১ই মে মেক্সিকো এবং ১২ই মে আরও তিনটি দেশের

সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৪ আই মে ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্বরতার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের ডাকে ঢাকায় একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং উক্ত সভায় “ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী হামলা বন্ধ কর” বলে উচ্চকিত স্লোগান দেয়া হয়। ১৭ই মে বঙ্গবন্ধুর সরকার ভোগ্যপণ্যের বিদ্যমান গগনচুম্বী মূল্য হ্রাস করার লক্ষ্যে সারাদেশব্যাপী ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ১৮ই মে বিদ্যমান ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার যাবতীয় দোষত্রুটি বিলোপ করে স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী একটি গনমূখি শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার লক্ষ্যে পরামর্শ প্রদানের জন্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিশিষ্ট ও প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ডঃ কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ১৯শে মে বিভিন্ন জটিলতা অতিক্রম করে অবশেষে পূর্ব গঠিত ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে গণহত্যা, লুন্ঠন, জনগণের বাড়ীঘর ও কলকারখানায় অগ্নিসংযোগ এবং নারী ধর্ষণে সহায়তা করার অপরাধে অভিযুক্ত রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ বাহিনীর সদস্য ও অন্যান্য ব্যক্তিদের বিচার শুরু হয়। ৩৯। ২১শে মে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ২৪শে মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেশে আনা হয়। বাংলা সাহিত্যে বৃটিশ শাসন অবসানের রাজনৈতিক আন্দোলনে, দূর্বল শ্রেণীর উপর শাসক ও শোষক শ্রেণীর সকল নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে এবং বিশেষ করে করে সকল সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ধর্ম, বর্ন, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকল মানুষকে সচেতন ও উজ্জীবিত করে করে তোলার লক্ষ্যে কবির অবিস্মরণীয় লেখনীর জন্যে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ বঙ্গবন্ধুর সরকার চিরস্থায়ীভাবে কবিকে দান করে ধানমন্ডির (পুরাতন) ২৮ নম্বর (নতুন ১৫ নম্বর) একটি দোতলা বাড়ী। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে কবিকে দেখতে যান। ঐ সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। সুদীর্ঘকাল পক্ষাঘাতে চলৎশক্তিহীন ও বাকশক্তিহীন কবির দুচোখ থেকে তখনও বিচ্ছুরিত হচ্ছিল বিদ্রোহের বাণী। ২৫মে বাংলাদেশে বিদ্রোহী কবির উপস্থিতিতে যথাযথ মর্যাদা ও শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো তাঁর জন্মদিন পালিত হয়। ৪০। এদিকে আরও অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ২৫শে মে আর্জেন্টিনা, ২৬শে মে হাইতি, ১লা জুন চিলি এবং ৬ই জুন ইকুয়েডরের সরকারগুলো বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৭ই জুন বঙ্গবন্ধু সরকার পাট রফতানি কর্পোরেশন গঠনে একটি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি করে। ২১শে জুন জাম্বিয়ার সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের কথা ঘোষণা করে। ২২শে জুন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ২৮শে জুন রুমানিয়া বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৯শে জুন যোগাযোগ মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী গণপরিষদে রেল- বাজেট পেশ করেন। ৩০শে জুন অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গণপরিষদে পেশ করেন জাতীয় বার্ষিক বাজেট। ৪১। ইত্যবসরে উপমহাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। ১লা জুলাই আকস্মিকভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর ১৭/১৮ বয়স্কা জ্যোষ্ঠ কন্যা বেনজীর ভুট্টোকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী সিমলায় আগমন করেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাকে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে অভ্যর্থনা জানান। অতঃপর প্রথমে ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে বৈঠক হয় অন্য কোন উপদেষ্টা বা পরামর্শদাতা ছাড়াই। এরপর উভয় সরকারের উপদেষ্টা ও পরামর্শদাতাদের উপস্থিতিতে ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধীর আরও কয়েক দফা আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। অতঃপর দুই দেশের মধ্যে অতীতের সমস্ত সংঘর্ষ ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের অবসান ঘটিয়ে বন্ধত্ব ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং উপমহাদেশে স্থয়ী শাস্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংকল্প ব্যক্ত করে ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধী একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিকে ঐতিহাসিক সিমলা চুক্তি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই চুক্তিতে জম্মু ও কাশ্মীর ভূখণ্ডে দুই দেশের মধ্যে ১৯৭১-এর ১৭ই ডিসেম্বরে যুদ্ধবিরতির সময়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রিত সীমানা মেনে নেয়া এবং পারস্পরিক মতবিরোধ ও এই চুক্তির আইনগত ব্যাখ্যার পার্থক্য স্বত্ত্বেও উক্ত নিয়ন্ত্রিত সীমানা লংঘনে ভীতি প্রদর্শন কিম্বা শক্তি প্রয়োগের যে কোন ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। পরবর্তীতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের যুদ্ধবন্দী ও বেসামরিক আটক ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও ঘোষনা করা হয় এই সিমলা চুক্তিতে। এর অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু বললেন, “বাংলাদেশের মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে।” কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে বললেন, “পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার করার কোন অধিকার বাংলাদেশের নেই। কারন পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে।” ভারতের পক্ষ থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলা হয়, “প্রকৃত সত্য এই যে, পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্র বাহিনীর কাছে। আর সে কারণেই যুদ্ধবন্দীদের প্রশ্নে যে কোন সিদ্ধান্ত ভারত ও বাংলাদেশের মতৈক্য ভিত্তিতেই গৃহীত হবে।” ৪২। ৩রা জুলাই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকের সদস্যপদ লাভ করে। ১২ই জুলাই তাঞ্জানিয়া এবং ২১শে জুলাই মাল্টার সরকারদ্বয় বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইতিপূর্বে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য পন্থা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের যুব নেতাদের মধ্যে মতবিরোধ চলছিল। এক গ্রুপ ছিল গনতান্ত্রিক পথ ও পন্থায় দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করায় বিশ্বাসী, আর অন্য গ্রুপ ছিল বৈপ্লবিক পথ ও পন্থায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র
(Unicoded by Mahmood Hussain)
ক্লিনিকে বঙ্গবন্ধুকে ভর্তি করানো হয়। ২৯শে জুলাই বঙ্গবন্ধুর তলপেটে অস্ত্রোপচার করে পাথরে ক্ষত গলব্লাডার অপসারণ করা হয়। ৩০শে জুলাই একটি সরকারী ইশতেহারে জানানো হয় যে, অস্ত্রোপচার সাফল্যজনক হওয়ায় বঙ্গবন্ধু ঝুঁকি মুক্ত হয়েছেন। ৪৫। ঐ সময় বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন। ৪ঠা আগষ্ট বাংলাদেশ সরকার ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে ১২ লক্ষ একর পতিত জমি বিনামূল্যে বন্দোবস্ত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ৫ই আগষ্ট বলিভিয়ার সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৮ই আগষ্ট বাংলাদেশ সরকার দেশের সকল বীমা কোম্পানীগুলোকে জাতীয়করণ করে এক অধ্যাদেশ জারি করে। একই তারিখে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে আবেদনপত্র পেশ করে। ৯ই আগষ্ট দালাল আইনের সংশোধনের প্রয়োজনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। ১০ই আগষ্ট তারিখে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভূক্তির ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক শুরু হয়। জাতিসংঘে নিযুক্ত গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। ৪৬। এদিকে ১৩ই আগষ্ট বঙ্গবন্ধু ক্লিনিক ত্যাগ করে লন্ডনের একটি হোটেলে গিয়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানে দলে দলে বাঙালী শুভাকাঙ্ক্ষী দর্শনার্থীদের উপস্থিতির চাপে বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকগণ বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন ছেড়ে ইউরোপের অন্য কোন দেশের স্বাস্থ্যকর স্থানে গিয়ে কিছুদিন বিশ্রাম নেয়ার জোর পরামর্শ দেন। অতঃপর ২১শে আগষ্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ চিকিৎসক অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে স্বাস্থ্যোদ্ধারের উদ্দেশ্যে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় চলে যান। স্বাস্থ্যকর নিরিবিলি স্থান এবং সেখানে বাংলাদেশের দূতাবাস থাকার কারণে বঙ্গবন্ধু জেনেভা যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ৪৭। এদিকে ২১শে আগষ্ট বাংলাদেশের জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রদানের বিষয়টি আলোচনা করার জন্যে নিরাপত্তা পরিষদে পুনরায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এবারও চীনের প্রতিনিধি জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবে আগের মতোই বিরোধিতা করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতির কারণে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকে। ২৩শে আগষ্ট তারিখে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দুস্কৃতিকারীরা হাতবোমা নিক্ষেপ করে। এতে কেউ হতাহত না হলেও উক্ত বোমার বিস্ফোরণে অফিসটির যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২৪শে আগষ্ট পানামা এবং উরুগুয়ের সরকারদ্বয় বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৫শে আগষ্ট তারিখে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের প্রশ্নের নিষ্পত্তির জন্যে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের পুনরায় বৈঠক বসে। নিরাপত্তা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ট ভোটে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব পাস হয়, কিন্তু দুঃখের বিষয় যে চীন এতে ভেটো প্রদান করে। উল্লেখ্য জাতিসংঘে সদস্যপ্রাপ্তির পর গন প্রজাতন্ত্রী চীন নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রথম ভেটো প্রদান করে। চীনের এই ভেটো প্রয়োগের প্রতিবাদে বাংলাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
৪৮। ২৯শে আগষ্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকার দালাল আইন সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এই সংশোধিত আইনে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৩ বছর সাজার ব্যবস্থা করা হয়। ইতিমধ্যে আউশ মৌসুমে অনাবৃষ্টির কারনে ফসলহানি এবং মুক্তিযুদ্ধে বিপর্যস্ত পরিবহনে খাদ্য পরিবহনে খাদ্য সরবরাহ বিলম্বিত হওয়ার ফলে সারাদেশে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রকট অভাব পরিলক্ষিত হয়। ৩০শে আগষ্ট তারিখে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে মন্ত্রী পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেশের এই পরিস্থিতিতে মাওলানা ভাসানীর আহ্বানে ৩রা সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকায় কিছু কিছু ভুখা মিছিল প্রদর্শিত হয় এবং পরে পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসমাবেশে মাওলানা ভাসানী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ৪৯। এদিকে ১০ই সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের আহ্বানে বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির ব্যপারে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভেটো প্রদানের প্রতিবাদে ঢাকার পল্টন ময়দানে বিশাল গণসমাবেশ হয়। উক্ত গণসমাবেশে NAP ( মোজাফ্ফর) ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা চীনের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের তীব্র নিন্দা করে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ১২ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকার দেশের ৫টি সাপ্তাহিক পত্রিকার উপর রাষ্ট্রবিরোধীমূলক সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে শো-কজ নোটিশ জারি করে। ১৩ই সেপ্টেম্বর তারিখে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক আয়োজিত সর্বদলীয় জনসভায় হাতবোমা নিক্ষেপে ২০ ব্যাক্তি আহত হয়। ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখে চিকিৎসাসহ স্বাস্থোদ্ধারে ৪৮ দিন বিদেশে থাকার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে এক সংক্ষিপ্ত সাংবাদিক সম্মেলনে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভেটো প্রদানের ব্যাপারটিকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনক আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ” অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ভেটো দিয়েছিল জাতিসংঘে গনচীনের অন্তর্ভূক্তির বিরুদ্ধে। আমারা তখন বলেছিলাম যে গনচীনকে বাদ দিয়ে জাতিসংঘ অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। আজ সেই গনচীন ভেটো দিয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে। গনচীন জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়েছে, নিশ্চয়ই বাংলাদেশও একদিন পাবে।” ৫০। ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে সরকার ১৯৭৩-এর মার্চ মাসে সংসদের নির্বাচন ঘোষনা করে। ১৮ই সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সম্মেলনে ভাষন দেন। ১৯শে সেপ্টেম্বর এক সরকারী আদেশে দুর্নীতির দায়ে আভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থার চেয়ারম্যান ও চার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করাহয়। ২১শে সেপ্টেম্বর তারিখে সরকার দূর্নীতির দায়ে জাতীয়করণকৃত বাওয়ানী মিলের জেনারেল ম্যানেজার এবং স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা ঢাকা উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যানকে চেয়ারম্যানকে সাসপেন্ড করে। ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু আরও ১৯ জন এম. সি. একে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত করেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ভ্যাটিকান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই তারিখে সরকার এক আদেশে বাংলাদেশ বিমানের প্রসাশককে দূর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড করে। ২৬শে সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের নাগরিকদের পবিত্র মক্কা শরীফে হজ্জব্রত পালনের সুযোগ প্রদান করার অনুরোধ জানিয়ে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সালের নিকট জরুরী তার বার্তা প্রেরণ করেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর তারিখে এক আদেশে সরকার দূর্নীতির দায়ে আধা-সরকারী সংস্থা ওয়াসা(WASA)- এর চেয়ারম্যানকে সাসপেন্ড করে। একই তারিখে সরকার রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের দায়ে তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকা “হককথা”, “মুখপত্র” এবং স্পোকসম্যান”- এর প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে বিমান বাহিনীর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়। এই দিবসটি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের এক সম্মেলনে ভাষনদানকালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জনগণের সেবা করার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালনে যোগ্যতাসম্পন্ন ও সুশৃঙ্খল বাহিনীরুপে বাহিনীরুপে বাহিনীরুপে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। ৫১। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে খাদ্য বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতার কারনে জনমনে অস্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হতে থাকে। মাত্র ছয় মাস আগে নয় মাসের যুদ্ধে এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং বাহিনী এবং বাহিনী এবং কেন্দ্রীয় সামরিক জান্তার সুপরিকল্পিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত হয়েছিল সর্বপ্রকারে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দিয়ে দিয়ে দিয়ে একটি বিশ্বস্ত দেশ হিসেবে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কৃষি ও শিল্প উভয় খাতেই উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল চরমভাবে। ১৯৭২ সালে অনাবৃষ্টি এবং বিধ্বস্ত শিল্প কলকারখানা গুলোকে পুনরায় সক্রিয় ও উৎপাদনযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা এবং শিল্প উৎপাদন কার্যক্রম নানা কারণে পদে পদে বিঘ্নিত হওয়ার ফলে দেশে এ সময় খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর অপ্রতুলতা দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত ছিল না। খাদ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের সাময়িক ঘাটতি মেটানোর ব্যপারে বঙ্গবন্ধু সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েওছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক যে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত, একশ্রেণীর মজুতদার, মুনাফাখোর, অসাধু চোরাচালানী গোষ্ঠীর কারসাজি এবং পাকিস্তানপন্থী আমলা ও অন্যান্য শ্রেণী-গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে সরকারের এতদবিষয়ে গৃহীত পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও ব্যবস্থা নানা ভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্যবস্ত্রসহ অন্যান্য সব দ্রব্যসামগ্রী হয়ে পড়ে দুষ্প্রাপ্য ও দুরমূল্য যার ভোগান্তি পোহাতে হয় স্বল্প ও সীমিত আয়ের এবং গ্রামের সাধারণ জনগনকে। এতদ্বাতীত পাকিস্তানী দালালদের অন্তর্ঘাত ও ধ্বংসাত্মকমূলক কার্যকলাপে দেশ
৪৮। ২৯শে আগষ্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকার দালাল আইন সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এই সংশোধিত আইনে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড এবং সর্বনিম্ন ৩ বছর সাজার ব্যবস্থা করা হয়। ইতিমধ্যে আউশ মৌসুমে অনাবৃষ্টির কারনে ফসলহানি এবং মুক্তিযুদ্ধে বিপর্যস্ত পরিবহনে খাদ্য পরিবহনে খাদ্য সরবরাহ বিলম্বিত হওয়ার ফলে সারাদেশে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের প্রকট অভাব পরিলক্ষিত হয়। ৩০শে আগষ্ট তারিখে দেশের খাদ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্যে মন্ত্রী পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেশের এই পরিস্থিতিতে মাওলানা ভাসানীর আহ্বানে ৩রা সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকায় কিছু কিছু ভুখা মিছিল প্রদর্শিত হয় এবং পরে পল্টনে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জনসমাবেশে মাওলানা ভাসানী সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ৪৯। এদিকে ১০ই সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের আহ্বানে বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির ব্যপারে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভেটো প্রদানের প্রতিবাদে ঢাকার পল্টন ময়দানে বিশাল গণসমাবেশ হয়। উক্ত গণসমাবেশে NAP ( মোজাফ্ফর) ও কমিউনিস্ট পার্টিসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা চীনের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো প্রদানের তীব্র নিন্দা করে জোরালো বক্তব্য রাখেন। ১২ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকার দেশের ৫টি সাপ্তাহিক পত্রিকার উপর রাষ্ট্রবিরোধীমূলক সংবাদ পরিবেশনের অভিযোগে শো-কজ নোটিশ জারি করে। ১৩ই সেপ্টেম্বর তারিখে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক আয়োজিত সর্বদলীয় জনসভায় হাতবোমা নিক্ষেপে ২০ ব্যাক্তি আহত হয়। ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখে চিকিৎসাসহ স্বাস্থোদ্ধারে ৪৮ দিন বিদেশে থাকার পর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তেজগাঁও বিমানবন্দরে এক সংক্ষিপ্ত সাংবাদিক সম্মেলনে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভেটো প্রদানের ব্যাপারটিকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও দুঃখজনক আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ” অতীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বছরের পর বছর ভেটো দিয়েছিল জাতিসংঘে গনচীনের অন্তর্ভূক্তির বিরুদ্ধে। আমারা তখন বলেছিলাম যে গনচীনকে বাদ দিয়ে জাতিসংঘ অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে। আজ সেই গনচীন ভেটো দিয়েছে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরুদ্ধে। গনচীন জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়েছে, নিশ্চয়ই বাংলাদেশও একদিন পাবে।” ৫০। ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে সরকার ১৯৭৩-এর মার্চ মাসে সংসদের নির্বাচন ঘোষনা করে। ১৮ই সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধু উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সম্মেলনে ভাষন দেন। ১৯শে সেপ্টেম্বর এক সরকারী আদেশে দুর্নীতির দায়ে আভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল সংস্থার চেয়ারম্যান ও চার উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করাহয়। ২১শে সেপ্টেম্বর তারিখে সরকার দূর্নীতির দায়ে জাতীয়করণকৃত বাওয়ানী মিলের জেনারেল ম্যানেজার এবং স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা ঢাকা উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারম্যানকে চেয়ারম্যানকে সাসপেন্ড করে। ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু আরও ১৯ জন এম. সি. একে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত করেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে ভ্যাটিকান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এই তারিখে সরকার এক আদেশে বাংলাদেশ বিমানের প্রসাশককে দূর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড করে। ২৬শে সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের নাগরিকদের পবিত্র মক্কা শরীফে হজ্জব্রত পালনের সুযোগ প্রদান করার অনুরোধ জানিয়ে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সালের নিকট জরুরী তার বার্তা প্রেরণ করেন। ২৭শে সেপ্টেম্বর তারিখে এক আদেশে সরকার দূর্নীতির দায়ে আধা-সরকারী সংস্থা ওয়াসা(WASA)- এর চেয়ারম্যানকে সাসপেন্ড করে। একই তারিখে সরকার রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের দায়ে তিনটি সাপ্তাহিক পত্রিকা “হককথা”, “মুখপত্র” এবং স্পোকসম্যান”- এর প্রকাশনা নিষিদ্ধ করে। ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে বিমান বাহিনীর দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়। এই দিবসটি উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের এক সম্মেলনে ভাষনদানকালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জনগণের সেবা করার ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালনে যোগ্যতাসম্পন্ন ও সুশৃঙ্খল বাহিনীরুপে বাহিনীরুপে বাহিনীরুপে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
হয়েছে যে, এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে খাদ্য বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতার কারনে জনমনে অস্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হতে হতে থাকে। মাত্র ছয় মাস আগে নয় মাসের যুদ্ধে এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং বাহিনী এবং বাহিনী এবং কেন্দ্রীয় সামরিক জান্তার সুপরিকল্পিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত হয়েছিল সর্বপ্রকারে অর্থনৈতিক সর্বপ্রকারে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দিয়ে দিয়ে দিয়ে দিয়ে একটি বিশ্বস্ত দেশ হিসেবে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কৃষি ও শিল্প উভয় খাতেই উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল চরমভাবে। ১৯৭২ সালে অনাবৃষ্টি এবং বিধ্বস্ত শিল্প কলকারখানা গুলোকে পুনরায় সক্রিয় ও উৎপাদনযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা এবং শিল্প উৎপাদন কার্যক্রম নানা কারণে পদে পদে বিঘ্নিত হওয়ার ফলে দেশে এ সময় খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর অপ্রতুলতা দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত ছিল না। খাদ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের সাময়িক ঘাটতি মেটানোর ব্যপারে বঙ্গবন্ধু সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েওছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক যে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত, একশ্রেণীর মজুতদার, মুনাফাখোর, অসাধু চোরাচালানী গোষ্ঠীর কারসাজি এবং পাকিস্তানপন্থী আমলা ও অন্যান্য শ্রেণী-গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে সরকারের এতদবিষয়ে গৃহীত পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও ব্যবস্থা নানা ভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্যবস্ত্রসহ অন্যান্য সব দ্রব্যসামগ্রী হয়ে পড়ে দুষ্প্রাপ্য ও দুরমূল্য যার ভোগান্তি পোহাতে হয় স্বল্প ও সীমিত আয়ের এবং গ্রামের সাধারণ জনগনকে। এতদ্বাতীত পাকিস্তানী দালালদের অন্তর্ঘাত ও ধ্বংসাত্মকমূলক কার্যকলাপে দেশে ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে থাকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ও জনগনের জান-মালের নিরাপত্তার। এসব কিছুর ফলে জনসমাজে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে অস্বস্তি, অসন্তোষ ও অস্থিরতা। দেশের এহেন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে মাওবাদী উগ্রপন্থী প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন কার্যকলাপ। এ সময়ে মাওলানা ভাসানীর অসহযোগ ও সরকার বিরোধী উক্তি, বক্তব্য ও ভূমিকা মাওবাদী উগ্র বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠন এবং পাকিস্তানপন্থী দালাল ও সংগঠনগুলোর উপরোক্ত কার্যকলাপ পরিচালনার সাহস ও শক্তি সঞ্চারে সহায়ক ফ্যাক্টর হিসেবে হিসেবে হিসেবে হিসেবে কাজ করে। গনচীনের অনুসারী সিরিজ সিকদারের পূর্ববাংলার সর্বহারা পূর্ববাংলার সর্বহারা পূর্ববাংলার সর্বহারা পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি “স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদানত” বলে উল্লেখ করে, “স্বাধীন জনগনতান্ত্রিক জনগনতান্ত্রিক জনগনতান্ত্রিক জনগনতান্ত্রিক জনগনতান্ত্রিক জনগনতান্ত্রিক জনগনতান্ত্রিক পূর্ববাংলা” কায়েমের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়। হক, তোহা, মতিন, , , , আলাউদ্দিন, , , , দেবেন সিকদার, শান্তি সেন, অমল সেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলও একইভাবে ভারত ও সোভিয়েট বিরোধী শ্লোগান দেয় এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের সংকল্প নিয়ে গোপন রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এদের অধিকাংশই হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেয় এবং সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এই প্রস্তুতিরই অংশ হিসেবে তাঁরা শুরু করেন (তাঁদের ভাষায়) “জাতীয় দুশমন” খতমের অভিযান। মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করে “নতুন পতাকা ওড়াবার” হুমকি দেন। ৫২। “হক কথা” নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে মাওলানা ভাসানী একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সরকার এবং ভারত ও (তৎকালীন) সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বল্গাহীন প্রচারণা চালাতে লাগলেন। মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর সরকার বিরোধী এরুপ উক্তি, বক্তব্য ও ভূমিকা লক্ষ করে একদিন আমি শ্বাশুড়িকে বললাম, “১৯৭১- এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাওলানা ভাসানীকে বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঐ উপদেষ্টা পরিষদ করায় সম্ভবতঃ মাওলানা ভাসানী মনক্ষুণ্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরোধী ভূমিকা অবলম্বন করেছেন।” শ্বাশুড়ী বললেন,” অতীতেও দেখেছি যে, তাঁর সেবা ও এটাসেটা প্রয়োজন মেটাতে শেখ সাহেব একটুও গাফিলতি বা অবহেলা করলে মাওলানা ভাসানী এরুপ আচরন করতেন। তোমার শ্বশুর একবার “হুজুর” বলে ভাসানী সাহেবের সাথে দেখা করলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।” উল্লেখ্য, এনায়েতুল্লাহ খানের সাপ্তাহিক “হলিডে” মাওলানা ভাসানীর “হক কথা”- এর অনুরূপ প্রচারনার সামিল হয়। ৫৩। অপরদিকে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও পি. ডি. পি. ইত্যাদি দলের নেতারা গোপনে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়ে ‘মুসলিম বাংলা’ কায়েমের গোপন তৎপরতায় লিপ্ত হয়। তখন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘সংগ্রাম’ পত্রিকা “মুসলিম বাংলা” আন্দোলনের ব্যাপক প্রচারণা চালাতে থাকে। ডাকযোগে এই পত্রিকা প্রচুর সংখ্যায় বাংলাদেশে প্রেরিত হতে থাকে। মাওলানা ভাসানীও চরম সাম্প্রদায়িক এসব অশুভ শক্তির গোপন তৎপরতার প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে বললেন, “মুসলিম বাংলার জন্য যারা কাজ করছে, তাদের আমি দোয়া করি। আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে।” অত্যন্ত দুঃখজনক যে, মাওলানা ভাসানী যিনি জীবনে দীর্ঘকাল প্রগতিশীল রাজনীতির কথা বলেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, জীবন সায়াহ্নে তিনি নিজেকে একাধারে বামপন্থী উগ্রপন্থীদের স্বঘোষিত অভিভাবক এবং চরম দক্ষিণ পন্থিদের বিশ্বস্ত মুখপাত্রে পরিণত করলেন। ৫৪। ১লা অক্টোবর তারিখ হতে বঙ্গবন্ধুর সরকার সারাদেশে ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করে। ৫ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে চোরাচালান রোধ করার জন্যে সীমান্তে নৌ ও সেনাবাহিনী প্ররণের নির্দেশ দেন। ৬ই
৫১। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে করা হয়েছে যে, এ বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশে খাদ্য বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্যতার কারনে জনমনে অস্বস্তির ভাব পরিলক্ষিত হতে হতে থাকে। মাত্র ছয় মাস আগে নয় মাসের যুদ্ধে এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং বাহিনী এবং বাহিনী এবং কেন্দ্রীয় সামরিক জান্তার সুপরিকল্পিত ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত শত্রুমুক্ত হয়েছিল সর্বপ্রকারে অর্থনৈতিক সর্বপ্রকারে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দিয়ে দিয়ে দিয়ে দিয়ে একটি বিশ্বস্ত দেশ হিসেবে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কৃষি ও শিল্প উভয় খাতেই উৎপাদন ব্যাহত হয়েছিল চরমভাবে। ১৯৭২ সালে অনাবৃষ্টি এবং বিধ্বস্ত শিল্প কলকারখানা গুলোকে পুনরায় সক্রিয় ও উৎপাদনযোগ্য করে তোলার প্রচেষ্টা এবং শিল্প উৎপাদন কার্যক্রম নানা কারণে পদে পদে বিঘ্নিত হওয়ার ফলে দেশে এ সময় খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রীর অপ্রতুলতা দেখা দেওয়াটা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত ছিল না। খাদ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের সাময়িক ঘাটতি মেটানোর ব্যপারে বঙ্গবন্ধু সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েওছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক যে দেশী-বিদেশী চক্রান্ত, একশ্রেণীর মজুতদার, মুনাফাখোর, অসাধু চোরাচালানী গোষ্ঠীর কারসাজি এবং পাকিস্তানপন্থী আমলা ও অন্যান্য শ্রেণী-গোষ্ঠীর অসহযোগিতার কারণে সরকারের এতদবিষয়ে গৃহীত পরিকল্পনা, কার্যক্রম ও ব্যবস্থা নানা ভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্যবস্ত্রসহ অন্যান্য সব দ্রব্যসামগ্রী হয়ে পড়ে দুষ্প্রাপ্য ও দুরমূল্য যার ভোগান্তি পোহাতে হয় স্বল্প ও সীমিত আয়ের এবং গ্রামের সাধারণ জনগনকে। এতদ্বাতীত পাকিস্তানী দালালদের অন্তর্ঘাত ও ধ্বংসাত্মকমূলক কার্যকলাপে দেশে ক্রমান্বয়ে অবনতি হতে থাকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ও জনগনের জান-মালের নিরাপত্তার। এসব কিছুর ফলে জনসমাজে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে অস্বস্তি, অসন্তোষ ও অস্থিরতা। দেশের এহেন পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে মাওবাদী উগ্রপন্থী প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠনগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন কার্যকলাপ। এ সময়ে মাওলানা ভাসানীর অসহযোগ ও সরকার বিরোধী উক্তি, বক্তব্য ও ভূমিকা মাওবাদী উগ্র বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও গুপ্ত সংগঠন এবং পাকিস্তানপন্থী দালাল ও সংগঠনগুলোর উপরোক্ত কার্যকলাপ পরিচালনার সাহস ও শক্তি সঞ্চারে সহায়ক ফ্যাক্টর হিসেবে হিসেবে হিসেবে হিসেবে কাজ করে। গনচীনের অনুসারী সিরিজ সিকদারের পূর্ববাংলার সর্বহারা পূর্ববাংলার সর্বহারা পূর্ববাংলার সর্বহারা পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি “স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদানত” বলে উল্লেখ করে, “স্বাধীন জনগনতান্ত্রীক পূর্ববাংলা” কায়েমের জন্যে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়। হক, তোহা, মতিন, , , , আলাউদ্দিন, , , , দেবেন সিকদার, শান্তি সেন, অমল সেন প্রমুখের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী গনচীনমূখী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলও একইভাবে ভারত ও সোভিয়েট বিরোধী শ্লোগান দেয় এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সরকার উৎখাতের সংকল্প নিয়ে গোপন রাজনৈতিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। এদের অধিকাংশই হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেয় এবং সশস্ত্র বিপ্লব সংগঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এই প্রস্তুতিরই অংশ হিসেবে তাঁরা শুরু করেন (তাঁদের ভাষায়) “জাতীয় দুশমন” খতমের অভিযান। মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করে “নতুন পতাকা ওড়াবার” হুমকি দেন। ৫২। “হক কথা” নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে মাওলানা ভাসানী একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সরকার এবং ভারত ও (তৎকালীন) সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বল্গাহীন প্রচারণা চালাতে লাগলেন। মাওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুর সরকার বিরোধী এরুপ উক্তি, বক্তব্য ও ভূমিকা লক্ষ করে একদিন আমি শ্বাশুড়িকে বললাম, “১৯৭১- এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মাওলানা ভাসানীকে বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ঐ উপদেষ্টা পরিষদ করায় সম্ভবতঃ মাওলানা ভাসানী মনক্ষুণ্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরোধী ভূমিকা অবলম্বন করেছেন।” শ্বাশুড়ী বললেন,” অতীতেও দেখেছি যে, তাঁর সেবা ও এটাসেটা প্রয়োজন মেটাতে শেখ সাহেব একটুও গাফিলতি বা অবহেলা করলে মাওলানা ভাসানী এরুপ আচরন করতেন। তোমার শ্বশুর একবার “হুজুর” বলে ভাসানী সাহেবের সাথে দেখা করলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।” উল্লেখ্য, এনায়েতুল্লাহ খানের সাপ্তাহিক “হলিডে” মাওলানা ভাসানীর “হক কথা”- এর অনুরূপ প্রচারনার সামিল হয়। ৫৩। অপরদিকে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও পি. ডি. পি. ইত্যাদি দলের নেতারা গোপনে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়ে ‘মুসলিম বাংলা’ কায়েমের গোপন তৎপরতায় লিপ্ত হয়। তখন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘সংগ্রাম’ পত্রিকা “মুসলিম বাংলা” আন্দোলনের ব্যাপক প্রচারণা চালাতে থাকে। ডাকযোগে এই পত্রিকা প্রচুর সংখ্যায় বাংলাদেশে প্রেরিত হতে থাকে। মাওলানা ভাসানীও চরম সাম্প্রদায়িক এসব অশুভ শক্তির গোপন তৎপরতার প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে বললেন, “মুসলিম বাংলার জন্য যারা কাজ করছে, তাদের আমি দোয়া করি। আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে।” অত্যন্ত দুঃখজনক যে, মাওলানা ভাসানী যিনি জীবনে দীর্ঘকাল প্রগতিশীল রাজনীতির কথা বলেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন, জীবন সায়াহ্নে তিনি নিজেকে একাধারে বামপন্থী উগ্রপন্থীদের স্বঘোষিত অভিভাবক এবং চরম দক্ষিণ পন্থিদের বিশ্বস্ত মুখপাত্রে পরিণত করলেন।
৫৪। ১লা অক্টোবর তারিখ হতে বঙ্গবন্ধুর সরকার সারাদেশে ন্যায্যমূল্যের দোকান চালু করে। ৫ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে চোরাচালান রোধ করার জন্যে সীমান্তে নৌ ও সেনাবাহিনী প্ররণের নির্দেশ দেন। ৬ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধু সরকার চোরাচালান রোধ করার কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্থাসমূহকে সেনাবাহিনীর অধীনে ন্যস্ত করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সিমান্ত বানিজ্য চুক্তির কার্যকরণ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
৫৫। ১০ই অক্টোবর তারিখে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে বিশ্বশান্তি পরিষদ এক ইশতেহারে বঙ্গবন্ধুকে নিপীড়িত ও শোষিত জনগনের অধিকার আদায় , আর্থ-সামাজিক মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জনে তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাঁর অত্যন্ত অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ‘জুলিও কুরী’ পদক পুরষ্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু আনন্দের সঙ্গে উক্ত পুরষ্কার গ্রহণে তাঁর সম্মতি এবং এই সম্মান প্রদানের জন্যে ধন্যবাদ ব্যাক্ত করে বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল শ্রী রমেশ চন্দ্রের নিকট তারবার্তা প্রেরণ করেন। ১২ই অক্টোবর তারিখে তারিখে তারিখে ডঃ কামাল হোসেন স্বাধীন বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান গণপরিষদের সুচিন্তিত বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য গণপরিষদে পেশ করেন। গণপরিষদে পেশ করেন। গণপরিষদে পেশ করেন। গণপরিষদে পেশ করেন। গণপরিষদে পেশ করেন। গণপরিষদে পেশ করেন। ১৪ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙলীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সাহায্য করার জন্যে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের নিকট জরুরী তারবার্তা প্রেরণ করেন। ১৫ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালীদের প্রত্যাবর্তনে সাহায্য করার জন্যে আন্তর্জাতিক রেডক্রস প্রধানের নিকটও একটি জরুরী তারবার্তা পাঠান। ১৭ই অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষকের পদ লাভ করে। ১৯শে অক্টোবর তারিখে গণপরিষদে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধানের উপর সাধারণ আলোচনা শুরু হয়।১৯শে অক্টোবর বাংলাদেশ ইউনেস্কো (UNESCO)- এর সদস্যপদ লাভ করে। এদিনই বিকেলে বঙ্গবন্ধু দুইজন পাকিস্তানী সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দান করেন। ২৩শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর আবেদনের জবাবে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালীদের অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের জন্যে তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ২৫শে আগষ্ট পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙ্গালীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্যে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ প্রতিনিধি স্যার রবার্ট জ্যাকসন পাকিস্তানের ইসলামাবাদে পৌঁছান। ৩১ অক্টোবর তারিখে মেজর (অবঃ) জলিলকে সভাপতি এবং আ. স. ম. রবকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। “বিপ্লবকে পরিপূর্ণতা প্রদান” এবং দেশে ” বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” কায়েম করা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আদর্শ ও লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, যদিও সিরাজুল আলম খান তখন গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কোনো কর্মকর্তার পদ গ্রহণ করেননি, তবে একথা কারও অজানা ছিল না যে, তিনিই ছিলেন ঐ দলের কর্নধার ও আদর্শিক গুরু।
৫৬। ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ গঠনের প্রায় মাস দেড়েক আগের ঘটনা। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি একদিন সকাল এগারোটার দিকে আমি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ অফিস (পুরাতন) গনভবনের (বর্তমান সুগন্ধা) নীচতলায় প্রধানমন্ত্রীর সচিব রফিকউল্লাহ্ চৌধুরীর অফিসে তাঁর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রী পরিষদ ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে উপরতলায় কমিটি কক্ষে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। এই সময় সিরাজুল আলম খান কিছুটা উত্তেজিত অবস্থায় রফিকউল্লাহ্ চৌধুরীর অফিসকক্ষে প্রবেশ করে। উত্তেজিত অবস্থায় সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত রাজনৈতিক নীতিমালা সম্পর্কে সমালোচনামূলক মন্তব্য করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তক্ষুনি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করার জন্যে রফিকউল্লাহ চৌধুরীকে অনুরোধ করে। অনুমতি পাওয়ার পর সিরাজুল আলম খান উপরের কমিটি কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যায়। মিনিট বিশেক পর উত্তেজিত অবস্থায়ই পুনরায় রফিকউল্লাহ চৌধুরর অফিসকক্ষে ফিরে এসে বলে, “বঙ্গবন্ধুকে আজ সেখানে উপস্থিত সকলের সামনে সবকিছু বিস্তারিতভাবে অবহিত করলাম। সময় বেশি নাই। এখন সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর উপর নির্ভর করছে।” তার উত্তেজিত হওয়ার কারণ জানার জন্যে আমি তাঁকে অফিসের বারান্দায় বঙ্গবন্ধুর বসার স্থানে নিয়ে যাই। তার উত্তেজনার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে আমাকে বলে, “ওয়াজেদ তুই বিজ্ঞানী, বিষয়টা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারবি।” অতঃপর চার চেয়ারের মাঝখানের একপায়া বিশিষ্ট টেবিলটির উদাহরণ দিয়ে সে আমাকে বলে, ওয়াজেদ তুই বল, এই টেবিলটি চারপায়া বিশিষ্ট হলে এর চেয়ে অধিকতর স্থিতিশীল হতো কিনা?” জবাবে আমি বললাম, যে কোন টেবিল বা আসনের চার পায়া থাকলে নিশ্চয়ই এক পায়াবিশিষ্ট টেবিল বা আসনের চেয়ে বেশী স্থিতিশীল ও অটল থাকে। আর যে কোন আসন বা টেবিলের পুরো নীচ অংশ জুড়ে পায়া সংযুক্ত রাখলে সবচেয়ে বেশী স্থিতিশীল ও অটল থাকে। অতঃপর ওকে আমি আরও বললাম, “সিরাজ এই টেবিলের উদাহরণ দিয়ে তুই এটা বুঝতে চাচ্ছিস যে বঙ্গবন্ধু জাতীয়বাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই চার মূলনীতির মধ্যে কেবলমাত্র জাতীয়তাবাদের নীতিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।” সিরাজুল আলম খান তখন বলে, তুই ঠিকই বুঝেছিস। বঙ্গবন্ধু এখন একপায়া বিশিষ্ট টেবিলের অবস্থায় রয়েছেন। সময় দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। । বঙ্গবন্ধু এক্ষুনি এবিষয়ে সংশোধনমূলক কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে যে কোন পরিস্থিতি উদ্ভব হলে তার জন্য তিনিই দায়ী থাকবেন বলে আমি তাঁকে পরিষ্কার বলে দিলাম।” তখন আমি তাকে বললাম, “তোমাদের আরও একটু ধৈর্য রাখা সমীচিন হবে।” অতঃপর আমার সঙ্গে পুনরায় আলাপ না করা পর্যন্ত তারা যেন অবাঞ্ছিত বা হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে সেবিষয়ে লক্ষ্য রাখার জন্যে আমি তাঁকে অনুরোধ করি। “আচ্ছা, পরে তোর সঙ্গে এ বিষয়ে আবার আলাপ করা হবে”- এই বলে তখন সিরাজুল আলম খান আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। উল্লেখ্য, এরপর প্রায় দেড়বছর সিরাজুল আলম খান কিম্বা তার অনুসারীদের কারও সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ কিম্বা আলাপ হয়নি।
৫৭। ৪ঠা নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান অনুমোদিত এবং তা ১৬ই ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে বলে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। অতঃপর ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করা হয়। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধু সরকার ঘোষনা দেয় যে, ১৯৭৩ সনের ৭ই মার্চ গণপরিষদে অনুমোদিত সংবিধানের বিধান অনুসারে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৪ঠা নভেম্বর তারিখে গণপরিষদে অনুমোদিত সংবিধানে জাতিয়তাবাদ, গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে চারটি রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শ ও নীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সাধারণ জনগণ কর্তৃক গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট জবাবদিহিমূলক সরকারের ব্যবস্থা রাখা হয়। উক্ত সংবিধানে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়ে বিচার বিভাগের সার্বভৌমত্ব, ধর্ম, বর্ন, বিশ্বাস ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা, ধর্ম-বিশ্বাস, চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ সংগঠনের অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান করা হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম, সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার অবসান এবং শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকারও লিপিবদ্ধ করা হয় উক্ত সংবিধানে। “সামর্থ অনুযায়ী কাজ এবং কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক” এই নীতির ভিত্তিতে সকলের জন্য কর্মসংস্থানের বিধানও উক্ত সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। সমতা, জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং জাতিসংঘের সনদকে গ্রহণ করা হয় বৈদেশিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে। “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সংগে বৈরীতা নয়” এই নীতিকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয় উক্ত সংবিধানে। স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী তরুণ সমাজের ভোটাধিকার প্রদান এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত তরুণ সমাজের আপোষহীন সংগ্রামের সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি হিসেবে ভোটাধিকার বয়ঃসীমা ২১ বছর থেকে ১৮ বছরে হ্রাস করে উক্ত সংবিধানে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান সন্নিবেশিত করে। মোটকথা, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে সার্বিক ন্যায় বিচার এবং শোষণহীন ও কল্যাণমূখী সমাজ ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার সকল বিধিবিধান ও সুযোগ রাখা হয়েছিলো উক্ত সংবিধানে। এতে ঘটেছিল বাংলাদেশের আপামর জনগণের দীর্ঘকাল যাবত লালিত স্বপ্ন, আশা ও আকাংখার প্রতিফলন। এরজন্যে দেশের আপামর জনগণ বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানিয়েছিল তাদের আন্তরিক ও অকৃত্রিম মোবারকবাদ, ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
৫৮। ইতিপূর্বে যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিদেশী উন্নত দেশগুলোসহ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। ৫ই নভেম্বর তারিখে জাপান সরকার যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণে সাহায্য-সহযোগিতা করার প্রস্তাব দেয়। ৬ই নভেম্বর তারিখে বাংলাদেশ কলম্বো পরিকল্পনা সাহায্য সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ১১ই নভেম্বর শেখ ফজলুল হক মনিকে সভাপতি এবং নূরে আলম সিদ্দিকীকে সেক্রেটারী জেনারেল নির্বাচিত করে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ গঠন করা হয়। ১৪ই নভেম্বর পাকিস্তানে আটক তাবলিগ জামাতের ৮০ জন বাঙ্গালীকে ঢাকায় তাবলিগ জামাতে যোগদান করার জন্যে মুক্তি দেয়া হয়। ১৫ই নভেম্বর খুলনা জেলার দৌলতপুরে ২৯টি পাটের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১০ কোটি টাকার পাট সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়।
৫৯। ১৮ই নভেম্বর তারিখে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির দাবী জানিয়ে ২৩টি দেশ যৌথভাবে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় একটি প্রস্তাব পেশ করে। ২০শে নভেম্বর তারিখে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে গণহত্যা ও অন্যান্য অপরাধমূলক কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ১৯৭১ সালে নিয়োজিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডাঃ এ. এম. মালিককে দালাল আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে। ২৩শে নভেম্বর তারিখে রাশিয়ার মস্কোস্থ লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সম্মান সূচক “পেটিস লুমুম্বা” পদক পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা করে। ২৭শে নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালে ভারতীয় পশ্চিম ফ্রন্টে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আটকপ্রাপ্ত ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের বিনা শর্তে মুক্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ৩০ শে নভেম্বর তারিখে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ দানের প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিভাবে অনুমোদিত হয়। ৬০। ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আটককৃত সৈন্যদের সমসংখ্যক পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালীদের বিচারের হুমকি প্রদান করেন। ৬ই ডিসেম্বর তারিখ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর দ্বিতীয় দলের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারী জওয়ানদের অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং অনুষ্ঠানে তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে জনগণ তথা জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করার জন্যে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সকল কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।
৬১। ৯ই ডিসেম্বর সকাল এগারোটার ডাঃ ওয়াদুদ ও ডাঃ মিসেস সুফিয়া ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে ধানমন্ডির ৩/এ, রোডস্থ তাঁদের ক্লিনিকে আমাদের দ্বিতীয় সন্তান (মেয়ে) ভূমিষ্ঠ হয়। ডাঃ ওয়াদুদ এই সুসংবাদ প্রথম বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন। এই সুসংবাদের খুশীতে বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ উক্ত ক্লিনিকে গিয়ে হাসিনাকে ও সদ্য ভূমিষ্ঠ তার নাতনীকে মোবারকবাদ ও দোয়া করেন। আমি তখন অফিসে ছিলাম। এর একটু পরেই ঐ সংবাদ পেয়ে আমি হাসিনা ও সন্তানকে দেখতে যাই। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার অনেক আগে থেকেই শ্বাশুড়ী ও বঙ্গবন্ধুর ছোট বোন লিলি ফুফু আম্মা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় সম্পন্ন হওয়ায় আমরা সবাই আল্লাহ-তায়ালার নিকট আমাদের শুকরিয়া জ্ঞাপন করি। এর দুদিন পর হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় নেয়া হয়। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১-এর যুদ্ধ চলাকালে আমাদের প্রথম সন্তানের(ছেলের) জন্মের সময় ডাঃ ওয়াদুদ যেমন তাঁর ফি ও অন্যান্য খরচ বাবদ কোন টাকা-পয়সা নেননি, এবারও তিনি ফি ও অন্যান্য খরচ বাবদ কোন টাকা-পয়সা নিতে অস্বীকৃতি জানালেন।
৬২। ১৪ই ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনের স্থায়ীত্বকাল ছিল মাত্র দুই দিন। উক্ত সময়কালে গণপরিষদের সদস্যবৃন্দ ৪ঠা নভেম্বর তারিখে অনুমোদিত সংবিধানের কপিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাক্ষর করেন। এরপর ১৫ই ডিসেম্বর তারিখ মধ্যরাতের পর থেকে গণপরিষদ ও গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল ঘোষণা করা হয়। স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ১০ মাসের মধ্যেই জাতিকে একটি সংবিধান প্রদান করে ১৬ই ডিসেম্বর (১৯৭২) তারিখ থেকে দেশে সংবিধান+ সম্মত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করায় বঙ্গবন্ধু দেশ ও বিদেশের জনগন ও নেতাদের কাছ থেকে ভূয়সী প্রশংসা, শ্রদ্ধা ও গভীর আস্থা অর্জন করেছিলেন। ৬৩। ১৬ই ডিসেম্বর অনেক আনন্দ ও উৎসবের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হয় জাতীয় বিজয় দিবস। উক্ত দিবস অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু উক্ত জনসভায় ভাষণ দেন। ১৭ই ডিসেম্বর তারিখে বঙ্গভবনে তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দসহ বঙ্গবন্ধু সংবিধান মোতাবেক পুনরায় শপথ গ্রহণ করেন।১৮ই ডিসেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু সুপ্রিমকোর্ট ভবন উদ্বোধন করেন। ২২শে ডিসেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু ঢাকার মিরপুরে ১৯৭১-এ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসরদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্বের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৮শে ডিসেম্বর তারিখে খুলনায় আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ানসহ দুজন আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। উক্ত ঘটনায় বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বেদনা ও মর্মাহত হন। এহেন রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়েই সমাপ্ত হয় ১৯৭২ সাল।
(Unicoded by Mahmood Hussain Dawn)

