বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বাণিজ্য উদারীকরণ করে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে বলে যে দাবি করা হয়, তা কি সঠিক? দের পরামর্শ সঠিক হলে এতদিনে আমরা কৃষি থেকে বেরিয়ে এসে পুনােপুৰি শিল্পনির্ভর হয়ে যেতাম। বিশ্বব্যাংক ওঁ আইএমএফ-এর ভর্তুকি কমানাের পরামর্শ মেনে নিলে কৃষিক্ষেত্রে আমরা বড় বিপদে পড়তাম। ১৯৯৬-২০০১ সালে কৃষিক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়ায় আমরা যে যােগফল পাই, তা ২০১০ সালে আমরা কৃষিকে অবহেলার জন্য ধরে রাখতে পারিনি। দেশে ১৯৯২ সালে জলের হার ছিল ছয় দশমিক চার শতাংশ। ১৯৯৯৯৯-২০০০ সালে তা কমে তিন দশমিক শূন্য তিন শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল তিন শতাংশ। ২০০১ সালে তা কমে এক দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়ায়। নারীনির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশের জনমত সংঘবন্ধ হয়েছে। সালিশের মাধ্যমে নারীনির্যাতন আর তেমন সহজ নয়।
২০০৭-০৮ সালের ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের স্থান ১৪০তম। গড় আয়ু বেয়ে পড়িয়েছে ৩৩ বছর ১ মাসে। বয়স্ক সাক্ষরতার হন ৪৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং স্কুল-কলেজে ভর্তির হার ৫৬ শতাংশ।
পাট ছিল পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির পক্ষে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য অস্ত্র। স্বাধীনতার পর উৎপাদন হতাে প্রায় এক কোটি বেল পাট এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৪০ থেকে ৫০ লাখ বেল। যে দেশে বিশ্বের ৭০ শতাংশ পাট উৎপাদন হতাে, যে দেশের আবহাওয়া পাটচাযের অনুকূল এবং চাষিরাও বিশেষভাবে দক্ষ, সেখানে পাটশিল্পের করুণ দশার জন্য কতখানি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দায়ী তা নির্ণয় করা কঠিন।
১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী ও রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে যত অভিযােগ দায়ের করা হয়, তার মধ্যে তিনটি মামলা হঙ্কান্তভাবে শেষ হয় এবং দােষী ব্যক্তি শাস্তি ভােগ করেন। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের দলে টানার জন্য স্তান আমিন দেওয়া-নেওয়া নিয়ে যে প্রহসনের সৃষ্টি হয়, তাতে আদালতের সুনাম ক্ষুণই হয়। প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের মামলার শুনানি বিলম্বিত হয় সরকারের আইন পরামর্শকদের অনাপত্ৰিতেই। | ১৯৪৭ সালের পর আমরা নানাধরনের খনিজদ্রব্য আবিষ্কার এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সাশ্রয়ের স্বপ্ন দেখে এসেছি। সেক্ষেত্রে একটি পূরণ হয়েছে। ১৯৬২ সালের ২৩ আগস্ট তিতাস গ্যাস ব্ৰাবিত হয়। ১৯৬৮ সালের ১ এপ্রিল সেই গ্যাস তােলা শুরু হয়। বিদেশি স্বার্থান্বেষী পরামর্শকেরা বলেন, বাংলাদেশ পাসের ওপর ভাসছে এবং যেহেতু আমাদের কথেষ্ট প্রকেীশল জ্ঞান নেই, গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশে গ্যাস রপ্তানি করা উচিত। দেশি বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের ২০টি পাসক্ষেত্রে মােট উত্তোলনযােগ্য গ্যাস মজুদ ছিল ১৩ দশমিক ৭৯১ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। ব্যবহার করার মতাে উত্তোলনযােগ্য গ্যাস রয়েছে ৯ দশমিক ৮৩০ টিএসএফ। আগামী ৫০ বছরের অন্য ৪২ থেকে ৪ টিএসএফ গ্যাস মজুদ থাকা দরকার। নির্বাচিত সরকারের কেউ-না-কেউ বিজ্ঞের মতো বলেছেন, মাটির নিচে ধন রেখে লাভ কী? বেগুনগাছ কেটে মূলা চাষের পরামর্শ দেন। প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার-সূচক এক সেমিনারে ২০০১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি কানাডার অধ্যাপক ড. ছন রিচার্ডস বলেন, “গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম পন্থা।
২০০৪ সালের আগস্ট মাসে অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিজ বলেন, সরকার যদি এখন রপ্তানি করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে ১৫ থেকে ২০ বছর পর আবার গ্যাস আমদানি করতে হবে এবং রপ্তানি ও আমদানি কাজে পূবার গ্যাস সঞ্চালনে অযথা বায়ভার বহন করতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষের অপ্রতিরোধ বিরােধিতায় এখন পর্যন্ত গ্যাস রপ্তানির কথা সাহস করে কেউ বলছে না। অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাবে, কিন্তু দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতে কোনাে অঞ্চযন্ত্র বরদাশত করবে না।
যুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত সারা ॥ ভৈরব ব্রিজসহ সেতু ও কালভার্ট মেরামত করে যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা হয়। গত কয়েক দশকে দেশে বহু রাস্তা ও ব্রিজ তৈরি হয়েছে। বাক্কায় গাড়ি চালাতে জ্বালানি তেলের যে ব্যয় হয়, তার সঙ্গে দাতারাষ্ট্রেগুলাের লাভজনক সম্পর্ক রয়েছে। নৌপথের উন্নয়নের জন্য সরকার বা সাহাগােষ্ঠী তেমন উৎসাহ দেখায়নি। ২০০৭ সালের মার্চের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর ১৮ হাজার কিলােমিটার নৌপথ বিলুপ্ত হয়ে এখন রয়েছে মাত্র ৬ হাজার কিলােমিটার। ২৩০ নদীর মধ্যে ১৭৫টির অবস্থা শোচনীয়।
রাজধানী এন নানাধরনের দুর্নীতির আখড়া। হাজারখানেক বাস চলে অবৈধভাবে। ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত এক সূত্র অনুযায়ী ঢাকা মহানগরে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ লাইসেন্সবিহীন রিকশা ছিল। বুড়িগঙ্গা বা তুরাগ নদীতীরে এবং, পথের পাশে অবৈধ স্থাপনার ইয়ত্তা নেই।
আমাদের পরামর্শদাতা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান, ডিআইএফডি যৌখাবে আমাদের জন্য বাইসহয়তা কৌশল (সিএএস) তৈরি এবং আমাদের অর্থমন্ত্রীকে দারিদ্র্যবিমােচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) তৈরি করতে অনুরােধ করছে। বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা দরিদ্রদেশগুলােকে যে সুপারিশ উপদেশ বর্ষণ করে, তার জন্য তাদের কোনাে জবাবদিহি নেই। স্কুল উপদেশের জন্য তাদের কোনো হিসাবদিহিও করতে হয় না।
দেশে-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও সস্তা শ্রমে মুনাফার জন্য বিদেশিরা যে বিনিয়ােগ করছে তাতে বিশেষ কোনাে কারিগরি বিদ্যা হস্তান্তর হচ্ছে না। বিদেশি বিনিয়ােগ বৃদ্ধি হলে দেশে উন্নতি হবে না, যদি কাঠামােগত প্রতিষ্ঠানগুলাে টেকসই না
বন্যা, প্লাবন, জলােচ্ছ্বাস, টর্নেডাের মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সামরিক শাসনের মধ্যে রাজনৈতিক দুর্যোগ বা অপদার্থ নির্বাচিত সরকারের নৈরাজ্যের মতাে দুর্ভোগ কাটিয়ে বাংলাদেশের মানুষ একাধিকবার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এই হরিদ্র দুঃখী মানুষের মধ্যে এমন একটা পতিময়তা এবং প্রাণবন্ততা রয়েছে, যা এদেশকে শুধু রক্ষা করছে না, কখনাে তাদের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ইংল্যান্ডের একটি ইন্ডিপেনডেন্ট থিংকট্যাংক ড্রিমস’ এক জরিপ করে এ সিদ্ধান্তে পেীছেছিল যে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষের দেশ।
বাংলাদেশ যদি সমৃদ্ধি লাভ করতে চায় তবে সন্ত্রাসের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হবে, অন্যদের অবিচার ও নিপীড়ন থেকে যতদূর সম্ভব সমাজের প্রতিটি সদস্যকে রক্ষা করতে হবে এবং যথাযথ বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ব্যবসা ও বাণিজ্যে সহায়তা, চুক্তির দায়দায়িত্ব পালন, আইনশৃক্ষলা রক্ষা এবং লেনদেনের খরচ কমানাের জন্য দুর্নীতিকে ন্যূনতম স্তরে সীমিত করার লক্ষ্যে দেশে ফলপ্রদ ও যথার্থ আইন থাকতে হবে। আমি অন্যত্র বলেছি, বাংলাদেশ যদি স্বাধীনসস্তায় সমৃদ্ধি লাভ করতে চায়, যার পূর্বাভাস সংবিধানের প্রস্তাবনায় বিধৃত রয়েছে, তবে তাকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং প্রয়ােজনে বাজারকে নিয়মিত করতে, মুক্ত-বাণিজ্যের আতিশয্যকে নিবৃত্ত করে শ্রমিক ও ভােক্তার অধিকার এবং সকলের জন্য মানবাধিকার সংরক্ষণের জন্য কার্যকর আইন প্রণয়ন করতে হবে। কারণ, আমাদের জন্য কেবল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের উদারীকরণ যথেষ্ট নয়, অসুবিধাগ্রস্ত এবং অনগ্রসর মানুষের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সামাজিক সুযােগ বৃদ্ধি করতে হবে।’
বড় দুর্দিনের সময় শেখ মুজিবের স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতির জন্য বাংলাদেশ তলাহীন ঝুড়ি হওয়া সত্ত্বেও ধীরে ধীরে স্বনির্ভরতার পথে এগােয়। অভুদয়কালে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা ছিল আজ তা অনেক কমেছে। প্রবাসীদের প্রেরিত টাকার সদ্ব্যবহার করতে পারলে পরনির্ভরতা উল্লেখযােগ্যভাবে আরও কমবে।
৩ ডিসেম্বর ২০০৭ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিয়াের সুবর্ণ জয়ন্তীতে অর্থনীতিবিদরা বলেন, ‘বিদেশি সাহায্য অনেক কমেছে, মানসিক নির্ভরতা রয়ে গেছে।’
একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের পরনির্ভরতা আপেক্ষিক ব্যাপার। যদি সেই পরনির্ভরতায় রাষ্ট্রটির উন্নয়ন ব্যাহত না হয়, স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ না হয় তবে আশঙ্কার কিছু নেই। দুর্ভাবনার কথা তখনই উঠবে যখন রাষ্ট্রটি ব্যর্থ, অকার্যকর বা ভঙ্গুর হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের সেই আশঙ্কা নাই। জয় বাংলা।
প্রথম আলাে ২৬ মার্চ ২০০৮
গ্রিক ঐজেডির হিরাে : তাঁর মৃত্যুহীন মহাজীবনের নতুন উত্থান
আবদুল গাফফার চৌধুরী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশ-বিদেশের অনেকেই আখ্যা দিয়েছেন গ্রিক ট্র্যাজেডির হিরাে। গ্রিক মহাকাব্যের নায়কদের চরিত্রের বিশালতা এবং নাটকীয়তা বঙ্গবন্ধুর জীবনে সম্পূর্ণভাবে ছিল বিরাজমান। পুরাকাল হলে তাঁর জীবন ও বীরােচিত মৃত্যু নিয়ে হয়তাে মহাকাব্য রচিত হত। এ যুগেও তাকে নিয়ে কবিতা গল্প উপন্যাস। এবং জীবনীও কম লেখা হয়নি। ইংরেজরা তাদের রাজার মৃত্যু সম্পর্কে বলে “কিং ইজ ডেড, বাট লং লিভ দ্য কিং (রাজা মৃত কিন্তু তিনি দীর্ঘজীবী হােন)। বাঙালিরা তাদের জাতির জনক সম্পর্কে বিনা দ্বিধায় বলতে পারে ‘মুজিব ইজ ডেড, লং লিভ মুজিব।’
এ বছর বঙ্গবন্ধুর ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকীর (১৫ আগস্ট) মাত্র তিন দিন আগে ১১ আগস্ট তারিখে ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর) নামের সংস্থার উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনকথা নিয়ে রচিত একটি বিশাল প্রামাণ্যগ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব ও আলােচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকার মুক্তমনা অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী এই আলােচনা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেছেন এবং সবাই স্বীকার করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতির জীবনকথা নিয়ে তাঁর মৃত্যুর তিন দশক পর একটি পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল যে বইটির প্রকাশ হওয়া উচিত ছিল বহু আগে । তবু শেষ পর্যন্ত বইটি প্রকাশিত হওয়ায় তারা প্রকাশক বাংলা একাডেমী ও সম্পাদক মােনায়েম সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এক হাজার পৃষ্ঠার বেশি এই বইটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’। বিএফডিআর পক্ষ থেকে মােনায়েম সরকার আরাে কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষকের সহযােগিতায় বইটি লেখা ও সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। বইটির সম্পাদনা ও প্রামাণ্যকরণে এই সহযােগিতায় ছিলেন ড, বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, গাজীউল হক, সন্তোষ গুপ্ত (প্রয়াত), অধ্যাপক সৈয়দ আনােয়ার হােসেন এবং আশফাক উল আলম। বাংলা একাডেমী বরেণ্য ব্যক্তির জীবনী প্রণয়ন ও প্রকাশ প্রকল্পের অধীনে জাতির জনকের এই জীবনীগ্রন্থটি প্রকাশ করে।
বঙ্গবন্ধুর তেত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে এ বইটি নিয়ে একটু বিশদ আলোচনা করছি এজন্য যে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে গত তেত্রিশ বছরে ছোট বড় অনেক বই লেখা হয়েছে, কিন্তু এরকম একটি সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগযুক্ত প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ এর আগে প্রকাশিত হয়নি। বইটির প্রথম সংস্করণে অবশ্যই ভুলত্রুটি কিছু থাকতে পারে, কিন্তু বইটিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বৈচিত্র্যময় জীবন, তার উত্থান পতন সংগ্রাম ও সাধনা এবং তার অমিত সাহসী রাজনৈতিক জীবনের নানা জানা অজানা ঘটনা। তাছাড়া রয়েছে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের স্বহস্তে লেখা চিঠি, বঙ্গবন্ধুর লেখা দুপ্রাপ্য চিঠি এবং আরাে নানা অজানা তথ্য। | রাষ্ট্রপিতার জীবন-সংক্রান্ত এ বইটি বহু আগে বাংলা একাডেমির প্রকাশ করা উচিত ছিল কিন্তু তারা তা পারেননি। এজন্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। দেশদ্রোহী চক্রের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তাদের সহযােগী যে গণবিরােধী স্বৈরশাসকরা ক্ষমতায় বসেছে তারা প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধুর নামােচ্চারণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধু-হত্যার কিছুকাল পর কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘মুজিব মানেই মুক্তি নামে একটি কবিতা লেখার জন্য থানায় হাজিরা দিতে আদিষ্ট হয়েছিলেন। গ্রেফতার করে তাকে থানায় নিয়ে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। | খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মনীষী আবুল ফজল বঙ্গবন্ধু-হত্যা নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলেন, নাম : মৃতের আত্মহত্যা। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল অধুনালুপ্ত সাহিত্য মাসিক সমকালে’। পত্রিকাটির ওই সংখ্যা তৎকালীন সামরিক সরকার বাজেয়াপ্ত করে। এছাড়া বিএনপি স্বনামে ক্ষমতায় আসার পর রাজপথে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর ছবির অবমাননা, বিভিন্ন সেতু, সৌধ ও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তার নাম মুছে ফেলা ইত্যাদি কালাপাহাড়ি তাণ্ডব শুরু হয়।
সুতরাং বাংলা একাডেমীর মতাে মূলত একটি সরকারি সংস্থার পক্ষে খালেদা জিয়া এবং তার সরকারের রক্তচক্ষুর শাসনির সামনে জাতির জনকের জীবনীগ্রন্থ সময়মতাে প্রকাশ করা ছিল একটি বিরাট সমস্যা। বঙ্গবন্ধুর জীবনীর বদলে অথবা তার পাশাপাশি জিয়াউর রহমানের জীবনীগ্রন্থ প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমীর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত ড. আফতাব আহমাদ এই জীবনীগ্রন্থ লেখার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে কয়েক লাখ টাকা নাকি আগামও নিয়েছিলেন। কিন্তু এই অমূল্য জীবনীগ্রন্থের এক লাইনও তিনি লিখে যাননি। মৃত মানুষের সমালােচনা নাকি করতে নেই। কিন্তু ড. আফতাব আহমাদ সম্পর্কে অনেক অভিযােগের মধ্যে জিয়াউর রহমানের জীবনী লেখার দায়িত্ব নিয়েও দায়িত্ব পালন না। করা একটি অভিযােগ। পরে ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়ে তিনি সব অভিযােগের জবাব দেয়ার দায় থেকে মুক্তি পেয়ে গেছেন।
বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থের মােড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ড. সৈয়দ মােহাম্মদ শাহেদ নিজেই বলেছেন—’একুশের বইমেলাতেই
বইটি বেরিয়েছে। এখন মােড়ক উন্মোচন করা হল। যতদিন বাঙালি পাঠক থাকবে ততদিন বইটিও বেঁচে থাকবে। নকই দশকেই বইটি প্রকাশনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতাবিরােধী শক্তি ক্ষমতায় আসা বইটি প্রকাশে বিলম্ব হয়েছে।’ ত এই গীকারােক্তির জন্য নয়, বইটি প্রকাশে যথাসম্ভব মেওয়াতেও তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে হয় । ধন্যবাদ জানাতে হয় বইটির সম্পাদক মােনায়েম সরকারকেও। এই বইটি রচনার উদ্যোগ নিয়ে তাকে নানা বাধা-বিপত্তি, অপবাদ ও হয়রানি পােহাতে হয়েছে। তা শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের হাতে জাতির জনকের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনচিত্র তিনি তুলে দিতে পেরেছেন। এ ব্যাপারে বিএফডিআজকেও ধন্যবাদ জানাতে হয়। তারা বিএনপি-জামায়াত শাসনামলের ভয়াবহ প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিলস নানা গবেষণামুলক বই, ছবি, পুস্তিকা, লিফলেট প্রকাশ করে চলেছেন এবং এ সম্পর্কিত সভা-সেমিনারেরও তারা উদ্যোক্তা।
বঙ্গবন্ধুর জীবন প্রকৃতপক্ষেই একটি মহাজীবন। তাতে একটি মহাকাব্য রচনার সব উপকরণই হয়েছে। এ যুগ মহাকাব্যের যুগ নয়। তবু আজ অথবা আগামীকাল তার জীবনভিত্তিক কালজয়ী আৱাে মহাগ্রন্থ যে বেরােবে তাতে সন্দেহ নেই। তিনি ইতিমধ্যেই বাইদ্রাহী এবং জনগণের শত্রুদের দ্বারা ছড়ানাে মিথ্যার কুয়াশা ভেশ করে আবার সূর্যরশ্মির মতাে ভাস্বর হয়ে উঠছেন এবং কবির কবিতায়, সুরশিল্পীর গানে কথাশিল্পীর গল্প-উপন্যাসে মহানায়কের অবস্থান গ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কবিতা লেখেননি—শামসুর রাহমান থেকে মহাদেব সাহা পর্যন্ত কোনাে কবির নাম করা যাবে কি? একথা বাংলাদেশের নবীন কবিদের জন্যও প্রযােজ্য। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালে ভাৱ ছয়দফা আন্দোলনের সময়েই তাকে নিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে কবিতা, গান, চা লেখা শুরু হয় এবং তাঁর নাম বাংলাদেশের গল্প-উপন্যাসে উঠে আসে। সৈয়দ শামসুল হকের প্রথমদিকের সাড়া জাগানাে খেলারাম খেলে যা” উপন্যাসেই সম্ভবত শেখ মুজিব তার ছয়দফা আন্দোলন নিয়ে প্রথম উঠে আসেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানি কারাগারে, তখন অন্নদাশঙ্কর বায় তাঁকে নিয়ে লেখেন তার অমর কবিতার চার লাইন যতাে কাল কবে পদ্মা মেঘনা গঙ্গা যমুনা রহমান ততাে কাল রবে কীর্তি তােমার শেখ মুজিবুর রহমান/ দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা রক্তবন্যা বহমান/ তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’
অনেকে অন্নদাশঙ্করের এই কবিতাকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে নিবেদিত রবীন্দ্রনাথের ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ’ কবিতাটির সঙ্গে তুলনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। এমনকি গ্রামের কবিয়ালের দল পর্যন্ত তাকে নিয়ে গান বেঁধেছে, ছড়াকাররা মুখে মুখে ছড়া তৈরি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গানগুলাের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘শােনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’ গানটি। আমেরিকার বিশ্বখ্যাত গায়ক পল রবসনের এক আফ্রিকান সাগরেদ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ইংরেজিতে একটি গান লিখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর লন্ডনের এক সভায় এই গানটি আমি শুনেছি। গানটি লনের সাপ্তাহিক ‘বাংলার স্তকে’ বাংলা তরজমাসহ প্রকাশ করা হয়েছিল। | বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সম্ভবত আমিই প্রথম বাংলার ডাক’ (অধুলালুপ্ত) পত্রিকায় মুজিব হত্যার নেপথ্যে’ শিরােনামে একটি ধারাবাহিক নিবন্ধ লিখতে শুরু করি। পরে আরাে একটি ছােট পুস্তিকা লেখি ‘ইতিহাসের রাখাল রাজা’। এ দুটি রচনা মিলিয়েই পরের ঢাকা থেকে ইতিহাসের বক্তপলাশ নামে আমার বইটি বেরােয়। ১৯৭৬ সালের দিকে যখন ‘মুজিব হত্যার নেপথ্যে’ নামের ধারাবাহিক লেখাটি লন্ডনের সাপ্তাহিক প্রকাশিত হচ্ছে তখন এমআর আখতার মুকুল (তিনিও তখন লন্ডনে অবস্থান করছিলেন) ‘মুজিবের রক্ত লাল’ নামে একটি বই লেখেন। বইটি প্রথমে লন্ডন থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। | ১৯৭৭ সালে আমি এবং লন্ডনপ্রবাসী প্রবীণ সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আবদুল মতিন মিলে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির ওপর আলােচনামূলক একটি বই ইংরেজিতে প্রকাশের উদ্যোগ নিই । বইটিতে আমার লেখা ছাড়াও যাঁদের লেখা ছিল তাদের মধ্যে ছিলেন বেহমান সােহান, ড. মােশাররফ হােসেন, ড. কামাল হােসেন, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়াত তাত্ত্বিক জ্যাক ওয়াডিস এবং আরাে অনেকে। বইটি প্রকাশ করেছিল লন্ডনের রেডিক্যাল এশিয়া বুকস। এই বই আমরা ব্রিটেনসহ ইউরােপের অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা ও সরকারপ্রধানের কাছে পাঠিয়েছিলাম। এ বইটি হাতে পেয়ে তঙ্কালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন আমাদের কাছে একটা ছােট্ট প্রাপ্তিসংবাদ পাঠিয়েছিলেন। তাতে লিখেছিলেন। শেখ মুজিবের মৃত্যু। তােমাদের জন্য ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি কিন্তু আমার জন্য পার্সোনাল ট্র্যাজেডি।’ | আমার জীবনের একটি পরম সৌভাগ্য এই যে, বঙ্গবন্ধু যখন জীবিত এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তখন তার একটি ছােট জীবনী-পুস্তিকা লেখার দায়িত্ব আমার ওপর পড়েছিল। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস বঙ্গবন্ধু তখন ৭৩ জাতি জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যােগ দিতে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় এই পুস্তিকাটি প্রকাশ করেছিল সেই সম্মেলনে বিতরণ করার জন্য ।
আমি বইটি লিখেছিলাম বাংলায়। বাংলাদেশ অবজারভারেণ এক সাংবাদিক বন্ধু সেটি ইংরেজিতে তরজমা করেন। ইংরেজি ও বাংলা দু-ভাষাতেই বইটি প্রকাশ করা হয়েছিল। বইটির প্রচছদ এঁকেছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী কালাম মাহমুদ। তিনি এখন প্রয়াত। সম্মেলনে আমরা তিন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী হয়েছিলাম। আমি বাংলাদেশ অবজারভাৱেৰ ওবায়েদুল হক এবং বর্তমানে জনকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক তােয়াব খান (তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর প্রেস সেক্রেটারি ও জনসংযোগ অফিসার)। আমি নিজহাতে বন্ধুর জীবনী-পুস্তিকাটি (ইংরেজি কপি) প্রিন্স সিহানুক শ্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ফিদেল কাস্ত্রোকে উপহার দিয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমখী থাকাকালে বিশ্বশান্তি পুরস্কার হিসেবে জুলিও কুরি পদক এবং বিশ্ব খেতাব পান এখনাে তাকে নিয়ে একটি রঙিন ছবি করার দায়িত্ব আমি পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় ছিল ছবিটির প্রযােজক। ছবিটির নাম ছিল ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববঙ্গ’। প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের ছিলেন বিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে। কাজিনী ও গান আমার। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা প্রয়াত চিত্রপরিচালক আলমগীর কৰিৱেৰ। সলিল চৌধুরী দুটি গানেই সুরারােপ করেছিলেন। এই ছবিটি যখন তৈরি করি তখন স্বপ্নেও ভাবিনি বছর ত্রিশেক পর বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাকেই সর্বপ্রথম একটি ছবি (পলাশী থেকে ধানমণ্ডি) তৈরি করতে হবে। একেই সম্ভবত বলে ভাগ্যের লিখন। | বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে বিদেশে বসে তিনি সবচেয়ে বেশি তথ্য সংগ্রহ এবং লেখালেখি করেছেন তিনি আব্দুল মতিন। ‘জেনেভায় বঙ্গবন্ধু বইটি প্রকাশ আগা তা যাত্রা শুরু, তারপর বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তিনি বহু বই লিখেছেন এবং প্রকাশ করেছেন। শেখ হাসিনার প্রথম জীবনীগ্রন্থ লেখার কৃতিত্বও তার। সম্প্রতি ভিয়েনার এক উদ্যোগী বাঙালি যুবক নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর ওপর বহু বিশিষ্ট লেখক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের রচনা সংগ্রহ করে দুই খণ্ডে এক বিশাল গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন নােবেল পরিয়েট অমর্ত্য সেন এবং লেখকদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে গত ত্রিশ বছরে যে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, গান-কবিতা বচিত হয়েছে, তার তালিকা প্রণয়ন আমার এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য, তাকে নিয়ে লেখা অতীত ও বর্তমানের কিছু বই, গান, ছবির কথা উল্লেখ করে তাঁর তেত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই একটি কথাই বলা যে, দানবের মৃঢ় অপব্যয় কখনাে ইতিহাসের শাশ্বত অধ্যায়কে মুছতে পারে না। দুখণ্ডে প্রকাশিত ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক মহাগ্রন্থটি তার সাম্প্রতিক প্রমাণ।
বঙ্গবন্ধু বেঁct থাকাকালেই অধ্যাপক ড. মজহারুল ইসলাম ওঁর একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তা ছিল অসম্পূর্ণ এবং তাতে কিছু তথ্যবিভ্রাট ছিল। এই বইটির সংশােধিত সংস্করণ প্রকাশ হওয়া প্রয়ােজন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে ভাসানী যখন ইউরােপে’ গ্রহের লেখক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস লিখেছিলেন সুবিশাল এক গ্রন্থ ‘মুজিববাদ’। আমেরিকায় বসবাসকারী ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রবার্ট পেইন ‘The torchired and the datened” নামে বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি উপন্যাস লিখেছেন। এসব বইয়ের পুনর্মুদ্রণ ও পুনঃপ্রকাশ প্রয়ােজন। দরকার রবার্ট পেইনের বইটির তরজমা বের হওয়া। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের কোনাে পুস্তক প্রকাশক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এই উদ্যোগ গ্রহণের এটাই সময়।
গ্রিক ট্র্যাজেডির হিরােদের মতােই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুহীন মহাজীবন। তিনি কালজয়ী মহাকাব্যের নায়ক। মহাকাব্যের যুগ আর নেই। তাই অসংখ্য খণ্ডকাব্য, গান, জীবনচিত্র, নাটক ও ছবির মধ্যদিয়ে এই মৃত্যুহীন মহাজীবনের নতুন উথান ঘটছে। পনেরাে আগস্ট সেজন্যই শুধু তাঁর প্রয়াণ দিবস নয়, তাঁর নতুন আবির্ভাব দিবসও।
একাত্তর ৭ মার্চ : বাঙালির স্বরূপে উচ্ছ্বাসের দিন
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম প্রস্তাবনায় নিবেদন যে, অতীব গুরুত্বের সঙ্গেই চিহ্নিত করে নেব কোটি বাঙালির জীবনে—বিশেষ করে আজ সাতই মার্চ এবং আন্তর বিশ্বাসে ধারণ করে নেব হাজার বছরের বাংলায় এই দিন উজ্জ্বলতম এক মাইলস্টোন। | এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে অবলােকন করছি—সন উনিশ শ’ একাত্তর, এসেছিল সেই দিন। সেদিনকার সাতই মার্চ-আগ্রাসী দুশমন কলােনিয়াল অপশক্তি পাকিস্তানিত্বের উৎখাতের নিশানায় রণাঙ্গনে লড়াইয়ের ডাক। তার পরের থেকে ইতিমধ্যে গড়িয়ে গেছে সাড়ে তিন দশকেরও বেশি। দেশের সম্মানুষ মাত্রেই অবশ্য জানা—সেই সাতই মার্চে অবধারিত নিয়তি কথা কয়েছিল কালের সন্তান মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে। ঢাকায় রমনার রেসকোর্স ময়দানে উপচেপড়া বিশাল জমায়েতে তার সে ডাক ছড়িয়ে গেল দেশের দূর-দূরান্তরে জনপদ অবধি সবখানেতে।
বছরে বছরে পাড়ি দিয়ে আবারাে আস্ত সাতই মার্চ। তবে নিশ্চয় নয় এ মােটা দাগের সংখ্যায় কোনাে এক তারিখ মাত্র এবং নয় নস্টালজিয়ায় অতিচারিতা-চর্বণ । অবকাশ এসেছে, অবশ্য করেই খেয়ালে আনতে চাইছি সেই সাতই মার্চ, আর সুস্থ উত্তরাধিকার চেতনার ধারাবাহিকতাতেই বাংলাদেশ-বাঙালি আমাদের সাতই মার্চ অনিবার্যতায় উত্তরণ। লক্ষ্য করতে বলি, বলা হচ্ছে এমন করে আমাদের ইতিহাসে ‘সাতই মার্চ’-অনিবার্যতা। সচেতন জন সন্ধান নেবেন অমন করেই। তাে আমাদের জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি’-অনিবার্যতা; এসেছে ছাব্বিশে মার্চ মােলই ডিসেম্বর। | দুই বাঙালিত্ব-আইডেনটিটির এবং বাঙালির একাত্তর মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী, “দেশমাত সত্য অবিশ্বাসী হিংস্র দালাল জোটের কথা নিশ্চয় করেই বাদ রাখব, কাল ব্যবধান বটে, আজো কিন্তু তেমনটাই সুস্পষ্ট শুনতে পাই, কী কথা কয় “দিবস’ সাতই মার্চ। অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতীকী কণ্ঠে দেশব্যাপী জনযুদ্ধের অমন মরণশপথ আহ্বান : ভায়েরা আমার,..প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। এবং এইসঙ্গে আরাে অমন দৃঢ়কঠিন চ্যালেঞ্জ : ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না ।… মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” | ইতিহাস সাক্ষ্য, অতঃপর আর অবশ্য অপেক্ষা করতে হয়নি। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সারাটা দেশজুড়ে দ্রুত লড়াইয়ের ময়দানে কোটি বাঙালি কেমন দ্রুত জীবনবাজি উৎসর্গ মন্ত্র কাতার বাধা; এবং দীক্ষামন্ত্রের আওয়াজ-বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’; ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’। এখন তাহলে বলবার—দেশপ্রেম-ঈমানে যার ব্রত সংকল্প, বারংবার করেই তার কাছে ফরজতুল্য হয়ে আসে ওই সাতই মার্চের ডাক। এবং সেইখানে জান, তাৎ মুক্তির সংগ্রাম, সর্বার্থেই স্বাধীনতার সংগ্রাম।
তিন, তবে গভীর বিধায় প্রশ্ন জাগে-এ কোনাে বাস্তবতার পটে এই বর্তমানে আমাদের বসবাস? জবাৰে যার যার নিত্যদিনের অভিজ্ঞতাতেই তাে জানান দিচ্ছে, চারদিক ছাপিয়ে কেমন বেজায় দুঃসময় আজ, অবক্ষয়ে অক্ষয়ে ভাঙনের ধস লেগেছে আমাদের সমুদয় শুভ মূল্যবােধে, মানুষে মানুষে প্রতারণা সীমাহীন অবিশ্বাস, মানসম্পদের নির্বাসন, সর্বত্র ছড়িয়ে ফ্রাস্ট্রেশনের পালা এবং গ্রাস করে নিয়েছে তৃণমূল অবধি জনমানুষের ঘরে-পরিবারে অভাব-বঞ্চনা-পারিদ্র্যের সর্বাত্মক হামলা। কী। বলব? ইতি নেই অভিশপ্ত হেন এই মতাে তালিকায়। আর কী যেন নিষ্ঠুর সত্য- সব ছাড়িয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে বাঙালি লক্ষ-কোটি মানুষের একাত্তর-অন, মার্চঅভিযান, সাতই মার্চের লড়াকু ডাক। | অতঃপর পুনরায় বলবার যে, উপরি বর্ণিত তাবৎ সত্ত্বেও আজকের এই দিনে আমাদের ওই সাতই মার্চ। ঘনি কবিতার চরণ থেকে ধার করে নিয়ে এমনতর বলা । ‘এসেছে সে একদিন/লক্ষ পানে শঙ্কা না মানে…’ আমাদের একাক্ত মার্চে সেই ইতিহাসের সূচনা-প্রহর। তবে অবশাই অকস্মাৎ ঘটে না কিন্তু এমন। পটভূমিতে বয়ে আসে ইতিহাসের ধারা। অতএব অতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করি, এই মতাে সন্ধানের তাগিদ- কেমন করে কোনাে সড়ক ধরে দিবস সাতই মার্চে আমাদের উত্তরণ। লক্ষ্য করব,-অবশ্যই নয় কাকতালীয় যােগাযােগঃ এই সেদিন গেল আমাদের ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি, দীক্ষা আমাদের একুশে’ সত্যে; আজ উদযাপন করছি মার্চ সাতই। প্রাণিত আমরা লাস্ট ফ্রন্টিয়ারে মুক্তির স্বাধীনতার সংগ্রামী মন্তে। এখন তবে সেই সড়ক। | চার, সৎ এবং সচেতন বিশ্বাসের সবারি জানা—ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নামের উপমহাদেশে একদা কায়েম হয় উদ্ভট অবয়বের সেই রাষ্ট্র পাকিস্তান। পৃষ্ঠপােষক মাতব্বর তারা প্রচার করতেন ‘Homeland of Indian Muslims”, প্রশ্ন আদপেই এবং সম্পূর্ণতই তাই কি? উন্মত্ততার তালে মাতা গগনবিদারী শ্লোগান ছিল ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। তা তদর্থে লড়াই কিন্তু মােটে করতে হয়নি। নেতা-কর্মী কারুকেই একবেলার জন্য হলেও ইংরাজ সরকারের জেলহাজত খাটতে হয়নি। আসলে পােড়াতে কাজ করে গেছে (দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তে। তখনকার সময়কার আন কার্যকারণহেতু, বশির্কী সাম্রাজ্যবার্দী ব্রিটিশ স্বাখলন্ডনে বসে ওদের পার্লামেন্টে প্রস্তাব গৃহীত হয় ‘Partition of India Act. 1947.’ 4 All Indian Muslim League All India Congress-46 রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভাগাভাগি, ক্ষমতার হস্তান্তর। আর তাই থেকে ওদের জন্য Indixারত/হিন্দুস্থান এবং আমাদের রাতে পাকিস্তান। | বলা গেছে উট সেই রাষ্ট্র। কেন কবে এমন হবে। বিশেষিত করা উট সহ জবাবে জেনে রাখতে চাইবদেশ যখন, প্রথমতই তখন ভৌগােলিক সংশ্লিষ্টরা। মােটে থাকবে না? বাসিন্দা মানুষে মানুষে মিল-সমন্বয়? বাস্তবতায় হয়েছিলটা কী? হাজার দেড় হাজার মাইলের দুস্তর দূরত্বে দুই ভূগোলাংশের দুটো অঞ্চল। এবং আবার এদিকটায় বলা হচ্ছে জাতীয় পরিচিতিতে পুবের-পশ্চিমের প্রান্তের সবাই মিলে এক জাতি পাকিস্তানি’। কিন্তু এই নয়া বানানাে পাকিন্তানিদের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক এথনিক বৈশিষ্ট্যে, ভাষা-সংস্কৃতি ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারে রয়ে গেছে বিশাল ব্যাপক ফারাক। হবে করাচি-লাহােৱ-পিক্তিকেন্দ্রিক সিংহাসনে প্রভুশকির তরফে প্রচারণা চালানাে হতাে “Five thousand years of Pakistan’, উচ্চকণ্ঠে সদা জানান দেওয়া হতাে ‘Pakistan has come to stay’ এবং শরা-শরিয়তের দোহাই পেড়ে তুঙ্গে সে কী জিগিরের বহরপাকিস্তান মানেই ইসলামি হুকুমং, ইসলামি উম্মাহ, ইসলামি কওম। তথাপি আমাদেরই সৱাসরি অতিকা-সেই জিপিৱেৱ অছিলাতে শাসক-শােষক পাকিকাম্বলাপের সর্বগ্রাসী আয় এসে পড়েছিল এই বাংলায়, এই বাংলার মানুষের ওপরে।
সদ্য ব্রিটিশ কলোনিয়াল প্রত্যক্ষত আগ্রাসনের অবসান ঘটেছে। অতঃপর এখন আরেক চেহারাতে পাকিস্তানিত্বেৰ আগাসন। এল ভাষা-দাসত্বর হামলা। এল পরভাষা। উঃ লেবাসে। সেই একই জিগির—উহার হরফ মূলে রয়েছে পবিত্র’ আৱৰি। অতএব ইসলামিয়াতের দেশের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। আসলে শাসকজােটের ভাষা ছিল উর্দু। ওদের শাসন-শােষণের স্বার্থেই ভাই উপনিবেশ বাংল-অঞ্চলের বালি জনমানুষের ওপরে উর্দুকে চালানাের যত অপপ্রয়াস। আর পাকি কায়েদে আজম তাে HD
fHufen, Urdu and Urdu alone shall be the State language of Pakistan.’ তবে মােকাবেলায় আমরাও কিন্তু প্রিলিরে বিভ্রান্ত হইনি: ফরমান মাথা পেতে নিইনি। আমাদের দিক থেকে প্রতিরোধ সেই প্রথম থেকেই। পাকিস্তান কায়েমের শুরু থেকেই লক্ষ্য করবার যে, আমাদের কিনানী-প্রতিরােধী। প্রত্যয় দানা বেঁধে উঠছে। অভিভাবক কাজী মােতাহার হােসেন এখন চুড়ান্ত করেই জানিয়ে দিচ্ছেন—’বর্তমানে যদি পায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চাপাবার চেষ্টা করা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।… শিগগিরই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বদ্ধের অবসান হওয়ার আশঙ্কা আছে। যুগপৎ অপর অভিভাবক , মুহম্মদ এনামুল হকের সতর্কবাণী=মােটের উপর বাংলাৰুে মাফিয়া উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে পূর্ব পাকিস্তানবাণী শহণ করিলে তাহাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মৃত্যু অনিবার্য। এবং সাথে যােগ দিচ্ছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তার উচ্চারণে আমাদের বাঙালিত্ব আইডেনটিটির মৌল সত্যটি—’আমরা বাঞ্চালি, এটি একটি বাস্তব কথা।
এখন চিহ্নিত করে নেব, সেই যাত্রা শুরু কাল থেকেই তাে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার নিয়ে, আর্থ-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির অভিযান নিয়ে এবং মাটির সন্তান স্বৰূপে বাঙ্গালি নিয়ে আমাদের যাত্রা কর পালা। কমে ওদের বঞ্চন যতই শক্ত হয়েছে, বাঙালিত্বে মুক্তির সড়কে দুঃসাহসী প্রতিরােধী আমাদের অভিযান ততই একাঠা কাতার-বাঁধা দুর্নিবার হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যে সন উনিশ শ’ বায়ান্ন, মাস ফেব্রুয়ারি এবং যেন অবশ্য করেই প্রতীকী ‘একুশে’। এখন বাতাস টুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গাে আর।’ | অতঃপর প্রস্তাব যে, চিহ্নিত করে যার একেক নিশানফলক, কথা কয় কাল সময়ের কণ্ঠ। চুন্নাতে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয়, সাতান্নতে টাঙ্গাইল কাগমারীতে সংস্কৃতি সম্মেলন, একাঠিতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন, বাষটিতে ছাত্রদের শিক্ষা-আন্দোলন, জয়শ্বঠিতে আর্থ ছয়দফা আন্দোলন, সাতটিতে আবারো নবীন্দ্রআন্দোলন এবং তার পরপরই তাে উনসত্তরে পাকিস্তানিত্বকে হটাবার নিশানায় সারাটা দেশজুড়ে অমন ঐতিহাসিক গণঅভূত্থান।
ইতিমধ্যে পৌছে গেছি আমরা সেই ইতিহাসধারার শেষপ্রান্তে-সামনেই সত্তরের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের ব্যানারে বাংলার জনমানুষের এক বিজয়। লক্ষ-কোটি কণ্ঠে ইমানের সেই মহত্তম উচ্চারণ দিকে দিকে উঠ বাজি’-তােমার দেশ আমার দেশবাংলাদেশ বাংলাদেশ”, ‘আমাদের সগ্রাম চলবেই চলবে।
বলাবাহুল্য, বর্তমান অবকাশে পটভূমি কথার কেবল অপরেখাটি তুলে ধরবার প্রয়াস খানিক পাওয়া গেছে। অবলােকন করতে চেয়েছি—কো সড়ক ধরে এগিয়ে আসছে বাঙালির একাত্তর, একাত্তরের মার্চ, কমে কেমন হয়ে উঠছে আমাদের ‘নেশন স্টেট’ বাংলাদেশ।
পেছন ফিরে ৭ মার্চ
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী একাত্তরের মার্চের মতাে ঘটনাবহুল মাস এদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার আট দশকব্যাপী জীবনে যে নেই, আমি হলফ করে বলতে পারি। পুরাে একটি মাস যার প্রতিটি দিন ছিল আশঙ্কা-উদ্বেগ প্রত্যাশায় ভরা। পুরাে একটি মাস যে সময় সমগ্র দেশ এক টানটান উত্তেজনায় শক্ত হয়ে বসেছিল। পুরাে একটি মাস যখন সারা দেশের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল একজন মানুষের ওপর, যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। | কী অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেদিন শেখ মুজিব, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তার নেতৃত্বে, তাঁর নির্দেশে যে অসহযােগ, এমন সফল অসহযােগ ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনের ইতিহাসেও নেই । মহাত্মা গান্ধীর সত্যাগ্রহ ছিল আদর্শগতভাবে অহিংস, তৰে শেষপর্যন্ত অহিংস থাকেনি। শেখ মুজিবের অসহযােগও ছিল আদর্শগতভাবে অহিংস, তৰে সহিংসতা রােধ করা যায়নি শেষপর্যন্ত। সৰ গণ-আন্দোলনের প্রকৃতি বােধহয় এই আন্দোলনের জোয়ারে সব নিয়মশৃখলা একপর্যায়ে ভেসে যায়। নেতৃত্ব তখন অসহায় দর্শকে পরিণত হয়।
সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের আহূত জনসভায় চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘােষণা করবেন বঙ্গবন্ধু। এভাবেই প্রচার হয়েছিল। ইতিমধ্যে অসহাযােগের সাফল্য সারা দেশ দেখেছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণায় (১ মার্চ) সারা দেশ ছিল ক্ষুব্ধ, স্তঙ্কিত। একদিকে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌছে যাওয়া অসংখ্য কর্মীর প্রত্যাশা, অন্যদিকে কেন্দ্রের সঙ্গে সংলাপের বাধ্যবাধকতা। সেখানে কোনাে ভুল পদক্ষেপের ফাদে না-পড়া। এমন এক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে ঠান্তা মাথায় ঠিক করতে হয়েছিল রেসকোর্সের জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কী বলবেন, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার কী নির্দেশনা দেবেন। অনেকের আশা ছিল, তিনি এই মুহতকেই বেছে নেবেন স্বাধীনতার ঘােষণার জন্য। চাপও ছিল। কিন্তু তিনি সে ভুল করেননি। স্বাধীনতার ঘােষণা দেননি। তবে আইন রক্ষা করে তার যত কাছে যাওয়া সম্ভব, তা-ই করেছিলেন। গান্ধীজির কুইট হভিয়া আহবানের সঙ্গে এখানেই তফাৎ এই আহ্বানের। গান্ধীজি দেশবাসীকে উদ্দেশ করে কিছু বলেননি, যা বলার বলেছেন প্রতিপক্ষকে। বঙ্গবন্ধু এই বক্তৃতায় একই সঙ্গে প্রতিপক্ষকে হুঁশিয়ার করেছেন ও দেশবাসীকে বলেছেন প্রস্তুত থাকতে। এবং স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, যুক্তির কথায় কাজ হবে না। অস্ত্রের ভাষাতেই যা বলার বলতে হবে। তিনি জনতার প্রতিরােধের শক্তিতে আস্থা রেখেছেন। এবং চূড়ান্ত জয়ের প্রশ্নে কোনাে অস্পষ্টতা রাখেননি। | ইতিপূর্বে কোনাে এক লেখায় আমি বলেছি, সাতই মার্চের ঘােষণাকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা গণ্য করা যায় না। না, তা করা যায় না। ওই ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার প্রতিটি বাক্য সতর্কভাবে উচ্চারিত। ওই বক্তৃতায় স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না। তবে স্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষ প্রস্তুত, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুত, সেই কথাটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং এটা মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। একমাত্র সে বিবেচনাতেই ওই দিনকে দেশের স্বাধীনতা দিবস গণ্য করা যায় । ছাব্বিশে মার্চ নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু সাতই মার্ট নিয়ে কোনাে বিতর্ক নেই। কোনাে অস্পষ্টতা নেই। | একাত্তরের প্রবাসী সরকার বিভিন্ন বিবেচনায় ছাব্বিশে মার্চকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের স্বীকৃতি দিয়েছে। সাতই মার্চ এর ফলে তার গুরুত্ব হারায়নি। এর গুরুত্বের ভিত্তিও খুব মজবুত। সেদিন এক জনসমুদ্রের সামনে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে সেটা অতুলনীয়, অদ্বিতীয়। এর তুলনা খুঁজতে হলে দেশের ইতিহাসের বাইরে যেতে হবে। সাতই মার্চের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর মুখে উচ্চারিত প্রত্যয়কে চেতনায় ধারণ করে বাঙালি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়েছে ও জয়ী হয়েছে।
এই বক্তৃতায়, আগামী মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামে তার সম্ভাব্য অনুপস্থিতির কথাও বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি…।’ ২৫ মার্চে দিনগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিলেন বঙ্গবন্ধু। এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা। বলেছে। সাতই মার্চের ওই একটি বাক্যের মধ্যেই স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। ২৫ মার্চের রাতের এই আত্মসমর্পণ” আগে থেকেই তার মাথায় ছিল। ওই রাতে কী ঘটেছে বা কী ঘটতে যাচ্ছ, তিনি জানতেন। রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথি সবাইকে আত্মরক্ষার পরামর্শ দিয়ে নিজে আত্বসমর্পণ, কোনাে সিদ্ধান্তহীনতার বিষয় নয় বরং একটা সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। তর্ক চলতে পারে। সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল কি ছিল না, তবে এটা যে দুর্বলের আত্মসমর্পণ নয়, আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান এক নেতার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, এ নিয়ে সন্দেহ নেই।
