পৃষ্ঠাঃ ২০১
এর আঞ্চলিক বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও দেশ যখন পুনর্গঠন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, ঠিক সেই সময়ে উপর্যুপরি দু’টি বিপর্যয় নেমে এলাে। প্রথমতঃ, মুদ্রাস্ফীতি। উপরােন্তু, আমাদের রফতানী পণ্যের মূল্য বিশ্ববাজারে এই সময়ে বৃদ্ধি তাে পায়ই নি, বরং অনেকাংশে কমে গেছে। দ্বিতীয়তঃ এবারের প্রলয়ংকরী বন্যা। যার ফলে ১৭টি (বৃহত্তর) জেলার ৪ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে মারাত্মকভাবে। দশ লক্ষ টনের বেশী খাদ্যশস্য হলাে নষ্ট। এই দুই বিপর্যয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আমাদের জাতীয় পুনর্গঠন হয়েছে বিঘ্নিত। এর সঙ্গে একদল নরপশু চোরাকারবারী, কালােবাজারী, মুনাফাখখার, মজুতদার ও ঘুষখােরের হীন কার্যকলাপ অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়েছে। সেপ্টেম্বরে বন্যার তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর থেকে ৫,৭০০ লঙ্গরখানা খুলে প্রতিদিন ৪৪ লক্ষাধিক লােককে খাবার সরবরাহ করা হয়েছে এবং কোন কোন অঞ্চলে এখনও তা অব্যাহত আছে। হেলিকপ্টার থেকে নৌকা পর্যন্ত যখন যেটা পাওয়া গেছে, তাতে করেই এই তৈরী খাদ্য পৌছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বন্যা কবলিত মানুষের কাছে।”
৬৩। অতঃপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ তিনটি মহাবিপদ তথা তিন শত্রুর মােকাবেলা করছে। (১) মুদ্রাস্ফীতি—যা আজ সারা বিশ্বে ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে, (২) প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যা এবং (৩) চোরাকারবারী, মুনাফাবাজ, মজুতদার ও ঘুষখাের—এই তিন শক্রর বিরুদ্ধে সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে হয়েছে নতুন প্রতিরােধ সংগ্রামে। আজ বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির দরুন তেল, খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্য আমদানীর জন্য আমাদের ব্যয় করতে হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি তথা বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের চক্রে অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশের ন্যায় বাংলাদেশের রফতানী পণ্য উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না। তাই দেশ-বিদেশের মুদ্রাস্ফীতির মােকাবেলায় উৎপাদন বৃদ্ধি, মিতব্যয়িতা ও মুদ্রা সরবরাহ কমিয়ে আনা, ওয়েজ আর্নার স্কীমে পণ্য আমদানী তথা পণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও সুষ্ঠু বিলি-বন্টনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা আমরা করছি। বাজারে ইতিমধ্যেই কোন কোন ক্ষেত্রে শুভ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।…বাংলাদেশে অফুরন্ত প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের সক্রিয় বিবেচনাধীন। এই পথে আমরা বেশ কিছুটা অগ্রসরও হতে পেরেছি। প্রাকৃতিক গ্যাসের সাহায্যে একাধিক ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরী স্থাপনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপআলােচনা চালিয়ে যাচ্ছি।……..আমাদের দেশের উপকূলীয় এলাকায় তেলের সন্ধান লাভের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। তেল অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য আমরা ইতিমধ্যেই কয়েকটি বিদেশী তেল কোম্পানীর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। মুদ্রাস্ফীতির পরেই আসে প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যার কথা। বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দুটি জিনিসের সবচেয়ে বেশী প্রয়ােজন— সময় ও অর্থ। পাকিস্তানী শােষকরা ২৫ বছরের শাসন ও শােষণে এ ব্যাপারে কিছুই করে নি। বরং বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বাংলাদেশের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে গেছে বিরাট ঋণের বােঝ।
পৃষ্ঠাঃ ২০২
বাংলাদেশ সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদী ভিত্তিতে চেষ্টা করছে। আমাদের নতুন প্রতিরােধ সংগ্রামে সর্বশেষ ও সর্বপ্রধান শত্রু চোরাকারবারী, কালােবাজারী, মুনাফাখখার ও ঘুষখােরের দল। মানুষ যখন অনাহারে মারা যায়, তখনও এই সব নরপশুর দল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখের গ্রাস অন্যত্র পাচার করে দিয়ে থাকে। বিদেশ থেকে ধারকর্জ, এমনকি ভিক্ষা করে নেয়া পণ্য ও বাংলার সম্পদ মজুতের মাধ্যমে এরা মুনাফার পাহাড় গড়ে। এদের কোন জাত নেই, নেই কোন দেশ। এই সব নরপশুদের উৎখাতে আমি আপনাদের সাহায্য ও সহযােগিতা চাই।”
৬৪। অতঃপর কতিপয় মহলের সহিংস, ধ্বংসাত্মক ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এখানে মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতকারীর কথা উল্লেখ না করে আমি পারছি না। রাতের অন্ধকারে সন্ত্রাস সৃষ্টিই তাদের প্রধান উপজীব্য। ৪ জন সংসদ সদস্যসহ তিন হাজার আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীকে এদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। তারা জনগণের সম্পদ বিনষ্ট করে জনগণের দুঃখ-কষ্ট বৃদ্ধি করতেও দ্বিধা করছে না। সরকার তাে দূরের কথা, কোন শান্তিপ্রিয় নাগরিকই এটা বরদাস্ত করতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে জনগণের কোন কল্যাণ বা সমস্যার সমাধান হয় না। এ পন্থা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বহু আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এছাড়াও ক্ষমাপ্রাপ্ত কিছু কিছু লােক দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানাের চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সে সুযােগ দেয়া হবে না। বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টান, বাংলাদেশে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা সকলেই এদেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা সমঅধিকার ভােগ করবেন।”
৬৫। এরপর তাঁর সরকারের অনুসৃত বৈদেশিক নীতির সাফল্যের কিছুটা উদাহরণ স্বরূপ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, “বিগত একটি বছরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যান্য সাফল্য সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু বলতে চাই না। আপনারাই তার বিচার করবেন। শুধু এইটুকু বলবাে, জাতিসংঘে আজ বাংলাদেশ স্বীয় ন্যায়সঙ্গত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন, ইসলামিক শীর্ষ বৈঠক ও কমনওয়েলথ—সর্বত্র বাংলাদেশ সম্মানিত এবং সমাদৃত। প্রতিবেশী প্রতিটি দেশ, বিশেষ করে, নিটকতম প্রতিবেশী ভারত ও বার্মার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চেষ্টা আমরা করেছি। এমনকি মানবতাবিরােধী জঘণ্য অপরাধের জন্য যাদের বিচার হওয়ার কথা ছিল, সেই সব যুদ্ধাপরাধীকেও আমরা মার্জনা করে দিয়েছি। বাংলার মানুষের এই বদান্যতা ও ঔদার্য ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সাবেক পাকিস্তানের সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বাটোয়ারা এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী নাগরিকদের (অবাঙালীদের) ফিরিয়ে নেয়া পাকিস্তানের কর্তব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় পাকিস্তান এ ব্যাপারে এগিয়ে আসছে না। আরব ভাইদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে উন্মােচিত হয়েছে সম্ভাবনাময় এক নতুন দিগন্ত।
পৃষ্ঠাঃ ২০৩
দুর্দিনে তারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সর্বনাশা বন্যার সময় তাঁরা যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শুরু থেকেই বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, শােষিত, নির্যাতিত মানুষের সঙ্গে একাত্মতা ও কারাে প্রতি বৈরীতা নয়, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের যে নীতি অনুসরণ করে আসছে, আজ তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।”
৬৬। ১৮ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ জায়েদ আল নাহিয়ান আবুধাবি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। ১৯শে ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু ও শেখ জায়েদের মধ্যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। একই তারিখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি দীর্ঘমেয়াদী ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০শে ডিসেম্বর আরব আমিরাতে সফর শেষে বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসকগােষ্ঠী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা যে কিরূপ আরাম-আয়েশ ও বিলাস-বৈভবে জীবন-যাপন করেন তিনি তার একটি মনােগ্রাহী বর্ণনা আমাদের কাছে করেছিলেন।
৬৭। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার যখন চরম সর্বনাশের করাল গ্রাস থেকে দেশকে উদ্ধারের পথের সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত ছিল, বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে তখন অবাধ গণতন্ত্রের সুযােগে দূর্দশাগ্রস্ত মানুষের দোহাই দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হয়। জাসদ থেকে শুরু করে মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ, মাওবাদী উগ্র বামপন্থী বিভিন্ন প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল, এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলােও সরকার বিরােধী অভিযানে সামিল হয়। স্বভাবতঃই, বেআইনী ঘােষিত স্বাধীনতা বিরােধী পাকিস্তানপন্থী দলগুলাের সদস্যবৃন্দ, রাজাকার, আলবদর, আল-শামস, প্রভৃতি পাকিস্তানী দালাল সংগঠনগুলাের সদস্য এবং সমাজবিরােধীরাও সরকার বিরােধী এই অভিযানে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে যােগদান করে। এই প্রকাশ্য তৎপরতার পাশাপাশি অধিকতর তীব্রতায় চলতে থাকে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি, জাসদের গণবাহিনী, প্রভৃতি গুপ্ত সংগঠনগুলাের হাতিয়ারবাজী এবং হত্যালীলা। নাশকতা, ব্যাংক ডাকাতি, রাহাজানি, গুপ্তহত্যা, থানা-ফাড়িতে সশস্ত্র আক্রমণ, খাদ্যশস্যের গুদাম লুট, খাদ্যশস্য বহনকারী ট্রাক, ট্রেনের বগি ও জাহাজ ধ্বংস, পাটের গুদামে অগ্নিসংযােগ, ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনার খবর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
৬৮। ৫ই জানুয়ারী পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে ঢাকায় ৬টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১০ই জানুয়ারী তারিখে ভােলার জাতীয় সংসদ সদস্য জনাব মােতাহার উদ্দিন কতিপয় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। ১১ই জানুয়ারী তারিখে দুষ্কৃতকারীদের কারসাজিতে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের প্রবেশমুখে ৮ হাজার টন সিমেন্টবাহী ‘গােল্ড কুইন’ জাহাজটি দুর্ঘটনায় পতিত
পৃষ্ঠাঃ ২০৪
হয়। ২৫শে জানুয়ারী তারিখে দুষ্কৃতকারীরা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী’ পাটের গুদামে এবং বালুর ঘাটের দুটো পাটের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। ২৭শে জানুয়ারী তারিখে দুষ্কৃতকারীরা অগ্নিসংযােগে ভস্মীভূত করে যশােরের জুট মিল। ১লা ফেব্রুয়ারী তারিখে দুবৃত্তরা পদ্মার কাটিছাটা চরে একই সময়ে ১০টি লঞ্চে ডাকাতি করে। ২রা ফেব্রুয়ারী তারিখে কতিপয় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন যশােরের প্রাক্তন এম. সি. এ. জনাব মােশাররফ হােসেন। ২৬শে ফেব্রুয়ারী তারিখে দুষ্কৃতকারীরা অগ্নিসংযােগে ভস্মীভূত করে আলীজান জুট মিল। ৪ঠা মার্চ তারিখে দুষ্কৃতকারীরা অগ্নিসংযােগে ভস্মীভূত করে দৌলতপুরের ২৩টি পাটের গুদাম। ৯ই মার্চ তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী ঢাকার মােহাম্মদপুরের জনতা ব্যাংকের শাখা থেকে ৭০ হাজার টাকা ছিনতাই করে। ১৫ই মার্চ তারিখে দুষ্কৃতকারীরা নারায়ণগঞ্জের একটি জনতা ব্যাংকের শাখা থেকে ৩ লাখ টাকা ছিনতাই করে। ১৬ই মার্চ তারিখে কতিপয় দুর্বত্তের গুলিতে নিহত হন ঢাকা জেলার মনােহরদি থানার সংসদ সদস্য গাজী ফজলুর রহমান। একই তারিখে দুষ্কৃতকারীদের কারসাজিতে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ লাইনের জামতৈল স্টেশনের অদূরে একটি ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটে। ২২শে মার্চ তারিখে রাজশাহীর নলডাঙ্গায় দুষ্কৃতকারীদের বােমা বিস্ফোরণে ৭ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। ২৭শে মার্চ তারিখে ভেড়ামারায় বােমা বিস্ফোরিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ২০শে এপ্রিল তারিখে কতিপয় দুবৃত্ত রাজশাহীর হরিয়ান জনতা ব্যাংকের শাখা হতে ৩৮ হাজার টাকা ছিনতাই করে। ৩০শে এপ্রিল সাভারে সােয়া লাখ টাকাসহ একটি টাকা জালকারী দলকে গ্রেফতার করা হয়।
৬৯। ২রা মে তারিখে দুষ্কৃতকারীরা চাঁদপুর মহকুমার ফরিদগঞ্জ থানায় সশস্ত্র হামলা চালায়। ৭ই মে তারিখে নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইল থেকে বিমান বিধ্বংসী কামান ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ২৯শে মে তারিখে দুষ্কৃতকারীরা সশস্ত্র হামলায় ঢাকা জেলার সাভারের নিকট শিমুলিয়া পুলিশ ফাঁড়িটি লুট ও ধ্বংস করে। ১১ই জুন তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্রাবাস থেকে ২৯৭ বাক্স গুলি উদ্ধার করা হয়। ১২ই জুন তারিখের রাতে চট্টগ্রামে ফেরার পথে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কারসাজিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও শ্রমিক লীগের সভাপতি জনাব এম. এ. হান্নান। ১৭ই জুন তারিখে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে বােমাবাজির ঘটনা ঘটে। ২৩শে জুন কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলায় বগুড়া জেলার ধুপচাঁচিয়া থানা লুট ও ধ্বংস করে। এতে ২ জন পুলিশ নিহত হয়। ৯ই জুলাই কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলা চালায় ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ থানায়। ১৬ই জুলাই কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলায় লুট ও ধ্বংস করে ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জ থানার ৮টি পুলিশ ফাঁড়ি। ১লা আগস্ট তারিখে চট্টগ্রাম জেলার চন্দ্রঘােনা থানায় কতিপয় দুষ্কৃতকারীর সশস্ত্র হামলায় ২ জন বিডিআর বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। ১৫ই আগস্ট তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলা চালায় ময়মনসিংহ জেলার বাজিতপুর থানায় এবং এতে ২ ব্যক্তি নিহত হয়। ২০শে আগস্ট তারিখে কতিপয় দুবৃত্ত ঢাকা জেলার
পৃষ্ঠাঃ ২০৫
মুন্সীগঞ্জ মহকুমার বেতকারস্থ জনতা ব্যাংকের শাখা হতে ৫৭ হাজার টাকা ছিনতাই করে। একই তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সন্দীপ দ্বীপের নিকট একটি ২২ হাজার মণ গমবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।
৭০। ২২শে আগস্ট মুন্সীগঞ্জ মহকুমার ভাগ্যকুলের জনতা ব্যাংক শাখায় সশস্ত্র ডাকাতি সংঘটিত হয়। ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কারসাজিতে ঘােড়াশাল ইউরিয়া সার কারখানার কন্ট্রোল রুমটি সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়। এই বিস্ফোরণে ২০ ব্যক্তি হতাহতসহ বৈদেশিক মুদ্রায় ১৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বিনষ্ট হয়। ১১ই অক্টোবর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলা চালায় মাদারীপুরের সাহেবরামপুর রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে। এই ঘটনায় ২ জন রক্ষীবাহিনীর সদস্যসহ ৯ ব্যক্তি নিহত হয়। ২০শে অক্টোবর তারিখে কতিপয় দুবৃত্ত রংপুর জেলার শ্যামপুর রেলওয়ে স্টেশনে সশস্ত্র হামলায় লুট করে কয়েকটি গমবাহী ওয়াগন।
৭১। ২১শে অক্টোবর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলা চালায় লৌহজং থানা ও রক্ষীবাহিনী ক্যাম্পে। ২৭শে অক্টোবর তারিখে ঢাকায় কতিপয় দুবৃত্তের গুলিতে নিহত হন পাকিস্তানের এককালীন প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী (বগুড়া)-এর পত্নী। ৩০শে অক্টোবর তারিখে খুলনা জেলার শরণখােলার সুন্দরবনে সশস্ত্র দুবৃত্ত ও রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। উক্ত ঘটনায় ৯ ব্যক্তি প্রাণ হারায়। ১লা নভেম্বর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কারসাজিতে সুনামগঞ্জের জালালপুর গ্রামের প্রাকৃতিক গ্যাস ফিল্ড অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয়। ৭ই নভেম্বর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলায় লুট ও ধ্বংস করে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান থানা। ২৯শে নভেম্বর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলায় লুট ও ধ্বংস করে ঢাকা জেলার কালিয়াকৈরের পুলিশ ফাঁড়ি। ১লা ডিসেম্বর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলা চালিয়ে লুট ও ধ্বংস করে বগুড়া জেলার ধুপচাঁচিয়া থানা। ২রা ডিসেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীদের দুটো দল সশস্ত্র আক্রমণে লুট ও ধ্বংস করে যথাক্রমে চট্টগ্রামের শুকুরছড়ি ও চন্দ্রঘােনা পুলিশ ফাড়িদ্বয়। একই তারিখে কতিপয় দুবৃত্ত সশস্ত্র হামলা চালিয়ে শিবালয় থানাস্থ জনতা ব্যাংকের শাখা হতে ৬৫ হাজার টাকা ছিনতাই করে। ৩রা ডিসেম্বর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারী সশস্ত্র হামলায় লুট ও ধ্বংস করে পার্বত্য চট্টগ্রাম। জেলার গােড়াইছড়ি পুলিশ ফাঁড়ি। ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে কতিপয় দুবৃত্তের সন্ত্রাসমূলক ঘটনায় মুন্সীগঞ্জে ১০ ব্যক্তি নিহত হয়। একই তারিখে কতিপয় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন ফরিদপুরের সাবেক এম. সি. এ. জনাব আবু ইউসুফ আমিনউদ্দিন। ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বােমাবাজী ও সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা চালায়। উক্ত তারিখে দুষ্কৃতকারীরা দেশের কয়েকটি রেলওয়ে স্টেশন ও তফসিল অফিসে সশস্ত্র হামলা চালায় ও অগ্নিসংযােগ করে। ১৫ই ডিসেম্বর তারিখে দুষ্কৃতকারীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে বােমাবাজী ও নাশকতামূলক তৎপরতা চালায়। ২০শে ডিসেম্বর তারিখে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর
পৃষ্ঠাঃ ২০৬
কারসাজিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয় টঙ্গীর নিশাত জুট মিলে। উক্ত অগ্নিকাণ্ডে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়।
৭২। ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে কতিপয় দুবৃত্ত পবিত্র ঈদের জামাত-নামাজে প্রকাশ্য দিবালােকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে সংসদ সদস্য গােলাম কিবরিয়াকে। ঐদিন সকাল দশটার দিকে বঙ্গবন্ধু গােপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া গ্রামের বাড়ী থেকে তাঁর গুরুতর অসুস্থ পিতা শেখ লুৎফর রহমান সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টার যােগে ঢাকায় ফিরছিলেন। হেলিকপ্টারেই বঙ্গবন্ধুকে উক্ত নৃশংস ও বর্বরােচিত হত্যাকাণ্ডের দুঃসংবাদ জানানাে হয়। ঐ ঘটনায় বঙ্গবন্ধু দারুণভাবে মর্মাহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পবািরবর্গের সদস্যদের বহনকারী হেলিকপ্টারে হাসিনাসহ আমিও ছিলাম। এর পর বঙ্গবন্ধু নিশ্চল হয়ে যান। তিনি সারাক্ষণ চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে থাকেন। কারও সঙ্গে কোন কথা বললেন না তিনি। ঢাকায় পৌছে হেলিকপ্টার থেকে নামবার সময় বঙ্গবন্ধু বিড় বিড় করে বললেন, ‘মানুষের ধৈর্য ও সহ্যের একটা সীমা পরিসীমা আছে। এখন আমার চরম কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। এতে হয় সকল হত্যা, নাশকতা, অন্তর্ঘাত ও সশস্ত্র সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অবসান হবে, নয় তাে আমি নিজেই শেষ হয়ে যাবাে।”
৭৩। ২৮শে ডিসেম্বর (১৯৭৪) তারিখে বঙ্গবন্ধু সরকারের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং আইন-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে অরাজকতাজনিত সঙ্কট মােকাবেলার জন্যে সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেন। সরকারের পক্ষ থেকে জম্মী অবস্থা ঘােষণা প্রসঙ্গে সারাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলা হয়, “অবাধ গণতন্ত্রের সুযােগের যেভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে, শান্তিপূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক তৎপরতার পরিবর্তে যেভাবে নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়েছে, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়ে জাতীয় বিপর্যয় অনিবার্য করে তােলার জন্য সমাজবিরােধীরা যেভাবে অশুভ তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে, নাশকতা, অন্তর্ঘাত ও সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ এবং নির্বিচার গুপ্তহত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেভাবে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা, ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করা হয়েছে, জনগণের নির্বাচিত ও আস্থাভাজন কোন সরকারই তার মােকাবেলায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। সুপরিকল্পিত এই নৈরাজ্য, অরাজকতা ও সঙ্কট থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্যে এই কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া সরকারের সামনে আর কোন বিকল্প পথ খােলা ছিল না।”
৭৪। সারা দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা আমার কাছে অশনি সংকেত—মহাবিপদের সংকেত বলে মনে হলাে। আমার বুক শিউরে ওঠে এক অজানা মহাবিপর্যয়ের আশঙ্কায়। দূর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা ও শঙ্কায় আমি মূহ্যমান হয়ে পড়ি। তখন দেশের অনেকেরই এ অবস্থা হয়েছিল বলে আমার মনে হয়। এহেন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার সঙ্গে সমাপ্ত হয় ১৯৭৪ সাল।
অষ্টম পরিচ্ছেদ
১৯৭৫ সাল
১। সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণার পর প্রথম চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল সিরাজ শিকদারের পতন। ১লা জানুয়ারী (১৯৭৫) মাওবাদী উগ্র বামপন্থী দল, ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি প্রধান সিরাজ শিকদারকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য যে, কমরেড সিরাজ শিকদার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাত করে শ্ৰেণীমূক্ত”স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা” কায়েমের সংকল্প নিয়ে ১৯৭২ সালে গঠন করেন গুপ্ত সংগঠন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি’। গুপ্তহত্যা, রাহাজানি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ফাঁড়িতে সশস্ত্র হামলা, খাদ্য ও পাটের গুদামে অগ্নিসংযােগ, খাদ্যদ্রব্য বহনকারী পরিবহন ধ্বংস, ইত্যাদি সহিংস, নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার অভিযােগ ছিল পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির সদস্যদের বিরুদ্ধে। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদের সময় সিরাজ শিকদার কোন কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান। অতঃপর তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় যে, তিনি কারাে সঙ্গে কথা বলতে চান কিনা, তখন তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কারােরও সঙ্গে নয়।” ২রা জানুয়ারী বিকেলে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলে প্রথম জানতে পারি যে, পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন অবস্থায় সিরাজ শিকদার পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই খবর শুনে আমি দারুণভাবে স্তম্ভিত ও মর্মাহত হই। বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করার উদ্দেশ্যে কোন বিরােধী কুচক্রী মহল এই অত্যন্ত অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয় ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করেন অনেকেই। যাহােক, পরের দিন অর্থাৎ ৩রা জানুয়ারী (১৯৭৫) তারিখে পুলিশের এক ভাষ্যে বলা হয় যে, নিজের দলের একটি গুপ্ত ঘাঁটি চিনিয়ে দেয়ার জন্যে পুলিশ গাড়ীতে করে সাভারের দিকে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গাড়ী থেকে লাফিয়ে পড়ে পালাবার সময় সিরাজ শিকদার পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। অতঃপর ঘটনাটির ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যে সরকার একটি কমিটি গঠন করে।
পৃষ্ঠাঃ ২০৮
২। ২রা জানুয়ারী (১৯৭৫) তারিখে দুর্নীতির অভিযােগে গ্রেফতার করা হয় শ্রমিক লীগের নেতা আবদুল মান্নানকে। ৩রা জানুয়ারী তারিখে জরুরী অবস্থা আইনবলে জরুরী ক্ষমতা বিধি-বিধান জারি করা হয়। উক্ত বিধি-বিধানে নাশকতা, সন্ত্রাসী ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ, চোরাচালানী, কালােবাজারী এবং গুপ্তহত্যার মতাে অপরাধের দায়ে দোষী ব্যক্তিদের প্রাণদণ্ড প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয় এবং এই সব সমাজ বিরােধী কাজের দমনে। সরকারের হাতে পর্যাপ্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়। ৪ঠা জানুয়ারী তারিখে খাদ্য বিভাগ ও বিজি প্রেসের মােট ৪৪ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এক লাখ রেশন কার্ড জালিয়াতির অভিযােগে। ৬ই জানুয়ারী তারিখে সরকার জরুরী অবস্থা আইনের আওতায় সারাদেশে সর্বপ্রকার সভা, শােভাযাত্রা, ধর্মঘট, লকআউট অনির্দিষ্টকালের জন্যে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ৭ই জানুয়ারী তারিখে সরকার এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে গঠন করে রেলওয়ে প্রােটেকশন ফোর্স। একই তারিখে হল্যান্ডের সরকার বাংলাদেশকে ১৬ কোটি টাকার সাহায্য ও ঋণ প্রদানের কথা ঘােষণা করে।
৩। জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের ঘটনা। আমি আমার বিদেশে উপার্জিত অর্থে একটি নিশান গাড়ী আমদানী করেছিলাম ১৯৭৪ সালে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার কর্মসূচীর অধীনে আমার ১৯৭৫-এর মার্চ মাসে (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানী যাওয়া চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হলে আমি উক্ত গাড়ীটি আইনসম্মত উপায়ে বিক্রী করার সিদ্ধান্ত নিই। এ ব্যাপারে প্রয়ােজন হয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি। অতএব উক্ত গাড়ীটি বিক্রী করার অনুমতি চেয়ে বাণিজ্য বিষয়ক মন্ত্রীর বরাবরে একটি পত্র লিখে তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার অনুমতি নিই।
৪। খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব ঐদিন বিকাল ৩টায় তাঁর আগামসি লেনস্থ বাসায় আমাকে যেতে বলেন। তিনি তখন তাঁর বাড়ীর ছাদের লবিতে ছিলেন। সিঁড়ি বেয়ে উপরে যাওয়ার সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক তরুণ কর্মকর্তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। সম্ভবত, তিনি খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চলে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজেকে মেজর রশীদ বলে পরিচয় দিলেন। উপরের ছাদের লবিতে পৌছে খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময়ের মুহূর্তে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার বড় ছেলে ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন সেখানে হাজির হন। অতঃপর ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন খন্দকার মােশতাক আহমদের উদ্দেশ্যে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে সমালােচনামূলক কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। এর অল্পক্ষণ পরেই খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব মইনুল হােসেনকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘বাবা মইনু, ওয়াজেদ অনেকদিন পর আমার কাছে এসেছে বিশেষ একটা দাপ্তরিক কাজে। অতএব তুমি আজকের মত চলে যাও। আগামীকাল আবার এসাে।” ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন চলে যাওয়ার পর আমার গাড়ী বিক্রির প্রয়ােজনীয়তার কারণ বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে
পৃষ্ঠাঃ ২০৯
লেখা চিঠিটি খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবকে প্রদান করি। অতঃপর খন্দকার মােশতাক আহমদ বলেন, “এটি অতি সামান্য ব্যাপার। আগামীকাল অফিসে গিয়ে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবাে। এখন এই সুযােগে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তােমার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।” অতঃপর, খন্দকার মােশতাক আহমদ আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তােমার শ্বশুর যে দেশের সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেছেন সে সম্বন্ধে তুমি কোন কিছু জান কিংবা শুনেছে কিনা? বঙ্গবন্ধুর এটা করা মারাত্মক ভুল হবে।” এর জবাবে আমি বললাম, “আপনি যদি আমাকে খুলে বলেন বঙ্গবন্ধু সংবিধানের কি ধরনের পরিবর্তন ঘটানাের পরিকল্পনা করেছেন তাহলেই তাে আমি বুঝতে পারবাে সেটা তাঁর ভুল পদক্ষেপ হবে কিনা। তবে বঙ্গবন্ধুকে আমি যতটুকু জেনেছি তা থেকে আমার বিশ্বাস যে, তিনি সংবিধানে এমন কোন পরিবর্তন ঘটাবেন না যার ফলে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ও বিধিব্যবস্থা বিনষ্ট হয়।” আমার এই কথার জবাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব বলেন যে, মন্ত্রী পরিষদের একজন সদস্য হয়ে তিনি সবকিছু প্রকাশ করতে পারেন না। যা হােক, উপরােক্ত ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য তিনি আমাকে পরামর্শ দেন। অতঃপর আমি তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি।
৫। এর দু-একদিন পর আমদানী ও রফতানী বিষয়ক নিয়ন্ত্রকের অফিস থেকে আমাকে উক্ত গাড়ীটি বিক্রি করার অনুমতি দেয়া হয় এই শর্তে যে, পরের তিন বছরে আমি আর কোন গাড়ী আমদানী করতে পারবাে না। এই শর্ত শিথিল করার আবেদন জানিয়ে চিঠি লিখে আমি আবার খন্দকার মােশতাক আহমদের বাসায় যাই। তিনি আমাকে আশ্বাস দেন যে, ঐ শর্ত প্রত্যাহার করার জন্যে তিনি প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেবেন। সেদিনও তিনি বঙ্গবন্ধুর সংবিধান পরিবর্তন করার পরিকল্পনার বিষয়টি উত্থাপন করেন। তখন আমি বললাম, “কাকা, স্বাধীনতার পর থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে বিশেষ কথাবার্তা বলি না। আপনি বরঞ্চ শেখ মণির সঙ্গে ব্যাপারটি নিয়ে আলাপ করুন।” এর জবাবে খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব বললেন, “মণিকে বলে কিছু হবে না, কারণ সে নিজেই তােমার শ্বশুরের পক্ষাবলম্বন করছে।” এ কথা বলেই তিনি আবারাে আমাকে ঐবিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বিদায় দিলেন। এর পর আমি আর কখনও খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবের বাসায় যাইনি।
৬। ১১ই জানুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধু কুমিল্লাস্থ সামরিক একাডেমীতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী জেন্টেলম্যান ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমরা পাকিস্তানী আমলে বাংলাদেশে সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠার জন্য বহুবার সংগ্রাম করেছিলাম। কিন্তু এতে কোন ফল হয়নি। আজ লাখাে শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। সেই জন্যই আজ বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সামরিক একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” অতঃপর এই সামরিক
পৃষ্ঠাঃ ২১০
একাডেমীর তখনকার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি অবশ্য জানি, আজ আমাদের এই একাডেমীর ধরতে গেলে কিছুই নেই। আমরা সামান্য কিছু জিনিস নিয়ে এর কাজ শুরু করেছিলাম। অনেক অসুবিধার মধ্যে তােমাদের ট্রেনিং নিতে হয়েছে। তােমাদের কমান্ডাররা অনেক অসুবিধার মধ্যে তােমাদের ট্রেনিং দিয়েছেন। কিন্তু আজ আমি যা দেখলাম, তাতে আমি বিশ্বাস করি, পূর্ণ সুবিধা পেলে আমাদের ছেলেরা যে কোন দেশের যে কোন সৈনিকের সঙ্গে মােকাবেলা করতে পারবে। তাদের সে শক্তি আছে। তবে একদিনে কিছু হয় না। আমরা তিন বছর হলাে স্বাধীনতা পেয়েছি। এর মধ্যে একাডেমীর জন্য যতটুকু দরকার, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করা হয়নি। এমনকি, আমার নিজের চেষ্টায়ও এটা-ওটা জোগাড় করে এক্ষেত্রে কাজ আরম্ভ করা হয়েছে।” এরপর সামরিক ক্ষেত্রে বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানী আমলের অবহেলার কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানীরা বসততা, বাঙালীরা সামরিক বাহিনীতে যােগদানের অযােগ্য। তারা কাপুরুষ, তারা যুদ্ধ করতে জানে না। কিন্তু পাকিস্তানের সৈন্যরা বাংলাদেশের মাটিতে দেখে গেছে, বাঙালীদের যুদ্ধ করবার ক্ষমতা কেমন। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে তাদের বড় বড় শক্তিধর বিশালদেহী পুরুষেরও জান বেরিয়ে যেতাে। আমরা বাঙালীরা আর যাই হই না কেন, কাপুরুষ নই।”
৭। অতঃপর দেশ থেকে সর্বপ্রকার দুর্নীতি উচ্ছেদ করার তাঁর সংকল্পের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে দুঃখী মানুষ দিনভর পরিশ্রম করে, তাদের পেটে খাবার নেই, গায়ে কাপড় নেই, বাসস্থানের বন্দোবস্ত নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। পাকিস্তানীরা আমাদের সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। কাগজ ছাড়া আমাদের কারও জন্য কিছু রেখে যায়নি। আমাকে বিদেশ থেকে ভিক্ষে করে সব জিনিস আনতে হয়। কিন্তু চোরের দল সব লুট করে খায়, দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে। এবার আমি শুধু জরুরী অবস্থাই ঘােষণা করিনি। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, বাংলাদেশের মাটি থেকে ঘুষখাের, দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখখার আর চোরাচালানকারীদের নির্মূল করবাে।” বাংলাদেশের আর এক শ্রেণীর মানুষের কার্যকলাপ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “আর একদল লােক আছে, যারা বিদেশীদের অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করতে চায়। তারা রাতের অন্ধকারে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। একটি লােক কেমন করে যে পয়সার লােভে মাতৃভূমিকে বিক্রি করতে পারে, তা ভাবলে আমরা শিউরে উঠি। যারা বিদেশের আদর্শ বাংলাদেশে চালু করতে চায়, এ দেশের মাটিতে তাদের স্থান হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন মন-মানসিকতা গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধু এর পর বলেন, ‘মনে রেখাে, তােমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানী মনােভাব না আসে। তােমরা পাকিস্তানীদের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তােমরা হবে আমাদের জনগণের। তােমরা পেশাদার বাহিনীও নও, কেবল সামরিক বাহিনীও নও। দরকার হলে তােমাদের আপন হাতে উৎপাদন করে খেয়ে বাঁচতে হবে।” পরিশেষে, বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। এ স্বাধীনতা
পৃষ্ঠাঃ ২১১
নিশ্চয়ই টিকে থাকবে। একে কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। তবে বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারলে এ স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে।”
৮। ১৫ই জানুয়ারী তারিখে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উদযাপন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ পালিত হচ্ছে। যতদিন বাংলার স্বাধীনতা থাকবে, যতদিন বাংলার মানুষ থাকবে, ততদিন এই রাজারবাগের ইতিহাস লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। (১৯৭১-এর) ২৫শে মার্চ রাতে যখন ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের মানুষকে (সশস্ত্র) আক্রমণ করে, তখন তারা চারটি জায়গা বেছে নিয়ে তার ওপর আক্রমণ চালায়। সেই জায়গা চারটি হচ্ছে রাজারবাগ, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর আমার বাড়ী। একই সময়ে তারা এই চার জায়গায় (সশস্ত্র) আক্রমণ চালায়। রাজারবাগের পুলিশেরা সেদিন সামান্য অস্ত্র নিয়ে বীর বিক্রমে সেই সামরিক বাহিনীর মােকাবেলা করেন। কয়েক ঘন্টা তুমুল যুদ্ধ করেন।…পুলিশ বাহিনীর অনেক কর্মী এখানে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা রাস্তায় নেমে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন নয় মাস পর্যন্ত। যাঁরা পুলিশ বাহিনীর বড় বড় কর্মচারী ছিলেন, তাদেরও অনেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন।”
৯। পুলিশ বাহিনীর বিদ্যমান নানান অসুবিধার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু অতঃপর বলেন, “আমার মনে আছে যেদিন আমি জেল থেকে বের হয়ে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বুকে ফিরে আসি, সেদিন দেখেছিলাম আমাদের পুলিশ বাহিনীর না আছে কাপড়, না আছে জামা, না কিছু। অনেককে আমি ডিউটি করতে দেখেছি লুংগি পরে। একদিন রাত্রে তারা আমার বাড়ী গিয়েছিল। তাদের পরনে ছিল লুংগি, গায়ে (গেঞ্জি) জামা, হাতে বন্দুক।…৭০ থেকে ৮০টা থানা হানাদার বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। সেগুলাে নতুন করে আমরা গড়তে চেষ্টা করছি। অনেকগুলাে গড়া হয়েছে, অনেকগুলাের কাজ চলছে। আপনাদের কিছুই ছিল না। আজ আস্তে আস্তে কিছু কিছু হতে চলেছে। একদিনে কিছু হবে না।”
১০। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্বের প্রতি সচেতন থাকার আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, এই কথা (সর্বদা) মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাবাে না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শােষণ করবেন, মানুষের ওপর অত্যাচার করবেন? গরীবের ওপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনাদের নয়, সমস্ত কর্মচারীকেই আমি অনুরােধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি তাদের যাতে কষ্ট না হয় তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন
পৃষ্ঠাঃ ২১২
করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লােকের ওপর যেন অত্যাচার না হয়। (কারণ) তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আপনারা যদি অত্যাচার করেন, শেষ পর্যন্ত আমাকেও আল্লাহর কাছে তার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, আমি আপনাদের জাতির পিতা, আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আমি আপনাদের নেতা।”
১১। ১৭ই জানুয়ারী তারিখে স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ওপেক-এর মধ্যে একটি দীর্ঘ মেয়াদী সাহায্য-সহযােগিতা চুক্তি। ১৮ই জানুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে কাপড় ও সুতার মূল্য শতকরা ৫ ভাগ হ্রাস করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ২০শে জানুয়ারী তারিখে স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও বিষয়ে সাহায্য ও সহযােগিতার তিনটি চুক্তি।
১২। ২০শে জানুয়ারী তারিখে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণ দেন (তৎকালীন) রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদুল্লাহ। ইতিপূর্বে , ১৮ই জানুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক। এই বৈঠকেই বঙ্গবন্ধু সংসদ সদস্যদের কাছে তুলে ধরেন তাঁর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কীমের রূপরেখা। উক্ত সভায় তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, “শতাব্দীর জীর্ণ ঘুণে ধরা সমাজব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে প্রশাসন যন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ ও গণতন্ত্রীকরণ এবং একটিমাত্র রাজনৈতিক প্লাটফরমের পতাকাতলে সমগ্র জাতিকে সমবেত করে সুসংহত ও সংঘবদ্ধ জাতীয় প্রয়াস ছাড়া সংকট থেকে পরিত্রাণের কোনাে পথ নেই। খণ্ডিত, বিক্ষিপ্ত এবং অসংলগ্ন পরস্পর বিরােধী কর্মতৎপরতা নয়—আজ যা প্রয়ােজন তা। হচ্ছে সকল দেশপ্রেমিক শক্তির নিবিড় একাত্মতা এবং ঐক্যবদ্ধ ও গঠনমূলক সর্বাধিক কর্মপ্রয়াস। কেবলমাত্র একটি শক্তিশালী ও বৈপ্লবিক ব্যবস্থার অধীনেই তা সম্ভবপর।” উল্লেখ্য, ১৯৭৪-এর জুলাইয়ের ৬ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী কমিটি এবং সংসদীয় দলের যৌথ বৈঠকে ‘শােষিতের গণতন্ত্র এবং সমাজ প্রতিষ্ঠাকল্পে’ প্রয়ােজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহবান জানানাে হয়েছিল। ১৯৭৪-এর জুলাই মাসের ১৫ তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গদলসমূহের এক সপ্তাহব্যাপী জরুরী সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি শােষিতের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রয়ােজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরূপ অনুরােধ জানানাে হয়েছিল। এসব প্রস্তাবসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮ই জানুয়ারী (১৯৭৫) তারিখের সভায় বঙ্গবন্ধু নতুন সিস্টেম। প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেন।
১৩। আওয়ামী লীগের একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর এই স্কীমের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। এই গ্রুপের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ, জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, ওবায়দুর রহমান, নূরুল
পৃষ্ঠাঃ ২১৩
ইসলাম মনজুর, নূরে আলম সিদ্দিকী, ব্যারিস্টার মইনূল হােসেন প্রমুখ। জেনারেল (অবঃ) ওসমানী ও নূরে আলম সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের ১৮ই জানুয়ারী (১৯৭৫) তারিখের বৈঠকে একদলীয় রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। জেনারেল (অবঃ) ওসমানী তাঁর বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন, ‘আমরা আইয়ুব খানকে দেখেছি, ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি। আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুজিবুর রহমান খান হিসেবে দেখতে চাই না।” জেনারেল (অবঃ) ওসমানী যখন এই মন্তব্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তখন মুচকি মুচকি হাসছিলেন। বক্তৃতা শেষ হলে জেনারেল (অবঃ) ওসমানীকে তাঁর কাছে ডেকে বঙ্গবন্ধু বলেন “Don’t be excited my old friend, people are fed up with fiery speeches. They want some revolutionary changes in the social, political and economic system।” ২১শে জানুয়ারী (১৯৭৫) তারিখে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠকে ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে প্রয়ােজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করা হয় সর্বসম্মতিক্রমে। এরপর বঙ্গবন্ধু দ্রুত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তন প্রবর্তনের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
১৪। ২৪শে জানুয়ারী তারিখে আমি সকাল সাড়ে আটটার দিকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব এবং বঙ্গবন্ধুর সম্পর্কে মামাশ্বশুর জনাব মঈনুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমার দাপ্তরিক বিষয়ে আলাপ করতে তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসায় যাই। সেখানে পৌছে দেখি যে, তিনি শেখ কামালের সঙ্গে আলাপ করছেন। শেখ কামাল তাঁর কাছে গিয়েছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে উচ্ছেদকৃত লােকজন ও বস্তিবাসীদের মীরপুরে পুনর্বাসন করার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আলাপ করার জন্যে। উল্লেখ্য, ঐ সমস্ত লােকজন অনধিকার ও অননুমােদিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় বসবাস করতাে। মঈনুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আলাপ শেষে কামাল চলে যাওয়ার সময় তিনি ওকে জিজ্ঞেস করেন, “আগামীকাল (২৫শে জানুয়ারী) থেকে তাের আব্বা (বঙ্গবন্ধু) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। অতএব এর পর তােরা রাষ্ট্রপতির বঙ্গভবনে না ধানমন্ডিস্থ তােদের নিজেদের বাসায় অবস্থান করবি”? এর জবাবে শেখ কামাল বলে, “না, নানা, আমরা কোন অবস্থাতেই বঙ্গভবনে যাবাে না। আমরা ধানমন্ডির নিজেদের বাসাতেই থাকবাে।” অতঃপর শেখ কামাল চলে যায়। আমি মঈনুল ইসলাম সাহেবকে উক্ত ব্যাপারটি একটু পরিষ্কার ও বিস্তারিতভাবে আমাকে জানানাের অনুরােধ জানালে তিনি বলেন, “তুই, দেখছি এ ব্যাপারে কিছুই জানিস না। আগামীকাল থেকে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা চালু হতে যাচ্ছে এবং তাের শ্বশুর (বঙ্গবন্ধু) রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। সংবিধানের প্রস্তাবিত পরিবর্তনে দেশে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথাও উল্লেখ করা থাকবে।” অতঃপর মঈনুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আলাপ শেষ করে আমি সরাসরি আমার আণবিক শক্তি কেন্দ্রের অফিসে চলে যাই।
পৃষ্ঠাঃ ২১৪
১৫। ২৪শে জানুয়ারী তারিখে আমি বিকেল পাঁচটার দিকে অফিস ত্যাগ করি। আমি গাড়ী চালিয়ে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাই। বাড়ীর গেটের কাছে পৌছে দেখি গেটের দরজা বন্ধ। গেটের দরজা খুলতে বললে সেখানে প্রহরারত নিরাপত্তা বাহিনীর লােকেরা আমাকে জানায় যে, বাইরের কারােরও গাড়ী নিয়ে বাড়ীর ভেতর যাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তখন লক্ষ্য করলাম যে, ঐদিন থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় পুলিশের অতিরিক্ত হিসেবে সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্যকেও ডিউটিতে নিয়ােজিত রাখা হয়েছে। আমি নিজের পরিচয় জানালেও তারা আমাকে গাড়ী নিয়ে বাড়ীর ভেতর যেতে দিতে সম্মত হলাে না। অতঃপর আমার বাসা বঙ্গবন্ধুর বাসার অতি নিকটে হওয়ায় আমি আমার গাড়ীটি আমার বাসায় রেখে আসি। গেটের পকেট দরজা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঢােকার সময় দেখি খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব বাইরে চলে যাওয়ার জন্যে সেখানে এসে পৌছেছেন। কাকা, আসসালামু আলাইকুম” বলে আমি তাঁকে সালাম জানানাে সত্ত্বেও খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব। কোন কিছু না বলে গেটের বাইরে চলে গেলেন। এর অব্যবহিত পরই খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব আবার গেটের ভেতরে এসে আমাকে আহবান জানিয়ে বললেন, ‘বাবা ওয়াজেদ, আমি দুঃখিত যে আমি তােমার উপস্থিতি খেয়াল করতে পারিনি।” অতঃপর খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেব আমাকে গেটের নিকটস্থ আম গাছটির কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আগামীকাল তােমার শ্বশুর (বঙ্গবন্ধু) সংবিধানের যে পরিবর্তন ঘটাতে যাচ্ছেন, তা করা হলে সেটা শুধু একটি মারাত্মক ভুলই হবে না, এর ফলে দেশে এবং বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তিও অপূরণীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব এক্ষুণি বাড়ীর তেতলার বৈঠকখানায় গিয়ে তােমার শ্বশুরকে এ বিষয়টি সঠিকভাবে অনুধাবন করানাের চেষ্টা করাে। আমি আমার শেষ চেষ্টা করে বিফল মনােরথে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বাসায় ফিরে যাচ্ছি।” এই কথাগুলাে বলেই খন্দকার মােশতাক আহমদ বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে চলে গেলেন। উপরােক্ত কথাগুলাে আমাকে বলার সময় খন্দকার মােশতাক আহমদ সাহেবকে ভীষণ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। আমার মনে হলাে যে, ইতােপূর্বে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্ভবতঃ তাঁর ভীষণ তর্কাতর্কি ও ঝগড়াঝাটি হয়েছে।
১৬। সেদিন আমি সােজা বাসায় তিন তলায় চলে যাই। বঙ্গবন্ধুর বাসার তিন তলায় রয়েছে একটি ছােট বৈঠকখানা ও তৎসংলগ্ন বাথরুম, একটি ছােট তােষাখানা এবং সংযুক্ত বাথরুমসহ শেখ কামালের শয়নকক্ষ। বঙ্গবন্ধু তখন সেখানের বৈঠকখানায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবদের সঙ্গে কথাবার্তা ও হাসি-ঠাট্টা করছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক যে, ঐ দুইজন মুরুব্বী ব্যক্তির উপস্থিতিতে রাজনৈতিক বিষয়ে আমি কখনােও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলিনি। অতএব আমি সেখানে পায়চারী করতে থাকলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবরা কখন চলে যাবেন তার অপেক্ষায়। এভাবে প্রায় পৌনে এক ঘণটা কেটে যায়। অতঃপর আমি কামালের শয়নকক্ষে শুয়ে আরও প্রায় পৌনে
পৃষ্ঠাঃ ২১৫
এক ঘন্টা কাটিয়ে দিলাম। এর পরেও তারা চলে যাচ্ছেন না লক্ষ্য করে আমি স্থির করলাম যে, রাতে খাবারের পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করবাে। অতঃপর আমি দোতলায় হাসিনাদের কাছে চলে যাই। হাসিনাকে প্রথমেই বলে রাখলাম যে, ঐ রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একত্রে খাবাে। ঐ সময়ে কোন এক ফাঁকে বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেবদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ীর বাইরে কোথায় যেন চলে যান। সে রাতে বঙ্গবন্ধু বাসায় ফেরেন সাড়ে দশটার দিকে। রাত এগারটার দিকে হাসিনা ও আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খেতে বসি। সে সময় বঙ্গবন্ধু কারাে সঙ্গে কোন কথা না বলে অতি দ্রুত তাঁর খাবার শেষ করে শয়নকক্ষে চলে যান। ঠিক ঐ মুহূর্তে শেখ ফজলুল হক মণি বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষে ঢুকেই ছিটকানি লাগিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষের দরজা ছিটকানি লাগিয়ে বন্ধ করে, বিশেষ করে, আমার শাশুড়ীকে শয়নকক্ষের বাইরে রেখে শেখ মণিকে ইতিপূর্বে কখনােও তাঁর (বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ করতে দেখিনি। রাত প্রায় পৌনে একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ততক্ষণেও শেখ মণির বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ শেষ হলাে না। অতঃপর হাসিনা ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমাদের বাসায় চলে যাই রাত একটার দিকে।
১৭। পরদিন, অর্থাৎ ২৫শে জানুয়ারী (১৯৭৫) তারিখে পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু সংসদে পেশ করেন সংবিধান চতুর্থ সংশােধন বিল। তখনকার সংবিধানে উল্লেখিত দেশের শাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন ঘটানাের জন্য পেশকৃত প্রস্তাবনাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিপ্লব’ হিসেবে। অতি স্বল্প আলােচনা এবং প্রায় বিতর্কহীন পরিবেশে সংসদে পাস হয়ে যায় চতুর্থ সংশােধন বিল। রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদুল্লাহ তখন তাঁর সংসদ ভবন অফিসে উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখিত চতুর্থ সংশােধন বিলটি সংসদে পাস হওয়ার অব্যবহিত পর রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহ তাতে স্বাক্ষর করেন এবং এর সঙ্গে সঙ্গেই তা বলবৎ হয়ে যায়। এই চতুর্থ সংশােধনী বলবৎ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়ে নতুনভাবে প্রবর্তিত হলে রাষ্ট্রপতির শাসন ব্যবস্থা। উল্লেখ্য যে, উক্ত সংবিধান চতুর্থ সংশােধনীতে দেশে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুযােগ রাখা হয় এবং তৎসংক্রান্ত বিধানটি নিম্নরূপঃ”(১) রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এই সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিসমূহের কোন একটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকর করিবার উদ্দেশ্যে অনুরূপ করা প্রয়ােজন, তাহা হইলে তিনি আদেশ দ্বারা নির্দেশ দিতে পারিবেন যে, রাষ্ট্রে শুধু একটা রাজনৈতিক দল (অতঃপর জাতীয় দল নামে অভিহিত) থাকিবে। (২) যখন (১) দফার অধীন কোন আদেশ প্রণীত হইবে, তখন রাষ্ট্রের সকল রাজনৈতিক দল ভাঙ্গিয়া যাইবে এবং রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করিবার জন্য প্রয়ােজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করিবেন। (৩) জাতীয় দলের নামকরণ, কাৰ্যসূচী, সদস্যভুক্তি, সংগঠন, শৃংখলা, অর্থসংস্থান এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কিত সকল বিষয় রাষ্ট্রপতির আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হইবে। (৪)- (৩) দফার অধীন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত
পৃষ্ঠাঃ ২১৬
আদেশ সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত যে কোন ব্যক্তি জাতীয় দলের সদস্য হইবার যােগ্য হইবেন।” আরও উল্লেখ্য যে, উক্ত সংবিধান চতুর্থ সংশােধনীতে নিম্নোক্ত বিধানও সন্নিবেশিত হয়ঃ (ক) এই আইন প্রবর্তনের অব্যবহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকিবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হইবে; (খ) জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হইবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করিবেন এবং উক্ত প্রবর্তন হইতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে। বহাল থাকিবেন যেন তিনি এই আইনের দ্বারা সংশােধিত সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হইয়াছেন।”
১৮। জাতীয় সংসদে সংবিধান চতুর্থ সংশােধন বিল গৃহীত হওয়ার পর প্রদত্ত প্রায় দেড় ঘন্টাব্যাপী সুদীর্ঘ ভাষণে বঙ্গবন্ধু এই পরিবর্তনের পটভূমি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে দাবী করেন যে, এই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। দেশে বিরাজমান নৈরাজ্য এবং রাজনৈতিক উদ্ধৃঙ্খলতার প্রসঙ্গ আলােচনাকালে বঙ্গবন্ধু সংসদকে জানান, “দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, আজ আপনার এই এসেম্বলী বা সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। যাঁদেরকে আগে হত্যা করা হয়েছে তাঁরা এই কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলীর মেম্বার ছিলেন। হত্যা করা হয়েছে গাজী ফজলুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে নূরুল হককে হত্যা করা হয়েছে মােতাহার মাস্টারকে। এমনকি, যা কোনদিন আমাদের দেশে আমরা শুনি নাই যে, নামাজে, (পবিত্র) ঈদের নামাজে (যখন) কোন লােক নামাজ পড়তে যায়, সেই নামাজের সময়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যারা স্বাধীনতার মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁদের হত্যা করা হয়েছে যাঁরা (সুদীর্ঘ) ২৫ বছর পর্যন্ত এই বাংলাদেশে পাকিস্তানী শােষকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কারানির্যাতন ভােগ করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোন একটি রাজনৈতিক দল যাদের আমরা অধিকার দিয়েছিলাম-তাঁরা কোনদিন এদের কনডেম করেছেন কি-না? তাঁরা কনডেম করেন নাই। তারা মুখে বলেছেন যে, তাঁরা অধিকার চান। তাঁরা মিটিং করেছেন, সভা করেছেন, রাজনৈতিক) পার্টি গঠন করেছেন। কিন্তু তারা কি করেছেন? আমাদের সংবিধানে অধিকার দেয়া আছে , ভােটের মাধ্যমে আপনারা সরকার পরিবর্তন করতে পারেন—এই ক্ষমতা আমরা দিয়েছিলাম। বাই-ইলেকশন আমরা তিন মাসের মধ্যে দিয়েছি। জনগণ ভােট না দিলে তার জন্য আমরা দায়ী নই। তখন তাঁরা বলেছিলেন, এই সরকারকে অস্ত্র দিয়ে উৎখাত করতে হবে। মুখে বলেছেন, তাঁরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করেন। কিন্তু গােপনে গােপনে তারা অস্ত্র যােগাড় করেছেন এবং সেই অস্ত্র দিয়ে, যাঁদের কাছ থেকে (আমরা) অস্ত্র নিয়েছি, যাঁরা অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন-তাঁদেরকে হত্যা করেছে ঘরের মধ্য গিয়ে।…আজকে আপনারা জানেন,
পৃষ্ঠাঃ ২১৭
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটা একটা ‘হট বেড অব ইন্টারন্যাশনাল ক্লিকে (পরিণত হয়েছে)। এখানে অর্থ আসে, এখানে মানুষকে পয়সা দেয়া হয়। এখানে তাঁরা বিদেশীদের দালাল হন। আজকে একটা কথা এখানে আমাদের ভুললে চলবে না যে, যে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি, দরকার হলে সেই রক্ত দিয়েই স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে। স্বাধীনতা নস্যাৎ হতে দেয়া হবে না এবং তাদের মনে রাখা দরকার, আমরা যারা দীর্ঘদিন, পচিশ। বছর মাথা নত না করে বাংলার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য, এদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছি, আমাদের রক্ত থাকতে এ দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ক্ষমতা কারাের নেই।”
১৯।…সর্বপ্রকার দুর্নীতিবাজদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি বহুদিন পর্যন্ত বার বার বলেছি। এ বাংলার মাটি থেকে কাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ।” …সংবিধান চতুর্থ সংশােধনী ঘটানাের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “(সংসদের) এই সীটে আমি আর বসবাে না। এটা কম দুঃখ আমার, স্পীকার সাহেব, তবুও আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি শাসনতন্ত্রকে। কারণ দেশে) সুষ্ঠু শাসন কায়েম করতে হবে—যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমােত পারে, যেখানে মানুষ অনাচার-অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারে। (এই) চেষ্টা নতুন—আমি বলতে চাই এটা আমাদের দ্বিতীয় বিপ্লব’। এই বিপ্লবের অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে। এর অর্থ অত্যাচার, অবিচার, নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। আমি চাই, এই হাউজ থেকে স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে দেশবাসী, দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলবাে, দেশকে ভালােবাসুন, জাতির চারটি প্রিন্সিপলস, (যথা) জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সেকুলারিজমকে ভালােবাসুন। আপনারা আসুন, কাজ করুন, (আমাদের দরজা খােলা। সকলকে, যারা এই মতে বিশ্বাস করে তাদের প্রত্যেককে সংগঠিত করুন। আসুন, কাজ করুন, দেশকে রক্ষা করুন, দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোের, চোরাকারবারীদের উৎখাত করুন।”
২০। অতঃপর দেশের স্বাধীনতা বিরােধী (পাকিস্তানপন্থী) ডানতত্ত্ববাদী সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ মৌলবাদী নিষিদ্ধ দলগুলাের কার্যকলাপ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলাম আমরা (যা) কোন দেশে করে নাই। স্পীকার সাহেব, আপনিও তাে ছিলেন। কোন দেশের ইতিহাসে নেই–পড়েন দুনিয়ার ইতিহাস। বিপ্লবের পর বিপ্লবকে বাধা দিয়েছে যারা, শক্রর সঙ্গে সহযােগিতা করেছে যারা, যারা এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের কোন দেশে, কোন যুগে ক্ষমা করে নাই। কিন্তু আমরা করেছিলাম (এদের) সবাইকে ক্ষমা করেছিলাম। (তখন) বলেছিলাম, দেশকে ভালােবাসুন, দেশের জন্য কাজ করুন, (দেশের স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে নিন, থাকুন। কিন্তু তাঁদের অনেকের পরিবর্তন হয় নাই। তারা এখনও গােপনে বিদেশীদের কাছ থেকে পয়সা এনে বাংলার
পৃষ্ঠাঃ ২১৮
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।” ….সংবিধান চতুর্থ সংশােধনীর উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “আজকে এমেন্ডেড কনস্টিটিউশনের মাধ্যমে) যে নতুন সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি এটাও গণতন্ত্র—শােষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভােটাধিকার থাকবে। এখানে আমরা সমাজ করতে চাই। আমাদের শােষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে কোনদিন আসতে পারবে না—আমরা এলাউ করবাে না। বাংলাদেশকে ভালােবাসবাে না, বাংলার মাটিকে ভালােবাসবাে না, বাংলা ভাষাকে ভালােবাসবাে না, বাংলার কালচারকে ভালােবাসবাে না, তা মানবাে না। আর এখন পর্যন্ত, বিকজ (কারণ) আমি ফ্রি স্টাইল দিয়ে দিয়েছিলাম—যার যা ইচ্ছে তাঁরা তা লেখেন, কেউ এই নামে বাংলাদেশকে ডাকেন, ও নামে বাংলাদেশকে ডাকেন। বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত বলতে যাঁরা লজ্জাবােধ করেন, তাঁদের অধিকার নাই বাংলার মাটিতে থাকার। যেমন নাই চোরাকারবারী, ঘুষখােরদের, যেমন নাই দুর্নীতিবাজদের, তেমন নাই ওই সমস্ত সন্ত্রাসবাদী যাঁরা মনে মনে ভুলে যান, ভুলে যান বাংলার মাটি।”
২১।…অতঃপর পরিবর্তিত সংবিধানের অধীনে এবং নতুন ব্যবস্থায় সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার ও মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য কাজ করার উদাত্ত আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, স্পীকার সাহেব, এজন্যে আজ আপনার মাধ্যমে যাঁরা যেখানে আছেন, যাঁরা দেশকে ভালােবাসেন, সকলকে আমি আহবান করবােঃ আসুন দেশ গড়ি, আসুন দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটাই, আসুন আমরা দেশের মানুষের দুঃখ দূর করি। তা না করতে পারলে ইতিহাস আমাদের মুখে কলঙ্ক লেপন করবে।” …এরপর নতুন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে সকলের প্রতি আহবান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমাকে তাঁরা প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন এবং আজকে নতুন সিস্টেমে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। সিস্টেম পরিবর্তন করেই আমরা সাকসেসফুল হতে পারবাে না। যদি আপনারা চেষ্টা না করেন এবং আপনারা যদি নিঃস্বার্থভাবে-যেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলেন, নিঃস্বার্থভাবে পচিশ বছর সংগ্রাম করেছিলেন—সেই সংগ্রাম আপনারা না করেন, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গঠনমূলক কাজে, দেশ গড়ার কাজে, উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে, তাহলে খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি এ অনুরােধ করবোেঃ চলুন আমরা অগ্রসর হই— বিসমিল্লাহ করে আল্লাহর নামে সর হই। ইনশাল্লাহ, আমরা কামিয়াব হবে।” …বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ সমাপ্ত হওয়ার পর জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন। অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়। অতঃপর বঙ্গবন্ধু পরিবর্তিত সংবিধানের অধীনে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন সংসদ কক্ষেই।
২২। ঐ দিন যথারীতি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ বাসায় দুপুরের খাবার খেতে গিয়ে আমি জরুরী ভিত্তিতে মধ্যাহ্ন সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় সংবিধান চতুর্থ সংশােধনীর বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারি। বঙ্গবন্ধু সেদিন দুপুরে বাসায় খেতে এলেন
পৃষ্ঠাঃ ২১৯
আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যা রাফিয়া আখতার ডলী ও হাসিনা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এক পর্যায়ে আমি রাফিয়া আখতার ডলীকে প্রশ্ন করে বসি, “আপনারা এটা কি করলেন?” আমার প্রশ্নের জবাবে রাফিয়া আখতার ডলী বললেন, “আমরা বঙ্গবন্ধুর অনুগত ও বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে তাঁর পেশকৃত প্রস্তাব অনুমােদন করেছি। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত মতামত, চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত করার প্রশ্নই ওঠে না।”
২৩। সেদিন অফিসের কাজকর্ম শেষে আমি সােজাসুজি বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে। বাসার দোতলায় উঠে দেখি যে, শাশুড়ী ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে রেহানা ও রাসেলকে রূঢ়ভাবে বকাবকি করছেন। এক পর্যায়ে রেহানা ও রাসেলকে উদ্দেশ্য করে শাশুড়ী বলেন, “তােদের আচার-আচরণ ও মেজাজ তাে এখন এরকম হবেই। কারণ তােরা তাে এখন পে-সিডেন্টের ছেলে-মেয়ে।” শাশুড়ী প্রেসিডেন্ট” শব্দটি ইচ্ছাকৃতভাবেই বিকৃত করে উচ্চারণ করলেন বলে আমার মনে হলাে। উক্ত কথাগুলাে বলতে বলতেই শাশুড়ী রাসেলের খেলনার জিনিসপত্রে ভর্তি বাক্সটি ঘরের বাইরে ফেলে দেন। আমি তখন সেখানে দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলাম শুধু কোন কিছু বলার সাহস পেলাম না। বরঞ্চ, শাশুড়ীর এহেন আচরণ দেখে আমি কিছুটা হতভম্ভ ও বিস্মিত হলাম। কারণ আমি শাশুড়ীকে ইতিপূর্বে কখনও তাঁর ছেলেমেয়েদের কাউকে এরকম কুদ্ধ ও রূঢ়ভাবে বকাবকি করতে দেখিনি। সেদিন বঙ্গবন্ধু বাসায় ফেরেন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার দিকে। তার সঙ্গে দোতলায় উঠে আসেন জাতীয় সংসদ ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন মধ্যবয়সী ও তরুণ সদস্য। বঙ্গবন্ধু হাতমুখ ধুয়ে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখার জন্যে তাঁর শয়ণকক্ষের সামনের লবিতে এসে বসতে না বসতেই শাশুড়ী তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সংবিধানের এত ব্যাপক পরিবর্তন, বিশেষ করে একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করবে সে সম্পর্কে তুমি আমাকে একটুও আভাস দেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করলে না। আর তােমার তক্ষুণি সংসদকক্ষেই দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার কি প্রয়ােজন ছিল? দু’চার দিন দেরী করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতাে? যাহােক, স্পষ্ট বলে রাখছি যে, আমি এ বাড়ী ছেড়ে তােমার সরকারী রাষ্ট্রপতি ভবনে যাচ্ছি না।” শাশুড়ীর এই কথাগুলাে বলার সময় বঙ্গবন্ধু মিটমিট করে হাসছিলেন। অতঃপর শাশুড়ীর প্রশ্নগুলাের কোন উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন, “আমি রাষ্ট্রীয় বিষয়ে তােমাকে সবকিছু বলতে পারি না।”
২৪। সে রাতে হাসিনা ও ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে আমি একটু তাড়াতাড়িই আমাদের বাসায় চলে আসি। অতঃপর আমি হাসিনাকে সংবিধান চতুর্থ সংশােধনী, বিশেষ করে এক দলীয় রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন সংক্রান্ত বিধি-বিধান সংবিধানে সন্নিবেশিত করার ফলাফল এবং পরিণতি সম্পর্কে বােঝানাের চেষ্টা করি। আমি হাসিনাকে বললাম, “বঙ্গবন্ধু দেশের জনগণ ও বিদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকট পরিচিত একজন জাতীয়তাবাদী, গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেই।
পৃষ্ঠাঃ ২২০
তিনি জাপানসহ পাশ্চাত্যের উন্নত, ধনী ও গণতান্ত্রিক দেশগুলাের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে এত সম্মান, মর্যাদা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন অনেকটা তাঁর এসব গুণাবলী ও রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্যেই। অতএব একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হলে বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শ সম্পর্কে এ সমস্ত দেশের নেতা ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে শুধু বিভ্রান্তিই সৃষ্টি হবে না, তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে মারাত্মকভাবে। এর ফলে এ সমস্ত দেশের সরকার ও দাতাসংস্থাগুলাে বঙ্গবন্ধু সরকারকে অর্থ , প্রযুক্তি ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সাহায্যে শুধু ইতঃস্ততই করবে না, এদের কেউ কেউ তা একেবারে বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণসহ পানিসম্পদ উন্নয়ন ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিখাতে যথাযথ উৎপাদন বৃদ্ধি করে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং দেশের শিল্পায়ন ও অন্যান্য সমস্যা মােকাবেলা করার জন্যে জাপানসহ পাশ্চাত্যের সহযােগিতা, অনুদান ও সাহায্য একান্ত প্রয়ােজন। সুতরাং দেশের তথা বঙ্গবন্ধুর সার্বিক স্বার্থেই এবং দেশের একজন সচেতন, শুভাকাঙক্ষী ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমার তােমাদের সকলকে জানানাে প্রয়ােজন বলে মনে করি যে, তাঁর দেশে এক দলীয় রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা কোনমতেই সমীচীন, যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত হবে না। কাজেই সংবিধান চতুর্থ সংশােধনী সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর উচিৎ হবে দেশে একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন সংক্রান্ত প্রয়ােজনীয় রাষ্ট্রপতির আদেশ জারি না করা।” সে রাতে মনে হলাে যে, হাসিনা আমার এই কথাগুলাে গভীর মনােযােগ ও গুরুত্ব সহকারে শুনলাে।
২৫। পরদিন অতি প্রত্যুষে হাসিনা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় চলে যায়। মাত্র আধা ঘন্টা পরেই হাসিনা হন্তদন্ত অবস্থায় আমাদের বাসায় ফিরে এসে বলে, “তুমি গতরাতে যেসব কথা বলেছিলে তা এতক্ষণ আব্বাকে বিস্তারিতভাবে বললাম। আব্ব সবকিছু চুপচাপ শুনলেন এবং কিছুক্ষণ গভীর চিন্তা-ভাবনা করে তােমাকে জানানাের জন্যে বললেন যে, দেশের এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা শুধু স্বল্পকালের জন্য। আব্ব আরও বলেছেন যে, তুমি যেন এ ব্যাপারে অযথা উত্তেজিত না হও এবং দুশ্চিন্তা না করাে। আবার এই কথাগুলাে যেন কারােরও কাছে জানাজানি না হয়ে যায় সে জন্য তিনি তােমাকে সর্বদা সংযত ও হুশিয়ার থাকতে বলেছেন অন্যের সঙ্গে তােমার কথাবার্তায়।”
২৬। ২৬শে জানুয়ারী অর্থাৎ তাঁর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন বিকালে বঙ্গবন্ধু ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি ১৭ সদস্যবিশিষ্ট নতুন মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। এই মন্ত্রী পরিষদে আওয়ামী লীগের খন্দকার মােশতাক আহমদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছাড়াও দু’জন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ডঃ মােজাফফর আহমদ চৌধুরী ও ডঃ এ. আর. মল্লিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহ উক্ত মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন
পৃষ্ঠাঃ ২২১
এবং তাঁকে ভূমি সংস্কার ও প্রশাসন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিলাে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, উক্ত মন্ত্রী পরিষদে তাজউদ্দিন আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
২৭। ২৬শে জানুয়ারী (১৯৭৫) তারিখে গ্রেফতার হন মাওবাদী চরমপন্থী নেতা ক্যাপ্টেন আলতাফ। ২৭শে জানুয়ারী বঙ্গবন্ধুর সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি পৃথক জেলায় বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১লা ফেব্রুয়ারী তারিখে পশ্চিম ইউরােপের ইউরােপীয় অর্থনৈতিক কমিউনিটি বাংলাদেশের জন্য ১ লাখ টন খাদ্যশস্য প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখে আওয়ামী লীগের জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনূল হােসেন সংবিধান চতুর্থ সংশােধনীর প্রতিবাদে জাতীয় সংসদ সদস্যের পদ থেকে ইস্তফা প্রদান করেন।
২৮। ১২ই ফেব্রুয়ারী আশুগঞ্জ সার কারখানা প্রতিষ্ঠায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বাংলাদেশকে ২২ কোটি টাকার প্রকল্প ঋণ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। ১৪ই ফেব্রুয়ারী পল্লী কবি জসীমউদ্দিন সংবিধান চতুর্থ সংশােধনীর প্রতিবাদে বাংলা একাডেমী প্রদত্ত সম্মান পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারী খুলনার দৌলতপুরের ৪টি পাটগুদাম দুষ্কৃতকারীদের কারসাজিতে অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের তাঁদের স্ব স্ব ব্যক্তিগত বিষয়সম্পত্তির হিসাব দাখিল করার জন্যে প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন।
২৯। ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহের গােড়ার দিকে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সীর সঙ্গে পত্রালাপে চূড়ান্তভাবে স্থির করা হয় যে, আমি (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানী কার্লসরুয়েস্থ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে পােস্ট ডক্টরাল কাজের উদ্দেশ্যে ১২ই মার্চ তারিখে বাংলাদেশ ত্যাগ করবাে। তখন যে কোন সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত কিংবা দাপ্তরিক যে কোন ব্যাপারে বিদেশে যাওয়ার জন্যে সরকারের পূর্বানুমতি গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক ছিল। একদিন আমার জার্মানী যাওয়ার ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধুকে জানালে তিনি একটু চিন্তা করে বলেন, ‘কাজের জন্যে তােমাকে অবশ্যই যেতে হবে। কিন্তু হাসিনাকে সঙ্গে নিতে পারবে না। কারণ এক বছর দেশের বাইরে থাকলে ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা বিঘ্নিত হবে। অতএব আপাততঃ তুমি একাই চলে যাও। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমি জ্যামাইকার কিংস্টনে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের জন্যে বিদেশ যাওয়ার সময় হাসিনা ও তােমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে পথে তােমার ওখানে রেখে যাবাে। অতঃপর মাস দুয়েক তােমার সঙ্গে কাটিয়ে ওরা দেশে ফিরে আসবে। এর ফলে একদিকে যেমন হাসিনার লেখাপড়ার বিশেষ ব্যাঘাত হবে না অপরদিকে তেমনি তােমার ছেলেমেয়েদের খুব বেশী দিন আমাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে না। যাহােক, তুমি তাে জানােই তােমার জয় ও পুলিকে না দেখে তােমার শাশুড়ী একদিনও স্থির থাকতে
পৃষ্ঠাঃ ২২২
পারে না।” উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালে হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এম, এ, ক্লাসের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিল।
৩০। ২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মােজাফফর) একীভূত হয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। অতঃপর বঙ্গবন্ধুকে এই দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি সংবিধান চতুর্থ সংশােধনীর বিধি বিধান অনুযায়ী এই দলকে ‘জাতীয় দল বলে আখ্যায়িত করে একটি আদেশ জারি করেন। ‘জাতীয় দল গঠিত হওয়ার ফলে দেশের অন্যান্য সব রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটে। আওয়ামী লীগ, কমরেড মণি সিং-এর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ-এর সদস্যগণ সামগ্রিকভাবে ‘বাকশালে’ যােগদান করেন। ব্যক্তিগতভাবে এবং গ্রুপ ভিত্তিতেও বিভিন্ন মহলও ‘বাকশালে’ যােগদানের জন্য এগিয়ে আসে। পরবর্তীতে জাতীয় সংসদের ৮ জন বিরােধী সদস্যের ৪ জন প্রবীণ নেতা জনাব আতাউর রহমান খান, জনাব আবদুল সাত্তার, মিস্টার খােয়াই বেয়ােজর এবং সৈয়দ কামরুল ইসলাম মােহাম্মদ সালাউদ্দিন ‘বাকশালে’ যােগদান করেন।
৩১। ৫ই মার্চ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এজেন্সী (আই, ডি, এ) বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীতে ১২ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। বাংলাদেশের আশুগঞ্জ সার কারখানা প্রকল্পের জন্যে আই. ডি. এ. পৃথকভাবে ২৪ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জর করে। ৬ই মার্চ রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু ঢাকার রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্থায়ী নতুন ভবনের উদ্বোধন করেন। ১২ই মার্চ আই. ডি. এ. বাংলাদেশের কয়েকটি কর্মসূচীতে আড়াই কোটি ডলার ঋণ মঞ্জুর করে।
৩২। ১২ই মার্চ বিকেল চারটার দিকে আমি (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। প্রথমে ঢাকা থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে দিল্লীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। ইতিপূর্বে সুইডেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব এ. রাজ্জাকে সঙ্গে পরিচয় হয় বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন পশ্চিম ইউরােপীয় দেশগুলাের বিষয়াদি সম্পর্কিত বিভাগের মহাপরিচালক জনাব রেজাউল করিমের অফিসে। সেদিন তিনিও একই ফ্লাইটে দিল্লী যাচ্ছিলেন। দিল্লী থেকে তিনি তখন তেহরান হয়ে সুইডেনের রাজধানী স্টকহমে ফেরার জন্য বন্দোবস্ত করেছিলেন। প্লেনটি সেদিন প্রায় ফাঁকা ছিলাে। পরবর্তীতে, আমি তাঁর পাশের সীটে গিয়ে বসি। কুশলাদি বিনিময় এবং এটাসেটার ব্যাপারে আলাপের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে জনাব রাজ্জাক আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ডঃ ওয়াজেদ, পাশ্চাত্য দেশগুলাের সাংবাদিকরা বঙ্গবন্ধুর দেশে একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে নানান ধরণের প্রশ্ন করেন। বিশেষ করে, তারা এই একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের আসল কারণ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে
পৃষ্ঠাঃ ২২৩
তথ্য জানতে চান। আমি বিশেষ সদুত্তর দিতে পারিনি। তাই ঢাকা এসেছিলাম এ ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে যথাযথ ব্রীফ নিতে।” অতঃপর তিনি জানতে চান যে, আমার এবিষয়ে কোন তথ্য জানা আছে কি না। তখন আমি তাঁর কাছে বঙ্গবন্ধু হাসিনাকে এব্যাপারে যেসব কথা বলেছিলেন তার পুনরুল্লেখ করে বলি যে, এর বেশি আমার আর কিছু জানা নেই। নয়াদিল্লী পৌছে তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব এ. এইচ. এস. আতাউল করিমের বাসস্থানে চলে যান তাঁর পরবর্তী ফ্লাইটের সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্যে। সেখানেও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টি প্রসঙ্গক্রমে উত্থাপিত হয়। ইতিপূর্বে আমি জনাব রাজ্জাককে এব্যাপারে যে কথা বলেছিলাম সেখানেও তার পুনরুল্লেখ করি। অতঃপর রাত বারােটার দিকে তাঁরা দুজনে আমাকে নয়াদিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে পৌছে দেন।
৩৩। লুফথানসার ফ্লাইটে আমি (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানীর ফ্লাহফুর্টে পৌছাই ১৩ই মার্চ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে। ইতিপূর্বে আমি কালরুয়েস্থ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে তখন কর্মরত আমার সহকর্মী ডঃ সৈয়দ রেজা হােসেনকে আমার জার্মানী পৌছানাের সময়সূচী সম্পর্কে অবহিত করেছিলাম। ডঃ ব্লেজা হােসেন সেখানে প্রশিক্ষণরত আমাদের কনিষ্ঠ সহকর্মী জনাব আমিরুল ইসলামকে নিয়ে ফ্লাহ্ফুর্ট বিমান বন্দরে এসেছিলেন আমাকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্যে। তাঁরা ছাড়াও, আমাকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্যে ফ্লার্ট বিমান বন্দরে গাড়ী নিয়ে এসেছিলেন পশ্চিম জার্মানীতে বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন সেকেন্ড সেক্রেটারী জনাব আমজাদুল হক। যাহােক, সকলে মিলে তাঁরা আমাকে কার্লরুয়ে পৌছে দেন। ঐ দিনই সকাল এগারােটার দিকে আমাকে অফিসের গাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয় কার্লরুয়ে শহর থেকে ২০ কিলােমিটার দূরে জার্মানীর প্রসিদ্ধ ব্ল্যাক ফরেস্টের কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত আমার জন্যে নির্ধারিত কর্মস্থল কার্লরুয়ে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে। প্রথমে উক্ত কেন্দ্রের প্রশাসনিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিভাগের পরিচালক ডঃ এইচ. জে. লাওয়ের অফিসে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানের দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমাকে নেওয়া হয় আমার কর্মস্থল হিসেবে নির্ধারিত উক্ত কেন্দ্রের নিউটন ফিজিক্স ও পরমাণু চুল্পী বিষয়ক ইন্সটিটিউটে। এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং ডেপুটি পরিচালক ছিলেন যথাক্রমে অধ্যাপক ডঃ কে হর্টিজ(Writz) ও মিস্টার কুখলে(Kuchle)। তাঁদের দু’জনের সঙ্গে আমার সেখানের গবেষণার কর্মসূচী নিয়ে আলােচনা হয়। তাঁদের সঙ্গে আলাপের সময় আমি জানতে পারি যে, তাঁরা দুজনেই ইতিপূর্বেই অবহিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা। আমার জন্যে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কার্লরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে। কার্লরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্লরুয়ে শহরের বিরাট এলাকাবিশিষ্ট একটি পুরাতন প্রাসাদ চত্বরের এক কোণায় অবস্থিত। ঐ প্রাসাদ চত্বরে রয়েছে
পৃষ্ঠাঃ ২২৪
ফুলের বাগান, লেক, গৰু ফিল্ড, নার্সারী এবং মনােরম ফরেস্ট। এক কথায় প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য ও সৌন্দর্যে ভরা ঐ প্রাসাদ চত্বর।
৩৪। (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানী পৌছার পর থেকেই সেদেশের রাজধানী বনস্থ বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে আমাকে নিয়মিত একটি ইংরেজী পত্রিকা সরবরাহ করা হতাে। পত্রিকার মাধ্যমে নিয়মিত বাংলাদেশের খবরাখবর পেতাম। ১৩ই মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদ সদস্যদের তাঁদের স্ব স্ব বিষয়-সম্পত্তির হিসাব দাখিলের জন্যে নির্দেশ প্রদান করেন। ১৬ই মার্চ (১৯৭৫) তারিখে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে দুষ্কৃতকারীদের বােমাবাজিতে ১ জন নিহত এবং ১২ জন আহত হয়। ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর সরকার বাংলাদেশের ৩৯ জন আদর্শ কৃষককে পুরস্কার প্রদান করে। ১৮ই মার্চ বাংলাদেশ, জাপান, কুয়েত ও সুইডেন থেকে মােট ৬২ কোটি টাকার ঋণ সাহায্য লাভ করে। ২০শে মার্চ তারিখে কতিপয় সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী মেহেরপুর ট্রেজারী লুট করে এবং তাতে অগ্নিসংযােগ করে। একই তারিখে সৈয়দপুরে এগারাে মেগাওয়াট শক্তির বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন করা হয়। ২২শে মার্চ তারিখে মাওবাদী চরম বামপন্থী নেতা আলাউদ্দিন আহমদ গ্রেফতার হন।
৩৫। ২৬শে মার্চ (১৯৭৫) তারিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়ােজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের বেশ কিছু স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী ও কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। প্রায় সােয়া ঘন্টাব্যাপী সুদীর্ঘ ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “…একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের দেশে প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লােক বাড়ে। আমার দেশের) জায়গা হলাে (মাত্র) ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি আমাদের দেশে প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ (লােক) বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলায় কোন জমি থাকবে না চাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সেজন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হলাে তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর হলাে, দুর্নীতিবাজ খতম করুন, দুই নম্বর হলাে (কল) কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে প্রােডাকশন বাড়ান, তিন নম্বর পপুলেশন প্লানিং আর চার নম্বর হলাে, জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্যে একদল (গঠন) করা হয়েছে। যাঁরা বাংলাকে ভালােবাসেন, এর আদর্শে বিশ্বাস করেন, চারটি রাষ্ট্রীয় (মূল) আদর্শ মানেন, সৎপথে চলেন, তাঁরা সকলেই এই (জাতীয়) দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশী এজেন্ট, যাঁরা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেন, এতে তাদের স্থান নাই। সরকারী কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবেন, কারণ তাঁরাও এই জাতির একটা অংশ। তাঁদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এই জন্য সকলে যে যেখানে আছেন একতাবদ্ধ হয়ে কাজে লাগতে হবে।” অতঃপর একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় দলের সাংগঠনিক কাঠামাের সম্ভাব্য রূপরেখা বর্ণনা করে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই জাতীয় দলের আপাততঃ ৫টা ব্রাঞ্চ থাকবে। একটা
পৃষ্ঠাঃ ২২৫
শ্রমিক ভাইদের অংগদল, কৃষক ভাইদের একটা, যুবক ভাইদের একটা, ছাত্রদের একটা এবং মহিলাদের একটা। এই পাঁচটা অংগদল মিলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। আমাকে অনেকে বলেন, কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ হলে আমাদের কি হবে। আমি বলি, আওয়ামী মানে তাে জনগণ, (তাই) ছাত্র, যুবক, শিক্ষিত সমাজ, সরকারী কর্মচারী, সকলে মিলে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ।”
৩৬।….নতুন রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থায় ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ও কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু বলেন, “সমাজ ব্যবস্থায় যেন ঘুণ ধরে গেছে। এই সমাজের প্রতি চরম আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানীদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আমি আপনাদের সমর্থন চাই। আমি জানি, আপনাদের সমর্থন আছে। কিন্তু একটা কথা-এই যে নতুন সিস্টেমে যেতে যাচ্ছি, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ কা হবে—ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেবাে না। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাবাে—তা নয়। পাঁচ বছরের প্ল্যান—এ বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিতে জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু যে বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ, যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে কোঅপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ফার্টিলাইজার যাবে তাদের কাছে, টেস্ট রিলিফ যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রােগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলের টাউটদেরকে বিদায় দেয়া হবে। তা না হলে, দেশকে বাঁচানাে যাবে না। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘােষণা করছি যে, পাঁচ বছরের প্ল্যানে প্রত্যেকটি গ্রামে পাঁচশত থেকে (এক) হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত কম্পলসারী কো-অপারেটিভ সদস্য হবেন। আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, (কিছু অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হাতে (আর বাকী) অংশ যাবে গভর্নমেন্টের হাতে। দ্বিতীয়তঃ থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারী কর্মচারী যেই হােক, একজন তার চেয়ারম্যান হবেন। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারী কর্মচারী। তার মধ্যে আমাদের কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুবক প্রতিনিধি থাকবে, ব্যাংক প্রতিনিধি থাকবে—তারাই থানাকে চালাবে। আর জেলা থাকবে না—সমস্ত মহকুমা জেলা হয়ে যাবে। সেই মহকুমায় একটি করে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে। তার চেয়ারম্যান থাকবে। সব কর্মচারী এক সঙ্গে তার মধ্যে থাকবে। এর মধ্যে পিউপিলস্ রিপ্রেজেনটেশন থাকবে। পার্টি রিপ্রেজেনটেশন থাকবে। সেখানে তাঁরা সরকার চালাবেন। এইভাবে আমি একটা সিস্টেমের চিন্তা করছি এবং করবাে বলে ইনশাআল্লাহ আমি ঠিক করেছি। আপনাদের সাহায্য ও সহযােগিতা চাই।”
৩৭।…নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের রূপরেখা উল্লেখ করে উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “আর একটা কথা বলতে চাই, বিচার। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা)
পৃষ্ঠাঃ ২২৬
ইংরেজ আমলের বিচার ব্যবস্থা)। আল্লাহর মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে, সেই মামলা শেষ হতে লাগে প্রায় ২০ বছর। আমি যদি উকিল হই, আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে কেস দিয়ে যাই। ঐ মামলার ফয়সালা হয় না। আর যদি ক্রিমিন্যাল কেস হয়, চার তিন বছরের আগে শেষ হয় না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে এমন করতে হবে যে, থানায় ট্রাইব্যুনাল করার ব্যবস্থা থাকবে) এবং সেখানে মানুষ এক বছর বা দেড় বছরের মধ্যে বিচার পাবে।”
৩৮। ২৮শে মার্চ তারিখে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যে ৩০ কোটি টাকার পণ্য বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৯শে মার্চ বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশের জন্য সাড়ে ১৫ লাখ মণ খাদ্যশস্য মঞ্জুর করে। ৩০শে মার্চ তারিখে হাসিনা আমাকে ফোনে জানায় যে, বঙ্গবন্ধুর আব্বা শেখ লুৎফর রহমান ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। ১২ই মার্চ তারিখে আমার জার্মানী যাত্রার দিনে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় ছিলেন। আমার শাশুড়ী সে সময় তাঁর নিরতিশয় সেবাশুশ্রুষা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আত্বার সঙ্গে আমার শাশুড়ীর (তাঁর বিয়ের পূর্বে) চাচার সম্পর্ক ছিল। ১৯৬৭ সালে হাসিনার সঙ্গে আমার বিয়ের পর দাদা আমার কাছে কতাে না মজার মজার গল্প বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শৈশবকাল, শিক্ষাকাল, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ভূমিকা ও তৎসময়ে কারাবরণ এবং রাজনৈতিক জীবনের বহু ঘটনা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর আব্বা আমাকে অনেক তথ্য দিয়েছিলেন। ঐ সব ঘটনার কথা সেদিন বারংবার মনে হয়।
৩৯। ১লা এপ্রিল তারিখে দু’দেশের সমুদ্রসীমানা নির্ধারণের প্রশ্নে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের পররাষ্টবিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেন এবং ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ওয়াই. বি. চ্যবনের মধ্যে আলাপ-আলােচনা বৈঠক। ৩রা এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের গুপ্ত সশস্ত্র সমাজবিরােধীদের প্রতি ১৫ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণের জন্য নির্দেশ দেন। ৫ই এপ্রিল তারিখে কুমিল্লার পালপাড়া খেয়াঘাটে স্টেনগানসহ তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। ৬ই এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে একশত টাকার নােট অচল ঘােষণা করে। ৮ই এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার অচল টাকার নােট জমা গ্রহণে কারচুপির অভিযােগে ৪ জন ব্যাংক ম্যানেজারসহ ১৬ ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে চাকুরী থেকে অপসারণ করে। ১৪ই এপ্রিল কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কারসাজিতে ক্রিসেন্ট জুটমিলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং এতে বিপুল সম্পদ বিনষ্ট হয়। ১৬ই এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন সম্পর্কিত একটি অধ্যাদেশ জারি করে।
৪০। ১৬ই এপ্রিল (১৯৭৫) তারিখে ঢাকায় ভারতের ফারাক্কা বাঁধ প্রশ্নে শুরু হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের আলাপ-আলােচনা বৈঠক। ১৮ই এপ্রিল তারিখে গঙ্গা নদীতে ভারতের ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির শর্তানুসারে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা নদীর ৫৫
পৃষ্ঠাঃ ২২৭
হাজার কিউসেক পানির মধ্যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশের জন্য সুনিশ্চিত করে ভারতকে মাত্র ১১ হাজার কিউসেক পানি ফারাক্কা বাঁধ হতে প্রত্যাহার করার অনুমতি প্রদান করা হয়।
৪১। ১৯শে এপ্রিল সরকার বাংলাদেশের দুটো সংবাদ সংস্থা বি. এস. এস. ও বি. পি. আই.-কে একত্রীভূত করে। ২১শে এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তব্যে অবহেলার দায়ে মাগুরার লাংগলবাঁধ ফাঁড়ির সকল পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ২৫শে এপ্রিল তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি অধ্যাদেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক জাতীয় শিক্ষা কাউন্সিল গঠন করে।
৪২। ইতিপূর্বে হাসিনা আমাকে ফোনে জানায় যে, বঙ্গবন্ধু ২৬শে এপ্রিল জ্যামাইকার কিংস্টনে ২৯শে এপ্রিল থেকে ৬ই মে অনুষ্ঠেয় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানীর ফ্রাংফুর্ট বিমান বন্দরে কিছু সময়ের জন্য যাত্রা বিরতি করবেন। ঐ সুযােগে বঙ্গবন্ধু আমাদের শিশু জয় ও পুতলীসহ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে আসার কথা ছিল। আমি সেই মােতাবেক ফ্রাংফুর্ট শহরে পৌছাই ২৬শে এপ্রিল সকালে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দাপ্তরিক ব্যাপারে সাক্ষাৎ করার জন্যে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলােতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতবর্গ। পশ্চিম জার্মানীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী ও তাঁর অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তখন তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারি যে, বাংলাদেশ বিমানের একমাত্র বােয়িং বিমানটি আগের দিন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী বিমানবন্দরে আটকে পড়ায় বঙ্গবন্ধু পরদিন সকালে ফ্রাফুর্ট পৌছাবেন জার্মানীর লুফথানসার একটি ফ্লাইটে।
৪৩। অতঃপর বঙ্গবন্ধু ফ্রাংফুর্ট বিমান বন্দরে পৌছান ২৭শে এপ্রিল সকালে। এর কিছু সময় পর তিনি লুফথানসার অপর একটি ফ্লাইটে জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন বিধায় তাঁর জন্য উক্ত বিমানবন্দরের ভি.ভি.আই.পি লাউঞ্জেই ব্যবস্থা রাখা হয়। উক্ত লাউঞ্জে গিয়ে অবগত হই যে, হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসেনি। মনে মনে আমি একটু ক্ষুব্ধ হই। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গীর একজন আমাকে একজন সুন্দরী তরুণীর একটি বড় আকারের ফটো প্রদান করে জানিয়ে ছিলেন যে, উক্ত মেয়েটির সঙ্গে শেখ কামালের বিবাহ স্থির হয়েছে। মেয়েটির নাম সুলতানা খুকী। ওর আব্বা দবিরউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগের প্রধান ছিলেন। যাহােক, কুশলাদি বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আব্বা তাঁর মৃত্যুর একদিন আগে বংশের বড় নাতী-বৌ দেখার ইচ্ছা ব্যক্ত করায় অত্যন্ত তড়িঘড়িতে কামালের বিয়ে স্থির করতে হয়। এর পরদিন আব্বা ইন্তেকাল করেন। বিবাহ অনুষ্ঠান আগামী জুলাই মাসের কোন এক তারিখে আয়ােজন করা হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্যে ঐ সময় তােমাকে অবশ্যই ঢাকায় যেতে হবে। ঐ
পৃষ্ঠাঃ ২২৮
অনুষ্ঠানের পর তুমি নিজেই হাসিনা ও তােমার ছেলেমেয়েদেরকে সঙ্গে করে জার্মানী নিয়ে আসবে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসে আমার পােল্যান্ড ও পশ্চিম জার্মানী সফরে আসার কর্মসূচী রয়েছে। সুতরাং ঐ সময়ে হাসিনারা আমার সঙ্গে ঢাকায় ফিরে যাবে।” অতঃপর কামালের বউকে আমার পছন্দ হয়েছে কি না বঙ্গবন্ধুর এই প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, “কামালের সঙ্গে খুকীর খুব ভাল মানাবে”। এর একটু পর আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম যে, জার্মানীর যে পরমাণু গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আমি কর্মরত রয়েছি তার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে জানিয়েছেন যে, উক্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের সঙ্গে পারস্পরিক সাহায্যসহযােগিতার চুক্তি সম্পাদন করার জন্য আগ্রহশীল। আমার এই কথার জবাবে বঙ্গবন্ধ বললেন, “মে মাসের ৮/৯ তারিখে আমি জ্যামাইকা থেকে লন্ডনে পৌছাবাে। তুমি প্রস্তাবিত সহযােগিতা চুক্তির খসড়া নিয়ে ঐ তারিখে লন্ডনে আমার সঙ্গে বিস্তারিতভাবে কথা বলাে”। অতঃপর বঙ্গবন্ধু সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতবর্গকে তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করার জন্যে ডেকে পাঠান।
৪৪। ঐ দিন বঙ্গবন্ধুর জ্যামাইকার উদ্দেশ্যে ফ্রাংকফুর্ট ত্যাগ করার পর সেখানের হােটেলের হমায়ুন রশিদ চৌধুরীর কক্ষে পশ্চিম ইউরােপের অন্যান্য দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতগণ সমবেত হন। এটা-সেটা বিষয়ে কথাবার্তার পর তাঁরা সবাই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে এক দলীয় রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণ সম্পর্কে আমার কাছ থেকে জানতে চান। আমি পূর্বের মতাে ঐসম্পর্কে বঙ্গবন্ধু হাসিনাকে যে সব কথা বলেছিলেন তা তখন পূর্বাপর উল্লেখ করি। তাঁরা আমার কথাগুলাে গভীর মনােযােগে শােনেন। অতঃপর তাঁরা শুধু একটু মাথা নাড়লেন, কিন্তু কোন কিছুই বললেন না।
৪৫। ৩০শে এপ্রিল তারিখে ফেনীতে ১৩২ কে, ভি. গ্রীড স্টেশনের উদ্বোধন করা হয়। ৩রা মে তারিখে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকার বাংলাদেশের জয়দেবপুরস্থ নির্মাণাধীন মেশিন টুলস কারখানার জন্যে এক কোটি ডলার সাহায্য প্রদানের প্রস্তাব করে। ৬ই মে তারিখে কুষ্টিয়া-কুমারখালী ৩৩ কিলােভােন্ট ট্রান্সমিশন লাইনের উদ্বোধন করা হয়।
৪৬। ৮/৯ই মে তারিখে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে আমি লন্ডন পৌছাই ৬ই মে সকালে। লন্ডনের রেলওয়ে স্টেশনে পৌছেই আমি সেখানের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর নূরুল মােমেন খান, মিহির ভাইকে ফোন করি। তিনি আমাকে সােজা তাঁর বাসায় চলে আসতে বলেন। অতঃপর একটি ট্যাক্সি করে আমি তাঁর ফিঞ্চলী এলাকার গ্যানভিল রােডস্থ বাসায় গিয়ে উঠি। সেদিনটি ছিল রােববার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পরদিন, অর্থাৎ ৭ই মে মিহির ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর অফিসে যাই। সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের হাই কমিশনার সৈয়দ আব্দুস সুলতান এবং ডেপুটি হাই কমিশনার ফারুক আহমদ চৌধুরীর সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে আমার সাক্ষাৎকার হয়। তাঁরা দুজনেই আমার কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণ সম্পর্কে
পৃষ্ঠাঃ ২২৯ জানতে চান। আমি আগের মতােই তৎসম্পর্কে হাসিনাকে বলা বঙ্গবন্ধুর কথাগুলাে পূর্বাপর উল্লেখ করে বললাম যে, এটা হয়তাে স্বল্পকালীন ব্যবস্থা মাত্র। কারণ আর একটা রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পুনরায় বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারেন। এর জন্যে সংসদের নতুন করে অনুমােদন নেওয়ার প্রয়ােজন নেই। তাঁরা দুজনেই আমাকে বলেছিলেন, ” Let us hope so।”
৪৭। পরদিন, অর্থাৎ ৮ই মে সকালে শেখ জামাল মিহির ভাইয়ের বাসায় আসে দুটো সুটকেস সঙ্গে নিয়ে। এর আগে মিহির তাই আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশে এখন আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি যা, তাতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। জামাল স্যানহান্ঠে সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন প্রশিক্ষণ কোর্স সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেছে। আমি ওকে বলেছিলাম যে, ওর উচিৎ হবে আর এক বছর সেখানে থেকে পােস্ট-গ্র্যাজুয়েশন প্রশিক্ষণ কোর্সটিও শেষ করা। এর জন্যে শেখ নাসের (বঙ্গবন্ধুর ছােট ভাই) সাহেব আমাদের হাই কমিশনারের নিকট প্রয়ােজনীয় টাকা পয়সা জমা রেখেছেন। কিন্তু জামাল আমার কথা কিছুতেই শােনে না। সে অতি শিগগির দেশে ফেরার জন্যে ওর মালপত্র নিয়ে আসবে। আপনাকে যেভাবেই হােক জামালকে আর এক বছর স্যানহান্ঠে থাকার জন্য সম্মত করাতে হবে। স্যানহারে উক্ত প্রশিক্ষণ কোর্সটি শুরু হয় আগষ্টের ১লা তারিখ থেকে। জুলাই মাসে শেখ কামালের বিবাহ অনুষ্ঠান শেষে জামাল লন্ডন চলে আসতে পারে।”
৪৮। সেদিন মিহির ভাইয়ের কথাগুলাে জামালকে বলে আমি আরও উল্লেখ করি যে, আমিও জার্মানীতে পােস্টডক্টরাল কাজ করছি। সুতরাং স্যানহাষ্টে পােস্ট-গ্র্যাজুয়েশন প্রশিক্ষণ কোর্সটি সম্পন্ন করলে তা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর : চাকুরীতে পদোন্নতির ব্যাপারে অনেক সহায়ক হবে। জামাল আমার কথাগুলাে গুরুত্ব সহকারে শুনে বলে, “দুলাভাই, আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মত তবে আমার একটি শর্ত আছে। আপনি যদি আপনার সেই সহকর্মীর মেয়ের সঙ্গে আমার বিবাহের বন্দোবস্ত করার আশ্বাস দেন তাহলে আপনার প্রস্তাব আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেবাে।” এর উত্তরে আমি জামালকে জানাই, “আমি ইতিপূর্বে জার্মানীর হ্যানােভার শহরে যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম তখন সেখানে স্বামীর সঙ্গে অবস্থানরত আমার উক্ত সহকর্মীর মেয়ের খালাতাে বােনের সঙ্গে আমার ঐবিষয়ে কিছুটা আলাপ হয়েছিলাে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমি ঐ মেয়েটির সঙ্গে তােমার বিবাহের বন্দোবস্ত করতে সক্ষম হবাে।” এর জবাবে জামাল আমাকে বলে, “তাহলে আমি আপনার প্রস্তাবে সম্মত। আগামীকাল এ কথাগুলাে বলে আব্বাকে রাজি করানাের সম্পূর্ণ ভার আপনার। তবে সত্যি কথা কি দুলাভাই, মা-কে ছেড়ে এতদূরে থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট
৪৯। ৯ই মে সকালে মিহির ভাই, জামাল ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান লন্ডনের হিথরাে বিমানবন্দরে। একটি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের নিয়মিত ফ্লাইটে বঙ্গবন্ধু যথাসময়ে লন্ডন
পৃষ্ঠাঃ ২৩০
পৌছান। লন্ডনস্থ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও কর্মী এবং বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রায় সব উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্যে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ব্রিটিশ সরকার হিথরাে বিমান বন্দরে ‘কইনস’ লাউঞ্জ হিসেবে অভিহিত সুরক্ষিত সুরম্য ভি.ভি.আই.পি বিশ্রামাগারে ব্যবস্থা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্বল্প সময়ের যাত্রাবিরতির জন্যে। প্রথমেই জামাল, বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান ও আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে। কুশলাদি বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধু আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ওয়াজেদ, বিদেশ সফরে গিয়েও আমি কোন কেনাকাটা করতে পারি না। তােমার ছেলে জয়ের জন্য তাে আমি কিছুই কিনতে পারিনি। ওর জন্যে কোনকিছু না নিলে তাে তােমার শাশুড়ী আমার মাথার চুল ছিড়ে ফেলবে”।
৫০। বঙ্গবন্ধুর এ কথার জবাবে আমি তাঁকে জানাই যে, জার্মানী থেকে জয়ের জন্য একটি অত্যাধুনিক সাইকেল সঙ্গে নিয়ে এসেছি। অতঃপর বঙ্গবন্ধু সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর নূরুল মােমেন খান সাহেবকে সাইকেলটি বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার জন্যে নির্দেশ দেন। এরপর বঙ্গবন্ধু জামালের কাছ থেকে জানতে চান যে, সে কবে নাগাদ দেশে ফিরবে এবং দেশে পাঠানাের জন্যে তার মালপত্রগুলাে বিমানবন্দরে আনা হয়েছে কি না? জামাল বলে, “আব্বা, আমার মালপত্রগুলাে তাে এনেছি, কিন্তু দুলাভাই এ ব্যাপারে আমাকে অন্য প্রস্তাব দিয়েছেন।” অতঃপর বঙ্গবন্ধু ঐব্যাপারে আমার মতামত চাইলে আমি জামালের স্যানহান্ঠে আর এক বছর থেকে তথাকার পােস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কোর্সটি সম্পন্ন করা সমীচীন হবে বলে মতামত ব্যক্ত করি। বঙ্গবন্ধু অতঃপর ঐবিষয়ে নূরুল মমামেন খান সাহেবের মতামত চাইলে তিনিও আমার প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। আমাদের কথা শােনার পর বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ চিন্তা করে জামালের উদ্দেশ্যে বলেন, “তােকে বিদেশে রেখে তাের মা স্থির থাকতে পারে না। তুই তাের মালপত্রগুলাে বিমানে উঠিয়ে দে। ভবিষ্যতে অনেক স্কলারশিপ পাওয়া যাবে। তখন পােস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কোর্স সম্পন্ন করার জন্যে আবার স্যানহ্যান্ঠে চলে আসবি।” এরপর বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জামাল ও আমি মিহির ভাইয়ের সঙ্গে চলে যাই আমাদের মালপত্রগুলাে বিমানে উঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে। উল্লেখ্য যে, এরপর বঙ্গবন্ধু ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) তারিখে নিহত হওয়ার পূর্বে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বা হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
৫১। ১১ই মে তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে আড়াই হাজার জাতীর ও গভীর নলকূপ বিদ্যুতায়নের ব্যাপক কর্মসূচী প্রণয়নের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ১৪ই মে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের কয়েক ধরনের সুতা ও কাপড়ের ওপর হতে সরকারী নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ১৯শে মে বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপিত হয় সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক। ২২শে মে বাংলাদেশ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্বাহী বাের্ডের
পৃষ্ঠাঃ ২৩১