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১৯৭৩ সাল

১। ১৯৭৩-এ বছর শুরু হয় এক দুঃখজনক ঘটনার মধ্য দিয়ে। ১লা জানুয়ারী তারিখে ন্যাপ (মােজাফফর)-এর আহবানে তৎকালীন উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতম বিমান হামলার প্রতিবাদে ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের দাবিতে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় বের হয় ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল। এরূপ একটি ছাত্র মিছিল ঢাকার তােপখানা রােডস্থ মার্কিন তথ্য কেন্দ্র(USIS)-এর নিকট এলে সেখানে মােতায়েনরত পুলিশ বাধা দেয়। অতঃপর ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। ফলে ২ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। আমি এ সময় সচিবালয়ের প্রধানমন্ত্রীর সংস্থাপন বিভাগের যুগ্মসচিব, বঙ্গবন্ধুর ছােট বােনজামাই এ.টি.এম. সৈয়দ হােসেন সাহেবের কক্ষে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর অফিস ছিলাে ঐ বিল্ডিংয়ের একই তলায়। গােলাগুলির আওয়াজ শুনে সৈয়দ হােসেন সাহেবসহ অফিসের সকলে বিচলিত হন। গােলাগুলির এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর অফিস কক্ষ হতে বারান্দায় চলে এসে সেখানে উপস্থিত উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এবিষয়ে খোঁজ-খবর নেন। গােলাগুলির ঘটনা বঙ্গবন্ধুর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল বলে মনে হলাে এবং তখন তাঁকে অত্যন্ত মর্মাহত দেখাচ্ছিল।
২। ৮ই জানুয়ারী (১৯৭৩) তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রথম শিল্প বিনিয়ােগ নীতি ঘােষণা করা হয়। অনধিক ২৫ লাখ টাকা মূল্যের কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান ১০ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত না করার অঙ্গীকার করা হয় উক্ত বিনিয়ােগ নীতিতে। ঐ দিনই বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর প্রথম শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু বিডিআর-এর জোওয়ানদের কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন এবং অভিবাদন গ্রহণ করেন। কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বিডিআর-এর সদস্যদের ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক তাঁদের ওপর আক্রমণকানে এবং মুক্তিযুদ্ধ

পৃষ্ঠাঃ ১৪৮
চলাকালে তাঁদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং স্বাধীন দেশে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে জাতির সেবায় আত্মনিয়ােগ করার জন্যে তাঁদের প্রতি আহবান জানান।
৩। ২১শে জানুয়ারী (১৯৭৩) তারিখে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু দল, গ্রুপ ও রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাস নির্বিশেষে নিষ্ঠা, সততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে এবং এক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়নে ও দেশ গড়ার কাজে তাঁর হাতকে শক্ত করার জন্যে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা কামনা করেন। এদিকে একই দিনে পল্টনে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক আয়ােজিত জনসভায় মাওলানা ভাসানী বললেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করে ছাড়বাে।” বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্যে মাওলানা ভাসানী বললেন, ‘মুজিব তুমি আমার সঙ্গে পিকিং চলাে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গণচীনের স্বীকৃতি এনে দেবাে। আমেরিকায় চলাে, যত সাহায্য দরকার এনে দেবাে। পাকিস্তান চলাে, ৫ লাখ বাঙ্গালীকে মুক্ত করে আনবাে।”
৪। ৭ই মার্চ (১৯৭৩) তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২২শে জানুয়ারী তারিখে। ২৫শে জানুয়ারী তারিখে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে নির্বাচনী প্রতীক বন্টন করা হয়। ২৮শে জানুয়ারী তারিখে শ্রমিক অসন্তোষজনিত কারণে ৪টি বস্ত্ৰমিলে লকআউট ঘােষণা করা হয়। ৩১শে জানুয়ারী আওয়ামী লীগের অংগদল শ্রমিক লীগের আহ্বানে ঢাকা শহরে হরতাল পালিত হয়।
৫। ২রা ফেব্রুয়ারী (১৯৭৩) তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকারের একটি সরকারী আদেশে ১৬টি শিল্প ইউনিট ‘সেনা কল্যাণ সংস্থার নিকট হস্তান্তর করা হয়। ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৭৩) তারিখে জাতীয় সংসদের ৯টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘঘাষণা করা হয়। এর দু’টো আসনে বঙ্গবন্ধু প্রার্থী ছিলেন। ৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধু কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শনে যান এবং উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ৯ই ফেব্রুয়ারী (১৯৭৩) তারিখে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ কুর্ট ওয়ালহেইম ২৪ ঘটার সফরে ঢাকা আসেন। ঢাকার তেজগাঁও বিমান বন্দরে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। ঐদিনই বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিকদের (অবাঙ্গালীদের) পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে জরুরী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে তাঁর প্রতি আবেদন জানান। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রদানের বিষয়েও বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ১৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৭৩) তারিখে ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যগণ কর্তৃক ঢাকায় বাঙ্গালীদের সশস্ত্র আক্রমণের সময়

পৃষ্ঠাঃ ১৪৯
বিধ্বস্ত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনঃনির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়। ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৭৩) তারিখে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ মাওলানা ভাসানীকে টাঙ্গাইলস্থ সন্তোষ থেকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে স্থানান্তর করে তাঁর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ৫ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু পিজি হাসপাতালে অসুস্থ মাওলানা ভাসানীকে দেখতে যান এবং তাঁর কুশলাদি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেন এবং তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে বেশ কিছু সময় কাটান।
৬। ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনের দিনটি যতই এগিয়ে আসছিল ততই উত্তপ্ত হয়ে আসছিল দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ। ১৬ই ডিসেম্বর (১৯৭২) তারিখে সংবিধান চালু হওয়ার পর থেকেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কথাবার্তা শুরু হয়। ছােট- বড়-মাঝারি সকল দলেই সাজ সাজ রব। কিন্তু আওয়ামী লীগের মােকাবেলায় নিজেদের শক্তি সম্পর্কে কম-বেশী সচেতন ছিল মােটামুটি সকলেই। তাই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইচ্ছে থেকেই উঠলাে সম্মিলিত বিরােধী ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব। আর তখনই প্রস্তাবিত ঐক্যফ্রন্ট গঠন এবং তার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে উগ্র বামপন্থী, ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তিসমূহ মাওলানা ভাসানীর প্রতি অনুরােধ জানায়। উল্লেখ্য, ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী প্রমুখ রাজনৈতিক দলগুলাে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ থাকায় তাদের দলগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোন অবকাশ ছিল না। যা হােক, নির্বাচনকে সামনে রেখে বাজিমাতের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলগুলাে বিভিন্ন অপপ্রচারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। অতীতের পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল শাসক ও শােষকদের মত তারাও ভারতবিরােধী প্রচারণা, ইসলামের দোহাই এবং সাম্প্রদায়িক জিগিরকেই বেছে নেয় আওয়ামী লীগকে খতম করার হাতিয়ার হিসেবে। এমনকি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর কণ্ঠেও ছিল একই সুর। আওয়ামী লীগকে উৎখাত করার উদ্দেশ্যে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এক ডজনেরও বেশী দল-উপদল গ্রুপ সমবায়ে গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ও মাওলানা ভাসানী নিজেও অনেক চেষ্টা করেন জাসদকে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে। কিন্তু একলা চলার নীতিতে বিশ্বাসী এবং এককভাবে নির্বাচনে অধিকতর সাফল্য অর্জনে আশাবাদী জাসদকে উক্ত সর্বদলীয় কমিটিতে যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তা সত্ত্বেও, এদের সবার নির্বাচনী প্রচারের সুর ছিল একই। ব্যতিক্রম ছিল শুধু অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং কমরেড মণি সিং-এর বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি। এই দু’টো দল নির্বাচনী অভিযানে নেমে যে বক্তব্য জাতির সামনে পেশ করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছাড়া তা মােটামুটি আওয়ামী লীগের বক্তব্যেরই অনুরূপ ছিল।

