You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন
ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, জি এম তারিকুল ইসলাম

৭ জুন ‘৭২ সােহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা

[ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি গ্রন্থের শুরুতেই অন্তর্ভুক্ত করা হল।–সম্পাদক]

আমার ভাই ও বােনেরা, আজ ৭ই জুন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৬৬ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ ছয়দফা ঘােষণা করেছিল। এই ঘােষণায় সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের শােষকগােষ্ঠী খেপে গিয়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরাও তাদের বুঝতে পেরেছি। তারা জানতে পেরেছিল, বাঙ্গালীদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই আইয়ুব খান ও মােনেম খান তাদের সৈন্যবাহিনী নিয়ে আমার লােকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আমি তখন কারাগারে বন্দী হয়ে যাই। | আপনাদের নিশ্চয়ই আরও মনে আছে, আমাকে যশােহরে গ্রেপ্তার করা হয়, এবং তারপর যশােহর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকা থেকে আমাকে সিলেট নেওয়া হয় এবং সেখানেও আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিলেট থেকে ময়মনসিংহ নেওয়া হয় এবং ময়মনসিংহেও আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনি করে গ্রেপ্তারের পালা চলে। সঙ্গে সঙ্গে ৭ই মে তারিখে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীন, জহুর আহমদ চৌধুরী, খােন্দকার মুশতাক আহমদ প্রমুখ নেতা গ্রেপ্তার হন। পরে আমার সহকর্মী বন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরী, শামসুল হক, মােল্লা জালালউদ্দীন, মনসুর আলী, মরহুম আবদুল আজিজ (চট্টগ্রাম), মরহুম আমজাদ হােসেন (যিনি পাবনায় মৃত্যুবরণ করেছেন) এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগপন্থী ছাত্র ও শ্রমিক কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়।

শুধু তাই নয়। ৭ই জুন তারিখে তেজগাঁ, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নারায়ণগঞ্জ, মুক্তাগাছা এবং আরাে অনেক জায়গাতে গুলি করে আমার শত শত ভাইবােনকে হত্যা করা হয়। আইয়ুব খান মনে করেছিলেন, গুলি করে বাঙ্গালীদের দাবিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি তা পারেন নাই । সেই দিনই শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম । অনেকে হয়তাে বুঝতে পারেন নাই। কিন্তু আমরা জানতাম, এ ব্যাপার কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এইজন্যে ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হয়। | এরপরে আমি যখন গ্রেপ্তার হয়ে চলে যাই, আমার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী সভাপতি হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তারপর যিনিই আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সম্পাদক হয়েছেন, তাঁকেই গ্রেপ্তার করে জেলে দেওয়া হয়েছে।

| তারপরেও যড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে তার মধ্যে থেকে একদলকে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান সরিয়ে নিয়ে যান। তাতেও আমাদের দাবাতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। আপনাদের সব ইতিহাসই মনে আছে। সেদিনও আপনারা শুনেছেন, অনেক দল আইয়ুব খানের টাকা খেয়ে ছয়দফা ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। আপনাদের একথাও জানা আছে যে, ৭ই জুন তারিখে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল।

তারপর আসুন ১৯৬৮-৬৯ সালের ঘটনাগুলির কথায়। সেসময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তােফায়েল আহমদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগও আন্দোলনে যােগদান করে এবং তাতে নেতৃত্ব দেয়। তারপর আইয়ুব খান আগরতলা মামলা থেকে আমাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। সেদিনও আমার দেশের বহু লােককে জীবন দিতে হয়েছে। রক্ত আমাদের অনেক দিতে হয়েছে। বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার জন্য যত রক্ত দিতে হয়েছে, কোনাে দেশ, কোনাে জাতি তা দেয় নাই। | আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। লােকে বলে, মানুষের স্মৃতিশক্তি নাকি দুর্বল। সে নাকি অল্পদিনেই সব ভুলে যায়। কিন্তু কেমন করে ভুলবে? ২৩-২৪ বৎসর আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমি সংগ্রাম করেছি। এই সময়ের মধ্যে মাত্র ১২-১৩ মাস সােহরাওয়ার্দী সাহেব ক্ষমতায় ছিলেন। সর্বক্ষণই উজানে আমাদের নৌকা বাইতে হয়েছে এবং বারবার গ্রেপ্তার হতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। সে ইতিহাস আজও অম্লান রয়েছে।

নির্বাচন বানচাল করবার চেষ্টা। তারপর যখন নির্বাচনে আপনারা আমাকে ভােট দিলেন, তখনও একদল লােক নির্বাচন বানচাল করবার চেষ্টা করেছিল। আমি বলেছিলাম, দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, বাংলার মানুষ এক, বাংলার মানুষ স্বাধীনতা চায়, বাংলার মানুষ তাদের পক্ষ থেকে কথা বলার অধিকার আমাকে দিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে এসব প্রমাণও হয়ে গেল। কিন্তু ষড়যন্ত্র বন্ধ হল না। ইয়াহিয়া খান সাহেব এসে গদিতে বসলেন। অর্থাৎ এক খান গেলেন, আর এক খান এলেন। ইয়হিয়া খান এসে শুরু করলেন নির্বাচনের কথা। মিষ্টি কথা, ফিসফিস কথা, ছােট ছােট কথা, বড় বড় কথা। আর, সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য বাড়াতে লাগলেন বাংলার বুকে, আমার ওপর আঘাত হানার জন্য। আমরা প্রস্তুত হলাম। আমরাও এখানে দাড়িয়ে শপথ নিলাম ৩রা জানুয়ারি তারিখে, যে আদর্শে বাংলার মানুষ আমাদের ভােট দিয়েছে, তাতে অপােষ নাই।

আপনারা জানেন, ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মনে করেছিলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রী বললেই আমি গলে গদগদ হয়ে যাব আর আমার দাবি ছেড়ে আমি তার সঙ্গে হাত মেলাব। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতেন না। আওয়ামী লীগকেও জানতেন না। তার এটাও জানা ছিল না যে, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য মুজিবুর রহমান রাজনীতি করে নাই। আমি রাজনীতি

করেছি বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার জন্য, বাংলার মানুষকে স্বাধীন দেবার জন্য, বাংলার মানুষের জন্য শােষণহীন সমাজ গড়ার জন্য। আমি রাজনীতি করেছি পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য। বাংলার মানুষ ব্যাতে মানুষের মতাে দুনিয়ায় দাঁড়াতে পারে তার জন্য এবং বাংলার সম্পদ যাতে পশ্চিমারা লুট করে খেতে

পারে তারই জন্য আমি সংগ্রাম করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য সংগ্রাম করি নাই। | এরপর অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন এবং তার পরের ঘটনালি সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু বলার চেষ্টা করব। সেসবের অলােচনায় আপনাদের বেশি সময় আজ আমি নেব না। কারণ, আন্তও অনেক কথা আপনাদের বলতে হবে। জেল থেকে বের হয়ে এখানে এসে আমি সামান্য কয়েকটি কথা বলেছিলাম। সেদিন আমি বেশিকিছু বলতে পারি নাই। কারণ, মাঝে মাঝে আমার চোখে পানি এসে গেছে। তার পরে কায়তের মহীয়সী নারী মিসেস গান্ধী যখন এখানে আসেন, তাকে অভ্যর্থনা জানাতে আপনাদের সামনে এসেছিলাম এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা করেছিলাম। তিনি অতিথি। র সামনে অন্য কথা বেশি বলা যায় না।

মুক্তিসংগ্রামের সূচনা আজ দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনাদের জানা দরকার। ত্রিশ লক্ষ লােক নৃক্ত দিয়েছে। ২৫শে মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়ার বর বাহিনী আমার ওপর আক্রমণ চালায়। সেদিন রাত্রে আমার অবস্থা যে কেমন ছিল, সেটা কেবল আমিই জানি। আমি জানতাম, ঘর থেকে বের হলেই আমাকে গুলি করে মারবে। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু বাংলার মাটিকে আমি ছাড়তে পারি নাই। রাত্রি ১১টার সময় আমার সমস্ত সহকর্মীকে, আওয়ামী লীগের নেতাদের হুকুম দিলাম, বের হয়ে যাও। সেখানে পারে, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। খবরদার, স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেয়াে।’

রাতে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম। আগে যাকে ই.পি.আর. বলা হত, তানের সদর দফর ছিল চট্টগ্রামে। পিলখা হেকোয়াটার তখন শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সাথে আমার যােপাযােগ ছিল। আমি যখন পিলখানার সাথে যােগায্যেপ করতে পারলাম না তখন আমি চট্টগ্রামের সাথে যােগাযােগ করে বললাম, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তােমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়ারলেসে এ খবর দিয়ে দাও। পুলিশ হােক, সৈনাবাহিনী হোক, আওয়ামী লীগ হােক, ছাত্র হােক, যে যেখানে আছেপশ্চিমাদের বাংলা থেকে খতম না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও । বাংলাদেশ স্বাধীন।’ তারা আমার কথামতাে খবর পেীছিয়েছিল।

সে রাত্রে কেবল আমার বাড়িতে নয়, রাজারবাগ, পিলানা, অাওয়ামী লীগের অফিস আর ছাত্রাবাসে আক্রমণ চলে। বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রাজারবাগের পুলিশরা ৬ ঘন্টা ৩০৩ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হিন-চারটে ন্যাটেলিয়ন ছিল। হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের অর্ধেককে মেরে ফেলা হয়।

এমনি করে সময় বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক-কৃঘৰুদের মেরে ফেলা হয়। আমার সহকর্মীরা পালিয়ে মুজিবনগরে আশ্রয় নেন। সেখানে তারা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন সরকার কায়েম করেন। নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হন আর তাজউদ্দিন হন প্রধানমন্ত্রী। মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং খােন্দকার মুশতাক আহমদকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়।

দালালদের সমালােচনা এখন যারা সমালােচনা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন তাদের কাউকে এসব কাজে দেখা যায় নাই। তাদের কেউ যুদ্ধে এগিয়ে আসেন নাই। তারা কেবল প্রাণ বাঁচানাের জন্য। পালিয়ে বেড়াতেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন মুজিবনগরে বসে আবার সকলকে একতাবদ্ধ করে যুদ্ধ শুরু করেন। তারা সারা দুনিয়ার লােক পাঠিয়ে বাংলাদেশের কথা সবাইকে জানিয়ে দেন। সেসময়ে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লােক পালিয়ে গিয়ে পশ্চিমবাংলা, মেঘালয়, আসাম আর ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। তারা প্রী-পুত্র-কন্যার হাত ধরে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তখন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। সারা বাংলার রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। নলীতে লাশ, ধরে গরে লাশ। মানুষের মা-বােনের আর্তনাদ, চারিদিকে হাহাকার, সর্বহারার আর্তনাদ। তনু সেদিন সমালোচকদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নাই। তারা বরং ইয়াহিয়া। প্রানের দালালি করেছে।

তার পরের যুদ্ধের ইতিহাস আপনারা জানেন। পাকবাহিনী ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। লােক দেশত্যাগ করল। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হল। শ্রমিক আর ছাত্রদের গুলি করে মাৱা হল। আজ অনেকেই সমালােচনা করে বক্তৃতা করুন আর এম,সি,এ.-দের এবং আওয়ামী লীগকে গালি দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভাগের কথা কারও মুখেই শোেনা যায় না। আওয়ামী লীগের এম,সি,এ আমার সহকর্মী মসিহুর রহমানকে দুই মাস পর্যন্ত মারতে মারতে হত্যা করা হয়েছে। আমার আর একজন এম,সি,এ, আমীন উদ্দিনকে আধামরা করে জিপের পিছনে বেঁধে তিন মাইল ঘুরিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমার এক চাচাকে হয় টুকরাে করে স্থায় রাস্তার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। সৈয়দপুরের এম,সি,এ, নজমূল হুদা সরকারকে গুলি করে হত্যা করে দুইভাগ করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন যারা বড় বড় কথা বলেন, তখন তারা কোথায় ছিলেন? সবাই স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন। কিন্তু এ কি চোরাকারবারীর স্বাধীনতা, মুনাফাখােরের আর মজুতদাৱে স্বাধীনতা? রাজাকারের আর আলবদরের স্বাধীনতা? আমি কিছু বলি না। এইজন্য কি তারা ভেবেছে, আমি নরম মানুষ! আমি নরম মানুষ নই। আমি তাদের খেলতে দিয়েছিলাম।

আমাকে আপনার জাতির পিতা’ আখ্যা দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য আসি নাই। আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ভালােবাসি। সাড়ে সাত কোটি বাত্তালি আমাকে ভালােবাসে। জীবনে কখনও আমি তাদের সাথে বেঈমানী করি নাই। চারবার আমাকে ফাঁসি দেবার চেষ্টা হয়েছে। তবু আমি মাথা নত করি নাই। তা সত্ত্বেও কেন এত কথা বলা হয়?

যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আমি বলেছিলাম, আমার কর্তব্য বােধ হয় শেষ হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পতাকা আজ দুনিয়ার আকাশে ওড়ে। আমার দেশ বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। আজ আমি বলতে পারি, আমি বাঙ্গালী। আজ আমি বলতে পারি, বাঙ্গালী একটি জাতি। আজ আমি বলতে পারি, বাংলার মাটি আমার মাটি । এর বেশি তাে আমি চাই নাই । আপনারাও আমাকে সৰ দিয়েছেন। আপনারা তাে আমাকে জাতির পিতা বানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব তাে আমার জন্য বড় জিনিষ নয় । যা কোনােদিন কোনো মানুষ পায় নাই, তা আমি পেয়েছি। আপনারা যা দিয়েছেন, সে হল আপনাদের ভালােবাসা। আমাকে আপনারা দোয়া করবেন। আমি যেন আপনাদের ভালােবাসা নিয়ে মরতে পারি। এর বেশি কিছুই আমি চাই না।

| জেল থেকে বের হয়ে এসে আমি দেখেছিলাম, রেলওয়ে ভেঙে গেছে চালের গুদম নাই; দোকানে মাল নাই। ব্যাঙ্কের টাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বৈদেশিক দ্ৰা লুট করে নিয়েছে। আমি আরও দেখেছিলাম, মানুষের কাছে বন্দুক। আমার দেশের লােক অামাকে ভালােবাসে। তাই আমার সহকর্মীরা বললেন, তোমাকেই সবকিছুর ভার নিতে হবে। তার ফলে আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব নিতে বাধ্য হলাম। বিশেষ করে এইজন্য যে, আমার বাংলার স্বীকৃতি দরকার। আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আবেদন জানালাম, তােমাদের অন্ত্র ফেরত দাও। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে আমার বাংলার মুক্তিযােদ্ধারা দুই লক্ষ অস্ত্র আমার হাতে দিয়েছে। অস্ত্র সমর্পণের এমন নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর দেখা যায় না।

আমাদের গুদামে চাল নাই। পকেটে পয়সা নাই। পাের্ট ভেঙে দিয়েছে। বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দিয়েছে। রেলগাড়ি চলে না। রাস্তায় গাড়ি চলতে পারে না। চট্টগ্রাম ও চালনা পাের্টের মুখে সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে রেখে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচাৰ কী করে? দস্যুর দল মানুষহত্যা করে খুশি হয় নাই। আমার সম্পদ ধ্বংস করে লুট করে নিয়ে গেছে। অথচ আজ একদল লােক এসবের জন্য ভারতকে দোষ দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এক কোটি লােককে মিসেস গান্ধী খাবার দিয়েৱিলেন, কাপড় দিয়েছিলেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন। এসব কি তারা দেখে আসে নাই?

খাদ্য ও ত্রাণ আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভাৱত হােক, আমেরিকা হােক, রাশিয়া হােক, গ্রেট ব্রিটেন হােক, কারাে এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, তুতক্ষণ আমার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু বন্ধুৱষ্ট্রেকে বন্ধু বলতে লজ্জা করা উচিত নয়। যেদিন আমার সরকার ক্ষমতায় আসে, সেদিন এক ছটাক চাল ছিল না। আমি তাই ভারতের কাছে চাল চাই। রত তখন আমাদের সাড়ে সাত লক্ষ টন চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে আমি এক কোটি বাষয়ি লক্ষ

মণ চাল পেয়েছি। এই চাল গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘আনরঙ’-ও চাল দিয়েছে। রাশিয়াও আমাকে সাহায্য করেছে। রাশিয়া আমার বন্দর মাফ করে না দিলে আমি থাবার আনতে পারতাম না। আমার বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামেও আমাদের সাহায্য করেছে। তবু একদল লােক তাদের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এ বন্ধুত্ব নষ্ট করবার ক্ষমতা কারও নাই।

| বাংলার মানুষকে আমি জানি। আমাকে বাংলার মানুষ চেনে। বাংলার মানুষ আমি ভালােবাসি। বাংলার মানুষ আমাকে ভালােবাসে। আমি তাদের জন্য কোনাে কাজে হাত দিয়ে কখনও হাল ছাড়ি না। আপনাদের কাছে আমি প্রথম দিন বলেছি, তিন বৎসর আপনাদের কিই দিতে পারব না। পরে সারা বাংলাদেশেই আমি এই কথা বলেছি। কিন্তু পারব না বললেও আমি দিয়েছি। রিলিফের জন্য, ঘরবাড়ি তৈয়ার করার জন্য এই ছয় মাসে উনত্রিশ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। টেট রিলিফের জন্য গ্রামঅঞ্চলে দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। স্কুল-কলেজের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। রিলিফ ক্যাম্পের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। মােট ৭৫ কোটি টাকা এই ছয় মাসে দেওয়া হয়েছে। রিলিফ, কৃষিঋণ এবং সমবায় ঋণ দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। এছাড়া, যত বকেয়া খাজনা ছিল, সব মাফ করে দিয়েছি। একদিন এই ময়দানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেব। তা আমি দিয়েছি। আমাদের পর ঠিক হয়ে গেছে। এখন বিদেশ থেকে মাল আসতে পারবে। আমার তেল ছিল না, তাতে তেল দিয়েছে। আমাদের সব জিনিসই অন্যের কাছ থেকে আনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ তাে কলােনি ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার ছিল। পশ্চিমারা সেখানে মাল তৈয়ার করত আর বাংলাদেশে সেই মাল বে5ে পকেটে টাকা নিয়ে উড়ে চলে যেত। আজ জিনিসপত্রের ঘাটতি পড়েছে। সব জিনিসই আমাকে বাইরে থেকে আনতে হবে।

শিল্প জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি। আমার শ্রমিক ভায়েরা, কৃষক ভাইদের জন্য আমি টেস্ট রিলিফ দিচ্ছি, তাকাভি ঋণ দিচ্ছি, খাজনা মাফ করেছি। এই সঙ্গেই আমি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করেছি। বড় বড় শিল্প-কারনা আর ইনসিওরেন্স কোম্পানিও জাতীয়করণ করেছি। এসব জাতীয়করণের অর্থ আমাদের বুকে দেখতে হবে। এগুলি সাড়ে সাত কোটি লােকের সম্পন। শ্রমিকেরা সারাজীবন শিল্প-কারখানা, ব্যাঙ্ক, ইনসিওরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি জাতীয়করণের দাবী জানিয়েছেন। এগুলি জাতীয়করণের অর্থ হল শােষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দেওয়া। আমরা শােষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, পশ্চিমাদের হাতে যে-সমস্ত কলকারখানা ছিল, তার সব টাকা তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, কারখানা চালাতে এ গভর্নমেন্টের একশাে আটান্ন কোটি টাকা দিতে হয়েছে। | যদি কারখানা চালিয়ে উৎপাদন না করতে পারেন, আমি বেতন বাড়াব কোথা থেকে আপনারা আমার কাছে চান নাই, আমার কাছে দাবি করার দরকার নাই।

আমি আপনাদের জন্য জীবনচর দাবি করেছি। আমার কাছে আপনারা কী দাবি। করবেন? আপনারা না বললেও আমি ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে নিয়েছি। তাতে ৩৫ কোটি টাকা বেক্তন বাড়াতে হয়েছে। আপনারা যদি উৎপাদন না করেন, আমি টাকা। দেব কোথা থেকে আমি কি অব বাংলাদেশটা বিক্রি করে টাকা দেব? না, বাংলাদেশকে বিক্রি করতে পারব না। আমাকে সমালােচনা করে বলা হয়েছে, আমি

মট কেন বন্ধ করলাম? কিন্তু আমি তাে ধর্মঘট বন্ধ করতে চাই নাই। তবে, আমি হলি শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য টঙ্গিতে টাকা পাঠাই বা হিলিফের টাকা দিই আর সেখানে সেই টাকা কেড়ে নেওয়া হয় এবং তারপর আবার যদি কেউ যেন নিতে আসে তাহলে সেটা কি ভালো হয়। শ্রমিকদের কর্তব্য হল উৎপাদন করা।

ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন আমি এখানে আজ আর একটা কথা ঘােষণা করছি। সরকার যেসব কারখানা জাীয়করণ করেছেন, এখন থেকে সেলর প্রত্যেকটির ম্যানেজমেন্ট বাের্ডে দুইজন মরে সদস্য থাকবে এবং শ্রমিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে এই সদস্যদের বাের্ডে পাঠাবেন। এ ছাড়া, বাের্ডে সৱকরেন এবং ব্যাংকের পক্ষ গেকে তিন সদস্য থাকবেন এবং এই পাঁচজন বসে কারখানা চালাবেন। যা-ই আয় হােক না কেন, আদমজি, দাউদ বা আমিনের পকেটে যাবে না। কোথায় যাবে, তা আপনারা জানতে পারবেন। আয়ের একটা অংশ আপনারা নেবেন। আর বাকি অংশ দেশের কৃষকদের কাছে যাবে। কারণ আপনারা হলেন শতকরা একজন বা দেড়জন, আর বাংলার কৃষক হল শতকরা ৮৫ জন। তাদের টাকা দিয়ে শিল্প-কারখানা চালানাে হয়। তাদেরও ভোগ করার অধিকার রয়েছে। শ্রমিক ভায়েরা, দুধ পান, গরু জবাই করে খেয়ে ফেলবেন না। তাতে দেশ চলবে না। আর, লাল বাহিনীর ভায়েরা, আপনারা হবেন আদর্শ কর্মী। আপনাদের আইনশৃংখলা রক্ষা করতে হবে। আর আপনাদের দেখাতে হবে যে, ৮ ঘন্টার জায়গায় লাল বাহিনীর ছেলেরা ১০ ঘন্টা পরিশ্রম করে। এবং এই কাজ দেখিয়ে অন্য শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হবে। আপনরা ১০ ঘন্টা না পারেন, ৯ ফুটা কাজ করুন বা ৮ ঘন্টা করুন। উৎপাদন বাড়ান। তাহলেই লাল বাহিনী আপনাদের ইজ্জত থাকৰে। লালটুপি মাথায় দিয়ে বেড়ালে লাল বাহিনীর ইজ্জত পাওয়া যাবে না । সমাজবিরােধী কার্যকলাপ ভায়েরা আমার, আজ আপনাদের বেতন বাড়ালেই সুবিধা হবে না। সেইজন্য বাংলাদেশে ৪,২০০ দোকান খােলা হচ্ছে। প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে ন্যায্যমূল্যে জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য শ্রমিক এলাকায়ও এ-ধরনে দোকান খােলা হবে। তাতে খরচ হবে ১৯ কোটি টাকা। তবে মজুদার, চোরাকারবারী আর চোরাচালানকারীর হুঁশিয়ার হয়ে যাও। তাদের আমি সােজা কথায় বলে দিচ্ছি, পাঁচ মাস আমি তাদের অনুবােধ করেছি, আবেদন করছি, বুঝিয়েছি, অনেক নগেছি, একাকা কোরাে না। আমার বিশ্বাস ছিল যে, তারা আমার কথা শুনবে। কিন্তু দেখছি, ‘চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী’। তাই তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি

বাড়ি, গাড়ি দখল করে আছ, যারা দােকান বা অন্যের জমি দখল করে আছে, যারা মজুদ করছ, জিনিস-পত্র বিক্রয় করছ না, জিনিসের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছ, তাদের রেহাই নাই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানাদেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরিব দুঃখীদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুটপাট করে খাচ্ছ, তাদেরও রক্ষা নাই। আমি ১৫ দিন সময় দিলাম। ১৫ দিনের মধ্যে যদি সরকারি বাড়ি না ছাড়াে, যদি মজুদ করে রাখাে, এক-একটা এলাকায় আমি কারফিউ দেব আর সমস্তু পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট আর আমরি স্বেচ্ছাসেবী সেখানে তল্লাশি চালাবেন। এতদিন আমি কিছু বলি নাই। এখন বলে দিলাম, দুম দিয়ে দিলাম। এর পরেও বড় বড় বক্তৃতা করবে আর রাত্রিবেলায় চোরা গাড়িতে চড়বে, এই হবে না। আমার প্রাণ থাকতে নয়। বারবার ঘুঘু তুমি ধান খেয়ে যাও। আর ঘুঘু পান খাওয়ার চেষ্টা কোরাে না। আমি পেটের মধ্য হতে ধান বের করে ফেলব। চিস্তার কারণ নাই।

এম.সি.এ.-দের সমালোচনা ভায়েরা আমার, আর একটা কথা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই। আওয়ামী লীগ ২৩ বৎসর এই বাংলাদেশে রাজনীতি করছে। এখন কিছু লােক এই আওয়ামী লীগের এম.সি.এ.-দের নিন্দা করে। কিন্তু ২৩ জন এম,সি,এ,কে বহিষ্কার করেছে কোন্ পাটি? এমন বহিষ্কারের নজির পৃথিবীর আর কোন দেশের ইতিহাসে আছে? কিন্তু আমি বহিষ্কার করেছি, আওয়ামী লীগ করেছে। ভবিষ্যতে যদি কোনাে এমসি,এ, না পার্টি সে যে পার্টিরই হােক না কেন,-কিংবা কোনাে শ্রমিকনেতা বা ছাত্রনেতা চুরি করে, তাহলে আমি মাফ করব না। | এখন এম,সি,এ,-দের সমালােচনা করার অর্থ কী? যারা সমালােচনা করেন, তাঁরা ভাবেন, আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করব। তারা যদি এম.সি.এ.-দের দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন, তাহলে নিজেরা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করবেন। কিন্তু সব এম, সি, এই কি চোর? কোনাে এম,সি,এ, কি যুদ্ধ করেন নাই? তারা কি গুলি খেয়ে মরে নাই? এম.সি.এ.-দের মধ্যে ভালােমানুষ আছে, খারাপ মানুষও আছে। সব দলেই ভালাে-মন্দ মানুষ আছে। যারা খারাপ, তারা সবসময়ই খারাপ। আমার দলের মধ্যে কেউ চুরি করে বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয়, আমি জানি। তার পরিষদ সদস্যপদ আমি কেড়ে নেব। কিন্তু এম,সি,এ.-দের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত করা খারাপ। তারা গণপরিষদের সদস্য। তারা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, তারা শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। আমি বাংলাদেশে শাসনতন্ত্র দিতে চাই। ইয়াহিয়া খান বা আইয়ুব খানের মতাে গভর্নমেন্ট চালাতে চাই না। জনগণকে আমি ভয় করি না। জনগণকে আমি ভালােবাসি। সেজন্য শাসনতন্ত্র যত শীঘ্ন হয় আমি দেন।

জাতির আদর্শ এখন আমাদের একটা স্লোগান। আগে ছিল ৬ দফা, এখন বলি ৪টা স্তন্তু। আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙ্গালী জাতি,–এ নিয়ে হল, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। বাংলায় বুকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হল আমার এক নম্বর স্তম্ভ।

দ্বিতীয় স্তম্ভ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আসতে চাই না, এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র। তার অর্থ হল শােষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বন্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধনসম্পদ বাড়াতে দেব না। বাংলার কৃষক, মজদুর, বাংলার বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক এদেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভােগ করবে।

| কিন্তু সমাজতন্ত্র যেখানে আছে, সেদেশে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি। থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্র কায়েম করব। আমি ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি জনগণকে ভালােবাসি, আমি জনগণকে ভয় পাই । দরকার হলে আবার ভােটে যাব। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।

চতুর্থত, বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খুষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার, আলবদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। এই হল চার দফা, চার স্তু।

পাকিস্তানে আটক বাতালি আর একটা কথা বলি। ভুট্টো সাহেব নারাজ হয়ে গেছেন। তিনি আবােলতাবােল বকছেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুলিবিকুলি করছেন। আমি বলেছি, বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিন। তারপর এসব বিবেচনা করে দেখব। তিনি এর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছেন। তিনি একটু ভয় পেয়ে গেছেন নাকি? যারা আমার মাবােনের ওপর অত্যাচার করেছে, যারা পশুর মতাে আমার জনসাধারণকে হত্যা করেছে, দ্বারা নিরপরাধ কৃষক-ছাত্রকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার করলে নাকি তিনি বড় অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব, শুনে রাখুন। তাদের বিচার বাংলার বুকে অবশ্যই

ভুট্টো সাহেব আমার চার লক্ষ বাঙালিকে আটকে রেখেছেন। তারা নিরপরাধ, কিছুই করে নাই। তবু তিনি দরকষাকষি করছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি আমার বাঙালিদের ইনশাল্লাহ বাংলার বুকে ফেরত আনব। তিনি ঠেকাতে পারবেন না।

তবে, একটা অনুরােধ করব আপনাদের কাছে। যে-সমস্তু অবাক্কালি এখানে আছে, যারা আলবদর, রাজাকার নয়, যারা বাংলার মাটিতে বাঙালি হিসেবে বাস করতে চায়, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, তাদের বাংলায় থাকবার অধিকার রয়েছে। যারা যেতে চায়, ভুট্টো সাহেব যেন মেহেরবানি করে তাদের নিয়ে যান। আমার আপত্তি নাই। তিনি বলছেন, তিনি তাদের নেবেন না। কেন নেবেন না? তাদের হাতে তো বন্দুক তারাই দিয়েছিলেন। তাদের তাে ব্যবহার করেছিলেন। তাদের দিয়ে বাঞ্চালিদের
হত্যা করিয়েছিলেন। এখন কেন নেবেন না। যারা যেতে চায়, তাদের নিয়ে যান। আমি ছেড়ে দেব। আমার চার লক্ষ লােক ফেরত দিন। ভুট্টো সাহেব যেন একথা মনে না করেন যে, বাংলাদেশে শুধু বিহারী আছে। পশ্চিমপাকিস্তানের ও অনেকে আমার কাছে আছে। সুমো সাহেব আমার লােক ফেরত দিন, আমিও তাদের লােক ফেরত দিচ্ছি। যুদ্ধবন্দীর সঙ্গে জনসাধারণ কোনােদিন এক হতে পারে না। এমন নজির দুনিয়ায় নাই। কোনাে দিন হয় নাই।
একদল লােক দুনিয়ায় চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন যে, বিহারীঝা বড় করে আছে। যখন আমার লােক না-খেয়ে মরছিল, যখন গুলি খেয়ে মরছিল, যখন এদেশের মানুষকে ধরে ধরে কুর্মিটোলায় গুলি করেছিল, যখন জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন কেন মেহেরবানি করে তারা প্রতিবাদ করেন নাই? এখন কেন তারা কেঁদেকেটে একেবারে অস্থির হয়ে পড়ছেন?
যাণ ও বিদেশী সাহায্য আমার বাংলার এক কোটি লােক পশ্চিমবাংলা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে ছ’ মাসে ফিরে এসেছে। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের খাবার দিতে হয়। আমার বাংলাদেশের দেড় কোটি লােক এ গ্রাম থেকে ও গ্রাম, ও গ্রাম থেকে এ গ্রামে পালিয়ে বেড়াত। তাদের জন্য কেউ মায়াকান্না কাদে নাই। আমি জানি। দেখে আসুন, আমার মানুষ না-খেয়ে আছে। আমার মানুষের পড় নাই। আমার কৃষকের বীজ নাই। আমার মানুষের চাল নাই।
আমি তাে পরিষ্কার বলেছি, দুনিয়ার সমস্ত দেশ থেকে আমি সাহায্য নিতে রাজি আছি। কিন্তু সে সাহায্য হবে শর্তহীন। শর্ত দিয়ে কারাে কাছ থেকে আমি ভিক্ষা আনতে পারব না। শর্ত ছাড়া যদি কেউ আমাকে সাহায্য করতে চায়, দুনিয়ার যে কোনাে দেশ থেকে সাহায্য নিতে আমি রাজি আছি। তবে এমন কিছু আনতে চাই না, যাতে ভবিষ্যতে আমার অসুবিধা হতে পারে। সেজন্য আমি একটু আস্তে আস্তে চলি।
শিল্পের উৎপাদন শ্রমিক কােৱা, আল্লাহওয়াতে একটু উৎপাদন করাে। আওয়াজে মিল খেয়ে ফেলাে না। পয়সা থাকবে না। ব্যাংক থেকে ১৫৭ কোটি টাকা তােমাদের আমি দিয়েছি শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালাবার জানা। অনেক মিল বন্ধ। তবু মাইনে দিয়ে চলছি। অনেক মিলে অর্ধেক কাজ হয়। সেখানেও আমি মাইনে দিয়ে চলছি। আমি তাদের ভালােবাসি, এই জন্যই তাে আমি বিনাকথায় ২৫ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ২/৩ বৎসর কষ্ট করতে হবে। উৎপাদন করতে হবে। ইন্শাল্লাহু একবার যদি উৎপাদন বেড়ে যায়, তাহলে আর কোনাে কষ্ট হবে না। শ্রমিকরা সমস্ত মানুষের সঙ্গে সমানভাবে দেশের সম্পদ ভাগ করে খেতে পারবে। কিন্তু চার সের দুধ হলে তারা এক সের খাবে। বাকি তিন সের গ্রামের লােককে দেবে। চার সেরই যেন নিজেরা না খায়। তা হলে গ্রামের লােক বাঁচবে না। গ্রামে থাকে কারা? আপনার আমার বাবা-মা। যারা গ্রামে বাস করে,
তাই কৃষক। তাদের প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে। তাদের আমি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত খাজনা মাফ করেছি। তাদের আমি ঋণ দিচ্ছি। দরকার হলে আরাে দেব। আমি চাই, তারা খাদ্য উৎপাদন করুক। আমি বেশিদিন ভিক্ষা করতে পারব না। আমার ৩০ লক্ষ টন খাদ্যের দরকার। ১৭ লক্ষ টন আমি পেয়েছি। আরও ১০ লক্ষ টন ইনশাল্লাহ আমি পাব। খাদ্যসামগ্রীর অভাব হবে না।
জিনিষপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আবার একটু রুমের দিকে যাচ্ছে। আমাদের অনেক খবরের কাগজ যেগুলি দাম বাড়তে দেখলে লাফ দিয়ে কেবল বাড়ায়। যখন কমে তখন আর মেহেরবানি করে কিছু লেখে না। তারা যেন দাম কমলে একটু লেখে। আমার তাে ছােট চাদরের অবস্থা। মাথায় দিলে পা খালি, পায়ে দিলে বুক খালি । চাল আনলে ভাল আসে না, ডাল আনলে নুন আসে না। নুন আনলে তেল আসে না, তেল থাকলে লবণ থাকে না। আনতে হয় চট্টগ্রাম পাের্ট থেকে, চালনা পাের্ট থেকে। | ভায়েরা আমার, আমি জানতে চাই, আপনাদের আমার ওপর আস্থা আছে কি নাই? আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা আছে কি নাই? বাংলাদেশকে গড়বেন কি গড়বেন
? তিন বছর আমি কিছু দিতে পারব না। দাবি-দাওয়া আমার কাছে চলবে না। একদল লােক বলছে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। কিন্তু মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে ফেলে বেহেস্তে গেলেও শান্তি পাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে সুখী করতে চায়। বাংলাকে সােনার বাংলা করতে চায়। লােকে বলে, মুজিবর রহমান ল-ন-জন খাবে। মুজিবুর রহমান সব ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমি কেন সব ছাড়ব? | আজ মুনাফাখাের, আড়তদার, চোরাকারবারী সাবধান হয়ে যাও। ভবিষ্যতে যদি জিনিসের দাম আর বাড়ে, আমি তােমাদের শেষ করে দেব কারফিউ করে করে। আর দরকার যদি হয়, আইন পাস করব। যদি চোরাকারবারী বা আড়তদাররা আমার কথা না শােনে, তাদের গড়ব না। আর যারা অস্ত্র নিয়ে চলে, তারা সােজা পথে না এলে আমি বাধ্য হয়ে আইন পাস করব, তাদের গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর সরকারি কর্মচাৰী ভায়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লােক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি৷ খােৱা নয় নম্বর ধারায় চাকরি যাবে, জেলখানায় যাবে। আর চোর, তথ্য, বদমাইশ, জাকাত, সাবধান হয়ে যাও।
কর্মী ভায়েরা, গ্রামে গ্রামে তােমরা পাহারা দাও, যাতে চোর-গা-মাইশ। মানুষের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট করতে না পারে।
| আর যারা শুধু সমালােচনা করে বক্তৃতা করে, তাদের কাছে অনুরােধ করি, খামে গিয়ে একটু কাজ করুন, একটু রিলিফের কাজ করুন। তাদের ফল হবে।
আমি এবার তাহলে চলি। খােদা হাফেজ।

আমার পিতা : শেখ মুজিব

শেখ হাসিনা।

বাইগার নদীর তীরে ঘেঁষে ছবির মতাে সাজানাে সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম। টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতী। নদীরই অসংখ্য শাখানদীর একটি নদী বাইগার নদী। নদীর দুপাশে তাল, তমাল-হিজল গাছের সবুজ সমারােহ। ভাটিয়ালী গানের সুর ভেসে আসে হালধৱা মাঝির কণ্ঠ থেকে, পাখির গান আর নন্দীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনােরম পরিবেশ গড়ে তােলে। প্রায় দুশাে বছর পূর্বে মধুমতী নদী এই গ্রাম ঘেঁষে বয়ে যেত। এই নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিল জনবসতি। প্রকৃতির অমােঘ নিয়মে ধীরে ধীরে নদীটি শুকিয়ে যায়। চর জেগে গড়ে ওঠে আরও অনেক গ্রাম।

| সেই দুশাে বছর আগে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়েই আমাদের পূর্বপুরুষরা এসে এই নদীবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমমণ্ডিত ছােট গ্রামটিতে তাদের বসত গড়ে তােলেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে। অনাবাদি জমিজমা চাষবাস শুরু করেন এবং গ্রামের বসবাসকারী কৃষকদের নিয়ে একটি আত্মনির্ভরশীল গ্রাম হিসেবেই এই গ্রামটিকে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্ৰামরূপে গড়ে তােলেন। যাতায়াতের ব্যবস্থা প্রথমে শুধু নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। পরে গােপালগঞ্জ থানা। স্টিমারঘাট হিসেবে গড়ে ওঠে। আমাদের পূর্বপুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালানবাড়ি তৈরি করেন, যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই যে দুটো দালানে বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটোই জ্বালিয়ে দেয়।

এই দালানকোঠায় বসবাস শুরু হবার পরে ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এই দালানেরই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চালাঘর তােলেন আমার দাদার বাবা শেখ আবদুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফর রহমান এই বাড়িতেই সংসার গড়ে তােলেন। আর এখানেই জন্ম নেন আমার বাবা।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। আমার আব্বার নানা শেখ আব্দুল মজিদ আমার আকার আকিকায় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমার দাদীর প্রথম দুই কন্যাসন্তানের পর প্রথম পুত্রসন্তান আমার আব্বা। আর তাই আমার দাদীর বাবা তার সব সম্পত্তি দাদীকে দান করেন এবং নাম রাখার সময় বলে যান, ‘মা সায়রা তাের ছেলের এমন নাম রাখলাম যে নাম জগৎজোড়া খ্যাত হবে।’

আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলােবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে গেলে, মাছরাঙ্গা কীভাবে দূব দিয়ে মাছ ধরে। কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দেহেল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠেঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালাে লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা খরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তাঁর কথামতো যা বলতেন তাই

রক। আবার এগুলাে দেখাশােনার চর নিতেন ছোটবােন হেলেনের ওপর। এই পােষা পাখি ৰজন্তুর প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না। মাঝে মাঝে এজন্য ছোটবােক বকাও খেতে হত।

আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ঘেঁষে একটি সরু খাল চলে গেছে, যে খাল আলী ও বাইগার নদীর সংযােগ রক্ষা করে। এই খালের পাড়েই ছিল বড় কাছারির আর এই কাহাবিবের পাশে মাস্টার, গুত ও মৌলঙ্গ শহরে থাকার ঘর ছিল। এক গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত ছিলেন এবং তাদের কাছে আমার বাবা আৱৰি, বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন।

আমাদের পূর্বপুরুষদেরই গড়ে তােলা গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। তখন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাড়ি থেকে প্রায় সােয়া কিলােমিটার দূর। আমার আকা এই ফলেই প্রথম লেখাপড়া করেন। একবার বর্ষাকালে নৌকা করে ফুল থেকে ফেরার কার্যকালে •ীকা করে ভুল থেকে ফেরার সময় নৌকানি হয়ে যায়। আমার আকা। খালের পানিতে পড়ে যান। এরপর আমার দাদী তাকে আর ওই স্কুলে যেতে দেননি। কার একৰি হেলে চোখের মণি গোটা বংশের অলিরের দুলাল আর এ কী যেন प्रकरण । म ग म नि मन हुन निमावि हुन र कत

সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাবার শেষে দুধ-ভাত-কলা ও গুড় ডাৰ পছন্দ করতেন।

আমার চার ফুফু ও এক চাচা ছিলেন। ছোট ভাইটির যাতে কোনাে কষ্ট না হয় এজন্য সদাসর্বদা ব্যস্ত থাকতেন বড় দুই বােন। বাকিরা জ্যেই কি সাদা-দাদীর কাছে খােকার আদর ছিল সীমাহীন।

আমাদের বাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যা ছিল প্রচুর। আমার দাদার বা দাদীর বােনদের ছেলেমেয়ের বিশেষ করে যারা পিতৃহারা বা মাতৃহারা তাদেরকে দাদা-দাদী নিজেদের কাছে এনেই মানুষ করতেন। আর তাই প্রায় সতেরাে-আঠারাে জন ছেলেমেয়ে একই সঙ্গে মানুষ হত। | আকার যখন এগারাে বছর বয়স তখন তার বিয়ে হয়। আমার মায়ের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। আমার মা পিতৃহারা হবার পর তার দাদা এই বিয়ে দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি মা ও খালার নামে লিখে দেন। আমার খালা মায়ের থেকে তিন-চার বছরের বড়। আত্মীয়ের মধ্যেই দুই বােনকে বিয়ে দেন এবং আমার দাদাকে (গাজিয়ান) রবধি করে দেন। আমার মার যবন ছয়-সাত বয়স তখন তার মা মারা যান এবং তখন আমার দার্দী কোলে তুলে নেন আমার মাকে। আর সেই থেকে একই সঙ্গে সৰ ছেলেমেয়ের সঙ্গে মানুষ হন।

| লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দরুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করছেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মােল্লারহাট যেতেন খেলতে। গােপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন। আশা যখন খেলতেন তখন দাদারাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন।

| দাদা আমার কাছে গল্প করতেন যে, তােমার বাবা এত রোগা ছিল যে, বলে জোরে লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়তেন। আব্বা যদি ধারে কাছে থাকেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন, আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর পেছনে মজার ঘটনা হল মাঝে মাঝে আকার টিম ও দাদার টিমের খেলা হত। এখনও আমি যখন ওইসব এলাকায় যাই, অনেক বয়স্ক লােকের সঙ্গে পরিচয় হয় যারা আকার ছোটবেলার কথা বলেন। আমাদের বাড়িতে অনেক ফটো ও কাগজ ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ফলে সব শেষ হয়ে যায়।

তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত পরোপকারী ছিলেন। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশােনার তেমন সুযােগ ছিল না। অনেকে বিন্নি বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশােনা করতেন। চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে আসতে হত। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসতেন। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেকদূর হেঁটে তাদের ফিরতে হত। যেহেতু আমাদের বাড়িটি ছিল ব্যাংক পাড়ায়, আব্বা তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধ-ভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি আবার খেতেন। পার্কীর কাছে শুনেছি আকার না মাসে কয়েকটা ছাতা কিনতে হত। কাশ আর কিছুই নয়। কোনো হেলে পবি, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ রােল বা বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে, তাদেরকে জাত দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন।

গােপালগঞ্জ ছিল আমার দাদার কর্মস্থল। সেই থেকে গােলাপগঞ্জেই তিনি লেখাপড়া করতে শুরু করেন। মাঝখানে একবার জানা মানারীপুর পলি হন, তখন কিলিগের এশ আশাৰীপুরেও লেখাপড়া করেন। সুরে আবার গােপালগকেই তার কৈশােকেলা কাটে।

আমার আকার শরীর ছিল বেশ রােগা। তাই আমার দাশী সবসময়ই ব্যস্ত আকতেন কীভাবে পােকার শরীর ভালাে করা হয়। আদর করে আদা-আণীও “খােকা” বলেই মতন। আর ভাইবােন গ্রামবাসীদের কাছে ছিলেন মিয়া ভাই’ বলে শক্তিক। আগের সহ-সকল মানুষদের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে কিনি মিশতেন। আমাৰ ৰী সকশময় বার থাকাকন খােকার শরীর সুস্থ করে তুলতে। তাই ঘরের দুখ, জানি, মাখন থকেই তৈরি হত। নিজের গানের স্কুল, ননীর তাজা মাছ সবসময় ভােস্কা একা বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকত। কিন্তু আমার আকা জোকােলা থেকে ছিপছিপে পাতলা ছিলেন, তাই দাদীর আপসােসের সীমা ছিল না কেন তা খােকা একই ইপু নাশ হয় না। খাবার বেলায় খুব সাধারণ জ্ঞপ্তি মাছের ঝােল

দাদীর কাছে গল্প শুনেছি যখন ছুটির সময় হত তখন দাদী আমগাছের নিচে এসে পড়াতেন। থােকা আসবে দূর থেকে, তাই রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খােকা পায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে। পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক পৰি লােককে শতছিন্ন কাপড়ে দেখে তাকে সৰ পিয়ে এসেছেন।

আমার দাদা-দাদী অত্যন্ত উদার প্রকৃতির ছিলেন। আমার আব্বা যখন কাউকে কিন্তু দান করতেন তখন কোনােদিনই বকাঝকা করতেন না, বরং উৎসাহ দিতেন। আমার দাদা ও দাদীর এই উদারতার আরও অনেক নজির রয়েছে।

স্কুলে পড়তে পড়তে আব্বার বেরিবেরি রােগ হয় এবং চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চার বছর লেখাপড়া বন্ধ থাকে। তিনি সুস্থ হবার পর পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন। এই সময় আব্বার একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, তাঁর নাম ছিল হামিদ মাস্টার। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় এবং বহু বছর জেল খাটেন। পরবর্তী পর্যায়ে আব্বা বিভিন্ন সময় যখন জেলে থাকতেন অথবা পুলিশ গ্রেফতার করতে আসত, আমার দাদী মাঝে মাঝেই সেই মাস্টার সাহেবের নাম নিতেন আর কাদতেন। এমনিতে আমার দাদা-দাদী অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন, ছেলের কোনাে কাজে কখনাে তারা বাধা দিতেন না বরং উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে আমার বাবার মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ যখনই যেটা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে আমার দাদা তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ দিয়েছেন।

আমার আল্লার একজন স্কুলমাস্টার ছোট্ট একটি সংগঠন করেন এবং বাড়ি ঘুরে ধান, টাকা, চাল যোগাড় করে গরিব মেধাবী ছেলেমেয়েদের সাহায্য করতেন। আমার আব্বা অন্যতম সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করতেন এবং অন্যদের উৎসাহ দিতেন। যেখানেই কোনাে অন্যায় দেখতেন সেখানেই তিনি প্রতিবাদ করতেন এবং একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি প্রথম সরকার-সমর্থকদের দ্বাত্রা অযছের শিকার হন এবং গ্রেফতার হয়ে কয়েকদিন জেলে থাকেন।

কৈশােরেই তিনি খুব বেশি অধিকার-সচেতন ছিলেন। একবার যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা গােপালগয়ে সফরে যান এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। সেই সময় সাহসী কিশাের মুজিব তার কাছে স্কুলের গৃহে বর্ষার পানি পড়ার অভিযােগ তুলে ধরেন এবং মেরামত করার অঙ্গীকার আদায় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

গােপালগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে তিনি কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। তখন বেকার হােস্টেলে থাকতেন। এই সময় তিনি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন (হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন)। এই সময় থেকে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু করেন।

১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। পাকিস্তান-ভারত ভাগ হবার সময় যখন দাঙ্গা হয় তখন দাঙ্গা দমনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। নিজের স্ত্রীবনের কি নিয়ে তখন কাজ করে যেতেন। আমার মেজো ফুফু তখন কলকাতায় থাকতেন। যার কাছে শুনেছি মাঝে মাঝে ফুফুর খোঁজখবর নিতে যেতেন, তখন ফুফু জোর করে কিছু খাবার

খাইয়ে দিতেন। অন্যায়কে তিনি কোনােদিনই প্রশ্রয় দিতেন না। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে তিনি কখনও পিছপা হননি।

পাকিস্তান হবার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সচিবালয়ের সামনে অবস্থান-ধর্মঘট করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। অল্প কয়েকদিন পর মুক্তি পান।

| গােপালগঞ্জ থানায় একটি বড় পুকুর আছে যার পাশে বড় খােলা মাঠ। ওই মাঠে আমরা দুই ভাইবােন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরবার জন্য ছুটে বেড়াতাম, আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি। ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হাসুআপা, তােমার আব্বাকে আমি একটু আৰু বলি।’

ঘাতকের বুলেটে শুধু আব্বাকেই ছিনিয়ে নেয় নাই; আমার মা, কামাল, জামাল, ছােট্ট রাসেলও রেহাই পায় নাই; কামাল জামালের নবপরিণীতা বধূ সুলতানা ও রােজী—যাদের হাতের মেহেদীর রং বুকের রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেছে। খুনিরা এখানেই শেষ করেনি, আমার একমাত্র চাচা শেখ নাসের, তরুণ নেতা আমার ফুফাতাে ভাই শেখ মণি, আমার ছােটবেলার খেলার সাথী শেখ মণির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজুকে খুন করেছে। এই খুনিরা একই সঙ্গে আক্রমণ করেছে আবদুর রব সেরনিয়াবাত (আমার ফুফা), তার তেরাে বছরের কন্যা বেৰী, দশ বছরের ছেলে আরিফকে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর চার বছরের শিশুপুত্র বাবু খুনিদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। আজও গুলির আঘাতে পঙ্গু হয়ে আছেন আমার মেজো ফুফু। যেদিন কামাল আব্বাকে ডাকার অনুমতি চেয়েছিল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে আব্বার কাছে নিয়ে যাই। আব্বাকে ওর কথা বলি। আব্বা ওকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করেন। আজ আর তারা কেউ বেঁচে নেই—আজ যে বারবার আমার মন আব্বাকে ডাকার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের সান্নিধ্য পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি। কিন্তু শত চিৎকার করলেও তাে কাউকে আমি পাব না। কেউ তাে আর সাড়া দিতে পারবে । তাদের জীবন চিরদিনের মতাে যে ঘাতকেরা স্তব্ধ করে দিল তাদের কি বিচার হবে ?

সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র আগস্ট ২০০৮

বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু

আনিসুজ্জামান যে মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সে মাটির সঙ্গে নিঃশর্ত একাত্বতা বােধ করেছিলেন, প্রবলভাবে ভালােবেসেছিলেন সে মাটির সন্তানদের। বাংলাদেশের নদী-মাঠ ক্ষেত ফুলফল আলাে বায়ু যেমন প্রাণ জুড়িয়েছিল তার, তেমনি সে প্রাণে ঠাই করে নিয়েছিল চঞ্চল কিশাের, শ্যামল রমণী, স্বেদাক্ত যুবক, মহাকালের সাক্ষী বৃদ্ধ। স্বদেশ ও মানুষের প্রতি এ নিখাদ ভালােবাসাই তাঁর জীবনের মূলকথা, তার শক্তি ও দুর্বলতার উৎস। | এই ভালােবাসা থেকে দেশ ও জাতির প্রতি নিজ কর্তব্য করে গেছেন তিনি অন্তত তিরিশ বছর ধরে। কখনাে জনতার মধ্যদিয়েই পথ করে নিয়ে তিনি গেছেন বক্তৃতার মঞ্চে, ক্ষমতার আসনে, কারাগারের অন্তরালে। কখনাে তিনি থেকেছেন অগণিত মানুষের মিছিলের পুরােভাগে প্রতিবাদে, ক্ষোভে, প্রত্যাশায়, দাবিতে। কখনাে পেয়েছেন রাষ্ট্র পরিচালনার ভার-সাফল্যে উল্লসিত, ব্যর্থতায় বেদনাহত, গৌরবের উত্মাসে দীপ্ত, সমালােচনার বাণে বিদ্ধ, কোলাহল থেকে অকস্মাৎ অম্ভহিত হয়েছেন নির্জন কারাপ্রকোষ্ঠের নিভৃতে, বাইরের জগতের সঙ্গে সংযােগ হারিয়ে থেকেছেন মৃত্যুর অপেক্ষায়। | তাঁর অদম্য সাহস ও অকুণ্ঠ আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শক্তি ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, মানুষের আপনজন হওয়ার ও তাদের বিশ্বাস অর্জনের পরগতা—এসবই তাকে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত করেছিল রাজনৈতিক কর্মী থেকে জননায়কে।

নিজের বাঙালিসার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। কখনাে স্বভাবের প্রেরণায়, কখনাে সযত্ন উৎসাহে তার উন্মোচন ঘটিয়েছিলেন। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালােবাসা থেকে এক মােহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সকলের প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তাে আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৬৯-এ, ১৯৭০-এ, ১৯৭১-এ, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা—দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে সমুদ্রে হল হারা, সেকথা লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। | বঙ্গবন্ধু নিজেও সেকথা জানতেন। তাই দেশের মানুষের কাছে কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না। ছয় দফা সম্পর্ক একটি ভাষণে তিনি বলেছিলেন ।

এই দাবি তুলতে গিয়ে আমি নির্যাতিত হয়েছি। একটার পর একটি মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আমাকে হয়রানি করা হয়েছে। আমার ছেলেমেয়ে, বৃদ্ধ পিতামাতা ও আপনাদের কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে কারাগারে আটক করে রাখা হয়েজিল। আমার সহকর্মীদেরকেও একই অন্যায় অত্যাচারের শিকার হতে হয়েছে। সেই দুর্দিনে পৱম করুণাময় আল্লাহর আশীর্বাদস্বরূপ আপনারাই কেবল আমার সাথে ছিলেন। কোনাে নেতা নয়, কোনাে দলপতি নয়, আপনারা বাংলার বিপ্লবী ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ওঁ সৰ্বহারা মানুষ রাতের অন্ধকারে কারফিউ ভেঙে মনু মিয়া, আসলমতিয়ুর, রুম, জহির, জোহা, আনােয়ারের মতো বাংলাদেশের নামল ছেলেমেয়েরা প্রাণ দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে তথাকথিত আৰুতলার ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিনের কথা আমি ভুলে যাই নাই, জীবনে কোনােদিন ভুল না, ভুতে পারব না। জীবনে আমি কি একলাও হয়ে যাই, মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতাে আবার অনি মৃত্যুর কাক আসে তবে সে মৃত্যুর সাথে বেঈমানি করব না। আপনারা যে ভালােবাসা আমার প্রতি আজও অক্ষুন্ন রেখেছেন, জীবনে যদি কোনোদিন প্রয়েক্সন হয় কবে আমার মুক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালােবাসার ঋণ পরিশোধ করব।’

১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযােগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত কয়েছিল সারা বিশ্ব। ক্ষাত্রশক্তির সঙ্গে নৈতিক শক্তির দ্বন্দ্ব পৃথিবীতে এই প্রথম সংঘটিত হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে যে ঐক্য যে শৃঙ্খলা যে। দুর্জয় সংকল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার লনা হয় না। তারপর সেই ৭ই মার্চের

ষণ, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ । যে অনেছে সে ভাষণ তাই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ। কী ছিল সে ভাষণে কোনাে অতি তথ্য নয়, কোনো অপ্রত্যাশিত ঘােষণা নয়, আমার কোনাে কারুকার্য নয়, কোনাে পরিশীলিত ভঙ্গি নয়। তাতে ছিল এদেশের সর্বশ্রেণীর মানুষের অকথিত বাণীর প্রাশ, তাদের চেতনার নির্যাস, বক্তব্যের অবিসংবাদিত আন্তরিকতা। বাংলাদেশে মানুষের সঙ্গে এই আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই তাে শত্রুদেশে বন্দি থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রেরণা ছিল সক্রিয়। স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিল সকলে, তেমনি প্রবল আকাকা ছিল তার নেতৃত্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ে তােলার।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে তিনিই ছিলেন প্রধান চালিকাশক্তি। বন্দিদশা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন কৱেই তিনি বলেছিলেন : যদি দেশবাসী খাবার

পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনমা ব্যর্থ হয়ে হাৰে-পূৰ্ণ হবে । এ ছিল প্রায় স্বপ্নেরই অংশ। যখন আর সবকিছু ছিল প্রতিকুলে, মানুষই ছিল একমাত্র সহায়, তখনও তিনি এই স্বপ্ন পরিক্সাগ করেননি। আমরা জানি সব স্বপ্ন সফল হয় না, হবু স্বপ্ন দেখে মানুষ, মানুষ ছিলেন তিনি নিজেও তাই বিচারের স্কুল তার। হয়নি একথা বলা যাবে না। কিন্তু ভুলের মাশুল তিনি নেননি, শিকার হয়েছিলেন গর্ভীর চক্রান্তে। সপরিবারে তার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নিমমি।

ঘটনা, সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায়। তবে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় বাংলাদেশের ইতিহাসের যে অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি সে-অধ্যায়ের নায়ক কিন্তু তিনিই। অকালে নিহত হওয়া সত্ত্বেও তাই শেখ মুজিবের স্মৃতি ও প্রেরণা নিঃশেষ হয়ে যায়নি—তা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার মতাে না বলে । সেই যে মানুষটি ভালােবেসেছিলেন আমাদের, বীর হতে চাননি শুধু ভয় পাননি শহীদ হতে। রক্ত দিয়ে দেশবাসীর ভালােবাসার ঋণ পরিশােধ করতে প্রস্তুত ছিলেন সর্বদা তাকে কী করে তুলবে বাংলাদেশের মানুষ? তিনি তাে শুধু প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন না দলবিশেষের প্রধান। দীর্ঘদিবস দীঘরজনী ঝড়-মেঘবিদ্যুতের মধ্যে ইতিহাসের পথে আমাদের যাত্রায় তিনি ছিলেন সঙ্গী, পথপ্রদর্শক। তাকে ডুব কেমন করে? | এবারের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যার ৩৪ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। স্বাধীনতাসংগ্রামের অনেক মহানায়ককে নিষ্ঠুর পরিণাম বরণ করতে হয়েছে। গান্ধী ও সুকর্ন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু-হত্যার মধ্যে যে পাশবিকতার পরিচয় আমরা পাই, তা ইতিহাসের অন্যান্য নিরর্তাকে ছাড়িয়ে যায়। আরাে শােচনীয় ব্যাপার এই যে, এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যাতে বিচার না হতে পারে, তার জন্যে আইন করা হয়েছিল। যে-কোনাে সভ্যসমাজের জন্যে তা কলঙ্কস্বরূপ। এতদিনে সেই কালাকানুন রদ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ অবাধ করা হয়েছে। আমরা আশা করব চূড়ান্ত বিচার ত্বরান্বিত হবে এবং সে বিচার বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সহায়ক হবে।

ইত্তেফাক ১৫ আগস্ট ২০০৮

পনেরােই আগস্ট তারিখটিকে কেন বঙ্গবন্ধু-হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল- আবদুল গাফফার চৌধুরী

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুব ভােরে লন্ডনের বাসায় আমি তখনাে বিছানা ছেড়ে উঠিনি। ঠিক এই সময় খবরটি প্রচারিত হল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর নেই। তাকে ওইদিনই বাংলাদেশ সময় শেষরাতের দিকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথম বেতারে প্রচারিত হয়েছিল শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। বেলা দুপুর না-গড়াতেই খবর পেলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তার পত্নী, ভাই, তিন ছেলে (ছােটছেলে রাসেলের বয়স তখন ১০ বছর ।), দুই ছেলের নববিবাহিত বউ, ভাগ্নে ও ভগ্নীপতিতাদের পরিবারের অনেক সদস্য কেউ নেই। বেঁচে গেছেন মাত্র তার দুই মেয়ে। তারা তখন বিদেশে। এমন নৃশংস ও বর্বর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ঘটতে পারে, তা আগে কেউ কল্পনা করতে পারেনি।

১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ভারত তখন বাংলাদেশের সবচাইতে বড় মিত্র দেশ। ওইদিন সন্ধ্যায় লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাস স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটা রিসেপশনের আয়ােজন করেছিল। লন্ডনে বসবাসকারী বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে আমিও এই রিসেপশনে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আমরা কেউ যাইনি। ঢাকায় এতবড় রক্তাক্ত পরিবর্তন ঘটার খবর শােনার পর কোনাে আনন্দ-উৎসবে যােগ দেয়ার মতাে মনের অবস্থা আমাদের কারােরই ছিল না। পরদিন লন্ডনের ইন্ডিয়া উইকলি’র তৎকালীন সম্পাদক লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ড, তারাপদ বসু আমাকে টেলিফোন করলেন। বললেন : গত সন্ধ্যায় আমাদের ইন্ডিপেন্ডেন্টস ডে-র অনুষ্ঠানে তােমাদের কাউকে দেখলাম না। আমিও আশা করিনি, তােমরা আসবে অথবা আসতে পারবে। সেজন্য তােমাকে টেলিফোন করিনি। মুজিব-হত্যার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে, তােমাদের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার জন্য হত্যাকারীরা কেন বেছে বেছে ভারতের স্বাধীনতা দিবসটিকেই বেছে নিল?

প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছিল। কিন্তু মহাশােকের আধিক্যে প্রশ্নটা মনে

তথনাে তেমন বড় হয়ে ওঠেনি। ভাই ও বসুকে বললাম, প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছে। তবে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ এখনাে পাইনি।

। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। যদি কোনাে জবাব খুঁজে পাই তােমাকে জানাব। তুমিও এ সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্তে এলে আমাকে জানিও।

তথাস্তু বলে টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু একটা কথা স্মরণ হতেই চমকে উঠলাম। স্মরণ হল লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় গতকাল ১৫ আগস্টের সংখ্যায় একটা ডাবল কলাম বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটির শিরােনাম ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—“মিনি ডিক্টেটর মুজিবকে উৎখাতের ডাক।” বিজ্ঞাপনের ভেতরে শেখ মুজিবকে স্বৈরাচারী, গণনির্যাতনকারী, রক্ষীবাহিনীর সাহায্যে ফ্যাসিসট কায়দায় দেশ শাসনকারী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে। তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ডাক দেয়া হয়েছে। কারা এই ডাকটি দিয়েছেন তাদের নাম নেই। কেবল লন্ডনের একটি ঠিকানা দেয়া হয়েছে এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে-“বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণকামী।”

‘টাইমস’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া এই বিজ্ঞাপনটি ১৫ আগস্ট (১৯৭৫) দুপুরেই আমার চোখে পড়েছিল। কিন্তু মন তথন শােকে এক অভিভূত এবং ঢাকার পরবর্তী ঘটনাবলি জানার জন্য এতই উদগ্রীব যে, তাকে কোনাে গুরুত্ব দেইনি। লন্ডনেও বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক লােক তখন মুজিববিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। তারা গােপন প্রচারপত্রও বিলি করত। সুতরাং এই বিজ্ঞাপনও তাদের কাজ মনে করে কোনাে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়ােজন মনে করিনি। | কিন্তু মনে শােকের প্রাবল্য কমতেই এবং একটা দিন চলে যেতেই বিজ্ঞাপনটির কথা আচমকা মনে পড়ল এবং আগের দিনের ‘টাইমস’ পত্রিকাটি বের করে। বিজ্ঞাপনটি আবার পড়লাম। উ, বসুর মতো আমার মনেও প্রশ্ন দেখা দিল । বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার জন্য ঘাতকের ১৫ আগস্ট দিনটিকে বেছে নিল কেন? সবচাইতে বড় কথা, তারা কি নিশ্চিত হয়েছিল যে, ১৫ আগস্ট তারিখেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানাে সম্ভব হবে? নইলে লন্ডনের কাগজে এই তারিখেই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের জন্য তারা আগে স্পেস বুকিং দিয়েছিল কীভাবে? | আমি নিজেই এ ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ‘টাইমস পত্রিকার অফিস তখন সেন্ট্রাল লন্ডনের গ্রেজ ইন রােডে। সেই অফিসে গিয়ে বিজ্ঞাপনটি কারা দিয়েছেন, কবে দিয়েছেন তার খোঁজ নিয়েছিলাম। টাইমসের বিজ্ঞাপন বিভাগ এই ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। আমি ওই বিজ্ঞাপনদাতাদের কেউ নই জেনে বললেন, এই ব্যাপারে আমাকে কিছু জানাতে তারা অপারগ।

| এর একবছর পর লন্ডন থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘বাংলার ডাক কাগজে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লেখা আমার এক কলামে এই

বিজ্ঞাপনটির কথা উল্লেখ করি। আরও কিছুকাল পর লন্ডনে বসবাসকারী বাংলাদেশের প্রবীণ সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক আবদুল মতিন যখন বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি বই লিখতে শুরু করেন, তখন আমার পুরােনাে লেখা থেকে এই বিজ্ঞাপনটির কথা উল্লেখ করেন এবং তিনি নিজেও বিজ্ঞাপনটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। এবার “টাইমস’ পত্রিকায় অফিসে গিয়ে বিজ্ঞাপনটির সম্পর্কে তথা সংগ্রহে আমার অসুবিধা হয়নি। ঘটনাটি বহু পুরােনাে বিধায় টাইমস-এর বিজ্ঞাপন বিভাগ এ সম্পর্কে আমাকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানাতে সাহায্য করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক বছর পর এই বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ব্যাপারে যে তথ্যটি জেনে আমি বিম্বিত হই, তা হল টাইমস-এ বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ডাক দেয়ার বিজ্ঞাপনটি দেয়া হয়েছিল ৬ আগস্ট তারিখে জাপা হওয়ার জনা। পরে তড়িঘড়ি ভারিখ সরিয়ে ১৫ আগস্টে নেয়া হয়। যারা বিজ্ঞাপনটি দেয়ার জন্য টাইমস’ পত্রিকার কন্ট্রা ফ েসই করেছিলেন তাদের একজন ছিলেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা সাপ্তাহিকের মালিক-সম্পাদক। তিনি খন্দকার মােশতাকের খুবই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। পরে মােশতাকের দল ছেড়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যােগ দিয়ে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তাঁর মন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই দুরারােগ্য ক্যান্সার রােগে মারা যান।

আমার মনে সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধিৎসা তখনই প্রবল হয়ে ওঠে যে, লন্ডনের কাগজে যে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হওয়ার কথা ছিল ৬ আগসট (১৯৭৫) তারিখে, সেটিকে ১৫ আগষ্ট ভারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে নেয়া হয়েছিল কেন? পরে এই প্রশ্নটির জবাব পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কোনাে কোনাে সূত্র থেকে। তারপর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা যখন শুরু হয় তখন কোনাে কোনাে অভিযুক্তের জবানবন্দি থেকেও বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে।

১৯৭৫ সালের ৮ আগস্ট তারিখে চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় একটি উপগ্রহ যােগাযােগ কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য বঙ্গবন্ধুর সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। ঘাতকেরা প্রান করেছিল তাকে চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় অ্যাম্বুশ করে হত্যা করা হবে। পরিকল্পনাটি পরে পাল্টানাে হয় এবং ১৫ আগস্ট তারিখে ঢাকায় বাসভবনেই তাঁকে সপরিবারে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। লন্ডনে হত্যাকারীদের সমর্থকদের তারিখ পাল্টানাের কথা জানিয়ে দেয়া হলে তারা বিজ্ঞাপনটি প্রকাশে দিনটিও পাল্টে দেন। | এরপরও একটি প্রশ্ন আমার মনে থেকে যায়, যে প্রশ্নটি ১৫ আগস্টের ঘটনার পরদিন “ইন্ডিয়া উইকলির’ সম্পাদক ড. তারাপদ বসু আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন । ১৫ আগস্ট তারিখটি ভারতের স্বাধীনতা দিবস জেনেও হত্যাকারীরা কেন ওই তারিখটিকেই বেছে নিয়েছিল? এই প্রশ্নটির সঠিক জবাব এই দীর্ঘকালেও আমি জানতে পেয়েছি তা বলতে পারব না। কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরে হত্যাকারীদের

নেতৃস্থানীয় কারাে কারো কথাবার্তা, সাংবাদিকদের দেয়া সাক্ষাৎকার এবং তাদের দ্বারা গঠিত ফ্রিজম পার্টির নেতা ও মুখপত্রটির প্রচার-প্রােপাগান্ডার থৱন সেখ বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত এবং হত্যাকাণের দিনটি অনেক ভেবেচিন্তে নির্ধারণ করা হয়েছিল। | মুজিবহুত্যার বহুপূর্বেই লন্ডনে বাংলাদেশের কিছু স্বাধীনতাবিরােধী ব্যক্তিকে জড়ো করে একটি চক্র গড়ে তোলা হয়েছিল। তার প্রধান নেতা ছিলেন ব্যারিস্টার আক্কাস আলি নামে বাংলাদেশের এক আইনজীবী। তিনি পাকিস্থানী এবং প্রচণ্ড ভারত-বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। তার নেতৃত্বে লনস্কিতিক একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার গঠন করা হয়। এরা নিয়মিত লিফলেট, বুকলেট প্রকাশ করতেন এবং ‘আলহেলাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি এখনাে আছে।

এই পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশী চক্রটিকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সর্বপ্রকার সমর্থন ও সাহায্য যুগিয়েছেন বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক নেতা মাহমুদ আলী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে) পালিয়ে যান এবং পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভায় যােগ দেন। এরপর পাকিস্তানে বহুবার সরকার। পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু মাহমুদ আলী প্রতিটি সকাৱে মন্ত্রী থেকে গেছেন। তার। প্রধান কাজ ছিল লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরােধী স্বভূষন্ত্রের একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার ব্যাপারে ইসলামাবাদে বসে সর্বপ্রকার আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য যােগানাে। এ কাজে জন্য তিনি মাঝে মাঝেই জনে আসতেন। এখানে এসে তার সমর্থকদের নিয়ে সভা করে বাংলাদেশের স্বাধীনকালাভৰু ভারতে ঔপনিবেশ হওয়া এবং শেখ মুজিবকে তাকানে তাবেদার বলে অভিযােগ তুলে বক্তৃতা করছেন। তার প্রধান শ্লোগান ছিল-“ভারতের দাসত্বের জিঞ্জিরা ভাতে হবে, আঁবেদার মুজিবকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হবে।”

মাহমুদ আলীর পাশাপাশি লড়না পাকিস্তানের দূতাবাসের গােয়েন্দা-চও বাংলাদেশবিরােধী চক্রান্তের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য যোগাতে থাকে। এই ব্যাপারে সউদি-কানেকশনের আজ্ঞাস পাওয়া যায়। সউদি অর্থসাহায্যে ব্রিটেনে পলাতক জামায়াত সদস্য এবং একাতরে জাপাধী এবং ঘাতকদের বেশ কয়েকজন শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। তাদের প্রচারণার প্রধান টার্গেট ছিল মুজিব সরকার এবং ভাস্ক। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন যে সহযােগিতা ও শৈলী গড়ে ওঠে তা ভাঞ্চন্তে পারলেই বাংলাদেশে মুজিব-সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব বলে তারা ধরে নিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে তারা বাংলাদেশে বন্যা। এ দুর্ভিক্ষ হওয়ার জন্য ভারতকে দায়ী করে এবং তাদের প্রচারপত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার কিন্তু আগেই কৰিমৰাণী করা হয়, শীই বাংলাদেশ মুজিব-সরকারকে উৎখাত করে ভারতের তাঁবেদারির অবসান ঘটানাে যাবে।

নানা তথ্যসূত্র থেকেই আমি জানতে পেরেছিলাম যে, পাকিস্থানের সামরিক অপ্তার গােয়েন্দাচক্রের অনুমােদনক্রমেই বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে ১৫ আগষ্ট তারিখটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই হাতটিকে একটু মুচড়ে দিয়ে প্রতিশােধ গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, ভাতের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ-উৎসবে বাংলাদেশের মানুষ যাতে আর কোনােদিন প্রসন্নয়নে যােগ দিতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। একই দিনে ভারতে স্বাধীনতা দিবসে আনন্দ-উৎসব এবং পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশে জাতি গভীর শােক দিবসের বেদনাবিধুর পরিবেশ। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবেশীর আনন্দে সাগ্রহে শরিক হবে, না নিজেদের গভীর শােকে নীরবে অথবা প্রকাশ্যে অশ্রুপাত করবে? | বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য কেবল ১৫ আগস্ট তারিখটিকেই বেছে নিয়ে খুনীচক খুশি থাকেনি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা বাটিয়ে দিয়েছিল ভারত শেখ পরিবারকে উদ্ধার করার জন্য শেষমুহূর্তে একটি সামরিক হেলিকপ্টার ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেটি ঢাকায় অবতরণ করতে না পেরে পালিয়ে যায়। ঢাকার বহু কাগজে বড় করে এই খবরটি প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে জানা গেছে, খবরটি ছিল সর্বৈৰ মিথ্যা। শেখ মুজিবকে ভারতের তাবেদার এবং ভারত বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী এটা প্রমাণ করার জন্য এই মিথ্যা প্রচারণাটি চালানাে হয়েছিল।

এই দােলােকেশনের ভুলেও দিল্লির তৎকালীন আচরণ দেশেই অনেক মানুষকে বিস্মিত করেছে। আশকার মােশতাক মুজিব হত্যা করে পালের গােদা এবং তার সরকার কয়েকজন খুনী মেজরের সমর্থননিৰ্তর জেনেও বঙ্গভবনে জুটে গিয়ে প্রশ্নকার মােশতাকের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন এবং তার সরকারকে মেনে নেন। জেনাজেল জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদটি দখল করেন, তখন স্বয়ং ভারতের রপতি তাকে স্বাধীনতার ঘােষক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপতি’ বলে সার্টিফিকেট দেন এবং জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বলা হয়, তিনি হচ্ছেন অন্ধকার মেঘে চিকন আলাের রেখা।” ভারতে রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে দুদেশেরই অনেকে মনে করতেন, বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের প্রকৃত পেইন হচ্ছে দিল্লির কংগ্রেস সরকার। অনেক পরে এরশান সম্পর্কে রাজীব গান্ধীর

ঢাকায় জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদ, এরশাল থেকে খালেদা জিয়া, এদের প্রত্যেকটি সন্ত্রকার নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে ভারত-বিদ্বেষের কার্ডটি ব্যবহার করেছেন। তাতে বাংলাদেশের জাৰ্তীয় স্বার্থের কল্যাণ হয়নি। বরং অকল্যাণই হয়েছে। জাতির জনক হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা নিয়েও প্রত্যেকটি সামরিক ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকার দাবার চাল চেলেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে

নিয়ে তাঁর দেশের মানুষের মনে যে ক্রমবর্ধিত আবেগ ও ভালােবাসা কাকে মানুপুলেট করে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।

জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসার পর আওয়ামী লীগারদের সমর্থন সংগ্রহের আশায় প্রলােভন দেখিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘােষণা করতে যাচ্ছেন। এ সম্পর্কে তার ঘােষণার খসড়াও নাকি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তারপর কী এক রহস্যময় কারণে সেই ঘােষণা প্রচার স্থগিত হয়ে যায়। তারপরই শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিকৃতির অপচেষ্টা। জেনারেল এরশাদও ক্ষমতা দখলের পর এমন ভাবসাব দেখাতে শুরু করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে সরকারিভাবে জাতির পিতা ঘােষণা মাত্র দিনক্ষণের ব্যাপার। কিন্তু তার প্রায় দীর্ঘ ১০ বছরের শাসনামলে দেখা গেল তিনি নিজেকে নিজেই ‘পঞ্জীবন্ধু’ খেতাব দিয়ে জাক্তির একমাত্র ত্রাণকর্তা সাজার চেষ্টা করছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করা দূরের কথা, অন্যতম প্রধান খুনী কর্নেল (অব.) ফারুককে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বদ্বিতা করারও সুযোগ দিয়েছিলেন। তার আমলেও ভারত বিরােধী প্রচারণা জোরেশােরে চলতে দেয়া হয় এবং যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাে হয় তার পেস্থানে ছিল তার সরকারের প্রত্যক্ষ মদল। | খালেদা-নিজামী সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা রক্ষা দূরের কথা, তাঁর ছবির অমর্যাদা, তার নামাঙ্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বদল, জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁর সমমর্যাদার জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানের নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চালানাে হয়। পাশাপাশি চলতে থাকে তার বিদ্বেষ প্রচার এবং আওয়ামী লীগকে ভারতের সেবাদাস’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনবরত প্রচারণা।

বর্তমান বছরে ১১ জানুয়ারির পটপরিবর্তনের পর অবশ্য এই অবস্থার কিছুটা বদল হয়েছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধুর অলিনে তার টুঙ্গিপাড়ার সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং আজ (১৫ আগস্ট) মৃত্যুদিবসেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা দুজনেই টুঙ্গিপাড়ায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য যাবেন।

অন্যদিকে সেনাপ্রধান বেশ কিছুকাল আগেই স্বীকার করেছেন, জাতির জনক এবং জাতীয় নেতাদের এতদিন যথাযােগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এখন তারা তা দেনে। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নাম মর্যাদার সঙ্গে সংযােজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতবিদ্বেন্ধী প্রচারের মাত্রাও এখন খুব কম। কিন্তু অতীতের নজির টেনে অনেকেই বলছেন, এই অবস্থাটা কতদিন বজায় থাকবে, তা দেখার বিষয়। নাকি পেছনে আবার অদৃশ্য কলকাঠি নড়ে উঠবে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট আর অঞ্জীতের মতাে বদলে যাবে। এ-সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনাে আসেনি।

বঙ্গবন্ধুর স্বঘােষিত খুনীদের আপিল মামলার শুনানি বহু টালবাহানার পর আবার শুরু হয়েছে। অনেকের ধারণা, এই মামলায় কী রায় হয় এবং খুনীদের দণ্ড বহাল থাকলে তা কীভাবে কার্যকর করা হয় তা দেখার জন্য এখন অপেক্ষা করাই ভালাে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মামলার শুনানির পরিণতি কী পাড়ায়, সেটাই হবে বর্তমান সরকারের চরিত্র-বিচারের সেরা মাপকাঠি।

আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ১৫ আগস্ট তারিখটিকে বেছে নিয়েছিলেন এবং লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তারা অনেকেই এখনাে বেঁচে আছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের সমর্থকদের যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। এবারের পনেরােই আগস্টেও দেখা যাচ্ছে, তাদের অবস্থান মােটেও দুর্বল হয়নি।

জনকণ্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৭

স্বাধীনতা দিবসে মুজিবের কথা – মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

৭ মার্চ ১৯৭১ শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে যে আওয়াজ তােলেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তা এক অপ্রতিরােধ্য গতিতে স্বাধীনতার ঘােষণায় পূর্ণতা লাভ করে। তবে যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঘাটতি দিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম গত সাঁইত্রিশ বছরে তা সম্পূর্ণ দূর হয়নি। স্বাধীনতাযুদ্ধ শেখ মুজিবের নামে পরিচালিত হয়। ৬ জানুয়ারি ১৯৭১ পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিব মুক্ত হন। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ লন্ডন ও নয়াদিল্লি হয়ে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এক নৃশংস হামলায় তিনি সপরিবারে নিহত হন। বিভিন্ন। স্বাধীনতা দিবসে প্রদত্ত শেখ মুজিবের কিছু কথা নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের এই রচনা।

প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশন মারফত শেখ মুজিব স্বাধীনতা অর্জনের পথে যে লক্ষ লক্ষ বীর শহীদ হয়েছেন, তাদের জন্য গভীর বেদনাপুত মন নিয়ে শােকাতুর দেশবাসীর সাথে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার দরবারে মাগফেরাত কামনা করেন। সেইসঙ্গে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিবাহিনীর সকল অঙ্গদল তথা বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যবৃন্দ, নির্ভীক যুবক, ছাত্র, কৃষক-মজদুর-বুদ্ধিজীবী এবং সংগ্রামী জনসাধারণকে অভিন্দন জানান। শেখ মুজিব মনে করেন, মুক্তিসংগ্রামের অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তিপাগল জনতার চেতনাকে উদ্ভাসিত করবে। তিনি বলেন : “আজ আমি যখন আমার সােনার বাংলার দিকে তাকাই দেখতে পাই যুদ্ধবিধ্বস্ত ধূসর পাণুর জমি, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ। আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন ও পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধার ফরিয়াদ । আমাদের স্বাধীনতা যদি এদের আশানিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে একমুষ্টি অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বােনের বেদনা, তাহলে সে স্বাধীনতা মিথ্যা, সে আত্মত্যাগ বৃথা।’ তিনি ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নততর জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিলেন। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত স্বাধীন জাতির জন্য সম্পূর্ণ অনুপযােগী একটি প্রাদেশিক

প্রশাসনিক কাঠামাে বদলে তিনি নারী এবং নতুন সমাজাের উপযােগী করে সমগ্র প্রশাসনযন্ত্রকে পুনর্গঠনের কথা বললেন। | শেখ মুজিব দেশের পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা দিয়ে বললেন । আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জোটবহির্ভূত ও সক্রিয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে চিত। বৃহৎ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাইরে আমরা শান্তিকামী। আমরা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেউ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করব। কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিষ্কন্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সব জাতির সমমর্যদার নীতিতে আহাশীল। অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করবেন না এটাই আমাদের কামনা।

তিনি মনে করেন, ‘হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে গেছে তাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে দশ বছর সময় দরকার। আমাদের বিপ্লবী সরকার আশা করছে ৩ বছর সময়ের মধ্যে এ কাজ সমাধা করবে।’

মজুদদারদেরকে শিয়ার করে শেখ মুজিব বলেন, “বিপুল খাদ্যঘাটতি আমাদের অন্য এক দুঃসহ অভিশাপ। কিন্তু আমি কাউকে না-খেয়ে মরতে দিতে চাই না।”

তিনি বলেন, অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পাটি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়ােজনের প্রেক্ষিতে পুরােনাে সামজিক কাঠামােকে ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে।

তিনি বলেন, শ্রমিক প্রতিনিধিদের সভায় শ্রমিক-সংক্রান্ত সরকারি নীতি এবং বিপ্লবী নীতিগুলো বাস্তবায়িত করতে তাদের যে পূর্ণ সহযােগিতা লাগবে সে-বিষয়ে আলােচনা করা হবে। এ ব্যাপারে পূর্ণ মতৈক্যে পৌছানাের পর শ্রমিকনেতারা সরকারের সঙ্গে একযােগে কাজ করবে এবং বিপ্লবী নীতিগুলাে সরাসরি শিল্প এলাকায় কার্যকর করবে।

শেখ মুজিব বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব সাধনের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশসহ তিনি একটি শিক্ষাকমিশন গঠন করতে চলেছেন।

তিনি চাষিদের স্বল্পমেয়াদি সাহায্যদানের জন্য ইতিমধ্যে বিবস্থা গ্রহণ করেন। ২৫ বিঘার কম জমি যাদের আছে তাদের খাজনা চিরদিনের জন্য মওকুফ করা হয়। ইতিপূর্বে সব বকেয়া খাজনা মাফ করা হয়। তাকাৰি ঋণ বাবদ ১০ কোটি টাকা এবং ১৬ কোটি টাকা টেস্ট রিলিফ হিসেবে বিতরণ করা হয়। লবণের ওপর থেকে কর তুলে দেওয়া হয়।

শেখ মুজিব বললেন, কুটিরশিল্পকে বেকারসমস্যা সমাধানের উপযােগী করে জনসাধারণের নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়ােজনের চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে কুখ ও শিল্পোন্নয়নে সহায়ক হিসেবে গড়ে তােলা হবে। শশান বাংলাকে সােনার বাংলা করে গড়ে তুলতে হবে, যে বাংলায় আগামীদিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। শােষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে নিশ্চয়ই সকলে তার সঙ্গে সহযােগিতা করবে।

১৯৭৩ সালের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ৫৪৬ জনকে খেতাব প্রদান করেন।

১৯৭৪ সালের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে শেখ মুজিব চিকিৎসাধীন অবস্থায় মস্কো। থকে তার এক শুভেচ্ছা-ভাষণে বলেন । | ‘আজ আমি অনেক দূরে, মস্কো বারভিকা ক্লিনিকে অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছি। এই দিনে আপনাদের কাছে থাকিতে পারিলাম না। এইজন্য নিশ্চয়ই আমি মনােকষ্ট ভােগ করিতেছি। আমার মনে পড়ে লক্ষ লক্ষ শহীদের কথা, লক্ষ লক্ষ মাবােনের কথা, যাহাৱা নির্যাতিত-অত্যাচারিত হইয়াছেন। লক্ষ লক্ষ বাপ, মা, ভাইদের কথা—যাহারা আপনজনকে হারাইয়াছেন, শয্যায় অসুস্থ অবস্থায় সবসময় তাহাদের কথাই আমার মনে পড়ে। আর মনে পড়ে আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের কথা। আমি আজ আমাদের কাছে বেশি কিছু বলিতে পারি না। ডাক্তারের হুকুম নাই আমার বেশি কথা বলার। শুধু এইটুকু বলিতে চাই যে, রক্তক্ষয়ী সগ্রামের ভিতর দিয়া বহু ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা পাইয়াছি। এই স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশের জনসাধারণের।…আজ এই দিনে আমার যে আফসােস, একদল লােক যাহারা বিদেশিদের হাতের পুতুল হইয়া এবং তাহাদের এজেন্ট হইয়া বাংলাদেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার চেষ্টা করিতেছে এবং সংসাত্বক কার্যকলাপ। করিতেছে ।… আপনারা দেশের পঠনমূলক কাজে হাত দিন।… দুর্নীতি হইতে দূরে থাকুন, স্বজনপ্রীতি হইতে দূরে থাকুন, আর যাহাতে জনসাধারণ জিনিসপত্র ন্যায্যমূল্যে। পায় সেদিকে খেয়াল রাখুন। | আজ বড় কর্তব্য হইল দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটানাে। এই দিনে সকলকে আমি আবেদন করি, আপনারা দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাইবার জন্য, সােনার বাংলা গঠন করার জন্য কাজ করুন। …যে বাংলার মাটিকে আমি এত ভালােবাসি, যে বাংলার মানুষকে আমি এত ভালােবাসি, যত দূৱেই যেখানেই আমি থাকি না কেন, একটি মুহূর্তের জন্য তাহাদের কথা আমি ভুলতে পারি না। আপনারা আমার বেয়াদবি মাফ করিকেন। খােদা হাফেজ। জয় বাংলা।

১৯৭৫ সালের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে শেখ মুজিব এক দীর্ঘ ভাষণে দেশের ভালোমন্দের কথা বলেন।

‘একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষকে আক্রমণ করেছিল । হাজার হাজার লাখ লাখ লােককে হত্যা করেছি। বাংলার মানুষকে আমি ডাক দিয়েছিলাম, ৭ মার্চ আমি তাদের প্রস্তুত করে নিয়েছিলাম। যখন দেখলাম আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে, সে-মুহুর্তে আবার আমি ডাক দিয়েছিলাম যে আর নয়, মােকাবেলা করাে।… বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীন করতে হবে। দুনিয়ার ইতিহাসে এত রক্ত স্বাধীনতা জন্য কোনাে দেশ দেয় নাই, যা বাংলার মানুষ দিয়েছে। বাংলাদেশ… আজ জাতিসংঘের সদস্য। বাংলাদেশ আজ জোটনিরপেক্ষ গােষ্ঠীর

সদস্য, কমনওয়েলথের সদস্য, ইসলামি সামিটের সদস্য। বাংলাদেশ দুনিয়ায় এসেছে, জীবনে যে ওয়াদা আমি করেছি জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমরা দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। আমরা ভেবেছিলাম পাকিস্ত নিরা নিশ্চয়ই দুঃখিত হবে। আমার সম্পদ ফেরত দেবে। আমি ওয়াদা করেছিলাম তাদের বিচার করব। এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাপ করেছি, তাদের আমি বিচার করিনি। আমি ছেড়ে দিয়েছি এজন্য যে, এশিয়ায়, দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম। আমি যখন বাংলাদেশ সরকার পেলাম, যখন সেল থেকে বের হয়ে এলাম, তখন আমি শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই পেলাম। ব্যাংকে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। আমাদের গােল্ড রিজার্ভ ছিল না। শুধু কাগজ নিয়ে আমরা সাড়ে সাত কোটি লােকের সরকার শুরু করলাম। আমাদের গুদামে খাবার ছিল না। গত তিন-চার বছরে না হলেও বিদেশ থেকে ২২ কোটি মণ খাবার বাংলাদেশে আনতে হয়েছে। ২২ শশা কোটি টাকার মতাে বিদেশ থেকে হেয় আমরা পেয়েছি। সেজন্য যারা আমাদের সাহায্য করছেন সেসব বন্ধুকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

| মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের বললাম, তােমাদের অস্ত্র জমা দাও। তারা আর জমা দিল। কিন্তু একদল লােক আমার জানা আছে যাদের পাকিস্তান অস্ত্র দিয়ে গিয়েছিল তারা অস্ত্র জমা দেয়নি। মানুষ-হত্যা থেকে আরম্ভ করে রেললাইন ধংস করে, ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ধ্বংস করে, জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে এমন সৃষ্টি করল যাতে বিদেশি এজেন্টরা যারা দেশের মধ্যে আছে তারা সুযােগ পেয়ে গেল। আমরা তাে কলােনি ছিলাম…আমাদের তাে সবকিছুরই বিদেশ থেকে কিনতে হয়। কিন্তু তারপরও বাংলার জনগণ কা স্বীকার করে কাজ করতে আরম্ভ করেছেন। কিন্তু তারা এগােবার দেয় না, কাজ করতে দেয় না। আর একদল বিদেশে সুযােগ পেল, তারা বিদেশ থেকে অর্থ এনে বাংলার মাটিতে বিশৃঙ্গলা সৃষ্টি করল।… | জনগণ যেদিন বলৰে বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও, বঙ্গবন্ধু একদিনও বইপতি, একদিনও প্রধানমন্ত্রী থাকবে না। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে নাই। বঙ্গবঙ্গ রাজনীতি করেছে দুঃখী মানুষকে ভালােবেসে। বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছে শােষণহীন সমাজ কায়েম করার জন্য।

দুঃখের বিষয়, তারা রাতের অন্ধকারে পাঁচজন পার্লামেন্ট সদস্যকে হত্যা করেছে, তিন-চার হাজ্জারের মশা কর্মীকে হত্যা করেছে। আরেক দল দুর্নীতিবাজ টাকা-টাকা, পয়সা-পয়সা করে পাগল হয়ে গেছে। তবে যেখানে খালি দুর্নীতি ছিল গত দুইমাসের মধ্যে সেখানে ইনশাআল্লাহ কিছুটা অবস্থা ইমপ্রুভ করেছে। প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম অব গভর্নমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন-দুজন নমিনেশন দেওয়া হবে। আমরা চাই শােষিতের গণত, আমরা চাই না শােষকের গণত-এটা পরিষ্কার।

রাজনৈতিক স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যায় যনি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না আসে। যদি দুঃখী মানুষ পেন্টি ভরে ভাত খেতে না পারে, কাপড় পরতে না পারে, যেকার সমস্যা দূর না হলে মানুষের জীবনে শান্তি ফিরে আসতে পারে না। আজ কে দুর্নীতিবাজ? যে ক ঋকি দেয় সে দুর্নীতিবাজ। যে ঘুষ খায় সে দুর্নীতিবাজ। যে স্বাগলিং করে সে দুর্নীতিবাজ। যে ব্ল্যাকমাঝেট করে সে দুর্নীতিবাজ। যে হাের্ভ করে সে দুর্নীতিবাজ। যারা কর্তব্য পালন করে না তারা দুর্নীতিবাজ। যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করে। তারাও দুর্নীতিবাজ। যারা বিদেশের কাছে দেশকে বিক্রি করে তারা দুর্নীতিবাজ। এই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আমাদের সাম সুরু করতে হবে। সরকারি আইন করে কোনােদিন দুর্নীতিবাজদের দমন করা সম্ভব নয় জনগণের সমর্থন জাঙ্কা। আজকে আমি বলৰ বাংলার জনগণের এক নম্বর কাজ হবে, দুর্নীতিবাজদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।… কেমন করে করতে হবে? আইন চালাব, ক্ষমা করব না। যাকে পাব ছাড়ব না। এমন আন্দোলন করতে হবে যে ঘুষখাের, যে দুর্নীতিবাজ, যে মুনাফাখাের, যে আমার জিনিস বিদেশে চােরাচালান দেয় তাদের সামাজিকঞ্জাবে বয়কট করতে হবে। পাকিস্তান সন নিয়ে গেছে, কিন্তু এই চোরাগুলোকে তারা নিয়ে গেলে

| ভিক্ষুকজাতির ইজ্জত নাই। আমি সেই ভিক্ষুকজাতির নেতা থাকতে চাই

।…আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক অযকভাইয়ের কাছে, যারা সত্যিকার কাজ করে। যারা প্যান্টপরা, কাপড়পরা ভদ্রলােক, তাদের কাছেও চাই-জমিতে যেতে হবে, বল ফসল করুন। ভিক্ষুকের মতাে হাত পাততে হবে না। আমি পাগল হয়ে যাই চিন্তা করে। এ বছর ‘৭৫ সালে আমাকে ছয় কোটি মণ আবার আনতে হবে। # কত মানুষকে ভাব? কী করে অন্যান্য জিনিস কিনব? ব্রামাদেব স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে পায়ের ওপর দাঁড়াতে হবে জাতি হিসেবে।…’

চারটি বড় সমস্যার কথা উল্লেখ করে শেখ মুজিব বলেন ।

‘এক নম্বর হল, দুর্নীতিবাজ খতম করে দুই নম্বর হল কারখানায়, ক্ষেতে, খামারে প্রোডাকশন বাড়াও; তিন নম্বর হল, পপুলেশন প্ল্যানিং চার নম্বর হল জাতীয় ঐক্য। জাতীয় একা গড়ার জন্য একদল করা হয়েছে। যারা বাংলাকে ভালােবাসে, এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মানে, সৎপথে চলে—তারা সবাই এই দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশি এজেন্ট, যারা বহিঃশকর কাছ থেকে পয়সা নােয়-এতে তাদের স্থান নাই। সরকারি কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটা অংশ। | আমরা শতকরা ২০ জন শিক্ষিত লােক। তার মধ্যে সত্যিকার অর্থে আমরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। শিক্ষিতদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন : আমি যে এই দুর্নীতির কথা ফললাম, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না আমার শ্রমিক? না। তাহলে দুধ খায় কারা? ব্লাকমাকেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টা চালান দেয় কারা?

হেঃ করে কারা? এই আমরা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত… রাতের অন্ধকারে খবরের কাগজের কাগজ ব্ল্যাকমাঝেটং করে সকালবেলা বড় বড় কথা লেখাৰ নাম নাই । হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মদ খেয়ে অনেস্টির কথা বলার নাম নাই। আমি আপনাদের জয় নেব না। ভয় পাবেন না …পাঁচ বন্ধনের প্ল্যান এ বাংলাদেশের ৬৫ হাজার গ্রামে কোঅপারেটিভ হবে … যে বেকার প্রত্যেকটি মানুষ যে মানুষ কাজ করতে পারে তাকে ঝেঅপারেটিজের সদস্য হতে হবে। এগুলাে বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে ফার্টিলাইজার আৰে অদের কাছে, টেক রিলিফ থাকে তাদের কয়ছে, ওয়ার্ক হোম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে হানিয়ন কাউন্সিলের টাউটদের বিদায় দেওয়া হবে, তা না হলে দেশকে বাঁচানাে যাবে না।

আপনার জমির ফসল আপনি নেবেন, অংশ যাবে কো-অপারেটিভের হতে, অংশ বাবে গভর্নমেষ্টের হাতে। দ্বিতীয় থানায় থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে। এই কাউন্সিলে রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারী যেই হয়, একজন তার চেয়ারম্যান হবে। এই থানা কাউন্সিলে থাকবে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের সরকারি কর্মচারী। তার মধ্যে আমাদের কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি থাকবে, যুবক প্রতিনিধি থাকবে, কৃষক প্রতিনিধি থাকবে। আর জেলা থাকবে না, সমস্ত মহকুমা হয়ে যাবে। সেই মহকুমায় একটি করে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল হবে।…’

অগ্রাসী বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান করে শেখ মুজিব বলেন ।

“তােমরা মেহেরবানি করে যুদ্ধের মনােভাব বন্ধ করে। আরমামেন্ট সে বন্ধ করো। তােমরা অস্ত্র প্রতিযােগিতা বন্ধ করে। ওই সম্পন্ন দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে

চানাের জন্য ব্যয় হৱা। তোমরা মনে করেছে আমরা পরিব, যে দামই হােক আমাকে বিক্রি করতে হবে। এই দিন থাকবে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, আমাদের মাটি আছে, আমার সােনার বাংলা আর আমার পাট আছে, আমার গ্যাস আছে, আমার চা আছে, আমার ফরেস্ট আছে, আমার মাছ আছে, আমার লাইভস্টক আছে। যদি কেজেলপ করতে পারি ইনশাআল্লাহ, এগিন থাকবে না। তোমরা আজকে সুযােগ পেয়ে জাহাজের আঙ্কা বাড়িয়ে দাও। জিনিসের দাম বাড়িয়ে দাও। ছেলেদের আগে কতে হবে। ফেল করানােতে আপনাদের তেমন বাহাদুরি নাই, পাশ কালো বয়সুরি আছে।’ | শিক্ষকদের উদ্দেশ করে শেখ মুজিব বলেন, ‘আবার আমার ওপর রাগ করেন।

বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমি বুদ্ধিজীবীদের কিছু বলি না। তাদের শুধু সম্মান করি। শুধু এইটুকুই বলি যে, বুদ্ধিটা জনগণের খেদমতে বায় করুন। এর বেশি কিছু বলি না। বাবা, ওঁদের কিছু বলে কী বিপদে পড়ব। আবার কে কী বই লিখে বসবে? খালি সমালােচনা করলে লাভ হবে না।’ | যুবকদের উদ্দেশ করে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি যে কো-অপারেটি করতে যাচ্ছি গ্রামে গ্রামে এর ওপর বাংলার মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করবে। আপনাদের ফুলপ্যান্টটা একটু হাফপ্যান্ট করতে হবে। পাজামা ছেড়ে একটু লুঙ্গি পরতে হবে। | তিনি বলেন, বিচার বিভাগকে নতুন করে এমন করতে চেষ্টা করেছেন যে, থানায় ট্রাইব্যুনালে মানুষ এক বছর বা দেড় বছরের মধ্যে বিচার পায়।

সবশেষে তার চারটি প্রােগ্রামে কো-পারেটিভ, থানা কাউন্সিল, সাব-ডিভিশনাল কাউন্সিল এবং ফসল দ্বিগুণ করার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “আর আমি যে আপনাদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ফসল চেয়েছি, জমিতে যে ফসল হয় তার ডবল, কলকারখানায় কাহ। সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, একটু ইনডিসিপ্লিন এসে গেছে। অফিসে যান, কাজ করেন। আপনাদের কষ্ট আছে, আমি জানি। দুঃখী মানুষ আপনারা। আপনারা কাজ করুন। তাদের পেটে খাবার নাই। তাদের ওপর ট্যাক্স বসিয়ে আমি আপনাদের পুষতে পারব না। এই কথাগুলাে আমি বললাম, আপনারা আমাকে সমর্থন করেন কি-না, আমার ওপর আপনাদের আস্থা আছে কি-না, আমাকে দুই হাত তুলে দেখিয়ে দিন ।…ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে।’

উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত দরিদ্র এবং অর্থনৈতিক দুর্বলতা সত্ত্বেও আমাদের দুর্নীতিপরায়ণতার জন্য আমরা আজ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি শেখ মুজিবকে প্রায় হুবহু ওই অবস্থায় মােকাবেলা করতে হয়। ভাৱ সময়কার দেশের আর্থিক অবস্থা ছিল আরাে খারাপ। আজ দেশের আর্থিক অবস্থা গত দুই দশক ধরে উল্লেখযােগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনের ফলে অনেক ভালাে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন ছিল তেমনি আছে। আমাসের খাসলতেও তেমন কোনাে উন্নতি দেখছি না। দেশের জন্য আমরা সােসাহে “জয় বাংলা’ বলেই বুক বাঁধব।

আমি অফ আছেন আপনারা হয়ে

সমকাল ২৬ মার্চ ২০০৮
ওই মহামানব আসে

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম যতদিন রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান/ততদিন রবে কীর্তি

তােমার শেখ মুজিবুর রহমান। অন্নদাশঙ্কর রায়। মহাকালের অমৃত সন্তান, তাঁর আবির্ভাবের এই পুণ্য দিবসে, তাঁর উদ্দেশে জানাই আমাদের যত আবেগের, ভালােবাসার, বিনীত শ্রদ্ধা নিবেদন। একই সঙ্গে আরাে যােগ করে নিই—এবং কী যে অনন্য গর্ব-অহঙ্কার আমাদের, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জন্মেছিলেন তিনি এই বঙ্গে। তারপর এ যেন অনিবার্য ইতিহাসেরই বিধান নির্দেশক্রমে উত্তরিত হয়ে গেলেন প্রতীকী সত্তার অমর ভাস্বর অবস্থানে।

অৰকাশ পাওয়া গেছে, প্রসঙ্গত জানান দেওয়ার ভারি বাসনা-আত্মশ্লাঘায় ক্ষীত হই, আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই লালন তার সঙ্গে সমকালে; বিগত শতকের সেই চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে সড়কযাত্রার কাতারে; নিশানবরদার মুজিব ভাইয়ের নেতৃত্বে। কী জানি, তখন কী অমন সচেতন বােধে ছিল, বরাবর কোন্ সীমান্তে আমাদের ঠিকানা, যেখানে বিশ্বমানচিত্রে মুক্ত স্বাধীন আরেক ‘নেশন স্টেট’ বাংলাদেশ? এখন আজকের এই দিনে পেছন ফিরে তাকিয়ে স্পষ্টই তাে অবলােকন করছি—একসময়কার ছাত্রকর্মী, ছাত্র-যুবনেতা সেই তিনি কখন যে ‘মুজিব ভাই’ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু এবং অতঃপর ‘বাংলাদেশ-বাঙালিত্বের স্থপতি, জনক পিতা। বেশ স্মরণে আনতে পারি, সংকটের মােকাবিলায় এ যে তারই ঈমানের উচ্চারণ ঃ “সির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলব—আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। দীক্ষাপ্রাণিত কোটি বাঙালি আমাদের আর অপেক্ষা করতে হয়নি। স্বাধিকার অর্জনের লড়াইতে জঙ্গি মিছিলে-ময়দানে আমরা শামিল হয়ে গিয়েছি—দুশমন পাকিস্তানিত্বের আগ্রাসন উৎখাতের লক্ষ্যে।

দুই. পূর্বকথার জের টেনে যােগ করতে চাইছি যে, অবশ্য যথার্থ কাল-বহমানতার ভুবনে আকস্মিকতার তেমন ঠাই নেই এবং তেমনতাই, পলিত জনমানুষের মুক্তির অভিযানে মহানায়ক-নেতার ভূমিকাতে যিনি, যারা অমন অকস্মাৎই নাজেল মতাে হন না, তারা সাত আসমানের দুর্জেয় ওপার থেকে। আদপেই সাধারণ্যের সবার মাঝে, সবার সঙ্গে তাদের হয়ে হয়ে ওঠা। আর ওই সবাইকে নিয়েই সড়কযাত্রার নানা সব বাঁক পাড়ি দিয়ে দিয়ে তবে অভিযানের অর্জন।

আমরা এখানে কিন্তু আপ্তবাক্য যােজনার প্রয়াস পাচ্ছি না। সেই তারা আসলে ইতিহাসেরই ফসল, সময়ের সন্তান। এমন করে বলি-তাবং পারিপার্শ্বিকতার টানাপড়েন নির্মাণ করে থাকে তাদেরকে। এবং অতঃপর তাই থেকে পথের দিশা।

আমাদেরও তেমনই ‘মুজিব ভাই”। প্রস্তাব যে, এখন তবে উজ্জ্বল কতিপয় সাম্প্রতিক প্রতি-নিদর্শনের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পাব। এশিয়াতেই যেমন কি-না—তুরস্ক দেশ-ভূখণ্ডের আতা, কামাল আতাতুর্ক মহাচীনে পেয়ে যাই চেয়ারম্যান মাও, কমরেড মাও-সে-তুং ভারতবর্ষে বাপুজী মহাত্মা গান্ধী; দক্ষিণপূর্বাঞ্চলে ইন্দোনেশিয়াতে তিনি বাং সুক, ভিয়েতনামে আঙুল হাে, হাে-চি-মিন। | অভিমতাতেই তাে জানাচ্ছে, আপন ঘরের মানুষ মুজিব ভাই; তার অন্তর গভীর থেকে শেষ এক উৎসারণ : ‘ভায়েরা আমার’, ‘আমি তােমাদেরই লোক। এমন সরল কৱেই আরাে জানিয়ে দেওয়া ; ‘সাত কোটি বাঙালির ভালােবাসার কাঙাল আমি, আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালােবাসা হারাতে পারব না।’ | তিন, দেশ তার গােপালগঞ্জ; কুড়ির শতকের প্রথম পাদে দক্ষিণবাংলার প্রত্যন্ত কোনাে এক অখ্যাত জনপদে; গাঁয়ের নামটাও তেমনি, টুঙ্গিপাড়া। কেন জানত তখন? মাত্র তিন দশকের কাল ব্যবধানে ওই টুঙ্গিপাড়া থেকে উত্তরণ তার আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অঙ্গনে,আন্তর্জাতিক ভুবনের ক্যানভাসে অত্যুজ্জ্বল আলােকিত একক এক চরিত্র। আপাতত জোরটা দেওয়া হচ্ছে বিশেষ এই তথ্যে,খেয়াল আনব, সেইখানে বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উঠে এসেছিলেন খাটি বাাল ঘরের সন্তান শেখ মুজিব। কত না সংকটের মােকাবেলা করে করে এবং কদাপি আপসের কাছে হার না মেনে, পত্রের কালে কিংবদন্তির নায়ক-নেতা, বিশ্বজুড়ে কী বিশাল ইমেজের প্রতিকৃতি তাতে। ১৯৭১এ মার্চে (২৬শের ডেটলাইনে) বিদেশি প্রেস মিডিয়া রিপাের্ট এমন বর্ণনায় জানিয়ে 1906- The making of a martyr Sheikh Mujibur Rahman: a symbol of Bengali resistance.’ বিশেষ এই চিহ্নিতকরণটা যেন অনুধাবন করে নিই। নির্দেশিত করা হচ্ছে Symbol of Bengali resistance.’কলবার যে, অতঃপর কেমন স্পষ্ট অবয়বে মূর্ত হয়ে এসেছে ইতিহাস-পর্যবেক্ষকের ভাষায় The Making of a Nation”।

জনক তিনি, বিশেষ করে আজ দিনের এই অবকাশে আমরা তাকে কাছের করে পেতে চাইছি। খল-পুত্তি-প্রতারক পাপজোটের ওরা বারংবারই জনকের মুখ বিকৃত করার ষড়যন্ত্রে, অপকাণ্ডে মেতে উঠেছে। দেশের সুসন্তানের দাবি যদি আমাদের, তাহলে এখনই সময় আপন জনককে চিনে নেব; পঞ্চেন্দ্রিয় দেহাবয়ব সার ওই মানুষটি কেবল কালজয়ী ইতিহাস হয়ে গেলেন। আন্মেগে আকুল হকজনের ‘বীর পূজা নয়, অবশ্য কবেই তাগিদ যে, আমরা সেই ইতিহাসে পাঠ নেব এবং বিশ্বাসের বিবেচনাতে রাখৰ=আমাদের জন্য বাংলাদেশ-বাত্তালি-বঙ্গবন্ধু একই ইতিহাসের ধারায় গ্রন্থিত। অতএব আমরা (ক) শেকড়ের সন্ধান নেব, (খ) কাল সমায় এবং দেশজ পটভূমির চেহারাটা বুঝে নেয়ার প্রয়াস পাব।

না, তদর্থে কিন্তু রুপাের চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে বংশপরিচিতিতে শেখ পরিবারের সন্তান; বিস্তাবস্থানে মধ্যবিত্ত শৈশব থেকে প্রথম যৌবনাবধি লালন ঘােরর মফস্বল পরিবেশে। চারিদিকজুড়ে নদীঘেরা সেই দেশাঞ্চল, দিগন্তবিস্তারী নদীচর, গ্রামীণ সৰ জনমানুষ প্রধানতই তারা তৃণমূল মাঝি, চাষী, কিষাণ। শেখৰাড়ির খােকা ছেলেটি বেড়ে উঠেছে। বিশেষ করেই খেয়ালে রাখছি, আগামী দিনের ‘বঙ্গবন্ধুর ভিত তৈরি হয়েছিল ওইখানে।

তারপর? তার পরের থেকে যেন ইতিহাস-নিয়তিরই সরাসরি ভূমিকা। আশা করব, দেশের সৎ মানুষেরা, সৎ সন্তানেরা তাৰং তা সব খুঁজে নেবেন। আজকের অবকাশে প্রাসঙ্গিক খানিকটা রূপরেখায় তুলে ধরা যাক।

| পরম্পরায় সেই সময়। কলকাতায় তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলন। এবং পরে ১৯৪৭-উত্তরকালে ঢাকায়, পূর্ববাংলায় সর্বত্র পাকিস্তানি দখলদার-হার্মাদ দস্যুদের হটানাের লড়াইতে আৱেক অগ্রপথিকের কমিটেড ভূমিকাতে ছিলেন তিনি, আমাদের মুজিব ভাই । ইতিপুর্বে বলাই তাে গেছে সেই তিনি কখন এই বাংলার কোটি মানুষের মুকুটহীন নায়ক-নেতা ‘বঙ্গবন্ধু।

এটাই ইতিহাসের দলিল।

স্মরণে আসছে অনেককাল আগে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লিখেছিলেন—’চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’; এবং আশায় প্রাণিত ঋষি কবি কি ভবিষ্যৎ দর্শন করেছিলেন’ঐ মহামানব আসে’। আমাদের কাছে কেমন যেমন মিলে যায়, এখন যখন প্রতিবাদী সংগ্রামী মানুষটিকে ওই যেন সামনেই তাে দেখতে পাই লাখ লাখ মানুষের জমায়েতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে, শক্ত মেরুদণ্ডের দীর্ঘদেহী, উন্নত শির, প্রশস্ত ললাট, আকাশপানে শূন্যে উথিত ডান বাহু-ছবিটা এবং ইমেজটা কেমন মেশামেশিতে একাকার হয়ে আসে। শুনতে পাই বিদ্রোহী কবি নজরুলের কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে সেই ডাক-বাংলার জয় হােক, বাঙালির জয় হােক’। কাল পরিক্রমণে অবশ্য এসেছে ফিরে—বঙ্গবন্ধুর আজ শুভ জন্মদিন। বিশেষ এ দিনে একান্ত করেই আমরা আশ্বাসউদ্দীপিত হতে চাই তার অমন উচ্চারিত দীক্ষামন্ত্রে । আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।’