এই আত্মপ্রত্যয়—এটা কী ধরনের আত্মপ্রত্যয়? এ এক নেতার আত্মপ্রত্যয়, যিনি একটি জাতির আকাঙ্ক্ষাকে ভাষা দিয়েছেন এবং যিনি একটি উজ্জীবিত জাতির হৃৎস্পন্দনকে কাছে থেকে শুনেছেন। যার ডাকে লাখাে মানুষ জাদুমন্ত্রে জড়ো হয়। রেসকোর্সের ময়দানে। তিনি জানেন, তার আসল কাজ তিনি করে ফেলেছেন। জাতিকে একটি চেতনায়, একটি আকাক্ষায় তিনি একতাবদ্ধ করেছেন। এ জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা কেউ ঠেকাতে পারবে না এবং পশুশক্তির কাছে পরাজিত হবে না এ জাতি। তার এই হিসাবটা যে কত সঠিক ছিল, পরবর্তী নয় মাসের ঘটনাবলি তা-ই প্রমাণ করেছে। আমি যদি না-ও থাকি’—কথাটার তাৎপর্য গঞ্জীর। তার থাকা নাথাকাটার তাৎপর্য গভীর। তাঁর থাকা না-থাকা এরপর আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। তিনি না থাকলেও তার জাতি এগিয়ে যাবে, যার শক্তির ভাণ্ডার তিনি সৃষ্টি করেছেন ও প্রত্যক্ষ করেছেন। যে ঐক্যের বাধনে তিনি সেই দুর্দিনে জাতিকে বেঁধেছিলেন, সেই একই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবলই অস্ত্রের লড়াই ছিল না, ছিল এক মনস্তত্বের লড়াই। এ লড়াইয়ে জয়ের অমােঘ অন্ত্রটি বঙ্গবন্ধু তার স্বদেশবাসীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্বের উত্থান-পর্বের শেষ শীর্ষবিন্দু এই সাতই মার্চের ভাষণ। স্বাধীনতা-উত্তর পর্বটি নিয়ে নানা মত আছে। সে এক ন্নি প্রসঙ্গ। পরিস্থিতিভেদে নেতৃত্বের প্রকৃতিও বদলায়। জাতির উত্থান-পর্বের বা গভীর সংকটে প্রয়ােজন যে নেতৃত্বে, প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনের পর যে ভিন্ন চাহিদা, সে চাহিদা প্রায়শই উত্থান-পর্বের নায়ক পূরণ করতে পারেন না—সেজন্য প্রয়ােজন হয় ভিন্নতর মেধার, ভিন্নতর প্রতিভার । দুই ভিন্ন প্রতিভার সমাবেশ একই ব্যক্তির মধ্যে, এক বিরল ঘটনা। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মধ্যে, মাও সেতুংয়ের মধ্যে, হে চিমিনের মধ্যেও সম্ভবত এটা ঘটেছিল। সব তথ্য আমার জানা নেই। | পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু নিহত না হলে, দেশকে তিনি কী উপায়ে কোন্ পথে পরিচালিত করতেন, সেই ভিন্ন ধরনের নেতৃত্বের পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতেন কি হতেন না—সে আলােচনা আজ একেবারেই অনাবশ্যক। যে কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা তিনি মনে মনে এঁকেছিলেন, তা নিমেষেই মুছে গিয়েছিল এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে মঞ্চে দেখা দিয়েছিল তাঁর হত্যায় যারা রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এলেন, সেই নতুন
নতুন নেতৃত্বের বড় দুর্বলতা ছিল, এটা কোনােভাবেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না, রাজনীতির চর্চার পথে এ নেতৃত্ব ছিল না, রাজনীতির চর্চার পথে এ নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। পঁচাত্তর থেকে নলই, ১৫ বছর কাল বাংলাদেশ এই মেকি ও আরােপিত নেতৃত্বশাসিত। হয়েছে এবং যত দিন গিয়েছে, প্রকৃত রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে এর চরিত্রগত তফাৎ ততই স্পষ্ট হয়েছে। এবং দেশের দুর্ভাগ্য, এ নেতৃত্ব নব্বইয়ের গণ-অভুথানের পরপর আপাতদৃষ্টিতে বিদায় নিলেও এ এক মারাত্মক উত্তরাধিকার রেখে গেছে। সে হল সন্ত্রাস ও দুর্নীতির উত্তরাধিকার। গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠানকে ভেতর থেকে নষ্ট করে রেখে যাওয়ার উত্তরাধিকার। গণতন্ত্রের সেই ভাণ্ডাঘর আবার খাড়া করতে পারেনি পর পর তিনটি নির্বাচিত সরকার। এমনকি মেরামতের কাজ হাত নেবে, সে ইচ্ছাটি পর্যন্ত দেখাতে পারেনি নামসর্বস্ব নির্বাচিত সরকার। স্বৈরতন্ত্র বিদায় নিয়েছে, কিন্তু গণতয় সে শূন্যতা পূরণ করেনি।
স্বৈরাচারের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের বা ব্যবস্থার একটি হল সংসদ ও সংসদীয় নির্বাচন। গণতন্ত্রের চাকা সচল রাখে নিয়মিত ও সুষ্ঠু নির্বাচন। স্বৈরতন্ত্র সবচেয়ে বেশি ভয় পায় নির্বাচনকে। আমরা গণতন্ত্রের মুখােশধারী রাজনৈতিক সরকারও দেখেছি, যারা বিদায়ী স্বৈরতন্ত্রের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার বহন করেছে ও নির্বাচনকে নানা কৌশলে প্রভাবিত করতে চেয়েছে। আমলাগােষ্ঠীর মাথায় লাঠি ঘুরিয়েছে। বিচারব্যবস্থাকে ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্বল করেছে। কোনাে ক্ষেত্রেই স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা রক্ষা করেনি। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে মাটি চাপা দিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সব কর্মকাণ্ড পরিচালনার মধ্যে নিজেদের ক্ষমতার নিরাপত্তা খুঁজেছে।
পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ফলে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ তার স্বপরিচয়ে স্থিত হতে পারেনি। একাত্তরের সাতই মার্চ আর আজকের সাতই মার্চের মধ্যে ৩৮ বছরের ব্যবধান। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আবার স্বাধীনতার সারবস্তু হারিয়েছে, স্বাধীনতার খােলস নিয়ে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছে। জরুরি অবস্থার মতো একটি আলাে-আঁধারির জগতে ঠেলে দিয়েছে দেশকে। বঙ্গবন্ধু এক অসামান্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু নেতৃত্বের উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেননি। সেজন্য তাঁকে দায়ী। করা যায় না। একাত্তরের সাতই মার্চে তিনি যে উচ্চতায় উঠেছিলেন, কৃতজ্ঞ জাতি আজ সে-কথাই স্মরণ করবে তাকে তার প্রাপ্য সম্মান জানাতে কুণ্ঠা করবে না।
প্রথম আলাে ৭ মার্চ ২০০৮
জয়তু বঙ্গবন্ধু, জয়তু বাংলাদেশ
সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ
“Great Caesar fell, O, what a fall was there, my countrymen. Then I and
you, and all of us feel down whilst bloody treason flourished over us. রােম সম্রাট জুলিয়াস সিজারকে তারই বন্ধু ব্রটাস গংরা হত্যা করে চলে যাওয়ার পর মার্ক অ্যান্টনি তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে উপরের কথা বলেছিলেন। তিনি বিরাট এক ভাষণ দিয়েছিলেন, যে ভাষণে রােমবাসীর চৈতন্য ফিরে আসে। তারা ক্ষুব্ধ হয়ে সিজারের হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে হত্যা করে। ক্রটাস অবস্থা বুঝে আত্মহত্যা করে। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা কোনাে মার্ক অ্যান্টনিকে পাইনি ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভয়াল দিবসে যখন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি সপরিবারে নিহত হন। এর কারণটা খুব পরিষ্কার। সিজারের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধ ষড়যন্ত্র রােম নগরীতে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পেছনে ছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পেল, অথচ স্বীকৃতি পেল না গণচীন এবং সৌদি আরবের। তারা বঙ্গবন্ধুর রক্তে সিক্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। বেশ কিছুদিন আগে ভুট্টো-তনয়া বেনজির এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তার বাবা শেষরাতেই জানতে পারেন যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এতে তারা নাকি দুঃখ পেয়েছিলেন। ঢাকার মানুষ জানতে পারে অনেক বেলায়।
আমি সেদিন ঢাকায়। সকালে উঠে বকশিবাজার থেকে মােহম্মদপুর যাওয়ার পথে ধানমণ্ডি ৮ নম্বর সড়কে পৌঁছার পর ঘটনা জানতে পারি। সেদিন শুধু বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন না, সেইসঙ্গে নিহত হল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে সংবিধানে যেসব পরিবর্তন আনা হয়, যেমন আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস, সামাজিক ন্যায়বিচার, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম—যেসব এজেন্ডা ছিল বঙ্গবন্ধুহত্যাকারীদের, ধীরে ধীরে যেসব কার্যকর করা হয়। আল্লাহর ওপর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসের কি অভাব ছিল? ‘৭১-এর ৭ মার্চ লাখাে জনতার সামনে ভাষণের একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এদেশের মানুষেকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। সৌদি আরবের সরকারি নাম কিংডম অফ সাউদি আরাবিয়া। এর অর্থ কি এই যে এটি মুসলিম রাষ্ট্র নয়? বরঞ্চ সৌদি আরব তাে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পর বাংলাদেশ বেতার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ, অর্থাৎ রেডিও পাকিস্তানের মামাতাে ভাই। সদ্য শপথ নেয়া জাতীয় বেইমান খন্দকার মােশতাক হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট মােশতাক। কয়েকদিন পর মুজিবনগর থেকে কর্মরত ক্যাবিনেট সচিব এইচ টি ইমামকে সরিয়ে সফিউল আযমকে সেখানে নিয়ােগ দেয়া হয়। তিনি এসে যে কাজটি করলেন, তা হল ‘৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর থেকে ‘৭৫-এর ১৪ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার যত্ন নিয়ােগ ও পদোন্নতি দিয়েছে যেসব পর্যালোচনা। এ মর্মে তিনি নির্দেশ জারি করেন। বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর ঢাকায় সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তৎকালীন সরকার একটি নির্দেশ দিয়েছিল যে “৭১-এর ১৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর ‘৭১ পর্যন্ত যত নিয়োগ ও পদায়ন হয়েছে সেসব পর্যালোচনা করে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কেননা সেসময় বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। সফিউল আযম এই যুদ্ধকে সমর্থন করেননি, তার চোখে বঙ্গবন্ধুর সরকার অবৈধ ছিল বলেই তিনি এই আদেশ দিতে পেরেছিলেন। | এরপর একদিকে শুরু হল ইতিহাসবিকৃতি, অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধে নায়কের ভূমিকা দাবি করে অনেক খলনায়কের আবির্ভাব। আমি মরহুম বিচারপতি এস এম হােসেনের কথা আবার উল্লেখ করতে চাই। তিনি স্বাধীনতা দিবস উৎযাপন উপলক্ষে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন—অবস্থাদৃষ্টে আজ মনে হচ্ছে যে মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কোনাে ভূমিকা নেই, কোনাে এক মেজরের ঘােষণায় স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। অথচ ২৬ মার্চ ‘৭১-এ সন্ধ্যার পর পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদানকালে একটি লােককে দোষারােপ করে বলেছিলেন—এবার তাকে শাস্তি পেতে হবে। তিনি বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সেই ব্যক্তিটি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। | ইতিহাসবিকৃতি কোন্ পর্যায়ে গেছে তার একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘৭৮ সালে বিজয় দিবসের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘৭১-এর ২৭ মার্চ জাতিকে উদাত্ত আহ্বান জানানাের সুযােগ হয়েছিল তার। এই ভাষণের অনুলিপি এখনাে তথ্য মন্ত্রণালয়ের আর্কাইভে থাকার কথা। এ ছাড়া বাংলা একাডেমী কিংবা ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভারের অফিসে সেই তারিখের পত্রিকার অনুলিপি পাওয়া যাবে। অথচ একাধিক উপাচার্য-সংবলিত কমিটি রায় দিল যে জিয়াউর রহমান সাহেব ২৬ মার্চ ‘৭১-এ এই ভাষণ অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন। এ বিকৃতিকে কী বলা যেতে পারে? আমার এক বন্ধু ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে—এবার যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসত, তাহলে বিএনপি ঘরানার এইসব উপাচার্য-বুদ্ধিজীবীরা রায় দিয়ে বলতেন যে কার্জন হল বিএনপির আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর বাংলাদেশ সরকারের ইতিহাসে সেইভাবে লিপিবদ্ধ হতাে যেমনটি পূর্বে লেখা হয়েছে। সম্মানিত পাঠক, তাদের নেতা নিজে যে তারিখের কথা বলেছেন, তার পরিবর্তন যারা করেন, তারা দিবালােকে ডাকাতি করার চেয়েও বড় ডাকাতি করার নায়ক, একথা বললে কি অন্যায় হবে? | আরেকটি অদ্ভুত কথা আমরা শুনি, তা হল : স্বাধীনতার ঘােষক। জনগণের অনুমােদন ছাড়া কোনাে ঘােষণা আসতে পারে না। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি এরকম ঘােষণা দিতে পাবেন। তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বহু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’, একথাটা প্রথম তিনি বললেন ৭ মার্চ ‘৭১-এ ঐতিহাসিক সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার সেই কাব্যিক ভাষণে। কেন বলেছিলেন। ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে জনগণ তাকে নিরঙ্কুশভাবে ভোট দিয়ে এই বার্তাই দিয়েছেন যে ছয়দফা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত করতে হবে। এখান থেকে সরে আসার ক্ষমতা জনগণ দেননি। এরপর এর প্রমাণ, পরবর্তী সময়ে জনগণের বঙ্গবন্ধুর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন। মার্চ ‘৭১-এ জেনারেল ইয়াহিয়া যখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পেছানাের ঘােষণা দেন, তখন বাংলার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসেন। কস্তুত ১ মার্চ ‘৭১-এ বাংলার জনগণ জানিয়ে দিয়েছেন যে তারা আর পাকিজানের সঙ্গে নেই। বাঙালিরা ক্রিকেট পাগল। সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা চলছিল ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান। দর্শকরা টেডিয়াম ছেড়ে প্রতিবাদ করতে করতে বেরিয়ে আসেন। খেলা বন্ধ হয়ে যায়। | আবার ফিরে আসি ‘৭৫-এর সেই ভয়াল দিনের কথায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশবিরােধী ব্যক্তি অর্থাৎ জামাত এবং মুসলিম লীগের লােকদের মনে এরকম ধারণা জনে গেল যে আবার পাকিস্তানের চিন্তাচেতনায় ফিরে এসেছে বাংলাদেশ। অনেক সময় অনেক ছোটখাটো ঘটনা দিয়ে অনেক কিছু বােঝা যায়। ‘৭৫-এ আমি বগুড়ায় সৱকারি চাকরিতে। সেসময় এক আওয়ামী লীগের সাংসদের সঙ্গে সবসময় একজন ইউপি চেয়ারম্যান ঘুরতেন। বয়স্ক লােক সবসময় সালা পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। মাথায় সাধারণ টুপি। ‘৭১-এ আমি যখন পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটে, তখন এই চেয়ারম্যান সম্পর্কে শুনেছি যে তিনি শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে খুব তৎপর পাকিস্তানিদের পক্ষে। স্বাধীনতার পর কীভাবে তিনি সাংসদ সাহেবের সঙ্গে দফারফা করলেন তা জানি না। তবে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তাকে যখন প্রথম বা কালেক্টরেট ভবনে দেখি, তখন তার পরনে শেরওয়ানি এবং মাথায় জিন্নাহ টুপি।
এ প্রসঙ্গে আরাে একটি কথা বলা প্রয়ােজন। অনেকে বলে থাকেন বাকশাল করার জন্য বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। বাকশাল পদ্ধতি চালু হওয়ার কথা ছিল ‘৭৫-এর ১ সেপ্টেম্বর থেকে। একটি ব্যবস্থা চালু হয়ে কিছুদিন গেলে তবে তার ভালােমন্দ বিচার কৱাৱ অৰকাশ থাকে। বাকশাল পদ্ধতিতে গ্রাম সমবায়, থানায় নির্বাচিত প্রশাসক এবং জেলায় গভর্নর নিয়ােগের/নির্বাচনের ব্যবস্থা ছিল। নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং সরকারি
কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত কমিটি দ্বারা প্রশাসন চালানাের কথা। লক্ষণীয় যে জিয়া এবং এরশাদ উভয়েই বিক্ষিপ্তভাবে বাকশালের কিছু ধ্যান-ধারণাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে সব কথার শেষ কথা : বাকশালের সমালােচনা করাটা অপরিপক্ক ও অর্বাচীন কাজ।
ইতিহাসবিকৃতিকারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই যে । আপনারা তাে অনেক জ্ঞানী। অনেক কিছু জানেন। মাখন খাওয়ার জন্য নাহয় এসব অপকর্ম করছেন। আপনারা জানেন যে নবাব সিরাজউদ্দৌলার চরিত্র হননের জন্য ইংরেজরা কত কিছু করেছে। অন্ধকূপের কাহিনী, হলওয়েল মনুমেন্ট, কত উপাখ্যান! তারপরেও বাংলার মানুষের হৃদয়ে তার কী অবস্থান, তা আর ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়ােজন নেই। আর এখন তাে অতি উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। কিছুদিনের জন্য ভুল তথ্য দিয়ে কিছু লােককে বােকা বানানাে যায়, চিরদিনের জন্য নয়। আর আমাদের দেশে সরকারি তথ্য লােকে কীভাবে গ্রহণ করে, তা আমরা সবাই জানি। আজ পর্যন্ত পাকিস্তান থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে যত বই লেখা হয়েছে, সেসবের পাতা উল্টিয়ে দেখলে বােঝা যাবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যমণি কে? হ্যা, এক এক লেখক এক এক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লিখেছেন। যেমন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ বলেছেন যে, মুজিবের উচিত ছিল প্রাদেশিকতার পণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা করা। বঙ্গবন্ধুর কাছে ছয়দফার অখণ্ডতা ছিল বড়। এটি বাঙালির ম্যাগনাকার্ট। অখণ্ড পাকিস্তানের অন্যতম বাঙালি ভক্ত ড, জি ডাৱ চৌধুরীও দোষারােপ করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। তিনিও বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করেছেন পাকিস্তান ভাঙার জন্য।
কিছুদিন আগে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের রোজনামচা পড়লাম। এটা পড়ে বােঝা যায় যে অলােক ম্যাগনাকার্টা এবং নার্সিসিস্ট। তার রােজনামচায় বহুবার বঙ্গবন্ধু নাম এসেছে। বলাবাহুল্য কটুক্তি রয়েছে তাৱ সম্পর্কে। অবশ্য খুব কম লােক সম্পর্কে তার ভালাে মন্তব্য রয়েছে। এমনকি যার তার জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তাদের সম্পর্কেও তাঁর নির্দয় এবং বিরূপ মন্তব্য। সেই ফিল্ড মার্শাল সাহেবও এক জায়গায় স্বীকার করেছেন যে, শেখ মুজিব বাস্তালির অবিসংবাদিত নেতা। গােপন প্রতিবেদনে তাকে জানানাে হয় যে পূর্বপাকিস্তানে মুজিবের সমর্থন শতকরা ৬০ ভাগ এবং ভাসানীর শতকরা ৩০ ভাগ। আইয়ুবের রােজনামচায় আরাে একটি বিষয় পাওয়া যায়। তা হল বাঙালিদের স্বার্থের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু আপোষহীন এবং অদমনীয়। তাই বলছিলাম, পাকিস্তানি লেখকরা যেভাবেই বিষয়ের ব্যাখ্যা করুন না কেন, ঘুরেফিরে বঙ্গবন্ধুরই নাম। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কে মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু বা kingpin।
কাক নাকি এই মনে করে চোখ বন্ধ করে বিষ্ঠা খায় যে অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না। এরকম ধ্যানধারণা নিয়ে ইতিহাসবিকৃতির প্রচেষ্টা চালালে বলার কিছু নেই। ইতিহাস খুব নিষ্ঠুর । কাউকে ছাড়ে না। কালের বিবর্তনে যার যে স্থান, তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া যায়। যারা এইসব বিকৃতির চেষ্টা করছেন, তারা একটু বাইরের দিকে চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করুন। বিভিন্ন এনসাইক্লোপেডিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ শতকের যে বিশ্বইিতিহাস বেরিয়েছে সেসবের পাতা উল্টিয়ে দেখুন। পাকিস্তানের বিভিন্ন জেনারেল এবং লেখকদের কথা তাে আগেই বলেছি। তবে এও জানি যে দ্বারা। বাংলাদেশের অভূদয়কে মেনে নিতে পারেননি অথচ আজ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে বড় আর্থিক-রাজনীতিক সুবিধা ভোগ করছেন, তারপরও তারা বঙ্গবন্ধুকে মেনে নেননি বা নিচ্ছেন না; তারা সবসময় বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য বিভিন্ন নােৱা চেষ্টা চালাবেন। এতে কিছু এসে যায় না। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমরা শুধু বলব । জয়তু বঙ্গবন্ধু, জয়তু বাংলাদেশ।
ভোরের কাগজ ১১ আগস্ট ২০০৭
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ : একটি বৈশ্বিক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ
সেলিম ওমরাও খান
প্রখ্যাত মার্কিনি জীবনীকার বিল এডলারের মতে ‘Nothing describes a person better than his won words.’ এর মর্মার্থ হল : একজন মহান ব্যক্তির জীবন ও রাজনৈতিক দর্শন অন্য কেউ বর্ণনা করার চেয়ে তার নিজস্ব বক্তব্যই তার দর্শনকে বুঝতে যথার্থ ভূমিকা রাখে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশাল কর্মময় রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক দর্শনকে বুঝতে মহান নেতার ভাষণ ও বক্তব্য সমকালীন বিশ্ব-ঐতিহাসিক বাস্তবতার বিচার-বিশ্লেষণ তাই জরুরি হয়ে পড়ে। জরুরি এ-কারণেই, কোনও কোনও জাতির ইতিহাসে এমন এক অভ্যন্ত রীণ বিপর্যয় উপস্থিত হয় যখন তার ঐতিহালব্ধ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের মন্দীভূত স্রোতে প্রবল আড়ােলন জাগে, আবৰ্ত সৃষ্টি হয়। এরপর জেগে ওঠে নতুন রাজনৈতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বৃহত্তর পললভূমি। আবার কখনও কখনও তা দেশের অভ্যন্তরে প্রবল আলােড়ন সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয় না, সীমান্ত অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়ে তা দূর দূর দেশে। বঙ্গবন্ধুর চিরী রাজনৈতিক দর্শন-সমৃদ্ধ ভাষণ কোথাও নিপীড়িত জাতিগুলাের মুক্তিসংগ্রামে, কোথাও সমাজদর্শনে, কোথাও সংস্কৃতি শিল্পে, কোথাও বা গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এখনও অমলিন। হয়তাে কখনই তার প্রেরণা অবসিত হবে না।
বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস হাজার বছরের। খরস্রোতা পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা তথা গঙ্গোত্রী অববাহিকায় বসবাসরত বাঙালি জনগােষ্ঠী হাজার বছর ধরে বিদেশী শাসন ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহে সােচ্চার হলেও এর কোনাে সঠিক রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহানের বিশিষ্টতা ছিল এখানেই। তিনি পরিপূর্ণ রাজনীতিক দর্শনের উন্মেষ ঘটিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে হাজার বছরের শােষণ ও বঞ্চনায় ক্ষতবিক্ষত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক দর্শনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। রাজনৈতিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গভীর দর্শনসমৃদ্ধ ভাষণ ও বক্তব্যে এ মহান বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতার রাজনৈতিক বিশ্বাস, আশা-আকাক্ষা, শঙ্কা এবং তার স্বপ্ন প্রতিফলিত হয়েছে। স্বপ্ন সংগ্রাম ছিল শত শত বছরে বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তির আকাক্ষা যা তারা বিভিন্ন সময় উপলখি করেছে কিন্তু তা বাস্তবায়নের সঠিক কোনাে দিকনির্দেশনা পায়নি।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, উনিশ শক্তকে বাংলার জনগণকে তিন ধরনের নিশীনের মুখােমুখি হতে হয়েছে। এগুলাে হল । ক, অর্থনৈতিক, খ, রাজনৈতিক এবং গ, সাম্প্রদায়িক পীড়ন। এসব শােষণ, পীড়ন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রবল গণসন্তোষ বারবার আত্মপ্রকাশ করেছে। কখনও তা অঞ্চলবিশেতে সীমাবদ্ধ থেকেছে, আবার কখনও তা দেশব্যাপী নিষ্কৃতি লাভ করেছে। এ ধরনের অগণিত গণঅসন্তোষগুলাের মধ্যে নিশ শতকের উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হল : ১. তিতুমিরের নেতৃত্বে বারাসাত বিদ্রোহ; ২, হাজি শরীয়তুল্লাহ ও তার পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন; ৩. ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ; ৪, ১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম |১৮৫৯ সালে নিউইয়র্ক ট্রিবিউন পত্রিকায় তৎকালীন ভারতবর্ষের পর প্রকাশিত নিবন্ধের মন্তব্যে একে ভারতের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধ বলা হয় যদিও ইংরেজ ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে সিপাহী বিদ্রোহ হিসেবে গণ্য করেন ॥]; ৫, বাংলার পূর্বাঞ্চলে কৃষকরা শমসের গাঞ্জীর নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহঃ ৬, ১৮৬০ সালের নীলবিদ্রোহ এবং ৭, ১৮৭৩ সালে পাবনায় এজাবিদ্রোহ।
এগুলাের মধ্যে তিনটি বিদ্রোহকে আমরা রাজনৈকি বিদ্রোহ বলতে পারি যা ইংরেজশাসন অবসানের লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছিল। আর বাকিগুলাে ছিল আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শােষণের বিরুদ্ধে যা নেতৃস্থানীয় কােনাে ব্যক্তি কখনও কখনও অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে জনগণকে উদ্ভুদ্ধ করেছিল। এগুলো ছিল খঞ্চিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব। সমন্বিত ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাহীনতার কারণে বালির জাৰ্তীয় ও অর্থনৈতিক মুক্তিসংগমে কোনও একক নেতৃত্বের আৰিৰ ঘটেনি। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন হাজার বছরের মধ্যে বালির ধারাবাহিক নেত্বে অপূর্ণকার মাঝে পূর্ণতার প্রতীক, যিনি বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে দিকনির্দেশনামূলক রাজনৈতিক দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন। মুক্তিসংগ্রামে তিনি বাঙালি জনগােষ্ঠীর সব মত, পথ, বর্ণ-গােত্র, ধর্ম ও সবশ্রেণী পেশার মানুষকে তার কাক্ষিত মুক্তির পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানেই তার বিশিষ্টতা। এজন্যই তিনি বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা। চিন্তা, চেতনা, জীবনাচরণ এবং সর্বোপরি আপাদমস্তক তিনি ছিলেন বাঙালির মুক্তিপ্রতীক।
বাঙ্গালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মুক্তির কথা ষ্টার ভাষণ ও বক্তব্যে বাবার এসেছে নতুন ধারায় ব্যঞ্জনায় ও দোয়। এজন্যই শেখ মুজিবুর রহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্কালি। ইতিহাসের নয়া চিন্তার (Sehcxol of new thoughs) প্রবক্তাদের মতে, বাঙালির জাতিরাষ্ট্র গঠনের আকাক্ষা শত শত বছরের হলেও বাঙালি জাতির সামনে এর কোনাে সংহত দিকদর্শন কোনােকালেই উপস্থাপিত হয়নি। একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক দিকদর্শন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সমাজে বিরাজমান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক মতবাদের বৈপরীত্যের সমন্বয় ঘটিয়ে সমাজে ধনী, গরিবসহ সৰ মত ও পথের মানুষকে তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত করেন। রাষ্ট্রের প্রচলিত কাঠামাের মধ্যেই ১৯৭১-এর মার্চের অসহযােগ আন্দোলনকালীন একপর্যায়ে ধারাবাহিক ৩২টি নির্দেশনার (Directives) মাধ্যমে তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপনিবেশ থেকে পূর্ববাংলাকে মূলত স্বাধীন ও পৃথক করে ফেলেন যা আজও বিশ্বের জাতীয় মুক্তির ইতিহাসে অনন্যসাধারণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু নির্গোষ কণ্ঠে ডাক দেন স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের। বাঙালি জাতির ইতিহাসে এই প্রথম প্রতিনিধিত্বমূলক একক নেতৃত্বে উদ্বেলিত জনসমুদ্র স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় ঘােষিত স্লোগানের আদলে ঘােষণা করল । Ordinay people are extraordinary-ইনসাধারণ, অসাধারণ। স্প্যানিশ সিভিল ওয়্যারের মহাকাব্যিক ঐতিহাসিক হাগ থামসের ভাষায় ; তিনি সাৱাৰিশকে জানালেন, with people in thousands target=হাজারাে ঝায় জনতার মাঝে তিনি বুঝিয়ে দিলেন বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে জনগণই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর। পশ্চিম পাকিস্তানি উপনিবেশ ও স্বৈরতা উচ্ছেদের পূর্ণ অধিকার। আছে বাঙালি জাতির। শত শত বছরের মধ্যে তার অমর কালজয়ী ভাষণসমূহ সমগ্র বাঙালি জনগােষ্ঠীকে জাতীয় মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছে। অবশেষে পাকিস্তানি নয়া ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সবচেয়ে চূড়ান্ত পদ্ধতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা ও একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান এবং নেতৃত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বাপ্নিক জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ। | মহান নেতার মুখনিঃসৃত বাণী, বক্তব্য ও মন্ত্রমুগ্ধ ভাষণ বাঙলি জাতিকে জাগ্রত করেছে এবং জাতি হয়েছে ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর এ অসাধারণ প্রজ্ঞাময় ও সম্মােহিত ভাষণ সম্পর্কে ১৯৭১-এর ৫ এপ্রিল বিশ্বখ্যাত সংবাদ সাময়িকী নিউজউইকের মূল্যায়ন ছিল। Mujib can attract a crowd of a million people to his rallies and hold them spell bound with great rolling waves of emotional rhetoric. বঙ্গবন্ধুর এসব অগণিত মুর্তী যুক্তিনির্ভর রাজনৈতিক ভাষণ, বক্তব্য ও রাজনৈতিক দর্শন সারাবিশ্বের কোটি কোটি নির্যাতিত জনগােষ্ঠী, বিশেষ করে আফ্রো-এশীয় ও লাতিন আমেরিকার নিপীড়িত জাতিসমূহের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক দর্শনে বুঝাতে চেয়েছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনের জোয়াল ছুড়ে ফেলা যেতে পরে সর্বোপরি তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, তাদের রাজনৈতিক ভাবাদর্শগত সংগ্রামের মাধ্যমে। এ সংগ্রাম সংগঠিত করার জন্য দরকার জনগণের আস্থা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞানজাত যুক্তিযুক্ত বক্তব্য। তিনি এ-বিষয়ে স্থির নিশ্চিত ছিলেন, সংগ্রামের ধারায় নেতৃত্বায়ক চিন্তা ও প্রয়ােগের সব কৃতিত্বকে গণ্য করা উচিত। এবং সুনির্দিষ্ট আস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে কার্যক্ষেত্রে তা যথাযথ প্রয়ােগ করা জরুরি। | পঞ্চাশের দশকে আফ্রিকায় গিনিবিসাউয়ের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মহান নেতা আমিলকার কারবাল পাগঞ্জ ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণের বিরুদ্ধে সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। চল্লিশের দশকে আফ্রিকার মুক্তি ও ঐক্যের প্রতীক, ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিক শােষণের বিরুদ্ধে অদম্য সংগ্রামের প্রতীক ছিলেন কওমে নকুমা (১৯১০-১৯৬০)। তিনি ছিলেন অসামান্য ভাৰাপতি ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। আকীয় মুক্তি আন্দোলনের যেসব অভ্যন্তরীণ ঋশের কারণে সংকট দেখা দেয় তিনি তা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন । নকুমার ছিল ঔপনিবেশিক দেশগুলাের জাতীয় ও সামাজিক মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে অসাধারণ দর্শনিক উপলব্ধি। | আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মহান ভাৰাদর্শিত ফানুস ফালােন ছিলেন সৰ নিপীড়িত জাতির পক্ষে যারা ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটাতে কৃতসংকল্প। ফানেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে আদর্শিক ধরায় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের আহবান জানিয়েছিলেন। এবং ষাটের দশকে ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তি, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী ও স্বাধীনতা সৎগ্রামের দুনিয়া কাপানাে ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভিয়েতনামের অবিসংবাদিত মহান নেতা হােচিমিন। আর ঐ একই সময়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঞ্চালির জাতীয় মুক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের এসব মহান নেতৃত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পার্থক্য ও বৈশি এই যে তাঁকে একদিকে বাঙালি জাতির বিস্মৃত আত্মপরিচয়ের উদ্বোধন করতে হয়েছে, অন্যদিকে দ্বিজাতিতত্ত্বের পাকিস্তানি রাষ্ট্রের মৌল ধর্মান্ধ ভিত্তি ও বৃত্ত ভেঙে চুরমার করে জাতিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল শােষকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই অব্যাহত রেখে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করতে হয়েছে।
আফ্রিকার কওমে নকুমা থেকে শুরু করে নেলসন ম্যান্ডেল এবং ভিয়েতনামের হােচিমিন পর্যন্ত কোনাে নেতাকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতাে সাম্প্রদায়িক দানবীয় শক্তি ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়াশীল শােষকশক্তির বিরুদ্ধে এমনভাবে লড়াই সংগ্রাম করতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অসামান্য কৃতিত্ব ছিল তিনি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে প্রধান দ্বন্দ্ব (pirncipal contradiction) 05119 (Minor contradiction) প্রজ্ঞার সঙ্গে পরখ এবং নির্ধারণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদ ঔপনিবেশিক শাসনকে ছড়ান্ত আঘাত হানার বহু আগেই বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাশের প্রেক্ষাপটে নিপুণ কুশীলবের মতাে এ ঘৰ নির্ণয় করে রাজনীতিতে কে তার মিত্র কিংবা শক্র হবে তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। গত শতাব্দীতে এসব মহান জাতীয়তাবাদী নেতার নেতৃত্বে রাজনৈতিক ঘটনা তাই বিশ্বইতিহাসে অবিস্মরণীয়, অভূতপূর্ব।
এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তিসংগ্রামের দর্শন, রাষ্ট্রীয় ভাবনা, সমাজ, প্রগতি, শােষণ-বৈষমা থেকে মুক্তি, ভাষা ও সাংস্কৃতিক দর্শন, মানবাধিকার প্রসঙ্গ, আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, পররাষ্ট্রনীতি, জাতীয়তাবাদ, উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাণী শােষণ, প্রচলিত প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প সম্পর্কে তার ভাবাদর্শ শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বেই প্রবলভাবে অনুভূত হয়। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন তার বিশাল রাজনৈতিক জীবনের অগণিত বক্তব্য, ভাষণ, বিবৃতি এবং নথনের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। আজীবন আপসহীন এবং লড়াই সংগ্রামে ক্লান্তিহীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক ভাষণ ও বক্তব্য তাই আমাদের জাতীয় জীবনে অমূল্য সম্পদ, অন্তহীন প্রেরণার উৎস। এসব কালজয়ী ভাষণ যেমন ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ, তেমনি পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তিসংগ্রামে অবিনাশী প্রেরণা, পাথেয় ও দিকনির্দেশনা।
আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা, সমাজ দর্শন, মানবাধিকার, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, জাতীয় মুক্তি তথা স্বাধীনতার মূলনীতির আলােকে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম কীৰে সুখী ও সমৃদ্ধিশালী সােনার বাংলা নির্মাণ করবে—বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনামূলক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক ভাষণ ও বক্তব্যে সেই দর্শনই বিধৃত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ও ভাষণ তাই আমাদের জাতীয় সম্পদ, যা সংরক্ষণের প্রয়ােজন জাতীয়ভাবেই অপরিহার্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দলের উর্ধে; সমগ্র দেশ এবং সারাবিশ্বের নিপীড়িত জাতিসমূহের মুক্তিকামী মানুষের প্রতীক ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর । | গত শতাব্দীর ইংরেজ কবি, চিন্তাবিদ ও প্রাবন্ধিক টিএস এলিয়ট তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ Traditiar Aid individual Tolerif-এ বলেছেন, একটি জাতির শত শত বছরের পুরােনাে প্রথা ভেঙে স্বপ্রতিভায় দীপ্ত বলিষ্ঠ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে এবং সে নেতৃত্ব একটি জাতিকে মুক্তির পথ দেখায়। রাশিয়ান সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক জঙ্গি প্লেখানত মনে করেন, ইতিহাসের উপজীব্য সাধারণ মানুষ নিম্নবর্গ শ্রেণী হলেও ইতিহাসের নিয়ন্ত্রক ও স্রষ্টা একক ব্যক্তি কিংবা নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালির আর্থ-সামাজিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বাঙালি জনগােষ্ঠীর মুক্তিসংগ্রামের সেই মহান নেতা, যিনি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ভেঙে জাতির নতুন ইতিহাস ও রাষ্ট্রনির্মাতা, তেমনি তিনি মহাকালের পাতায় নিজেও ইতিহসের উজ্জ্বল অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করেই বাঙালির চিরকাদিক্ষত বিজয়-ইতিহাস। মহান নেতার জীবন ও রাজনৈতিক দিকদর্শন বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের নিপীড়িত জাতিগুলাের মুক্তিসংগ্রামে চেতনা জাগায়, মুক্তির পথ দেখায়।
যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশসমূহেরই ইতিহাসটা একই, সবাই এসে পড়তে থাকে আ-বিশ্ব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে, তবে কোনও কোনও দেশ চলে এই প্রক্রিয়ার পায়ে পায়ে—কতগুলাে এগিয়ে যায়, কতগুলাে পিছিয়ে থাকে বঙ্গবন্ধু মানবমুক্তি ও সমাজপ্রগতির দীপশিখা হাতে এগিয়ে গেছেন মহাকালের পথপানে। এসৰ মহামানবের আত্মত্যাগেই চিরকাল পরিবর্তনের প্রশ্ন বাজবে কালের মন্দিরায়। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে তাই চিরঞ্জীৰ নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নেই। স্বাধীনতাবিরােধী প্রক্রিয়াশীল ঘাতকের বুলেট বিদীর্ণ। করেছে তার বক্ষ। তার শারীরিক প্রস্থান ঘটেছে এ মর্তলােক থেকে। কিন্তু তার আদর্শ ও দর্শন শুরু হয়নিস্তব্ধ হবার নয়। তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন এ বাংলায় আবহমান বাঙালির শ্যামল সবুজ পথপ্রান্তরে, আকাশে-নীলিমায়, শিশিরবিন্দুতে মাটিতে, প্রতিদিনের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে। তার কণ্ঠস্বর শােষকশক্তির বিরুদ্ধে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব অসঙ্গতি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে উচ্চারণ অবিনশ্বর।
সংৰাম ১৭ মার্চ ২০০৭
১৫ আগস্টকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠা জাতির অবধারিত কর্তব্য
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ
যখন দাবি জানাতে হয় ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস এবং সরকারি ছুটি ঘােষণা করা হােক তখন খুব অসহায় মনে হয়। নিজেদের ক্ষুদ্রতা যেন স্পষ্ট হতে থাকে। এমন অনেক ঘটনা থাকে যার অবস্থান হয় দলাদলির উর্থে। যা কোনাে দল বা গােষ্ঠীর গণ্ডিতে আটকে থাকে না—জাতীয় বিষয়ে পরিণত হয়। ১৫ আগষ্ট কি তেমন জাতীয় জীবনের একটি গভীর শােকাবহ ঘটনা নয়! এই দিবসটি কি শুধু আওয়ামী লীগের? যদি রাজনীতি দিয়েও না দেখি তবে সাধারণ হিসেবেও বললে বলতে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মুক্তিযুদ্ধের দিশারী, প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু এই দিনে সপরিবারে ঘাতকের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। একটি সভ্যদেশে এটুকুর কারণেই জাতীয় শােক দিবস ঘােষিত হতে পারত। ঘােষিত এবং পালিত অমন দিবসটি যে-কোনাে পক্ষ ক্ষমতায় এলেও অব্যাহত না-রাখার কোনাে কারণ থাকতে পারে না। এই দিবস অব্যাহত থাকা গাত্রদাহের বা শঙ্কার কারণ হতে পারে শুধু ১৫ আগস্টের ঘাতকদের। | পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পরে যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন তারা যে কেন ঘাতকের মতাে আচরণ করেছিলেন বােঝা গেল না। কারণ একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি এবং দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রপতি সপরিবারে নিহত হলেন, আর সেই দিনটিকে জাতীয়ভাবে যথাযােগ্য মর্যাদায় পালন করতে সরকার দ্বিধান্বিত থাকবে, এটি কোনাে সভ্য আচরণ হতে পারে না। ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় জেড-ফোর্সের অধিনায়ক থাকাকালে পাকিস্তানে কাৱা-অন্তরীণ বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কি যুদ্ধ করেননি? তিনিই কি বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘােষণা পাঠ করেননি? নাকি অর্বাচিন বিএনপি নেতাদের ভাষার তাৎপর্য অনুযায়ী তিনি রেডিওর বেতনভুক ঘোষকের সমান মর্যাদা পেয়েছিলেন?
শেষপর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গত ১০ আগস্ট বিবেক, কর্তব্য ও সংস্কৃতিবােধ সম্পন্ন হিসেবেই নিজেদের জাতির সামনে প্রতিষ্ঠিত করল। হাইকোর্টের আদেশের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সরকারি সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল—১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে শােকদিবস পালিত হবে, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত হবে এবং দিবসটিতে সরকারি ছুটি থাকবে। আমরা সরকারি এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই।
কিন্তু ১৫ আগস্ট ইস্যু নিয়ে বিএনপি গায়ে যে কলঙ্ক মেখেছে ভাতে ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়ানাে থেকে একে রক্ষা করতে পারবে না কেউ। পচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে সকচেয়ে সুবিধাদ্যোপী হয়েছিলেন মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমান; যিনি জাতির ক্রান্তিকালে ‘মহান জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে নয়মাস যুদ্ধ করেছিলেন—সেই তিনিই সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী হড়ী সদস্যদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সাপলুডুর নানা পাছ মাড়িয়ে দেশের প্রেসিভেন্ট হয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাবনত, বীরউত্তম পদবিধারী মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী যিনি ছিলেন, এই পরবর্তী পরিস্থিতিতে আর তখন প্রধান কর্তব্য থাকার কথা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রতি ব্যবস্থা নেওয়; সেখানে তিনি যেন খুব নির্লিপ্ত হয়ে গেলেন। বীর উত্তম’ মুক্তিযােদ্ধান্ত বন্ধু হতে লাগল জামাত তথা আলবদর রাজাকাররা। ভয় মন্ত্রিসভায় সসম্মানে জায়গা দেওয়া হল রাজাকারদের। তখনই বােঝা যাচ্ছিল নীলনকশার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে যাচ্ছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আচরণে মানাত তেমন আচরণ বেরিয়ে এল ক্ষমতায় আসীন হওয়া মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমানের মধ্যে। খুনিদের আড়াল নাহ! করলেন, কিন্তু ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় স্মরণ করায়। ভর দ্বিধা ছিল কেন?
এই জিয়াউর রহমানের স্তিষ্কের কোষে যে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলের ভ্ৰণশিত বেড়ে উঠছিল তার চেয়ে পরিশুদ্ধ রক্তে সঞ্চালন হবে কেমন করে! রামায় ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে সুবিধাবাদী পাঁচমিশেলি মানুষদের নিয়ে পরিচালিত বিএনপির ক্তের আর কোনো জায়-বিচার অবশিষ্ট থাকে না। এই দলটির প্রধান কর্তব্য হয়ে নাড়ায় বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের সোনালি পাতা থেকে মুছে ফেলা। কিন্তু এ তাে স্কুল চিন্তা। বাংলার মানুষের হৃদয়ে মার আসন পাতা, তাকে মুছে ফেলার ইরেজার পাবে কোথায়!
