You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

রােডে একটি ট্যাঙ্কে দেখেছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ট্যাঙ্ক থেকে নেমে মেজর মহিউদ্দীন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন হুদার সাথে কথা বলে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ফটকের সামনে যান এবং কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানকে ট্যাঙ্ক নিয়ে চলে যেতে দেখেন।
৪৬৭. পি.ডব্লিউ-১২ তার জবানবন্দিতে বলেছেন যে, ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে নাইট প্যারেড হয়েছিল, যেখানে তারা ভাের ৩.৩০টা পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন। তিনি এমন তিনজন অজ্ঞাত কর্মকর্তাকে ইউনিফর্ম পরিহিত দেখছিলেন, যাদেরকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম এবং মেজর বজলুল হুদা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান তাদেরকে বুঝিয়েছিল যে, তারা রাজতন্ত্রকে সমর্থন করতে পারবে না, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান। পরের দিন রাজতন্ত্র ঘােষণা করতে যাচ্ছেন এবং এই সব সৈন্যকে অবশ্যই তার আদেশের পাশাপাশি। তার কর্মকর্তাদের আদেশ মেনে চলতে হবে এবং কোটে থেকে গুলি নেওয়ার আদেশ প্রদান করেছিল। পি.ডব্লিউ-১২ তার সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান প্রকৃত অভিপ্রায় প্রকাশ না করেই সৈন্যদের উস্কে দিয়েছিল।
৪৬৮. পি.ডব্লিউ-১৩ নিজেও ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাতের প্যারেডে রাত ৮.৩০টায় যােগ দিয়েছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের জড়িত থাকার বিষয়ে পি.ডব্লিউ-১৪-এর মতাে এই সাক্ষী তার সাক্ষ্যের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৩ প্রথমে শেখ ফজলুল হক মনির বাড়িতে যান এবং সেখান থেকে তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে যান। অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডে আসে এবং তাদেরকে রেডিও স্টেশনে যেতে বলে। এই সাক্ষী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে বন্দুকের গুলির শব্দ শুনতে পান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের সামনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে দেখতে পান। পি.ডব্লিউ-৪৪ অন্যান্য পি.ডব্লিউ বিবৃতি সমর্থন করে বলেছেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান একটি ট্যাঙ্কে ছিল।
৪৬৯. পি.ডব্লিউ-১৪ ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের উপস্থিতি বর্ণনা করে করেছেন। তিনি প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন, লেফটেন্যান্ট কিসমত হাশেম, নাজমুল হােসেন আনসার এবং সিভিল পােশাকে আরাে কিছু ব্যক্তিকে দেখেছিলেন। অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান সিভিল পােশাকের লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার ও মেজর ডালিমকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান তাদেরকে আদেশ মানতে নির্দেশ দেয়। পি.ডব্লিউ-১৪ রেডিও স্টেশনে সকাল ৫.৩০টার দিকে অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। পি.ডব্লিউ-১৪ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এই অভিযানের দায়িত্বে ছিল এবং তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের একত্র করেছিল। পি.ডব্লিউ-২০ ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জামানের গাড়িচালক এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য বঙ্গভবনে ডেকে আনা হয়, যেখানে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক। রহমান, মেজর ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান এবং অন্যদেরকে দেখেছিলেন।
৪৭০. পি.ডব্লিউ-২৩ বলেছেন যে, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাতে তিনি প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। পরিষ্কার করা দশটি ট্যাঙ্কের কথাও তিনি বলেছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান সেখানে এসে
৬০১

লেফটেন্যান্ট কিসমত হাশেমের সাথে কথা বলেছে। ভাের প্রায় ৩.০০/৩.৩০ মিনিটের দিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান আবার বালুরঘাটে ফিরে আসে এবং তার আদেশে কর্মকর্তা ও সৈন্যদল তাদের নিজ নিজ ট্যাঙ্কগুলিতে আরােহণ করে। পি.ডব্লিউ-২৩-এর মতে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান প্রায় ৪.০০/৪.৩০ মিনিটের দিকে ট্যাঙ্ক নিয়ে চলে যায়। পি.ডব্লিউ-২৩ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান তার ল্যান্সার রেজিমেন্ট সংগঠিত করেছে এবং তার প্রকৃত অভিপ্রায় প্রকাশ না করেই অভিযান শুরু করে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করার জন্য ট্যাঙ্কসহ সৈন্যদের নগরীর বিভিন্ন স্থানে মােতায়েন করতে সফল হয়।
৪৭১. এছাড়া পি.ডব্লিউ-২৪ তার জবানবন্দিতে ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দিবাগত রাতের ভাের ৩.০০/৩ প্যারেড সম্পর্কে বলেছেন, যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান তাদের সিও, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং অন্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে তাদের ব্রিফ করেছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা যেমন মেজর ডালিম, মেজর রশিদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার এবং ক্যাপ্টেন মাজেদদের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ তাদেরকে ইউনিট থেকে গােলাবারুদ নেওয়ার নির্দেশ দেয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও খােন্দকার আবদুর রশিদ তাদের গুলি নিতে বলে। তিনি রেডিও স্টেশনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং অন্য কর্মকর্তাদেরও দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৫ ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের প্যারেড সম্পর্কেও বলেছেন, যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ অন্য কর্মকর্তাদের নিয়ে তাদেরকে ব্রিফ করেছিল।
৪৭২. পি.ডব্লিউ-৩৫ বলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক ঘন ঘন খােন্দকার আবদুর রশিদের অফিসে যেত। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতের নাইট প্যারেডের সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং খােন্দকার আবদুর রশিদ একত্রে রাত প্রায় ১০.০০টায় খােন্দকার আবদুর রশিদের কার্যালয়ে আসে এবং কিছু সময় পরে তারা চলে যায়। ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে তিনি বালুরঘাটে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। তিনি দেখেছিলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান পরামর্শের আগে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছিল এবং সৈন্য উদ্দেশ্যে কথা বলছিল এবং তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে তাদেরকে উস্কে দিচ্ছিল।
৪৭৩. পি.ডব্লিউ-৩৯ ছিলেন ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার রেজিমেন্টের গাড়িচালক। তিনি ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ৭.৩০টার নাইট প্যারেডের কথাও বলেন। তার মতে, মধ্যরাত ১২.০০টা অবধি প্যারেড অব্যাহত ছিল। তবে পরে রাত ২.০০/২.৩০টা অবধি প্যারেড অব্যাহত রাখার জন্য একটি আদেশ দেওয়া হয় এবং রাত ২.৩০ মিনিটে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক এবং জেসিওসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এই বক্তব্য দিয়েছিল যে, দেশের জরুরি প্রয়ােজনে তাদের একটি বিশেষ দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব পালনকালীন অবস্থায় তিনি (সাক্ষী) বঙ্গভবনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে দেখেন।
৪৭৪. পি.ডব্লিউ-৪০ ও ১৪ আগস্ট দিবাগত মধ্যরাত ১২.০০টার প্যারেড সম্পর্কে বলেছেন, যদিও তিনি ছুটিতে ছিলেন এবং বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান
৬০২

এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ এলএমজি সংযুক্ত জিপের পাশে কথা বলছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান পি.ডব্লিউ-৪০-কে এই রেজিমেন্টের দিকে নজর রাখতে বলেছিল। এক প্রশ্নের জবাবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান বলে, তারা মজিব সরকারকে উৎখাত করতে যাবে। জেনারেল শফিউল্লাহ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে চিনতেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি (সাক্ষী) বলেন, জেনারেল শফিউল্লাহকে জানানাের প্রয়ােজন মনে করেননি। তিনি ট্যাঙ্ক যােজনের কাজে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদের মধ্যে আলােচনা করতে দেখেছেন।
৪৭৫. পি.ডব্লিউ-৪৪ বলেন যে, ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ভাের ৬.০০টায় দরজায় কড়া আঁকুনি দেওয়া হয় এবং তিনি দরজা খুলে গেইটের বাইরে ট্রাকভর্তি সশস্ত্র সিপাই দেখতে পান। মেজর রশিদ তখন বলেছিল, “আমরা খােন্দকার মােশতাকের অধীনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছি, শেখ মুজিব মারা গিয়েছে, আমাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবেন না।” বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি একটি জিপ পেতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাড়িতে যান এবং সেই জিপযােগ তিনি ১ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে চলে যান, যেখানে গেটে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে একটি ট্যাঙ্কে আক্রমণাত্মক অবস্থায় দেখতে পান এবং সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক সাপ্লাই অ্যান্ড ট্রান্সপাের্ট কোম্পানির লাইনযুক্ত উঁচু যানবাহন থেকে ভারী মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়েছিল। চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে যায়।
৪৭৬. প্রত্যক্ষদর্শী তথা তথ্যদাতা পি.ডব্লিউ-১ তার জবানবন্দিতে বিশদভাবে বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর পর মেজর বজলুল হুদা গেটের পাশে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে বলে, “সবাই শেষ” (“all are finished”)। এ সময় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডের রাষ্ট্রপতির বাসভবনের সামনের রাস্তায় ট্যাঙ্ক চলছিল। পি.ডব্লিউ-১ ঘটনার সময় এবং ঘটনার পরেও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং মেজর বজলুল হুদাকে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে উপস্থিত দেখতে পান।
৪৭৭. পি.ডব্লিউ-৪২ তার জবানবন্দিতে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকালে রেডিও স্টেশনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের উপস্থিতি সম্পর্কেও বলেছেন। পি.ডব্লিউ-৪৫ তৎকালীন সেনাপ্রধান তার জবানবন্দিতে বলেন যে, ১৯৭৫ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের টু-আইসি ছিল। তিনি বলেন যে, ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান ছিল এবং ১৯ আগস্ট তিনি ফরমেশন কমান্ডারদের একটি সভা আহ্বান করেছিলেন এবং সেই সভায় মেজর রশিদ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান উপস্থিত ছিল।
৪৭৮. উপরােক্ত সাক্ষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ৩২ নম্বর রােডের রাষ্ট্রপতির বাসভবনে সংঘটিত অপরাধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের জড়িত থাকা, ঘটনার সময় তল্কালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবনের কিছু স্থানে তার উপস্থিতি এবং বালুরঘাট প্যারেড গ্রাউন্ড, নতুন বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চল, শাহবাগের রেডিও স্টেশন এবং বঙ্গভবনসহ নির্ধারিত স্থানসমূহে অস্ত্র ও গােলাবারুদসহ সেনা সমাবেশ ঘটানাের বিষয়গুলাে আসামিপক্ষ কর্তৃক খণ্ডিত হয়নি। সুতরাং, অভিযুক্ত-আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান পেনাল কোডের ৩০২, ৩৪ এবং ১২০বি ধারার অধীনে অপরাধ করেছে মর্মে প্রসিকিউশন যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমাণ করেছেন।
৬০৩

৪৭৯. লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)।
বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং রেসপন্ডেন্ট পক্ষের বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব আনিসুল হক কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন, যথা: পি.ডব্লিউ-১৬, পি.ডব্লিউ-১৭, পি.ডব্লিউ-১৮, পি.ডব্লিউ-২১, পি.ডব্লিউ-২২, পি.ডব্লিউ-২৪, পি.ডব্লিউ-২৫, পি.ডব্লিউ-২৬, পি.ডব্লিউ-২৭, পি.ডব্লিউ-২৯, পি.ডব্লিউ-৩২, পি.ডব্লিউ-৩৪ ও পি.ডব্লিউ-৩৫ এবং দাবি করেন যে, সাক্ষীরা অপরাধ সংঘটনে অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) সম্পৃক্ততা প্রমাণ করেছে।
৪৮০. পি.ডব্লিউ-১৭ দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের ল্যান্সনায়েক ছিলেন। তিনি বলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) তাদের কমান্ডিং অফিসার ছিল এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দিবাগত রাতে তিনি (সাক্ষী) নাইট প্যারেডেও ছিলেন এবং নাইট প্যারেডের জন্য রেজিমেন্ট গ্রাউন্ডে ৫.০০/৫.৩০টায় ফল ইন হয়েছিল। এরপর তারা ছয়টি কামানসহ সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে বালুরঘাট নতুন বিমানবন্দরে পৌঁছায়। রাতের প্রশিক্ষণ মধ্যরাত ১২.০০টা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং রাতের অনুশীলনে তিনি (সাক্ষী) মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের আলােচনা করতে দেখেন। অতঃপর তিনি পাপা ব্যাটারির কামানের পেছনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)-কে দেখেন যিনি নায়েক সুবেদার হাশেমকে কিছু আদেশ দেন। পি.ডব্লিউ-১৭ ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) কামানের সাথে। এই কামান রাত ৪.০০টায় কলাবাগান লেকের পাশে পৌঁছেছিল এবং তারপরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন। আহমেদের (আর্টিলারি) নির্দেশে কামানগুলাে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডের বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এবং উত্তরমুখী রক্ষীবাহিনীর হেড কোয়ার্টার্সের দিকে তাক করে স্থাপন করা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর তিনি (সাক্ষী) বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে হালকা অস্ত্র চালানাের আওয়াজ শুনতে পান। তারপরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) আদেশে তারা চারটি কামানের গােলা ছােড়েন এবং কিছুক্ষণ পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) আদেশে তাদের কামানগুলাে ব্যারাকে ফেরত নেওয়া হয়।
৪৮১. পি.ডব্লিউ-১৮ ছিলেন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের বন্দুকধারী (gunner) এবং তিনি পাপা ব্যাটারিতে ছিলেন। ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে তারা এম.টি. গ্যারেজের সামনে অস্ত্র-কামান রাখেন, যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) নির্দেশে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর কামানসহ তাদেরকে বালুরঘাটে নতুন বিমানবন্দরে নিয়ে যান, যেখানে রাত ১২.০০/১.০০টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ অব্যাহত ছিল। রাত প্রায় ৩.৩০/৪.০০টার দিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের বিশেষ মিশনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য বলেছিল, যেহেতু তাদের দক্ষিণ দিক থেকে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিরােধ করতে হবে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের নিজ নিজ গাড়িতে উঠতে বলে। গাড়িতে উঠার পরে তিনি চারটি কামানের গােলা এবং একটি ছােট অস্ত্র দেখতে পান এবং শেষ পর্যন্ত। | তিনি ধানমন্ডির খেলার মাঠের কাছে আসেন এবং সেখানে বিএইচএম কামালকে দেখতে পান। সেখানে তিনি তাকে বন্দুক তাক করার নির্দেশ দেন এবং দক্ষিণ দিকে রক্ষীবাহিনীকে প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। তিনি (সাক্ষী) উত্তরে যান এবং তখন ফজরের আজান চলাকালে তারা উত্তর-পশ্চিম থেকে
৬০৪

গােলাগুলির শব্দ শুনতে পান এবং কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে ৪টি কামানের গােলা নিক্ষেপের শব্দ শুনতে পান। তার কিছুক্ষণ পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) কামানগুলাে একসঙ্গে করার আদেশ দেয় এবং তারপর তিনি গাড়িতে কামান এবং ব্যক্তিগত অস্ত্রগুলাে নেন এবং কিছু সময় পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) আদেশে তার গাড়িসহ অন্যান্য গাড়ি উত্তর দিকে পাঠানাে হয় এবং গাড়িটি গণভবনের সামনে থামে, যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন। আহমেদ (আর্টিলারি) এবং অন্যরা প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান করেছিল।
৪৮২. পি.ডব্লিউ-২১ ছিলেন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির পাপা ব্যাটারির একজন সিপাহি। তিনি তার জবানবন্দিতে বলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। তিনি ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দিবাগত রাতের নাইট প্যারেডে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ রাত ২.০০টায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), মেজর খােন্দকার আবদুর রশীদ, মেজর বজলুল হুদা এবং আরাে কয়েকজন কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিল। বিশেষ জরুরি দায়িত্বের জন্য মেজর খােন্দকার আবদুর রশীদ তাদেরকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। তারা অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে একটি ট্রাকে চড়ে রাত ৪.০০/৪.৩০টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডে যায় এবং তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কাউকে যেন রাস্তা দিয়ে যেতে দেওয়া না হয়। ফজরের আজানের সময় তারা ওই স্থানের পূর্ব দিক থেকে গােলাগুলির এবং কামান চালানাের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।
৪৮৩. পি.ডব্লিউ-২২ ছিলেন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সিপাহি। জবানবন্দিতে তিনি বলেন যে, ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায় মাগরিবের পরে ফল-ইন হয়েছিল। খােন্দকার আবদুর রশিদের নির্দেশে রাত ৯.০০টায় তারা নতুন বিমানবন্দরে যান এবং রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্তে বসেছিলেন, যেখানে খােন্দকার আবদুর রশীদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন মােস্তফা, মেজর বজলুল হুদা ও আরাে কয়েকজন কর্মকর্তা ছিল। ৩২ নম্বর রােড দিয়ে কাউকে যেতে না দেওয়ার জন্য একটি আদেশ ছিল এবং কিছু সময় পরে তারা পূর্ব দিকে থেকে গুলির শব্দ এবং একই সাথে কামান চালানাের শব্দ শােনেন। পি.ডব্লিউ-২২-এর সাক্ষ্য থেকে ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাতে প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) উপস্থিতি প্রমাণিত হয়।
৪৮৪. পি.ডব্লিউ-২৭ বলেন যে, তার ব্যাটারি কমান্ডার ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং তিনি তার সাথে ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) কর্তৃক উক্ত রাস্তা দিয়ে কোনাে যানবাহন যেতে না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলে পি.ডব্লিউ-২৭ এবং ২/৩ জনকে কলাবাগানে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাত প্রায় ৩.০০/৩.৩০টার দিকে নতুন বিমানবন্দরে, কলাবাগানে এবং গণভবনে আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) উপস্থিতি পি.ডব্লিউ-২৭ প্রমাণ করেছেন।
৪৮৫. এছাড়া ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দিবাগত রাতের নাইট প্যারেডে এবং সন্ধ্যায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) উপস্থিতি পি.ডব্লিউ-৩৪ প্রমাণ করেছেন। তিনি আরাে দেখেছিলেন যে, ছয়টি বন্দুক নতুন বিমানবন্দরে নেওয়া হয়েছে। পি.ডব্লিউ-৩৪ বন্দুকের পাশে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদকে (আর্টিলারি) দেখেছিলেন এবং তিনি সৈন্যদের দেখতে বলেছিলেন যেন কেউ রাস্তা দিয়ে চলাচল না করে। পি.ডব্লিউ-৩৪ উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে হালকা অস্ত্রের আওয়াজ শােনেন। এবং তারপরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) দিক থেকে বন্দুকের শেল নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
৬০৫
৪৮৬. পি.ডব্লিউ-৩৫ তার জবানবন্দিতে বলেছেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিল। তিনি (সাক্ষী) পি.ডব্লিউ-১৮-এর কাছ থেকে শুনেছিলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) তার বেশির ভাগ সৈন্য ধানমন্ডিতে নিয়ে গিয়েছিল।
পূর্বোক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে দেখা যায় যে, মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দিবাগত রাতে নাইট প্যারেডে উপস্থিত ছিল, যেখানে সে মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং অন্যান্য কর্মকর্তার সাথে গােপনে আলােচনা করেছিল। সে কলাবাগানের লেকের পাশে রাখা কামানগুলাের দায়িত্বে ছিল, যেখানে তার আদেশ অনুসারে কামানগুলাে ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর রােডের বাসভবন এবং উত্তরমুখী রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরের দিকে তাক করা হয়েছিল। মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) অপরাধে সম্পৃক্ততার বিষয়ে পি.ডব্লিউদের সাক্ষ্যে যা উঠে এসেছে সেই অংশকে জেরার সময় চ্যালেঞ্জ করা হয়নি এবং সেই কারণে এসব সাক্ষ্য-প্রমাণ মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২, ৩৪ এবং ১২০বি ধারার অভিযােগ প্রমাণ করেছে।
৪৮৭. মেজর বজলুল হুদা
আপিলকারী মেজর বজলুল হুদার পক্ষে বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব আবদুল্লাহ-আল-মামুনের নিবেদনের জবাবে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং রেসপন্ডেন্ট-রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব আনিসুল হক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন যে, অপরাধ সংঘটনে অভিযুক্ত মেজর বজলুল হুদার জড়িত থাকার বিষয়ে বিচারিক আদালত এবং হাইকোর্ট বিভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন এবং এ প্রসঙ্গে তারা পি.ডব্লিউ-১, পি.ডব্লিউ-৪, পি.ডব্লিউ-৫, পি.ডব্লিউ-৬, পি.ডব্লিউ-৭, পি.ডব্লিউ-৮, পি.ডব্লিউ-৯, পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-১৫, পি.ডব্লিউ-২১, পি.ডব্লিউ-২২, পি.ডব্লিউ-৪২, পি.ডব্লিউ-৪৫, পি.ডব্লিউ-৪৭ এবং পি.ডব্লিউ-৬০-এর সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন। নীচে মূল সাক্ষীদের সাক্ষ্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলাে।
৪৮৮. প্রত্যক্ষদর্শী পি.ডব্লিউ-১ ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে রেসিডেন্ট পিএ এবং ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাত ৮.০০টা থেকে তার দায়িত্ব ছিল। তিনি সেখানে রাত কাটান। ১৫ আগস্ট ভাের ৪.৩০/৫.০০টার দিকে রাষ্ট্রপতি তাকে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সাথে যােগাযােগ করতে বলেছিলেন। তিনি সঠিকভাবে তা করতে না পারায় রাষ্ট্রপতি তার ঘরে নেমে আসেন। হঠাৎ তাদের জানালাগুলােতে এক ঝাঁক বন্দুকের গুলি বর্ষিত হয়। গুলি চালানাে বন্ধ হলে রাষ্ট্রপতি নিকটবর্তী সেনা ও পুলিশদের কাছ থেকে গুলি চালানাের বিষয়ে খোঁজখবর নেন। তখন শেখ কামাল নীচে নেমে আসেন। এ সময় ৩/৪ জন খাকি ও কালাে পােশাক পরিহিত আর্মি সদস্য বাসভবনে প্রবেশ করে এবং মেজর বজলুল হুদা কামালের দিকে গুলি চালালে তিনি ঘরে পড়ে যান। মেজর বজলুল হুদা তাদের ধরে ফেলায় তারা পালাতে পারেননি এবং তাদেরকে বাসভবনের প্রধান ফটকের সামনে লাইন। করে দাঁড় করানাে হয়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশেষ শাখার অফিসারকে গুলি করা হয়। এরপর কয়েকজন আসামি গুলি করতে করতে দোতলায় দিকে উঠে পড়ে। এক সময় গেটে থাকা মেজর বজলুল। হুদা লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে বলে, “সব শেষ” (“all are finished”)। তারপরে পি.ডব্লিউ-১ বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে তাঁর পরিবারের সদস্য এবং বাড়ির অন্যদের সাথে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। পি.ডব্লিউ-১-এর সাক্ষ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৫
সালের ১৫
৬০৬

আগস্ট ভােরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বেগম মুজিব, শেখ কামাল, শেখ নাসের, সুলতানা কামাল, রােজী জামাল, শেখ রাসেল এবং বিশেষ শাখার একজন পুলিশ অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পি.ডব্লিউ-১ দেখতে পেয়েছিলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং মেজর বজলুল হুদা ঘটনার সময় এবং ঘটনার পরেও তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে উপস্থিত ছিল।
৪৮৯. প্রত্যক্ষদর্শী পি.ডব্লিউ-৪ তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন যে, খুব সকালে আসছিল। পি.ডব্লিউ-৪ রাষ্ট্রপতির বাসভবনের গেটে মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদকে দেখতে পান। মেজর বজলুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী বারান্দায় উঠে আসে এবং শেখ কামালকে দেখেই অভিযুক্ত মেজর বজলুল হুদা স্টেনগান দিয়ে গুলি করে এবং পুনরায় অভ্যর্থনা কক্ষে যায়। মেজর বজলুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী পুলিশসদস্য এবং অন্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে। মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদের (ল্যান্সার) সঙ্গে মেজর বজলুল হুদা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী গুলি ছুড়তে ছুড়তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের সিঁড়িতে উঠে। এরপরে পি.ডব্লিউ-৪ দেখতে পান মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) বঙ্গবন্ধুকে নীচে নামিয়ে আনছে। পি.ডব্লিউ-৪ মেজর বজলুল হুদা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরীর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে কিছু কথা বলেছিল। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কাছ থেকে কিছু জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এর উত্তরে মেজর বজলুল হুদা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী তাদের স্টেনগান দিয়ে তাকে গুলি করে। এরপর মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ নীচে নেমে এসে গেটের বাইরে গিয়ে বাড়ির দক্ষিণে রাস্তার দিকে চলে যায়। এরপর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান (ল্যান্সার) আসে এবং ট্যাঙ্ক থেকে নামে। মেজর বজলুল হুদা ও অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাে. এ আজিজ পাশার উপস্থিতিতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান মেজর বজলুল হুদা এবং সুবেদার মেজর আব্দুল ওয়াহাব জোয়ার্দারের ব্যাজ পরিবর্তন করে দেয়। সকাল ৯.০০/১০.০০টার দিকে মেজর বজলুল হুদা পিকআপ ভ্যানে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহটি বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শী পি.ডব্লিউ-৫ ফার্স্ট ফিল্ড আর্টিলারিতে ছিলেন এবং ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবনের সুরক্ষার দায়িত্ব পি.ডব্লিউ-৪-এর কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি সাক্ষ্য দেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম তার সিও ছিল এবং মেজর বজলুল হুদা তার অ্যাডজুট্যান্ট ছিল। তাকে ঢাকায় বদলি করা হয় এবং ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত শেষে ভাের ৬.০০টা থেকে তাকে সুরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বিকেল ৫.০০/৫.৩০টার দিকে মেজর বজলুল হুদাকে ৩২ নম্বরে একটি মােটরসাইকেল চালাতে দেখেন। ভাের ৪.৪৫টার দিকে পি.ডব্লিউ-৪ তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে আসেন এবং পতাকা উত্তোলন করার সময় হঠাৎ করে দক্ষিণ দিক থেকে গুলি বর্ষিত হতে থাকে এবং ৫/৭ মিনিট পরে খাকি এবং কালাে পােশাকধারী সেনাদের সাথে মেজর বজলুল হুদা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী সেখানে আসে। পি.ডব্লিউ-৫ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলােতে পি.ডব্লিউ-১ এবং পি.ডব্লিউ-৪-এর সাক্ষ্য সমর্থন করেন। এছাড়া পি.ডব্লিউ-৫ ১৪ আগস্ট বিকেলে এবং ১৫ আগস্ট দুপুরে মেজর বজলুল হুদাকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং ৭/৮ সেনাসদস্যদের সাথে দেখেছেন।
৬০৭

৪৯০. এছাড়া পি.ডব্লিউ-৬ পি.ডব্লিউ ৪ এবং পি.ডব্লিউ-৫-এর প্রদত্ত বিবৃতির অনুরূপ বিবৃতি দিয়েছেন এবং তাদের সাক্ষ্য সমর্থন করেছেন।
৪৯১. পি.ডব্লিউ-২ এবং পি.ডব্লিউ-৩ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় তারাও পি.ডব্লিউ-১, পি.ডব্লিউ-৪,
পি.ডব্লিউ-৫ এবং পি.ডব্লিউ-৬-এর সাক্ষ্য সমর্থন করেছেন।
৪৯২. পি.ডব্লিউ-৭ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি কুমিল্লা ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টে যােগ দিয়েছিলেন। সে সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম কুমিল্লায় সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিল এবং মেজর বজলুল হুদা এ সময় অ্যাডজুট্যান্ট ছিল। প্রাসঙ্গিক সময়ে তাকে (সাক্ষী) তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবনে প্রহরীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। পি.ডব্লিউ-৭ লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিমকে এই ঘােষণা করতে শুনেছিলেন যে, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি মেজর বজলুল হুদাকে ‘মেজর’ এবং সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ার্দারকে ‘লেফটেন্যান্ট’-এর ব্যাজে দেখতে পান।
৪৯৩. পি.ডব্লিউ-৮ পূর্ব বেঙ্গল রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট (ক্যাপ্টেন) ছিলেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অবস্থা দেখে তার কাছে রিপাের্ট করার জন্য তার কমান্ডিং অফিসার তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং ১৫ আগস্ট সকাল ৮.৪৫টার দিকে ৩২ নম্বর রােডে গিয়ে পি.ডব্লিউ-৮ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে মেজর নূর এবং মেজর বজলুল হুদার সাক্ষাৎ পান। প্রশ্নের জবাবে পি.ডব্লিউ-৮ তাদের জানান যে, চিফ অব স্টাফ জেনারেল শফিউল্লাহ তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অবস্থা রিপাের্ট করার নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরে বাসভবনের ভিতর দেখানাের জন্য মেজর নূর মেজর বজলুল হুদাকে বলে এবং ক্যাপ্টেন হুদা তাদের বাড়ির ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল এবং তারপরে পি.ডব্লিউ-৮ অভ্যর্থনাকক্ষে শেখ কামালের মৃতদেহ এবং বাসভবনের ভিতরে অন্যান্য মৃতদেহ দেখেছিলেন।
৪৯৪. চিফ অব স্টাফের নির্দেশ অনুসারে পি.ডব্লিউ-৯ ১৫ আগস্ট বিকেল ৩.০০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে এসে মেজর বজলুল হুদাকে বাসভবনের গেটে দেখেছিলেন। মেজর বজলুল হুদা তাকে বাড়ির ভিতরে গিয়ে গেলে তিনি শেখ কামাল ও একজন পুলিশ কর্মকর্তার মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিলেন এবং দোতলার সিঁড়িতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃতদেহ দেখেছিলেন। আর যখন তিনি দোতলায় যান তখন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, মিসেস জামাল, মিসেস কামাল এবং শেখ রাসেলের মৃতদেহ দেখতে পান। পি.ডব্লিউ-১১ প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সারে ছিলেন এবং তিনি বলেন যে, নাইট প্যারেডে সেনা কর্মকর্তারা মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদের (ল্যান্সার) কার্যালয়ে গিয়েছিল, যা পি.ডব্লিউ-১১-এর কোয়ার্টারের বিপরীতে ছিল এবং সেখানে সিভিল পােশাকে তিনি কিছু অচেনা সেনা কর্মকর্তাকে দেখেছিলেন এবং মধ্যরাত প্রায় ১২টায় মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) সিভিল পােশাকের একজনকে “হুদা, এখানে আসেন” বলে ডাকতে শুনেছেন। তারপর হুদা বলে। “ডালিম, অপেক্ষা করেন”। রাত প্রায় ৩.৩০টার দিকে মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ নিজ দলকে ব্রিফ করে এবং গাড়িতে উঠতে বলে। পি.ডব্লিউ-১১ সিভিল পােশাকে উল্লিখিত দুই ব্যক্তিকে দেখেছিলেন যারা এখন সেনাবাহিনীর পােশাক পরা একজন ‘মেজর’ এবং অপরজন একজন ক্যাপ্টেন’। তিনি রিসালদার সারােয়ারের কাছ থেকে জানতে পারেন, তারা ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ও মেজর বজলুল হুদা।
পি.ডব্লিউ-১১ সকাল ৪.৩০টায় গাড়ি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের কাছে এসেছিলেন, যা ছিল বাসভবন থেকে প্রায় ৮০ ফুট দূরে। তিনি (সাক্ষী) রাষ্ট্রপতির বাসভবনের পাশ থেকে প্রচণ্ড বন্দুকের গুলিবর্ষণের খবর শুনেছিলেন এবং তিনি ৩/৪টি আর্টিলারি বন্দুকের গুলির শব্দও শুনেছিলেন।
৬০৮

পি.ডব্লিউ-১১কে এই নির্দেশসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটের বাইরে নিয়ােজিত করা হয়েছিল, যেন কোনাে ব্যক্তি বাসভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। এ সময় তিনি (সাক্ষী) মেজর একেএম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), লেফেটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং মেজর বজলুল হুদাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে প্রবেশ করতে দেখেন।
৪৯৫. পি.ডব্লিউ-১২ তার জবানবন্দিতে বলেন যে, ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দিবাগত রাতে নাইট প্যারেড হয়েছিল, যেখানে তারা রাত ৩.৩০টা অবধি উপস্থিত ছিলেন। তিনি পােশাক পরিহিত অচেনা তিনজন কর্মকর্তাকে দেখতে পান, যাদেরকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান পরিচয় করিয়ে দেয় লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম এবং মেজর বজলুল হুদা হিসাবে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান তাদের ব্রিফ করে যে, তাদের রাজতন্ত্রকে সমর্থন করা উচিত নয়, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান পরের দিন। রাজতন্ত্র ঘােষণা করতে যাচ্ছেন এবং সেজন্য সেনাবাহিনীকে অবশ্যই তার আদেশের পাশাপাশি তার কর্মকর্তাদের আদেশ মেনে চলতে হবে এবং এই অভিযানের জন্য কোটে’ (Kote) থেকে গােলাবারুদ নিতে নির্দেশ দেয়।
৪৯৬. পি.ডব্লিউ-২২ পি.ডব্লিউ-২১-এর প্রদত্ত বিবৃতির অনুরূপ বিবৃতি প্রদান করেছেন। তিনি (সাক্ষী) ঘটনাস্থলে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং মেজর বজলুল হুদা ও অন্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন।
৪৯৭. পি.ডব্লিউ ২১ ছিলেন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির একজন সিপাহি, যিনি বলেন যে, ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে নতুন বিমানবন্দরে তাদের নাইট প্যারেড ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাত ২.৩০টায় তাদের সিও অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং মেজর বজলুল হুদা ও অন্য কর্মকর্তারা সেখানে আসে। অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দিয়েছিল।
৪৯৮. পি.ডব্লিউ-৪৬ ছিলেন বঙ্গভবনের একজন টাইপিস্ট, যিনি বলেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গভবনে তিনি মেজর বজলুল হুদাকে মােশতাক আহমেদের সঙ্গে দেখেছেন।।
৪৯৯. পি.ডব্লিউ-৪৭ ছিলেন বিডিআর-এর পরিচালক। তিনি জবানবন্দিতে বলেছেন যে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকাল ১০.৩০টার দিকে তিনি রেডিও স্টেশনে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার ঘােষণা প্রচার শুনেছেন এবং সেখান থেকে তাকে তার সঙ্গীদেরসহ শপথ অনুষ্ঠানের জন্য বঙ্গভবনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং উক্ত অনুষ্ঠানে মেজর বজলুল হুদা, মেজর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক, মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার, মেজর ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং রিসালদার মােসলেম উদ্দিন উপস্থিত ছিল।
৫০০. মেজর বজলুল হুদাসহ অন্য ১১ জন আসামি সেনা কর্মকর্তাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে কর্মসংস্থানের জন্য তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিযুক্ত করাসংক্রান্ত সেনা সদর দফতর কর্তৃক জারিকৃত ১৬ আগস্ট, ১৯৭৬ তারিখের চিঠিসম্বলিত একটি নথি (প্রদর্শনী-১০/৫এ) বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পি.ডব্লিউ-৬০ উপস্থাপন করেছেন।
৫০১. এটি প্রতীয়মান হয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ কামাল ও বিশেষ শাখার কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডে মেজর বজলুল হুদাকে সম্পৃক্ত করে সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং একই সাথে ৬৭৭ নম্বর বাড়িতে এবং প্যারেড গ্রাউন্ডে তার উপস্থিতি এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাড়ির দিকে তার সৈন্যদলকে অগ্রসর করানাের বিষয়ে
৬০৯

সাক্ষীদের সাক্ষ্য অখণ্ডিত রয়েছে এবং সেহেতু, ঐসব সাক্ষ্য পেনাল কোডের ৩০২, ৩৪ এবং ১২০বি ধারার অধীনে অপরাধ সংঘটনে মেজর বজলুল হুদার দোষ প্রমাণিত করেছে।
৫০২. মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)। আসামিপক্ষের কৌসুলির বক্তব্যের জবাবে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব আনিসুল হক পি.ডব্লিউ-১, পি.ডব্লিউ-৪, পি.ডব্লিউ-৫, পি.ডব্লিউ-১১, পি.ডব্লিউ-১২, পি.ডব্লিউ-১৩, পি.ডব্লিউ-১৪, পি.ডব্লিউ-৩৯, পি.ডব্লিউ-৪০, পি.ডব্লিউ-৪২, পি.ডব্লিউ-৪৪, পি.ডব্লিউ-৪৭, পি.ডব্লিউ-৫৭ এবং পি.ডব্লিউ-৬০-এর সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন।
৫০৩. পি.ডব্লিউ-১১ বলেন যে, নাইট প্যারেডে সেনা কর্মকর্তারা মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদের (ল্যান্সার) কার্যালয়ে গিয়েছিল, যেটা ছিল পি.ডব্লিউ-১১-এর কোয়ার্টারের বিপরীত দিকে অবস্থিত এবং সেখানে তিনি সিভিল পােশাকের কিছু অজ্ঞাত সেনা কর্মকর্তাকে দেখতে পান এবং মধ্যরাত প্রায় ১২.০০টায় তিনি মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)-কে সিভিল পােশাকে একজন ব্যক্তিকে “হুদা, এখানে আসেন” বলে ডাকতে দেখেন। তারপর হুদা অন্যজনকে বলে, “ডালিম, অপেক্ষা করেন”। মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ তার দলকে ব্রিফ করে এবং গড়িতে উঠতে বলে। পি.ডব্লিউ-১১ গাড়ি নিয়ে ভাের ৪.৩০টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের কাছে আসেন, যা ছিল বাসভবন থেকে প্রায় ৮০ ফুট দূরে। তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবনের পাশ থেকে প্রচণ্ড বন্দুকের গুলিবর্ষণের খবর শুনেছিলেন এবং এরপরই তিনি “হ্যান্ডস আপ, হ্যান্ডস আপ” কথাগুলাে শুনেছিলেন। তিনি ৩/৪টি আর্টিলারি বন্দুকের গুলির আওয়াজও শুনেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১১-কে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটের বাইরে নিয়ােজিত রাখা হয়েছিল, যেন কেউ বাসভবনে প্রবেশ/বের হতে না পারে এবং সেখানে তিনি মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচএমবি নূর চৌধুরী এবং মেজর বজলুল হুদাকে প্রবেশ করতে দেখেন।
৫০৪. পি.ডব্লিউ-১২ তার জবানবন্দিতে বলেন যে, মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) ১৪ আগস্টের দিবাগত রাতের নাইট প্যারেডের ধরন পরিবর্তন করে, যেখানে তারা রাত ৩টা পর্যন্ত উপস্থিত ছিল। তিনি আরাে বলেন যে, কোটে’ (Kote) থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নেওয়ার পরে মেজর একেএম। মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) তাদের একটি ট্রাকে উঠতে বলেছিল এবং মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) তাদের ব্রিফও করেছিল এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রােড দিয়ে কোনাে যানবাহন চলাচল করতে না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।
৫০৫. ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাত ৮.৩০টায় প্যারেড গ্রাউন্ডে পি.ডব্লিউ-১৩ অংশ নিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত প্যারেডের দায়িত্ব অবশেষে মেজর মহিউদ্দীন আহমেদের (ল্যান্সার) হাতে দেওয়া হয়েছিল। প্রাতঃরাশের পরে ৩২ নম্বর রােডে গিয়ে তিনি মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)-কে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডের সংযােগস্থলে দেখেছিলেন। প্যারেড গ্রাউন্ডে এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে মেজর মহিউদ্দীন আহমেদের (ল্যান্সার) উপস্থিতি পি.ডব্লিউ-১৩ প্রমাণ করেছেন। পি.ডব্লিউ-১৩ অন্য সাক্ষীদের বিবৃত বক্তব্যের অনুরূপ বিবৃতি প্রদান করেছেন। ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাতে বালুরঘাটে নাইট প্যারেড, যা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ রাত ২.০০/২.৩০টায় শেষ হয়েছিল, সেই সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১৪ অন্যান্য পি.ডব্লিউয়ের মতাে অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন যে, প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন, লেফটেন্যান্ট কিসমত হাশেম, নাজমুল হােসেন আনসার এবং সিভিল পােশাকে আরাে কিছু ব্যক্তিকে দেখেছিলেন।
৬১০

৫০৬. পি.ডব্লিউ-৪৪ ছিলেন ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার। তিনি বলেন যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অপরাধ এবং ৩ নভেম্বরের জেল হত্যার পরে মধ্যস্থতার এক পর্যায়ে অভিযুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিসহ মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) দেশত্যাগ করে। তাতে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অপরাধে জড়িত থাকার কারণেই অভিযুক্ত মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) দেশত্যাগ করে।
৫০৭. বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পি.ডব্লিউ-৬০ সেনা সদর দফতর কর্তৃক জারি করা ১৬ আগস্ট ১৯৭৬ তারিখের চিঠিসম্বলিত একটি নথি (প্রদর্শনী-১০/৫এ) উপস্থাপন করেন, যাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে কর্মসংস্থানের জন্য মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদসহ অন্য ১১ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে নিযুক্ত করা হয়।
৫০৮. পূর্বোক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এই অপরাধে মেজর একেএম মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) জড়িত থাকার বিষয়ে জেরার সময় আসামিপক্ষ পি.ডব্লিউদের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সাক্ষীদের সাক্ষ্য অখণ্ডিত অবস্থায় থেকে যায় এবং সেহেতু প্রসিকিউটশন যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের উর্ধ্বে পেনাল কোডের ৩০২, ৩৪ এবং ১২০বি ধারার অধীনে অভিযুক্ত-আপিলকারীর দোষ প্রমাণ করেছে।
৫০৯. লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব আনিসুল হক, পি.ডব্লিউ-১, পি.ডব্লিউ-১৪, পি.ডব্লিউ-১৫, পি.ডব্লিউ-২০, পি.ডব্লিউ-২৪, পি.ডব্লিউ-৩৭, পি.ডব্লিউ-৩৮, পি.ডব্লিউ-৪২, পি.ডব্লিউ-৪৩, পি.ডব্লিউ-৪৪, পি.ডব্লিউ-৪৬, পি.ডব্লিউ-৪৭, পি.ডব্লিউ-৪৮, পি.ডব্লিউ-৫১ এবং পি.ডব্লিউ-৬০-এর সাক্ষ্য তুলে ধরেছেন।
৫১০. আমরা ইতােমধ্যে উপরােক্ত সাক্ষীদের সাক্ষ্যের সারসংক্ষেপ নিয়ে আলােচনা করেছি। তবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের উপস্থিতি নিয়ে আমি সংক্ষেপে আলােচনা করতে চাই। পি.ডব্লিউ-৪৩ তার জবানবন্দিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডে সংঘটিত অপরাধ সম্পর্কে বলেছেন। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের জুন/জুলাই মাসে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের বাড়িতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ এবং আরাে কিছু সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে মিটিং হয়েছিল। পি.ডব্লিউ-১৪ বলেন যে, ১৪ আগস্ট দিবাগত। রাতের প্যারেডে প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান সিভিল পােশাকে থাকা মেজর ডালিম এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ারকে পরিচয় করিয়ে দেয়। অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান তাদের আদেশ মানতে নির্দেশ দেয়। তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদকে রেডিও স্টেশন থেকে সকাল ৫.৩০টার পরে আসতে দেখেন।
৫১১. পি.ডব্লিউ-১৪ রাত ২.৩০টায় বালুরঘাটের কাছে ক্যান্টনমেন্টে প্যারেড গ্রাউন্ডে এবং ভাের ৫.৩০টায় রেডিও স্টেশনে অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খানের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। এরপর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ ইউনিট থেকে গােলাবারুদ নেওয়ার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়।
৫১২. পি.ডব্লিউ-২৪ তার জবানবন্দিতে আরাে বলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিবাগত রাত ৩.০০/৩.১৫টায় প্যারেড গ্রাউন্ডে গিয়েছিল, যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান তাদের ব্রিফ করেছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক বরখাস্তকৃত কর্মকর্তা মেজর ডালিম, মেজর রশিদ চৌধুরী,
৬১১

লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার এবং ক্যাপ্টেন মাজেদের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ তাদের ইউনিট থেকে গােলাবারুদ নেওয়ার নির্দেশ দেয়। যখন তারা ল্যান্সার ইউনিট থেকে শুরু করে একটি রাস্তায় থেমেছিলেন, তখন পি.ডব্লিউ-২৪ লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার, ক্যাপ্টেন মাজেদ এবং ক্যাপ্টেন মােস্তফাকে দেখেছিলেন। তিনি মেজর ডালিম, মেজর নূর, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মাজেদ, ক্যাপ্টেন মােস্তফা এবং অন্য কর্মকর্তাদেরও রেডিও স্টেশনের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখেছিলেন।
৫১৩. পি.ডব্লিউ-৩৭ রেডিও স্টেশনে খােন্দকার মােশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ারকে দেখতে পান। পি.ডব্লিউ-৩৮ লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ারের অনুমতি নিয়ে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সকাল ১০.০০টায় রেডিও স্টেশন ত্যাগ করেন।
৫১৪. পি.ডব্লিউ-৪২ মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অন্যদেরও রেডিও স্টেশনে দেখেছিলেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)-কে দেখেছিলেন।
৫১৫. পি.ডব্লিউ-৪৮ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রেডিও স্টেশনে এবং বঙ্গভবনেও দেখেছিলেন। ৫১৬. এছাড়া পি.ডব্লিউ-১৫, পি.ডব্লিউ-২০, পি.ডব্লিউ-৪৬, পি.ডব্লিউ-৪ও বঙ্গভবনে অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। ৫১৭. বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক পি.ডব্লিউ-৬০ সেনা সদর দফতর কর্তৃক জারি করা ১৬ আগস্ট ১৯৭৬ তারিখের চিঠিসম্বলিত একটি নথি (প্রদর্শনী-১০/৫এ) উপস্থাপন করেন, যেটির মাধ্যমে মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদসহ অন্য ১১ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে কর্মসংস্থানের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে ন্যস্ত করা হয়েছিল। পি.ডব্লিউ-৬০ বলেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে পুরস্কৃত করেছিল, যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনায় তার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়।
৫১৮. উপরােক্ত প্রসিকিউশন সাক্ষীদের সাক্ষ্য, যা অখণ্ডিত রয়েছে, সেটি থেকে এটি স্পষ্ট যে, ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে বালুরঘাট প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের উপস্থিতি, সেনানিবাসে সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার সময় তার উপস্থিতি, রেডিও স্টেশনে তার উপস্থিতি, রেডিও স্টেশনে সৈন্যদের আদেশ দেওয়া, বঙ্গভবনে উপস্থিত হওয়া এবং সরকারি চাকরিতে তার নিয়ােগ এবং বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশ মিশনে কর্মসংস্থানের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরবর্তীকালে আত্তীকৃত হওয়া পেনাল কোডের ৩০২, ৩৪ এবং ১২০বি ধারার অপরাধ সংঘটনে তার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে। বিশেষ করে এসব সাক্ষ্য ঘটনাস্থলের কাছাকাছি স্থানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। অধিকন্তু, এসব সাক্ষ্য এটি প্রমাণ করে যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ১৪ আগস্ট, ১৯৭৫ দিবাগত রাতে বালুরঘাট প্যারেড গ্রাউন্ডসহ নির্ধারিত স্থানে সাধারণ অভিপ্রায়কে সামনে রেখে অর্পিত কাজগুলাে করেছিল এবং সেজন্য এটি পেনাল কোডের ৩০২, ৩৪ এবং ১২০বি ধারার অধীনে অপরাধ সংঘটনে তার অংশগ্রহণকে প্রমাণিত করেছে।
৬১২

