This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫
হালিম দাদ খান
কথামুখ
১ মার্চ ১৯৭১ সােমবার দুপুর ০১-০৫ মি. রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার বিবৃতি শুনে সারাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দলে দলে মানুষ অফিস-আদালত, কল-কারখানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান বনাম বিশ্ব-একাদশের ক্রিকেট খেলা ফেলে হাজার হাজার দর্শক ‘জয় বাংলা’ বলে রাস্তায় নেমে আসে। শহরের সকল অলিগলি থেকে বিক্ষুব্ধ খণ্ড খণ্ড মিছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পল্টনে এসে জমায়েত হয়। মিছিলকারীদের হাতে বিভিন্ন ধরনের লাঠি ও লােহার রড, মুখে স্লোগান বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।’ পল্টনের জনসমুদ্রে অন্যতম বক্তা তােফায়েল আহমদ বলেন, “আর ৬ দফা, ১১ দফা নয়, এবার বাংলার মানুষ ১ দফার সংগ্রাম শুরু করবে। মুজিব আগেই ‘ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা অনুমান করেছিলেন। এদিন বেলা সাড়ে চারটায় হােটেল পূর্বাণীতে আয়ােজিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ‘অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ঘােষণা দেন এবং ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালনের আবেদন জানান। হাই কমান্ড গঠন আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের পক্ষ থেকে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি গ্রহণের জন্য মুজিবকে ‘সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়। নীতিনির্ধারণী বিষয়াদি ঠিক করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, তাজউদ্দিন আহমদ ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে নিয়ে দলীয় হাই কমান্ড গঠন করা হয়। তাজউদ্দিন আহমদকে কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ড, কামাল হােসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে করা হয় তার সাহায্যকারী। ইতােপূর্বে ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এবং দলের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের যৌথ সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নেতা’, ১. সৈয়দ আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কাগজ প্রকাশনা, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৪
নজরুল ইসলামকে ‘উপনেতা’, অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ‘চীফ হুইপ’ এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে সংসদীয় দলের সচিব নির্বাচিত করা হয়। প্রাদেশিক পরিষদের নেতা’ নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। অসহযােগ ও পতাকা উত্তোলন অকল্পনীয়ভাবে অসহযােগ আন্দোলন চলতে থাকে। ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্সের (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসভায় আনুপূর্বিক ঘটনাবলির বর্ণনা করে মুজিব দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’ ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ ৩৫-দফা নির্দেশ জারি করেন। বস্তুত এই নির্দেশাবলির মাধ্যমে মুজিব বাংলাদেশের সর্বময় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২৩ মার্চ লাহাের প্রস্তাব স্মরণে পাকিস্তান দিবসে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে প্রতিরােধ দিবস পালন করা হয় এবং মুজিবের বাসভবনসহ সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ইয়াহিয়ার সাথে ১৬ মার্চ শুরু হওয়া আলােচনার ‘অগ্রগতি নিষ্ফল বর্ণনা করে ২৪ মার্চ তাজউদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আলােচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।’ ২৪ মার্চ বিকাল থেকে ২৫ মার্চ রাত ১০টা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সাক্ষাৎ করতে আসা সকলকে মুজিব ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। আগত প্রায় প্রত্যেকের সাথে তিনি তার পেছনের ঘরে ১ মিনিট করে কথা বলেন এবং একে একে সকলকে বিদায় দেন। ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা তাকে আত্মগােপনের অনুরােধ করার জবাবে তিনি বলেন: আমাকে নিয়ে তােরা কোথায় রাখবি? বাংলাদেশে আত্মগােপন সম্ভব নয় (আত্মগােপনে তিনি অভ্যস্তও নন)। আমার হয়তাে মৃত্যু হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।
২. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০১, পৃষ্ঠা ২৯৯
৩. মুজিবের নির্দেশে ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দীকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহাজান সিরাজ এবং ডাকসুর সহ-সভাপতি আসম আব্দুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদুস মাখন -এই চার নেতা মিলে ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। অন্যরা প্রস্তাব করা সত্ত্বেও ১১দফা খ্যাত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদকে সক্রিয় করা বা অন্যান্য ছাত্র নেতাদের নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার প্রস্তাব গ্রহণ না করে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব সংকীর্ণতার পরিচয় দেয়। মুক্তিযুদ্ধের পর নানা অপকর্মের জন্য এরা চার খলিফা ‘ আখ্যা পেযে উপহাসের পাত্র হন কয়েকজন উৎসাহী ছাত্রলীগ কর্মীর উদ্যোগে নিউমার্কেটের ‘এপােলা থেকে কাপড় কিনে ‘পাক ফ্যাশানের ‘ জনৈক অবাঙালি দর্জিকে দিয়ে একটি পতাকা তৈরি করা হয়। সবুজ জমিনে লাল। বৃত্তের মাঝে বাংলাদেশের হলুদ মানচিত্র খচিত পতাকাটির নকশা করেন শিল্পী শিবনারায়ন দাশ। ২। মার্চ বটতলার ছাত্রসভায় যােগদানকারী একটি মিছিলে স্বত:স্ফূর্তভাবে এটি বহন করা হয় এবং জনতার উৎসাহে মঞ্চে তুলে প্রদর্শন করা হয়। এ আদলেই পরে স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি হয়। আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯
শহরের অবস্থার বর্ণনা শুনে তিনি বলেন : আমার কাছে সব খবর আছে। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছাড়ার পরই আক্রমণ শুরু হবে। আমি বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে হানাদাররা আমার জন্য ঢাকা শহরের সকল লােককে হত্যা করবে। আমার জন্য আমার জনগণের জীবন যাক-এটা চাই না।’ মার্চের প্রথম থেকেই মুজিব সশস্ত্র সংগ্রামের সমূহ সম্ভাবনা দেখতে পান এবং ১৯। মার্চ তিনি ও কর্নেল ওসমানী আলােচনা করে এর খুঁটিনাটি দিক প্রস্তুত করেন।’ একথা বলা হলেও বাস্তবে সশস্ত্র সংগ্রাম বা স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে মুজিব বা আওয়ামী লীগের কোনাে প্রস্তুতি ছিল না। ২৫ মার্চ রাতে পুরনাে ঢাকার একটা বাড়িতে সকলের প্রকত্রিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার বাসভবন থেকে বাইরে আসতে রাজি না হওয়ায় সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায় এবং একইসাথে তার সাথে অন্যান্যদের যােগাযোেগও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই মুহূর্তে তােমরা আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাও। আর তােমাদের দায়িত্ব তােমরা পালন করবে। মুজিবের এই শেষ আজ্ঞা শিরােধার্য করে ব্যারিস্টার আমীরউল ইসলাম ও ড. কামাল হােসেন তাদের দলনেতা’ তাজউদ্দিনের বাসায় আসেন। তাজউদ্দিন আত্মগােপনে ইতস্তত করছিলেন। ভগ্ন মনােরথ হয়ে বাড়িতে বসেছিলেন নিজেকে ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে। পরনে লুঙি, গায়ে পাঞ্জাবি, পায়ে কাপড়ের জুতাে, এক কাধে ঝােলানাে ব্যাগ ও অন্য কাধে একটি রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে এলেন তাজউদ্দিন। শুরু হল অনিশ্চিত যাত্রা। ধানমণ্ডির (তৎকালীন) ১৫ নম্বর সড়কের কাছাকাছি এলে আত্মীয়ের বাসায় থেকে যাওয়ার ইচ্ছায় ড. কামাল গাড়ি থেকে নেমে যান (একক সিদ্ধান্তে এই নেমে যাওয়াতেই তিনি গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানে কারাগারে নীত হন)। তাজউদ্দিন ও আমীর-উল লালমাটিয়ায় রেলওয়ের এককালের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যায়। অপারেশন সার্চলাইট’ এবং পরদিন কাফু। | ২৭ মার্চ ‘পথই ঠিকানা, পথই গন্তব্যে পৌঁছে দেবে’ ভেবে, উভয়ে রায়ের বাজার দিয়ে নদী পার হয়ে, হেঁটে নবাবগঞ্জ পৌছেন। পরদিন তারা মােটরসাইকেল যােগে পদ্মার পাড়ে, এর পরদিন নৌকায় পদ্মা পার হয়ে ঘােড়ায় চড়ে ফরিদপুর, সেখান থেকে রিক্সা-বাস ও হেঁটে মাগুরা এবং এর পরদিন জিপযােগে তারা সােহরাব হােসেনসহ ঝিনাইদহ পেীছেন; এরপর চুয়াডাঙ্গা হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। চলার পথে পদ্মার পাড়ের আগারগাঁওয়ে রাত্রিযাপনকালে স্বাধীনবাংলা বেতারে স্বাধীনতার ঘােষণা শুনতে পান। মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, যশাের প্রভৃতি স্থানে প্রতিরােধআন্দোলন দেখতে পান। স্থানে স্থানে তারা বৈঠক করে মনােবল ও সংগ্রাম জোরদার করার প্রয়াস পান। অবস্থাদৃষ্টে তাদের মনে হল, সারা বাংলায় গণযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
৪. আমীর-উল-ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস চতুর্থ খন্ড (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), গ্রন্থলােক, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ১২৩
দেন। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা এবং একটি বেতারস্টেশন স্থাপনের বিষয় আলােচনা হয়। নেতাদের খােজখবর নেয়ার জন্য একটি ছােট বিমানের ব্যবস্থা করা হয়। যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য জেনারেল (অব.) নগেন্দ্র সিংকে দায়িত্ব দেয়া হয়। | দিল্লিতে বসেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের একটি ভাষণ রচনা ও টেপ করা হয়। ৮ এপ্রিল কলকাতা ফিরে এসে তারা দেখতে পান, ততদিনে বেশ কিছু দলীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধি এখানে এসে পৌঁছেছেন। কলকাতা পৌছেই তারা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের আভাস পেলেন। এ-কথা রাষ্ট্র হয়ে গিয়েছিল যে, তাজউদ্দিন নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী পরিচয় দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সরকার গঠনের সংবাদে ‘অসন্তুষ্ট’ দলীয় নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিদের এক বৈঠক ইতােমধ্যে কামারুজ্জামানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সাধারণ অভিমত, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্যই দিল্লি যাওয়া হয়েছে। এত তাড়াহুড়া করে দিল্লি না গিয়ে নেতাদের বিশেষ করে হাইকমান্ডের সদস্যদের আসার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল। তাছাড়া তাজউদ্দিনের স্ব-উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর পরিচয় দান উচিত হয়নি। শহরের বিভিন্ন স্থানে গ্রুপে-গ্রুপে এ-আলােচনা হচ্ছে যা তাজউদ্দিনের জন্য খুবই বিব্রতকর। তাজউদ্দিন ও আমীর-উল কামারুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করলে তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেন এবং সেজন্য রাতে লর্ড সিনহা রােডে। একটি বৈঠক বসে। শেখ ফজলুল হক মণি তার বক্তৃতায় বলেন : স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রু শিবিরে বন্দি, বাংলার যুবকেরা বুকের তাজা। রক্ত দিচ্ছে, এখন কোনাে মন্ত্রিসভা গঠন করা চলবে না। মলি মন্ত্রি খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। এই যুদ্ধ পরিচালার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে।”
উপস্থিত প্রায় সকলই শেখ মণির বক্তব্য সমর্থন করেন। বক্তব্যটি যেহেতু তাজউদ্দিনকে উদ্দেশ করে, তাই তাঁর পক্ষে পাল্টা জবাব দেয়া শােভন নয় ভেবে আমীর-উল ইসলাম তাদের দিল্লি যাওয়ার সমর্থনে ও শেখ মণির বক্তব্যের বিপক্ষে যুক্তি পেশ করে বলেন : দিল্লি যাত্রার পূর্বে আমাদের জানা ছিল না কারা বেঁচে আছেন এবং কাকে কোথায় পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় যুক্তি হলাে, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দিন ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলেছেন। দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলার এখতিয়ার তাজউদ্দিন ভাইয়ের রয়েছে। তাছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রাথমিক আলােচনা হয়েছে মাত্র। ভবিষ্যতে আরও আলােচনা হবে। তখন দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হবেন। তৃতীয়ত, আমরা বঙ্গবন্ধুর নিয়ােজিত হাইকমান্ড নিয়ে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের পরিকল্পনা করেছি মাত্র।
১০ আমীর-উল-ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০
আমি আরও বললাম, বাংলাদেশ বারাে ভূঁইয়ার দেশ। বারােটি বিপ্লবী কাউন্সিল গড়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। আমাদের অবশ্যই আইনগত সরকার দরকার। কেননা, আইনগত সরকার ছাড়া কোনাে বিদেশী রাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার সুযােগ খুব কমই হয়েছে। স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার অধিকার একটি আন্তর্জাতিক নীতি। যে কোনাে জনগােষ্ঠীর, তাদের নির্বাচিত সরকার দ্বারা শাসিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের সে গণতান্ত্রিক অধিকারের অবমাননা করেছে। তাই আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার হরণই হচ্ছে জনগণের অধিকার হরণ। শেখ মণির বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য দুটি যুক্তি দিলাম। শেখ মণির প্রস্তাবিত বিপ্লবী কাউন্সিল যদি বিভিন্ন মতাবলম্বীরা দুইটি, পাঁচটি বা সাতটি গঠন করে তাহলে জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধারা কোনটির আদেশ মেনে চলবে না। কোন্ কাউন্সিলের সাথে বিদেশের সরকার সহযােগিতা করবে? এই ক্ষেত্রে একাধিক কাউন্সিল গঠনের সম্ভাবনাই নয় কি? সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকারই হচ্ছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আজকে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে অন্য কোনাে বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হলে জনগণের মৌলিক অধিকারকে অবমাননা করা হবে। সেটা নিশ্চয়ই আমাদের উদ্দেশ্য নয়।” আমীর-উল ইসলামের বক্তব্যের পর মিজান চৌধুরী ও শেখ মণি ছাড়া উপস্থিত সকলে তাদের পূর্বের মনােভাব পরিবর্তন করেন। কামারুজ্জামান আমীর-উলকে ডেকে শেখ মণির কথা অনুযায়ী বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা যায় কিনা পুনঃ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে আমীর-উল ‘তা করা হলে যুদ্ধ বিপন্ন হবে’ বলায় তিনি আর কোনাে প্রতিবাদ করেননি। সর্বশেষে তাজউদ্দিন বক্তৃতা দেন। উপস্থিত সকলে সরকার গঠন সংক্রান্ত তার বক্তব্য মেনে নেন। একটি বড় বিপর্যায়ের হাত থেকে মুক্তিযুদ্ধ রক্ষা পায়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী দলীয় নেতৃবৃন্দের খোঁজে ১০ এপ্রিল বিমানযােগে বিভিন্ন অঞ্চল সফরের ব্যবস্থা করা হয়। বিমানটি ছিল খুবই ছােট। ৫/৬টি আসন। তাতে চড়েই তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, শেখ মণি, তােফায়েল আহমেদ, আমীর-উল ও নগেন্দ্র সিং আগরতলা রওনা হন। বিকালে বাগডােগরা বন্দরে বিমান থেকে নেমে জিপে সকলে শিলিগুড়ি যান। শহর থেকে অনেক দূরে সীমান্তের খুব কাছে একটি বাংলােতে গােলক মজুমদার তাদের অভ্যর্থনা জানান। এখানে কোনাে একটি জঙ্গল থেকে গােপন বেতারকেন্দ্রের মাধ্যমে তাজউদ্দিনের ঐ টেপকৃত ভাষণ প্রচারিত হবে। এ সময় তােফায়েল আহমদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শেখ মণি কিছু নির্দেশ সহ তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন। মনসুর আলীও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তার সাথে এ-সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে আমীর-উল আলােচনা করেন। ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে প্রকৃত প্রস্তাবে
১১. আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪১-৪২
তিনিই প্রধানমন্ত্রী পদের স্বাভাবিক দাবিদার। অপর একটি সূত্রমতে, আনুপূর্বিক ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করে মনসুর আলী অভিমত দেন যে, ‘তাজউদ্দিন আহমদের রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিকতা সঠিক হয়নি। তবু বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীরূপে তাজউদ্দিনকে মেনে নেয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। আমীর-উলকে তার মত জানিয়ে মনসুর আলী বলেন, তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি কোনাে আপত্তি করবেন না। হাই কমান্ডের পাঁচজনের মধ্যে তিনজন সম্মত হওয়ায় ধারণা করা হয়, তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীরূপে মেনে নিতে প্রস্তাবিত উপ-রাষ্ট্রপতি তথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আপত্তি করবেন না। আর চারজন একমত হলে খন্দকার। মােশতাককেও রাজি করানাে সম্ভব হবে। প্রধানমন্ত্রীর বেতার ভাষণ এবার প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারের পালা। রেকর্ডকৃত ক্যাসেট গােলক মজুমদারের কাছে দেয়া হল। তিনি তা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে চলে গেলেন। কিন্তু বাধ সাধলেন শেখ মণি। তিনি আগরতলা গিয়ে জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে বৈঠক করে সরকার গঠনের প্রস্তাব করেন। অন্যথায়, বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।” এরূপ অবস্থায় আবার এগিয়ে এলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। তার ভাষায়: আমি সরকার গঠনের পক্ষে পুনরায় যুক্তি দিলাম। আমি বললাম, সরকার গঠন করতে বিলম্ব হলে সংকট আরাে বৃদ্ধি পাবে এবং ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি। তাছাড়া সরকার গঠনের পরিকল্পনা তাে নতুন কিছু নয়। মনসুর ডাই ও কামারুজ্জামান ভাই তাজউদ্দিন ভাইকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও খন্দকার মােশতাক আহমদের তখনাে দেখা নেই। তারা কোথায়, কী অবস্থায় আছেন, সে খবর এখনাে আসেনি। ইতিমধ্যে বন্ধুরাষ্ট্রের সাথে আমাদের কিছুটা রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সরকার গঠনে বিলম্ব হলে তাও নস্যাৎ হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার গঠন করার ব্যাপারে ভারত-সরকারকে আমরা আশ্বাস দিয়েছি। তাতে বিলম্ব হলে আমাদের নেতৃত্ব সম্পর্কেও তারা সন্দেহ পােষণ। করবেন। আমাদের মধ্যে যে কোন্দল রয়েছে কোনাে অবস্থাতেই তা বাইরে প্রকাশ হতে দেয়া উচিত নয়। ভারত সরকারও জানেন, আমাদের বক্তৃতা শিলিগুড়ির এই জঙ্গল থেকে আজ প্রচারিত হবে। আমার এসব কথা শেখ মণি মানতে রাজি নন। বেশি করে বুঝাতে চাইলে শেখ মণি জানান, তারা বঙ্গবন্ধু থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অতএব তাদের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কারাে প্রশ্ন তােলা উচিত নয়। এ সময় তাজউদ্দিন ভাই আমাকে বলেন, আমি যেন গোলক মজুমদারকে জানিয়ে দেই যে, প্রধানমন্ত্রীর
১২. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৫ ১০ চিত্তরঞ্জন সূতার এই বেতার-বক্তৃতার প্রচার বন্ধ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ৪২ জন আওয়ামী লীগ ও যুব নেতার স্বাক্ষর সংবলিত একটি প্রতিবাদলিপি পাঠান ডি. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০১) আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৪ – ৪৫
বক্তৃতা আজ প্রচার করা হবে না। এ-ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত তাকে যথাসময়ে জানানাে হবে। গােলক মজুমদারকে ফোন করে জানাই যে আজ বক্তৃতা প্রচার করা হবে না। একথা শুনে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘বিলম্ব করা কি ঠিক হবে?’ তিনি বলেন, যে-মুহূর্তে সবকিছু ঠিক-ঠাক সে-মুহূর্তে তা স্থগিত রাখলে সব মহলে যে প্রশ্ন দেখা দেবে, তা আমরা ভেবে দেখেছি কিনা। ইতিমধ্যে রেকর্ড-করা ক্যাসেট নির্ধারিত স্থানে (জঙ্গলে) পৌছে গেছে। আমি গােলক মজুমদারকে বললাম, ক্যাসেট যদি পাঠিয়ে থাকেন তাহলে প্রচার করে দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই একটিমাত্র সিদ্ধান্ত এককভাবে নিয়েছিলাম। এই দিন ছিল দশই এপ্রিল। রেডিও অন করে রেখে খেতে বসেছি। খাওয়ার টেবিলে তাজউদ্দিন ভাই ও শেখ মণি আছেন। রাত তখন সাড়ে ন’টা। সেই আকাঙিক্ষত মুহুর্ত আসল। প্রথমে আমার কণ্ঠ ভেসে আসল। ঘােষণায় আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রচারিত হল। সারা বিশ্ববাসী শুনল স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বেতার-বক্তৃতা। আমাদের সংগ্রামের কথা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল।
পরদিন ১১ এপ্রিল খুব নিচু দিয়ে বিমান উড়িয়ে দু’দেশের সীমান্ত সংলগ্ন বন্দরে নেমে নেমে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের খোঁজ নিতে গিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নানকে পাওয়া যায় এবং সকলে আগরতলা পেীছেন। সীমান্তবর্তী বিমানবন্দরেই তাজউদ্দিন সৈয়দ নজরুলকে একান্তে গতদিনগুলাের ঘটনাবলি অবহিত করেন। তিনি সব জেনে খুশি হন এবং তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মােবারকবাদ জানান সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান পদে ওসমানীর দায়িত্ব গ্রহণ ইতােমধ্যে কর্নেল ওসমানী, খন্দকার মােশতাক, এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুস সামাদ আজাদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী সহ অনেক নেতাকর্মী আগরতলা এসে পৌঁছেছেন। সার্কিট হাউস পুরােটা বাংলাদেশীতে পূর্ণ। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং ভিন্ন একটি ঘরে অবস্থান করেন। ওসমানী এরই মধ্যে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন। তাকে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানাে হল। তিনি এর পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজসরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন।
১৪.. ২৫ মার্চ রাতে সৈয়দ নজরুল তার আত্মীয় ডা. আলীম চৌধুরীর বােনের পুরানা পল্টনের বাসায় আসেন। ২৯ মার্চ তাকে পরচুলা, শাড়ি ও বােরকা পরিয়ে অন্য আত্মীয় আহমেদ সাহেবের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি প্রথমে কিশােরগঞ্জে গ্রামের বাড়ি এবং পরে ভারত যান ১৫ আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮
মন্ত্রীসভা চূড়ান্তকরণ ও মুজিবনগরে শপথগ্রহণ। রাতে খাবারের পর নেতৃবৃন্দের বৈঠক শুরু হয়। খন্দকার মােশতাক খুবই মনঃক্ষুন্ন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার পদে প্রার্থী হিসেবে তার নাম প্রস্তাবিত ছিল।” নিজেকে তিনি সবসময় সিনিয়র আওয়ামী লীগার ভাবতেন। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। সেটার সম্ভাবনা নেই দেখে তিনি খেদের সাথে বলেন, তাকে যেন মক্কায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং মৃত্যুর পর লাশ যেন বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সারারাত ধরে শলাপরামর্শ চলে। অবশেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাওয়ার শর্তে তিনি মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হন। বৈঠকে ইতােমধ্যে নেয়া সকল পদক্ষেপ অনুমােদন দেয়া হয়। এ বৈঠককে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের প্রথম বৈঠক বলা যেতে পারে। এই বৈঠকের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভবিষ্যৎ। নেতৃবৃন্দ এ বৈঠকে ব্যক্তি ও গােষ্ঠীস্বার্থের উর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। ১৭ এপ্রিল দুপুরে মুজিবনগরে মন্ত্রীসভা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বর্ণনায় : কিছু লােক সেখানে (ছােট একটি মঞ্চে) দৌড়াদৌড়ি করে চেয়ার সাজাচ্ছে, অধিকাংশই হাতল ভাঙা, কাছাকাছি গ্রামের বাড়িগুলাে থেকে যােগাড় করে আনা। জায়গাটিকে ঘিরে রাইফেল আর এলএমজি হাতে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঁচিশ তিরিশজন সৈন্য, তাদের ঠিক মুক্তিবাহিনীর ছেলে বলে মনে হয় না, খুব সম্ভবত প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের একটি বিদ্রোহী বাহিনী।…। আশেপাশের গ্রাম থেকে ধেয়ে আসছে বিপুল জনতা। অস্ত্রধারী সেনাদের বৃত্ত ভেদ করে তারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে না বলে অনেকেই আমগাছগুলােতে চড়তে শুরু করেছে। মাহবুব উদ্দীন ও তওফিক এলাহী মতান্তরে ইপিআর-এর ৪ উইং-এর একটি সুসজ্জিত দল ক্যাপ্টেন মাহবুবুল হাসানের নেতৃত্বে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘােষণা পত্র ১৭. এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যকারী? (অনুবাদ সােয়দ করিম ও হাফিজুর রশিদ হীরন), শিখা প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ৬৬ মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার একটি আমবাগান। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন এ স্থানকে ‘মুজিবনগর নামকরণ করেন। পরে এ নামে উপজেলা হয়েছে। এই শপথানুষ্ঠান ১৪ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় হওয়ার কথা ছিল। চুয়াডাঙ্গাকে রাজধানী করার কথা প্রকাশ হয়ে পড়ায় ১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। এর পর মানচিত্র দেখে মুজিবনগরকে উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ব-পশ্চিম, দ্বিতীয় খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৮৫-৮৭। আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪ ও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ রাইফেলস’ স্মরণিকা ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৭-১৪ স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি ১০ এপ্রিল ১৯৭১ প্রকাশিত হয়। এর পূর্ণ বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট ১ পড়ুন
পাঠ করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের শপথবাক্য পাঠ করান। ভাষণ দেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান। দেশী-বিদেশী বহু সাংবাদিক অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন এবং কলকাতায় ফিরে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে এই সংবাদ পরিবেশ করে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ায় সহায়তা করেন। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র প্রকাশ ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের ভাষণ বেতারে প্রচার এবং ১৭ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সদস্যদের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ স্বাধীনতা সগ্রামকে একটি ভিত্তির উপর স্থাপন করায়। কিন্তু সরকার গঠনের বিরুদ্ধপক্ষও বসে থাকেনি। তারা তাজউদ্দিনের প্রতি অধিকাংশের সমর্থন নেই’ বলে অপপ্রচার করে। এই অবস্থায় শিলিগুড়ির জঙ্গলে ৫ ও ৬ জুলাই আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ ও দলীয় নেতাদের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সরকারের কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে খােলাখুলিভাবে বিস্তারিত আলােচনার পর মুজিবনগর সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের প্রতি আস্থা ও সমর্থন প্রকাশ করা হয়। এই সমর্থনের উপর ভিত্তি করেই তাজউদ্দিনের নেতৃতে মুজিবনগর সরকার যুদ্ধসহ যাবতীয় কাজ পরিচালনা করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশ শত্রুমুক্ত হয়।
দেশ গড়ার কার্যক্রম
হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। এর দু’দিন পর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব রুহুল কুদুস ও পুলিশ মহাপরিদর্শক আবদুল খালেক ঢাকায় পৌছে তাদের কার্যভার গ্রহণ করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সরকারের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর/কলকাতা থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ঢাকাবাসী তাদেরকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। পরদিন ২৩। ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকের মাধ্যমে শুরু হয় নতুন পথযাত্রা। অন্যদিকে শেখ মুজিবকে প্রাণদণ্ড দিলে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আর দেশে ফিরতে পারবে না’ আশঙ্কা করে মুজিবকে ২২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারের। কনডেমড সেল থেকে স্থানান্তরিত করে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। পরদিন তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে আনা হয় এবং ২৪ ডিসেম্বর জুলফিকার ভুট্টো তার সাথে সাক্ষাত করেন। ৬ জানুয়ারি ১৯৭২ মুজিবকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ৮ জানুয়ারি পিআইএ’র একটি বিমানে উঠিয়ে লন্ডন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১০ জানুয়ারি। তিনি লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকা পৌঁছেন। প্রিয়-নেতাকে এক নজর দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ জনতা বিমানবন্দর ও রাজপথে নেমে আসে। এরূপ জনসমাগম অভূতপূর্ব।
১. ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ মন্ত্রিপরিষদে সিদ্ধান্ত হয় যে, যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি শত্রুর অধীনে দখলকৃত এলাকায় চাকুরিরত ছিলেন, বিনাবিচারে তাদের শাস্তি দেওয়া হবে না। যুদ্ধকালে অফিস। ত্যাগ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারীগণ পূর্বপদে যােগদান করবেন এবং বর্তমানে কর্মরতরা “ওএসডি হবেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজ শুরু করার জন্য ১৭ ডিসেম্বর দেশের। ১৯টির সব কটি জেলায় ডেপুটি কমিনার ও পুলিশ সুপার(ইনটেনডেন্ট) নিয়ােগ করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর রােববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার আবেগ-আনন্দে আপুত সরকারি কর্মচারিগণ কাজে যােগদান করেন। মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য মন্ত্রিগণ হলেন এ.এইচ, এম, কামারুজ্জামান (স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন), ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী (অর্থ), খােন্দকার মােশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র ও আইন)। পরে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ শেখ আবদুল আজিজ, ফণিভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ ও জহুর আহমেদ চৌধুরীকে এবং ২৮ ডিসেম্বর অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা। হয়। ২৯ ডিসেম্বর তাদের দায়িত্ব বণ্টনকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব মােশতাকের পরিবর্তে সামাদ আজাদের উপর ন্যস্ত করা হয় এবং মােশতাককে করা হয় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন মন্ত্রী তৎকালীন তেজগাও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে পৌছতে তাকে বহনকারী গাড়িটির চার ঘণ্টা সময় লাগে।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২’ জারির মাধ্যমে দেশে বহু আকাক্ষিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন এবং পরদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী রাষ্ট্রপতি, শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য ১১ জন মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যাগমন ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। ২৩ নভেম্বর ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার কর্তৃক কৃত দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। পরদিন উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত এক চুক্তি মােতাবেক মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লে. জে, জগজিৎ সিং অরােরার কমান্ডে ন্যস্ত করা হয়। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের তাবেদার গভর্নর মন্ত্রিপরিষদসহ পদত্যাগ করে। পরদিন সন্ধ্যায় উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে সমবেত হয় তবে লে.জে. আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির অনুরােধে ১৫ ডিসেম্বর বিকাল ০৫-৩০ মি: থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ০৩-০০ মি: পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি পালন করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০-৪০ মি: যৌথবাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে এবং বিকাল ০৪-৫৫ মি: (ভারতীয় প্রমাণ-সময় ১৬-৩১ ঘন্টা) রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরের। মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটে। ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২-এর মধ্যে আত্মসমর্পণকারী ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দি সকলকে ভারতে স্থানান্তর করা হয়। এই যুদ্ধে। ১,৯৭৮ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত ও আহত হয় কয়েক হাজার। | যৌথবাহিনীর প্রধান জে, অরােরা ১৯ ডিসেম্বর প্রদত্ত এক ঘােষণায় বলেন, ভারতীয় বাহিনী প্রয়ােজনের অতিরিক্ত সময় বাংলাদেশে অবস্থান করবে না।’ ঢাকাসহ সর্বত্র ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশের মানুষ আন্তরিক স্বাগত জানায়। লন্ডন টাইমসের প্রতিবেদক পিটার হ্যাজেলহাস্টের ভাষায় : জনগণ ভারতীয় সৈন্যদেরকে তাদের ত্রাণকর্তা হিসেবে গ্রহণ করে এবং সৈন্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশ থাকায় তারা হতবুদ্ধিতার সাথে প্রায় সকল স্থান থেকে আসা।
৩. ১০ এপ্রিল ১৯৭১ বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক মুজিবনগরে জারিকৃত ‘স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র প্রদত্ত প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা’ বলে রাষ্ট্রপতি এই সংবিধান আদেশ জারি করেন। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হলেন ১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২, তাজউদ্দিন আহমদ ৩, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ৪. খােন্দকার মােশতাক আহমদ ৫. আবদুস সামাদ আজাদ ৬. এএইচ এম কামারুজ্জামান ৭, শেখ আবদুল আজিজ ৮. অধ্যাপক ইউসুফ আলী ৯, জহুর আহমদ চৌধুরী ১০, ফণিভূষণ মজুমদার ও ১১. ড. কামাল হােসেন আত্মসমর্পণ দলিলের জন্য দয়া করে পরিশিষ্ট ২ পড়ুন সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভাসানী (প্রথম খণ্ড), ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৩৯৯। এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? শিখা প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২ পৃষ্ঠা ৮৭
বিনামূল্যের উপহার এবং খাদ্য প্রত্যাখ্যান করে। নয় মাসের অভিজ্ঞতার পর বাঙালিরা প্রকাশ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পেশাধারী ঐতিহ্য ও যােগ্যতার প্রশংসা করে। সরকার তথা শেখ মুজিবের একটি বিরল কৃতিত্ব হলাে ভারতীয় বাহিনীকে অভাবিত অল্প সময়ের মধ্যে তাদের দেশে ফেরত পাঠানাে। পক্ষে বা বিপক্ষে, আমন্ত্রণ বা আক্রমণ যে কোন উপলক্ষে কোন বিদেশী সৈন্য একবার ঢুকে পড়লে এদের ফেরত পাঠানাে খুবই কঠিন, অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরােপের বিভিন্ন দেশে এর প্রমাণ রয়েছে। সেদিক থেকে, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হওয়ার আগেই, অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে মাত্র তিন মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনীকে ফেরত পাঠানাে ছিল এক অসাধ্য সাধন। | ১২ মার্চ ১৯৭২ ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতীয় বাহিনীর বিদায়ী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৫ মার্চের মধ্যে তাদের প্রত্যাগমন সম্পন্ন হয়। বিদায়ী শুভেচ্ছা বাণীতে মুজিব তাদের উদ্দেশ্যে বলেন। আমাদের মহাসংকটের সময়ে আপনাদের প্রসারিত সাহায্যকে আমরা সর্বদা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবাে। ইচ্ছা থাকলেও বাংলাদেশের জনগণ তাদের আতিথেয়তার হস্ত আপনাদের দিকে প্রসারিত করতে পারেনি। কারণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের কারণে তাদের (বাঙালিদের) আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আপনাদের প্রতি তাদের রয়েছে অকৃত্রিম ভালবাসা। আমার অনুরােধ, আপনারা বাংলাদেশের জনগণের ভালবাসা সাথে করে নিয়ে যান। কিন্তু দুঃখজনক যে, ভারতীয় বাহিনী তাদের সুনাম শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। ফিরে যাওয়ার সময় ভালবাসার সাথে তারা কিছু দ্রব্যসামগ্রীও নিয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে যশাের, কুমিল্লা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এবং খুলনার শিল্পাঞ্চলে লুটপাটের অভিযােগ উঠে। ভারতীয় বিশিষ্ট লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায়ও এ অভিযােগের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায় : ঢাকায় এতসব বিদেশী জিনিস পাওয়া যায়, এসব তাে আগে দেখেনি ভারতীয়রা। রেফ্রিজারেটর, টিভি, টু-ইন-ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার-এইসব ভর্তি হতে লাগলাে ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে।… এসব দ্রব্য-সামগ্রী ছাড়াও সাধারণ্যে প্রচারিত হয় যে, আত্মসমর্পণকৃত পাকিস্তানি বাহিনীর সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র ভারতীয় বাহিনী তাদের সাথে করে নিয়ে যায়। ১৭ জুন ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, এসব অস্ত্র ও গােলাবারুদের বৃহদাংশ ভারত ফিরিয়ে দিয়েছে। তবে এসব ফিরিয়ে দিলেও ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়ে
৮. এএল খতিব, কারা মজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৩-২৪
মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ২৪৫ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পূর্ব-পশ্চিম (দ্বিতীয় খণ্ড), আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, ভারত, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ৪৮৭
গেছে। দু’দেশের জনগণ এবং সরকারের মধ্যেও ভালবাসার লাল গােলাপে তা অবিশ্বাসের কীট হয়ে দেখা দেয়। আর স্বভাবজাত ভারত-বিদ্বেষীদের তৃণে তা যােগ করে নতুন শর। প্রয়ােজনের অতিরিক্ত একদিনও অবস্থান না করে বা অবস্থান বিলম্বিত করার কোন অজুহাত সৃষ্টি না করে ভারতীয় বাহিনী যেমন ধন্যবাদাহ, কৃত লুটপাটের জন্য (ফেরত দেয়া সত্ত্বেও) তেমনি তারা নিন্দাবাদাহও বটে। আর সবাই জানে যে, উপকার নয়, অপকারের কথাই মানুষের স্মৃতিতে অধিককাল স্থায়ী হয়।
২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ডি.পি, ধর বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সব ধরনের সহযােগিতা প্রদানের ঘােষণা দেন। প্রত্যুত্তরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক উভয় দেশের সম্পর্ক উত্তরােত্তর। ঘনিষ্ঠ হওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। এমনই আবহে ১৭ মার্চ ১৯৭২ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশেষভাবে নির্মিত একটি বিশাল নৌকার উপর সুদৃশ্য ইন্দিরা মঞ্চে তাঁকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা দেয়া হয়। ঢাকার রাজপথ ও সােহরাওয়ার্দী উদ্যান জনসমুদ্রে পরিণত হয়। ইন্দিরা ও মুজিব উভয়ে দু’দেশের গড়ে উঠা রক্তের রাখীবন্ধন অটুট রাখার প্রত্যয় ঘােষণা করেন। মাওলানা ভাসানী ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রীর চিরস্থায়ীত্ব কামনা করে বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯ মার্চ উভয় দেশের যুক্ত ঘােষণা প্রকাশিত হয় এবং ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত ও আওয়ামী’ বিরােধীরা বিশেষ করে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের সুবিধাভােগীরা এ চুক্তিকে ‘দাস-খত’, ‘গােলামী চুক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করলেও কেউ-ই তা বাতিল করেনি, এমনকি চুক্তির বিবরণ প্রকাশও করেনি। যথানিয়মে ২৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর এর মেয়াদ আর বাড়াননা হয়নি। চুক্তির বিবরণ পাঠে এর মধ্যে গােলামীর কোন শর্ত আবিষ্কার করা সম্ভব না হলেও রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্যে। এর যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ চলাকালে ভারতের সাথে বাংলাদেশ গােপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে বলেও অপপ্রচার চালানাে হয় যা তাজউদ্দিন দৃঢ়তার সাথে ১৩ জানুয়ারি ১৯৭৪ প্রত্যাখ্যান করেন। বর্ষাকালে বন্যা ও শীতকালে পানির দুষ্প্রাপ্যতা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য ‘যৌথ স্টাডি গ্রুপ’, ‘যৌথ নদী কমিশন’ প্রভৃতি গঠন করা হয়। সময় সময় মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৬ জুলাই ১৯৭৩ গঙ্গার পানি বণ্টন সম্পর্কে উভয় দেশ একমত
হওয়া পর্যন্ত ফারাক্কা বাঁধ চালু না করার সিদ্ধান্ত হয় এবং ১৮ এপ্রিল ১৯৭৫ এবিষয়ে উভয়ের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ও ২১ মে ১৯৭৫ ফারাক্কা বাঁধ চালু হয়।১২
১১. মৈত্রী চুক্তির পুরাে বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট ৩ পড়ুন ১২. ১৬ মে ১৯৭৬ রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে আয়ােজিত এক জনসমাবেশে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে গুড়িয়ে। দেয়ার শপথ গ্রহণ করে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে এক মিছিল শুরু হয়। এবং পরদিন কানসাট সীমান্তে অনুষ্ঠিত সমাবেশে গরম বক্তৃতার মাধ্যমে মিছিলের সমাপ্তি ঘটে।
১১ জুন ১৯৭২ সীমান্ত রক্ষায় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৯৭৪ এর মধ্য-মে’তে মুজিব-ইন্দিরা শীর্ষ বৈঠকে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিমতে বাংলাদেশ বেরুবাড়ির পরিবর্তে ৪টি সিটমহল (enclave) পায়। এ চুক্তির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রীট পিটিশন করা হয় এবং তা খারিজ হলে সুপ্রীম কোর্টে আপীল করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ তা-ও খারিজ হয়। চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২৮ নভেম্বর ১৯৭৪ সংবিধানের (তৃতীয়) সংশােধনী পাস করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ থেকে উভয় দেশের মধ্যে পুনঃ পাসপোের্ট ভিসা চালু হয়। | ২৭ আগস্ট ১৯৭৩ ও ৩ জুলাই ১৯৭৪ যথাক্রমে ভারত-বাংলাদেশ পরমাণু সহযােগিতা চুক্তি ও আকাশপথ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২ জানুয়ারি ১৯৭৪ ভারত আন্তর্জাতিক বাজার দরে বাংলাদেশ থেকে ৬ লক্ষ বেল কাঁচা পাট আমদানির চুক্তি স্বাক্ষর করে। পুনর্বাসন-পুনর্গঠন পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে মুজিব বলেন : আজ সােনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি আমার এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য দানের জন্য এগিয়ে আসতে অনুরােধ করছি। আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকরি বা কাজ না পায়, তা হলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। আমাদের রাস্তাঘাট ভেঙ্গে গেছে, সেগুলাে মেরামত করতে হবে।…” ১ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শুরু হয় এবং ২৩ জানুয়ারির মধ্যে মােট ৯৮ লক্ষ ৯৩ হাজারের মধ্যে ৫০ লক্ষ শরণার্থী প্রত্যাবর্তন করে। মহাসচিব ওয়াইল্ড হেইম জাতিসংঘের স্বস্তি পরিষদে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য ৪১১ কোটি টাকার প্রস্তাব পেশ করেন। দেশেও নতুন কোন করারােপ না করেই ৫৫০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংবলিত পুনর্বাসন বাজেট পেশ করা হয়। পরে ৪,৪৫৫ কোটি টাকার প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। পুনর্বাসন-পুনর্গঠন ক্ষেত্রে সে সময়ে সরকার নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করে : • যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ৪টি রেলসেতু নির্মাণে ভারতের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর। • ১২ জুলাই ১৯৭২ তিস্তা রেলসেতু পুনঃ চালুকরণ।
জিয়ার সময়ে পানি বণ্টন চুক্তি হলেও মেয়াদান্তে তা নবায়িত হয় নি। পরে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি সম্পাদিত হয় ১৩. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৫
৩ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশের প্রথম মুদ্রা ১ টাকা ও ১০০ টাকার নােট বাজারে ছাড়া। হয়। ২ জুন ১৯৭২ ছাড়া হয় ৫ ও ১০ টাকার নোেট। ৮ জুন পাকিস্তানি ৫ ও ১০ টাকার নােট অচল ঘােষণা করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ পাকিস্তানি ১ টাকার নােট এক মাস মেয়াদে সচল ঘােষণা করা হয়। ১ মে ১৯৭৩ ভারতে ছাপা ৫ ও ১০ টাকার নােট প্রত্যাহার করা হয়। ১৩ নভেম্বর ১৯৭৩ নতুন ২৫ পয়সার মুদ্রা চালু করা হয়। ৫ এপ্রিল ১৯৭৫ একশত টাকার নােট বাতিল ঘােষণা করা হয়। ১০ মে ১৯৭২ ভারত-বাংলাদেশ অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চালু হয়। কিন্তু অচিরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং ৯ অক্টোবর তা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। সূতার ডিলারশীপ ও ডিস্ট্রিবিউশনশীপ বাতিল করে মিলে মজুত সূতা তাঁতীদের কাছে বন্টনের নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাদের ঋণদানের জন্য ব্যাংক কনসাের্টিয়াম গঠন করা হয়। | বাংলাদেশ ভারত থেকে ২৪ কোটি টাকা, বিশ্ব ব্যাংক থেকে ৫ কোটি ডলার ও ৮ কোটি টাকা, ডেনমার্ক থেকে ৩৬ কোটি টাকা, জাপান থেকে ৯ বিলিয়ন ইয়েন, সুইডেন থেকে ১৪ কোটি টাকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৮ মিলিয়ন ডলার ও জাতিসংঘ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার ঋণ/পণ্যঋণ লাভ করে বা চুক্তি স্বাক্ষর করে। | ভােগ্যপণ্যের মূলাহ্রসের উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী ইউনিয়ন পর্যায়ে ন্যায্যমূল্যের দোকান খােলা হয়। বস্ত্র বণ্টনে গােলমালের জন্য ১২ জুন ১৯৭৩ শহরে তা বন্ধ ঘােষণা করা হয়। ৩০ জুন ১৯৭২ দেশের প্রথম বাজেট পাস করা হয়। যুদ্ধোত্তরকালে মাত্র ৬ মাসের মধ্যে বাজেট প্রণয়ন করা ছিল খুবই কঠিন কাজ। ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ ও অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের বিষয় প্রাধান্য পায় বলে একে পুনর্গঠন বাজেট’ আখ্যা দেয়া হয়। বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন ঘােষণা করেন, ‘না খেয়ে মরব, তবু শর্তযুক্ত ঋণ নেব না। বাজেটে কোন নতুন কর আরােপ করা হয়নি। রেলেযাত্রী বা মালের ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়নি। উপরন্ত ১৪ এপ্রিল ১৯৭২ পর্যন্ত বকেয়া ও সুদ-সমেত কৃষিজমির খাজনা মওকুফ করা হয়, জমির সেচের বকেয়া মওকুফ করা হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয়। পৌরসভা ও শহর কমিটির অধীন সমস্ত বাড়ির বকেয়া ট্যাক্স ও এই খাতে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেয় সমস্ত পাওনা মওকুফ করা হয়। ইজারা প্রথা বাতিল ঘােষণা করা হয়। কৃষি আয়ের উপর থেকে কর প্রত্যাহার করা হয়। বাজেটে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত খাত ছিল কৃষি। প্রতিরক্ষার তুলনায় প্রাধান্য পায় শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ। একই ধারায় ২৭ নভেম্বর ১৯৭৩ প্রকাশ করা হয় ৪,৪৫৫ কোটি টাকার প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয় ও ব্যয় ধরা হয় ৪৭০.২৩ কোটি টাকা।
১৯. সংবাদ, ২ জুলাই, ১৯৭২
১৫ নভেম্বর ১৯৭২ শিল্পক্ষেত্রে ঋণ ও পরামর্শ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা গঠন করা হয়। জানুয়ারি ৬ ও মার্চ ৩১ বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রশ্নে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ মার্চ মাসে পাকিস্তানি আমলের রেজিস্ট্রিকৃত সকল ট্রেডমার্ক ও ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হয়। ১৪ মে ১৯৭৩ ৫টির স্থলে ২টি আলাদা বীমা কর্পোরেশন গঠন করা হয়। ৩১ জুলাই ১৯৭৩ ট্যারিফ কমিশন গঠন করা হয়। | ১৯৭৩-এর নভেম্বরে ধান ও চাউলের সংগ্রহ মূল্য যথাক্রমে ৪৫ ও ৭২ টাকা ঘঘাষণা করা হয়। পেট্রোল ও কেরােসিনের মূল্য ৩০% ভাগ বৃদ্ধি করা হয়। ফলে। ঢাকায় বাস ভাড়াও বৃদ্ধি পায়। ডিসেম্বর মাসে ইঞ্জিনের অভাবে গ্রীন এ্যারাে ও আখাউড়া-সিলেট মেইল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হয়। এপ্রিল ১৯৭৪ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৩ হাজার মেট্রিক টন ভােজ্যতেল আমদানির জন্য। বাংলাদেশ এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। জুলাই মাসে চায়ের উপর থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হয়। মার্চ ১৯৭৫ কয়লা ব্যবসা সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশ থেকে কেবল রপ্তানি শুরু হয়। এপ্রিল মাসে বহুমুখী পল্লী সমবায়ের নীল-নকশা তৈরির কাজ সম্পন্ন করা হয়। ৩ মে ১৯৭৫ কমনওয়েলথ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব পাকিস্তানকে বাংলাদেশের সম্পদ হস্তান্তর ও বাংলাদেশ থেকে ৬৬ হাজার পাকিস্তানি ফেরত নেয়ার আহ্বান জানান। শিল্প ব্যবস্থাপনা পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক আমলে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পোন্নয়ন সাধিত হয়েছিল খুব সামান্য। যা হয়েছিল, সরকারি অর্থে পৃষ্ঠপােষণা ও প্রবর্তনা দিয়ে আদমজী, বাওয়ানী, দাদা, ইস্পাহানী প্রভৃতি অবাঙালি পুঁজিপতিগােষ্ঠীকে শিল্পক্ষেত্রে অবাধ শােষণের আধিপত্যদান। তথাকথিত বেসরকারি শিল্পখাতে সরকারি অর্থ সিংহভাগ জুড়ে তাে ছিলই, ইপিআইডিসি ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত শিল্প-কারখানাও তুলে দেয়া হত [২২ পরিবার খ্যাত) বেসরকারি শিল্প-মালিকদের হাতে। ফলে দেশের কল-কারখানা, ব্যাঙ্ক, বীমা, বাণিজ্য তথা অর্থনীতির প্রায় সম্পূর্ণটাই নিয়ন্ত্রণ করত পশ্চিম পাকিস্তানি বাইশ পরিবার। হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রাক্কালে ওরা এসব ফেলে রেখে চলে যায়। তাই বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ সরকার এগুলাের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরে ২৬ মার্চ।
২০. এ অধ্যায়ে ব্যবহৃত তথ্যাবলি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ড. মােহাম্মদ হাননান, সিরাজ উদদীন আহমেদগণের পূর্বোক্ত গ্রন্থসমূহ ও অন্যান্য উৎস থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। ২১. শেখ আব্দুল জলিল, ময়মনসিংহের বৃহৎ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (প্রবন্ধ), ময়মনসিংহের জীবন ও জীবিকা (স্মারক গ্রন্থ), জেলা প্রশাসন, ময়মনসিংহ, ১৯৮৭ ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি ২৯টি (পরে সকল) বীমা কোম্পানি ও ৫ ফেব্রুয়ারি ৩৯২টি পরিত্যক্ত। শিল্প-প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করে। এগুলাের কয়েকটি মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ও সেনাকল্যাণ সংস্থাকে দেয় হয় এবং ৩৫টি ২৩ জানুয়ারি ১৯৭৫ বিক্রয় করে দেওয়া হয়।
স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকীতে ‘শিল্প-প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ আদেশ জারি করে এ-সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পরিত্যক্ত বৃহত্তম আদমজী জুটমিল চালু করা হয় এবং মে দিবসে শ্রমিকদের এডহক সাহায্যদানের ঘােষণা দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের ৮ জানুয়ারি শিল্প বিনিয়ােগ নীতি ঘােষণা করা হয়। এতে অনধিক ২৫ লক্ষ টাকা মূল্যের প্রতিষ্ঠান পরবর্তী ১০ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত না করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অক্টোবর-নভেম্বরে শিল্প-শ্রমিক মজুরি কমিশন অনুমােদন ও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প শ্রমিক | অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। বছরের শেষদিকে (২৭ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামে দেশের প্রথম পশম কারখানা উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু অদক্ষ, দুর্নীতিবাজ ও ভুল ব্যবস্থাপনা এবং লাল বাহিনীর দৌরাত্ম্যে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ লােকসান দিতে শুরু করে। এক হিসেবে দেখা যায়, মাত্র দেড় বছরে ১২টি শিল্পখাতে ৯৩ কোটি টাকা লােকসান ২৩ এ-সম্পর্কিত নীতিমালা ছিল নিম্নরূপ :
ক, ব্যাংক ও বীমা ব্যবসায় জাতীয়করণ খ, সমগ্র পাট, বস্ত্র, চিনি, শিল্প এবং অন্যান্য বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের বাঙালি মালিকানাধীনসহ দেশের মােট শিল্প খাতের শতকরা ৮৫ ভাগ] জাতীয়করণ গ. বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণ ঘ. ব্যক্তি-পুঁজির সিলিং ২৫ লক্ষ টাকায় নির্ধারণ [পরে ১৬ জুলাই ১৯৭৪ তা ৩ কোটি টাকায় বৃদ্ধি | করা হয়। ও, দেশীয় ব্যক্তি পুঁজির সাথে বিদেশী পুঁজির যৌথ বিনিয়ােগ নিষিদ্ধকরণ (২৩ মার্চ ১৯৭৩ বিদেশী পুঁজি বিনিয়ােগ বাের্ড গঠন করা হয়। চ, সরকারি খাতে বিদেশী পুঁজির যৌথ বিনিয়ােগের ক্ষেত্রে সরকারের অংশ ন্যূনতম শতকরা ৫১ ভাগ স্থিরিকরণ ইত্যাদি। [উদ্ধৃত নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি-একটি নিকট বিশ্লেষণ, প্রাচ্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮১, পৃষ্ঠা ১১৯-২০; পাদটীকা] ২বিএনপি-জামাত জোট সরকার ২০০২ সালে আদমজী বন্ধ করে দেয় স্বাধীনতার পূর্বে শিল্প-প্রতিষ্ঠান পরিচালনার উচ্চ ও মধ্য পর্যায়ের পদগুলাে অবাঙালিদের দখলে। ছিল। কৃষিজীবী বাঙালিদের মধ্যে এমনকি দক্ষ শ্রমিকেরও অভাব ছিল। এমতাবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে। প্রাক্তন মালিক বা সুবিধাভােগীদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়ে শিয়ালের হাতে মরগি বর্গা দেয়া হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনার জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস (আই এম এস) নামে একটি নতুন ক্যাডার সার্ভিসে যােগদানকারী কাউকে কাউকে তরুণ বয়সেই কোটিপতি বনে যেতে দেখা গেছে। (দ্রষ্টব্য ড, মােহম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র। আন্দোলনের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৬)। স্বাধীনতার পর শ্রমিক লীগ প্রধান এমএ মান্নানের নেতৃত্বে লাল বাহিনী নামে শ্রমিকদের একটি মাস্তান বাহিনী গড়ে ওঠে। লাল টুপি পরিহিত এসব শ্রমিক উৎপাদন কাজে নিয়ােজিত না হয়ে রাজপথে প্যারেড, চাঁদাবাজী, মুক্তিপণ আদায় প্রভৃতি দুষ্কর্ম করে বেড়াত ও মাস শেষে বেতনসহ যাবতীয় বৈধ-অবৈধ সুযােগ সুবিধা ভােগ করতাে। অবশেষে ঢাকা কটন মিলের ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযােগে ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ মান্নানকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ততদিনে বুড়িগঙ্গা দিয়ে অনেক পানি গড়িয়ে যায়।
হয়। ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভতুর্কি দিতে দিতে এগুলাে সরকার ও জনগণের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এ সুযােগে কেউ কেউ জাতীয়করণকে ভ্রান্ত নীতি আখ্যায়িত করে এগুলাে প্রাক্তন মালিকদের ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করেন। প্রসঙ্গক্রমে এ আওয়ামী লীগের নীতি নয়, বামপন্থীদের চাপে এ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে’ একথা বলে তারা আওয়ামী লীগকে মানসিকভাবে দুর্বল করার প্রয়াস পায়। | আওয়ামী লীগের জন্ম ও ক্রমবিকাশ এবং স্বাধীনতা আন্দোলন প্রভৃতি বিবেচনা করলে এ দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়। ১৯৪৯ খ্রি. ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে গৃহীত ১২ দফা কর্মসূচির ১১তম দফায় বলা হয় :
বিনা খেসারতে জমিদারি ও অন্য সকল মধ্যস্বত্ব বিলােপ করা হবে। সকল আবাদযােগ্য জমি পুনর্বণ্টন করা হবে। ১২তম দফায় বলা হয়, ‘সকল জমি জাতীয়করণ করা হবে।”২৮ ১৯৫৪ সালে নির্বাচন উপলক্ষে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ৩য় দফায় বলা হয় : পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে একে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাটচাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে…।” ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টিকারী ১১ দফার ৫ম দফায় বলা হয় : ব্যাংক, বীমা, ইনস্যুরেন্স ও বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ করতে হবে।” ১৯৭০ সালে প্রকাশিত নির্বাচনী ঘােষণায় আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করে।” ১১ জানুয়ারি ১৯৭০ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় শেখ ২। দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জুন ১৯৭৩। এ সময়কালে পাটকলে ২৫ কোটি, চিনিকলে ৭ কোটি, কাগজকলে ৩.৫ কোটি, ইস্পাতকলে ১.৫ কোটি ও খনিজ কর্পোরেশনে ১১ কোটি টাকা লােকসানের হিসেব সাপ্তাহিক সােনার বাংলা ৭ অক্টোবর ১৯৭৩ সংখ্যায় প্রকাশ করে। পাটকলে লােকসান হওয়ার অন্যতম কারণ হল অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে গুদামে আগুন লাগিয়ে কোটি কোটি টাকার পাট পুড়িয়ে দেওয়া। ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, কাঁচা পাটের অভাবে শুধু চট্টগ্রামে ১৭টি মিল বন্ধের উপক্রম হয়। তবে এত কিছুর পরও ২৩ এপ্রিল ১৯৭৪ প্রকাশিত সরকারি এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে ৯টি সেক্টর কর্পোরেশনের অধীন জাতীয়করণকৃত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ ১৭ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করে। * সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বেক্ত, পৃষ্ঠা ৭৪। তঙ্কালীন পূর্ববঙ্গে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেনি বলেই বােধহয় তা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ২৯ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৩৮৯ বঙ্গাব্দ (১৯৮২), পৃষ্ঠা ৩৭৩-৭৪ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০৫-০৮ ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ঘােষণায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কর্মসূচী ছিল নিম্নরূপ : ক, দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে | ব্যাঙ্ক, বীমা, পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প এবং অন্যান্য ভারী ও মৌলিক শিল্পের জাতীয়করণ। খ, ভূমিসংস্কার সম্পাদন এবং ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণের লক্ষ্যে জমির মালিকানা ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন ট্যাক্স ও খাজনা ব্যবস্থায় সংস্কার সাধন, বিশেষত লবণের উপর থেকে কর প্রত্যাহার এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ(করণ)
মুজিব ঘােষণা করেন :
আওয়ামী লীগ চায় কৃষকের, শ্রমিকের রাজত্ব কায়েম করতে। আওয়ামী লীগ দেশের সকল মূল শিল্পসহ ব্যাংক ও বীমা ব্যবসা জাতীয়করণ করবে। ওই
এ-ঘােষণা ছাত্রদের ১১-দফা দাবিরই প্রতিধ্বনি। যুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের অর্থমন্ত্রী এম, মনসুর আলী এক বেতারভাষণে বলেন :
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামাে হবে সমাজতান্ত্রিক। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে প্রথম সুযােগেই শেখ মুজিব ঘােষণা করেন, আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ।
১৪ জানুয়ারি ১৯৭২ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে শেখ মুজিব বলেন :
জনগণের আকাক্ষা শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের মাধ্যমেই পরিপূর্ণ। হতে পারে এবং নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় কৃষি, শিল্প ও অর্থ-ব্যবস্থার ‘প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন করতে হবে।”
উল্লেখ্য, ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমদিকে ঢাকায় সংবিধানের মূলনীতির ওপর অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান হবে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। উপযুক্ত ঘােষণাসমূহ থেকে বুঝা যায়, জাতীয়করণ বা সমাজতন্ত্রের ঘােষণা হঠাৎ করে বা পরিস্থিতির চাপে পড়ে আসেনি বা তা সরকারের পথভ্রষ্টতাও নয়। এটি স্বাধীনতার মতােই জনগণের দীর্ঘদিনের আকাক্ষা যা ক্রমে ক্রমে বিকাশ লাভ করেছে। তল্কালিন শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরকারের শিল্প সংক্রান্ত নীতিমালা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন :
শিল্প-কারখানার শেয়ার ৩০ শতাংশ শ্রমিকদের, ৩০ শতাংশ মালিক এবং ৪০ শতাংশ সরকারের কাছে বণ্টন করা হবে। ৭
তবে এ-ও সত্য যে, এ-বিষয়ে সরকারের কোনাে পূর্বপ্রস্তুতি বা অভিজ্ঞতা। কোনােটাই যেমন ছিল না তেমনি এগুলাে চালানাের মতাে সংগঠনিক কাঠামাে বা দক্ষ জনবলও ছিল না। সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য গণ্য করে পুঁজি বিনিয়ােগ সিলিং ২৫ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরে তা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা করা হয় (পরবর্তী সরকার সিলিং তুলে দিয়ে মুক্ত অর্থনীতির দ্বার উন্মােচন করে)। প্রকৃত প্রস্তাবে ২৫ লক্ষ টাকায় কোন শিল্প-কারখানা করা সম্ভব ছিল না। একই ভাবে পরিবারের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে জমির
ওই সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬৫ ৩০ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, জ্ঞানকোষ প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৯৬ * সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০৬
এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৯
এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৩ ৩৭ মনিং নিউজ, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
৩০ মার্চ ১৯৭৩ ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষা সেমিনার ও মাদ্রাসা শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব সেমিনার ও সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে মাদ্রাসা শিক্ষা অব্যাহত থাকা ও ধর্ম নিয়ে রাজনীতি না করার আহ্বান জানান।
১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২ বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্সসহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হয় এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩ স্বায়ত্তশাসন সংবলিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে ১৯৭৩ জারি করা হয়। অনুরূপভাবে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করা হয়। ১ নভেম্বর ১৯৭৩ অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষকগণ সরকারি চাকুরেতে পরিণত হন। ২২ এপ্রিল ১৯৭৩ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে ফরাসি দার্শনিক মসিয়ে আঁন্দ্রে মালরােকে ডক্টর অব ল’ ডিগ্রি প্রদান করে। মালরাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তােলেন। তিনি একজন সশস্ত্র যােদ্ধা হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণেরও ঘােষণা দিয়েছিলেন। ৯ ডিসেম্বর ১৯৭৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ সমাবর্তনে অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বােস (মরণােত্তর), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (মরণােত্তর), কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ড. হিরেন্দ্র লাল দে, ড. মুহাম্মদ কুদরাত-ই-খুদা, অধ্যাপক কাজী মােতাহার হােসেন ও অধ্যাপক আবুল ফজলকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করা হয়। ১৩ মার্চ ১৯৭৩ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ২,২৮৯ জন ডিগ্রীধারীকে সনদ প্রদান করা হয়। ১৮ মার্চ ১৯৭৫ ড. কাজী মােতাহার হােসেন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও শিল্পাচার্য। জয়নুল আবেদিনকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ করা হয়। | ৬ মার্চ ১৯৭৫ রামপুরায় নির্মিত টেলিভিশন ভবন উদ্বোধন করা হয়, ৩ জুলাই। ২০ ইঞ্চি টেলিভিশন (সাদা-কালাে) ও ১ ব্র্যান্ড রেডিওর লাইসেন্স ফি বাতিল এবং ২৯ মে নাট্যানুষ্ঠানের উপর থেকে প্রমােদর বিলােপ করা হয়। ১৫ এপ্রিল ১৯৭৫ ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা উদ্বোধন করা হয়। ১৬ জুলাই ১৯৭৫ সতের জন দুঃস্থ শিল্পী ও সাহিত্যিককে আর্থিক সাহায্য দান করা হয়। মুদ্রণ ও প্রকাশনা আধুনিক সমাজে মুদ্রণ ও প্রকাশনার গুরুত্ব অপরিসীম। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১ ঢাকা ফিরে এসেই ‘প্রেস ট্রাস্ট’ বিলুপ্ত করেন এবং ২ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশ সংবাদপত্র (প্রশাসন) আদেশ জারি করেন। পরে ২৮ আগস্ট ১৯৭৩ সাবেক প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডার বাতিল করে নতুন ‘প্রিন্টিং অর্ডিন্যান্স’ জারি করা হয়। ২৪ এপ্রিল ১৯৭২ টেলিভিশন কর্পোরেশনকে সম্পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি-প্রকৃতি
হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম রাজনৈতিক বিতর্কের সূত্রপাত হয় জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করা উচিত বলে মন্তব্য করেন। এ মন্তব্যের উত্তরে আওয়ামী লীগের সমাজসেবা সম্পাদক কে, এম, ওবায়দুর রহমান সর্বদলীয় সরকারের ধারণাকে ‘অবাস্তব’ আখ্যায়িত করে এর বিরােধিতা করেন। তবে প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এ প্রসঙ্গে একটি মধ্যপন্থি’ ঘােষণায় বলেন, যুদ্ধ চলাকালে সরকারের সাহায্যকারী ৫ দলীয় পরামর্শদাতা কমিটি বহাল থাকবে। ফলে তখনকার মতাে বিতর্কটির সমাপ্তি ঘটলেও উক্ত কমিটিকে আর বহাল করা হয়নি। পরে ৩
১ দৈনিক বাংলা, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭২
২. ওবায়দুর রহমান ত্রাণ তহবিল তছরুপ ও দালালদের আশ্রয়দানের অভিযােগে দলের সমাজকল্যাণ সম্পাদকের পদ থেকে বরখাস্ত হয়েও পরে ১৯৭৩ সালে প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মুজিবের খুনীদের সাথে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি জেলহত্যা মামলার অন্যতম আসামী ও বিএনপি দলীয় সাংসদ। দৈনিক বাংলা, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ দৈনিক বাংলা, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূত ডিপি ধর ২৯ আগস্ট কলকাতায় স্বাধীনতা সমর্থক সকল রাজনৈতিক দলকে একটি ফোরামে একত্রিত করার ভারত-সরকারের অভিপ্রায়ের কথা জানালে ৮ সেপ্টেম্বর শুধু পরামর্শ দানের জন্যে ১. মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (সভাপতি) ২. জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ (আহবায়ক) ৩, খন্দকার মােশতাক আহমদ ৪, কমরেড মণিসিংহ (কমিউনিস্ট পার্টি) ৫, শ্ৰী মনােরঞ্জ ধর (কংগ্রেস) ৬, অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ (ন্যাপ)-কে নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’ ১৭ সেপ্টেম্বর এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে : সর্ব দলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ায়, বাংলাদেশের ভিতরে মুক্তিসংগ্রামীরা যেমন অনুপ্রাণিত হবেন, তেমনি বাইরে বাংলাদেশের শুভাকাঙ্গী ও বন্ধুদেশগুলােও উৎসাহিত হবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও শেখ পরিবারের একাংশ তাতে অনুপ্রাণিত হওয়ার বদলে কুপিত হন। আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ আবদুল আজিজের নেতৃত্বে ৪০ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য (৫ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রী। তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি আনুষ্ঠানিক অনাস্থা প্রকাশ করে এবং কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ। সদস্যদের সমম্বয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ’ গঠনের দাবি জানায়। (মতান্তরে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে সেরনিয়াব্রত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং শেখ আজিজ ও শাহ মােয়াজ্জেম সহ কয়েকজন নেপথ্যে থেকে এ-প্রস্তাব চাঙা করেন। অবশ্য আলােচনার পর তা নাকচ হয়ে যায়)। ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় পরিষদ সদস্য এনায়েত হােসেন খানের সভাপতিত্বে এ-গ্রুপের পরবর্তী সভায় তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী ও দলের সাধারণ
সেপ্টেম্বর ১৯৭২ পল্টন ময়দানে ভুখা মিছিল উপলক্ষে আয়ােজিত জনসভায় মাওলানা ভাসানী মানুষ বাঁচানাের জন্য জাতীয় সরকার বাস্তবায়নের দাবি জানান। ২১ এপ্রিল ১৯৭৪ সর্বদলীয় (৬ দলীয়) যুক্তফ্রন্টের ৬ নেতা এক যৌথ বক্তব্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, খাদ্য সমস্যা ও জনজীবনের নিরাপত্তার লক্ষ্যে সম্মিলিত প্রয়াস’র” প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরেন এবং মাওলানা ভাসানী ৩ নভেম্বর ১৯৭৪ পল্টনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় পুনরায় মুজিবের প্রতি জাতীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানান। বলা বাহুল্য, এ ধরণের আহ্বানে ক্ষমতাসীন মহল সাড়া না দিয়ে বরং এর ভিন্ন অর্থ আবিষ্কারে অধিক মনােযােগী হয়েছেন। অথচ দেশ গড়া ও দুর্যোগকালে জাতীয় ঐক্যের প্রয়ােজনীতা সর্বজনবিদিত। সরকার বিরােধী বিক্ষোভ-আন্দোলন সত্তরের নির্বাচনে মুজিবের দেশব্যাপী প্রচারাভিযান মানুষকে রাজনীতি ও অধিকার সম্পাদক উভয় পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করার জন্য আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। অক্টোবরে প্রচারিত তাদের এক সার্কুলারে বলা হয়। It is Awami league alone which is eligible and competant to conduct present war We all are aware that taking NAP (two groups), Communist Party and Congress along with Awami league, a joint front infact has been formed naming a consultative committee for the liberation struggle against the avowed policy of our leader Sk, Mujibar Rahman. (দ্র. মইদুল হাসান, মুলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০১)। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাধীনতা সংগ্রামকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের চরিত্রদান এবং অ-আওয়ামী। স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ যুদ্ধের স্বার্থেই খুব প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী ১০ এপ্রিল তার প্রথম ভাষণেই এ-প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাংলাদেশের এই সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে শামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ও বাস্তব প্রয়ােজনেই একটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ার দাবি উত্থাপিত হয়। কিন্তু আওয়ামী-পরিবারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দম্ভ ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি এর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামান এ-প্রসঙ্গে বলেন, মুক্তিফ্রন্ট গঠনের কোনাে দরকার নাই, সকলে। বাংলাদেশ সরকার তথা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মানিয়া নিলেই সমস্যা চুকিয়া যায়’ (সাপ্তাহিক মুক্তিযুদ্ধ’ ২৬ জুলাই ১৯৭১)।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের আশীর্বাদপুষ্ট মুজিববাহিনী সৃষ্টির অন্যতম কারণই ছিল যুদ্ধে বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি মােকাবেলা করা। ফলে জাতীয় ফ্রন্ট তাে দূরের কথা কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মােজাফফর) সমর্থক ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিং নিতে তারা আপত্তি তােলে এবং বাধারও সৃষ্টি করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের প্রকৃত কাজই ছিল স্বাধীনতার ক্ষতিসাধন। উপরন্তু তিনি ছিলেন আদর্শ ও ঐতিহ্যগতভাবে বাম-প্রগতি বিরােধী। ফ্রন্ট সম্পর্কে তিনিও বিরূপ মন্তব্য করেন। ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭ ১৪ এপ্রিল ১৯৭৪ মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আতাউর রহমান খান, আমেনা বেগম, অলি আহাদ, সৈয়দ সিরাজুল হুদা প্রমুখের সমন্বয়ে গঠিত মুজিব সরকার বিরােধী ফ্রন্ট। কয়েকটি জনসভা অনুষ্ঠান ছাড়া তেমন কোন ভূমিকা পালনে এ ফ্রন্ট সক্ষম হয় নি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের তারিখ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯২। ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৩
সচেতন করে তােলে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ফলে মানুষের প্রত্যাশাও অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু বাস্তব অবস্থায় প্রত্যাশা পূরণ না-হওয়ায় মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে স্বাধীনতার দেড় মাসের মাথায়। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ বেকার যুবকেরা। চাকুরি প্রার্থনা করে ঢাকায় মিছিল করে। কিছুদিন পর ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬ জন মুক্তিযােদ্ধা বিভিন্ন দাবিতে অনশন ধর্মঘট করেন। এর এক সপ্তাহ পর ১ মার্চ খুলনায় খালি ‘টিন’ হাতে কেরােসিন তেলের দাবিতে অনুষ্ঠিত হয় বিক্ষোভ মিছিল। যুদ্ধের নয় মাস স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হয়। খাদ্যের উৎপাদন হ্রাস পায়। অন্যদিকে যুদ্ধকালে পাকিস্তানী শিল্পপতিরা বাংলাদেশ থেকে ৭৮৫ কোটি টাকা পাচার করে নিয়ে যায় এবং আত্মসমর্পণের পূর্বাহ্নে হানাদাররা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সকল টাকা পুড়িয়ে দেয়। অবকাঠামাে ধ্বংস হওয়ায় শূন্য হাতে ফিরে-আসা শরণার্থীদের কাছে সরবরাহ যা আছে তা পৌছানােও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তদুপরি রিলিফসামগ্রী বণ্টনে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযােগ পাওয়া যেতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৬ আগস্ট ১৯৭২ বরিশালের বানারিপাড়ায় ও ২১ আগস্ট রংপুরে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল অনুষ্ঠিত উপযুক্ত বিক্ষোভ-মিছিলগুলাে স্বত:স্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস থেকে মাওলানা ভাসানী ‘সংগঠিত’ সরকার বিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ৩ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় ভুখা মিছিল ও জনসভার আয়ােজন করেন। সভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করেছে বলে অভিযােগ তুলে প্রকারান্তরে পাকিস্তানি আমলের ভারত বিরােধী রাজনীতির অশুভ উদ্ভোধন করেন। এরপর তিন দফা দাবি (১. খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যমূল্যহ্রাস, ২. দমননীতি বন্ধ করা এবং ৩, শিল্প, ব্যবসা, চাকরিসহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে অরাজকতার অবসান ও জানমালের নিরাপত্তা বিধান) আদায়ের উদ্দেশ্যে ভাসানী ১৫ মে ১৯৭৩ ঢাকায় অনশন শুরু করেন ও ২১ মে সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। হরতাল-কালে একদল উচ্ছঙ্খল লােক এশীয় শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে নির্মিত ভিয়েতনাম মন্ডপ’ বিধ্বস্ত করে। কিন্তু একই কারণে আহুত ১২ অক্টোবরের হরতাল ব্যর্থ হয়।
১০ সংবাদ, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
সংবাদ, ২ মার্চ ১৯৭২। রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জির জন্য পরিশিষ্ট ৯ পড়ুন অনেকে মনে করেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যা দেখা দেওয়া ছিল স্বাভাবিক। গঠনমূলক সমালােচনার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দূর করার উদ্যোগ নেওয়া হত বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ভুখা মিছিল করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করাটা ছিল ‘ভিলেজ পলিটিক্সসুলভ অনৈতিক কাজ। ভাসানী সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পরিশিষ্ট ১৪ পড়ুন। ১৩ ভারতীয় সৈন্য নির্ধারিত সময়ে আগেই ২৫ মার্চ ১৯৭২ বাংলাদেশ ত্যাগ করে * বিশ্ব শান্তি পরিষদের উদ্যোগে ২৩ মে ১৯৭৩ ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এদিন শন্তির জন্য সংগ্রাম-এর স্বীকৃতিস্বরূপ মুজিবকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলিওকুরী পদক’ প্রদান করা হয় * মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের তারিখ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৮৩। এদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৬৫ সালে দুঃখজনকভাবে চীন ও রুশ পন্থি হিসেবে বিভক্ত হয়ে যায়। পরেও চীনপন্থিরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হওয়া অব্যাহত রাখেন। তবে প্রায় সকলই তাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক মঞ্চ বা আশ্রয় হিসেবে ভাসানী ন্যাপ ও ভাসানীকে ব্যবহার করেন। এদের আন্তঃউপদলীয় দ্বন্দ্বের সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৪ ন্যাপের (ভাসানী) কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিলের মধ্য দিয়ে। এসব দ্বন্দ্ব-কলহে মাওবাদী মাওলানা এতই বিরক্ত হন যে, ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি হুকুমতে রাব্বানী পার্টি’ নামে একটি দক্ষিণ পন্থি’ দল গঠন করে প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিতে নিজেকে নিয়ােজিত করেন। ভিয়েতনাম সংহতি ও ছাত্রহত্যা বাহাত্তরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ভিয়েতনামে ব্যাপক হারে বােমা বর্ষণের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন ও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কুশপুত্তলিকা দাহ করে এবং ১ জানুয়ারি ১৯৭৩ ভিয়েতনাম সংহতি দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেদিন ঢাকার তােপখানা রােডে অবস্থিত মার্কিন তথ্যকেন্দ্রের সামনে ছাত্র ইউনিয়নের কয়েক হাজার কর্মী বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান এবং তােপখানা রােডের মত অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে ঘৃণ্য মার্কিন তথ্যকেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা জঙ্গীরূপ ধারণ করে আর অসহিষ্ণু পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। ছাত্রনেতা মতিউল ইসলাম ও মীর্জা কাদের নিহত এবং পরাগ মাহবুব সহ ৭ জন আহত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে সংগঠিত প্রথম ছাত্রহত্যার ঘটনা মুহূর্তে শহরে ছড়িয়ে পড়ে ও সর্বস্তরে আলােড়ন সৃষ্টি করে। সচিবালয় থেকে সরকারি কর্মচারিরা দল বেঁধে রাজপথে নেমে এসে ছাত্র-জনতার সাথে যােগ দিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করে।
শহীদের লাশ নিয়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে চারদিক থেকে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা যােগ দেয়। মিছিল যত সামনে অগ্রসর হয়, ততই দীর্ঘ হয়। সারা শহর বিক্ষোভের শহরে পরিণত হয়। সরকারি দৈনিক বাংলাও বিকেলে বিশেষ টেলিগ্রাম বের করে।। ১৬ এ সময় দলের সভাপতি ছিলেন ভাসানী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী জাফর। ৪ মার্চ দলের। নতুন কমিটি গঠিত হয় এবং দালাল মশিউর রহমান যাদু মিয়া এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবির্ভূত হন। ‘টেলিগ্রাম’ বের করার অপরাধে দৈনিক বাংলার সম্পাদক কবি হাসান হাফিজুর রহমান ও বার্তা সম্পাদক আবু তােয়াব খান তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারিত হন। পরে তারা যথাক্রমে মস্কোতে বাংলাদেশের দূতাবাসের প্রেস সচিব ও ঢাকায় প্রধানমন্ত্রির প্রেস সচিব নিযুক্ত হন ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান শােক-বাণী প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। | শহর প্রদক্ষিণ শেষে লাশ-সমেত বিক্ষোভ মিছিল পল্টন ময়দানে এসে পৌছলে স্বতস্ফূর্ত জনসমাবেশে প্রদত্ত এক ভাষণে ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি ও ডাকসু সহসভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম শেখ মুজিবের ডাকসুর সদস্যপদ বাতিল ঘােষণা করে তা ছিড়ে ফেলেন। পরদিন সারাদেশে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে হরতাল পালিত হয়। | মুজিবের ডাকসুর সদস্যপদ বাতিল করা ও খুনী মুজিব গদী ছাড়, ফাঁসি চাই’ প্রভৃতি স্লোগান আওয়ামী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হয়। ৫ জানুয়ারি ঢাকা সহ সারা দেশে ন্যাপ (মােজাফফর), ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু অফিসে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও অগ্নিসংযােগ করা হয় এবং কোথাও কোথাও দখল করা হয়। ঢাকায় অফিসে অবস্থানরত তকালীন ন্যাপ নেত্রী অগ্নিকন্যা মতিয়া চৌধুরীকে লাঞ্ছিত করা হয়। দেশের সর্বত্র ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন নেতা-কর্মীদের উপর হামলা করা হয়। এ হামলা মােকাবেলার প্রয়ােজনীয় শক্তি বামপন্থিদের ছিল না। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে দুর্বল ও সাম্রাজ্যবাদী যড়যন্ত্র সফলতা লাভ করার আশঙ্কায় মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে জাসদ প্রমুখের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তাবও বাতিল করে দেয়া হয়। উল্টো আওয়ামী লীগ ১০ জানুয়ারী প্রতিরােধ দিবস’ হিসেবে পল্টনে জনসভা করে এবং ৩০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশালীন উক্তি, গুপ্তহত্যা ও নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলার অভিপ্রায়ে সারাদেশে সরকারি হরতাল পালন করে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত বীর ভিয়েতনামীদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য আয়ােজিত বিক্ষোভ-সমাবেশের প্রধান দুটি দাবিই মতিউল-কাদেরের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়। অচিরেই তােপখানা রােড থেকে মার্কিন তথ্যকেন্দ্র (ইউএসআইসি) সরিয়ে নেয়া হয়, ১ আগস্ট বাংলাদেশ ভিয়েতনামের বিপ্লবী
১৮ অবশেষে ১৭ নভেম্বর ১৯৭৩ মতান্তরে ২১ মার্চ ১৯৭৪ বিচারপতি নুরুল হুদার নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু কমিশনের রিপাের্ট সুপারিশ প্রকাশ এবং তা বাস্তবায়নে সরকারি কোন উদ্যোগের কথা জানা যায় নি। ১৯ ১৬ মার্চ ১৯৭২ শেখ মুজিবকে ডাকসু কর্তৃক এর আজীবন সদস্যপদ দেয়া হয়। তখন এর সহ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদুস মাখন ২০ স্বাধীন দেশে সরকার বিরােধী এই আন্দোলনে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি যথাযথভাবে পরিচালনার ব্যর্থতায় উদীয়মান বামপন্থি বিকল্প শক্তির জনপ্রিয়তা কমতে শুরু করে ২৯ সংবাদ, ৩১ জানুয়ারি, ১৯৭৩ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং ঢাকা-হ্যানয় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া সংবিধান রচনা ও নির্বাচন স্বল্পায়ু মুজিব-সরকারের সবচেয়ে বড় কীর্তি জনগণকে রক্তে লেখা’ সংবিধান উপহার। দান। সংবিধান-রচনায় পাকিস্তানিদের লেগেছিল ৯ বছর এবং বাঙালিদের ৯ মাস। হাজার বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন কাঠামােতে ইতােপূর্বে কয়েকবার স্বাধীন সত্তায় আসলেও এই প্রথম বাঙালির ইতিহাসে সংবিধান রচিত হল। আইনমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনের নেতৃত্বে ‘গণপরিষদ” এটি রচনা করে। এরশাদের উপ-রাষ্ট্রপতি ও বিএনপি সরকারের বর্তমান আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ-প্রসঙ্গে বলেন : মাত্র এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। এটি ছিল একটি ব্যাপক, সুলিখিত দলিল এবং এই উপমহাদেশের অন্যান্য সংবিধানের তুলনায় উন্নতমানের। কিন্তু রচনার চেয়েও কঠিন কাজ ছিল একে বাস্তবে রূপ দেয়া, যা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া ৪র্থ থেকে শুরু করে পরবর্তী সংশােধনীসমূহ (১৯৯১’র সংশােধনী ব্যতীত) এর মৌল চরিত্র বদলে দিয়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি বলে তৎকালীন বিরােধীদলীয় (ন্যাপ) একমাত্র গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এতে স্বাক্ষর করেননি। আর এখন ১৯৭২ সালের সেই সংবিধান ফেরত পাওয়ার জন্য, জনগণ ১৯৭৫ থেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। কী বিচিত্র এ দেশ! বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় ও বেশি ভােট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার বাসনা। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ বাংলাদেশের সংবিধানের অধীনে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে জাসদ ২টি, জাতীয় লীগ ১টি, স্বতন্ত্র ৬টি এবং অবশিষ্ট সব আসন আওয়ামী লীগ লাভ করে।
২২. ২৯ এপ্রিল ১৯৭২ মুজিব ভিয়েতনাম থেকে বিদেশী সৈন্য অপসারণের আহ্বান জানান এবং ১৪ মে ১৯৭২ আওয়ামী লীগ ঢাকায় এক প্রতিবাদ সভায় ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী হামলা বন্ধ করার আহ্বান জানায়। তাছাড়া বাংলাদেশ কোন প্রকার আন্তর্জাতিক জোটেই যােগদান করবেনা বললেও নির্জোট আন্দোলনে (NAM) যােগ দিয়ে কার্যত: সম্রাজ্যবাদ বিরােধী শিবিরে অবস্থান নেয় ও ২৩. ১৯৭০ সালে নির্বাচিত পাকিস্তানের ১৬৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য (এম এন এ) ও পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (এম পি এ) গণের মধ্যে দালালির অভিযােগে অভিযুক্ত ও নিহতদের বাদ দিয়ে ৪০৩ জনকে নিয়ে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ রাষ্ট্রপতির অস্থায়ী সংবিধান আদেশ বলে গণরিষদ’ গঠন করা হয়। এর সদস্যগণের (এম সি এ) মধ্য থেকে ড, কামাল হােসেনের নেতৃত্বে ৩৪-সদস্যের একটি খসড়া সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১২ অক্টোবর গণপরিষদে এর খসড়া উত্থাপিত হয়। সাধারণ আইন প্রণয়ন পদ্ধতিতে ৪ নভেম্বর তা গৃহীত হয়। ১৪ ডিসেম্বর সদস্যগণ এতে স্বাক্ষর দান করেন এবং ১৬ ডিসেম্বর থেকে তা বলবৎ ২৪. মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ শেখ মুজিবের শাসনকাল, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ১৬১ নির্বাচনের পূর্বে ১০ ফেব্রুয়ারি সকল জেলার ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের ঢাকায় ডেকে এনে শেখ মুজিব ‘নির্বাচনে সরকারি ও বিরােধীদলের মধ্যে কোনাে বৈষম্য না-করার আহ্বান জানান। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তার এই সদিচ্ছার মূল্য দেয়নি। মনােনয়নপত্র জমা দেয়ার দিন থেকেই তারা বিরােধীদলের প্রতি বিরূপ আচরণ ও স্থানে স্থানে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে। শেখ মুজিব ৪টির মধ্যে ২টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অনেক আওয়ামী নেতা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে বিশেষ মর্যাদা অর্জনের প্রতিযােগিতায় লিপ্ত হন। মাগুরার সােহরাব হােসেন, ফরিদপুরের কে এম ওবায়দুর রহমান, ভােলার তােফায়েল আহমদ এবং মােতাহার উদ্দিন বিরােধী প্রার্থীদের মনােনয়নপত্র জমা দিতেই। দেননি। রাজশাহীর এইচ এম কামারুজ্জামান, ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভূঞা, কিশােরগঞ্জের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জিল্লুর রহমান ও মনােরঞ্জন ধর বিরােধীপ্রার্থীদের মনােনয়নপত্র প্রত্যহারে বাধ্য করেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অপর দুটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টিকেও আওয়ামী লীগ মুজিবের সম্মানহানি হিসেবে বিবেচনা করে।
আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও যারা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারেননি, তারা। ‘বেশী ভােট পেয়ে তাদের জনপ্রিয়তা প্রদর্শনের প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হন। মুন্সিগঞ্জের শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন মােট ১ লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে ১ লাখ ৭ হাজার ৬ শত ও ঢাকার গাজী গােলাম মােস্তফা ১ লাখ ৬২ হাজারের মধ্যে ১ লাখ ১০ হাজার ভােট পান। শেখ মুজিব পাশের আসনে গাজী’র থেকে কম ভােট (১ লাখ ৫ হাজার) পান। এতেও মুজিবের সম্মানহানি’ বিবেচনা করে তার প্রাপ্ত ভােট বাড়িয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার ঘােষণা করা হয়! পরাজিত হয়েও নির্বাচিত টাঙ্গাইলের মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভাসানী ন্যাপের ড. আলীম আল রাজীর কাছে, সুনামগঞ্জের মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ন্যাপের (মাে.) সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কাছে, বরিশালে হরনাথ বাইন ও আবদুল মান্নান জাসদের মেজর জলিলের কাছে (২টি আসনে), নূরুল ইসলাম মঞ্জুর রাশেদ খান মেননের কাছে , ক্যাপ্টেন সুজাত আলী অধ্যাপক মােজাফফর আহমদের কাছে পরাজিত হয়েও জয়ী ঘােষিত হয়েছেন বলে। দেশবাসী মনে করে। চট্টগ্রামে ন্যাপের প্রার্থী মােশতাক আহমদ চৌধুরীকে। বেসরকারিভাবে নির্বাচিত ঘােষণা করেও পরে ১০ মার্চ বেতারে পরাজিত ঘােষণা করা হয়। ১০ মার্চ ১৯৭৩ ফরিদপুরে ন্যাপের প্রার্থীসহ ৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নির্বাচন ভাষ্যকার ও গবেষকরা মনে করেন, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ। নির্বাচনে তৎকালীন কোনাে রাজনৈতিক দলেরই আওয়ামী লীগকে মােকাবেলা করার ক্ষমতা ছিল না। তারপরেও আওয়ামী লীগের বহু নেতা ও কর্মীই নির্বাচনে অনিয়মের। ২৫ ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (বঙ্গবন্ধুর সময়কাল), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩ আশ্রয় নেয়। অন্তত ১৫টি আসনের অবস্থা ছিল অত্যন্ত বিপর্যকর, যেখানে সরকারি দলের কর্মিরা সন্ত্রাস, পুলিং এজেন্ট অপহরণ এবং ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটায়। নির্বাচনােত্তর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ড. আলীম আল-রাজী বলেন, সরকারি দলের কোন কোন বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষে প্রতি ১৮ সেকেণ্ডে একটি ভোেট পড়েছে যা বাস্তবে সম্ভব নয়।
ন্যাপপ্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, সুষ্ঠভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সকল বিরােধীদল মিলে ৫০টির মতাে আসন লাভ করত। অবজারভারের এক প্রতিবেদন মতে, বিরােধীদলকে কমপক্ষে ৩০টি আসন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিরােধীদলের দাবি পর্যালােচনা করে বলা যায়, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে পারত। অন্যদিকে সংসদে একটি দায়িত্বশীল বিরােধীদল থাকলে সরকার, দেশ ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকত। আওয়ামী লীগ দেশকে নিজেদের ‘তালুক’ মনে করে যথেচ্ছাচার করায় নির্বাচনের বিশ্বাসযােগ্যতা নষ্ট হয়। আসন বাড়াতে গিয়ে আস্থা হারা। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক চৌধুরী জানাচ্ছেন, শেখ মুজিব লন্ডনে তাকে বলেছিলেন যে, বিরােধী দলগুলাে যদি ১০০টি আসন পেত তাহলে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা অনেক কম হত।” খুবই সত্য কথা, কিন্তু নির্বাচনের পূর্বাপর ঘটনা এ-কথার সঙ্গে মেলে না। বরং কারও কারও ধারণা বিরােধীদলসমূহকে গুনে গুনে ৯টি আসন দেয়া হয়েছে। ১০টি আসন পেয়ে যেন তারা সংসদে বিরােধীদল গঠন না করতে পারে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনসংখ্যা বাড়াতে গিয়ে জনগণের আস্থা ও ভালােবাসা হারিয়েছে। বলা চলে এর মাধ্যমেই শুরু হয় জনবিচ্ছিন্নতা।” এ-প্রসঙ্গে কাজী ফজলুর রহমান বলছেন : আওয়ামী লীগ বিপুলভাবে জিতেছে।… কিন্তু যে অল্প কটি আসনে না-জেতার সামান্য সম্ভাবনাও ছিল, সেগুলােও দখল করেছে ছলে বলে কৌশলে।… ঠিকমতাে ২৫ তথ্যপঞ্জি নির্বাচন রিপাের্টিং, সেড, ঢাকা, ১৯৯৬, পৃষ্ঠা ৯৭ ২” সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভাসানী (প্রথম খণ্ড), ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৪৮১ ২৮ নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদন-১৯৭৩, সাপ্তাহিক ‘নতুন বাংলা’র ফেব্রুয়ারি ও মার্চের বিভিন্ন সংখ্যা, বাংলাদেশ অবজারভার ৯ মার্চ, এবং সংবাদ ৮-১৫ মার্চ ১৯৭৩ তিন বিশিষ্ট জনের (আনিসুজ্জামান, মাে. মুজিবুল হক, ফারুক চৌধুরী) একান্ত আলােচনা, প্রথম আলাে, ১৫ আগস্ট ২০০২ মাত্র দু’আড়াই মাস পর জুনে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে ‘অপরাজেয়’ আওয়ামী লীগ সিলেট ও রাজশাহীতে ২টি আসনে পরাজিত হয় এবং অন্যান্য আসনে জয়ী হলেও মার্চের তুলনায় কম ভােট পায় (ঢাকায় এক আসনে মার্চে ৯৩,৫৮১ ভােটের স্থলে জুনে পায় ৩৯,২১৫ ভােট)। মার্চে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত রাজশহীর আসনে জুনে ৮ হাজার ভােটের ব্যবধানে হারে। দ্রষ্টব্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, ভাসানী (প্রথম খণ্ড), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮৩-৮৪
নির্বাচন হলেও সরকারি দল বড়জোর ২০টি আসন হারাত। কিন্তু সেটাও এদের কেন সইল না … যে অবাঞ্ছিত একটা প্রিসিডেন্ট হল বিনা প্রয়ােজনে এই নির্বাচনী কারচুপিতে, তা ভবিষ্যতে দেশের জন্য শুভ হতে পারে না। বিষয়টা সাধারণ মানুষও জানে এবং নিম্নকণ্ঠে হলেও বলাবলি করছে। দেশের লােক আওয়ামী লীগকে বা তাদের মনােনীত প্রার্থীদের ভােট দেয়নি। দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। সবাই জানে এখন দেশে তার কোনাে বিকল্প নেই। বর্তমানে শাসনযন্ত্রের অক্ষমতা ও ক্রমবর্ধমান দুর্নীতির কথা জেনেশুনেই তবু মানুষ শেখ সাহেবকে ভােট দিয়েছে। তাকে দেশগড়ার জন্য আবার সুযােগ দিয়েছে। তবে পার্শ্বচরদের কবলমুক্ত হয়ে তিনি কি এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে পারবেন? চারদিকে যে চাপা অসন্তোষ ধুমায়িত হচ্ছে, তা যদি শক্তহাতে দূর না করা যায় তবে হয়তাে বছর দুইয়ের মাঝেই তাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দেখা দেবে। আর এমনটি হলে সেই আগুনে আমরা সবাই ভস্মীভূত হব।” কিন্তু এসব কথায় কান দেয়ার লােক তখন ছিল না। থাকলে এসব ঘটতে পারত। অন্তত ঘটে যাওয়ার পরও সংশােধনের চেষ্টা হত। পুনরাবৃত্তি রােধ করা হত। আর কী আশ্চর্য, দুই-আড়াই বছরের মধ্যেই অগ্নিকাণ্ডে মুজিব, তাঁর পরিবার, তাঁর আশা, তার আদর্শ সব ভস্মীভূত হল। বাস্তব অনেক সময় কল্পনাকেও হার মানায়! গণঐক্যজোট স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মােজাফফর), ন্যাপ (ভাসানী), কমিউনিস্ট পার্টি (মণিসিংহ) ও কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের একাংশের বিরােধীতার কারণে এটি যথার্থ ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। স্বাধীনতার পর প্রথমে অধ্যাপক মােজাফফর ও পরে মাওলানা ভাসানীর জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবও একই কারণে গ্রহণ করা হয়নি। ইতােমধ্যে কংগ্রেসের প্রধানব্যক্তি মনােরঞ্জন ধর আওয়ামী লীগে যােগ দেন এবং মাওলানা ভাসানী সরকার বিরােধী আন্দোলনে আত্মনিয়ােগ করেন। অন্যদিকে ভিয়েতনাম সংহতি দিবসে ছাত্র-হত্যাকে কেন্দ্র করে ন্যাপ (মােজাফফর)-কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সরকার তথা আওয়ামী লীগের দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর স্বার্থে’ এই দুরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ গণভবনে শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ (মােজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় উক্ত তিনদল একযাগে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ
৩১. কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্ন আশার দিনগুলি-দিনলিপি : ১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ১২ জুলাই ২০০২
করে। এই পটভূমিতে ১৪ অক্টোবর ১৯৭৩ ত্রিদলীয় গণঐক্যজোট’ গঠিত হয়। | ইতােপূর্বে ১৩ জুন ১৯৭৩ গণঐক্যজোটভুক্ত রাজনৈতিক দলসমূহের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ঢাকা শহরে অবৈধ রেশনকার্ড উদ্ধার সহ বিভিন্ন যৌথ কর্যক্রমের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা আশানুরূপ সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে নানা সমস্যায় মানুষ জর্জরিত। এসব সমস্যা সমাধানে সরকার ক্রমেই ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ফলে সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে সরকার বিরােধী মনােভাবের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য গণসংগঠনসমূহের ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি যথাযথভাবে কার্যকর না হওয়ায় মানুষ এদেকে সরকারের ‘বি-টিম’ হিসেবে গণ্য করে এবং এদের জনপ্রিয়তা ও দ্রুত হ্রাস পায়। এমতাবস্থায় গঠিত গণঐক্যজোট মানুষের মধ্যে কোন আশার আলাে দেখাতে ব্যর্থ হয়। অভ্যন্তরীণ দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণে এ জোট রাজনৈতিক অঙ্গনে কোনরূপ ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় নি। উপরন্তু একে মানুষ পরে গঠিত ‘বাকশালের’ ক্রন হিসেবে আখ্যায়িত করে।
৩২. ১৯৬১ সালে নভেম্বর-ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে কয়েকটি (৪টি) গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যৌথভাবে আন্দোলন গড়ে তােলার কর্মসূচি প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এসব সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব, তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া), মণিসিহ ও থােকা রায় এবং সমন্বয়কারী হিসেবে সাংবাদিক জহুর হােসেন চৌধুরী সভাসমূহে উপস্থিত ছিলেন। তখন ঢাকায় অবস্থানকারী শহীদ সােহ্রাওয়ার্দীও পরােক্ষভাবে আলােচনায় অংশ নেন। শেখ মুজিব কর্মসূচিতে ‘পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু ‘কৌশলগত কারণে তা গৃহীত হয়নি। বিস্তারিত আলােচনার পর নিম্নরূপ রূপরেখা ও কর্মসূচি গৃহীত হয় ১ পাকিস্তানের কেন্দ্রে ও প্রদেশে গণতান্ত্রিক কোয়ালিশন সরকার গঠন, ২ পূর্ববঙ্গের জন্য স্বায়ত্বশাসন, ৩ পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট প্রথা বাতিল করে সেখানকার জাতিসমূহের জন্য স্বায়ত্বশাসন, ৪ রাজবন্দিদের মুক্তি, ৫ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ৬ শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, ৭ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অবলম্বন। রূপরেখায় নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের কথাও বলা হয়। (দ্রষ্টব্য : বজলুর রহমান, ৬২-এর ছাত্র আন্দোলন : নেপথ্য প্রস্তুতি, একটি ঐতিহাসিক বেঠক ; সাপ্তাহিক একতা, ১৯ আগস্ট ১৯৮৮; খােকা রায়, সংগ্রামের তিন দশক, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৮২-৮৩; রাজনৈতিক রিপেটি, প্রথম কংগ্রস, পূর্ব-পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৫১ – ৫২। গণঐক্যজোট গঠনের লক্ষ্যে গণভবনে ত্রিদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠানের দিন (৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩) ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেল জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হয়। পরাজয়ের আশাতক্ষায় সরকার-সমর্থকরা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নির্বাচন ভন্ডুল করে দেয়-এ থেকে ও সরকার ও সরকার সমর্থক জোটের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে। একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায় ওআইসি সম্মেলন ও ধর্মনিরপেক্ষতা রাজনীতিতে ধর্মের সংমিশ্রণ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ তিক্ত। স্বাধীনতার পর প্রথম সুযােগেই সরকার সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলসমূহ নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এ-সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে বিশিষ্ট লেখক ইকবাল সিং ২১ জানুয়ারি ১৯৭২ ‘স্যোসালিস্ট ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় লেখেন : বাংলাদেশের আবির্ভাব মৌলবাদী শক্তিসমূহের উপর একটা চরম আঘাত হিসাবে এসেছে এবং সংস্কার-আন্দোলনের ফলে একটা নতুন বেগ সৃষ্টি হবে।…
প্রথমবার এই উপমহাদেশের ইতিহাসে অবস্থার এমন গুণগত পরিবর্তন এসেছে যে, পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় কাঠামাে বাংলাদেশ, ভারত, এমনকি পকিস্তানের সমাজকেও একটা মৌলিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিতে সাহায্য মুজিবও আশা করেছিলেন ধর্মীয় ইস্যুতে সৃষ্ট ও বিবদমান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ একটি প্রাবর-রাষ্ট্র (Buffer State) হিসেবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড স্বরূপ অবস্থান করবে। কিন্তু এদের আশা ফলবতী হয়নি। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষগতার নীতি পরিত্যক্ত হয়েছে। ভারতে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা স্বীকৃত থাকলেও কার্যত: সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের শাসকচক্র ধর্মাচারী (Ritualist) না হলেও সেখানে জনমনে ধর্মীয় বুদ সৃষ্টির চেষ্টা ক্রমবর্ধমান। ব্যক্তিগত জীবনে মুজিব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু প্রাত্যাহিক জীবনে নিষ্ঠধর্মাচারী বলতে যা বুঝায়, বাঙালির অধিকাংশই তা নয়, মুজিবও ছিলেন না। কথিত আছে, প্রায় চারশ বছর পূর্বে মুজিবের পূর্বপুরুষ (উর্ধ্বতন ৭ম পুরুষ) শেখ আওয়াল ধর্ম প্রচারের জন্য এদেশে আগমন করেন। শেখ আওয়ালের পুত্র শেখ জহিরুদ্দিন ধর্মপ্রচারের সাথে সাথে জীবিকার্জনে ব্যবসা শুরু করেন। ক্রমে তারা স্থানীয়দের সাথে ‘এক দেহে লীন হয়ে বাঙালি (মুসলমান) পরিচিতি লাভ করেন। মূলত মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ ও তরুণ সদস্যরা ভারতবিভাগের পর পাকিস্তানের। শুরুর দিকে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। কয়েক বছর পর ১৯৫৫ সালে মুসলিম’ শব্দ বিলােপ করে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক সংগঠনে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু সকল সদস্যই রূপান্তরিত হয়েছেন এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে এদের অধিকাংশের দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম লীগারদের থেকে ভিন্ন ছিল না, যদিও মুখে তারা ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বলতেন। তাছাড়া রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বন্ধ করা, কোনাে নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃষ্ঠপােষকতা না করে সকল ব্যক্তিকে তার নিজ ধর্ম পালনে কোনাে বাধা সৃষ্টি না-করার ‘নিরপেক্ষতার নীতি জনসাধারণ্যে প্রচার করে। ৩৪ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৩
৩৫. সিরাজ উদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়নি। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে কৃত শত্রুপক্ষের অপপ্রচার জনপ্রিয় হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জনৈক মুহিত মজুমদারের বরাতে এ এল খতিব বলেন : আওয়ামী লীগের মাঝে কিছু চরম ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি দর্শন হিসেবে রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রচলিত প্রথানুযায়ী ধর্ম পালনের যে বৈধ অধিকার রয়েছে তার পার্থক্য অনুধাবনে ব্যর্থ হন। সরকারি ছুটির তালিকা থেকে আশুরা বাদ দেওয়া হয় ও নতুন প্রত্যাশার প্রতীক হিসেবে নবান্ন উৎসবের ছুটি (১৭ ডিসেম্বর) ঘােষণা করা হয়। পরে মুজিব ছুটির তালিকায় নবান্ন দিবস বাতিল করেন এবং আশুরা দিবস যুক্ত করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম সপ্তাহেই (১৫ জানুয়ারি ১৯৭২) মুজিব সরকারি অনুষ্ঠানে মদপান নিষিদ্ধ করেন। পরে ১৬ এপ্রিল সমগ্র দেশে মদপান ও ঘােড়দৌড় ক্রীড়া নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন (ঘােড়া দৌড়ের সাথে জুয়াখেলার প্রচলন ছিল)। মদ, জুয়া প্রভৃতি বাংলাদেশে ধর্মীয়, নৈতিকতা এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞানেও অসমর্থিত। স্বাধীনতার প্রথম বছরে বাংলাদেশ বিদেশে ২২টি মিশন স্থাপন করে। ৯৮টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, ঢাকায় ২৮টি কুটনৈতিক মিশন স্থাপিত হয়। জাতিসংঘের ১০টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ বাংলাদেশ লাভ করে।” এ সাফল্য সহজে অর্জিত হয়নি। জাতিসংঘের সদস্যপদ তখনও পাওয়া যায়নি। এ পথে প্রধান বাধা পাকিস্তানের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। সৌদি আরবও ওআইসিতে পাকিস্তানের ঘনিষ্ট বন্ধু। পাকিস্তানের সঙ্গে অনেকগুলাে সমস্যার সমাধান করা প্রয়ােজন। আটকে-পড়া বাঙালি ও ‘বিহারীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানাে, যুদ্ধবন্দিদের ফেরৎ পাঠানাে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সম্পদের হিস্যা, সর্বোপরি স্বীকৃতি। মুজিব উপযুক্ত সমস্যাসমূহ সমাধানে ওআইসির ভূমিকার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ লাহােরে অনুষ্ঠেয় এর শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ইতােমধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি। দানকারীসহ বেশ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশকে মেনে নেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অনুরােধ জানায়। এ সবকিছুর ফলে সম্মেলনের আগের দিন পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃত দেয় এবং এই স্বীকৃতিকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য তাদের সংবিধান সংশােধন করে। আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হােয়ারি বােমেদীন ঢাকায় যাত্রাবিরতি করে মুজিবকে সাথে নিয়ে সম্মেলনে যান। মুজিবের উপস্থিতি ও ভাষণকে সকলে আন্তরিক স্বাগত জানান। তার ব্যক্তিত্ব রাজা-বাদশাসহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফেরার পথে
৩৬ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১২
সরদার আমজাদ হােসেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সঙ্কটকালে তৎকালীন সংসদ সদস্যদের আনুগত্য। (নিবন্ধ), দৈনিক জনকণ্ঠ, ঢাকা, ১৫ আগস্ট ২০০৩ মিশরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত বাংলাদেশ সফর করেন। ইরান ও তুরস্ক এ সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ জাতিসংঘ ১৩৬তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে (এবার আর চীন ভেটো প্রয়ােগ করেনি। তবে সৌদি আরব ও চীনের স্বীকৃতি মুজিবের মৃত্যুর পূর্বে পাওয়া যায়নি। ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সৌদি আরব ও সুদান এবং ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এ ঘটনাকে কেউ কেউ বলেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে সরে আসার পুরস্কার। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে এন দীক্ষিতের মতে : কালক্রমে বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয় এক ইসলামী প্রজাতন্ত্রে। এই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন শেখ মুজিব নিজেই, যখন তিনি ১৯৭৪ সালে লাহাের গমন করেছিলেন ইসলামী সংহতি শীর্ষ সম্মেলনে যােগদানের জন্য। কিছুদিন পরই (মার্চ মাসে) বেআইনি মুসলিম লীগের প্রাক্তন নেতা আবুল হাশিম ওআইসি সম্মেলনে যােগ দেওয়ায় মুজিবকে অভিনন্দিত করেন এবং অবিলম্বে পাকিস্তানের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু ও জেল-খাটা দালালদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানান। একাত্তরের মার্চে ঢাকায় জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘ভুট্টোর বুকে লাথি মারাে-বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।’ সেই ভুট্টো স্বাধীন বাংলায় বিপুল সংবর্ধনা লাভ করেন পঁচাত্তরের জুনে। দু’এক স্থানে পাকিস্তান-জিন্দাবাদ’ স্লোগান ওঠে বলেও শােনা। যায়। মিশর-ইসরাইল যুদ্ধে সমর্থনের নির্দশনস্বরূপ মুজিব মিশরে অক্টোবর, ১৯৭৩ -এ বিমান-ভর্তি (১ লক্ষ পাউন্ড) উৎকৃষ্ট মানের চা পাঠান। যুদ্ধে অর্থ ও অন্ত্রের প্রয়ােজন বেশি হলেও বাংলাদেশের। পক্ষে তা দেয়া সম্ভব ছিলনা। মিশর এ উপহার অত্যন্ত আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত। যুদ্ধ শেষে ১৯৭৪-এর বসন্তকালে কায়রাের কাছাকাছি (সিনাই) মরুভূমিতে সাজানাে বহুসংখ্যক টি-৫৪ ট্যাঙ্ক থেকে ৩০টি (মতান্তরে ৩২টি) ট্যাঙ্ক বাংলাদেশে উপহার দেওয়ার প্রস্তাব পাঠান একদিকে বাংলাদেশের আন্তরিকতার প্রতিদান, অন্যদিকে সদ্য-স্বাধীন দরিদ্র বাংলাদেশকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা। কিন্তু মুজিব এ প্রস্তাবে উৎসাহিত বােধ করেননি। সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে তার চিন্তা-ভাবনার সাথে সম্ভবত এ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তর ও মন্ত্রীবর্গের পরামর্শে তিনি সম্মতি দেন।
জুলাই ১৯৭৪-এ ৪০০ রাউন্ড গােলাসহ উক্ত ট্যাঙ্ক বাংলাদেশে পৌছায়। সামরিক বাহিনীর একমাত্র সাঁজোয়া রেজিমেন্ট ফার্স্ট বেঙ্গল লেন্সার্সের উপ-অধিনায়ক মেজর ফারুক আনুষ্ঠানিকভাবে এগুলাে গ্রহণ করেন। বহরের ইতােপূর্বের ৩টি ট্যাঙ্কসহ গঠিত ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট ঢাকায় মােতায়েন করা হয়। যদিও ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা ট্যাঙ্কযুদ্ধের উপযােগী নয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও ট্যাঙ্কযুদ্ধ হয়েছে যশাের, হিলি, কুমিল্লা প্রভৃতি এলাকায়। সতর্কতাস্বরূপ এগুলাের গােলাবারুদ গােপনে গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ডিপােতে তালাবদ্ধ করে রাখা হলেও সেনাপ্রধানের ঢাকায় ট্যাঙ্ক মােতায়েনের এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্যই গােলাহীন ট্যাঙ্কের আতঙ্ক সৃষ্টি করে দুষ্ট অফিসাররা ১৯৭৫-এর মধ্য-আগস্টে হত্যা যজ্ঞ ঘটাতে সক্ষম হয় * বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদাতা দেশ ও সংস্থাসমূহের তালিকার জন্য পরিশিষ্ট ৪ পড়ুন এমাজ উদ্দীন আহমদ, ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিতে শেখ মুজিবুর রহমান (নিবন্ধ), দৈনিক। ইনকিলাব, ১৫ আগস্ট ২০০২। কারাে কারাে মতে, ওআইসি সম্মেলনে স্বয়ং মুজিব না গিয়ে প্রতিনিধি পাঠালে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিটা হয়ত অক্ষুন্ন থাকতাে
মুজিবের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তিপ্রাপ্ত দালালেরা সুযােগ পেয়ে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৭৪-এ অনুষ্ঠিত স্থানীয় সংস্থার (ইউনিয়ন, পৌরসভা) নির্বাচনে বেশকিছু স্থানে এরা নির্বাচিত হয়। এদের সংখ্যা ১০-১৫ শতাংশের বেশি না হলেও এই পুনরুত্থান ছিল অশনি সংকেত। ১৬ এপ্রিল ১৯৭৫ এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সবকিছু ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে পেছনে ঠেসে দিয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা পুনরুজ্জীবনের পথ উন্মুক্ত করে। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার বা প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠলেই পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ইসলাম বিপ্ন জিগির তুলত। এসব কারণে মিশরের বাদশাহ ফারুক বলেছিলেন, মনে হয়, পাকিস্তান সৃষ্টি হবার পূর্বে ইসলাম বলতে কিছু ছিল না। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশেও তাদের দালালরা গােপনে গােপনে এই একই আওয়াজ তুলছিল। কিসিঞ্জারের আগমন ; তাজউদ্দিনের নির্গমন যুদ্ধের ক্ষত সেরে উঠার আগেই বাংলাদেশ আক্রান্ত হয় স্মরণাতীত কালের ভয়াবহ বন্যায়। বন্যার অনুষঙ্গ হয়ে দেখা দেয় মহামারী আর দুর্ভিক্ষ। ফলে দেশের দুর্বল অর্থনীতি হয়ে পড়ে আরােও বেহাল। না খেয়ে মরব, তবু শর্তযুক্ত ঋণ নেব না’ বলেছিলেন যে স্বাধীনচেতা অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, সেই তিনিই টানা ৩৭ দিনব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক দেশসমূহ সফরে গিয়ে ঋণ ও সাহায্য প্রার্থনা করে ১৩ অক্টোবর ১৯৭৪ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তাজউদ্দিনের জন্য এ ছিল এক। গ্লানিকর কর্তব্য। কিন্তু ভ্রমণ-ক্লান্তি দূর হওয়ার আগেই (২৬ অক্টোবর) ‘প্রিয় নেতা মুজিবের কাছ থেকে তিনি পেলেন এর উক্তৃষ্ট পুরষ্কার’, পদত্যাগের নির্দেশ।
৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ ওয়াশিংটনে মুজিব-কিসিঞ্জার বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার এক
৪১. এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৬
৭ অক্টোবর ১৯৭৪ আমেরিকা (জাতিসংঘে) সফর শেষে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে মুজিব ঘােষণা। করেন, সংকট সাময়িক ব্যাপার। কিন্তু সপ্তাহান্তে ১৩ অক্টোবর ৩৭ দিনের বিভিন্ন দেশ সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে তাজউদ্দিন সংকটের ভয়াবহতা উপলব্দি করে বলেন, বর্তমান অবস্থা চলতে পারে না। আমরা বালিতে মাথা গোঁজে চলতে পারি না।’ তিনি সর্বদলীয় খাদ্য কমিটি করা ও কারাবন্দি রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির পক্ষেও মত ব্যক্ত করেন। এ কারণেই তাকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয় বলে মহলবিশেষ মনে করেন। উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালের মার্চে ঢাকায় গুজব রটেছিল যে, অতিরিক্ত কাজের চাপে মুজিব অসুস্থ। তাই স্বাস্থ্য আর প্রশাসনিক প্রয়ােজনে তাজউদ্দিনকে। পুনঃ প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া হিসেবে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসকে মুজিব। বলেন, তারা কি মনে করে যে, আমি সরকার পরিচালনায় অক্ষম?’ এর পর থেকেই মুজিব। তাজউদ্দিনকে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন বলে ধারণা করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ বাংলাদেশ ১৩৬তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর এর। সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য প্রধামন্ত্রী শেখ মুজিব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথেও বৈঠক করেন।
মাসের মধ্যে (৩০ অক্টোবর) হেনরি কিসিঞ্জার ১৯ ঘণ্টার সফরে ঢাকা আসেন। এ সর্বজনবিদিত যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিপক্ষে তাে ছিলই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয় ছিল তাদের জন্য বড় রকম পরাজয়। মি. কিসিঞ্জার একে তার ব্যক্তিগত পরাজয় বলেও মনে করেন। এ হেন কিসিঞ্জারের আগমনের তিন দিন আগে তাজউদ্দিনের পদত্যাগকে রাজনৈতিক মহল সরকারের নীতিগত পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী মনে করেন। | তাজউদ্দিন ছিলেন দৈত্যকুলে প্রহাদ। বুর্জোয়া আওয়ামী পরিবারে সমাজতন্ত্রে আস্থাবান। চলনে-বলনে ধীর, কর্তব্যে নিষ্ঠাবান। মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কেউই পারিবারিক জীবন যাপন করবেন না। একমাত্র তাজউদ্দিনই এ প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন। প্রবাসে মুজিবনগর সরকার গঠন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা সর্বক্ষেত্রেই তিনি যথার্থ উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দিনের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলেই মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত সফল সমাপ্তি ঘটেছে। তবে প্রতিপদেই তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে। সকল বাধা চূর্ণ করেই তিনি উন্মোচন করেছেন সফল জগতের লৌহকপাট। দুঃখজনক যে, এসব বাঁধার একটি উল্লেখযােগ্য অংশ এসেছে নিজের দলের নেতা-কর্মীদের কাছ থেকেই। যুদ্ধ শুরু ও চলাকালে ব্যর্থ হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে তাজউদ্দিন বিরােধীরা সহজেই সফলকাম হয়।
বিশেষ ক্ষমতা আইন, জরুরী অবস্থা, ১৪৪ ধারা। স্বাধীনতার দ্বিতীয় বছরটি (১৯৭৩ খ্রি.) শুরু হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত। ভিয়েতনামীদের প্রতি সংহতি জানাতে আসা দু’জন ছাত্রহত্যা দিয়ে এবং শেষ হয় (২৭ ৪৫. কিসিঞ্জারের এই সফর বাংলাদেশ একটি তলাহীন ঝুড়ি’ উপাখ্যানের জন্ম দেয়। আর বাংলাদেশ এমনই বিচিত্র দেশ যে, এরূপ অপমানজনক মন্তব্য করার পরও বাংলাদেশী রাজনীতিকরা কিসিঞ্জারের সমালােচনা করেন না, বরং সুযােগ পেলেই এই ‘বেদ-বাক্য’ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে উপর দিকে থুথু ফেলে’। হায়! দেশের ভাবমূর্তি জ্ঞান! * স্বাধীন বাংলাদেশের মূল সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র গৃহীত হয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র অর্জনের কিছু কর্মসূচিও গৃহীত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে শেখ মুজিবের প্রকৃত মনােভাব বুঝার জন্য মার্চ ১৯৭১ -এ অসহযোেগ চলাকালে ‘এজেন্সি-ফ্রান্স-প্রেস’ এর জনৈক প্রতিবেদককে দেয়া বক্তব্য বিবেচনা করা যেতে পারে। মুজিব। বলছেন, পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার কি এটা জানে না যে, শুধুমাত্র আমি এবং শুধুমাত্র আমিই পূর্ব পাকিস্তানকে কমিউনিজমের হাত থেকে রক্ষা করতে পারি। তারা যদি আমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ন হয়, আমি ক্ষমতা হারাবাে, আর আমার জায়গা দখল করবে নক্সালপন্থিরা। আমি যদি খুব | বেশী ছাড় দিই তা হলে আমার কর্তৃত্ব নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এক কঠিন অবস্থানে রয়েছি।’ (লা ম, ৩১ মার্চ ১৯৭১, উদ্ধৃত : লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, কর্নেল তাহের সংসদ, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৪৪)
ডিসেম্বর) জামালপুরে নির্বাচনী হাঙ্গামায় পুলিশের গুলিতে ৩ জন নিহত ও ২০ জনের গ্রেফতারের মাধ্যমে। বছরের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির মধ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন ছাত্র খুন, প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, জাতীয় বেতন স্কেল ঘােষণা, পাকিস্তানী দালালদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা, রাষ্ট্রপতির পদ থেকে আবু সাঈদ চৌধুরীর পদত্যাগ প্রভৃতি অন্যতম। এছাড়া দ্রব্যমূল্য, লুটতরাজ, খুন-খারাবি প্রভৃতির ক্রমবৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সরকারি সন্ত্রাস’। বিরােধীদলের অফিস পুড়ানাে, দখল করা, এমনকি স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের টুটি চেপে ধরা হয়। বলা যায়, শুধুমাত্র দালাল ছাড়া আর কারও জন্যেই বছরটি সুখকর ছিল না। স্বাধীনতার পর দু’বছর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। জনজীবনের সমস্যা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। জাসদ, ন্যাপ (ভাসানী) ও অন্যান্য মাওবাদী দলসমূহের সরকার ও সমাজ বিরােধী কার্যকলাপও বেড়ে চলেছে একই তালে। এসব মােকাবেলায় ব্যবস্থাপনাগত ও রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে সরকার দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। ৫ জানুয়ারি ১৯৭৪ জাতীয় সংসদ বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ পাস করে। এ আইনের বলে জেলা প্রশাসক যে কোন নাগরিককে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর মনে করলে, তাকে বিনা পরােয়ানায় গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখতে পারেন। স্বভাবতঃই নিবর্তনমূলক এই আইনের বিরুদ্ধে সরকার-বিরােধী রাজনৈতিক দলসমূহের পক্ষ থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এমতাবস্থায় ১৩ জানুয়ারি প্রথমবারের মতাে সরকার। ‘জনজীবনে শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা অটুট রাখতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ পর্যন্ত সকল প্রকার সভা, মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করে।
জাসদ এই ঘােষণাকে অমান্য করে ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের। করে। পুলিশ মিছিল থেকে ১১ জনকে গ্রেফতার করে। এর প্রতিবাদে তারা পরদিন পুনঃ মিছিল বের করে এবং ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ২০ জানুয়ারি ঢাকাসহ অন্যান্য শহরেও জাসদ প্রতিবাদ মিছিল বের করে। সেদিন রাজশাহীতে সাংসদ
৪৬. কাজী ফজলুর রহমানের ভাষায়, মনে হচ্ছে অন্তত সরকারিদলের একটা প্রভাবশালী অংশ চাইছে পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে কংগ্রেস সরকার ক্যুনিস্ট আর নকশালীদের দমন করেছে, ঠিক সেভাবেই বিরােধী সকল দলকে খতম করতে। নয়মাস কলকাতা থাকাকালে এই শিক্ষাটা ভালোভাবেই নিয়েছে। তবে এখানে পশ্চিমবঙ্গের মতাে এত সহজ হবে বলে মনে হয় না।’ দ্রষ্টব্য প্রথম আলাে, ১২ জুলাই ২০০২ নিবর্তনমূলক এই আইনটি প্রণয়নের জন্য সকল মহল থেকে আওয়ামী লীগের সমালােচনা করা হয়। গত ২৯ বছরের মধ্যে সাড়ে ২৩ বছর অ-আওয়ামী সরকার ক্ষতায় থাকলেও কেউই তা বাতিল করেনি বরং প্রয়ােগ করেছে, করছে ১৮-২০ জানুয়ারি ১৯৭৪ ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। শহরে ১৪৪ ধারা জারি থাকা অবস্থায় কী করে তা সম্ভব হলাে? এমতাবস্থায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল দলের জনবিচ্ছিন্নতা নয় কী?