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্টকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্মরণ করার যাত্রা শুরু হলাে। দুঃস্বপ্ন ভেৰে অৰ্তীতকে আড়াল করে শেষপর্যন্ত ১৫ আগস্ট পালনের এই ট্রয় শীকৃতি মেনে নিয়ে কৃতজ্ঞ জাতি এগিয়ে চলছিল। কেই ভাবেনি অন্য কোনাে সরকার ক্ষমতায় এসে বন্ত্রীর দায়িত্ব অর্গীকার করে থামিয়ে দেৰে ১৫ আগস্ট তপণ । কিন্তু খালেদা-নিজাৰ্মীর জোট সরকার তাই করল। বাতিল হয়ে গেল ১৫ আগস্টের রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধা। ওঁর বদলে অত্যন্ত অসংস্কৃত, গাড়ল ৪ নিম্নমানের ফল রুচির প্রকাশ হিসেবে হঠাৎ ঘােষিত ১৫ আগষ্ট বেগম জিয়ার জন্মদিন পালিত হতে লাগলো ঘটা করে।
হঠাৎই প্রচার পেল এই দিনটিই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্মবার্ষিকী। হাস্যকরভাবে জন্মদিনের একাধিক তারিখ উঠে আসতে লাগল পত্রিকার পাতায়। যদি বেগম খালেদা জিয়ার ১৫ আগস্টের জন্মতারিখটিই আঁটি ধরে নেওয়া যায় তবে তার মধ্যদিয়ে বিএনপির কার্য রূপ আরাে স্পষ্ট হয়। এ প্রসঙ্গে আমার ছেলেবেলায় মনে রেখাপাত করা একটি ঘটনার স্মৃতি বারবার সামনে চলে আসে। কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় এই স্মৃতিটি উল্লেখ করেছিলাম। প্রাসঙ্গিক বলে এখানে উল্লেখ করছি।
… তখনাে শহর এলাকা ছাড়া লাল নীল বাতিতে বিয়েবাড়ি সাজানাের সুযােগ ছিল না। একবার পারিবারিক দাওয়াত এল গ্রামে চাচার মেয়ের বিয়েতে। চাচা অর্থশালী এবং বিলাসী মনের মানুষ। প্রচুর ধুমধাম করবেন তিনি। আমাদের কাছে বন্ধ সংবাদ ছিল তিনি শহর থেকে জেনারেটর জানিয়েছেন। এসেছে লাল নীল বাতি। গ্রামের বাড়ির গাছপালা আর ঘরকেরি রাকিয়ে ফেলেছেন। বিয়েতে যাওয়ার পেছনে এই জাকালাে আয়ােজন দেখার লােভই ছিল আমার বেশি। | বিয়ের আগের সন্ধ্যায় চাচার বাড়ি পৌঁছে দেখি একটি বাতিও জ্বলছে না। ছােটদের মন খুবই খারাপ। ব্যাপারটা কী! না, যার এতো উৎসাহ সেই চাচাই আদেশ দিয়েছেন কোনাে বাতি জ্বলবে না। কারণ গ্রামের পশ্চিমপাড়ার দিনমজুর সাহেলির ছােটমেয়েটি সকালে পুকুরে ডুবে মারা গেছে। চাচার মানবিক বােধ বলে দিয়েছে সাহেবালির শােককে ভাগ করে নেওয়াই মানবিক কর্তব্য। এক খচ করে আনা শহরের বাতি জ্বালানােটা তার বিবেকে সায় দেয়নি। আমার মন এখনাে গ্রামের এই সান্দা মনের চাচার স্মৃঙ্গি প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
অথচ একঝন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, একটি বড় দলের প্রধান, সরকারপ্রধান অবলীলায় বিবেক ও মনুষ্যত্ববর্জিত হয়ে গেলেন। ধরে নিচ্ছি কাকতালীয়ভাবে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মতারিখে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটে গিয়েছিল। নাহয় বিএনপি নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর বিশাল অবদান মনে না-ই রাখলেন। অন্তত একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা তো একটি দেশের জন্য দলমত নির্বিশেষে কম শােকাবহ আর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা নয়। এই গ্রামের চাচার ভেতরে থাকা মনুষ্যত্বের ছিটেফোটা নিয়ে বিএনপি নেত্রী তার অবস্থান থেকে যদি বলতেন, এই শােকর দিনে আমার জন্মদিনের সকল আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ থাকবে। তবে তিনি জাতির কাছে ইতিহাসের কাছে অনেক বড় হয়ে যেতেন। অন্তত এটুকু বলতে পারছেন এই দিনটির প্রতি শােক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে ঘােষিত অন্য আরেকটি দিনে জন্মউৎসব পালন করবেন। | কিন্তু হল তার উল্টো। ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের আয়ােজনে হতে থাকল কাস্যালিভোজ আর অন্যদিকে বিশেষ সাজসজ্জায় হাস্যোজ্জ্বল বেগম খালেদা জিয়া বিশাল বিশাল কেক কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শুভেচ্ছা জানাতে কিউতে দাঁড়ানাের প্রতিযােগিতায় ঘাম ঝরাতে লাগলেন ছােট বড় মাঝারি নেষ্টকিমারা। ১৫ আগস্টকে এতটাই উৎসবে ঢেকে দিতে চাইল বিএনপি-জামাত জোট যে রাতে বিটিভির খবরে বিশেষ সময় বন্যাদ্দ রাখতে হত জাতীয়তাবাদী ক খ গ ঘ ও কোন্ দল কত পাউন্ডের কেক কেটে নেত্রীর জন্মদিন পালন করেছে তা প্রচার করার জন্য । | অসলে ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ধের নায়কদের ঢেকে রাখা এবং এই ইতিহাসটি মুছে ফেলার জন্য এ ছিল স্কুল কদর্য আচৰণ। একটি স্যদেশের সমানুষের কাছে এ ঘটনা হৰে এক অবিশাস্য কাও। এমন হীনমানসিকতার জোট সরকারের ১৫ আগস্টের জাতীয় শােক দিবসের ঘােষণা ও সরকারি ছুটির সিদ্ধান্ত অবলুপ্ত করা স্বাভাবিক আচরণই ছিল। কিন্তু মাঝেমধ্যে আইনের শাসনও যে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়, ১৫ আগস্টকে যথাযােগ্য শ্রদ্ধার জায়গায় ফিরিয়ে আনার আদেশ দিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট তারই প্রমাণ করল। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক সরকার নয় বলেই বােধহয় মনুষ্যত্ব ও কর্তব্যজ্ঞানকে নির্বাসনে পাঠায়নি। সরকার হাইকোর্টের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে বিবেক সমুন্নত রেখে ১৫ আগস্টকে শ্রদ্ধার জায়গায় পুনর্বহাল করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ঋণ শােধ করার প্রয়াস নিয়েছে। ইতিহাস যতবার এই সময়টিকে স্মরণ করবে, রক্তস্নাত ১৫ আগস্ট রাজাকার-পরিবেষ্টিত বিএনপি জোট সরকারের অস্বীকার করার অপপ্রয়াসকে ততবার ঘৃণার সঙ্গে লিখে যাবে। আর একে স্বমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে।
ভোরের কাগজে ১৫ আগস্ট ২০০৮
জাতীয় শােক দিবস : আদালতের রায়, রাষ্ট্রের দায়
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী।
গত ২৭ জুলাই হইকোর্ট বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও রাজনীতির জন্য একটি যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছে। রায়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস পালন ও সরকারি ছুটির বিধান বাতিলের আদেশকে অবৈধ ও বেত্যাইনি ঘােষণা করা হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের সকল বিবেকবােধসম্পন্ন মানুষ মনে করছে যে, ১৫ আগস্টকে নিয়ে ১৯৭৫ সালের পর থেকে যে-ধরনের বিদ্বেষ, স্বেচ্ছাচারিতা, উপেক্ষাসহ নানা জনমানসবিরােধী আচরণ সরকারগুলাের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত করা হয়েছিল তার। অবসান হবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কী ঘটেছিল, কারা তা সংঘটিত করেছিল, এর ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র কীভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের রহস্য উন্মােচন করা সম্ভব হবে। জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন সঠিক ইতিহাস জানার, চিন্তা করার সুযােগ পাবে। তাছাড়া এই রায়ের ফলে এই প্রথম সমগ্র জাতি প্রায়শ্চিত্ত করার সুযােগ পাবে। | ১৫ আগষ্ট এই জাতির জন্য একটি কলঙ্কের দিন, একটি বড় ধরনের শােকের দিন—একথা ১৯৭৫ সালের পর থেকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা, জাতির বিবেকরা সবসময় বলে আসছিলেন। কিন্তু ১৫ আগস্টকে সংঘটিত করে যারা অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছিল, সেই অবৈধ ক্ষমতাদখলকারী শক্তির প্রত্যক্ষ মদদে যারা রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করার সুযােগ পেয়েছিল তারা এই দিবসটিকে নিয়ে এতােদিন জাতির সঙ্গে শঠতা, প্রতারণা, তামাশা এবং মিথ্যাচার করে আসছিল, তারাই এতােদিন দিবসটিকে নিয়ে কুৎসিত ও অপরাজনীতি করে আসছিল। ফলে এই দিনটিকে জাতি জাতীয় শােক দিবস হিসেবে পালন করার সুযােগ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে সর্বপ্রথম আওয়ামী লীগ সরকার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শােক দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা করে। সেভাবে তা ২০০১ সাল পর্যন্ত পালিত হয়। কিন্তু ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর ২০০২ সালের ২২ জুলাই মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে উক্ত শােক দিবস ও সরকারি ছুটি বাতিল ঘােষণা করে এই মর্মে ২৯ জুলাই একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ঐ বছরের ৩ আগস্ট সরকারের নির্বাহী আদেশে উক্ত প্রজ্ঞাপন কার্যকর করা হয়। জোট সরকার উক্ত শােক দিবস বাতিলের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিল যে, এরকম শােক দিবস ঘােষণার নজির নেই।’ নজির নেই, তাই জাতীয় শােক দিবস ও সরকারি ছুটি পালন করা যাবে না। কী চমৎকার (!) যুক্তি দিয়ে বিএনপি এবং এর মিত্রশক্তি বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে এসেছে। সুতরাং একথা বুঝতে কাৱে ৰাকি থাকে না বাংলাদেশের রাজনীতিকে কারা নিয়ন্ত্রণ করছিল, ১৫ আগস্টকে নিয়ে তাদের অবস্থানও কী ছিল তা যথেষ্ট পরিস্কার ছিল। | এটি অত্যন্ত স্পষ্ট বিষয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট যে হত্যাকায় সংঘটিত হয়েছিল, সেই রক্ত মাড়িয়ে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল, সেই রক্ত পান করে যারা রাজনীতিতে শক্তি সঞ্চয় করেছিল, তাদের কাছে ১৫ আগষ্ট মানে এক আতঙ্ক। সেই আতঙ্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্যই রাষ্ট্রক্ষমতাকে তারা ব্যবহার করে দিনটিকে বাহ্যিকভাবে স্বাভাবিক এবং অন্য কোনােভাবে অতিক্রম করার হীন চেষ্টা করেছে। ১৯৯৭ সাল থেকে হঠাৎ করে এই দিনে বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনের কেক কেটে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করার একটা নিকৃষ্ট বিকৃত মানসিকতার ধারা চালু করা হয়েছে দলের অভ্যন্তরে। | এইভাবে দিনটিকে নিয়ে টানাহেঁচড়া কম হয়নি। নােংরামি, ভণ্ডামি, মিখাচার, প্রতারণাও কম হয়নি। যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাতে ছিল তাই ৰাষ্ট্ৰীয়ভাবেই সেসব করা সম্ভব হয়েছিল। দেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে জাতীয় শােক দিবস কেটে ফেলা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য রাজনৈতিক মঞ্চে, বেতার-টিভিতে অহরহ প্রচার করা হয়েছিল। পাঠ্যপুস্তকেই বিকৃত তথ্য ও বর্ণনা উপস্থাপন করা হয়েছিল। বলার চেষ্টা করা হয়েছিল, যেন ১৫ আগস্ট না ঘটলে দেশ রসাতলে যেত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব চলে যেত। | ১৫ আগস্টকে যারা শােকের দিবস হিসেবে পালন করার চেষ্টা করত তাদের বিরুদ্ধে গুণ্ডা-পাতা লেলিয়ে দেওয়ার ঘটনাও কম ঘটেনি। দুস্থদের মধ্যে বিতরণের জন্য খাওয়ার হাঁড়ি-পাতিল লুটের ঘটনাও কম ঘটেনি।
বর্বরতা, অসভ্যতা, দলন-নিপীড়নের মানসিকতা সেই রাজনীতির অভ্যন্তরে ক্রমশ বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। তেমন বিকৃত রাজনীতিই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেও গ্রাস করে বসেছিল। আমাদের রাষ্ট্র হারাতে বসেছিল এর সকল আধুনিক, মানবিক গুণাগুণের চরিত্র, হয়ে উঠতে বসেছিল সেইসব দুবৃত্তের পাহারাদারে, অসৎ, অপরাজনীতিকে রক্ষা করার প্রতিষ্ঠান হিসাবে। আমরা রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে তফাৎ ভুলতে বসেলািম। সরকারই যেন রাষ্ট্র, যেমন ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই যিনি সদম্ভে বলতেন, “আমিই রাষ্ট্র’। | বিএনপি এবং জোট সরকারের আমলে রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে এভাবে নিজেদের মিমাংসা, প্রতিশোধ ও ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। কীভাবে তা সল্পব হল? কোন্ আদর্শের কাছে দীক্ষা নিয়ে এক বা একাধিক রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এভাবে তছনছ করে দিতে পারে, তা কি পুব সৎ, আন্তরিক ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেখা হয়েছে? বা দেখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কি? না, তেমনটি করা হয়নি। হয়নি। বলেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে নিয়ে অনেক অনাকাক্ষিত কথা শুনতে হচ্ছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের প্রত্যুষে যে হত্যাধ সংঘটিত হয়েছিল তা নিছক কোনাে হত্যা ছিল না, দুর্ঘটনাও ছিল না বা কিছুসংখ্যাক “উফখল ও বিপৰূপাৰ্মী’ সেনাসদস্যের কাকীর্তিও ছিল না। উচ্ছল ও বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে দেশপ্রেমিক যুগল সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক, বন্দুক ও অস্ত্রশস্ত্র যাওয়ার কথা নয়। কোনােভাবেই। আমাদের সেনাবাহিনী নিয়েই এতাে দুর্বল বা দায়িত্বহীন কোনাে বাহিনী নয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তো এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল যেখানে সেনাবাহিনীর বিশাল কয়েকটি বলকে ধানমষ্টি ও মিন্টু রোধে ব্যবহার করা হয়েছিল। সেখানে চালানাে হয়েছিল মানবেতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাগু। | আসলে বিষয়টি ছিল এক বড় ধানের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র-যার পেছনে আন্ত র্জাতিক বেশকিছু শক্তি জড়িত ছিল, আর ছিল আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের বেশকিছু গােষ্ঠী যারা দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে দ্রুত সরিয়ে নিতে গােপনে সংগঠিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে ৱা সামরিক বাহিনীর ভেতরে পরিকল্পনা মােতাবেক কাজ করে আসছিল। একসময় গােটা বাহিনীর চাৰিটা বাহ্যত তাদের হাতে চলে যায়।
পৃথিবীতে ষড়যন্ত্রের ধরন-ধারণটি এমনই হয়=যখন মস্ত বড় প্রতিষ্ঠানও এমন যযন্ত্রের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। আগে থেকে সচেতন না থাকলে রাষ্ট্র ও রাজনীতির কত বড় বিপর্যয় হতে পারে তা বাংলাদেশেই শুধু নয়, পৃথিবীর অনেক দেশেই যথেষ্ট নরি ওয়েছে। গত শীতে ঔপনিবেশিকার শুশল থেকে মুক্তি পাওয়া, স্বাধীনতা লাভকারী বেশিরস্কাপ রাষ্ট্রেই হত্যা, পাল্টা হত, সরকার উল্টিয়ে দেওয়া যেন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আসলে সম্পূর্ণ সশস্ত্র বা কম সশস্ত্র উপায়ে স্বাধীনতালাভের সঙ্গে অপর একটি বিষয় জড়িত থাকে, তা হচ্ছে তাতে নানা অপশক্তি সশস্ত্র পাছায় নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা, নিজেদের স্বার্থ ও কত্ব প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা খুঁজে নিতে সচেষ্ট থাকে। এরা খুব একটা সুস্থ স্বাভাবিক রাজনৈতিক চর্চা ও বিশ্বসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যে মাপের সশঘুদ্ধের বিস্তার নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল তাকে স্বাধীনতালাভের পর স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র অভ্যস্ত করা, গড়ে তােলা খুব সহজ কাজ ছিল না। পর্যাপ্ত সময় পেলে সেটিও হয়তাে বন্ধ করা সম্ভব হত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, আরব বিশ্বসহ কতিপয় শক্তি, যাদের কূটনৈতিক পরাজয় ঘটেছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে তারা মােটেও হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল না। তারা মােটেও জোটনিরপেক্ষ একটি নতুন রাষ্ট্র, অথবা সােভিয়েত ব্লক বলে পরিচিত একটি দেশকে সহজে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না; মেনে নিতে পারছিল সেই রাষ্ট্রের স্থপতি, সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে, যিনি তৃতীয় বিশ্বের জনগণের কাছে আৰু একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছিলেন। সেই সময়ের পরাশক্তির রাজনৈতিক চিন্তা এসব সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে পারেনি, বরং এসব সংকীর্ণ চিন্তাভাবনার আবর্তেই ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেক্ষেত্রে আদর্শবানী, সাড়াজাগানিয়া নেতাদের হত্যা বা দেশত্যাগের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে মােড়ল রাষ্ট্রের
সরকার, তাদের নানা গোপন কাহিনী ছড়যন্ত্রকারীদের হাতে অর্থ, অন্ত্র সরবরাহ করেছিল। সরকার উৎখাতে গােপনে সকল ষড়যন্ত্রই অব্যাহত রেখেছিল।
বাংলাদেশের এবং এর কনিষাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যা যা করা দরকার ছিল কা শুরু থেকেই করা হচ্ছিল। এর অন্তরে যেখানে থাকে বেচাকেনা বা বসানাে প্রয়ােজন ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাই করা হয়েছিল । সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক, কামান, বন্দুক, অশয়া ও একইভাবে দৃশ্যমান করানো সম্ভব হয়েছিল যা দেখে পােটা সেনাবাহিনী নিজেও হয়তো বিমূঢ়, হতবাক হয়ে গিয়েছিল। জনগণও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এর আগেই জনগণ ও রাষ্ট্রক্ষমতার মূল ভরসার ব্যক্তিটিকে হত্যা করা হল—যেন কেউ সারা আশ্রয় খুঁজে না পায়।
বামিতার বিরুদ্ধে গত শতাঈীর এসব ছড়যন্ত্রের ঘটনা খুলে নিখুঁত ছিল তা আমাদের সহ সকাল বিশ্বাস দিয়ে বােঝা যাবে না। এগুলাের পেছনে আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নানামাত্রিক গবেষণা করে এক এক দেশে, এক এক নেতার জন্য এক একটি পদ্ধতি উদ্যান করেছিল। আমরা কিউবার নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কথা জানি যাকে হ করার জন্য হাজার রকমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেইসব ঘড়যন্ত্র কিউবা রাষ্ট্র ব্যর্থ করে দিয়েছিল। যড়যন্ত্র ব্যর্থ করা সম্ভব হয়েছিল বলেই কিউবা গত ৪৮ বয়ে পৃথিবীতে একটি মর্যাদার আসন সৃষ্টি করতে পেরেছে। আমরা কিন্তু তা পারিনি। আমাদের রাষ্ট্রের জন্মের শুরুতে সবকিছুই ছিল অত্যন্ত দুর্বল, ভঙ্গুর এবং অবিন্যস্ত। এ সুযােগ তাই নিয়েছিল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের হােতা গােষ্ঠী। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর পুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলােকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের আলাপ, গতিপথসহ সবই পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিকে স্বাধীনতাবিরােধী, হঠকারী, সুবিধাবাদী আদর্শহীন। লুটপাটকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হল; অপরদিকে কঠিন করে দেওয়া হল আদৰ্শৰাণী সৎ, ত্যাগী মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এমন শক্তির রাজনীতি ও জীবনষাপনকে।
বাংলাদেশে এখন যে দুৰ্বতের নর্তন-কুর্দন, ছড়াছড়ি, বাড়াবাড়ি ও বিস্তার দেখা যাচ্ছে তা রাতারাতি হয়নি। এর বিস্তারের সুযােগ করে দিয়েছে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের হােত, তাদের সমর্থকগােষ্ঠী, পৃষ্ঠপােষক দেশী-বিদেশী শক্তিসমূহ। বাংলাদেশে নীতি-আদর্শের জলাঞ্জলি, মিথ্যাচার, ইতিহাসবিকৃতি, লুটপাট ইত্যাদি । কিছু এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা পঁচাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্র রাজনীতির অবদান ও ফসল মাত্র। এর দায় মােটেও এড়াতে পারে না পচাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই রাষ্ট্র জাতির জনকের হত্যার বিচার এ পর্যন্ত কার্যকর করতে পারেনি; কতাে ধরনের ওজর-আপত্তি, টালবাহানা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান থেকে শুনতে হচ্ছে।
আসলে এই রাষ্ট্রের অবস্থানটি কোনূদিকে সেটি রাষ্ট্র নিজেই লুকিয়ে রাখতে পারেনি। এই রাষ্ট্র ১৯৭১-এর ঘাহকদের বেশিরভাগকেই রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজসহ সকল প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠিত করেছে, ১৯৭৫ সালে সকল হত্যাকাণ্ডে ঘাতক ও সুবিধাভোগীদেরও অনুরূপভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কারােই বিচারের দায়িত্ব রাষ্ট্র
গ্রহণ করেনি। এটি সম্ভব হয়েছে ১৯৭৫ সাল থেকে একনাগাড়ে ২১ বছর এবং পরবর্তী ৫ বছর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রাজনীতি, আদর্শ ও রাষ্ট্রবিরােধী শক্তি বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনায় অবস্থান করার কারণে। ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে তারা সুকৌশলে সেভাবেই পরিচালিত ও পরিগঠিত করেছে। এতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মর্যাদা ভূলুষ্ঠিত হয়েছে, বাংলাদেশ এতোসৰ দুৰ্বত্ত ও সুবিধাবাদী, আদর্শহীন রাষ্ট্রের পরিচয়ে চলেছে। এর স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমােচন, শিক্ষা, সংস্কৃতির মান বরাবরই চলেছে ভঙ্গুর, টলটলায়মান এবং মেকি আহাদনে। কোথাও নেই কোনাে টেকসইয়ের ছাপ, নীতি-আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান, জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের প্রতি দায়বদ্ধতা। সেই রাষ্ট্রে আমরা হারিয়েছি ১৯৭৫ সালে। নেতা-নেতৃত্ব ও আদর্শবাদী দেশ হারিয়ে আমরা এখনাে দিকভ্রান্ত ও শােকাহত।
জোরের কাগজ ৬ আগস্ট ২০০৮
ফিরতে হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে
খােন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
পঁচাত্তরের পনেরােই আগস্ট কোনাে সাধারণ দুর্ঘটনার দিন ছিল না। ছিল কুটিল ও নৃশংস সন্ত্রাসের দিন—বলতে গেলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঘটনা। পনেরােই আগষ্ট ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্রের দিন-একাত্তরের পরাজিত শত্ৰু বিদেশী রাষ্ট্র এবং তাদের এদেশীয় সহযােগীদের মিলিত কাপুরুষােচিত বর্বর আক্রমণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর, রাষ্ট্রের রাষ্ট্ৰচরিত্র ছিনতাই করার জন্য। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একাত্তরপূর্ব রাষ্ট্রীয় চরিত্রে ফিরিয়ে নেয়। প্রাথমিকভাবে এক পাকিস্তান থেকে দুই পাকিস্তানের সৃষ্টি। পরবর্তীতে সম্ভব হলে কনফেডারেশন জাতীয় কাঠামাের মধ্যে ঢুকিয়ে কার্যত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনতাই করা।
একথা শুনে পরাজিত শত্রুরা সমস্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দেবে—এসবের প্রমাণ কী?’ যখন কোনাে অপরাধের চাক্ষুষ প্রমাণ না মেলে তখন আইনবিদরা পারিপার্শ্বিক প্রমাণ (সার্কামসট্যান্সিয়াল এভিডেন্স) খোজ করেন। শক্তিশালী পারিপার্শ্বিক প্রমাণ উপস্থাপন। করা গেলে বিচারক তা গ্রহণ করেন। আমাদের দেশের ঐ ষড়যন্ত্রের ঘটনার বিচারক দেশের জনগণ । আন্তর্জাতিক সুধীসমাজও নির্মোহ বিচার করতে পারে। | রাষ্ট্র ছিনতাইয়ের অভিযােগটির প্রমাণ পেতে হলে অনেক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে হবে। কিছু কিছু জবাব প্রশ্নের মাধ্যেই লুকিয়ে থাকবে। নিবন্ধটির সীমাবদ্ধতার কথা মনে রেখে কয়েকটি প্রশ্ন ও তার জবাব খোজার চেষ্টা করা যাক। | মৃত্যু অথবা অন্য কোনাে কারণে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সংবিধান অনুযায়ী। উপরাষ্ট্রপতি শূন্যপদে অধিষ্ঠিত হবেন। উপরাষ্ট্রপতিও না থাকলে জাতীয় সংসদের
স্পীকার শূন্যপদে কর্মপরিচালনা করবেন। পঁচাত্তর সালের পনেরােই আগস্ট বাংলাদেশে উপরাষ্ট্রপতিও ছিলেন, স্পীকারও ছিলেন। অথচ পদ ছিনতাই করে। স্বঘােষিত রাষ্ট্রপতি হলেন খােন্দকার মুশতাক নামক এক ব্যক্তি, যার সাংবিধানিক যােগ্যতা ছিল না ঐ পদে অধিষ্ঠিত হবার। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এই খােন্দকার মুশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার জন্য মার্কিন মহলে দেনদরবার করেছিলেন। তাহলে কি একাত্তরের ঐ স্বড়দেরই পায়ণ প্রয়াসে পচাত্তরে হত্যাকাণ্ড ঘটানাে হয়েছিল?
পঁচাত্তার ছিনতাইকৃত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন খােন্দকার মােশতাক, সেনাপ্রধান হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মুখ্য সচিবের দায়িত্ব পেলেন মাহবুবুল আলম চাষী । উল্লেখ্য, ঐ তিনজনই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কনফেডারেশন ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘শৃঙ্খলাবিরােধী কাজের অভিযােগে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী তৎকালীন মেজর জিয়ার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। শুধুমাত্র ঐক্য বজায় রাখার অজুহাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কঠোর ব্যবস্থা পরিহার করেছিলেন। তবে মেজর জিয়াকে সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে শুধু জেড-ফোর্স পরিচালনায় নিয়ােজিত রাখা হয়।
কনফেডারেশনের আরেক সমর্থক মাহবুবুল আলম চাষীকে সিভিল প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে নিয়ােগ দান কী ইঙ্গিত বহন করে? প্রতীয়মান হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে তিনজন কনফেডারেশন পরিকল্পনায় সরাসরি নিয়ােজিত ছিলেন তাদের একজন হলেন রাষ্ট্রপ্রধান, আরেকজন হলেন সেনাপ্রধান এবং অন্যজন হলেন প্রশাসনের মুখ কর্মকর্তা। রাষ্ট্রপ্রধান যেমন অসাংবিধানিকভাবে হয়েছে তেমনি জেনারেল সফিউল্লাহকে সরিয়ে সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন জেনারেল জিয়া এবং মাহবুবুল আলম চাষীও অনিয়মতান্ত্রিকভাবেই প্রশাসনিক মুখ্য কর্মকর্তার পদে আসীন হয়েছিলেন। এটাকে কি কনফেডারেশন ষড়যন্ত্র রূপায়ণের প্রাথমিক জপ হিসাবে রাষ্ট্রযন্ত্র ছিনতাই হিসাবে চিহ্নিত করা অনুচিত হবে? কেন এবং কোন যুক্তিতে?
| কয়েকগুন বিপথগামী সেনাসদস্যের দ্বারাই যদি আগস্টের হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তাহলে এই বিপথগামীদের’ রক্ষা করার জন্য ইনডেমনিটি ধ্যাদেশ জারি করা হল কেন? বিপথগামী হয়ে কেউ অন্যায় করলে ন্যূনপক্ষে আইন তাে নিজস্ব গতিতে পরিচালিত হয়ে অন্যায়ের বিচার করবে, এটাই তাে স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে অন্যায়কারীদের তৎকালীন সরকার ছত্রছায়া প্রদান করে আইনের গতি বন্ধ কাল কেন? তাহলে কি ক্ষমতাদখলকারীদের উস্কানি বা নিদেনপক্ষে সম্মতিতেই হত্যাকাও সংঘটিত হয়েছিল? বেনিফিশিয়ারি সরকারের আমলে হত্যাকারীরা শুধু নিরাপত্তা পেল তাই নয়, বরং দত্যাবাসসমূহে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হয়ে নিয়ােজিত হয়েছে। এ ঘটনা কি হত্যাকারী ও ক্ষমতাদখলকারীদের সমঝােতার ফসল নয়? | রাষ্ট্রপ্রধানসহ, এত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে হত্যাকারীরা বিমানপথে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়া, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে নির্বিঘ্নে যেতে পারল কীভাবে? লিবিয়া পাকিস্তান প্রভৃতি রাষ্ট্র সন্ত্রাসীদের কেন আশ্রয় দিয়েছিল, কোন কোন রাষ্ট্র কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছিল এবং কেন দিয়েছিল সে বিশ্লেষণ এই হত্যাকাণ্ডে বিদেশী রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা বােঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। কোন কোন দেশ সংশ্লিষ্ট ছিল এবং কোন কোন রত্র ছাতা ধরেছিল, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাদখলকারীদের কী ধরনের বােঝাপড়া ছিল, তা ইতিহাসের স্বার্থেই প্রকাশিত হওয়া দরকার। কারণ বাংলাদেশে চলার পথে কে বন্ধু আর কে শত্রু তা বুঝে নেবার প্রয়ােজন আছে, যদিও চিরশত্রু বা চিরমিত্র বলে কিছু নেই।
জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড যদি বিপথগামীদের বিচ্ছিন্ন কাজই হয়ে থাকে তাহলে প্রায় তিন মাস পরে ৩ নভেম্বরের জেলখানায় রাষ্ট্রীয় হেফাক্সতে রক্ষিত বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীসহ চারজন নেতাকে কেন কাঙ্গামাথায় হত্যা করা হল?
দু হত্যাকাও কি একই সুতােয় বাঁধা নয়? দু হত্যাকাণ্ড মিলে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী শক্তিকেই কি সন্ত্রাসের মাধ্যমে হত্যা করা হল না? তাহলে এটা কি শুধুই হত্যাকাণ্ড একে কি বিদেশী শক্ররাষ্ট্রের ছত্রছায়া ও সাহায্যে দেশীয় সন্ত্রাসী পশুশক্তি কর্তৃক রাষ্ট্রমন্ত্র ছিনতাই বলে আখ্যায়িত করা যায়?
ক্ষমতা ছিনতাই করে দখলকারীরা রাষ্ট্রের পরিচিতিই পাল্টে ফেলেছিল। গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিই তারা উলটে দিল, ফলে রাষ্ট্রও উলটে গেল। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আর রইল না। বাংলাদেশ নামের আড়ালে হয়ে উঠতে লাগল এক নতুন বাংলাদেশ (বাংলাস্তান)। ক্ষমতা ছিনতাইর সাথে রাষ্ট্রের এই পশ্চাৎগমনের সর্শক কী?
সর্বশেষ আইনের কাছে যাই। আইন কী বলে? একটি মামলার বিচারে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে : খােন্দকার মােশতাক, জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ-এ তিনজনের ক্ষমতাদখলই ছিল অসাংবিধানিক এবং অকার্যকর। রায়টি সুপ্রিমকোর্টে বাতিল হয়নি, স্থগিত রয়েছে। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়ও হাইকোর্ট পার হয়েছে, সুপ্রিমকোর্ট আটকে রয়েছে।
শােক প্রকাশ করা হয় সাধারণ মৃত্যুতে। শেরে বাংলার মৃত্যুতে বা মওলানা ভাসানীর পরলােকগমনের দেশবাসী শােক প্রকাশ করেছে, কারণ তারা চিরতরে আমদের ছেড়ে গেছেন। িবঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড কি সেরকম? বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ড ছিল এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। আমরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হারাইনি, হারিয়েছি মুযুিদ্ধের মাধ্যমে অর্জন করা বাংলাদেশ। কাজেই পনেরােই আগস্ট শুধু শােক প্রকাশের দিন নয় বরং নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ষড়যন্ত্রকারীদের বেনিফিশিয়ারিদের খপ্পর থেকে ছিনতাইকৃত বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেয়ার কাজ শুরু করা। সেইসঙ্গে সদাসতর্ক থাকতে হবে যেন নব্য ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্র ছিনতাই সুযােগ আর না পায়। কু, হত্যাকাণ্ড, গ্রেনেড-বােমা হামলা ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা না গেলে দেশের কোনাে মানুষই নিরাপদ থাকবে না। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই আমরা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদিবসে শােক পালনের নৈতিক অধিকার অর্জন করতে পারি।
জনকন্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৮
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের আরেক নাম
আতিউর রহমান “শ্মশান বাংলাকে আমরা সােনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শােষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলব।” (বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চ, ১৯৭২-এর বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ থেকে)
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য। কিন্তু কখনও তা স্বাধীন দেশ হিসেবে তার আত্মপরিচয় তুলে ধরতে পারেনি। আলেকজান্ডারের সঙ্গে আসা ইতিহাসবিদ চীনের পর্যটক হিউয়েন সাঙ (Huyen Sung) কিংবা মরক্কোর ইবনে বতুতার বিবরণীতে গঙ্গাপারের বঙ্গের নাম বারবার উঠে এলেও বৃহৎ ভারতবর্ষের কোনাে অঙ্গরাজ্য বা প্রদেশ হিসেবেই তার পরিচয় মেলে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে পূর্ববাংলা মাত্র কয়েক বছরের জন্য আলাদা প্রদেশের পুরােভাগে থাকলেও তা ফের বৃহৎ বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ১৯০৫-১৯১১ পর্বে পূর্ববাংলার অধিবাসীদের আঞ্চলিক শাসনের খানিকটা স্বাদ পাওয়ার পর হঠাৎ করেই তা শেষ হয়ে যাওয়ার পর নানাভাবে ব্রিটিশ শাসকরা এ অঞ্চলের উঠতি এলিটদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রচেষ্টার অন্যতম এক উদ্যোগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূর্ববাংলার উপেক্ষিত সংখ্যাগুরু মানুষের মন থেকে বঞ্চনার অভিযােগকে স্তিমিত করার জন্যই হয়তাে ফের বাংলাকে ভাগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মূলত অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় ততদিনে পূর্ব-বাংলার সংখ্যাগুরু মানুষ পাকিস্ত েিনর পক্ষ নিয়ে ফেলেছেন। স্বার্থন্বেষী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকরা বাঙালি মুসলমানের আর্থ-সামাজিক বঞ্চনকে কৌশলে দেশভাগের প্রচারণার কাজে লাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন । অখণ্ড বাংলার পক্ষে সীমিত আন্দোলন হলেও শেষপর্যন্ত তা দানা বাঁধেনি।
মূলত অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্ষায় পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের মােহভঙ্গ ঘটে। পাকিস্তানি অমানবিক অগণতান্ত্রিক নিপীড়নবাদ রাষ্ট্র পূর্ববাংলাকে বন্দিী বাজার করেই ক্ষান্ত হল না, তার অধিবাসীদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চাইল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করার সিদ্ধান্তে বাঙালির মনে দারুণ
ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষোভ প্রকাশের উদ্দেশ্যে তারা দেশব্যাপী প্রতিবাদে ফেটে পড়েন।
আটচল্লিশে শুরু হওয়া ভাষা-আন্দোলন ব্যাপক রূপ নিতে শুরু করল। একপর্যায়ে হল গুলি। ঝয়ে পড়ল অনেক তরুণ তাজা প্রাণ।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাঙালির আত্মপরিচয়ের বীজ বুনল সংগ্রামী তরুণরা। তাদের এই আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন অনেকেই। তারা প্রায় সবাই ছিলেন বিকাশমান বাালি মধ্যবিত্তের সন্তান। বলা চলে তারা ছিলেন কৃষি থেকে উত্তনির্ভর নব্যশিক্ষিত মধ্যবিত্তের সচেতন প্রতিনিধি।
আটচল্লিশের ১১ মার্চ ভাষা দিবসে বন্দি হয়েছিলেন আন্দোলনের অগ্রসৈনিক তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিব। মুক্তি পেয়ে তিনি আরও বেগবান করলেন ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ফের গেলেন জেলে। জেলেও বসে ছিলেন না। যােগাযােগ রেখেছেন আন্দোলনের ছাত্রনেতা ও রাজনীতিকদের সঙ্গে। ধীরে ধীরে তাই তিনিই হয়ে উঠলেন বাঙালির আশা-ভরসার প্রতীক। | বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালিকে আর তাই পেছনে তাকাতে হয়নি। প্রতিটি আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন শেখ মুজিব। পঞ্চাশের মাঝামাঝি তিনি প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদে, পরে জাতীয় শাসনতান্ত্রিক পরিষদে পূর্ববাংলার অবহেলিত জনগণের পক্ষে ব্যাপক আওয়াজ তােলেন। কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার পূর্ববাংলার প্রতি যে অন্যায্য আচরণ করছিল তিনি তা প্রাঞ্জল ভাষায় পরিষদে তুলে ধরেন। তখনই তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, এভাবে চললে পূর্ববাংলা শেষপর্যন্ত পাকিস্তানের কাঠামােকে থাকতে পারবে না। তাই বৈষম্যমূলক আচরণের অর্থসান করার পক্ষে সুযােগ পেলেই তিনি জোরালাে বক্তব্য তুলেন।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি তিনি বাত্তালির মুক্তি সনদ ৬-দফা উপস্থাপন করে হয়ে গেলেন তাদের নয়নের মণি। তিনিই প্রথম সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে কার্যকরীভাবে চ্যালেঞ্জ করে বারবার জেলে গেছেন।
একপর্যায়ে সাহসী এই নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি করা হল। তিনিই বীর যিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। শেখ মুজিব। এ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে নিশ্চিত ফাসিতে ঝুলতেন। কিন্তু তিনি মৃত্যুকে ভয় পাননি বলে সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছেন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে। ততদিনে তিনি সারা পূর্ববাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিকে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন।
কার্যত জেলের তালা ভেঙেই উনসত্তরের গণঅভ্যুথানের চুড়ান্তপর্বে শেখ মুজিবকে মুক্ত করে এনেছিলেন সংগ্রামী ছাত্র-জনতা। তাদের অকৃত্রিম ভালােবাসায় সিক্ত হয়ে তিনি বনে গেলেন বঙ্গবন্ধু। পতন হল স্বেচ্ছাচারী আইয়ুবের।
ইয়াহিয়া খান নয়া সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। দিলেন। নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বাঙালিকে ৬-দফার ছায়াতলে সমাবেত করলেন বঙ্গবন্ধু।
নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ী হয়েও তিনি পশ্চিমপাকিস্তানি এলিটদের ষড়যন্ত্রের কারণে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারলেন না। উল্টো পূর্ববাংলার বঞ্চিত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ . করে শুরু করলেন অসহযােগ আন্দোলন। একাত্তরের মার্চ জুড়ে তিনি এ আন্দোলনের পাশাপাশি কার্যত স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনভার হাতে নিলেন। ব্যাংক, বিমা, পুলিশসহ সব কর্মকর্তা তারই নির্দেশে সেসময় চলতেন। | কিছুদিন আলােচনার ভান করে ইয়াহিয়া-ভুটো মিলে ২৫ মার্চ রাতে বাঙালির ওপর সামরিক হামলার পরিকল্পনা করল। এই আক্রমণ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করলেন। সারা দুনিয়ায় বাংলাদেশ’ আর ‘শেখ মুজিব’ শব্দদুটো সমার্থভাবে উচ্চারিত হতে লাগল। শুরু হল দুঃখী মানুষের গৌরবান্বিত মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বন্দি হলেন। তথনই অন্নদা শংকর রায় লিখলেন । যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তােমার শেখ মুজিবুর রহমান! | পশ্চিমপাকিস্তানের এক জেলের অভ্যন্তরে সামরিক আদালতে তার বিচার হল। তাকে ফাঁসির নির্দেশ দেয়া হল। এবারও তিনি মাথা নামালেন না। সাহসের সঙ্গে মৃত্যুকে মােকাবেলা করলেন। বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের চাপ, মুক্তিযােদ্ধাদের সমর-সাফলের কারণে তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে ফের বীরের মতাে মাথা উচু করে ব্রিটেন-ভারত হয়ে স্বদেশে ফিরে এলেন।
বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যদিয়েই রচিত হল ‘অন্ধকার থেকে আলাের পথে তার যাত্রায় প্রথম পর্বের শেষ অঙ্ক। | এরপর তিনি দায়িত্ব নিলেন বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের। সারা পৃথিবী থেকে তিনি পেলেন শুভেচ্ছা সমর্থন। কিন্তু বাংলাদেশকে যারা চাননি তারা নানা ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকেন তাকে ধ্বংস করার জন্য। কিন্তু তিনি ভয় পাননি। চমত্তার একটি সংবিধান রচনা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাসম্পন্ন স্বদেশে রূপান্ত রিত করার অঙ্গীকার করলেন। | এই মহতী কাজে নিয়ােজিত থাকার সময় তিনি এক মুহূর্তের জন্যও দম নেননি। সর্বক্ষণ কাজে দুবে ছিলেন। বিধ্বস্ত অবকাঠামাে পুনর্নিমাণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ, সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, শরণার্থীদের পুনর্বাসন, মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্বস্ত করে ফের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার মতাে কঠিন সব চ্যালেঞ্জ মােকাবেলা করতে করতে তিনি তার জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত বিলিয়ে দিলেন।
স্বাধীন দেশের প্রত্যাশা মেটানাে মােটেও সহজ কাজ ছিল না। সবাই হয়তাে আশা করেছিলেন তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা একমুহুর্তেই তিনি তাঁর জাদুর স্পর্শে মিটিয়ে দেবেন। এ চাওয়া যে বাস্তবে কতটা অবাস্তব ছিল আমরা এখন ঠিকই বুঝি। কিন্তু সেদিন ছিল ভিন্ন সময় । তবুও তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার কর্মীর হাতের পরশ লাগিয়েছিলেন। কিন্তু অসহিষ্ণু তরুণ সমাজ, বাংলাদেশবিরােধী শক্তি, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা—সব মিলে তার কঠিন পথচলাকে আরও বাধার মুখে ফেলে দেয়।
সাহসী মানুষ বঙ্গবন্ধু এসব প্রতিবন্ধকতা মােকাবেলা করে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য নানা উদ্যেগ নিয়েছিলেন। বছর শেষ হত বাম্পার ফলন। বাস্তবেও তাই হয়েছিল।
গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু জটিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনিশ্চয়তা দূর করার লক্ষ্যে জরুরি আইন জারি করলেন। গড়লেন একক রাজনৈতিক মাের্চা—বাকশাল। তিনি নিয়েই বলেছেন, এ ছিল সাময়িক পিছু হটা। ঘনিষ্ঠজনদের মতে দ্রুতই পণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুর পরিকল্পনাও তাঁর ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্তের একাংশ তাকে ভুল বুঝলেন। তবে তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাকে এ কঠিন পর্যায় পার হওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় সময় দিতেও প্রস্তুত ছিলেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেসময় সমাজে বেশখানিকটা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দানা বেঁধেছিল। এই আপাত বিভ্রান্তির চোরাগলি দিয়ে ঢুকে পড়ে যড়যন্ত্রকারীর দল। সামরিক বাহিনীর ক্ষুদ্র একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা পঁচাত্তরের পনেরােই আগস্টের রাতের অন্ধকারে বাঙালির সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যা করল। তার দুই কন্যা বিদেশে থাকায় বেঁচে গেলেন। এভাবেই শারীরিকভাবে নিঃশেষ হয়ে গেলেন বাঙালির প্রিয়তম জাতীয় বীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু বাঙালির মন থেকে তাকে মুছে ফেলার হাজারও চেষ্টা বিফলে গেছে। আজ তিনি আরও বড় হয়ে বিপুলভাবে বাঙালির হৃদয়ে আসন গ্রহণ করেছেন। দীর্ঘদিন পরে হলেও পাঠ্যপুস্তকে বাঙালির জাতির পিতা হিসেবে তিনি তার যথাস্থান ফিরে পেয়েছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রায়েও তার বিপুল অস্তিত্বের স্বীকৃতি মিলেছে। যারা ব্রার রাজনীতিকে সমর্থন করেননি তারাও আজ বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের যথােপযুক্ত স্থানে দেখতে পেয়ে সন্তুষ্ট।
এদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ সৃষ্টির আন্দোলনের সব কথা সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি আমরা। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। কিন্তু তাই বলে তিনি হারিয়ে যাওয়ার নন। দিনদিনই তিনি বিস্তৃত হচ্ছেন বাংলার পথে-প্রান্তরে। কেননা তিনিই যে বাংলাদেশ। তাঁকে ছাড়া বাংলাদেশকে যে ভাবাই যায় না। সেই যে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করেছেন, তারপর একদিনের জন্যও বাংলাদেশের স্বার্থ ছাড়া।
অন্যকিছু ভাবতে পারেননি তিনি। আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাই বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু সংকটকালে তিনি যেমন করে বুক চেতিয়ে দাঁড়িয়েছেন বান্তালির মুক্তির জন্য তেমনটি আসলেই বিরল। আর সে কারণেই তিনি হতে পেরেছেন বাংলাদেশের আরেক নাম। সে কারণেই গবেষক এসএ করিম লিখতে পেরেছেন—বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশ ওই সময় স্বাধীন হতে পারত। কিনা সে বিষয়ে মাের সন্দেহ রয়েছে।
সর্বক্ষণ স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য নিমগ্ন ছিলেন বলেই তিনি হতে পেরেছেন বাঙালি জাতির পিতা। স্বাধীনতার প্রধান রূপকার। শ্রেষ্ঠতম বাঙালি। বাস্তালির মেজাজ, আবেপ, লড়াকু মন, প্রতিবাদ, প্রতিদান, মানবিকতা, নমনীয়তা, সাহস—সব বৈশিষ্ট্যেরই প্রতীক তিনি। এখনও তিনিই যে আমাদের ভরসার প্রতীক। আর এমন একজন জাতীয় বীরকে হত্যা করেছে এদেশেরই কতিপয় বিশ্বাসঘাতক। সে কারণেই জাতি হিসেবে বাঙালির দুঃখ যেন আর শেষ হচ্ছে না। জাতীয় এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের এই বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি দিতেই হবে। পাশাপাশি পুরাে জাতিকে প্রস্তুত করতে হবে তার আদর্শের কল্যানধর্মী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার জন্য। আমাদের সুকর্মের মধ্যেই তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন। তিনি যে আমাদের সচল অস্তিত্বের সমান। আমাদের জীবনেরই অংশ। আর সে কারণেই নিরন্তর মনে হয় তিনিই বাংলাদেশ।
যুগান্তর ১৫ আগস্ট ২০০৮
বাস্তালির ইতিহাস-চেতনা ও বঙ্গবন্ধু
আবদুল মান্নান চৌধুরী
প্রায় দশ বছর আগের কথা বলছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৌখিক পরীক্ষা নিতে স্থানীয় একটি কলেজে গিয়েছিলাম। বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নের সদুত্তর না-পেয়ে আমি একজন ছাত্রকে সাধারণ জ্ঞানের ওপর প্রশ্ন শুরু করলাম। আমার প্রথম প্রশ্নটি ছিল । বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস কবে?’ ছাত্রটি উত্তর দিতে গিয়ে ইতস্তত করতে থাকায় ভাইভা বাের্ডের অন্যতম সদস্য তারই শিক্ষক বলে বসলেন । আরে এ সাধারণ প্রশ্নের জবাবটাও পারলে না; বলাে, ১৬ ডিসেম্বর। আমার আক্কেল গুড়ুম হওয়ার অবস্থা। আমি তাকে আর কোনাে প্রশ্ন তাে নয়ই অন্য ছাত্রদেরও সেদিনের জন্য আর কোনাে প্রশ্ন করলাম না।
তার দুবছর পর এবারে খােদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে গেলাম। এবারে আমি পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। ছাত্রছাত্রীরা কোনাে প্রশ্নের তেমন সঠিক জবাব দিতে পারছিল না। আমি মানসিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সাধারণ জ্ঞানের বিষয়ে প্রশ্ন করতে সিদ্ধান্ত নিলাম। এই সময় শুধুমাত্র জহুরুল হক হলের ছাত্ররাই একের-পর-এক আসছিল। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘আচ্ছা তােমাদের হলের নামকরণ যার কারণে হয়েছে তিনি কে ছিলেন? বিন্দুমাত্র বিস্মিত না হয়ে হত্রটি জবাব দিল, সার্জেন্ট জহুর পুলিশের একজন সার্জেন্ট ছিলেন। তারপর আর একজন ছাত্রকে একই প্রশ্ন করলাম। তার জবাব, উহ, সার্জেন্ট জহুর বিমানবাহিনীর সার্জেন্ট ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অসাধারণ অবদানের জন্য তার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হলটির নামকরণ করা হয়েছে। আমি কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এরপর যে ছাত্রটি মৌখিক পরীক্ষা দিতে এল তাকেও একই প্রশ্ন করলাম। এই ছেলেটির জবাব শুনে আমার আবারও রাগান্বিত হওয়ার কথা। সে বলল : ‘সার্জেন্ট অজুর পুলিশের একজন সার্জেন্ট ছিলেন। একবার শেখ মুজিব একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অন্যদিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে গুলি করে বসল। বিদ্যুৎগতিতে সার্জেন্ট জহুর শেখ মুজিবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান। গুলি অহুৱেৱ বুকে লাগে এবং তিনি তখনই মারা যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শেখ মুজিব কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ জহুরের নামে একটি হল প্রতিষ্ঠা করেন। আমি এ ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলাম । এই যে শেখ মুজিব নামক একজনের কথা বললে তিনি আসলে কে? এ প্রশ্নের জবাবে ছাত্রটি বলল । আগে তাে জানতাম জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘােষক, এখন জানতে পেরেছি শেখ মুজিবই স্বাধীনতার ঘােষক।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের স্বাধীনতার ঘােষণা কৰে দেয়া হয়েছিল? ছেলেটি নির্ধিধায় জবাব দিল ২৭ মার্চ ১৯৭১। তাকে আমার শেষ প্রশ্ন ছিল : তাহলে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস কীভাবে হয়?’ এবার ছেলেটি স্বীকার করল যে আসলে আমরা তেমন কোনাে পড়াশুনা করি না। টেলিভিশনে যা শুনি তাই আমরা তোতাপাখির মতো বলি। খালেদা জিয়ার আমলে এক কথা এখন আর এক কথা শুনছি।’ আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। | এটা জানপাপীদের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। যারা অ-জ্ঞান, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা কেমন? আমি একজন বঙ্গবন্ধুপ্রেমিককে জানি যিনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন । ‘আচ্ছা বঙ্গবন্ধু নাকি কলকাতার বেকার হােটেলে থাকতেন। তিনি কি চাকরিবাকরি। করতেন না? এ অজ্ঞানতা ক্ষমার অযােগ্য অপরাধ নয়।
আর কী অজ্ঞতা আমাদের মন ও মনকে চেপে বসে আছে। আমি বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতাকে বলতে শুনেছি কায়েদে আযম মােহম্মদ আলী জিন্নাহ, অথচ তারা জাত্রজীবন থেকেই মােহাম্মদ আলী জিন্নাহকে অস্বীকার করে আসছিলেন। এসব নেতার অনেককেই বঙ্গবঙ্গকে শতাব্দীর মহানায়ক কিংবা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নেতা বলে গলা ফাটিয়ে বক্তৃতা দিতে শুনেছি। তারা যখন এসব কথা বলছিলেন তখন আমাদের মতো কলাম-লেখক, গবেষক ও বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করে আসছিলাম। | শুধু লেখায় নয়, একবার জাতীয় যাদুঘরে এক বক্তব্যে আমি বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে অভিহিত করলাম । যাদুঘর থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে এক ব্যক্তি আমার পিছু নিলেন। তিনি আমাকে থামিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তো বললেন বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, তাহলে নেতাজি সুভাষ বােস বা বিশ্বকৰি রবীন্দ্রনাথের স্থান কোথায়?’ আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ ও সুষ বােস যে ৰাস্কালি ছিলেন তা অনস্বীকার্য। তবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন কবি, দার্শনিক ও সমাজসংস্কারক। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তাই তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কোন্ ভিত্তিতে তুলনা করা যায়?