সদস্য নির্বাচিত হয়। ২৫শে মে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর গুলিতে নিহত হন মাদারীপুর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। ২৭শে মে ভেড়ামারায় ৪০ মেগাওয়াট প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ৩০শে মে বঙ্গবন্ধুর সরকার কতিপয় ভােগ্যপণ্য ও শিল্প পণ্যের শুল্ক হ্রাস করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে।
৫২। ৩রা জুন বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশের বেসরকারী এজেন্সীগুলােকে আন্তর্জাতিক রুটে জাহাজ ভাড়া করার অনুমতি প্রদান করে। ৪ঠা জুন বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে শিল্পায়ন সহজতর ও ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারী সংস্থা আদেশ প্রয়ােজনানুসারে সংশােধন করে। ৫ই জুন বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে ১৫ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৬ই জুন বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে ১২০ কোটি ডলার সাহায্য ঋণদানের জন্যে কনসাের্টিয়াম দেশসমূহের প্রতি আবেদন জানায়।
৫৩। ৭ই জুন (১৯৭৫) তারিখে রাষ্ট্রপতির এক আদেশবলে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র ও সাংগঠনিক কাঠামাে ঘােষণা করা হয়। উক্ত গঠনতন্ত্রে চারটি রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শের ভিত্তিতে শশাষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাকেই বাকশালের মূল রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে ঘােষণা করা হয়। ‘বাকশালের সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম, মনসুর আলী এবং অপর তিনজন সেক্রেটারী হিসেবে নিযুক্ত হন সর্বজনাব জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রাজ্জাক। একই সঙ্গে ‘বাকশালের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি এবং ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ‘বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা হলেন- রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম. মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমদ, জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, জনাব আব্দুল মালেক উকিল, জনাব মহিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর, ডঃ মােজাফফার আহমদ চৌধুরী, জনাব জিম্বর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি, জনাব আব্দুর রাজ্জাক, শেখ আব্দুল আজিজ এবং গাজী গােলাম মােস্তফা। বিস্ময়কর ব্যাপার যে, জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে ‘বাকশাল’ কার্যনির্বাহী কমিটি বা কেন্দ্রীয় কমিটির কোনটাতেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। জাতীয় দল, ‘বাকশালের রাজনৈতিক প্লটফরমে দেশের বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সমাবেশ ঘটানাের উদ্দেশ্যে এর কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পত্রিকা সম্পাদক এবং সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বিডিআর ও জাতীয় রক্ষীবাহিনীর প্রধানদের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। একই আদেশে ‘বাকশালের পাঁচটি অংগদলের নাম এবং সেগুলাের প্রধানদের নাম ঘােষণা করা হয়। জাতীয় কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে অধ্যাপক ইউসুফ আলী, জাতীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে জনাব তােফায়েল আহমদ, জাতীয় মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদিকার
পৃষ্ঠাঃ ১২৬২
পদে বেগম সাজেদা চৌধুরী এবং জাতীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে শেখ শহিদুল ইসলামকে নিয়ােগ করা হয়।
৫৪। জাতীয় দল ‘বাকশাল’ গঠিত হওয়ার পর থেকেই উক্ত দলে যােগদানের জন্যে দেশের বিভিন্ন মহল উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিভিন্ন সরকারী দফতরের চাকুরীজীবীদের অনেকেই বাকশালে যােগদানের জন্যে আবেদন করেন। হাজী মােহাম্মদ দানেশের মতাে প্রবীণ নেতাসহ এককালে বঙ্গবন্ধুর বিরােধী ছিলেন এমন অনেকে ‘বাকশালে’ যােগদান করেন। ২৩শে মে ঢাকার ২২৪ জন সাংবাদিক, ২রা জুন ঢাকার দুইজন পত্রিকা সম্পাদক এবং ৪ঠা জুন ঢাকার আরও ৩০২ জন সংবাদপত্রসেবী ‘বাকশালে’ যােগদানের জন্যে আবেদনপত্র পেশ করেন।
৫৫। ৯ই জুন ঢাকা জেলার সাভারে দেশের ৪৮তম টেক্সটাইল মিলের উদ্বোধন করা হয়। ১০ই জুন বঙ্গবন্ধুর সরকার ঢাকায় বাজার বিপণী নির্মাণে ৪ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমােদন করে। ১২ই জুন বঙ্গভবনে জাতীয় দল, বাকশালের সভাপতি এবং রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় উক্ত দলের কার্যনির্বাহী কমিটির প্রথম সভা। ১৩ই জুন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘােড়াশাল সার কারখানা সুদীর্ঘ ১০ মাস ধরে মেরামত করে পুনরায় চালু করা হয়। একই তারিখে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম জেলার বেতবুনিয়ায় উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের প্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র। ১৬ই জুন বঙ্গবন্ধুর সরকার সংবাদপত্র ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করে। উক্ত আদেশবলে চারটি দৈনিক পত্রিকা ও ১২৪টি সাময়িকী ব্যতীত দেশের অন্যান্য সকল পত্র-পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল ঘােষণা করা হয় এবং একই সঙ্গে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস সরকারী মালিকানাভুক্ত করা হয়।
৫৬। ১৯শে জুন (১৯৭৫) তারিখে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় দল ‘বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠক। উক্ত বৈঠকে বঙ্গবন্ধু দেশে একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা, এর আদর্শ, লক্ষ্য এবং তাঁর সরকারের স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রমসমূহ বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। সুদীর্ঘ প্রায় দেড় ঘন্টার ভাষণের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু দেশে এক দলীয় রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে ব্যাখ্যা করে বলেন, “…আর একটা জিনিস আমি মার্ক করলাম। সেটা হলাে এই যে, একদল (লােক) বলেন, আমরা পলিটিশিয়ান (আর) একদল (লােক) বলেন, আমরা ব্যুরােক্রেট। তাঁদের ব্যুরােক্রেটদের) মন-মানসিকতা ও চিন্তা-চেতনা হলাে রাজনীতিবিদদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করার উপায় উদ্ভাবনে সচেষ্ট থাকা। এই নিয়ে সমস্ত দেশ একটা ভাগ ভাগ অবস্থার মধ্যে থাকতাে। এই সন্দেহটা দূর করা দরকার। এবং (তা) দূর করে—সকলেই যে এক এবং সকলেই যে দেশকে ভালােবাসে এবং (এর) মঙ্গল চায়— এটা প্রমাণ করতে হবে। আমার সমাজে যে সমস্ত গুণী-জ্ঞানী লােক আছেন ও অন্য ধরনের যত লােক আছেন, তাঁদের নিয়ে আমার একটা পুল করা দরকার। এই পুল আমি করতে
পৃষ্ঠাঃ ২৩৩
পারি, যদি আমি নতুন একটা সিস্টেম চালু করি এবং একটা নতুন রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করি—’জাতীয়দল’ যার মধ্যে একমত, একপথ, একভাব (এবং এক হয়ে দেশকে ভালােবাসা যায়। যাঁরা বাংলাদেশকে ভালােবাসেন, তাঁরা এসে একতাবদ্ধ হয়ে দেশের মঙ্গলের জন্যে কাজ করে যেতে পারেন। এ জন্যে আজকে এটা করতে হয়েছে।”
৫৭।…অতঃপর দেশের ভবিষ্যত প্রশাসনিক কাঠামাের রূপরেখা বর্ণনা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “বাংলাদেশকে) ভাগ করা হবে ষাটটি জেলায়। প্রত্যেক জেলার জন্যে একজন গভর্নর থাকবেন। সেখানে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। তাঁর অধীনে এসপি থাকবেন। দলের প্রতিনিধিগণ থাকবেন, সংসদ সদস্যরা থাকবেন, জনগণের প্রতিনিধিরা থাকবেন। (ডিস্ট্রিক্ট) কাউন্সিলে সরকারী কর্মচারীরাও থাকবেন। প্রত্যেক জেলায় অর্থাৎ বর্তমান মহকুমাসমূহে একটি করে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল থাকবে এবং তার একজন গভর্নর থাকবেন। তিনি (গভর্নর) স্থানীয়ভাবে শাসন ব্যবস্থা চালাবেন। শাসন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা গভর্নরের কাছে যাবে আমার ওয়ার্কস প্রােগ্রামের টাকা। তাঁর কাছে যাবে আমার খাদ্যসামগ্রী। তাঁর কাছে যাবে আমার টেস্ট রিলিফ, লােন, বিল ও সেচ প্রকল্পের টাকা। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ও ডিস্ট্রিক্ট এ্যাডমিনিস্ট্রেশন পরিচালিত হবে। তবে কি—ব্রিটিশ আমলারা বলে গেছেন সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে হবে, এস. ডি. ও. সাহেব যা করবেন সেটাই হবে ফাইনাল কথা, সি. ও সাহেব শাসন করবেন থানায় বসে—সেই এ্যাডমিনিস্ট্রেশন রাখতে হবে? এতে দেশের মঙ্গল হবে না। কারণ আমি যে টাকা দেবাে থানায় সেই টাকা দেবাে সি. ও সাহেবকে। এনি পলিটিক্যাল ওয়ার্কার ইজ বেটার দ্যান এনি সি.ও ইফ দ্য পলিটিক্যাল ওয়ার্কার ইজ সিনসিয়ার। অন্যথায় ক্যাশের টাকা সেখান থেকে লুট হয়ে যাবে”। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “আমি অর্ডার দিয়েছি—আজকে অর্ডার হয়ে গেছে। ১৫ই জুলাই থেকে এই ৬০ জন গভর্নরকে ট্রেনিং দেয়া হবে। ১লা সেপ্টেম্বরের মধ্যে (মহকুমাগুলাে) ডিস্ট্রিক্ট হয়ে যাবে। এক বছরের মধ্যে থানা এ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল করতে হবে। সেখানে ‘বাকশালের’ রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, কৃষকের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, শ্রমিকের (রিপ্রেজেন্টেটিভ) থাকবে, যুবকের (রিপ্রেজেন্টেটিভ) থাকবে, মহিলাদের (রিপ্রেজেন্টেটিভ) থাকবে। একজন গভর্নর থাকবেন যিনি হবেন হেড অব এ্যাডমিনিস্ট্রেশন। সেখানে মেম্বার অব পার্লামেন্ট গভর্নর হতে পারেন। সেখানে পার্লামেন্টের মেম্বার নন, এমন পলিটিক্যাল ওয়ার্কার হতে পারেন। সেখানে সরকারী কর্মচারী—যাঁকে বিশ্বাস করি তিনিও হতে পারেন। আবার নাক উচু করা চলবে না। পার্টির মেম্বার হওয়ার পরে দে উইল টেক (ওভার) ব্রেসপনসিবিলিটিজ অব এ্যাডমিনিস্টেশন।”
৫৮।…এরপর উক্ত ভাষণে আত্মসমালােচনা করার প্রয়ােজনীয়তার ওপর যথাযথ গুরুত্বারােপ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আজকে এই যে নতুন এবং পুরানাে যে সমস্ত সিস্টেমে
পৃষ্ঠাঃ ২৩৪
আমাদের দেশ চলছে, এর জন্য আমাদের আত্মসমালােচনার প্রয়ােজন আছে। আত্মসমালােচনা না করলে আত্মশুদ্ধি করা যায় না। আমরা ভুল করেছিলাম। আমাদের বলতে হয় যে, ভুল করেছি। আমি যদি ভুল করে না শিখি, ভুল করে শিখবাে না, সে জন্য আমি সবই ভুল করলে আর সকলেই খারাপ কাজ করবে- তা হতে পারে না। আমি ভুল নিশ্চয়ই করবাে—আমি ফেরেস্তা নই, শয়তানও নই। আমি মানুষ, আমি ভুল করবােই। আমি ভূল করলে আমার মনে রাখতে হবে, আই ক্যান রেকটিফাই মাইসেলফ। আমি যদি রেকটিফাই করতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি। আর যদি গো ধরে বসে থাকি যে, না, আমি যেটা করেছি সেটাই ভাল—দ্যাট কানট বি হিউম্যান বিইং। ফেরেস্তা হইনি যে সবকিছু ভাল হবে। হতে পারে, ভাল হতে পারে। উই উইল রেকটিফাই ইট। এই সিস্টেম ইনট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে, খারাপ হচ্ছে, অল রাইট রেকটিফাই ইট। কেন না আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শােষণহীন সমাজ গড়তে হবে।”
৫৯।…তাঁর ভাষণের আর এক পর্যায়ে দেশের রাজনৈতিক ‘ইজম’ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তবে, এখানে যে শােষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি, সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। (অন্য কোন জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইমপাের্ট করে এনে কোন ‘ইজম’ চলে না- এ দেশে, কোন দেশেই চলে না। আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকনমিক সিস্টেম গড়তে হবে। কারণ আমার দেশে অনেক অসুবিধা আছে। কারণ, আমার মাটি কি, আমার পানি কতাে, আমার এখানে মানুষের কালচার কি, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড কি, তা না জানলে হয় না। ফান্ডামেন্টালী আমরা একটা শশাষণহীন সমাজ গড়তে চাই, আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি (প্রতিষ্ঠা করতে চাই। বাট দ্যা সিস্টেম ইজ আওয়ার্স। উই ডু নট লাইক টু ইমপাের্ট ইট ফ্রম এনিহােয়্যার ইন দ ওয়ার্লড। এটা আমার মত, পার্টির মত। ”
৬০।…অতঃপর দেশে এক দলীয় রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, “আজকে আপনারা মনে রাখবেন যে, নতুন সিস্টেমে আর্মি, নেভী, এয়ারফোর্স, সরকারী কর্মচারী, বেসরকারী কর্মচারী, পলিটিশিয়ান, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার চিকিৎসাবিদ), ইঞ্জিনিয়াস—যদূর সম্ভবপর—(জাতীয় দল, বাকশালে) এদের রাখার চেষ্টা করেছি। পলিটিশিয়ানদের মধ্যে অনেক এক্সপেরিয়েন্সড আমার পুরানাে বন্ধুরা আছেন যাঁরা আগে আমার সঙ্গে ছিলেন। কিছুদিন ডিফারেন্ট পার্টি করেছেন। আগে আমরা এক জায়গায়ই ছিলাম। মধ্যে ভাগ হয়ে গেলাম—এটা সব জায়গায় হয়। আমরা আবার এক হয়েছি। সেকেন্ড রেভল্যুশন ইজ নট দ্য এন্ড। সেকেন্ড রেভল্যুশন যে করেছি আমি, চারটা প্রােগ্রাম দিয়েছি, এটাই শেষ নয়। শেষ কথা নয়, এটা হলাে স্টেপ। ডেভেলপমেন্ট, মাের প্রােডাকশান, ফাইট এগেইনস্ট করাপশান, ফর ন্যাশনাল ইউনিটি
পৃষ্ঠাঃ ২৩৫
এ্যান্ড ফ্যামিলি প্ল্যানিং। এগুলাে করলে আমরা একটা শােষণহীন সমাজব্যবস্থা গড়তে পিরবাে—যেখানে মানুষ সুখে সাচ্ছন্দে বাস করতে পারবে। এটাই হলাে আমার সেকেন্ড রেভলুশনের মূল কথা—এ জন্যই আমি সেকেন্ড রেভলুশনের ডাক দিয়েছি। ”
৬১। ২০শে জুন বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে খাদ্যশস্যের সুষ্ঠু পরিবহনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য স্থল ও নৌবাহিনী নিয়ােগ করে। ২১শে জুন তারিখে মিশরের সরকার বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য বাংলাদেশকে সুয়েজ খালের তীরে একটি ভূমিখন্ড দান করে। ২২শে জুন তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার সারাদেশে ৬০টি জেলার প্রশাসনিক কাঠামাে ঘােষণা করে। একই তারিখে প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম, মনসুর আলী জাতীয় সংসদে জাতীয় দল, ‘বাকশালের সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৪শে জুন তারিখে বাংলাদেশ এবং কাবুল সরকারদ্বয়ের মধ্যে একটি কারিগরী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একই তারিখে বাংলাদেশ এবং (তৎকালীন সােভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৫শে জুন বৃটেন ও বেলজিয়াম সরকারদ্বয় বাংলাদেশের জন্য পণ্য ও ঋণ সাহায্য মঞ্জুর করে। ২৭শে জুন তারিখে ঢাকা ও কাবুলের মধ্যে একটি বিমান চলাচল সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২৮শে জুন তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বাের্ড গঠন করে।
৬২। ইতােপূর্বে (জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে) আমি শাশুড়ীর কাছ থেকে ১৫ই জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিতব্য শেখ কামালের বিয়েতে উপস্থিত থাকার অনুরােধ সম্বলিত একটি টেলিগ্রাম পাই। অতঃপর আমি উক্ত বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার আগ্রহ ব্যক্ত করে তদুদ্দেশ্যে স্বল্পকালের জন্য বাংলাদেশে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে কার্লসরুয়ের আমার ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ডঃ হুইটজ(Writz)-কে পত্র লিখি। প্রফেসর হইর্টজ তখন তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল এবং আরও কয়েকটি শহরে ছয় সপ্তাহের সফর কর্মসূচী শেষে দেশে ফিরেছেন। আমার উক্ত চিঠি পাওয়ার দুই-তিন দিন পর প্রফেসর হুইটজ আমাকে মৌখিকভাবে জানান, নির্ধারিত কর্মসূচীর ব্যাঘাত ঘটায় এমন প্রস্তাবে আমরা সাধারণতঃ সম্মতি দিই না। যাহােক, যেহেতু আপনি আপনার শ্বশুরের একমাত্র জ্যেষ্ঠ জামাতা, সুতরাং আমরা আপনাকে তদুদ্দেশ্যে আনঅফিসিয়াল অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু এবিষয়ে আপনার স্কলারশিপের উদ্যোক্তা, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেন্সীকে অবহিত করা যাবে না। আর একটা কথা। যেহেতু বাংলাদেশে যাওয়ার ফলে আপনার এখানের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী বিঘ্নিত হবেই, সুতরাং আপনি সেখানে সম্পূর্ণ আগষ্ট মাস কাটিয়ে ৯ই সেপ্টেম্বর তারিখে এখানে অনুষ্ঠিতব্য আণবিক শক্তি চুল্লী বিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য উক্ত তারিখের মাত্র দিন দুয়েক আগে ফিরবেন। যেহেতু আপনাকে অফিসিয়াল ছুটি দেওয়া হবে না, অতএব আপনার স্কলারশিপ উক্ত সময়কালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হবে না। আপনার কলারশিপের টাকা নিয়মিত
পৃষ্ঠাঃ ২৩৬
আপনার ব্যাংক-এ জমা দেওয়া হবে। আর একটা শর্ত এই যে, সেপ্টেম্বর মাসে এখানে ফিরে আসার সময় আপনি আপনার পরিবারবর্গকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারবেন না।”
৬৩। প্রফেসর হইর্টজের উপরােক্ত শর্তে তখন কামালের বিবাহ উপলক্ষে দেশে ফিরলে আমার ৮ সপ্তাহের কর্মসূচী ব্যাহত হবে। তবুও ছেলেমেয়েদের দেখার ইচ্ছা সম্বরণ করতে না পেরে সাময়িকভাবে দেশে ফেরার জন্য আমি মনস্থির করি। অতঃপর জুন মাসের চতুর্থ সপ্তাহের শেষের দিকে আমি হমায়ুন রশীদ চৌধুরীর কাছ থেকে একটি টেলিগ্রাম পাই। তখন তিনি ঢাকায় ছুটিতে ছিলেন। উক্ত টেলিগ্রামে তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপতি ও বেগম মুজিবের গভীর কামনা যে আমি যেন যেকোনেভাবে কামালের বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য স্বল্পকালের জন্য হলেও ঐ সময়ে ঢাকায় চলে যাই। তখন আমি আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি এজেন্সীর কলারশিপ সম্পর্কিত শর্তগুলাে ভালভাবে পরীক্ষা করি। তাতে উল্লেখ রয়েছে যে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি এজেসীর সম্মতি ব্যতিরেকে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচীর কোনরূপ ব্যাঘাত ঘটানাে হলে কলারশিপ বাতিল করা হতে পারে। অতঃপর এতদবিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক প্রফেসর হইর্টজের কাছ থেকে সাময়িকভাবে দেশে ফেরার জন্য লিখিত অনুমতি চাই। কিন্তু তিনি লিখিত অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান। অতএব বাধ্য হয়েই আমি সাময়িকভাবে দেশে ফেরার পরিকল্পনা পরিত্যাগ করি এবং তার কারণ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে শাশুড়ীকে চিঠি লিখি। জুন মাসের শেষের দিকে জার্মানীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী আমজাদুল হক আমাকে জানায় যে, শেখ কামালের বিয়েতে উপস্থিত থাকার জোর পরামর্শ দিয়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁদেরকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন এবং তিনি ঐবিষয়ে আমাকে সর্বতােভাবে সাহায্য করার জন্য তাঁদের নির্দেশ দিয়েছেন। জনাব আমজাদুল হককে আমি সবকিছু বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। এর পর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর নূরুল মােমেন খান (মিহির ভাই)-এর কাছ থেকে টেলিফোন পাই। তখন বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছােট ভাই শেখ নাসের (কাকা) সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমি ফোনে তাঁকেও ব্যাপারটি বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। অতঃপর নাসের কাকা আমাকে বলেন যে, সবকিছু সত্ত্বেও যদি আমার পক্ষে ঢাকায় যাওয়া সম্ভব হয়, তাহলে আমি যেন নুরুল মােমেন খান সাহেবের সঙ্গে যােগাযােগ করি এবং তিনি এব্যাপারে সবকিছু বন্দোবস্ত করে দেবেন। পরে জনাব নুরুল মােমেন খান সাহেবও আমাকে ফোন করেছিলেন। কিন্তু প্রফেসর হইর্টজের অনমনীয় ও অনড় অবস্থান নেওয়ার কারণে আমি আমার তখন দেশে না ফেরার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাঁকে জানিয়ে দিই।
৬৪। ৪ঠা জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার দেশে ৩৩টি নিত্যপ্রয়ােজনীয় পণ্যসামগ্রী সরকারী সরবরাহ ও নিয়ন্ত্রণ আদেশ বহির্ভূত ঘােষণা করে। ৭ই জুলাই (১৯৭৫) তারিখে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন পুনর্গঠন সংক্রান্ত বিল পেশ করা হয়। একই
পৃষ্ঠাঃ ২৩৭
তারিখে সরকার একটি রাষ্ট্রপতির আদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠন করে। ৮ই জুলাই তারিখে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি এবং বিভিন্ন জেলার ৫৫ জন নেতার সমভিব্যাহারে সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাওলানা খােন্দকার নাসির উদ্দিন বাকশালের সেক্রেটারী জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার কাছে ৪৯,০৫১ জন মাদ্রাসা শিক্ষকের ‘বাকশালে যােগদান করার সিদ্ধান্ত সম্বলিত আবেদনপত্র পেশ করেন। ৯ই জুলাই তারিখে জাতীয় সংসদ বাংলাদেশ জেলা পুনর্গঠন বিল অনুমােদন করে। সুদীর্ঘকাল পর মেরামত কাজ সম্পন্ন হওয়ায় বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর হার্ডিঞ্জ রেলওয়ে ব্রিজ পুনরায় চালু ঘােষণা করা হয় ১০ই জুলাই তারিখে। ১২ই জুলাই তারিখে গােয়ালন্দে দেশের ৪৯তম টেক্সটাইল মিলের উদ্বোধন করা হয়। একই তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার শেরপুরকে দেশের ৬১তম জেলা হিসেবে ঘােষণা করে। ১৪ই জুলাই তারিখে সরকার কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বাের্ডের ৫৫টি প্রকল্পের কথা ঘােষণা করে। ১৪ই জুলাই তারিখে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ বনবিভাগ মাত্র ১২ দিনে রাজধানী ঢাকা নগরীতে ৯৬ হাজার চারাগাছ রােপণ কর্মসূচী সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করে। ১৬ই জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধুর সরকার একটি রাষ্ট্রপতির আদেশে বাংলাদেশের ৬১টি জেলার জন্য গভর্নর নিয়ােগ করে তাদের নাম প্রকাশ করে।
৬৫। ১৭ই জুলাই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমি অফিস থেকে কার্লরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসের আমার কক্ষে পৌছাই। ঠিক ঐ মুহূর্তে আমাকে জানানাে হয় যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আমার সঙ্গে কথা বলবেন। অতঃপর ফোন এলে আমি উদ্বিগ্নাবস্থায় টেলিফোন রিসিভ করি। ফোনে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ শুনে আমি”আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছেন” বলি। কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলেন না বলে লন্ডনের লাইনে তিনি পুনরায় ফোন করবেন বলে আমাকে জানান। এর একটু পরে আবার বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ফোন আসে। বুঝা গেল এবার তিনি আমার কণ্ঠ পরিষ্কারভাবে শুনতে পাচ্ছেন। তিনি কেমন আছেন আমি জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু একটু ক্লান্তস্বরে টেনে টেনে বললেন, ‘বাবা, ভাল আছি।” তাঁর শরীর কেমন আছে আমি জানতে চাইলে তিনি আবারােও টেনে-টেনে বললেন যে শারীরিকভাবে তিনি সুস্থ, হাসিনা, আমার ছেলেমেয়ে, শাশুড়ী, কামাল, জামাল, রেহানা ও রাসেলসহ বাড়ীর সবাই ভাল আছে। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আমাকে জানান যে, কামালের বিয়েতে আমি উপস্থিত না হওয়ায় শাশুড়ী ভীষণ দুঃখ পেয়েছেন। আমি তখন ভীষণ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যে পরিস্থিতির কারণে দেশে ফিরতে পারিনি তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধুকে জানাই এবং আরও বলি যে, আমি বিস্তারিত জানিয়ে অনেক আগেই শাশুড়ীকে চিঠি দিয়েছি। আমার এ কথার উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন যে, শাশুড়ী আমার কোন চিঠিপত্র পাননি। অতঃপর বঙ্গবন্ধু আমাকে জানান যে, ১৮ই
পৃষ্ঠাঃ ২৩৮
জুলাই তারিখে এ. টি. এম. সৈয়দ হােসেন সাহেবের তৃতীয় কন্যা পারভীন রােজীর সঙ্গে শেখ জামালের বিয়ের আয়ােজন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে আরও জানান যে, রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে হাসিনা আমাদের ছেলেমেয়েদেরসহ জুলাই মাসের শেষের দিকে জার্মানী চলে আসবে। আর কয়েক মাস পর আমি দেশে ফিরতে পারি বিধায় হাসিনার অতাে টাকা পয়সা খরচ করে তখন জার্মানী চলে আসা সমীচীন হবে না, আমি একথা বললে বঙ্গবন্ধু বলেন, “তােমার ছেলে জয়কে কিছুতেই বুঝানাে যাচ্ছে না। ও সারাক্ষণ তােমার কথা বলে, তােমার খোঁজ করে এবং তােমার কাছে যেতে চায়। অতএব, তুমি আর কোন আপত্তি ওঠাইও না।” এ কথাগুলাে বলে বঙ্গবন্ধু আমাকে তখন হাসিনার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। হাসিনাকেও আমি একই কথা বলি। হাসিনাও আমাকে বঙ্গবন্ধুর কথাগুলাে বলে। হাসিনা আমাকে এও বলে যে, আমি যতােই আপত্তি করি না কেন সে জার্মানী চলে আসবেই। এই কথােপকথনে প্রায় বিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়। এরপর কিছুটা বিরক্ত হয়েই আমি ফোনের রিসিভার রেখে দিই।
৬৬। ১৯শে জুলাই রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন একান্ত সচিব জনাব মশিয়ুর রহমান আমার অফিসে ফোন করে আমাকে জানান যে, হাসিনারা ২৫শে জুলাই তারিখে প্যানামের একটি ফ্লাইটে ফ্লাফুর্ট পৌছাবে। তিনি আমাকে উক্ত ফ্লাইটের নম্বর ও সময়সূচীও জানান। ২০শে জুলাই তারিখে জনাব মশিয়ুর রহমান সাহেব আবার অফিসে ফোন করে আমাকে জানান যে, হাসিনারা উক্ত ফ্লাইটে যাচ্ছে না কারণ সেটি করাচী হয়ে ফাংফুর্ট যায়। তিনি আমাকে আরও জানান যে, পরিবর্তিত সফরসূচী অনুযায়ী হাসিনারা লুফথানসার একটি ফ্লাইটে ৩০শে জুলাই সকালে ফাংফুর্ট পৌছাবে। তিনি আমাকে উক্ত ফ্লাইটের নম্বর ও সময়সূচীও অবহিত করেন। তিনি আরও বললেন যে, যথাসময়ে তৎসম্পর্কে আমার নিকট তারবার্তাও পাঠানাে হবে।
৬৭। ২১শে জুলাই তারিখে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের নবনিযুক্ত গভর্নরদের জন্য আয়ােজিত ২১ দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধন করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন প্রায় সােয়া ঘন্টা ধরে। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দেশে একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কারণ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। এছাড়াও, তিনি দেশে প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়ােজনীয়তার কথাও উল্লেখ করেন উক্ত ভাষণে। সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু তার সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচীর রূপরেখা প্রদান করেন উক্ত ভাষণে। উক্ত ভাষণের এক পর্যায়ে নবনিযুক্ত গভর্নরদের প্রদত্ত প্রশাসনিক ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলেন, “গভর্নরশীপের যে ক্ষমতা আমরা আইনে দিয়েছি, তা কম নয়। আমরা সােজাসুজি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে জেলার কানেকশন রাখতে চাই। তেমনি সরাসরি জেলার সঙ্গে থানার, থানার সঙ্গে ইউনিয়নের কানেকশন রাখতে হবে। এখন আপনারা চিন্তা করে দেখুন। যে ক্ষমতা আইনে গভর্নরদের দেওয়া
পৃষ্ঠাঃ ২৩৯
হয়েছে, তা আগে একজন ডিসটি ম্যাজিস্ট্রেটও ভােগ করেন নাই। তার চেয়ে অনেক বেশী ক্ষমতা আপনাদের দেওয়া হয়েছে। আপনাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্সিল করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে পার্টি থাকবে। পার্টির (স্থানীয়) সেক্রেটারী থাকবেন, আপনার চেয়ে তার ক্ষমতা কোন অংশে কম থাকবে না। একদিকে আপনি যেমন রেসপনসিবল ফর দ্যা এ্যাডমিনিস্ট্রেশন, তেমনি পার্টির যিনি সেক্রেটারী থাকবেন তিনিও রেসপনসিবল সমস্ত পার্টির জন্য। যখন গভর্নর সাহেব কাউন্সিল মিটিং কল করবেন, তখন (পার্টির সেক্রেটারী সেখানে উপস্থিত হবেন। আবার, যখন, (পার্টির) সেক্রেটারী সাহেব পার্টি মিটিং কল করবেন, তখন গভর্নর সাহেব তার সামনে গিয়ে বসবেন।”
৬৮।…অতঃপর প্রশাসনে সংসদ সদস্যদের ভূমিকা ও অংশ গ্রহণের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যাঁরা পার্লামেন্টের মেম্বার, তাদের কাজ হলাে, …তারা এ্যাসেমীতে আইন পাস করে বাড়ী যাবেন, দেখবেন, শুনবেন…(শুধু তা নয়)। কিন্তু এখানে আপনাদের রেসপনসিবিলিটি দিয়েছি। কারণ, দেখা যায় বাংলার জনগণ পার্লামেন্টের মেম্বারদের এই আশায় ভােট দেন যে, তাঁরা সব কাজ করে দেবেন। কিন্তু বর্তমানে আইন পাস করা ছাড়া তাঁদের রেসপনসিবিলিটি এমন কিছু নাই। কিন্তু লায়াবিলিটি তাঁদের বেশী। তাঁদের গালাগালি খেতে হয়। কিন্তু শাসন তাঁরা চালাতে পারেন না। সেই জন্য আমি নতুন সিস্টেমে যাচ্ছি। আপনারা রেসপনসিবিলিটি নিন, আইনও পাস করুন। মাঠে ময়দানে কাজ করলে আপনারা সবই বুঝতে পারবেন।”
৬৯। এরপর নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য গভর্নরদের পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন,…”আপনাদের কেউ কেউ এমন জেলায় গভর্নর হয়েছেন, যেখানে আপনাদের নিজেদের বাড়ী ঘর, নিজেদের আত্মীয়-স্বজন, নিজেদের পার্টি রয়েছে। তাঁরা সাবধান। তাঁদের স্বজনপ্রীতির উর্ধ্বে উঠতে হবে, (সর্বপ্রকার) দুর্নীতির উর্ধ্বে উঠতে হবে, আত্মীয়স্বজনকে সাহায্য কবার উর্ধ্বে উঠতে হবে। তাদের একটা রিস্ক আছে।”…গভর্নরদের দায়িত্ব কিছুটা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘আপনাদের চার্জ দেওয়া হয়েছে। আপনারা এবার কর্মস্থলে গিয়ে কাজ করুন। ল এ্যান্ড অর্ডার আপনাদের দেখতে হবে। ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কস আপনাদের দেখতে হবে। জিনিসপত্র বিদেশ থেকে যা আসে, তার ডিসট্রিবিউশন ঠিক মত হচ্ছে কিনা (আপনাদের দেখতে হবে। পাবলিসিটি আপনাদের দেখতে হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে কিনা, আপনাদের দেখতে হবে। খাল কাটা হচ্ছে কিনা, আপনাদের দেখতে হবে। ঘুষ খাওয়া বন্ধ হচ্ছে কিনা, আপনাদের দেখতে হবে। থানার মধ্যে করাপশন আছে কিনা আপনাদের দেখতে হবে। আপনাদের সঙ্গে থাকবেন ম্যাজিস্ট্রেট, আপনাদের সঙ্গে থাকবেন এস. পি। আপনাদের সঙ্গে থাকবেন জয়েন্ট এস. পি (ক্রাইম)। আপনাদের সঙ্গে থাকবেন সমস্ত অফিসার, আপনাদের সঙ্গে থাকবেন রাজনৈতিক কর্মীরা। আপনাদের একটি কাউন্সিল হবে। কাউন্সিলকে আপনাদের কনফিডেন্সে নিতে হবে।
পৃষ্ঠাঃ ২৪০
কাউন্সিলকে বাদ দিয়ে নিজে সব সময় ডিকটেটরশীপ করতে যাবেন না। কাউন্সিল ডেকে তাঁদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে কাজ করতে হবে।”
৭০। অতঃপর সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন, “কিন্তু আজকে মেম্বার সাহেবদের একটি বড় ভয়ের ব্যাপার আছে। বাংলাদেশের জনগণ সাংঘাতিক রি-এ্যাক্ট করে, এটা মনে রাখবেন। সারা জীবন সাধনা করবেন, তারপর একটা অন্যায় করবেন, তার ফলেই মুছে যাবেন বাংলাদেশ থেকে। এইটেই বাংলাদেশের নিয়ম। সারা জীবন সাধনা করবেন, তারপর একটা অন্যায় করলে বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের মুছে দেবে। আপনারা যাঁরা যেখানে লােকালি থাকবেন, সেখানে পারমানেন্টলি থাকতে হবে, কাজ করতে হবে, এ্যাডমিনিস্ট্রেশন চালাতে হবে। দেখতে হবে, যে নতুন সিস্টেম আমরা করতে যাচ্ছি, তাতে আমরা সাকসেসফুল হতে পারি কিনা। বাংলাদেশ একটি ছােট দেশ—এ ব্রিজ বিটুইন দ্য সাবকন্টিনেন্ট এ্যান্ড সাউথইস্ট এশিয়া। অন্যান্য দেশ যতাে বড়ই হােক না কেন, ভবিষ্যতে তারা আমাদের ফলাে করবেন, যদি আমাদের সিস্টেম সাকসেসফুল হয়। এটা মনে রাখা দরকার। আর তা যদি না হয়, ইতিহাস থেকে আপনারা মুছে যাবেন।”
৭১। তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে থানার ভবিষ্যৎ প্রশাসনের রূপরেখা ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটু আভাস দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আজ আমি কেবল গােড়ায় হাত দিয়েছি। এখন ডিসষ্টি করেছি। এক বছরের মধ্যে আমি থানায় যাচ্ছি। থানায় আমি এ্যাডমিনিসট্রেটিভ কাউন্সিল করছি। থানায় যিনি হেড হবেন, তার নাম হবে থানা প্রশাসক। তিনি এম,পি হতে পারেন, গভর্নমেন্ট অফিসার হতে পারেন, বাইরের মানুষ হতে পারেন। সেখানেও হাই অফিসিয়াল থাকবেন। এইভাবে এ্যাডমিনিসট্রেশন চলবে। এমনি করে লােকাল ওয়ার্কস প্রােগ্রাম, (ট্যাক্স) কালেকশন—সব কাজই চলবে। ভবিষ্যতে আরও অনেক কাজই করতে হতে পারে। এই যে আমাদের ডিস্ট্রিক্টগুলাে হয়েছে , যখন আমরা সেগুলাের অবস্থাও জানতে পারবাে, তখন প্রােকিউরমেন্টের অবস্থা জানতে পারবাে, ডিসট্রিবিউশনের অবস্থাও জানতে পারবাে। তখন সেখানকার ফুল রেসপনসিবিলিটি তাঁদের নিতে হবে। ভবিষ্যতে সবকিছুর দায়িত্ব নিতে হবে।”
৭২। ঐ ভাষণের আর এক পর্যায়ে তার সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থসামাজিক কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, “ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্ক, ফ্যামিলি প্লানিং আর আমার দ্বিতীয় বিপ্লবের যে চারটি প্রােগ্রাম আছে, সেগুলােও আপনারা করুন। ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কে জন্য পাম্প পেলাম না এটা পেলাম না—এসব বলে বসে না থেকে জনগণকে মবিলাইজ করুন। যেখানে খাল কাটলে পানি হবে, সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। (মােটকথা) মবিলাইজ দ্যা পিউপল। পাম্প যদি পাওয়া যায় ভালাে। যদি না পাওয়া যায়, তবে স্বনির্ভর হােন। বাঁধ বেধে পানি আটকান, সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। আমাদের দেশে আগে কি পাম্প ছিলাে? দরকার হয়, কূয়া কেটে পানি আনুন। আমাদের দেশে পাঁচ হাত, সাত হাত,
পৃষ্ঠাঃ ২৪১
আট হাত কূয়া কাটলেই পানি ওঠে। সেখানে অসুবিধা কি আছে? যে দেশে পানি আটকে রাখলে পানি থাকে, সেখানে ফসল করবার জন্যে চিন্তার কি আছে? আর, এখন থেকে যে সমস্ত সার থানায় যাবে, তা যেন রেগুলারলি গরীব-দুঃখীরা পায়।”
৭৩।…এরপর বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ..”স্কুল-কলেজ আছে—সেখানে গভর্নমেন্ট টাকা দেন। প্রাইমারী স্কুলে আমরা টাকা দিয়েছি। অনেকে স্কুল করে না, অনেকে পড়ায় না, স্কুলেও যায় না। সেখানে লােকে গরু-ছাগল বেঁধে রাখে। টাকাও পায়, আবার রেশনও দেই। সেগুলি ওয়াচ করবেন। আপনি না পারেন, আপনার একজন অফিসার পাঠিয়ে দেবেন। ডিসট্রিক্ট অফিসার, স্কুল অফিসার এই সমস্তকে কন্ট্রোলে নিয়ে আসুন। তাঁরা এ সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে আসবেন। যদি দেখেন কোন টিচার কাজ করছে না, তাকে বদলি করে দিন। তাঁরা সরকারী কর্মচারী এখন। টাকা যা পাঠানাে হয়, তা তাঁরা) খেয়ে ফেলেন। সাবধান। দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। যত ডিপার্টমেন্ট আছে, সবগুলিরই ব্রাঞ্চ সব ডিসট্রিক্টে থাকবে। ওভারঅল রেসপনসিবিলিটি আপনাদের। ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। বাংলাদেশে এখানে বসে যে কাজ হয়, (তার) পাবলিসিটি এই ডিপার্টমেন্ট দেয়। প্রত্যেক ডিসটিক্টে, সাব ডিভিশনে এর ব্রাঞ্চ আছে। আল্লার মর্জি সেখানকার লােক কয়েকখানা কাগজ দরজায় লাগিয়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকেন আর বাকী কাগজ সের দরে বিক্রি করে দেন। তাঁর কাছে খোঁজ নিতে হবে, কত কাগজ এলাে। গ্রামে গ্রামে যান, পাবলিসিটি করুন।” পরিশেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এতে কিন্তু একটা কমপিটিশন আছে। এই সিস্টেমে গভর্নমেন্ট অফিসার আছেন, আর্মি অফিসার আছেন, পলিটিশিয়ানরা আছেন, আর এম,পি আছেন, নন এম,পি আছেন। ভাললা কমপিটিশন হবে।”
৭৪। ২২শে জুলাই কুয়েত সরকার বাংলাদেশকে ১ কোটি ১০ লাখ ডলার ঋণ সাহায্য প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ২৩শে জুলাই জনাব কে, এম, কায়সার জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। ২৪শে জুলাই বঙ্গবন্ধু সরকার, দেশের বিধিবদ্ধ রেশনিং এলাকার বাইরে প্রত্যেক শ্রমিকের জন্য মাসে ৩৫ সের গম বরাদ্দের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ২৫শে জুলাই ‘বাকশালে’ সদস্যপদ লাভের জন্যে দলের সম্পাদক এডভভাকেট জিল্লুর রহমানের কাছে ২০ জন ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনপত্র পেশ করেন। ২৬শে জুলাই ন্যাপ (ভাসানী)-এর ১৬ জন নেতা ও কর্মী, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ৮৩ জন, বাংলাদেশ পশু চিকিৎসা ইনস্টিটিউটের ২২ জন এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউটের ৬৮ জন বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা ‘বাকশালে’ যােগদান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আবেদনপত্র দাখিল করেন। ২৮শে জুলাই ১ লক্ষ সরকারী চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারী ‘বাকশালে যােগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করে দরখাস্ত পেশ করেন। একই তারিখে বৃটিশ সরকার বাংলাদেশকে ৭৫ কোটি টাকা ঋণ সাহায্য প্রদানের লক্ষ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
পৃষ্ঠাঃ ২৪২
৭৫। ২৯শে জুলাই সন্ধ্যায় ফাংফুর্ট শহরে গিয়ে একটি হােটেলে উঠি যাতে পরের দিন, অর্থাৎ ৩০শে জুলাই যথাসময়ে ফাংফুর্ট বিমান বন্দরে উপস্থিত হতে পারি। আমার সঙ্গে ছিলেন (পশ্চিম) জার্মানীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী, জনাব আমজাদুল হক। আমরা দু’জন ভাের সাড়ে সাতটার দিকে ফ্রাংফুর্ট বিমান বন্দরে পৌছাই। ঐ দিনে লুফথানসার ফ্লাইটটির ল্যান্ড করার কথা ছিল সকাল সােয়া আটটায়। কিন্তু সেটি নির্ধারিত সময়সূচীর পয়তাল্লিশ মিনিট আগেই ফাফুর্ট বিমান বন্দরে পৌছে যায়। যাহােক, আমজাদুল হক ও আমি তাড়াতাড়ি সেখানের তি, আই. পি. লাউঞ্জে চলে যাই। এর কয়েক মিনিট পূর্বে জার্মান কর্তৃপক্ষের লােকজন হাসিনা-রেহানাদের সেখানে নিয়ে গিয়েছেন। যাহােক, আমাকে দেখে বাচ্চারা ভীষণ খুশী হয়। ওদের মালপত্র সেখানে নিয়ে আনার পর দেখি যে, হাসিনা তার নামের সঙ্গে আমার নাম সংযােজন করে নতুন পাসপাের্ট ইস্যু করে নিয়েছে। নতুন পাসপাের্টে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে, “হাসিনা শেখ ওয়াজেদ” বলে। উল্লেখ্য যে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্রেও তার নাম রয়েছে হাসিনা। শেখ’ বলে। ১৯৬৯-এ আমার সঙ্গে ইটালী যাওয়ার সময় তার জন্য এই শেষােক্ত নামেই পাসপাের্ট ইস্যু করে নেওয়া হয়েছিলাে। এ ব্যাপারে আমি হাসিনাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “তুমি যদি বিমান বন্দরে না আসাে সেজন্য ইচ্ছা করেই এই পাসপাের্টে তােমার নাম সংযােজন করে নিয়েছি যাতে কার্লসরুয়ে শহরে গিয়ে সহজেই তােমাকে খুঁজে বের করা যায়। স্মরণ রাখবা, তুমি যেমন বুনাে ওল আমিও তেমনি বাঘা তেতুল।” যাহােক, একটু চানাস্তা খাওয়ার পর আমজাদুল হকের গাড়ীতে আমরা কার্লসৰুয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
৭৬। ১লা আগস্ট তারিখে এডভােকেট আবেদুর রেজা খানের নেতৃত্বে ঢাকা বার সমিতির ১৯৩ জন, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জনাব এ. এইচ. এম. কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে উক্ত ব্যাংকের ৪১২ জন, বাংলাদেশ বিমান বন্দর উন্নয়ন সংস্থার ৩৩৩১ জন এবং বাংলাদেশ গৃহনির্মাণ সংস্থার ১৫৮ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী ‘বাকশালে যােগদান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আবেদনপত্র পেশ করেন। একই তারিখে বাংলাদেশ দমকল বাহিনী, আনন্দবাজার বণিক সমিতি এবং বাংলাদেশ হােমিওপ্যাথ সমিতির পক্ষ থেকে ‘ বাকশালের সদস্যপদ লাভের জন্য আবেদনপত্র দাখিল করা হয়। ২রা আগস্ট বিশিষ্ট ন্যাপ (ভাসানী) নেতা জনাব আজাদ সুলতানের নেতৃত্বে উক্ত পার্টির ৪৫০ জন নেতা ও কর্মী ঢাকার সার্কিট হাউস রােডস্থ ‘বাকশালের কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে দলের অন্যতম সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণির কাছে ‘বাকশালে যােগদান করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে আবেদনপত্র দাখিল করেন। ৩রা আগস্ট বাংলাদেশের আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও জামালপুরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার উদ্দেশ্যে তদঞ্চলে ১৩২ কিলাে ভােন্ট লাইনের উদ্বোধন করা হয়। ৪ঠা আগস্ট রাষ্ট্রপতি ও বাকশালের চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু দেশের ৬১টি জেলার বাকশালের শাখার সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকদের
পৃষ্ঠাঃ ২৪৩
নাম ঘােষণা করেন। ৬ই আগস্ট কতিপয় দুষ্কৃতকারীর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনে হাতবােমা নিক্ষেপের ঘটনায় ৩ ব্যক্তি নিহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। ৮ই আগস্ট প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করার সংবাদও দ্রুত জানাজানি হয়ে যায়। ঐদিন বিকেলে হাসিনা, রেহানা ও বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে কার্লসরুয়ে শহরের প্রধান বিপণী কেন্দ্র পরিদর্শনে যাই। প্রথমে এদের সবার জন্য কিছু জামা-কাপড় কেনা হয়। অতঃপর একটি জুতাের দোকানে গিয়ে দেখি সেখানে হাসকৃত মূল্যে সুন্দর সুন্দর জুতাে পাওয়া যাচ্ছে। প্রত্যেকের জন্য জুতাে নির্বাচন করার সময় হাসিনা জয়ের জুতাের একই ডিজাইন ও রংয়ের এক জোড়া জুততা নেয় রাসেলের জন্য।
৭৭। ৯ই আগস্ট (১৯৭৫) তারিখে (পশ্চিম) জার্মানীস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব হমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বিশেষ আমন্ত্রণে আমি রেহানা-হাসিনাদের সঙ্গে নিয়ে রাজধানী বনে যাই। রাষ্ট্রদূতের অফিসিয়াল বাসভবনে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বনের কনিংসউইটারস্থ একটি টিলার ওপর অবস্থিত তাঁর তিনতলা বাসভবনটি। তাঁর ছেলেমেয়েরা লন্ডনে পড়াশুনারত থাকায় বাসাটির কয়েকটি শয়নকক্ষ খালি ছিল তখন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের রামর্শ দেন ঐ সময়ে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস ও ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস বেড়িয়ে আসার জন্য। সেই মােতাবেক তিনি বেলজিয়ামস্থ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব সানাউল হকের সঙ্গে আলাপ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সানাউল হক সাহেবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অতএব তিনি উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হন। ১০ই আগস্ট তারিখে সংযুক্ত সরকারী কর্মচারী পরিষদের ৩ লক্ষ ৫০ হাজার সদস্য বাকশালে’ যােগদান করেন। ১১ই আগস্ট সন্ধ্যায় হাসিনা ঢাকায় ওর মা’র সঙ্গে ফোনে কথা বলে। অতঃপর হাসিনা আমাকে জানায় যে, সেদিন ওর মা’র মন ভীষণ খারাপ ছিল। বঙ্গবন্ধু সেদিন তাঁর একমাত্র বােনের ছেলে শেখ শহীদের বিয়েতে তাঁকে যেতে না দেয়ায় তিনি ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলেন। হাসিনা আমাকে আরও বলে, “জয়ের এবং উক্ত ঘটনার কথা বলতে বলতে মা ভীষণ কাঁদছিলেন।”
৭৮। ১২ই আগস্ট সকালে আমরা ব্রাসেলসের উদ্দেশে রওনা হই এবং সেখানে পৌছাই বিকেল একটার দিকে। রাষ্ট্রদূতের বাসার তিনতলার দুটো কক্ষে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ১৩ই আগস্ট তারিখে রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবের হল্যান্ডের রাজধানী হেগ-এ যাওয়ার কথা ছিল সে দেশের সঙ্গে গুড়া দুধ সরবরাহ সম্পর্কিত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে। এই সুবাদে ১৩ই আগস্ট তারিখে তিনি আমাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে যান। হেগ শহরের কাছেই আমস্টারডাম শহরের একটি হোেটলে থাকার বন্দোবস্ত করে তিনি সে দিনই ফিরে যান ব্রাসেলসে বঙ্গবন্ধুকে উক্ত চুক্তির বিষয়ে অবহিত করার জন্যে। ১৪ই আগস্ট বিকেলে আমরা আমস্টারডাম থেকে ব্রাসেলসে ফিরে যাই। ১৫ই আগস্ট সকালে আমাদের প্যারিসের উদ্দেশে রওনা দেয়ার কথা ছিল। এই কারণে ১৪ই আগস্ট রাতে সানাউল হক সাহেবের বাসায় আমাদের জন্যে আনুষ্ঠানিক ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এক
পৃষ্ঠাঃ ২৪৪
বেলজিয়ান নাগরিকের সঙ্গে বিবাহিতা এক বাঙালী মহিলা বিজ্ঞানী ও তাঁর বিজ্ঞানী স্বামীকেও দাওয়াত করা হয়েছিল উক্ত ডিনারে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হয় রাত দশটার দিকে। এরপর ব্রাসেলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী আনােয়ার সাদাত আমাদেরকে নিয়ে যায় তার বাসায় রাত সাড়ে দশটার দিকে। সেখানে পৌছে হাসিনা বুঝতে পারে যে, আনােয়ার সাদাতের স্ত্রী ওর স্কুলের সহপাঠিনী ছিল। রাত সাড়ে বারােটার দিকে আমরা আনােয়ার সাদাতের বাসা থেকে রাষ্ট্রদূত সানাউল হক সাহেবের বাসায় ফেরার জন্য উক্ত বাসার দোতলা থেকে নীচে নেমে আসি। যদিও আমি গাড়ীর সামনের আসনে বসেছিলাম, কিন্তু রেহানা-হাসিনারা পেছনের আসনে উঠে দরজা বন্ধ করার সময় আমার বাঁ হাতের সবক’টি আঙুল উক্ত দরজার ফাঁকে আটকে পড়ে মারাত্মকভাবে পিষ্ট হয়। এই দুর্ঘটনায় আমি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে এটাসেটা ভাবতে থাকি। এক পর্যায়ে পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট তারিখে প্যারিস যাওয়ার কর্মসূচী বাতিল করার প্রস্তাব করি। কিন্তু রেহানা ও হাসিনা আমার প্রস্তাবে রাজি হলাে না।
৭৯। ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙ্গে ম্যাডাম রাষ্ট্রদূতের ডাকে। তিনি জানান যে, জার্মানীর বন থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের জন্য ফোন করেছেন। প্রথমে হাসিনাকে পাঠিয়ে দিই তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু দুই-এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে হাসিনা আমাকে জানায় যে , হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। হাসিনাকে তখন ভীষণ চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল। আমি দ্রুত নীচে দোতলায় চলে যাই। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা হেঁট করে রাষ্ট্রদূত সাহেব ধীরে ধীরে পায়চারি করছিলেন। আমাকে দেখেও তিনি কোন কথা বললেন না। ফোনের রিসিভারটি ধরতেই হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে বললেন, “আজ ভােরে বাংলাদেশে ‘কু-দে-টা হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এক্ষুণি আপনারা আমার এখানে বনে চলে আসুন।” “প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে” একথা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “এর বেশী আপাততঃ আমি আর কিছুই জানি না।” একথা বলেই তিনি আমাকে ফোনের রিসিভারটি সানাউল হক সাহেবকে দিতে বলেন। অতঃপর আমি আস্তে আস্তে তিনতলায় আমাদের কক্ষে চলে যাই। সেখানে পৌছাতেই হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে আমার কাছ থেকে জানতে চায় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কি বলেছেন। তখন আমি শুধু বললাম যে, তিনি আমাদেরকে প্যারিস যাওয়ার প্রােগ্রাম বাতিল করে সেদিনই বনে ফিরে যেতে বলেছেন। একথা বলেই আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি। সেখানে এটাসেটা ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকটা সময় কাটাই। ততক্ষণে রেহানা সজাগ হয়ে আমাদের কামরায় চলে আসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই রেহানা ও হাসিনা দু’জনেই কাঁদতে কাঁদতে বলে যে, নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আছে যা আমি তাদেরকে বলতে চাই না। তারা আরও বলে যে, প্যারিসে না যাওয়ার কারণ
পৃষ্ঠাঃ ২৪৫
তাদেরকে পরিষ্কারভাবে না বলা পর্যন্ত তারা ঐ বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। অতএব, বাধ্য হয়েই আমি তাদেরকে বলি যে, বাংলাদেশে কি একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। একথা শুনে তারা দু’বােন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাদের কান্নায় ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙ্গে যায়।
৮০। ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা বনের উদ্দেশে ব্রাসেলস ত্যাগ করি। পথে রেহানা ও হাসিনা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা বনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় পৌছাই। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হােসেন যুগােশ্লাভিয়ায় সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাফুর্টে যাত্রা বিরতি করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় উঠেছেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, ডঃ কামাল হােসেন ও হমায়ুন রশীদ চৌধুরী তিনজন মিলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া রেহানা ও হাসিনাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান। ড্রইংরুমে এভাবে কিছুক্ষণ কাটানাের পর হমায়ুন রশীদ সাহেবের স্ত্রী হাসিনাদের ওপর তলায় নিয়ে যান।
৮১। তখন ড্রইং রুমে ডঃ কামাল হােসেন, হমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও আমি ভীষণ উৎকণ্ঠিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি। এরই এক ফাঁকে আমি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই। নিরাপদ স্থানে না পৌছানাে পর্যন্ত হাসিনাদের আমি কোন কিছু জানতে দেবাে না, এই শর্তে তিনি আমাকে বললেন, “বিবিসি-এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই।” এই পরিস্থিতিতে আমাদের কোথায় আশ্রয় নেয়া নিরাপদজনক হবে, তাঁর কাছ থেকে একথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, “উদ্ভূত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোন দেশ আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়।”
৮২। পরদিন অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট সকাল আটটার দিকে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করার জন্য ডঃ কামাল হােসেন বনস্থ বিমান বন্দরে যাবেন বলে আমাকে জানানাে হয়। ডঃ কামাল হােসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে আমিও গাড়ীতে উঠে বসি। বিমান বন্দরে ডঃ কামাল হােসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দু’জনে একত্রে কিছু গােপন আলাপ করেন। অতঃপর আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মুহূর্তে আমি ডঃ কামাল হােসেন সাহেবের হাত ধরে তাঁকে বললাম, “খন্দকার মােশতাক আহমদ খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন যে, আপনি কোন অবস্থাতেই খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে আপােষ করে তাঁর মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করবেন না।”
পৃষ্ঠাঃ ২৪৬
আমার এই প্রশ্নের জবাবে ডঃ কামাল হােসেন আমাকে বললেন, “ডঃ ওয়াজেদ, প্রয়ােজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আপােষ করে আমি দেশে ফিরতে পারি না।” এই কথাগুলাে বলেই তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে চলে যান।
৮৩। বিমান বন্দর থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় ফিরে হাসিনার কাছ থেকে জানতে পারি যে, ইতিপূর্বে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর ফুফাতাে ভাই মােমিনুল হক খােকা (কাকা) ওদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তিনি আমাদেরকে লন্ডনে তাঁর কাছে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এক সময়ে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর ছােট ভাই কায়সার রশীদ চৌধুরী তাঁকে ফোন করেন। এই পরিস্থিতিতে খন্দকার মােশতাক আহমদের বিরুদ্ধে কোন কিছু না করার জন্য কায়সার চৌধুরী তাঁকে হুশিয়ার করে দেন। কায়সার রশীদ চৌধুরী, রেহানা ও হাসিনার সঙ্গেও কথা বলে তাদেরকে সান্ত্বনা দেন। অতঃপর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, রেহানা, হাসিনা ও আমাকে বলেন যে, লন্ডনে চলে যাওয়া সাব্যস্ত করলে আমরা সেখানে তাঁর বাসায় গিয়ে উঠতে পারি। তবে তিনি আমাদেরকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে, সেখানে মাত্র একটি সমস্যা আছে। ঐ বাসার নীচ তলায় কায়সার রশীদ চৌধুরী বসবাস করে এবং সে ভুট্টোর অন্ধ ভক্ত। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ১৫ই আগস্ট তারিখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, খন্দকার মােশতাক আহমদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে তৎব্যাপারে একাত্মতা ঘােষণা করার জন্য। যাহােক, ঐদিনই হমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কার্লসরুয়ে পাঠালেন সেখান থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য ভারী জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য।
৮৪। আমি সেদিন কার্লসরুয়ে গিয়ে বনে ফিরে আসি রাত সাড়ে দশটার দিকে। কিন্তু সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির কারণে অফিস বন্ধ থাকায় আমি কোন বইপত্র বা অন্য কোন জিনিসপত্র সঙ্গে আনতে পারিনি। রাত এগারােটার দিকে হমায়ুন রশীদ চৌধুরী তাঁর স্ত্রী ও আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজে গাড়ী চালিয়ে বাড়ীর বাইরে যান। পথে তিনি বলেন যে, একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের তাঁর পরিচিত একজন অফিসিয়াল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন আমাকে তাঁদের স্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যাহােক, উক্ত নির্ধারিত স্থানে পৌঁছার পর ভারতীয় সেই অফিসিয়ালের সঙ্গে তিনি আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমাকে তাঁর কাছে রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যান। ফিরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে পরামর্শ দেন যে, তাঁদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা শেষে রওনা হওয়ার সময় আমি যেন তাঁকে ফোনে অবহিত করি।
৮৫। অতঃপর ভারতীয় ঐ অফিসিয়ালের সঙ্গে আমি তাঁদের রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাই। তখন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন একজন মুসলমান জার্নালিস্ট। একটু ভয়ে ভয়ে আমাদের বিপর্যয়ের কথা আমি তাঁকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি। আমার কথা শােনার পর তিনি
পৃষ্ঠাঃ ২৪৭
আমাকে লিখে দিতে বলেন যে, আমরা ভারতীয় সরকারের কাছ থেকে কি চাই। অতঃপর তিনি সাদা কাগজ ও একটি কলম আমার হাতে তুলে দেন। তখন মানসিক দুশ্চিন্তা ও অজানা শংকায় আমার হাত কাঁপছিলাে। যাহােক, অতিকষ্টে রেহানাসহ আমার পরিবারবর্গের নাম উল্লেখপূর্বক সকলের পক্ষ থেকে আমি লিখলাম, শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয়, শিশু মেয়ে পুতলি এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট কামনা করি রাজনৈতিক আশ্রয়।”
৮৬। ১৭ই আগস্ট রােববার হমায়ুন রশীদ চৌধুরী সারাক্ষণ বাসায় ছিলেন। ঐ দিন লন্ডন থেকে আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা ও বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় রেহানা ও হাসিনাকে ফোন করেন। এক সময় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর পত্নী আমাদেরকে ফোন করে জানান যে, তিনি ঢাকায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে ইতিপূর্বে কথা বলেছেন এবং তিনি আশ্বাস দেন যে, আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। রাতে হমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, তিনি আমাদেরকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারেন কি না। আমি তাঁকে জানাই যে, হাসিনারা প্রত্যেকে মাত্র পচিশ ডলার সঙ্গে নিয়ে এসেছে। কার্লসরুয়ে গেস্ট হাউসে আমি রেহানার জন্য একটি পৃথক কক্ষ ভাড়া নিয়েছি। অতঃপর আমি তাঁকে হাসিনার সঙ্গে ঐবিষয়ে আলাপ করার জন্য পরামর্শ দিই। তখন হাসিনার সঙ্গে আলাপ করে আমরা হমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানাই যে, মাত্র হাজারখানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই আমরা মােটামুটি চালিয়ে নিতে পারবাে।
৮৭। ১৬ই আগস্ট ডঃ কামাল হােসেন লন্ডন চলে যাওয়ার পর হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী দেশের কতিপয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট আমলার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অনেক গােপন ও চাঞ্চল্যকর কাহিনী আমাকে শােনান। তিনি বলেন যে, তাঁর ছােট ভাই, কায়সার রশীদ চৌধুরী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর একান্ত সচিব ছিলেন যখন তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মন্ত্রী পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। ঐ সময় জুলফিকার আলী ভুট্টোর অনেক অপকর্ম ও কুকর্মে প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলাে কায়সার রশীদ চৌধুরীর। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কেও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে অনেক কাহিনী শােনান। তিনি তখন দিল্লীস্থ পাকিস্তানী দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৭১-এ পাকিস্তানী পক্ষ ত্যাগ করে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি সমর্থন ও আনুগত্য ঘােষণার পূর্বে তাঁকে দাফতরিক কাজে করাচী হয়ে ইসলামাবাদ যেতে হয়েছিল কয়েকবার। তখন পাকিস্তানের গােয়েন্দা বিভাগের লােকজন তাঁর গতিবিধির ওপর কড়া নজর রাখতাে। ১৯৭১-এর আগস্ট মাসে দিল্লী থেকে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ সফর শেষে ফেরার পথে করাচী বিমান বন্দরে তাঁকে গ্রেফতার করারও নির্দেশ দিয়েছিল পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য
পৃষ্ঠাঃ ২৪৮
ইসলামাবাদ থেকে তদুদ্দেশে প্রেরিত টেলেক্স বার্তাটি করাচীস্থ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিশ্বাসযােগ্য না হওয়ায় তিনি সেবার ভাগ্যক্রমে রেহাই পান। অতঃপর দিল্লী পৌছেই হমায়ুন রশীদ চৌধুরী পাকিস্তানী পক্ষ পরিত্যাগ করে তৎকালীন বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের প্রতি তাঁর সমর্থন ও আনুগত্য ঘােষণা করেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে আরও জানান যে, ১৯৭১-এ কোলকাতায় খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে তৎকালীন আওয়ামী লীগের জহিরুল কায়উম, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বিপ্লবী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিব মাহবুবুল আলম চাষী ও কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান হােসেন আলীসহ কতিপয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপন্থী প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জোর গােপন তৎপরতা চালিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাহত ও নস্যাৎ করার জন্য।
৮৮। ১৯৭৫-এ আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর রাজধানী লিমায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধু ইতিপূর্বে ডঃ কামাল হােসেন ও হমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের যথাক্রমে দলপতি ও সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। যে কারনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী নিউইয়র্ক ও লিমায় হােটেলও রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। কিন্তু ১৫ই আগস্টের ঘটনার পর খন্দকার মােশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা দখল করায় তাঁর লিমা সম্মেলনে যােগদান অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর দৃঢ় বিশ্বাস যে, খন্দকার মােশতাক আহমদ তাঁকে কোন অবস্থাতেই লিমা সম্মেলনে যেতে দেবেন না। কিন্তু তখন স্বল্প সময়ের মধ্যে নিউইয়র্ক ও লিমা হােটেলসমূহে তার পূর্ব নির্ধারিত রিজার্ভেশন বাতিল করা সহজ হবে যদি তিনি লন্ডন যান। সেই মােতাবেক হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ১৮ই আগস্ট তারিখে সপত্নীক লন্ডন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
৮৯। ১৮ই আগস্ট সােমবার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরেন দুপুর বারােটার দিকে। তিনি আমাদের সঙ্গে দুপুরে খাওয়ার সময় আমাদেরকে কার্লসরুয়ে শহরে পৌছেই যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সেসম্পর্কে আমাকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেন। এর এক ফাঁকে তাঁর সাহায্য ও সহানুভূতির প্রতীকস্বরূপ তিনি হাসিনাকে এক হাজার জার্মান মুদ্রা প্রদান করেন এবং ভবিষ্যতেও আমাদের তাঁর সাধ্যমত টাকাপয়সাসহ সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন। অতঃপর কাসরুয়ের উদ্দেশে রওনা হওয়ার মুহূর্তে ঘরের বাইরে এসে দেখি যে, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী তাঁর সরকারী রাষ্ট্রদূতের গাড়ীটি আমাদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আমাকে এও বলেন যে, কার্লসরুয়ে আমাদের জরুরী কাজগুলাে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আমি যেন ঐ গাড়ীটিকে সেখানে রেখে দেই। তাঁর এই সহমর্মিতা ও মহানুভবতায় আমি আবেগে এত অভিভূত হয়ে যাই যে, তখন আমার দু’চোখ অশ্রুতে আপ্লুত হয়ে পড়ে। এর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেয়ার
পৃষ্ঠাঃ ২৪৯
অন্য কোন ভাষা খুঁজে না পেয়ে আমি হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলাম।
৯০। ১৮ই আগস্ট বন থেকে ৩৫০ কিলােমিটার ভ্রমণ করে আমরা নিরাপদে কার্লসরুয়ে পৌছাই সন্ধ্যে সাতটার দিকে। আমাদের কার্লসৰুয়ে পৌছার সংবাদ পেয়ে সেখানে ছুটে আসে কার্লসরুয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য তখন গবেষণারত শহীদ হােসেন এবং কার্লসরুয়ে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে প্রশিক্ষণরত আমার কনিষ্ট সহকর্মী আমিরুল ইসলাম। অতঃপর হাসিনাদের গেস্ট হাউসে রেখে আমি শহীদ হােসেনকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কার্লসরুয়েতে উপস্থিতির কথা রিপাের্ট করার জন্য যাই সেখানকার বিশেষ নিরাপত্তা বিষয়ক দফতরে। ১৯শে আগস্ট আমি কার্লসৰুয়ে প্রমাণু গবেষণা কেন্দ্র থেকে আমার বইপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসি এবং অন্যান্য জরুরী কাজকর্ম সম্পন্ন করি উক্ত গাড়ীটি ব্যবহার করে। ২০শে আগষ্ট তারিখে আমরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের ঐ গাড়ীটি ফেরত পাঠিয়ে দিই। শােক ও শঙ্কায় তখন আমরা এত মূহ্যমান হয়ে পড়ি যে, আমাদের দেখাশুনার ভার নিতে হয় শহীদ হােসেন ও আমিরুল ইসলামকে। গেস্ট হাউসে আমাদের কক্ষ দু’টির পাশের কক্ষটি ভাড়া নেয়া হয় শহীদ হােসেন ও আমিরুল ইসলামের জন্য।
৯১। ২২শে আগস্ট বন থেকে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে ফোন করে ওদের (ভারতীয় দূতাবাসের) কেউ আমার সঙ্গে কার্লসরুয়েতে যােগাযােগ করেছেন কি না সেসম্পর্কে জেনে নেন। ২৩শে আগস্ট সকালে বনস্থ ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আমাকে ফোনে জানান যে, সেদিনই তার অফিসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারী কার্লসরুয়েতে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। বিকেল ২টার দিকে ঐ কর্মকর্তা ঐ গেস্ট হাউসে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখন তিনি আমাকে এও জানান যে, তিনি পরদিন অর্থাৎ ২৪শে আগস্ট সকাল ৯টার দিকে আমাদেরকে ফ্লাফুর্ট বিমান বন্দরে নিয়ে যাবেন। এদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঐ ভদ্রলােক উক্ত গেস্ট হাউসে পৌছান। অতঃপর মালপত্রসহ দুটো ট্যাক্সিতে আমরা কার্লসরুয়ে রেলওয়ে স্টেশনে যাই ফ্লাংফুর্ট শহরে যাওয়ার জন্য। নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আমি শহীদ হােসেনকেও সঙ্গে নেই। বিমান বন্দরের বহির্গমন হলে প্রবেশ করার মুহূর্তে শহীদ হােসেনের নিকট হতে বিদায় নেয়ার সময় তাকে শুধু আকার-ইঙ্গিতে জানাই যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি। উল্লেখ্য, ভারতীয় ঐ কর্মকর্তা আমাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন উক্ত ব্যাপারটি সম্পূর্ণ গােপন রাখার জন্য। শহীদ হােসেনও তখন মুখে কিছু বললাে না। সে আমাকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলাে। তখন আমাদের জন্য সহমর্মিতা ও সমবেদনায় তাঁর দু’চোখ ছিল অশ্রুতে ভরা।
৯২। আমরা এয়ার ইন্ডিয়ার একটি জাম্বাে বিমানে (পশ্চিম) জার্মানীর ফ্লার্ট থেকে দিল্লীস্থ পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করি ২৫শে আগস্ট সকাল সাড়ে আটটার দিকে। ‘আগমন হলে কাউকেও দেখলাম না আমাদের খোঁজ করতে। দেখতে দেখতে ঐ বিমানে
পৃষ্ঠাঃ ২৫০
আগত প্রায় সব যাত্রিই চলে যান। মেরামত ও নবরূপায়ণ কাজের জন্য উক্ত হলটির শীতলীকরণ সিস্টেম বন্ধ ছিল। নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কা এবং আগস্ট মাসের প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ার কারণে তখন আমার শরীর থেকে অঝােরে ঘাম করছিলাে। যাহােক, সেখানের এক কর্মকর্তার অফিস থেকে ফোনে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সঙ্গে যােগাযােগ করার চেষ্টা করলাম প্রায় পৌনে এক ঘন্টা ধরে কিন্তু কাউকে পেলাম না। ফলে, আমার দুশ্চিন্তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় উক্ত অফিস থেকে হল ঘরে এসে হাসিনাদের সেখানে দেখতে না পেয়ে ভীষণ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। যাহােক, এর একটু পরেই একজন শিখ কর্মকর্তা পাশের বিশ্রাম কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, আমি উক্ত দুই মহিলার সহযাত্রী কি না। আমি তাদের সফরসঙ্গী জেনে শিখ কর্মকর্তাটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঐ যুবতী মহিলাদ্বয়কে ঐ দুই বাচ্চাসহ ভিআইপি হিসেবে এই বিমান বন্দর হয়ে যেতে দেখেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে, আজকে তাঁদের কি নিদারুণ করুণ অবস্থা। এটা একেবারেই একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য।”
৯৩। প্রায় আধঘন্টা পর ঐ শিখ কর্মকর্তাটি আমাকে জানান যে, কতিপয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অতি শিগগির সেখানে পৌছবেন আমাদের ব্যাপারে কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য। এরও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর দুইজন কর্মকর্তা এলেন আমাদের খােজে। তাদের একজন নিজেকে ভারত সরকারের মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব বলে পরিচয় দিলেন। বিমান বন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়। অতঃপর ঐ দুই কর্মকর্তা আমাদেরকে দুটো ট্যাক্সিতে বিমান বন্দর থেকে নয়াদিল্লীর ডিফেন্স কলােনীর একটি বাসায় নিয়ে যান। তখন ভারতীয় সময় দুপুর ১টা। সুদীর্ঘ চার ঘন্টা বিমান বন্দরে অপেক্ষা, দিল্লীর প্রচণ্ড আবহাওয়া, পারিবারিক শােক, নিজেদের নিরাপত্তা এবং নানান দুশ্চিন্তা ও শঙ্কায় আমি তখন শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক দিয়ে দারুণভাবে বিপর্যস্ত।
৯৪। ডিফেন্স কলােনীর বাড়ীটির নীচতলায় ডাইনিং-কাম-ড্রইংরুম এবং প্রত্যেকটি সংযুক্ত বাথরুমসহ দুটো শয়নকক্ষ। এর ছাদে সংযুক্ত বাথরুমসহ একটি শয়নকক্ষ যা তখন গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। দুপুরের খাবার ও বিকেলের চা-নাস্তা খাওয়ার পর ঐ দুই কর্মকর্তা চলে যান। ঐ বাড়ীর জানালায় কোন গ্রীল ছিলাে না। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই রাতে রেহানাসহ সবাই মিলে একই শয়নকক্ষে থাকার। পরদিন অর্থাৎ ২৬শে আগস্ট উক্ত কর্মকর্তাদ্বয় ঐ বাসায় আসেন আমাদের খবরাখবর জানার জন্যে। তারা আমাকে পরামর্শ দেন সবকিছু বিস্তারিতভাবে উল্লেখপূর্বক জার্মানীর আমার ঐ স্কলারশিপটি কয়েক মাসের জন্য সংরক্ষিত রাখার অনুরােধ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখতে। অতঃপর ২৭শে আগস্ট তারিখে আমি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ঐমর্মে পত্র পাঠাই।
পৃষ্ঠাঃ ২৫১
৯৫। ঐ বাড়ীর চত্বরের বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারােরও নিকট আমাদের পরিচয় না দেওয়া কিংবা দিল্লীর কারােও সঙ্গে যােগাযােগ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিলাে আমাদের সকলকে। অতএব নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঐ বাড়ীর অতি ক্ষুদ্র চত্বরের মধ্যে আবদ্ধ থাকি আমরা সকলেই। আমি রাতে শুয়ে সারাক্ষণ জেগে থাকতাম এক রকম নিরাপত্তা প্রহরীর মত। মাঝে মাঝে জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরের গেটের দিকে তাকাতাম। রাতে কয়েক ঘন্টা পর পর গেটে প্রহরারত দারােয়ানের সঙ্গে বাইরের লােকের ফিসফিস কথা বলা সন্দেহের উদ্রেক করতাে। এরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে মাঝে মধ্যে হাসিনাকে সজাগ করতাম। সারা ভারতে তখন জরুরী অবস্থা আইন বলবৎ ছিল। সংবাদপত্রে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিশেষ কোন সংবাদ প্রকাশিত হতাে না। কাজেই তখনকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে আমরা থাকি সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এভাবেই অতিবাহিত হয় সপ্তাহ দুয়েক।
৯৬। ইতােমধ্যে রেহানাসহ বাচ্চারা চক্ষুপীড়ায় (কনজাংটিভাইটিসে) আক্রান্ত হয়। এমন সময়ে একদিন ভারত সরকারের উক্ত যুগ্ম সচিব হাসিনা ও আমাকে জানান যে, ঐ রাতে আটটায় আমাদের দু’জনকে অন্য এক বাসায় নেওয়া হবে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য। সে রাতে সেই বাসায় যাওয়ার পথে অপর একটি গাড়ীতে আমাদের সংগে যান একজন অতি উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা। সেখান থেকে মিনিট পনের জার্নি করার পর আমরা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে পৌছাই। অতঃপর অতি উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন ঐ কর্মকর্তা আমাদের দু’জনকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের একটি মাঝারি ধরনের বৈঠকখানায় নিয়ে যান। একটি লম্বা সােফায় হাসিনাকে বসানাে হয় আর আমাকে আর একটি লম্বা সােফায়। এর প্রায় মিনিট দশেক পর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী উক্ত কক্ষে প্রবেশ করে হাসিনার পাশে বসেন। সামান্য কুশলাদি বিনিময়ের পর ইন্দিরা গান্ধী আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, আমরা ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে পুরােপুরি অবগত রয়েছি কি না। এর জবাবে আমাদের জার্মানীর বনে থাকাকালীন সময়ে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাকে ‘রয়টার’ পরিবেশিত এবং ঢাকাস্থ বৃটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত যে দুটো ভাষ্যের কথা বলেছিলেন আমি তার পুনরুল্লেখ করি। অতঃপর ইন্দিরা গান্ধী সেখানে উপস্থিত ঐ কর্মকর্তাকে ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষপ্রাপ্ত তথ্য জানাতে বলেন। তখন উক্ত কর্মকর্তা দুঃখভারাক্রান্ত মনে ইন্দিরা গান্ধীকে জানান যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এই সংবাদে হাসিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধী তখন হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টায় বলেন, ‘তুমি যা হারিয়েছে তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তােমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তােমার ছেলেকেই তােমার আহ্বা এবং মেয়েকে তােমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এ ছাড়াও তােমার ছােট বােন ও তােমার স্বামী রয়েছে তােমার সঙ্গে। এখন তােমার ছেলে-মেয়ে ও বােনকে মানুষ করার ভার তােমাকেই নিতে হবে। অতএব এখন তােমার কোন অবস্থাতেই ভেঙ্গে
পৃষ্ঠাঃ ২৫২
পড়লে চলবে না।” উল্লেখ্য, ১৯৭৬-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতা থাকাকালে শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এটাই ছিল আমাদের একমাত্র সাক্ষাৎকার।
৯৭। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ঐ সাক্ষাৎকারের তিন-চার দিন পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে নয়াদিল্লীস্থ ভারতের স্বাধীনতায় যারা আত্মাহুতি দিয়েছে তাঁদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ‘ইন্ডিয়া গেটে’-এর নিকটবর্তী পান্ডারা রােডস্থ প্রতিতলায় দু’টি ফ্লাটের একটি সরকারী দোতলা বাড়ীর উপর তলার একটি ফ্ল্যাট আমাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়। ফ্লাটগুলােতে দুটো করে শয়নকক্ষ। এ ফ্লাটটিতে তখন কোন আসবাবপত্র ছিলাে না। যাহােক, আস্তে আস্তে বাজার থেকে ভাড়ায় কিছু আসবাবপত্র সংগ্রহ করে আমাদের জন্য বন্দোবস্ত করা হয়। অতঃপর ১লা অক্টোবর সাময়িক ও দৈনিক ভিত্তিতে ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশন থেকে আমার জন্য একটি পােস্ট-ডক্টরাল ফেললাশীপের বন্দোবস্ত করা হয়। ঐ ফেলােশীপের শর্তানুসারে বাসা ও অফিসে যাতায়াতের সুবিধাদির অতিরিক্ত আমাকে দৈনিক প্রদান করা হতাে বাষট্টি রুপী (ভারতীয় মুদ্রা) পঞ্চাশ পয়সা মাত্র। ঐ বাসাতেও আমাদেরকে একই নিয়ম পালন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। অর্থাৎ বাইরের কারােও নিকট আমাদের পরিচয় না দেওয়া, কারােও সংগে কোনরূপ যােগাযােগ না করা এবং নিরাপত্তা প্রহরী ব্যতিরেকে বাইরে না যাওয়া আমাদের জন্য অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব বলে আমাদের সকলকে স্মরণ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। সময় কাটানাে ও নিজেদের ব্যস্ত রাখার জন্য আমাদের বাসায় সরবরাহ করা হয় একটি ভারতীয় ‘সাদাকালাে টেলিভিশন। এ ছাড়া আমার একটি নিজস্ব ট্রানজিসটারও ছিলাে। ঐ বাসায় কোন টেলিফোন সরবরাহ করা হয়নি। সুতরাং বাংলাদেশ সম্পর্কে খবরাখবর রাখার আমাদের একমাত্র উপায় ছিলাে আমার ঐ ব্যক্তিগত ট্রানজিসটার।
৯৮। ৩রা অক্টোবর (১৯৭৫) তারিখে আমি ভারতীয় আণবিক শক্তি কমিশনের অধীন আণবিক খনিজ বিভাগের দিল্লীস্থ কেন্দ্রে যােগদান করি। উক্ত কেন্দ্রের প্রায়ােগিক পদার্থ বিজ্ঞান শাখার সঙ্গে আমাকে সংযুক্ত রাখা হয়। তখন এবং ভারতে আমার সারা অবস্থানকালে উক্ত কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন শ্রী জি. আর. নারায়ণ দাস। উক্ত অফিস প্রধান এবং পদার্থ বিজ্ঞান শাখার বিজ্ঞানী ব্যতীত অন্য কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীর নিকট আমার পরিচয় না দেওয়ার জন্য আমাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। শুরুতেই, উক্ত কেন্দ্রের খরচে পরমাণু চুল্লীর তাত্ত্বিক বিষয়াদি সম্পর্কিত ১০-১৫টি পুস্তক আমাকে সরবরাহ করা হয়। একই সংগে দিল্লীস্থ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনােলজীIIT)-এর পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সঙ্গে আমাকে সংযুক্ত করা হয়। তখন ঐ পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক এম. এস. সুডা(Sodha)।
৯৯। ইত্যবসরে বাংলাদেশের কিছু কিছু খবর আমার গােচরীভূত হয়। খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্র জাতীয় সংবিধান ও এতে উল্লেখিত চারটি মূল রাষ্ট্রীয় নীতি
পৃষ্ঠাঃ ২৫৩
অপরিবর্তিত এবং জাতীয় সংসদ বহাল রেখে রাষ্ট্রপতির নিকট যাবতীয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে জারি করে একটি বিশেষ অধ্যাদেশ। ২৩শে আগস্ট তারিখে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও খুনী মেজর চক্রের নির্দেশে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম. মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ, এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান, আব্দুস সামাদ আজাদ, শেখ আব্দুল আজিজ, এম কোরবান আলী, আব্দুল কুদুস মাখন, হাশেম উদ্দিন পাহাড়ী ও গাজী গােলাম মােস্তফা (গামা)সহ ২৬ জন ‘বাকশালের বিশিষ্ট নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। একই তারিখে খন্দকার মােশতাক আহমদ ও খুনী মেজর চক্র সারাদেশে সামরিক বিধি জারিপূর্বক এর আওতায় কয়েকটি বিশেষ সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করে। ২৪শে আগস্ট তারিখে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফের পদ হতে অপসারিত করে তাঁর স্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নিয়ােগ করা হয়। একই তারিখে জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির (খন্দকার মােশতাক আহমদের) সামরিক উপদেষ্টা নিয়ােগ করা হয়। ২৭শে আগস্ট তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন চীফ সেক্রেটারী শফিউল আজমকে বাংলাদেশ মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সেক্রেটারী নিয়ােগ করা হয়। ২৮শে আগস্ট তারিখে একটি সরকারী আদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের দেশে ৬১টি জেলা গঠন এবং সেসবের জন্য গভর্নর নিয়ােগ আদেশ বাতিল করা হয়। ৩০শে আগস্ট তারিখে একটি সরকারী আদেশে সারাদেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। ৩১শে আগস্ট তারিখে এই প্রথম গণচীন খন্দকার মােশতাক আহমদ ও খুনী মেজর চক্রের সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে।
১০০। ১লা সেপ্টেম্বর এক সরকারী আদেশে বঙ্গবন্ধুর কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) সংক্রান্ত আদেশ বাতিল করা হয়। ২রা সেপ্টেম্বর তারিখে তৎকালীন বাংলাদেশ রেডক্রস সমিতির চেয়ারম্যান, গাজী গােলাম মােস্তফাকে গ্রেফতার করা হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর তারিখে ‘বাকশালের’ এডভােকেট জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। একই তারিখে ঘােষণা করা হয় যে, পরবর্তী দশ দিনের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় বেআইনী অস্ত্র জমা দেবেন তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে। ১১ই সেপ্টে তারিখে ঝালকাঠির সংসদ সদস্য এবং ‘বাকশালের সদস্য আমির হােসেনকে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়। ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে ‘বাকশালের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য জনাব মহিউদ্দিন আহমদ খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের বিশেষ দূত হিসেবে মস্কো গমন করেন। ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্র অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদে ইস্তফা প্রদানে বাধ্য করে। একই তারিখে ডঃ মযহারুল ইসলামকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ থেকে অপসারিত করে তাঁর স্থলে সৈয়দ আলী আহসানকে নিয়ােগ করা হয়। ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে নিউইয়র্কে খুনী
পৃষ্ঠাঃ ২৫৪
খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্র কর্তৃক নিযুক্ত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পাকিস্তানের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমদের সঙ্গে বিশেষ আলােচনা বৈঠক করেন। বঙ্গবন্ধু তার পরিবার-পরিজন ও নিকটতর আত্মীয়স্বজনের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড সহ ১৫ই আগস্টের ‘কু- দে-টা’ -এর সংগে যারা পরােক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তারা এর দায় থেকে যাতে অব্যাহতি পেতে পারেন, যাতে তাদের আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াতে না হয় তজ্জন্য খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ২৬শে সেপ্টেম্বর তারিখে জারি করেন একটি ক্ষমা প্রদর্শন (ইনডেমনিটি) অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ (১৯৭৫ সালের ১৯ ন অর্ডিন্যান্স)। এই অর্ডিন্যান্সে বলা হয় যে, ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫)এর পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত কারােরও বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে দেশের কোন আদালতে কোন অভিযােগ পেশ করা যাবে না। ৩রা অক্টোবর তারিখে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ এক রেডিও ও টেলিভিশন ভাষণে ১৯৭৭ সানের ২৮শে ফেব্রুয়ারী তারিখে জাতীয় সংসদের জন্য দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘােষণা করেন। ৫ই অক্টোবর তারিখে খুনী চক্রের সরকার জাতীয় রক্ষী বাহিনীকে দেশের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে।
১০১। আরও খবর পাওয়া যায় যে, নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্র বেআইনী অস্ত্র উদ্ধারের নামে সমগ্র দেশে সৃষ্টি করে এক ত্রাসের রাজত্ব। তন্ন তন্ন করে খুজে গ্রেফতার করা হয় হাজার হাজার বঙ্গবন্ধুর অনুসারীকে। গ্রেফতারকৃতদের ওপর চালানাে হয় অমানবিক দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন। খুনী চক্রের এহেন নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য শত শত বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও ‘বাকশালের কর্মী ও নেতা গােপনে আশ্রয় গ্রহণ করে বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন এলাকায়। এদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর তিন ভাগ্নে, আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, যুবলীগের ওবায়েদুল কাদের, ইসমত কাদির গামা, রবিউল আলম মােক্তাদীর চৌধুরী, মােহাম্মদ নাসিম, মােস্তফা মহসিন মন্টু এবং ‘বাকশালের আনােয়ার চৌধুরী, সামসুদ্দিন মােল্লা, সিদ্দিক হােসেন, নুরুল ইসলাম ভান্ডারী, পীযুষ কান্তি ভট্টাচার্য, এস. এম. ইউসুফ, শাহ মােহাম্মদ আবু জাফর, লতিফ সিদ্দিকী, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, পংকজ ট্টাচার্য, খােকা রয়, ডাঃ এস. এ. মালেক প্রমুখ। আরও খবর পাওয়া যায় যে, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী তার অনেক অনুসারীকে সঙ্গে নিয়ে আগষ্ট মাসের শেষের দিকে ভারতের মেঘালয়ে আশ্রয় নিয়ে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্রকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে উৎখাতের অভিযান শুরু করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর তরুণ ভক্ত ও অনুসারীদের প্রতি আহবানও জানান তাঁর প্রতিরােধ সপ্তামে শরীক হওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর শত শত তরুণ ভক্ত ও অনুসারী সাড়াও দিয়েছিলাে তাঁর উক্ত আহবানে।
পৃষ্ঠাঃ ২৫৫
১০২। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর আমলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তানের দালালী ও স্বাধীনতাবিরােধী, সন্ত্রাসবাদ, নাশকতা, গুপ্তহত্যা ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের সুনির্দিষ্ট অভিযােগে যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছিল খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্র তাদের পাইকারী হারে মুক্তি দেয়। ফলে, অল্প দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও উগ্র বামপন্থীদের শুরু হয় উদগ্র আস্ফালন। আবার বাংলাদেশের দিকে ধূমায়িত হয়ে উঠতে থাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প। খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতাকে তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে পাঠান সৌদি আরব ও পাকিস্তানে। একই সময়ে পি. ডি. পি. , মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে খুনী, খন্দকার মােশতাক আমহদ চক্রের চলতে থাকে দেন-দরবার। এই সমস্ত দেন-দরবারে আলােচিত হয় (১) বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে নিয়ে কনফেডারেশন গঠন, (২) বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজান্ত্র ঘােষণা, (৩) বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার পরিবর্তন এবং (৪) বাঙ্গালী ও পাকিস্তানীদের ডবল নাগরিকত্ব প্রদানের প্রশ্নসমূহ। এই দেন-দরবার চলাকালেই ‘বাংলাদেশের ভাইদের জন্য পাকিস্তানী ভাইদের শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ’ চাউল ও কাপড় নিয়ে একটি পাকিস্তানী জাহাজ এসে পৌছায় চট্টগ্রাম বন্দরে। একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে উক্ত পাকিস্তানী জাহাজকে স্বাগত জানানাে হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানী ‘জাহাজ বরণের’ সেই দৃশ্য ঘটা করে টেলিভিশনেও প্রদর্শিত হয় বলে জানা যায়।
১০৩। ইত্যবসরে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ জাতীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ১৬ই অক্টোবর তারিখে একটি বৈঠকে মিলিত হওয়ার কর্মসূচী ঘােষণা করেন। ১৫ই অক্টোবর সংসদ সদস্যরা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে পরের দিনের বৈঠক সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করেন। এই আলােচনাকালে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ আহূত বৈঠকে যােগদান করা না করা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়। ১৬ই অক্টোবর সকালে এম. পি. হােস্টেলে সংসদ সদস্যরা পুনরায় একটি পূর্ণাংগ বৈঠকে মিলিত হন। জানা যায় যে, এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় এবং তাঁর আদর্শে অবিচল থাকার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। বিচিত্র ও বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অবিচল থাকার শপথ ঘােষণার পর মুহূর্তেই সংসদ সস্যরা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে সােজাসুজি বঙ্গভবনে চলে যান খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে পূর্বে আহুত বৈঠকে যােগ দিতে। তা সত্ত্বেও, উক্ত বৈঠকে কুমিল্লার এডভােকেট সিরাজুল হক খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘যেহেতু আপনি বৈধভাবে দেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হননি, সেইহেতু আমার বক্তৃতায় আমি আপনাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে সম্বােধন না করে, প্রিয় মােশতাক ভাই হিসেবে সম্বােধন করতে চাই।” অন্যান্য বক্তারাও তাঁদের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং তাঁর রুহের মাগফেরাত কামনা করেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৫৬
উক্ত বৈঠকের দু’দিন পরেই সরকারী পত্রিকা বাংলাদেশ টাইমস জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দেওয়ার দাবী জানায়।
১০৪। ১৬ই অক্টোবর তারিখে এয়ার ভাইস মার্শাল এ. কে. খন্দকারকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধানের পদ হতে অপসারিত করে তাঁর স্থলে এয়ার ভাইস মার্শালের পদমর্যাদায় পাকিস্তানপন্থী এম. জি. তােয়বকে নিযুক্ত করা হয়। ২১শে অক্টোবর তারিখে দেশের প্রত্যেক জেলা সদর দফতরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করা হয়। ২৩শে অক্টোবর শ্রমিক নেতা সায়েদুল হক সাদকে সামরিক আইনে গ্রেফতার করা হয়। ২৯শে অক্টোবর সরকার ৭টি সাপ্তাহিকী ও সাময়িকীর ডিক্লারেশন পুনর্বহাল করে। একই তারিখে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্র বঙ্গবন্ধুর জীবিত আত্মীয়-স্বজনের কাউকে কোন সংবাদ না দিয়ে, এমনকি তাঁদের অনুপস্থিতিতে ধানমন্ডীর ৩২ বম্বর সড়কস্থ তাঁর নিজ বাড়ীতে প্রাপ্ত সম্পত্তির হিসেব প্রকাশ করে।
১০৫। ইতিপূর্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের খাটি ভক্ত ও অনুসারীরা নিজেদের মধ্যে ব্যাপক যােগাযােগ ও আলােচনার পর গঠন করে জাতীয় সংগ্রাম পরিষদ’। ২০শে অক্টোবর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রলীগের একটি মিছিল বের হয়। মিছিলকারীরা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ও অন্যান্য শ্লোগান দেয়। পরদিন পুনরায় অনুরূপ মিছিল বের হলে ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীদের ওপর হামলা চালায় খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্রের ছাত্র নামধারী ভাড়াটে লােকজন। ফলে, বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও অনুসারীদের অনেকেই আহত ও গ্রেফতার হয়। ২২শে অক্টোবর ছাত্রলীগ কর্মীরা আরাে সংগঠিত হয়ে পুনরায় মিছিল বের করে। সেদিন সরকারের দালালরা হামলা চালালে তারা তার সমুচিত জবাব প্রদান করে। ছাত্রসমাজ তাদের আন্দোলনকে ব্যাপকতর করা এবং জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশে ৪ঠা নভেম্বর শােকদিবস পালন ও শােক মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের কর্মসূচী গ্রহণ করে।
১০৬। ইতিপূর্বে আরও খবর পাওয়া যায় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে খুনী মেজর চক্রের বিরুদ্ধে সঞ্চার হয়েছিল তীব্র অসন্তোষ। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব ও কলংকের অংশগ্রহণে অনীহা ছাড়াও আরেকটি কারণ ছিলাে এই অসন্তোষের পেছনে। উক্ত কারণটি ছিল সশস্ত্র বাহিনীর শৃংখলা ও মর্যাদার প্রশ্ন। সেনাবাহিনী থেকে বিতাড়িত মুষ্টিমেয় কর্মকর্তার চক্রটি সেনাবাহিনীর ভেতরের একটি ক্ষুদ্রাংশ কনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের সহায়তায় ট্যাংক বহর বের করে নিয়ে যেভাবে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদেরকে যেভাবে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করে, তা ছিল সামগ্রিকভাবে সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ও শৃঙ্খলার প্রতি আঘাতস্বরূপ। ফলে, মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তারা তাে বটেই, সাধারণভাবেই সশস্ত্র বাহিনীর জ্যেষ্ঠ ও অন্যান্য কর্মকর্তারা ঐ খুনী
পৃষ্ঠাঃ ২৫৭
মেজর চক্রটির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ঐ খুনী মেজর চক্রটির ক্ষমতার দাপট যতােই বৃদ্ধি পেতে থাকে তাঁদের বিরুদ্ধে এই অসন্তোষও ততই বাড়তে থাকে। এই বিক্ষোভ চরমে ওঠে যখন সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের সরিয়ে সেখানে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত পাকিস্তানপন্থী কর্মকর্তাদের পদস্থ করা শুরু হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা যায় যে, অচিরেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, ব্রিগেডিয়ার নজমুল হুদা, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, কর্নেল শাফাত জামিল, কর্নেল হায়দার প্রমুখ বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধাদের পদচ্যুত করা হবে।
১০৭। ৩রা নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে রেহানা, হাসিনা ও আমাকে জানায় যে, বাংলাদেশ রেডিও থেকে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তখন আমরা তিনজন মিলে চেষ্টা করতে থাকি বাংলাদেশ রেডিওর ঢাকা স্টেশন ধরার। কিন্তু প্রায় একঘণ্টা চেষ্টাতেও কোন ফল হলাে না। ভারতীয় সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে বাংলাদেশ রেডিওর ঢাকা স্টেশনের অনুষ্ঠান ধরা পড়ে। তখন উক্ত রেডিও স্টেশন থেকে ঘন ঘন বলা হচ্ছিল যে, খালেদ মােশাররফকে ব্রিগেডিয়ারের পদ হতে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। রাত সাড়ে আটটার দিকে ঐ রেডিও স্টেশন থেকে আরও বলা হয় যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিহত হয়েছেন। ৪ঠা নভেম্বর সকালে ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে এক ঘােষণায় বলা হয় যে, মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নতুন চীপ অব স্টাফ নিযুক্ত করা হয়েছে। ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে আরও বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতির মন্ত্রী পরিষদ থেকে চারজন প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, যাদের মধ্যে তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনকে ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঐ দিনই ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে প্রথম জানানাে হয় যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২রা অক্টোবর দিবাগত রাতে নিহত চারজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন—সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম. মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান। রাত ১০টার দিকে ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে আরও বলা হয় যে, কারাগারে নিহত চার নেতার মরদেহ তাদের আত্মীয়-পরিজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। রাত এগারটার দিকে ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে আরও এক ঘােষণায় বলা হয় যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। ঢাকা রেডিও স্টেশনের একই ঘােষণায় ৫ই নভেম্বরে পূর্ব আহূত হরতালের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, “দেশে সামরিক আইন বলবৎ রয়েছে এবং সামরিক আইন চালু থাকাকালে কোনরকম হরতাল বা বিক্ষোভ প্রদর্শন করা যাবে না।”
১০৮। ৫ই নভেম্বর রাত সাড়ে আটটার দিকে ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে ঘােষণা করা হয় যে, রাষ্ট্রপতি সামরিক বিধি সংশােধন করে তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ােগের বিধান সৃষ্টি
পৃষ্ঠাঃ ২৫৮
করেছেন এবং তদনুসারে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব এ.এস.এম. সায়েমের অনুকূলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। পরদিন, অর্থাৎ ৬ই নভেম্বর নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েম। ঐ তারিখ রাত আটটার দিকে প্রেসিডেন্ট সায়েম বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়ে প্রেসিডেন্ট সায়েম জাতীয় সংসদ বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। উক্ত ভাষণে তিনি আরও বলেন যে, তাঁর সরকার একটি নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় সরকার এবং ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীর মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই তাঁর সরকারের লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনভাবেই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জড়িত নয় এবং উক্ত নেতাদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
১০৯। ইতােমধ্যে বিভিন্ন সূত্রে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে আরও অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ৩রা নভেম্বর ভাের রাতে খুনী মেজর চক্রের একটি দল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যায়। কারাগারের ভেতর প্রবেশ করতে চাইলে জেলর তাদের ঢুকতে দিতে অস্বীকৃতি জানান। খবর পেয়ে কারাগারসমূহের ইন্সপেক্টর জেনারেলও আইনগত বিধিনিষেধ উল্লেখ করে একইভাবে তাদের কারাগারের ভেতরে প্রবেশে বাধাপ্রদান করেন। এক পর্যায়ে জেলের পাগলা ঘন্টি বাজিয়ে জেলরক্ষীরা জোর করে কারাগারে প্রবেশেচ্ছুক খুনী মেজর চক্রের ঐ দলকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তখন খুনী মেজর চক্রের ঐ দলটি জেলরকে জানায় যে, স্বয়ং রাষ্ট্রপতির নির্দেশে তারা সেখানে এসেছে কতিপয় রাজবন্দীদের সঙ্গে কথাবার্তা ও আলাপ-আলােচনা করার জন্য। এই পর্যায়ে জেলর বঙ্গভবনে ফোন করেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এ ব্যপারে কথা বলার জন্য। তখন খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ফোনে জেলরকে বলেন, “আমার নির্দেশেই তারা সেখানে গিয়েছে। তাদেরকে কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে কিনা। তৎসম্পর্কে জেলর জানতে চাইলে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ, “হ্যা, আমি তাদের এ ব্যাপারে অনুমতি প্রদান করেছি” বলেই ফোনের রিসিভারটি রেখে দেন। খন্দকার মােশতাক আহমদের ফোনের ঐ কথাবার্তাগুলাে খুনী মেজর চক্র টেপ করেছিল বলে জানা যায়। অতঃপর খুনী মেজর চক্রের ঐ দলটিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। তারা তখন কারাগারের বিভিন্ন কক্ষ থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম. মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে এনে একটি কক্ষে আবদ্ধ করে স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ার এবং বেয়নেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
পৃষ্ঠাঃ ২৫৯
১১০। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ এবং খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্রকে উৎখাতের উদ্দেশে ৩রা নভেম্বর ভাের রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে যে সামরিক অত্যুথান সংগঠিত হয়েছিল তাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ঢাকাস্থ পদাতিক ডিভিশন এবং বিমান বাহিনীর একটি অংশ অংশগ্রহণ করেছিল। অ্যুথানকারীরা খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের অবস্থানস্থল বঙ্গভবন অবরােধ করে ফেলেন, ঢাকা রেডিও স্টেশন দখল করেন, সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসভবন অবরােধ করেন এবং খুনী মেজর চক্রকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু ট্যাংক বাহিনীর পাকিস্তানপন্থী সদস্যদের সমর্থনপুষ্ট খুনী মেজর চক্রটি আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানায়। এই পর্যায়ে একটি জীপে সাদা পতাকা উড়িয়ে সেখানে হাজির হন জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী। তিনি খালেদ মােশাররফ এবং খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ ও মেজর চক্রকে শান্তিপূর্ণভাবে আলাপ-আলােচনায় একটি পরস্পর গ্রহণযােগ্য সমাধান খুঁজে বের করার প্রস্তাব দেন। দুই পক্ষই উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হন। ৩রা নভেম্বর সারাদিন অতিবাহিত হয় উক্ত আলাপ-আলােচনায়। অবশেষে, নিরাপদে বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করা হবে, এই শর্তে খুনী মেজর চক্রটি আত্মসমর্পণে সম্মত হয়। অতঃপর ৩রা নভেম্বর রাত আটটার দিকে খুনী মেজর চক্রটির লােকজনদের বাংলাদেশ বিমানের একটি বিমানে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে পৌছেই খুনী মেজর চক্রটির নেতা (তথা) লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের হত্যা করার কথা স্বীকার করেন। খুনী লেঃ কর্নেল ফারুকের সঙ্গে অন্যান্য যাঁরা তখন ব্যাংককে পালিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন (১) লেঃ কর্নেল (অবঃ) খন্দকার আব্দুর রশিদ, (২) মেজর (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম, (৩) মেজর (অবঃ) আজিজ পাশা, (৪) মেজর (অবঃ) মহিউদ্দিন, (৫) মেজর (অবঃ) শাহরিয়ার, (৬) মেজর (অবঃ) বজলুল হুদা, (৭) মেজর (অবঃ) রাশেদ চৌধুরী, (৮) মেজর (অবঃ) নূর, (৯) মেজর (অবঃ) শরফুল হােসেন, (১০) লেফটেন্যান্ট (অবঃ) কিসমত হােসেন, (১১) লেঃ খায়রুজ্জামান, (১২) লেঃ (অবঃ) আব্দুল মাজেদ, (১৩) হাবিলদার (অবঃ) মােসলেউদ্দিন, (১৪) নায়েক মারফত আলী এবং (১৫) নায়েক (অবঃ) মােঃ হাশেম।
১১১। পূর্ব ঘােষণা অনুযায়ী ৪ঠা নভেম্বর সকালে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ শােক মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য বিপুল সংখ্যক ছাত্র, বাকশাল ও যুবলীগের নেতা ও কর্মী, শ্রমিক ও জনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সমবেত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা হতে নীরব শােক মিছিলটি ধানমন্ডীর ৩২ নম্বর রােডস্থ বঙ্গবন্ধুর বাসায় যাওয়ার পথে নীলক্ষেত পুলিশ ব্যারাকের কাছে পৌছলে পুলিশ প্রথমে বাধা প্রদান করে। পরে অবশ্য পুলিশ মিছিলকারীদের পথ ছেড়ে দেয় এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবন পর্যন্ত মিছিলটিকে অনুসরণ করে। উক্ত মিছিলটি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে পৌছলে সেখানে
পৃষ্ঠাঃ ২৬০
এক অবর্ণনীয় শােকাবহ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। বাড়ীর ফটক ছিল তালাবদ্ধ। সশস্ত্র পুলিশ ছিলাে পাহারায়। মিছিলের কাউকেই বাড়ীর চত্বরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। বাড়ীর বাইরে দাড়িয়েই মিছিলকারীদের বঙ্গবন্ধুর বাসার অলিন্দে পুষ্পবর্ষণ করতে হয়। জনতার বিপুল অংশের মধ্যে তখন কান্নার রােল। সকলের দু’চোখ মর্মবেদনার অশ্রুতে ভরে ওঠে। বেতার ও সংবাদপত্র নীরব থাকলেও সেদিন লােকমুখে সারা ঢাকা শহরে প্রচারিত হয়ে যায় যে, খুনী মেজর চক্রের লােকজন ৩রা নভেম্বর রাতে দেশ থেকে পালিয়ে গেছে। অতএব ছাত্র-যুব নেতারা এক বৈঠকে মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের এবং ‘বাকশালের’ চার জাতীয় নেতার হত্যার প্রতিবাদে ৫ই নভেম্বর দুপুর বারােটা পর্যন্ত হরতাল পালন এবং ঐ দিন দুপুর ১টায় বায়তুল মােকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে মরহুমদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানের কর্মসূচী ঘােষণা করেন।
১১২। আরও জানা যায় যে, ৪ঠা নভেম্বর সন্ধ্যায় খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের সুনিশ্চিত পতনের মুখে তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্য ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মুহম্মদুল্লাহ এক বৈঠকে মিলিত হয়ে পাইকারী পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁরা সকলে একত্রে বঙ্গভবনে গমন করেন। খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে সেখানে তাঁদের। বৈঠক চলাকালেই বঙ্গভবনে গিয়ে পৌছেন (তখন) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ও কর্নেল শাফাত জামিল। কর্নেল শাফাত জামিল খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদকে উদ্দেশ্য করে বলেন, জাতির জনককে, দেশের প্রেসিডেন্টকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে আপনি প্রেসিডেন্ট সেজে বসেছেন। আপনাকে এর পরিণাম ভােগ করতে হবে”। তখন বঙ্গভবনে উপস্থিত জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী খন্দকার মােশতাক আহমদের সমর্থনে কিছু বলতে চেষ্টা করেন। কর্নেল জামিল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “আপনি দয়া করে থামুন, আপনি সব সময়ই খুনীদের পক্ষ সমর্থন করেন।” সে রাতে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের মন্ত্রীদের রাত তিনটা পর্যন্ত বঙ্গভবনে আটকে রাখা হয়। রাত তিনটার পর সবাই নিজ নিজ বাড়ীতে চলে যাওয়ার অনুমতি পান। কিন্তু খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ অঘােষিত বন্দী অবস্থায় বঙ্গভবনেই অবরুদ্ধ হয়ে থাকেন।
১১৩। ৩রা নভেম্বরের (১৯৭৫) অ্যুথানের পরে ‘রক্তপাত পরিহার করার উদ্দেশে আপােষ আলােচনার নামে কালক্ষেপণ করে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ চক্র এবং খালেদ মমাশাররফের বিরােধী অন্যান্য শক্তি দেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে দ্রুত যােগাযােগ করে পাল্টা অ্যুথানের জন্য চেষ্টা করতে থাকে। জানা যায় যে, জনৈক বাচ্চু করিম পাকিস্তান প্রত্যাগত পাকিস্তানপন্থী সিপাহীদের, জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী সেনাবাহিনীতে কর্মরত প্রাক্তন মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের এবং কর্নেল (অবঃ) তাহের সেনাবাহিনীতে জাসদপন্থী সিপাহীদের এ জাতীয় অভুথানের ব্যাপারে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চালাতে থাকেন। এই সময় মার্কিন-গণচীন-পাকিস্তানপন্থী শক্তিগুলাে সর্বাত্মক অপপ্রচার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। জাতীয়
পৃষ্ঠাঃ ২৬১
সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এই প্রচার অভিযানে সামিল হয়। ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য শহর ও বন্দরে তাঁরা একটার পর একটা প্রচারপত্র বিতরণ করে প্রচার করতে থাকে যে, ভারতের প্ররােচনা ও অর্থেই খালেদ মােশাররফ সামরিক অ্যুথান করেছেন। এমনও প্রচার করা হয় যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ‘বাকশাল’ নেতারা ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করে এই অত্যুথানের ব্যবস্থা করেছিলেন। ঢাকা থেকে প্রেরিত খবরের বরাত দিয়ে মার্কিন ও বৃটিশ পত্র-পত্রিকা প্রচার করতে থাকে যে নিহত হওয়ার পূর্বে জেলখানায় আটক নেতারা খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটানাের পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ডেকে এনে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিলেন। লন্ডনের ‘অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে মুজিব হত্যার পেছনে কোন বিদেশী হস্তক্ষেপ ছিল না। কিন্তু ৩রা নভেম্বরে খন্দকার মােশতাক আহমদ বিরােধী অভ্যুথানে বিদেশী হস্তক্ষেপ ছিল এবং এই অভ্যুত্থানের সমর্থনে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের চার মাইল ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল।”