মইনুদ্দীন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত মিছিল থেকে ৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর ৮ মার্চ ১৯৭৪ জাসদ ঢাকায় এক সমাবেশের আয়ােজন করে ১৫ মার্চের মধ্যে তাদের ১৫ দফা দাবি পূরণের আহ্বান জানায় এবং প্রদত্ত সময়সীমার মধ্যে তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় আন্দোলনকে জঙ্গী রূপ দিয়ে ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রির বাসভবন আক্রমণ করে। সেখানে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সাথে গােলাগুলিতে ৮ জন নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়। এই সূত্রে ২৩ মার্চ রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযােগে জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় জেলা শহরগুলােতেও পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ফলে ২৪ এপ্রিল ১৯৭৪ দুনীতি, চোরাচালান, সন্ত্রাস দমনে সেনাবাহিনীকে তলব কর হয়। একই সাথে সবরকম ধর্মঘট, বিক্ষোভ মিছিল বেআইনি ঘােষণা করা হয়। ২৬ এপ্রিল ঢাকা, খুলনা, রংপুর ও সিলেটে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২৯ এপ্রিল সামরিক ও বেসামরিক যৌথ অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। এদিন কুমিল্লায় রাজনৈতিক নেতাসহ ৬০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ জুন মশিউর রহমান যাদু মিয়া ও অলি আহাদকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুলাই চট্টগ্রামে ন্যাপ নেতা গােলাম কবিরকে গ্রেফতার করাহয়। ১৪ সেপ্টেম্বর ও ১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জাসদের জনসভায় যথাক্রমে রাজবন্দিদের মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগসহ ১৬ দফা দাবি পেশ করা হয়। ২৩ নভেম্বর শাজাহান সিরাজ ও নূরে আলম জিকুকে গ্রেফতার করা হয়। ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ সমাজ বিরােধীদের কার্যকলাপের কারণে সারা দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করা হয়। ধর্মঘট, লকআউট, জনসমাবেশসহ মৌলিক অধিকার স্থগিত ঘােষণা করা হয়। ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৫ গণকণ্ঠ কার্যালয় “সিজ’ করা হয়। বাকশাল মে মাসের মাঝামাঝি পিকিং -এ চৌএন লাই-ভূট্টো এবং দিল্লিতে মুজিব-ইন্দিরা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব বৈঠকে পারস্পরিক স্বার্থ ছাড়াও মহাদেশীয় রাজনৈতিক অবস্থা গুরুত্ব পায়। এসময় ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশেরই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও অর্থনীতি সংকটাভিমুখী। ভারত সফরের পর বিভিন্ন আলােচনায় মুজিবকে প্রশাসনিক গণতন্ত্র’ ও ‘রাজনৈতিক একনায়কতন্ত্র এ দুটি নতুন রাজনৈতিক পারিভাষিক শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়। চুয়াত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতি চালু করার পক্ষে প্রচারণা চালানাে হয়। এই লক্ষ্যে আমেরিকা, ফ্রান্স, তানজানিয়া প্রভৃতি দেশের দৈনিক গণকণ্ঠ, ১৯-২১ জানুয়ারি, ১৯৭৪। ক্রমেই সরকারের দমনকার্য বৃদ্ধি পায় এবং ২৮ জানুয়ারি রক্ষীবাহিনীকে বিনা পরােয়ানায় সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়।
সাংবিধানিক মডেল পরীক্ষা করেও দেখা হয়। নভেম্বরের আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের এক সভায় সাংবিধানিক পরিবর্তন সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গক্রমে মুজিব জানান যে, তার প্রস্তাবিত সাংবিধানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে যদি সংসদীয় দলে বিরােধিতা উত্থাপিত হয়, তবে জনগণের সঠিক রায় নেবার জন্য এর উপর গণভােট গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন। সময়ের সাথে সাথে নাশকতামূলক কাজ বেড়ে চলে এবং ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করার এক পর্যায়ে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী বিল পাস হয়। এ সংশােধনীতে সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার কায়েম ছাড়াও অনেক নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। এর অন্যতম হচ্ছে, একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের বিধান এবং এ বিধান অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (BKSALবাকশাল) গঠন করা হয়। চতুর্থ সংশােধনীর আওতায় শেখ মুজিব সাংসদদের ভােটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এবং তার প্রধানমন্ত্রীর শূন্য পদে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী নিযুক্ত হন। এঁরাই যথাক্রমে বাকশালের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক হন। জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি ও আবদুর রাজ্জাক হন সম্পাদক এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আবদুল মালেক উকিল, মহিউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, শ্রী মনােরঞ্জন ধর, ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, শেখ আব্দুল আজিজ ও গাজী গােলাম মােস্তফাকে নিয়ে ১৫ সদস্যের কার্যানিবাহী কমিটিসহ ১১৫ সদস্যের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি মনােনীত করা হয়। সকল আওয়ামী লীগ সদস্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাকশালের সদস্য হওয়ার অধিকারী ছিলেন। আওয়ামী লীগের বাইরে থেকে বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পাওয়াদের মধ্যে আতাউর রহমান খান, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, সং প্রু শাইন, মােহাম্মদ ফরহাদ ও অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ অন্যতম। মওলানা ভাসানী বাকশালে যােগ দেননি।
তবে তা গঠনের দ্বিতীয় সপ্তাহে কাগমারীতে (টাঙ্গাইল) অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মুজিব-ভাসানী উভয়েরই বক্তৃতা করা, বিশেষ করে ভাসানী কর্তৃক মুজিবকে দোয়া করে বক্তৃতা করায় সকলেই একে তার প্রচ্ছন্ন সমর্থন হিসেবে গণ্য করেন। তার এই কুশলী আশীর্বাদ বামপন্থী শক্তিগুলাের বিরােধিতার তীব্রতাকে নমনীয় করে তােলে। | মূল দলের বাইরে বাকশালের ৫টি অঙ্গ সংগঠন গঠন করা হয় এবং এদের আহবায়ক মনােনীত করা হয় : ১, জাতীয় কৃষক লীগ (ফণিভূষণ মজুমদার) ২. জাতীয় শ্রমিক লীগ (ইউসুফ আলী চৌধুরী) ৩. জাতীয় মহিলা লীগ (সাজেদা চৌধুরী)। ৫” এ এল খতিব, কারা মজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯১। সংসদীয় দলের সভার দ্বিতীয় দিন। প্রস্তাবিত পরিবর্তন বিরােধী ১০ জন সাংসদ ওবায়দুর রহমানের বাসায় মিলিত হয়। কিন্তু মুজিবের। সমর্থন ছাড়া পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ সম্ভব নয় বিধায় তারা রণে ভঙ্গ দেয়। ৫ দৈনিক বাংলা, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ ৪. জাতীয় যুবলীগ (তােফায়েল আহমদ) ৫. জাতীয় ছাত্রলীগ (শেখ শহীদুল ইসলাম)। ৩ আগস্ট ১৯৭৫ বাকশালের জেলা কমিটিসমূহের সম্পাদক ও যুগ্ম সম্পাদকদের নাম ঘােষণা করা হয়। কমরেড মােহাম্মদ তােয়াহা ও কাজী জাফর প্রমুখ বাকশালে যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এদের ১৫ জন ইতােমধ্যে ১২ আগস্ট যােগদানও করেন। ২ জুন ৯টি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, ২৩মে ২২৪ জন সাংবাদিক, ৩ জুন ৩০২ জন সাংবাদিক, ৭ জুলাই মওলানা নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে ৪৯ হাজার মাদ্রাসা শিক্ষক বাকশালের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেন। | বাকশাল গঠনের বিপক্ষে ছিলেন এমন লােকের সংখ্যা আওয়ামী পরিবারে ছিল অতি নগণ্য। ১৮ জানুয়ারি ১৯৭৫ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী এক সভায় কেবল জেনারেল ওসমানী ও নূরে আলম সিদ্দিকী এর বিরােধিতা করেন। মুজিবের সামনে দাড়িয়েই ওসমানী বলেছিলেন, ‘আমরা আইয়ুব খানের মতাে কোনাে মুজিবুর খান দেখতে চাই না।’ পরে জাতীয় সংসদে ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হােসেন (হিরাে) এর বিরােধীতা করেন। এজন্য তারা সংসদ থেকে পদত্যাগও করেন। | স্বাধীনােত্তর চতুর্মুখী সংকট নিরসনে বাকশাল ছিল শেখ মুজিবের মস্তিষ্কপ্রসূত এক উদ্ভাবন।
এর উদ্দেশ্যও কর্মপন্থা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। মুজিবের সমসাময়িক বক্তৃতা থেকে যা জানা যায় তা হল : রাজনীতিবিদ ও আমলাদের। পারস্পরিক সন্দেহ দূর করা, আমলাদের দ্বারা রাজনীতিবিদদের মর্যাদা ক্ষুন্নকরণ বন্ধ করা, সমাজের জ্ঞানী-গুণী ও অন্যধরনের লােকদের সম্পৃক্ত করা। সামরিক, বেসামরিক, সরকারি, বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যতদূর সম্ভব সবাইকে নিয়ে একটি নতুন দল, নতুন System -এর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য স্থাপন করা। তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী সমবায় করা। সকল কর্মক্ষম লােক এর সদস্য হবে। এটি পাঁচ বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা। কৃষকই জমির মালিক থাকবেন। Test relief, works program, সার, টাকা প্রভৃতি ইউনিয়ন কাউন্সিলের টাউটদের পরিবর্তে তাদের (সমবায়ীদের) নিকট দেয়া হবে। জমির ফসলের একাংশ পাবে জমির মালিক, একাংশ সমবায় সমিতি ও অবশিষ্ট সরকার। বলা হয়, প্রতিটি থানায় একটি প্রশাসনিক কাউন্সিল হবে। রাজনৈতিক কর্মী বা। সরকারি কর্মচারী এর চেয়ারম্যান হবেন। বিভিন্ন বিভাগের সরকারি কর্মচারী, বাকশালের প্রতিনিধি, কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, যুব প্রতিনিধি, ব্যাংক প্রতিনিধি এর সদস্য হবেন। এরাই থানা চালাবে। সব মহকুমা জেলা হবে। প্রত্যেক জেলায় একজন গভর্নর।
৫৩. ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮০
৫৪. এক ওসমানী ও মইনুল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য যথাক্রমে পরিশিষ্ট ১৩ ও ১৫ পড়ন।
থাকবেন। সাংসদ, রাজনৈতিক কর্মী, সরকারি কর্মচারী এই গভর্নর হতে পারেন। সেখানে দলের প্রতিনিধি, সাংসদগণ, জনগণের প্রতিনিধি, সরকারি কর্মচারী থাকবেন। এই system চালু হওয়ার পর খারাপ হলে rectify করা হবে। মুজিবের ভাষায় এটাও গণতন্ত্রশােষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভােটাধিকার থাকবে। … এটা। আমাদের দ্বিতীয় বিপ্লব। এই বিপ্লবের অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে।৫৫ প্রশ্ন হচ্ছে, এজন্য বাকশাল করা কী আবশ্যক ছিল? একমাত্র তাজউদ্দিন ছাড়া সকল আওয়ামী নেতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাকশালের সদস্য ছিলেন। অঙ্গুলিয়ে ক’জন ভিন্নদলের নেতা এর কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকার শেষ দিকে স্থান পেলেন। দলের নামও কার্যত ‘আওয়ামী লীগই’ রইল। সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব মাে. মুজিবুল হকের মতে :
…চাটার দল ও দুর্নীতির হতাশা…আইন শৃঙ্খলার অবনতি, ১৯৭৪এর খাদ্যাভাবজনিত পরিস্থিতিজাত হতাশা থেকেই বাকশাল হয়েছিল। কিন্তু এসব দুষ্কর্মের হােতারা সকলেই তাে বাকশালে ঠাই পেয়েছিল। মতিউর রহমানের ভাষায়,
বাকশালের সর্বস্তরের কমিটিতে স্থান পায় কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ছিল, বহু অভিযােগ ছিল। এমনকি বাকশালের সর্বোচ্চ কমিটিতে জায়গা পেল খন্দকার মােশতাক আহমদসহ পরিচিত ষড়যন্ত্রকারীরা।” বাকশাল গঠন কী তবে আওয়ামী বিরােধীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখার কৌশল ছিল? তাদের সে সময়কার ‘এক নেতা-এক দেশ, বঙ্গবন্ধু-বাংলাদেশ’ স্লোগান থেকে তা-ই প্রতীয়মান হয়। অথচ স্বাধীনতার পর মুজিবনগর সরকারের দুই উপদেষ্টা অধ্যাপক মােজাফফর ও মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবিত জাতীয় সরকার গঠন করা হলে পরিস্থিতির এরূপ সংকটজনক মোেড় না-ও নিতে পারত।
চুয়াত্তরের বন্যা ও দুর্ভিক্ষ
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা হওয়া সত্ত্বেও নানা ধরনের শােষণের ফলে ‘সােনার বাংলা ক্রমে শ্মশানে পরিণত হয়। ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই দেশের জন্য খাদ্য আমাদানী করা প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর পরই (৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১) খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে চালুকৃত ‘বােনাস ভাউচার ব্যবস্থা বিলােপ করে খাদ্য করপােরেশন’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩০ মার্চ ১৯৭৪ এক প্রেস “ব্রিফিং’-এ খাদ্যমন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার জানান :
জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী , ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ হক প্রথম আলাে, ১৫ আগস্ট ২০০২ (তিন বিশিষ্টজনের একান্ত আলােচনা)
মতিউর রহমান, পনেরাে আগস্ট : পেছনে ফিরে দেখা (নিবন্ধ), প্রথম আলাে ১৬ ও ১৭ আগস্ট ২০০২
দেশে এবার খাদ্য ঘাটতির পরিমান ১৭ লক্ষ টন। এটা বার্ষিক ঘাটতি সরকার খাদ্য আমদানী করছেন। সুতরাং দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা নেই।” ১৯৭৩-৭৪ বর্ষে বাংলাদেশে ১১৮,২২ লক্ষ টন খাদ্যশ্য উৎপন্ন হয়। ২৯ মে ১৯৭৪ জার্মানি ও বাংলাদেশের মধ্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন গম সাহায্যের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং সেপ্টেম্বর নাগাদ ১.৫ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানির পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যেই দেশ পূর্বের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করা ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হয় এবং লক্ষ লক্ষ বন্যার্থ মানুষের প্রাণ বাঁচানাের জন্য খাদ্য সচিব ঢাকাস্থ বিদেশী মিশন প্রধানদের কাছে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন জাতিসংঘে সাহায্য চেয়ে আবেদন করেন। অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৭ দিন ব্যাপী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করে ঋণ ও সাহায্য লাভের চেষ্টা করেন। জাতিসংঘ তার ৮৬টি সদস্য দেশকে বাংলাদেশের জন্য জরুরি খাদ্য সরবরাহের আহবান জানায়। জাতিসংঘ খাদ্য সংস্থা বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস প্রদান করে এবং বাংলাদেশ জাতিসংঘের জরুরি খাদ্য সাহায্য প্রাপ্তব্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখিত প্রচেষ্টার ফলে মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ-তহবিলে ২৫ হাজার ডলার, অষ্ট্রেলিয়া ১৬ লক্ষ টাকার ত্রাণ সামগ্রী, জার্মানী ২.৫ লক্ষ টাকার ত্রাণ সামগ্রী, জাতিসংঘ ত্রাণ অফিস ২০ হাজার ডলার সাহায্য, যুক্তরাষ্ট্র ৪ মিলিয়ন ডলার এককালীন বরাদ্ধ, সােভিয়েত ইউনিয়ন ১৪ হাজার পাউন্ড সাহায্য ও বুলগেরিয়া ৭০ হাজার ডলার ত্রাণ সাহায্য দান করে। বাংলাদেশের সাহায্য দাবি বিবেচনার জন্য ২৫ অক্টোবর ১৯৭৪ প্যারিসে বিশ্বব্যাঙ্কের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৪-৭৫ অর্থ বছরে ২৭৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্যদানের সিদ্ধান্ত হয়।
৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ জাতিসংঘের মুখপত্রে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লক্ষ দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের জন্য খাদ্যের প্রয়ােজন ছিল ৫ লক্ষ টন এবং বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার টন খাদ্য প্রেরণের অঙ্গীকার করে। কিন্তু জাহাজের অভাবে তা পাঠাতে বিলম্ব হয়।” এসময় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যের আমদানি মূল্যও বেড়ে যায়। অধিকন্তু, আমদানি ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় দুনীতি-স্বজনপ্রীতি, মজুতদারিকালােবাজারি প্রভৃতির জন্য খাদ্য পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। জুন মাসে (১৯৭৪) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক খাদ্য সাহায্য বন্ধ করে দেয়ায় পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করে।
৫৮. স্বাধীনতার পর প্রাপ্ত খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্যের ফলে ১৯৭২-৭৩ সময়কালে তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। ৫৯. আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, প্রকাশক আলী আহমেদ,
সভাপতি বঙ্গবন্ধু শিক্ষাগােষ্ঠীর ঢাকা, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ২৪ ৬০. বন্যায় ৩ কোটি লােক আক্রান্ত হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্ঘটনার জন্য পরিশিষ্ট ৮ দেখুন।
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪২
১ নভেম্বর ১৯৭৪ প্রকাশিত এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায়, সারাদেশে ৫,৭৫৭ টি অন্নসত্রের (লঙ্গরখানা) মাধ্যমে প্রতিদিন ৪২ লক্ষ বন্যার্থকে এক বেলা সামান্য খাবার দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ২২ নভেম্বর ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে। খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী সাড়ে ২৭ হাজার মানুষ অনাহার ও বাধিতে’ মৃত্যু বরণ করেছে বলে জানান। কিন্তু অনেকেই মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক বলে মনে করেন। ১ জানুয়ারি ১৯৭৫ অঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, ১৯৭৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে তারা ঢাকা শহরে ২ হাজার ৪শ’ ৪৩ টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। | প্রসঙ্গক্রমে, বন্যা ও দুর্ভিক্ষ পীড়িত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রতিবিম্ব হিসেবে সে সময় কাপড়ের অভাবে ‘জাল পরা অবস্থায় রংপুরের জনৈক বাসন্তীর ছবি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরে প্রমাণিত হয়, এটি ছিল হলুদসাংবাদিক গােষ্ঠী কর্তৃক তৈরী’। ঢাকায় তখন চালের মন আড়াইশাে” টাকা। কিন্তু বাজারে চালের কোন অভাব ছিল। টাকা হলে যে কোন পরিমাণ চাল পাওয়া যাচ্ছিল। হাতে টাকা না থাকায় মানুষ খাদ্য কিনে খেতে পায়নি। অর্থাৎ সরকারে অদক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে বাংলাদেশ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের শিকার হয়।
৬২, সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪২-৪৩
৬৩. ১৪ জুন ১৯৭৩ জাতীয় সংসদে পেশকৃত বাজেটে রেশনে চাউল ও গমের দাম প্রতিমন যথাক্রমে ৪০ ও ৩০ টাকা নির্ধারনের প্রস্তাব করা হয়। একই সালের নভেম্বরে ধান ও চাউলের সরকারি সহ মূল্য যথাক্রমে ৪৫ ও ৭২ টাকা নির্ধারন করা হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রচারে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের উদাহরণস্বরূপ প্রতিমন চালের দাম যথাক্রমে ৫০ ও ২৫টাকা উল্লেখ করা হয়।
বিভিন্ন বাহিনীর জন্ম ও অপকর্মছাত্রলীগ ১৯৪৭ সালের মধ্য-আগস্টে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ভারত ভাগ করে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে বাংলায় মুসলিমলীগ-পন্থী ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। কিন্তু সে-সময় ব্যক্তিগতভাবে ছাত্র না-থাকায় এবং নিজে কলকাতায় বাস করায় তিনি পাকিস্তানের পূর্ববাংলায় ছাত্রলীগ গড়ে তােলায় আগ্রহী হন নি। এমতাবস্থায় ৪ জানুয়ারি ১৯৪৮ শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ ঢাকায় ছাত্রলীগকে পুনর্গঠিত করেন। পরে মুজিব ও অলি আহাদের মধ্যে মতবিরােধ হওয়ায় দু’জন দুই রাজনৈতিক কেন্দ্রে অবস্থান নেন। | বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের দু-চারজন নেতা-কর্মী এদিক-ওদিক গেলেও সংগঠন হিসেবে তা সবসময় মুজিবের সাথেই ছিল। ১৯৬৬ সালে ৬-দফাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দ্বিধা-বিভক্ত হয়। আবদুস সালাম খান, খন্দকার মােশতাক প্রমুখের নেতৃত্বে প্রবীন আওয়ামী লীগাররা ৬ দফার বিরােধিতা করেন। ছাত্রলীগই তখন সারাদেশে প্রচার করে ৬ দফাকে জনপ্রিয় করে তােলে। ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানে, ১৯৭০-এর নির্বাচনে, ১৯৭১ -এর অসহযােগ আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকা অনন্য। ২৩ মার্চ ১৯৭১ প্রতিরােধ দিবসে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনসহ স্বাধীনতার পক্ষে সে সময়কার নানাবিধ কাজকর্মে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ছাত্রলীগের ষাটের দশকের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সিরাজুল আলম খান রাজনৈতিক পড়াশােনার প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে, শেখ ফজলুল হক মণি সবসময় কতিপয় তরুণ আওয়ামী লীগারদের নিয়ে দল পরিবৃত্ত হয়ে থাকতে ভালােবাসতেন। মুজিবের ভাগ্নে হিসেবে তিনি সর্বত্র প্রাধিকার দাবি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকার কর্তৃক১. ১৯৬০-৭২ পর্যন্ত ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের তালিকা নিম্নরূপ : কাল সভাপতিসাধারণ সম্পাদক ১৯৬০-৬৩ শাহ্ মােয়াজ্জেম হােসেন। শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৬৩-৬ ওবায়দুর রহমান, কে এম সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৫-৬৭ সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী। আবদুর রাজ্জাক ১৯৬৭-৬৮ ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী আবদুর রাজ্জাক ১৯৬৮-৬৯ আবদুর রউফখালেদ মােহাম্মদ আলী ১৯৬৯-৭০ তােফায়েল আহমেদআসম আবদুর রব ১৯৭০-৭২ নূরে আলম সিদ্দিকীশাজাহান সিরাজ কোনােরূপ প্রাধিকার না পাওয়ায় তিনি বিক্ষুব্ধ ছিলেন এবং সেজন্য সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে কোনােরূপ সহায়তাত করেনই নি বরং সব কাজে বিরােধিতা করেছেন। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ‘র’ -এর সহযােগিতায় এসব নেতৃবৃন্দ। মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি (বা পাল্টা) মুজিব বাহিনী গড়ে তােলেন।| স্বাধীনতার পর ২১ মে ১৯৭২ প্রথম ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়নকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের চার খলিফা এবং তাদের সমর্থক বিলুপ্ত মুজিববাহিনীর সদস্যরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সিদ্দিকী-মাখনের দল শেখ মণি এবং রব-সিরাজের দল সিরাজুল আলম খানের আশীর্বাদ লাভ করে। কিন্তু উভয় দলের প্রার্থীই ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থীদের নিকট পরাজয় বরণ করে।| অল্পদিনের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনেও ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের নিকট পরাজিত হয়। এরপর সারাদেশে স্কুলকলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের জয়ের হিড়িক পড়ে যায়। উপর্যুপরি এই পরাজয় ছাত্রলীগের মধ্যকার ‘আতঙ্ক, ক্রোধ ও আক্রোশ’ আরও বাড়িয়ে দেয়। উভয় দল মুজিবের সমর্থন লাভের আশায় নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। ২০-২৩ জুলাই ১৯৭২ আহুত হয় ছাত্রলীগের উভয় দলের জাতীয় সম্মেলন। সিদ্দিকী-মাখন সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ও রব-সিরাজ পল্টন ময়দানে সম্মেলনের মঞ্চ স্থাপন করে। উভয় দলের পােস্টারে প্রধান অতিথি উদ্বোধক হিসেবে শেখ মুজিবের নাম প্রচার করা হয়।শত জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেখ মুজিব সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের সম্মেলনে যােগ দেন। আনন্দে উল্লসিত কর্মীরা স্বাধীনতা এনেছি, মুজিববাদ আনব’ শ্লোগানে সম্মেলনস্থান মুখরিত করে তােলে। স্বভাবত এরাই মুজিববাদ” কায়েমের অধিকার পায়। সম্মেলনে শেখ শহিদুল ইসলামকে সভাপতি ও এম. এ. রশিদকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিববাদী’ ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়। | অপরদিকে, পল্টনে সম্মেলন আয়ােজনকারীরা মুজিবকে নিতে ব্যর্থ হয়ে তার বিকল্প হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ছাত্রলীগ নেতা স্বপনের পিতাকে দিয়ে সম্মেলন উদ্বোধন করায়। এরা মুজিববাদের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য ঘােষণা করে।২. ডাকসু সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে শেখ শহীদুল ইসলাম ও মনিরুল হক চৌধুরী সিদ্দিকী মাখনের এবং আফম মাহবুবুল হক ও জহুরুল ইসলাম রব-সিরাজের সমর্থন লাভ করেন। জাতীয়বাদ (বাঙালি), গণতন্ত্র (সংসদীয়), ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র -এই চারটি মৌল নীতিকে তারা ‘মুজিববাদ’ ঘােষণা করে। মুজিববাদ কায়েম প্রসঙ্গে স্বয়ং মুজিব বলেছিলেন, ‘যদি এটা করতে চাও, তবে আমার মৃত্যুর পরই কোরাে।’ উদ্ধৃত: এ.এল, খতিব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৪ সিরাজুল আলম খানই প্রথম মুজিববাদের প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। কিন্তু ছাত্রলীগের বিভক্তিতে মুজিব অপর পক্ষকে সমর্থন দেয়ার ফলে জনাব খানের পক্ষে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার আর সুযােগ না থাকায় তিনি জাতীয়তাবাদ ছেড়ে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত হন। শুধু তাই নয়, মার্কসের অনুকরণে দাড়ি রেখে, লম্বা চুল রেখে (হুমায়ুন আজাদের চোখে যাকে আজকাল ভগবান রজনিশের মতাে দেখায়’) তিনি সমর্থকদের মধ্যে নিজেকে ‘দাদা” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এখন অবশ্য তিনি পুনমূষিক হয়ে বাঙালি জাতীয়বাদের উপর গবেষণা করে বই লেখে ও বছরের অধিকাংশ সময় স্বপ্নের ‘আমেরিকায় বাস করতেই স্বাচ্ছন্দ বােধ করেন।আফম মাহবুবুল হককে সভাপতি ও শরীফ নূরুল আম্বিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় এ-দলের কমিটি।দুটি ভিন্ন স্থানে সম্মেলন অনুষ্ঠান ও দুটি কমিটি করার মধ্যদিয়ে ছাত্রলীগের বিভক্তি চূড়ান্ত হয়। দু-দলের সংঘর্ষে প্রাক্তন নেতা আবদুর রাজ্জাক ও আসম আবদুর রব সহ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়। সংঘর্ষ ক্রমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে শেখ মণি ও সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিত্বের সংঘাত প্রথমে নেতৃত্বের কোন্দলে ও পরে আদর্শগত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। বিশেষজ্ঞ মহল এই বিভক্তিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে বিষবৃক্ষের অঙ্কুরােদগম বিবেচনা করে শঙ্কিত হন। অথচ মুজিব কেন এ কলহ মিটিয়ে না দিয়ে ডাকসুতে দুটি প্যানেল হতে দিলেন বা ছাত্রলীগের দুটি সম্মেলন হতে দিলেন অথবা নিজে একাংশের সম্মেলনে যােগ দিয়ে বিভক্তির আগুনে ঘৃতাহুতি দিলেন তা কারও বােধগম্য হয়নি। দিন যত যাচ্ছিল, দেশে সমস্যা তত বাড়ছিল। সেই সাথে কমছিল আওয়ামী লীগ ও মুজিবের জনপ্রিয়তা। আওয়ামী-পরিবারের একাংশ দল ছেড়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে জাসদ গঠন করলে তা হয়ে উঠে মুজিব-বিরােধীদের কণ্ঠস্বর ও আশ্রয়কেন্দ্র। এই নতুন দল ও এর রাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। | স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগে বিভক্তি ও ছাত্র ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের স্লোগান ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু বিজয়ী ছাত্র-ইউনিয়ন নানা কারণে তাদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি, উপরন্ত সরকারের ‘বি-টিম’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়। ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দেয়। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। নির্বাচনে পরাজয়ের সম্ভাবনা অনুমান করে কতিপয় শস্ত্রপাণি ছাত্রলীগ কর্মী শহীদুল্লাহ হল সহ কয়েকটি হলের ব্যালটবাক্স ছিনতাই করে। নির্বাচনের ফলাফল কেড়ে নেয়ার শিক্ষা তারা পেয়েছিল মূল দল আওয়ামী লীগের কাছ থেকেই, ৭ মার্চের (১৯৭৩) প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে থাকলে সারাদেশ দখলে থাকবে’ তত্বে বিশ্বাসী হয়ে মােনায়েম খান উপাশ্চার্য ওসমান গনির সহায়তায় এন এস এফ-কে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলে রাখার চেষ্টা করে। ছাত্রলীগও ঐ দখল-তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে ব্যালট ছিনতাই করে জয়ী হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এ ঘটনা গণতন্ত্রকে প্রশ্নের সম্মুখীন করা ছাড়াও শাসকদলের ও তাদের মিত্রদের দেওলিয়াপনা জনসমুখে উন্মােচিত করে। এখানেই শেষ নয়, বিশিষ্ট সাংবাদিক গাফফার চৌধুরীর ভাষায় : এরপর পাঁচই এপ্রিলের সেই বিভীষিকাময় দিনটি। মাঝরাতের ব্রাশফায়ারে নিহত হলেন ছাত্রলীগের সাতজন নেতা। তাদের মধ্যে একজন কোহিনূর ছিলেন শেখ কামালের ব্যক্তিগত বন্ধু। গুজব রটল, এরা শেখ।মণির সঙ্গে যােগ দিয়ে পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এবং প্রধান গ্রুপের সঙ্গে একটা সশস্ত্র সংঘর্ষের জন্যও প্রস্তুত হচ্ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযােগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধানকে পুলিশ ৭ এপ্রিল ১৯৭৪ গ্রেফতার করে।” (তােফায়েলের মাথার উপরেও গ্রেফতারি পরােয়ানা ঝুলছে বলে ঢাকায় গুজব ছিল)। পরে ২৬ জুলাই ২৬ জন ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়। দলীয় নেতার গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রলীগের একাংশ আন্দোলন শুরু করে। তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রধান সমর্থকরা ১০-১২ এপ্রিল আওয়ামী লীগ অফিসে অনশন করে। ইতােপূর্বে ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মূলত ছাত্রলীগের দুই দল ও এদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফলেই এসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১৯ এপ্রিল ১৯৭৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে পুলিশ। তল্লাশি চালিয়ে প্রধান-সমর্থকের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ যুদ্ধাস্ত্র উদ্ধার করে। এর আগে ১১ জুন বিভিন্ন হল থেকে ২ লাখ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। বলাই বাহুল্য, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য অন্যকোনাে দুষ্কৃতকারীর প্রয়ােজন ছিল না, এক ছাত্রলীগই এজন্য যথেষ্ট ছিল। এদের এসব কার্যাবলি মুজিবকে জনগণ থেকে ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও লক্ষ্যভ্রষ্ট করে ফেলে। মুজিববাহিনী ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে যুগপৎ পাকবাহিনীর আক্রমণ ও বীর বাঙালির প্রতিরােধ শুরু। হয়। কিন্তু আক্রমণের প্রচণ্ডতায় টিকতে না পেরে ক্রমে প্রতিরােধকারীরা প্রথমে গ্রামাঞ্চলে ও পরে ভারতীয় সীমান্তের ওপারে আশ্রয় গ্রহণ করে। এছাড়া বিপুল সংখ্যক লােক সীমান্ত অতিক্রম করে শরণার্থী হয়। | মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ। শুরু হয়। এক লক্ষ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়। ওসমানী। রাজনৈতিক সচেতন’ ছেলেদের রিক্রুট করার অধিকার দিয়ে এপ্রিল মাসে রাজ্জাক, ততাফায়েলকে ‘অথােরাইজেশন লেটার’ দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মন্ত্রিসভাকে এড়িয়ে রিক্রুটিং ছাড়াও তাদের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন, এর ট্রেনিং ও আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০। মুসলিম লীগ নেতা রাজাকার গমিরউদ্দিন প্রধানের ছেলে শফিউল আলম প্রধান জিয়ার সামরিকশাসনামলে নিঃশর্ত মুক্তিলাভ করে সিরাজ শিকদারের কবরে পুষ্পস্তবক দিয়ে নতুন রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করে এবং কিছুদিন পর বায়তুল মােকাররমে সােনার দোকান লুট করতে গিয়ে ধরা পড়ে কয়েক বছর জেল খাটে। [ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, (বঙ্গবন্ধুর সময়কাল) পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৫২-৫৩]। উল্লেখ্য, এই প্রধান ৩০ মার্চ ১৯৭৪ ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টনে জনসভা করে গাজী গােলাম মােস্তফা, আবিদুর রহমান প্রমুখ ২৩ জন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ তুলে তাদের বিচার দাবি করে। ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ৫১পরিচালনার অধিকার প্রদান করেন। এসব সুযােগ গ্রহণ করে তারা মুজিব বাহিনী নামে আলাদা একটি বাহিনী গড়ে তােলেন। ভারতে এসে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান ‘আট দিকপাল” গােয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং (RAW) -এর বিশেষ সমাদর লাভ করেন। র’-এর সাথে পূর্বে থেকেই তাদের, বিশেষ করে শেখ মণির ‘লবি’ ছিল বলে শােনা যায়।উত্তর প্রদেশের দেরাদুনস্থ টানডাওয়া ও আসামের হাফলং -এ মুজিববাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ, বাসস্থান, খাদ্য, পােশাক সহ যাবতীয় রসদের যােগান ‘র’-এর মাধ্যমে দেয়া হত। জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু ছিল। প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশল প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান।” | ভারত-সরকার মুজিববাহিনী গঠন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত মুজিবনগর সরকারের কাছে গােপন রাখে। প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে ‘প্রথম দল বেরিয়ে আসলে এদের নামকরণ হয় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’, পরে মুজিববাহিনী। তখনই জানা যায়, এরা আলাদা কমান্ডে চলবে; সশস্ত্রবাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী, এমনকি বাংলাদেশ সরকারেরও এদের উপর কোনাে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এরা সরকার নয়, শেখ মণির প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে। শাহজাহান সিরাজের রিপাের্ট মতে : সরকার গঠনের শুরু হতে প্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ও মুজিববাহিনীর মধ্যে কোনাে প্রকার সরাসরি যােগাযােগ ছিল না। ভারতসরকারের সহযােগিতায় প্রাক্তন ছাত্রলীগ নেতাদের আপন চেষ্টায় মুজিববাহিনী ট্রেনিং ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা লাভ করেছিল। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন : জাতি যখন সম্পূর্ণভাবে একটি নেতৃত্বের পেছনে ঐক্যবদ্ধ ও আস্থাবান তখন যুবশক্তিকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের যেমন সহায়ক হয়নি, তেমনি পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজেও অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।১৩৮. ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৩ ৯. শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমদ, আসম আব্দুর। রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদ্দুস মাখন। এই আট ছাত্র নেতা। নিজেদের মুজিবের মনােনীত প্রতিনিধি দাবি করতেন। তবে নুরে আলম সিদ্দিকী প্রেম ও বিয়েতে জড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিব্বত নিয়ে চীন-ভারত বিরােধের সময় তিব্বতী যুবকদের গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে চীনে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম পরিচালনায় জে,ওবান বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ভারতীয় মিজো ও নাগা বিদ্রোহীদের নাশকতা প্রতিরােধের দায়িত্বেও তিনি কর্মরত ছিলেন।মঈদুল হাসান, মূলধারা ১৯৭১, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা,৭৭-৮০ ১০. শাহজান সিরাজ, সাধারণ সম্পাদকের কার্যবিবরণী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪১১. আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, কাগজ প্রকাশনা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ৬৬ মুজিববাহিনীর নেতারা দাবি করেন ১, সশস্ত্রবাহিনী গড়ে-তােলার ব্যাপারে একমাত্র তারাই শেখ মুজিবের মনােনীত প্রতিনিধি ২. আওয়ামী লীগের প্রধান নেতারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলে তারাই বিকল্প নেতৃত্ব দেবেন। ৩. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনাে কারণে দীর্ঘায়িত হলে এতে বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে পারে, তাহলেও এদের মােকাবেলায় পাল্টা শক্তি হবে এই মুজিববাহিনী। ভারত সরকার | সম্ভবত ‘এক বাক্সে সকল ডিম না-রাখার জন্য মুজিববাহিনী সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়। উল্লেখ্য বিএসএফ-এর প্রধান রুস্তমজি মুজিববাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য হয়নি। মুজিব বাহিনী সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে | দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। কিন্তু পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করারপরিবর্তে ওরা মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নেয়া ও আনুগত্য পরিবর্তন করানাে, অন্যথায় তাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়াতে অধিক সক্রিয় ছিল। আমীর-উল ইসলামও স্বীকার করেন : সামরিক বাহিনীর সাথে মুজিব বাহিনীর, মুজিব বাহিনীর সাথে অনিয়মিত মুক্তিযােদ্ধা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের খুঁটিনাটি বিরােধ দেখা দেয়। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির বৈঠকেও আলােচিত হয়। এ সব নিয়ে আওয়ামী লীগেও অসন্তোষ দেখা দেয় এবং ২১ ও ২৭ অক্টোবর কলকাতায় অনুষ্ঠিত দু’টি সভায় আবদুল মমিন তালুকদার, শামসুল হক, নুরুল হক, আবদুল মালেক উকিল, এম এ. হান্নান প্রমুখ নেতা প্রকাশ্যে মুজিববাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে অভিযােগ তােলেন এবং এ বাহিনীকে এক কমান্ডের অধীনে আনার জোর দাবি করেন। ওসমানী আগস্ট মাসে রিক্রুটিং-এর জন্য এর নেতাদের প্রদত্ত্ব প্রাধিকার প্রত্যাহার করেন এবং মুজিববাহিনীকে শিঘ্রই তার কমান্ডের অধীনে না দেওয়া হলে পদত্যাগের হুমকি দেন।” কিন্তু এসবের কিছুই কার্যকরী হয়নি। উপরন্তু তাজউদ্দিনকে | প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরাতে না-পেরে তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে এবং কমান্ডাে প্রেরণ করে। উপায়ান্তর না দেখে তাজউদ্দিন ২২ অক্টোবর এ-বিষয়ে মুজিববাহিনীর সমর্থক সৈয়দ নজরুলের উপস্থিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সরাসরি অভিযােগ উত্থাপন করেন। ইন্দিরা গান্ধী ডি পি ধরকে এ-বিষয়ে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন এবং সে মােতাবেক কলকাতায় একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।বৈঠকে ভারত-সরকারের পক্ষে মেজর জেনারেল বি এন সরকার ও ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাজউদ্দিন আহমদ ও কর্নেল ওসমানী এবং১৪. মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৯ ১৫. আমীর-উল-ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৬১৬. . ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৪-৭৫ ১৭. আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৫ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৬ মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮০ মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৫মুজিববাহিনীর পক্ষে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমদ উপস্থিত ছিলেন। মুজিববাহিনী-পক্ষ নিজেদের আওয়ামী লীগের পক্ষে কথা বলার | ‘একমাত্র অধিকার দাবি করায় বৈঠক ব্যর্থ হয়। ইতােপূর্বেও ডিপি ধর এবং ‘র’-এর প্রধান রামনাথ কাও -এর সাথে মুজিববাহিনীর স্বতন্ত্র কমান্ড হেতু মুক্তিযুদ্ধের জন্য অপ্রীতিকর ও ক্ষতিকর দ্বৈত কমান্ড’ বিষয়ে আলােচনা হয়। কিন্তু ভারতীয় পক্ষের নীরব-ভূমিকায় আলােচনা ব্যর্থ হয়।মুজিববাহিনীর নেতৃবৃন্দ শুধু যুদ্ধফ্রন্টে নয়, রাজনৈতিক ফ্রন্টেও সমস্যা সৃষ্টি করে। আমীর-উল ইসলামের ভাষায় :প্রথম থেকেই মন্ত্রিসভার প্রতি আমাদের যুব সমাজের একটা অংশের বিরূপ মনােভাব ছিল। তারা মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব মেনে নিতে অনীহা প্রকাশ করছিলেন। যুবকদের এই অংশের কাজ ছিল বিভিন্নভাবে সরকারকে অপদস্ত ও হয়রানি করা। তারা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্ব সম্পর্কে কুৎসা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করে।তবে এক পর্যায়ে মুজিববাহিনীর অভ্যন্তরেও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। শেখ মণি সংগঠক, সিরাজুল আলম খান তাত্ত্বিক। এ দুইয়ের সমন্বয়ে মুজিববাহিনী। কিন্তু শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে শেখ মণির প্রতি বাহিনীর আনুগত্যের অঙ্গীকারের বিরােধী হন সিরাজুল আলম খান। শুরু হয় দুজনের ব্যক্তিত্বের লড়াই।এ সবের মধ্যদিয়েই সময় এগিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অনুগত মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ঢাকা তখন এদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। পাবর্ত্য চট্টগ্রামের মধ্যদিয়ে পথ নির্ধারিত হওয়ায় মুজিববাহিনীর ঢাকা পৌঁছাতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়। আর ততক্ষণে রচিত হয়ে যায় বিজয়ের ইতিহাস, নির্ধারিত হয়ে যায় যার যার ভূমিকা। ২৬ ডিসেম্বর জেনারেল ওবান ঢাকা পৌছান। এদিনই শেখ মণি মুজিববাহিনীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত ঘােষণা করেন। বিলােপ না করে কোনাে উপায়ও ছিল না। কারণ কুমিল্লা (মাখনের এলাকা) ব্যতীত সারাদেশে মুজিববাহিনীর সদস্যরা ততদিনে ‘শপথ ভঙ্গ করে সিরাজুল আলম খানের অনুগত হয়ে পড়ে। | মুজিববাহিনী যত-না যুদ্ধ করেছে, গুপ্তহত্যা করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। | সিরাজুল আলম খান ক্রমে জাতীয়তাবাদের বাতাবরণে (প্রকৃত প্রস্তাবে নাৎসিবাদের | অনুকরণে) মুজিববাদ’ নামে একটি মতবাদ গড়ে-তােলার প্রয়াস পান।মুজিব বাহিনী মুজিবনগর সরকারকে অপদস্ত ও হয়রানি করা পরে দেশ পুনর্গঠনের কাজে অন্তরায় হিসেবে কাজ করা ছাড়াও মুজিব ও তার সরকারকে জনগণ২১ মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫২ ২৪ ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭৫ ২৩ আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৩।থেকে বিচ্ছিন্ন করতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। এর সদস্যরা সর্বশেষ রক্ষীবাহিনীতে ও গণবাহিনীতে গিয়ে সর্বনাশের ষােলােকলা পূর্ণ করেছে। রক্ষীবাহিনী মুজিব নগর সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিবাহিনী ছাড়াও মুজিববাহিনী, (ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির) সম্মিলিত গেরিলা বাহিনী, কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনীসহ আরও কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থাপনার ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্কটি মধুর ছিল না। যুদ্ধের পর এর আরাে অবনতি ঘটে। প্রাধান্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কোনাে কোনাে স্থানে সংঘর্ষে পর্যন্ত গড়ায়। স্থানে স্থানে কিছু তরুণ অস্ত্র হাতে মুক্তিযােদ্ধা সেজে পরিস্থিতি জটিল করে তােলে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করার সাথে সাথে বাংলাদেশ মিত্রবাহিনী তথা ভারতীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা বিশেষ করে প্রতিহিংসামূলক কার্যক্রম সংগঠিত হতে না-দেয়ার ব্যপারে ভারতীয় বাহিনী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর এই নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযােদ্ধাদের বিশেষ করে মুজিববাহিনীর পছন্দ হয়নি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকা প্রত্যাবর্তন করে সকল মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান। মুজিববাহিনীর সদস্যরা মুজিব ফিরে না-আসা পর্যন্ত অস্ত্র জমাদানে অস্বীকৃতি জানায়। অধিকাংশ মুক্তিযােদ্ধা অস্ত্র জমাদানের পর তাদের প্রতি অবমূল্যায়নের আশঙ্কা করে। মুক্তিবাহিনীর অছাত্র সদস্যরা বেকার হয়ে পড়ার শঙ্কায় ভীত হয়। এ সব কারণে অস্ত্র জমাদানের আহ্বান সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলকে দেশ পরিচালনায় সুযােগদানের জন্য জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের ঘােষণা দেন। তাজউদ্দিনকে চেয়ারম্যান করে ১১-সদস্যের জাতীয় মিলিশিয়া কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাের্ড গঠন করা২৪.সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার সদস্যদের নিয়ে সরকার নিয়মিত বাহিনী’ এবং ছাত্রযুবক, কৃষক-শ্রমিক অর্থাৎ সিভিল সদস্যদের নিয়ে ‘গণবাহিনী গড়ে তুলে। গণবাহিনী জনসাধারণ্যে মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এলাকা-বিশেষে তা “ফ্রিডম ফাইটার’, মুক্তিফৌজ নামেও পরিচিতি পায়। তবে সকল বাহিনী সদস্যদের সাধারণ পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা ২৫. পশ্চাদপসরণ ও পলায়নকালে পাকবাহিনী ও রাজাকার প্রভৃতি বাহিনীর সদস্যরা যত্রতত্র অস্ত্র ফেলে দেয়। এসব যােগাড় করে কিছু তরুণ ১৬ ডিসেম্বরের পর মুক্তিবাহিনী সাজে। অচিরেই এরা। ১৬শ ডিভিশন” আখ্যা পায়। পরে ২৬. ২৪-৩১ জানুয়ারির মধ্যে বাঘা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী, কমরেড মােহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে সম্মিলিত গেরিলা বাহিনী ও শেখ মণির নেতৃত্বে মুজিববাহিনীর অস্ত্র মুজিবের হাতে সমর্পণ করা হয়। ধারণাকৃত লক্ষাধিক অস্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ৩০ হাজার অস্ত্র জমা পড়ে। বাইরে থেকে যাওয়া অবশিষ্ট বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পরে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়।হয়। বাের্ডে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, (উভয় দল), কমিউনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস ছাড়াও মুজিববাহিনীর প্রতিনিধি রাখা হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত এ বাের্ডকে কার্যকরী করা হয় নি। আওয়ামী লীগ হয়তাে সরকারি কাজে অন্য দলের শরিকানা চায়নি। পরে ৮ মার্চ ১৯৭২ গ্রাম রক্ষীবাহিনী’ বিলুপ্ত করে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠনের আদেশ জারি করা হয়। ম্যাসকারনহাসের ভাষায় :… ঐ বাহিনীর সকল সদস্যই মুজিবের ব্যক্তিগত আনুগত্য স্বীকার করে শপথ গ্রহণ করত। নামটা খুব শ্রুতিমধুর হলেও, আসলে এই বাহিনী ছিল একধরনের প্রাইভেট আর্মির মতাে এবং হিটলারের নাৎসী বাহিনীর সঙ্গে এর খুব একটা তফাৎ ছিল না। প্রাথমিকভাবে রক্ষীবাহিনীকে পুলিশের সাহায্যকারী শক্তি হিসেবে গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনীর (মুজিববাহিনীর) পুরনাে সদস্যদের মধ্যে থেকে বাছাই করা ৮ হাজার লােক নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ভিত্তি স্থাপিত হয়। ২২ জুন ১৯৭২ ঢাকা শহরে অস্ত্র তল্লাশি অভিযানের মাধ্যমে রক্ষীবাহিনীর তৎপরতা শুরু হয়। এদের সুযােগ ও কার্য সম্পর্কে বলা হয় : মুজিবের বিরােধিতা দিন দিন বাড়তে থাকলে, তিনি সেনাবাহিনীর সঠিক বিকল্প হিসেবে রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে ২৫ হাজরে উন্নীত করেন। তাদেরকে মিলিটারি ট্রেনিং, আর্মি স্টাইলে পােষাক, স্টিল হেলমেট এবং আধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয়। এর অফিসারবৃদের প্রায় সকলই ছিল রাজনৈতিকভাবে একই মতাদর্শের সমর্থক। এই বাহিনীকে খােলাখুলিভাবে মুজিব আর আওয়ামী লীগের শক্র এমনকি সমালােচকদের নিধনকর্মে ব্যবহার করা হচ্ছিল। একসময়েরক্ষীবাহিনী জনসাধারণের মনে প্রকম্পিত সন্ত্রাসের সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। সময়ান্তরে অত্যাচার-নির্যাতন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যে, এদের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মাইজদি কোটে ৯ জুন ১৯৭৩ হরতাল পালিত হয়। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ্ জানাচ্ছেন : দেশবাসীর মধ্যে যেসব সমস্যা বিরাজ করছিল, সামরিক বাহিনীর মধ্যেও তা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাছাড়া সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এ মনােভাব ছিল যে, তারা অবহেলিত। অফিসিয়াল আর্মির পাশাপাশি রক্ষীবাহিনী গঠন নিয়ে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল।৩০” বাের্ডের সদস্যবৃন্দ হলেন তাজউদ্দিন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী) ২. এ এইচ এম কামারুজ্জামান(স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী) ৩, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ) ৪. মনােরঞ্জন ধর (কংগ্রেস) ৫, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (ন্যাপ) ৬. কমরেড মণিসিংহ (কমিউনিস্ট পার্টি) ৭. তােফায়েল আহমদ (মুজিববাহিনী) ৮, আবদুর রাজ্জাক (মুজিব বাহিনী) ৯, রফিক উদ্দিন ভূঞা (আওয়ামী লীগ) ১০, গাজী গােলাম মােস্তফা (আওয়ামী লীগ) ও ১১. ক্যাপ্টেন সুজাত আলী (আওয়ামী লীগ) অ্যান্থনি মাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩০ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩০ মতিউর রহমান, পনের আগস্ট : পেছনে ফিরে দেখা (নিবন্ধ), প্রথম আলাে, ১৬ ও ১৭ আগস্ট ২০০২২৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে রক্ষীবাহিনীকে বিনা-পরােয়ানায় যে-কোনাে সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা দেয়া হয়। বলাবাহুল্য, রক্ষীবাহিনী এ ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে এবং একপর্যায়ে ‘আইনের আওতা বহির্ভূত কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট রক্ষীবাহিনীকে দোষী বলে চরম তিরস্কার করে। সুপ্রিমকোর্ট দেখতে পায় যে, রক্ষীবাহিনী আইন-কানুন, নিয়ম-পদ্ধতি ইত্যাদি কিছুই মেনে চলে। এমনকি গ্রেফতার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের কোনাে রেজিস্টারও তাদের ছিল না। কোর্টের তিরস্কারের জবাবে মুজিব ‘ঐ সকল কাজে হস্তক্ষেপ না-করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব করেন। তবে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মনে করেন :জাতীয় রক্ষীবাহিনী কোনাে ভালাে কাজই করেনি এ-কথা ঠিক নয়। বিপুল পরিমাণ বেআইনি অস্ত্র এরা উদ্ধার করেছে এবং আটক করেছে প্রচুর পরিমাণ চোরাচালানকৃত পণ্য। কালােবাজারী এবং অবৈধ গােদামজাতকারীরা রক্ষীবাহিনীর নাম শুনেই আতভক্ষ বােধ করত। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করায় এই সুনাম তারা ধরে রাখতে পারে নি।শেষ দিকে রক্ষীবাহিনীর রাশ টেনে ধরার চেষ্টা করা হয়। বাড়াবাড়ির জন্য দায়ী সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়। ২৫ নভেম্বর ১৯৭৪ রক্ষীবাহিনীর দু’জন লিডারকে চাকুরি থেকে অপসারণ করা হয়। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার ততদিনে হয়ে গেছে। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাসে রক্ষীবাহিনীর কার্যক্রম বিপুলভাবে দায়ী।স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, শুরু থেকেই মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর শুরু হয় প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযােগিতা। কোথাও কোথাও কমান্ডাররা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস পায়। এমতাবস্থায় সরকার মুক্তিবাহিনীর নাম ভাঙিয়ে কোনাে কাজ করা যাবে না বলে ঘােষণা দেয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ মুজিববাহিনীসহ মুক্তিবাহিনীর সকল ইউনিট বাতিল করা হয়।কিন্তু তারপরও অবস্থার ইতরবিশেষ হয়নি। দু’সপ্তাহ পর ১৪ মার্চ ১৯৭২ ‘আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে। বাতিল মুজিববাহিনী-সদস্যরাই নতুন নামে পূর্বের অবস্থান গ্রহণ করে।৩১. অ্যান্থনি মাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২ মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশ : শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল, ইউনিভারসিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৮৪ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০জাসদ রক্ষীবাহিনীকে ভারতীয় সৈন্য বলেও প্রচারণার প্রয়াস পায়। | ‘উ, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮লালবাহিনী আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন শ্রমিক লীগের নেতা আবদুল মান্নান বাছাইকৃত শ্রমিকদের নিয়ে লাল বাহিনী গড়ে তুলেন। বাহিনীর সদস্যদের মাথায় লাল কাপড়ের পট্টি বাধা হত। এ থেকেই এই নাম। এরা কলকারখানায় কাজ না করে রাজপথে কুচকাওয়াজ করে বেড়াত। সময় সময় বিভিন্ন স্থান থেকে লােক ধরে এনে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করত। এদের দৌরাত্ম্য এতদূর পৌছেছিল যে, ৬ দফার অন্যতম প্রণয়নকারী, আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী, সিএসপি আহমদ ফজলুর রহমান পর্যন্ত তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাননি। বেগম হাছিনা রহমানের ভাষায় ;অনেকগুলাে লােক গাড়িতে করে এসে আমাদের ধানমণ্ডির (তৎকালীন) ৩০ নম্বর রােডের বাড়িতে ঢুকল। লােকগুলাের চেহারা ছিল গুণ্ডামার্কা, আর তাদের মাথায় ছিল লাল কাপড়ের পঠি বাঁধা। সবাই জানত এরা লালবাহিনীর লােক, আর লালবাহিনী ছিল শ্রমিকলীগের সভাপতি আবদুল মান্নানের নিজস্ব গুপ্তাবাহিনী। এ লােকগুলাে এসে রহমান সাহেবকে জোর করে ধরে টেনে হিচড়ে তাদের গাড়িতে তুলল, তারপর দ্রুত গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে গেল।… বঙ্গবন্ধু তখন বাসায় ছিলেন না। হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে নাহয় অন্য কোথাও কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আমার আকুল অবস্থা দেখে বেগম মুজিবই বঙ্গবন্ধুর কাছে রহমান সাহেবের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ দেন। বঙ্গবন্ধুর হস্তক্ষেপেই লালবাহিনীর নেতা আহমদ ফজলুর রহমানকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।… …পরে প্রকাশ্য জনসভায় রহমান সাহেবের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার মতাে সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছিল লালবাহিনীর ঐ স্বঘােষিত নেতা। এসব ঘটনা থেকেই বােঝা যায় যে, হঠাৎ করে লালবাহিনীর নেতার গায়ে হাত দেওয়ার মতাে ক্ষমতা তখন বঙ্গবন্ধুরও ছিল না।শেষপর্যন্ত অবশ্য এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। ২ জানুয়ারি ১৯৭৫ লালবাহিনীর নেতা ও সাংসদ আবদুল মান্নানকে ঢাকা কটনমিল ব্যবস্থাপনা চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ততদিনে বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে।৩৬.হাছিনা রহমান, বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও আহমদ ফজলুর রহমান, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা,১৯৯৩, পৃষ্ঠা ১২৩-২৮