৫১৯. বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে অভিযুক্ত-আপিলকারীদের বিজ্ঞ অ্যাডভােকেটবৃন্দ আসামিরা দোষী নয় মর্মে তাদের যুক্তি/দাবির প্রতি কোনাে ক্ষতি ছাড়াই অভিযুক্ত-আপিলকারীদের বয়স, সামাজিক অবস্থান এবং পারিবারিক অবস্থা বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত করার জন্য নিবেদন করেন। উত্তরে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং রেসপন্ডেন্ট-রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ অ্যাডভােকেট জনাব আনিসুল হক এই বলে উক্ত প্রার্থনার বিরােধিতা করেন যে, অভিযুক্ত-আপিলকারীরা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, তাঁর পরিবার ও আত্মীয়দের হত্যা করে মানবতার বিরুদ্ধে করা জঘন্য অপরাধের জন্য দোষী এবং সেজন্য মৃত্যুদণ্ডের সাজা হ্রাসকরণ উচিত নয়।
৫২০. নথিতে থাকা তথ্য-উপাত্ত থেকে আমি দেখতে পাই যে, অভিযুক্ত-আপিলকারীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল, যার মধ্যে তিনজন নারী এবং একটি নাবালক শিশু ছিল। ঘটনাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এটি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমগ্র পরিবার এবং তাঁর কাছে অত্যন্ত প্রিয় এমন কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে অপসারণ করার পূর্বপরিকল্পিত ও সুচিন্তিত পরিকল্পনা, মুক্তিসংগ্রামে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যাঁদের অবদান এবং আত্মবলিদানকে গভীরভাবে স্মরণ করা উচিত। যেহেতু অভিযুক্ত-আপিলকারীরা একটি দানবিক অপরাধ সংঘটিত করেছে, সেহেতু তারা মৃত্যুদণ্ডের সাজা হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে এই আদালতের কোনাে সহানুভূতি প্রাপ্য নয়।
৫২১. এটি হতাশার যে, ১৯৭৫ সালের প্রথম প্রহরের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করে বিচার পেতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেঁচে থাকা পরিবারের সদস্যদের এবং জাতিকে প্রায় ৩৪ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ইতােমধ্যে লক্ষ করা গেছে যে, ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ভােরে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের এবং আত্মীয়স্বজনদের সাথে হত্যা করার পরে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ, ১৯৭৫ জারি করে এবং ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ভয়াবহ হত্যার ঘটনায় কোনাে ফৌজদারি মামলা করা বন্ধ করতে পরবর্তী সরকার আরাে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। নথিতে থাকা সাক্ষীদের সাক্ষ্য এবং তথ্যাদি পর্যালােচনায় আমরা এটি লক্ষ করে হতবাক হয়েছি যে, তৎকালীন খােন্দকার মােশতাক আহমেদের সরকার এবং পরবর্তী সরকারগুলাে, যারা ছিল ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভােগী, তারা সামগ্রিকভাবে জাতিকে এবং বিশ্বের সভ্যসমাজকে সম্পূর্ণ অবাক ও হতাশায় নিমজ্জিত করেছিল এবং ১৫ আগস্টের খুনিদের, যারা বরখাস্তকৃত দণ্ডিত সেনা অফিসার, তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল এবং বরখাস্তকৃত দণ্ডিত সেনা অফিসারদের বেআইনিভাবে সরকারি চাকরিতে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল এবং পরে তাদেরকে বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশ মিশনে চাকরির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্থায়ীভাবে আত্তীকরণ করা হয়েছিল এবং এভাবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া এবং মৌলিক মানবাধিকার, জনগণের বিবেক এবং শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের আদর্শ, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, প্রসিকিউশনের মতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ ‘স্বঘােষিত খুনি’ ছিল এবং পরবর্তীকালে তাদের উচ্চতর পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মিশনে কূটনীতিক পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল। নিবেদন পেশকালে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে আদালতের নিকট কিছু পর্যবেক্ষণ প্রদানের প্রার্থনা করেন, যাতে ভবিষ্যতে দেশের কোনাে সরকার এই ধরনের কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি না করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, রেসপন্ডেন্ট-রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত বিজ্ঞ কৌসুলিবৃন্দ একযােগে আদালতের কাছে এই জাতীয় পর্যবেক্ষণের জন্য প্রার্থনা করেন। আমরা প্রাসঙ্গিক সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলাের উপরােক্ত আচার-আচরণ, মানসিকতা ও কর্মকাণ্ডকে পুরােপুরি
৬১৩

প্রত্যাখ্যান করি এবং আশা করি যে এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড, যা জাতির বিবেককে হতবাক করে দিয়েছে, তা যেন ভবিষ্যত কোনাে সরকার কর্তৃক পুনরাবৃত্তি করা না হয়। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি এবং বিশ্বাস করি যে, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি সাংবিধানিক আধিপত্য এ দেশে বহাল থাকবে।
৫২২. মামলার ঘটনা এবং অবস্থাদি বিবেচনায় নিয়ে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অধস্তন আদালতের রায় বিশদভাবে বিশ্লেষণের পরে আমি এই সিদ্ধান্ত দিচ্ছি যে, হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত রায় ও আদেশে কোনাে অবৈধতা নেই এবং তদনুসারে সকল আপিল খারিজ করার এবং ডেথ রেফারেন্স অনুমােদন করার জন্য আমি আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি মােঃ তফাজ্জল ইসলামের সঙ্গে একমত পােষণ করছি।
বিচারপতি এস কে সিনহা
আমি আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি জনাব মােঃ তাজুল ইসলাম কর্তৃক প্রস্তুতকৃত খসড়া রায়টি পড়েছি। এটি একটি অতি সুলিখিত রায়। সকল আপিলে তিনি যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সেটির সাথে আমি সম্মানের সাথে একমত পােষণ করি। তবে, এই বিষয়গুলির সাথে জড়িত পয়েন্টগুলাে, যা প্রকৃতপক্ষে জনগুরুত্বপূর্ণ, বিবেচনায় রেখে তা এবং বারে উত্থাপিত আইনি প্রশ্নগুলির পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার নিজস্ব যুক্তি প্রদান করতে চাই।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, পুত্রদের স্ত্রী সুলতানা কামাল কামাল, রােজী জামাল, ভাই শেখ নাসের, সুরক্ষা সদস্য এএসআই সিদ্দিকুর রহমান, সেনাবাহিনীর সিপাই শামসুল হক এবং কর্নেল জামিলকে হত্যার দায়ে পাঁচ আপিলকারী মেজর মােঃ বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)সহ অন্যান্য পদের ২০ (বিশ) সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার দায়রা জজ আদালতে ফৌজদারি কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। আপিলকারীদের। এবং আরাে ১০ জনকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ এবং ১২০বি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে তাদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। পেনাল কোডের ১২০বি ধারার অধীনে তাদের পৃথক সাজা প্রদান করা হয়নি।
৫২৪. আপিল ও ডেথ রেফারেন্স অনুমােদনের কার্যক্রম হাইকোর্ট বিভাগের একটি ডিভিশন বেঞ্চে শুনানি হয়েছিল। বিজ্ঞ বিচারকগণ ৪ আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর মােঃ বজলুল হুদা এবং মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদসহ ৯ আসামিকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে একমত হয়েছিলেন। আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)সহ ৬ আসামির দোষী সাব্যস্তকরণ বিষয়ে তাঁদের মতামতে পার্থক্য দেখা দেয়। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মােঃ কিসমত হাশেম, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার ও রিসালদার মােসলেম উদ্দিন ওরফে মােসলেহ উদ্দিনকে এই অভিযােগ থেকে। অব্যাহতি দিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদকে প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অভিযােগ থেকে খালাস দিয়েছেন, তবে পেনাল কোডের ১২০বি ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক সকল অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষী সাব্যস্তকরণ এবং দণ্ড বহাল রেখেছিলেন এবং ডেথ রেফারেন্স অনুমােদন করেছিলেন।
৬১৪

৫২৫. বিষয়টি তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক বিচারপতি জনাব মােহাম্মদ ফজলুল করিমের কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মােসলেম উদ্দিন ওরফে মােসলেহউদ্দিনকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা প্রদানের বিষয়ে দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারকের সাথে একমত হয়েছিলেন। তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক ৩ (তিন) জন দণ্ডিতের ক্ষেত্রে প্রথম বিজ্ঞ বিচারকের সাথেও একমত হয়েছিলেন। আমার বিজ্ঞ ভ্রাতা বিচারপতি জনাব মােঃ তফাজুল ইসলাম প্রসিকিউশনের মামলাটি নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন। সেহেতু, আমি এখানে এটির পুনরাবৃত্তি করা প্রয়ােজন বলে মনে করি না। ঘটনাটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভাের বেলা ঘটেছিল এবং উক্ত ঘটনার পরে এএফএম মােহিতুল ইসলাম (পি.ডব্লিউ-১) কর্তৃক ২ অক্টোবর, ১৯৯৬ তারিখে ধানমন্ডি থানায় একটি এফআইআর (প্রাথমিক তথ্য বিবরণী) দায়ের করা হয়।
৫২৬. জবানবন্দি প্রদানকরী ৬০ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৭ (সাতচল্লিশ) জন সাক্ষীর সাক্ষ্য, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তি, মেজর (অব) শাহাদত হােসেন খান (পি.ডব্লিউ-৮) এবং কমােডাের গােলাম রাব্বানী (পি.ডব্লিউ-১৫)-এর সাক্ষ্যের মাধ্যমে প্রমাণিত মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর নূর ও মেজর আজিজ পাশার বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি (এক্সট্রা জুডিশিয়াল কনফেশন) এবং আপিলকারীগণসহ অন্য আসামিদের আগের ও পরের আচরণসংক্রান্ত অবস্থাদির মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন তার মামলা প্রমাণিত বলে দাবি করেছে। আপিলকারীগণসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারের সময় তাদের নির্দোষিতা দাবি করে। তাদের মতে, স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি স্বেচ্ছায় প্রদান করা হয়নি; হত্যাকাণ্ডটি ছিল তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর একটি সফল বিদ্রোহের ফলাফল।
৫২৭. তৃতীয় বিচারকের মতামত।
৬ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্তকরণ বিষয়ে মতামতের পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ডিসেম্বর, ২০০০ তারিখে ডিভিশন বেঞ্চ নিম্নলিখিত আদেশ প্রদান করেন:
“ডেথ রেফারেন্স আংশিক গৃহীত হলাে, ফৌজদারি আপিল নম্বর ২৬০৪/১৯৯৮, ২৬১৩/১৯৯৮ এবং ২৬১৬/১৯৯৮ খারিজ হয়েছে। বিচারপতি জনাব মােঃ রুহুল আমিন পৃথক রায়ের মাধ্যমে ফৌজদারি আপিল নম্বর ২৬১৭/১৯৯৮ মঞ্জুর করেছেন। বিচারপতি জনাব এবিএম খায়রুল হক পৃথক পৃষ্ঠার রায়ের মাধ্যমে ডেথ রেফারেন্স আংশিক গ্রহণ করে ফৌজদারি আপিল নম্বর ২৬০৪/১৯৯৮, ২৬১৩/১৯৯৮, ২৬১৬/১৯৯৮ এবং ২৬১৭/১৯৯৮ খারিজ করেছেন।” বিও (BO)
“১৪.১২.২০০০. ডেথ রেফারেন্স নম্বর ৩০/১৯৯৮-এর রায় যেহেতু বিভক্ত, সেহেতু বিষয়টি কোড | অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারার বিধান অনুসারে প্রয়ােজনীয় আদেশের জন্য বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি সমীপে প্রেরণ করা হােক।”
বিচারপতি মােঃ রুহুল আমিন
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক
৬১৫

৫২৮. ন্যায়বিচারের স্বার্থে সমস্ত দণ্ডিত কারাবন্দির বিষয়ে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য আপিলকারীরা তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের কাছে আবেদন করেন। তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক দীর্ঘসময় ধরে বিজ্ঞ কৌসুলিগণকে শুনেছেন এবং ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০১ তারিখের একটি যুক্তিযুক্ত আদেশের মাধ্যমে আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আদেশটির কার্যকর অংশ নিম্নরূপ :
“উপযুক্ত আলােচনা এবং ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকদের সমভাবে বিভক্ত মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই মতামত নিয়েছি যে, উপরােক্ত যে ৯ জন দণ্ডিত কারাবন্দির বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারকরা বিভক্ত সিদ্ধান্ত নেননি, সেগুলাে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার বিধান অনুযায়ী শুনানি করার বিষয়টি বিবেচনা করা যায় না। তবে কেবল অভিযুক্ত আবদুল মাজেদ, যার বিরুদ্ধে পেনাল কোডের দুটি পৃথক ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্তকরণ এবং সেই ৫ জন দণ্ডিত কারাবন্দির দোষী সাব্যস্তকরণ করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারকরা মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন, অর্থাৎ একজন বিজ্ঞ বিচারক কর্তৃক দোষী সাব্যস্তকরণ এবং অন্য একজন বিজ্ঞ বিচারক কর্তৃক খালাস প্রদান করা হয়েছে, সেই বিষয়গুলােয় মতামত প্রদান এই আদালতের বিষয়। এই আদালত কর্তৃক মতামত প্রদানের পরে পুরাে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির জন্য রায় এবং আদেশ এই মতামত অনুসারে হবে।”
৫২৯. এটি একটি স্বাধীন যুক্তিসম্বলিত আদেশ এবং আপিলকারীরা তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের পূর্বোক্ত আদেশের বিরুদ্ধে কোনাে আপত্তি করেননি। বিজ্ঞ বিচারক কর্তৃক গৃহীত মতামত গ্রহণ করে এবং ঐ আদেশটি এই আদালতের সামনে চ্যালেঞ্জ না করে আপিলকারীরা আপিলগুলাে এবং ডেথ রেফারেন্স শুনানি করতে চেয়েছেন। এরপরে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক ৩০ এপ্রিল, ২০০১ তারিখের রায় ও আদেশের মাধ্যমে আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)সহ তিনজন দণ্ডিত কারাবন্দির দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা বহাল রাখেন এবং তাদের ডেথ রেফারেন্স গ্রহণ করেন এবং অবশেষে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করেন। রায়ের কার্যকর নিম্নরূপ :
“পরিণামে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রশিদ, মেজর মােঃ বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, বিইউ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল একেএম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), লেফটেন্যান্ট কর্নেল এসএইচবিএম নূর চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মােঃ আজিজ পাশা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), রিসালদার মােসলেম উদ্দিন ওরফে মােসলেহউদ্দিন এবং ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ প্রসঙ্গে ৩০/১৯৯৮ নম্বর ডেথ রেফারেন্স অনুমােদনক্রমে গৃহীত হয় এবং তদনুসারে অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের দায়েরকৃত ফৌজদারি আপিল নম্বর-২৬১৬, অভিযুক্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের দায়ের করা ফৌজদারি আপিল নম্বর-২৬১৬/১৯৯৮, অভিযুক্ত মেজর মােঃ বজলুল হুদা কর্তৃক দায়ের করা ফৌজদারি আপিল নম্বর-২৬১৩/১৯৯৮ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) কর্তৃক দায়েরকৃত ফৌজদারি আপিল নম্বর-২৬১৭/১৯৯৮ খারিজ করা হয়। তবে ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম, মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম এবং ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার সংশ্লিষ্ট ডেথ রেফারেন্স নম্বর-৩০/১৯৯৮ প্রত্যাখ্যান করা হয় এবং তদনুসারে এই অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা বাতিল করে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ থেকে তাদেরকে খালাস প্রদান করা হয়।”
৬১৬

৫৩০. আপিলকারীদের বিজ্ঞ কৌসুলিবৃন্দ অনর্থক বাক্যবিস্তার করে যুক্তি দেখান যে, যেহেতু হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকরা ভিন্নমত সম্বলিত রায় দিয়েছেন, সেহেতু তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের উচিত ছিল সমস্ত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে পুরাে ডেথ রেফারেন্স শুনানি করা, কিন্তু বিজ্ঞ বিচারক কেবল ৬ (ছয়) আসামির বিষয়ে রেফারেন্স শুনানি করেছেন এবং সেই কারণে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারা অনুসারে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক কর্তৃক রেফারেন্স নতুন করে শুনানির জন্য বিষয়টি হাইকোর্ট বিভাগে ফেরত পাঠানাে উচিত। আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) পক্ষে জনাব খান সাইফুর রহমান যুক্তি দেন যে, আইনের দৃষ্টিতে হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চের কোনাে রায় নেই, যেহেতু বিজ্ঞ বিচারকরা তাদের মতামত পৃথকভাবে প্রকাশ করে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৭ ধারা লঙ্ঘন করে তারা তাদের নিজ নিজ মতামত স্বাক্ষর করেছেন। বিজ্ঞ কৌসুলি আরাে যুক্তি দেন যে যেহেতু, সাজা অনুমােদন এবং দণ্ডিতদের করা আপিলগুলাে একই সাথে শুনানি হয়েছে, সেহেতু কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারা এই ক্ষেত্রে প্রযােজ্য, যার আবশ্যকতা হলাে বিচারকরা যখন মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন, তখন মামলাটি তাঁদের মতামতসহ তৃতীয় বিচারকের সামনে পেশ করা হবে এবং এই বিচারক শুনানির পরে তাঁর মতামত প্রদান করবেন এবং রায় ও আদেশ ঐ মতামত অনুসরণ করবে।
বিজ্ঞ কৌসুলি আরাে যুক্তি দেন যে, মতামতের পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে পুরাে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করার জন্য বিজ্ঞ প্রধান বিচারপতি ১৫ জানুয়ারি, ২০০১ তারিখের আদেশের মাধ্যমে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের কাছে প্রেরণ করেন। কিন্তু তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক এই আদেশ ও আইনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে ডেথ রেফারেন্সটি খণ্ডিত আকারে শুনেছেন বিধায় রেফারেন্সটি আইনের চোখে নিষ্পত্তি করা হয়নি। বিজ্ঞ কৌসুলি জোর দিয়ে বলেন যে, ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকদের মতামত কোনােভাবেই আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ এবং মেজর বজলুল হুদা সম্পর্কে ঐকমত্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ কৌসুলি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং যুক্তি দেন যে, তাদের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত নয় বিধায় প্রথম বিজ্ঞ বিচারক তা অবিশ্বাস করেন এবং দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক সেগুলাে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত মর্মে বিশ্বাস করলেও তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক এই যুক্তিতে তাদের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে বিবেচনা করেননি যে, তিনি গুণাগুণের ভিত্তিতে তাদের মামলা শুনছিলেন না এবং সেই কারণে এটি বলা যেতে পারে যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে তারা একমত হয়েছিলেন। বিজ্ঞ কৌঁসুলির মতে, যদি ডিভিশন বেঞ্চের একজন বিজ্ঞ বিচারকের কাছে তাদের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত মর্মে বিশ্বাস না হয় তবে কীভাবে তাদের ঐকমত্য হয়েছে?
৫৩১. আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খানের পক্ষে দাবি করা হয় যে, আইনের দৃষ্টিতে এই সাজার কোনাে অনুমােদন নেই, যেহেতু শাস্তির ঐকমত্যের কোনাে অনুমােদন ছিল না। বিজ্ঞ কৌসুলি দাবি করেন যে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকদের মতামত আইন অনুসারে কোনাে রায় ছিল না, যেহেতু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাজা নিশ্চিত করার বিষয়টি হাইকোর্ট ডিভিশনের কমপক্ষে দুজন বিচারক দ্বারা গৃহীত, প্রদত্ত ও স্বাক্ষরিত হয়নি। এই যুক্তির বিষয়ে বিজ্ঞ কৌসুলি অসবর্নের কন্সাইজ ল ডিকশনারি (Osborn’s Concise Law Dictionary), আইয়ারের জুডিশিয়াল ডিকশনারি (Ayer’s Judicial
৬১৭

Dictionary), ল লেক্সিকন (Law Lexicon), স্ট্রাউডের ল ডিকশনারির (Stroud’s Law Dictionary) এবং কিছু সিদ্ধান্তের বরাত দিয়ে রায়’-এর অর্থের প্রতি আমাদের মনােযােগ আকর্ষণ করেন। বিজ্ঞ কৌসুলি অবশেষে এই যুক্তি দেন যে, সাজা অনুমােদন করার সময় ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকদের মতামতের পার্থক্যের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিচারকের মতামত প্রাধান্য পাবে। জনাব আবদুল্লাহ-আল-মামুন উপরােক্ত নিবেদন সমর্থন করেন। বিজ্ঞ কৌসুলিবৃন্দ তাদের যুক্তির সমর্থনে Muhammad Shafi Vs. Crown, 6 DLR (WP) 104 (Full Bench), (Akdur Raziq Vs. State 16 DLR (WP) 73), Hethubha Vs. State of Gujarat reported in AIR 1970 SC 1266, Union of India Vs. BN Anantha Padma Nabiah reported in AIR 1971 SC 1836, Sajjan Singh vs. State of MP reported in 1999 SCC (Cri) 44 97 Mahim Mondal Vs. State reported in 15 DLR 615 মামলাগুলাে উদ্ধৃত করেন।
৫৩২. অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে জনাব আনিসুল হক যুক্তি দেন যে, অভিযুক্ত-দণ্ডিত যেই ছয়জনের বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন তাদের বিষয়ে পুরাে ডেথ রেফারেন্স ও মামলার শুনানি না করে দণ্ডিতদের আপত্তি নাকচ করে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক পুরােপুরি যৌক্তিক কাজ করেছেন এবং সেটি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারা অনুসারেই হয়েছে। জনাব হক আমাদেরকে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৭, ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এবং যুক্তি দেন যে, ৩৭৭ ধারা হলাে ৩৭৪ ধারা অনুসারে প্রদত্ত একটি রেফারেন্সের ক্ষেত্রে সাজা অনুমােদন করার পদ্ধতি সম্পর্কিত। জনাব হকের মতে, ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারায় ব্যবহৃত “তিনি যেমন উপযুক্ত মনে করেন” এবং “রায় বা আদেশ সেই মতামত অনুসরণ করবে”- অভিব্যক্তিগুলাে তাৎপর্যপূর্ণ।
জনাব হক যুক্তি দেন যে, এই অভিব্যক্তিগুলাের নিবিড় পাঠ এই কথা বলে যে, কোনাে মামলার বিচারকদের সমভাবে বিভক্ত মতামত তৃতীয় বিচারক সমীপে প্রেরণ করা হলে মামলাটির ঘটনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তিনি মামলাটি শুনবেন নাকি শুনবেন না, সে বিষয়ে আইনসভা তৃতীয় বিচারককে বিস্তৃত বিচক্ষণতা দিয়েছে। জনাব হক আরাে যুক্তি দেন যে, এটি তৃতীয় বিচারকের একচেটিয়া বিচক্ষণতা, যদি তিনি নথিতে থাকা সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনা করে বিচারিকভাবে তাঁর বিচক্ষণতা প্রয়ােগ করেন, তবে এই মতামতের বিরুদ্ধে কোনাে আপত্তি করা যাবে না। জনাব হক আরাে যুক্তি দেন যে, যার বিষয়ে মতামতের কোনাে পার্থক্য নেই বা মতপার্থক্য রয়েছে এমন মামলার শুনানি শেষে তৃতীয় বিচারকের মতামত অনুসারেই রায় ও আদেশ হবে। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ কৌসুলি তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের ৬ ফেব্রুয়ারি ২০০১ তারিখের আদেশের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং যুক্তি দেন যে, উভয় পক্ষের বিজ্ঞ কৌসুলিদের বক্তব্য শােনার পরে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক এই মতামত রেখেছিলেন যে, “উপরােক্ত ৯ জন দণ্ডিত-বন্দির যাদের বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারকরা মতামতে বিভক্ত হননি তাদের বিষয়ে শুনানি করার কথা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার বিধানের অধীনে ভাবা যায় না। তবে কেবল অভিযুক্ত আবদুল মাজেদের মামলার শুনানি করতে হবে, যার বিষয়ে পেনাল কোডের দুটি পৃথক ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্তকরণ এবং অন্য পাঁচজন দণ্ডিত-বন্দির ক্ষেত্রে বিজ্ঞ বিচারকগণ মতামতে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন…।”
জনাব হক যুক্তি দেন যে, যে ৯ (নয়) দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিচারকগণ মতামত প্রদানে বিভক্ত হননি বরং তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজার বিষয়ে বিচারকগণ একমত হয়েছেন, তাদের মামলা
৬১৮

শুনানি না করে তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক যথাযথভাবে তার বিবেচনা প্রয়ােগ করেছেন এবং অভিযুক্তদের কেউই এই মতামতের বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়নি। তাঁর যুক্তির সমর্থনে বিজ্ঞ কৌসুলি Babu Vs. State of UP reported in AIR 1965 SC 146, Tanviben Pankajkumar Divetia Vs. State of Gujarat reported in (1997) 7 SCC 156, Sarat Chandra Mitra Vs. Emperor reported in ILR 38 Cal 202, Ahmed Sher Vs. Emperor reported in AIR 1931 Lah 513, Subedar Singh Vs. Emperor reported in AIR 1943 Allahabad 272, Nemai Mondal Vs. State of West Bengal reported in AIR 1966 Calcutta 194, State of UP Vs. Dan Singh reported in (1997) 3 SCC 747, Grenade Venkata Vs. Corporation of Calcutta reported in 22 CWN 745, State Vs. Abul Khair reported in 44 DLR 284 মামলাগুলাের সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করেছেন।
বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জনাব আজমালুল হােসেন জনাব হকের বক্তব্যগুলাে সমর্থন করতে গিয়ে কিছু পয়েন্ট যুক্ত করেছেন এবং কিছু সিদ্ধান্ত উদ্ধৃত করেছেন। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দেন যে, যখন দুই বিচারকের বেঞ্চ একটি সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত হন, তখন তাঁদের উভয়কেই তাঁদের রায়ের বিষয়ে স্বাক্ষর করতে হবে, তবে যখন অধিক বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত একটি বেঞ্চে মাম হবে তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের সিদ্ধান্তই মামলার সিদ্ধান্ত হবে এবং সেই ক্ষেত্রে অনুমােদনের জন্য কমপক্ষে দুইজন দ্বারা রায়টি স্বাক্ষর করা প্রয়ােজন ছিল না। জনাব আজমালুল হােসেন দাবি করেন যে, ৩৭৮ ও ৪২৯ ধারার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যদিও ৩৭৮ ধারায় “বিচারকদের একটি বেঞ্চ” এবং ৪২৯ ধারায় “আপিল আদালতের বিচারকগণ”-এই অভিব্যক্তিগুলাে ব্যবহার করা হয়েছে। আবার ৪২৯ ধারার “একই আদালতের অভিব্যক্তিটি অন্য ধারায় ব্যবহৃত হয়নি। বিজ্ঞ কৌসুলির মতে, হাইকোর্ট বিভাগে রেফারেন্স প্রেরণের উদ্দেশ্য হলাে দুই বা ততােধিক বিচারক কর্তৃক সাজা অনুমােদন না করা পর্যন্ত সাজা কার্যকর করা যাবে না। বিজ্ঞ কৌসুলি আরাে যােগ করেছেন যে, কমপক্ষে দুজন বিচারকের দ্বারা একটি রেফারেন্স শােনা প্রয়ােজন এবং ৩৭৮ ধারায় ব্যবহৃত “বিচারকদের বেঞ্চ”- এই অভিব্যক্তির অর্থ হলাে, দণ্ড কার্যকর করার জন্য কমপক্ষে দুজন বিচারক দ্বারা সাজা অনুমােদন এবং স্বাক্ষরিত হতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, বিজ্ঞ কৌসুলি উপসংহার টানেন যে, ৩৭৪-৩৭৮ ধারার নিবিড় পাঠ এই সিদ্ধান্ত দেয় যে, বিচারকদের বেঞ্চের মতামতের পার্থক্যের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিচারকের মতামতের প্রশ্ন উঠে এবং যেক্ষেত্রে কোনাে একজন আসামির বিষয়ে মতামতের কোনাে পার্থক্য হয়নি, সেই ক্ষেত্রে তার বিষয়টি বিবেচনা করার এবং তার মতামত দেওয়ার দায়িত্ব তৃতীয় বিচারকের ছিল না।
৫৩৩. আমরা প্রথমে নিম্নবর্ণিত আইনের প্রাসঙ্গিক বিধানগুলাে বিবেচনা করি :
৩৭৬। সাজা অনুমােদন বা দোষী সাব্যস্তকরণ বাতিল করার জন্য হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতা। ৩৭৪ ধারার অধীন প্রেরিত কোনাে মামলার ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগ
(ঘ) সাজা অনুমােদন করতে পারে বা আইন দ্বারা অনুমােদিত অন্য কোনাে সাজা প্রদান করতে পারে, বা
(ঙ) দোষী সাব্যস্তকরণ বাতিল করতে পারে এবং দায়রা আদালত তাকে যে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করতে পারত এমন কোনাে অপরাধের জন্য অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করতে পারে অথবা একই অভিযােগে বা সংশােধিত অভিযােগে নতুন করে বিচারের আদেশ দিতে পারে, বা
৬১৯

(চ) অভিযুক্ত ব্যক্তিকে খালাস দিতে পারে :
তবে শর্ত থাকে যে, আপিল দায়েরের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বা ঐ মেয়াদের মধ্যে আপিল দায়ের হয়ে থাকলে ঐ আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এই ধারার অধীনে অনুমােদনের কোনাে আদেশ দেওয়া যাবে না।
৩৭৭। দুই বা ততােধিক বিচারক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চের কমপক্ষে দুজন জন বা ততােধিক বিচারক কর্তৃক প্রতিটি মামলায় সাজা অনুমােদন বা নতুন সাজা বা আদেশ প্রদত্ত এবং স্বাক্ষরিত হতে হবে।
৩৭৮। যখন একাধিক বিচারকের বেঞ্চে এই ধরনের কোনাে মামলার শুনানি হয় এবং বিচারকগণ তাঁদের মতামতে সমভাবে বিভক্ত হন, তখন মামলাটি তাদের মতামতসহ অন্য একজন বিচারক সমীপে পেশ করা হবে এবং তিনি উপযুক্ত মনে করলে শুনানির পরে তাঁর মতামত প্রদান করবেন এবং রায় বা আদেশ তার এই মতামত অনুসরণ করবে।
৪২৯। যখন আপিল আদালতের বিচারকগণ তাদের সিদ্ধান্তে সমভাবে বিভক্ত হন, তখন তাঁদের। মতামতসহ মামলাটি একই আদালতের অন্য বিচারকের সামনে পেশ করা হবে এবং তিনি উপযুক্ত মনে করলে শুনানির পরে (যদি থাকে) তার মতামত প্রদান করবেন এবং রায় বা আদেশ তার এই মতামত অনুসরণ করবে।
৫৩৪. ৪২৯ ধারাটি ভারতের ১৯৭৩ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৯২ ধারার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা নিম্নরূপ :
৩৯২। আপিল আদালতের বিচারকরা সমভাবে বিভক্ত হলে কার্যপদ্ধতি-
এই অধ্যায়ের অধীনে দায়েরকৃত আপিলের শুনানি যখন হাইকোর্টের বিচারকদের একটি বেঞ্চের সামনে হয় এবং তারা মতামত প্রদানে বিভক্ত হন, তখন তাদের মতামতসহ আপিলটি সেই আদালতের অন্য বিচারকের সামনে পেশ করা হবে এবং সেই বিচারক শুনানির পরে যেমন তিনি উপযুক্ত মনে করেন, সেভাবে তিনি তার মতামত প্রদান করবেন, এবং রায় বা আদেশ সেই মতামত
অনুসরণ করবে;
তবে শর্ত থাকে যে, যদি বেঞ্চ গঠনকারী বিচারকদের মধ্যে একজন বা যেখানে এই ধারার অধীনে অন্য বিচারকের সামনে আপিল করা হয়, তখন সেই বিচারক প্রয়ােজন মনে করলে আপিলটি পুনর্বার শুনানি করা হবে এবং বিচারকদের বৃহত্তর বেঞ্চ দ্বারা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
৫৩৫. ৩৯২ ধারার বিধানটি প্রথমে ১৮৭২ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরে প্রবর্তিত হয়েছিল এবং এই বিধান প্রবর্তনের আগে এই জাতীয় মামলাগুলি লেটারস পেটেন্ট (Letters Patent) দ্বারা পরিচালিত হতাে। তৃতীয় বিচারকের মতামত থেকে লেটারস পেটেন্টের ৩৬ অনুচ্ছেদের অধীনে অধিকতর আপিলের বিধান ছিল। এই ধারায় বিধৃত পদ্ধতিটি কোনাে পক্ষের অধিকার নয়, তবে বিচারকদের মধ্যে মতপার্থক্য হলে কেবল আদালত স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। কলকাতা হাইকোর্টের রুলসের অর্থ মতে, তৃতীয় বিচারকের মাধ্যমে কোনাে দ্বৈত বেঞ্চ গঠিত হয় না এবং সেজন্য বিষয়টি একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের কাছে প্রেরণ করার সুযােগ তৃতীয় বিচারকের ছিল না। তাই, মূল বিলে (Original Bill) ১৮৯৮ সালের আইনের ৩৭৮ ধারার সঙ্গে নিমরূপ অনুবিধি যুক্ত করার প্রস্তাব ছিল :
৬২০

তবে শর্ত থাকে যে, এই বেঞ্চের সদস্য হিসেবে কোনাে বিচারক ইচ্ছা করলে তাঁদের সামনে এবং অপর বিচারকের সামনে পুনর্বার শুনানি করা হবে অথবা প্রধান বিচারপতি বা জুডিশিয়াল কমিশনার নির্দেশ দিলে অন্য তিনজন বিচারকের সামনে শুনানি হবে এবং রায় বা আদেশ পুনর্বার শুনানি গ্রহণকারী বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামত অনুসরণ করবে।
৫৩৬. নিম্নলিখিত কারণে সিলেক্ট কমিটির সুপারিশক্রমে এই অনুশর্ত বাদ দেওয়া হয়েছিল :
বিলে মতামত প্রদানকরী বেশির ভাগ বিচারক ৩৭৮ ধারার এই সংশােধনী ব্যবহারের অযােগ্য বলে মত দিয়েছেন। যে সমস্যাটি পূরণকল্পে সংশােধনীটি আনতে চাওয়া হয়েছিল তা সম্ভবত বিরল ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হতাে এবং বর্তমানে জুডিশিয়াল কমিশনারস আদালত পাঁচ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত হয় না, বিধায়, এই বিধানের দ্বিতীয় অংশটি সেই সব আদালতের ক্ষেত্রে অপ্রযােজ্য হবে। সেজন্য আইনটি যেমন ছিল আমরা তেমনই রাখতে পছন্দ করি এবং আমরা এই অনুচ্ছেদটি বাদ দিয়েছি।
৫৩৭. ৩৭৮ ধারার প্রস্তাবিত সংশােধনীতে সুস্পষ্টভাবে এই পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল যে, আইনসভা তৃতীয় বিচারকের মতামতের চূড়ান্ত অবস্থা দেওয়ার ইচ্ছা পােষণ করেনি। প্রস্তাবিত ছিল যে, দ্বৈত বেঞ্চের বিচারকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলে মামলাটি তিন সদস্যের বেঞ্চ শুনানি করবে এবং রায় ও আদে মামলাটি পুনর্বার শুনানি গ্রহণকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামত অনুসরণ করবে। প্রস্তাবিত সংশােধনীটি এই যুক্তিতে বাদ দেওয়া হয়েছিল যে, বিরল ক্ষেত্রে মতামতের পার্থক্যের সম্ভাবনা রয়েছে এবং বৃহত্তর বেঞ্চ গঠনের জন্য জুডিশিয়াল কমিশনারস আদালতে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারক ছিল না। মামলার নিষ্পত্তি দ্রুত করার জন্য তৃতীয় বিচারককে তাঁর নিজস্ব মতামত প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এবং ১৮৯৮ সালের আইনের অধীনে মামলার রায় তাঁর মতামত অনুসারে হবে। ১৯৭৩ সালের ভারতীয় নতুন কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরে নতুন একটি অনুশর্ত যুক্ত করে প্রায় অনুরূপ বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। যুক্ত হওয়া এই অনুশর্তের বিধানবলে দ্বৈত বেঞ্চের কোনাে বিচারক বা তৃতীয় বিচারক যদি ইচ্ছা। করেন তবে পুনর্বার শুনানি ও সিদ্ধান্তের জন্য বৃহত্তর বেঞ্চে রেফারেন্সটি পাঠাতে পারবেন, এমনকি তৃতীয় বিচারক দ্বৈত বেঞ্চের একজনের সঙ্গে একমত হলেও এভাবে রেফারেন্স পাঠাতে পারবেন। ১৮৭২ সালের কোডে থাকা বিধানটি পুনরায় চালু করার আইনসভার উদ্দেশ্যটি সুস্পষ্ট। মতামতের কোনাে পার্থক্য হয়নি এমন দ্বৈত বেঞ্চের মতামত দ্বারা যদি তৃতীয় বিচারক আবদ্ধ না হন, তবে উপরে উদ্ধৃত ১৯৭৩ সালের কোডের ৩৯২ ধারায় ১৮৭২ সালের কোডের বিধান পুনঃপ্রবর্তনে আইনসভার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না।
৫৩৮. পূর্বের আইনটি পরবর্তী আইনের ব্যাখ্যায় দুইভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে আইন প্রণয়নে যে পন্থা অবলম্বন করা হয় তা বর্তমান আইনে কীভাবে ব্যাখ্যা করা হবে তা নির্দেশ করে। দ্বিতীয়ত, পূর্ববর্তী আইনে উল্লিখিত একটি বাক্যাংশ একই বিষয়বস্তু নিয়ে পরবর্তী আইনে উল্লিখিত কোনাে বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে বিশেষ আলােকপাত করতে পারে। পরবর্তী আইনও এরকম ব্যাখ্যার সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। একে “সংসদীয় ব্যাখ্যা” বলা হয়। অর্থাৎ, আইনসভা ইচ্ছাকৃতভাবে পরবর্তী কোনাে আইনে এমন একটি ব্যাখ্যা রেখে দেয়, যা পূর্ববর্তী কোনাে আইনের কোনাে অংশের অব্যাখ্যাকৃত অংশের সুনির্দিষ্ট অর্থ খুঁজে পেতে সহায়তা করে।
৫৩৯. যখনই দায়রা আদালত কর্তৃক কোনাে মৃত্যুদণ্ড আরােপ বা আদেশ প্রদান করা হয়, তখন কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৪ ধারা অনুসারে উক্ত দণ্ড অনুমােদনের জন্য মামলার কার্যক্রম হাইকোর্ট
৬২১

ডিভিশনের নিকট দাখিল করা হয়। দণ্ড অনুমােদনে হাইকোর্ট ডিভিশনের ক্ষমতা ৩৭৬ ধারায় বিধৃত রয়েছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অভিযুক্ত আপিল দায়ের করুক বা না করুক, ৩৭৪ ধারার অধীনে ন্যস্ত মামলার কার্যক্রম দেখার ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ডিভিশন তার আপিল গ্রহণের ক্ষমতা ব্যবহার করেন। হাইকোর্ট ডিভিশনকে অবশ্যই সাক্ষ্য পর্যালােচনা করতে হয় এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ বা নির্দোষিতা সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়। অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্তকরণ সাক্ষ্য দ্বারা সঠিকভাবে যৌক্তিক কিনা এবং মামলার অবস্থাদি বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ড শাস্তি হিসেবে যথােপযুক্ত কিনা সে বিষয়ে সন্তুষ্ট হওয়া হাইকোর্ট বিভাগের উপর একটি অর্পিত দায়িত্ব। এক্ষেত্রে হাইকোর্ট ডিভিশনের ক্ষমতার কোনাে বিধিবদ্ধ সীমা নেই। হাইকোর্ট ডিভিশন সতর্কতার সাথে সাক্ষ্য পর্যালােচনা করেন এবং দণ্ডপ্রাপ্ত কনডেমড আসামির পক্ষে আইনজীবীর উত্থাপিত সকল বিষয় নিষ্পত্তি করার পর সিদ্ধান্তসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমােদন করার ক্ষেত্রে, আসামিপক্ষের কোনাে গুরুত্বপূর্ণ দাবি হাইকোর্ট ডিভিশনের সামনে উত্থাপন করার পরও তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি- এমন কোনাে বৈধ দাবি করার কোনাে সুযােগ যেন রাখা না হয় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৫৪০. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার ভাষা প্রায় অভিন্ন। বলা হয়ে থাকে যে, কোনাে রেফারেন্স বা আপিল শােনার ক্ষেত্রে, বিচারকরা তাদের মতামতে যদি সমভাবে বিভক্ত হয়ে যান, তাহলে তাদের মতামতসহ মামলাটি একজন তৃতীয় বিচারকের নিকট শুনানির জন্য পাঠানাে হবে। শুনানি শেষে তৃতীয় বিচারক “তিনি যেভাবে ভালাে মনে করেন সেভাবে” তার মতামত প্রদান করবেন এবং মামলার রায় ও আদেশ উক্ত মতামতের অনুসরণেই হবে। উভয় ধারায় তিনি যেভাবে ভালাে মনে করেন সেভাবে”- এই শব্দগুচ্ছের ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন কোন বিষয়ে বা কার বিষয়ে তিনি যুক্তি-তর্ক শুনবেন সেই সিদ্ধান্ত নেবেন তৃতীয় বিচারকই। এটি এই ধারণা দেয় যে, তৃতীয় বিচারক যেভাবে ভালাে মনে করেন সেভাবে মতামতের ভিন্নতা নিরসনের ক্ষেত্রে তিনি স্বাধীন। তিনি যদি মনে করেন পূর্বের বিচারকদের মতের ভিন্নতা নেই, এমন কোনাে অভিযুক্তের বিষয়ে যদি তিনি কোনাে যুক্তি-তর্ক না শােনেন, তাহলে তিনি এমন যুক্তি-তর্ক শুনতে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন।
উভয় ধারায় “সমভাবে বিভক্ত” শব্দগুচ্ছের ব্যবহার এটি বােঝায় যে, বিচারকরা অভিযুক্তের অপরাধ-সংশ্লিষ্টতা বা তার বা তাদের বিরুদ্ধে প্রণীত চার্জ বা অন্য কোনাে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে যখন ভিন্নমত পােষণ করেন, তখন বলা যায় যে, তারা সমভাবে বিভক্ত। কিন্তু যখন বিচারকরা কোনাে সুনির্দিষ্ট অভিযুক্তের বিষয়ে এবং যে অপরাধে অভিযােগ প্রণীত হয়েছে সেই বিষয়ে একে অপরের সাথে একমত হন তখন এটি বলা যাবে না যে, বিচারকগণ অভিযুক্তের বিষয়ে সমভাবে বিভক্ত।
৫৪১. ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার গঠন সম্পর্কে বিভিন্ন হাইকোর্টের পূর্বের অভিন্ন পর্যবেক্ষণগুলাে ছিল যে, অপর বিচারকের নিকট যা দাখিল করা হয়েছে তা হলাে “মামলাটি” এবং দ্বিতীয়ত, উক্ত বিচারকের রায় ও আদেশ তাঁর মতামত অনুসরণেই। তৃতীয় বিচারকের মতামতকেই চূড়ান্ত রায় বলে গণ্য করা হবে। একটি মামলায় দুজন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। একজন আসামির আপিলে বিচারকরা, যাঁদের সমন্বয়ে কোর্ট গঠিত হয়, মতৈক্যে পৌছান। কিন্তু, অন্যদের বিষয়ে বিচারকদের মধ্যে মতের ভিন্নতা হয়েছিল। এই অবস্থায় “মামলা” শব্দের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যার আলােকে এমন ধারণা বহাল রাখা সম্ভব যে, অপর বিচারকের সামনে যা উত্থাপন করা হবে তা হলাে, যে অভিযুক্তের বিষয়ে বিচারকরা তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত, সেটিই অভিযুক্তের মামলা। আদালত শুধু সেই ক্ষেত্রে এই বিধানের বিবেচনা করবেন, যেক্ষেত্রে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারকরা একজন অভিযুক্তের দোষ সম্পর্কে তাদের মতামতে
৬২২

