You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

১৯১৭ সালের ৭ই নভেম্বর আর ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নিশ্চয়ই… স্পষ্ট। অ্যুত্থান সম্পর্কে কোনাে ধারণা তাদের ছিল না, আমরা পূর্বে এ-সম্পর্কে তাদের কোনাে ধারণাও দিইনি। গুরুত্বসহকারে তাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গেও আমরা শারিরীকভাবে সম্পর্কিত ছিলাম না। কাজেই বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে অ্যুত্থান সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার দুরূহ কাজটি আমরা করিনি। (সত্য বলতে কী অভ্যুথান সম্পর্কে আমাদেরও তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল।।) এ সম্পর্কে আত্মসমালােচনা দলিলে বলা হয় : আমরা ভুল করেছি এবং তা থেকে মূলত কোনাে শিক্ষা গ্রহণ করিনি। তার প্রমাণ হল উপরের ঘটনাগুলাে। কিন্তু সবচাইতে জাজ্বল্যমান নিদর্শন হল আরাে পরে, নভেম্বরের বিপর্যস্ত দিনগুলােতে। এর সবচাইতে বড় প্রমাণ ৬ই নভেম্বর সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ফোরামের ঢাকায় অবস্থানরত সদস্যদের (আমার যদি ভুল না হয়) বৈঠকে যখন প্রথম হঠাৎ করে সিপাহী অভ্যুত্থানের খবর (অথবা সিদ্ধান্ত) জানানাে হল। তখন আমরা যেন এক নৈর্ব্যক্তিক চেতনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। ১০ তারিখ হরতালের ব্যাপারে আর কিছুই আলােচনা হল না। তাড়াতাড়ি নিরাপদ আশ্রয়ে (সেল্টার) যেতে হবে নইলে আবার ধরা পড়ে যেতে পারি (?) তাই বিদায় নিলাম। বিশদভাবে কিছুই আলােচনা হল না, দুজনের উপর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলাম। একটা লিফলেট বের হল না কেন, কিংবা দেরি করে বের হল কেন’, নির্ধারিত মিছিল কেন বের হল না’, ‘পােস্টারিং দেয়ালে চিকা কেন লেখা হয়নি’ এ-ধরনের খবর নিতে আমরা (নেতারা) ক্ষিপ্রতায় অশ্ব, অথচ সেই আমরাই ছয় তারিখ রাতে তােফা ঘুম দিলাম। অভ্যুত্থানের মুহূর্তে এই সীমাহীন গাফিলতিকে বিপ্লব কখনও ক্ষমা করতে পারে না, আমাদেরও করেনি। আবারও দেখুন ৫ তারিখ রাত্রে৫১. মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৫-৮৬ শাহজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৬ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯ পৃষ্ঠা ২৫-২৭সেনানিবাসগুলােতে এস, এস. এর নামে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে, তাদের প্রকাশ্যে আহ্বান জানানাে হয়েছে বিদ্রোহ করতে। ভেবে দেখুন, জোয়ানদের হাতে খােলা অস্ত্র, সমস্ত দেশ ক্রোধে টগবগ করছে, এ লিফলেটের ফলাফল কী হতে পারে? অথচ ৬ তারিখ রাতেই পার্টি-নেতৃত্ব এ-ধরনের অভ্যুত্থানের খবর প্রথম পেলেন। হা হতােস্মি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোথায় এ অজ্ঞতার স্থান হতে পারে? ৭ই নভেম্বরের উপর আমরা এত পরস্পরবিরােধী বক্তব্য রেখেছি যে, এর মধ্য থেকে সত্যটা যে আসলে কী তা বার করাই মুশকিল। আমরা পাশাপাশি বক্তব্যগুলাে সাজিয়ে নিচ্ছি, যেমন আমরা লড়াইয়ে বলেছি, সে-মুহূর্তে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছিল, আবার ‘সাম্য’-৭-এ বলেছি, সিপাহী-অফিসারের দ্বন্দ্বকে ভিত্তি করে আমরা তখন সর্বহারার শক্তিভিত সংগঠিত করতে গিয়েছিলাম’… সাংগঠনিক শক্তি দুর্বল থাকার কারণে সামরিক ফ্যাসিবাদ ক্ষমতা দখল করে। আবার কেন এই পণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার? পুস্তিকায় বলেছি, আমরাই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করি, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে সে জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে…। এগুলাে এমন পরস্পরবিরােধী যা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আবার এরকমও বলা হয়েছে, অবস্থা এমন ছিল যে, আমরা কিছু না করলেও ঘটনা ঘটতই। পরবর্তীতে আমাদের নেতৃত্বে ৭ই নভেম্বর সংঘটিত হয়েছে এটাও বলা হয়েছে -এ থেকে একটি সঠিক মুল্যায়ন বের করা দুরূহ।সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতা সম্পর্কে বলা হয় : ৭ই নভেম্বর সকালে সামরিক আইন জারি, শহীদ মিনারের জমায়েতে এবং পরদিন বায়তুল মােকাররমের জনসভায় গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ঘটনাবলি অ্যুথানে আমাদের পরাজয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। এরপরও সংগঠিতভাবে পশ্চাদপসরণের কৌশল অবলম্বন না-করে আমরা আরও শক্তিসংগ্রামে অবতীর্ণ হলাম। স্বাভাবিকভাবেই, রাষ্টশক্তির বেপরােয়া আঘাতে আমরা অসহায় হয়ে গেলাম। বিরক্ত জনগণও আমাদের কার্যক্রমে সাড়া দেয়নি, কারণ তখন জনগণের কামনা ছিল একটু স্বস্তি।*… রাজনীতিতে স্থান-কাল-পাত্রের ধার আমরা তেমন ধারিনি। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন, বিপ্লব বা ক্ষমতা দখল যে-কোনাে মুহূর্তেই হতে পারে (অবশ্য আমরা যদি ঠিকমতাে কাজ করি) এরকম একটা ধারণা আমাদের অধিকাংশ সাথীর মধ্যে ছিল। আমাদের মতাে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যে একটা ধর তক্তা, মার পেরেক মার্কা ব্যাপার নয়, তা বুঝতে না-পারার কারণে মরীচিকার মতাে এর পেছনে ছুটে চলেছি এবং অযথা শক্তি ক্ষয় করেছি।৫৫ ৫৩. সৈনিক সংস্থা ৫৪. শাহজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপােট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৬ ৫৫আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৩৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এর ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে জনাব সাদী আরও বলেন: সাতই নভেম্বরের ঘটনাবলি দ্বারা আমরা বুর্জোয়া রাষ্ট্রশক্তির অন্তর্দেশে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছি এ-বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। ওই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করার জন্য আমরা অবশ্যই বিপ্লবী কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারতাম। কিন্তু ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে বিপ্লবী কৃতিত্ব তাে দূরের কথা, বিপ্লবী রাজনীতির ইতিহাসে আমাদেরকে নৈরাজ্যবাদী অপকীর্তির জন্য দায়ী থাকতে হবে। এই ধরনের ল আমরা কেন করলাম? যেহেতু আমরা বিপ্লবের স্তরকে সমাজতান্ত্রিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি, সেইহেতু এবং সেই অনুপাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সর্বহারা সারবস্তু (content) সৃষ্টি করতে গিয়েই আমরা এই ঘটনা ঘটিয়েছি। আমাদের তৎকালীন সংগঠনের সবগুলাে রূপই ছিল ভুল। যে-কারণে নবতর উপলব্ধির মাধ্যমে সেগুলােকে অবলুপ্ত করে দিয়ে আমরা আবার গণসংগঠন পর্যায়ে ফিরে এলাম।দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পর ১৯৮০ সালের মার্চে জাসদের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন | অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে এর অতীত মূল্যায়ন করে বলা হয় : আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময় বিচারে আত্মপ্রকাশ থেকে স্বীকৃতিলাভের” পূর্বকাল এবং স্বীকৃতিলাভের পর থেকে সংসদ নির্বাচনের পরবর্তী কিছু সময়, এই দু’টি পর্যায় চিহ্নিত করে দেখা যায় প্রথমটিতে বাম ঝোক এবং দ্বিতীয়টিতে ডান ঝোক স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে জনাব সাদীর মূল্যায়নও প্রায় সমরূপ : বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের কার্যকলাপের মধ্যে ডানপন্থী সুবিধাবাদের ঝোঁকের অস্তিত্ব থাকলেও প্রায় সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করে বিরাজিত ছিল যে ঝোকটি তা হচ্ছে বামপন্থী হঠকারিতা। সদ্য একটা অসমাপ্ত সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসা বুর্জোয়া। বিশ্বাসঘাতকতায় বিক্ষুব্ধ আমাদের অধিকাংশ নেতা ও কর্মীদের পাতি-বুর্জোয়া রােমান্টিকতাই এই বামপন্থী ঝোকের প্রাধান্য বিস্তারের জন্য দায়ী।উল্লিখিত ‘বামপন্থী হটকারিতার কারণ অনুসন্ধান করে বলা হয় : মার্কসবাদ যেহেতু একটা বিজ্ঞান, এ বিজ্ঞানকে সর্বহারা এমনকি বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়ারাও পাঠ্যবিষয়ের মতাে বুঝতে পারে। সমাজদ্বন্দ্বের কারণে যে-কেউ (সে নিউক্লিয়াসটিও) সমাজতন্ত্রের কথা বলতে পারেন।৫৬. মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৯-৯২ শাজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপোর্ট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৯ জিয়ার গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়ায় পিপিআর-এর অধীনে স্বীকৃতি লাভ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮১ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৪-১৫কিন্তু তখন পর্যন্ত তার শ্রেণীভিত্তি বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া। আমরা সেই নিউক্লিয়াসটি)” সেই বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই শুরু করেছিলাম। দেশ স্বাধীন হবার পরও আমাদের সাংগঠনিক ভিত্তি ঐ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অর্থাৎ পেটি-বুর্জোয়া। পেটিবুর্জোয়া দোদুল্যমান চরিত্রের। যখন যেদিকে জোয়ার তখন সেদিকে, আর যখন ভাটা তখন ভয়ে লেজ গােটায়। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস তখনও শেষ হয়নি। আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বক্তব্য নিয়ে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম। আমরা কারা? তখনও ছাত্রলীগ। আমরা ঘােষণা করলাম আমরা লড়ছি সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের রিপাের্টে শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলার আহ্বান জানালাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তদান, ত্যাগ, তিতিক্ষার পরাকাষ্ঠার পরেও স্বাধীনতা আন্দোলন বিজয় লাভ করার কারণেই এর ভুল-ত্রুটির মূল্যায়ন করা হল না। বরঞ্চ বিজয়ের জোয়ারে ভিন্নমত (সঠিক বা বেঠিক) চাপা পড়ে গেল। এটাও একটি পেটিবুর্জোয়া উচ্ছ্বাসপ্রবণতা। আবারাে বলতে হয়, পেটি-বুর্জোয়ারা সমাজতন্ত্র উচ্চারণ করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়? তা নয়; তবে পেটি-বুর্জোয়ারা সমাজতন্ত্রের কথা বললেই তারা সমাজতন্ত্রী হয়ে যায় না। তখনও পর্যন্ত তাদের শ্রেণীভিত্তিটি পেটি-বুর্জোয়াই থেকে যায়। আমাদেরও তাই থেকে গেছে। এই পেটি-বুর্জোয়া চরিত্র আমাদের কখন কোথায়, কীভাবে কাজ করেছে তা পার্টি-ইতিহাস পর্যালােচনা করলেই বেরিয়ে আসবে। শুধু কী তাই? জাসদ কাজও করতে গেছে স্বগােত্রীয়দের অর্থাৎ পােটি-বুর্জোয়াদের মধ্যেই। দলিলের ভাষায়:আমাদের সাংগঠনিক কাজ ছিল মূলত ভাসমান পেটি-বুর্জোয়াদের মধ্যে প্রােথিত। পেটিবুর্জোয়া দোদুল্যমান চরিত্রের বলেই একসময় যারা আমাদের চারিপার্শ্বে সমর্থনে সমবেত ছিল, জিয়ার বিজয়ে তারা তার পক্ষেই চলে গেল। আমাদের রাজনীতিও ব্যাপক জনগণের কাছে তেমন স্পষ্ট ছিল না।… পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মার্কসীয় দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে পেটি-বুর্জোয়াদের একটা অংশ সর্বহারা বিপ্লবীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের যাত্রা ছিল সেখান থেকে। কিন্তু আমাদের বড় রকমের ব্যর্থতাই হল আমরা পেটি-বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারিনি। ‘পেটি-বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করতে না-পারার কারণে জাসদের মধ্যকার নানা মতবিরােধ ক্রমে প্রকাশ্য রূপ নেয়। প্রথমে ছাত্রফ্রন্ট বিভক্ত হয়। পরে মূল দলও বিভক্ত হয়ে নির্ভেজাল বিপ্লবী দল’ বাসদ গঠিত হয়। বাসদও পুনঃবিভক্ত হয়৭১. উক্ত নিউক্লিয়াস সম্পর্কে পরিশিষ্ট ১৮ দেখুন আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৩ ও ৪১-৪২(অরাজনৈতিক কারণে)। কেউ কেউ দল ত্যাগ করে জিয়ার বিএনপিতে যােগ দেয়। অবশিষ্ট ক্ষুদ্র অংশটি এখনও তাদের অস্তিত্ব ও বিভক্ত হওয়া অব্যাহত রেখেছে। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে বর্তমানে এর পৃথক কোনাে গুরুত্ব আছে বলে মনে হয়না। | ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তাধারা’কে আদর্শ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’কে লক্ষ্য ঘােষণা করলেও জাসদ কোনাে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক দল নয়, এ একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন’ বা একটি পাটি প্রক্রিয়া। মেজর জলিলের ভাষায় :৬৩জাসদ মার্কসবাদী পার্টি নয়। জাসদকে আমরা সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন বলছি। এখানে বিভিন্ন শ্রেণীর সমন্বয় ঘটবে। এখানে আন্দোলনের মাধ্যমে কর্মী তৈরি। হবে। যেমন ধরুন, আপনি মাখন তৈরি করতে চান। তাহলে আপনাকে একটা কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দিতে হবে। দুধ গরম হলে মাখন উঠবে, আপনি তা তুলে রাখবেন। মাখন উঠবে, আবার তা তুলে রাখবেন। এখানে জাসদ হচ্ছে কড়াই এবং জনগণ হচ্ছে দুধ। অর্থাৎ ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিকজোটের মতাে জাসদও অপর একটি গণসংগঠন। তাদের পার্টি গঠনের তথাকথিত প্রক্রিয়া’ আর সম্পন্ন হওয়ার সুযােগ পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবে বলে মনে হয় না। মাঝখানে তারা হাজার হাজার তরুণকে বিপদগামী করেছে এবং ঠেকিয়ে দিয়েছে প্রকৃত লাল পতাকাকে, মেকি লাল পতাকা দিয়ে।অতঃপর ডান বিচ্যুতি আগস্ট-হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ঘাতক মহিউদ্দিনের (আটিলারি) নেতৃত্বে বিদ্রোহী সিপাহিদের দ্বারা ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পর কার্যত জিয়া সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। পরে তিনি পথের সম্ভাব্য সকল কাটা দূর করে দেশে তথাকথিত এক নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চালু করেন। রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে অন্যান্যের সাথে জাসদও তখন সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে রাজনীতি শুরু করে। এ প্রসঙ্গে জাসদের বক্তব্য নিম্নরূপ : ৬৬এরই মধ্যে ঘরােয়া রাজনীতির সুযােগে পরাজিত আওয়ামী লীগ হাঁটি হাঁটি পা পা। করে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে থাকে। অন্যদিকে জিয়া সরকারও বুর্জোয়াশ্রেণীর।৬৩. সাপ্তাহিক বিচিত্রা”, ১৮ এপ্রিল ১৯৮০, পৃষ্ঠা ৩৬ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল নামটি জার্মানীর নাৎসী হিটলারের National Socialist Party এর অনুকরণে নেয়া হয়েছিল অনেকে ধারণা করেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর পাকিস্তানের প্রভু আইয়ুব খানও ১৯৬২ সালে জাতীয় পরিষদ’ দ্বারা রাজনৈতিক দল বিধি’ প্রণয়ন করে ‘গণতন্ত্রায়ন প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন। জিয়া সেই ‘আইয়ুবী’ নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৬-৩৭অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে তার ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপের উপর তথাকথিত আইনী প্রলেপ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ বিভিন্নভাবে জিয়ার সম্মুখে ভীতি হয়ে দেখা দিতে শুরু করে। জিয়ার ধারণা ছিল, জাসদ হয়তাে আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলাতে পারে। জাসদ-আওয়ামী লীগ মিলিত শক্তি জিয়ার নিকট অনেক বিপদের কারণ ছিল। এই বিবেচনাতেই জিয়া জাসদ-সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে যে-কারণে আমরা রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিলাম, সে-কারণগুলােও তখনও পুরােমাত্রায় বিরাজ করছিল। তাই আমরাও চাচ্ছিলাম সরকার আমাদের সম্পর্কে নতুন সিদ্ধান্ত নিক। এর ভিত্তিতেই বিভিন্ন মহলের সাথে যােগাযােগ ও আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে ১৯৭৮-র এপ্রিলে আমরা সরকারি স্বীকৃতি লাভ করি। স্বীকৃতি লাভের পূর্বে আমরা কিছুটা সরকারি শৈথিল্যও লাভ করি। জাসদের ব্যানারে মিছিল,.. আলােচনা সভা, আমাদের অনেক নেতা কর্মীর মুক্তিলাভ ইত্যাদি তার প্রমাণ বহন করে। অনুমােদন লাভের পরপরই বিগতদিনের আন্দোলনগুলাে মুল্যায়ন করে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সুস্পষ্ট রাজনীতির ভিত্তিতে জাসদকে জনগণের কাছে যাওয়া দরকার ছিল। কিন্তু অতীত রাজনীতির মূল্যায়ন হল না। বর্তমান করণীয় সম্পর্কে তাই সুস্পষ্ট কিছু বলাও গেল না। সংগঠনের সামনে ভেসে-আসা অসংখ্য প্রশ্নের জবাব আমরা দিতে পারলাম না। প্রশ্নপত্রের এ-পাতায় ও-পাতায় ইতিউতি পাক খেতে থাকলাম। এও এক ধরনের সুবিধাবাদ। জাসদকে স্বীকৃতি দেওয়ার কারণ উল্লেখ করা হয়েছে পূর্বেই, জিয়া চাচ্ছিল বুর্জোয়াশ্রেণীর আভ্যন্তরীণ কোন্দলে আমাদেরকে তার গােষ্ঠীর স্বপক্ষে ব্যবহার করতে। এক্ষেত্রে তর্কাতীতভাবেই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে ব্যবহার করে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টি করা। … আন্দোলনের সাধারণ রূপ গােটা বুর্জোয়াব্যবস্থার (system) বিরুদ্ধে হলেও, বিশেষ রূপ কি অবস্থিত ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত করা। কিন্তু স্বীকৃতি লাভের পর থেকে আমাদের কর্মকাণ্ডে আমরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছি।৬৭. বলা হয়ে থাকে, জাসদের স্বীকৃতি লাভে জিয়া সরকারের সাথে সমঝােতা স্থাপনে মাহবুবুর রব সাদী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন এ যথার্থই সুবিধাবাদ। জনাব সাদী জানাচ্ছেন, বিভিন্ন সময়ে অতীতের মূল্যায়নের প্রশ্নে আদর্শগত সংগ্রাম শুরু করার জন্য কোনাে কোনাে ব্যক্তির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকে আমরা চিত্রিত করেছি সংগঠনের কাজে বাধা সৃষ্টি হিসেবে। মূল্যায়নকে এড়িয়ে গিয়ে বলতে চেয়েছি আন্দোলন সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিবে’ (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৫)ব্যর্থতার ফিরিস্তি এখানেই শেষ নয়। রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচনেও তারা পা দেয় ভুলের বালুচরে। শাহজাহান সিরাজের ভাষায় :স্বীকৃতিলাভের পরপরই আমাদের লক্ষ্য ছিল (আত্মসমালােচনা দলিলে ৩৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ‘লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল) বুর্জোয়াশ্রেণীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে ব্যবহার করে মেহনতী শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করা। | কিন্তু রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের সময় আমরা আমাদের রাজনীতিকে সঠিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারিনি। আমাদের নিজস্ব পত্রিকা ও অন্যান্য প্রকাশনা নাথাকাটা যদিও একটা কারণ, তবুও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সে-সময়ে আমাদের বক্তব্য ক্ষমতাসীনদের চাইতে ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়াগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে শাণিত হয়েছে বেশি। ফলে জনমতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এ প্রসঙ্গে আত্মসমালােচনা দলিলে বলা হয় : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে আমাদের বক্তৃতা-বিবৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নকে বার বার এড়িয়ে যেতে চাইলেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে আমাদের বক্তব্যে সব ছাপিয়ে যে-কথাটি বেরিয়ে এসেছে তা হল -এ যাত্রায় বাকশালকে পরাজিত করুন।”সংসদ নির্বাচনের সময়ও অবস্থার কোনাে ইতর-বিশেষ হয়েছে-তা বলা যায় না। যেমন:রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়কাল থেকে বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা পর্যন্ত আমাদের বক্তব্য ছিল-জাসদ আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। জনগণ, কর্মীবাহিনী, সংগঠনকে পুরােপুরিভাবে আমরা নির্বাচনমুখী করে তুলেছিলাম। আমাদের দাবি ছিল পার্লামেন্ট নির্বাচন দিতে হবে। আর নির্বাচনের তারিখ ঘােষণার পর আমরা নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিলাম। একদিকে নির্বাচন বয়কট ঘােষণা, অন্যদিকে তিনশ’ সীটে প্রার্থী দাঁড় করানাে ও জেতার জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলায় নেতা-কর্মী-সংগঠকদের মধ্যে দেখা দেয় বিভ্রান্তি। আবার নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এমনভাবে জনগণ জানল-যা কোনােভাবেই আমাদের রাজনৈতিক অর্বাচীনতাকে ঢেকে রাখতে পারেনি।” শাহজাহান সিরাজের ভাষায় : …স্বভাবতই রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের সময়ে যে বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছিল, বয়কটের সূচনা ও পরিসমাপ্তি, সিদ্ধান্ত ঘােষণার মারাত্মক পদ্ধতিগত ত্রুটি তা আরও বাড়িয়ে৬৯. শাজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপাের্ট, পৃষ্ঠা ১৭ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৮ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩৯-৪০ শাজাহান সিরাজ, রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৮-১৯ পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে যে, রাজনৈতিক রিপাের্টে (১৯৮০) রাজনৈতিক দলবিধির অধীনে স্বীকৃতি লাভের পর থেকে ১৯৭৯ -এর সংসদ নির্বাচন পরবর্তী কিছু সময় পর্যন্ত কালে জাসদের ডান-বিচ্যুতি ঘটে। লক্ষণীয়, এই ডান বিচুতিই ক্রমে জাসদের স্থায়ী নীতিতে পরিণত হয়ে জাসদকে একটি বুর্জোয়া সংসদীয় দলে রূপান্তরিত করে। এ এক বিরাট ট্রাজেডি। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জাসদের উত্থান ঘটে কালবৈশাখী ঝড়ের বেগে, আবার এর পতনও ঘটে উল্কার গতিতে, মাঝখানে নিঃশেষ হয়। হাজার হাজার তরুণের মূল্যবান জীবন ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। পেশা ভিত্তিক পার্লামেন্ট ২৪ এপ্রিল ১৯৭৮ রাজনৈতিক দলবিধির অধীনে রাজনীতি করার অনুমতি লাভের পূর্বেই রাজনৈতিক কাজকর্মে সরকারি শৈথিল্য লাভ ও তাদের অনেক নেতা-কর্মীর জেল থেকে মুক্তি লাভের বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জাসদকে একটা ভূমিকা গ্রহণ (জিয়াকে সমর্থন) করতে হয় এবং প্রথমে বয়কটের ঘােষণা দিয়েও পরে ‘অর্বাচীনভাবে’ সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে হয়।‘সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা দেয়া ‘অসংখ্য প্রশ্ন, হতাশা, দোদুল্যমানতা ও বিভ্রান্তি এবং নেতৃত্ব সম্পর্কে দ্বিধা ও অনাস্থার প্রেক্ষিতে ১৯৭৯ সালের মার্চে দলের অভ্যন্তরে (কেবলমাত্র সদস্যদের জন্য) জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রচারিত ৪৪ পৃষ্ঠার। আত্মসমালােচনা দলিলে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় : জাসদের নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্যে কিংবা কর্মকাণ্ডে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, জাসদ দিন দিন একটি পালার্মেন্টারি পার্টিতে রূপান্তরিত হচ্ছে? জাসদকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?… জাসদ কী কারণে হঠাৎ করে নির্বাচন বর্জন করলাে? নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত কোন্ ভিত্তিতে যৌক্তিক? নির্বাচন বর্জনের পর জাসদ আন্দোলনের কোনাে কর্মসূচি দিল না কেন? এটা কি সুবিধাবাদ নয়? বিরাট গলায় বর্জনের কথা বলা, যে-কেউ বর্জন থেকে ফিরে আসবেন, তিনি দেশ ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন ইত্যাদি বলার পরও আকস্মিকভাবে বঙ্গভবন থেকে খােদ জাসদেরই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত ঘােষণায় কী বুঝা। যায়? এতে কি প্রমাণ হয় না জাসদ নিজেই তার প্রদত্ত ওয়াদার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে? বিস্তারিত আলােচনার পর উল্লিখিত দলিলে উপযুক্ত প্রশগুলাের জবাব হ্যা-বাচক। হয়। তবে আত্মসমালােচনায় একে ডানবিচ্যুতির কথা বলা হলেও তা শােধরিয়ে কোনাে সঠিক পথের সন্ধান দেয়া হয় না। বরং নিচের আলােচনায় দেখতে পাওয়া যাবে যে,৭৩. নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ৩-৫তত্ত্বকথার নানা বাগাড়ম্বরের আড়ালে ক্রমে জাসদ বিপ্লব ত্যাগ করে সংসদীয় রাজনীতিতে দীক্ষা নিয়েছে। ১৯ জানুয়ারি ১৯৮০ জাসদ আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর। জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য ও কর্মসূচি উপস্থাপন করে। সেই কর্মসূচিতে বন্দিমুক্তি ও মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার বিষয়ক প্রথম দফার পরের এবং গােটা কর্মসূচির প্রধান দাবিই ছিল জমির দাবি। ভূমি সংস্কারকে এক নম্বরে রেখে মােট দশটি উপদফা সংবলিত কৃষিক্ষেত্রের প্রগতিশীল রূপান্তর সাধনের লক্ষ্যে একটা বিস্তৃত দাবিই ছিল সেই কর্মসূচির দ্বিতীয় এবং মূল দাবি। কিন্তু ৬ মাসের মধ্যেই ২২-৩০ জুন ১৯৮০ অনুষ্ঠিত জাসদের জাতীয় কমিটির সভায় উক্ত কর্মসূচির বিপরীতে নতুন রাজনৈতিক প্রস্তাব ও বিতর্কিত’ ১৮-দফা। কর্মসূচি গ্রহণ এবং ৪ জুলাই ১৯৮০ তা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে দেশবাসীর উদ্দেশে প্রচার করা হয়। ১৮-দফা কর্মসূচির প্রধান দাবি হল পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট। নতুন এই কর্মসূচিটাও শুরু হয়েছে ‘মৌলিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি দিয়ে। তবে জানুয়ারির কর্মসূচির ‘জমির দাবি’কে হটিয়ে এবার দু’নম্বরে স্থান দখল করেছে। ‘পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট’ আর ভূমি-সংস্কার সম্পর্কিত অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট দাবিটাকে ঠেলে পাঠানাে হয়েছে ১১ নম্বরে! ‘সংগঠনের অভ্যন্তরে বিরাজিত বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ের উপর একটা যৌথ মতামতে উপনীত হয়ে রচিত সমন্বয় কমিটির দলিলে বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ১৮-দফা কর্মসূচি শিরােনামে একটি পরিচ্ছেদে এ সম্পর্কে বিশদ আলােচনা করা হয়। উক্ত দলিলের ভূমিকায় বলা হয় : সব বিতর্কের সমাধান একদিনেই সম্ভব নয়। কিন্তু বিতর্কের অবসান করতে হলে আমাদের অবশ্যই মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সবার সুষ্ঠু ধারণা অর্জন করতে হবে। সেজন্য ১৮-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে ব্যাপক জনতার আন্দোলন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তােলার মৌলিক৭৫. নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯২ ততদিনে সিরাজুল আলম খান, মেজর জলিল আটকাবস্থা থেকে মুক্তি পান এবং রবও মুক্তি পেয়ে পশ্চিম জার্মানী থেকে বিশ্রাম লাভ করে ফিরে আসেন। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি (C.0.C.) ভেঙে দেয়ার কিছুকাল পর থেকে চার সহযােগী সংগঠন জাসদ, শ্রমিক জোট, কৃষক লীগ ও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে গঠিত হয় সমন্বয় কমিটি’। পরে সিরাজুল আলম খান, মির্জা সুলতান রাজা, শাজাহান সিরাজ ও নূরে আলম জিকুকে সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। উক্ত দলিলটি সামান্য পরিমার্জিত হয়ে কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ” নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়। তবে ১২ নেতার দলিল হিসেবে তা সমধিক পরিচিতি লাভ করে। বলা বাহুল্য, উক্ত দলিলের সর্বত্র সিরাজুল আলম খানের ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গের ছায়া বিরাজমানদৃষ্টিভঙ্গি কী হবে সে-সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা থাকলে ১৮-দফা কর্মসূচির যৌক্তিকতা আমরা বুঝতে ব্যর্থ হব।…. লক্ষ্য করুন, এখানে একটি গােলকধাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। কথিত মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা অর্জনের জন্যে প্রয়ােজন ১৮-দফার কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন, আবার ১৮ দফার যৌক্তিকতা বুঝার জন্য প্রয়ােজন মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা! দলিল রচয়িতাবৃন্দের এই লেজে-গােবরে অবস্থা থেকে অনুমান করা যায় যে, বিষয়টি তাদের কাছেই সুস্পষ্ট নয়। দলিলে বলা হয় :প্রচলিত বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনাে পরিবর্তনের পথ (বক্তব্য) হাজির না করে ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের দুই সমস্যাকে কেন্দ্র করে যে-কোনাে আন্দোলনের চরিত্র নিছক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক। তার মধ্যে কোনাে বিপ্লবী মর্মবস্তু নেই।… সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে সর্বহারা শ্রেণী নিছক বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে যাবে কেন? এতে তার কোনাে স্বার্থ নেই।”যে-ক্ষেত্রে আন্দোলন বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারে না সে-ক্ষেত্রে এর | মধ্যে একটা বিপ্লবী মর্মবস্তু (পুঁজিবাদ বিরােধী উপাদান) প্রবিষ্ট করিয়ে তাকে ‘বিপ্লবী আন্দোলনে’ রূপান্তরিত করতে হবে। জাসদ-নেতৃবৃন্দ মনে করেন, প্রস্তাবিত ১৮-দফা। হল সে ধরনের বিপ্লবী কর্মসূচি এবং পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টের দাবি’ হল সেই পুঁজিবাদ বিরােধী উপাদান। এই হল কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পথ’। দলিলের ভাষায়: এখনকার পালার্মেন্ট জনসাধারণের ভােটে নির্বাচিত এ-কথা সত্যি। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের জন্য বিভিন্ন শ্রেণী ও অংশের যে-প্রতিনিধিত্ব দরকার তা কোথায়? এই পার্লামেন্টকে যদি আনুপাতিক হারে বিভিন্ন পেশাজীবীদের (ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কর্মচারী, সাংবাদিক, কারখানা, শ্রমিক, কৃষি মজুর সরকারি (?) ইত্যাদি) প্রতিনিধি নির্বাচিত করে ৩৩০ জনের বদলে ৫০০ জনের পার্লামেন্টে পরিণত করা হয় এবং সে পার্লামেন্টকে সকলপ্রকার আইন প্রয়ােগের দায়িত্ব দেয়া হয় তাহলেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে-তােলার জন্য সে পার্লামেন্ট হবে একটি কার্যকরী কাঠামাে। চিন্তা করে দেখুন, আন্দোলনের মধ্যদিয়ে এমনি একটি কাঠামাে গড়ে তুলতে পারলে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে কিনা এবং যে সংগঠন বা সংগঠনসমূহ আন্দোলন পরিচালনা করবে তাদের স্বপক্ষেই আজ অথবা কাল পেটিবুর্জোয়া, উদারনৈতিক বুর্জোয়াসহ ব্যাপক জনতা যোগ দিবে কিনা? পেশার প্রতিনিধি সহ সার্বভৌম সংসদ গড়ে-তােলার আন্দোলন শুধুমাত্র জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করবে না, তা ফ্যাসিবাদবিরােধী চেতনাকেও কার্যকরীভাবে লালন করবে। সমাজতান্ত্রিক শক্তিভিত গড়ে-তােলার স্বপক্ষে এই নির্দিষ্ট শ্লোগানটি কি কোনােই অবদান রাখতে পারে না? অবশ্যই অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষকে তাদের নিজস্ব৭৭. কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা ১৮ কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তত্ত্বিক বিশ্লেষণ, পৃষ্ঠা ৪৫সংগঠনে সংগঠিত করার জন্য স্লোগানটি যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। সকল প্রকার আইন প্রণয়নের কাজে অংশগ্রহণের এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে যেহেতু কর্মজীবী মানুষেরা তাদের নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলবে সেহেতু সংগঠিত শক্তি হিসেবে কর্মজীবীদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানাের পথটাকে সুগম করে দেবে। তাই, পেশাজীবীদের প্রতিনিধিসহ সার্বভৌম সংসদের দাবির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা। গণতান্ত্রিক আন্দোলন ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদকে শুধু কোণঠাসা করে দেবে না, পুঁজিবাদবিরােধী সংগঠিত চেতনায়ও বিকাশ ঘটাবে। দেখা যাচ্ছে, জাসদ আশা করে, আন্দোলনের মাধ্যমে পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট’ গড়ে তুলতে পারলে তা (বা তা আদায়ের আন্দোলন) হবে আজ অথবা কাল পেটিবুর্জোয়া উদারনৈতিক বুর্জোয়াসহ ব্যাপক জনতার ১. ‘সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার একটি কার্যকরী কাঠামাে’ ২. ফ্যাসিবাদ বিরােধী। চেতনাকে লালনকারী’ ৩. ‘সমাজতান্ত্রিক শক্তিভিত গড়ে তােলার লক্ষ্যে ‘অসংগঠিত শ্রমজীবী মানুষকে তাদের নিজস্ব সংগঠনে সংগঠিত করার’ সংগঠক ৪. ‘পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক সচেতন সংগঠিত শক্তি সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান। অন্য কথায়, পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট হল পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গঠনকারী একটি প্রতিষ্ঠান যা একই সাথে শ্রমিকশ্রেণীকে কমিউনিস্ট পার্টিতে সংগঠিত করে সমাজতান্ত্রিক শক্তিভিত গড়ে তুলে পুঁজিবাদবিরােধী চেতনার বিকাশ ঘটাবে ও সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদকে কোণঠাসা করবে। অর্থাৎ বুর্জোয়া পার্লামেন্টে পেশাভিত্তিকতা (বিপ্লবী মর্মবস্তু/উপাদান) প্রবিষ্ট করিয়ে আন্দোলনকে বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রম করিয়ে সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসিবাদ বিরােধীও করা (এক ঢিলে বহু পাখি শিকার!) সম্ভব হবে। জাসদের তালিকায় নিচের দিকে স্থান পাওয়া কৃষি মজুররা সংখ্যায় মােট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি এবং তাদের সংগঠিত করতে পারলে এখনই পার্লামেন্ট দখল করা যায়। যেমনটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট-কোয়ালিশন সরকার করেছে। এজন্য সিপিআই(এম)-কে জমির দাবিকে হটিয়ে পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টের দাবিকে অগ্রাধিকার দিতে হয়নি। উপরন্তু, পালার্মেন্টের এলাকা বা পেশাভিত্তিকতা হল রাষ্ট্রকাঠামাের একটা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক রূপের (form) প্রশ্ন, তার মর্মবস্তুর (content) পরিবর্তন নয়। তাছাড়া এ কথা সর্বজনবিদিত যে, আইন সভার দ্বিতীয় (উচ্চ) কক্ষ চূড়ান্ত বিচারে প্রথম। (নিম্ন) কক্ষের কাজে কিছু বিলম্ব ঘটাতে পারে বটে, কিন্তু বাধা দিতে পারে না; সে কক্ষ যাদের সমন্বয়ে বা যে-ভাবেই গঠিত হােক না কেন। বাংলাদেশে জিয়ার গ্রাম সরকারেও দেখা গেছে ভূমিহীন কৃষক তার নিজস্ব স্বার্থের পরিবর্তে বিত্তবানদের প্রতি অনুগত থাকতে বাধ্য হয়। সুতরাং পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট নয়, প্রয়ােজন সমাজের শক্তির ভারসাম্য বদলে দেয়া, গ্রামীণ সর্বহারাকে ‘শ্রেণীতে রূপান্তরিত করা। আর এজন্য প্রয়ােজন তাদের জীবনের সমস্যাকেন্দ্রিক স্লোগান ও সে-স্লোগানের ভিত্তিতে তাদের সংগঠিত করার ধীরলয়ের নিরবচ্ছিন্ন কাজ।জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আবদুর রব একদা পালার্মেন্টকে। “শুয়রের খােয়াড়’ আখ্যা দিয়ে এবং তিনি নিজে যে খােয়াড়ে ‘গৃহপালিত বিরােধী দলীয় নেতা হয়ে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। ১৯৭৩ সালের প্রথম নির্বাচনকে তারা বাংলার বুকে ‘শেষ নির্বাচন ঘােষণা দিয়েছিলেন। তখন তাদের চেতনা ও কর্মের পুরােটা জুড়ে ছিল শ্রেণীসগ্রামের মাধ্যমে সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা। আর এখনকার অবাস্তব ও বিভ্রান্তিমূলক পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টের দাবি অর্থাৎ পার্লামেন্টের বহিরঙ্গের রূপ বদলানাের দাবি প্রকৃত প্রস্তাবে ‘শ্রেণী সংগ্রাম, সমাজিক বিপ্লব, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ প্রভৃতি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে দেশে পুঁজিবাদকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করার কৌশলের নামান্তর মাত্র। | প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, একের ভেতর বহু গুণের অধিকারী এই পেশা-ভিত্তিকতার ভিত্তিটি কী এবং এদের প্রতিনিধিত্বই বা নির্ধারিত হবে কিসের ভিত্তিতে? এ বিষয়ে সিরাজুল আলম খান তার একুশ শতকে বাঙালি’, ‘খােলা চিঠি’ প্রভৃতি পুস্তিকায় বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তিনি মনে করেন: …সম্পদ অনুসারে তাদের (জনগণের) সামাজিক বিভাজন- উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত ৩%, মধ্য-মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ২২% নিম্নবিত্ত ও গরীব মানুষ ৭৫%। উচ্চবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত সমাজ অর্থাৎ শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, বড় কৃষক, সমবায়ী, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, ব্যাঙ্কার, বড় দোকানদার, সমাজসেবী (এনজিও), সরকারি, আধা সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি সামাজিক গােষ্ঠী পেশাজীবী হিসেবে চিহ্নিত। আর শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, ছােট কৃষক, কর্মচারী, দোকান কর্মচারী, সাধারণ সৈনিক, পুলিশ, আনসার, রিক্সাচালক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী প্রভৃতি শ্রমজীবী, কর্মজীবী হিসেবে পরিচিত। এই শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীরাই হলাে আমাদের সমাজ জীবনের নব্য সমাজশক্তি।৮১. অবাস্তব এজন্য যে, দেশে মােট পেশার সংখ্যা, প্রতিটি পেশায় পেশাজীবীর সংখ্যা, প্রতিনিধিত্বের ভিত্তি ও নির্বাচন পদ্ধতি নির্ধারণ করা খুবই জটিল কাজ। প্রস্তাবানুযায়ী ডাক্তার-সমাজ আইন সভার উচ্চকক্ষে একটি আসন বা নারীসমাজ ষােলটি আসন পাবে। এম এ মতীন বা বদরুদ্দোজা চৌধুরী বা ফজলুল করিম বা আমানুল্লাহ প্রমুখ খ্যাতিমান ডাক্তারগণ সাংসদ মায় মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এবং অষ্টমটি ব্যতিরেকে সকল সংসদেই অন্যূন ১৫ থেকে ৩০ জন মহিলা সাংসদ এবং দু’একজন মন্ত্রী মায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন (বর্তমানেও প্রধানমন্ত্রী একজন নারী)। এরা নিজ নিজ পেশা বা “সমাজের হয়ে অতিরিক্ত কী-ই বা করতে পেরেছেন? সুতরাং বুর্জোয়া সংস্কারমূলক দাবি হিসেবেও ‘পেশা ভিত্তিক অপ্রয়ােজনীয়। ফলে পৃথিবীর কোথাও এরূপ পার্লামেন্ট দেখা যায় না। বা তা প্রতিষ্ঠার দাবিও লক্ষ্য করা যায় না। সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকে বাঙালি, এম, এন, ও, পাবলিকেসন্স (প্রা:) লিমিটেড, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ৩০তিনি আরাে মনে করেন, আমাদের দেশের পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী কাঠামাের বৈশিষ্ট্য। অনুযায়ী এখানে শ্রমজীবী-কর্মজীবীর শ্রমশক্তি ও পেশাজীবীর ‘দক্ষতা’ সমন্বয়ে উৎপাদন ইউনিট’ গড়ে উঠলেও রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় (আইন প্রণয়ন, প্রশাসন, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা) এই শ্রমশক্তি ও দক্ষতার জৈবিক একীভবন (Organic Integration) নেই। অর্থাৎ আইসভায় রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা আছে কিন্তু সামাজিক শ্রম, কর্ম ও পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব নেই। রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের বিভিন্ন অংশের সাধারণ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটলেও বিশেষ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। উপরন্তু নীতি প্রণয়নকারী রাজনৈতিক দল ও আমলাতন্ত্রের সাথে নীতি সঞ্চালনকারী (Transmitting agent) শ্রমজীবী-পেশাজীবীর অসঙ্গতি বা দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এসব কারণে দেশের এ যাবৎকাল চালু থাকা রাজনৈতিক, প্রশাসন ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। জনজীবনে কোন গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে পারে নি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠা জনগণের সকল অংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল হলেও স্বাধীনােত্তরকালে ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের মাধ্যমে সুদৃঢ় জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার বদলে ব্রিটিশ ধাচের দলীয় শাসন ভিত্তিক পার্লামেন্টারী ব্যবস্থা চালু হলাে- যা কিনা শাসনতান্ত্রিকভাবে জনগণকে সরকারী দল ও বিরােধী দলে বিভক্ত করে দেয়, ফলে জাতীয় ঐক্য ভেঙ্গে পড়ে। দেশ কার্যতঃ ব্রিটিশ-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক চিন্তা-চেতনা ও ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়ে আসছে। নাম পরিবর্তন ছাড়া (এবং দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া) ঔপনিবেশিক আমলের আইন বা বিধি রহিত করা হয়নি, বহাল রয়েছে। অর্থাৎ স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের উপযােগী শাসন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামাে গড়ে উঠে। নি। এমতাবস্থায় দিক নির্দেশনা হিসেবে জনাব খান বলেন:বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক কাঠামােকে অর্থবহ ও কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দল হতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পাশাপাশি শ্রমজীবী-পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সংবলিত আইন প্রণয়নকারী সংস্থা (পার্লামেন্ট) একান্ত প্রয়ােজন। পাঁচ বছর অন্তর রাজনৈতিক দলসমূহ ও আমলাতন্ত্রের কার্যকলাপকে অনুমােদন দান (সমর্থন বা বিরােধিতা উভয় অর্থে) করাকে গণতন্ত্রের কোন সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় না। গণতন্ত্র হতে হবে অংশীদারিত্ব ভিত্তিক। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সমাজ শক্তিসমূহের অংশীদারিত্বের স্বীকৃতি এবং এর ভিত্তিতে গড়ে তােলা ঝাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কাঠামােই হলাে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’। বাংলাদেশের সমাজ শক্তির বিন্যাস, সমাজের সামগ্রিক চাওয়া-পাওয়া এবং রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্রকে আইন প্রণয়ন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ওউৎপাদন কাঠামােয় প্রয়ােগ করতে হবে। উল্লেখ্য, জাসদের একদা তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খান কর্তৃক ১৯৭৬ সালে গণকণ্ঠে ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে’ শিরােনামে লিখিত প্রবন্ধে ‘পেশাভিত্তিকতা’,৮৩ সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকের বাঙালি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১তথা ‘১৮ দফা কর্মসূচি’ প্রথম জ্বণাকারে প্রকাশিত হয়। পরে তা নির্দিষ্ট অবয়ব লাভ করে ১৯৮০ সালের জুন মাসে জাসদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৮৩ সালে ড. জিল্লুর রহমান খান ও সিরাজুল আলম খান যৌথভাবে এর পরিমার্জিতরূপ অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’-র তত্ত্ব উপস্থাপন করেন এবং ১৯৮৭ সালে এর প্রতিষঙ্গীরূপ (Corresponding structure) নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সরকারের রূপ (form) ও পার্লামেন্টসহ নানাবিধ প্রতিষ্ঠান/সংস্থার গঠন ও পরিচালনা সংক্রান্ত ‘চার্ট’ বা মডেল তৈরি করে। কমিটি এলাকা ভিত্তিক প্রতিনিধি ৩০০ ও শ্রম-কর্ম-পেশা, এবং মহিলা ও উপজাতীয় প্রতিনিধি ২০০ সমন্বয়ে ৫০০ আসনের এককক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদের প্রস্তাব করে। পরে ১৯৯৩ সালে এক কক্ষের পরিবর্তে দুইকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের নিম্নরূপ সংশােধিত প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়:১. জাতীয় সংসদ : ‘নিম্নকক্ষ'(Lower House) এবং উচ্চকক্ষ’ (Upper House)নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। ক. নিম্নকক্ষ : ৩০০ (তিনশত) সদস্য বিশিষ্ট। রাজনৈতিক দলসমূহ কর্তৃক মনােনীত প্রাপ্তবয়স্কদের ভােট দ্বারা অঞ্চল ভিত্তিতে নির্বাচিত হবে। খ. উচ্চকক্ষ : ২০০ (দুইশত) সদস্য বিশিষ্ট। (১) শ্ৰম-কর্ম-পেশায় নিয়ােজিত (শ্রমজীবী, কর্মজীবী, পেশাজীবী) ব্যক্তিদেরদ্বারা অদলীয়ভাবে নির্বাচিত সদস্য।৮৪. আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে আলােচনার জন্য পরিশিষ্ট ১৭ পড়ুন জনাব খান মনে করেন, এই প্রস্তাবের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভূমিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। রয়েছে। জাতীয়তাবাদ এখানে প্রেরণার শক্তি হিসেবে কাজ করবে। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কেবল সমাজ শক্তির ভূমিকা (এম-কর্ম-পেশার ভূমিকা) বাংলাদেশের বৃহত্তর অর্থে যে কোন দেশের) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রয়ােজন মেটাতে পারবে না। আমাদের জাতীয়তাবাদ হাজার। বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, অভিজ্ঞতা এবং জনগণের আশা-আকাক্ষী ও সচেতন প্রয়াসে সৃষ্ট। এই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার লক্ষো আমি বাঙালির ঐক্যের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করি। (আমরা জাতি হিসেবে বাঙালি আর নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী)। বর্তমান পৃথিবীতে (প্রবাসী ৪০ লক্ষসহ) বাঙালির সংখ্যা ২০ কোটি (২০০ মিলিয়ন)। ২০২৫ সন নাগাদ এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪০ কোটি। শুধু ভাষা এবং ধর্মের গণ্ডি দিয়ে এই জাতীয়তাবাদকে সীমাবদ্ধ না রেখে, প্রতিটি বাঙালির জন্য শ্রম-কর্ম-পেশার মাত্রাকে সংযােজিত করে বাঙালিত্বের সংজ্ঞাকে নির্ধারণ করতে হবে। এর ফলে আমরা নিজেদেরকে যেমন সার্বিক উন্নতির পথে নিয়ােজিত করতে পারবাে, তেমনি অন্যদিকে বিশ্বপরিসরে যে কোন জাতির সমকক্ষ হয়ে উঠবে। আর তখনি সারা বিশ্বব্যাপী আমাদের থাকবে একটি রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয়।’ (একুশ শতকের বাঙালি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২-৩৩)। সিরাজুল আলম খানকে সমন্বয়ক এবং ড, জিল্লুর রহমান খান, অধ্যাপক আজমল আহমেদ, অধ্যাপিকা রাজিয়া আহমেদ, আমানুল্লাহ, সফিউল আলম, মােহাম্মদ শাহজাহান, আ.স.ম. আবদুর রব ও নূরে আলম জিকুকে সদস্য করে এই কমিটি গঠিত হয় সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকে বাঙলি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৯(২) প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের দ্বারা অদলীয়ভাবে নির্বাচিত সদস্য। (৩) উপজাতীয়দের দ্বারা অদলীয়ভাবে নির্বাচিত সদস্য। (৪) রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত সদস্য (মূলতঃ প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং আমলাকর্মকর্তা ও শান্তি-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীদের মধ্য থেকে)। (৫) জাতীয় নির্বাচনে প্রাপ্ত ভােট অনুযায়ী আনুপাতিক হারে রাজনৈতিকদলসমূহের মনােনীত সদস্য।২. গ্রুপ বিভক্তি :শ্রম, কর্ম, পেশা, মহিলা এবং উপজাতিসমূহকে নিম্নোক্ত ১৩ (তেরাে) ক্যাটিগ্যারিতে (Category) ভাগ করা হলাে : (১) বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী : যথা- শিক্ষক, আইনবিদ, সাংবাদিক,শিল্পী, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, প্রকাশক, চলচ্চিত্র শিল্পী-কুশলী, সংগীত শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী, ক্রীড়াবিদ ইত্যাদি। টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ যথা-বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, ডাক্তার, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, দক্ষ কারিগর, স্থপতি, পরিকল্পনাবিধ, শিল্প-ম্যানেজার, ব্যবসায়ী-এক্সিকিউটিভ, ব্যাংকবিশারদ, সমাজসেবী (এনজিও), একাউন্টেন্ট ইত্যাদি। (৩) ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প : যথা-শিল্পপতি, ব্যবসায়ী (ক্ষুদে, মাঝারি ওবৃহৎ), ফ্যাক্টরী মালিক, দোকানদার, ব্যাংকার, বীমা(বিদ) ইত্যাদি। শ্রমিক : যথা- শিল্প শ্রমিক, ফ্যাক্টরী শ্রমিক, ফ্যাক্টরী আইনের অন্তর্ভুক্ত শ্রমিক-কর্মচারী, যানবাহন (রিক্সাসহ) শ্রমিক, সরকারি, আধা-সরকারি স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সেক্টরের শ্রমিক ইত্যাদি। কৃষি শ্রমিক : যথা- ক্ষেতমজুর, দিনমজুর ও গ্রামীণ এলাকার সকল ধরনের মজুর ইত্যাদি। সমবায়ী কৃষক ; যথা- ধনী, মাঝারী ও ছােট কৃষক যারা সমবায়ের অন্তর্ভুক্ত। ক্যাডার সার্ভিস যথা- সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা। প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বাহিনী যথা- সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, বি.ডি.আর, আনসার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, সহযােগী বাহিনী ইত্যাদি। কর্মচারী ; যথা- সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি সেক্টরের অধীন সকল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। মহিলা : যথা- ১৮ বৎসরের অধিক বয়সী মহিলা। সমাজের অনগ্রসর অংশ : যথা- তাঁতী, জেলে, ধােপা, নাপিত, মুচি,কামার, কুমার, মেথর, বেদে ইত্যাদি। (১২) উপজাতি : যথা- চাকমা, মারমা, তনচুংগা, মুরং, লুসাই, বােম, টি,মগ, গারাে, সাঁওতাল, হাজং, কুকি, খাসিয়া ইত্যাদি।(১০) (১১)(১৩) অন্যান্য যারাই কোন না কোন জাতীয় উন্নয়নমূলক কাজেনিয়ােজিত-সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ৩. ভােট পদ্ধতি এক ব্যক্তি-দুই ভােট। এক ভোেট অঞ্চলভিত্তিক এবং দ্বিতীয়ভােট এম-কর্ম-পেশা ভিত্তিক। ৪. প্রত্যাহার পদ্ধতি (Re-Call System) ১৫% ভােটার দ্বারা যে কোননির্বাচিত ব্যক্তির সদস্যপদ প্রত্যাহারের জন্য স্পীকারের নিকট আবেদন করা যাবে। উদ্যোগ গ্রহণ (Initiative) ৫% ভােটার দ্বারা যে কোন আইন প্রণয়ন অথবা বাতিল করার জন্য স্পীকারের নিকট লিখিতভাবে আবেদন করার ব্যবস্থা থাকবে। জাতীয় সংসদ সে আবেদন বিবেচনা করতে বাধ্য থাকবে। নির্বাচন অনুষ্ঠান সকল পর্যায়ের নির্বাচন ঘােষণা এবং অনুষ্ঠানের সর্বময় ক্ষমতা থাকবে নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হবে।দেখা যাচ্ছে, ৮৬ ধরনের” শ্ৰম-কর্ম-পেশার লােককে ১২/১৩টি দলে’ বিন্যাস করে আইনসভার প্রস্তাবিত দ্বিতীয় (উচ্চ) কক্ষে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোন দলে ১৪, কোন দলে ৩, আবার কোন দলে মাত্র ১ ধরনের লােক রয়েছে। এদের প্রতিনিধিত্বের হার কী হবে তা বলা হয়নি। প্রতিনিধিত্বের হার সমান হলে, প্রতিটি দলে ১৬ জন (২০০ + ১২=১৬.৬৭) প্রতিনিধি পাওয়া যায়। তাহলে ২ নং দলের বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, ডাক্তার, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, দক্ষ কারিগর, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, শিল্প-ম্যানেজার, ব্যবসায়ী-এক্সিকিউটিভ, ব্যাংকবিশারদ, সমাজসেবী (এনজিও), একাউনটেন্ট প্রভৃতি সকলে বা ১২ নং দলের ১৩ উপজাতি পাবে ১৬ জনবাংলাদেশের শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবী প্রভৃতির পরিসংখ্যান নিম্নরূপ ডাক্তার-৩০,০০০; ইঞ্জিনিয়ার-৩০,০০০; ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার-৫০,০০০; শিক্ষক-৫,০০,০০০; সাংবাদিক-২,০০০ সংস্কৃতিসেবী-১০,০০০; কৃষিবিদ-১০,০০০; ডিপ্লোমা কৃষিবিদ-৫০,০০০; ব্যাংক কর্মকর্তাকর্মচারী-৩০,০০০; আইনবিদ-৪০,০০০; ব্যবসায়ী-শিল্পপতি-১০,০০০; দোকান মালিক১,৫০,০০০; দোকান-কর্মচারী-৩,৫০,০০০; সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত, বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী-১৫,০০,০০০; বিভিন্ন প্রকার বিশেষজ্ঞ-৭,০০০; প্রতিরক্ষা বিভাগ-১,০০০০০; পুলিশ-১,০০,০০; আনসার। প্যারামিলিটারি-৫,০০,০০০; ক্রীড়াবিদ-২০,০০০; প্যারামেডিকস১,০০,০০০; উপজাতি-৭,০০,০০০; সমবায়ী কৃষক-১০,০০,০০০; কৃষি শ্রমিক-১,৫০,০০,০০০; শিল্প-শ্রমিক-৬০,০০,০০০; রিক্সাচালক-৫,০০,০০০; দিনমজুর-১,০০,০০০; তাঁতী-জেলে প্রভৃতি১০,০০,০০০; কৃষক (সমবায়ভুক্ত নয়)-১,৫০,০০,০০০; গ্যারেজ, লেপ, মেসিন, ওয়ার্কশপ প্রভৃতি-৫,০০,০০০; অন্যান্য ক্ষুদ্র কর্মে জড়িত-২০,০০,০০০; (প্রবাসী বাঙালি-৫০,০০,০০০; জনসংখ্যা- ১৩ কোটি, ভােটার-৬ কোটি, নারী-পুরুষ অনুপাত ৫০: ৫০) সিরাজুল আলম খান, খােলা চিঠি (পুস্তিকা), এম, এন, ও.পাবলিকেসন্স, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ১৩ যদিও শ্রম-কর্ম-পেশাওয়ারী লােকসংখ্যা বিভাজনে মাত্র ২৯টি ধরন উল্লেখ করা হয়েছে (৮৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য)(পেশার প্রতি “ধরনে’ ১ জন) প্রতিনিধি, তেমনি ৭ নং দলের সরকারি; আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ১ম ও ২য় শ্রেণীর ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা ১৬ জন; ১০ নং দলের মহিলারা (মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক) ১৬ জন এবং ৫ নং দলের কৃষিশ্রমিকরা (সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ) ১৬ জন প্রতিনিধি পাবে। এই হিসেবে ১ নং দলের প্রতিটি পেশার প্রাপ্য ধরা যাক ১ জন (১৬.৬৭°১২ = ১.৩৯)। তা হলে ৫০ হাজার শিক্ষক বা ২ হাজার সাংবাদিক বা ৫ শত (অনুমান) প্রকাশক সবাই ১ জন প্রতিনিধি পাবে। অর্থাৎ ৯ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫ শত কৃষি শ্রমিকের জন্য যেখানে ১ জন, সেখানে ২ হাজার সাংবাদিকের (বা ৫ শত প্রকাশকের) জন্যও ১ জন প্রতিনিধি। অন্য কথায়, ১ জন সাংবাদিক ও ৪৬,৮৭৫ জন কৃষিশ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব সমান। প্রতিনিধিত্বের এরূপ হার সুষম বা গণতন্ত্রসম্মত কী না এবং এ-দ্বারা জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ নয় কী?”লক্ষণীয়, প্রস্তাবিত শ্ৰম-কর্ম-পেশায় নিয়ােজিত ব্যক্তিবর্গের প্রায় সকলই নিজ নিজ পেশাগত সংগঠনে পূর্ব থেকেই সংগঠিত। কোন কোন পেশায় একাধিক সংগঠনও রয়েছে। ডাক্তারদের বিএমএ, ইঞ্জিনিয়ারদের ইআইবি, শিক্ষকদের ‘সমিতি’ ব্যবসায়ীশিল্পপতিদের এফবিসিসিআই, আমলাদের ‘এসােসিয়েশন’ শ্রমিক-কৃষকদের ‘গণসংগঠনসমূহ এক্ষেত্রে খুবই সুপরিচিত। সব সংগঠন নিজ নিজ পেশার স্বার্থসংরক্ষণার্থে সুদূর অতীতকাল থেকে কাজ করে আসছে এবং তারা নিজেরাও এরূপ অংশীদারিত্বের দাবি উত্থাপন করে নি। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে, “বিপ্লবী মর্মবস্তু’ প্রবিষ্ট বুর্জোয়া চৌহদ্দি অতিক্রমকারী’ সমাজতান্তিক শক্তিভিত গড়ে তােলার কার্যকরি কাঠামাে ‘পেশাভিত্তিক পার্লামেন্টকে একই সাথে শ্রমিক-কৃষক ও শিল্পপতিব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বের ‘সােনার পাথর বাটি’ বানানাের চিন্তা করা হয়েছে। বরং বলা সমীচীন হবে যে, পেশাভিত্তিকতার নামে শ্রমিক শ্রেণী ও কৃষককুলের স্বার্থ বিরােধী পুঁজিবাদী ও সুবিধাভােগীদের স্বার্থই প্রকারান্তরে রক্ষার চিন্তা করা হয়েছে।৮৮ জনাব খান প্রস্তাবিত শ্ৰম-কর্ম-পেশার প্রতিনিধিত্বশীল জাতীয় সংসদের রূপরেখার জন্য পরিশিষ্ট ২০