আগস্ট ব্যুপাকিস্তানে প্রথম যেদিন সামরিক শাসন জারি হয়, সেদিনই মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। আইয়ুবী আমলের শেষদিকে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্রের মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অভিযােগ এনে সামরিক আদালতে তার বিচারকার্য শুরু হয় এবং তাকে সূর্যের আলাে দেখতে দেওয়া। হবে না’ বলে ঘােষণা করা হয়। প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সামরিক শাসনের পাকিস্তানি আমলের অধিকাংশ সময়টাই তার কেটেছে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে সামরিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করে কনডেমড সেলে রাখা হয় এবং সেলের পাশেই একটা কবরও খনন করা হয়। ১৯৬৯ ও ১৯৭১ -দু’বারই মৃত্যুর মুখ থেকে তিনি ফিরে এসেছেন। তিনি নির্যাতিত হয়েছেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়কালটা জুড়ে। এরূপ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন আপামর জনগণ। ফলে সামরিকবাহিনীর প্রতি মুজিবের একটি স্বাভাবিক ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুজিব বলেছিলেন যে, তিনি একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনের বিরুদ্ধে। তাঁর নিজের ভাষায় আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতাে একটা দানব সৃষ্টি করতে চাই না।” (মুজিব না চাইলেও সে দানবের সৃষ্টি হয় এবং সপরিবারে মুজিবই এর প্রথম শিকার হন)। বেগম মুজিবও সেনাবাহিনীর লােকদের ভীষণ ভয় করতেন। প্রহরারত সৈন্যদের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তিনি স্বামীকে বলতেন, এ সমস্ত লােকেরা একদিন তােমার বিরুদ্ধে তাদের বন্দুক প্রয়ােগ করবে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালেই সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দেখা দেয়। ছাত্র, যুবক, মুক্তিযােদ্ধা, সামরিক বাহিনী ও আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে যুবকদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস বিদ্যমান ছিল। সংসদ সদস্য ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করায় সামরিক অফিসাররা অ-খুশি ছিল এবং তারা ওসমানীকে এড়িয়ে চলত। মুজিববাহিনী সৃষ্টি তাদের অবিশ্বাসকে আরও বৃদ্ধি করে। শফিউল্লাহ্ জিয়া ও খালেদ মােশাররফ এই তিনজনের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। অপরদিকে যুবকরা মনে করত, সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এককালে পাকিস্তানি১. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯ ২. এএল খতিব, কারা মজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬২ বাহিনীর সাথে থাকায় তাদের ভাবধারায় প্রভাবান্বিত। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নিম্নোক্ত বক্তব্যেও -এর আভাস পাওয়া যায় : সামরিক বাহিনীর সকল অফিসারের সহযােগিতা ও সম্মান আমাদের অর্জন করতে হবে। আমাদের প্রতি এদের আস্থার অভাব স্পষ্টতই দেখা যায়।… ওদের এটাও বুঝানাে দরকার যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীনতাযুদ্ধ অচল এবং নতুন দেশ গড়াও অসম্ভব। তাই দেশপ্রেমের তাগিদে যারা অস্ত্র ধরেছেন, একই কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে ওদের কাতারবন্দি হওয়াও উচিত। এ থেকে বােঝা যায়, যুদ্ধকালেই সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও আওয়ামী-বিরােধিতার বিষবৃক্ষের অঙ্কুরােদগম ঘটে। অবহেলিত সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে (৭ মার্চ ১৯৭৩) আওয়ামী লীগ মােট প্রদত্ত (৫৫.৬২ শতাংশ) ভােটের ৭৩.২ শতাংশ লাভ করে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টগুলােতে ‘ সৈন্যেরা নির্বাচনে ৮০% ভাগেরও কিছু বেশি ভােট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রদান করেছিল।’ এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সামরিকবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের অবহেলিত মনে। করত। ১১ ডিসেম্বর ১৯৭৫ প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেন : আমরা সত্যিকার অর্থে কোনাে সেনাবাহিনী ছিলাম না। কাগজপত্রে আমাদের কোনাে অস্তিত্বই ছিল না। সেনাবাহিনীর জন্য আইনগত কোনাে ভিত্তি ছিল না। টেবল অব অর্গানাইজেশন এ্যান্ড এস্টাবলিশমেন্ট বলে কিছু ছিল না। সবই ছিল ‘এডহক’। সেনাবাহিনী বেতন পেত। কারণ শেখ মুজিব তা দিতে বলেছিলেন। মুজিবের মুখের কথার ওপর আমাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর (জিয়ার চিফ অব জেনারেল স্টাফ) -এর ভাষায় : এ দেশের সেনাবাহিনী একটা স্বেচ্ছাসেবক দলের মতাে।… প্রত্যেকেই এরা। হতভাগ্য, এদের খাবার নেই, কোনাে প্রশাসন নেই, অস্ত্রশস্ত্র নেই, জার্সি নেই, গায়ের কোট নেই, পায়ের বুট পর্যন্ত নেই। শীতের রাতে এদেরকে কম্বল গায়ে। দিয়ে পাহারা দিতে হয়। আমাদের অনেক সিপাই এখনও লুঙি পড়ে কাজ করে। এদের কোনাে ইউনিফরম নেই। তদুপরি, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অজ্ঞাতে বিশেষ আর্মি চ্যানেলে গােপনীয়ভাবে’ ৬। হাজার পাউন্ড প্রশিক্ষণ ফি পাঠিয়ে মুজিবের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী দ্বিতীয় পুত্র। জামালকে বিলেতের স্যান্ডহাস্ট মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষিত করে সেনাবাহিনীর উচ্চপদের জন্য তৈরি করার বিষয়টিও সামরিকবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়াসৃষ্টি করে।৩. আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পষ্ঠা ৯৩-৯৪ ৪. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬-২৭ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৭মুক্তিযােদ্ধা বনাম প্রত্যাগত দ্বন্দ্ব ৮ মার্চ ১৯৭২ সরকার পূর্বতন ‘গ্রাম রক্ষীবাহিনী’ বিলুপ্ত করে জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ গঠন করে। এই প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্যদের নিয়ােগ, শপথ, প্রশিক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও কার্যাবলি সাধারণ মানুষ এবং সামরিকবাহিনীর মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতার পর আটকে পড়া ১,২০০ অফিসার ও ৩৫ হাজার বাঙালি জোয়ান পাকিস্তান থেকে স্বদেশে প্রত্যাগমন করেন। সামরিকবাহিনীতে মুক্তিযোেদ্ধা’ ও ‘স্বদেশ প্রত্যাগত অমুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রদত্ত দুই বছরের সিনিয়রিটিতে অমুক্তিযােদ্ধারা বিক্ষুব্ধ হন। শেখ মুজিবের মহানুভবতায় তারা। (অমুক্তিযােদ্ধা অফিসাররা) সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন এবং একের-পর-এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে শুরু করেন। তাদের ষড়যন্ত্রের প্রধান লক্ষ্যই ছিল চরিত্র হননের মাধ্যমে সিনিয়র মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের স্বপদ থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলাে দখল এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করা। প্রত্যাগতদের, বিশেষ করে পাক ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সে কর্মরতদের নিয়ােগ করাকে অনেকেই ভুল সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ মেজরদের নেতৃত্বাধীন আক্রমণকারী তিনটি দলই ছিল পাকিস্তানি-সৃষ্টি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ইন্ডিয়ান রেভল্যুশন আর্মির সদস্যদের ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীতে পুনঃনিয়ােগের সুপারিশ-সংবলিত একটি নথি অনুমােদনের জন্য গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের নিকট পাঠালে ব্যাটন নেহেরুকে বলেন, আপনি চাইলে আমি অবশ্যই তা অনুমােদন করব, তবে আমি মনে করি শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। ওদের কৃতিত্বের জন্য অন্যভাবে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। নেহেরু তাই করলেন। বাংলাদেশেও তা করা উচিত ছিল বলে রাজনৈতিক বিশেষ মহল মনে করেন। মেজর ডালিম ও গাজীর পরিবারের দ্বন্দ্ব। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকা লেডিজ ক্লাবে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে রেডক্রস চেয়ারম্যান গাজী গােলাম মােস্তফার ভাই মেজর ডালিমের স্ত্রী তাসনিমকে উদ্দেশ্য৮. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত, মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১১২। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০। মতান্তরে, গাজীর এক ছেলে। উক্ত বিয়ের কনে ডালিমের বােনকে উত্যক্ত করে এবং ডালিম তাকে চড় মারে। কেউ কেউ বলেন, ডালিমপত্নী তার নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে অপমানিত হন- যা সত্য নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা ও মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের পর ১৮। এপ্রিল ১৯৭১ কলকাতাস্থ পাক-মিশনের একজন ব্যতীত সকল কর্মকর্তা হােসেন আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেন। সেই একজন হলেন আর আই চৌধুরী। (১৯৬৪ করে আপত্তিকর মন্তব্য করে। এ নিয়ে বাদানুবাদের একপর্যায়ে গাজীর ভাড়াটে গুণ্ডাবাহিনী যােগ দেয় এবং ডালিম-তাসনিম দম্পতিকে বেইজ্জতি করে ও কিডন্যাপের চেষ্টা করে। উভয়পক্ষ থেকেই মুজিবের কাছে বিচার প্রার্থনা করা হয়। প্রচলিত বাঙালিরীতি অনুযায়ী মুজিব গাজী ও ডালিম উভয়ের হাত মিলিয়ে দিয়ে উপস্থিত সবাইকে মিষ্টিমুখ করিয়ে এর মীমাংসা করে দেন। | কিন্তু বিষয়টি এখানে শেষ হলনা। ডালিমের সহকর্মী আর্মি বন্ধুরা দুটি ট্রাকে করে গিয়ে গাজীর নয়া পল্টনের বাড়ি তছনছ করে এবং হুমকি দেয় যে, ‘ডালিমের কিছু হলে শহরে রক্ত বয়ে যাবে।’ | শৃঙ্খলাই সামরিকবাহিনীর আইন। তাই এই উদ্ধৃঙ্খল ঘটনার জন্য সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার তদন্তপূর্বক ডালিম, “ নূর, হুদাসহ ২২ জন যুবা অফিসারকে চাকরিচ্যুত বা বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। শাস্তিপ্রাপ্তরা এজন্য ব্যক্তিগতভাবে মুজিবের প্রতি বিক্ষুব্ধ হন।সালে মােনায়েমী রাজত্বে তিনি ছিলেন পাবনার পুলিশ সুপার। সরকারবিরােধী মিছিল করার অপরাধে সে-সময় তার নেতৃত্বে বহু লােককে গ্রেফতার করা হয়। কিছুদিন পর তার স্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে কলকাতা পৌছার পরে অন্যান্যদের অনুরােধে তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। যুদ্ধ চলাকালে শরফুল হক ডালিম আহত হয়ে চিকিৎসা ও বিশ্রাম গ্রহণকালে আর.আই. চৌধুরীর কন্যা তাসনিমের প্রেমে পড়ে এবং বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কি জনাব চৌধুরী তাতে রাজি না হওয়ায় ছেলে ও মেয়ে নিজেদের উদ্যোগে বিয়ে করে। পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন তাদের সকলকে মিলিয়ে দেন। (আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮)। কলকাতার সানডে’ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বাড়ীর লনে তােলা ডালিম ও তার সুশ্রী স্ত্রী তাসনিমের ছবি দিয়ে একটি প্রচ্ছদকাহিনী প্রকাশ করে। এতে প্রতিবেদক মন্তব্য করেন, তাসনিমের চেহারাই মনে হয় ১৫ আগস্টের ভােরের সংঘটিত অ্যুথানের ট্যাঙ্কগুলােকে অগ্রসর হতে উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। (এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৯) এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫০। ডালিম, তার স্ত্রী তাসনিম ও শাশুড়ি হেনা মুজিবের বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত করত (এমনকি ডালিমের চাকরি থেকে অপসারিত হওয়ার পরও)। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ডালিমের মা মারা যায় এবং শােক কাটিয়ে উঠার আগেই তার বাবা এক যুবতীকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করায় সে বাবার সাথে দীর্ঘদিন সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রাখে। ডালিম রেগম মুজিবকে মা ডাকত এবং বাঙালির প্রথানুযায়ী বিশেষ বিশেষ দিনগুলােতে তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করত। বিয়ের দু-তিন বছর পরও সন্তান না হওয়ায় ডালিম এ-সম্পর্কে বেগম মুজিবের পরামর্শ গ্রহণ করে। চাকরি থেকে অপসারিত হয়ে ব্যবসা করার জন্য মুজিব ডালিমকে লাখ লাখ টাকার লাইন্সেস আর পারমিট দিয়ে সাহায্য করেন। দু’জনই মাঝে মাঝে একসাথে মুড়ি খেতেন। মুড়ি ছিল উভয়েরই প্রিয় খাদ্য। রেহানার সাথে একদিন কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ডালিম বলে, যখন সময় আসবে। তখন তুমি জানতে পারবে কারা তােমাদের বন্ধু। হেনা অবশ্য তার জামাতাকে এজন্য ভসনা। করেন এবং দায়িত্বহীন’ কিছু না-বলার উপদেশ দেন। দুর্ভাগ্য রেহানার। প্রবাসে থাকা অবস্থায়। প্রিয় মাতা-পিতা, ভাই-ভাবী ও অন্যান্য আত্মীয়দের রক্তের দামে ‘বন্ধুদের চিনতে হয়েছে। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সর্বনাশা বার্তাটি আনন্দে-উত্তেজিত কণ্ঠে ডালিমই প্রথম বেতারে ঘােষণা করেছিল।উচ্চাভিলাষী ফারুক-রশিদ মেজর ফারুকের পুরাে নাম দেওয়ান ইশরাতুল্লাহ সৈয়দ ফারুক রহমান। তার পিতা সৈয়দ আতাউর রহমান সেনাবাহিনীতে ডাক্তার (মেজর) ছিলেন। রাজশাহীর নওগাঁর বিশিষ্ট পীরবংশে তার জন্ম। ১৯৬৫ সালে রিসালপুরস্থ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যােগ দিয়ে স্নাতক হয়ে তিনি ল্যান্ডার্স রেজিমেন্টে যােগ দেন। ১৯৭০ সালে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন এবং আবুধাবীতে ‘সেকেন্ডমেন্টে গিয়ে আর্মড রেজিমেন্টে স্কোয়াড্রন কমান্ডার (ট্যাঙ্ক কমান্ডার) হিসেবে যােগ দেন। ১৯৭১ সালের মধ্য-জুনে ব্রিটিশ সানডে টাইমস’ ও চাচা নূরুল কাদেরের পত্র মারফত বাংলাদেশে সংঘঠিত পাক-সেনাবাহিনীর গণহত্যা-সংক্রান্ত বিবরণ পেয়ে পাক-সেনাবাহিনীতে আর চাকরি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ নভেম্বর লন্ডন হয়ে তিনি স্বদেশে পৌঁছেন। মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের পিতা ছিলেন একজন প্রাথমিক শিক্ষক। কুমিল্লাদাউদকান্দি সড়কের মাঝামাঝি ছয়ফরিয়া গ্রামে রশিদের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৫ তিনি সালে সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষে বেঙ্গল রেজিমেন্টে পােস্টিং চাইলে তাকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে কমিশন দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালে রশিদ ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হয়ে ছুটিতে বেড়াতে এসে চট্টগ্রামের শিল্পপতি এস, এইচ. খানের (এ কে খানের ভাই) জ্যেষ্ঠা কন্যা জোবায়দা (টিঙ্কু)-কে বিয়ে করে কর্মস্থল উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশের বানুতে নিয়ে যান। ১৯৭১ -এ পৃথিবীর বিভিন্ন রেডিও মারফত সংবাদ পেয়ে পাক-সেনাবাহিনী ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। পিতামাতার অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১০ দিনের ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে এসে স্ত্রী-কন্যা চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে ২৯ অক্টোবর ভারতের আগরতলা গমন করেন এবং জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্সের সাথে সংযুক্ত একটি মুক্তিবাহিনী দলের সাথে ডিসেম্বরের প্রথমদিকে সিলেট সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ঐ দলটির নাম দেয়া হয়েছিল মুক্তিবাহিনী হাউইটজার ব্যাটারি-যা স্বাধীনতার পর। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট হিসেবে উন্নীত হয় এবং রশিদ হন এর কমান্ডিং অফিসার। রিসালপুরের মিলিটারি একাডেমিতে ফারুকের সাথে তার পরিচয় হয়। ফারুক তার এক ব্যাচ সিনিয়র। স্বাধীনতার পর কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে এক বনভােজনে ফারুকের নজর কাড়ে রশিদের সুন্দরী শ্যালিকা ফরিদা (উর্মি)। রশিদের মধ্যস্থতায় ১২ আগস্ট ১৯৭২ ওদের বিয়ে হয়।১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মকাল থেকে ফারুক এবং রশিদ মুজিবকে হত্যা করার পরিকল্পনা করছিল। তারা পরস্পরে ভায়রা ভাই। ঢাকা সেনানিবাসে পাশাপাশি বাড়িতে১২. মিলিটারি একাডেমিতে মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর খালেদ মােশাররফ প্রশিক্ষক ছিলেন। তারা উভয়ে ফারুককে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যােগ দিতে বললেও তিনি তা করেননিবাস করায় উভয়ে একত্রে মিলিত হবার অবাধ সুযােগ পায় এবং এক বছর ধরে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে হত্যার ছক আঁকে।হত্যার পরিকল্পনা রচনা ও বাস্তবায়ন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশে জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। স্বাধীনতার পর জাতিসংঘের ঢাকাস্থ রিলিফ অপারেশনের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘আনবৃন্ড পরিচালিত দেশব্যাপী সাহায্য কর্মসূচি। দেশটিকে বাঁচিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দুশাে কোটি ডলার পরিমাণ আন্তর্জাতিক সাহায্য পাওয়ার পরও ১৯৭৩ সালের শেষদিকে দেশটি দেউলে হয়ে যায় ঘুস, দুনীতি, স্বজনপ্রীতি, কালােবাজারির কারণে। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে ২৭,০০০ লােক (বেসরকারি মতে লক্ষাধিক) মৃত্যুবরণ করে। | দলে দলে মানুষ কাজ, খাদ্য বা ভিক্ষার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় ছুটে আসে। কিন্তু সরকার এদের পেটের আগুন নেভানাের ব্যবস্থা করতে পারেনি। উপরন্তু, বিব্রত হয়ে ঢাকা শহর পরিচ্ছন্ন করার ব্যাপক অভিযান চালিয়ে প্রায় দুই লক্ষ ছিন্নমূল ও বস্তিবাসী মানুষকে জোর করে হয় তাদের গ্রামের বাড়িতে না হয় শহর থেকে দূরে ক্যাম্পে পাঠানাের ব্যবস্থা করে। এ অবস্থার সুযােগ নিয়ে বিরােধীদল বিশেষ করে জাসদ ও মাওবাদী বিভিন্ন দল সরকার উচ্ছেদে তৎপর হয়। রাতের আঁধারে বিরােধীদের আক্রমণে ৫ জন সাংসদসহ ৪ হাজার আওয়ামী-নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে বিভিন্ন আওয়ামী বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর হাতে হাজার হাজার বিরােধীদলীয় নেতাকর্মী নিখোজ ও নিহত হয়। বিরােধী কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য প্রথমে জরুরি অবস্থা ঘােষণা, মৌলিক নাগরিক অধিকার হরণ, বিচারবিভাগের ক্ষমতা খর্বকরণ ও পরে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।সার্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার উপক্রম হলে, অর্থাৎ ঘুষ-দুর্নীতি চোরা কারবার-মজুতদারী দমন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে প্রচলিত ব্যবস্থা অকার্যকর প্রতীয়মান হলে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে এসব১৩. এএল খতিব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ ১৪ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, চোরাইকারবার প্রভৃতি কারণে ১৯ জন সাংসদ ও ৯ জন মন্ত্রির পদ বাতিল করা হয়। এসবের বিস্তারিত বিবরণের জন্যে দয়া করে পরিশিষ্ট ৫ পড়ুন ঢাকার অদূরে ডেমরায় এরূপ একটি ক্যাম্পে ৫০ হাজারেরও অধিক লােক জড়ো করা হয়েছিল। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রক্ষীবাহিনী দ্বারা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। এতগুলাে লােকের জন্য মাত্র কয়েকটা পায়খানা ও টিউবয়েল এবং নামমাত্র রেশন। ঔষদের কোনাে সরবরাহ ছিল। পরিদর্শনে যাওয়া জনৈক সাংবাদিককে ঐ ক্যাম্পবাসী এক বুড়াে বলেছিল আমাদের খাইতে দেন, আর না হয় গুলি কইরা মারেন।’ ১৮.০২.৭৫ তারিখের গার্ডিয়ান পত্রিকা ঐ ক্যাম্পটিকে ‘মুজিবের লােকদের সৃষ্ট দুর্যোগ এলাকা’ নামে অভিহিত করে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিস্তারিত জানার জন্য পরিশিষ্ট ৬ পড়ুন | কাজে সামরিক বাহিনীকে মােতায়েন করা হয়। সামরিক সদস্যরা পূর্ণ উদ্যমে উপরিউক্ত দুষ্কৃতির অভিযােগে শত শত অপরাধীদের গ্রেফতার করে। ক্ষেত্র বিশেষে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার, নৃশংস ও প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করে। (কুমিল্লায় তারা কয়েকজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাকেও গ্রেফতার করে)। এই অভিযানের মাধ্যমে সামরিক সদস্যরা একদিকে ক্ষমতার স্বাদ পায়, অন্যদিকে তাদের মধ্যে এ আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় যে, বেসামরিক প্রশাসন যেখানে ব্যর্থ, সেখানে তারা সফল হবে। অথচ সামান্য কয়েকজন সম্মানিত ব্যক্তি বাদে, সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও লােকদের সৎ হিসেবে খ্যাতি ছিল না। স্বাধীনতার পরপরই কিছু কর্মকর্তা ও সৈন্যরা ছিনতাইসহ নানা ধরনের অসামাজিক কাজে জড়িত ছিল বলে অভিযােগ পাওয়া যায়। | যা হােক উক্ত অভিযানে বিভিন্ন অভিযােগে সামরিক সদস্যদের দ্বারা গ্রেফতারকৃত অপরাধীদের অধিকাংশই দুর্ভাগ্যবশত ক্ষমতাসীন আওয়ামী দলীয় এবং কিছু দিনের মধ্যে প্রায় সবাই উপরের টেলিফোন নির্দেশে বেকসুর খালাস পেয়ে যেতে থাকে। বিষয়টি জনমনে, বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। | ১৯৭৪ সালের জুলাই মাসে ‘পরিচ্ছন্ন অভিযানের দায়িত্ব পেয়ে মেজর ফারুক ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের ব্র্যাভাে স্কোয়াড্রন নিয়ে ডেমরা এলাকায় ২১ জন লােককে হত্যাকারী এক তরুণ ডাকাত সরদারকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাকালে হত্যাকারী স্বীকার করে যে, সে একজন আওয়ামীলীগার এবং তার ওস্তাদের নির্দেশে এ-কাজ করেছে। ফারুকের ভাষায় : ‘ঐ বদমায়েশের ওস্তাদ স্বয়ং শেখ মুজিব।’ ফারুক আরাে জানায়, এরপর একটি লিখিত নির্দেশে তাকে বলা হয় যে, সে কাউকে গ্রেফতার করলে, তার নিজ দায়িত্বেই তা করতে হবে। কোনাে অঘটন ঘটে গেলে, তার জন্য তার রেজিমেন্টাল কমান্ডার কিংবা ব্রিগেড কমান্ডার কেউই দায়ী হবেন না। ফারুকের ভাষায় :এর অর্থ ছিল এরকম যে, আমাদের অনাচার-দুর্নীতি দূর করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ দেখলেই থমকে দাঁড়াতে হবে। পুরাে ব্যাপারটাই এক দুঃখজনক ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছিল।সেই সময়কালে নব-বিবাহিত এক দম্পতি তাদের গাড়িতে টঙ্গী যাওয়ার পথে মােজাম্মেল নামে এক দুর্ধর্ষ আওয়ামী লীগার ও তার সহকর্মীদের হামলার শিকার হয়।১৭ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫২। প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পর পর এমনকি শফিউল্লাহ, মীর শওকত প্রভৃতি উঁচু পদমর্যাদার অফিসারদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধের সময় অবৈধ সম্পত্তির মালিক হওয়ার অভিযােগ উত্থাপিত ও তদন্ত শুরু হয়। (ল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮) অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, হাক্কানী পাবলিশার্স (পুনর্মুদ্রণ) ২০০০, পৃষ্ঠা ৪১-৪২। অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদি এলাকায়ও অনুরূপ অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায়গাড়ির চালক ও আরােহী(স্বামী)-কে খুন করে তারা মেয়েটিকে ধর্ষণ ও হত্যা করে। অপর দু’জন সঙ্গীসহ টঙ্গীতে মেজর নাসেরের হাতে ধরা পড়ার পর মােজাম্মেল তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেয়ার অনুরােধ জানায়। মােজাম্মেলের ভাষায় :ব্যাপারটিকে সরকারি পর্যায়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন না। আজ হােক, কাল হােক, আমাকে আপনার ছেড়ে দিতেই হবে। সুতরাং টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতে আপনার আপত্তি কেন? মেজর নাসের এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে মনে করে কোর্টে সােপর্দ করে। কিন্তু কিছুদিন পরই ঐ নৃশংস তিন খুনের আসামি মােজাম্মেলকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখে সকলেই বিস্মিত হয়। সেনাবাহিনীতে ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ কাণ্ডটি শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপেই সম্ভব হয়েছিল। ডেমরা ও টঙ্গীর ঘটনাবলি মেজর ফারুক ও তার সহকর্মীদের ভাবনা ও কর্মের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠে। ফারুকের ভাষায় :আমরা এমন এক সমাজে বাস করছিলাম, যেখানে অপরাধীরা নেতৃত্ব দিচ্ছিল। বাংলাদেশ যেন মাফিয়ার কর্তৃত্বাধীনে চলে গেল। আমরা সম্পূর্ণভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। এখানে এমন এক সরকার কায়েম হয়েছিল, যে সরকার খুনের মতাে জঘন্য কাজে শক্তি যােগাত। আর এমনসব চরম কর্মকাণ্ড ঘটাত, যেগুলাে থেকে। জনগণকে ঐ সরকারের বাঁচানাের কথা ছিল। তা আর চলতে দেয়া যাচ্ছিল না। আমরা তাকে (মুজিবকে) খতম করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ফারুক ব্যক্তিগতভাবে এবং ক্ষুদ্র দলে কর্নেল আমিন আহম্মেদ, মেজর হাফিজ, মেজর সেলিম, মেজর নাসের, মেজর গাফফার, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত প্রমুখের সাথে এ বিষয়ে আলােচনা করে। তাদের সকলেরই পরিকল্পনা ছিল দীর্ঘমেয়াদি। কিন্তু ফারুক পারলে তক্ষণই মুজিবকে খতম করে দেয়ার পক্ষপাতি। এ সময় সে। ইন্দোনেশিয়ার শােকর্ন-উৎখাতের পরিকল্পনার কিছু রচনা পাঠ করে এবং শােকর্নোর। মতাে মুজিবকে গদিচ্যুত করে একটি প্রাসাদে বন্দি করে রাখার কথা ভাবে। কিন্তু পরক্ষণেই এ পরিকল্পনা বাতিল করে দেয় এই ভেবে যে, তাহলে তার (মুজিবের) নামে অন্য একটি পাল্টা শক্তি নিজে বা ভারতকে ডেকে এনে তাদের (ফারুকদের) সরিয়ে দেবে। ফারুকের ভাষায় : এর কোনাে বিকল্প নেই। মুজিবকে মরতেই হবে।’শৌখিন পাইলট ফারুক মুজিবকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাত্রাকালে হেলিকপ্টারে মারার পরিকল্পনা করে। ফ্লাইট কন্ট্রোল অফিসার স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতকে সে অনুরােধ১৯. অ্যান্থনি ম্যাসকারহ্রাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪২-৪৩ ২০. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩। উল্লেখ্য, ডেমরা, টঙ্গী বা। অন্যত্র সংঘটিত ঘটনাবলি অবশ্যই নিন্দনীয়। কিন্তু এ গুলােকে অজুহাত করে স্বাধীনতার স্থপতি এবং নির্বাচিত সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানকে সপরিবারে হত্যা করা সহস্রগুণ বেশী নিন্দনীয়। ২১. এ সময় ফারুকের বন্ধু ও ভারাভাই মেজর রশিদ ভারতে বােম্বের নিকটবর্তী দেওলালীতে ১৪। মাস ব্যাপী একটি গানারি স্টাফ কোর্সে অংশ নিচ্ছিলকরেছিল যে, যখন মুজিবকে নিয়ে হেলিকপ্টার উড়বে, তার আগেই পিস্তলসহ সে (ফারুক) তার সাথে থাকবে। তারপর রেডিও যােগাযােগ বন্ধ করে দিয়ে মুজিবকে গুলি করে মেরে মৃতদেহ সুবিধেজনক একটা নদীতে ছুড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু পরে এ পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফারুক সামরিক কায়দায় অগ্রসর হয়। ফারুকের লক্ষ্যবস্তু মুজিব। তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে ভেবে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান এবং খালেদ মােশররফের উপর যথেষ্ট অনুসন্ধান করে শক্রর পাতায় মুজিবের আত্মীয় ও প্রভাবশালী আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ মণির নাম লিখে; এই তিনজনকেই মরতে হবে।’ | পর্যটনের গাইড বইয়ে প্রকাশিত ঢাকা শহরের ছােট একটি মানচিত্রকে কেন্দ্র করে ফারুক ছদ্মবেশে পায়ে হেঁটে পদক্ষেপ মেপে মেপে দূরত্ব নিরূপণ করে নিজ পরিকল্পনায় আর্টিলারি পজিশন স্থির করে। এজন্য প্রতিরাতেই দশটার দিকে সে সাধারণ মানুষের বেশে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রােডে ঘুরে বেড়াত। মুজিবের গতিবিধি, অভ্যাস, কাজ, খাবার জায়গা প্রভৃতিও সে লক্ষ্য রাখছিল-যাতে চূড়ান্ত মুহূর্তে কোনাে ভুল না হয়। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফারুক তার কৌশলগত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করে কুর জন্য প্রস্তুত হয়। গানারী স্টাফ কোর্স সমাপনান্তে ১৯৭৫’র মার্চের মাঝামাঝি ফিরে আসা রশিদকে ফারুক তার পরিকল্পনার কথা খুলে বললে রশিদ সময়-স্বল্পতা ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতির কথা তুললেও পরে তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করে। মুজিবের বিকল্প হিসেবে তারা জেনারেল জিয়ার কথা ভাবে। ফারুক জিয়ার সাথে একটি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে এবং অনেক ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দেশের দুর্নীতি, খুন-রাহাজানি ইত্যাদির জন্য একটি পরিবর্তন প্রয়ােজন এবং সেক্ষেত্রে তার (জিয়ার) সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনা করায় জিয়ার উত্তর ছিল : আমি দুঃখিত। আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না। তােমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু একটা করতে চাও, তাহলে তােমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত। আমাকে এসবের মধ্যে টেনে না।ফারুক প্রণীত কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ৩০০ লােকের প্রয়ােজন। দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির ছিল ৬টি ইতালীয় হাউইটজার, ১২টি ইয়ােগােস্লাভীয় ১০৫২২. ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে লন্ডনে মুজিবহত্যার ওপর গ্রানাডা টেলিভিশনের জন্য একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ উপলক্ষে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস কর্তৃক ফারুকের উপরিউক্ত বক্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞসিত হলে জিয়া তা স্বীকার বা অস্বীকার কোনটিই না করে উত্তরদানে বিরত থাকেন। পুনরায় জবাব পাওয়ার চেষ্টা করায় জিয়া অ্যান্থনিকে বহুবছর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারার ব্যবস্থা করেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মার্চ আদালতে প্রদর্শিত উক্ত টিভি অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্যাসেটে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে ফারুক জানাচ্ছেন, ‘পঁচাত্তরের ২৮ মার্চ জেনারেল জিয়াকে ম্যানেজ করি। সে সময় জিয়ার বক্তব্য ছিল-সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে সরাসরি কিছু করা সম্ভব নয়, তােমরা জুনিয়ারা চাইলে গাে এ্যাহেড’ (ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬০)। জিয়া সম্পর্কে আরাে অধিক জানার জন্য পরিশিষ্ট ১২ পড়ুন।মি. মি. হাউইটজার এবং ৬০০ সৈন্য। ফারুকের ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারে ছিল ৩০টি টি৫৪ ট্যাঙ্ক ও ৮০০ সৈন্য। সুতরাং অন্যদের সাহায্য না পেলে দুই ভায়রাভাই-ই পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে সক্ষম। প্রয়ােজন শুধু দুটো শক্তিকে একত্রিত করা। | সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নিয়মানুযায়ী বেঙ্গল ল্যান্সার মাসে দু’বার রাতে ট্রেনিং এক্সারসাইজ পরিচালনা করে। রশিদ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তার আর্টিলারিকে বেঙ্গল ল্যান্সারের সাথে একত্রে ট্রেনিং করার প্রস্তাব পেশ করে। এসব এক্সারসাইজের উদ্দেশ্য হল, অন্ধকারে নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র বেছে নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার কৌশল সম্পর্কে সৈন্যদের সম্যক অবগত করা। সুতরাং এ ট্রেনিং একত্রে হলে উভয় পক্ষই একে অপরের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে মনে করে সেনাসদর রশিদের প্রস্তাবে অনুমতি দিয়ে ফারুকের ট্যাঙ্ক ও রশিদের আর্টিলারি একত্রিত হওয়ার সুযােগ করে দেয়। কয়েকমাস ধরে চলা, দুই বাহিনীর রাত্রিকালীন মহড়ায় পাশ্ববর্তী সকলেই ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রের গুলির আওয়াজে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে মধ্য-আগস্টে ভিন্ন উদ্দেশ্যে বের হলেও লােকে এদের সন্দেহ করে না। ইতােমধ্যে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ও একদলীয় বাকশাল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ থেকে ৬১টি জেলায় মুজিব মনােনীত ‘গভর্নরগণ স্থানীয় প্রশাসন পরিচালনা শুরু করবেন। গভর্নরগণ নিজ নিজ এলাকায় অবস্থিত পুলিশ, বিডিআর, রক্ষী ও সামরিক বাহিনীর ইউনিটেরও নিয়ন্ত্রণ করবেন। শাসনব্যবস্থায় এই পরিবর্তনকে দ্বিতীয় বিপ্লব’ আখ্যায়িত করা হয়।এমতাবস্থায় ফারুক ও রশিদ দু’জন মিলে ১ সেপ্টেম্বরের পূর্বেই আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়। ফারুক ৩ জুলাই থেকেই চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত ছিল। তার রণকৌশলের পরিকল্পনা ও সৈন্যসামন্তও প্রস্তুত। ডায়েরি তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাতে বেঙ্গল ল্যান্সার ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির পরবর্তী যৌথ নৈশ ট্রেনিং অনুষ্ঠিত হবে। রাত পােহালে শুক্রবার। শুক্রবারের জাতক ফারুক পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসার দিনটি ছিল শুক্রবার। ফরিদার সাথে তার বিয়েও হয় শুক্রবারে। ধর্মীয় দিক থেকেও দিনটি গুরুত্ববহ। ফারুকের ধারণা, সে ইসলাম২৩. ফারুক ৩০ মার্চ ১৯৭৫ পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য তৈরি হয়ে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে, তার বড় বড় বুলি আওড়ানাে বন্ধুদের সবাই নিষ্ক্রিয়। মেজর হাফিজ, কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী। প্রমুখ রণে ভঙ্গ দেয়। এ সময় রশিদকে যশাের গানারী স্কুলে বদলি করা হলে কর্নেল শাফায়াত জামিলের অপ্রত্যাশিত সহায়তায় সে এপ্রিলে (৭৫) ঢাকাস্থ দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে কমান্ডিং অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে আসে। ২৪. কমান্ডিং অফিসৱা (সিও) ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের দেয়া বার্ষিক ট্রেনিং নীতিমালা অনুযায়ী নিজেদের ট্রেনিং প্রােগ্রাম তৈরি করে নিজ দায়িত্বে নিজেদের এলাকায় তা পরিচালনা করে। ইতঃপূর্বে নাইট ট্রেনিঙে দুটি ইউনিটের যৌথ অংশগ্রহণের নিয়ম ছিল না। ট্রেনিঙে লাইভ এমনিশন। নেয়ারও নিয়ম নেই। অ্যান্থনি মাসকারহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫২।আর দেশের স্বার্থে এ কাজ করতে যাচ্ছে। তাই এবারও শুক্রবার তার জন্য শুভ হবে। জিয়াকে দলে ভেড়াতে না পেরে ফারুক রশিদের ওপর রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে মুজিবের উত্তরসুরি বাছাইয়ে দায়িত্ব দিল। রশিদ চারটি দিক থেকে বিপদের সম্ভাবনার কথা ভাবলাে। ১. আওয়ামী লীগ, ২. রক্ষীবাহিনী ৩. মুজিব নিহত হলে প্রতিশােধ পরায়ণ লােকজন কর্তৃক আওয়ামী লীগারদের নির্বিচার হত্যা ও ৪, ভারতীয় হস্তক্ষেপ। রশিদ আওয়ামী লীগ থেকেই মুজিবের উত্তরসুরি বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর ফলে তার মতে, আওয়ামী লীগ ও রক্ষীবাহিনী বিদ্রোহী হবে না, প্রতিশােধ পরায়ণকারীরা সাহসী হবে না এবং ভারতীয় হস্তক্ষেপেরও সম্ভাবনা থাকবে না। কিন্তু মুজিবের বিকল্প বের করা খুব সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মােশতাককে রশিদ পছন্দ করল। | মােশতাক তখন বানিজ্য মন্ত্রী ও বাকশালের তিন নম্বর সদস্য। তিনি ও রশিদ। একই-কুমিল্লা জেলার অধিবাসী ও পরস্পরের আত্মীয়। তিনি একজন খ্যাতিমান এ্যাডভােকেট ও দাউদকান্দির পীরের সন্তান। আওয়ামীলীগার হিসেবেও তিনি কম বিতর্কিত। রশিদের ধারণা, তাকে পুতুলের মতাে যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে এবং সুবিধামতাে যে-কোনাে মুহূর্তে সরিয়ে দেয়াও সহজ হবে।১৯৭৫ সালের মার্চের শেষদিকে, খন্দকার মােশতাকের পৃষ্ঠপােষকতায় ও মাহবুবর আলম চাষীর উদ্যোগে কুমিল্লাস্থ বার্ডে’ (বাংলাদেশ একাডেমি অব রুরাল ডেভলাপমেন্ট) তিনদিনব্যাপী চট্টগ্রাম-বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে বিভাগের সকল ডিসি/এডিসি ছাড়াও মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, মাহবুব আলম চাষী, অধ্যাপক খুরশিদ আলম (কুমিল্লার গভর্নর মুজিব হত্যা মামলার ৪৩ নং সাক্ষি) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিকালে একটি আর্মি-জিপে সিভিল ড্রেসে মােশতাকের ভাগ্নে মেজর রশিদ ও মেজর বজলুল হুদা। বার্ডে আসেন এবং মাহবুব আলম চাষী ও তাহেরদ্দিন ঠাকুরসহ রেস্ট হাউসে মােশতাকের কক্ষে বৈঠক করেন।২৭. ফারুক ব্যক্তিগত জীবনে কতখানি ধর্মনিষ্ঠ তা জানা নেই। তবে তার এই ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে তিনি ঐশী মঞ্জুরীর প্রত্যাশায় কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামের হালি শহরের জন্মান্ধ বিহারী পীর আন্ধা হাফিজের সরণাপন্ন হন। পীর তাকে ১. আল্লাহ আর ইসলামের জন্য ছাড়া ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিছু না করা, ২. শক্তি অর্জন করা ও ৩. সঠিক সময় বেছে নেয়ার (আরাে তিন মাস অপেক্ষা করার) পরামর্শ দেন। ১৪ আগস্ট ফারুকের স্ত্রী ফরিদা পীরের সাথে সাক্ষাৎ করে সবুজ সংক্ষেতসহ পাঠ করার জন্য দুটি সুরা সংগ্রহ করে। [অ্যান্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫১ ও ৬৬-৬৭) মােশতাক সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দয়া করে পরিশিষ্ট ১১ পড়ুন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মােশতাক মুজিবনগর সর্বকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাহবুব আলম চাষী পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন। উভয়ে মিলে তারা আমেরিকার সহায়তায় পাকিস্তানের সাথে আপসমূলক কনফেডারেশন করার চক্রান্ত করে ধরা পড়েন ও দায়িত্ব হারান। পরে মুজিব কর্তৃক পুনর্বাসিত হয়ে মােশতাক চাষীকে বার্ডে নিয়ােগের ব্যবস্থা করেন। ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১৬, ১৭, ৫৬ ও ১৯০মে-জুন মাসে মােশতাকের গ্রামে অনুষ্ঠিত এক ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলায় মােশতাকের আমন্ত্রণে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী, সংসদের চিফ হুইপ শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, আলী আশরাফ এমপি ও অধ্যাপক খুরশিদ আলম অতিথি হয়ে আসেন। খেলাশেষে মােশতাকের বাড়িতে চা-পানের সময় মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও শাহ মােয়াজ্জেম উচ্চকণ্ঠে মুজিবের বিভিন্ন পলিসি ও কর্মসূচির সমালােচনা ও বিদ্বেষমূলক কটাক্ষ করেন। এই সময়কালে গাজীপুরের শালনা হাইস্কুলে ঢাকা-বিভাগীয় স্বনির্ভর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন চলাকালে মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার, মেজর ফারুক সহ ৪/৫ জন সেনা-অফিসার সেখানে উপস্থিত হন। মােশতাক তাদেরকে সমবায় মন্ত্রী সামসুল হক এবং তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাদের আন্দোলনের অবস্থা জানতে চান।১৯৭৫-এর জুন-জুলাই মাসে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে স্বাস্থ্য সচিব ডা. টি. হােসেন ও পরিকল্পনা সচিব ড. সাত্তার, খােন্দকার মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক খুরশিদ আলম, সাংসদ আলী আশরাফ, মাহবুব আলম চাষী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সম্মেলন চলাকালে আর্মির জিপে মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার, মেজর বজলুল হুদা প্রমুখ সেখানে আসেন এবং সম্মেলন শেষে তারা মােশতাক, ঠাকুর ও চাষী সমভিব্যাহারে মােশতাকের বাড়িতে যান। এছাড়া আইয়ুব আমলের জেনারেল এম আই করিম ও জনৈক জেনারেল চৌধুরীর সাথেও মােশতাকের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল এবং তারা তার গুলশানস্থ বাসভবনে যাতায়াত করতেন। | এ সময় কালে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল একদিন রশিদকে তার অফিসে ডেকে জানালেন যে, তার রশিদের) নাম জড়িয়ে ঢাকায় একটি অভ্যুত্থানের কথা শােনা যাচ্ছে। রশিদ বিপদ আঁচ করতে পেরে বেপরােয়া হয়ে ওঠে এবং বলে : | যদি আমার ওপর কোনাে কিছু চাপানাে হয়, তাহলে আপনাকেও আমি ছাড়ছি।… আমি বলব যে, আমি যা কিছুই করেছি সবই আপনার নির্দেশানুযায়ী। করেছি।… আমি বলব … আপনার কাজের সুবিধের জন্যই আপনি আমাকে। যশােরের বদলী বাতিল করিয়ে ঢাকায় থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ-কথা শােনার পর কর্নেল জামিল রশিদের সাথে এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করলেও রশিদ খুব কাছেই বিপদ-সংকেত দেখতে পাচ্ছিল। ফলে সে-ও ফারুকের।৩১. ১৯৭৪ সালে প্রলয়ঙ্করী বন্যার পর কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমির পরিচালক মাহবুব আলম। চাষীর উদ্যোগে খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পরে তা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়ে। ‘স্বনির্ভর বাংলাদেশ’ কর্মসূচি হিসেবে সারাদেশে চালু হয়।৩২. ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১৯ ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯০-৯১, ২১৯৩৩. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭মতােই মুজিবহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। তার ভাষায়, ‘আমাদের আর পিছিয়ে আসার পথ ছিল না। হয় তার (মুজিবের) সমাধি রচিত হবে, না হয় আমাদের।’ ২ আগস্ট ১৯৭৫ সন্ধ্যে ৭ টায় রশিদ আগামসিহু লেনের বাড়িতে মােশতাকের সাক্ষাপ্রার্থী হয়। সবার দৃষ্টি এড়ানাে ও সন্দেহ দূর করার জন্য রশিদ বেসামরিক পােশাকে স্কুটার কেনার পারমিটের একটি দরখাস্তসহ উপস্থিত হয়। দোতলার একটি ঘরে প্রায় দু-ঘণ্টা তারা আলাপ করেন। রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর মােশতাকের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে সাহস পেয়ে রশিদ জিজ্ঞাসা করেন : আওয়ামী লীগের প্রবীনতম সদস্য এবং শেখ মুজিবের একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লােক। হিসেবে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে দেশ কোনাে উন্নতি প্রত্যাশা করতে পারে বলে আপনি মনে করেন কি? মােশতাক পরিষ্কার ভাষায় জবাব দেন : , জাতি তার নেতৃত্বে কোনাে উন্নতি প্রত্যাশা করতে পারে না। ‘এটাই যদি সত্যি হবে, তাহলে আপনারা তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন না কেন?’ রশিদের এ প্রশ্নের উত্তরে মােশতাক বলেন এটাও আসলে অতটা সহজ নয়। দেশের এ পরিস্থিতিতে কেউ যদি শেখ মুজিবকে জোরপূর্বক সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, তাহলে তা কি ঠিক হবে? রশিদের এ প্রশ্নের উত্তরে মােশতাকের জবাব : এটি একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ। তবে কেউ যদি তা করতে পারে তাহলে সম্ভবত সেটি হবে একটি মহৎকর্ম। | ১২ আগস্ট ১৯৭৫ ফারুক-ফরিদা দম্পতির তৃতীয় বিয়ে বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা গলফ ক্লাবে এক জাঁকজমক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। রাতে প্রীতিভােজ শেষে অতিথিদের সবাই চলে যাওয়ার পর ফারুক-রশিদের পারিবারিক ছােট একটি দল লনে কফির সাথে সামান্য নাস্তা নিয়ে আলাপচারিতার জন্য মিলিত হয়। একসময় ফারুক রশিদকে একদিকে সরিয়ে এনে জানালেন, “আমি ১৫ তারিখেই তা ঘটাতে যাচ্ছি; শুক্রবার সকালেই আমি মুজিবকে জীবনের তরে সরিয়ে দিচ্ছি।’ এ কথা শুনে রশিদ চমকে উঠলেন এবং অনেকক্ষণ চুপ থেকে ফিসফিস করে বললেন ‘ এত তড়িঘড়িতে সব পণ্ড হতে পারে।…’ প্রত্যুত্তরে ফারুক বললেন : এটাই আমার সিদ্ধান্ত। রণকৌশলের পরিকল্পনা আমার কাছে তৈরি করা আছে। আমি একা হয়ে গেলেও এগিয়ে যাব। তুমি ইচ্ছে করলে সরে দাঁড়াতে পারাে। তবে জেনে রেখাে, আমি ব্যর্থ হলে শাসকচক্র তােমাকেও ফাঁসিতে লটকাবে।৩৫. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮-৫৯।৩৬. উল্লেখ্য, ১৯৭৫ -এর আগস্টের প্রথম সপ্তাহের কোনাে একদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার গভর্নর। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শেষে ঢাকা ফেরার পথে মােশতাক গভর্নর আলম সাহেবকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, : গভর্নর তাে হয়েছেন, কাজ শুরু করতে পারবেন তাে?’ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩রশিদ আবারও অনেকক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে বললেন : ঠিক আছে! যদি করতেই হয়, তবে কর। কিন্তু আমাদের এ নিয়ে আরও আলােচনা প্রয়ােজন। আরও কিছু অফিসার আমাদের সঙ্গে রাখা উচিত। হাতে মাত্র দুদিন সময়। পরদিন ১৩ আগস্ট দুপুরে কোনােরূপ এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই রশিদ আগামসিই লেনস্থ মােশতাকের বাসায় উপস্থিত হন। মাত্র ১০ মিনিট স্থায়ী আলােচনার উদ্দেশ্য ছিল ১৫ আগস্ট তিনি ঢাকায় আছেন কিনা তা জানা। | কর্মরত অফিসারদের নিয়ে কোনাে ভরসা নেই বুঝতে পেরে রশিদ চাকরিচ্যুতির কারণে মুজিবের প্রতি বিক্ষুব্ধ আর্টিলারি অফিসার ডালিমকে তার সাথে গল্পের আমন্ত্রণ জানান। ১৩ আগস্ট সকাল ১০টায় ডালিম রশিদের ক্যান্টেনমেন্টের বাসায় উপস্থিত হন। রশিদ অল্প কথায় চক্রান্তের বিষয় জানিয়ে তাদের সাথে ডালিম যােগ দিতে রাজি কিনা জানতে চান। ডালিম তার বন্ধু মেজর নূরের সাথে আলােচনাসাপেক্ষে রশিদের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং রাত ১টায় নূরকে নিয়ে পুনঃ রশিদের বাসায় আসেন। পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তারিত আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। মুজিবের স্থলে মােশতাককে বসালে পরিকল্পনা সফল হবে মনে করে নূরও তাদের সাথে থাকতে রাজি হয়ে গেল এবং মােশতাকের সম্মতির বিষয়ে বিশ্বাস জন্মানাের জন্য পরদিন (১৪ আগস্ট) বিকাল ৫টায় আনবিক শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের সম্মুখ থেকে। নূরকে সাথে নিয়ে রশিদ মােশতাকের বাড়িতে যাবে স্থির হল। যথাসময়ে প্রস্তাবিত স্থানে এসে রশিদ অপর একজন অফিসারসহ নূরকে দেখতে পেয়ে প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে তার সাথে পরিচিত হয়ে এবং নূর কর্তৃক বিশ্বস্ততার আশ্বাস পেয়ে মেজর শাহরিয়ারসহ তিনজনই আগামসিহ লেনে যান। | পূর্বনির্ধারিত কোনাে এপয়েন্টমেন্ট না থাকলেও মােশতাক তাদেরকে আন্তরিক স্বাগত জানান ও পরস্পরে পরিচিত হন। মেজর রশিদ একজন লােকের চাকরির সুপারিশ করেন এবং মােশতাক প্রার্থীকে পরদিন সকালে পাঠিয়ে দিতে বলেন। সম্ভবত এ কৌশলে পরদিন সকালে মােশতাকের বাসায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। তারপর সামান্য সরস-আলাপচারিতা শেষে তারা বেরিয়ে আসে। নূর ও শাহরিয়ার এর মাধ্যমেই সবকিছু বুঝে নেয় এবং যে-কোনাে সময়, যে-কোনাে ধরনের সহযােগিতা করার আশ্বাস দেয়। রশিদ রাতেই ডালিম, নূর আর শাহরিয়ারকে সামরিক প্রস্তুতি দেখা ও কৌশলগত পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক নিয়ে অধিকতর আলােচনার জন্য ক্যান্টনমেন্টে নৈশ-ট্রেনিং স্থলে মিলিত হতে বলে দেয়। সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুতির/পদত্যাগের পর লে, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ঢাকায় ‘মেরী এন্টারপ্রাইজ নামে পুরনাে টিভি, ফ্রিজ মেরামতের ব্যবসা শুরু করেন। চাকরিচ্যুত অফিসারদের মধ্যে ডালিম, নূর, আজিজ পাশা, বজলুল হুদা প্রায়ই মেরী এন্টারপ্রাইজে আসতেন ও আওয়ামী লীগ, সরকার, শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন কার্যকলাপ সম্পর্কে সমালােচনা করতেন।রাত অনুমান ১০টায় ডালিম, আজিজ পাশা, বজলুল হুদা, নূর চৌধুরী। শাহরিয়ারের বাসায় যান। কিছুক্ষণ পর ডালিম গিয়ে রাশেদ চৌধুরীকে নিয়ে আসেন। সবাই মিলে শাহরিয়ারের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করে। নানা ধরনের আলাচনার এক পর্যায়ে ডালিম বলেন যে, তিনি সিজিএসের কাছ থেকে এসেছেন। Army has been called on I.S. (Internal security) duty. Army will move out by first light মুক্তিযােদ্ধা অফিসার হিসেবে তিনি সহযােগিতা করার জন্য আমাদেরকে অনুরােধ করেছেন। এ বিষয়ে বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনার পর I.S. duty -তে সকলে অংশ। নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেজন্য নতুন এয়ারপাের্ট এলাকায় নাইট ট্রেনিংরত মেজর রশিদের দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির টেকটিকেল হেডকোয়ার্টারে রাত (ভোের) ০১-০০ থেকে ০১-৩০টার মধ্যে পুনরায় একত্রিত হওয়া সাব্যস্ত হয়। হত্যা-অভিযান। পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ রাত ১০টায় (মতান্তরে ৮টায়)। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উত্তরদিকে নতুন বিমানবন্দরের কাছে বালুরঘাট এলাকায় মেজর ফারুকের অধীনস্থ ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার (ট্যাঙ্কবাহিনী) ও মেজর রশিদের অধীনস্থ ২য় ফিল্ড আর্টিলারির (কামানবাহিনীর) যৌথ নৈশ-প্রশিক্ষণ শুরু হয়। উভয়। ইউনিটের প্রায় ৬০০ সৈন্য প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। মাঝরাতে মেজর ডালিম তার। চাকরিচ্যুত অন্যান্য বন্ধুদের নিয়ে নির্ধারিত স্থানে মেজর রশিদের সাথে মিলিত হন। রশিদ তার দল আর ১২টি ট্রাক বােঝাই ‘সশস্ত্র’ সৈন্য নিয়ে ট্যাঙ্ক গ্যারেজে ফারুকের সাথে যােগ দেয়। সেখানে প্রথমবারের মতাে সবাইকে অপারেশনের কারণ ও বিবরণ ব্যাখ্যা করে ফারুক উপস্থিত অফিসারদের (কর্মরত ও পদচ্যুত) যােগদানে রাজি কিনা জানতে চাইলে সকলেই সম্মতি জানায়। ফারুক ঢাকা শহরের একটি টুরিস্ট ম্যাপ টেবিলের উপর রেখে, যেসব স্থানে ব্লক স্থাপন করতে হবে সেসব স্থানে দাগ কেটে দেয়। তিনটি প্রধান টার্গেট ১. শেখ মুজিব ২. রব সেরনিয়াবাত ও ৩, শেখ মণির বাড়িতে আঘাতের দায়িত্ব যথাক্রমে ১, মেজর৩৮. পাকিস্তান থেকে ১৯৭৩ সালে ফিরে এসে যােগদানকারী (সিনিয়র) মেজর মােমিনের নিকট ১ম বেঙ্গল ল্যান্ডার্সের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ফারুককে এর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করতে হয়। এ সময় লে. কর্নেল মােমিন ছুটিতে থাকায় ফারুক ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ৩৯. হত্যাকাণ্ডের মাত্র ২৬ দিন আগে মেজর রশিদ ২য় ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডিং অফিসার হন। একত্রে একাধিক ইউনিটের নৈশ প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার নিয়ম ছিল না। রশিদের অনুরােধে সেনা সদর এর অনুমতি দেয়। এছাড়াও রশিদ জয়দেবপুরস্থ ১৬তম বেঙ্গল ইনফেন্ট্রির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর শাহজাহানকে এবং স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত ও ৪৬-তম পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হাফিজকে অপারেশনে অংশ নেয়ার জন্য বারংবার অনুরােধ করে ব্যর্থ হন। সৈন্যরা ক্লান্ত’ অজুহাত দিয়ে শাহজাহান প্রশিক্ষণে অংশ নিতে অস্বীকার করায় ক্ষেপে গিয়ে ফারুক মন্তব্য করে, মনে হচ্ছে সব বেঙ্গল টাইগারই এখন পােষা বিড়ালে পরিণত হয়ে গেছে নূর চৌধুরী ও মহিউদ্দিন ২. মেজর ডালিম ও ৩. রিসালদার মুসলিমের (মুসলেহউদ্দিন) ওপর দেয়া হয়। রশিদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় ১, অভিযান শুরুর সাথে সাথে স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতকে তার মিগ জঙ্গী বিমান নিয়ে প্রস্তুত রাখা-যাতে বাইরে। থেকে কোনাে সেনা-ইউনিট ঢাকায় আসার চেষ্টা করলে ঠৈকিয়ে দেয়া যায় ২. মােশতাককে রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসা এবং মুজিবহত্যা ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে মােশতাকের নাম ঘােষণা করা ও ৩, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সমর্থন আদায় করা। রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরােধ করাসহ অপারেশনের সর্বময় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ফারুক। মুজিব-সেরনিয়াবাত-মণিকে হত্যা, জামাল-কামালকে বন্দি করা ছাড়া আর কাউকে কিছু করা বারণ করা হলাে। তবে, পরিকল্পনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে এমন যে-কাউকে প্রয়ােজনবােধে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হল। শেষােক্ত নির্দেশটি বস্তুত হত্যাযজ্ঞের পরিধি প্রশস্ত করার পথ খুলে দেয়। অপারেশনে বেরােনাের আগে সৈনিকদের ব্রিফিং দেয়া হয়। সেনাবাহিনীতে অফিসারদের ব্রিফিং আদেশের সমতুল্য। ব্রিফিংকালে বলা হয় রক্ষীবাহিনী আর্মির উপর আক্রমণ করবে, প্রতিরােধ করতে হবে। এখন আমাদের একটি জরুরি কাজে অন্য জায়গায় যেতে হবে, পরবর্তী নির্দেশ সেখানে গিয়ে দেয়া হবে।’ যাকে যা অর্ডার করা হবে তা পুরােপুরি পালন করতে হবে, অন্যথায় কোর্টমার্শাল হবে। অর্ডারমতাে কাজ না করলে, ডিউটিতে শৈথিল্য দেখা দিলে, গুলি করে মেরে ফেলা হবে। পদচ্যুত অফিসারদেরকে সৈনিকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলা হয় আজকের এ জরুরি কাজে তারাও থাকবেন এবং তাদের নির্দেশও পালন করতে হবে। এভাবে প্রকৃত উদ্দেশ্যের কথা না বলে সৈনিকদের ধােকা দেয়া হয়। গভীর রাতে ফারুকের সই করা স্লিপ পাঠিয়ে অস্ত্রাগারের চাবি এনে ইচ্ছেমতাে অ্যামুনিশন সংগ্রহ করা হয়। সাক্ষি নায়েক ইয়াসিনের ভাষায় ‘অমন গােলাবারুদের স্তুপ আর বেহিসাবি গুলি নেয়ার ঘটনা জীবনে দেখিনি। ভাের পৌনে ৫টার দিকে ফারুকের বাহিনী সংগঠিত হয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়। রশিদের আর্টিলারি বাহিনী ৬টি ১০৫ মি.মি. যুগােশ্লাভ হাউইটজার (কামান) ও পর্যাপ্ত গােলাবারুদ নিয়ে নতুন বিমানবন্দরের প্রান্তে দণ্ডায়মান ছাড়াও আরাে ১১টি কামান ইউনিট হেডকোয়ার্টারে ক্রুসহ মােতায়েন রাখা হয়। ল্যান্সারপরবর্তী সময় মামলা চলকালে কয়েকজন সাক্ষি জানিয়েছেন যে, ব্রিফিংকালে শেখ মুজিব রাজতন্ত্র ঘােষণা করতে যাচ্ছে, সরকার উৎখাত করা হবে’ প্রভৃতিও বলা হয়েছে। সৈন্যদের মুজিবের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে মেজর মহিউদ্দিন বলেন : ভেতরে গুলি হলে ভয় পেয়াে না, ওখানে আমাদের মেজর ডালিমের লােকজন আছে। এসব অস্পষ্ট কথায় রাস্তায় দাঁড়ানাে সৈন্যরা বুঝতেই পারেনি ভেতরে কী ঘটানাে হয়েছে। সকালে ডালিমের রেডিও ঘােষণায় তারা জানতে পারে মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানি অভিজ্ঞতায় কর্তৃপক্ষের ধারণা জন্মেছিল যে, বিপদ সবসময় সেনাপতিদের দিক থেকেই আসে। তাই জুনিয়ার অফিসারদের ষড়যন্ত্র গােয়েন্দাদেরও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।গ্যারেজে সারিবদ্ধভাবে ২৮টি ট্যাঙ্ক, ২৯ ১২টি ট্রাক, ৩টি জিপ ও একটি কামান দণ্ডায়মান। এছাড়া রয়েছে রণসাজে সজ্জিত বাছাইকরা ৪০০ সৈন্যের একটি শক্তিশালী দল। এদের দুই-তৃতীয়াংশই ছিল ল্যান্সারের কালাে উর্দি পরিহিত। মণি, মুজিব, সেরনিয়াবাত -এই তিনটি টার্গেটের উদ্দেশ্যে কালােবাহিনী’ তিনটি দলে ভাগ হয়ে যাত্রা শুরু করে। ভয়ঙ্কর এ মিশনের দুরন্ত যাত্রায় ফারুক ছিল সর্বাগ্রের ট্যাঙ্কটিতে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতেই ভেসে এল ফজরের সুমধুর আজানের ধ্বনি। শুক্রবার ফজরের আজানের সময়ই ফারুক ভূমিষ্ট হয়েছিল। আজানের ধ্বনি। তাকে জন্মদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। তার বিশ্বাস আজও সে, হয় নবজীবনের সূচনা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে অমােচনীয়ভাবে তার নাম অক্ষয় করে রাখবে, নাহয়, ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। আগের দিন বিকেলে স্ত্রী ফরিদার মাধ্যমে প্রাপ্ত আন্ধা হাফিজ নির্দেশিত দুটি সুরা মনেপ্রাণে আর একবার তিনি পাঠ করে নিলেন। | ভাের সােয়া ৫ টার মধ্যে ঘাতকদলগুলাে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে পৌছে যায়। রক্ষীবাহিনীর ব্যারাকের কাছে পৌছে ফারুক দেখতে পায় ৩,০০০ রক্ষীবাহিনীর পুরাে ব্রিগেডটি ৬টি সারিতে যুদ্ধ সাজে সজ্জিত হয়ে (মাথায় স্টিলের হেলমেট, হাতে রাইফেল, কাধে প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর বান্ডিল) দাড়িয়ে আছে। ভয়ে তার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এখন আমি কী করব?’ ট্যাঙ্কের ড্রাইভারের এ-প্রশ্নের জবাবে ফারুক বললেন, ‘ তুমি তাদের নাকের ডগার মাত্র ছ’ইঞ্চি দূর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে।’ কামানগুলাে তাদের মাথা বরাবর তাক করে রাখার জন্য তিনি গানারদের নির্দেশ দিলেন এবং অন্যদেরকে ভাবভঙ্গিতে সাহসী ভাব ফুটিয়ে রাখতে বললেন। এ প্রসঙ্গে ফারুক আরাে বলেন :আমরা যখন ওদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, রক্ষীবাহিনীর লােকেরা তখন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। আমরা তাদের দিকে তীক্ষভাবে তাকিয়ে ছিলাম। সে ছিল এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমি ড্রাইভারকে বললাম, যদি ওরা কিছু৪২/১যান্ত্রিক গােলযােগের জন্য মিশর কর্তৃক উপহৃত ৩০টি টি-৫৪ ট্যাঙ্কের মধ্যে ২টি অকেজো ছিল।অভিযানে অংশগ্রহণকারী অবশিষ্ট ২৮টিও ছিল একেবারে গুলিশূন্য। ট্যাঙ্কের সকল গােলাবারুদ জয়দেবপুরের অর্ডন্যান্স ডিপােতে তালাবদ্ধ করে রাখা ছিল। এমনকি ট্যাঙ্কের মেশিনগানগুলােতেও কোনাে গুলি ছিল না। ফারুক ট্যাঙ্কগুলাে দিয়ে সবাইকে ধোঁকা দিয়ে কাজ হাসিল করে। তার ভাষায়, “ট্যাঙ্কগুলাে যে নিরস্ত্র তা জেনারেল হেডকোয়ার্টারের মুষ্টিমেয় কয়েকজন মাত্র অবগত ছিল। কিন্তু তারাও পুরােপুরি নিশ্চিত ছিল না। বাকি সকলের কাছেই ট্যাঙ্ক অত্যন্ত মারাত্মক অস্ত্র, এর সামনে যা পড়ে সবই উড়িতে দিতে পারে।… ট্যাঙ্ক দেখে জীবনের ভয়ে পালাবার চেষ্টা করবে, এমন সাহসী লােক খুবই কম পাওয়া যাবে। … মনস্তাত্ত্বিক অস্ত্র হিসাবে ট্যাঙ্ক যে কতটা কর্যকরী তা খুব কম লােকই জানে। তাছাড়া, কে-ই বা আমাকে অতটা পাগল ভাববে যে, আমি জিএইচকিউ আর রক্ষীবাহিনীর মােকাবেলা করার জন্য একেবারে ফাকা ট্যাঙ্ক নিয়ে এতবড় ভয়ঙ্কর অভিযানে পা বাড়াব!’ (অ্যান্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭২)। অধিনায়কদের ছাড়া প্রতিটি ইউনিটে মাত্র ৪ জন করে অফিসার উপস্থিত ছিল। পুরােপুরি বিশ্বাস করতে না পারায় দু’জন অফিসার ও কিছু সৈন্যকে মহড়ী থেকে বাদ দেয়া হয়। মতান্তরে সৈন্যসংখ্যা ছিল ২৫০ থেকে ৩০০ জন। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৪করতে শুরু করে অমনি আর দেরি না করে ওদের উপরই ট্যাঙ্ক চালিয়ে দেবে। তার আর দরকার হয়নি। দূর থেকে ভেসে-আসা গুলির আওয়াজ তাদের কানে বাজতে লাগলাে। তদুপরি, নিজেদের সামনে হঠাৎ ট্যাঙ্ক দেখে, ওরা গায়ের মশা পর্যন্ত নাড়াবার সাহস পেল না। রক্ষীবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনােরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখে ফারুক নিশ্চিত হয়। তার বিপদের সম্ভাবনা কেটে গেছে এবং বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ঐ অবস্থায় রক্ষীবাহিনীকে পাহারা দেয়ার জন্য একটি ট্যাঙ্ক রেখে সে ধানমণ্ডির দিকে রওয়ানা হয়। | অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভাগ্য মুজিবের, তার পরিবারের ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে। কাজ করছিল। ১০ আগস্ট ছিল মুজিবের ছােটবােনের মেয়ের বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে তার আত্মীয়স্বজন ঢাকায় জড়াে হয়েছিল। ১৪ আগস্ট ছিল সেরনিয়াবাতের মায়ের চেহলাম। সেজন্য অতিথিদের অনেকেই ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন এবং টার্গেটকৃত | তিন পরিবারের সবাই ধানমণ্ডির সন্নিহিত স্বল্প দূরবর্তী এলাকায় অবস্থান করছিলেন। মুজিবের ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত তখন বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ, বিদ্যু, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রি। তাঁর মন্ত্রিপাড়াস্থ বাসভবনে মাত্র একজন পুলিশ পাহারারত ছিল। মেজর ডালিমের নেতৃত্বাধীন আক্রমণকারীরা পৌছেই প্রহরীকে গুলি করে। গুলির শব্দে সবাই জেগে ওঠে। সেরনিয়াবাত ফোনে মুজিবকে সাহায্য পাঠানাের কথা বলতে গিয়ে তার বাড়িও আক্রান্ত জেনে আর একটিও কথা না বলে, ফোন নামিয়ে বিছানার উপর বসে পড়েন। তার ৩০ বছর বয়সী ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ্ ওঠে জানালার পাশ দিয়ে আগত কালাে উর্দিপরা সৈন্যদের লক্ষ্য করে তার কাছে থাকা স্টেনগান দিয়ে ম্যাগজিন শূন্য না হওয়া পর্যন্ত গুলি ছুড়তে থাকে। গুলি ফুরিয়ে গেলে আরাে গুলির জন্য বাড়ির উপরতলায় আসে। ততক্ষণে সৈন্যরা উপরে ওঠে আসার বুটের আওয়াজ পেয়ে সে লাফ দিয়ে চিলেকোঠার মেঝেতে/চালে বসে পড়ে। আর সৌভাগ্যক্রমে এতেই সে বেঁচে যায়। | সৈন্যরা মুহূর্তের মধ্যে শয়নকক্ষে ঢুকে, বিছানায় বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। থাকা সেরনিয়াবাতকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর তারা বাড়ির সবাইকে ধরে নিয়ে। ড্রইংরুমে জড়াে করে। মিনিট বিশেক ধরে থেমে থেমে চলছিল গুলির আওয়াজ আর কানফাটা চিকার। একসময় দূরে রাস্তায় সৈন্যদের বুটের আওয়াজ মিলিয়ে যায়। এরপর দু-একটি গােঙানির শব্দ ছাড়া সবই নিস্তব্ধ। আক্রমণকারীরা চলে গেছে বুঝতে৪৫. এ সময় রক্ষীবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান বিদেশে এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড কর্নেল সাবিহ উদ্দিনও ছুটিতে (বিদেশে) ছিলেন। একটি বাহিনীর প্রধান দুই কর্মকতা কীভাবে। একই সাথে ছুটিতে থাকতে পারে-তা বােধগম্য নয়। তাছাড়া, ফারুকের বাহিনী বেরিয়ে আসার সময় ৪র্থ ও ১ম বেঙ্গল পদাতিকবাহিনীর পিটিরত সৈনিকদের সাথে দেখা হয়। তারা সকলেই। ড্রিল বন্ধ করে ট্যাঙ্ক বহরকে হাত নাড়িয়ে শুভেচ্ছা জানায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার যে, ট্যাঙ্কের। অতবড় বহর তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ এলাকা ছাড়িয়ে বাইরে যেতে দেখেও কারাে মনে কোনাে। সন্দেহ জাগে নি। অ্যান্থনি ম্যাসকারানহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৮-৮০পেরে হাসনাত অতি সন্তর্পণে নিচে নেমে এসে দেখে ড্রইংরুম কসাইখানায় পরিণত হয়ে গেছে। চতুর্দিকে কেবল রক্ত, মৃতদেহ আর ভাঙাচূড়া আসবাবপত্রের স্থূপ। তার স্ত্রী, মা আর বিশ বছরের একটি বােন গুরুতর আহত। দুই কন্যা সােফার পেছনে পালিয়ে অক্ষত অবস্থায় কাঁপছে। তার পিতা, পাঁচ বছরের ছেলে, দশ ও পনেরাে বছরের দুটি বােন, এগারাে বছরের ছােটভাই, চাচাত ভাই শহীদ, আয়া, কাজের ছেলে ও বরিশাল থেকে আগত জনৈক বন্ধুর লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। | রিসালদার মােসলেহউদ্দিন দু’ট্রাক সৈন্য নিয়ে পৌছামাত্রই শেখ মণি শব্দ পেয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তারা তার বাড়ি পাহারা দিতে এসেছে কিনা জানতে চান এবং অনুরুদ্ধ হয়ে নিচে নেমে এলে মােসলেহ উদ্দিন তাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। শশারগােল শুনে ঐ মুহূর্তে তার সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি স্বামীকে বাঁচানাের জন্য লাফ দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর অমনি স্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে উভয়ই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বাড়ির আর কাউকে স্পর্শ না করে সংক্ষিপ্ত অথচ নৃশংসভাবে ‘মিশন সম্পন্ন করে মােসলেহ উদ্দিন মুজিবের বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি চালিয়ে দেয়।মহিউদ্দিন, নূর আর হুদার নেতৃত্বাধীন প্রধান ঘাতকদলটি ধানমণ্ডির তদানিন্তন ৩২ নম্বর সড়কে পেীছে মুজিবের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির সামনে, পূর্ব ও পশ্চিম প্রবেশমুখে এবং আশেপাশের বাড়ির ছাদে সৈন্য মােতায়েন করে। বাড়িটির চতুর্দিক ঘিরে ফেলে মিরপুর রােডে লেকের পাড়ে মুজিবের বাড়ির মুখােমুখি বসানাে হয় একটি হাউইটজার। প্রকৃতির অমােঘ নিয়মে পূর্বাকাশে উদিত হয় লাল সূর্য। বিউগলের সুরে জাতীয় সংগীতের মূর্ঘনার সাথে উত্তোলিত হয় জাতীয় পতাকা। আর্মি গার্ডদের কালভােরের পালাবদলের সময় ঘটে জঘন্য আক্রমণ। | বাড়ির এলাকার বাইরের প্রহরারত সশস্ত্র পুলিশ ভারি অস্ত্রে সজ্জিত উর্দিপরা সৈন্য দেখে ভড়কে যায় এবং কোনাে প্রকার বাদানুবাদ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করে। গেটে প্রহরারত ল্যান্সার প্রহরীরা তাদেরই কিছু সহকর্মী আর অফিসার দেখে প্রভাবিত ৪৮ হয়ে৪৭ মুজিবের ধানমণ্ডির বাড়ির অন্যতম আর্মি গার্ড কমান্ডার আব্দুল গণি হত্যা মামলায় তার সাক্ষ্যেবলেন যে, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ বিকাল অনুমান ৪টা ও ৫টায় যথাক্রমে ডালিম ও হুদা মােটর সাইকেলযােগে মুজিবের বাড়ি রেকি করে যায়। ১৯৭৫ সালের জুলাই পর্যন্ত মুজিবের ধানমণ্ডির বাড়ি ও গণভবনের প্রহরার দায়িত্ব ছিল ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের। জুলাইয়ের শেষদিকে তা পরিবর্তন করে কুমিল্লা থেকে ১ম ফিল্ড আর্টিলারির একটি ব্যাটারি এনে তাদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। মেজর ডালিম, পাশা ও হুদা ঐ আর্টিলারির অফিসার ছিল। গার্ড কমান্ডার হাবিলদার আব্দুল গণির মতে, তাদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ারদার ১৫ আগস্ট ভাের অনুমান সােয়া ৪টার দিকে এসে তাদের গার্ড চেক করেন। এবং নতুন গুলি দেবে বলে পুরনাে গুলি নিয়ে নতুন গুলি না দিয়েই গাড়িতে উঠে চলে যায়। ফলে তাদের পক্ষে ঘাতকদের চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়নি, বরং প্রাণভয়ে তারা গার্ড রুমে আশ্রয় নেয়। তবে উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে হত্যা মামলায় জোয়ারদারের বিরুদ্ধে গুলি নিয়ে নেওয়ার অভিযােগ সন্দেহাতীভাবে প্রমাণিত হয়নিপড়ে, তাদের কমান্ড এ্যান্ড কন্ট্রোল’ ভেঙে পড়ে এবং তারা ঘাতকদের হুকুম তামিল করতে বাধ্য হয়। সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীদের আক্রমণের সংবাদ পেয়ে মুজিব ইন্টারকমে তার রিসেপসনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ মহিতুল ইসলামকে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে টেলিফোন লাগাতে বলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি দোতলা থেকে নিচে নেমে আসেন। পুলিশ কন্ট্রোলরুম না পেয়ে মহিতুল গণভবন এক্সচেঞ্জ পায় কিন্তু সেখানেও কেউ উত্তর দেয় না। মুজিব মহিতুলের হাত থেকে রিসিভার নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’ বলার সাথে সাথেই একঝাক গুলি দক্ষিণদিকের জানালার কাঁচ ভেঙে অফিস কক্ষের দেয়ালে এসে লাগে। মুজিব টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। অল্পক্ষণ পর গুলি বন্ধ হলে তিনি উঠে বারান্দায় এসে আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি চলছে, তােমরা কী কর?’ বলে উপরে ওঠে গেলেন। আব্দুর রহমান রমার ডাকে ঘুম থেকে ওঠে হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরিহিত শেখ কামাল এ সময় নিচে বারান্দায় এসে ‘আমি ভাই, পুলিশ ভাই, সবাই আমার সাথে আসুন” বলার সাথে সাথে কয়েকজন কালাে ও খাকি-পপাশাকধারী সশস্ত্র লােক সামনে এসে তাকে গুলি করে। বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়ােজিত ডিএসপি নূরুল ইসলাম পুলিশকে পাল্টা গুলি চালাবার নির্দেশ দেন। ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল’-আশ্চর্য ও দ্বিধা মিশ্রিত কণ্ঠে এ-কথা উচ্চারিত হওয়ামাত্র বজলুল হুদা হ্যান্ডস আপ’ বলেই কামালকে গুলি করে হত্যা করে। গুলিতে মহিতুল এবং নূরুল ইসলামও আহত হন। এরপর ঘাতকরা ফাঁকা গুলি করতে করতে দোতলায় যায়, আর এদিকে আরাে ২০/২৫ জন সেনা বাড়ির ভেতর ঢােকে। অন্যদিকে, তাদের সাপাের্ট দিতে মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে হাউইটজার থেকে নিক্ষেপিত হয় রকেট। রকেটের প্রথম দু’টি ধানমণ্ডি লেকের দু’পাশে গিয়ে পড়ে। এরপর তারা কামান উচিয়ে আরও কয়েক রাউন্ড গােলা নিক্ষেপ। করে যার একটি প্রায় ৬ কি.মি. দূরে মােহাম্মদপুরে এক বিহারীর বাড়িতে পড়ে দু’ব্যক্তি নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। বাড়ির ভেতর ঢুকেই তারা নিচতলার প্রতিটি রুম পালাক্রমে তল্লাশী করে এবং মহিতুল, ডিএসপি নূরুল ইসলাম, টেলিফোন মিস্ত্রি আব্দুল মতিন, রাখাল আজিজ, কাজের বুয়া, এসবি’র অফিসার সিদ্দিকুর রহমান ও অন্যান্য পুলিশদের গেটের পাশে এনে লাইন করে দাঁড় করায়। হঠাৎ একজন আর্মি এসে এসবি’র অফিসারকে গুলি করে এবং কয়েকজন আর্মিকে সেখানে প্রহরায় রেখে বাকিরা মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে ফায়ার করতে করতে দোতলায় উঠে যায়।৪৯. সম্ভবত সেরনিয়াবাতের ফোন পেয়ে মুজিব ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। অ্যান্থনি ম্যাসকারনাস উল্লেখ করেছেন যে, শেখ কামাল এবং জামাল তাদের স্টেনগান নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দু’জন সৈন্যকে আহত করে। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সিঁড়ির গােড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৭৫)।এদিকে দোতলায় ওঠে মুজিব আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রথমেই রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে ফোন করেন। রক্ষীবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও টুআইসি কর্নেল সাবিহউদ্দিন উভয়েই তখন দেশের বাইরে। অন্যকোনাে সিনিয়র অফিসারকেও মিলাতে না পেরে তিনি সেনাবাহিনীর স্টাফপ্রধান জেনারেল শফিউল্লাহ, তার (মুজিবের) সামরিক সচিব ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক ও সামরিক গােয়েন্দাবিভাগের পরিচালক কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকে ফোন করে অবিলম্বে সাহায্য পাঠাবার নির্দেশ দেন। জেনারেল শফিউল্লাহ কোনাে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি বা গ্রহণে ব্যর্থ হন। ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক ফোন পেয়ে মুজিবের এডিসিদ্বয় ক্যাপ্টেন শরীফ আজিজ ও কমান্ডার গােলাম রব্বানীসহ ছুটে আসেন এবং মুজিবের বাড়ির কাছাকাছি এসে ঘাতকবাহিনীর হাতে বন্দি হন (পরে ফারুক তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করে)। কর্নেল জামিল সংবাদ পাওয়ামাত্র ফোর্সকে দ্রুত তৈরি হয়ে মুজিবের বাড়িতে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে গাউন পরিহিত অবস্থায়ই নিজের ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে রওয়ানা হন এবং মিরপুর রােডে সােবহানবাগ মসজিদের কাছে (মতান্তরে মুজিবের বাড়িতে ঢােকার প্রাক্কালে) ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন। | এরই মধ্যে ঘাতকরা বাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং মুজিবের সন্ধানে প্রতিটি কামরা তন্নতন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ, অপ্রত্যাশিতভাবে মহিউদ্দিন তাকে দোতলার সিঁড়ির গােড়ায় দাঁড়ানাে দেখতে পায়। মুজিবের ব্যক্তিত্ব এত প্রবল ছিল যে, মুখােমুখি হতেই মহিউদ্দিন মনােবল হারিয়ে নতজানু হয়ে পড়ে এবং আমতা-আমতা করে বলে স্যার, আপনি আসুন।’ এমতাবস্থায় ধমকের সুরে মুজিব বলেন : তােমরা কী চাও? তােমরা কি আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও! পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তােমরা কি মনে করাে-তা করতে পারবে? এমন সময় মেজর নূর সেখানে পৌছে এক-মুহূর্তও দেরি না করে চিৎকার দিয়ে মহিউদ্দিনকে একপাশে সরিয়ে আবােলতাবােল বকতে বকতে কাধের স্টেনগান দিয়ে৫১ জেনারেল শফিউল্লাহ দাবি করেন, ঘাতকদের আক্রমণের সংবাদ পেয়েই তিনি কর্নেল শাফায়াত জামিলকে তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়নকে নিয়ে তাদেরকে প্রতিহত করার নির্দেশ দেন এবং খালেদ মােশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে শাফায়েত জামিলকে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। কিন্তু শাফায়াত জামিল এ দাবি অস্বীকার করে বলেন : সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এই বিদ্রোহ সম্পর্কে সংবাদ পেয়ে অপর দুই বাহিনী প্রধান ও সেনানিবাসে অবস্থানরত ইউনিট কমান্ডারদের সাথে যােগাযােগ করা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। তিনি কাউকে প্রতিরােধ-উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ বা নির্দেশ দেননি। অধিকন্তু, সেনাপ্রধানের নির্দেশে সিজিএস খালেদ মােশাররফ শাফায়াতের কমান্ড অধিগ্রহণ করায় তার (শাফায়াত) উদ্যোগে সম্পন্নপ্রায় বিদ্রোহ দমন প্রস্তুতি’ আর কার্যকরী হওয়ার। সুযােগ পায়নি। অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা নস্যাতে নিবৃত্তিমূলক হামলা করার জন্য দু’ঘণ্টা সময় প্রয়ােজন। সেনাপ্রধান উদ্যোগ নিলে মুজিবকে বাঁচাতে না পারলেও ফারুক-রশিদ-মােশতাকের কু-কে প্রতিহত করা সম্ভব হত।ব্রাশ ফায়ার করে। গুলির আঘাতে তার দেহ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে সিঁড়ির মাথায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতার প্রাণহীন দেহ সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর গড়িয়ে গিয়ে থেমে যায়, মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করার কথা ছিল। মুজিবকে হত্যা করে নূর, হুদা, মহিউদ্দিন সবাই নিচে নেমে গেটের সামনে রাস্তায় চলে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে শেখ জামাল পরিবারের সকল সদস্যদের মুজিবের শয়নকক্ষে এনে জমায়েত করেন। এমন সময় মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মােসলেহ উদ্দিন তাদের ফোর্সসহ গেটের সামনে আসে। আজিজ পাশা তার ফোর্স নিয়ে দোতলায় ওঠে এসে শয়নকক্ষের দরজা খুলে দিতে বলে এবং না-খােলায় দরজায় গুলি করে। বেগম মুজিব তখন দরজা খুলে সামনে এসে তাদের না মারার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। কয়েকজন সৈনিক বেগম মুজিব, শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও একজন চাকরকে (রমা) সেখান থেকে বের করে নিয়ে আসে। সিড়িতে স্বামীর রক্তাক্ত লাশ দেখে বেগম মুজিব থমকে দাঁড়ান এবং বুকফাটা চিষ্কার করে বলতে থাকেন, ‘আমি আর কোথাও যাব না, আমাকে এখানেই মেরে ফেলাে।’ ঘাতকরা তখন নাসের, রাসেল ও চাকরটিকে নিচে নিয়ে গেটের পাশে লাইনে দাঁড় করায় এবং বেগম মুজিবকে পুনরায় শয়নকক্ষে নিয়ে যায়। এরপর আজিজ পাশা ও মােসলেহ উদ্দিন শয়নকক্ষের সকলকে অত্যন্ত কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার করে নির্দয়ভাবে হত্যা করে। ওরা তখন মেতে ওঠে রক্তের হুলি খেলায়। গুলি করে বােল্ট উড়িয়ে দিয়ে একের পর এক দরজা খুলে৫২. মুজিবহত্যার বর্ণনাটি অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের পূর্বোক্ত গ্রন্থের ৭৭ পৃষ্ঠা থেকে নেয়া। তবে, হত্যা মামলার ৮ নং সাক্ষী মেজর শাহাদাত হােসেন খান, মেজর হুদার জবানিতে বলেন : “আমি যখন দলবলসহ বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই, তিনি তখন বলেন : “তােমরা কেন আমার বাসায় এসেছে? কে তােমাদের পাঠিয়েছে? শফিউল্লাহ কোথায়? -এই বলিয়া আমাকে ঝটকা মারে। তখন আমি পড়ে যাই। এরপর আমরা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করি।’ (ড, মােহাম্মদ হাননান, পূর্বোক্ত, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পৃষ্ঠা ১৬৫)। মুজিবের বুকে, পেটে, হাতে ও পায়ের বিভিন্ন স্থানে ২৯টি (মতান্তরে ৫টি) গুলির ক্ষতচিহ্ন ছিল। একটি বুলেট পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বের হয়। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির উপরের অংশ ছিল বিচ্ছিন্ন এবং শাহাদাত অলিটি ছিল গুলির আঘাতে ছেড়। দু’পায়ের গোড়ালির রগ ছিল কাটা। তার পরনে ছিল ধূসর রঙের চেক লুপ্তি, গায়ে শাদা গেঞ্জি ও শাদা পাঞ্জাবি। সবই রক্তমাখা। ‘ডানহাতে ধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপ ও বামহাতে ম্যাচ (?)’ পাশেই পড়ে ছিল কালাে ফ্রেমের চশমা একজোড়া স্যান্ডেল ও একটি তােয়ালে। হত্যা করেও ঘাতকদের পৈশাচিকতা প্রশমিত হয়নি। এদের একজন (ঘাতক মােসলেহ উদ্দিন?) কাছ থেকে মুজিবকে দেখার সুযােগ না পাওয়ায় তার পায়ের বুট নিষ্প্রাণ-দেহের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে অত্যন্ত বর্বরােচিতভাবে হেচকা টানে মৃতদেহকে উল্টিয়ে সে সাধ পূরণ করে। এর প্রায় ৪ ঘন্টা পর কর্নেল মশিউদ্দৌলা ও কর্নেল মাহমুদুল হাসানের নেতৃত্বে তথ্য দফতরের জনৈক ফটোগ্রাফার ঐ অবস্থায় তার ছবি ওঠায়। বিলেতের স্যান্ডহাস্ট মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে সদ্য বিবাহিত জামাল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে সেনাবাহিনীতে কাজ করছিলেনব্রাশ ফায়ার করে ঘরগুলােকে ঝাঝড়া করে দেয়-যেন একটা প্রাণীও বেঁচে না থাকতে পারে।শেখ নাসেরের হাতে আগেই গুলি লেগেছিল এবং বেগম মুজিব তার শাড়ির পাড় ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়েছিলেন। জনৈক সেপাই তাকে গেটের পাশের লাইন থেকে বের করে অফিস সংলগ্ন বাথরুমে নিয়ে গুলি করে। গুলি খেয়ে তিনি যখন কাতরকণ্ঠে পানি পানি বলে চিৎকার করছিলেন তখন একজন সেপাই অপর একজনকে বলে : ‘যা পানি দিয়ে আয়। দ্বিতীয় সেপাইটি তখন সেই বাথরুমে গিয়ে নাসেরকে পুনঃ গুলি করে চিরতরে তৃষ্ণা মিটিয়ে দেয়।সুলতানা কামাল, রােজী জামাল, মুজিবের সদ্য বিবাহিতা দুই পুত্রবধূ ১০ বছরের শিশু রাসেলের গলা জড়িয়ে ধরে বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছিল। সেপাইরা তাদেরকে জঘন্যভাবে টেনে আলাদা করে। রাসেল তখন আলনা ও অন্যান্য আসবাবপত্রের আড়ালে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। সেপাইরা তাকে খুঁজে বের করে নিচে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করায়। অবােধ শিশু তখন মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য ‘আকুলি বিকুলি করে। মেজর নূরের নির্দেশে এক হাবিলদার ওকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ওপরে শয়নকক্ষে নিয়ে গুলি করে। মাথার মগজ ও চক্ষু বের হয়ে যাওয়া রাসেলের দেহ লুটিয়ে পড়ে তার মায়ের মৃতদেহের কাছে।সেনাদের লুটপাট কিছুক্ষণ পর ইউনিফরম পরিহিত ডালিম ও ফারুক মুজিবের বাড়ির গেটের সামনে আসে। ফারুকের খবর কী’ জিজ্ঞাসার জবাবে হুদা সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় ‘অল আর ফিনিশড’। হুদার এ সর্বনাশা উক্তির নিদর্শনস্বরূপ নূরের কপালে তখনাে লেগেছিল তাজা রক্তের দাগ। হত্যাযজ্ঞের পুরস্কার হিসেবে ফারুকের নির্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে লেন্সরের একজন অফিসার ক্যাপ্টেন হুদাকে মেজরের ব্যাজ এবং হুদা সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ারদারকে অনারারি লেফটেন্যান্টের ব্যাঙ্ক পরিয়ে দেয়। এরপর ডালিম ও ফারুক বেরিয়ে পড়ে যথাক্রমে ‘রেডিও বাংলাদেশ’ ও ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে। আর এদিকে আক্রমণকারীরা মেতে ওঠে লুটপাটে। আর্টিলারি আর ল্যান্সারের অফিসার, জোয়ান আর এনসিওরাও বাদ যায়নি। যে যেভাবে পেরেছে, দুহাতে লুটেছে। বাড়ির প্রতিটি কামরার প্রতিটি আলমারি, ড্রয়ার ও অন্যান্য আসবাবপত্র ভেঙে/খুলে মূল্যবান সামগ্রী হ্যাভারসেকে ঢুকায়, বাকি সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে তছনছ করে। ওয়াহাব জোয়ারদার” আলমারি থেকে একটি ব্রিফকেস বের করে এর মধ্যে ভরে নেয়৫৬. সঠিক অর্থেই তাদের হাতের বিয়ের মেহেদির রঙ তখনও মুছে যায়নি ৫৭ ওয়াহাব জোয়ারদারকে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার কাজে অবস্থানরত সেনাদের বেতন বিলি করতেএকদিনের জন্য ঢাকায় পাঠানাে হয়েছিল। কিন্তু হত্যাকান্ডের অনেকদিন পর সে তার কর্মস্থল কুমিল্লায় ফেরে এবং নিজমুখে হত্যাকান্ডের পর লুপাটের কথা বিবৃত করে।স্বর্ণালঙ্কার আর বিদেশী মুদ্রা। রেডিও, টেলিভিশন প্রভৃতি ভারি মালামাল তারা রাস্তার পাশে দণ্ডায়মান একটি জিপে উঠিয়ে নিয়ে যেতেও ভােলেনি। ক্ষমতা দখল এদিকে সকলকে প্রলয়ঙ্করী মিশনে পাঠিয়ে দিয়ে রশিদ সােজা চলে যায় স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের বাসায়। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে পূর্বপরিকল্পনামতাে মিগ নিয়ে প্রস্তুত হতে বলেন। কিন্তু লিয়াকত বিমানবাহিনীর প্রধানের নির্দেশ ছাড়া কিছু করতে পারবে না জানালে রশিদ সাথে সাথে ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেডের মেজর হাফিজের কাছে যায়। ১৬তম ইস্ট বেঙ্গলের মেজর শাহজাহান জয়দেবপুর থেকে এসে আক্রমণকারীদের সাথে মিলিত হতে অস্বীকার করায় রশিদ হাফিজকে দিয়ে ১ম ইস্ট বেঙ্গলকে তাদের সাথে জড়িত করার চেষ্টা করে। তার প্রত্যাশা ছিল, অভিযান শুরু হয়ে গেছে’ জানলে হাফিজ যােগ দিতে ইতস্তত করবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাফিজও রণে ভঙ্গ দিয়ে ব্রিগেড কমান্ডার বা সেনাপ্রধানের নির্দেশ ছাড়া কিছু করতে পারবে না। বলে জানায়। সশস্ত্র রশিদ তখন হাফিজকে নিয়ে তার কমান্ডিং অফিসার শাফায়াত জামিলের উদেশ্যে রওয়ানা হয়। কর্নেল আমিন আহমদ (সেনাসদর) ও মেজর হাফিজসহ রশিদ যখন শাফায়াত জামিলের বাসার কম্পাউন্ডে ঢােকে তখনই ধানমণ্ডির দিকে হাউইটজারের গােলা নিক্ষেপের আওয়াজ ভেসে আসে। দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে রশিদ শাফায়াতকে বলে : উই হ্যাভ ক্যাপচারড স্টেট পাওয়ার আন্ডার খন্দকার মােশতাক। শেখ ইজ কিন্ড। ডােন্ট টুই টু টেক এনি একশন এগেইনস্ট আস্। শুনে শাফায়াত ক্রুদ্ধ, শােকাভিভূত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ঠিক সেই মুহূর্তে ফোনে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ তাকে মুজিবের বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার খবর জানান (মতান্তরে ব্রিগেড নিয়ে মুজিবের সাহায্যে যেতে নির্দেশ দেন)। রশিদ তখন জিপ নিয়ে। ধানমণ্ডির দিকে ছুটে যায়। মুজিবের বাড়িতে পৌছে রশিদ দেখতে পায় সবকিছুই নীরব, নিস্তব্ধ। সৈন্যরা। বাড়ির বাইরে টহল দিচ্ছে। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনী ফারুকের ট্যাঙ্কের কাছে পরাস্ত। জেনারেল হেডকোয়ার্টার শােকে মুহ্যমান। অভিযানের সাফল্যে রশিদ এতই প্রলুব্ধ হয়ে৫৮. কুর পর ডালিম, নুর, শাহরিয়ার, মাজেদ ও ইঞ্জিনিয়ার্সের কিছু সৈন্য বাংলাদেশ বেতার ভবনের অভ্যন্তরে অবস্থান করতাে এবং ঢাকা ও আশেপাশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের ধরে এনে জোর করে। টাকা-পয়সা আদায় করতাে (কর্ণেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৮)। অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। প্রচুর টাকা বানিয়েছেন বলে রশিদ নিশ্চিত করে বলেছেন (অ্যান্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮)। ফারুকের বিপ্লব-সরকারি শাসনযন্ত্র নির্মল করার মহান” অভিযান-বিশেষ করে শেখ মুজিবকে। হত্যা করার আসল উদ্দেশ্য-তার মতে এজন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।পড়ে যে, নিজেরাই ক্ষমতা দখলের কথা ভাবতে শুরু করে। কিন্তু রেডিওতে ডালিমের ঘােষণা” শুনে রশিদের ভাবনায় ছেদ পড়ে। প্রথমত ডালিমের মতাে একজন চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসার কর্তৃক ঘটানাে অভ্যুত্থান সম্পর্কে ঢাকার বাইরের ব্রিগেডগুলােতে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয়ত মুজিবের পুরাে পরিবার খতম করা হয়েছে জানতে পারলে জনসমর্থন তাদের বিপক্ষে চলে যাবে এবং এজন্য আন্তর্জাতিকভাবেও তারা নিন্দিত হবে। ফলে নিজেদের দ্বারা ক্ষমতা দখলের চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলে রশিদ একটি ট্যাঙ্ক পেছনে নিয়ে দ্রুত আগামসি লেনের দিকে তার জিপ ছুটিয়ে দেয় এবং মােশতাককে নিয়ে রেডিও অফিসে পৌছে। এরপর তিন বাহিনী প্রধানকে এনে আনুগত্য প্রকাশের মােশতাককৃত প্রস্তাবকে রশিদ উত্তম’ বিবেচনা করে ক্যান্টনমেন্টে রওয়ানা হয়। | মুজিব নিহত নিশ্চিত হয়ে ফারুক রাজধানীর নিরাপত্তা বিধানের জন্য তার বহর থেকে ১০টি ট্যাঙ্ক নিয়ে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে যায়। সারিবদ্ধভাবে সাজানাে ট্যাঙ্কগুলাে দেখে রক্ষী বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। বিনাযুদ্ধে জয়লাভ করে ফারুক রক্ষীবাহিনীকে সে-মুহূর্ত থেকে সেনাবাহিনীর সাথে একীভূত ঘােষণা করে বলে যে, তাদেরকে এখন থেকে সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। একই সাথে সে ফোন উঠিয়ে এ বিষয়ে মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক কর্নেল নুর উদ্দিনের সাথে আলাপ করে নিয়ে। ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। সেখানে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে ঢােকার মুখে রাস্তায় অবস্থান। নিয়ে সে সাপ্লাই এ্যান্ড ট্যান্সপাের্ট কোম্পানির সারিবদ্ধ গাড়িগুলাের উপর হেভি মেশিনগান দ্বারা ফায়ার করে। এতে কয়েকটি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও কয়েকজন সৈনিক আহত হয়।রশিদ চলে যাওয়ার পর দ্রুত ইউনিফরম পড়ে শাফায়াত জামিল ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার পথে উপ-সেনাপ্রধান জিয়ার বাসায় যান। জিয়া তখন সেভ৫৯. হত্যাকাণ্ড ঘটানাের পরপরই ডালিম তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে রেডিও অফিসে গমন করে। সশস্ত্র। সৈন্যদের দেখে প্রহরারত পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী দল আত্মসমর্পণ করে। অস্ত্রের মুখে ট্রান্সমিটার অন করিয়ে ডালিম ঘােষণা দেয় : ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, স্বৈরাচার শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে, খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। কার্টু জারি করা হয়েছে।’ ঘােষণায় আরো বলা হয় : দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত হবে।’ (ড. মােহাম্মদ হাননান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৪ ও অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৪)।৬০. রশিদ পূর্ববর্তী তিনটি আলােচনায় মােশতাককে মুজিবের স্থলাভিষিক্ত করার ইঙ্গিত দিয়েছিল এবং ইতােমধ্যে রেডিওতে ‘ডালিমের ঘােষণা শুনে দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য মােশতাক প্রস্তুত হয়েই ছিল। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের বর্ণনামতে, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনে সবগুলাে ট্যাঙ্ক পার্ক করে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ফারুক বলে, “আমরা আমাদেরকে আপনাদের কমান্ডে ন্যস্ত করলাম’। অফিসাররা স্পষ্টতই বিক্ষুব্ধ ছিল। শাফায়েত জামিলের সাথে ফারুক সবিনয়ে কথা বলতে চাইলেও জামিল তাকে কে তােমাকে উপদেশ দিতে বলেছে? বন্ধ কর তােমার মুখ -বলে ধমক। দেন (এন্থনি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮৩)।করছেন। রশিদের কথা আর শফিউল্লাহর ফোনের বর্ণনা দিয়ে শাফায়াত জিয়ার নিকট করণীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা চান। প্রতিউত্তরে শান্তকণ্ঠে জিয়া বলেন : প্রেসিডেন্ট যদি বেঁচে না থাকেন, ভাইস-প্রেসিডেন্ট তাে আছেন। তােমরা হেডকোয়ার্টারে যাও এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করাে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকালে ধাক্কার শব্দ পেয়ে দরজা খােলে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ। তার ডিএমআই লে. কর্নেল সালাউদ্দিনের নিকট আমার ও আর্টিলারি শহরে (রেডিও সেন্টার, গণভবন, ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রােডে) যাচ্ছে জানতে পেয়ে শঙ্কিত হয়ে। তাৎক্ষণিকভাবে শাফায়াত জামিলকে (সালাউদ্দিনের মাধ্যমে ও ফোনে) তিনটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন দিয়ে তাদের প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণ পর মুজিব নিহত শুনে তিনি অপর দু’বাহিনীর প্রধান এবং সেনা-উপপ্রধান ও সিজিএসকে তার বাসায় আসতে বলেন। ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে নাইট ড্রেসে সিজিএস খালেদ মােশাররফ, প্যান্ট-শার্টে বিমানপ্রধান আব্দুল করিম খন্দকার, ক্লিন-সেভড ধােপদুরস্থ ইউনিফরমে সেনা-উপপ্রধান জিয়াউর রহমান ও নৌ-প্রধান মােশাররফ হােসেন খান এসে পৌঁছান। সংক্ষিপ্ত আলােচনায় জানা যায়, মাত্র গুটিকয় কর্মরত ও প্রাক্তন জুনিয়র অফিসার দুটি ইউনিটের কিছু সৈন্যসহযােগে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাই এটি যেন পুরাে আর্মিতে ছড়িয়ে না পড়ে বা পুরাে আর্মি যেন উদ্ধৃঙ্খল না হয়ে পড়ে তার ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সফিউল্লাহ শাফায়াত জামিলকে সাহায্য করার জন্য খালেদ মােশাররফকে ৪৬তম ব্রিগেডে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু জিয়া এর বিরােধিতা করে শফিউল্লাহকে বলেন ‘Don’t send him, he is going to spoil it.’ কিছুক্ষণ পর রেডিওতে মুজিবহত্যার ঘােষণা শুনে শফিউল্লাহ স্তম্ভিত হয়ে পড়েন। এ সময় জিয়া শফিউল্লাহকে আবার বলেন : সিজিএস খালেদ মােশাররফকে আর বাইরে যেতে দিও না। তাকে বলে Ops order তৈরি করতে। কারণ, ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন-ইন দিস প্রিটেক্ট। এমন সময় ইউনিফরম পরিহিত ডালিম ১০/১৫ জন সৈন্যসহ সশস্ত্র অবস্থায় দরজা ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে বলে : ‘President wants you in the radio station.’ প্রেসিডেন্ট তাে মারা গেছেন। সফিউল্লাহর এ-কথার পিঠে utiera ‘Sir, you should know Khandaker Mostaque is the president now.’ উত্তরে শফিউল্লাহ বলেন ‘Khandaker Mostaque may be your president, not mine.’ প্রত্যুত্তরে ডালিম বলে, ‘Sir, don’t make me do something for which I did not come.’ ‘তােমার যা খুশি করতে পারাে, আমি আমার টুপসের কাছে যাচ্ছি’৬২. শাফায়াত জামিল মুজিব হত্যা মামলায় তার সাক্ষ্যে বলেছেন, জিয়ার প্রতিক্রিয়া ও উক্তি ছিল। নিম্নরূপ: ‘তাতে কী, রাষ্ট্রপতি নিহত, উপরাষ্ট্রপতি আছেন, সংবিধান সমুন্নত রাখাে” ৬৩. সেনাপ্রধান বা উপপ্রধান কেউই এরূপ নির্দেশ দেননি বলে শাফায়াত জামিল জানানবলে শফিউল্লাহ অফিস থেকে বের হয়ে ৪৬ ব্রিগেডে রওয়ানা হন। ডালিম তার সশস্ত্র সৈন্য-সামন্তসহ তাকে অনুসরণ করে।কিছুক্ষণ পর নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয়ও সেখানে আসেন। রশিদ তিন বাহিনী প্রধানকে তাদের কৃতকর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে সহযােগিতা কামনা করে বলে : আমরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তা করেছি। আমরা আপনাদের ত্যাগ করছি না এবং আমরা ক্ষমতায়ও যেতে চাচ্ছি না। আমরা বরং আপনাদের নেতৃত্ব চাই। সুতরাং আপনারা রেডিও স্টেশনে আসুন এবং যা কিছু করণীয় তা করুন। কোনােরূপ কাউন্টার অ্যাকশনে রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করে এবং চাপের মুখে তারা তখন রেডিও সেন্টারে যান। ডালিম তাদের এসকর্ট করে। উপ-সেনাপ্রধান জিয়াও তাদের পেছনে পেছনে রেডিও সেন্টারে যান। তারা রেডিও সেন্টারে ঢােকার পর মােশতাক বলেন ‘Shafiullah, congratulation; your troops have done an excellent job, now do the rest.’ ‘what rest?’ শফিউল্লাহর এ প্রশ্নের জবাবে মােশতাক বলেন : ‘You should know it better’, ‘In that case, leave it to me’ বলে শফিউল্লাহ বের হতে উদ্যোগী হলে ডালিম-রশিদ প্রমুখ পথ আগলে তাকে অন্য একটি কামরায় নিয়ে যায়।”কিছুক্ষণ পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর কর্তৃক মুসাবিদাকৃত মােশতাক-সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকারের ঘােষণা পর্যায়ক্রমে তিন বাহিনী প্রধান, বিডিআর প্রধান (মে.জে. খলিলুর রহমান), রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান, পুলিশ প্রধান (নূরুল ইসলাম) প্রমুখের৬৩. রক্তপাত ও গৃহযুদ্ধের চেয়েও তাদের কাছে নিজেদের ক্ষমতা বা প্রাণহানির আশঙ্কা সম্ভবত বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিমানপ্রধানের ভাষায় সেখানে সম্পূর্ণ Indiscipline ও Chaotic অবস্থা বিরাজ করছিল। some of the armed officers were on the edge of irrationality and tension; minimum confrontation or disagreement could have lead to spree of killing.’ এবং ফারুকের ধারণাকে সত্য প্রমাণ করে মুজিবের মৃত্যুসংবাদ শুনে জেনারেলরা এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। মেজরদের বিরুদ্ধে কোনাে পদক্ষেপ নেয়ার সাহস কেউ দেখায় না। এ সময় ওসমানী ও কর্নেল তাহের রেডিওতে উপস্থিত ছিলেন মােশতাক তখন শাদা প্রিন্সকোট ও মাথায় কালাে (নেহেরু) টুপি পরিহিত ছিলেন। এ পােশাককে পরে তিনি রাষ্ট্রীয় পোশাক হিসেবে ঘােষণা করেন। মতান্তরে, ধুরন্ধর উকিল মােশতাক ফাঁদে ফেলার জন্য শফিউল্লাহকে উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন : “আমাকে বলুন, এ কাজ কি আপনি করেছেন? তার সামনেই ছিল হত্যাকারী মেজরবৃন্দ। তাই বেকায়দায় পড়ে জীবনের ভয়ে আস্তে আস্তে শফিউল্লা বলেন হ্যা আমরাই তা করেছি।’ অন্য দু’প্রধানও একই উত্তর দিলেন। আপনারা আমাকে দিয়ে কী করাতে চান? মােশতাকের এ প্রশ্নের জবাবে ভীত-সন্ত্রস্ত প্রধানত্রয় বললেন, “আপনি দয়া করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। এখন বাংলাদেশে আপনিই একমাত্র গ্রহণযােগ্য ব্যক্তিত্ব’। হত্যাকাণ্ডের পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর পশ্চিমা এক সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষৎকারে বলেছিল যে, মুজিবহত্যার পরিকল্পনাটি তার বাড়িতেই মাত্র দুই রাত আগে চূড়ান্ত করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি মােশতাকের প্রথম বেতার ভাষণটি তাহেরউদ্দিন ঠাকুর লিখেছিলেন। পরিষ্কার বােঝা যায় যে, এটা বেশ সময় ধরে যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করে লেখা হয়ে ছিল। উদ্ধৃত অ্যান্থনি, ম্যাসকারনহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০প্রত্যেকের কণ্ঠে রেকর্ড করা হয় ও বেতারে বারবার প্রচার করা হয়। এরপর তাদের এসকট করে বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয় (এবং সভা-সম্মেলন-আলােচনা প্রভৃতি বিভিন্ন অজুহাতে ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত সেখানে আটকে রাখা হয়)। সেখানে সকলকে অভ্যর্থনা জানান মিসেস যােবায়দা রশিদ। জুম্মার নামাযের আগেই মােশতাক রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বিকালে তার মন্ত্রিরা শপথ গ্রহণ করেন। সন্ধ্যায় মােশতাক জাতির উদ্দেশে রেডিওটিভিতে ভাষণ দেন। আল্লাহর নামে শুরু ও বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে শেষ করা এই ভাষণে তিনি কুদেতাকে সমর্থন করে বলেন : সকলেই এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছিল। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে পরিবর্তন সম্ভব। ছিল না বলেই সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়। …ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে সেনাবাহিনী জনগণের জন্য সুযােগের স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট হয়েই মােশতাক গাজী গােলাম মােস্তফাকে রেডক্রস প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি দান করেন এবং মাহবুব আলম চাষীকে তার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে নিয়ােগদান করেন।৬৯. ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানাে হয়েছে, জনমনে এমন একটি ধারণা দেয়ার উদ্দেশ্যে মোশতাক জুম্মার নামাজের জন্য দুপুরে ৩ ঘন্টার জন্য কার্য শিথিল করেন। মুজিবের রক্ত মাড়িয়ে মােহাম্মদউল্লাহ উপরাষ্ট্রপতি এবং ১. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। ২. অধ্যাপক ইউসুফ আলী ৩, ফণীভূষণ মজুমদার।৪. মনোরঞ্জন ধর। ৫. আব্দুল মােমিন৬. আসাদুজ্জামান খান ৭, ড, এ আর মল্লিক৮, ড, মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী ৯, আব্দুল মান্নান১০. সােহরাব হােসেন মন্ত্রী ও ১. তাহেরউদ্দিন ঠাকুর২. নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ৩, দেওয়ান ফরিদ গাজী৪. শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ৫. কে.এম, ওবায়েদুর রহমান ৬, মােসলেম উদ্দিন খান ৭. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল৮. রিয়াজ উদ্দিন আহমদ ৯, সৈয়দ আলতাফ হােসেন১০. মােমিন উদ্দিন আহমদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। (ক্রমিক নম্বর ৬১০ এই ৫ জন প্রতিমন্ত্রী ২০ আগস্ট শপথ গ্রহণ করেন) নিজেকে খাটি মুসলমান প্রমাণ করার জন্য পীরপুত্র মােশতাক সেদিন থেকে দাড়ি রাখতে শুরু করেন চুয়াত্তরের জানুয়ারিতে লেডিস ক্লাবে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গাজীপুত্র (মতান্তরে ভ্রাতা) ও ডালিমের মধ্য সংঘটিত অনাকক্ষিত এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে শৃঙ্খলার প্রশ্নে ডালিমসহ কয়েকজন সেনা অফিসারের চাকরিচ্যুতি ঘটে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক চাষীকে তার সচিব নিয়ােগ করেছিলেন এবং উভয়ে মিলে আমেরিকার সহযােগিতায় পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্র করে ধরা পড়েন। চাষী তাৎক্ষণিক ও মােশতাক বিজয়ের পরপরই পররাষ্ট্র মনন্ত্রীর দায়িত্ব হারান।এদিকে বিভিন্ন আলােচনা, সভা, কনফারেন্সের অজুহাতে বাহিনীপ্রধানদের এক কাপড়ে ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত বঙ্গভবনে আটকে রাখা হয়। তবে সমস্ত কিছু লক্ষ্য করে বিবেকপীড়িত হয়ে এই অন্যায় ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা অনুচিত ভেবে ১৭ আগস্ট কাউকে কিছু না বলে এ.কে. খন্দকার বঙ্গভবন থেকে চলে আসেন ও পরদিন সকাল ১০টায় পুন: বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র পেশ করেন। এ.কে. খন্দকার জানান, বঙ্গবন্ধু নিহত হবার খবরে সশস্ত্রবাহিনীর সদস্যরা ছিল মর্মাহত। দুটি ইউনিটের গুটিকয় অফিসার-সৈন্য ছিল বিশৃঙ্খল। গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা থাকায় উর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষ ওদের বিরুদ্ধে এ্যাকশনের কোনাে নির্দেশ দিতে পারেনি, তাই সামরিকবাহিনী কোনাে এ্যাকশনে যায়নি। বঙ্গভবন থেকে মুক্তি পেয়ে ১৮ আগস্ট রাতেই সফিউল্লাহ একটি কনফারেন্স ডাকেন। বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানসহ বেশকিছু উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা এতে উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত হয় যে, কিছু উচ্ছল চাকরিচ্যুত ও চাকরিরত সামরিক অফিসার ও সৈনিক দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। এ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যার সঙ্গে (পুরাে) সামরিকবাহিনীর কোনাে সম্পর্ক নেই। এসব উদ্ধৃঙ্খল অফিসারদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পরদিন শৃঙ্খলাভঙ্গকারী অফিসারদের সেনানিবাসে (চেইন অব কমান্ডে) ফেরত আনার উদ্দেশ্যে ফরমেশন কমান্ডারদের একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হলেও প্রকারান্তরে এটি ব্যর্থ হয়। একই উদ্দেশ্যে ২২ আগস্ট সফিউল্লাহ্ বঙ্গভবনে গিয়ে মােশতাককে টুপস’ ফিরিয়ে নিয়ে রিগ্রুপিং-এর প্রস্তাবের জবাবে মােশতাক wait and see’ বলায় কার্যত তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। শফিউল্লাহ্র এই উদ্যোগ সঙ্গতকারণে ঘাতকরা পছন্দ করেনি। দু’দিন পর (২৪ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে একটি নিউজ বুলেটিনে জেনারেল ওসমানীকে প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিযুক্তির ঘােষণা দেয়া হয়। এদিন বিকাল সাড়ে ৫টায় মােশতাক সফিউল্লাহকে বঙ্গভবনে যেতে বলেন। যথাসময়ে বঙ্গভবনে প্রবেশের মুখে তিনি জেনারেল জিয়া ও জেনারেল খলিলকে বের হতে দেখেন। ওসমানী ও মােশতাক উভয়ই তার অনেক প্রশংসা করে বলেন, ‘তুমি দেশের জন্য অনেক কিছু করেছ, এখন তােমার সার্ভিস দেশের বাইরে দরকার। ওসমানীর এই উপদেশ’-এর অর্থ উপলব্ধি। করেও সফিউল্লাহ ‘বিদেশে যেতে রাজি নন’ জানিয়ে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু৭৪। পরে মেজর রশিদকে পাঠিয়ে জার্মানি থেকে তাওয়াবকে এনে এই শূন্যপদ পূরণ করা হয়। গ্রুপ। ক্যাপ্টেন তাওয়াব ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনী থেকে সবরকম। বেনিফিটসহ চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জার্মানিতে অবস্থান ও ব্যবসা করছিলেন। তিনি পরে বাংলাদেশে সিরাতুন্নবী (স.) কালচারের পৃষ্ঠপােষকতা করেন। জনাব খন্দকার আরও জানান, তাওয়াব বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে যােগ দেবার পর তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওএসডি করা হয় এবং ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় হাই কমিশনার পদে নিয়ােগ করা হয়।ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসে দেখেন, জেনারেল জিয়া ইতােমধ্যেই ‘চিফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে’ অফিসারদের সঙ্গে সভা করছেন। জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ করার সঙ্গে সঙ্গে বিধি লঙ্ঘন করে তিনজন সিনিয়র। অফিসারকে ডিঙ্গিয়ে দিল্লীতে সামরিক কোর্সে অংশগ্রহণকারী ব্রিগেডিয়ার হাে. মাে. এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে প্রমােশন দিয়ে ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ করা হয়। জেনারেল খলিলুর রহমানকে করা হয় চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ। জেনারেল দস্তগীরকে করা হয় বিডিআর চিফ। অপরদিকে সফিউল্লাহকে বদলি করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সফিউল্লাহ মনে এই দুঃখ নিয়ে বিদায় নিলেন যে, সময়ের অভাবে ঘাতকদের তিনি কোর্ট মার্শালের আদেশ দিতে পারেননি। তার ভাষায় : বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায় স্থম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। সে-সময় খুনিচক্রের হাতে জিম্মি হয়ে যা করেছি, বাধ্য হয়েই করেছি। তিনি আরও বলেন : খুনিরা ছাড়া পুরাে সেনাবাহিনী ছিল আমার কন্ট্রোলে। ইচ্ছে করলে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হতে পারতাম। সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে যুক্ত করে ধ্বংস করতে চাইনি বলেই তা করিনি। অথচ জিয়া-এরশাদ ওই কাজটিই করেছে। বলাবাহুল্য, মেরুদণ্ডহীন’ সফিউল্লাহর স্থম্ভিত হয়ে পড়ার সুযােগে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের ক্ষমতা সংহত করার সুযােগ পায়। নিহতদের শেষকৃত্য। ১৬ আগস্ট সকালে বাড়ি নম্বর ৬৭৭, সড়ক নম্বর (তদানীন্তন) ৩২, ধানমণ্ডি থেকে। মুজিব ও এএসআই সিদ্দিকুর রহমান ব্যতীত অন্যদের এবং ঢাকা মেডিকেলের মর্গ থেকে আব্দুর রব সেয়নিয়াবাত ও শেখ মণির পরিবারের ৯টি সহ মােট ১৮টি লাশ লে, কর্নেল আবদুর রবের তত্ত্বাবধানে ‘হাইয়েস্ট অথরিটি বঙ্গভবনের নির্দেশে বনানী কবরস্থানে মাটিচাপা দিয়ে ‘ডিসপােজ’ করা হয়। লাশগুলাে থেকে তখন প্রচণ্ড দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। গােসল, কাফন, জানাজা প্রভৃতি কোনাে ধর্মীয় আচার পালিত হয়নি। যে যে-কাপড়ে ছিল, তাকে সে-কাপড়েই সমাহিত করা হয়। একের পর-এক কবর খোড়া আর একের পর-এক লাশ মাটি চাপা দেয়া। লাশগুলাের কোনাে ময়না তদন্তও হয়নি। | পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের নিহত এএসআই মাে. সিদ্দিকুর রহমানের জানাজা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অনুষ্ঠিত হয় এবং মিরপুর ১নং শহীদ বুদ্ধিজীবী গােরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।