পৃষ্ঠাঃ ১৫০
৭। নির্বাচনের আগে বঙ্গবন্ধু জনসংযােগ সফরে বের হন। বিভিন্ন স্থানে তার নির্বাচনী জনসভায় যে বিপুল জনসমাবেশ হয়, তাঁর সফর ও জনসভাকে কেন্দ্র করে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে প্রাণােচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয় তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সরকার বিরােধী মহলগুলাের অপপ্রচার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। জনসংযােগ সফরের বিভিন্ন পর্যায়ের সভা-সমাবেশে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু বললেন, “সত্তরের নির্বাচনে ৬ দফার পক্ষে ভােট চেয়েছিলাম। আপনারা ভােট দিয়েছিলেন আমার নৌকায়। পাকিস্তানীরা ৬ দফা মানেনি। আমিও আপােষ করিনি। আপনাদের সঙ্গে বেঈমানী করিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আজকের সংগ্রাম দেশ গড়ার সংগ্রাম। যুদ্ধ বিধ্বস্ত এই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। ষড়যন্ত্র চলছে স্বাধীনতা নস্যাৎ করার। এই ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতে হবে। মানুষের খাদ্য নাই, বস্ত্র নাই, মাথা গুজবার ঠাঁই নাই। আমার এই দুঃখী মানুষদের বাচাতে হবে। শােষণমুক্ত সমাজ গড়তে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এই চারটি মূল রাষ্ট্রীয় আদর্শের ভিত্তিতে সােনার বাংলা কায়েম করতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়, স্বাধীন, শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশে স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম পালন করার অধিকার মাত্র। জনগণের শত্রুরা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে। ডাকাতি, রাহাজানি, সন্ত্রাস, অন্তর্ঘাত আর গুপ্ত হত্যার দ্বারা এরা দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে। রাতে মানুষ ঘুমাতে পারে না। এদের অশুভ তৎপরতা প্রতিহত করতে হবে। বন্দুকের নল। নয়, বরং জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। শােষকের দিন শেষ হয়ে গেছে। শশাষিত মানুষের। মুক্তির জন্যেই আমি সারা জীবন সংগ্রাম করেছি। আজ আমার একমাত্র কামনা, বাংলার দুঃখী মানুষ, বাংলার গরীব চাষী, শ্রমিক-মজুর ও অন্যান্য ছিন্নমূল মানুষ যেন মাথা গুজবার ঠাঁই পায়, পেট ভরে খেতে পায়, পরনের কাপড় পায়, রােগের চিকিৎসা পায়, সন্তানসন্ততির লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করতে পারে। যদি আমার ওপর আস্থা থাকে, আমাকে ভােট দেবেন, আমার মার্কা নৌকা।”
৮। ১৯৭৩-এর সাধারণ নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনে ১৪টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের ৯৫৯ জন এবং ১২১ জন স্বন্ত্র প্রার্থী মিলে ১ হাজার ৮০ ব্যক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ৭ই মার্চ (১৯৭৩) তারিখে মােটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯২টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান, সােহরাব হােসেন, জিল্লুর রহমান, শ্রী মনােরঞ্জন ধর ও তােফায়েল আহমদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অপর ৮টি আসনে জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান, জাসদের আব্দুস সাত্তার এবং ৬ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেন। আওয়ামী লীগের এই বিপুল বিজয়ে বিরােধী দলগুলাের অনেক নেতা অভিযােগ করেছিলেন যে, নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক প্রার্থী হয়তাে বা ভয়ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে নির্বাচনের রায়কে নিজের পক্ষে এনেছেন। কিন্তু

পৃষ্ঠাঃ ১৫১
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের অপব্যবহার করে কিংবা রেডিও-টেলিভিশনে ঘােষণার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীকে নির্বাচনে জেতানাে হয়েছে এবিষয়ে কোনই সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
৯। ১৮ই মার্চ (১৯৭৩) তারিখে আওয়ামী লীগ ‘শপথ দিবস” পালন করে। এই উপলক্ষে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়ােজিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। ১৯শে মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার রেশনে সপ্তাহে মাথাপিছু তিন পােয়া চাউল ও সােয়া দুই সের গম বরাদ্দের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ২৫শে মার্চ (১৯৭৩) তারিখে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ মূল্যবান ও অসাধারণ অবদান রাখার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ৫৪৬ জনকে জাতীয় খেতাব প্রদান করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ২৮শে মার্চ লেবাননের সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। মুসলিম আরব জাহানের লেবাননই দ্বিতীয় দেশ, যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৩০শে মার্চ বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকাস্থ আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষা সেমিনার উদ্বোধন করেন।
১০। ১৮-২০শে মার্চ (১৯৭৩) তারিখে আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্র লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন আয়ােজন করা হয়েছিল। ইতিপূর্বে শেখ ফজলুল হক মণি শেখ শহিদুল ইসলামকে ছাত্র লীগের সভাপতি হওয়ার জন্যে তাকে রাজি করাতে আমার শাশুড়ীর ওপর ভীষণ চাপ সৃষ্টি করেছিল। শেখ শহীদ তখন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে চাকুরীতে নিয়ােজিত ছিল। শাশুড়ী কয়েকবার শেখ মণির প্রস্তাবে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবা, শেখ শহীদ এখন চাকুরী করায় আমার বােনের সংসারটা মােটামুটি চলে যাচ্ছে। শেখ শহীদ এই চাকুরী ছেড়ে দিয়ে ছাত্র লীগের সভাপতি হলে তারা পুনরায় অভাব অনটনের মধ্যে পড়বে।” যা হােক, পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ শহীদ ছাত্র লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিতে সম্মতি দেয়। অতঃপর ছাত্র লীগের উপরােল্লিখিত সম্মেলনে শেখ শহীদকে সর্বসম্মতিক্রমে ছাত্র লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১১। ৪ঠা এপ্রিল (১৯৭৩) তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার ‘বাংলাদেশ ব্রেডক্রস সমিতি আদেশ জারি করে। ৫ই এপ্রিল তারিখে টগী শিল্প এলাকায় দুই দল শ্রমিকের মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে ঢাকা স্টেডিয়ামের উনাক্ত প্রাঙ্গণে টঙ্গী শিল্প এলাকার কয়েক হাজার শ্রমিক আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ৭ই এপ্রিল (১৯৭৩) তারিখে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানের অধীনে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ১১ই এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের নিরাপত্তা বিধান ও তাদের অতিসত্বর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করার পুনরায় অনুরােধ জানিয়ে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলের নিকট জরুরী তারবার্তা প্রেরণ করেন। ১২ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ সরকারের নতুন

পৃষ্ঠাঃ ১৫২
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি সম্পর্কে মতবিনিময় ও আলাপ-আলােচনা করার উদ্দেশ্যে দিল্লী যাত্রা করেন। ১৭ই এপ্রিল (১৯৭৩) তারিখে বাংলাদেশ ও ভারতের এক যুক্ত ঘােষণায় পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের ফেরত আনা, বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানী নাগরিকদের (অবাঙ্গালীদের) পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে এবং পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ইস্যুগুলাে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করার পক্ষে ঐকমত্য প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক ৯৩ হাজার সদস্যদের থেকে মাত্র ১৯৫ জন কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে অবশিষ্টদের পাকিস্তানে আটক ৫ লাখ বাঙ্গালীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানাের জন্যে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা করা সাপেক্ষে নিঃশর্ত মুক্তিদানের ইংগিতও দেয়া হয় উক্ত যুক্ত ঘােষণায়। ২১শে এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বার্থপরিপন্থী কাজের অপরাধের জন্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ৩৯ জন জগত বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল ঘােষণা করে।
১২। এই সময়ে ঘটা একটি ঘটনা বিশেষভাবে প্রণিধানযােগ্য। ভারত সরকারের আণবিক শক্তি ডিপার্টমেন্ট-এর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন থেকে প্রকৌশলী জনাব এ.এস.এম. এনামুল হক, আণবিক চুল্লী বিশেষজ্ঞ ডঃ এম. আহসান ও আমাকে ভারতে পাঠানাে হয় ২১শে মার্চ (১৯৭৩) তারিখ থেকে বােম্বেস্থ ভাবা আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে দুই সপ্তাহব্যাপীFirst Indian National Conference on Nuclear Science and Technology-এ অংশগ্রহণ এবং ঐ সুবাদে ভারতের বিভিন্ন আণবিক শক্তি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা পরিদর্শন করার জন্যে। কনফারেন্স চলাকালে প্রতিদিন ভাবা আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক ডঃ রাজা রামান্না ঐ প্রতিষ্টানের কয়েকজন পরিচালক ও উর্ধ্বতন বিজ্ঞানীসহ আমাদের মধ্যাহ্নভােজনে আপ্যায়ন করতেন। একদিন ডঃ রামান্না ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণকৃত এবং ঐ সময় ভারতে আটককৃত ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের প্রসঙ্গে বলেন যে, তাদের দীর্ঘকাল ভারতে না রাখার পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের বুদ্ধিজীবী ও জনগণের অভিমত। সুতরাং তিনি বলেন যে, আমি যেন বাংলাদেশে ফিরেই তৎবিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করি। ডঃ রামান্না আরও বলেন যে, বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধীর উচিৎ হবে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের থেকে কেবলমাত্র কর্মকর্তাদের রেখে অন্যান্যদের অনতিবিলম্বে নিঃশর্তে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে অতি শীঘ্রই একটি ঘােষণা দেওয়া। ভাবা আণবিক গবেষণা কেন্দ্রে উপরােক্ত সম্মেলন শেষে মহারাষ্ট্রের তারাপুরে, মাদ্রাজের কালপাক্কামে, অন্ধ্র প্রদেশের হায়দ্রাবাদে, রাজস্থান প্রদেশের কোটায়, কাশ্মীরের শ্রীনগরস্থ গুলমার্গে এবং কোলকাতায় ভারতের বিভিন্ন আণবিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা পরিদর্শন করে আমরা এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে দেশে ফিরে আসি। আমার ভারত সফরের সময় হাসিনা বঙ্গবন্ধুর বাসায় থাকতাে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর বাসায় হাসিনার কক্ষটি একমাত্র

পৃষ্ঠাঃ ১৫৩
আমাদের জন্যেই সংরক্ষিত রাখা হতাে। আমাদের নিজৰ আলাদা ফ্ল্যাট থাকা সত্ত্বেও প্রায় প্রতিরাত আমরা বঙ্গবন্ধুর বাসায় থাকতাম। ভারত থেকে ফিরে এসেই ডঃ রামান্নার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি সম্পর্কিত অভিমত বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করি। আমি বঙ্গবন্ধুকে এও জানাই যে, সচিবের পদমর্যাদাসম্পন্ন ডঃ রামান্না শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশেষ উপদেষ্টা ও সমর্থক।
১৩। ২রা মে (১৯৭৩) তারিখে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল খাদ্যশস্য ঘাটতি মােকাবেলায় বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য দিয়ে সাহায্য করার জন্যে বিশ্বের নিকট আবেদন জানান। ৫ই মে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিনা মূল্যে ভূমিহীন কৃষকদের নিকট খাস জমি বন্টনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৭ই মে আওয়ামী লীগ খাদ্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের মূল্য হাস করার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্যে সরকারের নিকট ২০ দফা দাবী পেশ করে। এ সময় অতিবৃষ্টি ও পাহাড়িয়া ঢলে দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ৪টি জেলা বন্যাকবলিত হয়। ১২ই মে বঙ্গবন্ধু ঐ সমস্ত বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন। ১৫ই মে ৩ দফা দাবীতে মাওলানা ভাসানী অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৬ই মে বঙ্গবন্ধু অনশনরত মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৮ই মে নােয়াখালী জেলার চরক্লার্কে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে খাস জমি বন্টন করা হয়। ১৯শে মে বঙ্গবন্ধুর নিকট বেতন কমিশনের রিপাের্ট পেশ করা হয়। ২০শে মে তারিখে অনুষ্ঠিত সংসদের ৪টি আসনের উপনির্বাচনে, দুইটিতে আওয়ামী লীগ, একটিতে জাসদ এবং অপরটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়। ২২শে মে তারিখে মাওলানা ভাসানী বিরােধী দলীয় নেতাদের অনুরােধে তাঁর অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। ২৩শে মে বিশ্বশান্তি পরিষদের উদ্যোগে ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে বিশ্বশান্তি পরিষদের সেক্রেটারী জেনারেল শ্রী রমেশ চন্দ্র বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ‘জুলিও কুরী’ পদক প্রদান করেন। ২৬শে মে পাকিস্তানে বাঙ্গালী নির্যাতনের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের আহ্বানে সারাদেশে প্রতিবাদ সভা ও মিছিলের আয়ােজন করা হয়। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে পাকিস্তানে আটকেপড়া হাজার হাজার বাঙ্গালীর সর্বস্ব লুট করা এবং তাদের বন্দী শিবিরে আটক রাখার খবর পাওয়া গিয়েছিল। পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো হমকি দিয়েছিলেন এই বলে যে, পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের বিচার করা হলে প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙ্গালীদেরও বিচার করা হবে। ২৯শে মে তারিখে ফরিদপুরের নড়িয়ায় নিজ বাসভবনে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি নূরুল হক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
১৪। ৬ই জুন তারিখে কর্নেল শফিউল্লাহ এবং কর্নেল জিয়াউর রহমানকে ব্রিগেডিয়ারের পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। ৮ই জুন তারিখে ডঃ কুদরত-ই-খুদা বঙ্গবন্ধুর নিকট শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট পেশ করেন। ১৮ই জুন তারিখে দুষ্কৃতকারীদের একদল রাজশাহীর নিয়ামতপুর থানার ছাড়া ফাঁড়ি আক্রমণ করে সেখানকার সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র লুট করে। একই

পৃষ্ঠাঃ ১৫৪
তারিখে বাংলাদেশ বিমানের প্রথম ভাড়া করা বােয়িং বিমান লন্ডন যাত্রা করে। ২২শে জুন তারিখে দুষ্কৃতকারীর একটি দল কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার মাধিয়া ফাঁড়ি আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র লুট করে। ২৬শে জুন তারিখে দুষ্কৃতকারীর একটি দল কাঠালিয়া থানার আমুয়া ফাঁড়ি লুট করে। ২৮শে জুন তারিখে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং বাংলাদেশে প্রথম একটি ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বিল। ঐ দিন রাতে দুষ্কৃতকারীর একটি দল বরিশালের চরফ্যাশন পুলিশ থানা লুট করে। ২৯শে জুন দুষ্কৃতকারীর একটি দল রামগড়ের জালিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা চালায়।
১৫। ১লা জুলাই (১৯৭৩) তারিখে বাংলাদেশ বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ৩রা জুলাই তারিখে দুষ্কৃতকারীদের একটি দল খুলনার মােড়েলগঞ্জ থানার তেলিগাতি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র লুট করে। ৫ই জুলাই তারিখে আন্তর্জাতিক ব্যাংক বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে ৫ কোটি ৫১ লাখ ডলার সাহায্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৮ই জুলাই দুষ্কৃতকারীরা পটুয়াখালীর পাথরঘাটা থানায় চরকুয়ানী এবং বরিশাল জেলার বাউফল থানার বগা ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা চালায়। ৯ই জুলাই তারিখে দুষ্কৃতকারীর দুটি পৃথক দল যথাক্রমে ঢাকার বৈদ্যেরবাজার থানার অলিপুরা ফাঁড়ি এবং ফরিদপুর জেলার গােপালগঞ্জ থানার পাটগাঁথিয়া ফাঁড়ি আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র লুট করে। ১০ই জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্যে ১০টি বেতন স্কেল নির্ধারণ করে জাতীয় বেতন কমিশনের রিপোের্ট প্রকাশ করে। ১২ই জুলাই তারিখে সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীর একটি দল বরিশাল জেলার বাউফল থানার ধুলিয়া ফাঁড়ি লুট করে। ১৩ই জুলাই তারিখে মরকোর সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৪ই জুলাই জাতীয় সংসদ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে আইন প্রণয়ন করে। ১৬ই জুলাই গঙ্গা নদীর। পানি বন্টনের বিষয়ে দিল্লীতে ভারত ও বাংলাদেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়। উক্ত বৈঠকে গঙ্গার পানি বন্টন প্রশ্নে ভারত ও বাংলাদেশ একমত না হওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ চালু না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৭ই জুলাই তারিখে আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া ও মৌরিতানিয়ার সরকারগুলাে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৮ই জুলাই তারিখে দালাল আইনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ সাবেক কনভেনশন মুসলিম শীগ প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরী মারা যান। ২৫শে জুলাই তারিখে দুষ্কৃতকারীর দুটি পৃথক দল যথাক্রমে ঢাকার লৌহজং থানা এবং ফরিদপুরের কোতােয়ালী থানার রামকৃষ্ণ মিশন ফাঁড়ি লুট করে। ২৬শে জুলাই বঙ্গবন্ধু যুগােশ্লাভিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফর এবং কানাডার রাজধানী অটোয়ায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্যে ১৮ দিনের জন্যে বিদেশ যাত্রা করেন।
১৬। ঐ সময় আমি ইটালীর ট্রিয়েন্টে আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানবিষয়ক কেন্দ্রে জুন মাস থেকে ৬ মাসের জন্যে গবেষণা কাজে নিয়ােজিত ছিলাম। আমি টিয়েস্টের উক্ত

পৃষ্ঠাঃ ১৫৫
কেন্দ্রে যােগদান করেছিলাম ২১শে জুন (১৯৭৩) তারিখে। সেদিনই প্রফেসার আব্দুস সালাম আমার সঙ্গে প্রায় এক ঘন্টা কথাবার্তা বলেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রফেসার সালাম ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রধান বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্ৰীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেও প্রফেসার সালামকে তাঁর প্রধান বিজ্ঞানবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে বহাল রেখেছিলেন। ২১শে জুন তারিখে সাক্ষাতের সময় প্রফেসার সালাম কুশলাদি বিনিময়ের পর আমাকে বলেন যে, ১৯৭১-এর মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ সাহেবের আলাপ-আলােচনা বৈঠকের সময় তাঁকে ঢাকায় উপস্থিত থাকার জন্যে অবহিত করা হয়েছিল। তিনি সে অনুযায়ী করাচী পৌছেছিলেন ১৮ই মার্চ তারিখে। সে সময় প্রফেসার সালাম হাসিনার জন্যে একটি কার্ডিগান ও আমার জন্যে একটি কলম সঙ্গে এনেছিলেন। ঢাকা থেকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ উপদেষ্টা এম.এম. আহমেদ প্রফেসার সালামকে বলেছিলেন যে, ঢাকায় গিয়ে তাঁকে তাঁদের শর্তে শেখ সাহেবকে রাজি করাতে হবে। জবাবে প্রফেসার সালাম এম.এম. আহমেদকে জানিয়েছিলেন যে, শেখ সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল আমার মাধ্যমে এবং তাও স্বল্প সময়ের জন্যে এবং তিনি শেখ সাহেবের সঙ্গে আলাপ করতে সম্মত কিন্তু তাঁদের শর্তে তাঁকে রাজি করার কোন প্রতিশ্রুতি দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। পরের দিন প্রফেসার সালামকে জানানাে হয়েছিল যে, তাঁর ঢাকায় যাওয়ার আর কোন প্রয়ােজন নেই। অতঃপর প্রফেসার সালাম আমাদের জন্যে ক্রয়কৃত দ্রব্যগুলাে পাকিস্তান আণবিক শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডঃ আই.এইচ. উসমানীর কাছে রেখে এসেছিলেন পরবর্তীতে সেগুলাে আমাদের নিকট পৌছে দেয়ার জন্যে। প্রফেসার সালাম আমাকে আরও জানান যে, তিনি ঢাকাস্থ আণবিক শক্তি কেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক ডঃ শমসের আলীর নামে একটি প্রকল্পের অনুদান হিসেবে তিন হাজার ডলারের একখানা চেকও লিখেছিলেন ঐ সময়। এ কথা বলে তিনি ডয়ার থেকে ঐ চেকটি বের করে আমাকে দেখান। প্রফেসার সালাম আরও বলেন যে, বাংলাদেশে গণহত্যার ঘটনা হয়েছিল তা তিনি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। যা হােক, ১৯৭১-এ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বাংলাদেশে গণহত্যা ও অন্যান্য দুষ্কর্মের জন্যে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন আমার কাছে। অতঃপর প্রফেসার সালাম আরও বলেন যে, জনাব জুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর সঙ্গে প্রথম সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তাঁকে বলেছিলেন, “Professor Salam, Allama Iqbal dreamt of two Pakistans but Mr Jinnah wanted one Pakistan. Now see what has heappened. (প্রফেসার সালাম, আল্লামা ইকবাল কল্পনা করেছিলেন দুটি পৃথক পাকিস্তানের কিন্তু মিস্টার জিন্নাহ চেয়েছিলেন একটি পাকিস্তান। এখন দেখুন মিস্টার জিন্নাহর পাকিস্তানের কি দশা হয়েছে)।”

পৃষ্ঠাঃ ১৫৬
১৭। বঙ্গবন্ধুর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে যুগােশ্লাভিয়ায় রাষ্ট্রীয় সফরে আসার খবর পেয়ে প্রফেসার সালাম আমাকে বললেন যে, তিনি ঐ সময় বেলগ্রেড গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অত্যন্ত আগ্রহশীল এবং সেজন্যে আমি যেন ব্যবস্থা করি। অতঃপর এতদবিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুমতি নেয়ার জন্য আমি ঢাকায় হাসিনাকে ফোন করি। পরদিন হাসিনা আমাকে জানায় যে, প্রফেসার সালামের প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ কোন আপত্তি নেই তবে বিষয়টি অত্যন্ত গােপন রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধু ২৭শে জুলাই বেলগ্রেড পৌছাবেন বলে স্থির করা হয়েছিল। এর দিনসাতেক পূর্বে ইটালীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আমাকে অবহিত করা হয় যে, বঙ্গবন্ধু আমাকে ২৯শে জুলাই সকাল দশটার মধ্যেই বেলগ্রেডে পৌছাতে বলেছেন এবং সেজন্য তাঁরা ব্যবস্থা করেছেন। আমি সার্ভিস কোচে যথাসময়ে বেলগ্রেড পৌছাব বলে আমাদের দূতাবাসকে অবহিত করি। ইতব্যসরে জুলফিকার আলী ভুট্টো কানাডা ও আমেরিকা সফর শেষে পাকিস্তানে ফেরার পথে ইটালীর রাজধানী রােমে কয়েকদিনের জন্যে যাত্রাবিরতি করেন। এই পর্যায়ে প্রফেসার সালাম আমাকে জানান যে, ভুট্টো সাহেব ব্রোমে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করার জন্যে বার বার তাগিদ দিচ্ছেন। পাকিস্তান বাংলাদেশকে তখনও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় বঙ্গবন্ধু ভুট্রোর প্রস্তাব সম্পূর্ণ নাকচ করে দেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রফেসার সালাম আমার সঙ্গে তাঁর বেলগ্রেড যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে বঙ্গবন্ধুকে দেয়ার জন্যে তাঁর একটি পত্র আমাকে দিয়ে বললেন, “শেখ সাহেবের কাছে আমার বিশেষ অনুরােধ যে, তিনি যেন পাকিস্তানী ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে শুধুমাত্র ১৯৫ জন কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে অবশিষ্টদের বিনা শর্তে মুক্তি দেন।” তিনি আরও বলেন যে, পরবর্তীতে ১৯৫ জনের বিচার করে ওদের থেকে শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ফাঁসি দেয়া যেতে পারে। যা হােক, যথাসময়ে আমি বেলগ্রেড পৌছেই বঙ্গবন্ধুকে এ সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেন সাহেবকেও এবিষয়ে অবহিত করা হয়েছিল। অতঃপর বঙ্গবন্ধু তাঁর সফর সঙ্গীদের সঙ্গে নিয়ে ভূমধ্যসাগরের যুগােশ্লাভিয়ার উপকূলবর্তী প্রেসিডেন্ট টিটোর অবকাশস্থান ব্রিয়নী দ্বীপে তাঁর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের জন্যে চলে যান। এই সফরে। বঙ্গবন্ধু আমাকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। সেখানে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে রাষ্ট্ৰীয় ভােজে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেই সুবাদে প্রেসিডেন্ট টিটোকে অতি কাছে থেকে দেখার এই প্রথম সুযােগ ও সৌভাগ্য হলাে আমার। সেদিন প্রত্যক্ষ করলাম যে, বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রেসিডেন্ট টিটোর ছিল গাঢ় সহমর্মিতা, সম্মান ও শ্রদ্ধাবােধ। ৩১শে জুলাই তারিখে যুগােশ্লাভিয়ায় ৫ দিন রাস্ত্রীয় সফর শেষে বঙ্গবন্ধু কমনওয়েলথ সম্মেলনে যােগদান করার জন্যে রওনা দেন কানাডার রাজধানী অটোয়ার উদ্দেশ্যে। যুগােশ্লাভিয়া ও কানাডীয় সফর শেষে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফেরেন ১৩ই আগস্ট।

পৃষ্ঠাঃ ১৫৭
১৮। আগস্ট মাসে বাংলাদেশে মারাত্মক বন্যায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। দেশের অগণিত মানুষ নিপতিত হয় সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট ও অভাব-অনটনের মধ্যে। মানুষের এহেন নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশার করুণ চিত্রও কোন সাড়া জাগাতে পারেনি উগ্র বামপন্থী ও স্বাধীনতা বিরােধী লােকদের বিবেকে। তারা অব্যাহত রেখেছিল তাদের পূর্বপরিকল্পিত সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ। ১লা আগস্ট তারিখে দুষ্কৃতকারীরা ঢাকা জেলার ঘিওর থানার জাবড়া ফাঁড়ি লুট করে। ২রা আগস্ট তারিখে দুষ্কৃতকারীদের এক দল হামলা চালায় কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার আমলা ফাঁড়িতে। ৫ই আগস্ট তারিখে ঢাকার শিবপুর থানায় দুষ্কৃতকারীরা চালায় বেপরােয়া হামলা। ৭ই আগষ্ট তারিখে দুষ্কৃতকারীদের একদল সশস্ত্র হামলা চালায় বরিশালের বাবুগঞ্জ থানায় চানপাশা ফাঁড়িতে। ৯ই আগস্ট কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার আটগ্রাম ফাঁড়িতে চালানাে হয় সশস্ত্র হামলা। ১০ই আগস্ট দুষ্কৃতকারীদের এক দল সশস্ত্র হামলা চালিয়ে লুট করে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানার উচাখিলা ফাঁড়ি। ১১ই আগস্ট তারিখে দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায় চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনাটি ফাঁড়িতে। ১৩ই আগষ্ট তারিখে চট্টগ্রামে গ্রেনেড চার্জ করে একটি ব্যাংক ডাকাতি করা হয়। একই তারিখে দুষ্কৃতকারীরা সশস্ত্র হামলায় লুট করে পটুয়াখালীর পাথরঘাটার জ্ঞানপাড়া রেঞ্জার অফিস, বরিশালের স্বরূপকাঠি থানার ইন্দেরহাট ফাঁড়ি এবং ঢাকার কাপাসিয়া থানা। ১৫ই আগষ্ট দুষ্কৃতকারীরা হামলা চালায় পার্বত্য চট্টগ্রামের লামা থানার ফৈথান ফাঁড়িতে। ২০শে আগস্ট লৌহজংয়ে সংঘটিত হয় সশস্ত্র দুবৃত্ত ও জাতীয় রক্ষীবাহিনীর জোয়ানদের মধ্যে তিন ঘণ্টা গুলিবিনিময়। ২৩শে আগষ্ট তারিখে দুষ্কৃতকারীরা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে লুট করে কুমিল্লা জেলার হােমনা থানার চন্দনপুরা ফাঁড়ি। ২৫শে আগস্ট তারিখে সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীরা বৈদ্যেরবাজারের আনন্দবাজার হাট হতে ৯ ব্যক্তিকে অপহরণ করে এবং পরে ৭ জনকে হত্যা করে। উগ্র বামপন্থী ও স্বাধীনতাবিরােধী লােকদের এহেন সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে দিনরাত উৎকণ্ঠিত ও আতংকগ্রস্ত হয়ে থাকে সারাদেশের জনসাধারণ। দেশের এহেন আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিতে জনগণ আরও বেশী বিচলিত হয়ে পড়ে ঐ সময় প্রদত্ত মাওলানা ভাসানীর বঙ্গবন্ধুর সরকার বিরােধী বিভিন্ন উক্তি, বিবৃতি ও বক্তব্যে। ২৯শে আগস্ট (১৯৭৩) তারিখে মাওলানা ভাসানীর ৩দফা দাবীর পক্ষে জনসমর্থন প্রদর্শনে তাঁর অনুসারীরা সারা ঢাকা শহরে সাধারণ হরতাল পালন করে।
১৯। ১৯৭৩ সালের জুলাইয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে এবং আগষ্টে দিল্লীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা শ্রী পি.এন. হাকসার এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদের মধ্যে বিস্তারিত আলােচনার পর একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতে আটক পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দী, পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিকদের (অবাঙ্গালীদের) স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানাের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করা হয় এই চুক্তিতে। এই চুক্তিতে আরও বলা হয় যে, এই লােক বিনিময়