আমি আরাে বললাম । রাজনীতিবিদের সঙ্গে রাজনীতিবিদের তুলনা করতে গেলে নিঃসন্দেহে নেতাজি সুভাষ বােস ও ভর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তুলনা চলে আসে। সুভাষ বােস বাঙালির চেয়ে ভারতবাসীর মুক্তির আন্দোলন করেছেন এবং সশস্ত্র পন্থায় ভারতকে স্বাধীন করতে প্রয়াসী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়েছে, স্বাধীন হয়নি। ভারত বিভক্তিতে বাঙালিদের পরাধীনতার জিঞ্জির আবার নতুন করে পরতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এ কারণেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি যিনি বাঞ্চালিদের মনে ও চেতনায় স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে ক্ষান্ত হননি, তিলে তিলে তিলােত্তমা গড়ার সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের জন্য একণী আখীন সার্বঙ্গেীয় বার প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তদুপরি তিনি এমন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন যার পরিচিতি গোলিক সীমারেখায় শুধু আবদ্ধ নয়; তার আদর্শিক ভিত্তি হচ্ছে গাণিক, গণতাকি সাময় ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
আমার সেদিনের কথায় প্রলােক সন্তুষ্ট হতে পেরেছিলেন কিনা আমার বােধে আসেনি। হয়তাে তাকে আর বেশ কটি বছর অপেক্ষায় থেকে বিবিসির জাযাকারের সুখে কাকে ছিল। বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বালি”। বিবিসি অফিল শেষে তিনি আমার কথাটি মেনে নিয়েছিলেন, না ীয়বাদী আঁতেলদের মতাে কাঁধ দিয়ে ঠেলে বলে যাচ্ছিলেন-‘না শেখ মুজিব এটি নয়, শেখ মুজিব সেটা নয়, তাকে জাতির জনক বলা যায় না, স্থপতি বললেই তাকে মেনে নিতে আমাদের আপত্তি নেই। এসব কথা যারা বলেন কিংবা বলে যাচ্ছেন তাদের সুস্পষ্ট পরিচিতি ওলি পনা আছে। এমন মানুষ আছে যাদের পরিচিতি জানতে আরাে একটু গভীরে যেতে হয়। আমি তেমন একজনের দেখা পেয়েছিলাম। তার কথাই আমি এখন বলব। | তার নাম অলি আহাদ। তাকে চিনে এমন বান্ধলি করুন। আমার মাঝে মাঝে নিজের ওপরই গলা ধরে যায়। ক্লাসে ছাত্রদের তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেচ্ছিলাম। আমার পুরাে ক্লাসের একজনও তাকে চেনে না। এটি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রজন্ম। আমি দুখ পেয়েছি। | যাক প্রাসঙ্গিক কথায় ফিরে আসি। একবার যেকোনাে কারণেই হােক আমি প্রীতিমতাে সংবাদপত্রের পাতায় আসছিলাম। অলি আহাদ সাহেব আমাকে স্কেকে পাঠালেন। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ এড়াতে বিভিন্ন ছলচাতুরির আশ্রয় নিলাম। কেননা তিনি বঙ্গবধু শেখ মুজিব সম্পর্কে লেখা ও বক্তব্যে কদর্য অনেক কথা শিখিখায় বলে গেছেন। তবুও পীড়াপীড়িতে জমি অলি আহাদ সাহেবের বাসায় গেলাম। খেলামি, আলাপ করলাম ও উঠি উঠি করছিলাম। অনেক আলােচনা-সমালােচনার এক ফাকে তিনি তার দুটো হাতের কতি একত্র করে দুটো বুকে আঙুল স্পষ্ট উচিয়ে বললেন, আমার ভাইয়ের মতাে ব্যাড়া এই বাংলার মুলুকে কোনােদিন জান নেয়নি বা আর নেবেও না। আমি বললাম, আপন ভাইটি কে? তিনি বললেন, “আমার ভাইকে চিনলেন না, তাহলে আর কি দেশ সমাজ উদ্ধার করবেন। আমি বললাম, আমি আপনার ভাইকে বােধহয় চিনি, আপনাকেও চিনি, এৰে চিনেও চিনতে পারছিনে।” আমার কথার সূত্র টেনে ধরে অলি আহাদ বললেন, ‘আমার ভাইকে চিনলেন না, আমার ভাই হচ্ছে মুজিব ভাই, আপনার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। আমি বললাম, ‘সেটি যে আমি আপনার এক্ষণের আলাপ থেকে বুঝিনি তা নয়, তবে আপনাকে যে আজ চিনতে না হচ্ছে। আপনি কেমন করে এমন একজন মহামানব সম্পর্কে এত এত খারাপ কথা আপনা কে লিখতে পারলেন? কেমন করে বক্তৃতায় তাকে একজন ভিলেন বানিয়ে জানো আমার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিনি বললেন, ‘সেসব রাজনীতির ভাষা, আমার ভাইয়ের মতাে বাড়া এ মুলুকে আগে কখনো জানায়নি, ভবিষ্যতেও হন নেবে না।’ অলি আহাগ সাহেব বিবিসির জরিপের কারণে তা বলেননি। বিবিসির জরিপের অন্তত তিন বছর আগে তিনি এমন কথা বলেছিলেন। বিবিসির জরিপের পর বা নিকট অতীতে তার সঙ্গে আমার দেখা বা কথা হয়নি। কারণ, আমি এখন গুরুত্বহীন ব্যক্তি এবং অনেকের স্মৃতির কালাে হয় আমি নীত হয়েছি। আমি আজ এখন কারাে মতামত প্রভাবিত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। তবুও ক্লাসে ‘নে পড়াতে গিয়ে বাঙালির ইতিহাস রুনাকে আর একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলাম। জাতক ও স্নাতকোত্তৰ ছাদেরকে প্রশ্ন করলাম । “মেমার দৃষ্টিতে এ দেশে কে সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা? শিক্ষার্থীরা লিখিতভাবে তার জবাব দিয়েছে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম ছাত্রছাত্রীদের প্রায় নব্বই শতাংশ বঙ্গবন্ধুকে তাদের প্রিয় নেতা বলে অভিহিত করেছে। এবারে আমার নিজেকে নিজের প্রশ্ন করার পালা। এই যুদ্ধউর দ্বিতীয় প্রজটি কি সত্যিই ইতিহাসগছেন। তাদের পূর্বসূরি কি ইতিহাস-অচেন?’ আমার বিশাল কাদের পূর্বসূরিরা অনেকেই ইতিহাসসচেতন তবে সতের মুখোমুখি হতে অপারগ—অনেকটা সামাজিক প্রতিবন্ধী। তারা পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে ভীতসন্ত্রস্ত, জীবনজীবিকার তাগিদে পরিবেশের দাস।
এরচেয়ে বড় দাসের সন্ধান আমি পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেভিয়ামে ক্রিকেট খেলার কারণেই নাকি বিয়ে বঙ্গবন্ধুর নাম লেকেরা সুৰছে। সে কারণে তারা নাকি সবাইকে ছাড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বিবিসির জরিপে কেট নিয়েছে। তাই বঙ্গবন্ধুকে দুতে মুছতে তবু নামফলক মেয়ে নয়, ইতিহাস বিকৃত করে নয়, বরং ক্রিকেট স্টেডিয়ামাকে ফুটবল স্টেজিগমে রূপান্তর করা হয়েছে থাকে বিশ্বের বাঙালিরা বঙ্গবন্ধু নাম আর না শুনতে পারে এবং তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্কলি নামে অভিহিত না। করে। আমি বিস্মিত নই, তবে প্রসঙ্গত প্রফেসর রেহমান সােবহানের একটি কথা স্মরণ কবিয়ে দিতে চাই—“আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যারা ইতিহাসকে স্মরণ করতে চায় না, ইতিহাসের আঁস্তাকুফে নিক্ষিপ্ত হওয়াই ভাদের কপালে জোটে।
ভোরের কাগজ ১৫ আগস্ট ২০০৮
রক্তস্নাত একাত্তরকে ফিরে দেখা
এম, আবদুল হাফিজ
ঘােষণা দিয়েও স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশগ্রহণ না করে বঙ্গবন্ধু কেন বন্দিত্ব বরণ করেছিলেন সে বিতর্কের এখনও অবসান হয়নি। নিন্দুকরা সময় ও সুযােগমতাে এখনও এই অভিযােগের ফণা উত্তোলন করে এবং তা বঙ্গবন্ধুর বিপদসংকুল যুদ্ধের ময়দান এড়ানাের কৌশল বলে অভিহিত করে। নিবন্ধের শুরুতেই যে-বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়ােজন তা হল বঙ্গবন্ধু আজীবন জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রবক্তা ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে নেপােলিয়ন যুদ্ধবিগ্রহ ক্ষতবিক্ষত ইউরােপে ওয়েস্টফেলিয়া সন্ধির আওতায় প্রথম জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলেও এই প্রক্রিয়ার নিস্পত্তি দুটি বিশ্বযুদ্ধেও শেষ হয়নি। ঔপনিবেশিকতার অবসানে জাতিগত দ্বন্দ্ব বরং নতুন করে দাবানলের মতাে জ্বলে ওঠে। বিধ্বংসী যুদ্ধের ছােবল থেকে অব্যাহতি পেতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে জাতিগত বিদ্রোহের বিরুদ্ধে একটি অঘােষিত এক সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশ্বময় জাতিগত বিভক্তির ক্ষেত্রে এক চূড়ান্ত সীমারেখা টানতে উদ্যোগী হয়। নতুবা যেভাবে এই বিভক্তির প্রক্রিয়া অগ্রসর হচ্ছিল তাতে বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা ছিল মাত্র সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু ও তার ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের মধ্যে এই সত্যটি অনুধাবন করার প্রয়া অবশ্যই ছিল। খাটের দশকের শেষদিকে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রায় একটি জাতীয়তাবাদী আকাক্সক্ষার উন্মেষ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বলে চিহ্নিত হওয়ায় তা ব্যর্থ হয়েছিল। ইতিহাস ও সমকালীন বিশ্বের এই গতিপ্রকৃতি উপেক্ষা করার উপায় প্রচণ্ডভাবে জাতীয়তাবাদীদেরও ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল শুধু স্ব-সংরক্ষণের খাতিরেই নয়, বরং আজন্ম লালিত স্বাধিকারের স্বপ্নকে সংরক্ষণ করতে। তাই তিনি সব সময়ই আঘাত পাওয়ার পরই প্রত্যাঘাতের পক্ষপাতী ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর লক্ষ্যের যথার্থতা সম্বন্ধে তাঁর অবিচল বিশ্বাসও কম দায়ী ছিল না। তাই তিনি রণক্ষেত্রের চেয়েও বিপদসংকুল বন্দিত্বকে বরণ করে বাঞ্চালি জাতির দাবি এবং তা আদায় করার পথকে বিচ্ছিন্নতাবাদের মতো কলঙ্ক থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। | ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার আকস্মিক হানার প্রাক্কালে যেকোনাে রণক্ষেত্রের ভয়াবহতার চেয়েও মহাবিপদাপন্ন অবস্থানে ছিলেন বঙ্গবন্ধু তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ৩২ নম্বরের ছােট্ট নিরাপত্তাহীন দ্বিতল বাড়িটিতে।
‘সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার মাত্র পনেরাে মিনিটের মধ্যে মেজর বেলালের কমান্ডাে দল ৩২ নম্বরে হাজির। টিক্কা খার পরিকল্পনা অনুযায়ী মাত্র ৪ ঘন্টার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে বিদ্রোহী পূর্বাঞ্চলে। ইতিমধ্যে ২৫ মার্চের সন্ধ্যা ৭ টায় দেশের প্রধান সেনাধ্যক্ষ জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ রাতের অন্ধকারে চোরের মতাে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। তার নির্দেশানুযায়ী মধ্যরাতের কিছু পরে যখন চণ্ড আচরণের অপরিশীলিত দখলদার পাকসেনারা ইতিহাসের জঘন্যতম ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত, ইয়াহিয়া তখন রণক্ষেত্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে পৌছে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযােগ এনেছেন।
পাকিস্তানের লেনিন পুরস্কার বিজয়ী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ ২৫ মার্চে সূচিত হত্যাযজ্ঞকে ‘কলে আম কি মেলা’ বা ‘গণহত্যার উৎসৰ’ বলেছেন। লজ্জারও একটা দহন-যন্ত্রণা থাকে। সেই যন্ত্রণায় তিনি নাকি রাওয়ালপিন্ডির ফ্লাশমান হােটেলের এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মুখ লুকিয়েছিলেন। কবি-শিল্পীদের মনে সম্ভবত সর্বত্রই এমনই। প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকে। কবি এজরা পাউন্ডও নাকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা দর্শনে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন।
এদিকে কী হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ৩২ নম্বরের শত্রুসেনা পরিবেষ্টিত দ্বিতল হােট বাড়িটিতে? কোনাে রাজকীয় অভ্যর্থনা বা সমাদর অথবা শাহী মেহমানখানায় রাত্রি যাপনের আমন্ত্রণ—যেমনটি নিন্দুকরা নিরন্তর প্রচারে লিপ্ত থাকে। মাত্র দুদিন আগে আপস-নিস্পত্তির আলােচনার অন্তরালে যুদ্ধপ্রস্তুতি সমাপ্ত হয়েছে দুপক্ষেই। দখলদাররা। একটি আকস্মিক হামলার অপেক্ষায় এবং বঙ্গবন্ধুর অনুসারী মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি প্রতিরােধের। সারাদিনে তারই শলাপরামর্শে কেটেছে বঙ্গবন্ধুর সময়। হামলার অবশ্যম্ভাবিতা নিয়ে কোনাে দ্বিধায় ছিলেন না তিনি। প্রয়ােজনে বন্দিত্ব বরণেও অপ্রস্তুত ছিলেন না।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাঙ্গালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন—স্বাধিকারের জন্য সফল সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা লাভকে নিয়ে কোনাে বড়মাপের প্রামাণ্য পুস্তক বা গবেষণাগ্রন্থ বাংলাদেশে রচিত হয়নি। স্বাধীনতাযুদ্ধে নিজ নিজ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু কিছু পুস্তক অবশ্যই রচিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলাে এই এপিক সংগ্রামের বহু তথ্য, অনেক প্রশ্নের উত্তর এবং অন্দরমহলের অনেক চাঞ্চল্যকর বিষয়ের ওপর আলােকপাত করতে অক্ষম। মিত্রবাহিনীর একাধিক অধিনায়কের লেখাতেই আমরা পাই তাদের কৃতিত্ব কাহিনী এবং পাকিস্তানি লেখকদের রচনায় রয়েছে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে যথার্থ প্রমাণ করার প্রয়াস। তাই অনেক অজ্ঞাত কণা, ঘটনা এবং চরিত্র কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে এবং এখন সেগুলাে অতীতের অন্ধকার থেকে উদ্ঘাটনের অপেক্ষায় রয়েছে।
আমরা অনেকেই জানি না যে, বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের দায়িত্বে প্রেরিত কর্মকর্তার সহগামী এক হাবিলদার এই মহান পুরুষের মুখে চপেটাঘাত করেছিল। বঙ্গবন্ধু এদের। আগমনের আভাস পেয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলে এই কুলাঙ্গার হাবিলদার নিছক আক্রোশে বঙ্গবন্ধুর গনেশে চপেটাঘাত করে। বেগম মুজিব এবং শেখ কামালসহ তার কন্যাসন্তান মৃদু প্রতিরােধের চেষ্টা করলে কমান্ধো দলের কর্মকর্তা তাদের সঙ্গে আচরণ কৰে। গ্রেফতারের রাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে কানন্টে ফ্লাগ স্টাফ হাউসে রাখা। হলেও পরদিন কে বিশেষ বিমানে পাকিস্তানে প্রেরণ করা হয়। ২৬ মার্চ পাকিস্তানে কোনাে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়নি। ২৭ মার্চের সংবাদপত্রে শিয়ালকোটে অবস্থান এই নিবন্ধকার প্রথম পুলিশ প্রহরাধীন বঙ্গবন্ধুর শান্ত সৌম প্রতিকৃতিটি দেখে। | বঙ্গবন্ধুকে পশ্চিমা বিশ্বে পােয়েট অব পলিটিক্স’ বলা হয়েছিল। তাঁর রাজনীতিতে অবশ্যই কবিতায় সাবলীলতা ছিল, কিন্তু আমার ধারণায় তার ক্ষেত্রে পরমােৎকৃষ্ট (Consummata) রাজনীতিকে” পাদটীকাটিই অধিক প্রযােজ্য। তিনি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান, শক্তি ও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সদাসচেতন ছিলেন। তাই পাকিস্তানিদের বন্দিশালায় পিয়ে তাকে বিচলিত দেখায়নি। তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও যথার্থতা প্রমাণিত হয় যখন ইয়াহিয়া খাঁ তাকে দেশদ্রোহী প্রমাণিত অভিহিত করে এবং জেলের অভ্যন্তরে ব্রিগেড়িয়ার বহিষুদ্দীন খাঁর নেতৃত্বে তথাকথিত ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদকের রায় দিয়েও তা কার্যকর করতে ব্যর্থ হন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে যখন বঙ্গবন্ধুকে এই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, আন্তর্জাতিক জনমত তখন প্রচণ্ডভাবে পাকিস্তাদবিরােধী। স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ভুমিকার মূল্যায়নে থাৱাই ব্রতী হন তাদের শুরুতেই একটি কথা অনুধাবন করতে হবে যে, তিনি ছিলেন এ সংগ্রামের হোচিমিন; গিয়ানা নন।
কোনাে রাজনৈতিক দীক্ষাগুরুর মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে তাঁর অনুসারীদের সেই গুরুর দৈহিক অনুপস্থিতিতেই এমনষ্কাৰে অার লক্ষ্যে পৌৱে নিদর্শন ইতিহাসে বিরল। রাজনীতিতে সেই বিরল প্রজাতিরই একজন ছিলেন বঙ্গব, যিনি তাঁর প্রায় প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। সামানা আপস করলেই তিনি পাকিস্তানের মতো বৃহকর রাষ্ট্রসতার কথায় হতে পারতেন। আসলে পাকিজানিবা তাকে সেভাবে ভাবতে শুরু করেছিল। অনেক পাকিস্তানি, যার মধ্যে জেদ্ধ এ সুলেলির মতাে প্রচ বাঙালি স্ত্র মুজিব-বিদ্বেষীরাও অন্তর্ভূক্ত ছিল, তারা সত্তরের নির্বাচনের পর থেকে সংবাদপত্রে মুঝিবের প্রশস্তিমূলক কলাম লিখতে শুরু করেছিল। আমরা যারা বাঙ্গালি কর্মকর্তা সেসময় পাকিস্তানে অবস্থান করছিলাম, আমাদের ভাগ্যেও বাড়তি সম্মান ও মর্যাদা জুটেছিল। পাকিতানি সহকর্মী ও বন্ধু কারণে-অকারণে আমাদের জোয়াজ-ভাঙ্গিমে লিপ্ত হয়েছিল। সে এক অভিজ্ঞতা।
২৫ মার্চ যে গণহত্যার সূচনা হয়েছিল তার যুপকাষ্ঠে বলি হয়েছিল ত্রিশ লাখ বাঙ্গালি । নিন্দুকা বঙ্গবন্ধু প্রদত এই পরিসংখ্যানকে অতিরঞ্জিত বলেছেন এই যুক্তিতে যে, তিনি নাকি অযুত-নিযুতের পার্থক্য বুঝতেন না। তাই তিন লাখ বলতে গিয়ে তিনি ত্রিশ লাখের কথা বলেছেন। পাকিস্তানে প্রকাশিত একাত্তর সংক্রান্ত গ্রহলােতে তা ত্রিশ হাজার বলা হয়েছে এবং অধিকাংশই নাকি ছিল অবালি। বাংলাদেশে ছড়িয়েছিটিয়ে অসংখা বধ্যভূমিই প্রমাণ যে ফী পরিমাণ বাঙালি শােণিতে ‘রক্ত লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। এখানেই চেঙ্গিস খানের নতুন সংস্করণের ধ্বংসযজ্ঞের শেষ নয়। এরা ১ কোটি মানুষকে গৃহহীন করে সীমান্ত অতিক্রম করে ভিনদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছিল। হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া ছাড়াও পলায়নপর দরিদ্র জনগােষ্ঠীর সর্বস্ব লুণ্ঠন করেছিল। লুণ্ঠন করেছিল ২ লাখ মা-বােনের সম্রম। বিজয়ের আগমুহুর্তে এই নরপশুরা বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। ওদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদররা এখনও বুক ফুলিয়ে চলে। আর স্বাধীনতার সপক্ষের দাবিদাররাই শতধাবিভক্ত। | অতীতের অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে। তাই বারবার আমাদের একাত্তরকে ফিরে দেখার প্রয়ােজন আছে। নতুবা আমরা আগামীর পথ হারিয়ে ফেলব—যেমন হারিয়ে ফেলেছিও কিছুটা। একাত্তর আমাদের তীর্থ, যেখান থেকে বারবার আমাদের পরিশুদ্ধি লাভ করতে হবে।
সুগষ্ণর ২৭ মার্চ ২০০৮
বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কী করতেন?
আবদুল গাফফার চৌধুরী
১৭ মার্চ সােমবার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিবস। তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে তাঁর বয়স হতাে ৮৮ বছর। এই বয়সের চেয়েও বেশি বয়স পর্যন্ত অনেক জাতীয় বীর এবং রাষ্ট্রনায়ক বেঁচে ছিলেন এবং কেউ কেউ এখনও আছেন। চার্চিল, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা, আরও কতজনের নাম বলব! মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, তিনি ১২৫ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন। হয়তাে বাঁচতেন। তাকে বাচতে দেয়া হয়নি। নাথুরাম গডসে তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল। বঙ্গবন্ধুকেও বাঁচতে দেয়া হয়নি। | আজ কদিন যাবৎই দুই খণ্ডে প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক বইটি কখনও পড়েছি, কখনও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নতুনভাবে ভেবেছি। দুই খঞ্জের বইটি প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী। কিন্তু আসল কৃতিত্ব রাজনীতিক ও গবেষক মােনায়েম সরকার এবং তাকে এই বইটি সম্পাদনায় সহায়তা দিয়েছেন সেই সম্পাদনা ও প্রামাণ্যকরণ পরিষদের । এই পরিষদে যারা ছিলেন তারাও সবাই আমার। পরিচিত। কেউ কেউ বধু, কেউ কেউ শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এই পরিষদের সন্তোষ গুপ্ত (প্রয়াত), গাজীউল হক, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, বােরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আনােয়ার হােসেন এবং আশফাক-উল-আলম—সবাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক এবং গবেষক হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণা এবং সে সম্পর্কে এতদিন পর প্রকৃতই একটি প্রামাণ্য বই প্রকাশ করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য অবশ্যই মােনায়েম সরকার এবং সম্পাদনা পরিষদের সদসাদের কাছে জাতি কৃতজ্ঞতা বােধ করবে।
বইটি বহু আগে প্রকাশিত হতাে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে যে নরপশুরা হত্যা করেছে, তাদের কাজের বেনিফিশিয়ারি এবং একাত্তরের ঘাতকরা দীর্ঘকাল ক্ষমতায় অবস্থান করায় বাংলা একাডেমীর মতো সংস্থার পক্ষে বইটি যথাসময়ে প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। চক্রান্তের হােতারা বঙ্গবন্ধুকে কেবল হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ক্ষমতায় বসে তার নাম, পরিচয়, কীর্তি এবং স্মৃতি পর্যন্ত মুছে ফেলে তাদের পৈশাচিকতাকে তৃপ্ত করতে চেয়েছে। বাংলা একাডেমীর বর্তমান কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, কারণ তারা শেষপর্যন্ত এই ঐতিহাসিক গ্রন্থটি প্রকাশ করার সাহস দেখিয়েছেন।
অবশ্যই তা পঁচাত্তরের ঘাতকদের ক্ষমতা থেকে পতনের পর। তবু বলব, বেটার লেট ল্যান নেতার। | আজ এই বইটি নিয়ে আলােচনা করতে বসিনি। এতবড় বই সহসা শেষ করে ওঠা সম্ভব নয়। বও তথ্যসমৃদ্ধ বই। ভুলভ্রান্তি কিছু রয়ে গেছে কিনা জানি না। সুতরাং বইটির দুই খণ্ডই পড়া শেষ হলে আলােচনা করার ইচ্ছা রাখি। আমার আজকের আলােচনা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। মােনায়েম সরকার সম্পাদিত দুই খণ্ডের বইটি নাড়তে চাড়তে গিয়ে বারবারই মনে একটা প্রশ্ন জাগছিল। বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন। তাহলে কী করতেন? আজ বাংলাদেশের সামনে যে সমস্যা তা একাত্তরের চেয়েও ভয়াবহ। একাত্তরে সমস্যা ছিল একমাত্রিক। এখনকার সমস্যা বহুমাত্রিক এবং বহুগুণ। জটিল। কেবল সাহস দিয়ে এই সমস্যার মােকাবেলা করা যাবে না। সাহসের সঙ্গে চাই সম্পূর্ণ নতুন কৌশল ও নতুন রণনীতি। বর্তমানে বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধু কি সেই নতুন কৌশল ও নতুন রণনীতি উদ্ভাবন ও প্রয়ােগ করতে পারতেন? | ১৯৭১ সাল ও ২০০৮ সালের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। একাত্তর সালে বাঙালির শত্রু ছিল বিদেশী এবং চিহ্নিত পরিচয়ের। এই শত্রুর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কৃষক, মজুর, ছাত্র, জনতা, এমনকি উদীয়মান নব্যধনী, ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরাও ছিল ঐক্যবদ্ধ । কারণ দেশ স্বাধীন হলে কেরানি চিফ সেক্রেটারি হতে পারবে। মেজর হতে পারবে রাতারাতি জেনারেল। মিউনিসিপালিটির কর্মকর্তা হওয়ার যােগ্যতা নেই এমন রাজনীতিক হয়ে যাবেন সাংসদ, মন্ত্রী। বাঙালি পরিচয়ের জন্য যে ব্যক্তি এতদিন বিদেশের দূতাবাসে থার্ড সেক্রেটারির উপরে উঠতে পারেননি, তিনি হয়ে যাবেন রাষ্ট্রদূত। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা সবার জন্যই সােনার ডিম পাড়বে। এমন সম্ভাবনা সামনে থাকায় কেনা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে স্বাধীনতার সমরে বীর যােদ্ধা সাজবে। | এই যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সফল হয়নি। যুদ্ধটা ছিল। সরাসরি। একদিকে বিদেশী হানাদার, অন্যদিকে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি। নেতা বঙ্গবন্ধুর মতাে সাহসী সংগ্রামী মানুষ। বিশ্বপরিস্থিতিও ছিল এই যুদ্ধে বাঙালি জাতির অনুকূলে। বিশ্ব তখন দুই শিবিরে বিভক্ত। আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শিবির, অন্যদিকে সাবেক সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজবাদী শিবির। এই সমাজবাদী শিবির ছিল বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কাছের এবং বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতও ছিল এই মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক দেশ। তাই পাকিস্তানের হিস্র সামরিক জান্তা বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েও সফল হতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে জেলে পুরেও হত্যা করতে পারেনি। শ্বেতাঙ্গ কারাগারে দীর্ঘ ২৭ বছর বন্দি থেকেও নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণআফ্রিকার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছেন, তেমনি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে সম্ভাব্য ফাঁসির আসামি হিসেব বন্দি থেকেও বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।
কিন্তু আজকের অর্থাৎ ২০০৮ সালের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সােভিয়েত ইউনিয়নের অতি নেই। বিশ্ব আজ একটি শিবিরের করতলগত। আঠারাে শতকের ঔপনিবেশিক মিশ্র নিয়ে আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল wিই পেরিয়ালিজম এখান বিশ্বাসে পাক। ১৯৫৬ সালে ইঙ্গ-ফরাসি ও ইসরাইলি হামলার মুখে মিশৱ শুধু রক্ষা পায়নি, প্রেসিয়ে বসে প্রাণে বেঁচে গেছেন। কারণ নাসেরের পেছনে দাড়িয়েছিল সােভিয়েত ইউনিয়ন। একুশ শতকের গােড়ায় ইরাকে বিটেন ও আমেরিকা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অবৈধ আগ্রাসন চালিয়ে দেশটিকে শুধু কংস কলে, দেশটির প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকেও হত্যা করেছে। কারণ আজ সমাজৰাণী বিশ্বশিবির নেই। উপমহাদেশের চিত্রও আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যে জাতি ছিল এশিয়ায় গণতা ও ধর্মনিৰপেক্ষ দুগ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে প্রতিবােধের খাতি, সেই ভাবও আজ ধিকৃত, রক্তপিপাসু বুশ প্রশাসনের কাছে নতজানু পরমাণু-এ। বাংলাদেশে নরপশু গােলাম আযমসের অশে অকেও মাজ পশু নরেন্দ্র মােশিদের জয়জয়কার। আজ সিঞ্চি কল লকার এবং পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিষ্ট সাধক খোলীদের কাছে নতা এবং অন্যলিকে সেই কমিউনিটি সকাব নন্দিগ্রাম ও সিরে কুক আদােলন দমনে নির্বাচায় গুলি চালায়। একুশ শতকে এই ট্রাজেডিও আমাদের দেখে যেতে হল। | ভাৱতও কি আজ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ও আন্দোলনের পাশে মিত্র হিসেবে আছে। না, নেই। ভারতের জনগণ আছে। কিন্তু পিপলস পাওয়ায় ভারতেও আজ গণ্ডিত এবং বিশ্রা। শাসকশ্রেণী তাই বিগ বিদ্যানেলের কীড়নক হয়ে দেশের নিদেশ গতিতেও নেহরু ইন্দিরার আদর্শ থেকে সরে আসতে পেরেছে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের জোটকে জেতানাের লক্ষ্যে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলাে যে খোট পাকিয়েছিল, দিল্লিও তাতে সানন্দে ঘােপ দিতে পিছিয়ে থাকেনি। | বাংলাদেশে এগাৱেই জানুয়াৱিৱ পটপরিবর্তনের পেছনেও যে দিল্লির সক্রিয় সমর্থন ছিল এবং আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকেও সাজাৰে মামলায় আটক রাখার ব্যাপারে লিখিত বৰ সুতি আছে, তা তাে আজ আর কাও অজানা নয়। এলবড়কে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেলে বন্দি করে নাইজেতার মামলায় ফুলিয়েছিল, তখন তার জীবন রক্ষা ও তাকে মুক্ত করায় জল ঝতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারাবিশে ক্ষাবেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আর আজ যখন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান নেত্রী সাজানাে মামলায় জেলে বন্দি এবং গুরুতর অসুস্থ অবস্থাতেও তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেয়া হচ্ছে না, কখনও দিল্লি নীরব এবং ঢাকার সঙ্গে ‘ঘােড়া কূটনীতি’ নিয়ে ব্যস্ত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থাটাই বা আজ কী? একাকার সালে বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিকে তার পেছনে। সৎ, অসৎ, ধনী-নির্ধন, পেটিবুর্জোয়া, সর্বহারা, চৌকিদার থেকে চিফ সেক্রেটারি, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা থেকে প্রধান বিচারপতি সবাই জান বাজি রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। কারণ দেশ স্বাধীন হলে তাদেৱ সৰার লাভ। বাঙালি নব্যধনী ও ব্যবসায়ীদের চোখে স্বপ্ন ছিল আদমজি, বাওয়ানিদের তাড়িয়ে নতুন আদমছি, বাওয়ানি হবে। পাশে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মতো দুই মিত্রশক্তির সমর্থন এবং পেছনে ঐক্যবদ্ধ জাতি ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তরুণ মুক্তিযােদ্ধার দল; স্বাধীনতার সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর সাফল্য তাই কেউ আটকে রাখতে পারেনি। নয়মাসের যুদ্ধেই তিনি বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরেছেন। তাঁর দলে যে দ্বিতীয় মীরজাফর ছিলেন খােন্দকার মােশতাক আহমদ, জাকেণ্ড সামগ্রিক পরিস্থিতির চাপে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে হয়েছিল।
আজ সাঁইত্রিশ বছর পর সেই বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিটা কী? স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মধ্যে স্বাধীনতার স্থপতি ও নায়কদের হত্যা করা হয়েছে এবং তারপর স্বাধীনতার মূল স্তম্ভগুলােকেই ধ্বংস করা হয়েছে। নায়ককে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে বলনায়কের জয়ধ্বনি দেয়া হচ্ছে। জাতি বহুধাবিভক্ত। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় যা হয়, অসংখ্য শক্তিশালী স্বার্থগােষ্ঠী তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার সুবাদে চিফ ক্লার্ক চিফ সেক্রেটারি হয়ে গেছেন। মেজর হয়েছেন রাতারাতি জেনারেল। অনেক ব্রিফলেস উকিল হয়েছেন বিচারপতি। রেহমান সােহান কথিত একালের পানওয়ালা, বিড়িওয়ালারা হয়েছে এখন শিল্পপতি। আসল রাজনীতিকরা রাজনীতির মাঠ থেকে হটে গেছেন। তাদের হটিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের জায়গা দখল করেছে কালাে টাকা ও পেশিশক্তির অধিকারী একশ্রেণীর দুর্বত্ত। হাওয়া ভবনের সুষ্ঠন ও সচ্ছাসেন ঝহিনী অতীতের মগের মুহুকের কথা স্মরণ করায়। সারাক্তি স্বার্থদ্ধে বিভক্ত এবং পীড়নে ও শােষণে জবিত। ‘
সকচেয়ে হতাশার কথা, জাতিকে এ শােণ, পীড়ন, লুণ্ঠন, দুর্নীতি থেকে রক্ষা করার নামে যে ১১ জানুয়ারির আবির্ভাব, এক বছর না যেতেই ও আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। বর্তমান উপদেষ্টা সরকার শুধু পথ হারায়নি, হেডিবিলিটি হারাচ্ছে। একটা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে দশটা সমস্যা নি দিচ্ছে। জিয়াউর রহমান কারফিউ জারি (প্রথমে দিনে-রাতে, তারপর কেবল রাতে) রেখে দেশ শাসন করতে চেয়েছিলেন। বর্তমান সরকার মনে হয় জরুরি অবস্থা জারি রেখে দেশ শাসন করতে চায়। গুজবে গুজবে দেশ সয়লাব। নির্বাচনী রােল্ডম্যাপের কথা বলা হচ্ছে, সেই ম্যাপ এখন বিবর্ণ। কেউ বলছেন, ২০০৮ সালেই নির্বাচন হবে। কেউ বলছেন, হবে না বরং একটি অশির্বাচিত জাস্ত্রীয় সরকার আসছে। কেউ কেউ বলছেন, সরাসরি সামরিক শাসনও আসতে পারে। এককথায় দেশের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চত। জাতি বহুধাবিভক্ত, বিভ্রান্ত । একজন সাবেক বিশিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা বলছেন, দেশে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে।
এ অবস্থায় একমাত্র প্রতিকার দেশে পণতান্ত্রিক রাজনীতির সক্রিয় ভূমিকা। সে ভূমিকা আজ অনুপস্থিত। বঙ্গবন্ধুর একটা সুবিধা ছিল, তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগের পাশপাশি বাম দলগুলাে, বিশেষ করে সিপিবি ও মােজাফফর ন্যাপ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল। ছয় দফার ভিত্তিতে, এগারাে দফার ভিত্তিতে সম্মিলিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তােলা তাঁর পক্ষে সহজ ছিল। শেখ হাসিনার জন্য এ সুবিধা নেই। বামদলগুলাে সঙ্গে হাসিনার আদর্শিক মৈত্রী হতে পারে, শক্তির মৈত্রী হতে পারে না। কারণ দলগুলাে খুবই দুর্বল। আবার বামদলগুলাের কোনাে কোনােটি বিভ্রান্তি। তারা এই চরম দুঃসময়ে আওয়ামী লীগকে বর্জন করে ড. কামাল হােসেন ও ভা, বি, চৌধুরীর মতো নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করাকে তাদের প্রগতিশীল রাজনীতির অংশ মনে করেন। | এ পরিস্থিতিতে আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, তাহলে কী করতেন? তিনি কি তার এককালের বিশ্বস্ত সহযােগীদের বর্তমান ভূমিকা দেখে মর্মাহত হতেন? তিনি কি ভ, কামাল হোসেনদের বর্তমান ভুমিল দেখে বলতেন— দাউ টু ব্রুটাস? দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধুকে শেখ হাসিনার মতাে বন্দি রাখা সম্ভব হত না। মৃত্যুর ৩৩ বছর পরও যারা মৃত মুজিবের নাম শুনলে আতঙ্কিত হয়, তারা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহস পেত কি? বন্দি করে রাখার অর্থ তাে বাড়িয়ে রাখা। দেশী ঘাতকদের কবল থেকে বেঁচে গিয়ে একুশ শতক পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তিনি ক্যাস্ট্রো বা শ্যাভেজের মতাে নতুন রণকেীশল ও নতুন মিত্র গ্রহণ করতে না পারলে আন্তর্জাতিক চক্রীদের হতে আলেন্দে, সুবু প্রমুখের মতাে মৃত্যুবরণ করতেন। | বঙ্গবন্ধুর চেয়ে শেখ হাসিনার পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল এবং সংকট ভয়াবহ। বঙ্গবন্ধুর শক্তিশালী জাতীয় ও আন্তঃজাতীয় মিত্র ছিল। শেখ হাসিনার কেউ নেই। পাশের বিলিও এখন তার প্রকৃত মিত্র নয়। দেশের বামশক্তি যদি শক্তিশালী হতো তাহলে বঙ্গবন্ধুর মতো তাদের সঙ্গে মৈত্রী পড়ে শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শিবিরকে শক্তিশালী করতে পারতেন। কিন্তু বামদের অনৈক্য ও দুর্বলতার জন্য তাকে চরম আদর্শিক শক্রদের সঙ্গে ফতােয়া চুক্তি করে মহাজোট গঠন করতে হয়। তাতে ভঁর শক্তি বাড়েনি, ক্রেডিবিলিটি নষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক মিত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি বঙ্গবন্ধুর মাঙ্গে সােভিয়েত ইউনিয়ন, তাৱত ও পূর্ব ইউরােপীয় সমাজতন্ত্রী দেশগুলােকে পাননি। ফলে তাঁকে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের সমর্থনের ওপর। নির্ভর করতে হয়েছে এবং ইসলামাবাদের সঙ্গেও সম্পর্ক পড়ে জেলার গোপন চেষ্টা চালাতে হয়েছে। পরিণতি মিত্রহীন অবস্থায় জেলে বন্দি হওয়া।
এজন্য তাকে দোষ দেয়া যায় না। পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতেই হাসিনাকে বঙ্গবনুর চেয়ে ভিন্ন রণকৌশল গ্রহণ করতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ কয়েছেন চিহ্নিত শ বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধে। হাসিনাকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে সামনের কাতারে দেশী গণশিক্র এবং তাদের পেছনের গ্লোবাল শক্তির বিরুদ্ধে। দেশের ভেতরে ও বাইরে তার অচিহ্নিত শক্রশিবিরও কম নয়। তাদের মধ্যে রয়েছে নব্য এলিটশ্রেণী থেকে। উত তথাকথিত সুশীল সমাজ। বঙ্গবন্ধু এ সুশীল সমাজের সর্মথন পেয়েছিলেন। হাসিনা পেয়েছেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিরূপভা ও বিরােধিতা। বঙ্গবন্ধুর মতাে একই লক্ষ্যে পৌঁছার সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনারও। তাতে আমার কোনাে সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রণকৌশল বদলাতে গিয়ে তিনি সফল হননি। মিত্র বাছাইয়ে এবং আন্দোলনের মাঠ থেকে বারবার সরে এসে তিনি ভুল করেছেন।
বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও এই ভুলগুলাে করতেন কী? আমার ধারণা, করতেন না। তিনি ১৯৭১ সালেই মার্কিন দূত ফারল্যান্ডের প্রতিশ্রতি ও প্রলােভনের ফাদে পা দেননি। এ সময়ে মেরিন পিটার্স, হ্যারি টমাস, বিউটেনিস এবং গীতা পার্সিদের ফঁদে পা দিতেন না। তিনি সম্মানজক আপসের পথ খােলা রাখতেন, তবে আন্দোলন থেকে সরে আসতেন না। হাসিনা জনতার ঐক্যের চেয়েও নেতাদের ঐক্যে জোর দিয়েছিলেন। এমনকি এরশাদের মতাে ভাগাড়ের নেতাকেও মহাজোটের মঞ্চে টেনে এনেছিলেন। সুযােগ বুঝে এরা এখন পগারপার। বঙ্গবন্ধুর ‘৭১ সালেও নেতার ঐক্য নয়, জনতার ঐক্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। বর্তমানেও তাই দিতেন।
| আমার একটি বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু আজ যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে ‘৭১ সালের রণকৌশল যে ২০০৮ সালে অচল এটা তিনি তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দ্বারাই বুঝতে পারতেন। একটি নিরস্ত্র ও অহিংস অসহযােগ আন্দোলনকে যিনি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত করতে পেরেছিলেন, তিনি এ যুগেও জনতার ঐক্যকে কী করে জনযুদ্ধে পরিণত করা যায় সে কেীশল উত্তালন করা জানতেন। শেখ হাসিনার এ কৌশলটিই জানা দরকার।
লন্ডন। ১৬ মার্চ ৰােববার। ২০০৮
যুগাস্কর ১৭ মার্চ ২০০৮
বহুমাত্রিক বঙ্গবন্ধু : গুণীজনদের দৃষ্টিতে
ড. আতিউর রহমান।
আজ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। জাতির পিতার জন্মদিন। অথচ জাতীয় কোনাে অনুষ্ঠান নেই। সামাজিক অনুষ্ঠানও খুব বেশি নেই। শিক্ষায়তনেও তেমন উচ্চবাচ্য নেই। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলােও নিন্দুপ। অবশ্য আওয়ামী লীগ দিনটিকে জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে পালন করছে। কিন্তু তিনি তাে শুধুই একটি বিশেষ দলের নেতা ছিলেন না। সমগ্র জাতির মুক্তির জন্যই তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। শেষপর্যন্ত জীবনও দিয়েছেন। তবুও কেন আমরা তাকে জাতীয়ভাবে জন্মদিনের শ্রদ্ধা জানাতে পারছি না? গান্ধী ৰা মাওকে নিয়ে তাে এমন জাতীয় অবহেলা চোখে পড়ে না! জাতি হিসেবে তাহলে কি আমরা এতটাই ক্ষুদ্রমনা যে, ইতিহাসের এই মহানায়কের অবদানকে আমলেই নিতে চাইছি না? আমরা কি শেষপর্যন্ত একটি ঐতিহ্যবিহীন উল জাতি হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিতে যাচ্ছি। তা না হলে যার জন্ম না হলে হয়তাে বাংলাদেশই সৃষ্টি হত না—তাকে এমন উপেক্ষা কেন?
বিশ্বায়নের সুযােগ নিয়ে নিশ্চয় আমরা আধুনিক হতে চাই। উন্নত অবকাঠামাে ও প্রযুক্তির প্রসার চাই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা ইতিহাস ও শিকড়বিহীন এক দুর্ভাগা জাতির পরিচয় পেতে আগ্রহী। ইতিহাস আমাদের চলার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারত। কিন্তু আমাদেরই অপরিণামদর্শিতার কারণে ইতিহাসই বাঞ্চালির সবচেয়ে দুঃখের কারণ হয়ে গেছে। ইতিহাসের অমােঘ সত্যকে বিতর্কিত করে আমরা আমাদের নবীন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে চলেছি। তাদের আমরা সমৃদ্ধ অতীত অর্জনের অংশীদার হতে দিচ্ছি না। | অথচ পঞ্চাশাের্থ আমরা সবাই স্বচক্ষেই দেখেছি বাঙালির ইতিহাসের উলতম দিনগুলাে। আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সেসব দিনের নিয়ন্ত্রণ ছিল একজনেরই হাতে। ধীরে ধীরে একটি জাতির বেড়ে ওঠার চূড়ান্ত পর্বের পরিচালক শেখ মুজিব নিজগুণেই হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। স্বদেশের স্বাধীনতার জনা সর্বক্ষণ নিবেদিতপ্রাণ এই মহান নেতাকে সাধারণ মানুষ যেমন আজও গীরভাবে শ্রদ্ধা করেন, তেমনি দেশ-বিদেশের অনেক গুণীজনও তার বহুমাত্রিক অবদানকে বিপুলভাবে মূল্যায়ন করে থাকেন।
তাঁকে নিয়ে যত কবিতা এদেশের এবং বিদেশের কবিরা লিখেছেন তেমনটি অন্য কারও ভাগ্যে জুটেছে বলে আমার জানা নেই। একইভাবে দেশ-বিদেশের উচুমাপের বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তিনি প্রতিনিয়ত সিক্ত হয়েছেন এবং আজও হচেছন। দিনদিনই তিনি আরও বিরাট হচ্ছেন। আরও বেশি করে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিচ্ছেন। কড় আঙ্গিক থেকেই না স্ত্রীকে তারা দেখছেন। অস্ট্রিয়া প্রবাসী এম, নজরুল ইসলামের অক্লান্ত পরিশ্রমের কল্যাণে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থের দুটো পর্ব পেয়েছি। তৃতীয় পর্বের কাজ এখনও চলছে। দেশের ও বিদেশের নানা গুণীজনের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন—তার একটা আভাস মেলে এই গ্রন্থে। এই প্রবন্ধে আমার পছন্দের ষােলাে বুদ্ধিজীবী ও মানবতাবাসীর দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর নানামাত্রিক মূল্যায়নের খানিকটা পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। | বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান নােবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, বঙ্গবন্ধু শুধু বালির বন্ধু ও অধিনায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানবজাতির পথপ্রদর্শক ও মহান নেতা। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সভ্যতা, সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা, সৰ মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি। তাঁর সাবলীল চিস্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সমস্ত পৃথিবীও স্বীকার করে এ আশা আমাদের আছে এবং থাকবে।” (মুথবন্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থ, জ্যোৎস্না পাবলিশার্স, ২০০৭ পূ, ১৯৬।) স্বাধীনতা শব্দটির নানা মাত্রার কথা অমর্ত্য সেন তাঁর নানা লেখায় এনেছেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও যে এর অন্যান্য গভীর বক্ষ রয়েছে-সেকথা তিনিই সুশলভাবে তার ডেভেলপমেন্ট অ্যায় ফ্রিডম বইতে তুলে ধরেছেন। সেই তাত্ত্বিক কাঠামােৱ এক সুন্দর প্রয়ােগ করেছেন বঙ্গবন্ধুর চিন্তা ও চেতনার বিশ্লেষণ করার সময়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া যে অন্য কোনাে মুক্তি অর্থহীন সে-বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর ভাবনাকে যথার্থ মনে করেন অমর্ত্য সেন। | ভারীয় রাজনীতির অন্যতম দিকপাল প্রবীণতম সিপিএম নেতা এবং আরেক উল বাক্কালি জ্যোতি বসু মনে করেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। তার ভাষায়, “তখনও বাংলাদেশ হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান না হত। তখন সেখানে দুই অত্যাচার চলছিল। গণতন্ত্র বলে কিছুই ছিল না। পূর্বপাকিন্তানকে একটা কলােনির মতো মনে করত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা। বাংলাভাহাকেও ও মর্যাদা, সম্মান কিছু দিত না। এসবের বিরুদ্ধে মুজিবুর রহমানের নেতত্বে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সাধারণ মানুষ মরণপণ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে অবশেষে সেখানে স্বাধীনতা আসে এবং পূর্বপাকিস্তান বাংলাদেশ নামে ভূষিত হয় ।.. উনি যে অবিসংবাদী নেতা এবং বিশিষ্ট স্বার্থীনভাসংগ্রামী ছিলেন এটা সকলেই স্বীকার করে নিয়েছিল।” (জ্যোতি বসু, ঐ পৃ. ৮৭-৮৮)।
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মানুষ বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতায় অভিভূত। “গােটা বাংলাদেশটাই তাে শেখ মুজিবের নিজের বাড়ি, তবু নিজের জেলার প্রতি বােধ হয় তাঁর কিছুটা বেশি টান ছিল। ‘আপনারা তাে আমার দেশের লােক বলে তিনি দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন আমাদের। সেই উষ্ণ আলিঙ্গনে আমরা অভিভূত। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কোন্ গ্রামে আমাদের বাড়ি, এখনাে কেউ আছে কিনা ইত্যাদি…। তিনি আমাদের সঙ্গে এমন সহজ সরল ব্যবহার করলেন, যেন কত দিনের চেনা। কোথায় গেল সে পনেরাে মিনিটের গণ্ডি, ছাড়িয়ে গেল পঁয়তাল্লিশ মিনিটে।” (ঐ, পৃ. ১৭৯-১৮০)
শান্তিতে নােবেল বিজয়ী (১৯৭৪) মানবাধিকার আন্দোলনের পুরােধা শন মাই জানতেন বঙ্গবন্ধুকে ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামী এক মহান নেতা। হিসেবে। সর্বদাই তিনি ছিলেন সাম্য তথা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সমর্থক। শুধুমাত্র ভৌগােলিক স্বাধীনতা যে অর্থহীন সেকথা বঙ্গবন্ধু খুব ভালাে করেই জানতেন। তার S : “Bangabandhu had realised that obtaining of national freedom meant nothing unless it also involved freedom for the pople freedom to live, freedom not to starve, but to earn a living and to share the wealth with others. So, he was fundamentally a socialist while at the same time an ardent nationalist, because he realised the importance of protecting and saving the culture of Bengal. He also was determined that the state that he had created, should be a secular state. obviously a theocratic state or a dictatorship would not show justice or allow freedom to the people of Bengal. So he fought a struggle always to try and establish his four principles in your country.” 1..463) | শুধু বিদেশের গুণীজন কেন, স্বদেশের লেখক-বুদ্ধিগ্রীষীদের দৃষ্টিতেও বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সুউচ্চে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, সুলেখক বিচারপতি হাবিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুর নানা গুণের পাশাপাশি উপস্থিত বুদ্ধিরও দারুণ প্রশংসা করেছেন। উল্লিখিত স্মারকগ্রন্থে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কিছু কথা’ প্রবন্ধে লিখেছেন যে, তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল বিস্ময়কর।” তিনি আরও লিখেছেন, “নাইজেরিয়ার জেনারেল ইয়াকুব পাওয়ান যখন বললেন, ‘অবিভক্ত পাকিস্তান একটি শক্তিশালী দেশ, কেন আপনি দেশটাকে ভেঙে দিতে গেলেন? উত্তরে শেখ মুজিব বললেন, ‘কনুন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। আপনার কথাই হয়তাে ঠিক। অবিভক্ত পাকিস্তান হয়তাে শক্তিশালী ছিল। তারচেয়েও শক্তিশালী হয়তাে হত অবিভক্ত ভারত। কিন্তু সেসবের চেয়ে শক্তিশালী হত সংঘবদ্ধ এশিয়া, আর মহাশক্তিশালী হত একজোট এই বিশ্বটি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সবকিছু চাইলেই কি পাওয়া যায়?[ঐ, পৃ. ৯৭১) | ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাউদ্দীন আহমদ কী করে বঙ্গবন্ধু সকল বাঙালির হৃদয় এক করেছিলেন সেই কথা লিখেছেন এইভাবে ? ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনসাধারণ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ—হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সকলে একত্রিত হয়ে এক অখণ্ড বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়েছিল, যেটা আগে কখনও হয়নি। বস্তুত এই সময় এই অঞ্চলের সর্বস্তরের বাঙালিদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব
স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছিল, সেটা গত শতাব্দীর গােড়ার দিকে অর্থাৎ বিগত স্বদেশী যুগের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু সে আন্দোলনটা ছিল এই যে, তখনকার মুসলমান সমাজের বৃহত্তর অন এ আন্দোলন যােগ দেয়নি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে, স্বদেশী আন্দোলন বাংলার মুসলমানদের যােগ না-দেয়ার প্রধান কারণ ছিল তাঁর ভাষায় ; ‘তাহাদের সঙ্গে আমরা কোনােদিন হৃদয়কে এক হইতে দেই নাই’। ঐ, পৃ. ৫৩]
অধ্যাপক জিলুর রহমান সিদ্দিকী বর্তমান সময়ের এক ক্ষুরধার সমাজ বিশ্লেষক। তার মতে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি স্তার অপরিসীম ত্যাগতিতিক্ষা, সাহস ও প্রজ্ঞা দিয়ে ধাপে ধাপে রাজনতিক আন্দোলনের মাধ্যমে যথাসময়ে সঠিক রণকৌশল উদ্ভাবনের মধ্যদিয়ে, বাঙালি জাতিকে পরিণত করেছিলেন একটি একতাবদ্ধ লড়াকু জাতিতে। তার রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের মূল্য কেউ কমাতে পারবে
। তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিষয়ে জীবনীকার ও ইতিহাসবিদ সম্ভবত একমত হবেন না। এই প্রশ্নে আমরা আজও ইতিহাসের রায় পাইনি। হয়তাে সে-সময়ও আসেনি।” [ঐ, পৃ. ২৩৯] | এয়ার ভাইস মার্শাল (অব) এ, কে, খন্দকার ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সহ-অধিনায়ক। ‘বঙ্গবন্ধু : কিছু স্মৃতি’ নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিরাট এবং উদার মনের মানুষ। আমি জানি, স্বাধীনতার পর স্বাধীনতা-বিরােধী কিছু নেতা জেলে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু তাদের পরিবারের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্যে আর্থিক সাহায্য করতেন। আরও অনেক ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। কোনো একটি অপাথে সরকারি আইন অনুযায়ী সঙ্কত একজন কেরানির চাকুরিচ্যুতি ঘটে। কোনাে এক প্রয়ােজনে আমি সেদিন সেই সময় বঙ্গবন্ধুর অফিসে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব এই লােকটির চাকুরিচ্যুতির ফাইলে ভার স্বাক্ষরের জন্য নিয়ে আসেন। অনেক ইতস্তত করার পর তিনি ফাইলটি সই করে দেন। যখন মুখ্য সচিব ফাইল নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে বললেন, ‘চাকুরি তো গেল। লােকটি যেন পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে তার একটা বন্দোবস্ত করাে।’ বঙ্গবন্ধু এরকম বড় মনের মানুষ।” (ঐ, পৃ. ২৩৯]। | ড. আনিসুজ্জামান মনে করেন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন বলেই তাকে এভাবে জীবন দিতে হল। বঙ্গবন্ধুকে অবলােকন নিবন্ধে তাইতাে তিনি লিখেছেন, “হত্যাকারীদের কাছে বঙ্গবন্ধুর—এবং তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের-একমাত্র অপরাধ ছিল বাংলাদেশ সৃষ্টি। একথা যারা বােঝেন না, তাদের বােঝাতে চাওয়া বৃথা। যারা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করার চেষ্টা করেন কিংবা আরাে বড় করতে গিয়ে ছোটো করে ফেলেন, তাদের জানতে হবে, ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু অমরতা লাভ করেছেন, তিনি যা তিনি তাই, তাঁর আসন ধূলিমলিন হওয়ার নয়।” [ঐ, পৃ. ২৪৬|
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড, বােরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের মতে, বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে পাবলিক ডােমেইন বা গণনের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শেখ মুজিৰ ঠিকই বুঝেছিলেন যে, পাবলিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের মধ্যে প্রােথিত সমাজ ম্যানেজমেন্টের যুক্তি এবং সমাজ বাজনৈতিক প্রভুত্বের ক্ষেত্রে এলিটদের স্বার্থের মাধ্য মিল নেই, কিংবা প্রভুত্ব কখনােই নিরণ নয়। বস্তুতপক্ষে রাষ্ট্রের যুক্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে রাঠের স্বরূপ তদন্ত করা দরকার। এই যুক্ততা থেকে নির্মিত হয় গণভুবন, যে ভুষন হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে নাগরিকত্বে জয়পা। এই জায়গায় অস্তরিত পাবলিক প্রতিষ্ঠান এবং পাবলিক ডিসকোর্স। পাবলিক প্রতিষ্ঠান আরােপিত কিন্তু পাবলিক ডিসকোর্সের একটি অংশ শেখ মুজিব এবং তার সঙ্গীরা নিজেরাই নির্মাণ করেছেন । গণতন্ত্র, ভেট, নিৰাজল, শাসন, স্বাধীনতা, অংশগ্রহণ এগুলাের ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে। সেজন্যে বাংলাদেশ রাত্রে এ হয়েছে নির্শিী অর্থে বাজনৈতিক অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে দিয়ে। পু, ৭৫৬ ।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির ঐক্যের প্রতীক। বিশিষ্ট নাট্যকার ও শিক্ষাবিদ মমতাজউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, আমি যে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলাম, শেখ মুজিব কখনো বাকালি জাতি ও দেশ সম্পর্কে এক বিভেদমূলক কথা বলেননি। যেখানে গেছেন, যেখানে সুহােগ পেয়েছেন, সেখানে বাঙালির ন্যায্য পাওয়ার কথা বলেছেন। কখনাে কোনাে কারণে পিছপা হননি। কাউকে ভয়ও করেননি। কারাে কাছে কোনাে পারিতােষিক নেননি। বাংলাকে আর বাঙালিকে এমন করে ভালােবাসকে যিনি পারেন, তিনি যদি বঙ্গবন্ধু না হবেন, তবে আর কে হবে।…শেখ মুজিব তাে ম্রিান্ত হতে বাংলাতে আসেননি। তঁার এক লক্ষ্য, এক গন্তব্য—আমার নিপীতি বঞ্চিত বাংলাকে মুক্তি দাও।” [, পৃ. ৩৮৯ । | শিক্ষাবিদ মুস্তাফা নূরউল ইসলাম লিখেছেন : বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক-“কেবলই কি নির্বাচিত শব্দনিছয় মাত্র? তা তাে নয়। গভীরে ইতিবাচক বাবা ছিলেন রাজনৈতিক দলের একনিষ্ঠ আপােষহীন কর্মী। প্রত্যন্ত প্রদেশব্যাপী একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন নির্মাণ কর্মকাজের দক্ষতায়, সুনিদিষ্ট লক্ষ্যাক্তিলাকী দুঃসাহসিক পরিচালনা কৃতিত্বে তিনি অন্য নেতৃত্বে বরিত। তারপর কখন সেই মানুষটি নিজেকে ছাড়িয়ে, দলীয় সংগঠনকে ছাড়িয়ে সমগ্র জাতি কোটি মানুষের লিঙ্গ হয়ে গেলেন। সবাই আমরা তাঁকে আত্মার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতম করে হৃদয়ে ধারণ করে নিলাম। যেমন কিনা আতাতুর্ক, মহাত্মা আঙ্কল হাে । বুঝটা কী ছিল? আবেগটাই বা কী?” |ঐ, পৃ. ৭৪৯৭৫০]
বিশিষ্ট প্রবন্ধকার অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, তিনি ছিলেন জনগণের নেতা। ছিলেন সাহসী মানুষ। শেখ মুজিবের মতাে সাহস আর কারাে মধ্যে দেখা যায়নি। ঋসির মঞ্চ থেকে তিনি একাধিকবার ফিরে এসেছেন, আপােষ না করে।… শেখ মুজিবের সাহস ব্যক্তিগত স্বার্থের পুষ্টি সাধনে নিয়ােজিত হয়নি। তিনি দাড়িয়েছিলেন একটি পরিচিত বলের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের বিপক্ষে। তিনি তাঁর দলের লােক ছিলেন, শ্রেণীর ছিলেন। কিন্তু পার হয়ে গিয়েছিল ওই দুই সীমান্ত, পরিণত হয়েছিলেন জনগণের নেয়। কার সাহস জনগণৰ আকাক্ষা মূক্ত করার জাতীয়তাবাদী সাহস। (ঐ, পৃ. ৭৮০)।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লােহানী তার ‘লিডার’কে এভাবে স্মরণ করেছেন । “শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তৃণমূল থেকে যার পেীরপ্ত উথান। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের তেজস্বী ও বুদ্ধিী কিশাের পরিণত হয়েছিলেন সাহসী সংগঠকে। চারাগাহ থেকে মইজহর মাখা উচিয়ে আকাশ
ড়ে ওঠে একদিন, তেমনি স্বভাবজাত সংগ্রাম-সংক্ষুব্ধ পথপৰিমায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও গড়ে তুলেছিলেন তাঁর গৌরবময় রাজনৈতিক জীবন। চল্লিশের দশক থেকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি, সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের যথার্থ বড়ু, সৈনিক এবং ক্রমান্বয়ে নেতা এবং অবশেষে বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নায়কে পরিণত হয়েছিলেন। তাইতাে সাধারণ মানুষের অফুরন্ত ভালােবাসা পেয়েছিলেন শেখ মুজিব।” (ঐ, পূ, ৯৫৩-৯৫৪)
সে কারণেই বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হােসেন তাকে মৃত্যুঞ্জয় মুজিব’ বলে। আখ্যায়িত করেছেন। লিখেছেন, “যে মানুষের নামে ইতিহাসের দরজা খুলে যায়, সেই মহীন মানুষের সঙ্গেই তাে আমরা ইতিহাসের দীর্ঘ সড়কে হেঁটে যাৰ । স্বদেশের মানচিত্রজুড়ে বিছিয়ে থাকা তার বিশাল শীয় আমাদের জীবনে অটের ছায়া। এই ছায়া থেকে আমরা দূরে যেতে পাৱৰ না, শুধু আমরা চাই আমাদের পথের দুপাশে অবিস্মরণীয় আলাে থাকুক, যে আলাে ফুটে থাকবে পথ, পথের ধারের উজ্জ্বল বুনােফুল এবং আমাদের ইতিহাসের পুলে যাওয়া নতুন দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠৰে নকুন আলো। আমরাও গগনবিদারী কষ্টে চিৎকার করে বলব । মুজিবের মৃত্যু সহজ কথা। নয় । ঐ, পৃ. ৩২৭-৩২৮||
আরাে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর বিল গুণের কথা এই স্মরন্থে লিখেছেন। এসব লেখা থেকেই বােঝা যায়, কেন তিনি সাধারণের দৃষ্টিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। স্থানাভাবে সকলের কথা এখানে তুলে ধরা সম্ভব হল না।
নির্বাচিত গুণীজনদের লেখা খণ্ড খণ্ড এসব চিক্রকে এক করলে বহুমাত্রিক উজ্জ্বল এক মানুষকে আমরা খুঁজে পাই। বালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন আরেক জন দীঘল পুরুষের আবির্ভাব ঘটেনি। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি নিবেদন করে গেছেন বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য। এমন করে স্বদেশকে তাঁর জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতেন বলেই তিনি হাতে পেরেছিলেন এক অবিসংবাদিত নেতা। বৈরী এই সময়ে অনেকেই তাকে উপেক্ষা করতে পারেন, আনুষ্ঠানিকভাবে তঁার প্রাপ্য মর্যাদা নাও দিতে পারেন, আবার কেউ কেউ তাকে চিনেও না-চেনার ভান করতে পারেন। কিন্তু একথা কি অস্বীকার করার উপায় আছে যে, একদিন তুমিই এখানে পাখিদের মধ্যে পেয়েছে ভােরের গান তুমি কেউ নও, বলে ওরা, কিন্তু বাংলাদেশের আড়াইশত নদী বলে, তুমি এই বাংলার নদী, বাংলার সবুজ প্রান্তর তুমি এই চর্যাপদের গান , তুমি এই বাংলা অক্ষর, বলে ওরা, তুমি কেউ নও, কিন্তু তােমার পায়ের শব্দে নেচে ওঠে পদ্মার ইলিশ তুমি কেউ নও, বলে ওরা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান আর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বলে, তুমি বাংলাদেশের হৃদয়। (মহাদেব সাহা, এই নাম স্বতােৎসারিত’।)
বাংলার আকাশ, বাতাস, শস্যক্ষেত, ফুল-ফলের আরেক নাম শেখ মুজিব। বাংলাদেশেরই আরেক নাম বঙ্গবন্ধু। আমরা চাই বা না চাই, এদেশের সাধারণ মানুষ তাকে তাদেরই ‘লােক’ বলে যুগ যুগ বলে স্মরণ করবেন। সে কারণেই তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন।
৭ মার্চ ২০০৭
ধন্য সেই পুরুষ। আমিনুল হক বাদশা
মার্চ মাস বাঙালির জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক মাস। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দেশের নির্যাতিত শােষিত মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে সংযােজিত হয়েছে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি ও মুক্তিসগ্রামের অধ্যায়। এসব মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কদের নামের সঙ্গে যােগ হয়েছে আরও একটি নাম, সেই নামটি হল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নাম বিশ্ববাঙালির অন্তরে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো চিরজাগরূক। এছাড়া এই মাসই স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিবের জননার মাস। ১৭ মার্চ তার জনপিন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বজ্রকণ্ঠে রমনার রেসকোর্সে আয়ােজিত বিশাল জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন—’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তি সংগ্রাম…।’ নিউজ উইক ম্যাগাজিনে বঙ্গবন্ধুকে ‘Poet of Politics’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি হলেন রাজনীতির কৰি। ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল একটি মহাকাব্যের মতাে। এই মন্তব্য বহু নামীদামী ব্যক্তিই করেছেন।
এই ভাষণে ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের নির্যাতিত শােষিত বাঙালি জাতির প্রাণের কথা। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার অমােঘ বাণী। সাধারণ মানুষের প্রাণের ভাষায় তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ভাষণ ছিল আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন। আর ছিল নেতার প্রতি জনগণের নিঃশর্ত আস্থাবিশ্বাস। জনতার আহা বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু ভঙ্গ করেননি।
৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব সাধারণ মানুষের ভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন এবং হাটে মাঠ-ঘাটে-ক্ষেত-খামারে-কলকারখানার মানুষ যে-ভাষায় কথা বলে, সেই ভাষাই তিনি ব্যবহার করেছিলেন। এই নিবন্ধে সেই শব্দেরই উল্লেখ করে ভাষণটি বিশ্লেষণ। করা হয়েছে। এই কারণেই ওই ভাষণ সাধারণ মানুষের প্রাণে গিয়ে আঘাত করেছে। বঙ্গবন্ধু এসব সাধারণ মানুষের ভাষায় কথা বলতেন।
নামের ওপর পতাকার মতাে দুলতে থাকে স্বাধীনতা। ধন্য সেই পুরুষ, যার নামের ওপর ঝােলে মুক্তিযােদ্ধাদের জয়ধ্বনি। শামসুর রাহমান বাংলাদেশের কবিতাজগতের আর এক বিস্ময় কবি শামসুর রহমান। তিনি লিখেছিলেন স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তােমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীন’ শিরােনামে দুটি অমর
কবিতা। এরপরে কবির লেখনীতে ‘ধন্য সেই পুরুষ’ রচিত হয়েছিল। ‘ধন্য সেই পুরুষ বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতা শহীদ হবার পর শােকাতুর কবি লিখেছিলেন ।
তােমাকে হারিয়ে আমার হারিয়ে যাওয়া ছায়ার মতাে। হয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের দিনগুলাে ঢেকে যাচিছল শােকের পােশাকে, তােমার বিচ্ছেদের সঙ্কটের দিনে আমার নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে আকাশকে ব্যথিত করে তুলেছিলাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে রূপান্তরিত করে জীবনের হুতিগানে কেননা জেনেছি
জীবিতের অধিক জীবন্ত তুমি। জাতীয় কবি শামসুর রাহমান ছাড়াও নামী-অনামী বহু কবি-সাহিত্যিক শেখ মুজিবের ওপর হাজারাে কবিতা রচনা করেছেন। আমি নিজে ১৯৭৫ সালের আগে প্রায় এক হাজার কবিতা সংগ্রহ করেছিলাম।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘আমি আজ কারাে রক্ত চাইতে আসিনি’ শিরােনামের আবেগমিশ্রিত কবিতায় লিখেছেন :
শহীদ মিনার থেকে খসে পড়া একটি রক্তাক্ত ইট গল্কক্কাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তার কথা বলতে এসেছি। প্রতিষ্ঠিত কৰি না হলেও বঙ্গবন্ধুকে একজন স্বভাবকবি বলা চলে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে কবিতার পর্যায়ে বিবেচনা করেছেন অনেকেই। এই বক্তৃতায় প্রতি ছাত্র সাজিয়ে বিশ্লেষণ করলে এক অপূর্ব কবিতার সমারােহ চোখের সামনে ভেসে উঠবে।
এই কবিতায় লুকিয়ে রয়েছে বাঙালি জাতির জীবন-মরণ সমস্যা। আবেগের পাহাড়। বাঙালি জাতির জ্বালাময় জীবন। প্রতিটি ছত্র সাধারণ মানুষের অন্তরের কথা। প্রেরণা। জাতিকে সংগ্রামে প্রস্তুত করার আহবান। শত্রুর মােকাবেলা করার উদ্দীপনা। নতুন সৃষ্টির আহবান। প্রতিটি ছত্রে আশার আলাে খুঁজে পাওয়া যায় ।
মার্চ মাস। এই মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে সুখদুঃখের গর্জর ইতিহাস রেখে গেছে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। এই মার্চ মাস বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মার্চের প্রথম থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানি ফৌজি স্বৈরাচারীর বিশ্বাসঘাতকতা। অবশ্য পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালি জাতি সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শােষকদের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়। বৈষম্যের পাহাড় গড়ে তােলে তারা। এই
পুঞ্জীভূত বৈষম্য আর বিশ্বাসঘাতকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটল এই মার্চ মাসে। ১৯৭১ সালে।
৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকল ফৌজিনেতা প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। এর আগে বঙ্গবন্ধু ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যদের হাত তুলে শপথ গ্রহণ করালেন। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে প্রতিটি সদস্য ৬-দফার ওপর ভিত্তি করে কনসটিটিউশন রচনা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। বিশ্বাসঘাতকতা করলে জনগণ এদের শাস্তি দেবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, এমনকি আমাকেও আপনারা ক্ষমা করবেন না।
| ২৭ জানুয়ারি ভুয়া সাহেব ঢাকায় এলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হলেন। তিনদিন লাগাতার আলােচনার পর জুয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর সব আলােচনা ব্যর্থ হল। এর পরপরই ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বাতিল করলেন। এ-ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের সঙ্গে তারা আলােচনা করার প্রয়ােজন মনে করেননি। পয়লা মার্চ আকস্মিকভাবে সংসদ অধিবেশন বাতিল করলেন। এর প্রতিবাদে ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু হরতাল ডাকলেন। হরতালে জনগণ সাড়া দিল। সফল হল। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানালেন : আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন।
এরপর ৭ মার্চ। ঐতিহাসিক ভাষণ। পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের কথা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে বললেন । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ জনগণকে ইঙ্গিত দিয়ে প্রস্তুত করলেন আগামীদিনের স্বৈরাচারী ফৌজি শশাষকদের মােকাবেলার জন্য। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা—সবই হল মার্চ। | বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ পৃথিবীর প্রখ্যাত মানবদরদী রাজনীতিবিদদের ভাষণের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রথমে আসা যাক প্রাচীন গ্রিসের ভিমােস্থেনেস (খৃপ, ৩৮৪-৩২২) ছিলেন বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তা। স্বদেশের মুক্তির জন্য ভার ৩ টি ভাষণ অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। | এডমন্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭) ভারতের গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযােগ উথাপন করেন। এতে মানুষের দৃষ্টি ভুলে যায়। ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বিরূপ ধারণা পােষণ করেন। তাঁর দীর্থভাষণ বিশ্বের রাজনীতির ইতিহাসের এক অতুলনীয় সম্পদ হয়ে রয়েছে।
১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার ষােলােতম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন (১৮০৯-১৮৬৫) গেটিসবার্গ যুদ্ধে শহীদদের সমাধিস্কৃষি উদ্বােধনকালে মাত্র তিন মিনিটের ভাষণ দেন। দি এই তিন মিনিটের ভাষণ ‘গেটিসবার্গ এ্যাঞ্জেস’ নামে সারাবিশ্বের রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। | মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়র)-এর ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ শীর্ষক ঐতিহাসিক ভাষণের সাথে ৭ মার্চের ভাষণের তুলনা করা চলে। মার্টিন লুথার কিং-এর সেদিনকার কষ্ঠের
সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। | নেলসন ম্যাকেলার ভাষণ এবং তার জীবনের সঙ্গেও শেখ মুজিকের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। | এছাড়া ম্যালকম এক্স, মহাত্মা গান্ধী, সুভাষচন্দ্র বসু, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, চেয়েভারা, কর্নেল নাসের—এসন মানবদরদী ও জাতীয়তাবাদী নেভার বিভিন্ন পর্যায়ে প্রদত্ত বিভিন্ন ভাষণের সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণের সামঞ্জস্য রয়েছে। বঙ্গবন্ধু তাঁদেরই মতো বিশ্বপর্যায়ের নেতা।
আমার এক বন্ধু সাইফুল আলম চৌধুরী আমেরিকায় বসবাস করেন। সমাজ ও সংস্কৃতিসেবক। ৭ মার্চের ভাষণের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। ৭ মার্চের ভাণ নিয়ে আমি গবেষণা করতে গিয়েও যুক্তি-শুশলা, সঠিক শব্দ চয়ন ও তা উপযুক্ত স্থানে প্রয়ােগের প্রমাণ পেয়েছি। এই ভাষণে সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানুষের মনের কথার আভাস মেলে। | ৭ মার্চের ভাষণের সময় ছিল তিনটা কুড়ি মিনিট। স্থান-ঢাকা রেসকোর্স ময়দান। রবিবার। শেষ ফারুনের সামান্য গরম। সকাল ছিল উজ্জ্বল বােনে ভরপুর। তবে দুপুরের আগে আকাশে ছিল সামানা মেঘের আনাগােনা। এক পশলা বৃষ্টি ছিল। বক্তা ছিলেন একজনই—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রােদ আর মেঘের ছায়ায় রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনসম্র। অপেক্ষা করছে, ধৈর্য ধরে বসে আছে। কখন কবি আসবেন। শােনাবেন মুক্তির বাণী। শত্ৰুৱা আতঙ্কগ্রস্ত। প্রস্তুতি চলছে বাঙালিদের ধ্বংস করার।
আসলেন কবি। সিঁড়ি বেয়ে, ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠলেন বীর কবি। অলিখিত কবিতা শোনাবেন। এ কবিতা মনের কবিতা, এ মনের কথা কাগজে লিখে বলা যায় না।
মঞ্চে দাড়ালেন বীরদর্পে কবি। দাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সেলিনের সমবেত দশ লক্ষাধিক বাংলাদেশের পতাকা হাতে গগনবিদারী শ্লোগান দিয়ে উঠলেন । জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বাংলা; তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা যমুনা; বীৱ ৰাঞ্চালি অস্ত্র ধরাে বাংলাদেশ স্বাধীন করাে; আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সাম; তোমার নেতা, আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব।
| সাইফুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে আমিও একমত। ৭ মার্চের ভাষণে আমরা শব্দের কারুকার্য, ফানি ও শব্দের ব্যবহার, ভাষাগত বৈশিষ্ট্য ও অর্থের বহুমাত্রিকতা লক্ষ করি। পাঠকবৃন্দ আসুন এবার দেখা যাক এই ভাষণের বিশেষ বিশেষ দিকগুলাে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জাতির নিজের বিবেকের প্রশ্ন : কী অন্যায় করেছিলাম আমরা? কী পেলাম আমরা? কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব?