১১৪। বিভিন্ন বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এইসব খবরাখবর বি. বি. সি. এবং ভয়েস অব আমেরিকার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া হয়। দেশীবিদেশী সুপরিকল্পিত এই সমস্ত প্রচারাভিযানের মােকাবেলায় রাজনৈতিক লক্ষ্য ও সম্পর্কহীন খালেদ মােশাররফ এবং তাঁর সমর্থকদের কার্যকরী কোন প্রচার তৎপরতাই ছিল না। ফলে, জনগণ এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে একতরফা প্রচারণায় স্বভাবতঃই সৃষ্টি হয় মারাত্মক বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির সুযােগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সুপরিকল্পিত উদ্দ্যোগ। নিয়ে মঞ্চে ও নেপথ্যে সর্বাত্মক তৎপরতায় ঝাপিয়ে পড়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। জাসদের গণবাহিনী প্রধান কর্নেল তাহেরের সহায়তায় তাঁরা সেনাবাহিনীর শ্রেণী সংগ্রাম ও বিপ্লবের’ মন্ত্র ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে, বিশেষতঃ সিপাহীদের যেসব অভাব-অভিযােগ এবং অর্থনৈতিক দাবী-দাওয়া ছিলাে জাসদ তারই পূর্ণ সুযােগ গ্রহণের চেষ্টা করে। সিপাহীদের অবহেলিত অনুভূতিকে উস্কে দিয়ে তাদেরকে কাজে লাগানাের জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট ও ব্যারাকে প্রচারপত্র বিলি করে তাদের প্রতি সংগ্রামের আহবান জানায় জাসদ। এমন একটি প্রচারপত্রে বলা হয়, “অফিসাররা ক্ষমতা ও পদের লােভে অ্যুত্থান ঘটাচ্ছে। আর প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ সিপাহীরা। নিগৃহীত, অধিকারবঞ্চিত সিপাহীরা আর কামানের খােরাক হবে না। সিপাহী-জনতার ভাগ্য এক। তাই সিপাহীজনতার বিপ্লবের মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করতে হবে। সুতরাং বিপ্লবের জন্য, শ্রেণী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হউন।”
১১৫। ৬ই নভেম্বর সন্ধ্যায় বিভিন্ন সূত্রে এই মর্মে খবর পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশের যশাের, কুমিল্লা ও রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাজার হাজার সিপাহী খালেদ মােশাররফকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ঢাকার দিকে চলে যায়। ৭ই নভেম্বর ভােরে ঢাকা রেডিও স্টেশন
পৃষ্ঠাঃ ২৬২
থেকে ঘােষণা করা হয়, “বীর বিপ্লবী সিপাহী, জনতা, কৃষক, শ্রমিক, বি, ডি, আর, পুলিশ, বিপ্লবী গণবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়েছে। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে বেতার ভাষণ দেবেন।” অতঃপর সকাল আটটার দিকে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেন। তাঁর ভাষণের পর ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষণা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট সায়েমের নিকট দেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বও অর্পণ করা হয়েছে এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এদিন সন্ধ্যায় প্রথমে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং পরে প্রেসিডেন্ট এ. এস. এম. সায়েম বাংলাদেশ বেতারে ভাষণ দেন।
১১৬। ঐ দিন রাতে বিভিন্ন সূত্রে ৬ই নভেম্বর রাতে বাংলাদেশে সংঘটিত সিপাহী বিপ্লব সম্বন্ধে নিম্নরূপ তথ্য পাওয়া যায়। ৬ই নভেম্বর মধ্যরাত্রির পরে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিপাহীরা অফিসারদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান এবং পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণভার নিজেদের হাতে তুলে নেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সিপাহীদের সঙ্গে যােগদান করেন বাংলাদেশের অন্যান্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত সিপাহীরা। এমন কি খালেদ মােশাররফের সমর্থনে ব্রিগেডিয়ার নজমূল হুদার নেতৃত্বে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের যে সব সিপাহী ঢাকা এসেছিলেন তারাও খালেদ মােশাররফবিরােধী সিপাহীদের সংগে যােগদান করেন। ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) থেকে ঢাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মােতায়েনকৃত ট্যাংকগুলাে ৩রা নভেম্বরের পরে স্বল্পকালের জন্য ক্যান্টনমেন্টে ফিরে গেলেও ৬ই নভেম্বর রাতে সেগুলাে আবার রাজপথে নেমে আসে। ৬ই নভেম্বর মধ্যরাত্রির পর ঢাকা নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গােলাগুলির আওয়াজ শােনা যায়। এ সময় খালেদ মােশাররফ বঙ্গভবনে ছিলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে খালেদ মােশাররফ ব্রিগেডিয়ার নজমূল হুদা ও কর্নেল হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে শেরে বাংলা নগরে অবস্থানরত রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে আগত সেনা ইউনিটের নিকট চলে যান। এর কিছুক্ষণ পর বিদ্রোহী সিপাহীর গুলিতে খালেদ মােশাররফ, ব্রিগেডিয়ার নজমূল হুদা এবং কর্নেল হায়দার নিহত হন। প্রায় একই সময়ে বঙ্গভবনে কর্নেল শাফাত জামিল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেফতার হন এবং ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান ঢাকার বাইরে চলে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন।
১১৭। সেদিন মধ্যরাত্রির পর ভারী ও হাল্কা সকল ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের অবিরাম গােলাগুলি বর্ষণ করতে করতে সিপাহীরা দলে দলে রাজপথে নেমে আসেন। বিনা বাধায় তাঁরা ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখল করে নেন এবং জাসদের’ বিপ্লবী গণবাহিনী প্রধান কর্নেল (অবঃ) তাহের সাময়িকভাবে উক্ত বেতার ভবনের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করেন। সে রাতে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যখন গােলাগুলি চলছিল, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নিরাপদ জায়গায় সমবেত পাকিস্তানপন্থী উল্লসিত জনতা তখন সমানে শ্লোগান দিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ২৬৩
যাচ্ছিল। ট্রাকে ট্রাকে সােল্লাসে ভ্রমণরত সশস্ত্র সিপাহীরাও বিভিন্নি রাজনৈতিক শ্লোগান দেন। এই সব শ্লোগানের মধ্যে ছিলাে, “নারায়ে তকবির- আল্লাহ আকবর, সিপাহী-জনতা এক হও, স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়েছে, গণরাজ কায়েম হয়েছে, বিপ্লবী গণবাহিনী জিন্দাবাদ, কমরেড সিরাজ ভাই, লও সালাম”, ইত্যাদি। আরও খবর পাওয়া যায় যে, ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের নামে পাকিস্তানপন্থী সিপাহী এবং সেনাবাহিনীতে জাসদের গণবাহিনীর সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর অনেক মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের। ৭ই নভেম্বরের ক্ষমতার পটপরিবর্তনকে পরাধীনতার পরিসমাপ্তি হিসেবে অভিহিত করে এনয়েতুল্লাহ খান সম্পাদিত সরকারী পত্রিকা বাংলাদেশ টাইমস ঘােষণা করে, “Bangladesh Wins Freedom”।
১১৮। ৮ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এ. এস. এম. সায়েম একটি আদেশে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তিনজন স্টাফ প্রধানকে উপসামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেন। ১০ই নভেম্বর উপসামরিক প্রশাসকদের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন দায়িত্ব বন্টন করা হয়। ১১ই নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ব্রেডিওটেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১৩ই নভেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনী প্রধান রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১৫ই নভেম্বর ফখরুদ্দিন আহমদকে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বিশেষ দায়িত্ব প্রদান করে বাংলাদেশের একটি বৈদেশিক মিশনে পদস্থ করা হয় এবং তাঁর স্থলে পাকিস্তানপন্থী তােবারক হােসেনকে নিয়ােগ করা হয়। ২০শে নভেম্বর ভারতে বিশেষ উচ্চ প্রশিক্ষণ শেষে তৎকালীন মেজর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২৫শে নভেম্বর রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপের অভিযােগে জাসদের মেজর (অবঃ) এম. এ. জলিল, আ. স. ম. আব্দুর রব ও গণবাহিনী প্রধান কর্নেল (অবঃ) তাহেরসহ ১৯ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। ২৬শে নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এ. এস. এম. সায়েম তাঁর উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে তাঁদের মধ্যে সরকারী দফতরের দায়িত্ব বন্টন করেন। ঐ দিন সকালে তৎকালীন ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী সমর সেনকে সশস্ত্র হামলায় অপহরণ করার চেষ্টা করা হয়। উক্ত ঘটনায় শ্রী সমর সেন গুলিবিদ্ধ হন এবং ভারতীয় হাই কমিশনের সম্মুখে জাসদের চারজন কর্মী নিহত হন এবং দুই জন আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। ২৮শে নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৯ম ডিভিশনের পতাকা উত্তোলন করেন। ৫ই ডিসেম্বর বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল নয়া দিল্পী সফরে যান। একই দিনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বাংলাদেশে ৭ জন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেন। ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা বিচারপতি আব্দুস সাত্তার নয়া দিল্লীতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৬৪
৭ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার বেসরকারী খাতে পূজি বিনিয়ােগ ৩ কোটি টাকা হতে ১০ কোটি টাকায় উন্নীত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ১০ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সরকার জনাব এম. খুরশীদকে বাংলাদেশে পাকিস্তানের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ করে। ১১ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একজন ভক্ত ও অনুসারী আলহাজ্ব জহিরউদ্দিনকে পাকিস্তানে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিয়ােগ করে।
১১৯। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি হাসিনাদের ফুফাতাে ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও শেখ ফজলুর রহমান মারুফ প্রথম দিল্লী আসে। তাঁদের আমাদের বাসায় আনার জন্য আমি নয়াদিল্লী রেলওয়ে স্টেশনে যাই। তখন তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। শেখ সেলিম প্রায় মাসদেড়েক আমাদের সঙ্গে থেকে পুনরায় কোলকাতায় ফিরে যান। পক্ষান্তরে, শেখ মারুফ অসুস্থতার কারণে আমাদের সঙ্গে দুই মাসেরও অধিককাল থাকেন। শেখ মারুফ, বিশেষতঃ শেখ সেলিমের কাছ থেকে জানতে পাই ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫)-এ সংঘটিত ঘটনাবলী সম্বন্ধে অনেক তথ্য। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর পূর্বানুমােদিত কর্মসূচী অনুসারে ১৪ই আগস্ট (১৯৭৫) রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আর্মড কোরের প্রায় ৪০০ জন সৈন্যের একটি দল সামরিক মহড়া-কাম-প্রশিক্ষণের জন্যে জয়দেবপুরের দিকে গিয়েছিল। এই দলের নেতৃত্বে ছিল লেঃ কর্নেল ফারুক। লেঃ কর্নেল রশিদ ও আটজন মেজরও এই দলটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। তাঁদেরকে প্রদান করা হয়েছিল সীমিত অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ। সঙ্গে তিনটি ট্যাংক নেওয়ারও অনুমতি প্রদান করা হয়েছিল এই দলটিকে। কিন্তু ঐ ট্যাংকগুলােয় কোন গােলাবারুদ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। জয়দেবপুরে মহড়া ও প্রশিক্ষণ শেষে এই দলটি (তৎকালীন) কুর্মিটোলা বিমান বন্দরে এসে সমবেত হয় রাত সাড়ে তিনটার দিকে। তখন লেঃ কর্নেল ফারুক সমবেত সৈন্যদের উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে লেঃ কর্নেল ফারুক বঙ্গবন্ধু সরকারের তীব্র সমালােচনা করে উপস্থিত সৈন্যদেরকে ঐ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সম্মত করায়। কিন্তু তখন সৈন্যদের বলা হয়নি যে, বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারবর্গের কোন সদস্য কিংবা আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হবে। এ সময়ে মেজর (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম সামরিক পােশাকে সজ্জিত অবস্থায় সেখানে উপস্থিত হয় এবং তাদের দলে যােগদান করে। উল্লেখ্য যে, মেজর (অবঃ) ডালিম বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কতিপয় সদস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করতাে। তার শাশুড়ি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘাের সমর্থক এবং তিনি ঘন ঘন বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসে শেখ রেহানার বিছানায় শুয়ে থাকতেন। মেজর (অবঃ) ডালিমের স্ত্রী নিমি ছিল রেহানার স্কুলের সহপাঠিনী। তার মা বেঁচে ছিলেন না এই দুঃখ প্রকাশ করে মেজর (অবঃ) ডালিম আমার শাশুড়িকে ‘মা’ বলে সম্বােধন করার অনুমতি নিয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুর বাসায় এলে সে তাঁকে ‘মা’ বলেই সম্বােধন করতাে। কিন্তু ইতিপূর্বে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অন্যান্য অপরাধে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় মেজর ডালিমকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করা হয়েছিল।
পৃষ্ঠাঃ ২৬৫
১২০। যাহােক, সে রাতে আর্মড কোরের ঐ ক্ষুদ্র দলটিকে পাঁচটি উপদলে বিভক্ত করা হয়। ২০-২৫ জনের একটি গ্রুপকে একজন মেজরের নেতৃত্বে পাঠানাে হয় বঙ্গবন্ধুর ঘােট বােন জামাই ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টোরােডস্থ বাসায়। ১৫-২০ জনের অপর একটি গ্রুপকে অপর একজন মেজরের নেতৃত্বে পাঠানাে হয় শেখ ফজলুল হক মণির ধানমন্ডির ১৩/১ (পুরাতন) রােডস্থ বাসায়। ৩০-৪০ জনের তৃতীয় গ্রুপটিকে মেজর (অবঃ) ডালিমের নেতৃত্বে প্রেরণ করা হয় শাহবাগস্থ ঢাকা বেতার ভবনে। একটি ট্যাংক চালিয়ে কর্নেল ফারুক নিজে প্রায় ১০০ জন সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে তেজগাও বিমান বন্দর ও কুর্মিটোলা বিমান বন্দর এলাকার বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে অবস্থান নির্ধারণে ব্যাপৃত হয়। অবশিষ্ট ১০০-১২৫ জনের পঞ্চম গ্রুপটিকে দু’জন মেজরের নেতৃত্বে পাঠানাে হয় বঙ্গবন্ধুর বাসা ঘেরাও করার জন্য। ১৫-২০ জনের একটি বিশেষ টাস্কফোর্সকে। হাবিলদার মােসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণি ও বঙ্গবন্ধুর বাসায় বিশেষ কাজের জন্য গােপনে ব্রীফ করে পাঠানাে হয়। ১৫ই আগস্ট ভাের রাত সাড়ে চারটার মধ্যেই উপরােল্লিখিত গ্রুপ তিনটি যথাক্রমে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মণি ও বঙ্গবন্ধুর বাসা ঘেরাও করে সেখানের বিভিন্ন কৌশলগত জায়গায় অবস্থান নেয়। ভাের পাঁচটার দিকে আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় চারদিক থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়। অতঃপর একজন মেজর, একজন নায়েক ও কিছুসংখ্যক সৈন্যসহ উক্ত বাসার ভেতরে প্রবেশ করে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের উক্ত বাসার নীচ তলার ড্রইং রুমে জড়াে করে। উল্লেখ্য, আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের জ্যেষ্ঠ পুত্র আব্দুল হাসনাত আব্দুল্লাহ তখন উপরতলার একটি স্টোররুমে লুকিয়েছিল। খুনী মেজর চক্রের লােকেরা তাঁকেও ধরার জন্য ঐ বাড়ীর সমস্ত কক্ষ তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল। এর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে দু’জন সৈন্য স্টেনগান হাতে টলতে টলতে উক্ত ড্রইংরুমের দরজার কাছে এসেই সেখানে জড়ােকৃত সবার ওপর ব্রাশ ফায়ার করে চলে যায়। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের বেঁচে যাওয়া সদস্যরা জানান যে, ঐ সময় উক্ত দু’জন সৈন্যকে নেশাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। প্রায় একই সময়ে দু’জন সৈন্য শেখ ফজলুল হক মণির বাসার উপরতলায় উঠে শেখ মণি ও তাঁর পাশে দাঁড়ানাে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে স্টেনগানে পরপর দু’দফায় ব্রাশ ফায়ার করে।
১২১। ১৫ই আগস্ট ভাের সাড়ে পাঁচটার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসা চতুর্দিক থেকে গােলাগুলিতে আক্রমণ করা হয়। প্রায় মিনিট বিশেক গােলাগুলির পর দু’জন মেজর কিছু সংখ্যক সশস্ত্র সৈন্যসহ বঙ্গবন্ধুর বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। তখন সেখানে কর্তব্যরত। একজন কর্মকর্তা ও দু’জন পুলিশের সদস্য তাদেরকে বাধা দিলে তারা ঐ তিন ব্যক্তিকে গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত করে। স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ ও আহত পুলিশের আর্তচীৎকার শুনে শেখ কামাল নীচের অভ্যর্থনা কক্ষে গিয়ে পৌছামাত্রই তারা তাকেও ব্রাশ
পৃষ্ঠাঃ ২৬৬
ফায়ারে হত্যা করে। অতঃপর ঐ দু’জন মেজর কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসায় দোতলায় উঠে। প্রথমে তারা বঙ্গবন্ধুকে পদত্যাগ করার প্রস্তাব করে। এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, যে দেশের সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশের ও সেনাবাহিনীর আইনশৃঙ্খলা ও সংবিধান লংঘন করে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির বাসায় গােলাগুলিতে আক্রমণ করতে পারে আমি তার রাষ্ট্রপতি থাকতে চাইনা। তবে তােমাদের মত অধস্তন কর্মকর্তাদের নিকট আমি পদত্যাগপত্র পেশ করতে পারি না। অতএব সেনাবাহিনীর চীফ ও ডেপুটি চীফদেরকে এখানে নিয়ে এলে আমি তাঁদের নিকট আমার ইস্তফা প্রদান করবে।”
১২২। এর পর ঐ দু’জন মেজর বঙ্গবন্ধুকে বলেন যে, সেক্ষেত্রে তাঁকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে বেতারে তাঁর পদত্যাগ ঘােষণা করতে হবে। একটু ইতস্তত করে তখন বঙ্গবন্ধু তীদেরকে বলেন যে, তিনি বেতার কেন্দ্রে যেতে সম্মত রয়েছেন কিন্তু শেখ কামালকে তাঁর সঙ্গে যেতে দিতে হবে। অতঃপর ঐ দুই মেজর বঙ্গবন্ধুকে ঘেরাও করে উপরতলার প্রধান প্রবেশ দরজার নিকট নিয়ে আসে। ঐ সময় হাবিলদার মােসলেহউদ্দিন অপর দুই বাসায় হত্যাযজ্ঞ শেষ করে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ঢুকে সিড়ির গােড়ায় গিয়ে পৌঁছয়। বঙ্গবন্ধু যখন সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে উদ্যত হয়েছিলেন ঠিক ঐ মুহূর্তে হাবিলদার মােসলেহউদ্দিন তাকে তাক করে ব্রাশ ফায়ার করে। বুলেটে ক্ষতবিক্ষত বঙ্গবন্ধুর দেহ তক্ষুণি সিড়ির ওপর লুটিয়ে পড়ে। অতঃপর দু’জন মেজর ও হাবিলদার মােসলেহউদ্দিন আমার শাশুড়িসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের এক এক করে ঠাণ্ডা মাথায় গুলিতে হত্যা করে। এরই এক ফাঁকে রাসেল দৌড়ে নীচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে বাড়ীর কাজের লােকজনদের নিকট আশ্রয় নেয়। তাঁকে দীর্ঘকাল যাবত দেখাশুনার ছেলে আব্দুর রহমান রমা তখন রাসেলের হাত ধরে রেখেছিল। একটু পরেই একজন সৈন্য রাসেলকে বাড়ীর বাইরে পাঠানাের জন্য রমার কাছ থেকে তাঁকে নিয়ে নেয়। রাসেল তখন ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, “আল্লাহর দোহাই, আমাকে জানে মেরে ফেলবেন না। বড় হয়ে আমি আপনাদের বাসায় কাজের ছেলে হিসেবে থাকবাে। আমার হাসু আপা দুলাভাইয়ের সঙ্গে জার্মানীতে আছেন। আমি আপনাদের পায়ে পড়ি, দয়া করে আপনারা আমাকে জার্মানীতে হাসু আপা ও দুলাভাই-এর কাছে পাঠিয়ে দিন।” তখন উক্ত সৈন্যটি রাসেলকে বাড়ীর গেটস্থ সেন্টিবক্সে লুকিয়ে রাখে। এর প্রায় আধঘন্টা পর একজন মেজর সেখানে রাসেলকে দেখতে পেয়ে তাঁকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে তার (রাসেলের) মাথায় রিভলভারের গুলীতে।
১২৩। ১৫ই আগস্ট (১৯৭৫)-এর ভােরে বঙ্গবন্ধুর ধনমন্ডির (পুরাতন) ৩২ নম্বর (নতুন ১১ নম্ব) ব্লোডস্থ বাসায় আর যাঁরা খুনী মেজর চক্রের গুলিতে নিহত হয়েছেন তাঁরা হলেনঃ (১) বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব (রে, (২) বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, (৩) শেখ কামালের নববিবাহিতা স্ত্রী, সুলতানা কামাল (খুকী), (৪) বঙ্গবন্ধুর মেজো পুত্র শেখ জামাল, (৫) শেখ জামালের নববিবাহিতা স্ত্রী পারভীন জামাল (রােজী), (৬) বঙ্গবন্ধুর ১০ বছরের
পৃষ্ঠাঃ ২৬৭
১৯৭৫ সাল সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, (৭) বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ছােটভাই শেখ নাসের এবং (৮) কর্তব্যরত পুলিশের জনৈক ডি. এস. পি.। বঙ্গবন্ধুর বাসায় সৈন্যদের গােলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয় কাজের ছেলে আব্দুল। বঙ্গবন্ধুর বাসায় সশস্ত্র হামলার খবর শুনে রাষ্ট্রপতির মিলিটারী সেক্রেটারী কর্নেল জামিল নিজে গাড়ী চালিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের দিকে আসছিলেন। পথে সােবহানবাগ কলােনীর মসজিদের নিকট খুনী মেজর চক্রের লােকেরা তাঁকে বাধা দেয়। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসার দিকে পুনরায় যাত্রা করতে উদ্যত হলে সেখানে উপস্থিত একজন মেজর স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে তাঁকে হত্যা করে। মিন্টোরােডের সরকারী বাসায় যাঁরা নিহত হয়েছেন তাঁরা হলেনঃ (১) বঙ্গবন্ধুর ছােট বােনজামাই ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, (২) আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের ১৪ বছর বয়কা কন্যা মিস বেবী, (৩) তাঁর ১২ বছর বয়স্ক পুত্র আরিফ, (৪) তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আব্দুল হাসনাত আবদুল্লাহর ৪ বছর বয়স্ক পুত্র বাবু, (৫) আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের একজন মধ্যবয়সী ভাতিজা, (৬) তাঁর একজন কিশাের ভাগিনা নান্টু, (৭) তাঁর বাসায় আগত তিনজন অতিথি এবং (৮) তাঁর বাসায় কর্মরত চারজন কাজের লােক। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের বাসায় আরও পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়। এরা হলাে তাঁর বিশ বছর বয়সী যুবতী কন্যা হামিদুন্নেছা বিউটি, দশ বছর বয়সী কন্যা কামরুন্নেছা রিনা, চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছেলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খােন, তাঁর পত্নী ও বঙ্গবন্ধুর ছােট বোেন বেগম আমিনা সেরনিয়াবাত এবং তাঁর বড় ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর পত্নী সাহানারা বেগম। মিস হামিদুন্নেছা বিউটির তলপেট স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে বাবরা হয়। তাঁদের বাচার কথাই ছিল না। ৭৮ বছর ধরে তার চিকিৎসা করাতে হয়। পাঁচবার অস্ত্রোপচার করার পরও সে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে না। এই আধাপগুত্ব অবস্থায় সারাটা জীবন কাটাতে হবে এমন একটি সুন্দরী তরুণীকে। শেখ ফজলুল হক মণি গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইন্তেকাল করেন। গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত তাঁর সন্তানসবা স্ত্রী শামছুন্নেসা আরজুকে শেখ মণির ছােট ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে পৌছানাের কিছুক্ষণ পরেই আরজু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১২৪। উল্লেখ্য, আর্মির যে দলটি বঙ্গবন্ধুর বাসায় আক্রমণ চালিয়েছিল তার একটি অংশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ব্রোডস্থ ৩ নম্বর বাড়ীর আমাদের ফ্ল্যাটেও ভীষণ গােলাগুলি করে। প্রাণ রক্ষায় উক্ত বাড়ীর মালিক আইনুল হক সাহেব, তাঁর পরিবারবর্গ ও অন্যান্য লােকেরা বাথরুম ও চৌকির নীচে আশ্রয় গ্রহণ করেন। হাসিনা জার্মানী যাওয়ার সময় বাড়ীর মালিক আইনুল হক সাহেবের ছােট ভাইকে আমাদের ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছিল। গােলাগুলির পর একজন মেজর কিছু সংখ্যক সৈন্যকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটের কক্ষগুলােয় তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালায় আমাদের খোঁজে। হাসিনা ছেলেমেয়েদেরকে সঙ্গে নিয়ে ইতিপূর্বে আমার
পৃষ্ঠাঃ ২৬৮
উদ্দেশে জার্মানী চলে গেছে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল উক্ত মেজর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা সেখান থেকে চলে যায়।
১২৫। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে খুনী মেজর চক্র, তাঁদের দেশী-বিদেশী প্রভূ-সহযােগী, স্বাধীনতার আদর্শ-চেতনা বিরােধী মহল ও ব্যক্তিত্বরা ব্যাপক প্রচার অভিযান চালায় বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি, সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করার জন্যে। এ কথা বলা নিয়োেজন যে, তাঁদের সে হীন চক্রান্ত ধােপে টেকেনি, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ তাদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়নি। খুনীরা বাংলাদেশের জনগণের কাছে তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা ও স্বাধীনতার স্থপতির খুনী, দেশের কলঙ্ক ও ঘৃণার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে চিরকাল। পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধুর নিখুত চরিত্র, খাটি দেশপ্রেমিকতা এবং দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য অকৃত্রিম গভীর দরদ, অনুভূতি ও ভালােবাসার কথা বাংলাদেশের জনগণের অন্তরের গভীরে রয়েছে ও থাকবেও চিরঅম্লান। এ দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুকে একজন দলনেতা হিসেবে যেমন অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতে দেখেছেন, বঙ্গবন্ধুর পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে দেশের অবিসংবাদিত নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হবার পরও তারা তার কোনও পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেননি। বঙ্গবন্ধুর কি বেশভূষা, কি আচার-আচরণ, কি বসবাসের অবস্থা, কি বাড়ীর খাবার-দাবার, কোন কিছুর কোনও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি কোনদিন। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর (পুরাতন) ৩২ নতুন ১১) নম্বর ব্লোডস্থ বাড়ীরও হয়নি কোন পরিবর্তন। তাঁর ঐ বাড়ীর কোনও কক্ষে ছিল না কোন কার্পেট, এয়ারকন্ডিশনার বা শীতলীকরণ ব্যবস্থা। দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও ছুটির দিনে কিংবা অবসর সময়ে বঙ্গবন্ধু কতদিন না তাঁর কার্পেটবিহীন শয়নকক্ষের, মেঝেতে শুয়ে কত খেলা করেছেন তাঁর তখন শিশু নাতী জয় ও নাতনী পুতলীকে বুকে-পিঠে নিয়ে। সরকারী কর্মকর্তাদের বহু অনুরােধ-উপরােধ সত্ত্বেও কোনও দামী-সৌখিন চেয়ার-সােফা, আসবাবপত্র, কার্পেট কিংবা এয়ারকন্ডিশনার নেয়া সম্ভব হয়নি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর নিজ বাড়ীতে। এসব ও আরও অনেক গুণাবলীর জন্য বঙ্গবন্ধুর দেশের জনগণের কাছে এবং ইতিহাসে হয়ে আছেন ও থাকবেন একজন মহান ও বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে। এখানেই বঙ্গবন্ধুর ভিন্নতা দেশের অন্য নিকট-অতীত ও সাম্প্রতিকালের রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীদের থেকে। এজন্যই বঙ্গবন্ধুর স্থান রয়েছে সবার উর্ধ্বে এবং তা নিঃসন্দেহে থাকবে চিরকাল।
১২৬। বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের ও তার অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের চার নেতাকে হত্যা করার পেছনে কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল কিনা এবং এই সব হত্যাকান্ডে কে বা কারা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে জড়িত ছিল সে সমস্ত বিষয়ে ১৯৭৫ সালেই আমার বাংলাদেশের ও ভারতের অনেক প্রবীণ সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ
পৃষ্ঠাঃ ২৬৯
আলােচনা হয়। তাঁদের প্রত্যেকের অভিমত এই যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, লক্ষ্য, মূল্যবােধ ও চিন্তা-চেতনাকে বিনষ্ট করাই ছিল এই সব হত্যাকাণ্ড ঘটানাের প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অফিসার ও অন্যান্য সদস্য কোনভাবেই এই সমস্ত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জড়িত ছিল না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরােধী এবং পাকিস্তানপন্থ অতি মুষ্টিমেয় ও নগণ্য সংখ্যক অফিসার ও সাধারণ সৈনিক কতিপয় দেশী ও বিদেশী মহলের এজেন্ট হিসেবে এ সমস্ত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীনতা তাঁদের ষড়যন্ত্রের কার্যকরণকে সহজতর করেছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ফলাফলকে পাকিস্তানের মিলিটারীর একটি অংশ এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো, মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামীর কতিপয় নেতা কোনক্রমেই মেনে নেননি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই সেই সমস্ত পাকিস্তানী ব্যক্তিত্ব এই ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল চিন্তায় রেখে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে তেরজন জুনিয়র কর্মকর্তা এবং চার জন ননকমিশন্ড কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারবর্গের সদস্যদের এবং আওয়ামী লীগের চারজন প্রবীণ নেতার হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল বলে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে, তারা সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরােধী এবং পাকিস্তানপন্থী। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাকে বিনষ্ট করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যবহারের জন্য এ জাতীয় ব্যক্তিদের অনেককেই পাকিস্তানের মিলিটারীর এজেন্ট হিসেবে পাঠানাে হয়েছিল ১৯৭১-এ তৎকালীন বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীতে অনুপ্রবেশ করতে। খুনী মেজর চক্রের অন্তর্ভুক্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের ব্যাকগ্রাউন্ড পর্যালােচনা করলেই এই অভিমতের সত্যতা সহজেই প্রমাণিত হয়।
১২৭। স্বাধীন বাংলাদেশের অ্যুদয়ের পর থেকেই পাকিস্তান মিলিটারীর ঐ অংশটি জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন (অর্থাৎ হত্যা করার পরিকল্পনা করে। এদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, বঙ্গবন্ধুকে চিশ্চিহ্ন করতে পারলেই হয় পাকিস্তানের ১৯৭১-এর পূর্বাবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা নতুবা বাংলাদেশ ও বর্তমান পাকিস্তানের মধ্যে একটি কনফেডারেশনের সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হবে। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক, সমৃদ্ধ ও শক্তিধর দেশগুলাে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে যতােদিন প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সমর্থন ও সাহায্য প্রদান করছিল, পাকিস্তানের ঐ মহলটি তততদিন পর্যন্ত উক্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সুযােগ পায়নি। ১৯৭৫-এর জানুয়ারী মাসে বঙ্গবন্ধুর দেশে একদলীয় রাজনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন পাকিস্তানের ঐ মহলটির হাতে সে সুযােগ তুলে দেয় বললেই চলে। কারণ এর ফলে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানসহ পাশ্চাত্যের সমৃদ্ধ দেশগুলাে বঙ্গবন্ধুর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয় এবং আস্থা হারিয়ে ফেলে। অতঃপর মার্কিন যুদ্ধরাষ্ট্রের প্রশাসন, বিশেষতঃ
পৃষ্ঠাঃ ২৭০
সি. আই. এ.-এর কাছ থেকে সবুজ সংকেত এবং লিবিয়ার প্রশাসন, বিশেষতঃ এর রাষ্ট্র প্রধান কর্নেল (অবঃ) গাদ্দাফীর সম্মতি পাওয়ার পর পাকিস্তানের মিলিটারীর ঐ অংশটি জুলফিকার আলী ভূট্টোর নেতৃত্বে তাদের দীর্ঘ চার বছরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে তাদের এজেন্ট, গােড়া পাকিস্তানপন্থী ও সাম্প্রদায়িক সদস্য এবং পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের বিশিষ্ট নেতা ও আওয়ামীবিরােধী অন্যান্য মহল ও ব্যক্তিদের সহায়তায় ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার ও নিকটতর আত্মীয়-স্বজনের সদস্যদের এবং ৩রা নভেম্বরে আওয়ামী লীগের চারজন প্রবীণ ও বিশিষ্ট নেতা যথা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অবঃ) মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমদ ও এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানকে হত্যা করে। পাকিস্তানের বাংলাদেশী এজেন্টদের মধ্যে মাত্র অতি সীমিত সংখ্যক ব্যক্তিকেই যথা খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী, লেঃ কর্নেল ফারুক, লেঃ কর্নেল রশিদ, মেজর (অবঃ) ডালিম এবং জনাকয়েক হাবিলদার ও (সুবেদার) নায়ককে অবহিত করা হয়েছিল যে (১৯৭৫-এর) ১৫ই আগষ্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের সদস্যদের হত্যা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারবর্গের সদস্যদের, আওয়ামী লীগের চার নেতা ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে স্বাধীনতার পক্ষের অনেক মুক্তিযােদ্ধা অফিসার ও সদস্যকে হত্যা নতুবা ক্ষমতা থেকে অপসারণের মাধ্যমে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরাসরি নেতৃত্বে গৃহীত ও পরিচালিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ঐ অংশের উক্ত পরিকল্পনা অনেকাংশে সফল হয়েছে বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন।
নবম পরিচ্ছেদ
১৯৭৬-১৯৮১ সাল
১। ১৯৭৬ সালের গােড়া থেকেই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজের অবস্থান ও ক্ষমতাকে সুদৃঢ় ও সুসংহত এবং বিশেষ মহল ও জনগণের কাছে স্বীয় ভাবমূর্তি সৃষ্টি করার প্রয়াসে আত্মনিয়ােগ করেন। এতদুদ্দেশ্যে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন জনসমাবেশ ও জনসভার আয়ােজন করেন। একই সঙ্গে ব্যবহার করা হয় সরকারী ও বেসরকারী গণমাধ্যমগুলােকে তাঁর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি এবং তাঁর প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির জন্যে। একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েই তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে দ্রুত এগিয়ে যান। এই দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার উল্লেখযােগ্য ছিলঃ (১) সামরিক বাহিনীতে তাঁর ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সুসংহত করা, (২) বিদেশী, বিশেষতঃ জাপানসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাশ্চাত্যের ধনী ও সমৃদ্ধ দেশগুলাে এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের নেতৃবর্গের আস্থা ও সমর্থন লাভ করা এবং (৩) দেশে প্রগতিশীল, বিশেষ করে, বঙ্গবন্ধুর অনুসারী রাজনৈতিক দলগুলােকে দুর্বল করা যাতে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করা তাদের পক্ষে দুষ্কর ও দুরূহ ব্যাপার হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, এই শেষােক্ত উদ্দেশ্যে তিনি ব্যবহার করেন ডানপন্থী, সাম্প্রদায়িক, পাকিস্তানপন্থী এবং মাওবাদী রাজনৈতিক দল, বঙ্গবন্ধু বিরােধী বিভিন্ন কায়েমী মহল ও ব্যক্তিত্বদের। তাঁর শাসন আমলে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডেই প্রকাশ পায় তাঁর এ সমস্ত পরিকল্পনা।
২। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারীর মাঝামাঝি তৎকালীন বিমান বাহিনী চীফ ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব লিবিয়া সফরে যান। ঐ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত খুনী চক্রের লেঃ কর্নেল ফারুক, লেঃ কর্নেল রশিদ এবং মেজর (অবঃ) ডালিম লিপপালীতে তাওয়াবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। অতঃপর ২৩শে ফেব্রুয়ারী তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও অন্যতম উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর তৎকালীন, এডজুটেন্ট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নূরুল ইসলাম
পৃষ্ঠাঃ ২৭২
শিশুকে লিবিয়ার বেনগাজীতে পাঠান। তখন নূরুল ইসলাম শিশু প্রথমে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এবং পরে একত্রে খুনী মেজর চক্রের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি খুনী চক্রের সদস্যদের বাংলাদেশের যে কোন দূতাবাস বা মিশনে চাকুরী প্রদানের প্রস্তাব দেন। খুনী চক্রের অন্যান্য সকলেই উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হলেও লেঃ কর্নেল ফারুক ও লেঃ কর্নেল রশিদ রাজি হয়নি।
৩। ১৯৭৬ সালের মার্চের ৫ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় সিরাতুন্নবী সম্মেলন। তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান ও অন্যতম উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব গােলটুপি মাথায় দিয়ে এই সম্মেলনে যােগদান করেন এবং সেখানে উগ্র সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলেন। তিনি উক্ত সম্মেলনে সংবিধান পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করারও প্রস্তাব করেন।
৪। ১৯৭৬-এর মার্চ মাসে তৎকালীন বিমান বাহিনী প্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনে সফরে যান। ঐ সময়ে লন্ডনে ৩০ ও ৩১শে মার্চ তারিখে খুনী লেঃ কর্নেল ফারুক তাওয়াবের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, উক্ত বৈঠকগুলােয় খুনী লেঃ কর্নেল ফারুক এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াবের কাছ থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তার সমর্থক, বিশেষতঃ বেঙ্গল ল্যান্সারের অবস্থান সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেন। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে উক্ত বেঙ্গল ল্যান্সার গ্রুপকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। পাঁচশত সৈনিক ও চৌদ্দটি ট্যাংকের সমন্বয়ে গঠন করা হয় প্রথম ক্যাভালরী এবং এই অংশকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে স্থানান্তর করে সাভার ক্যান্টনমেন্টে প্রেরণ করা হয়। বেঙ্গল ল্যান্সারের অবশিষ্ট অংশকে বগুড়াস্থ ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তর করা হয়।
৫। ১২ই এপ্রিল (১৯৭৬) খুনী লেঃ কর্নেল ফারুক ইটালীর রাজধানী রােমে যান। রােম থেকে ফারুক সিংগাপুরে অবস্থানরত খুনী চক্রের অপর তিন সদস্য যথা হাবিলদার মােসলেহ উদ্দিন, নায়েক মারফত আলী ও নায়েক মােঃ হাশেমদের সঙ্গে ফোনে যােগাযােগ করেন। অপরদিকে খুনী লেঃ কর্নেল রশিদ লিবিয়া থেকে লন্ডনে চলে যান। ১৩ই এপ্রিল (১৯৭৬) রশিদ খুনী মেজর (অবঃ) ডালিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তখন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত তাঁর শ্বশুর আর. আই. চৌধুরীর বাসায়। ১৬ই এপ্রিল (১৯৭৬) তারিখে খুনী রশিদ সিংগাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করেন। রােম বিমান বন্দরে উক্ত ফ্লাইটে ওঠেন খুনী ফারুক ও তাঁর তিনজন সহযােগী সিংগাপুরের উদ্দেশ্যে। খুনী রশিদ ব্যাংকক থেকে ঢাকা পৌছান ২০শে এপ্রিল (১৯৭৬)। খুনী ফারুক তার সঙ্গীদের নিয়ে ঢাকা পৌছায় ২৩শে এপ্রিল (১৯৭৬)। খুনী ডালিম ঢাকা পৌছায় ২৫শে এপ্রিল (১৯৭৬)। এদিকে একই বিমানে ছিলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর তৎকালীন চীফ ও অন্যতম উপপ্রধান সামরিক প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব। ২৭শে এপ্রিল (১৯৭৬) বগুড়ায় বেঙ্গল ল্যান্সারদের মধ্যে গােলমাল দেখা দেয়। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও
পৃষ্ঠাঃ ২৭৩
অন্যতম উপপ্রধান সামরিক প্রশাসক মেঃ জেনারেল জিয়াউর রহমান খুনী ফারুককে বগুড়ায় পাঠান সেখানে বেঙ্গল ল্যান্সারদেরকে শান্ত করার জন্যে এবং একই সঙ্গে তিনি আরিচা ফেরীঘাটে পদাতিক বাহিনী মােতায়েন করেন। ২৭শে এপ্রিল (১৯৭৬) খুনী রশিদ ও ডালিমকে গ্রেফতার করে একটি নির্ধারিত ফ্লাইটে ব্যাংককে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এদিকে ঢাকায় ফিরে আসার কঠোর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও খুনী ফারুক বগুড়ায় বেঙ্গল ল্যান্সারদের ট্যাংক নিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকেন। তখন কর্নেল হান্নান শাহর নেতৃত্বে ৬ ইস্ট বেংগল রেজিমেন্ট ল্যান্সারদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়। সাভারেও একই অবস্থা বিরাজ করে। সেখানে মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীর নেতৃত্বাধীন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেড বেঙ্গল ক্যাভালরিকে ঘিরে থাকে। একই সঙ্গে বগুড়ায় ৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমর্থনে রংপুর থেকে বগুড়ার পথে মেজর জেনারেল লতিফের নেতৃত্বে ১১ পদাতিক ডিভিশন রওনা হয়। অতঃপর অবস্থা বেগতিক দেখে খুনী ফারুক আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তীতে খুনী ফারুককেও একটি বিমানে ব্যাংককে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
৬। বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীগুলাের উগ্র সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানপন্থী সদস্যরা এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াবকে কেন্দ্র করেই সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। তাওয়াব খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গেও যােগাযােগ করেন। ঐ সময় খন্দকার মােশতাক আহমদ সদ্য স্বদেশ প্রত্যাগত খুনী মেজর চক্রটিকে নিয়ে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেন। বিভিন্ন গ্রুপ ও মহলের ঘন ঘন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তাঁর আগামসিহ লেনস্থ বাসায়। এই পটভূমিতেই ১৯৭৬ সালের ৩০শে এপ্রিল তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম. এ. জি. তাওয়াবকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। অতঃপর তাঁকে একটি লন্ডনগামী বিমানে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐ সময় লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান পত্রিকার এক সংবাদে বলা হয়, ঢাকায় সদ্য প্রত্যাগত (খুনী) মেজর চক্রের সহযােগিতায় তাওয়াব ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছিলেন।”
৭। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানপন্থীদের উপরােল্লিখিত বিপর্যয়ের কয়েক ঘন্টা পরেই তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান যােগদান করেন ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাওবাদী বামপন্থীদের ১লা মে (১৯৭৬) দিবস উপলক্ষে আয়ােজিত জনসমাবেশে। উক্ত সমাবেশের ভাষণে জিয়াউর রহমান সাহেব প্রথমবারের মত বঙ্গবন্ধুর সরকারের সমালােচনা করেন। তিনি অভিযােগ করেন যে, তখনকার সামরিক শাসনের পূর্ববর্তী সরকারের আমলে জনগণকে অবাধে ধর্মকর্ম পালন করতে দেয়া হয়নি। এর দু’দিন পরে অর্থাৎ ৩রা মে (১৯৭৬) একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর আরােপিত বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়। ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর
পৃষ্ঠাঃ ২৭৪
অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপঃ”জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরােপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি ও সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে। তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করিবার অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবে না।” ৩রা মে (১৯৭৬) তারিখে জারিকৃত উপরােক্ত সংবিধান সংশােধনীর ফলে মুসলিম লীগ, পি. ডি. পি., জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, প্রভৃতি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহৃত হয়ে যায়। একই তারিখে সামরিক সরকার বিমান বাহিনী প্রধান এবং উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়ােগ করে জনাব কে. এম. বাশারকে। একই সঙ্গে তাকে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
৮। সংবিধানের উক্ত বিধানকে সংশােধন করে জারিকৃত প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অধ্যাদেশকে মওলানা ভাসানী স্বাগত জানান। তিনি বলেন, “সুখের বিষয় যে, সরকার দেশের রাজনীতিতে সকল নাগরিকের অংশ গ্রহণের সমান অধিকার প্রদানের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেছেন। তবে তিনি একই সঙ্গে বলেন, ‘আমি রাজনীতিতে ধর্মকে টেনে আনার বিরােধী। ধর্মের অপব্যবহারের জন্য এ অঞ্চলের জনগণ অনেক দুঃখভােগ করেছেন। উপরােক্ত সংশােধনীর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলােকে রাজনৈতিক অধিকার দেওয়ার পর কট্টর সাম্প্রদায়িক নেতা মাওলানা সিদ্দিক বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল। সংবিধানের চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শে বিশ্বাস করি না”। মুসলিম লীগের খান আব্দুস সবুর খান বলেন, “জাতি ১৯৫৪ সালে এবং ১৯৭১ সালে বিরাট ভূল করেছে।”
৯। ১৯৭৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন দিল্লীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের তৎকালীন হাই কমিশনার শামসুর রহমান (জনসন) সাহেব প্রথমবারের মত আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন সেখানে আমাদের পান্ডারা রােডস্থ ফ্ল্যাটে। উল্লেখ্য, জনাব শামসুর রহমান সাহেবের বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতাও ছিলেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন আইয়ুব খানের সরকার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যে ৩৫ ব্যক্তিকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করে জনাব শামসুর রহমান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। জানা যায় যে, ১৯৬৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারীতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬-দফা দাবী ঘােষণা দেওয়ার পেছনে জনাব শামসুর রহমান সাহেবের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিলাে। হাসিনারা জনাব শামসুর রহমানকে ‘কাকা এবং বেগম শামসুর রহমানকে ‘চাচী’ বলে সম্বােধন করে। যাহােক, শামসুর রহমান সাহেবের সঙ্গে এই সাক্ষাতের সময় রেহানা, হাসিনা ও শামসুর
পৃষ্ঠাঃ ২৭৫
রহমান সাহেব নিজে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু, আমর শাশুড়ী, কামাল ও কামালের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী সুলতানা খুকী, জামাল ও জামালের স্ত্রী পারভীন রােজী ও কিশাের রাসেলের মর্মান্তিক হত্যার কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন আমাদের সঙ্গে তাঁর আর কোন বিষয়ে আলাপ হয়নি। এটা ছিলাে আমাদের সঙ্গে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার।
১০। ৮ই মে বাংলাদেশের সামরিক সরকার সারা দেশে নয় জন আঞ্চলিক প্রশাসক নিয়ােগ করে। ১৬ই মে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঙ্গা নদীতে ভারত কর্তৃক নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের প্রতিবাদে উক্ত বাঁধ অভিমুখে মিছিল করার ঘােষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের মাদ্রাসা ময়দানে মিছিলকারীরা ফারাক্কা বাঁধে পৌছার জন্যে শপথ গ্রহণ করেন। এদিকে ভারত সরকার ফারাক্কা বাধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে। যাহােক, মিছিলকারীরা তখন ভারতে প্রবেশ করেনি। ১৪ই জুন বাংলাদেশের সামরিক সরকার রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের নামে জারিকৃত একটি আদেশে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গঠন করে বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনাল।
১১। ১৯৭৬ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ (১৯৭২ সালের পি, ও—৮ নম্বর আদেশ) বাতিল করে দেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বা. স. স.) পরিবেশিত এক খবরে প্রকাশ যে, ১৯৭৬ সালের বাংলাদেশ কোলাবােরেটর্স (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) বাতিল অধ্যাদেশ নামে অভিহিত এই অধ্যাদেশটিতে বলা হয়েছে যে, উক্ত আদেশটি বাতিল হওয়ায় কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিস্ট্রেট বা আদালত সমীপে ঐ আদেশ বাতিলের অব্যবহিত পূর্বে মূলতবি থাকা সমস্ত বিচারকার্য বা অন্যান্য মামলা এবং উক্ত আদেশ পরিচালিত সমস্ত তদন্তকার্য বা অন্যান্য মামলা বাতিল হয়ে যাবে এবং সেগুলাের কর্মকাণ্ড) আর চালানাে যাবে না। তবে শর্ত থাকে যে, উপরােক্ত আদেশবলে কোন ট্রাইব্যুনাল, ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোন দণ্ড বা সাজার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোন আপীল ব্যাহত হবে না। প্রেসিডেন্ট সায়েমের উক্ত অধ্যাদেশটিতে আরও বলা হয় যে, উপরােল্লিখিত আদেশ (নং পি, ও—৮, ১৯৭২) বাতিল হওয়ায় মূলতবি থাকা বিচার, তদন্ত ও অন্যান্য মামলা রদ হওয়া ছাড়া ১৮৯৭ সালের সাধারণ উপধারা আইন (১৮৯৭ সালের দমন আইন)-এর ৬ নম্বর ধারার প্রয়ােগও ব্যাহত হবে না।
১২। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে একদিন বিকেলে জনাব শামসুর রহমান সাহেব তাঁর পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যে পুনরায় আমাদের পান্ডারা রােডস্থ ফাটে আসেন। সেদিন চাচী (বেগম শামসুর রহমান) রেহানা ও হাসিনার কাছে তাঁর সমবেদনা ও সহানুভূতি ব্যক্ত করেন। তিনি ওদের অনেক আদর ও দোয়া করেন। ইতিপূর্বে আমার মার নিকট আমাদের গ্রামের বাড়ীর ঠিকানায় কিছু টাকা পাঠানাের জন্যে আমি
পৃষ্ঠাঃ ২৭৬
আমার ঢাকাস্থ ব্যাংককে কয়েকবার পত্র লিখেছিলাম। কিন্তু উক্ত ব্যাংক থেকে আমি তখনও কোন উত্তর পাইনি। একথা শােনার পর তখন শামসুর রহমান সাহেব পরবর্তীতে ঢাকায় গেলে আমার মার জন্যে প্রয়ােজনীয় টাকা পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দেন। অতঃপর সেদিনকার মত তাঁরা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান। পরবর্তীতে শামসুর রহমান সাহেব আমাকে জানান যে, তিনি বাংলাদেশে আমার মার জন্যে দুই হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন। দিল্লীতে আমি উক্ত অর্থ পরিশােধ করতে চাইলে তিনি তা গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানান। আমি আজ পর্যন্ত উক্ত টাকার জন্যে তাঁর কাছে ব্যক্তিগতভাবে ঋণী।
১৩। এদিকে ১৯৭৬ সালের ২১শে জুন ঢাকায় বিশেষ সামরিক আদালতে ‘সরকার উৎখাত ও সেনাবাহিনীকে বিনাশ করার চেষ্টা চালানাের অভিযােগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের ১৯ জন নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। উক্ত মামলায় আসামী পক্ষের প্রধান কৌসুলি ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও প্রাজ্ঞ আইনজ্ঞ এডভােকেট আতাউর রহমান খান। ১৭ই জুলাই (১৯৭৬) বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল উক্ত তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলার রায় ঘােষণা করে। উক্ত রায়ে কর্নেল (অবঃ) তাহেরের প্রাণদণ্ড এবং জাসদের মেজর (অবঃ) এম. এ. জলিল, আ. স. ম. আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, জাসদের আদর্শিক গুরু সিরাজুল আলম খান প্রমুখ ব্যক্তিদের যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। জনাব আতাউর রহমান খান সাহেবের মতে, বিশেষ সামরিক আদালতে ঐ রায় পক্ষপাতদুষ্ট ও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। কারণ সরকার পক্ষের কৌসুলি ষড়যন্ত্র প্রমাণে যে যুক্তি আদালতে পেশ করেছিল তা ভিত্তিহীন ও বানােয়াট বলে প্রমাণিত হয়েছিল। সরকার দাবী করেছিল যে, জাসদের নেতারা একদিন রাতে এর অন্যতম নেতা প্রফেসর আখলাকুর রহমানের বাসায় মিলিত হন। অতঃপর প্রফেসর আখলাকুর রহমান ফোনে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের ব্রিগেডিয়ার ভােরাকে উক্ত বৈঠকে যােগদান করার আমন্ত্রণ জানান। এর কিছুক্ষণ পর ব্রিগেডিয়ার ভােরা প্রফেসর আখলাকুর রহমানের বাসায় অনুষ্ঠিত সভায় যােগদান করেন। অতঃপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমােদনে উক্ত তথাকথিত ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে সরকার পক্ষ দাবী করেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রফেসর আখলাকুর রহমানের বাসায় তখন কোনও টেলিফোন সংযােগ ছিল না। কাজেই, বিশেষ সামরিক আদালতের উক্ত রায় উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। অতঃপর এ সমস্ত ক্রটি উল্লেখ করে উচ্চ আদালতে আপীল করা হলেও কোন ফল হয়নি।
১৪। জনাব আতাউর রহমান খান সাহেব তখন কর্নেল তাহেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনা করে আবেদন করতে। কিন্তু কর্নেল (অবঃ) তাহের সে প্রস্তাবে রাজি হননি। অবশেষে, কর্নেল তাহেরের পত্নী কর্নেল তাহেরের পক্ষে তন্মর্মে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েম কর্নেল তাহেরের উক্ত আবেদন নাকচ করে দেন।
পৃষ্ঠাঃ ২৭৭
অতঃপর ২১শে জুলাই (১৯৭৬)-এর ভােরে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্নেল (অবঃ) তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়। জনাব আতাউর রহমান খানের মতে উক্ত ফাঁসি প্রদানও আইনসিদ্ধ ছিল না। কারণ একজন পঙ্গু ব্যক্তিকে ফাঁসি দেওয়া আইনে নিষিদ্ধ এবং কর্নেল (অবঃ) তাহেরের একটি পায়ের হাঁটুর নীচের অংশ ছিলাে না বলে তিনি ছিলেন পংগু ব্যক্তিদের পর্যায়ভুক্ত। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যে, (তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে কর্নেল (অবঃ) তাহের মুক্ত ও রক্ষা করেছিল ৭ই নভেম্বর (১৯৭৫) তারিখে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে ৩রা নভেম্বর (১৯৭৫) তারিখে সংঘটিত মিলিটারী অভ্যুথানে সৈন্যদের হাতে তার বন্দীদশা থেকে, অথচ সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকাকালীন সময়ে তাঁকেই (কর্নেল তাহেরকে) এমন নিঃসহায় অবস্থায় ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হলাে। কর্নেল (অবঃ) তাহেরের এই ফাঁসির সংবাদে আমি একাধারে হতভম্ব ও মর্মাহত হই দারুণভাবে।
১৫। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট বিচাপতি এ. এস. এম. সায়েম এক আদেশে প্রেসিডেন্টের বিশেষ গার্ড রেজিমেন্ট গঠন করেন ২৪শে জুলাই (১৯৭৬)। ২৮শে জুলাই সামরিক সরকার একটি রাজনৈতিক বিধি জারি করে। ৩০শে জুলাই (১৯৭৬) সামরিক সরকার একটি আদেশে সামরিক শাসন প্রয়ােজনানুসারে কিছুটা শিথিল করতঃ ঘরােয়া রাজনৈতিক তৎপরতার অনুমতি প্রদান করে। ৪ঠা আগস্ট (১৯৭৬) সামরিক সরকার একটি আদেশে দেশে রাজনৈতিক দল গঠনের বিস্তারিত নীতিমালা ঘােষণা করে। ১৭ই আগস্ট (১৯৭৬) একটি সামরিক আদালত দুর্নীতির দায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরীকে দণ্ডিত করে। ২৪শে আগস্ট (১৯৭৬) সামরিক সরকার জাতিসংঘের অধিবেশনে ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রশ্ন বিবেচনার জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন পেশ করে। ২৯শে আগস্ট (১৯৭৬) ঢাকায় পি. জি. হাসপাতালে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলাে ৭৬ বছর। উল্লেখ্য, ইতিপুর্বে ১৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৭৬) তারিখে সরকার কবি নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেছিল। ৩০শে আগস্ট (১৯৭৬) তারিখে কবি নজরুল স্মরণে সাধারণ ছুটি ও জাতীয় শােক দিবস পালন করা হয়।
১৬। ১লা সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) তারিখে এক মর্মান্তিক বিমান মহড়া দুর্ঘটনায় বিমান বাহিনী প্রধান ও অন্যতম উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল কে. এম. বাশার নিহত হন। একই দুর্ঘটনায় আরও নিহত হন স্কোয়াড্রন লীডার মফিজুল হক। অনেকে এই দুর্ঘটনাকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধাদেরকে নির্মূল করার পাকিস্তানপন্থী বিশেষ মহলের ষড়যন্ত্রের অংশ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) তারিখে এয়ার কমোেডর এ. জি. মাহমুদকে নতুন বিমান বাহনী প্রধান হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। ওই সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) তারিখে বিমান বাহনী প্রধান এ. জি. মাহমুদকে অন্যতম উপপ্রধান
পৃষ্ঠাঃ ২৭৮
সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ৯ই সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) সামরিক সরকার বাংলাদেশের ১৮টি মহকুমায় সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করে। ১৪ই সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) সামরিক সরকার দেশের আরও ২৭টি মহকুমায় সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত গঠন করে।
১৭। ৪ঠা আগষ্টে দেশে রাজনৈতিক দল গঠনের নীতিমালা প্রকাশ হওয়ার পর পরই উক্ত নীতিমালা অনুসারে দরখাস্তের রাজনীতির হিড়িক পড়ে যায়। অর্ধ শতাধিক প্রস্তাবিত দল সামরিক সরকারের কাছে প্রয়ােজনীয় অনুমােদনের জন্যে আবেদন পেশ করে। ২১শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) চারটি রাজনৈতিক দল, যথা ন্যাপ (ভাসানী), মুসলিম লীগ, জাতীয় লীগ এবং পিপলস লীগ সরকারী অনুমােদন লাভ করে। ২২শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) সরকারী অনুমােদন লাভ করে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের বাংলাদেশ ডেমােক্রেটিক লীগ। ৯ই অক্টোবর (১৯৭৬) বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে খসড়া ভােটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। ১২ই অক্টোবর আরও দুটো রাজনৈতিক দল সরকারী অনুমােদন লাভ করে। ১৩ই অক্টোবর (১৯৭৬) সামরিক সরকার অনুমােদন প্রদান করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং মােঃ তােয়াহার সাম্যবাদী দলকে।
১৮। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩রা সেপ্টেম্বর (১৯৭৬) তারিখে প্রথম দলের ঘােষণাপত্র ও কর্মসূচী সরকারের নিকট পেশ করে। এর পর, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলােচনার ভিত্তিতে ৮ই অক্টোবর (১৯৭৬) তারিখে পুনরায় আওয়ামী লীগের সংশােধিত দলিলপত্র সরকারের কাছে পেশ করা হয়। কিন্তু সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের এই আবেদন নাকচ করে দেয়। ১৮ই অক্টোবর (১৯৭৬) তারিখের একটি চিঠিতে আইন ও সংসদ মন্ত্রণালয় তৎকালীন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরীকে জানান যে, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলবিধির শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। উক্ত চিঠিতে আরও জানানাে হয় যে, আওয়ামী লীগের দাখিলকৃত দলিলপত্রের বক্তব্য ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির ১০ নম্বর ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উক্ত চিঠিতে আওয়ামী লীগের দাখিলকৃত ঘােষণাপত্রের প্রস্তাবনার এক জায়গায় ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের ব্যবহারকে দলবিধি আইনের পরিপন্থী বলে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ, “জীবিত বা মৃত কোন ব্যক্তির পূজার উদ্রেক করে বা ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম প্রচার অথবা বিকাশে সহায়তা করে এমন বিষয় ” নিষিদ্ধ করা হয়েছে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির ১০ নম্বর ধারায়। উপরােল্লিখিত পরিস্থিতিতে পরবর্তী কর্মপদ্ধতি ও কর্তব্য নির্ধারণের জন্যে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ২৫শে ও ২৬শে অক্টোবর (১৯৭৬) তারিখে ঢাকায় জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। অতঃপর স্ট্রাটেজিক কারণে বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়েই আওয়ামী লীগের দলিলপত্র সরকারের কাছে পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই অনুসারে কাগজপত্র পুনরায় দাখিল করায় সামরিক সরকার ৪ঠা নভেম্বর তারিখে আওয়ামী
পৃষ্ঠাঃ ২৭৯
লীগকে অনুমােদন প্রদান করে। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে প্রফেসর মােজাফফর আহমদের ন্যাপ এবং কমরেড মণি সিং-এর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সরকারের অনুমােদন লাভ করেছিল।
১৯। সামরিক সরকারের নির্দেশে ৭ই নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ৯ই নভেম্বর (১৯৭৬) তারিখে বিমান বাহিনী প্রধান ও অন্যতম উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এ. জি. মাহমুদকে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে পদোন্নতি প্রদান করা হয়। ১৬ই নভেম্বর সামরিক সরকার ১৯৭৭ সালের জানুয়ারীতে সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ১৭ই নভেম্বর (১৯৭৬) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (৯৬ বছর বয়সে) ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে সামরিক সরকার এক সপ্তাহব্যাপী জাতীয় শােক পালনের ঘােষণা দেয়। ১৮ই নভেম্বর (১৯৭৬) তারিখে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় টাংগাইলের সন্তোষে মাওলানা ভাসানীর দাফনকার্য সম্পন্ন করা হয়।
২০। এদিকে সামরিক সরকার কর্তৃক দেশে ঘরােয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক শক্তিগুলাে সরকার সমর্থক ও সরকার বিরােধী এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এই দুই শিবিরের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। একদিকে, আওয়ামী লীগ পূর্ব ঘােষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীতে সােচ্চার হয়ে ওঠে। অপরদিকে, সরকারের সমর্থক জনসমর্থনহীন ডানপন্থী, পাকিস্তানপন্থী, ডানপন্থী সাম্প্রদায়িক এবং মাওবাদী বামপন্থী দলগুলাে নির্বাচনের বিরােধিতায় অবতীর্ণ হয়। ২১শে নভেম্বর (১৯৭৬) তারিখে ফেনী টাউন হলে আওয়ামী লীগের এক কর্মী সম্মেলনে ভাষণ প্রদানকালে জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার জনাব আব্দুল মালেক উকিল বলেন, “আমরাই তাে সত্যিকারের সরকার। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে দেশ শাসন করার অপচেষ্টা নিতান্তই বৃথা। জনগণের সরকার পুনরায় কায়েম করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সংঘবদ্ধ হতে হবে, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে হবে।”
২১। কিন্তু ঘরােয়া রাজনীতির সীমিত সুযােগটুকু সদ্ব্যবহার করে দলীয় কর্মীদের মধ্যে সংযােগ স্থাপিত হওয়ার আগেই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির উপর নেমে আসে এক অবাঞ্ছিত আঘাত। ২১শে নভেম্বর (১৯৭৬) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েম ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীর প্রতিশ্রুত সাধারণ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘােষণা করেন। উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে নিহত হওয়ার পর তখন ক্ষমতা দখলকারী খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ দেশে সাধারণ নির্বাচনের এই ওয়াদা দিয়েছিলেন। ৬ই নভেষ্ম (১৯৭৫) তারিখে দেশের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হওয়ার পর
পৃষ্ঠাঃ ২৮০
বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েম সর্বপ্রথম যে ভাষণটি দেন, তাতেও তিনি ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারীতেই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু, সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে ১৯৭৬ সালের ২১শে নভেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েম বলেন, “জাতীয় জীবনের বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে নির্বাচন জাতীয় সংহতি বিপন্ন করবে বিধায় পূর্বঘােষিত সময়ে জাতীয় পর্যায়ে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর হচ্ছে না। এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে বিভিন্ন মহলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক নেতার মতে দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে জাতীয় নিরাপত্তাকে নির্বাচনের চাইতে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়ােজন এবং আইন-শৃঙ্খলা ও জাতীয় উন্নয়ন কার্যক্রম যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়। জনগণও এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন চায় না। ক্রমবর্ধমান সীমান্ত গােলযােগ আমাদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। তার ওপরে ফারাক্কা সমস্যা অর্থনীতির ওপর ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। এই মুহূর্তে নির্বাচন জাতীয় ঐক্যের অন্তরায় হতে পারে। বৈদেশিক শক্তির যােগসাজশে মুষ্টিমেয় বিপথগামী যুবক দেশের অভ্যন্তরে ধ্বংসাত্মক তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। পরস্পর বিরােধী ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ কলুষিত হয়ে উঠেছে। অর্ধ শতাধিক রাজনৈতিক দল অনুমােদন প্রার্থী। অনেক নেতা তাঁদের সাবেক দল ছেড়ে নতুন দল পত্তন করছেন। এটা রাজনৈতিক অনৈক্যেরই প্রতিফলন। এই পটভূমিতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তবে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন আগামী জানুয়ারীতেই অনুষ্ঠিত হবে। এই সব নির্বাচন স্থানীয় প্রশাসনের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে এবং জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত করবে।”
২২। দেশে ঐ সময় সাধারণ নির্বাচন স্থগিত রাখার ঘােষণাকে কয়েকটি ঘােট ঘােট। রাজনৈতিক দল অভিনন্দন জানালেও এর ফলে আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শিবিরে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তারা অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণার দাবী জানান। এমনকি খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদও দেশে সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষণার সিদ্ধান্তকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলে আখ্যায়িত করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অবাধ রাজনৈতিক তৎপরতার সুযােগ, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং দেশে সাধারণ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দাবী করা হয়। তৎকালীন সামরিক সরকার এই সব দাবীর জবাব দেয় ২৯শে নভেম্বর (১৯৭৬) তারিখে আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। এই দিন জাতীয় সংসদের সাবেক স্পীকার জনাব আব্দুল মালেক উকিল, দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী, জনাব রফিকউদ্দিন ভূইয়া, জনাব আব্দুল মােমেন তালুকদার, জনাব সালাউদ্দিন ইউসুফ, জনাব মােজাফফর হােসেন পল্ট প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। একই দিনে গ্রেফতার করা হয় ন্যাপের
পৃষ্ঠাঃ ২৮১
(মােজাফফর) বেগম মতিয়া চৌধুরীকে। সামরিক সরকার একই দিনে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং তার সহযােগী জনাব ওবায়েদুর রহমান, ব্যারিস্টার মঈনুল হােসেন এবং শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনকেও গ্রেফতার করে। এর আগে, ২৬শে নভেম্বর (১৯৭৬) আত্মগােপনকারী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের দার্শনিক গুরু জনাব সিরাজুল আলম খানকে গ্রেফতার করা হয়।
২৩। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আটক ছিলেন আওয়ামী লীগের সর্বজনাব কোরবান আলী, আব্দুস সামাদ আজাদ, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, এম. মতিয়ার রহমান, এডভােকেট জিল্লুর রহমান, শেখ আব্দুল আজিজ, এম. নূরুল হক, সরদার আমজাদ হােসেন, এম. শামসুজ্জোহা, গাজী গােলাম মােস্তফা, এম. এ. মান্নান, আমির হােসেন আমু, এম. এ. জলিলসহ বিপুলসংখ্যক নেতা ও কর্মী। ঐ সময়ে প্রকাশিত এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপাের্ট অনুসারে ১৯৭৬ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের কারাগারসমূহে আটক রাজবন্দীর সংখ্যা ছিলাে প্রায় ৩০ হাজার। বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, এই বিপুল সংখ্যক রাজবন্দীর অধিকাংশই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অনুসারী এবং প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী গােষ্ঠীর লােক। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ক্রমবর্ধিতহারে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী দালালদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এবং প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযােদ্ধাদের জেলে ঢােকানাে হয়েছে। এদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু আমলের বেশ কিছু সরকারী কর্মচারী এবং প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী ও ডঃ মযহারুল ইসলামের মতাে শিক্ষাবিদরাও ছিলেন।
২৪। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েম দেশে সাধারণ নির্বাচন স্থগিত ঘােষণার কাজটি সমাধা করার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তাঁর ভাগ্যে নেমে আসে এক বিপর্যয়। ২৯শে নভেম্বর (১৯৭৬) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম এক ঘােষণায় জাতীয় স্বার্থে প্রধান সামরিক প্রশাসকের ক্ষমতা ও দায়িত্ব তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নিকট হস্তান্তর করেন। তখন দেশে যেহেতু সামরিক শাসন বিদ্যমান, সুতরাং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা ও দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েম কার্যতঃ ‘ফুটো জগন্নাথে’ পরিণত হন। প্রেসিডেন্ট সায়েমের উক্ত পদক্ষেপ প্রসংগে ৩রা ডিসেম্বর (১৯৭৬) তারিখে লন্ডনে গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়, প্রশাসন ক্ষেত্রে (প্রেসিডেন্ট) সায়েমের কোন ভূমিকা ছিল না এবং কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে পরামর্শও করা হতাে না। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিনি পীড়াপীড়ি করছিলেন এবং শাসনক্ষমতা থেকে সামরিক বাহিনীকে বিদায় দেওয়ার জন্য তিনি ঘরােয়াভাবে শলাপরামর্শ শুরু করেছিলেন। এখন তাঁকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে। সায়েমকে অসামরিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে এতদিন রাখা হয়েছিল (মেঃ জেঃ) জিয়ার সামরিক শাসনের চেহারা ঢেকে রাখার জন্য।”
পৃষ্ঠাঃ ২৮২
২৫। ৭ই ডিসেম্বর সামরিক সরকার দেশের চূড়ান্ত ভােটার তালিকা প্রকাশ করে। ১২ই ডিসেম্বর (১৯৭৬) সামরিক সরকার সারাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মনােনয়ন দাখিলের সময়সূচী ঘােষণা করে। ২৪শে ডিসেম্বর (১৯৭৬) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অপ্রীতিকর ঘটনায় একজন ছাত্র নিহত হয়। এই কারণে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হয়। ২৯শে ডিসেম্বর (১৯৭৬) তারিখে সামরিক সরকার খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের বিরুদ্ধে দুইটি দুর্নীতির মামলা দায়ের করে।
২৬। জাতীয় সংসদের জন্যে সাধারণ নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত রাখা হলেও ১৯৭৭ সালের জানুয়ারী মাসেই সারাদেশে সাড়ে চার সহস্রাধিক ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে ঘটে বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের বিপুল বিজয়। তখন আওয়ামী লীগের অনেক সদস্য উক্ত নির্বাচনে কারাগার থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীকালে একতরফা অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে এমন একটা ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু দেশে ইউনিয়ন পরিষদের উক্ত নির্বাচনে প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব হলেও তাঁর রাজনৈতিক সংগঠনকে নির্মূল করে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ৬৮ হাজার গ্রাম নিয়ে যে বিস্তীর্ণ গ্রামবাংলা তার গভীরে প্রােথিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভিত্তি।
২৭। ১৯৭৭ সালের ৩রা ও ৪ঠা এপ্রিল তারিখে ঢাকার ইডেন হােটেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন। উক্ত কাউন্সিল অধিবেশন উদ্বোধন করেন মরহুম তাজউদ্দিন আহমদের পত্নী বেগম জোহরা তাজউদ্দিন। শুরুতে, সম্মেলন প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন বেগম মনসুর আলী এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মােল্লা জালাল উদ্দিন। জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর সভামঞ্চে রক্ষিত বঙ্গবন্ধু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, জনাব এম. মনসুর আলী ও জনাব এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামানের প্রতিকৃতিতে পূষ্পমাল্য প্রদান করেন সেসময় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির অপর যুগ আহবায়ক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী। অতঃপর পবিত্র কোরান তেলাওয়াত এবং গীতা ও বাইবেল পাঠ করা হয়। সভার শুরুতে এক শােক প্রস্তাবে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন, ৩রা নভেম্বরে (১৯৭৫) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত আওয়ামী লীগের চার বিশিষ্ট ও প্রবীণ নেতা এবং ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। উক্ত সম্মেলনে প্রায় ১৪ শত কাউন্সিলর এবং ১৪ শত ডেলিগেট উপস্থিত ছিলেন। ঐ সম্মেলনকে উপলক্ষ করেই দীর্ঘ এক বছর সাড়ে সাত মাস পর প্রথম ঢাকার সংবাদপত্রে ছাপানাে হয় বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর চারজন ঘনিষ্ঠ সহযােদ্ধা ও সহকর্মীর ছবি।
পৃষ্ঠাঃ ২৮৩
২৮। উক্ত সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বেগম জোহরা তাজউদ্দিন বলেন, “স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি আমার স্বামী এবং তাঁর তিনজন সহকর্মী আর আজ (বেঁচে নেই। তাই আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের) কাছে প্রত্যাশা, তাঁরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবেন এবং রাষ্ট্রীয়) চারনীতি কায়েম, জনগণের অধিকার ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী রাজবন্দীদের মুক্তি দিয়ে দেশের সামরিক সরকারকে নিজেদের নির্দলীয় প্রমাণ করার আহবান জানান। অতঃপর তিনি আরও বলেন, “নেতা চলে গেলেও কর্মী রেখে গেছেন। যদি কোনদিন দেশে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে একমাত্র আওয়ামী লীগের পক্ষেই সেই সরকার গঠন করা সম্ভব।” সভাপতির ভাষণে মােল্ল জালাল উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান সামরিক সরকার নিজেদের নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে ঘােষণা করেছেন এবং দেশে) গণন্দ্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন প্রমাণ করেছে যে, দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতাে পরিবেশ ছিল। কাজেই (সামরিক সরকারের নিরপেক্ষতা এবং উদ্দেশ্যের সাধুতা প্রমাণ করতে হলে অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করতে হবে।”
২৯। ১৯৭৭ সালের ৩-৪ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উক্ত কাউন্সিল সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ ঘােষণা করেন যে, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই চারটি মূলনীতিকে সামনে রেখে শশাষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। তাঁরা প্রকাশ্য রাজনীতির সুযােগ সৃষ্টি, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জনগণের দ্বারা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্যে অবিলম্বে বাস্তব কর্মসূচী ঘােষণা, রাজবন্দীদের মুক্তিদান এবং বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবী ব্যক্ত করেন। উক্ত সম্মেলনে দলের পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশনে দলীয় কর্মকর্তা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত বেগম তাজউদ্দিনকে দলের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকা নিযুক্ত করা হয়। তখন জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন উক্ত পদের সবচেয়ে বেশী দাবীদার। কিন্তু প্রবীণ জননেতা শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, জনাব জহিরুল কাইয়ুম এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের উদ্যোগে কৌশলগত কারণে মরহুম তাজউদ্দিন আহমদের পত্নী বেগম জোহরা তাজউদ্দিন অস্থায়ীভাবে দলের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন।
৩০। ২১শে এপ্রিল (১৯৭৭) তারিখে প্রেসিডেন্ট বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েম তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নিকট রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। অতঃপর ২২শে এপ্রিল (১৯৭৭) তারিখে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক বেতার ভাষণে ঘােষণা করেন যে, ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে সাধারণ নির্বাচন
পৃষ্ঠাঃ ২৮৪
অনুষ্ঠিত হবে। উপরন্তু, তাঁর ওপর জনগণের আস্থা আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্যে ১৯৭৭ সালের ৩০শে মে অনুষ্ঠিত হবে দেশব্যাপী ‘গণভােট। ২২শে এপ্রিল তারিখে সামরিক সরকার একটি রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে ১৯৭২ সালে গৃহীত দেশের সংবিধানের কতিপয় সংশােধনীসহ উক্ত সংবিধানে বর্ণিত চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন করে। এই পদক্ষেপের কারণ হিসেবে বলা হয় যে, রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রশ্নে গণমনে অসন্তোষ থাকার দরুনই এটা করা হয়েছে। উক্ত অধ্যাদেশবলে ১৯৭২ সালে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধানের যে সব সংশােধন (3 পরিবর্তন করা হয় তার কয়েকটি উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে : (১) সংবিধানের শিরােনামের নীচে “বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহিম” সংযােজন, (২) সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে পূর্ববর্ণিত “জাতীয় মুক্তির জন্যে ঐতিহাসিক সংগ্রামের কথাগুলাের পরিবর্তে জাতীয় স্বাধীনতার জন্যে ঐতিহাসিক যুদ্ধের” কথাগুলাে প্রতিস্থাপন, (৩) চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে পুর্ববর্ণিত “জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা” কথাগুলাের পরিবর্তে”সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার” কথাগুলাে প্রতিস্থাপন এবং (৪) সংবিধানে রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সুসংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন” কথাগুলাে উল্লেখপূর্বক একটি উপধারা সংযােজন। ১৯৭২ সালে গৃহীত সংবিধানের উপরােল্লিখিত সংশােধনীগুলাের মধ্যে চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তনে সমাজে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ধর্মনিরপক্ষতাকে” বাতিলকরণের বিরুদ্ধে সমাজে উথিত হয় তীব্র মতভেদ, আপত্তি ও প্রতিবাদ যা এখনও দৃশ্যমান। উল্লেখ্য, ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বার বার বলতেন, “ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়, এর অর্থ) মানুষের যে কোন ধর্ম-কর্ম পালন ও আদর্শ চর্চার অবাধ অধিকার এবং মানুষের ধর্মানুভূতি ও মতাদর্শের প্রতি সহনশীলতা ও শ্রদ্ধাশীলতা।”
৩১। ৩০শে এপ্রিল (১৯৭৭) তৎকালীন সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচী ঘােষণা করেন। ১৯৭৭ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সামরিক সরকার এক সরকারী আদেশে মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী এবং মেজর নূরকে সেনাবাহিনীতে . পুনর্বহাল করে। শরিফুল হক ডালিম, রাশেদ চৌধুরী এবং নূর সেনাবাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আইন অবমাননা ও ভঙ্গের দায়ে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের জুন মাসে। ঐ সময়ে মেজর শাহরিয়ার নিজেই সেনাবাহিনী ছেড়ে দেন। দীর্ঘ তিন বছর পর ঐ মেজরদের সেনাবাহিনীতে প্রত্যাবর্তন এক নজিরবিহীন ঘটনা। উপরন্তু, তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বধীন সামরিক সরকার খুনী মেজর চক্রের ১৬ জন সদস্য যাঁরা ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও নিকটতর আত্মীয়
পৃষ্ঠাঃ ২৮৫
স্বজনদের হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন বলে নিজেরাই স্বীকার করেছেন তাঁদের মধ্যে লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেঃ কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশিদ বাদে অন্যান্য সবাইকে বাংলাদেশের বিদেশস্থ বিভিন্ন দূতাবাস ও মিশনে চাকুরী প্রদান করে। ৩০শে মে (১৯৭৭) তারিখে দেশে অনুষ্ঠিত হয় তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না তা যাচাইয়ের জন্যে তৎসম্পর্কিত ‘হ্যাঁ’-এর গণভােট। সরকারী ভাষ্য ও তথ্য অনুযায়ী উক্ত গণভােটে শতকরা ৮৮.৫ ভােটদাতারা অংশগ্রহণ করেন এবং প্রদত্ত ভােটের শতকরা ৯৮.৮৮ ভাগ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ওপর আস্থাসূচক ‘হা’ ভােট পড়ে বলে দাবি করা হয়।
৩২। সশস্ত্র বাহিনীর উগ্র সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানপন্থী সদস্যদের সাহায্য ও সহযােগিতায় বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থী, সাম্প্রদায়িক ও পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল এবং বঙ্গবন্ধুবিরােধী মহল ও ব্যক্তিদের ২৮শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৭) বিমান বাহিনী দিবসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের আর এক পরিকল্পনার খবর পাওয়া যায়। ২৭শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৭) তারিখে জাপান এয়ারলাইন্সের একটি ডি. সি-৮ বিমান ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে ব্যাংককের পথে ভারতের বােম্বে বিমান বন্দর ত্যাগ করার পর পরই হাইজ্যাক হয়। পাঁচ সদস্যের এই বিমান। ছিনতাইকারীরা ছিলেন জাপানী ব্লেড আর্মীর ‘হিদাকা কম্যান্ডাে ইউনিটের সদস্য। ছিনতাইকারীরা উক্ত বিমানটিকে ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করায়। অতঃপর তারা যাত্রীদের জিমী করে ৬ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ এবং জাপানের কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে আটক তাদের নয় জন সহযােগীর মুক্তি দাবী করে। তখন ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আপােষ রফার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান ও অন্যতম উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মর্শাল এ. জি. মাহমুদকে। তিনি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ারে অবস্থান নিয়ে ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আলােচনায় নিয়ােজিত থাকেন। উক্ত আলােচনায় তাঁকে সাহায্য করার জন্যে সেখানে উপস্থিত থাকেন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এবং আরও দুইজন সিনিয়র সিভিল অফিসার। উক্ত ঘটনার কারণে ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখের বিমান বাহিনী দিবসের সকল অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। এই কারণে ২৮শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৭) তারিখে সামরিক অ্যুথান ঘটানাের পরিকল্পনাও পরিবর্তন করা হয়।
৩৩। অতঃপর ৩০শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৭) তারিখে বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ২২ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাহীরা। তারা দুইজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাকে হত্যা করে এবং ৯৩ ব্রিগেড কমান্ডারসহ আরও কয়েকজন অফিসারকে বন্দী করে রাখে। অতঃপর তারা ১৯৭৬ সালের সিপাহী বিদ্রোহে সাজাপ্রাপ্ত ১৭ জন সৈনিককে জেলখানা থেকে মুক্ত করে আনে। এদিকে ঢাকাস্থ আর্মি ফিড সিগন্যাল ব্যাটেলিয়নের সৈন্যরা সিগন্যালম্যান শেখ
পৃষ্ঠাঃ ২৮৬
আব্দুল লতীফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। সিগন্যাল সৈনিকদের সঙ্গে যোগ দেয় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের কুর্মিটোলা এয়ার বেইসের সিপাহীরা। প্রায় ৭০০ সৈনিক এই অভিযানে যােগ দেয়। তারা সিপাহী বিপ্লবের ঘােষণা দিয়ে অফিসারদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। ভাের পাঁচটায় সাতটি ট্রাক ভর্তি সিপাহী ঢাকা রেডিও স্টেশন দখল করে। অতঃপর তারা রেডিওতে সিপাহী বিপ্লবের ঘােষণা দেয় এবং একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়েছে বলে দাবী করে। এয়ারফোর্সের সার্জেন্ট আফজাল নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান বলে ঘােষণা দেয় এবং নিজেকে বিপ্লবী কাউন্সিলের প্রধান বলে দাবী করে। এর অল্পসময়ের মধ্যে ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অফিসার নিধন শুরু হয়। বিমান বন্দরের হ্যাংগারের বাইরে প্রথমেই বিমান বাহিনীর দুইজন পাইলটকে হত্যা করা হয়। কয়েকশত সিপাহী এয়ারপাের্ট বিল্ডিং দখল করে নেয় এবং সেখানে নয় জন অফিসারকে হত্যা করে। দৈব্যক্রমে বিমান বাহিনী প্রধান এ. জি. মাহমুদ বেঁচে যান। জানা যায় যে, তখন তিনি লুংগি ও শার্ট পরে সেখানে আত্মগােপন করেছিলেন। অপরদিকে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অনুগত ও সমর্থকরা পাল্টা অভিযান চালায়। সকাল সাতটার দিকে মেজর মােস্তফার নেতৃত্বে এক কোম্পানী সৈনিক আক্রমণ চালিয়ে বিদ্রোহীদের ২০ জনকে হত্যা করে এবং অপর ৬০ জনকে গ্রেফতার করে। ২৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্য একটি দল রেডিও স্টেশন পুনর্দখল করে। এই রেজিমেন্টের সৈন্যরা ঢাকার ফার্মগেটের কাছে প্রায় ২০০ বিদ্রোহীকে পরাজিত করে এবং তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়। দিনের মধ্যভাগে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ঢাকা রেডিও স্টেশনে যান এবং রেডিওতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে তিনি বলেন, “সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সৈনিক সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা নষ্ট করতে চেয়েছিল। তাদের দমন করা হয়েছে।”
৩৪। উপরােল্লিখিত ঘটনার পর সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীগুলােতে তাঁর বিরুদ্ধাচরণকারীদের দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। প্রথমেই তিনি তৎকালীন ডিফেন্স ফোর্সেস ইনটেলিজেন্সের প্রধান এয়ার কমােডাের ইসলামকে বরখাস্ত করেন। তিনি এই বিদ্রোহে এয়ার ভাইস মার্শাল এ. জি. মাহমূদ জড়িত ছিলেন বলে সন্দেহ করেছিলেন। কিন্তু এতদব্যাপারে তদন্ত করার জন্যে গঠিত তদন্ত কমিশন বিমান বাহিনী প্রধানের উক্ত ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার কোন সাক্ষ্য-প্রমাণ খুঁজে পায়নি। তাসত্ত্বেও, ১৯৭৭ সালের ৮ই ডিসেম্বরে তৎকালীন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ. জি. মাহমুদকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। একই তারিখে এয়ার কমােডাের সদরুদ্দিনকে বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। অতঃপর যে সকল সৈনিক উক্ত বিদ্রোহে জড়িত ছিল বলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সন্দেহ করেছিলেন তাদের অনেককেই চরম শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। এক
পৃষ্ঠাঃ ২৮৭
সরকারী হিসেব অনুযায়ী সে সময় ১১৪৩ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল এবং আরও কয়েকশত ব্যক্তিকে প্রদান করা হয়েছিল বিভিন্ন মেয়াদে সশ্রম কারাদণ্ড।
৩৫। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে রেহানা লন্ডন থেকে দিল্পী আসে আমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার জন্যে। ইতিপূর্বে রেহানা ১৯৭৬-এর ডিসেম্বর মাসে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর ফুফাতাে ভাই মুমিনুল হক খােকা কাকার নিকট চলে যায়। ২৪শে জুলাই (১৯৭৭) তারিখে সেখানে ঢাকার আবু বকর সিদ্দিক সাহেবের দ্বিতীয় ছেলে শফিক সিদ্দিকে সঙ্গে রেহানার বিবাহ হয়। শফিক সিদ্দিক তখন লন্ডনে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত ছিল। দুঃখের বিষয়, আমাদের কারােরই তখন ভারত থেকে লন্ডনে গিয়ে উক্ত বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সম্ভব হয়নি। অতঃপর হাসিনা ও আমি আগস্ট (১৯৭৭)-এর শেষের দিকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী মােরারজী দেশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি তার ১ নম্বর সফরজংগ রােডস্থ বাসভবনে। শ্রী মােরারজী দেশাইয়ের অনুমতিক্রমে তখন রেহানাকে কিছুদিনের জন্যে লন্ডন থেকে দিল্লীতে আমাদের কাছে আনার বন্দোবস্ত করা হয়। উল্লেখ্য, যখন রেহানা হাসিনার সঙ্গে (১৯৭৫-এর ৩০শে জুলাই) পশ্চিম জার্মানী যায়, তখন সে ছিলাে উচ্চ মাধ্যমিক বাের্ড পরীক্ষার পরীক্ষার্থী। কিন্তু ১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টের দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মান্তিক ঘটনার কারণে রেহানা উচ্চ মাধ্যমিক বাের্ডের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি। অতঃপর ১৯৭৬-এর জুলাই মাসে রেহানার জন্যে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি নিকেতনে ভর্তি হওয়ার আয়ােজন করা হয়েছিল। এমন কি এতদুদ্দেশ্যে রেহানার জন্যে কিছু কিছু কেনাকাটাও করা হয়েছিলাে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিরাপত্তার কারণে তখন রেহানার শান্তি নিকেতন যাওয়া বাতিল করা হয়। এর ফলে, রেহানা ওর ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে, লেখাপড়ার চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে পড়ে। অতঃপর ১৯৭৬-এর ডিসেম্বর মাসে রেহানা লন্ডনে গিয়ে পড়াশুনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
৩৬। ১৫ই ডিসেম্বর (১৯৭৭) রাতে জাতীয় বিজয় দিবস উপলক্ষে সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তি, মহল ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক ‘ফ্রন্ট’ গঠনের অভিলাষ ব্যক্ত করেন। অতঃপর তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগের মতাে জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দল (জাগদল) গঠন করেন। জেনারেল আইয়ুব খান তখন যেমন নিজে তাঁর দলের প্রধান না হয়ে দলপতি করেছিলেন চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে, তেমনিভাবে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজে ‘জাগদলের আহ্বায়ক না হয়ে উক্ত পদে নিযুক্ত করেন তাঁরই ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে। অতঃপর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও
পৃষ্ঠাঃ ২৮৮
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের পক্ষে ‘জাগদলকে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। ১৯শে ডিসেম্বর তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান দুই দিনের সফরে দিল্লী যান। ২০শে ডিসেম্বর (১৯৭৭) তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ঐ দিন বিকেলে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ২২শে ডিসেম্বর (১৯৭৭) জিয়াউর রহমান সাহেব দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে পাকিস্তান যান। ২৩শে ডিসেম্বর (১৯৭৭) তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।
৩৭। ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসের ৩ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় আহবান হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ(BAL)-এর দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু নিহত(assassinated) হওয়ার পর এটাই ছিল, বি. এ. এলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রথম দ্বিবার্ষিক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন। বি. এ. এলের উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে রাজনীতির ক্ষেত্রে এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল) দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। একমাত্র এই দলেরই রয়েছে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত সংগঠন, পাড়ায় পাড়ায় নিষ্ঠাবান কর্মী এবং বলতে গেলে ঘরে ঘরে সমর্থক। বি. এ. এলের উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনের দলীয় নীতির পুনঃঘােষণা প্রসঙ্গে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়, “সামরিক শাসন বা যে কোন রকম স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে আপােষের প্রশ্নই ওঠে না। বি. এ. এল অবিচল থাকবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, অটল থাকবে জাতীয়তাবাদ, সমাজ, গণন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে এবং লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত রাখবে জাতির জনকের নির্দেশিত পথে শশাষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।” বি. এ. এলের উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর, সকল রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তিদান এবং বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় নেতাদের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের দাবী ঘােষণা করা হয়। বি. এ. এলের উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে দেশে সাধারণ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘােষণারও দাবী জানানাে হয়। তিন দিনব্যাপী উক্ত কাউন্সিল অধিবেশনে পরবর্তী দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল)-এর কার্যনির্বাহী পরিষদের কর্মকর্তা নির্বাচিত করা হয়। জনাব আব্দুল মালেক উকিল দলের সভাপতি এবং জনাব আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
৩৮। বি. এ. এলের ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশন থেকে ফিরে গিয়ে নেতারা স্ব স্ব এলাকার কর্মীদের নিয়ে নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাংগঠনিক তৎপরতায়। পূর্ব প্রতিশ্রুত সাধারণ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের প্রস্তুতির পাশাপাশি চলতে থাকে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে গণ-আন্দোলন গড়ে তােলার নীরব প্রস্তুতি। উল্লেখ্য,
পৃষ্ঠাঃ ২৮৯
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীকালে (১৯৭৭-এর জানুয়ারীতে) অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ এবং তৎপরবর্তীতে অনুষ্ঠিত পৌরসভার নির্বাচনে বি. এ. এলের সমর্থকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়লাভ এটাই সুস্পষ্ট করে তুলেছিল যে, ঘাতকের হাতে নিহত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব (গােপালগঞ্জের) টুংগিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হলেও দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি জীবন্ত, দীপ্তিমান। একই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, দেশে সংসদীয় পদ্ধতিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বি. এ. এলই জয়লাভ করবে। এই ধারণাকে কেন্দ্র করে বি. এ. এল শিবিরে যখন ক্রমবর্ধমান কর্মচাঞ্চল্য, বিরােধী শিবিরে যখন আতংক এবং সারাদেশের জনগণ যখন পূর্বপ্রতিশ্রুত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদের নিকট সামরিক সরকারের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রত্যাশায় অপেক্ষমাণ, ঠিক সেই সময় মার্চ মাসের শেষের দিকে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আকস্মিকভাবে সকলকে হতচকিত করে দিয়ে ঘােষণা করেন যে, জুন (১৯৭৮)-এর প্রথম সপ্তাহেই প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভােটে দেশের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
৩৯। ৫ই এপ্রিল (১৯৭৮) তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে প্রণীত বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন সংশােধনপূর্বক একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এর ফলে, বিদেশে, বিশেষ করে পাকিস্তানে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থবিরােধী ও স্বাধীনতা নস্যাৎ করার কাজ ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার দায়ে বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিত্বের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল তাদের পুনরায় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযােগ সৃষ্টি ও পথ সুগম হয়। ৯ই এপ্রিল (১৯৭৮) তারিখে জিয়াউর রহমান সাহেব তাঁর জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দলে (জাগদলে) যােগদান করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ১৮ই এপ্রিল (১৯৭৮) তারিখে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি সংক্রান্ত একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। ২১শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান সাহেবের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন ৩রা জুন (১৯৭৮) দেশে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের জন্য নির্ধারণ করে। ২২শে এপ্রিল (১৯৭৮) জিয়াউর রহমান সাহেবের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার ১লা মে (১৯৭৮) তারিখ থেকে দেশে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার অনুমতি দেয়। ২৮শে এপ্রিল (১৯৭৮) তারিখে জিয়াউর রহমান সাহেবের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার পূর্বজারিকৃত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স সংশােধনপূর্বক একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। এই সংশােধনীতে বলা হয় যে, সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে কেবলমাত্র সেনাবাহিনী প্রধান রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়াসহ রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। ১লা মে (১৯৭৮) তারিখে জাগদল,
পৃষ্ঠাঃ ২৯০
ভাসানী ন্যাপের মশিউর রহমান গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস পার্টির কাজী জাফর-হালিম গ্রুপ, মুসলিম লীগ, জাগমূই এবং বাংলাদেশ লেবার পার্টির সমন্বয়ে একটি ছয়-দলীয়
জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করা হয় এবং তৎকালীন সরকারী চাকুরীরত সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে উক্ত ফ্রন্টের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়।
৪০। ১৯৭৮ সালে দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘােষণার দিন এবং নির্বাচনের দিনটির মধ্যে ব্যবধান ছিলাে মাত্র মাস দুয়েকের। গৌরী সেনের অঢেল টাকার অধিকারী ক্ষমতাসীন দল ছাড়া অন্য কোন দলের পক্ষেই এত অল্প সময়ের মধ্যে দেশব্যাপী জনসংযােগ স্থাপন করে প্রত্যক্ষ ভােটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেওয়া ছিলাে দুঃসাধ্য ব্যাপার। উপরন্তু, বি. এ. এলের দাবী ছিলাে সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা। তবুও, কোন কিছুতেই বিনা চ্যালেঞ্জে যেতে দেওয়া হবে না” বলে ঘােষণা করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। (বি. এ. এল) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। বি. এ. এল, ন্যাপ (মােজাফফর), সি. পি. বি., জনতা পার্টি, পিপলস লীগ এবং গণআজাদী লীগ নিয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক ঐক্য জোটের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে মনােনীত করা হয় ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিবাহিনীর প্রধান ও পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের অন্যতম সদস্য জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানীকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীকালে, বিশেষতঃ খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের আমলে, ওসমানীর ভূমিকা ছিল বিতর্কিত, যে কারণে তাঁর মনোনয়নও সর্বজন সমর্থিত ছিল না। তবুও তাঁকে মনােনীত করা হয় কতকগুলাে কৌশলগত কারণে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী গণতান্ত্রিক ঐক্য জোটের প্রধান নির্বাচনী শ্লোগান ছিল দেশে সামরিক শাসনের অবসান, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠা।
৪১। ২রা মে (১৯৭৮) তারিখে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানীর এবং জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের পক্ষ থেকে তৎকালীন সরকারী চাকুরীরত সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের মনােনয়ন পেশ করা হয়। এই দুই জন ছাড়াও, আরও ৯ জন নির্দলীয় ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থিতার আবেদন জানিয়ে মনােনয়ন পেশ করেন। উল্লিখিত মনোনয়ন বাছাইয়ের পর নির্বাচিত কমিশন জেনারেল (অবঃ) ওসমানী ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ সর্বমােট ১০ জনের মনােনয়ন বৈধ বলে ঘােষণা করে। এই ১০ জন বৈধ প্রার্থীর সকলেই ৩রা জুন (১৯৭৮)-এর রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
৪২। ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন তারিখে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতি দুইটি শিবিরে বিভক্ত হয়। একদিকে ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী আর অপরদিকে তাঁরই
পৃষ্ঠাঃ ২৯১
তৎকালীন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। জেনারেল (অবঃ) ওসমানীর সমর্থন ও শক্তির উৎস ছিল মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল) ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও মহল। অপরদিকে, তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সমর্থন ও শক্তির উৎস ছিলাে, মুক্তিযােদ্ধাদের একাংশ, মুসলিম লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মহল এবং পিকিং (বর্তমানে বেইজিং)-পন্থী শিবির ও বিভিন্ন মহল। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টের মূল নির্বাচনী শ্লোগান ছিলাে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার কায়েম এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করা। জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট জোর গলায় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীদের কথা বললেও এর অধিকাংশ নেতা ও কর্মীরা ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করেছিল।
৪৩। নির্বাচনের কিছুদিন আগেই পারিষ্কার হয়ে যায় যে, জিয়াউর রহমান সাহেব নির্বাচনে জিতবেনই। গণতান্ত্রিক ঐক্যজোটের ভাষায় নির্বাচনের সময় ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্রলােভন ও চাপ সৃষ্টি এবং সরকারী প্রভাব, ক্ষমতা ও অর্থের অপব্যবহারের মাধ্যমে এই বিজয় সুনিশ্চিত করে ভােলা হয়। ৩রা জুন (১৯৭৮) তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পান শতকরা ৭৬.৭ ভাগ ভােট এবং জেনারেল (অবঃ) ওসমানী পান শতকরা ২১.৭ ভাগ ভােট। ৪ঠা জুন (১৯৭৮)-এর সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে জেনারেল (অবঃ) ওসমানী উক্ত নির্বাচনে ভয়ভীতি প্রদর্শন, সরকারী প্রভাব, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও অর্থের অপব্যবহার এবং কারচুপি করার অভিযােগ করেন। কিন্তু গণতন্ত্রের স্বার্থেই তিনি নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নেন এবং পরে টেলিফোনে জিয়াউর রহমান সাহেবকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানান।
৪৪। ২৯শে জুন (১৯৭৮) সেনাবাহিনী প্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ২৮ জন মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে তাঁর মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। ১৪ই জুলাই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ৯ই আগস্ট (১৯৭৮) তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর ১৯ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নে একটি ১৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন। ১লা সেপ্টেম্বর (১৯৭৮) তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদল-BNP) গঠন করে তার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট
পৃষ্ঠাঃ ২৯২
জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক পুস্তকটি বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে।