পৃষ্ঠাঃ ১৫৮
শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আলােচনার মাধ্যমে অবশিষ্ট ১৯৫ জন (পাকিস্তানী) যুদ্ধাপরাধীদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এর অব্যবহিত পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের পক্ষ থেকে ঘােষণা করা হয়, “একমাত্র সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতেই বাংলাদেশ এ ধরনের কোন আলােচনায় বসতে পারে।” ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উপরােক্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় স্বভাবতঃই আশা করা হয়েছিল যে, অতঃপর পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু স্বীকৃতি দেয়া তাে দূরের কথা, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ঠেকিয়ে রাখার জন্যে পাকিস্তান ধরণা দেয় গণচীনের দুয়ারে। ৩০শে আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ক (তৎকালীন) প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদ ছুটে যান পিকিংয়ে (বেইজিংয়ে)। সেখানে তাঁর চীনা নেতাদের সঙ্গে প্রধানতঃ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়েই আলােচনা হয়। অতঃপর আজিজ আহমদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন, “পাকিস্তানী ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীর বিচারের সিদ্ধান্ত বাতিল না করা পর্যন্ত পাকিস্তান ও গণচীন বাংলাদেশের জাতিসংঘভূক্তির বিরােধিতা করে যাবে।”
২০। ৬ই সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) তারিখে বঙ্গবন্ধু জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের জন্যে আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সের উদ্দেশ্যে রওনা হন। উক্ত সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, “বিশ্ব শােষক আর শােষিত এই দুই ভাগে বিভক্ত।” আর শােষকের বিশ্বের অন্তহীন ঐশ্বর্যের নগ্ন অহমিকার পদতলে পিষ্ট, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের নিদারুণ কষঘাতে জর্জরিত শােষিত বিশ্বের আত্মার আর্তনাদকেই বঙ্গবন্ধু প্রতিধ্বনিত করেন তাঁর বক্তৃতায়। বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “শােষিত বিশ্বকে বাঁচাতেই হবে।” জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সেখানে উপস্থিত বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বপ্রথম তাঁকে অভিনন্দন জানান কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো। ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “মুজিব, শশাষকের বিশ্বের বিরুদ্ধে শােষিত বিশ্বের এই বাঁচার সংগ্রাম আমারও সংগ্রাম।”
২১। এই সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রো, তানজিনিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে, কম্বােডিয়ার প্রিন্স নারােদম সিহানুক, সৌদি আরবের বাদশা ফয়সাল এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের আন্তরিক মতবিনিময় হয়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎকারের সময় ফিদেল ক্যাস্ট্রো সমাজতন্ত্রের মতাদর্শে বিশ্বাসী চিলির (তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে উৎখাত করার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেcIA-এর ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার কথা উল্লেখপূর্বক তাঁকে বলেছিলেন, “সি. আই. এ. সম্পর্কে সাবধান। সুযােগ পেলেই কিন্তু তারা আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।” ফিদেল ক্যাস্ট্রোর এই মন্তব্যের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “পরিণতি যাই হােক, আমি আপােষ করবাে না।” পাকিস্তানী আমলের ঊর্ধ্বতন আমলাদের বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চাকরির ধারাবিহকতা বজায় রাখার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে

পৃষ্ঠাঃ ১৫৯
ফিদেল ক্যাস্ত্রো তাঁকে আরও বলেছিলেন, “আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ প্রমূখ পেশার নেতৃস্থানীয়দের সরকারী প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করুন। এরা ভূলের পর ভুল করে সঠিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করবে—কিন্তু এরা কোনাে ষড়যন্ত্র করবে না। আপনার মুক্তিযােদ্ধা ছেলেদের আরও বেশী করে দায়িত্ব দিন এবং সম্পূর্ণভাবে ওদের বিশ্বাস করুন। অন্যথায়, আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।”
২২। আর একটি পৃথক সাক্ষাৎকারের সময় লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “আমি আপনার সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ বন্ধুত্ব করতে চাই। অবশ্য এর জন্যে প্রথমেই আমি আপনাকে অনুরােধ করবাে আপনার দেশের নাম বদলিয়ে ‘বাংলাদেশ ইসলামী প্রজান্ত্র রাখার জন্যে।” প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীর এই প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, তথা স্বাধীনতাযুদ্ধে মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তাছাড়া সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহাগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের একটি ভিন্নধর্মী চিন্তা-চেতনা, মনমানসিকতা। ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের মােট জনসংখ্যার এক ষষ্ঠাংশ অমুসলিম। সর্বোপরি, আল্লাহতায়ালা তাে শুধু আল মুসলেমীন নন, তিনি তাে রাম্বুল আলামীন, সব কিছুরই স্রষ্টা, মহান। সুতরাং আপনার প্রস্তাব কোনােক্রমেই গ্রহণযােগ্য নয়।” এরপর লিবিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশ কি প্রত্যাশা করে বা কি চায় প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীর এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমরা চাই লিবিয়ার স্বীকৃতি। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি লিবিয়ার স্বীকৃতি।”
২৩। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারের সময় সৌদি আরবের (তৎকালীন) বাদশা ফয়সাল প্রথমেই বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, “আমি শুনেছি যে, আসলে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্যের প্রত্যাশী। অবশ্য এসব সাহায্য দেয়ার জন্যে আমাদের পূর্বশর্ত রয়েছে।” বাদশা ফয়সালের এই কথার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আমার তাে মনে হয় না, বাংলাদেশ মিসকিন-এর মতাে আপনাদের কাছে কোনাে সাহায্য চেয়েছে। বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরীফে নামাজ আদায়ের অধিকার চাচ্ছে। পবিত্র কাবা শরীফে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। এ ব্যাপারে আবার শর্ত কেনাের আমরা আপনাদের কাছ থেকে ভ্রাতৃসুলভ সমান ব্যবহার প্রত্যাশা করি।” অতঃপর সৌদি আরবের কাছ থেকে বাংলাদেশ আসলে কি চায়, বাদশা ফয়সালের এই প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাই, কেননা সৌদি আরব আজও পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।” বঙ্গবন্ধুর এই প্রশ্নের উত্তরে বাদশা ফয়সাল বলেছিলেন, “সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে

পৃষ্ঠাঃ ১৬০
বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ রাখতে হবে।” বাদশা ফয়সালের এই প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু এসম্পর্কে ইতিপূর্বে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীকে যে কথা বলেছিলেন তার পুনরুল্লেখ করে আরও বলেছিলেন, “আপনাদের দেশটার নামও তাে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব সৌদি এ্যারাবিয়া নয়। আপনাদের দেশটার নাম মরহম বাদশা ইবনে সউদ-এর নামে কিংডম অব সৌদি এরাবিয়া রাখা হয়েছে। কই আমরা কেউই তাে এ নামে আপত্তি করিনি।” এরপর বাদশা ফয়সাল বলেছিলেন, এছাড়া আমার অন্য একটি শর্ত রয়েছে এবং তা হচ্ছে, অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে।” বাদশা ফয়সালের এই প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এটাতাে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। এই দুটো দেশের মধ্যে এ ধরনের আরও অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানী নাগরিকদের (অবাঙ্গালীদের) পাকিস্তানে ফেরত নেয়া এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া পাঁচ লক্ষাধিক বাঙ্গালীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানাে এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থসম্পদ পরিশােধ করা, এমন বেশ কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। এসবের মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধুমাত্র বিনাশর্তে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দেয়ার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর সৌদি আরবই বা এতাে উদগ্রীব কেন?” বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্যের জবাবে বাদশা ফয়সাল একটু রূঢ় সুরে বলেছিলেন, শুধু এটুকু জেনে রাখুন, সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। যাহােক, আমাদের দু’টো শর্তের বিষয় চিন্তা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘােষণা, আর একটা, বিনাশর্তে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি। আশা করি, এরপর বাংলাদেশের জন্যে সাহায্যের কোনাে কমতি হবে না।” আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত এই জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন শেষে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ১০ই সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) তারিখে।
২৪। বঙ্গবন্ধুর আলজিয়ার্স থেকে স্বদেশে ফেরার অব্যবহিত পর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা দিল্লীতে বৈঠক করে একটি যুক্ত ঘােষণায় বলেন যে, উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তােলার স্বার্থে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল করে দেয়া হবে। এই যুক্ত ঘােষণার পর, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের প্রথম দলটি একটি বিশেষ বিমানে ঢাকা এসে পৌছায় ১৯শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) তারিখে। এদিকে ২০শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতাকালে পাকিস্তানের (তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, “১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে ফেরত না পাঠানাে পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবের শর্ত অপূর্ণই থেকে যাবে। আর জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং

পৃষ্ঠাঃ ১৬১
বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের প্রশ্নই ওঠে না।” এর বার দিন পর ৩রা অক্টোবর (১৯৭৩) তারিখে গণচীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী চিয়ান কুয়ান হয়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বলেন, জাতিসংঘের প্রস্তাব কার্যকরী করার পরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে পারে—কোনক্রমেই তার আগে নয়।”
২৫। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা, গুপ্তহত্যা ও সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু হয় ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি। ১৯৭৩ সালের ফেব্রুয়ারী নাগাদ গুপ্তঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সংখ্যা দাঁড়ায় তিন শতাধিক। ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে সংসদ নির্বাচনের পর গুপ্তহত্যাকাণ্ডের সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিয়াত্তরের জুন মাস পর্যন্ত গুপ্তঘাতকদের হাতে নিহত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গদলসমূহের কর্মী ও মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা দুই হাজারকেও ছাড়িয়ে যায়। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও বহু নিরীহ ব্যক্তি প্রাণ হারায় গুপ্তহত্যা ও অন্যান্য সহিংস অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে। ফলে, ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ১৭ মাসে গুপ্তহত্যাকান্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯২৫টিতে। আর পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলাকারী বাহিনীর ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে ৬০টি। ফলে, দেশের সর্বত্র শহর, বন্দর, গঞ্জে ও গ্রামে নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির সঞ্চার হয়। এই পরিস্থিতিকে নিজের সহিংসতার রাজনীতির সাফল্য বলে মনে করে জাসদের সন্ত্রাসবাদী অংশ ও উগ্রপন্থী দলগুলাে তাদের তৎপরতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন আদর্শ-চেতনা বিস্তৃত, সামাজিক অনাচার ও অর্থনৈতিক অনটনজনিত হতাশায় জর্জরিত এবং বিভ্রান্ত ও বিপথগামী বহু তরুণ সন্ত্রাসবাদী এই গ্রুপ ও দলগুলােতে যােগদান করে। আদর্শগত কারণে নয় বরং নেহায়েত অস্ত্র সগ্রহ করে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থতার সুযােগের আশায় বহু রাজাকার, আলবদর ও আলসামস্-এর সদস্য সন্ত্রাসবাদী দলগুলােয় আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে, বহু সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা এবং পুলিশ ও অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র লুটপাট করার ঘটনা সংঘটিত হতে থাকে প্রতিদিন। ১লা সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যে সমস্ত সন্ত্রাসী ও সহিংস ঘটনার খবর পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তা থেকে এ সময়ের পরিস্থিতি সহজেই অনুমান করা যায়।
২৬। ১লা সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) তারিখে ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার ধানীখােলা ফাঁড়ি এবং কুষ্টিয়ায় চুয়াডাঙ্গা থানার শরৎগঞ্জ ফাঁড়ি লুণ্ঠিত হয় দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র হামলায়। ২রা সেপ্টেম্বর তারিখে আরিচা ফেরিতে রক্ষীবাহিনীর সদস্য ও দুবৃত্তের মধ্যে গুলি বিনিময়ে ৪ জন নিহত হয়। ৩রা সেপ্টেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় ফরিদপুরের কোতয়ালী থানার চানপুর ফাঁড়ি। ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে ব্রাশফায়ারে নিহত হয় ৪ জন ছাত্র। ৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে সেনাবাহিনী ও দুবৃত্তদের মধ্যে গুলি বিনিময়ে নিহত হয় ৬০ জন। ১৩ই সেপ্টেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র হামলায়

পৃষ্ঠাঃ ১৬২
লুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার কালারপুর ফাঁড়ি। ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখে দুবৃত্তের হাতে নিহত হয় চট্টগ্রাম বন্দরে ২ জন শ্রমিক। ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীর ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদী ট্রেন লাইনে একটি ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে এবং এতে শিশু ও নারীসহ বহু লােক হতাহত হয়। ২০শে সেপ্টেম্বর তারিখে দুৰ্বত্তের সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় বরিশাল জেলার গৌরনদী থানার সারিফল ফাঁড়ি। ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে দুবৃত্তরা সশস্ত্র হামলা চালিয়ে রাজশাহী জেলার বাঘমারা থানার দামনাস ফাঁড়ি লুট করে এবং এই ঘটনায় ৮ জন পুলিশ নিহত হয়। ৩রা অক্টোবর তারিখে পাবনা জেলার শাহজাদপুরে রক্ষীবাহিনীর সদস্য ও দুর্বত্তদের মধ্যে গুলি বিনিময়ে ৮ জন নিহত হয়। ৪ঠা অক্টোবর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র হামলায় লুষ্ঠিত হয় মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানা ও খাদ্যগুদাম। ৬ই অক্টোবর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় ময়মনসিংহ জেলার বারহাট্টা থানা। ৬ ও ৭ই অক্টোবর দুই রাত্রিতে ১৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটে চুয়াডাঙ্গায়। ৯ই অক্টোবর তারিখে দুষ্কৃতকারীরা সশস্ত্র হামলা করে যশাের জেলার হরিনাকুন্ড থানা লুট করে। ১০ই অক্টোবর ঢাকায় ৬ ব্যক্তি নিহত হয় দুবৃত্তদের হামলায়। ১৩ই অক্টোবর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের দুটো পৃথক দল সশস্ত্র হামলা চালিয়ে লুণ্ঠন করে কুষ্টিয়া জেলার মীরপুর থানার হালসা ফাঁড়ি এবং টাঙ্গাইল থানার পােড়াবাড়ি ফাঁড়ি।
২৭। উপরােল্লিখিত অশুভ রাজনীতির উদ্ধত চ্যালেঞ্জের মােকাবেলায় জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে অধিকতর বলিষ্ঠতার সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে সুসংহত করার লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ১৪ই অক্টোবর তারিখে গঠিত হয় ‘গণ ঐক্যজোট’। বাংলাদেশ আওয়মী লীগ, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কমরেড মণি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় এই ঐক্যজোট। এই গণঐক্যজোট গঠন সম্পর্কিত ঘােষণার পরদিন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘মুজিব-মণি-মমাজাফফর, বাংলার তিন মীরজাফর’ এই শ্লোগান তুলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ (NAP), চরম বামপন্থী দলগুলাে এবং এসব দলের ছত্রছায়ায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার দালাল দলগুলাের নেতা ও কর্মীরা তাঁদের দৃষ্টিতে ভারত-রাশিয়ার পুতুল সরকার উচ্ছেদের অভিন্ন লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে সম্রামের জন্যে ঐক্য মাের্চা’ গড়ে তােলার চেষ্টায় আত্মনিয়ােগ করেন।
২৮। ১৭ই অক্টোবর তারিখে জাপানে এক সপ্তাহের রাষ্ট্রীয় সফরের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ঢাকা ত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরে দিল্লীতে তিন দেশের যুক্ত ঘােষণায় ত্রিমুখী লােক বিনিময় যুগপৎ পরিচালিত হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও পাকিস্তান এ ব্যাপারে টালবাহানার আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৭৩ সালের ২২শে অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টোকিওতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে প্রতিটি বাঙ্গালীকে ফেরত নিচ্ছে।

পৃষ্ঠাঃ ১৬৩
কিন্তু বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী নাগরিকদের (অবাঙ্গালীদের) বিপুল সংখ্যককেই পাকিস্তান নিচ্ছে না।” ২৪শে অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধু জাপান সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এর কিছুদিন পর জুলফিকার আলী ভুট্টো পরিষ্কারভাবে ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তান বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিক অবাঙ্গালীদের ফেরত নেবে না। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে অবস্থানকারী প্রায় পাঁচ লাখ অবাঙ্গালীর অধিকাংশই পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করে সেখানে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলাে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর তারা ভারত থেকে এ দেশে এসেছিলাে।
২৯। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইসরাইল কর্তৃক ১৯৬৭-এর যুদ্ধে দখলকৃত তাঁদের স্ব স্ব ভূখন্ড মুক্ত করার লক্ষ্যে মিশর, সিরিয়া ও জর্দান যৌথভাবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। তখনও এই আরব দেশগুলাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। তদুপরি, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কমবেশি সব আরব দেশগুলােতে প্রচারণা চলছিলাে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। তবুও এক কূটনৈতিক অভিযানে অবতীর্ণ হলেন বঙ্গবন্ধু। ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আরবদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করলেন, ”আরবরা আমাদের স্বীকৃতি দিক বা না দিক, তাঁরা আমাদের ভাই। তাঁদের ন্যায্য সংগ্রামে আমরা তাঁদের পাশে আছি।” ইসরাইলের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশ থেকে স্বেচ্ছাসেবক দল পাঠানাের ইচ্ছা প্রকাশ করে। অতঃপর ১৮ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত এই আরব দেশগুলাের জন্যে চা এবং একটি মেডিকেল টিম পাঠায়।
৩০। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর (১৯৭৩)-এর মধ্যে আরও কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৩শে আগস্ট আইভরি কোস্টের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিযােগাযােগ ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করে। ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখে জায়ারের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে মিশর ও সিরিয়ার সরকারদ্বয় বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ২৪শে সেপ্টেম্বর তারিখে নাইজারের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ৩০শে সেপ্টেম্বর তারিখে গিনি বিসাউয়ের সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ৬ই অক্টোবর ক্যামেরুন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৬ই অক্টোবর তারিখে জর্দানের সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২৩শে অক্টোবর তারিখে দাহােমীর সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর ৪ঠা নভেম্বর কুয়েতের সরকার এবং ৫ই নভেম্বর ইয়েমেনের সরকার বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছিলাে।
৩১। ১৪ই অক্টোবর আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মােজাফফর) এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গণঐক্যজোট গঠিত হওয়ার পরেও ১৯৭৩ সালে জাসদের সন্ত্রাসী অংশ ও উগ্র বামপন্থীদের হত্যা, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ

পৃষ্ঠাঃ১৬৪
এবং পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষ ও ফাঁড়ি হামলার ঘটনা শুধু জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা ও ভীতির সঞ্চারই সৃষ্টি করেনি, এতে জানমালেরও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৭ই অক্টোবর কুষ্টিয়া জেলার মীরপুর থানার খাদিমপুর ফাঁড়িতে দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র হামলায় জানমালের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। ২১শে অক্টোবর দুবৃত্তদের সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় বরিশাল জেলার উজিরপুর থানার হারতা ফাঁড়ি। ২৩শে অক্টোবর দুষ্কৃতকারীদের একটি দল সশস্ত্র হামলা চালায় রাজশাহী জেলার তানাের থানার পাঁচনদার ফাঁড়িতে। ২৫শে অক্টোবর তারিখে দুৰ্বত্তের সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় ফরিদপুর জেলার বালিয়াকান্দি থানা। ২৬শে অক্টোবর তারিখে বরিশাল জেলার মেহেদীগঞ্জ থানার ভাষাণচর ফাঁড়ি লুষ্ঠিত হয় দুষ্কৃতকারীদের মারাত্মক হামলায় এবং এই ঘটনায় ৩ জন পুলিশ নিহত হন। ২৮শে অক্টোবর দুষ্কৃতকারীদের একটি দল সশস্ত্র হামলায় লুট করে পটুয়াখালী জেলার পাথরঘাটা থানা। ১লা নভেম্বর দুবৃত্তদের সশস্ত্র হামলায় টাঙ্গাইল থানার পাথরাইল ফাঁড়ি সম্পূর্ণভাবে লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত হয়। ১৪ই নভেম্বর তারিখে সুন্দরবনে সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে দুবৃত্তদের সশস্ত্র সংঘর্ষে অনেক ব্যক্তি হতাহত হয়। ২২শে নভেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানা। ২৩শে নভেম্বর দুষ্কৃতকারীরা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রসহ হামলা চালায় ঢাকা জেলার কালীগঞ্জ থানার বারােবাজার ফাঁড়িতে। ২৫শে নভেম্বর দুবৃত্তদের সশস্ত্র হামলায় লুণ্ঠিত হয় রাজশাহী জেলার তানাের থানার পাচনদর ফাঁড়ি। ২৯শে নভেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের মারাত্মক হামলায় কুমিল্লা জেলার মতলব থানা লুণ্ঠিত ও সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়।
৩২। ৩০শে নভেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার দালাল আইনে অভিযুক্ত ও আটক ব্যক্তিদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে এই আশায় যে, তারা অতীতের কৃত অপরাধের জন্যে অনুতপ্ত ও অনুশােচনার বশবর্তী হয়ে স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত করার জন্যে এবং দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়ােগ করবেন। সরকারের এই সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার ফলে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতা করার দায়ে অভিযুক্ত ও আটককৃত প্রায় ৩৪,৬০০ জন মুসলিম লীগ, পি.ডি.পি, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলগুলাে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদের নেতৃত্বে গঠিত রাজাকার, আলবদর, আলসামস ইত্যাদি সংগঠনগুলাের নেতা ও কর্মী ও অন্যান্য ব্যক্তিরা মুক্তি পান। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালে পি.ও. ৮-এর মাধ্যমে দালাল আইন নামে একটি জেনােসাইড এ্যাক্ট প্রবর্তন করেছিলাে। ১৯৭২-৭৩ সালে যখন পি.ও. ৮-এর অধীন কতিপয় চিহ্নিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিচার চলছিলাে, তখন দেশের উগ্র বামপন্থী এবং আওয়ামী লীগ বিরােধী মহলের অনেকেই সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র বিরােধিতা শুরু করেছিলেন। সে সময় যে সমস্ত রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী দালাল ও ঘাতকদের বিচারের বিরুদ্ধে সােচ্চার ছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মাওলানা ভাসানী,

পৃষ্ঠাঃ ১৬৫
ডঃ আলীম-আর-রাজী, অধ্যাপক আবুল ফজলসহ সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকাগােষ্ঠী। উপরন্তু মাওলানা ভাসানী এক পর্যায়ে ১৯৭৩ সালের ৩১শে জানুয়ারীর মধ্যে দালাল আইন বাতিল করার দাবি জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আলটিমেটামও দিয়েছিলেন। এছাড়াও ছিলাে বিদেশী চাপ এবং এতাে লােকের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ প্রমাণের জন্যে যথাযথ সাক্ষ্য-সাবুদ জোগাড়ের ক্ষেত্রে নানান দুরূহ অসুবিধা ও সমস্যা এবং প্রশাসনিক নিরতিশয় দূর্বলতা। সে যাইহােক, বঙ্গবন্ধুর সরকারের ঐ সাধারণ ক্ষমতার আওতায় সকল রাজাকার ও ঘাতক অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, যাদের বিরুদ্ধে কোনাে সুনির্দিষ্ট অভিযােগ ছিল না এবং যারা অভিযােগে বিচারাধীন ছিল না কেবল তাদের বেলায়ই প্রযােজ্য ছিল এই সাধারণ ক্ষমা। খুন, অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অপহরণ প্রভৃতি সুনির্দিষ্ট অভিযােগে অভিযুক্ত কোনাে ব্যক্তির জন্যে সাধারণ ক্ষমা প্রযােজ্য ছিল না। সর্বোপরি, এ জাতীয় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আর কখনও বিচার করা যাবে না এতদমর্মে সংবিধানগত কোনও বাধা-প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি অথবা ইনডেমনিটি বিধি-বিধানের ব্যবস্থা করেনি বঙ্গবন্ধুর সরকারের এই সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা।
৩৩। জাতীয় বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ১৫ই ডিসেম্বর (১৯৭৩) তারিখে বঙ্গবন্ধু বেতার (রেডিও) ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। অন্যান্য বক্তব্যের মধ্যে উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “…দু’বছর আগে কি নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম? চারিদিকে অসংখ্য নরককাল, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ, বীরাঙ্গনা মা ও বােনের আর্ত হাহাকার, অচল কলকারখানা, থানা-আইন-আদালত শূন্য ও বিধ্বস্ত, ব্যাংকে তালা, ট্রেজারী খালি, রেলের চাকা বন্ধ, রাস্তা-ব্রিজ ধ্বংস, বিমান ও জাহাজ একখানাও নেই। যুদ্ধের জন্যে অনেক ক্ষেতে ফসল বােনা সম্ভব হয়নি, পাট ঘরে ওঠেনি, নৌকা, স্টীমার, লঞ্চ, বাস, লরী, ট্রাকের শতকরা সত্তরভাগ হয় নষ্ট না হয় অচল। অনেকের হাতে তখন অস্ত্র। তাদের মধ্যে আছে বহু। দুষ্কৃতকারী। আমাদের প্রয়ােজনীয় সৈন্য ছিল না। পুলিশ ছিল না। জাতীয় সরকার চালাবার মতাে দক্ষ অফিসারও ছিল না। তখন পাকিস্তানে বন্দী কয়েক লাখ বাঙ্গালী। ভারত থেকে ফিরে আসছে প্রায় এক কোটি বাঙ্গালী উদ্বাস্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদারদের অত্যাচারে দেশত্যাগ করেছিল। তখনই দরকার এদের জন্যে রিলিফ, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা। ক্ষুধার্ত বাঙ্গালীকে বাঁচানাের জন্যে চাই অবিলম্বে খাদ্য। ওষুধ চাই, কাপড় চাই, চারদিকে এই ‘চাই চাই আর নাই নাই’-এর মধ্যে আমাদের যাত্রা শুরু।…আমি জানি না রক্তাক্ত বিপ্লবের পর। পৃথিবীর আর কোনাে দেশে সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হয়েছে কিনা। আমার জানা মতে হয়নি। বাংলাদেশ সরকার বিপ্লবের পর এক বৎসরের মধ্যে সংবিধান তৈরি করেছে। নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। ভােট দেয়ার বয়স একুশের বদলে আঠারাে বৎসর করে ভােটাধিকারের সীমা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব বিমান উড়ছে দেশ-বিদেশের আকাশে, তৈরি হয়েছে নিজস্ব বাণিজ্য জাহাজবহর। বি.ডি.আর. সীমান্ত পাহারায় নিযুক্ত,

পৃষ্ঠাঃ ১৬৬
স্থল (সেনা) বাহিনী মাতৃভূমির ওপর যে কোনাে হামলা প্রতিরােধে প্রস্তুত। গড়ে উঠেছে আমাদের নিজস্ব নৌ ও বিমান বাহিনী। থানা ও পুলিশ সংগঠনের যে ৭০ ভাগ পাকিস্তানীরা নষ্ট করেছিল, এখন আবার তা গড়ে উঠেছে। জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে আইন ও শৃঙক্ষা রক্ষার ব্যাপারে সরকার এখন আরও নজর দিতে পারবে।…দেশে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজ কায়েম করতে হবে। দেশের সকল ব্যাংক ও বীমা ব্যবসা এখন আপনাদের। কল-কারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৮০% ভাগ মালিক আপনারা।….পচিশ বিঘা পর্যন্ত (কৃষি) জমির খাজনা তুলে নেয়া হয়েছে। এটাকে আমরা বলতে পারি, শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের চেষ্টা। ফলে বাংলাদেশ ধীর গতিতে হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্যাটার্ন বদলাতে চলেছে। একটা কৃষিনির্ভর আধা সামন্ত সামাজিক অবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শােষণমুক্ত সমাজ গড়ার চেষ্টায় আমরা নিযুক্ত আছি।….এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে যেদিন বাংলাদেশের কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে। তাই আসুন, এই দিনে অভাব, দারিদ্র্য, রােগ-শােক ও জরার বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম ঘােষণা করি। সংগ্রাম ঘােষণা করি চোরাচালানী, কালােবাজারী, অসৎ ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ ও ঘুষখােরদের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে জয়লাভ করতে না পারলে সােনার বাংলা গড়ার কাজ সফল হবে না।….যারা ধ্বংস করে, ধ্বংসাত্মক চেষ্টা চালায়, তারা শুধু সরকারের শত্রু নয়, দেশ ও জনগণের শত্রু। তারা যে সম্পদ হরণ করে, ধ্বংস করে, তা জনগণের সম্পত্তি। কোনাে পুঁজিপতি বা ব্যক্তিমালিকের সম্পত্তি নয়। বিপ্লবের নামে যারা উদ্ধৃঙ্খল স্বেচ্ছাচারে মাতেন, তারা বিপ্লবের মিত্র নন, জনগণেরও বন্ধু নন। আপনারাও এই গুপ্তহত্যা ও ঘ্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলুন। আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশােধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন তাদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে আবার সুযােগ দেয়া হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, অন্যের প্ররােচনায় যাঁরা বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং হিংসার পথ গ্রহণ করেছেন তাঁরা অনুতপ্ত হলে তাঁদেরও দেশ গড়ার সংগ্রামে অংশ নেয়ার সুযােগ দেয়া হবে।”
৩৪। ১৬ই ডিসেম্বর আনন্দ-উল্লাস ও যথাযথ মর্যাদায় তৃতীয় জাতীয় বিজয় দিবস উদযাপিত হয়। দিনটি ছিল সাধারণ ছুটির দিবস। রাজপথে সেনা (স্থল): নৌ ও বিমান বাহিনীত্রয়, রক্ষীবাহিনী, বি.ডি.আর, পুলিশ, আনসার ও অনেক বেসরকারী সংগঠনের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়।
৩৫। ২৪শে ডিসেম্বর তারিখে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন। অতঃপর তাঁকে বিদেশে বাংলাদেশ সরকারের দূত হিসেবে নিয়ােগ করা হলে তিনি উক্ত পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জাতীয় সংসদের স্পীকার জনাব মুহম্মদ উল্লাহ অস্থায়ী