১৬ আগস্ট অনুমান বিকাল ২টায় গােপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়া থানার মাঠে। হেলিকপ্টারে মুজিবের লাশ নেয়া হয়। সঙ্গে যাওয়া ১৫/১৬ জন সেনা হেলিকপ্টার৭৬. ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭-৫৮, ১৯৮-৯৯, ২০৩-০৪থেকে লাফিয়ে নেমে মাঠের চারদিকে অবস্থান নেয়। আর্মি কর্তৃক লাশ ‘যে-অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় মাটি দেয়ার প্রচেষ্টার প্রতিবাদ করে উপস্থিত লােকজন বলেন, মুসলমানের লাশ বিনা গােসলে, বিনা কাফনে, বিনা জানাজায় দাফন করা যায় না।’ ফলে বাধ্য হয়ে তারা এজন্য ১০ মিনিট সময় দেয়। গােসল করানাের আগে এএসপি। শেখ আবদুর রহমানের সুরতহাল করানাের চেষ্টা দুজন আর্মি অফিসারের বাধার কারণে ভন্ডুল হয়। স্থানীয় রেডক্রস হাসপাতাল থেকে তিনটি শাদা শাড়ি ও পাশের দোকান থেকে ২টি ৫৭০ সাবান সংগ্রহ করে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মৌলভী আব্দুল হালিম শেখের তত্ত্বাবধানে গোসল করিয়ে কাফন পড়ানাে হয়। জানাজায় শরিক হওয়ার জন্য হাজার হাজার লােক হেলিপ্যাডের চারপাশে সমবেত হয়। কিন্তু সৈন্যরা তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি, জানাজায় শরিক হতেও দেয়নি। ২০/২৫ জন লোেক যারা গােসল-কাফনের কাজে যুক্ত হওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন, তাদের নিয়েই উক্ত ইমাম সাহেব জানাজা পড়ান এবং পারিবারিক কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পশ্চিমপাশে তাকে দাফন'”করেন। নিহতদের শেষকৃত্যের সাথে জড়িত ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন হেডকোয়ার্টারের স্টেশন স্টাফ অফিসার মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ (আটিলারি) ১৮ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিঃ ১৫ আগস্টের ঘটনায় নিহতদের অবস্থা ও দাফন-কাফন এবং ঘটনা সম্পর্কে নিম্নরূপ পরিস্থিতি প্রতিবেদন পেশ করেন : ১৯৭৫ -এর ১৬ আগস্ট ভাের ৩টায় ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডারের আদশে আমি প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি যাই। স্টেশন কমান্ডার আগেই পেীছে গিয়েছিলেন। মেজর বজলুল হুদা ও তার লােকজন পাহারা দিচ্ছিলেন বাড়িটি। হুদা আমাকে প্রথমে বাধা দিলেও পরে ঢােকার অনুমতি দেন। ১. সড়ক নম্বর ৩২, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি : সবগুলাে লাশ সিঁড়ির গােড়ায় আনা হলাে। রাখা হলাে কাঠের কফিনে। বরফ আনা হয়েছিল। রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রথম তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। বাড়ির সব বাসিন্দাকেই খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলােও ঝাঝরা হয়ে যায়। খােসাগুলাে মেঝেতে পড়া ছিল। কয়েকটি জানালার কাচ ভেঙে গুড়িয়ে যায়। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনসপত্র, গিফটবক্স ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিয়েগুলাের উপহারের প্যাকেট। পবিত্র কোরআন শরিফও মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলাম। ক. শেখ মুজিবের বাড়িতে নয়জনকে হত্যা করা হয়েছিল। লাশগুলাে (প্রদত্তরিপাের্ট মতে) যে অবস্থায় পাওয়া যায় : ১. শেখ মুজিব : প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানটায় যে সমতল অংশটি তারতিন-চার ধাপ ওপরে। চশমার ভাঙা কাঁচ ও একটি পাইপ সিঁড়িতে পড়ে ছিল।৭৭. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৯, ৫৩, ৯১, ৯২, ১৫৯৬১২. শেখ কামাল : অভ্যর্থনা কক্ষে। ৩. টেলিফোন অপারেটর : অভ্যর্থনা কক্ষে। ৪. শেখ নাসের : নিচতলার সিড়িসংলগ্ন বাথরুমে। ৫. বেগম মুজিব : মূল বেডরুমের সামনে। ৬. সুলতানা কামাল : মূল বেডরুমে।৭. শেখ জামাল : মূল বেডরুমে। ৮, রােজি জামাল : মূল বেডরুমে।৯. শিশু রাসেল : মূল বেডরুমে, তার দুই ভাবীর মাঝখানে। ২. বাড়ির সব বাসিন্দাকেই খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের সবাই তাৎক্ষণিকভাবে প্রাণ হারান। শেখ মুজিব : প্রথম তলার সিড়ির মাঝখানে যে সমতল জায়গাটা তার তিন-চার ধাপ ওপরে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে শেখ মুজিবকে খুন করা হয়। তার তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। শেখ মুজিব সব সময় চশমা পরতেন এবং তার ধূমপানের অভ্যাস ছিল। তার চশমা ও তামাকের পাইপটা সিড়িতে পড়া ছিল। পরনে চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চশমার একটি গ্লাস ভাঙা। রক্তে পাঞ্জাবির রঙ ছিল গাঢ় লাল। একটি বুলেট তার ডান হাতের তর্জনিতে গিয়ে লাগে এবং আঙুলটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। শেখ কামাল : কামালের বুক ও তলপেটে তিন থেকে চারটি বুলেট বিদ্ধ হয়। তার পরনে ছিল ট্রাউজার। নিচতলায় তাকে খুন করা হয়। টেলিফোন অপারেটর : তাকে নিচতলায় খুন করা হয়। শেখ নাসের : শেষ নাসেরকে খুন করা হয় বাথরুমের কাছে। তার হাত উড়ে গিয়েছিল। গুলিতে তার দেহের বেশ কিছু স্থান ছিল ক্ষত-বিক্ষত। তার গায়ে কোনাে পােশাক ছিল না এবং লাশ বিছানার চাদরে মােড়ানাে ছিল। বেগম মুজিব : বেগম মুজিবকে বুকে ও মুখমণ্ডলে গুলি করা হয়। তার পরনে ছিল। সুতি শাড়ি এবং কালাে রঙের ব্লাউজ। গলায় মাদুলি বাঁধা একটি সােনার নেকলেস। কনিষ্ঠা আঙুলে ছােট্ট একটি আঙটি। তখনাে তার পায়ে ছিল একটি বাথরুম স্লিপার। সুলতানা কামাল : সুলতানা কামালের বুকে ও তলপেটে গুলি লাগে। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ। শেখ জামাল : শেখ জামালের মাথা চিবুকের নিচ থেকে উড়ে গিয়েছিল। পরনে ট্রাউজার। ডান হাতের মধ্যমায় ছিল একটি মুক্তার আঙটি। সম্ভবত এটি ছিল তার বিয়ের আঙটি। রােজি জামাল তার মুখটি দেখাচ্ছিল বিবর্ণ, মলিন। মাথার একাংশ উড়ে গিয়েছিল। তার তলপেট, বুক ও মাথায় গুলি করা হয়। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ।শিশু রাসেল : সম্ভবত আগুনে তার পা ঝলসে যায়। মাথা উড়ে গিয়েছিল। পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। লাশ একটি লুঙ্গিতে মােড়ানাে ছিল। ৩, মেঝেতে ছড়ানাে-ছিটানাে ছিল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জামাল ও কামালের বিয়ের অনেক উপহার সামগ্রী ও গিফট প্যাকেট। কিছু বাক্স ছিল ফাকা। কামালের কক্ষে রূপার তৈরি অনেক জিনিসপত্র দেখা যায়। সিড়িটি ছিল আল্পনা আঁকা। অভ্যর্থনা কক্ষটি ছিল নােংরা। আমি ওপরতলা থেকে শুনলাম নিচতলায় হুদা চিৎকার করছেন। তিনি এ বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র চুরি করায় কয়েকজন সিপাহিকে গালাগাল দিচ্ছিলেন। ৪, সড়ক নম্বর ১৩/১, ধানমন্ডি, শেখ মণির বাড়ি মণি ও তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে তাদের এই বাড়িতে খুন করা হয়। তাদের বাড়ির দিকে সেনাবাহিনীর গাড়ি আসতে দেখে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব ছেড়ে সরে যায়। বাড়িটি ছিল আংশিক তছনছ করা। মেঝেতে স্পষ্ট রক্তের দাগ। মাঝের টেবিলে একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে কিছু ভেজানাে চিড়া। ৫. ৩৭ মিন্টু রােড, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি মন্ত্রীর বাড়িটি ছিল ফাঁকা। ড্রয়িংরুমজুড়ে দেখা গেল জমাটবাধা রক্ত। বাড়ির নিরাপত্তা পুলিশ আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। ৬. সেরনিয়াবাত ও শেখ মণি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। লাশগুলাে ছিল বিকৃত। তাপ ও আর্দ্রতা লাশের ক্ষতি করে। লাশ থেকে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। বনানী গােরস্থানে দাফনের জন্য আমরা লাশগুলাে সেনানিবাসে নিয়ে এলাম। শেখ মুজিবের লাশ ছাড়া ৩২ নম্বর সড়কের অন্য সবার লাশও আরেকটি ট্রাকে করে সেখানে আনা হয়। দাফন-কাফন সম্পর্কে প্রতিবেদন। ১. মৃতদেহ সংগ্রহ : ১৫ আগস্ট ঘটনায় নিহতদের লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। দুটি ট্রাকে করে ১৮টি লাশ দাফনের জন্য আনা হয়। বনানী গােরস্থানে দাফনের জন্য গুলশান মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। এএসসি (আর্মি সার্ভিসেস কোর) সিপাহিদের একটি প্লাটুন গােরখােদকের কাজ করে। স্টেশন কমান্ডার আগেই আমাকে বলেছিলেন, ১৬ আগস্টের দিনের প্রথম আলাে ফোটার আগেই যাতে দাফনের সব কাজ শেষ হয়ে যায়। ২. দাফন : আগস্ট মাসের তাপ ও আর্দ্রতায় কিছু লাশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে কোনাে ফ্যান ছিল না। ৩২ নম্বরের লাশগুলােতে বরফ দেওয়া ছিল। ফলে সেগুলাের অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালাে। সিপাহিদের কয়েকজন, খুবই গলা চড়িয়ে কথা বলছিল। তারা শেখ মুজিব বিরােধী মনােভাব প্রকাশ করছিল। ফলে আমাকে গােটা পরিস্থিতিকেই সতর্কতার সঙ্গে। সামাল দিতে হয়। অবশ্য কোনাে লাশেরই যাতে অমর্যাদা না হয় আমি সেটি নিশ্চিত করেছিলাম। সিপাহিদের কয়েকজন কবর খুঁড়তে অনীহা প্রকাশ করে, লাশের খারাপ অবস্থার কারণে কয়েকজন এমনকি ছুঁতে পর্যন্ত রাজি ছিল না। আমি নিজে প্রথম মৃতদেহটি (বেগম মুজিবের) ওঠাই এবং চিরশয্যায় শায়িত করি। শেখনাসেরের দেহাবশেষ একইভাবে দাফন করি। এরপর আর আমার সমস্যা হয়নি। চার নম্বর ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলাে কবর ঠিকভাবে খোঁড়া হয়। কারণ আমরা সূর্যোদয়ের আগেই সব সেরে ফেলার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলাম। গােরস্থানমুখী সড়কগুলােয় আমরা আগেই সিপাহি মােতায়েন এবং গােরস্থান এলাকায় কার্য্য জারি করি। ভােরে ঘুমভাঙা কিছু লােক ও পথচারী কী ঘটছে বােঝার চেষ্টা করলে তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। ৩. (গােরস্থানের) ৭ নম্বর সারির চারপাশে বেড়া দেওয়া হয় এবং অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে ২৪ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য গােরস্থানটিতে দাফন কাজ বন্ধ ও দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ৪, মৃতদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র : কয়েকটি লাশের সঙ্গে কিছু গহনা পাওয়া যায়। একটি তালিকা তৈরি করে গহনাগুলাে স্টেশন কমান্ডারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৫. শেখ মুজিবের দাফন : ১৬ আগস্ট, ১৯৭৫ বেলা ১১টায় শেখ মুজিবের লাশ সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে করে ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়। কাফন কেনা হয় সিএসডি (ক্যান্টিন স্টোরস ডিপার্টমেন্ট) থেকে। এটি কেনা হয়েছিল বাকিতে। অর্ডন্যান্সের জিডিও (গ্যারিসন ডিউটি অফিসার) মেজর মহিউদ্দিন আহমেদকে লাশের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। একটি বিএএফ (বাংলাদেশ এয়ারফোর্স) হেলিকপ্টারযােগে লাশ দাফনের জন্য টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মৃতদেহের গােসল ও জানাজা দেওয়া হয়। জানাজায় শেখ মুজিবের চাচাসহ ডজনখানেক লোক শরিক হন। একটি অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে কবরটি পাহারার জন্য রক্ষী মােতায়েন করা হয়। জিডিও টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে সদর দপ্তরের মিলিটারি অপারেশনসের ডিরেক্টরের কাছে তার রিপাের্ট পেশ করেন। ৬. নিহতদের বাড়িগুলাে সিল করা হয় : শেখ মুজিব, শেখ মণি ও সেরনিয়াবাতের বাড়ি তালাবদ্ধ করে সিলগালা করা হয় এবং চাবি স্টেশন সদর দপ্তরে রাখা হয়। ৭, অনেক বাধাবিপত্তি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা আমাদের সাধ্যমতাে সর্বোচ্চ যত্ন ও মর্যাদার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করি। বনানী গােরস্থান ; সারি নম্বর ৭-এ যাদের করব দেওয়া হয় : ১. বেগম মুজিব, ২, শেখ নাসের, ৩, শেখ কামাল, ৪. সুলতানা কামাল, ৫. শেখ জামাল, ৬, রােজি জামাল, ৭. শিশু রাসেল, ৮. অজ্ঞাত পরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি বালক, ৯, ফাকা, ১০, অজ্ঞাত পরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক, ১১. গৃহপরিচারিকা, বয়স ৪৫, ১২. অজ্ঞাত পরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে বালিকা, ১৩. শেখ মণি , ১৪, মিসেস মণি, ১৫, অজ্ঞাত পরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক, ১৬, অজ্ঞাত পরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক, ১৭, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ১৮, অজ্ঞাত পরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক। নােট : ৯ নম্বর কবরের নাঈম খানের লাশ লে. আবদুস সবুর খানের (এনওকে) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।৭৮ প্রথম আলাে, ১৫ আগস্ট ২০০৩
মুজিব-হত্যা প্রতিরােধ প্রচেষ্টা ও প্রতিবাদকোনাে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে নিবৃত্তিমূলক হামলা করার প্রস্তুতির জন্য প্রয়ােজন দু’ঘণ্টা সময় আর আগাম গােয়েন্দা-খবর। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এর বিদ্রোহ সম্পর্কে বাংলাদেশের সব গােয়েন্দা সংস্থা হয় বে-খবর ছিল, না-হয় তা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিল। সামরিক গােয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক (ডিএমআই) লে. কর্নেল (অব.) সালাহউদ্দিনের বরাতে কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল জানাচ্ছেন, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ এই বিদ্রোহ সম্পর্কে রাত প্রায় সাড়ে ৪টায় অবহিত হন এবং সেনানিবাসে অবস্থানরত প্রায় সকল ইউনিট কমান্ডারদের সাথে যােগাযােগ করেন। শাফায়াতের সাথে যােগাযােগ হয় সকাল প্রায় ৬টায়। সময় ও অবস্থানের বিচারে তখন তারা অভ্যুত্থানকারীদের তুলনায় দেড় ঘণ্টা পেছনে। বিস্ময়ের।১. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস গােয়েন্দা বিভাগের জনৈক কর্মকর্তার বরাতে জানাচ্ছেন, আগস্টের প্রারম্বে গােয়েন্দাবিভাগ মুজিবকে উৎখাতের কমপক্ষে পাঁচটি সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের তদন্ত চালাচ্ছিল। তরুণ। সেনা-অফিসারদের অসন্তোষ ছিল ঐ হিসেবের অতিরিক্ত। (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৬০)। হত্যা মামলার ৪২ তম সাক্ষী মেজর জিয়াউদ্দিন জানান, বঙ্গবন্ধুর সরকার উৎখাতের জন্য ফারুকরশিদ-ডালিম-নুরচক্র ষড়যন্ত্রে লিপ্ত একথা ১৫ আগস্টের ৮/১০ দিন আগেই ডিজিএফআই লিখিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেছিল। কিন্তু অজ্ঞাতকারণে ওদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি (ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৫)। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, (১৫ আগস্টের) এই বিরাট সমরসজ্জা সেনা-সদরের ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স। ইউনিটের মাত্র তিনশাে গজের মধ্যেই সম্পন্ন হচ্ছিল। অথচ, ঐ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের দিন-রাত সতর্ক দৃষ্টি রাখার কথা। ১৪ আগস্ট দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বােমা বিস্ফোরণের পরও এদের চৈতন্যোদয় হয়নি। কর্নেল শাফায়াত জামিল জানাচ্ছেন, ১৫ আগস্টের আগে বিভিন্ন সময়ে সেনা-সদরে অনুষ্ঠিত যেসব বৈঠকে তিনি উপস্থিত ছিলেন তার কোনােটিতেই এ ধরনের কোনাে ঘটনা ঘটার আশঙ্কা। প্রকাশ বা সতর্কীকরণ করা হয়নি। উপরন্তু, ঘটনার মাস-দুয়েক আগে তার ব্রিগেডের একমাত্র। গােয়েন্দা ইউনিটটিকে অজ্ঞাত কারণে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। যদিও অন্যান্য সকল ব্রিগেডের। গােয়েন্দা ইউনিট বহাল ছিল [একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়য়ন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১৯]২. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১৮বাংলাদেশের রাজনীতি – ১০ব্যাপার যে, সেনাপ্রধান কাউকে প্রতিরােধ-উদ্যোগ নেয়ার জন্য পরামর্শ বা নির্দেশ দেননি। বিদ্রোহের খবর পাওয়ার সাথে সাথে (হত্যাকাণ্ডের দেড় ঘণ্টা আগে রাত সাড়ে চারটায়) নিবৃত্তিমূলক হামলার তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেয়া হলে এ হত্যাকাণ্ড প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল। সেনাপ্রধান তা না করে কেন মহামূল্যবান দেড় ঘণ্টা সময় শুধু যােগাযােগের নামে অপচয় করলেন তা খতিয়ে দেখা আবশ্যক। এটা তার কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা বা ভীত হওয়ার কারণে হলে বলতে হবে অযােগ্য লােককে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানাের প্রতিফল মুজিব পেলেন তার প্রাণের দামে। আর ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে কোনােরূপ যােগসাজশ বা আপসের কারণে তা হয়ে থাকলেও একই ফলাফলই প্রাপ্য ছিল। মুজিবের ধানমণ্ডির বাড়ি ও গণভবনের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ছিল ১ম বেঙ্গল ল্যান্সারের ওপর। কিন্তু পঁচাত্তরের জুলাইয়ের শেষদিকে সেনা-সদর তা পরিবর্তন করে কুমিল্লা ব্রিগেডের ওপর ন্যস্ত করে। সে-মতে কুমিল্লা থেকে ১ম ফিল্ড আর্টিলারির একটি ব্যাটারি/কোম্পানি এনে ঐ গার্ড ডিউটিতে নিয়ােগ করা হয়। মেজর ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর বজলুল হুদা, সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ারদার বিন্নি সময়ে ঐ আর্টিলারির অফিসার ছিলেন। বিধি অনুযায়ী নিরাপত্তা সেনাদলটির প্রশাসনিক দায়িত্ব ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) হামিদের ওপর এবং সার্বিক দায়িত্ব লগ এরিয়া কমান্ডার ও সেনাপ্রধানের উপর থাকার কথা। মুজিবের বাসভবন আক্রমন করার সময় এই সেনাদলটিকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। ভাের সাড়ে চারটায় মুজিবের বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়ােজিত সেনাদলকে অগ্রসরমান হত্যাকারীদের প্রতিরােধ করার নির্দেশ দেয়া হলে তারা প্রতিরােধ করত এবং বিদ্রোহীদের দ্বারা এটা একটা সামরিক অভ্যুত্থান, পুরাে সামরিকবাহিনী এর পেছনে রয়েছে’ -রক্ষীদের এ-কথা বােঝানাে সক্ষম হত না। অন্তত এ নিয়ে উভয় দলের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিত। সে-সুযযাগে নিবৃত্তকারী দল হামলাকারীদের রুখে দিতে পারত। মুজিব হত্যা মামলার ৪র্থ সাক্ষী মুজিবের বাসভবনে নিয়ােজিত নিরাপত্তাবাহিনীর কমান্ডার হাবিলদার কুদুস সিকদার জেরাকালে জানান :হত্যকাণ্ডের সময় গােলাগুলির শব্দ শুনে আশপাশ থেকে অনেক লােক বঙ্গবন্ধুর৩. হত্যা মামলার ৪৫ তম সাক্ষী হিসেবে শফিউল্লাহকে জেরাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘সময় পেলে ১৫ আগস্টের ঘাতকদের কোর্ট মার্শালের আদেশ দিতাম। কিন্তু তা হয়নি। কারণ তার আগেই (২৪ আগস্ট ১৯৭৫) মােশতাক আমাকে সরিয়ে জিয়াকে করে সেনাপ্রধান”. ড. মােহাম্মদ হাননান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৫৭]। প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি প্রতিরােধ ও কোর্ট মার্শাল উভয়ের জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন, কিন্তু কিছুই করেন নি এবং সেনাপ্রধানের চাকরি হারালেও রাষ্ট্রদূত হয়ে তা পুষিয়ে নিয়েছেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও যড়য়ত্রময় নভেম্বর, পূর্বােক্ত, পৃষ্ঠা ১১৯ মুজিব-হত্যা মামলার বিবরণের জন্য পরিশিষ্ট ১৯ পড়ুনবাড়ির দিকে ছুটে এসেছিল। কিন্তু তাদের কাউকেই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ঘাতক আর্মির দল তাদের তাড়িয়ে দেয়।নিরাপত্তাবাহিনী ও আক্রমণকারীদের মধ্যে কোনাে বিরােধ দেখা দিলে সে-সুযােগে জনগণই বিদ্রোহীদের প্রতিরােধ করার সুযােগ পেত। মুজিবের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন কুমিল্লা ব্রিগেডকে দেয়া হল এবং কেন তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হল তার উত্তর হত্যার ষড়যন্ত্র উদঘাটনের জন্য প্রয়ােজন। জাতির দুর্ভাগ্য যে, সেনাপ্রধান সেদিন প্রতিরােধের কোনাে চেষ্টা তাে করেনইনি উপরুন্ত নৌ ও বিমান প্রধান সহযােগে বরখাস্তকৃত ডালিম ঘঘাষিত সামরিক শাসন সমর্থন ও অবৈধ মােশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে অন্যদের প্রতিরােধ-চিন্তায় পানি ঢেলে দেন।১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে দুটি ইউনিটের বাছাই করা সৈনিকদের নাইট ট্রেনিং’ -এর ‘ব্রিফিং’-এ ‘সরকার উৎখাতের যে ঘােষণা দেয়া হয়, তা ছিল ‘অস্পষ্ট।’ বালুর ঘাট মাঠ থেকে কোথায় যাওয়া হচ্ছে তা সৈনিকদের বুঝতে দেয়া হয়নি। হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পরই কেবল সৈনিকরা বুঝতে পারে যে, ‘অফিসাররা তাদের ‘ধোকা দিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে এনে এই ঘৃণ্যকাণ্ড ঘটিয়েছে। মুজিবের বাসার সেনা-নিরাপত্তাবাহিনী ভীত বা প্রভাবিত হয়ে ঘাতকদের প্রতিরােধ করতে ব্যর্থ হয় বা বাধাদানে বিরত থাকে। নিরাপত্তায় নিয়ােজিত পুলিশের ডিএসপি ৫০তম সাক্ষী নূরুল ইসলাম খান বলেন :ঘাতকদের আক্রমণের মুখে পুলিশকে তিনি পাল্টা গুলি চালানাের নির্দেশ দিয়েছিলাম, কিন্তু ঘাতকদের গুলিতে নিজে আহত হওয়ায় আর কিছুই করতে পারিনি।’মুজিবের ফোন পেয়ে সামরিক গােয়েন্দাবিভাগের ডাইরেক্টর কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ এক-মুহূর্তও দেরি না করে পাজামা-গাউন পরিহিত অবস্থায় তার গাড়িতে চড়ে (মতান্তরে ট্রাকভর্তি সৈন্য নিয়ে) প্রতিরােধে এগিয়ে আসেন। বাড়িতে ঢুকতে বাধা পেয়ে কড়া বাক্য বিনিময় করে গেটের বাইরে গাড়ি থেকে নেমে সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢােকার মুখে বুকে ও মাথায় গুলি খেয়ে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়েন (মতান্তরে সােবহানবাগে গাড়িতে বসা থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন)। তিনিই একমাত্র বীর সামরিক কর্মকর্তা, যিনি নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে কর্তব্য পালনে এগিয়ে এসে বিরল নজির স্থাপন করেন। | ১৫ আগস্ট ভােরে প্রধানমন্ত্রী (একই সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মনসুর আলীর ফোন পেয়ে বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান রেডিও স্টেশন দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ট্রুপস রেডি করার নির্দেশ দেন। তখনও তিনি জানতেন না যে, সপরিবারে মুজিব নিহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার৬ . ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৪৭। ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮কিউ, জি, দস্তগীর মােশতাক সরকারকে না মানার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনাে কোনাে আওয়ামী লীগ নেতাকে প্রতিবাদ মিছিল বের করার পরামর্শ দেন ও বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষণা প্রচারের উদ্যোগ নেন। কিন্তু চট্টগ্রামের ভীতু আওয়ামী লীগ নেতারা। মিছিল বের করা থেকে নিবৃত্ত থাকেন। | সকাল ৬টায় দরজা ধাক্কিয়ে, ঘুম ভাঙিয়ে মেজর রশিদ (পরে লে. কর্নেল অব.) কর্নেল শাফায়াত জামিলকে মুজিবহত্যার সর্বনাশা বার্তাটি দেয়। একই সাথে মােশতাকের নেতৃত্বে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কথা জানিয়ে এর বিরুদ্ধে কোনাে এ্যাকশনে গিয়ে গৃহযুদ্ধের উসকানি না দেয়ার জন্য হুশিয়ারি দেয়। রশিদের কথা শেষ না হতেই বেজে ওঠে শফিউল্লাহর ফোন। বিদ্রোহে শফিউল্লাহর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত না হতে পারলেও বিদ্রোহীদের মােকাবেলা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে শাফায়াত তার ব্রিগেডের তিনজন ব্যাটেলিয়ন কমান্ডারকে ফোন করে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে বলে দ্রুত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। পথিমধ্যে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনের মমাড়ে একটি ট্যাঙ্কের উপর মেশিনগান নিয়ে বীরের ভাব করে বসা মেজর (পরে লে, কর্নেল অব.) ফারুককে দেখতে পান। অবস্থাদৃষ্টে নিরস্ত্র অবস্থায় অরক্ষিত হেডকোয়ার্টারে যাওয়া নিরাপদ নয় ভেবে সংলগ্ন পদাতিক ব্যাটালিয়ন দুটোর (১ম ও ৪র্থ বেঙ্গল) প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করার জন্য তিনি ইউনিট লাইনে চলে যান। সেখানে গিয়ে ব্যাটালিয়ন দুটোর মাঝখানে ৩টি ও ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের সামনে ফারুকেরটি ছাড়াও আরও ১টি ট্যাঙ্ক দেখতে পান এবং শুনতে পান যে, মিরপুরে ফিল্ড রেজিমেন্টের আর্টিলারি গানগুলােও তৈরি রয়েছে। যাহােক, ফোনে প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী ১ম ও ৪র্থ বেঙ্গলের সদস্যরা অপারেশনের জন্য তৈরি হতে থাকে।সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ” ইউনিট লাইনে ১ম বেঙ্গলের অফিসে এসে সেনাপ্রধানের বরাতে সমস্ত অপারেশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অর্থাৎ সেনাপ্রধানের নির্দেশে সিজিএস ৪৬ ব্রিগেডের শাফায়াতের কমান্ড অধিগ্রহণ করেন। তবে বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি এরই মধ্যে প্রায় সম্পন্ন হয়ে দিয়েছিল। শাফায়াতের ভাষায় :আমি আশা করছিলাম, বিমানবাহিনীর সহায়তায় সেনা-সদরের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনে একটি সমন্বিত আন্তঃবাহিনী পরিচালনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ৮. কর্ণেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩২ কর্নেল শাফায়াতের অধীনস্থ আর্টিলারি রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর রশিদ বিদ্রোহের মাসখানেক আগে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফিরে আসলে তাকে যশােরে পােস্টিং দেয়া হয়। কিন্তু কয়েকদিন পরই তাকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। জনশ্রুতি হল, কর্নেল শাফায়াতের অনুরােধে তা করা হয়। কিন্তু শাফায়াতের মতে, এ ধরনের পােস্টিং সেনাপ্রধানের একান্তই নিজস্ব দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বিদ্রোহী ফারুকের মামা বলে শােনা যায়।ট্যাঙ্কবাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক সেনাদল এককভাবে কখনােই আক্রমণযুদ্ধ পরিচালনা করে না। পদাতিক সেনাদলের সহায়কশক্তি হিসেবে বিমান অথবা ট্যাঙ্কবাহিনীর সহায়তা প্রয়ােজন।” সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটায় ১ম বেঙ্গলের অফিসের সামনে একটি কনভয় এসে থামে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ও উপপ্রধান জিয়া নেমে আসেন গাড়ি থেকে। পেছনে সশস্ত্র ডালিম ও কয়েকজন সৈন্য। সামান্য পরেই এসে পৌছান বিমানপ্রধান আব্দুল করিম খন্দকার ও নৌপ্রধান মােশাররফ হােসেন খান। মিনিট-দশেক অবস্থানের পর তারা সবাই চলে যান রেডিও স্টেশনের উদ্দেশ্যে। দুঃখের বিষয় যে, তিন বাহিনীর প্রধান একাধিকবার একত্র হওয়ার পরও সেনাপ্রধানের উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনের কোনাে যৌথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় নি। | অনুমান সকাল সাড়ে ৯টার দিকে খালেদ মােশাররফ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে। ফিরে শাফায়াত জামিলের অফিসে বসে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেতারে সশস্ত্রবাহিনীর প্রধানগণ ‘অবৈধ ও খুনী সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ও আনুগত্য প্রকাশ করায় বিদ্রোহ দমনের সকল প্রস্তুতি’ অকার্যকর হয়ে। পড়ে। এরপর বিদ্রোহের সাফল্যকে সংহত করা’ ও ‘সরকারের অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করার জন্য বঙ্গভবন থেকে আদিষ্ট হয়ে খালেদ মােশাররফ দিনভর একের-পর-এক নির্দেশ জারি এবং নাজুক এলাকা ও স্থাপনায় সেনা মােতায়েন করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু যেহেতু ইতােমধ্যে নিহত হয়েছেন, সেহেতু গৃহযুদ্ধ ও রক্তক্ষয়ের আশঙ্কায় কোনাে পদক্ষেপ নেয়া সমীচীন হবে না’ বিবেচনা থেকে খালেদ মােশাররফ ফোনে রক্ষীবাহিনীকে কোনােরকম আক্রমণাত্মক ভূমিকা না নেয়ার পরামর্শ দেন। সর্বত্র যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন বাতাসের উল্টোদিকে যাওয়া ঠিক হবে না-এমন ধারণা বিস্তার লাভ করে। গুটিকয় মেজরের কৃত পাপ সমগ্র সামরিকবাহিনীকে কলুষিত করে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ সাধারণভাবে বলা হয়, মুজিবহত্যার কোনাে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি। কথাটির। সত্যাসত্য বিচার প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে ১৫ আগস্ট ভােরবেলা মুজিব-হত্যা, মােশতাক কর্তৃক ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসন ও সান্ধ্য-আইনের ঘােষণা একই সাথে। বেতারে প্রচার করা হয়। সর্বনাশা এই ঘােষণা শুনে একে তাে মানুষ বিহ্বল, অধিকন্তু সান্ধ্য আইন জারি করে মানুষকে ঘরে আটক থাকতে বাধ্য করা হয়। এতদাঞ্চলে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ -এর আগে-পরে বেশ ক’বার সামরিক শাসন জারি। হয়েছে। কিন্তু কখনােই তা তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়নি। বরং কখনাে কখনাে।১১. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৫ এ এল খতিবের ভাষায়, কিছু সংখ্যক মানুষ সেদিন ছিল খুশিতে আত্নহারা, কিন্তু হাজার হাজার মানুষ তখন সব হারানাের বেদনায় মূক (কারা মুজিবের হত্যাকারী, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৮) মানুষ উল্লসিত হয়ে স্বাগত জানিয়েছে। পাকিস্তানি আমলে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রথম সামরিক শাসন জারি হয়। নির্দেশ শুনেই মানুষ স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে নিজের আশেপাশের ময়লা-আবর্জনা, ঝােপ-জঙ্গল পরিষ্কারে মনযােগী হয়ে উঠে। কয়েকদিনের মধ্যে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আইয়ুব খান ঢাকা সফরে এলে ‘সর্বস্তরে তিনি প্রাণঢালা সংবর্ধনা লাভ করেন।এরশাদ ২৪ মার্চ ১৯৮২ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। সেদিনও বাংলাদেশে সামরিক শাসনবিরােধী কোনাে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়নি।” পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশে বহু আন্দোলনে বহু নিবেদিতপ্রাণ নেতাকমী বহুভাবে আত্মােৎসর্গ করলেও সামরিক শাসন এবং সান্ধ্য আইন জারিকালে ট্যাঙ্ক-মেশিনগানের গুলি চ্যালেঞ্চ করে রাজধানীতে তাৎক্ষণিক কোনাে প্রতিবাদ কোনােকালেই হয়নি। তবে ১৯৫৮ সালের ময়মনসিংহের মতাে ১৯৭৫ সালেও বরগুনা ও কিশােরগঞ্জে স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে। দুর্জয় বরগুনা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকাল সাড়ে ৭টায় বেতারে ডালিমের সর্বনাশা ঘােষণা শুনে ‘হত্যাকাণ্ড ও সংবিধান লঙ্নের বিরুদ্ধে বরগুনা মহকুমা প্রশাসক সিরাজ উদদীন। আহমেদ ‘বাকশাল ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী এবং রক্ষীবাহিনী ও বঙ্গবন্ধুর অনুগত সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরােধ শুরু করেন। তিনি ও তার সহগামী ছাত্রলীগ ও বাকশালের কর্মীরা সশস্ত্র হয়ে জিপে চড়ে প্রতিবাদকারীদের সংগঠিত করেন। পুলিশের ভূমিকা সন্তোষজনক না হওয়ায় তাদের থানা থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়। সেদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং খুনী সরকারের পক্ষে সকল১০. এর উল্লেখযােগ্য ব্যতিক্রম ছিল ময়মনসিংহ। ছাত্রনেতা (পরে ন্যাপনেতা) কাজী আব্দুল বারী (মাসুক মিয়া)-র নেতৃত্বে শহরে তাৎক্ষণিক সামরিক শাসনবিরােধী প্রতিবাদ-মিছিল বের হয়। পরে ১৯৫৯ সালে আত্মগােপনাবস্থায় তিনি ধৃত হয়ে সামরিক আদালতে এই অপরাধে বেদণ্ড ভােগ। করেন। এমন নিষ্ঠুরভাবে বেত্রাদেশ কার্যকর করা হয় যে, তিনি বাকি সারাজীবনের জন্য বধির হয়ে পড়েন এবং অন্যান্য রােগে আক্রান্ত হয়ে অশেষ যন্ত্রণা ভােগ করেন। আজীবন সংগ্রামী এই বীর ১৯৩৭ সালে কিশােরগঞ্জের অষ্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৮৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ৩০ মে ১৯৮১ চট্টগ্রামে এক সামরিক বিদ্রোহে জিয়া নিহত হন। বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল। করতে সক্ষম হয়নি। এরপরও জিয়া হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৩০ বা ৩১ মে কোনাে মিছিল হয়নি। তবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় এবং বিদ্রোহের প্রধান ও অন্যান্য নেতার হত্যার পর ১ জুন জিয়ার লাশ (‘কবর’ থেকে উত্তোলিত একটি শাদা বিছানার চাদরে মােড়া তিনটির একটি) ঢাকায় নিয়ে আসার পর অনুষ্ঠিত জানাজায় প্রচুর লােক উপস্থিত হন। নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হলেও মহকুমাসমূহকে তখনও প্রশাসনিকভাবে জেলা করা হয়নি। ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ এগুলােকে জেলা করার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ‘গভর্নরদের কার্যক্রম শুরু করার কথা ছিল। পরে জিয়া মহকুমাসমূহকে জেলার মর্যাদা দান করেন। তিনি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রন্থের প্রণেতা, বর্তমানে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যপ্রকার মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। ১৫ থেকে ১৭ আগস্ট ৩ দিন বরগুনার সকল দপ্তরের কাজ বন্ধ রাখা হয়। ১৫ ও ১৬ আগস্ট মহকুমা প্রশাসকের সরকারি বাসভবনে প্রতিবাদ ও শােকসভা অনুষ্ঠিত হয়। পটুয়াখালী জেলা-সদরে অবস্থিত রক্ষীবাহিনীর লিডারের মাধ্যমে ও অন্যান্যভাবে ঢাকায় যােগাযােগ করে কোনাে পথ-নির্দেশ না পাওয়ায় ও অবৈধ সরকার নিজেকে সংহত করতে সক্ষম হওয়ায় তিনদিন পর প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে। মহকুমা প্রশাসক সিরাজ উদদীন আহমেদ আত্মগােপন করেন। এ জন্য তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয় এবং পটুয়াখালী জেলায় তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। একই সাথে তার পরিবারকে সরকারি বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। মৃত্যু অনিবার্য জেনেও সেদিন যারা সিরাজ উদদীন আহমেদের সাথে প্রতিরােধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হলেন : ১. সিদ্দিকুর রহমান, যুবনেতা, পরে ১৯৭৯ সালে সাংসদ, পরলােকগমন ২৯জুন ১৯৮৬। ২. জাহাঙ্গীর কবীর, ছাত্রলীগের তৎকালীন বরগুনা জেলা সভাপতি। ৩. আবদুর রশীদ, তকালীন ছাত্রলীগ সম্পাদক। ৪. সুলতান উদ্দিন আহমেদ, তৎকালীন ছাত্রলীগ সহ-সভাপতি, পরে।এ্যাডভােকেট, পরলােকগত। ৫. ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, ছাত্রনেতা পরে সাংসদ ও উপমন্ত্রি। ৬. দেলওয়ার হােসেন। ৭. আবদুল মােতালেব। ৮, এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম সিকদার, আওয়ামী লীগ সম্পাদক। ৯. এ্যাডভােকেট নিজামউদ্দিন আহমেদ, পরে সাংসদ (১৯৮৬), ঢাকায় সড়কদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ ৯ ডিসেম্বর ১৯৯০। ১০. ইউনুস শরীফ। ১১. অধ্যক্ষ শামসুল আলম, বরগুনা কলেজ। ১২. আবদুল লতিফ ফরাজী। ১৩. আবদুল মান্নান। ১৪. ফররুক আহমেদ, তৎকালীন মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা। ১৫. মাহমুদুর রহমান, তকালীন জনসংযােগ কর্মকর্তা। ১৬. আলী আসগর, তৎকালীন সাব-রেজিস্ট্রার। ১৭. মােখলেসুর রহমান, তৎকালীন সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন)। ১৮, বিপ্লব কুমার শর্মা, তৎকালীন মহকুমা ত্রাণ কর্মকর্তা। ১৯, আসমত আলী সিকদার, তকালীন স্থানীয় সাংসদ। ২০. সাংসদ শাহজাদা আব্দুল মালেক খান ও অন্যান্য।শাহজাদা আবদুল মালেক খান ছিলেন রাষ্ট্রপতি মােশতাকের ভায়রা-ভাই। তিনি মােশতাকের মন্ত্রী করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনে যােগ দিয়ে বিরল অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ খালেদ-শাফায়াতের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে বরগুনার অকুতােভয় নেতৃবৃন্দ পুনঃসংগঠিত হন। জেলহত্যার প্রতিবাদে বাবু জ্ঞানরঞ্জন ঘােষের বাসায় গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিরাজ উদদীন আহমেদ, এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম সিকদার, এ্যাডভােকেট জয়নাল আবেদীন (বাকশালে বিলুপ্ত ন্যাপ সম্পাদক), অধ্যক্ষ শামসুল আলম প্রমুখ। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলহত্যার প্রতিবাদে বরগুনায় ৬ নভেম্বর পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। ৭ নভেম্বর সফল সেনা-বিদ্রোহের পর বরগুনায় নেমে আসে সরকারি নির্যাতন। সিদ্দিকুর রহমান, ইউনুস শরীফ, এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম সিকদার, নূরুল ইসলাম পাশা, আবদুল মান্নান (বেতাগী), জাহাঙ্গীর কবীর, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, আব্দুর রশীদ, মােতালেব প্রমুখসহ আগস্টের শােকসভায় যােগদানকারী সকলকে গ্রেফতার করা হয়। সিরাজ উদদীন আহমেদ বরগুনা ত্যাগ করে বরিশালে আশ্রয় নেন। পরে ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে এঁদের কেউ কেউ ঢাকায় মিলিত হয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। সাংসদ নিজাম উদ্দিন আহমদের মামা আলহাজ জয়নাল আবেদীনের ইস্কাটন গার্ডেনস্থ বাসায় অনুষ্ঠিত এক গােপন সভায় ভারতের সহায়তায় সরকার উৎখাতের কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। সে-মতে চট্টগ্রামের সাংসদ নূরুল আলম ও আমতলীর সাংসদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ কলকাতায় অবস্থানরত যশােরের সাংসদ রওশন আলীর সাথে প্রথম দফায় সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দ্বিতীয় দফায় বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজন সাংসদ ও সিরাজ উদদীন আহমেদের কলকাতা যাওয়ার কথা হয়। ইতােমধ্যে কমবেশি ৪০ জন সাংসদের সাথে যােগাযােগ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাংসদদ্বয় নুরুল আলম ও নিজাম উদ্দিন আহমেদ কলকাতা যাওয়ার পথে যশােরে গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় এ পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। গ্রেফতারকৃত সাংসদদ্বয়কে দীর্ঘদিন পর যশাের থেকে ঢাকা জেলে স্থানান্তর করা হয়। নিজাম উদ্দিন আহমেদসহ বরগুনার গ্রেফতারকৃত নেতাকর্মীগণ প্রায় দু-বছর পর জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। বিসিএস (প্রশাসন) কর্মকর্তা হওয়ার জন্য বা যে-কোনাে কারণেই হােক সিরাজ উদদীন আহমেদ শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তবে তার বিরুদ্ধে সামরিক সরকার একাধিক মামলা দায়ের করে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ‘প্রকাশ্যে রিভলভার উঁচিয়ে জনগণকে তিনি ভয় দেখিয়েছেন’-এই অভিযােগ প্রমাণের জন্য পুলিশ বহুভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কারণ বরগুনার ৭ লক্ষ বীর-জনতার একজনও তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়নি। সবশেষে সরকার তাকে ক্ষমা চাইতে বলার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করে গর্বিত, আমি ক্ষমা চাইতে পারি না।’ অবশেষে অভিযােগ থেকে অব্যাহতি পেয়ে ১ বছর ৪ মাস পর তিনি চাকরিতে পুনর্বহাল হন।সিরাজ উদদীন আহমেদ বি.এম. কলেজে (বরিশাল) ফজলুল হকের (পরে ফ্লাইট সার্জেন্ট ও আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ ফজলুল হক মণির সহপাঠী ছিলেন। ১৯৬২-র সামরিক আইন বিরােধী আন্দোলন ও ১৯৬৪-র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে মােনায়েম খান বিরােধী আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বরগুনা ক্লাব প্রাঙ্গণে তিনি তার বন্ধু আসমত আলী সিকদারের সাথে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সিরাজ উদদীন। আহমেদ ৭ বছর বরগুনায় ছিলেন। ১৯৭৪ সালে সকলের সহযােগিতায় দক্ষতার সাথে তিনি দুর্ভিক্ষ মােকাবেলা করেন। তার ভাষায়, “কেউ না-খেয়ে মারা যায়নি।’ ১৯৭৫ সালে বরগুনা জেলার সাংসদত্রয় (আসমত আলী সিকদার, শাহজাদা আব্দুল মালেক খান ও নিজাম উদ্দিন আহমেদ) মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে সিরাজ উদদীন আহমদকে বরগুনার গভর্নর নিয়ােগের সুপারিশ করেন। কিন্তু তখন তিনি উপসচিব’ না-হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। ১৯৮৫ সালে বরগুনাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে টাউনহলের নাম ‘সিরাজ উদদীন মিলনায়তন’ রাখা হয় এবং তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়। বর্তমানে তিনি সরকারি কর্ম কমিশনের অন্যতম সদস্য। তিনি ১০টির অধিক গ্রন্থের প্রণেতা। তার ভাষায় : “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অস্ত্র দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশােধ নিতে পারিনি। তাই প্রতিবাদ জানাতে কলম ধরেছি।দুর্মদ কিশােরগঞ্জ২০ ১৫ আগস্ট ভােরে মেজর ডালিমের সর্বনাশা বেতার ঘােষণায় সারাদেশের মতাে। কিশােরগঞ্জেও নেমে আসে অদ্ভুত নিঃশব্দতা-নিঃস্পন্দনতা। তবে নিমিষেই ঘাের কাটিয়ে অমিত-তেজী কিছু যুবক শহরের স্টেশন রােডের (রঙমহল সিনেমা হল সংলগ্ন) ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জমায়েত হয়। তারা প্রায় সবাই ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ (মােজাফফর) ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী। সংক্ষিপ্ত আলােচনার পর এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও সামরিক শাসন জারির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার প্রস্তাব নিয়ে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে তারা বাকশাল নেতৃবৃন্দের সাথে যােগাযোেগ১৯. ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে মােনায়েম বিরােধী আন্দোলন করার অপরাধে আসমত আলী সিকদার ও শেখ মণির ডিগ্রি কেড়ে নেয়া হয়। তিনি শেখ মুজিবের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি বরগুনায় আইনব্যবসা শুরু করেন এবং পরে সাংসদ নির্বাচিত হন সিরাজ উদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্কর প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০১, ভূমিকা। “আমার কথা ২০. ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সংঘটিত বিক্ষোভ-মিছিলে অংশগ্রহণকারী ১২ জনের সাথে গত ২০০২ সালের। জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকার, জনকণ্ঠ ২০ আগস্ট ১৯৯৬, সংবাদ ১৫ আগস্ট ১৯৯৮ ও ১৪ আগস্ট ১৯৯৯ -এ প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ‘দুর্মদ কিশােরগঞ্জ’ অধ্যায়টি রচিত বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তখন বাকশালের অঙ্গসংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রলীগে একীভূত হলেও এর। আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম তখনও শুরু হয়নি। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) তখন বাকশালে একীভূতকরেন। কিন্তু জেলা বাকশাল নেতৃবৃন্দ ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তাদের কেউ ঢাকায় কিশােরগঞ্জের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যােগাযােগের পরামর্শ দেন, কেউ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন এবং কেউ আগত পরামর্শপ্রার্থীদের ভৎসনা করেন। তাদের সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত, কেউ ঘােরে আবিষ্ট, কেউ মােশতাকের প্রতি মােহাবিষ্ট। কেউ নিরাপত্তার প্রয়ােজনে’ গ্রেফতার বরণের জন্য প্রস্তুত। নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে কোনাে দিক-নির্দেশনা না পেয়ে প্রতিবাদাকাজী যুবকেরা। ফিরে এসে পুনঃ আলােচনায় বসেন। প্রসঙ্গক্রমে কোনাে একজন একাত্তরের ২৬ মার্চের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ২৬ মার্চ ১৯৭১ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চ লাইটের সংবাদ পেয়ে গুটিকয় অকুতােভয় তরুণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে শহরে শুরু করেছিলেন। প্রতিবাদ মিছিল। পরে দেখা গেল মিছিল যত এগােয়, অংশ গ্রহণকারী তত বাড়ে এবং যখন তা শেষ হয় তখন লােকসংখ্যা অগণন, জনসমুদ্র। একাত্তরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে উপস্থিত সবাই অধিক উদ্দীপিত হয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করার পক্ষে মত। দেন। সময় তখন সকাল সাড়ে ন’ বা দশটা। একজন কেউ দাড়িয়ে বজ্রমুষ্ঠি উঁচিয়ে স্লোগান দেন, মেজর ডালিমের ঘােষণা সাথে সাথে সকলে দাড়িয়ে সাহসের ঝড় তােলে গগনবিদারী প্রত্যুত্তর মানি না, মানব’ বলতে বলতে রাস্তায় নেমে আসে। চলতে শুরু করে ক্ষুদ্র কিন্তু তাৎপর্যময় মিছিল। আরও যেসব প্রধান প্রধান স্লোগান ওঠে, তা হল ‘মুজিবহত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম, মুজিবহত্যার বদলা নেব, বাংলাদেশের মাটিতে’, সামরিক আইন তুলে নাও, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’। মিছিলটি পূর্বদিকে যাত্রা করে শহরের পুরান থানা, একরামপুর, বড়বাজার, গৌরাঙ্গবাজার হয়ে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। | কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিক্ষোভে-বিদ্রোহে মানুষ একাত্তরের মতাে এগিয়ে আসেনি। রাস্তার মােড়ে মােড়ে, রেডিওর পাশে মানুষের নিম্নস্বর আলােচনা। দু’চারজন যাত্রাপথে মিছিলে যােগ দিলেও অধিকাংশই শঙ্কিত, বিহ্বল। ফলে মিছিলের গতি বাড়িয়ে স্বল্পসময়ে শহর প্রদক্ষিণ সমাপ্ত করা হয়। মিছিলশেষে সকলেই পাশের জাহেদের চা-পানশালায় এসে সকালের নাশতা/চা-পান করেন। সাথে সাথে চলে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আলােচনা। শহরের থমথমে ভাব দেখে সবাই পরিস্থিতি বিরূপ হওয়ার আশঙ্কা করেন। সেরূপ ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য আত্মগােপন করা, গ্রেফতার এড়িয়ে২০. বাকশালের জেলা-সম্পাদক মােস্তাফিজুর রহমান (চুন্ন মােক্তার), সহ-সম্পাদক এ্যাডভােকেট নূরুল ইসলাম, সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম, মহিউদ্দিন আহমেদ, বাকশাল নেতা আব্দুল কুদুস মােক্তার ও জমিয়ত আলীর সাথে যােগাযােগ করা হয়। সহ-সম্পাদকদের মধ্যে আব্দুল হামিদ। এ্যাডভােকেট ও কাজী আব্দুল বারী সেদিন কিশােরগঞ্জে উপস্থিত ছিলেন না।২১. মতান্তরে আখড়া বাজার, কালীবাড়ি হয়ে থানার সামনে দিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে ফিরে এসে। মিছিলটি শেষ হয়। সেখানে পরে ‘সাগর অডিও ও ভিডিও’, ‘পদ্মা ইলেক্ট্রনিক্স প্রভৃতি দোকান হয়েছেচলা এবং সাময়িকভাবে তাড়াইল থানাস্থ তালজাঙ্গায় গােপন যােগাযােগ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এমন সময় পুলিশ ভর্তি একটি ট্রাক ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ের সামনে এসে থামে। কিছু পুলিশ ট্রাক থেকে নেমে পরিবেশ পর্যবেক্ষণে মনােযােগী হয়। মিছিলকারীরা বিপদ আঁচ করে প্রথমে রােকেয়া সরণী, খরমপট্টি, নীলগঞ্জ রােড এলাকায় ও পরে তাড়াইল, করিমগঞ্জ, ইটনা থানায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। | পরে জানা যায়, কিশােরগঞ্জ ও বরগুনা শহর ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও এ ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি। প্রতিবাদের এই ক্ষুদ্র আয়ােজনটি তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেও তা আবেগের ফসল ছিল না; ছিল যুক্তিনিষ্ঠ কর্তব্যানুরাগী, | রাজনৈতিক লক্ষ্যাভিসারী, গণতন্ত্রের চেতনা শাণিতকারী। জাতীয় সংসদের বর্তমান বিরােধীদলীয় উপনেতা আবদুল হামিদ এ্যাডভােকেট সেদিন ঢাকায় শেরেবাংলা নগরস্থ সাংসদ-হােস্টেলে অবস্থান করছিলেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান : ঘটনার তিনদিন পর কিশােরগঞ্জ শহরে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-মিছিলের সংবাদ পাই। তখন এ-ও জানতে পাই যে, সারাদেশে এরূপ মিছিল শুধু কিশােরগঞ্জেই সংগঠিত হয়েছে। কিশােরগঞ্জের অধিবাসী হিসেবে এজন্য আমি গর্ববােধ করি। মিছিলকারীদের প্রতি আমি সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই।কিশােরগঞ্জ তথা সারা বাংলাদেশের জন্য গৌরবময় এ কীর্তি স্থাপনকারী দুঃসাহসিক বীরগণ হলেন : ১. ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, পরে এ্যাডভােকেট ও সাধারণ সম্পাদক, জেলাগণতন্ত্রী পার্টি, কিশােরগঞ্জ।২. আমিরুল ইসলাম, পরে এ্যাডভােকেট ও সভাপতি, জেলা কমিউনিস্ট পার্টি। ৩.গােলাম হায়দার চৌধুরী, পরে অধ্যক্ষ, খালিয়াজুরী মহাবিদ্যালয়,খালিয়াজুরী, নেত্রকোণা। ৪. সেকান্দার আলী ভূঞা, পরে বীমা কর্মকর্তা, কিশােরগঞ্জ। ৫. হাবিবুর রহমান মুকু (তার প্রকৃত ডাকনাম মুফতি ক্রমে ‘মুকু’তেরূপান্তরিত হয়)।অলক ভৌমিক। ৭. আকবর হােসেন খান। ৮. অশােক কুমার সরকার, পরে এ্যাডভােকেট ও সচেতন নাগরিক কমিটিনেতা। ৯, হালিম দাদ খান (রেজওয়ান), পরে অধ্যক্ষ, আদর্শ মহাবিদ্যালয়, খাড়াচুড়াইন, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ; এ গ্রন্থের লেখক। ১০. নূরুল হােসেন সবুজ, পরে ঠিকাদার। ১১. এনামুল হক ইদ্রিস, পরে পল্লী চিকিত্সক, সিপিবি নেতা। ১২. পীযুষ কান্তি সরকার, পরে কৃষি-যন্ত্রপাতি ব্যবসায়ী। ১৩. রফিক উদ্দিন পনির, পরে সরকারি চাকরিজীবী। ১৪. অরুণ কুমার রাউত। ১৫. আবদুল আহাদ, উল্লিখিত চা-পানশালার মালিক জাহেদের ছােটভাই;পরলােকগত। ১৬. নির্মলেন্দু চক্রবর্তী, পরে চাকরিজীবী। ১৭, সাইদুর রহমান মানিক, পরে এ্যাডভােকেট, ঢাকা জজকোর্ট। ১৮. আলী আসগর স্বপন, পরে বার্তাজীবী, জনকণ্ঠ, ঢাকা। ১৯. সৈয়দ লিয়াকত আলী বুলবুল ও বেশ কিছু পথচারী।দুর্বার ঢাকা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঢাকায় জাতীয়ভাবে মুজিবহত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি। তবে তরুণ-ছাত্রকর্মীরা সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর প্রতিবাদ জানাতে সচেষ্ট হয়। ২৪/২৫ আগস্ট কিছু ছাত্র নেতাকর্মী মধুর ক্যান্টিনে জমায়েত হয়। ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান জমায়েতে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন এবং পুলিশমিলিটারি টের পাওয়ার আগেই একটি ঝটিকা প্রতিবাদ মিছিলও সংঘটিত হয়। এটা। ঢাকায় প্রথম এবং বাংলাদেশে তৃতীয় প্রতিবাদ। এরপর ২০ ও ২১ অক্টোবর মধুর ক্যান্টিনসহ ক্যাম্পাসে সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সময় অল্পকিছু ‘দেয়াল-লিখনও চোখে পড়ে। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সংবাদ পাওয়ামাত্র জাতীয় সংসদের সদস্য-ভবনে অবস্থানরত সাংসদগণ অতি সাধারণ পােশাকে পায়ে হেঁটে নিজ নিজ নিরাপদ আশ্রয়ে গমন করেন। অনেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতি অবহিত করার জন্য তাদের ঠিকানা/ফোন নম্বর সংসদের বেয়ারাদের দিয়ে যান। কেউ কেউ পরে নিজে এসে লােক পাঠিয়ে অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হয়ে সদস্যভবনে পুনঃ বাস| জনকণ্ঠ ও সংবাদ পত্রিকার প্রতিবেদনে এই মিছিলে অংশগ্রহণকারী ক্রমিক নম্বর ১৬১৯ পর্যন্ত নামসমূহ নিয়ে মতদ্বৈধতা রয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত আসাদুল্লাহ খান জানিয়েছেন, ঐদিন কিশােরগঞ্জে অবস্থান না করায় তিনি ঐ মিছিলে অংশ নিতে পারেননি (এজন্য তার আফসােসের অন্ত নেই)। প্রথম দুটি প্রতিবেদনে উল্লিখিত মতিউর রহমান (তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা, বর্তমানে পক্ষাঘাতে অসুস্থ) ৩ জুলাই ২০০২ এক সাক্ষাৎকারে জানান, মিছিলটি পুরান থানার দিক থেকে পশ্চিমদিকে যাত্রাকালে হােটেল মােবারকের সম্মুখ থেকে তিনি এতে যােগ দেন। কোথায় গিয়ে মিছিলটি শেষ হয়, মিছিলে শেষাবধি বা কোনাে স্থান পর্যন্ত তিনি ছিলেন, কীভাবে প্রথম মুজিবহত্যার সংবাদ পান, হােটেল, মােবারকের সামনে এ সময় কেন এসেছিলেন এসব কিছুই তিনি সাক্ষাৎকার প্রদানকালে স্মরণ করতে পারেননি। ঐ সাক্ষাৎকারে উপস্থিত স্টেশন রােডের গােপাল চন্দ্র দাস জানিয়েছেন, মিছিলটি একরামপুর থেকে পবিত্র লন্ড্রীর সামনে দিয়ে যাত্রাকালে তিনি তাতে যােগ দিয়ে কাটাখালী (বড়বাজার) পুল পর্যন্ত যান এবং তার দলীয় (ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ) কাউকে দেখতে না পেয়ে মিছিল ত্যাগ করে চলে আসেন মুনীরুজ্জামান, মুজিবহত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ), বিশেষ সংগ্রহক সংখ্যা (বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার), সংবাদ, ৯ নভেম্বর, ১৯৯৮ ভােরর কাগজ, ১৭ আগস্ট ১৯৯৬করতে আসেন। সুনামগঞ্জের ছাতক-দোয়ারা বাজার থেকে নির্বাচিত তৎকালীন স্বতন্ত্র সাংসদ আবুল হাসনাত মাে. আব্দুল হাই গত ২৯ অক্টোবর ২০০২ প্রদত্ত এক সাক্ষাঙ্কারে জানান যে, হত্যাকাণ্ডের সংবাদ পাওয়ার পর তিনি সদস্যভবন ছেড়ে গ্রিনরােডে তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। কয়েকদিন পর ইসমাইল নামক এক বেয়ারার মারফত তিনি জানতে পারেন যে, শাহ মােয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান। প্রমুখ সদস্যভবনে গিয়ে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে সকল সাংসদকে ফিরে আসতে বলেছেন। একই সাথে উঠিয়ে নেয়া নিরাপত্তা-পুলিশ পুনর্বহাল করা হয় এবং কেটে দেয়া ফোনেরও পুনঃসংযােগ দেয়া হয়। ফলে পরিস্থিতি অনুকূলে বিবেচনা করে সাংসদগণ ফিরতে শুরু করেন। মােশতাক তার ক্ষমতা-দখলকে জাতীয় সংসদ কর্তৃক বৈধতাদানের অভিপ্রায়ে অধিবেশন আহ্বানের পরিকল্পনা করেন। সেজন্য মনােভাব বােঝ এবং প্রয়ােজনবােধে তাদের হাত করার জন্য ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ বঙ্গভবনে সাংসদদের একটি সভা” আহ্বান করা হয়। কিন্তু নগণ্যসংখ্যক সাংসদ উপস্থিত হওয়ায় সভার উদ্দেশ্য ব্যর্থ। হয়। তাই হুইপ আব্দুর রউফের নেতৃত্বে লােক পাঠিয়ে ব্যক্তিগতভাবে যােগাযােগ করে সাংসদদের প্রলুব্ধ করে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং ১৬ অক্টোবর (সরদার আমজাদের মতে ১৫ অক্টোবর) পুনঃ বঙ্গভবনে সভা আহ্বান করা হয়। জাতীয় সংসদের সদস্যভবনসমূহে অবস্থানকালে সাংসদগণ বঙ্গভবনে আহুত সভাকে উপলক্ষ করে নিজেদের মধ্যে আলােচনার সুযােগ পান। গাজীপুরের কালিগঞ্জ থেকে নির্বাচিত সাংসদ এ্যাডভােকেট ময়েজুদ্দিনের (পরে তিনি স্বৈরাচারবিরােধী আন্দোলনে শহীদ হন) উদ্যোগে মুজিব-সমর্থক সাংসদগণ গােপনে সংগঠিত হতে শুরু করেন। তারা নিজেরা পূর্বাহ্নে বৈঠক করে বঙ্গভবনে যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়ে মনস্থির করার সিদ্ধান্ত নেন। সে-মতে ১৬ (মতান্তরে ১৫) অক্টোবর বেলা ১১টায় নাখালপাড়াস্থ সাংসদ-হােস্টেলে শতাধিক সাংসদ সভায় মিলিত হন। সাংসদ ময়েজুদ্দিন, ময়মনসিংহের রফিক উদ্দিন ভূঞা প্রমুখ সভায় ভাষণ দেন। কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী মুজিবহত্যার বিচার চেয়ে স্লোগান দেন। (মানিক চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন ইউসুফ মােশতাকের দুই প্রতিনিধিকে ইতােপূর্বে সদস্যভবন থেকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন)। মন্ত্রি সােহরাব হােসেন মােশতাক সরকারের পক্ষে উক্ত সভায় যােগ দেন এবং বঙ্গভবনের সভায় সকলকে কথা বলতে পারার নিশ্চয়তা প্রদান করেন। সভায় মুজিব ও অন্যান্যদের হত্যাকাণ্ডে শােক প্রকাশ করা হয়। এরপর সবাই বঙ্গভবনের সভায় গমন করেন। ডাকসু, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের কিছু তরুণ। নেতাকর্মী সাংসদদের বঙ্গভবনের সভায় যােগদান থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ২৬ সরদার আমজাদ হােসেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সঙ্কটকালে তৎকালীন সংসদ সদস্যদের আনুগত্য(নিবন্ধ), জনকণ্ঠ ৩১ শ্রাবণ, ১৪০৯ বাংলাহন। সাজেদা চৌধুরী, ডা. আবুদল মালেক, নূরুল কাদের, লুৎফর রহমানসহ ১০/১২ জন ছাড়া প্রায় সকল সাংসদই উক্ত সভায় যােগদান করেন। যা হােক বঙ্গভবনের সাংসদ সভায় মােশতাক কাঙ্ক্ষিত সমর্থন পাননি। কুমিল্লার সাংসদ সিরাজুল হক (পরে মুজিব হত্যা মামলার প্রধান কৌসুলী) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন আইন অনুযায়ী আপনাকে বৈধ রাষ্ট্রপতি বলা যায় না’। ‘অসন্তুষ্ট’ মােশতাক। সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন “আজ আপনারা সাহসের সাথে কথা বলতে পারছেন। আগে এরূপ বললে (অর্থাৎ বাকশালের বিরােধিতা করলে) এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত।। | এরই মধ্যে প্রধানত সিপিবি’র উদ্যোগে ন্যাপ ও গ্রেফতার এড়ানাে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে গােপন যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সংগঠিতভাবে মুজিবে হত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানানাের সিদ্ধান্ত হয়। সেমতে ডাকসু ও ছাত্রসংগঠনগুলাের উদ্যোগে ২৯ অক্টোবর প্রকাশ্যে জাতীয় শােক দিবস (মতান্তরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি দিবস) পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পরে প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ থাকায় ৪ নভেম্বর -এর তারিখ পুনঃনির্ধারিত হয়। কর্মসূচির প্রচারের অংশ হিসেবে দুটি প্রচারপত্র (লিফলেট) প্রকাশ করা হয়। এর একটিতে ছিল ব্যাখ্যাসহ বাকশাল কর্মসূচি ও মুজিবহত্যার বর্ণনা এবং অপরটিতে ৪ নভেম্বরের কর্মসূচি অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববদ্যালয় বটতলা থেকে মুজিবের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি পর্যন্ত মৌন মিছিল সফল করার আহ্বান। প্রচারপত্র প্রকাশ করা ছিল তখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এবং তা বিলি করতে গিয়েও বেশ ক’জন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ৪ নভেম্বরের কর্মসূচিসহ তৎকালীন আন্দোলনে সবচেয়ে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন ডাকসু ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান ও ছাত্রলীগ নেতা ইসমত কাদির গামা। আরাে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তারা হলেন ছাত্রলীগের খ, ম, জাহাঙ্গীর, ওবায়দুল কাদের, সৈয়দ নূরুল ইসলাম, রবিউল আলম চৌধুরী, মকুল বােস, কাজী ইকবাল, মমতাজ হােসেন, বাহলুল মজনুন চুন্ন প্রমুখ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল আলম লেনিন, কাজী আকরাম হােসেন, কামরুল আহসান খান, অজয় দাশগুপ্ত, খােন্দকার শওকত জুলিয়াস, আব্দুল মান্নান খান, মৃণাল সরকার, নিয়াজ আহমেদ অপু, গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, নূর আলী প্রমুখ। | পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী ৪ নভেম্বর সকালে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সমাগত হয়। কিছু আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি, শ্রমিক ও নারী নেতাকর্মীও তাদের সাথে যােগ দেন। সকাল ১০টার কিছু পর বুকে কালাে ব্যাজ ধারণ করে দুই সারিতে মিছিলকারীগণ ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অনেকের হাতে ছিল ফুল। শুরুতে অত্যুৎসাহী দু’একজন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান৩০ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭দেন।” নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সামনে মিছিল আটকে দেয়া হয়। মিছিলের সামনের কাতারে থাকা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সাথে শুরু হয় পুলিশের বাকবিতণ্ডা। একজন পুলিশ অফিসার তার ওয়ারলেস-ফোনে অপরপ্রান্তের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘গুলি চালানাে সম্ভব নয়, শত শত ছাত্র মিছিলে যােগ দিয়েছে। প্রায় ২০/২৫ মিনিট পর উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সাথে যােগাযােগ করে স্লোগান না দেয়ার শর্তে রাস্তা ছেড়ে দেয়া হয়। মিছিল যতই এগােয়, ততই রাস্তার দু’পাশ থেকে মানুষ শামিল হয়। কলাবাগান পৌছানাের পর শত শত ছাত্রের মিছিল হাজার হাজার শােকার্ত বাঙালির করুণ সারিতে পরিণত হয়। কলাবাগান থেকেই খালেদ মােশাররফের মা ও ভাই (সাংসদ রাশেদ মােশাররফ) মিছিলে যােগ দেন। সামরিক প্রহরা পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত মিছিল গন্তব্যে পৌছে। মুনীরুজ্জামান জানান : বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেট ছিল বন্ধ। সামনে ছিল পুলিশ। কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়নি। এক অভূতপূর্ব শােক-বিহ্বল দৃশ্যের অবতারণা হয় ৩২ নম্বরের বাড়িটির গেটের সামনে। কান্নার রােল পড়ে যায়। সমস্ত পরিবেশ হয়ে পড়ে শোকাভিভূত। এরই মধ্যে মানুষ ফুল অর্পণ করে বন্ধ করা গেটের সামনে।আগের দিন ৩ নভেম্বর ভােরে খালেদ-শাফায়েতের নেতৃত্বে আগস্ট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। শত্রুর শত্রু হলাে বন্ধু’ এই সমীকরণের ভিত্তিতে অত্যুত্থানটিকে নিজেদের পক্ষের ভেবে বটতলায় উপস্থিত আওয়ামী পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উৎফুল্লতা দৃষ্ট হয়। কিন্তু এই ধারণা সঠিক ছিল না। ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৮ মােশাররফ ভ্রাতৃবৃন্দের মা মিছিলে যােগ দেয়ায় রটানাে হয় যে, এ মিছিল ৩ নভেম্বর-অভুথানের নেতা খালেদ মােশাররফের আশীর্বাদপুষ্ট ও তার মায়ের নেতৃত্বে সংগঠিত। প্রকৃতপ্রস্তাবে, আরাে অনেক অংশগ্রহণকারীর মতাে কলাবাগান থেকে যােগ দিয়ে ৩২ নম্বর সড়ক পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া ছাড়া রাশেদ মােশাররফ ও তার মা’র অন্য কোনাে ভূমিকা ছিল না। রাশেদ মােশাররফ আওয়ামী রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও তার ভাই খালেদ মােশাররফ ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী সমর্থক ছিলেন অদ্যুত্থানের আগে-পরে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে কোনাে যােগাযােগও করেননি। শােকমিছিল যাত্রাকে বাধাহীন করার জন্য এর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মাত্র একবারই ৪ নভেম্বর সকালে খালেদ মােশাররফকে ফোনে বলেন, ‘আমাদের নেতা জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা তার প্রতিবাদ করব। তার জন্য চোখের পানি ফেলবে, শোক করব, মিছিল করব। আপনার আর্মি যেন বাধা না দেয়। এ প্রসঙ্গে খালেদ মােশারফের সংক্ষিপ্ত জবাব ছিল :“ওটা সিভিলিয়ানদের ব্যাপার, আর্মির কিছু করার নেই।’ মুিনীরুজ্জামান, পূর্বোক্ত)। খালেদ মােশাররফের অভুথানের পর এই শােক-মিছিল অনুষ্ঠিত হওয়ায় শত্রুপক্ষ মিছিলকে তার আশীর্বাদপুষ্ট বলে অপপ্রচার করে। প্রকৃতপক্ষে অ্যুত্থান ও মিছিল দুটোরই প্রস্তুতি ও সংঘটন সম্পর্কহীনভাবে সমান্তরালে সম্পন্ন হয়। মিছিলের তারিখ প্রস্তুতির অভাবে ২৯ অক্টোবর থেকে পিছিয়ে ৪ নভেম্বর পুনঃ নির্ধারিত হয়। কাকতালীয়ভাবে অভুথানটিও ঘটে এর আগের দিন। সময়ের কাকতাল’ ও খালেদের মায়ের মিছিলে যােগদানের ঘটনাকে পুঁজি করে সারাদেশে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে একটি ভারতবিরােধী উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয় মুনীরুজ্জামান , মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ),পূর্বোক্তশােক প্রকাশনার্থে মৌনমিছিল হলেও এটাই মুজিবহত্যার প্রথম সংগঠিত জাতীয় প্রতিবাদ।”৩৫প্রতিবাদ সর্বব্যাপী হল না কেন? এ অধ্যায়ের শুরুতে বলা হয়েছে, সামরিক শাসন/সান্ধ্য আইন জারির প্রাক্কালে ট্যাঙ্কমেসিনগানের সামনে বুক পেতে দিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ এদেশে কখনােই হয়নি। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন-চার বছর আগে একটি ফুলকে বাঁচাননার জন্য লক্ষকোটি মানুষ যেখানে জীবন-মৃত্যু’কে ‘পায়ের ভৃত্য’সম গণ্য করেছে সেখানে যথাযথ প্রতিবাদ না। হওয়ার উপযুক্ত যুক্তি সর্বজন গ্রাহ্য নয়। এ প্রসঙ্গে কলামবিদ মুনীরুজ্জামান বলেন : …ঘটনাটা শুধু অপ্রত্যাশিত ছিল না, বরং এতটাই অবিশ্বাস্য ছিল যে, বঙ্গবন্ধুর যারা সমর্থক ছিলেন-তারা তাে বটেই, যারা সমর্থক ছিলেন না-তারাও প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি। পক্ষাঘাতগ্রন্থ রােগীর মতাে বােধশক্তি হারিয়ে বসেছিলেন অনেকেই। | এই সারপ্রাইজ এলিমেন্ট’-এর ওপরই নির্ভর করেছিল ঘাতকদের ষড়যন্ত্রের সাফল্য। তারা হিসাব করেছিল, বাঙালির মানসে বঙ্গবন্ধুর যে-আসন, সেটা যে কখনাে কক্ষচ্যুত হতে পারে-এটা বাঙালির বােধে ধরা পড়তে পড়তে তারা পরিস্থিতি গুছিয়ে নেবে।… কার্যত হয়েছিলও তা-ই। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হােসেন এ প্রসঙ্গে বলেন : আশ্চর্যজনক যে, এতবড় ঘটনার কোনাে প্রতিবাদ কোথাও থেকে ওঠেনি, এমনকি ১৫ তারিখ সকাল থেকেই এমপি হােস্টেল এবং অন্যান্য জায়গা হতে সংসদ সদস্যগণ, যার বেশিরভাগ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য, তাদের পরবর্তী করণীয় বা তারা আমাদের (মানে সেনাবাহিনীর) কোনাে কাজে আসতে পারে কিনাএসব জানার জন্য ব্রিগেড এবং অন্যান্য হেডকোয়ার্টারে অনবরত ফোন করেই যাচ্ছিল। কী বিচিত্র সাংসদগণ তাদের করণীয় কী তা জানার জন্য ফোন করছেন। ক্যান্টনমেন্টে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও কিশােরগঞ্জের প্রতিবাদকারীগণের মিছিল করার প্রস্তাবে স্থানীয় নেতৃত্ব সাড়া দেননি। এ প্রসঙ্গে মুনীরুজ্জামানের মূল্যায়ন হল : তারা ভয় পেয়েছিলেন বা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন অথবা জনগণ থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন ছিলেন যে, সাধারণ মানুষের মাঝে মুভ’ করার মতাে অবস্থা তাদের ছিল ৩৫. বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তার বাহিনী নিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি নেন এবং এর পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য ভারত গমন করেন। পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়ায় তিনি সেখানে স্বেচ্ছা-নির্বাসন জীবনযাপন করেন, পরে পরিবেশ অনুকূল হলে দেশে ফিরে আসেন। মুনীরুজ্জামান, মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ), পূর্বোক্ত ঢাকায় এ সময় মনােনীত জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ চলছিল। কিছুদিন পূর্বে জেলা বাকশালের সম্পাদক ও সহ-সম্পাদকদের মনােনীত করা হয়। জেলা কমিটির সদস্যপদে ও থানা বাকশাল কমিটিতে মনােনয়ন প্রভৃতি তদবিরের জন্য অধিকাংশ সাংসদ তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। যদিও সংসদ তখন অধিবেশনে ছিল না। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হােসেন (অব.), বাংলাদেশ : রক্তাক্ত অধ্যায় পৃষ্ঠা ৪৬ কিশােরগঞ্জের তখনকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের বেলায় যেটি পরীক্ষিত সত্য, বৃহত্তর জাতীয় পরিসরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বেলায়ও এসব কারণের প্রায় সবগুলােই সত্য। জাতীয় পর্যায়ে কেউই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে রাস্তায় নামেননি। … সংসদ-সদস্যগণ মুজিবহত্যার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও রাজনৈতিকভাবে নিহত হয়ে সেনাবাহিনী-নির্ভর হয়ে পড়েছিলেন। চিন্তা করার বা উদ্যোগ নেয়ার সাহস, ক্ষমতা বা ইচ্ছা কোনােটাই তাদের ছিল না।…৩৯ মুজিবহত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ না হওয়ার অপর একটি কারণ হল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অন্তর্দ্বন্দ্ব। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালেই তা প্রকাশ পায় এবং স্বাধীনােত্তরকালে আপসকামী ও দায়িত্বহীন মােশতাক-শেখ মণিগং মুজিবের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রকৃত অনুসারীদের কোণঠাসা করে ফেলে। হত্যার পরপরই মােশতাকের ক্ষমতারােহণ এবং স্বল্পসময়ের ব্যবধানে আওয়ামী লীগেরই একাংশ মন্ত্রি হওয়ায় আওয়ামী মহলে এই ধারণা বিস্তার লাভ করে যে, মুজিব নিহত হলেও ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতেই রয়েছে। ততদিনে মুজিবের জনপ্রিয়তাও হ্রাস পেয়েছিল, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মােশতাকের বিরােধিতা করে হালুয়া-রুটির ভাগ থেকে বঞ্চিত হওয়া ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকিও কেউ কেউ নিতে চায়নি। ঘাতকরা দক্ষতার সাথে এই মনােভাবকে তাদের অনুকূলে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৩ সালে ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মুজিবের আজীবন ডাকসুর সদস্যপত্র ছিড়ে ফেলা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অশালীন উক্তির অভিযােগে ডাকসু অফিস ও সারাদেশে ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন অফিস জ্বালিয়ে দিয়ে, হরতাল পালন করে যারা প্রতিশােধ নিয়েছিল তারাই ১৯৭৫ সালে সিড়িতে মুজিবের রক্তাক্ত লাশ মাড়িয়ে মন্ত্রির ‘চাকরি’ গ্রহণে দ্বিধাবােধ করেনি। এমনকি মন্ত্রিত্ব না-পাওয়া কেউ কেউও মুজিবকে ‘ফেরাউন’ প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করতেও পিছপা হয়নি।” মুনীরুজ্জামান আরাে বলেন :১৫ আগস্টের মুজিবহত্যার প্রতিবাদ না হওয়ার পেছনে আরাে দুটো কারণ উল্লেখ করতে হবে। এর একটি হচ্ছে বাকশাল গঠন। বাকশাল সম্পর্কে বিরুদ্ধপক্ষের প্রচার ছিল শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করে আজীবনের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। এ-কারণেও মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তি। আরেকটি হচ্ছে দুর্ভিক্ষ ও অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টে ব্যর্থতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উদ্ধত আচরণ ও দুর্নীতির জন্য সর্বত্র মানুষ থেকে বিচ্ছিন্নতা। এসব কারণে মুজিবহত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে মানুষ কতটা সাড়া দেবে তা নিশ্চিত ছিল না ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল ৩৯. মুনীরুজ্জামান মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ), পূর্বোক্ত সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, সামাদ আজাদ, রাজ্জাক, তােফায়েল প্রমুখ যারা মােশতাকের সাথে হাত মেলাতে চাননি তাদেরকে সপ্তাহকালের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যেতে হল। তবে দুঃখজনক যে, তাঁরাও ঝুঁকি নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে এগিয়ে আসেননি। যদিও প্রথমােক্ত চার নেতাকে শেষপর্যন্ত জীবন দিতেই হল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। আর যেহেতু ক্ষমতাসীন বাকশাল তথা আওয়ামী লীগ। প্রতিবাদ করেনি, সে-কারণে অন্য রাজনৈতিক দল বা জনসাধারণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদে রাস্তায় নামে নি। কিশােরগঞ্জের প্রতিবাদটি ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম।” ক্ষমতাসীন আওয়ামী-বাকশালীরা প্রতিবাদে এগিয়ে না আসার কারণ হিসেবে মুজিব হত্যা মামলার রায়ে বর্ণিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির উল্লেখ করে বলা হয় : অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পূর্বে ও পরে তার অনুসারীগণের। ব্যবহারে অনেক পার্থক্য। ইহা কিছুটা বােধগম্য আমাদের দেশের নেতা ভিত্তিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে; যেমন নেতা আছে তাে সব আছে, নেতা নাই তাে কেউ নাই। উপযুক্ত বিষয়সমূহের সার-সংক্ষেপ হিসেবে বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের ব্যর্থতা, দুনীতি, গণবিচ্ছিন্ন, রাজনৈতিক আনুগত্য ও নেতৃত্বের অভাবে এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ঢাকাসহ সারাদেশে সংগঠিত হয় নি। | প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, খুনীদের মুখপাত্র (সে নিজেও খুনী) মেজর ডালিমের স্ত্রী তাসনিম হত্যাকাণ্ডের পর কিছুদিন বিকৃত মস্তিষ্কের মতাে আচরণ করে। অন্য সবাই যখন খুনী মেজরদের না-রাগানাের জন্য সতর্ক, তাসনিম তখন ওদের আমল দেয়া তাে দূরের কথা বরং দেখলেই থুতু ফেলত।মুজিব নিহত হওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী সৈয়দ নজরুল ইসলামের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করার কথা। কিন্তু কোনাে দুঃসাহসিক কাজের উদ্যোক্তা হিসেবে তার পরিচিতি ছিল না। পরে খুনিদের সরকারে যােগদানের প্রস্তাব নিয়ে তাহের ঠাকুর ও শাহ মােয়াজ্জেম তার কাছে গেলে তিনি বলেন ; আমার আর কোনাে সরকারি পদের দরকার নেই। মােশতাককে বলাে আমাকে। ছেড়ে দিতে। আমি ময়মনসিংহে চলে যাব। আর ক’দিনই বাঁচব। একটু অবসর জীবন কাটাতে চাই।” তাজউদ্দিন ছিলেন মােশতাকের চিরশত্রু। মুজিবনগর সরকার ঢাকায় পৌছেই ষড়যন্ত্রকারী মােশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। কিন্তু মুজিব তাকে পুনর্বাসিত করেন। ১৯৭৪-এর নভেম্বরে কিসিঞ্জারের ঢাকা সফরের প্রাক্কালে মুজিবের মন্ত্রীসভা থেকে তাজউদ্দিনের বিদায় ও বাকশালে তার অন্তর্ভুক্ত না-হওয়ার পেছনে মােশতাকের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। তাই মােশতাক তাজউদ্দিনের কাছে কাউকে পাঠাননি। তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েই মােশতাক তাজউদ্দিনের বাড়িতে সশস্ত্র প্রহরা মােতায়েন করে তাকে নজরবন্দি করে রাখে। প্রহরায় নিয়ােজিত সেনাদের ৪১. মুনীরুজ্জামান, মুজিব হত্যা : প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদ (নিবন্ধ) পূর্বোক্ত এএল খতিব, কারা মজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫১ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫
ক্ষমতার পালাবদলমুজিবকে হত্যার পর হত্যাকারীদের একাংশ বেতার কেন্দ্র দখল করে মােশতাক ও সামরিকবাহিনীর নামে ক্ষমতা দখলের ঘােষণা দেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আইন। জারি হয় ২০ আগস্ট। ১৫ আগস্টের ঘটনা কোনাে সামরিক অভ্যুত্থান’ ছিলনা। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল মাত্র দুটি রেজিমেন্টের (১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ও ২য় ফিল্ড আর্টিলারি) অল্পসংখ্যক জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকসহ নগন্যসংখ্যক বহিষ্কৃত/অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি। সামরিকবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকতা বা পুরাে বাহিনী এতে জড়িত ছিল না। অবস্থার চাপে পড়ে ও গৃহযুদ্ধের আশঙ্কায় তারা সেদিন আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে প্রথম সুযােগেই বিমানবাহিনী প্রধান বিবেকের তাড়নায় পদত্যাগ করেন। সেনাপ্রধান ঘাতকদের শাস্তিদানের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন। ইতােমধ্যে অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত বহিষ্কৃত/অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়মিত হিসেবে আত্মীকরণ করা হয় এবং বিভিন্ন ইউনিটে পােস্টিং দেওয়া হয়। কিন্তু নিয়ােগ গ্রহণ করলেও তারা কেউ-ই কোন পােস্টিং গ্রহণ করে নি। ফারুক ও রশিদ অবস্থান করতাে মােশতাকের সাথে বঙ্গভবনে এবং ডালিম, নূর, শাহরিয়ার ও অন্যরা বেতার ভবনে। বঙ্গভবনে ৮টি, সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮টি ও ক্যান্টনমেন্টে ল্যান্সার লাইনে ১২টি ট্যাঙ্ক মােতায়েনকৃত ছিল। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। সেনাসদর থেকে এক নির্দেশে বঙ্গভবনে তিনটি রেখে বাকী সব ট্যাঙ্ক অবিলম্বে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনতে বলা হয়। কিন্তু ৭ দিনের মধ্যেও পালিত না হওয়ায় নির্দেশটি বাতিল করা হয়। এই ছিল শৃঙ্খলার অবস্থা। বিদ্রোহীরা বিশেষ করে ট্যাঙ্ক ও গােলন্দাজ বাহিনী ছিল যাবতীয় আইনের উর্ধ্বে। অধিকন্তু উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ ‘মেজরদের নির্দেশ শুনতে ও মানতে মানতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। জেনারেল জিয়াসহ সামরিক বাহিনীর একটা অংশ এ অবস্থা মেনে নেয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান (রক্ষী বাহিনীর প্রধান), কর্নেল১. অক্টোবরের শেষার্ধে সেনাবাহিনীর প্রমােশন বাের্ড রশিদ, ফারুক ও ডালিমকে লে. কর্নেল র্যাঙ্কে পদোন্নতি দেয়। উল্লেখ্য, উক্ত প্রমােশন বাের্ডের সভায় কর্নেল শাফায়াত জামিল ‘প্রমােশনের পরিবর্তে তাদের বিচারের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেন এবং মেজর জেনারেল কিউ জি দস্তগীর, ব্রিগেডিয়ার সি আর দত্ত ও কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল আমজাদ হােসেন চৌধুরী তা সমর্থন করেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য খুনীদের পদোন্নতির পক্ষে মত দেয়। বেতার ভবনে অবস্থানকারীরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে ধরে এনে নির্যাতন ও চাঁদা আদায় করতাে। বলে অভিযােগ পাওয়া যায় শাফায়াত জামিল প্রমুখ যারা তা মেনে নিতে পারেনি তারা ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ একটি অভুত্থান ঘটান। অ্যুত্থানকারীদের অন্যতম কর্নেল শাফায়াত জামিলের মতে এর মূল লক্ষ্য ছিল : ক, সেনবাহিনীর চেইন অব কমান্ড পুনপ্ৰতিষ্ঠা করা; খ. ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ এবং হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা করা; গ, সংবিধান-বহির্ভূত অবৈধ সরকারের অপসারণ এবং ঘ, একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে ৬ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। অভ্যুত্থান সূচনার ইঙ্গিত হিসেবে ২ নভেম্বর রাত তিনটায় বঙ্গভবনে মােতায়েনকৃত ১ম বেঙ্গলের কোম্পানী দুটো ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসে। ‘খুনী মােশতাক-রশিদ চক্রের কবল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার উদ্দেশ্যে ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহর নেতৃত্বে সেনাপ্রধান জিয়াকে বাসায় নিরাপত্তা-হেফাজতে রাখা হয়। রেডিও-টিভিতে অবস্থানকারী ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অফিসাররা শাফায়াত জামিলের নির্দেশে ফারুক-রশিদের আনুগত্য ত্যাগ করে রেডিও-টিভি বন্ধ করে দেয়। ৩ নভেম্বর ভােরে (ফাস্ট লাইটে) স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের নেতৃত্বে হেলিকপ্টার ও ফাইটার প্লেন আকাশে উড়ে সারাদিন পর্যায়ক্রমে মােতায়েনকৃত ট্যাঙ্কসমূহের উপর আক্রমনের মহড়া চালায়। একই সাথে শুরু হয় টেলিফোনে বঙ্গভবনে অবস্থানকারী রশিদ-ওসমানী-মােশতাকের সাথে খালেদ মােশাররফের বাক-যুদ্ধ। এক রকম বিনা প্রতিরােধে টেলিফোন-যুদ্ধেই খুনীরা পরাজয় মেনে নিয়ে দেশত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে। তাদের পরাভূত করতে একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি।’ ফারুকের ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ব্যতীত অন্য সকল ইউনিট খালেদ-নূরুজ্জামান-শাফায়াতের সাথে যােগ দেয়। ‘সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয়’ এড়ানাে ও প্রয়ােজনে পরে ইন্টারপােলের সাহায্যে ধরে আনা যাবে বিবেচনা করে খুনীদের দেশত্যাগের ‘সেইফ পেসেজ দেয়া হয়। আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিন ব্যতীত ঘাতকদের ১৭ জন বিমানবাহিনী প্রধান এম. জি. তাওয়াবের ব্যবস্থাপনায় রাত ১১টায় ব্যাঙ্কক অভিমুখে রওয়ানা হয়।৩ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ১২৬ ৩ নভেম্বর দুপুর দুটোর দিকে জিয়া নিজেকে রাজনীতিতে জড়াতে চান না কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। ক্ষমতা সংহত করার পর জিয়াকে জাতিসংঘে স্থায়ী প্রতিনিধি করে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল বলে শাফায়াত জামিল জানান। জেলহত্যার ঘটনা তখনও জানা যায় নি বলেই খুনীদের দেশত্যাগের অনুমতি দেয়া হয়। কর্নেল শাফায়াতের ধারণা, ১৫ আগস্ট মুজিবকে হত্যার উদ্দেশ্যে আর্টিলারি গান থেকে ৩২ নম্বর রােডের বাড়িতে গােলা ছুঁড়কারী মহিউদ্দিনকে কৌশলগত কারণে দেশে রেখে যাওয়া হয়। উল্লেখ্য, ৭ নভেম্বর এই মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে সৈনিকরা জিয়াকে মুক্ত করে ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে যায়। খালেদ মােশাররফ একজন নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত মােশতাককেই স্বপদে বহাল রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরদিন ৪ নভেম্বর সকালে বর্বর ও নিষ্ঠুরতম জেলহত্যার সংবাদ পাওয়ার পর তাকে অপসারণের জন্য বেলা ১১টার দিকে তিনি বঙ্গভবনে যান। ক্যান্টনমেন্টের ক্ষমতা খালেদ দখল করলেও বঙ্গভবন তখনও মােশতাকের নিয়ন্ত্রণে। চারদিকে নানা গুজব, আশঙ্কা আর উত্তেজনা! সারাদিন হেডকোয়ার্টারে অপেক্ষা করে কোন সংবাদ না পেয়ে সন্ধ্যায় তিনজন অফিসারসহ শাফায়াত জামিল বঙ্গভবনে যান। সেখানে তখন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত জিয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণ ও খালেদকে পদোন্নতিসহ সেনাপ্রধান পদে নিয়োেগদান, সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরী, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি কেএম সােবহান ও বিচারপতি সৈয়দ মােহাম্মদ হােসেন সমন্বয়ে জেলহত্যা তদন্ত কমিশন গঠন এবং রাষ্ট্রপতির পদত্যাগপত্রে মােশতাকের স্বাক্ষরদান সম্পন্ন হয়। এরপর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ও ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযােগে মােশতাককে গৃহবন্দি করে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে এবং শাহ মােয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও নূরুল ইসলাম মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হয়। জেলহত্যার ঘটনা জেনেও চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ হিসেবে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় ‘ডিসপ্রেসফুল আচরণের জন্য মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকেও গ্রেফতার করা হয়। | ৫ নভেম্বর সারাদিন সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে বৈঠক ও নতুন রাষ্ট্রপতির ভাষণের খসড়া নিয়ে আলােচনা ও প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণে রাজী করানােতেই কেটে যায়। ৬ নভেম্বর দুপুরে সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণদান করেন। ভাষণের মূল বিষয় ছিল সেনাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর জেলে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার,৪. প্রধান যে গুজবটি সর্বত্র ছড়ানাে হয়, তা হলাে : খালেদ মােশাররফ ভারতের চর এবং যে কোন। মুহুর্তে ভারত বাংলাদেশ দখল করতে আসছে। গুজবটির ভিত্তি রচনা করেন মােশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ওসমানী। অক্টোবরের মাঝামাঝি বঙ্গভবনে আহুত সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের এক কনফারেলে ওসমানী সবাইকে রাষ্ট্রপতি মােশতাক ও তার সরকারের প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ দেন এবং যে কোন রকম অবাধ্যতা সমূলে উৎখাত করা হবে বলে জানান। তিনি এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রেজিমেন্টের সিনিয়র জেসিওদের ডেকে নিয়ে বলতে লাগলেন যে, যারা সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করবে-তারা ভারতীয় প্ররােচনাতেই তা করবে, তারা সব ভারতীয় এজেন্ট। এসব কথা বলে ১৫ আগস্টের অ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের বিরােধীদের প্রতি ভারতের। দালাল’ লেবেল সেঁটে দেয়া হয় এবং জাসদ তা সর্বত্র প্রচার করে ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। বার বার অনুরােধ করা সত্ত্বেও খালেদ রেডিও-টিভিতে ভাষণ দেন নি। তার এক কথা, নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ভাষণ দেবেন। ৩ দিন ধরে একটানা রেডিও-টিভি বন্ধ থাকায় কী ঘটছে তা মানুষ জানতে পারেনি। এ সুযােগে একদিকে গুজব ‘সত্যে রূপান্তরিত হওয়ার সুযােগ পায় এবং অন্যদিকে বিরােধীরা সংগঠিত হয়৬ মাসের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা ও নিষ্কলুষ-নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তােলা প্রভৃতি। এদিন সন্ধ্যার মধ্যে বঙ্গভবন ও সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের সব ট্যাঙ্ক ক্যান্টনমেন্টে তাদের ইউনিট লাইনে ফিরে আসে (গােলন্দাজ রেজিমেন্টের কামানগুলাে ৪ নভেম্বরেই লাইনে ফেরত এসেছিল)। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বঙ্গভবনে খালেদ এবং নৌ ও বিমান। বাহিনী প্রধানদের এক সভা বসে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটির অধিকারী। রাষ্ট্রপতি না সেনাপ্রধান হবেন এই ছিল সভার আলােচ্য বিষয়। নৌ ও বিমান বাহিনী। প্রধানদ্বয়ের অভিমত হলাে রাষ্ট্রপতি পূর্বানুরূপ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং তিন বাহিনী প্রধানগণ উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন। খালেদের অভিমত হলাে। যেহেতু সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের দায়-দায়িত্ব কার্যত সেনাপ্রধানের উপর বর্তায় সেহেতু এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুবিধার্থে সেনাপ্রধানেরই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। হওয়া উচিত। সভা চলাকালে রাত ১২ টার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোনে সিপাহি বিপ্লব শুরু হওয়ার কথা জানানাে হয়। ফলে পদ/ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বালখিল্য দর কষাকষি মূলতবী রেখে প্রধানত্রয় বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। কর্নেল কে এন হুদা (রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার) ও লে. কর্নেল এটিএম হায়দারকে নিয়ে খালেদ রংপুর ব্রিগেড থেকে আগত ১০তম বেঙ্গলের অবস্থানস্থল শেরেবাংলা নগরে গমন ও রাত্রি যাপন করেন।| ৩ নভেম্বর খালেদের অভুত্থানের পর সেনানিবাসে ফারুকের ল্যান্সার ও রশিদের আর্টিলারিকে নিরস্ত্র করে ব্লক দিয়ে রাখা হয়েছিল। ফারুক-রশিদের দেশত্যাগ ও জিয়া-মােশতাক-ওসমানীর পদত্যাগের কারণে এসব সৈনিক অনিরাপদ বােধ করছিল। সিপাই বিদ্রোহ সংক্রান্ত বামপন্থী জাসদ ও ডানপন্থী মুসলিম লীগের লিফলেট তাদের সাহস সঞ্চারে সহায়ক হয়। প্রধানত পাকিস্তান-প্রত্যাগত সৈনিকরা এ বিদ্রোহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। রাত ১টার মধ্যেই তারা পুরাে ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ে। নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার, সিপাই সিপাই ভাই ভাই-সুবেদারের উপর অফিসার নাই, সিপাই সিপাই ভাই ভাই-অফিসারদের রক্ত চাই, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ-সিপাই৯. জাসদের গােপন সশস্ত্র শাখা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে ৫ ও ৬ নভেম্বর ঢাকাসহ বিভিন্ন সেনানিবাস ও শহরে (বিশেষ করে ঢাকা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফুটবল খেলার দর্শকদের মধ্যে) উস্কানিমূলক লিফলেট ছড়ানাে হয়। সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে সেনাছাউনিকেন্দ্রিক ১২ দফা দাবি সংবলিত এই লিফলেটে ছড়ানাে হয় ঘৃণা, হিংসা, বিদ্বেষ আর উত্তেজনা। একই সাথে সেদিন মুসলিম লীগের একটি লিফলেটও ঢাকা সেনানিবাসে ছড়ানাে হয়। উল্লেখ্য, ৬ নভেম্বর রাত দশটার দিকে সিপাইদের বিদ্রোহ এবং খালেদ ও শাফায়াতকে মেরে ফেলার নির্দেশ সংক্রান্ত সংবাদ শাফায়াতকে জানানাে হয়। তিন-প্রধানের বৈঠকের এক পর্যায়ে তা খালেদকেও জানানাে হয়। কিন্তু খালেদ বিষয়টিকে গ্রাহ্য করেন নি এবং কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। অপরিণামদর্শীতার এ এক নিদর্শন বৈকি! ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জে, নিয়াজিকে এসকর্ট করে নিয়ে। আসা বীর মুক্তিযোেদ্ধা হায়দার চট্টগ্রামের একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন। এ সময় সম্ভবত তিনি ছুটিতে ছিলেন এবং ঘটনাচক্রে খালেদের সাথে তার দেখা হয় ও নির্মম হত্যার শিকার হন।বিপ্লব জিন্দাবাদ প্রভৃতি স্লোগান ও এলােপাথাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঘাতক মেজর মহিউদ্দনের (আর্টিলারি) নেতৃত্বে (মতান্তরে হাবিলদার সারােয়ারের নেতৃত্বে) ১ম | বেঙ্গল ল্যান্সারের একদল সৈন্য জিয়াকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে নিয়ে আসে। সেখানে জিয়ার ভারত-বিরােধী উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা সিপাইদের আরাে উন্মত্ত করে তােলে। ৭ নভেম্বর সকালে ১ম বেঙ্গল ল্যান্সার ও ২য় ফিল্ড আর্টিলারির একদল সৈন্য এসে ১০ম বেঙ্গলকে বিদ্রোহে যােগ দিতে আহ্বান জানালে এখানেও গােলযােগ ছড়িয়ে পড়ে এবং এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন আসাদ ও ক্যাপ্টেন জলিলসহ কয়েকজন অফিসার ঠাণ্ডা মাথায় গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে খালেদ, হুদা ও হায়দারকে হত্যা করে।” | ৭ নভেম্বর এই তিনজনকে হত্যা করা ব্যতীত আর কোন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। তবে পরদিন ৮ নভেম্বর শুরু হয় সিপাই কর্তৃক অফিসার নিধন যজ্ঞ। খালেদের অ্যুত্থানের সাথে কোন যােগসাজশ না থাকা সত্ত্বেও ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেন, লে. মুস্তাফিজুর রহমান, মেজর আজিম, ডেন্টাল সার্জন করিম, ডা. চেরি প্রমুখ ১৩ জন অফিসার এবং লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর স্ত্রীকে খুন করা হয়। সৈনিকদের অরাজকতা এরূপ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ অফিসার কোন রকমে তাদের কমান্ড বজায় রাখতে সক্ষম হন এবং অবশিষ্টরা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে সাধারণ মানুষের বেশে যে যেখানে পারে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। এমনকি জিয়া ও অন্যান্যরা ৭ দিন ধরে অফিসের ভেতরেই নাওয়া-খাওয়া-দ্রিার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। অবশেষে জিয়া যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৭ম, ৯ম, ১১শ ও ১২শ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডাে দল এনে অফিসারদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়া পুনঃ সামরিক ক্ষমতা ফিরে পান। ক্রমে ডেপুটি থেকে ‘চিফ মার্শাল-ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও পরে প্রেসিডেন্টের পদ অলঙ্কৃত করেন। তিনি সামরিক আইনকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেন। জিয়া ক্ষমতা হাতে নিয়ে ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিদেশে বাংলাদেশী মিশনগুলােতে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসিত করেন। খুনিচক্র সবসময়ই (চিফ হওয়ার পূর্বেও) জিয়ার আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে। মােশতাক-জিয়া চাকরিচ্যুত ঘাতকদের চাকরিই কেবল ফিরিয়ে দেননি, রাতারাতি প্রমােশন দিয়ে ওদের পুরস্কৃতও করেছেন। ফারুক-রশিদ দূতাবাসের চাকরি গ্রহণ করেনি বরং ১৯৭৬ সালে গােপনে ডালিমসহ দেশে ফিরে ফারুক সাভার ও বগুড়া এবং রশিদ-ডালিম ঢাকা সেনানিবাসে বিভিন্ন ইউনিটের কমান্ড-কট্রোল হাতে১১ খালেদের নির্দেশে রংপুর ব্রিগেড থেকে দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য ৬ নভেম্বর ঢাকায় আসে। এর একব্যাটালিয়ন শেরে বাংলা নগরে এবং অপরটির কিছু অংশ সাভারে ও বাকী অংশ নগরবাড়ি ঘাটে। অবস্থান নেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরা ‘কে’ ফোর্সের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে। কিন্তু এই দশম বেঙ্গলের অফিসারদের হাতেই খালেদ প্রমুখের প্রাণহানি ঘটে।১২. ‘সিপাই বিপ্লব সংঘটন সম্পর্কে জাসদ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে ১৩ জিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পরিশিষ্ট ১২ পড়ুন।করে সাজা দেন, এমনকি খােদ বেঙ্গল লেন্সার ভেঙ্গে দেন। কিন্তু ‘ওই হােতাদের বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে তিনি তাদের আবার বিদেশে পাঠিয়ে দেন। এবংবিধ কারণে কৌসুলী সিরাজুল হক মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়ার ভূমিকাকে ‘রহস্যজনক বলে মন্তব্য করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, জে, এরশাদও ক্ষমতা দখল করে ঘাতকদের দ্বিতীয়বার পুনর্বাসন করেন এবং তাদের সাকুল্য বকেয়া বেতন পরিশােধ করেন। অন্য কথায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত সকল সরকারের আমলেই ১৯৭৫-এর ঘাতকরা বিশেষ আনুকল্য পেয়ে এসেছে। যাহােক, সামরিকবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ ও রাজনৈতিক-উচ্চাভিলাষীপনার সর্বশেষ ছােবল ১৯৮১ সালের ৩১মে’র জিয়া হত্যা। নানা কারণে মঞ্জুর-মতি-এরশাদ সেদিন ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ দুর্নীতি, নারী-কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিকবাহিনীর হিস্যা দাবি প্রভৃতি কারণে প্রেসিডেন্ট সাত্তার এরশাদকে বরখাস্ত করে। মে. জে. শামসুজ্জামানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি সরকারের তথ্যমন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরি আদেশটি প্রচারের জন্য রেডিও-টেলিভিশনেপাঠিয়ে ‘বােধগম্য কারণে এরশাদের নিকট পাঠিয়ে দিলে এরশাদ ‘রক্তপাতহীন অ্যুত্থান ঘটিয়ে দ্বিতীয়বার সামরিক শাসন জারি ও ক্ষমতা দখল করেন। দুর্ভাগ্য গণতন্ত্র-প্রিয় বাঙালি-জাতির। স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে পাকিস্তানি সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে না পেতেই শুরু হয়। বাংলাদেশী সামরিক নিষ্পেষণ। ১৯৭৫ ও ‘৮২ দু-বারই সামরিক শাসন জারি হয় বরখাস্তকৃত অফিসারদের (ডালিম ও এরশাদ) দ্বারা। প্রভু নয় বন্ধুর প্রভু আইয়ুব খানের ভাষায়, বৈদ্যুতিক বােতাম টিপলে যেমন হয়, সামরিক আইন ঠিক তেমনিভাবে আসলেও একে তাড়ানাে খুবই কঠিন ব্যাপার। বহু কাঠ-খড় পুড়িয়ে, রক্ত-অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ১৯৯০ সালে সভ্য মানুষের (সিভিল) অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সামরিক শাসন দূরীভূত করা হয়েছে। তবে এ ‘ভূত’ সত্যিই দূর হয়েছে-না কার্পেটের নিচে গা-ঢাকা দিয়ে আছে, তা নিশ্চয় করে বলা মুশকিল। জেল হত্যাকাণ্ড ক্ষমতা দখলের পর মােশতাক ‘হিসেব কষে দেখলেন যে, আসল হুমকি-সেনাবাহিনীকে বাদ দিলে, আসছে তারই পুরনাে পার্টি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। তাই তিনি বিলম্ব না করে তার সকল সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিকে সরিয়ে দেয়ার ধূর্ত ও ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ’র সূচনায় মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রী চতুষ্ঠয় নজরুল, তাজউদ্দিন, মনসুর ও কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দেন। এঁদের খুন করার কারণ। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফারুক বলে যে, শেখ মুজিবকে ওরা যেভাবে উৎখাত করেছে,১৫. সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে জারি করা এক ফরমানে বলা হয়, যদি কোন ব্যক্তি দুর্নীতি করে, এমনকি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোেগও ওঠে (রিপুটেড টু বি করাপ্ট) তাহলে তাকে বিচারপূর্বক মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। সম্ভবত এজন্যই শেষ সাক্ষাৎকারে স্ত্রী জহুরাকে তাজউদ্দিন। বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমার মনে হয় না যে, জীবিত অবস্থায় আমরা কোনদিন জেল থেকে বের হতে পারবসেভাবে খােন্দকার মােশতাকওতাে উৎখাত হতে পারে। ঐ অবস্থায় ভারতের সহায়তায় কোন পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে গেলে, জেলের চার নেতার যে কোন একজনকে টেনে এনে পাল্টা সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হবে। সুতরাং তাদেরকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করাটাই নিরাপদ। তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয়, মােশতাককে হত্যা করা হলে বা কোন পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটলে অবিলম্বে শূন্যতা পূরণের জন্য প্রধান বিচারপতিকে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়াতে হবে এবং জেলে অবস্থানরত চার নেতাকে হত্যা করতে হবে। হত্যা করার দায়িত্ব দেয়া হয় রিসালদার মুসলেহ্ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সারের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জল্লাদ বাহিনীর (হাস্টর কিলার টিম) উপর। পরিকল্পনাটি সময়মত তাৎক্ষণিক ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকরী হওয়ার উপযােগী করে তৈরি করা হয়। বাস্তবে হয়েছিল তাই। খালেদের অভ্যুত্থান শুরু হতেই জল্লাদ বাহিনী জেলগেটে পৌছে যায়।| মােশতাক, ওসমানী, খলিল, ফারুক ও রশিদের ‘পঞ্চায়েত’ অক্টোবরের শেষ দিকে একটি আসন্ন অ্যুত্থান সম্পর্কে মােটামুটি নিশ্চিত হয়। সেটা জিয়া না খালেদের পক্ষ থেকে-তা নিয়ে মােশতাক ও রশিদ ২ নভেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত পর্যালােচনা করেন। কিন্তু ততক্ষণে খালেদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান শুরু হয়ে যায় এবং এর প্রতিফলন স্বরূপ বঙ্গভবনে ‘একদিকে টেলিফোন বাজছে, অন্যদিকে নির্দেশের পর নির্দেশ জারি হচ্ছে। লােকজন খবর নিয়ে উভ্রান্তের ন্যায় ছুটাছুটি করছে। ভাের ৪টা বাজার একটু পর ঐ বিশৃঙ্খল অবস্থার মাঝেই বেজে উঠা ফোনের রিসিভার উঠিয়ে ভারী কণ্ঠে ‘আমি ডিআইজি-প্রিজন কথা বলছি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ করতে চাই’ শুনতে পেয়ে রশিদ ফোনের রিসিভারটি মােশতাকের হাতে দেয়। মােশতাক কিছুক্ষণ ধরে কেবল হা, হা করতে থাকেন। তার কথা পরিষ্কার বুঝা না গেলেও যে-কোন ব্যাপারেই হােক তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করছিলেন-এতে আর কোন সন্দেহ ছিল না। অন্য একটি সূত্রমতে, ফোনে তিনি জেলারকে বলেন, “আমি খােন্দকার মােশতাক বলছি, ওদের আমি পাঠিয়েছি। ওরা যা করতে বলছে- তাই করুন।” এরপর ডিআইজি জনাব আউয়াল ঘাতক মুসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন চার কালাে পােশাকধারীদের জেলের ভেতর প্রবেশের অনুমতি দেন। তারা পাশের একটি সেল থেকে কামারুজ্জামান ও মনসুর আলীকে নজরুল-তাজউদ্দীনের সেলে এনে একত্র করে খুব কাছে থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে নৃশংসভাবে খুন করে। তাদের কেউ কেউ। সাথে সাথেই মারা যান, কেউ কেউ কিছুক্ষণ অস্ফুট কণ্ঠে পানি পানি বলে মর্মভেদী। আর্তনাদ করে করে নিস্তেজ হয়ে অনন্ত তৃষ্ণা নিয়ে ধীরে ধীরে মারা যান।১৫. অ্যান্থনি ম্যাসাকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৪ ১৬. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৬ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, জ্ঞানকোষ প্রকশানী, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা ২৮ ক্ষমতার পালাবদল৩ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে পুলিশের আইজি বঙ্গভবনে ফোন করে জেনারেল খলিলকে জেলহত্যার সংবাদ জানালে সাথে সাথে তিনি প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি মাহবুবুল আলম চাষীকে ঘটনাটি প্রেসিডেন্টকে জানাতে বলেন। শুনামাত্রই চাষী। প্রেসিডেন্টের রুমে যান এবং এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এসে বলেন, তিনি তা। জানেন।