সাম্রাজ্যবাদের নীল-নকশাপ্রথমে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্বীকার করা, পরে তাদের আজ্ঞাবহ মােশতাকের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন’ গঠন করে মীমাংসায় পৌঁছা সম্ভব না হওয়ায় শেষে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উদ্যত হয়। কিন্তু এসবের কোন কিছুই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। বলা বাহুল্য, এই পরাজয়কে তারা সহজভাবে নেয় নি। তঙ্কালিন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের সহকারী রজার মরিসের ভাষায় : স্বাধীন বাংলাদেশের অ্যুদয় এবং শেখ মুজিবের ক্ষমতায় আসাটা ছিল উদ্যতের মতে, আমেরিকা এবং আমেরিকার তাবেদারদের জন্য এটা প্রকৃত অর্থেই পরাজয়স্বরূপ এবং আমেরিকার প্রশাসনের জন্য এটা খুবই বিব্রতকর ঘটনা … তার (হেনরি কিসিঞ্জার) কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলী ব্যক্তিগত পরাজয় (as a personal defeat) হিসেবে প্রতিভাত হয়। সাম্রাজ্যবাদ কোন পরাজয়কেই সহজে মেনে নেয় না। যে কোন পরাজয়কেই সে ভাবতে চায় সাময়িক এবং বাস্তবেও সাময়িক পরাজয়কে জয়ে পরিণত করার জন্য মারি অরি পারি যে কৌশলে’ নীতি অবলম্বন করে। সে পথ ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অচিরেই বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। | ১৯৬৪ সালের আগে থেকেই আমাদের জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করা প্রয়ােজন হয়। অর্থাৎ নিজস্ব খাদ্যোৎপাদন দিয়ে দেশের সকল মানুষকে খাইয়ে বাঁচানাের সামর্থ্য দেশ হারিয়ে ফেলে। ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে জনসংখ্যার ১২.৫% ভাগের জন্য খাদ্য আমদানি করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, একই সময়ে দেশ পরিণত১. নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১১ (পাদটীকা ৭ ও ৮)।২. জনৈক মার্কিন ছাত্র কর্তৃক চিলির সালভাদর আয়েন্দের সরকার উৎখাত ও সামরিক অভ্যুত্থানে (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩) নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাওয়া প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। (প্রথম আলাে, ১৮ এপ্রিল ২০০৩)

সংযােজিত হতে থাকে এবং অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে পরিণত হয় যাতে পরস্পর বিরােধী স্বার্থসম্পন্ন শ্রেণী ও ব্যক্তির সমাবেশ ঘটে। ফলে ‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ঐসব প্রগতিশীল কর্মসূচি বাস্তবায়নের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠে না, যদিও আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকে তারই হাতে। স্বাধিকারের আন্দোলন ১৯৭১ সালে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। সগ্রামটাকে ভাবা হয়েছিল জাতীয় পরিধিতে সীমাবদ্ধ, অভ্যন্তরীণ ব্যাপার; কিন্তু পরে দেখা গেলাে তা ঠিক নয় এবং বাইরের দুনিয়ার ভূমিকাও এর প্রতি নিরপেক্ষ নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে মাওবাদী চীন পাকিস্তানের পক্ষে এবং (তৎকালীন) সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়।মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই জনগণ প্রথম প্রকাশ্যে দেখতে পায় ‘বাঙালি-পাকিস্তানী বিরােধে পাকিস্তানী শক্তির সাথে সাম্রাজ্যবাদের গাঁটছড়া বাঁধা রয়েছে। ফলে স্বাধীনতার পর বৈদেশিক ক্ষেত্রে মুজিব সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়’ নীতি ঘােষণা করেও ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু এই সত্য মেনে চলতে শুরু করেন। এছাড়া ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ফোরামে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বক্তব্য (‘দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত-শােষক এবং শশাষিত; আমি শােষিতের দলে’) দিতে থাকেন। তবে পেটিবুর্জোয়া সীমাবদ্ধতার কারণেই মুজিব সে সময় দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক জরুরী কর্তব্য কি কি এবং কীভাবে তা সম্পাদন করা যায়, তা সঠিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম হন নি।সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু খাদ্য ও উন্নয়নের জন্য সে আবার সাম্রাজ্যবাদের উপরই নির্ভরশীল। কাজেই সাম্রাজ্যবাদের উপর অর্জিত বিজয়কে বিপদমুক্ত ও অপরিবর্তনীয় (irreversible) করার জন্য প্রয়ােজন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। আর বাংলাদেশের ভাগ্যোন্নয়ন মানে হলাে গ্রামের ভাগ্যোন্নয়ন। এজন্য প্রয়ােজন ছিল গ্রামীণ জীবনের বিকাশের পথ উন্মুক্ত করার জন্য গ্রামীণ সামাজিক কাঠামােতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন।মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মনে সৃষ্টি হয়েছিল বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা, আত্মত্যাগের মনােভাব ও দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করার প্রস্তুতি। সৃষ্টি হয়েছিল যুগান্তকারী সামাজিক পরিবর্তনের সূচনার উপযুক্ত মুহূর্ত। লক্ষাধিক বীর মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য থেকে উপযুক্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গঠন করা যেতাে প্রয়ােজনীয় কর্মীবাহিনী। কিন্তু স্বাধিকার/স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্তই মুজিবের আন্দোলনসংগ্রামের প্রয়ােজন ছিল। গরীব মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’-এগুলাে তার কাছে যুদ্ধ বা সংগ্রামের বিষয় বলে বিবেচিত হয়নি। তাই তিনি, অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার কাজে ফিরে যেতে মুক্তিযােদ্ধাদের আহ্বান জানান। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েতিনি রচনা করেন সংবিধান, অনুষ্ঠান করেন নির্বাচন এবং সময় ও শক্তি ব্যয় করেন বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয় সাধনে। পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ১৯৬৯-৭০ সালে আওয়ামী প্ল্যাটফরমে’ পরস্পর বিরােধী স্বার্থসম্পন্ন শ্রেণী ও ব্যক্তির সমাবেশ ঘটে। খন্দকার মােশতাক, শাহ মােয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে অনেকেই সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকরা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তারা দলের অভ্যন্তরেই ২৬ মার্চের ঘঘাষিত নীতির বিরােধী লবী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের শক্তিকে অবশ করে দেয়। উপরন্তু, তারা নিজেরা কিংবা তাদের আশীর্বাদপুষ্টরা নিয়ােজিত হন। আত্মস্বার্থ চরিতার্থতায়। পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল, লাইসেন্স-পারমিটবাজী, রেশন ও রিলিফ সামগ্রী চুরি থেকে শুরু করে চোরাচালান, মজুতদারী, কালােবাজারীপনা কিছুই। বাদ পড়লাে না। এসব কারণে ১৯ জন সাংসদ ও ৯ জন মন্ত্রীর পদও বাতিল করা হয়। | যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সৃষ্ট আত্মত্যাগের পটভূমিতে মানুষ মুজিবের ঘােষণা ‘আমি তােমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারব না মেনে নিতে সম্মত ছিল। কিন্তু কিছু লােকের দ্রুত পায়ে হাঁটা থেকে মার্সেডিজে আরােহণ’ সাধারণভাবে দেশে একটি দুঃখজনক হতাশার সৃষ্টি করে, স্বাধীনতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে, সর্বোপরি আওয়ামী লীগের উপর জনগণের আস্থার ফাটল ধরায়। | স্বাধীনতার পর কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাঙের ছাতার মতাে গজিয়ে উঠা বিভিন্ন সাপ্তাহিক, এনায়েত উল্লাহ খানের ‘হলিডে’, হােসেন ভ্রাতৃদ্বয়ের ইত্তেফাক” প্রভৃতি এবং পরাজিত পাকিস্তান ও মাওপন্থী রাজনীতিবিদরা মাওলানা ভাসানীর ছত্রছায়ায় মিলিত হয়ে আওয়ামী ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হয়। এ সময় গোদের উপর বিষফোড়ার ন্যায় ‘মুজিবের ভাবমূর্তির উপর জাসদের প্রচণ্ড আঘাত জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।’ ‘নিজের দলের লােক এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হওয়ায় তাদের পক্ষে মুজিবের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ করা সহজসাধ্য হয়। | মুক্তিযুদ্ধের পর পরই ভারতের আশ্রয় থেকে দেশে ফেরা প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, সমুদ্র বন্দরসমূহের মাইন অপসারণ, রেলসেতুসহ যােগাযোেগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এক কথায় স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি (১৯৭২ সালে জাতিসংঘের জরীপ অনুযায়ী তখনকার মূল্যে ১২০ কোটি ডলার) কাটিয়ে উঠা ছিল বড় কঠিন।৩. কিন্তু কারচুপি হওয়ায় নির্বাচন জনগণের বিশ্বাসযােগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয় নি ইত্তেফাক সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পরিশিষ্ট ১৫ পড়ুন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুজিব ধীরে হলেও ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। এ অভিযােগে বেশ ক’জন মন্ত্রী, সাংসদ ও দলীয় কর্মীর সদস্যপদ বাতিল করেন। কিন্তু যতই তাকে উৎখাতের সংগ্রাম তীব্র হয়। ততই তিনি নিজের দলের উপর নির্ভর করেন। ফলে দলকে দুর্নীতিমুক্ত করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় মুজিব বিরােধী নানা ধরনের চুটকিতে দেশ সয়লাব হয়ে যায়

মুজিব ভেবেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের মতাে সমাজতন্ত্র’ও ‘সকলকে নিয়েই। করা যাবে। যে সব বাঙালি’ পাকিস্তানী ২২ পরিবার হটে যাওয়ার পর তাদের কলকারখানা, ব্যবসায় দখলের আশায় আওয়ামী লীগে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন, জাতীয়করণ ও সিলিং’ ঘােষণার নীতিতে তারা অসন্তুষ্ট হয়। শুরুতেই মুজিব তাদের দমন না করে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি প্রাক্তন মালিকদেরই জাতীয়করণকৃত কারখানা পরিচালনায় নিয়োেগ করে উভয়কূল রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। | ভূমি সংস্কারের বেলায়ও একই ফল হলাে। পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা সিলিং নির্ধারণ করে উদ্বৃত্ত ভূমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টনের নীতি ঘােষণা করা হয়। কিন্তু দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের ভিত্তি হলাে মূলত গ্রামের অবস্থাশালী অংশ; যাদের অনেকেই শহরে উকালতিসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত কিন্তু গ্রামে নিজের বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে প্রচুর জমিজমার (অনুপস্থিত) মালিক। ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফের ঘােষণায় তারা খুশী হলেও ১০০ বিঘার ‘সিলিং’ ঘােষণায় তারা অসন্তুষ্ট হয়, (দেশে মানুষের তুলনায় ভূমির পরিমাণ এত কম যে, ১০০ বিঘার সিলিং প্রকৃত অর্থৈ কোন সিলিংই নয়)। কিন্তু তাদের সঙ্গে রাখতে মুজিব পরিবারের সংজ্ঞা পাল্টালেন। ফলে ভূমি সংস্কার হলাে না। অথচ দেশের সামনে উপস্থিত কর্তব্যের বিচারে শিল্পের জাতীয়করণের চাইতেও গ্রামীণ জীবনের বৈপ্লবিক পুনর্গঠন ছিল অধিক জরুরী। অন্যদিকে, ১৯৭৩ সালের (অক্টোবরে শুরু) আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের বিশেষ করে খাদ্যসহ অন্যান্য আমদানিকৃত পণ্যের দাম এক লাফে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মজুতদার-কালােবাজারীরা এর সুযােগ গ্রহণ করে মানুষের জীবন ও দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলে। অবৈধ অস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি এর সাথে যােগ হয়ে দেশ অরাজকতার দিকে এগুতে থাকে।এমতাবস্থায়, ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে অনন্যোপায় হয়ে সশস্ত্র বাহিনী তলব করা হয়। সামরিক-অভিযানে পেশাদার দুষ্কৃতকারীদের সাথে বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগারও ধরা পড়ে। স্থানে স্থানে শাসক দলের সাথে সামরিক বাহিনীর বিরােধ দেখা দেয় এবং দলীয় চাপে মুজিব অভিযান অসমাপ্ত রেখেই সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে১৫. একদিকে জাতীয়করণকৃত কল-কারখানা ও ব্যবসায় পরিচালনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর কালাে টাকা অর্জন করে তা সাদা করার জন্য ব্যক্তি পুঁজির উপর সিলিং উঠিয়ে দেয়া ও বিদেশী পুঁজির সাথে যৌথ বিনিয়ােগ আইনসঙ্গত করার দাবি জানায়; অন্যদিকে প্রাক্তন বাঙালি পাটকল মালিক সমিতি’ প্রভৃতি গঠন করে ইত্তেফাকের মাধ্যমে জাতীয়করণের কুফল প্রচার করে তা ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। উপরন্তু তারা অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অন্তর্ঘাতের জন্য পরিশিষ্ট ৭ পড়ুন। ১৬. পিতা জীবিতাবস্থায় বিবাহিত-অবিবাহিত সকল পুত্রদের নিয়ে এক পরিবার গণ্য করার বিধান পরিবর্তন করে বিবাহিত পুত্রকে আলাদা পরিবার এবং তার নামেও ১০০ বিঘা জমি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। স্মর্তব্য, জন্মকালে আওয়ামী লীগের দাবি ছিল ‘সকল জমি জাতীয় করণ করাফিরিয়ে আনেন। এতে সামরিক বাহিনী অপমানিত বােধ করে এবং জনগণও হতাশ হয়। সামগ্রীকভাবে সরকার, আওয়ামী লীগ ও মুজিবের উপর জনগণের আস্থাহীনতা আরও বৃদ্ধি পায়। এতদিন মুজিবের উপর মানুষের যে একটি শেষ ভরসা’ ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়। সামগ্রীক পরিস্থিতির কারণে মুজিবের নিজের নজীরবিহীন সক্রিয় জনসমর্থন পরিণত হয় নিষ্ক্রিয়তায় বা নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এ সুযােগে আওয়ামী লীগের ভেতর ও বাইরের উচ্চাভিলাষীরা ২৬ মার্চ ১৯৭২-এর প্রগতিশীল কর্মসূচিকে চ্যালেঞ্জ করে। এ রকম পরিস্থিতিতে জুন ১৯৭৪ এ শতাব্দির দীর্ঘস্থায়ী প্রলয়ঙ্করী বন্যায় প্লাবিত হয় বাংলাদেশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল নিঃশেষিত। সরকারি খাদ্যের গুদাম শূন্য।” ধনবান ব্যক্তিবর্গ ও মজুতদারদের গােলার সংরক্ষিত খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে তা পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ মােকাবেলা করার নৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি ততদিনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও ব্যক্তি হিসেবে মুজিবের অবশিষ্ট নেই। সকলের চোখের সামনে অনাহার ক্লিষ্ট অসহায় মানুষ মুখে ফেনা তুলে ঢলে পড়তে লাগলাে মৃত্যুর কোলে। লাশে ছেয়ে গেলাে রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঢাকার রাজপথ। জুলাই মাসে (১৯৭৪) সরকার তার নীতি সংশােধন করে ব্যক্তি পুঁজির সিলিং ২৫ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করে, বিদেশী পুঁজির সাথে যৌথ বিনিয়ােগের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং বিশ্ব ব্যাংকের কাছে চিঠি লিখে কনসর্টিয়াম গঠনে তার সম্মতির কথা জানায়। কিন্তু বেকায়দায় পড়ে গৃহিত মুজিবের এসব আপােস সাম্রাজ্যবাদকে খুশী করতে পারে না, বরং এ নাজুক অবস্থা থেকে অধিক সুবিধা আহরণে সে (সাম্রাজ্যবাদ) তৎপর হয়। দুর্ভিক্ষের পর সরকার বা মুজিবের প্রতি মানুষের আর কোনই উৎসাহ রইলাে না। অন্যদিকে, প্রায় তিন বছরের দেশ শাসনের অভিজ্ঞতায় মুজিব দেখলেন, “দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে তাে দূরের কথা, তিনি তাদের অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকেই বাঁচাতে পারছেন না। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিনি ১৯৭৫ সালের শুরুতে নতুন পথে দেশ চালানাের এক বিতর্কিত (বাকশাল) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। এভাবেই মুজিবকে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অপসারণের পটভূমি সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ কয়েক বছরের অনুসন্ধান এবং দু’শরও বেশি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মুজিব হত্যার নেপথ্য-কাহিনী সম্পর্কে জনৈক বিদেশী সাংবাদিক বলেন : ১৮…ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসে সে-সময় কর্মরত মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার থেকে এবং অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত বাঙালি মহল থেকে পাওয়া নতুন তথ্য থেকে দেখা যায় যে, শুধু যে শেখ মুজিবকে হত্যা এবং উৎখাতকারী এই কু সম্বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব থেকেই অবহিত ছিল, তাই নয়; ঘটনার ছয় মাস১৭. মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশের কেনা গম পাঠাতেও ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করে ক্ষুধার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৮আগেই মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত ব্যক্তিদের সাথে শেখ মুজিব উচ্ছেদের এই ষড়যন্ত্রে (Plot) জড়িত ব্যক্তিদের আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারকে উৎখাত করতে মনস্থ ব্যক্তিরা আমেরিকান দূতাবাসের সাথে যােগাযােগ করে।…১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে তাদের পর পর অনেকগুলাে বৈঠক (a series of meetings) অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কূটনৈতিক এবং বৈদেশিক দপ্তরের কর্মকর্তা পর্যায়ে যােগাযোগটা বিচ্ছিন্ন। করা হলেও এই যােগসাজশটা অধিগ্রহণ করে চালিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকান দূতাবাসের সি.আই.এ, স্টেশন-প্রধান ফিলিপ চেরী এবং স্টেশনের অন্য এজেন্টদের মাধ্যমে। তিনি আরও জানান যে, সরকারিভাবে শেখ মুজিব হত্যা এবং তার সরকারের উৎখাতটাকে শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ সামরিক অফিসারদের কাজ বলে চিত্রিত করা হয়। এটা একটা বিশুদ্ধ ‘গল্প’ (Myth), যদিও অনেকের কাছে এই গল্পটাই সত্যের স্থান দখল করে আছে।” | কিন্তু প্রকৃত সত্য হলাে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঘাতক মেজরবৃন্দ এবং সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছা ও কর্ম এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে এই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। কলামবিদ গাছপাথরের (অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) ভাষায় :শেখ মুজিবুর রহমান যে, একজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন এমন দাবি করার দরকার নেই। কিন্তু তিনি যে পূজিবাদের পক্ষে তেমনভাবে কাজ করছিলেন না-যেমনভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদীরা চাইছিল-সেটা মানতেই হবে। তাকে তাই সরে যেতে হয়েছে অতি দ্রুত।১৯. নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১০ সময় বহিয়া যায়, সংবাদ, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯০।
স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র (অনূদিত]। মুজিবনগর, বাংলাদেশ ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন, এবং যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার জন্য আহ্বান করেন, এবং যেহেতু এই আহূত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়, | এবং যেহেতু পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং | বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলােচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও। বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘােষণা করে, এবং যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগত অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬ শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান, ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগরে ঘােষিত ও জারিকৃত এবং ২৩ মে ১৯৭২ বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত এবং যেহেতু একটি বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনায় পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ, অন্যান্যের মধে বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের উপর নজিরবিহীন নির্যাতন ও গণহত্যার অসংখ্য অপরাধ সংঘটন করিয়াছে এবং এখনও অনবরত করিয়া চলিতেছে, এবং যেহেতু পাকিস্তান সরকার একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়া, গণহত্যা করিয়া এবং অন্যান্য দমনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের পক্ষে একত্রিত হইয়া একটি সংবিধান প্রণয়ন এবং নিজেদের জন্য একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, এবং যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী উদ্দীপনার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের উপর তাহাদের কার্যকর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, [সেহেতু আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম, এবং পারস্পরিক আলােচনা করিয়া, এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘােষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘােষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমােদন করিলাম, এবং | এতদ্বারা দৃঢ়ভাবে ঘােষণা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, সংবিধান প্রণীত না। হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থকিবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রয়ােগ করিবেন, | একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ এবং তাহার বিবেচনায় প্রয়ােজনীয় অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ােগ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, কর আরােপন ও অর্থ ব্যয়ন ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, গণপরিষদ আহ্বান ও মূলতবীকরণ ক্ষমতার অধিকারী হইবেন, এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় অন্যান্য সকল কার্য করিতে পারিবেন। আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, কোন কারণে রাষ্ট্রপতি না থাকা বা রাষ্ট্রপতি তাহার কার্যভার গ্রহণ করিতে অসমর্থ হওয়া বা তাহার ক্ষমতা প্রয়ােগ করিতে অসমর্থ হওয়ার ক্ষেত্রে, রাষ্ট্রপতির উপর এতদ্বারা অর্পিত সমুদয় ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপতির থাকিবে এবং তিনি উহা প্রয়ােগ ও পালন করিবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, জাতিমন্ডলীর সদস্য হিসাবে আমাদের উপর যে দায় ও দায়িত্ব বর্তাইবে উহা পালন ও বাস্তবায়ন করার এবং জাতিসংঘের সনদ মানিয়া চলার প্রতিশ্রুতি আমরা দিতেছি।। আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘােষণাপত্র ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, এই দলিল কার্যকর করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য আমরা অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে আমাদের যথাযথ ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি নিয়ােগ করিলাম। অধ্যাপক ইউসুফ আলী বাংলাদেশের গণপরিষদের ক্ষমতাবলে ও তদধীনে যথাযথভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি।
হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিল INSTRUMENT OF SURRENDER SIGNED AT DACCA AT 16-31 HOURS (IST)ON 16 DEC 1971The PAKISTAN Eastern Command agree to surrender all PAKISTAN Armed forces in BANGLADESH to Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Conmanding in Chief of the Indian and BANGLADESH forces in the Eastern Theatre. This surrender includes all PAKISTAN land, air and naval forces as also all para-military forces and civil armed forces. The forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA.The PAKISTAN Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA as soon as this instrument has been signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of the surrender terms and will be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of the surrender terms.Lieutenant-General JAGJIT SINGH AURORA gives a solemn assurance that persennel who surrender shall be treated with dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with the provisions of the GENEVA Convention and guarantees the safety and well heing of all PAKISTAN military and para-military forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personel of WEST PAKISTAN origin by the foreces under the command of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA.(JAGJIT SINGH AURORA)Lieutenant-General General Officer Commanding in Chief Indian and BANGLADESH Forces inthe Eastan Theatre 16 Decomber 1971(AMIR ABDULLAH KHAN NIAZI)Lieutenant-General Martial Law Administrator Zone B and Commander Eastar Command (PAKISTAN)16 Decomber 1971আত্মসমর্পন দলিলে ভারতীয় মান সময় ১৬-৩১ ঘণ্টা উল্লিখিত। লে. জে. নিয়াজি অশ্রুসজল। চোখে তার বেল্ট ও ব্যাজ খুলে ৩৮ বােরের রিভলবার লে, জে, অরুরার হাতে সমর্পন করে যখন দলিলে স্বাক্ষর করেন তখন বাংলাদেশ মান সময় (BST) ১৬-৫৫ ঘণ্টা
ভারত-বাংলাদেশ মেত্রী চুক্তি
অনুচ্ছেদ এক। চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ স্ব স্ব দেশের জনগণ যে আদর্শের জন্যে একযােগে সংগ্রাম এবং স্বার্থ ত্যাগ করছেন, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মর্যাদার সঙ্গে ঘােষণা করছেন যে, উভয় দেশ এবং তথাকার জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও মৈত্রী বজায় থাকবে। একে অপরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষে উল্লেখিত নীতিমালার ভিত্তিতে এবং পারস্পরিক সমতা ও সম্মানজনক নীতিসমূহের ভিত্তিতে উভয় দেশের মধ্যেকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সুপ্রতিবেশীসুলভ সার্বিক সহযােগিতার সম্পর্কের আরাে উন্নয়ন জোরদার করবে। অনুচ্ছেদ দুই জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি, সমতার নীতিতে আস্থাশীল থাকার আদর্শে পরিচালিত হয়ে চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ সর্ব প্রকারের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের নিন্দা করছে এবং তাকে চূড়ান্তভাবে ও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্যে প্রচেষ্টা চালানাের ব্যাপারে তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা পুনরুল্লেখ করছে। চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ উপরােক্ত অভীষ্ট সিদ্ধির জন্যে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযােগিতা করার এবং উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবিরােধী সংগ্রামে জনগণের ন্যায়সঙ্গত আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সমর্থন দান করবে। অনুচ্ছেদ তিন। বিশ্বের উত্তেজনা প্রশমন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব। ও স্বাধীনতা মজবুত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জোটনিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি তাদের অবস্থার পুনরুল্লেখ করছে। অনুচ্ছেদ চার উভয় দেশের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী নিয়ে। চুক্তিকারী উভয় পক্ষ সকল স্তরে বৈঠক ও মতবিনিময়ের জন্যে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করবে।
অনুচ্ছেদ পাঁচ
চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে পারস্পরিক সুবিধাজনক ও সর্বাত্বক সহযােগিতা শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত করবে। উভয় দেশের ক্ষমতা ও পারস্পরিক সুবিধানীতি ভিত্তিক বাণিজ্য, পরিবহন ও যােগাযােগের ক্ষেত্রে সহযােগিতা প্রসারিত করবে।
অনুচ্ছেদ ছয়
বন্যানিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুৎ শক্তি ও সেচব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ অভিন্ন মত পােষণ করে।
অনুচ্ছেদ সাত
চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ শিল্পকলা, সাহিত্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন সাধন করবে।
অনুচ্ছেদ আট
দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান গুরুত্বপুর্ণ সম্পর্ক অনুযায়ী চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ প্রত্যেকে মর্যাদার সঙ্গে ঘােষণা করছে তারা একে অপরের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোনাে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না বা অংশ নেবে না। অন্যের উপর আক্রমণ থেকেও নিবৃত্ত থাকবে এবং তাদের এলাকায় এমন কোনাে কাজ করতে দেবে।
যাতে চুক্তিকারী কোনাে পক্ষের ক্ষতি হতে পারে বা তার কোনাে পক্ষের নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অনুচ্ছেদ নয়
কোনাে এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় কোন পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তিকারী প্রত্যেকে এতদোল্লেখিত তৃতীয় পক্ষকে যে কোনাে প্রকার সাহায্য দানে বিরত থাকবে। তা ছাড়া যে কোন পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সেই আশঙ্কা নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা নিতে উভয়পক্ষ সঙ্গে সঙ্গে আলােচনায় মিলিত হয়ে নিজেদের দেশের শক্তি এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে।
অনুচ্ছেদ দশ
চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ ঘােষণা করছে, এই চুক্তির পক্ষে অসামঞ্জস্য হতে পারে এমন গােপন বা প্রকাশ্য এক বা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে উভয়ের কেউই। কোনাে অঙ্গীকার করবে না।
অনুচ্ছেদ এগারাে
এই চুক্তি পঁচিশ বছরের মেয়াদের জন্যে স্বাক্ষরিত হলাে। চুক্তিকারী উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানাে যেতে পারে। অত্র চুক্তি সই করার দিন থেকে কার্যকর হবে।
অনুচ্ছেদ বারাে
এই চুক্তির কোনাে একটি বা একাধিক অনুচ্ছেদের বাস্তব অর্থ করার সময় চুক্তিকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোনাে মতপার্থক্য দেখা দিলে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বােঝাপড়ার মনােভাবের দ্বারা শান্তিপূর্ণ আলােচনায় নিষ্পত্তি করতে হবে।
১. ১৯ মার্চ ১৯৭২ ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ১৮ মার্চ ১৯৯৭ এর মেয়াদ শেষ হয় এবং কোন পক্ষই তা নবায়নের উদ্যোগ নেয়নি

খন্দকার মােশতাকখন্দকার মােশতাক আহমেদ ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট ও পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের এ্যাডভােকেট। জন্ম কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। পিতা পীর খন্দকার কবির উদ্দিন আহমেদ। গড়ন হালকা-পাতলা, উচ্চতা মাঝারি, মাথায় অবাঙালি-সুলভ ‘নেহেরু টুপি। চেহারায় ধূর্ততার আভাস। তিনি কথা বলতেন মন জুগিয়ে। গাফফার চৌধুরীর। বর্ণনায়, তার ছিল মাথায় টুপি, মুখে মধু, মনভরা ছলনা। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার স্বামীবাগে রােজ গার্ডেনে (কাজী মুহাম্মদ বশীর হুমায়ুনের বাসভবন) ৩০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি বিরােধী রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সম্পাদক করে ৪০ সদস্যের একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। খন্দকার মােশতাক ও শেখ মুজিব-উভয়ই কমিটিতে যুগ্ন-সম্পাদক নির্বাচিত হন। (মুজিব তখন জেলে। যুগ্ম সম্পাদকদের মধ্যে মােশতাকের নামটি মুজিবের আগে উল্লিখিত হওয়ায়, মােশতাক নিজেকে মুজিবের সিনিয়র বলে প্রচার করার প্রয়াস পায়। কিন্তু ১৯৫৩ সালে মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত প্রথম কাউন্সিল সভাতে মুজিব মােশতাককে ডিঙ্গিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন)। | ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনয়ন না পেয়ে মােশতাক স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন (মনােনয়ন না পাওয়ার পেছনে মুজিবের হাত ছিল বলে গুজব ছিল) এবং আইন পরিষদের হুইপ পদ পাওয়ার লােভে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যােগ দেন। | ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করার সময় আবদুস সালাম, খন্দকার মােশতাক প্রমুখ এর বিরােধিতা করেন এবং নাজিমুদ্দিন রােডে আলাদা ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘ চালু রাখেন। এদের নিকট দলটি আওয়ামী শব্দ যুক্ত মুসলিম লীগের বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু তাদের সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন অপরিবর্তিত মুসলিম-লীগার’। ১৯৬৪ সালে মােশতাক যখন পুনঃ আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন তখন তার ‘অবস্থান’ চলে যায় বেশ পেছনে। কেননা ততদিনে কামারুজ্জামান, নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, তাজউদ্দিন প্রমুখ নিজেদেরকে দলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগে আবার ভাঙন দেখা দেয়। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ-সালাম খান প্রমুখ অপর একটি আওয়ামী লীগের (পিডিএম বা ৮ দফাপন্থী) জন্ম দেন। সহ-সভাপতি খন্দকার মােশতাক এঁদের সাথে যােগ দেন ; কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে আবার মুজিবের নেতৃত্বাধীন মূলদলে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯১টি এবং প্রদত্ত ভােটের ৭২ শতাংশ লাভ করে। অথচ মােশতাক মাত্র ৭০০ ভােটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। তাও সম্ভব হয়েছে শেষ মুহূর্তে মুজিব তার নির্বাচনী এলাকা সফর করেছেন বলে। একজন পুরনাে সহকর্মীর বিজয় নিশ্চিত করতে পেরে মুজিব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু মােশতাক মুজিবের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষায় কাতর হন। | ২৪ মার্চ বিকাল থেকে ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত সাক্ষাৎ করতে আসা সকলকে মুজিব আত্মগােপনের পরামর্শ দেন। সকলেই সে-মতে আত্মগােপন করেন এবং কারফিউ শিথিলের প্রথম সুযােগে ঢাকা ত্যাগ করে প্রথমে গ্রামাঞ্চলে ও পরে ভারত গমন করেন। অথচ জাতীয় পরিষদের স্পিকার পদপ্রার্থী মােশতাক নির্বিঘ্নে তার বাসায় অবস্থান করেন। ২৮ মার্চ বন্ধু ডা. টি. হােসেন তাকে সেখান থেকে তার নার্সিংহােমে নিয়ে যায়। জনৈক অবাঙালি ডা. রব তাকে দেখার পরও তিনি সেখানে প্রায় ১০ দিন অবস্থান করেন এবং ১০ এপ্রিল ঐ টি, হােসেনই তাকে আগরতলায় নিয়ে যান। | আওয়ামী লীগের দলীয় ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক সভা ১১ এপ্রিল আগরতলায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সভাতেই মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করা হয়। মােশতাক তথাকথিত “সিনিয়রিটির দাবিতে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে-সম্ভাবনা তিরােহিত দেখে তিনি আক্ষেপ করে বলেন আমাকে আর কী দরকার? আমাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। সারারাত ধরে শলাপরামর্শের পর শেষ পর্যন্ত পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার শর্তে তিনি মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হন। মােশতাকের দাবি অনুযায়ী মাহবুবুল আলম চাষী ও তাহেরুদ্দিন ঠাকুরকে আগরতলা থেকে কলকাতায় আনা হলে চাষীকে তিনি পররাষ্ট্র সচিব পদে নিয়ােগ। করেন। তিনি বাংলাদেশ মিশন’ থেকে পররাষ্ট্র ব্যতীত অন্যান্য বিভাগ সরিয়ে দেন। তাজউদ্দিনের সাথে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ভিন্ন। মনােভাব, যে-কোনাে কারণেই হােক না কেন, মােশতাক মুজিবনগর সরকারের অনেক কাজেই বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে শেখ মণিসহ যুবনেতাদের উসকিয়ে দেন। যুদ্ধ চলাকালে তার ভাবশিষ্য তাহের ঠাকুর স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের দিয়ে ধর্মঘট করার ‘পাকা ব্যবস্থা করে ব্যর্থ হন। | হানাদার কবলিত বাংলাদেশে যখন আমেরিকার অস্ত্রে ও সমর্থনে মরমেধ যজ্ঞ চলছিল, কলকাতার সার্কাস এভেনিউতে তখন সেই আমেরিকার সরকারি ও বেসরকারি নানা সাহায্যসংস্থা দানছত্র খুলে বসেছিল। বিদেশীদের ভিড়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে১. কর্নেল তাহেরের বিশ্লেষণ, মােশতাকের কোনাে রাজনৈতিক ভিত ছিল না, একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া সমগ্ন সেনাবাহিনীতে তার সমর্থন ছিল না এবং জনগণের মধ্যেও তার সমর্থন ছিল না। (এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৮-২৯) আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৬ঢােকা মুশকিল ছিল। ওদের অধিকাংশই মার্কিন সাংবাদিক, সেবা ও সাহায্যসংস্থার কর্মকর্তা। এদের সার্বক্ষণিক সাথী হলেন মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের ঠাকুর, হােসেন আলী, আর,আই. চৌধুরি, আনােয়ার চৌধুরি জয়, আমিনুল হক বাদশা, কর্নেল ওসমানী প্রমুখ এবং অবশ্যই ওদের নেতা খন্দকার মােশতাক। কিছুদিনের মধ্যে জানা গেল, সরকারের গােপন ফাইলের বিষয়বস্তু ফাস হয়ে আমেরিকা, পাকিস্তানে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেখা গেল, মুজিবনগর প্রশাসনের একটা শক্তিশালী অংশ ভারত ও সােভিয়েট-বিরােধী সূক্ষ্ম প্রচারণা এবং গুজব ছড়াতে ব্যস্ত। তাজউদ্দিনের ভাষায়, ‘শত্রু এখন বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকেছে। ওরা ঔষধ, দুধ, কম্বল, নগদ টাকা, বিদেশ ভ্রমণের টিকেট প্রভৃতি দিয়ে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, মিলিটারি ও মুক্তিযােদ্ধাদের নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলার চেষ্টা করে। সরকারের মধ্যে তাদের গ্রুপ’ তৈরি করে। বেনামা প্রচারপত্র প্রকাশ করে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিলি করে। আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ এবং যুব অংশের বাংলার বাণী থাকার পরও মােশতাক ‘অভিযান’ নামে নিজের একটি পত্রিকা বের করেন। পত্রিকাটিতে অতিকৌশলে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও তাজউদ্দিনবিরােধী প্রচারণা করা হত। মুক্তিযুদ্ধ যখন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নিতে চলেছে তখন মােশতাক গ্রুপ ‘স্বাধীনতা, না মুজিব?’ শিরােনামে একটি প্রচারপত্র মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিলি করেন। প্রচারপত্রটির বক্তব্য ছিল :আমরা যদি পাকিস্তানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করি, তাহলে পাকিস্তানিরা। কারাগারে শেখ মুজিবকে হত্যা করবে। শেখ মুজিবকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে। সুতরাং স্বাধীনতার আগে মুজিবের মুক্তি দরকার এবং মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সাথে আলাপ-আলােচনা দরকার। প্রচারপত্রটি মুক্তিযােদ্ধাসহ সকল মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। একই সাথে তারা কৌশলে গুজব ছড়ালেন যে, তাজউদ্দিন পাকিস্তানের সাথে কোনাে আলাপ-আলােচনাসমঝােতা চান না, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান কারণ তিনি চান জেলে শেখ মুজিবের মৃত্যু হােক। তাহলে তিনি নির্বিঘ্নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদটি স্থায়ীভাবে পাবেন, ভাগ্যবিধাতা হবেন। (এ প্রচারণাটি স্বাধীনতার পর বেগম মুজিব এবং মুজিবের কানেও তােলা হয়। তাজউদ্দিনের সাথে মুজিবের সম্পর্কের অবনতিতে এটি কোনাে ভূমিকা রেখেছে কিনা, গবেষকরা তা খুঁজে দেখতে পারেন। মােশতাক এ প্রচারণার মাধ্যমে তাজউদ্দিন ও স্বাধীনতা উভয়ের বিরােধিতা করে এক ঢিলে দু-পাখিই মারতে চেয়েছিলেন)।জাতিসংঘের লবিতে বাংলাদেশের বক্তব্য পেশ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে মােশতাকের নিউইয়র্ক যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তার সচিব মাহবুবুল আলম চাষী কর্তৃক২. আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪ওয়াশিংটনে প্রেরিত একটি গােপন বার্তা ধরা পড়ে। বার্তায় পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে মার্কিন সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে আলােচনা শুরু করার জন্য ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাজউদ্দিন সাথে সাথে চাষীকে বরখাস্ত করেন, মােশতাকের নিউইয়র্ক যাত্রা বাতিল করেন এবং তার বদলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘ লবিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার নির্দেশ দেন। এ ঘটনার পরও সৈয়দ নজরুলের আনুকূল্যে মােশতাক বেঁচে যান। তবে মন্ত্রী থাকলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজে তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয় এবং স্বাধীনতার পরপর ২৯ ডিসেম্বর তার হাতে আইন মন্ত্রণালয় রেখে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। আমেরিকার সাথে মােশতাক গংদের যােগাযােগ প্রসঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জার বলেন : We established contact with the Bangladesh people in Calcutta and during August, September and October of this Year (1971), no fewer than eight such contacts took place. We approached President Yahya Khan three times in order to begin negotiations with Bangladesh people in Calcutla. The government of Pakistan accepted. মােশতাক গং শেষদিকে এত মরিয়া হয়ে গিয়েছিল যে, ১৩ ডিসেম্বর বরখাস্তকৃত চাষী মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব স্বাক্ষরের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের কাছে নিয়ে যায়। অথচ পরিস্থিতি তখন এমন পর্যায়ে যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক স্বাক্ষর করা হলেও যুদ্ধবিরতি তখন সম্ভব হত না। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ মুজিব তার সােনার বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। সবাই করমর্দন, কোলাকুলি করলেও মােশতাক অতিরিক্ত একটি চুম্বন দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। | ৩১ মে ১৯৭৪ মুজিবের মা সায়রা খাতুন মারা যান। মুজিব তার মায়ের জন্য যতনা কাঁদলেন, তারচেয়ে বেশি কাদলেন মােশতাক। মায়ের দাফন কাজে টুঙ্গীপাড়ায় মুজিবের সফরসঙ্গী হলেন মােশতাক ও তাহের ঠাকুর। আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকায় হেলিকপ্টার কয়েকঘন্টা আকাশে উড়তে পারেনি। ফলে তাদের পৌছতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়। মুজিব মাকে স্পর্শ করতে চাইলে তার বড়বােন মিসেস ফাতেমা অনুমতি দিলেন না। কিন্তু মােশতাক অলক্ষে কাছে গিয়ে খালাম্মার মাথা স্পর্শ করেন। সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাঙালি মােরারজী’ মােশতাক ছিলেন মুজিবের ‘ছায়া-সহচর। যখন তখন তিনি মুজিবের বাড়িতেও যেতেন। তিনি ছিলেন মুজিবের সকল ছেলেমেয়ের বিশেষ করে রাসেলের খুব প্রিয় চাচা। মুজিবের সামনে তিনি থাকতেন ভেজা বেড়াল হয়ে, বলতেন মন ভেজানাে কথা। এসবের পুরস্কারও তিনি৪. ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯০ India Pakistan, Background briefing with Henry A. kissinger on December, 1971, Congressional record, December-9, 1971, Page 15735, মঈদুল হাসানের মূলধারা গ্রন্থে উদ্ধৃত ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯০পেয়েছেন। বহুবার তার বহু অন্যায় মুজিব ক্ষমা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচার না করে মুজিব তাকে আইনমন্ত্রী থেকে প্রমােশন দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী করেন। বাণিজ্যে তার লক্ষ্মীর বসতি হয়েছিল। ধর্মের ধ্বজাধারী হয়েও তিনি ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অবশেষে জড়িয়ে পড়েন মুজিবকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ষড়যন্ত্রে। মুজিব-হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের মূল কৌসুলি সিরাজুল হক তার ফিরতি আরগুমেন্টের সমাপ্তিকালে বলেন, মােশতাক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তিন আর্মি অফিসারকে নিয়ে কুমিল্লায় ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত করে, পরে ঢাকায় তা বাস্তবায়ন করা হয় ১৫ আগস্ট পঁচাত্তরে।’ মামলার অন্যতম আসামি তাহের , রশিদ, ফারুক ও সাক্ষী অধ্যাপক খুরশিদ আলমের বক্তব্য থেকে জানা যায়, মােশতাক ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা কুমিল্লার বার্ড, মােশতাকের গ্রামের ও ঢাকার বাড়ি, মন্ত্রণালয়, গাজীপুরের সালনা প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন সময় মিলিত হয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে। মােশতাকের মুজিব-হত্যা পরবর্তী কার্যক্রম থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। | ১৯৭৫ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে মােশতাকের চোখে ঘুম ছিল।। সেদিন তার ৫৪ নম্বর আগা মসীহ্ লেনের বাড়িতে অনেকের মধ্যে মেজর রশিদ ও তাহের ঠাকুর এসেছিলেন। কোনাে ফোন এলে তিনি নিজেই রিসিভার উঠাচ্ছিলেন, সীমাহীন অস্থিরতায় নিজেকে ঠিক রাখার জন্য তিনি দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। রাতে গােসল করে তিনি যেন কোথায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। অবশেষে তার প্রতিক্ষার অবসান হল পরদিন সকাল সাড়ে ৭টায়। একটা ট্যাঙ্ক পেছনে নিয়ে রশিদের জিপ এসে থামে তার বাড়ির সামনে। ডালিমের মারাত্মক বেতার ঘােষণা ইতােমধ্যে প্রচার হয়ে গিয়েছে। তিনি নেমে এলেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘রেডিও অফিসে যাওয়ার জন্য। এর আগে রশিদের আগমনের উদ্দেশ্য পরীক্ষার করে নেন নানা নাটকীয়’ কৌশলে। | তাহের ঠাকুর তার আগেই রেডিওতে পৌছে প্রেসিডেন্টের ভাষণ রচনায় নিয়ােজিত হন। সামরিক ও পুলিশবাহিনী প্রধানদের ওকালতি বুদ্ধিতে ফাঁদে ফেলে। মােশতাক ‘বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের সম্মতি ও আনুগত্য আদায় করে। নেন এবং বেতারে তা প্রচার করাতে থাকেন। বেলা ১১-১৫ মি, তিনি নিজে ভাষণ দেন এবং বলেন, সকলেই এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছিল। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে তা সম্ভব ছিলনা বলে ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে সেনাবাহিনী এগিয়ে এসে জনগণের জন্য সুযােগের স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলার পরিবর্তে ‘পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে তিনি ভাষণ শেষ করেন। সামরিক আইন ও কাফু জারি করা হলেও দুপুরে জুম্মার নামাজের জন্য তা শিথিল করা হয়।৭. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬৮ এ এল খতিব, কারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০সব মিলিয়ে একটা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর মােশতাক দায়িত্ব গ্রহণের ১ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। অল্পসময়ের মধ্যে মােশতাক তার বিশেষ দূত হিসেবে দালাল পীর দুদু মিয়াকে পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। এছাড়া শফিউল আজম, তােবারক হােসেন, সালাহউদ্দিন, এবিএম সফদর প্রভৃতি দালালকে গুরুত্বপুর্ণ সরকারি দায়িত্বে নিয়ােজিত করেন। পাকিস্তানি পােশাকের সাথে তার টুপি যােগ করে জাতীয় পােশাক’ প্রবর্তন করেন। এসব তার ১৯৭১ -এর অতৃপ্ত বাসনার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে, তার বিরােধী বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের ফাঁসিতে ঝােলানাের জন্য মােশতাক একটি ফরমান জারি করেন। এতে বলা হয়, কোনাে ব্যক্তি যদি দুর্নীতি করে বা কারাে বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ ওঠে (reputed to be corrupt) তাহলে তাকে বিচারপূর্বক মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। | বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘােষণা না করায় এবং মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগাররাই নিয়ােগ পাওয়ায় মানুষ এই হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্রপতি পদে মােশতাকের অধিষ্ঠান ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছিল না। বরং ক্রমে মানুষের মনে মুজিবের প্রতি সহানুভূতি বাড়তে থাকে। ২৪ সেপ্টেম্বর তার চল্লিশার দিনের ‘গুরু গম্ভীরতা হত্যাকারীদের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশের নামান্তর হিসেবে বিবেচিত হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর “দি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫-এর মাধ্যমে হত্যাকারীসহ হত্যার পরিকল্পনা, কুমন্ত্রণা প্রভৃতির সাথে যুক্ত সকলকে বিচারের হাত থেকে রেহাই দেয়া হয়। তবে এটি করা হয় গােপনে। তাছাড়া ৩ অক্টোবর প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে তিনি খুনীদের ‘সেনাবাহিনীর সাহসী সূর্যসন্তান বলে প্রশংসা করা ছাড়াও ডালিম, ফারুক আর রশিদকে প্রমােশন দিয়ে লে. কর্নেল পদে উন্নীত করেন। এসব কাজে মুজিব হত্যায় মােশতাকের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়। মীরজাফর শব্দটি যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশব্দে রূপান্তরিত হয়েছে; মােশতাক শব্দটিও প্রায় অনুরূপ ব্যঞ্জনার দ্যোতক। আবদুল গাফফার চৌধুরী ক্লাইভের ওপর লেখা একটি প্রাচীন বই পাঠ করতে গিয়ে মীরজাফরের চারিত্রিক ও শারিরীক বৈশিষ্ট্যের সাথে মােশতাকের বিস্ময়কর মিল দেখে চমকে উঠেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরও কিছু মিলের সন্ধান পেয়েছেন। যেমন : সিরাজ-হত্যা আর মুজিব-হত্যার ষড়যন্ত্রের সূচনা একই এলাকায়, পুরনাে ঢাকায় আগামাসিহ লেন-নওয়াব গঞ্জে। পলাশীর ‘৫৭ কে উল্টিয়ে সাজালেই হয় ‘৭৫। মাঝখানে ২১৮ বছরের ব্যবধান। তাই পাত্রপাত্রীর বদল, কিন্তু নাটক একই।৯. ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রদত্ত ভাষণে মােশতাক বলেন, ‘এই সরকার কখনও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কিংবা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আপস করবে না। কিন্তু মাত্র ৮৩ দিনের ক্ষমতাচ্যুতির পর তিনি দুর্নীতির অভিযােগে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভােগ করেন। (এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১০)।