পৃষ্ঠাঃ ১৬৭
রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এর প্রায় ৭৮ মাস আগে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডস্থ বাসায় এসেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতে। তখন রাষ্ট্রপতি চৌধুরী সংসদীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির কাজকর্ম বিশেষ না থাকায় তাঁর অস্বস্তি বােধের কথা বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছিলেন এবং উক্ত পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার তাঁর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পদ হতে অন্য কোনাে নিম্নতর পদে নিয়ােগ করা দৃষ্টিকটু দেখায় বিধায় বঙ্গবন্ধু তখন তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হননি। বঙ্গবন্ধু তখন রাষ্ট্রপতি চৌধুরীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বইপত্র লেখার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে।
৩৬। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ইউনিয়ন কাউন্সিলগুলাের নির্বাচন ২৩শে ডিসেম্বর তারিখে শুরু হয় এবং ৩০শে ডিসেম্বর তারিখে সমাপ্ত হয়। গােপন ব্যালট ও সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে এবং নির্দলীয় ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে ঘটেছিল বহু গােলযােগ, সংঘর্ষ ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা। যার ফলে বহুলােক হতাহত হয়। এহেন অনভিপ্রেত, অপ্রীতিকর ও অত্যন্ত দুঃখজনক রক্তপাতের মধ্যদিয়ে সমাপ্ত হয় ১৯৭৩ সাল।

সপ্তম পরিচ্ছেদ
১৯৭৪ সাল

১। ইটালীর টিয়েস্টেস্থ আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক পদার্থ বিষয়ক কেন্দ্রে ৬ মাস গবেষণা কর্ম শেষে আমি ১লা জানুয়ারী (১৯৭৪) তারিখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করি। দেশে ফেরার ১ সপ্তাহের মধ্যেই আমি মারাত্মক বসন্ত রােগে আক্রান্ত হই। মস্তক ও মুখমণ্ডলসহ সারা শরীরে বসন্তের ফোঁড়া ওঠে। এই রােগে আক্রান্ত হওয়ায় আমি ছেলে-মেয়েদের স্বার্থেই পৃথক শয়নকক্ষে অবস্থান নিই। একদিন দেখি যে, আমার ছেলে জয় আমার রুমে এসে সেখানে রাখা একটি চেয়ারে বসলাে। তখন ওর বয়স মাত্র আড়াই বছর। আমার কামরায় আসা ওর উচিৎ হয় নি। আমি বললাম, “আব্বু, আমি তাে অসুস্থ, তােমার এখানে আসা ঠিক হয়নি।” জয় বললাে, “আব্বু, আমি তাে তােমাকে দেখতে এসেছি, তুমি কেমন আছ।” আমার অসুস্থতায় আমার ঐ আড়াই বছরের শিশুর এই সংবেদনশীলতার কথা স্মরণ করলে এখনও আমার মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে জয়ের প্রতি স্নেহ ও ভালােবাসায়। আমি অসুস্থ হওয়ার পর শাশুড়ী প্রায় প্রতিদিন আসতেন আমাদের বাসায়। উল্লেখিত ঘটনার দিন কয়েক পর একদিন বঙ্গবন্ধু আসেন আমাকে দেখতে ও আমার কুশলাদি জানতে। তিনি সােজা চলে আসেন আমার রুমে। তখন জয়ের ঐ কাহিনীর বর্ণনা করে আমি বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “আমার ছেলের কাছে আপনি কিন্তু হেরে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তখন জয়কে কোলে নিয়ে আদর করে বললেন, “তােমার ছেলের কাছে ভবিষ্যতে অনেকেই হেরে যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।” যাহােক, হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন সেবা-শুশ্রুষায় আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠি। সে সময় হাসিনা যেরকম কষ্ট করে ও ঝুকি নিয়ে আমার সেবা-যত্ন করেছিল তা কোনদিন বিস্মৃত হবার নয়। যাহােক, সে সময় সৌভাগ্যক্রমে হাসিনা, ছেলে-মেয়ে কিংবা বাসার আর কেউই বসন্ত রােগে আক্রান্ত হয়নি।
২। আমার বসন্ত রােগ এমন গুরুতর ছিল যে তা সেরে গেলেও আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে দারুণভাবে। এবার দায়িত্ব নিলেন আমার শাশুড়ী স্বয়ং। প্রতিদিন দুপুরে আমার সর্বকনিষ্ঠ

পৃষ্ঠাঃ ১৬৯
শ্যালক শিশু রাসেলকে স্কুল থেকে নেয়ার সঙ্গে আমাকেও আমার অফিস থেকে তাঁর বাসায় নেয়ার ব্যবস্থা করলেন আমার শাশুড়ী। হাসিনা ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেখানেই কাটাতে সারাদিন। এই সময় থেকে আমার নিত্য রুটিন হয়ে গেল শাশুড়ীর বাসায় দুপুরে খাবার খাওয়া। এ ছাড়াও রাতে বঙ্গবন্ধু বাসায় না ফেরা পর্যন্ত হাসিনা বাচ্চাদের নিয়ে সেখানে থাকতাে বলে প্রায় প্রতিরাতেই খাবার খেতে হতাে শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে। কোন কোন দিন রাত বেশী হয়ে গেলে আমরা সে বাসায়ই থাকতাম। বঙ্গবন্ধুর বাসার উপর তলার হাসিনার রুমটি শাশুড়ী আগের মতই সংরক্ষিত রেখেছিলেন যাতে আমরা যে কোন সময় সেখানে থাকতে পারি। বঙ্গবন্ধুর আদেশে আমাদের আর একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল জয়কে রােজ সকাল সাড়ে আটটার মধ্যেই তাঁর কাছে রেখে আসা। অবস্থামত হাসিনা অথবা আমাকে নতুবা আমাদের বাড়ীর কাজের ছেলে মােঘলকে এই কর্তব্য পালন করতে হতাে। বঙ্গবন্ধু সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় জয়কে সযত্নে খাওয়াতেন। তাঁর পাকা ফলের রসের শেষাংশটুকু তাঁর পরমাদরের নাতী জয়কে পান করানাে ছিল বঙ্গবন্ধুর নিত্যকার রুটিন। জয়ও পরমাগ্রহে পান করতাে সেই ফলের রস।
৩। ১৮-২০শে জানুয়ারী (১৯৭৪) ঢাকায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অফিস প্রাঙ্গণে দলের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের আয়ােজন করা হয়। ১৮ই জানুয়ারী তারিখে এই কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু দলীয় কর্মীদের প্রতি আত্মসমালােচনা, আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির উদাত্ত আহবান জানান এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। সমাজ জীবনের পরতে পরতে দুর্নীতির যে ভয়াবহ বীজ অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে তার উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরােধ গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যৎ গভীর তমিসায় ছেয়ে যাবে।” দুর্নীতিবাজ, ঘুষখাের, চোরাচালানী, মজুতদারী, কালােবাজারী ও মুনাফাখখারদের সমাজ ও রাষ্ট্রের শত্রু বলে আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এদের শায়েস্তা করে জাতীয় জীবনকে কলুষমুক্ত করতে না পারলে আওয়ামী লীগের দুই যুগের ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানের গৌরবও ম্লান হয়ে যেতে পারে।” দুর্নীতিবাজ ও সমাজ শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করার জন্যে তিনি ছাত্র-যুব সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণীসহ সর্বশ্রেণীর জনগণের প্রতিও আহবান জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অর্থের লােভে যারা বুভুক্ষুর মুখের গ্রাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, চোরাচালান-কালােবাজারী করছে, যারা ওষুধের লেবেল লাগিয়ে মুমূর্ষর মুখে তুলে দিচ্ছে বিষ, তাদের লােলুপ জিহ্বা কেটে দিতে হবে।” সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা ও গুপ্তহত্যাকাণ্ডে লিপ্ত উগ্র বামপন্থী প্রকাশ্য ও গােপন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও গ্রুপগুলাের তীব্র সমালােচনা করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘তারা যা করছে তা বিপ্লব নয়, বিপ্লবের বিকৃতি—পার্ভারসন। নিদ্রিত মানুষকে হত্যা করে আর অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়ে বিপ্লব হয় না। জাতীয়তাবাদ, গণ, সমাজ ও

পৃষ্ঠাঃ ১৭০
ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সােনার বাংলা কায়েমের দলীয় ওয়াদার কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই লক্ষ্যে আওয়ামী লীগকে নিরলসভাবে সংগ্রাম করে যেতে হবে।” কাউন্সিল অধিবেশনের শেষপর্যায়ে দলীয় কর্মকর্তা নির্বাচনের প্রসঙ্গ যখন সাবজেক্ট কমিটিতে আলােচিত হয়, তখন কমিটি সর্বসম্মতভাবে বঙ্গবন্ধুকেই পুনরায় দলের সভাপতির পদে সমাসীন থাকার অনুরােধ জানায়। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে দলের কোন সদস্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, স্পীকার, রাষ্ট্রদূত প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলে তিনি আর দলের কর্মকর্তা থাকতে বা নির্বাচিত হতে পারেন না। দেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে প্রস্তাবাকারে গৃহীত সর্বসম্মত বিশেষ অনুরােধে বঙ্গবন্ধু তখন বৃহত্তর জাতীয় ও দলীয় স্বার্থে সাময়িকভাবে দলীয় প্রধান হিসেবে কাজ চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু উপরােল্লিখিত কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, “প্রথমতঃ দলের গঠন আমি অমান্য করতে পারি না। দ্বিতীয়তঃ দেশবাসী আমাকে ‘জাতিরজনক হিসেবে সম্মানিত করেছেন। কি করে আমি একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতি থাকি?” শেষ পর্যন্ত ২০শে জানুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধুরই প্রস্তাব অনুসারে জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জনাব জিলুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জনাব কামরুজ্জামান বাণিজ্য মন্ত্রীর পদে ইস্তফা প্রদান করেন।
৪। ২১শে জানুয়ারী তারিখে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সুইজারল্যান্ডের জেনেভাস্থ জাতিসংঘের দফতরে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যােগদানের জন্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৪শে জানুয়ারী তারিখে জনাব মুহম্মদ উল্লাহ জাতীয় সংসদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২৪শে জানুয়ারী জনাব মুহম্মদ উল্লাহ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ২৮শে জানুয়ারী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুল মালেক উকিল জাতীয় সংসদের স্পীকার নির্বাচিত হন।
৫। ২৯শে জানুয়ারী তারিখে যুগােশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আগমন করেন। ৩০শে জানুয়ারী তারিখে মার্শাল টিটো ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২রা ফেব্রুয়ারী তারিখে বাংলাদেশ-যুগােশ্লাভিয়া যুক্ত ইশতেহার ঘােষণা করা হয়। ঐ দিনই প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ঢাকা ত্যাগ করেন। ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে ইসলামী সম্মেলনের সেক্রেটারী জেনারেল জনাব তােহামী: ঢাকা আগমন করেন। জনাব তােহামী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতকারের সময় ২৩-২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে পাকিস্তানের লাহােরে অনুষ্ঠেয় ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানান।
৬। জাতীয় সংসদের ১৯৭৪ সালের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ১৫ই জানুয়ারী তারিখে তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদ উল্লাহর ভাষণ প্রদানের মধ্য দিয়ে। ঐ দিনই

পৃষ্ঠাঃ ১৭১
সংসদে পেশ করা হয় ১৬টি অর্ডিন্যান্স ও ১৪টি বিল। ১লা ফেব্রুয়ারী তারিখে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ ও প্রেস সেন্সরশীপের বিধানসহ বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়নে আরও একটি বিল সংসদে পেশ করা হয়। ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বিশেষ ক্ষমতা বিলটি সংসদে বিপুল ভােটে পাস হয়। অতঃপর শেষ হয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। উল্লেখ্য যে, বিশেষ ক্ষমতা আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল ঐ সময়ের বিশেষ পরিস্থিতি মােকাবেলা করার জন্যে। বঙ্গবন্ধুর সরকারের কোনও চিন্তা বা অভিপ্রায় ছিল না এটিকে স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে সংরক্ষিত রাখার।
৭। ফেব্রুয়ারীর ৫ই থেকে এই তারিখে ঢাকায় আয়ােজন করা হয় আওয়ামী যুবলীগের জাতীয় কাউন্সিল। এর কিছুদিন আগে শেখ ফজলুল হক মণি আমার কাছে প্রস্তাব দেয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হবার জন্যে। আমি তার এ প্রস্তাবে অসম্মতি জানালে আমাকে রাজি করানাের জন্যে আমার শাশুড়ীর কাছে শেখ ফজলুল হক মণি ধর্ণা দেয়। শাশুড়ী তাে শেখ মণির প্রস্তাবে কোন সায় দেননি বরং তিনি আমাকে এবিষয়ে হুশিয়ার করে দেন। শেখ মণি দ্বিতীয়বার তার প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করলে আমি তাকে বললাম, “মণি, তুমি নিশ্চয়ই জান যে, কোন সরকারী বা আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা সরকারী অনুদানপুষ্ট স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকুরীরত অবস্থায় কোন রাজনৈতিক দল কিংবা –এর অঙ্গদলের সদস্য হতে পারে না। তােমাকে আমি পরিষ্কার বলে দিতে চাই যে, এই মুহূর্তে আণবিক শক্তি কমিশনের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে রাজনীতিতে জড়িত হওয়ার কোন অভিপ্রায় কিংবা বাসনা আমার নেই।” এর জবাবে শেখ মণি বলল, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ও কল-কারখানাগুলাের সুলতান শরীফসহ অনেক প্রশাসকই তাে যুবলীগে যােগদান করেছেন। আমি তখন বললাম, “এটা তােমাদের শুধু ভ্রান্ত নীতিই নয়, একটি অন্যায় কাজও বটে।” আমার এই কথা বলার পর শেখ মণি আমাকে এ ব্যাপারে আর কোন রকম পীড়াপীড়ি করেনি। যাহােক, ৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধুর প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধনী ভাষণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী যুবলীগের প্রথম জাতীয় কাউন্সিল শুরু হয়। এই কাউন্সিলে শেখ মণি দ্বিতীয়বারের জন্য আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আর। নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন জনাব সৈয়দ আহমদ।
৮। ১৯শে ফেব্রুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার ঢাকা পৌরসভাকে একটি করপােরেশনে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। নতুন করপােরেশনের মেয়র ও অন্যান্য ওয়ার্ড সদস্যদেরও প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গােপন ব্যালটে নির্বাচিত করার কথাও উল্লেখ করা হয় উক্ত সরকারী ঘােষণায়। একই তারিখে বাংলাদেশ ও ইরাকের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই প্রথম আরব জাহানের একটি মুসলিম রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ধরনের পারস্পরিক সহযােগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়। উল্লেখ্য, ইরাকই আরব জাহানের সর্বপ্রথম রাষ্ট্র যে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

পৃষ্ঠাঃ ১৭২
৯। অনেক লব ও বাগাড়ম্বর প্রদর্শন করার পর অবশেষে ২২শে ফেব্রুয়ারী (১৯৭৪) তারিখে পাকিস্তান বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। একই তারিখে তুরস্ক ও ইরানের সরকারদ্বয়ও বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের কথা ঘােষণা করে। পাকিস্তানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের সংবাদে বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনগণ স্বস্তি ও সন্তোষ প্রকাশ করে। ঐদিন বাংলাদেশ বেতারের দুপুর ১টার সংবাদ বুলেটিনে বলা হয় যে, বঙ্গবন্ধু লাহােরে ২৩-২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠেয় ইসলামী সম্মেলনে যােগদান করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেছেন। ঐদিন বিকেল পাঁচটার দিকে শাশুড়ীর বাসায় গিয়ে দেখি যে, শেখ মণি বঙ্গবন্ধুর লাহােরে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁকে (শাশুড়ীকে) রাজি করানাের চেষ্টা করছে। আমার শাশুড়ী বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত ছিলেন না এই কারণে যে, বঙ্গবন্ধু লাহােরে গেলে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। আর এই সুযােগে জনাব ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসে পাকিস্তানী দালাল রাজনৈতিক দলগুলাের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে আবার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শুরু করবে। শাশুড়ী আরও বলেন যে, যেহেতু পাকিস্তানে বাংলাদেশের কোন দূতাবাস খোেলা হয়নি, সুতরাং সেখানে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধুর দেখাশুনা করার কর্তৃত্ব থাকবে সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। এসব কারণে আমার শাশুড়ী বঙ্গবন্ধুর ঐ মুহূর্তে পাকিস্তানে যাওয়ার বিরােধিতা করে তাঁর পরিবর্তে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা মন্ত্রী পরিষদের সর্বজেষ্ঠ্য সৈয়দ নজরুল ইসলামকে লাহােরে অনুষ্ঠিতব্য ইসলামী সম্মেলনে যােগদানের জন্য পাঠানাে যুক্তিযুক্ত ও সমীচীন হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। শেখ মণি ও আমার শাশুড়ীর মধ্যে যখন এসব কথাবার্তা হচ্ছিল ঠিক ঐ মুহুর্তে বঙ্গবন্ধু বাসায় ফেরেন। অতঃপর শাশুড়ী ইসলামী সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ব্যাপারে তাঁর মতামত বঙ্গবন্ধুকে জানালে তিনি বলেন, “আমার লাহাের যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার আর কোন অবকাশ নেই, কারণ সৌদী আরবের বাদশাহ ফয়সাল লাহাের সম্মেলনে যােগদান করার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে অনুরােধ জানিয়ে আমার নিকট তারবার্তা পাঠিয়েছেন। উপরন্তু, আমার শুভাকাঙক্ষী ও সুহৃদ বন্ধু আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হরারি বুমেদিন তাঁর প্রেসিডেনসিয়াল প্রেন পাঠিয়েছেন আমাকে লাহাের নেয়ার জন্যে এবং ঐ প্লেনটি ইতােমধ্যেই ঢাকায় পৌঁছেছে। সুতরাং আমার লাহাের যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করা সমীচীন হবে না।” উল্লেখ্য, ঐ দিন বিকেলে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর ইসলামী সম্মেলনে যােগদানের প্রশ্নে মতভেদ দেখা দেয়। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে একজন মন্ত্রীকে লাহােরে পাঠানাের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি এই যুক্তি দেন যে, বঙ্গবন্ধু লাহােরে গেলে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলাের সুরাহার জরুরী তাগিদ হাস পাবে এবং বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থীরা অধিকতর সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় হওয়ার সাহস ও প্রেরণা পাবে।

পৃষ্ঠাঃ ১৭৩
১০। ২৩শে ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু ঢাকা ত্যাগ করেন পাকিস্তানের লাহােরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্যে। লাহাের বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান পাকিস্তানের জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো। পাকিস্তানের তিন সামরিক বাহিনীর একটি সুসজ্জিত দল বঙ্গবন্ধুকে ‘গার্ড-অব-অনার প্রদান করে। অতঃপর উপস্থিত সামরিক বাহিনীর দল বঙ্গবন্ধুকে সম্মানসূচক অভিবাদন প্রদান করে। এই সময় বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত বাজানাে হয়। উপস্থিত ভি.ভি.আই.পি’দের সঙ্গে পরিচয় শেষে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের তিন সামরিক প্রধানের নিকট পৌছান। প্রথমে নৌবাহিনীর প্রধান বঙ্গবন্ধুকে সামরিক কায়দায় স্যালুট করে করমর্দন করেন। এরপর বিমান বাহিনী প্রধান বঙ্গবন্ধুকে স্যালুট করে তার সঙ্গে করমর্দন করেন। সবার শেষে ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান এবং ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জনসাধারণের বিরুদ্ধে নৃশংস সামরিক অভিযান ও গণহত্যার নেতৃত্বদানকারী নরপিশাচ জেনারেল টিক্কা খান। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্যালুটের জবাবে একটু হাত ওঠালেন বটে কিন্তু তাঁর দিকে তাকালেনও না কিংবা তাঁর সঙ্গে করমর্দনও করলেন না। সম্মেলন শেষে অতিথি রাষ্ট্র নেতাদের সম্মানে লাহােরস্থ ইতিহাসখ্যাত শালিমার গার্ডেনে প্রদান করা হয় গণসংবর্ধনা। মঞ্চে দেখা গেল ফিলিস্তিন নেতা ইয়াসের আরাফাত এবং লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মােয়ামের গাদ্দাফিকে এক এক করে বঙ্গবন্ধুকে সােৎসাহে আলিঙ্গন করতে। পরিশেষে, জনাব ভুট্টো ও বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বসুলত সম্পর্কের প্রতীকস্বরূপ পরস্পরের হাত ধরে দু’জন একত্রে দু’হাত উঠিয়ে উপস্থিত জনগণের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
১১। লাহােরে একান্তে শীর্ষ বৈঠকের সময় বঙ্গবন্ধু জনাব ভুট্টোর নিকট প্রস্তাব রাখেন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত প্রশ্ন ও সমস্যাদির সুরাহা করার লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে। জনাব ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর এই কথার জবাবে পরবর্তীতে এ ব্যাপারে ঢাকায় শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তাব করেন। যাহােক, বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে জনাব ভুট্টোকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানান। অতঃপর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলন এবং ঐ সুযােগে জনাব ভুট্টোর সঙ্গে শীর্ষ বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন ২৫শে ফেব্রুয়ারী তারিখে। ২৫শে ফেব্রুয়ারী তারিখে এক সংক্ষিপ্ত রাষ্ট্রীয় সফরে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত ঢাকায় আগমন করেন। রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ উল্লাহ ও বঙ্গবন্ধু ঢাকা তেজগাঁও বিমান বন্দরে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একান্ত শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন রাতেই প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৭শে ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুর সরকার অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ২রা মার্চ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৭৫টি ভুয়া তাঁত কারখানা বাতিল করা হয়। একই দিনে দুর্নীতির দায়ে বিসিকের চট্টগ্রাম অফিসের

পৃষ্ঠাঃ ১৭৪
৪ জন উর্ধতন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়। এই তারিখে আরও ৪৪টি ভুয়া তাত ফ্যাক্টরী বাতিল করা হয়। ৬ই মার্চ তারিখে সিমেন্ট এবং ঢেউটিনের ৯৮১টি ভুয়া ডিলারশীপ বাতিল করা হয়।
১২। ইতােমধ্যে শেরেবাংলা নগরে তখন আধাসম্পন্ন সংসদ ভবনের পাশেই প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও দফতর ভবনের কাজ সম্পন্ন করে এই চত্বরের নামকরণ করা হয় গণভবন’। ইতিপূর্বে পুরাতন গণভবন (বর্তমান সুগন্ধা অতিথি ভবন) প্রধানমন্ত্রীর বৈকালিক অফিস হিসেবে ব্যবস্থা করা হতাে। একদিকে এই পুরাতন গণভবনটি আয়তনে ছােট বলে বৈকালিক অফিস ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের জন্য এটি উপযুক্ত ছিল না। তাছাড়া পুরাতন গণভবনের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রচণ্ড বিতৃষ্ণা, কারণ অতীতে আইউব খান ও ইয়াহিয়া খান উভয়েই সেখানে অনেক অপকর্ম, দুষ্কর্ম ও কুকর্ম করেছেন। যাহােক, ৭ই মার্চ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর দফতর আনুষ্ঠানিকভাবে শেরেবাংলা নগরস্থ নতুন গণভবনে স্থানান্তর করা হয়। ঐ দিনই ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন গণভবন তৈরী হয়েছে এই মর্মে সমালােচনা করে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় একটি সংবাদ পরিবেশন করা হয়। আমার শাশুড়ী কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই বাসভবনে অবস্থান করতে অস্বীকৃতি জানান। এর কারণ হিসেবে তিনি বললেন যে, সরকারী ভবনের আরাম-আয়েশে প্রতিপালিত হলে তার ছেলে-মেয়েদের মনমানসিকতা ও আচার-আচরণে অহমিকাবােধ ও উন্নাসিক ধ্যান-ধারণা সৃষ্টি হবে। আত্বীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই বঙ্গবন্ধু সপরিবারে ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর রােডস্থ তাঁর নিজস্ব বাড়ীতেই রয়ে গেলেন।
১৩। বঙ্গবন্ধু লাহােরে ইসলামী সম্মেলনে যােগদানকে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি ও পাকিস্তানীপন্থীরা নিজেদের সাফল্য বলে বিবেচনা করে নিজেদের শক্তি সম্পর্কে অধিকতর আস্থাশীল হয়ে ওঠে। সম্ভবতঃ সেই কারণেই বেআইনী ঘােষিত জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পি.ডি.পি প্রভৃতি দলের একশ্রেণীর সদস্য এবং অন্যান্য পাকিস্তানীপন্থীরা বেনামীতে রাজনীতির আসরে নামার প্রয়াসে ‘চাঁদ তারা মার্কা’ পতাকা নিয়ে জাতীয় গণতন্ত্রী দল গঠন করেন। এদের এক সভায় ‘ভারতের রাহুগ্রাস থেকে বেরিয়ে লাহােরে ইসলামী সম্মেলনে যােগদান করার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানাে হয় এবং অবিলম্বে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার জন্য তার কাছে দাবী জানানাে হয়। শুধু তাই নয়, এই মহল মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ এবং কারাগারে আটক দালালদের জন্য সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবী করে। সারা দেশে মসজিদে মসজিদে এবং ধর্মীয় সমাবেশের মাধ্যমে শুরু হয় তীব্র সরকারবিরােধী প্রচারণা। মার্চের গােড়ার দিকে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তরুণ কবি দাউদ হায়দারের একটি কবিতায় মহানবী হজরত মােহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে অশালীন উক্তির অজুহাতে সারাদেশে এটিকে উপলক্ষ করে সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরােধী

পৃষ্ঠাঃ ১৭৫
চক্র চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে এবং নিজেদের অবস্থানকে পাকাপােক্ত এবং শক্তিশালী করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। দাউদ হায়দারের চাকুরীচ্যুত ও গ্রেফতার হওয়ার পরও সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরােধী মহল ও শক্তিগুলাের এই বিক্ষোভ ও আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘটনায়ই প্রমাণ করে যে, তাদের এহেন কর্মকাণ্ড ছিল মূলতঃ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক।
১৪। ৮ই মার্চ আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হরারি বুমেদিন স্বল্পকালীন রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আগমন করেন। হৃদ্যতা, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বসুলভ পরিবেশে বঙ্গবন্ধু ও জনাব বুমেদিনের মধ্যে শীর্ষ বৈঠক হয়। ১১ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে কুমিল্লায় বাংলাদেশের প্রথম সামরিক একাডেমী উদ্বোধন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে সেখানে বিশেষ সামরিক কুচকাওয়াজ ও মহড়ার আয়ােজন করা হয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে বঙ্গবন্ধু সেখানে সামরিক মহড়া পর্যবেক্ষণ করেন।
১৫। ১৩ই মার্চ তারিখ সকালে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার শ্বাসনালী থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ চিকিৎসক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর শ্বাসনালী থেকে রক্তক্ষরণের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে তাঁর ১১ই মার্চ তারিখে কুমিল্লায় সুদীর্ঘ সময় ধরে ধুলােবালির মধ্যে সামরিক পর্যবেক্ষণ করাকে দায়ী করেন। অতঃপর বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বঙ্গবন্ধুর চিকিৎসার জন্যে গঠিত চিকিৎসা বাের্ড এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তাঁর ফুসফুসের ক্ষতস্থান থেকে এই রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। অতএব তাঁরা বঙ্গবন্ধুর ফুসফুসের ক্ষতস্থান নিরাময়ের লক্ষ্যে উপযুক্ত ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু কোন ওষুধেও বঙ্গবন্ধুর অসুস্থতার কোন উন্নতি পরিলক্ষিত হলাে না। তার শ্বাসনালী দিয়ে রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকে। অতঃপর চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞগণ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, একটি বিশেষ যন্ত্র বঙ্গবন্ধুর শ্বাসনালী দিয়ে প্রবেশ করিয়ে একটি সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচার করা ছাড়া তাঁর ফুসফুসনালীর ঐ ক্ষত নিরাময় করা সম্ভব হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে তখন এই বিশেষ যন্ত্র কিংবা উক্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সার্জন ছিলাে না। অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়।
১৬। ১৭ই মার্চ তারিখে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) কর্তৃক পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আহবান করা হয়। এই দিবসটি ছিলাে বঙ্গবন্ধুর ৫৪তম জন্ম দিন। বঙ্গবন্ধু তখন অসুস্থতায় শয্যাশায়ী এবং তাঁর পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় জাসদ-এর সভাপতি মেজর (অবঃ) জলিল বলেন যে, পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাঁর সমর্থক এবং তাদের নিয়ে জাসদ অস্ত্রবলে সরকারকে উৎখাত কপ্রবে। পল্টনে জনসভা শেষে জাসদ-এর নেতাদের নেতৃত্বে একটি বিরাট জঙ্গী মিছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (মন্ত্রীদের এলাকার) মিন্টু রােডস্থ বাড়ীতে আক্রমণ চালায়। তখন সেখানে কর্তব্যরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের সদস্যদের সঙ্গে মিছিলকারীদের