সমকাল ১৭ মার্চ ২০০৮
বঙ্গবন্ধু, তাঁর জীবন ও রাজনীতি -জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

একেক জাতির ইতিহাসে একেক নেতার নাম, রাষ্ট্রনায়কের নাম, স্রষ্টার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হয়ে যায়। সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে লেনিনের, তুরস্কের সঙ্গে কামাল আতাতুর্কে, ভারতের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর, নয়া চীনের সঙ্গে মাও সেতুতের। নাম যেমনভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সঙ্গে তেমনি অবিচেছদ্যভাবে জড়িত আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। এ এমন এক প্রতিষ্ঠিত সত্য যে ওই সত্যকে অস্বীকার করার চেষ্টা বাতুলতার নামান্তর। দুঃখের বিষয়, লজ্জার বিষয়, সে চেষ্টাও হয়েছে এবং সে চেষ্টা করুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সে চেষ্টা কারা করেছিল, কেন করেছিল, কিছুই রহস্যাবৃত নয় আমাদের কাছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় আরােহণ করে এরা বঙ্গবন্ধুকে জাতির স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার অপচেষ্টাও করেছিল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যার দিন জাতীয় শােক দিবস সংক্রান্ত আইনি সিদ্ধান্ত ওরা বাতিল করে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিনটি উদ্যাপন বন্ধ করে দেয়। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহারে ইতিহাসেও এর মতাে সভ্যতা-শালীনতা এমনকি কাণ্ডজ্ঞান-রিহিত অপকর্মের দ্বিতীয় নজির খুঁজে পাওয়া ভার। এই শােকের দিনকে আনন্দ ও উৎসবের দিনে পরিণত করার উকট পরিকল্পনাও কারও কারও মাথায় এসেছিল। অনেক রকমের মস্তিষ্কবিকৃতি রয়েছে, তবে এই বিকৃতিও তুলনাবিহীন। | হাইকোর্টের রায়ে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শােক দিবস হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং বর্তমানে জরুরি অবস্থার সরকার এর বৈধতা মেনে নিয়েছে। দিনটি সরকারিভাবে জাতীয় শােক দিবস হিসেবে পালিত হবে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং সরকারপ্রধানসহ আরও দুজন উপদেষ্টা ওইদিন টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন, বঙ্গবন্ধুর মাজারে গিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন—সংবাদসূত্রে আমরা এ তথ্য জানতে পারলাম। এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ভেতর দিয়ে যে বার্তাটি সারাদেশ পাবে, তা হল জাতির পিতা, রাষ্ট্রের স্থপতি পরিচয়ে বঙ্গবন্ধু—এ এক প্রতিষ্ঠিত সত্য। দলীয়ভাবে এ সত্য কিছুদিনের জন্য ছাইচাপা থাকতে পারে, কিন্তু সত্যের স্ফুলিঙ্গ নেভে না।

সত্যের সঙ্গে অসত্যের বিরােধ চিরকাল। অসত্য যদি কোনােভাবে ক্ষমতায় আসে। তখন এই বিরােধটা প্রকট হয়ে ওঠে। অসত্য কখনও নিজের শক্তিতে দাঁড়াতে পারে

। তার প্রয়ােজন হয় সহায়ক শক্তির । যেমন রাজনৈতিক ক্ষমতা। রাজনৈতিক ক্ষমতার লম্বা হাত। সে হাত সংস্কৃতির নিরপেক্ষতার দুর্গ পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। বাংলাদেশে এর বড় দৃষ্টান্ত বাংলা একাডেমী । বাংলা একাডেমীর কাজ পুরােপুরি

সাংস্কৃতিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা প্রকাশনা ইত্যাদি । বাংলা একাডেমী সরকারি অর্থে পরিচালিত, যদিও বিস্তর বই প্রকাশনার সূত্রে এর নিজস্ব আয়েরও একটা উপায় আছে, তবে এর বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়ােজন হয় সরকারি অর্থ বরাদ্দের। অনেক ভালাে কাজ সম্পন্ন হয়েছে সরকারি অর্থ বরাদ্দের সুবাদে। এমনি একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলা একাডেমী দেশের পাঁচজন জাতীয় নেতার জীবর্দীগ্রন্থ প্রকাশের যে উদ্যোগ গ্রহণ করে, বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ রচনা তার অন্তর্ভুক্ত।

বেশকিছু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত বিগত একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে দুই খণ্ডে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : জীবন ও রাজনীতি’। বঙ্গবন্ধুর ওপর এটি বাংলাভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনীর স্বীকৃতি লাভ করবে। ইংরেজিভাষায় অবশ্য ইতিপূর্বে প্রকাশিত এসএ করিমের ‘শেখ মুজিব, ট্রয়াম অ্যান্ড ট্র্যাজেডি’ এ ধারায় প্রথম বই । এক গবেষণার ফল এ বইয়ের সঙ্গে বাংলা একাডেমী প্রকাশিত দুই খণ্ডে সমাপ্ত বইয়ের তুলনা অন্য কেউ করবেন। সেজন্য যে বিশেষ যােগ্যতার প্রয়োজন, তা আমার নেই। আমি শুধু একটি মৌলিক প্রভেদের কথা বলতে চাই । ইংরেজি বইটি গ্রন্থকারের একক গবেষণার ফল, আর বাংলা বইটি একাধিক ব্যক্তির সমষ্টিগত গবেষণার ফল। এই সমষ্টির কাজ সম্পন্ন হয়েছে বা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শাহ এএমএস কিবরিয়া, যিনি ঘাতকের গ্রেনে হামলায় ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি নিহত হন। ফাউন্ডেশনের বর্তমান কর্ণধার জনাব মােনায়েম সরকার একদল গবেষকের কাজের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে সবার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বইয়ের সম্পাদকও তিনি। তার ভূমিকায় বইটির পরিকল্পনা, রচনা, তথ্য সংগ্রহ, সম্পাদনা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা স্বীকারেও কোনাে কার্পণ্য করেননি তিনি। কাউকে দোষারােপ না করে একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে তিনি জানিয়েছেন। বিভিন্ন কারণে গ্রন্থটি প্রকাশে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনীর সিংহভাগ জুড়ে থাকবে রাজনীতি, এত বিস্ময়ের কিছু নেই। সব রাজনীতিকের জীবনী বলতে তাদের রাজনৈতিক জীবনই বােঝায়। আত্মজীবনী ও এঁদের বেলায় ব্যক্তিজীবনের কাহিনী নয়। বঙ্গবন্ধুর বেলায় ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক আজীবন ছিল একটি প্রান্তবর্তী বিষয়। তিনি যে-ধরনের রাজনীতি করেছেন সেখানে রাজনীতি তার দিনরাত্রির সব প্রহর দাবি করেছে। তিনি সে দাবির কাছে নতিস্বীকার করেছেন। এর মধ্যেও তার এই জীবনীগ্রন্থে ব্যক্তি মুজিবের দেখা মেলে, কঢ়িৎ কদাচিৎ এবং কয়েকটি ব্যক্তিগত পত্রে আমরা সেই ব্যক্তিটিকে পাই। অত্যন্ত ব্যস্ত জীবনেও তাঁর পুত্র পরিচয়ে, স্বামী ও পিতা পরিচয়ে, নিকটাত্মীয়দের প্রতি স্নেহ ও প্রীতিপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে, তাঁর সমগ্র পরিচয়, কোনােদিন অজানা ছিল না দেশবাসীর কাছে। নানা সূত্রে আমরা এ বিষয়ে যা জানার জানতে পেরেছি। তার জীবনীৱচয়িতার কাছে আমাদের মুখ্য দাবি, তাঁর রাজনৈতিক জীবন তুলে ধরা-সে রাজনীতি কীভাবে তাকে গড়েছিল আর তিনি সে রাজনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন তার বিশদ উপস্থাপনা।

অবিভক্ত বাংলার ‘৩৭ (১৯৩৭)-এর নির্বাচন ও ‘৪৭-এর দেশবিভাগ এবং স্বাধীনতা এই দশকের রাজনীতি মূলত মুসলিম লীগের উত্থান ঃ সাফল্যের কাহিনী। এই সাফল্য মুসলিম লীগের একক কৃতিত্ব নয়, এর পেছনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অবদানও প্রচুর। ভারত বিভক্তির জন্য জিন্নাহ ও সয় মুসলিম গীগকে দন্ধী করার প্রবণতা এখন ক্ষান্ত। পণ্ডিত নেহক, সৱলার বল্লভ ভাই প্যাটেল পরিচালিত কংগ্রেসের দায়দায়িত্ব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ইতিহাসবিদের দৃষ্টিতে। শেখ মুজিব ওই দশকেই তার। রাজনীতি শুরু করেন মুসলিম লীগের তরুণ ও তেজি কর্মী হিসেবে এবং শইক সােহরাওয়ার্দীর নজর কাকল। তর এই রাজনৈতিক শিষ্যত্ব স্টার রাজনৈতিক চেতনার বিকাশে অত্যন্ত কার্যকর হয়েছিল। তাঁর এই শিষ্যত্ব থেকেই শেষপর্যন্ত আওয়ামী লীগের তথ্য স্বাধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বের দায় স্ত্রীর ওপর বর্তেছিল। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির এবং দেশে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির যে পাঠ তিনি গ্রহণ নচ্ছিলেন। সােবাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে, সেটা তিনি কোনােদিন ভোলেননি।

মুসলিম লীৰ দুজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ রাজনীতির উর্ধ্বতন আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনায় যারা প্রধান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁদের মধ্যে ধান। প্রাক-সাতচল্লিশ মুসলিম রাজনীতির লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর সেই লক্ষের মধ্যে যুগােপযােগী পরিবর্তন আনতে পুরােপুরি ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের শাসকরা, যারা সবাই মুখে গণতপ্রের কথা বলতেন। কিন্তু বারে গণতন্ত্রের চর্চা করেননি। পূর্বপাকিস্তানে ক্ষমতার আসনে ছিল মুসলিম লীগ, আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল তাদের। কিন্তু বছত্রের পর বছর তারা আইনসভার শুন্য আসনে কোনাে উপনির্বাচন দেয়নি। প্রথম যে উপনির্বাচন দিল লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হল মুসলিম লীগ । অর্থাৎ ইতিমধ্যে এই দল তার সংশ্লিষ্টতা হারিয়েছিল, এমনকি পূর্বপাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রের যে অবহেলা, এরও প্রতিবাদ করার নৈতিক বল হরিয়ে আসছিল।

| শেখ মুজিবের উত্থানের পেছনে যে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পটভূমি তার জীবনী যিনিই লিখুন, যেভাবেই লিখুন, সেটা গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে। সেই হতাশা ও বঞ্চনার যুগে তিনি পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান পুরুষে পরিণত হন। তাঁকে দমন করার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। সবচেয়ে মারাত্মক প্রচেষ্টা ছিল তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা। প্রবল প্রতিবাদ প্রতিরােধের মুখে এ মামলা পরিত্যক্ত হয়। এই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে তিনি যখন মুক্ত হয়ে আসেন ততদিনে তিনি বীরের মর্যাদা লা করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু’ নামে সৰ বাঙালির আশাআকাক্ষার প্রর্তীকে পরিণত হয়েছেন। যে আস্থা তার ওপর অর্পিত হয়েছিল তিনি তার মর্যাদা রক্ষা করেছেন, নিলে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় নিশ্চিত করেছিল সঙ্করের নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ায় একাত্তরে তাজউদ্দিন আহমদের সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের বৈধ সরকারের দাবি নিয়ে কথা বলার ও কাজ করার অধিকার ছিল। সন্দেহ মত্রি নেই যে, একাতরের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ভিত্তি রচনা করেছিল শেখ মুজ্জিবের নেতৃত্বে সত্তরের নির্বাচনে জয়।

স্বাধীনতার পর, রাষ্ট্রপ্রধান সরকারপ্রধানের ভূমিকায় শেখ মুজিবের কৃতিত্ব নিয়ে ঐকমত্য নেই। সৈয়দ আনােয়ারুল করিম এককথায় এই সময়কে ট্রাজেডি বলে রায় দিয়েছেন। ট্র্যাজেডি বলতেই বােঝায় নায়কের পতন। নায়কের মৃত্যু ও তার পতন একসূত্রে গাঁথা। ট্র্যাজেডির এই ব্যাখ্যা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে তার পতনের অনিবার্য পরিণতি, এই সরল ব্যাখ্যা আমাকে সন্তুষ্ট করে না। আসলেই তার পতন হয়েছিল কিনা সেটাও বিতর্কের বিষয়। আমার ধারণা তিনি ব্যর্থতার মধ্যদিয়ে বেরিয়ে আসার এক নতুন দিকনির্দেশনার দিকেই অগ্রসর হচ্ছিলেন। চক্রান্তকারীরা তাকে সে সুযােগ। দেয়নি। তার মৃত্যুর জন্য খাতকের ভূমিকা প্রত্যক্ষ হতে পারে। কিন্তু চক্রান্তকারীদের পরােক্ষ ভূমিকা পরােক্ষ বলেই গৌণ নয়। দেশে ও বিদেশে এই চক্রান্তের জাল বিস্তৃত হয়েছিল। তার হত্যা-পরবর্তী ১৫ বছরের সেনাশাসন এই চক্রান্তের পরিধি নির্দেশ করে।

একদিকে অন্ধ বিরােধিতা, অন্যদিকে অন্ধ মােহ—এই দুই প্রবণতার আকর্ষণমুক্ত হয়ে একটি বস্তুনিষ্ঠ জীবনী রচনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায় মােনায়েম সরকার সম্পাদিত গ্রন্থে। এজন্য গবেষকদেরকে সব ঘটনার উৎস সন্ধান করতে হয়েছে এবং এতকাল অজানা বেশকিছু গােপনীয় দলিল খুঁজে পেতে হয়েছে। সত্যানুসন্ধানের আন্তরিক প্রচেষ্টার এই ফসল এতদিনের একটা অভাব পূর্ণ করল, এজন্য গ্রন্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই আমাদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার পাত্র।

সুগার ১৫ আগস্ট ২০০৮

বঙ্গবন্ধু আছেন এবং থাকবেনও আমিনুল হক বাদশা আজ ১৭ মার্চ। বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি বিশেষ স্মরণীয় দিন। ১৯২০ সালের এই দিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। বেঁচে থাকলে আজ তাঁর বয়স হত ৮৮ বছর। কিন্তু ঘাতকরা তাকে বাঁচতে দেয়নি। সপরিবারে তারা তাকে হত্যা করেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আদালতের দেয়া তার ঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডাদেশের রায় আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হল না। এ লজ্জা জাতি রাখবে কোথায়? | সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই যে, বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি তার অসীম ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাহস, প্রজ্ঞা, বলিষ্ঠ এবং আপােসহীন নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতিকে অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে এক সংগ্রামী জাতিতে পরিণত করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একই আদর্শে বিশ্বাসী তাঁর একান্ত রাজনৈতিক সহচর তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রমুখ। আর ছিল বাঙালি শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রশিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ সর্বস্তরের জনগণ ।

বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন লেখক, কবি, সাহিত্যিক অনেক মন্তব্য করেছেন। আমি এখানে তাদের কয়েকজনের উদ্ধৃতি দেব।

বঙ্গবন্ধুকে একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ আখ্যায়িত করেছেন ‘পােয়েট অব পলিটিক্স’ বলে। সত্যিই তিনি ছিলেন রাজনীতির কবি। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কবি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত যেমন সাধারণ মানুষের ভাষায় কবিতা লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু সেই ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন।

তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গের ঐতিহাসিক ভাষণের সঙ্গে অনেকেই তার তুলনা করেছেন। | আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক সিডনি সেনবার্গ (বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু) মন্তব্য করেছেন যে, মুজিব বাঙালি জাতির একটি পবিত্র সম্পদ। এ পবিত্র সম্পদকে রক্ষা করার দায়িত্ব বাঙালি জাতির। | ৭ মার্চের ভাষণে আমেরিকার সিভিল লিবার্টি আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর ‘মাই ড্রিম’ ভাষণের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ নােবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও अभिनाई। | প্রখ্যাত সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘নই দ্য বিলাভ কান্ট্রি’- কাদো প্রিয় দেশ কাদে’-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, এ ক্রন্দন অন্তুরের স্বতঃস্ফূর্ত ক্রন্দন। সত্যিই আজও বাঙালি জাতি কাদছে শেখ মুজিবের জন্য। এ ক্রন্দনের শেষ নেই। এ আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

কেএম সােবহান বলেছেন, শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দীন হােসেন বলেছেন, সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষক ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সাহিত্যিক সেলিনা হােসেন বলেন, মুত্যকায় মুজিব।

স্বনামধন্য কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেছেন, শেখ মুজিব দেশকে দুবার স্বাধীন করেছেন।

ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ লর্ড ফেনার ব্রকওয়ে তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবের আপােসহীন সাহসী নেতৃত্বের জন্যই পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাঙালিরা জয়ী হয়েছে।’

মিশরের প্রখ্যাত সাংবাদিক হেইলে মিশরের প্রেসিডেন্ট আমাল আব্দুল নাসেরের জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে তুলনা করে শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেছেন যে, ‘শেখ মুজিব ইজ এ গ্রেট লিডার।’

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, জয় বাংলার মহানায়ক শেখ মুজিব।

নােবেল পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব শন ম্যাকব্রাইট শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের আত্মা’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। | এ ছাড়া ফরাসি বিপ্লবের নায়ক চার্লস দ্য গলের মতাে তার নেতৃত্ব ছিল বলে আঁদ্রে মালরো মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে আঁদ্রে মালরো জীবনের মূল্যবান সময়ে কারাবরণকারী মানবপ্রেমের যােদ্ধা অসহযােগের বীর মুজিবকে তাঁর অন্তরে কিংবদন্তির নায়কের স্থানে অধিষ্ঠিত করেছেন। নাসিবিরােধী প্রতিরােধে ফরাসি বীর মালবো আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে একজন দূৱস্থির সৈনিক ছিলেন। কী আশ্চর্য, ফরাসি আর বাঙালির মধ্যে স্বাধীনতার সেতুবন্ধন বেঁধে দিয়েছেন মালরো! আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মালরো গুরুত্বসহকারে একাত্মতা ঘােষণা করেছিলেন। তিনি একজন কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক সৈনিক। তিনি তার বর্ণাঢ্য জীবনের সব পর্বে বিশ্বাসের সত্যতা খুঁজেছেন কর্মে, বাস্তবের প্রয়ােগে । তিনি লেখনী ছেড়ে অস্ত্র ধরেছিলেন স্পেনের প্রজাতন্ত্রের পক্ষে তিরিশের দশকে। আবার সত্তর দশকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চাইলেন। কথায় নয়, একটি ট্যাঙ্ক বহরের পরিচালক হিসেবে। তখন বয়স তার ৭০ বছর। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিনি গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের পরামর্শও দিয়েছেন।

এই তথ্য আমরা হয়তাে অনেকেই জানি না। তাঁর জীবনের মতাে শেখ মুজিবও অনেকবার মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন।

বাংলাদেশে কোনাে কোনাে ক্ষমতালােভী ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার চেষ্টা করলেও বিশ্ব-ইতিহাসে যেসব জাতীয় মুক্তিনায়কের নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতাে জ্বলজ্বল করছে সেখানে বঙ্গবন্ধুর নামও আসন করে নিয়েছে স্থায়ীভাবে। এ ইতিহাস মনগড়া ইতিহাস নয়। এ ইতিহাসকে স্নান করা যাবে না। যারা ইতিহাসের সত্য থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে, কালের ইতিহাসে তারাই হারিয়ে

| ৬ দফার ম্যান্ডেট নিয়ে কার নেতৃত্বে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, কার বকণ্ঠের ডাকে আপামর জনতা মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, বাঙালি জাতির চেতনাকে সমুন্নত রাখা ও বিকাশের জন্য কার নির্ভীক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেশবাসীকে অসহযােগ আন্দোলনে চালিত করেছে, বাঙালির স্বাধীনতার জন্য ক্ষমতাকে পদদলিত করে, জনতার দাবির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার পথে বেছে না নিয়ে কে আপােসহীন সংগ্রাম করেছেন? এসব প্রশ্নের জবাবে একটিমাত্র নামই উচ্চারিত হবে ইতিহাসে—তিনি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত করার অপচেষ্টা বাঙালি জাতির অপমৃত্যুর শামিল হবে। বঙ্গবন্ধুর অভাব আজ আমরা তিলে তিলে অনুভব করছি। মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আজ যারা নানা কথা বলছে তাদের জন্য কবিগুরুর ভাষায় বলতে হয়

রথ ভাবে আমি দেব পথ ভাবে আমি, সূর্য ভাবে আমি দেব

হাসে অন্তর্যামী। তাই সবশেষে আবারও বলছি : বাঙালির প্রাণে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, আছেন, আর থাকবেনও।

জনকণ্ঠ ১৭ মার্চ ২০০৮

ঐতিহাসিক ভাষণের নেপথ্যে — ড. কামাল হােসেন

৭ মার্চ জনসভার জন্য দলীয় অবস্থান বিবেচনার উদ্দেশ্যে ৬ মার্চ শেখ মুজিবের বাসভবনে আওয়ামী লীগ নির্বাহী কমিটির সদস্যদের বৈঠক ডাকা হল। সারাদেশে প্রত্যাশা দেখা দিয়েছিল যে, ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘােষণা দেবেন। বস্তুত ছাত্র ও যুবসমাজ এ-ধরনের ঘােষণার প্রবল পক্ষপাতী ছিল। ৭ মার্চ নাগাদ দলীয় সদস্যদের মধ্যে সামান্যই সন্দেহ ছিল যে, কেবল স্বাধীনতাই একটি গ্রহণযােগ্য লক্ষ্য হতে পারে। এটা পরিষ্কার ছিল যে, ছাত্রসমাজ, যুবসম্প্রদায় এবং রাজনীতিসচেতন ব্যাপক জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনােকিছুই গ্রহণযােগ্য হবে না। কিন্তু এক্ষেত্রে দায়দায়িত্বের ভার ছিল শেখ মুজিব এবং দলের ওপরই ন্যস্ত।

৭ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণার সম্ভাব্য সার্বিক ফলাফল তাই সতর্কভাবে বিবেচনা করে দেখার প্রয়ােজন ছিল। একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার অর্থ দাঁড়াত সামরিক বাহিনীকে তার সব শক্তি নিয়ে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়তে প্ররােচিত করা। এতে তারা যে কেবল শক্তিপ্রয়ােগের ছুতো খুঁজে পেত তাই নয়, বলপ্রয়ােগে তাদের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে তারা সবকিছুর ওপর সব উপায়ে আঘাত হানত। কোনাে নিরস্ত্র জনগােষ্ঠী কি ওই ধরনের হামলার আঘাত সহ্য করে বিজয়ী হতে পারে? বহির্বিশ্বে এর প্রতিক্রিয়াই বা কী দাঁড়াবে। অন্যান্য দেশের সরকারগুলাে কি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেৰে? একটি সুসংগঠিত সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের জন্য যতদিন প্রয়ােজন ততদিন টিকে থাকতে পারবে তাে? এসব প্রশ্ন ছাড়াও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলাের বিরাজমান বিভিন্নমুখী বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক স্বার্থসমূহের কারণে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে তারা মেনে নেবে এবং স্বীকৃতি দেবে শো-অস্ত্র প্রশ্নের মধ্যে এগুলাে ছিল কয়েকটি, যা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে দেখা হল।

বৈঠকে শেখ মুজিব বিভিন্ন সদস্যের বিভিন্ন মত শুনলেন, তবে নিজের অভিমত সংরক্ষিত রাখলেন। যাবতীয় মতামতই বৈঠকে প্রকাশিত হল। ওই বৈঠক যখন চলছিল তখন তােৱে ইয়াহিয়া খান আবির্ভূত হলেন এবং একটি বিবৃতি দিলেন। বিবৃতিটি ছিল সুনির্দিষ্টভাবে উস্কানিমূলক এবং বাঙালি অনুভূতির প্রতি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক। বিরাজমান পরিস্থিতির জন্য ইয়াহিয়ার বিবৃতিতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হল। প্রকারান্তরে ভীতি প্রদর্শনের স্বরে বিবৃতিতে বলা হল : ‘পর্যাপ্ত শক্তি প্রয়ােগ করে পরিস্থিতিকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা সক্ষম জানা সত্ত্বেও আমি বিশেষভাবে বিবেচনা করেই পূর্বপাকিস্তানের কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছি যাতে লুটপাট, অগ্নিসংযােগ ও খুনখারাবি থেকে আইনভঙ্গকারীদের বিরত রাখতে শক্তি প্রয়ােগ একেবারেই কমমাত্রায় করা হয়। | হম্বিতম্বিগুলাে বাদ দিলে বার্তাটি ছিল এরকম : ইয়াহিয়া বিশ্বাস করেন পরিস্থিতির একটি সামরিক সমাধান সম্ভব এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়ােজনে তিনি যেকোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ এবং তার বিবেচনানুযায়ী প্রয়ােজনীয় যে-কোনাে মাত্রার শক্তি প্রয়ােগের জন্য নিজেকে যথাযােগ্য কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী বলেই মনে করেন। ইয়াহিয়ার বার্তায় হুকুমটি ছিল পরিষ্কার। | বেতার-ঘােষণাটি শেষ হওয়ার পর শেখ মুজিব নির্বাহী কমিটির বৈঠক ওইদিন সন্ধ্যার পর পর্যন্ত মুলতবির নির্দেশ দিয়ে বললেন, ইতিমধ্যে তিনি পরদিনের জন্য গ্রহণীয় কর্মপন্থার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। | সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই নির্ভর করছিল শেখ মুজিবের ওপর। তিনি শীর্ষস্থানীয় দলীয় নেতৃবৃন্দ তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খােন্দকার মুশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানের পরামর্শ চাইলেন। আমাকেও তাদের সঙ্গে যােগ দিতে বলা হল। খােলাখুলি স্বাধীনতা ঘােষণার ফলাফল সতর্কতার সঙ্গে হিসাব করে দেখা হল। সেনাবাহিনী একটি সামরিক হামলা চালানাের সুযােগ খুঁজছিল এবং এ-ধরনের কোনাে ঘােষণা যে তাদের সেই সুযােগটিই যােগাবে তা পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছিল। সিদ্ধান্ত হল যে, ওই সুযােগ আপাতত তাদের দেয়া উচিত হবে না। একই সঙ্গে আন্দোলনের গতি অবশ্যই ধরে রাখতে হবে এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহিয়ার ওপর চাপও বজায় রাখতে হবে। বিবেচনা করে দেখা হল, যদি আন্দোলনের জোয়ার ধরে রাখা এবং জনগণের ঐক্য জোরদার করা যায়, তাহলে ইয়াহিয়া ও সামরিক জান্তার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, সামরিক শক্তি প্রয়ােগ তাদের লক্ষ্য অর্জনে ফলপ্রসূ হবে না। কাজেই সিদ্ধান্ত হল যে, পরদিন খােলাখুলি স্বাধীনতা ঘােষণার অবস্থান নেয়া হবে না। ইয়াহিয়ার ওপর চাপ প্রয়ােগ করতে স্বাধীনতাকে চূড়ান্ত লক্ষ্য নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরা হবে এবং ওইসব দাবির সমর্থনে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। ওইসব দাবির মধ্যে থাকবে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, পশ্চিমপাকিস্তান থেকে পূর্বপাকিস্তানে আরও সৈন্য আনা বন্ধ করা এবং যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার তদন্ত করা। শেখ মুজিব নির্দেশ দিলেন, দুটি প্রধান দাবি জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। দাবি দুটি হল । অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।

৭ মার্চের জনসভার পর সংবাদমাধ্যমে দেয়ার উদ্দেশে আওয়ামী লীগের অবস্থান তুলে ধরে আমাকে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতির খসড়া তৈরি করতে বলা হল। যে ঘােষণা দেয়া হবে তার গুরুত্ব বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হল যে জনসভায় শেখ মুজিবের। ভাষণের পরপরই সংবাদমাধ্যমে দেয়ার জন্য ঘােষণার একটি লিখিত ভাষ্য প্রস্তুত রাখা উচিত। ওইদিনই সন্ধ্যার মধ্যে একটি খসড়া ভাষা তৈরি করা হল। ওই ভাষ্যে সামরিক শাসন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করে শেষ অনুচ্ছেদে বলা হল :

আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ের লক্ষ্য হল অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই লক্ষ্য অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত আমাদের অসহযােগ আন্দোলন চলবেই।

শেখ মুজিব নির্দেশ দিলেন, প্রস্তুতকৃত ভাষ্যটি তাজউদ্দিন আহমদের হেফাজতে থাকবে এবং জনসভায় ভাষণটি প্রকৃতপক্ষে যেভাবে দেয়া হবে তার আলােকে যদি প্রয়ােজন হয় সে-অনুযায়ী সংশােধন করে তা প্রচারের দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে তাজউদ্দিন আহমদই পালন করবেন। | ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল মাত্র ১৯ মিনিটের। ভাষণের মূল বাক্যটি ছিল । *এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুনির্দিষ্ট দাবিও তুলে ধরা হল। লিখিত ভাষ্যটি যথাযথভাবে পরিমার্জিত করে তাজউদ্দিন আহমদ তা প্রচারের জন্য সংবাদমাধ্যমে পাঠালেন। কাজেই চূড়ান্ত লক্ষ্য স্থির হল স্বাধীনতা’, কিন্তু শেখ মুজিব কেবল একটি আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেয়া থেকে বিরত রইলেন। কেননা এটা পরিষ্কার ছিল যে, সেনাবাহিনী মােতায়েন করা হয়েছে এবং নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােতে তারা অবস্থানও নিয়ে ফেলেছে যাতে স্বাধীনতার ঘােষণা দেয়া হলে তৎক্ষণাৎ তারা আক্রমণ শুরু করতে পারে।

যুগান্তর, ৭ মার্চ ২০০৭
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড : কিছু প্রশ্ন

ডা, এস এ মালেক

১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতি দেখে মনে হয় এটা নিছক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল না। এটা ছিল জিঘাংসা চরিতার্থ করার এক হিংস্র প্রক্রিয়া। তা না হলে ১০ বছরের রাসেলকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নির্মমভাবে হত্যা করা হবে কেন? শেখ কামাল ও জামালের নবপরিণীতারা, যাদের হাতের মেহেদির দাগ শুকায়নি, তাদেরই-বা ওভাবে জীবন দিতে হবে কেন? সেদিন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে না থাকলে তাদেরও একই পরিণতি হতাে। হত্যাকাণ্ডের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধু-পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করা, যাতে ওই পরিবারের আর কোনাে সদস্য বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকারী হিসেবে তার আদর্শ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে অবতীর্ণ হতে না পারে। এ ধরনের জিঘাংসা তাদের ভেতর সক্রিয়ভাবে বিদ্যমান ছিল তা বুঝতে কারাে পক্ষে অসুবিধা আছে বলে মনে হয় না।

স্বাধীনতার শক্র ও তাদের আন্তর্জাতিক দোসররা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে পারেনি এবং প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশােধ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেই মুক্তিযুদ্ধবিরােধী চক্রান্তই ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল পাকিস্তান নামক ধর্মরাষ্ট্রের বৃহত্তর জনগােষ্ঠী নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। পাকিস্তানি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ভাষা সংস্কৃতি, আচার, ঐতিহ্যভিত্তিক নতুন জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। বাঙালি জাতিসত্তাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা ও স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্রের প্রবর্তন। ২৩ বছরের পাকিস্তানের প্রতি বাঙালিদের যে সমর্থন ছিল, তা প্রত্যাহার করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য প্রতিষ্ঠা।

আসলে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রই শুধু পূর্বপাকিস্তানের বিকল্প একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির লক্ষ্য ছিল না, এটা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সব ভাবধারা পাল্টে দিয়ে নতুন আদর্শভিত্তিক একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বাঙালি জাতীয়তাবাদই ছিল যে রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী চক্র পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করে। সে যুদ্ধে পরাজয়ের পর তারা নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রায় অসম্ভব হওয়ায় তাদের রাজনীতি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাকে অব্যাহত রাখে।

এ কারণেই দেখা যায় ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ মসজিদ-মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। জামায়াতে ইসলামীর নামে রাজনীতি পরিচালনা করা সম্ভব নয় বলেই তারা। অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তাদের মাধ্যমেই জামায়াতের রাজনীতিকে সক্রিয় ও সরল রাখে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল একেবারেই একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এ-ধরনের হত্যাকাও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব কারণে ঘটে থাকে, বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে তাই ঘটেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন করার ব্যাপারে যারা বিরােধী ছিল, যারা বাঙালিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত ৱেখে শােষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চেয়েছিল, তারাই তাদের আন্তজাতিক দোসরদের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির ফলে আর্থসামাজিক অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছাত যে তথন আর বঙ্গবন্ধুর গায়ে আঁচড় দেয়া সম্ভব হত না। তাই বাকশাল কর্মসূচি ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। | বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানি শাসকদের শােষণের জাতাকল থেকে চিরতরে মুক্ত করে একটা স্বাধীন স্বয়ম্ভর জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়ােজনেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করেন এবং স্বাধীন হওয়ার পরই তিনি দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

১৯৭১-এ যে আন্তর্জাতিক চক্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা করেছিল। তাদের ধারণা ছিল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য শেখ মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশের এমন কোনাে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যা তাদের স্বার্থের পরিপন্থী হবে না এবং স্বাধীন বাংলাদেশে তারা পাকিস্তানের মতাে তাদের রাজনৈতিক প্রভাববলয় বজায় রাখতে সক্ষম হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ওই ঘােষণা করেন বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত-শােষক আর শােষিত, আমি শােষিতের পক্ষে।’ চক্রান্তকারীরা তাকে সমাজতলের পক্ষের শক্তি বলে মনে করল ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশােধ নিল। যে জিঘাংসাৱধ তাদের ভেতর কাজ ছিল তা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই তাদের শত্রু বলে মনে করেনি, ওই পরিবারের ১০ বছরের শিত রাসেলকেও ভবিষ্যতের শত্রু বলে গণ্য করেছে এবং সে কারণেই তারা রাসেলকে পর্যন্ত বাঁচতে দেয়নি। তাই এ মানবতাবিরােধী এবং শিশু ও নারী হত্যা। নবপরিণীতা বধূরা তাে আর এমন কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিল না। যাদের হত্যা করার প্রয়ােজন ছিল।

তাই রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ হত্যার বিচার করলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় হত্যাকাণ্ডের পেছনে এক চরম জিঘাংসাধে কাজ করেছিল। মৌলবাদী স্বাধীনতাবিরােধী সন্ত্রাসী চক্রই ওই হত্যাকাণ্ডের হােত। আন্তর্জাতিক যে চক্র এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের অনুঘটক, তাদের সঙ্গে স্বাধীনতাবিরােধীদের সৌহার্দ্য আছে বিদ্যমান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে এমন এক সময়ে যখন তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্ত বায়নে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উদ্যত হন। স্বাধীনতার শলাে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর আরব্ধ কর্মসূচি বাস্তাবায়ন করতে দিলে তিনি বাঙালি জাতি

ও বাংলাদেশকে এমন এক পর্যায়ে পেীছে দেবেন যে আর্থসামাজিকভাবে বাংলাদেশ আর কারাে মুখাপেক্ষী থাকবে না। রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের ভাবাদর্শ বাংলাদেশে কার্যকর রাখা সম্ভব হবে না। এ কারণে জাতীয় স্বাধীনতা সুসংহত করার আগেই তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের সপক্ষের শক্তির হাতে অর্পণ করে ও সেই সুবাদে পাকিস্তানের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক ধারা পুনঃপ্রবর্তন করে। তাই দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরপর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সন্ত্রাসী রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। স্বাধীনতার শত্রুরা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন দখল করে নেয়। রাজাকাররা মন্ত্রিসভার সদস্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বনে যান। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটে। সাম্প্রদায়িকতা সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্ত্রাসবাদ জাতীয় রাজনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে স্থান করে নেয়।

বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পরপরই হত্যার কারণ হিসেবে যেসব ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছেল তা যে প্রকৃত কারণ ছিল না তা বাংলার সাধারণ মানুষের বুঝতে বেশ সময় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু পরে যখন সঠিক তথ্য জানা যায় তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্র নেতৃত্বশূন্য হওয়ার কারণে জেনারেল জিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে হয়, যা তার দলের অনুসারীরা প্রায় বলে থাকেন, তা একমাত্র কারণ ছিল না। বরং বঙ্গবন্ধু ও চার নেতাকে অপসারণ করে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি করেই তাকে ক্ষমতা দখল করতে হয়। তাই ইতিহাসের কাছে প্রশ্ন : জেনারেল জিয়া যদি একজন মহান নেতা বা ব্যক্তিই হবেন, তাহলে সরকারপ্রধান জাতির জনকের হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা জানার পরও তিনি নীরব থাকলেন কেন? এসব প্রশ্ন যদি কোনাে বাঙালি হৃদয়কে আলােড়িত করে, তবে তা যুক্তিগ্রাহ্য নয় বলে বিবেচনা করা যাবে কি? আজ ১৫ আগস্টকে আমনে রেখে এসব প্রশ্নের সমাধান কোথায়?

যায়যায়দিন ১৫ আগস্ট ২০০৮
জাতির পিতাকে স্মরণ করছি ভিন্ন আঙ্গিকে

| কে এম সোবহান

২০০৭-এর ১৫ আগস্ট এসেছে দেশে জরুরি অবস্থা যখন জারি হয়েছে। জাতির পিতা বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারাজীবনের আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল বাংলা ও বাঙালির জন্য এবং সবশেষে স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল বাঙালির এই ভূখণ্ডে বাঙালির সব অধিকার স্বীকৃত হবে এমন সরকার গঠন করবেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় তাঁর নামে। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন। তার বিচার হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে। | জে. ইয়াহিয়া ২৬ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা ছেড়ে চলে যান। বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়ে পাকিস্তান ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দেন। তাতে স্পষ্ট ভাষায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, ‘সে জাতির শত্রু। সে জাতির পিতার ছবি (জিন্নার) অপবিত্র করেছে। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার অসম্মান প্রদর্শন করেছে। এবার সে শাস্তির হাত থেকে রেহাই পাবে না। এ ধমক এসেছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে। তার ক্যাঙারু কোর্ট বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং তার সেলের পাশেই তার কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের তিনটি রাষ্ট্র, যাদের ভেটোর অধিকার তাদের রাত্রীয় নেতারা পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। ব্যতিক্রম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণপ্রজাতন্ত্রী কমিউনিস্ট চীন। সেই চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুর ফঁসি কার্যকর করতে পারেনি। | ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকারে বিরাট পরিবর্তন আসে। সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয় সিভিল সরকারের হাতে। ভুঠো হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার। অবশেষে ভুট্টো ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত করে ব্রিটেনের পথে একটি প্লেনে চাপিয়ে দেন।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। গণতন্ত্রমনা বঙ্গবন্ধু তিনদিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতির পদ ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭২ সালের ৪ তারিখে সংবিধান বাংলাদেশের গণপরিষদে গৃহীত হয়। অতি দ্রুততার সঙ্গে সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হওয়া সরকারের

কৃতিত্ব বহন করে। এই সংবিধানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর নামকরণে । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। এর অপর বৈশিষ্ট হলাে হচ্ছে জাতীয় ভাষা হল বাংলা যার জন্য ‘৫২তে শহীদরা জীবন উৎসর্গ করেছিল। বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালি বলে পরিচিত হল। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে এই সংবিধানে ‘প্রাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতা প্রয়ােগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।

সংবিধান প্রদত্ত সকল ক্ষমতার মালিকানা জনগণের হাত থেকে ছিনতাই হয়ে গেছে স্বৈরশাসকের হাতে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবৈধভাবে সংবিধান সংশোধন হয়েছে বারবার। যার ফলে বাঙালি জাতিসত্তার বিলুপ্ত করে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব যােগ হয়েছে। সেকুলার বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম করে অমুসলমান বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিককে পরিণত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আজীবন আন্দোলন, সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ছিল গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চারটি হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিলনার মূলমন্ত্র। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক বন্দুকের গুলির আঘাতে এসব উড়িয়ে দেয়। | সামরিক শাসকরা ক্ষমতা দখল করেন বন্দুক দেখিয়ে এবং ক্ষমতা রক্ষণ ও প্রদর্শনও কৱেন বন্দুকের রুল দেখিয়ে। গণচীনের নেতা মাও সেতুঙের কথা ‘ক্ষমতা। আসে বন্দুকের নল থেকে এই নীতি বাংলাদেশের সামরিক শাসকরা বিশ্বাস করতেন এবং তার প্রয়ােগও করতেন। তারপর সময় যখন আসে তখন ঐ বন্দুক লুকিয়ে ক্ষমতায় থাকার প্রয়াস পাওয়ার জন্য নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং সাধারণ নির্বাচনে সবরকম দুর্নীতির পথে হাঁটেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল এবং মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আদর্শিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। দল গঠন, নির্বাচন এবং সামরিক শাসন ও আইন বৈধকরণ—সবই ঘটে সামরিক শাসন বজায় রেখে। | বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দুই সামরিক শাসক ও ঐ কর্মটি করে গেছেন। এই আজকের বাংলাদেশের দুর্যোগ-দুর্বিপাকের তারাই আনি পাপ । বাংলাদেশের এই পাপ অঞ্চন হয়নি। একজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং অপরজন নিজেকে নিজেই মাইনাস করেছেন অর্থের লােভ এবং বিবাহিতা নারীর প্রতি অদম্য এবং অন্তহীন কামনা-লালসার জন্য। পনেরাে বছর বাংলাদেশ এই পাপ বহন করেছে।

পাপ ছিল ক্ষমতা দখল করার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে। জিয়া ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যে দল এবং যারা বিশ্বাস করেনি দেশের রাজনীতির মঞ্চে। তাদের স্থান দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালে তারা যুদ্ধাপরাধ করেছিল পাকিস্তান এবং ইসলাম রক্ষা করার জন্য। কি পারেনি। যেমন পারেনি বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনকে ঠেকিয়ে রাখতে এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বহাল রাখতে। ভাষা-আন্দোলন সফল হয়েছিল বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা করতে বাধ্য করার মধ্যদিয়ে। আর পাকিস্তান রক্ষা করতে ৩০ লাখ বাঙালিকে

শহীদ হতে হয়েছে, সাড়ে চার লক্ষাধিক বাঙালি নারীর সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস লুট পরতে হয়েছে। এরা পাকিস্তান, উর্দু আর ইসলামকে যােণ অল্প করে পাটিগণিতে

মুলায় নিয়ে যায়। কিন্তু তাদের অঙ্ক ভুল হয়ে পাকিস্তান আর উর্দু মাইনাস হয়ে যায় বাংলাদেশ থেকে।

পাকিস্তানের দালাল আর দোসর, যুদ্ধাপরাধীরা পাকিস্তানের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে মাটির তলায় চলে যায়। আর সবচেয়ে বড় অপরাধী গােলাম আযম পাকিস্তান আর আরবে থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনর্থক বক্তব্য রেখেছে। কিন্তু সবই বিফলে গেছে। এই লুকিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের মাটির তলা থেকে বার করে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুচ্ছেদ মূলনীতি থেকে বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জনের শেষ কাজটি করেছিলেন ২৫ মার্চ ‘৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের বিশ্বস্ত সামরিক দুনিয়ার কর্মকর্তা জিয়া। ১৯৭৯ সালে সামরিক ছাউনিতে রাজনৈতিক দল গঠন এবং নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে নির্বাচিত হওয়া সামরিক আইন বহাল রাখা ছিল জিয়ার কৃতিত্ব। তারচেয়েও বড় কৃতিত জিয়ার ৭৯ সালে নির্বাচনে জামাত আর দোসরদের নির্বাচনে জাতীয় সংসদে ৬টি আসন দিয়ে।

| জামাত এবং ধর্মের লেবাসে যুদ্ধাপরাধীদের সংসদে নির্বাচিত করানাে ছিল বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। যুদ্ধাপরাধীরা ফিরে এল। বাংলাদেশের আবির্ভাব তাদের ঈমানের পর সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল। তবে যুদ্ধাপরাধীরা অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে কখন মাথা হেঁট করে থাকতে হয়, আবার কখন উকি মারতে হয় মঞ্চের দিকে। তাদের পুনর্জন্মের জন্য তারা সামরিক আইনের প্রতি কৃতজ্ঞ, বিশেষ করে জিয়ার প্রতি। তাদের এ কৃতজ্ঞতা তারা পরবর্তীকালে বারে বারে দেখিয়েছে খালেদা জিয়াকে সংসদে প্রথমবার সমর্থন করে এবং পরেরবার একেবারে খালেদা জিয়ার কাধে চেপে সরকার গিয়ে।

বিশ্ববেহায়া এরশাদ ধর্মের প্রতি কতখানি আনুগত্য পােষণ করত তা প্রশ্নাতীত নয়। কিন্তু জিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে এরশাদ শিখেছিল যে ক্ষমতায় থাকতে হলে মৌলবাদী সমর্থন অপরিহার্য। তাই হঠাৎ করে সংবিধান সংশােধন করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের সঙ্গে যােগ করে বাহবা নিল মৌলবাদীদের। ব্যক্তিগতভাবে পরনারীর প্রতি আর যে অদম্য লালসা ইসলামধর্মসম্মত কিনা তা সন্দেহের বিষয়। | সেই যে ‘৭৯ সাল থেকে দীপরাধী জামাত বাংলাদেশের রানীতিতে আসন গেড়েছে এবং অনির্বাচিত সরকার কর্তৃক পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছে, তা থেকে এদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এদের স্থান পাকা হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী প্রধান জাতির পিতাকে ইতিহাসে তার যথাযথ স্থানে স্থাপন করার কথা বলেছিলেন তা বাস্তবায়ন হবে কি হবে না তা জানা নাই। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতিতে বাঙালি জাতি নিশ্চয়ই উৎসাহিত হয়েছে। এতে দুরাত্মা যুদ্ধাপরাধী নিজামী এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রেখেছে। বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বলে গ্রহণ করা যায় তবে তাকে জাতির পিতা বললে অনেকের কাছে তা গ্রহণযােগ্য হবে না। দুর্বিনীত যুদ্ধাপরাধী নিজামী মনে করেছে

বাংলাদেশের অনির্বাচিত সরকার চিরস্থায়ী হবে এবং সেরকম একটি সরকারের কাছ থেকে মৌলবানী সন্ত্রাসীদের জন্মদাতা জামাত চিরকাল সমর্থন পাবে। বাংলাদেশের ইতিহাস বড় নির্মম। যুদ্ধাপরাধী নিজামী ভুলে গেছে তাদের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান সরকার এবং তাদের ৯৩ হাজার সেনাবাহিনীকে পরাজিত হয়ে মাথা নিচু করে বাংলাদেশ থেকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিদায় নিতে হয়েছিল এবং তার দালাল নিজামীকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশের মানুষ এবং কোনাে একদিন তাদের বিচার হবে বাংলার মাটিতে।

বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলে গ্রহণ করতে তাদের ঘােরতর আপত্তি আছে। এটা নাকি ইসলামবিরােধী ধারণা। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানে একজন ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিকে জাতির পিতা বলে গ্রহণ করতে এই ধর্মরাষ্ট্রের কোনােরকম আপত্তি নেই। জামাতে ইসলামি পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ধ্বজধারী; তার নেতা যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযম, নিজামী ৰা জামাতের জন্মদাতা মওদুদীর কোনাে আপত্তি ছিল না এবং যুদ্ধাপরাধী নিজামীর মনের কোণে ঐ স্থান নেতাকে (জিন্নাহকে) জাতির পিতা বলে। চিরস্থায়ী আসন দিতে । যথাযথ সময়ে যুদ্ধাপরাধী নিজামীর ঔদ্ধতের জবাব সে পাবে। | ২০০৭-এর ১৫ আগস্ট যেটা জাতীয় শােকদিবস, এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলার জনগণ পালন করছে যখন সবকিছুর ওপরই সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ওপর কোনাে আলােচনাসভা করা নিষিদ্ধ, শােকমিছিল নিয়ে তার প্রতিকৃতিতে মাল্যদান নিষিদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির পিতাকে সমবেতভাবে সম্মান দেখানাে নিষিদ্ধ করা ছিল জাতির পিতার প্রাপ্য। | খালেদা জনােত্সব করছেন ঘটা করে যেদিন বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বাঘাতকরা নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। বর্তমান সরকারকে অন্তত নন্যবাদ দিতেই হবে-এই দিন কোনাে উৎসব-আয়ােজন না-করার জন্য । এতসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে, এত হতাশার মধ্যে অত্যন্ত আশার কথা যে, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা ১৫ আগস্ট টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে মালদান করবেন। জাতি নূ্যনতম যেটা আশা করে যখন তারা নিজেরা পারছে না জাতির পিতাকে সম্মান দেখাতে, যখন শেখ হাসিনা পারছেন না বােধহয় দেশে ফেরার পর এই প্রথম বছর টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তাঁর পিতা জাতির পিতাকে যথাযথ সম্মান জানাতে। সমস্ত জাতি গর প্রতি সহানুভূতি জানাচ্ছে। তিনি পিতা, মাতা, ভাই ভাবী এবং অপর ঘনিষ্ঠজন খুনিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার সংবাদ পেয়েছিলেন যখন তিনি বিদেশে ছিলেন। একজন কন্যার তার পিতা, মাতা, ভাই এবং ঘনিষ্ঠজনদের হত্যার পর তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে না পেরে তিনি এবং তার বােন শেখ রেহানা মানসিকভাবে নিশ্চয়ই বিধ্বস্ত দুই নিঃসঙ্গ নারী। তাঁদের প্রতি জাতি সহানুভূতি জানাচ্ছে। দুর্নীতির দায়ে দেওয়া মামলায় তিনি আজ কাৱাবন্দি। হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামিন পেয়েও সরকারের উৎসাহের কারণে সে জামিন আদেশ থমকে গেছে। এই দিনে ন্যূনতম যেটা তাকে সরকার দিতে পারত তা হচ্ছে জামিনে মুক্তি করে টুঙ্গিপাড়ায় এই জাতীয় শােক দিবসে তার পিতার কবরে দুটো চোখের পানি ফেলতে দিতে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চললে এই একটা বা দুটো বা পাঁচটা দশটা দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং এককালীন সরকারপ্রধানের জামিন না-পাওয়ার কারণ বােঝা মুশকিল। তার পাসপোের্ট সরকারের কাছে জমা আছে, জমা না থাকলেও তিনি বিদেশে পালিয়ে যেতেন না। তিনি যুদ্ধাপরাধী নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদি নন যে বিপদ দেখলেই আইনিভাবে দেবেন। দুর্নীতির মামলা দায়ের করার পর ঐ মামলার কথা জেনেই সাক্ষীগণকে এ মামলার মােকাবিলা করার জন্য দেশে ফিরে আসেন। যদিও সরকার প্রথমে তাকে আসতে দিতে অস্বীকার করে, তারপর যখন সরকারি বিরােধী। আন্তর্জাতিক কন্ঠস্বর উচ্চ হল এবং সরকারের ভাবমূর্তি ধূসর হল তখন সরকার তাকে ফিরতে দিল। | ১৫ আগস্ট শুধু রাষ্ট্রপ্রধান এবং সরকারপ্রধান নয়, জনগণ আশা করে যে উপদেষ্টা পরিষদের সকলেই টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন এবং সেখানে তিন বাহিনী কর্তৃক তার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানাবে। জাতির দাবি ছিল এবং আছে ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস এবং সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করার, যেমন হয়েছিল শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। বঙ্গবন্ধু-হত্যার দিন একশ্রেণীর বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহীরা উৎসব করেছিল। খালেদা জিয়া হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে ঐদিন তার জন্মদিন। সেইদিন কেক কেটে বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য তার প্রয়াত স্বামীকে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ দেন। এবারে তার জন্মদিন আর তার বয়সের ওজনের কেক কাটা হবে কিনা তা জনগণ দেখতে চায়।

আগস্ট মাসে হস্তারকদের আপিল করতে দেওয়ার অনুমতির দরখাস্তের শুনানি চলছে। বর্তমান সরকার তাতে বাধা দেয় নাই যেমন দিয়েছিল খালেদা জিয়ার সরকার। জাতি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে জাতির পিতা বাংলাদেশের স্থপতিকে এই দিন। তার আত্মার শান্তি কামনা করবে নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাসমতাে। জাতি বলবে সজল চক্ষে : পিতা, আমরা তােমাকে ভুলি নাই ভুলব না।

ভােরের কাগজ ১৫ আগস্ট ০৭

বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন

বেৰী মওদুদ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল বড় আনন্দের। যদিও জীবনের অনেকটা সময় তাঁর কেটেছে কারাগারে এবং রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততায়। পরিবারের সবার সঙ্গে থেকেও যেন থাকা হত না। তার বাবা-মায়ের আদর-যত্ন, ভাইবােনের ভালােবাসা, স্ত্রীর প্রেম ও মমত্ব, সন্তানদের শ্রদ্ধা এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের নিবিড় সম্পর্ক একদিকে তাঁর ব্যক্তিজীবনকে পরিপুষ্ট করেছে, ভরপুর করেছে উদারতায়; আবার ইস্পাতসম কাঠিন্যে শক্তি যুগিয়েছে, লক্ষ্যে পৌঁছাতে আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী করে তুলেছে। একসঙ্গে তাঁর দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের জন্য ভালােবাসা যেন তাঁর প্রাণশক্তি ছিল। পারিবারিক জীবনের সুখ ও আনন্দ ফেলে এসে জনগণের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলেন। শুধু সমাজ, দেশ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের জন্য। নিজের জীবনের জন্য কখনও ভাবেননি। নিজের মা-বাবার দিকে ফিরে। তাকাননি। বৃদ্ধ মা-বাবারও কোনাে খোঁজখবর রাখার সময় পাননি। অথচ তার জন্য তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের ওপরেও আঘাত এসেছে; তাঁদেরও নানারকম যাতনা ও লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়েছে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়া নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে শেখ মুজিবের জন্ম হয়। তাঁর জন্মগ্রগ্রণ পুরাে ‘শেখ বংশে আনন্দ বয়ে এনেছিল। দু-মেয়ের পর ছেলে জন্ম নেয়ায় মা সায়রা খাতুন খুব খুশি হয়েছিলেন। তার পিতা নাতির নামকরণ করে গর্বিত মাকে সেদিন বলেছিলেন, ‘মা সায়রা, তােমার ছেলের জগৎজোড়া নাম। হবে।’ বৃদ্ধা মা বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসাবে তাঁর ছেলেকে দেখে একথা স্মরণ করতেন এবং সেই গর্ব নিয়েই জীবন-অতিবাহিত করেন।

বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশাের মা-বাবার আদর-শাসনে এবং যত্নে কেটেছিল। মায়ের চিন্তা ছিল তার রোগাপাতলা ছেলে ‘খােকা’ কবে বড় হবে? টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে তাঁর শৈশব কেটেছিল। গ্রামীণজীবনের রূপ-রস-গন্ধ তাঁকে যেমন সরল-সাধারণ ও কোমল করে গড়ে তােলে, তেমনি গ্রামের মানুষের সংগ্রাম তাকে অভিজ্ঞ করে তােলে।

মুজিবের এগারাে বছর বয়সে বিয়ে হয় চাচাত বােন ফজিলাতুননেছা রেণুর সঙ্গে। তার বয়স ছিল তখন মাত্র তিন বছর। কালাকালে খেলার সাথী বেণু পরবর্তীকালে সুযােগ্য জীবনসঙ্গী হিসেবে ভালােবাসা দিয়ে পরবর্তী জীবনে আরও বেশি করে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক জীবনকে প্রতিষ্ঠিত

তে। বেগম মুজিবই তার শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয় স্বজনদের দেখাশােনা, সন্তু নিদের লালনপালন করে সংসার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছেন। আবার অন্যদিকে স্বামীর রাজনীতি, সংগ্রাম, কারাবরণ, মামলা পরিচালনা ও পার্টির ভালাে-মন্দ দেখেছেন। নিজের বাড়িতে সভা বা বৈঠক করা, তাদের জন্য নিজে রান্না করে পরিবেশন করা, কারাবরণকারী নেতা ও কর্মীদের পরিবারকে সাহায্য করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। রাজবন্দি স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বাইরের আন্দোলনের খবর পৌছানাে, পরামর্শ করা এবং নির্দেশ শুনে এসে নেতাকর্মীদের কাছে পৌছে দিতেন। স্বামী রাজনীতি করতেন বলে সামাজিকভাবে অনেক সময় নিগৃহীত হয়েছেন। ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে কষ্ট-দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছে অনেক। ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাতে, সংসার চালাতে এবং নিজের গহনা বিক্রি করে স্বামীর মামলা চালাতেও দ্বিধাবােধ করেননি কখনও। তারপরও স্বামীর কাছে কখনও কোনাে অভিযােগ করেননি। বরং স্বামীর সুবিধার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, হাসিমুখে পাশে দাড়িয়ে সহযােগিতা করেছেন। গ্রামে তাঁর নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকায় বাড়ি তুলেছেন একটু একটু করে, সংসারের খরচ মিটিয়েছেন। একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন দায়িত্বশীল নিষ্ঠাবান গৃহকত্রী ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ঢারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রধানতম দিকটা হল, একজন নির্ভীক ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী হিসেবে সবার আপনজন ছিলেন। এই আত্মোপলব্ধি তাকে এতবেশি সচেতন করেছিল বলেই স্বামীর বাজনৈতিক চিন্তাভাবনার একান্ত সঙ্গী ছিলেন। শেখ মুজিবের অনেক গুৰুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় অনেক ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতেন। একজন রাজনীতিবিদ স্বামীর উপযুক্ত স্ত্রী ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বালি জাতির অবিস্মরণীয় নেতা হতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বাস্কালি জাতির পিতা হতে পেরেছেন। | চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকে শেখ মুজিব যথন নেতা হিসেবে গড়ে উঠছেন, কারাগারে যাচ্ছেন, আন্দোলন-সংগ্রামে সারাদেশ ঘুরছেন এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করছেন—স্ত্রী ফজিলাতুননেছার সতর্ক দৃষ্টি ছিল তার প্রতি এবং মা-বাবার সথে, ও সন্তানদের প্রতি গভীর ভালােবাসাও ছিল। এ সময়টা শেখ মুজিবের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হয়ে ওঠার সময়। পাকিস্তানের স্বৈর সামরিক শাসকগােষ্ঠীর প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ মুজিব-যাকে অর্থবিত্ত মন্ত্রিত্ব দিয়ে তারা ক্রয় করতে পারেনি তাদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য। কেননা মুজিব ছিলেন সৰ স্বার্থে। * দেশ ও মানুষের স্বার্থকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তিনি পাকিস্তানের বৈষম্য ও শােষণের শাসনের নিজে ছিলেন দুর্বার, দুর্দান্ত এক অনলবর্ষী বক্তা। তিনি ছিলেন সব প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে আতঙ্ক। | একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা এঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। সামরিক আদালত গােপন বিচার করে মৃত্যুদস্ত প্রদান করে। আর তার ফেলে যাওয়া ঘর-সংসার নিয়ে বেগম মুজিবকে কম লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়নি। ঢাকা শহরে থাকার জায়গা খুঁজতে হয়েছে। পাকসেনাদের ভয়ে আত্মীয়স্বজন আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। ৩২ নং বাড়ি পাকিস্তানি সৈন্যরা লুটপাট করে সিল মেরে রেখে দিয়ে বেগম মুজিব ও সন্তানদের খুঁজে বের করে ধানমথি ১৮ নং রােডের একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখে, যেখানে খাদ্য ও ঘুমানাের নূ্যনতম সুবিধাটুকু দেয়নি। বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় বসিয়ে রেখে গ্রামের বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দোয়। | তারপরও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, হাজার হাজাৰ নাৰীৰ সম্বমহানি ঘটেছে। সে এক নিদারুণ অমানিশার কাল ছিল। তারপরও দেশ স্বাধীন হয়েছে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সংগীৱৰে প্রত্যাবর্তন করেছেন। আপন পরিবারে স্ত্রী-সন্তানের ভালােবাসা, মা-বাবার মমত্বের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই পারিবারিক আনন্দ ও শান্তি ছিল তার সব সংগ্রামের উৎস। বাঙালি জাতির সফল ও সার্থক নেতা হিসেবে, বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তাঁর কীর্তিময় জীবন দেখে গর্ব করেছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। | বঙ্গবন্ধু পরিবার ছিল একটি আদর্শ বাঙালি পরিবার। জীবনযাপন ছিল খুব। সাধারণ। সুনেতৃত্ব, নীতিবান, মিতব্যয়ী এবং সদ্ব্যবহারের জন্য তাদের একটা বংশগত মর্যাদা ছিল। এতক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হয়েও বত্রিশ নম্বর বাড়িতে কোনাে এসি, কার্পেট ও দামি আসবাবপত্রের বাল্য ছিল না। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবােধ ছিল উন্নত, আঁীবনাচরণ ছিল রুচিসম্মত।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হলেন নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে। থাম্বকের দল তাঁকে হত্যা করেছিল রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু তার স্ত্রী ফজিলাতুননেছা বেণু, তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল; সলাধু হয়ে আসা সুলতানা কামাল ও পারভীন জামালকেও ঘাতকের দল হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ছােট ভাই আবু নাসের এ-বাড়িতে থাকায় সেদিন তাঁকেও হত্যা করে ঘাতকরা। কী ছিল তাদের অপরাধ? বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল আমিলকেও হত্যা করে বাড়ির সামনের রাস্তায়। তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী আরজু মণি, অগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও দুর দুই কন্যা ও পুত্র এবং শিশু নাতিকেও হত্যা করেছিল। এসব হত্যাকাণ্ড কেন করা হয়েছিল? মানুষের মাঝে আতঙ্ক ও নৃশংসতা সৃষ্টি করতে।

বঙ্গবন্ধুরই বা কী অপরাধ ছিল? বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতির পিতা হওয়াটাই কি তালের চক্ষুশূল ছিল। তাই তারা মেনে নিতে পারেনি বলেই এমন রক্তাকাণ্ড ঘটিয়েছে? ঘাতকের দল তাঁকে যদি রাজনৈতিক কারণে হত্যা করে থাকে, তাহলে তার স্ত্রী, শিশুসন্তান রাসেল, নববধূসহ পুত্র ও অন্য আত্মীয়স্বজনদেরও এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল কেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরিবার ও বংশকে ধ্বংস করে দেয়াটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। মানবিকতার আদর্শচ্যুত, বিবেকহীন এই ঘাতকদের বিচার শেষ হবে কবে? শাস্তি কেন হবে না?

বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর পরিবার ভীবন দিয়ে যে বিরাট আত্মদান করে গেছেন তা সংগ্রাম, সাহস, শক্তি, মানবিকতা ও কল্যাণের আদর্শে মহীয়ান করে রাখতে পারি, আজ এটাই আমাদের একমাত্র প্রার্থনা।

যুগান্তর ২৬ আগস্ট ২০০৮
চীনের স্বীকৃতির জন্য শেখ মুজিবের উৎকণ্ঠা ছিল

| ফয়েজ আহমদ রাজনৈতিক ব্যক্তিকে শাসনক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাকালে শাসনব্যবস্থার প্রয়ােজনে অনেক সময় কূটনেতিক সম্পর্ক রাখতে হয়। প্রধানমন্ত্রীকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন। প্রথমশ্রেণীর কূটনীতিকের ভূমিকা নিতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী। ছিলেন, তখন তার শাসনব্যবস্থার একটি প্রধান দিক ছিল কূটনৈতিক সম্পর্ক। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার নিয়মিত সম্পর্ক গভীর ছিল। একজন প্রধানমন্ত্রীকে এভাবেই বিদেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য ও রাজনৈতিক সম্পর্কের পথ বেছে নিতে হয়। তিনি ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রধানদের সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। প্রধানমন্ত্রীকে এই কাজটা সর্বক্ষেত্রে নজরে রেখে চলার অনেক দেশেই নিয়ম আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর সবটা সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ছেড়ে দেন না। বিশেষ করে বড় কোনাে নিয়েই আমাদের পররাষ্ট্র দফতর শেখ সাহেবকে নাজানিয়ে করতে পারেনি। | শেখ সাহেবের জীবদ্দশায় চীনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তখনাে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকারও কোনাে সুযােগ ছিল না। কিন্তু দুঃখজনক যে, শেখ মুজিবের জীবিতকালে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনাে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর বিশেষ কারণও সন্ধান করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন কে এম কায়সার। তার সঙ্গে পিকিংয়ে চীনা কৃষি গবেষণার জন্য সিএসপি ওবায়দুল্লাহ কাউন্সিলর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেননি এবং তাদের ঢাকায় ছুটিতে আসতে দেয়া হয়নি। নানা কৌশলে এ দুজন উচ্চস্তরের বাঙালির করাচিতে প্রত্যাবর্তন ঠেকিয়ে রেখেছিল এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তির জনা পিকিংয়েই অবস্থান করছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এই দুই বাঙালি কূটনীতিক পিকিং থেকে সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন এবং শেখের আনুগত্য স্বীকার করেন। তখন তারা শেখ সাহেবকে বলেছিলেন, চীন সরকার নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। এবং তারা আরাে বলেন যে, যে রাজনৈতিক অবস্থায় চূড়ান্ত পরিবর্তন হয়েছে, সেটা চীন উপলব্ধি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের এই সুযােগ এখনই গ্রহণ করা উচিত। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেন। চীনের পক্ষ থেকেও কোনােপ্রকার ইঙ্গিত আসতে পারে—এ কথাও তিনি বলেছিলেন। কিন্তু চীন সরাসরি বা কোনাে রাষ্ট্রের মাধ্যেমে বাংলাদেশের সঙ্গে যােগাযােগ তখনাে করেনি। বাংলাদেশ অন্য দেশের মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে ঠিকই, তবে কোনােভাবেই চীনের দিক থেকে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সম্প্রসারিত হয়নি। তখন বাংলাদেশ মনে করেছিল অন্য কোনাে রাষ্ট্রর গােপন হস্তক্ষেপের কারণে হয়তাে চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হচ্ছে না। এ অবস্থার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক যােগাযােগের চেষ্টা অব্যাহত রেখেও বেসরকারিভাবে তিনি পিকিংয়ের সঙ্গে যােগসূত্র রক্ষার চেষ্টা করেন।

| চীনে তখন চরম রাজনৈতিক দুর্যোগ ছিল। ছেখঠি সালের মাঝামাঝি থেকে । মে) সমগ্র চীনে একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটে। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল বেনামে মাওসেতুংয়ের নেতৃত্বে সমগ্র চীনে আচ্ছাদিত রাজনৈতিক উত্থান। তিনি এই উত্থানে যুবক-যুবতীদেরই প্রধানত যােগদানের আহবান জানিয়েছিলেন। তরুণদের এই জাগরণ ক্রমান্বয়ে সরাসরি গােপন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর হয়। বয়স্ক রাজনীতিকর বিপক্ষ হয়ে যান এবং শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এই বিপ্লব দশবছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেসময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের বিশেষ কোনাে নতুন ভূমিকা ছিল না। এর মধ্যে এই বিপ্লব নিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং চীনদেশে সেসময় কর্মরত প্রায় ২২ হাজার ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিক্যাল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাইকে সােভিয়েত রাশিয়া প্রত্যাহার করে নেয়। বৈদেশিক নীতিতে চীন এই সময় নতুন কোনাে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি সেসময়ে স্থগিত রেখেছিল বলে। আমাদের ধারণা। সমগ্র বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শক্তি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সােভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এই জাতীয় বিপ্লবের বিরােধী। অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব তখন দুভাগে বিভক্ত। এমন পরিস্থিতিতে আমরা নতুন স্বাধীন দেশ হিসেবে চীনাদের তখনকার বৈদেশিক নীতিতে নতুন অবস্থানের দৃষ্টিতে ছিলাম।

চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার পর একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। কিন্তু বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। আমাদের তখন মনে হয়েছে, নিজেদের রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নটি তাদের সম্মুখে বৃহৎ রূপ লাভ করেনি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা শেখ মুজিবের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত চীনের স্বীকৃতিহীন অবস্থায় ছিলাম। শেখ সাহেবের জীবিতকালে চীনকে বন্ধু হিসেবে দেখানাের জন্য অন্য বাস্তুৰ পন্থাও গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি একপর্যায়ে চীনের কাছে অযাচিতভাবে পাঁচ হাজার টন পাট প্রেণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাটের অর্থ বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দাবি করা হয়নি। কিন্তু একটি নিউজ এজেন্সি চীনের সঙ্গে এই পাটকূটনীতি সংক্রান্ত গোপন খবর প্রকাশ করে দেয়। তার ফলে আমেরিকানদের চাপে

বাংলাদেশ, এমনকি গােপনে সেই পাট টানে রফতানি করতে সক্ষম হয়নি। চীন এসব রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। | সাংস্কৃতিক বিপ্রণের সাতবছর সেসময় চলে গেছে। রাজনৈতিকভাবে মা সমর্থকরা চীনে এমেই দুর্বল হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী চৌয়েন লাই ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী-তের তখন মৃত্যু ঘটেছে। ইতোমধ্যে মাও-এর মৃত্যু ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে চীন রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেসময় অর্থায়, ১৬ খ্রিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের স্বীকৃতি অর্জনে সমর্থ হয়। চীন তখন স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন প্রবীণ নেতাদের অধিকাংশকে হারিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চাঁনের পক্ষে কারো সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্ন ছিল না। যদিও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল, চীনের কাছে সেই তাৎপর্য অতটা ছিল না। ফলে আমাদের স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটা ছিল মন্থর। কিন্তু আমাদের দিক থেকে চীনের শীকৃতি লাভের চেষ্টা অব্যাহত ছিল। এসময় আমাকে এক অপরাহ্নে শেখ সাহেব নিজস্ব এক বিশেষ আলােচনায় ডেকে পাঠান। ৭৪ সালের কোনাে এক সময় শেখ সাহেবের সখে আমার চীনের সম্পর্ক সম্পর্কে নী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

দেন শিয়াওপিং, ছাড়া চীনে প্রাচীন নেতাদের আর কে জীবিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নির্বাসিত নিজ এলাকার একজন সাধারণ নাগরিক ঐ শ্রেষ্ঠ মুক্তিযােদ্ধা। শাসকদের এই অনুপস্থিতিকালে এক নতুন প্রজন্ম এখয়ে ক্ষমতা হস্তগত করতে থাকে। এই পরিবর্তনে বিপ্লবী-প্রতিবিপ্লবীদের কোনাে ভূমিকা ছিল না। এ সময়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রবীণ নেতৃবর্গের সবারই অবসান ঘটেছে। আমার সঙ্গে পিকিংয়ে সম্পর্কিত রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করে আমাকে গ্রসর হতে হবে, এ ভাবনাই ভাবতে লাগলাম।

শেখ সাহেবের সঙ্গে আলাপের পর আমাকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পথ খুঁজতে হল। শেষপর্যন্ত ঠিক হল হ্যানয় থেকে আমি চীনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করব। প্রথম অভিযানে হংকং হয়ে আমি হ্যানয়ে পেীছেছিলাম। শেখ সাহেবের প্রশাসনে গােপন নির্দেশে আমার গােপনীয় টিকিট ও অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। এখানে থেকেই আমার গােপন কুটনৈতিক কর্মকাঞ্জের যাত্রা এর হল। সরকারের বাইরে অবস্থান করে এ ধরনের দায়িত্ব পালনের নজির দ্বির্তীয়টি আছে কিনা জানা নেই।

আমি ও শেখ সাহেবই কেবল ওই বিষয় সম্পর্কে জানতাম, বিশ্বের অন্য কেউ এটা জানত না। হংকং-নয় দশদিনব্যাপী মিশন ব্যর্থ হয়। ওখান থেকে প্রকৃত শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী কার্যক্রম যেভাবে স্থির করা হয়েছিল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম, কেবল অপেক্ষায় ছিলাম একটি ম্যাসেজের। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান টীনের সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য এই ন্যাকুল ছিলেন যে তিনি ২/১ দিন পরপরই আমার সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করতেন । ষ্টার এই ব্যাকুলছার কারণ হচ্ছে, তিনি আমেরিকানদের দৃষ্টতা ও কার্যক্রমের উত্তর দিতে চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক করে। সে কারণে চীন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল । কিন্তু দুঃখজনক যে, সেসময় চীনের অভ্যন্তরীণ গােলযােগের কারণে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরিসমাপ্তি প্রান্তদেশে এসে চীনে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ ছিল। তারা সেসময় তাৎক্ষণিক কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া বৈদেশিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। তারা ভেবেছিল, বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিশেষ জরুরি নয়। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্গলা ফেরত আসলেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া যাবে। বাংলাদেশের স্বীকৃতি চীনা দৃষ্টিকোণ থেকে তখন আর কোনাে বাধার সম্মুখীন ছিল না, কেবল দাফতরিক কাজটাই বন্ধ ছিল। বিভিন্ন সূত্রে টীনা বিদেশ-অফিসের এই অবস্থান আমি জানতাম। | আমার কাছে আকস্মিকভাবে খবর আসল দিল্লিতে চলে যাওয়ার জন্য। শেখ সাহেব জানতেন। তিনি আমাকে বললেন, তুই সাবধান। আমি জানি, তোর অভিযানের সঙ্গে কোনােভাবেই আমার নাম সম্পর্কিত তা বলিস না!’ এবার দিল্লিতে আমাদের দূতাবাসে আমার কয়েকজন নিকটবন্ধু অফিসার ছিলেন। এদের কেউ কাউন্সিলর, কেই ফাস সেক্রেটারি, সর্বোপরি হাইকমিশনার (আঘাসের) এক্সার মল্লিকের আমি একসময় নিকটব্যক্তি ছিলাম। প্রেস কাউন্সিলর এসএমএ চৌধুরীকে টেলিফোনে বললাম, আমার দিল্লিতে বিশেষ কাজে যাওয়ার তাগিদ আছে এবং তাকে “সহনশীল’ ভাড়ায় একটা হােটেল বুক করতে বললাম। তিনি ফোনে জানালেন=সব তৈরি আছে, এয়ারপাের্টে আমি আপনাকে রিসিভ করব। | এয়ারপাের্টে নেমে দেখি মি, চৌধুরী আরাে দুজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়িতে আমাকে উঠালেন। আমি বললাম, কোন্ হোেটলে যাচ্ছি? মি, চৌধুরী কথা বলেন কম, সবসময় তঁার ওষ্ঠাধারে হাসি । তিনি হাসলেন। আমরা শেষ পর্যন্ত একটা বাসায় পেীছলাম। তিনি বললেন, এটাই আপনার হােটেল। সেই বাড়িটা ছিল মি, চৌধুরীর সরকারি আবাস বা রেসিদ্ধ, দূতাবাসের অংশ। অর্থাৎ আমি তাঁর বাড়িতে উঠলাম। আমার পূর্বপরিচিত তাঁর স্ত্রী ও দুটি ছােট মেয়ে দৌড়ে আসল।

সকাল সাড়ে ৯ টায় দূতাবাসের টেলিফোনে বলা হল- ফয়েজ আহমেদকে চাই। ফোন ধরে দেখি হাইকমিশনার ভক্টর ময়িক। তিনি তখনই তার অফিসে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। দশটার পর তার সঙ্গে দেখা করে অনেক কথাই হল। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি। তঁার চিন্তা হল ‘আমি কেন দিব্বিতে’—এ গােপন তথাটা বের করতে হবে। সেজন্য তিনি বললেন । আমার বাসায় তুমি থাকো এবং মি, চৌধুরীকে তােমার জিনিসপত্র আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বলাে। আমার বাড়িতে রােজ দীর্ঘসময় তাস খেলা হবে তোমাকে নিয়ে।

হাসিমুখে বললাম ; এখন বেবী চৌধুরীর বাসাতেই থাকি, তবে তাস খেলার আস্থায় আজকে থেকেই আমি যাব।এই শুরু হল আমাদের প্রাত্যহিক ১টা থেকে তাস খেলা এবং সেই খেলা কোনাে কোনােদিন রাত ১টা পর্যন্তও গড়িয়েছে।

এভাবে আমি ন’লিন দিল্লিতে তাঁর বাসায় প্রত্যহ ৰাৱে ঘন্টা তাস খেলেছি। ভক্টর মল্লিকের মতো ঝানু ব্যক্তি আমাকে চোখের আড়ালে যেতে দেননি। তবুও এই তাসের আজ্ঞর মধ্যথেকেই আমি দিল্লিস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে যােগাযােগ করেছি এবং টীনা অ্যাম্বাসিতে দুদিন তাদের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। অসুস্থতা দেখিয়ে আমি , মরিকের তাসের প্রাক্তার ফাকে ফাকে চীনা অ্যাম্বাসিতে যাই।

তখনকার দিল্লিস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডর মি, শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে আমাকে রেঙ্গুনস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে যােগাযােগ করতে বললেন। আমি ড, মন্ত্রিককে একদিন বললাম : কাজের চাপে দিল্লিতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য এসেছিলাম, খুব ভালাে কাটল, আমি কালকে ঢাকায় চলে যাচ্ছি। মনে হল তিনি অবাক হয়ে ভাবছিলেন, ফয়েজ তাে বেহুলা দিল্লিতে আসেনি। তার কাজটা কী ছিল? আমাদের অ্যাম্বাসির বিরুদ্ধে নয় তাে? আমার কাছে তাে তিনি হাসিমুখ ও তাস খেলা ছাড়া কিছুই পাননি। আমি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে টেলিফোনে তাঁকে কৃতজ্ঞতা ও ধনবাদ জানিয়েছি। এবার আমার রেঙ্গুনে দ্রুত পৌছানাের কথা। | বেঙ্গুনে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় একজন সিনিয়র রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সার ছিলেন। জার সঙ্গে আমার আগে থেকেই গর্ভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি একসময় ‘৬৫-এর পাকঅৱত যুদ্ধের পর আমাকে চিনা রেডি গুতে চাকরিতে যাওয়ার জন্য পাসপাের্ট পেতে সহায়তা করেছিলেন। সেসময় তিনি ছিলেন পাকিস্তান সফরেন অফিসের ডিজি, একমাত্র বাকলি। সেন্য আমি তঁার কাছে কৃ৪। স্কুলের পথে ব্যাংককে প্লেন বদলাতে হয়। আমি ব্যাংককে এক হােটেলে উঠে রেঙ্গুনে আমার আগমনের কথা তাকে ফোনে জানানাের চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভঁর স্ত্রী জানালেন, কায়সার সাহেব একদিন আগেই ব্যাংককে চলে গেছেন এবং ব্যাংকক থেকে তিনি ঢাকায় যাবেন। বাংককের কোনােনা-কোনাে হােটেলেই তঁাকে পাওয়া যাবে। আমি কায়সার সাহেবকে বাংককের একটা নামকরা হােটেলে পেয়ে গেলাম । এই হােটেলটি ভঁয় শখের এবং ব্যাংকক এলে তিনি এ হােটেলেই থাকেন বলে আগে থেকেই তথ্য জানা ছিল।

কেএম কায়সার আমার টেলিফোন পেয়েই বললেন । কথা পরে হবে, তুমি আমার হােটেলে গেস্ট হিসেবে এসে যাও। সেই বিকালেই আমি তাঁর হোটেলে চলে গেলাম। সন্ধ্যার পর ভার কক্ষে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে জানালেন ; রেসুনের চীনা অ্যাম্বাসির সঙ্গে যােগাযােগ করব। তিনি বললেন : কোনাে চিন্তা নেই, সব হবে, তুমি রেসুনে গিয়ে আমার বাসায় থাকবে। দুদিন পর কায়সার সাহেব ঢাকামুখী হলেন আর আমি গেলাম রেঙ্গুনে। বেঙ্গুন এয়ারপাের্টে দুস্কাবাসের একজন কাউন্সিলর আমাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নেন। আমাকে রেঙ্গুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সাবের বাসায় তুলে দেয়া হল। ভাৰী (মিসেস কায়সার) ও ভঁর মেয়ে আমাকে রিসিভ করল। আমি তাদের সঙ্গে রাতে খাওয়ার পরপরই আবার সেই কাউন্সিলরকে হাজির পেলাম। তিনি বললেন : টানা রাষ্ট্রদূত মাই মুং-এর সঙ্গে আমরা আগামীকাল সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ করব, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছে। কাল আমি আসব।

পরদিন সন্ধ্যায় সেই কাউন্সিলর আমাকে গাড়িতে করে চীনা আম্বানির দিকে নিয়ে গেলেন। আমরা অ্যাম্বাসিতে যথাসময়ে পৌছলাম। ঠিক সাড়ে ছটায় নির্ধারিত সময়ে চীনা অ্যাম্বাসেডরের অফিসকক্ষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল । আমাদের আলাপে একপর্যায়ে অ্যাম্বাসেডর মি, মু বললেন, ‘তােমরা খুব শিগগির সুখবর পাবে। এটাই তার কুটনৈতিক বক্তব্য। আমি তাদের এই ভাষা জানি। আনন্দে হিল্লোলিত হয়ে আবার মাওতাই গ্লাসে ঠোট ভেজালাম। আমি চীনে ছিলাম দুৰছৰ-একথা জেনে তিনি উল্লসিত হয়ে উঠলেন । আমাদের নানাধনের আলাপ প্রায় দুমণ্টা স্থায়ী হল।

সবচেয়ে ট্রাজেডির ব্যাপার যে, আমি যখন রেঙ্গুনে তখন শেখ সাহেন আর বেঁচে নেই। তার স্থান দখল করেছেন খন্দকার মুশতাক। আমির দখলে দেশটা । শেখ সাহেবের দেহ পড়ে ছিল তারই বাসার সিঁড়ির ওপরে। সপরিবারে তিনি নিহত হয়েছেন। তার পরিবারের সবাইকেই হত্যা করা হয়েছে। এই নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে সমগ্র দেশ তখন নিমজ্জিত। দূতাবাসের কাউপিলর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে টেলিগ্রাম করে সাইফার জানিয়েছিল—“আমি রেঙ্গুনস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে সেই রাতে প্রায় দুঘন্টা আলাপ করেছি। স্বীকৃতির প্রশ্নে রেঙ্গুন চীনা অ্যাম্বাসের তাকে বলেছেন তােমরা যে-কোনাে সময় স্বীকৃতির ব্যাপারে সুসংবাদ পাবে।” এই টেলিগ্রামটা ফরেন অফিসে মহামূল্যবান সম্পদে পরিণত হল। এ জাতীয় স্বীকৃতির খবরের আশায় ঢাকা তখন অপেক্ষা করছিল। ফরেন অফিসে তখন সেক্রেটারি ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। | এ পরিস্থিতিতে আমি কয়েকদিন পর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। আমি ঢাকায় পৌছার আগেই ব্যাংককে পত্রিকায় দেখতে পেলাম চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশে তখন চারদিক থেকে হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। শেখ সাহেবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মুশতাক হত্যাকারীদের সাহায্যে প্রেসিভেন্ট হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে দেশে দুখন লিখিত্ত-অলিখিত সামরিক শাসন বিদ্যমান। আমি এসে প্রেসিডে ভবনের এক কাহিনী শুনে অবাক হলাম। তা ছিল চীনের “রিকগনিশনের ব্যাপার। আমার এক সাের্স আমার বাড়িতে এসে বললেন কাহিনীটি। তিনি বললেন : রােজার মাস, সব অফিসার বঙ্গভবন থেকে রােজা খুলতে সন্ধ্যায় অল্পক্ষণের জন্য কাজকর্ম বন্ধ করে দেন। সেসময় অর্থাৎ সেই সন্ধ্যায় বঙ্গবনের একজন ডেপুটি সেক্রেটারির টেবিলে একগালা চিঠিপত্রের ডাক এসে পেীছে। অফিসারটি পত্রগুলাে রেখে রােজা খুলতে গেলেন। কয়েকটি চিঠি তিনি খুলেছিলেন। তার মধ্যে একটা ছিল লন্ডনস্থ চীনা অ্যাম্বাসির চিঠি। তিনি ভাবলেন, গুরত্বপূর্ণ চিঠি-রােজা খুলে এসে খুলবেন। তিনি ফিরে এসে চিঠিগুলাে খুলতে খুলতে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ান এবং চীনা অ্যাম্বাসির সেই চিঠিটা ব্যতিক্রমি ইংরেজিতে ছিল। তার মনে হচ্ছিল এই পত্রে স্বীকৃতি-সংক্রান্ত কোনাে বক্তব্য আছে। আরাে কটা চিঠির সঙ্গে এই চিঠিটি তিনি প্রেসিডেন্ট সফরে পাঠিয়ে দেন।

সেসময় প্রেসিডেন্ট মুশতাক, কয়েকজন মন্ত্রী ও কেএম কায়সার রােজা খুলে আড্ডা দিচ্ছিলেন নামাজের পূর্বক্ষণে। চিঠির ভাষা খন্দকার সাহেব উদ্ধার করতে না পেরে কায়সার সাহেবকে বলেন ? দেখুন সম্ভবত এই চিঠিটা চীনাদের। রাষ্ট্রদূত কায়সার সতর্কতার সঙ্গে সময় নিয়ে চিঠিটা পাঠ করে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন । এ তাে রিকগনিশন। চীনাদের এই চিঠির বার্তায় প্রেসিডেন্ট, কায়সার সাহেব ও অন্যরা আনন্দে কোলাকুলি করলেন। চীনারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এই স্বীকৃতির চিঠি তাদের ফরেন অফিস থেকে না এসে লন্ডনস্থ চীনা অ্যাম্বাসি থেকে আসল কেন? স্বাভাবিকভাবেই সে প্রশ্ন উঠেছিল। রাষ্ট্রদূত কায়সার সাহেব বলেছিলেন, সম্ভবত তাদের ফরেন অফিস আমাদের সঠিক ঠিকানা জানে না। তাই লন্ডন অফিসকে বলেছিল।

প্রশ্ন উঠেছিল : শেখ সাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে এই স্বীকৃতির সম্পর্ক বা যোেগসূত্র আছে কি?

কায়সার সাহেব বলেছিলেন—এ ভাবনা ভুল!

অামার দেশ ১৫ আগস্ট ২০০৮

চীনের স্বীকৃতির জন্য শেখ মুজিবের উৎকণ্ঠা ছিল –ফয়েজ আহমদ

রাজনৈতিক ব্যক্তিকে শাসনক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাকালে শাসনব্যবস্থার প্রয়ােজনে অনেক সময় কূটনেতিক সম্পর্ক রাখতে হয়। প্রধানমন্ত্রীকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই একজন। প্রথমশ্রেণীর কূটনীতিকের ভূমিকা নিতে হয়। শেখ মুজিবুর রহমান যখন প্রধানমন্ত্রী। ছিলেন, তখন তার শাসনব্যবস্থার একটি প্রধান দিক ছিল কূটনৈতিক সম্পর্ক। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তার নিয়মিত সম্পর্ক গভীর ছিল। একজন প্রধানমন্ত্রীকে এভাবেই বিদেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য ও রাজনৈতিক সম্পর্কের পথ বেছে নিতে হয়। তিনি ঢাকাস্থ কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রধানদের সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। প্রধানমন্ত্রীকে এই কাজটা সর্বক্ষেত্রে নজরে রেখে চলার অনেক দেশেই নিয়ম আছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর সবটা সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ছেড়ে দেন না। বিশেষ করে বড় কোনাে নিয়েই আমাদের পররাষ্ট্র দফতর শেখ সাহেবকে নাজানিয়ে করতে পারেনি। শেখ সাহেবের জীবদ্দশায় চীনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক তখনাে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ চীনের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক থাকারও কোনাে সুযােগ ছিল না। কিন্তু দুঃখজনক যে, শেখ মুজিবের জীবিতকালে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনাে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর বিশেষ কারণও সন্ধান করা সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন কে এম কায়সার। তার সঙ্গে পিকিংয়ে চীনা কৃষি গবেষণার জন্য সিএসপি ওবায়দুল্লাহ কাউন্সিলর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তারা পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেননি এবং তাদের ঢাকায় ছুটিতে আসতে দেয়া হয়নি। নানা কৌশলে এ দুজন উচ্চস্তরের বাঙালির করাচিতে প্রত্যাবর্তন ঠেকিয়ে রেখেছিল এবং তারা মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তির জনা পিকিংয়েই অবস্থান করছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরপরই এই দুই বাঙালি কূটনীতিক পিকিং থেকে সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন এবং শেখের আনুগত্য স্বীকার করেন। তখন তারা শেখ সাহেবকে বলেছিলেন, চীন সরকার নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। এবং তারা আরাে বলেন যে, যে রাজনৈতিক অবস্থায় চূড়ান্ত পরিবর্তন হয়েছে, সেটা চীন উপলব্ধি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের এই সুযােগ এখনই গ্রহণ করা উচিত। নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেন। চীনের পক্ষ থেকেও কোনােপ্রকার ইঙ্গিত আসতে পারে—এ কথাও তিনি বলেছিলেন। কিন্তু চীন সরাসরি বা কোনাে রাষ্ট্রের মাধ্যেমে বাংলাদেশের সঙ্গে যােগাযােগ তখনাে করেনি। বাংলাদেশ অন্য দেশের মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে ঠিকই, তবে কোনােভাবেই চীনের দিক থেকে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সম্প্রসারিত হয়নি। তখন বাংলাদেশ মনে করেছিল অন্য কোনাে রাষ্ট্রর গােপন হস্তক্ষেপের কারণে হয়তাে চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর হচ্ছে না। এ অবস্থার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক যােগাযােগের চেষ্টা অব্যাহত রেখেও বেসরকারিভাবে তিনি পিকিংয়ের সঙ্গে যােগসূত্র রক্ষার চেষ্টা করেন।

চীনে তখন চরম রাজনৈতিক দুর্যোগ ছিল। ছেখঠি সালের মাঝামাঝি থেকে । মে) সমগ্র চীনে একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের বিস্ফোরণ ঘটে। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল বেনামে মাওসেতুংয়ের নেতৃত্বে সমগ্র চীনে আচ্ছাদিত রাজনৈতিক উত্থান। তিনি এই উত্থানে যুবক-যুবতীদেরই প্রধানত যােগদানের আহবান জানিয়েছিলেন। তরুণদের এই জাগরণ ক্রমান্বয়ে সরাসরি গােপন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর হয়। বয়স্ক রাজনীতিকর বিপক্ষ হয়ে যান এবং শেষপর্যন্ত এই আন্দোলন সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এই বিপ্লব দশবছর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। সেসময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের বিশেষ কোনাে নতুন ভূমিকা ছিল না। এর মধ্যে এই বিপ্লব নিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ছিন্ন হয় এবং চীনদেশে সেসময় কর্মরত প্রায় ২২ হাজার ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিক্যাল কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবাইকে সােভিয়েত রাশিয়া প্রত্যাহার করে নেয়। বৈদেশিক নীতিতে চীন এই সময় নতুন কোনাে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি সেসময়ে স্থগিত রেখেছিল বলে। আমাদের ধারণা। সমগ্র বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক শক্তি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সােভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এই জাতীয় বিপ্লবের বিরােধী। অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব তখন দুভাগে বিভক্ত। এমন পরিস্থিতিতে আমরা নতুন স্বাধীন দেশ হিসেবে চীনাদের তখনকার বৈদেশিক নীতিতে নতুন অবস্থানের দৃষ্টিতে ছিলাম।

চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার পর একটি কথাও উচ্চারণ করেনি। কিন্তু বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। আমাদের তখন মনে হয়েছে, নিজেদের রাজনৈতিক বিপর্যয় এবং অর্থনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশের স্বীকৃতির প্রশ্নটি তাদের সম্মুখে বৃহৎ রূপ লাভ করেনি। এমন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা শেখ মুজিবের মৃত্যুর দিন পর্যন্ত চীনের স্বীকৃতিহীন অবস্থায় ছিলাম। শেখ সাহেবের জীবিতকালে চীনকে বন্ধু হিসেবে দেখানাের জন্য অন্য বাস্তুৰ পন্থাও গ্রহণ করা হয়েছিল। তিনি একপর্যায়ে চীনের কাছে অযাচিতভাবে পাঁচ হাজার টন পাট প্রেণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাটের অর্থ বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দাবি করা হয়নি। কিন্তু একটি নিউজ এজেন্সি চীনের সঙ্গে এই পাটকূটনীতি সংক্রান্ত গোপন খবর প্রকাশ করে দেয়। তার ফলে আমেরিকানদের চাপে

বাংলাদেশ, এমনকি গােপনে সেই পাট টানে রফতানি করতে সক্ষম হয়নি। চীন এসব রাজনৈতিক অগ্রগতি সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। সাংস্কৃতিক বিপ্রণের সাতবছর সেসময় চলে গেছে। রাজনৈতিকভাবে মা সমর্থকরা চীনে এমেই দুর্বল হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী চৌয়েন লাই ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী-তের তখন মৃত্যু ঘটেছে। ইতোমধ্যে মাও-এর মৃত্যু ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে চীন রাজনৈতিকভাবে নিশ্চিত হয়ে পড়ে। সেসময় অর্থায়, ১৬ খ্রিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের স্বীকৃতি অর্জনে সমর্থ হয়। চীন তখন স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন প্রবীণ নেতাদের অধিকাংশকে হারিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চাঁনের পক্ষে কারো সঙ্গে নতুন সম্পর্ক স্থাপনের প্রশ্ন ছিল না। যদিও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল, চীনের কাছে সেই তাৎপর্য অতটা ছিল না। ফলে আমাদের স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটা ছিল মন্থর। কিন্তু আমাদের দিক থেকে চীনের শীকৃতি লাভের চেষ্টা অব্যাহত ছিল। এসময় আমাকে এক অপরাহ্নে শেখ সাহেব নিজস্ব এক বিশেষ আলােচনায় ডেকে পাঠান। ৭৪ সালের কোনাে এক সময় শেখ সাহেবের সখে আমার চীনের সম্পর্ক সম্পর্কে নী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

দেন শিয়াওপিং, ছাড়া চীনে প্রাচীন নেতাদের আর কে জীবিত ছিলেন না। তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নির্বাসিত নিজ এলাকার একজন সাধারণ নাগরিক ঐ শ্রেষ্ঠ মুক্তিযােদ্ধা। শাসকদের এই অনুপস্থিতিকালে এক নতুন প্রজন্ম এখয়ে ক্ষমতা হস্তগত করতে থাকে। এই পরিবর্তনে বিপ্লবী-প্রতিবিপ্লবীদের কোনাে ভূমিকা ছিল না। এ সময়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রবীণ নেতৃবর্গের সবারই অবসান ঘটেছে। আমার সঙ্গে পিকিংয়ে সম্পর্কিত রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করে আমাকে গ্রসর হতে হবে, এ ভাবনাই ভাবতে লাগলাম।

শেখ সাহেবের সঙ্গে আলাপের পর আমাকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পথ খুঁজতে হল। শেষপর্যন্ত ঠিক হল হ্যানয় থেকে আমি চীনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করব। প্রথম অভিযানে হংকং হয়ে আমি হ্যানয়ে পেীছেছিলাম। শেখ সাহেবের প্রশাসনে গােপন নির্দেশে আমার গােপনীয় টিকিট ও অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা ছিল। এখানে থেকেই আমার গােপন কুটনৈতিক কর্মকাঞ্জের যাত্রা এর হল। সরকারের বাইরে অবস্থান করে এ ধরনের দায়িত্ব পালনের নজির দ্বির্তীয়টি আছে কিনা জানা নেই।

আমি ও শেখ সাহেবই কেবল ওই বিষয় সম্পর্কে জানতাম, বিশ্বের অন্য কেউ এটা জানত না। হংকং-নয় দশদিনব্যাপী মিশন ব্যর্থ হয়। ওখান থেকে প্রকৃত শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী কার্যক্রম যেভাবে স্থির করা হয়েছিল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম, কেবল অপেক্ষায় ছিলাম একটি ম্যাসেজের। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান টীনের সঙ্গে সম্পর্ক করার জন্য এই ন্যাকুল ছিলেন যে তিনি ২/১ দিন পরপরই আমার সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করতেন । ষ্টার এই ব্যাকুলছার কারণ হচ্ছে, তিনি আমেরিকানদের দৃষ্টতা ও কার্যক্রমের উত্তর দিতে চেয়েছিলেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক করে। সে কারণে চীন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল । কিন্তু দুঃখজনক যে, সেসময় চীনের অভ্যন্তরীণ গােলযােগের কারণে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরিসমাপ্তি প্রান্তদেশে এসে চীনে অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ ছিল। তারা সেসময় তাৎক্ষণিক কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া বৈদেশিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করত না। তারা ভেবেছিল, বাংলাদেশকে স্বীকৃতির প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিশেষ জরুরি নয়। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্গলা ফেরত আসলেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া যাবে। বাংলাদেশের স্বীকৃতি চীনা দৃষ্টিকোণ থেকে তখন আর কোনাে বাধার সম্মুখীন ছিল না, কেবল দাফতরিক কাজটাই বন্ধ ছিল। বিভিন্ন সূত্রে টীনা বিদেশ-অফিসের এই অবস্থান আমি জানতাম। | আমার কাছে আকস্মিকভাবে খবর আসল দিল্লিতে চলে যাওয়ার জন্য। শেখ সাহেব জানতেন। তিনি আমাকে বললেন, তুই সাবধান। আমি জানি, তোর অভিযানের সঙ্গে কোনােভাবেই আমার নাম সম্পর্কিত তা বলিস না!’ এবার দিল্লিতে আমাদের দূতাবাসে আমার কয়েকজন নিকটবন্ধু অফিসার ছিলেন। এদের কেউ কাউন্সিলর, কেই ফাস সেক্রেটারি, সর্বোপরি হাইকমিশনার (আঘাসের) এক্সার মল্লিকের আমি একসময় নিকটব্যক্তি ছিলাম। প্রেস কাউন্সিলর এসএমএ চৌধুরীকে টেলিফোনে বললাম, আমার দিল্লিতে বিশেষ কাজে যাওয়ার তাগিদ আছে এবং তাকে “সহনশীল’ ভাড়ায় একটা হােটেল বুক করতে বললাম। তিনি ফোনে জানালেন সব তৈরি আছে, এয়ারপাের্টে আমি আপনাকে রিসিভ করব। | এয়ারপাের্টে নেমে দেখি মি, চৌধুরী আরাে দুজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তার ব্যক্তিগত গাড়িতে আমাকে উঠালেন। আমি বললাম, কোন্ হোেটলে যাচ্ছি? মি, চৌধুরী কথা বলেন কম, সবসময় তঁার ওষ্ঠাধারে হাসি । তিনি হাসলেন। আমরা শেষ পর্যন্ত একটা বাসায় পেীছলাম। তিনি বললেন, এটাই আপনার হােটেল। সেই বাড়িটা ছিল মি, চৌধুরীর সরকারি আবাস বা রেসিদ্ধ, দূতাবাসের অংশ। অর্থাৎ আমি তাঁর বাড়িতে উঠলাম। আমার পূর্বপরিচিত তাঁর স্ত্রী ও দুটি ছােট মেয়ে দৌড়ে আসল।

সকাল সাড়ে ৯ টায় দূতাবাসের টেলিফোনে বলা হল- ফয়েজ আহমেদকে চাই। ফোন ধরে দেখি হাইকমিশনার ভক্টর ময়িক। তিনি তখনই তার অফিসে চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। দশটার পর তার সঙ্গে দেখা করে অনেক কথাই হল। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ব্যক্তি। তঁার চিন্তা হল ‘আমি কেন দিব্বিতে’—এ গােপন তথাটা বের করতে হবে। সেজন্য তিনি বললেন । আমার বাসায় তুমি থাকো এবং মি, চৌধুরীকে তােমার জিনিসপত্র আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে বলাে। আমার বাড়িতে রােজ দীর্ঘসময় তাস খেলা হবে তোমাকে নিয়ে।

হাসিমুখে বললাম ; এখন বেবী চৌধুরীর বাসাতেই থাকি, তবে তাস খেলার আস্থায় আজকে থেকেই আমি যাব।এই শুরু হল আমাদের প্রাত্যহিক ১টা থেকে তাস খেলা এবং সেই খেলা কোনাে কোনােদিন রাত ১টা পর্যন্তও গড়িয়েছে।

এভাবে আমি ন’লিন দিল্লিতে তাঁর বাসায় প্রত্যহ ৰাৱে ঘন্টা তাস খেলেছি। ভক্টর মল্লিকের মতো ঝানু ব্যক্তি আমাকে চোখের আড়ালে যেতে দেননি। তবুও এই তাসের আজ্ঞর মধ্যথেকেই আমি দিল্লিস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে যােগাযােগ করেছি এবং টীনা অ্যাম্বাসিতে দুদিন তাদের সঙ্গে আমার বৈঠক হয়েছে। অসুস্থতা দেখিয়ে আমি , মরিকের তাসের প্রাক্তার ফাকে ফাকে চীনা অ্যাম্বাসিতে যাই।

তখনকার দিল্লিস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডর মি, শেষপর্যন্ত বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে আমাকে রেঙ্গুনস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে যােগাযােগ করতে বললেন। আমি ড, মন্ত্রিককে একদিন বললাম : কাজের চাপে দিল্লিতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য এসেছিলাম, খুব ভালাে কাটল, আমি কালকে ঢাকায় চলে যাচ্ছি। মনে হল তিনি অবাক হয়ে ভাবছিলেন, ফয়েজ তাে বেহুলা দিল্লিতে আসেনি। তার কাজটা কী ছিল? আমাদের অ্যাম্বাসির বিরুদ্ধে নয় তাে? আমার কাছে তাে তিনি হাসিমুখ ও তাস খেলা ছাড়া কিছুই পাননি। আমি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে টেলিফোনে তাঁকে কৃতজ্ঞতা ও ধনবাদ জানিয়েছি। এবার আমার রেঙ্গুনে দ্রুত পৌছানাের কথা। বেঙ্গুনে আমাদের অত্যন্ত প্রিয় একজন সিনিয়র রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সার ছিলেন। জার সঙ্গে আমার আগে থেকেই গর্ভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি একসময় ‘৬৫-এর পাকঅৱত যুদ্ধের পর আমাকে চিনা রেডি গুতে চাকরিতে যাওয়ার জন্য পাসপাের্ট পেতে সহায়তা করেছিলেন। সেসময় তিনি ছিলেন পাকিস্তান সফরেন অফিসের ডিজি, একমাত্র বাকলি। সেন্য আমি তঁার কাছে কৃ৪। স্কুলের পথে ব্যাংককে প্লেন বদলাতে হয়। আমি ব্যাংককে এক হােটেলে উঠে রেঙ্গুনে আমার আগমনের কথা তাকে ফোনে জানানাের চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভঁর স্ত্রী জানালেন, কায়সার সাহেব একদিন আগেই ব্যাংককে চলে গেছেন এবং ব্যাংকক থেকে তিনি ঢাকায় যাবেন। বাংককের কোনােনা-কোনাে হােটেলেই তঁাকে পাওয়া যাবে। আমি কায়সার সাহেবকে বাংককের একটা নামকরা হােটেলে পেয়ে গেলাম । এই হােটেলটি ভঁয় শখের এবং ব্যাংকক এলে তিনি এ হােটেলেই থাকেন বলে আগে থেকেই তথ্য জানা ছিল।

কেএম কায়সার আমার টেলিফোন পেয়েই বললেন । কথা পরে হবে, তুমি আমার হােটেলে গেস্ট হিসেবে এসে যাও। সেই বিকালেই আমি তাঁর হোটেলে চলে গেলাম। সন্ধ্যার পর ভার কক্ষে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে জানালেন ; রেসুনের চীনা অ্যাম্বাসির সঙ্গে যােগাযােগ করব। তিনি বললেন : কোনাে চিন্তা নেই, সব হবে, তুমি রেসুনে গিয়ে আমার বাসায় থাকবে। দুদিন পর কায়সার সাহেব ঢাকামুখী হলেন আর আমি গেলাম রেঙ্গুনে। বেঙ্গুন এয়ারপাের্টে দুস্কাবাসের একজন কাউন্সিলর আমাকে তার গাড়িতে উঠিয়ে নেন। আমাকে রেঙ্গুনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কেএম কায়সাবের বাসায় তুলে দেয়া হল। ভাৰী (মিসেস কায়সার) ও ভঁর মেয়ে আমাকে রিসিভ করল। আমি তাদের সঙ্গে রাতে খাওয়ার পরপরই আবার সেই কাউন্সিলরকে হাজির পেলাম। তিনি বললেন : টানা রাষ্ট্রদূত মাই মুং-এর সঙ্গে আমরা আগামীকাল সন্ধ্যায় সাক্ষাৎ করব, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা হয়েছে। কাল আমি আসব।

পরদিন সন্ধ্যায় সেই কাউন্সিলর আমাকে গাড়িতে করে চীনা আম্বানির দিকে নিয়ে গেলেন। আমরা অ্যাম্বাসিতে যথাসময়ে পৌছলাম। ঠিক সাড়ে ছটায় নির্ধারিত সময়ে চীনা অ্যাম্বাসেডরের অফিসকক্ষে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল । আমাদের আলাপে একপর্যায়ে অ্যাম্বাসেডর মি, মু বললেন, ‘তােমরা খুব শিগগির সুখবর পাবে। এটাই তার কুটনৈতিক বক্তব্য। আমি তাদের এই ভাষা জানি। আনন্দে হিল্লোলিত হয়ে আবার মাওতাই গ্লাসে ঠোট ভেজালাম। আমি চীনে ছিলাম দুৰছৰ-একথা জেনে তিনি উল্লসিত হয়ে উঠলেন । আমাদের নানাধনের আলাপ প্রায় দুমণ্টা স্থায়ী হল।

সবচেয়ে ট্রাজেডির ব্যাপার যে, আমি যখন রেঙ্গুনে তখন শেখ সাহেন আর বেঁচে নেই। তার স্থান দখল করেছেন খন্দকার মুশতাক। আমির দখলে দেশটা । শেখ সাহেবের দেহ পড়ে ছিল তারই বাসার সিঁড়ির ওপরে। সপরিবারে তিনি নিহত হয়েছেন। তার পরিবারের সবাইকেই হত্যা করা হয়েছে। এই নিদারুণ পরিস্থিতির মধ্যে সমগ্র দেশ তখন নিমজ্জিত। দূতাবাসের কাউপিলর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে টেলিগ্রাম করে সাইফার জানিয়েছিল—“আমি রেঙ্গুনস্থ চীনা অ্যাম্বাসেডরের সঙ্গে সেই রাতে প্রায় দুঘন্টা আলাপ করেছি। স্বীকৃতির প্রশ্নে রেঙ্গুন চীনা অ্যাম্বাসের তাকে বলেছেন তােমরা যে-কোনাে সময় স্বীকৃতির ব্যাপারে সুসংবাদ পাবে।” এই টেলিগ্রামটা ফরেন অফিসে মহামূল্যবান সম্পদে পরিণত হল। এ জাতীয় স্বীকৃতির খবরের আশায় ঢাকা তখন অপেক্ষা করছিল। ফরেন অফিসে তখন সেক্রেটারি ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমদ। এ পরিস্থিতিতে আমি কয়েকদিন পর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। আমি ঢাকায় পৌছার আগেই ব্যাংককে পত্রিকায় দেখতে পেলাম চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। দেশে তখন চারদিক থেকে হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস সৃষ্টি হচ্ছে। শেখ সাহেবকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মুশতাক হত্যাকারীদের সাহায্যে প্রেসিভেন্ট হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে দেশে দুখন লিখিত্ত-অলিখিত সামরিক শাসন বিদ্যমান। আমি এসে প্রেসিডে ভবনের এক কাহিনী শুনে অবাক হলাম। তা ছিল চীনের “রিকগনিশনের ব্যাপার। আমার এক সাের্স আমার বাড়িতে এসে বললেন কাহিনীটি। তিনি বললেন : রােজার মাস, সব অফিসার বঙ্গভবন থেকে রােজা খুলতে সন্ধ্যায় অল্পক্ষণের জন্য কাজকর্ম বন্ধ করে দেন। সেসময় অর্থাৎ সেই সন্ধ্যায় বঙ্গবনের একজন ডেপুটি সেক্রেটারির টেবিলে একগালা চিঠিপত্রের ডাক এসে পেীছে। অফিসারটি পত্রগুলাে রেখে রােজা খুলতে গেলেন। কয়েকটি চিঠি তিনি খুলেছিলেন। তার মধ্যে একটা ছিল লন্ডনস্থ চীনা অ্যাম্বাসির চিঠি। তিনি ভাবলেন, গুরত্বপূর্ণ চিঠি-রােজা খুলে এসে খুলবেন। তিনি ফিরে এসে চিঠিগুলাে খুলতে খুলতে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ান এবং চীনা অ্যাম্বাসির সেই চিঠিটা ব্যতিক্রমি ইংরেজিতে ছিল। তার মনে হচ্ছিল এই পত্রে স্বীকৃতি-সংক্রান্ত কোনাে বক্তব্য আছে। আরাে কটা চিঠির সঙ্গে এই চিঠিটি তিনি প্রেসিডেন্ট সফরে পাঠিয়ে দেন।

সেসময় প্রেসিডেন্ট মুশতাক, কয়েকজন মন্ত্রী ও কেএম কায়সার রােজা খুলে আড্ডা দিচ্ছিলেন নামাজের পূর্বক্ষণে। চিঠির ভাষা খন্দকার সাহেব উদ্ধার করতে না পেরে কায়সার সাহেবকে বলেন ? দেখুন সম্ভবত এই চিঠিটা চীনাদের। রাষ্ট্রদূত কায়সার সতর্কতার সঙ্গে সময় নিয়ে চিঠিটা পাঠ করে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন । এ তাে রিকগনিশন। চীনাদের এই চিঠির বার্তায় প্রেসিডেন্ট, কায়সার সাহেব ও অন্যরা আনন্দে কোলাকুলি করলেন। চীনারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এই স্বীকৃতির চিঠি তাদের ফরেন অফিস থেকে না এসে লন্ডনস্থ চীনা অ্যাম্বাসি থেকে আসল কেন? স্বাভাবিকভাবেই সে প্রশ্ন উঠেছিল। রাষ্ট্রদূত কায়সার সাহেব বলেছিলেন, সম্ভবত তাদের ফরেন অফিস আমাদের সঠিক ঠিকানা জানে না। তাই লন্ডন অফিসকে বলেছিল।

প্রশ্ন উঠেছিল : শেখ সাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে এই স্বীকৃতির সম্পর্ক বা যোেগসূত্র আছে কি?

কায়সার সাহেব বলেছিলেন—এ ভাবনা ভুল!