৪৫। এদিকে শ্রী মােরারজী দেশাই ১৯৭৭-এর গােড়াতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আমাদের ওপর নানানভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয় যাতে আমরা ভারত ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। ১৯৭৮ সালের গােড়া থেকে এই চাপ ও হয়রানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রথমে আমাদের দিল্লীর পান্ডারা রােডস্থ ফ্ল্যাটের ইলেকট্রিসিটি ও পানির বিল পরিশােধ করা বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে, আমার অফিসে যাতায়াতে অফিসের গাড়ী ব্যবহারের সুবিধাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অতঃপর সাধারণ পরিবহনে আমি অফিসে যাতায়াতে ব্যবহার করতে বাধ্য হই। ইতিপূর্বে সুদীর্ঘ নয় মাস অপেক্ষা করার পর ১৯৭৬-এর ২৭শে মে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা(IAEA) আমার তৎকালীন পশ্চিম জার্মানীর ফেললাশীপ বাতিল করে। উল্লেখ্য, ভারত ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালেই আমি দীর্ঘমেয়াদী চাকুরীর জন্যে আবেদন জানিয়ে প্রথমে চিঠি লিখি ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার পি. এইচ. ডি-এর সুপারভাইজার প্রফেসর ই. জে. ফয়ার্সের কাছে এবং পরবর্তীতে (তৎকালীন) পশ্চিম জার্মানীর বিলেফেল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১২ই ডিসেম্বর (১৯৭৬) তারিখে আমি চাকুরীর জন্য দরখাস্ত করি তৎকালীন ইরানের আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের নিকট। অতঃপর ১৯৭৮-এর ৭ই জুনে আমি চাকুরীর জন্যে দরখাস্ত করি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আর. জে. ইলিয়টের কাছে। কিন্তু দুঃখজনক যে, তাঁদের প্রত্যেকেই বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে চাকুরী প্রদানে তাদের অপারগতা ব্যক্ত করেন।
৪৬। পূর্ব অনুসৃত নিয়ম-রীতি অনুসারে ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে গােড়াতেই আমার ভারতের পােল্ট-ডক্টরাল ফেলােশীপ ১লা অক্টোবর থেকে আর এক বছরের জন্যে নবায়ন করার আবেদন জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ব্যক্তিগতভাবে পেশ করি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী পরিষদ বিভাগীয় সচিব এন. কে. মুখার্জী (আই. সি. এস)-এর কাছে। পরবর্তীতে, আমার নিকট হতে আরও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র চাওয়া হলে আমি সেগুলােও যথাসময়ে তাঁকে প্রদান করি। এরপর তিন মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আমার ফেলােশীপ নবায়িত না হওয়ায় এবং অর্থ সংকটের কারণে নভেম্বর (১৯৭৮)-এর মাঝামাঝি একদিন আমি প্রধানমন্ত্রী শ্রী মােরারজী দেশাইয়ের অফিসে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সেদিন তাঁর সঙ্গে বেশ দীর্ঘ বিতর্ক হয়। যাহােক, এর দিন সাতেক পর আমার ভারতীয় ফেলােশীপ ১লা অক্টোবর (১৯৭৮) থেকে আর এক বছরের জন্য নবায়িত করা হয়েছে বলে তৎমর্মে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অফিস স্মারক পাই।
৪৭। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচন কমিশন ৩০শে নভেম্বর (১৯৭৮) তারিখের এক ঘােষণায় ১৯৭৯ সালের ২৭শে জানুয়ারী তারিখ নির্ধারণ করে দেশে জাতীয় সংসদের
পৃষ্ঠাঃ ২৯৩
সাধারণ নির্বাচনের জন্যে। ১৫ই ডিসেম্বর (১৯৭৮) তারিখে প্রধান সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এক ফরমান জারি করে দেশের রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটান। এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালে প্রবর্তিত এক দলীয় সরকার ব্যবস্থা রহিত করা হলেও রাষ্ট্রপতি পদ্ধতিকে শুধু বহালই রাখা হয়নি বরং রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা আরও কেন্দ্রীভূত করে রাষ্ট্রপতিকে স্বৈরশাসকে পরিণত হওয়ার সুযোেগ সৃষ্টি করা হয়। ২৬শে ডিসেম্বর (১৯৭৮) নির্বাচন কমিশন পূর্ব ঘােষিত তারিখ পরিবর্তন করে ১৯৭৯-এর ১২ই ফেব্রুয়ারী তারিখ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্যে পুনঃনির্ধারণ করে। সবশেষে, ৫ই জানুয়ারী (১৯৭৯) বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচন কমিশন ১৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৭৯) তারিখ দেশের জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনের জন্যে চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করে। ১৫ই জানুয়ারী (১৯৭৯) তারিখে বাংলাদেশ সরকারের নির্বাচন কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী প্রতীক বরাদ্দ করে। ১৬ই জানুয়ারী (১৯৭৯) তারিখে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমে বলা হয় যে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ২,৩৪৮ জন মনােনয়ন পত্র দাখিল করেন।
৪৮। ১৯৭৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সেনাবাহিনী চীফ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদল-বি. এন. পি.) প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতােই জোর-জবরদস্তি, ভয়ভীতি প্রদর্শ সরকারি প্রভাব ক্ষমতা ও অর্থ এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা যথেচ্ছাভাবে ব্যবহার করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের ‘উপঢৌকন হিসেবে ‘মিত্রতুল্য বিরােধী রাজনৈতিক নেতাদের আপােষে বেশ কয়েকটি সংসদের আসন ছেড়ে দেন জিয়াউর রহমান সাহেব। উক্ত নির্বাচনে মূল লড়াই হয় নিপীড়ন ও আঘাতে আঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ( বি. এ. এল) এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদল-বি. এন. পি.) -এর মধ্যে। মাত্র কিছু সংখ্যক আসন বাদে সবগুলােতেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা ভােটে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। সরকারী ঘােষণা অনুযায়ী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল) জয়লাভ করে মাত্র ৩৯টি আসন। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজাদল-বি. এন. পি.) একাই জয়লাভ করে ৩০০টি আসনের ২০৭টি আসন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি জনাব আব্দুল মালেক উকিলের ভাষায় গােটা পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় একটি পূর্ব পরিকল্পিত নীলনক্সা অনুসারে। কোন দলকে কয়টি আসনে জয়লাভ করতে দেওয়া হবে, কোন কোন বিশিষ্ট প্রার্থীকে যে কোন ভাবে হােক হারিয়ে দিতে হবে, তাও আগে থেকেই ঠিক কের রাখা হয়। উল্লেখ্য যে, তখনও সারাদেশে সামরিক আইন বহাল ছিল এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন একাধারে সেনাবাহিনী চীফ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং রাষ্ট্রপতি।
পৃষ্ঠাঃ ২৯৪
৪৯। ২৬শে ফেব্রুয়ারী (১৯৭৯) তারিখে তৎকালীন বি. এন. পি.-এর সরকার ঢাকার শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সচিবালয় নির্মাণ কর্মসূচী অনুমােদন করে। ৯ই মার্চ (১৯৭৯) তারিখে জিয়াউর রহমান সাহেবের মন্ত্রী পরিষদের সিনিয়র মন্ত্রী মশিউর রহমান (যাদু মিয়া) হৃদরােগে আক্রান্ত হন। অতঃপর সংকটজনক অবস্থায় তাঁকে ঢাকার পি. জি. হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। ১১ই মার্চ (১৯৭৯) তারিখে তাঁর অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটে। ১২ই মার্চ তারিখে মশিউর রহমান (যাদু মিয়া) ইন্তেকাল করেন। ৩১শে মার্চ (১৯৭৯) মীর্জা গােলাম হাফিজ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদের স্পীকার নির্বাচিত হন। একই দিনে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দালালী করার অভিযােগে অভিযুক্ত এবং পাকিস্তানপন্থী শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করেন।
৫০। ৫ই এপ্রিল (১৯৭৯) তারিখে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় সংবিধান পঞ্চম সংশােধনী বিল। ৬ই এপ্রিল (১৯৭৯) তারিখে উক্ত সংশােধনী বলবৎ হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশােধন) আইন (১৯৭৯ সালের ১ নং আইন)-এ বলা হয় ঃ”১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ ও অন্যান্য আইন এবং উক্ত মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোন ফরমান দ্বারা এই সংবিধানে যে সকল সংশােধন, সংযােজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলােপসাধন করা হইয়াছে তাহা এবং অনুরূপ কোন ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোন আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে অথবা অনুরূপ কোন ক্ষমতা প্রয়ােগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোন আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোন ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত, আদেশকৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কর্মধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমােদিত ও সমর্থিত হইল এবং ঐ সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গ্রহীত হইয়াছে বলিয়া ঘােষিত হইল এবং তৎসম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”
৫১। ৬ই এপ্রিল (১৯৭৯) সারাদেশ হতে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইস্যু করা হয় কয়েকটি অস্বাভাবিক সরকারী গেজেট নােটিফিকেশন। ১৯৭৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী তারিখের গেজেট নােটিফিকেশন নং ৭/৮/১৭৫-১৬০ অনুযায়ী তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান নিজেকে মেজর জেনারেলের পদ হতে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদে উন্নীত করেন। ১৯৭৯ সালের
পৃষ্ঠাঃ ২৯৫
৯ই এপ্রিল তারিখের গেজেট নােটিফিকেশন নং ৭/৮/১৭৫/২৭০ অনুযায়ী পূর্ব-ইস্যুকৃত নােটিফিকেশন বাতিল করতঃ জিয়াউর রহমান সাহেব পুনরায় নতুনভাবে নিজেকে মেজর জেনারেলের পদ হতে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদে উন্নীত করেন, যা ১৯৭৮ সালের ২৮শে এপ্রিল তারিখ থেকে কার্যকর করা হয়। সর্বশেষে, ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল তারিখের অন্য একটি গেজেট নােটিফিকেশন নং ৭/৮/১৭৫-২৭০ অনুযায়ী জিয়াউর রহমান সাহেব লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন, যা ১৯৭৮ সালের ২৯শে এপ্রিল তারিখ থেকে কার্যকর করা হয়। এসব কার্যকলাপের কোন সুস্পষ্ট কারণ জানা না গেলেও এটা সুস্পষ্ট যে, জিয়াউর রহমান সাহেব ১৯৭৯ সালের ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক অফিসার অর্থাৎ সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। ‘ব্যাক ডেটে নিজের পদোন্নতি এবং অবসর গ্রহণ ঘােষণা করে জিয়াউর রহমান সাহেব এটাই প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তিনি যা খুশী তাই করতে পারেন। কিন্তু তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে ব্যাক ডেটে নিজের যােগ্যতা নির্ধারণ করা শুধু নৈতিকতা বিরােধীই নয়, বেআইনীও বটে। কাজেই তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন তারিখে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচিত ঘােষণা করা সাংবিধানিকভাবে বৈধ ও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল কি-না, সে সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয় বলে প্রতীয়মান হয়।
৫২। ১৯৭৯ সালের ১৫ই এপ্রিলের দিনটি ছিল বাংলা নববর্ষ। ঐদিনে জিয়াউর রহমান সাহেব তাঁর একটি ৪২ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। ১৬ই এপ্রিল (১৯৭৯) তারিখে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী মােরারজী দেশাই দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন। ১৭ই এপ্রিল (১৯৭৯) তারিখে জিয়াউর রহমান এবং মােরারজী দেশাইয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় শীর্ষ বৈঠক। ঐ দিনেই শ্রী মােরারজী দেশাই দিল্পী প্রত্যাবর্তন করেন। ৪ঠা নভেম্বর (১৯৭৯) তারিখে কমােডর মাহবুব আলী খান নতুন নৌবাহিনী চীফ নিযুক্ত হন। ১৮ই ডিসেম্বর (১৯৭৯) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল) নেতা, প্রাক্তন মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মােল্লা জালালউদ্দিন ইন্তেকাল করেন।
৫৩। ১৯৮০ সালের শুরুতেই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ করেন। ৮ই জানুয়ারী (১৯৮০) তারিখে জিয়াউর রহমান সাহেব নির্বাচনে সাফল্যের জন্যে অভিনন্দন জ্ঞাপন করে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিকট তারবার্তা প্রেরণ করেন। ২১শে জানুয়ারী জিয়াউর রহমান সাহেব এক দুইদিনব্যাপী ইউনিভাের সম্মেলনে যােগদান করার উদ্দেশ্যে দিল্লী যান। ২২শে জানুয়ারী (১৯৮০) তারিখে তিনি ইউনিভাের সম্মেলনে ভাষণ দেন। ২০শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮০) তারিখে জিয়াউর রহমান সাহেবের সরকার বাংলাদেশে ১৯৭১-এর মুক্তিযােদ্ধা চাকুরীজীবীদের দুই বছরের সিনিয়ারিটি প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে।
পৃষ্ঠাঃ ২৯৬
৫৪। ১৯৮০ সালের জুন মাসে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার ও নিকটতর আত্মীয়-স্বজনের সদস্যদের হত্যাকারী খুনী মেজর চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী ও পাকস্তানপন্থী সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সদস্য এবং পাকিস্তানের দালাল-দোসর রাজনৈতিক নেতা ও ব্যক্তিদের সহায়তায় সামরিক অভুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের প্রয়াস চালান। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৯ সালের মে মাসে তখন তুরস্কের বাংলাদেশ দূতাবাসে ফাস্ট সেক্রেটারী হিসেবে নিয়ােজিত খুনী লেঃ কর্নেল আনােয়ার আজিজ পাশা পাকিস্তানের ইসলামাবাদে যান। তখন ইসলামাবাদের বাংলাদেশ দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারী ছিলেন খুনী মেজর বজলুল হুদা। লেঃ কর্নেল আনােয়ার আজিজ পাশার পত্নী হলেন মেজর বজলুল হুদার আপন বােন। যাহােক, পরে তারা তখন পিকিং (বর্তমানে বেইজিং-এর বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারী হিসেবে কর্মরত খুনী মেজর ডালিমের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। খুনী মেজর ডালিম অতঃপর স্বল্প সময়ের জন্য ইরানের তেহরানে যান এবং তখন সেখানের বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী হিসেবে কর্মরত খুনী মেজর নূরের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। তারা অনেক পরিকল্পনার পর তখন বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত আর্টিলারীর অফিসার দিদারুল আলম এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লেঃ কর্নেল নূরুন্নবী খানকে তাদের দলে অন্তর্ভূক্ত করেন। অতঃপর উপরােক্ত খুনী মেজর চক্রটি ১৯৭৯ সালের ২৬-২৯শে ডিসেম্বরে মিলিত হয় তুরস্কের আংকারাতে। লিবিয়া থেকে খুনী লেঃ কর্নেল রশীদ উক্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সে সময়ে বাংলাদেশের জেলে বন্দী থাকায় খুনী লেঃ কর্নেল ফারুক উক্ত বৈঠকে যােগদান করতে পারেননি।
৫৫। এর পাচ মাস পর উক্ত খুনী চক্রটি পুনরায় আর একটি বৈঠকে মিলিত হয়। ইতিপূর্বে জিয়াউর রহমানের সরকার খুনী লেঃ কর্নেল ফারুককে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে লিবিয়ায় ফেরত পাঠানাের ফলে তিনিও উক্ত বৈঠকে যােগদান করতে পেরেছিলেন। তখন তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন একটি সিপাহী বিদ্রোহ ঘটানাের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার। এরপর ১৯৮০ সালের ১৭ই জুনে বাংলাদেশে কতিপয় সিপাহীরা ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নেয়। সশস্ত্রবাহিনীর সংশ্লিষ্ট অফিসাররা এতে রাজি না হওয়ায় সবকিছু গােলমেলে হয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে দিদারুল আলম প্রথমে ভারতের কোন এক এলাকায় আত্মগােপন করেন। পরে ১১ই নভেম্বর (১৯৮০) বাংলাদেশে ফেরার প্রাক্কালে কুষ্টিয়ার এ্যাম্বাসেডর হােটেল থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। একই সময়ে লেঃ কর্নেল আনােয়ার আজিজ পাশাকে আংকারা থেকে ঢাকাতে ডেকে পাঠানাে হয়। ১৮ই নভেম্বর (১৯৮০) তারিখে ঢাকায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আটক করা হয়। পরবর্তীতে, সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযােগে গ্রেফতার করা হয় সশস্ত্র বাহিনীর আরও কতিপয় সদস্যকে। শেষমেষ , সর্বমােট পাঁচজনকে সরকারকে সশস্ত্র অভূত্থানের মাধ্যমে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়। এরা ছিলেন, লেঃ কর্নেল দিদারুল আলম, লেঃ কর্নেল
পৃষ্ঠাঃ ২৯৭
নূরুন্নবী খান, তখন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে প্রশিক্ষণরত অফিসার মােশাররফ হােসেন, লেঃ কর্নেল আনােয়ার আজিজ পাশা এবং মেজর কাজী নূর হােসেন। তখন সরকার পক্ষের কৌসুলী অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু বিচার শেষে দিদারুল আলমকে ১০ বছরের, মােশাররফ হােসেনকে দুই বছরের এবং নূরুন্নবী খানকে ১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিচার শেষে , লেঃ কর্নেল আনােয়ার আজিজ পাশা ও মেজর কাজী নূর হােসেনকে তাঁদের পূর্বের স্ব স্ব কর্মস্থল যথাক্রমে বাংলাদেশের আংকারাস্থ ও তেহরানস্থ দূতাবাসে ফেরত পাঠানাে হয়। উল্লেখ্য যে, উপরােক্ত ষড়যন্ত্র মামলায় লেঃ কর্নেল আনােয়ার আজিজ পাশা এবং মেজর কাজী নূর হােসেন তাদের সমস্ত দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন।
৫৬। এদিকে হাসিনা শিশু জয় ও পুতলীকে সঙ্গে নিয়ে ৪ঠা এপ্রিল (১৯৮০) তারিখে দিল্লী থেকে লন্ডন চলে যায় রেহানার কাছে। তখন রেহানা সন্তানসম্ভবা ছিল। অতঃপর ২১শে মে (১৯৮০) তারিখে সিজেয়্যারিয়ান অস্ত্রোপচারে রেহানার পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হয়। সন্তানের নাম রাখা হয় ‘ববি’। ৩রা সেপ্টেম্বর (১৯৮০) তারিখে জিয়াউর রহমান সাহেব আঞ্চলিক কমনওয়েলথ সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্যে দিল্লী যান। ১২ই অক্টোবর তারিখে বাংলাদেশের খুলনার কারাগারে কয়েদীরা ডেপুটি জেলারসহ ২৪ জন ব্যক্তিকে জিম্মি হিসেবে আটক করে। ২১শে অক্টোবর (১৯৮০) তারিখে পুলিশ বাহিনীর একটি অভিযান চালানাে হয় খুলনা কারাগারে উপরােক্ত জিম্মিদের মুক্ত করার উদ্দেশ্যে। উক্ত সশস্ত্র অভিযানে ২৪ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা হয় ৩৫ জন কয়েদীকে হত্যা ও আরও অনেককে আহত করে। ২৬শে অক্টোবর (১৯৮০) তারিখে সুদীর্ঘ সাড়ে ছয় মাস লন্ডনে রেহানার সঙ্গে কাটিয়ে হাসিনা শিশু জয় ও পুতলীকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লী ফিরে আসে।
৫৭। উল্লেখ্য, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এবং জনাব আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ তাঁদের স্ব স্ব পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কোলকাতায় নিয়ে আসেন ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝিতে। শেখ সেলিমের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন তাঁর আম্মা (বঙ্গবন্ধুর বড় বােন), স্ত্রী, এক শিশু কন্যা এবং নাবালিকা ছােট বােন রেখা। জনাব আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ-এর পরিবারের সদস্যরা ছিলেন তাঁর আম্মা (বঙ্গবন্ধুর ছােট বােন), স্ত্রী, একটি কিশােরী কন্যা (কান্তা), একটি শিশু ছেলে, দুই বােন (তাদের মধ্যে খুনী মেজরদের ব্রাশফায়ারে মারাত্মকভাবে আহত যুবতী বিউটি ও বুলেট বিদ্ধ কিশােরী রিনা) এবং ছােট ভাই। ১৯৭৬-এর জুলাই মাসে এঁদের সকলে দিল্লী চলে আসেন আমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার জন্যে। ১৩ই আগস্ট (১৯৭৬) তারিখে আমরা সবাই মিলে আজমীর শরীফ যাই সেখানে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর মাজার জিয়ারত এবং ১৯৭১-এর ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও নিহত আত্মীয় স্বজনের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি কামনায় মিলাদ মাহফিল ও কাঙ্গালী ভােজ অনুষ্ঠান আয়ােজন করার জন্যে। অতঃপর সেখান থেকে
পৃষ্ঠাঃ ২৯৮
দিল্লী ফিরে আসি ১৭ই আগস্টে। এ সময় ফুফু আম্মারা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দিল্লীতে আমাদের সঙ্গে ছিলেন প্রায় মাস দুয়েক। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে ফেরার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিবছর ফুফু আম্মারা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে আগস্ট মাসে দিল্লীতে আমাদের কাছে আসতেন একই উদ্দেশ্যে এবং ঐ সুবাদে মাসাধিককাল ধরে আমাদের দিল্লীস্থ পান্ডারা ব্লেডের ফ্ল্যাটে থাকতেন। ১৯৭৮-এর মাঝামাঝি চাচী (বেগম শেখ নাসের) তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দিল্লী আসেন আমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাটানাের জন্যে। এর ফলে হাসিনা ও আমাদের ছেলেমেয়েরা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গ পাবার সুযােগ পায়।
৫৮। ১৯৭৯ ও ১৯৮০ এই দু’বছরে কয়েকজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা দিল্লী আসেন আমাদের খোঁজখবর ও কুশলাদি জানার জন্যে। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাটাবার জন্যে কোলকাতা থেকে দিল্লীতে প্রথম আসেন হাসিনার সম্পর্কে ভগ্নীপতি ডাঃ শেখ আব্দুল মালেক। ডাঃ এস. এ. মালেক পেশায় একজন বিশিষ্ট ও অভিজ্ঞ মেডিক্যাল ডাক্তার। ১৯৭৩ সালে তিনি রাজবাড়ী থেকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডাঃ মালেক তখন মাসখানেক কাটিয়ে কোলকাতায় ফিরে যান। এর কয়েক মাস পর ডাঃ এস. এ. মালেক বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৯৭৯ সালের ২১শে আগস্ট তারিখে আওয়ামী লীগের আব্দুর রাজ্জাক তখন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে যাওয়ার পথে দিল্লীতে যাত্রাবিরতি করেছিলেন আমাদের খোঁজখবর ও কুশলাদি জানার জন্যে। অতঃপর কাবুল থেকে ফেরার পথেও তিনি দিল্লীতে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর কয়েক মাস পর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা এডভােকেট জিল্লুর রহমান তার পত্নী বেগম আইভি রহমানকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লী আসেন আমাদের খোঁজখবর ও কুশলাদি জানার জন্যে। ঢাকা থেকে ডাঃ এস. এ. মালেক প্রথমবার দিল্লীতে আমাদের কাছে আসেন ১৯৮০-এর ৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে। কিছুদিন আমাদের সঙ্গে কাটানাের পর তিনি ঢাকা ফিরে যান ২১শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮০)। ১৯৮০ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ দিল্লীতে আসেন আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা ও কুশলাদি জানার জন্যে। তার ঢাকা ফেরার পর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব এম. কোরবান আলী দিল্লী আসেন আমাদের কুশলাদি জানার জন্যে। ডাঃ এস. এ. মালেক ঢাকা থেকে পুনরায় দিল্লীতে আমাদের কাছে আসেন ১৯৮০-এর ২৭শে অক্টোবরে। ২০শে নভেম্বর (১৯৮০) তারিখে তিনি ঢাকায় ফিরে যান। তৎকালীন যুবলীগ নেতা আমির হােসন আমু দিল্লীতে আমাদের কাছে আসেন ১৯৮০-এর ডিসেম্বরের মাঝামাঝির দিকে। প্রায় সপ্তাহখানেক আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে তিনি বাংলাদেশে ফিরে যান। তৎকালীন আওয়ামী লীগের ন্যতম যুগ্ম সম্পাদক বেগম সাজেদা চৌধুরী দিল্লীতে আমাদের কাছে আসেন ১৯৮১ সালের ১৬ই জানুয়ারীতে। তিনি আমাদের জন্যে সঙ্গে এনেছিলেন
পৃষ্ঠাঃ ২৯৯
(তাজা) কইমাছ যা দিল্লীতে পাওয়া যায় না। হাসিনা তাঁকে ফুফু বলে সম্বােধন করে। বেগম সাজেদা চৌধুরী ঢাকায় ফিরে যান ২৬শে জানুয়ারী (১৯৮১) তারিখে।
৫৯। আওয়ামী লীগের উপরােল্লিখিত নেতৃবৃন্দের দিল্লীতে আমাদের কাছে আসার অন্যতম কারণ ছিল ঢাকায় ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের ব্যাপারে হাসিনার সঙ্গে মতবিনিময় করা। এদের সবাই এবং হাসিনার চাচী (বেগম নাসের), ফুফু আমারা এবং ফুফাতাে ভাইয়েরা চাচ্ছিলেন যেন হাসিনা আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হয়। আমি এ প্রস্তাবে কখনই সম্মত ছিলাম না। আমি তাঁদের সকলকেই বলেছিলাম যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের অকল্পনীয় মর্মান্তিক ঘটনার পর বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়স্বজনদের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল)-এর নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা উচিৎ হবে না অন্ততঃ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত। তাছাড়া কোন সিদ্ধান্ত দলের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করাও অগণতান্ত্রিক। সুতরাং, আরও কয়েক বছর বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়-স্বজনদের রাজনীতি থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয় হবে। অতঃপর সাব্যস্ত হয় যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংগঠনে পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে বি. এ. এলের তৎকালীন গঠনন্ত্র কিছুটা সংশােধন করে ১০-১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম গঠন করা হবে। দলীয় প্রেসিডেন্ট ও সাধারণ সম্পাদক পদাধিকারবলে উক্ত প্রেসিডিয়ামের যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও সদস্য সচিব হবেন। উক্ত প্রেসিডিয়ামের দায়িত্ব হবে জরুরী ইস্যু ও বিষয়াদি সম্পর্কে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংবিধানিক এবং অন্যান্য জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম গ্রহণে দলের সংশ্লিষ্ট বৃহত্তর নীতি নির্ধারক বডি যথা কেন্দ্রীয় কমিটি ও দ্বিবার্ষিক কাউন্সিলকে পরামর্শ প্রদান করা। আরও সাব্যস্ত হয় যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সম্মেলনের সদস্যরা যদি একান্তই চান তাহলে হাসিনাকে উপরােল্লিখিত প্রেসিডিয়ামের কেবলমাত্র অন্যতম সদস্য নির্বাচিত করা যেতে পারে।
৬০। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের নিকট প্রদত্ত আমার উপরােল্লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐকমত্য ব্যক্ত করেছিলেন তৎকালীন ঢাকার দৈনিক মর্নিং নিউজের সুদীর্ঘকালের নিউজ এডিটর, একজন বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট জনাব এ. এল. খতিব। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি নিযুক্ত করে দিল্লীতে পদস্থ করেছিলেন। জিয়াউর রহমান সাহেব ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৬ সালে তাঁর উক্ত নিয়ােগ বাতিল করা হয়। তাঁর আদি আবাসস্থল ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশে। প্রবীণ ও বয়ােজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক অর্থকষ্টজনিত কারণে তাঁর পরিবারকে মহারাষ্ট্রের গ্রামে তাঁর আত্মীয়-স্বজনের নিকট পাঠিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৩০০
দেন। ১৯৭৬ সালে তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তিনি প্রায় প্রতিদিন আমাদের বাসায় আসতেন। বলতে গেলে, দিল্লীতে স্থায়ীভাবে তিনিই ছিলেন আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ও পরামর্শদাতা। হাসিনা তাঁকে আংকেল বলে সম্বােধন করতাে। আমার ছেলে ও মেয়েকে তিনি ভীষণ আদর করতেন। কালক্রমে, তিনি দিল্লীতে আমার পরিবারের অন্যতম সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন আমাদের সকলের কাছে। তিনি ১৯৮১ সালের মাঝামাঝিতে একটি পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন, “Who Killed Mujib” শিরােনামে। বাংলাদেশে উক্ত পুস্তকটি নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালের শেষের দিকে খতিব সাহেব কোলকাতায় গিয়েছিলেন তাঁর উপরােক্ত পুস্তকটি বাংলায় সংস্করণের জন্যে। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি আমাকে শেষ চিঠি লিখেছিলেন। ১৯৮৩ সালের ৪ঠা জানুয়ারীতে তিনি কোলকাতায় ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার দিন দুয়েক পর উক্ত চিঠিটি আমার নিকট পৌছায়। তার উক্ত চিঠিটি আমি সযত্নে রেখে দিয়েছি আমার বিশেষ চিঠি-পত্রাদি বিষয়ক নথিতে।
৬১। হাসিনার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করে এবং ওর সম্মতি নিয়ে আমি আলজিরিয়ায় শিক্ষকতার চাকুরী ও রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জানিয়ে তৎকালীন দিল্লীস্থ আলজিরিয়ার রাষ্ট্রদূত জনাব রউফ বােদজাকজী(Raouf Boudjakdji)-এর নিকট একটি দরখাস্ত পেশ করি ১৯৮১ সালের ২৪শে জানুয়ারী তারিখে। ফেব্রুয়ারী (১৯৮১) মাসের প্রথম সপ্তাহে রেহানা ওর শিশু সন্তান ববিকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডন থেকে দিল্লী আসে আমাদের সঙ্গে কিছুদিন কাটানাের জন্যে। ১৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮১) তারিখের সকালে লন্ডন থেকে ফোনে সংবাদ পাওয়া যায় যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল)-এর ১৩-১৫ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮১) তারিখে অনুষ্ঠিত দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে হাসিনাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর ঢাকা থেকে শেখ সেলিমও হাসিনাকে ফোনে একই সংবাদ দেন। এর পর ঢাকা ও লন্ডন থেকে আরও অনেকে টেলিফোনে হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। পরের দিন দিল্লীস্থ অনেক সাংবাদিক হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে হাসিনার মন্তব্য ও মতামত প্রকাশ করে। ২৪শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮১) তারিখে ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের আব্দুল মালেক উকিল, ডঃ কামাল হােসেন, এডভােকেট জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ, এম. কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দিন, স্বামী গােলাম আকবার চৌধুরীসহ বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হােসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, প্রমুখ নেতৃবৃন্দ দিল্লী পৌছান। ডাঃ এস. এ. মালেক ইতিপূর্বেই ঢাকা থেকে দিল্লী পৌছেছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮১) পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন। অতঃপর ডঃ কামাল হােসেন এবং বেগম সাজেদা চৌধুরী বাদে আর সকলেই ঢাকায় ফিরে যান।
পৃষ্ঠাঃ ৩০১
৬২। ডঃ কামাল হােসেন এবং বেগম সাজেদা চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল আমাদের পারিবারিক ও অন্যান্য বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ করে হাসিনার ঢাকা ফেরার তারিখ চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করার জন্যে। ১লা মার্চ (১৯৮১) রাতে ডঃ কামাল হােসেন ও বেগম সাজেদা চৌধুরী ১৭ই কিংবা ২৬শে মার্চ (১৯৮১) তারিখে হাসিনার ঢাকা ফেরার প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাবের জবাবে আমি তাঁদের জানাই যে, ২৯শে এপ্রিল আমাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলের পরীক্ষা শেষ হবে এবং তারপর যে কোন তারিখে হাসিনা বাংলাদেশে ফিরতে পারে। আমি তাঁদের আরও অবহিত করি যে, যেহেতু এর আগের বছর অর্থাৎ ১৯৮০ সালে হাসিনা ছেলেমেয়েদের লন্ডনে সাড়ে ছয় মাস অবস্থান করায় তাদের স্কুলের পরীক্ষা বিঘ্নিত হয়েছে, অতএব ২৯শে এপ্রিল তারিখের পূর্বে হাসিনার ঢাকা ফেরা কিছুতেই যুক্তিযুক্ত হবে না। অনেক বিতর্কের পর তাঁরা সবাই আমার প্রস্তাবে সম্মত হন। এর দুই-তিন দিন পর ডঃ কামাল হােসেন ও বেগম সাজেদা চৌধুরী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
৬৩। মার্চ (১৯৮১) মাসের প্রথম সপ্তাহে একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি যে, জয় বসার ঘরের জানালার পাশে বসে চিড়িয়াখানার মডেল বানানােয় নিমগ্ন। হাসিনা তখন বাইরে কোথায় যেন গিয়েছিল। পুতলি পাশের একটি শয়নকক্ষে (রেহানার কক্ষে)। রেহানার কাছ থেকে গল্প শুনছিল। এই সুযােগে আমি জয়কে উদ্দেশ্য করে বললাম, “আব্দু জয়, তুমি তাে অনেক কিছু দেখলে। এখন বলাে, তুমি তােমার আম্মার সঙ্গে ঢাকায় যাবে, না মুন্নার রেহানার) সঙ্গে লন্ডনে যাবে?” এই কথা শােনার পর জয় আমার দিকে তাকিয়ে বলে, এর আগে জার্মানী গিয়েছিলাম। তার পর ঢাকায় কত কি ঘটে গেল। এর আগে আমাদের বাসায় তাে এত লােক আসেনি? হঠাৎ আম্মুর কি যেন হয়ে গেল। আমার মনে হয় আম্মুর ঢাকায় ফেরার পর সেখানে কিছু একটা ঘটবেই। কাজেই আমি আম্মুর সঙ্গে ঢাকায় যাবাে না। আমাকে মুন্নার (রেহানার) সঙ্গে লন্ডনে পাঠানাের ব্যবস্থা করাে।” এই মুহুর্তে মেয়ে পুতলি সেখানে উপস্থিত হয়। ও কোথায় যেতে চায় সে সম্পর্কে আমি ওর মতামত জানতে চাইলে পুতলি বলে, “আন্তু, আমি ইংরেজী ভুলে যাচ্ছি। আমাকেও মুন্নার (রেহানার) সঙ্গে লন্ডনে পাঠানাের ব্যবস্থা করাে।” পরদিন ছিলাে শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে হাসিনা আস্তে আস্তে বলে, “ইতিমধ্যে পাকিস্তানপন্থী এবং জিয়ার রাজনৈতিক দলেরা সারা বাংলাদেশে লিফলেট, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি বিলি করে আমার ঢাকায় ফেরা যেকোনভাবেই প্রতিরােধ করার ডাক দিয়েছে। আমার মনে হয় জয়-পুতলিকে সঙ্গে নিয়ে আমার ঢাকায় ফেরা সমীচীন হবে না। অতএব, ওদের জন্য তুমি পৃথক আন্তর্জাতিক পাসপাের্টের ব্যবস্থা করাে যাতে ওরা রেহানার সঙ্গে লন্ডন যেতে পারে।” রেহানাও এ ব্যাপারে ঐকমত্য ব্যক্ত করে।
৬৪। অতঃপর দিল্লীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে জয় ও পুতলির জন্যে পৃথক আন্তর্জাতিক পাসপাের্ট ইস্যু করিয়ে নিই। এরপর একদিন সকালে দিল্লীস্থ বৃটিশ দূতাবাস থেকে জয় ও
পৃষ্ঠাঃ ৩০২
পুতলির লন্ডন যাওয়ার ভিসার জন্যে ওদেরকে তাঁদের অফিসে নিয়ে যাই। তৎপর জয় ও পুতলিকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি আমার অফিসে চলে যাই। ঐ দিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই ভীষণ উদ্বিগ্ন অবস্থায় রেহানা আমাকে জানায় যে, পুতলি বসন্তরােগে আক্রান্ত হয়েছে। এর কয়েক দিন পর রেহানা কেবলমাত্র জয়কে সঙ্গে নিয়ে লন্ডন চলে যায়। লন্ডনে পৌছার কয়েক দিন পর রেহানা টেলিফোনে আমাদেরকে জানায় যে, তখন জয় ও ববিসহ সেও বসন্তরােগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে।
৬৫। মে (১৯৮১) মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গােড়ার দিকে মেয়ে পুতলি যখন একটু সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন ঢাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপআলােচনার পর তাঁর ১৭ই মে (১৯৮১) তারিখে ঢাকা ফেরার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর দিন কয়েক পূর্বে , আওয়ামী লীগের আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম. কোরবান আলী সাহেবরা ঢাকা থেকে দিল্লী আসেন। ১৬ই মে (১৯৮১) সন্ধ্যায় হাসিনা ও পুতলিকে সঙ্গে নিয়ে আব্দুস সামাদ আজাদ ও এম. কোরবান আলী সাহেবরা ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের একটি বিমানে দিল্লী থেকে কোলকাতায় চলে যায়। ১৭ই মে (১৯৮১) তারিখ সন্ধ্যায় তাঁরা কোলকাতা থেকে ঢাকায় পৌছান। ঐদিন বিকেলে ঢাকায় একটু একটু ঝড়বৃষ্টি হয়। যাহােক, ঢাকায় পৌছেই রাত এগারােটার দিকে হাসিনা আমাকে টেলিফোনে জানায় যে, সেদিন সভাস্থল মানিক মিয়া এভিনিউ হতে তৎকালীন ঢাকা-কুর্মিটোলা বিমান বন্দর পর্যন্ত ছিল লােকে লােকারণ্য। ঐদিন তাঁকে সম্বর্ধনা জানানাের জন্যে ১০-১২ লাখ লােকের সমাগম হয়েছিল বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সূত্রে বলা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নেতা -কর্মীদের মতে ঐদিন ঢাকায় অন্যূন ১৫ লাখ লােকের সমাগম হয়েছিল। আমি তখন হাসিনাকে বললাম, “১০-১৫ লাখ লােকের সমাগম হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন থেকে তােমাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে দলীয় কাজকর্ম চালাতে হবে। অন্যের তােষামােদিতে তােমার মাথা যেন মােটা না হয়ে যায় তার জন্য তােমাকে এখন থেকে সতর্ক থাকতে হবে নিরন্তর।”
৬৬। ৩০শে মে (১৯৮১) তারিখে সকাল সাড়ে দশটার দিকে লন্ডন থেকে সুলতান শরীফ টেলিফোনে আমাকে জানান যে, জিয়াউর রহমান সাহেব বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরস্থ সার্কিট হাউসে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে নিহত হয়েছেন। উক্ত ঘটনায় জিয়াউর রহমান সাহেবের ৮ জন দেহরক্ষীও নিহত হয়েছেন। অতঃপর দুপুর বারােটায় অল-ইন্ডিয়া রেডিওতে উক্ত ঘটনার সংবাদ উল্লেখ করে আরও বলা হয় যে, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে করে সারা বাংলাদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেছেন। রাতে বি. বি. সি., ভয়েস-অব-আমেরিকা, অল-ইন্ডিয়া রেডিও প্রভৃতি প্রচার কেন্দ্র থেকে বলা হয় যে, বাংলাদেশে বিদ্রোহী সৈন্যরা চট্টগ্রামস্থ বেতার কেন্দ্র দখল করেছে। ৩১শে মে (১৯৮১) তারিখে তৎকালীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান লেঃ জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ বাংলাদেশ বেতারে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। উক্ত
পৃষ্ঠাঃ ৩০৩
ভাষণে তিনি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগের সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল মনজুরসহ বিদ্রোহী সৈন্যদের প্রতি আত্মসমর্পণের আহবান জানান। ১লা জুন বাংলাদেশ বেতারে বলা হয় যে, চট্টগ্রামে সৈন্যদের বিদ্রোহ দমন করা হয়েছে। পরবর্তীতে উক্ত বেতারে আরও বলা হয় যে, মেজর জেনারেল মনজুরকে চট্টগ্রামের গ্রাম অঞ্চলে পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রেফতার করা হয় এবং পরে তাঁকে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে আসার সময় তিনি অন্য একদল বিক্ষুব্ধ সৈন্যদের হাতে নিহত হন। ঐ দিন বাংলাদেশ বেতারে আরও বলা হয় যে, চট্টগ্রামের রাংগুনিয়া পাহাড় থেকে জিয়াউর রহমান সাহেবের মরদেহ উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ২রা জুন (১৯৮১) তারিখে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে মরহুম জিয়াউর রহমানের জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানের জাতীয় সংসদ ভবনের সন্নিকটস্থ স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। ঐ দিনই বাংলাদেশ সরকার জিয়াউর রহমানের হত্যার ব্যাপারে তদন্ত এবং উক্ত ঘটনায় জড়িত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিচারের জন্যে গঠন করে তদন্ত আদালত ও কোর্ট মার্শাল’।
৬৭। চট্টগ্রাম শহরের সার্কিট হাউসে বিদ্রোহী সৈন্যদের হাতে জিয়াউর রহমান সাহেবের নিহত হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে আরও অনেক বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় ৩রা জুন (১৯৮১) তারিখে। ৩০শে মে (১৯৮১)-এর রাতে চট্টগ্রামস্থ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রকারী সদস্যরা শহরের নিকটবর্তী কালুরঘাট স্থানে পৌছতে থাকেন। সেখানে প্রথমে পৌছেন লেঃ কর্নেল মতিউর রহমান, মেজর মােজাফফর , ক্যাপ্টেন সৈয়দ এবং ক্যাপ্টেন এম. মুনির। এর কিছুক্ষণ পর একটি এক্স জীপ ও দুইটি এক্স পিকআপে ৬ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন এম. হােসেন খান, ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, ক্যাপ্টেন রফিকুল হােসেন খান, লেঃ মােসলেউদ্দিন আহমদ, সুবেদার সাফদার রহমান এবং ২১ ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন জামিল হককে সঙ্গে নিয়ে সেখানে পৌছেন ৬ ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল ফজলে হােসেন। এঁদের পর, দুইটি এক্স জীপ ও একটি পিকআপে সেখানে পৌছেন ১৯ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর গিয়াসউদ্দিন, ২৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর কাজী মনিরুল হক এবং ১১ ইষ্ট বেংগল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। সবশেষে, সেখানে পৌছান ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার মেজর এস. এম. খালেদ, ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর ফজলুল হক এবং ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের স্টাফ ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন এবং ১ ইস্ট বেংগল রেজিমেন্টের এ্যাডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান।
৬৮। অতঃপর লেঃ কর্নেল মতিউর রহমানের নিকট হতে বিস্তারিত ব্রীফ নিয়ে বিদ্রোহীরা রাত সাড়ে তিনটার দিকে কালুরঘাট ত্যাগ করে শহরের সার্কিট হাউসের দিকে চলে যায়। তখন চট্টগ্রাম শহরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত ৪টার দিকে লেঃ কর্নেল মতিউর
পৃষ্ঠাঃ ৩০৪
রহমান কয়েকজন সহযােগীকে সঙ্গে নিয়ে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়তে ছুঁড়তে অতর্কিচে সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে দ্রুত উক্ত বিল্ডিংয়ের উপর তলায় চলে যান। প্রথমে তারা প্রেসিডেন্টের ৮ জন দেহরক্ষীকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেন। এই পর্যায়ে জিয়াউর রহমান সাহেব তাঁর কক্ষ থেকে বের হয়ে পাশের সিঁড়ি বেয়ে সার্কিট হাউসের ছাদে পলায়নে উদ্যত হন। ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে উপস্থিত বিদ্রোহীদের কয়েকজন সদস্য তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। গুলিতে আহত জিয়াউর রহমান সাহেব তখন বারান্দার মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। অতঃপর বিদ্রোহীরা স্টেনগানের ব্রাশফায়ারের গুলিতে জর্জরিত করেন জিয়াউর রহমান সাহেবের সারা দেহ, মুখমণ্ডল ও মাথা। এ সমস্ত ঘটনা সম্পন্ন হয় প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে। এর পর তাঁরা দ্রুত চলে যান। সকাল ৮টার দিকে বিদ্রোহীরা পুনরায় পাঁচটি জীপে সার্কিট হাউসে এসে জিয়াউর রহমান সাহেব, প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা অফিসার লেঃ কর্নেল এহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ নিয়ে চলে যান। অতঃপর রাংগুনিয়ার একটি পাহাড়ের পাদদেশে উক্ত লাশ তিনটি দাফন করা হয়। লাশগুলাে দাফন করার সময় সেখানের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিনজন ছাত্র তা দেখে ফেলে। উল্লেখ, ঐ রাতে সার্কিট হাউসের অপর একটি কক্ষে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি.)-এর তৎকালীন সেক্রেটারী জেনারেল ও জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী পরিষদের বিশিষ্ট সদস্য ডাঃ এ. কিউ. এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বিদ্রোহীরা তাঁর কোন খোঁজ করেনি। তিনি ঐ হত্যাকাণ্ডের সময় গােপনে সার্কিট হাউজ ত্যাগ করে ঢাকায় চলে যান।
৬৯। ৩০শে মে (১৯৮১) শনিবার ভােরেই বিদ্রোহীদের অপর একটি অংশ বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রামস্থ স্টেশন দখল করে। অতঃপর সকাল ১০টার দিকে তাঁরা চট্টগ্রাম বেতার স্টেশন থেকে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগের সেনাবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল মনজুরের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ গঠনের ঘােষণা দেয়। ঐদিন দুপুরের দিকে মেজর জেনারেল মনজুর চট্টগ্রাম শহরস্থ কোর্ট বিল্ডিংয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন এবং তৎপর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে তিনি সরকারী, আধাসরকারী, কর্পোরেশন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও আইন প্রয়ােগকারী বিভাগসমুহের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করেন। অতঃপর, মেজর জেনারেল মনজুরের নির্দেশে ঢাকাতে তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ তৎকালীন সেনাবাহিনীর জেনারেল স্টাফ প্রধান মেজর জেনারেল নুরুদ্দিনের নিকট মেজর জেনারেল মনজুরের পেশকৃত চার-দফা দাবীর কথা উল্লেখ করেন। এ দাবীগুলাে ছিলঃ (১) সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা, (২) দেশে প্রধান বিচারপতিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়ােগ করা, (৩) জাতীয় সংসদ বাতিল করা এবং (৪) (বিদ্রোহীদের) বিপ্লবী পরিষদকে স্বীকৃতি প্রদান করা। উত্তরে তখন মেজর জেনারেল নুরুদ্দিন বলেন যে, কেবলমাত্র নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ ছাড়া সরকারের কাছে অন্য কোন কিছুই গ্রহণযােগ্য নয়। ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী চট্টগ্রামে যাতে পৌছতে না পারে সে জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৩০৫
বিদ্রোহীরা তাঁদের সেনাবাহিনীর একটি দলকে যুদ্ধ প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মােতায়েন করেন শুভপুর ব্রিজের কাছে। কিন্তু ঐ দলটি বিদ্রোহীদের পক্ষ পরিত্যাগ করে সরকারী দলে যােগ দেন। ফলে সংশ্লিষ্ট দলের কমান্ডিং অফিসার ও অন্যান্য নেতারা দ্রুত চট্টগ্রামের সেনানিবাসে ফিরে যান। তাঁদের উক্ত ব্যর্থতার সংবাদে মেজর জেনারেল মনজুর চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
৭০। ৩১শে মে (১৯৮১) তারিখে রাত তিনটার দিকে মেজর জেনারেল মনজুর একটি জীপে তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে এবং কর্নেল দেলওয়ারের স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের পাইদং গ্রামে পৌছান। অতঃপর তাঁরা জীপ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের দিকে যান এবং সেখানের খৈয়াপাড়া নামক একটি চা বাগানে গিয়ে জনৈক উপজাতীয় কুলির ঘরে আশ্রয় নেন। ১লা জুন (১৯৮১) বিকেলে হাটহাজারী থানার তৎকালীন সার্কেল ইন্সপেক্টর মােস্তফা গােলাম কুদ্স এন. এস. আই বিভাগের জনাব সাত্তার ও আজাদ এবং ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ কয়েকজন কনস্টেবলকে সঙ্গে নিয়ে উক্ত চা-বাগানে গিয়ে ঐ কুলির ঘর থেকে মেজর জেনারেল মনজুর ও অন্যান্যদের গ্রেফতার করেন। ঐ দিন বিকেল পাঁচটার দিকে তৎকালীন মেজর জেনারেল মনজুরকে হাটহাজারী থানায় নিয়ে আসা হয়। এর পর রাত দশটার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল হাটহাজারী থানায় উপস্থিত হয়ে সেখান থেকে মেজর জেনারেল মনজুরসহ সকলকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের দিকে চলে আসেন। উল্লেখ্য, ইত্যবসরে তৎকালীন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন আহমদ তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সাত্তারের নিকট থেকে নির্দেশ পেয়ে পুলিশকে বন্দীদের চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার আব্দুল আজিজের নিকট হস্তান্তর করার নির্দেশ দেন। অতঃপর, পুলিশ হাটহাজারী থানা থেকে আসার পথে বন্দীদের ক্যাপ্টেন ইমদাদুল হকের নিকট হস্তান্তর করেন। তখন ক্যাপ্টেন ইমদাদুল হক মেজর জেনারেল (তখন বরখাস্তকৃত) মনজুরের হাত-পা দড়ি দিয়ে এবং চক্ষু একটি কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলেন। অতঃপর একটি জীপে মহিলা ও শিশুদের চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের মনজুরের বাসার নিকটস্থ ফ্লাগ হাউসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। অপর একটি জীপে মেজর জেনারেল মনজুরকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দফতরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। মেজর জেনারেল মনজুরসহ জীপটি সেখানের সেন্ট্রাল ডিপার্টমেন্টাল শপের সামনের রাস্তার তেমাথার কাছে পৌছানাে মাত্রই ২০-৩০ জন সশস্ত্র সৈনিকের অপর একটি দল সেটিকে থামিয়ে ঘেরাও করে। অতঃপর, ঐ ২০-৩০ জন সশস্ত্র সৈনিকের দলটি মেজর জেনারেল মনজুরকে উক্ত জীপটি থেকে টেনে নামিয়ে নিয়ে গুলী করে হত্যা করে। হাত-পা ও চক্ষু বাধানাে মেজর জেনারেল মনজুরকে তখন কেন গুলী করে হত্যা করা হয় তার কারণ এখন পর্যন্তও উৎঘাটিত হয়নি।
পৃষ্ঠাঃ ৩০৬
৭১। ৪ঠা জুন (১৯৮১) তারিখে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার সংবিধানের শর্তানুযায়ী দেশে ১৮০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করার ঘােষণা দেন। ৭ই জুন (১৯৮১) জিয়াউর রহমানের ৩০শে মে তারিখের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যে সরকার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। ৯ই জুন (১৯৮১) তারিখে মেজর জেনারেল মীর শওকতকে পদোন্নতি দিয়ে চাকুরী থেকে অবসর প্রদান করা হয়। ১২ই জুন (১৯৮১) তারিখে সরকার হাসিনার নিকট বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীর (পুরাতন) ৩২ নম্বর (নতুন ১১ নম্বর) রােডস্থ বাড়ীটির দায়িত্ব হস্তান্তর করে। ২২শে জুন (১৯৮১) তারিখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি.) অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ২৪শে জুন (১৯৮১) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য প্রফেসর আব্দুল মতিন চৌধুরী হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। ২৯শে জুন (১৯৮১) তারিখে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনােনয়নের বৈধতা সম্পর্কে সংসদে তুমুল বাকবিতণ্ডা হয়। ১লা জুলাই (১৯৮১) তারিখে সংসদে পেশ করা হয় সংবিধান ষষ্ঠ সংশােধনী বিল। ৮ই জুলাই (১৯৮১) তারিখে জাতীয় সংসদে পাস হয় সংবিধান ষষ্ঠ সংশােধনী। সংবিধান ষষ্ঠ সংশােধনী (১৯৮১)-এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপ-মন্ত্রীর ন্যায় যাতে কোন ব্যক্তি “কেবল রাষ্ট্রপতি বা উপ-রাষ্ট্রপতি হবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলে গণ্য না হন তার ব্যবস্থা করা। হয়। এভাবে বিচারপতি সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আইনগতভাবে যােগ্য করা হয়।
৭২। ১০ই জুলাই (১৯৮১) তারিখে জিয়াউর রহমানের চট্টগ্রাম শহরস্থ সার্কিট হাউসে ৩০শে মে (১৯৮১) তারিখে হত্যার অভিযােগে অভিযুক্ত ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে কোর্ট মার্শালে বিচার শুরু হয়। ১৭ই জুলাই (১৯৮১) তারিখে হাসিনা শিশু কন্যা পুতলিকে সঙ্গে নিয়ে বি, ও. এ. সি’র একটি বিমানে লন্ডনে রেহানার কাছে চলে যায়। সেখানে পৌছেই হাসিনা দিল্লীতে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলে। ২৩শে জুলাই (১৯৮১) তারিখে গ্রুপ ক্যাপ্টেন সুলতান মাহমুদকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ২৭শে জুলাই (১৯৮১) তারিখে এক ঘােষণায় নির্বাচন কমিশন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য নির্ধারণ করে ১৫ই অক্টোবর (১৯৮১) তারিখ। ৪ঠা আগস্ট (১৯৮১) তারিখে বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রামে সেনা-বিদ্রোহ ও জিয়াউর রহমানের হত্যার ব্যাপারে শ্বেতপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৭ই আগস্ট (১৯৮১) তারিখে হাসিনা লন্ডন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। ১১ই আগস্ট (১৯৮১) তারিখে কোর্ট মার্শাল আদালত ৩০শে মে (১৯৮১) তারিখে চট্টগ্রামে বিদ্রোহের দায়ে ১২ জন সেনাবাহিনীর অফিসারকে প্রাণদণ্ডাদেশ প্রদান করে। ১৫ই আগস্ট (১৯৮১) তারিখে সরকার ৩০শে মে (১৯৮১) চট্টগ্রামে সেনাবিদ্রোহ ও জিয়াউর
পৃষ্ঠাঃ ৩০৭
রহমানকে হত্যা করার অভিযােগে সেনাবাহিনীর আরও ৩১ জন অফিসারকে অভিযুক্ত ঘােষণা করে। ২২শে আগস্ট (১৯৮১) তারিখে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর দুর্নীতির অভিযােগে সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) তাওয়াবকে গ্রেফতার করা হয়। ২৮শে আগস্ট (১৯৮১) তারিখে ঢাকা থেকে হাসিনা দিল্লীতে আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথাবার্তা বলে। ১লা সেপ্টেম্বর (১৯৮১) তারিখ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ১২ জন সামরিক অফিসারের মৃত্যুদণ্ড মওকুফের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। ৫ই সেপ্টেম্বর (১৯৮১) তারিখে নির্বাচন কমিশন দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ১৫ই অক্টোবর তারিখ পরিবর্তন করে পুনঃনির্ধারণ করে ১৫ই নভেম্বর (১৯৮১) তারিখ। ৬ই সেপ্টেম্বর (১৯৮১) তারিখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের বাসভবনে সংঘটিত হয় এক দুঃসাহসিক চুরি। এই সময় শাহ আজিজুর রহমানের বাসভবন থেকে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা চুরি হয় এবং উক্ত ঘটনায় তাঁর এক ছেলে জড়িত ছিল বলে অনেকেই সন্দেহ পােষণ করেন।
৭৩। ২০শে সেপ্টেম্বর (১৯৮১) তারিখে ১৬টি রাজনৈতিক দলের জোট, ন্যাশনাল ফ্রন্ট, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ২১শে সেপ্টেম্বর (১৯৮১) তারিখে সর্বমােট ৮৩ জন ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর মনােনয়ন দাখিল করেন। ২২শে সেপ্টেম্বর (১৯৮১) তরিখে বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে চট্টগ্রামে ৩০শে মে (১৯৮১) তারিখে বিদ্রোহ করার দায়ে অভিযুক্ত ১২ জন সামরিক অফিসারের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই তারিখে নির্বাচন কমিশনার দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে সর্বমােট ৭২ জন ব্যক্তির মনোনয়ন বৈধ ঘােষণা করে। ১৪ই অক্টোবর (১৯৮১) তারিখ ছিলাে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থীদের মনােনয়ন প্রত্যাহরের শেষ দিন। ঐদিন নির্বাচন কমিশনের অফিস থেকে ঘােষণা করা হয় যে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সর্বমােট ৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ৩১শে অক্টোবর (১৯৮১) তারিখে পরলােকগমন করেন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
৭৪। ১৫ই নভেম্বর (১৯৮১) তারিখে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। উক্ত নির্বাচনের জন্যে ৩,৮৯,৫১,০১৪ জন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি ভােট দেওয়ার মােগ্য হিসেবে ভােটার তালিকাভুক্ত হন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল কর্তৃক মনােনীত প্রার্থী বিচারপতি আব্দুস সাত্তার তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৮৫,২২,৭১৭ বেশী ভােট পেয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল)-এর মনােনীত প্রার্থী ডঃ কামাল হােসেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী মওলানা হাফিজজী হুজুর ৩,৮৭,২১৫ ভােট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন। মাওলানা হাফেজী হুজুর, জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী, মেজর (অবঃ) জলিল, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদসহ অন্যান্য প্রার্থীদের জামানত পর্যাপ্ত ভােট না পাওয়ার কারণে বাজেয়াপ্ত হয়। ২০শে নভেম্বর (১৯৮১) তারিখে বঙ্গভবনের দরবার হলে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার নির্বাচিত
পৃষ্ঠাঃ ৩০৮
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অতঃপর ২৪শে নভেম্বর (১৯৮১) তারিখে প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার তাঁর উপদেষ্টা ডঃ এম. এন. হদাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেন। ২৭শে নভেম্বর (১৯৮১) প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার গঠন করেন ৪২ সদস্যের নতুন মন্ত্রী পরিষদ।
৭৫। ১৯৮১ সালের ১৫ই নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, অর্থ, প্রশাসন ব্যবস্থার অপব্যবহার, ভীতি প্রদর্শন, ভােট কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ইত্যাকার বিভিন্ন কারচুপির অভিযােগ উত্থাপিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি.) এবং মনােনীত প্রার্থী আব্দুস সাত্তারের বিরুদ্ধে। ২৫শে নভেম্বর (১৯৮১) তারিখে প্রধান নির্বাচনী কমিশনার বিচারপতি এ. কে. এম. নূরুল ইসলামের কাছে পেশ করা হয় উক্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযােগ সম্বলিত অনেক দরখাস্ত। ডঃ কামাল হােসেনের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এক প্রেস ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অর্ডিন্যান্স লংঘন করার অভিযােগ উত্থাপন করে বলেন যে, উক্ত নির্বাচনে ভােট গ্রহণ, গণনা ও নির্বাচনী ফলাফল ঘােষণা করার ব্যাপারে উল্লিখিত অর্ডিন্যান্স অনুসরণ করা হয়নি।
৭৬। ২৭শে ডিসেম্বর (১৯৮১) তারিখে সেনাভবনে জাতীয় পত্র-পত্রিকা ও সংবাদসংস্থা সমূহের সম্পাদকদের সমাবেশে এক বিবৃতি দানকালে তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ বলেন, “আমাদের সর্বস্তরের সামরিক লােকজন রাজনীতিতে সামরিক এ্যাডভেঞ্চার কামনা করেন না, কিংবা সশস্ত্র বাহিনীতে তাঁরা রাজনৈতিক এ্যাডভেঞ্চার চান না। তাঁরা কেবলমাত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণকে সাহায্য করতে এবং যে কোন ভবিষ্যৎ (সামরিক) অ্যুথানের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ভারসাম্য বজায় রাখতে চান।” অতঃপর তিনি ১৯৭১-সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সর্বশেষে তিনি বলেন, “উপরােল্লিখিত উদ্দেশ্যে তথা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে জাতীয় পর্যায়ে প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে গঠন করা দরকার এমন একটি দায়িত্ব ও ক্ষমতাসম্পন্ন ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ যার সদস্য থাকবেন উপ-রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, উপ-প্রধানমন্ত্রী ও কতিপয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ছাড়াও তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণ।” সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল এরশাদ সাহেবের উপরােক্ত বক্তব্যে জনমনে সৃষ্টি হয় নানান জল্পনা-কল্পনা ও আশঙ্কা।
দশম পরিচ্ছেদ
১৯৮২-১৯৯০ সাল
১। ১৯৮১ সালের নভেম্বরে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রীয় শাসনভার গ্রহণ করার পর থেকে বিভিন্ন মহল ও পত্র-পত্রিকায় চলতে থাকে তাঁর স্বাস্থ্য সম্পর্কে নানান কথাবার্তা ও জল্পনা-কল্পনা। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দীর্ঘকাল যাবত নানান জটিল রােগে আক্রান্ত ছিলেন। উপরন্তু, তখন তাঁর বয়সও পঁচাত্তর পেরিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং তাঁর বেশীদিন বাঁচার সম্ভাবনার ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান হয়ে পড়েন। এই বিষয়ে সবচেয়ে বেশী অবগত ছিলেন দেশের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলের ব্যক্তিত্বরা। বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের মৃত্যু ঘটলে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল নিজেদের অনুকূলে নিতে পারবে বলে উক্ত মহলসমূহ সুনিশ্চিত হতে পারছিল না। কারণ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের পরিবর্তে তাঁদের এমন কোন প্রার্থী ছিলেন না যাঁকে সম্ভাব্য নির্বাচনে জেতানাের জন্যে মরহুম জিয়াউর রহমান সাহেবের ভাবমূর্তির প্রভাব খাটানাে যাবে। বিশেষ করে, ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিশেষতঃ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের প্রতি বিপুল গণসমর্থন প্রত্যক্ষ করে তাঁরা নিপতিত হন নিরতিশয় শংকা ও দুর্ভাবনায়। তাঁদের দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তার আর একটি কারণ ছিল জিয়াউর রহমান সাহেবের অভাবে সৃষ্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বাজাদল-বি. এন. পি.)-এর নেতাদের মধ্যে কোন্দল ও দলাদলি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতাদের মধ্যে কোন্দল ও দলাদলির অন্যতম কারণ ছিল আওয়ামী লীগ, বিশেষতঃ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের কি উপায়ে সম্ভাব্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল প্রতিরােধ করা যায় তার কৌশলগত ব্যাপারে মতভেদ ও অনৈক্য। যাহােক, দেশের এই অস্থির রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিকে নিজেদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে ব্যবহার করার জন্যে তৎপর হয়ে ওঠে দেশের সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগবিরােধী গ্রুপ ও ব্যক্তিত্ব। এদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল এক ও অভিন্ন এবং তা ছিল
পৃষ্ঠাঃ ৩১০
আওয়ামী লীগ, বিশেষতঃ বঙ্গবন্ধুর অনুসারীরা যাতে অতি শিগগির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত না হতে পারে তার জন্যে বিভিন্ন কলা-কৌশল উদ্ভাবন করা। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনীর কিছু স্বার্থান্বেষী ও উচ্চাভিলাষী উচ্চপদস্থ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে সমাসীন সদস্য এবং আওয়ামী লীগ, বিশেষতঃ বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরােধী সূযােগ সন্ধ্যানী ও ক্ষমতালি গ্রুপ ও ব্যক্তিত্ব প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে সরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার পর তা দীর্ঘকাল নিজেদের কর্তৃত্বে রাখার দীর্ঘমেয়াদী নীলনক্সা ও পরিকল্পনাও তৈরী করে উক্ত মহলটি। এদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত ছিল নিজেদেরকে দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার জন্যে দেশের দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল অর্থাৎ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল.) এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি.) দুটির নেতাদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। এই সমস্ত ধারণা ও মতামতের যথার্থতা পরিস্ফুটিত ও প্রতিভাত হয় দেশে ১৯৮২ সালে ও তৎপরবর্তী প্রায় ৮ বছরে সংঘটিত ঘটনাবলীর পর্যালােচনা ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ থেকে।
২। ১লা জানুয়ারী (১৯৮২) তারিখে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এক অধ্যাদেশে একটি দশ সদস্যবিশিষ্ট ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করেন। প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে উক্ত পরিষদে সদস্য রাখা হয় উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর তিন প্রধানকে। এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রসিডেন্টের তৎকালীন উপদেষ্টা দাউদ খান মজলিস বলেন, “জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সার্বিকভাবে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সকল বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেবে।” তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ সশস্ত্র বাহিনীর প্রাথমিক দায়িত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণের উপায় ও পদ্ধতি খুঁজে বের করবে। উক্ত পরিষদ এসব কাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিবেচিত হলে অন্য যে কোন বিষয়েও পরামর্শ দেবে।” পরবর্তীতে, ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যসংখ্যা দশ থেকে কমিয়ে ছয়ে আনা হয়। উক্ত পরিবর্তিত পরিষদে সদস্য থাকেন রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর তিন প্রধান। এই জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনকে কেন্দ্র করে দেশে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগসহ দেশে সার্বভৌম সংসদের নিকট জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থায় বিশ্বাসী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠনকে সরকারের ওপর আর একটি সরকার বলে আখ্যায়িত করেন। এর জবাবে রাষ্ট্রপতি সাত্তার বলেন, “এর ভূমিকা হবে মামুলি উপদেশমূলক। মন্ত্রী পরিষদের চেয়ে শক্তিশালী তথাকথিত সংস্থা গঠনের কোন প্রশ্নই ওঠে না। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানে এরূপ কোন বিধান নেই।” পরবর্তীতে, রাষ্ট্রপতি সাত্তার আরও বরেন, “সেনাবাহিনী সরকারের একটি অংশ। তাদের কর্তব্য হচ্ছে দেশের স্বাধীনতা ও
পৃষ্ঠাঃ ৩১১
সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার দায়িত্বে নিয়ােজিত থাকা। এর বাইরে এবং এর বেশী কোন কাজ করার কোন দরকার আছে বলে আমি মনে করি না।”
৩। দেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর ১৯৮১-এর ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে হাসিনা লন্ডন চলে যায় সেখানে রেহানা ও ছেলেমেয়ে জয় ও পুতলির সঙ্গে কিছুদিন কাটানাের জন্যে। ২রা জানুয়ারী (১৯৮২) তারিখে দিল্লী থেকে হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে ওদের কুশলাদি জেনে নিই। তখন আমি হাসিনাকে আরও জানাই যে, ভারতে আমার বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম জানুয়ারী (১৯৮২)-এর মধ্যেই শেষ হবে। কাজেই আমি হাসিনাকে ফেব্রুয়ারী (১৯৮২) মাসে দিল্লী আসার প্রস্তাব করি যাতে একত্রে দেশে ফিরতে পারি। উল্লেখ্য যে, ১৯৮১ ফেব্রুয়ারীতে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মে (১৯৮১)-এর ১৭ই তারিখে হাসিনা যখন দেশে ফিরে যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ ও ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ছাত্রদের জন্যে একটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনার কাজে আমি ব্যতিব্যস্ত ছিলাম। ছয়শত পৃষ্ঠারও বেশী পাঠ্যপুস্তকটির প্রুফ দেখতে সময় লাগে প্রায় এক বছর। এই বিশেষ কারণেই ভারত সরকার হাসিনার দেশে ফেরার পরও আমাকে ভারতে অবস্থান করার অনুমতি প্রদান করে।
৪। এদিকে বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিজনিত নানান খবরাখবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ১৬ই জানুয়ারী (১৯৮২) তারিখে ঢাকার তেজগাঁওস্থ পুরাতন বিমান বন্দরের গুদাম থেকে সুড়ঙ্গ পথে দেড় কোটি টাকার মালামাল লােপাট হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও, ঢাকা, আদমজীনগর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের বিভিন্ন দলের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং বিভিন্ন শিল্পকারখানায় কোন্দল ও সংঘর্ষের খবরাদিও পাওয়া যায়। অভিজ্ঞ মহলের ধারণা যে, তখন দেশের সেনাবাহিনীর কিছু স্বার্থান্বেষী ও উচ্চাভিলাষী উচ্চপদস্থ ও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত সদস্য কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের যােগসাজশে সারাদেশে অর্থনৈতিক সংকট ও অরাজকতাপূর্ণ সামাজিক অবস্থার সৃষ্টির জন্যে দায়ী ছিল অনেকাংশে। এতদুদ্দেশ্যে চক্রান্তকারীদের সারাদেশে স্বার্থান্বেষী মহল বিশেষের মধ্যে কোটি কোটি টাকা বিতরণের খবরাদি পাওয়া যায় বিভিন্ন নির্ভরযােগ্য সূত্রে।
৫। ৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮২) তারিখে রাষ্ট্রপতি সাত্তারের যুবমন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারী মিন্টো রােডস্থ বাসা ঘেরাও করে পুলিশ ঢাকার নাখালপাড়ার আলী হােসেন হত্যা মামলার আসামী এমদাদুল হক (ইমদু)কে গ্রেফতার করে। যুবমন্ত্রী আবুল কাশেম তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ আব্দুল মতিনের সঙ্গে আলােচনা করেই ইমদুকে গ্রেফতারের অনুমতি দেন। উল্লেখ্য, এককালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কর্মী ইমদু পরবর্তীতে বি. এন. পি’তে যােগদান করে। এর কিছুকাল পর, একদিন প্রকাশ্য বিদালােকে ইমদু নাখালপাড়ার আলী হােসেন তালুকদারকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। যাহােক, একজন মন্ত্রীর বাসভবনে
পৃষ্ঠাঃ ৩১২
আশ্রয়লাভকারী এই ধরনের একজন খুনীকে গ্রেফতারের ফলে রাষ্ট্রপতি সাত্তারের মন্ত্রী পরিষদ নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। ১১ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮২) তারিখে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ও টিভি ভাষণে তার ৭৭ দিনের ৪২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে দেওয়ার কথা ঘােষণা করেন। পরদিন অর্থাৎ ১২ই ফেব্রুয়ারী, রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার তাঁর ভাষায় সামগ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থাকে দুর্নীতি ও স্থবিরতা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে গঠন করেন নতুন মন্ত্রী পরিষদ। উল্লেখ্য, এই নতুন মন্ত্রী পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই ছিলেন পূর্ববর্তী মন্ত্রী পরিষদের অন্তর্ভুক্ত। এই মন্ত্রী পরিষদে ছিলেন ১০ জন মন্ত্রী ও ৮ জন প্রতিমন্ত্রী। সর্বোপরি, শাহ আজিজুর রহমান নিযুক্ত হন এই মন্ত্রী পরিষদের প্রধানমন্ত্রী।
৬। ১৩ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮২) রাতে হাসিনা লন্ডন থেকে দিল্লীতে টেলিফোনে আমাকে অবহিত করে ওর দিল্লী হয়ে বাংলাদেশে ফেরার সিদ্ধান্ত। অতঃপর ১৮ই ফেব্রুয়ারী তারিখে হাসিনা লন্ডন থেকে দিল্লী আসে। ২০শে ফেব্রুয়ারী তারিখে আমরা আজমীর যাই সেখানে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতীর কবর জিয়ারত ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠান করার জন্যে। সেখান থেকে দিল্লী প্রত্যাবর্তন করি ২৩শে ফেব্রুয়ারী তারিখে। অতঃপর ২৬শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮২) দিল্লীর পান্ডারা রােডস্থ আমাদের সাড়ে ছয় বছরের সংসার গুটিয়ে থাই আন্তর্জাতিক বিমানে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। সেদিন উক্ত বিমানের প্রথম শ্রেণীতে ছিলেন তঙ্কালীন পররাষ্ট্র সচিব হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও তাঁর পত্নী। বিমানটি দিল্লী ছাড়ার কিছুক্ষণ পর হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী ও তাঁর পত্নী সাধারণ শ্রেণীতে এসে আমাদের পাশের সিটে আসন গ্রহণ করেন। তাঁরা সারা পথ আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। সুদীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর পারস্পরিক সাক্ষাতে আমরা খুশীতে অভিভূত হই। ঢাকা বিমান বন্দরে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা এবং আওয়ামী লীগ ও তার অংগদলের নেতা ও কর্মীরা সমবেত হয়েছিলেন হাসিনাকে সংবর্ধনা জানানাের জন্যে। অতঃপর, বিমান বন্দর থেকে মিছিল করে আমাদের বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির (পুরাতন) ৩২ নতুন ১১) নম্বর রােডস্থ বাসায় নেয়া হয়। সেখানে পৌছানাের পর আমার মনে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয় তা প্রকাশ করার কোন ভাষা নেই।
৭। তখন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ঐ বাড়ীটি ছাড়া আমাদের আর কোন বাসা ছিল না। সংগত কারণে, বঙ্গবন্ধুর ঐ বাসায় অবস্থান নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাজেই হাসিনার সম্মতিক্রমে আমরা তখন গিয়ে উঠি আমার ভাগ্নীজামাই সিদ্দিক হােসেন চৌধুরীর মােহাম্মদপুরের ১১/১২, ইকবাল রােডস্থ ফ্লাটে। পরদিন অর্থাৎ ২৭শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮২) আমি আমার কর্মস্থল বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে যােগদানপত্র পেশ করি। কিন্তু দুঃখজনক যে, কমিশন আমার যােগদানপত্র গ্রহণ না করে এবং আমাকে কোন দায়িত্ব না দিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে তৎব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তের জন্যে তা প্রেরণ করে। কমিশনের এই পদক্ষেপ গ্রহণে আমি শুধু মর্মাহতই নয় কিছুটা বিস্মিতও হই। কারণ, ইতিপূর্বে কমিশন
পৃষ্ঠাঃ ৩১৩
এক অফিস স্মারকে আমাকে এই মর্মে অবহিত করেছিল যে, ১লা মার্চ (১৯৮২) তারিখের মধ্যে বাংলাদেশে ফিরে কমিশনে যােগদান না করলে আমার তখন ভারতে অবস্থান সংক্রান্ত লীয়েন বাতিল করা হবে। কমিশনের উক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে আমাকে শুধু কোন দায়িত্ব পাওয়া থেকেই বঞ্চিত করা হলাে না, সরকার কর্তৃক আমার যােগদানপত্র গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত কমিশন থেকে আমার বেতন ভাতাদি পাওয়ার কোন সুযােগ থাকলাে না। তদুপরি কমিশনে আমার চাকুরীর ব্যাপারে আমি নিপতিত হই মানসিক দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনায়।
৮। ১১ই মার্চ (১৯৮২) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দল ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ সংঘটিত হলে ২ জন নিহত ও ৪৫ জন আহত হয়। ১৬ই মার্চ (১৯৮২) তারিখে মংলা বন্দরে এক অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৫ কোটি টাকার সম্পদ ভস্মীভূত হয়। ১৮ই ফেব্রুয়ারী বিচারপতি সাত্তারের সরকার ৩ জন সাবেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করে দুর্নীতির মামলা। ১৯শে মার্চ (১৯৮২) তারিখে সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিনের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় দুর্নীতির মামলা। ২৩শে মার্চ (১৯৮২) তারিখে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ডঃ এম. এন. হদার পরিবর্তে মুহম্মদুল্লাহকে নতুন উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন। ২৪শে মার্চ (১৯৮২) ভােরে রেডিও ও টেলিভিশনে ঘােষণা করা হয় যে, সারাদেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ প্রধান সামরিক আইন। প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন। অতঃপর, সকাল এগারােটার দিকে রেডিও ও টেলিভিশনে এক ভাষণে বিচারপতি সাত্তার বলেন যে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি ও স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের অনুকূলে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। উক্ত ভাষণে বিচারপতি সাত্তার মন্ত্রী পরিষদ ও জাতীয় সংসদ বাতিলের কথাও ঘােষণা করেন। তখন টেলিভিশনে বিচারপতি সাত্তারের চেহারা দেখে এবং বক্তব্য শুনে কারাে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, তাঁর কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করা হয়েছে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি প্রদানের মাধ্যমে। তখন জনমনে এই ধারণা উপলব্ধি করেই এরশাদের সামরিক সরকার পুনঃ পুনঃ প্রচার করতে থাকে বিচারপতি সাত্তারের টেপে ধারণকৃত ঐ ভাষণ।
৯। ২৪শে মার্চ (১৯৮২) তারিখে সামরিক শাসন জারি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পুনরায় শুরু হয় সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক উচ্চপদস্থ ও ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্যের পুরাতন কুটিল লীলাখেলা ও কুটক্রিয়াকলাপ। ২৫শে মার্চ (১৯৮২) তারিখে বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীকে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়। ২৭শে মার্চ (১৯৮২) তারিখে রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত করা হয় প্রধান আইন প্রশাসকের আত্মীয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে। অতঃপর, সামরিক সরকার দেশে গঠন করে ৩রা এপ্রিল (১৯৮২) তারিখে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ও পাঁচটি সামরিক আদালত এবং ৪ঠা এপ্রিল (১৯৮২) তারিখে ২৩টি সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালত।
পৃষ্ঠাঃ ৩১৪
২২শে এপ্রিল (১৯৮২) তারিখে সামরিক সরকার দেশে প্রতিটি বিভাগে একটি হাই কোর্ট বেঞ্চ এবং থানা সদরে একটি আদালত গঠনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। অতঃপর, ৮ই জুন (১৯৮২) তারিখে দেশে হাই কোর্ট ডিভিশনের চারটি স্থায়ী বেঞ্চ গঠন করা হয়।
১০। ১০ই জুন (১৯৮২) তারিখে হাসিনা লন্ডন যায় সেখানে রেহানা ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কয়েক মাস কাটানাের জন্যে। ইতিপূর্বে, আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা ও প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য ডঃ কামাল হােসেন লন্ডন গিয়েছিলেন ৬ই এপ্রিল (১৯৮২) তারিখে। মে (১৯৮২) মাসে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৮ই জুন (১৯৮২) তারিখে তিনি পুনরায় লন্ডন চলে যান। ডঃ কামাল হােসেন সেবার দেশে ফেরেন ২৭শে জুলাই (১৯৮২) তারিখে।
১১। জুলাই (১৯৮২)-এর শেষের দিকে একদিন আণবিক শক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও অন্যতম উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ আমাকে তাঁর ক্যান্টনমেন্টস্থ বিমান বাহিনী দফতরে যেতে বলেন কমিশনে আমার যােগদানপত্রের ব্যাপারে আলাপের জন্যে। সেদিন তিনি আমার কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নেন আমি সাড়ে ছয় বছর ভারতে থাকাকালীন সময় কি কি কাজকর্ম করেছি। অতঃপর ভারতে অন্যান্য কাজকর্মের ফাঁকে আমার লেখা এবংTata Mcgraw Hill Publishing Company কর্তৃক প্রকাশিত “Fundamentals of Electromagnetics” পাঠ্যপুস্তকটির একটি কপি আমি তাকে উপহার দিই। কথাবার্তায় এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদকে বিজ্ঞান অনুরাগী বলে মনে হলাে। তিনি পুরাে পুস্তকটির পাতা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখে এর প্রশংসা করেন এবং সাফল্যজনকভাবে কাজটি সম্পন্ন করার জন্যে আমাকে মােবারকবাদ জানান। অতঃপর, কমিশনে আমার যােগদানের ব্যাপারে অতি শিগগির সিদ্ধান্ত প্রদানের আশ্বাস দিয়ে তিনি আমাকে বিদায় দেন। এর দিন দশ-বারাে পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আমার ভারতে অবস্থানের সময়কালকে বেতনবিহীন ছুটি হিসেবে গণ্য করে আমাকে কাজে যােগদান করার অনুমতি প্রদানে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনকে নির্দেশ দেয়
১২। সেপ্টেম্বর (১৯৮২)-এর শেষের দিকে লন্ডন থেকে হাসিনা আমাকে চিঠিতে জানায় যে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে সে ডিসেম্বরের মধ্যেই ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতএব এর পূর্বেই ধানমন্ডী আবাসিক এলাকার আশেপাশে একটি অন্ততঃ তিন শয়ন কক্ষবিশিষ্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার জন্যে হাসিনা আমাকে পরামর্শ দেয়। এর পর থেকে আমি ধানমন্ডী, কলাবাগান, লেকসার্কাস, লালমাটিয়া, মােহাম্মদপুর ইত্যাদি এলাকায় একটি উপযুক্ত ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করি। প্রায় ৫০-৬০টি ফ্ল্যাট দেখি কিন্তু দুঃখজনক যে, আমার পরিচয় জানার পর কোন বাড়ীওয়ালা আমাকে ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে রাজি হন না। অতঃপর নভেম্বর (১৯৮২) মাসের গােড়ার দিকে আণবিক শক্তি কমিশনের মহাখালীস্থ আবাসিক কলােনীর একটি দু’কক্ষবিশিষ্ট ফ্ল্যাট খালি হবে জেনে সেটিকে আমার জন্যে
পৃষ্ঠাঃ ৩১৫
বরাদ্দের অনুরােধ জানিয়ে আমি কমিশনের চেয়ারম্যানের নিকট দরখাস্ত করি। কিন্তু সাড়ে ছয় বছর ভারতে বেতনবিহীন ছুটিতে থাকায় চাকুরীর জ্যেষ্ঠতা সত্ত্বেও মূল্যায়নের নিরিখে আমার সহকর্মী ডঃ আমির হােসেন খান উক্ত ফ্ল্যাটটি পাওয়ার যােগ্য বলে বিবেচিত হন। যাহােক, আমির হােসেন খান সদয় হয়ে তাঁর দাবী প্রত্যাহার করলে উক্ত ফ্ল্যাটটি আমার জন্যে বরাদ্দ করা হয়। অতঃপর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ঘটনার পর যে সমস্ত আত্মীয়-স্বজন তখন আমাদের বাসার আসবাবপত্রগুলাে নিজেদের যত্নে রেখেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যােগাযােগ করে সেই পুরানাে আসবাবপত্রগুলাে নিয়ে মহাখালীস্থ কমিশনের উক্ত ফ্ল্যাটটিতে গিয়ে উঠি ডিসেম্বর (১৯৮২)-এর মাঝামাঝি সময়ে। এর সপ্তাহ খানেকের মধ্যে হাসিনা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ফিরে উক্ত ফ্ল্যাটে অবস্থান নেয়। এর কিছুদিন পর ছেলেমেয়েদেরকে ভর্তি করে দিই ধানমন্ডীস্থ স্কলাসটিকা মাধ্যমিক স্কুলে।
১৩। ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৩) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি, এন, পি”র অন্যতম অংগদল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতৃত্বাধীন ছাত্র গ্রুপের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগ নেতৃতাধীন ছাত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে অনেক ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। ১৪ই। ফেব্রুয়ারী (১৯৮৩) তারিখের সকালে একটি ছাত্র-মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল পেরিয়ে শিক্ষাভবনের নিকট পৌছলে সেখানে মােতায়েনকৃত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর লােকেরা ছাত্রছাত্রীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জসহ এলােপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করে। এতে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর হতাহতের খবর পাওয়া যায়। অতঃপর দুপুরে এক সরকারী ঘােষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ করে দেয়া হয়। সেদিন রাতেই কতিপয় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার কয়েকশত সৈন্য সঙ্গে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলােয় ঢুকে ছাত্র-ছাত্রীদের নির্মমভাবে প্রহার ও নির্যাতন করে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৩) তারিখে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ ঘােষণা করা হয় এবং একই সাথে সহস্রাধিক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। সেদিন রাতেই আওয়ামী লীগের হাসিনা, বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, ডঃ কামাল হােসেন, তােফায়েল আহম্মদ, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হােসেন আমু, মােহাম্মদ নাসিম ,মােজাফফর হােসেন পন্টু ও ডাঃ এস. এ. মালেকসহ অনেক নেতাকে গ্রেফতার করে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ১লা মার্চ (১৯৮৩) তারিখে সামরিক সরকার দেশে রাজনৈতিক আলােচনার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের নেতাদেরসহ অন্যান্য গ্রেফতারকৃতদের মুক্তিদান করে।
১৪। ১৪ই মার্চ (১৯৮৩) তারিখে সামরিক সরকার দেশের থানা দফতরগুলাের নাম পরিবর্তন করে উপজেলায় রূপান্তরিত করে। ২৫শে মার্চ (১৯৮৩) তারিখে তৎকালীন
পৃষ্ঠাঃ ৩১৬
সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল এরশাদ এক রেডিও ও টিভি ভাষণে ১লা এপ্রিল (১৯৮৩) হতে দেশে ঘরােয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। অতঃপর ১লা এপ্রিল (১৯৮৩) থেকে দেশে ঘরােয়া রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ২রা এপ্রিল (১৯৮৩) তারিখে অনুষ্ঠিত একটি তলবী সভায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি) নেতৃত্বের কোন্দলে দ্বিধা বিভক্ত হয়। ২৮শে এপ্রিল (১৯৮৩) তারিখে এরশাদ সাহেবের তৎকালীন জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয় এক আলাপ-আলােচনা বৈঠক। জুন (১৯৮৩) মাসের গােড়ারদিকে হাসিনার সভাপতিত্বে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডীস্থ বাসভবন চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক দু’দিনব্যাপী বর্ধিত সভা। উক্ত সভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযােগ আনা হয়। উক্ত সভার সমাপ্তি অধিবেশনের পূর্বে আমি সেখানে উপস্থিত হই। সমাপ্তি অধিবেশন শুরুর আগে আওয়ামী লীগের দুই প্রবীণ নেতা সর্বজনাব এম. কোরবান আলী ও আব্দুস সামাদ আজাদ হাসিনাকে এই মর্মে পরামর্শ দেন যে, সে তার বক্তৃতায় এমন কিছু যেন না বলে যার ফলে দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কলহ ও অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। অতঃপর দুজনেই একত্রে উক্ত কক্ষ ত্যাগ করেন। এর অব্যবহিত পরেই জনাব কোরবান আলী দ্রুত উক্ত কক্ষে প্রবেশ করে বলেন, “সভানেত্রী, সামাদ সাহেবের উপস্থিতিতে আমি আপনাকে যে কথা বলেছি তা আমার মনের কথা নয়। অতএব, আপনার ভাষণে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।”
১৫। ইতিপূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল)-এর নেতৃত্বে একটি ১৫ দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। এই জোট একটি ৯-দফার কর্মসূচী ঘােষণা করে। এর মধ্যে উল্লেখযোেগ্য দাবী ছিলাে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর পূর্বেকার ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রবর্তন এবং তদনুযায়ী অনতিবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অপরদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি)-এর নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি ৭ দলীয় ঐক্যজোট। এই জোটের উল্লেখযােগ্য দাবী ছিলাে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদের পদত্যাগ এবং রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা অপরিবর্তিত রেখেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
১৬। এদিকে জুলাই (১৯৮৩) -এর গােড়ার দিকে তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এক ইফতার পার্টিতে দাওয়াত করেন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের। ১৫ দলীয় ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের নেতৃবৃন্দ উক্ত দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু এরশাদ সাহেবের উক্ত ইফতার পার্টিতে উপস্থিত হন সর্বজনাব আতাউর রহমান খান, টি. আলী, আমেনা বেগম, মাওলানা মতিন, শামসুল হুদা, সিরাজুল হক, কাজী কাদের, আলী আমজাদ খান, বি. এন. পি-এর শামসুল হুদা চৌধুরী, ডাঃ এম এ মতিন, রিয়াজউদ্দিন আহমদ ভােলা মিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
পৃষ্ঠাঃ ৩১৭
১৭। ৮ই জুলাই (১৯৮৩) তারিখে এক বেতার ও টিভি ভাষণে তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক অইন প্রশাসক মেজর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ দেশে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সূচী ঘােষণা করেন। ২রা আগস্ট আওয়ামী লীগ (হাসিনা) থেকে জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ও জনাব আব্দুর রাজ্জাকসহ ৬ জন নেতাকে বহিষ্কৃত করা হয়। ৫ই আগস্ট (১৯৮৩) সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভিত্তিতে তৈরী চুড়ান্ত ভােটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। ২৮শে আগস্ট (১৯৮৩) বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে অভিযুক্ত মাহবুবুল আলম চাষী জেদ্দায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। ২২শে অক্টোবর (১৯৮৩) তারিখে জনাব মহিউদ্দিন। আহমদকে সভাপতি এবং জনাব আব্দুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং ১৯৭৫ সালে তাঁর ঘােষিত আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কায়েম করা উক্ত ‘বাকশালের লক্ষ্য হিসেবে ঘােষণা করা হয়। ১লা নভেম্বর (১৯৮৩) তারিখে সর্বাত্মক অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয় ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের যৌথ আহবানে।
১৮। ১৪ই নভেম্বর (১৯৮৩) তারিখে প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর থেকে পূর্বারােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। ২৭শে নভেম্বর (১৯৮৩) তারিখে এরশাদ সাহেবের ইঙ্গিতে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে একটি কনফারেন্সে মিলিত হন। প্রেসিডেন্ট ও বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে চেয়ারম্যান, জনাব এ. আর. শামসুদ্দোহাকে সেক্রেটারী জেনারেল, ৭ জনকে ভাইস চেয়ারম্যান, ২ জন জয়েন্ট সেক্রেটারী এবং ২০৮ জনকে সদস্য নির্বাচিত করে জনদল গঠন করা হয়। কতিপয় পুরাতন রাজনৈতিক কর্মী উক্ত দলে যােগদান করেন। অনেকে অন্য রাজনৈতিক দল ত্যাগ করে ‘দলছুট’ হিসেবে জনদলে যােগ দেন। আবার কতিপয় নেতা তাদের স্ব স্ব গােটা দল নিয়েই উক্ত সরকারী দলে যােগদান করেন। সর্বোপরি, বিভিন্ন মামলার আসামী ও সাজাপ্রাপ্ত অনেক ব্যক্তি তড়িঘড়ি করে সরকারী জনদলে যােগদান করেন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে।
১৯। ২২শে নভেম্বর (১৯৮৩) ১৫ দল ও ৭ দল ঐক্যজোটদ্বয়ের কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। ২৮শে নভেম্বর (১৯৮৩) তারিখে বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচী পালিত হয় ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের যৌথ আহবানে। হাজার হাজার নেতা, কর্মী ও জনগণের সঙ্গে সচিবালয়ের দু’পাশে অবস্থান নেন হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া। উক্ত অবস্থান ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে সেদিন ঢাকায় সংঘটিত হয় ব্যাপক উত্তেজনা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা। অতঃপর রাতে এক রেডিও ও টিভির ঘােষণায় সারাদেশে সকল রাজনৈতিক তৎপরতা পুনরায় নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। এ ছাড়া সারা ঢাকায় পুনরায় সান্ধ্য আইন বলবৎ করা হয়। ঐ রাতেই বেগম
পৃষ্ঠাঃ ৩১৮
খালেদা জিয়া ও হাসিনাকে তাঁদের যথাক্রমে ক্যান্টনমেন্টস্থ ও মহাখালীস্থ স্ব স্ব বাসস্থানে অন্তরীণ রাখা হয়। এ ছাড়াও, অবস্থান ধর্মঘটের সময়ও ঐদিন রাতে অনেক নেতা, কর্মী ও সাধারণ লােককে গ্রেফতার করা হয়।
২০। ১১ই ডিসেম্বর (১৯৮৩) তারিখে তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিচারপতি আহসান উদ্দিনকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও গ্রহণ করেন। কারণ হিসেবে বলা হয় যে, কেবল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বিদেশ ভ্রমণে গেলে নানান জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। বিশেষতঃ, উক্ত নামে গণতান্ত্রিক দেশে তাঁকে যথাযােগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানে নানান প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। তাই তিনি নিজেই রাষ্ট্রপতি হয়ে গেলেন।
২১। ১৪ই ডিসেম্বর (১৯৮৩) তারিখে ২২শে ও ২৮শে নভেম্বরের ঘটনার অভিযােগে দায়েরকৃত মামলাসমূহ প্রত্যাহারসহ উক্ত দিবসদ্বয়ে গ্রেফতারকৃতদেরকে মুক্তি প্রদান করা হয়। ২৬শে ডিসেম্বর (১৯৮৩) তারিখে ইতিপূর্বে বহিস্কৃত ৫ জন তৎকালীন সােভিয়েট কূটনীতিক ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৭শে নভেম্বর (১৯৮৩) তারিখে দেশে শুরু হয় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন।
২২। ২রা জানুয়ারী (১৯৮৪) ছিল সারাদেশে পৌরসভা নির্বাচনে মনােনয়ন দাখিলের দিন। ৭ই জানুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে সামরিক সরকার পুনরায় দেশে ঘরােয়া রাজনীতির অনুমােদন দেয়। ঐ দিনই ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের বাইরের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা এরশাদ সাহেব কর্তৃক আহূত ‘রাজনৈতিক সংলাপের অংশ হিসেবে বঙ্গভবনে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। ১০ই জানুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে দেশে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষকালব্যাপী নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ১২ই জানুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি. এন. পি)-এর চেয়ারম্যান (চেয়ারপারসন) মননানীত হন। ২৭শে জানুয়ারী (১৯৮৪)তারিখে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয় উপজেলা নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৭ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে ঘােষণা করা হয় তখনকার রাজনৈতিক সংলাপের সমাপ্তি। ১১ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় দেশের ৭৮টি পৌরসভার নির্বাচন। ১৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে লন্ডনে ইন্তেকাল করেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী। অতঃপর তাঁর মরদেহ সিলেটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয় ২০শে ফেব্রুয়ারী তারিখে। ২৪শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮৪) ছিল উপজেলা নির্বাচনে মনােনয়নপত্র দাখিলের তারিখ। ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে ঢাকার নওয়াবপুর রােডে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের একটি মিছিলের ওপর পুলিশ গাড়ী চালিয়ে দিলে তার আঘাতে এবং চাকার নীচে পিষ্ট হয়ে দুইজন ছাত্র অকুস্থলেই প্রাণ হারায় এবং অনেক ছাত্র দারুণভাবে আহত হয়। ২৯শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮৪) তারিখে সামরিক সরকার দেশে
পৃষ্ঠাঃ ৩১৯
২৬শে মার্চ (১৯৮৪) থেকে অবাধ রাজনীতির এবং ২৭শে মে (১৯৮৪) তারিখে একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে।
২৩। ১লা মার্চ (১৯৮৪) ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বযের আহ্বানে সারাদেশব্যাপী পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। ৩রা মার্চ (১৯৮৪) তারিখে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয় সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানায় উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের। ৪ঠা মার্চ (১৯৮৪) উপজেলা নির্বাচনে ৭ শতাধিক প্রার্থী তাঁদের মনােনয়ন প্রত্যাহার করেন। ১৮ই মার্চ (১৯৮৪) সামরিক সরকার উপজেলা নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্যে স্থগিত ঘােষণা করে। ২৪ শে মার্চ (১৯৮৪) সামরিক সরকার দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাের সঙ্গে পুনরায় সংলাপ অনুষ্ঠানের ইচ্ছা ব্যক্ত করে। ২৭শে মার্চ (১৯৮৪) তারিখে ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতির মিলনায়তনে একটি রাজনৈতিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় মুসলিম লীগের বি. এ. সিদ্দিকী, খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ এবং জাতীয় লীগের আতাউর রহমান খান যােগদান করেন। তাঁর ভাষণে আতাউর রহমান খান বলেন, “এরশাদ গণতন্ত্রের শেষ হত্যাকারী।” ২৮শে মার্চ (১৯৮৪) রাতে আতাউর রহমান খান এরশাদ সাহেবের সঙ্গে বৈঠক করেন তাঁর ক্যান্টনমেন্টস্থ সেনাভবনে। ঐ দিন রাত ১১টার সংবাদে আতাউর রহমান খানের সামরিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগের কথা ঘােষণা করা হয়। ৩০শে মার্চ (১৯৮৪) আতাউর রহমান খানকে প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করান তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তখন চাপানের সময় সাংবাদিকরা আতাউর রহমান খানকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনি এরশাদ সাহেবকে গণতন্ত্রের হত্যাকারী বলার পর এখন কেন তার সঙ্গে যােগ দিলেন?” এ প্রশ্নের উত্তরে প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান খান নির্দ্বিধায় ও নিঃসংকোচে বলেন, “গণতন্ত্রকে জীবিত করার জন্যেই তাঁর সঙ্গে যােগ দিলাম।”
২৪। ইত্যবসরে সামরিক সরকারের সঙ্গে পুনরায় শুরু হয় দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাের সংলাপ। ৯ই এপ্রিল বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোটের ২০ জন সদস্য বঙ্গভবনে যান উপরােক্ত সংলাপ বৈঠকের উদ্দেশ্যে। আতাউর রহমান খানের উপস্থিতির ব্যাপারে বেগম খালেদা জিয়া আপত্তি উত্থাপন করেন। তাঁকে বেগম খালেদা জিয়া বেঈমান ও বিশ্বাস-ঘাতক বলেও উল্লেখ করেন। কারণ তিনি ইতিপূর্বে চলমান ৫ দফার আন্দোলন থেকে সম্পর্কচ্ছেদ করে প্রধানমন্ত্রীত্ব গহণ করেছেন। অতঃপর, আর অন্যকোন কথা না বলে ৩৩-দফা দাবীনামা পেশ করেই ৭ দলীয় ঐক্যজোটের নেতারা বঙ্গবভন ত্যাগ করেন। ১০ই এপ্রিল (১৯৮৪) তারিখে জামাতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত হয় এরশাদ সাহেবের নেতৃত্বে সরকার পক্ষের সংলাপ বৈঠক।
২৫। ১১ই এপ্রিল (১৯৮৪) তারিখে হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের ৩৮জন নেতা বঙ্গভবনে যান এরশাদ সাহেবের নেতৃত্বে সামরিক সরকার পক্ষের সঙ্গে রাজনৈতিক
পৃষ্ঠাঃ ৩২০
সংলাপের উদ্দেশ্যে। উক্ত বৈঠকে হাসিনা ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষে দাবীনামা পেশ করেন। উক্ত দাবীনামায় অন্তর্ভুক্ত ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক আইনে সাজাপ্রাপ্ত ১৪ ব্যক্তির দণ্ড মওকুফের বিষয়ও। প্রায় তিন ঘন্টা ধরে চলে সরকার পক্ষ ও ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের নেতাদের বাকবিতণ্ডা। অতঃপর আলােচনা মুলতবি ঘােষণা করা হয়।
২৬। ১২ই এপ্রিল (১৯৮৪) তারিখে বি. এন. পি-এর চেয়ারপারসন ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গভবনে এরশাদ সাহেবের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। ১৪ই এপ্রিল (১৯৮৪) তারিখে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত হয় হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এরশাদ সাহেবের নেতৃত্বে সামরিক সরকার পক্ষের দ্বিতীয় দফা সংলাপ বৈঠক। ২০শে এপ্রিল (১৯৮৪) তারিখে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত হয় এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক সরকার পক্ষের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দের তৃতীয় দফা সংলাপ বৈঠক। উক্ত বৈঠক চলে প্রায় দুই ঘন্টা ধরে। ২৮শে এপ্রিল (১৯৮৪) তারিখে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত হয় এরশাদের নেতৃত্বে সামরিক সরকার পক্ষের সঙ্গে খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে ১০ দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দের সংলাপ বৈঠক। ১লা মে (১৯৮৪) তারিখে বঙ্গভবনে এরশাদ”জনদলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। ১৮ই মে (১৯৮৪) তারিখে পালিত হয় সাংবাদিকদের ২৪ ঘন্টার প্রতীক ধর্মঘট। ১০ই জুন (১৯৮৪) তারিখে এরশাদের সামরিক সরকার”দৈনিক দেশ পত্রিকার। প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘােষণা করে।
২৭। জুন (১৯৮৪) মাসের শেষের দিকে একদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া আমার আণবিক শক্তি কমিশনের অফিসে এসে আমার কাছ থেকে জানতে চান যে, তাঁদের দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমার কোন আপত্তি আছে কিনা। বেগম জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমার কোনরূপ আপত্তি নেই জেনে তিনি ঐব্যাপারে আমার সঙ্গে পুনরায় আলাপ করবেন বলে চলে যান। উল্লেখ্য, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া আশির দশকের গােড়া থেকে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এর আইন উপদেষ্টা হিসেবে। ১৯৮৩ সালের গােড়ার দিকে তার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ-পরিচয় হয়। এরপর, কমিশনের কাজে আমাদের অফিসে এলে তিনি কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আমার সঙ্গে দেখা করতেন। মাঝে মধ্যে এটাসেটা বিষয় ছাড়াও তিনি কিছু কিছু রাজনৈতিক বিষয়েও আমার সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর কথাবার্তা থেকে আমার ধারণা হয় যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে সার্বভৌম সংসদের নিকট জবাবদিহিমূলক সংসদীয় রাষ্ট্ৰীয় শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। যাহােক, উপরােক্ত ঘটনার দিন ছয়েক পর ব্যারিস্টার রফিকুর ইসলাম মিয়া আমাকে জানান যে, ঐ দিনই সন্ধ্যায় বেগম জিয়ার ক্যান্টনমেন্টস্থ বাসায় তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের জন্যে বন্দোবস্ত করা হয়েছে। অতঃপর, ঐদিন যথাসময়ে আমার অফিসের গাড়ীতে ব্যারিস্টার রফিকের সঙ্গে বেগম
পৃষ্ঠাঃ ৩২১
খালেদা জিয়ার বাসায় যাই। আমার জন্যে সময় রাখা হয়েছিল মাত্র আধাঘন্টা। কারণ ঐ রাতেই বি, এন, পি-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নির্ধারিত ছিলাে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা। যাহােক, সেদিন ব্যারিস্টার রফিকের উপস্থিতিতে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়। বেগম খালেদা জিয়াকে স্বল্পভাষিণী বলে মনে হলাে। কাজেই প্রায় সারাক্ষণ আমিই কথা বললাম। ১৯৭৪-এর অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে তৎকালীন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেবের সঙ্গে আমার দু’বার যে দীর্ঘ আলাপ হয়েছিলাে তার সম্পর্কে তখন বেগম খালেদা জিয়াকে বিস্তারিতভাবে অবহিত করি। এ ছাড়াও আমার সপরিবারে দিল্লীতে থাকাকালীন ১৯৭৭ সালের গােড়ার দিকে জিয়াউর রহমান সাহেব ভারতে নিযুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জনাব শামসুর রহমানের মাধ্যমে আমাকে যে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিষয়ক কাউন্সিলর নিয়ােগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তৎসম্পর্কেও বেগম জিয়াকে অবহিত করি। যাহােক, এ জাতীয় কথাবার্তার মধ্যদিয়ে সেদিনের সাক্ষাৎকার সমাপ্ত হয়। এটাই বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎকার।
২৮। ৯ই জুলাই (১৯৮৪) তারিখে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা ও হাসিনার অন্যতম পরামর্শদাতা এম. কোরবান আলী এরশাদের মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করেন। ১২ই জুলাই (১৯৮৪) তারিখে সামরিক সরকার ৮ই ডিসেম্বর (১৯৮৪) তারিখে কেবলমাত্র জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৩০শে জুলাই (১৯৮৪) তারিখে এরশাদের মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করেন বি. এন. পি-এর অন্যতম প্রবীণ ও বিপ্লবী নেতা ক্যাপ্টেন (অবঃ) আব্দুল হালিম চৌধুরী। এই দুই নেতার সামরিক জান্তার মন্ত্রী পরিষদে যােগদানে জনগণ শুধু বিস্মিতই নয়, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও বিক্ষুব্ধও হন। কারণ, ইতিপূর্বে এই নেতৃদ্বয় সামরিক শাসন অবসানের দাবিতে জোরালাে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং স্ব স্ব দলের নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের কোন মতপার্থক্যের একটু আভাসও কোনভাবেই ইতিপূর্বে পরিলক্ষিত হয়নি। সুতরাং, তাঁরা যে গদি, ক্ষমতা ও অর্থের লােভে সামরিক জান্তার মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করেছিলেন সেসম্পর্কে জনমনে কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
২৯। ৪ঠা আগস্ট সামরিক সরকার প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গােপালগঞ্জের টুংগীপাড়ায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করেন। এতে তাঁর কোন আন্তরিকতা বা কৃতজ্ঞচিত্ততা ছিল বলে আওয়ামী লীগের কেউই বিশ্বাস করেনি। ১৫ই আগস্ট (১৯৮৪) তারিখে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ও জাতীয় শােক দিবস উপলক্ষে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে আয়ােজিত আওয়ামী লীগের জনসভায় বােমাবাজি সংঘটিত হয়। এতে বেশ কিছু লোক। কমবেশী আহত হয়। ১৮ই আগস্ট (১৯৮৪) তারিখে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ রেডিও ও টিভি ভবনদ্বয়ের সামনে প্রদর্শিত হয় এক বিক্ষোভ মিছিল। ২৭শে
পৃষ্ঠাঃ ৩২২
আগস্ট (১৯৮৪) তারিখে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। ৩০শে আগস্ট (১৯৮৪) তারিখে দেশের ডাক্তাররা পালন করেন ২৪ ঘন্টাব্যাপী ধর্মঘট। ১৪ই সেপ্টম্বর (১৯৮৪) তারিখে অনুষ্ঠিত সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবীদের সমাবেশে হাসিনা তাঁর ভাষণে ১৯৭৫ সালের পর সকল সরকারকে অবৈধ বলে আখ্যায়িত করে। এর ফলে বি. এন. পি-এর নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। ২৪শে সেপ্টেম্বর (১৯৮৪) তারিখে”দৈনিক দেশ” পত্রিকা প্রকাশের দাবীতে সারাদেশের সংবাদপত্রগুলাে একদিনের জন্য বন্ধ থাকে।
৩০। ২৭শে সেপ্টেম্বর (১৯৮৪) ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের আহবানে সারাদেশে পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। এদিন কালিগঞ্জে প্রদর্শিত বিক্ষোভ মিছিলে সামরিক সরকারের গুণ্ডারা সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। এর ফলে উক্ত মিছিলে অংশগ্রহণকারী অনেক লােক আহত হয়। অতঃপর ছত্রভঙ্গ মিছিল থেকে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও তৎকালীন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সমিতির চেয়ারম্যান জনাব ময়েজুদ্দিন আহমদ যখন আওয়ামী লীগ অফিসে ফিরছিলেন তখন গুণ্ডার সরদার আজম খানের নেতৃত্বে সামরিক সরকারের গুণ্ডা বাহিনী তাঁকে প্রকাশ্য দিবালােকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রতিবাদ বিবৃতি প্রদান ছাড়া তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর কোন কর্মসূচী বা কার্যক্রম গৃহীত হয়নি। এরশাদের মন্ত্রী পরিষদের অন্যতম মন্ত্রী ও জনদলের তৎকালীন মহাসচিব মাহবুবুর রহমান উক্ত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অনেককেই কানাঘুষা ও অভিযােগ করতে শােনা যায়।
৩১। ১লা অক্টোবর (১৯৮৪) তারিখে এরশাদ সাহেব মাহবুবুর রহমানকে একই সাথে মন্ত্রী পরিষদ এবং জনদলের মহাসচিবের পদ থেকে অপসারণ করেন। ঐদিনই মিজানুর রহমান চৌধুরীকে ‘জনদলের নতুন মহাসচিব নিযুক্ত করা হয়। ৩রা অক্টোবর (১৯৮৪) এরশাদের সামরিক সরকার সাপ্তাহিক ‘ইত্তেহাদ’ ও ‘খবর’ পত্রিকা দুটোর প্রকাশনা নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ১১ই অক্টোবর (১৯৮৪) তারিখে ঢাকার শেরেবাংলা নগরস্থ মানিক মিয়া এভিয়ে এরশাদ সাহেব জনসভায় ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে এরশাদ সাহেব বলেন যে, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাে ৮ই ডিসেম্বর (১৯৮৪) তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে সম্মত হলে তিনি তাঁর মন্ত্রী পরিষদ ভেঙ্গে দেবেন। এরশাদ সাহেব আরও বলেন যে, মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করার পর তাঁর ভূমিকা হবে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয়। এদিকে জনদলের নতুন মহাসচিব মিজানুর রহমান চৌধুরী বিভিন্ন জনসভায় বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলােকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার আহবান জানান। কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের প্রধান শর্ত ছিল সামরিক আইন প্রত্যাহার। তখন সামরিক সরকারের। পক্ষ হতে বলা হয়, “ইতােপূর্বে সামরিক শাসনামলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে তাতে অংশগ্রহণ করেছে। অতএব এখন আপত্তি কেন?”