সমভাবে বিভক্ত, যদিও মামলার অন্যান্য বিষয়ে তাঁরা তাঁদের পর্যবেক্ষণে একমত। এই ধরনের অবস্থায়, তৃতীয় বিচারকের সামনে যা উত্থাপন করা হবে তা হলাে, বিচারকরা তাদের মতামত প্রদানে যে বিষয় বা বিষয়সমূহে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন তা নয়, বরং সম্পূর্ণ “মামলাটি”। এটি সুস্পষ্টভাবে বােঝায় যে, উক্ত অভিযুক্তের যতটুকু সংশ্লেষ রয়েছে, সম্পূর্ণ মামলাটিই তৃতীয় বিচারকের সামনে দাখিল করা হয়েছে। মতামত প্রদানের পূর্বে এটি তৃতীয় বিচারকের দায়িত্ব যে, তিনি সকল সংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনায় আনবেন। রায় বা আদেশ এই মতামতের অনুসরণেই হবে এবং তা তিনজন বিচারকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত হওয়া জরুরি নয়। তৃতীয় বিচারকের সামনে উত্থাপিত মামলাটি হলাে আপিলকারী বা আপিলকারীগণের সম্পণ মামলা, যেটি প্রথমে দুজন বিচারক শুনেছিলেন এবং নির্দিষ্ট আপিলকারী বা আপিলকারীগণ সম্পর্কে বিচারকগণ ভিন্ন মত প্রদান করেন। কিন্তু যে আপিলকারীদের বিষয়ে। বিচারকগণের মতামতের ভিন্নতা নেই এটি তাদের মামলা নয়।
৫৪২. Sarat Chandra Mitra os Emperor ILR 38 Cal 202 মামলায় নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে :
“আমি এখন দুজন আবেদনকারীর বিচারের প্রশ্নে চিন্তান্বিত নই, যাদের মধ্যে একজনের বিষয়ে আপিল আদালত গঠনকারী বিচারকরা একমত হয়েছেন, যখন অপরদিকে অন্যদের বিষয়ে বিচারকরা তাদের মতামতে সমভাবে বিভক্তও হতে পারেন। এই অবস্থায় “মামলা” শব্দের যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা সম্পর্কে পর্যবেক্ষণের এমন ধারণা আসা সম্ভব যে, অপর বিচারকের সামনে যা উত্থাপন করা হবে তা হলাে, যে অভিযুক্তের বিষয়ে বিচারকরা তাঁদের মতামতে সমভাবে বিভক্ত, সেই অভিযুক্তের মামলাটি। আমি এখন কেবল সেই পরিস্থিতি নিয়েই চিন্তান্বিত, যেখানে আপিল আদালতের বিচারকরা ইতিমধ্যে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষী সাব্যস্তকরণ প্রশ্নে মতামত প্রদানে বিভক্ত হয়েছেন, যদিও মামলার কয়েকটি দিক থেকে তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একমত। এই ধরনের অবস্থায়, অপর বিচারকরা তাদের মতামতে যে বিষয় বা বিষয়সমূহে সমভাবে বিভক্ত হয়েছেন কেবল সেটিই বিচারকের সামনে উত্থাপন করা হবে তা নয়, বরং সম্পূর্ণ “মামলাটি”। এটি সুস্পষ্টভাবে বােঝায় যে, উক্ত অভিযুক্তের যতটুকু সংশ্লেষ রয়েছে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ মামলাটিই তৃতীয় বিচারকের সামনে দাখিল করা হয়েছে। মামলাটিতে মতামত প্রদানের পূর্বে তৃতীয় বিচারকের এটি দায়িত্ব যে, তিনি সকল সংশ্লিষ্ট বিষয় বিবেচনায় আনবেন।”
৫৪৩. এই পর্যবেক্ষণ Ahmed Sher vs. Emperor AIR 1931 (Lah) 513, Subeder Singh vs. Emperor, AIR 1943 All 272, Nemai Mandal vs. State of West Bengal, AIR 1966 Cal 194-97 এর মামলাগুলােতেও অনুসৃত হয়েছে। এই বিষয়ে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণগুলাে অভিন্ন নয়। একটি দৃষ্টিভঙ্গি হলাে তৃতীয় বিচারককে পুরাে মামলাটি স্বাধীনভাবে পরীক্ষা করতে হবে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কারাে ক্ষেত্রে কোনাে পার্থক্য না থাকলেও তিনি ডিভিশন বেঞ্চের দুই বিচারকের মতামত দ্বারা বাধ্য নন। অপর মতটি হলাে, তৃতীয় বিচারক কোন যুক্তিগুলি শুনবেন তা নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ তৃতীয় বিচারকের বিবেচনার অধীন এবং তিনি মতামতের পার্থক্য নিরসনে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
৫৪৪. ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকগণ কখনাে কখনাে কোনাে বিষয়ে ভিন্নমত পােষণ করতে পারেন। তবে তাঁরা যদি দায়রা আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সাথে একমত হন এবং সাজা নিশ্চিত করেন, তবে এটি বলা যাবে না যে, বিচারকরা তাদের মতামতের ক্ষেত্রে সমভাবে বিভক্ত। ধারা ৩৭৭-এর বিধানে বলা হয়েছে। যে, এরূপ দাখিলকৃত প্রতিটি মামলায় হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক দণ্ড অনুমােদন বা নতুন কোনাে দণ্ড বা

৬২৩

আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে, যখন উক্ত আদালত দুই বা ততােধিক বিচারক সমন্বয়ে গঠিত হয়, তখন তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে দুই জন বিচারক কর্তৃক উক্ত আদেশ প্রদত্ত ও স্বাক্ষরিত হতে হবে। এই ধারা মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিশ্চিতকরণের আদেশ স্বাক্ষর করার পদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা করে। যেখানে আদালত দুই বা ততােধিক বিচারক নিয়ে গঠিত, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের সাজা নিশ্চিত করার আদেশটি কমপক্ষে তাঁদের দুজন দ্বারা স্বাক্ষরিত হওয়া উচিত। যদি তাঁদের একজন কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড অনুমােদিত হয়, তাহলে ৩৭৭ ধারার বিধান অনুসারে মৃত্যুদণ্ড বৈধভাবে অনুমােদন করা হয় না। উক্ত ধারায় উল্লেখ আছে যে, কোনাে কোনে রেফারেন্সে কোনাে আদেশ কমপক্ষে দুই বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দ্বারা হতে হবে। ডিভিশন বেঞ্চ গঠনকারী বিচারকগণ যখন তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হন, তখন কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারার সাথে পঠিতব্য ৪২৯ ধারায় বিধৃত পদ্ধতিতে মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, অর্থাৎ তাদের মতামতসহ মামলাটি ততীয় বিচারকের সামনে উত্থাপন করা হবে। ধারাটিতে ব্যবহৃত “মতামতের পার্থক্য” শব্দগুচ্ছ অভিযুক্তের দোষ বা নির্দোষিতা নিরূপণের ক্ষেত্রে বা যথাযথ সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে হতে পারে। মামলার এইরূপ কোনাে ক্ষেত্রে ধারাগুলি অপর বিচারকের কাছে রেফারেন্স প্রেরণের বিধান বর্ণনা করে। যে বিচারকের সামনে মামলাটি তার মতামতের জন্য উত্থাপন করা হয় তিনি অভিযুক্তকে পুনরায় বিচারের নির্দেশ প্রদানসহ যথাযথ বলে মনে করেন এমন যে কোনাে আদেশ প্রদান করার অধিকারী। সাজা নিশ্চিত করার সময় একজন বিচারক কোনাে একটি প্রমাণ গ্রহণ না করেও অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত ও সাজা প্রদান অনুমােদন করতে পারেন, যার অর্থ এই নয় যে, দোষী সাব্যস্ত হওয়া ও সাজা সম্পর্কে তাঁর মতামতের পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং, মূল প্রশ্নটি হচ্ছে, ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৭ ধারার বিধানের মধ্যে থেকে দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা অনুমােদন করেছেন কিনা।।
৫৪৫. Babu Vs. State of uP, AIR 1965 SC 1467 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ তৃতীয় বিচারকের সত্যিকারের উদ্দেশ্য এবং ক্ষমতা বিবেচনা করেছিলেন। উক্ত মামলায় তিন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্তকরণ বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চ দুটি ভিন্ন মতামত প্রদান করেন। মামলাটি বিচারপতি তাকরুর নিকট উত্থাপিত হয়, যিনি প্রসিকিউশন কেসটি মেনে নেওয়ার বিষয়ে বিচারপতি মাথুরের সাথে একমত হয়েছিলেন। সে অনুযায়ী দোষীদের আপিল খারিজ করা হয়েছিল। উপযুক্ততার সনদপত্রের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুজন বিচারক, যারা আপিলগুলাে শুনেছিলেন, পুনরায় মুলতুবি করেন। বিচারপতি মাথুর সনদপত্র প্রত্যাখ্যান করার পক্ষে ছিলেন এবং বিচারপতি জ্ঞানেন্দ্র কুমার এটি প্রদানের পক্ষে ছিলেন। তিনি মতামত দিয়েছিলেন যে, পূর্বের মতপার্থক্যের মূল বিষয় ছিল এফআইআরের বিশ্বাসযােগ্যতা এবং বিচারপতি তাকরু কেবল বলেছিলেন যে, যদি তাঁর এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া প্রয়ােজন হতাে তবে তিনি বিচারপতি মাথুরের সাথে একমত হতেন এবং এফআইআরটি বিশ্বাসযােগ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। বিচারপতি জ্ঞানেন্দ্র এই মতামত দিয়েছিলেন যে, বিচারপতি তারুর সামনে এই বিষয়টি নিয়ে সম্পূর্ণভাবে যুক্তি-তর্ক করার পরেও তিনি তা নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেননি। বিষয়টি আবারও বিচারপতি বােমে-র (Boome, J) নিকট উত্থাপন করা হয়, যিনি বিচারপতি জ্ঞানেন্দ্রর সাথে এই বিষয়ে একমত হয়েছিলেন যে, বিচারপতি তাকরু এফআইআরের বৈধতা নিরূপণের মধ্যে যাননি। তিনি সনদপত্র দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। সুপ্রীম কোর্টে আপিলের উপযুক্ততার বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছিল। এতে নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল :
৬২৪

“ধারা (৪২৯) অনুসারে, তৃতীয় বিচারক নির্ধারণ করবেন যে, কোনাে বিষয় সম্পর্কে যুক্তি-তর্ক যদি থাকে, তিনি শুনবেন এবং এটি ধারণা দেয় যে, তিনি যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে মতের পার্থক্য নিরসনে পরােপরি স্বাধীন। আমাদের রায় অনুসারে, বিচারপতি তারুর জন্য এটক বলাই যথেষ্ট ছিল যে, প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর প্রশ্নে তিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়ােজন মনে করেননি, তবে, যদি তা প্রয়ােজন হয় তবে তিনি বিচারপতি মাথুর যা বলেছিলেন তার সব কিছুর সাথে একমত। সুতরাং, এটি বিচারপতি তারুর একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত ছিল এবং প্রাথমিক তথ্য বিবরণী ও এ সংক্রান্ত সন্দেহের বিষয়ে আলােচনা না করার উপর সনদপত্রের ভিত্তি রাখা যায়নি।”
৫৪৬. Hethubha, AIR 1970 SC 1266 মামলায় তিনজন আসামিকে হত্যা ও অন্যান্য অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। বিচারিক আদালত পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে অভিযুক্ত সব আসামিকে খালাস প্রদান করে; তবে সব আসামিকে পেনাল কোডের ৩০৪ ধারার পার্ট II-এর সাথে পঠিতব্য ৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করে। দুজন আসামিকে পেনাল কোডের ৩২৩ ধারার অধীনে এবং আরেকজনকে পেনাল কোডের ৩২৩/৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। আসামিরা উপরােক্ত দোষী সাব্যস্তকরণ ও দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করে। গুজরাট হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে আপিলের শুনানি হয়। একজন বিচারক বিচারপতি ডিভান পেনাল কোডের ৩০২ ধারা অনুসারে ১ নম্বর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং অন্য দুই আসামিকে পেনাল কোডের ৩২৪/৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন। অপর বিচারক বিচারপতি শেলাত (Shelat, J) সব অভিযুক্তকে অভিযােগের দায় থেকে খালাস প্রদান করেন। বিষয়টি এরপর তৃতীয় বিচারক, বিচারপতি মেহতার নিকট উত্থাপন করা হয়, যিনি আপিলটি শােনেন এবং ১ নম্বর অভিযুক্তকে পেনাল কোডের ৩০২ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং অপর দুই আসামিকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন। তিনি পেনাল কোডের ৩২৩ ধারার অধীনে প্রথম দুই অভিযুক্তের দোষী সাব্যস্তকরণ এবং পেনাল কোডের ৩২৩/৩৪ ধারার অধীন তৃতীয় অভিযুক্তের দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখেন। অভিযুক্তরা এরপর ভারতের সুপ্রীম কোর্ট যায়। আসামিপক্ষে দাবি করা হয় যে, তৃতীয় বিচারক কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারা লঙ্ন করে পুরাে মামলাটি নিষ্পত্তি করে আইনগতভাবে ভুল করেছেন। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট বাবু (Supra) মামলায় গৃহীত মতামত অনুমােদন করেন এবং নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“এই আদালত Babu Vs. State of Uttar Pradesh, (1965) 2 SCR 771= AIR 1965 SC 1467 মামলায় উল্লেখ করেন যে, এটি বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের সিদ্ধান্তের বিষয় যে, তিনি কোন
যুক্তিতর্ক শুনবেন এবং তাই যেভাবে উপযুক্ত বলে মনে করবেন সেভাবে মতদ্বৈধ নিরসন। করতে তিনি স্বাধীন। বিচারপতি মেহতা এখানে পুরাে মামলাটি পরিচালনা করেছেন। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪২৯ ধারায় বলা হয়েছে যে, “যখন আপিল আদালত গঠনকারী বিচারকরা মতামত নিয়ে সমভাবে বিভক্ত থাকেন, তখন মামলাটি একই আদালতের অপর বিচারকের সামনে শুনানির জন্য রাখা হবে এবং এই শুনানির পরে, যদি তিনি উপযুক্ত মনে করেন, তাঁর মতামত প্রদান করবেন, এবং রায় ও আদেশ তার মতামত অনুসারে হবে”। দুটি বিষয় লক্ষণীয়; প্রথমত, মামলাটি অপর বিচারকের সামনে উত্থাপিত হবে এবং দ্বিতীয়ত, রায় ও আদেশ বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের মতামত অনুসারে হবে। সুতরাং, এটি প্রকাশিত যে, বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক পুরাে মামলাটি পরিচালনা করতে পারেন বা করবেন।”
৬২৫

৫৪৭. Tanviben Pankaj Kumar Divetia Vs. State of Gujarat, AIR 1997 SC 2193, (1997 (7) SCC 156) মামলায় AIR 1965 SC 1467 মামলায় প্রদত্ত মতামত অনুমােদন করা হয়েছে এবং নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে :
“ধারা ৩৯২ (আমাদের ধারা ৪২৯)-এর সরল পাঠ এটি পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, কোনাে বিষয়ে যদি কোনাে যুক্তি-তর্ক থাকে তাহলে তা তৃতীয় বিচারক শুনবেন কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার শুধু তাঁরই, এবং এটি অবশ্যই ধারণা করা যায় যে, তৃতীয় বিচারক যেভাবে যথাযথ মনে করেন সেভাবে মতদ্বৈধ নিরসন করে আপিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যপারে স্বাধীন।”
৫৪৮. State of uP Vs. Dan Singh, (1997) 3 SCC 747 মামলায় বিভিন্ন অপরাধসহ ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২/১৪৯ ধারার অধীনে বত্রিশ আসামির বিচার করা হয়েছিল। বিচারিক আদালত সব আসামিকে খালাস প্রদান করে। রাষ্ট্র কর্তৃক দায়ের করা একটি আপিলে, ডিভিশন বেঞ্চের দুজন বিচারকের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। বিচারপতি বি এন কাটজু ভারতীয় পেনাল কোডের ৩২৫/৩৪ ধারার অধীনে দুই আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং অন্যান্য আসামিকে খালাস প্রদান করেন। | বিচারপতি রাজেশ্বর সিং ছয় আসামিকে সব অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত করেন। উভয় বিচারক ২২ জন আসামির বিষয়ে একমত হন এবং অপর ৬ জন আসামি এবং ৪ জন নারী আসামি সম্পর্কে মতপার্থক্য ছিল। তৃতীয় বিচারক বিচারপতি মাথুর বিচারপতি কাটজুর মতামতের সাথে একমত হয়েছিলেন। স্টেট অব ইউপি চার নারী অভিযুক্ত ব্যতীত সব আসামির বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি পায়। এই কারণে যে, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আপিল ডিভিশন বেঞ্চ কর্তৃক খারিজ করা হয়েছিল এবং তা চূড়ান্ত হয়ে যায় এবং তৃতীয় বিচারকের চূড়ান্ত আদেশের বিরুদ্ধে কোনাে আপিল দায়ের করা হয়নি। অভিযুক্ত-রেসপন্ডেন্ট পক্ষে দাবি করা হয় যে, ১৫ এপ্রিল, ১৯৮৭ তারিখে ডিভিশন বেঞ্চ কর্তৃক ২২ আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের আপিল খারিজ করা হয়েছিল এবং তা চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় বিচারকের ১৯ এপ্রিল, ১৯৮৮ তারিখের চূড়ান্ত মতামতের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করা হয়। এই আদেশটি চার নারী অভিযুক্ত এবং অপর ছয়জনের সাথে সম্পর্কিত। চারজন নারীর খালাসের বিরুদ্ধে আপিলের বিশেষ অনুমতি না থাকায়, আপিলটি কেবল ছয় আসামির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, যার বিষয়ে মতামতের পার্থক্য থাকার কারণে তৃতীয় বিচারকের কাছে উত্থাপন করা হয়েছিল। ডিভিশন বেঞ্চের মতামতের পার্থক্য থাকায় তৃতীয় বিচারকের মতামত বহাল থাকবে বলে সুপ্রীম কোর্ট এই মতামত প্রত্যাখ্যান করেন। সুপ্রীম কোর্টের দুই সদস্যের বেঞ্চ নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“যখন আপিলটি সামগ্রিকভাবে তৃতীয় বিচারক কর্তৃক শ্রুত হয়, তখন তার কাছে কেবল তার মতামত দেওয়ার সুযােগই নয়, বরং তিনি চাইলে আপিলটি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারা ৩৯২-এর বিধান অনুযায়ী কোনাে বৃহত্তর বেঞ্চ কর্তৃক আপিলের পুনঃশুনানি ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আদেশও দিতে পারেন। এটি বিধানের অধীনে এমন একটি উপায় ছিল যা দুই বিচারকের যে কোনাে একজন যথা, বিচারপতি বিএন কাটজু এবং বিচারপতি রাজেশ্বর সিংয়ের জন্য উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু তারা তা করেননি। যা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান তা হলাে, আপিলটি শেষ পর্যন্ত রায় ও আদেশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয় ততীয় বিচারকের মতামতকে অনুসরণ করে। এটি হওয়ায়, বিশেষ লিভ আবেদনটি কেবল ১৯.৫.১৯৮৮ তারিখের চূড়ান্ত আদেশের মাধ্যমে হাইকোর্ট কর্তৃক আপিল নিষ্পত্তি হওয়ার পরে দায়ের করা যেত। যদিও উক্ত আদেশটি বত্রিশ জন অভিযুক্তের মধ্যে দশ জন সম্পর্কে প্রদান করা হয়েছে, এই আদেশটি ১৫.৪.১৯৮৭ তারিখের পূর্ববর্তী আদেশের সাথে পড়তে হবে এবং আইন
৬২৬

অনুসারে, ১৫.৫.১৯৮৮ তারিখের আদেশটি চূড়ান্ত আদেশ হিসেবে বিবেচিত হবে, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হয়েছিল, বত্রিশ জন অভিযুক্তের মধ্যে মাত্র দুজনকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩২৫ ধারার সাথে পঠিতব্য ৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করে, যখন অন্য সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছিল।”
৫৪৯. Sajjan Singh (1999 SCC 44) এ, ১১ মামলায় ১১ অভিযুক্ত ব্যক্তি দায়রা জজের সামনে বিচারের মুখােমুখি হয়েছিল। দায়রা জজ তাদের মধ্যে ১০ আসামিকে পেনাল কোডের ৪০৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন। দোষী সাব্যস্ত আসামিরা আপিল দায়ের করে এবং রাষ্ট্রপক্ষও খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে একটি আপিল দায়ের করে। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক আনীত আপিল খারিজ করে দেন। ১০ জন দোষী সাব্যস্ত আসামির অপর আপিলের বিষয়ে বিচারকবৃন্দ তাদের মতামত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত হয়েছিলেন। একজন বিচারক এই মতামত দেন যে, সব আসামির দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল হওয়া উচিত এবং অপর বিচারক বলেন যে, ৩ আসামির দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখা উচিত এবং বাকিদের খালাস দেওয়া উচিত। বিষয়টি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৯২ ধারার অধীনে তৃতীয় বিচারকের কাছে প্রেরণ করা হয়, যিনি ৬ জনকে দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখেন এবং অন্য ৪ আসামিকে খালাস প্রদান করেন। তৃতীয় বিচারক ৩ জন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির মামলা বিবেচনা করেননি। কারণ তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চ সমভাবে বিভক্ত ছিলেন না। সুপ্রীম কোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ AIR 1965 SC 1467 এবং AIR 1970 SC 1266 মামলায় গৃহীত মতামত উপেক্ষা করে তৃতীয় বিচারকের গৃহীত মতামত অনুমােদন করেননি এবং নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন :
“আইনের বক্তব্য এখন বেশ স্পষ্ট। এখানে তৃতীয় বিচারকের মতামতই গুরুত্বপূর্ণ; এই রায়ের বিরুদ্ধে সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদ বা সংবিধানের ১৩৪ অনুচ্ছেদের অধীনে বা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৯ ধারার অধীনে বিশেষ লিভ আবেদনের মাধ্যমে এই আদালতে আপিল করা হয়েছে। সেহেতু, তৃতীয় বিচারকের স্বাধীনভাবে পুরাে মামলাটি পরীক্ষা করার প্রয়ােজন ছিল এবং এটি বলা যায় না যে, তিনি ডিভিশন বেঞ্চ গঠনকারী দুই বিচারকের মতামতের সেই অংশের দ্বারা বাধ্য যেখানে কোনাে পার্থক্য নেই। প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় বিচারক ডিভিশন বেঞ্চের এ জাতীয় কোনাে মতামত দ্বারা বাধ্য নন। তিনি বিষয়টি এভাবে শুনছেন না, যেন তিনি তিন বিচারকের বেঞ্চে বসে আছেন, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত বহাল থাকবে। সেহেতু, আমাদের মতামত এই যে, বিচারপতি প্রসাদ তাঁর অ্যাপ্রােচের ক্ষেত্রে সঠিক ছিলেন না এবং তিনজন আপিলকারী- গজরাজ সিং, মেহেরবান সিং এবং বাবু সিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর হাত বাঁধা ছিল না। যাদের বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চের উভয় বিচারকই মতামত দিয়েছেন যে, তারা দোষী ছিল এবং তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা বহাল রাখা হয়েছিল।”
৫৫০. এই ধরনের পর্যবেক্ষণ সত্ত্বেও, আদালত তৃতীয় বিচারকের মতামতে হস্তক্ষেপ করেননি এই যুক্তিতে যে,
“যেহেতু, আমরা তিনজন আপিলকারীর বিষয়টি দীর্ঘ সময় শুনেছি, আমরা মনে করি না যে, এই পর্যায়ে মামলাটি রিমান্ডে নেওয়া বাঞ্ছনীয়, যখন কেবল কয়েকজন আপিল আবেদনকারী বিচারপতি প্রসাদের গৃহীত পদ্ধতির কারণে অন্যায্যতায় পড়েছেন মর্মে বলা যেতে পারে মাত্র।” এরপর সুপ্রীম কোর্ট গুণাগুণের ভিত্তিতে আপিলটি শােনেন এবং আপিলটি খারিজ করেন। Dhan Singh I Sajjan Singh-এর মামলাগুলিতে ১৯৭৩ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৯২ ধারার বিধানের আলােকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
৬২৭

৫৫১. BN Ananta Padma Nabiah (AIR 1971 SC 1836) মামলায় ৩ জন আসামিকে পেনাল কোডের ১২০বি ধারা, তৎসহ পঠিতব্য প্রিভেনশন অব করাপশন অ্যাক্টের ধারা ৫(এইচ), ৫(১)(গ) এবং ৫(১)(ডি) এবং পেনাল কোডের ৪৬৭ এবং ৪৭১ ধারার অধীনে দুটি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হাইকোর্টে পৃথকভাবে রিভিশন পিটিশন দায়ের করেছিল মূলত এই বিষয়গুলি চ্যালেঞ্জ করে যে, গৌহাটির বিশেষ বিচারকের দিল্লির বিশেষ পুলিশ সংস্থা কর্তৃক তদন্ত হওয়া মামলাগুলি বিচার করার কোনাে এখতিয়ার নেই, আসাম সরকারের কোনাে সম্মতি নেওয়া হয়নি, এবং দিল্লির ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের অধীনে তদন্ত সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত তদন্ত কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৯৬এ ধারা অনুযায়ী হয়নি। আসাম ও নাগাল্যান্ডের হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে প্রথম দুটি বিষয় প্রত্যাখ্যান করেন, তবে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী সংস্থাকে মামলাগুলি তদন্তের অনুমতি দেওয়ার জন্য তার বুদ্ধি প্রয়ােগ করেছিলেন কিনা এবং ধারা ১৯৬এ-এর অধীনে অনুমােদন প্রয়ােজন ছিল কিনা তা নিয়ে তাদের মতামতগুলি বিভক্ত ছিল। বিষয়টি তখন তৃতীয় বিচারকের সামনে উত্থাপন করা হয়। তৃতীয় বিচারক বলেন যে, তদন্তকারী সংস্থাকে বিষয়টি তদন্তের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট এখতিয়ার ছাড়াই কাজ করেছিলেন এবং তদনুসারে তিনি মামলাটি বাতিল করেন। তর্কিত প্রশ্নটি ছিল, তদন্তের অনুমতি প্রদানের ক্ষেত্রে দিল্লির ম্যাজিস্ট্রেটের যােগ্যতা থাকা নিয়ে একটি নতুন বিষয় হিসেবে তা তৃতীয় বিচারকের সামনে উত্থাপিত হতে পারত কিনা। কারণ এই বিষয়টি ডিভিশন বেঞ্চের সামনে উত্থাপিত হয়নি। বিচারপতি এ এন রায় AIR 1970 SC 1266 মামলায় গৃহীত পর্যবেক্ষণগুলাে অনুমােদন করেন। যেখানে বলা হয়েছিল যে, “বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক সম্পূর্ণ মামলা বিবেচনায় নিতে পারতেন”। আইনের বক্তব্যে কোনাে বিরােধ নেই। মামলা পরিচালনা করা তৃতীয় বিচারকের স্বেচ্ছাধীন এবং মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কোনাে বিষয় প্রয়ােজনীয় হয়ে দেখা দেয় তখন তিনি উক্ত পয়েন্টটি সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
৫৫২. Muhammad Shafi Vs. Crown, 6 DLR (WP) 104 (Full Bench)মামলায় মো: শফীকে পেনাল কোডের ৩০২ ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। মামলাটি থেকে উদ্ভূত আপিল ও দণ্ড নিশ্চিতকরণের বিষয়টি সিন্ধু হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চের সামনে উত্থাপিত হয়েছিল। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারার বিধানগুলি মেনে চলা হয়েছে কিনা এবং তা না হলে, বিচার কলুষিত হয়েছে কিনা সেটি নিয়ে বিজ্ঞ বিচারকরা দ্বিমত পােষণ করেন। বিষয়টি এরপর একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে প্রেরণ করা হয়েছিল। পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, ৩৪২ ধারার বিধানগুলি প্রতিপালন করা হয়নি এবং এটি সংশােধনযােগ্য হওয়ায় এই ত্রুটির কারণে বিচার কলুষিত হয়নি। যেহেতু বিষয়টি একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে প্রেরণ করা হয়েছিল, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে, এই আইনের ৩৭৮ ধারার অধীনে মতামত দেওয়ার জন্য মামলাটি তৃতীয় বিচারকের কাছে ফেরত পাঠানাে উচিত। বিষয়টির এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ বিচারকরা এই যুক্তির সাথে একমত হয়েছিলেন যে, “তৃতীয় বিচারক বিচারকদের একটি বেঞ্চের কর্তৃত্ব প্রয়ােগ করেছেন এবং সেহেতু তাঁকে সিন্দ কোর্ট অ্যাক্টের ১২ ধারার অধীনে একক বিচারক নয়, বরং একটি বেঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।” এই মামলার ক্ষেত্রে উক্ত মামলাটির কোনাে প্রযােজ্যতা নেই।
৫৫৩. Abdur Raziq Vs. State 16 DLR (WP) 73 মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যে, “কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারার কোথাও এটি উল্লেখ করা হয়নি যে, যে বিচারক অভিযুক্তের পক্ষে তার মতামত দিয়েছেন সেই বিচারকের মতামত তৃতীয় বিচারকের অনুসরণ করা উচিত বা তিনি তা
৬২৮

করতে পারেন। এই প্রস্তাবনাটিতে কোনাে বিরােধ নেই যে, অভিযুক্তকে খালাস প্রদানের পক্ষে ডিভিশন বেঞ্চের যে বিচারক মতামত দিয়েছেন সেটির দিকে তৃতীয় বিচারকে ঝুঁকতে হবে। যদি এই প্রস্তাবনাটি গৃহীত হয়, তাহলে “এইরূপ বিচারক”– কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ ধারায় বিধৃত এই অভিব্যক্তি ব্যবহার করার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। ঐরূপ শুনানির পরে তিনি যেমন উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে তার মতামত প্রদান করবেন এবং রায় বা আদেশ তাঁর এই মতামতের অনুসরণে হবে।
৫৫৪: উপরােক্ত সিদ্ধান্তসমূহের সামগ্রিক নিরীক্ষা থেকে আমরা দেখতে পেলাম যে, ডিভিশন বেঞ্চের বিচারকরা সমভাবে বিভক্ত এমন একটি মামলায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তৃতীয় বিচারকের ক্ষমতা সম্পর্কে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের পরস্পরবিরােধী মতামত রয়েছে। এখানে লক্ষণীয় যে, আপিলকারী পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ আমাদের সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, ভারতের সুপ্রীম কোর্ট Babu (AIR 1965 SC 1467) মামলায় নেওয়া মতামতকে বাতিল করে দিয়েছে, যা আমার মতে, এখন পর্যন্ত এই বিষয়ের সিদ্ধান্ত ধারণ করে। উক্ত সিদ্ধান্তটি পাঁচ সদস্য বিচারক কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে এবং এরপরে গৃহীত মতামতগুলি পরবর্তীকালে বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়েছে। দুজন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি বিপরীত মতামত দিয়েছেন, তবে এ জাতীয় মতামত নেওয়ার সময়, বিজ্ঞ বিচারকরা পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন। যেহেতু, এই মতামত আইনের বিধানগুলির সঠিক কাঠামাের উপর ভিত্তি করে এসেছে, সেহেতু এর সাথে শ্রদ্ধার সাথে সম্মত হওয়ায় আমি এই মতামত থেকে সরে যাওয়ার কোনাে জোরালাে ভিত্তি পাই না। যদি এমন ধারণাও করা হয় যে, বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের উচিত ছিল সব দোষী সাব্যস্ত আসামির বিষয়ে রেফারেন্স শােনা, তবুও আপিলকারীরা এ কারণে অন্যায্যতার শিকার হয়েছেন তা বলা যায় না। কারণ আমরা গুণাগুণের ভিত্তিতেই আপিলকারীদের আপিল শুনেছি। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের এই মতামত সম্পূর্ণরূপে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৭৮ এবং ৪২৯ ধারা অনুসারে দেওয়া হয়েছে। এই ধারা এটি প্রতিফলিত করে যে, তৃতীয় বিচারকই সিদ্ধান্ত নেবেন কোন বিষয়ে এবং কার বিষয়ে তার যুক্তি-তর্ক শােনা উচিত। তিনি যেভাবে উপযুক্ত মনে করেন সেভাবে মতপার্থক্য সমাধানে সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করে দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা সম্পর্কে মতামতের কোনাে ভিন্নতা নেই এমন ৯ জন আসামির মামলা শুনতে অস্বীকৃতি জানান এবং তিনি তাদের মামলায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়ােজন মনে করেননি। তবে যদি উক্ত ৯ আসামির মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিতও হতাে, তাহলেও বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারক ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকদের সাথে একমত ছিলেন এবং উক্ত আসামিদেরও তিনি দোষী সাব্যস্তকরণের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন। বিজ্ঞ তৃতীয় বিচারকের মতামতের কার্যকর অংশটি (operating portion) হাইকোর্ট বিভাগের চূড়ান্ত রায় হিসেবে বিবেচিত। অতএব, আমি আপিলকারী পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের উত্থাপিত আপত্তিটি প্রত্যাখ্যান করছি।।
৫৫৫. বিলম্ব
বিজ্ঞ আইনজীবীগণ কর্তৃক উত্থাপিত পরবর্তী বিষয়টি হলাে এই যে, এফআইআর দায়েরে অতিরিক্ত বিলম্ব এবং ২১ বছরের এই অযৌক্তিক বিলম্ব প্রসিকিউশনকে কারসাজিপর্ণ প্রমাণ সংগ্রহ করে মিথ্যাভাবে আপিলকারীদের জড়িত করার গল্প আনয়ন করতে সক্ষম করেছে যা আপিলকারীদের প্রতি অন্যায্য ক্ষতির কারণ হয়েছে এবং হাইকোর্ট ডিভিশন এই দিকটি বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়ে অবৈধ কাজ করেছেন। আরাে দাবি করা হয়েছে যে, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারির কারণে এই বিলম্ব হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হলেও ইনডেমনিটি রিপিল অর্ডিন্যান্স, ১৯৯৭ দ্বারা দায়মুক্তি বাতিল করার তারিখ ১৪ নভেম্বর,
৬২৯

১৯৯৬ থেকে এফআইআর দায়েরের তারিখ ২ অক্টোবর, ১৯৯৬ পর্যন্ত প্রায় তিন মাসের বিলম্বের কোনাে ব্যাখ্যা নেই।
৫৫৬, অন্যদিকে, বিজ্ঞ আইনজীবী জনাব আনিসুল হক এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, প্রসিকিউশন কেবল কারণগুলি ব্যাখ্যা করেনি, এমনকি এফআইআর দায়েরে বিলম্বের কারণ প্রমাণ করার জন্য উপযুক্ত সাক্ষ্যও প্রদর্শন করেছে। তাদের মতে, ঘটনার পরপরই এফআইআর দায়ের না করতে পারার কারণ হলাে, ধারাবাহিক সরকারগুলি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করার মাধ্যমে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের বাধাগ্রস্ত করেছে; এবং ঘটনার পরে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তৎকালীন সরকারগুলির তত্ত্বাবধানে প্রভাবশালী ও শক্তিশালী পদে অধিষ্ঠিত ছিল এবং তাদের আচরণের কারণে জীবনের নিরাপত্তাহীনতা বােধ করে এজাহারকারী এফআইআর দায়ের করেননি। দাবি করা হয়েছিল যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান “ফ্রিডম পার্টি” নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিল এবং মেজর বজলুল হুদা সেই দলের সেক্রেটারি ছিল; বেশির ভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেদের রাষ্ট্রপতির খুনি হিসেবে ঘােষণা করার পরও জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে তাদের তৎকালীন বৈদেশিক মিশনে নিয়ােগ দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। আরাে দাবি করা হয়েছে যে, এটি একটি ব্যতিক্রমী মামলা, যেখানে তৎকালীন ধারাবাহিক সরকারগুলি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আশ্রয় দেয় এবং সুরক্ষিত রেখেছিল। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত এজাহারকারী কোনাে মামলা দায়ের করলে তাতে তাঁর জীবনের ঝুঁকি ছিল এবং যেহেতু উক্ত দলের সভাপতি কোনাে পদক্ষেপ নেননি, তাই তিনি এফআইআর দায়ের করেন। এই 1167 on State Vs. Fazal, 39 DLR (AD) 166, Md. Shamsuddin @ Lambu Vs. State, 40 DLR (AD) 69, Tara Singh and others Vs. State of Punjab 1991 Supp (1) SCC 536, Jamna Vs. State of UP 1994 Supp (1) SCC 185 978 State of HP Vs. Shreekanta Shekari (2004)
8 SCC 153- মামলাগুলাে উদ্ধৃত করেছেন।
৫৫৭. এই মামলাটি ঘটনার তারিখের ২১ বছর পরে দায়ের করা হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিলম্বের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা হয়েছে এবং বিজ্ঞ বিচারকরা ব্যাখ্যাটি বিশ্বাস করেছেন এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, প্রসিকিউশন উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে বিলম্বকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এ বিষয়ে প্রথম বিজ্ঞ বিচারক নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ করেছেন :
“বর্তমান মামলায়, এফআইআর দায়েরে বিলম্বের বিষয়টি নিয়ে যথেষ্টভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং তা বিবেচনায় রেখে, বেশ কয়েক বছর বিরতির পরে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে এমন যুক্তিতে কারসাজি এবং মিথ্যাভাবে সম্পৃক্ত করার অভিযােগ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা যায় না।”
৫৫৮. অপরদিকে, বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক, পি.ডব্লিউ-৪৪ এবং অন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য-প্রমাণাদি বিবেচনা করে নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন :
“বেশির ভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তি ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সাল থেকে বঙ্গভবনে অবস্থান করত এবং অলিখিত কমান্ড কাউন্সিলের নামে তারা ৪ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করত। যদিও তারপরও তারা প্রভাব ছাড়া থাকেনি। অভিযুক্ত মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান সাভার ও বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ করার চেষ্টা করে এবং অভিযুক্ত মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ ১৯৭৬ সালে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কমান্ড গ্রহণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৯৮০
৬৩০

সালে তারা আবার সরকার উৎখাত করার আরেকটি প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু তখনও সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বরং তাদের সবাইকে বকেয়া বেতন দেওয়া হয়েছিল। এমনকি অভিযুক্ত মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করে (পি.ডব্লিউ-৪৪)। সুতরাং, এজাহারকারীর তাঁর জীবন এবং শরীরের নিরাপত্তা সম্পর্কে আতঙ্ককে অযৌক্তিক বলা যায় না। এইরূপ পরিস্থিতিতে, এফআইআর দায়েরে বিলম্ব বিচারকে কলুষিত করতে পারে না, কারণ সর্বোপরি প্রসিকিউশনকে সর্বদাই প্রমাণের ভিত্তিতে তার মামলা প্রমাণ করতে হয়, এবং মামলা দায়েরে বিলম্বের বিষয়ে আপিলকারীদের পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবীর বক্তব্যের কোনাে ভিত্তি নেই।”
৫৫৯. আমার কাছে মনে হয়, কারণ নির্ধারণের বিষয়ে বিজ্ঞ বিচারকগণ বিলম্বের ব্যাখ্যাটিকে যুক্তিসঙ্গত হিসেবে বিশ্বাস করেছেন। এটি নথিতে থাকা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ঘটনা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত। সেহেত, সত্যতার সন্ধান বের করার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য পর্যালােচনায় কোনাে ভুল না থাকলে বা যুক্তি-তর্কে উল্লিখিত সাক্ষ্য-প্রমাণের উপাদান উপেক্ষিত না হয়ে থাকলে এই আদালত তাতে কোনাে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। এটি সত্য যে, ফৌজদারি মামলায় প্রাথমিক তথ্য বিবরণী বিচারের সময় উপস্থাপিত মৌখিক সাক্ষ্যকে সমর্থন করার লক্ষ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান সাক্ষ্য। প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর গুরুত্ব অভিযুক্তের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। এই বিবরণী দাখিলে বিলম্ব কখনাে কখনাে পরবর্তী চিন্তার সৃষ্টি ফল। বিলম্বের কারণে বিবরণীটি কেবল যে স্বতঃস্ফূর্ততার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় তা নয়, এতে পরামর্শের মাধ্যমে সাজানাে কথা, সাজানাে গল্প বর্ণনার মতাে বিপদেরও আশঙ্কা তৈরি করে। অভিযুক্তকে জড়িত করার ক্ষেত্রে যদি সাক্ষীদের কোনাে বিশেষ উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে এমনকি দীর্ঘ বিলম্বও অগ্রাহ্য করা যেতে পারে।
৫৬০. বিলম্বের পয়েন্টে আইনের নীতিটি বিতর্কিত নয়। উচ্চ আদালতগুলির সামঞ্জস্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হলাে কেবল মামলা দায়েরে বিলম্ব প্রসিকিউশনের মামলা অবিশ্বাস করার ভিত্তি নয়। কারণ এমন বিভিন্ন পরিস্থিতি রয়েছে যেখানে অপরাধ সংঘটনের বিষয়ে কোনাে মামলা দায়ের করা বিলম্বিত হতে পারে। Srikanta Shekari (supra) মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে যে :
“প্রাথমিক তথ্য বিবরণী দাখিল করতে বিলম্ব হলে তা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা বাতিল করার এবং মামলার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ করার জন্য কোনাে প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এক্ষেত্রে বিলম্বের জন্য কোনাে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে কিনা তা অনুসন্ধান এবং দেখাটাই আদালতের বিষয়বস্তু। একবার এটি করা হলে, তা সন্তোষজনক কিনা আদালত কেবল সেটিই দেখবেন। যদি প্রসিকিউশন সন্তোষজনকভাবে বিলম্বের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয় এবং এই জাতীয় বিলম্বের কারণে প্রসিকিউশনের বর্ণনা অতিরঞ্জিত সৃজিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে এটি একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়। অন্যদিকে, বিলম্বের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা মিথ্যা সম্পৃক্ততা ও প্রসিকিউশন মামলার প্রতি মিথ্যা বা দুর্বলতার অপবাদ প্রত্যাখ্যান করার পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী।”
৫৬১. Ramjag Vs. State of uP, AIR 1974 SC 606 মামলায় নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে :
“এটা সত্য যে, প্রতি ঘণ্টা বিলম্বের বিষয়ে সাক্ষীদের প্রশ্ন করা যায় না এবং অযৌক্তিক বিলম্বের পরে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী দাখিল করা হয়েছিল কিনা, যেখানে সাক্ষ্যের হেরফের ঘটানাের পর্যাপ্ত সুযােগ থেকে যায়, সেটি নিরূপণের জন্য একটি সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে। বিলম্ব
৬৩১

এতটা দীর্ঘ কিনা যা রাষ্ট্রপক্ষের মামলাকে সন্দেহের মেঘে আবৃত করার মতাে, সেটি অবশ্যই বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে যা মামলাভেদে ভিন্ন হতে পারে। এমনকি একটি ঘটনার বিবরণ দাখিল করতে দীর্ঘ বিলম্বকেও মওকুফ করা যেতে পারে, যদি যেসব সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপর প্রসিকিউশন নির্ভর করে তাদের অভিযুক্তকে মামলায় সম্পৃক্ত করার কোনাে উদ্দেশ্য না থাকে।”
৫৬২. এজাহারকারী তার এফআইআরে মাত্র ১৪ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করেছেন। তিনি আপিলকারী মেজর বজলুল হুদার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অপরাধ করার সুনির্দিষ্ট অভিযােগ করেছেন এবং আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানসহ আরাে ৩ জন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছেন এবং বাকি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের মাধ্যমে জড়িত করেছেন। তাঁর যদি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মামলায় সম্পৃক্ত করার কোনাে অসৎ উদ্দেশ্য থেকে থাকত তবে তিনি সেখানে প্রতিটি অভিযুক্ত ঢক্তির ভূমিকা সরাসরি উল্লেখ করতে পারতেন, তবে তিনি সেই পথে অগ্রসর হননি। এসব থেকে এটি দেখা যায় যে, এই এফআইআরটি সাজানাে বা পরবর্তী চিন্তার ফসল নয়, বরং এজাহারকারী ঘটনাস্থলে যা দেখেছিলেন এটি তারই সত্য বর্ণনা। আপিলকারীগণ এবং অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এই ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে যেসব সাক্ষ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তার সবই মামলার তদন্ত চলাকালীন তদন্তকারী সংস্থার মাধ্যমে এসেছে।
৫৬৩. এফআইআর দায়েরে বিলম্বের বিষয়টি বিবেচনার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় রয়েছে, যা উপেক্ষা করা উচিত নয়। ঘটনার পরে খােন্দকার মােশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং ২০ আগস্ট, ১৯৭৫-এ সামরিক আইন জারি করেছিলেন এবং ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ থেকে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতাসহ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এরপরে তিনি ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ তারিখে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ জারি করেন। এই অধ্যাদেশটিতে নির্দিষ্ট কিছু কাজের ক্ষেত্রে ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনাে আইনি বা অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা রাখা হয়েছিল; যে কাজগুলাে এই ব্যক্তিদের দ্বারা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন এবং ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর সামরিক আইন ঘােষণার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে বা এর সাথে সম্পর্কিত কোনাে পরিকল্পনার প্রস্তুতি বা তা কার্যকর করার জন্য করা হয়েছিল। উক্ত অধ্যাদেশ জারির পরেও এফআইআর দায়ের করা যেত কি না তা একটি আইনের ব্যাখ্যার বিষয়, তবে অভিযুক্তকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে এই জাতীয় অধ্যাদেশ জারির পর যে কেউ এ বিষয়ে কোনাে মামলা দায়ের করার আগে দ্বিতীয়বার ভাববেন। এটির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে, যা কর্নেল শাফায়াত জামিলের (পি.ডব্লিউ-৪৪) সাক্ষ্য থেকে প্রমাণিত। তিনি বলেছেন যে, ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা এবং হত্যাকারী কর্মকর্তা মেজর ফারুক রহমান এবং রশিদ সব সময় বঙ্গভবনে থাকত; তাদের সহযােগী কর্মকর্তারা রেডিও স্টেশনে অবস্থান করত এবং তারা অলিখিত বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল গঠন করে নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ বজায় রেখে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের নেতৃত্বে দেশ শাসন করছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন, যেহেতু ১৫ আগস্টের ঘটনার পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত হত্যাকারীরা ক্ষমতাসীন সরকারের সুরক্ষায় ছিল, সেহেতু হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব ছিল না। এই বিবৃতিটি অতিরঞ্জিত বলা যায় না। এটি স্বীকৃত যে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যদের বাসভবনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ক্ষমতাসীন সরকারগুলাে যদি অপরাধীদের সমর্থন না করত তাহলে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণের জন্য একটি মামলা দায়ের করা এবং তাদেরকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা তাদের কর্তব্য ছিল। কিন্তু এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে, মাইনি প্রক্রিয়াকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া হয়নি। বরং ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে তারা।
৬৩২

অপরাধীদের রক্ষা করতে চেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে তারা বরখাস্তকৃত সেনা কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করেছিল এবং এরপর তাদের প্রায় সবাইকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করা হয়েছিল এবং বৈদেশিক মিশনগুলােতে নিয়ােগ দিয়েছিল। ক্ষমতায় থাকা ধারাবাহিক সরকারগুলি কেবল এটাই প্রকাশ করেনি যে, এই হত্যাকাণ্ডের পক্ষে তাদেরও মৌন সমর্থন ছিল, একই সাথে তারা আইনের শাসনের প্রতি দৃশ্যমান অসম্মান প্রদর্শন করেছিল।
৫৬৪. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল দেশের রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না, তিনি জাতির পিতা। কিন্তু দেশের মানুষ হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে ২১ বছর অপেক্ষা করেছিল, কারণ ঐ সময়ের ক্ষমতাসীন সরকারগুলাে হত্যাকারীদের সুরক্ষা দিয়েছিল। এই বিষয়টি এজাহারকারীর দেওয়া ব্যাখ্যাকে যৌক্তিক করেছে যে, প্রতিহিংসার ভয়ে তিনি কোনাে মামলা দায়ের করেননি। সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ে শপথ গ্রহণ করেন :
“আমি সংবিধান সংরক্ষণ, সুরক্ষণ এবং রক্ষা করব এবং আমি আইন অনুসারে সকল মানুষের অধিকার রক্ষা করব- ভয়, পক্ষপাত, আনুকূল্য বা বৈরী ইচ্ছা ছাড়াই।” (That I coill preseroe, protect, and defend the Constitution and that I will do right to all manner of people according to law, without fear and favor, affection or ill-will.)
৫৬৫. রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর শপথের প্রতিটি শব্দ এবং অভিব্যক্তি একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়। প্রতিটি লাইন পাঠ করে এই বার্তার অন্তর্নিহিত বক্তব্য বুঝতে হবে এবং যা দেখা যায় তার বাইরেও দৃষ্টি দিতে হবে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে অবশ্যই সংবিধানের প্রতি বিশ্বাস এবং আনুগত্য বহন করতে হবে। এটি কেবল সাংবিধানিক নীতিগুলিতে বিশ্বাস দাবি করে না, বরং সাংবিধানিক বিশ্বাসের সাথে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের অনুরূপ একটি আনুগত্য এবং নিষ্ঠার বিষয়। এই পবিত্র ঘােষণা তারা উপেক্ষা করেছিলেন যখন তাদেরই প্রয়ােজন ছিল দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের। গৃহীত শপথের অধীনে তারা সংবিধান রক্ষা ও সুরক্ষার জন্য এবং “আইন অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন করার জন্য বাধ্য ছিলেন। কিন্তু সেই সরকারগুলি “আইন অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। হত্যার অপরাধ একটি আমলযােগ্য অপরাধ এবং এই জাতীয় অপরাধের জন্য এফআইআর দায়ের করা এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই অপরাধের তদন্ত করা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৭৩ ধারার অধীনে তার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় থানার অফিসার-ইন-চার্জের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এমনকি কোনাে ব্যক্তির আত্মহত্যা বা সন্দেহভাজন হত্যার ক্ষেত্রেও যদি থানার অফিসার-ইন-চার্জ কোনাে তথ্য পেয়ে থাকেন তবে তিনি সুরতহালের জন্য নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটকে অবিলম্বে তা অবহিত করবেন এবং সরকার কর্তৃক ভিন্নরূপ নির্দেশিত না হলে নিহতের মরদেহ যে জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল সেখানে গিয়ে তার আশপাশের দুই বা ততােধিক দায়িত্বশীল বাসিন্দার উপস্থিতিতে তদন্ত করবেন এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৭৪ ধারার বিধান অনুসারে মৃত্যুর আপাত কারণ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন। যত দ্রুত সম্ভব ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সুরতহাল প্রতিবেদন জমা দেওয়াও পুলিশ কর্মকর্তার কর্তব্য। এক্ষেত্রে এই পদ্ধতিগুলি পুলিশ অফিসার কর্তৃক সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে, যা তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেক কথা বলে। কারাে কর্তৃক দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে যদি কোনাে মামলা দায়ের না-ও হয়ে থাকে, তবু সরকারের একটি মামলা দায়ের করার বাধ্যবাধকতা ছিল এবং যেহেতু তারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, তারা অবশ্যই তাদের গৃহীত শপথ লঙ্ঘন করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, পরিবারের সদস্যদের
৬৩৩