যারা আমার মানুষের বুলে বক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে সন? (জাতির জন্য প্রশ্ন।
ভাষণে উচ্চারিত ব্যক্তিবর্গের নাম : ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খান, ভুট্টা, শেখ মুজিবুর রহমান।
যেসব স্থানের নাম উচ্চারুণ হয়েছে, সেগুলাে হল : ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, পেশােয়ার, করাটি (পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের)।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন প্রসঙ্গে পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান, বাংলা, পূর্ববাংলা ঐ বাংলাদেশ শব্দ ব্যবহার করেছেন।
বাংলাদেশের ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের বিন্নি পর্বের কথাও স্টার ভাষণে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অলাত ও মেয়াদ উত্তীর্ণের পূর্বেই ক্ষমতাচ্যুতি। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন। ১৯৬৬-এর ৬-দফা প্রস্তাব। ১৯৬৯-এর গণঅত্যুথান ও আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার। ১৯৭০-এর নির্বাচন ও নতুন হড়যন্ত্র। | অষণে উচ্চারিত শব্দচয়ন ও আবেগ, চ্যালেঞ্জ। আমার জয়ের রক্তে রাজপথ বতি, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার, আমার বাংলার মানুষের। বুকের উপর,.. । আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। | উপরের বাক্য শগুলাের মধ্যে আমরা র’ এবং ‘স’-এর অনুপ্রাসগত প্রভাব দেখতে পাই।
৭ মার্চের ভাষণে সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রবাদ এবং সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত উপমার উচ্চারিত হয়েছে। যেমন। ভাতে মারব, পানিতে মার। অর্থাৎ আঘাত দিয়ে নয়, হাতে নয়, উপবাসে রেখে কিংবা অন্য কৌশলে শত্রুকে কাৰু কিংবা বশ করা হবে। এই কৌশল অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ব্যবহৃত প্রবাদ বাপৰেও রূপলাভ করেছিল অসহযােগ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে।
ভাষণের বিভিন্ন পর্যায়ে শব্দগুলাে কাব্যের রূপ নিয়েছে। যেমন জীবনের তরে, বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। তেইশ বছরের ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস; তেইশ বছরের ইতিহাস, মুর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে। ৰাজপথ রহি করার ইতিহাস। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। অামরা ভাতে মারব, পানিতে মারব।
আমরা আরও খুঁজে পাই সমতট বা দক্ষিণবাংলার ভাটি অঙ্গলের সাধারণ মানুষের চলতি ভাষা। যেমন—তাে ভায়েরা আমার, সবই, বচ্ছর(হুর)। সাহঅই (সাতই)। বােঝা (বন্ধ), শুখায় (শুকালাে), যদ্র, দমাতে, দাবায়ে দেবার, যায়না-পত্র, পয়সা, পারবা (পায়বে), পাড়া, পেীছায়ে রাথবা (রাখবে), যায়ে (গিয়ে), পাত্রে (পনেরো), কোল ইত্যাদি। | শব্দের ও বাক্যাংশের আর্থের সম্প্রসারণ ঘটেছে কোনাে-কোনাে অংশে। সেই বাক্যসমূহ সেই সময়কার বৈরী পরিবেশের জন্য উপযুক্ত ছিল। আমি যা বলি, তা মানতে হবে (নির্দেশ অর্থে অথােরিটিসহ)। তােমাদের যা-কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর
মােকাবেলা করতে হবে। (সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়ার আভাস ও মনােবল যােগানাে।) আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি।
জোড়া সমার্থক শব্দের বহুল ব্যবহারও ভাষণে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। টাকা-পয়সা, কোট-কাচারি, কল-কারখানা, রাস্তাঘাট, মায়না-পর, হিন্দু-মুসলমান, সামরিক আইন মার্শাল-ল, রেডিও-টেলিভিশন, টেলিফোন-টেলিগ্রাফ, খাজনা-ট্যাক্স, আদালতফৌজদারি, বালি-ননবাঙালি, হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্ট ইত্যাদি। | বঙ্গবন্ধুর ভাষণে সর্বাধিক উচ্চারিত বাক্যাংশ। এই বাক্যাংশ মঙ্গবন্ধুর স্বভাবগত এ হৃদয় থেকে অকৃত্রিম ভালােবাসা আর আবেগে ভরা। বঙ্গবন্ধুর মনের কথা : আমার। আমার গরিব। আমার বাংলার । আমার মায়ের। ভায়েরা আমার। আমার মানুষের। আমার লােকের। আমার বুকের। আমার দাবি। আমার দেশের । আমার অনুরােধ। আমার মানুষ। আমার রিলিফ কমিটি। আমার সঙ্গে। বাংলার–পূর্ব বাংলার। বাঙালির ইতিহাস। বাংলার মানুষ। বাংলার অত্যাচারের । বাংলার মানুষকে।
বাংলার মানুষকে বঙ্গবন্ধু এত ভালােবাসতেন, হৃদয়ের গভীরে এত টেনে নিয়েছিলেন, এত আত্মবিশ্বাস সমগ্র বাঙালি জাতিকে তিনি এক আত্মায় মিশিয়ে নিয়েছিলেন, বাঙ্গালিকে “তুমি” বলে সম্বােধন, নির্দেশে আলিঙ্গন করলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা একটা অনন্য ব্যতিক্রমী ঘটনা।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু, সমগ্র বাঙালি জাতিকে “তুমি” বলে সম্বােধন করে বলেছেন, তোমাদের কাছে আমার অনুরােধ রইল। তােমাদের যা-কিছু আছে, তাই নিয়েই প্রস্তুত থাকো। মনে রাখনা…সগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে। আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তােমরা বন্ধ করে দেবে।
ভাষণে বঙ্গবন্ধু কোনাে কোনাে জায়গায় ‘জোর বা স্ট্রেস দিয়েছেন। যেমন : আজ, আমি, মানুষ, সম্পূর্ণভাবে…। | মানুষ ও দেশের মাটির জন্যে বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালােবাসার প্রতিফলন ঘটেছে ভাষণে। তিনি বলেছেন : সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।…পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিতে চাই। যদি আমার লােককে হত্যা করা হয়। শহীদদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যােগদান করতে পারে না। মরতে যখন শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।
শামছুল আলম চৌধুরীর মত । এখানে দাবায়ে রাখতে, বলে দেবার, আমার লােককে, রক্তে পাড়া ইত্যাদি শব্দ বা শব্দৰহ্মের সমাহারে ৭ মার্চের ভাষণ অর্জন করেছে বাংলার প্রকৃত লােকায়ত চরিত্র। ভাষণে তৎসম, তম্ভব, দেশী, আরবি-ফারসি, ইংরেজিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শব্দের আশ্চর্য ও অভূতপূর্ব সমন্বয়, সুন্দর প্রয়ােগ ও ব্যৰহ্যর ভাষণটিকে ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্য কোনাে নেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মতাে সাধারণ মানুষের ভাষা এত সাবলীল ও স্পষ্টভাবে পাওয়ার নজির বিরল। শব্দগুলাে হল : আজাদি, গােলাম, হরতাল, গুলি,
দরজা, কসাইখান, বাজনা, কাচারি, ফৌজদারি, লুটতরাজ, বিজ্ঞা, হুকুম, খতম, দোকান, অক্ষর, পরিষ্কার, পয়সা, বৈঠক, অস্ত্র, বললাম, মােকাবেলা, সংগ্রাম, দোষ, হাজির, দুর্গ, হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট, জজকোর্ট, ব্যাপক, রেল, লঞ্চ, স্টেশন, রেডিও, টেলিভিশন, সেক্রেটারিয়েট, কনফারেন্স, এ্যাসেম্বলি, মার্চ, সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট, রাউন্ড টেবিল, টাঙ্গ, ব্যারাক, মেজরিটি, ওয়াপদা, রিলিফ, কমিটি, সেমি-গভর্নমেন্ট, টাকা, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, নিউজ, আওয়ামী লীগ, কোট, জোর, কলকারখানা ইত্যাদি।
৭ মার্চের ভাষণে এয়ী শব্দের সংমিশ্রণে সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার পাওয়া যায়। যেমন ধরুন ; দুঃখ-ভারাক্রান্ত মন, বাউ-টবিল কনফারেন্স, সুপ্রিমকোর্ট-হাইকোর্টজজকোর্ট, বুঝে শুনে কাজ, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, আসুন দেখুন বিচার করুন।
এছাড়া এ ভাষণে বাচ্যের ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন । আমি বললাম, তিনি বললেন, উনি বললেন প্রকৃতি বাজার ব্যবহারি ভাষণকে আরও প্রাণবন্ত ও কােরবার। করে তুলেছে। | ভাষণের প্রথম পর্বে সংগ্রাম, আন্দোলন ও অত্যাচারের ইতিহাস, ভাষা-আন্দোলন, নির্বাচনে যু ন্টর জয়লা ও ষড়যন্ত্র, আইয়ুব খান কর্তৃক জারি করা সামরিক শাসন, ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রণয়ন ও গণআন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও গণঅ্যুত্থান এবং সত্তরের নির্বাচনের প্রসঙ্গ এসেছে। | দ্বিতীয় পর্বে সমসাময়িক ঘটনাবলি তুলে ধরা হয়েছে। সকারের নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ জয়লাভের পর পাকিস্তানের স্বৈরশাসক অনান্য নেতৃবর্গের ষড়যন্ত্র অসহযােগ আন্দোলনের ডাক আর বিভিন্ন শর্ত আরােপের বিবরণ। | তৃতীয় পর্বে আছে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা তথা সারা বাংলাদেশের ওপর শেখ মুজিবুর রহমানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে স্পষ্টভাবে।
এই তৃতীয় পর্বে জানানাে হয়েছে কিন্তু আবেদন, হুঁশিয়ারি এবং নির্দেশাবলি। | শেষ পর্বে স্বাধীনতা ঘােষণা। অনগণকে সংগ্রামের জন্য নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে প্রস্তুত করা হয়েছে।
ধীরে ধীরে জনগণকে মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শর্তাবলি । সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, সকল হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত হতে হবে, জনগণের প্রতিনিধির কাছে অবিলম্বে ক্ষমা ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভাষণের নির্দেশাবলি (পরিস্থিতি আয়ত্তে আনা হয়েছে)। কোট, কাচারি, আদালত ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। সেক্রেটাডিয়েট, সুপ্রিমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গকর্নমেন্ট দফতরসমূহ, ওয়াপদা বন্ধ থাকবে।
বিক্স ও ঘােড়ার গাড়ি, রেল-লঞ্চ চলবে। মাসের ২৮ তারিখে কর্মচারীর বেতন নেবেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলে।
যারা শহীদ বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের সাহায্যার্থে রিলিফ কমিটিতে অর্থ সাহায্যদানের আহ্বান। হরতালে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের বেতনদানের জন্য। শিল্পমালিকদের প্রতি নির্দেশ।
সরকারি কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশ : যা বলি তা মানতে হবে—আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন। অর্থাৎ দেশের সার্বিক মুক্তি অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স প্রদান না
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও প্রতিক্রিয়াশীলদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সতর্ক থাকা (সাবধানবাণী)।
| রেডিও-টেলিভিশনে অসহযােগ ও বাঙালিদের সংবাদ প্রচারের নির্দেশ, ব্যাংকের কর্মচারীদের প্রতি আদেশ, টেলিফোন বিভাগের প্রতি নির্দেশ, সর্বোপরি স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তােলার নির্দেশ।
একাত্তরের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যেন বাঞ্চালি জাতির জন্য একটি উপহার। কবিতার উপহার। এই উপহারের জন্য হাজার বছর ধরে বালি অপেক্ষা করছিল। বিগত দশকের পুঞ্জীভূত আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটল ৭ মার্চের রেসকোর্সে রাজনৈতিক কৰি শেখ মুজিবুর রহমানের মুখ দিয়ে। কবি শামসুর রাহমানের ‘ধন্য সেই পুরুষ’ বাঙালি জাতির নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মার্চ মাসও ধন্য।
লন্ডন ১২ মার্চ ১৯৯৯
উত্তাল মার্চ ও ইতিহাসের মহানায়ক –আবুল মাল আবদুল মুহিত
বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব প্রক্রিয়া অতি দীর্ঘ সময়ব্যাপী বিস্তৃত। সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে রাজা শশাঙ্ক (৬০৬-৬৩৭) যখন গৌড় রাজা বরেন্দ্র, রাঢ় ও সমতটকে একীভূত করলেন, তখনই শুরু হয় বাংলার ভৌগােলিক সীমানা নির্ধারণ প্রক্রিয়া। অষ্টম শতাব্দীতে (ভিন্নমতে দশমে) শুরু হয় বাংলাভাষা ও সাহিত্য বিকাশের প্রক্রিয়া। বাংগালা’ নামের ব্যবহার শুরু হয় ১৩৪২ সালে, যখন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ হলেন শাহ-এ বাংগালিয়া’। হিন্দু, বৌদ্ধ, প্যাগান ও মুসলমান নিয়ে যৌগিক জাতিসত্তার উন্মেষ হয় ১৪৪৩ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হােসেন শাহের আমল থেকে। মােগল আমলে সপ্তদশ শতাব্দীতে শুরু হল বাঙালি সত্তায় খ্রিস্টান প্রভাব। ব্রিটিশ শাসনামলেই উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই আধুনিক বাঙালি জাতিসত্তার চেতনা দানা বাঁধতে শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় (১৯০৫-১১) তা বেশ শক্তিশালী হয়। কিন্তু দুটি কারণে এই জাতিসত্তার দাবি যৌক্তিক রূপ পায়নি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আন্দোলনে সর্বভারতীয় সত্তা বাঙালি জাতিসত্তাকে চেপে রাখে এবং বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষক্রিয়া বাঙালি জাতিসত্তার ক্ষতিসাধন করে। তবুও ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস বেংগল প্যাক্টের মাধ্যমে বীজটি জাগিয়ে রাখলেন। আবার একটি উদ্যোগ হল ১৯৪৭ সালে সংযুক্ত বাংলার সােহরাওয়ার্দী-বসু পরিকল্পনায়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তানের অ্যুদয়ে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের স্বপ্ন তিরােহিত হল।
পাকিস্তানে দুটি স্বতন্ত্র অঞ্চল নিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের ধারণা ছিল অত্যন্ত আগুয়ান ও সুসভ্য চেতনার বিমূর্ত প্রকাশ। কিন্তু এই আকাক্ষা শুরুতেই কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে দেখা গেল তীব্র প্রাদেশিকতা ও স্বার্থপর ব্যবহার। সেখানকার সংগঠিত জনবিচ্ছিন্ন জমিদার-আমলা-সেনাপতিদের এলিটের শাসন ও শােষণপ্রবৃত্তি একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করল। বিভক্ত দেশের। সর্বকর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হল পশ্চিমাঞ্চলের করাচি-পিণ্ডিতে। পূর্বাঞ্চলের অংশীদারিত্ব। মােটেই থাকল না অথচ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের (প্রথমে ৬৩ শতাংশ ও পরে মােহাজেরদের অংশগ্রহণের ফলে ৬৫ শতাংশ) বাসস্থান ছিল পূর্বাঞ্চলে। আরও দেখা গেল, বিনিয়ােগের সর্বপ্রকার ব্যবস্থা হল পূর্বাঞ্চালকে বাদ দিয়ে পশ্চিমে এবং সেজন্য। পূর্বাঞ্চলের বৈদেশিক সম্পদ বিপুলভাবে পশ্চিমে পাচার চলল। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ পূর্ববাংলায় (পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন হল পূর্ব পাকিস্তান) এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ধারণা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ আন্দোলন চালিয়ে গেল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম নতার মর্যাদা দিতে। এজন্য বাঙালিকে শাহাদত বরণ করতে হল। ভাষার দাবি জয়যুক্ত হলেও কিন্তু সাংস্কৃতিক অবদমনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রইল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এবং প্রশাসনে উগ্র প্রাদেশিকতা ও শােষণপ্রবৃত্তি পূর্বাঞ্চলকে অনবরত গরিব করে তুলল, আর বৈষম্য ক্রমেই বাড়তে থাকল। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি করে পূর্বাঞ্চলকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়ােগ থেকেও বঞ্চিত করা হল।
১৯৬৬ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগ বাংলার স্বাধিকারের দাবি ছয়দফা কার্যক্রমে তুলে ধরল। বিশ্বসভ্যস্তায় অগ্রগতি সময় ও দূরত্বকে ক্রমে ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছিল। এই পরিবর্ধন বিবেচনা করেই এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নজরে রেখে ছয়দফা কার্যক্রম দুটি স্বশাসিত ইউনিট নিয়ে একটি কনফেডারেশনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত প্রদান করে। অদূরদর্শী ও অপরিণামদর্শী পাকিস্তানি সেনানেতৃত্ব এই ইঙ্গিতটি বুঝতেই পারল না। এবং উচ্চাভিলাষী ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদী পশ্চিমী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দুৰ্বত্ত সেনাবাহিনীর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। এদের সম্মিলিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনাে বিকল্প রইল না। সংলাপের মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযােগ থাকল না। বিংশ শতাব্দীতে ১৯০৮ সালে নরওয়ে ও সুইডেনের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়। আবার ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বিচ্ছেদ হয়। এই দুটি বিচ্ছেদই ছিল সংলাপ ও সমঝােতার ফসল। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে অ সব হল না সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের অশুভ চক্রান্তের ফলে। এবং সেজন্যই একাত্তরের মার্চ মাসে সমঝোতার যে স্বপ্ন জেগেছিল তা চুরমার হয়ে মার্চ হল স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত মাস। | বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সামনে সংসদ অধিবেশনের মুলতবি ঘােষণা দেখা দিল একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে। পূর্বাঞ্চলের জনগণ এটা মানতে মােটেও রাজি নয়। সেনাবাহিনী এই প্রতিবাদকে বিদ্রোহ বিবেচনা করার জন্য যুদ্ধংদেহী অবস্থানে রয়েছে। তিনি এই ঘােষণার প্রতিবাদ করলেন, ৩ মার্চ ডাকলেন ধর্মঘট ও জনসভা। ৩ মার্চ তিনি দেশব্যাপী অসহযােগ আন্দোলনের ঘােষণা দিলেন। তার দাবি হল তিনটি যথা—সামরিক শাসনের অবসান, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক বাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন। পরে চতুর্থ দাবি দিয়ে আন্দোলনকালে সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার। রাষ্ট্রনেতা হিসেবে তার নির্দেশ হল—সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে তৎপরতা। তিনি আরও জানান, ৭ মার্চ তিনি পূর্ণ কার্যক্রম ঘােষণা দেবেন।
ইতিমধ্যে এমহল স্বাধীনতার ঘােষণা দাবি করল। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন পতাকা উত্তোলন করল। উৎসাহ-উদ্দীপনা বজায় রাখার জন্য সামরিক প্রশিক্ষণেরও মহড়া চলল। সারাদেশে পরিচালিত হল একটি অনন্য অসহযােগ আন্দোলন। প্রশাসন পুরােপুরি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করতে শুরু করল। আওয়ামী লীগের কর্মীরা দেশে শান্তিশৃখলার দায়িত্ব গ্রহণ কাল এবং রাতারাঝি তারা সব সাম্প্রদায়িক হানাহানি বন্ধ করে দিল। বহু প্রতীক্ষিত ৭ মার্চে বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্রে হল প্রথম বিদ্রোহ। সেনাবাহিনী হুকুম দিল, ৭ মার্চের ভাষণ সম্প্রচার করা যাবে প্রতিবাদে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনী তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করল।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ১৮ মিনিটে তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ প্রদান করলেন। ৮ মার্চের মার্কিন প্রধান সংবাদপত্রে সেই ভাষণের বিবরণ পাওয়া গেল। চারটি প্রধান সংবাদপত্রে এই খবরের শিরােনাম ছিল নিম্নোক্ত
HCG. EP Leader stops short of declaration of independence. G ED Fight for litarty East Pakistan told বাল্টিমাের সান। East Pakistan Strikes Called. ASED New demands by the East Pakistan leader বিশ্বের অনেক মহান নেতা তাদের কোনাে-না-কোনাে ভাষণের জন্য বিখ্যাত। মার্কিন রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গ বক্ততার জন্য বিখ্যাত। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ফ্রাংকলিন রুয়েলের খাজি হচ্ছে- “The only King we ha | M in fear itself” উক্তির জন্য। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন কেনেডির বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে “Ask not what your country can do for you, ask what you can do for your country.” আফ্রোমার্কিন মহান নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর বাণী হচ্ছে- “have a dream” ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বিখ্যাত তার স্বাধীনতার প্রাপ্তিলগ্নে বক্তব্যের জন্য- “Long your ago we sea tryst with destiny”, স্যার উইনস্টন চার্চিল ছিলেন নামকরা বাগী এবং তার অসংখ্য বক্তৃতা জগৎবিখ্যাত। আমার বিবেচনায় ডানকার্কের পশ্চাদসরণ উপলক্ষে ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠ বক্তব্য—’Never in the field of human conflict was so much owed by so many to so few. | বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ছিল নরম-গরম কথা। এতে ছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য। বালির লড়াইয়ের কাহিনী। এতে ছিল অসহযােগ আন্দোলনের অন্য দিকনির্দেশনা। এতে ছিল আলােচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আহ্বান। এতে ছিল জনগণকে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুতির আহ্বান এবং সর্বশেষে এই ভাষণে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রচ্ছন্ন ঘােঘণা। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস এবং এখনও এই বক্তৃতা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে, উসাহিত করে আর করে আশান্বিত। এই বক্তৃতাকে বলা হয় সব কুল রক্ষা করে অসমসাহসী ভাষণ যা একেবারেই অতুলনীয় এবং এই ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তা ও এর ন্যায্যতা তুলে ধরে এবং গৃহযুদ্ধ বা একটি দেশের অন্তস্তরীণ বিষয় বলে তাকে অবহেলার সুযােগ রহিত করে। এই ভাষণের ফলেই মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী গ্রহণযােগ্যতা আহরণ করে।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, সকাবের দশকে একটি দেশের অন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী আগ্রহ, যা হস্তক্ষেপ ছিল একেবারে নিষিদ্ধ এবং একই সঙ্গে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার মা তেমন চিন্তাবনা ছিল না। তদুপরি একটি দেশ সশস্ত্র বিদ্রোহ প্রক্রিয় মােটেই গ্রহণযােগ্য ছিল না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাজনীতির মহাকবি (সাপ্তাহিক সাময়িকী Men’s wered তাকে এই খেতাব প্রদান করে। আর এই ভাষণে তিনি সৰ কুল Bক্ষা করে দেন একটি ঐতিহাসিক অদ্বিতীয় ভাষণ। মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন তাদের কাছে এ ভাষণ হিল উদ্দীপনা, প্রণােদনা, সাহস ও ভরসার স্থল। তাঁর বক্তৃতার শুরুতে ছিল বাংলাদেশের শ্বাশত লক্ষা: বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়।’ প্রতিপক্ষের প্রতি ছিল সাবধানবাণী : সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু সংক্ষিপ্ত ভাষণের উপসংহারে বলেন, ‘এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে—বাঙালিরা বুঝেসুয়ে কাজ করে প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি আরও রক্ত দিব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লা। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ | রাজনীতির চারুশিল্পে ৭ মার্চের বড় ছিল অতি চমৎকার একটি ভাষণ। বাংলাদেশ বিচ্ছেদে জন্য যুদ্ধ শুরু করল না, বাংলাদেশ পাকিস্তানি আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াল। ২৬ মার্চের কালাে রাতে যে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হল তাকে প্রতিহত করতে শুরু হল মুক্তিযুদ্ধ। সসম্মানে পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে আলােচনা। করে সংকট সমাধানের চালটাও ছিল খুবই কুশলী পদক্ষেপ।
শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধানের জন্য বাংলাদেশ তাে শেষ মাইলটি পর্যন্ত গেল। বঙ্গবন্ধু একজন দক্ষ সেনাপতি ছিৰে মার্চের পঁচিশ দিনে সায়া জাতিকে স্বশীলনে প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা প্রদান করেন। অসহযােগ আন্দোলন সারাদেশে জনঞ্জীবনের রুটিন প্রবাহ বজায় রাখে আওয়ামী লীগের সর্বমােট ৫টি নির্দেশনা। সারাটি প্রশাসনযন্ত্র হয়ে যায় আৰ। বলা তা যে পাকিস্তানের অস্তিত্ব সে পচিশ দিন ছিল শুধু সেনাছাউনিতে সীমাবদ্ধ, সারাদেশে অনল ছিল বাঙালির স্বশাসন। এতে যে আত্মপ্রত্যয় বলব, হয় এবং স্বাধীনতার যে অভিজ্ঞতা মিলে, তাতে মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া জাতির সামনে আর কোনাে বিকল্প ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ও মুক্ত এলাকা শাসনেও পঁচিশ দিনের অভিজ্ঞতা ছিল অতি মূল্যবান। অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনায় তাজউদ্দিনের নেতত্বে আঞয়ামী লীগ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলােচনা করে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করে। সারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক। তঁার পক্ষে হঠকারী বা অসম্মানজক কোনাে পদক্ষেপ কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির মানসপুত্র। পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধের আশঙ্কা ছিল একান্তই একটি আষাঢ়ে গল্প। বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র বিপ্লবের কোনাে প্রস্তুতি বিবেচনাই করেননি। তার কৌশল ছিল জনগণকে চেতনায় সশস্ত্র করা। প্রতিরােধ ও স্বাধিকার এমনভাবে তাদের মনমানসে প্রােথিত হবে যে আত্মরক্ষার উপায় তারাই বের করে নেবে। একটি জাতি জাতির প্রতিবাদ কোনােমতেই অস্ত্রের জোরে বানচাল করা যায় বঙ্গবন্ধু এই শাশ্বত সত্যে বিশ্বাস করতেন। তাঁর কৌশলের সাফল্য ছিল দুটি ক্ষেত্রে এবং তার ফলে মুক্তিযুদ্ধে ব্যর্থতার কোনাে আশঙ্কাই ছিল না। প্রথমটি ছিল জনমনে তিনি সে স্বাধিকারের বাসনা জাগিয়ে দেন এবং প্রতিরােধে তাদের যে আত্মবিশ্বাস তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাতে তাদের অবদমনের কোনাে সুযােগ ছিল না। মাত্র লাখ পাঁচেক রাজাকার, আলবদর ও আলশামস ছাড়া আর কেউ হানাদার দস্যুদের সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। সেজনাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছাত্র, চাষি, জেলে, শ্রমিক, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী, সংস্কৃতিকর্মী, বুদ্ধিজীবী, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সবাই হয়ে যায় মুক্তিযােদ্ধা। দ্বিতীয়ত, তিনি সার্থকভাবে প্রমাণ করেন যে, সমঝােতার কোনাে প্রচেষ্টা তিনি বাদ দেননি। পাকিস্তানি আক্রমণের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার ইতিবাচক বার্তার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি আরও প্রমাণ করেন যে, মুক্তিযুদ্ধ ঘােষণার জন্য তিনি কারও সঙ্গে কোনাে ষড়যন্ত্র করেননি। তিনি জনগণের দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বের সদিচ্ছার ওপরই ভরসা করে এগিয়ে যান। তার ন্যায্য অবস্থান, স্বচ্ছ ও উক্ত নেতৃত্ব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মানুষের ক্ষমতায়নে তার নিবেদন ও প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এবং দুর্দান্ত সাহস তাকে এনে দেয় বিজয়ের আনন্দ। কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত ও নির্জন কারাগারে বন্দি এবং সবরকম সংবাদ বা যােগাযােগ থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষটি নির্লিপ্তভাবে এবং নিয়ে ভার জনগণের ভালােবাসা ও দৃঢ়তার পর বিশ্বাস রেখে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হন।
মার্চ আমাদের গৌরবের মাস। মার্চে আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। ১৯৪৮ সালে এই মার্চেই শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪-তে এই মার্চেই প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে গণবিরােধী মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়। ১৯৫৬ সালে মার্চেই বাংলাভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। ১৯৬৬ সালে মার্চ মাসেই আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ছয়দফা কার্যক্রম ঘােষণা করে ও বঙ্গবন্ধুকে দলের সভাপতি নির্বাচন করে। ১৯৬৯-এর মার্চেই পাকিস্তানে গণতন্ত্র উদ্ধারের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হয় গােলটেবিল বৈঠক। আর একাত্তরের কাহিনী তাে আমরা এখানেই শুনলাম। ১৯৭২ সালে এই মার্চেই আমাদের মিত্রবাহিনী আমাদের ভূখণ্ড থেকে বিদায় নেয়। একাত্তরে যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ঘােষণা আমরা দিই তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ বাহাত্তরের ১৫ মার্চেই চিরতরে রুদ্ধ হয়। যে শ্রেষ্ঠ বাঙালি মহানায়কের নেতৃত্বে আমরা আমাদের জাতি রাই অবশেষে প্রতিষ্ঠা করলাম তারও জন হয় ১৯২০ সালে মার্চের সতেৱে তারিখ।
স্বাধীনতার সাইত্রিশতম বার্ষিকীতে আজ জাতি আছে এক মহাসংকটে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রায় দুঃসহ। সরকার চূড়ান্ত সমস্বয়হীনতায় দু। গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি প্রশ্নবােধক। বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে গ্রাধিকার নির্ধারণ করতে সরকার একেবারেই অপারগ। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটের খড়গহস্ত। সুপ্রসারিত। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘােড়া উৎপাদনে ধস এবং সরবরাহে অব্যবস্থা ও অপর্যাপ্ততার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনগণের সুখ-শান্তি অপহরণ করেছে। এক অদৃশ্য শক্তি যেন ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবতাবোধ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। সরকার একেবারেই গণবিচ্ছিন্ন। এই বিপর্যয় থেকে উত্তরণের পথ এই মার্চেই খুঁজতে হবে। প্রথমেই উন্মুক্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে সচল করতে হবে, রাজনীতিকে বিতাড়ন করার অশুভ উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে হবে। আত নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য অনতিবিলম্বে রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে হবে। স্বাধীনতার মাসে আমার প্রত্যাশা=গােষ্ঠীস্বার্থ এবং গােপন রাজনৈতিক এজেন্ডা দেশপ্রেমের কাছে পরাজয় মেনে নেবে। আবারও আমরা আওয়াজ তুলব : জয় বাংলা এবং জয় বঙ্গবন্ধু।
যুগান্তর ২৬ মার্চ ২০০৮
বঙ্গবন্ধু থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসজুড়ে
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বাংলাদেশের ইতিহাস বরাবরই উপনিবেশি আগ্রাসনের নিচে পড়েছে। উপনিবেশি শাসকেরা নিজেদের মতাে করে এই ইতিহাস লিখে নিয়েছেন, প্রয়ােজনে বদলে দিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের ইতিহাস বইগুলাে খুলে দেখলেই বােঝা যায় একটি অসাম্প্রদায়িক জাতির গায়ে সাম্প্রদায়িকতার একটি চাদর চাপানাের কত চেষ্টাই না হয়েছে। কিন্তু যে-ব্যাপারটি উপনিবেশি শাসনকালে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায় স্বাধীন দেশে তা কোন যুক্তিতে গ্রাহ্য হবে? কেন স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হবে, বদলে ফেলা হবে? কেন আবারও বাঙালিকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করার জন্য সরকারি ইতিহাসবিদেরা কোমর বেঁধে নেমে পড়বেন? যে ঘটনাটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্বল অধ্যায়, তাকে কেন ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হবে মানুষের মন থেকে?