পৃষ্ঠাঃ ৩২৩
৩২। ১৪ই অক্টোবর (১৯৮৪) ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয় তাদের স্ব স্ব সমাবেশে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচী ঘােষণা করে। ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের সমাবেশে ৮ই ডিসেম্বরে ২৪ ঘন্টার হরতালসহ ২৭শে নভেম্বর থেকে ১১ই ডিসেম্বর (১৯৮৪) পর্যন্ত অসহযোেগ আন্দোলনের আহবান জানানাে হয়। অপরদিকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের সমাবেশেও প্রায় অনুরূপ কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়। উপরন্তু, ৭ দলীয় ঐক্যজোটের জনসভায় সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার বলেন, “আমি এখনও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে বহাল রয়েছি।” উক্ত জনসভায় বি. এন. পি আমলের সংসদের স্পীকার, মির্জা গােলাম হাফিজ বলেন, “আমি এখনও নির্বাচিত সংসদ স্পীকার। সুতরাং এরশাদের রাষ্ট্রপতি থাকার কোন বৈধ এখতিয়ার নাই।” এদিকে এরশাদ সাহেব নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন এবং বলেন, “বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সামরিক শাসন অব্যাহত থাকবে। এছাড়াও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হবে।”
৩৩। ২৭শে অক্টোবর (১৯৮৪) তারিখে সরকার দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাের বিরােধিতার কারণে ৮ই ডিসেম্বর (১৯৮৪) তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন স্থগিত ঘােষণা করে। ২৫শে নভেম্বর (১৯৮৪) তারিখে এরশাদ সাহেব সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে তাঁর চাকুরীর মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য বৃদ্ধি করেন। ৮ই ডিসেম্বর (১৯৮৪) ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় ২৪ ঘন্টাব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল। ১৫ই ডিসেম্বর (১৯৮৪) তারিখে এক বেতার ও টিভি ভাষণে এরশাদ সাহেব ৮ই ডিসেম্বর (১৯৮৪) তারিখে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন বাতিলের কারণ ব্যাখ্যা করে যথাশীঘ্র নির্বাচনের নতুন সময়সূচী ঘােষণার প্রতিশ্রুতি দেন। ইত্যবসরে, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ (কপ) ২২শে ও ২৩শে ডিসেম্বর (১৯৮৪) তারিখে বিরতিহীন ৪৮ ঘন্টার সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচী ঘােষণা করে। এরই প্রেক্ষিতে ২০শে ডিসেম্বর (১৯৮৪) তারিখে সামরিক সরকার ২২শে ও ২৩শে ডিসেম্বর (১৯৮৪) দুই দিনের জন্য হরতালসহ সর্বপ্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। সামরিক সরকারের উক্ত ঘােষণা সত্ত্বেও সারাদেশে ২২শে ও ২৩শে ডিসেম্বর (১৯৮৪) বিরতিহীনভাবে পালিত হয় ৪৮ ঘন্টার সর্বাত্মক হরতাল। ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরের শেষেরদিকে শফিক সিদ্দিক রেহানা ও তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে লন্ডন থেকে ঢাকায় চলে আসে কয়েক মাস তাঁর আব্বা-আম্মার সাথে কাটানাের জন্যে।
৩৪। ১৯৮৫ সালের ১৫ই জানুয়ারী তারিখে এক সরকারী ঘােষণায় দেশে মন্ত্রী পরিষদ ও বিশেষ সামরিক আইন আদালতের বিলুপ্তি এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারা পুনর্বহালের কথা বলা হয়। একই দিনে ৬ই এপ্রিল (১৯৮৫) তারিখ সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্ধারণপূর্বক নির্বাচন অনুষ্ঠানের নতুন তফসিল ঘােষণা করা হয়। ১৬ই জানুয়ারী (১৯৮৫) এরশাদ সাহেব ৭ জন নির্দলীয় ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নতুন মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। ১৯শে জানুয়ারী (১৯৮৫) তারিখে আরও ৪ জন নির্দলীয় ব্যক্তিকে মন্ত্রী হিসেবে শপথ প্রদান করা
পৃষ্ঠাঃ ৩২৪
হয়। ৩১শে জানুয়ারী (১৯৮৫) তারিখে এক সরকারী ঘােষণায় আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও দপ্তরের বিলুপ্তির কথা বলা হয়। ১৩ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৫) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে রাত সাড়ে এগারটার দিকে আততায়ীর গুলীতে ছাত্রনেতা রাউফুন বসুনিয়া নিহত হয়। উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন অর্থাৎ ১৪ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৫) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে সরগরম হয়ে ওঠে। এহেন উত্তেজিত ও উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র গ্রুপ এবং বি. এন. পি-এর অংগদল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বাধীন ছাত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ. রহমান ছাত্রাবাসে কে বা কারা অগ্নিসংযােগে উক্ত ছাত্রাবাসের অনেক ছাত্রের বিছানা-বইপত্রসহ বিপুল ক্ষতিসাধন করে। উক্ত ঘটনায় সামরিক সরকারের বিশেষ বিভাগের কতিপয় লােকের হাত ছিল বলে অনেককেই কানাঘুষা ও অভিযােগ করতে শােনা যায়। একই তারিখে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয় সরকার ঘােষিত ৬ই এপ্রিল (১৯৮৫) তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকায় আংশিক হরতাল পালিত হয় এবং সিলেটে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অফিসে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটে। ২২শে ফেব্রুয়ারী (১৯৮৫) তারিখে এক সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে মনােনয়নপত্র দাখিল স্থগিত ঘােষণা করা হয়।
৩৫। ১লা মার্চ (১৯৮৫) তারিখে তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও (স্বঘােষিত) রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রেডিও ও টিভিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে তিনি বলেন যে, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাের অসহযােগিতার কারণে প্রস্তাবিত ৬ই এপ্রিল (১৯৮৫) তারিখের সংসদ নির্বাচন বাতিল ঘােষণা করা হয়েছে। অতঃপর, তাঁর প্রতি জনগণের আস্থা আছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্যে তিনি ২১শে মার্চ (১৯৮৫) তারিখে গণভােট’ অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেন। একই সঙ্গে এরশাদ সাহেব দেশে পুনরায় আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও দফতর এবং বিশেষ সামরিক আইন আদালত পুনর্বহালের কথা ঘােষণা করেন। এছাড়াও, সর্বপ্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ এবং দেশে সকল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করা হয়। অতঃপর ২রা মার্চ (১৯৮৫) তারিখে নির্বাচন কমিশন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচন সংক্রান্ত কর্মসূচী বাতিল ঘােষণা করে।
৩৬। ৬ই এপ্রিল (১৯৮৫) তারিখে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচন বাতিল ঘােষিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহলে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের ১৪ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৫) তারিখে উক্ত নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়। এ প্রসংগে উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত এরশাদ সাহেবের সমর্থক ও সহযােগিতাকারী জনদলের সাংগঠনিক অস্তিত্ব কিংবা জনসমর্থন বা জনপ্রিয়তা ছিল না বললেই চলে। তাছাড়া তখন ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের দাবীর
পৃষ্ঠাঃ ৩২৫
প্রেক্ষিতে মন্ত্রী পরিষদ, আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসকের পদ ও দফতর এবং বিশেষ সামরিক আইন আদালত বিলুপ্ত করা হয়েছিল। সর্বোপরি, সংবিধানের মৌলিক ধারাসমূহও পুনর্বহাল করা হয়েছিল। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের তখন সংসদ নির্বাচন বর্জন করার সিদ্ধান্তকে অনেকেই রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতা, অদূরদর্শিতা ও অবিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
৩৭। ইতিপূর্বে একদিন ছেলে জয় আমাকে কিছুটা অভিযােগের সুরে বলে, “আম্মু সারা দিনরাত রাজনীতি নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকায় আমাদের জন্যে বিশেষ সময় দিতে পারে না। রােজ সকালে বেরিয়ে যায়। কোনদিন দুপুরে বাসায় ফেরে, আবার কোনদিন ফেরে না। কোনও দিন রাতে এগারাে-বারােটার আগে বাসায় ফেরে না। তাছাড়া রাজনীতির কারণে আম্মুকে সরকার কয়েক মাস পরপরেই ঘরে বন্দী করে রাখে। এ অবস্থায় আমাদের লেখাপড়ার ভীষণ অসুবিধা হয়। কাজেই, আব্বু, আমাদেরকে ইন্ডিয়ার কোন বাের্ডিং স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করাে।” হাসিনাও ছেলেমেয়েদের এই প্রস্তাবে রাজি হয়। অতঃপর, হাসিনা এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী জনাব আজিজ সাত্তারের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে। তাঁর কাছ থেকে ভারতের উত্তর প্রদেশের পাহাড়ী শহর নৈনীতালস্থ স্কুলের ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়। অতঃপর, ১২ই মার্চ (১৯৮৫) তারিখে রেহানা ও আমি ছেলে জয় ও মেয়ে পুতলিকে নিয়ে দিল্লী হয়ে নৈনীতাল যাই। তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন জনাব আজিজ সাত্তার, বেগম সাত্তার ও তাঁদের ঘােট মেয়ে। তাঁদের সব ছেলে ও মেয়ে নৈনীতালস্থ মিশনারী স্কুলে পড়াশুনা করেছে। সেবার, জনাব আজিজ সাত্তার কাকা জয় ও পুতলির নৈনীতালস্থ স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে যে সাহায্য-সহযােগিতা করেছেন তা কোনদিনই বিস্তৃত হবার নয়। উল্লেখ্য, নৈনীতালস্থ মিশনারী স্কুলগুলাে অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ছেলেমেয়েদের মানুষ করা ও লেখাপড়া শেখানােই তাদের প্রধান ব্রত। প্রতি ছাত্রের জন্য খাওয়া-দাওয়া ,হােস্টেলভাড়া, বইপত্র, স্কুল ফি, চিকিৎসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়াদির খরচ বাবদ প্রতিবছরে বিল হয় ভারতীয় মুদ্রায় পাঁচ হাজার রূপীর মত। তাদের শুধু একটাই শর্ত। তা হচ্ছে, নাবালক ছেলেদের এবং বয়স নির্বিশেষে মেয়েদের শিক্ষাবর্ষের শুরুতে স্কুলে রেখে আসা এবং শিক্ষাবর্ষ শেষে স্কুল থেকে নেওয়ার সময় তাদের বাবা কিংবা মায়ের উপস্থিতির আবশ্যকতা।
৩৮। ২১শে মার্চ (১৯৮৫) তারিখে দেশে গণভােট অনুষ্ঠিত হয় তৎকালীন সেনাবাহিনী চীফ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও (স্বঘােষিত) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ওপর জনগণের আস্থা আছে কিনা তা যাচাইয়ের জন্যে। উক্ত গণভােটে এরশাদ সাহেব বিপুল আস্থাভােট পেয়েছিলেন বলে নির্বাচন কমিশন ঘােষণা করে। ২৪শে মার্চ (১৯৮৫) তারিখে এরশাদ সাহেবের মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করেন তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার দ্বিতীয় পুত্র ও তৎকালীন ইত্তেফাকের সম্পাদক আনােয়ার হােসেন মঞ্জু। ৯ই
পৃষ্ঠাঃ ৩২৬
এপ্রিল (১৯৮৫) তারিখে নির্বাচন কমিশন ১৬ই ও ২০শে মে (১৯৮৫) তারিখে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা দেয়। ১৬ই মে (১৯৮৫) তারিখে প্রথম ২৫১টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশিষ্ট উপজেলাগুলােয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০শে মে (১৯৮৫ তারিখে। ২৫শে মে (১৯৮৫) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান।
৩৯। ৩রা জুলাই (১৯৮৫) তারিখে এরশাদ সাহেব পুনরায় জনদলের নেতৃস্থানীয় ১১ জন নেতাকে তাঁর মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯শে জুলাই (১৯৮৫) তারিখে এরশাদ সাহেব আরও ১ জন মন্ত্রী, ১ জন উপমন্ত্রী ও ১ জন উপদেষ্টা নিয়ােগ করেন। ২৩শে জুলাই (১৯৮৫) তারিখে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে দীর্ঘ ৫ মাস বন্ধ থাকার পর পুনরায় ক্লাস শুরু করে। ২রা আগস্ট (১৯৮৫) তারিখে এরশাদ সাহেব আরও ৪ জন মন্ত্রী নিয়ােগ করেন। ৫ই আগষ্ট (১৯৮৫) তারিখে এরশাদ সাহেবের মন্ত্রী পরিষদে যােগদান করেন বি. এন. পি-এর বিশিষ্ট নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ১৬ই আগস্ট (১৯৮৫) তারিখে জনদল ভেঙ্গে দিয়ে এরশাদ সাহেব গঠন করেন পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি জাতীয় ফ্রন্ট’। ১৭ই সেপ্টেম্বর (১৯৮৫) তারিখে সামরিক সরকার দেশে ১লা অক্টোবর (১৯৮৫) থেকে পুনরায় ঘরােয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৫ই অক্টোবর (১৯৮৫) তারিখে সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ইন্তেকাল করেন। ১১ই নভেম্বর (১৯৮৫) তারিখে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ১৫ই ডিসেম্বর (১৯৮৫) তারিখে এক রেডিও ও টিভি ভাষণে এরশাদ সাহেব দেশে ১লা জানুয়ারী (১৯৮৬) তারিখ থেকে পুনরায় রাজনৈতিক তৎপরতার অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন।
৪০। ১লা জানুয়ারী (১৯৮৬) তারিখে এরশাদ সাহেব নিজেকে (অঘােষিত) চেয়ারম্যান করে গঠন করেন ‘জাতীয় পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল। ২রা মার্চ (১৯৮৬) তারিখে এক রেডিও ও টিভি ভাষণে এরশাদ সাহেব ২৬শে এপ্রিল (১৯৮৬) তারিখে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। এর পর ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের পক্ষ থেকে হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি আহ্বান জানানাে হয় প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে তাঁদের প্রত্যেকে ১৫০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য। এরই প্রেক্ষিতে সামরিক সরকার সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থীর একসঙ্গে ৫টির বেশী আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সীমাবদ্ধতা আরােপ করে একটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ই মার্চ (১৯৮৬) তারিখে। ইত্যবসরে, ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয় ঘােষণা দেয় ২২শে মার্চ (১৯৮৬) তারিখে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালনের কর্মসূচী।
৪১। ২১শে মার্চ (১৯৮৬) তারিখ সন্ধ্যায় ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের নেতৃবৃন্দ স্ব জোটের আলােচনা বৈঠকে মিলিত হন। ঐদিনই রাত সাড়ে আটটায় এরশাদ সাহেব রেও ও টিভিতে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে তিনি প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য
পৃষ্ঠাঃ ৩২৭
বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতি পুনরায় আহ্বান জানান। অন্যথায় সামরিক আইনের আওতায় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতাদের হুশিয়ার করে দেন। সেদিন ১৫ দলের বৈঠক শেষে হাসিনা, আওয়ামী লীগের আব্দুল মান্নান, আমির হােসেন আমু, তােফায়েল আহমদ, আব্দুল জলিল, সাজেদা চৌধুরী, বেগম মতিয়া চৌধুরী, প্রমুখ নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে করে আমাদের মহাখালীস্থ আণবিক শক্তি আবাসিক কলােনীর ফ্ল্যাটে ফেরে রাত আড়াইটার দিকে। তাঁদের কাছ থেকে আমি জানতে পারি যে, ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয় প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু পরদিন অর্থাৎ ২২শে মার্চ (১৯৮৬) তারিখের সকালে রেডিওতে কেবলমাত্র ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়। সেদিন সারাদিন ৭ দলীয় ঐক্যজোট কিংবা অন্য কোন দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
৪২। ২২শে মার্চ (১৯৮৬) তারিখে ছিলাে ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের সকাল-সন্ধ্যা সারাদেশে হরতাল পালনের কর্মসূচী। কিন্তু উপরােল্লিখিত কারণে হরতাল পালনে আগের মতাে তেমন কোন জোর ত্যপরতা বা কর্মচাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়নি। সেদিন সন্ধ্যা ৭টায় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডস্থ বাসভবনে নির্ধারিত ছিলাে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের নেতাদের আলােচনা বৈঠক। আমি সেখানে পৌছাই পৌনে আটটার দিকে। উক্ত সভা থেকে এক এক করে বেরিয়ে এসে আমার সঙ্গে কথাবার্তা বলেন আওয়ামী লীগের আব্দুল জলিল, আমির হােসেন আমু এবং তৎকালীন বাকশালের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। সবার শেষে আমার সঙ্গে একান্তে আলাপ করেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেনন। প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে আমি তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে রাশেদ খান মেনন বলেন, “ওয়াজেদ ভাই, একথা সত্য যে, গতরাতে আমরা ১৫ ও ৭ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের নেতারা পারস্পরিক আলাপ-আলােচনার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার। কিন্তু আজ দুপুরে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনের আলাপে মনে হলাে তিনি, নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি নন। এই সভায় আসার আগেও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমি এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু তিনি ইতিবাচক কোন কথা দেননি। আমি জানি, বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে আপনার সুসম্পর্ক রয়েছে। অতএব, আপনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝালে বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হতে পারেন।” রাশেদ খান মেননের এ প্রস্তাবের জবাবে আমি তাঁকে বললাম, “এগুলাে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এ সমস্ত ব্যাপারে তােমাদের আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন হবে।” এর প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমি সেখান থেকে চলে আসি। পরদিন অর্থাৎ ২৩শে মার্চ (১৯৮৬) তারিখে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জানা
পৃষ্ঠাঃ ৩২৮
যায় যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের নির্মল সেন, রাশেদ খান মেনন, দিলীপ বড়ুয়ার তিনটি দলসহ মাওবাদী বামপন্থী পাঁচটি দল এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় ঐক্যজোট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার। ১৫ দলীয় ঐক্যজোটের অবশিষ্টাংশ, আ. স. ম. আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগের বিভিন্ন উপদল এবং আরও বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল প্রস্তাবিত সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ইত্যবসরে, সংসদ নির্বাচনের তারিখ ২৬শে এপ্রিলের পরিবর্তে ৭ই মে (১৯৮৬) তারিখ চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করা হয়।
৪৩। ২৩শে মার্চ (১৯৮৬) তারিখে এরশাদ সাহেবের পূর্ব ঘােষণা মােতাবেক সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু ব্যক্তিরা তাঁর মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২রা এপ্রিল (১৯৮৬) তারিখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী, প্রগতিশীল, প্রাজ্ঞ বিচারপতি মােহাম্মদ হােসেন ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গভীর শােক ও সমবেদনা ব্যক্ত করেন। সেদিন আমিও মরহুমের বাসায় গিয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ২৯শে এপ্রিল (১৯৮৬) তারিখে সামরিক সরকার দেশে নির্বাচনবিরােধী যে কোন তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোেষণা করে। ৪ঠা মে (১৯৮৬) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র গ্রুপের সঙ্গে বি. এন. পি-এর অঙ্গদল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বাধীন ছাত্র গ্রুপের সংঘর্ষ ঘটলে ছাত্রদের ছাত্রাবাস ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়।
৪৪। ৭ই মে (১৯৮৬) তারিখে দেশে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত নানান প্রকারের হিংসাত্মক ঘটনায় বহুলােক আহত এবং ১৯ জন নিহত হয়। ১০ই মে (১৯৮৬) তারিখ পর্যন্ত ঘােষিত ফলাফলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ঐক্যজোট বিপুলসংখ্যক আসনে অনেক ভােটের ব্যবধানে অগ্রগামী ছিল। এর পর, তিন-চার দিনের জন্যে নির্বাচনী ফলাফল ঘােষণা বন্ধ রাখা হয়। অতঃপর পুনরায় নির্বাচনের ফলাফল ঘােষণা শুরু করা হয় এবং তা শেষ হয় ১৯শে মে (১৯৮৬)। তারিখে। ঐ দিনের রেডিও ও টিভির সংবাদে সরকারী দল জাতীয় পার্টি নির্বাচনে ১৫৮টি আসনে জয়লাভ করে সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে বলে ঘােষণা দেয়া হয়। উক্ত সংবাদ বুলেটিনে আরও বলা হয় যে, তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ঐকজোট ৯৬টি আসন, জামাতে ইসলামী ১০টি আসন, আ. স. ম. আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৪টি আসন এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র দলগুলাে ১০টি আসন এবং নির্দলীয় প্রার্থীরা ২২টি আসনে জয়লাভ করে। ঐদিন এক সাংবাদিক সম্মেলনে ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন যে, এরশাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকার নির্বাচনে ভয়ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়ােগে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জালভােট প্রদান এবং সর্বোপরি, সরকারী।
পৃষ্ঠাঃ ৩২৯
প্রশাসনিক যন্ত্রসহ নির্বাচন কমিশনকে ভীতি প্রদর্শনে সরকারের পক্ষে ব্যবহার করে মিডিয়া কুর মাধ্যমে ৮ দল দলীয় ঐক্যজোটের (প্রকৃত) বিজয়কে নস্যাৎ করা হয়েছে।
৪৫। ১৫ই জুন (১৯৮৬) তারিখে এরশাদ সাহেব একটি অধ্যাদেশে গঠন করেন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দেহরক্ষী বাহিনী। ২৮শে জুন (১৯৮৬) তারিখে প্রবীণ রাজনীতিবিদ হাজি দানেশ ৮৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ৭ই জুলাই (১৯৮৬) জাতীয় পার্টির ৩০ জন মহিলাকে সংসদে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৩০টি আসনে নির্বাচিত ঘােষণা করা হয়। ৯ই জুলাই (১৯৮৬) এরশাদ সাহেব নতুন মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ছাড়া, উক্ত মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্যরা ছিলেন জাতীয় পার্টির সদস্য। মিজানুর রহমান চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা নিযুক্ত করা হয়। জাতীয় পার্টির শামসুল হুদা চৌধুরী সংসদ স্পীকার নির্বাচিত হন। ১০ই জুলাই (১৯৮৬) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশন। উক্ত অধিবেশনে এরশাদ সাহেব ভাষণ দেন। আ. স. ম. আব্দুর রবের জাসদ এবং স্বন্ত্র সদস্যরা ব্যতীত সকল বিরােধী দলের সদস্যরা উক্ত অধিবেশন বর্জন করেন।
৪৬। ২০শে আগস্ট (১৯৮৬) তারিখে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ৮৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ২৬শে আগস্ট (১৯৮৬) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় সংসদের ৮টি আসনের উপনির্বাচন। উক্ত উপনির্বাচনে প্রকাশ্যে বল প্রয়োেগ, ব্যালট বাক্স ছিনতাই ও সরকারী প্রার্থীদের পক্ষে জালভােট প্রদানের মাধ্যমে ৮টি আসনেই জাতীয় পার্টির প্রার্থীদেরকে জয়যুক্ত করা হয়। ২৮শে আগস্ট (১৯৮৬) তারিখে তৎকালীন মেজর জেনারেল আতিকুর রহমানকে সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়। ১লা সেপ্টেম্বর (১৯৮৬) তারিখে তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল এইচ. এম. এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পার্টিতে যােগদান করে নিজেকে তার চেয়ারম্যান ঘােষণা করেন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর (১৯৮৬) তারিখে এরশাদ সাহেব নিজেকে লেঃ জেনারেলের পদে উন্নীত করে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ইত্যবসরে, এক সরকারী ঘােষণায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে নির্ধারণ করা হয় ১৫ই অক্টোবর (১৯৮৬) তারিখ।
৪৭। উক্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনােনয়নপত্র দাখিলের জন্য নির্ধারণ করা হয় ১৭ই সেপ্টেম্বর (১৯৮৬)। মনােনয়নপত্র দাখিলের তারিখের চার-পাঁচ দিন আগে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, ৭ দলীয় ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে উক্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে সুপারিশ করা হয়েছে। অপরদিকে, ৮ দলীয় ঐক্যজোট সিদ্ধান্ত নেয় এই মর্মে যে, বেগম খালেদা জিয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলে ম্যাডাম হাসিনা হবেন এই ঐক্যজোটের প্রার্থী। মনােনয়ন দাখিলের আগের দিন সকাল ১০টার দিকে বি. এন. পি-এর অন্যতম বিশিষ্ট নেতা ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া হাসিনার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা করার জন্যে আমাদের
পৃষ্ঠাঃ ৩৩০
মহাখালীস্থ আণবিক শক্তি আবাসিক কলােনীর ফ্ল্যাটে আসেন। তাঁদের আলােচনার সময় আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এরশাদ যদি কোনক্রমে উক্ত নির্বাচনে বিজয়ী হন তাহলে তিনি (এরশাদ) বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের কাছ থেকে বৈধভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। এর ফলে এরশাদের অবস্থান শুধু শক্তিশালীই হবে না, এরশাদবিরােধী আন্দোলনও দুর্বল হয়ে যেতে পারে। অতএব, সাব্যস্ত হয় যে হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া এই দুই নেত্রীর কেউই প্রস্তাবিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। অতঃপর, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া আমাদের বাসা থেকেই টেলিফোনে বেগম খালেদা জিয়াকে তৎমর্মে অবহিত করেন। তখন তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে এও বলেন যে, উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে আমার উপস্থিতিতেই।
৪৮। ১৭ই সেপ্টেম্বর (১৯৮৬) তারিখে এরশাদ সাহেব প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনােনয়নপত্র দাখিল করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ঐক্যজোট, বি. এন. পি. নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় ঐক্যজোট, মাওবাদী বামপন্থী ৫ দলীয় ঐক্যজোট এবং জামাতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। যাহােক, এরশাদসহ, খুনী লেঃ কর্নেল (অবঃ) ফারুক, কয়েকটি ক্ষুদ্র ও নামসর্বস্ব দলের প্রার্থী এবং রাজনীতিতে অপরিচিত কয়েকজন প্রার্থীদের নিয়ে মােট ১৬জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন উক্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের বিরােধিতায় সামরিক সরকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনবিরােধী যে কোন তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। অতঃপর, ১৫ই অক্টোবর (১৯৮৬) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ঐ দিনই হসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিপুল ভােটে নির্বাচিত হয়েছেন বলে ঘােষণা করা হয়। উল্লেখ্য, ৮ দল, ৭ দল, ৫ দল ও জামাতে ইসলামীর আহবানে সেদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হরতাল পালিত হয়। ২৩শে অক্টোবর (১৯৮৬) তারিখে লেঃ জেনারেল (অবঃ) এইচ. এম. এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
৪৯। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর শুরু হয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের জাতীয় পার্টির সদস্যভূক্ত করার লীলাখেলা। অতঃপর মন্ত্রিত্ব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে বিভিন্ন আকর্ষণীয় পদ ও অর্থের লােভে ২২ জন স্বতন্ত্র সদস্যের প্রায় সবাই জাতীয় পার্টিতে যােগদান করেন। ১০ই নভেম্বর (১৯৮৬) তারিখে সরকারী দল, আ. স. ম. আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), ক্ষুদ্র দলের কয়েকজন সদস্য এবং স্বতন্ত্র সদস্যদের সহযােগিতায় সংসদে পাস করিয়ে নেয় সংবিধান সপ্তম সংশােধনী। উক্ত সপ্তম সংশােধনীর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ই নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইনের ক্ষমতাবলে গৃহীত ও কৃত সকল পদক্ষেপ, ক্রিয়াকলাপ ও কার্যক্রমকে বৈধ করে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, মুক্তিযােদ্ধা ও তৎকালীন বাকশালের বিশিষ্ট নেতা লতিফ সিদ্দিকীর পত্নী ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য লায়লা সিদ্দিকী সপ্তম সংশােধনীর পক্ষে ভোেট দেন। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয়
পৃষ্ঠাঃ ৩৩১
ঐক্যজোট এবং জামাতে ইসলামীর সংসদ সদস্যরা সপ্তম সংশােধনীর বিপক্ষে ভােট প্রদান করেন। যাহােক, ঐদিনই সারাদেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। অতঃপর ১৩ই নভেম্বর (১৯৮৬) তারিখে ইতিপূর্বে সামরিক আদালতে ৪২ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা ও তৎকালীন বাকশালের নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ৩০শে নভেম্বর (১৯৮৬) তারিখে এরশাদ সাহেব তাঁকে এবং তাঁর দলকে যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচনদ্বয়ে বিজয়ী করার ব্যাপারে সহযােগিতা করার জন্যে তাঁর (এরশাদের। কৃতজ্ঞতার প্রতীক স্বরূপ তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি নুরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন।
৫০। এদিকে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রধান হিসেবে ম্যাডাম হাসিনা সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী নির্বাচিত হন। অতঃপর আওয়ামী লীগের আব্দুল মালেক উকিলকে সংসদে বিরােধী দলীয় উপনেতা নিযুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ঐক্যজোট ঘােষণা দেয় যে, জোটের সংসদ সদস্যরা সংসূদে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের জনস্বার্থবিরােধী, কাণতান্ত্রিক, স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী কার্যক্রম’ও ক্রিয়াকলাপের বিরােধিতা করবেন। ৮ দলীয় ঐক্যজোট আরও ঘােষণা করে যে, তারা সংসদের বাইরে অন্যান্য সমমনা ও সমমতাবলম্বী দলগুলাে ও জনগণের সঙ্গে গণতান্ত্রিক পন্থায় সংগ্রাম ও আন্দোলন চালিয়ে যাবে স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে দেশে জনগণের নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট জবাবদিহিমূলক দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক সরকার, শাসন ব্যবস্থা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্যে। ৫ দলীয় পিকিং (বেজিং পন্থী ঐক্যজোটও অনুরূপ ঘােষণা দেয়। অপরদিকে, বি. এন. পি. নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় ঐক্যজোট ও জামাতে ইসলামী স্বৈরতন্ত্র তথা এরশাদ সরকারকে উৎখাত করার সংগ্রাম ও আন্দোলন অব্যাহত রাখার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে।
৫১। ১লা জানুয়ারী (১৯৮৭) তারিখে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন শিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি. এ. এল)-এর তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন। উক্ত অধিবেশনে উদ্বোধনী ভাষণে ম্যাডাম হাসিনা বলেন, . . . “আমরা সুদীর্ঘকালের সংগ্রাম শেষে রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, জীবন দিয়ে হলেও আমাদের সেই স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ভিত্তিতে শশাষণহীন সােনার বাংলা গড়ে তােলার লক্ষ্যে যে কোন মূল্যে চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। নির্বাচিত সার্বভৌম জাতীয় সংসদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা করে বাংলাদেশকে একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশরূপে আমরা গড়ে তুলতে চাই।”. . . এক পর্যায়ে দেশের সামরিক বাহিনীর উদ্দেশ্যে ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “আওয়ামী লীগ যে কোন মূল্যে আমাদের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর। সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের হাতিয়ারে পরিণত না করে সংবিধানে
পৃষ্ঠাঃ ৩৩২
লিপিবদ্ধ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার যে পবিত্র দায়িত্ব সেনাবাহিনীর উপর অর্পিত (রয়েছে) তা রক্ষা করা এবং সেনাবাহিনীকে জনগণের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় না করিয়ে জনগণের আস্থাভাজন সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানাে এবং তার সত্যিকার উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য।” তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনের শেষে হাসিনা ও বেগম সাজেদা চৌধুরী আওয়ামী লীগের যথাক্রমে সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদিকা নির্বাচিত হন।
৫২। ১৪ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৭) তারিখে ঢাকায় ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। ১৬ই ফেব্রুয়ারী ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ২১শে এপ্রিল (১৯৮৭) সরকার একটি শিক্ষা কমিশন গঠন। করেন। ২১শে জুন (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের আহবানে দেশব্যাপী। পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ২৬শে জুন (১৯৮৭) তারিখে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগ নেতৃত্বাধীন এবং বি. এন. পি. -এর অংগ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতৃত্বাধীন দুই ছাত্র গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ১২ই জুলাই (১৯৮৭) তারিখে সরকার জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) সংশােধনী বিল তাড়াহুড়াে করে কয়েক মিনিটের মধ্যে পাস করিয়ে নেয়। উক্ত বিলের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনে জড়িত করার ব্যবস্থা করা হয়। ৮ দলীয় ঐক্যজোটের সংসদ সদস্যরা উক্ত বিল পাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদ থেকে বেরিয়ে আসেন। পরদিন অর্থাৎ ১৩ই জুলাই (১৯৮৭) তারিখে ৮ দলীয় ঐক্যজোটের আহবানে উক্ত বিল পাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ১৪ই জুলাই (১৯৮৭) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্র গ্রুপ এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতৃত্বাধীন ছাত্র গ্রুপের মধ্যে তুমুল সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটে যার ফলে অনেক ছাত্র আহত ও দুই জন নিহত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করে। ১৮ই জুলাই (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে ঘােষণা করে জেলা পরিষদ বিল পাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ২২শে জুলাই (১৯৮৭) তারিখ থেকে সারাদেশে বিরতিহীন ৫৪ ঘন্টা সর্বাত্মক হরতালের কর্মসূচী। এই হরতাল কর্মসূচী সাফল্যজনকভাবে পালিত হয়। ২৪শে জুলাই (১৯৮৭) তারিখে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় ৮ দলীয় ঐক্যজোট ৩০শে জুলাই (১৯৮৭) তারিখে সারা ঢাকায় বিক্ষোভ ও রাষ্ট্রপতির সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচী ঘােষণা করে। বি. এন. পি. ৩০শে জুলাই (১৯৮৭) তারিখের কর্মসূচীতে যােগদান করে কিন্তু রাষ্ট্রপতির সচিবালয় ঘেরাও করতে অস্বীকার করে। অতঃপর ১লা আগষ্ট (১৯৮৭) তারিখে এরশাদ সাহেব বাধ্য হয়ে জেলা পরিষদ বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্যে সংসদে ফেরত পাঠান।
৫৩। ১২ই আগস্ট (১৯৮৭) তারিখে সারাদেশে পালিত হয় শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ আহূত ২৪ ঘন্টা হরতাল। ১৩ই আগষ্ট (১৯৮৭) তারিখ সরকার দৈনিক বাংলার বাণী
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৩
পত্রিকার প্রকাশনা অনির্দিষ্টকালের জন্যে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ১৬ই আগস্ট (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে ঘােষণা করে ৭ই অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে ঢাকা অবরােধ কর্মসূচী। ২৮শে আগস্ট (১৯৮৭) তারিখে এরশাদ সাহেব এক ঘােষণায় রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতি ৭ই সেপ্টেম্বর (১৯৮৭) তারিখে বঙ্গভবনে আলােচনা বৈঠকের আহবান জানান। ২৯শে আগস্ট (১৯৮৭) তারিখে ৮ দলীয় ঐক্যজোট এরশাদ সাহেবের উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ৩রা সেপ্টেম্বর (১৯৮৭) তারিখে ৭ দলীয় ঐক্যজোটও এরশাদ সাহেবের উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ১৪ই সেপ্টেম্বু (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয় দেশে ভয়াবহ বন্যায় উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ঢাকা অবরােধের কর্মসূচী ৭ই অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখের পরিবর্তে ১০ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ই অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদে বিরােধী দলের উপনেতা আব্দুল মালেক উকিল ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ১৯শে ও ২০শে অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে পালিত হয় শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্যপরিষদ আহূত বিরতিহীন ৪৮ ঘন্টার হরতাল। ২১শে অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে অনুষ্ঠিত হয় প্রস্তাবিত ঢাকা অবরােধ কর্মসূচীর ব্যাপারে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের প্রতিনিধিদের বৈঠক। ২৪শে অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে সরকার বিরােধী ঐক্যজোটত্রয়ের ‘ঢাকা অবরােধ কর্মসূচীকে বেআইনী ঘােষণা করে। ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোট সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ইতিপূর্বে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে ঘােষণা করে ২৬শে অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে উপজেলা সদরসমূহ এবং ১লা নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে জেলা সদরসমূহ ঘেরাও কর্মসূচী। ২৬শে অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে ‘উপজেলা সদরসমূহ’ ঘেরাও কর্মসূচী যথাযথভাবে পালিত হয়।
৫৪। ২৮শে অক্টোবর (১৯৮৭) তারিখে সন্ধ্যা ৬টার দিকে হাসিনা মহাখালীস্থ আণবিক শক্তি কমিশনের আবাসিক কলােনীর ফ্ল্যাটে আমাকে টেলিফোনে জানায় যে, বেগম খালেদা জিয়া বি. এন. পি. -এর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যে ৭টার দিকে সেখানে আসবেন তাঁর ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সাথে আলাপ-আলােচনার জন্যে। হাসিনা আমাকে আরও বলে যে, আমি যেন আণবিক শক্তি কমিশনের গেস্টহাউসের বৈঠকখানাটি তদুদ্দেশ্যে বন্দোবস্ত করে রাখি। বেগম খালেদা জিয়া কয়েকজন বি. এন. পি.-এর শীর্ষস্থানীয় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে আসেন রাত পৌনে সাতটার দিকে। হাসিনা তখনও সেখানে পৌঁছায়নি। অতএব আমি বেগম খালেদা জিয়া ও বি. এন. পি. -এর অন্যান্য নেতাদের আণবিক শক্তি কমিশনের গেস্টহাউসের বৈঠকখানায় নিয়ে যাই। অনেক সাংবাদিক ও বি. এন. পি.-এর কর্মীদের ভিড়ে সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় আমি বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দলীয় নেতৃবৃন্দদেরকে গেস্টহাউসের একটি কক্ষে বসানাের ব্যবস্থা করি। হাসিনা আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৪
পৌছায় সােয়া সাতটায়। কিছু কথাবার্তার পর নেতৃবৃন্দরা আমার ফ্ল্যাটের বৈঠকখানাটি সাব্যস্ত করেন আলােচনা বৈঠকের জন্যে। অতঃপর তাঁরা সবাই চলে আসেন আমার ফ্ল্যাটের বৈঠকখানায়। নেতা-নেত্রীদের অনুরােধে আমিও সেখানে উপস্থিত থাকতে বাধ্য হই। প্রায় এক ঘন্টা ধরে আলােচনার পরও তাঁরা আন্দোলনের দাবীনামার ব্যাপারে মতৈক্যে পৌছতে ব্যর্থ হলে আমি তাঁদেরকে সবিনয়ে বললাম, “আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালাবেন শুধু এই মর্মে আজকের মতাে একটি যৌথ ঘোেষণা দিন। এর ফলে সরকারবিরােধী আন্দোলনে সঞ্চারিত হবে দারুণ গতি ও শক্তি। ইত্যবসরে, বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে আন্দোলনের দাবীনামা ও অন্যান্য কর্মসূচী সাব্যস্ত করা নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।”
৫৫। এরপর নেতৃবৃন্দ আরও কিছু কথাবার্তা বলে দুই নেত্রীর নামে একটি যৌথ ঘোেষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত মােতাবেক তৎক্ষণাৎ একটি যৌথ ঘােষণাপত্র তৈরী করা হয়। অতঃপর নেতৃবৃন্দ পুনরায় গেস্টহাউসের বৈঠকখানায় গিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের উক্ত ঘােষণাপত্রটি পাঠ করে শােনান। উক্ত যৌথ ঘােষণায় বলা হয়, “স্বৈরাচারী (এরশাদ) সরকারের পতন ঘটানাের জন্যে আমরা ১লা ও ১০ই নভেম্বরসহ আন্দোলনের সকল। কর্মসূচীর সাফল্যের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবাে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে ১৯৭১-এর চেতনা পুনরুজ্জীবিত করা আমাদের লক্ষ্য। এরশাদের স্বৈরাচারী) সরকারের পদত্যাগের লক্ষ্যে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আমরা আহবান জানাই।” উল্লেখ্য, উক্ত ইশতেহার দুই নেত্রীর নামে ঘােষিত হলেও তাতে কেউই স্বাক্ষর করেননি। এই ঘােষণার মধ্যদিয়ে সেদিন সমাপ্ত হয় দুই নেত্রীর শীর্ষবৈঠক। সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় বেগম খালেদা জিয়া কতিপয় সাংবাদিককে বলেন, “আজকের আলােচনা বৈঠকের আয়ােজন করার জন্যে আমরা ডঃ ওয়াজেদকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।”
৫৬। ১লা নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের জেলা দফতরসমূহ ঘেরাও কর্মসূচী যথাযথভাবে পালিত হয়। ইতিপূর্বে উপজেলা দফতর ঘেরাও কর্মসূচী পালনের সময় ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের বহু স্থানীয় নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ২রা নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সরকার চারজন সংসদ সদস্যসহ ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের দুইশতেরও বেশী নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করে। ৮ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে এক সরকারী প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা শহরে পাঁচ বা ততােধিক লােকের মিছিল ও সমাবেশ ১৫ই নভেম্বর (১৯৮৭) পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। ঐদিনই সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘােষণা করে। ৯ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সরকার দেশের কয়েকটি ফেরীঘাট ও ঢাকামুখী যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ করে দেয়।
৫৭। ১০ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে ছিল ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের এরশাদ সরকার পদত্যাগের দাবীতে আহূত ‘ঢাকা অবরােধ কর্মসূচী। সরকার ঘােষিত ১৪৪ ধারা
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৫
ভঙ্গ করে হাজার হাজার লোক রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের করে। বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-জনতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়। কয়েক স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মিছিলকারীদের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপসহ গুলিবর্ষণ করে। এতে চারজন নিহত এবং অনেক লােক আহত হয়। নিহতদের অন্যতম ছিল নূর হােসেন নামে এক বলিষ্ঠ সুঠামদেহী যুবক। নূর হােসেন তার জামাবিহীন শরীরের বুকে স্বৈরাচার নিপাত যাক’ এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখিয়ে নিয়ে একটি ছাত্র-জনতার মিছিলের অগ্রভাগে ছিল। মিছিলটি গুলিস্তানস্থ ‘গােলাপ শাহ মাজার হয়ে জি,পি,ও-এর সম্মুখস্থ জিরাে পয়েন্টে পৌছানাের পূর্বেই ঘাতকের বুলেট নূর হােসেনের বুক ভেদ করে বের হয়ে যায়। লুটিয়ে পড়ে নূর হােসেনের দেহ। অকুস্থানেই তাঁর মৃত্যু হয়। নূর হােসেনের শরীরের বুকে ও পিঠে লেখা ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক’ ও ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ শ্লোগান সম্বলিত ছবি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
৫৮। ১১ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সরকার ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী হাসিনা ও ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে তাঁদের স্ব স্ব বাড়ীতে অন্তরীণ করে রাখে। হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকার মিরপুর রােডের এক মিছিল থেকে এবং বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয় ঢাকার হােটেল পূর্বাণীর একটি কক্ষ থেকে। ৯ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখ রাতে বেগম খালেদা জিয়া সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১২ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সরকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিরাপত্তা বাহিনীগুলােকে দেখামাত্র গুলী করার নির্দেশ দেয়। তা সত্ত্বেও ১২ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সারাদেশে পূর্ণ হরতাল পালনের সময় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল অব্যাহত থাকে। ১৪ থেকে ১৭ই নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে প্রতিদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। এ সমস্ত দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ছাত্র-জনতার অনেক সংঘর্ষ হয়। এই সময় শত শত রাজনৈতিক, শ্রমিক ও ছাত্র নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ২১শে ও ২২শে নভেম্বর(১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় বিরতিহীন ৪৮ ঘন্টা সর্বাত্মক হরতাল। অতঃপর ২৩শে ও ২৪শে নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ২৫শে নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সরকার ঢাকার কয়েকটি স্থানে সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ২৬শে নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে চট্টগ্রাম বন্দরে ঘটে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। ২৭শে নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সরকার সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণাসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও নারায়ণগঞ্জে ‘সান্ধ্য আইন জারি করে।
৫৯। ২৮শে নভেম্বর (১৯৮৭) তারিখে এরশাদ সাহেব এক রেডিও ও টিভি ভাষণে রাজনৈতিক সমস্যার নিরসনে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আলাপ-আলােচনার প্রস্তাব দেন। ২৯শে, ৩০শে নভেম্বর ও ১লা ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখগুলােয় ৮, ৭ ও ৫ দলীয়
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৬
ঐক্যজোটগুলাের আহবানে সারাদেশে বিরতিহীন ৭২ ঘন্টা সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৩রা ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে সরকার সাপ্তাহিক ‘রােববার’ পত্রিকার প্রকাশনা অনির্দিষ্ট কালের জন্য নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ৫ই ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে জামাতে ইসলামীর ১০ জন সংসদ সদস্য সংসদপদ থেকে ইস্তফা দেন। ইত্যবসরে, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের এক সভায় জাতীয় সংসদ থেকে আওয়ামী লীগ সদস্যদের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৬ই ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে এরশাদ সাহেব তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘােষণা করেন। ১০ই ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। একই দিনে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের ১৯ জন নেতাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ১১ই ডিসেম্বর সরকার দেশে ঘরােয়া রাজনীতির অনুমতি প্রদান করে। ১২ই ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের আহবানে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। ২২শে ও ২৩শে ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের আহবানে সারাদেশে বিরতিহীন ৪৮ ঘন্টা সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অতঃপর ২৯শে ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের আহবানে শুধু ঢাকা শহরে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ৩০শে ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে আওয়ামী লীগের আব্দুল মান্নানসহ মােট ৪ জন রাজনৈতিক নেতাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
৬০। ৬ই ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখে তৃতীয় জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘােষণার পর একদিন পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এরশাদ সাহেব বলেন, সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান মােতাবেক অর্থাৎ ৬ই ডিসেম্বর (১৯৮৭) তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যেই চতুর্থ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।” এদিকে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের নেতৃত্বে পরিচালিত গণআন্দোলনে এরশাদ সাহেব নতি স্বীকার করায় সরকারী জাতীয় পার্টির নেতা ও কর্মীদের মনােবল ভেঙ্গে পড়ে দারুণভাবে। একই সঙ্গে দেশের বিপুল জনগােষ্ঠী তখন জাতীয় পার্টির হাই কমান্ড’সহ নেতা ও কর্মীদের ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ। এহেন পরিস্থিতিতে চতুর্থ সংসদের নির্বাচনে শােচনীয় বিপর্যয়ের আশংকায় জাতীয় পার্টির নেতা ও কর্মীরা নিপতিত হয় দারুণ দুশ্চিন্তায়। এই প্রেক্ষাপটে তখন বিভিন্ন মহল ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের নেতৃবৃন্দের প্রতি আকার-ইংগিতে আহবান জানায় অন্ততঃ ন্যূনতম ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে চতুর্থ সংসদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্যে। এদিকে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের নেতৃবৃন্দও পৃথকভাবে আবার কখনাে কখনাে লিয়াজোঁ কমিটির মাধ্যমে যৌথভাবে বিভিন্ন সময়ে বৈঠকে মিলিত হন পরিস্থিতি পর্যালােচনাপূর্বক নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
৬১। ঐ সময় আমি স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত হয়ে ৮ দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দের কয়েকটি আলােচনা বৈঠকে উপস্থিত থাকি। ৮ দলীয় ঐক্যজোটের অনেক নেতাই এই অভিমত ব্যক্ত
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৭
করেন যে, বেগম খালেদা জিয়ার ৭ দলীয় ঐক্যজোট নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি হলেই কেবল ৮ দলীয় এক্যজোটের উক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত হবে। ৫ দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দও একই মত পােষণ করেন। উপরন্তু, তাঁরা ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের ন্যূনতম ঐকমত্য ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে উক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তাব করেন। চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের নেতৃবৃন্দের যখন নিজেদের মধ্যে এসব আলাপ-আলােচনা বৈঠক চলছিল, তখন জানুয়ারী (১৯৮৮)-এর গােড়ার দিকে একদিন সন্ধ্যায় আমি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে যাই। তখন সেখানে বেগম খালেদা জিয়ার সভানেত্রীত্বে ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেতৃবৃন্দের আলােচনা বৈঠক চলছিল। বৈঠক শেষে, উক্ত কক্ষে আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরিচয় ও কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি তাঁদের ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে একান্তে কিছু কথাবার্তা বলার প্রস্তাব করি। আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে তখন ৭ দলীয় ঐক্যজোটের অন্যান্য নেতারা উক্ত কক্ষ ত্যাগ করেন। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থাকেন বি. এন. পি.-এর প্রফেসর জাহানারা বেগম। অতঃপর আমাকে কিছু কথা বলার অনুমতি দেওয়ার জন্য বেগম। খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি তার কাছ থেকে জানতে চাই যে, ৭ দলীয় ঐক্যজোট চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি-না। এর জবাবে বেগম খালেদা জিয়া বললেন, এরশাদের পদত্যাগের পূর্বে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের কোনও নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোন প্রশ্নই ওঠে না।” এরপর আমি তাঁর কাছ থেকে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের ন্যূনতম ঐকমত্য ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বেগম খালেদা জিয়া কোন কথাই বললেন না। যাহােক, পুনরায় তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সেখান থেকে চলে আসি। এর কয়েক দিন পর ৮ই জানুয়ারী (১৯৮৮) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের লিয়াজোঁ কমিটি এক বৈঠকে এরশাদের অধীনে চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
৬২। ২০শে জানুয়ারী (১৯৮৮) তারিখে সারাদেশে পালিত হয় ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের: আহূত হরতাল। ২০শে জানুয়ারী (১৯৮৮) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের আহূত হরতাল চলাকালে ঢাকা শহরের কয়েকটি স্থানে জাতীয় পার্টির মাস্তানদের সঙ্গে তাদের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। ২৪শে জানুয়ারী (১৯৮৮) তারিখে হাসিনা চট্টগ্রাম শহরের লালদীঘির ময়দানে পূর্বনির্ধারিত ৮ দলীয় ঐক্যজোটের জনসভায় যােগদানের উদ্দেশ্যে সেখানে যায়। ৮ দলীয় ঐক্যজোটের অনেক নেতৃবৃন্দই তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন। নেতৃবৃন্দকে সংবর্ধনা জানানাের জন্য বিপুল ছাত্র-জনতা তাের থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। সকাল সাড়ে আটটার দিকে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে নেতৃবৃন্দ পৌছান এবং লালদীঘির ময়দানে মাত্র আধঘন্টার পথ যেতে তাদের সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘন্টা।
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৮
৬৩। বিকেল পৌনে ছটায় বিশাল মিছিলসহ হাসিনা একটি ট্রাকে ফোর্ট রােডস্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের মােড়ে পৌছায়। লালদীঘির ময়দানে ভাষণ দেওয়ার পূর্বে হাসিনার আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল সেখানের আইনজীবী সমিতির মিলনায়তনে। কিন্তু পুলিশ সেখানে মুসলিম হাই স্কুলের সামনের মােড়ে হাসিনার গাড়ীকে বাধা দেয়। তখন জনৈক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে হাসিনার বাকবিতণ্ডা চলাকালে হঠাৎ মুসলিম হাই স্কুলের সামনে থেকে কে বা কারা হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলী ছোঁড়ে। তমুহূর্তে হাসিনাকে গুলীর মুখ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাঁচাতে গিয়ে সেই গুলীতে সেখানেই প্রাণ হারায় আবুল কাসেম নামে এক যুবক। এর পর শুরু হয় এক নারকীয় ঘটনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলী বর্ষণে সেখানে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। এক পর্যায়ে আদালত ভবন থেকে কয়েকশত আইনজীবী মিছিল সহকারে সেখানে গিয়ে হাসিনাকে তার গাড়ীসহ আদালত ভবনে নিয়ে যান। এরপর শুরু হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ছত্রছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী সরকারের ভাড়াকরা সশস্ত্র মাস্তান-গুণ্ডাদের সঙ্গে ছাত্র-জনতা-শ্রমিকের তুমুল সংঘর্ষ। উক্ত ঘটনায় নিহত হয় ২৫/৩০ জন এবং আহত হয় বিপুল ছাত্র-জনতা। আহত ও নিহতদের চাপে হাসপাতাল ভরে যায়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৫শে জানুয়ারী (১৯৮৮) তারিখে চট্টগ্রামে অর্ধদিবস এবং ২৬শে জানুয়ারী (১৯৮৮) তারিখে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়।
৬৪। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত ছিল ৩রা মার্চ (১৯৮৮) তারিখ। উক্ত নির্বাচনে বিরােধী দলের অংশগ্রহণ দেখানাের জন্যে এরশাদ সাহেব নিজেই অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য প্রদানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর আ. স. ম. আব্দুর রবের নেতৃত্বে গঠন করান সম্মিলিত বিরােধী দল, coP (Combined Opposition party)। অপরদিকে, উক্ত নির্বাচন বর্জন করার জন্য সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে ইতিপূর্বে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে ৩রা মার্চ সকাল ৬টা থেকে ৪ঠা মার্চ (১৯৮৮) সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিরতিহীন ৩৬ ঘন্টা সর্বাত্মক হরতালের কর্মসূচী ঘােষণা করে। উক্ত হরতাল পালিত হয় যথাযথভাবেই যার ফলে নির্বাচনের দিনে জাতীয় ওCOP-এর লােকেরা ছাড়া ভােট কেন্দ্রসমূহে ভােটারদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। এ সত্ত্বেও সরকারী প্রচার মাধ্যমগুলােয় ঘােষণা করা হয় যে, ৬০ শতাংশেরও বেশী ভােটার উক্ত নির্বাচনে ভােট প্রদান করেন। প্রহসনমূলক উক্ত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংসদের ৩০০ আসনের ২৫১টি এবং সম্মিলিত বিরােধী দল(COP) ১৯টি, ক্ষুদ্র দলগুলাে ৫টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৫টি আসন পান বলে ঘােষণা করা হয়।
৬৫। ২১শে এপ্রিল (১৯৮৮) তারিখে আ. স. ম. আব্দুর রব কয়েকজন স্বন্ত্র সদস্যকে সম্মিলিত বিরােধী দলে অন্তর্ভুক্ত করে চতুর্থ জাতীয় সংসদের বিরােধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ইতিপূর্বে দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়ােজিত জনসভায় এরশাদ সাহেব বলেন যে, যেহেতু
পৃষ্ঠাঃ ৩৩৯
বাংলাদেশের আশি শতাংশেরও বেশী লােক মুসলমান, সেহেতু ‘ইসলাম ধর্মকে জাতীয় ধর্ম হিসেবে ঘােষণা করা উচিৎ। ৩রা মার্চ (১৯৮৮) তারিখের সংসদের তথাকথিত নির্বাচনের পর বিভিন্ন সাংবাদিক সম্মেলনেও তিনি একই কথা বলেন। এরপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় উল্লেখ করা হয় যে, এরশাদ সাহেবের ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক জাতীয় সংসদে পৃথক প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থাদিসহ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তনপূর্বক ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘােষণা করার পরিকল্পনা রয়েছে। অতঃপর ১১ই মে (১৯৮৮) তারিখে এরশাদের সরকার ইসলাম ধর্মকে জাতীয় ধর্মের মর্যাদাদানের উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদে পেশ করে একটি সংবিধান অষ্টম সংশােধন (১৯৮৮) বিল। ৭ই জুন (১৯৮৮) তারিখে জাতীয় সংসদে সংবিধান অষ্টম সংশােধনী (১৯৮৮) অনুমােদিত হয়। সংবিধানের এই অষ্টম সংশােধনীর মাধ্যমে অন্যান্য বিষয়সহ সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ শিরােনামে একটি অনুচ্ছেদ সংযােজন করে তাতে বলা হয়, “ইসলাম প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় ধর্ম, তবে প্রজাতন্ত্রে অন্যান্য ধর্মও শান্তি ও সম্প্রীতিতে পালন করা যাবে।” সংবিধান অষ্টম সংশােধনীর এই বিষয় সম্পর্কে ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘােষণা করার কোন প্রয়ােজন নেই। কারণ আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের রীতিনীতি মেনে চলি। অপরদিকে, বি. এন. পি. নেত্রী ও ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এরশাদ সাহেবের এই ঘােষণাকে একটি ভণ্ডামিমূলক প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, “এরশাদ বিরােধী আন্দোলন প্রতিহত করাই এর উদ্দেশ্য।” ঐ সময়ে বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সি, আর, দত্তের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় রাষ্ট্রীয় ধর্ম বিল প্রত্যাহারের দাবীতে গঠিত হয় ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্ঠান ঐক্য পরিষদ। উক্ত সভায় এই তিন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, “এ প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও চেতনার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করতে পারে। দেশের বিভিন্ন মহলের বিরােধিতা সত্ত্বে এরশাদের সরকার ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম বিল সংসদে পাস করিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ১৩ই জুন (১৯৮৮) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস সর্বাত্মক হরতাল।
৬৬। জুন মাসের পর ১৯৮৮ সালে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে এরশাদ বিরােধী কোন আন্দোলন সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ দেশের দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বি. এন. পি.-এর মধ্যে আদর্শগত এবং রাষ্ট্রীয় সরকার ও শাসন পদ্ধতিগত ব্যাপারে মতভেদ। এ ছাড়াও, এই দল দুইটির নেতৃত্বের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে কৌশল, পথ ও পন্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে পার্থক্যও অনেকাংশে দায়ী। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিককাল অধিষ্ঠিত থাকার লক্ষ্যে এরশাদ সাহেব এই বিষয়গুলাের শুধু ব্যবহারই করেননি, তিনি এই দুইটি দলের নেতৃত্বের
পৃষ্ঠাঃ ৩৪০
বিরােধকে আরও প্রকট করে তুলতে সক্ষম হন সুচতুর কূটকৌশলে। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৮৮ সালের জুন মাসের পর হতে এই দুইটি দলের নেতৃত্বদ্বয় যতােটা সময় ব্যয় করেন এরশাদ ও তাঁর সরকারের কার্যকলাপের বিরােধিতায়, তার চেয়ে বেশী সময় ব্যয় করেন ও ব্যস্ত থাকেন পারস্পরিক সমালােচনায়। একদিকে ম্যাডাম হাসিনা জিয়াউর রহমান সাহেবের শাসন আমলে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যা, জনগণের বাড়ীঘর, দোকানপাট ও কলকারখানায় অগ্নিসংযােগ ও নারী ধর্ষণে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর লোকদের সাহায্য ও সহযােগিতাকারী শান্তিকমিটি, রাজাকার, আলবদর, আল শামস, ইত্যাদি বাহিনীর নেতা ও কর্মী এবং স্বাধীনতাবিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাের নেতা-কর্মী ও স্বাধীনতাবিরােধী অন্যান্য ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসন এবং সর্বোপরি, বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারবর্গ ও নিকট আত্মীয়-স্বজনদের আত্মস্বীকৃত খুনী ফারুক-রশিদ-ডালিম চক্রের সদস্যদের চাকুরীতে পুনর্বহালপূর্বক বাংলাদেশের বিদেশস্থ দূতাবাস ও মিশনসমূহে পদস্থকরণের কথা উল্লেখ করে বি. এন. পি.-এর তীব্র সমালােচনা করতে থাকেন। অপরদিকে, বেগম খালেদা জিয়া তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় ও বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর শাসন আমলে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে লাখ লাখ লােকের মৃত্যু হয়েছে বলে বারংবার উল্লেখ, বঙ্গবন্ধুর একদলীয় রাষ্ট্রপতি) সরকার ও শাসন প্রবর্তনের জন্য দোষারােপ এবং মুসলিম লীগ, পি. ডি. পি., জামাতে ইসলামী প্রভৃতি দলগুলাের নেতা ও কর্মীদের মতাে বঙ্গবন্ধুর সরকার ভারতের তল্পীবাহক ও তাঁবেদার সরকার ছিল বলে আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগের তীব্র সমালােচনা করতে থাকেন। দেশের এরশাদ ও তার সরকারবিরােধী এই দুইটির বৃহৎ দলের নেতৃত্বের এহেন বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রদানে জনগণ শুধু হতাশাগ্রস্তই হয়নি, বিভ্রান্তও হন দারুণভাবে। এসব কিছুর ফলশ্রুতিতে এরশাদ ও তার সরকার শুধু লাভবানই হননি, নির্বিঘ্ন ও নিঝন্ঝাটে অতিবাহিত করেন ১৯৮৮ সাল।
৬৭। ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৮৮ সালের জুন মাসের পর হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে এরশাদবিরােধী কোন গণআন্দোলন সংঘটিত করতে সমর্থ হয়নি। তিন বিরােধী ঐক্যজোটের এই ব্যর্থতার কারণ সম্পর্কেও ইতােপূর্বে কিছু আলােকপাত করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্তও প্রায় একই অবস্থা বিরাজিত ছিল। এই সময়কালে ঐক্যজোটগুলাে পৃথক ও অসংলগ্নভাবে মাত্র কিছু কর্মসূচী পালন করে। আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা এবং বি. এন. পি. নেত্রী ও ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মধ্যে চলে বক্তৃতা ও বিবৃতির লড়াই। ১৯৮৯ সালেই ম্যাডাম হাসিনা বক্তৃতা-বিবৃতি দেন প্রায় ৩৫০টি এবং বেগম খালেদা জিয়া দেন। প্রায় ৪০০টি। এগুলাের প্রায় সবগুলােতেই করা হয় পারস্পরিক সমালােচনা। এসব সমালােচনার ভাষা ছিলাে শক্ত ও বিদ্বেষমূলক। আবার কখনাে কখনাে ঐক্যের আহবানও উচ্চারিত হয়। তবে ঐক্যের সব আহবানই ছিলাে শর্তযুক্ত। শর্ত পূরণ করে না কেউই। তাই
পৃষ্ঠাঃ ৩৪১
দুই মেরুতেই অবস্থান করেন তাঁরা। একদিকে ম্যাডাম হাসিনা বলেন, ৭ দফার বিকল্প নেই। অতএব ঐক্য কেবল ৭ দফার ভিত্তিতেই হতে পারে। অপরদিকে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “কেবল এক দফার (অর্থাৎ এরশাদের পদত্যাগের দাবীর) ভিত্তিতেই ঐক্য হতে পারে।” এরশাদকে কে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছেন তা নিয়েও বেশ উত্তপ্ত বিতর্ক হয় দুই নেত্রীর মধ্যে। দু’জনেই একে অপরকে স্বৈরাচারের দোসর বলে অভিহিত করেন। দেশের দুইটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের দুই নেত্রীর এহেন বিরােধের সুযােগে এরশাদ তাঁর অদৃশ্য মহল বিশেষের কারসাজিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগ এবং বি. এন. পি.-এর অঙ্গ সংগঠন জাতীয় ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিয়ে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ফলে, উল্লিখিত সময়কালে দেশের এক শতকেরও অধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘােষিত হয়। সর্বোপরি, এসব ছাত্র সংঘর্ষে অনেক তরুণ ছাত্র ও যুবক হয় হতাহত।
৬৮। ১১ই জানুয়ারী (১৯৮৯) তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য কংগ্রেসম্যান এবং উক্ত পরিষদের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান, স্টিফেন সােলার্জ ঢাকা আসেন। মিঃ সােলার্জ সাক্ষাৎ করেন ম্যাডাম হাসিনার সঙ্গে ঐদিনই এবং এরশাদ সাহেব ও বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে ১২ই জানুয়ারী তারিখে। তিনি বলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া দেখতে আগ্রহী।” ২৪শে জানুয়ারী (১৯৮৯) তারিখে ৭ দলীয় ঐক্যজোট ও জামাতে ইসলামীর আহবানে সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। এই হরতাল কর্মসূচী ছিল আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলার জন্য। উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম শহরে ম্যাডাম সিনা ও ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশের বেপরােয়া গুলিবর্ষণে হতাহত হয় অনেক লােক। ৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৯) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও ১৩টি ছাত্রাবাস সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ ছাত্রাবাস সংসদ, বিশেষ করে ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ১৫ দলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পূর্ণ প্যানেল। নির্বাচনের এই ফলাফলে বিক্ষুব্ধ হয়ে বি. এন. পি.-এর ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একাংশ রােকেয়া হলের ছাত্রী মিছিলে হামলাসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গােলাগুলি চালিয়ে ব্যাপক ত্রাসের সৃষ্টি করে। ১৭ই ফেব্রুয়ারী (১৯৮৯) তারিখে বি. এন. পি. নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী ব্যক্ত করে। ২১শে মার্চ (১৯৮৯) তারিখে আওয়ামী লীগ জাতীয় সরকার গঠনের দাবী করে। ৩রা জুন (১৯৮৯) তারিখে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরােপের কয়েকটি দেশে দেড় মাসব্যাপী সফর শেষে দেশে ফেরেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি সিনেটের কতিপয় সদস্যসহ প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য কংগ্রেসম্যান স্টিফেন সােলার্জের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ২৮শে জুন (১৯৮৯) তারিখে দেশে নিত্যপ্রয়ােজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির অস্বাভাবিক
পৃষ্ঠাঃ ৩৪২
মূল্যবৃদ্ধি ও সরকারের বাজেটে করবৃদ্ধির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় ঐক্যজোটের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল।
৬৯। ১০ই আগস্ট (১৯৮৯) তারিখে গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির (পুরাতন) ৩২ (নতুন ১১) নম্বর রােডস্থ বাসায় কে বা কারা গ্রেনেড নিক্ষেপসহ সশস্ত্র হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা তখন ঐ বাসাতেই ছিলেন। ম্যাডাম হাসিনা এই ঘটনাকে তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা বলে অভিযোেগ করে এর জন্য ডানপন্থী ‘ফ্রিডম পার্টির খুনী ফারুক চক্রকে দায়ী করেন। ১৯শে আগস্ট (১৯৮৯) তারিখে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ম্যাডাম হাসিনার উক্ত প্রাণনাশের চেষ্টার প্রতিবাদ জানানাের জন্য লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ৩রা সেপ্টেম্বর (১৯৮৯) তারিখে ৮ দলীয় ঐক্যজোটের আহবানে ঢাকায় পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল।
৭০। ১৭ই ও ১৮ই অক্টোবর (১৯৮৯) তারিখে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় বিরতিহীন ৪৮ ঘন্টার সর্বাত্মক হরতাল। ২২শে অক্টোবর (১৯৮৯) তারিখে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের ৯টি ছাত্র সংগঠন আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের নেতৃত্ব পরিষদের কোনও অংগ সংগঠনের সঙ্গে আলাপ-পরামর্শ না করেই একতরফাভাবে ডাকসু অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাংগানাের প্রতিবাদে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ ত্যাগ করে। ১লা নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে বেগম খালেদা জিয়া পালন করেন প্রতীক অনশন ধর্মঘট। ৫ই নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। ১১ই নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে ৭ দলীয় ঐক্যজোট একতরফাভাবে এরশাদ সরকার বিরােধী আন্দোলনের কর্মসূচী ঘােষণা করে। উক্ত ঘােষণায় ২০শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং ২৮শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে সচিবালয়ের চারিদিকে অবস্থান ধর্মঘটের আহবান জানানাে হয়। ১৯শে নবেম্বর (১৯৮৯) তারিখে সরকারী দল জাতীয় পার্টি ঢাকায় আয়ােজন করে এক ‘হরতাল বিরােধী মিছিল। এরশাদ সাহেব নিজেও উক্ত মিজিলে শরীক হন। ২০শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে ঢাকায় আয়ােজিত এক জনসমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই সরকারকে হটাতে না পারলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। আজ সেমিফাইনাল, ২৮শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে হবে ফাইনাল। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা জনগণের প্রতি আহবান জানান ২৯শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে সারাদেশে পূর্ণদিবস হরতাল পালনের জন্য। ২৮শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে ৭। দলীয় ঐক্যজোটের সচিবালয়ের চারিদিকে অবস্থান ধর্মঘট ছিলাে অনেকটা শান্তিপূর্ণ। ম্যাডাম হাসিনার ঘােষিত ২৯শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখের কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে বেগম খালেদা জিয়া বাধ্য হন ২৮শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে আয়ােজিত এক সমাবেশে ২৯শে নভেম্বর তারিখে পূর্ণদিবস এবং ৩০শে নভেম্বর তারিখে অর্ধদিবস হরতাল পালনের আহবান
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৩
জানাতে। ৩০শে নভেষ্ম (১৯৮৯) তারিখ সকালে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কিছু সশস্ত্র নেতা ও কর্মী ডাকসু অফিস তছনছ করে এবং সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণ করে। ৩০শে নভেম্বর (১৯৮৯) তারিখে অর্ধদিবস হরতাল, শেষে বিকেলে আয়ােজিত আওয়ামী লীগের সভায় কে বা কারা হাতবােমা নিক্ষেপ করে। উক্ত ঘটনায় ১ জন নিহত ও ১২ জন দারুণভাবে আহত হয়। ২০শে ডিসেম্বর (১৯৮৯) তারিখে ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয় সারা ঢাকায় আয়ােজন করে এরশাদ সরকারবিরাধী বিক্ষোভ মিছিল।
৭১। ১০ই জানুয়ারী (১৯৯০) তারিখে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও তথ্য প্রচারের দাবীতে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ৯টি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ রেডিও ও টেলিভিশন ভবনদ্বয়ের সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ৩রা ফেব্রুয়ারী (১৯৯০) তারিখে আওয়ামী লীগ এরশাদ সরকারী বিরােধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে সারাদেশে উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচী পালন করে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী (১৯৯০) তারিখে ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচী। ২৫শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯০) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র লীগ এবং বি. এন. পি.-এর অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মধ্যে চলে দুই ঘন্টাব্যাপী প্রচণ্ড গােলাগুলি। এই সংঘর্ষে নিহত হয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগ নেতা চুনু। এই ঘটনার অজুহাতে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালে জন্য বন্ধ ঘােষণা করে। ২৭শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯০) তারিখে ঢাকায় ৭ দলীয় ঐক্যজোটের এক জনসমাবেশে”এরশাদ সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের (তাদের মতে) আতাত” প্রতিহত করার আহবান জানানাে হয়। ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯০) তারিখে আওয়ামী লীগের আহবানে সারা ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। ৭ই এপ্রিল (১৯৯০) তারিখে দীর্ঘ ৪০ দিন বন্ধ রাখার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খােলার ঘােষণা দেওয়া হয়। ৭ই মে (১৯৯০) তারিখে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ দেশে স্বৈরতন্ত্র অবসানের লক্ষ্যে ঘােষণা করে এক আন্দোলন কর্মসূচী।
৭২। ৬ই জুন (১৯৯০) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডাকসু ও ১৩টি হলের সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ‘ডাকসুসহ ১০টি হল সংসদে বি. এন. পি.-এর অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। ২৮শে জুন (১৯৯০) তারিখে এরশাদ সরকারের ঘােষিত বাজেটে কর বৃদ্ধির প্রতিবাদে সারাদেশে পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ৩০শে জুন (১৯৯০) তারিখে ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাকসু’ সহ হলগুলাের ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। ঐদিন নির্বাচনের ফলাফল ঘােষিত হওয়ার অব্যবহিত পর আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগ এবং বি. এন. পি.-এর অঙ্গ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মধ্যে সংঘটিত হয় এক তীব্র সশস্ত্র সংঘর্ষ। উক্ত ঘটনার অজুহাতে এরশাদ সাহেবের সরকার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৪
৭৩। ১২ই জুলাই (১৯৯০) তারিখে এরশাদ সাহেব অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলােচনা বৈঠকের প্রস্তাব করেন। ১৩ই জুলাই (১৯৯০) ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ১লা আগস্ট (১৯৯০) তারিখে সরকার মেজর জেনারেল নুরুদ্দিনকে সেনাবাহিনীর এবং কমােডাের মােস্তফাকে নৌবাহিনীর নতুন প্রধান নিয়ােগের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৩১শে আগষ্ট (১৯৯০) তারিখে মেজর জেনারেল নুরুদ্দিন সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ইত্যবসরে, দেশের বিভিন্ন মহল থেকে পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা এবং বি. এন. পি. নেত্রী ও ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি পরামর্শ দেওয়া হয় একই মঞ্চ থেকে যৌথভাবে এরশাদ সরকারবিরােধী আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য। ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও মঞ্চের ঐক্যের কথা বলেন। কিন্তু ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “মঞ্চের ঐক্যের প্রয়ােজন নেই, রাজপথের ঐক্যই স্বৈরাচারের পতন ঘটাবে।”
৭৪। ১৯৯০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসদ্বয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বি. এন. পি.-এর অংগ সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ কলহের একাধিক ঘটনা ঘটে। তবে সেপ্টেম্বর (১৯৯০) মাসের শেষের দিকে ডাকসুর’ উদ্যোগে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে একটি সফল ছাত্র কনভেনশন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অনেকাংশে অপসৃত হয়। এই কনভেনশন থেকে ‘ডাকসু এরশাদ সরকারের পতন ঘটানাের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী ঘােষণা করলে সারাদেশে সরকার বিরােধী মনােভাব চাঙ্গা হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে গণমনা সকল ছাত্র সংগঠনের মধ্যে স্বৈরতন্ত্রবিরােধী মনােভাব সম্প্রসারিত হয়। অতঃপর ডাকসুর’ তৎকালীন সহসভাপতি আমানুল্লাহ আমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগসহ অন্যান্য গণতন্ত্রমনা ও স্বৈরাচারবিরােধী ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়।
৭৫। ১০ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে ছিলাে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের সচিবালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচী। এই ঘেরাও কর্মসূচী চলাকালে সচিবালয় ও মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় পুলিশ ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের ওপর বেপরােয়াভাবে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাও পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাস্থ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ও বিদেশী সংস্থার অফিসের অনেক গাড়ীতে অগ্নিসংযােগ করে। কয়েক ঘন্টা ধরে চলে বিক্ষুব্ধ জনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ। এ সমস্ত সংঘর্ষে উল্লাপাড়া কলেজের জেহাদসহ ৫ জন নিহত এবং ৪০ জন পুলিশসহ তিন শতকেরও বেশী ছাত্র-যুবক আহত হয়। ঐ দিনই ২২টি ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে আন্দোলন পরিচালনার ঘােষণা দেয়।
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৫
৭৬। ১১ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে ছিলাে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয় আহূত সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল। ঐ দিন সকাল ১১টার দিকে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে একটি মিছিলসহ শাহবাগ চৌরাস্তার মােড়ে পৌছলে পুলিশ তাঁদের ওপর বেপরােয়াভাবে লাঠিচার্জ করে, যার ফলে ডাকসুর সহসভাপতি আমানউল্লাহ আমান, সাধারণ সম্পাদক খায়রুল কবির খােকন, আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র লীগের তৎকালীন সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিব, নাজমুল হক প্রধান, নাজিমুদ্দিন আলম ও গােলাম মােস্তাফা সুজনসহ শতাধিক ছাত্রনেতা ও কর্মী আহত হয়। পুলিশের এহেন নির্যাতনমূলক আচরণের প্রতিবাদে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১৩ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে ধর্মঘট পালনের আহবান করা হয়। ১৩ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে ধর্মঘট চলাকালে পুলিশের গুলীতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিউটিটের মনিরুজ্জামান মনিরসহ দুইজন ছাত্র নিহত ও ২৫ জন আহত হয়। ঐ দিন দুপুরে মনিরুজ্জামান মনিরের লাশ ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের। চত্বরে নিয়ে আসে। অতঃপর স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেখানে এক বিশাল ছাত্র সমাবেশ ঘটে। ছাত্রদের সমাবেশ সমাপ্ত হওয়ার পর সরকারের কতিপয় সশস্ত্র গুণ্ডা-মাস্তান বিকেল আড়াইটার দিকে বাংলা একাডেমী ও টি. এস. সির মাঝখানে অবস্থিত আণবিক শক্তি কেন্দ্রের ক্যাম্পাসে ঢুকে আটটি গাড়ী অগ্নিসংযােগে ভস্মীভুত করে। অতঃপর তারা আড়াই ঘন্টা ধরে আণবিক শক্তি কমিশনের প্রশাসনিক অফিস, আণবিক শক্তি কেন্দ্রের অফিস ও ল্যাবরেটরীর সমস্ত দরজা ও জানালার কাঁচ টুকরাে টুকরাে করে ভেঙ্গে ফেলে। আণবিক শক্তি কেন্দ্র ক্যাম্পাসসহ ঢাকার অন্যান্য স্থানে সরকারের গুন্ডা-মাস্তান দল কর্তৃক ঘটানাে এ সমস্ত ঘটনার অজুহাতে এরশাদের সরকার এক অধ্যাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করে।
৭৭। নতুন আইনের আওতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘােষণা সর্বস্তরের ছাত্র সমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। পাড়ায় পাড়ায় ও মহল্লায় মহল্লায় স্কুল ছাত্ররাও সরকার বিরােধী মিছিল সংঘটিত করতে শুরু করে। সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের কয়েকজন নেতা আহত অবস্থায় হাসপাতালে থাকাকালীন সময়ে আন্দোলনের একটা চরম মুহূর্তে ছাত্রনেতা মােস্তাফিজুর রহমান বাবুল, জাহাংগীর সাত্তার টিংকু, ফজলুল হক মিলন, নূর আহমদ বকুল, মােস্তফা ফারুক, শফী আহমেদ, অসীম কুমার উকিল, নাসিরু-উদ-দুজা, ফয়জুল হাকিম, আখতার সােবহান, মাশরুর কামাল হােসেন, আনােয়ার হােসেন মুকুল, প্রমুখ ছাত্রনেতারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় ১৪ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে। দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘটিত সংঘর্ষে ৫৫ জন ছাত্র-জনতা আহত হয়। ঐ দিনই অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের এক সভায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের ঘােষণাকে তার স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী বলে অভিহিত করা হয়। ১৫ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে ঢাকায় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহবানে
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৬
পালিত হয় অর্ধদিবস হরতাল। ঐদিন জাহাংগীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশ ছাত্রদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ করে। একই দিনে ছাত্ররা ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেনে অগ্নিসংযােগ এবং রাজশাহীতে ট্রেন চলাচলে বাধা প্রদান করে। ঐ দিনই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা এবং উক্ত সভায় ছাত্ররা ১৫ দিনব্যাপী আন্দোলনের কর্মসূচী ঘােষণা করে। অপরদিকে ৮,৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন আন্দোলনের ঐক্যের প্রশ্নে অভিন্ন মত ব্যক্ত করে পৃথক পৃথক বিবৃতি প্রদান করে। ১৬ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে এরশাদ সাহেবকে পদত্যাগে বাধ্য করার লক্ষ্যে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোয়ের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় সর্বাত্মক অর্ধদিবস হরতাল। ঐ দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উৎপাটন, রেল স্টেশনে অগ্নিসংযােগ, ব্যাপক ভাংচুর, ব্যারিকেড স্থাপন, ইত্যাদি ঘটনা সংঘটিত হয়। চট্টগ্রামে জনতা-পুলিশ সংঘর্ষে ১৫ জন আহত হয়। ঐদিন বিকেলে ঢাকায় আয়ােজিত ৮ দলীয় ঐক্যজোটের এক সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা ঘােষণা করেন, “রক্তের বিনিময়ে গড়ে ওঠা ঐক্য ভাঙার সাধ্য কারও নেই। অপরদিকে, ঢাকায় আয়ােজিত ৭ দলীয় ঐক্যজোটের অপর এক সমাবেশে বিএনপি নেত্রী ও ৭ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সর্বস্তরের জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন, এরশাদ সরকারের উৎখাতের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।”
৭৮। ১৭ই অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে এরশাদ সাহেবের সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করে। ঐদিনই ছাত্রনেতা আমানউল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খােকন, হাবিবুর রহমান হাবিব, নাজমুল হক প্রধান, নাজিমুদ্দিন আলম, গােলাম মােস্তফা সুজনসহ অন্যান্য ছাত্রনেতারা ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এরশাদ সরকারের পতনের লক্ষ্যে পুনর্বার দৃপ্ত শপথ ব্যক্ত করে। ১৯শে অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য ঢাকার জিরাে পয়েন্টে এরশাদ সাহেবের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কালাে পতাকা উত্তোলন করে। ২০শে অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টি. এস. সি. চত্বরে ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়ে পঞ্চাশ জনেরও বেশী ছাত্র ও নাট্যকর্মীকে গ্রেফতার করে। ২২শে অক্টোবর তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ। উক্ত সমাবেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নতুন আইনের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, “ছাত্র-শিক্ষক সম্মিলিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে খুলে দেবে।” কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়ােজিত উক্ত সমাবেশে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘােষণা করা হয়।
৭৯। ২৩শে অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে ৮,৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোয়ের আহবানে সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ও উপজেলা ঘেরাও কর্মসূচী পালিত হয়। ঐদিন দেশের
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৭
বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে তিন শতাধিক ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী আহত হন। ২৪শে অক্টোবর সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অধ্যাদেশ চ্যালেঞ্জ করে আবেদন পেশ করা হয়। আদালত এ ব্যাপারে সরকারের ওপর কারণ দর্শানাের রুলনিশি জারি করে। ২৭শে অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোয়ের আহবানে সারাদেশে সড়ক ও রেলপথ অবরােধ কর্মসূচী পালিত হয়। ২৮শে অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে সরকার ন্যাপ সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্যকে গ্রেফতার করে তাঁকে চার মাসের আটকাদেশে কারারুদ্ধ করে। ৩০শে অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের এক সভায় অবিলম্বে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি ঘােষণা করা হয়।
৮০। স্বৈরাচার বিরােধী আন্দোলন থেকে জনসাধারণের দৃষ্টি ও মনোেযােগ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্যে এরশাদ সাহেব, তীর গােষ্ঠী ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল এক কুটিল খেলায় মেতে ওঠে। ভারতের ‘বাবরি মসজিদ’ ইস্যকে কেন্দ্র করে সে দেশের কয়েকটি শহরে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক গােলযােগের সুযােগে এরশাদ সাহেব লেলিয়ে দেয় তাঁর গুণ্ডা ও মাস্তান বাহিনীকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরদ্বয়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকদের আক্রমণ ও তাদের বাড়ীঘর, দোকানপাট ও উপাসনালয় লুটপাট ও ধ্বংস করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও দাঙ্গা সৃষ্টিতে। এ সমস্ত ঘটনায় ঢাকা ও চট্টগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লােকের প্রাণহানিসহ বিষয়-সম্পত্তি ও উপাসনালয়ের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই অজুহাতে সরকার ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরদ্বয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্যে কার্ফ জারি করে ৩১শে অক্টোবর (১৯৯০) তারিখে। সরকারের এই হীন চক্রান্ত বুঝতে পেরে ৮,৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার সরকারের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে হুশিয়ারি ব্যক্ত করে ঘােষণা দেয় অভিন্ন কর্মসূচীর। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে আয়ােজন করে জনসমাবেশ ও শান্তি মিছিল। যাহােক, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, ছাত্রসমাজ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের ও পেশার প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির সময়ােচিত ও সক্রিয় হস্তক্ষেপে সরকারের এই হীন ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১লা। নভেম্বর (১৯৯০) তারিখের মধ্যেই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত ও স্বাভাবিক হয়। ঐ দিনই সরকার ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক পংকজ ভট্টাচার্যকে জেল থেকে মুক্তি দেয়। ৪ঠা নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহবানে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মিছিলসহ গােলাপ শাহ মাজার এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় একটি সমাবেশ। ঐদিন মিছিল ও সভাসমাবেশে পুলিশের হামলায় ২০ জন আহত হয়। ৫ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ৮,৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোয়ের দেশে রেডিও-টেলিভিশনে বস্তুনিষ্ঠ ও সঠিক খবর ও তথ্য পরিবেশনের দাবিতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয় সভা-সমাবেশ। ঐ দিনই সারাদেশে মেডিকেল ডাক্তাররা ২৪ ঘন্টা ধর্মঘট পালন করে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৮
৮১। ৬ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বেঞ্চে সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সংক্রান্ত নতুন অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আনীত রীটের শুনানি শুরু হয়। ৮ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ সংক্রান্ত নতুন অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ‘সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী পালিত হয়। ঐ দিন ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর সমাবেশ শেষে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিল প্রেসিডেন্টের সচিবালয় অভিমুখে যাওয়ার সময় গ্রীনরােড-পান্থপথ মমাড়ে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়ার’ উত্তেজনা সারাশহরে ছড়িয়ে পড়ে। পাড়ায়-মহল্লায় সরকারের বিরুদ্ধে সৃষ্ট মিছিলসমূহ জঙ্গী আকার ধারণ করে। ঐদিন এই পর্যায়ে ঢাকায় একজন মন্ত্রীর বাড়ী বিক্ষুদ্ধ ছাত্র-জনতার হামলায় আক্রান্ত হয়। ৯ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য তৃতীয় ও শেষবারের মতাে কর্মসূচী ঘােষণা করে। ১০ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ৮,৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় সকাল-সন্ধ্যা সার্বাত্মক হরতাল। ১১ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে সরকারী আদেশ উপেক্ষা করে ছাত্র-শিক্ষক যৌথভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়। ছাত্র-শিক্ষকের এই যৌথ উদ্যোগ চলমান আন্দোলনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অনেকের মতে উপরােক্ত ঘটনার পর থেকেই শুরু হয় সরকারের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন পেশাজীবীদের অসহযােগ কার্যক্রম।
৮২। ১২ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহবানে সারাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও এরশাদ সরকারের উৎখাতের আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় অনেক সভা-সমাবেশ। ১৩ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঢাকার তেজগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র-শ্রমিক সংহতি সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দের আহবান ছিল, যে কোন মূল্যে সরকার বিরােধী আন্দোলন সফল করতে হবে।” ঐদিনই সরকারের শিক্ষা প্রতিষ্ঠিান বন্ধ সংক্রান্ত নতুন অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ঢাকায় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঢাকার টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র-শ্রমিক সংহতি সমাবেশে ছাত্র নেতৃবৃন্দ এরশাদের সরকারের উৎখাতের লক্ষ্যে চলমান আন্দোলনকে আরও তীব্র ও গতিশীল করার শপথ নেয়। ১৬ই নভেম্বর (১৯৯০) নরসিংদীতে অনুষ্ঠিত এক সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও ১৯৯০ সালেই এরশাদের পতন ঘটানাে হবে।” ঐদিনই নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিলস্ চত্বরে অনুষ্ঠিত ছাত্র-শ্রমিক সংহতি সভায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের হাবিবুর রহমান হাবিবকে এক সাথে সভামঞ্চে উপস্থিত দেখে ছাত্র জনতা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। এই সভায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন, “জেহাদ-মণিরের লাশ ছুঁয়ে আমরা শপথ নিয়েছি। কাজেই এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাবাে না।”
পৃষ্ঠাঃ ৩৪৯
৮৩। ১৭ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ছিল ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের’ সারাদেশে গণদুশমন প্রতিরােধ দিবস পালনের আওতায় ছাত্রদের ঢাকায় মন্ত্রীপাড়া মন্ত্রীদের সরকারী বাসস্থানসমূহের এলাকা) ঘেরাওয়ের কর্মসূচী। এই দিন সরকারের ভাড়া করা কিছু লােক কাকরাইল মসজিদ এলাকাসহ ঢাকার ১৩টি স্থানে সভার আয়ােজন করলেও, ছাত্র-জনতার তীব্র প্রতিরােধের মুখে তারা টিকতে পারেনি। এক পর্যায়ে ছাত্ররা শেরাটন হােটেল মােড়ে এরশাদ সমর্থকদের তৈরী একটি সভামঞ্চ ভেঙ্গে দেয়। উক্ত সময়ে পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় সরকারের ভাড়াটে কতিপয় গুণ্ডা-মাস্তান ছাত্রদের মিছিলে গুলী চালায়। ঐদিনই ছাত্রদের ব্যাপক প্রতিরােধের মুখে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সরকার সমর্থকদের আয়ােজিত এক সভাস্থল থেকে দুই জন মন্ত্রী পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ঐদিনই সরকারের ভাড়াটে গুণ্ডামাস্তান কর্তৃক আয়ােজিত একটি সভায় এরশাদ সাহেব পূর্বের মতাে বলেন, অতীতের সব সরকারই অবৈধ। বাংলাদেশের শুরু হয়েছিল একটা অবৈধ সরকার দিয়ে।” ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের এই গণদুশমন প্রতিরােধ দিবসে ছাত্রদের মিছিলে সরকারী প্রা-মাস্তান ও পুলিশের হামলা-গুলীবর্ষণে ৬৩ জন আহত হয়। এরপর ছাত্রদের আন্দোলন আরও সংগঠিত হয়। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, যশাের, বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের সর্বত্র সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রদের নেতৃত্বে এরশাদ, তাঁর মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে তীব্র হয়ে ওঠে অসহযােগ আন্দোলন। এই দিন সরকার ছাত্র ঐক্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মাস্তান গােলাম ফারুক অভিকে হঠাৎ করে জেল থেকে মুক্তি দেয়।
৮৪। ১৮ই নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে সরকারের গুণ্ডা-মাস্তান বাহিনীর একটি দল পুলিশের ছত্রচ্ছায়ায় ঢাকার রায়ের বাজারে আওয়ামী লীগের একটি মিছিলে গুলীবর্ষণ করে। ঐদিনই মানিকগঞ্জে ৮,৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের সঙ্গে এরশাদের জাতীয় পার্টির গুণ্ডা-মান্তান ও সমর্থকদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হয়। ১৯শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ছিল ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোয়ের সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল ও সভা-সমাবেশের কর্মসূচী। হরতালের সমর্থনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, বগুড়াসহ নানাস্থানে আয়ােজিত মিছিলসমূহে সরকারী গুন্ডা-মাস্তান ও পুলিশের হামলায় আহত হয় দুই শতকেরও বেশী লােক। ঐদিন বিকেলে অনুষ্ঠিত পৃথক। পৃথক জনসমাবেশে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে ঘােষণা করে এরশদের সরকার উৎখাত আন্দোলনকে আরাে জোরদার, তীব্র ও গতিশীল করার লক্ষ্যে অন্নি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা।
৮৫। তিন জোটের এরশাদ ও তাঁর সরকারের উৎখাত আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ও দায়িত্ব সম্পর্কিত উক্ত ঘােষণায় বলা হয়(১) হত্যা, ক্য, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ধারায় প্রতিষ্ঠিত স্বৈরাচারী এরশাদ ও তাঁর সরকারের
পৃষ্ঠাঃ ৩৫০
শাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাকল্পেঃ (ক) সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী তথা সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদের ক(৩) ধারা এবং ৫৫ অনুচ্ছেদের ক(১) ধারা এবং ৫১ অনুচ্ছেদের ৩ নং ধারা অনুসারে এরশাদ ও তাঁর সরকারকে। পদত্যাগে বাধ্য করে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরােধী আন্দোলনরত তিন জোটের নিকট গ্রহণযােগ্য একজন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করতে হবে। বর্তমান সরকার ও সংসদ বাতিল করতঃ রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করে উক্ত উপরাষ্ট্রপতির নিটক ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। (খ) এই পদ্ধতিতে উক্ত ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে যার মূল দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে একটি সার্বভৌম সংসদের অবাধ ও নিরপেক্ষ, নির্বাচনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা। (২)- (ক) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সাথে সম্পৃক্ত হবেন না অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি বা সংসদ পদের জন্য নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন মন্ত্রী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবেন না। (খ) অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার শুধুমাত্র প্রশাসনের দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনাসহ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম ও দায়িত্ব পুনর্বিন্যাস করবেন। (গ) ভােটারগণ যাতে করে নিজ ইচ্ছা ও বিবেক অনুযায়ী প্রভাবমুক্ত ও স্বাধীনভাবে তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করতে পারেন সেই আস্থা পুনঃ স্থাপন এবং তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। (ঘ) গণ-প্রচার মাধ্যমকে পরিপূর্ণভাবে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশ্যে রেডিও-টেলিভিশনসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থায় পরিণত করতে হবে এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সকল রাজনৈতিক দলের প্রচারপ্রচারণার অবাধ সুযােগ নিশ্চিত কতে হবে। (৩) অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদের নিকট অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এবং এই সাংসদের নিকট সরকার জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। (৪)-(ক) জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশের সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরংকুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যে কোন পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা প্রতিরােধ করা হবে। নির্বাচন ব্যতীত অসাংবিধানিক বা সংবিধান বহির্ভূত কোন পন্থায়, কোন অজুহাতেই নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবেনা। (খ) জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা হবে। এবং (গ) মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল আইন বাতিল করা হবে।”
৮৬। ২০শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ছিলাে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয়ের সারাদেশে সর্বাত্মক সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচী। হরতাল চলাকালে ঢাকায় ছাত্রনেতা