সাথে দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পরেও আইনকে নিজের পথে চলার অনুমতি না দিয়ে পরবর্তী সরকারগুলির আচরণ প্রমাণ করে যে, আইনের শাসনের প্রতি তাদের কোনাে সম্মান ছিল না। তকালীন রাষ্ট্রপতির আক্রমণকারীরা কেবল হত্যার অপরাধই সংঘটিত করেনি, বরং তারা একটি শিশু এবং তিনজন নিরীহ নারীকে হত্যা করে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে।
৫৬৬. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জনাব আজমালুল হােসেন ক্ষমতাসীন সরকারগুলাের আচরণের তীব্র সমালােচনা করেছেন। জনাব হােসেন দাবি করেন যে, বিচারব্যবস্থা উক্ত সময়ে সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। যা দায়মুক্তি পেতে পারে না। বিচারব্যবস্থার এই ব্যর্থতা দেশে ব্যাপক এবং বিপর্যয়কর প্রভাব এনেছে, জনস্বার্থ রক্ষার্থে যার পুনরাবৃত্তি কখনােই ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। তাঁর মতে, এটি ইতিহাসের এমন একটি অংশ যা কখনই মুছে ফেলা যায় না। পুরাে প্রশাসনের শীর্ষ থেকে নীচ পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি আমাদের ইতিহাসের একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে অভিহিত হবে, এবং এই ধরনের অনুশীলন চিরকালের জন্য বন্ধ হওয়া উচিত- এর পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া উচিত নয়। আমি বিজ্ঞ আইনজীবীর মতামতের সাথে পুরােপুরি একমত। যখনই কোনাে ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হয়, এ সাথে কোনাে দেওয়ানি ক্ষতি জড়িত থাকুক বা না থাকুক, অপরাধী রাষ্ট্র দ্বারা শাস্তির জন্য দায়ী হয়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন কোনাে ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ বা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে নয়, বরং অপরাধের শাস্তি হিসেবে এবং অনুরূপ অপরাধকে নিরুৎসাহিত করার জন্য এবং কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীর সংশােধনের জন্য। এখানে বিষয়টি পাবলিক ল’-এর একটি, ক্ষতিগ্রস্ত যে কোনাে ব্যক্তির সম্মতি ছাড়াই অপরাধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র মামলা দায়ের করতে পারে।
৫৬৭. উপরােক্ত যুক্তিগুলিকে সমর্থন করার সময় রাষ্ট্রপক্ষের বিজ্ঞ কাউন্সেল জনাব তৌফিক নওয়াজ নিবেদন করেন যে, এই আপিলগুলিতে উত্থাপিত সাংবিধানিক ইস্যুগুলাে সমাধান করা এই আদালতের প্রতি একটি গুরুদায়িত্ব রয়েছে এবং তা যেন সংবিধানের বিধানগুলি অবজ্ঞা করে বা পর্যাপ্তভাবে বিবেচনা না করে কেবল সংবিধিবদ্ধ আইন, বিদেশি সংবিধিবদ্ধ আইন বা নজিরগুলির রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করে করা হয়; বিশেষত, যেহেতু এই হত্যার শিকার সংবিধানের অধীনে একজন রাষ্ট্রপতি এবং জাতির পিতা।
৫৬৮. ন্যায়বিচার কী? আইনের সঙ্গে ন্যায়বিচার কীভাবে সম্পর্কিত? Lucas (1980:3)-এর মতে, ন্যায়বিচার “অনুগ্রহ, উদারতা, কৃতজ্ঞতা, বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতার থেকে পৃথক”। এটি এমন কিছু নয় যার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞতা বােধ করা উচিত, বরং এটি এমন কিছু যার উপর আমাদের জোর দেওয়ার অধিকার। রয়েছে। প্লেটোর মতে ন্যায়বিচার সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। ন্যায়বিচার চারটি নাগরিক গুণগুলির মধ্যে একটি; অন্যগুলাে হলাে প্রজ্ঞা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সাহস। একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্রে প্রত্যেকে তার ভূমিকা পালন করে এবং অন্যদের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। সেটিই প্রতিটি ব্যক্তির ভূমিকা যেটির জন্য ঐ ব্যক্তি প্রাকৃতিকভাবে সর্বোত্তমভাবে যেখানে উপযুক্ত সেখানে থাকে। তাহলে স্বাভাবিক আইন বহাল থাকে। অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে, আইনের মধ্যেই ন্যায়পরায়ণতার অস্তিত্ব রয়েছে এবং আইন হলাে “সকলের বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অলিখিত প্রথা যা কোনটি সম্মানজনক এবং কোনটি নয় তার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে।” নিরপেক্ষতার ধারণাটি আমাদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল বিষয়।
৫৬৯. আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতৃপুরুষরা তাদের নতুন রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন এভাবে : “সরকার মানুষের নয়, আইনের”। প্রথম দিকের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট, যেখানে বাক্যটি প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা ছিল :
“আইনের সরকার, মানুষের নয়”। এমন একটি সরকারব্যবস্থা যেখানে নির্বাহী, আইনসভা ও বিচার
৬৩৪

বিভাগ প্রতিটি পৃথক হাতে থাকে এবং এর প্রত্যেকটি মূলত তার নিজস্ব ক্রিয়াকলাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে- সেটি আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা পিতৃগণ স্বাধীনতার সেরা সুরক্ষা হিসেবে গণ্য করেছিলেন। যেখানে আইনের শেষ, সেখানে অত্যাচার শুরু- এই শব্দগুলি ওয়াশিংটন ডিসিতে বিচার বিভাগের বিল্ডিংয়ের উপরে চিত্রিত রয়েছে। উভয়ের অন্তর্নিহিত কথা এই যে, আইন হলাে স্বেচ্ছাচারী শক্তির বিরােধিতা মাত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আঠারাে শতকের ইউরােপের নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিরােধিতা করে সচেতনভাবে গঠিত হয়েছিল। স্বৈরাচারী শাসকের অত্যাচারের বিভীষিকা আমেরিকান সংবিধান প্রণেতাদের মনকে আলােড়িত করেছিল।
৫৭০. বাংলাদেশ যখন তার স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠাতা পিতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যেখানে শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ এবং অন্য কোনাে ধরনের বৈষম্য। নির্বিশেষে সকলের জন্য সমান সুযােগ থাকবে। আমরা গণতন্ত্রকে সরকারের রূপ হিসেবে গ্রহণ করেছি। কারণ এটি মর্যাদাবােধ, অধিকার এবং মানবজাতির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে উদ্বিগ্ন মানুষের মধ্যে বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিবর্তিত উত্তম এবং সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য ধারণা। মৌলিক অধিকারের অধ্যায়টি কেবল স্বাধীনতা এবং স্বাধিকার নিশ্চিতের জন্য নয়, বরং তা সমতা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে সমান সুযােগ নিশ্চিত করার জন্য রচিত হয়েছিল। আমরা যে গণতান্ত্রিক পরিকাঠামাে গ্রহণ করেছি তা যেন নিজেকে একটি নৈরাজ্যিক রাষ্ট্রে রূপান্তর না করতে পারে সেই লক্ষ্যে গণপরিষদ কিছু নির্দিষ্ট মৌলিক ধারণাসহ সংবিধান রচনা করেছিল, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলাে আইনের শাসনের ধারণা। আইনের শাসন সুনির্দিষ্ট নীতি এবং বাধ্যতামূলক নজিরের উপর নির্ভর করে, যা একই সাথে নিশ্চয়তা, অভিন্নতা এবং অনুমানযােগ্যতার সুযােগ দেয়, যার ফলস্বরূপ ন্যায্যতা এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তি তৈরি হয়। আইনের শাসন’ শব্দটি আলবার্ট ভেন ডাইসির নামের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, যার লেখা Introduction to the study of the Laao of the Constitution, বইটি সম্ভবত ব্রিটিশ সংবিধানের উপর লেখা সেরা এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বই। ডাইসি “আইনের শাসন” সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে নিম্নবর্ণিত অন্তত তিনটি স্বতন্ত্র ধারণা অন্তর্ভুক্ত করেছেন :
“(১) প্রথমত, আমরা মনে করি যে, এর অর্থ হলাে দেশের সাধারণ আদালতের সামনে সাধারণ আইনি পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠিত আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ন ব্যতীত কোনাে মানুষ শাস্তিযােগ্য হবে না অথবা তাকে শারীরিক বা সম্পদের দিক থেকে আইনতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। এই অর্থে, আইনের শাসন হলাে বিস্তৃত, স্বেচ্ছাচারী বা discretionary powers of constraint-এর ভিত্তিতে ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের অনুশীলন যা গঠিত প্রতিটি সরকারব্যবস্থার বিপরীত।
(২) দ্বিতীয়ত আমরা বলতে চাই, যখন আমরা আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য হিসেবে “আইনের শাসন” সম্পর্কে কথা বলি তখন কেবল আমাদের সাথে কোনাে মানুষ আইনের ঊর্ধ্বে নয় তা নয়, বরং (যা একটি আলাদা বিষয়) এখানে প্রতিটি মানুষ, তার পদমর্যাদা বা অবস্থা যা-ই হােক না কেন, রাষ্ট্রের সাধারণ আইনের অধীন এবং তারা সাধারণ ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারের অধিভুক্ত।
(৩) এখানে একটি তৃতীয় এবং ভিন্ন ধারণা রয়ে গেছে, যেখানে আইনের শাসন বা আইনি চেতনার প্রাধান্যকে ইংরেজ প্রতিষ্ঠানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। আমরা বলতে পারি যে, সংবিধান আইনের শাসন দ্বারা এই ভিত্তিতে বিস্তৃত হয়েছে যে, সংবিধানের সাধারণ নীতিগুলি (উদাহরণস্বরূপ ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার বা জনসাধারণের বৈঠকের
৬৩৫

অধিকার) সাধারণ ব্যক্তিদের অধিকার নিরূপণের জন্য আদালতের সামনে আনার ফলে বিচারিক সিদ্ধান্তের ফলাফল হিসাবে আমরা পেয়েছি; যদিও অনেক বিদেশি সংবিধানের অধীনে ব্যক্তির অধিকারের নিরাপত্তা (এক্ষেত্রে যেমন) সংবিধানের সাধারণ নীতির ফলে আসে বা আসে বলে প্রতিভাত।”
৫৭১. আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, “আইনের শাসন” অর্জন অন্যতম লক্ষ্য। মাহমুদুল ইসলাম তাঁর Constitutional Lab of Bangladesh শীর্ষক গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণের ১.৮৪ অনুচ্ছেদে বলেছেন : “আইনের শাসন বাংলাদেশের সংবিধানের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সংবিধানে “আইনের শাসনের অর্থ কীভাবে বিধৃত হয়েছে? প্রস্তাবনা থেকে দেখা যায় যে, মৌলিক মানবাধিকার এবং স্বাধীনতা, সাম্য এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার আইনের শাসনের” পরে উল্লেখ করা হয়েছে, যেন এই ধারণাগুলি “আইনের শাসনের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ থেকে একজন যুক্তি দেখাতে পারেন যে, সংবিধানে বিধৃত ‘আইনের শাসন আইনের নিশ্চয়তা, আইনের প্রচার এবং এর অভিন্ন। প্রযােজ্যতা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং এখানে আইনের গুণগত মানের কোনাে উল্লেখ নেই; সংবিধান ‘আইনের শাসন থেকে পৃথকভাবে ন্যায়বিচারের বিষয়টি আলােচনা করে। এই যুক্তিটি নিছক একাডেমিক। আইনের শাসন’-এর প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। সংবিধানের প্রণেতারা, প্রস্তাবনায় ‘আইনের শাসন’ উল্লেখ করার পরে, আইনের গুণাগুণের দিকগুলি স্পর্শ করে অন্যান্য ধারণাগুলি উল্লেখ করার জন্য বাড়তি যত্ন নিয়েছিলেন। এর ফলে পরবর্তী পর্যবেক্ষকদের দ্বারা প্রস্তাবিত আইনের শাসনের ধারণার সাথে তাদের আনুগত্য দৃশ্যমান হয়। প্রস্তাবনার প্রাসঙ্গিক অনুচ্ছেদটি যদি এটির যথাযথ প্রেক্ষাপটে সার্বিকভাবে পাঠ করা হয়, তবে সেখানে কোনাে সন্দেহ থাকে না যে, সংবিধানের প্রণেতাদেরও উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী পর্যবেক্ষকদের সমর্থিত ‘আইনের শাসন’ অর্জন। রাষ্ট্রের এই মৌলিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য, সংবিধানে এমন একটি রাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠায় মূল বিধান রাখা হয়েছে যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি কার্যনির্বাহীকে অবশ্যই আইনের রেফারেন্সসহ তার কাজের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করতে হবে।”
৫৭২. বিভিন্ন ধরনের অপরাধের মধ্যে হত্যার অপরাধ বা হত্যাকাণ্ড সংঘটনে আদেশ প্রদান স্পষ্টতই অবৈধ এবং অনৈতিক। হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতন, এমনকি নাৎসিদের অধীন জার্মানিতেও অন্য যে কোনাে জায়গার মতাে বেআইনি ছিল। এ কারণেই নাৎসিরা কখনােই গণহত্যার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেনি; কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের হত্যার নির্দেশ সবসময় প্রচ্ছন্ন ভাষায় দেওয়া হয়েছে। এমনকি নাৎসিরা এটি স্বীকার করে নিয়েছিল যে, কোনাে আইনি ব্যবস্থার মধ্যে এই ধরনের আচরণ কখনই ন্যায়সঙ্গত হতে পারে না। ১৮৮৫ সালের ডাইসির দ্বারা প্রযুক্ত আইনের শাসনের ধারণাটি আমরা কেবল উপেক্ষাই করিনি, বরং মানবতার বিরুদ্ধে হওয়া কোনাে অপরাধকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম এবং নাৎসিদের সরকার যেভাবে সেই অপরাধের অপরাধীদের প্রতি অন্ধ দৃষ্টি রেখেছিল, সেইভাবে এই অপরাধের জন্য অপরাধীদের পুরস্কৃত করেছিলাম। এটি এই জাতির ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আইনের শাসনের ধারণাটি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত এবং আমাদের সংবিধানের প্রতিষ্ঠাতা পিতৃগণও সেই নীতিটি গ্রহণ করেছিলেন। তবে আমাদের জাতির পিতার হত্যার ক্ষেত্রে আমরা তা প্রয়ােগ করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম।
৫৭৩. ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মূল উপাদানগুলি হলাে একটি নিরপেক্ষ সত্য-অনুসন্ধান প্রক্রিয়া এবং একটি সুষ্ঠু ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান। যারা এই ব্যবস্থার ভেতরে কাজ করেন তাদের নৈতিক দায়িত্ব হলাে
৬৩৬

ন্যায়বিচারের ধারণার সাথে স্বাভাবিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকা। একটি দেশে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা দেশের নাগরিকদের এই ধরনের কার্যকলাপে লিপ্ত এক শ্রেণির মানুষের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা করার জন্য গঠিত হয়। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের অভিভাবক হিসেবে বিচার, প্রশাসন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার কর্তব্যকাজে বাধ্য। যে অপরাধী অপরাধমূলক কর্মে লিপ্ত তার অপরাধ যত দ্রুত সম্ভব নির্ধারণ করা জনগণের স্বার্থেই প্রয়ােজন। তবে, দুর্ভাগ্যক্রমে, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ক্ষেত্রে এই ধারণাটি উপেক্ষিত হয়েছে। একটি শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা থাকার জন্য, অপরাধের সাথে জড়িত প্রত্যেক অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা জরুরি এবং তার বিচারটি যুক্তিসঙ্গত দ্রুত গতিতে চলতে হবে। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সামনে চ্যালেঞ্জগুলি হলাে নাগরিকদের অধিকারে সমতা আনা এবং একই সাথে নাগরিকদের জন্য কল্যাণরাষ্ট্র নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত এবং কার্যকর বিচার সম্পন্ন করে অভিযুক্তদের অধিকারের ভারসাম্য রক্ষা করা। সাধারণ মানুষের ন্যায়বিচারের অধিকার না থাকলে আইনের শাসন অর্থহীন।
৫৭৪. বিদ্রোহের অজুহাত (Plea of Mutiny)
যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, নথিতে থাকা সাক্ষ্য এটি প্রকাশ করেছে যে, ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এ হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতা পরিবর্তন কিছু সেনা কর্মকর্তার বিদ্রোহের ফল এবং সেহেতু কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের বিধানের অধীনে আপিলকারীদের বিচার ছিল এখতিয়ারবিহীন। বিজ্ঞ আইনজীবীদের মতে, বিচারটি আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এর বিধানের অধীনে কোর্ট মার্শাল দ্বারা অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ আর্মি অ্যাক্টের ধারা ৩১(ক), ৫৯(৩), ৯২(২), ৯৪ এবং ৯৫, পেনাল কোডের ধারা ৫ এবং ১৩৯ এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ধারা ৫৯৪(২) উদ্ধৃত করেছেন।
৫৭৫. জনাব খান সাইফুর রহমান যুক্তি দেখিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ড সৈনিকদের আলােচিত বিদ্রোহের ঘটনা ছিল কিনা সেটি নির্ধারণ ছাড়া সাধারণ ফৌজদারি আদালত কর্তৃক আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ এখতিয়ারবহির্ভূত। বিজ্ঞ আইনজীবীগণ আরাে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আলােচ্য ঘটনাটি ১৪ আগস্ট রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, যা থেকে পরিষ্কার যে, এটি নিছক একটি বিদ্রোহ ছিল, হত্যাকাণ্ড নয়। সুতরাং, আপিলকারীদের বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা বিনষ্ট হয়েছে। বিজ্ঞ আইনজীবী যুক্তি দেখিয়েছেন যে, পেনাল কোডের ধারা ৩৪ এবং ১২০ক-এর মাঝে বিধৃত অর্থের আলােকে কোনাে ঐকমত্য, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, পূর্বপরিকল্পনা বা প্রি-অ্যারেঞ্জড প্ল্যান ছিল না। সুতরাং পেলে কোডের ধারাগুলাের অধীনে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ ছিল বেআইনি। বিজ্ঞ আইনজীবী আরাে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, যখন কোনাে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার বা এমন কোনাে ব্যক্তি, যিনি আর্মি অ্যাক্টের অধীন নন, তিনি ১৪ আগস্ট-পরবর্তী রাতের ঘটনায় যুক্ত হন, তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে আর্মি অ্যাক্টের ৩১ ধারার অধীন বিদ্রোহ সংঘটন করেছিলেন এবং তাদের আর্মি অ্যাক্টের অধীনে কোর্ট মার্শালে বিচার হওয়া উচিত ছিল। বিজ্ঞ আইনজীবী সবশেষে যুক্তি দেখান যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই তারা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন এবং তারা আর্মি অফিসারদের দ্বারা নিহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে আর্টিলারি এবং ল্যান্সার ইউনিটের আর্মিরা ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে ১৫ আগস্ট ভােরে তার অফিসিয়াল বাসভবনে তাঁকে হত্যা করে। অন্যদিকে, জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে আর্মি বের হয়ে ২৯ মে-পরবর্তী রাতে সার্কিট হাউজে, যেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন, সেখানে তাঁকে হত্যা করে। যেহেতু উভয় ঘটনা
৬৩৭

একইভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তাই আপিলকারীরা, যদি ১৫ আগস্টের ঘটনার সাথে তারা আদৌ জড়িত হয়ে থাকে, তাহলে চিফ অব আর্মি স্টাফ দ্বারা আহূত কোর্ট মার্শালে তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল, যেমনটি করা হয়েছিল জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যার ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে বিজ্ঞ আইনজীবী Jamil Huq s. Bangladesh, 34 DLR (AD) 125 মামলাটি উদ্ধৃত করেছেন।
৫৭৬. অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক এবং বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন যে, ঘটনাটি কোনাে বিদ্রোহ নয়, বরং একটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং সেহেতু কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের অধীনে আপিলকারীদের বিচার করতে কোনাে আইনগত বাধা নেই। এ সম্পর্কে তারা আর্মি অ্যাক্টের ধারা ৫৯, ৯২, ৯৪ এবং ৯৫ এবং ১৯৬১ সালের নেভি অর্ডিন্যান্সের ৩৫ ধারা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারা উদ্ধৃত করেছেন। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল যােগ করেন যে, আপিলকারীরা বিচার আদালতে এই বিষয়টি উত্থাপন করেনি এবং মামলাটির নিষ্পত্তি বিলম্বিত করার হীন উদ্দেশ্যে হাইকোর্টে বিষয়টি উত্থাপন করেছে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, নথিতে থাকা সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্রোহের কোনাে কেস সমর্থন করে না, বরং এগুলাে হত্যার মামলাকেই প্রকাশ করে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল সবশেষে মতামত ব্যক্ত করেন যে, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ঘটনাটি আর্মি অ্যাক্টের ধারা ৫৯(২) ও ৮(২)-এর আলােকে একটি সিভিল অফেন্স’, তবু এই আইনের ৯৪ ধারা অনুযায়ী ঐ অপরাধের বিচারে ফৌজদারি আদালতের সমান্তরাল এখতিয়ার রয়েছে।
৫৭৭. উভয় পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীগণের প্রদর্শিত যুক্তি সম্পর্কে আলােচনা করার আগে আমি এই মামলায়
কিছু স্বীকৃত বিষয় তুলে ধরতে চাই। আমি লক্ষ করেছি যে, জেরার মাধ্যমে বা রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের প্রতি সাজেশন প্রদানের মাধ্যমে বা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারার অধীনে তাদের পরীক্ষার লিখিত জবাবদানের মাধ্যমে বা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪০(৩) ধারা অনুসারে সাক্ষ্য উপস্থাপনের মাধ্যমে আসামিপক্ষ বিদ্রোহের কোনাে অজুহাত (plea of mutiny) উত্থাপন করেননি। যেহেতু প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীরা বিদ্রোহের অজুহাত (plea of mutiny) সম্পর্কে কোনাে কিছু বলেননি, সেহেতু আসামিপক্ষের উচিত ছিল অন্তত সাক্ষীদের প্রতি এই সাজেশন রাখা যে, ঘটনার সাথে জড়িত আর্মি অফিসাররা সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষের নিকট তাদের দাবি-দাওয়া জমা দেওয়ার পরও তাদের দাবি না মানার কারণে তারা বিদ্রোহ করেছিল। দ্বিতীয়ত, দাবিকৃত মতে ‘বিদ্রোহ’ হয়ে থাকলে বিদ্রোহী বাহিনী তাদের কমান্ডিং অফিসারকে আক্রমণ করত এবং কমান্ডিং অফিসার জড়িত থাকলে তারা চিফ অব আর্মি স্টাফকে আক্রমণ করত। কিন্তু তারা তাদেরকে আক্রমণ করেনি, বরং তারা রাষ্ট্রপতিকে খুন করেছিল, যা প্রমাণ করে যে এটা কোনাে বিদ্রোহ নয়।
৫৭৮. লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের পক্ষ থেকে পি.ডব্লিউ-২৪ মােঃ আমিনুর রহমানকে এই সাজেশন (জেরা করাকালে) দেওয়া হয় যে, সেই সময় (যখন মেজর ডালিম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ প্রচার করছিল) মার্শাল ল’ ঘােষণার বিষয় এবং খােন্দকার মােশতাক প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি (পি.ডব্লিউ-২৪) জ্ঞাত ছিলেন। এই সাজেশন থেকে আসামিপক্ষ এটি প্রতিপাদন করতে চেয়েছিলেন যে, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ কর্তৃক একটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানাে হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হয়েছিল। আসামিপক্ষের এই দাবিটি প্রসিকিউশন পক্ষের এই কেসকে সমর্থন করে যে, খােন্দকার মােশতাক এবং কিছু বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা নির্মমভাবে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেছিল। সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিধান ছিল, কিন্তু সেই বিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হয়নি। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে বা সংবিধানে উল্লিখিত
৬৩৮

যে কোনাে কারণে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করার কথা ছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধান উপেক্ষা করা হয়েছিল। যদি সেনা অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে থাকে তাহলে অভ্যুত্থানকারী সেনাসদস্যদের অভ্যুত্থানের দায়ে আর্মি অ্যাক্টের অধীনে বিচারের আওতায় আনা উচিত ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে সেরকম কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে, দেখা যায় যে, অপরাধ সংঘটনকারীদেরকে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়েছিল এবং সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছিল পরিবর্তনের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে। পি.ডব্লিউ-৩৭ মােঃ রিয়াজুল হক তার জবানবন্দিতে বলেন, সকাল ৯টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধান, বিডিআর প্রধান, পুলিশের আইজিকে মেজর ডালিম দুই নম্বর স্টুডিওতে নিয়ে এসেছিল এবং সেখানে পরিবর্তনের পক্ষে তাদের আনুগত্যের বার্তা রেকর্ড করার পর তা প্রচার করা হয়েছিল। লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদের পক্ষ থেকে | পি,ডব্লিউ-৪৫ মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে এই সাজেশন দেওয়া হয়েছিল যে, ১৯৭৫ আগস্ট ভােরে একটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছিল যার ফলে খােন্দকার মােশতাক দেশের প্রেসিডেন্ট হন এবং প্রতিরক্ষা বিভাগের সকল প্রধানরা পরিবর্তনের পক্ষে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তিনি (সাক্ষী) এই ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, খােন্দকার মােশতাক হত্যাকারীদেরকে সূর্য রাজবংশের রাজা সূর্যের উত্তরসূরি (King Surya of the Surya Dynasty) হিসেবে ঘােষণা করেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের পক্ষ থেকে এক প্রশ্নের জবাবে কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাফায়েত জামিল (পি.ডব্লিউ-৪৪) বলেছেন যে, ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পরবর্তী সকল সরকার কর্তৃক সুরক্ষা প্রদান করা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্রকারী এবং ঘাতকরা বঙ্গভবনে অবস্থান করত এবং বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করে তারা মােশতাক সরকার পরিচালনা করত।
৫৭৯. সাক্ষীদের প্রতি প্রদত্ত উপযুক্ত সাজেশন থেকে এটা প্রতীয়মান হয়েছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ঘটনাটিকে রাষ্ট্রপতি হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হিসেবে অভিহিত করলেও পরবর্তী সরকারগুলাে তাদের হত্যার কর্মকাণ্ডকে আইনসিদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাদেরকে সূর্যসন্তান (‘Surya Santan’) | হিসেবে ঘােষণা করে পুরস্কৃত করেছিল এবং তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও নিযুক্ত করে। তারা ঘটনাটিকে বিদ্রোহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেনি, বরং তাদের কার্যক্রমকে একটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে বৈধ করার চেষ্টা করেছিল। তারা বিচার পর্যায়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে যে ডিফেন্স প্লি নিয়েছিল হাইকোর্টে তার বিপরীত এবং নতুন প্লি তুলে ধরে, যদিও সেই প্লি-এর সমর্থনে কোনাে প্রমাণ। ছিল না। এখন বিজ্ঞ আইনজীবীগণ কর্তৃক উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয়ের আইনগত দিকগুলাে বিবেচনা করা যাক। আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২-এ ‘বিদ্রোহ’ (Mutiny)-এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। কিন্তু ৩১ ধারায় বিদ্রোহের শাস্তির বিধান রয়েছে। নেভি অর্ডিন্যান্স-১৯৬১-এর ৩৫ ধারায় বিদ্রোহকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা নিম্নরূপ :
35. In this Ordinance, mutiny means a combination between two or more persons subject to service law, or between persons two at least of whom are subject to service law-
(d) to overthrow or resist lawful authority in the armed forces of Bangladesh or any forces co-operating therewith or in any part of any of the said forces;
৬৩৯

(e) to disobey such authority in such circumstances as to make the disobedience
subversive of discipline, or with the object of avoiding any duty or service, or in connection with operations against the enemy; or
(f) to impede the performance of any duty or service in the armed forces of Bangladesh or in any forces co-operating therewith, or in any part of any of
the said forces.
৫৮০. এটি নিয়ে কোনাে বিরােধ নেই যে, নেভী অর্ডিন্যান্স-এর 4(xxxiv) ধারায় সার্ভিস ল’-এর যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে তার আলােকে মিউটিনি বা বিদ্রোহের এই সংজ্ঞা আর্মি অ্যাক্টে প্রযােজ্য। সেখানে বলা হয়েছে যে, সার্ভিস ল’ বলতে “এই অর্ডিন্যান্স, আর্মি অ্যাক্ট-১৯৫২, এয়ার ফোর্স অ্যাক্ট, ১৯৫৩ এবং এই সকল আইনের অধীনে প্রণীত রুলস এবং রেগুলেশনকে বােঝাবে।” জনাব খান সাইফুর রহমান বলেন যে, আর্মি অ্যাক্টের ৫৯ ধারায় ব্যবহৃত একটিভ সার্ভিস’ অভিব্যক্তিটি এই ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। কিন্তু কেন এই অভিব্যক্তিটি আপিলকারীদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয় তা তিনি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা দৃশ্যত একটি সাংঘর্ষিক বক্তব্য। কারণ আপিলকারীরা আর্মি অ্যাক্টের কিছু ধারার উপর নির্ভর করে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ারকে চ্যালেঞ্জ করছে। আবার একই সাথে তারা উক্ত অ্যাক্টের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধানকে অস্বীকার করতে চাইছে। জনাব হক নিবেদন করেন যে, সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানাের জন্য বিদ্রোহের এই সংজ্ঞা আর্মি অ্যাক্টের ৩১ ধারার সাথে একত্রে মিলিয়ে পড়তে হবে। তাহলে আপিলকারীদের কর্মকাণ্ড বিদ্রোহের সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে না।
৫৮১. আর্মি অ্যাক্টের ৩১ ধারার (ক) উপধারা ‘বিদ্রোহ’ (mutiny)-এর অপরাধ এবং ইনসাব অর্ডিনেশনের সাথে সম্পর্কিত, যেখানে অন্য তিন উপধারা (খ), (গ) এবং (ঘ) মিউটিনি বা বিদ্রোহ সংঘটনের সহায়তা সম্পর্কিত ৷ ‘বিদ্রোহ’-এর কোনাে অপরাধকে এই আইনের আওতায় আনতে হলে অবশ্যই সশস্ত্র বাহিনীর আইনগত কর্তৃত্বকে উৎখাত বা প্রতিরােধ করা, অথবা এমন পরিস্থিতিতে কর্তৃপক্ষকে অমান্য করা যা শৃঙ্খলা পরিপন্থি হিসেবে বিবেচিত হবে অথবা বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কোনাে দায়িত্ব বা সেবা পালনে বাধা দেওয়ার মতাে অপরাধের প্রমাণ থাকতে হবে। এটি দেখানাের জন্য নথিতে এমন কিছু নেই যে, | আপিলকারীরা এবং অন্য অভিযুক্তরা তাদের কর্মকাণ্ডকে ‘বিদ্রোহ বা বিদ্রোহে সহায়তার মতাে আওতায় আনতে সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র বাহিনীর কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছিল বা অগ্রাহ্য করেছিল অথবা কর্তৃপক্ষকে মানতে অস্বীকার করেছিল। নথিতে থাকা সাক্ষ্য এটাই প্রমাণ করে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সশস্ত্র বাহিনীর আইনগত কর্তৃপক্ষকে বাধা দেওয়া বা শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করা বা অবাধ্যতার অপরাধ করার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছিল এবং তাদের অপরাধের সহযােগীদের রাষ্ট্রপতির অফিসে বসিয়েছিল যা অবশ্যই ‘বিদ্রোহের’ অপরাধ। কোনাে ব্যক্তি শাস্তিযােগ্য হবে না যদি অভিযুক্ত অপরাধটিকে কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা না যায়।।
৫৮২. ধারা ৫৯(১) অনুসারে, উপধারা ২-এর বিধানসাপেক্ষে আর্মি অ্যাক্টের অধীন কোনাে ব্যক্তি কোনাে স্থানে। কোনাে সিভিল অফেন্স’ করলে তা এই আইনের অধীনে অপরাধ বলে গণ্য হবে। আর্মি অ্যাক্টের ৮(২) ধারা অনুযায়ী ‘সিভিল অফেন্স’ হলাে সেই ধরনের অপরাধ যা বাংলাদেশে সংঘটিত হলে ফৌজদারি আদালতে বিচারযােগ্য। আর্মি অ্যাক্টের ৫৯(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, আর্মি অ্যাক্টের অধীন কোনাে ব্যক্তি আর্মি অ্যাক্টের অধীন নয় এমন ব্যক্তির প্রতি খুন বা অন্য কোনাে অপরাধ সংঘটন করলে আর্মি অ্যাক্টের
৬৪০

অধীনে বিচার করা যাবে না, যদি না সে ‘অ্যাকটিভ সার্ভিস’-এ থাকাকালীন অপরাধটি সংঘটন করে। ‘অ্যাকটিভ সার্ভিস’ কী তা ধারা ৮(১)-এ বলা হয়েছে ,যা নিম্নরূপ :
“active service”, as applied to a person subject to this Act, means the time during which such person is attached to, or forms part of a force which is engaged in operations against an enemy, or is engaged in military operations in, or is on the line of march to, a country or place wholly or partly occupied by an enemy, or is attached to or forms part of a force which is in military occupation of a foreign country.
৫৮৩. তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডটি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা যখন তারা শত্রুদের বিরুদ্ধে অভিযানে ব্যস্ত ছিল বা সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছিল বা শত্রুদের দ্বারা পুরােপুরি বা আংশিকভাবে দখলকৃত দেশ বাঁচানাের অভিযাত্রায় নিয়ােজিত ছিল- এমন সময়ে সংঘটিত হয়নি। ফলে ‘অ্যাকটিভ সার্ভিস’-এর আওতায় তারা নিজেদের ফেলতে পারবে না। উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আইনজীবী অকপটে স্বীকার করেন যে, আপিলকারীগণ ঘটনার সময় অ্যাকটিভ সার্ভিস’-এর আওতায় ছিল না। যদি আপিলকারীগণ ‘অ্যাকটিভ সার্ভিস’-এ থাকাকালীন কোনাে সিভিল অফেন্স’ করে তাহলে তারা আর্মি অ্যাক্টের অধীনে দোষী হবে। কিন্তু অন্যদিকে, অপরাধ সংঘটনের সময় তারা ‘অ্যাকটিভ সার্ভিস’-এ ছিল না বিধায় আর্মি অ্যাক্টের ৯২ ধারায় বিধৃত শর্তসাপেক্ষে কোর্ট মার্শাল এবং সাধারণ ফৌজদারি আদালতের সমান্তরাল এখতিয়ার থাকবে। ৯২ ধারায় বলা হয়েছে যে, যখন আর্মি অ্যাক্টের অধীন কোনাে ব্যক্তি কোনাে অপরাধ সংঘটন করেন এবং যখন তিনি আর্মি অ্যাক্টের অধীন নন তখন ঐরূপ অপরাধের জন্য তার বিচার করা যেতে পারে, যদি তার দ্বারা সংঘটিত অপরাধটির বিচার তিনি আর্মি অ্যাক্টের অধীন না থাকার ছয় মাসের মধ্যে শুরু হয়। ধারা ৮(১), ৮(২), ৫৯ ও ৯২ একত্রে পাঠ এ বলে যে, যদি আর্মি অ্যাক্টের অধীন কোনাে ব্যক্তি ‘অ্যাকটিভ সার্ভিস’-এ থাকাকালীন আর্মি অ্যাক্টের অধীন। নন এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে খুনের মতাে ‘সিভিল অফেন্স’ করেন তাহলে আর্মি অ্যাক্টের অধীন না থাকলেও ছয় মাসের মধ্যে তার বিচার শুরু হলে আর্মি অ্যাক্টের অধীনে কোর্ট মার্শালে তার বিচার করা যাবে। আপিলকারীদের আর্মি অ্যাক্টের অধীন না থাকার ছয় মাসের তামাদির মেয়াদ এই মামলা শুরু হওয়ার বহু পূর্বেই অতিবাহিত হয়েছে। এমনকি যদি তামাদির এই মেয়াদ অতিবাহিত না-ও হতাে তাহলেও তাদের বিচারের জন্য সাধারণ ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার বারিত হতাে না। কারণ এই আইনের ৯৪ এবং ৯৫ ধারা অনুযায়ী সিভিল অফেন্সের বিচার করার সমান্তরাল এখতিয়ার সাধারণ ফৌজদারি আদালতের রয়েছে।
৫৮৪. সাধারণ ফৌজদারি আদালত কর্তৃক সিভিল অফেন্সের বিচারের জন্য আর্মি অ্যাক্টের নবম অধ্যায়ে ধারা ৯৪ এবং ৯৫ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ৯৪ ধারা অনুযায়ী আর্মি অ্যাক্ট বা বিদ্যমান আইনের অধীনে শাস্তিযােগ্য কোনাে কর্মকাণ্ড বা বিচ্যুতির ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালত এবং কোর্ট মার্শালের সমান্তরাল এখতিয়ার রয়েছে। আর্মি অ্যাক্টের অধীনে অপরাধ হিসেবে গণ্য এমন অপরাধের ক্ষেত্রেও এটা উত্থাপিত হতে পারে। উপযুক্ত দুটি ধারার আওতায়, প্রথম ক্ষেত্রে, কোন আদালতে মামলাটি দায়ের করা হবে সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বেচ্ছাধীন বিবেচনা নির্ধারিত কর্মকর্তার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ঐ অফিসার যদি মনে করেন মামলাটি কোর্ট মার্শালে দায়ের করতে হবে তাহলে অপরাধীকে সামরিক হেফাজতে রাখতে হবে। যাই হােক, যদি কোনাে ফৌজদারি আদালত মনে করেন যে, উক্ত অপরাধটি উক্ত আদালতের দ্বারা বিচার্য তবে তিনি অপরাধীকে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণের জন্য অথবা মামলার কার্যক্রম
৬৪১

স্থগিত রাখতে সরকারের নিকট রেফারেন্স প্রেরণের জন্য ৯৫ ধারার অধীনে নােটিশ জারি করতে পারেন। ঐরূপ অনুরােধ প্রাপ্তির পর নির্ধারিত কর্মকর্তা হয় অপরাধীকে উক্ত আদালতে প্রেরণ করবেন অথবা কোন আদেশটি চূড়ান্ত হবে তা নির্ধারণের জন্য প্রশ্নটি সরকারের নিকট প্রেরণ করবেন।
৫৮৫. পরবর্তী প্রশ্নটি হলাে পেনাল কোডের ১৩৯ ধারা এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারা অনুযায়ী ফৌজদারি আদালত কর্তৃক আপিলকারীদের বিচার বারিত করা হয়েছে কিনা। ১৩৯ ধারাটি পেনাল কোডের সপ্তম অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে যেখানে ১৩১-১৪০ পর্যন্ত ধারাসমূহ সন্নিবেশিত রয়েছে। ১৩১ ধারায় বিদ্রোহে সহায়তাকরণ বা কোনাে সৈন্য, নাবিক বা বৈমানিককে স্বীয় কর্তব্য থেকে বিপথগামী করতে প্ররােচিত করে সেই সম্পর্কে, ১৩২ ধারায় বিদ্রোহে সহায়তার বিষয়টি এবং যদি এর ফলে সেই বিদ্রোহ সংঘটিত হয় সে সম্পর্কে বিধৃত হয়েছে এবং অন্যান্য ধারাগুলােয় অন্যান্য অপরাধ। সংঘটনে সহায়তা সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেসব ব্যক্তি আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫২, দ্য নেভি অর্ডিন্যান্স, ১৯৬১, দ্য এয়ার ফোর্স অ্যাক্ট, ১৯৫৩-এর অধীনে উপরে বর্ণিত পেনাল কোডে বিধৃত কোনাে অপরাধ অর্থাৎ ১৩১ থেকে ১৩৮ ধারায় বর্ণিত অপরাধগুলাে সংঘটনে সহায়তার জন্য কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান ১৩৯ ধারা অনুযায়ী বারিত করা হয়েছে। সুতরাং, পেনাল কোডের ১৩৯ ধারা এই মামলার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। কারণ আপিলকারীগণকে বিদ্রোহে সহায়তা করার অপরাধ সংঘটনের জন্য নয়, বরং খুনের মতাে একটি স্বতন্ত্র অপরাধের জন্য বিচার করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। কোড অব ক্রিমিনাল
প্রশিডিউরের ৫৪৯ ধারাটি একটি বিশেষ প্রকতির ধারা, যা সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী আইনের অধীন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার নিয়ে নেয়। এই ধারায় ব্যবহৃত “is liable, to be tried either by a Court to which the Code applies or by a Court-Martial”-93 অভিব্যক্তিটির অর্থ হচ্ছে, যে অপরাধের জন্য অপরাধীর বিচার করা হবে সেই অপরাধটিকে এমন একটি অপরাধ হতে হবে যেটির কগনিজেন্স নেওয়ার ক্ষমতা ফৌজদারি আদালত ও কোর্ট মার্শালের থাকবে। এই অভিব্যক্তিটি অপরাধ আমলে নেওয়ার বিষয়ে দুই আদালতের প্রাথমিক এখতিয়ার সম্পর্কে উল্লেখ করেছে, অন মেরিট সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে তাদের এখতিয়ার সম্পর্কে নয়। ফৌজদারি আদালত এ কোর্ট মার্শাল উভয় আদালতে বিচার হতে পারে- এমন অপরাধের ক্ষেত্রে এই দুই আদালতের এখতিয়ারগত সমস্যা নিরসনে আর্মি অ্যাক্টের ৯৪ এবং ৯৫ ধারায় উপযুক্ত বিধান বিধৃত করা হয়েছে, যে বিষয়ে আমি উপরে আলােচনা করেছি।
৫৮৬. Joginder Singh os. State of Himachal Pradesh, AIR 1971 SC 500 মামলায় আপিলকারী জগিন্দর সিংকে চাকরিতে সক্রিয় থাকাকালীন এবং আর্মি অ্যাক্ট, ১৯৫০ (ভারত) দ্বারা পরিচালিত অবস্থায় | পেনাল কোডের ৩৭৬ ধারা অনুযায়ী সহকারী দায়রা জজ কর্তৃক শাস্তি প্রদান করা হয়। সে তার বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা এই গ্রাউন্ডে চ্যালেঞ্জ করে যে, কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৪৯ ধারার অধীনে প্রণীত আর্মি অ্যাক্টের সাথে পঠিতব্য ফৌজদারি আদালত এবং কোর্ট মার্শাল বিধি, ১৯৫২ বিচারে প্রতিপালিত হয়নি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারতের আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫০-এর ১২৫ ও ১২৬ ধারা এবং বাংলাদেশের আর্মি অ্যাক্ট ১৯৫২-এর ৯৪ ও ৯৫ ধারা হুবহু একই। তার শাস্তি আপিল আদালতে বহাল থাকে এবং তার আপত্তি নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণ প্রদানে বাতিল করা হয় :
It is further clear that in respect of an offense which could be tried both by a criminal Court as well as a Court-Martial, sections 125, 126 and the Rules have made suitable provisions to avoid a conflict of jurisdiction between the
৬৪২

ordinary criminal Courts and the Court Martial. But it is to be noted that in the first instance, discretion is left to the officer mentioned in section 125 to decide before which Court the proceedings should be instituted. Hence the officer commanding the army, army corps, division, or independent brigade in which the accused person is serving or such other officer as may be prescribed will have to exercise his discretion and decide under section 125 in which Court the proceedings shall be instituted. It is only when he exercises his discretion and decides that the proceeding should be instituted before a Court Martial, that the provisions of section 126(1) come into operation. If the designated officer does not exercise his discretion and decide that the proceedings should be instituted before a Court-Martial, the Army Act would not obviously be in the way of a criminal Court exercising its ordinary jurisdiction in the manner
provided by law.
৫৭৮. Balbir Singh vs. State of Punjab (1995) 1 SCC 90 মামলায় অনুরূপ মতামত প্রদান করা হয়েছে: When a criminal Court and Court Martial each have jurisdiction in respect of the trial of the offense, it shall be in the discretion of the officer commanding the group, wing or station in which the accused is serving or such other officer as may be prescribed, in the first instance, to decide before which Court the proceedings shall be instituted and if that officer decides that they should be instituted before a “Court Martial”, to direct that the accused persons shall be detained in Air Force custody. Thus, the option to try a person subject to the Air Force Act who commits an offense while on “active service” is in the first instance with the Air Force Authorities. The criminal Court, when such an accused is brought before it shall not proceed to try such a person or to inquire with a view to his commitment for trial and shall give a notice to the Commanding Officer of the accused, to decide whether they would like to try the accused by a Court Martial or allow the criminal Court to proceed with the trial. In case, the Air Force Authorities decide either not to try such a person by a Court Martial or fail to exercise the option when intimidated by a criminal Court within the period prescribed by Rule 4 of the 1952 Rules, the accused can be tried by the ordinary criminal Court in accordance with the Code of Criminal Procedure.
৫৮৮ Major EG Barsay vs. State of Bombay, AIR 1961 মামলায় ইজি বারসে চাকরিতে সক্রিয় থাকা অবস্থায় বা অ্যাকটিভ সার্ভিসে থাকাকালীন অন্য ৫ জন বেসামরিক লােককে সাথে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে অসাধু উপায়ে সামরিক গুদামঘর আত্মসাৎ করে এবং সরকারি কর্মচারী হয়েও অবৈধ উপায়ে তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সামরিক গুদামঘর নিজেদের দখলে রাখার ষড়যন্ত্র করে ও চুরির অপরাধ করে। তাদের সকলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরােধ আইন, ১৯৪৭ এবং পেনাল কোডের ৩৪ ধারাসহ ৩৮১, ৪১১ ধারার অধীনে অপরাধ সংঘটনের অভিযােগ আনা হয়েছিল। বিশেষ জজ ইজি বারসেকে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা প্রদান করেন। পরবর্তী সময়ে বােম্বে হাইকোর্ট এবং ইন্ডিয়ান সুপ্রীম
৬৪৩