জিয়াউর রহমান জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বগুড়া জেলার গাবতলী থানার মহিষাভান গ্রামের মনসুর রহমান ছিলেন একজন রসায়নবিদ এবং মা জাহানারা খাতুন একজন গায়িকা। পিতার কর্মস্থল করাচি থেকে ১৯৫২ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন এবং ১৯৫৩ সালে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যােগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি দ্বিতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশন পান। পরে তাকে ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। পড়াশােনায় তেমন মেধার পরিচয় দিতে না পারলেও ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। লাহােরের খেমকারান সেক্টরে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিতে তিনি কমান্ডার হিসেবে সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব | দেন। শত্রুবাহিনীর একটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে তার বাহিনী দ্বিতীয় বীরত্ব পদক পায়। কমিশন পাপ্তির ৪ বছর পরই বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে গােয়েন্দা-বিভাগে নিয়ােগ করা হয়। সেখানে তিনি ১৯৫৯-৬৪ পর্যন্ত ৫ বছর কাজ করেন। তিনি রাইনে অবস্থানরত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথেও তিনমাস কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে তাকে মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষক নিয়ােগ করা হয়। এ সময় প্রশিক্ষণরত ফারুক ও রশিদের সাথে তার পরিচয় হয়। ইতােমধ্যে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পান এবং ১৯৭০ সালে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড কমান্ডার হিসাবে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করে তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কিছুদিন ১নং সেক্টরের কমান্ডার ও পরে ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যুদ্ধশেষে তাকে বীরােত্তম পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭২ সালে তিনি কর্নেল, ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার ও শেষদিকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে (২০ আগস্ট) তিনি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। সাহসিকতা, ব্যক্তিগত সততা ও ভদ্র ব্যবহারের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন। জনপ্রিয় অফিসার। এজন্য তার পদোন্নতিও ঘটে অসম্ভব দ্রুতগতিতে। ১৯৭১ সালের মার্চে ‘অসহযােগ’ চলাকালে ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে আলােচনার নামে সময়ক্ষেপনের সুযােগে নানাভাবে সৈন্য, অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে মজুদ করছিল। তাদের পরিকল্পিত অভিযানকে নির্বিঘ্ন করার জন্য তারা বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রখম পদক্ষেপহিসেবে ১৯ মার্চ ১৯৭১ জয়দেবপুরে (গাজীপুর) অবস্থানরত এক ব্যাটালিয়ান বাঙালি সৈন্যকে কর্তৃপক্ষ অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলে ২২ মাইল দূরবর্তী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল পাঞ্জাবি সৈন্য বাঙালিদের নিরস্ত্র করতে সেখানে পৌছে। এ খবর বিদ্যুৎবেগে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে ছড়িয়ে পড়ে এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হকের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের পক্ষে রাস্তায় নেমে এসে স্থানে স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে গােলাগুলি শুরু হয় এবং কমপক্ষে ২০ জন এতে নিহত হয়। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে পাক-বাংলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এমতাবস্থায় খালেদ মােশাররফ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে ২৪ মার্চ জিয়াসহ। তার অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার আগেই পাকিস্তানিদের উপর আঘাত হানার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে জিয়া খালেদকে। আশ্বস্ত করতে গিয়ে মন্তব্য করেন : ঘাবড়ানাের কিছু নেই। ওরা অতদূর যাবে না। হাজী গােলাম মাের্শেদের মাধ্যমে মুজিব চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামতে না দেয়ার জন্য একটি নির্দেশ পাঠান। কিন্তু এ ব্যাপারে জিয়া কোনাে সক্রিয় ভূমিকা পালন না করায় পরবর্তীকালে তার সাথে আর যােগাযােগ করা হয়নি। মেজর রফিকের বরাত দিয়ে অ্যান্থনি ম্যাসকরনহাস জানাচ্ছেন : ২৬ তারিখে জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি সােয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ খালাসের কাজ তদারকি করার জন্য রওয়ানা হয়ে যান। পথিমধ্যে তিনি শুনতে পান যে, পাকিস্তানি হানাদারেরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন্দ্রে আক্রমণ চালিয়ে বহু। নিরস্ত্র বাঙালি সৈন্য হত্যা করেছে। এই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গেই জিয়া ফিরে আসেন এবং বিদ্রোহে যােগ দেন। তারপরই তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে তিনি পটিয়ায় চলে যান, যেখানে কবি বেলাল তাকে আবিষ্কার করেন। অসহযোেগকালে ৭ মার্চ ১৯৭১ প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে মুজিব বলেন : … প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোেল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা-যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে।… এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এরূপ ঘােষণার পর এবং ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের পর ২৫,২৬ বা ২৭ মার্চ কোনােরূপ ঘােষণা না দেয়া হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনাে১. ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯। অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩২ আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮ অ্যান্থনি ম্যাসকরনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৩২ইতর-বিশেষ হত না। পাক হানাদারবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের পর কার্ফ শিথিলের প্রথম সুযােগেই ঢাকাবাসী ঢাকা ছেড়ে গ্রামাঞ্চল হয়ে ভারতে গমন শুরু করে এবং স্থানে স্থানে দেশবাসী প্রতিরােধ আন্দোলন শুরু করে। দু’সপ্তাহ পর ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র প্রকাশ ও প্রচার করা হয় এবং অস্থায়ী সরকার ঘােষণা করা হয়। তবে ইতােপূর্বে মুজিব, হান্নান ও বিশেষ করে জিয়ার ঘােষণা জনগণের মনােবল বৃদ্ধি করেছে -এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। ৭ মার্চের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবি বেলাল মােহাম্মদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বেতারের শব্দ সৈনিকেরা ২৬ মার্চ ১৯৭১ হানাদার সামরিক সরকারের সংবাদ প্রচার বন্ধ করে দেয় এবং অপরাহ্নে শহর থেকে দূরে কালুরঘাট থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন। সেখান থেকে বেলা আড়াইটায় এমএ হান্নানের কণ্ঠে। মুজিবের স্বাধীনতা ঘােষণা সম্প্রচার করা হয়। | পরদিন ২৭ মার্চ শহর থেকে ১৬ মাইল দূরে পটিয়ায় অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের অধিনায়ক মেজর জিয়াকে বেলাল মােহাম্মদ ও তার বন্ধুরা বেতার কেন্দ্রটির নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণের অনুরােধ জানালে সাথে সাথে তিনি রাজি হয়ে ৩ ট্রাক সৈন্য নিয়ে বিকালে কালুরঘাটে আসেন এবং বেতার কেন্দ্রের চারদিকে তাদের মােতায়েন করেন। সন্ধ্যায় নিতান্ত কৌতূহলবশে বেলাল মােহাম্মদের অনুরােধে জিয়া স্বকণ্ঠে নিম্নোক্ত ঘােষণা দেন : I Major Zia, Provisional Commander in Chief of the Bangladesh Liberation Army hereby proclaim on behalf of our great leader the Supreme Commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, the indeperndence of Bangladesh. এভাবেই ২৭ মার্চের ঘােষণার মাধ্যমে জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে তার স্থান করে নেন। অথচ ২৬ মার্চ পর্যন্ত এটিকে একটি রাজনৈতিক এবং বেসামরিক ব্যাপার বিবেচনায় জিয়া বাংলাদেশ-আন্দোলনে নিজেকে জড়াতে চাননি। চট্টগ্রামে প্রতিরােধ যুদ্ধে জিয়ার সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তিনি রামগড়ে অবস্থান নেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিএসএফ -এর ব্রিগেডিয়ার পান্ডের তথ্য ও অনুরােধ অনুযায়ী তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার থেকে চতুর্থ ও দ্বিতীয় বেঙ্গলের দুটো শক্তিশালী কোম্পানিকে জিয়ার সাহায্যার্থে রামগড়ে পাঠানাে হয়। পরের সপ্তাহে তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে জিয়া রামগড় থেকে এসে যােগদান করেন।৫. দু’দিন পর ‘বিপ্লবী’ শব্দটি পরিহার করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামকরণ করা হয়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের কিছুক্ষণ আগে তিনি স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান করেন সিরাজউদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৪৬ অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩১ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার জেল হত্যাকাণ্ড গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৭) বলেন যে, ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সামরিক অধিনায়কগণ তেলিয়াপাড়ায় মিলিত হয়ে ওসমানীকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন। শফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে যথাক্রমে এস, জেড ও কে নামে তিনটি ফোর্স গঠন করা হয়পরে জিয়া গারাে পাহাড়ের পাদদেশে তেলঢালায় এসে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং তৃতীয়, প্রথম ও অষ্টম বেঙ্গল একত্রিত হয়ে ২৫ জুন নাগাদ বাংলাদেশের প্রথম পদাতিক ব্রিগেড হিসেবে ‘জেড ফোর্স’ সংগঠিত হয়। জেড ফোর্স ২৮ জুলাই পর্যন্ত সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ৩১ জুলাই স্বদেশে প্রবেশ করে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত| স্বাধীনতার পর ৭ এপ্রিল ১৯৭২ জেনারেল ওসমানী ও জেনারেল আব্দুর রব সামরিকবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ৮ এপ্রিল সম্মিলিত কমান্ড বাতিল করে সেনা, নৌ ও বিমান-এই তিনটি বাহিনী গঠন করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধান পদের জন্য শফিউল্লাহ ও জিয়া সমযােগ্যতা সম্পন্ন হলেও বাই-নম্বরে জিয়া সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু ওসমানীর সুপারিশে সফিউল্লাহকে প্রধান করা হয়। সপ্তাহখানেক পর একটি নতুন পদ “ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ’ সৃষ্টি করে ঐ পদে জিয়াকে পােস্টিং দেয়া হয়। প্রধান হতে না পারার ক্ষোভ নিয়েই জিয়া উপ-প্রধানের পদে যােগ দেন। | ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াত জামিলকে মুজিব হত্যার খবর দেয় এবং একই সাথে এর বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা না নেয়ার হুমকি দেয়। এমতাবস্থায় শাফায়াত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার পথে জিয়ার বাসায় যান। জিয়া তখন শেভ করছিলেন এবং ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে শাফায়াতকে বলেন :So what, President is dead? Viee President is there, Get your troops ready. Uphold the constitution?জেনারেল সফিউল্লাহ জানান : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে আমার কাছে খালেদ মােশাররফ ছুটে আসেন নাইটড্রেসেই, আর জিয়া হাজির হয় ক্লিন শেভ-ধােপদুরন্ত হয়ে।মুজিব হত্যা মামলায় সফিউল্লাহর সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তােলে আর্মার ও আর্টিলারি শহরে রেডিও সেন্টার, গণভবন ও ৩২ নম্বর রােডের (ধানমন্ডি) দিকে যাচ্ছে জানানাে হলে, তিনি শঙ্কিত হয়ে তার ডিএমআই লে. কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে শাফায়াত জামিলকে ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়ান দিয়ে ওদের প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। একই সাথে তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধান এবং সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়া ও চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মােশাররফকে ফোনে ঘটনা জানিয়ে দ্রুত তার বাসায় আসতে বলেন। ১৫২০ মিনিটের মধ্যেই জিয়া ইউনিফরম পরিহিত হয়ে ও খালেদ নাইট-ড্রেসে এসে পৌছান। ইতােপূর্বে প্রেরিত নির্দেশের কোনাে প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে শফিউল্লাহ।১১. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮ কর্নেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৩ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৫৭ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৬-৯৭খালেদকে দ্রুত ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে শাফায়াতকে সাহায্য করার নির্দেশ দিলে জিয়া বলেন : Don’t send him, he is going to spoil it’. কিছুক্ষণ পর শফিউল্লাহর অফিসে অবস্থানকালে রেডিওতে মুজিব হত্যার ঘােষণা প্রচারিত হলে জিয়া শফিউল্লাকে বলেন :সিজিএস খালেদ মােশাররফকে আর বাইরে যে দিও না। তাকে বললাে Ops order তৈরি করতে, কারণ ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন – ইন দিস প্রিটেক্ট। এ সময় মেজর (অব.) ডালিম ১০-১৫ জন সশস্ত্র সৈন্যসহ অফিসে ঢুকে শফিউল্লাহকে রেডিও স্টেশনে যেতে পীড়াপীড়ি করে। অল্পক্ষণ পরে নৌ ও বিমান প্রধান আসেন। একটি জিপে করে মেজর রশিদ ও মেজর (অব.) ডালিম জেনারেল শফিউল্লাকে এসকর্ট করে রেডিও অফিসে নিয়ে যায়। পেছনে সশস্ত্র আর্মির গাড়িসহ নৌ ও বিমান প্রধানের গাড়ি তাদের অনুসরণ করে। জিয়াও এই বহরের অনুগামী হয়ে। রেডিও স্টেশন ও পরে বঙ্গভবনে যান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৫-২৪ আগস্ট ১৯৭৫ শফিউল্লাহ সেনা প্রধান থাকা পর্যন্ত জিয়া ও তাকে সর্বক্ষণ একসাথে একে অপরের ছায়ার মতাে লেগে থাকতে দেখা যায়। | শফিউল্লাহ আরাে জানাচ্ছেন, আলােচনা, সভা প্রভৃতি অজুহাতে তাদেরকে ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত বঙ্গভবনে আটকে রাখা হয়। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ১৮ আগস্ট রাতে একটি কনফারেন্স এবং ১৯ আগস্ট ফরমেশন কমান্ডারদের অপর একটি কনফারেন্স ডেকে ‘চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা ও উচ্ছঙ্খল অফিসারদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। ২২ আগস্ট বঙ্গভবনে গিয়ে একই উদ্দেশ্যে ট্রপস ফিরিয়ে এনে রিপিং -এর প্রস্তাব করলে মােশতাক তাকে অপেক্ষায় থাকতে (wait and see) বলেন। এরপর ২৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে একটা নিউজ বুলেটিনে জেনারেল ওসমানীকে প্রেসিডেন্টের ডিফেন্স এ্যাডভাইজার করার ঘােষণা দেওয়ার পরই মােশতাক শফিউল্লাহকে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় বঙ্গভবনে যেতে বলেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল খলিলকে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে দেখেন। ওসমানী ও মােশতাক উভয়ই তাকে বিদেশে দূতাবাসে নিয়োগের প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মতি না দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসে দেখেন, জিয়া ইতােমধ্যে চিফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে অফিসারদের সাথে সভা করছেন। দেশের রাষ্ট্রপতির মৃত্যুসংবাদ শুনে জিয়ার ‘তাতে কী? (so what) বলা, অন্যরা যেখানে শােনামাত্র নৈশ-পােশাকে সেনাপ্রধানের বাসায় হাজির, সেখানে তার ধােপদুরস্ত হয়ে আসা,১৩/১ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, ১১১ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৮-৯৯। শফিউল্লাহ তার সাক্ষ্যে এ-ও জানান যে, কর্নেল তাহের একদিন তার অফিসে এসে তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে জিয়ার জন্য সেনাপ্রধানের পদটা ছেড়ে দিতে বলে। এজন্য তাহেরকে মেডিকেলি অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ফোন পেয়ে ২৪ আগষ্ট ৪টায় বঙ্গভবনে গেলে ওসমানী তাকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ ও জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ ঘােষণা করেন (ড. হাননান, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৫-৯৬ ও ২০১)নিরুত্তাপ থাকা, সিজিএস খালেদকে একশান গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে বলা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করা, অযাচিত হয়ে বেতারকেন্দ্র ও বঙ্গভবনে যাওয়া, শফিউল্লাহর সাথে ছায়ার মত লেগে থাকা, ১০ দিনের মধ্যেই প্রেষণে। শফিউল্লাহকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলিজনিত সেনাপ্রধানের শূন্যপদে যােগদান করা প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষণ করলে হত্যাকারে সাথে জিয়ার সংলগ্নতা/বিদিততা প্রতীয়মান ১৯৭৪-এ সেনা-অভিযানে এসে ফারুকগং শাসকদলের নেতৃবৃন্দের সাথে অপরাধীদের সম্পর্ক দেখতে পায় এবং তখনই প্রতিকারের জন্য একটা কিছু করার কথা ভাবে। একপর্যায়ে সবকিছুর জন্য মুজিবকে দায়ী করে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার বিকল্প হিসেবে জিয়ার কথা ভাবে। ফারুকের ভাষায় : ঐ সময় জেনারেল জিয়ার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধাবােধ ছিল। আমার ইচ্ছে ছিল, সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাকে দেশের শাসনভার তুলে নেয়ার অনুরােধ জানাবাে। তবে এ কথা সরাসরি বলা সম্ভব ছিল না বলে দেশের দুর্নীতি, খুন-রাহাজানি প্রভৃতি প্রসঙ্গে আলােচনার একপর্যায়ে দেশে একটা পরিবর্তন প্রয়ােজন এবং সেক্ষেত্রে তার সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনার উত্তরে জিয়া বলেন : আমি দুঃখিত। আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না। তােমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি একটা কিছু করতে চাও, তাহলে তােমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত। আমাকে এসবের মধ্যে টেনে না। তবে রশিদের ধারণা ছিল, শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলে জিয়াও তাদের সমর্থন করবে। কারণ জিয়া কখনােই তাদের এ-কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেননি। | কানাডা টেলিভিশনের জন্য অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্যাসেট ও ৩০ মে ১৯৭৬ সংখ্যা সানডে টাইমস পত্রিকা লন্ডন থেকে সংগ্রহ। করে আদালতে প্রদর্শন করা হয়। এতে দেখা যায় ফারুক বলছেন :পঁচাত্তরের ২৮ মার্চ জেনারেল জিয়াকে ম্যানেজ করি। সে সময় জিয়ার বক্তব্য ছিল সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে সরাসরি কিছু করা সম্ভব নয়। তােমরা জুনিয়ররা করতে চাইলে গাে এ্যাহেড।” উক্ত পত্রিকার ১১ নং পৃষ্ঠায় I halped to kill Mujib, dare you put me on trial শিরােনামে প্রকাশিত স্টেটমেন্টে (যা ঐ ক্যাসেটের সাক্ষাৎকারের অনুরূপ) বলা১৩. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের, ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮। ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৭ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০the man who engineered the killing of the ‘father’ of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, in August last year, challenges the present resime to put him on trail for murder. The man, Lieutenant Colonl Farook Rahman, accuses the present resime, led by Ceneral Ziaur Rahma of betraying a movement that considered reform so vital that it killed the state’s founding father in an effort to achive it.” এছাড়া কার্যবিধির ১৬৪ ধারামতে আদালতে প্রদত্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক। জবানবন্দিতে ফারুক বলেন : ‘ আলাপের মাধ্যমে তিনি (জিয়া) আমাকে instegate করে বললেন, দেশ বাঁচানাের জন্য একটা কিছু করা দরকার।’ ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস ফারুকের বলা এসব কথা। সম্পর্কে সামনাসামনি জিজ্ঞাসা করলে জিয়া তা স্বীকার বা অস্বীকার না করে জবাবদান থেকে বিরত থাকেন। অ্যান্থনির ভাষায়, ‘আমি পুনরায় জবাব পাওয়ার প্রচেষ্টা চালালে , তিনি আমাকে বহুবছর ধরে বাংলা দেশের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করেন। রহস্যময় কারণে জিয়া শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযােগে চাকরিচ্যুত মেজরদের প্রশ্রয়দান করেন। শফিউল্লাহর ভাষায়,খুনিচক্র সবসময়ই পেয়েছে জিয়ার আশ্রয়-প্রশয়।… সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় মেজর নূরকে চাকরিচ্যুত করেছিলাম, কিন্তু তাকে শেল্টার দেয় জিয়া। পঁচাত্তরের আগস্টের প্রথম থেকেই ডালিম ও নূরকে ক্যান্টনমেন্টে লন-টেনিস। কোর্টের আশেপাশে ঘােরাফিরা করতে ও টেনিস খেলতে দেখা যেতাে। ওরা জুনিয়র ও চাকরিচ্যুত অফিসার হওয়ায় এ ছিল অস্বাভাবিক। ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল হামিদের ‘তােমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলিতে আস’ প্রশ্নের জবাবে মেজর নুর। জানায় যে, তারা জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়ে খেলতে আসে। শুধু তাই নয়, সেনাপ্রধান হয়েও জিয়া আর্মিতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার কোনাে চেষ্টা করেন।নি।| এমন কি মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন মােশতাক-জিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত। সেনাবাহিনী থেকে চাকরি হারানােদের চাকরিই কেবল ফেরত দেননি, রাতারাতি প্রমােশন দিয়ে ওদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল।২০. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২২ ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৬ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৬ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০-৬১কার্যবিধির ১৬৪ ধারামতে লে. কর্নেল মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) আদালতে তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন :… জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে পাঠানাে সকল মেজরদেরকে কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দেন। কিন্তু মেজর রশিদ ও ফারুক চাকরি নিতে অস্বীকার করেন এবং আর্মিতে পুনর্বহাল হওয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। মেজর রশিদ, মেজর ফারুক ও মেজর ডালিম ১৯৭৬ সনে গােপনে হঠাৎ বাংলাদেশে চলে আসেন এবং মেজর ফারুক সাভার সেনানিবাসে গিয়ে বেঙ্গল কেভালরির কমান্ড হাতে তুলে নেন। বগুড়ায় অবস্থানরত বেঙ্গল কেভালরির অন্য ইউনিটের সৈন্যরাও ফারুক রহমান সেখানে না গেলে তারা মার্চ করিয়া ঢাকা আসিবে বলিয়া হুমকি দিলে ফারুক রহমান বগুড়া চলিয়া যায় এবং সেখানে গিয়ে ল্যান্সার ইউনিটের কমান্ড গ্রহণ করেন। জেনারেল জিয়া ফারুক রহমানকে ঢাকায় ফেরত আনেন। পরে এই অপরাধে এই ইউনিটের অনেক সৈনিককে কোর্ট মাশাল করে বিন্নি মেয়াদের সাজা দেন, এমনকি ইউনিটটিকে নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু মেজর ফারুককে সাজা না দিয়ে বিদেশে প্রেরণ করেন। ইতিমধ্যে মেজর ফারুকের সঙ্গে আগত মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে ২-ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ড ও কন্ট্রোল হাতে নেওয়ার চেষ্টা চালান এবং সৈনিক লাইনে গিয়ে বিদ্রোহ করার উসকানি দিতে থাকেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাদের বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ৩/৪ দিন পরে বিদেশে ফেরত পাঠান। ইহাতে আমার মনে হয় যে, ১৫ আগস্টের ঘটনায় জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল, যার জন্য তিনি ফারুক এবং রশিদের কাছে খুবই দুর্বল ছিলেন।২৮২৮. মুজিব হত্যা মামলার ৬০ নং সাক্ষী রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ আল হাসান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি ও সেনা-সদরের চিঠি উপস্থাপন করে বলেন জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন আমলে ১৯৭৬ সালের ১৬ আগস্ট সেনা-সদরের এই চিঠিতে পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত ১২ জন সেনা-অফিসারের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খুন হওয়ার আগে সাড়ে ৫ বছরের শাসনামলে জিয়ার বিরুদ্ধে ২০টি বিদ্রোহ/অ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৮০ সালের শেষদিকে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসের চাকরিতে পুনর্বাসিত আগস্ট-হত্যাকারীরা গােপনে মিলিত হয়ে জিয়াকে উৎখাতের একটি ষড়যন্ত্র করে। একপর্যায়ে তা ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। ষড়ন্ত্রকারীরা সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে (চাকরি ত্যাগ করে) যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ বা ফেরারি জীবনযাপন করে। যদিও এজন্য সেনাবাহিনীতে কর্মরত লে. কর্নেল দীদারুল আলম, লে. কর্নেল নুরুন্নবী খান প্রমুখের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু সৌভাগ্যবান’ খুনীরা পরবর্তী এরশাদ আমলে বিনা অনুমতিতে প্রায় তিন বছরের অনুপস্থিতিকালের পুরাে বেতন-ভাতাসহ দ্বিতীয়বার পূনবাসিত হয় এবং ১৯৯৬ সালের জুনে শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বপর্যস্ত বেগম খালেদার আমলেও অনুরূপ ‘জামাই আদর’ লাভ করে। সুতরাং এদের প্রাপ্ত সুযােগ-সুবিধা ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর কৃত জেল হত্যাকাণ্ডেরই পুরস্কার ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১৮। রশিদ ফারুক, ডালিমের বাংলাদেশে আগমনের সালটি উক্ত গ্রন্থে মুদ্রণ প্রসাদ বশত ১৯৭১ উল্লিখিত হয়েছে।কার্যবিধির ১৬৪ ধারামতে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেখা যায়, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দুপুরে সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে ঠাকুরকে মােশতাক বলেন যে : ..এই সপ্তাহে ব্রিগেডিয়ার জিয়া দুইবার এসেছিলেন। সে এবং তাহার লােকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। ঠাকুরের জিজ্ঞাসার জবাবে মােশতাক আরাে জানায় : বলপূর্বক ক্ষমতা বদলাইতে চায়। প্রয়ােজনবােধে যে-কোনাে কাজ করতে প্রস্তুত।… আমার ডাকের জন্য অপেক্ষা করাে। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। পরদিন ভােরেই তাদের ক্ষমতা দখলের ডাক এসে যায়। কিন্তু হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ৮১ দিনের মাথায় ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান (রক্ষীবাহিনীর সাবেক প্রধান) ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে একটি স্বল্পস্থায়ী সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হলে জিয়া বন্দী হন এবং ৬ নভেম্বর রাত ১২টায় নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার’, “সিপাই সিপাই ভাই ভাই-অফিসারদের রক্ত চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে সিপাইরা খুনী মেজর মহিউদ্দিনের (আটিলারি) নেতৃত্বে মতান্তরে হাবিলদার সারােয়ারের নেতৃত্বে বেঙ্গল ল্যান্সারের একদল সৈন্য জিয়াকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। মুক্ত হয়েই জিয়া জেনারেল খলিলকে ফোন করে বলেন, ‘আমি মুক্ত। আমি বেশ আছি। আমার জন্য কিছু ভাববেন না। আপনি দয়া করে খবরটা মার্কিন, ব্রিটিশ এবং ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের জানিয়ে দিন (অ্যান্থনি, পূর্বাক্ত-১২১), পরদিন সকালে মিশনগুলােতে রিং করে খলিল জানতে পারেন, ইতােমধ্যে জিয়া তাদের সাথে কথা বলেছেন। ৭ নভেম্বর দুপুরে জিয়া সৈনিক সংস্থার ১২ দফায় স্বাক্ষর করলেও সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান, পােশাকের ব্যবস্থা গ্রহণ ও অবমানাকর ‘ব্যাটম্যান’প্রথা বাতিল করার ঘােষণা দান ছাড়া অন্য দাবিগুলাে সম্পর্কে নীরব থাকেন এবং ২৩ নভেম্বর বিপ্লবের’ ‘অভিভাবক’ রব, জলিল, ইনু, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ২০. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২০ গ্রানাডা টেলিভিশনের জন্য অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে রশিদ বলেছিলেন, ‘আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে মােশতাকের সাথে কথা হয়।’ (ড, হাননান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০)। মুজিব-হত্যা মামলার ৪৭ নং সাক্ষী মেজর জেনারেল (অব.) খলিলুর রহমান বিডিআর এর। ডাইরেক্টর থাকাকালে (১৯৭৪) সশস্ত্রবাহিনীতে ক্ষুব্ধতা লক্ষ্য করেন। তার ভাষায় ‘তখন। সামরিকবাহিনীর জন্য পৃথক বেতন কমিশন গঠন না করার কারণে সামরিকবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছিল। সামরিক-বেসামরিক যৌথ বেতন কমিশনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন জেনারেল জিয়া। কিন্তু জে, জিয়া এই বিষয়টি কখনও কমিশনে তুলে ধরেন নাই।’ (ড, হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০০)(তাহেরের বড়ভাই) ও কর্নেল তাহেরকে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে লুকিয়েথাকা অবস্থায়) গ্রেফতার করার মাধ্যমে কার্যত সিপাহী বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটান। পরে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘বৈধভাবে গঠিত সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা, ও অন্যান্য অভিযােগে তাহেরসহ জাসদ, বিপ্লবী গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৩৩ জনকে কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ ভাবে গঠিত সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। রহস্যজনক তড়িঘড়ির এই বিচারে তাহেরের ফাসি, রবের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ বিভিন্নজনের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়। জিয়াকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তকারী। তাহেরই হল তার প্রথম শিকার। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ আরও একটি সিপাহী বিপ্লব/বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এবার জিয়াকে নায়কের পরিবর্তে বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে তার অপসারণ চাওয়া হয়। কয়েকজন সঙ্গীসহ শহরে একটি গােপন স্থানে আত্মগােপন করে তিনি রক্ষা পান। ২ অক্টোবর বিদ্রোহ থেমে গেলে পরবর্তী দু’মাসের মধ্যে এজন্য ১,১৪৩ জনকে ফাঁসিসহ বহুশত সৈনিককে ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। কোর্ট মার্শালের প্রচলিত নিয়মও এক্ষেত্রে মানা হয়নি। বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈন্যদের হত্যা করা হয়েছিল মাত্র। | ৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে (৭ নভেম্বর) অন্তরীণাবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়া। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘােষণা। করেন। উচ্ছলতাপূর্ণ রাত্রির অবসানের পর ৭ নভেম্বর বেলা ১১টায় ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদর-দফতরে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার উদ্দেশ্যে জিয়া একটি সভা ডাকেন। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খলিল, বিমানবাহিনীর প্রধান তাওয়াব, নৌবাহিনীর প্রধান এমএইচ খান, প্রেসিডেন্টের সচিব মাহবুবুল আলম চাষী, কর্নেল তাহের প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় ওসমানী ও চাষী উত্থাপিত। রাষ্ট্রপতি পদে মােশতাককে পুনর্বহালের প্রস্তাব গ্রহণ না করে সায়েমকে বহাল রাখা। হয়। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ওপরে অন্য কারাে ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়’ জেনারেল খলিল ও কর্নেল তাহেরের এই যুক্তি গ্রহণ করে সায়েমকেই সিএমএলএ এবং তিন বাহিনীপ্রধানকে সমমর্যাদার ডিসিএমএলএ করা হয়। বলা বাহুল্য, এ সিদ্ধান্ত জিয়ার পছন্দ হয়নি এবং ২৮ নভেম্বর ১৯৭৬ রাতে এরশাদ, মঞ্জুর, মীর শওকত এবং নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয় সমভিব্যাহারে বঙ্গভবনে গিয়ে জিয়ার অনুকূলে সিএমএলএ’র পদ হস্তান্তরের কাগজে স্বাক্ষর দিতে সায়েমকে বাধ্য করেন। এরপর ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সায়েম শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে৩২. রব, জলিল ও মােহাম্মদ শাহজাহান আগে থেকেই বন্দি ছিলেন এবং বিপ্লবের ফলে ৭ নভেম্বরইমুক্তি পান। রবকে পরে এক ক্ষমা ঘােষণায় মুক্তি দেয়া হয়। অ্যান্থনি মাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৪-৫৯ পাঠানী জেনারেল আজম খান যেমন পিস্তল উঁচিয়ে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগপত্রে ইস্কান্দার মির্জার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় বসাতে সাহায্য করেছিলেন।জিয়াকে মনােনীত করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। তখন তার বয়স মাত্র ৪৩ বছর। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালে জিয়া একই সাথে স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। সে-সময় তাে বটেই, এমনকি তার সাড়ে ৫ বছর শাসনামলে জেলহত্যাকাণ্ড তদন্ত কমিশনকে কাজ করতে তিনি সম্মতি দেননি। আগস্ট হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা মহলে আলােচনা থাকলেও জেলহত্যার ব্যাপারে মানুষ তাকে সন্দেহ করে না। কিন্তু এ-ব্যাপারে আইনকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে না দেয়ার কারণ বােধগম্য নয়। | সায়েমকে সরিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরদিন এক ঘােষণায়। জিয়া সংবিধান সংশােধন করেন। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বহাল রেখেই সংবিধানের প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ শব্দসমূহ সংযােজন করে দেশকে ইসলামী চরিত্রের ধারণা দিয়ে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়। বাঙালি। জাতীয়তাবাদে অবিশ্বাসী ও স্বাধীনতাবিরােধী পাকিস্তানি মনােভাবাপন্নদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নাগরিকত্ব বাংলাদেশীকে ‘জাতীয়তাবাদ’ অভিধায় উপস্থাপন করা হয়। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরের মাসে জিয়া একটি লােক-দেখানাে গণভােটের আয়ােজন করেন। ১৯৭৮ সালে সাংবিধানিকভাবে অযােগ্য হয়েও জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নিয়ে নির্বাচিত হন। ১ ডিসেম্বর ১৯৭৮ জিয়া এরশাদকে এপ্রিল মাসের ব্যাক ডেট’ দিয়ে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়ােগ করেন। যার অর্থ রাষ্ট্রপতি নিবার্চনের সময় তিনি চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে সরকারি চাকরিতে থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছেন। এ কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার অযােগ্য ছিলেন। এই অযােগ্যতাকে এড়ানাের জন্য তিনি ‘অবৈধভাবে ২৯ এপ্রিল দ্বিতীয় ঘােষণা (ত্রয়ােদশ সংশােধনী) ১৯৭৮, জারি করেন। এ প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিয়া বলেন :ওসমানী এম.পি, হয়েও (মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক) কমান্ডার ইন চিফ পদে বহাল ছিলেন। আমি তাে সিইসি হয়ে তিন বাহিনী প্রধানের মাধ্যমে আমার ক্ষমতার ব্যবহার করছি মাত্র। আমার পদত্যাগ দেশের জন্য খুব ভালাে হবে না।”অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৪-৩৫। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, কয়েক বছর পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিয়া বলেছিলেন আমি ক্ষমতা দখল করিনি। আমাকে ক্ষমতায় বসানাে হয়েছিল।’ (অ্যান্থনি, বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, পৃষ্ঠা-১৩৫)। সায়েম প্রেসিডেন্ট ও সিএমএলএ-উভয় দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করছিলেন এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করছিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার জন্য এবং নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য জিয়া সিএমএলএ পদ জোর করে দখল করেছিলেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭ ঘােষণা দিয়ে এরূপ সংশােধন সংবিধানের পরিপন্থী কাজ। পরে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ ঘােষণা করে একই প্রতারণা করেন অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৭ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৮এ সময় তিনি সাফারি-স্যুট পরিহিত জেনারেল হিসেবে আখ্যায়িত হন। কিন্তু মার্শাল-ল রেগুলেশন বলবত থাকায় এর বিরুদ্ধে সেদিন বৈধতার প্রশ্ন কোনাে কোর্টে উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি।১৯৭৯ সালে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন ও মাস্তানবাহিনী কাজে লাগিয়ে জিয়া একটি রাবার স্টাম্প পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তার মনােনীত প্রার্থীদের মধ্যে ২৫০ জনই ছিল দালাল-গােত্রের রাজনীতিবিদ। তিনি রাজাকার কূল শিরােমণিদের অন্যতম শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ পার্লামেন্টে সংবিধানের পঞ্চম সংশােধী পাস করে মােশতাকের জারিকৃত সামরিক আদেশ ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ যাবতীয় কালাকানুন সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা| পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গােয়েন্দাবিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে। তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরােহণ করেন এবং গণভােট, রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুলভােট জয়ী হয়ে ক্ষমতাকে সংহত করেন। এরপর তিনি আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার বাসনা মনে পােষণ করতে থাকেন। এজন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকলেও উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেন। তিনি একদিকে ঘােষণা দিলেন : ‘I will make politics difficult for the politician.’ অন্যদিকে তার অনুগ্রহভােগীদের জন্য ঘােষণা দিলেন ‘Money is no problem.’ তরুণ সমাজকে তার পেছনে কাতারবন্দি করা ও তাদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করে ক্রীড়নকে পরিণত করার জন্য তিনি সৃষ্টি করেন যুব কমপ্লেক্স। কেবল ১৯৭৯-৮০ ও ৮০-‘৮১ -এই দুই অর্থবছরে হাট-বাজার থেকে সংগৃহীত প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা ওরা আত্মসাত করে। অন্যান্য উৎসের টাকা যােগ হলে টাকার অঙ্ক অনেক বড় হবে।দুর্নীতির অপর একটি খাত ছিল জিয়ার তথাকথিত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে খালকাটা বিপ্লব। কোদাল হাতে শ্রমিক জিয়া ও তার মন্ত্রীরা অনেক ঢােল-সহরত করে টিভি পর্দায় এ বিপ্লব সাধন করেন। বাস্তবে কেউ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেনি। কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও অন্যান্য উৎস থেকে এ কর্মসূচিতে অর্থ যােগান দেয়া হয়। অথচ ঐ অর্থের সিংহভাগ চলে যায় বিএনপি কর্মীদের পকেট কিংবা স্থানীয় কর্মকর্তাদের পকেটে।জিয়ার অপর একটি সখ ছিল মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে নৌ-বিহার করা। এর মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ওদের সাথে পরিচিত হন ওঅ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূবােক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৯ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪০ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪০পরে তাদেরকে তার দলের ছাত্রফ্রন্টে রিট করেন। অবশেষে তাদের অনেকেই দেশখ্যাত শন্ত্রপাণি সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত হয়েছে। জিয়ার সাড়ে ৫ বছরের শাসনামলে কোনাে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত অর্থে সুবিধাভােগীদের জন্য ঢাকার বাজার সৌখিন পণ্যে ভরে ওঠে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে মানুষের অভাব বাড়তে থাকে। এ ধরনের অবস্থায় সন্ত্রাস, অপরাধজনিত ঘটনা আর হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। জিয়া আর জনগণউভয়পক্ষের জন্যই রঙিন স্বপ্ন মান হয়ে যেতে থাকে। রাজনৈতিক হত্যা আর ডাকাতি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। কুষ্টিয়ায় পুলিশ কনস্টেবলের হাতে জেলা প্রশাসক প্রহৃত হয়। স্ত্রীলােকদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যায় এবং এতে পুলিশের হাত থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। এ ধরনের অপকর্ম বাংলাদেশে এর আগে এমন ব্যাপকহারে ঘটতে কখনও শােনা যায়নি। সে-সময় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে স্বয়ং জিয়াও স্বীকার করেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাষায় : “ঠিক শেখ মুজিবের শেষ দিনগুলাের মতাে, রিপোের্ট ও গুজব চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল যে, অচিরেই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এমনই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের পৃষ্ঠপােষকতায় লে, কর্নেল মতিউর রহমান, লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান, লে. কর্নেল দেলােয়ার হােসেন, ৬৯ পদাতিকের ব্রিগেড মেজর এসএম খালিদ প্রমুখের পরিকল্পনায় ৩০মে,১৯৮১ অতি প্রত্যুষে চটগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়াকে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা বিনা বাধায় সার্কিট হাউসে ঢুকে সকলকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য কিছু গােলাগুলি ছুড়ে এবং প্রেসিডেন্টের ৪ নং কক্ষের একটি দরজা লাথি মেরে ভাঙার চেষ্টা করে। অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে জিয়া তােমরা কী চাও?’ জিজ্ঞাসা করার মুহূর্তেই লে. কর্নেল মতি এসএমজি থেকে গুলি চালিয়ে তার বুক ঝাঝরা করে দেয়। দরজার কাছেই মেঝেতে মুখ-থুবরে লুটিয়ে পরে জিয়ার প্রাণহীন দেহ। মতি এসএমজির নল দিয়ে দেহটিকে উল্টিয়ে মুখমণ্ডল আর বুকের উপর ট্রিগার টিপে রেখে ম্যাগজিন খালি করে খুনের নেশা মেটায়। | পুরাে অভিযানটি ২০ মিনিটেরও কম সময়ে সম্পন্ন হয়। সফরসঙ্গী, স্থানীয় অনুসারী ও প্রশাসনের কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। মৃত্যুর পর সামান্য শ্রদ্ধাও কেউ দেখায়নি। একপর্যায়ে মিজান চৌধুরী তার বিছানার চাদর দিয়ে মৃতদেহকে ঢেকে দেয়ার পূর্বপর্যন্ত তা পড়েছিল বেওয়ারিশ লাশের মত।* অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪৩অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪৪ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪৪
আতাউল গনি ওসমানীকর্নেল (স্বাধীনতার পর জেনারেল) মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নিত্য সাথী ছিল। পােষা কুকুর মন্টি’ (পাকবাহিনীর গুলিতে হত) ও একজোড়া জঙ্গী গোঁফ (যাকে খাড়া রাখার জন্য মােম ঘষার কাজে দৈনিক ২ ঘন্টা ব্যয় হয়)। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আইয়ুববিরােধী (কিন্তু চলনে-বলনে আইয়ুবকে অনুকরণকারী)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার তার কৃতিত্বের অনেক কাহিনী (অধিকাংশের কাছে অতিশয়ােক্তি) শােনা গেলেও কর্নেল হিসেবেই তিনি অবসর নিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, শুধু বাঙালি হওয়ার কারণেই তাকে কর্নেলের উপর প্রমােশন দেয়া হয়নি, এমনকি সিভিল সার্ভিসে। কোনাে উচ্চপদও দেয়া হয়নি।পাকিস্তানি আমলে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই দুটি বাহিনীর তিনিই উদ্যোক্তা বলে দাবি করতেন। নিজের অতীত কৃতিত্ব বর্ণনায়। তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। তিনি নিজের সামরিক জ্ঞান ও কৌশল সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পােষণ করতেন। ২ এপ্রিল ১৯৭১ -এর পর ওসমানী কুমিল্লার মতিনগর সীমান্ত পার। হয়ে ভারতে গমন করেন। বিএসএফ-এর ব্রিগেডিয়ার পান্ডে তাকে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া (বেঙ্গল) হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসেন। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চাবাগানে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, লে. কর্নেল আব্দুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরি প্রমুখ বঙ্গশার্দুলেরা প্রতিরােধ যুদ্ধের নকশা প্রণয়নে’ মিলিত হন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল বিদ্রোহী ইউনিটের সমন্বয়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ’ গঠন করে ওসমানীকে তা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেঙ্গলকে দিয়ে ভারতের সােনামুড়া সংলগ্ন গােমতি নদী পার হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে দখল করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু উর্ধ্বতন অফিসারদের প্রবল আপত্তির মুখে এই অসাধ্য ও অবাস্তব প্রস্তাব নাকচ হয়ে ব্যাটালিয়ন দুটো অঙ্কুরেই বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে রক্ষা পায়। এপ্রিলেরমঈদুল হাসান, মূলধারা ১৯৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল এইড’ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পৃষ্ঠা ৯৪) জানাচ্ছেন, সাংসদ থাকা সত্ত্বেও ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি করায় বহু সামরিক অফিসার অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাকে এড়িয়ে চলেছেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে জিয়া একই সঙ্গে সিইসি, সিএমএলএ, সিএএস পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়া অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ -এই প্রশ্নের জবাবেও ওসমানী সাংসদ হয়েও সিইসি থাকার উল্লেখ করেন। যদিও এটি ছিল জিয়ার ছোঁদো। युछि কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫দ্বিতীয় সপ্তাহে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে একটি বড় ধরনের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে ওসমানী, জিয়া, রুস্তমজি (বিএসএফ প্রধান), পান্ডে, ২য় ও ৪র্থ ব্যাটালিয়ান এবং বিএসএফ-এর কয়েকজন সিনিয়র অফিসারসহ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এসডিও কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও খাদ্য সামগ্রী দিয়ে ভারতের সহায়তাদান এবং মুক্তিযুদ্ধকে বৈধতাদান ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভের জন্য একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের অত্যাবশ্যকতা বিশেষ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়।কনফারেন্স চলাকালে সকাল সােয়া আটটায় একজন সিগন্যাল জেসিও একটি ToT at 8.30′ মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে আনে। যার অর্থ বাংলাদেশের কোনাে একটি জায়গায় সাড়ে আটটায় বিমান থেকে বােমা হামলা হবে। ওসমানী এতে বেশ অস্থির হয়ে পড়েন এবং বিমান হামলার ভয়ে চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। অথচ অবস্থান ও কৌশল উভয় বিবেচনায় তেলিয়াপাড়ায় তখন বিমান হামলার সম্ভাবনা ছিল। তার বই ভীরুতা ভারতীয়দের সামনে উপস্থিত বাঙালিদের অপ্রস্তুত করে।১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাজউদ্দিন প্রমুখ শিলিগুড়ি থেকে আগরতলায় ফিরে এসে। দেখতে পেলেন ওসমানীসহ বেশকিছু নেতৃবৃন্দ ইতােমধ্যে এখানে এসে পৌঁছেছেন। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং (ভারত সরকার নিযুক্ত যুদ্ধ সহায়ক (অব.) জেনারেল সার্কিট হাউসের একই কক্ষে অবস্থান করছেন। ওসমানী ইতােমধ্যে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন। তাকে সশস্ত্রবাহিনী প্রধানের (প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নেয়ার আমন্ত্রণ জানানাে হলে তিনি (সম্মত হয়ে) পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন। ১৩ এপ্রিল মন্ত্রীবর্গের সাথে একই বিমানে ওসমানী কলকাতা পৌঁছেন এবং ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের অভিষেকানুষ্ঠানে যােগদান করেন।| যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি কদাচিৎ যেতেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে অফিসের মানচিত্র দেখে নির্দেশ পাঠাতেন। মে মাসের দ্বিতীয়/তৃতীয় সপ্তাহে শাফায়াত জামিল ওসমানীর সাথে সীমান্তকর্নেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯। অন্য একটি ঘটনায়ও তার ভীরুতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যুদ্ধ চলাকালে জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল গাফফার চৌধুরী সাক্ষাৎকারের জন্য তার সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন নূরের (পরে মুজিব-ঘাতক মেজর) সাথে দিনক্ষণ ঠিক করে সার্কাস এভেনিউর অফিসে যান এবং তিনি প্রবেশমাত্র রিভলবার উঁচিয়ে ওসমানী তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। পরিচয় পেয়ে নিশ্চিত হয়ে বলেন, পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করার জন্য প্রায় শ’দেড়েক গুপ্তঘাতক নিযুক্ত করেছে। তাই নিরাপত্তার কারণে এই সতর্কতা, এমনকি অপরিচিত দর্শনার্থীদের দেহতল্লাশিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে (আব্দুল গাফফার চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৬)। শাফায়াত জামিল সীমান্ত ক্যাম্প পরিদর্শনে ওসমানীর সফরসঙ্গী হিসেবে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জানাচ্ছেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ভারতের মতাে নিরাপদ জায়গাতেও পাকিস্তানি কমান্ডাে হামলার ভয়ে তিনি সারাক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে থাকতেন (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৫) আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। তিনদিনের এই কর্মসূচিতে তারা প্রায় আড়াইশশা মাইল পথ পরিভ্রমণ করেন। যাত্রাপথে বেশকয়েকটি ক্যাম্পে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু সর্বত্রই তিনি অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেন। শাফায়াত জামিলের ভাষায় :ওসমানীকে এ সময় বেশ অসহিষ্ণু মনে হতে লাগল। কোনাে বড় ধরনের সমস্যা দেখলেই তিনি শুধু বলছিলেন, “আমার পক্ষে এত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। আই উইল রিজাইন। পুরাে সফরে তিনি প্রায় কুড়িবার পদত্যাগের হুমকি দিলেন। প্রায় সবক’টি ক্যাম্পের কমান্ডার এবং কোনাে কোনাে জায়গায়। স্থানীয় সাংসদদের সাথেও দুর্ব্যবহার করলেন। বসিরহাটের কাছে একটি ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন জলিলের (পরে মেজর, ও জাসদ নেতা) সাথে দেখা হয়। ওসমানী জলিলকে রীতিমতাে অশালীনভাবে তিরস্কার করলেন। তার এহেন আচরণ আমাকে লজ্জিত না করে পারল না। জলিলের অপরাধ ছিল, বরিশালে পাকবাহিনীর আচমকা হামলায় বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্রসহ তার একটি লঞ্চ ডুবে যায়। ক্যাপ্টেন জলিল চুপচাপ ওসমানীর বকাঝকা মাথা পেতে নিল। আমার তখন যুদ্ধক্ষেত্র আর কলকাতার নিরাপদ জীবনের ফারাকটা বেশি করে মনে পড়ছিল। মনে হল, ওসমানী সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলে হয়তাে জলিলকে এভাবে দোষারােপ এবং তিরস্কার করতে পারতেন না।…(বাগডােগরা) এয়ারফিল্ডের কাছাকাছি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের। সাংসদ সিরাজ সাহেবের সাথেও দুর্ব্যবহার করলেন কর্নেল ওসমানী। একপর্যায়ে দু’জনের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হলে অতিকষ্টে আমি সেটা সামাল দিলাম। কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল ওসমানীর এহেন কার্যকলাপ ও আচরণে অত্যন্ত নিরাশ হলাম আমি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দেহ জাগল। হিরতাহীন, মানসিকভাবে অশান্ত একজন লােককে মুক্তিবাহিনীর সর্বোচ্চপদে বসানাে কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে, এরকম প্রশ্ন জাগল মনে। তিনদিনের এই সফরে মুক্তিযুদ্ধ, অপারেশন, যুদ্ধকৌশল, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের সংস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি ওসমানী। দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ। সেনাবাহিনীর আইনের ক্ষেত্রে MPML (Manual of Pak Military Law) কতটুকু গ্রহণযােগ্য আর কতটুকু বাদ দেয়া উচিত, সারাপথ সেই আলােচনাতেই মেতে রইলেন তিনি। যুদ্ধের কেবল শুরু, বিজয় কতদূরে রয়েছে তার কোনাে ঠিক-ঠিকানা নেই, অথচ সেনাবাহিনীর আইন নিয়ে এখনি চিন্তার অন্ত নেই তার!’…যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ বা কৌশগত বিশেষ অবদান রেখেছেন-এমন কাহিনী জানা যায় না। তিনি কোন বিশেষ পদকে ভূষিত হননি। সামরিক কর্মকর্তাগণ যে তাকেস্বাধীনতার পর ‘যৌথ বাহিনী কর্তৃক দখলকৃত পাকিস্তানি অস্ত্রশস্ত্র ভারতে সরিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সরকার জলিলকে ‘অবাধ্যতার অভিযােগে গ্রেফতার করে এবং সামরিক ট্রাইবুসালে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে এক বছর পর জেলে থেকে মুক্তি পান। উল্লেখ্য, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারমান ছিলেন কর্নেল তাহের। কর্ণেল সাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪-৫৫এড়িয়ে চলত তার একটি কারণ উপরের বর্ণনা থেকেও বােধগম্য হয়। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম বাজেট প্রণয়নকালে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন না খেয়ে মরব, তবু শর্তযুক্ত ঋণ নেব’ ঘােষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক যে, সেবা ও সাহায্যের নামে যুদ্ধ চলাকালেই আমেরিকা ও তার পাশ্চাত্য বন্ধুরা বাংলাদেশকে অদৃশ্য শর্তে আবদ্ধ করতে শুরু করে। সার্কাস এভেনিউ ও বাংলাদেশ দূতাবাস তখন বিদেশী সাংবাদিক ও সাহায্যসংস্থার কর্মকর্তার ভিড়ে রাতদিন গমগম করে। কেউ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিককে নগদ সাহায্য দিচ্ছেন, কেউ উদ্বাস্তু শিবিরের জন্য ঔষধ, দুধ, কম্বল দিচ্ছেন। তাজউদ্দিনের ভাষায়,শত্রু এখন বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকেছে… এখন আমাদের ভেতর। থেকে শুরু হয়েছে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানাে। আমাদের সাহায্যকারী মিত্র দেশগুলাের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে গুজব ছড়ানাে হচ্ছে। এমনকি আমাদের নিজেদের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবচাইতে বিপদের কথা, সাহায্য দেওয়ার নাম করে এগিয়ে এসে টাকা ছড়িয়ে পাশ্চাত্যের কোনাে কোনাে দেশ আমাদের সরকারের মধ্যেই তাদের শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করেছে এবং মুক্তিবাহিনী (অফিসারদের সাথে গােপন যােগাযোেগ প্রতিষ্ঠা করে) ও বুদ্ধিজীবীদের নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলার জন্য চেষ্টা করছে।… শুধু গুজব প্রচার নয়, বেনামা প্রচারপত্রও প্রকাশ করা হয়েছে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে।… | বিদেশীদের মধ্যে আমেরিকানদের সংখ্যাই বেশি। আর এই আমেরিকানদের সাথেই মােশতাক, হােসেন আলী, চাষী, ঠাকুরদের ঘনঘন ওঠাবসা। এই দলের সাথে যুক্ত হয়েছেন ওসমানীও।… মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহের নামে মেজর মােশাররফ, মেজর জলিল ও মেজর জিয়ার সাথে তাদের (বিদেশী সাংবাদিকদের) নিত্য-বৈঠক।”একটা ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের খােন্দকার মােশতাকের সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর ছিল দারুণ মিল, দুজনই ভারতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ; দু’জনেরই মূল আস্তানা সার্কাস এভেনিউতে এবং মাখামাখি ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাহায্যসংস্থার লােক, কূটনীতিক ও সাংবাদিকের সঙ্গে। মিলিটারি সার্ভিস থেকে রিটায়ার করিয়ে দেওয়া ওসমানী ১৯৭০ সালে তখনকার জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগে যােগদান করে কার্যত মােশতাক গংদের ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তি বৃদ্ধি করেন।শােনা যায়, ওসমানির সুপারিশে তার প্রিয় পাত্র লে, কর্নেল ফিরােজ সালাহউদ্দিন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদে নিযুক্তি পান। একসময় তিনি ব্রিগেডিয়ার এবং আশির দশকের শেষদিকে রাষ্ট্রদূত হন। কর্নেল ফিরােজআবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনের আগস্ট পর্চাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮-১০০, ১০৫-১০৯। কিছুদিনের মধ্যে সরকারের গােপনীয় ফাইলের বিষয়বস্তু ফাঁস হয়ে আমেরিকা ও পাকিস্তানে প্রচার হয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে সার্কাস এভেনিউর দূতাবাসে বিদেশীদের আনাগোনার ওপর কঠোর নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশমন্ত্রী মােশতাকের সাথে তাজউদ্দিনের বিরােধীতার সূচনা হয় এ-নিয়েই। আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনের আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্তি, পৃষ্ঠা ১০৭পাকিস্তানিদের সঙ্গে আত্মসমর্পণকারী বাঙালি অফিসার। জনশ্রুতি যে, তিনি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পনের পূর্ব পর্যন্ত পাকবাহিনীর প্রধান রাজাকার রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত-পছন্দ অপছন্দ ও গোঁ ধরার কারণে একই ব্যাচের মধ্যে সিনিয়র জিয়াকে ডিঙিয়ে সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীপ্রধান করায় বহু অনর্থের সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ। কাজের জন্য নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন পদক বিতরণেও তার। পক্ষপাতিত্বের অভিযােগ শােনা যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বে ফাটল সৃষ্টি, সামরিকবাহিনীতে পাকিস্তানি মনােভাবাপন্ন অফিসারদের শক্তিবৃদ্ধি ও মুজিববিরােধী মনােভাব তৈরিতে ওসমানী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধকারী পাকমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের ছেলে জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনের সাথে তার আঁতাতের কথা সর্বজনবিদিত। মন্ত্রিত্বকালে বিলাতে বিমানের টিকেট বিক্রির এজেন্সি বণ্টন ও শিপিং কর্পোরেশনের বাণিজ্য-জাহাজ সংগ্রহে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ উঠেছিল। বিমানবালাদের পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কে বাধ্য করার অভিযোেগ একসময় সারা ঢাকায় চাউর হয়েছিল।১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ওসমানীকে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। ৭ এপ্রিল তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী পাস হয়। এতে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থা, একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হয়। সংসদে ব্রুট মেজরিটি’ থাকার কারণে তা সম্ভব হয়। এর প্রতিবাদে ওসমানী ও মঈনুল হােসেন ১১ ফেব্রুয়ারি সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠা ও মুজিবের বিরােধিতা করার সাহস প্রদর্শনের জন্য সারাদেশে তিনি ও মঈনুল আলােচিত ও প্রশংশিত হন। কিন্তু মাত্র ৬ মাসের মাথায় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে, মানবতাকে ধ্বংস করে, স্বাধীনতার স্থপতিকে নির্বংশ করে অবৈধ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া মােশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হতে ‘পাপা টাইগার’ ওসমানী বিবেকে এতটুকুও দংশনবােধ করেননি। অ্যান্থনির ভাষায়, ওসমানী ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল ইন চিফ এবং তাকে তিনি (মােশতাক) সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করতেন বলে প্রতীয়মান হয়। ১৫ আগস্ট সকালে রেডিও অফিসে সেনা প্রধানদের সাথে ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন।| মােশতাক যে অপাত্রে বিশ্বাস স্থাপন করেননি তা অচিরেই বােঝা গেল। অক্টোবরের মাঝামাঝি বঙ্গভবনে ডাকা সিনিয়র সেনা-কর্মকর্তাদের এক কনফারেন্সে ওসমানী সবাইকে রাষ্ট্রপতি মােশতাক ও তার সরকারের প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ১০ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনের আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৭| অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯২। ১২ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩১দেন। তিনি আরও বলেন, যারা সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করবে তারা ভারতীয়দের প্ররােচনাতেই করবে, তারা সব ভারতীয় এজেন্ট। যে-কোনােরকম অবাধ্যতা সমূলে উৎখাত করা হবে বলেও তিনি হুঙ্কার দেন। ২ নভেম্বর দিবাগত রাত তিনটায় (৩ নভেম্বর ১৯৭৫) বঙ্গভবনে পাহারারত জনৈক পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে খালেদ মােশাররফের অভ্যত্থান সূচনার কথা জানতে পেরে মেজর রশিদ সাহায্যের জন্য নানা স্থানে ফোন করে কোথাও থেকে উপযুক্ত সাড়া না পেয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ওসমানীকে ফোন করেন। তিনি সাথে সাথে বিডিআর, জিয়া ও খালেদ মােশাররফকে ফোন করেন। বাসায় গাড়ি না-থাকায় বহু কষ্টে তিনি বঙ্গভবনে এসে পৌছেন। ততক্ষণে খালেদ মােশাররফের পক্ষ থেকে একটি নেগুসিয়েশন টিম’ বঙ্গভবনে এসে” ট্যাঙ্কগুলাে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানাে, জিয়ার পরিবর্তে অন্য একজনকে সেনাবাহিনীপ্রধান করা, পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা প্রভৃতি দাবি জানায়। মােশতাক ভাের ৬টার পর থেকে রাষ্ট্রপতি না-থাকার ঘােষণা দিয়ে দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানান। তখন তারা ওসমানীকে এ-সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, মােশতাক প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায় প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে তার ক্ষমতা আপনাআপনি শেষ হয়ে গেছে। ডালিম তখন কর্কশভাবে ওসমানীকে বলেন :তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলুন। আমি জানি, আইয়ুব খান কেন আপনাকে বৃদ্ধ নকুল বলে ডাকতেন। কিন্তু এই অবস্থায় জেদ দেখাবার চেষ্টা করবেন না।”শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে প্রেসিডেন্ট মােশতাক কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ওসমানী মুজিবের হত্যাকারীদের দেশত্যাগের জন্য সেফ প্যাসেজের অঙ্গীকার দাবি করেন। সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষতি এড়ানাের জন্য এবং প্রয়ােজনে ইন্টারপােলের সাহায্যে ধরে আনা যাবে বিবেচনা করে তাওয়াবকে ফারুক-রশিদ গংদের ব্যাঙ্কক পৌছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। অভ্যুত্থানকারীরা তখনও না জানলেও ওসমানী ও খলিলুর রহমান (ডিফেন্স স্টাফ প্রধান) জেলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কথা জানতেন বলে ধারণা করা হয়। | ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় মােশতাক ও খালেদ মােশাররফের মধ্যে বঙ্গভবনের করিডােরে। উত্তেজিত বাক্য বিনিময়ের একপর্যায়ে সেখানে অবস্থানরত মেজর ইকবালের (পরে মন্ত্রী) নেতৃত্বে সৈনিকরা গুলি চালানাের প্রস্তুতি নিলে পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা ওসমানী শাফায়াতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘Stafayat’ save the situation. Dnot’ repeat Burma!” শাফায়াত তখন ইকবালকে বাধা দিয়ে মােশতাকসহ কেবিনেট কক্ষে প্রবেশশাফায়াত জামিল জানান, দরদস্তুরকারী দলটি ‘দুপুরের পর’ পাঠানাে হয়েছিল (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৩৫) অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৮ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অর), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫-৩৬। কর্ণেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়য়ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৮করেন। অন্য একটি সূত্রমতে, হঠাৎ দরজায় সজোরে চিৎকার শুনে ভেতরের গরম বাক্য বিনিময় থেমে যায়। শাফায়াত জামিল আরাে পাঁচজন অফিসার নিয়ে স্টেনগান হাতে কেবিনেট রুমে জোরপূর্বক ঢুকে পড়েন। এতে কেবিনেট রুমে ত্রাসের সঞ্চার হয় এবং মন্ত্রীরা চেয়ার ছেড়ে যে-যেভাবে পারে পালাতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট মােশতাককে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে দেখা যায়। তার মাথার উপর এক মেজর স্টেনগান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওসমানী তাকে বাঁচানাের জন্যে দৌড়ে যান এবং অনুরােধের সুরে বলতে থাকেন, ‘খােদার দোহাই, কিছু করােনা। এই অবস্থায় কিছু করা পাগলামাে ছাড়া আর কিছুই নয়। তােমরা দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলবে। প্রচণ্ড হটগােল বেশকিছুক্ষণ ধরে চলে। যতবারই বন্দুকধারী অফিসাররা মন্ত্রীদের প্রতি বন্দুকের নল উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ততবারই ওসমানী তাদের ধাক্কিয়ে ফিরিয়ে রাখছিল।’৭।কী বলিহারি দেশপ্রেম। মােশতাক ও তার দোসরদের মারলে বার্মার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, দেশ ধ্বংস হয়। আর শেখ মুজিবকে তার শিশুপুত্র ও পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনসহ হত্যা করলে সূর্যসন্তান’ আখ্যা পাওয়া যায়। আর এই ‘সূর্যসন্তানদের সেফ প্যাসেজের ব্যবস্থা করার জন্য গণতন্ত্রী ওসমানীর কী অন্তহীন। চেষ্টা!১৭ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১১
মাওলানা ভাসানীধারণা করা হয়, মাওলানা ভাসানী কারাগারে আটক থাকাকালে আইয়ুব খানের সাথে এক গােপন সমঝতায় পৌছেন। আইয়ুব খানের প্রতি নমনীয় মনােভাব এবং তার অনুসারী কয়েকজনের ওপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার হওয়াই এরূপ ধারণার ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ বলেন :১৯৬৩ সালে আইয়ুব খান ও মাওলানা ভাসানীর মধ্যে এক গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকের পর থেকে মাওলানা প্রকৃতপক্ষে সরকারবিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণে তীব্র অনীহা প্রকাশ করতেন এবং বিরত থাকতেন। কালক্রমে এই প্রবণতাই ন্যাপ (ভাসানী) আইয়ুব খানের গদি রক্ষার সহায়ক শক্তিতে পরিণত করে।১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যখন প্রবল ছাত্র আন্দোলন ও বিস্ফোরণােন্মুখ পরিস্থিতি তখন মাওলানা ভাসানী আইয়ুব কর্তৃক মনােনীত হয়ে সরকারি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে চীন সফর করেন। চীন কমিউনিস্ট’ দেশ হলেও ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর শত্রুর শত্রু বন্ধু সমীকরণে পাকিস্তানের সাথে তার নতুন সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। এ সময় মােল্লাদের একাংশও হঠাৎ করে স্মরণ করেন যে, মহানবী (দ.) জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন যাওয়ার কথা বলেছিলেন। হুজুগে বাঙ্গাল, হেকমতি চীনা’ প্রবাদকে প্রমাণ করতেই যেন ‘আন্তর্জাতিক দায়িত্ব হিসেবে বন্ধুদেশের নেতাকে এমন ‘অতিপ্রমুখ’ সমাদর করা হয় যে, ভাসানী একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েন। অতঃপর মাও সেতুং তাকে বলেন :আপনি আমাদের বন্ধু এবং বর্তমান সময়ে যদি আপনি আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে। আপনার সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তবে তা কেবল রাশিয়া, আমেরিকা ও ভারতের হাতই শক্তিশালী করবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি-বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে ধীরে ও সতর্কতার সাথে অথসর হতে উপদেশ দেই। আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব গভীর হওয়ার সুযােগ দেন।১২ অক্টোবর ১৯৫৭ তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৬২ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি পান। অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩৬৬। উল্লেখ্য, আইয়ুব খানের আমন্ত্রনে তিনি মার্চ ১৯৬৩ রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করেন। Tariq Ali, Pakistan Military Rule or Peoples Power, William Morrow and Company Inc, New York, 1970, Page 150. উদ্ধৃত ; ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, (দ্বিতীয় খণ্ড) ওয়ার্সী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৭, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪০বলা বাহুল্য, লাল চীনের সাথে শাদা-সবুজ পাকিস্তানের এই বন্ধুত্ব গভীর করার সুযােগ করে দেয়ার জন্যেই মাওলানার ‘don’t disturb Ayub’ উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে। তবে, আইয়ুব আমলে কয়েকমাস মাওলানাকে গৃহবন্দি করে রাখা হলেও এজন্য তাকে মােট ৯ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল বলে তৎকালীন আইনমন্ত্রী বিচারপতি ইব্রাহিম যে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তা-ও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে তথ্যাভিজ্ঞমহল মনে করে। | চীনা নেতাদের উপদেশে মাওলানা ভাসানী হয়ে পড়েন আইয়ুবের অনুগত। ফলে আইয়ুবের ‘মৌলিক গণতন্ত্র মাওলানার অনুসারীদের কাছে গণতন্ত্রের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে প্রতিভাত হয়। এরশাদের ‘ঝাড়ুদার মন্ত্রী আনােয়ার জাহিদ তাে পাকিস্তানে আইয়ুব আর ভাসানী এই দুই জন ছাড়া অন্য কোনাে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কণ্ঠস্বরই শুনতে পাননি। ডাকসাইটে এইসব অনুসারীরা কালে কালে যে সামরিক বেসামরিক সৈরাচারের সেবাদাস হয়েছেতার শেকড়ও এখানেই প্রােথিত। মাওলানা ভাসানীর এই নীতি আইয়ুবের উন্নয়নের দশক জুড়েই কার্যকর ছিল। তােফায়েল আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালের শুরুতে ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য ছাত্রনেতৃবৃন্দ মাওলানাকে অনুরােধ করলে তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় দলের সম্মেলনে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে এর সমর্থনে বিবৃতি দিতে পারছেন না বলে জানান। লক্ষণীয়, এই সময়কালে (৫ জানুয়ারি ১৯৭১) ন্যাপের ৮২৯ জন নেতাকর্মী মাওলানার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে দল থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগীদের অন্যতম হাজী দানেশ তার পদত্যাগপত্রে অভিযোেগ করে বলেন…।আমাদের ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে আপনার একনায়কত্ববাদী নীতি। ইসলামী সমাজতন্ত্রকে ন্যাপের লক্ষ্য হিসাবে ঘােষণা করার পূর্বে আপনি কখনও দলীয় কাউন্সিল অথবা ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলােচনা করার প্রয়ােজনবােধ করেননি। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা। ঘােষণার পূর্বেও আপনি দল, দলীয় কাউন্সিল অথবা ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলােচনার প্রয়ােজন বােধ করেননি।… দলের জাতীয় কাউন্সিল নির্বাচনে (১৯৭০) অংশগ্রহণের পক্ষে সিদ্ধান্তগ্রহণ করা সত্ত্বেও কোনাে পূর্ব সিদ্ধান্ত ছাড়াই আপনি নির্বাচন বর্জনের স্লোগান দেন। নির্বাচনেরআবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু, র্যডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১৯-২০ তারিক আলী, পাকিস্তান : মিলিটরি রুল অর পিপলস পাওয়ার, পূর্বোক্ত (দিল্লি সংস্করণ), পৃষ্ঠা ১৪৩ ২ নভেম্বর ১৯৭০ ঢাকা শহর থেকে মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী খাজা খয়ের উদ্দিন নির্বাচনকে পাকিস্তান টিকে থাকবে কি থাকবে না ইস্যুর গণভােট আখ্যা দেন। ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১-এ এসএম সােলায়মান, লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন (আহবায়ক, লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি), মেজর আফসার উদ্দিন, আতাউর রহমান খান, পীর মােহসীন উদ্দিন দুদু মিয়া, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখদের সমন্বয়ে সন্তোষে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভাসানী লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়নে ফিরে যানমাত্র কয়েকদিন পূর্বে আপনি হঠাৎ বিবৃতি দিয়ে দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানাের নির্দেশ দেন।… ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আপনি ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না; অথচ তখন ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। ১৯৬৮ সালে করাচি থেকে ফিরে এসে আপনি ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন যে, দেশে সামরিক আইন জারি হবে। আপনি বিশ্বাস করতেন যে, ইসকান্দার মির্জা ও আইয়ুব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন। আইয়ুবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলােকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শশাষকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যােগ ছিল।’…এই শশাষকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসকগােষ্ঠীর সাথে থাকা ‘যােগই প্রকৃত প্রস্তাবে মাওলানাকে শুরুতে ১১ দফা সমর্থনে বিরত রাখে। ‘দলের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অন্তত আইয়ুবী আমলে তিনি দল পরিচালনা করেননি, ওটা ছিল অজুহাত। তাছাড়া ১১ দফাতে অন্তর্ভুক্ত আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে তাে তিনি বহুপূর্বেই সিআইএ কর্তৃক প্রণীত বলে খারিজ করে দিয়েছিলেন। | মাওলানা ভাসানী ধর্মীয় ও অতিবাম রাজনীতির এক বিপজ্জনক মিশ্রণ। রেড মাওলানা অব দি ইস্ট’ -এর আচরণ প্রায়শই স্ববিরােধী ও রহস্যময়। ১৯৬৮-৬৯ সালে আইয়ুববিরােধী আন্দোলন যতই দানা বাঁধতে থাকে মাওলানার আচরণে স্ববিরােধিতাও ততই বাড়তে থাকে।২ জানুয়ারি ১৯৬৫ অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান নাজায়েজ নারীপ্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ থেকে মাত্র ২,৫৭৮টি (মৌলিক গণতন্ত্রীর) ভােট বেশি পান। সকল সুযােগ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পরও এই ফলাফল আইয়ুবের জনসমর্থনহীনতার পরিচায়ক। সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধাবসানে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আইয়ুব কর্তৃক পাকিস্তানকে হেয় করার শামিল গণ্য করে। ফলে উভয় অংশেই তার সমর্থন হ্রাস পায়। ১৯৬৭ সালের শেষদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হয়। ১৯৬৮ সালের ২০ জুন ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ১৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্যদান সমাপ্তির তারিখ নির্ধারিত হয়। ২৭ অক্টোবরে আইয়ুবের ক্ষমতা দখলের ১০ বছর পূর্তিতে উন্নয়নের এক দশক’ ‘তামাশার আয়ােজন বাঙালির জন্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটারূপ প্রতিক্রিয়া হয়। নভেম্বর থেকে আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দল আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করে। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষ্য সমাপ্তির দিনে) সকল বিরােধীদল মিলে জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে।| পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মাওলানাও আন্দোলনের মাঠে নামেন এবং ১৩-র পূর্বে ৬ ডিসেম্বর পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই স্বউদ্যোগে জুলুম প্রতিরােধ দিবস আহ্ববান করেন। এদিন”পল্টনে জনসভায় ১২ ডিসেম্বর হরতাল আহ্বান করেন। তদুপরি স্কুটার ড্রাইভারদের অনুরােধে ৭ ডিসেম্বরও হরতাল ডাকেন। নীলক্ষেত এলাকায় পিকেটর’ স্কুটার ড্রাইভারদের দমন করতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ৩ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয় এবং পাঁচ শতাধিক লােক গ্রেফতার বরণ করেন। এই নির্যাতনের প্রতিবাদে সকল রাজনৈতিকদল পরদিন পুনঃ হরতাল ঘােষণা করে। ৮ ডিসেম্বর মাওলানা তার ১২-র অতিরিক্ত ১১ ডিসেম্বর আবার হরতাল আহ্বান করেন। স্বভাবতই মাওলানার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং তিনি ‘জ্বালাও পুড়াও’ নেতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। যাহােক ১৩ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জুলুম প্রতিরােধ দিবস হরতালে রূপ নেয়। আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। | উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে মুজিবসহ সকল রাজবন্দি মুক্তিলাভ করে। এঁদের মুক্তির জন্য মাওলানাও বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়ায়, তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায়, মাওলানাও ঈর্ষান্বিত বােধ করতেন। এ সময় মাওলানার মধ্যে আরও একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়-তিনি ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। বদরুদ্দিন উমরের ভাষায় :১৯৬৯ সালের মার্চ মাসের গােড়া থেকেই মাওলানা ভাসানী ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রচারক। প্রায় পনেরাে ষােল বছর পর রাজনীতির ক্ষেত্রে সেই প্রথম তার ইসলাম আমদানী।… সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে মাওলানার ইসলামী সমাজতন্ত্রের ধ্বনী আকস্মিক হলেও তার আসল উদ্দেশ্য জনগণের গণতান্ত্রিক অগ্রগতিকে রােধ করা।২১ মার্চ ১৯৭০ পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রাকালে ঢাকা বিমানবন্দরে ভাসানী মন্তব্য। করেন :পূর্ববাংলায় হিন্দু বামপন্থী নেতারা তাদের ভক্ত নগণ্য মুসলমান কর্মীদের সাথে নিয়ে ন্যাপ ও কৃষক সমিতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। … পূর্ববাংলার জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ জনই মুসলমান, কাজেই তাদের এ-ব্যাপারে বিভ্রান্ত করা। সম্ভব নয়।” ভাসানীর এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বদরুদ্দিন উমর বলেন : বামপন্থী নেতাদেরকে হিন্দু হিসাবে আখ্যায়িত করে মাওলানা ভাসানী যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইছেন, তা মূলত মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামীর উদ্দেশ্য থেকে পৃথক নয়, বরং তার পরিপূরক।… রাজনীতিতে ধর্ম টেনে। আনার এর থেকে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? এই কাজই তাে এতদিন পর্যন্ত এদেশে মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামী একটানাভাবে করে এসেছে। মাওলানা ভাসানীও -এ কাজে শরিক হয়েছেন।”…আজাদ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৮ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ১২ এপ্রিল ১৯৭০ দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভার, ২২ মার্চ ১৯৭০ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ২৯ মার্চ ও ১৯ এপ্রিল ১৯৭০উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান মানুষকে রাজনীতিমুখী করে তালে। এতদিন রাজনীতি ছিল কতিপয় রাজনীতিকদের বিষয়। এ নিয়ে তারাই ভাবতেন, কর্মসূচি দিতেন। সংশ্লিষ্ট কিছু লােক এসবে যােগ দিত। কিন্তু এখন এমনকি গ্রামের খেয়াঘাট-চায়ের দোকানও রাজনীতির আলােচনায় মুখর। ৬ দফা, ১১ দফা, আগরতলা মামলা, নির্বাচন, মুজিব প্রভৃতি নিয়ে নিত্য তর্ক, যুক্তি, অভিমত শােনা যায়। এ সময় হঠাৎ করে মাওলানা ঘােষণা দিলেন, তিনি আর কৃষক সমাবেশ করবেন না। ১ জুন ১৯৭০ থেকে তিনি গ্রামে গ্রামে চোর-ডাকাত ধরবেন। তিনি আশা করেন, ইয়াহিয়া না হলেও সাহেবজাদা ইয়াকুব খান (পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রধান) একজন পরহেজগার মুসলমান হিসাবে তাকে নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন।বলতে কি, এ-ও এক ‘রাজনীতি’ এবং এর কুফল সম্পর্কে বদরুদ্দিন উমরের ভাষ্য হচ্ছে :এদেশের সামন্ত-বুর্জোয়া শশাষকদের সাথে পরােক্ষভাবে হাত মিলিয়ে মাওলানা ভাসানী চোর-ঘুসখাের ধরার যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন তার স্বরূপ সম্পর্কে আজ গণতান্ত্রিক কর্মীদেরকে সচেতন হতে হবে।”বস্তুত রাজনীতি থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্যই তিনি এসব ফালতু কর্মসূচি দিচ্ছিলেন। তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও গণতান্ত্রিক শক্তি এ নিয়ে ব্ৰিত ও শঙ্কিত হলেও দৈনিক পূর্বদেশ’ ‘সংগ্রাম’ প্রভৃতি ডানপন্থী মহল মাওলানাকে সাধুবাদ জানায়।১৪| ‘চোর পালানাের পর মাওলানা আবার তার বুদ্ধি বাড়ার প্রমাণ দিলেন। ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০ সন্তোষে (টাঙ্গাইল) এক কৃষক সমাবেশে তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তের পরিকল্পনা সংবলিত একটি গােপন সিআইএ রিপাের্ট তিনি পেয়েছেন। এর একটি কপি তিনি ইয়াহিয়ার কাছে। পাঠিয়েছেন, অপর এক কপি জনগণের জ্ঞাতার্থে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য মােহাম্মদ তােয়াহাকে (ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক) দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তােয়াহা তা প্রকাশ করেননি। এই অভিযােগের উত্তরে তােয়াহা জানাচ্ছেন :যখন সন্তোষে মাওলানা সাহেব আমার ওপর দোষ আরােপ করিতেছিলেন, তখন সন্তোষেই ঐ দলিলের কয়েকশত সাইক্লোকরা কপি ছিল, তাকে তা জানানােও হয়, কিন্তু তিনি তা সেখানে বিলি করেন নাই।”১২ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ২৬ এপ্রিল ১৯৭০সাপ্তাহিক গণশক্তি, ১০ মে ১৯৭০ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৩ মে ১৯৭০ ও দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ মে ১৯৭০ বাংলাদেশ অবজারভার, ২০ জানুয়ারি ১৯৭০ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ৩১ মে ১৯৭০| তােয়াহা যদি তা প্রকাশের দায়িত্ব পালন না করে থাকেন, ভাসানী নিজেই তা করতে পারতেন এবং তার উচিত ছিল এসব তথ্যের সূত্র ও বিবরণ সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বিভ্রান্তির অবসান ঘটানাে। তিনি এ-কাজ না করায় জনগণ তার উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে স্বভাবতই নানা প্রশ্ন তুলে এবং এসব প্রশ্ন তুলেই তখন দলে দলে তার কর্মীরা তাকে ত্যাগ করে।১৯৭০ সালে পাকিস্তান যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমনি সময় ১২ নভেম্বর (১১ নভেম্বর রাতের শেষ প্রহরে) পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্রোপকূলাঞ্চলে ঘটে যায় এক প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড়। এতে ১০ লক্ষাধিক মানুষ নিহত ও তাদের ঘরবাড়ি, পশুপাখি, ফল-ফসল প্রভৃতি যাবতীয় সম্পদহানী হয়। আহতদের উদ্ধার ও ত্রাণকার্য ছিল অপ্রতুল এবং শুরুও হয় দেরিতে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘ওরা কেউ আসে নি। পঁয়ষট্টির পাকভারত যুদ্ধের পর প্রদেশবাসী আবারও দেখল শােকে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। তাই কাদো দেশবাসী কাঁদো’ বলার পাশাপাশি নিজেরাই ঝাপিয়ে পড়ে ত্রাণকার্যে। এসব অবহেলা, শশাষণ-বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয় ক’দিন পরের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯ -এর মধ্যে ১৬৭টি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধকৃত আসনে জয়লাভ করে-যা সমগ্র পাকিস্তানের ৩১৩টি আসনের তিপ্পান্ন শতাংশের বেশি। | নির্বাচনের এই ফলাফল ছিল পাক-সামরিক শাসক ও তাদের গােয়েন্দাবিভাগের হিসেবের বিপরীত। মাওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ভােটের আগে ভাত (স্বায়ত্বশাসন) চান। কিন্তু কোনাে সাড়া পাননি। তার দলের যে অল্পকজন প্রার্থী ছিল তারাও শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পরপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে (৯ ডিসেম্বর) তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন-সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানিদের রায় যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি গণভােট অনুষ্ঠানের দাবি করেন। তিনি বলেন, দুদিন আগে একটি নির্বাচনে জনগণ যে রায় দিল, তা কোনাে ব্যক্তি বা পার্টি কিংবা দফার জয় নয়। তিনিএ নির্বাচনের রায় ৬ দফা, ১১ দফা ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনগণের রায়’ বলে শেখ মুজিবের এই ঘােষণাকে নাকচ করেন।” স্মর্তব্য, নির্বাচনের প্রাক্কালে ৫ নভেম্বর ১৯৭০ রেডিও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে জাতির উদ্দেশে মাওলানা বলেছিলেন :Even if there are thousands of differance among us; all should love Pakistan. … The name of this country is Pakistan, there is no such country anywhere in the world.১৭ দৈনিক পাকিস্তান, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭০স্বাধীনতার দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৫৭উল্লেখ্য, নির্বাচনী ফলাফলকে অস্বীকার করে পিডিপি নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের ‘আবেগ ও উত্তেজনার পরিবেশে দেশে এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে’ এবং জামাতের নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি’ মন্তব্যের সাথে প্রাচ্যের লাল মাওলানা’র সুর। কী করে একই মূৰ্ছনায় বেজে ওঠে-তা নিশ্চয়ই কৌতুহলােদ্দীপক! ১ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া ‘ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জাতীয় পরিষদের (৩ মার্চ অনুষ্ঠেয়) বৈঠক স্তগিত করলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে পথে নেমে আসে। ৭ মার্চ মুজিব ‘অসহযােগ’ কর্মসূচি ঘােষণা করেন। মানুষ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। এ সময় ভাসানী ও তার সহযােগীরা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। মেননের ভাষায় :এ সময় আমরা অস্ত্র সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে এ সময়েই আমরা বিস্ফোরক দ্রব্য ছিনতাই করি। এজন্য অসহযােগ আন্দোলনে আমরা ছিলাম না।”২৫ মার্চের পর পাকবাহিনী মাওলানার সন্তোষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তিনি যমুনায় নৌকায় আশ্রয় নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আসামের গােয়ালপাড়া জেলার শিশুমারীতে আশ্রয় নেন। সেখানে ইন্দিরার মন্ত্রী মঈনুল হকের সাথে বৈঠকের পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর ম্যানসনের পাঁচতলায় একটি ফ্ল্যাটে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সেখানেই মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের সাথে তার এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পর পুনঃ আসামের ভাসান চরে যাওয়ার পথে কুচবিহারে পুনডিবাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিমানযােগে দিল্লি নেয়া হয়। সুস্থ হওয়ার পর ইন্দিরার সাথে এক একান্ত বৈঠকশেষে পূর্ণ বিশ্রামের জন্য তাকে দেরাদুনের শৈত্যাবাসে পাঠানাে হয়। ৩১ মে বাংলাদেশের কোনাে এক স্থানে (মতান্তরে কলকাতায়) অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সকলপ্রকার প্রস্তাব। সরাসরি নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া ছাড়া অন্য কোনােভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।* নসরুল্লাহ্ খান ৩ জানুয়ারি ১৯৭০ খ্রি. ৬ দফার জন্য মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ভােটের আগেভাত চাওয়ার জন্য ভাসানীকে হনুমান বলে অভিহিত করেন (সিরাজউদ্দিন আহমেদ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা। ২৬৪) ড. মােহাম্মদ হাননান -এর সাথে রাশেদ খান মেননের সাক্ষাৎকার। উদ্ধৃত :বাংলাদেশের ছাত্র। আন্দোলনের ইতিহাস পূর্বোক্ত, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পৃষ্ঠা ১৬০ মাওলানা ভাসানী যখন বিভাগপূর্ব আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ও আসাম আইনসভার সদস্য ছিলেন, তখন মঈনুল হক মুসলিম লীগের একজন তরুণ নেতা ছিলেন একই ফ্ল্যাটে জোহরা তাজউদ্দিন সন্তানদের নিয়ে বাস করতেন। তাজউদ্দিন স্বয়ং থিয়েটার রােডে (বর্তমান সেক্সপিয়ার সরনি) বাংলাদেশ সরকারের সবিচালয়ে বাস করতেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৬২৪ জুন ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে তিনি। বলেন, একমাত্র পথ পূর্ণ স্বাধীনতা, নাহয় মৃত্যু।”২৪ | ৮ সেপ্টেম্বর তিনি দেরাদুন থেকে কলকাতা আসেন এবং সরকারের উপদেষ্টা কমিটিতে যােগ দেন। এ সময় তিনি আবার আসাম যান এবং সেখান থেকে ফিরে। এসে দেরাদুনের শৈত্যাবাসে ৭ সপ্তাহকাল অবস্থান কালে চীনের মাও সেতুং -এর কাছে বাংলাদেশকে সমর্থন জানানাের জন্য তারবার্তা প্রেরণ করেন। | স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যপর্নের আগের দিন (২১ জানুয়ারি ১৯৭২) আসামের ফকিরগঞ্জের এক জনসভায় মাওলানা বলেন, বাংলাদেশের জনগণ মিসেস গান্ধীর মতাে দয়ালু মহিলা এবং ভারতীয় জনগণের সহানুভূতির কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না : তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতবর্ষের মতাে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।১২ মার্চ ১৯৭২ ভারতীয়বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যায়। ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী শুভেচ্ছা-সফরে বাংলাদেশে আসেন। এদিন দু-দেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী, সহযােগিতা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ২৪ মার্চ মাওলানা বলেন ‘ভারতই যে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে ভারত তার প্রমাণ দিয়েছে। আমি তা কখনাে ভুলতে পারি না।’ তিনি চান, দেশের সমস্যাগুলাে সমাধান করতে জনগণ মুজিব সরকারকে দুই-তিন বছর অন্তত সময় দেবে। কিন্তু তিনি নিজেই সময় দিলেন না। মে মাসের শুরুতেই ‘মাওলানা ভাসানী খােলাখুলিভাবে সরকারের ও তার মিত্র দলগুলির সমালােচনা শুরু করেন। এইটি বােধহয় তার চৈনিক লাইনের প্রতিফলন। তিনি ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন। হক কথা ও অপর মাওবাদী হলিডে’ সত্য-মিথ্যা-গুজব সংমিশ্রণে আজগুবি ‘খবর প্রচার করে মানুষকে সরকার এবং ভারত ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। এরা কথায় কথায় সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার’ গাল দিয়ে খুব আনন্দ পেতেন। “চির বিদ্রোহী’ মাওলানা ভাসানী ৩ সেপ্টেম্বর২৫ সিরাজউদ্দিন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০৪স্বাধীনতার পরপর ১১ সদস্যদের জাতীয় মিলিশিয়া কেন্দ্রীয় বাের্ডেরও তিনি সদস্য হন। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে ভারতীয় লােকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত সরকার মাওলানা ভাসানীকে ভিআইপি হিসাবে গণ্য করেন। তার থাকা-খাওয়া এবং চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় ভারত সরকার বহন করে। হাত খরচের জন্য তাকে মাসিক দু’ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয় এবং শুধুমাত্র তার চিকিৎসার জন্য ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। দ্র. Jyoti Sen Gupta, Histroy of Freedom Movemuent in Bangladesh, Naya Prokash Calcutta, 1974, page 461 Press Trust of India report date-line south Salmara, 22 January 1972. To: আবদুল মতিন, জেনভায় বঙ্গবন্ধু, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৬ কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্নআশার দিনগুলি, দিনলিপি :১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ১৪ জুন ২০০২১৯৭২ ঢাকায় ভূখা মিছিল সংগঠিত করেন। এ উপলক্ষে পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় তিনি মানুষ বাঁচানাের জন্য জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানান। তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করছে দাবি করেন আবার বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার সমন্বয়ে ‘রহস্যঘেরা’ বৃহত্তর বঙ্গ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তার এই ধরনের বক্তব্যে স্বভাবতই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। পরদিন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমদ এ দাবিকে উদ্ভট ও ভিত্তিহীন। আখ্যায়িত করে দেশে একটিও ভারতীয় সৈন্য থাকলে তা প্রমাণ করার জন্য ভাসানীর প্রতি আহ্বান জানান। তাজউদ্দিন আহমদ এর নিন্দা করে বলেন, জনগণের সৌভ্রাতৃত্ব নষ্ট করার বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র ও পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি পূর্বাপর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ভাসানীকে ‘সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদের ক্রীড়নক’ বলে দাবি করে। ভারতের পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা প্রমােদ দাশগুপ্ত এক বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানীর বৃহত্তর বাংলার সাথে তার আন্দোলনের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্যের সংকট স্বাভাবিক হলেও ভাসানী একে রাজনীতিকরণ করেন এবং ‘ভারত’কে রাজনীতির উপাদানে পরিণত করে পাকিস্তানি আদলের ভারতবিরােধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অশুভ সূচনা করেন। ১৫ মে ১৯৭৩ ভাসানী ৩ দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন। ১৬ মে শেখ মুজিব তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তিনি অনশন ভাঙেননি উপরন্তু ২১ মে সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। ঐদিন হরতাল চলাকালে এশীয় শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে নির্মিত ভিয়েতনাম মণ্ডপ বিধ্বস্ত করা হয়। ২২ মে তিনি অনশন ভাঙলেন বটে তবে ২৯ আগস্ট পুনঃ হরতাল আহ্বান করেন। ভাসানী ন্যাপ একটি পুরনাে দল এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এর ভিত্তি থাকলেও এর রাজনীতি এবং ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মওলানা ভাসানীসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের অসঙ্গতিপূর্ণ ভূমিকার কারণে বেশ আগেই এরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানী ন্যাপের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১০ ডিসেম্বর ১৯৭২। সম্মেলনে ভাসানীকে চেয়ারম্যান ও কাজী জাফরকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু অব্যাহত কোন্দলের ফলে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৩ নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দেয়া হয় এবং ৪ মার্চ যাদুমিয়া পুনঃ সাধারণ সম্পাদক রূপে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে ১৫ জুলাই মাওলানা সুধারামী ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে তলবী ন্যাপ’ গঠিত হয়। ইতােমধ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ মাওলানা ভাসানীভুট্টো লণ্ডন থেকে বিশেষ বাহকের মাধ্যমে একড জনের মতাে চিঠি সন্তোষে মাওলানার নিকট পাঠান। এগুলােতে তিনি মুসলিম বাংলার ব্যাপারে মাওলানার সাহায্য চান এবং বিনিময়ে তিনি ভাসানীর আশা পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। (জ্যোতি সেন গুপ্ত, হিস্ট্রি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বাংলাদেন র্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৭৬)। দু’বছর আগে এমন একটি প্রস্তাবকে তিনি সিআইএ-এর প্রস্তাব বলে আখ্যায়িত করে প্রকাশ করতে চেয়েও করেননি বলে ব্যাপক প্রচার রয়েছে। এসব প্রতিক্রিয়া ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ থেকে পর পর কয়েকদিন ‘সংবাদসহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায়। প্রকাশিত হয়।বিক্ষুদ্ধ হয়ে হুকুমতে রাব্বানী পার্টি গঠন করেন। এরপর ক্রমে তিনি নিজেকে রাজনীতিবিদ পরিচিতির ওপর ‘পীর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করার অধিকার আওয়ামী লীগের নেই। প্রস্তাবিত চার মূলনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি পবিত্র কোরান, সুন্নাহ ও হাদিসকে ভিত্তি করে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার আহ্বান জানান। আবার তিনিই ৭ মার্চ ১৯৭৩ অনুষ্ঠিত। ‘নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশে অবিমিশ্র সমাজতন্ত্র কায়েমের ইঙ্গিতবহ’ বলে মন্তব্য করেন। মুজিবের ভাষায়, মাওলানা ভাসানীকে চেনা দুষ্কর। তাকে খুশি করা আরও কঠিন। মাওলানা ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ গঠিত বাকশালে যােগ দেননি। তবে (৮ মার্চ) টাঙ্গাইলের কাগমারিতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি মঞ্চে উপবিষ্ট মুজিবকে দোয়া করে বক্তৃতা করেন। আবার মুজিব নিহত হবার পর পর মুজিব সরকারকে হঠানাের জন্য সাহসের তারিফ করে মােশতাককে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি তারবার্তা প্রেরণ করেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিদ্রোহী কৃষক জনতার নেতৃত্বদানকারী ফাদার গ্যাপনের সাথে মাওলানা ভাসানীর তুলনা করা চলে। সংগ্রামী। জনগণের নেতৃত্ব দেয়া সত্ত্বেও এরা দুজনই ছিলেন সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীল নেতা।৩২১৭। মর্ণিং নিউজ, ঢাকা, ৮ অক্টোবর ১৯৭২ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ ” রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫ আবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০ আবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু পৃষ্ঠা ২২ ইত্তেফাকভারত-ভাগের পর পশ্চিমবঙ্গীয় মাওলানা আকরাম খাঁর ‘আজাদ’ (মুসলিম লীগের। নাজিমউদ্দিন গ্রুপের সমর্থক) ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। সােহরাওয়ার্দী-সমর্থক ইত্তেহাদ’। কলকাতায় রয়ে যায়। কিছুদিন পর তুচ্ছ অজুহাতে কলকাতার আনন্দবাজার, যুগান্তর’, ইত্তেহাদ’ প্রভৃতি ‘পূর্ব-পাকিস্তানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। | ‘পূর্ববাংলায় আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে ১৯৪৯ সালে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রস্তাবিত ইত্তেহাদ’ নামে সাপ্তাহিক প্রকাশের অনুমতি দেয়া না হলে, একটু পাল্টে নাম রাখা হয় ইত্তেফাক’। মাওলানা ভাসানী এর। প্রতিষ্ঠাতা, ইয়ার মােহাম্মদ খান প্রকাশক ও ফজলুর রহমান খাঁ সম্পাদক হন। নিদারুণ সংকটের মধ্যদিয়ে ইত্তেফাকের যাত্রা শুরু হয়। মাওলানা ভাসানী এবং শেখ। মুজিব যেখানেই আওয়ামী লীগের সভা করতে যান, সেখানেই ইত্তেফাকের জন্য চাদা। তােলেন। মুসলিম লীগ সরকারের কাছে তখন ইত্তেফাক রাষ্ট্রদ্রোহীদের কাগজ এবং মার্কিনিদের কাছে ছদ্মবেশী কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত বিপজ্জনক পত্রিকা। একপর্যায়ে মুজিবের অনুরােধে মানিক মিয়া (তফাজ্জল হােসেন) ইত্তেফাকের দায়িত্ব। নেন। তখন তিনি সম্পাদকীয় লিখতে জানেন না, কোনােদিন রিপাের্টও লিখেননি। সুতরাং প্রথম দিকে যুক্ত হলেন পত্রিকা ব্যবস্থাপনায়। | বরিশাল কালেক্টটের কেরানি মানিক মিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের ‘প্রােপাগান্ডা অফিসার নিযুক্ত হয়ে জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ানোের সময়। সােহরাওয়ার্দীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং তিনি তাকে কলকাতায় নিয়ে যান। রাজনীতির প্রতি উৎসাহী মানিক মিয়া সরকারি চাকরি ছেড়ে মুসলিম লীগের কাজ শুরু করেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর সােহরাওয়াদী বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে দৈনিক ইত্তেহাদ বের করেন এবং মানিক মিয়া সেখানে চাকরি পান (সাংবাদিকতার নয়)।| দেশভাগের পর তিনি চরম আর্থিক দুরবস্থায় পড়েন। এ সময় তিনি ইনফরমেশন অফিসার পদে ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য বরিশাল থেকে ঢাকা আসেন। হােটেলে থাকার পয়সা না থাকায় মােগলটুলীতে ছাত্রলীগ-অফিসে ওঠেন। ছাত্রলীগ তখন বাংলা ভাষা। দাৰি দিবস (১১ মার্চ) পালনের আয়ােজনে ব্যস্ত। সে-রাতে দাবি দিবস উপলক্ষে ছাত্রদের এক গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ খবর পেয়ে শেষরাতে হানা দিয়ে কয়েকজন ছাত্রনেতার সাথে মানিক মিয়াকেও ধরে থানায় নিয়ে যায় এবং যখন তিনি১ ঢাকার কারকুন বাড়ি লেন থেকে এটির প্রকাশনা শুরু হয়। আব্দুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পাঁচত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬০ছাড়া পান ততক্ষণে ইন্টারভিউর সময় উত্তীর্ণ। পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকায় চাকরির ব্যাপারে তিনি বেশ আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু এখন তার সংসারের কী উপায় হবে ভেবে একেবারে ভেঙে পড়েন। এ-সময় মুজিব এসে পাশে দাঁড়ালেন, তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, মানিক ভাই, ভাববেন না। আপনি বরং ইত্তেফাকের ভার নিন। আমি আর মাওলানা (ভাসানী) সাহেব ভিক্ষা করে হলেও টাকা জোগার করে দেব।| মানিক মিয়া রাজি হলেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা বরিশাল থেকে নিয়ে এসে কমলাপুরের এক বস্তিতে বাসা নেন। হঠাৎ ‘মােসাফির’ ছদ্মনামে রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ শিরােনামে নূরুল আমীনের মুসলিম লীগ রাজত্বের কীর্তিকাণ্ড নিয়ে তিনি এক নিবন্ধ লিখেন। ‘ভাষা গ্ৰাম্য, ব্যাকরণগত ভুলে ভর্তি। কিন্তু যুক্তি ও আক্রমণ তীব্র’। প্রথম লেখাতেই চারদিকে হৈচৈ পড়ে গেল। শুরু হল মােসাফিরের নিয়মিত কলামরাজনৈতিক ধোঁকাবাজি; শুরু হল সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের জয়যাত্রা। ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ (শহর বাংলা) থেকে পূর্ববঙ্গ (গ্রামবাংলা) বিছিন্ন হয়। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামবাংলায় তার উপযােগী নেতৃত্ব, সংগঠন, সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক প্রচারের চাহিদা ছিল। এই চাহিদা পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন ভাসানী-মুজিব, ইত্তেফাক ও মানিক মিয়া (মােসাফির)। ইত্তেফাক সাধারণ মানুষের সহজবােধ্য ভাষার কাগজ হওয়ায় প্রথমদিকে নাক উঁচু শিক্ষিতদের কেউ ঠাট্টা করে একে ‘বিড়িওয়ালা ও লুঙ্গিওয়ালাদের’ কাগজ বলত। মােসাফিরের রাজনৈতিক কলামের ভাষারীতিও ছিল গ্রাম্য ও অপরিশীলিত। প্রচলিত ও অপ্রচলিত গ্রাম্য গল্প ও প্রবাদে ভর্তি। ফলে সাধারণ অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাছে এর আবেদন ছিল বিপুল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, লীগ। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলা হয় ‘নূরুল আমীনের চোখে বিড়ালে মুতিয়া দিয়াছে’ অন্যত্র, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলা হয় বাজারে গিয়াছিলাম। গরুর দামে একটা মুরগী কিনিয়া। লইয়া আসিয়াছি।’ এভাবেই গাফফার চৌধুরীর ভাষায়, ভাসানী-মুজিব-মানিক মিয়ার। মাধ্যমে গ্রামবাংলায় শুরু হয় এক নবজাগরণ (‘রাইজ অব রুবাল বেঙ্গল’)।১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি দৈনিক পত্রিকার প্রয়ােজন অনুভূত হওয়ায় ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর (মতান্তরে ২৫ ডিসেম্বর) ইত্তেফাক দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দৈনিক ইত্তেফাক সারাদেশে যুক্তফ্রন্টের মুখপত্ররূপে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। | নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে বিপাকে পড়ে। ফজলুল হক তার ভাগ্নে সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া)-কে মন্ত্রী করতে চাইলে সােহরাওয়ার্দী। মুজিবকেও মন্ত্রী করার দাবি জানান। এমতাবস্থায় ৩ এপ্রিল ফজলুল হকসহ মাত্র চারজন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন (সংকট কাটিয়ে পুরাে মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ১৫ মে)। এ নিয়ে আওয়ামী লীগেও দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ইত্তেফাকে কেউ কেউ মাওলানা ভাসানীর১. আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬২ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৩সমালােচনা করতে থাকেন। এমতাবস্থায় ১৪ মে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকার জেলা প্রশাসন (ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াহিয়া চৌধুরি) থেকে ইয়ার মােহাম্মদ খানের স্থলে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে প্রিন্টার ও পাবলিশার করা হয় (পূর্ব থেকেই তিনি সম্পাদক ছিলেন) এবং মাওলানা ভাসানীকে প্রতিষ্ঠাতার স্থলে পৃষ্ঠপােষক করা হয় (পরে সুযােগমতাে মাওলানাকে পৃষ্ঠপােষকতা থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয় এবং প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মানিক মিয়ার নাম ছাপা হয়)। অর্থাৎ মালিকানা কু করা হয়। দলের ঐক্য ও ভাবমূর্তির কথা বিবেচনা করে মাওলানা বা ইয়ার মােহাম্মদ এর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেননি। ফলে ভাসমান মানিক মিয়া হলেন সম্রান্ত পত্রিকা মালিক। ইত্তেফাকের প্রথম যুগে এর বেতনভুক সম্পাদক মানিক মিয়া চীন সফর করে ফিরে এসে নয়া চীনে কি দেখিলাম’ শিরােনামে সমাজতান্ত্রিক চীনের তাৎপর্য জন-জ্ঞাতার্থে। তুলে ধরছিলেন। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সেদিন সাম্রাজ্যবাদী, যুদ্ধবাজ হিসেবে আখ্যায়িত করছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তার কলম গতিপথ পরিবর্তন করে মার্কিনপন্থী হয়ে যায়। কমিউনিস্টরা তখন তার ভাষায় ‘লালমিয়া’ বই কিছু নয়। | ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনামলে ‘অত্যাসন্ন পাকিস্তান বিভক্তির আশঙ্কায় ‘স্বপ্রণােদিত হয়ে পাকিস্তান বিভক্তি ঠেকানাের চেষ্টায় নিয়ােজিত থাকাকালে’ ১৯৬৯ সালের ৩১ মে রাতে রাওয়ালপিন্ডিতে মানিক মিয়া মারা যান। তার নেতা সােহরাওয়ার্দীর পাশে সরকারি জায়গায় কবরস্ত করার জন্য স্বয়ং মুজিব অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হয়ে তাকে আজিমপুরে কবরস্ত করা হয়। মুজিব নিজের কাঁধে তার মানিক ভাইয়ের লাশ বহন করে কবরস্থানে নিয়ে যান। | মানিক মিয়ার মৃত্যুর পরই ইত্তেফাকের ‘জাতীয়তাবাদী’ ভূমিকার ইতি ঘটে। ইত্তেফাক পরিণত হয় আওয়ামী লীগের ভেতরে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও মার্কিনঘেঁষা লবীটির মুখপত্রে। উল্লেখ্য, শুরুতে ইত্তেফাক ৬ দফাকে সমর্থন করেনি। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধকে ইত্তেফাক সমর্থন তাে করেইনি বরং বিরােধিতা করেছে। একাত্তরের মার্চে পাকবাহিনী ‘পিপল,’ ‘সংবাদ’ ও ‘ইত্তেফাক’ কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়। সংবাদ ও পিপল স্বাধীনতার পরই কেবল পুন: প্রকাশিত হয়। কিন্তু ইত্তেফাক মাত্র ক’দিন পরই পুনঃ প্রকাশিত হয়। শােনা যায়, জেনারেল টিক্কা এজন্য মােটা টাকা ক্ষতিপূরণ” দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় মানিক মিয়ার এক ছেলেও মুজিবনগর যায়নি। এ সময় অন্য কোনাে বাঙালি অনুমতি না পেলেও, মানিক মিয়ার এক পুত্র টিক্কার অনুমতি নিয়ে লন্ডন সফর করার সুযােগ পান। সেখানে তার সাথে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে যােগাযােগ করে মুজিবনগর থেকে ইত্তেফাক প্রকাশের অনুরােধ জানানাে হয়। তিনি সে-অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করে শক্রকবলিত ঢাকায় ফিরে এসে ঢাকা থেকে ইত্তেফাক৪. সিরাজ উদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০২ এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৯। আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১প্রকাশ করতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনা-লেখক সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু | সারেন্ডার’ গ্রন্থে মঈনুলকে পিতার সুযােগ্য পুত্র’ অখ্যায়িত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধবিরােধী।ভূমিকার জন্য সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিন উভয়ই ইত্তেফাকের প্রতি বিরূপ ছিলেন। কিন্তু মুজিব স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে ‘পুত্রবৎ’ ‘হিরাে-মঞ্জুকে’ (মানিক মিয়ার দু’ ছেলের ডাকনাম) ক্ষমা করে দেন। অথচ মঈনুল ১৯৬৭ সালে তার কাকা মুজিবের ওপর আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখিত একটি কবিতা ইত্তেফাকে ছাপেননি। উপরন্তু | শেখ মুজিবকে অত বড় করে না দেখিয়ে আন্দোলন নিয়ে কবিতা দেখার জন্য তিনিকবিকে উপদেশ দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুজিব মিশর ও সিংহলের মতাে সংবাদপত্র শিল্পকে জাতীয়করণের আওতায় আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মানিক মিয়ার ইত্তেফাক পত্রিকা ও মানিক মিয়ার পরিবারের প্রতি দুর্বলতাবশত তিনি তা করেননি। অথচ একটি দৈনিক পত্রিকা ছাপাখানাসহ প্রতিষ্ঠায় তখন জাতীয়করণের জন্য নির্ধারিত সীমা ২৫ লক্ষ টাকার বেশি মূলধন প্রয়ােজন ছিল। এছাড়া ইত্তেফাককে ব্যক্তিমালিকানায় রাখার অনুমতি দিতে গিয়ে বাংলার বাণী’, জনপদ প্রভৃতিকে প্রকাশে অনুমতি দিতে হয়। সর্বশেষ বাকশালী’ নিয়ন্ত্রণের যুগেও বাংলাদেশের প্রগতিবিরােধী’ ইত্তেফাক প্রকাশে অনুমতি পায়। | ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও একদলীয় (বাকশাল) ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রতিবাদে ব্যারিস্টার মঈনুল হােসেন ও এমএজি ওসমানী জাতীয় সংসদের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। কিন্তু মঈনুল হােসেন গণতান্ত্রিক নীতি আঘাতপ্রাপ্ত হবার কারণে পদত্যাগ করেননি। তিনি তার প্রভুর আশীর্বাদেই তা করেছিলেন। মুজিবের মৃত্যুর পর মােশতাক আওয়ামী লীগারদের জয় করতে ব্যর্থ হয়ে ডেমােক্রেটিক লীগ গঠন করলে মঈনুল হােসেন এতে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে যােগ দেন। গণতন্ত্রের কী পরাকাষ্ঠা! | ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ -এর মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার পটপরিবর্তন সম্পর্কে। পরদিন ইত্তেফাক বলে :গতকাল ছিল গতানুগতিক জীবনধারার একটি ব্যতিক্রম। চলার পথে শক্তি সঞ্চয়ের দিন। তাই আমাদের জাতীয় জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। দেশের প্রবীণ নেতা খন্দকার মােশতাক আহমেদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী দেশের ভার গ্রহণ করিয়াছে। প্রত্যুষে বেতারে এই ঘােষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া একটি আকাক্ষিত সূর্য-রাঙ্গা প্রভাত দেখিতে পায়।প্রকৃতপ্রস্তাবে মুজিব তার সতীর্থ’ মানিকভাই, ‘পুত্রবৎ’ ভাইপােদ্বয় এবং তাদের ‘দখলকরা প্রতিষ্ঠান ইত্তেফাকের প্রতি বারবার যে অতিশয় স্বজনপ্রীতি’ দেখিয়েছেন, উপযুক্ত প্রতিবেদন তারই প্রতিফল স্বরূপ। বলা বাহুল্য, সময় ও পরিবেশমতাে সামান্য এদিক-ওদিক হলেও ইত্তেফাকের ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকার মৌল চরিত্র অব্যাহত গতিময়।*৯. আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৮ এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৬