জাসদআওয়ামী-পরিবার ত্যাগ করার পর সিরাজুল আলম খান, আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ এবং তাদের সমর্থক বিলুপ্ত মুজিববাহিনী ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগের অভিভাবকত্বের জন্য একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত হয়। সেমতে ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ মেজর (অব) এম এ জলিল ও আসম আবদুর রবকে যুগ্ম আহবায়কসহ ৭-সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি করে গঠন করা হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। পরে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ অনুষ্ঠিত একস্ট্রা কাউন্সিলে মেজর জলিলকে সভাপতি ও আসম আবদুর রবকে সাধারণ সম্পাদক করে ১০৫-সদস্যের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি এবং ১২ মে ১৯৭৩ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সম্মেলনে জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। জাসদ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তাধারাকে তার আদর্শ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য ঘােষণা করে এবং বুর্জোয়া শােষকশ্রেণীর’ মুজিব-সরকারকে উৎখাতের সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গী মনােভাব ও সমাজতন্ত্রের প্রতি আকাক্ষা ছাত্রলীগের তুলনামূলকভাবে সচেতন, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী অনেককে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী জাসদ আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। অন্যদিকে দুর্নীতি ও অন্যান্য কারণে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এবং ভারতবিদ্বেষী, স্বাধীনতাবিরােধী, মৌববাদী ও১. আহবায়ক কমিটির অন্যান্য সদস্যবৃন্দ হলেন : ১. বিধানকৃষ্ণ সেন ২. শাহজাহান সিরাজ ৩, নূর | আলম জিকু ৪, সুলতান উদ্দিন আহমেদ ও ৫, রহমত আলী (এডভােকেট)।আত্মসমালােচনা দলিল, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৩-১৪। জাসদের জাতীয় কমিটি কর্তৃক পার্টির অভ্যন্তরে কেবলমাত্র সদস্যদের জন্য ৪৪ পৃষ্ঠার এই দলিলটি মার্চ ১৯৭৯ প্রচারিত হয়। উদ্ধৃত : নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি একটি নিকট বিশ্লেষণ, প্রাচ্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮১, পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪ (টীকা)। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, জাসদ-সম্পর্কিত আলােচনায় যতদূর সম্ভব তাদের নিজেদের দলিলসমূহ যথা আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, শাজাহান সিরাজের রাজনৈতিক রিপাের্ট ১৯৮০, মাহবুবুর রব সাদী’র বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব (আন্তপার্টি মতাদর্শগত সংগ্রাম বিষয়ক) ১৯৭৮, সিরাজুল আলম খানের আন্দোলন ও সংগঠন প্রসঙ্গে ১৯৭৬, কর্মসূচি, সংগঠন, আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ (১২ নেতার দলিল) প্রভৃতির ভাষ্য জনাব নজরুল ইসলামের পূর্বোক্ত গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০০, পৃষ্ঠা ৩১ রাজাকার-আলবদরদের পরিবারের তরুণ সদস্যরা জাসদকে তাদের নিরাপদ আশ্রয়। এবং আওয়ামী ও ভারতবিরােধী মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করার প্রয়াস পায়। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনােত্তর দ্বিতীয় ‘ডাকসু’ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ‘মুজিববাদী’ ছাত্রলীগের যৌথ-প্রার্থীদের পরাজিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগ জয়ী হয় বলে মনে করা হয় (ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের কারণে ফলাফল প্রকাশ হতে পারেনি)। | স্বাধীনতা-পরবর্তী উদ্ভূত পরিস্থিতি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের কার্যকলাপে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত না-হওয়ায় ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারাচ্ছিল এবং ‘বিপরীত মেরুতে অবস্থানের কারণে জাসদের সমর্থন বেড়ে উঠছিল’ দেখে তারা একের পর এক সরকারবিরােধী কার্যক্রম গ্রহণ করতে থাকে। যেমন ৩০ ডিসেম্বর ১৯৭৩ ও ২০ জানুয়ারি ১৯৭৪ প্রতিরােধ দিবস, ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ হরতাল ও ৩১ মার্চ ১৯৭৪ থেকে সারা দেশে সি.ও. (সার্কেল অফিসার; তৎকালীন থানা প্রশাসনের প্রধান ব্যক্তি), চেয়ারম্যান প্রভৃতি ঘেরাও শুরু করা প্রভৃতি। স্বাধীনতার পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে স্বাভাবিক অনুষজ্ঞ হিসেবে খাদ্যসমস্যা দেখা দেয়। মাওলানা ভাসানী একে উপলক্ষ করে সরকার বিরােধী রাজনীতির সূচনা করেন। এ-সময়কালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বহারা পার্টি, নক্সালপন্থী প্রভৃতি মাওবাদীরা শ্রেণী শত্রু খতমের নামে উপযুপরি খুন-খারাবিতে লিপ্ত হয়। সবকিছু মিলে রাজনীতিতে একটি অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং তা সামাল দিতে সরকার ১৩ জানুয়ারি ১৯৭৪ ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। | ৩০ জানুয়ারি ১৯৭৪ অনুষ্ঠেয় পূর্ব-ঘােষিত প্রতিরােধ দিবস পালনােপলক্ষে জাসদ ১৮ জানুয়ারি ১৪৪ ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রচার-মিছিল বের করে। এদিন শাসকদল আওয়ামী লীগের তিনদিন ব্যাপী দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। ফলে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী উভয়ই অধিকতর তৎপর হয়। তারা ঢাকায় ১৮ জানুয়ারি ১১ জন ও ১৯ জানুয়ারি ১০ জন এবং ২০ জানুয়ারি রাজশাহীতে ৫৭ জনকে গ্রেফতার করে। এরপরও মফস্বলের অনেক স্থানে সফল হরতাল পালিত হয়। এমতাবস্থায় দেশজুড়ে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে রক্ষীবাহিনীকে বিনা-পরােয়ানায় যে-কোনাে সন্দেহভাজনকে গ্রেফতারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়।৪. ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৪-২৫ ও ৩১। প্রসঙ্গক্রমে, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযােগে আদমজী পাটকল থেকে পদচ্যুত এম এ আওয়াল, স্বাধীনতাবিরােধী মাওলানা মতীন, ভারতবিদ্বেষী কবি আল-মাহমুদ প্রমুখ জাসদের নীতি-নির্ধারকদের অন্যতম গণ্য হয়েছিলেন। আল-মাহমুদ দলীয় মুখপত্র গণকষ্ঠের সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে তিনি ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মৌলবাদী জামাত-বিএনপি জোটে যােগ দেন। এমনকি সভাপতি মেজর জলিল হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান কার্ল মার্কস-চুলে দাঁড়িতে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতিরূপ; পরে দীক্ষা নিয়েছিলেন ইসলামিক মৌলবাদেও আদম ব্যবসায়। দৈনিক গণকণ্ঠ, ১৯, ২০ ও ২১ জানুয়ারি ১৯৭৪স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও এতদসত্ত্বেও জাসদ তাদের পূর্বনির্ধারিত ‘সি.ও. চেয়ারম্যান ঘেরাও কর্মসূচি বাস্তবায়নে এগিয়ে যায় এবং ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ‘প্রতীকী’ ঘটনা হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিন্টু রােডস্থ বাসভবন ঘেরাও করে। ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ও ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ -এর ব্যর্থতা এবং তৎপরবর্তী সরকারি নির্যাতনের চাপে তাদের রাতারাতি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রঙিন স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসে। সমাজের মধ্যস্তর থেকে আগত অস্থিরমতি তরুণ হতাশ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ফলে মধ্য-গগনে পৌছার আগেই উদীয়মান জাসদের গতি হয়ে পড়ে নিম্নগামী। এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্যে শুরু হয় অতীত-পর্যালােচনা (প্রকৃত প্রস্তাবে ১৭ মার্চ ও ৭ নভেম্বরের মধ্যবর্তীকালে অতীত-পর্যালােচনা শুরু হয় কিন্তু তা কোনাে নির্দিষ্ট পরিণতি লাভ করেনি)। পর্যালােচনায় বসে আবিষ্কার হয়, ডেনমার্কের যুবরাজ ছাড়াই জাসদ হ্যামলেট মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল! শাজাহান সিরাজের ভাষায় :১৭ই মার্চের পূর্বে বাংলাদেশের সমাজকাঠামাে সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, বিপ্লবের স্তর সম্পর্কে আমাদের কোনাে সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। স্বভাবতই শত্রু-মিত্র নির্ধারণ ও আন্দোলনের রূপরেখা সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা ছিল অনুপস্থিত। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে : বস্তুত ১৭ই মার্চ ১৯৭৪-এ আমরা কী করতে চেয়েছিলাম? তখনকার সাহিত্যগুলাে খুঁজে দেখলে মূলত একটি জবাব বেরিয়ে আসবে। (চেয়েছিলাম) গণআন্দোলনের ছেদ ঘটিয়ে তাকে বিপ্লবী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে। অন্যান্য কিছু টুটকো কথাবার্তা বলেছিলাম বটে, কিন্তু সেটা আসলে ধর্তব্যের মধ্যে আসতে পারে না। তখন পার্টির থিসিস ছিল না। রণনীতি রণকৌশল ছিল অনির্ধারিত। পার্টি থিসিস নেই (মার্কসবাদ, লেনিনবাদের কথা বলছি)। প্রলেতারিয়েত শক্তিভিত নেই। এ অবস্থায় আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, হতে পারে? ক্ষমতা দখল? কার? জাসদের? এগুলাে কোনাে কিছুই নিষ্পত্তি হয়নি। অথচ আন্দোলন এগিয়ে যেতে লাগল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ১৭ মার্চ ১৯৭৪ -এর আগে জাসদের মধ্যে বাংলাদেশের সমাজ কাঠামাে’, ‘বিপ্লবের স্তর’, শত্রু মিত্র, ‘আন্দোলনের রূপরেখা’, পার্টি থিসিস, ‘রণনীতি, রণকৌশল,’ ‘আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য’ প্রভৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিলনা বা এগুলাে সম্পর্কে ‘নিষ্পত্তি হয়নি। বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য এগুলাের৬. ২৯ মার্চ ১৯৮০ তে অনুষ্ঠিত জাসদের দ্বিতীয় কাউন্সিলে (কার্যকরী) সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক রিপাের্ট, পৃষ্ঠা ১৪। আত্মসমালােচনামূলক দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৯ ও ২০ ১৭ মার্চ ১৯৭৪ ও ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি সময়ে পার্টি থিসিস উত্থাপিত (এবং পরে সংশােধিত) হলেও এবং রণনীতি, রণকৌশল নির্ধারণ করা হলেও জাসদ সঠিক আন্দোলন রচনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দেয় বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা ও তদানুসারে কার্যক্রম গ্রহণ একান্ত বাঞ্চনীয় হলেও জাসদ তা না করেই ঘােড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। | ১৭ মার্চ ১৯৭৪ প্রকৃতপক্ষে কিভাবে কী ঘটেছিল তার বর্ণনায় শাজাহান সিরাজ জানাচ্ছেন :১৭ই মার্চের আগেই ৩০শে জানুয়ারি, ৮ই ফেব্রুয়ারির কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনমুখী অবস্থার যখন বিকাশ হচ্ছিল, (তখন) আমরা প্রতিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে বর্ধিত সভা করে যে-আন্দোলনের কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেছিলাম তাতে বলা হয়েছিল, গ্রাসরুট লেভেল-এ আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে হবে এবং সেখান থেকে একে আবার কেন্দ্রমুখী করা হবে। কেউ কেউ এটাকে গ্রাম থেকে শহর ঘেরাওয়ের অর্থে বুঝে থাকলেও ব্যাপারটি সেরকম ছিল না। সেভাবেই ঢাকা শহরে একটি টোকেন ঘেরাও অভিযান পরিচালনা করার কথা ছিল। অথচ ঘটল কী? টোকেন ঘেরাও বলা সত্ত্বেও, কেবল মেমােরেন্ডাম দেওয়ার কথা থাকা সত্ত্বেও এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাড়ি না-থাকা সত্ত্বেও আমরা সন্ধ্যার পরে সেখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে লাগলাম। ইতিমধ্যেই ধস্তাধস্তি, ঠেলাঠেলি, অস্ত্র ছিনতাই, গােলাগুলি ইত্যাদি। শহীদ হলেন অনেকে। গ্রেফতার হলেন জলিল, রবসহ অনেকে। অর্থাৎ শাজাহান সিরাজ বলতে চান যে, আন্দোলনের কর্মসূচি (কেন্দ্র থেকে গ্রসরুট মুখী এবং গ্রাসরুট থেকে কেন্দ্রমুখী) সম্পর্কে নেতৃত্বের ব্যাখ্যা আর কর্মীদের বুঝ’ এক ছিল না। টোকেন ঘেরাও’ সেজন্য শেষ পর্যন্ত আর টোকেন থাকেনি। কিন্তু জাসদের অন্যতম নেতা মাহবুবুর রব সাদী তার সাথে ভিন্নমত পােষণ করে বলেন : পার্টির সিদ্ধান্ত ছিল এই ঘেরাওয়ের সঙ্গে সারাদেশে উনত্রিশটি জায়গায় সশস্ত্র ঘটনা ঘটানাে এবং দুই জায়গায় সিদ্ধান্ত পালিতও হয়েছিল। এরপরও আমরা যদি বলতে চাই চুয়াত্তরে মার্চ মাসে আমরা রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে যেতে চাইনি, বা এ ধরনের কোনাে ইচ্ছা আমাদের ছিল না, তাহলে একে মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছু বলা যাবে। পল্টন ময়দানে সমবেত লক্ষাধিক মারমুখি জনতাকে, চরম উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতার মাধ্যমে আরও মারমুখি করে তুলে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরায়ের ঘােষণা দিয়ে, জঙ্গী মিছিল সহকারে তার বাসভবন পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আমরা যদি বলি শুধু ভাবে memorandum দিতে গিয়েছিলাম, তাহলে এটাকেও মিথ্যাচার ছাড়া কিছু বলা যাবে৯. আত্মসমালােচনা দলিল, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৯ তৎকালীন ছাত্রনেতা আফম মাহবুব হক বিনা উস্কানিতে পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীকে লক্ষ্য করে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করেন। (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২৮ নভেম্বর ১৯৮০ পৃষ্ঠা ৪৩; খন্দকার মােজাম্মেল হকের পত্র) এ ঘটনায় কমপক্ষে ৮ জন নিহত হয় (এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৭)। মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব (আন্তঃপার্টি মতাদর্শগত সগ্রাম বিষয়ক), ১৯৭৮, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০ সেদিনকার পার্টি-নির্দেশ ছিল, যত শক্ত ব্যারিকেডই হােক তা অতিক্রম করে memorandum দিয়ে আসতেই হবে। এর অর্থ কি? যেখানে একজন সাধারণ বুদ্ধিমান লােকও বুঝতে পারে একজন সরকারি মন্ত্রী ঐ ধরনের একটি মিছিল থেকে memorandum নিতে চাইবে না, সেখানে যেমন করেই হােক memorandum দিয়ে আসার নির্দেশ দেওয়া কি সংঘর্ষ সৃষ্টি করার নির্দেশ নয়?জানা যায়, এর পূর্বেই জাসদ ‘৩১ মার্চ থেকে সারা দেশে সি.ও, চেয়ারম্যান প্রভৃতি ঘেরাও শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং মার্চ মাসের (সম্ভবত) দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাসদের বর্ধিত সভায় ঢাকায় একটা Token (প্রতীকী) ঘটনা না ঘটলে সারাদেশে সি.ও. চেয়ারম্যান ঘেরাও শুরু করতে অসুবিধা হবে-জেলা প্রতিনিধিদের এই মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ই মার্চের ঘটনাটি ঘটে। জনাব সাদী বলেন :১৯ | এই সিদ্ধান্তটি ছিল প্রথম বড় রকমের ভুল। ঘেরাও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের একটা চরম পর্যায়ের পদক্ষেপ। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, সারাদেশ জুড়ে সরকারি কর্মচারী এবং প্রতিনিধিদের ব্যাপকভাবে ঘেরাও করার কর্মসূচি গ্রহণ করার অর্থই রাষ্টশক্তির সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া। কারণ এ ধরনের অন্দোলনকে মােকাবেলা করতে গিয়ে রাষ্ট্রশক্তি আঘাত হানতে বাধ্য। অতঃপর শাজাহান সিরাজ ১৭ মার্চের আন্দোলনকে মূল্যায়ন করে বলেন : ১৭ই মার্চে যে লক্ষ্য নিয়ে আমরা আন্দোলন রচনা করেছিলাম, তা তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছেনি। বিচ্ছিন্ন ও ভ্রান্ত কর্মসূচিগত পরিকল্পনার কারণে বিশেষ করে শ্রমিক এলাকাসমূহে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া যায়নি। উপরন্তু ১৭ই মার্চের ঘটনার পর জনগণ ও আমাদের মাঝে তৈরি হয় নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৬ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৮ কার্যকরী সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক রিপাের্ট, দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৪ ১৭ মার্চ ১৯৭৪ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়ের লক্ষ্য কী ছিল তা জাসদ কখনই স্পষ্ট করে কিছু। বলেনি। আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯ -এ বলা হয় স্মারকলিপি প্রদানের নিমিত্তে টোকেন ঘেরাও (গ্রাম থেকে শহর ঘেরাও নয়) কিন্তু জনাব সাদীর বরাতে জানা যায়, সারাদেশে সি, ও, চেয়ারম্যান ঘেরাও ও উনত্রিশটি স্থানে সশস্ত্র ঘটনা ঘটানাের সুবিধার্থে ঢাকায় ঐ টোকেন ঘটনাটি ঘটানাে হয়। সাম্যবাদ”-এ একে ১৯০৫-এর মস্কো অ্যুত্থানের সাথেও তুলনা করা হয়। ১৯০৫ সাল ছিল প্রথম রুশবিপ্লবের প্রথম বৎসর। আর ডিসেম্বরের মস্কো অ্যুথান ছিল সে-বৎসরের জানুয়ারি মাস থেকে শুরু-হওয়া বিপ্লবী ঘটনাবলীর সর্বোচ্চ পর্যায়, যখন মস্কোর শ্রমিকশ্রেণী ক্রাসূনােপ্রেসনেস্কি এলাকায় ব্যারিকেড নির্মাণ করে জারের সেনাবাহিনীর সাথে সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়।’ (নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৫ পাদটীকা-৪) অন্যদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় সে সময় শ্রমিকরা ছিল ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় লিপ্ত। সুতরাং এ তুলনাও যথার্থ নয়। বাংলাদেশের তৎকালীন শ্রমিক রাজনীতির অবস্থা জানার জন্য পরিশিষ্ট ১০ পড়ুন।যােগসূত্রহীনতা। এই কারণে আমাদের রাজনীতি ও আন্দোলনগত কর্মকাণ্ড জনগণের কাছে অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। বস্তুত ১৭ই মার্চের পর আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তখনও কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি নেই; যেমন হাঁকডাক করলাম। অথচ জনগণ জানল আমাদের মারাত্মক শক্তি আছে। মুজিব সরকারের ক্ষমতা নাই আমাদের গায়ে হাত দেয়। তাই পরবর্তীতে আমরা যখন মূলত প্রকাশ্যে সশস্ত্র সমস্ত ক্রিয়াকলাপ শুরু করলাম তখনও জনগণ নীরব দর্শক। তারা দেখছেন আমরা কী করি। জনগণের নিজস্ব কোনাে ক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। ১৭ই মার্চের পর ফোরামভিত্তিক যে-সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে তােলা হয়েছিল তাও বিকশিত হয়নি। সংগঠন হয়ে ওঠে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বিপ্লবী রাজনীতির অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে আমরা তকালীন আন্দোলনের প্রবাহকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারিনি। তাই বুর্জোয়াব্যবস্থা যেখানে আক্রমণস্থল সেখানে আমাদের কর্মকাণ্ডের ফলে আন্দোলনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় তৎকালীন সরকার, বিশেষত সরকার প্রধান (ব্যক্তি)।” অন্যত্র তিনি বলেন : ভুল মানুষ মাত্রই করে, কিন্তু সে-ই বুদ্ধিমান যে কম ভুল করে এবং ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। ১৭ই মার্চ, ১৯৭৪-এ আমরা যে ভুল করেছি তার মাশুল আমরা এখনও যােগাচ্ছি। ১৭ মার্চের আন্দোলন মূল্যায়ন করে জনাব সাদী আরও বলেন:২০ আত্মসমালােচনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমরা যদি আমাদের অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, আমরা সব সময়ই এমন সব কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যেসব কাজ করার আপেক্ষিক যােগ্যতা আমাদের ছিল না। আমরা কখনও শক্রর শক্তির সাথে তুলনামূলকভাবে নিজেদের শক্তিটুকু যাচাই করে দেখার চেষ্টা করিনি। বরং মাঠে-ময়দানে, স্লোগানে, মিছিলে আমরা এমন বক্তব্য রেখেছি, যাতে নিজেদের শক্তি সম্বন্ধে নিজেদেরকে এবং সঙ্গে সঙ্গে জনগণকেও ভাওতা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে আমাদের সমর্থন যেভাবে বেড়েছে, মাঠ-ময়দানে গরম বক্তৃতা দিয়ে যেভাবে আমরা হাততালি পেয়েছি, তাতে করে বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে গেছি। বুঝতে পারিনি এই সমর্থন ছিল নেতিবাচক।…১৭. আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ১৫-১৬ কার্যকরী সাধারণ সম্পাদকের রাজনৈতিক রিপােট, দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলন, ১৯৮০, পৃষ্ঠা ১৫ আত্মসমালােচনা দলিল ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ২০ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৮, ৮০ জাসদের দুর্ভাগ্য যে, মুজিব সরকারকে উৎখাত করার জন্য তারা যে জনসমর্থন পেয়েছিল বলে দাবি করে তা ১৫ আগস্ট মােশতাককে ও ৭ নভেম্বর জিয়াকে বেছে নেয়, কখনই তাদেরকে নয়এই সমর্থন আমাদের প্রতি জনগণের আস্থা সৃষ্টি হওয়ার কারণে নয়। আমরা বুঝতে পারিনি এই ক্ষোভ বিশেষ এক বুর্জোয়া দলের প্রতি, সমগ্রভাবে বুর্জোয়াশ্রেণী বা বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রতি নয়। যাইহােক, এই নেতিবাচক সমর্থন থেকে ইতিবাচক শক্তি গড়ে তােলা এবং তার ইতিবাচক সমর্থন সৃষ্টি করার যে-কাজটুকু করার ছিল এবং তারজন্য যে সময়টুকু নেওয়ার প্রয়ােজন ছিল, তার জন্য অপেক্ষা না করে আমরা ঐ নেতিবাচক সমর্থনকে পুঁজি করে শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হই। উনিশশাে চুয়াত্তর সালের ১৭ই মার্চের ঘটনার মধ্য দিয়ে এর চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে।… মােটামুটি উনিশশাে চুয়াত্তরের ১৭ই মার্চ পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন এবং বিশেষ করে ১৭ই মার্চের ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব, আমাদের আন্দোলনে প্রায় সর্বত্রই একটা বামপন্থী হঠকারী ঝোঁক ছিল এবং এই ঝোকটি শুধু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিসমষ্টির মধ্যেই নয় বরং পার্টির কেন্দ্রসহ সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করেই এটা বিরাজমান ছিল। ১৭ মার্চের গােলাগুলিতে কর্মীদের হত্যা ও নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে পরদিন হরতাল আহূত হলেও তা সফল হয় না। এর পর জাসদকে আর খুব-একটা সভা-সমাবেশ করতেও দেখা যায় না। বেশ কিছুদিন পর ১৬ নভেম্বর ১৯৭৪ ঢাকার পল্টনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সে-সভায় সরকারের পদত্যাগের দাবি সহ ১৬-দফা দাবি পেশ করা হয়। কিন্তু এর এক সপ্তাহের মধ্যে ২৩ নভেম্বর দলের সহসাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ ও সাংগঠনিক সম্পাদক নূরে আলম জিকুকে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতার-নির্যাতনের ফলে জাসদ ক্রমে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে জনাব মাহবুবুর রব সাদীর পর্যবেক্ষণ হল: * সতেরই মার্চের পর থেকে আমাদের আন্দোলনে আরেকটা ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠল, সেটি হচ্ছে গণ-আন্দোলনের প্রতি অনীহা এবং সশস্ত্র গােপন রাজনীতির প্রতি আসক্তি। কোনাে কোনাে জায়গায় সশস্ত্র মুজিববাদীদের আক্রমণ আমাদেরকে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তুলতে বাধ্য করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজমান না-থাকলেও উপর্যুপরি কেন্দ্রীয় নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে আমরা আন্দোলনকে সশস্ত্র কার্যকলাপের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করি। উল্লেখ্য, ১৭ মার্চের ঘটনার পর প্রকাশিত সাম্যবাদের’ ২য় সংখ্যায় মাও। সেতুং-কে উদ্ধৃত করে বলা হয়, দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। এখানে সংগ্রাম অর্থ যুদ্ধ আর সংগঠন মানে সেনাবাহিনী।’ এ-কথার সাথে সঙ্গতি রেখে গড়ে উঠতে২২ মাহবুবুর রব সাদী, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮২ ২৩ নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২থাকে ‘গণবাহিনী’। গােটা এই প্রক্রিয়াটা চরমে গিয়ে ঠেকে ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলিতে। আত্মসমালােচনা দলিলেও এর স্বীকৃতি পাওয়া যায় এবং সেখানে এর সমালােচনা করে বলা হয় :২৯ গণবাহিনী গড়ে উঠতে লাগল।… ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ নেই বলেই গণবাহিনী সদস্য সংগ্রহ করতে লাগল গণসংগঠনগুলাে থেকে এবং এভাবে সংগঠনসমূহের মৃত্যু ঘটতে লাগল। পার্টি প্রক্রিয়ার মূল দুর্বলতা মূলত এখানেই এবং এভাবেই। কারণ যেভাবে পার্টি গড়ে উঠছিল, তাও হয়ে পড়ল গণসংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন শক্তি। আজকে যেভাবেই এটাকে ব্যাখ্যা দিই না কেন, সংশ্লিষ্ট সকলেরই জানা আছে গণবাহিনীর জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে গণসংগ্রামের অভ্যন্তর থেকে হয়নি। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে তথা আমাদের সাথী সংগঠকদের কাছে শক্তি ছিল। মুজিবী স্বৈরশাসনের বিপক্ষে রাজনৈতিক মহল এমনকি জনগণের বেশ বড় রকমের একটা অংশে একটা প্রতিরােধ গড়ে উঠুক এ প্রত্যাশা ছিল। এরকম মুহূর্তে গণসংগ্রামে ছেদ ঘটিয়ে বা গণআন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েই গড়ে উঠেছিল গণবাহিনী। … এই ছেদ ঘটানাের বক্তব্যটি (১৭ই মার্চের ঘটনার পর থেকে গণআন্দোলনে ছেদ ঘটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নিয়ােজিত হওয়া-লেখক) একটি মৌলিক ভুল। সে ভুলের ভিত্তিতে যে নতুন ধরনের সংগঠনসমূহ গড়বার চেষ্টা করা হল, গণআন্দোলনের অনুপস্থিতিতে তা গণসংগঠনসমূহকে খেয়ে ফেলল। নিজেও সাধারণ অর্থে বিকশিত হতে পারল না।আগস্ট কুমূল্যায়ন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে সামরিক কু-এর মাধ্যমে উৎখাত করা হয়। এ প্রসঙ্গে জনাব সাদী বলেন: বাকশাল বিরােধী জনগণের নেতিবাচক সমর্থনকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ মুজিবের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন পুষ্ট মােস্তাক-চক্র।যেহেতু জনগণের ক্ষোভ বুর্জোয়াশ্রেণীর বিরুদ্ধে, বা বুর্জোয়া সমাজের বিরুদ্ধে নয় বরং একটি বিশেষ বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে, সেইহেতু সেই বিশেষ সরকারটির পরিবর্তনেই জনগণ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল এবং আরাে কিছুদিন ধৈর্য ধরে পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। আমরা আমাদের নেতিবাচক সমর্থন বিপুল পরিমাণে হারালাম।২৪. আত্মসমালােচনা দলিল, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা ২০-২৪। ২৫. মাহবুবুর রব সাদী, পূর্বোক্ত, বাংলাদেশের সামাজিক বিকাশ ও সমাজ বিপ্লব, পৃষ্ঠা ৮৩-৮৪জনাব শাজাহান সিরাজের রিপাের্টের ভাষাও প্রায় অনুরূপ: তাই পরবর্তীকালে ১৫ আগস্ট ব্যুদেতার মাধ্যমে মুশতাক ক্ষমতা দখল করলে জনতা তাকেই সমর্থন যুগিয়ে যায়। মুজিবের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই জনগণের প্রয়ােজন আপাতত ফুরিয়ে যায়! কিন্তু কর্নেল তাহের এর বিপরীত মনােভাব পােষণ করেন। ১৫ আগস্ট সকালে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির এক অফিসার মেজর রশিদের পক্ষে ফোনে মুজিবের হত্যাকাণ্ডের খবর দিয়ে তাকে বাংলাদেশ বেতার ভবনে যেতে বলেন। ১৫ আগস্টের ব্যু সম্পর্কে তার ভাষ্য হল : আমি তখন রেডিও চালিয়ে দিয়ে জানতে পেলাম, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খন্দকার মােশতাক ক্ষমতা দখল করেছে। এই খবর শুনে আমি যথেষ্ট আঘাত পাই। আমার মনে হলাে এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। এমনকি জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।… ১৭ই আগস্ট এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এই ঘটনার নেপথ্য-নায়ক। আমি আরও বুঝতে পারলাম যে, এর পেছনে খােন্দকার মােশতাকসহ আওয়ামী লীগের উপরের তলার একটা অংশও সরাসরি জড়িত। এই চক্র অনেক আগেই যে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করে নিয়েছিল সেটাও আর গােপন রইল না। সেদিন থেকেই আমি বঙ্গভবনে যাওয়া বন্ধ করি ও এই চক্রের সাথে সব যােগাযােগ ছিন্ন করি।” পরবর্তীকালে মেজর জলিল মুজিবের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন : শেখ সাহেবের মৃত্যুটা হচ্ছে একটা ট্রাজেডি। ইটস এ ট্রাজেডি ফর দ্য নেশন। শেখ সাহেবের ইমেজ এই জাতি ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু সবচেয়ে বড় ট্যাজেডি হল আমরা তা ব্যবহার করতে পারিনি। শেখ সাহেবের মৃত্যুর জন্য তিনি যতটা দায়ী, আমার মনে হয় জাতি হিসেবে আমরাও কম দায়ী নই। জাতীয়তাবাদী চেতনাটার যেভাবে মৃত্যু ঘটল, তা আমি সহজে মেনে নিতে পারি না। এখনও মেনে নিতে পারছি না। ইতিহাস শেখ সাহেবকে মহানায়ক হিসেবে, আমার মনে হয় সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করবে।”২৮ দ্বিতীয় সম্মেলনের রাজনৈতিক রিপাের্ট, ১৯৮০ পৃষ্ঠা ১৫ লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব তাহেরের শেষ কথা (অনুবাদ : মুনীর হােসেন), কর্ণেল তাহের সংসদ, ঢাকা, ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ১৩৩-৩৫ যে-সময়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছিল ঠিক সে-সময়ে (১৫ আগস্ট ভােরে) আমেরিকান দূতাবাসের কয়েকটি গাড়ী শহরের চতুর্দিকে ছােটাছুটি করছিল। আর পাকিস্তান হত্যাকাণ্ডের এক ঘণ্টার মধ্যেই মােশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দেয় তবে ঘাতকদের সাথে তাহেরদের সম্পর্কটি বুঝা যায় রশিদ কর্তৃক তাহেরকে ১৫ আগস্ট মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব ও সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে লে. কর্ণেল জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে মােশতাকের জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করার মধ্য দিয়ে। সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ ১৮ এপ্রিল ১৯৮০, (সাক্ষাৎকার), পৃষ্ঠা ৩৬সিপাহী ব্যু মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলৎস’র ভাষ্যমতে, মুজিবের উৎখাতের কয়েক মাস আগে থেকেই জাসদ এক সার্বিক গণঅভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্তন গেরিলা সৈনিক সমবায়ে গঠিত ‘বিপ্লবী গণবাহিনী ও কার্যরত সৈনিকদের গােপন সংগঠন ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জাসদের এই দুই সশস্ত্র শাখা নিয়ে গােপন সামরিক অধিনায়ক তাহেরের নেতৃত্বে এই প্রস্তুতি চলছিল। ১৯৭৬ সালের মার্চএপ্রিলের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার কথা ছিল। তারা ভেবেছিলেন, এই সময়ের মধ্যে শুধু যে তাদের সামরিক সংগঠনগুলােই উপযুক্ত হয়ে উঠবে তা নয়, সেই সাথে শহরে ও গ্রামে তাদের গণসমর্থনকে তারা আবার সংগঠিত করে তুলতে পারবেন। কিন্তু ঘটনার গতি-প্রকৃতি তাদের তাড়াহুড়াে করে কাজ করতে বাধ্য করেছে। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ভাের ৪টায় অভ্যুত্থান ঘটানাের প্রস্তুতিতে খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে সৈনিকরা সেনাবাহিনী প্রধান মে. জে. জিয়াউর রহমানের বাসভবনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছে। জিয়া ঘুম থেকে জেগে অবস্থা বুঝে নারায়ণগঞ্জে কর্নেল তাহেরকে ফোন করে তার বিপন্ন জীবন রক্ষার অনুরােধ করেন। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই লাইন কেটে যায়। পরদিন ৪ নভেম্বর বিকালে জিয়া তার এক আত্মীয়কে তাহেরের বাসায় পাঠিয়ে পুনঃ অনুরােধ করেন, তিনি (তাহের) যেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে তার প্রভাব কাজে লাগিয়ে জিয়াকে মুক্ত করেন এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেন। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও সব ধরনের অপকর্মের অবসান ঘটানাের প্রতিশ্রুতি দেন। পঁচাত্তরের মধ্য-আগস্টের অভ্যুত্থানের পটভূমি ও ফলাফল সম্পর্কে ললিফশুলৎস বলছেন: ১৯৭৪ সালটা ছিল বাংলাদেশের জন্য বিপ্লবী বাম’-এর বছর। জাসদ আর সর্বহারা পার্টি থেকে শুরু করে মাওলানা ভাসানী আর তােয়াহার সাম্যবাদী দল-সবাই এক সাথে, এক সুরে ক্ষয়িষ্ণু ও অসাধু মুজিব সরকারের ওপর ক্রমবর্ধমান জনঅসন্তোষ অত্যন্ত স্বার্থকভাবে তুলে ধরছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যদিও বামপন্থী দলগুলােই প্রকাশ্য আন্দোলন আর গােপন তৎপরতার ভেতর দিয়ে গণবিদ্রোহের এক নতুন পটভূমি প্রস্তুত করেছিল, কিন্তু সময় আসলে ডানপন্থীরা ধূর্ততার চরম (পরাকাষ্ঠা) দেখিয়ে সুযােগ ছিনিয়ে নিল। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী পনের আগস্টের সকালে জেগে উঠে জানলে মাত্র ছয়জন আর্মি মেজর আর তাদের অধীনস্থ সৈন্যদের অস্ত্রে পরিবারের প্রায় ৪০ জন সদস্যসহ শেখ মজিবুর রহমান৩১. লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব তাহেরের শেষ কথা, পৃষ্ঠা ১৪। উল্লেখ্য, সামরিক ট্রাইব্যুনালে অনুষ্ঠিত বিচারে তাহেরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগসমূহের অন্যতম ছিল ১৯৭৪ সালের জুলাই থেকে আইনসিদ্ধ বৈধ সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করা। (লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৫) লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা উনিশ (বাংলা সংস্করণের ভূমিকা) লরেন্স লিফশলুৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩ ও ১৩৭ লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৩নিহত হয়েছেন। বিনিময়ে দেশকে দেবার মতাে তেমন কোন উপহার ছিল না ছয় মেজরের হাতে। কেবল মুজিবের দল আওয়ামী লীগের অতি ডানপন্থী রাজনীতিক খােন্দকার মােশতাক আহমেদ আর পাকিস্তান আমলের পুরনাে সেই নীতি-রাষ্ট্রের ভিত্তি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, আমেরিকা হল যার সামরিক ও অর্থনৈতিক ভরসা। আয়ুব খানের মতােই এরাও সােভিয়েত সমর্থিত ভারতীয় আগ্রাসনবাদের প্রতি পিকিং(ওয়ালা)দের গাত্রদাহ মনােভাবকেই দাবার খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করল।সে সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে কর্নেল তাহেরও প্রায় অনুরূপ মনােভাব পােষণ করতেন। তার ভাষায়:৩৬… মােশতাক সরকার জনগণকে মুজিব সরকারের চাইতে কোন ভাল বিকল্প উপহার। দিতে পারে নি। পরিবর্তন হয়েছিল শুধু এই রুশ-ভারতের প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত হয়ে দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে ঝুঁকে পড়েছিল। এছাড়া দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল আগের মতই। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্যদিকে রাজনৈতিক নিপীড়ন আগের থেকেও বেড়ে গিয়েছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অত্যাচারের প্রবৃত্তি যেন দিন দিন বেড়েই চলছিল। জনগণের দুর্ভোগ ও হয়রানি আগের মতােই চলতে থাকে, রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার অব্যাহত থাকে। সত্যিকার অর্থে দেশ তখন একটা বেসামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে সামরিক-আমলাতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়ে গিয়েছিল। মানুষ অস্থির হয়ে উঠে। তারা এই অবস্থা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। রুশ-ভারতের চর আর জনতার কাছে অগ্রহণযােগ্য অসামাজিক শক্তিগুলাে পরিস্থিতির সুযােগ নেয়ার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। মােশতাক সরকারের ব্যর্থতার সুযােগে আমাদের জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করার জন্য একটা ষড়যন্ত্র গড়ে উঠে। এই চক্রান্তের নায়ক ছিলেন উচ্চাভিলাষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ। প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পঁচাত্তরের তেসরা নভেম্বর খালেদ মােশাররফ ক্ষমতায় আসেন। খালেদ মােশাররফের অ্যুত্থানের দিনই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য বেশ কিছু। সিপাহী, এনসিও (নন-কমিশনড অফিসার) এবং জেসিও (জুনিয়র কমিশনড অফিসার)।৩৫. ল, লিফশুলৎস অ্যুত্থানকারী ছয় মেজরের কথা উল্লেখ করলেও তাদের নাম উল্লেখ করেন নি। অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস তার বাংলাদেশ এ লেগেসি অব ব্লান্ড’ -এ সাত মেজরের নাম উল্লেখ করেন। এরা হলাে : ১. ফারুক রহমান, ২. খন্দকার আব্দুর রশিদ, ৩. শরিফুল হক (ডালিম), ৪, বজলুল হুদা, ৫, আব্দুল আজিজ পাশা, ৬. শাহরিয়ার রশিদ খান ও ৭. নূর চৌধুরী। হত্যা মামলায় এরা ছাড়াও আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল ১. মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), ২, রাশেদ চৌধুরী, ৩, মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), ৪, আহমেদ শরিফুল হােসেন প্রমুখসহ অন্যান্য কয়েকজন। একই সাথে নিহত লােকের সংখ্যাও ৪০ নয়, ২০ জন। ল, লিফশুলস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫-৩৬ তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাসায় হাজির হয়। আরেকটি বিদ্রোহের জন্য শুরু হয় সামরিক-প্রক্রিয়াকরণ। তাহেরের নির্দেশনায় ৪ থেকে ৬ নভেম্বর প্রতি রাতে জুনিয়র অফিসার আর সেপাইদের মধ্যে গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাস ও শহর এলাকায় হাজার হাজার প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়। অ্যুত্থানের ডাক হিসেবে বারাে দফা দাবি পেশ করা হয়। ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকার সব সেনা ইউনিটের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে ও তাহেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় অ্যুত্থান পরিকল্পনাকে দু’ভাগে ভাগ করে কার্যকর। করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং অন্যান্য সেনানিবাসেও সতর্কতার সাথে জানিয়ে দেয়া হয়। যে, ৭ নভেম্বর ভাের একটায় সিপাহী অভুত্থান শুরু হবে। সভার সিদ্ধান্তসমূহ ছিল :১. খালেদ মােশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, ২. বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা, ৩. একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা, ৪. দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তিদান, ৫. রাজনৈতিক কর্মীদের উপর থেকে গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার, ৬, বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন ও ৭. বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বারাে দফা দাবি মেনে নেয়া ও তার বাস্তবায়ন করা। জাসদের পক্ষ থেকে এই অভ্যুত্থান সংঘটনের পক্ষে পরিপ্রেক্ষিত ও যুক্তি দেখিয়ে বলা হয় : খালেদ মােশাররফ আর তার সহযােগীরা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে ইন্দোসােভিয়েত প্রভাব বলয়ের বিস্তার ঘটাবার কাজে ব্যাপৃত হয়। আওয়ামী লীগ আর তার লেজুড়ে মণি-মােজাফফর চক্র প্রকাশ্যে বের হয়ে এসে শেখ মুজিবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে আত্মনিয়ােগ করে। এরই মধ্যে দেশের সেনাবাহিনী বিশেষ করে জোয়ানরা তাদের অফিসারদের মধ্যে ক্ষমতার লালসা আর নিজেদের উচ্চাকাক্ষা চরিতার্থ করতে সাধারণ সিপাহীদেরকে পুতুলের মতাে ব্যবহার করতে দেখে ভেতরে ভেতরে রােষায়িত হয়ে উঠছিল। পাঁচই নভেম্বরে প্রকাশিত ও ঢাকা সেনানিবাসে প্রচারিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার প্রচারপত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তাদের মনােভাব। পরদিন রাত্রিতে বিপ্লবী গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা। যৌথ সভায় চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যারাক থেকে বের হয়ে এসে খালেদ মােশাররফ চক্রের পতন ঘটাতে।… যে সব কারণে এই সংঘাতে জড়ানােটা জরুরি। হয়ে পড়ে তা হচ্ছেপ্রথমত : এর মাধ্যমে বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার সবচেয়ে সক্রিয়, সংগঠিত ও স্বেচ্ছাচারী সামরিক চক্রের ঐক্যে ফাটল ধরানাে,”৩৭. ললিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩,১৪, ৭৪, ১৩৬ ও ১৩৮রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক রিপাের্ট : ৭ই নভেম্বর ও পরবর্তী ঘটনাবলী, সাম্যবাদ, ৪র্থ সংখ্যা, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ১৩-১৪। উদ্ধৃত ; ল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৭৪-৭৫দ্বিতীয়ত : বুর্জোয়া শক্তির সাংগঠনিক ক্ষমতা একেবারে পঙ্গু করে দেয়া, তৃতীয়ত : জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রধান পৃষ্ঠপােষক সব রকমের সাম্রাজ্যবাদী, সংশােধনবাদী, আধিপত্যবাদী শক্তিকে দুর্বল করে দেয়া, চতুর্থত নতুন আইনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির যতদূর সম্ভব পুনঃপ্রচলন করে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কবর রচনা করা ও পঞ্চমত : বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমান্তরালে সর্বহারা শক্তিগুলাের রাষ্ট্র ও রাজনীতির শক্তিভিত গড়ে তােলা। সব কিছুই পরিকল্পনামাফিক হয়। বেতার, টিভি, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পােস্টঅফিস, বিমানবন্দর ও অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলাে প্রথম আঘাতেই দখল করা হয়। ভােররাত্রে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদরদপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান ও ট্রাক ভর্তি সেনা সমভিব্যাবহারে কর্নেল তাহের তাের তিনটার দিকে সেখানে উপস্থিত হলে এক আবেগপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। নৈশপােশাক পরিহিত জিয়া তাহের ও তার ভাইকে। গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেন, জীবন বাঁচানাের জন্য পানি ভর্তি চোখে কৃতজ্ঞতা জানান। সিপাহীরা জিয়ার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিলে জিয়া তা খুলে নিয়ে এই লােকই মালা পাওয়ার যােগ্য বলে তাহেরের গলায় পরিয়ে দিয়ে জাসদ বা তাহের যা বলবেন তিনি তা-ই করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। ভাের চারটায় তাহের ও জিয়া একসাথে বেতার ভবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে দু’জনে যে সব তাৎক্ষণিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলােচনা করেন তার একটি হলাে সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে সেনা-জনসমাবেশে উভয়ের ভাষণদান। পরে জিয়া “তিনি একজন সৈনিক, তার গণজমায়েতে বক্তৃতা দেয়া সাজে না’ বলে শহীদ মিনারে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ঐ কর্মসূচি বাতিল করা হয়। | স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়া ও তাহের উভয়ই ১১ নং সেক্টরে যুদ্ধরত ছিলেন। সে সময় বিভিন্ন কৌশলগত প্রশ্নেও উভয়ই এক মত পােষণ করতেন। ফলে উভয়ের মধ্যে একটি প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে যা যুদ্ধের পরেও কিছু টানাপােড়েন সত্ত্বেও টিকে ছিল। যে জন্য খালেদ মােশাররফের অভ্যুত্থানে বন্দি জিয়া মুক্তির জন্য তাহেরের সাথে যােগাযােগ করেন। নভেম্বরের অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানকালে সম্ভবত উভয়ই একে অপরকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ব্যবহার করতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন। জিয়ার সাথে নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত জনৈক জাসদ নেতার মতে : আমরা তার (জিয়ার) সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখতাম।… আমরা ধরে নিয়েছিলাম। উপযুক্ত সময় আসলে জিয়া হয়তােবা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করবেন।… পরে৩৯. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের মতে, উপস্থিত অন্যান্য অফিসারগণ নিরাপত্তার কারণে জিয়াকে তাহেরের সাথে রেডিও অফিসে যেতে দেন নি। তখন একটি রেকর্ডিং ইউনিট নিয়ে এসে তার ভাষণ রেকর্ড করে প্রচার করা হয়। বিকালে জিয়া রেডিও অফিসে যান এবং ১২ দফায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন।প্রমাণিত হয় এটা ছিল একটা মস্তো বড় ভুল। ৪০ অভ্যুত্থানের প্রথম পর্ব সফল হলাে। খালেদ মােশাররফ ও তার সহযােগী অফিসারদের উৎখাত ও হত্যা করা হলাে। বেলা ১১টার দিকে সেনা সদর দপ্তরে তাহের, জিয়া, তাওয়াব, এম, এইচ, খান, খলিলুর রহমান, ওসমানী ও মাহবুব আলম চাষীর উপস্থিতে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়ে যে, সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন এবং তিনি। জিয়া, তাওয়াব ও এম.এইচ, খানকে উপ-প্রধান সামরিক প্রশাসক করে একটি উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করবেন। সেই সথে সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে।বিকালে জিয়া সিপাহীদের ১২ দফা মেনে নিয়ে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করেন। বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি সায়েম জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তার সরকারের করণীয় সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। পরদিন মেজর জলিল ও আ.স.ম. রব প্রমুখকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেয়া হয়। অভ্যুত্থানের মূল লড়াই ঢাকায় সংঘটিত হলেও ৭ ও ৮ নভেম্বর দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে বিশেষ করে চট্টগ্রাম, রংপুর, কুমিল্লা, যশােরে তা ছড়িয়ে পড়ে। উন্মত্ত সিপইদের হাতে অসংখ্য অফিসার প্রাণ হারায়। অনেক অফিসার লুকিয়ে সেনানিবাস ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচায়। এমতাবস্থায় ৯ নভেম্বর বায়তুল মােকাররমে জাসদের পূর্বানুমতিপ্রাপ্ত সমাবেশ পুলিশ এসে ভেঙ্গে দেয়। এখান থেকেই শুরু হয় জিয়া-জাসদ দ্বন্দ্ব। | বলা অসঙ্গত হবে না যে, সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবির বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করেই এ দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ। কলকাতার সাপ্তাহিক ফ্রন্টিয়ার এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা সতের (বাংলা সংস্করণের ভূমিকা)। প্রসঙ্গত, পরে এ মূল্যায়ন ভুল প্রমাণিত হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ৭ নভেম্বর সকালে সৈনিক সংস্থার সদস্যরা ট্রাকে চড়ে সেনানিবাস ছেড়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে ও ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই, খুনী অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান দিতে দিতে ঢাকা শহর প্রশিক্ষণ করে। শহরের জাসদ কর্মী-সমর্থক ও ভাসমান লােকজন তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে-ট্রাক মিছিলে যােগদান করে আনন্দ প্রকাশ করে। এই মিছিলেই নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার’ স্লোগানও ফিরে আসে। এ সভায় ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের নেপথ্যে কলকাঠি নাড়িয়েছেন ও সুবিধা পেয়েছেন এমন লােকদের সাথে বিপ্লবীদের সম্মিলন ঘটেছে। তাওয়াব ও এম, এইচ, খান মাত্র তিন দিন আগে সহাস্যবদনে খালেদ মােশাররফকে মেজর জেনারেলের ব্যাচ পড়িয়ে দিতে দেখা গেছে। বিচারপতি সায়েমকে ৫ নভেম্বর খালেদ মােশাররফই রাষ্ট্রপতি নিয়ােগ করেছিলেন। প্রকৃতই সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রতি নিষ্ঠ হলে রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে উপরাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতির অবর্তমানে স্পীকারকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হতাে। সর্বোপরি সংবিধানে কোন অবস্থাতেই সাময়িক শাসন জারি বা জোর করে ক্ষমতা দখল করার কর্তৃত্ব কাউকে দেয়া হয়নি। অ্যান্থনি মাসকারনহাসের মতে, অফিসার হত্যা প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় পরের দিন অর্থাৎ ৮ই নভেম্বর। … এতে করে সেনাবাহিনীতে প্রয়ােজনের তুলনায় অফিসারের সংখ্যা শতকরা ৩০ ভাগে নেমে আসে। (বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পৃষ্ঠা-১২৪) Bangladesh State and Revolution, Frontier, Calcutta, India, 13 December 1975. উদ্ধৃত : ল. লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকেরা তাদের অফিসারদের বিরুদ্ধে এক গণঅভ্যুত্থানের আয়ােজন করে, এর মাধ্যমে ‘চর’ খালেদ মােশাররফের অপসারণই তাদের একমাত্র দাবি ছিল না। সেই সাথে তারা বারাে দফা দাবির তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নের দাবি জানায়। এই দাবি শুধুমাত্র প্রতিদিন পেটভরে ডালভাত পাবার নিশ্চয়তার দাবি না, এটা হচ্ছে একটা সংগঠিত সেনাবাহিনীতে সুপরিকল্পিত বামপন্থী ধারার বহিঃপ্রকাশ, দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এ এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। এটা হচ্ছে একটা নিয়মিত বাহিনীকে একাত্তরে গেরিলা বাহিনীতে পরিণত করার ফল, গত চার বছরে যা তিলে তিলে অঙ্কুরিত হয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। উক্ত ১২ দফা দাবির ভূমিকায় বলা হয় : শুধুমাত্র নেতৃত্ব পরিবর্তনের জন্য আমাদের এই বিপ্লব নয়… নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে এরা (ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকারী সেনাবাহিনী-লেখক) আমাদের পুতুলের মত ব্যবহার করে যাচ্ছে-পনের আগস্টের ঘটনা তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।…আজ থেকে এদেশের সেনাবাহিনী নির্যাতিত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে নিজেদের গড়ে তুলবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটনা সেরূপ ঘটেনি। অভ্যুত্থান সফল হলেও এর নেতৃত্বের কোনরূপ পরিবর্তন তাে হয়ইনি, বরং অ্যুত্থানকারীরা জিয়া কর্তৃক পুতুলের মতই ব্যবহৃত হয়েছে এবং সেনাবাহিনী নির্যাতিত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা তাে দূরের কথা বহুদিন যাবৎ তাদেরকে শাসন-নির্যাতন করেছে, এমনকি আজও পরােক্ষভাবে তা অব্যাহত আছে। অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের মতে :কর্নেল তাহের আর জাসদ বাংলাদেশের মানুষকে তাদের স্বাভাবিক ইচ্ছার বাইরে ঠেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সে কারণেই তারা ব্যর্থ হয়েছিল। আর্থিক সুবিধে আর হেয় ভাবাপন্ন ব্যাটম্যান’ প্রথা উঠিয়ে নেয়ার ফলে জোয়ানদের মনে বিপ্লবের পক্ষে সমর্থন দ্রুত লােপ পেয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট পরিপূর্ণভাবে শান্ত হয়ে পড়ে। “সিপাহী বিপ্লবের’ মূল্যায়ন প্রসঙ্গে শাফায়াত জামিল বলেন : …আসলে এতে অংশ নেয়া সৈনিকদের বেশিরভাগই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোন একটি ব্যাটালিয়নও এর মধ্যে ছিল না। … …৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি (৩ নভেম্বরের ঘটনার) কোন পাল্টা অ্যুত্থান ছিল না। মােশতাক-রশিদ-ফারুক চক্র এই পাল্টা অ্যুত্থান ঘটায় নি এবং সেজন্য তারা ক্ষমতায়ও ফিরে আসতে পারে নি। জিয়ার ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে জাসদ ও কর্নেল তাহেরই ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা চালায় ৭ নভেম্বর। সেই দিনের অভূত্থান-প্রচেষ্টায় তাদের কোন বিপ্লবী রাজনীতি সম্পৃক্ত ছিল না। সৈনিক সংস্থার ১২ দফায় বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে এমন একটি দফাও স্থান পায়নি। সবগুলােই ছিল সেনা৩৫. The Twelve Demands’, Far Eastern Economic Review, 5 December 1975. উদ্ধৃত ;ল, লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১২৬ ছাউনিকেন্দ্রিক। সেনা ছাউনিতে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে রচিত ১২ দফায় ছিল শুধু ঘৃণা, হিংসা আর বিদ্বেষ। …মাত্র ১২ ঘন্টার ব্যবধানে জিয়া এবং তার অনুগতরা জাসদ ও তাহেরের ঐ অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। জাসদ তাদের লক্ষ্য অর্জনে শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু জাসদ ও তাহেরের হঠকারিতায় এরই মধ্যে নিহত হন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সেনানীদের কয়েকজন। মূলত চেইন অব কমান্ড ও জিয়ার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তাকে সেদিন সফল হতে সাহায্য করে, তাহের ও তার রাজনৈতিক সহযােগীরা ব্যর্থ হন। জিয়া ক্ষমতা নিয়ে আমাদেরই নিযুক্ত প্রেসিডেন্টকে বহাল রাখেন। বিমান ও নৌ বাহিনী প্রধানদ্বয়ও (যারা খালেদের সঙ্গে সামরিক আইন প্রশাসনে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারে দরকষাকষি করেছিলেন) স্বপদে বহাল রইলেন। মােশতাক অপসারিত এবং ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তথাকথিত সূর্যসন্তানেরা দেশ থেকে বহিষ্কৃত হলাে। দৃশ্যপটে কেবলমাত্র খালেদ মােশাররফ রইলেন না। বাংলাদেশের কোন শহরবন্দরে বিপ্লবের কোন আলামতই পরিলক্ষিত হলাে না। তাহলে ‘বিপ্লব’ কোথায় এবং কিভাবে ঘটলাে? আমার ধারণা, ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত রাখার ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সুচতুরভাবেই এই দিনটিকে জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’রূপে ঘােষণা করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার একটি মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ। এর অবসান হওয়া প্রয়ােজন। সেই সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের বিধান করা প্রয়ােজন।” যা হােক, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ আগস্টের কু’-এর পাল্টা একটি কু’ সংঘটিত হয় এবং ৭ নভেম্বর সংঘটিত হয় তার পাল্টা সিপাহী বিদ্রোহ। এগুলাে সম্পর্কে জনাব সাদী বলেন :এরপর আসলাে ৩রা নভেম্বর। যেদিন পাক-মার্কিন সমর্থনপুষ্ট মােস্তাক সরকারকে উৎখাত করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে রুশ-ভারত সমর্থনপুষ্ট বুর্জোয়ারা ক্ষমতা দখল করল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নানা কারণে ভারতীয় আধিপত্যের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়ায় সর্বস্তরে জনগণের মধ্যে নতুন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখা দিল এবং নেতিবাচক সমর্থন পাকমার্কিন সমর্থনপুষ্ট মােস্তাক সরকারের সপক্ষে যেতে থাকল। ঠিক এমনি একটা অবস্থায় পাঁচই নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে একটি লিফলেট বিলি করা হল। এই লিফলেটের মাধ্যমেই আমরা প্রথম এই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করলাম। ঐ লিফলেটের মাধ্যমে খালেদ মােশাররফ চক্রের ক্ষমতা৫৭. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯-৫১ মধ্য-আগস্ট ১৯৭৫-এর কু’-এর সমর্থকরা খালেদ মােশাররফকে রুশ-ভারত ও আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে প্রচার করে একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও পরে প্রমাণিত হয় যে, তিনি তা ছিলেন নাদখলকে ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং দেশকে নিয়ে অফিসারদের এই ছিনিমিনি খেলার বিরুদ্ধে সিপাইদের ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থানের আহ্বান জানানাে। হয়। ঐ লিফলেট সাধারণ সিপাহীদের মধ্যে অত্যন্ত সাড়া জাগায় এবং ছয়ই নভেম্বর দিবাগত রাত্রে সৈনিক সংস্থার উদ্যোগেই অ্যুত্থান শুরু হয়। সাতই নভেম্বর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে সিপাহীদের বারাে দফা দাবির ভিত্তিতে আরেকটি লিফলেট দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য, সেনাবাহিনীর অফিসারদের সকলেই বিশ্বাসঘাতক ছিল না। তাদের মধ্যে অল্পসংখ্যক হলেও দেশপ্রেমিক অফিসার নিশ্চয়ই ছিল। আমরা আমাদের কোনাে আমলে অফিসারদের কাছে কোনাে আবেদন তুলে ধরার চেষ্টা করিনি। উপরন্তু আমরা ৭ই নভেম্বরের লিফলেটের মাধ্যমে সিপাহীদের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়ার আন্দোলন তুলে ধরি। অর্থাৎ আমরা আমাদের কার্যকলাপে সিপাহীঅফিসার দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করার চেষ্টা করি। ৭ই নভেম্বর অত্যন্ত স্বল্পসংখ্যক সিপাহী ছাড়া প্রায় সকল সিপাহীই মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আহ্বানে অফিসারদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। খালেদ মােশাররফের ক্ষমতা-দখলকে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধী রুশ-ভারত চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এর বিরুদ্ধে দশই নভেম্বর হরতালের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সাতই নভেম্বর অত্যুথান সংঘটিত হওয়ায় এই সিদ্ধান্ত কার্যকারিতা হারায়। সাতই নভেম্বরের অ্যুত্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে বিচারপতি সায়েমকে নামমাত্র প্রেসিডেন্ট রেখে বর্তমান সরকার ক্ষমতা দখল করে। সরকার জাসদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক (যথাক্রমে) মেজর এম. এ. জলিল ও আ.স.ম, রবকেও মুক্তি দান করে। কিন্তু ক্রমেই সরকারের সঙ্গে আমাদের নেতৃত্বের বিরােধ বেড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে ২৩শে নভেম্বর আবার জলিল, রব ও হাসানুল হক ইনু এবং তার পরদিন কর্নেল তাহের গ্রেপ্তার হন। সরকারের এই ধরনের আচরণের কারণ হিসেবে সরকারি বক্তব্য হচ্ছে জাসদ, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা পুনর্বার অ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার-উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আমরা আজ পর্যন্ত এ-ব্যাপারে কোনাে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরিনি। সাতই নভেম্বর ও তার পরবর্তী সময়ে আসলে কী কী ঘটেছিল তার অনেক কিছুই এখনও পর্যন্ত নেতাদের অনেকের কাছেও অজ্ঞাত। অবশেষে ছাব্বিশে নভেম্বর। ভারতীয় হাই কমিশনের ঘটনা ঘটল। যাকে আমরা দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে একটি অবিপ্লবী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করে ঘটনার নায়কদের বিপ্লবী সদিচ্ছা এবং ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। এরপর আমাদের উপর নেমে আসে নির্যাতন। খণ্ড মিছিল, লিফলেট, পােস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে-তােলার চেষ্টা করে আমরা বারবার ব্যর্থতা বরণ করি। অপরদিকে সরকারের সঙ্গে সমঝােতা সৃষ্টি করার নানারকম চেষ্টা চালিয়ে৪৯. ভারতীয় হাই কমিশনারকে হাইজ্যাক করে কর্ণেল তাহেরসহ জাসদের নেতৃবৃন্দের মুক্তিপণ হিসেবে। তাকে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়।ব্যর্থ হই। সাতই নভেম্বর এবং তার পরবর্তী সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলির সঠিক। মূল্যায়ন তুলে ধরতে হলে প্রয়ােজন সংগৃহীত সঠিক তথ্যাবলি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই সময়কার ঘটনাবলির কোনাে তথ্যবহুল বিবরণ সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা তুলে ধরতে পারিনি। এই সময় জাসদ, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কার্যকলাপ মূলত পরিচালিত হয়েছিল তৎকালীন সময়ে অবস্থিত। পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির (C.0.c.) নেতৃত্বে। তকালীন C.0.C.-নেতারা এ-ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরতে অনিচ্ছুক বা অপারগ। সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে জনাব শাজাহান সিরাজ বলেন : বস্তুত ৭ই নভেম্বর আমরা কী করতে চেয়েছিলাম তা জনগণ জানত না। কারণ আমাদের দিক থেকে এ সম্পর্কে কোনাে ধারণা জনগণকে দেয়া হয়নি। জনগণের সামনে কোনাে বক্তব্য বা দিকনির্দেশনা ছিল না।