ইতিহাসবিকৃতিতে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট যা করেছে তার কোনাে তুলনা নেই। যখনই ওই সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে তখনই জোটের নেতারা চিৎকার করে বলেছেন, একটি মীমাংসিত বিষয়ে কেন নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হচ্ছে? অথচ মুক্তিযুদ্ধের মতাে একটি ঘটনাকে কী সহজে তারা মানুষের মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছেন। ফলে জিয়াউর রহমান হয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বের দাবিদার, একমাত্র কাণ্ডারি। বঙ্গবন্ধু চলে গেছেন অন্যজনের সারিতে, গৌণ ভূমিকায়। যেন ছাব্বিশ মার্চ ১৯৭১ জিয়াউর রহমানের বেতার-ভাষণের আগে বাংলাদেশের কোনাে ইতিহাস ছিল না। অবশ্য ১/১১-এর পর জোটের কোনাে কোনাে ইতিহাসবিদ কাগজে লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধে স্বীকার করেছেন-ছাব্বিশে মার্চ নয়, জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘােষণা দেন ২৭ মার্চ এবং সেটি বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। জোটের এক মন্ত্রী (বর্তমানে দুর্নীতির দায়ে কারান্তরীণ) একবার জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন। সাতই মার্চে (অর্থাৎ ১৯৭১ সালের সাতই মার্চে) আবার এমন কী হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে কোনােক্রমেই কোনাে স্বীকৃতি দিতে তিনি বা তার দল বা জোট রাজি ছিল না। জোটভুক্ত দল জামায়াতে ইসলামির ক্ষোভটা অবশ্য বােঝা যায়। রাজাকার আলবদরদের উস্বাটাও বােঝা যায়। কিন্তু বিএনপি কেন বঙ্গবন্ধুকে এরকম বিষ অবৰে, তার কথা মুখে নিলে বিরাট পাপ হয়েছে বলে মনে করবে? বেগম খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট বিশাল কেক কেটে জন্মোৎসব করতেন, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তােলার কারণ নেই। মানুষের একটা জন্মদিন থাকে এবং সেটি ১৫ আগস্ট অবশ্যই হতে পারে। আর জন্মদিনে কেক কেটে খাওয়া, আনন্দ করা—এসবও তাে স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু জোট সরকারের রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসে দেয়া তার বাণীর অর্ধেকটায় বন্দনা করবেন জিয়াউর রহমানের এবং এক ক্ষুদ্র প্যারাগ্রাফে শেরেবাংলা, ভাসানী প্রমুখের সঙ্গে একবার মাত্র বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করবেনকেমন কথা? রাষ্ট্রপতি মহােদয় এখনাে আছেন এবং পনেরােই আগস্ট তিনি কী বাণী দেন তা দেখার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। | তবে আন্দাজ করতে পারি তিনি বঙ্গবন্ধুকে এবার অনেক বড় মর্যাদায় স্মরণ করবেন। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পনেরােই আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য সরকার নিয়েছে এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের একটি রাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। আমার মনে হয়েছে এ কাজটি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অনাবশাক গ্লানি থেকে জাতিকে মুক্ত করল। যে মানুষটি সারাজীবন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করলেন, যাঁর নেতৃত্বে মুক্তিসংগ্রামের জন্য দীর্থ প্রস্তুতি সম্পন্ন হল, দীর্ঘ নয় মাস বাঙালি এক পরাক্রমশালী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করল, ঔরই অনুপস্থিত নেতৃত্বে এবং যিনি এক প্রতিক্রিয়াশীল বিবেকহীন গােষ্ঠীর চক্রান্তে পরিবারের প্রায় সবার সঙ্গে নিহত হলেন, সেই মানুষটির প্রতি কোনাে দলের বা জোটের এমন তীব্র বিদ্বেষ কেন থাকবে? যে জাতি তার ইতিহাসকে বিশ্বাস করে না, তার মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে না, সে জাতির ভবিষণ্টা উজ্জ্বল হতে পারে না। ইতিহাস সেই জাতিকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেবে। বাঙালি জাতির একটি অংশ মাত্র অবশ্য এই দােষে দুষ্ট। কিন্তু তারা দেশের ক্ষমতায় ছিল বলে ইতিহাস নিয়ে জোরেশােরে মিথ্যাচার করেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতির পক্ষ থেকে ইতিহাসকে সেই মিথ্যাচার থেকে অনেকটাই মুক্ত করেছে। এজন্য সরকারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। ভবিষ্যতে যদি চারদলীয় জােট সরকার ক্ষমতায় যায় তাহলে আবার তারা পনেরােই আগস্টের মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয় কি না সেটি দেখার বিষয়, যদিও জাতীয় শােক দিবসের পক্ষে রায়টি উচ্চ আদালতের। কিন্তু জোট সকার উচ্চ আদালতকে যে খুব মান্য করে চলবে তাও তাে বলা যায় না, অতীত ইতিহাস যদি কোনাে উদাহরণ হয়ে থাকে।
পনেরােই আগস্টকে নিশ্চয় বিএনপি-জামায়াত জোট জাতীয় শােক দিবস হিসেবে পালন করবে না। আপাতত তাদের আপত্তি তারা হয়তাে উহ্য রাখবে, সময় এলে জানিয়ে দেবে। আমার ভয়, বিএনপি-জামায়াতে ইসলামি যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে মূলায়ান করছে এতকাল তার ধারা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারবে না। একইভাবে আওয়ামী লীগও যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করছে এতকাল, সে ধারা থেকেও তারা বেরিয়ে আসতে পারবে না। ফলে ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তাদের মূল্যায়নে পাওয়া যাবে না, বরং যা পাব তা একদিকে কিছু বিদ্বেষের কালিতে আঁকা ছবি, অন্যদিকে জীবন থেকে বড় একটি মিথের বিস্তার। প্রথম মূল্যায়নটি বিবেচনারও যােগ্যতা রাখে না। জোট সরকারের কিছু ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক এবং নেতারা যতই বঙ্গবন্ধুকে খাটো করাতে চান করতে পারেন। তাতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থানের কোনাে পরিবর্তন হবে না, তাই বরং আরও খাটো হয়ে যাবেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু যা ছিলেন না তাঁকে তা প্রমাণ করা মানুষ হিসেবে এবং মানুষের স্বাভাবিক জুলটিসহ একজন মানুষ হিসেবে কে না দেখে একজন মহামানব হিসেবেই শুধু কল্পনা করাটা তাকে কোনাে অতিরিক্ত উচ্চতাতেও নিয়ে যায় না। | আমি কোনাে ইতিহাসবিদ নই, আমি একজন সাধারণ নাগরিক মাত্র। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে যখন তিনি পাকিস্তানিদের ছয়দফার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, আগরতলা মামলার আসামি হয়েছেন, তখন আমি বেড়ে উঠেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, তার বক্তৃতা শুনেছি, তাঁকে দেখেছি, স্টার থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছি, বাঙালি হিসেবে আত্মবিশ্বাসের পাঠ নিয়েছি, তার মহিমায় আরও কোটি কোটি বাঙ্গুলির মধ্যে উপসিক্ত হয়েছি। আবার ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির পর তাকে ক্ষমতার শীর্ষে দেখেছি। তার অর্জনগুলাে, তার অর্জন এবং ভুলগুলােকেও দেখতে পেয়েছি। তারপর তার মৃত্যুতে শােকাহত স্তব্ধ হয়েছি। আমার সবসময় মনে হয়েছে তিনি অসাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু শেষপর্যন্ত মানুষই। এই পরিচয়টিই ঊকে জনগণের হৃদয়ে স্থান নিয়েছি। এটি ভুলে গেলে চলবে না।
তিনি ইতিহাসের মহানায়ক ছিলেন, আবার একজন সাধারণ বাক্কালিও ছিলেন। ভঁকে স্মরণ করা তাই শুধু অর্থহীন কিছু স্মৃতি করে যাওয়া নয়, বরং মানুষ হিসেবে। তাকে বােঝার চেষ্টা করা। একজন মানুষ প্রায় একা একটা বিশাল শক্রর এই ছেড়ে দিলেন, সেই পৌরাণিক গােলিয়াথের বিরুদ্ধে ডেভিডের মতো সাফললা; ভঁর এই দিকটা যেমন আমাদের চিরস্থায়ী অনুপ্রেরণার উৎস, তেমনি যে সাপ্ত তিন বছর তিনি ক্ষমতায় ছিলেন সে সময়টাকে কেন বাংলাদেশকে একটা সুন্দর ভবিষ্যতের মজবুত ভিক্তি তিনি গড়ে দিতে পারলেন না সে বিষয়টি বােকাও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধুর বড় বন্ধ অর্জনের পেছনে যদি থাকে তার প্রতিক্ষা, উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা এবং উদ্দেশ্য সাধনে অবিচল সংগ্রাম কঁার দল, তাঁর সহকর্মীদের সহযােগিতা। এবং দেশের মানুষের সমর্থন ও ভালােবাসা; তাহলে তার অসলাগুলাের পেহনেও নিশ্চয় কারণ ছিল, যার মধ্যে ভঁর নিজের কিছু ভুল যেমন ছিল, তেমন ছিল দল ও সহকর্মীদের ব্যর্থতা এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। কিন্তু বঙ্গবধুর অঞ্জলি অর্জন নিয়ে প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস-খনিই তেমন কোনাে মূল্যায়ন হয়নি। একদল ইতিহাসবিদ তার অর্জনের কোনাে উল্লেখ না করে শুধু অনর্জনগুলােকেই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তাকে দানব বানানাের চেষ্টা করেছেন, যদিও তাদের গায়ে দলের লেবেল আঁটা থাকায় তালের বইপত্র, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ওই দল বা সহমর্মী দলের রাতকানা সমর্থকদের জন্যই। আবার আরেক দল ইতিহাসবিদ শুধু স্বর অর্জনগুলাে নিয়েই গবেষণা করেছেন, স্কুলের দিকগুলােকে এড়িয়ে গেছেন বা নানা মুক্তির আলে বৈধতা দিয়েছেন। এখানে শুধু দুতিনটি এরকম অর্থন না স্কুলের উদাহরণ দেয়া যায় যেগুলাের নিরপেক্ষ বিশ্লেণ আমাদের অনেক সমস্যার নিষ্পত্তিতে সহায়তা করবে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় শতাগ সাফল্য রক্ষীবাহিনী গঠন এবং দেশজুড়ে বিরােধীদের ওপর নির্যাতন। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর্ব-পরিস্থিতি বুঝতে না-পারা। এ ছাড়া ভাজউদ্দীন আহমদের মতাে একজন সৎ যােগ্য এবং দেশপ্রেমিক নেতাকে এবং কেন দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন এ প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা ও গুরুত্বপূর্ণ। | এসব ঘটনার প্রতিটির পেছনে আন্থে দলের দাবিকে সবার ওপরে স্থান দেয়ার বিষয়টি। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে ভালােবাসবেন, সেটি স্বাভাবিক। কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাড়াও দেশের স্বাধীনতার জন্য অনান্য দলের সদস্যরা এবং বিরাটসংখ্যক সাধারণ নাগরিক যুদ্ধ করেছেন। তালের বাইরে বেরে ক্ষমতায় শুধু আওয়ামী লীগকে জায়গা দেয়াটা ছিল অনুচিত। রক্ষীবাহিনী দিয়ে বিরােধীদের শাস্তি দেওয়াটা ছিল অনুচিত। ইমামের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে বাক্কালি হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়টা ছিল অনুচিত। এসব অনুচিত কর্মের বােঝা কিন্তু এখনাে আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। এখনাে আমাদের গগয়ে ইনার টেক অল’ অর্থাৎ যে জেতে সবকিছু তার—এই মানসিকতা চলছে। আমাদের দেশে এখন রবের ক্রসফায়ারে মানুষ মাছে। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার মানুষজন শুধু-যে অধিকার-বঞ্চিত, তা নয়, অনেকে নিয়ে দেশে আছেন। পরবাসীর মতাে। যদি বঙ্গবন্ধু আরেকটু উদার হতেন, দলের ইয়োম্যানদের থেকে দূরে থেকে তাজউদ্দীনের মতাে মানুষদের পরামর্শ নিতে, যদি ধৈর্যশীল হতেন ছাত্রদের প্রতি, স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া অঙ্গনের প্রতি বাংলাদেশের অনেক সমস্যাই এখন অতীতের বিষয় হয়ে পড়িতি।
সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশকে নিয়ে যে গভীর চক্রান্ত চলছিল, পাকিস্তানিদের অহঙ্কারলাে চুর্ণ করার জন্য তাকে যে পাকিস্তানি মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স ক্ষমা করবে না এবং এদেশীয় রাজাকার-আলবদর যে সুযােগ পেলেই তাদের প্রন্তিশােধ নেবে—এ বিষয়টি নিয়ে না বঙ্গবন্ধু, না তাঁর দলের হর্তাকর্তা, কারও কোনাে উদ্বেগ ছিল। বিষয়টি সত্যি অবাক করার মতো। মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি যুক্তরাষ্ট্রের অহমিকায় ছিল বড় আঘাত, পাকিন্তানি সামরিক জান্তার জন্য ছিল একটি অন্তহীন দুঃস্বপ্ন। কে না জানে এই দুই দেশের তখন গলায় গলায় বন্ধুত্ব! তাদের সঙ্গে আৱে মিলেছে চীন, যার সঙ্গে পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে মিল হল যুক্তরাষ্ট্রের। বেইজিংয়ে জুলাই ১৯৭১-এর শুরুর দিকে, কিসিঞ্জারের গােপন সফরের সময় প্রথম সুযােগেই যে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত শক্তি বললা নেবে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তা বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় ইতিহাসে কোনাে প্রথম বর্ষের ছত্রেরওঃ বিশেষ করে দেশে যখন রাঙ্কাকারআলবদরেরা পুনর্বাসিত হচ্ছে, পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা, পাকিস্কানি মনােবৃত্তির কিছু সেন যােগ দিয়েছে সামরিক বাহিনীতে। এসবের বিপরীতে সরকার ও আওয়াশী লীগে নিস্পৃহতা দেখে ইতিহাসই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে।
বঙ্গবন্ধু অনেককিছুর জন্য নির্ভর করেছেন স্ত্রীর সহকর্মীদের ওপর, কিন্তু তাদের অনেকেই তখন ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে, দল ক্ষমতা নিয়ে। তারা বঙ্গবন্ধুকে সঠিক পরামর্শ দেননি। তাঁদের ধারণা ছিল আওয়ামী লীগ অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে। জনগণের মন তারা বুঝতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর হাতে একশােটি কাজ ছিল, কিন্তু তিনি ভালাে সমর্থন পাননি। পনেরােই আগস্ট ১৯৭৫-এর পর যখন তার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কয়েকজন বাদে তার সহকর্মীরা কেউ রাস্তায় নামলেন না, পালিয়ে প্রাণ বাঁচালেন, কেউ কেউ খন্দকার মােশতাকের মন্ত্রিসভায় নাম লেখালেন, তখনই আমার মনে হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু খুৰ খাটো উচ্চতার দেশে দীর্ঘ উচ্চতার একজন মানুষ। ঝড়টা তার ওপর দিয়েই গেল, কিন্তু ঝড়ের জন্য তিনি যথাযথ প্রস্তুত ছিলেন না। | আমি জানি, আমার এ লেখাটির ওপরের কয়েকটি লাইন পড়ে একদিকের কিছু মানুষ হাততালি দেবেন, আবার অন্যদিকের কিছু মানুষ খুবই বিরক্ত হবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কেন মাত্র সাড়ে তিন বছরেই চলে গেলেন, তঁার সােনার বাংলার স্বপ্ন এতবড় একটা আঘাত পেল কেন, সেই আঘাত থেকে আমরা এখনাে উঠে দাঁড়াতে পারলাম
, তা নিয়ে পুনুগুল আলােচনা এবং গবেষণা হওয়া প্রয়ােজন। তাতে দেখা যাবে একটি জালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু আটকা পড়েছিলেন, যেটি ছিল দলনির্ভরতা, ক্ষমতা অসঠিক নানা সিদ্ধান্ত এবং দেশের ভেতরে ও বাইরের নানা চক্রান্তের; তার দায় কতটা বঙ্গবন্ধুর, কতটা অন্যদের—সেটিও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে। আন্তজাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বাস্তব তা কোনাে কল্পনা নয়। ১৯৭১ সালে আমেরিকার কী ভূমিকা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে, সম্প্রতি অবমুক্ত করা মার্কিন সরকারের কাগজপত্রে তা এখন স্পষ্ট। ওপরে যেমন উল্লেখ করেছি অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিলে আমাদের ভবিষ্যতের পথচলা সহজ হয়।
বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস কল্পনা করা বাতুলতা মাত্র। তার মতাে উচ্চতার নেতা আবার কবে আমরা পাব, জানি না। তাকে আমি তার অসঙ্কৰ বাঙালিয়ানার জন্য, তার অসাধারণ সাধারণত্বের জন্য, মানুষের হৃদয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ার ক্ষমতার জন্য শ্রদ্ধা জানাই।
প্রথম আলাে, ১৫ আগস্ট ২০০৮
একটি কাক্ষিত রায় এবং জাতির জনকের মূল্যায়ন
সুবিদ আলী ভূঁইয়া।
একটি রায়। কাক্ষিত রায়। ইতিহাসের ধারা ও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি রায়। একটি দিন—১৫ আগস্ট। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এদিন। রাজনৈতিক নীতিহীনতার কারণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদিবসটিও রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের কবলে ছিল। ১৯৯৬ সালে ১৫ আগস্টকে সরকারিভাবে জাতীয় শােকদিবস হিসেবে পালন, সরকারি ছুটি এবং জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার বিধান করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এই সরকার এই দিবসটি বাতিল করে। কিন্তু গত ২৭ জুলাই ১৫ আগস্টকে জাতীয় শােকদিবস, সরকারি ছুটি, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার বিধানকে পুনর্বহাল করেন হাইকোর্ট। এই রায়ের ফলে এখন থেকে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত হবে। | আসলে বঙ্গবন্ধুর মূল্যায়ন যেভাবেই করা হােক না কেন এদেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক তিনি। দলমতের ঊফে তার স্থান। তাকে অবমূল্যায়ন করা বা ছােট করে দেখার অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি বা মূল্যায়ন রাষ্ট্রীয় বিধান দিয়ে আটকে রাখা যাবে না। রাখা যায়নি। কারণ তার অবস্থান এদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে। তবে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাপ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার কথা উল্লেখ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদও তার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন বিভিন্ন সময়। ইতিমধ্যে পাঠ্যপুস্তকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান দেখানাের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের একটি উক্তি এখানে তুলে ধরছি। তিনি ২০০৭ সালের ২৭ মার্চ মুক্তিযােদ্ধাদের এক সংবর্ধনা-সভায় বলেছেন, ‘আমরা ৩৭ বছরেও আমাদের জাতির জনকের যথাযােগ্য সম্মান দিতে পারিনি। তার এই বক্তব্য শুনে একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে আমি খুবই গর্বিত হয়েছিলাম। আমি সে-সময়কার আমার লেখায় এবং বিভিন্ন সভা-সমিতি ও গােলটেবিল বৈঠক এই সাহসী বক্তব্যের জন্য সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। | আসলে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। ৩৭ বছর বয়সী কোনাে ‘দেশ’ প্রতিষ্ঠার পর তাদের স্বাধীনতার ইতিহাস এভাবে বিতর্কিত হয়েছে কিনা আমার সন্দেহ। তবে একথা সত্য যে, আমাদের স্বাধীনতার খুব অল্পসময়েই সরকারে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি তথা বিরােধীরা পরােক্ষভাবে ক্ষমতায় ছিল। তারা সেই সিঁড়ি বেয়ে একসময় প্রকাশ্যেই আসে। তবে স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিতর্কিত করা হয় মূলত ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। ওই সময় স্বাধীনতার ঘােষকসহ বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার অপচেষ্টা শুরু হয়। এককথায় আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসের মীমাংসিত বিষয়গুলাে বিতর্কিত করা হয়েছিল সেসময়ই।
ওয়ান-ইলেভেন সত্যকে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে এসেছিল। সঠিক হিসকে তুলে খরার দায়িত্ব নেয়া হয়েছিল। ২৭ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধানের ওই বক্তব্যের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ, প্রধান নির্বাচন কমিশনার শামসুল হক সেই প্রত্যয়ে শরিক হয়েছিলেন। তাদের মনােভাবে মনে হয়েছিল জাতির জনকের প্রকৃত মূল্যায়ন তথা পুনর্জন হচ্ছে এটা অনেকটা নিশ্চিত। কিন্তু তারও দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। সে বছর কম সময় নয়। যে-দেশ ৯ মাসে বিশ্বের এক সজ্জিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই কবে মুক্ত হয়, স্বাধীন হয়—সেই দেশের জনের সঠিক ইতিহাস নির্মাণে কেন সে বছর লাগবে। তাহলে এখনও কি আমরা সেই ৩৭ বছরের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটছি। সরকারপ্রধান, সেনাবাহিনী প্রধান, সিইসির মঙ্গে দেশের কর্ণধাররা তাদের সদিচ্ছা দেখানাের পরও কেন ইতিহাস আর সঠিক পথে এগােবে না? কেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার বিচারকাজ মাঝপথে থেমে থাকবে। এর পেছনে কি অন্য কোনাে রহস্য আছে? | ছাত্রজীবন থেকেই অধিকার আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন শেখ মুজিব। সেসময় থেকেই তার মাঝে এক মানবীয় গুণ লক্ষ্য করা গেছে। গােপালগঞ্জের এক অজপাড়াগাঁয়ে জন হলেও অধিকাৰসচেতন ছিলেন সবসময়। আহামরি অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও শৌর্শ, সৌম্য ও মানবিকতায় তিনি ছিলেন ধীরােদাত্ত। দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়েই তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্যের যে মুক্ত বাতাস তার নেতৃত্বেই বাঙালি পেয়েন্ধে ১৯৭১ সালে। বাঙালিদের স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। স্বীকৃতি পেলেন জাতির জনক হিসেবে। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই জাতির জনক নির্মমভাবে খুন হন সপরিবারে । দেশী-বিদেশী ষড়যয়ের কারণে সংঘটিত হয় এই নির্মম ট্রাজেডি।
বঙ্গবন্ধুর নামেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমরা তার আন্ধানেই জীবনবাজি রেখে দীর্থ নয়মাস যুদ্ধ করেছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মুক্তিসংগ্রাম যেভাবে সংঘটিত হয়েছিল আমরাও সেভাবে মরণপণ লড়াই করেছি। যেমনটা ফটেছিল পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী দেশগুলােতে। দক্ষিণ আফ্রিকার জীবন্ত কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলা দীর্থ ২৭ বছর কারাবাসে ছিলেন। সেদেশের কারা তাঁর নামের ওপরই শেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছিল। ইন্দোনেশিয়ার কথা ভাবলে কী দেখতে পাই। সুকর্মোর সংগ্রামী জীবনের চিত্র। ভিয়েতনামের হাে চি মিশ। তুরস্কের কথা ভাবলেই কামাল আতাতুর্কের কথা এসে যায়। আলজেরিয়া আর চিলির সঙ্গে মিশে আরে বেনবো এবং আলেশের নাম। এটাই ইতিহাসের স্বাভাবিক ধারা।
ইতিহাসে এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ আছে। আসলে জাতির মুক্তির সংগ্রামের নেতা একজনই। আর সবাই সে নেতার নির্দেশিত পথে যার-যার দায়িত্ব শুধু পালন করেন। মুক্তিসংগ্রামে সবার অবদানকেই গুরুত্ব দেয়া হয় কিৰ মূল নেতা থেকে যান তাঁর অবস্থানেই। বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেলাতেও এটি প্রযােজ্য। দীর্ঘ আপসহীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরঙ্কুশ জনসমর্থন এবং সর্বোপরি জাতির ক্রান্তিলগ্নে ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনা মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বতােভাবেই পরিণত হয়েছিলেন এই জাতির অবিসংবাদিত নেতায় । শেখ মুজিবের উচ্চতায় কেবল শেখ মুজিবকেই মানায়। আসলে ইতিহাসই ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা নির্ধারণ করে দেয়। জোর করে চাপিয়ে দিয়ে কাউকে ইতিহাসের নায়ক বানানাে যায় না। ইতিহাসে যার যেটা প্রাপ্য সেটা ইতিহাসই নির্ধারণ করে দেয়।
বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি তথা এই স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলের ১৩ বছরই কারাগারে ছিলেন। বাঙালির স্বাধিকারের জন্য আপস করেননি তিনি। এমনকি পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় থাকার পরও তার নামে এবং নেতৃত্বই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। তাই তাে তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক। এভাবেই ইতিহাসে নির্ধারিত হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান। চাকরিসূত্রেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ হয়। বিশাল জয়ের এই মানুষটিকে কাছ থেকে দেখার স্মৃতি আজও আমাকে তাড়িত করে। ১৫ আগস্ট কালাে রাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক কারণে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের পথটি বন্ধ করা হয় এক আদেশবলে। | চাকরিসূত্রে অনেক দেশ সফরের সুযােগ হয়েছিল আমার। সেখানে আলাপআলােচনায় দেখেছি সেদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে খুব সম্মান দেখায়। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি—চীনের নামের সঙ্গে যেমন মাও সেতুংয়ের নাম, তুরস্কের সঙ্গে কামাল আতাতুর্ক, দক্ষিণ আফ্রিকার নামের সঙ্গে নেলসন ম্যান্ডেলার নাম জড়িয়ে আছে, তেমনি তাদের কাছে বাংলাদেশের নামের সঙ্গে শেখ মুজিবের নামও জড়িয়ে আছে। আমি আবারও সেনাবাহিনী প্রধান মইন উ আহমেদের ওই বক্তব্যের সূত্র ধরে বলছিআমাদের জাতির জনকের যথাযথ সম্মান অবশ্যই দিতে হবে। দায়মুক্তির জন্যই তার হত্যার বিচান হতে হবে। আর এটা এখনই সময়। এই সরকারই তা করতে পারে। সম্প্রতি সরকারিভাবে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শােকদিস, সরকারি ছুটি এবং জাতীয় পতাকা অবনমিত রাখার জন্য হাইকোরে দেয়া কাতি রায়ই এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ এই রায়টি এদেশের বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর সেন্টিমেন্টের বহিঃপ্রকাশ। এই রায়ে আবারও প্রমাণিত হল বিতর্কিত ইতিহাস কখনও স্থায়ী হয় না। সরকারকে মনে রাখতে হবে ইতিহাসকে সঠিক পথে চলতে দিলে নিজেও ইতিহাসের অংশ হয়ে যায়।
যুগান্তর, ১ আগস্ট ২০০৮
বঙ্গবন্ধু : কিংবদন্তির প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা
মহিউদ্দিন আহমেদ
গত ১১ আগস্ট সােমবার, ১৩ আগস্ট বুধবার এবং ১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার—এই তিন দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজত তিনটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। প্রথম অনুষ্ঠানটি ছিল মােনায়েম সরকার সম্পাদিত এবং বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জীবন ও রাজনীতি’ শীর্ষক ১০২৭ পৃষ্ঠার দুই ভন্যুমের বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটি ছিল প্রধান ফটোসাংবাদিক আলহাজ জহিরুল হকের বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ছবির প্রদর্শনী চিরভাস্বর বঙ্গবন্ধু’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আর তৃতীয় অনুষ্ঠানটি ছিল নােয়াখালীর মাইজদিকোটে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের কয়েকটি দিক নিয়ে বক্তৃতা দিতে ওখানকার রাসেল স্মৃতি সংসদ সতীর্থ বন্ধু, কথাশিল্পী রশীদ হায়দার এবং আমাকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির পক্ষে অ্যাডভােকেট রানাদাসও বুধবার তাদের একটি সভায় বঙ্গবন্ধুর ওপর কিছু কথা বলতে গত রোববার একটি অনুরােধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এটি রক্ষা করতে পারিনি। যুগান্তরের জন্য এই লেখাটি সােমবার বিকালের মধ্যে পত্রিকা অফিসে পাঠাতে হবে। তার ওপর ঢাকানােয়াখালী-ফেনী গ্রামের বাড়ি হয়ে ঢাকা-প্রত্যাবর্তন কিছুটা ক্লান্তবােধ করছি।
| এই তিনটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকালে এবং তার আগে-পরে লােকজনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, বিচারপতি আব্দুর রশীদ এবং বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের। সমন্বয়ে গঠিত আমাদের হাইকোর্ট ডিভিশনের বেঞ্চটি সম্প্রতি যে বায়টি দিয়েছেন সেটি আমাদের জাতিকে পাপমুক্ত এবং কলঙ্কমুক্ত করতে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। বলে বিভিন্ন ব্র্যাকগ্রাউন্ড এবং বয়সের মানুষজন মনে করছেন। এসব মানুষের কথাবার্তায় বিচারপতি আব্দুর রশীদ এবং বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে প্রত্যাশিতভাবেই। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমিও করছি। তবে সঙ্গে এই ক্ষোভটিও কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে আমারও-বঙ্গবন্ধু-হত্যা মামলার চুড়ান্ত বিচারটি আমাদের সুপ্রিমকোর্ট ডিভিশনে শেষ হতে পারছে না এই এত বছরেও, কারণ মােহতারেমা খালেদা জিয়া যখন এই শেষবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী এবং মওদুদ আহমদ তার আইনমন্ত্রী, তখন তারা এই বিচারকাজটি হতে দেননি। আইনময়ী হয়েও মওদুদ আহমদ আইনের শাসনকে যেভাবে এই দেশে প্রকাশ্যে
লাঞ্ছিত করেছেন তাতে আমার একান্ত প্রার্থনা, মওদুদ আহমদের যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। আমার আশঙ্কা জেল থেকে বের হলেই এই পলিটিক্যাল এলিমেন্ট মিটমিট করে হাসতে হাসতে আবার দলবদল করে মন্ত্রী হয়ে যাবেন।
আমাদের বিচারপতিদের ব্রিত হওয়ার বিষয়টিকে আমার কাছে অগ্রহণযােগ্য মনে হয় । ফরেন সার্ভিসে চাকরির সুবাদে লন্ডন, নয়াদিল্পি, নিউইয়র্কেও চাকরি করেছি। কিন্তু এসব দেশের কোনাে বিচারপতিকে বিব্রত হয়ে বিচারকাজ থেকে বিরত থাকার খবর কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ে না। আমাদের কিছু বিচারপতির মতাে অন্যসব কর্মক্ষেত্রের লােকজনও যদি ব্রিত হতে থাকেন তাহলে দেশটাই বিকল হয়ে যেত। আমাদের পুলিশবাহিনীর সদস্যদের দু-তিন বছর আগে কতবার দেখলাম এককালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদেরই মন্ত্রী মােহাম্মদ নাসিমকে নিষ্ঠুরভাবে পেটাতে। পুলিশবাহিনীর কাউকে কখনও বিব্রত হতে দেখা যায় না। আর একটি কথা আমরা ছােটকাল থেকেই শুনে আসছি । জাস্টিস ডিলেড, জাস্টিস ডিনাইড। ‘জাস্টিস ডিলে’ করা হলে তাতে মানুষজন ‘জাস্টিস’-এ আর বিশ্বাস রাখতে পারে না। তাই তাে পথেঘাটে সন্দেহজনক লােকজনকে মানুষজন পিটিয়েই মেরে ফেলে। মানুষজন কোট-কাচারির বিচারের জন্য অপেক্ষা করে না। কোনাে সভ্যদেশে এমনটি ঘটে না। দেশের বিচারব্যবস্থায় মানুষজনের আস্থা-বিশ্বাস আছে কিনা, হাল আমলে ব্যর্থ রাষ্ট্রের মূল্যায়নে এই সূচকটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়।
দুই মােনায়েম সরকারের সম্পাদনায় বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত বইটির প্রকাশনা-অনুষ্ঠানটি হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরির শওকত ওসমান মিলনায়তনে। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে এই অনুষ্ঠানের মঞ্চে আরও ছিলেন প্রফেসর খান সারওয়ার মুরশিদ, প্রফেসর সালাহউদ্দিন আহমেদ, প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং প্রফেসর মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। এদের এই পাঁচজনের প্রত্যেকের বয়স ৮০ বছরের ওপর। এই পাঁচজনের যে-কোনাে একজনের উপস্থিতি যে-কোনাে অনুষ্ঠানকেই আরও মর্যাদাবান করে তােলে। তারপর শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে ছিলেন মতিয়া চৌধুরী, তােফায়েল আহমেদ, এএমএ মুহিত, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান। | নির্বাহী ডা, জাফরউল্লাহ চৌধুরী, সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রেস
কাউন্সিলের বর্তমান চেয়ারম্যান কাজী এবাদুল হক, আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ডা. দীপু মনি, মুক্তিযুদ্ধের গবেষণায় নিবেদিতপ্রাণ এক মানুষ মেজর শামসুল আরেফীন।
শেষপর্যন্ত বাংলা একাডেমীই এই বইটি প্রকাশ করেছে। দেশে যে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় নেই তা এই একটি ঘটনা থেকেও বােঝা যায়। বিএনপি জামায়াতিরা যতদিন ক্ষমতায় ছিল ততদিন এই বইটি প্রকাশ করতে
দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুকে কনটেস্পট’ দেখাতে | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-১৮
শুধু-যে কেক কেটে জন্মদিন পালন করেন তা তাে নয়, ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা। যােগাযােগমন্ত্রী হয়েই বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দিয়ে ওখানে ‘যুমনা শব্দটি বসিয়ে দেন, মােহতারেমা বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর ছবিটি আড়াল করে পাশে ‘শহীদ জিয়াউর রহমানের বড় এক ছবিও স্থাপন করেন। খালেদা জিয়া স্বাধীনতা পুরস্কার দেন বঙ্গবন্ধুকে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একই পুরস্কার দেন তার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্টকেও! বঙ্গবন্ধুকে আড়াল করলেই যে জিয়াউর রহমান উঠে আসবেন, বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিলেই যেন জিয়াউর রহমান গ্রীষ্মের সূর্যের মতাে আলাে ও। তাপ ছড়াবেন—এই ‘খােয়াব’ মােহতারেমা, তার দল, ক্যাডার এবং নেতাকর্মীদের এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
জামায়াত ও জাতীয়তাবাদীদের জোট সরকারের আমলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার যে দ্বিতীয় প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় তার সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এর সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং প্রকাশিতব্য দলিল ও ইতিহাসগ্রহের তথ্যাদি নিরপেক্ষ ও সঠিকভাবে বাছাই করে দেশের সব অঞ্চলের প্রামাণিক তথ্যের বিবরণ সংবলিত বস্ত নিষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ দলিল সাধারণ মানুষের পাঠোপযােগী ও বােধগম্য করে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাগ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রধানমন্ধীর অনুমােদনক্রমে দেশের বিশিষ্ট বরেণ্য ব্যক্তিত্বের সমন্বয়ে ৯-সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রত্যয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ওই প্রত্যয়ন কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সভাপতি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সর্বজনাব প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া, প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার মমিনুল হােসেন, ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম, প্রফেসর কে এম মােহসীন, প্রফেসর আবুল কালাম মধুর মােরশেদ, প্রফেসর জসীমউদ্দিন আহমেদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।”
জাতীয়তাবাদী ও জামায়াতিদের ইতিহাসৰিকৃতির এই দ্বিতীয় প্রকল্পের সফল বস্তিবায়নের পর ১৫ ভলমে তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ; দলিলপত্র’ ২০০৮ এর মার্চে প্রকাশিত হয়। পুনঃমুদ্রণ প্রাকথন’ শিরােনামে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও প্রত্যয়ন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মােঃ রেজাউল করীমের একটি ভূমিকা প্রতিটি ভলুমের শুরুতেই আছে। উপরের উদ্ধৃতিটি এই ‘পুনঃমুদ্রণ প্রাককথন থেকে নেয়া হয়েছে।
এই প্রকল্পের অধীনে রচিত সেক্টরভিত্তিক ইতিহাসের এক নম্বর ওকামে অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদের একটি দীর্থ ভূমিকা আছে। এই ভূমিকার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন ২৫ মার্চের বর্বরােচিত পাকিস্তানি আক্রমণের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রস্তুত ছিল বলে মনে হয় না। তার একটু পরেই তিনি লিখছেন : ২৭ মার্চে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তিনি (মানে জিয়াউর রহমান) স্বাধীনতার ঘােষণা দান করেন। জাতীয়তাবাদী পণ্ডিত শিরােমণি অধ্যাপক এমাজউদ্দিন বলছেন তিনি ‘২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। তারপরও জাতীয়তাবলী জামায়াতিদের এক কথা । জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চেই স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন। জাতীয়তাবাদীদের এই সমানের পেছনে আছে আরেক জাতীয়তাবাদী অধ্যাপক মরহুম সৈয়দ আলী আহসানের এক ঘােষণা; আর জাতীয়তাবাদী সম্পাদক কাজী সিরাজের গল্প ও কথিকাসমূহ। সৈয়দ আলী আহসান নাকি ২৫ মার্চ রাতে জিয়ার্টর রহমানকে স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে নিজ কানে শুনেছিলেন! এই একই আলী আহসান দশ বারাে বছর আগে নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক পত্রিকা ঠিকানাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার প্রতি রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অসদাচরণ ও বেয়াদবির উদাহরণ দিয়েছেন।
ঠিন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণাকারী জামায়াত আর জাতীয়তাবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ওপর মােনায়েম সরকারের সম্পাদিত বইটি এক্ত বছরে প্রকাশ করতে দেয়নি বাংলা একাডেমীকে। তাই তাে সেদিনের আলোচনাসভায় প্রফেসর মুস্তফা নূরুল ইসলাম বললেন প্রাপ্তিতেই তৃপ্তি। এই যে বইটা পাওয়া গেল, বাংলা একাডেমী প্রকাশ করতে পারল, সেজন্য প্রবীণ আলােচকদের সবাই বাংলা একাডেমী এবং এর বর্তমান মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মােহাম্মদ শাহেলকে ধন্যবাদ জানান। ধন্যবাদ জানান। ভায় মােনায়েম সকাকেও।
| বইটি পুৱাে পড়ে উঠতে পারিনি। তবে পাতা উল্টিয়ে দেখেছি বইটিতে অনেক ঐতিহাসিক জুৰি আছে বঙ্গবন্ধুর আয় বঙ্গবন্ধুর কতগুলো ঐতিহাসিক চিঠিও। মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দিন আহমদ, আলী আহমদসহ বিভিন্ন জনকে জেল থেকে লেখা চিঠিগুলাের মধ্যে তার স্ত্রী রেণুকে ১৯৫৯ সালের ১৬ এপ্রিলে লেখা চিঠিটি আমাকে বেশি স্পর্শ করেছে। পরিবারের প্রধান হিসেবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি তিনি কেন যত্নবান ছিলেন তা দেখতে পাই তার এই কয়েকটি বাক্যে । হাসিনাকে মন দিয়ে পড়তে লিখ। কালের স্বাস্থ্য মােটেও ভালো হচ্ছে না। ওকে নিয়মমতাে খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি এঁকে যেন নিয়ে আসে, আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট, ওকে কিছুদিন পরে স্কুলে দিও কামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপঙ্কা করি। | বঙ্গবন্ধুর এই মানবিক গুণগুলাে আরও প্রখরভাবে দেখতে পাই আলহাজ জহিরুল হকের চিরভাস্বর বঙ্গবন্ধু’ দুর্লভ ছবির প্রদর্শনীতে। একটি ছবিতে দেখা যায় তরুণ ফটোগ্রাফার জহিরুল হকের কান ধরে টানছেন বঙ্গবন্ধু, জহিরুল হকের ক্যামেরাটি জালায় ঝোলানাে। বাবার কানমলা খেয়েও জহিরুল হক হাসছেন। স্নেহপ্রবণ বঙ্গবন্ধু জহিল হয়ে পেঁয়ত্যি সহ্য করেছেন সকালে-বিকালে-দুপুর-রাতে। খালি গায়ে । গেঞ্জি গায়ে; ৩২ নম্বরে, অফিসে-সজ্জা সমিতিতে, দেশী বিদেশী নেতাদের সঙ্গে, সাধারণ শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রদের পাশে। তাই তাে জহিরুল হক ১২ হাজার ছবি তুলতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধুর আর সেখান থেকে মাত্র ৫৫০টি প্রদর্শিত হয়েছে জাঙ্গীয় প্রেস ক্লাবে মাল স্ক্রিন দিনের এই প্রদর্শনীতে। একজন সাধারণ মানুষ, স্নেহ-মমতা-ভালােবাসা রক্ত-মাংসের বাঙালির নেতা হিসেবে উঠে এসেছে বইতে এবং প্রদর্শনীতে।
বঙ্গবন্ধুর ছবির এমন আর একটি প্রদর্শনীর আয়ােজন করেছিল আমাদের শিল্পকলা একাজেমীও। শিল্পকলা একাডেমীর এই প্রদর্শনীতে আমি যেতে পারিনি। তবে এই একাডেমীর বর্তমান মহাপরিচালক ভূঁইয়া সফিকুল ইসলামকে আমি ঘনিষ্ঠভাবেই জানি। ২০ বছর আগে আমি যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এরশাদ জামানায় নির্বাসনে গিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে আড়াই বছর কাজ করি, তখন সফিক আমার সহকর্মী হিসেবে অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারির পদে সরাসরি আমার সঙ্গে কাজ করেছে। সৎ, দক্ষ এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী একজন নবীন কর্মকর্তা হিসেবে তাকে তখন কাছে থেকেই দেখেছি। শিল্পকলা একাডেমীর এই ফটোপ্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে ভূইয়া সফিকুল ইসলাম শিল্পকলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করেছেন। আমি নিশ্চিত যে, যে আদর্শ-উমেশা মনে রেখে বঙ্গবন্ধু শিল্পকলা একাছেমী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং অধ্যাপক মুস্তফা নূরউল ইসলামকে এই একাডেমীর প্রথম মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সফিক তা সমুন্নত রাখবেন। সফিক তা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
চার নােয়াখালীর অনুষ্ঠানটি ওখানকার রাসেল স্মৃতি সংসদ’ আয়ােজন করলেও রশীদ হায়দার এবং আমাকে ওখানে নিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রবল ভূমিকা পালন করেছে কানাডা প্রবাসী বঙ্গবন্ধুভক্ত কবি শহীদ রহমান। কানাডা থেকে সকাল-সন্ধ্যা আমাদের দুশলকে টেলিফোন করে এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে শহীw রহমান বলতে গেলে বাধ্য করে। বিদেশেও যে কত লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা মনে পড়লে আমি সাহস অনুপ্রেরণা পাই। ভিয়েনা-প্রবাসী এক বঙ্গবন্ধুভক্ত নজরুল ইসলামের কথা লিখেছিলাম ২০০৭-এর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে এই যুগান্তরেই প্রকাশিত ‘অমর একুশে বইমেলা ও বঙ্গবন্ধু স্মারক গ্রহ’, শিরােনামের এক কলামে। নজরুলও এই ভিয়েনাতে বসেই এখানে-ওখানে টেলিফোন করে দুই খণ্ডের ১৯৯০ পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে অমর্ত্য সেন, জ্যোতি বসুসহ দেশবিদেশের ১৪৬টি লেখা জোগাড় করে। তাৱপৱ (পরিবেশক জ্যোত্মা পাবলিশার্স) ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাৱকই বইটির সম্পাদক নজরুল নিজেই। আর এতে তার খরচ হয়েছে ৪০ লাখ টাকা! বঙ্গবন্ধুর ওপর আরও ৫০-৬০ জনের লেখা নিয়ে আগামী বইমেলায় তৃতীয় ভলুমও প্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে নজরুল কয়েকদিন আগে টেলিফোন জানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ওপর নজরুল ইসলাম এবং মােনায়েম সরকারের মােটামুটি এই চারটি অ জাও আরও শত শত বই গত কয়েক বছরে প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রকাশ হওয়া উচিত আরও হাজার হাজার বই। গত ১৪ তারিখে নােয়াখালীর অনুষ্ঠানে আমি সবাইকে এই অনুরােধাই করেছি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অল্পবিস্তর আর যাই সুতি আছে তা যেন তারা লিখে প্রকাশ করেন। সেদিন সন্ধ্যায় নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক হানিফ তার লেখাপড়ার সাহায্যে বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সহায়তার যে বর্ণনা দিলেন তাতে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধায় ভালােবাসায় আবারও অভিভূত হলাম। ইকবাল হলের (বর্তমানের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) আবাসিক ছাত্র হিসেবে ডাইনিং হলের পাওনা পরিশোধ করতে পারছিলেন না বলে অধ্যাপক হানিফের এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশ স্থগিত থাকে। মেধাবী ছাত্র হানিফ কঠোর সংগ্রাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু তা জানতেন। জানতেন, কারণ হানিফ যে তখন থেকেই ছাত্রনেতা। বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক হানিফের আর্থিক সংকটের কথা জেনে সেই ১৯৬৫-তেই কয়েকশাে টাকা হানিফের হাতে গুঁজে দেন যেন তার এমএ পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশে আর দেরি না হয়।
পাচ মােনায়েম সরকার সম্পাদিত বইটিতে একটি ক্রটি আমার নজরে পড়েছে। এই ক্রটির বিষয়টি আমি সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে জানি বলেই তা এখানে উল্লেখ করছি। বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ চ্যাপ্টারে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ কনস্যুলেটের তদানীন্তন উপপ্রতিনিধি রেজাউল করিমই হলেন বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানানাে প্রথম বাঙালি কর্মকর্তা।’ রেজাউল করিম সাহেবের সঙ্গে ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি ভােরে আমি এবং আমাদের আর একজন সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমেদ জায়গিরদারও উপস্থিত ছিলাম, হিথ্রো বিমানবন্দরের ‘আলক অ্যান্ড ব্রাউন ভিআইপি স্যুটে’। সেই ভােরে আমরা তিনজনই বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলাম। আমিও তখন একজন সেকেন্ড সেক্রেটারি । আমার ওই দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯৯৬ এর ৮, ৯ ও ১০ জানুয়ারি পরপর তিন কিস্তির লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক সংবাদ”-এ পরপর তিনদিন ‘মুকুৰাধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান এই শিরোনামে। মনে হচ্ছে মােনায়েম সরকার আমার এই লেখাটি দেখেননি। তিনি দেখেননি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে গত বছরের ১০ জানুয়ারি যুগান্তরে প্রকাশিত আমার আর একটি লেখা সিংহপুরুষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন । ভয় নেই আমি এসে গেছি। | তারপর রেজাউল করিম সাহেব বাংলাদেশ কনস্যুলেটের তদানীন্তন উপপ্রতিনিধি ছিলেন না। মােনায়েম সরকার যেটিকে কনস্যুলেট বলছেন সেটিকে আমরা ‘বাংলাদেশ মিশন’ নাম দিয়েছিলাম। ব্রিটিশ সরকার তখনও আমাদের স্বীকৃতি দেয়নি, আর আমরা কমনওয়েলথ-এর সদস্যপদও পাইনি। সুতরাং আমরা বাংলাদেশ হাইকমিশন বা বাংলাদেশ অ্যাঘেসি বলতে পারছিলাম না। আমরা একধরনের কম্প্রোমাইজ করে মিশন বলছিলাম আমাদের এই স্থাপনা’কে। [ রেজাউল করিম সাহেবকে তখন বড় এক বঙ্গবন্ধুভক্ত হিসেবে দেখেছি, তিনি পরে নব্বইয়ের দশকে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বিএনপি নেত্রীর উপদেষ্টা হয়ে
গেলেন। সেজন্যই বােধহয় বইয়ের রচয়িতাদের মরহুম রেজাউল করিমের নাম মনে আছে।
আওয়ামী লীগ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে তারা শত্রু-মিত্রের মধ্যে শক্রকেই বেশি চেনে, বেশি মর্যাদা দেয়। আর আওয়ামী লীগের লােকজন লেখাপড়াও করে না। লেখাপড়া করতে চায় না। অথচ বঙ্গবন্ধু লেখাপড়াকে কেমন গুরুত্ব দিতেন তা উপরে দেয়া তার একটি চিঠির উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। | বিচারপতি আব্দুর রশীদ তার রায়ের উপসংহারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা-ভালােবাসা জানিয়েছেন। আমিও আজকের লেখার শেষে বিচারপতি আবদুর রশীগ ও বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের সেই প্যারাগ্রাফটি উদ্ধৃত করে আরেকবার তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতস্মতা জানাচ্ছি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের ধরাছোয়ার উধ্বে একটি ইতিহাস। তাঁর কণ্ঠস্বর আজও লাখ লাখ মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। এ জাতি হয়তাে নিজ জাতি রাষ্ট্রের সংগ্রাম ও বিজয়ের
জনসমূহের মূল্যায়নের অভিন্ন অবস্থানে নাও পেতে পারে, কিন্তু তাই বলে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাকে কাপুরুষােচিতভাবে হত্যার দিনটিকে সবটুকু শ্রদ্ধা ও গাম্ভীর্যে স্মরণ না করার অধিকার হতে বঞ্চিত হতে পারে না। জাতীয় শােক দিবস পালন হবে মুজিব নামের এক কিংবদন্তির প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা নিবেদন।
ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান—এরকম একটি ইতিহাস নির্মিত এবং নির্ধারিত বিষয় নিয়ে বিতর্ক করা চলে না, যায় না; কোনাে জাতি তা করে বলে মনেও হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে এটিই যেন স্বাভাবিক ঘটনা, স্বাভাবিক নিয়ম। কারণ এখানে ইতিহাস নিয়ে অনেকেই কথা বলেন, ওয়ানপান করেন, এমনকি পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস’ও রচনা করেন। এর জন্য তাদের। ইতিহাসের অ্যাকাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ এবং গবেষণা করার প্রয়োজন পড়ে না; ইতিহাসতত্ত্ব জানা, বােঝা এবং প্রয়ােগ করার ধার ধারতে হয় না। বরং দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা, জনগণের ভূমিকা ইত্যাদি। নিয়ে কিছু সাংবাদিক, ইতিহাসবহির্ভুত বিষয়ের শিক্ষক-অধ্যাপক, লেখক, আমলা, “বুদ্ধিজীবী’ বলে পরিচিত (রাজনৈতিক বিবেচনায়) ব্যক্তি বাংলাদেশে ইতিহাস পঠন-পাঠন ও আলােচনা-সমালােচনার জায়গাগুলাে দখল করে নিয়েছেন। তারা ইতিমধ্যে ইতিহাস দখলের যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তার নজির খুঁজে পাওয়া ভার। তাদের খপ্পরে পড়ে বাংলাদেশের ইতিহাস নামক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এমন বিবর্ণরূপ ধারণ করেছে যে, কোনাে মেধাবী ছাত্র এমন একটি বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এখন খুব একটা আগ্রহ প্রকাশ করে না। তাদের শুনতে হয় ইতিহাসবিকৃতির কথা, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। ঐতিহাসিক ঘটনা ও ব্যক্তির নাম তারিখও বদল হয়ে যাওয়ার কথা!
ইতিহাস বিষয়টি নিয়ে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রচারমাধ্যমসহ সর্বত্র। দলীয় সংকীর্ণ ও ননাংরা রাজনীতি যে পর্যায়ে চলে গেছে, সেখানে অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তােলা খুবই কষ্টকর কাজ। দলীয় সংকীর্ণ মনােবৃত্তি জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে এতটাই বিভাজিত এবং হীনতর পর্যায়ে চলে গেছে, কেউ যদি এখন নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয়দান করে, কেউ যদি বঙ্গবন্ধু উপাধিটি শেখ মুজিবের নামের সঙ্গে ব্যবহার করে তাহলে তাকে নির্ঘাত একজন আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক বানিয়ে ফেলা হয়, বা সেভাবে বাঁকা চোখে দেখাও হয়ে থাকে। আসলে দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন এবং রাজনীতির সর্বত্র জাতীয় এসব বিষয় নিয়ে অ্যাকাডেমিক শিক্ষাটি দারুণভাবে উপেক্ষিত, ক্ষতবিক্ষত এবং ব্যাহত হওয়ার ফলে এমন একটি অনাকাক্ষিত, অস্বস্তিকর, বিভ্রান্তিকর এবং দুঃখজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে—যা কোনােভাবেই চলতে দেয়া উচিত নয়। আমাদের মনােজগতে ইতিমধ্যে বাসা বাঁধা দলীয় রাজনীতির সংকীর্ণ চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাসগুলােকে
নতত্ত্বের চর্চায় যথাসম্ভব সংশােধন করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রকৃত ইতিহাসচর্চা একটি উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। লেখার শুরুতেই উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান ইতিহাস নির্মিত এবং নির্ধারিত। আমি, আপনি বা যে-কেউ ইচ্ছা করলে নিজের পছন্দ-অপছন্দ, ঈর্ষা বা রাজনতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস দিয়ে ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে যা-কিছু ঘটেছিল তা চাপা দিয়ে রাখতে পারি না, অস্বীকার করতে পারি না, যা খুশি তা লিখে ইতিহাস রচনা করতে পারি না। তেমনটি যারা করেন তারা ইতিহাসতত্ত্ব সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যে ইতিহাস নির্মিত হয়ে আছে তাকে ভেঙে ফেলা যায় না, তাকে নিয়ে মনগড় ইতিহাস রচনা করার নাম কিন্তু ইতিহাস নয়, বরং বিকৃত ইতিহাস। যিনি যখন যে ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হন তিনি সেই সময়ের ইতিহাস নির্ধারিত স্থানে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাঁকে তাঁর আসন থেকে সরানাে, সেখানে অন্য কাউকে বসানাে কারও পক্ষে সম্ভব নয়। রচিত ইতিহাসে ইতিহাসবেত্তা বাস্তব ইতিহাসকে যথাযথভাবে তুলে ধরেন, উপস্থাপন করেন মাত্র। সেনা ইতিহাস হচ্ছে অতীতে ঘটে যাওয়া বাস্তবতার প্রতিবিম্বিত ধারণা। এর বাইরে কোনােকিছু বলা, লেখা বা মতামত দেয়ার সুযোগ সং, মেধাবী, দক্ষ এবং যথার্থ ইতিহাসবেত্তার নেই। অন্য যারা ইতিহাস বিকৃত কনে তারা ইতিহাসই জানেন না।
পাকিস্তান সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এবং এর সংস্কৃতিকে বিকশিত না-হওয়ার সল্লাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ঢাকায় একজন স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে জীবন শুরু করলেও সেই স্বাধীনতা তার কাছে যথার্থ মনে হয়নি, আর একধরনের পরাধীনতাই বাঙালির জাতীয় জীবনে শুরু হওয়া বলে তার কাছে ধরা দেয়। ফলে পাকিন্তান সৃষ্টির ৪-৫ মাস যেতে-না-যেতেই পূর্বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য যারা সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন তাদের সঙ্গে শেখ মুজিবের নামটা বিশেষভাবে চলে আসে। তার জেলে যাওয়া, অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগঠিত করা, ১৯৪৮ সালে ভাষা-আন্দোলন গড়ে তােলা তাকে একজন সাহসী, নিক এবং নিবেদিতপ্রাণ তরুণ নেতা হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত ও অপরিহার্য করে তােলে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, দীর্ঘমেয়াদী জেলে যাওয়া ইত্যাদি ঘটনার মধ্যদিয়ে তিনি অনেকটাই সম্মুখে চলে আসেন। শেখ মুজিব হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দীসহ তৎকালীন নেতৃবৃন্দকে নিয়ে পূর্ববাংলার জন্য অপরিহার্য জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রাজনীতি ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে শুরু করলেও অন্য কোনাে নেতাই সেই ধারায় বিশ্বস্ত থাকেননি। একমাত্র শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদকে পূর্ববাংলার জনগণের রাষ্ট্র, রাজনীতির আধুনিক ধারণা ও ধারা হিসেবে বিকশিত করার সব শক্তি নিয়ােগ করেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ, পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদসহ সর্বত্র শেখ মুজিব বাংলা ও বাঙালির অধিকার, বৈষমাহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য তাদের দাবি উত্থাপন করতে থাকেন।
শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সম্পর্কোন্নয়নসহ সব অবস্থাতেই পূর্ববাংলার জনগণের অধিকারকেন্দ্রিক পাকিস্তানকে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি তার অবস্থানকে আরও বেশি জোরালাে ককেন। তিনি পূর্ববাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে যে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তা
স্পা করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভূত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন ইত্যাদির মধ্যদিয়ে শেখ মুজিব বাঙালির নতুন দেশবন্ধু তথা বঙ্গবন্ধুতে পরিণত হন। তিনি পূর্ববাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নেতারূপে আবির্ভূত হন। এতে তিনি তার কনিষ্ঠ বা সমসাময়িক নেতৃবৃন্দ। থেকে অনেক বেশি এগিয়ে যান। মাওলানা ভাসানী চীন, সমাজতন্ত্র, পাকিস্তান এবং পূর্ববাংলার জনগণের অধিকার ইত্যাকার অবস্থানের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, আতাউর রহমানও দোলাচলে দুলছিলেন। আসলে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় বাঙালি জাতিসত্তাকে টেনে আনা, উদ্ভুদ্ধ করার মতাে একক কর্তৃত্বশীল ধারা। নির্মাণের রাজনীতি শেখ মুজিব যতটা নিরবচ্ছিন্নভাবে বছরের-পর-বছর করেছেন তা পূর্ববাংলার অন্য কোনাে রাজনীতিবিদ করেননি, করার মতাে চিন্তাও তাদের ছিল না। এক্ষেত্রে শেখ মুজিবের অবস্থান ছিল আগাগােড়া আয়নার মতাে স্বচ্ছ।
শেখ মুজিব ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রব্যবস্থায় পূর্ববাংলার জনগণকে যে আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এরপর স্বাধীনতা লাভে ঝাপিয়ে পড়া ছাড়া বাঙালির সমুখে আর কোনাে বিকল্প পথ খােলা ছিল না। এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালি জাতির নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের মূল নায়কের আসনে আসীন হলেন। এই আসন কেউ তার জন্য বয়ে আনেনি কিংবা তৈরি করে রাখেনি। তিনি রাজনীতিতে গণজাগরণের চেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। পাকিস্তান থেকে বাঙালির অন্য কোনাে উপায়ে স্বাধীন হওয়ার সুযােগ ছিল না, সুযােগ তাকে কেউ করেও দেয়নি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে থাকলে বৈষম্যের বেদনা নিয়ে পূর্ববাংলার জনগণকে অনন্তকাল ধরে পড়ে থাকতে হত। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির ২৩ বছরের মাথায় সব বৈষম্য থেকে মুক্তির পথ রচনার কাজটি আর কোনাে রাজনীতিবিন ততটা পরিকল্পিতভাবে, ততটা নিবেদিতভাবে করতে পারেননি, করেননি—যতটা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে-কারণেই তার ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের পর ‘স্বাধীনতার বার্তাই হয়ে উঠেছিল বাঙালির কাছে স্বাধীনতার ডাক, স্বাধীনতার ঘােষণা হিসেবে। বাংলাদেশের জনগণ তার সেই ঘােষণায় আস্থা স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। করে, দেশকে স্বাধীন করে। সে কারণেই বঙ্গবন্ধু আমাদের রাষ্ট্রের স্থপতি, রাষ্ট্র-ইতিহাসের প্রধান নেতা।
যুগান্তর ১৫ আগস্ট ২০০৭
অভিশপ্ত সেই ভােরবেলা মােহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
১২ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। জাতির জনকের বিশ্বস্ত সৈয়দ রেজাউল হায়াতের কাছে আমি রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবের দায়িত্ব অর্পণ করি। ১৩ ও ১৪ তারিখে একদিকে হায়াতের নিরাপদ, সৎ ও সুদক্ষ হাতে বঙ্গবন্ধুর অফিসের কাজকর্ম চলছে আর অন্যদিকে আমি সুযােগমতাে রাষ্ট্রপতির সান্নিধ্যে চলে আসছি বারবার তার মুখেই তাঁর চিন্তাচেতনা অনুভূতি সম্পর্কে শােনার জন্য। তবে তিনি নিজেই বেশি বেশি জানতে চাচ্ছিলেন। দুবছর বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে কাজ করার যে দুর্গত সুযােগ পেয়েছিলাম তাতে বােধ হয় তাঁর বিশ্বাসভাজন হতে পেরেছিলাম। সে কারণে এবং উপমহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও ব্যক্তিত্ববর্গ সম্পর্কে সময় সময় আমার মতামত হয়তােবা বঙ্গবন্ধুর পছন্দ হয়েছিল। তারই অনুমতি ও অনুমােদন নিয়ে আজীবনের স্বপ্ন অর্থনীতিতে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ যাওয়ার আগে কেন জানি না বঙ্গবন্ধুর দেশের শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কেও অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করতেন আমাকে। কয়েকবারই মনে হয়েছে নিজস্ব বলয়ের বাইরে গিয়ে ভিন্নমতের মূল্যায়নে তিনি আগ্রহী ছিলেন।
| ১৪ আগস্টের বিকেলবেলাটা আমি বঙ্গবন্ধুর কাছেই ছিলাম। পরদিন শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন। কয়েকটি নতুন বিভাগ খােলার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়রূপে ঘােষণা দেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। সন্ধ্যার সময় এলেন শিক্ষামন্ত্রী এবং সম্ভবত শিক্ষাসচিব। বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ কথা বললেন উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে। মিসেস রাজিয়া মতিন চৌধুরীর নিজ হাতে রান্না করা খাবারের কথা পর্যন্ত হল। কিন্তু গল্পীর ছিলেন রাষ্ট্রপতি তথা চ্যান্সেলর। পরের দিন তার সম্মানসূচক ডক্টর অব ল ডিগ্রি পাওয়ার কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিছুটা বিমর্ষভাবে একটা ক্ষোভের কথা বললেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যাত্রা নাকি কোনাে সময়ই সুখকর হয়নি। ১৯৪৮ সালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষ নিয়ে আন্দোলন করেন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন আরও অনেকের সঙ্গে। বাকিরা দণ্ডমূলক জরিমানা পরিশােধ করলেও শেখ মুজিব অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া ফাইন দিতে অস্বীকার করলেন। কার প্ররােচনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হলেন তাও বললেন।
দ্বিতীয় দফা পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়। ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি আবদুল আউয়াল ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মােমিন তালুকদারের আমন্ত্রণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সফরে। বাদ সাধলেন ডাকসু ভিপি একরামুল হক। সােজা বক্তব্য তার ঐতিহ্য অনুসারে কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কেবলমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ছাত্র সংসদের আমন্ত্রণেই এই পবিত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাটিতে পা রাখতে পারেন। ফিরে গেলেন শেখ মুজিব। পরবর্তী সময়ে একরামুল হক আমন্ত্রণ পাঠালেও বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় করে উঠতে পারেননি শেখ মুজিব।
১৪ আগস্টের সন্ধ্যাবেলা খানিকটা মনস্তাপ নিয়েই বঙ্গবন্ধু আরও জানালেন, ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ সালে তারই স্নেহের পরশে বেড়ে ওঠা কতিপয় বিপথগামী ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতির জনকের আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণে আয়ােজিত সফরকে ভণ্ডুল। করে দেয়। জন্ম নেয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামীয় একটি নতুন রাজনৈতিক দল।
| এই তিনটি ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যাত্রার পরিণতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এ স্বগতােক্তি করছিলেন।
উপাচার্য মতিন চৌধুরীর বিদায়ের পর গণভবনের লনে ৰানিক পায়চারি করেন রাষ্ট্রপতি। বাইরে প্রায় নিত্যসন্ধ্যার দলবল নিয়ে বসা মুক্ত-আলােচনার আসর সেদিন বসেনি। তবে লেকের ঘাটে পেীছে মাছের সঙ্গে খানিকটা খেলা করার কাজ সে রাতেও চলে। রাত ৮টা থেকে সােয়া ৮টার মধ্যে বঙ্গবন্ধু গণভবন থেকে ৩২ নম্বর তার বাসভবনের দিকে রওনা হয়ে যান। আফসােস করেন : মনােয়ার ও ফরাস দুদিন পরই চলে যাবে, ছেলেদুটো মায়া লাগিয়ে যাচ্ছে, খারাপ লাগবে খুবই । ভাগ্যিস জামিল এখানেই থাকছে।
| কালাে গাড়িতে উঠতে গিয়েই মন খারাপ করলেন। খুবই বিষন্ন মনে বিদায় নিলেন বাঙালি জাতির পরম সুহৃদ। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন সময় তার ফুরিয়ে এসেছে?