পৃষ্ঠাঃ ১৭৬
সহিংস সংঘর্ষ বাধে। এই সংঘর্ষে পারস্পরিক গােলাগুলিতে ৬ জন নিহত এবং আরও অনেকে আহত হন। একই সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত জাসদ-এর সভাপতি মেজর (অবঃ) জলিল এবং সাধারণ সম্পাদক আ.স.ম. আব্দুর রবসহ ১৭ ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রেফতার করেন। এই সহিংস সংঘর্ষের সংবাদে অসুস্থ বঙ্গবন্ধু ভীষণ মর্মাহত হন। গণমিছিলসহ মন্ত্রীর বাসস্থানে সহিংস হামলা করার ঘটনাটি ছিল অপ্রত্যাশিত ও অকল্পনীয়, কারণ এ ধরনের ঘটনা ইতিপূর্বে কখনও সংঘটিত হয়নি।
১৭। ইতােপূর্বে চিকিৎসকরা অসুস্থ বঙ্গবন্ধুকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দিলে বঙ্গবন্ধু প্রথমে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এদিকে তাঁর ফুসফুসের রক্তক্ষরণ কোনক্রমেই বন্ধ করা যাচ্ছিলাে না। একদিন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ চিকিৎসক অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ব্যাধির বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে আমাকে জানালেন যে, এর চিকিৎসার জন্যে তাঁর বিদেশে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। অতএব এই প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুকে রাজি করানাের জন্যে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আমাকে সবিশেষ পরামর্শ দিলেন। যাহােক, অবশেষে চিকিৎসার জন্যে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু সম্মত হলেন। কিন্তু এখন সমস্যা হলে তিনি কোন দেশে যাবেন। এই সময় (তৎকালীন সােভিয়েট ইউনিয়নের সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। সেদিন শেখ মণির সঙ্গে সােভিয়েট সরকারের এই আমন্ত্রণ সম্বন্ধে আমার বিস্তারিত আলাপ হয়। শেখ মণি বঙ্গবন্ধুর সােভিয়েট ইউনিয়নের প্রস্তাবে পূর্ণ সমর্থন জানান। অতঃপর ১৯শে মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু, আমার শাশুড়ী, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শিশু রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসার জন্যে মস্কোর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসস্থানের দেখাশুনার দায়িত্ব দেয়া হলাে হাসিনা ও আমার ওপর। ফলে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে হাসিনা ও আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঐ সময় সার্বক্ষণিক হিসেবে অবস্থান নিতে বাধ্য হই।
১৮। মস্কো থেকে আমার শাশুড়ী প্রায় প্রতিদিন ফোনে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে হাসিনাকে অবহিত করতেন। ঐ সময় বঙ্গবন্ধুর বাসায় ছিল একমাত্র হাসিনার (আপন) খালাতাে ভাই শেখ শহীদুল ইসলাম। শেখ শহীদ তখন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। শেখ শহীদ প্রায় সারাদিন বাইরে থাকতাে। ওর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হতাে শুধু রাতে খাবারের সময়। এই সময় ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিলাে–এক গ্রুপ বিভিন্ন সভা-মিছিলে শেখ মণির বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে। শেখ মণির পত্নী আরজু হাসিনার নিকট এতদবিষয়ে অভিযােগও করেছিল কয়েকবার। একদিন হাসিনা শেখ শহীদকে এবিষয়ে প্রশ্ন করলে সে জানায় যে, ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান (বর্তমানে প্রাণের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা) এবং তার সমর্থকরা শেখ মণিবিরােধী তৎপরতার জন্য দায়ী। শেখ শহীদ আরও বলে যে, শেখ মণিই শফিউল আলম প্রধানকে ছাত্রলীগের সাধারণ

পৃষ্ঠাঃ ১৭৭
সম্পাদক নির্বাচিত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং জনাব আলম ও তার সমর্থকদের ওপর তার (শেখ শহীদের) কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। পরদিন, আরজু হাসিনার নিকট ফোনে শেখ শহীদের বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযােগ করলে সে হাসিনা তাকে (শেখ শহীদের) বক্তব্য উল্লেখ করে। ফোনে কথাবার্তার এই পর্যায়ে হাসিনার শেখ শহীদের বক্তব্যকে সমর্থন করার কারণে আরজু রাগে ফেটে পড়ে এবং তৎক্ষণাৎ টেলিফোন ছেড়ে দেয়। তখন আরজু এও বলে যে, সে হাসিনার সঙ্গে আর কোনদিন কথা বলবে না। উল্লেখ্য, হাসিনা ও আরজুর মধ্যে পরস্পর বােনের সম্পর্ক এবং ওরা সমবয়সী দুই বন্ধু। এই ঘটনার পর শেখ মণির বাসা থেকে টেলিফোন আসা বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর মস্কো যাত্রার পর থেকে শেখ। মণি একবারও আমাদের দেখতে না আসায় তখন আমি শুধু মনঃক্ষুন্নই হইনি, অত্যন্ত বিস্মিতও হই।
১৯। চিকিৎসার জন্যে বঙ্গবন্ধুর মস্কোয় অবস্থানকালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ৪ঠা এপ্রিল সকাল সাড়ে আটটার দিকে শেখ কামাল মস্কো থেকে প্রত্যাবর্তন করে। হাসিনা ও আমি তখন নাস্তা খাচ্ছিলাম। কামালের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কুশলাদি সম্পর্কে অবহিত হই। অতঃপর সাড়ে নয়টার দিকে কামাল নাস্তা খেতে শুরু করে। হাসিনা ও আমি কামালের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলাম, ঠিক এই সময় কামালের কক্ষে টেলিফোন বেজে ওঠে। অতঃপর কামাল টেলিফোন রিসিভ করার জন্যে ওর কক্ষে যায়। অল্পক্ষণ পরেই কামাল আমাদের কাছে এসে জানায় যে, আগের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের ছাত্রলীগের ৭ জন সদস্যকে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে ওর জনৈক বন্ধু ওকে টেলিফোনে ঐ সময় অবহিত করেছে। অতঃপর হাসিনা ও আমার আপত্তি সত্ত্বেও কামাল নাস্তা অসমাপ্ত রেখে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে চলে যায়। এদিকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে হাসিনা এখানে সেখানে টেলিফোন করে ঐবিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করে। বেলা বারটার দিকে কামালকে সঙ্গে নিয়ে শেখ মণির বঙ্গবন্ধুর বাসায় আসার সংবাদ পাই। শেখ মণি প্রায় দেড়ঘন্টা যাবত কামালের সঙ্গে নীচের বসার ঘরে গােপন আলাপ করে চলে যায়। ঐ সময় এদের একজনও হাসিনা কিংবা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কোন আলাপ করেনি। দুপুরে খাবার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ ৭ জন ছাত্রের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কামাল আমাদের অবহিত করে। হত্যাকাণ্ডে নিহত ঐ ৭ জন ছাত্রলীগের সদস্য সূর্যসেন হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। ঐ রাতে ভাের ২টার দিকে হল থেকে তাদেরকে ধরে নিয়ে মহসিন হলের ‘কমনরুমের পাশে ছাত্রলীগের অপর একটি গ্রুপের কয়েকজন সদস্য স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। যারা ঐ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যাদি জোগাড় করে কামাল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবে বলে আমাদেরকে আশ্বাস দেয়। কামাল আরও বলে, “দোষী ব্যক্তিদের কাউকেও ক্ষমা করা হবে না।” এর দিন দুয়েক

পৃষ্ঠাঃ ১৭৮
পর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানসহ ১৫ জন ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ জন ছাত্রকে হত্যার অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়।
২০। ৫ই এপ্রিল দিল্লীতে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শুরু হয়। ৯ই এপ্রিল তারিখে এই ত্রিপক্ষীয় সম্মেলন সমাপ্ত হয়। অতঃপর ঐ দিনেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের অবশিষ্ট ১৯৫ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের কথা ঘােষণা করা হয়। ১১ই এপ্রিল তারিখে মস্কোতে প্রায় ২১ দিন চিকিৎসায় আরােগ্য লাভ করে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। দেশে ফিরেই ১৩ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ও দলীয় নেতাদের সঙ্গে সারাদিন আলাপ পরামর্শ করেন। পরিশেষে বঙ্গবন্ধু গুপ্তহত্যা এবং সমাজবিরােধী তৎপরতা বন্ধ করার লক্ষ্যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার এবং সমাজবিরােধীদের দমনের জন্যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।
২১। এদিকে কয়েকটি ডানপন্থী এবং চরম বামপন্থী মাওবাদী রাজনৈতিক দল মওলানা ভাসানীকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর সরকারবিরােধী একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নেয়। অতঃপর ১৪ই এপ্রিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ (ভাসানী), জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী), শ্রমিক-কৃষক সাম্যবাদী দলের সমন্বয়ে একটি ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে ৬-দলীয় ঐক্যজোট গঠনের ঘােষণা দেয়া হয়। শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে সর্বপ্রকার সংগ্রাম ও তৎপরতা পরিচালনার দৃঢ় সংকল্পও ব্যক্ত করা হয় এই ঘােষণায়। অতঃপর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ৬-দলীয় ঐক্যজোট (যুক্তফ্রন্ট) ২৩শে এপ্রিল পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়ােজন করে। উক্ত জনসভায় মওলানা ভাসানী তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাত এবং আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।
২২। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝির ঘটনা। শাশুড়ী দুপুরে আমার অফিসে গাড়ী পাঠালেন আমাকে তাঁর বাসায় নেয়ার জন্যে। হাসিনা ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেখানেই ছিল। খাবার সময় তিনি আমাকে একটি ইংরেজীতে লেখা চিঠি দিলেন পড়ে দেখার জন্যে। শাশুড়ীকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের একজন ব্রিগেডিয়ার লিখেছেন উক্ত চিঠিটি। এটি লন্ডন থেকে তাকে পাঠানাে হয়েছে। এর একটি অনুলিপি শেখ মণির নিকটও পাঠাননা হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব বঙ্গবন্ধুর শ্বাসনালী থেকে রক্তক্ষরণের সংবাদে উৎকণ্ঠিত হয়ে লিখেছেন উক্ত চিঠি। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, লাহােরে ২৩-২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানে উপস্থিতির সুযােগে তাঁর শরীরে গােপনে অনুপ্রবেশ করানাের উদ্দেশ্যে তাঁকে ক্যান্সার জাতীয় মারাত্মক ব্যাধির ভাইরাস প্রস্তুত করার

পৃষ্ঠাঃ ১৭৯
নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাঁকে বলা হয়েছিল যে, ঐ ভাইরাস এমন একটি সূচের ভেতর সংরক্ষিত থাকবে যা হাতের তালুতে কিংবা আঙুলে সংগােপনে রাখা যায়। উক্ত ভাইরাস ভর্তি সূচটি জুলফিকার আলীর হাতের তালুতে কিংবা আঙুলে স্থাপন করা হবে যাতে শেখ মুজিবের সঙ্গে ভূট্টোর করমর্দন কিংবা আলিঙ্গনের সময় সেটিকে তাঁর (শেখ মুজিবের) শরীরে ঢুকিয়ে দেয়া যায়। একজন মুসলমান হিসেবে অপর একজন মুসলমানের ক্ষতি করার এ প্রস্তাবে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে উক্ত চিঠিটিতে। সম্ভবতঃ, অন্য কোন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে এ জাতীয় ভাইরাস প্রস্তুত করিয়ে নিয়ে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তা শেখ সাহেবের শরীরে ঐ সময়ে অনুপ্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন বলে তিনি সন্দিহান। পরিশেষে, ব্রিগেডিয়ার সাহেব বঙ্গবন্ধুর রােগমুক্তির জন্য কামনা করেছেন আল্লাহর দরবারে।
২৩। ৪ঠা মে তারিখে আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেশের খাদ্যদ্রব্য পরিস্থিতি, অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা ও দুর্মূল্য, আইন-শৃঙক্ষলা পরিস্থিতি তথা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা ও বিশ্লেষণ করা হয় উক্ত সভায়। এ সমস্ত সমস্যার সমাধানকাল্পে আণ্ড কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মােট কথা, এ সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানানাে হয় বঙ্গবন্ধুর প্রতি। অতঃপর দেশের স্বার্থ, বিশেষ করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পরিপন্থী কাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযােগে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১০১ জন রাজনৈতিক ও অন্যান্য ব্যক্তির বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করে।
২৪। ১২ই মে ভারত সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ-আলােচনা ও পারস্পরিক মতবিনিময়ের জন্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে দিল্লী যাত্রা করেন। ঐ দিনেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৩ই মে নয়াদিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠিত হয় ইন্দিরা-মুজিব আনুষ্ঠানিক শীর্ষ বৈঠক। এর পর বাংলাদেশ ও ভারত সরকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ই মে ভারত ও বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদনে মতৈক্য ব্যক্ত করে। ১৬ই মে তারিখে ভারত ও বাংলাদেশ একটি যুক্ত ঘােষণায় স্বাক্ষর করে। উক্ত যুক্ত ঘােষণায় বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী কয়েকটি ছিটমহল সম্পর্কে গৃহীত সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে সমস্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে বেরুবাড়ী ছিটমহল ভারতের এবং দহগ্রাম, আংগােরপােতা, আসালং লাঠিয়াল ও পাথুরিয়া ছিটমহলগুলােকে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দহগ্রাম ও আংগােরপােতা ছিটমহল দু’টির সঙ্গে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সরাসরি সংযােগ স্থাপনের ব্যবস্থা হিসেবে ভারতের তিনবিঘা (দৈর্ঘে ১৭০ মিটার, প্রস্থ ৮০ মিটার) আয়তনের একটি

পৃষ্ঠাঃ ১৮০
করিডাের চিরস্থায়ী মেয়াদে বাংলাদেশকে ইজারা দেওয়ার অঙ্গীকারও করা হয় উক্ত যুক্ত ঘােষণায়। ১৬ই মে সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু দিল্লী থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ..
২৫। ১৭ই মে তারিখে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে স্বস্তি পরিষদের বৈঠক শুরু হয়। এ সময় এক সন্ধ্যায় হাসিনা ও ছেলেমেয়েসহ আমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ছিলাম। তখন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি ব্যক্তিমালিকানায় শিল্প-কারখানা স্থাপন ও পূজি বিনিয়ােগে সরকারের নীতি প্রণয়নের সুপারিশমালাসম্বলিত একটি স্মারকলিপি বঙ্গবন্ধুর নিকট পেশ করেন। বাংলাদেশ সরকার অতি শিগগির শিল্প ও পুজিবিনিয়ােগ নীতি ঘােষণা করবে বিধায় বঙ্গবন্ধু ঐ স্মারকলিপিটি আমাকে দিয়ে ঐ রাতেই সে সম্পর্কে আমাকে মতামত দিতে বলেন। আমি স্মারকলিপিতে উল্লেখিত প্রস্তাবসমূহ গভীর মনােযােগে পড়ে এবং চিন্তা করে সে রাতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খাওয়ার পর তাঁকে আমার মতামত জানাই। বঙ্গবন্ধু তৎক্ষণাৎ আমার মতামতের সঙ্গে ঐকমত্য ব্যক্ত করে যে সমস্ত বিষয়ে আমার ইতিবাচক সম্মতি রয়েছে সেগুলােকে চিহ্নিত করে দিতে বলেন। আমার এতদবিষয়ে মতামত দেয়ার আইনগত অধিকার, পদমর্যাদা কিংবা ক্ষমতা না থাকার কারণে আমি সে সমস্ত বিষয়ে আমার মতামত পরদিন টাইপ করে দেওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি তাতে সম্মত হন। অতঃপর পরদিন অফিসে আমি আমার আরও কয়েকজন উর্ধ্বতন সহকর্মীর সঙ্গে তৎবিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করে একটি প্রতিবেদন তৈরী করি এবং সেদিন রাতেই তা বঙ্গবন্ধুকে দেখাই। সেটি পড়ে বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন যে, তাঁর সরকারী কোন উপদেষ্টা কোন বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক পরামর্শ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আমাকে পরদিনই আমার এই প্রতিবেদন তাঁর অর্থনৈতিক বিষয়ক সচিব ডঃ সাত্তারকে দিয়ে আসতে বলেন। বঙ্গবন্ধু আরও বললেন, “ডঃ সাত্তারকে বলবে, তিনি যেন তােমার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকারী প্রস্তাব তৈরী করে আমার বিবেচনার জন্য পেশ করেন যথাশীঘ্রই, বিশেষ করে, শিল্প বিনিয়ােগ নীতি প্রণয়ন শুরু করার পর্যাপ্ত সময়ের আগেই।”
২৬। ৩রা জুন (১৯৭৪) তারিখে সংসদে বাজেট অধিবেশন শুরু হয়। ঐ তারিখেই সংসদে ৩টি শােক প্রস্তাব ও ৯টি বিল পেশ করা হয়। ৬ই জুন তারিখে বাংলাদেশকে জাতিসংঘে সদস্যপদ প্রদানের প্রশ্নে স্বস্তি পরিষদের আরও একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১০ই জুন (১৯৭৪) তারিখে অনুষ্ঠিত স্বস্তি পরিষদের বৈঠকে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রদানের জন্যে সর্বসম্মত সুপারিশ গৃহীত হয়। ১৫ই জুন তারিখে ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি.তি, গিরি ৫ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন। ১৮ই জুন তারিখে শ্রী ভি, ভি, গিরি সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ভাষণ দেন।
২৭। জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশের প্রায় সর্বত্র প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। অতিবৃষ্টির কারণে সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলসমূহ বন্যায় প্লাবিত হয় এবং

পৃষ্ঠাঃ ১৮১
ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৪ সালের শুরু থেকেই দেশে খাদ্যাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ১৯৭৩ সালে প্রথম অনাবৃষ্টিতে এবং পরে বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেশে এই খাদ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ। এই বছরে একই কারণে ভারতেও খাদ্য ঘাটতি হয়েছিল। এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সরকার যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ই.ই.সি সদস্যভূক্ত কয়েকটি দেশ ও অস্ট্রেলিয়া থেকে পর্যাপ্ত খাদ্য আমদানী করার জন্যে। কিন্তু চোরাচালানী, মজুতদারী, কালােবাজারীদের এবং দুষ্কৃতকারীদের খাদ্যগুদামে অগ্নিসংযােগ ও খাদ্য বহনকারী ট্রাক, ট্রেন ও জাহাজ ধ্বংস করার মত অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে দেশে সৃষ্টি হয় দারুণ খাদ্য সঙ্কট। উপরন্তু, দুষ্কৃতকারী ও দুবৃত্তদের সশস্ত্র সহিংস কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশে নাজুক ও অস্বস্তিকর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে নির্ধারিত ছিল পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফর।
২৮। ২৭শে জুন (১৯৭৪) তারিখে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ৩ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন। তার সঙ্গে সর্বমােট সফরসঙ্গী ছিলেন ১০৭ জন। স্বাধীন বাংলাদেশে জনাব ভূট্টোর এটাই ছিল প্রথম সফর। জনাব ভুট্টোর ঢাকা পৌছানাের আগেই পাকিস্তান সরকারের গােয়েন্দা বিভাগসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বর্তী দলকে পাঠানাে হয়েছিল। তখন বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, এই অগ্রবর্তী দলের লােকজন পি.ডি.পি, মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে প্রচুর উপটৌকন ও অর্থকড়ি বিতরণ করেন। এসব করা হয়েছিল যাতে জনাব ভুট্টো ভালাে সংবর্ধনা পান সে জন্যে। যাহােক, বঙ্গবন্ধুর সরকার একজন বিদেশী রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হিসেবে জনাব ভুট্টোকে যােগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বর্বরতা ও গণহত্যার সেই ভয়াল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে জনাব ভুট্টোর মুখ্য ভূমিকার কথা বাংলার মানুষ তখনও ভুলে যায়নি। তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় জনাব ভুট্টোর ঢাকায় আগমনের দিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় কোন রকম মন্তব্য ছাড়াই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার সামরিক বাহিনীর ভয়াবহ বর্বরতা ও গণহত্যার কিছু আলােকচিত্র প্রকাশে। বিমান বন্দরে ঠিকই প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল জনাব ভুট্টোকে সংবর্ধনা জানানাের জন্যে। তবে এই সংবর্ধনাকারীদের অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তানী নাগরিক (অবাঙালী) এবং বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থক। জনাব ভুট্টোর এই সফরকালেও তার বাঙালী বিরােধী ভূমিকার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ফলে স্বভাবতই জনমত বিক্ষুব্ধ হয় এবং তিনি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুস্তস্তবক অর্পণ করতে গেলে এক বিরাট জনতা তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা খুনী ভুট্টো ফিরে যাও” বলে শ্লোগান দেয়।

পৃষ্ঠাঃ ১৮২
২৯। ২৮শে জুন প্রথমে কোন উপদেষ্টা ছাড়াই বঙ্গবন্ধু ও জনাব ভুট্টোর একান্তে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণসহ বঙ্গবন্ধু ও জনাব ভুট্টোর মধ্যে সুদীর্ঘ ও আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনাকালে বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানী নাগরিকদের (অবাঙালীদের) পাকিস্তানে ফেরত নেয়া এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য পরিসম্পদ পরিশােধের প্রশ্ন তুলে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কাছে ৫ হাজার কোটি টাকা দাবী করেন। কিন্তু জনাব ভুট্টো এই মৌলিক ইস্যুগুলাে এড়িয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রদূত বিনিময়ের ওপরই সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু জনাব ভুট্টোকে সাফ জানিয়ে দেন যে, বাংলাদেশের দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ অবাঙালীদের পাকিস্তানে ফেরত না নেওয়া এবং পাঁচ হাজার কোটি টাকা পরিসম্পদ পরিশােধ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রদূত বিনিময় করা হবে না। জনাব ভুট্টো ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ সময়কার ঘটনাবলীকে ভ্রান্তভাবে চিহ্নিত করে তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বর্বরতা ও গণহত্যার কথা অস্বীকার করার অপচেষ্টা করেন। এর জবাবে, জনাব ভুট্টোর সম্মানে আয়ােজিত এক রাষ্ট্রীয় ভােজসভায় বঙ্গবন্ধু জনাব ভুট্টোকে এবিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ইচ্ছা করলেই ইতিহাসকে বিকৃত করা যায় না।” অতঃপর ২৯শে জুন তারিখের পত্র-পত্রিকায় বলা হয় যে, বাংলাদেশে আটকেপড়া ৫ লাখ পাকিস্তানী নাগরিক (অবাঙালীদের) পাকিস্তানে ফেরত নেওয়া এবং বাংলাদেশের পাওনা পরিশােধের জন্য উত্থাপিত বাংলাদেশের দাবীর প্রশ্নে ভুট্টোর অনমনীয় মনােভাবের দরুন মুজিব-ভুট্রো আলােচনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।
৩০। জনাব ভুট্টো ঢাকায় এসে (পিকিংপন্থী) বামপন্থী এবং সাম্প্রদায়িক (পাকিস্তানপন্থী) ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গিয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন ন্যাপ (ভাসানী)-এর শীর্ষস্থানীয় নেতা মশিউর রহমান (যাদু মিয়া)। বিভিন্ন সূত্রের মতে জনাব মশিউর রহমান জনাব ভুট্টোকে অনুরােধ করেছিলেন কোন অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সব বিষয়ে ফয়সালা না করার জন্যে। ২৯শে জুন বাংলাদেশ ত্যাগ করার প্রাক্কালে গণভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুট্টো বাংলাদেশের দায়দেনা ও পাওনা সম্পর্কে বলেন, “I have not brought a blank chequel” পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনকালে প্লেনে জনাব ভুট্টো এক সাংবাদিককে বলেছিলেন যে, শেখ মুজিবের সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়াদির ব্যাপারে সমঝােতা না করে তিনি যুক্তিযুক্ত কাজ করেছেন। অথচ পাকিস্তানে পৌছেই জনাব ভুট্টো এক সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, ‘বাংলাদেশে আমার তাৎপর্যপূর্ণ সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে।”
৩১। ২৯শে জুন মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি পথ মিছিল বঙ্গভবনের দিকে যাওয়ার পথে পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। অতঃপর মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদে

পৃষ্ঠাঃ ১৮৩
মওলানা ভাসানী ৩০শে জুন তারিখে সারা ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। এই কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ঐ দিন বায়তুল মােকাররাম প্রাঙ্গণ থেকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি জঙ্গী মিছিল বের করার চেষ্টা চালানাে হলে পুলিশের হস্তক্ষেপে তা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ২৯শে জুন রাতে মওলানা ভাসানীকে জনাব মশিউর রহমানের মগবাজারস্থ বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। অতঃপর ঐ রাতেই তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে নিয়ে গিয়ে তাঁর নিজ বাড়ীতে অন্তরীণ রাখা হয়। মওলানা ভাসানীর গ্রেফতার করার প্রতিবাদে তার নেতৃত্বাধীন ৬-দলীয় ঐক্যফ্রন্ট সারা ঢাকায় ৫ই জুলাই তারিখে হরতাল পালনের আহবান জানায়। কিন্তু সেদিন ঢাকায় কোন হরতাল পালিত হয়নি।
৩২। ৬ই জুলাই (১৯৭৪) তারিখে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক যুক্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় দেশের বুক থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতি ও সমাজবিরােধী তৎপরতার মূলােচ্ছেদ, চোরাচালান, মজুতদারী, কালােবাজারী ও মুনাফাখখারী নিরােধ ও গুপ্তঘাতকদের হাতিয়ারবাজির অবসান ঘটিয়ে জনজীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিধানকল্পে কঠোরতর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উক্ত বৈঠকে দুষ্কৃতকারীদের সমাজবিরােধী ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ দমনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, ফাঁসি ও ফায়ারিং স্কোয়াডের ব্যবস্থা করার জন্যে আইন প্রণয়নেরও প্রস্তাব করা হয়। এই বৈঠকের পরেই বঙ্গবন্ধু প্রশাসন যন্ত্রকে অধিকতর সচল ও সক্রিয় করে তােলার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমেই জুলাই মন্ত্রী পরিষদ থেকে ছয়জন মন্ত্রী এবং তিনজন প্রতিমন্ত্রীকে অপসারণ করে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রী পরিষদের পুনর্বিন্যাস করেন। যাঁরা মন্ত্রী পরিষদ হতে অপসারিত হন তাঁরা ছিলেন সর্বজনাব শামসুল হক, মােল্লা জালালউদ্দিন, মতিউর রহমান, শেখ আব্দুল আজিজ, জেনারেল (অবঃ) এম.এ.জি. ওসমানী, ডঃ মফিজ চৌধুরী, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, শাহজাহান আব্দুল মালেক এবং বেগম নূরজাহান মুর্শেদ। ঐ দিনই বঙ্গবন্ধুর সরকার কতিপয় বিশেষ ব্যতিক্রম বাদে বাংলাদেশের নাগরিকদের স্থল, নৌ ও বিমান পথে বিদেশ যাত্রার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরােপ করে। ৯ই জুলাই তারিখে ঘােষণা করা হয় যে, চোরাচালান রােধে সেনাবাহিনীকে সীমান্তে পাঠিয়ে সীমান্ত সীল করে দেবার জন্যে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ১১ই জুলাই চারজন উচ্চপদস্থ আমলাকে দুর্নীতির অভিযােগে বরখাস্ত করা হয় এবং চট্টগ্রামে একজন নব্য কোটিপতি ও তার কতিপয় সহযােগীকে গ্রেফতার করার কথা সরকারীভাবে ঘােষণা করা হয়। ১৬ই জুলাই শিল্পমন্ত্রী নতুন পুঁজি বিনিয়ােগ নীতি ঘােষণা করেন। এই পুঁজি বিনিয়ােগ নীতিতে ব্যক্তিমালিকানায় পুঁজি বিনিয়ােগ সিলিং ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয় এবং ১৫ বছরের মধ্যে এরূপ কোন শিল্প জাতীয়করণ না করার অঙ্গীকার করা হয়। ১৮ই জুলাই জনস্বার্থের পরিপন্থী কাজে লিপ্ত থাকা এবং দুর্নীতির অভিযােগে ঢাকার ডি.আই.জি.-কে