পৃষ্ঠাঃ ৩৫১
নাজমুল হক প্রধান আহত হয় সরকারী দলের অঙ্গদল যুব সংহতির সশস্ত্র হামলায়। এই খবর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়লে ছাত্রদের জঙ্গী মনােভাব আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ২১শে নভেম্বর তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে ঘােষণা করে ১২ই ডিসেম্বর (১৯৯০) পর্যন্ত অভিন্ন কর্মসূচী। ঐদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও গঞ্জে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ ঘটে। ২২শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে পুলিশ ঢাকা কলেজ এলাকায় ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের মিছিলে গুলীবর্ষণ করে। ২৩শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঢাকায় পুলিশ মহানগর বি. এন. পি.-এর মিছিলে লাঠি চার্জ করে। ঐ সময় পুলিশ বি. এন. পি.এর অংগ সংগঠন যুবদল নেতা মির্জা আব্বাসকে গ্রেফতার করে। ঐদিনই বি. এন. পি.-এর এক সভায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতা সানাউল হক নীরুসহ ৬ জনকে ছাত্রদল হতে বহিষ্কার করা হয়। ২৪শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঢাকায় পুলিশ এক সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের’ মিছিলে লাঠি চার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এই দিন সানাউল হক নীরুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবীতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কারামুক্ত নেতা গােলাম ফারুক অভিসহ কতিপয় ছাত্র নেতা, কর্মী ও বহিরাগত যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিলসমাবেশ করে এবং ‘ডাকসু অফিসে তালা লাগিয়ে দেয়। সমাবেশে এরা আমানউল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খােকন, নাজিমুদ্দিন আলম, প্রমুখ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। পরের দিন অর্থাৎ ২৫শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন চত্বরস্থ ‘অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের’ এক পূর্ব নির্ধারিত সমাবেশ চলছিলাে। এই সময় গােলাম ফারুক অতি আরও কয়েকজনসহ একটি এম্বুলেন্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বর প্রদক্ষিণ করে নিকটস্থ সূর্যসেন হলে অবস্থান নেয়। সমাবেশ শেষে , ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের একটি বিরাট মিছিল লেকচার থিয়েটারের কাছে পৌছার সঙ্গে সঙ্গেই অভির নেতৃত্বে সূর্যসেন হল থেকে মিছিলটিকে লক্ষ করে গুলীবর্ষণ শুরু হয়। একদিকে অস্ত্রধারী কয়েকজন মাস্তান অপরদিকে হাজার হাজার ছাত্রের লড়াই এক ভয়াবহ রূপ নেয়। প্রায় ১ ঘন্টা যাবত সংঘর্ষে ৭ জন ছাত্র গুলীবিদ্ধ হয়। অতঃপর অতির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র মাস্তানরা ক্যাম্পাস থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ঐ দিনই গােলাম ফারুক ছাড়াও আরও ৬ জন ছাত্রনেতাকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
৮৭। ২৬শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে অতি-নীরুর যৌথ নেতৃত্বে একদল সশস্ত্র মাস্তান ফিল্মী কায়দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘ্রাস-হামলা শুরু করে। এদের গুলীতে নিমাই নামক একজন যুবক পান দোকানদার নিহত হয়। অতঃপর ঢাকার জিরাে পয়েন্টে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সমাবেশ শেষে ছাত্রদের একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসার সময় বাংলা একাডেমীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মাইক্রোবাস থেকে সরকারী মদদপুষ্ট অভি-নীরুর নেতৃত্বাধীন মাস্তানরা উক্ত মিছিলে গুলী চালালে ৭ জন
পৃষ্ঠাঃ ৩৫২
ছাত্র নেতা ও কর্মী গুলীবিদ্ধ হয়। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অব্যাহত সন্ত্রাসের সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় আন্দোলনকারী শ্রমিকজনতা ও বিভিন্ন পেশার মানুষও ছাত্রদের সহায়তা করার জন্যে ক্যাম্পাসে ছুটে আসে। অতঃপর ঐদিন ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের পক্ষ থেকে সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়।
৮৮। ২৭শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখ ভােরে পুলিশ আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের সভাপতি মােস্তফা মহসিনের এলিফ্যান্ট রোডস্থ বাসা ঘেরাও করে তাঁকে গ্রেফতার করে। এই দিন সকাল দশটার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন চত্বর ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবীতে বিভিন্ন সংস্থার লােকজনও মিছিল করে ক্যাম্পাসে আসে। এইদিন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সিদ্ধান্ত ছিল লাঠি-মিছিল প্রদর্শন করার। বুয়েট-এর ছাত্রদের একটি লাঠি-মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকে কয়েকবার কলাভবন প্রদক্ষিণ করে। ইত্যবসরে, অভি-নীরুর যৌথ নেতৃত্বাধীন সরকারী সশস্ত্র মাস্তানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে অবস্থান নেয়। অতঃপর ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের একটি মিছিল শহীদুল্লাহ হলের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে অভি-নীরুর মাস্তানরা উক্ত মিছিলে গুলী চালায়। ফলে, গুলীবিদ্ধ হয় তিনজন ছাত্র। সকাল সাড়ে এগারটার দিকে বুয়েট-এর ছাত্রদের মিছিলটি ব্রোকেয়া হলের সামনের রাস্তা দিয়ে টি. এস. সি. অভিমুখে যাওয়ার সময় সােহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অভি-নীরুর মাস্তানরা উক্ত মিছিলে গুলীবর্ষণ শুরু করে। ঐ সময় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল থেকে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা ও বাংলাদেশ মেডিকেল সমিতি (বি. এম. এ.)-এর তৎকালীন মহাসচিব ডাঃ মােস্তাফা জালাল মহিউদ্দিন এবং যুগ্মসচিব ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের তরুণ শিক্ষক, ডাঃ শামসুল আলম খান মিলন একত্রে একটি রিক্সায় টি. এস. সি.-এর মােড় অতিক্রম করছিলেন। রিক্সাটি টি. এস. সি. এর মােড় অতিক্রম করার সাথে সাথেই সােহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে অভি-নীরুর মাস্তানদের বুলেট ডাঃ মিলনের পিঠে বিদ্ধ হয়। মরণ যন্ত্রণায় রিক্সা থেকে ছিটকে পড়ে যান ডাঃ মিলন। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। ডাঃ মিলনের মৃত্যুর সংবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তুমুল উত্তেজনার সৃষ্টি করে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ছাত্র-শিক্ষকডাক্তারসহ সকল পেশাজীবী মানুষ ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় নেমে পড়েন। ডাঃ মিলন হত্যার প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য সারাদেশে ছাত্র-জনতার এরশাদ বিরােধী আন্দোলন চরম জঙ্গী আকার পরিগ্রহ করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সকল শিক্ষক ও ডাক্তাররা একযােগে পদত্যাগের ঘােষণা দেন। অপরদিকে রাতে এরশাদ সাহেব এক রেডিও ও টেলিভিশন ভাষণে সরাদেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা
করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৩
৮৯। ২৭শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখের রাতে দেশের জরুরী আইন ঘােষণা এবং ঢাকা শহরে কার্ফ জারি করা হলেও ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ থামেনি। জরুরী আইন উপেক্ষা করে মিছিল সমাবেশ বাড়তে শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘােষণা করা হলেও ছাত্র-ছাত্রীরা ছাত্রাবাস ছাড়ল না। শিক্ষকরা পদত্যাগ ও আইনজীবীরা কোর্ট বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ডাক্তাররা এরশাদ সরকারের অধীনে কাজ না করার সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখেন। ২৮শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে পরিস্থিতির দারুণ অবনতি ঘটে। জরুরী আইন ও কার্ফ ভঙ্গ করে ছাত্রছাত্রী, শ্রমিক-জনতা ও পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা নামলেন বিক্ষোভ মিছিলে। এই দিন বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালালাে ধানমন্ডিস্থ সরকারের জাতীয় পার্টির প্রধান কার্যালয়ে। সেখানে গুলীবিদ্ধ হলাে ৫ জন। ঢাকার বিকাতলায় শ্রমিকরা লড়লাে বাঘের মতাে। ঢাকার মালিবাগে রেলপথ বন্ধ করে দিলাে শ্রমিক-জনতা। ডেমরার দিকে সংঘর্ষ হলাে শ্রমিক-জনতা এবং পুলিশ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে। এসব স্থানে গুলীবর্ষণে প্রাণ হারায় ৪ জন। গুলী চললাে ময়মনসিংহে। চট্টগ্রাম ও ননায়াখালীতে ছাত্রশ্রমিক-জনতা রেলপথ ভার করে। খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, যশােরসহ দেশের অন্যান্য শহরেও চললাে বিক্ষোভ মিছিল। এসব স্থানে পুলিশ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রশ্রমিক-জনতার সংঘর্ষে বহুলােক গ্রেফতার ও আহত হয়। এহেন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই দিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও জাপান এরশাদ সরকারের দেশে জরুরী অবস্থা সম্পর্কিত আইন জারির কঠোর সমালােচনা করে।
৯০। ২৯ শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখের মধ্যেই সরকরী মদদপুষ্ট অভি-নীরু বাহিনী ও মাস্তানদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকার সব চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে প্রতিরুদ্ধ হলাে। তখন অভি-নীরুর নেতৃত্বাধীন গুণ্ডা-মাস্তানরা ঢাকার বাড়ীতে বাড়ীতে হামলা শুরু করে রাজনৈতিক এবং ছাত্রনেতা ও কর্মীদের সন্ধানে। সংবাদপত্র প্রকাশে সরকারের সকল চেষ্টা হলে ব্যর্থ। এই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র-শিক্ষক সমাবেশে উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক পদত্যগের ঘােষণা দেন। একই দিনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সকল শিক্ষক পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা কাফু উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন করে। অতঃপর সরকার। সেনাবাহিনীকেও পুলিশ ও বি. ডি. আরের পাশাপাশি মােতায়েন করে। সচিবালয়ের গেটে অবস্থান নেয় মন্ত্রীদের প্রাইভেট বাহিনী। ঢাকার শাহজাহানপুর ও খিলগাঁওয়ে সরকারের ভাড়াটে মাস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর গুলীতে নিহত হয় ৩ জন। এদিন ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয় এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহবানে সারাদেশে পালিত হয় সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য শহরেও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং ছাত্র-শ্রমিক- জনতার। এ সমস্ত ঘটনায় বহলােক আহত ও গ্রেফতার হয়।
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৪
৯১। ৩০শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখ ছিলাে শুক্রবার। এদিন ঢাকায় জরুরী অবস্থা আইন উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ বায়তুল মােকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণে সমবেত হয় শহীদদের স্মরণে গায়েবানা জানাজার উদ্দেশ্যে। গায়েবানা জানাজা শেষে, জনগণ মিছিল করে কাকরাইলের দিকে অগ্রসর হয়। রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিশাল মিছিলটি কাকরাইল মােড়ে পৌছলে সরকারের ভাড়াটে মাস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর লােকেরা তার ওপর গুলী চালায়। এদিন রামপুরায় সরকারের ভাড়াটে মাস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর লােকেরা ঘরে ঘরে গুলী চালালে বুকে দুগ্ধপােষ্য বাচ্চা নিয়ে নিহত হয় শিশুটির মা এবং আহত হয় অনেক লোক। এদিন ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশ আয়ােজন করে ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’। স্বনামধন্য কবি ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভানেত্রী বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে শত শত নারী রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন করে স্বৈরশাসক এরশাদের পদত্যাগের দাবীতে। দেশের চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহসহ অন্যান্য শহরেও হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং ছাত্র-শ্রমিকজনতা গায়েবানা জানাজা শেষে বিক্ষোভ মিছিল প্রদর্শন করে।
৯২। ১লা ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে ছিল ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয় এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের আহবানে সারাদেশে সর্বাত্মক সকাল-সন্ধ্যা হরতালের কর্মসূচী। এদিন ঢাকায় জরুরী অবস্থা আইন ও কাফ্ট উপেক্ষা করে হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বিভিন্ন পেশাজীবীর লােক এবং ছাত্র-শ্রমিক-জনতা রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ-মিছিল বের করে। কাজীপাড়া, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, গেন্ডারিয়া, সদরঘাট, খিলগাঁও, রামপুরা, মীরপুর, পল্লবীসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সরকারের ভাড়াটে মাস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর লেকেরা মিছিলের ওপর গুলীবর্ষণ করে। মীরপুরে সরকারের ভাড়াটে গুণ্ডা-মাস্তান এবং সশস্ত্র বাহিনীর লােকেরা বাড়ী বাড়ী হামলা চালিয়ে লােকদের বেধড়ক মারধাের ও নির্যাতন করে। এ সমস্ত ঘটনায় বহুলােক আহত হয় এবং ৮জন প্রাণ হারায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট, নারায়ণ গঞ্জের মন্ডলপাড়া ও খুলনায় বিক্ষুব্ধ মানুষের ওপর নির্মমভাবে গুলীবর্ষণ করে সরকারী বাহিনী। খুলনায় ৩ জন গুলীবিদ্ধ এবং ২ শতাধিক লােক আহত ও গ্রেফতার হয়। মেলান্দহে বিক্ষুব্ধ জনতা টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি অগ্নিসংযােগে ভস্মীভূত করে। দেশের অন্যান্য শহর ও গঞ্জেও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বিভিন্ন পেশাজীবীর লােক এবং ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এসব মিছিলেও লাঠিচার্জ ও গুলীবর্ষণ করে সরকারী বাহিনীর লােকেরা। ঢাকা শহরের সঙ্গে দেশের অন্যন্য শহরের সড়ক ও ট্রেন যােগাযোেগ দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে সরকারের জাতীয় পার্টির সাবেক উপপ্রধান মন্ত্রী ডাঃ এম. এ. মতিন ও অপর ৩ জন মন্ত্রীসহ ১৯ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন।
৯৩। ২রা ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে কোন হরতাল ছিল না। এই দিন ঢাকায় কার্য্য শিথিল থাকার সুযােগে বেতন নিতে যান বিভিন্ন অফিস এবং সংস্থার কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৫
এদিন, ঢাকায় ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের এক সমাবেশে দেশের টেলিভিশনের সংবাদ পাঠক ও ঘােষকদের একটি কালাে তালিকা ঘােষণা করা হয়। ঐ দিনই জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আবুল হাসনাতকে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নয়া মেয়র নিযুক্ত করা হয়। সরকারের জাতীয় পার্টির ঢাকা পৌর ওয়ার্ড কমিশনারগণ, ভাড়াটে গুণ্ডা-মাস্তান এবং সশস্ত্র বাহিনীর লােকেরা ঢাকার বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় ছাত্র-জনতার খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ মিছিল দমনে তৎপরতা শুরু করে। এইদিনই ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়ােজিত আইনজীবীদের এক সমাবেশে এরশাদ সরকারকে অবৈধ ও খুনী আখ্যায়িত করে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি ডঃ কামাল হােসেন। এদিন ঢাকার সর্বত্র প্রচার ও বিতরণ করা হয় বিদ্রোহ আজ, বিপ্লব চারিদিকে’ শিরােনামে গণঅ্যুথানের বুলেটিন। চট্টগ্রাম শহরে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা প্রকাশ্য আদালতে বিচার করে এরশাদকে ফাঁসির সাজা দিয়ে তাঁর কুশপুত্তলিকা ঝুলিয়ে রাখে। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যান্য শহর ও গঞ্জে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়।
৯৪। ৩রা ডিসে (১৯৯০) তারিখে ছিল ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয় এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য আহূত সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল। সরকার বিধিনিষেধ শিথিল করা সত্ত্বেও এদিনও সাংবাদিকরা পত্রিকা প্রকাশে অনীহা ব্যক্ত করেন। হাজার হাজার রাজনেতিক নেতা-কর্মী, বিভিন্ন পেশাজীবীর লােক, বুদ্ধিজীবী এবং ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিক্ষোভ মিছিল সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকার সেনাকল্যাণ ভবনে বােমা নিক্ষেপ করে। এদিন বি. সি. এস. (প্রশাসনিক) ক্যাডারের ২০৫ জন সদস্য পদত্যাগ করার কথা ঘােষণা করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া এবং আইন মন্ত্রী হাবিবুল ইসলাম ভূঁইয়ার সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ বাতিল ঘােষণা করা হয়। সরকারের নেতৃত্ব পরিত্যাগ করে ৫৮টি এন. জি.ও. সরকার বিরােধী চলমান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। জাতিসংঘের এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকায় জাতিসংঘের সকল কার্যক্রম ও দফতর বন্ধ ঘােষণা করা হয়। চট্টগ্রামে সরকারী সশস্ত্র বাহিনীর গুলীতে ১ জন নিহত হয়। চাঁদপুরেও সরকারী সশস্ত্র বাহিনীর গুলীতে এক ব্যক্তি প্রাণ হারায়। এই ঘটনার প্রতিবাদে চাঁদপুরের ডেপুটি কমিশনার পদত্যাগ ঘােষণা করেন। রাতে এরশাদ সাহেব এক রেডিও ও টেলিভিশন ভাষণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মনােনয়নপত্র দাখিলের ১৫ দিন পূর্বে রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘােষণা করেন। ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয় এবং সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের’ নেতৃবৃন্দ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এরশাদ সাহেবের এই প্রস্তাব।
৯৫। ৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখ সকালে লাখাে লাখাে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর লােক, সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহের নেতা-কর্মী
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৬
এবং ছাত্র-শ্রমিক-জনতার বিক্ষোভ-মিছিলে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তা ভরে ওঠে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও গঞ্জে এরশাদ সাহেবের ছবি ভাঙ্গা ও কুশপুত্তলিকা দাহের ঘটনা ঘটে ব্যাপকহারে। এদিন ঢাকায় সিভিল সার্ভিস সমন্বয় পরিষদের সদস্যরা সচিবালয় ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে ছিলেন বি. সি. এস. (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরাও। এদিন বিকেলে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটয়ে ঢাকায় পৃথক পৃথক সমাবেশে এরশাদ সাহেবের আগের দিনের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখান করে তক্ষুণি তাঁর পদত্যাগ দাবী করে। ‘সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃবৃন্দও একই দাবী জানায়। এদিন সন্ধ্যায় টেলিভিশনে সরকারের জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এরশাদ সাহেবের পূর্বরাতের প্রস্তাবের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এর দুই ঘন্টা পর টেলিভিশনের রাত ১০ টার সংবাদের সময় এরশাদ সাহেবের অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। এই সংবাদের সঙ্গে সঙ্গেই জরুরী অবস্থা আইন ও কাফ্ট উপেক্ষা করে লাখাে লাখাে মানুষ আনন্দ-উল্লাসে রাস্তায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে হাজার হাজার মানুষের বিজয় মিছিল।
৯৬। ৫ই ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটত্রয় সর্বসম্মতভাবে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি পদে মনােনীত করে। এদিনই এরশাদ সাহেব চতুর্থ জাতীয় সংসদ বাতিল ঘােষণা করেন। ৬ই ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখ সকালে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ উপরাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দেন। অতঃপর এরশাদ সাহেব বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন। সবশেষে, এরশাদ সাহেব রাষ্ট্রপতি পদে ইস্তফা দেন। অতঃপর সরকারী চাকুরীজীবী বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ তাঁর প্রধান বিচারপতির পদে ইস্তফা না দিয়েই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করলেন। বিশ্বয়কর যে, সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহবুদ্দিন আহমদ তাঁর সরকারী চাকুরী অর্থাৎ প্রধান বিচারপতির পদ বহাল রেখেই উপ-রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সংযােজন করলেন সংবিধান লংঘনের আর একটি দৃষ্টান্ত। যাহােক অবশেষে, ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতৃত্বে সংগঠিত সফল গণআন্দোলন ও গণঅ্যুথান এবং উপরােক্ত ঘটনা সমূহের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে অর্থপিশাচ, কপট, কুটিল, দুর্নীতিবাজ, মােনাফেক, লম্পট ও ক্ষমতা-লিলু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তাঁর দুঃশাসন এবং তাঁর সমদুর্নীতিপরায়ণ পারিষদবর্গ ও সাঙ্গপাঙ্গদের।
৯৭। ৮ই ডিসেম্বর (১৯৯০) অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন গােপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে এবং ঢাকায় মরহুম জিয়াউর রহমানের মাজারে। ১২ই ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ও জনগণের দাবীতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের সরকার ঢাকার গুলশানস্থ একটি বাড়ীতে অন্তরীণ রাখে লেঃ জেনারেল (অবঃ) এইচ. এম. এরশাদ ও তাঁর পত্নী রওশন এরশাদকে। তাঁদের সঙ্গে থাকতে দেওয়া
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৭
তাঁদের পােষ্য এক নাবালিকা মেয়ে এবং এক নাবালক ছেলেকে। একই দিনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরশাদের জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, কাজী জাফর আহমদ, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনসহ ১৫ জন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করে।
৯৮। ১৪ই ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে নির্বাচন কমিশন পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্ধারণ করে ২রা মার্চ (১৯৯১) তারিখ। ১৫ই ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঘােষিত হয় পঞ্চম সংসদ নির্বাচনী তফসিল। উক্ত তফসিল মােতবেক ১০ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখ মনোনয়ন দাখিলের জন্য নির্ধারণ করা হয়। ১৭ই ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরশাদ ও তাঁর মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোেগ তদন্ত করার জন্যে বিচারপতি আনসারউদ্দিনকে প্রধান করে গঠন করে একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। ১৯শে ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে নির্বাচন কমিশন ২রা মার্চ (১৯৯১) তারিখের পরিবর্তে ২৭শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখ পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য পুনঃনির্ধারণ করে। তদনুযায়ী মনােনয়নপত্র জমা দেওয়া ও প্রত্যাহার করার শেষ তারিখ হিসেবে নির্ধারণ করা হয় যথাক্রমে ১৩ই ও ২১শে জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখ।
৯৯। ২২শে ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে জামাতে ইসলামী ছাত্র সংগঠন প্রগতিশীল ছাত্রদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হয়। ২৭ শে ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে জামাত-শিবিরের বিরুদ্ধে বিচারের দাবিতে সারাদেশে পালিত হয় বিক্ষোভ-সমাবেশ। ২৯শে ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ সাহেবদের সামরিক শাসন আমলে সামরিক ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্তরা তাদের মুক্তির দাবীতে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। উক্ত ঘটনায় নিহত হয় ৩ জন এবং আহত হয় শতাধিক। ৩১শে ডিসেম্বর (১৯৯০) তারিখে পরলােকগমন করেন বামপন্থী আন্দোলনের কিংবদন্তী-পুরুষ, প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য কমরেড মণি সিংহ। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একদিকে জনতার অভূতপূর্ব জয় এবং অপর দিকে দুঃখজনক, বিয়ােগান্তক ও শােকাবহ নানান ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় ১৯৯০ সাল।
একাদশ পরিচ্ছেদ
১৯৯১-১৯৯২ সাল
১। ১৯৯১ সাল জাতির ইতিহাসে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাতির কাছে এই প্রথম সুযােগ আসে একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের মাধ্যমে সত্যিকারের গণপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার নির্বাচন করার, আর উক্ত নির্বাচনকে অর্থবহ ও গ্রহণযােগ্য করে তােলার জন্য প্রয়ােজন শান্তিপূর্ণ ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এর দায়িত্ব শুধু অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ও তাঁর নির্দলীয় সরকারেরই ছিল না, জাতীয় এই প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য প্রয়ােজন ছিল সরকারী প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের লােকজন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবী মহল, বিভিন্ন পেশাজীবীর লােকজন, ছাত্র-যুবক ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মী তথা সমাজের সর্বস্তরের লােকজনের সচেতনতা ও সক্রিয় সহযােগিতা। অতীতে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, স্বার্থান্বেষী মহল ও ব্যক্তিত্বের সংকীর্ণতা, স্বার্থবাদিতা, ক্ষমতালিপ্সা ও দুর্নীতিপরায়ণতার কারণে সামাজিক পরিবেশ হয়ে পড়েছিল ব্যাপকভাবে কলুষিত ও দুরাচারগ্রস্ত। এহেন পরিস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ ও তার নির্দলীয় সরকারের পক্ষে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কাজটি ছিল শুধু দুরূহ ও দুষ্করই নয়, দুষ্কল্পনীয়ও বটে।
২। ১লা জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে এরশাদ সাহেবের সাবেক বাসস্থান সেনাভবন থেকে নগদ প্রায় দুই কোটি টাকা পাওয়া যায় বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঘােষণা করে। একই দিনে ক্ষমতাচ্যুত জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করেন তাঁর দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত। ২রা জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে, ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে কারাগারে বিদ্রোহ ও স্বার্থন্বেষী মহল বিশেষের অপপ্রচারকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত
পৃষ্ঠাঃ ৩৫৯
হিসেবে উল্লেখ করে যৌথ বিবৃতি প্রদানে ঐকমত্যে পৌছাতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর ৮ দলীয় ঐক্যজোট উপরােক্ত ঘটনাবলীকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত হিসেবে অভিহিত করে এ জাতীয় সকল প্রচেষ্টা মােকাবেলা করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করে। ঐ দিনই বি.এন.পি.তে যােগদান উপলক্ষ্যে আয়ােজিত একটি সভায় বেগম খালেদা জিয়া অভিযােগের সুরে বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নিশ্চিত বিজয়ে ভীত হয়ে কেউ কেউ বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে।” ৩রা জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ‘হিন্দু-বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিনিধিদের বলেন, “বি.এন.পি, ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাবে না।” ৪ঠা জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অভিযোেগ করে বলেন, ‘নির্বাচন বানচালের জন্য একটি মহল বিশেষ চক্রান্ত করছে।” ঐদিনই আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা চট্টগ্রামের পেশাজীবী সংগঠনগুলাের এক বৈঠকে বলেন, “(দেশে) সংসদীয় গণতন্ত্র না এলে (গণ-আন্দোলনের বিজয় নস্যাৎ হয়ে যাবে।” একই দিনে জামাতে ইসলামী তার কর্মপরিষদের এক সভায় নির্বাচনে এককভাবে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
৩। ৫ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত এক সভায় ৮ দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দ ১৯শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাের পক্ষ হতে প্রদত্ত ঘােষণায় উল্লেখিত দায়িত্ব কার্যকরভাবে পালন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। ৭ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে ৩০০ টি আসনের ২৯৭টি আসনে মনােনয়ন প্রদানের জন্য প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে। ৮ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বাজা দল-বি.এন.পি.) জাতীয় সংসদের ৩০০ টি আসনের ২৯২টি আসনে মনােনয়ন প্রদানের লক্ষ্যে প্রার্থী তালিকা ঘােষণা করে। ঐদিনে ৮ দলীয় ঐক্যজোটের তিনটি শরীক দল যথা সি.পি.বি., ন্যাপ (মােজাফফর) ও গণন্ত্রী পার্টির পক্ষ থেকে স্ব-স্ব দলের প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সি.পি.বি. ১৬৩ আসনে, ন্যাপ (মােজাফফর) ১৭২ টি আসনে এবং গণতন্ত্রী পার্টি ১০৮ টি আসনে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। একই দিনে ৮ দলীয় ঐক্যজোট জোটগতভাবে নির্বাচন করার সম্ভাব্যতা যাচাইপূর্বক সুপারিশ প্রদানের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। ঐদিনই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের ২ নম্বর দুর্নীতি প্রতিরােধ আইনের ৫ (২) ধারা ও বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা বলে দায়ের করে দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহার সংক্রান্ত একটি মামলা। ৯ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে ৮ দলীয় ঐক্যজোটের অন্যতম শরীক দল ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ২৪৮টি আসনের প্রার্থী তালিকা ঘােষণা করে। এদিকে জোটগতভাবে নির্বাচনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে ৮ দলীয়
পৃষ্ঠাঃ ৩৬০
ঐক্যজোট কর্তৃক গঠিত কমিটির আলাপ-আলােচনা বৈঠক অব্যাহত থাকে। একই দিনে জামাতে ইসলামী সংসদের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৯৪ টি আসনে মনােনয়ন প্রদানের লক্ষ্যে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে। ১০ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও ৮ দলীয় ঐক্যজোট নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়ােজিত এক জনসভায় তাঁর ভাষণে বলেন, “জিয়া-এরশাদ পদ্ধতির সরকার না জনগণের সরকার এটাই (এখন) ভােটারদের কাছে মুখ্য প্রশ্ন।” ১১ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে জাতীয় পার্টি সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৬৮টি আসনে মনােনীত প্রার্থীর তালিকা ঘােষণা করে। ঐদিন ৮ দলীয় ঐক্যজোটের জোটগতভাবে নির্বাচনের প্রশ্নে অচলাবস্থা ও অনিতা পরিলক্ষিত হয়। ১২ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে ক্ষমতাচ্যুত হসেইন মুহম্মদ এরশাদকে অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে অভিযুক্ত করে একটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়।
৪। মনােনয়ন দাখিলের শেষদিনের আগের দিন অর্থাৎ ১২ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে ৮ দলীয় ঐক্যজোটের সর্বশেষ সভা জোটগতভাবে নির্বাচনের অংশগ্রহণ প্রশ্নে কোনরূপ সমঝােতা ও ঐকমত্য ছাড়াই সমাপ্ত হয়। ১৩ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখ ছিল জাতীয় পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে মনােনয়ন দাখিল করার শেষ দিন। ঐদিনে তিন সহস্রাধিক প্রার্থী মনােনয়নপত্র দাখিল করেন। ৮ দলীয় ঐক্যজোটের জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে কোনরকম সমবােতা না হওয়ায় শরীক দলগুলাের প্রার্থীরা পৃথক পৃথকভাবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঢাকায় ২টি, চট্টগ্রাম, ফেনী ও বগুড়ায় ১টি করে মােট ৫টি আসনে প্রার্থী হন। আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা ঢাকায় ২টি এবং গােপালগঞ্জে ১ টিসহ মােট ৩টি আসনে প্রার্থী হন। ক্ষমতাচ্যুত হসেইন মুহম্মদ এরশাদ রংপুরের ৫টি আসনে প্রার্থী হন। ১৪ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে নির্বাচন কমিশন মনােনয়নপত্র বাছাইয়ের পর ৩, ৭৬৪টি মনােনয়পত্র বৈধ বলে ঘােষণা করে। মনোনয়নপত্র দাখিলে পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে এরশাদ সাহেবের সবগুলাে মনােনয়নপত্র সাময়িকভাবে অবৈধ ঘােষণা করা হয়। এদিকে এক জনসভায় বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচন সুষ্ট হওয়া সম্পর্কে আশংকা প্রকাশ করে বলেন, “ভােটার তালিকা দেখে মনে হচ্ছে না দেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে।” ঐ দিনেই ‘সম্মিলিত পেশাজীবী সংগ্রাম পরিষদ’ এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের পর গণন্ত্রকে সুদৃঢ় ও অর্থবহ করার জন্য জাতীয় সরকার গঠনে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি পরামর্শ প্রদান করে। ১৭ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে মনােনয়নপত্র বাতিলের প্রতিবাদে এরশাদ সাহেবের পক্ষে নির্বাচন কমিশনে আপীল করা হলে, নির্বাচন কমিশন তাঁর ৫টি মনােনয়নপত্রই বৈধ ঘােষণা করে। ২১শে জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখ ছিল মনােনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। ঐ দিন ১ হাজার ১৮ জন প্রার্থী মনােনয়পত্র প্রত্যাহার করেন। ২২শে জানুয়ারী (১৯৯১) আওয়ামী লীগ
পৃষ্ঠাঃ ৩৬১
শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ৮ দলীয় ঐক্যজোটের শরীক দলগুলাের জন্য ৩৬টি আসন ছেড়ে দেয়। ৮ দলীয় ঐক্যজোটের শরীক দলগুলাের নেতারা এটা মেনে নিলেও দলগুলাের নেতা ও কর্মীদের মধ্যে তা ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগের মনােনীত ৩৬ জন প্রার্থীরাও বিব্রতকর অবস্থায় নিপতিত হন। কারণ মনােনয়ন প্রত্যাহারের আর কোন সুযােগ না থাকায় তাঁরা নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য হন। এদিকে নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধা-১ আসন ছাড়া ২৯৯ টি আসনে মােট ২,৭৮১ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বলে চূড়ান্তভাবে ঘােষণা দেয়। ২৫শে জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে জামাতে ইসলামী ঘােষণা করে যে, তারা সর্বমােট ২২০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
৫। ২৬ শে জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে ক্ষমতাচ্যুত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে অস্ত্র রাখার অভিযােগে আনীত মামলার চার্জশীট সংশ্লিষ্ট আদালতে পেশ করা হয়। ২৮শে জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত এক নির্বাচনী সমাবেশে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার ভাষণে বলেন, দেশের সরকার পদ্ধতির প্রশ্নে সংসদেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।” ঐদিন আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা অপর এক নির্বাচনী সমাবেশে তাঁর ভাষণে বলেন, আওয়ামী লীগের গণজোয়ারে বি.এন.পি, আতংকিত হয়েছে। একই দিনে বি.এন.পি. তার নির্বাচনী ইশতেহার (মেনিফেস্টো) প্রকাশ করে। বি.এন.পি.-এর উক্ত নির্বাচনী ইশতেহারে (মেনিফেস্টোতে) সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিষয়াদি সম্পর্কে ঘােষিত নীতি, কর্মসূচী, প্রস্তাব ও প্রতিশ্রুতির কিছু অংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলােঃ “….বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা। সর্বপ্রকার কালাকানুন বাতিল করিয়া জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। বহুদলীয় গণতন্ত্র নিশ্চিতকরণ। সব দল ও মতের স্ব-স্ব মতাদর্শ প্রচারে স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ। সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা। বিদেশী আগ্রাসনের হাত হইতে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র দায়িত্বে নিয়ােজিত প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সুদক্ষ, সুসজ্জিত ও শক্তিশালী প্রার লক্ষ্যে শহীদ জিয়ার উদ্যোগ অব্যাহত রাখা। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ ও সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সহিত সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়িয়া তােলা। প্রতিবেশী দেশসমূহ বিশেষতঃ মুসলিম দেশসমূহের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করা। আধিপত্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় নীতি অবলম্বন করা।… সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং গণপ্রচার মাধ্যমসূহকে নিরপেক্ষ রাখার উদ্দেশে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করার পদক্ষেপ গ্রহণ। অনগ্রসর উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলসমূহের উন্নয়নে বিশেষ প্রচেষ্টা গ্রহণ। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন সাধনপূর্বক ছাত্রদের সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধি। নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। মাদ্রাসা শিক্ষাকে সমাজের
পৃষ্ঠাঃ ৩৬২
মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্তকরণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ।.. শাসনতন্ত্রের (সংবিধানের) চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় বিচারের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।… ধর্ম, বর্ণ, গােত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ ও জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ়করণ।… মুক্ত ও প্রতিযােগিতামূলক অর্থনীতি চালু এবং দেশী-বিদেশী পুজি বিনিয়ােগের সুযােগ সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়ন।… মানব সম্পদের উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দের আনুপাতিক বৃদ্ধি ও দ্রুত শিল্পায়নের মাধ্যমে সংস্থানের অধিকতর সুযােগ সৃষ্টি। বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ম্ভর করিতে কৃষিখাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া। কৃষককে সহজ শর্তে ঋণ দানের সুযােগ বৃদ্ধি এবং কৃষি ও সেচ কাজের সাহায্যার্থে বৈদ্যুতিক সংযােগের সুযােগ-সুবিধা দেওয়া। গরীব চাষীদের ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ ও সুদ মওকুফ করা। খালকাটা প্রকল্পসমূহ চালুকরণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। সড়করেল-নৌ-যােগাযােগ, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও টেলিযােগাযােগের মত অবকাঠামােগত উন্নয়নে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা। যমুনা বহুমুখী ও মেঘনা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ। বেসরকারী খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া। বিনিয়ােগের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি ও ইহার পক্ষে যাবতীয় বাধা ও জটিলতা দূরীকরণ।… জাতীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসূহকে যেমন বিদ্যুৎ, টেলিফোন, রেলওয়ে ও শিল্প ইউনিটসমূহে শৃংখলা ফিরাইয়া আনিয়া দক্ষ ও গতিশীল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিযােগিতা সৃষ্টি ও জবাবদিহিকরণের ব্যবস্থা নেওয়া।… বাংলাদেশে সার্বিক উন্নয়নে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সার্বিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে দ্রুত শিল্পায়নের পথ প্রশস্তকরণ। শিক্ষিত ও বেকার যুবকদের স্বল্প ব্যয় অথবা বিনামূল্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান ও সহজ শর্তে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে পুঁজি যােগান দিয়া আত্ম-কর্মসংস্থানে উৎসাহিত করিয়া বেকার সমস্যার সমাধানে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ।… জাতীয় স্বার্থ ও চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন কোন শর্তে বৈদেশিক ঋণ বা সাহায্য গ্রহণে অস্বীকৃতি। গ্রাধিকার খাতসমূহে বৈদেশিক বিনিয়ােগে উৎসাহ দান। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন ও ইহাদেরকে জাতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আরও সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্তকরণের উদ্দেশে প্রচলিত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণ।… বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আলােকে দেশের সংস্কৃতির স্বাভাবিক ও সুষ্ঠু বিকাশ ঘটানাে। দেশজ সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ধারাকে অব্যাহত গতিতে চালনা করিয়া সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এদেশমুখী করা এবং বাংলাদেশী শিল্পী ও সাহিত্যিকদের প্রতিভা বিকাশে বাংলা একাডেমীর ভূমিকাকে আরও অর্থবহ করা। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সকল ধর্ম ও মতাবলম্বীদের তাহাদের নিজস্ব বিশ্বাস অনুসারে চলিবার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান। ইহা ছাড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ‘ঘােষণাপত্র, গঠনতন্ত্র ও পার্টির আদর্শ
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৩
পুস্তিকায় উল্লেখিত কর্মকাণ্ডে জাতিকে উদ্বুদ্ধকরণও ও এই কর্মসূচীর একটি অপরিহার্য অঙ্গ বলিয়া বিবেচিত হইবে….।”
৬। উল্লেখ্য, উপরােল্লিখিত নির্বাচনী ইশতেহারে রাষ্ট্রীয় সরকার ও শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কোন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। তবে যেহেতু বি.এন.পি. এর ‘ঘােষণাপত্র, গঠন ও পার্টির আদর্শ পুস্তিকায় উল্লেখিত বিষয়াদিও উপরােল্লিখিত নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তর্ভুক্ত বলে ঘােষণা করা হয়, সেহেতু উক্ত পুস্তিকায় রাষ্ট্রীয় সরকার ও শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে যে বক্তব্য রয়েছে তা এতে (নির্বাচনী ইশতেহারে) বর্ণিত নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দলীয় গঠনতন্ত্রের ২ ছে) ধারা অনুসারে রাষ্ট্রীয় সরকার ও শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে জাতীয়তাবাদী দল (বি.এন.পি.)-এর বক্তব্য নিম্নরূপঃ “একাধিক দলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত সক্রিয়ভাবে জনসমর্থিত প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীল গণতন্ত্র কায়েম করা এবং সুষম জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আনয়ন।” সুতরাং নির্বাচনী ইশতেহারেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বি.এন.পি.) রাষ্ট্রপতি সরকার ও শাসন পদ্ধতির পক্ষেই তাদের বিশ্বাস ও সমর্থন ব্যক্ত করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
৭। ৩১শে জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখ ৫ দলীয় ঐক্যজোট সংবিধানের প্রথম ও তৃতীয় সংশােধনী ব্যতীত সকল সংশােধনী বাতিল, অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের ধারা প্রত্যাহার এবং ক্ষমতাচ্যুত হসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তাঁর সহযােগীদের বিচারে নতুন আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার করে তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ১লা ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, দেশের বিরাজিত আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে মিশ্র অর্থনীতি সবচেয়ে উপযােগী বলে তাঁরা দৃঢ় মত পােষণ করেন। ৪ঠা ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে চট্টগ্রামে আয়ােজিত এক নির্বাচনী জনসমাবেশে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভাষণে বলেন, “নির্বাচনে) সন্ত্রাস প্রতিরােধে প্রয়ােজনে লাঠি নিয়ে ভােট কেন্দ্র রক্ষা করবাে।”
৮। ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার (মেনিফেস্টো) প্রকাশ করা হয়। উক্ত নির্বাচনী ইশতেহারে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়ে ঘােষণা করা হয় : “জনগণের সার্বভৌমত্বই সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। এই মূল আদর্শের পরিপন্থী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে কোন প্রক্রিয়া অবৈধ বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে একটি জনপ্রতিনিধিত্বশীল জবাবদিহিমূলক সংসদীয় পদ্ধতির (সরকার ও) শাসন ব্যবস্থা কায়েমসহ সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক জীবন পদ্ধতি প্রবর্তন করা দলের লক্ষ্য। এতদুদ্দেশে শুধুমাত্র সাংবিধানিক ও আইনগত পন্থায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছানুযায়ী সংসদীয় পদ্ধতির সরকার গঠন, পরিবর্তন ও ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করা। উপরােক্ত লক্ষ্য অর্জনে ১৯৭২ সালের সংবিধান চতুর্থ
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৪
সংশােধনী-পূর্বাবস্থায় পুনর্বহাল করা। বাকস্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ প্রতিটি মৌলিক অধিকারকে নিশ্চিত করা ও আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংরক্ষিত করা। গণ-প্রচার মাধ্যমসমূহের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা। আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখা ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সংবিধান কর্তৃক সংরক্ষিত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সকল নিবর্তনমূলক আইন ও কালাকানুন বাতিল করা।” ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারবর্গ ও আত্মীয়-স্বজন এবং ৩রা নভেম্বরে চার জাতীয় নেতা যথা-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) এম, মনসুর আলী ও এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানের হত্যাকারীদের বিচারের নিম্মিতা বিধানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আওয়ামী লীগের উক্ত নির্বাচনী ইশতেহারে প্রস্তাব করা হয়, তাই, কোন রাষ্ট্র (বা সরকার) প্রধানকে যাতে কতিপয় উচ্চাভিলাষী ও সন্ত্রাসী ঘাতকের হাতে প্রাণ হারাতে না হয়, সেজন্য সংবিধানের প্রয়ােজনীয় পরিবর্তন ও সংশােধনের মাধ্যমে খুনীদের আইনানুগ বিচারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে, যাতে সরকার বা ক্ষমতার পরিবর্তন শুধু সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সংঘটিত হয়, খুন বা হত্যালীলার মাধ্যমে নয়।”
৯। ৬ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের উক্ত নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনৈতিক নীতিমালার মূল দৃষ্টিভঙ্গী তথা দর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়ঃ”.. বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারী খাতের স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগকে সর্বাত্মকভাবে উৎসাহিত করা হবে। প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, অর্থনৈতিক কার্যকারিতা ও সামাজিক উপযযাগিতার নিরিখে সরকারী খাতের অগ্রাধিকার নির্ণীত হবে। এই লক্ষ্যে দক্ষ ও প্রতিযােগিতামূলক বাজারের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই প্রতিযােগিতামূলক বাজারের সুযােগ সুবিধা যাতে সবাই গ্রহণ করতে সক্ষম হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। কোন বিশেষ গােষ্ঠীকে অন্যায়ভাবে এই বাজার ব্যবস্থার সুযােগ গ্রহণ দেয়া হবে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় এবং সামগ্ৰীক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে সহায়কের-নিয়ন্ত্রকের নয়। সাধারণভাবে কোন ব্যবসা-শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হবে না। ব্যক্তি খাতকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় খাতের প্রত্যক্ষ ভূমিকাও হবে গুরুত্বপূর্ণ। এই লক্ষ্যে রাস্ত্রীয় খাতের ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান অদক্ষতা ও অনভিপ্রেত অলাভজনকতা দূর করে দক্ষ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও প্রতিযােগী বাজার ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ধারায় উৎপাদনশীলতার দ্বারা এদেরকে লাভজনক করতে হবে।”
১০। ৬ই জানুয়ারী (১৯১১) তারিখে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দারিদ্র্য দূরীকরণের কৌশল ও উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়: … দারিদ্র্য নিরসনের কৌশল হতে হবে বহুমুখী, বাস্তবানুগ এবং সামগ্রীক উন্নয়ন ধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বিভিন্ন
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৫
উন্নয়নশীল দেশের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, কার্যকর দারিদ্র্য নিরসনের জন্য উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অত্যাবশ্যক। দারিদ্র্য সীমার নীচে নিপতিত অধিকাংশ জনগােষ্ঠি যেহেতু গ্রামাঞ্চলে বাস করে, সেহেতু গ্রামীণ অর্থনীতির সামগ্রিক পুনরুজ্জীবন আশু কর্তব্য হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই লক্ষ্যে উন্নত ভৌত অবকাঠামাে সৃষ্টি ও উন্নত প্রযুক্তির কৃষির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। ঐসব খাতের বিনিয়ােগের গ্রাধিকার দারিদ্র্য নিরসনের বাস্তব ভিত্তি সম্প্রসারিত করবে। প্রবৃদ্ধিমুখীন এই প্রক্রিয়ায় জনগােষ্ঠির যে অংশ অবহেলিত থাকবে, তাদের জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। মূলতঃ, সমাজের চরম দরিদ্র অংশই ঐসব কর্মসূচীর আওতায় আসবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষি খাতের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে বিবেচনায় নিয়ে কৃষিখাতমুখীন ঋণ ও প্রশিক্ষণ নির্ভয় কর্মসংস্থান কর্মসূচী নিতে হবে।” … বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য গ্রহণ ও ব্যবহার সম্পর্কিত নীতি হিসেবে উপরােল্লিখিত নির্বাচনী ইশতেহারে ঘােষণা করা হয়ঃ” ক্রমান্বয়ে স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় সম্পদ সমাবেশ ঘটানাের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে বৈদেশিক সাহায্যের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে।… কেবলমাত্র জাতীয় স্বার্থের অনুকুল বৈদেশিক সহায়তাই আমরা গ্রহণ প্রবাে। আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈদেশিক সাহায্যকে কেন্দ্র করে অযৌক্তিক চাপ সৃষ্টির প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা হবে।”
১১। ৬ই জানুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কৃষিখাতের উন্নয়নের নীতি ও কর্মসূচী হিসেবে উল্লেখ করা হয়ঃ”….. গ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষিতে বাৎসরিক উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ও কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণে প্রয়ােজনীয় বরাদ্দের ব্যবস্থা করতে হবে এবং উচ্চ ফলনশীল আবাদের প্রসার ঘটাতে হবে।… শস্যখাতে আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে মৎস্য, গবাদি পশু ও অন্যান্য (প্রয়ােজনীয় ও অর্থকরী) অকৃষি খাতের বিকাশ ত্বরান্বিত করা হবে এবং দারিদ্র্য নিরসনে তা প্রত্যক্ষ অবদান রাখবে। কৃষির আধুনিকীকরণের কর্মসূচীর আলােকে কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত সরবরাহ কৃষিজাত পণ্যের মূল্য ও কৃষি উপকরণ মূল্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানকল্পে উপযােগী বন্টন ব্যবস্থা, ভর্তুকি, সংগ্রহ বাজার ও গুদামজাতকরণ নীতিমালা গ্রহণ করা হবে।… কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের যুক্তিসঙ্গত মূল্যের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। .. প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে গবাদি পশুর উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
১২। ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশে দ্রুত শিল্প উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে নীতি ও কর্মসূচী হিসেবে ঘােষণা করা হয়ঃ” উন্নয়নশীল বিশ্বের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, দক্ষ ব্যবস্থাপনা, উপযুক্ত শিল্প উদ্যোক্তা শ্রেণীর উপস্থিতি, বাজারের প্রতিযােগিতামূলক চরিত্র, পুঁজির বাজারের নির্দিষ্ট বিকাশ ছাড়া সফল শিল্পায়ন প্রয়াস সম্ভব নয়। বাংলাদেশের জন্য মিশ্র অর্থনীতির
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৬
কাঠামােতেই শিল্পায়নের বিকাশ ঘটাতে হবে। প্রকৃত শিল্পোদ্যোক্তা-নির্ভর শক্তিশালী বেসরকারী খাতের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ও গােষ্ঠির স্বার্থে ঢালাওভাবে বিরাধীয়করণের নীতি পরিহার করা হবে। দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা, লাভজনকতা ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ সংরক্ষণ হবে বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতির মাপকাঠি। উন্নয়ন অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানসমূহ দ্বারা সমর্থিত হওয়া সত্ত্বেও অধিকাংশ বেসরকারী শিল্প কারখানার ভূমিকা সন্তোষজনক নয় এবং এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ আদায়ের হারও খুব নাজুক। অন্যদিকে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ধস নামার কারণে রাষ্ট্রীয় খাতও তার যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। দক্ষ ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় খাত পরিচালনা এবং যােগ্য শিল্পোদ্যোক্তাদের হাতে বৃহদায়তন- ক্ষুদ্রায়তন বেসরকারী খাতের বিকাশ—এই দুই উপাদানের সমন্বয়ই হবে শিল্প নীতির মাপমাঠি। রপ্তানিমুখীন শিল্পের সাথে যারা জড়িত তাদেরকে প্রয়ােজনীয় সহায়তাদানের সকল প্রকার ব্যবস্থা নিতে হবে। এই খাতকে জরুরী খাত হিসেবে ঘােষণা করে, উৎপাদন ও রপ্তানীর ক্ষেত্রে যাতে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয় সেই লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।… দেশের শিল্পায়নের জন্য যথাযথ প্রযুক্তি নীতি, শিল্পাদ্যেক্তাদের জন্য সহায়ক পরামর্শ ব্যবস্থা (সার্ভিস), ভৌত অবকাঠামােগত সুযােগসুবিধা সুনিশ্চিতকরণ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনের বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়ােজন।…বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় ক্ষুদ্র কুটির শিল্পোদ্যোক্তরা তাদের নিজস্ব উদ্যোগে নীচ থেকে শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার যথাসাধ্য অবদান রাখছে। এসব শিল্পোদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে, ঋণ, প্রযুক্তিগত সমর্থন ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক সহযােগিতা প্রদান নিশ্চিত করে তাদের রপ্তানী-নির্ভর, এমনিবিড় শিল্প প্রতিষ্ঠা করতে উৎসাহিত করা হবে।”
১৩। ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কৃষি ঋণ নীতি ও ভূমি সংস্কারের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করে ঘােষণা করা হয়ঃ” …কৃষি ঋণ যাতে প্রতিটি চাষী (কৃষক) বিশেষ করে, প্রান্তিক চাষী (কৃষক) ও বর্গাদারদের ন্যায্য চাহিদা মেটাতে পারে তার ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হবে। পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত বিদ্যমান কৃষি ঋণ সুদসহ মওকুফ এবং ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণের সুদ মওকুফ করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সকল বকেয়া ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষতি সাশ্রয়ের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল গঠন করা হবে। ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা মওকুফ করার মাধ্যমে মালিকের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা বিধান করে তাকে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা হবে।…যেহেতু বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের সিংহভাগ জনসংখ্যা ভূমিহীন বা প্রান্তিক চাষীর কৃষকে) দলে এবং এদের সংখ্যা ক্রমইে বৃদ্ধি পাচ্ছে এজন্য ভূমি সংস্কারের আবশ্যকতা ও প্রাসংগিকতা অপরিহার্য (অনস্বীকার্য। ভূমি সংস্কারের লক্ষ্য চারটিঃ (১) কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি ; (২) আয়ের সুষম বন্টনের সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা ; (৩) ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ বৃদ্ধিতে সহায়তা
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৭
করা এবং (৪) এই ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে – (ক) ভূমি সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও বিধি পর্যালােচনার মাধ্যমে উপযুক্ত সংস্কার ও পরিবর্তন সাধন, (খ) সরকারী খাস জমি ভূমিহীনদের মধ্যে গৃহীতব্য নীতিমালা অনুযায়ী বন্টনের ব্যবস্থা এবং (গ) ভূমি ব্যবস্থাপনাকে দক্ষ, উন্নত, দুর্নীতিমুক্ত ও যুগােপযােগী করে পুনর্গঠন, যাতে ভূমি সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।”
১৪। আওয়ামী লীগের ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে সারাদেশে দ্রুত ভৌত অবকাঠামাের উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারােপ করে এতদুদ্দেশ্য লক্ষ্য, নীতি ও কর্মসূচী হিসেবে বলা হয়ঃ” কৃষি, শিল্প তথা সার্বিক উন্নয়নের জন্য ভৌত অবকাঠামাের ভূমিকাকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিতে হবে। শুধুমাত্র আন্তঃনগর যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রসার নয়, বরং প্রধান গুরুত্ব আরােপিত হতে হবে গ্রামঞ্চলে সারা। বছরের জন্য উপযােগী যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে তােলার উপর। গ্রামীণ অর্থনীতিতে একটি অভিন্ন বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা হবে তাৎপর্যপূর্ণ, যা কৃষি ও শিল্পের উন্নয়নের সমন্বয় সাধন সুদৃঢ় করবে। যমুনা বহুমুখী ও মেঘনা-গােমতী সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে আভ্যন্তরীণ যানবাহন ব্যবস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়ােজনীয় রাস্তাঘাট নির্মাণ, নদী সংস্কার ও রেলপথ ব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
১৫। আওয়ামী লীগের ৬ই ফেব্রুয়ারি (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে একটি দক্ষ ও দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তােলার লক্ষ্যে দলীয় দৃষ্টিভংগি, নীতি ও কর্মসূচীর ঘােষণায় বলা হয়, একটি স্বাধীন দেশে প্রশাসন ব্যবস্থা যেমনি জনগণের কাছে দায়বদ্ধকর ও জনগণের সেবায় নিয়ােজিত, তেমনি জাতীয় উন্নয়ন প্রচেষ্টায় একটি দক্ষ হাতিয়ার। এই উদ্দেশেঃ (১) প্রশাসন ব্যবস্থাকে গণমুখী করে তােলা এবং জনগণের সেবায় আত্মোৎসর্গে উদ্বুদ্ধ করা হবে। প্রশাসনযন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা হবে। প্রশাসন ব্যবস্থায় নিযুক্ত সরকারী কর্মচারী ও) কর্মকর্তাগণ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী রূপে বিবেচিত হবেন—সরকারের নয়। (২) অর্থনৈতিক উন্নতির সামগ্রিক লক্ষ্যের দিকটি বিবেচনা করে প্রশাসনযন্ত্রকে রদবদল অথবা পুনর্বিন্যাস করা হবে। (৩) ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ সামগ্রিক প্রশাসন পুনর্বিন্যাসের একটি অন্যতম মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত হবে। (৪) সরকারী কর্মকান্ডের অযৌক্তিক সম্প্রসারণ এবং সেই সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনসাধারণের জীবন পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার প্রবণতা রােধ করতে হবে। জনগণ তাদের সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট সৃজনশীল ও সক্রিয়— এই উপলব্ধি থেকে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের উদ্যম (উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় সরকারগুলােকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।” আওয়ামী লীগের উপরােল্লিখিত নির্বাচনী ইশতেহারে দলীয় সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত নীতিতে বলা হয়, “দেশকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৮
উদ্দেশ্যে একটি সুদক্ষ, শক্তিশালী, সুশৃংখল ও কার্যকর সেনাবাহিনী কর্তৃক এই পবিত্র দায়িত্ব সংবিধানে বর্ণিত নীতিমালা অনুযায়ী পালিত হবে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা সাংবিধানিক অনুশাসন অনুযায়ী নিশ্চিত করা হবে। প্রতিরক্ষা বাহিনীকে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত পালনে উপযুক্ত করে গড়ে তােলার লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
১৬। ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রস্তাবনা, কর্মসূচী ও নীতি হিসেবে বলা হয়ঃ”শিক্ষা, সুযােগ নয়—প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে ন্যূনতম সময়ের মধ্যে জাতীয় জীবনে থেকে নিরক্ষতার অভিশাপ দূর করতে হবে। অবৈতনিক বাধ্যতামূলক সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের নীতি কার্যকর করতে হবে। বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিক্ষার সকল স্তরে প্রতিটি নাগরিকের সুযােগ-সুবিধার সমতা সাধন এবং দারিদ্র্য যাতে প্রতিভা ও মেধা বিকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। জাতির ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ ব্যাপকভিত্তিক কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও পেশাগত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা হবে। শিক্ষকতা বৃত্তিকে আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্ভরশীল বৃত্তি হিসেবে চিহ্নিতকরণ ও শিক্ষকের মর্যাদা এবং সৎ জীবন-যাপনের উপযােগী। ন্যায়ানুগ বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হবে।…বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালুকরণ এবং সরকারী-বেসরকারী, অফিস-আদালতের সকল কাজকর্মে বাংলা ভাষার প্রচলন করা হবে।” আওয়ামী লীগের উপরােল্লিখিত নির্বাচনী ইশতেহারে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি ও কর্মসূচী হিসেবে বলা হয়ঃ”দেশের প্রতিটি নাগরিকের চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। উপজেলা পর্যায়ে দেশের সকল হাসপাতালের চিকিৎসা। ব্যবস্থাকে উন্নত ও আধুনিক করে গড়ে তােলা হবে এবং যথাসম্ভব প্রয়ােজনীয় ঔষধ সরবরাহের মাধ্যমে চিকিৎসাকে বাস্তব অর্থে ফলপ্রসূ করে তােলা হবে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে অন্যতম প্রধান সমস্যা। এ বিষয়ের উপর বিভিন্ন গবেষণালব্ধ যথাযথ কৌশল অবলম্বন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জন্মহার সকল্পে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ সুতে হবে।”
১৭। আওয়ামী লীগের ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবহারের নীতি ও কর্মসূচী হিসেবে বলা হয়ঃ বাংলাদেশের ভৌগােলিক (অবস্থান ও) পরিস্থিতি এবং তার ফলে বন্যার ভয়াবহ পরিণতি সমস্ত অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টি করে, সেহেতু বন্যা সমস্যা সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরােপ করা হবে। এই সমস্যা সমাধানে সমস্ত আন্তর্জাতিক কৌশলগত প্রচেষ্টার সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে আলাপ-আলােচনা করে সত্বর জরুরী
পৃষ্ঠাঃ ৩৬৯
ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পানি বন্টনের প্রশ্নে বাংলাদেশের ন্যায্য জাতীয় চাহিদাকে সংরক্ষিত করে ভারতের সাথে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে এই সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান নিশ্চিত করা হবে।” আওয়ামী লীগের উপরােল্লিখিত নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানী বিষয়াদি সংক্রান্ত নীতি ও কর্মসূচী হিসেবে বলা হয়ঃ “পানি, গ্যাস, (তেল), কয়লা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের প্রচেষ্টাকে সুদৃঢ় করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির ফলে যে বিরাট আর্থিক লােকসান হচ্ছে তা রােধ করার জন্য উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে উন্নত ব্যবস্থাপনার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে একদিকে যেমন বিদ্যুতের দাম কমানাে সম্ভব হবে, অন্যদিকে এইখাতে রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”
১৮। আওয়ামী লীগের ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের উপজাতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে দলীয় নীতি ও কর্মসূচী হিসেবে বলা হয়ঃ”দেশের উপজাতিদের স্বীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা সংরক্ষণ ও বিকাশের নিশ্চয়তা ও বিশেষ সুযােগ প্রদান করা হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাবলী সাংবিধানিক কাঠামাের মধ্যে আলােচনার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা হবে।” আওয়ামী লীগের উপরােল্লিখিত নির্বাচনী ইশতেহারে ১৯৭১ সালে দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাদের স্বার্থ সংরক্ষণের প্রশ্নে দলীয় নীতি হিসেবে বলা হয়ঃ”মুক্তিযযাদ্ধাদের অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। তাই মুক্তিযােদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযােদ্ধা পরিবারের সদস্যদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নিশ্চিত করা হবে।”
১৯। আওয়ামী লীগের ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে দলীয় পররাষ্ট্র নীতি হিসেবে বলা হয়ঃ”জনসাধারণের আশা-আকাংক্ষা ও রাষ্ট্রের মৌলিক স্বার্থের দিকে দৃষ্টি রেখেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (বি.এ.এস.) স্বাধীন নিরপেক্ষ, জোটবর্হিভূত পররাষ্ট্র নীতিতে বিশ্বাসী। স্বাধীনতা, সমতা এবং আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্যের হস্তেক্ষেপ না করার ভিত্তিতে সমস্ত সাহায্য ও সহযােগিতা গ্রহণ করা হবে। সকলের প্রতি বন্ধুত্বসূলভ মনােভাব এবং কারাে প্রতি বৈরী মনােভাব নয়’ এই মূলনীতি অনুযায়ী সকল রাষ্ট্রের সাথে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসী। জাতিসংঘের সনদে উল্লেখিত নীতিসমূহ এবং উক্ত সনদে বর্নিত আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি রয়েছে আমাদের পূর্ণ সমর্থন। আওয়ামী লীগ আগ্রাসন, (আধিপত্যবাদ), সাম্রাজ্যবাদ ও (সর্ব প্রকার) বর্ণবাদের বিরােধী এবং বিশ্বের নিপীড়িত, মুক্তিকামী এবং স্বাধীনতা সম্রামে নিয়ােজিত জাতিসমূহের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থনে বিশ্বাসী। আওয়ামী লীগ ফিলিস্তিনীদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও একাত্মতা ঘােষণা করছে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন,
পৃষ্ঠাঃ ৩৭০
কমনওয়েলথ, ইসলামী রােমণ্ডল) সংস্থা এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযােগিতা বিষয়ক সমিতি(SAARC) ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সদ্ভাব বজায় রাখা হবে।”
২০। ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে নির্বাচনী ইশতেহার ঘােষণা উপলক্ষে আয়ােজিত সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা সদম্ভে ও দৃঢ়তার সাথে বলেন, “আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে।” ৭ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে মুসলিম লীগ ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘােষণার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ৯ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে একজন প্রার্থীর মৃত্যুতে সেখানকার নির্বাচন স্থগিত ঘােষিত হয়। ১০ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে ক্ষমতাচ্যুত জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং সংসদের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার ঘােষণা করে। ঐ দিনেই ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য ক্ষমতাচ্যুত এরশাদ সাহেবের বিচার দাবি করে একটি বিবৃতি প্রদান করে। একই দিনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সি.পি.বি.) দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার ঘােষণা করে। ১১ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে নির্বাচন উপলক্ষে আয়ােজিত এক জনসভায় বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বহালরত রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে তাঁর দলীয় নীতির কথা ঘােষণা করেন। ১২ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে নির্বাচন উপলক্ষে আয়ােজিত এক জনসভায় বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, নারীদের মর্যাদাহানির কারণেই স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে।” ১৩ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে আয়ােজিত এক নির্বাচনী প্রচারণা জনসভায় আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা সংসদীয় গণন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে তাঁর দলীয় নীতির কথা ঘােষণা করেন।
২১। ১৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে ঢাকায় এক দলীয় নির্বাচনী প্রচার মিছিলে অংশগ্রহণকালে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “বি.এন.পি.-ই আগামী দিনে ক্ষমতায় যাবে।” ১৯শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে আয়ােজিত এক দলীয় নির্বাচনী জনসমাবেশে আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনরকম পক্ষপাতিত্ব বরদাস্ত করা হবে না।” ঐ দিনেই আটরশীর পীর সাহেব ক্ষমতাচ্যুত এরশাদ সাহেবের বিচার দাবি করে একটি বৃিবতি প্রদান করেন। ২০শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে জাপান ও কমনওয়েলথের দুটি পৃথক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল ঢাকায় আসে। ২২শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে বাংলাদেশ আইনজীবী সমিতির নেতৃত্বে একটি নির্বাচন পর্যবেক্ষকমণ্ডলী গঠিত হয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে চট্টগ্রাম শহরস্থ সার্কিট হাউসে এক নির্বাচনী জনসভায় বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভাষণে ঘােষণা করেণ, বি.এন.পি. ক্ষমতায় এলে চট্টগ্রাম শহরকে একটি বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তােলা হবে।” একই দিনে ঢাকায় এক নির্বাচনী জনসমাবেশে আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, “(আওয়ামী লীগ প্রতীক) নৌকায় ভােট দিলে
পৃষ্ঠাঃ ৩৭১
গণন্ত্র দেবাে।” ২৪শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে খুলনায় এক নির্বাচনী সভায় আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা তাঁর ভাষণে বলেন, “দেশে-বিদেশে রব উঠেছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাবে।” একই দিনে কেরাণীগঞ্জে এক নির্বাচনী জনসমাবেশে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, নির্বাচনে কারচুপি করা হলে বি.এন.পি. প্রতিরােধ গড়ে তুলবে।” নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিনে অর্থাৎ ২৫শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে ঢাকার পান্থপথে এক বিশাল নির্বাচনী জনসমাবেশে আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, . . . (আওয়ামী লীগ প্রতীক) নৌকায় ভােট দিলে মানুষ গণতন্ত্র পাবে, অর্থনৈতিক মুক্তি পাবে। ” এদিনেই ঢাকার মানিকমিয়া এভিনিউয়ে আয়ােজিত এক বিশাল জনসমাবেশে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, “বি.এন.পি.-এর হাতেই রয়েছে স্বাধীনতার পতাকা। অন্যদের হাতে রয়েছে গােলামীর জিঞ্জির।” উক্ত সমাবেশে তিনি অভিযােগ করে বলেন, নির্বাচনে কারচুপির চেষ্টা চলছে।”
২২। ২৬শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখ সন্ধ্যায় রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘এবারের নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে বাধ্য।” এদিন রাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, যে কোন মূল্যে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করা হবে।” ২৭শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১) তারিখে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দেশে অনুষ্ঠিত হয় পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সব মহল নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে। গভীর রাত পর্যন্ত বেসরকারীভাবে ঘােষিত ফলাফলে বি.এন.পি. এগিয়ে থাকে। ২৮শে ফেব্রুয়াররী (১৯৯১) তারিখের বিকেল চারটার মধ্যে ২৯৪ টি আসনের ফলাফল বেসরকারীভাবে ঘােষণা করা হয়। এর মধ্যে বি.এন.পি. ১৩৭ টি, আওয়ামী লীগ ৮৫টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি, জামাতে ইসলামী ১৮টি, সি.পি.বি. ৫টি, বাকশাল ৫টি, ন্যাপ (মােজাফফর) ১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ১টি, গণতন্ত্রী পার্টি ১টি, ইসলামী ঐক্যজোট ১টি, জাসদ (সিরাজ) ১টি, এনডিপি ১ টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩টি আসন পায়। বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ উভয়ই পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পাঁচটিতেই বিজয়ী হন। অপরদিকে আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র একটিতে বিজয়ী হন। এদিন বিকেল ২ টার দিকে আমি টেলিফোনে বি.এন.পি. চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে তাঁর ব্যক্তিগত ও দলের সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানাই। এদিন সন্ধ্যায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা অভিযােগ করে বলেন, “কতিপয় অদৃশ্য শক্তির গােপন আতাতের মাধ্যমে নির্বাচনে অতি সূক্ষ্ম ও সুকৌশলে কারচুপি করা হয়েছে।”
পৃষ্ঠাঃ ৩৭২
২৩। ১লা মার্চ (১৯৯১) তারিখে এক নির্বাচনােত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘নির্বাচন অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, সুস্থ ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তবে ভােটার তালিকা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। ভােটার তালিকায় ত্রুটি না থাকলে বি.এন.পি. দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেতাে।” অতঃপর তিনি আরও বলেন, “প্রয়ােজনে গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিয়ে আমরা কোয়ালিশন সরকার গঠন করবাে।” এদিনেই আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের অন্যতম বিশিষ্ট সদস্য এবং নির্বাচনে পরাজিত ডঃ কামাল হােসেন এক বিবৃতিতে গণরায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমি আশা করি, সবাই অর্জিত গণতন্ত্র রক্ষা করবেন। একই দিন রাতে রেডিও ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে নির্বাচনােত্তর ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, কোন দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এ ব্যাপারটি নিশ্চিত না হওয়ায় এ মুহূর্তে মন্ত্রিপরিষদ গঠন সম্ভব নয়।” ২রা মার্চ (১৯৯১) তারিখে বি.এন.পি. নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেন, সরকার গঠনে কোন প্রকার দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকা উচিৎ নয়।” ৩রা মার্চ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনা সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব স্বীয় কাঁধে নিয়ে সভানেত্রীর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদিকার নিকট পদত্যাগপত্র পেশ করেন। এদিন বি.এন.পি.-এর এক সংসদীয় দলের সভায় বেগম খালেদা জিয়া সর্বসম্মতভাবে বি.এন.পি.-এর সংসদীয় দলের প্রধান নির্বাচিত হন। অতঃপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
২৪। ৪ঠা মার্চ (১৯৯১) তারিখে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির (পুরাতন) ৩২ নেতুন ১১) নম্বর রােডস্থ বাড়ী, ‘বঙ্গবন্ধু ভবনে সমবেত হয়ে ম্যাডাম হাসিনার প্রতি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরােধ জানান। একই দিনে, এক জরুরী সভায় মিলিত হয়ে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি ম্যাডাম হাসিনার প্রতি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরােধ জানায়। ঐ দিন সন্ধ্যায় ম্যাডাম হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, “অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক মীমাংসা ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ গঠন করতে পারেন না। এর জবাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ প্রতিনিধিদলকে বলেন, “যিনিই প্রধানমন্ত্রী হােন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষতা হারাবেন না।” ৫ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের চাপে ম্যাডাম হাসিনা তাঁর পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে সম্মত হন। এদিকে গণন্ত্রী পার্টি, বাকশাল, ন্যাপ (মােজ্জাফফর) ও সিপিবি যৌথভাবে ঘােষণা করে যে, বি.এন.পি, সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে রাজি হলে তারা বি.এন.পি. কে সমর্থন দেবে। ৬ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আয়ােজিত এক বিজয় সমাবেশে বি.এন.পি. চেয়ারপারসন বেগম খালেদা
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৩
জিয়া তাঁর ভাষণে বলেন, জনগণের রায় মেনে নিয়ে একসঙ্গে কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।”
২৫। ইতিপূর্বে জানা গিয়েছিল যে, ৭ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে ১৯৭১ সালের ঐদিনে বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে) প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ দিবস উপলক্ষে রেডিও ও টেলিভিশনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। কিন্তু এই মার্চ (১৯৯১) তারিখে জানা যায় যে, সরকার তর্মে পূর্বগৃহীত সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এর প্রতিবাদে এবং রেডিও ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ (১৯৭১)-এর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারের দাবীতে ঐদিন সকালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হাজার হাজার লােক পৃথক পৃথকভাবে ঘেরাও করে রেডিও ও টেলিভিশন ভবন। এর ফলে ঐদিন কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। ঐদিন বিকালে ঢাকার পান্থপথে এক বিশাল জনসমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনা তাঁর ভাষণে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানান দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। ৮ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে জাতীয় পার্টির এক সংসদীয় দলের সভায় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে সংসদের ৪টি আসনের কিছু কিছু নির্বাচনী এলাকার স্থগিত নির্বাচন পুনরায় অনুষ্ঠিত হলে এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩টিতে এবং বি.এন.পি. ১টিতে বিজয়ী হয়। ১০ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের এক সভায় ম্যাডাম হাসিনা সর্বসম্মতভাবে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের নেত্রী নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের উক্ত সভায় অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম বহাল রেখেও প্রয়ােজনীয় সংবিধান সংশােধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রবর্তন করা সম্ভব।
২৬। ১১ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে জামাতে ইসলামীর এক প্রতিনিধিদল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সরকার গঠনে বি.এন.পি.কে পূর্ণ সমর্থন প্রদানে তাঁদের দলের সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এদিনই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ততাফায়েল আহমদ বলেন, ‘সংসদীয় পদ্ধতিতে বি.এন.পি. রাজি না হলে আওয়ামী লীগই (সংসদে) সংসদীয় (সরকার) পদ্ধতির বিল আনবে।” ১২ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে মুন্সীগঞ্জে আয়ােজিত এক নির্বাচন প্রচারণী সভায় বি.এন.পি, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেললে মন্ত্রী এমপিরাও রেহাই পাবে না।” ১৪ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সংকীর্ণ স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনে ভূমিকা পালনে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানানাে হয়। উক্ত সভায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের অন্যতম সদস্য ডঃ কামাল হােসেন ১২ পৃষ্ঠাব্যাপী এক চিঠিতে নির্বাচন সংক্রান্ত কতিপয় বিষয় উল্লেখ করে বলেন, (নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে) অতি উচ্চ ধারণা ও বিশ্বাস, আত্মম্ভরিতা এবং নেতা ও কর্মীদের
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৪
কর্মবিমুখতা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণ।” এদিনই মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বি.এন.পি. প্রার্থী বিজয়ী হন। ১৫ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর উপদেষ্টা পরিষদ বিলুপ্ত ঘােষণা করেন। ১৮ই মার্চ (১৯৯১) তারিখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলােকে বঙ্গভবনে গােল টেবিল বৈঠকে আহবান জানালে বি.এন.পি., নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় ঐক্যজোট উক্ত বৈঠকে যােগদান করতে অস্বীকৃতি জানায়।
২৭। ১৯শে মার্চ (১৯৯১) তারিখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বি.এন.পি. চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও ২১ জন প্রতিমন্ত্রীর সমন্বয়ে একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোেষণা করেন। ২০শে মার্চ (১৯৯১) তারিখে বিকেল আড়াইটায় বঙ্গভবনে নির্ধারিত ছিল প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। ম্যাডাম হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের অন্যান্য সংসদ সদস্যদের উক্ত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে এই ভেবে কোন আমন্ত্রণপত্র ছাড়াই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার জন্যে আমি অফিস থেকে যথাসময়ে বঙ্গভবনে যাই। বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে কর্তব্যরত কর্মকর্তাদেরকে আমার পরিচয় জানালে তাঁরা আমাকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেন। অতঃপর, বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত স্থান ‘দরবার হলে প্রবেশের পূর্বে আমার পরিচয় জানালে সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাকে প্রতিমন্ত্রীদের সারিতে বসিয়ে বলেন, “আপাততঃ এখানে বসুন। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনা এলে আপনাকে তাঁর সঙ্গে মন্ত্রীদের সারিতে বসানাে হবে।” শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয় বিকেল তিনটায়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধান মন্ত্রী, ১০ জনকে পূর্ণমন্ত্রী ও ২০ জনকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ প্রদান করেন। প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত করায় আব্দুল মতিন চৌধুরী সেদিন শপথ গ্রহণ করেননি। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনা কিংবা তাঁর দলের কোন নেতা বা সংসদ সদস্য উক্ত শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে আমি বেগম খালেদা জিয়া ও কতিপয় পরিচিত মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদেরকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ঐদিনই আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটসমূহের ১৯শে নভেম্বর (১৯৯০) তারিখে ঘােষিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও তার দায়িত্ব সম্পর্কিত রূপরেখা গ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির মন্ত্রিপরিষদ গঠনে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
২৮। ২১শে মার্চ (১৯৯১) তারিখে সরকারীভাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনাকে পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিরাধী দলীয় নেত্রী ঘােষণা করা হয়। ২৭শে মার্চ (১৯৯১) তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মিঃ মাইলাম প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে অভিনন্দন জানান। ২৮শে মার্চ (১৯৯১) তারিখে জাতীয়
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৫
সংসদে সংরক্ষিত ৩০টি মহিলা আসনের জন্য বি.এন.পি. ২৮ জনকে এবং জামাতে ইসলামী ২ জনকে মনােনয়ন প্রদান করলে তাদেরকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘােষণা করা হয়। এদিনে জাতীয় সংসদের কুষ্টিয়া-২ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এতে বি.এন.পি. প্রার্থী বিজয়ী হন। ১লা এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা কতিপয় সাংবাদিকের নিকট বলেন, ‘সংসদীয় সরকার পদ্ধতির লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তুলব।” ২রা এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হানিসার নেতৃত্বে দলের একটি প্রতিনিধিদল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তাঁদেরকে বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি জাতীয় সংসদে সমাধান হওয়া উচিৎ।”
২৯। ৪ঠা এপ্রিল রাতে বি.এন.পি. পঞ্চম জাতীয় সংসদে আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে স্পীকার এবং শেখ রাজ্জাক আলীকে ডেপুটি স্পীকারের পদদুটির প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন প্রদান করে। অপরদিকে, বিরােধী দলের সঙ্গে আলােচনা না করেই স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার পদদুটিতে মনােনয়ন প্রদান করায় আওয়ামী লীগ স্পীকার পদে সালাউদ্দিন ইউসুফকে এবং ডেপুট স্পীকার পদে জনাব আসাদুজ্জামানকে মনােনয়ন প্রদান করে। ৫ই এপ্রিল (১৯৯১) তারিখ সকাল নয়টায় পঞ্চম জাতীয় সংসদের উদ্বোধনী (প্রথম) অধিবেশন শুরু হয় বিদায়ী স্পীকার শাসুল হুদা চেধুরীর সভাপতিত্বে। তুমুল বাক-বিতণ্ডার মধ্যদিয়ে অবশেষে জাতীয় সংসদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতাে বিভক্তি ভােটে সংসদের স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার পদদুটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে আবদুর রহমান বিশ্বাস স্পীকার এবং শেখ রাজ্জাক আলী ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। সেদিন বিকেল তিনটায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ সংসদে প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে ভাষণ দেন। উক্ত ভাষণে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি বা সংসদীয় পদ্ধতি—কি ধরনের সরকার হবে সেটা আমার ব্যাপার নয়, সেটা সংসদের ব্যাপার। আমার ইচ্ছা এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়া। ”
৩০। ৭ই এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে সংসদে কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনার নাম সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পরেই স্থান না দেওয়ার প্রতিবাদে বিরাধীদল একজোটে সংসদ থেকে ওয়াক আউট করে। এই সময় সংসদের সকল বিরােধীদল এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোেগ করে বলে, “সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠায় বি.এন.পি’র কোন উদ্যোগ নেই।” ৮ই এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে বি.এন.পি. বিরােধীদলের দাবির প্রেক্ষিতে কার্য উপদেষ্টা কমিটির নামের তালিকা সংশােধন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ১০ই এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে বলেন, ‘বার ঘন্টার মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত) এরশাদকে কারাগারে পাঠাতে হবে। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সংসদে বলেন,
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৬
“এরশাদকে শিগগিরই কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হবে। কিন্তু কারাগারে পাঠাতে অনেক নিয়ম-কানুন আছে। কাজেই এ ব্যাপারে কিছু সময়ের প্রয়ােজন।” ১৮ই এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে এরশাদ সাহেবকে গুলশানস্থ অন্তরীণ রাখা বাড়ি থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ২৪শে এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দল গত ১৪ই এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে সংবিধান একাদশ সংশােধনী বিল সংসদ সচিবালয়ে জমা দিয়েছে।” ২৫শে এপ্রিল (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত রেডিও এবং টেলিভিশন সংস্থাকে সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করার বিরােধী দলীয় প্রস্তাব সরকারী সংসদীয় দলের কণ্ঠভােটে নাকচ হয়ে যায়।
৩১। ২৮শে মে (১৯৯১) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করে শিক্ষার উপযােগী পরিবেশ গড়ে তােলার উপায় খুজে বের করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করার জন্যে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সম্মেলন কক্ষে আয়ােজিত প্রস্তাবিত সভায় যােগদান করতে গিয়ে জামাতে ইসলামীর সংসদীয় দলের নেতা মতিউর রহমান নিজামী কতিপয় ছাত্র কর্তৃক প্রহৃত হন দারুণভাবে। ১লা জুন (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা অকস্মাৎ সিঙ্গাপুর চলে যান চিকিৎসার জন্যে। ৫ই জুন (১৯৯১) তারিখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক রেডিও ও টেলিশিনের ভাষণে বলেন, ‘সরকার পদ্ধতির প্রশ্নটির) মীমাংসা করে আমাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব থেকে অনতিবিলম্বে অব্যাহতি দিন।” ৬ই জুন (১৯৯১) তারিখে ঢাকার গুলিস্তান চত্বরে বি.এন.পি. কর্তৃক আয়ােজিত এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “বি.এন.পির (সরকারের) বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।” ৭ই জুন (১৯৯১) তারিখে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ৯ই জুন (১৯৯১) তারিখে দেশের সরকার পদ্ধতির প্রশ্নে আয়ােজিত বি.এন.পি, কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় নাটকীয়ভাবে সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১০ই জুন (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত বি. এন. পি. সংসদীয় দলের এক সভায় সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে। ১২ই জুন তারিখে বিশেষ আদালত অস্ত্র আইনে ক্ষমতাচ্যুত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করে। ১৭ই জুন (১৯৯১) তারিখে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “বি.এন.পি. এখন সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পক্ষে।” ৩০শে জুন (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদে বিরােধীদলের চীফ হুইপ মােহম্মদ নাসিম, খুনী খন্দকার মােশতাক আহমদ কর্তৃক
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৭
১৯৭৫ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর তারিখে জারিকৃত ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) বাতিলকরণ প্রস্তাব সংক্রান্ত একটি বিলের নােটিশ সংসদ সচিবালয়ে দাখিল করেন। ঐ দিনই রংপুরের ১১ জন জাতীয় সংসদ সদস্যের চিঠিপত্র আটক সংক্রান্ত বিষয়ে জাতীয় সংসদে এক ভীষণ উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা হয়। এর এক পর্যায়ে সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা অভিযােগ করে বলেন, “বি.এন.পি.-এর স্বৈরাচারী চেহারা প্রকাশ পাচ্ছে।”
৩২। ১লা জুলাই (১৯৯১) তারিখে রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, ‘সময়ের চাহিদা অনুসারে সংসদীয় সরকার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জাতীয় সংসদ শিগগির এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।” এদিনই প্রধানমন্ত্রীর উক্ত ভাষণের ব্যপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, ‘জনগণের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে বি.এন.পি. সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” ২রা জুলাই (১৯৯১) তারিখে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে জাতীয় সংসদে পেশ করেন সংসদীয় সরকার পদ্ধতি সংক্রান্ত সংবিধান দ্বাদশ সংশােধনী বিল (১৯৯১)। অতঃপর, আইন বিচার বিষয়ক মন্ত্রী মির্জা গােলাম হাফিজ সংসদে পেশ করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের পূর্বপদে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে) ফিরে যাওয়া সংক্রান্ত সংবিধান একাদশ সংশােধন বিল (১৯৯১)। ৪ঠা জুলাই (১৯৯১) তারিখে বহু আগে সংসদের বিরােধী দলীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ কর্তৃক পেশকৃত সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহবুদ্দিন আহমদের পূর্বপদে প্রত্যাবর্তন সংক্রান্ত বিলটি সংসদে পুনরায় উথাপিত হয়। সংসদের স্পীকার উক্ত বিলটিকে সংবিধান ত্রয়ােদশ সংশােধনী বলে রুলিং দিলে প্রায় আড়াই ঘন্টা ভীষণ উত্তপ্ত বিতর্কের পর বিরােধী দলের সাংসদরা সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন। ৬ই জুলাই (১৯৯১) তারিখে ৫ দলীয় ঐক্যজোটের নেতৃবৃন্দ সংবিধান সংশােধনীর ব্যাপারে একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনার সঙ্গে। ৯ই জুলাই (১৯৯১) তারিখে সরকারী দলের দুইটি সংবিধান সংশােধন বিল এবং আওয়ামী লীগের সংবিধান সংশােধন বিলগুলাে সংসদের বিশেষ স্থায়ী কমিটিতে পাঠানাের জন্যে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
৩৩। ১০ই জুলাই (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন ইউসুফ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আনয়নের লক্ষ্যে সংসদ সচিবালয়ে একটি সংবিধান সংশােধন বিলের নােটিশ পেশ করেন। ১৪ই জুলাই (১৯৯১) তারিখে সংসদ উপনেতা এ.কিউ.এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে সংসদকে অবহিত করেন যে, এরশাদের
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৮
শাসন আমলে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৩২ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত হয়েছে এবং ৮১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১৫ই জুলাই (১৯৯১) তারিখে তৎকালীন সংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী ওসমান গনি খান জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে সংসদকে জানান যে, দেশে ৬২ হাজার ৭৭টি সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। ১৬ই জুলাই (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদে ‘গণভােট’ আইন (১৯৯১) উথাপিত হয়। এই বিষয়ের ওপর বিরােধী দলীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদকে বক্তব্য রাখতে না দেওয়ার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ সাংসদরা একজোটে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন। ২৮শে জুলাই সংবিধান সংশােধনী বাছাই সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি সংসদে তাঁদের রিপাের্ট পেশ করেন। সরকারী দলের উত্থাপিত বিলটিতে ২৬ টি পরিবর্তন আনা হয়। ৩০শে জুলাই (১৯৯১) তারিখে সংসদে শুরু হয় সংবিধান সংশােধন বিল দু’টির ওপর আলােচনা। বিরােধী দল, আওয়ামী লীগে এ ব্যাপারে আরও কিছু গ্রহণ-বর্জনের দাবি করে। ঐ দিনেই বাকশাল আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হওয়ার জন্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একই দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয়তাবাদী দলের অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে শত শত রাউন্ড গুলী বিনিময় হয়। উক্ত ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হয়। ৩১শে জুলাই (১৯৯১) তারিখে সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদরা সংবিধান সংশােধন বিল (১৯৯১)-এর ওপর আলােচনায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের পূর্বপদে (সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে) ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তােলেন।
৩৪। ১লা আগস্ট (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের সাংসদরা ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ বাতিলের ব্যাপারে সরকারী দল বি.এন.পি.-এর নেতত্বের প্রতি আহবান জানান একটি সমঝােতায় পৌছনাের জন্য। ২রা আগস্ট (১৯৯১) তারিখে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়া অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে বলেন, সংবিধান সংশােধন বিল পাশে আওয়ামী লীগ রাজি নাও হতে পারে। এর জবাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধান সংশােধন বিল পাস না হলে আমি পদত্যাগ করবাে।” ৩রা আগস্ট (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর কাছে সংবিধান সংশােধনীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। ৪ঠা আগস্ট (১৯৯১) তারিখে পত্রপত্রিকায় এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সশস্ত্র বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও তাঁর পরিবারবর্গ ৩১শে জুলাই (১৯৯১) থেকে জিম্মি হয়ে আছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্ত করার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের নির্বাচিত
পৃষ্ঠাঃ ৩৭৯
সদস্যগণ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে জরুরী তারবার্তা পাঠান। একই দিনে জাতীয় সংসদে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। বিরােধী দলের নেত্রী ম্যাডাম হাসিনার বক্তব্যের সময় ট্রেজারী বেঞ্চ থেকে হৈ চৈ করা হলে সংসদে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এর ফলে, ১ ঘন্টা ১০ মিনিট ধরে কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর আবার সংসদে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়। ৫ই আগস্ট (১৯৯১) তারিখে বি.এন.পি. সরকার সংবিধান একাদশ ও দ্বাদশ সংশােধন বিল পাস করানাের লক্ষ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সংগে জাতীয় পার্টির শীর্ষ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যথাপার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান চৌধুরী, সংসদে পার্টির সংসদীয় দলের নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং পার্টির সেক্রেটারী জেনারেল ও সংসদ সদস্য শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন সাহেবদের দুই ঘন্টা বৈঠক করার অনুমতি দেয়। কেন্দ্রীয় কারাগারে অনুষ্ঠিত উক্ত বৈঠকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য হসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় পার্টির সাংসদদেরকে সংসদে সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পক্ষে ভােট দেয়ার নির্দেশ দেন।