কোর্টে বার সে আপিল করে ব্যর্থ হয়। সে অন্যান্য বিষয়ের সাথে বিশেষ জজের তাকে বিচার করার এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করেছিল। বিচারপতি সুববা রাও নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণ দেন :
The scheme of the Act therefore is self-evident. It applies to offenses committed by army personnel described in section 2 of the Act; it creates new offenses with specified punishments, imposes higher punishments to pre-existing offenses, and enables civil offenses by a fiction to be treated as offense under the Act; it provides satisfactory machinery for resolving the conflict of jurisdiction. Further it enables, subject to certain conditions an accused to be tried successively both by Court Martial and by a criminal Court. It does not expressly bar the jurisdiction of criminal Courts in respect of acts or omissions punishable under the Act, if they are also punishable under any other law in force in India; nor is it possible to infer any prohibition by necessary implication. Sections 125, 126 and 127 exclude any such inference, for they in express terms provide not only for resolving conflict of jurisdiction between a criminal Court and a Court Martial in respect of a same offense, but also provide for successive trials of an accused in respect of the same offense.
৫৮৯. জামিল হক মামলায় ১৯৮১ সালের ২৯ মে পরবর্তী রাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সংঘটিত বিদ্রোহের অপরাধের কারণে রিট আবেদনকারীদের বিচার আর্মি অ্যাক্টের অধীনে গঠিত কোর্ট মার্শালে হয় এবং তাদের শাস্তি প্রদান করা হয়। আর্মি অ্যাক্টের অধীনে গঠিত কোর্ট মার্শালের সিদ্ধান্তকে তারা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের করে। হাইকোর্ট বিভাগ এখতিয়ারহীনতার কারণ দেখিয়ে রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দেন। উক্ত মামলায় আপিল বিভাগ পর্যবেক্ষণ দেন- “if the Court Martial is constituted properly and the offense committed is cognizable by it then the rest is a question of fact based on evidence which is held by all the authorities that the writ jurisdiction is not available to interfere. This Court is only concerned to examine the question whether the jurisdiction under Article 102 has been conferred and once it comes to the conclusion that the jurisdiction has not been conferred that is the end of the matter.” উক্ত মামলা এই মামলার ঘটনার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়।
৫৯০. আপিলকারীদের পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী Ros. Grant, Daois Riley and Topleu, (1957) 2 AllER
694 মামলাটিও উদ্ধৃত করেছেন। এই মামলায় আপিলকারীদেরকে বিদ্রোহের অপরাধের অভিযােগে সাইপ্রাসের নিকোশিয়াতে সাধারণ কোর্ট মার্শালে শাস্তি প্রদান করা হয়েছিল। ঘটনার দিন রাতে ব্যারাকে কোলাহল সৃষ্টি হয়েছিল। আপিলকারীরা একটা হােটেলের ছাদে অবস্থান নিয়ে মিটিং করছিল এবং সেখান
থেকে নেমে তারা ব্যারাকের দোকান ভেঙে দেয়। কারণ কর্তৃপক্ষ তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করেনি।
৫৯১. ওয়ারেন্ট অফিসারের নিকট থেকে ছত্রভঙ্গ হওয়ার আদেশ পেলেও তারা ছত্রভঙ্গ হয়নি। তাদের শাস্তির বিষয়ে হাউজ অব লর্ডস হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেন নিমােক্ত যুক্তির মাধ্যমে:
I have not thought it necessary to take up time by going through the evidence in detail. The Court is quite satisfied that there was evidence on which the
৬৪৪

Court Martial could find in a proper direction that there Was a mutiny, and it is not for us to criticize the finding provided there was evidence on which they could come to the decision they did. For the reasons which I have endeavored to state as shortly as I can, the Court is of opinion that there was no misdirection; that, although perhaps, criticism could be made of the words the Judge-Advocate used when he made his interlocutory observation, there was a perfectly fair direction and nothing was said by the Judge-Advocate which could have misled the Court Martial. Therefore, on all these grounds the appeals should, we think, be dismissed.
৫৯২. আর্মি অ্যাক্টের অধীনে আসামিরা বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল তা দেখানাের মতাে কোনাে সাক্ষ্য না থাকায় এবং যেহেতু বিদ্রোহের জন্য বিচার করে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি, সেহেতু উপরে বর্ণিত এই পর্যবেক্ষণের আলােকে বর্তমান মামলাটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। উপরে বর্ণিত মামলায় ঐ অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযােগের সমর্থনে আইনগত সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল যার উপর নির্ভর করে কোর্ট মার্শাল তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা অ্যাকটিভ সার্ভিসে ছিল না এবং তারা আর্মি অ্যাক্টের ৮(২) ধারা মতে কোনাে ‘সিভিল অফেন্স’ সংঘটিত করেনি এবং সেহেতু ফৌজদারি আদালত এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এমনকি তারপরও বিতর্ক এড়ানাের জন্য বিজ্ঞ দায়রা জজ আপিলকারী ও অন্যান্য অভিযুক্তদের বিচারের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অনুমােদন প্রার্থনা করেছিলেন, যদিও তাদের কার্যক্রম আর্মি অ্যাক্টের ব্যাপ্তির মধ্যে পড়ে না। ফলে, আমি আপিলকারীদের পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবীদের দ্বারা উত্থাপিত আপত্তিতে কোনাে সারবত্তা খুঁজে পাইনি।
৫৯৩. অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র
এখন অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আলােচনা করা যাক। আপিলকারীদের পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ মতামত ব্যক্ত করেছেন যে, বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য উপস্থাপন করে হত্যা সংঘটনের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র প্রমাণ করতে প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে, নথিতে থাকা সাক্ষ্য-প্রমাণ শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার পরিবর্তনের জন্য বিদ্রোহ সংঘটনে ষড়যন্ত্রের বিষয়টিকে উন্মোচন করে। বিজ্ঞ আইনজীবীগণ যুক্তি দেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগের সমর্থনে আদৌ কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। বরং লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল বাশার বিএ (পি.ডব্লিউ-৭), লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল হামিদ (পি.ডব্লিউ-৯), এএলডি সিরাজুল হক (পি.ডব্লিউ-১২), হাবিলদার মােঃ আমিনুর রহমান (অবসরপ্রাপ্ত) (পি.ডব্লিউ-২৪). নায়েক (অবসরপ্রাপ্ত) মােঃ ইয়াসিন (পি.ডব্লিউ-২৫), মােঃ রিয়াজুল হক (পি.ডব্লিউ-৩৭), অনারারি লেফটেন্যান্ট (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ আহমেদ (পি.ডব্লিউ-৪০), কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাফায়েত জামিল (পি.ডব্লিউ-৪৪), মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) শফিউল্লাহ, (পি.ডব্লিউ-৪৫), মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) খলিলুর রহমান (পি.ডব্লিউ-৪৭), এয়ার ভাইস মার্শাল (অবসরপ্রাপ্ত) এ কে খােন্দকার (পি.ডব্লিউ-৪৮) এবং রিয়ার এডমিরাল (অবসরপ্রাপ্ত) এম এইচ খান (পি.ডব্লিউ-৪৯)-এর সাক্ষ্য স্পষ্টভাবে পূর্ব কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত দেয়। হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণের সিদ্ধান্ত অনুসারে এই মামলায় এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার কোনাে প্রযােজ্যতা ছিল না এবং এই মামলায় অপরাধমূলক
৬৪৫

ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব অনুপস্থিত। কিন্তু বিজ্ঞ বিচারকগণ পেনাল কোডের ১২০খ ধারার অধীনে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞ আইনজীবীগণ Kehar Singh os. State, AIR 1988 SC 1883 মামলাটি উদ্ধৃত করেছেন।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রপক্ষে মতামত দেওয়া হয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের পেছনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগের সমর্থনে যথেষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে। আরাে দাবি করা হয় যে, আসামিপক্ষ বিদ্রোহ সংঘটনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করলেও এই প্লি সমর্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আপিলকারীগণ হত্যা সংঘটনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। আরাে যুক্তি দেখানাে হয় যে, আপিলকারীগণের স্বীকৃত মতে তারা একটি অপরাধ সংঘটনের লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র করেছিল। এলডি বসির আহমেদ (পি.ডব্লিউ-১১), এএলডি সিরাজুল হক (পি.ডব্লিউ-১২), দফাদার (অবসরপ্রাপ্ত) শফিউদ্দিন সরদার (পি.ডব্লিউ-১৩), দফাদার (অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুল জব্বার মৃধা (পি.ডব্লিউ-১৪), রিসালদার আব্দুল আলিম মােল্লাহ (পি.ডব্লিউ-২৩), হাবিলদার (অবসরপ্রাপ্ত) মােঃ আমিনুর রহমান (পি.ডব্লিউ-২৪), নায়েক (অবসরপ্রাপ্ত) মােঃ ইয়াসিন (পি.ডব্লিউ-২৫), সুবাদার মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) আনিসুল হক চৌধুরী (পি.ডব্লিউ-৩৫), রিসালদার মুনসুর আহমেদ (পি.ডব্লিউ-৩৯), অনারারি লেফটেন্যান্ট (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ আহমেদ (পি.ডব্লিউ-৪০), কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) শাফায়েত জামিল (পি.ডব্লিউ-৪৪) এবং সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমান, কিউরেটর (পি.ডব্লিউ-৫৩)-এর সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ বহাল রেখে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকগণ কোনাে miscarriage of justice করেননি।
৫৯৪. অভিযুক্তদের মধ্যে আপাত দৃশ্যমান অভিন্ন অপরাধমূলক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কৃত কোনাে অপরাধমূলক এ থেকে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি অনুমান করা যায়। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র কেবল দুই বা ততােধিক ব্যক্তির উদ্দেশ্য সাধনেই গঠিত হয় না, বরং তা একটি বেআইনি কাজ করা বা একটি আইনসম্মত কাজ বেআইনি উপায়ে করার জন্য দুই বা ততধিক ব্যক্তির সম্মতিতে গড়ে ওঠে। কর্মকাণ্ডের প্লট কার্যকর করতে যখন দুজন সম্মত হয় এবং প্রত্যেকের কর্ম কার্যকর হয়, যদি তা আইনসম্মতও হয়, তা অপরাধমূলক উদ্দেশ্য বা অপরাধমূলক উপায়ের ব্যবহারের জন্য সম্ভব হয় (When two agree to carry it into effect the very plot of act itself, and the act of each of the parties capable of being enforced, if lawful, possible if for a criminal object or for the use of criminal means)। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের চারটি উপাদান হলাে : (ক) দুই বা ততােধিক ব্যক্তির মধ্যে ঐকমত্য, (খ) একটি বেআইনি কাজ করা, অথবা (গ) একটি আইনসম্মত কাজ বেআইনি উপায়ে করা এবং (ঘ) ষড়যন্ত্র অনুসারে প্রকাশ্য কোনাে কাজ হওয়া। পেনাল কোডের ১২০খ ধারা অনুযায়ী অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র প্রমাণ করতে হলে প্রসিকিউশনকে এটি প্রমাণ করার প্রয়ােজন নেই যে, অপরাধীরা প্রকাশ্যে বেআইনি কাজটি করতে বা করার কারণ হতে সম্মত হয়েছে। ঐকমত্যের বিষয়টি প্রয়ােজনীয় implication দ্বারা প্রমাণিত হতে পারে। একটি ষড়যন্ত্রে অপরাধীদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কাজ করতে হতে পারে। এমনকি যদি কেউ কেউ প্রথম ষড়যন্ত্রের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে যােগ দেয় তবে তারাও ষড়যন্ত্রের সদস্য হবে, যদি তাদের কর্মকাণ্ড ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে বিবেচিত হয়। সন্দেহ নেই যে, ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে একটি ঐকমত্য তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই অপরাধটি সম্পূর্ণ হয়। ধারা ১২০বি-র অধীনে তারা শাস্তিযােগ্য হবে। এই ধারাটির অধীনে অপরাধকে একটি অবিরাম অপরাধ (continuous offence) হিসেবে গণ্য করা হয় এবং ঐ সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের একজন পক্ষ হিসেবে অভিযুক্ত সেও ১২০বি ধারার অধীনে দায়ী হবে।
৬৪৬

৫৯৫. অপরাধটির মূল কথা হলাে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য ঐকমত্যের সংমিশ্রণ। অপরাধ সংঘটনের ঐকমত্যই হলাে ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে actus reus, এটি সম্পাদিত হতে হবে এমন নয়। বেআইনি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ঐকমত্য ও মনের মিলই যথেষ্ট। এটা প্রত্যক্ষ বা পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব। গােপনীয়তা একটি ষড়যন্ত্রের বৈশিষ্ট্য, জনগণের জন্য প্রকাশ্য স্থানে উন্মুক্ত আলােচনা ষড়যন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। ষড়যন্ত্র রচনার তারিখ, স্থান এবং সময়, এটি রচনায় যে ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছিল, ষড়যন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য যা তারা ঠিক করেছিল এবং কী প্রক্রিয়ায় ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য পরিচালিত হবে- এই সব বিষয় সম্পর্কে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য দেওয়া সম্ভব নয়। এই সকল বিষয় অনুমানের ব্যাপার, যা মামলার ঘটনাদি থেকে বের করা যায়।
৫৯৬. একজন ষড়যন্ত্রকারী ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যটি সম্পাদনে তার সহযােগীদের একজন এজেন্ট। সুতরাং, যেমন করে কোনাে এজেন্টের কাজ ও ঘােষণা তার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে গ্রহণযােগ্য, তেমনিভাবে একই নীতিতে কোনাে ষড়যন্ত্রকারীর কাজ ও ঘােষণাগুলি অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অপরাধ প্রমাণের সাক্ষ্যসম্পর্কিত বিধান এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় বিধৃত রয়েছে। এই ধারাটি সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম অর্থাৎ যে কোনাে ব্যক্তির কাজ, বিবৃতি বা লেখা কেবল তার নিজের বিরুদ্ধেই গ্রহণযােগ্য এবং অন্যের বিরুদ্ধে নয়। তাই ষড়যন্ত্রকারীর কাজ, বিবৃতি বা লেখাগুলি একজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে নেওয়া যেতে পারে যদি এটি দেখানাে যায় যে, বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যে, অভিযুক্ত এবং যে সকল ব্যক্তির কাজ, বিবৃতি বা লেখাগুলাে সাক্ষ্য হিসেবে নেওয়া হবে তারা একটি ষড়যন্ত্রের সহযােগী ব্যক্তি ছিল। “ষড়যন্ত্র” প্রমাণের জন্য কঠোর সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়ােজন নেই; এই ধারা অনুসারে যা প্রয়ােজন তা হলাে এটি বিশ্বাস করার “যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি” থাকতে হবে যে, অভিযুক্ত এবং ব্যক্তিগণ যাদের কর্ম, বিবৃতি বা অন্য বিষয়সমূহ প্রমাণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে যে তারা অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করেছিল। কমন ল-এ ষড়যন্ত্র বলতে দুই বা ততােধিক ব্যক্তি কর্তৃক বেআইনি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ঐকমত্য বােঝায়। বেআইনি’ কথাটি এখানে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। অপরাধটি মিলিত হওয়ার মধ্যে নিহিত। যতক্ষণ পর্যন্ত এই জাতীয় কর্মকাণ্ড কেবল অভিপ্রায়ে স্থির থাকে, ততক্ষণ এটি অভিযােজ্য (indictable) নয়। যখন দুজন ব্যক্তি এটি কার্যকর করতে সম্মত হয়, তখন ষড়যন্ত্রটিই একটি অপরাধ। এই অপরাধটি তাই সম্পূর্ণ হয়, যদিও ঐকমত্য অনুসারে আর কোনাে কাজ না হয়ে থাকে। যদি কথাবার্তা পাকা হয়ে থাকে তাহলে এটি ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হবে, এমনকি “where the parties had not settled the means to be employed.” এমনকি ষড়যন্ত্রের আলাপ-আলােচনা পাকাপােক্ত হলেও ষড়যন্ত্রের চেষ্টার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হতে পারে।
৫৯৮. কথিত ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে সরাসরি যােগাযােগ থাকার প্রয়ােজন নেই। যদি ‘এ’ ‘বি’ এবং ‘সি’-র সাথে যােগাযােগ করে অথবা ‘এ’ ‘বি’-র সাথে যােগাযােগ করে এবং ‘বি’ যখন নিজেই ‘সি’-র সাথে যােগাযােগ করে তাহলে তিনজনকেই সহযােগী ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করা যেতে পারে। এই বিধান সাক্ষ্য আইনের বিশেষ বিধানের আলােকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যা ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য (নীচে)। ষড়যন্ত্রের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে একজন সহযােগী হওয়ার প্রয়ােজন নেই। Dr Glanville Williams-এর ভাষায়:
৬৪৭

“Mere knowledge of and mental consent to a crime about to be committed by another does not make a man a conspirator, but quite a slight participation in the plan will be sufficient.”
৫৯৯. বস্তুত, যদি ‘এ’ ‘বি’-কে একটি অপরাধ করার জন্য প্ররােচিত করে এবং ‘বি’ সেটা করার জন্য সম্মত হয় তাহলে ‘এ’ এবং ‘বি’ যৌথভাবে ষড়যন্ত্রের অপরাধে দোষী হবে। এ-ও অবশ্যই প্ররােচনার দায়ে দোষী হবে।
৬০০. বিধিটির উদ্দেশ্য হলাে এটা নিশ্চিত করা যে, একজন ব্যক্তি অন্যের কাজ বা কর্মের জন্য দায়বদ্ধ হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের মধ্যে একটি এজেন্সির মতাে কোনাে বন্ধন প্রতিষ্ঠিত না হয়। প্রথম ঘটনায় ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে এবং অভিযুক্তকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে সাক্ষী তার বিরুদ্ধে, সহ-ষড়যন্ত্রকারীর কর্ম বা ঘােষণার বিরুদ্ধে কোনাে সাক্ষ্য দিতে চায় কিনা তা প্রমাণ করা জরুরি। এটি প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার প্রয়ােজন নেই যে, অভিযুক্ত এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা যাদের কাজ, বিবৃতি বা লেখা তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে দেওয়া হবে যে, তারা একটি অপরাধ করার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। যেহেতু ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য খুব কমই পাওয়া যায়, ফলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাদি বা অভিযুক্তের পূর্বের বা পরবর্তী কোনাে আচরণের দ্বারা একটি ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হতে পারে। কী কী বিষয় আসলে পক্ষদেরকে একত্র করেছে এ-সম্পর্কিত প্রমাণ দ্বারা একটি ষড়যন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়ােজন নেই। অন্য কোনাে ঘটনার মতাে এটিও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা দেখানাে যেতে পারে। উপরের পর্যবেক্ষণ মতে, বিশেষ কোনাে অপরাধ সংঘটনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার জন্য এটি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়ােজন যে, অভিযুক্ত এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের যে কাজকর্ম, বিবৃতি বা লেখা সাক্ষ্য হিসেবে দেওয়া হয় সেগুলাে এজন্য বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে যে, তারা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের সদস্য। যদি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অস্তিত্বের আপাতদৃষ্ট সাক্ষ্য প্রদত্ত হয় এবং সাধারণ অভিপ্রায় সম্পর্কিত একজন ষড়যন্ত্রকারী কর্তৃক প্রদত্ত বিবৃতি বা কর্মকাণ্ড সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে তা সকলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য।
৬০১. Zulfiqar Ali Bhutto vs. State PLD 1979 SC 53 মামলায় পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের বিচারক আনােয়ারুল হকের পর্যবেক্ষণ নিম্নরূপ :
In criminal law a party is not generally responsible for the acts and declarations of others unless they have been expressly directed, or assented to by him; “nemo reus est nisi mens sit rea’. This section, however, is based on the concept of agency in cases of conspiracy. Conspiracy connotes a partnership in crime or actionable wrong. A conspirator is considered to be an agent of his associates in carrying out the objects of the conspiracy and anything said, done or written by him, during the continuance of the conspiracy, in reference to the common intention of the conspirators, is a relevant fact against each one of his associates, for the purpose of proving the conspiracy as well as for showing that he was a party to it. Each is an agent of the other in carrying out the object of the conspiracy and in doing anything in furtherance of the common design.
৬৪৮

৬০২. এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় ব্যবহৃত “in reference to their common intention“ অভিব্যক্তিগুলাে দ্বারা এটি বােঝায় যে, অভিপ্রায় প্রসূত কাজটি ভবিষ্যতে হবে এবং এই ধারাটি ভবিষ্যতের রেফারেন্সসহ ষড়যন্ত্রকারী কর্তৃক প্রাসঙ্গিক বিবৃতি সম্পর্কে বর্ণনা করে। এই অভিব্যক্তিটির অর্থ হচ্ছে বিবৃতি প্রদানের সময় ভবিষ্যতের কী অভিপ্রায় বােঝানাে হয়েছে সেই প্রসঙ্গে। ষড়যন্ত্রকারীদের কাছ থেকে তাদের অতীতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আসা বিবরণগুলি তাদের সাধারণ অভিপ্রায়ের সাথে যােগসূত্র রয়েছে তা বলা যায় না। অতএব, এটি স্পষ্ট যে, ষড়যন্ত্রের সাধারণ অভিপ্রায়টি আর কার্যকর না থাকলে এবং তার অস্তিত্ব না থাকলেও তা অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য। এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারাটি কেবল তখনই কার্যকর হবে যখন আদালত সন্তুষ্ট হবে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একসাথে কোনাে অপরাধ বা একটি শাস্তিযােগ্য অন্যায় করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি রয়েছে। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তার কাজটি ব্যবহার করার আগে প্রাথমিকভাবে এই সাক্ষ্য থাকতে হবে যে, ঐ ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের একজন সদস্য ছিল। একবার এ জাতীয় যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অস্তিত্ব পাওয়া গেলে সাধারণ অভিপ্রায় সম্পর্কে উল্লেখ করে ষড়যন্ত্রকারীদের যে কারাে দ্বারা যে কোনাে কিছু বলা, করা বা লেখা অন্যদের বিরুদ্ধেও প্রাসঙ্গিক হবে। এটা কেবল ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যই নয়, এটাও প্রমাণ করার জন্য যে, অন্য ব্যক্তিও ষড়যন্ত্রের একজন সদস্য ছিল। উল্লিখিত কাজটির সাক্ষ্যগত মূল্য দুটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, যথা : এই কাজটি তাদের সাধারণ অভিপ্রায় অনুসরণে হতে হবে এবং তাদের যে কেউ কাজটি শুরু করার পর থেকে সময়সীমা প্রসঙ্গ গণ্য হবে।
৬০৩. অভিপ্রায়’ (‘intention’) শব্দটি দ্বারা এটি বােঝায় যে, কাজটি ভবিষ্যতে হবে এবং ষড়যন্ত্রকারী কর্তৃক কৃত প্রাসঙ্গিক বিবৃতি হতে হবে ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে। ষড়যন্ত্রকারীদের কারাে কর্তৃক যা কিছু বলা, করা বা লেখা হয়েছে তা এই ধারার অধীনে গ্রহণযােগ্য, যদি তা তাদের সাধারণ অভিপ্রায়কে তুলে ধরে। এমনকি যদি এটি তাদের সাধারণ অভিপ্রায় অনুসারে না-ও হয় তবু তা গ্রহণযােগ্য। সেই অনুসারে ষড়যন্ত্র রচনার পরে অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের অংশগ্রহণে হওয়া ষড়যন্ত্রে কোনাে ষড়যন্ত্রকারী অংশ নেওয়ার আগে বা পরে তার কর্তৃক যা কিছু বলা, করা বা লেখা হলে তা অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হবে। যখন অভিযুক্তদের প্রত্যেকের দ্বারা তাদের সাধারণ অভিপ্রায় অনুসারে নির্দিষ্ট কাজগুলাে করা হয়, সেটি প্রতিষ্ঠিত হলে তখন তা অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধেও গ্রহণযােগ্য।
৬০৪. ধারা ১০-এর সাথে পেনাল কোডের ধারা ১২০ক-এর সম্পর্ক রয়েছে, যা নিম্নরূপ :
when two or more persons agree to do, or cause to be done, (a) an illegal act, or (2) an act which is not illegal by illegal means, such an agreement is designated a criminal conspiracy.
একটি অনুবিধি যােগ করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে, অপরাধ সংঘটনের সম্মতি ব্যতিরেকে অন্য কোনাে সম্মতিই ষড়যন্ত্র সৃজনের জন্য বিবেচিত হবে না। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা প্রয়ােগের জন্য ষড়যন্ত্রের বিষয়টির একটি প্রাথমিক সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেখানে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকতে হবে যে, পেনাল কোডের ১২০ক ধারার ভাষ্যের আলােকে দুই বা euroliga The UP69 Vya 765069 i Bhagwan Swarup vs. State of Maharashtra, AIR1 965 SC 682 মামলায় এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অর্থ ও প্রয়ােগের সুযােগ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, এই ধারার শুরুর শব্দগুলাের অর্থ হচ্ছে যখন আদালত সন্তুষ্ট হবে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একসাথে কোনাে অপরাধ বা একটি শাস্তিযােগ্য অন্যায় করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে বলে
৬৪৯

বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে, তখনই এটি ব্যবহার করা যাবে। অর্থাৎ, ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে তার আচরণ ব্যবহার করার আগে আপাতদৃষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকতে হবে যে, সে ষড়যন্ত্রের একজন সহযােগী সদস্য। এ জাতীয় যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অস্তিত্ব পাওয়া গেলে সাধারণ অভিপ্রায় সূত্রে ষড়যন্ত্রকারীদের যে কারাে দ্বারা যে কোনাে কিছু বলা, করা বা লেখা অন্যদের বিরুদ্ধে প্রাসঙ্গিক হবে। এটা কেবল ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যই নয়, এটাও প্রমাণ করার জন্য যে, কারা কারা ষড়যন্ত্রের সদস্য ছিল। কোনাে কিছু বলা, করা বা লেখা তখনই প্রাসঙ্গিক হবে যখন “as against each of the persons believed to be so conspiring as well for the purpose of proving the existence of the conspiracy as for the purpose of showing that any such person was a party to it”. সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সুব্বা রাও নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন:
It can only be used for the purpose of proving the existence of the conspiracy or that of the other party or for the purpose of showing that such a person was not a party to the conspiracy. In short, the section can be analyzed as follows: (1) there shall be a prima facie evidence affording a reasonable ground for the Court to believe that two or more persons are members of the conspiracy; (2) if the said condition is fulfilled, anything said, done or written by any one of them in reference to their common intention will be evidence against the other; (3) anything said, done or written by him should have been said, done or written by him after the intention was formed by any one of them; (4) it would also be relevant for the said purpose against another who entered the conspiracy whether it was said, done or written before he entered the conspiracy or after he left it; and (5) it can only be used against a co-conspirator and not in his favor.
৬০৫. Shivanarayan Laxminarayan Joshi vs. State of Maharashtra, AIR 1980 SC 439 TOUCO
একই মতামত প্রদান করা হয়, যা নিম্নরূপ :
In these circumstances, therefore, we are unable to accept the contention put forward by appellant No. 24. We may point out that under the principle contained in section 10 of the Evidence Act, once a conspiracy to commit an illegal act is proved; act of one conspirator becomes the act of the other. This principle clearly applies to appellant No. 24 once the knowledge of the conspiracy is proved.
৬০৬. Bhagaban Subarup (Supra)-এর মামলায় বিচারপতি সুব্বা রাওয়ের গৃহীত মতামত বিচারপতি ওজা কর্তৃক Kehar Singh os. State, AIR 1988 SC 1883 মামলায় অনুমােদিত হয়েছে। এখানে বলা হয়েছিল যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারাকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায় : প্রথম অংশটি হলাে যেখানে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি রয়েছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি কোনাে অপরাধ বা একটি শাস্তিযােগ্য অন্যায় করার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং কেবল তখনই এই পূর্বশর্তটি পূরণ হয় যখন ধারাটির পরবর্তী অংশটি কার্যকর হয়। এটি লক্ষণীয় বিষয় যে, ধারাটির এই অংশটি এটি বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির কথা
৬৫০
বলে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একসাথে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং ধারা ১২০ক-এর সাথে এটির স্পষ্টত অভিসম্বন্ধ রয়েছে যেখানে বলা হয়েছে “When two or more persons agree to do, or cause to be done”. এটিকে আরাে একটি অনুবিধি দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়েছে যে, কোনাে অপরাধ করার ঐকমত্য ব্যতীত কোনাে ঐকমত্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র হিসেবে গণ্য হবে না। সুতরাং, এটি আবশ্যক যে, ১০ ধারা প্রয়ােগের জন্য ষড়যন্ত্রের আপাতদৃষ্ট ঘটনা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ধারাটির দ্বিতীয় অংশ সাধারণ অভিপ্রায় সম্বন্ধে এই জাতীয় ব্যক্তির যে কোনাে কথা, কাজ লেখা যা উক্ত অভিপ্রায় প্রথম শুরু হওয়ার পর এই জাতীয় ব্যক্তির প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রাসঙ্গিক এবং ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে ঐ জাতীয় যে কোনাে ব্যক্তিই যে ষড়যন্ত্রের অংশ সে সম্পর্কে বলে। বিচারপতি ওজা বিচারপতি সুব্বা রাওয়ের মতামতের সাথে একমত হয়ে নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ দেন :
It is clear that this second part permits the use of evidence which otherwise could not be used against the accused person. It is well settled that the act or action of one of the accused could not be used as evidence against the other. But an exception has been carved out in section 10 in cases of conspiracy. The second part operates only when the first part of the section is clearly established i.e. there must be reasonable ground to believe that two or more persons have conspired together in the light of the language of section 120A. It is only then the evidence of action or statements made by one of the accused, could be used
as evidence against the other.
৬০৭. এটি বলা ঠিক হবে না যে, হাইকোর্ট বিভাগের বিজ্ঞ বিচারকগণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ প্রমাণের জন্য এই মামলায় এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা প্রযােজ্য হবে না। বিজ্ঞ বিচারকগণের মতামত ছিল যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা অনুসারে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিকে যথাযথ প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পরীক্ষা করে দেখা যাক যে, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগের সমর্থনে নির্ভরযােগ্য সাক্ষ্য রয়েছে কি না। প্রসিকিউশন পক্ষের বক্তব্য অনুসারে, অভিযুক্ত আপিলকারীরা এবং অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের তাদের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে এবং তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার মানসে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এই উদ্দেশ্যে তারা ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে একটি প্যারেডের ব্যবস্থা করেছিল এবং আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং অন্য সহ-আসামিরা সেখানে উপস্থিত জওয়ানদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বক্তৃতা দিয়ে উস্কে দিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করেছিল যে, তাদের বক্তব্যগুলাে মিথ্যা এবং ক্ষতিকর অভিপ্রায়ে ছিল এবং এর মাধ্যমে জওয়ানদের সমর্থন নিয়ে অপরাধমূলক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব। অভিযুক্ত কর্মকর্তারা সৈন্যদের কোটে (kote) থেকে অস্ত্র এবং গােলাবারুদ নিতে বাধ্য করেছিল, যদিও বিধি অনুসারে তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। প্যারেডে দুই ইউনিট একত্র করার কোনাে বিধান না থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তরা বিধি উপেক্ষা করে তাদের অপরাধমূলক উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য ল্যান্সার এবং আর্টিলারি ইউনিট একত্র করে। রাত ১১টার পরেও রাত্রিকালীন প্যারেড চালু রাখার কোনাে রীতি বা নিয়ম না থাকা সত্ত্বেও অভিযুক্তরা ১৫ আগস্ট ভাের পর্যন্ত রাত্রিকালীন প্যারেড অব্যাহত রাখতে সৈন্যদের বাধ্য করেছিল। প্যারেড অব্যাহত থাকাকালীন অভিযুক্তরা তাদের নিজেদের মধ্যে গােপনে আলােচনা করেছিল এবং এরপর তারা নগরীর দিকে অগ্রসর হয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল, যেমন- মিন্টু রােড, রেডিও স্টেশন, রক্ষীবাহিনী, বিডিআর সদর
৬৫১

দপ্তর এবং ধানমন্ডির রােড নম্বর ৩২ এবং তারা পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছিল। ডিফেন্স প্লি হলাে, রাত্রিকালীন প্যারেড সেনাবাহিনীর একটি বাৎসরিক স্বাভাবিক আয়ােজন যার সাথে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের কোনাে যােগসূত্র নাই। এটি ছিল সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ এবং বিদ্রোহের ফলস্বরূপ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা হয়েছিল। এখন বিবেচনা করা যাক যে, অভিযােগ প্রমাণে প্রসিকিউশন কতটুকু সমর্থ হয়েছে।
৬০৮. পি.ডব্লিউ-১১ বর্ণনা করেন, প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছে তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, কুচকাওয়াজটি বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। কুচকাওয়াজে মেজর ফারুক রহমান মেজর আহমেদ হােসেনের সাথে এসেছিল। তারপরে মেজর ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অন্য আফিসাররা মেজর মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) অফিসে গিয়েছিলেন। তিনি মেজর মহিউদ্দীনের অফিসে সাদা পােশাকে কিছু ব্যক্তিকে দেখেছিলেন। তিনি তাদের অফিসার মনে করেছিলেন। তিনি মধ্যরাত ১২টার দিকে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং লক্ষ করেন যে, সাদা পােশাক পরিহিত ব্যক্তিরা মেজর মহিউদ্দিনের অফিস থেকে তাকে অনুসরণ করে বের হচ্ছে। এরপর মহিউদ্দীন হুদাকে তার সামনে আসতে বলে। সেই সময় মেজর হুদা মেজর ডালিমকে কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে বলে এবং তারপর মেজর মহিউদ্দিনের দিকে এগিয়ে যায়। মেজর মহিউদ্দীন তাদের জন্য ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করে। এই সাক্ষীর বক্তব্যে এটি যথেষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সেনা অফিসারদের পাশাপাশি সিভিল পােশাক পরিহিত কিছু কর্মকর্তা এসে তাদের সাথে যােগ দিয়েছিল, যারা পরবর্তীকালে সেনা কর্মকর্তা মেজর ডালিম এবং মেজর হুদা হিসেবে শনাক্ত হয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, কুচকাওয়াজ নির্ধারিত সময়ের বাইরে অব্যাহত ছিল। এই সাক্ষীর বক্তব্য থেকে এটাও উঠে আসে, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) মধ্যরাতের দিকে পারেড গ্রাউন্ড থেকে মেজর ফারুক, মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন, মেজর নুরুল হক, লেফটেন্যান্ট কিসমত হাশেম এবং অন্যদের তার অফিসে নিয়ে গিয়েছিল এবং গােপনীয় আলােচনা করেছিল, যখন সেখানে বরখাস্তকৃত সেনা সদস্যরাও তাদের সাথে উপস্থিত ছিল। এই সাক্ষী আরাে বলেন যে, কুচকাওয়াজটিকে রাত ৩.৩০ মিনিটে আবার ফল-ইন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং তারপর তিনি কোটে (kote) থেকে অস্ত্র নেন। তখন জওয়ানদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা হয় এবং সেই সময় মেজর মহিউদ্দীন জওয়ানদের কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। এই সাক্ষী আরাে বলেন যে, তারা অগ্রসর হয়ে ভাের ৪.৩০ মিনিটে ৩২ নম্বর রােডে পৌঁছেছিল যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাস করছিলেন। আসামিপক্ষ এই সাক্ষীকে তার জবানবন্দির বিষয়ে এমন কোনাে জেরা করেনি যে, কুচকাওয়াজটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণভাবে পরিচালিত হয়েছিল, তিনি (সাক্ষী) মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং মেজর ফারুককে সিভিল পােশাকে থাকা অন্য কর্মকর্তাদের সাথে প্যারেডে দেখেছিলেন, মেজর মহিউদ্দীন এবং সিভিল পােশাকধারী কর্মকর্তারা তার কার্যালয়ে গিয়ে রাত ১২টা অবধি আলােচনা করেছিল, তারপর সেই কর্মকর্তাদের জন্য পােশাকের ব্যবস্থা করেছিল এবং তারপর ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে তারা অস্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়েছিল।
৬০৯. পি.ডব্লিউ-১২ বলেন যে, প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি মেজর ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং আরাে কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন। এই কুচকাওয়াজ রাত ৩.৩০ অবধি অব্যাহত ছিল এবং তারপর তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল। প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর শরিফুল আহমেদ (ল্যান্সার), লেফটেন্যান্ট নাজমুল হােসেন আনসার গােপনীয়ভাবে প্যারেডের পাশে জেসিওর সাথে কথা বলছিল এবং এরপর তারা তাদের সামনে এসেছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, তিনি তিনজন অজ্ঞাত কর্মকর্তাকে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায়
৬৫২

দেখেছিলেন। মেজর ফারুক রহমান তাদেরকে মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কিন্তু তিনি (সাক্ষী) অন্য একজন ব্যক্তির নাম স্মরণ করতে পারেননি। মেজর ফারুক রহমান তাদের ব্রিফ করে যে, ১৫ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সভা হবে, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান রাজতন্ত্র ঘােষণা করবেন। তারা রাজতন্ত্রকে সমর্থন করে না এবং সেজন্য তাদেরকে সে ও অন্য অফিসাররা যে নির্দেশনা দেবে সেগুলি তাদের অনুসরণ করতে হবে। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, এরপর মেজর ফারুক রহমান তাদের কোটে (kote) থেকে অস্ত্র নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল এবং এ জাতীয় নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কোটে (kote) থেকে অস্ত্র নিয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এরপর তাদেরকে গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দিলে তারা চারটি ট্রাকে উঠেছিলেন এবং লক্ষ করেছিলেন যে, জওয়ানদের নিয়ে আরাে দুটি ট্রাক সেখানে উপিস্থিত ছিল। পরে তিনি (সাক্ষী) জানতে পেরেছিলেন যে, তারা আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান, যারা তাদের সাথে অংশ নেবেন। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, তারা যৌথভাবে বালুরঘাট, মহাখালী সড়ক, ফার্মগেট হয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং ৩২ নম্বর রােডের সংযােগস্থলে (মিটিং পয়েন্ট) পৌছেছিলেন এবং তখন মহিউদ্দীন তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, কোনাে ব্যক্তিকে যেন রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে না দেওয়া হয়। মহিউদ্দীন তাদের বলেছিল যে, তারা যদি গুলি চালানাের কোনাে আওয়াজ পায় তবে তারা তাদের নিজস্ব লােক হওয়ায় তারা যেন ভীত না হয়। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে। কেননা রাত ৩.৩০ অবধি কুচকাওয়াজ অব্যাহত ছিল, আপিলকারী ফারুক রহমান এবং মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)সহ কর্মকর্তাদের মধ্যে গােপনীয় আলােচনা হয়েছিল, দুটি ইউনিটের জওয়ানদের একত্র করা হয়েছিল, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান তাদের উত্তেজিত করেছিল এবং গােলাবারুদ নেওয়ার পর ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে তারা ৩২ নম্বর রােডের দিকে অগ্রসর হয়েছিল।
৬১০. পি.ডব্লিউ-১৩ ল্যান্সার ইউনিটের একজন সদস্য এবং তিনিও রাত্রিকালীন প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে, নাইট প্যারেডে মেজর ফারুক রহমান এবং মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) উপস্থিত ছিল, প্যারেড রাত ৩.৩০ অবধি অব্যাহত ছিল। সেই সময় মেজর খােন্দকার রশিদ (আর্টিলারি) তাদের ইউনিটে আসে। এরপর মােসলেমউদ্দিন এবং অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা সেখানে এসে একটি ট্রাকে উঠেছিল | এবং তারপর তারা তাদের অনুসরণ করার নির্দেশনা দেয়। তিনি (সাক্ষিী) আরাে বলেন যে, তাদের গাড়ি মহাখালীতে থামলে সেখানে তিনি লক্ষ করেন যে, আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ানরা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সময় তাদের গাড়িতে আর্টিলারি ইউনিটের এক কর্মকর্তা উঠেছিল। এরপর তারা ইন্দিরা রােড-মিরপুর রােড-সাত মসজিদ রােডের দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং তারপর মিরপুর রােডের সংযােগস্থলে তাদের গাড়ি থামে। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, গভীর রাত অবধি রাতের কুচকাওয়াজ অব্যাহত ছিল এবং তারপর সৈন্যরা মহাখালীর দিকে অগ্রসর হয়েছিল, যেখানে তারা আর্টিলারি ইউনিটের সেনাদের উপস্থিত দেখতে পায়। মেজর রশিদ মধ্যরাতে তাদের ইউনিটে আসে এবং তাদের গাড়িটি ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে মিটিং সড়কের সংযােগস্থলে এসে থেমেছিল।
৬১১. পি.ডব্লিউ-১৪ বলেন যে, তিনি ল্যান্সার ইউনিটের একজন সদস্য ছিলেন। তিনিও রাতের প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন যা ১৪ আগস্ট রাতের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল। তিনি মেজর ফারুক, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর আহমেদ শরিফুল হােসেন, লেফটেন্যান্ট কিসমত এবং লেফটেন্যান্ট নাজমুল হােসেন আনসার এবং সিভিল পােশাকে আরাে কয়েকজনকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি মেজর রশিদের সাথে আর্টিলারি ইউনিটের কিছু কর্মকর্তাকেও দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, মেজর ফারুক তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছিল এবং তাদের বলেছিল যে, জরুরি কাজের জন্য
৬৫৩

তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারপর সে সিভিল পােশাক পরিহিত ব্যক্তিদের মেজর ডালিম এবং মেজর শাহরিয়ার বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। তিনি আরাে বলেন যে, মেজর ফারুক তাদের বলেছিল, এই দুই কর্মকর্তা তাদের সাথে কাজ করবে এবং তাদের নির্দেশনা অনুসরণ করতে বলেছিল। তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, দায়িত্বে কোনাে অবহেলা করলে তাদেরকে কঠোরভাবে দেখা হবে। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, ভাের ৪.০০টার দিকে মেজর ফারুক ট্যাঙ্কগুলি সচল করার নির্দেশনা দিয়েছিল এবং ফারুক নিজেই একটি ট্যাঙ্ক পরিচালনা করছিল। ট্যাঙ্কগুলি একই সময়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল এবং কিছু ট্যাঙ্ক বালুরঘাট-ক্যান্টনমেন্ট-মহাখালী হয়ে রেডিও স্টেশনে গিয়েছিল। সেখানে পৌঁছানাের পরে মেজর শাহরিয়ার, মেজর ডালিম, মেজর শরিফুল হােসেন কিছু সময় কথা বলেছিল এবং তারপর তারা রেডিও স্টেশনে প্রবেশ করে। এই সাক্ষীর বক্তব্য : কুচকাওয়াজটি গভীর। রাত অবধি অব্যাহত ছিল, কিছু সেনা কর্মকর্তা সিভিল পােশাকে অংশ নিয়েছিল, সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিট যৌথভাবে রেডিও স্টেশনের দিকে ট্যাঙ্ক নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল এবং কিছু অভিযুক্ত ব্যক্তি রেডিও স্টেশনে ট্যাঙ্ক নিয়ে প্রবেশ করেছিল- এই সাক্ষীর জবানবন্দিতে বিবৃত এসব বিষয় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল তা প্রমাণিত করেছে।।
৬১২. পি.ডব্লিউ-১৭ বলেন যে, তিনি সংশ্লিষ্ট ঐ সময়ে আর্টিলারি ইউনিটের একজন সদস্য ছিলেন। মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল পাপা ব্যাটারির কমান্ডার। তিনি আরাে বলেন যে, তিনি (সাক্ষী) রাতের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং এটি রাত ১২টা অবধি অব্যাহত ছিল। এরপর, ১ নম্বর ক্যানন ইউনিটের হাবিলদারের নির্দেশ অনুসারে তারা কামানের গােলা নিয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন, তিনি দেখেছিলেন যে, রেজিমেন্ট কর্মকর্তারা নৈশ প্যারেডের সময় কামানগুলির পিছনে কথা বলছিল। তিনি সেখানে কথা বলা কর্মকর্তাদের মধ্যে মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), ক্যাপ্টেন মােস্তফা, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এবং আরাে দুজনকে চিনতে পেরেছিলেন। এরপর তিনি (সাক্ষী) বলেন, কিছু সময় পরে মেজর মহিউদ্দীন সেখানে উপস্থিত হয়ে সুবেদার হাশেমকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল এবং তারপর হাশেম সৈন্যদেরকে ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয় এবং তারপর হাশেম ছয়টি কামান ছয়টি ট্রাককে একসাথে করে। এরপর কামান বােঝাই ট্রাকগুলি ভাের ৩.৩০/৪.০০টায় চলতে শুরু করে। তিনি মেজর মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) সাথে গাড়িতে ছিলেন। ভাের ৪.০০টায় তাদের ট্রাক ধানমন্ডি লেকের পাশে থামলে মহিউদ্দীন তাদেরকে ৩২ নম্বর সড়ক এবং রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর লক্ষ করে কামান স্থাপনের নির্দেশ দেয় এবং তার নির্দেশ অনুসারে ৩২ নম্বর সড়ক লক্ষ করে কামান স্থাপন করা হয়। তিনি আরাে বলেন, মহিউদ্দীন তার নির্দেশ, যখন সে নির্দেশ দেবে, কামানের গােলা ছােড়ার আদেশ দিয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পর তারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে গুলি চালানাের আওয়াজ শুনতে পান। সে সময় মহিউদ্দীনের নির্দেশনামতাে তারা ৪ রাউন্ড কামানের গােলা নিক্ষেপ করেছিল। আসামিপক্ষ এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেহেতু তার সাক্ষ্য অনুযায়ী মহিউদ্দীনের নির্দেশমতাে কামান বসানাে এবং কামানের গােলা নিক্ষেপের বিষয়টি অখণ্ডিত (uncontroverted) রয়ে গেছে। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য এটি প্রমাণ করে যে, আপিলকারীরা তাদের সাথে ভারী অস্ত্র বহন করেছিল এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে গােপন আলােচনা হয়েছিল।
৬১৩. পি.ডব্লিউ-১৮ বলেন যে, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের একজন বন্দুকধারী (gunner) ছিলেন, যেখানে খােন্দকার আবদুর রশিদ কমান্ডিং অফিসার এবং মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ছিল ব্যাটারি কমান্ডার। তিনি রাতের প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি আরাে বলেন, তাদের পাপা ব্যাটারিতে তাদের সাথে ছয়টি কামান ছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন, মেজর মহিউদ্দীনের নির্দেশ অনুসারে তারা কামান নিয়ে
৬৫৪