আমার দেশ ১৫ আগস্ট ২০০৮
সেসময় প্রেসিডেন্ট মুশতাক, কয়েকজন মন্ত্রী ও কেএম কায়সার রােজা খুলে আড্ডা দিচ্ছিলেন নামাজের পূর্বক্ষণে। চিঠির ভাষা খন্দকার সাহেব উদ্ধার করতে না পেরে কায়সার সাহেবকে বলেন ? দেখুন সম্ভবত এই চিঠিটা চীনাদের। রাষ্ট্রদূত কায়সার সতর্কতার সঙ্গে সময় নিয়ে চিঠিটা পাঠ করে লাফিয়ে উঠলেন, বললেন । এ তাে রিকগনিশন। চীনাদের এই চিঠির বার্তায় প্রেসিডেন্ট, কায়সার সাহেব ও অন্যরা আনন্দে কোলাকুলি করলেন। চীনারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে এই স্বীকৃতির চিঠি তাদের ফরেন অফিস থেকে না এসে লন্ডনস্থ চীনা অ্যাম্বাসি থেকে আসল কেন? স্বাভাবিকভাবেই সে প্রশ্ন উঠেছিল। রাষ্ট্রদূত কায়সার সাহেব বলেছিলেন, সম্ভবত তাদের ফরেন অফিস আমাদের সঠিক ঠিকানা জানে না। তাই লন্ডন অফিসকে বলেছিল।
প্রশ্ন উঠেছিল : শেখ সাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে এই স্বীকৃতির সম্পর্ক বা যোগসূত্র আছে কি?
কায়সার সাহেব বলেছিলেন—এ ভাবনা ভুল!
আমার দেশ ১৫ আগস্ট ২০০৮
সামরিক সমাজের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর স্ট্র্যাটেজি
বােরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আমলে স্বৈরতন্ত্রী সামরিক ব্যবস্থার বদলে। লিবারেল সমাজের কথা ভেবেছেন। আর এই সমাজের ভিত্তি হিসাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। সেইসঙ্গে একথাও উপলব্ধি করেছেন, দীর্ঘস্থায়ী সামরিক ব্যবস্থা লিবারেল গণতান্ত্রিক তত্ত্ব ও এথিকস বিরােধী। যেক্ষেত্রে লিবারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিটি ব্যক্তির সুষম ও সম্পূর্ণ পরিবৃদ্ধির ওপর জোর দেয়, সেক্ষেত্রে সামরিক ব্যবস্থা সামরিক স্বার্থ, সামরিক স্বার্থ-উদ্ভূত রাজনীতি, সামরিক স্বার্থ-উদ্ভূত অর্থনীতির অগ্রাধিকারের ওপর সকল মানুষের স্বার্থের বিপরীতে জোর দেয়। সেজন্য লিবারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সামরিক ব্যবস্থা পরস্পরবিবাের্থী। লিবারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল মানুষ সমস্বাধীনতার অধিকারী, সেক্ষেত্রে সামরিক ব্যবস্থায় সামরিক ব্যক্তিরা অধিকতর স্বাধীনতার অধিকারী এবং অন্যান্য মানুষ শৃঙ্খলাবদ্ধ, প্রত্যক্ষ ফিজিক্যাল ডমিনেশনে আবদ্ধ।
বঙ্গবন্ধুরা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, সামরিক ব্যবস্থা সামরিক স্বার্থের ওপর অগ্রাধিকার দেয়ার দরুন সামরিক স্বার্থ-উদ্ভূত রাজনীতি সাধারণ মানুষের রাজনীতি দমন করে রাখে। অন্যপক্ষে সামরিক স্বার্থ-উদ্ভূত অর্থনীতি জেনুইন ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দেয় এবং দেশের সম্পদের ওপর নিজেদের কজা শক্তিশালী করে। নির্বাচনের প্রহসন দিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ক্যান্টনমেন্টের বাইরে প্রসারিত করে এবং ক্যান্টনমেন্ট ক্ষমতার কেন্দ্র, এই ডকট্রিন প্রচার করতে থাকে। ক্ষমতার কেন্দ্র সামরিক শক্তি এবং সাধারণ মানুষ প্লেভ এবং সার্কের সমন্বয়ে গড়া এক সভ্য ।
বঙ্গবন্ধুদের সামরিক শক্তিবিরােধী ক্রিটিকের মূল এখানেই। সামরিক ব্যবস্থার মধ্যে মানুষী অন্তঃসার বিকশিত হওয়ার কোনাে পরিসর ও সম্ভাবনা নেই। তার কারণ মানুখী অন্তঃসার কেবল মুক্ত, সচেতন ও সৃষ্টিশীল পরিসরে বিকাশ লাভ করে। সাধারণ মানুষ এই পরিসরে নির্বাচনের মধ্যদিয়ে নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারে। সামরিক ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের অন্তঃশীল মনুষ্যত্ব পর্যায়ে বাতিল
একজন লিবারেলের পক্ষে গণতন্ত্র থেকে সরে এসে সামরিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করা সম্ভব হয় না। সেজন্য বঙ্গবন্ধুদের একপক্ষে লিবারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে লড়াই করতে হয়েছে, অন্যপক্ষে সামরিক ব্যবস্থার বিপক্ষে সাধারণ মানুষদের মবিলাইজ করতে হয়েছে।
পাকিস্তানের মতাে অসম সমাজে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস সামরিক শক্তি, সেজন্য বঙ্গবন্ধুদের কাছে স্পষ্ট রাজনৈতিক ক্ষমতার উদ্দেশ্য অসম সমাজ টিকিয়ে রাখা নয় এবং সামরিক শক্তির কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়া নয়। এই দুই ফ্রন্টে তারা কাজ করেছেন।
রাজনৈতিক ক্ষমতা সামরিক শক্তিবিরােধী বলেই রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সামরিক শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে, আবার রাজনৈতিক ক্ষমতা পর্যায়ে সামরিক শক্তির সঙ্গে আপস শুরু করলে সমাজের রূপান্তর কখনও সম্ভব হয় না। বঙ্গবন্ধুরা একপক্ষে রাজনীতি দিয়ে সমাজের রূপান্তর করতে চেয়েছেন, অন্যপক্ষে রাজনীতি দিয়ে সামিরক শক্তি চূর্ণ করতে চেয়েছেন। তারা বুঝেছেন রাষ্ট্র ফ্রিডমকে বহিষ্কার করে শাসন করছে এবং এই শাসনে ডেসপটিক পটেনশিয়াল স্পষ্ট হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুরা লিবারেল গণতান্ত্রিক এজেন্টের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। এটা ঠিক নয়, তারা ভেবেছেন লিবারেল গণতন্ত্র সবসময় গণতন্ত্রী বাজার সমাজ শ্রেণীবিভাজনসহ মেনে নেবে। এক্ষেত্রে তারা যেমন ধনতন্ত্রী বাজার ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থা যারা টিকিয়ে রাখছে সেই সেনাশাসনের বিরােধিতা করেছেন, তেমনি এই বিরােধিতার স্ট্র্যাটেজি হিসাবে বিপ্লবের কথা ভেবেছেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনা ও শক্তি তৈরি করে ক্ষমতার কেন্দ্র হিসাবে সামরিক শক্তির একচ্ছত্র অধিকার চূর্ণ করে দিতে হবে, অন্যপক্ষে সাধারণ মানুষকে ধনতন্ত্রী বাজার ব্যবস্থার শােষণ থেকে মুক্তি দিতে হবে। তাদের কাছে গণতন্ত্র নির্বাচন নয়, বরং নির্বাচন হচ্ছে সার্বিক ব্যবস্থার মধ্যে সাধারণ মানুষের শক্তির অংশগ্রহণ। সেজন্য নির্বাচনের বৈপ্লবিক পটেনশিয়ালের সামরিক ব্যবস্থার ডেসপটিক পটেনশিয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। বন্দুকের শক্তির ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা বঙ্গবন্ধুরা কখনও সমর্থন করেননি। পাকিস্তান রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে তাদের এই জেহাদ কখনও শেষ হয়নি। রাষ্ট্রশক্তি যদি সামরিক শক্তি হয়, তাহলে সামরিক শক্তি সবসময় সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে। তখন তৈরি হয় দমননীতি, নির্যাতন, গােয়েন্দাশাসন।
গােয়েন্দাশাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অধিকার অবারিত করার জন্য তারা সাংবিধানিক শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতার ভিত্তি ও মূল হিসাবে ভেবেছেন। একদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের নির্যাতনময় অভিজ্ঞতা মনে রেখে বঙ্গবন্ধুরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের
সাংবিধানিক ভিত্তিকে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্র হিসাবে গ্রহণ করেছেন, অন্যদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন কু থেকে বর্তমান সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত্তিকে রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্র হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। বাংলাদেশ বিপ্লবের পক্ষে বঙ্গবন্ধুরা যে নৈতিক টোন তৈরি করেছেন এবং সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন তার একেবারে বিপরীত সামরিক শক্তিউক্ত ক্ষমতা। এই ক্ষমতা একদিকে যেমন বাংলাদেশ উদ্ভবের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ক্ষমতার সঙ্গে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। এই দ্বন্দ ও সংঘাতের অবসানের ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। জনকণ্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৮ তােমরা তোমাদের নেতাকে হত্যা করলে?
আবুল মাল আবদুল মুহিত
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি ম্যানিলায় ছিলাম। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রস্তাবমতে আমি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আগস্টের ১৫ তারিখ সকালে বাসায়ই ছিলাম। অসুস্থতার কারণে অফিসে যাইনি।
ইতিমধ্যে একজন ভারতীয় বহু টেলিফোন করে আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি বাংলাদেশে সামরিক অত্যুথান বা এ-ধরনের কোনাে ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানি কিনা। আমি তাকে বললাম । অসম্ভব, বাংলাদেশে যেখানে আমরা সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীন হয়েছি, সেখানে এ-ধনের একটা ঘটনা ঘটতে পারে না।
বন্ধুটি বললেন । আমরা একটা অসমর্থিত খবর পেয়েছি যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। তিনি হত কি আহত সেটা জানা যায়নি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ম্যানিলায় অবস্থিত এশিয়ান প্রেস ফাউন্ডেশনের কর্ণধার অমিতাভ চৌধুরীকে টেলিফোন করলাম। মনে হল বাংলাদেশে কিছু ঘটলে তারা জানতে পারেন।
তিনি বললেনঃ হ্যা, আমরাও খবর পেয়েছি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বললেন : সেখানে নাসের নামে একজন বাঙালি ছেলে আছে। তাঁকে পাঠিয়েছি খোঁজখবর নেয়ার জন্য।
এরপর আমি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অফিসে চলে যাই। সেখানে ৪-৫ জন বাঙালি ছিল। খবরটি সবাইকে হতবাক করে। আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না বাংলাদেশে এরকম একটি ঘটনা ঘটতে পারে।
আর আমার ব্যক্তিগত বেদনা অন্যখানে। আমি জুলাই মাসে ঢাকায় আসি। কয়েকদিন ঢাকায় ছিলাম। এর আগে সৌদি আরবে যাই দুটি সথেলনে যােগ দিতে। তখন বঙ্গবন্ধু ভীষণ ব্যস্ত। ফলে আমি আর দেখা করার চেষ্টা করলাম না। এর আগে ১৯৭২ সাল থেকে যখনই ঢাকায় আসতাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতাম। কিন্তু পচাত্তরের জুলাই ছিল ব্যতিক্রম। ৪ আগস্ট থেকে ম্যানিলা চলে যাই।
আবার ১৫ আগস্টের প্রসঙ্গে আসি। অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসি। আমার বাসী তখন কারবালা হয়ে গেছে। সবাই শােকে মুহ্যমান। আমার ছেলেমেয়েরা বঙ্গবন্ধুকে জানত। বড়মেয়ে ৬-দফা আন্দোলনের সময়ে স্কুলে পড়ে। সে তার

ডায়েরিতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ছােট্ট ছােট্ট মন্তব্য লিখে রাখত। ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমার কাছে শুনত। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু যখন ওয়াশিংটন যান তখনও তারা তার সঙ্গে দেখা করেছে।
বঙ্গবন্ধুর মানবিক গুণ ছিল অসাধারণ । মানুষকে সহজেই তিনি মােহিত করতে পারতেন, আপন করতে পারতেন। অনেক সময় কোনাে কারণে হয়তাে তাঁর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়েছি। তিনি সবকিছু শুনলেন। তারপর একটা দিলখােলা হাসি দিয়ে আমার সব ক্ষোত-বেদনা প্রশমিত করে দিলেন। এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে আমি এডিবিতে যােগ দিই। ওয়াশিংটন থেকে সরাসরি ম্যানিলায়। মার্চ মাসে ম্যানিলা থেকে ঢাকায় আসি এডিবির কাজে। সেসময় আমি অফিসিয়াল দায়িত্ব ছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাদা দেখা করি। তখন বাকশাল গঠন করা হয়েছে, যদিও কমিটির নাম ঘােষণা করা হয়নি। বাকশাল নিয়ে আমি সন্তুষ্ট ছিলাম না, সেটি তাকে জানাই। তিনি হাসতে হাসতে আমাকে বললেন : “তুমি বাকশাল সম্পর্কে আমাকে বলছ। আমি তাে সারাজীবন সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলন করে এসেছি। আমি কী দুঃখে এ ব্যবস্থায় যাচ্ছি তা তােমাকে বুঝতে হবে।’ আমি বলতে চেষ্টা করেছিলাম। বিরােধিতা করার সুযােগ না দিলে আপনি হয়তাে। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। এতে তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধই হয়েছিলেন। আমার কথার উত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন । বেশ কিছুদিন ধরে তুমি দেশের বাইরে আছি। এজনা বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে। তবে তিনি এটি বলেছিলেন কথার কথা হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেটাই ছিল আমার শেষ সাক্ষাৎ।
ম্যানিলায় সেসময় বাঙালি সমাজটি খুবই ছোট ছিল। তবে ভারতীয়রা সংখ্যায় অনেক বেশি। বাংলাদেশে সামরিক অত্যুত্থানের খবর শুনে অনেকেই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে এরকম একটি ঘটনা ঘটতে পরে তারা তা ভাবতে পারেনি। ম্যানিলায় কূটনৈতিক মহলেও বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে আলােচনা হত। একজন মহামানবের মৃত্যু আমাদের জন্য যে অপূরণীয় ক্ষতি বয়ে আনল তা আমরা না বুঝতে পারলেও বিদেশীরা ঠিকই বুঝেছিল। এ প্রসঙ্গে বছর ১১ পরে মিশরের একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। ১৯৮৫ সালে আমি সস্ত্রীক মিশরের আসওয়ান শহরে যাই। শহরটি বিখ্যাত আসওয়ান বাঁধের পাশেই। আমাদের গাইড ও চালক ছিল একজন মিশরীয়। কথা প্রসঙ্গে সে জানতে চাইল আমরা কোন্ দেশের মানুষ। বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারণ করতেই সে উচ্ছসিত হয়ে উঠল। বলল : ওহ রহমান। রহমান! পরে সে পুরাে নামটিই বলে গেল : শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের সঙ্গে তার নামটি কীভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল সেই মিশরীয় গাইডের কথা থেকেই সহজেই অনুমান করা যায়। এটি ছিল আমার একটি একান্ত প্রিয় অভিজ্ঞতা। আমি যখন আমেরিকায় গিয়েছি তখন অনেকে সাগ্রহে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে চাইতেন। বলতেন । দ্যাখাে, ইন্দোনেশিয়ায় সুকর্নকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু তাকে তাে প্রাণে মারেনি। আর তােমরা তােমাদের নেতাকে সপরিবারে হত্যা করলে।
আমি তিস্বরে জবাব দিতে চেষ্টা করেছি ; মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মূল্যবােধ যে নৃশংসতার শিকার হয়েছিল এটি হয়তাে তারই জের। মার্কিন সিনেটর কেনেডি, যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার করেছেন, দুদর্শান্ত শরণার্থীদের দেখতে কলকাতায় এসেছিলেন, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশেও গিয়েছিলেন ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে—সেসময়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। সেটিই সিনেটর কেনেভির একমাত্র সফর হবে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে : বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণেই কি তিনি আর বাংলাদেশ সফরে যাননি। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর ওয়াশিংটন সফরের সময়েও সিনেটর কেনেডি, সিনেটর সেক্সবি ও সিনেটর পার্কসহ বিশিষ্ট মার্কিন রাজনীতিকদের সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে। মার্কিন রাজনীতিক-কূটনীতিকদের সেই বিরাট আয়ােজনেও বঙ্গবন্ধুকে আলাদাভাবে চেনা যেত। সবার কাছে তিনি ছিলেন ‘গ্রেটম্যান’।
যুগান্তর ১৫ আগস্ট ২০০৭

ইতিহাসের ইতিকথা জানার অপেক্ষায়
এবিএম মুসা।
এক বছর আগে ২০০৭ সালের ১৫ আগস্টের প্রথম আলাের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় প্রধান খবর ছিলঃ “আজ শােকাবহ ১৫ আগস্ট। আগামীকাল ২০০৮ সালের ১৫ আগস্টের পত্রিকায় অবশ্যই প্রধান শিরােনাম থাকবে : আজ জাতীয় শােক দিবস রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পালিত হবে। গত বছরের সংবাদ-বিবরণীতে অবশ্য ইপতি, প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করার আগাম খবরটিও ছিল। তা হলে সরকারের তরফ থেকে না হলেও সরকারের শীর্ষমহলের সম্মানিত মর্যাদাবান ব্যক্তিরা জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। সরকারের তরফ থেকে অগ্রিম কোনাে আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দিয়ে একটি শােক দিবস পালন করা হয়নি বরং সেই দিনটিতে সরকারি নির্দেশনায় প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেই প্রশাসনে ছিল সদ্য-ক্ষমতা-ত্যাগকারী জোট সরকারের ভূত। তাই বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলােচনা করছি। | গত বছর রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান ও সেনাপ্রধানের বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদানের রীতিটি পালিত হয়েছিল ভিন্ন রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। এ সম্পর্কে প্রথম আলাে ১৬ আগস্ট ২০০৭ সংখ্যাটির একটি প্রতিবেদন পুনরুল্লেখ করছি। প্রতিবেদনটি একটুখানি দীর্ঘ মনে হতে পারে তবে এর বিশেষত্ব রয়েছে। দীর্ঘ ছয় বছর পর দিনটি রাষ্ট্রীয় ও সরকারি মর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে ‘শােকাহত’ দিনটি কীভাবে এল আর গেল তার পর্যালােচনা করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বিশেষ করে প্রথম আলাের প্রতিবেদনে প্রথমেই বলা হয়েছিল পঁচাত্তরের পর বিচিত্র পরিবেশে রাজনীতিবিহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শােকাহ ১৫ আগসই পালিত হয়েছে। আমার মতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি না বলে সরকারের ও রাষ্ট্রের পরস্পরবিরােধী অবস্থান বলাই সঠিক হতাে।
সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি ছিল ‘প্রথম ২১ বছর ১৫ আগস্ট পালিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় অবহেলায়। অতঃপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিবসটি রাষ্ট্রীয়ভাবে শােক দিবস হিসেবে পালিত হয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস বাতিল করে। প্রতিবেদনের পরবর্তী বাক্যটিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে যখন বলা হল ‘বিএনপি জোট সরকার জাতীয় পতাকা বিথি সংশােধন করে সরকারিভাবে নির্ধারিত দিন ছাড়া জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে।’ বাক্যটির অন্তর্নিহিত অব্যক্ত কথাটি হচ্ছে ১৫ আগস্ট জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হল। সেদিনের পত্রপত্রিকায় আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ খবর ছিল, একই দিনে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিবস’ পালন করবেন। অতঃপর বঙ্গবন্ধুহত্যাৱ দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে শােক পালনে বিএনপি জোট সরকারের অনীহা শুধু নয়, অমর্যাদার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। কারণটি ব্যাখ্যার কোনাে প্রয়ােজন আছে কি? বরং মৃত্যু ৰা হত্যার দিনে কারও জ্ঞানাের বা পুনর্জন্মের সম্পর্ক নিয়ে যদি কারও মনে বিভ্রান্তি জেগে থাকে, তা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক অর্থহীন। তার পরও ১৫ আগস্ট সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক দলের অ্যালার্জি অথবা হীনম্মন্যতার একটুখানি আলােচনার অবকাশ রয়েছে। কারণ, ১৫ আগস্টের বেনিফিশিয়ারি বা সুফলভােগকারীদের নিয়ে নানা জন নানা কথা বলতে পারে বইকি।
| অপ্রিয় প্রসঙ্গ নিয়ে আর আলােচনা নয়, ২১ বছর যাই ঘটুক, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার রাষ্ট্রীয় ও সরকারি পর্যায়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস’ ঘােষণা করল। পতাকা অর্ধনমিত হল, সরকারি ছুটি পুনর্বহাল হল। পাঁচ বছর পর আবার বিএনপি জোট সরকার ক্ষমতায় এসে দিবসটিকে রাষ্ট্রীয় শােক দিবসের মর্যাদাচ্যুত করল। তারপর দিনে দিনে দিন যে গেল। বিএনপি জোটের বৈরী পরিস্থিতির অবসান ঘটল, কয়েকটি নাটকীয় ঘটনার পর স্থায়ী হল ইয়াজউদ্দিনফখরুদ্দীনের সরকার। প্রথম বছরই বিএনপির রাষ্ট্রপতি আর নির্দলীয় প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান টুঙ্গিপাড়ায় ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতিকে আবেগাপুক্ত করলেন। তবে অন্য যেসব কাণ্ড ঘটেছিল তা জাতিকে অবাক করেছিল। প্রথম আলাের প্রতিবেদন পড়লাম : ‘সরকার বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের সামনে ২০ জনের বেশি একত্র হতে পারবেন না বলে নির্দেশ দিয়েছে। আরও আছে । বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচারের রায় কার্যকরী করার দাবিতে কোনাে কর্মসূচি দেয়া যায়নি। অনুমতি না পাওয়ায় ১৬ আগস্টের আলােচনা সভা বাতিল করা হয়েছে। আলােচনা সভার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, মাইক ব্যবহার না করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একবছর পর প্রশ্ন করা যেতে পারে, তখন সেই নিষেধাজ্ঞা আর নির্দেশ কে দিয়েছিলেন। তারা আজ কী বলেন, জানতে ইচ্ছা করে।
পুরােনাে সেই দিনের কথা বর্ণনা করলাম পাঠক সমীপে একটি মূল বক্তব্য পেশ করার জন্য। জাতি শােকাহত কি না জানি না, তবে রাষ্ট্র ও সরকারের নীতি কিংবা ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস পালনের ব্যাপারে মনােভাবের পরিবর্তনের ভিন্ন একটি তাৎপর্য অন্তর্নিহিত হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস পালনের বিএনপি আমলের বাতিল সরকারি কার্যক্রম পুনর্বহাল করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সিদ্ধান্তটি প্রসন্নচিত্রে গ্রহণ করে, অন্য সব অপছন্দের রায়ের বিরুদ্ধে যেমনটি করেছে তেমনি আদালতের এই নির্দেশনাটি বাতিলের জন্য কোনাে ‘আপিল’ করেনি। কেন যেন মনে হচ্ছে তারা খুশি হয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে, এ ধরনের কিছু ঘটুক তারই অপেক্ষায় ছিল। অর্থাৎ তাদের মনের মধ্যে ‘সরকারি কোনাে
পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধা অথবা মনের ভেতরে কাতরঙা ছিল, তা দূর করার। উপলক্ষটি পেয়ে স্বস্তিবােধ করেছে। তাই বিনাবিধায় এবার ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস ও ছুটি ঘােষণায় ইতস্তত করেনি।
জাতির পিতার প্রতি বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের এজাৰােখ এবং তার হত্যাকাণ্ডের জন্য বেদনাবােধের এই বহিঃপ্রকাশ তাদের মর্যাদাবান করেহে। আমি আরও আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করছি, সেনাপ্রধান মঈন উ আহমদ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার আসনে অধিষ্ঠিত করার প্রসঙ্গটি নিয়ে সােচ্চার হয়েছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা ফখীন আহমন, তার সহকর্মীরা এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন। যুদ্ধাপরাধীদের ভােটাধিকারের প্রসঙ্গটি আলােচনায় এনেছেন। তার পর বুঝতে হয়েছে একটি নির্দলীয় সরকানুকে কোনাে-কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনাে আন্তর্নিহিত প্রতিবন্ধকতা থাকে। যে কারণে এ সরকারের প্রশংসিত সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হয়েছে। মহামান্য আদালত সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করেছেন। |আপনজন হারানাের বেদনা যখন মনের ভেতর গুমরে ওঠে, তবে তা চাপা থাকে, কিন্তু পারিপার্শ্বিক কারণে সময়ে তা প্রকাশ করা যায় না। যেমনটি যায়নি ২১ বছর। বন্ধ ঘরে কোটি নরনারী চাপাস্বরে ফুলে-ফুলে কেঁদেছে, প্রকাশ্যে বিলাপ করতে পারেনি। ফখরুমীন সরকার সেই বন্ধ আবেগের বহিঃপ্রকাশের পথটি দুইবছর পর আবার খুলে দিল। | কিন্তু বঙ্গবন্ধু-হত্যার ইতিকথার এখানেই ইতি ঘটতে পারে না। সরকারের গৃহীত “শােক দিবস’ ঘােষণা হােক ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ করার প্রাথমিক পদক্ষেপ। বর্তমান নির্মাহ সরকারকে বঙ্গবন্ধু হত্যার গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করার প্রক্রিয়াটি শেষ করতে হবে। এজন্য বিচারিক প্রক্রিয়ার দোহাই দিয়ে চূড়ান্ত বিচার কেন বিলম্বিত করা হয়েছে, তা জানতে হবে। বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার মামলাটি প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক কারণেই ফুলে আছে, তা নিশ্চয়ই অরাজনৈতিক সরকার অনুধাবন করবে। আমি ইতিপূর্বে বারবার প্রশ্ন করেছি, “ন্ত্রিত হওয়ার দোহাই দিয়ে কতিপয় বিচারক মামলাটি ঝুলিয়ে দিয়ে সংবিধান (তৃতীয় দুফসিল-১৪৮’ অনুচ্ছেল- উপচ্ছেদ—“আমি অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহিত আহরণ করিব) লঞ্চন করেছেন। আমার সঠিক ৰা ৰেঠিক যুক্তি ছিল, তারা বিরাগের বশবর্তী হয়ে শপথ অঙ্গ করেছিলেন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানও তাঁর স্মৃতিকথায় প্রশ্ন করেছেন। কোনাে বিচারপতি কেন ব্ৰিত হয়েছেন, তা কেন বলেননি?” বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য অভিযুক্তদের কারও প্রতি কি তাদের কারও অনুরাগ ছিল, নাকি বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিরাপ ছিল, যে কারণে মামলাটির আপিল শুনানিতে বিচারপতি পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল? শ্রী ঘটিবও এখন মীমাংসা হওয়ার সময় এসেছে। | তাই বলছিলাম, নিছক রক্ট্রীয় শােক দিবস পালনের একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, জারি পিতার হত্যাসম্পৰ্কীয় সব গুঢ় তথা জানার জন্য বর্তমান সরকারের কাছে আবেদন, বঙ্গবন্ধু-হত্যা রহস্যের উদঘাটনে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে দিয়ে যান। কেনেডি হত্যার পর জাস্টিস ওয়ারেন কমিশন গঠিত হয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধী হত্যার ফৌজদারি আইনে বিচার হলেও রহস্য উদ্ঘটনের জন্য উচ্চপর্যায়ের তদন্ত হয়েছিল।
শুধু বাংলাদেশের সুপতি ৰা জাতির পিতা বলে নয়, একজন পতিকে হত্যার ঘটনার ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে ইতিকথার শেষ পাতাটি লেখার জন্য হলেও একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। শােক দিবসকে সরকারি মর্যাদা দেয়া হল কি হল না তাতে কিছু যায় আসে না। শােক প্রকাশ দর বন্য আফ্রিকার কোনাে কোনাে গােষ্ঠী নাকি লােক তাড়া করে আমাদের কান্না নিজেরাই কেঁদে থাকি—সরকারের কোনাে নির্দেশের অপেক্ষায় থাকি না। আনুষ্ঠানিক দিবস ঘােষণা অথবা হত্যার চূড়ান্ত বিচার বিলম্বিতকরণকে এজন্যই আমি গুরুত্ব দেব না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র উদ্মাটন করে ভিন্ন ভিন্ন সরকারের আমলে ১৫ আগস্ট সরকারিভাবে উদ্যাপন করা বা না-করার রহস্যটি কী তা জানতে হবে। সর্বোপরি হত্যা-মামলার যে রায়ই হােক। দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের পেছনের সব কাহিনী জানার জন্য হলেও জাতীয় ও আন্তজাতিক পর্যায়ে একটি তদন্ত প্রক্রিয়া শুধু এ সরকারই শুরু করে দিয়ে যেতে পারে।
প্রথম আলাে ১৪ আগস্ট ২০০৮

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ

মাে. নুরুল ইসলাম

দিন, মাস, বছর আসে আবার চলেও যায় অনন্তকালের মধ্যে। কিন্তু বিশ্বের প্রতিটি জাতির জীবনে কিছু কিছু দিন আছে যা সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতির মানুষের মনে বিপুল আনন্দ জাগিয়ে তােলে। আবার এমন কিছুদিন আছে যা সমগ্র দেশকে দুঃখ ও বেদনায় মথিত করে এবং কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে এই অনুভূতি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র বিশ্বকে তার আওতায় নিয়ে আসে। এমনি একটি দিন পনেরই আগষ্ট বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ হারানাের দিন। | ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরােধী ঘৃণ্য পিশাচ খুনিচক্রের হাতে সপরিবারে শাহাদত বরণ করেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ববিবেক সেদিন এ হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের শােকে মুয়মান এবং প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়ে উঠেছিল। ১৫ আগস্টের ঐ ঘটনার কথা যখন আমরা স্মরণ করি, তখন একদিকে আমাদের হৃদয় অসহনীয় শশাকে বিদীর্ণ হয়, অন্যদিকে যারা প্রত্যক্ষ হত্যাকারীদের সাহায্য সমর্থন দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা, ক্রোধ ও ক্ষোভ লেলিহান অগ্নিশিখার মতাে জ্বলে ওঠে। আমরা আশা করি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ও এর হােতাদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিবাদ, ঘৃণা ও ধিক্কার চিরকাল প্রবহমান থাকবে। আমরা মহান আল্লাহর দরবারে জাতির জনকসহ ১৫ আগস্টের শাহাদত বরণকারী সকল শহীদের রুহের মাগফিরাত ও চিরশান্তি কামনা করছি।

| কোন্ মানুষটিকে তারা হত্যা করল? তিন দশকের বেশি সময় ধরে যিনি বাংলাদেশের কথা ভেবে আসছেন, যিনি প্রগতিশীল রাজনীতির অঙ্গনে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ মার্চ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনের ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। যিনি ১৯৬৬ সালে দেশের মানুষের সামনে তার ঐতিহাসিক ৬-দফা পাৰি উপস্থিত করেছিলেন যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ লুকিয়ে ছিল। এইসব করতে গিয়ে ঘর-সংসারের সর্ববিধ কাজ বিসর্জন দিয়েছেন, দীর্ঘ সময় স্বৈরশাসকদের কারাগারে কাটিয়েছেন, ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলার আসামি হয়ে মৃত্যুর মুখােমুখি হয়েছেন কিন্তু মুহূর্তের জন্যও দুর্বল হননি। | বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশের মানুষের প্রচও প্রতিবাদ ও আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২০ লাখ মানুষের এক বিশাল সমাবেশে দেশের জনগণ তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে তার মাথায় পরিয়ে দিল নেতৃত্বের মুকুট। তারপর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যায় তার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের

| এরপরের ইতিহাস সবারই জানার কথা থাকলেও গত ২১ বছরের বিকৃত ধারার প্রচারের কারণে ৩০ বছরের কমবয়েসী সত্যটা জানেন না, আবার অনেকে জেনেও না-জানার ভান করেন। রেসকোর্সে তার ৭ মার্চের ভাষণ এখন বিশ্বইতিহাসের অন্তর্গত। ইংরেজরা বিদায় নিলেও পশ্চিমপাকিস্তানের একচেটিয়া স্বৈরশাসনে তখন পূর্ববঙ্গবাসীদের অর্থনীতি সর্বস্বান্ত, সংস্কৃতি ৰিপর্যন্ত এবং জীবন বিপন্ন। সেই সময়ে মুক্তিদাতারূপে এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বাঙালি জাতির শত বছরের বেদনাকে ভাষায় ৰূপ দিলেন, কর্মে রূপান্তরিত করলেন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চে তিনি ঘােষণা দিলেন । এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বর্বর পাকিস্তান বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা দেন, গােপন আশ্রয়ে চলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দেন তঁার ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের। কিন্তু নিজের প্রাণরক্ষার জন্য তিনি পালিয়ে যেতে অস্বীকার করেন। পাক সৈন্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের কারাগারে আটক রাখে। বিজয়ের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সফল অবসানের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে আসেন। বিমানবন্দর থেকে সােজা সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে তিনি কয়েক লাখ আনন্দ-উদ্বেল দেশবাসীর সামনে আবেগাপ্লুত গলায় বলেন, ‘আমার জীবনের স্বপ্ন সার্থক হয়েছে। আমি জানতাম আমার বাংলার মানুষ মুক্ত হবেই। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনাে দেশের স্বাধীনতার জন্য এত অল্প সময়ে এত প্রাণ বলি দিতে হয়নি। আমি জানতাম তারা আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু তাদের কাছে আমার একটাই প্রার্থনা ছিল তােমরা আমার মৃতদেহটি আমার সােনার বাংলায় পাঠিয়ে দিও।’ বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে একটি আধুনিক রাষ্ট্র। যেখানে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না, রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় ধর্ম কোনাে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করবে না, ধর্ম হবে নাগরিকের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তিনি এমন একটি

বাংলাদেশ চেয়েছিলেন যেখানে চিরকালের নিপীড়িত মানুষ উপরে উঠে আসার সুযােগ পাবে, শােষণমুক্ত হবে, ধনী-দরিদ্রের নৈমা কমে আসবে। যেখানে শৈরতন্ত্র নয়, বিরাজ করবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। নিহত হওয়ার কিছুকাল আগে আলজিয়ার্সে একটি আন্তর্জাতিক সঘােলনে তিনি স্বার্থহীন ভাষায় উচ্চারণ করেছিলেন যে, তিনি হচ্ছেন শােষিতের গণতন্ত্রের পক্ষে। এরপর দেশী-বিদেশী। নানা চলান্তে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেখা রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে তিনি যখন আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও শােষণ মুক্তির নবতর কর্মসূচি সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন সেসময় পরাজয় নিশ্চিত জেনে অন্ধকার ও পশ্চাৎপদতার ঘৃণ্য অপশক্তি তার ওপর চরম আঘাত হানে। তাঁকে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরােধী পাত্রি শক্তি এবং কুচক্রীরা জাতির জনকের আদর্শ ও স্বাধীন দেশের ইতিহাস ও অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে চেয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। গত ২১ বছর ধরে স্বাধীনতা, জাতীয় অগ্রগতি ও প্রগতির ধারা, অঞ্জিত সকল সুফলকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। জাতির বিবেকের কষ্ট বােধ করে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ধ্বংস করে এবং নৈরাজ্যের শাসন কায়েম করে জাতির প্রাণস্পন্দনকে থামিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড কোনাে ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড ছিল না। কারণ তিনি তাে শুধু একজন ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান। একটি আন্দোলন। জাতি নির্মাণের কারিগর। একটি ইতিহাস। এই ইতিহাসের ব্যাপ্তি হাজার বছর। তাই সমকাল তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে। ভাবীকাল তাঁকে স্বীকৃতি দেবে মহাকালের মহানায়ক জপে। ইতিহাসে তিনিও অক্ষয় ধ্রুবতারার মতাে অম্লান গরিমায় ভাস্বর হয়ে থাকবেন। বাঙালি জাতিকে পথ দেখানেন। তার স্বপ্ন বাঙালি ও তার সজ্ঞাতার নবদয়। জনগণের কাছে তিনি বঙ্গবন্ধু। জাতির কাছে তিনি পিতা। বিদেশীদের চোখে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। স্ত্রীর সম্পর্কে বিদেশী সাংবাদিক সিরিল ডান বলেছেন, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেছা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জন্মসূত্রে ছিলেন খাটি বাঙালি। তার দীর্থ শালধাংশু দেহ, বজ্রকণ্ঠ, মানুষকে মন্ত্রমুগ করার বাগিতা এবং জনগণের নেতৃত্বদানো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহস কে এ যুগের এক বিরল মহানায়কে রূপান্তরিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজ উইক পত্রিকা বলেছে ‘শেখ মুজিব রাজনীতির কবি’। মনীষী লওঁ ফেনার একওয়ে বলেছেন, ‘জর্জ ওয়াশিংটন, মহাত্মা গান্ধী, ডি ভ্যালেয়ার চেয়েও শেখ মুজিব এক অর্থে বড় নেতা।’ কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি। আমি হিমালয় দেখার সৌভাগ্য অর্জন করলাম।’

আসলে জাতির পিতা বলতে এখানে ন্যাশন স্টেটের প্রতিষ্ঠাতাকে বুঝানাে হয়েছে। আধুনিক ইউরােপের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেতনার ফসল আধুনিক জাষ্টীয়তা ও জাতীয় রাষ্ট্র। এই আধুনিক ম্যাশন ও ন্যাশন স্টেট প্রতিষ্ঠায় যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতি তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে পিতা ও রাষ্ট্রনির্মাতার সুউচ্চ মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। এজন্য কামাল আতাতুর্ক নব্য তুরস্কের জনক, মহাত্মা গান্ধী নতুন ভারতের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান রাঙ্গুলির মস্তর্ন সেক্টটের নির্মাতা এবং বাঙালি জাতির জনক। | কামাল আতাতুর্ক এবং গান্ধীর চেয়েও শেখ মুজিব আয়ে বেশি সার্থকভাবে জাতির পিতার মর্যাদার অধিকারী। অটোমান সাম্রাজ্যের আমলেও তুর্কি জাতির নাম ও অক্তিত্ব বহাল ছিল। | গান্ধীর আগে এবং তার আমলে ভারত তার নাম এবং ভারতবাসী তাদের জাতিত্বের পরিচয় হয়নি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের পর বাংলাদেশ ও বাঙালি নামটি মুছে দেয়া হয়েছিল। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হাজার বছরের মাতিত্বের পরিচয় মুছে দিয়ে তাদের কপালে একমাত্র পরিচয় সেঁটে দেয়া হয় পাকিস্তানি । কিন্তু বাালি জাতিকে ধ্বংস করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু ১৯৫৫ সালের ২৫ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে প্রতিবাদ করে বলেন, “স্পিকার মহােদয়, ওরা (সরকার) পূর্ব বাংলার নাম বদল করে পূর্ব পাকিস্তান রাখতে চায়। আমরা বারংবার দাবি জানাচ্ছি আপনারা ‘বাংলা” এই নাম ব্যবহার করুন। বাংলা নামের ইতিহাস আছে। আছে নিজস্ব ঐতিহ্য ট্রাডিশন। এই নাম পরিবর্তন করতে হলে বাংলার জনগণকে জিজ্ঞাসা করতে হবে তারা এই নাম বদল মানতে রাজি আছে কিনা?” বঙ্গবন্ধুর সেই দাবি দুখন গ্রাহ্য করা হলেও ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু ঘােষণা করেন যে, একসময় এ দেশ থেকে, এ দেশের মানচিত্র থেকে বাংলা কথাটার সর্বশেষ চিহ্ন চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও নামটির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে আমি ঘােষণা করছি, আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বালের নাম পূর্ব পাকিস্তানের বদলে শুধু বাংলাদেশ’ হবে।’

প্রকৃতপক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশের নবজন্মের ক্রান্তিলগ্নের প্রথম প্রকাশ্য ঘােষণা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকেই উচ্চারিত হয়। এটা বাংলাদেশ ও বাপ্পালি সংস্কৃতির অবরুদ্ধ স্রোতের মুক্তিলাভের ঘােষণা। বাংলাদেশ ও বালি এই দুটি লু নামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা যাঁর হাতে বাঙালির নিজ দেশ প্রতিষ্ঠা, দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের ফুল, পিতা ছাড়া আর কী যােগ্য নামে স্ত্রীকে ভাকা যায়? | বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ কীর্তি বাংলাদেশ। তিনি বাংলার চিরকালের প্রাণপ্রবাহ। বাংলার পাখির গানে, নদীর কলতানে, বাতাসের উচ্ছ্বাসে, আকাশের পরিমায়, সূর্যের

শীর্যে, চাঁদের কিরণে, নক্ষত্রের ছায়াপথে, ভােরের শিশিরে, মসজিদের আজানে, মন্দিরের কাসরধ্বনিতে, গির্জার ঘন্টায়, জারি-সারি-ভাটিয়ালির সুরে, বসন্তের উল্লাসে, বার ক্রন্দনে, শরতের শ্যামলিমায়, বৈশাখের ভৈরবীতে, বাঙালিরা হাসিকান্না, প্রেম-ভালােবাসায়, মিলনে-বিরহে তিনি চিরদিনের জন্য জাগ্রত, জীবন্ত। তার মৃত্যু হয়নি। তিনি আরাে বেশি জীবিত চিরকালের বাঙালির মনে ও মননে। | ১৫ আগস্টের দুরপনেয় কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্ত করার পথে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘােষিত হয়েছে। বাঙালি জাতির মৃণা আর ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ঠাই হয়েছে কলঙ্কিত ঘাতকদের । ধর্মান্ধ ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলাের বিরুদ্ধে ফলপ্রসু প্রতিরােধ গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর সােনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে পারলেই আমাদের ১৫ আগস্টের বেদনাৰহ দিন স্মরণ করা অর্থবহ হবে।

১১ আগস্ট ২০০৭ ভোরের কাগজ
শেখ মুজিব তােমাকে শুদ্ধতম ভালােবাসা শ্রদ্ধা সশ্রদ্ধ সালাম –

তোফায়েল আহমেদ

শেখ মুজিব তােমাকে শুদ্ধতম ভালােবাসা, শ্রদ্ধা, সালাম । তােমার জন্য বাঙালি লাল সবুজের পতাকা পেয়েছে। স্বতন্ত্র মানচিত্রের মালিকানা হয়েছে। সেই তােমার রক্তের সিঁড়ি বেয়ে জাতি বন্ধুর পথ পাড়ি দিচ্ছে। অমানিশার নিকষ আঁধারে আটকে আছে। তােমার প্রিয় মাতৃভূমির প্রিয় স্বজনরা ভালাে নেই। দিকভ্রান্ত হয়ে আছে। | ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের কালাে রাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হয়েছেন। ওই রাতে বাংলাদেশ বিদীর্ণ হয়েছে। ক্ষতবিক্ষত হয়েছে বহু রক্তে কেনা জাতীয় পতাকা। এরপর পানি গড়িয়েছে। বছর গেছে। অপশক্তি বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেয়নি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করেনি। ইতিহাসকে নিজেদের মতাে করে বিকৃত করেছেন ঘৃণিত ওই অপশক্তি। | কিন্তু সেটা ধােপে টেকেনি। ইতিহাস আপন আলােয় উম্ভাসিত হয়েছে। জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেছে। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারে বিচার হয়েছে। এরপরেও ইতিহাসের গতি বদলে দেয়ার অপচেষ্টা করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেনি। জাতীয় শােক দিবসের ছুটি বাতিল করেছে।

শেষতক এই অপচেষ্টা বিফল হয়েছে। আদালতের রায়ে মর্যাদা পেয়েছে জাতীয় শােক দিবস। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারও আদালতের দেয়া রায়ের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। জাতীয় শােক দিবসে সরকারি ছুটি ঘােষণা করেছে। তাই বাঙালি জাতি এবারকার জাতীয় শােক দিবসকে আরেক দফায় নতুন প্রেক্ষাপটে জাতির পিতাকে স্মরণ করছে। | বন্ধু কেমন ছিলেন? ছােট্ট এই প্রশ্নের জবাব অনেক বড়। ২১ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব হয়ে দেখেছি জীবনে বহুবার আশাভঙ্গের ব্যর্থতার তীব্র আঘাত বঙ্গবন্ধুর হৃদয় বিদীর্ণ করেছে। জীবন-মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়েছেন। চোখের সামনে মৃত্যু দেখেছেন। হও নৈরাশ্য গ্রাস করেনি কখনাে। মাঝে মাঝে কিছু ঘটনাপ্রবাহ, জীবনকে বিরূপ ঘূর্ণির আবর্তে ফেলে আছাড় দিলেও আবার ভেসে। উঠেছেন।

ষাটের দশক ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিলপ্লের শেষপর্যায়। পাকিস্তানের প্রতি বাঙালি মােহভঙ্গ শেষ হয়ে গেছে। বাংলার রাজনীতির আকাশে উদয় হয়েছে তরুণ সূর্যের।

শেখ মুজিব তখন বঙ্গবন্ধু হিসেবে পরিচিত নন। কিন্তু অমিত সাহস, অসাধারণ বাগিতা, অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতা, অনমনীয় মনােবল, দূরদৃষ্টি ও দেশের প্রতি, প্রতিটি বালির প্রতি উদার ভালােবাসার ভাণ্ডার নিয়ে তখনই তিনি দেশবাসীর দৃষ্টি কেড়েছেন। | তার সাহচর্যে এসেই আমার জীবনের সবচেয়ে বিস্ময় ও তুকির পরিবর্তন ঘটেছে। নিবেন স্বপ্নভঙ্গের মতাে হঠাৎ যেন সূর্যের আলাে চোখে লেগেছে। সেই থেকে প্রতিদিন জীবন-জগৎকে নতুনভাবে দেখছি। এখনাে মনের অজান্তে হৃদয়ের গভীরে স্বপ্নের উনােথ ঘটেছে। আমার রাজনৈতিক জীবনের গৌরবময় সুৰূর্ণ মুহূর্তগুলাে স্বাটের দশকের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছিল। | ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভুথান এবং সবশেষে মহান মুক্তিযুদ্ধ একে একে সব যেন ছবির মতাে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আমি ছিলাম এসব আন্দোলনের পুরােভাগে এবং সৌভাগ্য সেই দিনগুলােতে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেই আমার ভূমিকা পালনের দুর্লভ সুযােগ পেয়েছিলাম। সত্যিই খুব ভাগ্যবান আমি। ১৯৬২ সালের শিক্ষা-আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। | আজকাল অনেকেই অনেক কথা বলছেন। এখন স্বাধীনতার ঘােষক হিসেবে যার কথা বলা হচ্ছে তিনি জীবিত থাকাকালে কখনাে নিজেকে ঘােষক বলে দাবি করেননি। বঙ্গবনুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। আর বঙ্গবন্ধু একদিনে স্বাধীনতার ডাক দেননি। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি হয়েছিলেন স্বাধীনতার মূল নেত্র। মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম দিলেও তা হয়নি। | ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পূর্বাণী হােটেলে বঙ্গবন্ধু এমএনএদের নিয়ে মিটিং করার সময়ে ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ সংসদ অধিবেশন মূলতবি করে। ওই সময়ে পটনে লাখাে মানুষের সমাবেশে অনেকের মধ্যে আমিও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন। বাংলাদেশের ঘােষণা দেই। কিন্তু হয়নি।

আমরা শ্লোগান তুলেছিলাম ; ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। পাঞ্জাব না বাংলা, পিত্তি না ঢাকা।’ ২ তারিখে ওই যে পতাকা উত্তোলনের বিষয়টি, সেই পতাকা বাংলাদেশের মানচিত্র দিয়ে আগেই তৈরি ছিল। জাতীয় সংগীত কী হবে তাও ঠিক করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সঠিক পথে এগিয়ে গেছেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি বিজয়ী না হত তাহলে কী ঘটত সেটাও বুঝতে হবে। ভাসানী থেকে শুরু করে অনেকেই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে “ভােটের বাক্সে লাথি মারাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’ স্লোগান দিয়েছেন। কিন্তু ভােটের বাজে লাথিও পড়েনি, বাংলাদেশও স্বাধীন হয়নি। বঙ্গবন্ধু যখন ঘােষণা দেন তখনই দেশ স্বাধীন হয়েছে।

ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে অসহযােগ আন্দোলনে সারা বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে বঙ্গবন্ধুর ডাকে এগিয়ে এসেছিল তা ছিল কল্পনাতীত। একদিক দিয়ে মাশলি ল

রেগুলেশন (এমএলআর) আরেক দিকে আওয়ামী লীগ রেগুলেশনে (এএলআর) দেশ চলেছে। বঙ্গবন্ধু যা বলেছেন মানুষ তাই করেছে। তিনি একটা নিরা নিরীহ বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার ঘােষণা দেন। জাতি ট্রেনিং নেয়। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আগেই বােঝাপড়া ছিল কিছু হলে তারা সহযােগিতা করবে।

২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করল তখন নিৱন্ত্র জাতি সশন্ত্রে রূপান্বিত হয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করল। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালি শহীদ হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছে পাঁচ লাখ মা বােন। বঙ্গবন্ধু জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাঙালি এক কাতারে মিলে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কিছু দালাল যারা স্বাধীনতা চায়নি, তারা ছাড়া সবাই যে যেখানে ছিলেন সমর্থন করেছেন।

সুতরাং কৃতিত্ব সবার। নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু । অথচ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরেই বিভক্তি সৃষ্টি করেছে চিহ্নিত পরাশক্তি। বাঙ্গালি স্লোগান দিয়েছিল । “তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাপ্পালি।’ অথচ বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বাঙালি হয়েছে বাংলাদেশী। ‘জয় বাংলা”, শ্লোগান দিয়ে মানুষ হাতিয়ার তুলে নিয়ে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। সেখানে আনা হয়েছে জিন্দাবাদ। ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে।

বঙ্গবন্ধুর সময়জ্ঞান অত্যন্ত প্রবল ছিল। প্রতিদিন সকাল ৯টায় গণভবনে যেতেন। তার মতাে পাচুয়াল মানুষ পৃথিবীতে বিরল। এক মিনিটও এদিক-ওদিক হত না। একবার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কুষ্টিয়ায় যাওয়ার কথা। দুমিনিট দেরিতে গিয়ে দেখি হেলিকপ্টার ছেড়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু কুষ্টিয়া থেকে ফোন করলেন । এ বয়সেই মিস করা এক করেছ? সেজন্য তােমাকে একটু শিক্ষা দিলাম যাতে ভবিষ্যতে আর মিস না হয়।’

বঙ্গবন্ধুর মন ছিল সুবিশাল। অপরের দুঃখ সইতে পারতেন না। শিশুদের ভালােবাসতেন। একদিন গাড়িতে যাচ্ছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ছােট একটা বাচ্চা বলল । আসসালামু আলাইকুম মুজিব সাহেব।’ বঙ্গবন্ধু গাড়ি থামিয়ে শিশুটিকে কাছে নিয়ে আদর করলেন। | বঙ্গবন্ধু শত্রুকেও আপন করে নিতেন। তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন তখন যারা সেখানে ডিউটি করত কিংবা কয়েদি হয়েছিল তারাও নেতার আপন হয়ে যেত। তিনি পৃথিবীর যেখানেই গেছেন আমাকে সঙ্গে নিয়েছেন। ছেলের মতাে স্নেহ করতেন। রাজনৈতিক শিক্ষা দিতেন ছাত্রের মতাে। আমি চিরদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। আমার জীবন ধন্য বঙ্গবন্ধুর আদর-স্নেহে মানুষ হয়েছি। বড় হয়েছি। তাঁর ভালােবাসার ঋণ কখনাে শেষ করতে পারব না।

| পুরােনাে গণভবনে একটা বড় বটগাছ ছিল। একদিন ওই গাছের পাশ দিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ পায়চারি করছিলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন : তােফায়েল লুক আট দি ট্রি। এই গাছটি আর বড় হবে না। পাতা ঝরে যাবে। ডাল ভাবে। একসময়ে গাছটি যে এখানে ছিল তার কোনো চিহ্নই থাকবে না। তেমনি আমিও এত জনপ্রিয় হয়েছি যে আর জনপ্রিয় হতে পারব না। আমি দেশের জন্য কিছু করতে চাই। এখন অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে হবে।’

বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বপ্ন পরিপূর্ণভাবে পূরণ করে যেতে পারেননি। দেখে যেতে পারেননি অর্থনৈতিক মুক্তি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা অর্থনৈতিক অবস্থানকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাড় করলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তা ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে। আগামী বাংলাদেশে আবারাে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত হবে, এই বিশ্বাস সবার, প্রতিটি বাঙালির এবং আমারও।

| তাই তাে এবারকার জাতীয় শােক দিবসে বাঙালির অঙ্গীকার বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করতে হবে। খুনিদের ফাঁসিতে ঝােলাতে হবে। তবেই বাংলাদেশ অপবাদ মুক্ত হবে। বাঙালির পাপ মােচন হবে। শতভাগ পরিশুদ্ধ হব আমরা সবাই। আর তখনই আমরা উচ্চকিত কণ্ঠে বলতে পারব ‘শেখ মুজিব তােমাকে শুদ্ধতম ভালােবাসা, শ্রদ্ধা, সশ্রদ্ধ সালাম। জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু।

আমার দেশ ১৫ আগস্ট ২০০৮
জাতীয় শােক দিবস সনৎ কুমার সাহা।

হাইকোর্ট সম্প্রতি রায় দিয়েছেন ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস হিসেবে রাষ্ট্রকে পালন করতে হবে। সেদিন সরকারি ছুটি থাকবে; এবং জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখতে হবে। আমরা জানি এ নির্দেশনা নতুন নয়। ১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ আগস্ট সরকারিভাবে জাতীয় শােক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত জানায়। সেই অনুযায়ী দিনটি পালিতও হতে থাকে। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করে, তারা এ আদেশ বাতিল করে দেয়। যুদ্ধাপরাধী বলে যারা অভিযুক্ত অথবা তাদের সঙ্গে যাদের আত্মিক সম্পর্ক, তারা তখন ক্ষমতার দখলদার। এই ইতরতার পরিচয় তারা দেবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে রাষ্ট্রের নৈব্যক্তিক ভূমিকা এতে খণ্ডিত হয় । তার ঐতিহ্যিক, ঐতিহাসিক ও গণচেতনানির্ভর যৌক্তিক ভূমিকাও অস্বীকার করা হয়। এবার হাইকোর্টের রায়ে তার সংশােধন ঘটবে এইটিই প্রত্যাশা।

তবে পুরােপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ স্বাধীনতার মূল্যবােধবিরােধী স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররােচনায় সুপ্রিমকোর্টে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল মামলা রুজু হতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা কাগজে দেখেছি। যেখানে ৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে গত ৩৩ বছরের অধিকাংশ সময়ই ক্ষমতার চাবিকাঠি ছিল কার্যত তাদেরই দখলে এবং পরিণামে রাষ্ট্রব্যবস্থার সব প্রতিষ্ঠানেই তাদের লােকজনের অল্পসময়ের বিরতি দিয়ে প্রায় ধারাবাহিক নিয়ােগ ও আধিপত্য; সেখানে তাদের চেহারায় ও চরিত্রে তাদের ছাপ যে মােছা দুষ্কর এবং মােছার চেষ্টাও যে প্রত্যাশিত নয়, ঘটনা-পরম্পরায় চাই বা না চাই এটিই বাস্তব বলে মেনে নিতে হয়। তাছাড়া ক্ষমতার আশ্রয়প্রশ্রয়ে তাদের ধ্যানধারণাও দেশে একরকম অবাধেই ছড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার ও ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। তার পেছনে যে ক্ষমতার কায়েমি স্বার্থ ও প্রশাসনিক সহযােগিতা উসকানি দিয়ে এসেছে, এমন অভিযােগও শােনা যায়। দেশের সব মানুষ যে একই তালে একই রকম বদলে গেছে এটা অবশ্য সত্য নয়। কিন্তু মানুষের ওপর যে তার আছর পড়েছে এটা অস্বীকার করা যায় না। ক্ষমতার খাসমহলের কাছাকাছি থেকে ফন্দিফিকিরে আখের গােছানােয় ব্যস্ত যারা তাদের ওপর তাে বটেই।