পৃষ্ঠাঃ ১৮৪
সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। ২২শে জুলাই (১৯৭৪) তারিখে সংসদে পাশ হয় চোরাচালান, মজুতদারী, কালােবাজারী, মুনাফাখখারী, গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের দায়ে দোষী ব্যক্তিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত প্রদানের বিধান সম্বলিত আইন।
৩৩। জনজীবনে নিরাপত্তা বিধান এবং চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয় রােধের উদ্দেশ্যে সমাজ শত্রুদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক উপরােক্ত কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজবিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত বিভিন্ন মহল সংঘবদ্ধভাবে সরকারী প্রয়াস বানচালের চক্রান্ত জোরদার করার কাজে কৃতসংকল্প হয়। ভােগ্যপণ্য বাজারে ব্যাপকভাবে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম সঙ্কট এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বেড়ে যায় হু হু করে। একপর্যায়ে চাউলের সের দশ-পনের টাকা, লবণের সের বিশ টাকা, সরিষার তেল চল্লিশপঞ্চাশ টাকা এবং শুকনাে মরিচের সের আশি টাকায় পৌছায়। একইভাবে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনী দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্য।
৩৪। বলাবাহুল্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সৃষ্টি হয়েছিল প্রধানত মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর তরুণ যুবকদের একটি বিরাট অংশকে নিয়ে। কিন্তু পরবর্তীতে জাসদ হয়ে দাঁড়ালে বঙ্গবন্ধুর সরকারবিরােধী যে কোন ধরন ও চরিত্রের লােকের আশ্রয়স্থল। ফলে, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ করার জন্যে যে জাসদের জন্ম পরিশেষে হয়ে দাড়ায় এক বহুশ্রেণী ভিত্তিক সংগঠন। এমনকি দুর্নীতির অভিযােগে সরকারী, আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেশনের পদচ্যুত কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত নেতাদের ঠাঁই মিললাে জাসদ-এ। এ ছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে পরাজিত এবং স্বাধীনতাবিরােধী পাকিস্তানপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে জাসদকে ব্যবহার করে। স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শবিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল, পুঁজিপতি ও শােষিত শ্রেণীর লােকেরা স্বস্বার্থে জাসদকে সাহায্য-সহযােগিতা ও অর্থ-সম্পদ প্রদান করে। অতঃপর ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এবং আসন্ন খাদ্য সঙ্কটের মুখে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) কর্নেল (অবঃ) আবু তাহেরের নেতৃত্বে অতি গােপনে সারা দেশব্যাপী গড়ে তােলে মুক্তিযােদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও প্রাক্তন সৈনিকদের সমবায়ে সশস্ত্র ‘বিপ্লবী গণবাহিনী। শুধু তাই নয়, জাসদ, কর্নেল (অবঃ) তাহেরের সহায়তায় অতি গােপনে সংগঠিত করতে থাকে বাংলাদেশের প্রতিটি সেনানিবাসের সৈনিক ভাইদেরকে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে। উল্লেখ্য, সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শ্ৰেণীমুক্ত ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের সংকল্প নিয়ে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে গঠিত গুপ্ত সংগঠন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি’-এর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন যথাযথ সংযােগ রক্ষা করতেন বিপ্লবী গণবাহিনীর নেতা কর্নেল (অবঃ) তাহেরের সঙ্গে।

পৃষ্ঠাঃ ১৮৫
৩৫। জনাব ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের আট সপ্তাহ পর আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ আফগানিস্তান ও ইরানে সফরে যান। আফগানিস্তান ও ইরান সফর শেষে খন্দকার মােশতাক আহমদ বেসরকারীভাবে জেদ্দায় গমন করেন। ঐ সময় খন্দকার মােশতাক আহমদ ইরানে গণচীনের নেতা ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জেদ্দায় গিয়ে খন্দকার মােশতাক আহমদ পাকিস্তানী দলের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। খন্দকার মােশতাক আহমদের এ সফর সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত মঞ্চ নেপথ্যে বলা হয়, গত বছরে ইত্তেফাকের একটি নিজস্ব সংবাদে বলা হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের জনৈক নেতার সহিত চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে আলােচনা হয় এবং চীনা নেতার তরফ হইতে এ ব্যাপারে বিশেষ অনুকুল সাড়া পাওয়া যায়। গত ২৪শে মে’র নিবন্ধে আমরা তৎসম্পর্কে লিখিয়াছিলাম, বাংলাদেশের সেই নেতা তখন নিজের নাম প্রচারে অস্বীকৃতি জানাইলেও আমরা প্রবর্তীকালে জানিতে পারি যে, বাংলাদেশ সরকারের সেই নেতাটি ছিলেন আমাদের বিচক্ষণ বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ। আর অকুস্থলটি ছিল বাগদাদ। আর আফগানিস্তান সফরকালে কাবুলে চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতকারের কথা জানা গিয়াছে। এটা অনস্বীকার্য যে, তিনি ‘ফরেন ট্রেড করার উপলক্ষে বেশ কিছু ‘ফরেন এ্যাফেয়ার্সের কাজও করিয়াছিলেন এবং তাহা করিতে গিয়া তিনি হয়তাে কোন কোন মহলের বিরাগভাজনও হইয়াছিলেন।” খন্দকার মােশতাকের উক্ত বিদেশ সফরের পর পরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো কাকুলের মিলিটারী একাডেমীতে এক ভাষণে বলেন, “Soon some changes are going to take place in this region. (অতি শীগগির এতদঞ্চলে কিছু পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।”
৩৬। ১৯৭৪ সালের জুলাই ও আগষ্ট মাসদুটোতে বাংলাদেশের জনজীবনে এক নজিরবিহীন খাদ্য-বস্ত্রসহ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির দুষ্প্রাপ্যতা ও মূল্যজনিত বিপর্যয়ের পাশাপাশি নেমে আসে আর এক অভিশাপ—সর্বনাশা বন্যা। ৫ই জুলাই রংপুর, সিলেট, পাবনা ও জামালপুর জেলাগুলাের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ৮ই জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে এই সমস্ত জেলার বন্যাকবলিত এলাকাগুলাে পরিদর্শন করেন। ১৭ই জুলাই দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। ২৩শে জুলাই দেশের উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতির সংবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২৯শে জুলাই তারিখে রংপুর জেলার বন্যা দুর্গত এলাকাসমূহে খাদ্য-বস্ত্রসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির তীব্র অভাবের কথা বিভিন্ন পত্র-পতিকায় প্রকাশিত হয়। ৩০শে জুলাই ঢাকাস্থ বিভিন্ন বিদেশী মিশন ও দূতাবাস বন্যার ধ্বংসলীলার সংবাদে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ৩১শে জুলাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গণভবনে ত্রাণ কেন্দ্র খোেলা হয়।

পৃষ্ঠাঃ ১৮৬
৩৭। ১লা আগস্ট বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলাদু’টির সড়ক ও ট্রেন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়। ২রা আগস্ট দেশের বন্যা পরিস্থিতির মােকাবেলায় সেনা বাহিনীকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। ৩রা আগস্ট মন্ত্রিসভার এক জরুরী বৈঠকে যুদ্ধকালীন জরুরী ভিত্তিতে দেশের বন্যা পরিস্থিতি মােকাবেলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধুর সরকার বন্যা দুর্গত এলাকাগুলাের জনগণকে সাহায্য ও তাদের নিকট ত্রাণ সামগ্রী পৌছানাে ও বিতরণের জন্যে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীত্রয়কে নিয়ােগ করে। ৪ঠা আগস্ট তারিখে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে সিলেট জেলার বন্যা দুর্গত এলাকাগুলাে পরিদর্শন করেন। ৫ই আগস্ট তারিখে রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহ হেলিকপ্টারে ময়মনসিংহ জেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করেন। ৬ই আগস্ট তারিখে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে মেঘনা নদীর পানি বিপদসীমার পাঁচ ফুটেরও উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ভয়াবহ এই বন্যায় বিধ্বস্ত হয় অগণিত ঘরবাড়ী এবং বিনষ্ট হয় বিস্তীর্ণ এলাকার জমির ফসল। ৮ই আগস্ট তারিখে প্রকাশিত এক সরকারী তথ্য বিবরণীতে এ যাবত বন্যায় সহস্রাধিক লােকের প্রাণহানী হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হয়। ৯ই আগস্ট ঢাকার বন্যা পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটে। ১০ই আগস্ট তারিখে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেশের সার্বিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকার উর্ধ্বে হবে বলে আশঙ্কা করা হয়। ১১ই আগস্ট রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চলের সড়ক ও ট্রেন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১২ই আগস্ট তারিখে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা খাদ্য-সাহায্য কর্মসূচীর অধীনে বাংলাদেশের জন্য ১০ লাখ ডলার মঞ্জুর করে।
৩৮। ১৪ই আগষ্ট বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বলা হয় যে, দেশে ১৯৭৪ সনের বন্যার ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা ১৯৫৫ সনের অবস্থাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই ভয়াবহ বন্যায় প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ লােক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বলা হয়। ১৮ই আগস্ট তারিখে জাতীয় রেডিও-টেলিভিশনের এক বিশেষ ভাষণে বঙ্গবন্ধু বন্যাজনিত বিপর্যয়ের মােকাবেলায় সাহায্য সহযােগিতা করার জন্যে দলমত নির্বিশেষে সকল মহলের প্রতি আকুল আবেদন জানান। উক্ত ভাষণে তিনি বিদেশী রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিও আবেদন জানান বাংলাদেশের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রপীড়িত জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে খাদ্য-বস্ত্র ও অর্থ সাহায্য প্রদানের জন্যে। ৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারযােগে রংপুর জেলার চিলমারী মহকুমার বন্যা দুর্গত এলাকাগুলাে পরিদর্শন করেন। ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে ফরিদপুর জেলার বন্যা উপদ্রুত এলাকাসমূহ পরিদর্শন করেন। ১২ই সেপ্টেম্বর তারিখে আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুরারি বুমেদিন বাংলাদেশের বন্যা দুর্গত মানবতার সাহায্য করার জন্যে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলাের প্রতি আহবান জানান। ১৬ই সেপ্টেম্বর আলজিরিয়ার সরকার বাংলাদেশের বন্যার্তদের সাহায্যে ১০লাখ ডলার অনুদান প্রদানের কথা ঘােষণা করে। ২২শে সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু বন্যার্তদের বাঁচানাের উদ্দেশ্যে বন্যা

পৃষ্ঠাঃ ১৮৭
উপদ্রুত এলাকাগুলাের প্রতিটি মহল্লা ও গ্রামে লংগরখানা খােলার জন্যে দলমত নির্বিশেষে সকল মহল এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের প্রতি আকুল আবেদন জানান।
৩৯। ইতােপূর্বে (১৮ই সেপ্টেম্বর তারিখে) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমােদনে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যাজনিত দুর্ভিক্ষাবস্থা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে নিউইয়র্কে যেতে হয় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্যে। ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের অধিবেশনে ভাষণ দেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপস্থিত উল্লাসমুখর প্রতিনিধিবর্গের তুমুল করতালির মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ দেন মাতৃভাষা বাংলায়। বঙ্গবন্ধুই প্রথম ব্যক্তি যিনি জাতিসংঘে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই বলেন, “আজই এই মহামান্বিত সমাবেশে দাঁড়াইয়া আপনাদের সাথে আমি এই জন্য পরিপূর্ণ সন্তুষ্টির ভাগীদার যে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ এই পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করিতেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পূর্ণতা চিহ্নিত করিয়া বাঙালী জাতির জন্য ইহা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। স্বাধীনভাবে বাঁচার অধিকার অর্জনের জন্য এবং একটি স্বাধীন দেশে মুক্ত নাগরিকের মর্যাদা নিয়া বাঁচার জন্য বাঙালী জনগণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী সংগ্রাম করিয়াছেন, তাঁহারা বিশ্বের সকল জাতির সঙ্গে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিয়া বাস করিবার জন্য আকাঙিক্ষত ছিলেন। যে মহান আদর্শ জাতিসংঘ। সনদে রক্ষিত আছে আমাদের লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন। আমি জানি, শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সকল মানুষের আশা-আকাঙক্ষা বাস্তবায়নের উপযােগী একটি বিশ্ব গড়িয়া তােলার জন্য বাঙালী জাতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমাদের এই অঙ্গীকারের সহিত শহীদানের বিদেহী আত্মাও মিলিত হইবেন। ইহা বিশেষ আনন্দের ব্যাপার যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় যােদ্ধা সভাপতি থাকাকালেই বাংলাদেশকে এই পরিষদের অন্তর্ভুক্ত করিয়া নেওয়া হইয়াছে।”
৪০। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, …”আজিকার দিনে বিশ্বের জাতিসমূহ কোন পথ বাছিয়া নিবে তাহা লইয়া সংকটে পড়িয়াছে। এই পথ বাছিয়া নেওয়ার বিবেচনার উপর নির্ভর করিবে আমরা সামগ্রিক ধ্বংস, ভীতি এবং আণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়া এবং ক্ষুধা, বেকারী ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানবিক দুর্গতিকে বিপুলভাবে বাড়াইয়া তুলিয়া আগাইয়া যাইব অথবা আমরা এমন এক বিশ্ব গড়িয়া তােলার পথে আগাইয়া যাইব যে বিশ্বে মানুষের সৃজনশীলতা এবং আমাদের সময়ের বিজ্ঞান ও কারিগরী অগ্রগতি আণবিক যুদ্ধের হুমকিমুক্ত উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের রূপায়ণ সম্ভব করিয়া তুলিবে এবং যে কারিগরীবিদ্যা ও সম্পদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে সুন্দর জীবন গড়িয়া তােলার অবস্থা সৃষ্টি করিবে। যে অর্থনৈতিক উত্তেজনা সম্প্রতি সমগ্র বিশ্বকে নাড়া দিয়াছে

পৃষ্ঠাঃ ১৮৮
তাহা একটি ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিয়া জরুরীভাবে মােকাবিলা করিতে হইবে।”
৪১। অতঃপর বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যাজনিত ও অন্যান্য কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে মারাত্মকভাবে আঘাত হানিয়াছে। যুদ্ধের ধ্বংসলীলার উপর সৃষ্ট বাংলাদেশ পর পর কতিপয় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হইয়াছে। আমরা সর্বশেষ যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হইয়াছি তাহা হইতেছে এই বৎসরের নজিরবিহীন বন্যা। এই পরিস্থিতি মােকাবিলায় বাংলাদেশকে সাহায্য করার ব্যাপারে সক্রিয় উৎসাহ প্রদর্শন করায় আমরা জাতিসংঘ, তার বিভিন্ন সংস্থা ও মহাসচিবের কাছে কৃতজ্ঞ। আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বুমেদিন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুতােফ্লিকা বাংলাদেশের সাহায্যে আগাইয়া আসার জন্য জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের প্রতি আহবান জানাইয়াছেন। মিত্রদেশগুলি এবং বিশ্বের মানবিক সংস্থাসমূহ এ ব্যাপারে সাড়া দিয়াছে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিই শুধু বিঘ্নিত হয় নাই, ইহার ফলে দেশে আজ দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে। ইহা ছাড়া, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির দরুন আমাদের মত দেশগুলিতে দায় পরিশােধের ক্ষেত্রে হাজার হাজার ডলার শূন্যতার সৃষ্টি হইয়াছে।” নতুন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে জাতিসংঘের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “একটি যথার্থ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়িয়া তােলার পদক্ষেপ নিতে জাতিসংঘকে এর আগে কোথাও এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করিতে হয় নাই। এই ধরনের ব্যবস্থায় শুধু মাত্র নিজ নিজ প্রাকৃতিক সম্পদের উপর প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকারকে নিশ্চিত করাই নয়, ইহাতে একটা স্থায়ী এবং যথার্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য বিশ্বের দেশগুলির সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক কাঠামাে প্রণয়নেরও ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। এই মুহূর্তে আমরা প্রত্যেক মানুষের জন্য মানবাধিকারের। আন্তর্জাতিক ঘােষণায় স্বীকৃত মুক্তভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুবিধা ভােগের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে পুনরুল্লেখ করিতেছি। আন্তর্জাতিক ঘােষণা অনুযায়ী প্রত্যেকটি মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবারের কল্যাণের জন্য জীবন যাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে হইবে। আমরা এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন যে, বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট শুধুমাত্র শান্তি এবং আন্তর্জাতিক সমঝােতার পরিবেশেই সমাধান করা সম্ভব। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বর্তমান অস্ত্র প্রতিযােগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জরুরী ব্যবস্থা নিতে হইবে। ইহাতে শুধুমাত্র এই ধরনের পরিবেশই সৃষ্টি হইবে না, ইহাতে অস্ত্র সজ্জার জন্য যে বিপুল সম্পদ অপচয় হইতেছে তাহাও মানবতার কল্যাণে নিয়ােজিত করা যাইবে।”
৪২। অতঃপর বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপােষ মীমাংসার

পৃষ্ঠাঃ ১৮৯
পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতঃপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তির কাঠামাে এবং স্থায়ীত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহা ছাড়া, আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সংঘর্ষ ও বিরােধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযােগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। আমরা আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সঙ্গে শুধুমাত্র সুপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কই প্রতিষ্ঠা করি নাই, অতীতের সমস্ত গ্লানি ভুলিয়া গিয়া পাকিস্তানের সঙ্গেও সম্পর্ক করিয়া নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করিয়াছি। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য আমরা কোন উদ্যোগ বাদ দেই নাই এবং সবশেষে ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দীকে ক্ষমা প্রদর্শন করিয়া আমরা চূড়ান্ত অবদান রাখিয়াছি। ঐ সকল যুদ্ধবন্দী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ মারাত্মক অপরাধ করিয়াছে। ইহা হইতেছে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ও উপমহাদেশে ভবিষ্যতে শান্তি ও স্থায়ীত্ব গড়িয়া ভােলার পথে আমাদের অবদান। এই কাজ করিতে গিয়া আমরা কোন পূর্বশর্ত আরােপ অথবা কোন দর কষাকষি করি নাই। আমরা কেবলমাত্র আমাদের জনগণের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের কল্পনায় প্রভাবিত হইয়াছি।” পরিশেষে, বঙ্গবন্ধু বলেন, “জনাব সভাপতি, মানুষের অজয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস, মানুষের অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতেছি। আমাদের মত যেসব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাহাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভােগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চ্যালেঞ্জ মােকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযােগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকাণ্ডকেও সহজতর করিবে ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।” জাতিসংঘে এই ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল কুর্ট ওয়ান্ডহেইমের সঙ্গে ২৯শে সেপ্টেম্বর তারিখে সাক্ষাৎ করেন।
৪৩। কোন দেশের সরকার প্রধান যখন প্রথমবারের মত জাতিসংঘে ভাষণ দিতে যান। তখন সাধারণতঃ প্রটোকল প্রথানুযায়ী তাঁকে সৌজন্যমূলকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে ওয়াশিংটন সফরের আমন্ত্রণ জানানাে হয়। বাংলাদেশ সরকারের ফরেন মিনিষ্টি থেকে বার বার অনুসন্ধান করা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর ওয়াশিংটন সফর সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ মুহূর্তে যখন এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যাই হােক না কেন বঙ্গবন্ধু তাঁর বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য ওয়াশিংটন যাবেনই, তখন নিরুপায় হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্ট হােয়াট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ডফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের জন্য ১লা অক্টোবর তারিখে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড বঙ্গবন্ধুকে শীতল ও আন্তরিকতাহীন অভ্যর্থনা জানান। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী

পৃষ্ঠাঃ ১৯০
আলােচনা যতক্ষণ চলার কথা ছিল তার আগেই মিস্টার ফোর্ড আলােচনা শেষ করে দেন। আরও উল্লেখ্য যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার তখন ওয়াশিংটনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতও করেননি, যদিও এর আগে তিনি নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের দফতরে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এহেন আচরণে বঙ্গবন্ধু অপমানিত বােধ করেন এবং মর্মাহত হন। বঙ্গবন্ধুর মনে আঘাত লেগেছিল আরেকটি কারণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে ব্যাঙ্গোক্তি করে বলেছিলেন, “Bangladesh is an international basket case।” নিজের দেশ সম্পর্কে ডঃ কিসিঞ্জারের এই তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্রোক্তি গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। কিন্তু তিনি কিছু বলেননি তখন। এবার ওয়াশিংটন সফরের সুযােগে বঙ্গবন্ধু ডঃ কিসিঞ্জারের ঐ বক্রোক্তির জবাব দিলেন খােদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই। ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “কেউ কেউ বাংলাদেশকে’International basket case’ বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশbasket case নয়। দুইশাে বছর ধরে বাংলাদেশের সম্পদ লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেষ্টার, করাচী, ইসলামাবাদের।…আজো বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবাে বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।”
৪৪। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু চার দিনের জন্য ইরাকে রাষ্ট্রীয় সফরে বাগদাদ পৌছান ৩রা অক্টোবর তারিখে। ৪ঠা অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধু ইরাকী শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােপ-আলােচনা করেন। ৬ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইরাকের প্রেসিডেন্ট বকরের সঙ্গে একান্তে আলাপ-আলােচনা করেন। ঐ দিনই বাংলাদেশ ও ইরাকের মধ্যে দুটো পারস্পরিক সহযােগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৭ই অক্টোবর তারিখে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাক সফর শেষে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
৪৫। ৮ই অক্টোবর তারিখে খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা(FAO) বাংলাদেশকে তার খাদ্য সংকট মােকাবেলায় সহায়তা করার জন্যে জরুরী ভিত্তিতে যথাসাধ্য খাদ্যশস্য প্রদানের আশ্বাস দেন। ১০ই অক্টোবর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা(IDA) বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য জরুরী প্রয়ােজনীয় পণ্য ক্রয়ে সহায়তা করার জন্যে ৫ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের কথা ঘােষণা করে। একই তারিখে কাতার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ত্রাণ সামগ্রী প্রদান ও পুনর্বাসনের জন্যে বাংলাদেশকে ১৫ লাখ ডলার অর্থ সাহায্যের কথা ঘােষণা করে। ১৬ই অক্টোবর জাপান বন্যার্তদের ত্রাণ সামগ্রী প্রদান ও পুনর্বাসনের জন্যে ৮০ লাখ ডলার অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়।
৪৬। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের সবচেয়ে সংকটময় সময় ছিল আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর—এই তিন মাস। জুলাই ও আগষ্ট মাসে নজিরবিহীন বন্যায় বিপুল শস্যহানীসহ

পৃষ্ঠাঃ ১৯১
সারাদেশের অর্ধেক জনগােষ্ঠীরও বেশী লােকের ঘরবাড়ী ও বিষয়-আশয় বিধ্বস্ত হয়। ফলে, দেশের প্রায় ৪ কোটি লােক সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। বৃহত্তর রংপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও ফরিদপুর জেলাগুলাের বন্যা উপদ্রুত এলাকার লােকেরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অর্থ, অন্ন, বস্ত্র ও ওষুধপত্রের অভাবে জর্জরিত লাখ লাখ মানুষ ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষে কষে বেঁচে থাকার কঠিন সাধনা চালাতে থাকে। বাঁচার দুর্নিবার তাগিদেই অগণিত মানুষ পথে নেমে আসে। গ্রাম থেকে গঞ্জে, গঞ্জ থেকে বন্দরে-শহরে গিয়ে আছড়ে পড়ে নিরন্ন মানুষের অন্তহীন মিছিল। জীবন্ত কংকালের মিছিল। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, রাজপথে, জনপদে অযুত মানুষের সকরুণ কণ্ঠ কেবলই”আমাদের অন্ন দাও, রুটি দাও, ওষুধপত্র দাও, বস্ত্র দাও” বলে আর্তনাদ করে ফিরতে থাকে। এই দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্যে বঙ্গবন্ধুর সরকার স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী ও অন্যান্য সরকারী সংস্থা, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, দলীয় কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলাের লােকদের নিয়ােগ করাসহ দলমত নির্বিশেষে দেশের সর্বস্তরের লােকদের প্রতি আকুল আবেদন জানান। যুদ্ধকালীন জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মােকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর সরকার। বিদেশ থেকে জরুরী ভিত্তিতে আমদানীকৃত খাদ্য-শস্য দ্রুততার সঙ্গে বিলি বন্টনের ব্যবস্থা করা। হয়। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয় রিলিফের গম। বাংলাদেশের সাড়ে চার হাজার ইউনিয়নে ৫৭৫৭টি লংগরখানা খােলা হয় এবং লংগরখানাগুলােতে নিয়মিত খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র ও বস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্যে গাড়ী, লঞ্চ, বিমান ও হেলিকপ্টারে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ত্রাণ সামগ্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয়। এতদসত্ত্বেও, সরকারের হিসাব মতেই দেশে দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকাসমূহে প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার লােকে অনাহারে ও অনাহারজনিত বিভিন্ন রােগে প্রানহানী ঘটে। এই সময় বঙ্গবন্ধু সারাক্ষণ থাকতেন বিমর্ষ ও মর্মাহত। তিনি সারা দুর্ভিক্ষকাল ভাতের পরিবর্তে কেবল রুটি খেয়ে কাটালেন এই বলে, “দেশের জনগণ ভাত পাচ্ছে না, আমি ভাত খাবাে কোন অধিকারে।”
৪৭। ১৯৭৪ সালের এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিতে দেশ ও বিদেশের কতিপয় বিশেষ মহলের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ ভূমিকা ছিল বলে তখন দেশ-বিদেশের কিছু পত্র-পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল। ১৯৭৪ সনের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর সরকার খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য অস্ট্রেলিয়া, কয়েকটি ইই.সি সদস্যভুক্ত দেশ, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্য ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করে। চলতি বাজার দরেই এসব খাদ্য ও পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের কথা ছিল। অর্থ যােগান দেওয়ার কথা ছিল সুদহারের ঋণ থেকে। ১৯৭৪-এর গ্রীষ্মে বঙ্গবন্ধুর সরকার বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র ঘাটতির সম্মুখীন হয়। এমতাবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্যশস্য সরবরাহকারী কোম্পানীগুলাে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পৌছানাের জন্যে স্থিরকৃত দুটো বড় চালানের বিক্রয় বাতিল করে। বাংলাদেশ ঐ সময় বহু

পৃষ্ঠাঃ ১৯২
চেষ্টা করেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ঋণ লাভে ব্যর্থ হয়। একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পি.এল-৪৮০ কর্মসূচীর আওতায় বাংলাদেশকে প্রদত্ত খাদ্যশস্য পাঠানাে বিলম্বিত করে। কারণ হিসেবে বলা হয় যে, বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাট বিক্রয় করায় বাংলাদেশ সাহায্য পাওয়ার যােগ্য কি না সর্বাগ্রে তা নির্ধারণ করা প্রয়ােজন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলাে এই যে, কিউবার সঙ্গে গােপনে ৪০ লাখ পাটের থলে রপ্তানীর চুক্তি সম্পর্কিত একটি খবর বাংলাদেশের বিশেষ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ঐ সংবাদের কাটিং নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেনের সঙ্গে দু’দুবার সাক্ষাৎ করেন। ফলশ্রুতিতে যথাসময়ে বাংলাদেশে খাদ্যশস্য প্রেরণের ক্ষেত্রে নানা অজুহাত ও অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়। নিঃসন্দেহে খাদ্য দ্রব্যাদির সংকট নিরসনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। যেমন ১৯৭৩ সালের ১লা আগস্টে ওয়াশিংটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে বাংলাদেশের তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বৈঠক করেন। উক্ত বছরের ৩০শে আগস্ট বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থার সহকারী প্রশাসক মিস্টার মরিস উইলিয়ামের মধ্যে এক বৈঠক হয় এবং ১৯৭৪ সালের ৯ই জানুয়ারী ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহকারী পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সুদীর্ঘ আলাপ-আলােচনা করেন। এসব সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য ছিল একটাইঃ খাদ্যশস্য সাহায্য প্রার্থনা।
৪৮। বাংলাদেশের এই দুর্দিনে (তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নের সরকার যথাসাধ্য সহায়তা ও সহযােগিতা করেছিল। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে সােভিয়েত ইউনিয়নের নগদ অর্থে কেনা ২ লাখ টন খাদ্যশস্য জাহাজযােগে সে দেশের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার অনুরােধ জানালে সে খাদ্যশস্য সােভিয়েত ইউনিয়ন সরকার বাংলাদেশকে প্রদান করে যার ফলে সংকটপূর্ণ রেশন ব্যবস্থা সে সময় চালু রাখা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষে। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় তা ছিল অতি নগণ্য।
৪৯। ১৩ই অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ৩৭ দিন ধরে কয়েকটি বিদেশী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ও আলাপ-আলােচনা শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তেজগাঁও বিমান বন্দরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাজউদ্দিন সাহেব বলে বসলেন, “ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা রসাতলে গিয়েছে।” জনাব তাজউদ্দিন আহমদের এই মন্তব্য পত্র-পত্রিকায় বড় বড় হেডলাইনে ফলাও করে ছাপানাে হয়। এর পরে কতিপয় পত্র-পত্রিকায় তাঁর এই মন্তব্য উল্লেখপূর্বক বঙ্গবন্ধুর সরকারের নেতৃত্বে ঐক্য ও অনুসৃত অর্থনীতি সম্পর্কে নানান মতামত ব্যক্ত করা হয়। এর ফলে তাঁর ঐ মন্তব্যকে কেন্দ্র