সিরাজ শিকদারনিজ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে চট্টগ্রামের কাছাকাছি একটা এলাকা থেকে মাওপন্থী ‘পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির আত্মগােপনকারী প্রধান নেতা সিরাজুল হক শিকদার ১ জানুয়ারি ১৯৭৫ গ্রেফতার হন। বিশেষ প্রহরায় ঢাকায় এনে তাকে ‘আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশকে ‘প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। পুলিশ। তাকে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ কন্ট্রোলরুমে নিয়ে যায়। পরদিন সাভারের কাছে ‘পালানাের চেষ্টা কালে’ (মতান্তরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষকালে) তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শিকদারের বােন ভাস্কর শামীম জাকারিয়ার মতে, নিহতের বুকে ৬টি গুলির চিহ্ন ছিল। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে মুজিব দম্ভোক্তি করে বলেন : আমি ফ্রি স্টাইল দিয়ে দিয়েছিলাম-যার যা ইচ্ছে তারা তা লেখেন, কেউ এই। নামে বাংলাদেশকে ডাকেন, ও নামে বাংলাদেশকে ডাকেন। বাংলাদেশের নাম। পর্যন্ত বলতে যারা লজ্জাবােধ করেন, তাদের অধিকার নাই বাংলার মাটিতে থাকার।… কোথায় আজ সিরাজ শিকদার?… তারা বলেছিল, এই সরকারকে অস্ত্র দিয়ে উৎখাত করতে হবে।… আপনরা কবে প্রস্তুত হইয়া উৎখাত করবেন? আমার যা শক্তি আছে-সে শক্তি দিয়ে দুই মিনিটের মধ্যে আমি (তাদের) উৎখাত করতে পারি।’ গুজব ছিল, শেখ মণির নেতৃত্বাধীন যুবলীগের উগ্র কর্মীরা পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে শিকদারকে হত্যা করে। নিঃসন্দেহে এটি একটি কাপুরুষােচিত ও মানবাধিকার-বিরােধী কাজ। | ১৯৭২-এর মার্চে স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকীতে শিকদারের অনুসারীরা মুজিববিরােধী পােস্টার দিয়ে ঢাকা শহর হেঁয়ে ফেলে। বিজয় দিবসেও অনুরূপ করা হবে বলে গােয়েন্দা বিভাগ খবর পায়। শেখ কামাল তা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন। কামাল তার পরিবার, দল বা সরকার বিরােধী সমালােচনা বা কাজকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা জ্ঞান করতেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া (তার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ২০৭) বলেন, “সিরাজ শিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুজিবের ‘অতিভক্তরা শিকদারের এই আশা পূরণ করতে দেয়নি।১. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪১ জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২। রাত গভীর হয়ে এলে কামাল তার সঙ্গীদের নিয়ে স্টেনগান আর রাইফেল সহ একটি মাইক্রোবাসে করে শিকদারের খােজে বেরিয়ে পড়ে। ওদিকে ওপর থেকে নির্দেশিত হয়ে’ সার্জেন্ট কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটি পুলিশ-স্কোয়াড একটা টয়ােটা গাড়িতে করে শিকদারের তল্লাশি চালাচ্ছেন। কোনাে দলই অপর দলের কথা জানে না। শিকার খোজের পালায় একে অপরকে দেখতে পেয়ে শিকদার-গ্যাং ভেবে অনুসরণের এক পর্যায়ে মতিঝিলস্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে উভয় দলের গুলি। বিনিময় হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাইক্রোবাস থেকে লাফিয়ে পড়েআর গুলি ছুড়ােনা, আমি কামাল’ চিৎকার শুনে গােলাগুলি বন্ধ হয়। ক্ষতস্থান থেকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। সামান্যের জন্য শ্বাসনালী রক্ষা পায়। আহত কামালকে দ্রুত পিজি হাসপাতালে ভর্তি করে আতঙ্কিত সার্জেন্ট ডেপুটি কমিশনার আবুল হায়াতের বাসায় পেীছে ঘটনার বিবরণ জানিয়ে বলে, ‘আমরা এক মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। স্বৰ্গকে আমাদের মাথার উপর এনে দাড় করিয়েছি।”আবুল হায়াত কালবিলম্ব না করে সরাসরি মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে ঘটনা অবহিত করেন। নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে মুজিব বলেন, ‘তাকে মরতে দাও।’ মুজিবের প্রতিক্রিয়ায় আবুল হায়াত আশ্চর্য হন। সংশ্লিষ্ট পুলিশদের ব্যাপারে কী করা উচিত জিজ্ঞাসার জবাবে মুজিব তাদের কাজে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, তাদের ভয়ের কোনাে কারণ নেই। পুলিশের উপর কোনাে এ্যাকশন নেয়া হয় নি। এমনকি দু’দিন পর্যন্ত মুজিব ছেলে কামালকে দেখতে হাসপাতালেও যাননি।কিন্তু পরদিন সারা ঢাকা শহর চাউর হল-ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে কামাল। গুলিবিদ্ধ হয়েছে।সিরাজ শিকদারের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে সারা শহরে এ-ও প্রচার হল যে, মুজিবের নির্দেশেই শিকদারকে হত্যা করা হয়েছে। সিরাজের বােন, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার অর্জনকারী ১৯ বছরের যুবতী ভাস্কর শামীম শিকদারও তাই বিশ্বাস করে এবং ‘ভ্রাতৃহন্তা’ মুজিবকে হত্যা করে প্রতিশােধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটি রিভলভার সংগ্রহ করে সুযােগের অপেক্ষায় থাকে এবং একই সাথে সুযােগ সৃষ্টিরও চেষ্টা করে। শামীম বহুবার মুজিবের সাথে সাক্ষাতের আর্জি পেশ করে ব্যর্থ হয়। তারপর একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণ জানালে মুজিব তা গ্রহণ করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হন। পরে স্মৃতিচারণ করে শামীম জানায়, ‘আমি ভয়ানক বেপরােয়া হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তাকে আমার গুলির দুরত্বের মধ্যে আনতে পারলাম।’ ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। পরে শামীম জনৈক জাকারিয়া চৌধুরীর প্রেমে পড়ে বিয়ে করে স্বামীর সাথে বিদেশ চলে যায়।২. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪১প্রকাশ্য বা গােপন সকল মাওপন্থী মুজিববিরােধী ছিল। সিরাজ শিকদার হত্যাকাণ্ড তাদের বিরােধিতাকে আরও তীব্র করে। তাদের অধিকাংশই প্রতিবছর শিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে এবং মুজিব ও তার শাসনের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে।একাত্তরের মার্চে মাওবাদীদের কেউ কেউ (মাহফুজউল্লাহ গং) অসহযােগ আন্দোলনকে ‘অর্থহীন’ ভেবেছেন, কেউ কেউ (মেননগং) অস্ত্র সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকায় অ-যােগদানযােগ্য ভেবেছেন। অন্য অর্থে চীনপন্থী বিপ্লবীরা জনগণের আন্দোলনে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন (পরে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পাটি) ২ মার্চ ১৯৭১ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে খােলা চিঠিতে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পাটি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সম্বলিত’… ‘অস্থায়ী সরকার কায়েম…’ করে ‘প্রয়ােজনবােধে এ সরকারের কেন্দ্রীয় দফতর নিরপেক্ষ দেশে স্থানান্তরিত করে… ‘সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিসমূহ বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব করে।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, আবদুল হক গং মূল শক্র ভারতের বিরুদ্ধে পাকবাহিনীর মিত্র। হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের খতমের লাইন গ্রহণ করে সশস্ত্র লড়াই করেন। তােয়াহা গং একই সাথে পাকবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়ার লাইন গ্রহণ করলেও পাকসামরিক অফিসারদের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্রমে প্রবল হয়ে ভারসাম্য সেদিকে হেলে পড়ে। এসময় কোনাে কোনাে চৈনিকদের ‘দুই কুকুরের লড়াই, এর মাঝে আমরা নাই’ মতবাদটি বহুলত বুলির অন্যতম। যাদু মিয়ার গােয়েন্দাগিরি ও অন্তর্ঘাত কার্যক্রম, আনােয়ার জাহিদের ক্যান্টনমেন্টে মুরগি সরবরাহের ঠিকাদারী প্রভৃতি মােটা দাগে বিভ্রান্ত মাওপন্থীদের পাকিস্তান প্রীতির পরিচায়ক। জাতীয় প্রশ্নে এদের কারও কারও অবস্থানকে লরেন্স লিফশুলৎস ভদ্রলােকের ভাষায় দ্বিধান্বিত’ আর নিন্দুকের ভাষায় ‘দালালির সমতুল্য’ বলে অভিহিত করেছেন। সিরাজ শিকদার গং ভারতকে পাকিস্তানের সমতুল্য মূল্যায়ন করে দেশের অভ্যন্তরে থেকে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়। ৭ জুন ১৯৭১ প্রকাশিত দলের এক প্রচারপত্রে বলা হয় :পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী, সকল দেশপ্রেমিক পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি ঐ বিদ্ধ হয়ে সঠিক পথে সংগ্রাম পরিচালনা করতে আহ্বান জানায়। বরিশাল জেলার ঝালকাঠির মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিকরা এ আহ্বানে সারা দেয়। তাদের অংশগ্রহণ সহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের নিয়ে, স্থানীয় ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা হয়। ঐক্যবদ্ধ মুক্তিবাহিনী তফসিলী হিন্দুসম্প্রদায় অধ্যুষিত পূর্ববাংলার বৃহত্তম পেয়ারা বাগান, চুরিয়ান, ডুমুরিয়া, ভীমরুলী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। এই গেরিলা যুদ্ধের রূপ হয় প্রধানত জাতীয় শত্রু খতম করা। অতি অল্প সময়ের৪. লরেন্স লিফলস, অসমাপ্ত বিপ্লব, তাহেরের শেষ কথা, (অনুবাদ মুনীর হােসেন), কর্ণেল তাহের সংসদ, ঢাকা; ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৩৩
বাংলাদেশের রাজনীতিমধ্যেই কয়েক শত জাতীয় শত্রু খতম করা হয়; পাক সামরিক দস্যুদের একখানি লঞ্চ আক্রমণ করা হয় এবং প্রায় তিরিশজন সামরিক দস্যকে খতম করা হয়, দুজন। পুলিশ সহ দু’ইঞ্জিন বিশিষ্ট একটি স্পীডবোেট দখল করা হয়…। মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয় শত্রু’ ছাড়াও জন্মলগ্ন থেকেই শিকদারের দলের। ‘শ্রেণীশত্রু খতমের কাজ অব্যাহত ছিল। গ্রামাঞ্চলে অনেক জোতদার-মহাজন, ধনিকবণিক, প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য দলের রাজনীতিক এদের খতমের’ শিকার। হয়। স্থানে স্থানে নিরীহ জনগণও এদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের শিকার হয়। সারাদেশে তারা একটি আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এরপরও ১৯৭৪ সাল থেকে সমস্যাকীর্ণ বাংলাদেশে হতাশ ও বিপ্লবাকাক্ষী তরুণ সমাজ আকৃষ্ট হয়ে সর্বহারা পাটিকে বিকাশমান করে তােলে। কয়েকটি স্থানে তাদের শক্তিশালী অবস্থান/ঘাটি সৃষ্টি হয়। পুরনাে প্রায় সকল কমিউনিস্টদের তারা সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতক’ বলে চিহ্নিত করে। শিকদারের ‘সন্ত্রাসবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ অনেকেরই পছন্দ নয়। কিন্তু তা মােকাবেলায়। সরকারি কার্যক্রম বিশেষ করে রক্ষীবাহিনীর দমনাভিযানও সর্বদা আইনানুগ রীতি মেনে। চলেনি। তাই চূড়ান্ত বিচারে মানুষের সহানুভূতি শিকদারের দিকেই প্রকাশ পায়। ‘শত্রুর শত্রু বন্ধু’ নীতিও এক্ষেত্রে কার্যকরী হতে দেখা যায়। চুয়াত্তরের শেষার্ধে মুজিব। সেনাবাহিনীকে নক্সালদের মূলােৎপাটনের নির্দেশ দেন। কিন্তু মেজর ফারুক এ-নির্দেশ পালনে উৎসাহী না হয়ে বরং এদের কাউকে ধরতে পারলেও ছেড়ে দিয়েই অধিক আনন্দ পেতেন। সিরাজুল আলম খানের ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে ‘১৭ মার্চ ১৯৭৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রমনের ঘটনার পর জাসদের যে ‘পার্টি। থিসিস’ উত্থাপিত হয় তাতে ‘রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াশ্রেণীর উচ্ছেদ এবং তার পরিবর্তে সর্বহারাশ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন করার কথা বলা। হয় (নজরুল ইসলাম, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪) এবং সে-ধারাতেই ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ ঘটে।এ দু’টি ঘটনা ও সামগ্রিক আন্দোলন-সংগঠন সম্পর্কে ১৯৭৯ সালের মার্চে ৪৪। পৃষ্ঠার একটি আত্মসমালােচনা দলিল জাসদ থেকে প্রকাশ করা হয়। এর পূর্বে ১৯৭৮ সালের প্রথমার্ধে মাহবুবুর রব সাদী নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেন ১২৩ পৃষ্ঠার। বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব (আন্ত পার্টি মতাদর্শগত সংগ্রাম বিষয়ক)’ রচনা। তারও আগে ১৯৭৬ সালে সিরাজুল আলম খান লেখেন ‘আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে প্রবন্ধ।জনাব খানের রচনাটি সম্ভবত ১৭ মার্চ ও ৭ নভেম্বরের ব্যর্থ আন্দোলনের পর এ ধরনের প্রথম উদ্যোগ। সে-কারণে আশা করা হয়েছিল, অতীত আন্দোলনের একটি অনুপুঙ্খ মূল্যায়ন এতে স্থান পাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত জনাব খান অতীত নিয়ে এক বর্ণও আলােচনা না করে রায় দিয়ে বসেন যে, “আগােছাল, এলােপাতাড়ি, গোঁজামিল, দায়সারা কাজ দিয়ে বিপ্লব হয় না’ (ঐ, পৃষ্ঠা ৭)। শুধু তাই নয়, প্রবন্ধের মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়শ্রেণীকে উচ্ছেদ নয়, বরং কীভাবে বুর্জোয়াশ্রেণীর সাথে মিলে বা তার অধীনে (প্রথম পর্যায়) মন্ত্রী হয়ে ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠা করা যায়। জাসদের জন্য এ সম্পূর্ণ অভাবিতপূর্ব নতুন ধরনের বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক প্রস্তাব -যা তিনি জেলে বসে উদ্ভাবন করেন।জনাব খান উক্ত প্রবন্ধে তিন ধরনের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরেন। প্রথমটি হল, যখন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ আগ্রাসন বিদ্যমান তখন দরকার হবে এই শক্তি ও তার সহায়তাকারী দেশীয় শক্তির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনগণের ও সকল শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী দল, গােষ্ঠী, শক্তি ও ব্যক্তির মাের্চা। দ্বিতীয়টি হল, যখন সাম্রাজ্যবাদী প্রত্যক্ষ আগ্রাসন অনুপস্থিত কিন্তু পরােক্ষ প্রভাব বর্তমান ও বুর্জোয়ারা।সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে জনাব খান বা জাসদের ব্যাখ্যা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্মত। ব্যাখ্যার অনুরূপ নয়। সাম্রাজ্যবাদ বলতে জনাব খান বুঝেন যে-কোনাে ধরনের বিদেশী প্রভাব’। এ প্রবন্ধে তিনি সাম্রাজ্যবাদ বলতে সাম্রাজ্যবাদ, সংশোধনবাদ ও সম্প্রসারণবাদকেও বুঝিয়েছেন। (পৃষ্ঠা ১০ ও ১৬)ক্ষমতাসীন। তৃতীয়টি হল, যখন হিটলার, মসােলিনী, বাতিস্তা, রেজা শাহ, ফ্রাঙ্কোর মতাে ফ্যাসিবাদী শক্তি ক্ষতাসীন তখন প্রয়ােজন তাদের তাদের সহায়তাকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সকল বিরােধীদল, সংস্থা, গােষ্ঠী, শক্তি ও ব্যক্তির গণমাের্চা।আমাদের দেশের জন্যে জনাব খান দ্বিতীয় ধরনেরটি প্রযােজ্য মনে করেন এবং এ অবস্থায় কর্তব্য হল, ‘তিনটি পর্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন’ (ঐ, পৃষ্ঠা ৮)। প্রথম পর্যায়-সর্বহারাশ্রেণীটি দুর্বল অর্থাৎ সংগঠিত নয়, তখন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য শ্রেণীর প্রতিনিধিরা মূলত প্রধান শক্তি। দ্বিতীয় পর্যায়সর্বহারাশ্রেণী প্রথম পর্যায় থেকে অনেকখানি শক্তিশালী ও অন্যান্য শ্রেণীর অংশীদারিত্ব মােটামুটি সমান। তৃতীয় পর্যায়-সর্বহারাশ্রেণী সরকারের মধ্যে বৃহত্তম অংশের নিয়ন্ত্রক, কিন্তু অন্যান্য শ্রেণীও অংশীদার। (ঐ, পৃষ্ঠা ৮)।জনাব খান আরও যােগ করেন যে, ‘মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের এই তিনটি পর্যায়ের মধ্যে কোনাে চীনের প্রাচীর নেই। তবে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের আন্দোলন ও অংশগ্রহণ একটা মৌলিক ও অবশ্যকরণীয় বিষয়। (ঐ, পৃষ্ঠা ৮)।দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করেই ‘সর্বহারাশ্রেণীর তেজটা পরিহার করে সর্বশ্রেণী সমন্বয়ে গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের আন্দোলনে অংশগ্রহণকে জনাব খান “অবশ্যকরণীয়’ বিবেচনা করছেন। কারণ ইতােমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে যে, (জাতীয়) বুর্জোয়ারও যথেষ্ট সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা আছে। তাই বুর্জোয়ার সাথে কেবল সগ্রামই নয়, ঐক্যেরও প্রশ্ন আছে। তিনি মনে করেন :ঐক্য ও সংগ্রাম-উভয়ই দ্বন্দ্বের প্রকাশ-এ কথা মনে রেখে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। সর্বহারাশ্রেণী বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনকে বুর্জোয়াদের সহযােগিতায় জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সর্বহারার শক্তিভিতকে গড়ে তােলার কাজে লাগাবে। আবার বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যবাদঘেষা নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে সর্বহারার শক্তিভিত গড়ে তােলার সপক্ষে আনতে হবে।এই যে প্রতি মুহূর্ত, প্রতিদিনকার ও প্রতিঘটনার সঙ্গে ঐক্য ও সংগ্রামের সূক্ষ্ম দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের প্রক্রিয়া তাকে সুকৌশলে পরিচালনা করতে হবে-গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করার জন্য প্রতিনিয়ত দাবি জানিয়ে অথবা গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করে… (ঐ, পৃষ্ঠা ৯)। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থান করে এবং বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে সর্বহারার শক্তিভিত গড়ে তােলার এই যে, কৌশলগত আন্দোলন – এরই নাম বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, এই যে, কর্মসূচি এরই নাম বিপ্লবী গণতান্ত্রিক কর্মসূচি। বিপ্লবী গণতন্ত্রের এই কৌশলের রূপ ও কাঠামাে হল গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন বা গঠনের জন্য আন্দোলন… (ঐ, পৃষ্ঠা ৯)।প্রস্তাবিত এ সরকার গণতান্ত্রিক, কারণ আরও বেশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এ সগ্রাম; এ সরকারটি জাতীয়, কারণ ‘বিদেশী শক্তি ও প্রভাবের বিরুদ্ধে সকল শ্রেণীর সম্মিলিত জাতীয় প্রচেষ্টা এর অন্তর্ভুক্ত’ আর ‘এ সরকারের অর্থনৈতিক কর্মসূচি হল সকল শ্রেণীর কাছে গ্রহণীয় গণমুখী অর্থনীতি (ঐ, পৃষ্ঠা ৭-৮)।জনাব খান আরও জানান, তার প্রস্তাবিত এই দুরূহ আন্দোলনটির সফলতা নির্ভর করে সর্বহারাশ্রেণীর দল কর্তৃক সঠিকভাবে প্রণীত একটি সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কর্মসূচির মধ্যে। অতঃপর তিনি সকল শ্রেণীর কাছে গ্রহণযােগ্য’ ৮ দফার ‘অজাতশত্রু’ এক ‘সাধারণ’ কর্মসূচি প্রস্তাব করে বলেন, এই কর্মসূচি সম্পর্কে আপস রক্ষা না হওয়া পর্যন্ত সরকারে অংশগ্রহণের প্রশ্নই আসেনা। আর আপসরফা হলে বুর্জোয়াদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করা যায় ও এক্ষেত্রে সর্বহারার দলকে উক্ত সরকারের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়গুলাের দায়িত্ব গ্রহণ করা দরকার’ (এছাড়া আরও গণতন্ত্র ও গণমুখী অর্থনীতি চালুর সহায়তার জন্য শ্রম কল্যাণ, ভূমি প্রশাসন ও সমবায়, শিক্ষা ও পরিকল্পনা দপ্তর গ্রহণের চেষ্টা করা দরকার) এবং এই দুই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলে, যে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে হবে-তিনটি শিরােনামে ৩০ দফা বিশিষ্ট সেরূপ একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও তিনি তার প্রবন্ধে সংযােজিত করেন (ঐ, পৃষ্ঠা ১১-১৪)।মন্ত্রণালয় ভাগাভাগির এ সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালীন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াদের সাথে সরকার গঠনের আশু সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই জনাব খান এ প্রবন্ধ লেখেন। একই সাথে তিনি ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়াদের লক্ষ্য করে একটি ‘অল পাজিটিভ’ সূত্র আবিষ্কার করেন যা হল, সর্বহারার দল একদিকে যেমন ক্ষমতাসীন বুর্জোয়ার ‘আপসকামিতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে ও তার সাম্রাজ্যবাদবিরােধিতাকে অব্যাহত রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চাপ দিবে তেমনি ক্ষমতার বাইরের বুর্জোয়ার সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসকামিতার বিরুদ্ধে অনুরূপভাবে সমালােচনা ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে এবং সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকাকে বহাল রাখার জন্য চাপ দেবে। অর্থাৎ বুর্জোয়ার উভয় অংশের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী মনােভাবের সুফলতাকে জনগণের স্বার্থে কাজে লাগানাের চেষ্টা করা হবে। ফলে, প্রস্তাবিত গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারে অংশগ্রহণ করলেও ক্ষতাসীন বুর্জোয়ারা সর্বহারাশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী দলকে ‘কেবল বিরােধিতার পর্যায়ভুক্ত করতে পারবে না, আবার ক্ষমতার বাইরে অবস্থানকারী বুর্জোয়ারা সর্বহারাশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী দলকে শাসকগােষ্ঠীর দালাল’ বলেও চিহ্নিত করতে পারবে না (ঐ, পৃষ্ঠা ১০-১১)। সুতরাং উভয় কলঙ্ক থেকেই রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা!শুরুতেই উল্লিখিত হয়েছে যে, আলােচ্য প্রবন্ধে জনাব খান রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বুর্জোয়াশ্রেণীর উচ্ছেদের বিপরীতে বুর্জোয়াশ্রেণীর সাথে মিলে বা অধীনে থেকে (তিন শ্রেণীর) সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রূপরেখা তুলে ধরেছেন। তার ভাষায় যেহেতু বিদেশী প্রভাব (সাম্রাজ্যবাদ) প্রতিটি শ্রেণীরই কোননা-না-কোনােভাবেস্বার্থহানি করে, সে-কারণে সকল শ্রেণীই একটি সাধারণ যােগসূত্র খুঁজে বের করার জন্য সচেষ্ট হয়। যেহেতু কোনাে একক শ্রেণীর স্বার্থ নয়, সেহেতু সকল শ্রেণীর সমন্বয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। আবার সকল শ্রেণীর সমন্বয়ে গােটা জাতি এ সংগ্রামে নিয়ােজিত-তাই জাতীয় ঐক্য গড়তে হবে (ঐ, পৃষ্ঠা ১০)।সকল শ্রেণীর সমন্বয়ে’ (জাতীয়) ‘ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাবিত এই সংগ্রামের নেতৃত্বের প্রশ্নে জনাব খান মনে করেন যে, কোন্ শ্রেণী কতখানি সার্থকতার সাথে এই সংগ্রামকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম, তার ওপরই নির্ভর করে, কার হবে নেতৃত্ব।’ তার আরও অভিমত হল, তত্ত্বগতভাবে সর্বহারাশ্রেণী ছাড়া অন্য কেউ এর সফল পরিণতিতে পৌছাতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে। বিশেষ করে আমাদের দেশে সর্বহারাশ্রেণী ততখানি সংগঠিত ও সচেতন না বিধায় তাকে ঐক্যফ্রন্ট’ করতে হয় অন্যান্য শ্রেণীর সঙ্গে (ঐ, পৃষ্ঠা ১০)। | ধরা যাক, জনাব খানের নতুন ‘গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় বিপ্লবী গণতান্ত্রিক কর্মসূচি বাস্তাবায়নে জাসদ সম্মত হল। কিন্তু কেউ যদি সুদীর্ঘ চার বছরের ‘যে আন্দোলনে কর্নেল তাহেরসহ হাজার হাজার কর্মী জীবন দিল, অসংখ্য কর্মী ও নেতা আজও কারার অন্তরালে, জীবনধারণের প্রয়ােজনে কোনাে কোনাে কারারুদ্ধ কর্মীর কুলবধূ বেশ্যায় পরিণত হয়েছে সে-আন্দোলনের কী কী ভুল ছিল? ভুলের কারণ কী? ভুল থেকে কী শিক্ষা গ্রহণ করা হল তা-জিজ্ঞাসা করে তবে এর কী উত্তর হবে? কিংবা বর্তমান’ (১৯৭৬) ক্ষমতাসীন ‘সেনাবাস নির্ভর সরকারের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে, তবে নির্বাচিত মুজিব সরকারকে উৎখাতের সংগ্রাম কেন করা হয়েছিল?এ প্রশ্নের আগাম উত্তর হিসেবে তিনি (ব্র্যাকেটের মধ্যে ) বলেন ‘মনে রাখতে হবে যে, যদি ক্ষমতাসীন বুর্জোয়ারা সম্পূর্ণভাবে সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে পরিণত হয় এবং কোনাে গণতন্ত্রাভিমুখী কার্যকলাপ চালু রাখতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে সে বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করতে হবে (ঐ, পৃষ্ঠা ১০)। | কিন্তু ইতিহাস জনাব খানের মুজিব সরকারের চরিত্র বিশ্লেষণ ভুল প্রমাণ করেছে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি মুজিবের চেয়ে অধিক সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কোনাে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। (এমনকি, ১৯৯৬-২০০০ কাল পর্বের শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারও নয়)। কর্নেল তাহেরও বুঝেছিলেন যে, “জাতির পিতাকে হত্যা করার ব্যাপারে কোনাে বিদেশী শক্তি (জনাব খানের ভাষায় সাম্রাজ্যবাদ) জড়িত।যাহােক, জনাব খানের এই নয়া তত্ত্বের কল্যাণেই সম্ভবত: জাসদ ক্রমে তার ‘বিপ্লবীপনা বাদ দিয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক দলে রূপান্তরিত হয়ে সংসদীয়২| মাও সেতুং ১৯৩৪ সালে লেখা নয়া গণতন্ত্র পুস্তিকায় বলেছেন, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবসর্বহারার নেতৃত্ব ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। (আত্মসমালােচনা দলিল ‘৭৯, পৃষ্ঠা ১৩-১৪)। মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৫-৯৬গণতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে তার ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব আজও টিকিয়ে রেখেছে এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক আসম আব্দুর রব সামরিক-স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ‘শুয়ারের খােয়ারে’ গৃহপালিত বিরােধীদলীয় নেতা ও শেখ হাসিনার ঐকমত্যের সরকারের মন্ত্রী (পশু/নৌ) হয়েছিলেন। আর শাজাহান সিরাজ হয়েছেন (এবং ছিলেন) বেগম খালেদার মৌলবাদী জোট সরকারের মন্ত্রী (পরিবেশ/নৌ)।জনাব খান এখন বছরের অধিকাংশ সময় বিদেশী প্রভাবের মূল কেন্দ্র স্বপ্নের অ্যামেরিকায় প্রবাসে থাকেন এবং বিপ্লব ভুলে (সে সমাজতান্ত্রিকই হােক আর জাতীয় গণতান্ত্রিকই’ হােক) মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর গবেষণা করে ও গ্রন্থ লিখে সময় কাটান। তিনি বছরের যে সামান্য সময় বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন, তার অধিকাংশই ব্যয় করেন পাঁচতারা হােটেলে (সােনার গাঁ/শেরাটনে) রব-সিরাজ বা অন্যান্য সাবেক ‘বিপ্লবী’ পরিবেষ্টিত হয়ে আড্ডা দিয়ে। লক্ষণীয়, এত কাল পরও ‘বিপ্লব স্পন্দিত হয়ে রাখা শত্রু ও দীঘল কেশ শােভিত হয়ে মার্ক্সের অবয়ব ধারণ করে এবং অকৃতদার থেকে তিনি বিপ্লবী ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, যাকে আজকাল ভগবান রজনিশের মতাে দেখায়। সুতরাং আর কী চাই?
নিউক্লিয়াস‘স্বাধীনতার পক্ষে কর্মী সৃষ্টির লক্ষ্যে’, ‘ছাত্রলীগকে গতিশীল ও সুশৃঙ্খল সংগঠন রূপে গড়ে তুলতে’ ও ‘স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে থেকেই একটি আত্মসচেতন কেন্দ্র হিসেবে পিকিং ও মস্কোপন্থী ধারার পাশপাশি ‘তৃতীয় মার্কসীয় ধারা’ হিসেবে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণীকে একত্র করে এদেশে সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ১৯৬২ সালে একদল সচেতন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন বলে দাবি করা হয়। | আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী দল’ আর শেখ মুজিব স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন’ বলে ‘সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে এরা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে আওয়ামী লীগে যােগ দেয় ও দলের সাথে নিজেদের আত্মস্থ করে। এরা বরাবরই ছিল দলের ভেতর একটি সুস্পষ্ট, সচেতন ও স্বাধীন নিউক্লিয়াস।” এটি স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’, ও ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী কেন্দ্র’ নামেও অভিহিত বলে দাবি করা হয়। বলা হয়, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ -এ তিনজন -এ গােপন সংগঠন সৃষ্টি করেন। আবুল কালাম আজাদ (পরে অধ্যাপক ও প্রাথমিক শিক্ষক নেতা) ও চট্টগ্রামের এম এ মান্নান যথাক্রমে ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত হন। তবে তারা শেষাবধি সক্রিয় ছিলেন না। আরাে বলা হয়, ১৯৭০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিউক্লিয়াস ও এর রাজনৈতিক শাখা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি এল এফ) -এর কর্মপদ্ধতি, সাংগঠনিক বিস্তৃতি ও বিস্তারিত কার্যাবলি সম্পর্কে অবহিত করার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপােষহীন হন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিবের সুপারিশে শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমেদকে বি এল এফ’র ‘হাইকমান্ডে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৬৮,৬৯,৭০ সালে মহকুমা (বর্তমানে জেলা) পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের শাখা বিস্তৃত হয়। প্রতিটি মহকুমায় ৪-৫ জন সদস্য সংগৃহিত হয়। এর সদস্য মূলতঃ ছাত্রলীগ থেকে এবং সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী বাইরে থেকে সংগৃহিত হত। দাবি করা হয়, ‘১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সবকটি আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন সবকিছুরই মূলে ছিল নিউক্লিয়াস।’ ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের ফলে পূর্ব।১. লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩ নিউক্লিয়াসের শাব্দিক অর্থ মূলধারা অর্থাৎ যাকে ঘিরে অন্যান্য অংশ বিন্যস্ত/সংহত হয়পাকিস্তানে অবাঙালি অধ্যুষিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে নিউক্লিয়াস সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিকল্প সমাজ শক্তি হিসেবে ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক ‘ব্রিগেড’ গড়ে তুলে নৈশ প্রহরা, ট্রাফিক-ব্যবস্থা, মেইল-ট্রেন চালু, লঞ্চ-স্টিমার-নৌ বন্দর পরিচালনা, এমসিসি-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা পরিচালনা, থানা পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, শিল্প-কল-কারখানায় শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি’ যাবতীয় কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।আরাে দাবি করা হয়, ১২ আগস্ট ১৯৭০ ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির এক বর্ধিত সভায় জনৈক স্বপন কুমার চৌধুরীর মাধ্যমে এরা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং এদের সাথে আলােচনা করেই মুজিব ৭ মার্চের ভাষণদানও অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। ২৫ মার্চের আগেই এরা বিএলএফ। | গড়ে তােলে যুদ্ধকালে যা মুজিব বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পায়। অসহযােগকালে এরাস্বাধীনতার ইশতেহার ঘােষণা, পতাকা তৈরি ও উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত প্রভৃতি নির্ধারণ করে। এক কথায় ১৯৬৫-র পর থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কৌশল নির্ধারণ ও পরিকল্পনার নির্দেশনা নিউক্লিয়াস থেকেই আসতাে।’ | মাওলানা ভাসানী, সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন, পূর্ব। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (হক-তােয়াহা) ও ন্যাপের (ভাসানী) একাংশ এবং শ্রমিককৃষক সমাজবাদী দলের সঙ্গে নিউক্লিয়াস যােগাযােগ রক্ষা করতাে। মরহুম কামরুদ্দিন আহমেদ ও ড. আহমদ শরীফ শুরু থেকেই এদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন বলেও দাবি করা হয়। | ১৯৭৪ সালের জুনে জাসদের জাতীয় কমিটির বর্ধিত সভার পর একটি ক্ষুদ্র সমন্বয় কমিটি গঠন করা হলে ‘নিউক্লিয়াস’ নিজেদেরকে বিলুপ্ত করে উক্ত সমন্বয় কমিটির সাথে একীভূত হয়।এ প্রসঙ্গে ষাটের দশকের গােড়া থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত ও ১৯৬৭-৬৮ সালের সভাপতি ফেরদৌস আহমদ কোরেশী জানান :ছাত্রলীগের ষাটের দশকের তথাকথিত নিউক্লিয়াসের কথা কখনও ঐ দশকে শুনিনি।… এটা প্রচারিত হয় স্বাধীনতার পরে, জাসদ গঠনের পর থেকে। এটা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কারাে কারাে অতিরিক্ত অবদান| সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকে বাঙালি, এম. এন. ও. পাবলিকেশন্স, (প্রা.) লিমিটেড, ঢাকা,২০০০, পৃষ্ঠা ১৪-১৬ (টাকা)। উল্লেখ্য, এর প্রতিষ্ঠাঁদের অন্যতম কাজী আরেফ আহমেদ প্রয়াত। নির্ধারিত সাক্ষাৎ-সূচি অনুযায়ী ১৮ ও ২৩ ডিসেম্বর ২০০৩ নাখালপাড়াস্ত সাংসদ হােস্টেলের ৪২ নং কক্ষে গিয়ে সাক্ষাৎলাভে সমর্থ হলেও ব্যস্ততার অজুহাতে জনাব আবদুর রাজ্জাক এ প্রসঙ্গে কিছু বলার সময় করতে পারেন নি। লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৬। প্রসঙ্গক্রমে প্রতিষ্ঠাতাক্রয়ীর অন্যতম। আবদুর রাজ্জাক যেহেতু জাসদের সাথে যুক্ত হননি এবং নিউক্লিয়াসের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি সেহেতু স্বাধীনতার পর এর অস্থিত্ব ও জাসদে বিলুপ হওয়ার বিষয়টি প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি।দেখানাের মানসেই এই প্রচারণা, এ প্রচার রাজনৈতিক অসততার পরিচায়ক। ষাটের দশকের অন্যতম ছাত্র নেতা (পরে চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতা) রাশেদ খান মেননের অভিমত হচ্ছে, নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত তথ্য পরবর্তীকালের বানানাে কথা, এরকম চক্রের অস্তিত্বের কথা তারা কোন দিনও শােনেননি। | ১৯৬৮-৭০ কালপর্বে প্রতিটি মহকুমায় ছাত্রলীগ থেকে ৪-৫ জন সদস্য সংগ্রহ করে নিউক্লিয়াসের শাখা গঠন সম্পর্কে কিশােরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৬৪) গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৬২৬৩) ও সহ-সভাপতি (১৯৬৪-৬৫) বর্তমানে সংসদে বিরােধীদলীয় উপনেতা আবদুল হামিদ এডভােকেট এক সাক্ষাৎকারে জানান : গােটা ষাটের দশকে (১৯৬২-৬৯) ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকা কালে কিশােরগঞ্জ বা অন্য কোথাও নিউক্লিয়াস নামে কোন সংগঠনের কথা শুনিনি। ছাত্রলীগের মধ্যে দু’চারজন অপেক্ষাকৃত অগ্রসর চিন্তার সমর্থক থাকলেও নিউক্লিয়াস বা অন্য কোন নামে কোন সংগঠিত রূপের কোন অস্থিত্ব কখনও টের পাইনি। আর সে-সময় আমার জানার বাইরে, কিশােরগঞ্জে ও মহকুমা ছাত্রলীগে কিছু হওয়া বা ঘটা অকল্পনীয় বলা যায়।ষাটের দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির সাথে জড়িত অপর এক ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান চৌধুরী জানান, ছাত্রলীগে এমন সংগঠিত তথাকথিত নিউক্লিয়াসের কথা আমার জানা ছিলনা। তবে আজ যারা তা দাবি করেন, সে সময় স্বাধীনতার প্রশ্নে। তাদের ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়া পন্থি।৩. ড, মােহাম্মদ হাননানকে প্রদত্ত ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর সাক্ষাৎকার। উদ্ধৃত: ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব) পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২৮-২৯ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৩০ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব) পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২৯। জনাব চৌধুরী আরাে জানাচ্ছেন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘােষণার পর এর প্রচারে কোন জেলায় গেলেই মুজিবকে গ্রেফতার করা হতাে। এর প্রতিবাদে ৮মে (১৯৬৬) পল্টনে ছাত্রলীগ আহুত একটি প্রতিবাদ সভায় ‘জাগো জাগাে-বাঙালি জাগাে’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা-ঢাকা-ঢাকা’ স্লোগান দেয়া হলে সিরাজুল আলম খান ও শাহ মােয়াজ্জেম স্লোগানদাতাদের হাত থেকে মাইক কেড়ে নেন এবং এ ধরনের স্লোগান দেয়ার জন্য তাদের ভৎর্সনা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য, ১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান মাঠে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে অন্যতম সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ফেরদৌস আহমদ কোরেশী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উত্থাপনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বিদায়ী সভাপতি শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন তাকে তা পড়ার অনুমতি দেন নি। অধিকন্তু শাহ। মােয়াজ্জেমের সহায়তায় সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শাহ মােয়াজ্জেম ও সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগে এক গ্রুপ হয়ে কাজ করতেন।
মুজিব-হত্যা মামলা মুজিবের বাসভবনের তৎকালীন রিসেপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম দীর্ঘ একুশ বছর পর ২ অক্টোবর ১৯৯৬ ধানমন্ডি থানায় লিখিত এজাহারের মাধ্যমে মামলা রুজু করেন। মামলা নম্বর ধানমণ্ডি ১০ (১০) ৯৬। বাদির জীবনের নিরাপত্তা এবং নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থার কারণে এই ঘটনার এজাহার করতে বিলম্ব হয়। ঘটনার পর থানায় গেলে এজাহার না নিয়ে বাদিকে বলা হয়, ‘তুই নিজে মরবি, আমাদেরকেও মারবি, এখন চলে যা, অনুকূল পরিস্থিতি আসলে তখন এজাহার করিস। আদালতে জেরার জবাবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি আব্দুল কাহার আকন্দ জানান : পঁচাত্তরের নির্মম হত্যাকাণ্ডগুলাের ব্যাপারে পৃথক মামলা হয়েছে ৫টি। এগুলাে হচ্ছে, ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের হত্যাকাণ্ড, ধানমণ্ডিতে শেখ মণির বাসার হত্যাকাণ্ড, মন্ত্রিপাড়ায় আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার হত্যাকাণ্ড, কামানের গােলায় মােহাম্মদপুরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও ৩ নভেম্বরে জেল হত্যাকাণ্ড।নিরাপত্তা প্রতিবিধান (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রকারী, হত্যাকারী ও সুবিধাভােগীরা নিজেদের আইনের আওতামুক্ত রাখার জন্য হত্যাকাস্ত্রে পর পরই সামরিক আইন জারি করে। পরে যখন বুঝতে পারে হত্যার দায় থেকে রেহাই পেতে সামরিক আইন জারি যথেষ্ট নয়, তখন ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ মােশতাক নিরাপত্তা প্রতিবিধান অধ্যাদেশ ১৯৭৫ জারি করে। ১৯৭৯ সালে জেনারেল জিয়া এটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে। দুনিয়ার কোনাে সভ্যদেশের সংবিধানে খুনির এরকম পৃষ্ঠপােষকতা নজিরবিহীন। অধ্যাদেশটির মূল কথা নিম্নরূপমামলার রায়ের অংশবিশেষ, উদ্ধৃত ; ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামীপ্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ২৩৬ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩। শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত মেজর ডালিম ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে মুজিব ওঅন্যান্যদের হত্যা পর বেতারকেন্দ্র দখল করে ঘােষণা করেন : “আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচারী শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হইয়াছে; আর্মি ক্ষমতা দখল করিয়াছে।’ পরে রাষ্ট্রপতি মােশতাক ২০ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আইন জারি করেন।
THE BANGLADESH GAZETTEExtraordinary Published by AuthorityFRIDAY, SEPTEMBER 26, 1975 GOVERNMENT OF THE PEOPLES REPUBLIC OF BANGLADESH MINISTRY OF LAW PARLIAMENTARY AFFAIRS AND JUSTICE(Law and Parliamentary Affairs Division)NotificationDhaka, The 26 September 1975No. 692-Pub The following ordinance made by the President of the Peoples Republic of Bangladesh, on the 26th September 1975, is hereby published for general information.THE INDEMNITY ORDINANCE 1975 ORDINANCE NO XLX OF 1975.ANORDINANCE to restrict the taking of any legal or other Procedings in respect of certain acts or things done in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitatiing, the historical change and the Poclamation of Martail Law on the moring of the 15 August, 1975. Whereas it is expendient to restrict the taking of any legal or other proceedings in repsect of certain acts or things done in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitating, the historical change and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975; AND WHEREAS Parliament is not in session and president is satisfied that circumstances exist which render immediate action neccessary; NOW, THEREFORE, in persuance of the proclamation of the 20th August 1975 and in exercise of the Power conferred by clause (1)of article 93 of the Constitution of the Peoples Republic of Bangladesh, the President is pleased to make and promulgate the following Ordinance : 1. SHORT TITLE This Ordinance may be called the Indemnity Ordinance, 1975. 2. RESTRICTIONS ON THE TAKING OF ANY LEGAL OR OTHER PROCEEDINGS AGAINST PERSONS IN RESPECT OF CERTAIN ACTS AND THING; (1) Notwithstanding anything contained in any law, including a law relating to any defence service, for the time being in force, no suit, prosecution or other proceedings, legal or disciplinary, shall lie, or be taken, in, before or by any Court, including the Supreme Court and Court Martial, or other authority against any person including a person who is or has, at any time, been subject to any law relating to any defence service, for on account of or in respect of any act, matter or thing done or step taken by such person in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step towards the change of Government of the Peoples Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August. 1975. (2) For the purpose of this section, a certificate by the President, or a person authorised by him in this behalf, that any act, matter or thing was done or step taken by any person mentioned in the certificate in connection with or in perparation or execution of any plan for, or as necessary step towards as the change of Government of the Peoples Republic of Bangladesh and the Proclamation or Martial Law on morning of the 15th August, 1975, shall be sufficient evidence of such act, matter or thing having been done or step having been taken in connection with, or in preparaton or execution of any plan for, or a necessary step towards the change of such Government and the Proclamation of Martial Law on that morning.DACCA The 26th September 1975KHANDAKER MOSHTAQUE AHMED Presidentসাংবিধানিক বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি এবং উভয়ের অনুপস্থিতিতে স্পিকার কর্তৃক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা। মােশতাক উপরাষ্ট্রপতি বা স্পিকার না হওয়ায় তার রাষ্ট্রপতির পদ দখল করা ছিল অবৈধ। সুতরাং অবৈধ রাষ্ট্রপতির জারিকৃত অধ্যাদেশও অবৈধ। কিন্তু জেনারেল জিয়া তার শাসনআমলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সকল অবৈধ কার্যক্রমকে সংসদ কর্তৃক ‘পঞ্চম সংশােধনী আইন ১৯৭৯’ পাসের মাধ্যমে সাংবিধানিক বিধিতে পরিণত করেন।শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর ১২ নভেম্বর ১৯৯৬ জাতীয় সংসদে কুখ্যাত এই নিরাপত্তা-প্রতিবিধান অধ্যাদেশ-১৯৭৫ বাতিল করা হয়। প্রধান বিরােধীদল বিএনপি এ অধ্যাদেশ বাতিল পক্রিয়ার পুরাে সময় সংসদ বর্জন করে। জামাতে ইসলামীর সাংসদগণ এদিন সংসদে অনুপস্থিত থাকেন। | কর্নেল (অব.) ফারুকের মা মাহমুদা রহমান ও কর্নেল (অব.) শাহরিয়ার রশিদ খান বাদি হয়ে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে পৃথক দুটি রিট আবেদন করেন। ২৮ জানুয়ারি ১৯৯৭ হাইকোর্ট রিট আবেদনদ্বয় খারিজ করে দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা প্রতিবিধান (বিলােপ) আইন ১৯৯৬ যথাযথভাবে পাস হয়েছে। এর ফলে হত্যাকাণ্ডের বিচারের রুদ্ধদ্বার অর্গলমুক্ত হয়। পরে সুপ্রিমকোর্টে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিমকোর্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।লন্ডনে গঠিত হত্যা তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক রিপাের্ট ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনাবিচারে অন্তরীণ সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপরাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দিন আহমদ (প্রথম প্রধানমন্ত্রী), মনসুর আলী (তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী) ও কামারুজ্জামান (শিল্পমন্ত্রী) -এ চার জাতীয় নেতা হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন ও বিচারের প্রক্রিয়াকে যে-সমস্ত অবস্থা বাধাগ্রস্ত করেছে সেগুলাে তদন্ত করার জন্য মুজিবের রক্ষাপ্রাপ্ত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র মােহাম্মদ সেলিম ও উপরাষ্ট্রপতির পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আবেদনক্রমে স্যার থমাস উইলিয়ামস, কিউ সি, এমপির নেতৃত্বে লন্ডনে একটি তদন্ত কমিশন। গঠনের উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর স্যার থমাস উইলিয়ামসের সভাপতিত্বে হাউস অব কমন্সের একটি কমিটিকক্ষে এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেফ্রি থমাস, কিউ সি, এমপি এবং সলিসিটার মি. অ্যাওব্রে রােজ এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভাশেষে তদন্ত কমিশন গঠন ও তার কার্যপদ্ধতি ঘােষণা করে ঐদিনই অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।| কমিশন নিম্নোক্ত বিষয়ের ওপর কমিশনের প্রতিটি সদস্যের কাছে সরবরাহকৃত প্রমাণ-সংবলিত দলিলপত্রাদি পরীক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে :পরে জানা যায়, জিয়া কর্তৃক পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা-প্রতিবিধান অধ্যাদেশ ১৯৭৫ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হলেও মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার পরিপন্থী’ হওয়ায় তা সংশােধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থন প্রয়ােজন ছিল না। এমনকি তা হত্যা মামলা দায়েরের পথে আইনগতভাবে বাধাও ছিল না। তবে, পরিবেশ অনুকূলে না-থাকায় তা কাগুজে বাঘ স্বরূপ মনস্তাত্ত্বিক বাঁধা’ হিসেবে কাজ করেছে।ক. ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাএবং ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতার হত্যা; খ, জনসমক্ষে যে-সমস্ত ব্যক্তি হত্যার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং গ. এ সমস্ত বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ। প্রাপ্ত কাগজপত্র পরীক্ষা থেকে নিম্নোক্ত ঘটনা পরিস্ফুট হয় : ক. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভােরে ঢাকার ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ৩২নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের নিম্নোক্ত সদস্যবৃন্দকে নিজ বাসভবনে হত্যা করা হয় : ১. বেগম ফজিলাতুন্নেসা, শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী। ২. শেখ কামাল, শেখ মুজিবুর রহমানের বড়ছেলে। ৩, শেখ জামাল, শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে ৪. শেখ রাসেল, শেখ মুজিবুর রহমানের ছােটছেলে (৯ বছর)। ৫. সুলতানা আহমেদ খুকু, শেখ কামালের স্ত্রী। ৬. পারভীন জামাল রােজী, শেখ জামালের স্ত্রী ও৭. শেখ নাসের, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাই। খ. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একই সময়ে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদেরও হত্যা করা হয় : ১. আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি (বিদ্যুৎ,সেচ পানিসম্পদ মন্ত্রী)। ২. বেবী (১৩ বছর), জনাব সেরনিয়াবাতের মেয়ে ৩, আরিফ, জনাব সেরনিয়াবাতের ছেলে। ৪, বাবু (৪ বছর), জনাব সেরনিয়াবাতের নাতি ৫. একজন অভ্যাগত ভাগ্নে ৬. তিনজন অতিথি ৭. চারজন গৃহভৃত্য। ৮, শেখ ফজুলল হক মণি, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং ক্ষমতাসীন | দলের অন্যতম সম্পাদক ৯. মিসেস ফজলুল হক (আরজু মণি), শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনেয়ী| এবং সে-সময় অন্তঃসত্ত্বা। গ. ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর নিম্নোক্ত জাতীয় নেতাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেহত্যা করা হয় : ১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপরাষ্ট্রপতি) ২. জনাব তাজউদ্দিন আহমদ (প্রথম প্রধানমন্ত্রী) ৩. জনাব মনসুর আলী (তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী)৪. জনাব এএইচএম কামারুজ্জামান (শিল্পমন্ত্রী ও ভূতপূর্ব দলীয় সভাপতি)। ঘ. এ হত্যাকাণ্ডগুলাে অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কতিপয় সামরিক অফিসারেরনেতৃত্বে স্বল্পসংখ্যক সৈনিক দ্বারা সংঘটিত হয়।ঙ. ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ত্যাগ করে ব্যাংকক যাওয়ার জন্যসামরিকবাহিনীর যেসব ব্যক্তি আপােস-আলােচনা চালিয়েছিলেন, তাদের তালিকা থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের শনাক্ত করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরিচালিতএকটি অভ্যুত্থানের পরই ওদের দেশত্যাগ ঘটে। বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে পলায়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল :১. লে. কর্নেল ফারুক ২. লে. কর্নেল আবদুর রশিদ৩. মেজর শরিফুল হক (ডালিম)। চ, নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা অভ্যুত্থানের নেতা ছিল বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় :১. লে. কর্নেল ফারুক ২. লে. কর্নেল রশিদ৩. মেজর শরিফুল হক (ডালিম)। ছ, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দনজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের হত্যার দায়দায়িত্ব লে. কর্নেল ফারুক ব্যাংককে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে স্বীকার করেছে। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডন সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক-সাক্ষাৎকারে এবং ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে প্রদত্ত টিভি-সাক্ষাৎকারে হত্যার দায়িত্ব দৃঢ়ভাবে পুনঃব্যক্ত হয়েছে।৫. সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসকে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে (গ্রানাডা ফিল্ম লাইব্রেরি, ইংল্যান্ড থেকে সংগৃহিত) তারা মুজিব হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করে। ৩০ মে ১৯৭৬ দি সানডে টাইমসে (লন্ডন) ফারুকের বরাতে I helped to kill Mujib, dare you put me on trail শিরােনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তৎকালীন জিয়ার সরকার এই ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধেও কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা লন্ডনে গঠিত তদন্ত কমিশনে খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য (To bring the murderers to trial) নিম্নরূপ আবেদন জানান : My father, Bangabandhu Shekih Mujibur Rahman, members of our family and four of my father’s closest political associates were assassinated on 1 August and 3 November, 1975 respectively. Sheikh Mujib was the founding father of the Bangladesh Republic and both he and his colleagues were democratically elected representatives of their people. They stood for secular democratic Bangladesh and it was the purpose of their murderers and fellow conspirators to defeat these ends and create a sectarian society. Their death, which part of a coup, signalled the end of democracy in the infant state and marked the beginning of military rule. The asassination was obviously part of a wider conspiracy involving leading figures in the countrys military and political establishment. Thus, despite repeatedজ. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভােরে ঐতিহাসিক পরিবর্তন সংঘটন ও সামরিক শাসন জারির জন্য কৃত যে-কোনাে কর্ম বা এর পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন বা প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ বা অন্য কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা প্রতিবিধান অধ্যাদেশ, ১৯৭৫’ শিরাে নামে এক অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশের বরাতে দায়মুক্তির নিমিত্তে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ভােরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন এবং সামরিক শাসন জারির উদ্দেশ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন বা উহার বাস্তবায়ন বা সেই নিমিত্তে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র প্রয়ােজন। বলা হয়, এ জাতীয় প্রত্যয়নপত্র উল্লিখিত ঘটনার চূড়ান্ত সাক্ষ্য বলে বিবেচিত হবে। এ জাতীয় প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর ৭৬৮ নং গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগের বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরিকে চেয়ারম্যান এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কেএম সােবহান। ও বিচারপতি সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেনকে সদস্য করে সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয়promises by the Dacca regime, none of the murderers have been brought to book. Indeed, they and their fellow conspirators have, during these interviening years, enjoyed the protection and patronage of the Government. Some of them have been appointed to diplomatic missions abroad, while others occupy positions of privilege at home. In this instance crime has paid. Unable to get satisfaction from the Bangladesh authorities the families of the victims and their democratic minded supporters in Britain, determined that the matter must not be allowed to rest, persuaded a number of distinguished jurists to set up a commission to inquire into the murder of Bangabandhu and his family and of the four national leaders while under detention without trial in the Dacca central jail. Their names and reputations are a guarantee that the inquiry will conform to the highest standards of judicial propriety. Their findings will, we hope, arouse the world’s conscience to these acts of terror and to the abuses of the rule of law that have disfigured the political and social life of Bangladesh these past seven years. It is right and duty of governments and peoples, who cherish democratic values, to support the democratic rights of peoples in all parts of the world. And when such norms are violated, they should express their abhorrence in every manner open to them. The Dacca junta is critically dependent on the largesse of foreign governments and peoples. International opinion can, therefore, play an important part in helping to bring the murderers to trial as a first step towards restorationa of the rule of law and democratic life in Bangldesh.London, 3 November 1982কারাগারে চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কী পরিস্থিতিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার তাৎক্ষণিক তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংঘটিত হত্যা সম্পর্কে ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার লালবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। প্রতীয়মান হয় যে, অল্পবিস্তর তদন্তের পর বিষয়টি সিআইডিতে পাঠানােহয়। ঠ. ৬ বছরের অধিককাল অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সংশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেকোনাে বিধিগত ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ড. তদন্ত কমিশনের সদস্য মি, সিন ম্যাকব্রাইডের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালের এপ্রিলমাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিশন বাংলাদেশ পরিদর্শন করে এবং রাষ্ট্রপতিসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলােচনার সময় জেলহত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া হবে। পরবর্তী সময়ে লক্ষ্য করা যায়, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে পলায়নকারী হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়। কূটনৈতিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন : ১. লে. কর্নেল (সাবেক মেজর) শরিফুল হক (ডালিম) ২. লে. কর্নেল আজিজ পাশা ৩. মেজর মহিউদ্দিন ৪. মেজর শাহরিয়ার। ৫. মেজর বজলুল হুদা। ৬. মেজর রাশদ চৌধুরি ৭. মেজর নূর। ৮. মেজর শরিফুল হােসেন ৯, ক্যাপ্টেন কিসমত হােসেন ১০. লে, খায়রুজ্জামান১১. লে, আব্দুল মজিদ ণ, দেখা যায়, উল্লিখিত ব্যক্তিদেরকে তাদের পদগুলােতে স্থায়ী করা হয় এবংতা বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়। ত, উপযুক্ত ঘটনা ও প্রাগুক্ত হত্যা সম্পর্কে আইন ও বিচারের প্রক্রিয়া।স্বীয়গতিতে চলার পথে কী অন্তরায় রয়েছে, সরেজমিনে তদন্তের উদ্দেশ্যে। কমিশনের একজন সদস্যের ঢাকা সফর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, কমিশনের অন্যতম সদস্য মি. জেফ্রি থমাস, কিউ.. সি, একজন সাহায্যকারীসহ সরেজমিনে তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য ১৯৮১ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকা গমন করবেন। মি. জেফ্রি থমাস ও তার।সহযােগীর ঢাকা গমনের ভিসা লাভের জন্য তদন্ত কমিশনের সচিব।সলিসিটার মি. অ্যাওত্রে রােজ দরখাস্ত পেশ করেন। দ, তদন্ত কমিশনের সদস্যদের সময়মতাে বাংলাদেশ গমনের ভিসা দেয়া হবে।ইঙ্গিত করে (লণ্ডনস্থ) বাংলাদেশ হাই কমিশন বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। ধ, ১৯৮১ সালের ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটের সুযােগগ্রহণ করতে দেয়ার লক্ষ্যে সকালে জরুরি অনুরােধ জানালে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন পাসপাের্ট ও ভিসা অপরাহ্নে ফেরত দেয়া হবে জানায় কিন্তু সময় মতাে এগুলাে চাওয়া হলে জানানাে হয়, কলার বিভাগবন্ধ। ন, পরে বাংলাদেশ হাই কমিশন জানায়, তারা মি, জেফ্রি থমাসের ঢাকা ভ্রমণেরজন্য ভিসা দিতে অপারগ। তদন্ত কমিশনের সচিব কর্তৃক বহুবার চিঠি, টেলিফোন ও সরাসরি যােগাযােগ করা এবং সশরীরে উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে তাকে ভিসা প্রত্যাখ্যানপত্র বাএ-জাতীয় কোনাে ব্যাখ্যা দেয়া হয় নি। উপরে বিবৃত ঘটনাসমূহ থেকে আমরা যে প্রাথমিক উপসংহারে উপনীত হয়েছি। তা হল :ক, আইন ও বিচারের প্রক্রিয়াকে স্বীয়গতিতে চলতে দেয়া হয়নি। খ, প্রতীয়মান হয় এ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিতে সরকারই দায়ী।গ. সমস্ত বাধা উপড়ে ফেলে আইন ও বিচারকে স্বীয়গতিতে চলতে দেয়া উচিত। ২০ মার্চ ১৯৮২ ১৪-১৮ হাই হলবর্ন, লন্ডন ডব্লিউসিআই।মামলার এজাহারপ্রতি : ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ধানমণ্ডি থানা ঢাকা। বিষয় : এজাহার। আমি আ.ফ.ম. মহিতুল ইসলাম, পিতা (মৃত) এ.ওয়াই.এম. নূরুল ইসলাম, সাং ইসলাম কুটির, হাসপাতাল রােড, ঝিকরগাছা, থানা ঝিকরগাছা, জেলা যশােহর, বর্তমানে ফ্ল্যাট নং ২৬, বিল্ডিং নং ১, সেকশান ১৪, মিরপুর, ঢাকা এই মর্মে জানাচ্ছি যে, ১৯৭৫ সালে তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি নং-৬৭৭, রােড নং-৩২, ধানমণ্ডি, ঢাকার বাড়ির রিসিপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে রাত্র ৮টা থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত আমার ঐ বাড়িতে ডিউটি ছিল। যথারীতি আমি রাত্র ৮টার সময় প্রেসিডেন্টের বাসভবনেডিউটিতে আসি। ঐ সময় ঐ বাড়ির নিচতলায় টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিন, বাড়ির রাখাল আবদুল আজিজ, একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এবং একজন কাজের বেটি, উপরতলায় কাজের ছেলে মাে. সেলিম ওরফে আবদুল এবং আবদুর রহমান ওরফে রমা ছিল। ঐদিন ঐ বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর ৩ (তিন) ছেলে যথাক্রমে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রােজী জামাল, বেগম মুজিব ছিলেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছােটভাই শেখ নাসেরও বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ঐ রাতে ঐ বাড়িতে নিরাপত্তা ডিউটিতে পুলিশের ডিএসপি জনাব নুরুল ইসলাম। খান, ইন্সপেক্টর খােরশেদ, এসবি’র একজন অফিসার এবং পুলিশের আরাে অন্যান্য পদের লােক ছিল। পুলিশ ছাড়া নিরাপত্তা ডিউটিতে সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য ছিল। রাত্র আনুমানিক ৮-৯ টার সময় বঙ্গবন্ধু বাইরে থেকে বাসায় আসেন। তার সঙ্গের সিকিউরিটি এবং অন্যরা তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে যান। তারা চলে যাবার পর আমি গেটে পাহারারত আর্মি ও পুলিশের সাথে গল্প করছিলাম। রাত ১ টার দিকে আমাদের জন্য নির্ধারিত বিছানায় শুতে গেলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিন ধাক্কা দিয়ে আমাকে উঠান এবং বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে টেলিফোনে ডাকছেন। সম্ভবত তখন সময় হবে ৪-৩০টা বা ৫টা। চারিদিক বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। তখনাে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছিল। আমি তাড়াতাড়ি এসে টেলিফোন ধরলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোলরুমে টেলিফোন লাগা।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন লাগাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানাের চেষ্টা করি। সে-মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু উপর থেকে নিচে নেমে আমার রুমে আসেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হল, পুলিশ কন্ট্রোলরুম লাগাতে বললাম, লাগালি না?’ আমি বললাম, ‘স্যার, পুলিশ কন্ট্রোলরুম ধরছে না। আমি গণভবন এক্সচেঞ্জ ধরেছি। গণভবন থেকে টেলিফোন ধরেছে, কিন্তু কথার কোনাে উত্তর দিচ্ছে না। আমি ‘হ্যলাে হ্যালাে’ বলে চিৎকার করছিলাম তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ ঠিক তখনি একঝাঁক গুলি আমাদের অফিসকক্ষের দক্ষিণদিকের জানালার গ্লাস ভেঙে দেয়ালে এসে লাগে। অন্য টেলিফোনে চিফ সিকিউরিটি অফিসার মহিউদ্দিন টেলিফোন করেন, আমি। ধরি। ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গ্লাসভাঙা আমার ডানহাতের কনুইর কাছে এসে বিধে কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। এই সময় জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধু আমার টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং আমার হাত ধরে টেনে শুতে বলেন। আমি শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে গুলি বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু উঠে। দাঁড়ালেন এবং আমিও উঠলাম। উপর থেকে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুলবঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে এল। আমার অফিসকক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি পাঞ্জাবি পরলেন। বারান্দায় এসে তিনি বললেন, “আমি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি চলছে, তােমরা কী করাে?” এই বলে তিনি উপরে উঠে গেলেন। সেই সময় শেখ কামাল নিচে বারান্দায় এসে বললেন, ‘আর্মি-পুলিশ ভাই, সবাই আমার সাথে আসুন।’ বলার সাথে সাথে ৩/৪ জন কাল ও কিছু খাকি-পােশাকধারী লােক অস্ত্রসহ সামনে এসে দাঁড়াল। আমি ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম সাহেব কামাল ভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন ডিএসপি নূরুল ইসলাম সাহেব আমাকে পিছন দিকে টান দিয়ে অফিসকক্ষের মধ্যে নিয়ে গেলেন। ওখান থেকে বাইরে কী হচ্ছে দেখতে চেষ্টা করলাম। আবারাে গুলির শব্দ শুনলাম। এই সময় কামাল ভাই গুলি খেয়ে লাফ দিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়েন। কামাল ভাই চিকার করে বললেন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, তা ওদেরকে বলেন। আক্রমণকারীদের মধ্যে কালাে-পােশাকধারী ও খাকিপােশাকধারী ছিল। আমি তাদেরকে বললাম : ‘ভাই, উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ ওরা সঙ্গে সঙ্গে কামাল ভাইকে লক্ষ্য করে আবার ফায়ার করল। আবার কামাল ভাইয়ের শরীরে গুলি লাগে, একটি গুলি আমার হাঁটুতে লাগে। একই সঙ্গে ডিএসপি নূরুল ইসলাম সাহেবের পায়েও গুলি লাগে। তখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম তারা সবাই আর্মির লােক, তারা এই বাড়িতে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানাের জন্যই এসেছে। ডিএসপি সাহেব আমাকে টেনে উনার কক্ষে নিয়ে যান, ওখানে দেখি এসবি’র একজন অফিসার। রিভলভার তার পায়ের কাছে পড়ে আছে এবং সে খুব ভীত-সন্ত্রস্ত। ডিএসপি সাহেব আমাদের দু’জনকে পিছনের দরজা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। তখন আর্মির মেজর বজলুল হুদা আমাদের মাথার চুল টেনে ধরে। তার সাথে আরাে অস্ত্রধারী আর্মির লােক ছিল। বজলুল হুদা আমাদের নিয়ে গেটের নিকট লাইন করে দাঁড় করায়। সেখানে তখন পুলিশের লােক এবং টেলিফোন মিস্ত্রিকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিনের পাশে ডিএসপি সাহেব ও আমাকে দাঁড় করায়। আমার পাশে এসবি’র পুলিশ অফিসার দাঁড়ানাে ছিল। হঠাৎ একজন আর্মি এসে এসবি’র পুলিশ অফিসারকে গুলি করে, সাথে সাথে তিনি গুলি খেয়ে পড়ে যান। কয়েকজন আর্মিকে আমাদের পাহারায় রেখে বাকিরা ফায়ার করতে করতে দোতলায় যায়। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনতে পেলাম। এরপরই অনেক গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। সাথে সাথে মহিলাদের আহাজারি ও আর্তচিঙ্কার শুনলাম। এই সময় নিচে রান্নার ঘর ও গােয়ালঘর থেকে বুড়ি ও রাখাল আজিজকে আমাদের লাইনে এনে দাঁড় করায়। উপর থেকে শেখ নাসেরকে। এনে আমাদের লাইনে দাঁড় করায়। তার হাতে গুলির রক্তাক্ত জখম ছিল। শেখ নাসের বললেন, স্যার আমি তাে রাজনীতি করি না, ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।’ তখন পাশে দাঁড়ানাে একজন আর্মি বললেন, ‘শেখ মুজিব ইজ বেটার দেন নাসের।’ যে অস্ত্রধারী আর্মির লােকটি শেখ নাসেরকে নিয়ে এসেছিল সে বলল।‘ঠিক আছে আপনাকে কিছু বলব না, আপনি ঐ রুমে গিয়ে বসুন’ -এই বলে। আমাদের লাইন থেকে তাকে বের করে আমাদের অফিসরুমের সাথে এটাচড। বাথরুমে নিয়ে তাকে গুলি করে। তারপর ঐ অস্ত্রধারী আর্মির লােকটি আমাদের লাইনের কাছে ফিরে আসে। শেখ নাসের ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করেন। তখন একজন আর্মির লােক অন্য একজন আর্মির লােককে বলে যা পানি দিয়ে আয়।’ সে পুনরায় সেখানে যায় এবং পানির পরিবর্তে আবার গুলি করে। ইতােমধ্যে শিশু রাসেল ও রমাকে নিচে নিয়ে আসে। শিশু রাসেল প্রথমে রমাকে ও পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাইয়া আমাকে মারবে না তাে? আমার ধারণা ছিল, শিশু রাসেলকে তারা মারবে না। সেই ধারণাতেই আমি বলি, না ভাইয়া তােমাকে মারবে না।’ খাকি-পপাশাকধারী একজন আমার কাছ থেকে রাসেলকে জোর করে নিয়ে গেল। রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে তাকে মায়ের কাছে নেবার কথা বলে ভিতরে নিয়ে যায়। এরপরই গুলির শব্দ শুনি। এই সময় মেজর বজলুল হুদাকে গেটের নিকট মেজর ফারুক কী যেন জিজ্ঞেস করে। তখন বজলুল হুদা বলেন, ‘অল আর ফিনিশড।’ আমরা যখন গেটের নিকট লাইনে দাঁড়ানাে ছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ট্যাংক যাওয়া-আসা করতে দেখি। ট্যাংকের উপরে কালাে-পােশাকধারী আর্মির লােক দেখি। বেলা অনুমান ৮টার দিকে কর্নেল জামিল সাহেবের ডেডবডি তার গাড়িতে করে আর্মির একজন ড্রাইভার ড্রাইভ করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসে। এক সময়ে মেজর ডালিমকে খাকি পােশাক পরা অবস্থায় ঘটনাস্থলে দেখেছি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত আর্মিদের সাথে তাকে কথা বলতে দেখি। গত ১৫.০৮.১৯৭৫ তারিখে ভােরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী। রােজী জামাল, শেখ নাসের ও এসবি’র একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করা হয়। সাবেক মেজর ফারুক, মেজর বজলুল হুদা, মেজর নূর ও মেজর ডালিমকে এই হত্যাকাণ্ডের সময় এবং পরপরই আমি ঘটনাস্থলে দেখেছি এবং চিনতে পেরেছি। তারা ছাড়াও আমি ঘটনার পর বিজ্ঞি লােকমুখে এবং দেশী-বিদেশী সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও এই সংক্রান্ত লিখিত বইয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, খন্দকার মােশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মেজর রশিদ, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর শরফুল হােসেন, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন কিসমত, রিসালদার মােসলেহ উদ্দিনসহ সাঁজোয়া, গােলন্দাজবাহিনীর সদস্য ও সেনাবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের কিছু সদস্য, উচ্চাভিলাষী কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে নিজ নিজ স্বার্থে গত ১৫.০৮.১৯৭৫ তারিখে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তার পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।এজাহারে অভিযুক্ত আসামি ছাড়া অন্য যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল, তাদের নাম তদন্তে প্রকাশ পাবে। আমার জীবনের নিরাপত্তা এবং নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থার কারণে এই ঘটনার এজাহার করতে বিলম্ব হল।স্বামহিতুল ইসলাম। ০২.১০,৯৬ (আ.ফ.ম. মহিতুল ইসলাম) পিতা : (মৃত) এ.ওয়াই.এম, নূরুল ইসলাম সাং: ইসলাম কুটির, হাসপাতাল রােড ঝিকরগাছা, থানা : ঝিকরগাছা জেলা : যশােহর।ধানমণ্ডি থানার তৎকালীন ওসি শফিউল্লাহ মামলার ৫৬তম সাক্ষী উক্ত এজাহার রেকর্ড করেন। মামলার নম্বর ১০ (১০) ৯৬।আভিযােগপত্র (চার্জশিট) হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রাথমিক পর্যায়ে ধানমণ্ডি থানার ওসি। গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে সিআইডিকে দেয়া হয়। দীর্ঘ ৩ মাস ১৩ দিনের তদন্ত শেষে সিআইডির এএসপি আবদুল কাহহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি চার্জশিট দাখিল করেন। | ৩৪ পৃষ্ঠার চার্জশিটে ১ থেকে ২৪ পৃষ্ঠা জুড়ে সন্নিবেশিত হয়েছে আসামি ও সাক্ষীদের তালিকা, তাদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা এবং ৪৫টি আলামতের বিবরণ; ২৪ থেকে ৩৪ নম্বর পর্যন্ত মােট ১১ পৃষ্ঠাব্যাপী রয়েছে মামলার অভিযােগ তথা অপরাধের নাম, সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও অভিযােগের ধারাসমূহ। চার্জশিটের গুরুত্বপূর্ণ। অংশবিশেষ নিম্নরূপ :বাদীর লিখিত এজাহার পাইয়া (ধানমণ্ডি) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা রুজু করেন এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মােতাবেক আমি মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করি। তদন্তকালে আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শনপূর্বক ঘটনাস্থলের পৃথক-সূচিসহ খসড়া মানচিত্র তৈরি করি, আলামত জব্দ করি এবং সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া তাহাদের জবানবন্দি কার্য বিধির ১৬১ ধারামতে পৃথক পৃথকভাবে লিপিবদ্ধ করি। মামলায় জড়িত আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (অব.), লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (অব.), লে, মহিউদ্দিন (সাবেক সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি), ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বিএনসিসি ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা (অব.), অনারারি ক্যাপ্টেন আ, ওহাব জোয়ারদার, মাে, ইউনুস আলী (আর্টিলারি), মাে. আবু মুসা। মজুমদার (ল্যান্ডার), মিসেস যােবায়দা রশিদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুরগণকে গ্রেফতার করিয়া জিজ্ঞাসাবাদপূর্বক কোর্টে প্রেরণ করিলে তাহাদের মধ্যে আসামি লে. কর্নেল।সৈয়দ ফারুক রহমান (অব.), লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (অব.), লে, মহিউদ্দিন (সাবেক সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি), অনারারি ক্যাপ্টেন আ, ওহাব জোয়ারদার (অব.), শেখ মাে. ইউনুস আলী, মাে, আবু মুসা মজুমদার, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মিসেস যােবায়দা রশিদগণ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রতীয়মান হয় যে, বিক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত সেনাসদস্য আসামি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খন্দকার আ. রশিদ, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন মােস্তফা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর আজিজ পাশা, মেজর আহমদ শরিফুল হােসেন, লে. নাজমুল হােসেন আনসার, লে. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন মাজেদ, অনারারি ক্যাপ্টেন আ, ওহাব জোয়ারদার, রিসালদার মােসলেমউদ্দিন, রিসালদার সারােয়ার, দফাদার মারফত আলী শাহ, এলডি আবুল হাসেম মৃধা, মেজর সুলতান শাহরিয়ার (অব.), চাকরিচ্যুত সেনাসদস্য মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এএইচএমবি নূর চৌধুরী, মেজর রাশেদ চৌধুরি এবং উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আসামি খন্দকার মােশতাক আহমেদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী, মিসেস যােবায়দা রশিদ-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাহার পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজন সকলকে হত্যা করার চক্রান্তে লিপ্ত হন। এই চক্রান্তে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে উল্লিখিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও উল্লিখিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে এই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া মদদ যােগায় ও সহযােগিতা করেন। তদন্তে আরাে প্রমাণিত হয় যে, ঘটনার দিন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ অত্র অভিযােগপত্রে ২ ও ৩ নং কলামে বর্ণিত আসামি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খন্দকার আ. রশিদ, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন মােস্তফা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর আজিজ পাশা, মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন, লে, নাজমুল হােসেন, লে. কিসমত হাসেম, রিসালদার মােসলেমউদ্দিন, রিসালদার সারােয়ার, দফাদার মারফত আলী শাহ, এলডি আবুল হাসেম মৃধা, চাকরিচ্যুত মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এইচ এমবি নূর চৌধুরী, মেজর রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার (অব.) -ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপার্শ্বে বালুরঘাট এলাকায় এবং সংলগ্ন ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটে নাইট ট্রেনিঙের অজুহাতে বেআইনিভাবে গােলাগুলি সগ্রহপূর্বক সমবেত ল্যান্সার ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান এবং টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খন্দকার আ. রশিদ তাহাদের অধীনস্থ কতিপয় সদস্যদেরকে ব্রিফিং দেন এবং ব্রিফিংকালে অধীনস্থ সেনা-সদস্যদেরকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা বক্তব্য দিয়া প্ররােচিত ও উত্তেজিত করেন এবং পূর্বপরিকল্পিত নীল নকশা মােতাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাহার পরিবারের সদস্যবর্গ, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্যদের হত্যা করার জন্য তাহাদের সহযােগীরা কে কোথায় যাইবে এই বিষয়ে তাহারা নির্দেশ প্রদান করেন। সেই মােতাবেক আসামিগণ তিন দলে বিভক্ত হইয়া একটি দল ভাের সাড়ে ৪টা।হইতে ৫টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সশস্ত্র আক্রমণ চালাইয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁহার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা এবং তাঁহার ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শেখ রাসেল, কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রােজী জামাল ও বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসার এএসআই সিদ্দিকুর রহমানকে গুলি করিয়া নৃশংসভাবে হত্যা করেন এবং হত্যার উদ্দেশ্যে বাদী মহিতুল ইসলাম, ডিএসপি নুরুল ইসলাম ও বাড়ির চাকর সেলিমকে গুলি করিয়া মারাত্মক জখম করেন। ইহা ছাড়াও ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সাবেক এএসপি কর্নেল জামিল ও তাহার বাড়িতে পাহারাত সেনাসদস্য সৈয়দ সামছুল হককেও গুলি করিয়া হত্যা করে। তদন্তে ও সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রাথমিকভাবে আরাে প্রমাণিত হয় যে, ঘটনাস্থল ও উহার আশপাশে উপস্থিত কতিপয় সাক্ষী এই হত্যাকাণ্ডের সময় হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের শনাক্ত করিয়াছেন এবং হত্যাকাণ্ড ঘটাইতে দেখিয়াছেন। এই হত্যাকাণ্ড ঘটানাের পর হত্যাকারীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ড ঘটাইবার কথা স্বীকার করিয়া বাংলাদেশ বেতারে ঘােষণা দেন এবং পরস্পর যােগসাজশে অবৈধভাবে খন্দকার মােশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আসামিদের কৃত অপরাধ হইতে নিজেদের বাঁচাইবার জন্য বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্যদের লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত না করাইয়া হত্যার আলামত বিনষ্ট করেন। তাছাড়া ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে আসামিরা বাড়ির মালামাল তছনছ করেন এবং মূল্যবান মালামাল চুরি করিয়া লইয়া যান। পরবর্তীতে তৎকালীন সামরিক সরকার অধিকাংশ হত্যাকারী আসামিকে বিদেশে চাকরি দিয়া পুরস্কৃত করেন। তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে অত্র অভিযােগপত্রে ২ ও ৩ নং কলামে অভিযুক্ত আসামিগণ পরস্পর যােগসাজশে একই উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং উদ্দেশ্য সাধনকল্পে আসামিগণ কলাম নং ২ এর ১ হইতে এবং ৩ নং কলামে ১, ২, ৪ ও ৫ নং আসামিগণ বেআইনিভাবে গোলাগুলি সংগ্রহপূর্বক সশস্ত্র অবস্থায় বেআইনি সমাবেশে সমবেত হইয়া পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁহার পরিবারের সদস্যবর্গ, অত্মীয়স্বজন ও অন্যান্যদের হত্যা করিয়া এবং আরাে কতিপয় ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করিয়া মারাত্মক জখম ও মূল্যবান মালামাল চুরি করিয়া ও নিজেদের কৃত অপরাধ হইতে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ দণ্ড বিধির ৩০২/১২০/(বি) ৩২৪/৩০৭/২০১/৩৮০/১৪৯/৩৪/১০৯ ধারা মােতাবেক অপরাধ করিয়াছে বলিয়া প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালতে বিচারার্থে আমি তাহাদের বিরুদ্ধে উপরোক্ত ধারায় অত্র অভিযােগপত্র দাখিল করিলাম। কলাম নং ২-এর ক্রমিক নং ১৫ হইতে ১৮ পর্যন্ত আসামিদের বিরুদ্ধে বর্ণিত ধারায় অভিযােগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু তাহারা মৃত বিধায় তাহাদেরকে বিচারের জন্য সােপর্দ করা গেল না। একই কলামের ৬, ৭ এবং ৮ ক্রমিকের আসামিদের বিরুদ্ধে ঘটনা প্রমাণের যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় বিচারে সােপর্দ করা গেল না। বিধায় তাদের মামলার দায় হইতে অব্যাহতি দানের সুপারিশ করা হইল।

THE BANGLADESH GAZETTEExtraordinary Published by AuthorityFRIDAY, SEPTEMBER 26, 1975 GOVERNMENT OF THE PEOPLES REPUBLIC OF BANGLADESH MINISTRY OF LAW PARLIAMENTARY AFFAIRS AND JUSTICE(Law and Parliamentary Affairs Division)NotificationDhaka, The 26 September 1975No. 692-Pub The following ordinance made by the President of the Peoples Republic of Bangladesh, on the 26th September 1975, is hereby published for general information.THE INDEMNITY ORDINANCE 1975 ORDINANCE NO XLX OF 1975.ANORDINANCE to restrict the taking of any legal or other Procedings in respect of certain acts or things done in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitatiing, the historical change and the Poclamation of Martail Law on the moring of the 15 August, 1975. Whereas it is expendient to restrict the taking of any legal or other proceedings in repsect of certain acts or things done in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or steps necessitating, the historical change and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975; AND WHEREAS Parliament is not in session and president is satisfied that circumstances exist which render immediate action neccessary; NOW, THEREFORE, in persuance of the proclamation of the 20th August 1975 and in exercise of the Power conferred by clause (1)of article 93 of the Constitution of the Peoples Republic of Bangladesh, the President is pleased to make and promulgate the following Ordinance : 1. SHORT TITLE This Ordinance may be called the Indemnity Ordinance, 1975. 2. RESTRICTIONS ON THE TAKING OF ANY LEGAL OR OTHER PROCEEDINGS AGAINST PERSONS IN RESPECT OF CERTAIN ACTS AND THING; (1) Notwithstanding anything contained in any law, including a law relating to any defence service, for the time being in force, no suit, prosecution or other proceedings, legal or disciplinary, shall lie, or be taken, in, before or by any Court, including the Supreme Court and Court Martial, or other authority against any person including a person who is or has, at any time, been subject to any law relating to any defence service, for on account of or in respect of any act, matter or thing done or step taken by such person in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary step towards the change of Government of the Peoples Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August. 1975.
(2) For the purpose of this section, a certificate by the President, or a person authorised by him in this behalf, that any act, matter or thing was done or step taken by any person mentioned in the certificate in connection with or in perparation or execution of any plan for, or as necessary step towards as the change of Government of the Peoples Republic of Bangladesh and the Proclamation or Martial Law on morning of the 15th August, 1975, shall be sufficient evidence of such act, matter or thing having been done or step having been taken in connection with, or in preparaton or execution of any plan for, or a necessary step towards the change of such Government and the Proclamation of Martial Law on that morning.DACCA The 26th September 1975 KHANDAKER MOSHTAQUE AHMED Presidentসাংবিধানিক বিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি এবং উভয়ের অনুপস্থিতিতে স্পিকার কর্তৃক রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা। মােশতাক উপরাষ্ট্রপতি বা স্পিকার না হওয়ায় তার রাষ্ট্রপতির পদ দখল করা ছিল অবৈধ। সুতরাং অবৈধ রাষ্ট্রপতির জারিকৃত অধ্যাদেশও অবৈধ। কিন্তু জেনারেল জিয়া তার শাসনআমলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সকল অবৈধ কার্যক্রমকে সংসদ কর্তৃক ‘পঞ্চম সংশােধনী আইন ১৯৭৯’ পাসের মাধ্যমে সাংবিধানিক বিধিতে পরিণত করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর ১২ নভেম্বর ১৯৯৬ জাতীয় সংসদে কুখ্যাত এই নিরাপত্তা-প্রতিবিধান অধ্যাদেশ-১৯৭৫ বাতিল করা হয়। প্রধান বিরােধীদল বিএনপি এ অধ্যাদেশ বাতিল পক্রিয়ার পুরাে সময় সংসদ বর্জন করে। জামাতে ইসলামীর সাংসদগণ এদিন সংসদে অনুপস্থিত থাকেন। কর্নেল (অব.) ফারুকের মা মাহমুদা রহমান ও কর্নেল (অব.) শাহরিয়ার রশিদ খান বাদি হয়ে এর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে পৃথক দুটি রিট আবেদন করেন। ২৮ জানুয়ারি ১৯৯৭ হাইকোর্ট রিট আবেদনদ্বয় খারিজ করে দিয়ে বলেন, নিরাপত্তা প্রতিবিধান (বিলােপ) আইন ১৯৯৬ যথাযথভাবে পাস হয়েছে।
এর ফলে হত্যাকাণ্ডের বিচারের রুদ্ধদ্বার অর্গলমুক্ত হয়। পরে সুপ্রিমকোর্টে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিমকোর্ট হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।লন্ডনে গঠিত হত্যা তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক রিপাের্ট ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুজিব ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনাবিচারে অন্তরীণ সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপরাষ্ট্রপতি), তাজউদ্দিন আহমদ (প্রথম প্রধানমন্ত্রী), মনসুর আলী (তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী) ও কামারুজ্জামান (শিল্পমন্ত্রী) -এ চার জাতীয় নেতা হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন ও বিচারের প্রক্রিয়াকে যে-সমস্ত অবস্থা বাধাগ্রস্ত করেছে সেগুলাে তদন্ত করার জন্য মুজিবের রক্ষাপ্রাপ্ত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র মােহাম্মদ সেলিম ও উপরাষ্ট্রপতির পুত্র সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আবেদনক্রমে স্যার থমাস উইলিয়ামস, কিউ সি, এমপির নেতৃত্বে লন্ডনে একটি তদন্ত কমিশন। গঠনের উদ্যোগ গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর স্যার থমাস উইলিয়ামসের সভাপতিত্বে হাউস অব কমন্সের একটি কমিটিকক্ষে এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। জেফ্রি থমাস, কিউ সি, এমপি এবং সলিসিটার মি. অ্যাওব্রে রােজ এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভাশেষে তদন্ত কমিশন গঠন ও তার কার্যপদ্ধতি ঘােষণা করে ঐদিনই অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। কমিশন নিম্নোক্ত বিষয়ের ওপর কমিশনের প্রতিটি সদস্যের কাছে সরবরাহকৃত প্রমাণ-সংবলিত দলিলপত্রাদি পরীক্ষা করার উদ্যোগ গ্রহণ করে :পরে জানা যায়, জিয়া কর্তৃক পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা-প্রতিবিধান অধ্যাদেশ ১৯৭৫ সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হলেও মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার পরিপন্থী’ হওয়ায় তা সংশােধনের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থন প্রয়ােজন ছিল না। এমনকি তা হত্যা মামলা দায়েরের পথে আইনগতভাবে বাধাও ছিল না। তবে, পরিবেশ অনুকূলে না-থাকায় তা কাগুজে বাঘ স্বরূপ মনস্তাত্ত্বিক বাঁধা’ হিসেবে কাজ করেছে।ক. ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাএবং ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতার হত্যা; খ, জনসমক্ষে যে-সমস্ত ব্যক্তি হত্যার দায়দায়িত্ব গ্রহণ করেছে এবং গ. এ সমস্ত বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহ। প্রাপ্ত কাগজপত্র পরীক্ষা থেকে নিম্নোক্ত ঘটনা পরিস্ফুট হয় : ক. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভােরে ঢাকার ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকায় ৩২নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের নিম্নোক্ত সদস্যবৃন্দকে নিজ বাসভবনে হত্যা করা হয় : ১. বেগম ফজিলাতুন্নেসা, শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী।
২. শেখ কামাল, শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে ৩, শেখ জামাল, শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় ছেলে ৪. শেখ রাসেল, শেখ মুজিবুর রহমানের ছােটছেলে (৯ বছর)। ৫. সুলতানা আহমেদ খুকু, শেখ কামালের স্ত্রী। ৬. পারভীন জামাল রােজী, শেখ জামালের স্ত্রী ও৭. শেখ নাসের, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাই। খ. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একই সময়ে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদেরও হত্যা করা হয় : ১. আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি (বিদ্যুৎ,সেচ পানিসম্পদ মন্ত্রী)। ২. বেবী (১৩ বছর), জনাব সেরনিয়াবাতের মেয়ে ৩, আরিফ, জনাব সেরনিয়াবাতের ছেলে। ৪, বাবু (৪ বছর), জনাব সেরনিয়াবাতের নাতি ৫. একজন অভ্যাগত ভাগ্নে ৬. তিনজন অতিথি ৭. চারজন গৃহভৃত্য। ৮, শেখ ফজুলল হক মণি, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং ক্ষমতাসীন | দলের অন্যতম সম্পাদক ৯. মিসেস ফজলুল হক (আরজু মণি), শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনেয়ী| এবং সে-সময় অন্তঃসত্ত্বা। গ. ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর নিম্নোক্ত জাতীয় নেতাদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেহত্যা করা হয় : ১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম (উপরাষ্ট্রপতি) ২. জনাব তাজউদ্দিন আহমদ (প্রথম প্রধানমন্ত্রী) ৩. জনাব মনসুর আলী (তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী)৪. জনাব এএইচএম কামারুজ্জামান (শিল্পমন্ত্রী ও ভূতপূর্ব দলীয় সভাপতি)। ঘ. এ হত্যাকাণ্ডগুলাে অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত কতিপয় সামরিক অফিসারেরনেতৃত্বে স্বল্পসংখ্যক সৈনিক দ্বারা সংঘটিত হয়।ঙ. ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ত্যাগ করে ব্যাংকক যাওয়ার জন্যসামরিকবাহিনীর যেসব ব্যক্তি আপােস-আলােচনা চালিয়েছিলেন, তাদের তালিকা থেকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের শনাক্ত করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরিচালিতএকটি অভ্যুত্থানের পরই ওদের দেশত্যাগ ঘটে। বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে পলায়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল :১. লে. কর্নেল ফারুক ২. লে. কর্নেল আবদুর রশিদ৩. মেজর শরিফুল হক (ডালিম)। চ, নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা অভ্যুত্থানের নেতা ছিল বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় :১. লে. কর্নেল ফারুক ২. লে. কর্নেল রশিদ৩. মেজর শরিফুল হক (ডালিম)।
ছ, শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সৈয়দনজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের হত্যার দায়দায়িত্ব লে. কর্নেল ফারুক ব্যাংককে অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে স্বীকার করেছে। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডন সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাংবাদিক-সাক্ষাৎকারে এবং ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে প্রদত্ত টিভি-সাক্ষাৎকারে হত্যার দায়িত্ব দৃঢ়ভাবে পুনঃব্যক্ত হয়েছে।৫. সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসকে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে (গ্রানাডা ফিল্ম লাইব্রেরি, ইংল্যান্ড থেকে সংগৃহিত) তারা মুজিব হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করে। ৩০ মে ১৯৭৬ দি সানডে টাইমসে (লন্ডন) ফারুকের বরাতে I helped to kill Mujib, dare you put me on trail শিরােনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তৎকালীন জিয়ার সরকার এই ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধেও কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা লন্ডনে গঠিত তদন্ত কমিশনে খুনীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য (To bring the murderers to trial) নিম্নরূপ আবেদন জানান : My father, Bangabandhu Shekih Mujibur Rahman, members of our family and four of my father’s closest political associates were assassinated on 1 August and 3 November, 1975 respectively. Sheikh Mujib was the founding father of the Bangladesh Republic and both he and his colleagues were democratically elected representatives of their people. They stood for secular democratic Bangladesh and it was the purpose of their murderers and fellow conspirators to defeat these ends and create a sectarian society. Their death, which part of a coup, signalled the end of democracy in the infant state and marked the beginning of military rule. The asassination was obviously part of a wider conspiracy involving leading figures in the countrys military and political establishment. Thus, despite repeatedজ. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভােরে ঐতিহাসিক পরিবর্তন সংঘটন ও সামরিক শাসন জারির জন্য কৃত যে-কোনাে কর্ম বা এর পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন বা প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কোনাে ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ বা অন্য কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর নিরাপত্তা প্রতিবিধান অধ্যাদেশ, ১৯৭৫’ শিরাে নামে এক অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশের বরাতে দায়মুক্তির নিমিত্তে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ভােরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পরিবর্তন এবং সামরিক শাসন জারির উদ্দেশ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন বা উহার বাস্তবায়ন বা সেই নিমিত্তে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত প্রত্যয়নপত্র প্রয়ােজন। বলা হয়, এ জাতীয় প্রত্যয়নপত্র উল্লিখিত ঘটনার চূড়ান্ত সাক্ষ্য বলে বিবেচিত হবে। এ জাতীয় প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি।
১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর ৭৬৮ নং গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগের বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরিকে চেয়ারম্যান এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কেএম সােবহান। ও বিচারপতি সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেনকে সদস্য করে সম্প্রতি ঢাকা কেন্দ্রীয়promises by the Dacca regime, none of the murderers have been brought to book. Indeed, they and their fellow conspirators have, during these interviening years, enjoyed the protection and patronage of the Government. Some of them have been appointed to diplomatic missions abroad, while others occupy positions of privilege at home. In this instance crime has paid. Unable to get satisfaction from the Bangladesh authorities the families of the victims and their democratic minded supporters in Britain, determined that the matter must not be allowed to rest, persuaded a number of distinguished jurists to set up a commission to inquire into the murder of Bangabandhu and his family and of the four national leaders while under detention without trial in the Dacca central jail. Their names and reputations are a guarantee that the inquiry will conform to the highest standards of judicial propriety. Their findings will, we hope, arouse the world’s conscience to these acts of terror and to the abuses of the rule of law that have disfigured the political and social life of Bangladesh these past seven years. It is right and duty of governments and peoples, who cherish democratic values, to support the democratic rights of peoples in all parts of the world. And when such norms are violated, they should express their abhorrence in every manner open to them. The Dacca junta is critically dependent on the largesse of foreign governments and peoples. International opinion can, therefore, play an important part in helping to bring the murderers to trial as a first step towards restorationa of the rule of law and democratic life in Bangldesh.London, 3 November 1982কারাগারে চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কী পরিস্থিতিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তার তাৎক্ষণিক তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সংঘটিত হত্যা সম্পর্কে ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার লালবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। প্রতীয়মান হয় যে, অল্পবিস্তর তদন্তের পর বিষয়টি সিআইডিতে পাঠানােহয়। ঠ. ৬ বছরের অধিককাল অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সংশিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেকোনাে বিধিগত ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। ড. তদন্ত কমিশনের সদস্য মি, সিন ম্যাকব্রাইডের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালের এপ্রিলমাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিশন বাংলাদেশ পরিদর্শন করে এবং রাষ্ট্রপতিসহ অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলােচনার সময় জেলহত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছিল যে, আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া হবে। পরবর্তী সময়ে লক্ষ্য করা যায়, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ থেকে ব্যাংককে পলায়নকারী হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়ােজিত করা হয়। কূটনৈতিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হলেন : ১. লে. কর্নেল (সাবেক মেজর) শরিফুল হক (ডালিম) ২. লে. কর্নেল আজিজ পাশা ৩. মেজর মহিউদ্দিন ৪. মেজর শাহরিয়ার। ৫. মেজর বজলুল হুদা। ৬. মেজর রাশদ চৌধুরি ৭. মেজর নূর। ৮. মেজর শরিফুল হােসেন ৯, ক্যাপ্টেন কিসমত হােসেন ১০. লে, খায়রুজ্জামান১১. লে, আব্দুল মজিদ ণ, দেখা যায়, উল্লিখিত ব্যক্তিদেরকে তাদের পদগুলােতে স্থায়ী করা হয় এবংতা বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত হয়। ত, উপযুক্ত ঘটনা ও প্রাগুক্ত হত্যা সম্পর্কে আইন ও বিচারের প্রক্রিয়া।স্বীয়গতিতে চলার পথে কী অন্তরায় রয়েছে, সরেজমিনে তদন্তের উদ্দেশ্যে। কমিশনের একজন সদস্যের ঢাকা সফর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, কমিশনের অন্যতম সদস্য মি. জেফ্রি থমাস, কিউ.. সি, একজন সাহায্যকারীসহ সরেজমিনে তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য ১৯৮১ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকা গমন করবেন। মি. জেফ্রি থমাস ও তার।সহযােগীর ঢাকা গমনের ভিসা লাভের জন্য তদন্ত কমিশনের সচিব।সলিসিটার মি. অ্যাওত্রে রােজ দরখাস্ত পেশ করেন। দ, তদন্ত কমিশনের সদস্যদের সময়মতাে বাংলাদেশ গমনের ভিসা দেয়া হবে।ইঙ্গিত করে (লণ্ডনস্থ) বাংলাদেশ হাই কমিশন বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখে। ধ, ১৯৮১ সালের ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যার ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইটের সুযােগগ্রহণ করতে দেয়ার লক্ষ্যে সকালে জরুরি অনুরােধ জানালে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন পাসপাের্ট ও ভিসা অপরাহ্নে ফেরত দেয়া হবে জানায় কিন্তু সময় মতাে এগুলাে চাওয়া হলে জানানাে হয়, কলার বিভাগবন্ধ। ন, পরে বাংলাদেশ হাই কমিশন জানায়, তারা মি, জেফ্রি থমাসের ঢাকা ভ্রমণেরজন্য ভিসা দিতে অপারগ।
তদন্ত কমিশনের সচিব কর্তৃক বহুবার চিঠি, টেলিফোন ও সরাসরি যােগাযােগ করা এবং সশরীরে উপস্থিত হওয়া সত্ত্বেও লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশন থেকে তাকে ভিসা প্রত্যাখ্যানপত্র বাএ-জাতীয় কোনাে ব্যাখ্যা দেয়া হয় নি। উপরে বিবৃত ঘটনাসমূহ থেকে আমরা যে প্রাথমিক উপসংহারে উপনীত হয়েছি। তা হল :ক, আইন ও বিচারের প্রক্রিয়াকে স্বীয়গতিতে চলতে দেয়া হয়নি। খ, প্রতীয়মান হয় এ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টিতে সরকারই দায়ী।গ. সমস্ত বাধা উপড়ে ফেলে আইন ও বিচারকে স্বীয়গতিতে চলতে দেয়া উচিত। ২০ মার্চ ১৯৮২ ১৪-১৮ হাই হলবর্ন, লন্ডন ডব্লিউসিআই।মামলার এজাহারপ্রতি : ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ধানমণ্ডি থানা ঢাকা। বিষয় : এজাহার। আমি আ.ফ.ম. মহিতুল ইসলাম, পিতা (মৃত) এ.ওয়াই.এম. নূরুল ইসলাম, সাং ইসলাম কুটির, হাসপাতাল রােড, ঝিকরগাছা, থানা ঝিকরগাছা, জেলা যশােহর, বর্তমানে ফ্ল্যাট নং ২৬, বিল্ডিং নং ১, সেকশান ১৪, মিরপুর, ঢাকা এই মর্মে জানাচ্ছি যে, ১৯৭৫ সালে তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি নং-৬৭৭, রােড নং-৩২, ধানমণ্ডি, ঢাকার বাড়ির রিসিপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে রাত্র ৮টা থেকে ১৫ আগস্ট সকাল ৮টা পর্যন্ত আমার ঐ বাড়িতে ডিউটি ছিল। যথারীতি আমি রাত্র ৮টার সময় প্রেসিডেন্টের বাসভবনেডিউটিতে আসি। ঐ সময় ঐ বাড়ির নিচতলায় টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিন, বাড়ির রাখাল আবদুল আজিজ, একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি এবং একজন কাজের বেটি, উপরতলায় কাজের ছেলে মাে. সেলিম ওরফে আবদুল এবং আবদুর রহমান ওরফে রমা ছিল। ঐদিন ঐ বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর ৩ (তিন) ছেলে যথাক্রমে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রােজী জামাল, বেগম মুজিব ছিলেন। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছােটভাই শেখ নাসেরও বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ঐ রাতে ঐ বাড়িতে নিরাপত্তা ডিউটিতে পুলিশের ডিএসপি জনাব নুরুল ইসলাম। খান, ইন্সপেক্টর খােরশেদ, এসবি’র একজন অফিসার এবং পুলিশের আরাে অন্যান্য পদের লােক ছিল।
পুলিশ ছাড়া নিরাপত্তা ডিউটিতে সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য ছিল। রাত্র আনুমানিক ৮-৯ টার সময় বঙ্গবন্ধু বাইরে থেকে বাসায় আসেন। তার সঙ্গের সিকিউরিটি এবং অন্যরা তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে চলে যান। তারা চলে যাবার পর আমি গেটে পাহারারত আর্মি ও পুলিশের সাথে গল্প করছিলাম। রাত ১ টার দিকে আমাদের জন্য নির্ধারিত বিছানায় শুতে গেলাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম তা খেয়াল নেই। হঠাৎ টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিন ধাক্কা দিয়ে আমাকে উঠান এবং বলেন, প্রেসিডেন্ট সাহেব আপনাকে টেলিফোনে ডাকছেন। সম্ভবত তখন সময় হবে ৪-৩০টা বা ৫টা। চারিদিক বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। তখনাে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলছিল। আমি তাড়াতাড়ি এসে টেলিফোন ধরলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোলরুমে টেলিফোন লাগা।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোন লাগাবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লাইন পাচ্ছিলাম না। তারপর গণভবন এক্সচেঞ্জে লাইন লাগানাের চেষ্টা করি। সে-মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু উপর থেকে নিচে নেমে আমার রুমে আসেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, কী হল, পুলিশ কন্ট্রোলরুম লাগাতে বললাম, লাগালি না?’ আমি বললাম, ‘স্যার, পুলিশ কন্ট্রোলরুম ধরছে না। আমি গণভবন এক্সচেঞ্জ ধরেছি। গণভবন থেকে টেলিফোন ধরেছে, কিন্তু কথার কোনাে উত্তর দিচ্ছে না। আমি ‘হ্যলাে হ্যালাে’ বলে চিৎকার করছিলাম তখন বঙ্গবন্ধু আমার হাত থেকে রিসিভার নিয়ে বললেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ ঠিক তখনি একঝাঁক গুলি আমাদের অফিসকক্ষের দক্ষিণদিকের জানালার গ্লাস ভেঙে দেয়ালে এসে লাগে। অন্য টেলিফোনে চিফ সিকিউরিটি অফিসার মহিউদ্দিন টেলিফোন করেন, আমি ধরি ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গ্লাসভাঙা আমার ডানহাতের কনুইর কাছে এসে বিধে কেটে রক্ত ঝরতে থাকে।