বিষয়টাকে যে বিতর্কিত করা গেছে এবং কেতাদুরস্ত মাথাভারী ভদ্রসন্তানদের কেষ্ট কেষ্ট জাতীয় শােক দিবসের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রকাশ্যেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, গণমান নাগরিক হওয়ার সুবাদে তাদের কথা খবরের কাগজেও গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় এবং মহাপরাক্রমশালী মাতারদের ছক কষে দাবার চাল দেয়ায় তাকে সই খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা চলে—এসবে বােঝা যায় গত ৩৩ বছরে তারা তাদের অনুকূল পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা ও লক্ষ্যকে কিছুটা হলেও ঘোলাটে করে ফেলতে পেরেছে। প্রশাসনিক কর্তত্ব শতকরা ৮০ কাপের পর সময় থেকেছে তাদেরই দখলে। ফলে সাংগঠনিকভাবে তারা তাদের অবস্থা মধ্যযুগীয় ৰাজ্যশাসনের কায়দায় মজবুত করেছে। প্রচারণায় এ প্ররােচনায় জনগণের মনে বিভ্রান্তিও এনেছে। তাতে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালি জাতিসত্তার যে স্বাভাবিক ও স্বতা প্রকাশ, তাই প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছে। গায়ের জােরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানেও মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। আবহমান বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যকে খণ্ডিত বিকৃত বিপর্যস্ত করা হয়েছে। পেছনে থেকেছে ২৪ বছরের পাকিস্তানি ভাবধাৱাৰ ইন্ধন। তাকেই নতুন করে বিভিন্ন স্তরের মানুষের ভেতরে সঞ্চারিত করার চেষ্টা জোরদার হয়েছে।

স্বার্থান্বেষী ও প্রভাবশালী বাইরের কয়টি দেশের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্বন্ধও তার ছাপ রেখে চলেছে। জনশক্তি রফতানির অনিবার্য তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছে লাখ লাখ জীবিকাখী মানুষ। তাদের বড়লােক হওয়া ও ধ্যানধারণায় ধর্মমুখী হওয়া দেশের জনগণের চিন্তাভাবনার ওপর প্রভাব ফেলছে। মনমানসিকতা ও দৈনন্দিন অভ্যাস কারও কারও এতে পাল্টে যাচ্ছে বৈকি।

চারদিক থেকে এসব বিপরীতমুখী স্রোতের ধাক্কায় বাঙালি জাতির সহজাত ঐক্য ও অবিচ্ছিন্নতা অলি আহত হয় তবে তাতে অবাক হওয়ার কোনাে কারণ নেই। তার সঙ্গেই জড়িত এ জাতির যিনি স্থপতি, তার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকারের ও কত থাকার প্রশ্ন। গত ৩৩ বছরের বেশ সময় ধরে তা ভুলে থাকার শিক্ষাই আমরা। পেয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে মনে করার উদ্যোগ বারবার প্রতিহত হয়েছে বৈরী শাসকের দরবারে। হাইকোর্টের বর্তমান রায়ের পরও তা বানচাল করার ইতর উৎসাহ তাদের ভেতর আবার চোখে পড়ে। দুরে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এখনো জান্না সংখ্যালঘু। জনগণের অতি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। যদিও অন্ত্রে বর্মে প্রভাবে প্রতিপতিতে প্রবল, তা সত্ত্বেও অধিকাংশ সাধারণ মানুষের ডেহ ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় চেতনা ও জাতির পিতার অবিসংবাদী ভাবমুর্তি ক্ষুণই আছে।

তবে যে জাতির শিরায় শিরায় তিনি নতুন জীবনীশক্তি সঞ্চারিত করেছেন, যে আধুনিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জনকল্যাণকামী সমাজতন্ত্রমুখী রাষ্ট্রের তিনি স্থপতি, তাদের বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকেই তঁার স্মৃতিটুকুও নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়ার এ দখলদার আক্রোশ, এটা কেবল মধ্যযুগের স্বৈরাচারী রাজশক্তির বর্বরতাকেই মনে করিয়ে দেয়। আধুনিক গণস্তান্ত্রিক রাষ্ট্র কতকগুলাে মৌলিক প্রত্যয়ের ওপর গড়িয়ে থাকে। তাতে ধর্ম-বর্ণ-বিশাস ৰা সম্পদের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বৈষম্য অচল। অধিকাংশ মানুষ যদি একই মতাবলী হয়, মুও না। একইকালে তার দায়িত্ব থাকে গুৱকম সব মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব থাকে সর্বদায়ের লক্ষ্যে, শােষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তি ও কল্যাণের পক্ষে রাষ্ট্রের নৈর্ব্যক্তিক কাঠামােকে ভিত্তি করে নিরন্তর কাজ করে যাওয়ার। এগুলাে প্রাথমিক শর্ত। সংসদে ক্ষমতাসীন বা বিরােধীপক্ষ প্রত্যেকের বেলায়ই এদের মেনে চলা যৌক্তিকভাবে বাধ্যতামূলক। এখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কতটা সাড়া দেয়, সাড়া জাগায়—তার উপরে। নির্ভর করে মানবমুক্তির পক্ষে তার কার্যকরিতা। ভেতরে-বাইরে তার ও তার জনগণের কাক্সিক্ষত মর্যাদার পরিমাপ হয় তাই নিয়ে। তাদের সমৃদ্ধির পথে অগ্রযাত্রাকেও তা সাবলীল করে। আমাদের বাংলাদেশ কাঠ ও পাকিস্তানি খােলদ ভেঙে এদেশের বাঙালি জাতি এই দুইয়েরই অলয় ছিল এই মহৎ লক্ষ্য সামলে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। একেবারে শূন্য থেকে তার স্বপ্নকল্পনা রচনা করে তাকে বাস্তু বে রূপ নিতে অসামান্য | সাহস ও ত্যাগের প্রতিমুপ্তি হয়ে পী সংগ্রামের প্রতিটি অৱে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। এখন তিনি কারান্তরালে, তখনো তিনি নো। ভাৱ সংগ্রামই প্রেরণা। তাই তিনি জাতির পিতা। জাতি মানে আমরা যে। আধুনিক উদার ও মানবিক ‘নেশন” ভাবনার বাস্তব রইরূপ নির্মাণ করতে চেয়েছি, তা-ই। বাংলাদেশ তার আধার। তার প্রয়ােজন পড়েছিল, কারণ পাকিস্তান তাকে অস্বীকার করেছিল। স্বীকার করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়ােজন হত না। বঙ্গবন্ধুকেও মুক্তি সংগ্রামের স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দিতে হত না। তার ৭ মার্চের স্মরণীয় ভাষণ খুঁটিয়ে পঞ্চলেই এর সত্যতা ধরা পড়ে। তাই বাংলাদেশকে যদি আমরা এক মহান অর্জন বলে মনে করি-রাজ্য ভাঙা গড়ার খেলামাত্র নয়-হুরে তার সংগ্রাম ও সাধনার কাছে আমাদের মাথা নষ্ট করতেই হবে। | ১৫ আগস্ট বঙ্গীয়ভাবে জাতীয় শােক দিবস পালন করে তাকে সপরিবারের নৃশংস হত্যার অপরাধ বিন্দুমাত্র দূর হবে না, কেবলমাত্র তার গ্লানি থেকে আমরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারব। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আরােগের জন্য তা অত্যাবশ্যক। কে খুন করে এবং গায়ের জোরে উাকে অশ্বীকার করে রাষ্ট্র হিসেবে আমরা যে শুধু এতিম হয়েছি তাই নয়, আমাদের স্তাত্ত্বিক পরিচাএ আর কিছু অবশিষ্ট নেই। কোনাে দশমিক ভিত্তি বা কোনাে সুচিখিত গন্তব্য কোনােটিই আমরা দেখাতে পারব না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে এক দুরপনেয়া বিচ্ছেদ ৱজিত হয়ে গেছে। ফলে আমরা কেবলই একজন গােষ্ঠী। যে যখন দখল নেয় তখন আমরা তার। কালাসের জীবন আরােপিত হয়েছে গােটা জনসমষ্টির ওপর। ক্ষমতার দখলদারদের চক্রান্তে রাষ্ট্র স্বাধীনতার মূল্যবােধহীন। জনগণ সার্বিক দায়বােধহীন, এন্তে গরু যেন, যা যা তার তার সবচেয়ে বেশি দামে হাষ্ট বিকোবার জন্য উন্মুখ। অল্পতে যেমন রায়ানা নামে চলত রাজ্য, এও প্রায় তেমনি। রাষ্ট্রও যে এক প্রাণনান দায়িত্ববান সন্তা, ‘সামূহিক জীবনযাত্রার মূল্যবােধােৱ নির্মাতা’ প্রত্যয় আর কাজ করে না। আমাদের স্বঘােষিত নাগরিক সমাজের যখন যেমন তখন তেমন” বাক্যবাগীশ মাতৃকারদের এতে কি কোনাে নাচড়া নেই। নিরাপদ দূরত্বে থেকে মুখে ঢুশিকাঠি (বিকষ্টে চুইংগাম দিয়ে বােধহয় ভাৱ পৱতী ও মারার ধ্যানে চোখ বুজে মা থাকে। এটা ভেবে দেখেন

, রাষ্ট্রের কোনাে সত্য না থাকলে জনগণ নিরবণথ। যে যেমন পারে ছলে-বলেকৌশলে ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারে মাতে। রাষ্ট্র ও পরিচালিত হতে থাকে একই তাড়নায় এবং তার প্রতিফলন আমরা দেখে চলেছি বছরের-পর-বছর। বঙ্গবন্ধু হত্যার এবং সেই হত্যাকে ক্ষমতা দখলদার পালাল বিকৃত উল্লাসে উপেক্ষা করার এ হল অনিনা পরিণাম । ৰাই কেবল ক্ষমতা ব্যবহারে হাতিয়ার মাত্র হয়ে থাকে। সেটাই তার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। তার সঙ্গে জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রদর্শনের কোনাে সম্পর্কই প্রতিষ্ঠিত হয় না। জবাবদিহির ব্যাপারটা অবাস্তব হয়ে পড়ে। | অশীকার করার উপায় নেই বাংলাদেশের অন্য ছিল গণমানুষের অসাথা সাধনের এক অকল্পনীয় ঘটনা। নেতা ও প্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার সহচর ছিলেন যে ৪ নেতা উপদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বন্দী অবস্থায় জেলৰানার ভেতরে। হত্যা করে একই অপশক্তি এবং এসব হত্যাকাণের কোনাে বিচার হয়নি আজও। শুধু যে হত্যার মতো অপরাধ এতে প্রশ্রয় পায়, তাই নয়, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির যৌক্তিক ও নৈতিক ভিত্তিও বিপর্যস্ত হয়। কেন যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, কেন যে এদেশের মানুষের এত দুঃখবরণ আর বিজয় ছিনিয়ে এনে অসম্ভবকে সম্ভব করা, তার কোনাে সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। জাতির জনক ও তাঁর সহচরদের হস্ত্যার জন্য কোনাে অনুশােচনাও রাষ্ট্রের পক্ষে তখন কেউ করে না। রাষ্ট্র স্বয়ং এর ফলে তাৎপর্য হয়। অথ্যস্ত গান্ধী, হাে চি মিন, ফিদেল কাস্নাে, নেলসন ম্যান্ডেলা, তারা যেমন আপন আপন রাষ্ট্রের প্রাণপুরুষ-বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বেলায় বঙ্গবন্ধু। তেমনই। ওইসব নেতাকে তাদের নিজ নিজ দেশ যদি রাষ্ট্রীয় বিধানে প্রত্যাখ্যান করে তুৰে । সেসব রাষ্ট্রব্যবস্থাও ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে প্রকারান্তরে। কাঠায়ভাবে তাকে অনুমোদন করায় বাংলাদেশ সহ এক লক্ষহীন ভূখণ্ডে পরিণত হয়। তার অস্তিত্ব এক প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে কোনো সদুত্তর খাড়া করতে পারে না। আজ এত ক্ষতির পর রাষ্ট্র যদি জাতীয় শােক দিবস পালনে আন্তরিক হয় তবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার একটা সঙ্গত জায়গা নীতিগতভাবে ফিরে পাওয়ার অধিকার অন্তত সে কিটা দাবি করতে পারে। এদেশের মানুষ হিসেবে বিশ্বের দরবারে আমরাও মুখ তুলে তাকাতে পারি।

আমরা জানি জোর যার মুল্লুক তার এই আদিম প্রবৃত্তির শিকার হই আমরা ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের পাকিস্তান রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখলের ভেতর দিয়ে। ক্ষমতার সংস্কৃতিতে তার ছাপ পড়ে সুদূরপ্রসারী। রাজনীতিকে বিকৃত ও নষ্ট করার শুরুও সেই থেকে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ছিল তা থেকে বেরিয়ে আসার। গণমানুষের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার। মুক্তির সংগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য ছিল এটি। এ লক্ষ্যে পেীছার জন্যই স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমরা জয়ী হই তাতে বঙ্গবন্ধুরই নেতৃত্বে। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, এ স্বাধীন বাংলাদেশেরই ওই অশুভ শক্তি বঙ্গবন্ধুর জীবনাবসান ঘটায়। আবার দেশটির ঘাড়ে চেপে বসে। বাংলাদেশ লক্ষ্যভ্রষ্ট চরিত্রভ্রষ্ট হয়। যদিও ভুগভুগি বাজানাের লােকের অভাব হয় না। ধােপদুরস্ত সুশীল সমাজেও না। এমনই পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের এ রায়। সুস্থতায় ফিরতে প্রাথমিক পা ফেলার ছােট সুযােগ। একটা। তা আমাদের স্বাধীনতাকে অতি মূল্যে অর্থবহ করারও। আমরা কি এ বিষয়ে সচেতন? | একটা বিষয় সবার মনে রাখা দরকার। আমাদের স্বাধীনতা যেমন দলমতের উর্ধে, বঙ্গবন্ধুও তেমনই। জাতীয় শােক দিবসে তার স্মৃতির প্রতি যথাযােগ্য সম্মান জানিয়ে রাষ্ট্র ভার অতীত ভুল শুধু সংশােধন করতে পারে তাই নয়, দুরারােগ্য ব্যাধি থেকে নিরাময়ের পথরেখাও হয়তাে একটা অনেক জঞ্জালের ভিড়েও খুঁজে পেতে পারে।

দৈনিক ডেসটিনি ১৫ আগস্ট, ২০০৮

প্রবাসে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবরটি যেভাবে পেলাম

উ, এম, সাইদুর রহমান খান
পৃথিবীর ইতিহাসে উল্লিখিত কলঙ্কময় দিনগুলাের অন্যতম দিন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। আজ থেকে তেত্রিশ বছর পূর্বে এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর প্রিয় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংযােজিত হয় আরেকটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড।

| সেই মর্মন্তুদ ঘটনার খৱৰটি আমার কাছে কীভাবে পৌঁছাল তা আজও স্মৃতিপটে। উজ্বল হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তখন আমি উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়াল হলওয়ে কলেজে ছিলাম সপরিবারে। আমাদের বড়মেয়ে সিমকির বয়স তখন চার বছর তিন মাস। সবেমাত্র নার্সারি স্কুলে গুপ্তি হয়েছে। রুটিনমাফিক প্রতিদিন সকালে ওকে স্কুলে রেখে আমার স্ত্রীকে তার অফিসে নামিয়ে দিয়ে বাসায় গিয়ে নাস্তা সেরে ল্যাবরেটরিতে যাই।

উল্লেখ্য যে, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঘনিষ্ঠ বঙ্গ মইন উদ্দিন আফজা (সােভিয়েত ইউনিয়নের বাকুতে পিএইচডি করছিল) গ্রীষ্মের ছুটির কাটাতে পাঁচ সপ্তাহের জন্য আমাদের বাসায় এসেছিল। সে ছাত্রজীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় একজন ছিল। এখনও মুজি-আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হয়নি। বর্তমানে আমেরিকায় পেনসিলভেনিয়ার রুমসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। | ওইদিন সকাল নয়টায় দু’বন্ধু নাস্তার টেবিলে দেশের অবস্থা ও রাজনীতি নিয়ে অনেক আলােচনা করলাম, তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। এটা ঠিক যে, মহান হৃদয় বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযােগে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতার কারণে, উগ্র বামপন্থীদের হটকারিতা এবং সর্বোপরি স্বাধীনতাবিরােধী পাকিস্তানপন্থিদের নেতার ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের সার্বিক অবস্থা আশানুরূপ ছিল না। দেকটি সত্ত্বেও কেন জানি বঙ্গবন্ধুর যে-কোনাে সমালােচনা আমি সহ্য করতে পারি না, যদি না তা গঠনমূলক হয়। | ফিরে আসা যাক ঘটনার শুরুতে। যেহেতু তখন গ্ৰীশ্বকাল, কাজেই কাজকর্মে সবার মধ্যেই একটা ঢিলেঢালা ভাব। নাস্তা সেরে (তখন সকাল দশটা) দু’বন্ধু কলেজে যাই। বাসা থেকে তিন মিনিটের হাঁটাপথ। ল্যাবরেটরিতে ঢুকতেই এক মিশরীয় মহিলা, নাম কারিমা রুগৰ (আমার সুপারভাইজারের অধীনেই তিনি গবেষণারত) ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বললেন : তুমি কি শুনেছ তােমাদের দেশের

প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে? শুনে তাে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বলাে । তুমি ঠিক শুনেছ তাে? তিনি বললেন : বিবিসির রেডিওঅবরে শুনেছেন।

হত্যার বিবরণ তিনি শুনলেও তা প্রকাশ করতে পারলেন না। দু’বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে আসি। ঘন্টায় ঘন্টায় রেডিও সংবাদ । হা কারিমা ঠিকই শুনেছেন। আফজা চিৎকার করে উঠল । সাইদুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে। অপেক্ষায় থাকলাম ১২ টার বিবিসি টিভি সংবাদের জন্য, আর মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যা শুনলাম তা যেন সঠিক না হয়। | ইতিমধ্যে লক্তন ও তার আশপাশ থেকে বন্ধুবান্ধবের বেশ কয়েকটি ফোন পেলাম। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল টিভি খবর শােনার পর। নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশনার জন্য বিবিসির সুনাম পৃথিবীব্যাপী। লন্ডনে যাবার পর বিবিসির প্রতি আমার অনুরাগ আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ওইদিন বিবিসির খবর শােনার পর আমার ভেতরে যে কী প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। খবরের লিড নিউজ ছিল : শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড। খবরে বলা হল ঃ মেজর ডালু (আসলে হবে ডালিম) রেডিওতে ঘােষণা দিয়েছে, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ওপর বিবিসি তার নিজস্ব বিশ্লেষণ দেয়, যা খুব একটা খারাপ ছিল না। স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের মূল্যায়ন মােটামুটি সঠিক ছিল। | কিন্তু যে-বিষয়টি আমাদের স্তম্ভিত করে তা হল স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার। ভাবটা এই যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সম্পর্কে মতামত দেবার মতাে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে নিরপেক্ষ কোনাে ব্যক্তি নেই। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও কেন গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার নেয়া হল তা আজও আমার কাছে বােধগম্য নয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যায় গোলাম আযম এতই আনন্দিত ও উল্লসিত যে, প্রথম ত্রিশ সেকেন্ড তিনি কোনাে কথাই বলতে পারেননি। মুখে ছিল অট্টহাসি। তার প্রথম মন্তব্য : ‘The traitor of the country has been killed and the people are now very happy ক্ষোভে দুঃখে গা জ্বালা করছিল। বেশি রাগ হচ্ছিল বিবিসির ওপর। শেষপর্যন্ত ওরা গােলাম আযমের সাক্ষাৎকার নিল? এটাই কি ওদের নিরপেক্ষতার নমুনা? যে ব্যক্তির জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না তাকে ‘Traitor” বলার মতাে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সুযােগ দেয়া হল। একই সঙ্গে লন্ডনে প্রানীস্তন হাইকমিশনার সৈয়দ অবদুস সুলতানের সাক্ষাৎকার নেয়া হল পার্শ্ববর্তী থাই অ্যামবেসির বারান্দা থেকে। তিনি সুকৌশলে একুল ওকুল বজায় রাখলেন তার বক্তব্য। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই তিনি কথা বলেছেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ঠিক একবছর পর ১৯৭৬ সালে ১৫ আগস্ট লন্ডনের আইটিভিতে এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস (যিনি বঙ্গবন্ধুর বিশেষ বন্ধু ছিলেন) বাংলাদেশের ওপর আধঘন্টার একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর আত্মীকৃত খুনী কর্নেল ফারুক ও তার ভায়রা কর্নেল রশিদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তাতে ওরা দুজনেই

বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরিকল্পনার বর্ণনা দেন, যাতে স্পষ্টভাবে অশকার মােশতাক ও জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা প্রকাশ পায়। অন্দকার মােশতাক সরাসরি জড়িত ছিলেন, আর জিয়াউর রহমান (তদানীন্তন ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ) অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করেন। তবে মূলত তার ইঙ্গিতেই ছিল ওই অপকর্মে খুনীদের মূল শক্তি ও সাহসের উৎস।

১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপে লন্ডন যাই। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে বয়লি হলওয়ে কলেজ ছাত্রসংসন বিদেশী ছাত্রদের এক সংবর্ধনার আয়ােজন করে। ছাত্রসংসদের সম্ভাপতি আগেই বলে রেখেছিল আমাকে দু-কথা বলতে হবে। অবাক হলাম অনুষ্ঠানের শুরণতই আমার নাম ডাকা দেখে। শুধু তাই নয়, সভাপতি মহোদয় আমাকে বিশেষভাবে পরিচয়

FOR ‘Mr. Khan from Sheikh Mujibur Rahman’s Bangladesh”। মনে হয়েছিল আমিই যেন অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। আসলে আমাকে তো তাদের চেনার কথা নয়। আমি যে ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ সমাস শেলায় তার কারণ আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ থেকে আগন্ত—যার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। | সারা বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশকে জানে শুধুমাত্র শেখ মুজিবের আশা। শুনে চার বছর থাকাকালীন লক্ষ করেছি, রাস্তাঘাটে, পার্কে, শপিং মলে অনেকেই যখন জিজ্ঞাসা করত আমরা কোন্ দেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ বলার সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠত শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ। অনেকে আবার বাংলাদেশ না চিনলেও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সঙ্গে পরিচিত। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রাণ চালায় এবং বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত টাই বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের ফান্তে অর্থ জমা দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য হওয়াতে ফু হয়ে পাকিস্তান কমনওলেথ ত্যাগ করে। | আমরাই প্রথম ব্যাচ কমনওয়েলথ স্কলারশিপ ব্রিটেন আই। ও আমি নই, ওই সময় যারা বিটেন গিয়েছে তারা দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে ব্রিটিশের কাছে। খুব ভালাে লাগত ওমের উষ্ণ আতিথেয়তা। গর্ববােধ কাল যে আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি। অনেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেইসব সিমের অভিজ্ঞতা জানতে চাইত কৌহল । ওরা আমাদেৱকে বীবের জকি হিসেবে মর্যাদা দিত। কারণ মাত্র হামাসের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতাে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পৱাক করে মাখিকে মুক্ত করা কম কৃতিত্বের কথা না। আর এ কৃতিত্বের মূলে হিলেন অদম্য সাহসী শেখ মুজিব। তিনি তার এই অসীম সাহস অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে পুৱে আওলি এতির মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। স্বাধীনতার

জন্য এত ত্যাগ পৃথিবীর কোনাে জাতি করেনি, আর তাই তাে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের ছিল এত মর্যাদা ও কদর।

আগেই উল্লেখ করেছি বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে বিশ্বদরবারে একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশী ও বিদেশী ঘষয়ের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে সেই গৌরবমাখা মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে একটি অসভ্য বর্বর জাতিতে পরিণত করা হল। সংঘটিত হল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ঘন্য হত্যাকাণ্ড। জাতির জনকের সন্তানসম্ভবা পুত্রবধূ ও দশ বছরের নিস্পাপ শিশুসন্ধান ব্যাসেলও সে নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা ও রেহানা দেশের বাইরে ছিলেন, নইলে তাদেরকে একই জ্ঞাগ্য বরণ করতে হত।

১৫ আগয়ে সেই বেদনাময় ঘটনার পর প্রায় মাসখানেক আমি কলেজে আইনি। কীভাবে সহপাঠী বিদেশী বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সামনে মুখ দেখাব? ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন ওই নারকীয় হত্যাকান্দ্রে নিন্দা জানিয়ে লেখা ছাপা হত। বাঙালি বলে পরিচয় দিতে যেখানে গর্ববােধ করেছি সেখানে আমাদের এখন পরিচয় বর্বর অসত। জাতি হিসেবে। অনেকেই প্রশ্ন করতেন । যে ব্যক্তির জন্ম না হলে তােমরা কোনােদিন স্বাধীন হতে পারত না, তাকে কী করে হত্যা করতে পারলে? শুধু আমি নই, প্রবাসী সকল বাংলাদেশীকেই তখন এ-ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে-প্রশ্নের কোনাে জবাব জানা নেই। | প্রবাসজীবনে অনেক ঘটনার মধ্যে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি এ সংক্ষিপ্ত লেখার ইতি টানব। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ এই দুবছর আমি লুসাকাতে জাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। ওই সময় সমগ্র জাথিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ৮০টি বাঙালি পরিবার বাস করত। পেশায় অধিকাংশই শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও এ্যাকাউন্টেন্ট। সেখানে বাংলাদেশীর একটি সমিতি ছিল—’জাম্বিয়াবাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এ্যাসােসিয়েশন’। আমি ছিলাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে আমরা জাতীয় দিবসগুলো পালন করতাম। ১৯৮১ সালে বেশ জমক করে স্বাধীনতা দিবস পালন করেছিলাম হােটেল ইন্টারনে। প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম জামিয়া সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. মাপুজাকে।

অনুষ্ঠান উপলক্ষে যে সুভেনির প্রকাশ হবে তাতে সভাপতির ভাষণ থাকবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল এই ভাষণ নিয়েই। ভাষণে তিনি যা লিখেছেন তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমানের কোনাে নামগন্ধ নেই। বিএনপির মতাে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘােষক হিসেবে উল্লেখ করে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে যে-কেউ মনে করবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জিয়াউর রহমানই সর্বেসর্বাশেখ মুজিব নামে ওই সময় কেউ ছিল না।

সমিতির কার্যনির্বাহী বাের্ডের আরও ২/১ জনসহ আমি বেঁকে বসলাম। এমনভাবে ইতিহাসবিকৃতি করে বিদেশের মাটিতে সমিতির নামে স্বাধীনতা দিবস।

উদযাপিত হতে পারে না। সস্তাপতিকে তার ভাষণ সংশােধন করে প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সভাপতিও অনড় থাকলেন, এটা কার ভাষণ। তিনি যেভাবে ইচ্ছা লিখতে পারেন। আমরা বললাম এটা তার ব্যক্তিগত লেখা নয়। সমিতির পক্ষ হতে সভাপতি হিসেবে তার লেখা। অনেক চাপ সৃষ্টির পর তিনি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন এবং জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার বাণী পাঠ কৱেন তা উল্লেখ করলেন। সমস্যার সমাধান হল।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল প্রধান অতিথির ভাষণে ৬, মাতা যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে Founding fathed of Bangladesh বলে উল্লেখ করলেন তখন হলে উপস্থিত সবার হাততালিতে এক অনাবিল আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হল। | দুঃখজনক বিষয় হল বিদেশীরা যখন ঐতিহাসিক সত্যকে স্বীকার করে, তখন আমরা অনেক শিক্ষিত মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে বা গােষ্ঠীস্বার্থে ইতিহাসবিকৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কথায় বলে । ‘Truth shall prevail=সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না। ইতিহাস খণ্ডিত ৰা বিকৃতি করে নিরবচ্ছিন্নভাবে অপপ্রয়াস চালানাে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তিসমূহের অবমূল্যায়ন করে মানুষের স্মৃতি থেকে তার নাম-নিশানা মুছে ফেলার জন্য। তারই একটা ছােট্ট উদাহরণ। লুসাকার ওই ঘটনা।

কিন্তু আমরা জানি ইতিহাস চিরন্তন সত্য প্রকাশ করে থাকে। শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। তাই তাে ২০০৪ সালে বিবিসির শ্ৰোতৃমণ্ডলীর রায়ে তিনি নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্কালি হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব বাংলার আকাশে, বাতাসে, মাটিতে ও পানিতে মিশে আছে, যা মুছে ফেলা সম্বব নয়। বিশ্বব্যাপী তিনি ছিলেন দারুণভাবে জনপ্রিয়। তাই বিদেশে যখনই বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে জবাব পেয়েছি—তুমি শেখ মুজিবের দেশের লোক। বাঙালি হিসেবে এটা কি আমাদের কম সৌভাগ্য? বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পরই খ্যাতনামা নিউজউইক ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে ‘পােয়েট অব পলিটিকস’ অভিধায় আখ্যায়িত করে। | আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধা জানাই সেই মহান মানব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘাঁর আজীবন নিরলস নিঃস্বার্থ আন্দোলন সংগ্রামের সফল স্বাণীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের অনেক ভুল হয়েছে, অনেক ক্ষতি হয়েছে, অনেক পিছিয়ে গেছি। তাই আজকের দিনে প্রতিজ্ঞা হােক— স্বাধীনতাবিরােধী ও উগ্র মৌলবাদীদের রুখতে স্বাধীনতার পক্ষে সবাই আমরা। ঐক্যবদ্ধ হই হব।

জনকণ্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৮
বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।

আতাউস সামাদ

শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি এবং তা সর্বতােভাবে, কেবল আলঙ্কারিক অর্থে নয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান, যা এখন বাংলাদেশ, সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইঅেপূর্বে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বপাকিস্তানকে বছরের-পর-বছর ধরে অর্থনৈতিকভাবে শােষণ, সামাজিকভাবে দুর্বল ও রাজনৈতিকভাবে নিপীড়ন করে আসছিল। ষাটের দশকে পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা এই শােষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে বারবার ফেটে পড়ছিল। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পূর্বপাকিস্তানের অসহায়ত্ব তথা অস্তিত্বের সংকট এবং পূর্ব-পশ্চিম বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে পূর্বপাকিস্তানের মানুষকে সসম্মানে বাঁচার অধিকার প্রদানের লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের লাহােরে এক সর্বদলীয় রাজনৈতিক সম্মেলনে তাঁর ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন।

পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয়দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং এর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তান সরকার তথা সামরিক শাসক আইয়ুব খান ও তাঁর বশংবদ পূর্বপাকিস্তানের গর্ভনর বঙ্গভাষী মােনেম খান শুরু করে শেখ সাহেব ও তাঁর সহকর্মীদের ওপর অকথ্য নির্যাতন। শেখ মুজিব তখন পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ছয় দফার আন্দোলন বাঁধভাঙা বন্যার মতো শক্তি অর্জন করে এবং মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তৎপরতায় ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঘটতে থাকে গণঅভ্যুত্থান, যার প্রবল চাপে শেখ মুজিবুর রহমান তার সহ-অভিযুক্তদের নিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হন।

কারামুক্তির দুদিন পর ঢাকার রমনা রেসকোর্সে এক ঐতিহাসিক জনসভায় ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক, বর্তমানে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অন্যতম, তােফায়েল আহমেদ বঙ্গবন্ধু’ নামে ভূষিত করেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই সভাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন, তিনি আওয়ামী লীগের ছয়-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফা বাস্তবায়নের জন্য আমরণ সংগ্রাম করে যাবেন। আইয়ুব খানের ঢাকা গোলটেবিল বৈঠক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ভিত্তিতে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার প্রস্তাব দেন, যা আইয়ুব ও পশ্চিম পাকিস্তানি

অন্য নেতারা প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর আইয়ুবের পতন ঘটে এবং তার স্থান নেয়। ইয়াহিয়া খান।

| এই ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনামলের মধ্যেই ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পায়। ছয়দফার পক্ষে এই জনরায় বাস্তবায়নের উদ্যোগী হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র ও তাদের দেশের পশ্চিমপাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্রো চক্রান্ত করে নির্বাচনের মাধ্যমে লব্ধ গণতান্ত্রিক এ রায় না মেনে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই বাংলাদেশে শুরু করে গণহত্যা, জেনােসাইড। বাধ্য হয়েই বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেন। পাকিস্তানিরা তাকে গ্রেফতার করে। বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এবং দেশজুড়ে ছাত্র-জনতা প্রতিরােধ গড়ে তােলে। | এর মধ্যে পূর্বপাকিস্তান থেকে জাতীয় সংসদে ও পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সব সদস্য, দু-তিনজন বেঈমান ছাড়া, দিনকয়েকের মাঝে সীমান্তের কাছে ভারতের এক স্থানে মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মর্মে ঘােষণা দেন। অতঃপর ১৭ এপ্রিল ১৯৭১, মেহেরপুরে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি; কিন্তু তিনি পাকিস্তানে বন্দি থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম হন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন তাজউদ্দীন আহমদ।

১৯৭১ সালের পরবর্তী নয়মাস জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সরকারের সব কাজকর্ম পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। তাকে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে, রমনা রেসকোর্সে ও পথে পথে বাংলার মানুষ যেভাবে সংবর্ধনা দেয়—এদেশে আজ পর্যন্ত আর কেউ তেমনটি পাননি। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের স্থপতি, রাষ্ট্রপতি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফেরার দিনকয়েকের মধ্যে দেশে পার্লামেন্টারি প্রথার সরকারব্যবস্থা চালু করে তিনি প্রধানমন্ত্রী, তথা সরকারপ্রধানের দায়িত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন। এ দায়িত্ব নিযুক্ত থাকার সময় তিনি অনেকগুলাে কঠিন কাজ সফলভাবে সম্পাদন করেন। এগুলোর মধ্যে প্রধানতম হল । ১. দেশ পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফেরত পাঠানাে; ২, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মুখে পাকিস্তানিরা যে হাজার হাজার মাইন পেতে

রেখেছিল-সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় সেগুলাে অপসারণ করে। বন্দৱদুটিতে জাহাজ চলাচল শুরু করা (খাদ্য ও সাহায্য সাশ্রী আমদানি করার জন্য এ কাজটি খুবই জরুরি ছিল); ৩. চনি ছাড়া বিশ্বের বৃহৎ শক্তিসমূহের এবং সৌদি আরব ছাড়া অন্য প্রায় সব দেশের

কাছ থেকে পাকিস্তানের চরম বিরােধিতার মুখে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভ

করা ৪, পাকিস্তান থেকে সামরিক-বেসামরিক সব বাংলাদেশীকে ফিরিয়ে আনার ৫. ১৯৭১-এর যুদ্ধে দেশের ঝংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, সেতু ও ট্রন লাইনগুলাে চালু করা

৬. দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলাের জন্য বৈদেশিক সাহায্য আনা, ৭, আওয়ামী লীগের বিন্নি অংশসহ যেসব গেরিলাগােষ্ঠী প্রথমে অস্ত্র সমর্পণ করতে

রাজি হচ্ছিল না তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ফেরত নেয়া, ৮, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও পাস করা এবং ৯. দেশের জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা। এ কাজগুলাে হওয়ায় বাংলাদেশ মােটামুটি অল্পসময়ে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে এবং উন্নতির পথে যাত্রা শুরু করে। সবচেয়ে বড় কথা হল—আমরা একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমারেখার মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানসহ স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হই। আমাদের এই পরিচয় অর্জিত হয়েছে যাঁর নেতৃত্বে ও যাঁর অজেয় সাহসের কারণে, তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী তাে আমরা জাতীয় শােক দিবস হিসেবে পালন কৰবই। তদুপরি চক্রান্ত করে সেনাবাহিনীর একাংশকে হস্তাবক হিসেবে ব্যবহার করে ভােরবেলায় তার প্রায় অরক্ষিত বাসভবনে সামরিক যানবাহন ও অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে, বিদেশে অবস্থানরত তাঁর দুই কন্যা হাড়, যেভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অতি দুঃখজনক ও লজ্জাজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। অন্তত আমাদের প্রজন্ম তাে এজন্য লজ্জিত বটেই। | এখানে তর্ক করা যায় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তারই নেতৃত্বে প্রণীত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংবিধানকে নিজেই ছিড়েফুড়ে ফেলে অগণতান্ত্রিক ও একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন। তাঁরই প্রদত্ত ঐতিহাসিক ছয়-দফায় যেখানে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার করায় প্রতিশ্রুতি দেয়া ছিল এবং সেই পদ্ধতি ১৯৭২-এ সংবিধান গ্রহণ করা হয়েছিল তা বদলে ফেলে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার চাপিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ওপর । প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একনায়কতন্ত্র, তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত রক্ষীবাহিনী দেশজুড়ে চালিয়েছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বামপন্থী বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদারকে বন্দি অবস্থায় পুলিশ কাপুরুষের মতাে হত্যা করে, তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব জাতীয় সংসদে এ নিয়ে দছোক্তি করেন, তিনি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করার মতাে ব্যবস্থা নিতে পারেননি, তাই যত বড় নেতাই হােন না কেন তিনি ক্ষমতায় থাকার অধিকার হারিয়েছিলেন।

কিন্তু কাউকে ক্ষমতাচ্যুত করা আর সবংশে হত্যা করা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। স্বেচ্ছাচারী বা স্বৈরতান্ত্রিক বা ক্ষমতার অপব্যবহারকারীকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে অপসারণ করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে, আর বিনাবিচারে কাউকে হত্যা করা, তাও আবার নিরপরাধ শিশু ও নারীদের, কঠিন শাস্তিযােগ্য অপরাধ। এ নিয়ে তর্কের কোনাে অবকাশ নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার দিন ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস ঘােষণা করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে

ক্ষমতায় ফিরে এসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার তা বাতিল করে। এখন হাইকোর্ট থেকে রায় হয়েছে, সেই বাতিল করার হুকুম অবৈধ ছিল। বর্তমান সরকার সে অনুযায়ী ১৫ আগস্টকে আৰাৱ জাতীয় শােক দিবস হিসেবে ঘােষণা দিয়েছে এবং দিনটিতে সরকারি ছুটি দিয়েছে। আমরা আশা করব, এখানেই দেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতির মৃত্যুবার্ষিকী জাতীয়ভাবে পালন করার বিষয়ে বিতর্কের অবসান ঘটবে। | একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের প্রতি অনুরােধ থাকবে, তারাও যেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনার ঘােষক, মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমানকে অনর্থক গালাগাল না করেন। জাতীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই বীর সৈনিকেরও অবদান আছে অনেক। | আর তার পত্নী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে ঐকান্তিকভাবে অনুরােধ রাখব, তিনি কারামুক্ত হয়ে যখন আবার জন্মদিন পালন করবেন সেই জন্মদিনের উৎসব যেন ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবসে না করে একদিন পরে করেন। এরকমভাবে বিশেষ কারণে কোনাে উৎসব দু-একদিনের হেরফের করে পালন করা পাশ্চাত্য জগতে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অন্যকে দুঃখ বা কষ্ট না-দেয়ার জন্য যদি আমরা সেরকম কিছু করি তা তাে ভালাে ছাড়া মন্দ নয়।

আমার দেশ ১৫ আগস্ট ২০০৮

তিনিই বাংলাদেশ

আতিউর রহমান এই আমি আজকে আমি হতে পারতাম না যদি বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশটি না পেতাম। আজিও হয়তো পরাধীন পূর্বপাকিস্তানের কোন অজপাড়াগাঁয়ের কোন এক স্কুলে বড়জোর একজন শিক্ষক হিসেবে বেঁচেবর্তে থাকতাম। নাহয় কোন ছােট অফিসের উচ্চমান সহকারী । আমার ধারণা, আমার মতাে এমন আরও অনেকেই এই ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থানে থেকে যেতেন। পাশাপাশি পরাধীন দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর একজন নাগরিক হিসেবে মাথা নিচু করে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর আদেশনির্দেশ পালন করে কোনমতে বেঁচে থাকার ভান করতেন। কেউ কেউ হয়তােবা তাদের খুশি করে সামাজিক মইয়ের দু-এক ধাপ উপরে উঠতেন। | কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ফসল বাংলাদেশ হতাশাজনক এই বাস্তবতাকে পুরােপুরি বদলে ফেলে। হতে পারে আমাদের অনেক ভাইবােনের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এখনও আসেনি। কিন্তু তাই বলে পরাধীন দেশের নাগরিকদের মতাে সারাক্ষণ বিদেশী। প্রভুকে খুশি করে তাদের চলতে হয় না। অনেক সংগ্রাম করে হয়তাে তাদের অনেককে বাঁচতে হয়। কিন্তু কারও কৃপায় তাদের বাঁচতে তাে হয় না। স্বাধীনতার এই সুফল কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা যারা পরাধীনতার নাগপাশে ছিলেন না তারা ঠিক বুঝতে পারবেন না।

স্বাধীনতা আমাদের জন্য যে বহুমাত্রিক সুযােগ সৃষ্টি করেছে সেসবের কারণেই আজ বিশ্বজুড়েই একাধিক বাংলাদেশের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ছে। লন্ডন, সিডনি, নিউইয়র্ক, দুবাইসহ দুনিয়াজুড়েই পরিশ্রমী, উদ্যমী বাঙালির অবদান আজ স্বীকৃত। বিশেষ করে সারাবিশ্বের দ্বিতীয় প্রজন্মের বাঙালির শিক্ষা, গবেষণা, শিল্পোদ্যোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে প্রাণবন্ত পদচারণা জাতি হিসেবে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করছে। | এ কথা ঠিক, স্বদেশের নানা স্থানে এখনও রয়েছে দুঃখ, বঞ্চনা, বৈষম্য, অবিচার। রয়েছে নানা মাত্রার অপূর্ণতা। আছে স্বাধীনতার শত্রুরা। তাই এখনও সমাজে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে প্রত্যাশিতভাবে কাটেনি আঁধার। তবুও আমরা গর্বিত আমাদের প্রিয় স্বদেশের জন্য । সুখে-দুঃখে যেভাবেই থাকি না কেন, প্রিয় বাংলাদেশকে আরও সজীব ও সুন্দর করার স্বপ্ন এবং সদিচ্ছার কোনাে অভাব আমাদের বেশিরভাগ মানুষের মাঝে নেই। কিন্তু সে স্বপ্ন রূপায়ণে আমরা কতটা আন্তরিক সে প্রশ্ন যে-কেউই করতে পারেন।

তরু একটি প্রশ্ন বারবার মনে জাগে। সবার প্রিয় এই বাংলাদেশ কি এমনি এমনি অর্জন করেছি আমরা? অলি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামের হ্যামিলনের বংশীবাদকের জনু না হতাে এদেশে। যদি তিনি এমন করে স্বদেশের স্বাধীনতার মা বাবার মৃত্যুর মুখােমুখি হওয়ার সাহস না দেখাতেন; যদি সারাটা জীবন শুধুই স্বদেশের গরিব-দুঃখী মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য স্বদেশের এ প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত দৌস্কে না বেড়াতেন; যদি পাকিকানি শাসকগােষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে পােড়াই কেয়ার করে বারবার জেলে যাওয়ার মতো দেশপ্রেমের প্রমাণ না রাখতেন—তাহলে কি এত দ্রুত আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারতাম? সর্বশেষ স্বদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির আশায় বড় ধরানের রাজনৈতিক প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠনে যদি হাত না দিলে, তাহলে কি তিনি। পঁচাত্তরে এমন ট্রাজিক পরিণলি শিকার হতেন? | এসব প্রশ্ন আমি তুলছি এ কারণে যে, তাকে বাদ দিয়ে তারই দেয়া নাম বাংলাদেশটিকে যে খুঁজেই পাওয়া যায় না। আক্ষরিক অর্থেই তিনি এবং বাংলাদেশ সমার্ণ। যেন দ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এমনি যার অবদান, স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা কি তার প্রাপ্য সম্মান কর্মীয়ভাবে দিয়েছি? হীনমনা এই আমরাই কি শেয়াল থেকে তার ছবিটি নামাইনি? ‘ বঙ্গবন্ধু সেতু লেখা অক্ষরগুলাে কি আমরাই উপড়ে ফেলিনি? এই ‘শিক্ষিত’ আমৱাই কি কোমলমতি শিদের পাঠ্যপুস্তক থেকে তাকে আড়াল করার পাঁয়তারা করিনি? আজও তঁার জনদিন ও শাহাদত দিবস থ্রিীয় পরিমণ্ডলে নীরবে পার হয়ে যায়। আঙ্কত ওই দুদিনও কি মনে পড়ে না সুবিধাভােপী এলিটদের যে, তিনি ছাড়া বাংলাদেশ অস্তিত্ববিহীন! তারা কি জানেন না, তিনিই বাংলাদেশ। একথা ঠিক, যে শৌল আকাক্ষা বুকে নিয়ে। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করেছিলেন, স্কা থেকে আমরা এখনও বন্দরে। তবুও যতটুকু সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি আমরা অর্জন করেছি তার ভিত্তিটা কি তিনিই তৈরি করে দেননি আমাদের?

তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে এতগুলাে বছর পরও কেন আমরা আমাদের জাৰ্কীয় জীবনের সর্বোচ্চ আসনে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসাতে পারিনি? কেন তার আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার আজও সম্পন্ন করতে পারিনি? জাতির এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা কী করেছি? | একথাও ঠিক, এখন তিনি পাঠ্যপুস্তকে স্বমহিমায় উপস্থাপিত হচ্ছেন। তার সমাধিতে দেশচালকরা শ্রদ্ধা জানাতে এখন হচ্ছেন। তবুও এই আনুষ্ঠানিকতার বাইরে এখনও আমরা তাঁকে আমাদের জাস্ত্রীয় জীবনে অংশ করে তুলতে পারিনি। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের সন্তানরা তাকে গান্ধী, হো চি মিন, মাও সেতুং বা ম্যান্ডেলার মতাে করে খুঁজে পাচ্ছে না। তেমন সুযােগ আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি। উল্টো একটা সময় ছিল, যখন তার অবদানকে করা হয়েছে কটাক্ষ। স্বাধীনস্কার ঘােষণা কে দিয়েছেন—সে প্রশ্নে অযথাই ভকে করা হয়েছে বিতর্কিত।

আজ আমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছি যে, এই দুঃখজনক বিতর্কের কোনই মানে নেই। ইচ্ছা করলেই ইতিহাসের সত্যকে কেউ তার মতাে করে তৈরি করতে পারেন না। ইতিহাসের সত্যকে জোর করে মনগড়া খাতে প্রবাহিত করা যায় না। করলেও তা টিকবে

। ইতিহাস তার আপন গতিতেই নদীর মতাে তার আপন পথ তৈরি করে নেবেই। ইতিহাস ছাইচাপা আগুনের মতাে ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকবে। ইতিহাস কারও ক্রীতদাস নয়। সম্পূর্ণ স্বাধীন ইতিহাসের অন্তরাত্মা। বাংলাদেশের জনের প্রকৃত ইতিহাস এবং তার সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়টি ইচ্ছা করলেই কেউ বিকৃত করে পার পেয়ে যাবেন বলে মনে হয় না। হয়তাে সাময়িক বিভ্রান্তি ছড়ানাে যাবে। কিন্তু ইতিহাসের প্রকৃত সত্য ঠিকই সময়ের ব্যবধানে স্বমহিমায় থিতু হবেই, ঠিক যেমন এখন হতে শুরু করেছে। দেরিতে হলেও বিভ্রান্তির কালাে মেঘ বির্দীর্ণ করে সত্যের উজ্জ্বলতা ঠিকই ঠিকরে পড়তে শুরু করেছে।

এমনটিই যে হবে সে বিশ্বাস আমার মনে বরাবরই ছিল। আর সে-কারণেই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম অংশ ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সেই ইতিহাস নির্মাণে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অতুলনীয় অবদানের কথা বৈরী সময়েও বারবার বলেছি, লিখেছি। মহান এই মানুষটির কাছে আমাদের ঋণের কোনাে সীমা-পরিসীমা নেই। এই বাংলাদেশ সৃষ্টি না হলে, আগেই যেমনটি বলেছি, সময়ের স্রোতােধারায় খড়কুটোর মতাে আমরা অনেকেই ভেসে যেতাম। তাই বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যার দান সর্বোচ্চ, তাঁর জীবন ও জনগণের প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ও কর্ম ঠিকমতাে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। ঋণশােধের একধরনের চেষ্টাও বলা চলে।

| মাও সেতুং বলেছিলেন, কোনাে মানুষের ৭০ শতাংশ ভালাে গুণ থাকলেই তিনি ভালাে মানুষ। ৩০ শতাংশ খারাপ বৈশিষ্ট্য সহজেই উপেক্ষা করা যায়। আমার বিচারে বঙ্গবন্ধুর ভালাে বৈশিষ্ট্য এর চেয়ে ঢের বেশি। আপাদমস্তক ভালাে মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান দুর্বলতা ছিল তিনি অতি গভীরভাবে মানবিক ও দয়ালু ছিলেন। সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী, বন্ধু রাজনীতিকদের বরাবরই তিনি বেশি ভালােবাসতেন। কখনও বিরােধী রাজনীতিকেরও ব্যক্তিগত অমঙ্গল চাইতেন না। দুঃসময়ে তারা জেলে গেলেও তাদের পরিবারের ভরণপােষণের ভার তিনি পেচ্ছায় কাঁধে তুলে দায়িত্ব নিয়েছেন। এসবের ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। আর সে কারণেই তিনি অনেক সময় তাদের ওপর কঠোর হতে পারেননি। আর যখন তিনি শক্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন তখনই তাকে অনেকে ভুল বুঝলেন। ইতিহাসের স্রোতোধারা যখন খানিকটা থিতু হচ্ছে তখন ঠিকই সত্যি কথাটি বের হয়ে আসছে যে, জনগণের মঙ্গলের জন্যই সাময়িকভাবে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার ঘনিষ্ঠজনরা জানতেন, সময়মতাে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ঠিকই তিনি ফিরে আসতেন।

কেননা, গণতন্ত্র যে ছিল তার মজ্জাগত এক বিষয়। আজীবন জনগণের অধিকারের জন্য লড়েছেন তিনি। তাই প্রচলিত গণতন্ত্র থেকে দূরে থাকা কি তার পক্ষে সম্ভব ছিল?

বড়ই দুঃখের বিষয় যে, এই কথাগুলাে সেদিন মধ্যবিত্তের কাছে কেউ তুলে ধরার চেষ্টা করেননি। আজকের এই অস্থির সময়ে আমরা কি অনুভব করতে পারি, কেন তিনি সে সময় এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন?