বালুরঘাট হয়ে নতুন বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। তারা রাত ১২.৩০/১.০০টা অবধি তাদের রাতের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রেখেছিল। তিনি আরাে বলেন যে, প্রশিক্ষণের সময় খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) প্যারেড পরিদর্শন করেছিল। তিনি আরাে বলেন যে, রাত ৩.৩০/৪.০০টার দিকে আবুল কালাম তাদের বন্দুকগুলি একত্র করতে বলে এবং সেগুলাে তাদের | গাড়িতে তুলতে নির্দেশ দেয়। তিনি আরাে বলেন যে, তারা সারিবদ্ধভাবে দাড়ানাের পর মেজর মহিউদ্দীনের উপস্থিতিতে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের বলেছিল, তাদের একটি জরুরি কাজ করতে হবে এবং সেটি হলাে রক্ষীবাহিনীকে নিবৃত্ত করা। এরপর তাদের গাড়ি অনুসরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর তিনি (সাক্ষী) বর্ণনা করেছেন, কীভাবে রক্ষীবাহিনী সদর দফতরের দিকে তাদের ইউনিট অগ্রসর হয়েছিল। এই সাক্ষী আরাে প্রমাণ করেছেন যে, ১৫ আগস্ট রাতের প্রায় প্রথম প্রহর পর্যন্ত প্যারেড অব্যাহত ছিল এবং তারা রক্ষীবাহিনীকে নিবৃত্ত করার মিথ্যা আশ্বাসে তাদের সাথে ভারী অস্ত্র বহন করেছিল।
৬১৪. পি.ডব্লিউ-২১ বলেন যে, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের একজন জওয়ান ছিলেন, যেখানে খােন্দকার রশিদ কমান্ডিং অফিসার এবং মহিউদ্দীন ছিল পাপা ব্যাটারির কমান্ডার। তিনিও (সাক্ষী) রাতের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে, রাত ২.০০টার দিকে মেজর রশিদ, মেজর মহিউদ্দীন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং আরাে কিছু কর্মকর্তা বিমানবন্দর রানওয়েতে এসেছিল, যেখানে তারা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঐ সময় মেজর রশিদ তাদের জরুরি দায়িত্ব পালনে যাওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে প্রস্তুত হতে বলেছিল। তার নির্দেশে তারা গােলাবারুদ নেয় এবং তারপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা তাদের ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দেয় এবং এরপর ট্রাকগুলি ধানমন্ডির দিকে যাত্রা শুরু করে। তিনি আরাে বলেন যে, রাত প্রায় ৪.০০/৪.৩০ নাগাদ কেউ একজন ৩২ নম্বর রােডে তাদের কয়েকজনকে ট্রাক থেকে নামতে নির্দেশ দেয়। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন কোনাে ব্যক্তিকে ৩২ নম্বর রােড দিয়ে যেতে না দেওয়া হয়। তিনি (সাক্ষী) আরাে প্রমাণ করেছেন যে, আপিলকারীরা তাদের সাথে ভারী অস্ত্র ও গােলাবারুদ বহন করেছিল এবং প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে ৩২ নম্বর সড়কের দিকে যাত্রা করেছিল যেখানে বঙ্গবন্ধু বাস করছিলেন।
৬১৫. পি.ডব্লিউ-২২ বলেন যে, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের একজন জওয়ান ছিলেন এবং দুর্ভাগ্যজনক ঐ রাতে তিনি প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে, কুচকাওয়াজটি রাত ১২টা অবধি অব্যাহত ছিল এবং ত ২.০০/২.৩০ মিনিটে কিছু বিশ্রাম নেওয়ার পরে খােন্দকার আবদুর রশিদ সেখানে মেজর মহিউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মােস্তফা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং আরাে কয়েকজন অজ্ঞাত কর্মকর্তার সাথে এসেছিল। ঐ সময় মেজর আবদুর রশিদ তাদের অস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে এবং তখন তারা তাদের অস্ত্র দেখিয়েছিল। তারপর সে তাদের বলেছিল যে, তাদের জরুরি কাজে নেওয়া হবে এবং প্রয়ােজনে তারা তাদের অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। তারা তাদের ট্রাকে গােলাবারুদ নিয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, বিএইচএম তাদের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে তাদের ট্রাকটি ৩২ নম্বর সড়কের দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং ফজরের আজানের সময় তাদের কয়েকজনকে ৩২ নম্বর রােডে ট্রাক থেকে নামতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন কাউকে ৩২ নম্বর সড়কে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়। আসামিপক্ষ তার সাক্ষ্যের incriminating অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করেনি। এই সাক্ষী আপিলকারীদের তত্ত্বাবধানে প্যারেড গ্রাউন্ড। দিকে ভারী অস্ত্র নিয়ে জওয়ানদের অগ্রসর হওয়া এবং এরপর ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহরে জওয়ানদের রাস্তায় গাড়ি থেকে নামার বিষয়টি প্রমাণ করেছেন।
৬৫৫

৬১৬. পি.ডব্লিউ-২৩ বর্ণনা করেন যে, তিনি ল্যান্সার ইউনিটের একজন জওয়ান ছিলেন এবং ১৪ আগস্টের রাত্রিকালীন প্যারেডে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরাে বর্ণনা করেন যে, মেজর ফারুক ট্যাঙ্কের সম্মুখে আসে এবং লেফটেন্যান্ট কিসমতের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। এরপর লেফটেন্যান্ট কিসমত রিসালদার শামসুল হককে স্কোয়াড্রনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করাতে নির্দেশ প্রদান করে। তারপর মেজর ফারুক, লেফটেন্যান্ট কিসমত এবং রিসালদার শামসুল হক সেখানে আসার পর মেজর ফারুক ট্যাঙ্ক বাহিরে নেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে এবং জওয়ানদের মধ্যে কে ট্যাঙ্ক চালাতে সক্ষম তা জিজ্ঞেস করে। এরপরই তার নির্দেশে তাদের মধ্য থেকে ৬ জন ট্যাঙ্কচালক এবং আরাে কিছু জওয়ানকে বাছাই করা হয়। মেজর ফারুক জওয়ানদের ৬টি ট্যাঙ্কে ওঠার নির্দেশ দেয় এবং অফিসারদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়। তিনি (সাক্ষী) আরাে বর্ণনা করেন যে, রাত তিনটা/সাড়ে তিনটার দিকে মেজর ফারুক রহমান পুনরায় আসে এবং তার নির্দেশমতাে অফিসাররা এবং জওয়ানরা ট্যাঙ্কে ওঠে। তারপর ট্যাঙ্কগুলাে গ্যারেজ থেকে বের করা হয় এবং সেগুলােকে সিগন্যাল গেইটের সম্মুখে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়। এরপর মেজর ফারুক একটি ট্যাঙ্কে উঠে বসে এবং অন্যান্য অফিসারকে অন্যান্য ট্যাঙ্কে উঠতে নির্দেশ দেয় এবং তার নির্দেশমতাে ট্যাঙ্কগুলাে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়েছিল। ১৫ আগস্ট খুব ভােরে ফারুক রহমানের নির্দেশে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্কগুলাে যে অগ্রসর হয়েছিল তা এই সাক্ষী প্রমাণ করেছেন।
পি.ডব্লিউ-২৪ বলেন যে, তিনি ঐ সময়ে আর্টিলারি ইউনিটের একজন জওয়ান ছিলেন। তিনি মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদের নির্দেশে রাত্রিকালীন প্যারেডে যােগ দিয়েছিলেন। তারা মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদের নির্দেশে বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। তিনি আরাে বর্ণনা করেন যে, যাত্রা শুরুর পূর্বে সাথে আগ্নেয়াস্ত্র নেওয়ার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে, মজর রশিদ তাদেরকে বলেছিল যে, জরুরি কাজের জন্য তাদের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার প্রয়ােজন। হতে পারে এবং তারপর তাদের ব্যাটারি কমান্ডার তাদেরকে ল্যান্সার ইউনিটে নিয়ে যায়। তিনি ল্যান্সার ইউনিটের জওয়ানদের প্রস্তুত অবস্থায় পান। ল্যান্সার ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার সৈয়দ ফারুক রহমান দুই ইউনিটকে একত্র করে কথা বলছিল। এই সময়ে তিনি আর্টিলারি ইউনিটের কিছু অফিসারকে দেখতে পান। তিনি (সাক্ষী) আরাে কিছু বরখাস্তকৃত অফিসারকেও দেখতে পান। খােন্দকার রশিদ এবং সৈয়দ ফারুক তাদেরকে মেজর ডালিম, মেজর রাশেদ চৌধুরী, মেজর শাহরিয়ার এবং ক্যাপ্টেন মাজেদ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তারপর খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর ডালিম বক্তৃতা করে বলছিল, তারা রক্তের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছে, বর্তমান সরকার নারীদের সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে, মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে, সুতরাং এই সরকারকে উৎখাত করতে হবে। তারপর মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান এবং মেজর আবদুর রশিদ তাদেরকে গােলাবারুদ/অস্ত্র সাথে নেওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করে এবং তাদের নির্দেশে তারা অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র/গােলাবারুদ নেন। তারপর। শহরের দিকে অগ্রসর হয়।

৬১৭. এই সাক্ষীর (পি.ডব্লিউ-২৪) সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে, প্যারেড শেষ রাত্র পর্যন্ত চলেছিল, উপস্থিত থাকার কথা নয় এমন কিছু বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তাও যেটিতে অংশ নিয়েছিল। শহর অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের নির্দেশে তারা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েছিল, মেজর ডালিম এবং মেজর রশিদ বক্তৃতাদানের মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করবে মর্মে জওয়ানদেরকে উস্কানি প্রদান করেছিল যা তারা মিথ্যা হিসেবেই মনে করেছিল এবং শহরের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে দুই ইউনিটের সেনাদের একত্র করা হয়েছিল। মেজর ফারুক মেজর আবদুর রশিদের উপস্থিতিতে ল্যান্সার ও আর্টিলারি এই দুই ইউনিটকে একত্র করেছিল, ইউনিটকে ব্রিফ করেছিল- এসব বিষয়ে এই সাক্ষীর
৬৫৬

(পি.ডব্লিউ-২৪) সাক্ষ্যকে আসামিপক্ষ চ্যালেঞ্জ করেনি। জেরার সময় এই সাক্ষী বর্ণনা করেন যে, নৈশ প্যারেডে বিভিন্ন ইউনিটের যৌথ প্যারেডের কোনাে বিধান ছিল না। সাক্ষী তার জবানবন্দিতে এটি নিশ্চিত করেছেন যে, মেজর ফারুকের নির্দেশে তাদের ইউনিট ল্যান্সার ইউনিটের সাথে একত্র করা হয়েছিল। মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের নির্দেশে ইউনিটগুলি অস্ত্র/গােলাবারুদ নিয়েছিল- এটিও আসামিপক্ষ কর্তৃক অস্বীকৃত হয়নি।
৬১৮. পিডব্লিউ ২৫ প্রাসঙ্গিক সময়ে আর্টিলারি ইউনিটের একজন জওয়ান ছিলেন। তিনিও রাতের প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন এবং বলেন যে, রাত প্রায় ৩.০০/৩.৩০টার দিকে ক্যাপ্টেন মােস্তাকের নির্দেশ অনুযায়ী তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয়েছিল। তারপর তারা ট্যাঙ্ক ইউনিটের একটি খােলা জায়গায় যান যেখানে ট্যাঙ্ক ইউনিটের জওয়ানদের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। তিনি আরাে বলেন যে, তারা ছয়টি গ্রুপে বিভক্ত ছিল। তাদের কমান্ডিং অফিসার মেজর খােন্দকার আবদুর রশীদ এবং ট্যাঙ্কের কমান্ডিং অফিসার মেজর ফারুক রহমান তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেয়। মেজর রশিদ, ক্যাপ্টেন মােস্তফা, মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন মাজেদ এবং অন্যান্য কর্মকর্তা সেখানে উপস্থিত ছিল। মেজর ডালিম সেখানে বক্তব্য দেয়। এরপর মেজর ফারুক ও রশিদও বক্তব্য দেয়। তারা বলেছিল যে, তারা বহু জীবনের বিনিময়ে দেশকে স্বাধীন করেছে। সরকার মা ও বােনদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে; মানুষ অনাহারে মারা যাচ্ছে। তাই সরকার উৎখাত করতে হবে। তারপর তারা তাদের গােলাবারুদ নেওয়ার নির্দেশ দেয় এবং তাদের আদেশ অনুসারে তারা মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। এরপর। তিনি (সাক্ষী) সেরনিয়াবাতের পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনাটি বর্ণনা করেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন কর্তৃক জেরার সময় এই সাক্ষী বলেছিলেন যে, ল্যান্সার এমিউনিশন স্টোরের সামনে গােলাবারুদ জড়াে করা ছিল এবং মেজর ফারুক রহমানের আদেশ অনুসারে তারা গােলাবারুদ নিয়েছিল। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটি প্রতিভাত হয়েছে যে, আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ানরা ট্যাঙ্ক ইউনিটের জওয়ানদের সাথে একত্র হয়েছিল এবং মেজর ফারুক, মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিম সরকারকে উৎখাতের জন্য বক্তব্য দিয়েছিল এবং তাদের নির্দেশ অনুসারে তারা তাদের সাথে গােলাবারুদ নিয়েছিল। আসামিপক্ষ এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে কোনােভাবেই ডিফেন্স কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
৬১৯. পি.ডব্লিউ-২৬ বলেন যে, তিনি প্রাসঙ্গিক সময়ে আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন, যেখানে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। তিনি বলেন যে, মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ তাকে গােলাবারুদ স্টোরের চাবিটি তার সাথে রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে, রাত প্রায় ১১.০০/১১.৩০টায় মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ এবং ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর আর্টিলারি ও ল্যান্সার ইউনিটের ১০/১২ জন জওয়ান নিয়ে গােলাবারুদ স্টোরের সামনে আসে। রশিদদের নির্দেশ অনুসারে তিনি (সাক্ষী) গােলাবারুদের স্টোরটি খুলে দেন এবং তার নির্দেশ অনুসারে জওয়ানরা কামানের গােলা, রাইফেল, স্টেনগান, এসএমজি, পিস্তল ইত্যাদির গােলাবারুদ নিয়ে যায়। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য আসামিপক্ষ কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি এবং সেহেতু তার সাক্ষ্যটি অখন্ডিত রয়ে যায়।
৬২০. পি.ডব্লিউ-২৭ বলেন যে, তিনি প্রাসঙ্গিক সময়ে ফিল্ড আর্টিলারির একজন জওয়ান ছিলেন। তিনি রাতের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং এরপর প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে তারা নতুন বিমানবন্দর সড়কের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। রাত প্রায় ৩.০০/৩.৩০টায় মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) সেখানে এসে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানাের নির্দেশ দেয় এবং কিছু জওয়ানকে মেজর মহিউদ্দিনের সাথে গাড়িতে উঠতে নির্দেশ দেয়। মেজর মহিউদ্দীন তাদের বলেছিল যে, রক্ষীবাহিনী সৈন্যদের আক্রমণ করতে পারে এবং
৬৫৭

তাদের উচিত এ জাতীয় ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকা। তিনি (সাক্ষী) দেখেন যে, গাড়ির সাথে একটি কামান সংযুক্ত এবং অন্য গাড়িগুলাের সাথে আরাে চারটি কামান সংযুক্ত ছিল। এরপর তারা মহাখালী-ফার্মগেট-গ্রিন রােড-এলিফ্যান্ট রােড-মিরপুর রােডের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন এবং এরপর কলাবাগান এলাকায় লেকের (হ্রদে) কাছে আসেন এবং এখানে তাদেরকে গাড়ি থেকে নামতে নির্দেশ দেওয়া হয়। মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তাদের নির্দেশ দিয়েছিল যে, কেউ যেন এই সড়ক দিয়ে চলাচল করতে না পারে। এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে আসামিপক্ষ কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। তিনি (সাক্ষী) এটি প্রমাণ করেছেন যে, রক্ষীবাহিনী তাদের উপর হামলা চালাতে পারে এই মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে অফিসাররা জওয়ানদের উত্তেজিত করেছিল এবং তাদের মিথ্যা অজুহাত বিশ্বাস করিয়ে তাদের উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তারা তাদের সাথে ভারী অস্ত্র বহন করতে বাধ্য করেছিল।
৬২১. পি.ডব্লিউ-৩২ বলেন, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের একজন জওয়ান ছিলেন, যেটির অধিনায়ক ছিল মেজর মহিউদ্দীন। তিনি নৈশকালীন কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং প্যারেডে মেজর খােন্দকার আবদুর রশীদ, মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি), মেজর জুবায়ের সিদ্দিক, ক্যাপ্টেন মােস্তফা এবং লেফটেন্যান্ট হাসানকে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছেন, শেষ রাত ৩.০০/৩.৩০টা পর্যন্ত প্যারেড অব্যাহত ছিল, যখন হাবিলদার মুজাফফর তাদের ফল-ইন করিয়েছিল। ঐ সময় মেজর ডালিমসহ ঐ অফিসাররা সেখানে উপস্থিত ছিল। রশিদের নির্দেশ অনুসারে হবিলদার মােস্তফা তাদের ৩/৪টি ট্রাকে উঠার জন্য বলে। এরপর kote এনসিও সামসুল ইসলাম তাদেরকে গােলাবারুদ দিয়েছিল। ডিফেন্স কর্তৃক এই সাক্ষীর সাক্ষ্যের বিরােধিতা করা হয়নি এবং তা অখণ্ডিত রয়েছে। তারপর তিনি (সাক্ষী) বলেন, তারা। কিছু সময় সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পর তাদেরকে তেজগাঁও বিমানবন্দরের পাশে নেমে যেতে বলা হয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে, তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন রাস্তা দিয়ে যেন কেউ চলাচল করতে না পারে।
৬২২. পি.ডব্লিউ-৩৪ বলেন যে, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের একজন জওয়ান ছিলেন, যেটির ব্যাটারি কমান্ডার ছিলেন মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি)। তিনিও (সাক্ষী) প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, কুচকাওয়াজের পরে তারা ছয়টি ট্যাঙ্ক নিয়ে নতুন বিমানবন্দর অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। তিনি গােলন্দাজ সৈনিকের সাথে আলাপরত থাকাকালে রাত অনুমান ১০.০০টার দিকে মেজর মহিউদ্দিনের বন্দুকের গুলির শব্দ শুনেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেছেন যে, রাত প্রায় ২.৩০টার সময় তাদের সারিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং একটি গাড়িতে উঠার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তারা ফার্মগেট হয়ে লেকের পূর্বদিক দিয়ে মিরপুর রােডের দিকে অগ্রসর হন এবং সেখানে অবস্থান নেন। সেখানে অস্ত্র স্থাপন করা হয়েছিল। সেই সময় মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) বন্দুকের পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল এবং কোনাে লােককে সে রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের অনুমতি না দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল। ডিফেন্স এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। পি.ডব্লিউ-৩৯ বলেছেন যে, তিনি সংশ্লিষ্ট সময়ে ল্যান্সার ইউনিটের গাড়িচালক ছিলেন এবং মেজর ফারুক ছিল তাঁর ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার-ইন-চার্জ। তিনিও রাতের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর শরিফুল ইসলাম এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্যারেডে উপস্থিত পেয়েছিলেন। তিনি বলেছেন যে, জরুরি প্রয়ােজনে ট্যাঙ্কগুলাে বাইরে বের করতে হবে জানিয়ে মেজর ফারুক সেগুলােকে প্রস্তুত করতে নির্দেশ দিয়েছিল। এরপরে মেজর ফারুক জওয়ান এবং কর্মকর্তাদের তাদের দায়িত্ব পুনরায় শুরু করতে বলে। (সাক্ষী) বলেন যে, ঐ সময় মেজর ডালিম এবং অন্য একজন
৬৫৮

কর্মকর্তা তাদের ইউনিটে এসেছিল। মেজর ডালিম ইউনিফর্ম চাইলে তাকে ইউনিফর্ম সরবরাহ করা হয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে, ট্যাঙ্ক ইউনিটটি এয়ারপাের্ট হয়ে বঙ্গভবনের দিকে যাত্রা করেছিল। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকে এটি প্রতিভাত হয় যে, ট্যাঙ্কগুলাে বাহিরে নিয়ে যাওয়ার কোনাে নিয়ম বা বিধি না থাকা সত্ত্বেও ঘটনার দিন সেগুলােকে বাহিরে নেওয়া হয়েছিল এবং বহিস্কৃত সেনা কর্মকর্তারা সাধারণ পােশাকে সেই প্যারাডে অংশগ্রহণ করেছিল।
৬২৩. পি.ডব্লিউ-৪০ বলেন যে, সংশ্লিষ্ট সময়ে তিনি লেফট্যানেন্ট ছিলেন। তিনি দাবি করেন যে, তিনিও নৈশ প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন এবং মেজর ফারুক ছিল তাদের কমান্ডার। তিনি মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার)-কে প্যারেডটি হস্তান্তর করেছিলেন, পরে মেজর ফারুককে এই কুচকাওয়াজটি হস্তান্তর করে। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, প্যারেডটি রাত ১২টায় শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটি রাত ২.০০/৩.০০টা অবধি চলমান ছিল। তিনি আরাে বলেন যে, মেজর ফারুক তাকে রেজিমেন্টটির দেখাশােনা করতে এবং দরজা বন্ধ করতে বলেছিল। তার (সাক্ষী) এক প্রশ্নের জবাবে মেজর ফারুক তাকে বলেছিল যে, তারা স্বৈরাচারী সরকারকে অপসারণ করতে চলেছে। ডিফেন্স এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি, যদিও এই সাক্ষী সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন যে, মেজর ফারুক ও অন্য ব্যক্তিরা সরকারকে উৎখাত করতে যাচ্ছিল।
৬২৪. পি.ডব্লিউ-৪৪ বলেছেন যে, পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা সেনা কর্মকর্তাদের আগমনের পর তাদের পদোন্নতি, বেতন এবং অন্য সুবিধাদি নিয়ে আপিলকারীদের মধ্যে অসন্তুষ্টি, একই সাথে রক্ষীবাহিনীর বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে রটনা প্রচার করা হয়েছিল। সেই সময় মেজর ডালিম পূর্বের আক্রোশ কমানাের জন্য কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে অস্ত্র উদ্ধারের নামে হয়রানি করেছিল। এজন্য মেজর ডালিমকে বিশৃঙ্খলামূলক কাজের জন্য চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। এর ফলস্বরূপ মেজর নূর চৌধুরী অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে সরকারকে আক্রমণ করেছিল। সেনাবাহিনীর দুই ইউনিটের নৈশকালীন যৌথ প্রশিক্ষণেরও কোনাে বিধি ছিল না; রাতের প্রশিক্ষণে সরাসরি গােলাবারুদ নেওয়ার কোনাে বিধি ছিল না এবং ১৫ আগস্টের ভাের ৬.০০টার দিকে দরজায় কড়া পদাঘাতের শব্দে তার (সাক্ষী) ঘুম ভাঙ্গায় তিনি দরজা খুললে ঐ মেজর এবং তার দুই অফিসারকে সাথে নিয়ে ভারী অস্ত্রসহ দরজার সামনে দেখতে পান, যে সদর্ভে বলেছিল তারা শেখকে হত্যা করে খােন্দকার মােশতাকের অধীনে ক্ষমতা দখল করেছে; তাকে (সাক্ষী) কোনাে ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য সতর্ক করা হয়। তার সাক্ষ্য থেকে এটি পাওয়া যায় যে, রক্ষীবাহিনী প্রতিষ্ঠা করার পর থেকেই আসামিরা তাদের ষড়যন্ত্রের বীজ বুনেছিল। তিনি (সাক্ষী) প্রমাণ করেছেন যে, অস্ত্রসহ দুটি ইউনিটের যৌথভাবে নৈশকালীন প্রশিক্ষণের কোনাে বিধান ছিল না। ডিফেন্স এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্যের অপরাধসংশ্লিষ্টতার অংশ চ্যালেঞ্জ করেনি।
৬২৫. পি.ডব্লিউ-৫৩ বলেন যে, তিনি আর্টিলারি ইউনিটের একজন সুবেদার মেজর ছিলেন, যেটিতে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। তিনি আরাে বলেছেন যে, মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান তাদের কমান্ডিং অফিসার মেজর আবদুর রশিদের কার্যালয়ে যেত এবং ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তার সাথে বিভিন্ন সময়ে কথা বলেছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেছিলেন যে, মেজর রশিদ আগস্টে নৈশকালীন প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল এবং প্রােগ্রাম অনুসারে তিনি ১৪ আগস্ট রাতে এর ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, মেজর মহিউদ্দীন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে কুচকাওয়াজের দায়িত্ব নিয়েছিল এবং তারপরে মেজর রশিদের কাছে প্যারেড হস্তান্তর করে। তিনি আরাে বলেছেন যে, রাত প্রায় ১০.০০টায় মেজর রশিদ এবং মেজর ফারুক তার অফিসের বারান্দায় এসেছিল এবং কিছু সময় পর তারা একত্রে একটি জিপযােগে চলে যায়।
৬৫৯

৬২৬. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগের সমর্থনে সাক্ষ্য রয়েছে। এসব সাক্ষ্য থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদ তাদের পূর্বপরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র সম্পন্ন করার জন্য ১৪ আগস্ট রাতে যৌথ নৈশ কুচকাওয়াজের আয়ােজন করেছিল। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত কুচকাওয়াজটি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং উক্ত প্যারেডে অপরসারিত সেনা কর্মকর্তারাও অংশ নিয়েছিল। অফিসাররা মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) কার্যালয়ে গােপনে কথাবার্তা বলেছিল এবং রক্ষীবাহিনী তাদের আক্রমণ করবে বলে মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে জওয়ানদের প্ররােচিত করেছিল এবং এটিও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ না করা হলে তিনি ১৫ আগস্ট দেশে রাজতন্ত্র ঘােষণা করবেন। প্রকৃতপক্ষে, তারা জওয়ানদের কাছে তাদের এই পরিকল্পনা গােপন করেছিল যে, তারা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করতে যাচ্ছিল, যাতে তাদের পরিকল্পনা ভণ্ডুল না হয়ে পড়ে এবং তাদেরকে সরকার উৎখাত করার কথা বলেছিল। তারা ভারী অস্ত্র, ট্যাঙ্ক, গােলাবারুদ ইত্যাদি নিয়েছিল যা কেবল যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা। যেতে পারে। তারা প্রতিষ্ঠিত আর্মি রুলস লঙ্ঘন করে সেনাবাহিনীর দুটি ইউনিটকে একত্র করে ভারী আর্টিলারিসহ সেনানিবাসের বাইরে গিয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাওয়ার আগে মূল পয়েন্টগুলিতে কর্মকর্তাদের সাথে সশস্ত্র সেনা মােতায়েন করেছিল।।
৬২৭. উপযুক্ত সাক্ষ্য থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, পি.ডব্লিউ-১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৩, ২৪, ২৫, ৩৫, ৩৯ এবং ৪০ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানকে, পি.ডব্লিউ-১১, ১২, ১৪ এবং ৩৯ মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদকে; পি.ডব্লিউ-১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৬, ২৭, ৩২, ৩৪ এবং ৫৩ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)-কে; পি.ডব্লিউ-১৪ এবং ২৪ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে; এবং পি.ডব্লিউ-১১, ১২, ২১ এবং ২২ মেজর বজলুল হুদাকে নৈশ প্যারেড গ্রাউন্ডে শনাক্ত করেছেন, যেখানে তারা ঘটনার দিন রাতে প্রেসিডেন্ট ও অন্যদের হত্যার উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে এই সাক্ষীগণ প্রদত্ত সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশ ডিফেন্স কর্তৃক চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
৬২৮. আমাদের আদালতগুলাে কর্তৃক শত বছরেরও বেশি সময় ধরে অনুসৃত বিদ্যমান ফৌজদারি আইনবিজ্ঞান অনুসারে প্রসিকিউশনকেই তার মামলাটি যুক্তিসঙ্গত সকল সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণ করতে হবে এবং ডিফেন্সকে তার মামলা প্রমাণ করার দরকার নেই। যদি সাক্ষীদের জেরা করাকালীন বা সাক্ষীদের প্রদত্ত সাজেশন থেকে ডিফেন্স তাদের অনুকূলে কোনাে তথ্য বের করে আনতে সমর্থ হয় তবে ডিফেন্স সন্দেহের সুবিধা পাবে। যদিও আসামিপক্ষকে কোনাে কিছু প্রমাণ করতে হয় না, তবে যদি আসামিপক্ষ তাদের কেসের সমর্থনে কোনাে বিশেষ প্লি উত্থাপন করে, তাহলে সাক্ষ্য আইনের ১০৫ ধারা অনুসারে সেটির অস্তিত্ব প্রমাণের দায়িত্ব আসামিপক্ষের। বর্তমান মামলায় ডিফেন্স স্বীকার করে যে, আপিলকারীগণসহ অন্যান্য আভিযুক্তের কর্মকাণ্ড ছিল বিদ্রোহ সংঘটনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু ডিফেন্স এই দাবি প্রমাণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। আসামিপক্ষ আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে যদি কোনাে ঘটনা স্বীকার করে, কিন্তু সেটি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটি অবশ্যই তার বিপক্ষে যাবে। বর্তমান মামলায় ডিফেন্স স্বীকার করে যে, আপিলকারীগণসহ অন্যান্য আভিযুক্তের কর্মকাণ্ড ছিল বিদ্রোহ সংঘটনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু ডিফেন্স এই দাবি প্রমাণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
৬২৯. অভিযুক্ত ব্যক্তি পেনাল কোড বা অন্য কোনাে আইনের কোনাে সাধারণ বা বিশেষ ব্যতিক্রমের সুবিধা দাবি করলে সেটা প্রমাণের ভার অবশ্যই তার উপর বর্তায়। তবে, সেইরূপ অজুহাত প্রমাণ করার ভার
৬৬০

তখনই আসামিপক্ষের উপর বর্তাবে যখন প্রসিকিউশনপক্ষ প্রমাণ করতে পারে যে, সেইরূপ ব্যতিক্রমের অনুপস্থিতিতে আসামি অবশ্যই প্রণীত অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত হবে। যদি প্রসিকিউশন ইতিবাচকভাবে এটি প্রমাণ না করে যে, অভিযুক্ত এমন কোনাে কর্ম করেছিল যার জন্য তাকে দায়ী করা হয়েছে, কিন্তু ডিফেন্স এমন কোনাে প্লি নেয় যা দোষ স্বীকারােক্তির নামান্তর, তখন আদালত তাকে সেইরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের উপর ভিত্তি করে দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন; কিন্তু যদি প্লিটি ঘটনার স্বীকারােক্তি হয় এবং এর যৌক্তিকতা প্রতিপাদনের দাবি করা হয়, তখন আদালত মামলাটিতে অগ্রসর হতে পারেন না, যেন ঘটনাগুলাের স্বীকারােক্তি যেগুলাে প্রসিকিউশন কেসের অংশ ছিল না। যেহেতু, আসামিপক্ষ প্রসিকিউশন পক্ষের আনীত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্বীকার করেছে কিন্তু অভিযুক্ত তার প্লি প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে, সেহেতু যে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত যা infer করা যেতে পারে তা হলাে যুক্তিযুক্তভাবে এটি ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, তারা আত্মপক্ষ সমর্থনে যেরূপ আজুহাতে কাজটি করেছিল বলে দাবি করেছে সেটি ছাড়া অন্য কোনাে উদ্দেশ্যে তারা ঘটনায় অংশগ্রহণ করেছিল।
৬৩০. ১৪ আগস্ট রাতে নৈশকালীন প্যারেডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সভা, বেআইনি পরিকল্পনার বিষয়টি Communications এবং transmission of thoughts-এর মাধ্যমে ভাগ করে নেওয়া যা মামলায় প্রমাণ করা কঠিন হলেও মামলায় প্রাসঙ্গিক। নৈশকালীন প্যারেড থেকে ভারী অস্ত্র এবং গােলাবারুদসহ ঘটনাস্থল অভিমুখে এবং অন্য মূল পয়েন্টগুলােতে তাদের অগ্রসর হওয়া ছিল তাদের এইরূপ ষড়যন্ত্রের পরিণতি। ঘটনাপরবর্তী তাদের কর্মকাণ্ড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানাের জন্য যথেষ্ট যে, আপিলকারীরা অন্য সহযােগী আসামিদেরসহ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেছিল। তাই হাইকোর্ট কর্তৃক আসামিদের অপরাধমূলকে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত করাটা যৌক্তিক।
৬৩১. দোষ স্বীকার (Confession)
আপিলকারীদের পক্ষে যুক্তি ছিল যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি পুলিশ কর্তৃক দীর্ঘদিন তাদেরেকে পুলিশ হেফাজতে রেখে পুলিশ কর্তৃক নির্যাতন ও জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং সেহেতু, দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত না হওয়ায় সেগুলাে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ভিত্তি হতে পারে না। আরাে দাবি করা হয়েছিল যে, প্রথম বিজ্ঞ বিচারক কর্তৃক প্রদত্ত যুক্তি এবং সিদ্ধান্ত থেকে এটি স্পষ্ট যে, এই আসামিদের দোষ স্বীকারােক্তিগুলি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ছিল না এবং সেহেতু এসবের উপর নির্ভর করে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করাটা অবৈধ। আরাে দাবি করা হয়েছিল যে, যেহেতু ডিভিশন বেঞ্চের বিজ্ঞ বিচারকগণ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাের বিষয়ে মত প্রদানে সমভাবে বিভক্ত ছিলেন, সেহেতু, দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে বিবেচনা করা তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারকের জন্য বাধ্যতামূলক (obligatory) ছিল। কিন্তু তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক সেগুলাে বিবেচনা না করায়, এইসব দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির উপর ভিত্তি করে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ অবৈধ এবং এখতিয়ারবহির্ভূত।
৬৩২. অন্যদিকে জনাব আনিসুল হক এবং জনাব মাহবুবে আলম যুক্তি দিয়েছেন যে, প্রথম বিজ্ঞ বিচারক দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে অবিশ্বাস করে কেবল রেকর্ডে থাকা তথ্যাদির misread নয়, তিনি
৬৬১

আইনের ভুল ধারণাবশত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলােকে অবিশ্বাস করেছেন। ডিফেন্স পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি খণ্ডন করতে গিয়ে দাবি করা হয়েছে যে, কোনাে ক্ষেত্রেই দোষ স্বীকারকারী আসামিগণকে তাদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার আগে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৬৭(২) ধারায় বর্ণিত সময়সীমার বেশি পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়নি। এই প্রসঙ্গে, বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল পি.ডব্লিউ-৬১-এর জবানবন্দির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং নিবেদন করেছিলেন যে, | ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর মামলা দায়ের করার আগে লালবাগ পিএস কেস নম্বর ১১ (১১)৭৫ সূত্রে আপিলকারী ফারুক রহমানকে দুই দফায় মােট ১৩ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল, এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে এই মামলায় ৩ অক্টোবর ১৯৯৬ তারিখে গ্রেফতার দেখানাের পূর্বে তিন দফায় মােট ১৫ দিনের পুলিশ হেফাজত নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এই বিষয়গুলাে বিবেচনা না করেই তাদেরকে নির্ধারিত সময়ের বাইরে অব্যাহতভাবে পুলিশ হেফাজতে রাখার কারণ দেখিয়ে তাদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিগুলাে অবৈধভাবে অবিশ্বাস করেছেন। উপযুক্ত বিবেচনায় বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেছেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, লেফট্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং লেফটেন্যান্ট শাহরিয়ার রশিদ খানের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত নয় মর্মে প্রথম বিজ্ঞ বিচারক প্রদত্ত সিদ্ধান্তের আদৌ কোনাে ভিত্তি নেই।
৬৩৩. লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে ৩ অক্টোবর, ১৯৯৬ তারিখে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানাে হয়েছিল এবং ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৬ তারিখে তাকে ৭ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল, এবং তারপর ৭ ডিসেম্বর, ১৯৯৬ তারিখে তাকে আরাে ৫ দিনের পুলিশ হেফাজতে হয়েছিল এবং তারপরে ১১ ডিসেম্বর, ১৯৯৬ তারিখে তার দোষ স্বীকারােক্তি রেকর্ড করা হয়েছিল। তার স্বীকারােক্তির ইংরেজি অনুবাদ বিজ্ঞ বিচারকগণ সতর্কতার সাথে উপস্থাপন করেছেন। স্বীকারােক্তিতে তিনি সেনাবাহিনীতে তার যােগদান, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন স্টেশনে তার পােস্টিং নিয়ে বলেছেন এবং এরপর তিনি বলেছিলেন যে, তিনি সহ-অভিযুক্ত মেজর ডালিমের এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিলেন যে, শেখ মুজিবের misdeed গুলাের সমাধান করা দরকার। তিনি আরাে বলেছেন ‘শেরী এন্টারপ্রাইজ নামে তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন আসামির সাথে প্রাথমিক আলােচনা হয়েছিল এবং তারপরে মেজর নূর, মেজর আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদার সাথে বিভিন্ন স্থানে এবং তার বাসায় সহ-আসামি ও খােন্দকার মােশতাক আহমেদের সাথে আলােচনা হয়েছিল এবং তার বাসায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাত ১০.০০টায় তাদের পরিকল্পনার চূড়ান্তকরণ হয়; হত্যার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নৈশকালীন প্যারেডে তার অংশগ্রহণ, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাতের প্রথম প্রহরে মিন্টু রােডে, রেডিও স্টেশনে, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ বিভিন্ন মূল পয়েন্টে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের বণ্টন, আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর স্ত্রী হত্যা, বঙ্গবন্ধুর হত্যা, রেডিও স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা, তাহের উদ্দীন ঠাকুরের মাধ্যমে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের বক্তব্য প্রস্তুত এবং তিন বাহিনীর প্রধানের অনুগত্যের ঘােষণা প্রচারের জন্য তা ধারণ করা হয়েছিল, জেনারেল জিয়াউর রহমানসহ অন্য উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তা রেডিও স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন, এবং দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে খােন্দকার মােশতাকের এবং কেবিনেটের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে তার বাসায় আলােচনা হয়। তিনি তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে আপিলকারীগণকে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। তার এই জবানবন্দিকে আমার কাছে দোষসূচক (inculpatory) বলে প্রতীয়মান হয়। পি.ডব্লিউ-৫১ তার জবানবন্দিকে প্রমাণ করেছেন।
৬৬২

৬৩৪. লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে দেখা গেছে যে, তাকে এই মামলায় ৩ অক্টোবর ১৯৯৬ তারিখে গ্রেফতার দেখানাে হয়েছিল। এরপরে তাকে ১২ ডিসেম্বর ১৯৯৬ তারিখে ৭ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল; তারপরে ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৯৬ তারিখে তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছিল। তার স্বীকারােক্তিটিও বিজ্ঞ বিচারকগণের দেওয়া রায়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। তিনি সেনাবাহিনীতে তার যােগদান, বিভিন্ন সেক্টরে তার ডেপুটেশন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় কর্নেল ওসমানীর সাথে তার মিটিং, তারপর বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে তার যােগদান সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এরপর তিনি মুন্সিগঞ্জ ও নরসিংদীতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের সময় ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এবং ঢাকার লেডিস ক্লাবে গাজী গােলাম মােস্তফার ছেলের সঙ্গে মেজর ডালিমের স্ত্রীর ঘটে যাওয়া ঘটনা, গাজী গােলাম মােস্তফার বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনার কারণে মেজর ডালিম, মেজর নুরসহ আরাে কিছু সেনা কর্মকর্তার অপসারণ, বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর দেশের পরিবর্তন সাধনের জন্য মেজর রশিদের সাথে আলােচনা, রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মেজর রশিদ ও খােন্দকার মােশতাক আহমেদের আলােচনা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সরকারব্যবস্থা নিয়ে মেজর জিয়ার সাথে তার যােগাযােগ এবং আলােচনা, ১২ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে লেফট্যানেন্ট কর্নেল আবদুর রশিদের সাথে আলােচনা, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখ সকালবেলায় তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৪ আগস্টের নৈশকালীন প্যারেডে তাদের পরিকল্পনার চূড়ান্তকরণ, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সেটি কিছু আসামিকে প্রকাশের ব্যাপারে বলেছেন। তারপর তিনি তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অফিসারদের উদ্দেশ্যে তিনি যে নির্দেশাবলি দিয়েছিলেন তা বর্ণনা করেছেন। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অস্ত্রভাণ্ডার থেকে অস্ত্র নেওয়া, নৈশকালীন প্যারেড থেকে ট্যাঙ্কসহ সৈন্যদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মােতায়েন করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং শেখ ফজলুল হক মনিকে তাদের পরিবারসহ হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারপর তিনি পরবর্তী ঘটনাসমূহ বর্ণনা করেছেন। তার জবানবন্দি দোষসূচক (inculpatory) প্রকৃতির এবং পি.ডব্লিউ-৫১ তার জবানবন্দিটি প্রমাণ করেছেন।
৬৩৫. লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) সম্পর্কে নথিদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়েছে যে, তাকে ১৯ নভেম্বর ১৯৯৬ তারিখে ৭ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। তারপর তিনি ২৭ নভেম্বর, ১৯৯৬-এ তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার জবানবন্দি হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকগণও বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বেতন, রেশন ও ইউনিফর্ম নিয়ে জওয়ানদের অসন্তোষ, রক্ষীবাহিনী গঠন, বাকশাল এবং গভর্নরদের নিয়ােগের বিভিন্ন বিষয় প্রকাশ করেছেন। এরপর তিনি মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদের সাথে তার যােগাযােগ এবং ১৯৭৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে রমনা পার্কে তাদের আলােচনার বর্ণনা দিয়েছিলেন এবং রশিদ তাকে কলাবাগান, লেক সার্কাসের খেলার মাঠ এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবন দেখিয়েছিলেন। তারপরে তিনি ঘটনার রাতে বালুরঘাটে প্রশিক্ষণরত থাকার কথা, তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পন্থা দেখিয়ে মেজর ফারুক রহমানের বক্তব্য, তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অফিসারকে তাদের দায়িত্ব বণ্টন, প্রশিক্ষণ মাঠ থেকে অস্ত্রসহ মিন্টু রােড, বেতার কেন্দ্র, বিডিআর সদর দফতর এবং রক্ষীবাহিনী সদর দপ্তরের অভিমুখে অগ্রসর হওয়া, বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ করে কলাবাগান খেলার মাঠে কামান স্থাপন এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খােন্দকার মােশতাক আহমেদের অধীনে দেশে কমান্ড কাউন্সিল গঠনসহ ঘটনার পরবর্তী সময়ে আসামিগণের আচার-আচরণ নিয়ে বলেছেন। তিনি কলাবাগান খেলার মাঠে উপস্থিত থেকে অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তার এই স্বীকারােক্তিটি দোষসূচক (inculpatory)। তার এই জবানবন্দি পি.ডব্লিউ-৫২ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
৬৬৩

৬৩৬. পি.ডব্লিউ-৫১ বলেছেন যে, তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারা অনুসারে প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা মেনে সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করেছিলেন। তিনি অভিযুক্তকে তার বিবৃত জবানবন্দির বিষয়বস্তু সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং বিবৃতি রেকর্ড করার পরে তিনি এই বিবৃতিটির যথার্থতা সম্পর্কে একটি সত্যতা প্রতিপাদন প্রদান করেছিলেন। এই আপিলকারী তার বিবৃতি, যা তিনি (সাক্ষী) ৩৬৪ ধারা অনুসারে রেকর্ড করেছিলেন, তা আপিলকারী চ্যালেঞ্জ করেননি। তিনি (সাক্ষী) স্বীকার করেছেন যে, তিনি ফর্মের ৮ নম্বর কলামে মন্তব্য করেননি। তিনি (সাক্ষী) এই ব্যাখ্যা দেন যে, অভিযুক্ত তাকে কোনাে ধরনের মন্দ আচরণের অভিযােগ না করায় তিনি উক্ত কলাম পূরণ করেননি। আসামিকে অবৈধভাবে পুলিশ হেফাজতে রেখে চাপে ফেলে ও তাকে নির্যাতন করে তার স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়েছেন অথবা তার জবানবন্দিটি তাকে পড়ে শােনানাে হয়নি এবং তা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ছিল না- এই মর্মে তাকে (সাক্ষী) প্রদত্ত ডিফেন্স সাজেশন তিনি অস্বীকার করেছেন। এই সাক্ষী আরাে বলেছেন যে, তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারায় নির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন করেই কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিটি রেকর্ড করেছিলেন এবং সেটি রেকর্ড করার পর আসামিকে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফেরত পাঠানাে হয় এবং চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট একই দিনে আসামিকে গ্রহণ করেছেন এবং সে মর্মে প্রত্যয়নও প্রদান করেছেন। স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান তার জবানবন্দিটি আইনের বিধান অনুসারে লিপিবদ্ধ করা হয়নি মর্মে চ্যালেঞ্জ করেননি। তার জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তদন্তকারী অফিসার- সিআইডির একজন এএসপি এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসার তার (সাক্ষী) রুমে উপস্থিত ছিলেন বলে আসামিপক্ষের দেওয়া সাজেশন এই সাক্ষী অস্বীকার করেছেন। তিনি (সাক্ষী) স্বীকার করেছেন যে, তিনি দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির ফরমের ৩, ৪, ৮ এবং ১০ নম্বর কলাম পূরণ করেননি। তিনি এই ডিফেন্স সাজেশনও অস্বীকার করেছেন যে, তার কাছে আসামিকে উপস্থাপন করার পর আসামি তাকে পুলিশ কর্তৃক নির্যাতনের বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
৬৩৭. মােঃ হাবিবুর রহমান (পি.ডব্লিউ-৫২) বলেছেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তিনি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৪ ধারায় বিধৃত পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলেন এবং জবানবন্দি রেকর্ড করার পর তিনি প্রত্যয়ন প্রদান করেছিলেন এবং অভিযুক্তকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছিল। এই দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী আসামিও এই সাক্ষীর এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেনি যে, আসামির বিবৃতি আইনের প্রয়ােজনীয় পদ্ধতি অনুসরণ করে রেকর্ড করা হয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) স্বীকার করেছেন যে, ফর্মের ১ নম্বর কলামটি শূন্য রাখা হয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) ডিফেন্সের এই সাজেশন অস্বীকার করেছেন যে, আসামি তার কাছে কোনাে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেননি বা তিনি (সাক্ষী) তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক প্রস্তুতকৃত জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করেছেন বা পুলিশের উপস্থিতিতে জোর করে জবানবন্দিতে আসামির স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল এবং জবানবন্দিটি সত্য ও স্বেচ্ছাপ্রণােদিত নয়।
৬৩৮. লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের জবানবন্দির ফর্মের ১ নম্বর কলামে, পি.ডব্লিউ-৫২ কর্তৃক উল্লেখ করা হয়েছিল যে, অভিযুক্তকে ২৭ নভেম্বর ১৯৯৬ তারিখে সকাল ১১.০০টায় হাজির করা হয়েছিল এবং তার বিবৃতি বেলা ২.০০টায় রেকর্ড করা হয়েছিল। অতএব, এটি সঠিক নয় যে পি.ডব্লিউ-৫২ অভিযুক্তকে উপস্থাপন করার তারিখ এবং তার বক্তব্য রেকর্ড করার সময় উল্লেখ করেননি। ফর্মের কলাম নম্বর ৩ ও ৪ হলাে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক প্রদত্ত ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অবশ্যপালনীয় নির্দেশনা। ৫ নম্বর কলামে বর্ণিত বিষয়াদি হলাে দোষ স্বীকারকারী
৬৬৪