এই সময় জানালা দিয়ে অনর্গল গুলি আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধু আমার টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন এবং আমার হাত ধরে টেনে শুতে বলেন। আমি শুয়ে পড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যে গুলি বন্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু উঠে। দাঁড়ালেন এবং আমিও উঠলাম। উপর থেকে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুলবঙ্গবন্ধুর পাঞ্জাবি ও চশমা নিয়ে এল। আমার অফিসকক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি পাঞ্জাবি পরলেন। বারান্দায় এসে তিনি বললেন, “আমি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি চলছে, তােমরা কী করাে?” এই বলে তিনি উপরে উঠে গেলেন। সেই সময় শেখ কামাল নিচে বারান্দায় এসে বললেন, ‘আর্মি-পুলিশ ভাই, সবাই আমার সাথে আসুন।’ বলার সাথে সাথে ৩/৪ জন কাল ও কিছু খাকি-পােশাকধারী লােক অস্ত্রসহ সামনে এসে দাঁড়াল। আমি ও ডিএসপি নূরুল ইসলাম সাহেব কামাল ভাইয়ের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন ডিএসপি নূরুল ইসলাম সাহেব আমাকে পিছন দিকে টান দিয়ে অফিসকক্ষের মধ্যে নিয়ে গেলেন। ওখান থেকে বাইরে কী হচ্ছে দেখতে চেষ্টা করলাম। আবারাে গুলির শব্দ শুনলাম। এই সময় কামাল ভাই গুলি খেয়ে লাফ দিয়ে আমার পায়ের কাছে এসে পড়েন। কামাল ভাই চিকার করে বললেন, আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল, তা ওদেরকে বলেন। আক্রমণকারীদের মধ্যে কালাে-পােশাকধারী ও খাকিপােশাকধারী ছিল। আমি তাদেরকে বললাম : ‘ভাই, উনি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ ওরা সঙ্গে সঙ্গে কামাল ভাইকে লক্ষ্য করে আবার ফায়ার করল। আবার কামাল ভাইয়ের শরীরে গুলি লাগে, একটি গুলি আমার হাঁটুতে লাগে। একই সঙ্গে ডিএসপি নূরুল ইসলাম সাহেবের পায়েও গুলি লাগে। তখন আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম তারা সবাই আর্মির লােক, তারা এই বাড়িতে একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানাের জন্যই এসেছে। ডিএসপি সাহেব আমাকে টেনে উনার কক্ষে নিয়ে যান, ওখানে দেখি এসবি’র একজন অফিসার। রিভলভার তার পায়ের কাছে পড়ে আছে এবং সে খুব ভীত-সন্ত্রস্ত। ডিএসপি সাহেব আমাদের দু’জনকে পিছনের দরজা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বের করে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। তখন আর্মির মেজর বজলুল হুদা আমাদের মাথার চুল টেনে ধরে। তার সাথে আরাে অস্ত্রধারী আর্মির লােক ছিল। বজলুল হুদা আমাদের নিয়ে গেটের নিকট লাইন করে দাঁড় করায়। সেখানে তখন পুলিশের লােক এবং টেলিফোন মিস্ত্রিকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। টেলিফোন মিস্ত্রি আবদুল মতিনের পাশে ডিএসপি সাহেব ও আমাকে দাঁড় করায়। আমার পাশে এসবি’র পুলিশ অফিসার দাঁড়ানাে ছিল। হঠাৎ একজন আর্মি এসে এসবি’র পুলিশ অফিসারকে গুলি করে, সাথে সাথে তিনি গুলি খেয়ে পড়ে যান। কয়েকজন আর্মিকে আমাদের পাহারায় রেখে বাকিরা ফায়ার করতে করতে দোতলায় যায়। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর উচ্চকণ্ঠ শুনতে পেলাম। এরপরই অনেক গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। সাথে সাথে মহিলাদের আহাজারি ও আর্তচিঙ্কার শুনলাম।
এই সময় নিচে রান্নার ঘর ও গােয়ালঘর থেকে বুড়ি ও রাখাল আজিজকে আমাদের লাইনে এনে দাঁড় করায়। উপর থেকে শেখ নাসেরকে। এনে আমাদের লাইনে দাঁড় করায়। তার হাতে গুলির রক্তাক্ত জখম ছিল। শেখ নাসের বললেন, স্যার আমি তাে রাজনীতি করি না, ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।’ তখন পাশে দাঁড়ানাে একজন আর্মি বললেন, ‘শেখ মুজিব ইজ বেটার দেন নাসের।’ যে অস্ত্রধারী আর্মির লােকটি শেখ নাসেরকে নিয়ে এসেছিল সে বলল।‘ঠিক আছে আপনাকে কিছু বলব না, আপনি ঐ রুমে গিয়ে বসুন’ -এই বলে। আমাদের লাইন থেকে তাকে বের করে আমাদের অফিসরুমের সাথে এটাচড। বাথরুমে নিয়ে তাকে গুলি করে। তারপর ঐ অস্ত্রধারী আর্মির লােকটি আমাদের লাইনের কাছে ফিরে আসে। শেখ নাসের ‘পানি পানি’ বলে চিৎকার করেন। তখন একজন আর্মির লােক অন্য একজন আর্মির লােককে বলে যা পানি দিয়ে আয়।’ সে পুনরায় সেখানে যায় এবং পানির পরিবর্তে আবার গুলি করে। ইতােমধ্যে শিশু রাসেল ও রমাকে নিচে নিয়ে আসে। শিশু রাসেল প্রথমে রমাকে ও পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ভাইয়া আমাকে মারবে না তাে? আমার ধারণা ছিল, শিশু রাসেলকে তারা মারবে না। সেই ধারণাতেই আমি বলি, না ভাইয়া তােমাকে মারবে না।’ খাকি-পপাশাকধারী একজন আমার কাছ থেকে রাসেলকে জোর করে নিয়ে গেল। রাসেল তার মায়ের কাছে যেতে চাইলে তাকে মায়ের কাছে নেবার কথা বলে ভিতরে নিয়ে যায়। এরপরই গুলির শব্দ শুনি। এই সময় মেজর বজলুল হুদাকে গেটের নিকট মেজর ফারুক কী যেন জিজ্ঞেস করে। তখন বজলুল হুদা বলেন, ‘অল আর ফিনিশড।’ আমরা যখন গেটের নিকট লাইনে দাঁড়ানাে ছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ট্যাংক যাওয়া-আসা করতে দেখি। ট্যাংকের উপরে কালাে-পােশাকধারী আর্মির লােক দেখি। বেলা অনুমান ৮টার দিকে কর্নেল জামিল সাহেবের ডেডবডি তার গাড়িতে করে আর্মির একজন ড্রাইভার ড্রাইভ করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতরে নিয়ে আসে। এক সময়ে মেজর ডালিমকে খাকি পােশাক পরা অবস্থায় ঘটনাস্থলে দেখেছি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত আর্মিদের সাথে তাকে কথা বলতে দেখি। গত ১৫.০৮.১৯৭৫ তারিখে ভােরে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, শেখ জামালের স্ত্রী।
রােজী জামাল, শেখ নাসের ও এসবি’র একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করা হয়। সাবেক মেজর ফারুক, মেজর বজলুল হুদা, মেজর নূর ও মেজর ডালিমকে এই হত্যাকাণ্ডের সময় এবং পরপরই আমি ঘটনাস্থলে দেখেছি এবং চিনতে পেরেছি। তারা ছাড়াও আমি ঘটনার পর বিজ্ঞি লােকমুখে এবং দেশী-বিদেশী সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও এই সংক্রান্ত লিখিত বইয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে, খন্দকার মােশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মেজর রশিদ, মেজর শাহরিয়ার, মেজর পাশা, মেজর শরফুল হােসেন, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন কিসমত, রিসালদার মােসলেহ উদ্দিনসহ সাঁজোয়া, গােলন্দাজবাহিনীর সদস্য ও সেনাবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের কিছু সদস্য, উচ্চাভিলাষী কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে নিজ নিজ স্বার্থে গত ১৫.০৮.১৯৭৫ তারিখে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, তার পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে।এজাহারে অভিযুক্ত আসামি ছাড়া অন্য যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল, তাদের নাম তদন্তে প্রকাশ পাবে। আমার জীবনের নিরাপত্তা এবং নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থার কারণে এই ঘটনার এজাহার করতে বিলম্ব হল।স্বামহিতুল ইসলাম। ০২.১০,৯৬ (আ.ফ.ম. মহিতুল ইসলাম) পিতা : (মৃত) এ.ওয়াই.এম, নূরুল ইসলাম সাং: ইসলাম কুটির, হাসপাতাল রােড ঝিকরগাছা, থানা : ঝিকরগাছা জেলা : যশােহর।ধানমণ্ডি থানার তৎকালীন ওসি শফিউল্লাহ মামলার ৫৬তম সাক্ষী উক্ত এজাহার রেকর্ড করেন। মামলার নম্বর ১০ (১০) ৯৬।আভিযােগপত্র (চার্জশিট) হত্যাকাণ্ড-সম্পর্কিত এ মামলার তদন্তের দায়িত্ব প্রাথমিক পর্যায়ে ধানমণ্ডি থানার ওসি। গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে সিআইডিকে দেয়া হয়। দীর্ঘ ৩ মাস ১৩ দিনের তদন্ত শেষে সিআইডির এএসপি আবদুল কাহহার আকন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি চার্জশিট দাখিল করেন।
৩৪ পৃষ্ঠার চার্জশিটে ১ থেকে ২৪ পৃষ্ঠা জুড়ে সন্নিবেশিত হয়েছে আসামি ও সাক্ষীদের তালিকা, তাদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা এবং ৪৫টি আলামতের বিবরণ; ২৪ থেকে ৩৪ নম্বর পর্যন্ত মােট ১১ পৃষ্ঠাব্যাপী রয়েছে মামলার অভিযােগ তথা অপরাধের নাম, সংক্ষিপ্ত বিবরণ ও অভিযােগের ধারাসমূহ। চার্জশিটের গুরুত্বপূর্ণ। অংশবিশেষ নিম্নরূপ :বাদীর লিখিত এজাহার পাইয়া (ধানমণ্ডি) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা রুজু করেন এবং কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মােতাবেক আমি মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করি। তদন্তকালে আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শনপূর্বক ঘটনাস্থলের পৃথক-সূচিসহ খসড়া মানচিত্র তৈরি করি, আলামত জব্দ করি এবং সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া তাহাদের জবানবন্দি কার্য বিধির ১৬১ ধারামতে পৃথক পৃথকভাবে লিপিবদ্ধ করি। মামলায় জড়িত আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (অব.), লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (অব.), লে, মহিউদ্দিন (সাবেক সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি), ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বিএনসিসি ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা (অব.), অনারারি ক্যাপ্টেন আ, ওহাব জোয়ারদার, মাে, ইউনুস আলী (আর্টিলারি), মাে. আবু মুসা। মজুমদার (ল্যান্ডার), মিসেস যােবায়দা রশিদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুরগণকে গ্রেফতার করিয়া জিজ্ঞাসাবাদপূর্বক কোর্টে প্রেরণ করিলে তাহাদের মধ্যে আসামি লে. কর্নেল।সৈয়দ ফারুক রহমান (অব.), লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (অব.), লে, মহিউদ্দিন (সাবেক সেকেন্ড ফিল্ড আর্টিলারি), অনারারি ক্যাপ্টেন আ, ওহাব জোয়ারদার (অব.), শেখ মাে. ইউনুস আলী, মাে, আবু মুসা মজুমদার, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মিসেস যােবায়দা রশিদগণ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রতীয়মান হয় যে, বিক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত সেনাসদস্য আসামি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খন্দকার আ. রশিদ, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন মােস্তফা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর আজিজ পাশা, মেজর আহমদ শরিফুল হােসেন, লে. নাজমুল হােসেন আনসার, লে. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন মাজেদ, অনারারি ক্যাপ্টেন আ, ওহাব জোয়ারদার, রিসালদার মােসলেমউদ্দিন, রিসালদার সারােয়ার, দফাদার মারফত আলী শাহ, এলডি আবুল হাসেম মৃধা, মেজর সুলতান শাহরিয়ার (অব.), চাকরিচ্যুত সেনাসদস্য মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এএইচএমবি নূর চৌধুরী, মেজর রাশেদ চৌধুরি এবং উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আসামি খন্দকার মােশতাক আহমেদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী, মিসেস যােবায়দা রশিদ-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাহার পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজন সকলকে হত্যা করার চক্রান্তে লিপ্ত হন। এই চক্রান্তে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে উল্লিখিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও উল্লিখিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে এই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইয়া মদদ যােগায় ও সহযােগিতা করেন। তদন্তে আরাে প্রমাণিত হয় যে, ঘটনার দিন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ অত্র অভিযােগপত্রে ২ ও ৩ নং কলামে বর্ণিত আসামি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খন্দকার আ. রশিদ, মেজর মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), মেজর মহিউদ্দিন (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন মােস্তফা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর আজিজ পাশা, মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন, লে, নাজমুল হােসেন, লে. কিসমত হাসেম, রিসালদার মােসলেমউদ্দিন, রিসালদার সারােয়ার, দফাদার মারফত আলী শাহ, এলডি আবুল হাসেম মৃধা, চাকরিচ্যুত মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর এইচ এমবি নূর চৌধুরী, মেজর রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার (অব.) -ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপার্শ্বে বালুরঘাট এলাকায় এবং সংলগ্ন ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটে নাইট ট্রেনিঙের অজুহাতে বেআইনিভাবে গােলাগুলি সগ্রহপূর্বক সমবেত ল্যান্সার ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান এবং টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খন্দকার আ. রশিদ তাহাদের অধীনস্থ কতিপয় সদস্যদেরকে ব্রিফিং দেন এবং ব্রিফিংকালে অধীনস্থ সেনা-সদস্যদেরকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা বক্তব্য দিয়া প্ররােচিত ও উত্তেজিত করেন এবং পূর্বপরিকল্পিত নীল নকশা মােতাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাহার পরিবারের সদস্যবর্গ, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্যদের হত্যা করার জন্য তাহাদের সহযােগীরা কে কোথায় যাইবে এই বিষয়ে তাহারা নির্দেশ প্রদান করেন। সেই মােতাবেক আসামিগণ তিন দলে বিভক্ত হইয়া একটি দল ভাের সাড়ে ৪টা।হইতে ৫টার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সশস্ত্র আক্রমণ চালাইয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁহার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা এবং তাঁহার ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শেখ রাসেল, কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল, জামালের স্ত্রী রােজী জামাল ও বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ অফিসার এএসআই সিদ্দিকুর রহমানকে গুলি করিয়া নৃশংসভাবে হত্যা করেন এবং হত্যার উদ্দেশ্যে বাদী মহিতুল ইসলাম, ডিএসপি নুরুল ইসলাম ও বাড়ির চাকর সেলিমকে গুলি করিয়া মারাত্মক জখম করেন।
ইহা ছাড়াও ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর সাবেক এএসপি কর্নেল জামিল ও তাহার বাড়িতে পাহারাত সেনাসদস্য সৈয়দ সামছুল হককেও গুলি করিয়া হত্যা করে। তদন্তে ও সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রাথমিকভাবে আরাে প্রমাণিত হয় যে, ঘটনাস্থল ও উহার আশপাশে উপস্থিত কতিপয় সাক্ষী এই হত্যাকাণ্ডের সময় হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীদের শনাক্ত করিয়াছেন এবং হত্যাকাণ্ড ঘটাইতে দেখিয়াছেন। এই হত্যাকাণ্ড ঘটানাের পর হত্যাকারীরা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ড ঘটাইবার কথা স্বীকার করিয়া বাংলাদেশ বেতারে ঘােষণা দেন এবং পরস্পর যােগসাজশে অবৈধভাবে খন্দকার মােশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আসামিদের কৃত অপরাধ হইতে নিজেদের বাঁচাইবার জন্য বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্যদের লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত না করাইয়া হত্যার আলামত বিনষ্ট করেন। তাছাড়া ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে আসামিরা বাড়ির মালামাল তছনছ করেন এবং মূল্যবান মালামাল চুরি করিয়া লইয়া যান। পরবর্তীতে তৎকালীন সামরিক সরকার অধিকাংশ হত্যাকারী আসামিকে বিদেশে চাকরি দিয়া পুরস্কৃত করেন। তদন্তে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে অত্র অভিযােগপত্রে ২ ও ৩ নং কলামে অভিযুক্ত আসামিগণ পরস্পর যােগসাজশে একই উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং উদ্দেশ্য সাধনকল্পে আসামিগণ কলাম নং ২ এর ১ হইতে এবং ৩ নং কলামে ১, ২, ৪ ও ৫ নং আসামিগণ বেআইনিভাবে গোলাগুলি সংগ্রহপূর্বক সশস্ত্র অবস্থায় বেআইনি সমাবেশে সমবেত হইয়া পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁহার পরিবারের সদস্যবর্গ, অত্মীয়স্বজন ও অন্যান্যদের হত্যা করিয়া এবং আরাে কতিপয় ব্যক্তিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করিয়া মারাত্মক জখম ও মূল্যবান মালামাল চুরি করিয়া ও নিজেদের কৃত অপরাধ হইতে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশ দণ্ড বিধির ৩০২/১২০/(বি) ৩২৪/৩০৭/২০১/৩৮০/১৪৯/৩৪/১০৯ ধারা মােতাবেক অপরাধ করিয়াছে বলিয়া প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় আদালতে বিচারার্থে আমি তাহাদের বিরুদ্ধে উপরোক্ত ধারায় অত্র অভিযােগপত্র দাখিল করিলাম। কলাম নং ২-এর ক্রমিক নং ১৫ হইতে ১৮ পর্যন্ত আসামিদের বিরুদ্ধে বর্ণিত ধারায় অভিযােগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু তাহারা মৃত বিধায় তাহাদেরকে বিচারের জন্য সােপর্দ করা গেল না। একই কলামের ৬, ৭ এবং ৮ ক্রমিকের আসামিদের বিরুদ্ধে ঘটনা প্রমাণের যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায় বিচারে সােপর্দ করা গেল না। বিধায় তাদের মামলার দায় হইতে অব্যাহতি দানের সুপারিশ করা হইল।

মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এর চার্জশিট দাখিল করা হয়। ইতােপূর্বে গ্রেফতারকৃত আসামিদের ২০ জানুয়ারি ও ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ আদালতে হাজির করা হয়। ১ মার্চ এ হত্যা মামলা সিএমএম আদালত থেকে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের আদালতে প্রেরণ করা হয় এবং ৩ মার্চ নাজিমউদ্দিন রােডে কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে একটি বিশেষ আদালত স্থাপন করা হয়। ১২ মার্চ ১৯৯৭ গ্রেফতারকৃত ৬ জন আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচারকাজ শুরু হয়। ৬ জুলাই ১৯৯৭ শুরু হয় মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা পর্ব। মােট ৭২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৬১ জনকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ১৩ অক্টোবর ১৯৯৮ শুনানি সমাপ্ত হয়। জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট এবং বিএনপি আহুত হরতাল, বিচারকের বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন, আদালতের স্থান নির্ধারণে আপত্তি, যােবায়দা রশিদকে অভিযুক্ত করার বিরুদ্ধে দায়েকৃত রিভিশন মামলা প্রভৃতি হাইকোর্ট থেকে নিষ্পত্তি হওয়া, বিচারকের অসুস্থতা ও অন্যান্য কারণে বেশকয়েকবার বিচারকার্য স্থগিত হয়ে যায় এবং ৪৬১ দিনের মধ্যে ১৪৯ কার্যদিন বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হয়। ৮ নভেম্বর ১৯৯৮ মামলার রায় ঘােষিত হয়। ১৭১ পৃষ্ঠাব্যাপী রায়ে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ও ১২০ ক ধারার অভিযােগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ১৯ জন আসামির মধ্যে ১৫ জনকে প্রকাশ্যে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড ও ৪ জনকে ‘সন্দেহের সুবিধায়’ অভিযােগের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।মামলার রায়ের চুম্বক-অংশ বিচারকার্যের ইতিহাসে এই জাতীয় হত্যার মামলা বিরল হইলেও নজিরবিহীন নহে। এই হত্যাকাণ্ডটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সত্ত্বেও বিচারকার্যের ক্ষেত্রে আদালতের কাছে অন্যান্য হত্যা মামলার ন্যায় ইহাও কেবল একটি হত্যার মামলা, 4194. We have to dispense justice in accordance with law and not according to our moral conviction with regard to the occurrence. The strict requirement of law is that the onus lies on the prosecution to prove its case beyond reasonable doubt. When human life pends in the scales, caution becomes the primary duty of any tribunal called upon to assess the evidence of the case, having regard to this statutory rule of caution. বিচারকার্যের এই অবিস্মরণীয় নীতি অনুসরণ করিয়াই উভয়পক্ষের উপস্থাপিত মৌখিক, দালিলিক, তথ্যগত, অবস্থাগত সাক্ষ্য ও আলামতের ভিত্তিতে এই মামলায়ও সুবিচার নিশ্চিত করার সাধ্যমতাে প্রয়াস নেওয়া হইয়াছে। এই মামলার ঘটনাবলি হইতে দেখা যায়-১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্টের কয়েক মাস পূর্ব হইতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও চাকরিচ্যুত বিক্ষুব্ধ কিছু লােক রাজনৈতিক”মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি আবদুল কাহ্হার আকন্দের মতে, তদন্তকালে প্রায় সাড়ে ৪ শশা।ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং এদের মধ্য থেকেই সাক্ষী বাছাই করা হয়েছে।
উচ্চাভিলাষী কিছু ব্যক্তির সহযােগী হইয়া যৌথ ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও তাহার সরকারকে উৎখাত করার চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। অতঃপর শলাপরামর্শ ও পরিকল্পনামতে সেনাবাহিনীর ঐ সমস্ত লােক ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত্রে নাইট ট্রেনিং/প্যারেডের অজুহাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বালুরঘাটে একত্রিত হইয়া সৈনিকদেরকে বঙ্গবন্ধু ও তাহার সরকারের বিরুদ্ধে ব্রিফিং করিয়া ট্যাংক, কামান, অস্ত্র ও গােলাগুলি লইয়া বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের আশপাশে ও শহরের বিভিন্ন জায়গায়/পয়েন্টে সৈন্য মােতায়েন করত ৩ দলে বিভক্ত হইয়া এক দল অনুমান ডাের ৫টার সময় ধানমন্ডির ৩২নং রােডস্থ বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭নং বাসভবনে সশস্ত্র আক্রমণ চালাইয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাহার স্ত্রী ফজিলাতুন নেছা, ৩ ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, ২ পুত্রবধু সুলতানা কামাল, রােজী জামাল, ভাই শেখ নাসের, স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সাব-ইনস্পেক্টর ছিদ্দিকুর রহমান, পেট্রোল ডিউটির সৈনিক সামছুল হক এবং রাষ্ট্রপতির মিলিটারি সেক্রেটারি। কর্নেল জামিলসহ মােট ১১ জনকে গুলি করিয়া হত্যা করে। পরে মৃতদেহগুলাের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন না করিয়া কবরস্থ করে। প্রসিকিউশন দেশের সুষ্ঠু ও সামাজিক শান্তি নিশ্চিত করার এবং আইন ও বিচারব্যবস্থাকে বাঁচাইয়া রাখার স্বার্থে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের সহিত জড়িত দোষী ব্যক্তিদের আইনত বিচার ও উপযুক্ত শাস্তি দাবি করে। পক্ষান্তরে আসামিদের পক্ষ হইতে দাবি করা হয় যে, এই মামলার হত্যাকাণ্ডের সহিত তাহারা কেহই জড়িত ছিল না। কোনাে তৃতীয় পক্ষ এই হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়া। থাকিবে। আরাে বলা হয় যে, সামরিক আইনের ছত্রছায়ায় এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হইয়াছে এবং উক্ত কারণে সাংবিধানিকভাবে এই মামলার বিচার চলিতে পারে না। প্রায় ২১ বৎসর পর রুজুকৃত এজাহারের ভিত্তিতে পুলিশ এই মামলার ঘটনাটি তদন্তপূর্বক ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারা মােতাবেক বর্তমানে মৃত খন্দকার মােস্তাক আহমেদ, মাহবুব আলম চাষী, ক্যাপ্টেন মােস্তফা ও রিসালদার সৈয়দ সারােয়ার হােসেনসহ উপস্থিত (১) লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, (২) লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, (৩) লে. কর্নেল মহিউদ্দিন (আর্টিলারি), (৪) অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার, (৫) তাহেরউদ্দিন ঠাকুর (প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী) (৬) জোবায়দা রশিদ এবং (৭) পলাতক লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ, (৮) পলাতক মেজর বজলুল হুদা, (৯) পলাতক লে. কর্নেল এ, এইচ, এম, বি. নূর চৌধুরী, (১০) পলাতক লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, (১১) পলাতক লে. কর্নেল মাে. আজিজ পাশা, (১২) পলাতক লে. কর্নেল এমএ রাশেদ চৌধুরী, (১৩) পলাতক মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) (১৪) পলাতক রিসালদার মােসলেহ উদ্দিন ওরফে মােসলেমউদ্দিন, (১৫) পলাতক মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন, (১৬) পলাতক ক্যাপ্টেন মাে, কিসমত হাশেম, (১৭) পলাতক ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন, (১৮) পলাতক ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, (১৯) পলাতক দফাদার মারফত আলী শাহ ও (২০) পলাতক এলডি আবুল হাশেম মৃধার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০বি/৩০২/৩৪/১৪৯/৩২৪/৩০৭/
৩৮০/২০১ ধারার অপরাধের অভিযােগপত্র/ চার্জশিট দাখিল করত জীবিতদের বিচারের জন্য সােপর্দ করে। আদালত প্রসিকিউশনসহ সকল আসামিপক্ষের বিস্তারিত বক্তব্য শ্রবণ ও মামলার নথিভুক্ত কাগজপত্র/তথ্যাবলি পর্যলােচনাপূর্বক গত ৭/৪/৯৭ তারিখে ফৌজদারি কার্য বিধির ২৬৫ (ঘ) ধারা মােতাবেক জীবিত ২০জন আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০ বি/৩০২/৩৪/২০১ ধারার অপরাধের ৩ দফা বিশিষ্ট অভিযােগ/চার্জ গঠন করিয়া, পড়িয়া শুনাইয়া আসামিদের মতামত চাহিলে তাহারা সকলেই নির্দোষ বলিয়া বিচার চায়। উল্লেখ্য যে, রাষ্ট্রের খরচায় নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীগণ পলাতক আসামিদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন। আসামি জোবায়েদা রশিদ রিভিশন মামলায় মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের আদেশে অভিযােগের দায় হইতে অব্যাহিত লাভ করে। অতঃপর এই মামলার অবশিষ্ট ১৯ জন আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের প্রদত্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণের পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা মােতাবেক তাহাদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পৃথক পৃথক ভাবে ব্যাখ্যা করিয়া অভিযােগ/অপরাধ সম্পর্কে পুনরায় মতামত চাহিলে এইবারও উপস্থিত আসামি (১) লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (২) লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান (৩) লে. কর্নেল মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) (৪) অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার ও (৫) তাহের উদ্দিন ঠাকুর (প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী) প্রত্যেকে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে। কিন্তু কোনাে সাফাই সাক্ষী দেয় না।…
বিচার্য বিষয় ১, ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট অনুমান ভাের ৫টার সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাহার পরিবারবর্গ ও অন্যান্যদেরকে ধানমণ্ডির ৩২নং রােডস্থ নিজ ৬৭৭ নং বাসভবনে গুলি করিয়া হত্যা করা হয় কিনা? সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও চাকরিচ্যুত বিক্ষুব্ধ কিছু লােক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী কিছু ব্যক্তির সহিত চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করিয়া যৌথ ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পনা মতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় কিনা এবং আসামিগণ এই ষড়যন্ত্রে ও হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল কিনা? সামরিক আইনের ছত্রছায়ায় এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হইয়াছে কিনা বা উক্ত। কারণে এই মামলাটি চলিতে আইনগত কোনাে বাধা আছে কিনা? আসামীগণ এই হত্যাকাণ্ডের অপরাধ হইতে বাঁচিবার জন্য মৃতুদেহগুলির আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন না করিয়া হত্যার সাক্ষ্য/আলামত বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করিয়া মৃতদেহগুলি
কবরস্থ/মাটি চাপা দেয়া কিনা? ৫. কোনাে তৃতীয় পক্ষ এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় কিনা?
৬. আ ফ ম মহিতুল ইসলাম কর্তৃক এই মামলায় রুজুকৃত এজাহারটি হেতুহীন
বিলম্ব দোষে দুষ্ট কিনা বা এজাহারটি বিচারকার্যে আঘাত হানিয়াছে কিনা? ৭. সেনা আইনে এই মামলার বিচার অত্র আদালতের এখতিয়ার বহির্ভূত কিনা? ৮, এই মামলার হত্যাকাণ্ডে কোনাে মােটিভ ছিল কিনা?
সাক্ষ্য, আলােচনা ও সিদ্ধান্ত ১নং বিচার্য বিষয়। ‘ঢাকার ধানমণ্ডি একটি পুরাতন অভিজাত আবাসিক এলাকা। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ধানমণ্ডির ৩২নং রােডস্থ নিজ ৬৭৭ নং বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করিতেন। ৩ তলায় ২ রুমবিশিষ্ট বাড়িটিকে আড়াই তলা বলা যায়। দক্ষিণদিকে বাড়ির প্রধান গেইট। বাড়িটির পূর্বে-পশ্চিমে ও উত্তরে ভিন্ন ভিন্ন লােকের আবাসিক বাড়ি। দক্ষিণে রাস্তা। এই রাস্তা অনুমান ২০০/২৫০ গজ পূর্বদিকে গিয়া উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত মিরপুর রােডে এবং পশ্চিমে আবাসিক এলাকার অন্য রাস্তার সহিত মিলিয়াছে। রাস্তার ১৫/২০ফুট দক্ষিণে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গার্ড-শেড। গার্ড-শেডের দক্ষিণে ধানমণ্ডি লেক যাহা পূর্বে মিরপুর রােড পর্যন্ত বিস্তৃত। লেকের পূর্বদক্ষিণকোণায় খেলার মাঠ/নার্সারি যাহা মিরপুর রােডের লাগ পশ্চিমে অবস্থিত। বঙ্গবন্ধু এবং তাহার পরিবারবর্গ বাড়ির দোতলায় ও ৩ তলার অংশে থাকিতেন। নিচতলা পিএ কাম রিসেপশন রুমসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হইত। এই বাড়িতেই বঙ্গবন্ধু ও তাহার পরিবারবর্গ এবং অন্যান্যদের হত্যা করা হইয়াছে বলিয়া প্রসিকিউশন দাবি করে। ৬১ নং সাক্ষী তদন্তকারী অফিসার ঘটনাস্থলের মানচিত্র একজিবিট-১৩ ও সূচিপত্র একজিবিট-১৪ প্রমাণ করেন। | মামলাটি তদন্তকালে তদন্তকারী অফিসার আবদুল কাহার আকন্দ ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন শ্রেণীর মােট ৪৫০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া অভিযােগপত্রে চার্জশিটে ৭২ জন সাক্ষী মানিয়াছে। প্রসিকিউশন ৬১জনকে আদালতে হাজির করান। প্রসিকিউশনের ১নং সাক্ষী এজাহারকারী আ. ফ. ম. মুহিতুল ইসলাম ২/১০/৯৬ তারিখে তাহার রুজুকৃত এজাহার একজিবিট-১ এবং ইহাতে তাহার স্বাক্ষর একজিবিট-১/১ প্রমাণ করিয়া এজাহারের সহিত সঙ্গতিপূর্ণ সাক্ষ্য প্রদান করেন। ৫৬ নং সাক্ষী পুলিশ ইন্সপেক্টর শফিউল্লাহ ২-১০-৯৮ তারিখে ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে ঐদিন মুহিতুল ইসলামের লিখিত এজাহারের ভিত্তিতে এজাহার ফরম পূরণ করিয়া ধানমণ্ডি থানার ১০ (১০) ৯৬ নম্বর মামলা রুজু করেন। তিনি ঐ এজাহার ফরম একজিবিট-৮ এবং ইহাতে তাহার স্বাক্ষর একজিবিট-৮/১ প্রমাণ করেন।… | ৯ নং সাক্ষী লে. কর্নেল হামিদ ও ১০ নং সাক্ষী মেজর জেনারেল আবদুর রবসর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের-বঙ্গভবনের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ বাদে তাহার পরিবারবর্গের মৃতদেহ নিজ বাড়ি হইতে এবং সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির মৃতদেহসহ তাহাদের নিজ
নিজ বাড়িতে নিহতদের মৃতদেহ মর্গ হইতে সংগ্রহ করিয়া মােট ১৮টি মৃতদেহ ১৬ আগস্ট ভােরবেলা বনানী গােরস্থানে দাফন করে এবং ১৭ আগস্ট সকাল ৯/১০ টার সময় বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ নিজ বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করার জন্য হেলিকপ্টারযােগে। পাঠানাে হয়।
| ২৮, ৩০ ও ৫৪ নং সাক্ষীগণের ভাষ্যমতে স্থানীয় কর্মকর্তা/লােকজন ১৭ তারিখে বেলা ২.০০ টার সময় বঙ্গবন্ধুর মৃতদেহ হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়া পৌছাইলে তাহার পিতামাতার কবরের পাশে তাহাকে দাফন করা হয়। দাফনের আগে গােছল ও কাফন পরানাের সময় বঙ্গবন্ধুর হাতে, পেটে, বুকেসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তাক্ত গুলির। চিহ্ন দেখে।
| ‘তাছাড়া ঘটনার পর ৭,৮,৯,১০,২১,২২, ও ২৪ নং সাক্ষীগণ কেহ ডিউটিতে থাকা অবস্থায়, কেহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃক্ষের নির্দেশে ১৫ আগস্টে ঘটনার বাড়িতে গিয়া বঙ্গবন্ধু ও তাহার পরিবারবর্গের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত মৃতদেহগুলি পড়িয়া থাকিতে দেখেন। | ‘৫৩ নং সাক্ষী সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমান বর্তমানে বঙ্গবন্ধু যাদুঘরের কিউরেটর। হিসাবে কর্মরত আছেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের আলামত হিসাবে রক্তমাখা ও গুলির ছিদ্রযুক্ত জামাকাপড়, ভােয়ালে, টুপি-জামা, বইপুস্তক, বুলেট, পিলেট, গুলির খােসা, ভাঙা কাচের টুকরা, ভাঙা গ্লাসের টুকরা, ভাঙা কাচের চুড়ি, বাঁধানাে ছবি ইত্যাদি আলামত শনাক্ত করেন-যাহা মেটারিয়াল একজিবিট I-XXXII হিসাবে চিহ্নিত হয়। তিনি এই সমস্ত মেটারিয়াল জব্দ করা সংক্রান্ত জব্দতালিকা একজিবিট-৬, ইহাতে তাহার এবং সাক্ষীদের স্বাক্ষর যথাক্রমে একজিবিট-৬/১,৬/২,৬/৩ প্রমাণ করেন। | ‘প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নিজ বাসভবনে গুলি করিয়া হত্যা করার ঘটনাটি তখন দেশী-বিদেশী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ এবং রেডিও-টেলিভিশনে। প্রচার করা হয়-যাহা দেশ-বিদেশে কোটি কোটি মানুষ এই ঘটনার খবর পত্রিকায় পড়ে এবং রেডিও-টেলিভিশনে শােনে। পরবর্তীতে সকল সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই হত্যার ঘটনা স্বীকার করা হয়। আসামিপক্ষ এই হত্যার ঘটনাটি অস্বীকার করে না। সুতরাং বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য মৃতদেহগুলির সুরতহাল/ময়নাতদন্ত না হইলেও কিংবা আসামি মেজর ফারুকের পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমানের মতে হত্যাকারীরা গাড়িতে আসিয়া, পায়ে হাঁটিয়া, গুলি করিয়া হিপ-পাওয়া পজিশনে বা অন্য কোনােভাবে আসিয়া হত্যাকাণ্ডটি ঘটানাের প্রমাণ অস্পষ্ট দাবি করিলেও তাহা এই ক্ষেত্রে অবান্তর এবং উহা বিবেচনায় না আনিয়া নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট অনুমান ভোের ৫.০০ টার সময় বঙ্গবন্ধু, তাহার পরিবার ও অন্যদেরকে ধানমণ্ডির ৩২নং রােডস্থ নিজ বাসভবনে গুলি করিয়া হত্যা করা হয়। উক্ত মর্মে এই বিচার্য বিষয়টি নিষ্পত্তি হইল।
২ নং বিচার্য বিষয় উল্লেখিত ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৭, ১৮, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ২৯, ৩২, ৩৪, ৩৫, ৩৯, ৪০ এবং ৪১ নং সাক্ষীগণের বক্তব্য হইতে দেখা যায়- ১৯৭৫
সনের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত্রে ঢাকায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর ২টি রেজিমেন্ট যথা-১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ও ২য় ফিল্ড আর্টিলারির নাইট ট্রেনিং/প্যারেড ছিল। যদিও একাধিক রেজিমেন্ট একত্রে ট্রেনিং/প্যারেড বা লাইভ এমিউনিশন লইয়া ট্রেনিং প্যারেড করার নিয়ম ছিল না তবুও ঐদিন ইহার ব্যতিক্রম ঘটে। | ‘তখন ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মােমিনের ছুটিজনিত কারণে টু আইসি মেজর ফারুক ঐ রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ঐ রেজিমেন্টে এ,বি,সি ও হেডকোয়ার্টার নামে ৪টি স্কোয়াড্রনে যথাক্রমে মেজর শরিফুল হােসেন, মেজর আবু বকর, লে. কিসমত (ভারপ্রাপ্ত) ও মেজর এ. কে. এম. মুহিউদ্দিন স্কোয়াড্রন কমান্ডার ছিলেন।
| ‘অপরদিকে মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ ২-ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার। ছিলেন। এই রেজিমেন্টেও পাপা, কিউবেক, রােমিও ও হেডকোয়ার্টার নামে ৪টা ব্যাটারিতে যথাক্রমে মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন জোবায়ের সিদ্দিকী, লে, লেনিন কামাল (ভারপ্রাপ্ত) ও ক্যাপ্টেন মােস্তফা ব্যাটারি ছিলেন। ঐ ২ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ ও মেজর ফারুক পরস্পর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অর্থাৎ ভায়রা ছিলেন। ২/১ জন বাদে আসামিগণ ও সাক্ষীগণ ঐ দুই রেজিমেন্টেরই সদস্য
ছিল।
তাহাদের সাক্ষ্য হইতে দেখা যায় – বঙ্গবন্ধু ও তাহার সরকারকে উৎখাত করার জন্য মেজর রশিদ, মেজর ফারুক ও মেজর ডালিম ট্রেনিং/প্যারেডে সৈনিকদেরকে। ব্রিফিঙ করিয়া ট্যাংক, কামান, অস্ত্র ও গােলাবারুদ লইয়া সৈনিকদেরকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করত বিভিন্ন জায়গায়/পয়েন্টে ডিউটিতে মােতায়েন করিয়া এই ঘটনা করে। | এই মামলার চাক্ষুষ সাক্ষীসহ উপস্থাপিত সকল সাক্ষ্য ও তথ্যাবলি পর্যালােচনায়। ইহা প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সংঘটিত হত্যার ঘটনায় আসামি মেজর হুদা, মেজর নূর চৌধুরী, মেজর একেএম মুহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা, মেজর ফারুক, মেজর ডালিমসহ অন্যান্যরা প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। প্ল্যান অনুযায়ী দলে দলে বিভক্ত হইয়া প্রায় একই সময় আসামিগণ অন্যান্য জায়গায়ও হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়া রেডিও সেন্টারে ও পরে বঙ্গভবনে ঘটনার সমর্থনে বিভিন্ন কার্যক্রমে। অংশগ্রহণ করে।
| ‘আসামিগণ দলে দলে বিভক্ত হইয়া যেখানে ঘটনায় অংশগ্রহণ করে সেখানের সাক্ষী তাহাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিয়া আদালতে তাহাকে শনাক্ত করে। সাক্ষীদেরকে আসামিপক্ষ বিস্তারিত জেরা করে, কিন্তু প্রধান বিষয়ে অর্থাৎ হত্যার ঘটনায় এবং হত্যাকারীদের শনাক্তকরণ সম্পর্কে তাহাদের বক্তব্যে অমিল দেখা যায়।
। তাহাদেরকে অবিশ্বাস করাও যায় না। হত্যার আগে বঙ্গবন্ধুর সহিত হত্যাকারীদের। কথােপকথনের ধরন হইতে প্রতীয়মান হয় যে, তাহারা বঙ্গবন্ধুর প্রতি বল প্রয়ােগ। করিতে চাহিয়াছিল, যাহা ছিল তাহার ধারণার বাইরে এবং গুলি খাওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করিতে পারেন নাই যে, তাহারই লােকেরা তাহাকে এমনভাবে গুলি করিয়া হত্যা করিবে।
‘উল্লেখ্য যে, সাক্ষীগণের বক্তব্য ও অন্যান্য তথ্যাবলি হইতে দেখা যায়-এই হত্যাকাণ্ড ঘটানাের পূর্বে সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও চাকরিচ্যুত বিক্ষুব্ধ কতিপয় সদস্য কিছু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহিত বিশেষ করিয়া খন্দকার মােস্তাক আহমেদ এর সহিত চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র ফলপ্রসূ করার জন্য খন্দকার মােস্তাকের আত্মীয় মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এই কাজে তাহার সহিত মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার, মেজর আজিজ পাশা, মেজর হুদাসহ অন্যান্যরা কুমিল্লা বার্ডে, তাহার গ্রামের বাড়ি, দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে, গাজীপুরের শালনা হাইস্কুলে, ঢাকার বাসায়/অফিসে ইত্যাদিতে মিটিং করিয়া সকল আসামি একই অভিপ্রায়ে সম্মত হইয়া পরিকল্পনা গ্রহণ করে। উক্ত পরিকল্পনা ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট অনুমান ভাের ৫টায় এই ঘটনা দ্বারা কার্যকর করে। ঘটনার পর তাহাদের আচরণ/কার্যকলাপ দ্বারাও তাহাদের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা প্রমাণিত হয়।
‘নিম্নের তথ্যগুলিও তাহাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক হত্যার অভিযােগ সমর্থন করে।
১. আসামিগণের অনেকে ঘটনার পর হইতে বেশ কিছুদিন সপরিবারে বঙ্গভবনে থাকে। ইহা তাহাদের ঘটনার সহিত জড়িত থাকার পক্ষে বেশ জোরাল সমর্থন প্রদান করে। | ২. স্বীকৃত মতে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনে আসামিগণের চাকরি প্রদান ও ঘটনার সহিত তাহাদের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে।
৩. তেমনি চাকরিচ্যুত কতিপয় সেনাকর্মকর্তার ঘটনার সময় হইতে কর্তৃপক্ষের বিনা আদেশে চাকরিতে পুনরায় যােগদান মামলার ঘটনায় তাহাদের বিজড়ন সমর্থন করে। | ৪, আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর কর্তৃক প্রদত্ত কার্য বিধির ১৬৪ ধারামতে জবাববন্দি যাহাতে ঘটনার মূল বিষয়ে অর্থাৎ ষড়যন্ত্রমূলক হত্যার সহিত মৌখিক সাক্ষীদের সাক্ষ্যের ও প্রদত্ত তথ্যাবলির মিল থাকা (ঘটনায় তাহাদের জড়িত থাকা সমর্থন করে)। | ৫. সানডে টাইমস্ পত্রিকার ৩০/৫/৭৬ তারিখের বিষয়বস্তু ও আসামি মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুকের একই বিষয়ে সাক্ষাৎকার সংক্রান্ত ভিডিও ক্যাসেট একজিবিট XXXII এবং XXXIII যাহা তাহাদেরকে আত্মস্বীকৃত হত্যাকারি বলিয়া চিহ্নিত করে। | ৬. পরিশেষে এই মামলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন স্বীকারােক্তি ও সাক্ষ্যপ্রমাণে ইহা প্রতিষ্ঠিত। হয় যে, কতিপয় সেনা-কর্মকর্তা ও গুটিকয়েক রাজনীতিবিদ ব্যক্তিগত আক্রোশে ও ক্ষোভ এবং ক্ষমতালিপ্সার মােহে ঘটনার কিছুদিন পূর্ব হইতেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা স্বভাবতই নিজেদেরকে এই ব্যাপারে আইনের আওতামুক্ত রাখার চেষ্টা করে প্রথমে সামরিক আইন ঘােষণার মাধ্যমে এবং
পরে যখন বুঝিতে পারে যে উক্ত ঘােষণায় সেই উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে সাধিত হয় নাই। তখন Indemnity Ordinance -এর মাধ্যমে তাহা করায় সচেষ্ট হয়। এই অধ্যাদেশের
187 no proceeding shall lie against any person in respect of act matter or thing done or step taken by such person in connection with, or in perparation or execution of any plan for, or as necessay step towards, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial law on the morning of the 15h August, 1975. RICO
স্পষ্ট যে Plan বা conspiracy তথা ষড়যন্ত্রের দায় হইতে নিজেদের মুক্ত রাখার জন্যই উক্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের উচ্চতম আদালত হইতে উক্ত অধ্যাদেশকে অসাংবিধানিক ও বাতিল ঘােষণায় ষড়যন্ত্রকারীদের শাস্তিমুক্ত থাকার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
‘প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ইহা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সংঘটিত হত্যার মামলা। একটি বিষয় উল্লেখ থাকা প্রয়ােজন যে, এই মামলার হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইবার সময় যাহারা উক্ত বাড়িতে বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না তাহাদের বিরুদ্ধে দণ্ড বিধির ৩৪ ধারা প্রযােজ্য হইবে কি না?
‘এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায়, একই অভিপ্রায়ে আসামিগণ এই হত্যাকাণ্ড ঘটানাের উদ্দেশ্যে সম্মত হইয়া পরিকল্পনামতে উহা কার্যকর করিয়াছে। একই অভিপ্রায়ে প্ল্যান অনুযায়ী সকল আসামির অভিপ্রায় চরিতার্থ হওয়াতে সকলের ক্ষেত্রে দণ্ড বিধির ৩৪ ধারা প্রয়ােগে আইনগত বাধা নাই। ঘরে অপরাধ ঘটিল, সে বাহিরে ছিল, সাধারণ অভিপ্রায় প্রমাণিত হইলে তাহার বিরুদ্ধে ৩৪ ধারা প্রযােজ্য।
‘উপরােক্ত সকল মৌখিক, দালিলিক তথ্যাবলি ও পারিপার্শ্বিকতায় ইহা। স্পষ্টভাবে/সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে (১) আসামি লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, (২) লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, (৩) লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), (৪) পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুর রশিদ (৫) পলাতক মেজর বজলুল হুদা (৬) পলাতক লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, (৭) মেজর শরিফুল হােসেন ওরফে শরফুল হােসেন, (৮) লে. কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী, (৯) লে, কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), (১০) লে. কর্নেল এএইচএমবি নূর চৌধুরী, (১১) লে. কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা, (১২) ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, (১৩)। ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার, (১৪) ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, (১৫) রিসালদার। মােসেলেমউদ্দিন ওরফে মােসলেহউদ্দিন-এর বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২/৩৪ ধারার অভিযােগ প্রমাণিত হয়। ঘটনার পর সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত কর্মকর্তাগণ চাকরিতে পুনরায় যােগদান করেন এবং মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করায়। অন্যান্য আসামিদেরকে বৈদেশিক কূটনৈতিক মিশনে চাকরি প্রদানের সুবিধা দেয়া হয়। | ‘ঘটনার পর সাংবিধানিক রীতি অনুসারে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার কথা কিন্তু এই ক্ষেত্রে ঘটনার।
পরে সে জাতীয় কোনাে পদক্ষেপ নেয়ার তথ্য দেখা যায় না। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ১৫ আগস্ট সকালেই ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বেই তকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী মােস্তাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করিয়া ভাষণ দেন। এই ঘটনার পর আরাে কিছু লােকসহ তিনি বেশ সুবিধা লাভ করিয়াছেন। | যাহা হউক, উপরােক্ত সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ পর্যালােচনায় ১৫/৮/৭৫ তারিখে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের আসামি তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের লিপ্ত থাকা সম্পর্কে স্পষ্ট প্রমাণ বা সম্মতি নাই। কিন্তু ঘটনার পরপরই রেডিও স্টেশনে গমনসহ ক্ষমতাসীনদের সাথে তাহার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হইল, এই বিজড়নের কারণে। তাহাকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলা যায় কিনা? এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাহা এই যে, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার পূর্বে ও পরে নেতার অনুসারীগণের ব্যবহারে অনেক পার্থক্য। ইহা কিছুটা বােধগম্য আমাদের দেশের নেতাভিত্তিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে, যেমন নেতা আছেন তাে সব আছে, নেতা নাই তাে কেউ নাই। জনাব ঠাকুরের মতাে বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠজনেরাও পরে মােস্তাক মন্ত্রিসভায় যােগদান করেন। এমতাবস্থায়, ফৌজদারি বিচারকার্যের প্রতিষ্ঠিত নীতির আলােকে জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের ষড়যন্ত্রে বিজড়ন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হইয়াছে কিনা দেখা প্রয়ােজন। এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণসহ তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের নিজের ও অন্যান্য সহযােগী আসামিগণের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে ষড়যন্ত্রে তাহার বিজড়ন সম্পর্কে কোনাে স্বীকৃতি নাই। অথচ ষড়যন্ত্রের অভিযােগ প্রমাণ করিতে হইলে ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়ার সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্মতি ও সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ প্রয়ােজন। এই ক্ষেত্রে আসামি ঠাকুরের দোষ বা নির্দোষ সম্পর্কে আদালতের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রহিয়াছে এবং এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূরীকরণে যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ নাই। সুতরাং, তাহাকে benefit of doubt -সন্দেহের সুবিধা দেওয়া সিদ্ধান্ত হইল।
আসামি অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার, দফাদার মারফত আলী ও এলডি আবুল হাশেম মৃধার বিরুদ্ধে প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণগুলি পরস্পর সমর্থন করে না এবং অনারারি ক্যাপ্টেন জোয়ারদার কর্তৃক ঘটনার বাড়ি হইতে গুলি নেয়ার অভিযােগটিতে সন্দেহ থাকার ফলে অপরাপর সাক্ষ্যগুলিতে পরস্পর সঙ্গতিপূর্ণ সাক্ষ্য না-থাকায় তাহাদেরকে benefit of doubt -সন্দেহের সুবিধা দেয়া হইল।
৩ নং বিচার্য বিষয় এই বির্চায বিষয়টির ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে নিম্নলিখিত কেসগুলি পর্যালােচনা করা হয়।
1. State Vs. Dosso, 11 D.L.R. (SC) Page 1 2. Asma Jillani Vs. Govt. of Punjab, P.I.D. 1972, (SC) Page-139.
3. Halima Khatun Vs. Bangladesh, 30 D. L. R. (SC), Page-207. 4. Sultan Ahmed Vs. Chief Election Commissioner, 30 D. L. R. (SC)
Page-291. 5. Haji Joynal Abedin, 32 D. L. R. (AD), Page-110. 6. Jamil Haque Vs. Bangladesh, 34 D. L. R. (AD), Page – 125. 7. Ehtasamuddin’s Case, 33 D. L. R. (AD). 8. Nasiruddin Vs. Bangladesh, 32 D. L. R. (AD), Page-216. 9. 8ch Amendment Case 4 D. L.R. (AD), Page-165.
‘আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ বিশেষ করিয়া আসামি মেজর ফারুকের বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমান বলেন, সংবিধানের ৪র্থ তপছিলের ৩ (ক) এবং ১৮ দফার বিধান বলে ২০ আগস্ট রাষ্ট্রপতি খন্দকার মােস্তাক আহমেদ স্বাক্ষরিত ও জারিকৃত ফরমানটি নিপাতনে সিদ্ধ একটি আইন। উক্ত ফরমানে বলা হয় And whereas I placed, on the morning of the 15th August, 1975, the whole of Bangladesh under martial law by a dcelaration broadcast from all stations of radio.
‘তিনি ২৬, ২৭, ৩০, ৩৫, ৪০ নং সাক্ষীর বরাত দিয়া বলেন, ঐদিন ভাের হইতে ফরমান অন্তর্ভুক্ত ঘােষণা দ্বারা সমগ্র বাংলাদেশকে সামরকি শাসনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। উক্ত ফরমানের বিধিতে—Any declaration made by or under this proclamation or mentioned in this proclamation to have been made of anything done or any action taken by or under this proclamation or mentioned in this proclamation to have been done or takenweg 1 এই ফরমান অনুসরণে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএসএম সায়েম কর্তৃক ১৯৭৫ সনের ৮ নভেম্বরে জারিকৃত ফরমানে বলা হয় Whereas the whole of Bangladesh has been under Martial Law since the 15th August, 1975. And whereas I deem it necessary to keep in force the Martial Law proclaimed on the 15th August, 1975 -এই ফরমানটিও ১৯৭৫ সনের ২০ আগস্ট-এর অংশবিশেষ এবং আইন হিসেবে সমমর্যাদাসম্পন্ন।
| ‘বিজ্ঞ আইনজীবী ১, ৪, ৫, ৬, ১৮, ১৯, ২২, ২৪, ২৬, ২৯, ৩৯, ৪০, ৪৭, ৪৯, ৫০ ইত্যাদি সাক্ষীগণের বক্তব্য উল্লেখ করিয়া আর্মিতে মৌখিক আদেশ Legal and Valid’ আদেশ ও এই মামলার বিষয়বস্তু অর্থাৎ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনাটি সামরিক আইন জারি হওয়ার পরে সামরিক আইনের ছত্রছায়ায় সংঘটিত হইয়াছে বলিয়া সাংবিধানিকভাবে এই মামলা চলিতে পারে না বলিয়া দাবি করেন।
পক্ষান্তরে প্রসিকিউশন কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষ্যপ্রমাণ বিশেষ করিয়া রেডিও সেন্টারে উপস্থিত ৩৭ ও ৩৮ নং সাক্ষীগণের বক্তব্য হইতে ইহা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুকে
হত্যার পরে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট সকাল ৮টায় বা উহার আগে/পরে যখনই | যাহার মুখে বা কর্তৃত্বে সামরিক আইন জারির বিষয় ঘােষিত হয় তাহা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা
করার পরেই হয়। বস্তুত সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রমাণিত হয় যে, অনুমান ভাের ৫টার সময়েই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। | ‘প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ৪৯ নং সাক্ষী নৌপ্রধান এমএইচ খান, ৪৭ নং সাক্ষী বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, ৪৪ নং সাক্ষী ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার
কর্নেল শাফায়েত জামিল, ৯ নং সাক্ষী লে. কর্নেল হামিদ, ১০ নং সাক্ষী মেজর | জেনারেল আবদুর রব, ৪১ নং সাক্ষী ব্রিগেডিয়ার শাহজাহান, ৪২ নং সাক্ষী।
ডিজিএফআই-এর অফিসার মেজর জিয়াউদ্দিন প্রমুখ সশস্ত্রবাহিনীর সাক্ষীদের বক্তব্য পর্যালােচনায় বা রেকর্ডভুক্ত অন্য কোনাে সাক্ষী/তথ্য প্রমাণ দ্বারা ইহা প্রমাণিত হয় না। যে, ঘটনার তারিখে মাত্র কিছু জুনিয়র আর্মি অফিসার ও তাহাদের অধীনস্থ রেজিমেন্টের কিছু কিছু সদস্য বাদে অন্য কোনাে রেজিমেন্টের অফিসার/সৈনিক এই হত্যাকাণ্ডের সহিত জড়িত ছিল ; বরং দেখা যায় যে, মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধানের পদ হইতে সরাইয়া দেওয়া হয় এবং বিমানপ্রধান এ. কে. খন্দকার চাকরি হইতে ইস্তফা দেন। আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণের মতে, সামরিক আইনের ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁহার সরকারকে উৎখাত করা হইলে সশস্ত্রবাহিনীর উল্লেখিত সিনিয়র অফিসারগণ অবশ্যই অবহিত থাকিতেন। কিন্তু ঘটনায় তাহাদের ভূমিকা/আচরণ ইত্যাদি দৃষ্টে তাহারা সামরিক আইনজারি সম্পর্কে আদৌ কিছু জানেন না বলিয়া মনে হয়।
‘নিম্নে উল্লেখিত ফরমানটি সম্পর্কে উচ্চ আদালতের কিছু আলােচনা ও সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত হইল।
In the preamble of the Proclamation of 20th August, 1975, there was no mention of the fact that the president of the country was killed which necessitated the proclaimer accused Kh. Mostaque Ahmed to take over as President. In the same proclamation clause (e) it is said that the Constitution of the People’s Republic of Bangladesh shall, subject to this proclamation and the Martial Law Regulation and orders made by accused Kh. Mostaque in pursunace thereof, continue to remain in forces. By this clause (e) Proclamation itself kept alive the constitution of the People’s Republic of Bangladesh in places where it does not came in conflict with the Proclamation of 20th August, 1975. The effect of this Proclamation of 20th August, 1975, therefore, is that the fundamental rights given by the Constitution (Part-III of the Constitution) remained inforce even though the country was placed under Martial Law.