এ প্রশ্নের উত্তর সহজে দেয়া সম্ভব নয়। যারা তাকে কাছে থেকে তার গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ দেখেছেন, তারাই অবাক হয়েছিলেন তাঁর একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের সিদ্ধান্তে। এর খুঁকি সম্বন্ধে তার ঘনিষ্ঠজনরা অবহিত ছিলেন। তাজউদ্দীনসহ অনেকেই তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তারা ভার মঙ্গলই চেয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের জীবনের মানের যেন সত্যি সত্যি উন্নতি হয়, সেই আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের শত্রুরা এই সাময়িক বিভ্রান্তির সুযােগ নিয়ে ঠিকই মরণকামড় বসিয়েছিল বাঙালির শ্রেষ্ঠতম সন্তানটির শরীরে। | শারীরিকভাবে তাকে নিঃশেষ করলেও তিনি যে বয়ে গেছেন আমাদের নিশ্বাসেপ্রশ্বাসে। দিনদিনই তিনি ছাড়িয়ে যাচ্ছেন নিজেকে। তিনি যে আমাদের অস্তিত্বে সমান। আমাদের জীবনেরই অংশ। তাই আমাদের সন্তানদের কাছে তাকে সঠিকভাবে তুলে ধরা আমাদের সবারই এক নৈতিক দায়িত্ব। বিশেষ করে তার জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করা খুবই প্রাসঙ্গিক বলে আমি মনে করি। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাঁর জন্মদিন দেশজুড়ে পালন করা হলে আরও ভালাে হতাে। কেননা, এই রাষ্ট্রটিই যে আমরা পেতাম না, যদি না তিনি তার জীবনকে বাজি রেখে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য এমন করে সংগ্রামে লিপ্ত না হতেন। সেজন্যই যদি বলি, তিনিই বাংলাদেশ, তা ভুল হবে না।

প্রতিটি বিদ্যায়তন, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলাে স্বউদ্যোগে তার জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নিলে সবচেয়ে ভালাে হতাে। তবুও বলতে চাই, শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দিনদিন তিনি আমাদের মনােজগতে থিতু হচ্ছেন। প্রতিদিন তিনি আরও বড় হচ্ছেন। পুরাে বাংলাদেশকেই যেন তিনি তার দীঘল ছায়া দিয়ে ঢেকে দিতে চাইছেন। প্রতিদিন শান্তির সেই ছায়া দৈর্ঘ্য-প্রহে বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষের অতি কাছে শুয়ে থাকা বাঙালির প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধু আমাদের ইতিহাসের প্রধানতম নায়ক। শ্রেষ্ঠতম জাতীয় বীর। | এই জন্মদিনে আমাদের প্রত্যাশা, তিনি আমাদের সারাক্ষণ সঙ্গেই থাকবেন। তাঁর গরিব-হিতৈষী ভাবনাগুলাের সঠিক বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকার করার দিন আজ। আসুন, আমরা সে পথেই হাঁটি।

যুগান্তর ১৭ মার্চ ২০০৮
ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্থান নির্ধারণ ও কিছু কথা

ড. হারুন অর-রশিদ আগস্ট মাস বাঙালি জাতির শােকের মাস। ৩২ বছর পূর্বে ৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতের আঁধারে একদল ঘাতক খুনীচক্র ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের নিজ বাসগৃহে পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দ্বারা হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ পড়ে থাকে সিড়িতে। বয়ে যায় রক্তগঙ্গা। ১০ বছরের শিশু, গর্ভবতী নারী, গৃহভৃত কেউই পরিত্রাণ পায়নি। এ নির্মম হত্যার ঘটনা যেন গ্রিক ট্রাজেডি, কারবালার হত্যাকাণ্ডকেও হার মানায়। এ ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার মর্মমূলে কুঠারাঘাত। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশকে নেতৃত্বহীন করে দ্বিজাতিভিত্তিক পাকিস্তানি ভাবধারায় একে ফিরিয়ে নেয়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নিছক খুনের ঘটনা ছিল না। তা ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ড। তাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে একমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরােধী দেশী-বিদেশী গােষ্ঠী উযু হয়। শুরু হয় বাংলাদেশের পেছনপথে চলা, যা আজও অব্যাহত। ১৯৯৬২০০১ সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন ও দেশ পরিচালনার সুযােগ পেলে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা ও ধারায় দেশের পুনর্থত্যাবর্তন শুরু হয়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে স্বাধীনতাবিরােধী জামায়াতসহ ৪ দলীয় জোটের বিজয় পুনরায় পাকিস্তানি ধারায় দেশকে নিয়ে যায়।

আজকে যে ভৌগােলিক এলাকা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত, সেখানে প্রাচীনকাল থেকে জনবসতি ছিল। তবে তা গ্রিক নগররাষ্ট্রের মতাে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদে বিভক্ত ছিল। উপরন্তু, একক জাতিসত্তাৰােধ বলতে কিছুই ছিল না। ইতিহাসের ক্রমধারায় কালক্রমে একই প্রশাসনিক কাঠামােয় অন্তর্ভুক্ত হলেও এই অঞ্চল ও এর জনগণ পূর্বে কখনও স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন রাষ্ট্রে বলতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় যা বুঝায় তা ছিল না। জাতিসত্তা ও রাষ্ট্র গঠনের উপাদান ছড়িয়ে ছিল মাত্র। ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই প্রথম সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠালাভ করি। বিশ্বের মানচিত্রে অ্যুদয় ঘটে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। যার পীণ আন্দোলন-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সুযােগ্য নেতৃত্বগুণে আমরা বিশ্বদরবারে

এই পরিচিতি লাভ করি, তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান।

তাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেই প্রতিক্রিয়াশীলচক্র ক্ষান্ত হয়নি। ৭৫-পরবর্তী শাসকগােষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করার পরিবর্তে বার্মীয় পৃষ্ঠপােষকতা প্রদান করে আসে। অনেককে বিদেশ বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। বঙ্গবন্ধুহত্যার যাতে বিচার না হয় সেজন্য কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স (সেপ্টেম্বর ১৮/১৯৭৫) জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে মানুষের, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে চালানাে হয় ইতিহাসবিকৃতি। মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্ব, বাঙালির বীরগাথা সৰই পাঠ্যপুস্তক থেকে হেঁটে ফেলা হয়। বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল অন্য কাউকে দাঁড় করার অপচেষ্টা হয়। তাই হয়তাে সম্প্রতি দেশের সেনাপ্রধান জেনালের মইন উ আহমেদ পর্যন্ত একাধিকবার প্রকাশে বলেন : “আমরা এমন এক জাতি যাৱা ৩৬ বছরেও জাতির জনককে যথাযােগ্য মর্যাদা দিতে পারি নাই।’ বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের যথাযযাগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করারও তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তার এই ঘােষণা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্থান কী হবে? মনে রাখা আবশ্যক, লিখিত কিছুমাত্রই তা ইতিহাস নয়। লিখিত অনেককিছুই ইতিহাসে স্থান পায় না, বরং আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। লিখিত অলিখিত, ইতিহাসের উপকরণ অনেক। বহুকিছু নিয়ে ইতিহাস তৈরি হয়। ইতিহাস সত্যনিষ্ঠ, কালােত্তীর্ণ স্বয়ম্ভর। ইতিহাস সমসাময়িকতার উঞ্চে, কালের সাক্ষী। ইতিহাস স্বমহিমায় প্রকাশিত। ইতিহাস কথা কয়। এতে বিকৃতির স্থান নেই। হাজার বছরের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। অবিসংবাদিত নেতা। মহানায়ক। স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক। রাষ্ট্রের স্থপতি। এ ছাড়া বিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধ কালপর্বে সম্রাবাদ, উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ বিরােধী তৃতীয় বিশ্বের শােষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত, স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী জনগণের অন্যতম কণ্ঠস্বর হিসেবে তিনি বিশ্বপরিসরে সমাদৃত হন। বিশেষ করে কাল থেকে কালস্তির যতদিন স্বাধীন বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র থাকবে, ততদিন ইতিহাসের পাতায় বঙ্গবন্ধুর নাম থাকবে দেদীপ্যমান। জাতির ভবিষ্যৎ সন্তানেরা শ্রদ্ধাভরে বাংলাদেশের সঙ্গে উচ্চারণ করবে একটি নাম—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যেমনি বিশ্বের দেশে দেশে উচ্চারিত হয় সেখানকার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নাম।

বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে জেনারেল মইন উ আহমেদ-এর বক্তব্য ইতিহাসের ধারায়ই অনুসৃত। স্বাধীনতার ৩৬ বছর একটি জাতির জীবনে কিছুতেই বেশি সময় নয়। এর মধ্যেই বাঙালির অনাগত ইতিহাসের অমােঘ বাণী তার কণ্ঠে উচ্চারিত হল। এ দ্বারা যা-কিছু সত্য, ন্যায় তার পক্ষে, ইতিহাসের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন। তার এই ইতিহাসবােধ, সময়ােচিত সাহসী উচ্চারণ সমগ্র জাতির প্রশংসা কুড়িয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিকগবে জাতির জনক ও রাষ্ট্রের স্থপতি ঘােষণা করলে ভালাে। না করলেও ইতিহাসে তার স্থান নির্ধারণে অসুবিধা নেই। বঙ্গবন্ধুর স্থান ইতিহাসে সেভাবেই নির্ধারিত হয়ে আছে। তবে জাতির নিজের প্রয়ােজনেই বঙ্গবন্ধুকে যথাযােগ্য মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করা আবশাক। কেননা বঙ্গবন্ধুকে উপেক্ষা কিংবা স্বীকার করে বাঙালির স্বাধীন পথ চলা, উন্নয়ন, অস্তিত্ব সংরক্ষণ কিছু সম্ভব নয়। তবে যা কিছুতেই না হলে নয়, তা হচ্ছে জাতির কালিমা বিলােপন। সেজন্য ১৫ আগস্টকে জাতীয় শােক দিবস ঘােষণা এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের রায় কার্যকর। করা একান্ত জরুরি।

আর একটি কথা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আজ কারাবন্দি। একের-পর-এক তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে। হাইকোর্ট জামিন দিলেও সরকার সুপ্রিমকোর্টে লড়ছে। জাতির জনকের কন্যা ছাড়াও শেখ হাসিনা একজন নারী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। যেভাবে টেনেহেঁচড়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়, সে দৃশ্য দেশের অগণিত মানুষকে ক্ষুব্ধ। ও ব্যথিত করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, সর্বোপরি একজন নারী শেখ হাসিনার প্রতি কি যথাযােগ্য আচরণ করা হয়েছে? গ্রেফতারের সময় সকল কাগজপত্র জমা করে এখন জেল অন্তরীণ অবস্থায় সরকার কর্তৃক তাঁর সম্পদ-বিবরণী ব্যাংকের হিসাব, আয়কর সম্পর্কিত তথ্য চাওয়া হচ্ছে। তাও আবার বেঁধে দেয়া নির্দিষ্ট সময়ের। মধ্যে। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নিকট সহায়তা চেয়েও তিনি তা থেকে বঞ্চিত হন। | কে না জানে, শেখ হাসিনা একজন সত্যিকার এতিম। ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট তিনি মা-বাবা, ভাই সকলকে হারিয়েছেন। প্রাণে বেচে যান তিনি নিজে ও ছোটবােন রেহানা। তাও ঐ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করার কারণে। অন্যথায় পরিবারের অন্যদের সঙ্গে একই ভাগ্য বরণ করতে হত এ দুই বােনকে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠান, মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগের হাল ধরেন।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ধারা ও চেতনার দেশকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী জাতিদ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সফল হন। ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি চুক্তি সম্পাদন করেন। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন কর্মকাকে তাদের অংশগ্রহণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সাক্ষরতার হার শতকরা ৬৫ ভাগ এবং প্রবৃদ্ধির হার ৬.৫ (ছয় দশমিক পাঁচ) ভাগে উন্নীত করতে সক্ষম হন। এই প্রথম বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। সহায়হীন, আশ্রয়হীন, বৃদ্ধ, স্বামী পরিত্যক্তা বিধবা এদের জন্য আশ্রয়ণের ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় ভাতা প্রবর্তন করা হয়। বিশ্বে বাংলাদেশ একটি উন্নয়ন সম্ভাবনার দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর দীর্ঘ ২৬ বছর শেখ হাসিনা দেশ ও জাতির সেবায় ক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এ সময় একাধিকবার তিনি সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারানাে থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিন্যর সমাবেশে জঙ্গীগােষ্ঠীর বৃষ্টির মতো গ্রেনেড হামলার হাত থেকে অলৌকিকভাবে প্রাণে বাঁচেন। তিনি । ঐ হামলায় নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। এই হল। শেখ হাসিনার সংক্ষিৰু জীৱন-আলেখ্য। | সরকারের অংশীদার সেনাবাহিনী প্রধান একদিকে বঙ্গবন্ধুকে যথাগাে মূল্যায়নের কথা বলছেন, অপরদিকে সরকার ১৫ আগস্ট শােক দিবসে বঙ্গবন্ধু ও অন্য শহীদের স্মরণ ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনাৰ্থে আলােচনাসভাসহ গুহী কর্মসূচি পালনে প্রয়ােজনীয় অনুমতি দিচ্ছে না। যা দেয়া হচ্ছে, তা খুবই সীমিত। দেশের অধিকাংশ জেলা আজ বন্যাকবলিত। ভয়াবহ বন্যাপরিস্থিতি জান্তীয় দুর্যোগে রূপ নিয়েছে। সরকারি হিসাব মতে, ইতোমধ্যে ১৬০ জনের অধিক লােক প্রাণ হারিয়েছে। মাঠের ফসল, রাস্তা, কালভার্ট, নদীর উপকূলীয় ধাঁধ, কাঁচা ঘরবাড়ি, গবাদিপত সবকিছু বানে ভেসে গেছে। দেখা দিচ্ছে পানিবাহিত রােগ। বানজামি মানুষ আজ খুবই অসহায়। নিকট অতীতে ১৯৯৮, ২০০৪ সালেও দেশে মারাত্মক বন্যা দে দিয়েছিল। বন্যার্তদের সাহায্য প্রথা বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় তখনকার রাজনৈতিক সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা সর্বজনবিদিত। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৯৮ সালের দীর্ঘ ৭৬ দিন স্থায়ী ভয়াবহ বন্যা মােকাবেলায় তার সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ দেশবিদেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ‘মডেল হিসেবে স্বীকৃত হয়। বিদেশী সংবাদমাধ্যম দু-কোটি লােক মারা যেতে পারে বলে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল, তা আলো ঘটেনি। কিন্তু বর্তমান বন্যা মোকাবেলায় আমরা কি সে তৎপরতা লক্ষ্য করি? অবশ্য বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা এবং এর নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে জাতীয় এই দুর্যোগমুহূর্তে বন্যার্তদের পাশে রাজনৈতিক দল, বেসরকারি, সাহায্য সংস্থা (এনজিও), পেশাজীবী, সংগঠন, সংস্কৃতিসেবী, বিত্তবান সবাই যাতে সর্বাত্মকভাবে দাঁড়াতে পারে, সেক্ষেত্রে কোনােরূপ সরকারি বিধিনিষেধ থা৷ আপৌ উচিত নয়। তা হবে বড় নিষ্ঠুরতা ও বন্যা নিয়ে রাজনীতির শামিল। সর্বাগ্রে প্রয়ােজন, সমাজজুড়ে যে ঐতির প্রাচীর সৃষ্টি হয়েছে, তা দুরীভূত করা। সরকারকেই তা করতে দেশ যখন ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে, তখন শেখ হাসিল কারান্তরীণ অবস্থায় আর্তমানুষের জন্য ছটফট করছেন। অসহায় মানুষের পাশে যা-কিছু আছে চা নিয়ে দাঁড়াবার জন্য তিনি দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া একজন বন্দি মানুষ আর কী করতে পারে। নিজ দল নিয়ে তাঁকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াবার সুণে দিলে দেশ জাতি এমনকি সরকারের এমন ক্ষতি হত? দেশবাসীর এখন স্পষ্ট জানা, জাতির জনকের কন্যা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাকা শহরে কোনাে বাড়ি এমনকি একটি ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। একমাত্র স্বামীর বাড়িটিই সম্বল। পৈতৃক সূত্রে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের যে-বাড়িটি স্বর ও শেখ রেহানার পাওয়ার কথা, সেটি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে তারা দেশবাসীর উদ্দেশে উৎসর্গ করেছেন। সততা, দেশপ্রেম, মানবকল্যাণের আর কী নিদর্শন বাকি থাকে? | ঘর-সংসার, সংগঠন, ছােটখাটো প্রশাসন পরিচালনা করতে গিয়ে মানুষের অনেক ভুলত্রুটি হয়। আর সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার তাে কথাই নেই। ইচ্ছা করলে শতকরা একশাে ভাগ সৎ একজন মানুষেরও একশাে একটি দোষ ত্রুটি বা বিচ্যুতি খুঁজে বের করা যাবে। সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে বা ভিন্ন সময়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর অনুরূপ অন্য কেউ তেমনটি কিছু করে থাকলে দুজন্য তাদের প্রতি একটি উদার, সহনীয় মনােভাব প্রদর্শন করা কি যায় না? দেশ ও জনসেবা, মানুষের জন্য আত্মােৎসর্গ সবই বিফলে যাবে। মনে রাখা দরকার, বিদ্বেষ, বিভেদ, জিঘাংসা, নিষ্ঠুরতা সমাজরাষ্ট্রে অনুরূপটি জন্ম দেয়, যা কারও কল্যাণে আসে না। আশা করি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

পরিশেষে ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার উর্বে বঙ্গবন্ধুর স্থান ইতিহাসের পাতায় যেমন নির্ধারিত হয়ে আছে, তেমনি আমার ধারণা, বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও নিজ কর্তব্যগুণে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে দীর্ঘদিন জনগণমননন্দিত নেত্রী হিসেবে আপন স্থান করে নিবেন।

জনকন্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৭
৭ মার্চ ছিল অনিবার্য

মুনতাসীর মামুন

অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম আলােচনাকালে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ৭ মার্চ কি অনিবার্য ছিল? বিষয়টি নিয়ে আগে কখনও গভীরভাবে চিন্তা করিনি। সাতই মার্চ তাে সাতই মার্চ। পরে ভেবে দেখলাম, প্রশ্নটি তাৎপর্যময়। ঘটনাপরম্পরা আলােচনা করলে দেখা যাবে ৭ মার্চ ছিল অনিবার্য। | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আরও অনেকে ১৯৪৭ সাল থেকেই পৃথক একটি রাষ্ট্র বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন। স্বপ্নও হয়তাে দেখেছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বপ্ন। দেখেননি ৰা বলেননি, কীভাবে তা কার্যকর করা যায় সেটিও ভেবেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৬৯ সাল এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। থেকে সবাইকে মুক্ত করার মাধ্যমে বাঙালি আরেকটি ধাপ এগিয়েছিল। অর্থাৎ এটি ছিল দ্বিতীয় পদক্ষেপ।

অন্যদিকে ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী ঝড়ের পর ইয়াহিয়া সরকার বাঙালিদের ত্রাণ কাজে তৎক্ষণাৎ এগিয়ে আসেনি। পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘােষণা। করলেন- ‘ওরা কেউ আসেনি।’ শামসুর রহমান সেই জনসভা প্রত্যক্ষ করে লিখলেন- ‘সফেদ পাঞ্জাবি। এল নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ম্যান্ডেট পেল বাকালির ৬দফা কার্যকর করার। সুতরাং একধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছিল সবার। একথা ভুললে চলবে না যে, ১৯৬৯ সালেই শ্লোগান উঠেছিল- ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তােমার আমার ঠিকানা। | ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশনের ঘােষণা বাঙালির মনস্থির করতে সাহায্য করে। বিষয়টি এমন—যথেষ্ট হয়েছে আর নয় । ১ মার্চ থেকে ৭ মার্চ যেসব ঘটনা ঘটেছে তা বিশ্লেষণ করলেই মনস্থির করার বিষয়টি বােঝা যাবে। সবকিছু মিলে অনিবার্য করে তুলেছিল ৭ মার্চ। ১-৬ মার্চের ঘটনাবলি পর্যালােচনা করলেও তা প্রমাণিত হবে।

স্বাধীনতার বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কোনাে দ্বিধা ছিল না, তবে তিনি ধীরস্থির এগােতে চেয়েছিলেন। প্রথমে তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে সৰ আলােচনায় যােগ দিয়েছিলেন যাতে ভবিষ্যতে কেউ বলতে না পারে, তিনি একতরফা কাজ করেছেন। এ দূরদর্শিতা পরে

বাংলাদেশ আন্দোলনে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোকে বাধা দেননি। আমরা তখন জাহ। তরুণদের প্রবল চাপ ছিল তাৎক্ষণিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণার । কি বঙ্গবন্ধু তাদের আরেকটি সুযোেগ দিতে চেয়েছেন নিজের দাবিতে অনড় থেকে। সব মিলিয়ে ৭ মার্চ স্বাধীনতা ও মুক্তির ঘােষণা দিয়েছেন। সাক্ষ্য করবেন, তিনি শুধু ভৌগােলিক স্বাধীনতাই চাননি, সাধারণ মানুষের মুক্তিও চেয়েছিলেন।

১ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা চলছে বিসিসিপি ও আন্তর্জাতিক একাদশে কে খেলা। স্টেজিয়াম প্রায় ভর্তি। চাপা টেনশন থাকলেও শহর শান্ত। বেলা ১টার সময় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার-ভাষণ দিলেন, যার মূল কথা ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত। বেতাৱা-ভাষণটি শেষ হতে-না-হতেই পুরাে শহরটি বদলে যেতে লাগল। ফেন আড়মােড়া তেকে জেগে উঠছে শহর। ইত্তেফাক’ থেকে আমরা ক’জন বেরিয়েছি রাস্তায়। এরই মধ্যে বেরিয়ে গেছে ছোট ছােট মিছিল—যাচ্ছে গুলিস্তান, পল্টন। পূর্বাণী হােটেলের সামনে মিছিল আর স্লোগান । জয় বাংলা”, “তােমার আমার ঠিকানা, পদা-মেঘনা-যমুনা’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, “জয় বাংলা’…।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ পঞ্চ। খেলােয়াড়রা দৌড়ে আশ্রয় নিয়েছে ড্রেসিংরুমে। টেডিয়ামের কোথাও কোথাও জ্বলছে আগুন। সব মানুষ কােন রাস্তায়। হােটেল পূর্বাণীর সামনে লােকে লােকারণ্য। বিকাল ৩টায় সেখানে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পাটির বৈঠক। সব » আশাকে শাস্তি হতে হলে দুদিনের কর্মসূফি দিলেন আর বললেন, ৭ মার্চ হবে জনসভা। সেখানে তিনি তার বক্তব্য দেবেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির দুপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘১ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুরু হল ব্যাপক অসহযােগ আন্দোলন।

১ থেকে ৭ মা প্রতিদিন কিছু-না-কিছু ঘটতে থাকে ঢাকা শহরে, সারাদেশে। অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-জনতার সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ আর গগনবিদারী স্লোগান জয় বাংলা”, …………লা। সন্ধ্যায় জারি করা হয় কারফিউ। মানুষ বলে ‘জয় বাংলা’ আর রাস্তায় নামে, মানুষ বলে তােমার-আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনাযমুনা আর কারফির ভাঙে, মানুষ বলে ‘জয় বাংলা’ আর অলি খায়, আবারও বলে ‘জয় বাংলা”, আবারও গুলি খায়। হাসপাতালে বুলেটবিদ্ধ মানুষের ভিত্ব বাড়তে থাকে আর গণ্ডীর রাতে শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশে আগুন জ্বালাবেন না। যদি জ্বলান, সে দাবানল থেকে আপনারাও রেহাই পাবেন না ।… সাবধান, শক্তি দিয়ে জনগণের মােকাবেলা করবেন না।’

একাত্তরের ৩ মার্চ। আগের রাতের শহীদদের নিয়ে মিছিল বের হয়। পল্টনে শেখ মুজিব ঘােষণা করেন, গণতান্ত্রিক নিয়মে প্রণীত এক শাসনতন্ত্র থলি কা চান, তাহলে

আপনাদের শাসনতন্ত্র আপনারা রচনা করুন। বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র আমরাই বচনা করব।’ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জয় বাংলা’ নিতে কেঁপে ওঠে পল্টনের চারদিক। শেখ মুজিব বললেন, ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় বার্তা চালানাের জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়। গরিব বাঙালির টাকায় কেনা বুলেটের ঘায়ে কাপুরুষের মতো গণহত্যার বদলে অবিলম্বে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিন ।… ২৩ বছর ধরে রক্ত দিয়ে আসছি। প্রয়ােজনে আবার বুকের রক্ত দেব। মৃত্যুর মুখে দাড়িয়ে বীর শহীদদের সঙ্গে বেঈমানী করব না।’ বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন—’ভায়েরা আবার আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তারাই নেতৃত্ব দেবেন। আর যদি কেউ না থাকে, তবু আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’ চারদিক থেকে গগনবিদারী গর্জন শােনা যায়—’জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা”।

রাতে সারাদেশে মানুষ কারফিউ তেন্তে নেমে আসে রাস্তায় আর বলে জয় বাংলা’। আলি বলে “জয় বাংলা। ৭৫ জন লাশ হয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়, অগণিত কাতরাতে থাকে গুলি খেয়ে-তবুও বলে ‘জয় বাংলা”।

৭ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধু চিৎকার করে বলেছে ‘জয় বাংলা’। আর বদলে পেয়েছে গুলি। আমরা ভাবছি কী বলবেন শেখ মুজিব? তিনি কি বলবেন, বাংলাদেশ হয়ে গেছে স্বাধীন? কিন্তু বলার আর বাকি কী? বরং তিনি যদি না বলেন, তাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে যাবে মানুষ। ইতিমধ্যে উত্তোলিত হয়েছে স্বাধীন বাংলার পতাকা আর বাংলাদেশ ক্ষণে ক্ষণে কেপে উঠছে সেই গগনবিদারী আওয়াজে ‘জয় বাংলা’! ‘জয়। বাংলা’!

ড. কামাল হােসেন লিখেছেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী বলবেন তা ঠিক করার জন্য ৬ মার্চ বসল আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভা। | সারাদেশে প্রত্যাশা দেখা দিয়েছিল যে, ৭ মার্চ শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘােষণা দেবেন। বস্তুত হত্র ও যুবসমাজ এ ধরনের ঘােষণার প্রবল পক্ষপাতী ছিল। ৭ মার্চ নাগাদ দলীয় সদস্যদের মধ্যে সামান্যই সন্দেহ ছিল যে, ছাত্রসমাজ, যুবসম্প্রদায় এবং রাজনীতিসচেতন ব্যাপক জনগণের কাছে স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনােকিছুই গ্রহণযােগ্য হবে না।’

সুতরাং দল ও দলীয় নেতা শেখ মুজিবের ওপর দায়িত্ব এসে পড়েছিল এমন কিছু না বলা, যা পাকিস্তানি পক্ষকে তখনই অজুহাত দেবে অপ্রস্তুত জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার। আবার একই সঙ্গে চা ৰাখতে হবে আন্দোলন ও জনগণকে। এ ভারসাম্য বজায় রাখা নিতান্ত সহজ ছিল না। এছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে, তখনও তাকে কাজ করতে হচিছল পকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামাের মধ্যে যেখানে তার অবস্থান ছিল সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। এখন আমাদের কাছে ব্যাপারটি যত সহজ মনে হচ্ছে তখন নিশ্চয় তা ছিল না। এছাড়া ছিল তরুণ, বিশেষ করে ছাত্রদের প্রবল চাপ। তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের পতাকা উত্তােলন করে ফেলেছেন। আন্দোলনের তারাই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। তাদের বিরূপ করা সম্ভব ছিল না। | ৭ মার্চ দুপুর থেকে ঢাকা শহর এপােতে থাকে রমনা রেসকোর্সের দিকে। মনে আছে, রেসকোর্সের এককোণে আমি, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ও রফিক নওশাদ বিক্রি করছি সারারাত ধরে ছাপা লেখকদের মুখপত্র প্রতিরােধ, যার হেডলাইন আপসের প্রস্তাব আগুনে জ্বালিয়ে দাও” এরকম একটা কিছু।

বিকাল ৩টার মধ্যে লােকে লােকারণ্য। রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন এখনকার মতো তখনও ছিল সরকারি। শেখ মুজিব জেনেশুনেই বলেছিলেন মনে রাখবেন রেক্তিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শােনেন তাহলে কোনাে বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয় কোনাে বাঙ্গালি টেলিভিশনে যাবেন না।”

| রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র ও মার্চের ভাষণ প্রচারের বন্দোবস্ত করল। পাকিস্তানি সেনা অফিসার সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘ৱেকিওর ঘােষকরা আগে থেকেই রেসকোর্স থেকে ইস্পাতদৃঢ় লাখ দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা জার করতে শুরু করল।’ সালিক আরও লিখেছেন, এ ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসকের দফতর হস্তক্ষেপ করে এ বাজে ব্যাপারটি বন্ধের নির্দেশ দিল । মালিকও তা ৱেক্তিও কর্তৃপক্ষকে আনালেন। আদেশটি শুনে টেলিফোনের অপরপ্রান্তে ব্যালি অফিসাৱটি বললেন, “আমরা যদি সাড়ে ৭ কোটি জনগণের কণ্ঠ প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না।’ এ কথার সঙ্গে সঙ্গে বেতারকেন্দ্র নীরব হয়ে গেল। বালি সেসময় এ ধরনের সাহস দেখানাের ক্ষমতা দেখিয়েছিল। কারণ তারা শেখ মুজিবের পর এই বিশ্বাস স্থাপন করেছিল যে, তিনি বিশ্বাস ভঙ্গ করবেন না। লেখিতে ভাষণটি অবশেষে প্রচারিত হয়েছিল। | শেখ মুজিব এসে মঞ্চে উঠলেন। সারা রেসকোর্স কাপিয়ে ঝড়ো হাওয়ার মতাে সেই শব্দটি বয়ে গেল— জয় বাংলা | বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠেন। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালাে মুজিব কোট পরুেন। আমরা যারা টিএসসির মােড়ে, তারা দূর থেকে কাপস একটি অবাৰ দেখি। সভায় কোনাে আনুষ্ঠানিকতা নেই। কালে ভারী ফ্রেমের চশমাট খুলে রাখলেন ঢালু টেবিলের ওপর। শান্ত গর্ভীর কগেল বললেন, আমরা আমার! এ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে। হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন, সবই বােঝেন।

উনিশ মিনেটের ভাষণ, লিখিত নয়। কিন্তু একবারও থাকাতে হয়নি। পরে বিবিসির কিওতে ক্লোজআপে দেখেছি আবেগে কাঁপছে তার মুখ, কিৰ সৰ অবয়বে দৃঢ় প্রতিজ্ঞয়ার স্থাপ। বােঝা যায় তিনি পিছােনে না।

৭ মার্চ তিনি রেসকোর্সে ছিলেন না, তাকে বােঝানাে যাবে না ৭ মার্চ ল ছিল। বাংলাদেশের জন্য। বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ বাঙালি মাত্রই জানেন। এ ভাষণের প্রতিটি উকিই উদ্ধতিযােগ্য। কিন্তু মূল বক্তব্যটি ছিল—“আর তােমরা গুলি করার চেষ্টা কোকাে না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখছি, তখন কেউ আমাদের পাতে পারবা না।’ সবশেষে বললেন, যা শােনার জন্য উন্মুখ ছিল বাংলাদেশ—’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

কঠিন সংকটে এত ভারসাম্যপূর্ণ অথচ আবেগময় বক্তৃতার সংখ্যা বিরল। কীভাবে তিনি অ পেরেছিলেন, আজ ভাবলে অবাক লাগে। পাকিস্তানি সৈনিক সিদ্দিক সালিক লিখেছেন| ‘বতার শেষদিকে তিনি জনতাকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিলেন। যে জনতা সাগরের ফেউয়ের মতাে প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে কেসকোর্স ভেকে পড়েছিল ভাটার টান ধৱা জােয়ারের মতাে তারা ঘরে ফিরে চলল। তাদের ধর্মীয় কোনাে জনসমাবেশ তথা মসজিল কিংবা গির্জা থেকে ফিরে আসা জনতার ঢলের মতােই দেখাচ্ছিল এবং ফিরে আসছে তারা সন্তুষ্টচিত্তে-ঐশীবাণী বুকে ধরে। তাদের ভেতরকার সেই আগুন যেন থিতিয়ে গেছে। ইচ্ছা করলে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে সেই আগুনকে ধাবিত করা যেত। আমাদের অনেকেরই আশঙ্কা ছিল এরকমই। এ এক সামরিক আইন সদর দফতরে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিল। সদর দফতর থেকে টেলিফোনে কথােপকথনকালে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, এখন সামরিক আইন প্রশাসক বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ।

বিএনপির স্বপ্নদ্রষ্টা জিয়াউর রহমান লিখেছিলেন, ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল’ বলে মনে হল। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চুড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনাে ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালি ও পকিস্তানি সৈনিকদের মাঝে উত্তেজনা কমেই চরমে উঠেছিল।

মঈদুল হাসান লিখেছেন, সম্ভবত তিন সপ্তাহধিক কালের অসহযােগ আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় এমন এক মৌল রূপান্তর ঘটে যে, পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলার স্বাধীনতাই তাদের জন্য অভিন্না ও একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ মানুষের কাছে শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঘােষণা হয়ে ওঠে এক অভ্রান্ত পথনির্দেশ।

এ ভাষণের পর শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরাে দেশটি বদলে যায়। বাষ্পে ভরা পাত্রের মতো টগবগ করতে থাকে ৭ কোটি মানুষ। জোরদার হয়ে ওঠে অসহযােগ আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়। শেখ মুজিবের নির্দেশই হয়ে ওঠে সরকারি নির্দেশ। মানুষ অ মানতে থাকে। এমনকি সরকারি প্রশাসনও। | এভাবেই সৃষ্টি হয় একটি সমান্তরাল রাষ্ট্রের। সেদিক বিচার করলে ২৫ মার্চের স্বাধীনতা ঘােষণা ছিল একটি ফর্মাল ডিক্লারেশন যাত্র। আসলে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের পতন হয় ৭ মার্চ। মহাত্মা গান্ধীও এত স্বল্পসময়ে এত পরিপূর্ণ অসহযোেগ আন্দোলন করতে পারিনি। যারা পিছিয়ে ছিল এতদিন, ভুগছিল, দোদুল্যময়তায়, তারাও এগিয়ে আসতে থাকে। কী জানি কারাভা যদি তাদের ফেলে এগিয়ে যায়। এভাবেই বাংলাদেশ এগােতে থাকে ২৫ মার্চের দিকে। ওই যে সেদিন শেখ মুজিব আঙুল তুলে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ৰাম্ভালি তা মেনে চলে গিয়েছিল। পরাধীন পাকিস্তানে আর তারা ফিরে আসেনি।

যুগান্তৱ ৭ মার্চ ২০০৮
১৫ আগস্ট : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশের দিন

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রতি, দেশটির স্থপতি এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। তার দুই নিকটাত্মীয়কেও সপরিবারে হত্যা করা হল। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একজন রাষ্ট্রপতি এবং দেশটির স্থপতিকে এভাবে হত্যা করার ঘটনা শুধু পৃথিবীতেই বিরল নয়, এর মধ্যে হিংস্রতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতাও যে-কোনাে সভ্য মানুষের কল্পনার সীমানাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। সেই হত্যাকাণ্ডের বীভৎসতার কথা ভাবতে যে-কোনাে মানুষের মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়, এমনকি শরীর শিউরে ওঠ। কিন্তু এ মাটির কিছু নষ্ট মানুষ এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঠিকই সংঘটিত করতে পেরেছে, তাতে তাদের হাত হয়তাে কাপেনি, হৃদয় কাদার কথা ভাবাই যায় না। এ হত্যাকারীরা এতগুলাে মানুষকে হত্যা করে বীরদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছে, দেশে-বিদেশে দীর্ঘদিন গুরুত্বপূর্ণ পদে কেউ কেউ অবস্থানও করেছে, কেউ কেউ প্রভূত বিত্তের মালিক হয়ে বিদেশে দীর্ঘদিন নিরাপদ জীবনযাপনও করেছে। কীভাবে তা সম্ভব হল ?

| হ্যা, সব সম্ভবের এই বাংলাদেশে এমনটি ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবেই সম্ভব হয়েছিল। কেননা, ১৯৭৫ সালেই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা এসব খুনিচক্রের বিচাৱক্রম নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। কারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে ৪ জন জাতীয় নেতাকে হত্যা করে দুনি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে দোষী হয় না? কারা তাদেরকে দেশে-বিদেশে পুরস্কৃত করেছিল?

কেন করেছিল? কারণ, এ খুনিদের এতগুলাে হত্যাকাণ্ডের ফলেই সব হয়েছিল একটি গােষ্ঠীর ক্ষমতায় আরােহণ, ক্ষমতার মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চরিত্রটিকেই বদলিয়ে ফেলা, যারা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ চায়নি, যারা চেয়েছিল বড়োজোর দ্বিতীয় আর একটি পাকিস্তান; তারাই ঐ ঘাতক, খুনিচক্রকে নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং অবশেষে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় বড় দায়িত্ব দিয়েছে। কিন্তু এই শক্তিকে আগে তেমন চেনা যায়নি, বােঝাও যায়নি। বর্ণচোৱা এই শক্তি সর্বত্র লুকিয়ে ছিল, তাদের ষড়যন্ত্রের হাত, বিত্ত ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ১৫ আগস্টের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত করেছিল। সুতরাং ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার মতাে ঘটনার মধ্যে

সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশ থেকে গােটা দেশ এবং জাতিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র, নীল নকশার বাস্তবায়নের যাত্রা। | বাঙালি জীবনে ১৭৫৭ সালেও একটি বড় ধরনের দুর্যোগ নেমে এসেছিল। সেখানেও দেশীয় ক্ষমতার অংশীদার কিছু মন্ত্রী, রাজপারিষদ, বিদেশী ইংরেজ গােষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, রাষ্ট্রক্ষমতা ও সম্পদ লাভের লােঞ্চে তারা নিজেদের নবাবকে প্রথমে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে ছলে-কৌশলে হারিয়ে দিল। অবশেষে ৩ জুলাই নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হলেন। ক্ষমতা ও ধনসম্পদলােভী তৎকালীন নবাবের কয়েকজন বিশ্বস্ত পারিষদের ষড়যরে কারণে বাংলার মসনদ হারাতে হল আমাদেরকে। ২০০ বছরের কিছু বেশি সময় আমাদের ইংরেজ এবং পাকিস্তানিদের অধীন থাকতে হল।

যে সময় আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম তখন আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষদের পরিচিতি ছিল না, সামন্ত রাষ্ট্রে রাজনীতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের যােগাযােগ খুব একটা ঘটেনি। তাই তখনকার ষড়যন্ত্রের ধরন-ধারণ, জনগণের জীবনব্যবস্থায় এর প্রভাব যেভাবে পড়েছিল, আধুনিক যুগের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিষয়গুলো অনেক বেশি ভিন্নতর। আধুনিক যুগে রাষ্ট্র-রাজনীতির বাইরে মানুষের অবস্থান খুব একটা থাকে না। এখন যড়যন্ত্র এবং বর্বর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি ক্রিয়াশীল হওয়ার কথাঃ’ মানুষ দ্রুত এর বিষয়-আশয় ধরে ফেলতে পারার কথা কিন্তু আমাদের জন্য অভিজ্ঞতাটা খুবই কষ্টের এবং বেদনাদার। আমরা ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ, মীরজাফরসহ অন্যদের ষড়যন্ত্র, নৰা-হত্যা নিয়ে এখন যতটা আবেগ এবং সংবেদনশীল। ১৯৭৫ সালের আগস্ট-নভেম্বরের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ফলে আমাদের রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বিপর্যয়ের স্বরূপটি কোনাে কোনাে মহলে সেভাবে লক্ষ্য করা যায় না; সেভাবে নির্ণয় করতে দেখা যায় না। আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটির পেছনে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারী শক্তির গভীর, সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক স্বার্থ ও উচ্চাভিলাষে বাংলাদেশটাকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে নয়, বরং পাকিস্তানের আদলেই আর একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনা থেকে করা হয়েছিল এই সত্যটুকু বুঝতে।

আমাদের এখানে পীদিন বই-পুস্তক, প্রচারমাধ্যম এবং রাজনীতির অঙ্গনে ১৯৭৫ সালের সকল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডকে আড়াল করে শুধু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নামে একটি ধারণার ব্যবহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনটি ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি’। কেন ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি? কারণ, তাদের ভাথায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই ১৫ আগস্টের দুঃখক্সনক ঘটনা। যারা এমন বক্তব্য ও ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন তাদের মধ্যে ১৯৭১-এর কিছু মুক্তিযােদ্ধা, রাজাকার, এককালের কিছু বামপন্থী এবং শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীও রয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার পেছনের কার্যকারণ, দেশীয়-আন্তর্জাতিক বাস্তবতাসহ অনেক কিছুই গম্ভীরভাবে বিচারবিশ্লেষণ করে থারণাগুলাে প্রতিষ্ঠিত করা হলে এমন সরলীকৃত সিদ্ধান্ত টানা কোনো বিবেকবান যুক্তিবাদী ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব হত না। আমরা বলব না সেই সময়ে। বঙ্গবন্ধু-সরকারের কোনাে ত্রুটি-বিচ্যুতি-দুর্বলতা ছিল না। কোনাে সরকারই রুটিবিচ্যুতি বা দুর্বলতার উর্ধ্বে নয়। তবে বুঝতে হবে সেই সময়ের সমস্যার বিস্তৃতি, গজীৱত, জটিলতা মােকাবিলা করার ক্ষেত্রে সেই সৱকারের আন্তরিকতা কতােখানি ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সমস্যার যে পাহাড় সৃষ্টি হয়েছিল তা সাড়ে তিন বছরে সমাধান। দেওয়ার মতাে সম্পন, অভিজ্ঞতা, দেশী-বিদেশী সমর্থন সেই সরকারের ছিল না। সেইসব বিস্তৃত আলােচনায় যাওয়া এই নিবন্ধে সম্ভব নয়। তারপরও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের একটি বঙ্গবন্ধুর সরকার নানা প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে যতটুকু সামলিয়ে উঠেছিলেন তাকে বুঝতে চেষ্টা না করলে আমার মনে হয় তাঁর প্রতি জীষণ ভাবে অবিচার করা হবে।

বঙ্গবন্ধু একটি সময়ে এ উপলব্ধি করলেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এর মৌলনীতিসমূহের বাস্তবায়ন ভর জন্য বেশ জরুরি এবং অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। অথচ তাকে তখন বিপ্লববাদে বিশ্বাসী নানা গােষ্ঠী অধিকতর সমাজতন্ত্রে ধাবিত করার জন্য, কেউবা সন্ত্রাসবাদী ধারায়, কেউবা রাতারাতি জাতীয়করণ, কেউবা চৈনিক পথে, কেউ মস্কোর পথে যেতে চাপাচাপি করছিলেন। আসলে ১৯৭০-এর দশকের বিশ্ববাস্তবতায় সমাজতন্ত্রের প্রভাব, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিপুল আহৃদনের মতো বিষয়। এর ফলে এখানকার সমাজ-রাজনীতিতে যে রূপান্তর ঘটেছিল তাতে দ্রুত সমাজতন্ত্রে উত্তরণের স্পৃহা উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বেগবান হয়ে ওঠে, যা এই রাষ্ট্রের বাস্তবতার সঙ্গে মােটেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। যে তরুণসমাজ। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছে তারা সমাজতন্ত্রকে কল্পনায় যতটা বুঝেছে,

ত্ব ও বাস্তবতায় এর কিছুই শেখেনি, উপলব্ধি করতে পারার কথা নয়। দ্রুত দাবি থেকে মুক্তির আকাকা হিসেবে সমাজতন্ত্র তখন ছিল একমাত্র মহৌষধ। কিন্তু এটিতে উত্তরণের যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভিত্তির অপরিহার্যতা অরুরি ছিল তা কেউ তলিয়ে দেখতে চায়নি। ফলে সর্বত্র নানা ভান-বামের বিচ্যুতি ঘটতে থাকে। সমাজে অস্থিরতা, রাজনীতিতে সহিংসতা, অর্থনীতিতে যুদ্ধবিধ্বস্ততা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা সংকট বৈরিতা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে কতটা টালমাটাল অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল । অনেকটা বিবেচনায় নিতে চায় না।

সেই অবস্থায় একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হয়েও বঙ্গবন্ধু সমাজবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে যে পথে অগ্রসর হতে চেয়েছিলেন তা টনি, যােঙিয়েত বা অন্য কোনাে দেশের মঞ্চেল নয়, বরং তিনি নিজস্ব একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য জাতীয় সংসদে অনুমতি চাইলেন, সেই অনুমতি তিনি লাভও করেছিলেন। তিনি একটা নিরীক্ষাধর্মী পথেই অগ্রসর হতে চাইলেন। জনগণের মধ্যে তার বাকশাল পদ্ধতির

নিরীক্ষার প্রতি গীর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সংশয় থাকার পরও মানুষ পাৱিবৰ্তনটাকে সাদরে গ্রহণও করছিলেন। সেই পরিবর্তন বিদেশী কোনাে কোনো মহলের মােটেও পছন্দের ছিল না। তারা এখানে মীর জাফর, মীর কাশেম, উখির্চা, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ, স্বর পর্চাসদের সংগ্রহ কয়েছে। গােপনে তারা মিলিত হয়েছে, প্রস্তুতি নিয়েছে, যড়যন্ত্রের জাল সেনাবাহিনীর ভেতরেও কারাে কারাে সঙ্গে বিস্তৃত করেছে। কেননা, বঙ্গবন্ধুর মতাে এত বড় নেতাকে কামান ট্যাংক বন্দুক ছাড়া এমনি এমনি হত্যা করতে যাওয়া যন্ত্রকারীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তা বুঝেশুনেই তাদের। দেশী-বিদেশী পরামর্শতারা অন্যদের জাল বিস্তার করেছে।

অবশেষে অকস্মাৎ ১৫ আগস্ট ট্যাংক-বন্দুকের বহর নিয়ে যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে সক্ষম হয়। স্বয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করাকে কেউ যদি অনিবার্য পরিণতি’ বলে ইতিহাসের ওপর দায় চাপিয়ে দেয় জ্ঞাহলে সেই দোষ নিশ্চয়ই ইতিহাসের নয়। | বলা হল, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তন কল দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হল ইত্যাদি অনেক কিছুই দাবি করা হয়েছে, এথনাে হচ্ছে। কিন্তু গত ৩২ বছরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র কতখানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সকলেই হাড়ে হাড়ে এখন টের পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার করার ৩২ বছর পরও বাংলাদেশে ২৯ জানুয়ারির মতো একপক্ষীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের চরিত্র কোনাে সরকার, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগের একটি অংশ যদি দেখাতে পারে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের গণতন্ত্র কতটা মেকি অবস্থার ভেতর দিয়ে এত বছর চলেছে। আমরা দেখেছি এই ৩২ বছরে পাকিস্তানের প্রেতাত্মা আবার কীভাবে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছে। গোলাম আযমনিজামীরা বিএনপির সহযােগী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সমাজের বন্ত্রে রন্তে প্রবেশ করেছে, জঙ্গিবাণী ধ্যানধারণার বিস্তার ঘটেছে, তালেবান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি দুর্বলতা গােপন বিষয় নয়। গােটা দেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতিতে এখন পাকিস্তানের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে যে বিজ্ঞান সৃষ্টি করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সঙ্গে মােটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়, বরং এর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক আদর্শের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তানের রেখে যাওয়া, ১৯৭১ সালে আমাদের ত্যাগ করা সেই ধ্যান ধারণা আর বিশ্বাসে আমাদেরকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সাল থেকে, বঙ্গবন্ধু এবং তার অনুসারীদের হত্যা করার পর থেকে। যারা এমন ধরনের গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করেন তারা গণতন্ত্রের মর্মকে ধারণ করেন না, মানুষকে শুধু প্রতারণা করতে পারেন।

দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধুর নামই তাে এদেশে উচ্চারণ করা যেত না, নিষিদ্ধ ছিল তাঁর নামে, তার শাসনকল, মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা সম্পর্কে নানা মিথ্যা রটনা। বিকৃত ইতিহাস প্রচারমাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক ও বাজনৈতিক অঙ্গনে প্রচার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচারের কাজও নিষিদ্ধ ছিল। বেগম জিয়ার জামিনও ১৫ আগষ্ট পালন করার রাজনীতি চালু করা হয়েছে। সত্যিই এই বাংলাদেশকে আমরা অনেকদিন চিনতে পারিনি। ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। অবশেষে ১৯৯৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকাজ শুরু হলে কিছুটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। কিন্তু ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময় বিচারকের স্বল্পতার দোহাই দিয়ে মামলাটি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। | অবশেষে সুপ্রিমকোর্ট বিচারের কাজ আবার শুরু করেছে। খুনিদের কয়েকজন জেলে আছে। কয়েকজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় আছে। ঘাতকরা দীপিন বীরদর্পে। ঘুরে বেড়ালেও এখন তারা আদালতে বিচারের সম্মুখীন। তবে জনগণের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে যুণ, ক্ষোভ এবং ব্যায় অনেক আগেই হয়ে আছে। সেই রায়ও আদালত ইতিমধ্যে দিয়েছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সদস্য, নিকটাত্তীয় এবং ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত খুনিদের বিচার একে একে সম্পন্ন হবে।

এসব মানবতাবিরােধী হত্যাকাণ্ডের বিচার যেদিন সম্পন্ন হবে সেদিন থেকে ১৫ আগস্ট ঘুরে এলে বাংলাদেশের জনগণের আর কোনাে গ্লানি বা পাপবােধ হয়তাে থাকবে না। ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ড নিয়ে জাতীয়ভাবে কষ্ট ও শােক কোনােকালেই শেষ হবে না, তবে রায় কার্যকর হলে সান্ত্বনা একটা খুঁজে পাওয়া যাবে। এই রাষ্ট্রের পিতাকে তাঁর পরিবারের সদস্য, নিকটাত্মীয়দের ঘনিষ্ঠজনদের হত্যা করেও ইতিহাস থেকে, মানুষের মন থেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি বরং ঘাতকরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সকল বিচারের রায়ে এমনটি সকলে আশা করে। তাহলেই বাংলাদেশ তার আপন জায়গায় আবার ফিরে আসতে পারবে।

ভোরের কাগজ ১৫ আগস্ট ২০০৭
ইতিহাসের কালিমালিপ্ত দিন –সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
বাংলাদেশের নালগ্নে আমরা ভাবতে পারিনি যে, আমাদের লালচিহ্ন ধারণকারী জাতীয় দিবসগুলাের পাশাপাশি থাকবে কালােচিহ্নের একটি শােক দিবস। এটাও তাে ভাবতে পারিনি যে, শােক দিবসটি হবে জাতির জনকের হত্যাকে ঘিরে। আমরা আনন্দের বর্তমান চাই, সুখের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনায় উদ্বেলিত হই। জাতি হিসেবে আমাদের সর্বোত্তম অর্জন স্বাধীনতা প্রাপ্তির লগ্নে আমাদের মানসিকতা এমনিই ছিল। কিন্তু আমরা না চাইলেও স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় আমরা শােকাভিভূত হয়েছিলাম।
আমাদের শােক ছিল জাতির জনকের কলঙ্কজনক হত্যার। যে জাতি নির্মাণ প্রয়াসে জনকের জীবন ও কর্ম নিবেদিত ছিল, সে জাতিরই বিপথগামী কিছু মানুষ তাঁকে হত্যা করল, ৭৫-এর ১৫ আগস্ট। শত্রু পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তার প্রাণ হরণ করতে সাহসী হয়নি, অথচ বাঙালি তার প্রাণ হরণ করেছিল।
স্বজনের হাতে প্রাণ যাওয়ার ব্যাপারটি তাে নজিরবিহীন নয়। নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রাণ গিয়েছিল মােহাম্মদী বেগের হাতে। ৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জুলিয়াস সিজারকে বলতে হয়েছিল । ব্রুটাস তুমিও!’ অর্থাৎ ক্রুটাস যে তার হন্তারক হবে তা সিঙ্গার ভাবতে পারেননি। কাজেই জুলিয়াস সিজারের উচ্চারণটি ছিল বিপন্ন বিস্ময়ের। যেমন বিপন্ন বিস্ময় ছিল সিরাজউদ্দেলৈ ও বঙ্গবন্ধুরও। তবে জুলিয়াস সিজারের মতাে তাদেরও বিপন্ন বিস্ময়ের কোনাে উক্ত ছিল কিনা তার কোনে প্রমাণ ইতিহাস খাণ করেনি। কিন্তু তাদেরও যে বিপন্ন বিস্ময় ছিল তা সন্দেহাতীত। আর বিপন্ন হয়েছে জাতি হিসেবে বাঙালির ভাবমুর্তিও। জাতিটি চিহ্নিত হয়ে থাকল জনকে হন্তারক হিসেবে বাতালির ভাবমূর্তিও। জাতিটি চিহ্নিত হয়ে থাকল জনকের হন্তারক হিসেবে। একাত্তরের অজন বাঙালিকে মর্যাদার শীর্থে তুলেছিল আর পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যা করে সে বাঙালি নিষ্পেকেই কলিমালিপ্ত করেছিল।
কেন জাতির জনকের হত্যা? জানা নেই এমন একটি নির্মম প্রশ্নের সঠিক ও সুস্পষ্ট উত্তরের জন্য আমাদেরকে কতদিন অপেক্ষমাণ থাকতে হবে বা অপেক্ষার শেষ হবে কিনা তাও জানা নেই। তবে যুক্তির খাতিরে ধরে নিতে হবে হস্তারকদের স্বার্থ বিঞ্চিত হয়েছিল বলেই এ হত্যা। বঙ্গবন্ধুর বড় অপরাধ ছিল, কিনি স্বাধীন বাংলাদেশের অ্যুদয় নিশ্চিত করেছিলেন। আর এতেই কিছু বাঙালির স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছিল। কারণ তারা আসলে ছিল স্বাধীনতার বিপক্ষশক্তি।
তাছাড়া রাজনৈতিক বৈরিতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও জনকের হত্যা বাঙালির ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায় সংযােজন করেছিল। আর যা হােক রাজনৈতিক বৈরিতার সমাধান হত্যা হতে পারে না; তা হয় বর্বরতা। হন্তারক কজন বাঙালি ইতিহাসে বর্বর হিসেবেই স্থান পাৰে । অবশ্য ভালাে কথা হল, সামগ্রিকভাবে বাঙালি জাতি বর্বর বা অকৃতজ্ঞ নয়; কারণ বাঙালি জনমত জরিপের ভিত্তিতেই ২০০২-এ বিবিসি বাংলা সার্ভিস কুড়িজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় বঙ্গবন্ধুকে শীর্ষ ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাঙালির জন্য অবদানের মৌলিক ও বৈচিত্র্যের নিরিখে অসংখ্য বাঙালি উল্লেখ্য। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অবদানের ব্যতিক্রমী দিক হল, তিনি বাঙালিকে রাষ্ট্রীয় সত্তায় ভূষিত করেছেন। ফলে বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তাও তৈরি হয়েছে।
উপরন্তু বাঙালি যে অকৃতজ্ঞ নয়; তাদের যে অনুশােচনা আছে, তার সাক্ষ্য বহন করছে ১৫ আগস্টকে শােক দিবস হিসেবে পালন করা। এই শােক দিবস আমাদের সামনে তাকানােরও। আমরা সামনে তাকাব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শােষণহীন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে। এ দিন আমরা স্মরণ করব বঙ্গবন্ধুর উক্তি । ফাসির মঞ্চে যাওয়ার সময়ও বলব বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
আমরা স্মরণ করতে পারি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সে কাব্যিক মূল্যায়নঃ “আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস আর ব্যক্তিত্বে এ মানুষটি হিমাদ্রিসম। কাজেই আমার হিমালয় দর্শনের অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে।’ বলা বাহল্য ফিদেল কাস্ত্রোর বিবেচনার হিমাদ্রিসম মানুষটিকে হত্যা করে বাঙালির পাপ হয়েছে হিমাদ্রিসম।
বাংলাদেশ সময় ১৫ আগস্ট ২০০৮
বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন –মােহাম্মদ গােলাম রাব্বানী
১৫ আগস্ট, ২০০৮। অবশেষে আজ বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন হল বাংলাদেশে। এই বাক্যটি লেখা শেষ হতে না হতেই এক ঐতিহাসিক ঘটনা মনের ভিতরে আপনা-আপনি হাজির হল। ১৮২১ সালে সেন্ট হেলেনা নামে একটি নির্জন দ্বীপে নেপােলিয়ন বােনাপার্ট মারা যান। সম্ভবত তাকে বিষ প্রয়ােগে হত্যা করা হয়। তারপর অনেক বছর পরে জনগণের শ্রদ্ধা-ভালােবাসার নিদর্শনস্বরূপ প্যারিস শহরের একটি পার্কে তার মর্মর প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হয়। তখন নেপােলিয়নের জননী জীবিত ছিলেন, কিন্তু পুরােপুরি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। এক ষােড়শী দৌহিত্রীর কাঁধে হাত রেখে পায়ে হেঁটে তিনি পুত্রের মর্মর প্রতিমূর্তির সামনে পৌঁছলেন। সস্নেহে প্রতিমূর্তির গায়ে হাত বুলিয়ে বারবার প্রার্থনা করার মতাে মৃদুস্বরে বলতে থাকলেন । সম্রাট স্বদেশে ফিরে এসেছে। দু-চোখ দিয়ে ঝর্নাধারার মতাে আনন্দাশ্রু গাল বেয়ে নেমে তার বুক ভিজিয়ে দিল। | ১৯৮৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা বিভাগ প্রচার করেছিল একটি ধারাবাহিক অনুষ্ঠানমালা, যার নাম ছিল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ১৫ বছর’। এগুলাে পরে বিবিসি বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান সিরাজুর রহমান কর্তৃক সংকলিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিত হয়। বইটি থেকে সংক্ষেপিত উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
| “২৫ শে মার্চ-এর শেষবেলার ঘটনাবলি সম্বন্ধে জমিরুদ্দিন আহমেদ বলেন, তখন ইয়াহিয়া খান ও সরকারি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের কথাবার্তা চলছিল। আমাকে ভুট্টোর সঙ্গে যােগাযােগ রাখার কাজ দেয়া হয়েছিল। হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আমি চারটের সময় গেলাম। মুস্তফা খার বললেন, ভুট্টো সাহেব ঘুমাচ্ছেন। তুমি সন্ধ্যা আটটায় আসাে। আমি আটটার সময় গেলাম। আর বললেন, চিড়িয়া তাে ভেগে গিয়েছে। চিড়িয়া অর্থাৎ ইয়াহিয়া খান। আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসলাম । মুজিব ভাইকে বললাম, প্রেসিডেন্ট তাে চলে গিয়েছে। তিনি বললেন, ভুট্টো ক বলে শুনে আসাে। আমি আবার গেলাম। তখন প্রায় দশটা বাজে। আর বললেন ভুট্টো দেখা করতে চান না।
| আমি ফিরে মুজিব ভাইকে ভুট্টোর কথা বললাম। তিনি বললেন, জানিয়ে আমি তাজউদ্দিনদেরকে বলেছি আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার জন্য, কিন্তু আমি কী করি বলআমি কী কলি বল। যদি ধৱা না দিই, ওরা তাে পাগলা কুত্তার মতন আমার সব ওয়ার্কারদের ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। দু-ঘন্টা ধরে এদিক-ওদিক গুলি শুনতেছি।
আমি মুজিব ভাইকে টেলিফোন করলাম ভাবী ধরলেন। বললাম, মুজিব ভাইকে কি নিয়ে গিয়েছে। তিনি বললেন, না এখনও নেয়নি। তবে গুলি করছে আমাদের বাড়িতে। এরপর টেলিফোন বন্ধ হয়ে গেল।” (পৃষ্ঠা ৫-৬) | ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাদের গােলাগুলি শুরু হওয়ার পরক্ষণেই ঢাকা রেডিওতে ব্যবহৃত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি বেতারে শােনা গেল বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। এটাই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর অধীনে বাংলাদেশ তখন ছিল কার্যত স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু অবশ্যই জানতেন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হবে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি অফিসাররা, বিশেষ করে ইলেকট্রিক মেকানিক্যাল কোৱে যারা কর্মরত ছিলেন তারা গােপনে বঙ্গবন্ধুকে জানিয়েছিলেন তাদের ওয়ার্কশপে ট্যাঙ্কগুলাের চাকার সঙ্গে সংযুক্ত লােহার বেল্টের ওপরের অংশে রাবারের বেন্ট জুড়ে দেয়ার কাজ চলছে। যার অর্থ ট্যাংকগুলাে শহরের রাস্তায় ব্যবহার করা হবে। এই খবর পেয়ে ধ্বংসযজ্ঞ কী পরিমাণ ভয়াবহ হবে সেটা বঙ্গবন্ধু আঁচ করতে পেরেছিলেন। | প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, আপনারা এখন এই প্রশ্নটি করতেই পারেন যে, কে বা কারা ওই রেকর্ডটি প্রচার করেছিলেন এবং সেটার খোঁজ নেই কেন? যেহেতু ঘােষণটি যে ওই তারিখে ওই সময়ে প্রচারিত হয়েছিল সেটা প্রমাণিত সত্য, সল্প সকল প্রকার প্রমাণ-অনুমান যাচাই করে আমি প্রশ্নটির উত্তর পেয়েছি। মগবাজারের টেলিফোন হাউসের ক্যারিয়ার এ্যান্ড ওয়ারলেস ডিভিশন’-এর কক্ষ থেকে রেকর্ডটি প্রচার করা হয়েছিল, ঢাকা রে%ি কেন্দ্র থেকে নয় । আমার এই উৱটির পক্ষে জোরালাে তথ্য হচ্ছে, পাকিস্তানি সেনারা স্বাধীনতা প্রচারের ঘটনাটি জেনেছিল। সেসময়ে কর্মরত একজন সামরিক অফিসার সিদ্দিক সালিক পরবর্তীকালে স্তর লেখা ‘উইটনেস ? সারেন্ডার’ বইটিতে লিখেছেন, যখন প্রথম গুলিটি ছােড়া হল তখন শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণকণ্ঠ সরকারি পাকিস্তান রেডিওর কাছাকাছি বেতার-কঙ্গে শােনা গেল। এটা নিশ্চিত এবং সে মতই শােনা গেল যেন এটা পূর্ব-রেকর্ডকৃত বাণী-শেখ পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘােষণা করছেন।” (পৃষ্ঠা ৭৫)। এটা জানার কারণে পাকিস্তানি সেনারা রেডিও কেন্দ্রে নয়, মণবাঙ্গাৱেৱ টেলিফোন হাউসে হামলা করে কর্মচারীদেরকে মেরে ফেলেছিল ও সেখানকার সবকিছু পুড়িয়ে ফেলেছিল।
| দেখা যাচ্ছে বঙ্গণার অন্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের নকশা আঁকা ছিল। কিন্তু কবে থেকে? এই প্রশ্নটির উত্তর পাওয়ার জন্য একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির সাক্ষ্য উপস্থিত করছি। একাত্তরে মওলানা ভাসানীর ভারত প্রবাসীকালীন সময়ে তার ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন সাইফুল ইসলাম। তিনি আওয়ামী লীগের নয়, বরাবর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন এবং বামপন্থী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তার লেখা ১৯৮৭ সালে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা ভাসানী ভাৱত’ বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি।
অনেকে বলে থাকেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমানের পূর্বে কোনও চিন্তাভাবনা ছিল না। কথাটা সত্য বলে আমি অন্তত মেনে নিতে পারি না। ১৯৯০ সালে আমার বন্ধু খুরশীদ আলম ও আমি প্রথম পশ্চিম পাকিস্তানে আই। তৎকালীন প্লিাহ এভিনিউতে অবস্থিত মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের ওপরতলা হতে ট্রাভেলার্স চেক সংগ্রহ করে নিচে নেমে আসেতই গলির মধ্যে শেখ সাহেব ও আইডিয়াল লাইফ ইনসিওরেন্সের আঞ্চলিক কর্মকর্তা শফিউর রহমানের সঙ্গে আমাদের মুখােমুখি সাক্ষাৎ হয়। আমাদের দেখেই উহায় শেখ সাহেব তার স্বভাবসুলভ আচরণে এগিয়ে এলেন। কাধে হাত রাখলেন। হাতে ট্রাভেলার্স চেক দেখে জিজ্ঞেস করলেন আমরা কোথায় যাচ্ছি। করাচি যাচ্ছি শুনে শফিউর রহমান ঠাট্টা করে বললেনঃ ওরা ন্যাপ করে, ওদের অত তােষামােদ করছেন কেন? ন্যাপ করে তাতে হয়েছে কী? আমি যেদিন স্বাধীন বাংলার ডাক দিব, ওরা হবে প্রথম কাতারের সৈনিক’।” (পৃষ্ঠা ৪২-৪৩)।
সােনার বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালােবাসার অন্ত ছিল না। এরকম ভালােবাসা বিপদ ডেকে আনে। গান্ধী, বঙ্গবন্ধু এদের জীবনটাই তার প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জনসভায় তার হঙ্কার আর দাবায়ে রাখতে পারবা না”—মুক্তিযােদ্ধা জনগণকে এমন সাহস যুগিয়েছিল যে তারা ২৮৪ দিনের সশস্ত্র যুদ্ধেই জয়ী হওয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিশ্বসভায় আসন পেয়েছে।
আনন্দে-উচ্ছাসে এতক্ষণ লেখার পর যখন শেষ করার কথা ভাবছি তখন দেখছি গােড়াতেই ভুল করেছি। লেখার শিরােনামটিই ভুল। বঙ্গবন্ধু তার অন্তরে যে বাংলাদেশের নকশা এঁকেছিলেন সে বাংলাদেশ কই? তাঁর অবর্তমানে সমাজতন্ত্র বদলে হয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার। ধর্মনিরপেক্ষতা উধাও হয়েছে আল্লাহর প্রতি আস্থা। মুক্তিযুদ্ধের নাম বদলে দেয়া হয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধ। জয়বাংলা বলে মুক্তিযুদ্ধ হল, অথচ সেটা উচ্চারিত হচ্ছে না, শুনছি বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর অপরিচিত বাংলাদেশ। এ বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু কেন প্রত্যাবর্তন করবেন।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা, এই প্রশ্নটির উত্তর আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি পাচ্ছেন?
জনকণ্ঠ ১৫ আগষ্ট ২০০৮
বঙ্গবন্ধুর দর্শন একটি অসম্পূর্ণ অবলােকন