রাষ্ট্রপতির বিদায়ের পর শুরু হয় অন্য একটি বিদায় অনুষ্ঠান। জামিল ভাই (শহীদ কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমদ) রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদ থেকে গণভবন ছেড়ে ডাইরেক্টর, ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স, ডিএফআই (পদটি পরবর্তীকালে ডিজিএফআই পর্যায়ে উন্নীত) হিসেবে যােগ দেবেন। আর মনোেয়ার ভাইয়ের (মি, এম মনােয়ারুল ইসলাম) ও আমার অর্থনীতিতে আরও পড়াশােনার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমতি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা ১৭ আগস্ট। তাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ও অভিপ্রায় অনুসারে ১৪ আগস্ট রাতে একটি নৈশভােজের মাধ্যমে এই বিদায়-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সে অনুষ্ঠানে তার রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমেদ আমাদের বিদায় দিলেন। তাঁর বিচলতা কতিপয় আমলার বিরহবেদনার চেয়েও অনেক অনেক
গভীর ছিল। বিদায় অনুষ্ঠানের পরপরই নাকি তোফায়েল সাহেব ৩২ নম্বরে গিয়েছিলেন। তিনি কি বঙ্গবন্ধুকে তেমন কোনাে তথ্য দিয়েছিলেন যার ভিতিতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়া সব এবং উচিত ছিল? সেই বিদায়-অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির সচিব অনুপস্থিত ছিলেন কেন? তিনি সে রাতে কোথায় ছিলেন?
| ১৫ আগস্টের ভােরবেলা। সকাল তখন ৫টা থেকে সােয়া ৫টার মধ্যে। মালেক সাহেব (মি, আবদুল মালেক ভূঁইয়) ফোন করলেন । সার, সামথিং টেরিবল হজ হ্যাপেন। বঙ্গবন্ধুকে দুশমনরা হত্যা করেছে। হাউমাউ করে কাঁদছিলেন ভদ্রলােক। আমি মকের সুরে তাকে এত সিরিয়াস ৰিয়ে পরিহাস করতে বারণ করলাম। তিনি আমাকে রেডিও খুলতে অনুরােধ করলেন। আমাদের এএসটিএমসি শেৱেবাংলানগরে সরকারের ভবনে তখন বহু লােকের বাস। মা সঙ্গেই থাকতেন। শাড়ি এসেছিলেন মেয়ে জামাই নাতি-নাতনীকে বিদায় দিতে। এক সপ্তাহ আগে বিয়ে করা ছোটই আশরাফ, তার নববধু এবং বাড়িতে নিয়মিত বসবাসকারী দু’পড়ুয়া ভাসেহ আরও অনেকেই সে বাসস্থানের বাসিন্দা সেদিন।
আজীবনের অভ্যাস হাতের কাছে রাখা ছোট রেডিও খুলতেই সব অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করল। শুনতে পেলাম, খন্দকার মােশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। গলাটা যে মেজর ডালিমের তা তিনি নিজেই বলে দিলেন।
অমি যখন এবােরেই ভেস্তে পড়ছিলাম তখন বরাবরের মতাে আসমা নির্ভর করতে চাইল। লাল ফোনটা হাতের কাছে এনে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করতে বলল। লাল, নীল,
বু ও সাধারণ—এই চার রকমের ফোন করতে বলল। লাল, নীল, সবুজ ই সাধারণ এই চার কৱমের ক্ষেনের প্রত্যেকটিতে রাষ্ট্রপতিকে যােগাযােগ করতে গিয়ে কেবল এনগেজ টোন পাচিছলাম। সৈয়দ হােসেন সাহেবের বাড়িতে কেউ একজন ফোন ধরলেন, কিন্তু ৪ বাড়িতে অবস্থানকারী সৈয়দ হােসেন, বেগম হেসেন, ও, সেলিমুজ্জামান, মিসেস সেলিনা জামান বা অন্য কাউকেই ফোন দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। তাড়াতাড়ি লাল ফোনে জামিল ভাইকে ডায়াল করতেই আঞ্চম আৰী ফোন ধরলেন। বললেন । দেখেন না ভাই কী ফাজলামি করছে কতিপয় বিপথগামী লােক। আপনার জমিল ভাই ফোর্সকে ৩২ নম্বরের দিকে মার্চ করার হুকুম দিয়ে এইমাত্র নিজেও রওনা দিয়েছেন।
ফোন রেখে দৌড়ে বের হলাম। কিন্তু দোতলা থেকে নেমে বাইরে এসে কেক জামিল ভাই লাল রশ্নের পাতিখানাকে দ্রুতগতিতে চলে যেতেই দেখলাম। আমার চিৎকার তিনি শােনেননি। শুনলে অবশ্যই তাৰ মহতী ও দুঃসাহসী মিশনে একজন সঙ্গী পেতেন। কর্নেল জামিল সে সকালে যে আদেশ দিয়েছিলেন তা পালন করতে করা এবং কেন আখীকার করল?
ঘরে ফিরে একটা প্যান্ট পরে কিছু টাকা পকেটে পুরে বের হয়ে যাই। পেছনে স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মা, শাশুড়িসহ সবাই অঝোরধারায় কাঁদছেন। নিকট প্রতিবেশী ইউসুফ ভাই (খ, ফজলুল হাসান ইউসুফ), ঝর্ণা (মিসেস ইউসুফ) আমার আবেগের সঙ্গে একমত হয়েও বাড়ি থেকে বের হতে বারণ করলেন। একই পাড়ার অধিবাসী ড, কফিদ্দিন ও ভা, আশিকুর রহমান খানও সপরিবারে বাইরে এসে আমার যাত্রাপছে পড়ালেন। একটা রিকশা চেপে ধানমণ্ডির দিকে রওনা হওয়ার আগে পেছন ফিরে তিন বছরের মেয়ে সােমার দিকে তাকাতেই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। রিকশা যখন বর্তমানের মানিক মিয়া এভিনিউর কোণে পৌছে তখন চালককে সামনে এগিয়ে ৩২ নম্বর রোডে যেতে অনুরােধ করি। রিকশাচালক সে কথা না শুনে রিকশা ঘুরিয়ে সােজা আমাদের বাসার সামনে চলে আসেন। তার একটাই বক্তব্য : আপনার আত্মীয়-পরিজন কেন কাঁদছিলেন এখন তা বুঝতে পারছি। ৩২ নম্বর শেখ মুজিবের বাড়িতে যেতে গিয়ে নিজেও মরবেন এবং আমাকেও মারবেন।
রিকশাচালক ফেরার পথে গভীর মমতায় বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রাণপ্রিয় নেতা হিসেবে উল্লেখ করলেন এবং শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা জাতির জনকের হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ভাড়া না নিয়েই রিকশাচালক বিদায় নিলেন, আমারও ভাড়া পরিশােধের কথা মনেই ছিল না।
গণভবনে ফোন করে বিশেষ চেষ্টা করলাম সেই ব্যাগটি উদ্ধার করার জন্য যাতে জাতির জন্য অনেক দিকনির্দেশনা ছিল। বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত লেখার ভার ছিল সর্বজনাব গাফফার চৌধুরী, তােয়াব খান ও শহীদুল হকের (মরহুম) ওপর। সাহায্য করতেন সহকর্মী বঙ্গ মাহবুব তালুকদার ও সফিউল। মাঝে মাঝেই সাহায্য করতে আসতেন বাংলা একাডেমীতে আমাদের বন্ধু শামসুজ্জামান খান ও আমিনুল হক বাদশা। বঙ্গবন্ধুর জীবনচরিত রচনার কাজে জড়িত হতে চেয়ে অনেকেই বিফলমনােরথ হয়েছিলেন। দুপুরবেলা রচয়িতাত্রায় এবং সহায়তাকারীদের অধিবেশন বসত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। কখনও কখনও ঘণ্টার পর ঘন্টা বলে যেতেন বঙ্গবন্ধু । প্রশ্ন করে ব্যাখ্যা চাইতেন গাফফার ভাই সবচেয়ে বেশি। ছয় মাসেরও অধিক সময় ধরে আলােচিত, লিৰিত পঠিত শেখ মুজিব জীবনচরিতের মূল পাণ্ডুলিপি একটি ব্যাগে থাকত। সেটি পাবার জন্য ফোন করে বারবারই নেতিবাচক জবাব পাচ্ছিলাম গগণভবন থেকে। বঙ্গবন্ধু এবং আমার হাতে লেখা বাকশালের নীতিমালা, জেলা গভর্নর নিয়ােগ ও নীতিমালা, ঝােলা কমিটির তালিকা, নিহত সহকর্মীদের জীবিত আপনজনদের নাম ঠিকানাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র ছিল, যাতে আবুল খয়রাতসহ বঙ্গবন্ধুর অনেক নির্ভরযােগ্য সংবাদদাতার হাতে লেখা তথ্যচিত্র আসত জাতির জনকের কাছে। পত্রলেখকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কাগজগুলাে কেন পুড়িয়ে ফেললাম সে মর্মযাতনায আজও পুড়ে মরছি।
সারাটা দিন একটা অস্থিরতায় কাটল। ১৯৫২ সালে পিতৃহাৱা আমি প্রথমবারের মতাে আবারও প্রাণভরে কাঁদলাম। সবসময় মনে হচ্ছিল, এমন একজন লােক যিনি সারাটা জীবন উৎসর্গ করলেন বাঙালির স্বাধীনতা, সুখ ও শান্তির জন্য, যাকে কৃতসংকল্প অথচ মহাশক্তিধর পাকবাহিনীর সর্বোচ্চ ডালিম সর্বাধিনায়করাও প্রানদণ্ড দিতে সাহস করেননি, তাকে কিনা এদেশের গরিব দুঃখী মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একটি চমৎকার চূড়ান্ত প্রােগ্রাম বাস্তবায়নের পূর্বক্ষণে এদেশেরই কতিপয় সন্তান হত্যা করে ফেলল।
| বঙ্গবন্ধুর দেহের মতােই হৃদয়টা ছিল বিরাট। তাঁর হাতের পরশ ছিল নরম হাতের আন্তরিকতা, উষ্ণ মমতাপূর্ণ ও গভীর ভালোবাসায় পূর্ণ। যারা এই মহানায়কের মহৎ হৃদয়ের চিরন্তন কল্যাণ কামনার স্পর্শ অনুভব করেননি তারা সত্যিই ভাগ্যহত। আমরা জাতির জনকের এই ঋণ কীভাবে শােধ করব?
বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
এ জেড এম আবদুল আলী।
মাত্র একজন লােক এদেশে এসে নানা বিষয়ের প্রতি এত মানুষের চক্ষু উন্মোচনে এতভাবে সহায়তা করেছিলেন সেরকমটি আর খুব কমই দেখা যায়। সেই মানুষটি আর কেউ নন, লরেন্স লিফশুলজ (Lawrence Lifschulz) নামে একজন সাংবাদিক। এই মার্কিন সাংবাদিক বহুদিন আগে একটি বই লিখেছিলেন, তাতে তিনি বাংলাদেশের দুটি ঘটনাকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছিলেন তেমনটি এর আগে-পরে খুব কম মানুষই করেছেন। তাঁর ‘বাংলাদেশ : অ্যান আনফিনিশড রিভলিউশন’ বইটির প্রথম অংশে তিনি লিখেছেন কীভাবে পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধা কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান, যাকে কর্নেল তাহেরই বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছিলেন। কীভাবে তাহেরকে গ্রেফতারের পর নতুন আইন করে সেই আইনের ভূতাপেক্ষিক প্রয়ােগ ঘটিয়ে তাহেরকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। বইটির দ্বিতীয় অংশে আছে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কীভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা সপরিবারে হত্যা করেছিল সেই কাহিনী।
| লিফশুলজ আর বাংলাদেশ এসেছিলেন ২০০৫ সালে তাহেরের মৃত্যুবার্ষিকীতে। এবার তিনি যতটা সম্ভব আরও খােলামেলা কথা বলে গেছেন। কোনাে রাখঢাক না করেই বলে গেছেন কতরকম অন্যায় এবং অবিচার করে গেছেন ক্ষমতালি জিয়াউর বহমান। তিনি এবং ভয়ভীতিতে কম্পিত-হৃদয় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েম মিলে তাহেরকে ফাঁসি দেয়ার মতাে অন্যায়কর্মটি করেছিলেন। লিফশুলজ আরও বলেছেন কীভাবে তখনকার সরকারি পক্ষের কৌসুলী এবং পরে দেশের প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজাল নীরব থেকে সেই অপকর্মে সহায়তা করেছিলেন। যেসব বিষয় নিয়ে অনেক মানুষের মনেই নানারকম সন্দেহ এবং প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, সেসব সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে প্রশ্নগুলাের স্পষ্ট পরিষ্কার উত্তর দিয়েছেন তিনি। এর জন্য লিফশুলজ সবারই ধন্যবাদ পাবেন নিঃসন্দেহে। ঠিক এই সময়েই লিফশুলজ আর একটি বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি উন্মোচন করেছিলেন তাঁর কাছে লেখা তার এক বন্ধু সাংবাদিকের একটি চিঠি হুবহু ছেপে দিয়ে। পাকিস্তানি সেই সাংবাদিকের নাম এম বি নাকতি (MB Nagvi)। তিনি এখনও লেখেন এবং তার কলম প্রায়শই আমরা পড়ি দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকায়। বঙ্গবন্ধু-হত্যায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের বহুদিনই ভাবিয়েছে। লিফশুলজকে লেখা নাকভির পত্রটি এ বিষয়ে কিছুটা আলােকপাত করেছে।
চিঠিটিতে নাকভি তার বন্ধু লিফশুলজকে সম্বােধন করছেন প্রিয় লিফশুলজ” বলে। তারপর লিখেছেন : I have been an interested reader and admirer of your writngs largely because I share most of your conclusions. With regard to the assassination of Sheikh Mujibur Rahman, I carry a Secrete. (আমি আপনার একজন ভক্ত পাঠক এবং আপনার লেখার প্রশংসা করি, কেননা আমি আপনার সিদ্ধান্তগুলাের সঙ্গে প্রায়শই একমত। শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমি একটি গােপনীয় তথ্য জানি)। এরপর তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ওইদিন অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নাকভিকে ছােট একটি সভায় ডেকেছিলেন পাকিস্তান রেডিওর ডিরেক্টর জেনারেল ইজলাল হায়দার জায়সি। তখন নাকভি পাঁচ বছরের জন্য রেডিও পাকিস্তানের কন্ট্রোলার অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স হিসেবে কর্মরত ছিলেন। রেডিওর প্রধান ডিরেক্টর জেনারেল জায়নি ছিলেন পাকিস্তানের একজন অত্যন্ত জাদরেল কর্মকর্তা এবং আফগান সেলের প্রধান। ওই সভায় আরও ছিলেন পাকিস্তান বেতারের ডিরেক্টর অব নিউজ, অধুনা প্রয়াত সরদার হুসেন আনসারি। (The meeting was attended by Ijlal Haider Zaidi, then Director General of Radio Pakitan. Late Sardar Hussain Ansari. Director of News and M B Naqvi, who for a brief period of five years the controller of Current Affairs)। খুব সকালেই সভাটি ডেকেছিলেন ইজলাল হায়দার জায়দি। তার মুকুম ছিল, ওই সভা চলাকালীন অফিসের সঙ্গে যেন রেডিওর কেন্দ্রীয় বার্তাকক্ষের একটি হটলাইন খােলা থাকে। বােঝা যাচ্ছিল, তিনি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খবর আসার কথা আগে থেকেই জানতেন। তাই তার নির্দেশটি ছিল, খবরটি যথনই যেভাবে নিউজরুম বা বার্তাকক্ষের টেলিপ্রিন্টারে আসতে থাকবে তেমন লাইন-বাই-লাইন তাকে ওই সভাকক্ষের হটলাইন মারফত জানাতে হবে।
নাকভি এরপর তার চিঠিতে লিখেছেন : সভা শুরু হল কিন্তু দেখা গেল, কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই আলােচনা হচ্ছে না। নানানরকম সাধারণ কথাবার্তা, গল্প, হাসিঠাট্টার মধ্যদিয়ে সময় কাটতে লাগল। চা-কফি পান চলতে লাগল। এর মধ্যে প্রায় তিনচারবার অধৈর্য হয়ে ডিজি জায়দি সংবাদবিষয়ক পরিচালক আনসারিকে জিজ্ঞাস করতে লাগলেন, নতুন কোনাে খবর এসেছে কিনা জানতে। কিন্তু কোনাে খবরই আসছিল না। সময় কাটতে লাগল নানারকম খুচরাে আলােচনার মাধ্যমে। অবশেষে দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে খবরটি এল যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। প্রথমে একটি ফ্লাশ নিউজ। তারপর ধীরে ধীরে খুঁটিনাটি। ইজলাল হায়দার জায়দি দৃশ্যত নিশ্চিন্ত হলেন এবং হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। (a sigh of relief escaped from ljlal Haider: he certainly seemed relieved) জায়দি তৎক্ষণাৎ তার সভা সমাপ্ত ঘােষণা করে দিয়ে ছুটলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে খবর দিতে। মনে হল, আয়দি খবরটি পাওয়ার আশাতেই বসেছিলেন এবং খবরটি পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন।
| চিঠির শেষাংশে নাকভি পাকিস্তান বেকারের ওই কর্মকর্তা ইজলাল হায়দার সম্পর্কে বলেছেন ? তখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিদায়ের পর কোন্ নীতি গ্রহণ করা হবে তা নিয়ে আলােচনার জন্য একটি সেল ছিল। সেটির প্রধান ছিলেন ইজশাল হায়দার জায়নি। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের গােয়েন্দা কর্মরত ছিলেন। সেখানে আফগানিস্তানের নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার এবং সােভিয়েত সমর্থিত প্রেসিডেন্ট নছিবের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মুজাদ্দেদি সেপ্টেম্বর মাস থেকে এসে বাস করতে শুরু করেছিলেন।
চিঠিটি এখানে শেষ করে নাকভি লিফশুলজকে বলেছেন। আমার এই সামান্য তথ্যটি বিশ্লেষণ করে আপনি নিশ্চয়ই আরও কোনাে বৃহত্তর সত্যের সন্ধান করতে পারবেন। | আমরাও এরকমটিই মনে করি। ষড়যন্ত্র ও হত্যার রাজনীতিতে এশিয়া অঞ্চলে সে-সময় পাকিস্তান যে মােটামুটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সহযােগীর ভূমিকা পালন করছিল তা আর কারও অজানা নেই। আফগানিস্তানে তালেবানদের আগমন এবং বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় হত্যা-পরবর্তী দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের প্রতি পাকিস্তানের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল তা মেনে না নিয়ে কোনাে উপায় আছে বলে মনে হয় না।
অবশেষে ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট এসে গেছে আমাদের সামনে। সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশ, জি ধরনের শাসন আমরা পেয়েছি দুবছরের জন্য। এই পরিস্থিতিতেই বঙ্গবন্ধু-হত্যার থেমে যাওয়া বিচার আবার শুরু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা প্রয়ােজন। ছয় বছর আগে বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার যখন চলেছিল তখন তা কিন্তু কোনাে বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে হয়নি। সে সময় অনেকে চেয়েছিলেন, একটি বিশেষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সেই বিচারকাটি শিগগির সমাধা করা হােক। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার তা করেনি। সেটা না করে যে কত ভালাে হয়েছিল তার প্রমাণ আমরা ইদানীং পেয়েছি। সপ্তাহ কয়েক আগে আমেরিকা থেকে ফেরত আনা হত্যাকারী মেজর মহিউদ্দিনকে কোনাে উপায়ে কানাডায় পাঠিয়ে দেয়ার বিষয়ে বেশকিছু মানুষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে বিএনপি-জামাতিরা এ-বিষয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন। কানাডা সরকার খানিকটা রাজিও হয়েছিল। কেননা তাদের বােঝানাে হয়েছিল শেখ মুজিব হত্যার বিচার করা হয়েছে বাংলাদেশের একটি ক্যাঙ্গারু কোটে। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু মানুষ যখন কানাডা সরকারের কাছে কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করে যে, ওই বিচার দেশের সাধারণ আদালতে হয়েছিল দীঘদিন ধরে। এবং উভয়পক্ষ পক্ষে-বিপক্ষে সবরকম সাক্ষীসাবুদ উপস্থিত করতে পেরেছিল সেই আদালতে এবং সংবাদমাধ্যমও অবাধে সেসব খবরাখবর প্রচার করেছিল, কেবল তখনই কানাডা সরকার মহিউদ্দিনকে তাদের দেশে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ করব আমাদের আশাবাদ ব্যক্ত করে। এবার ওই বিচার সমাপ্ত হবে এবং যার যা প্রাপ্য শান্তি তাদের সেটুকুই দেয়া হবে। আমরা দায়মুক্ত হব।
যুগান্তর ১৫ আগস্ট ২০০৭
৭ মার্চের ভাষণ ও স্বাধীনতা
ড. এম সাইদুর রহমান খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমালােচকরা (যাদের অধিকাংশই স্বাধীনতাবিরােধী বা উগ্র বামপন্থী) প্রায়ই বলে থাকেন কেন তিনি ৭ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেননি। তাদের মতে, ওইদিন স্বাধীনতা ঘােষণা করলে নাকি অতি সহজেই দেশ স্বাধীন হত এবং ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হত। প্রশ্ন হল : আসলেই কি ব্যাপারটি অত সহজ ছিল? পরিবেশ-পরিস্থিতি কি ওই মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘােষণা করার অনুকূলে ছিল? এসব প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে তখনকার বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ দরকার।
ষাটের দশকে এশীয় রাজনীতিতে পাকিস্তান ছিল আমেরিকার প্রধান মিত্র। চীনের সঙ্গেও পাকিস্তানের ছিল মধুর সম্পর্ক। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলাে ছিল। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্ধ-সমর্থক। এমন এক পরিবেশে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হয়েছিল। তার পেছনে যে হতদরিদ্র ও অশিক্ষিত জনগােষ্ঠী, তারাও কিছুদিন আগপর্যন্ত প্যান-ইসলামিক আবেগে তাড়িত হয়ে মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র আবাসভূমি পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল। শহরাঞ্চলে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছাত্র-জনতার কণ্ঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে’ স্লোগান উঠেছে ঠিকই, তবে সে স্লোগান সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে কতটুকু আসন করতে পেরেছে তার পরীক্ষা তখনও হয়নি। উনসত্তরের গণঅভূত্থান ও সত্তরের নির্বাচনে তারা ৬-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায় দিয়েছে, স্বাধীনতার পক্ষে নয়। এমতাবস্থায় হঠাৎ করে স্বাধীনতার ঘােষণা দিলে তার প্রতিক্রিয়া দেশে ও বিদেশে কিরূপ মারাত্মক হতে পারে বিচক্ষণ মুজিব তা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আলােচনার টেবিল ছেড়ে এসে রাজপথে এরূপ ঘােষণা দিলে তিনি বিশ্বদরবারে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত হতেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম পৃথিবীর কোনাে জাতিই সমর্থন করে না। মুজিবকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানাে বিশ্ববাসীর কাছে বৈধ বলে গণ্য হত। এরূপ অবস্থায় পাকিস্তানের বন্ধুরা পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পেত। সপ্তম নৌবহর তখন আর হয়তাে বঙ্গোপসাগর হতে ফিরে যেত না।
১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সেই উত্তাল দিনগুলােতে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মাথা তুলে পড়ল পূর্ববাংলা, বিশ্ববাসী দেখল এক অবিস্মরণীয় অসহযােগ আন্দোলন। এই সমটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনে কেমন সবচেয়ে গৌরবের তেমনি আবার সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সময়ও বটে। অনেকগুলাে বিকল্পের মধ্যথেকে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। সে সিদ্ধান্তে এতটুকু ভুল হলে জাতিকে দিতে হয় চরম মূল্য। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য, এমন এক বিচক্ষণ দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন তার কাণ্ডারী। | ৭ মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধুর ওপর নানা মহলের চাপ আসতে থাকে। ৬ মার্চের রাত ছিল তার জীবনে এক মারাত্মক সমস্যাপূর্ণ রাত। তার তখন বিশঃ অবস্থা। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামান্য ভুল হলে তা হবে দেশের জন্য ভয়াবহ। পরদিন ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ওই বৈঠকে মার্কিন দূত পরিষ্কার ভাষায় ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন। পূর্ববাংলায় স্বঘােষিত স্বাধীন হলে মার্কিন যুক্তরই তা সমর্থন করবে না। এরপর বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন। সে বৈঠক শেষে ইকবাল হল (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থেকে আগত এ জন্ধীয়তাবাদী ছাত্রনেতবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা বলে। এদের নেতৃত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আসম রব প্রমুখ। তাদের দাবি পূর্ববাংলার স্বঘােষিত স্বাধীনতা। অন্যদিকে দলের প্রবীণ ও দক্ষিণপন্থী নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের ভৌগােলিক কাঠামাের মধ্যে আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে। এহেন বিভিন্নমুখী চাপের মুখে এক উত্তপ্ত পরিবেশে স্বাধিকার আন্দোলন যখন একেবারে চরম পর্যায়ে এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রায় পুরােটাই উগ্র জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণ, তখন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে লাখাে জনতার সামনে কী ভাষণ দেন তা জানার আশা সবাই উদগ্রীব। অবশেষে তিনি মাত্র ১৭ মিনিটের সেই ঐতিহাসিক ভাষণে সব মহলকেই সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন।
পাকিস্তানের সামরিক চক্র চেয়েছিল শেখ মুজিব একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা (Unilateral declaration of Independnce) দিক। তাহলে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং এক স্বীকৃত সার্বভৌম রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার নায়ক হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে চিহ্নিত করা সহজ হত। দূরদর্শী ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ মুজিব সামরিক জান্তার সেই দে পা দেননি। তিনি বায়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পথ অনুসরণ করেননি।
একটি ভাষণ একটি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে কী দারুণভাবে প্রােৎসাহিত করেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। অনেকের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের চেয়েও আবেগময়। ভাষণটি ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত। মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা ও স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদানে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ কণ্ঠস্বর সংবলিত এ-ভাষণের গুরুত্ব, তাৎপর্য ও সময়ােপযােগিতা বিশ্লেষণ গবেষকদের জন্য এক স্বর্ণখনি। এ ভাষণ বাঙালি জাতিকে যেভাবে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ও দীক্ষিত করেছিল তা পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছে নতুন এক বক্তৃতাআলেখ্য। এই বক্তৃতা আক্ষরিক অর্থেই ছিল একটি বিপ্লব, যার ফলশ্রুতি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
যুগান্তর ৭ মার্চ ২০০৭
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : তার প্রেক্ষাপট ও শিখরচূড়া
শামসুজ্জামান খান
আজ ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। শুধু ঐতিহাসিক দিন বললে এই দিনের বৈশিষ্ট্য, এই দিনের অগ্নিগর্ভ নানা উপাদান, এই দিনে বাঙালির আবেগ-উত্তেজনা-উদ্বেগ-শঙ্কা, এই দিনের আশা-প্রত্যাশা, নতুন দিনের স্বপ্ন-সম্ভাবনা আর কোনাে ঐতিহাসিক দিনের মতােই নয়। সেজন্যই এই দিনের সঙ্গে অন্য কোনাে দিনের তুলনা চলে না। তবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের সঙ্গে এই দিনের একটা,মিল আছে। ৭ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির সার্বিক ঐক্যের সাযুজ্য আছে। তবে ৭ মার্চে যে শঙ্কা ও উদ্বেগ ছিল, ১৬ ডিসেম্বর সেখানে ছিল আনন্দ ও উল্লাসের সঙ্গে স্বজন হারানাের বেদনা। দেশের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবীদের পাকি দখলদার ও জামায়াতি স্বাধীনতাবিরােধী ফ্যাসিস্টদের দ্বারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যার অচিন্তনীয় ও হতবাক করে দেয়া ঘটনার উদঘাটন।
পূর্ববাংলার বাঙ্গালিরা শতসহস্র বছর ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে বাংলার অন্য অংশের বাঙালিদের সঙ্গে। কিন্তু বাঙালি জাতির স্বাধীনতার পরম আকাক্ষাসহ সেই ফাইনেস্ট আওয়ার বা সুন্দরতম সময়কে সম্ভব করে তুলেছে ‘বাঙ্গাল’ বঙ্গের একসময়ে উপেক্ষিত তুচ্ছতাচ্ছিল্য-করা কৃষকসন্তানেরা। তবে যারা বাঙ্গাল’ বলে একসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল তারাই স্বাধীনতাকামী উনূল বাঙ্গালদের ‘জয় বাংলার মানুষ হিসেবে আপন করে তুলতে সর্বাত্মক সহযােগিতা দিয়েছে। ইতিহাসের এ এক মধুর ক্ষতিপূরণ।
এ
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ একদিনে বা আকস্মিকভাবে আসেনি। তিলে তিলে বছরের পর বছরের স্বপ্ন, সংগ্রাম, ত্যাগ ও ছােট ছোট সাফল্যের মধ্যে দিয়ে এই দিনটি সৃষ্টি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-পূর্ববাংলার শােষিত-বঞ্চিত জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তাদের এবং তার নিজের জীবনের বিপুল ত্যাগ-তিতিক্ষা-জেলজুলুম-অত্যাচারনির্যাতনের ভেতর দিয়ে যেয়ে। বহু আগে থেকে স্থির লক্ষ্যে দ্বিধাহীন চিত্তে অনড়
মনােভাব নিয়ে এগুতে না পারলে এমন ঠাসা একটা দিন সৃষ্টি করা যায় না। আম্প করে বা উরুক্ষনের মাধ্যমে এমন একটা দিনকে সম্ভব করা অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু এ সম্পর্কে বলেন । “আমি জাম্প করার মানুষ নই। আমি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি ১৯৪৭৪৮ সালে। কিন্তু আমি ২৭ বছর পর্যন্ত স্টেপ বাই স্টেপ মুক্ত করেছি। আমি ইমপ্যাসেন্ট হই না। আমি এ্যাডভাঞ্চারিস্ট নই।” (বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ১৯৭৫)
| বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতা-অন্বেষার ধাপসমূহ তিনি নিজেই বিয়ে দিয়েছেন আমাদের। তাঁর বক্তব্য । “১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হল। সেই দিন বুঝতে বাকি রইল না যে, বাংলাদেশকে উপনিবেশ করার জন্য, বাংলার মানুষকে শােষণ করে গােলামে পরিণত করার জন্য তথাকথিত স্বাধীনতা এসেছে। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৪৭ সালে। কলকাতার পার্ক রােডের সিরাজউদদৌলা হােস্টেলে একটা ঘরােয়া বৈঠক করি । কলকাতা থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় এলাম। ঢাকায় এসে রাজনৈতিক পরিবেশ দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, বাঙালি জাতি শেষ হয়ে গেছে। সেইদিন শপথ নিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। ১৯৪৭ সালেই হল আমাদের সংগ্রামের সূচনা।” (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কামরুজ্জামান লিটন সম্পাদিত সংকলন)
১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনে তার লড়াকু ভূমিকা তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামেরই অংশ। ভাষা-আন্দোলনের মধ্যদিয়েই বাঞ্চালি জাতি শেষ হয়ে গেছে পর্যায়কে পেছনে ফেলে বাক্কালি জাতির উত্থানের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৮-এর এই প্রথম ভাষাআন্দোলনে তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৫২-র ভাষা-আন্দোলনে তিনি জেলে থাকলেও এ আন্দোলনেও গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জেল থেকে অসুস্থ অবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের কেবিনে আনা হলে গভীর রাতে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের নিয়ে মিটিং করে আন্দোলনের পদ্ধতি ও কৌশল নির্ধারণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া তার মুক্তির দাবিতে তিনি জেলে অনশন শুরু করার ঘােষণা দিলে তাকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। সেই জেলে তিনি ও মহিউদ্দিন আহমদ ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ দিনব্যাপী অনশনের পর মুক্তিলাভ করেন। অতএব ১৯৪৮ ও ‘৫২ দুই ভাষাআন্দোলনেই তিনি মুক্ত অবস্থায় এবং জেলের ভেতরে লঙ্কাকু ও মরণপণ লড়াই করেন। শেখ মুজিবের পাকিস্তান-আমলের প্রথমদিকের আন্দোলনের তাৎপর্য ভূমিকা সম্পর্কে লন্ডনের অবজার্ভার পত্রিকা বলেছে : “১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশের নেপথ্যে শেখ মুজিবই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি। এর তিন বছর পরে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে গৃহীত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির পেছনেও শেখ মুজিবই ছিলেন প্রধান চালিকাশক্তি।” (লন্ডন, ২৮ মার্চ ১৯৭১)
এভাবে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখলে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা চিন্তার একটা ধারাবাহিক ও সুস্পষ্ট চিন্তা ও তদনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় । ১৯৪৮ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগ গঠন, একই বছরে প্রথম ভাষা-আন্দোলনে অংশগ্রহণ, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন, ১৯৫২-৫৩ সালে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তােলা, ১৯৫৫ সালে বাঙালি জাতির নিজস্ব গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতিরাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বর্জন। ১৯৫৫-৫৬ সালে এই লক্ষ্যে পাকিস্তান গণপরিষদে সংসদীয় সংগ্রাম। যথা বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্নে : 4. “It is very serious matter for us and here nobody can
force us not to speak in our own mother tongue. I will hear and now, speak in Bengali and nobody can prevent me from doing that (21.9.1955) We would like to be called ourselves as Bengali (21.9.55). Do not play with fire. Give us autonomy with three powers in the centre. I know this that the rulling clique. the ruling junta is as just like a knife while the people of East Pakistan are
considered to be fish (21.9.55). 6. Zulum mat karo Bhai, If you do not allow the people to
follow contitutional means. They will perforce unconstitutional means. 5. Democratic Provisons to be inserted otherwise a time is
coming when you will realise the consequences of this weig ation (22155)
নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক শাসক আইয়ুবের নেতৃত্বে সামরিক শাসন জারি করে (১৯৫৮)। পূর্ব-বাংলার জনগণকে দাবিয়ে রাখার অপচেষ্টাকে রুখে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৬০-এর দশক থেকেই বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করেন। ১৯৬১ সালে জনগণের মধ্যে ফিলার” হিসাবে তাঁর নির্দেশে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান’ শীর্ষক একটি লিফলেট ছাড়া হয়। সামরিক শাসনের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা ও ফজলুল হক হলে এই লিফলেট বিলি করা হয়। তখন সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্রআন্দোলনের মাকটাইম শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধু এভাবেই ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার স্বাধীনতা-সংক্রান্ত ধ্যানধারণা, চিন্তা ও প্রতাক্ষ-পরােক্ষ চিন্তাধারা বাজারে ছেড়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতেন। এর পরপরই ছাত্রলীগকে পুনর্জীবিত করার লক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের কমনরুমে অনুষ্ঠিত সভায় অনেকটা সঙ্গোপনে শাহ মুজালেমকে সভাপতি ও শেখ ফজলুল হক মণিকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগকে পুনতি করা হয়। বর্তমান কলাম লেখক সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কিছুটা সংশ্লিষ্ট ছিলেন, এর পরপরই তিনি ঢাকা হল শাখা অলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মপরিকল্পনকে বাস্তবরূপ। দেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু হত্রনেতাদের নিয়ে স্বাধীনতার ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করে দেন। এই নিউক্লিয়াসের সদস্য ছিলেন সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেন, আবদুর রাজ্জাক ও শেখ ফজলুল হক মনি। এই নিউক্লিয়াস ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস হিসাবে পরিচিত ছিল। এই নিউক্লিয়াসের প্রথম কাজ ছিল কিন্তু উপযােগী ও জনগণকে আকৃষ্ট করে এ-ধরনের স্লোগানের উন্নাবল। বঙ্গবন্ধুর অনুমােদন প্রাপ্ত প্রথম
টি স্লোগান ছিল । ‘জাগাে, আগে বাজালি আগাে’, ‘তােমার আমার ঠিকানা, পা, মেঘনা, যমুন’। এ দুটি শ্লোশান ১৯৬২ সালে চালু হয়। এর পর পর্যায়ক্রমে আসে । টাকা না পিণ্ডি, ঢাণ চা এবং তারপরই বিক্ষোবক শ্লোগান ‘জয়বাংলা’। এই শােন বাঙালি জাতিকে এমন ঐক্যবদ্ধ করে যার না ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫ পরবর্তীকালে পাকিস্তানি চেতনায় আচ্ছন্ন জিয়া বাংলাদেশী’ ও ‘
জিন্দাবাদ’ স্লোগান সামনে এনে ৰাস্তালির ঐক্যকে ভেঙে দেন এবং বাংলাদেশের গােটা বাঙ্গালি জাতিকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করে ফেলেন। সেই বিজ্ঞানই বাংলাদেশের বাঙালিকে দুর্দশাগ্রস্ত এবং স্টার অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে।
দুই
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাত্তালি শত শত বছর ধরে যে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে, সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে, অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে এবং তাঁর ফল স্বাধীনতার যে প্রত্যাশাটি উন্মুখ হয়ে উঠেছে তাকে কথা দিয়েছেন এবং এই স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রস্তুত একট ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি সৃষ্টি কতেছে। তাই তিনি বাঙালি জাতির স্রষ্টা এবং এই সংগ্রামের কালে অঞ্জ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা।
কী নেই উচিশ মিনিটের এই মাস্টারপিসতুল্য ভাষণ বাঙ্গালি জনগােষ্ঠীর বঞ্চনার ধারাবাহিক করুণ ইতিহাস আছে, তা বর্ণনা করার সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া আছে আবেগ, এক জানাের নির্মম স্মৃতি এবং তার সঙ্গে গায়িক আশা-প্রত্যাশার মাধ্যতা, আজে বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ এবং মুক্তির জোরালাে উপস্থিতি। এইসব মিলে এই ভাষণ এক জগশ্রেষ্ঠ প্রাণ। বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতাই এ-ভাষণের মূলকথা। বাঙালি যে এক লড়াকু জাতি, স্বাধীনস্তার জন্য জীবননান তার কাছে এক তুচ্ছ ঘটনা; আর তাই বঙ্গবন্ধু শেণ। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। সাহিত্যের তােরাপ, হানিফ, পুরাণের চাঁদ সওদাগর আর রাজনীতির শেখ মুজিবের মুখেই এমন উক্তি মানায়। এরপরই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কেড়ে তিনি মূল কথাটি বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাত্তালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ উচ্চারণ।
আর এই উচ্চারণকে সফল করার জন্য তিনি গেরিলাযুদ্ধের রূপরেখা নির্দেশ করেছিলেন । “তােমাদের কাছে অনুরােধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলে। তােমাদের যা-কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তােমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, পানিতে মারব। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। “
জনকণ্ঠ ৭ মার্চ ২০০৭
রাজনীতির অমর কবি
আতিউর রহমান স্বাধীনতা এৰু বহুমাত্রিক বিষয়। রাজনৈতিক স্বাধীনতা সেই স্বাধীনতার প্রাথমিক শর্ত পূরণ করে মাত্র। রাজনৈতিক স্বাধীনতার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই অন্যান্য পরাধীনতাকে মােকাবেলা করতে হয়। যুগে যুগে তাই স্বাধীনতার দীর্ঘ সড়কে হেঁটেছেন যেসব বীর তারা অর্থনৈতিক মুক্তিসহ অন্যান্য অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন এবং কাজ করেছেন। বর্তমান সময়ের কিংবদন্তিসম স্বাধীনতা সংগ্রামী নেলসন মেন্ডেলা মুক্তির এই গভীরতম আকাক্ষাকে স্পষ্ট করে তুলেছিলেন দীর্ঘ কারাবন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পর।
| ‘অবশেষে আমরা আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এখন আমরা অঙ্গীকার করছি আমাদের সব জনগণকে দারিদ্র্য, বঞ্চনা, দুঃখ, লিঙ্গসহ সবধরনের বৈষম্য থেকে মুক্ত করার জন্য।’ ১৯৯৪ সালে ১০ মে তারিখে ২৭ বছর জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর নির্বাচনে জয়ী নেলসন মেন্ডেলা একথাগুলাে বলেছিলেন। একজনের হাতে আরেকজন উৎপীড়িত হওয়ার মতাে পরিস্থিতি আর যেন সৃষ্টি না হয় সেকথা তিনি ফ্লোর দিয়ে বলেছেন। সর্বক্ষণ মুক্ত থাকার যে অভিপ্রায় তিনি প্রকাশ করেছিলেন তা থেকে তাকে বঞ্চিত করেননি তাঁর দেশবাসী। কিন্তু আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য যে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা তাঁর স্বপ্ন পূরণ করতে দিইনি। বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, গৌরবের নির্যাসকে আত্মস্থ করে যে মহান নেতা বাংলাদেশ নামের স্বপ্নের স্বদেশকে সৃষ্টি করলেন তাকেই কিনা অকৃতজ্ঞ একদল বাঙালিই হত্যা করল! শারীরিকভাবে নিঃশেষ করেই স্বার্থান্বেষী মহল তাদের আক্রমণ শেষ করেনি, সার্বিক মুক্তির জন্য তার যে আকাক্ষা ও আদর্শ তাকে তারা হত্যা করেছে। যাকিছু সুন্দর, শুভ, মানবিক তাকেই যেন তারা ভােলা তরবারি নিয়ে আক্রমণ করেছে। নির্দয় এই আক্রমণের পালা আজও শেষ হয়নি। | এমনি এক বাস্তবতায় এসেছে এবারের পনেরােই আগস্ট। একই সঙ্গে এসেছে পঁচাত্তরেরই মতাে ক্রন্দনরত বর্ষা। যার ধারাবাহিকতায় এসেছে বন্যা। দুঃখী মানুষের দুঃখে ভেসে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বর্ষার নিরন্তর বর্ষণের মতোই প্লাতির দু
চোখ বেয়ে বইছে শােকের ছায়া। জানি না কৰে এই ৰণ শেষ হবে। জানি না করে জাতির দুঃখ শেষ হবে। তবে মন বলে সারাদেশে আনাচে-কানাচে কিনি ছড়িয়ে পড়েছেন। দিন দিনই তিনি থিতু হচ্ছে। আরও বড় ও বিকৃত হচ্ছেন। পাখির গানে, নদীর কলকল রবে, সবুজ প্রান্তরে রয়েছেন তিনি নিরন্তর। স্বাধীন, সবুক, শামল এই বাংলার সর্বত্রই পড়ে আছে তার বিশাল শরীর। অসামান্য ব্যক্তিত্ব। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বাংলাদেশের অৱেক নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একথা বলা মিথ্যা হয়ে যায় না যে, আমরা মূলত আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যেই বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম। আর এই যুদ্ধের তিনিই ছিলেন প্রধান নায়ক। সঙ্গে পেয়েছিলেন আরও অসংখ্য জনকে। জেলে নিহত চার নেতা ছিলেন তাদের ভেতর অন্যতম। আর পেয়েছিলেন বীর মুক্তিযােদ্ধাদের। সবাই মিলেই তারা শত্রুকে পরাজিত করে ছিনিয়ে এনেছিলেন আমাদের প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমিকে। আজীবন তিনি অফাজনের চাওয়া-পাওয়ার কথাই বলে গেছেন। তাকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার মর্মকথা বােঝার চেষ্টার কোনাে মানে হয় না। একথা ঠিক, আরও অনেকেই আমাদের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু তিনিই প্রথম এসব অর্জনকে, নেতৃত্বের ফসলকে বাঙালির ঘরে তােলার মহৎ আয়োজন করেছিলেন। আর সে কারণেই মনে হয় তিনি না জন্মালে কি এত তাড়াতাড়ি বাংলাদেশ নামের দেশটি আমাদের হত?
| কে না জানেন বঙ্গ ও বাংলাদেশ অবিভাজ্য, অবিচ্ছেদ্য! একটি ছাড়া অন্যটিকে কল্পনাও করা যায় না। আজও বিদেশ বিইয়ে প্রবীণ কোনাে বিদেশীর কাছে বাংলাদেশের নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন । ও আপনি শেখ মুজিবের দেশ থেকে এসেছেন।’ কী গম্ভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁরা এই মহান নেতার নাম উচ্চারণ করেন তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমাদের দেশেও কতিপয় দুর্লভ ছড়িী অধিকাংশ মানুষেরই প্রিয় মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিবিসির জরিপ মতে, তিনিই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বালি। আপাদমস্তক বাঙালি এবং একই সঙ্গে বিশ্বজনীন, মানবিক এই সহজ-সরল মানুষটির প্রতি যে অন্যায় ও অবিচার করা হয়েছে সেজন্য এদেশের সাধারণ মানুষ দারুণ ক্ষুব্ধ। থিত টুঙ্গিপাড়ায় প্রতিদিন গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাবনত উপস্থিতিই প্রমাণ করে তিনি এখনও তাদের হৃদয়ের কতটা কাঙ্গাকাছি রয়ে গেছেন। দেরিতে হলেও দেশাচালকরা সর্বত্র তার বিশাল উপস্থিতি অনুভব করতে পারছেন। শিক্ষাসূচিতে জাতির পিতার অবদান ফের স্বীকৃতি পেয়েছে। তার হত্যাকারীদের অন্তত একজনকে বিদেশ থেকে এনে ছেলে তলা হয়েছে। অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার চুড়ান্তভাবে নিষ্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ক্ষমতাশালীদের পক্ষ থেকে জাতির পিতাকে উপযুক্ত স্বীকৃতি ও সম্মান দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা !
সেনাবাহিনীপ্রধান টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তাঁর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন। চারদিকে হতাশা সত্ত্বেও এসবই ইতিহাসকে তার পথে চলতে দেয়ার এক কাক্ষিত ইচ্ছের প্রকাশ।
পঞ্চাশ-উত্তর পুরােটা সময়ই রাজনৈতিক-সামাজিক-নান্দনিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ ছিল বঙ্গবন্ধুরই হাতে। া বকণ্ঠ, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলার নির্দেশনা, অঞ্জলি হেলন, মাথা উচু করে দাড়ানাের ভঙ্গিই প্রভাবান্বিত করেছে সদ্যোজাত বাঙালি জাতিকে। সেই অর্থে একাত্তরের ৭ মার্চের কালজয়ী সেই নান্দনিক ভাষণটিই ছিল তার শ্রেষ্ঠ এক রাজনৈতিক কবিতা। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায়ের মতাে দীঘলদেহী এক শ্রেষ্ঠ বাঙালির সেদিনের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে নয়া এক মাত্রা যােগ করেছে। এই ভাষণেই আমরা লক্ষ্য করলাম রাজনীতির এই অতুলনীয় কবির আবেগ, গরিবের প্রতি মমত্ববােধ, চরম উত্তেজনাময় পরিবেশেও সংযতবােধ, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের শেষ পরিণতি সার্বিক মুক্তির আহবান। তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। বললেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব তিনি চান না। তিনি চান মানুষের অধিকার। এই ভাষণেই তিনি প্রমাণ করেছেন যে তিনি ছিলেন এদেশের মাটি ও মানুষেরই অংশ। ঐতিহ্যের সন্তান। ‘দাবাইয়া রাখতে পারবা না’র মতাে আঞ্চলিক ভাষা ও অনুভূতির মিশেলে এমনি সাহসী উচ্চারণের কারণেই তার ওই ভাষণটিকে রাজনীতির এক মহাকাব্য হিসেবে অভিহিত করেছেন অনেকে। এমন মহাকাব্য একদিনেই তৈরি হয় না। মাটিঘেয়া রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতি নিরন্তর অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন বলেই তিনি এমন অনুপম এক রাজনৈতিক কবিতা লক্ষ-কোটি মানুষের সামনে সেদিন ওভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন। এমন একটি ভাষণ যিনি দিতে পারেন তার নান্দনিক চিন্তার হল কতটা গভীরে থাকতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। বাঙালির স্বাতন্ত্র্য বিকাশের পেছনে যে মানুষটির অবদান অতুলনীয় তাঁর সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচেতনার খানিকটা স্পর্শ তাই আমরা পেতে চাই।
এদেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরা তাদের সৃজনশীল কাজকর্মে বঙ্গবন্ধুকে আরও ভালােভাবে তুলে ধরতে এগিয়ে আসবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে যতই মন্দ হােক আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ তার সৃষ্টির বেদনার প্রায় পুরােটাই বয়ে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি না জনালে বাংলাদেশ নামের দেশটি আজও হয়তাে বিশ্বমানচিত্রে স্থান করে দিতে পারত না। আমরাও হতে পারতাম না একটি স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক। সুতরাং আমাদের নিজেদের প্রয়ােজনেই এই বিশাল আকৃতির মানুষটিকে তুলে ধৱা চাই আমাদের কবিতায়, গানে, উপন্যাসে, পেইন্টিতে, ভাস্কর্যে, নাটকে ও চলচ্চিত্রে। তিনি ছাড়া। বাংলাভাষা এবং বাংলাদেশ আসলেই যে অপূর্ণ। অচেনা। তাঁর জীবন ও কর্মের কথা তাই শিল্পী-সাহিত্যিকদেরই বেশি করে মনে পড়ার কথা। আসুন, নানা আয়ােজনে, নানা উদ্যোগে আমরা তাকে আমাদের এবং আমাদের সন্তানদের নিত্যসঙ্গী করে তুলি। আসুন শামসুর রাহমানের মতাে আমরা প্রতিজ্ঞা করি ।
যতদিন আমি এই পৃথিবীতে প্রত্যহ ডােরে মেলব দু’চোখ দেখব নিয়ত রৌদ্র ছায়ার খেলা/ যতদিন পারব বাতাসের চুমাে দেখব তরুণ/হরিণের লাফ, ততদিন আমি লালন করৰ শােক।’ (শামসুর রাহমান, ইলেকট্রার গান)
যুগান্তর ১৫ আগস্ট ২০০৭
ঝড়ের গতির রাজনীতিক
স্বদেশ রায়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন মােটেই দীর্ঘ নয়। সব মিলিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন প্রায় আঠাশ বছরের। এর ভিতর মাত্র ২০ বছর তিনি সময় নিয়েছিলেন তাঁর জাতিকে একটি স্বাধীনতার সংগ্রামের মুখােমুখি দাঁড় করাতে। সে সংগ্রামে তিনি তাদেরকে বিজয়ী করেছিলেন। এত কম সময়ে খুব কম নেতাই তার দেশকে মুক্তি ৰা স্বাধীনতা দিতে পেরেছেন। এদিক থেকে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির সফলতম নেতা। | বাঙালির শ্রেষ্ঠ নেতাদের তালিকা করতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর দুজন নেতার নাম আসে। এই দুজন নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে জনগণের দেয়া পদবিতে ভূষিত হয়েছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন জনগণ বঙ্গবন্ধু খেতাবে ভূষিত করেছিলেন, ওই দুজনকেও জনগণ অমনি পদৰি দিয়েছিলেন। এদের একজন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, অপরজন নেতাজি সুভাষ বসু। এ দুজনের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে শ্রদ্ধা ছিল তাতে তাঁর জীবদ্দশায় এদের সারিতে বঙ্গবন্ধুকে দাঁড় করালে তিনি কুষ্ঠিত হতেন। কিন্তু ইতিহাস সফলতায় এঁদের সারিতে শুধু নয়, সফলতম নেতা হিসেবে বাঙালির শ্রেষ্ঠ নেতায় পরিণত করেছে শেখ মুজিবকে।
| চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ বসু দুজনই বাঙালি ছিলেন। কিন্তু এরা কেউই শুধু বাঙালির নেতা ছিলেন না। দুজনই ছিলেন ভারতবর্ষের নেতা। তাঁদের রাজনীতির ক্ষেত্র ছিল সমগ্র ভারতবর্ষ। তারা ভারতের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। সেটা ছিল ওই প্রজন্মের দাৰি। শেখ মুজিবুর রহমান ওই প্রজন্মের নন, যদিও তিনি ভারতবর্ষের রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন। তবে তিনি যখন তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন এই সময়ে চিত্তরঞ্জন দাশ মারা গেছেন, সুভাষ বসুও নিরুদ্দেশ হয়েছেন। চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক ধারা তখন ভারতের রাজনীতি থেকে গত হয়েছে। সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ঢেউ ভারতসাগর তীরে আছড়ে পড়লেও সেটা তরঙ্গ তুলতে পারছে না ওইভাবে। কারণ ততদিনে সুভাষ নিরুদ্দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইঙ্গ-মার্কিন বিজয় ঘটেছে। তাছাড়া ভারতের রাজনীতিতে তখন মানুষের তুলনায়, জাতির তুলনায় ধর্ম সামনে এসে গেছে। অধিকাংশই তখন ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ধর্মের মিথ্যে স্রোতের তােড়ে তারা ভেসে চলেছেন। অন্যদিকে কেউ কেউ কোনােরকমে ধর্ম থেকে আপস করে নিজেকে বাঁচানাের চেষ্টা করছেন। চেষ্টা করছেন দেশ ও মানবসম্প্রদায়কে বাচানাের। এই সময়েই শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবর্ষের রাজনীতির একজন কর্মী হিসেবে আবির্ভূত হন।
কেউ কেউ বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ওই সময়ে ধর্মীয় রাজনীতির একজন কর্মী। হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে নিউজ উইক শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর প্রচ্ছদ করতে গিয়ে সেখানে লিখেছিল : পাকিস্তান আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে শেখও ইটের টুকরাে মুড়েছিলেন ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে। পাকিস্তান আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে শেখ মুজিব ঠিকই ব্রিটিশ পুলিশের বিরুদ্ধে ইটের টুকরাে ছুড়েছিলেন। কিন্তু তার মানে কখনও। এই নয় যে, ধর্মীয় রাজনীতির যে উন্মাদনা, যে অন্ধত্ব আমরা দেখি, সেটা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রাস করেছিল। কারণ সকলেই জানেন, পাকিস্তান আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান হােসেন ছিলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর একজন বিশ্বস্ত কর্মী। ইতিহাসের এ পর্বে এসে আজ এটা স্বীকৃত যে, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ওই সময়ে যে কজন নেতা ধর্মের উন্মাদনার হাত থেকে ভূখণ্ড ও মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, সােহরাওয়ার্দী তাদের একজন। তাই পাকিস্তানের থেকেও তার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল মানুষের জীবন। এ কারণে ধর্মের উন্মাদনায় সৃষ্ট ভারত-পাকিস্তানে অধিকাংশ যখন ক্ষমতা গ্রহণে ব্যস্ত, ওই সময়ে যে ক’জন জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে মানুষকে বাঁচাতে নেমে পড়েছিলেন—হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাদের একজন। অন্যদিকে তার কর্মী শেখ মুজিবুর রহমানকেও দেখা যায় পাকিস্তান নামক ওই ধর্মীয় রাষ্ট্রটির ক্ষমতা গ্রহণকারীদের কারােই ধারেকাছে যাচ্ছেন না। বরং সােহরাওয়ার্দী দূরে থাকলেও তার প্রতি অবিচল আস্থা শেখ মুজিবের। এবং তিনি তখন থেকেই ওই ধর্মীয় রাষ্ট্রের বদলে মানুষের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছেন।
চিত্তরঞ্জন দাশ ও সুভাষ বসুর সঙ্গে এখানেই শেখ মুজিবুর রহমানের মিল। এখানে এসেই বলা যায় তিনি এ উপমহাদেশে ওই ধারার রাজনীতির সফলতম পুরুষ। চিত্তরঞ্জন দশ-এর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন সুভাষ বসু। দুজনেই একই ধারার রাজনীতি করেছেন। এ দুজনই চেয়েছিলেন গান্ধী, জিন্নাহ প্রমুখের ধর্মীয় উন্মাদনার রাজনীতি থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে অর্থাৎ গােটা ভারতবর্ষকে মুক্ত করে একটি মানুষের ভারতবর্ষ তৈরি করতে। সেই স্বাধীন ভারতবর্ষ সৃষ্টি করতে। চিত্তরঞ্জনের সংক্ষিপ্ত জীবন দুর্বল স্বাস্থ্য তাকে এ কাজ থেকে ব্যর্থ করেছিল। অন্যদিকে বিশ্বরাজনীতির সন্তান সুভাষ বসু হেরে গিয়েছিলেন এ-কাজে বিশ্বরাজনীতির পটপরিবর্তনের কারণে। শেখ মুজিবুর রহমান এ দুজনের রাজনৈতিক জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন কিনা সেটা তিনি কোথাও লিখে রেখে যাননি। তবে তিনি বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে এ দুই রাজনীতিকের প্রতি বা নেতার প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধার কথা জানিয়েছেন। তাই আজ মনে করলে ভুল হবে না নেতাজি।
তার জাতিকে ধর্মের অন্ধত্ব ও সামরিক শাসনের বর্বরত্ব থেকে মুক্ত করতে হয় তাহলে ঝড়ের বেগে রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রস্তুত করতে হবে আরও বেগে মানুষকে। নইলে একজীবনে একটি জাতিকে স্বাধীনতার দ্বারে পৌছানাে যাবে না। যেমন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, বঙ্গবন্ধুর মতাে আরেক নেতা ইয়াসির আরাফাত পারেননি তার জাতিকে স্বাধীনতার দ্বারে পৌছে দিয়ে যেতে। তার আগেই তিনি সন্তানের কাধে পিতার মৃতদেহ হয়েছেন। তাকে শুধু তার জীবনের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এ ব্যর্থতা মেনে নিতে হয়নি। মেনে নিতে হয়েছে বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তনের কারণেও। দেশবন্ধু ও নেতাজির জীবন মেলালেও এই দুই পাওয়া যায়। দেশবন্ধু পারেননি তার সংক্ষিপ্ত জীবনের কারণে। আর নেতাজি পারেননি বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তনের কারণে। শেখ মুজিবুর রহমান হয়তাে এই সংক্ষিপ্ত জীবন আর বিশ্বরাজনীতির দুত পটপরিবর্তন মাথায় রেখেছিলেন শুরু থেকে। তাই দেখা যায় তার রাজনীতির গতি বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে যে দুরন্ত গতির গাের্কি আঘাত হেনে উপকূল বিধস্ত করে দেয় তার থেকেও গতিশীল।
লন্ডন টাইম ‘৭১ সালে লিখেছিল ঃ শেখ মুজিব মাত্র ২০ বছর তাঁর জাতিকে প্রস্তুত করে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন হিসেব করলে সেটাই মনে হয়। এখানে শেখ মুজিবকে দুটি পর্বে কাজ করতে হয়েছে। এখন প্রচণ্ড ধর্মীয় উন্মাদনায় ভেসে আসা একটি জাতিকে তার আত্মপরিচয়ে ফেরত আনতে হয়েছে। জাতি হিসেবে সে যে বাম্ভালি এটা তাকে বােঝাতে হয়েছে। এ কৃতিত্ব শেখ মুজিবের অবশ্য একক নয়। পাকিস্তানি উন্মাদনা থেকে বাঙালিকে বাঙালি হতে ওই সময়ে বাঙালির শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সকলেই কাজ করেছিল। তবে এটা সত্য যে, ওই সময়ে এ রাজনীতির শক্ত ধারক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীদের ভাষা যেখানে পৌছে না, ওই সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক ভাষায় বাঙালিত্বকে হাজির করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সহজে সাধারণ কথায় ও আচরণের ভিতর দিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভিতর অল্পকিছু দুরাচারসহ সকলকেই বাঙালিতে পরিণত করেছিলেন। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের আরও বড় কৃতিত্ব হল তিনি তার নেতৃত্বকালে তরুণসমাজের সবথেকে বড় আকর্ষণ ছিলেন। অন্য কোনাে নেই তাঁর সমান জনপ্রিয় ছিল না তরুণদের কাছে। দেশের ওই তরুণ সম্প্রদায়ের কাছেই তিনি বাঙালিত্ব এবং “দেশ আমার এই দুই আদর্শকে বড় করে তুলতে পেরেছিলেন। দেশের তরুণসম্প্রদায় মনেপ্রাণে সেটা গ্রহণ করেছিল। এ কারণে দেখা যায় যাটের দশকে এ ভূখণ্ডে পাকিস্তানি হয়ে যায় হাতেগােনা আর বাঙালি তখন প্রায় সকলে, যতটা বাঙালি আমরা এখন সকলে। মই।
শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিবিদ। দেশের মানুষের মনের খবরটি তাঁর আগে অন্য কেউ জানতে পারত না। তাই ষাটের দশকে এসে তিনিই সঠিক উপলব্ধি করেন, লােহা তপ্ত হয়েছে ঠিক ঠিক। অর্থাৎ আঘাত করার সময় বয়ে যায়। তাই ‘৬৬ সালে
তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ আন্দোলনকে একটি ফ্রেমওয়ার্কের ভিতর এনে স্বাধীনতার প্রচ্ছন্ন কর্মসূচি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয়দফা ঘােষণা করেন। তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে ছয়দফা ঘােষণার পর আর রাজনীতির কোনাে উপায় থাকবে না হেঁটে চলা। তখন রাজনীতিকে আপন গতিবেগেই ঝড়ােগতিতে চলতে হবে। শেখ মুজিবের ধারণা সঠিকই হয়। ছয়দফা ঘােষণা করার পরে পাকিস্তানের রাজনীতিকে আরা কোনােকিছুর ভিতর বেঁধে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি তখন বাত্তালির প্রতিপক্ষ আইয়ুব খান সরাসরি বলতে বাধ্য হয়, পাকিস্তানের কাঠামাের ভিতর বসে ছয়দফা মেনে নেবার কোনাে উপায় নেই। তাই তিনি অস্ত্রের মাধ্যমে ছয়দফার জবাব দিতে নামেন। আর রাজনীতির বিরুদ্ধে যখনই অস্ত্র নিয়ে, রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে নামা হয় তখনই শক্তিশালী হয় রাজনীতি। জয়ী হন রাজনীতিবিদ। তাই রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে অস্ত্রের ভাষায় ছয়দফাকে যতই জবাব দেবার চেষ্টা চলে ততই শেখ মুজিবুর রহমান চলে যান বাংলার মানুষের মণিকোঠায়। দেখা যায় মাত্র তিন বছর না-যেতেই শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুতে রূপান্তরিত হন। অর্থাৎ একজন শেখ মুজিবুর রহমান তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের আকৃতি লাভ করেন।
মানুষের এই মূর্তি হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু মানুষের শক্তিকে ভুলে যাননি। অন্য অনেক রাজনীতিক নির্বাচনে বিরােধিতা করলেও বঙ্গবন্ধু নির্বাচনের ব্যাপারে থাকেন আপসহীন। এমনকি মানুষের শক্তিতে বিশ্বাস করে তিনি স্বৈরাচারের ফ্রেমওয়ার্কের ভিতরই নির্বাচনে যান। কিন্তু নির্বাচনের রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই ওই ফ্রেম টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। শেখ মুজিব তখন মানুষের নির্বাচিত নেতা। তাকে ও তার মানুষের দাবিকে অস্বীকার করে এ সাধ্য তখন আর কার? অর্থাৎ তিনি তখন স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে যেখানে পৌছে গেলে ওই রাক্ষসের প্রাণভােমরা মারা পড়ে যায়। রাজকন্যা উদ্ধার হয়। বাঙালি তখন শেখ মুজিবের হাত ধরে সেখানেই পৌছে গেছে। আর এখানে পৌছাতে রাজনীতির এ-পর্বে শেখ মুজিব সময় নিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ বছর। এ-কারণে একটি জীবনের আর বিশ্বরাজনীতির বড় কোনাে মােড় নেয়ার আগেই শেখ মুজিব পেীছে যেতে পেরেছিলেন তার কাঙ্কিত লক্ষ্যে। | শেখ মুজিবের এই জীবন ও রাজনীতির গতির দিকে তাকলে তাই মনে হয় এ যেন সত্যিই ঝড়ের গতি। সত্যিই তিনি ছিলেন এক ঝড়ের গতির রাজনীতিক।
জনকণ্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৭
আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং দুবৃত্তদের শাস্তির প্রত্যাশায়
আবুল মাল আবদুল মুহিত গােপালগঞ্জের সাহসী এক কিশোের ধাপে ধাপে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৩৯ সালে স্কুলের জীর্ণদশা ও ভাঙা ছাদ নিয়ে ছাত্র শেখ মুজিব নালিশ তুলে ধরেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও আর একজন মন্ত্রীর রাস্তা রােধ করে। সেই লােক তিরিশ বছর পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্তি পান ১৯৬১ সালে। গােলটেবিল বৈঠকে দেশের সঙ্কট সমাধানের জন্য প্রয়ােজন পড়ে এই বিচারাধীন কারাবন্দী মহান রাষ্ট্রনেতার। দেশের জনতা তাকে প্রদান করে বঙ্গবন্ধু খেতাব, আর তিনি ঘােষণা দেন যে ছয়দফার ফর্মুলায় তিনি গণতা ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করে ছাড়বেন। ১৯৭০ সালে যখন সাধারণ নির্বাচন হল, ছয়দফার মহাসনদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ৮২ শতাংশ ভােট পেয়ে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হলেন দলপতি। ৩১৩ আসনের মধ্যে তার আওয়ামী লীগের হল ১৬৭ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পশ্চিমের নেতা ভুয়ো কোনমতেই আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছাড়বেন না। কোনমতেই দুয়দফা যে স্বাধিকার প্রদান করে তা মানবেন না। মুখােমুখি সংঘর্ষ ব্যতিরেকে আর কোন সমাধান রইল না। বাংলাদেশের মহানায়ক ১৯৭১-এর ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঘোষণা করলেন তার চূড়ান্ত প্রস্তাব, নিয়মতান্ত্রিক কায়দায় সংলাপের আহবান। একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন প্রতিরােধের সমাধানবাণী এবং জাতিকে দিলেন মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান। তাঁর উদাত্ত আহ্বান ছিল।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, আরাে রক্ত দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
| সারাদেশ ঐক্যবদ্ধ। ‘জয় বাংলার শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। সংলাপ ব্যর্থ করে পাক সেনাবাহিনী ২৫ মার্চের রাতে শুরু করল একটি নিষ্ঠুর যুদ্ধ, অন্ত্রহীন জনগণের বিরুদ্ধে বন্দুক, কামান, বােমা ও আগুনের আক্রমণ। এ অসম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মেতে উঠল বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তারা পশ্চিমে নিয়ে গেল। কিন্তু এই হানাদারদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে তার সহযােগীবৃন্দ
জনসমর্থনের জোয়ারে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করলেন। অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধু হলেন এই স্বাধীনতা পাগল বাংলাদেশের প্রতীক্ষ রাষ্ট্রপতি। পাকিস্তানে বলি বঙ্গবন্ধুর দেশদ্রোহী হিসেবে বিচার হল, ফাসির আদেশ ও হল। কি বাংলাদেশের বিজয় এবং দস্য পাকিস্তানের অবমাননাকর পর্যায় বাংলার রাখালকে তঁার মুক্ত দেশে ফিরিয়ে আনল বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই মহামানব হলেন দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার। কুচক্রী দেশশ কতিপয় সেনাসদস্য মিথ্যা অজুহাতে জাতির জনক তাঁর পরিবার এবং সহযোগীসহ ১৮ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে। তারা শুরুতে সামনে রাখে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মােশতাককে কিন্তু নেপথ্যের নায়করা অচিরেই বেরিয়ে এল। নানা অঘটন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে বিফল করা হল এই দেণশত্রুদের মিশন। মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাকেও তারা ক্রেলে ঢুকে হত্যা করে। তারপর মার্কিন তদবিরে তারা দেশত্যাগ করে এবং লিবিয়ায় আশ্রয় নেয়। বিদেশে সামরিক অ্যুথানের প্রথম ঘােষণা আসে পাকিস্তান বেতারে আর ভুৱা এই দেশশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে সবাইকে আহ্বান করেন। স্বদেশে সেনাবাহিনী এ হঠকারীদের মেনে নেয় আর চক্রান্তকারীরা সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর চিফ অব স্টাফদের প্রতিরক্ষা সংগঠন থেকে বিদায় করে দেয়। এই প্রতিবিপ্লব নির্বিবাদে বহাল থাকে যেটি বছর। অবশ্যি, নানা লেবাসে। তাদের এজেন্ডা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসবিকৃতি। যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ চার চরিত্র হনন এবং ভুয়া জাতীয় নেতার ফর্দ বানিয়ে জাতির জনককে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জন। তাদের সুপরিকল্পিত কৌশল হয় লাগামহীন নির্যাতন, অত্যাচার আর নিষেধাজ্ঞা, সর্বত্র এস ও ভীতি সৃষ্টি, লােভে মৃত্যহূতি প্রদান এবং রাজনীতির দুতায়ন নিবচ্ছিন্নকাবে দীর্ঘ ষােলটি বছর চালিয়ে যায় তিনটি অবৈধ সামরিক সরকার। এতকিছুর পরও ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হল বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীবনের উৎসব। আর সেখানে ছিল কান্নার প্রিনি, সেই মার্সিয়া। সেদিন সেখানে ২৮ বছর আগে সাহসী বিচারপতি জাতির সুসন্তান সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন তাঁর বক্তব্য শেষ কৱন নিমােক্ত ভাষণে ।
এই দেশের ইতিহাসের কষ্টিপাথরের এ যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাংলাভাষা থাকবে, যতনি বাংলা কবে, বাঙালি থাকবে। গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, করতােয়া, কীর্তনখােলা নদীর দুই তীরের মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, যতদিন এদেশের মানুষের হৃদয়ে উত্তাপ থাকবে। ততদিন অন্তৱৰ মণিকোঠায় একটি নাম চিরজাগরূক থাকবে—শেখ মুজিবর। রহমান।
প্রতিবিপ্লব ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগ্রামী ইতিহাসের অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে। প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল জনহিত নিবেদিত বাট্টাদশ উচ্ছেদ করে মুৎসুন্দি স্বার্থের প্রতিষ্ঠা। প্রতিবিপ্লব চায় গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা। যেকোনাে মহাল বিপ্লবই এইরকম প্রতিবিপ্লবের মুখােমুখি হয়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের উচ্চাদর্শ মাত্র বারাে বছরেই নিঃশেষ হয়ে যায়। রাজতন্ত্র ১৭৯৩ সালে বিদায় হল; কিন্তু তার জায়গায় এল ভয়াবহার রাজত্ব। সমতা, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতার বাণী ডুকরে কেঁদে উঠল। ১৭৯১ সালে গৃহীত নাগরিক মানবাধিকারের মহাসনদ তুলুষ্ঠিত হল। পুৰৰ পরে আসল নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের পদধ্বনি, ১৭৯৯ সালে নেপােলিয়ন বােনাপার্ট হলেন একনায়ক এবং ১৮০৪ সালে সম্রাট । পরবর্তী ৬ বছরে মাত্র চার বছর স্থায়ী হয় প্রজাতন্ত্র (১৮৪৮-৫২)। তারপর ছিল তৃতীয় নেপােলিয়নের ১৮ বছরের সাম্রাজ্য। ফ্রান্সের তৃতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় মাত্র ১৮৭০ সালে। কিন্তু বিপ্লবের আকর্ষণ হল যে, তার আদর্শ জনমনে সব সময়ই কোনাে-না-কোনােভাবে বিরাজ করে। এবং অবশেষে সেই চেতনারই বিজয় হয়। | জাতির জনকের জন্য যেমন আইন লাগে না; মহাত্মা গান্ধী, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা শােয়েকৰ্ম যেভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও সেভাবে জাতির জনক, জনগণের হৃদয়েমানসে। শত পাঠ্যবই লেখে, শত মিথ্যাচার করে এ শাশ্বত সত্যকে ঢাকা দেয়া যায় না। জাতীয় স্লোগান তেমনি জয় বাংলা, এই নিনাদে আমাদের বীর সেনানীরা শত্রুর ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। এই শ্লোগানে জনমানৰ জেগে উঠেছে, বিপদে পানি পেয়েছে। কোনাে প্রতিবিপ্লব এই মৌলিক মূল্যবোেধ চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে পারে। না। আমাদের বেলায়ও ১৬ বছরের অবৈধ সরকার এবং বিগত পাঁচ বছরে দুবৃত্ত রাজাকার সরকার আমাদের জাতীয় মজ্জায় হানি সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। | বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক, বাংলাদেশের জাতির জনক। তবুও তিনি ছিলেন একহ্মন মানুষ, দােষেগুগে মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি, তঞ্চত অবশ্যই জনগণ ও মুক্তিযুদ্ধে বিপ্লী সমাজ বিবর্তন থেকে তিনি কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার হাতে হয় ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন যেজন্য অবশ্যি তরুণ, নেতৃত্বের অনধিতা অনেকাংশে দায়ী ছিল। তিনি ছিলেন তার সহকর্মীদের প্রাণের বন্ধু এবং সবসময় তাদের ভুলত্রুটির প্রতি ছিলেন নমনীয়। মহামানবের উদারতা ও ক্ষমা ছিল তার মাহাত্ম্য। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং তাতে ব্যক্তিত্বের পাল্লা অত্যন্ত ভারী। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিচ্ছেন প্রক্রিয়া বিংশ শতাব্দীতে অন্য কোথাও সফল হয়নি। নরওয়ে, সুইডেন বা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের বিচ্ছেদ হয়। সমঝোতার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় আতিয়ার উদ্ভব আঞ্জাতিক অঙ্গনে কোথাও সুনজর পায়নি। বঙ্গবন্ধু এই বিপত্তি সহজেই অতিক্রম করেন। | ১৯৭২-এর ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য হয়, ১৯৭৩ সালে জুলাইয়ে হয় জোটনিরপেক্ষ সংস্থার সদস্য এবং ১৯৭৪-এ ফেব্রুয়ারিতে ইসলামি সংস্থার সদস্য হয়। জাতিসংঘের সদস্য হতে অবশ্যি পাকিস্তান ও চীনের কুচক্রে ১৯৭২ সালে ছিল ব্যর্থতা, তবে ১৭ সেন্টেম্বর ১৯৭৪ সালে আমার সমস্যপদ লাভ করি এবং ২৪ অক্টোবর বঙ্গন্ধু বাংলায় জাতিসংঘে ভাষণ দেন। ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারতের
কটনৈতিক স্বীকৃদ্ধি বাংলাদেশ পায়, ১৯৭২ শেষ হতে হতে মােট ১১৯টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করে। | বিজয়ের তিন মাসের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু একটি প্রশাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৭২ সালে ১২ মার্চ ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ভারতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেন। শুধু ভারত ও সােভিয়েত বলয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নির্ভরশীল না হয়ে তিনি বিশেষ বাণিজ্যচুক্তির পর জোর দেন এবং কুটনৈতিক স্বীকৃতির অপেক্ষা না করে বাণিজ্যসম্পর্ক গঞ্জে তােলেন। পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। পররাষ্ট্রনীতির তিনি যে ভিত্তি স্থাপন করে যান আজও আমরা তাই অনুসরণ করছি। শুধু তাঁর স্বপ্ন যে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড সেট রয়েছে অপূর্ণ। | ভঁর ব্যর্থতা ছিল যে স্বাধীনতা দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে তিনি শক্তিশালী, স্বনির্ভর এ নির্বাচিত জেলা সরকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরের ঘােষণা দেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তৃণমূল গণতন্ত্রায়নের তেমন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারেননি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মৌলিক নীতিমালা অতি উত্তমভাবে সংবিধানে সমুন্নত হলেও আইনের শাসন দেশে প্রতিষ্ঠা পেল না। সার্বিক নিরাপত্তা বিষয়েও কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন হল না।
জাতিকে অতি উত্তম একটি মৌলিক আইন-সংবিধান উপহার দেয়া ছিল তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব। এই সংবিধানে স্বৈরাচারী গ্রেফতারের কোনাে সুযােগ ছিল না। এমনকি জরুরি অবস্থা ঘােষণারও বিধান কিছু ছিল না। মানবাধিকার শুধু সংজ্ঞায়িত ছিল না তা নিশ্চিত করার জন্যও ছিল বিধান। তণমূলে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের ছিল বাধ্যবাধকতা। একই ধারায় জাতিকে শিক্ষিত করার ছিল মহান অঙ্গীকার। বিচার বিষ্কাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের ছিল বিধান। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ছিল নিষিদ্ধ। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই সুন্দর সংবিধানের সমূহ সংশােধন ঠার হতেই ঘটে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ছিল তার প্রয়োগবাদী ধারণা। যুগের তালে ত জনমতের সম্মানে জাতীয়করণ নীতি গৃহীত হয়। পরিত্যক্ত সম্পত্তির কারণেও এর কোনাে বিকল্প ছিল না। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের সূচনা তিনিই করে যান। পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত হয় ১৯৭২ সালে। আমনানি উনারীকরণের ব্যবস্থা হয় ১৯৭৩ সালে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণও শিথিল হয় তখন । ১৯৭৪ সালে শিল্পনীতির মৌলিক পরিবর্তন ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে মর্যাদা প্রদান করে। ১৯৭৫-এ মুদ্রা ও করনীতির সংস্কার গগণচুমী মূল্যস্ফীতির টুটি চেপে ধরে।
প্রতিবিপ্লবের ক্ষেত্র অবশ্যি সবসময়ই বিপ্লবােজর অবস্থা—খানিকটা অরাজকতা, প্রত্যাশার বহর, বিপ্লবীদের আত্মবিশ্বাসের আধিক্য এবং বিপ্লবাের ও গগণচুখী সমস্যাই সৃষ্টি করে দেয়। বাংলাদেশেও এর অন্যথা হয়নি। পাকিস্তান যেভাবে
দেশটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পালায়, তাতে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন ছিল অসাধারণ একটি সমস্যা। ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ২ বিলিয়ন ছিল খুগ্ধক্ষতি। আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার যে অবক্ষয় হয় তা থেকে উদ্ধার ছিল দুই চ্যালেঞ্জ। অশয়হীন নাগরিক ছিল প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা। আড়াই লাখ বিহারি আর প্রায় পাঁচ লাখ রাজাকার ছিল পুরােপুরি ব্যাহত, বন্দরগুলােও বিপদশূন্য ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃশলা ও প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ ছিল সংকটাপন্ন। সেখানে রক্ষীবাহিনীর বেপরােয়া আচরণ, লালবাহিনীর দৌরাত্ম্য শ্রমিক সক্রিয়) এবং দলীয় কর্মীদের বাহাদুরি সৱকাকের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবােধক করে তােলে। পরাজিত শক্তি যে মাথা তুলতে পারে সরকারের সে ধারণাটিই ছিল না। সরকারপক্ষীয় অতিবিপ্লবীরা এই পরকি শক্তিকে সুযােগ করে দেয় নানাভাবে। জাসদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট-ছাত্রদল এগুলােতে আশ্রয় নেয় সব রাজাকার ও সুকৃতকারীরা। আওয়ামী লীগের অর্থব-মােশতাকের উচ্চাভিলাষ, শেখ মণির ক্ষমতা মােহ, তাজউদ্দিন আহমদের প্রান্তিকীকরণ—সব মিলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যেখানে ষড়যন্ত্রকারীদের হয় পােয়াবারাে। তার সঙ্গে তারা সুযোগ পায় ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের। এই দুর্ভিক্ষের ছিল তিনটি উপাদান। বন্যা ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, খাদ্য আমদানির সীমিত সুযােগ এবং যােগাযােগব্যবস্থার দুরবস্থা। রাজনৈতিক কারণে ক্রয়-করা খাদ্য আমেরিকা থেকে আসতে দেরি করল। বৈদেশিক মুদ্রা বা বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার অপারগতা দিয়েও যােগাযােগব্যবস্থার দুর্বলতা সাৱা গেল না। সরকারের ত্রুটি ছিল মাত্র দুইটি ক্ষেত্রে মােকাবেলায় পদক্ষেপ কিছুটা বিলম্বিত ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতি মৃত্যু ইত্যাদির তথ্য বিতরণে সরকার ছিল অহেতুক রক্ষণশীল। অন্যদিকে পরাজিত গােষ্ঠী কিন্তু অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা প্রচারণায় রেকর্ড স্থাপন করে। তাই অগােছালাে পরিস্থিতির সুযােগটি প্রতিবিপ্লব পুরােপুরি ব্যবহার করে। | এবারের আগস্টে একটিই প্রত্যাশা। আইনের শাসনের একটি মৌলিক স্বল্প অবশেষে প্রতিষ্ঠা পাবে। মুক্তি কাপুরুষ খুনিদের শাস্তি হবে। যে বিচারের রাস্তা জেনারেল জিয়া রুদ্ধ করে দেন তার সুরাহা অবশেষে হবে।
সংবাদ ১৫ আগস্ট ২০০৭
আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠা এবং দুবৃত্তদের শাস্তির প্রত্যাশায় –আবুল মাল আবদুল মুহিত
গােপালগঞ্জের সাহসী এক কিশোের ধাপে ধাপে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৩৯ সালে স্কুলের জীর্ণদশা ও ভাঙা ছাদ নিয়ে ছাত্র শেখ মুজিব নালিশ তুলে ধরেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও আর একজন মন্ত্রীর রাস্তা রােধ করে। সেই লােক তিরিশ বছর পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্তি পান ১৯৬১ সালে। গােলটেবিল বৈঠকে দেশের সঙ্কট সমাধানের জন্য প্রয়ােজন পড়ে এই বিচারাধীন কারাবন্দী মহান রাষ্ট্রনেতার। দেশের জনতা তাকে প্রদান করে বঙ্গবন্ধু খেতাব, আর তিনি ঘােষণা দেন যে ছয়দফার ফর্মুলায় তিনি গণতা ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করে ছাড়বেন। ১৯৭০ সালে যখন সাধারণ নির্বাচন হল, ছয়দফার মহাসনদ নিয়ে বঙ্গবন্ধু ৮২ শতাংশ ভােট পেয়ে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হলেন দলপতি। ৩১৩ আসনের মধ্যে তার আওয়ামী লীগের হল ১৬৭ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পশ্চিমের নেতা ভুয়ো কোনমতেই আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা ছাড়বেন না। কোনমতেই দুয়দফা যে স্বাধিকার প্রদান করে তা মানবেন না। মুখােমুখি সংঘর্ষ ব্যতিরেকে আর কোন সমাধান রইল না। বাংলাদেশের মহানায়ক ১৯৭১-এর ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঘোষণা করলেন তার চূড়ান্ত প্রস্তাব, নিয়মতান্ত্রিক কায়দায় সংলাপের আহবান। একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন প্রতিরােধের সমাধানবাণী এবং জাতিকে দিলেন মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান। তাঁর উদাত্ত আহ্বান ছিল।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, আরাে রক্ত দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’
| সারাদেশ ঐক্যবদ্ধ। ‘জয় বাংলার শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। সংলাপ ব্যর্থ করে পাক সেনাবাহিনী ২৫ মার্চের রাতে শুরু করল একটি নিষ্ঠুর যুদ্ধ, অন্ত্রহীন জনগণের বিরুদ্ধে বন্দুক, কামান, বােমা ও আগুনের আক্রমণ। এ অসম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মেতে উঠল বাংলাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তারা পশ্চিমে নিয়ে গেল। কিন্তু এই হানাদারদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে তার সহযােগীবৃন্দ
জনসমর্থনের জোয়ারে নিজেদের সরকার প্রতিষ্ঠা করলেন। অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধু হলেন এই স্বাধীনতা পাগল বাংলাদেশের প্রতীক্ষ রাষ্ট্রপতি। পাকিস্তানে বলি বঙ্গবন্ধুর দেশদ্রোহী হিসেবে বিচার হল, ফাসির আদেশ ও হল। কি বাংলাদেশের বিজয় এবং দস্য পাকিস্তানের অবমাননাকর পর্যায় বাংলার রাখালকে তঁার মুক্ত দেশে ফিরিয়ে আনল বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই মহামানব হলেন দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের শিকার। কুচক্রী দেশশ কতিপয় সেনাসদস্য মিথ্যা অজুহাতে জাতির জনক তাঁর পরিবার এবং সহযোগীসহ ১৮ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে। তারা শুরুতে সামনে রাখে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মােশতাককে কিন্তু নেপথ্যের নায়করা অচিরেই বেরিয়ে এল। নানা অঘটন ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে বিফল করা হল এই দেণশত্রুদের মিশন। মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাকেও তারা ক্রেলে ঢুকে হত্যা করে। তারপর মার্কিন তদবিরে তারা দেশত্যাগ করে এবং লিবিয়ায় আশ্রয় নেয়। বিদেশে সামরিক অ্যুথানের প্রথম ঘােষণা আসে পাকিস্তান বেতারে আর ভুৱা এই দেশশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে সবাইকে আহ্বান করেন। স্বদেশে সেনাবাহিনী এ হঠকারীদের মেনে নেয় আর চক্রান্তকারীরা সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর চিফ অব স্টাফদের প্রতিরক্ষা সংগঠন থেকে বিদায় করে দেয়। এই প্রতিবিপ্লব নির্বিবাদে বহাল থাকে যেটি বছর। অবশ্যি, নানা লেবাসে। তাদের এজেন্ডা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসবিকৃতি। যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ চার চরিত্র হনন এবং ভুয়া জাতীয় নেতার ফর্দ বানিয়ে জাতির জনককে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জন। তাদের সুপরিকল্পিত কৌশল হয় লাগামহীন নির্যাতন, অত্যাচার আর নিষেধাজ্ঞা, সর্বত্র এস ও ভীতি সৃষ্টি, লােভে মৃত্যহূতি প্রদান এবং রাজনীতির দুতায়ন নিবচ্ছিন্নকাবে দীর্ঘ ষােলটি বছর চালিয়ে যায় তিনটি অবৈধ সামরিক সরকার। এতকিছুর পরও ১৯৭৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হল বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীবনের উৎসব। আর সেখানে ছিল কান্নার প্রিনি, সেই মার্সিয়া। সেদিন সেখানে ২৮ বছর আগে সাহসী বিচারপতি জাতির সুসন্তান সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন তাঁর বক্তব্য শেষ কৱন নিমােক্ত ভাষণে ।
এই দেশের ইতিহাসের কষ্টিপাথরের এ যুগের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাংলাভাষা থাকবে, যতনি বাংলা কবে, বাঙালি থাকবে। গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, করতােয়া, কীর্তনখােলা নদীর দুই তীরের মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, যতদিন এদেশের মানুষের হৃদয়ে উত্তাপ থাকবে। ততদিন অন্তৱৰ মণিকোঠায় একটি নাম চিরজাগরূক থাকবে—শেখ মুজিবর। রহমান।
প্রতিবিপ্লব ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের সংগ্রামী ইতিহাসের অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে। প্রতিবিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল জনহিত নিবেদিত বাট্টাদশ উচ্ছেদ করে মুৎসুন্দি স্বার্থের প্রতিষ্ঠা। প্রতিবিপ্লব চায় গণতন্ত্র উচ্ছেদ করে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা। যেকোনাে মহাল বিপ্লবই এইরকম প্রতিবিপ্লবের মুখােমুখি হয়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের উচ্চাদর্শ মাত্র বারাে বছরেই নিঃশেষ হয়ে যায়। রাজতন্ত্র ১৭৯৩ সালে বিদায় হল; কিন্তু তার জায়গায় এল ভয়াবহার রাজত্ব। সমতা, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতার বাণী ডুকরে কেঁদে উঠল। ১৭৯১ সালে গৃহীত নাগরিক মানবাধিকারের মহাসনদ তুলুষ্ঠিত হল। পুৰৰ পরে আসল নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচারের পদধ্বনি, ১৭৯৯ সালে নেপােলিয়ন বােনাপার্ট হলেন একনায়ক এবং ১৮০৪ সালে সম্রাট । পরবর্তী ৬ বছরে মাত্র চার বছর স্থায়ী হয় প্রজাতন্ত্র (১৮৪৮-৫২)। তারপর ছিল তৃতীয় নেপােলিয়নের ১৮ বছরের সাম্রাজ্য। ফ্রান্সের তৃতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় মাত্র ১৮৭০ সালে। কিন্তু বিপ্লবের আকর্ষণ হল যে, তার আদর্শ জনমনে সব সময়ই কোনাে-না-কোনােভাবে বিরাজ করে। এবং অবশেষে সেই চেতনারই বিজয় হয়। | জাতির জনকের জন্য যেমন আইন লাগে না; মহাত্মা গান্ধী, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বা শােয়েকৰ্ম যেভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুও সেভাবে জাতির জনক, জনগণের হৃদয়েমানসে। শত পাঠ্যবই লেখে, শত মিথ্যাচার করে এ শাশ্বত সত্যকে ঢাকা দেয়া যায় না। জাতীয় স্লোগান তেমনি জয় বাংলা, এই নিনাদে আমাদের বীর সেনানীরা শত্রুর ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। এই শ্লোগানে জনমানৰ জেগে উঠেছে, বিপদে পানি পেয়েছে। কোনাে প্রতিবিপ্লব এই মৌলিক মূল্যবোেধ চিরদিনের জন্য মুছে ফেলতে পারে। না। আমাদের বেলায়ও ১৬ বছরের অবৈধ সরকার এবং বিগত পাঁচ বছরে দুবৃত্ত রাজাকার সরকার আমাদের জাতীয় মজ্জায় হানি সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। | বঙ্গবন্ধু ছিলেন ইতিহাসের মহানায়ক, বাংলাদেশের জাতির জনক। তবুও তিনি ছিলেন একহ্মন মানুষ, দােষেগুগে মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে পারেননি, তঞ্চত অবশ্যই জনগণ ও মুক্তিযুদ্ধে বিপ্লী সমাজ বিবর্তন থেকে তিনি কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তার হাতে হয় ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন যেজন্য অবশ্যি তরুণ, নেতৃত্বের অনধিতা অনেকাংশে দায়ী ছিল। তিনি ছিলেন তার সহকর্মীদের প্রাণের বন্ধু এবং সবসময় তাদের ভুলত্রুটির প্রতি ছিলেন নমনীয়। মহামানবের উদারতা ও ক্ষমা ছিল তার মাহাত্ম্য। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং তাতে ব্যক্তিত্বের পাল্লা অত্যন্ত ভারী। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিচ্ছেন প্রক্রিয়া বিংশ শতাব্দীতে অন্য কোথাও সফল হয়নি। নরওয়ে, সুইডেন বা মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের বিচ্ছেদ হয়। সমঝোতার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় আতিয়ার উদ্ভব আঞ্জাতিক অঙ্গনে কোথাও সুনজর পায়নি। বঙ্গবন্ধু এই বিপত্তি সহজেই অতিক্রম করেন। | ১৯৭২-এর ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য হয়, ১৯৭৩ সালে জুলাইয়ে হয় জোটনিরপেক্ষ সংস্থার সদস্য এবং ১৯৭৪-এ ফেব্রুয়ারিতে ইসলামি সংস্থার সদস্য হয়। জাতিসংঘের সদস্য হতে অবশ্যি পাকিস্তান ও চীনের কুচক্রে ১৯৭২ সালে ছিল ব্যর্থতা, তবে ১৭ সেন্টেম্বর ১৯৭৪ সালে আমার সমস্যপদ লাভ করি এবং ২৪ অক্টোবর বঙ্গন্ধু বাংলায় জাতিসংঘে ভাষণ দেন। ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারতের
কটনৈতিক স্বীকৃদ্ধি বাংলাদেশ পায়, ১৯৭২ শেষ হতে হতে মােট ১১৯টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করে। | বিজয়ের তিন মাসের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধু একটি প্রশাসন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন এবং অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৭২ সালে ১২ মার্চ ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ভারতে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেন। শুধু ভারত ও সােভিয়েত বলয়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক নির্ভরশীল না হয়ে তিনি বিশেষ বাণিজ্যচুক্তির পর জোর দেন এবং কুটনৈতিক স্বীকৃতির অপেক্ষা না করে বাণিজ্যসম্পর্ক গঞ্জে তােলেন। পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী। পররাষ্ট্রনীতির তিনি যে ভিত্তি স্থাপন করে যান আজও আমরা তাই অনুসরণ করছি। শুধু তাঁর স্বপ্ন যে বাংলাদেশ হবে এশিয়ার সুইজারল্যান্ড সেট রয়েছে অপূর্ণ। | ভঁর ব্যর্থতা ছিল যে স্বাধীনতা দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে তিনি শক্তিশালী, স্বনির্ভর এ নির্বাচিত জেলা সরকারের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তরের ঘােষণা দেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তৃণমূল গণতন্ত্রায়নের তেমন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারেননি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মৌলিক নীতিমালা অতি উত্তমভাবে সংবিধানে সমুন্নত হলেও আইনের শাসন দেশে প্রতিষ্ঠা পেল না। সার্বিক নিরাপত্তা বিষয়েও কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন হল না।
জাতিকে অতি উত্তম একটি মৌলিক আইন-সংবিধান উপহার দেয়া ছিল তাঁর অসাধারণ কৃতিত্ব। এই সংবিধানে স্বৈরাচারী গ্রেফতারের কোনাে সুযােগ ছিল না। এমনকি জরুরি অবস্থা ঘােষণারও বিধান কিছু ছিল না। মানবাধিকার শুধু সংজ্ঞায়িত ছিল না তা নিশ্চিত করার জন্যও ছিল বিধান। তণমূলে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের ছিল বাধ্যবাধকতা। একই ধারায় জাতিকে শিক্ষিত করার ছিল মহান অঙ্গীকার। বিচার বিষ্কাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের ছিল বিধান। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ছিল নিষিদ্ধ। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই সুন্দর সংবিধানের সমূহ সংশােধন ঠার হতেই ঘটে।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ছিল তার প্রয়োগবাদী ধারণা। যুগের তালে ত জনমতের সম্মানে জাতীয়করণ নীতি গৃহীত হয়। পরিত্যক্ত সম্পত্তির কারণেও এর কোনাে বিকল্প ছিল না। কিন্তু ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের সূচনা তিনিই করে যান। পরিত্যক্ত সম্পত্তি বিক্রির সিদ্ধান্ত হয় ১৯৭২ সালে। আমনানি উনারীকরণের ব্যবস্থা হয় ১৯৭৩ সালে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণও শিথিল হয় তখন । ১৯৭৪ সালে শিল্পনীতির মৌলিক পরিবর্তন ব্যক্তির সৃজনশীলতাকে মর্যাদা প্রদান করে। ১৯৭৫-এ মুদ্রা ও করনীতির সংস্কার গগণচুমী মূল্যস্ফীতির টুটি চেপে ধরে।
প্রতিবিপ্লবের ক্ষেত্র অবশ্যি সবসময়ই বিপ্লবােজর অবস্থা—খানিকটা অরাজকতা, প্রত্যাশার বহর, বিপ্লবীদের আত্মবিশ্বাসের আধিক্য এবং বিপ্লবাের ও গগণচুখী সমস্যাই সৃষ্টি করে দেয়। বাংলাদেশেও এর অন্যথা হয়নি। পাকিস্তান যেভাবে
দেশটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পালায়, তাতে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন ছিল অসাধারণ একটি সমস্যা। ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির ২ বিলিয়ন ছিল খুগ্ধক্ষতি। আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার যে অবক্ষয় হয় তা থেকে উদ্ধার ছিল দুই চ্যালেঞ্জ। অশয়হীন নাগরিক ছিল প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা। আড়াই লাখ বিহারি আর প্রায় পাঁচ লাখ রাজাকার ছিল পুরােপুরি ব্যাহত, বন্দরগুলােও বিপদশূন্য ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃশলা ও প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ ছিল সংকটাপন্ন। সেখানে রক্ষীবাহিনীর বেপরােয়া আচরণ, লালবাহিনীর দৌরাত্ম্য শ্রমিক সক্রিয়) এবং দলীয় কর্মীদের বাহাদুরি সৱকাকের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবােধক করে তােলে। পরাজিত শক্তি যে মাথা তুলতে পারে সরকারের সে ধারণাটিই ছিল না। সরকারপক্ষীয় অতিবিপ্লবীরা এই পরকি শক্তিকে সুযােগ করে দেয় নানাভাবে। জাসদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট-ছাত্রদল এগুলােতে আশ্রয় নেয় সব রাজাকার ও সুকৃতকারীরা। আওয়ামী লীগের অর্থব-মােশতাকের উচ্চাভিলাষ, শেখ মণির ক্ষমতা মােহ, তাজউদ্দিন আহমদের প্রান্তিকীকরণ—সব মিলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যেখানে ষড়যন্ত্রকারীদের হয় পােয়াবারাে। তার সঙ্গে তারা সুযোগ পায় ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষের। এই দুর্ভিক্ষের ছিল তিনটি উপাদান। বন্যা ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতি, খাদ্য আমদানির সীমিত সুযােগ এবং যােগাযােগব্যবস্থার দুরবস্থা। রাজনৈতিক কারণে ক্রয়-করা খাদ্য আমেরিকা থেকে আসতে দেরি করল। বৈদেশিক মুদ্রা বা বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার অপারগতা দিয়েও যােগাযােগব্যবস্থার দুর্বলতা সাৱা গেল না। সরকারের ত্রুটি ছিল মাত্র দুইটি ক্ষেত্রে মােকাবেলায় পদক্ষেপ কিছুটা বিলম্বিত ছিল এবং ক্ষয়ক্ষতি মৃত্যু ইত্যাদির তথ্য বিতরণে সরকার ছিল অহেতুক রক্ষণশীল। অন্যদিকে পরাজিত গােষ্ঠী কিন্তু অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা প্রচারণায় রেকর্ড স্থাপন করে। তাই অগােছালাে পরিস্থিতির সুযােগটি প্রতিবিপ্লব পুরােপুরি ব্যবহার করে। এবারের আগস্টে একটিই প্রত্যাশা। আইনের শাসনের একটি মৌলিক স্বল্প অবশেষে প্রতিষ্ঠা পাবে। মুক্তি কাপুরুষ খুনিদের শাস্তি হবে। যে বিচারের রাস্তা জেনারেল জিয়া রুদ্ধ করে দেন তার সুরাহা অবশেষে হবে।
সংবাদ ১৫ আগস্ট ২০০৭