হত্যার পরে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট সকাল ৮টায় বা উহার আগে/পরে যখনই যাহার মুখে বা কর্তৃত্বে সামরিক আইন জারির বিষয় ঘােষিত হয় তাহা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরেই হয়। বস্তুত সাক্ষ্যপ্রমাণে প্রমাণিত হয় যে, অনুমান ভাের ৫টার সময়েই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
| ‘প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ৪৯ নং সাক্ষী নৌপ্রধান এমএইচ খান, ৪৭ নং সাক্ষী। | বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান, ৪৪ নং সাক্ষী ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার
কর্নেল শাফায়েত জামিল, ৯ নং সাক্ষী লে. কর্নেল হামিদ, ১০ নং সাক্ষী মেজর জেনারেল আবদুর রব, ৪১ নং সাক্ষী ব্রিগেডিয়ার শাহজাহান, ৪২ নং সাক্ষী ডিজিএফআই-এর অফিসার মেজর জিয়াউদ্দিন প্রমুখ সশস্ত্রবাহিনীর সাক্ষীদের বক্তব্য পর্যালােচনায় বা রেকর্ডভুক্ত অন্য কোনাে সাক্ষী/তথ্য প্রমাণ দ্বারা ইহা প্রমাণিত হয় না যে, ঘটনার তারিখে মাত্র কিছু জুনিয়র আর্মি অফিসার ও তাহাদের অধীনস্থ রেজিমেন্টের কিছু কিছু সদস্য বাদে অন্য কোনাে রেজিমেন্টের অফিসার/সৈনিক এই। হত্যাকাণ্ডের সহিত জড়িত ছিল ; বরং দেখা যায় যে, মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধানের পদ হইতে সরাইয়া দেওয়া হয় এবং বিমানপ্রধান এ, কে, খন্দকার চাকরি হইতে ইস্তফা দেন। আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণের মতে, সামরিক আইনের ছত্রছায়ায় বঙ্গবন্ধুকে ও তাঁহার সরকারকে উৎখাত করা হইলে সশস্ত্রবাহিনীর উল্লেখিত সিনিয়র অফিসারগণ অবশ্যই অবহিত থাকিতেন। কিন্তু ঘটনায় তাহাদের ভূমিকা/আচরণ ইত্যাদি দৃষ্টে তাহারা সামরিক আইনজারি সম্পর্কে আদৌ কিছু জানেন বলিয়া মনে হয়।
“নিম্নে উল্লেখিত ফরমানটি সম্পর্কে উচ্চ আদালতের কিছু আলােচনা ও সিদ্ধান্ত। উদ্ধৃত হইল।
In the preamble of the Proclamation of 20th August, 1975, there was no mention of the fact that the president of the country was killed which necessitated the proclaimer accused Kh. Mostaque Ahmed to take over as President. In the same proclamation clause (e) it is said that the Constitution of the People’s Republic of Bangladesh shall, subject to this proclamation and the Martial Law Regulation and orders made by accused Kh. Mostaque in pursunace thereof, continue to remain in forces. By this clause (e) Proclamation itself kept alive the constitution of the People’s Republic of Bangladesh in places where it does not came in conflict with the Proclamation of 20th August, 1975. The effect of this Proclamation of 20th August, 1975, therefore, is that the fundamental rights given by the Constitution (Part-III of the Constitution) remained inforce even though the country was placed under Martial Law.
Assuming that the Martial law Proclamation and orders passed thereunder superseded and disrupted the constitutional process, the constitutional provisions which were not expressly annulled or taken away by the Proclamation or any order under it will, therefore, remain in force for all practical purposes.
The Proclamation of 20th August. 1975 has no where stated that the Constitution is abrogated rather it was provided that “the Constitution of Bangladesh shall subject to Proclamation of Martial law Regulation and orders made under the Martial Law shall continue to remanin in force.” The Martial Law became supreme law of the land and though the Constitution has not been abrogated, it has been made subordinate to Martial law, but the Constitution will continue in force subject to Martial Law, that is to say, it will have effect so long it does not come in conflict with Martial Law. The Proclamation of 1975 did not make any regulation or rules which came in conflict with Article 31 (right to protection of law) and Article 32 (Protection of right to life and personal liberty) of the Constitution. As such these constitutional provision were alive before and from the time the proclamation was made. From the above observations of the Supreme Court of Bangladesh (Appellate Division) it can be safely argued that at no stage did the Proclamation or Proclamations give or empower any person the right to take away the life of any person or give power to deprive anybody of the right to enjoy protecton of law. So, the killing of Banga Bandhu Sheikh Mujibur Rahman and his family members (subject matter of this case) was not authorised or protected by the Proclamation itself. Article 31 and 32 or the Constitution remained intact even though the Martial Law was in force. Article 31 reads as follwos: *To enjoy the protection of the law, and to be treated in accordance with law, and only in accordance with law, is the inalienable right of every citizen, whoever he may be, and of every other persons for the time being within Bangladesh, and in particular no action detrimental to the life, liberty, body, reputation or property of any person shall be taken except in accordance with law. “From this, it follows till the time of his killing Banglabandhu Sheikh Mujibur Rahman and his family members were citizens of Bangladesh and entitled to enjoy the benefit of Article 31 and 32.
‘প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ফরমান জারির পরও যখন বঙ্গবন্ধু হত্যকারীদের অপরাধের দায় হইতে সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিতভাবে রক্ষা করা যাইতেছে না, তখন উহার এক মাসেরও অধিককাল পর অর্থাৎ ২৬/৯/৭৫ তারিখে Indemnity Ordinance জারি করা হয় যাহার ২ ধারা নিম্নরূপ।
(2) For the purpose of this section, a certificate by Persident, or a person authorised by him in this behalf, that any act, matter of thing was done or step taken by any person mentioned in the certificate in connection with, or in perparation or execution of any plan for, or as necessary step towards, the change of Government of the People’s Republic of Bangladesh and the Proclamation of Martial Law on the morning of the 15th August, 1975 shall be sufficient evidence of such act, matter of thing having been done or step having been taken in connection with, or in preparation or execution of any plan for, or as necessary steps towards, the change of such Government and the Proclamation of Martial Law on that morning.
এই ২ ধারায় প্রদত্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য কোনাে আসামি রাষ্ট্রপতি কিংবা তাহার মনােনীত প্রতিনিধি হইতে হত্যাকাণ্ডের দায় হইতে নিজেকে বাঁচানাের জন্য কোনাে সার্টিফিকেট দাখিল করে নাই। সুতরাং এই অর্ডিন্যান্সের কারণেও কোনাে আসামির বিরুদ্ধে মামলাটি চলিতে বাধা নেই। দেখা যায় যে, ইহার পর ১৯৯৬ সনের ২১ নং আইন দ্বারা Indemnity Ordinance, 1975 রহিত করা হয় যাহা নিম্নরূপ :
১. The Indemity Ordinance, 1975 (L of 1975 যাহা XIX of 1975 নম্বরে। মুদ্রিত), অতঃপর উক্ত অর্ডিন্যান্স বলিয়া উল্লেখিত এতদ্বারা রহিত করা হইল।
‘২. এই আইন বলবৎ হইবার পূর্বে কোনাে সময় উক্ত অর্ডিন্যান্স-এর অধিকৃত কোনাে কার্য, গৃহীত কোনাে ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনাে সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ। অথবা অর্জিত কোনাে অধিকার বা সুযােগসুবিধা, অথবা সরকার বা কোনাে কর্তৃপক্ষের জন্য সৃষ্ট কোনাে দায়দায়িত্ব যদি থাকে, এর ক্ষেত্রে General Clauses Act, 1887 (X of 1987)-এর Section-6 এর বিধানাবলি প্রযােজ্য হইবে না এবং উক্তরূপ কৃতকার্য, গৃহীত ব্যবস্থা, প্রদত্ত সার্টিফিকেট বা আদেশ-নির্দেশ বা অর্জিত অধিকার বা সুযােগসুবিধা বা সৃষ্ট দায়দায়িত্ব উপধারা (১) দ্বারা উক্ত অর্ডিন্যান্স রহিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে এইরূপে অকার্যকর বাতিল ও বিলুপ্ত হইয়া যাইবে যেন উক্ত অর্ডিন্যান্স জারি করা হয় নাই এবং উক্ত অর্ডিন্যান্স-এর কোনাে অস্তিত্ব ছিল না ও নাই। | ‘এই রহিতকরণের বিরুদ্ধে লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান ও লে. কর্নেল ফারুক রহমানের পক্ষে মহামান্য হাইকোর্ট ৫৩২১ ও ৫৩১৩ নং রিট পিটিশন দায়ের করা হয়। মহামান্য হাইকোর্ট উক্ত রিট পিটিশনদ্বয় অন্যান্য আদেশসহ নিম্নলিখিত আদেশ দ্বারা নিষ্পত্তি করেন যাহা নিম্নরূপ
(1) (2) (3) It is held that the Indemnity ordinance, 1975 (Ordinance no. 50 of
1975) is void since it is repugnant to the Constitution. *(4) It is held that since the Indemnity ordinance 50 of 1975 is ultra
vires the Constitution and Indemnity (Repeal) Act no. 21 of 1996 does not offend and infringe any provision of the Constiution, the prayer for declaring the institution of Dhanmondi P.S. Case No. 10 (10) 96 and Lalbagh P. S. Case No. 11 (11) 75 without lawful authority and illegal are hereby refused.
(5)
‘এই রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল হইলে আপিল বিভাগ উক্ত রায় বহাল রাখেন। সুতরাং উপরােক্ত আলােচনার মর্মানুসারে আলােচ্য বিষয়ে আসামিপক্ষের দাবি নাকচ করা হইল এবং মামলাটি সর্ব অবস্থায় চলিতে পারে বলিয়া সিদ্ধান্ত হইল।’
৪ নং বিচার্য বিষয় ‘প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও স্বীকৃতমতে ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট অনুমান ভাের ৫টার সময় বঙ্গবন্ধু তাহার পরিবারবর্গ ও আত্মীয়স্বজনকে গুলি করিয়া হত্যা করা হয়। | ‘৪ নং সাক্ষী হাবিলদার কুদুস বলেন, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাত্রে মেজর হুদা তাহাকে মােহাম্মদপুর শেরশাহ রােডে একটি কাঠের আড়তে নিয়া আড়তদারকে ১০টি কাঠের বাক্স বানাইয়া বাক্সগুলি ৩২ নং রােডস্থ ঘটনার বাড়িতে পৌছাইয়া দিবার আদেশ দেয়। সেখান হইতে মেজর হুদা তাহাকে ঘটনার বাড়িতে নামাইয়া দিয়া চলিয়া যায়। শেষ রাত্রে আড়তদার ঠেলাগাড়িতে করিয়া ১০টি বাক্স নিয়া আসিলে লাশগুলি ঐ বাক্সে রাখে। ফজরের আগে মেজর হুদা আবার আসে। তখন সেনাবাহিনীর গাড়িতে করিয়া বঙ্গবন্ধুর লাশ বাদে বাকি লাশ নিয়া যায়। | ‘৯ নং সাক্ষী লে. কর্নেল হামিদ বলেন যে, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাত্রে ৩টার সময় বঙ্গভবন হইতে মেজর এমএ মতিন টেলিফোনে তাহাকে জানায় যে, সূর্য উঠার আগে বঙ্গবন্ধুর লাশ বাদে অন্যান্য লাশগুলি বনানী গােরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। নির্দেশ মােতাবেক ফোনে ব্যাটালিয়ান কমান্ডার এমএ রবকে তাড়াতাড়ি বনানী গােরস্থানে লাশ দাফনের জন্য নির্দেশ দিয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কিছু ফোর্স পাঠাইয়া নিজেও বঙ্গবন্ধুর লাশ বাদে বাকি লাশগুলি দাফন করার জন্য বনানীতে পাঠাইয়া দেন। তিনি বলেন যে, সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অর্থাৎ বঙ্গভবনের নির্দেশে মেজর মতি তাহাকে লাশ দাফনের নির্দেশ দেন। পরে হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়া পাঠানাে হয়।
‘৩০ নং সাক্ষী বলেন যে, তাহারা কফিনের উপরের ডালা খুলিয়া বরফ সরাইয়া বঙ্গবন্ধুর লাশ বাহির করে। বঙ্গবন্ধুর লাশ বুঝিয়া পাইয়া আর্মিদের দেওয়া একটি প্যাডে দাফন করার সার্টিফিকেট দেয়। সার্টিফিকেটে তিনি এবং ল-ইয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট আ. কাদের স্বাক্ষর করেন। | ২৮ নং সাক্ষী আবদুল হাই ও অন্যান্য স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বঙ্গবন্ধুর লাশ গােসল করাইয়া কাফন পরাইয়া দাফন করার কথা বলে। ১০ নং সাক্ষী বলে যে, ৯ নং সাক্ষী কর্নেল হামিদের টেলিফোন নির্দেশে বঙ্গবন্ধু, সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির বাড়ির অপরাপর মােট ১৮টি লাশ বনানীতে দাফন করে। তাহার উপরে কেবল নির্দেশ ছিল লাশগুলি তাড়াতাড়ি দাফন করা। তাহারা যে-সমস্ত লাশ দাফন করে সেইগুলাে মনে। হয় যে কাপড়ে লাশগুলাে আনা হয় সেই কাপড়েই কবরস্থ করে। বলা যায় লাশগুলি মাটিচাপা দেয়।
| ‘প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ঘটনার সাথে সাথে রেডিওতে পুনঃপুনঃ প্রচার হয়। ২৪ ঘণ্টা পর লাশগুলি করবস্থ করা হয়। ১০ নং সাক্ষী বলেন, লাশগুলিতে পচন ধরিয়াছিল এবং এইগুলি কবরস্থ করা জরুরি ছিল। এমতাবস্থায় লাশগুলি গােপন করা হয় বলা যায় না। বঙ্গভবন হইতে প্রদত্ত লাশগুলি দাফনের নির্দেশের সাথে আসামিগণ জড়িত ছিল কিনা বা হত্যার পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা। সম্পন্ন না করিবার বা না করিতে দিবার ব্যাপারে আসামিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে পারে নাই। দাফনের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় কার্যসম্পন্ন না করার বা করিতে না দেওয়ার ব্যাপারে আসামিদের কোনাে ভূমিকা ছিল কিনা সেই সম্পর্কে সাক্ষ্যপ্রমাণ নাই। উপস্থিত সাক্ষীদের মধ্যে কেহই বলে নাই যে আসামিরা নিজেদেরকে বাঁচানাের জন্য লাশ কবরস্থ বা কবরস্থ করার সহযােগিতা করিয়াছিল। লাশগুলির ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের ক্ষেত্রে দণ্ড বিধির ২০১ ধারার অপরাধের সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় না। সুতরাং আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত ২০১ ধারার অভিযােগ নাকচ করা হইল।
৫ নং বিচার্য বিষয় “আসামিপক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ বিশেষ করিয়া আসামি ফারুকের পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী খান সাইফুর রহমান বলেন যে, এই মামলার ঘটনার সহিত আসামিগণ জড়িত নয়-কোনাে তৃতীয় পক্ষ ইহা ঘটাইয়া থাকিবে। ইহার সমর্থনে তিনি রেকর্ডকৃত সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতে কিছু তথ্যের উল্লেখ করেন। কিন্তু ২ নং বিচার্য বিষয়ের সিদ্ধান্তে যেহেতু প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আসামিগণ এই ঘটনার সহিত জড়িত ছিলেন বলিয়া সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় সেহেতু উক্ত আসামিগণ এই ঘটনায় জড়িত না থাকার কোনাে প্রশ্ন উঠে না এবং ইহাতে কোনাে তৃতীয় পক্ষ জড়িত ছিল কিনা সেই বিষয়টির উপর কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ রেকর্ডে আসে নাই। এমতাবস্থায় আসামিপক্ষের এই দাবিও গ্রহণযােগ্য নহে।
৬ নং বিচার্য বিষয় ‘ফৌজদারি মামলায় কতদিনের মধ্যে এজাহার রুজু করিতে হইবে উহার বাঁধাধরা নিয়ম নাই কিংবা সময় নির্ধারণী কোনাে আইন নাই।
‘এক্ষেত্রে বিলম্বে এজাহার দায়ের হওয়ার দরুন প্রসিকিউশনের কোনাে লাভ বা আসামিদের কোনাে ক্ষতি হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। যাহা হউক, এই মামলার ঘটনাটি ১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট অনুমান ভাের ৫টার সময় সংঘটিত হয়। ১ নং সাক্ষী আ, ফ, ম, মুহিতুল ইসলাম বলেন, তিনি ঘটনার পর থানায় এজাহার দিতে গেলে তাহাকে বলা হয় ‘তুই নিজে মরবি, আমাদেরকেও মারবি, এখন চলে যা, অনুকূল পরিস্থিতি আসিলে তখন এজাহার করিস’-এই বলিয়া তখন তাহার নিকট হইতে এজাহার নেয় নাই। সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায় যে, এই ঘটনার পর যেসব সরকার ক্ষমতায় আসিয়াছে তাহারা সকলেই এই মামলার হত্যাকারীদেরকে দেশে-বিদেশে আশ্রয়/প্রশয় দিয়া চলিয়াছে। সুতরাং, ঘটনার পর হইতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্বপর্যন্ত কোনাে সরকারের আমলেই এই মামলার এজাহার রুজু করা নিরাপদ ছিল না বলিয়া প্রসিকিউশন হইতে দাবি করা হয়। উল্লেখ্য যে, ইহা একটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী মামলা। এইক্ষেত্রে ঘটনার পরবর্তী সরকারের সাথে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সম্পর্ক, ঘটনার পরবর্তী পরিস্থিতিসহ সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করিয়া বিলম্বে এই মামলার এজাহার রুজু করাটা দোষণীয় হয় নাই। কারণ শত্রুতার ক্ষেত্রে এজাহার দায়েরের বিলম্ব প্রাসঙ্গিক। তাহা ছাড়া ঘটনার বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর কোনাে আত্মীয়স্বজনকে জীবিত রাখে নাই। এজাহারকারী ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। তিনি এজাহার রুজু করার উপযুক্ত ব্যক্তি। তিনি বিলম্বে এজাহার রুজু করার যে ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহা আদালত সন্তোষজনক বলিয়া মনে করে। | ‘এছাড়া ৫৬ নং সাক্ষী ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বক্তব্য হইতে দেখা যায় যে, বর্তমান এজাহারের পূর্বে তাইদউদ্দিন খান ও মাে. মহসীনুল হক আরেকটি এজাহার দায়ের করে, যাহা তথ্যভিত্তিক ছিল না এবং উহা গণহত্যার বিষয় ছিল বলিয়া সিদ্ধান্তের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠাইয়া দেন। তাহা এখন কোথায় আছে। বলিতে পারেন না। | নথি পরীক্ষায় দেখা যায়, পলাতক আসামিদেরকে হাজির হওয়ার নির্দেশ ঘােষণা দিয়া প্রকাশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট আদালত ঘােষণাটি যথাযথভাবে প্রকাশিত হইয়াছে মর্মে বিবৃতি দেন। ইহাতে কার্য বিধির ৪৭ ধারার শর্ত পূরণ হইয়াছে। সুতরাং বিজ্ঞ কৌশলী জনাব খান সাইফুর রহমানের এতদসংক্রান্ত আপত্তি নাকচ করা হইল।
৭ নং বিচার্য বিষয় “এই মামলার আসামিদের মধ্যে মিলিটারি অফেন্ডার্স’ থাকার কারণে ১৯৫৮ সালের ফৌজদারি কার্য বিধির (মিলিটারি অফেনডার্স) ২ নং বিধি মােতাবেক এই মামলার বিচারের জন্য অত্র আদালত হইতে সেনাপ্রধানকে গত ২৭/৩/৯৭ তারিখে নােটিশ
প্রদান করা হয়। উক্ত নােটিশের প্রেক্ষিতে সেনাপ্রধান ২/৪/৯৭ তারিখে অত্র বেসামরিক আদালতে ঐ সেনা-সদস্যদের বিচারের ক্ষেত্রে সেনা আইনের বিধানে কোনাে বাধা নাই বলিয়া জানান। সুতরাং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৯ ধারার আনুষ্ঠানিকতা পালন করিয়া অত্র আলাদত এই মামলার বিচারকার্য শুরু করে। ইহাতে মামলাটির বিচারে কোনাে অনিয়ম হয় নাই বলিয়া আসামিপক্ষের এতদসংক্রান্ত দাবি নাকচ করা হইল।’
৮ নং বিচার্য বিষয়। মামলার মােটিভ প্রমাণ করিতে প্রসিকিউশন আইনত বাধ্য নহে। তবুও প্রাপ্ত। সাক্ষীপ্রমাণে দেখা যায় এই ঘটনার পূর্বে আসামি মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর সুলতান শাহরিয়ারসহ অনেকের সেনাবাহিনী হইতে চাকরি চলিয়া যায়। মেজর ফারুক ২ বৎসর জ্যেষ্ঠতা পায় না, ল্যান্সারের কমান্ডিং অফিসার। হইতে তাহাকে টু আইসি হিসেবে পদাবনত করা হয়; মেজর ডালিমের স্ত্রীকে কেন্দ্র করিয়া গাজী গােলাম মােস্তফার ছেলের সহিত অবাঞ্ছিত ঘটনাও সেনাবাহিনীর লােক কর্তৃক তাহাদের বাড়ি তছনছ করা; সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি, পােস্টিং, দলাদলিসহ আরও সৃষ্ট কারণে অসন্তোষ; অস্ত্র উদ্ধারের সময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর সহিত গােলমাল, খন্দকার মােস্তাকের মন্ত্রিত্ব যাবার কথাবার্তা, বাকশাল গঠন; জেলা গভর্নর নিয়ােগ ইত্যাদি কারণে আসামিগণ ক্ষোভ-দুঃখে যৌথ ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে একই অভিপ্রায়ে পরিকল্পনামতে এই ঘটনা করিয়া থাকিবে।
| ‘আসামীগণের আইনজীবীগণ দাবি করেন যে, ঘটনার সময়ের সঠিকতা নাথাকায় এবং সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিলসহ এই মামলায় অনেক দোষত্রুটি রহিয়াছে যাহা বিচারকার্য ব্যাহত করে। আইনজীবীগণ আরও উল্লেখ করেন যে, Accomplice দের সাক্ষ্য দ্বারা আসামিগণকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। উল্লেখ্য যে, মামলার ঘটনাটি সংঘটিত হয় ২৩ বছর পূর্বে। এই সময়ে অনেক পরিবর্তন হইয়াছে – অনেক আসামি ও সাক্ষী মারা গিয়াছে। সময়ের এই দীর্ঘ ব্যবধানের কারণে ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনায় কিছু অমিল থাকিতে পারে। তবুও প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণে দেখা যায় যে, ঘটনার মূল বা প্রধান বিষয়ে বড় ধরনের কোনাে অমিল/গরমিল নাই। ছােট ধরনের কিছু গরমিল থাকিলেও তাহা বিচারকার্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নাই বলিয়া আদালত মনে করে। আরাে উল্লেখ্য যে, আসামিপক্ষের আইনজীবীগণ মূল ঘটনার উপর বেশি বক্তব্য না রাখিয়া টেকনিক্যাল পয়েন্ট-এর ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বাঁচাইবার যথেষ্ট চেষ্টা করেন। আরাে লক্ষ্য করা যায় যে, অনুপস্থিত আসামিদের পক্ষে ও উপস্থিত আসামিগণের বিজ্ঞ আইনজীবীরা বিস্তারিত জেরা, যুক্তিতর্ক ও সাবমিশনের মাধ্যমে মামলা পরিচালনা করেন। মেজর বজলুল হুদার পদোন্নতি সম্পর্কে লে. কর্নেল ফারুকের আইনজীবী জনাব খান সাইফুর রহমান আদালতে কাগজপত্র দাখিল করেন।
‘আসামী ফারুকের পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবী খান সাইফুর রহমান বলেন যে সরকারপক্ষে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার যে আদর্শ অপরিহার্য ও বাঞ্ছনীয়
তাহা বর্তমান মামলার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অস্তিত্ববিহীন, কারণ এই মামলায় সরকারপক্ষের নিয়ােজিত বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর জনাব সিরাজুল হক এই ঘটনার সময় এমপি ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ছােটকালের বন্ধু ছিলেন। এই ঘটনার পর ১৯৭৫ সনের অক্টোবর মাসে কোনাে একদিন এমপিদের এক সমাবেশে তিনি খন্দকার মােস্তাক আহম্মদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মানেন না বলিয়া বক্তব্য পেশ করেন এবং প্রতিবাদ করেন। কাজেই এই মামলায় তিনি বিচারকার্যে সুবিচার প্রত্যাশার উপর হানিকর প্রভাব ফেলিতে পারেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সরকারপক্ষে নিয়ােজিত ৮/১০ জন বিজ্ঞ আইনজীবী একটি টিমের মতাে মামলাটি পরিচালনা করেন। জনাব সিরাজুল হক এই মামলার প্রধান আইজীবী হইলেও মামলা চলাকালে কখনও তাহার আচরণ/কথাবার্তায় কোনাে পক্ষ অবলম্বনের চেষ্টা আদালতের গােচরীভূত হয় নাই। এমনকি কোনাে আসামির পক্ষেও এই জাতীয় আপত্তি উত্থাপন করা হয় নাই বরং আসামিপক্ষ এবং তাহাদের পক্ষে নিযুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীদেরকে বিভিন্ন সুযােগ/সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি উদার সমর্থন জানাইয়াছেন এবং শেষপর্যন্ত মামলাটিতে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে তাহার ভূমিকা পালন করিয়াছেন বলিয়া আদালত মনে করে। সুতরাং তাহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোেগটি নাকচ করা হইল।’
উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাগণ দায়িত্ব পালন করেননি প্রাসঙ্গিকভাবে ইহা উল্লেখ না করিয়া পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিশেষ করিয়া যাহারা ঢাকায় অবস্থান করিতেছিলেন, তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই, এমনকি পালনের কোনাে পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নাই যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন আদেশ পাওয়ার পরও তাহার নিরাপত্তার জন্য কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। সাক্ষ্যপ্রমাণে ইহা পরিষ্কার যে, মাত্র দুইটি রেজিমেন্টের খুবই অল্পসংখ্যক জুনিয়ার সেনা অফিসার/সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন এই কতিপয় সেনাসদস্যকে নিয়ন্ত্রণ/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে নাই তাহা বােধগম্য নয়। ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত। হইয়া থাকিবে।’
দন্ডবিধির ৩০২/৩৪ ও ১২০-ক ধারা প্রমাণিত ‘এই মামলায় প্রাপ্ত মৌখিক, দালিলিক, তথ্যগত, অবস্থাগত, সাক্ষ্য ও আলামত। পরীক্ষা/পর্যালােচনা ও বিচার-বিশ্লেষণে আদালত এই স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, এই মামলায় আসামি (১) লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, (২) লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, (৩) লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারী) (৪) পলাতক।
আসামি লে. কর্নেল আবদুর রশিদ (৫) পলাতক মেজর বজলুল হুদা (৬) পলাতক লে, কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, (৭) মেজর শরিফুল হােসেন ওরফে শরফুল হােসেন (৮) লে. কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী, (৯) লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার) (১০) লে. কর্নেল এএইচএমবি নূর চৌধুরী, (১১) লে. কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা, (১২) ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, (১৩) ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার (১৪) ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ (১৫) রিসালদার মােসলেমউদ্দিন ওরফে মােসলেহউদ্দিন গণ ১৯৭৫ সনে ১৫ আগস্ট অনুমান ভাের ৫টার সময় ধানমণ্ডিস্থিত নিজ ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু তাহার পরিবারবর্গ, আত্মীয়স্বজন ও অন্যান্যকে ষড়যন্ত্র ও পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক গুলি করিয়া হত্যা করার অপরাধে তাহাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ এবং ১২০-ক ধারার অভিযােগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। হইয়াছে। ঘটনার পর কোনাে কোনাে আসামি দেশ-বিদেশে নিজেদেরকে আত্মস্বীকৃত। খুনী হিসাবেও পরিচয় দিয়া দাম্ভিকতা প্রকাশ করে। ঘটনাটি কেবল নৃশংস নহে, এই ঘটনায় ২জন সদ্যবিবাহিতা মহিলাকে ও ১০ বৎসরের একজন শিশুকেও নির্মমভাবে গুলি করিয়া হত্যা করে। উল্লেখ্য যে, আসামিদের এই অপরাধ এমন একটি ক্ষতির কার্য যাহা শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্যই ক্ষতিকর নহে, বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষেও ইহা একটি মারাত্মক ক্ষতি। দেখা যায় যে, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ পরিণতির বিষয়। স্বজ্ঞানে জ্ঞাত থাকিয়াও ষড়যন্ত্র পরিকল্পিতভাবে ঘটাইয়াছে। সুতরাং তাহাদের প্রতি কোনােপ্রকার সহানুভূতি ও অনুকম্পা প্রদর্শনের যুক্তি নাই। এই অনুকম্পা পাওয়ার কোনাে যােগ্যতাও তাদের নাই। তাহাদের কৃত অপরাধের জন্য তাহাদের প্রত্যেককে দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ ধারামতে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত হইল। তাহাদেরকে উক্ত চরম দণ্ড প্রদানের পর ১২০-ক ধারার অভিযােগে কোনাে শাস্তি প্রদান করা হইল না। | ‘আসামি (১) তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, (২) অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব। জোয়ারদার, (৩) দফাদার মারফত আলী ও (৪) এলডি আবুল হাশেম মৃধা-এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোেগ এই মামলায় সন্দেহাতীভাবে প্রমাণিত হয় নাই বিধায় তাহাদিগকে অভিযােগের দায় হইতে অব্যাহতি দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়া হইল।
অতএব, আদেশ হইল যে, এই মামলায় উপরােক্ত সিদ্ধান্ত মােতাবেক আসামি ১. লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক। রহমান ২. লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, ৩, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), ৪. পলাতক আসামি লে. কর্নেল আবদুর রশিদ ৫. পলাতক। মেজর বজলুল হুদা, ৬. পলাতক লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম,৭. মেজর শরিফুল হােসেন ওরফে শরফুল হােসেন, ৮, লে. কর্নেল এম এ রাশেদ চৌধুরী, ৯, লে কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), ১০. লে. কর্নেল এএইচএমবি নূর চৌধুরী, ১১, লে, কর্নেল আবদুল আজিজ পাশা, ১২. ক্যাপ্টেন মাে. কিসমত হাশেম, ১৩, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার, ১৪. ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, ১৫, রিসালদার।
মােসলেমউদ্দিন ওরফে মােসলেহউদ্দিনকে দ. বি. ৩০২/৩৪ ধারার অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হইল। একটি ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রকাশ্যে তাহাদের প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ হইল।
| ‘নির্দেশ মােতাবেক তাহাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিতে কর্তৃপক্ষের কোনাে অসুবিধার কারণ থাকিলে তাহাদের মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত নিয়মানুসারে ফাসিতে ঝুলাইয়া কার্যকর করার নির্দেশ রইল। আসামি ১, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ২. অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার, ৩. দফাদার মারফত আলী, ৪. এলডি আবুল হাশেম মৃধাকে অন্য কোনাে মামলায় প্রয়ােজন না হইলে এই মামলা হইতে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ হইল।’ আমার জবানিতে
(কাজী গােলাম রসুল)। জেলা ও দায়রা জজ, ঢাকা।
মামলার ডেথ রেফারেল মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও মেজর (অব.) বজলুল হুদা এই চার গ্রেফতারকৃত আসামি দায়রা জজের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। পলাতক ১১ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পক্ষে তাদের রাষ্ট্র নিয়ােজিত আইনজীবীগণ ডেথ রেফারেন্স শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি মাে. রুহুল আমিন ও বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে ২৮ জুন থেকে ২৮ নভেম্বর ২০০০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ৬৩ কার্যদিবস এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ১৪ ডিসেম্বর, ২০০০ বিচারপতিদ্বয় বিভক্ত রায় প্রদান করেন। | বিচারপতি খায়রুল হক নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন। কিন্তু বিচারপতি রুহুল আমিন ১৫ জনের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং ১, মেজর (অব.) শরিফুল (ওরফে শরফুল) হােসেন, ২. লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ, ৩. ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হােসেন আনসার, ৪, ক্যাপ্টেন (অব.) মাে. কিসমত হাশেম ও ৫, রিসালদার মােসলেমউদ্দিন (ওরফে মােসলেহউদ্দিন) এই ৫ জনকে খালাস প্রদান করেন। এই বিভক্ত রায় নিষ্পত্তির জন্য গঠিত তৃতীয় বেঞ্চের বিচারক বিচারপতি মােহাম্মদ ফজলুল করীম ৩০ এপ্রিল ২০০১ প্রদত্ত চূড়ান্ত রায়ে ১. মেজর শরিফুল ওরফে শরফুল হােসেন, ২. ক্যাপ্টেম মাে, কিসমত হাশেম ও ৩, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার এই তিনজনকে খালাস ও অবশিষ্ট ১২ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।
বিচারে বাধাদান। প্রথম আলাে’র ১২ আগস্ট ২০০২ সংখ্যায় জনৈক শহীদুজ্জামানের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সুপ্রিমকোর্টের আপিলবিভাগে একজন বিচারকের অভাবে মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে কারাবন্দি চার আসামির আপিলের অনুমতির (লিভ) আবেদন গত ১৬ জুলাই ২০০১ থেকে ঝুলে আছে এবং ২০০৩ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরের আগে এ আবেদনের শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
| বিধিমালা অনুযায়ী মামলাটির শুনানির জন্য আপিলবিভাগের তিনজন বিচারপতির সমন্বয়ে বেঞ্চ গঠন করতে হয়। বর্তমানে দুজন অস্থায়ীসহ সাতজন বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি মাে. রুহুল আমিন ও বিচারপতি মােহাম্মদ ফজলুল করিম হাইকোর্টে এ মামলার রায়ে অংশ নেন এবং বিচারপতি কেএম হাসান, বিচারপতি সৈয়দ জেআর মােদাচ্ছির হােসেন ও বিচারপতি আবু সাঈদ আহাম্মদ আগেই ‘ব্ৰিত’ হওয়ায়। মামলাটি শুনতে পারছেন না। মৃত্যুদণ্ডাদেশাধীন আসামি বজলুল হুদার কৌসুলিদের অনাস্থা জ্ঞাপক আবেদনের ফলে বিচারপতি মােহাম্মদ গােলাম রাব্বানীও বিব্রত বােধ করেন। ফলে বিচারপতি মাে. ফজলুল হক ও প্রধান বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী এ দুজন মামলাটি শুনতে পারেন। উক্ত প্রতিবেদন মতে, ২০০১ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের বিচারপতি মাে. নূরুল ইসলামকে আপিলবিভাগে অস্থায়ী বিচারপতি নিয়ােগের পরামর্শ দিলেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। যদিও এ মামলা প্রসঙ্গে ‘আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে বলে খালেদা সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী, বিচারপতি মাে. ফজলুল হক ও বিচারপতি আবু সাইদ আহাম্মদ যথাক্রমে ২৩ জুন, ৩০ জুন ও ২৩ আগস্ট ২০০৩ -এ অবসরে যাবেন। ফলে অতিরিক্ত অস্থায়ী বিচারক নিয়ােগ না করা হলে ২৩ আগস্ট ২০০৩ -এর পর অবসরজনিত শূন্যপদে বিচারক নিয়ােগের পরই কেবল এ মামলার শুনানি শুরু হতে পারে? অতএব আপিলবিভাগে এ মামলা শুনার যােগ্য একজন বিচারপতি নিয়ােগ দিয়ে হিমাগার থেকে উদ্ধার করে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সমীচীন হবে।
বর্তমান আইন ও বিচার মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ প্রসঙ্গে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০২ তার দফতরে সাংবাদিকদের বলেন :
দুর্ভাগ্যবশত সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এডহক ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের আপিলবিভাগে একজন বিচারক নিয়ােগ করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি এডহক ভিত্তিতে একজনের বেশি বিচারক নিয়ােগ দিতে পারেন না। এ-কারণে শেখ মুজিব হত্যা মামলার শুনানি সম্ভব হচ্ছে না।”
মন্ত্রী আরাে বলেন : ‘মূল সংবিধানে এডহক বিচারক নিয়ােগে কোনাে সংখ্যা বেঁধে। দেয়া ছিল না। কিন্তু ১৯৭৮ সালের সংশােধনীতে সংখ্যা একজনে সীমিত করা হয়।’
* জনকণ্ঠ, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০২ বাংলাদেশের রাজনীতি – ২৩
মুজিব হত্যা মামলার শুনানি গ্রহণের জন্য অতিরিক্ত অস্থায়ী (এডহক) বিচারক নিয়ােগ প্রশ্নে সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর উপযুক্ত ব্যাখ্যা অনেকের কাছেই গ্রহণযােগ্য নয়। মামলার বাদি রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম আইনজীবী এডভােকেট আনিসুল হক ‘এডহক ভিত্তিতে একজনের বেশি বিচারপতি নিয়ােগ করা যায় না বলে আইনমন্ত্রী সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের যে ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে তিনি একমত নন বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে ৯৮ অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপ :
এই সংবিধানে ৯৪ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সত্ত্বেও প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ। করিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সুপ্রিমকোর্টের কোনাে বিভাগের বিচারক-সংখ্যা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি করা উচিত বলিয়া সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে তিনি যথাযথ যােগ্যতাসম্পন্ন এক একাধিক ব্যক্তিকে অনধিক দুই বৎসরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা তিনি উপযুক্ত বিবেচনা করিলে হাইকোর্ট বিভাগের কোনাে বিচারককে যে কোনাে অস্থায়ী মেয়াদের জন্য অপিলবিভাগে আসন গ্রহণের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন; তবে শর্ত থাকে যে, অতিরিক্ত বিচারকরূপে নিযুক্ত কোনাে ব্যক্তিকে এই সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদের অধীনে বিচারকরূপে নিযুক্ত হইতে কিংবা বর্তমান অনুচ্ছেদের অধীনে আরও এক মেয়াদের জন্য অতিরিক্ত বিচারকরূপে নিযুক্ত হইতে বর্তমান অনুচ্ছেদের কোনােকিছুই নিবৃত্ত করিবে না।
উক্ত বিধানমতে, সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে রাষ্ট্রপতি ‘সুপ্রীমকোর্টের কোনাে বিভাগের’ অর্থাৎ হাইকোর্ট বা আপিল যে-কোনাে বিভাগের বিচারক-সংখ্যা সাময়িকভাবে বৃদ্ধি করার জন্য যথাযথ যােগ্যতাসম্পন্ন এক একাধিক ব্যক্তিকে অনধিক দুই বছরের জন্য অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করিতে পারিবেন। তাছাড়া তিনি উপযুক্ত বিবেচনা করিলে হাইকোর্ট বিভাগের কোনাে বিচারককে (সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। এক বা একাধিক হতে পারে) যে কোনাে অস্থায়ী মেয়াদের জন্য (মেয়াদকাল নির্দিষ্ট নয়, রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নির্ধারিত) আপিলবিভাগে’ নিযুক্ত করতে পারবেন। অর্থাৎ যথাযথ যােগ্যতাসম্পন্ন এক একাধিক ব্যক্তিকে অনধিক দুই বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি সরাসরি আপিলবিভাগেও বিচারক নিযুক্ত করতে পারবেন। মিজানুর রহমান খানের মতে,
সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর পর ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবিধানে ৯৮ অনুচ্ছেদের ইংরেজি ভাষ্যে দেখা যায়, হাইকোর্ট বিভাগের কোনাে বিচারককে কথাটির যথার্থ ইংরেজি তরজমা বিধৃত হয়েছে may require a judge’। এই a বর্ণ সংখ্যাবাচক নয়, ইংরেজী ভাষারীতির অংশ। ১৯৭৮ সালের সামরিক ফরমান বলে এই অনুচ্ছেদটির প্রয়ােজনীয় সংশােধন করা হয়। এর ফলে অনুচ্ছেদটি আরাে স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন হয়েছে। এমনটা বলার কোনাে অবকাশ নেই যে, মূল সংবিধানে বর্ণিত হাইকোর্ট বিভাগের কোনাে বিচারককে’ কথাটির পর ১৯৭৮ সালে ‘একজন এডহক বিচারক
হিসাবে’ কথাটি জুড়ে দিয়ে সংখ্যা-সম্বন্ধীয় কোনাে বিধিনিষেধ আরােপ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মূল সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদে এডহক’ বলে কোনাে শব্দই ছিল। তাই মূল সংবিধানে এডহক বিচারক নিয়ােগে কোনাে সংখ্যা বেঁধে দেয়া ছিল না আইনমন্ত্রীর এই উক্তিটি যেমন যথার্থ নয় তেমনি ১৯৭৮ সালের সংশােধনীতে সংখ্যা। একজনে সীমিত করা হয় অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি (আপিলবিভাগে) এডহক ভিত্তিতে। একজনের বেশি বিচারক নিয়ােগ দিতে পারেন না তার এই দাবিও গ্রহণযােগ্য নয়। | ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংবিধানের অনেক বিধান ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রণীত বিভিন্ন আইন বিশেষ করে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন থেকে সরাসরি। বা ‘ভাব’ হিসেবে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদও এর ব্যতিক্রম নয়। ১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইনের ২২২ নম্বর ধারায় বলা হয়, যদি কখনও যে-কোনাে কারণেই হাইকোর্টের বিচারকের সাময়িক শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তখন গভর্নর জেনারেল উপযুক্ত যােগ্যতাসম্পন্ন কোনাে ব্যক্তিকে একজন বিচারক হিসেবে নিয়ােগ করতে পারবেন (Governor General may appoint a parson)। এখানে a person অর্থ একজন মাত্র ব্যক্তিকে নয়। এই a হল any বা কোনাে ব্যক্তিকে। পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ১৫৪ অনুচ্ছেদ, ১৯৬২ সালের সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদ, ভারতের সংবিধানের ১২৭(১) ও ২২৪ (২) অনুচ্ছেদ। এমনকি বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের (ইংরেজি তর্জমায়) ‘a judge বলতে কোনাে বিচারক বােঝানাে হয় , সিঙ্গুলার অর্থে নয়। সাবেক এটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম তার কনস্টিটিউশনাল ল’ অব বাংলাদেশ গ্রন্থেও ৯৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যায় একজন বিচারককে সিঙ্গুলার নয়, পুরাল অর্থে অর্থাৎ হাইকোর্টের কোনাে বিচারককে এডহক বিচারক হিসেবে নিয়ােগের কথা বলেছেন। এখানে একজন মানে one নয়। উল্লিখিত সকল ক্ষেত্রেই যেখানে a ‘কোন বা পুরাল’ (একাধিক) অর্থে ব্যবহৃত হয় তবে ৯৮ অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে একই বাক্য বিন্যাস দ্বারা কেন আইন ও সংসদ মন্ত্রীর ব্যাখ্যানুযায়ী সংখ্যাবাচক একজন (one) বােঝাবে তা বােধগম্য নয়। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য আদালতের শরণাপন্ন। হতে বলেছেন। মামলার বাদি হিসাবে রাষ্ট্রপক্ষেরই তা করা উচিত। এমনকি সরকার। আপিলবিভাগের কাছে এতদসংক্রান্ত উপদেষ্টামূলক মতামতও চাইতে পারে।
মিজানুর রহমান খানের ভাষায় রাষ্ট্র তার প্রধান স্থপতির হত্যার ন্যায়বিচারকে ত্বরান্বিত করতে আগ্রহী কিন্তু সংবিধান তাকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে -এই বার্তা বিশ্ববাসীকে
* মিজানুর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা শাসনতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ নয় (নিবন্ধ), যুগান্তর, ২৪।
সেপ্টেম্বর ২০০২ ১৭ মিজানুর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা : শাসনতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ নয় (নিবন্ধ), পূর্বোক্ত ” মিজানুর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা : শাসনতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ নয় (নিবন্ধ), পূর্বোক্ত
দেয়া কোনাে গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য গৌরবজনক হতে পারে না। আর প্রকৃতই যদি সংবিধান এক্ষেত্রে বাধা হয়ে থাকে তবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্তমান সরকার তা সংশােধন করতে পারে। কিন্তু যারা চালু সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়াস পায়, তারা সংবিধান সংশােধন করবে -এ বােধহয় অরণ্যে রােদন। | মুজিব হত্যার পর মােশতাক, জিয়া, এরশাদ ও খালেদা ক্ষমতায় এসেছেন। হত্যার বিচার না হওয়ার জন্য মােশতাক নিজের ও অন্যান্য খুনীদের জন্য নিরাপত্তাপ্রতিবিধান (ইনডেমনিটি) আদেশ জারি করেন; জিয়া তা ‘সাংবিধানিক আইনে’ (পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে) পরিণত করেন এবং এরশাদ ও খালেদা তা বহাল রাখেন। জিয়া খুনীদের চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করেন এবং এরশাদ ও খালেদা তা বহাল রাখেন। খালেদা ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল করেছেন, পতাকা অর্ধ নমন বেআইনি করেছেন, সরকারি অফিস থেকে মুজিবের প্রতিকৃতি অপসারণ করেছেন, পাঠ্য পুস্তক থেকে তাকে হেঁটে ফেলেছেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তার নাম বিয়ােগকরণ অব্যাহত রেখেছেন। উল্লিখিতদের কেউ কেউ মুজিব হত্যার সাথে জড়িত এবং সবাই এ হত্যার সুফলভােগী। বােধগম্য কারণে তারা ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর হত্যার বিচারে উদ্যোগ নেয়নি। খুনীদের নিরাপত্তা-প্রতিবিধান আদেশ বাতিলে সহযােগিতা করেনি। অবশেষে বিচারের শেষ পর্যায়ে সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিলবিভাগে প্রয়ােজনীয় অতিরিক্ত/অস্থায়ী বিচারপতি নিয়ােগ না দিয়ে বিচারকে অহেতুক প্রলম্বিত করছে। তবে বিচারকে তারা চিরতরে বন্ধ রাখতে পারবে না। তারা ইতােমধ্যে প্রমাণ। করেছে, এ মামলা শুধু আদালতে বিচার্য বিষয় নয়, এ তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট এবং এ বিষয়ে ক্রমশই তাদের হীন-উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বিচারকদের ‘তি’ ফোবিয়া এই মামলা নিষ্পত্তিতে অন্যতম বাধা হল বিচারপতিদের একের-পর-এক ব্ৰিত বােধ করা। ‘আবেগ বা বিরাগের বশবর্তী হইব না ‘ বলে শপথ নেয়ার পর বিচারপতিদের ব্রিত বােধ করার সুযােগ নেই। তবু কেন তারা তি হয়েছেন তার কারণ অনুসন্ধান করা মিজানুর রহমান খানের ভাষায় হয়তাে অনেক বেশি ব্রিতকর’। সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের ভাষায় :
সাধারণত বিচারকরা বিব্রত বােধ করেন সেসব মামলায়, যেসব মামলা আইনজীবী থাকাকালীন তারা পরিচালনা করেছেন অথবা যে-সব মামলায় তাঁদের কোনাে আত্মীয় বা বিশেষ বন্ধুবান্ধব জড়িত। অথবা কোনাে না কোনােভাবে বিচারকরা সে মামলায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এছাড়া কোনাে বিচারপতি কোনাে মামলা গ্রহণ করতে অস্বীকার করতে পারেন না।”
১২ মিজানুর রহমান খান, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা : শাসনতান্ত্রিক পথ রুদ্ধ নয় (নিবন্ধ), পূর্বোক্ত * বিচারপতি লতিফুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিনগুলি ও আমার কথা, প্রকাশক আয়েশা
রহমান, ঢাকা, ২০০২, পৃষ্ঠা ৫৩
এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হয়ে মামলার অন্যতম কৌসুলী আনিসুল হক দুটি উদাহরণ দেন। এরশাদের অস্ত্র মামলায় বিচারপতি নঈমুদ্দিন ও শেখ হাসিনার আদালত অবমাননা মামলায় বিচারপতি আমিরুল ইসলাম বিব্রতবােধ করলে তল্কালীন প্রধান বিচারপতি মামলা দু’টি সংশ্লিষ্ট ব্রিত’ বিচারপতিদেরকেই শুনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।” লতিফুর রহমানও লিখেছেন :
| যখন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি করতে বেশিরভাগ প্রবীণ বিচারক বিব্রতবােধ করলেন, তখন কাউন্সিলের মনে হল, বিচারকরা মামলা শুনতে অনীহা দেখাচ্ছেন ও তাদের দায়িত্ব এড়াচ্ছেন। … তাছাড়া বিচারক যখন কোনাে মামলার শুনানি করতে চান না, তখন তার সঠিক কারণ প্রধান বিচারপতির জানা প্রয়ােজন বলে আমি মনে করি। বিচারকের সৎসাহস থাকা একান্ত প্রয়ােজন।”
প্রধান বিচারপতি থাকাকালে বিচারপতি লতিফুর রহমান এটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম ও প্রধান কৌসুলী সিরাজুল হকের দরখাস্তের প্রেক্ষিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের জন্য দু’টি কোর্ট গঠন করে মুজিব হত্যা মামলার বিচার সামনে এগিয়ে এনে তা নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি এম, এম. রুহুল আমীন ও বিচারপতি মােহাম্মদ মতিনের কোর্টে প্রেরণ করেন। তারপর, তাঁর ভাষায় :৬।
আশ্চর্যের বিষয় ঐদিন বেলা ৩টায় সময় ঐ মামলার নথি আমার কাছে ফেরত আসে। নথির অর্ডার বইয়ে লেখা ছিল যে, দুজন বিচারকই বিব্রতবােধ করছেন। সাধারণ নিয়মে মামলা আদালতে তালিকাভুক্ত না হলে কোনাে বিচারক বিব্রতবােধ করতে পারেন না। আমার জানামতে সুপ্রিমকোর্টের এমন কোনাে পূর্ব-নজির নেই যেখানে মামলা তালিকাভুক্ত হবার আগেই বিচারকরা ব্রিতবােধ করেছেন। আমার মনে হল দু’জন বিচারক হয়তাে মামলাটি পরিচালনা করতে সাহস পাচ্ছেন না।
তারপর প্রধান বিচারপতি দু’জন জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে (কে এম হাসান ও মাে. গােলাম রাব্বানী) মৌখিকভাবে মামলাটির শুনানি গ্রহণ করার অনুরােধ করলে তারা কেউই রাজি হননি। তারা কেন অরাজি বা ব্ৰিত হলেন, নজির থাকার পরও কেন ব্ৰিত বিচারকদের মামলা টি শুনতে বাধ্য করা হলনা, তা জানা সত্যিই ব্রিতকর’। অতঃপর তার বিচারকের সংখ্যা বাড়ানাের প্রচেষ্টাও সরকারি মহলের রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা প্রাধান্য পাওয়ায় ফলবতী হয়নি। সুপ্রিমকোর্ট সম্পর্কে অসতর্ক মন্তব্য, লাঠি মিছিল, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে আপিলবিভাগে বিচারপতি নিয়ােগ, শেখ হাসিনার সরকারের আমলের এসব কাজও এক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যা হােক, অবশেষে বিচারপতি রুহুল আমিন ও বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের কেটে এর
১৯ এবিএম মূসা, বিচারের জটিল আবর্তে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা (নিবন্ধ) * বিচার লতিফুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিনগুলি ও আমার কথা, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪ * বিচার লতিফুর রহমান, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দিনগুলি ও আমার কথা, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৬৬-৬৭
বাংলাদেশের রাজনীতি
শুনানী হয়ে বিভক্ত রায় হয়। এখন এ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি কবে হবে-তা কেউ বলতে পারে না। | উল্লেখ্য, প্রথম আলাের প্রতিবেদক শহীদুজ্জামানের আশঙ্কাকে সত্যে পরিণত করে ১৬ জুলাই ২০০১ থেকে ঝুলে থাকা মামলার ডেথ রেফারেন্স ২০০৩ সালের নভেম্বর পার হওয়ার পরও ঝুলেই আছে। ইতােমধ্যে শুনানির যােগ্য প্রধান বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরী ও বিচারপতি মাে. ফজলুল হক এবং বিচারপতি মােহাম্মদ গােলাম রাব্বানী (খুনী বজলুল হুদার কৌসুলী কর্তৃক অনাস্থা জ্ঞাপিত) অবসর গ্রহণ করেছেন এবং তাদের শূন্যপদে বিচারপতি এম. এম. রুহুল আমিন, বিচারপতি মাে. হামিদুল হক ও বিচারপতি মাে. তােফাজ্জল ইসলাম যােগদান করেছেন। কিন্তু বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন পূর্বেই বিব্রত হওয়ায় এখনও শুনানির যােগ্য বিচারকের সংখ্যা সেই দুই জন। তবে ২০ ডিসেম্বর ২০০৩ ও ২৭ জানুয়ারি ২০০৪ যথাক্রমে বিচারপতি মাে. হামিদুল হক ও প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান অবসর গ্রহণ করলে তাদের শূন্যপদে নতুন শূনানীর যােগ্য বিচারক নিযুক্ত হলে এবং তারা ব্ৰিত রােগে আক্রান্ত না হলে ২৭ জানুয়ারি ২০০৪-এর পর যে কোন সময় মামলার। কার্যক্রম পূন: শুরু হতে পারে। | বিলম্বন ঘটানাে বিচার অস্বীকার করার নামান্তর হলেও, না হওয়ার চেয়ে বিলম্বে হওয়াও ভাল। যত বিলম্বই হােক, সত্য প্রতিষ্ঠিত হবেই।

Previous