পৃষ্ঠাঃ ১৯৩
করে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ দলের নেতাদের মধ্যে যথাক্রমে তাজউদ্দিন আহমদের পক্ষে ও বিপক্ষে মতামতের সৃষ্টি হয়।
৫০। এই ঘটনার দিন সাতেক পর এক সন্ধ্যায় খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব। বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করেন আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। আমি তখন সেখানেই ছিলাম। তিনি আমাকে পরদিন সকালে তাঁর বাসায় যেতে বলেন। সে মােতাবেক আমি আমার বন্ধু তৎকালীন রাষ্ট্রায়াত্ব শিল্প কোম্পানী ‘বাংলাদেশ ফাইসন্স’-এর প্রশাসক সুলতান শরিফকে সঙ্গে নিয়ে খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের আগামসি লেনস্থ বাসায় যাই। খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব তখন তাঁর বিশেষ বৈঠকখনায় বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে একান্তে আলাপ-আলােচনায় ব্যস্ত ছিলেন। এ কারণে খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব আমাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলেন। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর তাহের উদ্দিন ঠাকুর তাঁর সঙ্গে আলাপ শেষে বেরিয়ে গেলে খন্দকার মােশতাক আহমদ আমাকে তাঁর উক্ত বৈঠকখানায় ডেকে পাঠান। একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে, আমাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জনাব তাজউদ্দিন আহমদের ১৩ই অক্টোবর তারিখের মন্তব্য সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া আমার কাছে ব্যক্ত করা। তিনি অতঃপর বললেন, মন্ত্রী পরিষদের একজন সদস্য হয়ে তাজউদ্দিন আহমদ সাহেবের প্রকাশ্যে সরকারের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে মন্তব্য কিংবা সমালােচনামূলক মন্তব্য করার কোন অধিকার নেই। অতএব তাঁকে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে তাঁকে পদচ্যুত করতে হবে।” খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের এই মন্তব্যের জবাবে আমি বললাম, “১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারীতে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ ফিরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নেতৃত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করার পর থেকে আমি রাজনীতি সম্পর্কে কোনই চিন্তা-ভাবনা করি না। কাজেই এবিষয়ে আমার কোনরূপ মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।” অতঃপর সুলতান শরীফকে সঙ্গে নিয়ে আমি সেখান থেকে চলে আসি। এর কিছুদিন পর, ২৬শে অক্টোবর তারিখে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীপরিষদ থেকে ইস্তফা দেন। এই দুঃখজনক ঘটনার পর থেকে তাজউদ্দিন আহমদ রাজনীতিতে বেশ নিষ্ক্রিয় থাকেন। তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী বা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মীর সঙ্গে তিনি বিশেষ যােগাযােগ রক্ষা করেছেন বলেও কোন খবর শােনা যায়নি। শুধু মাঝে মধ্যে তাঁকে সকালে দেখা যেত আবাহনী স্পাের্টস ক্লাবের মাঠে তাঁর ছােট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে।
৫১। ১৯৭৪-এর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝির ঘটনা। ঐ সময় আমি বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের প্রস্তাবিত আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য কমিশনের পক্ষে বাংলাদেশের সরকারের নিকট হতে ২০০-২৫০ একর জমি বরাদ্দ নেয়ার। ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলােচনা করার দায়িত্বে নিয়ােজিত

পৃষ্ঠাঃ ১৯৪
ছিলাম। ইতােপূর্বে এ বছরের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার কর্মসূচীর আওতায় আমার আণবিক চুল্লী ও পরমাণু শক্তির সার্বিক শান্তিপূর্ণ প্রায়ােগিক প্রযুক্তির সম্পর্কে পােস্ট ডক্টরাল প্রশিক্ষণার্থে এক বছরের জন্য জার্মানী যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি বরাদ্দ না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন সময়ের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক এম. ইন্নাছ আলী আমার জার্মানী যাওয়া স্থগিত করে দেন। কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা প্রস্তাবিত আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাথমিকভাবে তিনটি স্থান নির্বাচন করেছিলাম। এই তিনটি স্থান ছিল যথাক্রমে (১) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের স্থান (তৎকালীন জাতীয় রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার্সের জন্য নির্ধারিত বর্তমানে বাংলাদেশ (স্থল) সেনাবাহিনীর ক্যান্টনম্যান্ট), (২) গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ স্থান এবং (৩) গণকবাড়ীস্থ স্থান (বর্তমানে যেখানে আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত রয়েছে)। গণকবাড়ীস্থ স্থানটি একটু বেশী দূরে হওয়ায় একদিন বঙ্গবন্ধুকে বললাম যে, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানটি সশস্ত্র বাহিনীর জন্য যুক্তিযুক্ত নয়। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন স্থানটি আণবিক শক্তি কমিশনের জন্য বরাদ্দ করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পার্শ্বস্থ স্থানটি রক্ষীবাহিনীর জন্য নির্ধারণ করা সব দিক দিয়ে যুক্তিযুক্ত হবে। আমার প্রস্তাবটি অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ও সঠিক বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু আমাকে পরামর্শ দেন তাঁর রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে। বঙ্গবন্ধু এও বললেন যে, উক্ত স্থানে রক্ষীবাহিনীর স্থাপনা নির্মাণের কাজ খুব বেশী দূর সম্পন্ন না হয়ে থাকলে ঐ স্থানটিই আণবিক শক্তি কমিশনের প্রস্তাবিত আণবিক শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ করা হবে।
৫২। অতঃপর পরদিন সকালে শেরে বাংলা নগরস্থ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তােফায়েল আহমদের সঙ্গে এবিষয়ে আলাপ করতে যাই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গেটে কর্তব্যরত একজন লােক আমার পরিচয় জেনে আমাকে সােজাসুজি তােফায়েল আহমদের অফিস কক্ষে পৌছে দেন। তােফায়েল আহমদের অফিস কক্ষে তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান কিছু দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অফিস টেবিলের এক পাশে মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমান বসে ছিলেন। আমি তােফায়েল আহমদের মুখােমুখী হয়ে সেখানের চেয়ারে বসে থাকলাম। প্রায় বিশ মিনিট ধরে বিভিন্ন দফতরে ফোন করে তােফায়েল আহমদ মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমান কতৃক উথাপিত বিষয়গুলাের ব্যাপারে ব্যবস্থা করেন। আমি মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমানকে তখন চেহারায় চিনতাম, কারণ তিনি ইতােপূর্বে কার্যোপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসেছিলেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু তখন কেউই আমাকে মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমান যখন অফিস কক্ষ থেকে চলে যাওয়ার জন্য দরজা খুলছিলেন, এই পর্যায়ে তােফায়েল আহমদ আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্যে

পৃষ্ঠাঃ ১৯৫
তাঁকে আহবান জানায়। প্রথমে আমাকে তাঁর কাছে দুলাভাই” বলে পরিচয় করিয়ে দিলে জিয়া সাহেব আমার নাম ও বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। আমার সঠিক পরিচয় জেনে জিয়া সাহেব বললেন, “আপনিই তাহলে সেই ডঃ ওয়াজেদ। গত এপ্রিলের (২৪-২৭ তারিখে) প্রথম জাতীয় ইলেকট্রনিক্স সিম্পােজিয়াম’-এর একটি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার জন্যে আমি আপনাদের আণবিক শক্তি কেন্দ্রে গিয়েছিলাম। আমি যেখানেই যাই লােকজন আপনার সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা করে। আমি আশা করেছিলাম যে, উক্ত সিম্পােজিয়াম উপলক্ষে আপনাদের অফিসে যাওয়ার সুযােগে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হবে।” এরপর তিনি আমাদের আণবিক শক্তির ব্যবহার বিষয়ক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নিলেন। পরিশেষে, মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমান আমাকে বললেন যে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা’ -এর দেখাশুনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত রয়েছে এবং উক্ত খাতে গবেষণার জন্য বেশ কিছু অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। আণবিক শক্তি কমিশন থেকে প্রস্তাব করলে তিনি গবেষণার জন্য উক্ত খাত হতে কিছু অর্থকড়ি আমাদেরকে প্রদান করতে পারবেন। অতঃপর এবিষয়ে যে কোন সময় তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন।
৫৩। ২৯ শে অক্টোবর (১৯৭৪) তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সেক্রেটারী (মন্ত্রী) ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার দু’দিনের বাংলাদেশ সফরে ঢাকায় আগমন করেন। ৩০শে অক্টোবর তিনি গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুদীর্ঘ দুই ঘন্টা ব্যাপী আলাপ-আলােচনা করেন। আলােচনা শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তিনি বলেন, “A man of vast conception. I had rarely met a man who was the father of his nation and this was a particularly unique experience for me. (শেখ মুজিবুর রহমান প্রগাঢ় ধ্যান-ধারণা সম্পন্ন ব্যক্তি। একটা জাতির স্থপতি এ জাতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমার কদাচিৎ সাক্ষাৎ হয়েছে এবং এজন্যে এটা (আজকের সাক্ষাৎকার) আমার জন্য ছিল একটি অনন্য সাধারণ অভিজ্ঞতা)।” বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারের উপরােক্ত মন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত বা সূচনা বলে জনমনে ধারণার সৃষ্টি করে, সঞ্চার করে সুদিনের প্রত্যাশা।
৫৪। ১৯৭৪-এর নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের গােড়ার দিকের ঘটনা। ঐ সময় একদিন সকালে অফিসে আসে আমার রংপুর জিলা স্কুলের সহপাঠী মুকিতুর রহমান খােকনের পরলােকগতা একমাত্র বড় বােনের বড় ছেলে ইসকান্দার আলভী মঞ্জ। ১৯৫৬ সালে যখন আমি রংপুর জিলা স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম সে সময় মুকিতদের বাসায় আমি প্রায়ই যেতাম এবং সারা দিন গল্প গুজব করে কাটাতাম। মঞ্জুর আম্মা (নেলী আপা), নানা। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ জনাব মকবুলুর রহমান সাহেব ও নানী (খােকনের আম্মা)

পৃষ্ঠাঃ ১৯৬
আমাকে ভীষণ স্নেহ করতেন। পরবর্তীতে কতদিন না ওদের রংপুর শহরের ধাপ বাড়ীতে রাত্রি যাপন করেছি। মুকিতুর রহমান খােকনের আম্মা আমাকে নিজের ছেলের মতই আদরযত্ন করতেন এবং আমি তাঁকে খালা’ বলে সম্বােধন করতাম। এইভাবে মুকিতদের পরিবারের সঙ্গে আমার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে যা আজ পর্যন্ত অটুট আছে। মজুও আমাকে নিজের মামার মতই মনে করে এবং আমিও ওকে নিজের ভাগ্রের মত স্নেহ করি। মঞ্জু এত মেধাবী যে, ছােট বেলায় আব্বা-আম্মাকে হারানাে সত্ত্বেও পরবর্তীতে ভালােভাবে লেখাপড়া করে ১৯৭২ সালে ঢাকা বাের্ডের এস,এস,সি পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। ১৯৭৪ সালে মঞ্জু ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল এবং একজন আদর্শ ছাত্র হিসেবে তাকে তার হােস্টেলের ক্যাপ্টেন নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেদিন মঞ্জু আমাকে জানায় যে, এর কিছুদিন আগে তার হােস্টেলের অন্যান্য ছেলেরা এক সন্ধ্যায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দালালী করার অভিযােগে ঐ হােস্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্টকে দৈহিকভাবে লাঞ্ছিত করে। পরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঐ ঘটনাটি সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে মেঃ জেঃ জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। অন্যান্যদের সঙ্গে মঞ্জুকে দায়ী করে উক্ত সুপারিনটেন্ডেন্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযােগ করেছিল। মঞ্জু আমাকে জানায় যে, কেবলমাত্র হােস্টেলের ক্যাপ্টেন বলেই তাকে উক্ত ঘটনার জন্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
৫৫। যাহােক মঞ্জুর ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই পরদিন আমি টেলিফোনে জিয়াউর রহমান সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁর ঢাকাস্থ সেনানিবাসের অফিসে যাই। কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি ১৯৭১-এর মার্চ মাসে এবং তৎপরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অতি প্রশংসনীয় ভূমিকার উল্লেখ করে তাঁর কাছ থেকে সে সময়ের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই। তাঁর কথাবার্তার মধ্যে আত্মম্ভরিতা বা অহমিকার কোন চিহ্ন দেখলাম না। তিনি ধীরে ধীরে ও শান্তভাবে আমাকে ১৯৭১-এর মার্চ মাসের ২৬ তারিখ হতে তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করলেন। এর এক পর্যায়ে আমি তাঁকে জানাই যে, ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের দিকে এক বছরের জন্য আমি তৎকালীন পশ্চিম জার্মানী যাবাে পােস্ট ডক্টরাল গবেষণার কাজে। এইভাবে কথাবার্তায় প্রায় দেড় ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। আলাপের শেষে, আমি তাঁকে মঞ্জুর ব্যাপারটি সম্পর্কে অবহিত করি। এই সাক্ষাতের পর প্রায় দেড় মাস যাবত জিয়াউর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার কোনরূপ যােগাযােগ বা সাক্ষাৎ হয় নি। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি একদিন সকালে বঙ্গবন্ধুকে গণভবনের হেলিপ্যাডে বিদায় জানাতে গিয়ে জিয়া সাহেবের সঙ্গে আমার দু’এক মিনিট কথাবার্তা হয়। মঞ্জুর ব্যাপারে আর কোনও খোঁজ না নেয়ায় তিনি আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন বলে আমাকে জানালেন। তিনি আমাকে এও জানালেন যে, ঐ ঘটনার জন্য ঐ হােষ্টেলের সুপারিনটেন্ডেন্টই দায়ী ছিলেন। অতঃপর ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে আমার (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানী যাওয়া চূড়ান্তবাবে নির্ধারিত হয়েছে জেনে

পৃষ্ঠাঃ ১৯৭
জিয়া সাহেব বললেন, “ডঃ ওয়াজেদ, hats off to you। আমি সর্বান্তকরণে আপনার সর্বাঙ্গীন সাফল্য ও মঙ্গল কামনা করি।” মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এটাই ছিল আমার শেষ সাক্ষাৎ।
৫৬। ৩রা নভেম্বর কয়েকজন বিশেষজ্ঞসহ দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে। ৪ঠা নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর সরকার যমুনা সেতুর জন্যে আরিচা ঘাটের উত্তরে একটি উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে। ৫ই নভেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধু মিশর ও কুয়েতে রাষ্ট্রীয় সফরে নয় দিনের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি প্রথমে মিশরের রাজধানী কায়রাে গমন করেন। ইত্যবসরে ৬ই নভেম্বর তারিখে হল্যান্ডের সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশকে ২ কোটি ১০ লাখ ডলার সাহায্য প্রদানের কথা ঘােষণা করে। একই তারিখে বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে একটি পারস্পরিক সহযােগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১০ই। নভেম্বর তারিখে কায়রােতে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় শীর্ষ আলাপ-আলােচনা বৈঠক। অতঃপর বাংলাদেশ ও মিশরের মধ্যে যৌথ সহযােগিতা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ তারিখেই কায়রাে থেকে বঙ্গবন্ধু কুয়েত যান। কুয়েতের আমির শেখ জাবের আল্ সাবাহ বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। ১১ই নভেম্বর কুয়েতের আমির শেখ জাবের আল সাবাহ্ এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় এক শীর্ষ বৈঠক। ১২ই নভেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে ১০ কোটি টাকার। জরুরী ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ১৪ই নভেম্বর তারিখে মিশর ও কুয়েতে ৯ দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধু বর্ণনা করলেন কি রকম আরাম-আয়েশ ও বিলাস বৈভবে জীবন যাপন করেন কুয়েতের আমির ও তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা। কুয়েতের আমির শেখ জাবের আল সাবাহু বঙ্গবন্ধুকে আংকেল শেখ মুজিব বলেও সম্বােধন করেছিলেন বলে বঙ্গবন্ধু আমাদের অবহিত করেন। কুয়েতের আমির শেখ জাবের বঙ্গবন্ধুকে এও আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, তাঁদের দু’জনের মধ্যে স্থাপিত চাচাভাস্তের সম্পর্ক ক্ষণিকের নয়—চিরস্থায়ী।
৫৭। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝির দিকে একদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু তাঁর শয়নকক্ষের সামনের লবিতে বসে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখছিলেন। শাশুড়ী, হাসিনা ও আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এক পর্যায়ে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন মধ্যবয়সী ও তরুণ নেতা সেখানে উপস্থিত হন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এটাসেটা বিষয়ে কথাবার্তা বলার এক পর্যায়ে তাঁদের একজন তাকে বলেন, লীডার, আপনি জাতির জনক হয়েও প্রধানমন্ত্রী থাকবেন আর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদমর্যাদায় আর এক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এটা বেমানান ও দৃষ্টিকটু বলে মনে হয়। সুতরাং আমরা সবিনয়ে আপনার কাছে আবেদন জানাই যে, দেশের সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন করে তদস্থলে রাষ্ট্রপতির শাসন পদ্ধতি প্রবর্তনপূর্বক আপনি দেশে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হােন।” উপস্থিত অপরাপর নেতারা সমবেতভাবে উক্ত

পৃষ্ঠাঃ ১৯৮
প্রস্তাবের প্রতি জোর সমর্থন ব্যক্ত করেন। আচ্ছা, ভেবে দেখবাে” এই বলে বঙ্গবন্ধু তাদের বিদায় দেন। এর সপ্তাহখানেক পর যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের সেই একই নেতারা বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রস্তাব করেন, লীডার, আপনাকে শুধু রাষ্ট্রপতি হলেই চলবে না, পরবর্তীতে সংসদে আমরা আপনাকে আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘােষণা দিতে চাইবাে।” এই প্রস্তাবের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, “রাষ্ট্রীয় কোন পদে কাউকে আজীবনের জন্য নির্বাচিত করা গণতান্ত্রিক বিধিবিধান ও রীতিনীতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। সুতরাং এইটি করা চলবে না।” এর দিন পাঁচেক পরের ঘটনা। একদিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের অপর কয়েকজন মধ্যবয়সী ও তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধুকে বলেন, “লীডার, আপনি এমন এক ব্যক্তি যে, আপনি জনগণকে যদি ডানদিকে যেতে আহবান জানান তাঁরা তাই করবেন আর যদি তাঁদেরকে বাম দিকে যেতে বলেন তাঁরা তাও করবেন। আপনার প্রতি জনগণের রয়েছে অপরিসীম বিশ্বাস ও আস্থা।” বঙ্গবন্ধু তাঁদের কথা গভীর মনােযােগের সঙ্গে শুনলেন বটে কিন্তু তার জবাবে কোনকিছুই বললেন না।
৫৮। ২৫শে নভেম্বর তারিখে প্রায় চার বছর পর বাংলাদেশ থেকে প্রথম হজুফ্লাইট মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ২৬শে নভেম্বর তারিখে (তৎকালীন পূর্ব জার্মানীর প্রধানমন্ত্রী মিস্টার হােষ্ট ঝিডারম্যান ৪ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আগমন করেন। ২৮শে নভেম্বর তারিখে। পূর্ব জার্মানীর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি ১৯ কোটি টাকার ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৩রা ডিসেম্বর তারিখে মালয়েশিয়ার রাজা টুংকু আবদুল হালিম ও রাণী বারমায় সুবী ৪ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আগমন করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহ ও বঙ্গবন্ধু তেজগাঁও বিমান বন্দরে তাঁদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
৫৯। ১০ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনী দিবস উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষে চট্টগ্রামস্থ নৌঘাঁটিতে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ঐ সময় এক দাপ্তরিক কাজে আমি চট্টগ্রামে উপস্থিত ছিলাম। সুতরাং ঐ সুবাদে এই বিশেষ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার আমার সুযােগ হয়। সেদিন সকালে প্রথম যাই চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্যে। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রীয় বিশেষ প্লেন ‘বলাকায় সেখানে যথাসময়ে পৌছান। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু প্রথমে নৌজোয়ানদের কুচকাওয়াজ পর্যবেক্ষণ করেন এবং পরে তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রথমে বলেন, ‘…আজ আপনাদের দেখে সত্যিই আমার বুক আনন্দে ভরে ওঠে। আপনারা অনেককেই জানেন, (বাংলাদেশের) স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় নৌবাহিনীর যে কয়জন বাঙালী সৈনিক বাংলাদেশে ছিল, তারা সামান্য শক্তি নিয়ে সামরিক বাহিনীর ভাইদের সঙ্গে মিলে বাংলার জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের কাছে (নৌ) জাহাজ ছিল না। তাদের কাছে (পর্যাপ্ত) গােলাবারুদ ছিল না। তাদের কাছে (প্রায়) কিছুই ছিল না। কিন্তু তারা নিজেরা নৌকা পর্যন্ত ক্রয় করে শত্রুর মােকাবেলা করবার চেষ্টা করেছে। তখন আপনাদের অনেক

পৃষ্ঠাঃ ১৯৯
ছেলে (সৈনিক) শহীদ হয়েছে, অনেকে আত্মাহুতি দিয়েছে, রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা এনেছে। পাকিস্তানী আমলে বাঙালীদের নৌবাহিনীকে চান্স দিত না। আপনাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে আছে যে, আমরা তখন তাদের সঙ্গে এই নিয়ে সংগ্রাম করেছিলাম। যারা জীবনে কখনাে পানি দেখে নাই, যারা পানির মধ্যে গােসল করে নাই, তাদের নৌবাহিনীতে গ্রহণ করা হতাে। আর যারা বাংলাদেশের মানুষ, যারা পানির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে, যারা পানির মধ্যে খেলে বেড়িয়েছে, নদীমাতৃক এই বাংলার সেই বাঙালীদের নৌবাহিনীতে স্থান হতাে না। এর জন্য সংগ্রাম বহুদিন চলেছে। আজ তিন বছর হতে চলেছে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। বাংলার ছেলেরা যখন আত্মাহুতি দিয়ে সংগ্রাম চালায়, আমি যখন (পাকিস্তানের) জেলখানা থেকে ফিরে আসি, তখন সামান্য কয়েকজন লােক ছাড়া নৌবাহিনী বলে কোন পদার্থ ছিল না। আজ দেখে আমার আনন্দ হয়, সামান্য কিছু দিনের মধ্যেই আপনাদের নৌবাহিনী গড়ে উঠেছে। দেশের মানুষ আজ দুঃখী। দেশের মানুষ আজ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। বিদেশ থেকে খাবার আনতে হয়। দুনিয়ায় জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলার অর্থনীতি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেই আমি চেষ্টা করেছি, যেখান থেকে হােক, আমাদের সামরিক বাহিনী, নৌবাহিনী, সকলকে যাতে কিছু কিছু জিনিস দিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করবার উপযােগী করে গড়ে তুলতে পারি।”
৬০। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী তা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু অতঃপর বলেন, “বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। আমাদের নৌবাহিনীর প্রয়ােজন আমাদের সম্পদাদি রক্ষা করবার জন্যে। সাইক্লোনের মােকাবেলা করবার জন্যে। আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না। আমরা শান্তিকামী জাতি। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু আত্মরক্ষা করার মতাে ক্ষমতাও আমাদের থাকা দরকার।” নৌবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “নৌবাহিনীর ছেলেরা, তােমরা যা করেছে তার জন্য আমার অভিনন্দন নাও। সামান্য জিনিস নিয়ে, একখানা, দু’খানা ভাঙ্গা (নৌ) জাহাজ কোনমতে মেরামত করে তােমরা আজ এই সমুদ্র পাহারা দিচ্ছ। এর জন্য আমি তােমাদের মােবারকবাদ জানাই। দুঃখের বিষয়, পাকিস্তানীরা আমাদের টাকা দিয়ে পচিশ বৎসরে যে নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিল, তার একখানা সম্পদও আমরা পাই নাই। একখানা যুদ্ধ জাহাজ, একখানা গাদাবােট বা একখানা মালবাহী জাহাজও আমাদের দেওয়া হয় নাই। দেবে কিনা, তাও জানি না। দেওয়ার ইচ্ছা বােধ হয় তাদের নাই। তা তাদের কাছ থেকে কিছু না-ই বা পেলাম। মাটি যখন পেয়েছি, বাংলার মানুষ যখন আছে, বাংলার ভবিষ্যৎ বংশধররা যখন আছে, বাংলার সম্পদ যখন আছে, তখন ইনশাআল্লাহ সবই আমরা গড়ে তুলতে পারবাে, আমাদের সব জিনিসই হবে।” এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “আস্তে আস্তে আমাদের সবই গড়তে হবে। চারদিকে যা অবস্থা, গঠনমূলক কাজ দিয়ে মানুষকে তা থেকে বাঁচানাে দরকার। দেশের মানুষকে বাঁচাতে

পৃষ্ঠাঃ ২০০
হবে। রাস্তাঘাট, সামরিক বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, রক্ষীবাহিনী, সবই আমাদের গড়তে হবে।”
৬১। দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তােমাদের কমান্ডারের কাছে শুনেছি, তােমরা অনেক কষ্টে আছে। তিনি বলেছেন, তােমাদের প্রয়ােজন অনেক। হ্যাঁ, সত্যিই অনেক প্রয়ােজন। সবই তােমরা পাবে, কিন্তু আস্তে আস্তে। আমি বাংলাদেশকে বিক্রি করতে চাই না, মর্টগেজ রাখতে চাই না। বিক্রি করলে বা মর্টগেজ রাখলে জিনিসের অভাব হয় না। কিন্তু আমি নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখে সাহায্য চাই, নিজেকে বিক্রি করে বা মর্টগেজ দিয়ে চাই না। আমি আস্তে আস্তে নৌবাহিনী গড়বাে। নৌকায় করে আমার নৌবাহিনীর ছেলেরা চলবে। তবুও আমি বাংলাদেশকে মর্টগেজ দিয়ে কারও কাছ থেকে কিছু আনবাে না। …অবশ্য যারা বন্ধু রাষ্ট্র, যারা আমাদের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে সাহায্য করতে চায়, তাদের কাছ থেকে আমি নিশ্চয়ই সাহায্য নেবাে। যতদিন আমি বেঁচে আছি, বাংলার মানুষকে, বাংলাদেশকে মর্টগেজ রেখে সাহায্য নেবাে না। সে সাহায্যকে আমি ঘৃণা করি।”
৬২। ১৫ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু রেডিও-টেলিভিশনে জাতীয় বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘১৯৭১ থেকে ১৯৭৪, সময়ের দিক থেকে মাত্র তিন বছর। একথা সত্য যে, তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারবাে না, একথা আমি আপনাদের বলেছিলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেয়ার খাতা একেবারে শূন্য পড়ে থাকেনি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য কোটি কোটি মণ খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানী করা ছাড়াও ২৫ বিঘা পর্যন্ত (কৃষি) জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিক ভাইদের নিম্নতম মজুরী বৃদ্ধি, বেতন কমিশনের সুপারিশ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন, পাটের নিম্নতম মূল্য বৃদ্ধি এবং প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের সরকারী কর্মচারীদের মর্যাদা দিয়ে বর্ধিত হারে বেতন প্রদান—এ জাতীয় কয়েকটি ব্যবস্থা, যা সরকার কিছুটা ঝুঁকি নিয়ে হলেও কার্যকর করেছে। একই সঙ্গে আমাদের দেশের বিধ্বস্ত যােগাযােগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে শুধু পুনঃপ্রতিষ্ঠাই করা হয়নি, মীরপুর, নয়ারহাট, তরাঘাট প্রভৃতি স্থানে নতুন নতুন সেতু নির্মাণ করে দেশের উন্নততর সড়ক যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে তােলা হচ্ছে। আপনারা নিশ্চয়ই এটাও জানেন যে, যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের জরিপ কাজের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছিল, খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কমানাে সম্ভব হয়েছিল। দেশবাসীও শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির কিছুটা ফল লাভ করতে শুরু করেছিল। শুধু তাই নয়, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপযােগী প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলার চেষ্টা করা হয়েছে। সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে গঠন করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে, দেশ পুনর্বাসন পর্যায় শেষ করে প্রবেশ করেছিল পুনর্গঠনের নতুন দিগন্তে। ১৯৭২-এর দীর্ঘস্থায়ী অনাবৃষ্টি, ১৯৭৩-

Next