৩৫। ৬ই আগস্ট (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদে সংবিধান একাদশ ও দ্বাদশ সংশােধনীদ্বয় অনুমােদিত হয়। সংবিধান একাদশ সংশােধন (১৯৯১) বিলে জাতীয় পার্টি ও এন.ডি.এফ. ভােটদানে বিরত থাকলেও সংবিধান দ্বাদশ সংশােধন (১৯৯১) বিল পাস হয় সর্বসম্মতভাবে। উল্লেখ্য, সংবিধান একাদশ সংশােধনীর মাধ্যমে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার দিবস হতে তাঁর পূর্বপদে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদে) ফিরে যাওয়ার দিবস পর্যন্ত সময়কালে গৃহীত ও কৃত সকল পদক্ষেপ ও ক্রিয়াকলাপ বৈধ বলে ঘােষিত হয়। সংবিধান একাদশ সংশােধন আইন (১৯৯১) সংবিধানের চতুর্থ তফশিলের ২০ অনুচ্ছেদের পর ২১ অনুচ্ছেদ হিসেবে সংযযাজিত করা হয়। এতে বলা হয়ঃ ১৩৯৭ বঙ্গাব্দের ২১শে জুহায়ন মােতাবেক ১৯৯০ সালে ৬ই ডিসেম্বর তারিখে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ােগ ও শপথ প্রদান এবং তাঁহার নিকট পদত্যাগ প্রদান এবং ১৩৯৭ বঙ্গাব্দের ২১শে অগ্রহায়ন মােতাবেক ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর হইতে সংবিধান (একাদশ সংশােধন) আইন, ১৯৯১ (আইন নং ২৪, ১৯৯১) এর প্রবর্তনের তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে বা ২১ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হইয়া কার্যভার গ্রহণ করা পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে (যাই পরে হউক) উক্ত উপ-রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রয়ােগকৃত সকল ক্ষমতা, প্রণীত সকল আইন ও অধ্যাদেশ এবং প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত অথবা প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত বলিয়া বিবেচিত সকল আদেশ, সকল কাজকর্ম এবং সকল ব্যবস্থা এতদ্বারা অনুমােদিত ও সমর্থিত হইল এবং আইনানুযায়ী যথাযথভাবে প্রণীত, প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘােষিত হইল।”
পৃষ্ঠাঃ ৩৮০
৩৬। সংবিধান দ্বাদশ সংশােধনীর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ও শাসনের ব্যবস্থা করা হয়। সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী সরকারের কার্যনির্বাহী প্রধান। উল্লিখিত দ্বাদশ সংশােধনীতে প্রধানমন্ত্রীর ও রাষ্ট্রপতির যে দায়িত্ব ক্ষমতা প্রদান করা হয় তা মােটামুটি বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালে প্রবর্তিত সংবিধানে প্রদত্ত দায়িত্ব ও ক্ষমতার অনুরূপ। জাতীয় সংসদে সংবিধাধান একাদশ এবং দ্বাদশ সংশােধনীদ্বয় পাস হওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার ৭ই আগস্ট (১৯৯১) দিবসকে সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা করে। ৭ই আগষ্ট (১৯৯১) সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও এবং টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে জাতীয় সংসদে সংবিধান একাদশ ও দ্বাদশ সংশােধনীদ্বয় পাস হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন। এদিকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা জাতীয় সংসদে সংবিধান দ্বাদশ সংশােধনী পাস হওয়ার ঘটনাকে জনগণের আশা ও আকাংক্ষা বাস্তবায়নের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে অভিহিত করেন।
৩৭। ৮ই আগস্ট (১৯৯১) তারিখে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা ও সংসদে বিরােধী দলের চীফ হুইফ মােহাম্মদ নাসিম জাতীয় সংসদে পেশ করেন ‘ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অর্ডিন্যান্স (১৯৭৫ সালের ১৯ নং অর্ডিন্যান্স) বাতিল সংক্রান্ত বিল। বিলটির ওপর কিছু আলােচনার পর সেটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে সংসদে গঠিত একটি ১৫ সদস্যবিশিষ্ট বিশেষ (স্থায়ী কমিটিতে পাঠনাের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১২ই আগস্ট (১৯৯১) তারিখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি মােহাম্মদ আব্দুর রউফ রেডিও ও টেলিভিশনে জাতীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন যে, সংবিধানের বিধান মােতাবেক সংবিধান দ্বাদশ সংশােধনীর জন্য গণভােট গ্রহণ আবশ্যক এবং তা অনুষ্ঠিত হবে ১৫ই সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে। ১৩ই আগষ্ট (১৯৯১) তারিখ রাত ২ টা ৪৫ মিনিটে বিরােধী দল সমূহের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও জাতীয় সংসদে পাস করানাে হয় সরকারী দল বি.এন.পি. কর্তৃক পেশকৃত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন (১৯৯১) বিল। উক্ত আইনে সাংসদদের প্রকাশ্য ভােটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
৩৮। ১৪ই আগস্ট (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৫ই আগস্ট (১৯৯১) তারিখ আওয়ামী লীগ কর্তৃক ঘােষিত বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ১৬ তম শাহাদাত দিন শােক দিবস হিসেবে পালিত হয়। ঐদিন জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ও জনাব আব্দুর রাজ্জাকসহ ‘বাকশালের নেতা ও কর্মীরা। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। বিষয়ক যে, জনগণ কর্তৃক গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সরকারও অতীতের জিয়াউর রহমান, বিচারপতি আব্দুস সাত্তার এবং এরশাদ সরকারগুলাের মতাে বঙ্গবন্ধুর
পৃষ্ঠাঃ ৩৮১
শাহাদাতের দিবস উপলক্ষে সরকারী প্রচার মাধ্যম, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদিতে কোন অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। ৩১শে আগষ্ট (১৯৯১) তারিখে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ. এম. এরশাদের বিরুদ্ধে বিশেষ আদালতে দেশের বৃহত্তম সােনা চোরাচালান মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়।
৩৯। ১লা সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে উপ-নির্বাচনের পূর্বে বি.এন.পি.-এর ত্রয়ােদশ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজিত এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “পাঁচ বছরের আগে কোন চক্রান্ত করে বি.এন.পি.কে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না।” ৬ই সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে উপ-নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা মানিক মিয়া এভিনিউয়ে আয়ােজিত এক বিশাল জনসমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা অভিযােগ করে বলেন, “বি.এন.পি. সরকার গণতান্ত্রিক আচরণ করছে না।” ১১ই সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে সংসদের ১১ টি আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার একটি আসনে ব্যাপক সন্ত্রাস হয়। ঐদিন সকালে ঢাকার ভোেট কেন্দ্রগুলাে পরিদর্শনকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনা সেন্ট্রাল রােডস্থ তােটকেন্দ্রে যাওয়ার সময় কে বা কারা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলী ছোঁড়ে। ঐ গুলী উক্তস্থানে দণ্ডায়মান এক রিক্সা চালককে আঘাত করলে সে অকুস্থলেই প্রাণ হারায়। এরপর, সেখানে আরও কিছুক্ষণ গােলাগুলী চলে। ঢাকার অপর আসন সহ বাকি আসনের নির্বাচন মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। উপ- নির্বাচনের ১১টি আসনের মধ্যে ৫টিতে বি.এন.পি., ৪টিতে জাতীয় পার্টি এবং ২ টিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হন। ১২ই সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে রেডিও ও টেলিভিশনে জাতীর উদ্দেশ্য প্রদত্ত এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, “ গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দেয়ার শেষ পর্যায়ে রয়েছি।” এদিনই আওয়ামী লীগ দলীয় সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনার ১১ই সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে ভােটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে সেন্ট্রাল রােডে প্রাণনাশের চেষ্টার প্রতিবাদে ১৪ই সেপ্টেম্বর (১৯১১) তারিখ সারাদেশে অর্ধদিবস হরতালের কর্মসূচী ঘােষণা করে। উক্ত কর্মসূচী অনুযায়ী ১৪ই সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে বিছিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার মধ্য দিয়ে সরাদেশের অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়।
৪০। ১৫ই সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে দেশে গণতােট অনুষ্ঠিত হয় সংবিধান দ্বাদশ সংশােধনীর ব্যাপারে জনগণের মতামত গ্রহণে। উক্ত গণভােটে মােট ভােটারের মাত্র ৩৪.৯৩ শতাংশ ভােটার ভােট প্রদান করে। এর মধ্যে সংবিধান দ্বাদশ সংশােধনীর পক্ষে ভোেট পড়ে ৮৪.৪২ ভাগ। অতঃপর দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বলবৎ হয়। ১৯ শে সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে বেগম খালেদা জিয়া সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ও শাসন ব্যবস্থার অধীনে নতুন করে প্রধামন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই অনুষ্ঠানে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রীসভার সদস্যগণও শপথ গ্রহণ করেন। এদিনই নির্বাচন কমিশন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ও শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ধার্য করে ৮ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখ।
পৃষ্ঠাঃ ৩৮২
২৪শে সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে বি.এন.পি. তৎকালীন সংসদ স্পীকার আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য মনােনয়ন প্রদান করে। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের উদ্দেশ্যে মনােনয়ন দাখিলের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫শে সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখ। ঐ দিন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জাতীয় ঐকমত্যের প্রার্থী হিসেবে বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে নির্বাচনের জন্যে মনােনয়ন প্রদানের কথা ঘােষণা করা হয়। এছাড়াও আওয়ামী লীগের আলহাজ মকবুল হােসেনও রাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হন। ২৬শে সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদের সবগুলাে বিরােধী দল এক সভায় মিলিত হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করে। সভাশেষে, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলের নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, “বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী দলীয় প্রার্থী নন। তিনি জাতীয় ঐকমত্যের প্রতীক।” ঐদিনই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মনােনয়ন বাছাইয়ের পর নির্বাচন কমিশন প্রাপ্ত ৩টি মনােনয়নপত্রই বৈধ ঘােষণা করে। ৩০শে সেপ্টেম্বর (১৯৯১) তারিখ ছিল রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের মনােনয়ন পত্র প্রত্যাহারের জন্য নির্ধারিত। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী আলহাজ মকবুল হােসেন তাঁর মনােনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। ঐদিনেই সরকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সংসদের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ঘােষণা করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন (১৯৯১)-এর সংশােধনী হিসেবে একটি অধ্যাদেশ জারি করে।
৪১। ১লা অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন (১৯৯১)-এর সংশােধন অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগে তিনটি পৃথক রীট দাখিল করেন আওয়ামী লীগসহ বিরােধী দলগুলাের কতিপয় নেতা। এদিনই জাতীয় সংসদের সবগুলাে বিরােধী দল এক জরুরী সভায় মিলিত হয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন (১৯৯১)-এর সংশােধন অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে সােচ্চার হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান। ২রা অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন সংশােধন অধ্যাদেশটির বিরুদ্ধে পেশকৃত রীটগুলাে শুনানির বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্যে হাইকোর্টের অবকাশকালীন বেঞ্চ সেগুলাে সুপ্রীম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নিকট পাঠান। এদিকে, বি.এন.পি.-এর মহাসচিব ব্যারিস্টার আবদুস সালাম তালুকদার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন (১৯৯১) সংশােধন অধ্যাদেশটি সংবিধান সম্মতভাবেই জারি করা হয়েছে।” ৩রা অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে সরকার গণদাবির মুখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন (১৯৯১) সংশােধনী অধ্যাদেশটি প্রত্যাহার করে। ৪ঠা অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দুইজন প্রার্থী যথাআব্দুর রহমান বিশ্বাস এবং বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী পাকিস্তানী নাগরিক হয়েও জামাতে ইসলামীর কার্যতঃ আমীর অধ্যাপক গােলাম আযমের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁর দোয়া চান। একই দিনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রকাশ্য ভােটের বিধানের বিরুদ্ধে সংসদে বিরােধী দলীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদসহ ৭ নেতার
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৩
পেশকৃত রীট আবেদনের শুনানি শুরু হয়। ৫ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অন্যতম প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। ৬ই অক্টেবর (১৯৯১) তারিখে হাইকোর্টে শুনানি হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন স্থগিত হবে কিনা সে প্রশ্নে সংসদে বিরােধী দলীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদসহ ৭ নেতার পেশকৃত রীট আবেদনের প্রেক্ষিতে। একই দিনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জাতীয় ঐকমত্যের প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী সাক্ষাৎ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনার সঙ্গে। এদিকে বি.এন.পি. সংসদীয় দলের এক সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বি.এন.পি. সংসদ সদস্যদের প্রকাশ্যে ভােট প্রদানের জন্যে। ৭ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবকাশকালীন বেঞ্চ ৮ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠেয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন স্থগিত রাখার আবেদন নাকচ করে দেন।
৪২। ৮ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ কক্ষে সাংসদদের প্রকাশ্য ভােট প্রদান ব্যবস্থায় অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। উক্ত নির্বাচনে বি.এন.পি. প্রার্থী আব্দুর রহমান বিশ্বাস ১৭২ ভােট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘােষিত হন। অপর প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী মাত্র ৯২ ভােট পান। জাতীয় পার্টি এবং জামাতে ইসলামীর সাংসদরা উক্ত নির্বাচনে ভােটদানে বিরত থাকেন। ৯ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে আব্দুর রহমান বিশ্বাস সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এই শপথ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির সাংসদরা উপস্থিত ছিলেন না। ১০ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ তাঁর। পূর্বপদে অর্থাৎ বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচরপতির পদে ফিরে যান। ১২ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত সংসদীয় পদ্ধতির প্রথম সংসদ অধিবেশনে সংসদের ডেপুটি স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী সংসদের নতুন স্পীকার নির্বাচিত হন সর্বসম্মতভাবে। ১৩ই অক্টোবর (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদের নতুন ডেপুটি স্পীকার হিসেবে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত হন বি,এন,পি’র হমাউন খান পন্নী। ২৭শে অক্টোবর (১৯৯১) তারিখ বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকায় প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে সশস্ত্র সংঘর্ষ চলে বি.এন.পি.-এর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের মধ্যে। উক্ত ঘটনায় ছাত্রদলের দুইজন সশস্ত্র ছাত্র, ছাত্রলীগের একজন নিরস্ত্র ছাত্র এবং একজন টোকাই কিশাের প্রাণ হারায়। এই ঘটনার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের তৎপরতা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন।
৪৩। ১৯৯১ সালের ৩০শে অক্টোবর তারিখে একটি ঘটনা ঘটে যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রণিধানযােগ্য। উক্ত ঘটনাটি হলাে “প্ৰজন্ম ১৯৭১” নামক একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ।
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৪
দেশের অনেক যুবক-যুবতী এবং তরুণ-তরুণী যারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে ছিল অবুঝ শিশু এবং যাদের জন্য স্বাধীনতা উত্তরকালে গঠন করে এই সংগঠন। এদের অনেকেই ১৯৭১ সালে দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর তথাকথিত শান্তি বাহিনী, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি সংগঠনের সদস্যদের হাতে নিহত শহীদ পরিবারের সন্তান। তাদের মনে অনেক জিজ্ঞাসা ও প্রশ্ন। মূলতঃ, তারা জানতে চায় স্বাধীন বাংলাদেশের অ্যুদয় ও সৃষ্টির সঠিক ইতিহাস ও নেপথ্যকাহিনী। ১৯৭১ সালে এদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বিভিন্ন পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী তথা আপামর জনসাধারণকে কেনইবা ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী ও তার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে? কিসের লক্ষ্য, আদর্শ, মূল্যবােধ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশের লাখাে লাখাে নরনারী আত্মাহুতি দিয়েছিল ১৯৭১-এর মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে কেন ও কিভাবে জাগ্রত ও উজ্জীবিত হয়েছিল তাদের এই চেতনা। এই উপলব্ধি ও চেতনাবােধ কি একদিনে ঘটেছিল, না এর পেছনে ছিল সুদীর্ঘকালের ত্যাগ, তিতিক্ষা, আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস? কে বা কারা জনগণকে দিকনির্দেশনা প্রদান ও সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুদীর্ঘকালের সেই সমস্ত আন্দোলন ও সামে? লাখাে লাখাে নরনারীর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমানের তরুণ সমাজের সেই সুদীর্ঘকালের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও সম্রামের সঠিক তথ্য ও ইতিহাস জানতে চাওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত। একই সঙ্গে শহীদ পরিবারের সন্তানরা চায় সেই সমস্ত ব্যক্তির বিচার যারা সজ্ঞানে ও সক্রিয় অংশগ্রহণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহায়তা ও সহযােগিতা করেছিলাে গণহত্যা, নারীর সম্ভ্রমহানী, মানুষের বাড়ীঘর, হাটবাজার ও কলকারখানায় অগ্নিসংযােগ, সয়সম্পত্তি ধ্বংস, লুণ্ঠন ইত্যাদি গর্হিত অপরাধমূলক ও মানবতাবিরােধী কার্যকলাপে।
৪৪। ৩রা নভেম্বর (১৯৯১) তারিখে সারাদেশে পালিত হয় আওয়ামী লীগের ‘জেল হত্যা প্রতিবাদ কর্মসূচী। এই কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ঢাকায় আয়ােজিত এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অর্ডিন্যান্স (১৯৭৫) বাতিল করা নিয়ে টালবাহানা জাতি বরদাশত করবে না।” ৪ঠা নভেম্বর (১৯৯১) তারিখে জাতীয় সংসদে ১৯৭৫ সালের ৩ রা নভেম্বর তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যার ব্যাপারে আলােচনার সময় এক উত্তপ্ত বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিতর্কের এক পর্যায়ে বিরােধীদল আওয়ামী লীগের সাংসদরা বলেন, “সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডেরই আমরা নিন্দা করি।” ৮ই নভেম্বর (১৯৯১) তারিখে প্রয়াত কর্নেল (অবঃ) তাহেরের স্মৃতিচারণ উপলক্ষে জাসদ (ইনু) আয়ােজিত এক আলােচনা সভায় কতিপয় বক্তা বলেন, জিয়াউর রহমান কর্নেল (অবঃ) তাহেরকে হত্যার মধ্য দিয়ে (১৯৭৫ সালের) ৭ই
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৫
নভেম্বরের চেতনাকে ধ্বংস করেছে।” ২রা ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশে সফরে আগত পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইশতেকলাল পার্টি প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) আসগর খান বলেন, “শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড অত্যন্ত দুঃখজনক। বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলন ছিল ন্যায্য।” ৫ই ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক জরুরী সভায় বলা হয়, “(জাতীয়) বিজয় দিবসের কর্মসূচী সংকুচিত করা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র।” ৬ই ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে ৮ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটগুলাে এবং বি.এন.পি. ঢাকায় পৃথক পৃথকভাবে তিনটি জনসভার আয়ােজন করে এরশাদ ও তার সরকারের পতনের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে। বি.এন.পি. জনসভার আয়ােজন করে গুলিস্তান এলাকায়, ৮ দলীয় ঐক্যজোট বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে এবং ৫ দলীয় ঐক্যজোট জিরাে পয়েন্ট এলাকায়। পুলিশ ৮ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটদুটির জনসভায় বেপরােয়াভাবে লাঠিচার্জ ও কাঁদনে গ্যাস নিক্ষেপসহ গুলীবর্ষণ করে। এই ঘটনায় শতাধিক লােক আহত এবং ৪২ জন গুলীবিদ্ধ হওয়াসহ ৮ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটদ্বয়ের জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। পুলিশ দিয়ে জনসভা ভেঙ্গে দেওয়ার প্রতিবাদে ৮দলীয় ঐক্যজোট ৮ই ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে সারাদেশে ৮ ঘন্টা হরতাল পালনের কর্মসূচী ঘােষণা করে। অতঃপর ৮ই ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে সারাদেশে পালিত হয় ৮ দলীয় ঐক্যজোট আহূত ৮ ঘন্টা হরতাল।
৪৫। ১০ই ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে দ্বিধাবিভক্ত বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদের দুইটি পৃথক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত আব্দুল আহাদ চৌধুরী ও আব্দুল আজিজের নেতৃত্বাধীন সমাবেশে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান উচ্চারিত হয়। এই সমাবেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচার দাবি করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঘাতকদের নেতা অধ্যাপক গােলাম আযমের সরকার বিচার না করায় এবং স্বাধীনতা বিরােধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। ২৭শে ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে ‘ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অর্ডিন্যান্স’ (১৯৭৫) বাতিল বিল সম্পর্কে অনুষ্ঠিত সংসদীয় বিশেষ (স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এর আইনগত বিষয়ে ঐকমত্য ব্যক্ত করা হয়। ২৯শে ডিসেম্বর (১৯৯১) তারিখে জামাতে ইসলামী আমীর (দল প্রধান হিসেবে নির্বাচিত করে ১৯৭১-এর দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা, জনগণের বাড়ীঘর-কলকারখানায় অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন, নারীধর্ষণ, ইত্যাদি অপরাধমূলক ও মানবতাবিরােধী কার্যকলাপে সহায়তা ও সহযােগিতাকারী অথবা স্বয়ং নিজেরা এ জাতীয় কার্যকলাপ সংঘটনের জন্য দায়ী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীগুলাের প্রধান সংগঠক ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রবিরােধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপ সংগঠনের অন্যতম নেতা অধ্যাপক গােলাম আযমকে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৬
৪৬। ৪ঠা জানুয়ারী (১৯৯২) তারিখে জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হলে স্বাধীনতা বিরােধী পাকিস্তানী নাগরিক অধ্যাপক গােলাম আযমকে জামাতে ইসলামীর দলের আমীর (দলীয় প্রধান) নির্বাচিত করা সংবিধানের ৩৮ ধারামতে আইন সম্মত কিনা সে সম্পর্কে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে তখন সংসদে তুমুল বাক-বিতণ্ডা ও হৈ চৈ হয়। এর এক পর্যায়ে সংসদ স্পীকার ৮ই জানুয়ারী (১৯৯২) তারিখ এই বিষয়ে সংসদে আলােচনার জন্য ধার্য করেন। ৮ই জানুয়ারী (১৯৯২) তারিখে সংসদে অধ্যাপক গােলাম আযমকে জামাতে ইসলামীর দলের আমীর (দলীয় প্রধান নির্বাচিত করার বিষয়কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের মােহাম্মদ শামসুল হক, আজিজুর রহমান, আব্দুল আওয়াল মিয়া এবং ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ৪টি পৃথক মূলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সংসদ স্পীকার, শেখ রাজ্জাক আলী মােহাম্মদ শামসুল হকের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে সে সম্পর্কে সাধারণ আলােচনার সুযােগ প্রদান করেন। অতঃপর, মােহাম্মদ শামসুল হক বলেন যে, বিদেশী কোন নাগরিককে বাংলাদেশে অবস্থানকালে বাংলাদেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন মেনে চলতে হয়। সুতরাং পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে আধ্যাপক গােলাম আযম কোন অবস্থাতেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। বিতর্কের দ্বিতীয় বক্তা জামাতে ইসলামীর সংসদ সদস্য রহুল কুদ্দুস বলেন, গােলাম আযম জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তার নাগরিক অধিকার অন্যায়ভাবে হরণ করা হয়েছে।” এরপর ওয়ার্কার্স পার্টির একমাত্র সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একজন নাগরিক অধিকার রহিত ব্যক্তিকে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নির্বাচিত করে একটি মুক্তিযুদ্ধের ফসল আমাদের সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে।” জনাব রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, “অধ্যাপক গােলাম আযম কেবল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই স্বাধীনতাবিরােধী ছিলেন না, স্বাধীনতার পরও ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৮ সালে গােলাম আযম পাকিস্তানের পাসপাের্টে বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন—জন্মসূত্রের নাগরিকত্বের দাবি নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেননি।” অতঃপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সদস্য হওয়ার ব্যাপারে সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে জনাব রাশেদ খান মেনন বলেন, “আজকে আমাদের আলােচ্য বিষয়ে জানার কথা জামাতে ইসলামীর কাছ থেকে নয়, ক্ষমতাসীন বি.এন.পি, সরকারের কাছ থেকে।”
৪৭। এরপর এদিন সংসদে আওয়ামী লীগের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “অধ্যাপক গােলাম আযম পাকিস্তানে বসে ‘মুসলিম বাংলা কায়েম কমিটি’, ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি প্রভৃতির সদস্য হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অ্যুদয়ের পরও বাংলাদেশের বিরােধিতা করেছেন, আন্তর্জাতিক সংস্থায়ও বাংলাদেশ বিরােধী বক্তব্য রেখেছেন।” জনাব আব্দুর রাজ্জাক আরও
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৭
বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করেছেন, জিয়াউর রহমান সরকার ১৯৭৫এর পর সেই রাজাকার বাহিনীর নেতা ও সদস্যদেরকে শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিতই করেননি, তাদেরকে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও বানিয়েছেন। পরিশেষে, জনাব আব্দুর রাজ্জাক অধ্যাপক গােলাম আযমের মতাে যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে শাস্তি বিধানের জোর দাবি জানান। এর পর জামাতে ইসলামীর সংসদ সদস্য শেখ আনসার আলী বলেন, “জামাতে ইসলামী, বাংলাদেশ, (অধ্যাপক) গােলাম আযমকে দলের) আমির বানিয়ে ভুল করেনি।” বিতর্কের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন আহমদ স্বাধীনতা বিরােধী পাকিস্তানের নাগরিক আধ্যপক গােলাম আযমকে জামাতে ইসলামীর আমির নির্বাচিত করার কঠোর সমালােচনা করে বলেন, ‘অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন বি.এন.পি.কে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য জামাতে ইসলামীর সমর্থন নিতে হয়েছে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সরকারই রাজাকারদের (রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে) পুনর্বাসিত করেছেন এবং অধ্যাপক গােলাম আযমকে বাংলাদেশে এনেছেন।” এদিন বি.এন.পি.-এর সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া বলেন, “একজন লােক যদি অপরাধ করে থাকে, তাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে।” সংসদে এই পর্যায়ে বিরােধী দল থেকে শেইম’, ‘শেইম’, উচ্চারিত হতে থাকে এবং তার বক্তব্য কোলাহলে তলিয়ে যায়। সরকারী দলের কয়েকজন সংসদ সদস্যকেও তার বক্তব্যে বাধা। দিতে দেখা যায়। এদিন সংসদে সর্বশেষ বক্তা আওয়ামী লীগের তােফায়েল আহমদ বলেন, “স্বাধীনতা বিরােধী অধ্যাপক গােলাম আযম ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রগুলােকে অনুরােধ করেছিলেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার জন্য, সাহায্য না। দেওয়ার জন্য।” অতঃপর জনাব তােফায়েল আহমদ প্রস্তাব করে বলেন, “অধ্যাপক গােলাম। আযমকে শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। এর পর সংসদ স্পীকার আলােচনা মুলতবি রাখেন ১২ই জানুয়ারী (১৯৯২) রােববার পর্যন্ত।
৪৮। ৯ই জানুয়ারী (১৯৯২) তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের টি.এস.সি. সড়ক দ্বীপ এলাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্রলীগের ৪৪ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজন করা হয়েছিল একটি আলােচনা সভা। এই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা। সভা চলাকালে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এর কিছুক্ষণ পর, সভাস্থলের অদূরেই শামসুন্নাহার হলের সম্মুখে ছাত্র লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান বাদল গুলীবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, জগন্নাথ হল এবং এস.এম. হল এলাকাগুলােয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে গােলাগুলী চলে। সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও জগন্নাথ হলদ্বয়ের ১০/১২ টি কক্ষ ভাচুরের ঘটনা ঘটে। উক্ত সভায় প্রধান অতিথির ভাষণে ম্যাডাম
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৮
হাসিনা নব্য স্বৈরাচারের তৎপরতা, শিক্ষাঙ্গনসহ সবকিছুকে (ক্ষমতাসীন বি.এন.পি.-এর) দলীয়করণ ও (শিক্ষাঙ্গনে) সন্ত্রাস প্রতিরােধে ছাত্র সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়ে বলেন, “আমরা শিক্ষাঙ্গনে শান্তি চাই, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের মাধ্যমে জনগণের ভাত-কাপড়-শিক্ষাসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে চাই।” উক্ত ভাষণে ম্যাডাম হাসিনা আরও বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অপসারণ করা হয়েছে জামাত-শিবিরের সঙ্গে আতাত করে। একইভাবে ১৯৭১-এর গণহত্যা ও নারীধর্ষণের হােত গােলাম আযমকে রাজনীতির অঙ্গনে নামানাে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। মানুষের পবিত্র আমানত, পবিত্র ধর্মকে ব্যবহার করে এসব করা হচ্ছে।”
৪৯। ১০ই জানুয়ারী (১৯৯২) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সম্মুখে আয়ােজিত এক জনসমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “যে চক্রান্তের মাধ্যমে ছাত্রলীগ নেতা রাউফুন বসুনিয়া ও চুন্নকে হত্যা করা হয়েছিল সেই একই চক্রান্তের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুজ্জামান বাদলকে ৯ই জানুয়ারী (১৯৯২) তারিখে হত্যা করা হয়েছে। এই (বি.এন.পি.) সরকার (শিক্ষাঙ্গনে) সন্ত্রাস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।” উক্ত সমাবেশে ম্যাডাম হাসিনা আরও বলেন, “আমি বার বার বলেছি, সরকার ইচ্ছে করলেই এক ঘন্টার মধ্যেই অস্ত্র উদ্ধার করতে পারে। আমি এখনও বিশ্বাস করি অস্ত্রধারীরা কারাে নয়। সরকার দুর্নীতি ও ঘ্রাসে জড়িয়ে পড়েছেন। আজ দেশে আইন-শৃংখলা নেই, দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। (বি.এন.পি.) যাদের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, আজ তাদের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। সরকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যলয়ে অস্ত্র উদ্ধার না করে বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ লংঘনের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। (বি.এন.পি.) সরকার ইনডেমনিটি আইন (১৯৭৫) বাতিল প্রশ্নে টালবাহানা করছে। (বি.এন.পি. সরকার) দেশকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
৫০। ১২ই জানুয়ারী (১৯৯২) তারিখে জাতীয় সংসদে অধ্যাপক গােলাম আযম প্রসঙ্গে উথাপিত মূলতবি প্রস্তাবের ওপর শেষ আলােচনা হয়। আলােচনার সূত্রপাত করে জামাতে ইসলামী সংসদ সদস্য জনাব এনামুল হক বলেন, “গােলাম আযম জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। যে আদেশ বলে তার নাগরিকত্ব হরণ করা হয়েছে, তা অবৈধ। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবেই তাকে আমরা দলের আমির (প্রধান) নির্বাচিত করেছি।” এর জবাবে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সংসদে বিরােধী দলীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ বলেন, “এটা জামাতে ইসলামী এবং আমাদের মধ্যে বিতর্কের ব্যাপার নয়। সমস্ত দায়িত্ব (বি.এন.পি.) সরকারের। সরকারকেই জবাব দিতে হবে গােলাম আযম বাংলাদেশের
পৃষ্ঠাঃ ৩৮৯
নাগরিক কিনা, তাঁর কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য কিংবা কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়ার অধিকার রয়েছে কিনা।” অতঃপর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মেজর (অবঃ) হাফিজ বলেন, “জামাতীদের বক্তব্য শুনে আমরা বুঝতে পারছিনা, আমরা বাংলাদেশে আছি নাকি পাকিস্তানে আছি। যে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছিলেন, তিনিই গােলাম আযমকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছিলেন। ক্ষমতার মােহ এমনই জিনিষ যে, তাঁর স্ত্রী যিনি পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে নিগৃহীত হয়েছিলেন, তিনিই গােলাম আযমকে একটি রাজনৈতিক দলের আমীর (প্রধান) হওয়ার সুযােগ করে দিয়েছেন। গােলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেওয়া হলে বাংলাদেশ মিথ্যে হয়ে যাবে।” এর পর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সালাউদ্দিন ইউসুফ বলেন, “গােলাম আযম সম্পর্কে জিয়া ও এরশাদের ভূমিকা একই তারাই গােলাম আযমকে আজকের পর্যায়ে এনেছেন। জামাতে ইসলামীর সঙ্গে আতাত করে বি.এন.পি. সরকার গঠন করেছে, তারা গােলাম আযম সম্পর্কে কিছু বলছেন না।”
৫১। এদিনে সংসদে পঞ্চম বক্তা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলেন, “২৭শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯১)-এর নির্বাচনের আগে বেগম খালেদা জিয়া গােলাম আযমের সঙ্গে দেখা করে ৮৬ টি (সংসদের) আসনে আঁতাত করেছিলেন। এই আতাত করেও বি.এন.পি, সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি। তখন বি.এন.পি. আবার স্বাধীনতা বিরােধীদের সঙ্গে আতাত করে সরকার গঠন করেছে। এই সেদিন এডলফ হিটলারের প্রশংসা করায় জন অস্টিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা যদি এটা করতে পারে, তবে আমি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গােলাম আযমের বিচারই শুধু দাবি করি না, জামাতের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করার দাবি করি। আমরা ক্ষমা করার কে? জিজ্ঞেস করুন ধর্ষিতা বােনকে সে ক্ষমা করবে কিনা। জিজ্ঞেস করুন শমী কায়সারকে, সে ক্ষমা করবে কিনা।” বিতর্কের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “১৯৭১-এ যদি গােলাম আযমরা জয়ী হতাে তাহলে আমরা (দেশে) থাকতে পারতাম না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর গােলাম আযম, দুজনই ছিলেন স্বাধীনতা বিরােধী, তাই বুঝা যায় কোন দিক থেকে কি হচ্ছে। এর পর সিপিবির সংসদ সদস্য শামসুদ্দোহা বলেন, “গােলাম আযমকে (জামাতে ইসলামীর) আমির দেলীয় প্রধান) করার মধ্য দিয়ে আমাদের সংবিধান ও আইনকে লংঘন করা হয়েছে।” অতঃপর জাসদ (সিরাজ)-এর শাহজাহান সিরাজ বলেন, গােলাম আযমকে যদি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, তাহলে বি.এন.পি.-এরই প্রথম জনতার আদালতে বিচার করতে হবে। এর পর আওয়ামী লীগের সদস্য ও বরােধী দলীয় চীফ হুইপ মােহাম্মদ নাসিম বলেন, “গােলাম আযমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা করা হয়েছিল।” অতঃপর সরকারী গেজেট দেখিয়ে তিনি আরও বলেন, “গােলাম আযমকে ভােটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা জানিয়েছে।”
পৃষ্ঠাঃ ৩৯০
৫২। জাতীয় সংসদে এদিন গােলাম আযম সম্পর্কে আনীত মুলতবি প্রস্তাবের ওপর শেষ বক্তা ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মতিন চৌধুরী। (বি.এন.পি.) সরকারের পক্ষ থেকে তিনি বলেন, ‘সরকার গােলাম আযমকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়নি। একজন বিদেশী হয়েও তাঁর (জামাতে ইসলামীর) আমীর (প্রধান) নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি সরকারের গােচরীভূত হয়েছে। এর আইনগত বিষয়াদি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।” অতঃপর অধ্যাপক গােলাম আযমের বাংলাদেশে অবস্থানের নেপথ্যকাহিনী উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদকে জানান, “(বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গােলাম আযম (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামী শাখার) আমীর ছিলেন। ২২শে নভেম্বর (১৯৭১) তারিখে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৭২ সালে তাকে বিদেশী নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে তিনি (বাংলাদেশের) নাগরিকত্বের আবেদন করেন। ১৯৭৮ সালেও তিনি আবেদন। করেন। কিন্তু দু’বারই তাঁর আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়। ১১ ই জুলাই (১৯৭৮) তারিখে (বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে তিন মাসের ভিসা নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। আসার সময় তিনি তাঁর মায়ের অসুস্থতার কারণ দেখিয়েছিলেন। ৩০শে এপ্রিল (১৯৮১) তারিখে গােলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভের জন্য আনুগত্য প্রকাশ করে হলফনামা দাখিল করেন। কিন্তু এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। গােলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিক নন।”
৫৩। ২০শে ফেব্রুয়ারী (১৯৯২) তরিখে বাংলা একাডেমীতে মহান একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে আয়ােজিত”বাংলাদেশের বিশ বছরঃ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চা” শীর্ষক আলােচনা সভায় কতিপয় বক্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস আজও লেখা হয়নি। অশুভ রাজনীতির শিকার হয়ে ১৯৭৫ সালের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত হয়ে আসছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বেতার-টিভিতে ও জাতীয় প্রচার মাধ্যমগুলােতে অনুচ্চারিত রাখা হচ্ছে। ব্যক্তি, দলীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করে জাতিকে সঠিক ইতিহাস থেকে দূরে রাখা যাবে না। ইতিহাস তাঁর নিজস্ব সত্তায় একদিন গর্জে উঠবেই।” আলােচনায় অংশগ্রহণ করে (১৯৭১-এর) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক শামসুল হুদা চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬শে মার্চ (১৯৭১)-এর প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। এ ঘােষণা প্রথমে চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব এম. এ. হান্নান পাঠ করে শােনান। পরবর্তীতে, একজন তরুণ ব্যবসায়ী ঘােষণাটির বঙ্গানুবাদ পাঠ করেন। অতঃপর ২৭শে মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংক্রান্ত একটি ঘােষণা পাঠ করেন। এগুলাে ইতিহাসের অংশ। যারা এ সমস্ত বিষয়ে বিকৃত তথ্য প্রকাশ করেন প্রকারান্তরে তারা এসব বীর সন্তানদেরই অবমাননা করেন। জেনারেল জিয়ার অবিকৃত ঘােষণাটি এখন বেতার কর্তৃপক্ষের কাছে রয়েছে।”
পৃষ্ঠাঃ ৩৯১
৫৪। ৬ই মার্চ (১৯৯২) তারিখে নেত্রকোনায় এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, ‘১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) তারিখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে (দেশে) স্বৈরাচারের বিষবৃক্ষ রােপিত হয় এবং ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ জারি করে ও তৎপরবর্তীকালে সংবিধান পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে তাঁর খুনীদের অপকর্ম জায়েজ করা হয়। শুধু তাই নয়, তৎকালীন সামরিক সরকারের প্রধান বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বাংলাদেশের বিদেশস্থ দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করেন এবং স্বাধীনতা বিরােধী জামাত-শিবির চক্রকে পুনর্বাসিত করেন। পৃথিবীর কোন দেশের সংবিধানে এমন জঘন্য কালাকানুন নেই। ৮,৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটসমূহ কর্তৃক (১৯ শে নভেম্বর ১৯৯০)-এর প্রকাশিত ঘােষণায় উক্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করার কথা থাকলেও বর্তমান বি.এন.পি. সরকার তা কার্যকর করছে না।” অতঃপর উক্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিলের সংগ্রামে শরীক হওয়ার জন্য জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “আমরা দেশে আইনের শাসন কায়েম করতে চাই।”
৫৫। ৭ই মার্চ (১৯৯২) তারিখে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ (১৯৭১) উপলক্ষে আওয়ামী লীগ কর্তৃক ঢাকায় আয়ােজিত এক আলােচনা সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদের বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, ‘৭ই মার্চ (১৯৭১) একদিনে আসেনি। বৃটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পাকিস্তানীরা আঘাত করেছিলাে আমাদের ওপর, আমাদের জাতীয় সত্তার ওপর। সেই থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধাপে ধাপে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এ দিনটি আমাদের মাঝে উপনীত হয়। জাতির জনক এদিন এ দেশের মানুষের (রাজনৈতিক ও) অর্থনৈতিক মুক্তি তথা স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে ঘাতকের নির্মম বুলেটে তাঁকে হত্যা করা হয়। কিন্তু হত্যার বিচার আজও হয়নি। ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অর্ডিন্যান্স দিয়ে তাঁর (হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।” অতঃপর বর্তমান বি.এন.পি. সরকারের আচার-আচরণের তীব্র সমালােচনা করে ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “দীর্ঘ পনের বছর ধরে আমরা সংগ্রাম করেছি। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, স্বৈরাচারের পতন হলেও একই চেহারা এই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। নামে মাত্র সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে, স্বৈরাচারের অবসান ঘটেনি।”
৫৬। ১৬ই মার্চ (১৯৯২) তারিখ সকালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকার ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে সামাজিকসাংস্কৃতিক সংগঠন ‘রক্তলালের’ উদ্যোগে আয়ােজিত ‘হস্তাক্ষর প্রতিযােগিতা ও শিশু কিশোের সমাবেশে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা অভিযােগ করে বলেন, “বিকৃত ইতিহাসের মাধ্যমে আমাদের (জাতীয়) চরিত্র নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে (জাতির) সঠিক ইতিহাস জানা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।”
পৃষ্ঠাঃ ৩৯২
অতঃপর তিনি নব প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির গৌরবমন্ডিত প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার জন্যে দেশের সচেতন নাগরিকদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান। উক্ত সমাবেশে ম্যাডাম হাসিনা আরও বলেন, ‘যাঁর পুণ্যজনমে দেশ হয়েছে ধন্য, বাঙ্গালীর গৌরবের হয়েছে চরম বিকাশ, আজ তাঁর ৭২ তম জন্মবার্ষিকী। এই সংগ্রামী মহাপুরুষ সারা জীবন ভিনদেশী শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে অসহনীয় জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, এমনকি দুইবার ফাঁসির কাষ্ঠে গিয়েও আমাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনের দীর্ঘ চূড়ান্ত পথ পরিক্রমায় ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ এই বাড়ি থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। এই বাড়িতেই স্বাধীনতার শত্রু ঘাতকরা তাঁর জীবন কেড়ে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র জাতি কাধে কাঁধ মিলিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই পরিচালনা করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনে। এই গৌরবদীপ্ত স্বাধীনতা অর্জনে ৩০ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে, দুই লক্ষ মা-বােন সম্ভ্রম হারিয়েছে। দেশবাসী অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছে। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও সাহসী নেতৃত্ব আর বাংলার আপামর জনগণের সম্মিলিত সফল সংগ্রামের ফসল আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দীশালা থেকে ফিরে এসে শূন্য হাতে যুদ্ধবিধ্বস্ত আর পােড়ামাটি বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সুযােগ্য নেতৃত্ব, আন্তরিকতা এবং বিজ্ঞানসম্মত-পরিকল্পিত দেশ শাসনের ফলে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন কর্মসূচী সমাপ্ত হয়। সাধারণ মানুষের কাছে স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ তথা অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু যখন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তখনি স্বাধীনতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকের দল তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। মানবতার শত্রুদের কাছ থেকে শিশু-নারী-পুরুষ কেউই রেহাই পায়নি। জিয়াউর রহমান সংবিধানের পঞ্চম সংশােধনীতে ইনডেমনিটি (ক্ষমাপ্রদর্শন) অর্ডিন্যান্স সংযােজন করে সেই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। তাই আজ দেশ ও জাতির স্বার্থে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হবে।”
৫৭। ১৭ই মার্চ ১৯৯২) তারিখে ঢাকার ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭২ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়ােজিত আলােচনা সভায় সভাপতির ভাষণে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “চারিদিকে আজ হতাশার ধ্বনি। নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি, সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, অরাজকতা, সবমিলে সারাদেশে একটি অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। মানুষের আয় বাড়ছে না, অথচ সবকিছু ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। জনগণ চরম অর্থনৈতিক দৈন্যে নিপতিত। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্বাভাবিকভাবে কাজ করার সুযােগ দেয়া হচ্ছে না। দলীয়করণ করে তাদেরকে দলীয় কাজে ব্যবহার করছে এই (বি.এন.পি.) সরকার।… এই ক্রান্তিলগ্নে গণতন্ত্রের শুভফল
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৩
জাতিকে দেয়ার জন্য আমরা অর্থনৈতিক কর্মসূচী হাতে নিয়েছি। সারাবিশ্বে আর্থরাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আধুনিক, সময়ােপযােগী অর্থনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে যাচ্ছি। এ নিয়ে আলােচনা চলছে। ইনশাআল্লাহ এ কর্মসূচী জনগণের মঙ্গল ও কল্যাণে শুভফল বয়ে আনবে।” অতঃপর (বি.এন.পি.) সরকারের আচার-আচরণের তীব্র সমালােচনা করে ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছি। জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে এটাই ছিল আন্দোলনের প্রত্যাশা। কিন্তু বর্তমান বি.এন.পি.) সরকার তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ সরকার অতীতের সরকারের পথ অনুসরণ করে চলছে। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, এ সরকার এরশাদের জুতা পরে ও চশমা লাগিয়েই দেশ শাসন। করছে।” বিস্ময়কর যে, জনগণের ভােটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও বেগম খালেদা জিয়ার সরকারও অতীতের জিয়াউর রহমান, বিচারপতি সাত্তার ও এরশাদ সাহেবের সরকারগুলাের মতাে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিবস উপলক্ষে বেতার-টিভি এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলােকে কোন অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিতে ব্যর্থ হয় চরমভাবে।
৫৮। ১৯শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে ইফতার পার্টি উপলক্ষে আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালা ঘােষণা করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা। ঘােষিত এই অর্থনৈতিক নীতির মূল দৃষ্টিভঙ্গী ও দর্শন হিসেবে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তি খাতের অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ ও স্থায়ীভাবে স্বপ্রণােদিত সমবায় প্রচেষ্টাকে সর্বাত্মকভাবে উৎসাহিত করা হবে। প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতে ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, অর্থনৈতিক কার্যকারিতা ও সামাজিক উপযযাগিতার নিরিখে সরকারী ও ব্যক্তিখাতের ভূমিকা নির্ণীত হবে। কাংক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে দক্ষ ও প্রতিযগিতামূলক বাজারের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এই প্রতিযােগিতামূলক বাজারের সুযােগ সুবিধা যাতে সবাই গ্রহণ করতে সক্ষম হয় তার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। কোন বিশেষ গােষ্ঠীকে অন্যায়ভাবে এই বাজার ব্যবস্থার সুযােগ গ্রহণ করতে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় এবং সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাপনায় রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে সহায়ক ও সম্পূরক। (ব্যক্তি বা বেসরকারী খাতে প্রতিষ্ঠিত) কোন আর্থিক সংস্থা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হবে না। রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান অদক্ষতা ও অনভিপ্রেত অলাভজনকতা দূর করে দক্ষ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও প্রতিযােগী বাজার ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ধারায় উৎপাদনশীলতার দ্বারা এগুলােকে লাভজনক করতে হবে। উল্লেখ্য, ১৯ মার্চ (১৯৯২) তারিখে ঘঘাষিত অর্থনৈতিক নীতিমালা ও কর্মসূচী এবং আওয়ামী লীগের ১৯৯১ সালের নির্বাচনী ইশহেতারে প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক নীতিমালা ও কর্মসূচীর মধ্যে উল্লেখ্যযােগ্য পার্থক্য বা ভিন্নতা শুধুমাত্র একটি ব্যাপারেই। তা
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৪
হচ্ছে এইঃ ১৯৯১ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহারে অর্থনীতির মূল দৃষ্টিভঙ্গী ও দর্শন হিসেবে বলা হয়েছে, সাধারণভাবে কোন ব্যবসা-শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হবে না।” পক্ষান্তরে, ১৯শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে ঘােষিত অর্থনীতির মূল দৃষ্টিভঙ্গী ও দর্শন হিসেবে বলা হয়েছে, “কোন আর্থিক সংস্থা বা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করা হবে না।”
৫৯। ২১শে মার্চ (১৯৯২) তারিখ” এ.টি.পি.” বিমান ক্রয় সম্পর্কিত দুর্নীতির মামলার চার্জ আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয় ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বরে ক্ষমতাচ্যুত এইচ. এম. এরশাদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিভাগীয় বিশেষ আদালতের জজ কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী উক্ত চার্জশীট অভিযুক্তদেরকে পাঠ করে শুনান। লেঃ জেনারেল (অবঃ) এইচ. এম. এরশাদসহ চার ব্যক্তির বিরুদ্ধে পেশ করা হয় এই চার্জশীট। অপর তিনজন অভিযুক্তরা ছিলেন সাবেক মন্ত্রী লেঃ কর্নেল (অবঃ) এইচ. এম. এ. গাফফার, জিয়াউদ্দিন আহমদ বাবলু এবং সাবেক শিল্প সচিব এ. কে. এম. মােশাররফ হােসেন। অভিযােগে বলা হয় যে, ১৯৮৯ সালে দাম বৃদ্ধি করে এটিপি বিমান ক্রয়ে ২০ কোটি ১৮ লক্ষ ৮ হাজার ২৬০ টাকা বাংলাদেশের। ক্ষতিসাধন করেছেন অভিযুক্তরা। ক্ষমতার অপব্যাবহার করে নিজেরা কিংবা অন্যকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের এই অর্থের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরােধ আইনের ৫(২) ধারার অধীনে তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। অভিযােগে আরও বলা হয় যে, ১৯৮৯ সালে লেঃ জেনারেল (অবঃ) এইচ. এম. এরশাদ ও সাবেক সচিব এ. কে. এম. মােশাররফ হােসেন বৃটিশ এরােস্পেস কোম্পানী ভ্রমণকালে দাম বৃদ্ধি করে ‘এটিপি বিমান ক্রয় করেন। বিমান ক্রয়ে তাঁরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। সাবেক পর্যটন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রী লেঃ কর্নেল (অবঃ) এইচ, এম. এ. গাফফার বিমানের আর্থিক লােকসান জানা সত্ত্বেও উক্ত বিমান ক্রয়ের চুক্তি করেন। সাবেক বেসামরিক বিমান প্রতিমন্ত্রী জিয়াউদ্দিন বাবলু বেসামরিক বিমান চলাচল বিভাগের দয়িত্বে থেকেও উক্ত বিমান ক্রয় বন্ধ করার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
৬০। ইতিপূর্বে ১১ই ফেব্রুয়ারী (১৯৯২) মাসে বেগম জাহানারা ইমামকে আহবায়িকা ও অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে গঠন করা হয় একটি ৪২ সদস্যবিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তাবয়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ (The National Coordination Committee for the implementation of the spirit of the Liberation War and annihilation of the Killers and Collaborators of 1971)। এই সমন্বয় কমিটির সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত থাকেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জনাব আব্দুর রাজ্জাক, সিপিবির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নাহিদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-ইনু-এর সভাপতি কাজী আরেফ আহমদ, ন্যাপ (মােজাফফর)-এর মাওলানা আহমেদুর রহমান আজমী, বাসদ-এর আব্দুল্লাহ সরকার,
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৫
আওয়ামী লীগের মির্জা সুলতান রাজা, বঙ্গবন্ধু পরিষদের ডা: এস. এ. মালেক, বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান আব্দুল আহাদ চৌধুরী, নাট্যশিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, মুক্তিযােদ্ধা সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান কর্ণেল (অব:) শওকত আলী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের গােলাম কুদ্ছ, প্রমুখ রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। উক্ত কমিটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালের মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বাস্তাবায়নে সচেষ্ট থাকা এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে গণহত্যা, নারীধর্ষণ, লােকজনের বাড়িঘর-দোকানপাট-কলকারখানায় অগ্নিসংযােগ, ধ্বংস, লুণ্ঠন, ইত্যাদি অপরাধমূলক ও মানবতাবিরােধী কার্যকলাপে সহায়তা ও সহযােগিতাকারী অথবা স্বয়ং নিজেরাও এ জাতীয় কার্যকলাপ সংগঠনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আইনানুগ বিচারের ব্যবস্থা করা। এ লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সমন্বয় কমিটি ঘােষণা দেয়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উপরােল্লিখিত গর্হিত অপরাধমূলক ও মানবতাবিরােধী কার্যকলাপের প্রধান সংগঠক এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে স্বাধীনতা বিরােধী ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কার্যকলাপের জন্য দায়ী অন্যতম বিশিষ্ট নেতা গােলাম আযমের বিরুদ্ধে ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে গণ-আদালতে বিচার অনুষ্ঠানের। ঢাকা শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও মহল্লাসহ দেশের অন্যান্য শহর, বন্দর ও গ্রামগঞ্জেও গঠন করা হয় উক্ত সমন্বয় কমিটির শাখা-প্রশাখা। উক্ত জাতীয় সমন্ময় কমিটির কার্যক্রম বাস্তবায়নে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি ৮-সদস্য বিশিষ্ট স্টয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। এই স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যরা হলেনঃ (১) শহীদ জননী বেগম জাহানারা ইমাম, (২) অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, (৩) জনাব আব্দুর রাজ্জাক এমপি, (৪) কাজী আরেফ আহমদ, (৫) নূরুল ইসলাম নাহিদ, (৬) আব্দুল আহাদ চৌধুরী, (৭) সৈয়দ হাসান ইমাম এবং (৮) শাহরিয়ার কবির।
৬১। গােলাম আযমের গণ-আদালতে বিচারের দিন যতই ঘনিয়ে আসে ততােই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে উক্ত অনুষ্ঠানের পক্ষে জনসমর্থন। দেশের এহেন পরিস্থিতিতে সরকার ২৩শে মার্চ (১৯৯২) তারিখ গভীর রাতে গােলাম আযমের প্রতি কারণ দর্শানাের নােটিশ জারি করে এই মর্মে যে, কেন তিনি একজন বিদেশী নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে তাঁর অবস্থানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন না এবং বাংলাদেশের সাংবিধানিক বিধি লংঘন করে জামাতে ইসলামীর আমীর (দল প্রধান নির্বাচিত হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। সরকার একই সঙ্গে উপরােল্লিখিত গণআদালতের উদ্যোক্তাদের প্রতিও শােকজ নােটিশ জারি করে তাঁদের সংবিধান ও আইনের শাসন অবজ্ঞা করে গণ-আদালত’ আয়ােজন করার অভিযােগে অভিযুক্ত করে। গােলাম আযমের কারণ দর্শানাের নােটিশের জবাব সন্তোষজনক নয় এই বিচেনায় সরকার ২৪শে মার্চ তারিখ রাতে তাঁকে বিদেশী নাগরিক (প্রবেশ) আইনের আওতায় গ্রেফতার করে এক মাসের ডিটেনশনে প্রেরণ করে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে।
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৬
৬২। ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তরিখে সরকারের সকল ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বাধা প্রদান সত্ত্বেও ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হয় গােলাম আযমের বিরুদ্ধে গণ-আদালতে বিচার অনুষ্ঠান। কয়েক লাখ লােক স্বতঃস্ফূর্তভাবে উপস্থিত ছিলেন উক্ত বিচার অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার জন্যে। অনেক বিদেশী সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকও উপস্থিত ছিলেন উক্ত ‘গণআদালতে বিচার অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার জন্যে। বেগম জাহানারা ইমামকে চেয়ারপারসন করে গঠিত বিচারকমণ্ডলীতে ছিলেন বেগম জাহানরা ইমাম, এড়ভােকেট গাজীউল হক, ডঃ আহমদ শরীফ, স্থপতি মযহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমদ, ফয়েজ আহমদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, শিল্পী কলিম শরাফী, মাওলানা আব্দুল আউয়াল, লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান, লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী ও ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান। গােলাম আজমের বিরুদ্ধে উক্ত ‘গণ-আদালতে উপস্থাপিত বিচার্য বিষয় ছিলঃ (১) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সহায়তা করে। ত্রিশ লক্ষ নিরস্ত্র নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা এবং দুই লক্ষ নারী অপহরণ ও ধর্ষণে সহায়তা করে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরােধী অপরাধ করেছেন? (২) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি ২৬শে মার্চ থেকে ডিসেম্বর (১৯৭১) মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আলবদর, আলশামস, ইত্যাদি বাহিনী গঠন করে এবং তাঁর অনুগত রাজাকার বাহিনী দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীকে দুই লক্ষ নারী অপহরণ ও ধর্ষণে শ্লীলতাহানিজনক অপরাধ সংঘটন করতে সাহায্য করেছেন? (৩) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি পাকিস্তানী বাহিনীকে গণহত্যায় উকানি এবং প্ররােচনা দান করেছেন? (৪) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি আলবদর, আলশামস, ইত্যাদি বাহিনী গঠন করে তাদের দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের নিরীহ পরিবার পরিজনের ওপর সশস্ত্র ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করছেন? (৫) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে বিদ্বেষ ও সহিংসতা ছড়ানাের লক্ষ্যে ধর্মের বিকৃত ব্যাখা প্রদান করে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছেন এবং এই দেশের শিল্প সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন? (৬) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি তাঁর নিজস্ব অনুগত বাহিনী আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী দিয়ে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ করে অসংখ্য জনপদ ধ্বংস করে মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটন করেছেন? (৭) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি পাকস্তানী হানাদার বাহিনীর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে এই দেশে ১৯৭১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসদুটিতে তাঁর অনুগত বাহিনী আলবদর ও আলশামস দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যা সংঘটন করেছেন? (৮) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠন করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করেছেন? (৯) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে প্রচার চালিয়ে
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৭
মানবতাবিরােধী অপরাধ করেছেন? (১০) অভিযুক্ত গােলাম আযম কি স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তাঁর অনুগত আলবদর, আলশামস বাহিনী এবং রাজাকার বাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে জঘন্যতম মানবতাবিরােধী অপরাধ করেছেন?”
৬৩। ২৬ মার্চ (১৯৯২) তারিখে অনুষ্ঠিত গণ-আদালতে অভিযােগকারীদের পক্ষে কৌসলী ছিলেন এডভভাকেট জেড.আই. পান্না, এডভােকেট শামসুদ্দিন বাবুল ও এডভােকেট উম্মে কুলসুম রেখা। ‘গণ-আদালতের বিচারে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অনুপস্থিত থাকায় ন্যায় বিচারের জন্যে গণআদালত এডভােকেট মােহাম্মদ নজরুল ইসলামকে গােলাম আযমের পক্ষে কৌসলী নিযুক্ত করেন এবং তাঁকে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগসমূহ পাঠ করে শােনান। ফরিয়াদীর পক্ষে ১২ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। তাঁরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিভাগের শিক্ষক ডঃ মেঘনাদ গুহ ঠাকুরতা, বাংলাদেশের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, কবি ও নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক, খ্যাতনামা সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শাহরিয়ার কবির, খ্যাতনামা লেখিকা মুশতারী শফী, শহীদ প্রকৌশলী ফজলুর রহমানের পুত্র সাইদুর রহমান, শহীদ প্রখ্যাত সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারের পুত্র অমিতাভ কায়সার, হামিদা বানু, মাওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ, প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী আলী জাকের ও ডঃ মুশতাক হােসেন। সাক্ষীদের সাক্ষ-প্রমাণ বিবেচনা করে বিচারকমণ্ডলী অভিযুক্ত গােলাম আযমের বিরুদ্ধে ঘােষণা করেন নিম্নোক্ত রায়ঃ ”আমরা সাক্ষীদের প্রদত্ত সাক্ষ্য সত্য এবং দাখিলকৃত প্রদর্শনীসমূহ অকাট্য বিবেচনা করে সর্বসম্মতভাবে অভিযুক্ত গােলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিযােগ প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করি এবং আনীত প্রতিটি অভিযােগের প্রত্যেক অপরাধে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করছি। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশে উপরােক্ত অপরাধ দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যুদণ্ড যােগ্য অপরাধ। যেহেতু গণ-আদালত কোন দণ্ডাদেশ কার্যকর করেনা, সেহেতু অভিযুক্ত গােলাম আযমকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্যে বাংলাদেশ সরকারের নিকট অনুরােধ জানাচ্ছি।”
৬৪। ২৭শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে ‘ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিল বিলের বিশেষ সংসদীয় কমিটির একাদশ সভা অনুষ্ঠিত হয় সংসদ ভবনের স্ট্যান্ডিং কামিটির এক নম্বর কক্ষে। সকাল দশটা থেকে বারােটা পর্যন্ত এ সভাকাল স্থায়ী হয়। বি.এন.পি.-এর দিক থেকে উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন না ডাঃ এ. কিউ, এম. বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও খন্দকার দেলােয়ার হােসেন। বিশেষ সংসদীয় কমিটির জাতীয় পার্টির সাংসদ ফজলে রাব্বি এবং জামাতে ইসলামীর সাংসদ শেখ আনসার আলীও উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন না। কতিপয় সূত্র থেকে জানা যায় যে, মাত্র একদিন আগে উক্ত সভার নােটিশ দেওয়ায় এরা সেখানে
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৮
উপস্থিত থাকতে পারেননি। বিশেষ সংসদীয় কমিটির উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন কমিটির চেয়ারম্যান ও আইন ও বিচারমন্ত্রী মির্জা গােলাম হাফিজ, তথ্যমন্ত্রী ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা, সংসদের বিরােধী দলীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদিকা ও সংসদ সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সাংসদ শুধাংশু শেখর। হালদার, সংসদের বিরােধী দলীয় চীফ হুইপ মােহাম্মদ নাসিম এবং গণন্ত্রী পার্টির সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে, বিশেষ সংসদীয় কমিটির উপরােক্ত সভায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিলের ব্যাপারে সেদিন কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।
৬৫। ২৮শে মার্চ তারিখে গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি আলােচনা সভা। উক্ত সভায় গণন্ত্রী পার্টির সভাপতি আহমদুল কবির তাঁর ভাষণে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফলশ্রুতি হচ্ছে গণন্ত্র। তাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।… জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে সংসদীয় গণতন্ত্র বিফল হতে বাধ্য। আর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।” জনাব আহমদুল কবির আরও বলেন, ‘বর্তমানে সময় এসেছে। এখন দেশের জনগণই বাধ্য করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমস্ত রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত হতে এবং তাদের ন্যায্য দাবি পূরণ করতে।” গণন্ত্রী পর্টির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মােহম্মদ আফজাল তাঁর ভাষণে বলেন, ‘এবারের স্বাধীনতা দিবসে জনতার মূল সুর হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুসরণ। ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা না দেখালে জাতি শেকড় চ্যুত হবে।” তিনি আরও বলেন, “অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, স্বাধীনতা দিবস পালন করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ না করে। বিগত ১৬/১৭ বছর ধরেই স্বাধীনতা দিবসে রেডিও-টেলিভিশনে তাঁর নামও উচ্চারিত হয় না। ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকারের নামও উচ্চারিত হয় না।” অতঃপর মােহাম্মদ আফজাল অতীতের সরকারগুলাে এবং বর্তমান বেগম খালেদা জিয়ার সরকাররের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মানুষ আবারও জেগে উঠেছে। আজকের প্রধান দ্বন্দ্ব হচ্ছে সাম্প্রদায়িক, অাণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিষ্ট শক্তিগুলাের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের ওপর নির্ভর করবে দেশ কোন পথে যাবে।” উক্ত সভায় গণন্ত্রী পার্টির সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত তাঁর ভাষণে বলেন, “১৯৭৫-এর পরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধ শব্দ নেই। এর পরিবর্তে এসেছে স্বাধীনতা যুদ্ধ বা(War of Independence)। এই দুইটি টার্ম-এর মধ্যে পার্থক্য আছে। মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে একটি ধারাবাহিকতা, যা আমরা অর্জন করেছিলাম ৬ দফা, ১১ দফার ভিত্তিতে।War of Independence কথাটি সংবিধানে জুড়ে দেয়ায় মনে হয় যে, কোন একজন সামরিক কর্মকর্তা হুইসেল বাজিয়ে দেশের স্বাধীনতা এনেছেন।” .. অতঃপর শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্তব্য
পৃষ্ঠাঃ ৩৯৯
করেন, “গণতন্ত্রের মূল শত্রু হচ্ছে মৌলবাদী শক্তি। মৌলবাদী শক্তি মানবতার শত্রু। বিশ্বব্যাপী এখন গণতন্ত্রের আওয়াজ উঠেছে মৌলবাদের বিরুদ্ধে। আবার সময় এসেছে জাতীয় ঐক্যের, অর্থাৎ সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের।”
৬৬। এদিকে ২৮শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে বি.এন.পি. সরকার ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত ‘গণ-আদালতের’ ১২-সদস্য বিচারকমণ্ডলী, ৪ জন কৌসলী এবং ১২ জন সাক্ষীর ৭ জন এবং সমন্বয় কমিটির সদস্য-সচিব অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীর বিরুদ্ধে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আজিজুল হক ভূইয়ার কোর্টে মামলা দায়ের করে। উক্ত কোর্টে সরকারের পক্ষে মামলা দায়ের করেন রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সৈয়দ আখলাক হােসেন। সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন ঢাকার পিপি আব্দুর রাজ্জাক খান। দায়েরকৃত মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আজিজুল হক ভূঁইয়া উক্ত গণ-আদালতের ১২-সদস্য বিচারকমণ্ডলী, সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব, ৪ জন কৌসলী এবং ৭ জন সাক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করে ২৭শে এপ্রিল (১৯৯২) মামলাটির শুনানির জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন। গণ-আদালতে সাক্ষী হিসেবে অংশগ্রহণকারী ১২ জন সদস্যের মধ্যে যে ৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয় তারা হলেন: ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, শাহরিয়ার কবির, মাওলানা ইয়াহিয়া মাহমুদ, আলী জাকের ও ডঃ মােস্তাক হােসেন। উপরােল্লিখিত ২৪ জন অভিযুক্তদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২১ (এ), ১২১ (বি), ১৪৮, ১২৪(এ), ৩০৭, ৫০৫(এ) ও ৫০৫(ডি) ধারাগুলাের আওতায় অভিযােগ কগনিজেস নেয়া হয় এবং তদনুযায়ী গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করা হয়। উল্লেখ্য, ১২১ ধারাটি হচ্ছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, হওয়ার চেষ্টা করা অথবা লিপ্ত হতে সহায়তা করা, ১২১ (এ) ধারাটি হচ্ছে ১২১ ধারাবলে দণ্ডনীয় অপরাধসমূহ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করা, ১২৪ (এ) ধারাটি হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার, ১৪৮ ধারাটি হচ্ছে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে দাঙ্গাহাঙ্গামা করা, ৩০৭ ধারাটি হচ্ছে খুনের চেষ্টা করা এবং ৫০৫ ধারাটি হচ্ছে জনগণের অনিষ্ট হতে পারে এমন ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদানের অভিযােগ।
৬৭। ২৯শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে অনুষ্ঠিত গণ-আদালতের” সঙ্গে বিভিন্নভাবে জড়িত থাকার কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা বেগম জাহানারা ইমাম ও সদস্য-সচিব অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীসহ বি.এন.পি. সরকার কর্তৃক অভিযুক্ত ২৪ জনই ‘সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে উপস্থিত হন। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী ডঃ কামাল হােসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম সহ সুপ্রীম কোর্টের বিপুল সংখ্যক আইনজীবী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। সেখানে উপরােল্লিখিত ২৪ জনের
পৃষ্ঠাঃ ৪০০
বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারির প্রেক্ষিতে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় তৎবিষয়ে বিস্তৃত আলাপের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে তাঁদের জন্য আগাম জামিনের আবেদন পেশ করার। অতঃপর ডঃ কামাল হােসেন, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামসহ বিপুল সংখ্যক আইনজীবী জামিনের আবেদনটি নিয়ে। বিচারপতি আনােয়ারুল হক চৌধুরী ও বিচারপতি এম. এ. করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগ বেঞ্চের কক্ষে হাজির হন। ডঃ কামাল হােসেন উপরােক্ত জামিনের আবেদনটি ডিভিশন বেঞ্চে পেশ করার অনুমতি প্রার্থনা করলে বিচারপতি আনােয়ারুল হক চৌধুরী প্রথমে যে আদালত থেকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করা হয়েছে সেখানে তা পেশ করার পরামর্শ দেন। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি হয়ে যাবার পর নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করাই সমীচীন হবে।” এর। জবাবে ডঃ কামাল হােসেন নিবেদন পেশ করে বলেন, “আলােচ্য মামলাটি এ দেশের ইতিহাসে একটি ভিন্ন প্রকৃতির ঘটনা। এটি একটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী মামলা যার মাধ্যমে দেশের ২৪ জন বরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে কতিপয় কাল্পনিক অভিযােগ আনা হয়েছে।” অতঃপর, হাইকোর্ট বিভাগ বেঞ্চ সরকারী পক্ষের এটর্নি জেনারেলের বক্তব্য শুনে ঐদিন অথবা পরের দিন অর্থাৎ ৩০মে মার্চ (১৯৯২) তারিখে আবেদনটির ওপর শুনানি গ্রহণে সম্মত হন এবং শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামিনের আবেদনকারী ২৪ জনকে গ্রেফতার না করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্যে আদেশ জারি করেন।
৬৮। এদিকে ২৯শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘের সম্মুখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শাখার উদ্যোগে একটি জনসমাবেশ শাখার অন্যতম যুগ্ম আহবায়ক মােহাম্মদ জাকারিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্টিত হয়। সমাবেশের শুরুতে উপরােল্লিখিত কমিটিরি যুক্তরাষ্ট্র শাখার যুগ্ম আহবায়ক ডঃ নুরুন্নবী ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত গােলাম আযমের বিরুদ্ধে গণ-আদালত কর্তৃক প্রদত্ত রায় প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের সামনে তুলে ধরেন। অতঃপর, উক্ত সমাবেশে গৃহীত একটি প্রস্তাবে, (বাংলাদেশের) মুক্তিযুদ্ধবিরােধীদের বিচার এবং জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, জামাত-শিবিরের হামলার নিন্দা করে তাদের গ্রেফতার ও শাস্তি প্রদান, ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটসমূহ কর্তৃক ১৯শে নভেম্বর (১৯৯১) তারিখে প্রদত্ত যৌথ ঘােষণায় উল্লেখিত বিষয়সমূহের বাস্তাবায়নের মাধ্যমে দেশে) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবােধ সুপ্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানানাে হয়। অপর এক প্রস্তাবে, (বাংলাদেশে) ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূলের লক্ষ্যে সৃষ্ট আন্দোলনের প্রতি ব্যাপক গণসমর্থন অক্ষুন্ন রাখার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। পরিশেষে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির’ জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা বেগম
পৃষ্ঠাঃ ৪০১
জাহানারা ইমামসহ ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে অনুষ্টিত গণ-আদালতের বিচার কাজের সাথে জড়িত ২৪ ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিএনপি সরকার কর্তৃক গ্রেফতারী পরােয়ানা জারির তীব্র নিন্দা করে তা প্রত্যাহার করার দাবি জানানােনা হয়। উক্ত সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তা ছিলেন ‘সাপ্তাহিক প্রবাসী সম্পাদক সৈয়দ মােহাম্মদ উল্লাহ, আওয়ামী লীগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শাখার সাধারণ সম্পাদক এম. এ. সালাম”প্রজন্ম ১৯৭১” এর যুক্তরাষ্ট্র শাখার পক্ষ থেকে দিলীপ নাথ, নিউজার্সী আওয়ামী লীগ শাখার সভাপতি এম. এ. খালেক, গণতন্ত্রী পার্টির যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি গজনফর আলী, জাসদ (ইনু) যুক্তরাষ্ট্র শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান শাহেদ চৌধুরী, কমিটি ফর ডিমােক্রেসীর সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব, প্রয়াত লেঃ কর্নেল আবু তাহের স্মৃতিসংসদের নাজমুল হক হেলাল, বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা নুরুন্নবী, ডঃ ফরিদা মজিদ, গিয়াসউদ্দিন প্রমুখ।
৬৯। গােলাম আযমের বিরুদ্ধে গঠিত গণ-আদালতের বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারপারসন বেগম জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন অভিযুক্তদের জামিনের আবেদনটির শুনানি সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি আনােয়ারুল হক চৌধুরী ও বিচারপতি এম. এ. করিমের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে শুরু হয় ৩০শে মার্চ (১৯৯২) তারিখ সকাল দশটায়। আবেদনকারীদের পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, কে. এস. নবী, সুধাংসু শেখর হালদার প্রমুখ। অপরদিকে সরকার পক্ষে ছিলেন টি. এইচ. খান, অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রমুখ। মামলার শুনানি আংশিকভাবে অনুষ্ঠানের পর ৩১শে মার্চ (১৯৯২) তারিখ সকাল দশটা পর্যন্ত মুলতবি রাখা হয়। এদিন ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম তাঁদের বক্তব্য পেশ করেন। ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ তাঁর বক্তব্যে বেগম জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগকে অবাস্তব ও হাস্যকন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “দেশের এসব বরেণ্য ব্যক্তিরা তাঁদের জ্ঞান, মেধা ও প্রতিভা দিয়ে গােটাজাতির সেবা করেছেন এবং করছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ সকল প্রকার ব্যক্তিগত বা গােষ্ঠীগত স্বার্থের উর্ধ্বে থেকে জাতির বিবেক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। তাঁরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন প্রার্থনা করেছেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ এখন আদালতের হেফাজতে আছেন এবং তাদের জামিন মঞ্জুর অথবা কারাগারে প্রেরণ সবকিছুই এখন আদালতের এখতিয়ারভুক্ত। অভিযুক্তদের জামিন প্রদানের পূর্ণ আইনগত এখতিয়ার সুপ্রীম কোর্টের রয়েছে। যে আদালত থেকে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করা হয়েছে, সেই আদালতেই আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করতে হবে এমন কথা আইনে নির্দিষ্ট করে বলা নেই, যদিও সেটি প্রচলিত প্রথা। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এমন কিছু ধারায় অভিযােগ আনা হয়েছে যেগুলাে জামিনবিহীন হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সুপ্রীম কোর্ট যে কোন অভিযােগে অভিযুক্ত কোন নাগরিককে জামিন প্রদানের পূর্ণ এখতিয়ার
পৃষ্ঠাঃ ৪০২
রাখেন।” এর পর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেন, এই মামলার অভিযুক্তরা বিদেশী নাগরিক গােলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়। গােলাম আযম আর রাষ্ট্র সমার্থক নয়। তাঁর ( গােলাম আযমের বিরুদ্ধে কিছু বলার অর্থ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলা নয়।” অতঃপর, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এই মামলাটিকে পাকিস্তানী স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাথে তুলনা করে বলেন, “তখনও ষড়যন্ত্র হয়েছিলাে, এখনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তবে এসব ষড়যন্ত্র রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, দেশবাসীর বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্য থেকে এ ধরনের মামলা অতীতেও হয়েছে, আবার হয়তাে ভবিষ্যতেও হবে।” ৩১শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে হাইকোর্ট বেঞ্চে অভিযুক্তদের জামিনের প্রশ্নে আরও শুনানি চলে। এ দিন শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন। রায়ে ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন আদালতকে অবিলম্বে এই মর্মে একটি আদেশ জারি করতে, নির্দেশ দেয়া হয় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ঐ আদালতে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের পর থেকে মামলাটির নিষ্পত্তি পর্যন্ত জামিন মঞ্জুরীর স্বীকৃতি থাকবে।
৭০। এপ্রিল (১৯৯২)-এর গােড়ার দিকে অনুষ্ঠিত ‘১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একটি সভায় কমিটির আহবায়ক জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত স্টিয়ারিং কমিটিতে সেদিন পর্যন্ত ১২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত সদস্যরা হলেন: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান, সৈয়দ হাসান ইমাম, জনাব মাহফুজুর রহমান, বেগম মুশতারী শফি, বেগম হামিদা বানু, জনাব মামুনুর রশীদ, জনাব শাহরিয়ার কবির, জনাব সাদেক আহমেদ খান, মিয়া আবুল হাশেম, জনাব ফতেহ আলী চৌধুরী, ডঃ হাসান এবং”প্রজন্ম ১৯৭১” এর সভাপতি জনাব সাইদুর রহমান। উক্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পরবর্তীতে আরও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন রণাঙ্গন অধিনায়ক এবং দেশের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীদেরকে স্টিয়ারিং কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ৮ই এপ্রিল(১৯৯২) ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবয়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ ১০ই এপ্রিল তারিখে ঢাকার প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে সমাবেশ ও গণমিছিল এবং ১২ই এপ্রিল তারিখে গণমিছিল নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনে গিয়ে সেখানে অবস্থান ও স্মারকলিপি পেশ করার কর্মসূচী ঘােষণা করে। ১২ই এপ্রিলের কর্মসূচীকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে কমিটি ঢাকার সকল শাখা কমিটিগুলােকে মিছিল সহকারে বিকেল ৩টার মধ্যে শাহবাগ চৌরাস্তার মােড় ও জাতীয় যাদুঘরের সামনের রাস্তায় সমবেত হওয়ার আহবান জানান। এদিকে ৫ দলীয় জোটের তৎকালীন আহবায়ক জনাব নঈম জাহাঙ্গীর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির’ ১২ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখের কর্মসূচীকে
পৃষ্ঠাঃ ৪০৩
সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সর্বস্তরের ব্যক্তিদের প্রতি আহবান জানান ঐদিন বিকেল ৩টায় ঢাকার শাহবাগ চৌরাস্তার মােড়স্থ জাতীয় যাদুঘরের সামনের রাস্তায় সমবেত হওয়ার পর সেখান থেকে মিছিল সহকারে জাতীয় সংসদ ভবন অভিযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্যে।
৭১। ৯ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখে ইনডেমনিটি (ক্ষমাপ্রদর্শন) অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিল বিল সংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটির দ্বাদশ বৈঠক কমিটির চেয়ারম্যান আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী মির্জা গােলাম হাফিজের সভাপতিত্বে সংসদের স্থায়ী কমিটির ১ নম্বর কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির মাত্র সাতজন সদস্য উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন। উক্ত সভায়ও উল্লেখিত বিলটির ব্যাপারে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। উল্লেখ্য, ১৯ শে এপ্রিল (১৯৯২) তারিখ ছিল এ ব্যাপারে পূর্বনির্ধারিত সময়ের শেষ দিন। বিলটির ব্যাপারে তখন পর্যন্ত তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। আর ৯ দিনে উক্ত বিল সংক্রান্ত কাজগুলাে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই সরকার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আরও ২ মাস সময় নেয়ার কথা বলা হয়। উক্ত কমিটিতে রয়েছেন আওয়ামী লীগের এমন একজন সংসদ সদস্য বলেন, “পুনরায় সময় বাড়ানাের কোন যৌক্তিক কারণ নেই। এ পর্যন্ত চার বার সময় বাড়ানাে হয়েছে।” আওয়ামী লীগের অপর একজন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য বলেন, সরকার যদি অ্যথা কালক্ষেপণের নামে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান, তাহলে আওয়ামী লীগ সংসদ বর্জন করে রাজপথে নামতে বাধ্য হবে।” উল্লেখিত ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিল সংক্রান্ত বিলটি সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে সংসদে বিরােধী দলীয় চীফ হুইপ মােহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘এ বিল পাস করতে বি.এন.পি. সরকারের সদিচ্ছা আমরা বরাবরই আশা করছি। অনেক পথ-ঘাট পেরিয়ে আমরা গণতন্ত্রের উষালগ্নে পদার্পণ করেছি। সরকারী দল যদি ১৯ শে নভেম্বর (১৯৯০) তরিখে ৮, ৭ ও ৫ দলীয় ঐক্যজোটসমূহ কর্তৃক ঘােষিত রূপরেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন এবং তারা হত্যা-ক্র রাজনীতি বন্ধ করতে চান, তাহলে অবশ্যই উক্ত বিলের প্রতি তাদের সমর্থন জানাতে হবে। নইলে আবারও গণতন্ত্রের শক্ররা নবজাত গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে উৎসাহিত হবে।” বিলটির অবস্থা সম্পর্কে বি.এন.পি. সরকার পক্ষের সংসদের চীফ হুইপ খন্দকার দেলওয়ার হােসেন বলেন, “আর দুই মাসের মত সময় প্রয়ােজন হতে পারে। বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। এটার ওপর কমিটির বারােটি বৈঠক হয়েছে। আলােচনা হয়েছে। অতএব এতদবিষয়ে ধৈৰ্য্য হারাবার কোন কারণ নেই। লক্ষ্য ঠিক থাকলে মত ও পথের ভিন্নতা সত্ত্বেও কাংক্ষিত স্থানে পৌছানাে যায়, যেমন করে আমরা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংদীয় পদ্ধতিতে গমন করেছি।”
৭২। ১২ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখ বিকেল তিনটায় পঞ্চম সংসদের স্বল্পকালীন পঞ্চম অধিবেশন শুরু হয়। ঐ দিন বিকেল ৩টায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তাবায়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি কর্তৃক পূর্ব ঘােষিত সংসদ ভবন অভিমুখে
পৃষ্ঠাঃ ৪০৪
পদযাত্রা কর্মসূচী অনুযায়ী ঢাকার শাহবাগ চৌরাস্তার মােড়স্থ জাতীয় যাদুঘরের সামনে গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা বেগম জাহানারা ইমাম ছাড়াও কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, ছাত্রনেতা এস. এম. কামাল, শফি আহমদ ও রুহিন হােসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। প্রস্তাবিত পদযাত্রায় যােগদাননের উদ্দেশ্যে ঢাকা নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে মুক্তিযােদ্ধা, দালাল নির্মূল কমিটির বিভিন্ন ওয়ার্ড ও প্রতিষ্ঠানের শাখার নেতা-কর্মী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপ (মােজফফর), গণন্ত্রী পার্টি, কেন্দ্রীয় পাঁচদল, মুক্তিযােদ্ধা সংহতি পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ ছাত্র, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের হাজার হাজার নেতা-কর্মী ব্যানার-ফেস্টুন শােভিত মিছিল সহকারে সেখানে উপস্থিত হন। পদযাত্রার প্রাক্কালে তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে বেগম জাহানারা ইমাম ২৬ শে মার্চ (১৯৯২) তারিখ অনুষ্ঠিত গণ-আদালতের বিচারে যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমকৃত অপরাধ মৃত্যুদন্ডযােগ্য বলে যে গণরায় ঘােষিত হয়েছিল তা অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য বি.এন.পি. সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে বলেন, “এ রায় বাংলাদেশের জনগণের। এ রায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে অবশ্যই কার্যকর করতে হবে। আমরা একটি গণতান্ত্রিক দেশের অধিবাসী হিসেবে গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছি। আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ।” অতঃপর জাতীয় সংসদ স্পীকার ও সদস্যদের নিকট স্মারকলিপি পেশের উদ্দেশ্যে পদযাত্রা শুরু হয় বিকেল পাঁচটায়। এ সময় পদযাত্রীদের ‘গণ-আদালতের গণরায় বাস্তাবায়ন করতে হবে’,’আর কোন দাবি নাই, গােলাম আযমের ফাঁসি চাই’, ‘একাত্তরের দালালরা হুশিয়ার সাবধান’ ও ‘জামাত শিবির রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলার ছাড়’ প্রভৃতি শ্লোগানে রাজপথ ও আশে পাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে উঠে। পথের দুই ধারে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পথচারীরা হাততালি দিয়ে পথযাত্রীদের অভিনন্দন জানান। সুশৃংখল ও শন্তিপূর্ণভাবে অগ্রসরমান পদযাত্রীরা বাংলামােটর মােড়ে প্রথম পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেখানে উপস্থিত পদস্থ পুলিশ কর্মকতাদের সাথে নেতৃবৃন্দের আলাপের পর পুলিশ ব্যারিকেড প্রত্যাহার করে নেয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় হােটেল সােনারগাঁওয়ের পেছনে পৌছলে পথযাত্রীরা পুলিশের দ্বিতীয় দফা ব্যারিকেডের মুখােমুখি হয়। সেখানে কিছুক্ষণ উত্তেজনার পর নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। অতঃপর, বেগম জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদলকে স্মারকলিপি পেশের জন্যে সংসদ ভবনে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। বেগম জাহানারা ইমাম ছাড়া প্রতিনিধিদলে অন্যান্য যাঁরা ছিলেন তারা হলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ডঃ আহমদ শরীফ, এডভােটে গাজীউল হক, কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী, লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান, জাকী আরেফ আহমদ, সৈয়দ হাসান ইমাম, মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী মায়া এবং আশরাফ কায়সার। প্রতিনিধিদলটি জাতীয় সংসদ ভবনে স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী, সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে
পৃষ্ঠাঃ ৪০৫
বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনার সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে সাক্ষাৎ করে স্মারক পত্র প্রদান করে। এ ছাড়াও, সংসদে উপস্থিত ৩১০ জন সংসদ সদস্যকেও স্মারকপত্র প্রদান করা হয়।
৭৩। নির্মূল কমিটি কর্তৃক পেশকৃত স্মারকলিপিতে বলা হয়ঃ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সকল শক্তির মধ্যে সম্প্রতি অসাধারণ জাগরণের সূচনা হয়েছে। এই জাগরণ দেখা দিয়েছে মূলতঃ একাত্তরের দালাল ও ঘাতক গােলাম আযমের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবীতে দেশবাসীর ব্যাপক ঐক্যের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং তার পরবর্তীকালে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে গােলাম আযমের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা আপনাদের কারাে অজানা নয়। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানী পাসপাের্ট ও বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে এদেশে প্রবেশ করে তিনি বেআইনী ভাবে রয়ে যান। তার এই বেআইনী অবস্থান সম্পর্কে জনগণের পক্ষ থেকে বহুবার প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়েছে এবং সরকারের কাছে এ বিষয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানানাে হয়েছে। জাতীয় সংসদে সরকার একাধিকবার জানিয়েছে। যে, এই বিদেশী ব্যক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দানের কোন অভিপ্রায় তাদের নেই। এই রকম অবস্থায় গােলাম আযমকে আকস্মিকভাবে জামাতে ইসলামীর আমীর (দল প্রধান) ঘােষণা করায় জনগণের ক্ষোভ অত্যন্ত তীব্র হয়ে ওঠে। গােলাম আযমের পক্ষে এই পদ গ্রহণ এবং জামতে ইসলামীর পক্ষে তাঁকে এই পদে নির্বাচন উভয়ই বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ ধারার লংঘন। এ বিষয়টি জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হলেও তার কোন সুরাহা হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ নাগরিকসমাজ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি সমবেত ভাবে ১৯৭১ সালে কৃত যুদ্ধাপরাধের জন্য এবং ১৯৭১ সালের পরবর্তীকালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য গণআদালতে গােলাম আযমের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই গণআদালত সংবিধানে প্রতিষ্ঠিত কোন আদালত বা কর্তৃপক্ষের সমান্তরাল বা প্রতিযােগী নয়—এই গণআদালত জনসাধারণের মতামত প্রকাশের একটি বৈধ ও শক্তিশালী মাধ্যম। বিগত ২৬ শে মার্চ (১৯৯২) সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল শান্তিপূর্ণ সমাবেশের মধ্যে এই গণআদালতের কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। বিচারে গােলাম আযমকৃত অপরাধ মৃত্যুদণ্ড যােগ্য বলে ঘােষিত হয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলা হয় যে, গণআদালত কোন দণ্ড প্রদান বা কার্যকর করতে পারে না। গােলাম আযমের দুস্কৃতি সম্পর্কে এই সর্বসম্মত রায়ের ভিত্তিতে বালাদেশ সরকারকে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহবান জানানাে হয়। বিদেশী নাগরিকদের সম্পর্কিত বিধান লংঘন করার দায়ে গত ২৪ মে মার্চ (১৯৯২) সরকার গােলাম আযমকে গ্রেফতার করে এবং এক মাসের জন্য তার আটকাদেশ দেয়া হয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের জন্য, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জন্য এবং সংবিধানের ৩৮ ধারা লংঘনের জন্য তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যতদিন না তা করা। হয়, ততােদিন গােলাম আযমের বিরুদ্ধে বর্তমান গণআন্দোলন চালিয়ে যেতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাগরিকরা সংকল্পবদ্ধ। জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্য হিসেবে এই
পৃষ্ঠাঃ ৪০৬
আন্দোলনে আপনি যােগ দেবেন বলে নির্বাচকমণ্ডলী আপনার কাছে প্রত্যাশা করে। আমরা দাবী করি, গােলাম আযমের প্রতি গণরায় বাস্তাবায়নের জন্য সংসদের ভেতরে ও বাইরে আপনি আরাে সক্রিয় হােন। সরকার যাতে কালবিলম্ব না করে এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয় সেই লক্ষ্যে আপনি সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ করবেন বলে আমরা আপনার কাছে দাবী করি।”
৭৪। এদিকে ১২ ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখ বিকেলে ৩ টায় সংসদের অধিবেশন শুরু হলে তােফায়েল আহমদ, রাশেদ খান মেনন, আব্দুর রাজ্জাক, শাহজাহান সিরাজ, মতিউর রহমান নিজামী সহ ৪২ জন সংসদ সদস্য ‘গণআদালত এবং গােলাম আযম প্রসঙ্গে মুলতবী প্রস্তাবের নােটিশ দেন। পাশাপশি, শাহজাহান সিরাজ, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, রাশেদ খান মেনন, প্রমুখ সংসদ সদস্যগণ সংসদ কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৬ ও ১৪৭ ধারার অধীনে সাধারণ আলােচনারও নােটিশ দেন। স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী তখন বলেন যে, বিষয়গুলাে মুলতবী প্রস্তাবের আওতায় বিবেচিত হলে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হবে না বিধায় সেগুলাে বৃহত্তর আঙ্গিকে বিবেচনা করা সমীচীন হবে। অতঃপর, স্পীকার তৎবিষযে সাধারণ আলােচনার জন্যে তিন ঘন্টা সময় ধার্য করেন। এই পর্যায়ে জামাতে ইসলামীর মাওলানা আব্দুস সােবাহান বিষয়গুলাে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিধায় তৎসম্পর্কে আলােচনা না করার আহবান জানান। জামাতে ইসলামীর অপর একজন সদস্যও একই কথা বলেন। এর পর বি.এন.পি, সরকারের তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা গণআদালত এবং গােলাম আযম সংক্রান্ত বিষয়গুলাে সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচারাধীন রয়েছে এই কারণে সেগুলাে সংসদে আলােচনা করা যায় না বলে দাবী করেন। এই শেষােক্ত তিনজন সংসদ সদস্যের বক্তব্যের জবাবে স্পীকার সংসদ কার্যপ্রণালী বিধির ১৫০ ধারায় প্রদত্ত তাঁর ক্ষমতা উল্লেখ করে বিষয় দুটোর ব্যাপারে সাধারণ আলােচনার অনুমতি দেন। তদনুযায়ী এদিন মাগরিবের নামাজের পর সন্ধ্যে ৭টায় গণআদালত এবং গােলাম আযম প্রসঙ্গে সাধারণ আলােচনা শুরু হয়।
৭৫। এদিন আওয়ামী লীগের তােফায়েল আহমদ, জাতীয় পার্টির মিজানুর রহমান চৌধুরী, জামাতে ইসলামীর মাওলানা আব্দুস সােবাহান এবং বি.এন.পি.-এর কর্নেল (অবঃ) আকবর হােসেন, এই চারজন সংসদ সদস্য সাধারণ আলােচনায় বক্তব্য রাখেন। আলােচনার সূত্রপাত করে জনাব তােফায়েল আহমদ বলেন, “দেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যে এই সংসদেকে এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। (পঞ্চম সংসদের) চতুর্থ অধিবেশন শেষ হবার পর গত দু’মাসে এ দেশের রাজনীতিতে অনেক পানি গড়িয়েছে। একজন শহীদের মা বেগম জাহানারা ইমাম, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তাবায়ন এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে গঠিত গণআদালতের মাধ্যমে ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে জনমত সৃষ্টি করেছেন। গণআদালত যাঁরা করেছেন তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র। বর্তমান বি.এন.পি.) সরকারের আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী
পৃষ্ঠাঃ ৪০৭
মির্জা গােলাম হাফিজ (বিগত এরশাদ সরকার বিরােধী গণআন্দোলনের সময় গণআদালতে এরশাদের বিচারের কথা বলেছিলেন। ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলন (ও গণঅভ্যুথান)-এর মুখে এরশাদ জনগণের কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। ১৯৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলুণ্ঠিত করে গােলাম আযমকে দেশে আসার সুযােগ করে দেন, শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী বানান, (বঙ্গবন্ধুর আমলের) দালাল আইন বাতিল করেন এবং দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সুযােগ করে দেন।” অতঃপর, তােফায়েল আহমদ, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার উক্তি” এই বি.এন.পি. সেই বি.এন.পি. নয়”-এর উল্লেখ করে বলেন, “১৯৭৫ সালের পর সংবিধান সংশােধন করে গােলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে আমরা যে ভুল করেছি আজ আমাদের সে ভুল শােধরাতে হবে। গণঅ্যুথানের ফসল এ সরকার। গণআদালতের উদ্যোক্তাদের ২৪ জনের বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ এনেছেন তা সত্যিই নিন্দনীয়। বৃটিশ সরকার তিতুমীর, সূৰ্য্যসেন, হাজি শরিয়তউল্লাহ, ক্ষুদিরাম, প্রমুখের মতাে দেশপ্রেমিকদেরও দেশদ্রোহী বলে অভিযােগ এনেছিল। পাকিস্তান সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানরে বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ এনে (তথাকথিত) আগরতলা মামলা’ সাজিয়েছিল। কিন্তু জনগণ তা নস্যাৎ করে দেয়। তাই বলছি, আগুন নিয়ে খেলবেন না।”
৭৬। এদিন সংসদে জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, “১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জামাতে ইসলাম ১০টি আসন পেয়েছিল। তখন (তারা) গােলাম আযমকে দিলের) আমীর করে নাই। এবার (বি.এন.পি.) যখন তাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছে, তখনই তারা গােলাম আযমকে (দলের) আমীর (দল প্রধান) করার সাহস পেয়েছে। (বি.এন.পি.) সরকারের আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই গােলাম আযমকে জামাতে ইসলামী (তাদের দলের) আমীর করেছে। আবার যখন গােলাম আযমের বিচারের জন্যে গণআদালত গঠিত হয়েছে, তখন (বি.এন.পি.) সরকার তাকে ডিটেনশন দিয়েছে। কাজেই) গােলাম আযমের ব্যাপারে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিরােধী দলগুলাের খুব একটা করণীয় কিছু নেই।” অতঃপর মিজানুর রহমান চৌধুরী আত্মঘাতী রাজনীতি পরিহার করার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘এর মাধ্যমে দেশের কোন কল্যাণ হতে পারে না। মুক্তমন ও চিন্তা নিয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে সরকারকে গােলাম আযমের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এ সিদ্ধান্ত যত শিগগির নেয়া সম্ভব ততােই জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। গােলাম আযমকে যদি দেশে আসার ভিসা দেয়া না হতাে, তাহলে) জাতি অনেক আইনগত জটিলতা থেকে রক্ষা পেতাে। ১৯৭৫ সালের আগে গােলাম আযম দেশে আসেননি। তিনি পাকিস্তানী পাসপাের্ট নিয়ে (এদেশে) এসেছিলেন। তাঁর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া হয়নি। (তার) ভিসাও নবায়ন করা হয়নি। তবুও তিনি কিভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে
পৃষ্ঠাঃ ৪০৮
এদেশে আছেন, জানি না। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করার জন্য গােলাম আযম কখনই অনুতাপ প্রকাশ করেননি বা ভুল স্বীকার করে জাতির কাছে ক্ষমাও চাননি।” অতঃপর জামাতে ইসলামীর মাওলানা আব্দুস সােবহান সাধারণ আলােচনায় অংশগ্রহণ করে বলেন, “গােলাম আযম ১৪ বছর যাবত বাংলার জমিনে আছেন, রাজস্ব দিচ্ছেন। গােলাম আযম ‘ইসলামের জন্যে কাজ করেছেন। তিনি এদেশে ইসলামী আন্দোলনই করেছেন—ইসলামী পরিবেশ রচনার জন্যেই কাজ করেছেন—এর বাইরে কিছু করছেন না। গােলাম আযম এদেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করছিলেন। আমরা মেরহুম) জিয়াউর রহমানকে সমর্থন দিয়েছি, বর্তমান (বি.এন.পি.) সরকারকেও সমর্থন করেছি। এদেশ ও এ জাতি আমাদের কাছে সব চাইতে বড় কোন ব্যক্তি নয়। তাই দেশের জন্যে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য যা কিছু কল্যাণকর এ সংসদে সে ধরনেরই সিদ্ধান্ত নেয়ার আহবান জানাই।”
৭৭। এর পর এদিন বি.এন.পি. দলীয় সংসদ সদস্য কর্নেল (অবঃ) আকবর হােসেন বলেন, “জনমত হচ্ছে সবচেয়ে বড় মত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এদেশের মানুষ যে রায় দিয়েছিল, সেই রায়কে যারা নস্যাৎ করতে চেয়েছিল তারাই অপরাধী। গণআদালত জনমত প্রকাশের মাধ্যম। এতে জনমত যাচাইয়ের ধারা সৃষ্টি হয়। কিন্তু অপরাধীর বিচার কাজ করা হয় দেশে প্রচলিত আইনের মাধ্যমে। সরকার গণআদালতের রায় কার্যকরী করতে পারে না। সরকার জজকোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্টের রায় বাস্তবায়ন করবে।” অতঃপর কর্নেল (অবঃ) আকবর হােসেন গণআদালত গঠন করে দেশের প্রচলিত আইন-আদালতকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে বলে একটি মহলের বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে বলেন, “গণআদালত জনমত সৃষ্টি করেছে, নতুন প্রজন্মের কাছে ১৯৭১-এর ধিকৃত অপরাধীদের সম্পর্কে, গােলাম আযমের ঘৃণ্য ভূমিকা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। মাওলানা মান্নানকে চাঁদপুরে আমরা মুক্তিযােদ্ধারাই সেদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম।” অতঃপর তিনি এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ, সাক্ষীপ্রমাণসহ এনে কোর্টে তার বিচারের আহবান জানিয়ে বলেন, ‘যদি কোর্ট বলে গােলাম আযমের ফাঁসি দেয়া হােক, তাহলে আমার চেয়ে বেশী খুশী আর কেউ হবেন না। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে একটি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। আইনের আদালতই সবচেয়ে বড় আদালত। গণআদলত হচ্ছে জনমত সৃষ্টির একটি মাধ্যম মাত্র।” কর্নেল (অবঃ) আকবর হােসেনের বক্তব্য শেষ হবার পর স্পীকার সংসদের বৈঠক ১৩ই এপ্রিল বিকেল তিনটা পর্যন্ত মুলতবী ঘােষণা করেন।
৭৮। ১৩ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখে মাগরিবের নামাজের বিরতির পর সন্ধ্যে ৭-৪০ মিনিটে সংসদে শুরু হয় গণআদালত এবং গােলাম আযম প্রসঙ্গে দ্বিতীয় দফা সাধারণ আলােচনা। এ দিনের আলােচনায় পর্যায়ক্রমে অংশগ্রহণ করেন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, বি.এন.পি.-এর সরদার সাখাওয়াত হােসেন বকুল, আওয়ামী লীগের বেগম সাজেদা চৌধুরী, জামাতে ইসলামীর শেখ আনসার আলী, আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল করিম
পৃষ্ঠাঃ ৪০৯
সেলিম, জাসদ-এর শাহজাহান সিরাজ, বি.এন.পি.-এর লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী এবং আওয়ামী লীগের সালাউদ্দিন ইউসুফ ও কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী। জনাব রাশেদ খান মেনন বলেন, “গােলাম আযম কোন ব্যক্তি নন, তিনি হত্যা ও ধ্বংসের প্রতীক। যুদ্ধাপরাধী এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তার সকল অপকর্মের বিচার করতে হবে। একই সাথে পাকিস্তানী নাগরিক গােলাম আযমকে যাঁরা দেলের) আমীর (দল প্রধান) বানিয়েছে সেসব জামাতে ইসলামী নেতাদেরও বিচার করতে হবে। বেগম জাহানারা ইমাম এবং গণ-আদালতের সদস্যরা আমাদের দায়মুক্ত করেছেন। আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।” অতঃপর গণআদালত আইনানুগ নয়, সরকারী দল বি.এন.পি.-এর এই অভিমত খন্ডন করে রাশেদ খান মেনন বলেন, “সংবিধানে অন্তবর্তীকালীন সরকার বলে কোন কথার উল্লেখ নেই। আমরা এরশাদকে হটিয়ে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করেছি। বি.এন.পি. নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করেছে। তাহলে এটাও কি সংবিধান বিরােধী? এরশাদকে হটানাের জন্য জনমত ছিল। (তখন) অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল জনমতের ভিত্তিতে। (বর্তমানে) গােলাম আযমের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছে। (অতএব) সরকারকেও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে।”
৭৯। এর পর এদিন আলােচনায় অংশ গ্রহণ করে বি.এন.পি.-এর সরদার সাখাওয়াত হােসেন বকুল বলেন, ‘স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের সরকার যে ভুল করেছিলাে, বিএনপি সরকার সেই একই ভুল করতে চায় না। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধবিরােধীদের পুনর্বাসিত করেছেন। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার গােলাম আযমকে গ্রেফতার করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। কিন্তু গণআদালত বলে কিছু নেই। কারাে বিরুদ্ধে কোন অভিযােগ প্রমাণের জন্যে কোর্টের আশ্রয় নিতে হবে। এর পর এদিনের তৃতীয় বক্তা বেগম সাজেদা চৌধুরী বলেন, ‘জনতার রুদ্ররােষ থেকে বাঁচানাের জন্যে সরকার সুকৌশলে গােলাম আযমকে জেলে পাঠিয়েছে। বিদেশী নাগরিক, খুনী, নরঘাতক গােলম আযমের বিচার করতে হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। প্রয়ােজনে নতুন আইন তৈরী করে তাকে ফাঁসি দিতে হবে। গােলাম আযমের অপকর্মের সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে। গত ২৬শে মার্চ (১৯৯২) সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে (অনুষ্ঠিত গণ-আদালতে) তিন জন মহিলা এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন। গােলাম আযমের বিচারের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের অস্তিত্ব।” এর পর এদিনের চতুর্থ বক্তা জামাতে ইসলামীর শেখ আনসার আলী বলেন, “গােলাম আযম এদেশের অধিবাসী, স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবেই অবস্থান করছেন। তাঁর গ্রেফতারের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। অতএব এ বিষয় নিয়ে সংসদে) আলােচনা হতে পারে না। গণআদালত থাকলে সুপ্রীম কোর্ট থাকে না। (বি.এন.পি.) সরকার যথাযথভাবে গণআদাতকে অবৈধ বলেছিলেন। এই অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর হলে তারা সংসদ পর্যন্ত আসতে সাহস পেতাে না।”
পৃষ্ঠাঃ ৪১০
৮০। এদিন সংসদে গােলাম আযমের বিষয়ে আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল করিম সেলিম। বলেন, ১৯৭১-এর ঘাতকদের বিরুদ্ধে সরকারকে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আজ এক হয়েছে। জনগণের রায়ের চেয়ে অন্য কোন রায় গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। প্রয়ােজনে সংসদে আইন করে ঘাতক গােলাম আযমের বিরুদ্ধে গণরায় কার্যকর করতে হবে। এ জন্যে (বিশেষ) ট্রাইব্যুনাল করা হােক।” অতঃপর আললাচনায় অংশগ্রহণ করে জাসদ (সিরাজ)-এর শাহজাহান সিরাজ বলেন, ‘১৯৭০ সালে গণরায় পাকিস্তানীরা মানেনি বলে আমরা হাতে অস্ত্র নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করেছি। গােলাম আযমের বিচার না করা হলে বাংলার জনগণ তা মেনে নেবে না। সংসদ যে আইন করবে সে আইন অনুযায়ী হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট চলবে। নরঘাতককে কোন আইনে এদেশে আনা হয়েছে, তার জবাব আজ দিতে হবে। গত ১৪ বছর সরকারগুলাে শুধু তাকে লালনই করেনি, তারা আবার আলবদর বাহিনী গঠন করে মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করেছে। সংসদ সিদ্ধান্ত না দিলে, সুপ্রীম কোর্টের কি সুযােগ আছে বিচারের? এটা চুরির মামলা নয়, এটা দেশ ও জাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন। আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এদেশ কোন চেতনার ভিত্তিতে চলবে। যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে চলে, তাহলে গােলাম আযমকে ফাঁসি দিতে হবে। তার কবর এদেশে হবে না, হবে (পাকিস্তানে) নুরুল আমিনের পাশে। সরকারী দলের ওপর আজ বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করছে। স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের কোন ইতিহাস রচিত হতে পারে না।”
৮১। এর পর এদিন বি.এন.পি.-এর লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী বলেন, “বিশ বছর পর আজকে দালালদের বিচারের কথা শুনে একজন মুক্তিযােদ্ধা সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আমি আনন্দিত। মুক্তিযুদ্ধ করেছিল এদেশের আপামর জনতা, কিছু সংখ্যক দালাল ও ঘাতক ছাড়া। ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের পর আর একটি বিজয় আশা করেছিলাম, হানাদারদের বাংলার মাটিতে বিভিন্ন মােড়ে মােড়ে ঝুলানাে হবে—এই আশা ছিল। সেসময় সরকারও বলেছিল যে, তাদের (যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। কিন্তু সে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার বিরােধিতা যারা করেছিল, তারা ইতিহাসের অন্ধকারে স্বাভাবিকভাবেই মিশে যাবে। অতএব, বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে গড়ে তুলতে আসুন ঐক্যবদ্ধ হই।” এর পর আওয়ামী লীগের সালাউদ্দিন ইউসুফ বলেন, “গণআদালতের রায়ে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। সরকারের কাছে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আছে। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার (গােলাম আযমের) বিচারের ক্ষেত্রে সরকারের কেন দোদুল্যমানতা? সরকার তাকে (গােলাম আযমকে) যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ঘােষণা না দিয়ে শুধুমাত্র আটক করেছে।” এদিনের শেষ বক্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের কর্নেল (অবঃ) শওকত আলী। কিন্তু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তিনি বিশেষ কোন বক্তব্য রাখেননি। তাঁর বক্তৃতার সাথে ১২ই ও ১৩ই এপ্রিল (১৯৯২) এই দুইদিনে গণআদালত এবং গােলাম আযম প্রসঙ্গে সাধারণ
পৃষ্ঠাঃ ৪১১
আলােচনার জন্য পূর্বনির্ধারিত তিন ঘন্টা সময় শেষ হয় এদিন রাত ১০টা ৫ মিনিটে। অতঃপর সংসদের বৈঠক মুলতবী ঘােষণা করা হয় ১৫ই এপ্রিল (১৯৯২) বিকেল তিন ঘটিকা পর্যন্ত।
৮২। ১৪ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখ বিকেলে, ১৯৭১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের সমন্বয়ে গঠিত ‘১৯৭১-এর প্রজন্ম সংগঠনের ২৫ জন সদস্য পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ বাসভবন ‘বঙ্গবন্ধু ভবনে আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সংসদে বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনার সাথে এক শুভেচ্ছা সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়। সাক্ষাৎকারের প্রাক্কালে ‘১৯৭১-এর প্রজন্মের সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। অতঃপর তারা ম্যাডাম হাসিনার কাছে পেশ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ দেশ ও জাতি গঠনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী এবং তাদের জীবনে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যাদি উল্লেখ করে একটি স্মারকলিপি। এ সময় শহীদ নূরুল আলমের কন্যা মুক্তি, ফুলের তােড়া, শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার তাঁর লেখা বই”মুক্তি”, কন্যা শমী কায়সারের লেখা বই “আর কতদূর” এবং “প্ৰজন ১৯৭১” এর পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ওপর একটি চিত্রকর্ম’ ম্যাডাম হাসিনাকে উপহার দেয়া হয়। আলাপকালে”প্রজন্ম ১৯৭১” এর সদস্যরা বলে, “সুকৌশল আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। যার ফলে একটি বিকৃত প্রজন্ম তৈরী হতে চলেছে। সেই অশুভ যােতধারার বিপরীতে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে যথােচিত অবদান রাখতে এবং ভূমিকা পালন করতে চাই। আমরা অবিলম্বে ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিলের দাবি জানাই।”
৮৩। ১৫ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখে সংসদের চীফ হুইপ খন্দকার দেলওয়ার হােসেন ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিল সংক্রান্ত বিল সম্পর্কে রিপাের্ট প্রদানের জন্য সংসদের বিশেষ কমিটির পক্ষে আরও ৭০ দিন সময় চেয়ে সংসদ স্পীকারের কাছে অনুরােধ জানান। এ সময় তিনি বলেন, ‘ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিল বিল সংক্রান্ত সংসদীয় বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী মির্জা গােলাম হাফিজ দেশের বাইরে রয়েছেন। এদিকে পূর্ববর্ধিত ৭০ দিন এ মাসের ১৯ তারিখে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই সংসদীয় বিশেষ কমিটির পক্ষ থেকে আরও ৭০ দিন। সময় চাচ্ছি।” অতঃপর সংসদ স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী সরকারী দলের চীফ হুইফ খন্দকার দেলওয়ার হােসেনের আবেদন মঞ্জুর করে উল্লেখিত উদ্দেশ্যে আর ৭০ দিন সময় বাড়িয়ে দেন।
৮৪। ১৫ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখ সন্ধ্যে ৮টা ৫মিনিটে সংসদে শুরু হয় ‘গণআদালত এবং গােলাম আযম’ প্রসঙ্গে তৃতীয় দফা সাধারণ আলােচনা। এদিনের সাধারণ আলােচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ করেন বি.এন.পি.-এর পূর্তমন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম
পৃষ্ঠাঃ ৪১২
মিয়া, আওয়ামী লীগের সুধাংশু শেখর হালদার, গণতন্ত্রী পার্টির সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত ও বি.এন.পি.-এর শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। আলােচনার সূত্রপাত করে ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, “১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে নতুন দিল্লীতে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীসহ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সকলকে মুক্তি দেয়া হয়। এ ছাড়াও, তৎকালীন শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার দালালদের সাধারণ ক্ষমা প্রদান করেন। রাজাকার বাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযােগী (বাহিনী) ছিল না। অতএব এ কারণে বর্তমান আইনে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গােলাম আযমের বিচার করা যায় না। আমরা সামনের দিকে এগুতে চাই। বিএনপি সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে দেশের সব সমস্যা সমাধানে এগিয়ে যাচ্ছে।” এর পর আওয়ামী লীগের সুধাংশু শেখর হালদার বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্যকারী অন্য যে কোন বাহিনীই সহযােগী বাহিনী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীকে সর্বতােভাবে সাহায্য করেছে (তৎকালীন) রাজাকার বাহিনী। তৎকালীন, ইস্ট পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স (১৯৭১) অনুসারে রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর সহযােগী বাহিনী ছিল। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধাপরাধী আইনে (তৎকালীন) রাজাকারদের বিচার করা যায়। শুধু পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীই নয়, যেকোন বেসামরিক ব্যক্তি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অপরাধ করে থাকলে উক্ত আইনে তারও বিচার করা যায়। গােলাম আযমকে নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে অনেকেই বিষয়টি বিচারাধীন রয়েছে এই কারণে তার ব্যাপারে আলােচনা করা যাবে না বলে দাবি করেছেন। আমার প্রশ্ন, পাকিস্তানী নাগরিক গােলাম আযম জামাতে ইসলামীর আমীর (দল প্রধান) হয়েছেন, সে বিষয়ে কোন মামলা দায়ের করা হয়েছে কি?” অতঃপর সুধাংশু শেখর হালদার আরও বলেন, “গােলাম আযমের বিচারের পথ তদানীন্তন সরকার বন্ধ করে দেয়নি। পরিশেষে সুধাংশু শেখর হালদার গােলাম আযমের বাংলাদেশে পাকিস্তানী পাসপাের্টে এদেশের এন্ট্রি ভিসা নিয়ে প্রবেশের কথা উল্লেখ করে বলেন, “গােলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্বের আবেদনেও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর আনুগত্যের কলাম পূরণ করেননি। গােলাম আযম এদেশে নিবন্ধীকৃত বিদেশী হিসেবে অবস্থান করছেন। ১২ই জুলাই (১৯৭৮) তারিখে তিনি ফরেনার্স রেজিস্টারে নিবন্ধীকৃত হয়েছেন। তারপর থেকে তিনি বৈধ ভিসা ছাড়াই এদেশে অবস্থান করছেন। অথচ, তিনি বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলের আমীর বা প্রধান হয়েছেন। তিনি তা হতে পারেন না।”
৮৫। এদিন সংসদে গােলাম আযমের বিষয়ে গণতন্ত্রী পার্টির সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেন, “গােলাম আযমের বিচারের দাবীতে জনমত সৃষ্টি হয়েছে। অতএব সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই তাঁর বিচার সম্ভব। তদন্ত এবং ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু হলেই গােলাম আযমের বিরুদ্ধে সব অভিযােগ প্রমাণিত হয়ে যাবে। দেশের ১২ কোটি মানুষ
পৃষ্ঠাঃ ৪১৩
গােলাম আযমের বিচারের পক্ষে। সরকারকেও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। এই (বি.এন.পি.) সরকার গােলাম আযমের বিচার না করলে অন্য সরকার তার বিচার করবে।” অতঃপর গণআদালত সম্পর্কে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত বলেন, “গণআদালত শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করেছে। সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ সমাবেশে আইন প্রয়ােগকারী সংস্থা বাধা দিতে পারে না। গণআদালতের সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ। অতএব এর কার্যক্রম রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে না।” এদিনের শেষ বক্তা বি.এন.পি.-এর শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার প্রাসঙ্গিক আইনের বিভিন্ন ধারার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, ‘গণআদালত কোনভাবেই আদালত নয়, এটা অবৈধ। সংবিধান বা ফৌজদারী আইনে এই ধরনের আদালতের কোন বিধান নেই। অতএব এই আদালতের কাজে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি হতে পারে। জনমত কোন ব্যক্তিকে দোষী বলতে পারে না। গণআদালত গঠনের অথরিটি তাদের নেই। সুতরাং এটা একটা ষড়যন্ত্র। তাছাড়া গণআদালতের বিষয়টি এখন বিচারাধীন রয়েছে। (তৎকালীন) রাজকাররা ‘অকজিলিয়ারী’ ফোর্স নয়। তারা পুলিশ নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং পুলিশ কোন আর্মড ফোর্স নয়। তারা মিউনিসিপ্যাল ফোর্স, আইন শৃংখলা রক্ষাই তাদের কাজ। তাছাড়া (১৯৭৪ সালে) তিন দেশের (বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ঐ চুক্তিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও পাকিস্তানী নাগরিকদের ক্ষমা করা হয়েছিল। পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে গােলাম আযমও উক্ত ক্ষমার মধ্যে পড়েন। পাকিস্তানী হানাদারদের প্রটেকশন যে আইনে দেয়া হয়েছে, সেটা তাদের সহযােগীদের জন্যও প্রযােজ্য। অধিকন্তু, ‘দালাল আইন’ যেহেতু বাতিল হয়ে গেছে, সেহেতু সে আইনেও গােলাম আযমের বিচার করা যায় না। তবে তাঁকে। পেনাল কোডের আওতায় অভিযুক্ত করা যায়।” এই কথাগুলাের পর তাঁর এক মন্তব্যকে কেন্দ্র করে সংসদে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়। এই পর্যায়ে (রাত ১০ টা ২০ মিনিটে) সংসদ স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী সংসদের বৈঠক মুলতবী ঘােষণা করেন ১৬ই এপ্রিল (১৯৯২) সকাল ১১টা পর্যন্ত।
৮৬। ১৬ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখ বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সংসদে শুরু হয় ‘গণআদালত এবং গােলাম আযম’ প্রসঙ্গে চতুর্থ দফা সাধারণ আলােচনা সরকারী দলের সংসদ উপনেতা ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বক্তৃতা দিয়ে। ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বক্তৃতার পর স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী আলােচ্য বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না দিয়েই তৎবিষয়ে সাধারণ আলােচনার সমাপ্তি ঘােষণা করে সরাসরি রােহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে আলােচনা করার আহবান জানান। সংসদ স্পীকারের এই বক্তব্যের পরপরই বিরােধী দলের সদস্যরা গােলাম আযমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবী জানান। কিন্তু স্পীকার তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে বিরােধীদলের সংসদ সদস্যরা তুমুল হৈচৈ শুরু করেন। এই পর্যায়ে স্পীকার শেখ রাজ্জাক আলী বলেন,
পৃষ্ঠাঃ ৪১৪
“আমি সরকারী ও বিরােধী উভয় দল থেকেই গােলাম আযমের প্রশ্নে দুটো পৃথক প্রস্তাব পেয়েছি। এ দুটো দেখে এবং বিশ্লেষণ করে শনিবার ১৮ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখে আলােচ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবাে।” স্পীকারের জবাবে বিরােধী দলের পক্ষ থেকে বৈঠক কিছু সময়ের জন্য মুলতবী রাখার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু স্পীকার এই প্রস্তাবেও রাজী হননি। অতঃপর রাত ৮টা ১০ মিনিটে স্পীকার বি.এন.পি.-এর শাহজাহান খানকে রােহিঙ্গা সমস্যার ওপর বক্তব্য রাখার আমন্ত্রণ জানালে সংসদে বিরােধীদলের সদস্যরা আবারও তুমুল হৈ চৈ শুরু করেন। এই পর্যায়ে বিরােধীদলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনা বক্তব্য রাখার চেষ্টা করলে সরকারী (বি.এন.পি.) দলের সংসদ সদস্যরা একযােগে দাঁড়িয়ে তুমুল হৈ চৈ শুরু করেন। অতঃপর রাত ৮টা ১০ মিনিটে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, গণন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ (মােজাফফর), ওয়ার্কার্স পার্টি এবং স্বতন্ত্র নূরুল ইসলাম মণি ও মেজর (অবঃ) হাফিজউদ্দিন আহমদ একযােগে সংসদ হতে বেরিয়ে যান। এ সময় জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী ফ্লোর নিয়ে বলেন, “বিরােধীদলের নেতা বা নেত্রী যখন ফ্লোর নিয়ে বক্তব্য রাখতে দাঁড়ান তখন তাঁর প্রতি সম্মান দেখানাে উচিৎ। আপনাদের আচরণে যদি গণন্ত্র হুমকীর সম্মুখীন হয় তাহলে বি.এন.পি, সরকারকেই দায়ী হতে হবে। আমরাও গােলাম আযমের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার প্রতিবাদে ওয়াকআউট করলাম।” এর পর বিরােধীদলহীন সংসদে জামাতে ইসলামীর এনামুল হক, বি.এন.পি.-এর যােগাযােগমন্ত্রী কর্নেল (অবঃ) অলি আহমদ ও সংসদ সদস্য আশরাফ হােসেন কিছু বক্তব্য রাখেন। তাঁদের বক্তব্য শেষে রাত ৯ ঘটিকায় স্পীকার সংসদের বৈঠক মুলতবী ঘােষণা করেন ১৮ই এপ্রিল (১৯৯২) বিকেল ৪ ঘটিকা পর্যন্ত।
৮৭। ১৮ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখ বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে সংসদের অধিবেশন পুনরায় শুরু হয়। ১৬ই এপ্রিল (১৯৯২) বৃহস্পতিবারে স্পীকার গােলাম আযমের প্রশ্নে তাঁর সিদ্ধান্ত না দেয়ার প্রতিবাদে এদিনেও কেবলমাত্র জামাতে ইসলামীর সদস্যরা ছাড়া স্বতন্ত্র সদস্য নূরুল ইসলাম মণি ও মেজর (অবঃ) হাফিজউদ্দিন আহমদসহ সকল বিরােধী দলের সদস্যরা সংসদ বর্জন অব্যাহত রাখেন। এহেন পরিস্থিতিতে, সরকারী দলের উপনেতা ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অনুরােধে স্পীকার ৪.৪৫ মিনিটে কিছু সময়ের জন্য সংসদ মুলতবী ঘােষণা করেন বিরােধী দলের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে আলােচ্য বিষয়ে সমঝােতা প্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্টা চালানাের জন্যে। এর পর সুদীর্ঘ পৌণে আট ঘন্টা ধরে পৃথক পৃথকভাবে প্রধান বিরােধী দলীয় নেত্রী ও উপনেতার কক্ষ, প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ, স্পীকারের কক্ষসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অনুষ্ঠিত হয় ২১ টি আলােচনা বৈঠক। কিন্তু তা সত্ত্বেও আলােচ্য বিষয়ে কোন সমঝােতা হয়নি। যাহােক, রাত ১২.২৫ মিনিটে পুনরায় সংসদের সভা শুরু হয়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে স্পীকার ১৯ শে এপ্রিল সন্ধ্যে ৭ টা পর্যন্ত সংসদের অধিবেশন মুলতবী ঘােষণা করেন।
পৃষ্ঠাঃ ৪১৫
৮৮। ১৯ শে এপ্রিল (১৯৯২) সন্ধ্যে ৭টা ২৩ মিনিটে সংসদের অধিবেশন পুনরায় শুরু হয়। কিন্তু জামাতে ইসলামী ছাড়া স্বতন্ত্র সদস্য নূরুল ইসলাম মণি ও মেজর (অবঃ) হাফিজউদ্দিন আহমদসহ আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, এনডিপি, জাসদ (সিরাজ) ও ইসলামী ঐক্যজোটের সংসদ সদস্যরা তাদের সংসদ বর্জনের সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখেন। তখন সংসদে উপস্থিত ছিলেন সরকারী দল বি.এন.পি.-এর ১৭০ জন সদস্যের মধ্যে ১৩৬ জন এবং জামাতে ইসলামীর ১৭ জন সদস্য। ১৮ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখের মতাে এদিনেও প্রধানমন্ত্রী সংসদকক্ষে উপস্থিত ছিলেন না। যাহােক, গােলাম আযমের প্রশ্নে বিরােধী দলীয় ও সরকারী প্রস্তাব দুটোর ওপর ভােট গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্পীকার প্রথমে বিরােধী দলীয় প্রস্তাবের ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহবান জানান। ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামাতে ইসলামীর আমীর (দল প্রধান) পাকিস্তানী নাগরিক গােলাম আযম ও তার সহযােগীদের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম এ্যাক্ট (১৯৭৩)-এর অধীনে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার অনুষ্ঠান এবং জনমতের প্রতিফলনকারী গণআদালতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহারের বিরােধী দলীয় প্রস্তাব কেবলমাত্র জামাতে ইসলামী এবং সরকারী দল বি.এন.পি.-এর সদস্যদের উপস্থিতিতে কণ্ঠভোেট প্রত্যাখ্যাত হয়। এর পর স্পীকার সংসদ উপনেতা ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে গােলাম আযমের প্রশ্নে সরকারী প্রস্তাব পেশ করার আহবান জানান। সরকারী প্রস্তাবে বলা হয়ঃ ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীন দেশে নয় বছরের সংগ্রামের পর নির্বাচিত সংসদের ওপর তাকিয়ে আছে জাতি। এ অবস্থায় সংসদ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। তাই অনাগরিক গােলাম আযমের বিষয়টির নিস্পত্তি করা হবে সাংবিধানিক রীতির প্রচলিত আইনের নিয়মানুযায়ী।” প্রস্তাবটি পাঠের সময় জামাতে ইসলামীর সংসদ নেতা মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেন, “আমরা আগেই বলেছি যে, গােলাম আযমের বিষয়টি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিধায় এ ব্যাপারে সংসদের সিদ্ধান্ত নেয়া যুক্তিগত হবে না। অতএব, সরকারী দলের এতদবিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রস্তাবের প্রতিবাদে আমরা সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলাম।” যাহােক, একমাত্র বি.এন.পি. সদস্যদের উপস্থিতিতে কণ্ঠভােটে সরকারী প্রস্তাবটি সংসদে গৃহীত হয়। এর পর রাষ্ট্রপতির আদেশে রাত ৮টা ২৩ মিনিটে পঞ্চম জাতীয় সংসদের পঞ্চম অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়। ২২শে এপ্রিল (১৯৯২) তারিখে এক সরকারী আদেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটককৃত গােলাম আযমের আটকাদেশের মেয়াদ আরও ৬০ দিন বৃদ্ধি করা হয়।
৮৯। ২২শে এপ্রিল (১৯৯২) ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ বেগম জাহানারা ইমামকে চেয়ারপারসন ও অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে এর পূর্ব-গঠিত ৮-সদস্য স্টিয়ারিং কমিটির
পৃষ্ঠাঃ ৪১৬
পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে গঠন করে একটি ১৮ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি। উক্ত উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে থাকেনঃ কবি বেগম সুফিয়া কামাল, ডঃ আহমদ শরীফ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, ডঃ আনিসুজ্জামান, ডঃ বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, স্থপতি মযহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শওকত আলী খান, ব্যারিস্টার শফিক আহমদ, শিল্পী কলিম শরাফী, ফয়েজ আহমেদ, লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান, এডভােকেট গাজীউল হক, লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী ও মাওলানা আব্দুল আওয়াল। একই সঙ্গে ঘােষণা করা হয় ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে জামাতে ইসলামী আমীর (দল প্রধান) গােলাম আযমের বিরুদ্ধে ঘােষিত গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবীতে ২৬শে এপ্রিল (১৯৯২) বিকেল ৪ ঘটিকায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গণসমাবেশ আয়ােজন করার সিদ্ধান্ত।
৯০। ২৬শে এপ্রিল (১৯৯২) বিকেল ৪ ঘটিকায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে এবং কমিটির আহবাহিকা বেগম জাহানারা ইমামের সভানেত্রীত্বে অনুষ্ঠিত হয় এক বিশাল জনসভা। সভানেত্রীর ভাষণে বেগম জাহানারা ইমাম বলেন, “আজ দেশে একদিকে স্বাধীনতার পক্ষে সাড়ে এগারাে কোটি মানুষ, অন্যদিকে মাত্র ৪০/৪৫ লাখ ফ্যাসিস্ট।” জাহানারা ইমাম তাঁর ভাষণে জামাতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির, ফ্রীডম পার্টিসহ পাকিস্তানপন্থী অন্যান্য সংগঠনের তরুণ সদস্যদের প্রতি আহবান জানান ঐ সব স্বাধীনতা বিরােধী সংগঠন। থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় মূল স্রোতধারায় অংশ নেয়ার। অতঃপর তিনি বলেন, “তাহলেই জাতির সঠিক ইতিহাস আর বিকৃত করার সাহস আর কেউ করবে না।” জাহানারা ইমাম আরও বলেন, “জাতীয় সংসদে এক প্রতারণামূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বি.এন.পি.-এর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বহু নেতা গােলাম আযমের বিচারের পক্ষে জোরালাে বক্তব্যও রেখেছিলেন। সে সমস্ত নেতাদের মধ্যে সরকারী বি.এন.পি. দলের উপনেতাও ছিলেন। কিন্তু প্রস্তাব পাস করার সময় প্রস্তাব থেকে ব্যারিস্টারী কায়দায় বিচার শব্দটি তুলে দেয়া হয়। স্বৈরশাসককে হটানাে যতাে সহজ স্বৈরকাঠামাে নির্মূল করা তত সহজ নয়। বি.এন.পি. সরকার স্বৈরশাসকের আচরণ করছে।” উক্ত জনসভায় আরও বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির’ সর্বজনাব আব্দুর রাজ্জাক, নূরুল ইসলাম নাহিদ, ডঃ আহমদ শরীফ, এডভােকেট গাজীউল হক, হাসান ইমাম, অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান, ফয়েজ আহমদ, কাজী আরেফ আহমদ, আব্দুল আহাদ চৌধুরী, বীর মুক্তিযােদ্ধা মােফাজ্জল হােসেন মায়া প্রমুখ সদস্যরা। উক্ত সভায় জামাতে ইসলামীর আমীর গােলাম আযমের বিরুদ্ধে ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে ঘােষিত গণআদালতের রায় কার্যকর এবং গণআদালতের উদ্যোক্তাদের ২৪ জনের বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত মামলা
পৃষ্ঠাঃ ৪১৭
প্রত্যাহারের দাবীতে ১৮ই মে (১৯৯২) তারিখে ঢাকা মহানগরীতে সকাল ৬টা থেকে বিকেল ২ ঘটিকা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালনের কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়। উক্ত সভায় জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সংবিধানের ৩৮ নং ধারা লংঘনের জন্য অনতিবিলম্বে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তাঁর দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্যেও সরকারের প্রতি দাবি জানানাে হয়।
৯১। ২৯শে এপ্রিল (১১৯২) তারিখে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের এক জরুরী সভায় জামাতে ইসলামীর গােলাম আযমের প্রশ্ন ও তাঁর বিরুদ্ধে ঘঘাষিত গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ আহুত ১৮ই মে (১৯৯২) তারিখে সারা ঢাকা শহরে ৮ ঘন্টা হরতালের বিষয়টি আলােচিত হয়। আওয়ামী লীগের উক্ত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ১৮ই মে (১৯৯২) তারিখের হরতাল কর্মসূচীকে সমর্থন করে সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহবান জানানাে হয় তা সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে। এদিনে জামাতে ইসলামীর গােলাম আযমসহ ১৯৭১-এর ঘাতক দালালদের আইনানুগ বিচারের দাবীতে আরও একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে। ঐদিনেই ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির শরিক সংগঠন ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক প্রতিনিধি সভা। উক্ত সভায় অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশের ২০০টি উপজেলার এক হাজারেরও অধিক প্রতিনিধি। দেশের ২৫টি জেলার প্রতিনিধিরা তাঁদের স্ব স্ব শাখা সংগঠনের প্রতিবেদন পেশ করেন উক্ত সভায়। ঐ প্রতিনিধি সভার প্রথম অধিবেশনে বেগম জাহানারা ইমামকে আহবায়িকা ও লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামানকে প্রধান সমন্বয়কারী। নির্বাচিত করে গঠন করা হয় উক্ত সংগঠনের ১৬৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি। উক্ত জাতীয় কমিটিতে সদস্য হিসেবে রাখা হয় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার সংগঠনের শাখা কমিটির আহবায়কদের। সভার উক্ত অধিবেশনে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে উপরােল্লিখিত জাতীয় কমিটিকে (রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ ও দলীয় প্রভাবমুক্ত সংগঠন হিসেবে রক্ষা করে সকল কার্যক্রম চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এরপর মে মাসের প্রথম সপ্তাহেই, ১৮ই মে (১৯৯২) তারিখে সারা ঢাকা শহরে সর্বাত্মক অর্ধদিবস হরতাল কর্মসূচীর প্রতি সর্বপ্রকার সমর্থন ও সহযােগিতা প্রদানের কথা ঘােষণা করে ৫ দলীয় রাজনৈতিক জোট, পিডিএফ, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপ (মােজাফফর), জাসদ (ইনু), জাসদ (সিরাজ), জাসদ (রব), বাসদ (খালেক), বাসদ (মাহবুব), অলি আহাদের ডেমােক্রেটিক লীগ, বিভিন্ন মুক্তিযােদ্ধা সংগঠন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং আরও অনেক সাংস্কৃতিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও শ্রমিক সগঠন। এ ছাড়াও, বাংলাদেশ আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত, বাংলাদেশ উলেমা পরিষদ, আনজুমান-ই-তরিকত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী লীগ এবং আরও অনেক
পৃষ্ঠাঃ ৪১৮
ইসলাম ধর্মানুরাগী সংগঠন জামাতে ইসলামীর ধর্ম বিকৃতি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরােধী ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করে এবং বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীর সকল তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষণা করার জন্যে বিএনপি সরকারের প্রতি জোর দাবি জানায়।
৯২। ১১ই মে (১৯৯২) তারিখ সকাল সাড়ে দশটায় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (আলমঅসীম)-এর দুইদিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশন। এতে সভাপতিত্ব করে ছাত্রলীগ (আ-অ)-এর সভাপতি শাহে আলম এবং প্রধান অতিথি হিসেবে এর উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও জাতীয় সংসদের বিরােধী দলীয় নেত্রী ম্যাডাম হাসিনা। উক্ত অধিবেশনের প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধনী ভাষণে ম্যাডাম হাসিনা ছাত্রলীগের সংগ্রামী ইতিহাসের পটভূমি উল্লেখ করে বলেন, “অত্যন্ত সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য শহীদদের তালিকায় ছাত্রলীগের নাম সর্বাগ্রে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, প্রতিটি (জাতীয়) আন্দোলনে, সংগ্রামে তারা সংগ্রামের ঐতিহ্য সমুন্নত রেখেছে।”… অতঃপর ছাত্রলীগকে আরও শক্তিশালী সুসংগঠিত করে তােলার জন্যে সর্বস্তরের ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি চাই, (কোন) ব্যক্তিবিশেষের নয়, ছাত্রলীগ জাতির তথা দেশের জনগণের জন্য কাজ করবে।”… এর পর ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের সংগঠনের মূলমন্ত্র শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির ধারণায় উজ্জীবিত হবার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার আলাে জ্বালাতে হবে। প্রতিটি ছাত্র, তথা নেতাকর্মীকে সর্বপ্রথমে শিক্ষার দিকে মনােনিবশ করতে হবে এবং শিক্ষাঙ্গনে যাতে শান্তি (ও শিক্ষার পরিবেশ বজায় থাকে সেজন্যে সবাইকে (ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যেতে হবে। তার সাথে প্রগতির ধারাকে অব্যাহত রেখে বাঙালী জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।” এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের কারণ হচ্ছে ‘রাজনৈতিক। ১৯৭৫-এর ১৫ ই আগস্টে জাতির জনককে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের। যে প্রক্রিয়া চলেছে এবং সে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যারা রাষ্ট্রীয়) ক্ষমতা দখল করেছে, তারা সবসময় সচেতন ছাত্র সমাজকে ভয় করেছে। সে কারণে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ছাত্র সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে। এখনও সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।” সাম্প্রতিককালের গণআন্দোলনে ছাত্র সমাজের কথা উল্লেখ করে ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটিয়ে আমরা গণতন্ত্র এনেছি। (কিন্তু এখন আমরা দেখছি, একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে কিন্তু তারপরেও দেখি যে, স্বৈরাচারীর পতন ঘটলেও স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটেনি। স্বৈরাচার অব্যাহত রয়েছে। চলছে চরম স্বেচ্ছাচারিতা। (এখন) যাঁরা ক্ষমতাসীন, তারা জানেন না, বােঝেন না, গণতন্ত্রের অনুশীলন কিভাবে করতে হয়। এখানে তাঁদের শিক্ষার অভাব রয়েছে। এদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহসহ সারাদেশের কোনও শিক্ষাঙ্গনে
পৃষ্ঠাঃ ৪১৯
শিক্ষার কোন সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নেই। দেশের প্রতিটি) শিক্ষাঙ্গন (এখন) এসব সন্ত্রাসীদের কবলে।”
৯৩। উক্ত ভাষণে অতঃপর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আদর্শ, লক্ষ্য ও কর্মসূচীর উল্লেখ করে ম্যাডাম হাসিনা বলেন, “আমরা সকলের ভাত, কাপড়, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা, বিশেষ করে গরীবের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এসমস্ত কর্মসূচী নিয়েছি। আমাদের (অর্থনৈতিক কর্মসূচীর পরিবর্তন করা হয়েছে (এ কথা সত্য) কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্দিষ্ট রয়েছে। আমরা যে (অর্থনৈতিক) নীতিমালা দিয়েছি তার মাধ্যমে ধনী-গরীবের মধ্যে বিরাজিত) ব্যবধান ঘুচাতে চাই। স্বাধীনতার স্বাদ (জনগণের ) ঘরে ঘরে পৌছে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করা হলে যে কর্মসূচী তিনি দিয়েছিলেন তা (এতােদিন) বাস্তবায়িত হতাে। গরীব আর গরীব থাকতাে না। দেশের) প্রতিটি মানুষ ন্যূনতম বাচার অধিকার ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা পেত। তিনি (বঙ্গবন্ধু) চেয়েছিলেন, ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়ে সুখী-সমৃদ্ধিশালী জাতি গড়তে। কিন্তু সে সুযােগ তাঁকে (বঙ্গবন্ধুকে দেয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে (তাঁর) সেই ইচ্ছাকে তিরােহিত করা হয়। (তাই এখন সময়ের সাথে তাল রেখে আমরা পথ পরিবর্তন করেছি মাত্র কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্য এক ও অভিন্ন)।” … পরিশেষে, তিনি বলেন, “এই (বি.এন.পি.) সরকার অবৈধ অস্ত্রধারীদের মদদ দিয়ে সারাদেশে মাস্তানী কর্মকাণ্ড পরিচালিত করছে। আজকে যারা দেশে অবৈধ অস্ত্র নিয়ে আছে, তাদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হয় না। ১৯৭১-এর ঘাতক ও স্বাধীনতাবিরােধী চক্র যারা (অতীতে) বিদেশে বসে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, আজ তারাই দেশে এসে বিদেশ থেকে অস্ত্র এনে স্বাধীনতা নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র করছে। আজকে সেই ঘাতক চক্র ও স্বাধীনতাবিরােধীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যখন শহীদ রুমীর মা বেগম জাহানারা ইমামসহ মুক্তিযোেদ্ধা বুদ্ধিজীবীরা প্রতিবাদ করলেন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে এ (বি.এন.পি.) সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করলাে। পক্ষান্তরে) যারা অস্ত্র নিয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, সরকারী (বি.এন.পি.) দল তাদেরকে মদদ দেয়। এর চেয়ে লজ্জার, এর চেয়ে ঘৃণার আর কি আছে?”
৯৪। ১৩ ই মে (১৯৯২) তারিখে দুইদিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলন শেষে আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ৬৯ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়। নতুন কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের নাম প্রকাশ করা হয় তারা হলােঃ সভাপতি, মঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, ইকবাল রহিম, সাংগঠনিক সম্পাদক, মাহবুবুল হক শাকিল, যুগ্ম সম্পাদক, ইকবাল হােসেন অপু এবং ইসহাক আলী খান পান্না। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির নতুন কর্মকর্তাদের নামও ঘােষণা করা হয়। ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা কমিটির
পৃষ্ঠাঃ ৪২০
কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের নাম প্রকাশ করা হয় তারা হলােঃ সভাপতি, খিজির হায়াত লিজু, সাধারণ সম্পাদক, পংকজ দেবনাথ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক, বাহাদুর বেপারী। ১৪ই মে (১৯৯২) তারিখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির ৩১ জন ছাত্রনেতা উক্ত সংগঠনের নতুন কমিটিকে একটি ‘পকেট কমিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে একটি বিবৃতি প্রদান করে। বিবৃতিদাতাদের কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল সৈয়দ কামরুল হাসান (সহসভাপতি), আতাউর রহমান (সহ-সভাপতি), শাহে আলম মুরাদ (গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক), সৈয়দ ফজলুর রহমান (সমাজসেবা সম্পাদক), রেবেকা সুলতানা রােমা ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক), লুৎফর রহমান (শিক্ষা ও পাঠক্রম সম্পাদক), কাজী নজীবুল্লাহ হিরু (অর্থ সম্পাদক) এবং ২৪ জন সদস্য ছিল, নির্মল গােস্বামী, মিজানুর রহমান আজাদ, জিল্লুর রহমান টিটো, সৈয়দ সাখাওয়াত হােসেন সাকু, ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী হ্যাপী, ওয়াহিদুজ্জান মণি, লুৎফর রহমান চৌধুরী রিপন, গােলাম রাব্বানী বাবলু, ডাঃ মােখলেসুর রহামান হিরু, নূর হােসেন বলাই, ইকবাল জামাল জুয়েল, মাসুম আহমেদ, মিজানুর রহমান মিজান, হমাউন কবির বুলবুল, বাদশা আলম, মােক্তার হােসেন, লিয়াকত আলী খান, এজাজ আহমেদ, মহিউদ্দিন আহমেদ, স্বপন কুমার রায়, ইউসুফ আলী, এনায়েত কবির, সাইদুল ইসলাম ও গােলাম মােস্তফা। উক্ত বৃিবতিতে তারা বলে; ১৩ই মে (১৯৯২) ভাের। ৫টা পর্যন্ত সাবজেক্ট কমিটির বৈঠক চলার পর সকাল ১০ টা পর্যন্ত মুলতবি ঘােষণা করা হয়। কিন্তু এর পর, সাবজেক্ট কমিটির বৈঠক আর না করে একটি বিশেষ মহলের ষড়যন্ত্রে তাদের হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য গভীর রাতে বিষয় নির্ধারণী কমিটিকে উপেক্ষা করে একটি ‘পকেট কমিটি ঘােষণা করা হয়। এই কমিটির সাথে (জাতীয় সম্মেলনের) সভা ও কাউন্সিলরদের কোন সম্পর্ক নেই। এটা ছাত্রলীগকে ধ্বংস করার একটি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র।” অতঃপর বিবৃতিদাতারা বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগের রাজনীতিকে দুর্বল ও হেয় প্রতিপন্ন। করার যে কোন ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহবান জানায়। অচিরেই গণতান্ত্রিক পন্থায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে বলেও বিবৃতিদাতারা ঘােষণা করে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের উপরােক্ত নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশের মতাে অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ দেশের রাজনৈতিক কিংবা রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে সম্পর্কিত দল বা সংগঠনের ক্ষেত্রে এরূপ অনভিপ্রেত ঘটনা প্রায়শঃই পরিলক্ষিত হয়। বলা বাহুল্য, এর অন্যতম অন্তর্নিহিত কারণ এদেশে গণতন্ত্রের বড় বড় বুলি বাহ্যতঃ উচ্চারিত হলেও কার্যতঃ গণতন্ত্রের অনুশীলন ও চর্চা এবং নিয়ম-রীতিনীতি প্রতিপালিত ও অনুসৃত না হওয়া।
৯৫। ১৮ই মে (১৯৯২) তারিখে ছিল ২৬শে মার্চ (১৯৯২) তারিখে ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে কয়েক লাখ লােকের সমাবেশে জামাতে ইসলামীর গােলাম আযমের
পৃষ্ঠাঃ ৪২১
বিরুদ্ধে ঘােষিত গণআদালতের রায় কার্যকরীকরণ, স্বাধীনতার শত্রু আলবদর-রাজাকার বাহিনীর দোসর জামাত-শিবিরের ও সকল সাম্প্রদায়িক শক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ এবং গণআদালতের সাথে সম্পর্কিত ২৪ জন বিশিষ্ট জাতীয় ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে বি.এন.পি. সরকারের দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিট আহূত রাজধানী সারা ঢাকা শহরে ভাের ৬টা থেকে বিকেল ২টা পর্যন্ত আট ঘন্টাব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল। হরতাল শেষে, বিকেল ৪ টায় ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় সভানেত্রীত্ব করেন বেগম জাহানারা ইমাম। সর্বাত্মক হরতাল পালনে সর্বপ্রকার সহযােগিতা করায় রাজধানীর নাগরিকদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বেগম জাহানারা ইমাম তাঁর ভাষণে বলেন, “অতীতে সবসময়ই হরতাল হয়েছে। কিন্তু আজ যে হরতাল হলাে তা অতীতের সব হরতাল থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। অতীতে হরতাল হয়েছে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের ডাকে। কিন্তু আজকে এই প্রথম হরতাল পালিত হয়েছে একটি অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় সংগঠনের আহবানে। আজকের হরতাল ও জনসভায় প্রমাণিত হয় যে, গােলাম আযমসহ ১৯৭১-এর ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জনগণের দাবি। এটা তাদের প্রাণের দাবি।” বেগম জাহানারা ইমাম আরও বলেন, “আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত যাবাে। আমরা ধৈর্য্যের শেষ সীমা পর্যন্ত অপেক্ষা করবাে। তারপরও দাবি আদায় না হলে, সরকার আমাদের ওপর আক্রমণে উদ্যত হলে, অবশ্যই আমরা শেষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। তখন শুরু হবে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ও নতুন প্রজন, দালাল, ঘাতক, খুনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার প্রস্তুতির জন্য দীর্ঘকাল অপেক্ষারত।” উক্ত জনসভায় আরও বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের আব্দুর রাজ্জাক এমপি, জাসদের সভাপতি কাজী আরেফ আহমদ, মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূরুজ্জামান, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নাহিদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের নেতা বদরুদ্দিন উমর, প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম, পাঁচ দলীয় জোটের আহবায়ক নঈম জাহাঙ্গীর, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ফয়েজ আহমদ, ঐক্যবদ্ধ নারী সমাজের পক্ষে বেলা নবী, গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মােহাম্মদ আফজাল, আওয়ামী লীগের মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। উক্ত জনসভায় আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মসূচীও ঘােষণা করা হয়, যার উল্লেখযােগ্য ছিল ২১শে জুন (১৯৯২) তারিখে সারা বাংলাদেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল পালন।
৯৬। ইতিপূর্বে জামাতে ইসলামী এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যার নায়ক কর্নেল (অবঃ) ফারুকের ফ্যাসিস্ট ফ্রিডম পার্টি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি (সংক্ষেপে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি)-এর গণতান্ত্রিক এবং জনসচেতনতা ও
পৃষ্ঠাঃ ৪২২
জনমত সৃষ্টির আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য যৌথভাবে গঠন করে এক ফ্যাসিস্ট ‘যুব কমান্ড বাহিনী। এই ‘যুব কমান্ড বাহনী’-এর লােকেরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মূল কমিটির’ শান্তিপূর্ণ সভা, সমাবেশ ও মিছিলে সহিংস ও সশস্ত্র হামলা চালাতে থাকে। দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বি.এন.পি.-এর সরকার যুব কমান্ডের’ এ সমস্ত সহিংস ও বর্বরােচিত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে দৃশ্যতঃ নির্লিপ্ত ও নির্বাক থাকে। ফলে, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনীও ‘যুব কমান্ডের এহেন আইন লংঘনীয় সহিংস ও বর্বরােচিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে, প্রতিরােধমূলক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা প্রদর্শন করে।
৯৭। ৫ই জুন (১৯৯২) তারিখে আমি ছেলে জয়সহ হাসিনার সঙ্গে সৌদি আরবের বাদশার অতিথি হিসেবে পবিত্র হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি এয়ারলাইন্সযােগে ঢাকা ত্যাগ করি। সেদিন সৌদি এয়ারলাইন্সের একই ফ্লাইটে বি.এন.পি.-এর সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী তাঁর পত্নীসহ ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া এবং সংসদ সদস্য ও ঢাকা নগরীর মেয়র মির্জা আব্বাসও সৌদি বাদশার অতিথি হিসেবে হজুব্রত পালনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ। করেন। সৌদি আরবের জেদ্দা নগরীতে বি.এন.পি.-এর উল্লেখিত নেতাদ্বয়সহ আমাদেরও সৌদি বাদশার কনফারেন্স প্যালেস’ ভবনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ৯ই জুন (অর্থাৎ ৮ই জেলহজ্ব) তারিখে পবিত্র হজ্ব অনুষ্ঠানের প্রথম দিন এবং পরদিন আরাফাত ময়দানে পবিত্র হজ্বের অবস্থান ও নামাজ পালন শেষে পবিত্র হজ্বের অংশ হিসেবে মিনায় তিন দিনের অবস্থানের জন্য বি.এন.পি.-এর উল্লেখিত নেতাদ্বয়ের সঙ্গে আমাদেরও সেখানে অবস্থিত সৌদি বাদশার একই ভবনে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। মক্কায় পবিত্র হজ্ব শেষে ১৪ ই জুন (১৯৯২) তারিখে জেদ্দা থেকে উল্লেখিত বি.এন.পি. নেতাদের সঙ্গে আমরাও একই বিমানে মদিনায় যাই। মদিনা শহরে একদিন অবস্থানকালে সেখানে রসুল্লাহ (সাঃ)-এর পবিত্র মাজার জেয়ারতসহ ইসলামের অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানসমূহ পরিদর্শনের সময়ও বি.এন.পি.-এর উল্লেখিত নেতাদ্বয় ও আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। সৌদি আরবে হজ্বব্রত পালন শেষে জেদ্দা ও মদিনায় অবস্থানকালে হাসিনা এবং বি.এন.পি.-এর ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও মির্জা আব্বাসের মধ্যে খােলামেলা ও বন্ধুত্বসুলভ আচরণ ও কথাবার্তায় আমি বিমুগ্ধ হই। সৌদি আরবের শহরগুলােয়, বিশেষ করে জেদ্দা ও মদিনা শহরদ্বয়ের বনায়ন প্রয়াস নিয়ে আলােচনাকালে হাসিনা বি.এন.পি.-এর উল্লেখিত নেতাদ্বয়ের সঙ্গে বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে, কিভাবে পরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত বনায়নের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা যায় সে সম্পর্কে সৌহার্দপূর্ণ ও খােলাখুলিভাবে মত বিনিময় করে। সেখানে একত্রে ভ্রমণকালে কয়েক বার বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীর গােলাম আযমের বিচার প্রসঙ্গে এবং জামাতে ইসলামী ও ফ্যাসিস্ট ফ্রিডম পার্টির যৌথ নেতৃত্বে গঠিত ফ্যাসিস্ট ‘যুব কমান্ড বাহিনীর সহিংস অপরাধজনক ও বর্বরােচিত কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও বি.এন.পি.-এর উল্লেখিত নেতাদ্বয়ের সঙ্গে হাসিনার কথাবার্তা হয়। ব্যারিস্টার
পৃষ্ঠাঃ ৪২৩
রফিকুল ইসলাম মিয়া ও মির্জা আব্বাস উভয়েই গােলাম আযমের তার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতা বিরােধী সক্রিয় ভূমিকা ও মানবতাবিরােধী কৃতকর্ম এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরােধী ভূমিকার জন্য যথাযথ বিচার হওয়া উচিৎ বলে তাদের ব্যক্তিগত মত ব্যক্ত করেন। যাহােক, সৌদি আরবের মক্কায় পবিত্র হজ্ব পালন ও মদিনা শরিফে রসুলে পাকের মাজার জেয়ারত শেষে আমরা ১৭ই জুন স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করি।
৯৮। ১৮ই জুন (১৯৯২) তারিখে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয় এবং এদিনেই অর্থমন্ত্রী সংসদে সরকারের বাজেট পেশ করেন। কিন্তু একমাত্র জামাতে ইসলামী ছাড়া, দুজন স্বতন্ত্র সদস্যসহ সংসদের অন্যান্য বিরােধী দলগুলাে তাদের ১৭ই এপ্রিল (১৯৯২) তারিখে গৃহীত সিদ্ধান্ত মােতাবেক সংসদ অধিবেশন বর্জন অব্যাহত রাখেন। উল্লেখ্য, এপ্রিল মাসের সংসদের স্বল্পকালীন অধিবেশনের শেষের দিকে ১৭ই এপ্রিল তারিখে সংসদ থেকে ওয়াকআউট করার পর দুজন স্বতন্ত্র সদস্যসহ এই বিরােধী দলগুলাের সদস্যরা ৪-দফা দাবি ঘােষণা করেন। উক্ত ঘােষণায় বলা হয়েছিলঃ (১) দেশের প্রচলিত আইন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন (ট্রাইব্যুনাল আইন ১৯৭৩) অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমের বিচার করতে হবে, (২) (গােলাম আযমের গণবিচারের জন্য গঠিত) গণআদালতের উদ্যোক্তা ও সংশ্লিষ্ট ২৪ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে (সরকার কর্তৃক) দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, (৩) রাজনৈতিক মত পার্থক্য নির্বিশেষে প্রতি দলের সভাসমাবেশসহ গণতান্ত্রিক আচার আচরণ নিশ্চিত করতে হবে এবং (৪) (সংসদে বিরােধী দলীয় (নেতা) নেত্রীর মাইক কোনও অবস্থাতেই বন্ধ করা যাবে না ও সকল সংসদ সদস্যের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। উক্ত ঘােষণায় এও বলা হয়েছিল যে, সরকার তাদের এই ৪-দফা। দাবি না মানা পর্যন্ত তাঁরা সংসদ অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখবেন।
৯৯। ১৯শে জুন (১৯৯২) তারিখে ঢাকার সেগুন বাগিচায় আয়ােজিত এক সমাবেশে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য ডঃ কামাল হােসেনকে আহবায়ক কমিটির চেয়ারম্যান করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ফোরাম” নামে একটি নির্দলীয় সংগঠন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেয়া হয়। এই ফোরামের ঘােষণায় বলা হয়ঃ ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী শাসনের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের যে পথ উনােচিত হয়েছিল এবং জনগণের যে প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণের কার্যকর প্রচেষ্টা কিংবা দিক নির্দেশনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এমন কি, স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনের সময় তিন জোটের (১৯৯০ সালের ১৯শে নভেম্বর তারিখে ঘােষিত) রূপরেখায় জনগণের কাছে দেয়া ওয়াদা আজ উপেক্ষিত। ফলে, জনজীবনে হতাশা ও অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। দেশে আজ (১৯৭১ সালের) মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ। বিপর্যস্ত। দেশের অর্থনীতি পঙ্গু ও দেশ নৈরাজ্য ও দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। আইনের শাসন ও প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতার দাবি উপেক্ষিত। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের কাছে
পৃষ্ঠাঃ ৪২৪
পরাভূত। এই অবস্থায় সংকট থেকে জনগণের পরিত্রাণের লক্ষ্যে তাদেরকে সচেতন ও সংগঠিত করার জন্য জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি আশু প্রয়ােজন। আর সে কারণেই এই ফোরামের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।” উক্ত সমাবেশের উদ্বোধনী অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ ফজলুল হালিম চৌধুরী। উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত ভাষণ দেন ডঃ কামাল হােসেন। ডঃ কামাল হােসেন তার ভাষণে বলেন, “আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্র, বিভিন্ন মত থাকতে পারে, কিন্তু ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনের সময় ১৯শে নভেম্বর তারিখে ঘােষিত তিন জোটের রূপরেখার প্রশ্নে ভিন্নমত থাকার অবকাশ নেই।… বহু রক্ত দিয়ে আজকে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠিত। সংসদকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, জবাবদিহি করা হয়েছে, কিন্তু তিন জোটের রূপরেখা ও জনগণের আশা-আকাংক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষণ নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীসহ খুনীদের বিচার হয় না। স্বাধীনতা বিরােধী গােলাম আযমকে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলে। দেশে গণতান্ত্রিকভাবে সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও স্বৈরতন্ত্র যায়নি। গণতন্ত্র আজ হুমকির সম্মুখীন। এ অবস্থায়, গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপদান তথা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে গণতন্ত্রের সুষ্ঠ চর্চার লক্ষ্যে এই ফোরাম গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।” অতঃপর ডঃ কামাল হােসেন দলমত নির্বিশেষে মৌলিক বিষয়সমূহকে নিয়ে জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে একস্থানে উপনীত হওয়ার জন্য সবাইকে আহবান জানান। উক্ত সমাবেশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বেগম সুফিয়া কামাল, ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম, ডাঃ সৈয়দা ফিরােজা বেগম, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, সিপিবির নূরুল ইসলাম নাহিদ, জাসদ (সিরাজ)এর শাহজাহান সিরাজ, ন্যাপের পংকজ ভট্টাচার্য, ওয়ার্কার্স পার্টির আবুল বাশার, জাসদ (ই-এর শিরিন আখতার, গণতন্ত্রী পার্টির আমিনুল হক বাদশা, বিচারপতি কে, এম, সােবহান এবং বিএফইউজে এর রিয়াজউদ্দিন আহমদ।
১০০। ২১শে জুন তারিখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ এর আহ্বানে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গােলাম আযমের বিচার করে গণআদালতের রায় বাস্তবায়ন ও গণআদালতের উদ্যোক্তা ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকার কর্তৃক দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এই হরতাল আহবান করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ৫ দলীয় জোট, দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক ফ্রন্টসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন হরতালের প্রতি সমর্থন জানায়। ঢাকার মতিঝিল, পল্টন, তােপখানা, গুলিস্তান, শাহবাগ, ফার্মগেট, আসাদ গেট, মগবাজার, মালিবাগসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সারাদিন ছিল হরতাল পালনকারীদের মিছিল ও সমাবেশে মুখরিত। হরতালের সময় কোন দোকানপাট খােলেনি। যানবাহান পথে নামেনি। রিকশাচালকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রিকশা
পৃষ্ঠাঃ ৪২৫ চলাচল বন্ধ রাখে। কলকারখানা ছিল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। মতিঝিল অফিসপাড়া ছিল কর্মহীন। লঞ্চ চলাচল করেনি। ট্রেন চলাচল হয় বিঘ্নিত। ঢাকা থেকে কোন বিমান উড়েনি। সচিবালয়ে কর্মচারীদের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত নগণ্য। ব্যাংক, বীমা, ব্যবসাবাণিজ্য, যানবাহন প্রভৃতি বন্ধ থাকায় রাজধানীতে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছিল।
১০১। ২১শে জুন (১৯৯২) তারিখে অভূতপূর্ব স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হবার পর সন্ধ্যার পূর্বক্ষণ থেকে প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে সরকারের পুলিশ বাহিনী রাজধানীর কেন্দ্রস্থল বায়তুল মােকাররম থেকে প্রেসক্লাব ছাড়িয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চত্বর পর্যন্ত স্মরণাতীতকালের এক জঘন্যতম পৈশাচিক ও বর্বরােচিত হামলাযজ্ঞ চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জ, অসংখ্য রাবার বুলেটের আওয়াজ এবং আড়াই ঘন্টা ধরে মূহুর্মুহু কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের ফলে গােটা এলাকা জুড়ে এক চরম ত্রাস ও যন্ত্রণাময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। পুলিশ শুধু রাজপথে সাংবাদিক, পথচারীদের ওপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা সাংবাদিকদের যানবাহন ভাংচুর এবং ক্যামেরা, ঘড়ি, ফ্ল্যাশগান, প্রভৃতি লুটপাট করে। এক পর্যায়ে পুলিশ প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে ঢুকে প্রেস ক্লাবের দরজা-জানালা ও সেখানে রক্ষিত সাংবাদিকদের মােটরসাইকেল ভাংচুর করে এবং সাংবাদিকদের বেপরােয়া প্রহার ও সাংবাদিক বহনকারী বেবীট্যাক্সি ড্রাইভারদের বেধড়ক মারধর করে। পুলিশের এই নারকীয় হামলায় অর্ধশতাধিক সাংবাদিকসহ প্রায় দুই শতাধিক নিরীহ পথচারী আহত এবং প্রেস ক্লাবের প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। পুলিশের এ আচরণের প্রতিবাদে সাংবাদিকগণ একটি প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়ে পরদিন অর্থাৎ ২২ শে জুন তারিখে ২৪ ঘন্টা প্রতীক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেন। এ ছাড়াও, তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ ও ঘটনার হােতা ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশ কমিশনার মির্জা রফিকুল হদার অপসারণ দাবি করেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও আহত সাংবাদিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদানসহ এহেন ঘটনার কারণে ক্ষমা চাওয়ার জন্যে সরকারের প্রতি আহবান জানান। এদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ হরতালের দিনে সন্ত্রাসী-ফ্যাসিস্ট যুবকমাণ্ডের লােকদের সরকারের মদদদান, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জনতার ওপর পুলিশের বেপরােয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, ঢাকার প্রেস ক্লাবে পুলিশের নজিরবিহীন হামলা এবং নেতৃবৃন্দ-সাংবাদিক ও জনগণকে নির্যাতনের প্রতিবাদে ২২ শে জুন ঢাকার স্টেডিয়াম গেটে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল, ২৩ শে জুন সারাদেশে সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদ দিবস পালন এবং ৩০ শে জুন শাহবাগ চৌরাস্তার মােড় ও জাতীয় যাদুঘরের সামনে জমায়েত হয়ে সেখান থেকে জাতীয় সংসদ অভিযাত্রার কর্মসূচী ঘােষণা করে।
১০২। ইতিপূর্বে, আওয়ামী লীগসহ অনেক আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতসেবী ও অন্যান্য মহল বহুবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বি.এন.পি. সরকারের প্রতি আহবান
পৃষ্ঠাঃ ৪২৬
জানিয়েছে দেশে আইনের শাসন ও গণন্ত্রকে সুসংহত করার লক্ষ্যে অন্যতম পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জারিকৃত ইনডেমনিটি ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য। একই লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের ৮ই আগস্ট তারিখে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে পেশকৃত ইনডেমনিটি বাতিল বিল সংসদে পাশ করানাের জন্য বহু আহবানও জানিয়েছে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহল। বি.এন.পি, সরকারের আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী মির্জা গােলাম হাফিজের নেতৃত্বে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি এই বিলটির ব্যাপারে বিভিন্ন আইনগত ও সাংবিধানিক বিষয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্যে ইতিপূর্বে ৭০ দিন করে ৪ দফা সময় বাড়িয়ে নেয়। এই সময়কালে উক্ত কমিটর বহু সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংসদীয় বিশেষ কমিটির উক্ত বিলটির ব্যাপারে রিপাের্ট প্রদানের জন্য চতুর্থবারের বর্ধিত সয়সীমার শেষ তারিখ ছিল ২৫শে জুন (১৯৯২)। এদিন সংসদে সরকারী দলের চীফ হুইপ খন্দকার দেলােয়ার হােসেন ইনডেমনিটি বাতিল বিলটির ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালােচনা করার জন্য আরও সময় প্রয়ােজন এই মর্মে আবেদন জানালে স্পীকার কমিটিকে তার প্রতিবেদন প্রদানের সময়সীমা আরও ৭০ দিন বাড়িয়ে দেন। এর ফলে ইনডেমনিটি বাতিল বিলটি পাসের ভবিষ্যৎ শুধু অনিশ্চিতই হয়নি, সে ব্যাপারে বি.এন.পি. নেতৃত্বের আন্তরিকতা সম্পর্কে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহল ও জনমনে সৃষ্টি হয় দারুণ সন্দেহ ও নানান জল্পনা-কল্পনা।
১০৩। ২৯শে জুন (১৯৯২) তারিখ পর্যন্ত প্রধান বিরােধীদল আওয়ামী লীগসহ দুজন সন্ত্র সদস্য ও অন্যান্য ক্ষুদ্র দলগুলাের সদস্যগণ সংসদের বাজেট অধিবেশন বর্জন অব্যাহত রাখেন। এদিকে বিরােধী দলগুলাের অনুপস্থিতিতে কেবলাত্র নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে বাজেট পাস কানাে আইনসম্মত হলেও তা ন্যায়সঙ্গত হবে না এই মর্মে বিভিন্ন পত্রিকায় বিরূপ মন্তব্য করা হয়। এরই প্রেক্ষাপটে এবং সংসদে উদ্ভূত অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে প্রধান বিরােধীদল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের ক্ষুদ্র দলগুলাের পূর্বঘােষিত ৪-দফার ব্যাপারে একটি সমঝােতায় আসার প্রয়াস চালানাে হয়। অবশেষে, ২৯শে জুন (১৯৯২) তারিখ সােমবার দিবাগত রাত ২ টা ৩০ মিনিটে সরকার ও প্রধান বিরােধীদল আওয়ামী লীগের মধ্যে একটি যৌথ ঘােষণা স্বাক্ষরিত হয়। এই যৌথ ঘােষণায় স্বাক্ষর করেন সরকারের পক্ষে সরকারী দলের সংসদীয় উপনেতা অধ্যাপক ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও চীফ হুইপ খন্দকার দেলােয়ার হােসেন এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সংসদীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ও চীফ হুইপ মােহাম্মদ নাসিম। এই যৌথ ঘােষণায় বলা হয় : “যেহেতু (বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশ এবং নয় বছরের সুদীর্ঘ যৌথ সাম ও আত্মত্যাগের মূল্যে স্বৈরাচার উৎখাতের পর গণ অর্জিত হয়েছে; এবং যেহেতু এ দেশের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সার্বভৌম সংসদ নির্বাচিত করেছে; এবং যেহেতু জনগণ পূর্ণ আস্থা রেখেছে যে, এই
পৃষ্ঠাঃ ৪২৭
সংসদের প্রতিটি কার্যক্রমের মাধ্যমে সংসদ সদস্যগণ জনগণের ইচ্ছা ও আকাংক্ষার বাস্তবায়ন করবেন, জনগণের দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের সকল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য আন্তরিক অবদান রাখবেন; এবং যেহেতু সংসদে বাদ-প্রতিবাদ, সাময়িক (সংসদ) বর্জন, ইত্যাদি যেমন সংসদীয় রীতিসিদ্ধ তেমনি সকল সংসদ সদস্য সক্রিয় অংগ্রহণের মাধ্যমেই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান ও সংহতিকরণে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারেন এবং যা জনগণের একান্ত প্রত্যাশা; এবং যেহেতু মূলতঃ গােলাম আযম প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে বিরােধীদলের সদস্যবৃন্দ সংসদের চলতি অধিবেশনে আজ পর্যন্তও যােগদান করেননি; এবং যেহেতু সংসদের কার্যকারিতা সরকারীদল ও বিরােধীদলের সহযােগিতা ও সমঝােতার ওপর নির্ভরশীল এবং যেহেতু সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং সর্বতােভাবে সফল করার জন্য এই সহযােগিতা ও সমঝােতা একান্তই অপরিহার্য, সেহেতুঃ (১) সংসদে গােলাম আযম সম্পর্কিত আলােচনা ও প্রস্তাবের আলােকে দেশের সংবিধানসম্মত প্রচলিত আইন অনুযায়ী গােলাম আযমের বিচার করা হবে। সরকার গােলাম আযমের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ইতিপূর্বেই তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করেন এবং তার নাগরিকত্বের আবেদন নাকচ করেন। (২) একই লক্ষ্যে গণআদালত সংক্রান্ত ২৪ ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকার পক্ষ থেকে যে মােকদ্দমা দায়ের করা হয়েছে তা প্রত্যাহার করা হবে। এ ব্যাপারে উভয় পক্ষের আইনজীবীগণ প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। (৩) একই সাথে সংসদের ভেতরে ও বাইরে গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ প্রতিষ্ঠার সপক্ষে সকল সংসদ সদস্য ও দলসমূহের গণতান্ত্রিক অধিকার সংরক্ষণে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।”
১০৪। ৩০শে জুন বিকেল ৩ টায় পূর্ব-ঘােষণা মােতাবেক হাজার হাজার পেশাজীবী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, মুক্তিযােদ্ধা, ইত্যাদি সংগঠনের নেতা ও কর্মী ঢাকার শাহবাগ চৌরাস্তার মােড় ও জাতীয় যাদুঘরের সামনের রাস্তায় সমবেত হয়। কিন্তু ২৯ শে জুন রাতে স্পীকার পরদিন অর্থাৎ ৩০শে জুন তারিখে সংসদের অধিবেশন বিকেলের পরিবর্তে সকাল ৯টায় অনুষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত দেয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ এ দিনের পূর্ব-ঘােষিত সংসদ ভবন অভিযাত্রা কর্মসূচী বাতিল করে সেখানে জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত জনসভায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তাবয়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির আহবায়িকা শহীদ জননী বেগম জাহানারা ইমাম বলেন, “ঘাতক গােলাম আযমের বিরুদ্ধে জনগণের দেয়া রায় যতদিন পর্যন্ত কার্যকর না করা হবে, ২৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবৈধ মামলা যতদিন পর্যন্ত প্রত্যাহার না করা হবে, ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না। সরকার আমাদের দাবি সম্পর্কে যেটুকু নমনীয় হয়েছে তাতে দেশবাসী সন্তুষ্ট নয়।” অতঃপর সংসদে বিরােধী দলের সঙ্গে বি.এন.পি. সরকারের যে সমঝােতা চুক্তি হয়েছে সে চুক্তিকে তিনি
পৃষ্ঠাঃ ৪২৮
জনগণের সংগ্রামের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘সংসদ ভবন অভিযাত্রার ভয়ে ভীত হয়ে সরকার সংসদ অধিবেশন মুলতবি ঘােষণা করেছে। এটাও সরকারের পরাজয়, সংগ্রামের বিজয়।” এর পর ফ্যাসিস্ট জামাত-শিবির খুনীচক্র ফীডম পার্টির রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবি জানিয়ে বেগম জাহানারা ইমাম বলেন, সর্বপ্রকার ঘাতকেরা আজ এক কাতারে মিলিত হয়েছে। (বি.এন.পি.) সরকার এদের (মূল) পৃষ্ঠপােষক। পরিশেষে, বেগম জাহানারা ইমাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ১৯৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির পরবর্তী কর্মসূচী ঘােষণা করেন। চার দফা আদায়ের লক্ষ্যে গৃহীত এই কর্মসূচী ছিল নিম্নরূপঃ (১) কমিটির ১৪ই অক্টোবর (১৯৯২) তারিখে ঢাকায় মহাসমাবেশ আয়ােজন; (২) এর পূর্বে ১৯শে জুলাই প্রতিটি উপজেলা কেন্দ্রে এবং ২৩শে আগস্ট প্রতিটি জেলা-কেন্দ্রে সমাবেশ ও ঘেরাও কর্মকান্ড আয়ােজন এবং (৩) ১৪ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠান।
১০৫। ৯ই জুলাই (১৯৯২) তারিখে ঢাকার ২৯ নম্বর মিন্টু রােডস্থ সংসদে বিরােধীদলীয় নেত্রীর সরকারী বাসভবনে দলীয় সভানেত্রী ম্যাডাম হাসিনার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিলের প্রশ্নে বি.এন.পি, সরকার কালক্ষেপণ করায় গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। উক্ত সভায় গৃহীত প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয়, তিন জোটের ১৯৯০ সালের ১৯ শে নভেম্বর তারিখে ঘােষিত রূপরেখা অনুযায়ী হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বি.এন.পি. সরকারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে জনমণে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ সভা মনে করে যে, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির চির অবসান, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে মর্যাদা রক্ষা ও বিকাশের স্বার্থে অনতিবিলম্বে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কুখ্যাত ইনডেমনিটি (ক্ষমা প্রদর্শন) অধ্যাদেশ (১৯৭৫) বাতিল করার দাবি জনগণের দাবি।” পরিশেষে, উক্ত সভায় জনগণের দীর্ঘদিনের উল্লেখিত কাংক্ষিত দাবি বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ১৫ই আগস্ট (১৯৯২) জাতীয় শােক দিবসে দেশব্যাপী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল পালনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। এই কর্মসূচীকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উপরােল্লিখিত গণদাবিসমূহ আদায়ের জন্য দেশব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টি এবং গণ-আন্দোলন সংগঠিত করার একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ বলে ঘােষণা করা হয়।
১০৬। বলা বাহুল্য, ১৯৫২ সালে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনের পর, বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদীর্ঘকাল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬-দফার সংগ্রাম, ১৯৭১-এর মার্চ মাসে আপােষহীন সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম, অক্লান্ত পরিশ্রম ও
পৃষ্ঠাঃ ৪২৯
ব্যক্তিগত ত্যাগ-তিতিক্ষার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে এদেশের অগণিত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, ছাত্র-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবি, বিভিন্ন পেশাজীবি তথা দেশের আপামর জনসাধারণকে যে অধিকার আদায়ের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তারই ফসল ১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলদেশের অ্যুদয়। জনগণের দাবি মেনে নেয়ার পরিবর্তে, পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক শাসকচক্র ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাতে বাংলার জনগণের ওপর বর্বরােচিত সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু দেশকে পাকিস্তানের কবল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আহবান জানান। তাঁর সেই আহবানে সাড়া দিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান নির্বিশেষে সকল প্রগতিশীল ছাত্র-শ্রমিক, কৃষক-মজুর, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, বুদ্ধিজীবি, বিভিন্ন পেশাজীবি তথা আপামর জনসাধারণ সুদীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহনের মাধ্যমে লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ধর্ম, বর্ণ, গােত্র-গােষ্ঠী ও শ্ৰেণী-সম্প্রদায় নির্বিশেষে তার গণতান্ত্রিক, মানবিক ও ন্যায়বিচারের অধিকারভােগ ও মৌলিক চাহিদাপূরণ এবং শশাষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যমুক্ত পরিবেশে ও শান্তি-সম্প্রীতিতে ধর্মকর্ম পালন, সংস্কৃতি চর্চা ও সুন্দর জীবন যাপন করার নিশ্চয়তা পাবে এই ছিল মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবােধ। ১৯৭২ সালে স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণের পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে কতিপয় বিদেশী শক্তি এবং তাদের মদদপুষ্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার আদর্শবিরােধী মুষ্টিমেয় ব্যক্তিত্ব ও মহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সপরিবারে নিহত হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু উল্লেখিত লক্ষ্যে নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে দেশীয় সেই একই স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শবিরােধী চক্র ও কতিপয় বিদেশী শক্তি ক্রমাগত গােপন ও প্রকাশ্য ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘকালের আশা-আকাংক্ষাকে বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। কিন্তু এই মুক্তিসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ও আদর্শ বিরােধী অপশক্তি জনগণের কিছু অংশকে বিভ্রান্ত করতে সমর্থ হলেও, দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রয়েছে নিরন্তর সচেতন। তাই, দেশে মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবােধ সুদৃঢ়ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশের সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মী, ছাত্র-জনতা, বুদ্ধিজীবি, সংস্কৃতিসেবী, পেশাজীবি তথা সমগ্র জাতি এখন দৃপ্ত কণ্ঠে সােচ্চার। সুতরাং মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবােধের বিরােধী ব্যক্তিত্ব ও মহলের মনে যতােশীঘ্র শুভবুদ্ধি ও কল্যাণকামী মনমানসিকতা সৃষ্টি হবে ততােই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল। দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, পরমতসহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক
পৃষ্ঠাঃ ৪৩০
শ্রদ্ধাবােধ জাগ্রত করার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হােক এবং মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতা যুদ্ধের নিরপেক্ষ ও সঠিক ইতিহাস রচিত হােক এবং তা জনসাধারণ, বিশেষ করে, স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা হােক, সমগ্র জাতির এই-ই ঐকান্তিক ও আন্তরিক কামনা। কিন্তু বাংলাদেশ তথা জাতির ভাগ্যে কি লেখা আছে তা কেবল ভবিষ্যৎ ঘটনাবলীই নির্ণয় করবে।
পরিশিষ্ট-৫
১৯শে মার্চ (১৯৭২) তারিখে স্বাক্ষরিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং প্রজাতন্ত্রী ভারতের মধ্যে (পারস্পরিক) মৈত্রী, সহযােগিতা ও শান্তি চুক্তি
Treaty of Friendship, Co-operation and Peace between the People’s Republic of Bangladesh and the Republic of India signed on 19 March, 1972.
INSPIRED by common ideals of peace, secularism, democracy, socialism and nationalism;
HAVING STRUGGLED together for the realisation of these ideals and cemented ties of friendship through blood and sacrifices which led to the triumphant emergence of a free, sovereign and independent Bangladesh;
DETERMINED to maintain fraternal and good-neighbourly relations and transform their border into a border of eternal peace and friendship;
ADHERING firmly to the basic tenets of non-alignment, peaceful coexistence, mutual co-operation, non-interference in internal affairs and respect for territorial integrity and sovereignty;
DETERMINED to safeguard peace, stability and security and to promote progress of their respective countries through all possible avenues of mutual co-operation;
DETERMINED further to expand and strengthen the existing relations of friendship between them;
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৫
CONVINCED that the further development of friendship and co-operation meets the national interests of both States as well as the interests of lasting peace in Asia and the world;
RESOLVED to contribute to security and to make efforts to bring about a relaxation of internatioal tension and the final elimination of vestiges of colonialism, racialism, and imperialism;
CONVINCED that in the present-day world international problems can be solved only through co-operation and not through conflict or confrontation;
RE-AFFIRMING their determiation to follow the aims and principles of the United Nations Charter, the Republic of India, on the one hand, and the People’s Republic of Bangladesh, on the other, have decided to conclude the present Treaty.
Article 1
The High Contracting Parties, inspired by the ideals for which their respective people struggled and made sacrifices together, solemnly declare that there shall be lasting peace and friendship between their two countries and their peoples, each side shall respect the independence, sovereignty and territorial integrity of the other and refrain from interfering in the internal affairs of the other side.
The High Contracting Parties shall further develop and strengthen the relations of friendship, good-neighbourliness and all-round co-opration existing between them, one the basis of the above metioned principles as well as the princple of equality and mutual benefit.
Article 2
Being guided by their devotion to the priciples of equality of all peoples and States, irrespective of race or creed, the High Contracting Parties condemn colonialism and racialism in all forms and manifestations and are determined to strive for their final and complete elimination.
The High Contracting Parties shall co-operate with other States in achieving these aims and support the just aspirations of peoples in their struggle against colonialism and racial discrimination and for their national liberation.
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৬
Article 3
The High Contracting Parties reaffirm their faith in the policy of nonalignment and peaceful co-existence as important factors for easing tension in the world, maintaining international peace and security, and strengthening national sovereignty and independence.
Article 4
The High Contracting Parties shall maintain regular contacts with each other on major international problems affecting the interests of both States, through meetings and exchanges of views at all levels.
Article 5
The High Contracting Parties shall continue to strengthen and widen their mutually advantagous and all-round co-operation in the economic, scientific and technical fields. The two countries shall develop mutual cooperation in the fields of trade, transport and communications between them on the basis of the principles of equality, mutual benefit and the mostfavoured nation principle.
Article 6
The High Contracting Parties further agree to make joint studies and take joint action in the fields of flood control, river basin development and the development of hydro-electric power and irrigation.
Article 7
The High Contracting Parties shall promote relations in the fields of art, literature, education, culture, sports and health.
Article 8
In accordance with the ties of friendship existing between the two countries, each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not enter into or participate in any military alliance directed against the other party.
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৭
Each of the High Contracting Parties shall refrain from any aggression against the other party and shall not allow the use of its territory for comitting any act that may cause military damage to or constitute a threat to the security of the other High Contracting Party.
Article 9
Each of the High Contracting Parties shall refrain from giving any assistance to any third party taking part in an armed conflict against the other party. In case either party is attacked or threatened with attack, the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultations in order to take appropriate effective measures to eliminate the threat and thus ensure the peace and security of their countries.
Article 10
Each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not undertake any commitment, secret or open, toward one or more States which may be incompatible with the present Treaty.
Article 11
The present Treaty is signed for a term of twenty-five years and shall be subject to renewal by mutual agreement of the High Contracting Parties.
The Treaty shall come into force with immediate effect from the date of its signature.
Article 12
Any differences in interpreting any article or articles of the present Treaty that may arise between the High Contracting Parties shall be settled on a bilateral basis by peaceful means in a spirit of mutual respect and understanding.
Done in Dacca on the nineteenth day of March, nineteen hundred and seventy-two.
Indira Gandhi
Prime Minister
For the Republic of India
Sheikh Mujibur Rahman
Prime Minister
For the People’s Republic of Bangladesh
পৃষ্ঠাঃ ৪৪৮
উপরােল্লিখিত মৈত্রী, সহযােগিতা ও শান্তি চুক্তির বঙ্গানুবাদ:
শান্তি, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবােধের একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এই আদর্শের বাস্তব রূপায়ণের লক্ষ্যে একযােগে সম্প্রাম, রক্তদান এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার অঙ্গীকার নিয়ে মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় অ্যুদয় ঘটিয়ে; সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক রক্ষা করতে এবং উভয় রাষ্ট্রের সীমান্তকে চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্বের সীমান্ত হিসেবে রূপান্তরের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে; নিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, পারস্পরিক সহযােগিতা, অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থেকে এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান প্রদর্শনের মূলনীতি সমূহের প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল থেকে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এবং সম্ভাব্য সকল প্রকারের পারস্পরিক সহযােগিতার মাধ্যমে স্ব স্ব দেশের অগ্রগতির জন্য; উভয় দেশের মধ্যকার বর্তমান মৈত্রীপূর্ণ সম্পর্ক আরাে সম্প্রসারণ ও জোরদার করার জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়ে; এশিয়া তথা বিশ্বের স্থায়ী শান্তির স্বার্থে এবং উভয় রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের প্রয়ােজনে পারস্পরিক মৈত্রী ও সহযােগিতা আরাে সম্প্রসারিতকরণে বিশ্বাসী হয়ে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমনে এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ ও সামন্তবাদের শেষ চিহ্নটুকু চূড়ান্তভাবে নির্মূল করার লক্ষ্যে প্রয়াস চালানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে; আজকের বিশ্বের আন্তর্জাতিক সমস্যাগুলাের সমাধান যে শুধুমাত্র সহযােগিতার মাধ্যমে সম্ভব, বৈরিতা ও সংঘাতের মাধ্যমে নয়-এ ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে রাষ্ট্রসংঘের সনদের নীতিমালা ও লক্ষ্য সমূহ অনুসরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা পুনর্ব্যক্ত করে একপক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও অন্য পক্ষে প্রজান্ত্রী ভারত বর্তমান চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনুচ্ছেদ ১: চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ স্ব স্ব দেশের জনগণ যে আদর্শের জন্য একযােগে সংগ্রাম এবং স্বার্থত্যাগ করেছেন, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘােষণা কছে যে, উভয় দেশ এবং তথাকার জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও মৈত্রী বজায় থাকবে। একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে অবিচল থাকবে। চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ উল্লেখিত নীতিমালা এবং সমতা ও পারস্পরিক উপকারিতার নীতি সমূহের ভিত্তিতে উভয় দেশের মধ্যেকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সুপ্রতিবেশীসুলভ সার্বিক সহযােগিতা ও সম্পর্কের উন্নয়ন আরাে জোরদার ক রবে।
অনুচ্ছেদ ২: জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি সমতার নীতিতে আস্থাশীল থাকার আদর্শে পরিচালিত হয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ সর্ব প্রকারের উপনিবেশবাদ ও বর্ণ বৈষম্যবাদের নিন্দা করছে এবং তাকে চূড়ান্তভাবে ও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল
পরিশিষ্ট – ৫
৪৪৯
করার জন্য প্রচেষ্টা চালানাের ব্যাপারে তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা পুনরুল্লেখ করছে। চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ উপরােক্ত অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযােগিতা করবে এবং উপনিবেশবাদ ও বর্ণ বৈষম্যবিরােধী এবং জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জনগণের ন্যায়সঙ্গত আশা-আকাংক্ষার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দান করবে।
অনুচ্ছেদ ৩: ৫ চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ বিশ্বের উত্তেজনা প্রশমন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা মজবুত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জোটনিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি তাদের অবিচল আস্থা পুনরুল্লেখ করছে।
অনুচ্ছেদ ৪: উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয় সকল স্তরে বৈঠক ও মত বিনিময়ের জন্য নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করবে।
অনুচ্ছেদ ৫: চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাম্পন্ন উভয়পক্ষ অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধা ও সর্বাত্মক সহযােগিতা শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করে যাবে। উভয় দেশ সমতা, পারস্পরিক সুবিধা এবং সর্বোচ্চ আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের বেলায় প্রযােজ্য নীতির ভিত্তিতে বাণিজ্য, পরিবহন ও যােগাযােগের ক্ষেত্রে সহযােগিতা সম্প্রসারিত করবে।
অনুচ্ছেদ ৬: চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জল বিদ্যুৎ শক্তি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে অভিন্ন মত পােষণ করে।
অনুচ্ছেদ ৭: ৫ চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধূলার ক্ষেত্রে সম্পর্ক উন্নয়নে স্বচেষ্ট হবে।
অনুচ্ছেদ ৮: দুই দেশের মধ্যেকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে ঘােষণা করছে যে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোন সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না বা অংশগ্রহণ করবে না। চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পক্ষদ্বয় একে অন্যের উপর আক্রমণ থেকেও নিবৃত্ত থাকবে এবং তাদের ভূখণ্ডে এমন কোন কাজ কতে দেবে না যাতে চুক্তি সম্পাদনকারী কোন পক্ষের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোন ক্ষতি হতে পারে অথবা কোন পক্ষের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অনুচ্ছেদ ৯ ঃ কোন এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে এতদুল্লেখিত তৃতীয় পক্ষকে যে কোন
পৃষ্ঠাঃ ৪৫০
প্রকার সাহায্য দানে বিরত থাকবে। এতদ্ব্যতিত যে কোন পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হওয়ার আশংকা দেখা দিলে সেই আশংকা দূরীভূত এবং নিজেদের দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উভয়পক্ষ জরুরী ভিত্তিতে আলাপ-আলােচনায় মিলিত হবে।
অনুচ্ছেদ ১০: চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ নিষ্ঠার সাথে ঘােষণা করছে যে, এই চুক্তির সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও অহিতকর হতে পারে এমন কোন গােপন বা প্রকাশ্য এক বা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে উভয়ের কেউই কোন প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হবে না।
অনুচ্ছেদ ১১: এই চুক্তি পচিশ বছরের মেয়াদের জন্য স্বাক্ষরিত হলাে। চুক্তি সম্পাদনকারী উভয়পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানাে যেতে পারে। অত্র চুক্তি স্বাক্ষর করার দিন থেকে কার্যকরী হবে।
অনুচ্ছেদ ১২: এই চুক্তির কোন এক বা একাধিক অনুচ্ছেদের বাস্তব অর্থ নিয়ে চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোন মত পার্থক্য দেখা দিলে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝােতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করতে হবে।
এই চুক্তি ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকায় সম্পাদিত ও স্বাক্ষরিত হলাে।
ইন্দিরা গান্ধী
প্রধানমন্ত্রী
প্রজান্ত্রী ভারতের পক্ষে
শেখ মুজিবুর রহমান
প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। অমৃত অধিকারী, “ন্যায়িকের ভাবনা মহাপ্রয়াণ”, নিথী পাবলিশার্স, ঢাকা, ৭ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২
২। এম. আর. আখতার মুকুল), “মুজিবের রক্ত লাল, প্রথম সংস্করণ, লণ্ডন (১৯৭৬); দ্বিতীয় সংস্করণ, সাগর পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯
৩। এম. আর. আখতার মুকুল), “আমি বিজয় দেখেছি, সাগর পাবলিশার্স, ঢাকা, ডিসেম্বর, ১৯৮৫
৪। এম. আর. আখতার মুকুল), “পাকিস্তানের চব্বিশ বছর: ভাসানী-মুজিবের রাজনীতি”, সাগর পাবলিশার্স, ঢাকা, ১৫ই অক্টোবর, ১৯৮৬
৫। এম. আর. আখতার মুকুল) সম্পাদিত, “জয় বাংলা ফল অব ঢাকা, ১৯৭১”, সাগর পাবলিশার্স, ঢাকা, ডিসেম্বর, ১৯৯০
৬। এম. আর. আখতার (মুকুল), “মহাপুরুষ”, সাগর পাবলিশার্স, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১
৭। এম. আনিসুজ্জামান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু”, কাকলী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী ১৯৯১
৮। আশফাক আলম (স্বপন), “মুজিব হত্যা চক্রান্ত”, ত্রিধারা প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৮
৯। মওদুদ আহমদ, “Bangladesh: Era of Sheikh Mujibur Rahman”, University Press Ltd., 2nd Edition, Dhaka 1990
১০। আবীর আহাদ, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ”, প্রকাশক: ফাতেমা খায়রুন্নেছা জেবু, ঢাকা ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২
১১। আবীর আহাদ, বঙ্গবন্ধু: দ্বিতীয় বিপ্লবের রাজনৈতিক দর্শন”, প্রকাশক: ফাতেমা খায়রুন্নেছা জেবু, ঢাকা, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯১
১২। খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস (সম্পাদিত), “বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন”, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৯
৪৫২
১৩। মযহারুল ইসলাম, “কিশাের নবীনদের বঙ্গবন্ধু”, সংবর্ত প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২।
১৪। সরদার সিরাজুল ইসলাম, “বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন: সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ”, প্রকাশক: নাজিনা রাওফিন, ঢাকা, জানুয়ারী, ১৯৮৯
১৫। জাওয়াদুল করিম, “মুজিব ও সমকালীন রাজনীতি”, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১
১৬। গােলাম সামদানী কোরায়শী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব”, বাংলাদেশ শিশু একামেী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২
১৭। এ. এল. খতিব (সােয়দ করিম ও হাফিজুর রশীদ হীরন কর্তৃক অনূদিত), “কারা মুজিবের হত্যাকারী-Who killed Mujib”, শিখা প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২
১৮। তিতু চৌধুরী, মুজিব হত্যার তত্ত্বকথা”, জেবুন্নেছা প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯
১৯। তিতু চৌধুরী, “শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানে বন্দী”, জেবুন্নেসা প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১
২০। আব্দুল ওয়াহেদ তালুকদার, “১৯৭০ থেকে ১৯৯০: বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট”, পাণ্ডুলিপি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯১
২১। কালীপদ দাস, “ছােটদের শেখ মুজিব”, সাহিত্যমালা, ২১শে ফেব্রুয়ারী) গ্রন্থমেলা, ১৯৯১
২২। রবার্ট পেইন (গােলাম হিলালী কর্তৃক অনূদিত), “ম্যাসাকার-বাংলাদেশ-গণহত্যার ইতিহাসে ভয়ংকর অধ্যায়”, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৯
২৩। শিরিন মজিদ, মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব”, নওরােজ কিতাববিতান, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৫
২৪। রামেন্দু মজুমদার (সম্পাদিত), বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত বক্তৃতা ও বিবৃতি”, কথন প্রকাশনী, ঢাকা, ২১শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯
২৫। আব্দুল মতিন, “জেনেভায় বঙ্গবন্ধু”, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশানস, লন্ডন, মে, ১৯৮৪
২৬। আব্দুল মতিন, “স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাংগালী”, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশানস, লণ্ডন, এপ্রিল, ১৯৮৯
২৭। আব্দুল মতিন, “শেখ হাসিনা-একটি রাজনৈতিক আলেখ্য”, র্যাডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশানস, লণ্ডন, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২
২৮। নাজিমুদ্দিন মানিক, একাত্তুরের অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলাে”, ওয়ারী বুক সেন্টার, ঢাকা, জুলাই ১৯৯২
২৯। মােরাদুজ্জামান, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু”, প্রকাশক: তানিয়া রহমান লুনা, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯
৩০। শাহজাহান বিন মােহাম্মদ ও কাজী লতিফুর রহমান, “শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ”, প্রভিন্সিয়াল বুক ডিপাে লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৭৩
৩১। জিয়াউর রাহমান, “Speeches of Sheikh Mujib in Pakistan Parliament (1955-56)” Vol-I, হাক্কানী পাবলিশার্স, ঢাকা, ১৭ই মার্চ, ১৯৯০
৩২। আব্দুর রউফ, “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও আমার নাবিক জীবন”, প্যাপিরাস প্রকাশনী, ঢাকা, ফেব্রুয়ারী, ১৯৯২
৩৩। আলী রীয়াজ, “শেখ মুজিব ও অন্যান্য প্রসঙ্গ”, আনন্দধারা, ঢাকা, জুলাই, ১৯৮৭
৩৪। মােহাম্মদ শাহজাহান সম্পাদিত, “মুজিব মানেই মুক্তি”, বন্ধু সংহতি পরিষদ, ঢাকা, ১৭ই এপিল, ১৯৮৪
৩৫। আবু সাইয়িদ, মেঘের আড়ালে সূর্য: বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বিতর্ক”, ২য় সংস্করণ, মুক্তি প্রকাশনী, ঢাকা, একুশে ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৯
৩৬। আবু সাইয়িদ, “বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড -ফ্যাক্টস এণ্ড ডকুমেন্টস”, জ্ঞানকোষ, ঢাকা, ১৫ই নভেম্বর, ১৯৮৮
৩৭। আবু সাইয়িদ, “ছােটদের বঙ্গবন্ধু”, মুক্তি প্রকাশনী, ঢাকা, ১৫ই আগস্ট, ১৯৮৭
৩৮। কাজী সামসুজ্জান, “আমরা স্বাধীন হলাম”, প্রকাশিকা: নার্গিস জামান, ঢাকা, এপ্রিল, ১৯৮৫
৩৯। ইশতিয়াক হাসান, “মুজিব হত্যার অন্তরালে”, নয়াবার্তা প্রকাশনী, ঢাকা, ডিসেম্বর, ১৯৮০
৪০। তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) আব্দুল হাফিজ কর্তৃক সম্পাদিত), “পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর”, বাংলাদেশ বুক্স ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ঢাকা , মে, ১৯৮১
৪১। মােজাম্মেল হােসেন (বেলাল) সম্পাদিত, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু”, প্রকাশক: আমরা ক’জন মুজিব সেনা, ঢাকা, ২৩শে আগস্ট, ১৯৯০
৪২। ডঃ এম. ডি. হুসেইন, “International Press on Bangladesh Liberation War”, প্রকাশক: রাহফাত এম. হুসেইন ও আইমন শামস হুসেইন, ঢাকা, জুলাই, ১৯৮৯
—X—