রংগলাল সেন। বাঙালি জাতির জনক, বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভােরবেলা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় একশ্রেণীর আমলা রাজনীতিবিদ এবং ধনিকশ্রেণীর ভাড়াটে ঘাতক প্রতিরক্ষা বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী অফিসার ও জোয়ানের হাতে সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন।

২০০৮ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর তেত্রিশতম শাহাদাত বার্ষিকী পালিত হবে। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের পর প্রতি বছরই বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ১৫ আগস্ট পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু এবারের শাহাদাত বার্ষিকী উদযাপন বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত এ কারণে যে, গত ২৭ জুলাই বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্ট বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার কর্তৃক ২০০২ সালের ২২ জুন বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণ দিবসকে ‘জাষ্ঠীয় শােক দিবস’ ও ‘সরকারি ছুটি বাতিলকে অবৈধ ঘােষণা করে এক ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন। যার ফলে ১৯৯৬ সালের ৫ আগস্ট জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে গঠিত সরকার এ সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। সুখের বিষয় এই যে, গত ১০ আগস্ট বাংলাদেশের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার মহামান্য হাইকোর্টের এ ঐতিহাসিক রায়কে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অতএব জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলের মতাে পুনরায় ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস হিসাবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হবে এবং ঐদিন সরকারি ছুটি থাকবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাম্রাজ্যবাদবিরােধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক সার্থক মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনের একজন মহান সৈনিক এবং সমকালীন বিশ্বে মানবমুক্তি সংগ্রামে নিবেদিতপ্রাণ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের অন্যতম। বঙ্গবন্ধু ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে কলকাতায় তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। সুদীর্ঘ ৩৭ বছর তিনি একটি শােষণহীন, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রচলিত অর্থে তিনি দার্শনিক না হলেও তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, বিশেষ করে সত্তর সালের নির্বাচনের সময় থেকে ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই পর্যন্ত তিনি যে সকল মূল্যবান ভাষণ, বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করেছেন সেসবের মধ্যদিয়ে তার কর্মসূচিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে। বর্তমান নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুপ্রদত্ত এসব ভাষণ প্রতিফলিত তাঁর চিন্তাভাবনাকেই তাঁর দর্শনকাপে আখ্যায়িত করে এর অসম্পূর্ণ অবলােকন উপস্থাপনের একটি প্রাথমিক প্রয়াস রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ গবেষণামূলক রচনা খুবই অপ্রতুল। এ বিষয়ে ১৯৭৭ সালে গঠিত বঙ্গবন্ধু পরিষদ সর্বপ্রথম একটি সংকলন প্রকাশ করে ১৯৭৯ সালের ১৫ আগস্ট, আর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন বিখ্যাত বই ‘ভাসানী যখন ইউরােপের লেখক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, যিনি স্বউদ্যোগে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবস উপলক্ষে মুজিবাদ’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত ও খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস কর্তৃক সম্পাদিত উক্ত সংলগ্রন্থটির নাম বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন যেখানে রয়েছে ১৯৭০ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শাহাদানৱণের পূর্বে প্রদত্ত মূল্যবান চলিশাট ভাষণ ও বক্তা। উক্ত লংকলপ্রস্থর মুখবন্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী পরিষদের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে লিখেছেন : ‘বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আষ্টীয় মুক্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে গৃহীত কর্মধারা, বক্তৃতা, বিকৃতি ও তার কার্যকর পদক্ষেপসমূহ সম্পর্কে গবেষণা, বিশ্লেষণ ও প্রশিক্ষণ চালাৰে এবং জনমত সৃষ্টির কাছে আত্মনিয়ােগ করবে।’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও একথা সত্য যে, স্বাধীনতার স্বপক্ষের বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য কোনাে অবদান রাখতে পারেননি।

তবে সম্পূর্ণ গবেষণামূলক রচনা না হলেও দীর্ঘ তেত্রিশ বছরে যে কয়েকটি গ্রা প্রকাশিত হয়েছে তথ্যে এম নজরুল ইসলাম সম্পাদিত দুই খতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থ’ (ফেব্রুয়ারি ২০০৭) বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য, যার মুখবন্ধ লিখছেন ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নােবেল পুরস্কাপ্রাপ্ত অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। ২০০৫ সালের ১ জুন তারিখে লিখিত ঠাৰ মুখবন্ধে অমর্ত্য সেন বলেছেন । বঙ্গবন্ধু শুধু বাতালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মহান নেতা। পৃথিবীর ইতিহাসের এই কঠিন মুহুর্তে এ বইটি প্রকাশিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন, আদর্শ ও নেতৃত্ব নিয়ে আলােচনা প্রয়ােজন আজ খুবই । তার আদর্শবােধর গভীরতায় এবং চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্যে আমরা আবারও অনুপ্রাণিত হব…’।

কাজেই একথা বলাই বাহ্ন যে, বঙ্গবন্ধু দর্শন অনুসন্ধান, অনুসরণ ও অণুবীক্ষণ আজ অতি জরুরি ও প্রয়ােজনীয়। সে লক্ষ্যেই আমি বর্তমান নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু পরিষদ কর্তৃক প্রকাশিত পূর্বোক্ত গ্রন্থভুক্ত বঙ্গবন্ধুর চব্বিশটি ভাষণ ও বক্তৃতার মর্মার্থ ও বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটকালে এসবের তাৎপর্য উপলব্ধির প্রয়াস পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে একথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে উক্ত গ্রন্থের সম্পাদক বঙ্গবন্ধু-প্রদত্ত এ-সকল ভাষণ ও

বক্তৃতার এক-একটি শিরােনাম দিয়েছেন। প্রত্যেকটি শিরােনামই সংশ্লিষ্ট ভাষণ কিংবা বক্তৃতার মর্মবাণী। অর্থাৎ সম্পাদক বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও বক্তৃতার মধ্যথেকেই শিরােনাম সংগ্রহ করেছেন। এখানে একথাও বলা আবশ্যক যে, বর্তমান নিবন্ধে এ-সকল ভাষণ ও বক্তৃতা যথাসম্ভব পর্যালােচনা করা হয়েছে। তবে যে-সকল ভাষণ ও বক্তৃতা আজকের বাংলাদেশে আমার কাছে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে শুধু সেসবের মর্মবাণী এখানে বিশেষভাবে তুলে বলা হয়েছে।

গ্রন্থভুক্ত প্রথম ভাষণটির শিরােনাম হচ্ছে । নিজের বনের বিনিময়ে হলেও দেশকে সঙ্কটমুক্ত করতে চাই।” এটি হচ্ছে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের আরে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বেতার-ভাষণ। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও বঞ্চনা-অত্যাচারের কাহিনী অত্যন্ত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি পাকিস্তানে প্রচলিত যড়যন্ত্রের রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। তিনি নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছাকেই শেষ কথা বলেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্ববান ও দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করছেন। তিনি আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও ছাত্রসমাজের ১১ দফার কিতে পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অঙ্গীকার করেছেন। উক্ত ভাষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে, তিনি বলেছেন “লেবেলসর্ব ইসলাম নয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ ইসলামে বিশ্বাস করে না। একবার জবাবে তিনি বলেছেন, “আমাদের সুস্পষ্ট বক্ত-লেবেলসৰ্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে, যা জগার্সীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমােঘ মন্ত্র।* আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ইসলাম সম্পর্কে এ-ধরনের অপবাদ এখনও চলছে। তিনি তার এ ভাষণে বলেছেন : “সমাজে ক্যানসারের মতাে দুর্নীতি বিদ্যমান, তাকে নির্মূল করতে আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।”

উল্লেখ্য, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি থেকে দুর্নীতি দূর করার যে অভিযান আরম্ভ করেছে তার পরিণতি কী হতে চলেছে তা ইতােমধ্যেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। উক্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন। শ, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানাে সম্ভব এবং অন্যায়, অবিচার ও শােষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সব হবে।” রাজনীতি ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার ঐ ভাষণে বলেন। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সশস্ত্রবাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের গুরুভার বহন করতে দেয়া কোনােকাৱেই উচিত নয়। রাজনীতিতে সশস্ত্রবাহিনীর জড়িয়ে পড়া একেবারেই অনুচিত। সবশেষে বলেছেন, প্রকৃত প্রাণবন্ত গণতন্ত্র দেশে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। বঙ্গবন্ধুর এসব উক্তি চার দশক পরেও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা স্ত্রীর বক্তব্যের

সারব কি প্রমাণিক্ত করছে না? অধিকন্তু যে-কথাটি বঙ্গবন্ধুর প্রহ্মার পরিচায়ক তা হচ্ছে এই যে, তিনি ঊার ঐ ভাষণের এক জায়গায় অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বলেছেন, আগামী নির্বাচন আজাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটবে।” | গ্রন্থভুক্ত দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের শিরােনাম হল ! “এবারের সগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, একবের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, যা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে প্রন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ। ৰদন তাঁর এ ভাষণের একপর্যায়ে আসন্ন মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা-কৌশল অবলম্বনের কথা উল্লেখ করে বলেন, “তােমাদের কাছে অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তােমরা রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবে।” আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা কি একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে এ কৌশল অবলম্বন করেনি? | এন্থভুক্ত বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় ভাষণের শিরোনাম হল : “শ্রম ও পুঁজির বিবােধ বিলুপ্ত করা হবে, শ্রমিক-কর্মচারী এবার ব্যবস্থাপনায় থাকবে। এটি হচ্ছে জাতীয়করণের নীতি ঘােষণা উপলক্ষে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবসে প্রদত্ত বেতারটেলিভিশনে তার ঐতিহাসিক ভাষণ। তিনি তার ঐ ভাষণে বলেছেন, ‘আমার সরকার অভান্তরীণ সমাপ্লিবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবান্তৰ কাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পাটি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবণ্ঠনে প্রতিবন্ধ।” বঙ্গবন্ধু জাতীয়করণের মাধ্যমে সম্পদের সামাজিকীকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচির শুভ সূচনা করেন। আর এভাবেই তিনি সােনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে উদ্যোগী হন। | বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক অসাধারণ সাহসী নেতা। তিনি বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার প্রতি ছিলেন দৃঢ় অঙ্গীকাৱবদ্ধ। সেজন্যই তাে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়ােজিত জনসমাবেশে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন : “ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমায় দেশ। বাংলা আমার ভাষা।” কতটা আত্মপ্রত্যয়ী ও দেশপ্রেমিক হলে তিনি একথা উচ্চারণ করতে পানে। তিনি তার ঐ ভাষণে আরও বলেছিলেন : “…আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে—পূর্ণ হবে না। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৩৭ বছর পর দেশে আর্থ-সামাজিক ব্যস্ততা কি বলে দেয় বঙ্গবন্ধুর এসব প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে?

| বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ফুিল বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল ৰাষ্ট্ৰ । উপরােক্ত ভাস্থলের একপর্যায়ে তিনি সেকথাই দ্বিধাহীন চিত্তে ঘােষণা করেন।

আমি স্পষ্ট ও ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে। এখানে দুটি প্রধান ধর্মাবলম্বী জনগােষ্ঠীর কথা বললেও বঙ্গবন্ধু আসলে বাংলাদেশে বসবাসরত সকল ধর্মাবলম্বী জনগােষ্ঠীর কথাই বলেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার মুখােমুখি হয়ে আমরা কি বলতে পারব যে, বঙ্গবন্ধুর এ ইচ্ছা সফল হয়েছে? যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগােষ্ঠীর ধনসম্পদ ও অস্তিত্ব প্রতিনিয়ত হুমকির সম্মুখীন। | বাংলাদেশের বাহাত্তর সালের সংবিধানে যে চারটি মূলনীতি (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা) অন্তর্ভুক্ত হয় তা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কিত প্রস্তাবে প্রথম উল্লিখিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদের উদ্বােধনী অধিবেশনে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর উক্ত প্রস্তাবে বলেন, “জনাৰ স্পীকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি কল্পকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।” বঙ্গবন্ধুর ওই প্রস্তাব বাংলাদেশ গণপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে সেদিন গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১ মে মহান মে দিবস উপলক্ষে জাঙ্গির উদ্দেশে যে ভাষণ দেন তাতে তিনি। ‘শােষণহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য শ্রমজীবীদের প্রতি আহবান জানান। বঙ্গবন্ধু তঁার এ আহ্বানের প্রকিনি করেন এক সপ্তাহ পরেই ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে আয়ােজিত জনসমাবেশে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে। তিনি ঘােষণা করেন । “সমাজতন্ত্র ছাড়া বাংলার দুঃখী মানুষ আর বাঁচতে পারে না। তিনি ঐ সভায় কৃষকদের সকল বকেয়া খানা চিরদিনের জন্য মাফ করে দেন। তবে সবাইকে শুধু কাজ করতে হবে”। বঙ্গবন্ধু উক্ত জনসভায় সকলকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, “দেখবেন, আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ বারী বাংলাদেশ। মুসলমান কার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে মুট করে খেতে দেয়া হবে না।” বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন এবং ধর্মের নামে শােষণ-বঞ্চনা বন্ধ করতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। আসলে ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া যে। প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না সে-সম্পর্কে ভর সম্যক উপলব্ধি ছিল বলা যায়। | বাংলাদেশের গণপৰিষদে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর খসড়া শাসন-ত্র অনুমােদন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন তাতে তিনি পূর্বোক্ত “চারটি স্তম্ভের ওপর শাসনতন্ত্র রচনা করা হয়েছে বলে উয়েখ করেন। বঙ্গবন্ধু

তাঁর উক্ত ভাষণে প্রত্যেকটি মূলনীতির মর্মার্থ ব্যাখ্যা কৱেন। তিনি জাষ্টীয়তাবাদ’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুনিদিষ্টভাবে বলেন, “এটি হৰে ৰালি জাতীয়তাবাদ”, আর গণতন্ত্র হবে ‘শােষিতের গণতন্ত্র’, “আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শােষণহীন সমাজ’, আর ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, আমাদের শুধু শ্ৰাপতি হল এই যে, ধর্মকে কেউ বাজনৈতিক আয় হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।” বঙ্গবন্ধু তার এ ভাষণ শেষ করেন এই বলে, বিষ বংশধর, ভবিষ্যৎ জনসাধারণ কী করে কীভাবে শাসনতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে কারই ওপর নির্ভর করে শাসনতন্ত্রের সাফল্য, তার কার্যকারিতা।” কিন্তু পৱম পরিহাস ও দুঃখের বিষয় এই যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর যারা বাংলাদেশ জাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তারা ১৯৭২ সালের উক্ত চার মূলনীতিবিশিষ্ট সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। প্রত্যেকটি মূলনীতিই তার পূর্বের তৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে। পঞ্চম ও অষ্টম সংশােধনীর মাধ্যমে দুই সমরনায়কের শাসনামলে পর্যায়ক্রমে ইসলামকে রাম করা হয়েছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের নির্বাচনে দেশের জনগণ কি পুনরায় বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম করতে পারবে—এটিই হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতায় এক বড় প্রশ্ন।

বঙ্গবন্ধুর যে-সকল ভাষণ ও বক্তৃতা-বিবৃতি খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস সম্পাদিত পূর্বোক ঘয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেসবের মধ্যে ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাভাষায় প্রদত্ত তার বাটি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। উক্ত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যেসব বিষয়ের ওপর আলােকপাত করেন সেগুলাে হল নয়া আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থা ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা। এছাড়া বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রামে নৌবাহিনীর জোয়ানদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, “আমরা আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চাই।” জাতীয় দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় তার ভাষণে বলেন,

কঠোর পরিশ্রম করে উৎপাদন বাড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু স্কার ভাষণে আরও স্পষ্ট করে বলেন, “বাংলাদেশে আজ তিনটি মহাবিপদ তথা তিন শত্রুর মােকাবিলা করতে হচ্ছে। এসব হল : (১) মুদ্রাস্ফীতি-যা আজ সারা বিশ্বে ভয়াবহ আকারে দেখা দিয়েছে, (২) প্রাকৃতিক বিপর্যয় তথা বন্যা এবং (৩) চোরাকারবান্ধী, মুনাফাজ, মথুইলার ঔ মুযপাের—এই তিন শত্রুর বিরুদ্ধে সরকারকে সশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে নতুন প্রতিরোধ সমে।” স্বাধীনতার ৩৭ বছর পর এ তিন শর বিরুদ্ধে সমম করা কি শেষ হয়েছে বলা যাবে?

১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রথমে পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর উদ্বোধনী ভাস্কণে বলেন । “গরিব-দুঃখীর সুখেই স্বাধীনতার

সার্থকতা।” তিনি এ উপলক্ষে “দুনীতিবাজদের খতম করার আহ্বানও জানান। “দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে”—এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ তারিখে প্রদত্ত তার ঐতিহাসিক ভাষণে দ্বিতীয় বিপ্লব, জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঘােষণা দেন। বঙ্গবন্ধু তার উক্ত ভাষণে দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা বলেছেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে প্রথম বিপ্লব। কোনটি? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধই যে প্রথম বিপ্লব একটা বলাই বাহুল্য। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐ ভাষণের শেষে দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য বলেন ঃ … আর এ লক্ষ্যেই ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘােষিত হয়। এখানে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, “আমরা চাই শােষিতের গণত, আমরা চাই না শােষকের গণতন্ত্র, এটা পরিষ্কার।”

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বাকশাল গঠনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু দেশী-বিদেশী চক্রান্তের ফলে বঙ্গবন্ধু ঘােষিত দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি সফল করার সুযােগটি নষ্ট হয়।

বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তেত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও এবং বিশ্ববাস্তবতার মৌলিক পরিবর্তন ঘটলেও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে তার মূল্যবান ভাষণ ও বক্তৃতায় ব্যক্ত দিগদর্শনসূচক চিন্তাভাবনা মােটেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি। তাই মনে হয় বঙ্গবন্ধুর দর্শনের আমার এ অসম্পূর্ণ অবলােকন অমূলক নয়। বঙ্গবন্ধুর তেত্রিশতম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমার প্রত্যাশা যে, বাংলাদেশের জনগণ সােনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে যথাযােগ্য ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসবে।

জনকণ্ঠ, ১৫ আগস্ট ২০০৮
স্বাধীনতা দিবসে পরনিতার কথা

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ-এর উপসংহারে আমি বলেছিলাম । বাঙালি নাকি কোনাে দিন স্বাধীন ছিল না। যে অর্থে আমরা স্বাধীন” বা “স্বাধীনতার কথা ব্যবহার করি, তা দু’শ বছর আগে সে অর্থে ব্যবহৃত হতাে না। এখনাে কথাটা খুব পরিষ্কার নয়। অর্থনৈতিক অর্থে ‘স্বাধীন’ শব্দটা আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সহযােগিতার ক্ষেত্রে কখনাে ভাসছে, আবার কখনাে ডুবছে। এই অর্থে পৃথিবীতে কয়টি স্বাধীন রাষ্ট্র আছে তা আমরা হাতের আঙুলে শুনতে পারব। ব্যাপক অর্থে সেই দেশকে প্রকৃত স্বাধীন বলা যেতে পারে, যে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনে স্বাধীনতার আশীর্বাদ সহজে পরিলক্ষিত হয়। এই অর্থে স্বাধীন হতে আমাদের বহুযুগ অপেক্ষা করতে হবে। সাধারণ অর্থে “স্বাধীন” মানে রাজনৈতিক স্বাধীনতাই বােঝায়। বাংলার বাংলা যা অতীতে সমতট ও বঙ্গ বলে পরিচিত ছিলাে তা অন্যান্য অঞ্চল থেকে সবচেয়ে কম পরাধীন ছিলাে। রাঢ় ও বরেন্দ্রের ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন ছিলাে না, ওগুলাের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা বয়ে গেছে। | একটা দেশ স্বাধীন ছিলাে কি না, তা নির্ণয় করতে হয়তাে এটা জানা প্রয়ােজন, যারা দেশে রাজত্ব করতেন তারা দেশের ছেলে ছিলেন কিনা, বা দেশের রাজা দেশের হেলে না হলেও তিনি সেই দেশে বাস করতেন কিনা, রাজ্যে যা আয়-আমদানি হতাে তা দেশের থাকতাে কিনা, বা দেশের মুখ্য কর্মগুলাে দেশে, না বিদেশে কোথাও নিয়ন্ত্রিত হতাে। এত কথা বলার দরকার এইজন্যে যে, ইতিহাসে আমরা দেখছি বিদেশ থেকে রাজা এনেও কোনাে কোনাে দেশ নিজেদেরকে পরাধীন ভাবেনি। ইংল্যান্ডে রােমান, ডেন, নর্মান-ফ্রেঞ্চ, ডাচ ও জার্মান রাজারা রাজত্ব করেছেন। সেই ইতিহাসে আলােচনা করে ইংরেজরা মাতম করে না যে তারা স্বাধীন ছিল না।”

প্রথম স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তাঁর ভাষণে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জোট-বহির্ভূত ও সক্রিয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে রচিত। বৃহৎ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাইরে আমরা শন্তিকামী । আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেহ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করব। কিন্তু সে সাহায্য হতে হবে নিষ্কণ্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্বে ওসব জাতির সমমর্যাদার নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেহ হস্তক্ষেপ করবেন না—এটাই আমাদের কামনা। | তিন বছরের মাঝে বাংলাদেশ যােগ দিয়েছিল কমনওয়েলথে, লাভ করেছিল জাতিসংঘের সদস্যপদ, হয়েছিল ইসলামিক জোট সম্মেলনে সাদরে আমন্ত্রিত, যােগ দিয়েছিল জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রমগুলীর দলে। তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধিদের মাঝে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুগােস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হুয়ারি বােমেদিয়ান, সেনেগালের প্রেসিডেন্ট লিওপােল্ড সেনগর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। জাপান থেকে এসেছিল ৪৫ সদস্যের সুবৃহৎ একটি অর্থনৈতিক প্রতিনিধিদল। শেখ মুজিব এবং তার নিযুক্ত বিশেষ প্রতিনিধিরা গিয়েছিলেন বেশকটি দ্বিপক্ষীয় সফরে। বিশ্বের দরবারে। সুপ্রতিষ্ঠিত দেশ পাকিস্তান ভেঙে বেরিয়ে আসা, যুদ্ধ-উত্তর পুনর্গঠনে নাভিশ্বাস, নবগঠিত দরিদ্র একটি রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই প্রতিষ্ঠা লাভ শেখ মুজিবের সফল পররাষ্ট্রনীতিরই পরিচায়ক।

মাত্র তিন বছরে ১৯৭৩ সালের আগস্টে কানাডার অটোয়ার কমনওয়েলথ সম্মেলন, সেই বছরেরই সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, ১৯৭৪-এর ফেব্রুয়ারিতে লাহােরে ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন, সেই বছরের সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ আর ১৯৭৫-এর মে মাসে জ্যামাইকার কিংসটনে কমনওয়েলথ সম্মেলনে শেখ মুজিব রেখেছিলেন তার উপস্থিতির উজ্জ্বল স্বাক্ষর।

১৯৭২ সালে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়াকুব গওন আমাদের কমনওয়েলথের সদস্যপদ লাভের বিরােধী ছিলেন। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভকে বায়াফ্রার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে বলে ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন। জেনারেল ইয়াকুবু গওন শেখ মুজিবকে একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা, বলুন তাে, অবিভক্ত পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী দেশ। কেন আপনি সেই দেশটিকে ভেঙে দিতে গেলেন?’

হাে হাে করে তার স্বভাবসিদ্ধ হাসিতে নীরবতা ভাঙলেন শেখ মুজিব। ওই হাসির ফাঁকেই উত্তরটি ঠিক করে নেন। তিনি তর্জনী সংকেতে গম্ভীরভাবে বললেন, ‘শুনুন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আপনার কথাই হয়তাে ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তাে শক্তিশালী ছিল। তার চেয়েও শক্তিশালী হয়তাে হতাে অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হতে সংঘবদ্ধ এশিয়া, আর মহাশক্তিশালী হতাে একজোট এই বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?’

কথাটি বলেই তিনি তার গলার সাদা চাদরটি হাতে নিয়ে তুলে দিলেন প্রেসিডেন্ট গওনের হাতে। তিনি বললেন, ‘এই নিন, বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে আমার এই ক্ষুদ্র উপহার।’

উপস্থিত সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে তিনি হেসে বললেন, ‘মহােদয়েরা, এটা ছাপবেন না যেন।’ নাইজেরিয়া তখনাে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

| তারপর শেখ মুজিব জোর আশা প্রকাশ করলেন যে কমনওয়েলথের সরকারপ্রধানগণ, পাকিস্তানিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং দুই দেশের মাঝে সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা বিষয়ে তাদের চিন্তা সরকারিভাবে ব্যক্ত করবেন। জ্যামাইকার প্রধানমন্ত্রী মাইকেল ম্যানলি বললেন যে, তাঁর মতে যুগ ইশতেহারে বাংলাদেশের বক্তৰ্যাট ব্যক্ত হওয়া উচিত এবং কী ব্যক্ত হবে তার একটি খসড়া যেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল প্রণয়ন করে। স্বাগতিক দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাইকেল ম্যানলি ছিলেন সেই সম্মেলনের সভাপতি। তার বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গেই হ্যারল্ড উইলসন বললেন, বাংলাদেশের দাবি ব্রিটেন সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করে। তার ভাষায়, ইতিহাসে এমন কোনাে নজির নেই যে দুই জাতিতে পরিণত একটি রাষ্ট্রের মাঝে সম্পত্তির যথাযথ বাটোয়াৱা হয়নি। | তানজানিয়ার জুলিয়াস নিয়েরেরে অবশ্য প্রশ্ন করলেন, ‘পাকিস্তান কমনওয়েলথ ক্লাবের সদস্য নয় এবং তাকে জড়িয়ে কোনাে প্রস্তাব পাস করা কি ঠিক হবে?’ শেখ মুজিব তার কালাে চশমাটা অপসারণ করে স্থিরদৃষ্টিতে নিয়েরেরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ জুলিয়াস। কমনওয়েলথ একটি ক্লাব। কিন্তু আমি সেই ক্লাবেৱই একজন সদস্য। অন্য সদস্যরা যদি সামান্য একটি প্রস্তাব পাস করে। আমাকে সাহায্য না করেন তা হলে এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার আমার কাই ছিলাে প্রয়ােজন। একটি দরিদ্র দেশের রাষ্ট্রপ্রধান আমি। কেন তবে আমি অর্ধেক পৃথিবী পেরিয়ে এসেছি এই সম্মেলনে?”

| হেসে জুলিয়াস নিয়েরেরে বলেন, “ঠিক আছে মুজিব। তুমি যা চাও তা-ই হবে।’

৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, “বিশ্ব শােষক আর শােষিত—এই দুভাগে বিভক্ত। শােষিতকে বাঁচাতে হবে।’ কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো শেখ মুজিবকে জড়িয়ে ধরে বলেন, মুজিব, শােষকের বিরুদ্ধে শােষিত বিশ্বের এই বাচার সংগ্রাম আমার সংগ্রাম।’ একপর্যায়ে কিউবার প্রেসিঙ্কেট ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘সিআইএ সম্পর্কে সাবধান। সুযােগ পেলেই কিন্তু তারা আপনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘দেশের আইনজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, বৈজ্ঞানিক, ডাক্তার,

প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ প্রমুখ পেশার লােককে সরকারি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করুন। এরা ভূলের পরে ভুল করে সঠিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অনি করবে, কিন্তু এরা কোনাে যড়যন্ত্র করবে না। আপনার মুক্তিযােদ্ধা ছেলেদের আরও কাজের দায়িত্ব দিন এবং সম্পূর্ণভাবে ওদের বিশ্বাস করুন। অন্যথায় আপনি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।’

সম্মেলনে সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো, তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নিয়েৱেরে, কম্বােডিয়ার প্রিন্স নরােদম সিহানুক ও মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাতের সঙ্গে শেখ মুজিবের মতবিনিময় হয়।

একান্ত সাক্ষাতে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশা ফয়সল শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, ‘আমি শুনেছি যে, আসলে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্যের প্রত্যাশী। অবশ্য সাহায্য দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্বশর্ত আছে। এই কথার উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, আমার তাে মনে হয় না, বাংলাদেশ মিসকিনের মতাে আপনাদের কাছে কোনাে সাহায্য চেয়েছে। বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানের পবিত্র কাবা শরিফে নামায আদায়ের অধিকার চাচ্ছে। পবিত্র কাবা শরিফে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নামায আদায়ের হক রয়েছে। এ ব্যাপারে আবার শর্ত কেন? আমরা আপনাদের কাছ থেকে ভ্রাতৃসুলভ সমান ব্যবহার প্রত্যাশা করি। এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাই, কেন সৌদি আরব আজও স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছে না।’

বাদশাহ ফয়সল বলেছিলেন, ‘সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পৰিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে হবে।’

জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন আপনার দেশের নামটাও তাে ইসলামিক রিপাবলিক অব অ্যারাঝিয়া নয়। আপনার দেশটির নাম মরহুম বাদশাহ ইবনে সৌদের নামে কিংডম অব সৌদি আরাবিয়া রাখা হয়েছে। কই, আমরা কেউই তে এ নামে আপত্তি করিনি।’

এরপরও বাদশা বললেন, ‘তাছাড়া আপনাদের অন্য একটি শর্ত আছে, আর তা হচ্ছে অলিখে সমস্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর মুক্তি দিতে হবে।’

শেখ মুজিব সৌদি বাদশাহর এই কথাটিরও প্রতিবাদ করে বললেন, ‘এটা তাে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। এই দুটো দেশের মধ্যে এ-ধরনের আরও অনেক সমস্যা অমীমাংসিত রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানি নাগরিকের পাকিস্তানে ফেরত আনা এবং পাকিস্তানে আটকে পড়া পাঁচ লক্ষাধিক বালিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানাে, বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থসম্পদ পরিশােধ করা—এমন বেশকিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। এসব মীমাংসা

কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। শুধু বিনাশর্তে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবক্ষিকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি আলাদাভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর সৌদি আরবই বা এত উদগ্রীব কেন? | তখন খাল শাহ বললেন, ‘শুধু এটুকু জেনে রাখুন, সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। যাহােক, আমাদের দুটো শর্তের বিষয় চিন্তা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে, বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘােষণা আর একটা বিনাশর্তে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি। আশা করি, এরপর বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের কোনাে কমতি হবে না।’

সৌদি আরবের বাদশাহর মতাে লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফিও অনুরােধ করেছিলেন বাংলাদেশের নাম বদলে যেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র রাখা হয়। শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তা ছাড়া সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের একটি ভিন্নধর্মী চিন্তাচেতনা, মনমানসিকতা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশের মােট জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠাংশ অমুসলিম। সর্বোপরি আল্লাহতায়ালা তাে শুধু আলমুসলেমিন নন, তিনি তাে বাবুল আলামিন, সবকিছুই স্রষ্টা, মহান। সুতরাং আপনার প্রস্তাব কোনােক্রমেই গ্রহণকাগ্য নয়।

আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সঘেলন শেষ করে শেখ মুজিব দেশে প্রত্যাবর্তন কৱেন ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। কিছুদিন পরেই পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত পাঠানাের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জনা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নিল্লিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক শেষে ঘােষণা করা হয় : উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদেৱ বিচার বালি করা হল। এই ঘােষণায় কিছুদিন পরেই আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের প্রথম একটি দল ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ চাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ শেখ মুজিবের বক্তব্য পাকিস্তানের বেতার সম্মেলন কক্ষ থেকে সরাসরি প্রচার করা হয়। মানুষ এখন বন্ধুগত দিক থেকে বৃহত্তর শক্তি অর্জন করেছে, যা সে আর কখনাে পারেনি। সে পৃথিবীকে অর্জন করেছে, যা সে আর কখনাে পারেনি। সে পৃখিবীকে ধ্বংস করার ক্ষমত্তা অর্জন করেছে। আমরা যুদ্ধের অন্য শক্তির অপব্যবহার করতে দেখেছি, জনগণকে নিপীড়ন করতে দেখেছি। আমরা তাদের ন্যায়সংগত অধিকার অস্বীকার করতে দেখেছি। অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে তাদের ফেলে দিতেও দেখেছি। আর এসব অকল্য আমার এ নিদর্শন হয়ে আছেন আমাদের প্যালেস্টাইনি ভাইয়েরা। আর এজন্যই অীতের তুলনায় আজ এই শক্তিকে প্রজ্ঞার সঙ্গে কাজে লাগানাের প্রয়ােজন বেশি।…এই সম্মেলন শুধু আরব ভাইদের। সংগ্রামের প্রতি সমর্থন আমাদের ঐক্য সংহত করার জন্যই নয়, বরং জোটনিরপেক্ষ দেশগুলাের সঙ্গে এবং সারা বিশ্বের শান্তি ও প্রগতিশীল শক্তিগুলাের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা ঘােষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও সকল প্রকার শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একত্মতার ওপর জোর দিতে হবে ।…অন্যায়ভাবে দখলকৃত আরবভূমি অবশ্যই ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে জেরুজালেমের ওপর।…আল্লাহর কৃপায় আমরা এখন আমাদের সম্পদ ও শক্তি এমনভাবে সুসংহত করতে পারি, যাতে আমাদের সকলের জন্য শান্তি ও ন্যায়বিচার অর্জন করা যায়। এই সাফল্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সকল যৌথ প্রচেষ্টা সফল করুন।”

শেখ মুজিব কোনাে আরব রাষ্ট্রপ্রধানের অনুগ্রহভাজন হওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে বারবার দৌড়ে যাননি। শীর্ষস্থানীয় আরবদেশগুলাের রাষ্ট্রপ্রধানেরাই বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে তার সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করার জন্য বাংলাদেশ সফরে এসেছেন। কোনাে আরবরাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশের কোনাে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার কিংবা দেশের নামের আগে বিশেষ কোনাে শব্দ সংযােজনের প্রস্তাব করারও সাহস পাননি। আরবরা শেখ মুজিবের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা প্রদর্শন করতেন। ভিক্ষা নয়, আৱৰ সাহায্য আসা শুরু হয়। সে-সময় আরব আমিরাত বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬০ লাখ দিনার বা ৭৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা জমা রাখে।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ শেখ মুজিব সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর শুধু দেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ল না, এরপর বাংলাদেশে এমন কোনাে স্বাধীনচেতা নেতা তার মতো মাথা উঁচু করে সকলের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে সমানে সমান হয়ে কথা বলতে পারলেন না। | বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামি নীতিমালা সংযােজনের পরে আমাদের রাষ্ট্রপতিকে সৌদি আরবের বাদশাহ খালেদ অভিনন্দন জানান।

২৫ আগস্ট ১৯৯০ জাতীয় সংসদে একদিনের বিশেষ অধিবেশনে সৌদি আরবের বাদশাহের অনুরােধে তার প্রতিরক্ষার সহায়তার উদ্দেশ্যে প্রতীকী সৈন্যদল পাঠানাের জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এক প্রস্তাবে বলা হয় । “এই পদক্ষেপ ওই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে এবং ইসলামি উম্মাহর সার্বিক স্বার্থরক্ষায় বিশেষভাবে সহায়ক হবে।’ সেই পদক্ষেপের প্রতিবাদে ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯০ আট দল, পাঁচ দল ও জনমুক্তি পার্টির ডাকে সারাদেশে অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। ২০০৮ সালের ১০ মার্চের খবর। সৌদি রাজকুমার এবং উপপ্রধানমন্ত্রী সুলতান বিন আব্দুল আজিজ প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদকে মার্সিডিজ বেজ ৩৫০ একটি মােটরগাড়ি উপহার পাঠিয়েছেন। আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা পরকালের জন্য কতটা কী করেন তা আল্লাহ জানেন, কিন্তু ইহকালে ভােটারদের কাছে ধর্মভীরুতার ভাবমূর্তি তৈরি করতে তারা প্রায়ই ওমরাহ করে থাকেন। * বাংলাদেশে বর্তমানে সৌদি আরব ও সালাফিয়া আদর্শের প্রভাব রয়েছে উল্লেখযােগ্যভাবে। সৌদি আরবের পর আমাদের দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব উল্লেখযােগ্য। ৫ আগস্ট ১৯৯৮ পাঁচ বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্ট নিডস অ্যাসেসমেন্ট (হানা) প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরােধে মানবিক সহায়তা ও প্রয়ােজন নিরূপণে কর্মসূচি বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করে। ১০ আগষ্ট ১৯৯৮ বাংলাবাজার পত্রিকায় এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় এ বিষয়ে একটা ঢাক গুড় গুড় ব্যাপার ছিল। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা হানা চুক্তির ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। পররাই প্রতিমখীর মতে, ‘এটা কোনাে চুক্তি নয়। এটি মন্ত্রণালয়ের রুটিন ওয়ার্কের অংশ। নৈতিকতার দিক থেকে এটি অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। ঠিকই আছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভবিষ্যতে এভাৰে হুট করে কোনােকিছু যেন করা না হয়।’ | বিশ্বের প্রধান শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিহত করা কঠিন ব্যাপার। মাদক পাচারকারী একজন দণ্ডপ্রাপ্ত মার্কিন তরুণীকে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করে দেন। মালয়েশিয়ার মাহাথির অনুরূপ ব্যাপারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর অনুরােধ রক্ষা করেননি। ইরাক কুয়েত আক্রমণ করলে আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পক্ষ সমর্থন করি। রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাের শীর্ষনেতাদের সম্মতিতে আমাদের আকাশসীমা, বিমানবন্দর, বিমানৰ্ঘাটি ও সমুদ্রবন্দর যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। ১৮ অক্টোবর ২০০১ সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক সহকারী শফি সামি বলেন, বাংলাদেশের স্বার্থ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের আলােকে জাতিসংঘ সনদ ও নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হাইকোর্টে এ নিয়ে একটি বিট আবেদন করা হয়। আফগানিস্তানে মার্কিন ও ব্রিটিশ হামলার বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামি, ইসলামি ঐক্যজোট ও বাম রাজনৈতিক দল অবস্থান নেয়। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কোনাে মন্তব্য করেনি। নভেম্বর ২০০১ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে বিএনপি সমর্থন জানায়।

কোরিয়ার যুদ্ধের কল্যাণে পাটজাতদ্রব্য রপ্তানি করে পাকিস্তান তার সন্তোগমের কালে প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বিরাট সুযােগ পায়। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ওপেকের কারণে পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধির ফলে এক বিরাট সংকটে পক্ষে। সাধারণ কাপড়কাচা সাবান থেকে টিনের দুগ্ধজাত খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশকে নিয়ে দেশে-বিদেশে বিবিধ তত্ত্ব ও তথ্য নিয়ে গবেষণা চলছে, তা কখনাে-সখনাে আমাদের বিভ্রমের সৃষ্টি করে। পরিসংখ্যান, রেখাচিত্র ও নানা সারণির মধ্যে আমরা ধান্ধায় পড়ি। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০১ অখনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল বারকাত বলেন, ‘গত তিন দশকে বাংলাদেশে সরকারিভাবে ঋণ অনুদান হিসেবে আনুমানিক ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য এসেছে। এর ৭৫ ভাগ নানাভাবে লুট হয়েছে। সেই ৭৫ ভাগের ২৫ ভাগ বিদেশি কনসালট্যান্সির নামে, ৩০ ভাগ আমলা, রাজনীতিবিদ, কমিশন এজেন্ট, স্থানীয় পরামর্শক ও ঠিকাদার এবং ২০ ভাগ গ্রাম ও শহরে উচ্চবিত্তদের সাহায্যে ব্যয়িত হয়েছে।”

১৩ আগস্ট ২০০৩ বিআইআইএস-এর রজতজয়ন্তী বক্তৃতায় নােবল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জোসেফ ই স্টিগলি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতাে স্বল্পোন্নত দেশগুলাে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে অথচ এই ঝুঁকি মােকাবিলায় সবচেয়ে কম প্রস্তুত। কারণ, তাদের কথা শোনার কেউ নেই। বরং আইএমএফ এদের ঝুঁকিকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে ভুল পরামর্শ চাপিয়ে দিয়ে সংকটকে তীব্র করে তােলে। বিশ্বায়ন অর্থনীতিকে গতিশীল করে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে, তবে তা আইএমএফ-এর পরামর্শ বা নীতিমালার মধ্যে নয়। যেসব দেশ নিজের মানুষ ও মাটি এবং জলবায়ুকে হিসেবের মধ্যে নিয়ে নিজেরা তাদের কর্মসূচি নির্ধারণ করে, তাদের উন্নয়নের হার তুলনামূলকভাবে ভালাে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলাে যে হারে আগে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছিল, দাতাগােষ্ঠীদের তদারকিতে সে হার অনেক . নিচে নেমে যায়।

বাংলাদেশের এ অর্থনৈতিক উন্নতির কারণ সম্পর্কে নানাধরনের তন্তু পেশ করা। হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হয়তো এই যে, বাংলাদেশের মানুষ নতুনকে খুব সহজভাবে গ্রহণ করেছে—সে নতুন বীজ, সেচ বা ভিন্ন উৎপাদন পদ্ধতিই হােক বা কর্মক্ষেত্রে অধিকতর নারীর অংশগ্রহণই হােক। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের যে উদয়াস্ত পরিশ্রম করার ক্ষমতা, তারও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অধিকতর সম্পৃক্ততা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে ঋণগ্রহীতা ও বিনিয়ােগকারী হিসেবে নারীদের অবস্থান এবং তৈরি পােশাকশিল্পে নারীশ্রমিকদের অধিকতর অংশগ্রহণ দেশের অর্থনৈতিক আবহাওয়া বদলে দিয়েছে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানি লন্ডারিং টাকা ধােলাইবিরােধী আইন দেশে ও বিদেশে কার্যকর হওয়ার পর প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে হুতি-প্রণা কমেছে।

বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০০০-২০০১ সালে দেখা যায়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের বৈষম্য অনেক কমে গেছে। পাকিস্তানের তথাকথিত উন্নয়নের দশকে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল, ৩০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ তা সম্পূর্ণ দূর করতে সক্ষম হয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সত্তরের দশকে তিন শতাংশ, আশির দশকে চার শতাংশ এবং নব্বইয়ের দশকে পাঁচ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মােটকথা, প্রায় আড়াই দশক ধরে জাতীয় আয় বছরে শতকরা চার থেকে পাঁচ ভাগ হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে দেশে এক শতাংশ হারে দারিদ্র্যবিমােচন হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যবিমােচনে দেশের এই যে অগ্রগতি, এটা সম্ভব হয়েছে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যক্ষেত্রে সংস্কারের বদৌলতে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণও উল্লেখযােগ্যভা বৃদ্ধি পেয়েছে। মাথাপিছু। আয় বৃদ্ধির হার বেড়েছে শতকরা দেড় ভাগ থেকে সাড়ে নি ভাগ। তবে এ প্রবৃদ্ধি। সম্ভাবনার তুলনায় যথেষ্ট নয় এবং দেশের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। অর্জনযােগ্য সর্বাধিক উন্নয়নের হারের অনেক নিচে আমাদের প্রকৃত উন্নয়নের হার । অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়ােগের স্বল্পতা, রাজস্ব আদায়ের স্বল্পতা এবং দুর্বল অবকাঠামাে হচ্ছে অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল কারণ। তৈরি পােশাকনির্ভর রপ্তানি আয় প্রধানত সংরক্ষিত বাজারে বিক্রি হয়। দেশে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য ও পরিবেশদূষণ এখনাে ব্যাপক।

২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা অর্ধেকে নামিয়ে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ করতে হলে কৃষিখাতে ৪ শতাংশ এবং অকৃষি খাতে ৭ শতাংশ হারে উৎপাদন বাড়াতে হবে। ২০০৭ সালে কৃষি উৎপাদনের হার ছিল ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ। ৮০ শতাংশ দরিদ্রের মধ্যে ৫৩ শতাংশই গ্রামের মানুষ, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কুষি ও গ্রাম—এই দুই খাতে অবহেলা ও কম বিনিয়ােগ করা হচ্ছে।

২০০৭ সালের আগস্টে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দারিদ্দ্যবিমোচনে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের স্থান ভারতের পরে। ১৯৯১ সালে যেখানে ৫৭ শতাংশ লােক দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল এবং তা ২০০০ সালের ৪৯ শতাংশে নেমে আসে এবং সে হার ২০০০-২০০৫ সালে আরও কমে ৪০ শতাংশে। স্থির হয়ে আছে।

গ্রামীণ এলাকায় সামাজিক সচেতনতা বেড়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে অগ্রগতি হচ্ছে। দেশে সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিনিৱতা অতি সামান্য হলেও হ্রাস পেয়েছে। গ্রামীণ পরিবারের উপার্জনকারীদের ৫২ শতাংশ আজ অকৃষি কর্মোদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১৯৮৭-৮৮ সালে সে হার ছিল ৩৭ শতাংশ। কৃষিভিত্তিক বৃত্তি ১৬ শতাংশ কমেছে। কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা অর্ধেক কমেছে। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। যান্ত্রিক চাষ, যান্ত্রিক সেচ, রাস্তাঘাট, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক ও পেশাগত চলমান নতুন চাহিদা ও আকাক্ষার সৃষ্টি করে এক পরিবর্তনের সূচনা করেছে।

১৯৭৩-৭৪ সালে যখন প্রথম সারিদ্রের ওপর জরিপ করা হয়, তখন দেশের শতকরা ৭০ জন মানুষকে দুবেলা পেট পুরে খেতে প্রাণান্ত চেষ্টা করতে হতো। ১৯৯১-৯২ সালে এমন দুস্থ মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে শতকরা ৫৮ দশমিক ৮ এবং ১৯৯৯-২০০০ সালে আরও হ্রাস পেয়ে শক্তকরা ৪৯ দশমিক ৮-এ দাঁড়ায়। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের সর্বশেষ জরিপে আমাদের দেশের দাদ্রিাৱেম্বা ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। | ১৯৯১-৯২ সালে যেখানে সর্বাধিক ৫ শতাংশ ধনী পরিবারের জার্কীয় আয়ের অংশ ছিল ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০০০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৬৬ শতাংশে। ধন বন্টনের অসমতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রপতি এরশাদের আমলে এক শতাংশ লােক ২৭ ভাগ সম্পদের মালিক ছিল। ২০০৭ সালে। এক শতাংশ লােক ৪০ ভাগ সম্পদের মালিক। ধনী ও হতদরিদ্রের মধ্যে নবজাত শিশুমৃত্যুর হারে বৈষমা ৪৮ শকাংশ, পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হারে এ বৈষম্য। ৯৩ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় প্রবেশের ক্ষেত্রে এর হার ৪৬ শতাংশ ও মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৪ শতাংশ, শিশুপুষ্টিতে ধনী ও হতদরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য ১০৪ শতাংশ এবং মাতৃপুষ্টির ক্ষেত্রে এ বৈষম্য ৮৯ শতাংশ। এ বৈষম্য দূর করতে না। পারলে বাংলাদেশে অন্তত চার থেকে পাঁচ কোটি মানুষ গরিবই থেকে যাবে। বৈষম্যের কারণে অরিপুতাড়িত সাধারণ ছাপোষা মানুষ যেকোনাে সময় ক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে।

দুর্নীতি ও বৈষম যুগপৎ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রবৃদ্ধির বদৌলতে উন্নয়নের গতি চুইয়ে চুইয়ে নিবিকের দিকে যাবে বলে যে আশা দা হয়েছিল বাস্তবে তেমন দেখা যাচ্ছে না। | আমাদের দারিদ্রের একটি বড় কারণ মূলাস্ফীতি। কেননা মূল্যস্ফীতিই নারি বৃদ্ধির একটি বস্তু উৎস। এতে দরিদ্র লােকজন ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দেশের সাধারণ মানুষের পােশাক-আশাক, কেনাবেচা ও হ্যৰঙাৰ দেখে মনে হ্যা দুস্থ মানুষের গায়ে একটু মাংস লেগেছে। সীমান্তবর্তী গ্রামাঞ্চলে যে অর্থনৈতিক কর্মকায় দেখা যায়, তা থেকে কেউ কেউ অনুমান করেন যে চোরাচালান এবং অবৈধ পাচার-ব্যবসার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে টাকাপয়সার বিনিময় বেড়েছে। গ্রামে টিনের বাড়ি এবং শহরে বহুতলবিশিষ্ট ইমাররে সংবা বৃদ্ধি পেয়েছে।

খাদ্য-নিরাপত্তা অঞ্জনে বাংলাদেশের অবস্থান চরম খারাপ অবস্থার খানিকটা ওপরে, কিন্তু গড় মানের নিচে। এ ছাড়া শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকাণে লিঙ্গবৈষম্য দূর ও পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশ রয়েছে গল্প মানের নিচে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাত ও শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান গন্তু মায়ের ওপরে। মাধীর ক্ষমতায়ন এবং তথ্যবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ।

২০০৪ সালের তথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে বাংলাদেশে ৮ ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। তাত ও পাকিস্তানে এ

সংখ্যা ১১। বাংলাদেশে সব ক্রিয়া শেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করতে লাগে ৩৫ দিন, ভারতে ৭১ দিন। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় ব্যবসা-বাণিজ্য কম সময়ে শুরু করা গেলেও দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই এর জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে লাইসেন্স পেতে ১৮৫ দিন লাগে, আর সবচেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হয় ভারতে, ২৭০ দিন। আর এজন্য বাংলাদেশে খরচ হয়। মাথাপিছু আয়ের ২৯১ শতাংশ, ভারতে ৭৮ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ পাকিস্তানে ১ হাজার ১৭০ শতাংশ। বাংলাদেশে শ্রম নিয়ােগে কোনাে অর্থ-লাগলেও কর্মচারী-কর্মকাদের চাকরিচ্যুত করতে দিতে হয় ৪৭ সপ্তাহের বেতনের সমপরিমাণ অখ। ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার একটি বড় উপাদান জমি। বাংলাদেশে জমি নিবন্ধনে প্রয়ােজন হয় ৩৮৩ দিন এবং খরচ হয় মােট জমির মূল্যের ১১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই সর্বোচ্চ। পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করতে বাংলাদেশে অনেক সময় লাগে। যেমন- আমদানি করতে বাংলাদেশে লাগে ৫৭ দিন, রপ্তানিতে ৩৬ নিন। আমদানি করতে ৩৮টি স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হয়, আর রপ্তানিতে ১৫টি।

Next