আসামিকে ব্যাখ্যা করতে হয় যেন সে তার জবানবন্দি প্রদান করার পূর্বে স্বেচ্ছায় তা প্রদান করবে কি না ভেবে দেখতে পারে, এই বিষয়টির সাথে ৩ নম্বর কলাম সম্পর্কিত। ৫ কলামে অভিযুক্তদের যেসব প্রশ্ন করতে হয় তা ৬ নম্বর কলামে বর্ণিত হয়েছে। পি.ডব্লিউ-৫১ যথাযথভাবে কলামগুলি পূরণ করেছিলেন এবং সেহেতু অভিযুক্তের এ বিষয়ে কোনাে অভিযােগ থাকা কাম্য নয়। জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় তার কক্ষে পুলিশ উপস্থিত ছিল- এই মর্মে ডিফেন্সের দেওয়া সাজেশন এই সাক্ষী অস্বীকার করেছেন। ৮ নম্বর কলামে (ফর্মের) জবানবন্দি প্রদানকারীর জবানবন্দিটি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত মর্মে ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টির সংক্ষিপ্ত বিবৃতি সম্পর্কিত। পি.ডব্লিউ-৫১ বলেছেন যে, এটি আইন অনুসারে রেকর্ড করা হয়েছিল এবং বিবৃতিটির যথার্থতা বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়েই অভিযুক্ত ব্যক্তি সেখানে স্বাক্ষর করেছিল। ১০ নম্বর কলামে দোষ স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার পরে অভিযুক্তকে প্রেরণের সময় নিয়ে বলা হয়েছে। পি.ডব্লিউ-৫১ বলেছেন যে, বিবৃতি রেকর্ড করার পরে তিনি অভিযুক্তকে রেকর্ডসহ একই দিনে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করেছিলেন।
৬৩৯. দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানে ইচ্ছুক এমন কাউকে প্রশ্নগুলাে করার উদ্দেশ্য হলাে স্বীকারােক্তিটি এভিডেন্স অ্যাক্টের ২৪ ধারায় বর্ণিত চাপ প্রয়ােগ, হুমকি বা তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগ তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আদায় করা হয়নি সেইরূপ নিশ্চয়তা প্রদান। জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে যেরূপ অনিয়মের কথা আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, সেরূপ অনিয়ম হয়নি বললেই চলে। নথিতে থাকা সাক্ষ্য-প্রমাণ এটিই প্রমাণ করে যে, এই মামলায় দোষ স্বীকারকারী আসামিকে statutory period-এর বাইরে পুলিশ হেফাজতে রাখা হয়নি। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক নথিতে থাকা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি অস্পষ্ট বিবেচনায় জবানবন্দিগুলাে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত নয় বলে বিশ্বাস করেননি।
৬৪০. কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৪৫ নম্বর অধ্যায়টি সাধারণত অনিয়মিত কার্যধারার সাথে সম্পর্কিত। মূলত এখানে বলতে গেলে যে প্রশ্ন আসে তা হলাে এরূপ ক্রটি বা অনিয়ম আসামির বিচারপ্রাপ্তিতে কোনাে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে কিনা বা যে কয়টি ধারায় তা রাখা হয়েছে তার ফলে ন্যায়বিচারের ব্যর্থতা ঘটেছে কিনা। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর নির্দিষ্ট কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছে এবং সেসব শােধরানাের পন্থাও বলে দিয়েছে। সেইরূপ প্রত্যেক ক্ষেত্রে আদালত আইনসভার দৃশ্যমান আদেশগুলিকে কার্যকর করতে বাধ্য এবং সেই ক্ষেত্রে অধিকতর ভাবনার কোনাে সুযােগ নেই। যেসব বিষয়ে স্পষ্ট বিধান রাখা হয়নি শুধু সেই শ্রেণির মামলার ক্ষেত্রে আদালত সেরূপ সিদ্ধান্তে আসতে স্বাধীন।
৬৪১. এই বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৩ ধারার বিষয়ে চিন্তা মগ্ন। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার সময় কোনাে ত্রুটি বা বিচ্যুতি বা অনিয়ম হয়েছিল কিনা তা বিবেচনা করতে গিয়ে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৫৩৭ ধারাটি ভুলভাবে দেখেছেন। ধারা ৫৩৩ যা বলে তা নিম্নরূপ :
“533. Non-compliance with provisions of section 164 or 364(1)-If any Court, before which a confession or other statement of an accused person recorded or purporting to be recorded under section 164 or section 364 is tendered or has been received in evidence, finds that any of the provisions of either of such sections have not been complied with by the Magistrate recording the statement, it shall take evidence that such person duly made the statement
৬৬৫

recorded; and, notwithstanding anything contained in the Evidence Act, 1872, section 91, such statement shall be admitted if the error has not injured the accused as to his defense on the merits.
(2) The provisions of this section apply to Courts of Appeal, Reference and Revision.”
৬৪২. এই ধারাটি ১৬৪ ধারা বা ৩৬৪ ধারার যে কোনাে বিধান প্রতিপালিত না হওয়ার কারণে উদ্ভূত ত্রুটি সংশােধনের জন্য একটি পদ্ধতি বিধৃত করেছে। উদ্দেশ্য হলাে : এরকম non-compliance-এর কারণে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির বাধাকে প্রতিরােধ করা। কোনাে ম্যাজিস্ট্রেট যদি এই ধারার কোনাে বিধান প্রতিপালন করেন, তবে যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণের পর এই ধারার অধীনে দলিলটি যথাযথভাবে লিখিত হয়েছে। বলে বিবেচনা করা যেতে পারে, যদি ঐরূপ অপ্রতিপালন আসামির ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে কোনাে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। ১৬৪ ধারা বা ৩৬৪ ধারার কোনাে বিধান প্রতিপালন না করার কারণে যদি দোষ স্বীকারােক্তি বা বিবৃতি অগ্রহণযােগ্য হয়, তাহলে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৯১ ধারায় যা-ই বলা থাকুক না কেন স্বভাবজাত সাক্ষ্য প্রদান করে এটি প্রমাণ করা যেতে পারে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি যথাযথভাবে বিবৃতি প্রদান করেছেন। এবং বিবৃতিটি যখন সেইরূপ প্রমাণিত হয় তখন সেটি মামলার সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা বা ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি ঐরূপ অপ্রতিপালন আসামিকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। সেইরূপ অপ্রতিপালন কেবল তখনই শােধরানাে যায় যখন সেটি আসামিকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের গুণাগুণকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। Muhammad Ali vs. Emperor, 35 Cr LJ 385(FB) মামলায় একই রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, যেটি নিম্নরূপ :
“In view of the provisions of the sections of the Code of Criminal Procedure, particularly those contained in section 533, Criminal Procedure Code, it is difficult to say that the omission to record questions and answers is a fatal defect, and that it is only by recording such questions and answers that a confession can furnish data which enable the Court to arrive at the conclusion as to the voluntary nature of the confession. It is equally difficult to hold that when supplying these data or materials it would always be ‘impossible’ for the trial Court to form an estimate as to the voluntary nature of such confession. The defect no doubt is a gross irregularity and it may in certain special cases injure the accused in his defense on the merits, but barring such cases such a defect is completely cured by the provisions of section 533 of the Code of Criminal Procedure. It is open to a Court to come to a conclusion from the internal evidence furnished by the statement itself or from other evidence that the statement had been voluntarily made, and the mere fact that there was an omission to record questions and answers would not debar the Court from coming to that conclusion. Nor can it be said that without these data or materials it is ‘impossible for a Court to arrive at
৬৬৬

the conclusion that the confession had been made voluntarily. Where, of course, the defect is not merely one of recording it in due form and in accordance with law but there is a defect that the statement was not duly made at all, the position would be different.”
৬৪৩. Kehar Singh vs. State (Delhi Admn) reported in AIR 1988 SC 1883 (0241/1988) মামলায় কেহের সিংয়ের দোষ স্বীকারােক্তি রেকর্ড করার পদ্ধতিতে ক্রটি সম্পর্কে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হলে বিচারপতি বি সি রায় নজির আহমেদ মামলা এবং ধারা ৫৩৩-এর বিধানগুলি বিবেচনা করে নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন :
“On a consideration of the above decisions it is manifest that if the provisions of section 164(2) which require that the Magistrate before recording confession shall explain to the person making confession that he is not bound to make a confession and if he does so it may be used as evidence against him and upon questioning the person if the Magistrate has reasons to believe that it is being made voluntarily then the confession will be recorded by the Magistrate. The compliance of the sub-section (2) of section 164 is therefore, mandatory and imperative and non-compliance of it renders the confession inadmissible in evidence. Section 463 (old section 533) of the Code of Criminal Procedure provides that where the questions and answers regarding the confession have not been recorded evidence can be adduced to prove that in fact the requirements of sub-section (2) of section 164 read with section 281 (old section 364) have been complied with. If the Court comes to a finding that such a compliance had in fact, been made the mere omission to record the same in the proper form will not render it inadmissible evidence and the defect is cured under section 463 but when there is noncompliance of the mandatory requirement of section 164(2), Criminal Procedure Code and it comes out in evidence that no such explanation as envisaged in the aforesaid sub-section has been given to the accused by the Magistrate, this substantial defect cannot be cured under section 463, Criminal Procedure Code.”
৬৪৪.নলিনী মামলায় (1999) 5 SCC 253অনুরূপ দৃষ্টভঙ্গি প্রকাশ করা হয়েছে:
“Even if there is an error committed by the Magistrate while recording a statement of the confessing accused if it is mere an irregularity and if such error or defect or non-compliance has not prejudiced the accused in taking his defense, it is curable under section 533, CrPC and by this irregularity under no stretch of imagination it can be said that the accused is likely to be prejudiced in his defense on the merits on account of such omission and irregularity.”
৬৬৭

৬৪৫. সুতরাং, ৫৩৩ ধারা যেটি করে সেটি হলাে এটি ১৬৪ ধারায় বর্ণিত পদ্ধতিগুলি বাস্তবে অনুসরণ করা হয়েছিল তা প্রমাণ করার জন্য মৌখিক সাক্ষ্য প্রদানের অনুমতি দেওয়া, যখন আদালত উপস্থাপিত নথি থেকে দেখেন যে তা করা হয়নি। যদি মৌখিক সাক্ষ্য এটি প্রমাণ করতে পারে যে, পদ্ধতিগুলাে যথার্থভাবে অনুসরণ করা হয়েছিল, তাহলে তখনই নথি সাক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হতে পারে। এই ধারাটি বাস্তবে পদ্ধতিগুলাে অনুসরণ করা হয়েছিল তা প্রমাণের জন্য মৌখিক সাক্ষ্য প্রদানের অনুমতি দেয়, যখন নথিদৃষ্টে তা প্রতিভাত হয় না। এ মামলায় পি.ডব্লিউ-৫১ ও ৫২ ত্রুটিগুলাে ব্যাখ্যা করেছেন এবং দোষ স্বীকারকারী আসামিগণ সেইসব বিষয়ে সাক্ষীগণকে জেরা করেছেন। তা সত্ত্বেও ঐরূপ ত্রুটির কারণে আসামিপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিধায় তারা সংক্ষুব্ধ- এ মর্মে তাদের কোনাে অভিযােগ নেই বললেই চলে।
৬৪৬. নথি থেকে দেখা যায়, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান তার স্বীকারােক্তি প্রদানের ৫২ দিন পর ১৯৯৭ সালের ৩০ ফেব্রুয়ারি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান তার স্বীকারােক্তি প্রদানের ৪৩ দিন পর ১৯৯৩ সালের ৫ মার্চ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) তার স্বীকারােক্তির ৩০ দিনেরও বেশি সময় পরে তাদের স্ব স্ব স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করে। প্রত্যাহারের (retraction) আবেদন দাখিল করতে বিলম্ব সম্পর্কে আসামিপক্ষের কোনাে ব্যাখ্যা নেই। সুতরাং, এটি অনুমান করা যেতে পারে যে, স্বীকারােক্তি প্রদান করার পর প্রত্যাহারের (retraction) এই আবেদনসমূহ স্বীকারােক্তি প্রদান-পরবর্তী চিন্তাপ্রক্রিয়া (afterthought devices), বিবৃতিগুলােতে স্বীকৃত বিষয়গুলাে nullify করার জন্য। এভিডেন্স অ্যাক্টের ৮০ ধারায় বিচারিক কার্যক্রম চলাকালীন গৃহীত দলিলাদি সম্পর্কিত নীতি Omnia praesumuntur rite et solemniter esse acta-কে অনুমােদন দেওয়া হয়েছে। এটি কোনাে নির্দিষ্ট ধরনের সাক্ষ্যকে গ্রহণযােগ্য করে না, তবে আইন অনুসারে গৃহীত কিছু দলিলাদির ক্ষেত্রে কেবল আনুষ্ঠানিক প্রমাণের প্রয়ােজনীয়তার সাথে সম্পর্কিত। এ ধারাটি দলিলাদির শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রযােজ্য,
(a) purporting to be the record of the evidence of a witness given in a judicial proceeding and,
(b)purporting to be the record of the statement or confession of a prisoner or an accused person.
৬৪৭. এভিডেন্স অ্যাক্টের ৮০ ধারার অধীনে অনুমানের উত্থাপনের জন্য যা প্রয়ােজনীয় তা হলাে কোনাে মামলায় আসামির প্রদত্ত স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি হিসেবে গণ্য হওয়া কোনাে বিবৃতি আইন অনুসারে নেওয়া উচিত ছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তির জবানবন্দি বা দোষ স্বীকারােক্তি গ্রহণ করার প্রক্রিয়া সম্পর্কিত আইন কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৬৪ এবং ৩৬৪ ধারায় বিধৃত রয়েছে। তাকে করা প্রতিটি প্রশ্ন এবং তার দেওয়া প্রতিটি উত্তরসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যে ভাষায় পরীক্ষা করা হয়েছে সেই ভাষায় তা পুরােপুরি রেকর্ড করতে হবে, বা যদি তা সম্ভব না হয় তবে আদালতের ভাষায় বা ইংরেজিতে এই জাতীয় রেকর্ড তাকে দেখানাে হবে এবং যদি তিনি লিখিত ভাষাটি বুঝতে না পারেন তবে তাকে এমন ভাষায় ব্যাখ্যা করা হবে যা তিনি বুঝতে পারেন। রেকর্ডটি অভিযুক্ত এবং ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক স্বাক্ষরিত হবে। যখন এই জাতীয় দলিল প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয় এবং দেখা যায় যে, ধারা ১৬৪(৩)-এ বর্ণিত নিয়, প্রয়ােজনীয় একটি প্রত্যয়ন (memorandum) প্রদত্ত হয়েছে, তাহলে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৮০ ধারার অধীনে একটি অনুমান সামনে আসে যে, সব প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন করা হয়েছে এবং সেইরূপ দলিলগুলি অধিকতর প্রমাণ ছাড়াই সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠে।
৬৬৮

৬৪৮. একটি প্রশ্ন হলাে, এই ধরনের প্রত্যাহার (retraction) বিবেচনায়, জবানবন্দিকারীর বিরুদ্ধে দোষ স্বীকারােক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে কি না বা এগুলাে অন্যান্য সহ-আসামির বিরুদ্ধে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে কি না। Joygun Bibi os. State, 12 DLR (SC) 156 মামলায় জয়গুন বিবির স্বামী আব্দুস সামাদকে হত্যার বিষয়ে আবদুল মজিদ নিজেকে এবং জয়গুন বিবিকে সম্পৃক্ত করে দোষ স্বীকারােক্তি প্রদান করেছিল। বিচারিক আদালত এটি এবং জয়গুনের গহপরিচারিকা জহুরার জবানবন্দি বিশ্বাস করে আবদুল মজিদ এবং জয়গুন বিবি উভয়কেই দোষী সাব্যস্ত করেছিল। হাইকোর্ট আবদুল মজিদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিকে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত বলে বিশ্বাস করেন, যেটি অবস্থাগত সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয়েছিল এবং জবানবন্দির retraction সত্ত্বেও আবদুল মজিদকে দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখেছিলেন। জয়গুন বিবির বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ সহ-অভিযুক্ত মজিদের দোষ স্বীকারােক্তি এই যুক্তিতে বিবেচনা করেননি যে, স্বীকারােক্তিটি প্রত্যাহার করা হয়েছে, কার্যত জয়গুন বিবির বিরুদ্ধে এটির কোনাে সাক্ষ্যগত মূল্য নাই। তবে জহুরার সাক্ষ্য এবং অন্যান্য অবস্থাগত সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে তাকে দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখেছিলেন। পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টের ব্যাখ্যায়িত আইনের অবস্থান গ্রহণ করেনি। এটি বলা হয়েছিল যে, দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাহার একটি অবস্থা, তা স্বেচ্ছায় প্রদান করেছিল কি না এবং এটি সত্য কি না এমন অধিকতর প্রশ্নে যেটির কোনাে প্রভাব নেই। দোষ স্বীকারােক্তি প্রদানকারী পরবর্তীকালে সেটি ধারণ করেন কি না তা স্বীকারােক্তিটি সত্য বা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত কি না এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে কোনাে প্রভাব ফেলতে পারে না, এবং যদি তা হয় এবং তা সত্য কি না তবে তা অভিযােগের পরিণতির সরাসরি দোষসূচক বক্তব্য থেকে সরে আসার জন্য, যা এটির ফলাফলের সম্ভাব্যতা দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা উচিত, এবং এটির স্বেচ্ছাপ্রণােদিত প্রকৃতি বা বর্ণিত ঘটনাগুলাের সত্যতার সাথে সেরূপ কোনাে সংযােগের প্রয়ােজন নেই। হাইকোর্ট প্রথমে এই দুটি প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ ছিলেন এবং দোষ স্বীকারােক্তিটি নিজেই যথেষ্ট ছিল কি না এর উত্তর ছিল ‘হ্যা’ সূচক যা অন্যান্য ঘটনা ও অবস্থাদির সাথে বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং তা আবদুল মজিদকে দোষী সাব্যস্তকরণ সমর্থন করেছিল। প্রধান বিচারপতি কর্নেলিয়াস নিম্নবর্ণিত যুক্তি প্রদান করেছিলেন :
The retraction of the confession was wholly immaterial once it was found that it was voluntary as Well as true. That being the case, no reason whatsoever can be found for the inability felt by the learned Judges in taking the confession into consideration against the co-accused. It is true that if there were no other evidence against Joygun Bibi except the confession of Abdul Majid, then, the confession by itself being merely a matter to be taken into consideration, and not having the quality of evidence against Joygun Bibi, it could rightly be held in law that her conviction could not be sustained on the confession alone. The grounds for this conclusion would undoubtedly gain weight if the confession were also retracted. But in the present case, Abdul Majid’s confession is by no means the only material in the case to be taken into consideration against Joygun Bibi. As will be seen presently, the evidence of the maid-servant Zohura furnished a very complete and detailed account of
৬৬৯

the movements and behaviour of Joygun Bibi on the night in question, and particularly at and after the time of the murder. Joygun Bibi has not offered any explanation in answer to the questions put to her on the basis of Zohura’s evidence and Abdul Majid’s confession as to her behavior that night. She has been content to repeat that she is innocent and to suggest that the case has been fabricated against her by her husband’s younger brother, Sattar.”
৬৪৯. Mohd. Hussain Umar vs. KS Dalipsinghhi, AIR 1970 SC 45, Ram Parkash vs. State of
Punjab AIR 1959 SC 1, 478 State vs. Fazu Kazi alias Kazi Fazlur Rahman 29 DLR (SC) 271 মামলাগুলােতে অনুরূপ মতামত প্রদান করা হয়েছে। কাজী ফজলুর মামলার ক্ষেত্রে জয়গুন বিবির মামলায় দেওয়া পর্যবেক্ষণগুলি পুনরায় ব্যক্ত করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমে আমাদের সুপ্রীম কোর্ট সেখানে দেওয়া যুক্তিমতে আইনের বিবৃতি অনুসরণ করেছেন।
৬৫০. রাম প্রকাশের মামলায় সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি এস জাফর ইমাম নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন :
“It will be clear from the terms of this section that where more persons than one are being tried jointly for the same offense, a confession made by any one of them affecting himself and any one of his co-accused can be taken into consideration by the Court not only against the maker of the confession but also against his co-accused. The Evidence Act nowhere provides that if the confession is retracted, it cannot be taken into consideration against the co-accused or the confessing accused. Accordingly, the provisions of the Evidence Act do not prevent the Court from taking into consideration a retracted confession against the confessing accused and his co-accused. Not a single decision of any of the Courts in India was placed before us to show that a retracted confession was not admissible in evidence or that it was irrelevant as against a co-accused.”
৬৫১. হােসেইন ইমামের মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট ভুবনি সাহুর (AIR 1949 PC 257) মামলার পর্যবেক্ষণকে অনুসরণ করে নিম্নবর্ণিত মতামত দিয়েছেন :
“At the trial he retracted the confession. Under section 30 the Court can take into consideration this retracted confession against Mukherjee. But this confession can be used only in support of other evidence and cannot be made foundation of a conviction.”
৬৫২. State os. Minhun alias Gul Hassan, 16 DLR (SC) 598 মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে যে, দোষ স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত প্রমাণিত হলে তা প্রত্যাহার করা হলেও দোষী সাব্যস্তকরণের ভিত্তি গঠন করতে পারে। পর্যবেক্ষণগুলি হলাে :
“As for the confessions the High Court, it appears, was duly conscious of the fact that retracted confessions, whether judicial or extrajudicial, could legally
৬৭০

be taken into consideration against the maker of those confessions himself, and if the confessions were found to be true and voluntary, then there was no need at all to look for further corroboration. It is now well settled that as against the maker himself his confession, judicial or extra judicial, whether retracted or not retracted, can in law validly form the sole basis of his conviction, if the Court is satisfied and believes that it was true and voluntary and was not obtained by torture or coercion or inducement. The question, however, as to whether in the facts and circumstances of a given case the Court should act upon such a confession alone is an entirely different question, which relates to the weight and evidentiary value of the confession and not to its admissibility in law.”
৬৫৩. আইন অনুসারে দোষ স্বীকারােক্তি দোষী সাব্যস্তকরণের ভিত্তি হতে পারে যদি এটি আইন অনুসারে রেকর্ডকরা হয়ে থাকে; যদি এটি সত্য এবং স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হিসেবে পাওয়া যায়, এটি যদি দোষসূচক হয় এবং বিবৃতিটি সামগ্রিকভাবে পরীক্ষা করার পর রাষ্ট্রপক্ষের মামলার সাথে তা সাজুয্যপূর্ণ হয়। কোন মামলায় কতটুকু মাত্রার সমর্থন (corroboration) প্রয়ােজন হবে সেটি একটি ঘটনাসম্পর্কিত প্রশ্ন (question of fact) যা প্রতিটি মামলার অবস্থাদির আলােকে নির্ধারণ করতে হবে। কখনও কখনও কোনাে corroborative evidence পাওয়া যায় না এবং আদালত দোষ স্বীকারােক্তিটি, তা প্রত্যাহার করা হােক বা না হােক, বিবৃতি প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারেন, যদি দোষ স্বীকারােক্তিটি সত্য এবং স্বেচ্ছাপ্রণােদিত বলে পাওয়া যায় এবং নির্যাতন করে বা প্রলােভন দেখিয়ে তা আদায় করা না হয়। সহ-আসামির বিরুদ্ধে যখন একটি দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি বিবেচনা করা হয়, সেই দোষ স্বীকারােক্তি প্রত্যাহার করা হােক বা না হােক এবং যদি সেই দোষ স্বীকারােক্তি স্বেচ্ছাপ্রণােদিত ও সত্য বলে পাওয়া যায়, তবে দোষ স্বীকারােক্তি দোষী সাব্যস্তকরণের ভিত্তি হতে পারে না এবং সেটি কেবল অন্যান্য সাক্ষ্যের সমর্থনে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ধরনের কোনাে মামলায় প্রথম কর্তব্যটি হচ্ছে দোষ স্বীকারােক্তি বিবেচনায় নেওয়া ছাড়া আসামির বিরুদ্ধে অন্যান্য সাক্ষ্যগুলাে marshall করা এবং এটি দেখা যে, এটি বিশ্বাস করলে তা দোষী সাব্যস্তকরণের ভিত্তি হতে পারে কিনা। যদি সেগুলাে স্বাধীনভাবে বিশ্বাসযােগ্য হয় তবে অবশ্যই সেগুলাের সমর্থনে স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিটিকে ব্যবহার করার প্রয়ােজন নেই। আদালত যেখানে অন্য কোনাে সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাজ করার জন্য প্রস্তুত নয়, তখন এই জাতীয় ঘটনায় বিচারক দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিকে অন্যান্য সাক্ষ্যের সমর্থনসূচক হিসেবে
ব্যবহার করতে পারেন।
৬৫৪. উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের দোষ স্বীকারােক্তি আইন অনুসারে রেকর্ড করা হয়েছিল এবং প্যারেড গ্রাউন্ডে তার উপস্থিতি সম্পর্কে তার বক্তব্য এবং সেখান থেকে সেরনিয়াবাতের বাড়িতে তার উপস্থিতি এবং তারপর রেডিও স্টেশনে উপস্থিতিটি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। ঘটনা-পরবর্তী তার আচরণের বিষয়ে তার বক্তব্য পি.ডব্লিউ-১৫, ৩৭, ৪৬ এবং ৪৭ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার
৬৭১

রশিদ খান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। পি.ডব্লিউ-১, ৪, ১১, ১২, ১৫, ২১, ৪২ এবং ৪৬ তার দেওয়া বিবৃতির মূল বিষয়গুলাে সমর্থন করেছেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) দোষ স্বীকারােক্তিটির মূল বিষয়গুলাে অন্যান্য দোষ স্বীকারকারী আসামি কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে। তার প্রদত্ত বক্তব্যও পি.ডব্লিউ-১৭, ১৮, ২৭ এবং ৩৪ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। নৈশকালীন প্যারেডে তার উপস্থিতি সম্পর্কে তার বক্তব্য পি.ডব্লিউ-১১, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৯ এবং ৩৫ দ্বারা সমর্থিত হয়েছে। দোষ স্বীকারােক্তি প্রদানকারী এই আসামিরা মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং মেজর বজলুল হুদাকেও মূল বিষয়গুলােতে সম্পৃক্ত করেছে। ১৪ আগস্ট নৈশ প্যারেডে আপিলকারীদের অংশগ্রহণ এবং ঘটনার সময় বিভিন্ন মূল পয়েন্টে বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপে তাদের অংশগ্রহণ বিষয়ে তাদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে কোনাে অসঙ্গতি নেই। বজলুল হুদার বিপক্ষে সহ-আসামির দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি ছাড়াও পি.ডব্লিউ-১, ৪, ৫, ৬, ১২, ২১ এবং ২২-এর সমর্থনমূলক সাক্ষ্য রয়েছে এবং পি.ডব্লিউ-৪, ৫, ৭, ১১, ১২, ২১ এবং ২২ মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদের সম্পৃক্ততা সমর্থন করেছে।
৬৫৫. এখন পরবর্তী প্রশ্ন হলাে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অধীনে ষড়যন্ত্র শেষে ফৌজদারি ষড়যন্ত্রের অভিযােগ প্রমাণ করার জন্য অভিযুক্ত আপিলকারীগণের দোষ স্বীকারােক্তিগুলি তাদের এবং সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য কি না। ষড়যন্ত্র মানে কোনাে অপরাধ সংঘটনের জন্য দুই বা ততােধিক ব্যক্তির যৌথ পদক্ষেপের চেয়ে বেশি কিছু; যদি সেটি অন্য কিছু হয়ে থাকে। ধারা ১০-এর উদ্দেশ্য হলাে ষড়যন্ত্র চলাকলীন ষড়যন্ত্রটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন ষড়ন্ত্রকারীদের মধ্যে যােগাযােগের বিষয়টি সম্পর্কে সাক্ষ্য গ্রহণ করা। Mirza Akbar os. King Emperor, AIR 1940 (PC) 176 মামলায় এই বিষয়টির উত্তর দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন কর্তৃত্ব (authorities) এবং এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারা বিবেচনায় প্রিভি কাউন্সিলের বিচারকগণ এই মতামতে এসেছিলেন যে, ষড়যন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের অবসান হলে সেটি substantive সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। এই সম্পর্কে নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল :
“This being the principle, their Lordships think the words of section 10 must be construed in accordance with it and are not capable of being widely construed so as to include a statement made by one conspirator in the absence of the other with reference to past acts done in the actual course of carrying out the conspiracy, after it has been completed. The common intention is in the past. In their Lordships’ judgment, the words “common intention” signifies a common intention existing at the time when the thing was said, done or written by one of them. Things said, done or written while the conspiracy was on foot are relevant as evidence of the common intention, once reasonable ground has been shown to believe in its existence. But it would be a very different matter to hold that any narrative or statement or confession made to a Third party after the common intention or conspiracy was no longer operating and had ceased to exist is admissible against the other party. There
৬৭২

is then no common intention of the conspirators to which the statement can have reference. In their Lordships’ judgment section 10 embodies this principle. That is the construction which has been rightly applied to section 10 in decisions in India, for instance, in 55 Bom 839 and 38 Cal 169. In these cases the distinction was rightly drawn between communications between conspirators while the conspiracy was going on with reference to the carrying out of conspiracy and statements made, after arrest or after the conspiracy has ended, by way of description of events then past.”
৬৫৬. এইরূপ মতামতগুলি Zulfiqar Ali Bhutto vs. State PLD 1979 SC 53, State vs. Nalini (1999) 5 SCC 283, Mohd Khalid vs. State of West Bengal (2002) 7 SCC 334, Sidharth and others vs. State of Bihar (2005) 12 SCC 545, and State vs. Navjot Sandhu alias Afsan Guru (2005) 11 SCC 600 মামলাগুলাে অনুমোদিত হয়েছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো মামলায় পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আনােয়ারুল হক উপমহাদেশের এই মামলাগুলাের পূর্ব সিদ্ধান্তসমূহ বিবেচনা করে নিমের মতামত প্রদান করেছিলেন :
“The methodology employed in the actual application of section 10 of the Evidence Act is fully demonstrated in these cases to the effect that its actual application follows and does not precede the finding that there is reasonable ground to believe that a conspiracy exists and certain persons are conspirators. It merely speaks of the use of evidence in the case, and the section does not control the sequence in which the evidence should be let in. It appears that these are but only two phases in the exercise of the application of section 10 of the Act, and not two distinct and separate stages laying down the order in which evidence is to be led. In the initial phase and as a condition precedent under this section, the Court has got to find from evidence aliunde on the record that there are reasonable grounds to believe that two or more persons have conspired together to commit an offense or an actionable wrong. After having passed this test, the next phase in the exercise consists in the actual application of the operative part of this section whereby anything said, done or written by any one of such persons in reference to their common intention, during the continuance of the conspiracy, is treated as a relevant fact against each of the persons believed to be so conspiring, as well for the purpose of proving the existence of conspiracy as for the purposes of showing that any such person was a party to it. In fact, this section deals with the mode of evaluation and the use of the evidence brought on the record. It does not provide that the proof of existence of the conspiracy must necessarily precede any proof of the acts and declarations of the co-conspirators of the accused for use against them.”
৬৭৩

৬৫৭. ভারতের সুপ্রীম কোর্টের আরাে একটি মতামত রয়েছে। এটি বলা হয় যে, স্বাভাবিকভাবে ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত একজন ষড়যন্ত্রকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাদের হেফাজতে রাখলে ষড়যন্ত্রের অন্য ষড়ন্ত্রকারীদের এজেন্ট হিসেবে তার অংশগ্রহণ বন্ধ হয়ে যাবে। আইনের এমন কোনাে ধারণা প্রদান সম্ভব না-ও হতে পারে যে, ষড়যন্ত্রের সাথে একজন ষড়যন্ত্রকারীর সংযুক্তি তার গ্রেফতারের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং, গ্রেপ্তারের পরে অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি, যদি তা গ্রহণযােগ্য ও বিশ্বাসযােগ্য হয়, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অধীনে দোষ স্বীকারকারীর বিরুদ্ধে অন্যতম সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে অন্যান্য অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এর ব্যবহার কেবল অন্যান্য সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
৬৫৮. State of Maharashtra os. Damu (2000) 6 SCC 269 = AIR 2000 SC 1691 মামলায় সহ-আসামি বালু যােশি দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল, যেখানে সে আরাে দুজন ব্যক্তিকে সম্পৃক্ত করেছিল। সুপ্রীম কোর্ট সহ-আসামিদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দির সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করেছিল, যেহেতু দোষ স্বীকারােক্তি প্রদানকারী আসামি ষড়যন্ত্রকারীদের সাধারণ স্বার্থের প্রসঙ্গে বলেছিল। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল :
“In this case there can be no doubt, relying on Ex. 88 that there are reasonable grounds to believe that all the four accused have conspired together to commit the offences of abduction and murders of the children involved in this case. So what these accused have spoken to each other in reference to their common intention as could be gathered from Ex.88 can be regarded as relevant facts falling within the purview of section 10 of the Evidence Act. It is not necessary that a witness should have deposed to the fact so transpired between the conspirators. A dialogue between them could be proved through any other legally permitted mode. When Ex.88 is legally proved and found admissible in evidence, the same can be used to ascertain what was said, done or written between the conspirators. All the things reported in that confession referring to what A-1 Damu Gopinath and A-3 Mukinda Thorat have said and done in reference to the common intention of the conspirators are thus usable under section 10 of the Evidence Act as against those two accused as well, in the same manner in which they are usable against A-4 Damu Joshi himself.”
৬৫৯. Baburao Bajiroa Patil vs. State of Maharashtra, (1971) 3 SCC 432 মামলায়ও অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। সেখানে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছে :
“After having so held the confessional statements of the co-accused, in our opinion, could legitimately be taken into account by the Court to receive assurance to its conclusion. In regard to the appellant’s presence at Angar on the morning of December 7, 1961 and in regard to the request by Rangya, Shankar and Kalyan to the appellant to help and protect them, the
৬৭৪

confessional statements of the co-accused could also be appropriately taken into consideration as provided by section 30 of the Indian Evidence Act. In a case of conspiracy in which only circumstantial evidence is forthcoming, when the broad-features are proved by trust-worthy evidence connecting all the links of a complete chain, then on isolated event the confessional statements of the co-accused lending assurance to the conclusions of the Court can be considered as relevant material and the principle laid down in the case of Haricharan Kurmi (supra) would not vitiate the proceedings.”
৬৬০. এই পর্যবেক্ষণগুলাে Mokbul Hossain os. State, 12 DLR (SC) 217 মামলায় অনুমােদিত হয়েছে। মকবুল হােসেনের বিরুদ্ধে মামলাটি অন্য দুই আসামি রেজিস্টারে তার নামজারি করার জন্য তহশিলদারকে ঘুষের টাকা দেওয়ার সময় যা বলেছিল বলে দাবি করা হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে সেটির উপর নির্ভরশীল ছিল। বিচারকালে ঐ দুই অভিযুক্ত তাদের কথিত বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিল। যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল সেটি হলাে যে, এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ এবং ৩০ ধারাবলে তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের কাছে দুজন সহ-আসামির বিবৃতি ছিল কিনা। আদালত নিম্নরূপ মতামত দিয়েছিলেন :
“Section 10 of the Evidence Act declares that where there is reasonable ground to believe that two or more persons have conspired together to commit an offense or an actionable wrong, anything said, done or written by any one of such persons in reference to their common intention, after the time when such intention was first entertained by any one of them, is a relevant fact as against each of the persons believed to be so conspiring, as well for the purpose of proving the existence of the conspiracy as for the purpose of showing that any such person was a party to it. A plain reading of this section makes it clear that apart from the act or statement of the coconspirator, some prima facie evidence must exist of the antecedent conspiracy in order to attract section 10. Such evidence of a pre-existing conspiracy between the appellant and the two Revenue Officers is conspicuous by its absence in this case.”
৬৬১. যথাযথ সম্মানের সাথে বলছি, আমি পরবর্তী মতামতগুলি সমর্থন করতে পারছি না, একবার যদি বিশ্বাস করার জন্য যক্তিসঙ্গত ভিত্তি উপস্থিত হয় যে, দই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে কোনাে অপরাধ সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্র করেছে, সাধারণ অভিপ্রায় নির্ধারিত হওয়ার পর ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা কিছু বলা, করা বা লিখিত হয়েছে, তাহলে সেগুলাে কেবল তার বিরুদ্ধে নয়, অন্যদের বিরুদ্ধেও প্রাসঙ্গিক। শুধু ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যেই নয়, বরং অন্যরাও যে সেটির অংশীদার সেটি প্রমাণের জন্য।
৬৬২. এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার অধীনে সাক্ষ্যের গ্রহণযােগ্যতার বিষয়ে দুটি আপত্তি থাকতে পারে। প্রথমত,
যে ষড়যন্ত্রকারীর সাক্ষ্য সহ-ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাওয়া হয়েছে তা সহ-ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে আদালতে মুখােমুখি হয় নাই এবং দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপক্ষ কেবল বিশ্বাস করার জন্য যুক্তিসঙ্গত ভিত্তির অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি কোনাে অপরাধ করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে যা
৬৭৫

সহ-ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পৃক্ত করতে agency relationship-এর অস্তিত্বকে প্রক্রিয়ার মাঝে নিয়ে আসে। ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হওয়ার পর বা সেটি পরিত্যক্ত হলে বা ব্যর্থ হলে বা এই সময়ের মধ্যে ষড়যন্ত্রকারী সেটি প্রত্যাহার করার কারণে সেটি শেষ হয়ে গেলে সেটির সম্পর্কে কোনে সহ-আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার কর যাবে না। ষড়যন্ত্রের সময়কাল নির্ধারণ করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারার বিধান কেবল ষড়যন্ত্রের অস্তিত্বকালীন সময়ের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে।
৬৬৩. কোনাে নির্দিষ্ট আসামি ষড়যন্ত্রকারী হওয়া থেকে সরে গিয়েছিল কিনা তা এমন একটি বিষয়, যেটি সম্পর্কে প্রদত্ত মামলার ঘটনা ও অবস্থাদির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। একজন ষড়যন্ত্রকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করার পরপরই ষড়যন্ত্রে তার অংশগ্রহণটি বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তখন সে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীর নিযুক্তি (agent) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তবে এমন কিছু মামলা রয়েছে যেখানে কোনাে ষড়যন্ত্রকারী গ্রেফতার হওয়ার পরও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীর সাথে যােগাযােগ অব্যাহত রাখতে পারে এবং সেইরূপ মামলায় দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দোষ স্বীকার প্রদানকারীসহ অন্য আসামির বিরুদ্ধে যাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এই মামলায় প্রসিকিউশন এমন কোনাে সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারেনি যে, এই তিনজন দোষ স্বীকারকারী আসামি গ্রেপ্তারের পরেও বাইরে থাকা অন্য ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিল।
৬৬৪. বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি (Extra Judicial Confession)- এমনকি আমরা যদি এই দোষ স্বীকারমূলক জবানবন্দিগুলােকে স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হিসেবে বিশ্বাস না করি, তবু রাষ্ট্রপক্ষ চারজন আপিলকারীর বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি (Extra Judicial Confession) প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যেটিকে আইনানুগ সাক্ষ্য হিসেবে বিচেনায় নেওয়া যেতে পারে এবং সেটিকে নির্ভর করে তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখা যেতে পারে। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল পি.ডব্লিউ-৮ এবং ১৫-এর জবানবন্দির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল মনে করেন যে, যেহেতু এই জবানবন্দিগুলাে নির্ভরযােগ্য, বিশ্বাসযােগ্য এবং সন্দেহের উর্ধ্বে, সেহেতু এই জবানবন্দিগুলাে দোষী সাব্যস্তকরণের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
৬৬৫. প্রাসঙ্গিক সময়ে পি.ডব্লিউ-৮ ক্যাপ্টেন পদে সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। কমান্ডিং অফিসারদের আদেশ অনুসারে এই সাক্ষী আরাে দুজন কর্মকর্তাসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বিদ্যমান প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। তদানুসারে, তিনি (সাক্ষী) ১৫ আগস্ট সকাল ৮.৪৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন পরিদর্শন করেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) বলেছেন যে, মেজর নূর চৌধুরী এবং মেজর বজলুল হুদা তাদের গ্রহণ করেছিল এবং তারপরে মেজর বজলুল হুদা তাকে বাসভবনের ভিতরে নিয়ে যায় এবং কথােপকথনের সময় বজলুল হুদা নিম্নরূপভাবে তার দেওয়া প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল :
“ক্যাপ্টেন হুদা আমাদিগকে বাড়ির ভিতর নিয়া গেলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির রিসিপশন রুমে টেলিফোন টেবিলের পাশে শেখ কামালের লাশ গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে দেখি। আমি তখন বজলুল হুদাকে জিজ্ঞাসা করি, শেখ কামালকে কেন মেরেছেন? উত্তরে বজলুল হুদা জানায়, শেখ কামাল ফোনে বাহিরে খবর দিতেছিল- সেই জন্য তাহাকে মেরেছি।
ঐ রুমের টেবিলের সামনে লুঙ্গি পরা ও গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আরাে একজনের লাশ দেখিতে পাই। ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করি কেন তাকে মেরেছেন? জবাবে হুদা জানায়, সে পুলিশের লােক; তাকে
৬৭৬

চলে যেতে বললে সে তর্ক শুরু করে দেয়- সেইজন্য তাকে আমরা মেরেছি। তৎপর বজলুল হুদা আমাদিগকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। সিঁড়ির দক্ষিণ দিকে বাথরুম দেখাইয়া বলে :
“এখানে শেখ নাসেরের লাশ আছে। আমরা বাথরুমে গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় নাসেরের লাশ দেখি। হুদাকে জিজ্ঞাসা করি কেন তাকে মেরেছেন?”
ক্যাপ্টেন হুদা কোনাে উত্তর দেয় না। এরপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা আমাদিগকে নিয়া সিঁড়ির দিকে ওঠে। সিঁড়ির কয়েক ধাপ উঠিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ দেখিয়া আমরা হতভম্ব হইয়া যাই। সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরিহিত বুকের বাম পাশে, পেটের ডান দিকে, ডান হাতে অর্থাৎ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় পা ভাঁজ করে চিত হইয়া সিঁড়ির মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়িয়া আছেন। পাশে তাহার চশমাও দেখিতে পাই। আমি ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করিলাম :
“আপনারা কেন দেশের প্রেসিডেন্টকে এইভাবে মারলেন?”
উত্তরে ক্যাপ্টেন হুদা বলিল, আমি যখন দলবলসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে যাই সে তখন বলে,
“তােমরা কেন আমার বাসায় আসিয়াছাে? কে তােমাদেরকে পাঠাইয়াছে? শফিউল্লাহ কোথায়? এই বলিয়া আমাকে ঝটকা মারে- তখন আমি পড়ে যাই। ইহার পর আমরা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করি।”
তারপর আমাদেরকে নিয়া ক্যাপ্টেন হুদা খাবারঘরের পাশে গেলে আমরা সেখানে (বঙ্গবন্ধুর বেড রুমের দরজায়) বেগম মুজিবের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত লাশ দেখিতে পাই। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর বেডরুমের ড্রেসিং টেবিলের সামনে গুলিবদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় আরাে চারিটি লাশ পড়িয়া থাকিতে দেখি। তখন আমি ক্যাপ্টেন হুদাকে জিজ্ঞাসা করি : “কেন এদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন?” জবাবে ক্যাপ্টেন হুদা বলে : “সশস্ত্র সৈনিকরা out of control হইয়া এদেরকে হত্যা করিয়া লুটপাট করিয়াছে এবং সেই জন্য সে সৈনিকদেরকে বাহিরে রাখিয়াছে।”
ক্যাপ্টেন আরাে জানায়,
“কর্নেল জামিলকে বাহিরে মেরে তার লাশসহ গাড়ির ভিতরে পিছনে রাখা হইয়াছে।”
৬৬৬. মেজর বজলুল হুদা এই সাক্ষীর কাছে স্বীকার করেছে যে, সে শেখ কামালকে হত্যা করেছিল। কারণ তিনি (কামাল] বাইরে এই ঘটনার তথ্য প্রেরণ করছিলেন। আরাে স্বীকার করে যে, তারা একজন নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যা করেছেন। কারণ সে তাদের সাথে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়েছিল এবং তারপর শেখ নাসেরকে হত্যার কারণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মেজর হুদা চুপ করে ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিষয়ে আরাে জিজ্ঞাসাবাদে জবাব দিয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছিলেন কেন তারা। সেখানে এসেছে এবং শফিউল্লাহর অবস্থান চেয়েছিলেন সেজন্য এবং তাকে গুলি করে ফেলে দেন। নারীদের হত্যার বিষয়ে আরাে জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায় যে, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল এবং সেজন্য সিপাইরা তাদের হত্যা করেছে। হত্যাকাণ্ড স্বীকারের বিষয়টি সম্পর্কে এই সাক্ষীর জবানবন্দিকে এই আপিলকারী প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে চ্যালেঞ্জ করেনি। মেজর বজলুল হুদা এই
৬৭৭

বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তিতে (extra judicial confessions) বন্দুকের গুলিতে শেখ কামালের হত্যাকাণ্ডে এবং এরপর বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় তার অংশগ্রহণ স্বীকার করেছে। এই সাক্ষীর সাক্ষ্য অখণ্ডিত (uncontroverted) রয়ে গেছে। মেজর বজলুল হুদার উপরে বর্ণিত বিবৃতি ছাড়াও পি.ডব্লিউ-১৫-ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল খােন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, মেজর বজলুল হুদা, মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অন্যান্য আসামির বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক বিবৃতি (extra judicial confessions) প্রমাণ করেছেন। বিবৃতির (সাক্ষীর) প্রাসঙ্গিক অংশ নিম্নরূপ :
“যেহেতু আমরা বঙ্গভবনে কাজ করার সুবাদে অভিজ্ঞ ছিলাম সেই কারণে মন্ত্রিপরিষদের শপথ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্য আমাদের উপর দায়িত্ব দেয়। সেই অনুযায়ী আমরা উক্ত দায়িত্ব পালন করি। এরপর মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খােন্দকার আঃ রশিদ, মেজর সুলতান শাহরিয়ার, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর বজলুল হুদা, ক্যাপ্টেন মাজেদ, রিসালদার মােসলেম উদ্দিনের কথাবার্তায় জানতে পারি যে, তাহারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে অর্থাৎ তাঁহার স্ত্রী, তাহার তিন ছেলে, দুই ছেলের বউ ও ভাই শেখ। নাসের এবং কর্নেল জামিলকে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রােডস্থ বাড়িতে হত্যা করে।”
.. “তাহারা দাপটের সঙ্গে বলিত দেশকে বাঁচাইবার জন্য আমরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটাইয়াছি।”
৬৬৭. পি.ডব্লিউ-১৫ বলেন যে, তিনি বঙ্গভবনে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর সুলতান শাহরিয়ার, মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দীন। (ল্যান্সার), মেজর বজলুল হুদা এবং অন্যদের মধ্যকার কথাবার্তা থেকে জানতে পারেন যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারসহ অর্থাৎ তার স্ত্রী, তাঁর তিন পুত্র, দুই পুত্রের স্ত্রীদের, শেখ নাসের এবং কর্নেল জামিলকে হত্যা করেছে এবং বিস্ময়করভাবে তারা দাবি করেছিল যে, তারা দেশের স্বার্থে তাদের হত্যা করেছে। তারা এই সাক্ষীকে জেরা করে বা কোনাে সাজেশন দিয়ে তার এই জবানবন্দি অস্বীকার করেনি। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ এই সাক্ষীকে অস্পষ্টভাবে সাজেশন দিয়েছিল, কিন্তু এই সাক্ষীর বক্তব্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করেনি। এগুলি অখণ্ডিত বিবৃতি হিসেবে রয়ে গেছে এবং এই বিবৃতিগুলাে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, ঐ চারজন আপিলকারী এবং অন্যান্য সহ-আসামি এই হত্যার জন্য দায়ী। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই বক্তব্যকে (সাক্ষীর) কি বিচারবহির্ভূত স্বীকারােক্তি (extra judicial confession) হিসাবে গ্রহণ করা যেতে পারে কিনা, যেহেতু তারা এই সাক্ষীকে সরাসরি জানায়নি যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। বিজ্ঞ আইনজীবীগণ যুক্তি দেখান যে, এই বিলম্বিত পর্যায়ে এই বিবৃতিগুলি বিবেচনা করা যায় না, যেহেতু অধঃস্তন আদালত এই বিষয়টি বিবেচনা করেনি। এগুলি রেকর্ডে থাকা ঘটনাসম্পর্কিত অখণ্ডিত নির্ভরযােগ্য সাক্ষ্য এবং আমি এগুলি বাতিল করার এবং এগুলি বাদ দিয়ে মামলাটিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনাে জোর ভিত্তি খুঁজে পাচ্ছি না। সাক্ষ্য আইনের প্রথম অংশে বিধূত সাক্ষ্যের সংজ্ঞামতে, যেসব ঘটনা। সাক্ষ্য হিসেবে দেওয়া যেতে পারে তা উল্লেখপূর্বক দ্বিতীয় অংশে কীভাবে গৃহীত তথ্যগুলি প্রথম অংশের অধীনে গ্রহণযােগ্য প্রমাণ হিসাবে দেওয়া যেতে পারে সেটির উল্লেখ করা হয়েছে। এটি একটি মৌলিক বিধি যে, কোনাে ঘটনার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনাে অনুমান না থাকলেও সেটির অস্তিত্ব আদালতের সন্তুষ্টির জন্য প্রমাণ করতে হবে। সুতরাং, যে পক্ষ আদালতকে একটি ঘটনার অস্তিত্ব বিশ্বাস করাতে চায়,
৬৭৮

অবশ্যই তাদেরকে এটি প্রমাণ করতে হবে। তবে, দুটি ব্যতিক্রম রয়েছে। সেগুলাে হলাে : (১) অপর পক্ষের দ্বারা স্বীকৃত একটি ঘটনা প্রমাণিত হওয়ার দরকার নেই, এবং (২) যে বিষয়গুলি সম্পর্কে আদালত judicial notice-এ নেবেন তা প্রমাণিত হওয়ার দরকার নেই। এখানে তারা যে ঘটনার জন্য বিচারের মুখােমুখি হয়েছেন সেটির সাথে সম্পর্কিত অভিযােগ নির্ধারণের জন্য এটি প্রাসঙ্গিক এবং এখানে অভিযুক্ত তা স্বীকার করে নিয়েছে এবং সুতরাং, এই সাক্ষ্য বিবেচনায় নিতে আইনগত কোনাে বাধা নেই।
৬৬৮. আবেদনকারী বজলুল হুদা পি.ডব্লিউ-৮-এর নিকট স্বীকার করেছে যে, সে শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ব্যতীত অন্য আপিলকারীরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছে যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদেরসহ কর্নেল জামিলকে হত্যা করেছে। এটিও সত্য যে, এই বিষয়টি তারা পি.ডব্লিউ ১৫-কে জানায়নি, তবে যে সময়ে বঙ্গভবনে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিল, সেই সময়ে তিনি (সাক্ষী) তাদেরকে এসব বলতে শুনেছেন, যখন তারা উক্ত হত্যাকাণ্ড সংঘটন ও সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে তাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে আলােচনা করছিল। এই বিবৃতিসমূহে (সাক্ষীর) রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার বিষয়টি এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের কথা পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এভিডেন্স অ্যাক্টের ২৪-৩০ ধারায় স্বীকৃতি ও দোষ-স্বীকারােক্তির গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে বিধান রয়েছে। এগুলি হলাে প্রমাণের সাধারণ নিয়মের (general rule of evidence) ব্যতিক্রম এবং এগুলি প্রাসঙ্গিক ঘটনা’-র শ্রেণিতে রাখা হয়েছে। যেহেতু এগুলি বক্তব্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ঘােষণা; এই জাতীয় স্বীকৃতি বা দোষ-স্বীকারােক্তির সাক্ষ্যগত মূল্য অন্য ব্যক্তিদেরকে জানানাের উপর নির্ভর করে না এবং কোনাে সাক্ষী দ্বারা তা প্রমাণিত হলে এগুলাে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য হতে পারে। কোনাে দোষ-স্বীকারােক্তিমূলক স্বগতােক্তি হচ্ছে আবেগের দ্বন্দ্বের প্রকাশ, চক্রান্তদুষ্ট বিবেককে দমিয়ে রাখার একটি সচেতন প্রচেষ্টা বা। এই কাজের জন্য একটি আনন্দময় উপলব্ধি যা একটি প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য। এই মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের বাকি সদস্যদের হত্যাকারী হতে পেরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। তারা তাদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি আড়াল করেনি বরং বঙ্গভবনে এটি প্রকাশ করে, যেখানে নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। Taylor Zuvi A Treatise on the Lack of Evidence শীর্ষক গ্রন্থে দোষ-স্বীকারােক্তির নীতি সম্পর্কে নিমােক্ত যুক্তি দিয়েছেন : “What the accused has been overheard muttering to himself, or saying to his wife or to any other person in confidence, will be receivable in evidence.”
৬৬৯. W M Best তাঁর The Principles of Lao of Eoidence শীর্ষক গ্রন্থে একই বিষয়ে আলােচনা করেছেন, যা নিম্নরূপ : “Words addressed to others, and writing, are no doubt the most usual forms; but words uttered in soliloquy seem equally receivable.”
৬৭০. Phipson on Evidence, সপ্তম সংস্করণে নিম্নলিখিত অনুচ্ছেদটি উল্লিখিত রয়েছে :
“A statement which the prisoner had been overheard muttering to himself, if otherwise than in his sleep, is admissible against him, if independently proved.”
৬৭১. সাক্ষ্যসম্পর্কিত আইনের লেখকগণের উপযুক্ত যুক্তি থেকে আমি দেখতে পাই যে, কোনাে অভিযুক্তের ঘােষণা, বিবৃত বা বিড়বিড়ানি (muttering), যদি তা কোনাে অপরাধ সংঘটনের দোষ প্রকাশ করে তবে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে, যখন যিনি এটি শুনেছিলেন তার কর্তৃক তা যদি প্রমাণিত হয়।
৬৭৯

৬৭২. Sahoo os. State of uttar Pradesh, AIR 1966 SC 40 মামলায় দোষী সাব্যস্ত সাহু তার পুত্রবধূ সুন্দর পট্টির (ছেলের স্ত্রী) সাথে অবৈধ ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলেছিল। ঘটনার আগের রাতে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছিল এবং সুন্দর পট্টি তার প্রতিবেশী মােঃ আবদুল্লাহ নামক ব্যক্তির বাড়িতে পালিয়ে যায়। দোষী সাব্যস্ত আসামি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং তার সাথে নিজ বাড়ির এক ঘরে রাত কাটায়। ঘটনার দিন সকালে সুন্দর পটিকে ঘরে জখমি অবস্থায় পাওয়া যায় এবং আসামিকে সেখানে উপস্থিত পাওয়া যায়নি। সুন্দর পট্টিকে ঐদিন বিকেলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল এবং ১২/১৩ দিন পরে সে মারা গিয়েছিল। হত্যার অভিযােগে সাহুকে বিচারের মুখােমুখি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক উত্থাপিত সাক্ষ্য ছিল বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি (extra judicial confession) এবং অবস্থাগত সাক্ষ্য। চারজন সাক্ষী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি (extra judicial confession) প্রমাণিত হয়েছিল, যেখানে। তারা বলেছিল যে, ঐ দুর্ভাগ্যজনক সকালে, যখন ঘড়িতে সময় সকাল ৬ ঘটিকা, তারা দোষী সাব্যস্ত আসামিকে তার বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখেছিল, যখন সে বিড়বিড় বলছিল- সে সুন্দর পটিকে শেষ করে দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে প্রতিদিনের ঝগড়াও শেষ করে ফেলেছে। এই মামলায় প্রশ্ন উঠেছিল যে, চারজন সাক্ষী কর্তৃক প্রমাণিত আসামির ঐ স্বগতােক্তি বা বিড়বিড় করে কথা বলার বিষয়টি বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি (extra judicial confession) হিসেবে গ্রহণযােগ্য হতে পারে কিনা। তখন এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সুব্বা রাও নিম্নরূপ যুক্তি দিয়েছিলেন :
“But there is a clear distinction between the admissibility of evidence and the weight to be attached to it. A confessional soliloquy is a direct piece of evidence. It may be an expression of conflict of emotion, a conscious effort to stifle the pricked conscience; and argument to find excuse or justification for his act; or a penitent or remorseful act of exaggeration of his part in the crime. The tone may be soft and low; the words may be confused; they may be capable of conflicting interpretations depending on the witnesses, whether they are biased or honest, intelligent or ignorant, imaginative or prosaic, as the case may be. Generally they are mutterings of a confused mind. Before such evidence can be accepted, it must be established by cogent evidence what were the exact words used by the accused. Even if so much was established, prudence and justice demand that such evidence cannot be made the sole ground of conviction. It may be used only as a corroborative piece of evidence.”
৬৭৩. পি.ডব্লিউ-৮ ও ১৫ কর্তৃক বিচারবহির্ভূত দোষ-স্বীকারােক্তির বিষয়টি প্রকাশের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। মেজর বজলুল হুদা পি.ডব্লিউ-৮-এর কাছে যে স্বীকারােক্তি দিয়েছিলেন সেটি ছিল প্রত্যক্ষ প্রকৃতির এবং অন্যটি যা ৯ নম্বর আসামি দিয়েছিলেন তা পি.ডব্লিউ-১৫ শুনেছিলেন, সেটি ছিল পরােক্ষ প্রকৃতির। এগুলাের উভয়ের সাক্ষ্যগত মূল্য একই। মেজর বজলুল হুদাকে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা করাকালে পি.ডব্লিউ-৮-এর কাছে দেওয়া দোষ স্বীকারােক্তির মুখােমুখি করা হয়েছিল। মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) ছাড়া অন্য তিনজন আপিলকারীকে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারায় পরীক্ষা করাকালে পি.ডব্লিউ ১৫ কর্তৃক প্রমাণিত তাদের বিবৃতিগুলাের মুখােমুখি করা হয়েছিল। তারা উক্ত সাক্ষীকে কোনাে সাজেশন দিয়ে বা জেরার মাধ্যমে বর্ণিত জবানবন্দি চ্যালেঞ্জ করেনি। সেহেতু উক্ত জবানবন্দি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার
৬৮০

করা যেতে পারে। এই বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তিগুলাে (extra-judicial confessions) আইনত বৈধভাবে দোষী সাব্যস্তকরণের একমাত্র ভিত্তি হতে পারে, যদি আদালত সেগুলােকে মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের বিরুদ্ধে সত্য এবং স্বেচ্ছাপ্রণােদিত বলে বিশ্বাস করেন, যেমনটি পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল Minhun Ali alias Gul Hassan-এর মামলায়। হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করার সময় এই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য উপেক্ষা করেছেন।
৬৭৪. বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তির (extra judicial confession) গ্রহণযােগ্যতার বিষয়ে জনাব আজমালুল হােসেন, কিউসি State of uP os. MK Anthony, AIR 1985 SC 48 মামলার সিদ্ধান্ত উদ্ধত করেছেন। ঐ মামলায় অভিযুক্ত তার স্ত্রী এবং দুই শিশুসন্তানকে হত্যা করেছিল। অভিযুক্তকে পার্শ্ববর্তী ঘরে বসে থাকতে দেখা গিয়েছিল এবং তাকে দেখে একজন সাক্ষী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল হত্যার বিষয়ে কী পাওয়া গেছে। জবাবে অভিযুক্ত তাকে ক্ষমা করার জন্য ঈশ্বরের কাছে এই বলে প্রার্থনা করেছিল যে, “তিনি তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে হত্যা করে ভুল করেছিলেন।” সাক্ষীর কাছে অভিযুক্ত যা বলেছিল বিজ্ঞ দায়রা জজ সেটির পুনরুল্লেখ করেছেন এভাবে:
“Oh God, pardon me, I have done blunder, I have murdered my wife and children.”
৬৭৫. এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাক্ষীর জবানবন্দিতে বিবৃত এই বিচারবহির্ভূত দোষস্বীকারােক্তি (extra judicial confession) একজন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করার একমাত্র ভিত্তি হতে পারে কিনা। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট সাহুর মামলা (পূর্বোক্ত) এবং অন্যান্য সিদ্ধান্তসমূহের (AIR 1974 SC 1545, (1975) 1 SCR 747, AIR 1975 SC 258, AIR 1966 SC 40 and AIR 1977 SC 2274) আলােকে বিচারপতি দেশাই এই মতামত দেন যে, এমন কোনাে বিধি বা নজির নাই যে, বিচারবহির্ভূত দোষস্বীকারােক্তির (extra judicial confession) মাধ্যমে প্রদত্ত সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করা যাবে না, যদি না সেটি অন্যান্য বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয়। এ বিষয়ে সুপ্রীম কোর্ট নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন:
“It thus appears that extra-judicial confession appears to have been treated as a weak piece of evidence but there is no rule of law nor rule of prudence that it cannot be acted upon unless corroborated. If the evidence about extra-judicial confession comes from the mouth of witness/witnesses who appear to be unbiased, not even remotely inimical to the accused, and in respect of whom nothing is brought out which may tend to indicate that he may have a motive for attributing an untruthful statement to the accused; the words spoken to by the witness are clear, unambiguous and unmistakably convey that the accused is the perpetrator of the crime and nothing is omitted by the witness which may militate against it, then after subjecting the evidence of the witness to a rigorous test, on the touchstone of credibility, if it passes the test, the extra-judicial confession can be accepted and can be the basis of a conviction. In such a situation to go in search of corroboration itself tends to cast a shadow of doubt over the evidence. If the evidence of extra-judicial
৬৮১

confession is reliable, trustworthy and beyond reproach the same can be relied upon and a conviction can be founded thereon.”
৬৭৬. অতএব, আমি এটি পেয়েছি যে, বাংলাদেশ ও ভারতের সুপ্রীম কোর্টের অভিন্ন অভিমত হচ্ছে যে, যদি বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি (extra judicial confession) নির্ভরযােগ্য হয় এবং এই জাতীয় দোষ স্বীকারােক্তির সাক্ষ্য এমন কোনাে সাক্ষীর মুখ থেকে বের হয় যে নিরপেক্ষ, তবে সেটির উপর নির্ভর করা যেতে পারে এবং তার উপর ভিত্তি করে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে। আমাদের হাতের মামলাটিতে এটি পেয়েছি যে, পি.ডব্লিউ-৮ ও ১৫ নিরপেক্ষ সাক্ষী এবং তারা হত্যাকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে চারজন আপিলকারীর স্বীকারােক্তি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। সাক্ষীদেরকে জেরার মাধ্যমে ডিফেন্স এমন কিছু আনতে ব্যর্থ হয়েছিল যেটি ইঙ্গিত দিতে পারে যে, আসামিদের সম্পর্কে অবিশ্বাস্য বক্তব্য প্রদানে তাদের (সাক্ষীগণের) অভিসন্ধি রয়েছে, বরং তারা সাক্ষীগণের বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। এই সাক্ষীগণ কর্তৃক প্রদত্ত জবানবন্দিতে প্রকাশিত বিবৃতি স্পষ্ট ছিল, যা বলে যে, চারজন আপিলকারী এবং অন্যরা হত্যাকাণ্ডের সংঘটনকারী। তাদের বিবৃতিসমূহ নথিতে থাকা অন্যান্য সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয়। এই বিচারবহির্ভূত দোষস্বীকারােক্তির (extra judicial confessions) উপর নির্ভর করে অভিযুক্ত আপিলকারীগণকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে।

হত্যার অভিযোগ(Charge of murder)
৬৭৭. আপিলকারী মেজর বজলুল হুদা এবং মেজর এ কে এম মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) পক্ষে উপস্থিত বিজ্ঞ কৌঁসুলি জনাব আবদুলাহ-আল-মামুন যুক্তি দেখিয়েছেন যে, রাষ্ট্রপক্ষের কাহিনির সমর্থনে কোনাে নির্ভরযােগ্য প্রমাণ নেই যে, পি.ডব্লিউ-১ ও ৪ এই ঘটনাস্থলে আপিলকারীগণকে শনাক্ত করতে পেরেছিল এবং মেজর হুদা শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছিল বলে যে অভিযােগ করা হয়েছে। সেটিও নথিতে থাকা পরস্পরবিরােধী সাক্ষ্যের ভিত্তিতে, এবং সেহেতু হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা বহাল রেখে আইনগত ভুল করেছেন। বিজ্ঞ কৌঁসুলি নথিতে থাকা সাক্ষ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং যুক্তি দেখিয়েছেন যে, প্রসিকিউশনটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের উপস্থাপন করেনি; যেমন, শেখ ইউনুস আলী, কর্নেল মশিউদ দৌলা এবং কর্নেল মাহমুদুল হাসানকে উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে উপস্থাপন করেননি। যেহেতু, তারা প্রসিকিউশন পক্ষের প্রতিকূল হতে পারত; এবং সেহেতু এই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের উপস্থাপন না করায় তা প্রসিকিউশন পক্ষের প্রতিকূলে একটি বিরূপ অনুমান (adverse inference) ইঙ্গিত দেয়। বিজ্ঞ আইনজীবী আরাে যুক্তি দেন। যে, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) বঙ্গবন্ধুকে দোতলা থেকে নামিয়ে নিচে নিয়ে আসে এই অভিযােগটির ভিত্তি হিসেবে কোনাে বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষ্য নথিতে নেই এবং ঘটনাস্থলে সাক্ষীগণ কর্তৃক তাকে চিনতে পারা (শনাক্তকরণ) সম্পূর্ণ অবাস্তব এবং অবিশ্বাস্য গল্প। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ কৌঁসুলি পি.ডব্লিউ- ১, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১১, ১২, ১৫, ২২ এবং ৪২-এর প্রদত্ত সাক্ষ্যের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিজ্ঞ কৌঁসুলি একটি বিষয় দেখানাের চেষ্টা করেছেন যে, ঘটনাস্থলে বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীন আহমে উপস্থিতি সম্পর্কিত বিষয়ে নথিতে পরস্পরবিরােধী সাক্ষ্য রয়েছে, কিন্তু হাইকোর্ট ডিভিশন এই বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। বিজ্ঞ কৌঁসুলি তার বক্তব্যের সমর্থনে Nurul Islam os. State, 43 DLR (AD) 6, Hazrat Khan @ Hazrat Ali vs. State, 54 DLR 636, Moslem Uddin vs. State, 38 DLR (AD) 311, Safdar Ali vs. Crown, 5 DLR (FC)107 47% Moyez Uddin vs. State, 31 DLR (AD) 37 মামলাসমূহ উদ্ধৃত করেছেন।
৬৮২

৬৭৮. আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) পক্ষে বিজ্ঞ কৌঁসুলি জনাব খান সাইফুর রহমান যুক্তি পেশ করেন যে, তাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যদের হত্যার অভিযােগের সমর্থনে কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ নে কৌঁসুলি আরাে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, পি.ডব্লিউ-১ ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী নয় এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এফআইআরভুক্ত অভিযুক্ত নয়, যার অন্তর্ভুক্তি একটি যােগসাজশি কার্যের ফল এবং সেজন্য তিনি এটির সন্দেহের সুবিধা পেতে অধিকারী। বিজ্ঞ কৌঁসুলি নিবেদন করেছেন যে, সাক্ষীগণ কর্তৃক বিবৃতমতে বর্ণিত ঘটনা সংঘটনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পতাকা উত্তোলন এবং বিউগল বাজানাের ঘটনাটি বিশ্বাসযােগ্য ছিল না, যেহেতু পি.ডব্লিউ ১-৩ বলেছেন যে, আক্রমণকারীরা ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ছিল। বিজ্ঞ কৌঁসুলি নিবেদন করেছেন যে, প্রাসঙ্গিক সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের উপস্থিতি সম্পর্কে নথিতে কোনাে নির্ভরযােগ্য সাক্ষ্য নেই। এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞ কৌঁসুলি পি.ডব্লিউ-১৪ ও ২৩-এর প্রদত্ত সাক্ষ্যের কিছু অংশের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিজ্ঞ কৌঁসুলি আরাে যুক্তি দিয়েছেন যে, ট্যাঙ্কের ক্রুদের উপস্থাপন না করার (সাক্ষী হিসেবে) পরিপ্রেক্ষিতে প্রসিকিউশনের বিরুদ্ধে এমন একটি বিরূপ অনুমান গ্রহণ করা যেতে পারে যে, যদি তাদের উপস্থাপন করা হতাে তবে তারা প্রসিকিউশনের মামলা সমর্থন করতেন না। বিজ্ঞ কৌঁসুলি আরাে যুক্তি দিয়েছেন যে, প্রসিকিউশন সাক্ষীদের মুখ নিঃসৃত সাক্ষ্য থেকে এটা প্রতিভাত হয়েছে যে, ঘটনার প্রকৃত পরিকল্পনাকারী ছিল জোবাইদা রশিদ। এটিও স্পষ্ট ছিল যে, আপিলকারীদের এই ঘটনায় জড়িত হওয়ার কোনাে সাধারণ অভিপ্রায় বা পূর্বপরিকল্পিত মন ছিল না এবং সেহেতু পেনাল কোডের ৩০২ ও ৩৪ ধারার অধীনে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্তকরণ অবৈধ ছিল। বিজ্ঞ কৌঁসুলি আরাে যুক্তি দিয়েছেন যে, কলাবাগান খেলার মাঠে কামানসহ লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) উপস্থিতি নির্ভরযােগ্য সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়নি।
৬৭৯. লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খানের পক্ষে বিজ্ঞ কৌঁসুলি জনাব আবদুর রাজ্জাক খান যুক্তি দিয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার ঘটনায় শাহরিয়ার রশিদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কোনাে নির্ভরযােগ্য প্রমাণ নেই। বিজ্ঞ কৌঁসুলি নিবেদন করেছেন যে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকগণ অন্য কোনাে সমর্থনযােগ্য সাক্ষ্যের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বালুরঘাটে নাইট প্যারেডে তার উপস্থিতির বিষয়ে পি.ডব্লিউ-১৪-এর সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করে আইনগত ভুল করেছেন এবং এভাবে হত্যার অভিযােগের তাকে দোষী সাব্যস্তকরণ ছিল বেআইনি। বিজ্ঞ কৌসুলি আরাে দাবি করেছেন যে, পি.ডব্লিউ-১৪-এর সাক্ষ্য যদি অবিশ্বাস করা হয় তবে ১৫ আগস্ট সকাল ৬টার দিকে রেডিও স্টেশনে শাহরিয়ার রশিদের উপস্থিতি বিষয়টি তার বিরুদ্ধে একমাত্র সাক্ষ্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার সাথে এই ঘটনার কোনাে সম্পর্ক নেই। যেহেতু, তিনি ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখ থেকে পুনঃনিয়ােগ পেয়েছিলেন, তাই তার কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশ অনুসারে রেডিও স্টেশনে উপস্থিত থাকা তার অফিসিয়াল দায়িত্বের একটি অংশ ছিল। উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞ কৌসুলি এই বলে তার বক্তব্যের সমাপ্তি টেনেছেন যে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ও সাজা বহাল রেখে আইনগত ভুল করেছেন।
৬৮০. বিজ্ঞ কৌসুলিবৃন্দ কর্তৃক উত্থাপিত সাধারণ যুক্তিগুলাে হলাে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নথিতে থাকা সাক্ষ্য অগভীরভাবে বিবেচনা করেন এবং অভিযােগের সমর্থনে নথিতে কোনাে আইনগত প্রমাণ না থাকার বিষয়টি বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়ে আপিলকারীদের মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি অনুমােদন করেছেন। তাদের আরাে যুক্তি ছিল যে, আপিলকারীরা তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে রাতের
৬৮৩

কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিল এবং তাদের উপস্থিতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার সাথে যুক্ত হতে পারে না। বিজ্ঞ কৌঁসুলিদের মতে, হত্যাকাণ্ড ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে উৎখাত করার জন্য সেনা বিদ্রোহের ফলস্বরূপ, যেখানে আপিলকারীরা জড়িত ছিলনা। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তি উত্থাপন করা হয় যে, আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে অনুমান এবং সন্দেহের উপর ভিত্তি করে এবং উচ্চ আদালতের বিজ্ঞ বিচারকগণ তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ এবং সাজা বহাল রেখে আইনগত ভুল করেছিলেন।
৬৮১. বিজ্ঞ কৌঁসুলিগণের যুক্তি-তর্ক নিয়ে আলােচনার পূর্বে, হাইকোর্ট ডিভিশন এবং বিচারিক আদালত কর্তৃক আপিলকারীদের বিরুদ্ধে প্রদত্ত রায় এবং দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজার আদেশের বিরুদ্ধে আপিলগুলিতে সীমিত সুযােগ রয়েছে, সেটি নজরে রাখা প্রয়ােজন। সংবিধানের ১০৩(৩)অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক প্রদত্ত রায় ও আদেশের বিরুদ্ধে যে কোনাে পক্ষকে আপিলের অধিকার দেওয়া হয়নি। এটি কেবল এই আদালতকে স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়ােগের সুযােগ দিয়েছে, যাতে বিশেষ পরিস্থিতিতে অভিযুক্তের প্রতি যথেষ্ট এবং গুরুতর অন্যায় করা হয়েছে এমন ক্ষেত্রেই নিজেকে সন্তুষ্ট করার জন্য যাচাই-বাছাই এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। যদিও ভারতের মতাে (অনুচ্ছেদ ১৩৬) আমাদের দেশে ১০৩ অনুচ্ছেদে “discretionary” অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করা হয়নি, তথাপি এই আদালতকে এখতিয়ার প্রয়ােগের জন্য প্রদত্ত ক্ষমতাগুলাে বিবেচনা করলে এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, যখন এই আদালত রায়, আদেশ বা সাজা থেকে লিভ মঞ্জুর করে তখন এই ক্ষমতা একটি স্ববিবেচনার (discretionary) ক্ষমতা। অনুচ্ছেদ ১০৩(৩) ভারতের সংবিধানের ১৩৬ অনুচ্ছেদের। অনুরূপ ভাষায় আবদ্ধ। Hargun Sundar Das vs. State of Maharashtra, AIR 1970 SC 1514 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট দোষী সাব্যস্তকরণের বিরুদ্ধে আপিলে সাক্ষ্য-প্রমাণ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তার এখতিয়ারের পরিধি বিবেচনা করে নিমরূপ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন :
“We may appropriately repeat what has been pointed out by this Court under Article 136 of the Constitution, this Court does not normally proceed to review the evidence in criminal cases unless trial is vitiated by some illegality or material irregularity of procedure or the trial is held in violation of rules of natural justice resulting in unfairness to the accused or the judgment or order under appeal has resulted in grave miscarriage of justice. This article reserves to this Court a special discretionary power to interfere in suitable cases when for special reasons it considers that interference is called for in the larger interest of justice.”
৬৮২. Metro vs. State of UP AIR 1971 SC 1050, Suheder vs. State of UP AIR 1971 SC 125 এবং Ram Sanjizoan Singh os. State of Bihar, AIR 1996 SC 3265 মামলাসমূহে একই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে।
৬৮৩. আপিলকারীগণ এই আপিলসমূহে এমন কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করেনি যে, আপিলকারীদের বিচার কিছু অবৈধতার দ্বারা কলুষিত হয়েছে বা এটি স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের বিধি লঙ্ঘন করে করা হয়েছে বা সাক্ষ্যের ভুল পাঠের কারণে হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখে ন্যায়বিচার মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা আপিলকারীদের ন্যায়বিচার প্রদানের উদ্দেশ্যে, যেহেতু তাদের
৬৮৪

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, সেহেতু সেই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নথিতে থাকা সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আপিলকারীদের পক্ষে যুক্তি-তর্ক করার জন্য বিজ্ঞ কৌসুলিগণকে সুযােগ দিয়েছি। আপিলকারী মেজর বজলুল হুদার বিরুদ্ধে প্রণীত অভিযােগের সমর্থনে প্রসিকিউশন এএফএম মােহিতুল ইসলাম (পি.ডব্লিউ-১), হাবিলদার (অবসরপ্রাপ্ত) মােঃ কুদুস শিকদার (পি.ডব্লিউ-৪), এন কে সুবেদার (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল গণি (পি.ডব্লিউ-৫), হাবিলদার গানার (অবসরপ্রাপ্ত) সােহরাব আলী (পি.ডব্লিউ-৬), এএলডি সিরাজুল হক (পি.ডব্লিউ-১২), লেফটেন্যান্ট নায়েক আবদুল খালেক (পি.ডব্লিউ-২১), হাবিলদার আবদুল আজিজ (পি.ডব্লিউ-২২)-কে সাক্ষী হিসেবে পরীক্ষা করেছেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নথিতে থাকা সাক্ষ্য-প্রমাণাদি বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেছেন। আমি কেবল তাদের জবানবন্দির এক ঝলক উল্লেখ করব।
৬৮৪. পি.ডব্লিউ-১ হলেন তথ্যদাতা (এজাহারকারী) এবং তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দাবি করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবাসিক পিএ ছিলেন এবং ঘটনার সময় তিনি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রােডের ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে, যেখানে রাষ্ট্রপতি অবস্থান করছিলেন, সেখানে দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বলেছেন যে, ঘটনার দিন ভাের প্রায় ৪.৩০/৫.০০টার দিকে তিনি টেলিফোন মেকানিক আবদুল মতিনের একটি কল পেয়ে ঘুম থেকে উঠেছিলেন এবং মতিন তাকে জানিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি তার সাথে টেলিফোনে কথা বলতে চান। এরপর দ্রুত তিনি রিসিভার গ্রহণ করেন, যখন রাষ্ট্রপতি তাকে এই বলে পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, দুবৃত্তরা সেরনিয়াবাতের বাড়িতে আক্রমণ করেছে। তিনি (সাক্ষী) পুলিশ কন্ট্রোল রুমের পাশাপাশি গণভবনেও ফোন লাইনটি সংযুক্ত করতে ব্যর্থ হন। এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধু নিচে নেমে অফিসঘরে আসেন এবং তার (সাক্ষী) কাছ থেকে রিসিভার নিয়ে নিজেই কথা বলতে চেয়েছিলেন। সেই সময় ঘরের দেয়ালে গুলি বর্ষিত হয়েছিল, যার ফলে জানালার কাচ ভেঙে নিচে পড়ে যায়। তারা টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে শেখ কামাল নীচে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। নিরাপত্তাকর্মীরা তার সাথে এসেছিল এবং সেই সময় খাকি ও কালাে পােশাকধারী ৩/৪ সেনা সদস্য তাদের হাতে অস্ত্র নিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন আপিলকারী মেজর বজলুল হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করেছিল, যিনি পি.ডব্লিউ-১-কে বলেছিলেন যে, তিনি যে শেখ মুজিবের পুত্র সেটি যেন তিনি হামলাকারীকে জানান এবং শেখ কামাল তার পায়ের পাশে লুটিয়ে পড়েছিলেন। পি.ডব্লিউ-১ হামলাকারীকে শেখ কামালের পরিচয় সম্পর্কে জানান এবং তার পরেই সে শেখ কামালকে লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করে। একটি বুলেট তার পায়ে লাগে এবং অন্যটি পি.ডব্লিউ-৫০-এর পায়ে লাগে। শেখ কামাল ঘটনাস্থলেই মারা যান। এক পর্যায়ে পি.ডব্লিউ-৫০ পেছনের দরজা দিয়ে পি.ডব্লিউ-১ এবং শেখ কামালকে বের করতে চেয়েছিলেন এবং তারা যখন দরজার কাছে এসে পৌঁছান তখন মেজর বজলুল হুদা তার চুল ধরে তাকে টেনে নিয়ে যায়। তার সাথে অন্য সশস্ত্র সেনাসদস্যরাও ছিল। মেজর বজলুল হুদা পি.ডব্লিউ-১ ও অন্যদের মূল গেটের সামনে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করায়। এর কিছুক্ষণ পরে তিনি (সাক্ষী) বঙ্গবন্ধুর চিৎকার-চেঁচামেচি এবং নির্বিচার গুলিবর্ষণের শব্দ এবং নারীদের চিৎকার শুনেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) এটিও বর্ণনা করেছেন কীভাবে শেখ নাসেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল এবং মেজর ফারুকের জিজ্ঞাসার পরিপ্রেক্ষিতে বজলুল হুদার বক্তব্য ছিল, “all are finished”। বজলুল হুদার এই কথা শুনে সাক্ষী বুঝতে পেরেছিলেন যে, রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই সাক্ষী ইতিবাচক জবানবন্দি দিয়েছেন যে, মেজর বজলুল হুদা শেখ কামালকে ঘটনাস্থলে গুলি করে হত্যা করেছে। জেরা করাকালে (এই সাক্ষীকে) ডিফেন্স তার বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেহেতু আপিলকারী শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করেছিল মর্মে তার বক্তব্য অখণ্ডিত থেকে যায়।
৬৮৫

৬৮৫. পি.ডব্লিউ-৪ আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তিনি প্রাসঙ্গিক সময়ে ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে পদায়িত একজন সেনা জওয়ান এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে তাকে এবং তার কোম্পানির আরাে কয়েকজন সেনাসদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) বলেছেন যে, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং অন্য আরাে ৩ জন সেনাবাহিনীর কর্মীও ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটে ছিল। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকাল অনুমান ৫.০০টার দিকে তিনি অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীর সাথে লক্ষ্য করেছিলেন যে, সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ার্দার ৩১ নম্বর রােডের বাড়ির সামনে জিপ থেকে নামছিলেন, যেখানে তিনি অন্য নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে রাষ্ট্রপতির বাসভবন রক্ষার জন্য অস্থায়ী ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করে অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি অন্য রক্ষীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আসেন এবং সেখানে পৌঁছানাের পরে বিউগল বাজিয়ে তারা পতাকা উত্তোলন করেন। সেই সময় তিনি লেকের দক্ষিণ দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ লক্ষ করেন। সেই সময় কালাে এবং খাকি পােশাকধারী সেনাসদস্যরা ‘hands up’ বলে চিৎকার করে বাসভবনে প্রবেশ করে। যেখানে তিনি (সাক্ষী) ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অন্য একজন যিনি গেটে ছিলেন, তাদেরকে চিনতে পেরেছিলেন। শেখ কামাল তখন বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাকে দেখে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা তার হাতে থাকা স্টেনগান দিয়ে তাকে গুলি করে। শেখ কামাল অভ্যর্থনাকক্ষের ভিতরে লুটিয়ে পড়েন। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা পুনরায় শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) তার ফোর্সসহ ফাঁকা গুলি ছুড়তে ছুড়তে দোতলার দিকে যেতে থাকে। এরপরে বজলুল হুদা ও নূর তাদের ফোর্সসহ তাকে অনুসরণ করেছিল। তাদের নির্দেশে তারাও (পি.ডব্লিউ-৪ এবং তার কোম্পানির
য়েকজন) তাদেরকে অনুসরণ করেছিল। তিনি (সাক্ষী) দেখেছিলেন যে, মেজর মহিউদ্দীন এবং তার ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নিচতলায় নিয়ে আসছিল। সেই সময় বঙ্গবন্ধু তাদের জিজ্ঞাসা করেন যে, তারা কী করতে যাচ্ছে এবং এরপর সাথে সাথেই, হুদা ও নুর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছিল। এবং বঙ্গবন্ধু ঘটনাস্থলেই মারা যান। তিনি বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীনকে (ল্যান্সার) গেটে দেখেছিলেন; বজলুল হুদা, মেজর নূর এবং তার ফোর্স দোতলার দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং হুদা ও নূর সিঁড়ির উপরে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করেছিল- সে মর্মে এই সাক্ষীর জবানবন্দি জেরার সময় বা কোনাে সাজেশন দিয়ে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা কর্তৃক অস্বীকার করা হয়নি। এই সাক্ষীর জবানবন্দির দোষসূচক অংশ অখণ্ডিত রয়ে গেছে। এই সাক্ষী মহিউদ্দীনকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দেখেছিলেন এবং তিনি (সাক্ষী) মহিউদ্দীন ও তার ফোর্সসহ বঙ্গবন্ধুকে নিচতলায় নামিয়ে আনতে দেখেছিলেন। সেই মর্মে এই সাক্ষী কর্তৃক প্রদত্ত জবানবন্দি আপিলকারী মেজর মহিউদ্দীনও চ্যালেঞ্জ করেনি। এছাড়া পি.ডব্লিউ-৫ আর্টিলারি ইউনিটের জওয়ান ছিলেন এবং তাকে নিরাপত্তা-প্রহরী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিয়ােজিত রাখা হয়েছিল। ঘটনার সময় সকাল ৫.০০টার সময় তিনি (সাক্ষী) বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেছেন যে, পতাকা উত্তোলনের পরে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের বিষয়টি লক্ষ করেছিলেন, তখন তিনি প্রহরীকক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এবং এর ৫/৭ মিনিট পরে গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়ে যায় এবং সে সময় তিনি দেখতে পান, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর নূর এবং খাকি ও কালাে পােশাকধারী অন্য জওয়ানরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে একটি গাড়ি থেকে নেমে এসেছিল। বজলুল হুদা (সাক্ষীর) কাছে জানতে চাইল এবং অতঃপর সে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে অন্যদের সাথে যােগারে করল। এর পরপর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং তার ফোর্স hands up বলে পূর্বদিক থেকে এসে গুলি চালাতে চালাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করেছিল এবং অন্যান্য প্রহরীসহ তাকে (সাক্ষী) প্রহরীকক্ষে আটক রাখে। ঘটনার সময়ে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং মেজর মহিউদ্দীন যখন গুলি চালাতে চালাতে
৬৮৬

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করছিল তখন এই সাক্ষী তাদের চিনতে পেরেছিল- সে মর্মে এই সাক্ষীর প্রদত্ত বক্তব্যকে ডিফেন্স চ্যালেঞ্জ জানায়নি।
৬৮৬. পি.ডব্লিউ-৬ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে দায়িত্বপালনকারী সুরক্ষা দলের একজন সদস্য ছিলেন। তিনি এই ঘটনার আরাে একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তিনি বলেছেন যে, ১৫ আগস্ট ভাের অনুমান ৪.৩০টার সময় হাবিলদার গণি সব নিরাপত্তাকর্মীকে প্রহরীকক্ষের সামনে ফল-ইন করিয়েছিলেন এবং এর কিছু সময় পরে ২/৩টি ট্রাক কালাে পােশাকধারী ফোর্সসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের পশ্চিম পাশের দিকে এসে থেমেছিল এবং লেকের পাশ থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। পি.ডব্লিউ-১ এবং ৪-এর প্রদত্ত সাক্ষ্যেকে সমর্থন করে তিনি বলেছেন যে, কামাল যখন তাকে অনুসরণ করার জন্য নিরাপত্তা দলকে ডেকেছিলেন, তখন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, সাথে কালাে পােশাক পরিহিত ল্যান্সার ইউনিটের আরেক কর্মকর্তা, আর্টিলারি ইউনিটের অন্য কয়েকজন জওয়ান বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করেছিল। এর পরপর ক্যাপ্টেন হুদা এবং অন্য একজন শেখ কামালকে গুলি করেছিল, যিনি বন্দুকের গুলির আঘাতে জখমপ্রাপ্ত হয়ে সংবর্ধনা কক্ষের ভিতরে লুটিয়ে পড়েছিলেন। ক্যাপ্টেন হুদা আবারও তাকে গুলি করেছিল। এরপরে ক্যাপ্টেন হুদা এবং অন্য একজন কর্মকর্তা দোতলার দিকে এগিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পরে তিনি (সাক্ষী) গুলিবর্ষণের শব্দ এবং নারীদের আর্তচিৎকার শুনতে পেয়েছিলেন। বজলুল হুদা এই সাক্ষীর বক্তব্যের দোষসূচক অংশটি চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেহেতু পি.ডব্লিউ-৬-এর সাক্ষ্যে বিবৃত মতে তিনি বজলুল হুদাকে শেখ কামালকে গুলি করতে দেখেছিলেন, তা অখণ্ডিত রয়েছে।
৬৮৭. পি.ডব্লিউ-১১ ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ নাইট প্যারেডে অংশ নিয়েছিলেন, যেটির ব্যবস্থা তার স্টোরের সামনে হয়েছিল। তিনি সেখানে ক্যাপ্টেন হুদা, মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং মেজর ফারুক রহমানকে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) বলেছেন যে, ভাের প্রায় ৪.০০টায় একটি গাড়িতে থাকা সৈন্যরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল এবং তাদেরকে ভাের প্রায় ৪.৩০টার সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের প্রায় ৮০ গজ পশ্চিমে গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়েছিল, যখন রিসালদার সারওয়ার তাকে মেজর মহিউদ্দীনের আদেশ অনুসরণ করতে বলেছিল। মেজর মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে লােকদের যাতায়াত করতে না দেওয়ার জন্য এবং দায়িত্বরত পুলিশদের নিরস্ত্র করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ভিতরে গুলিবর্ষণের শব্দ শুনেছিলেন এবং তারপরে ‘hands up’ বলার আদেশটি শুনেছিলেন। রিসালদার সারওয়ার তাকে নির্দেশ দিয়েছিল কাউকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করতে না দিতে এবং ঐ সময়ে মেজর মহিউদ্দীন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং অন্যরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করেছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবন থেকে গুলিবর্ষণের শব্দ এবং নারীদের আর্তচিৎকার শুনেছিলেন। এরপর মেজর মহিউদ্দীন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা বের হয়ে আসে। তখন মেজর নূর সুবেদার মেজরকে বাসভবনের ভিতরে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল- সব শেষ হয়ে গেছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য। হ্রদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য ক্যাপ্টেন হুদা সারওয়ারের মাধ্যমে তাকে নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর তিনি (সাক্ষী) ট্যাঙ্ক চলার শব্দ শুনতে পান এবং একটি ট্যাঙ্ক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে থামলে মেজর ফারুক ঐ ট্যাঙ্ক থেকে নেমে আসে। তখন মেজর মহিউদ্দীন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন হুদা এবং অন্যরা তার কাছে এসে কিছু সময়ের জন্য তার সাথে কথা বলেছিল এবং তারপরে মেজর ফারুক ট্যাঙ্কে করে চলে গিয়েছিল। ঘটনার সাথে আপিলকারী বজলুল হুদার সম্পৃক্ততার বিষয়টি সম্পর্কে এই সাক্ষীর জবানবন্দিকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরােক্ষভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। সুতরাং এই জবানবন্দি অখণ্ডিত থেকে গেছে।
৬৮৭

৬৮৮. প্রাসঙ্গিক সময়ে পি.ডব্লিউ-১২ ফাস্ট বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিটে কর্মরত ছিলেন, যেখানে মেজর ফারুক রহমান তাদের কমান্ডিং অফিসার ছিল। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি আপিলকারী বজলুল হুদাসহ অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেখেছিলেন, যাদের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান এবং মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) ছিল। তিনি আরাে বলেছেন যে, ভাের অনুমান ৩.৩০টার পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্বের প্যারেডে তিনি আপিলকারী বজলুল হুদাকে অন্যান্য কর্মকর্তা এবং সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) সাথে দেখেছিলেন। মেজর ফারুক রহমান তখন মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং অন্য একজনকে পরিচয় করিয়ে দেয়। এরপর মেজর ফারুক তাদেরকে কোটে থেকে গােলাবারুদ নেওয়ার নির্দেশ দেয়। নির্দেশ অনুসারে তারা গােলাবারুদ নিয়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত হন। মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) তাদেরকে গাড়িতে ওঠার নির্দেশ দিয়েছিল। সেনা কর্মকর্তারা ৩টি ট্রাকে এবং অন্যরা অন্য একটি ট্রাকে আরােহণ করে। ভাের অনুমান ৪.৩০টার দিকে তারা বালুরঘাট সেনানিবাস-রেলক্রসিং হয়ে ফার্মগেট এবং ফার্মগেট থেকে মিরপুর রােড হয়ে ধানমন্ডি রােড ৩২ অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল এবং ৩২ নম্বর রােডের সংযােগস্থলে মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) তাদেরকে ট্রাক থেকে নামতে নির্দেশ দিয়েছিল। এরপর মহিউদ্দীন তাদেরকে গুলি চালানাের শব্দ শুনে ভয় না পেতে বলে, যেহেতু তারা তাদের এবং মেজর ডালিমের লােক এবং তাদের নির্দেশ দিয়েছিল কাউকে রােড ৩২-এ প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ার জন্য। এরপর তিনি (সাক্ষী) রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার পরে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। প্যারেড গ্রাউন্ডে বজলুল হুদা, মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), ডালিম ও ফারুককে চিনতে পারা এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতির বাসভবন অভিমুখে সেনাদের অগ্রসর হওয়া সম্পর্কে এই সাক্ষীর প্রদত্ত জবানবন্দির দোষসূচক অংশটিকে আপিলকারী চ্যালেঞ্জ করেনি।
৬৮৯. পি.ডব্লিউ-২১ প্রাসঙ্গিক সময়ে পাপা ব্যাটারির দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারিতে নিয়ােজিত ছিলেন। তিনি বলেছেন যে, তিনি রাতের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন এবং তারপর তাকে অন্য সেনাদের সাথে বিমানবন্দর রানওয়ের দক্ষিণ দিকে রাখা হয়েছিল। মধ্যরাত প্রায় ২.০০টার সময় তাদের কমান্ডিং অফিসার মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদের সাথে মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং অন্য কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়। মেজর খােন্দকার আবদুর রশিদ তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে তৈরি হতে বলেছিল, যেহেতু তাদের একটি জরুরি দায়িত্ব পালনে নেওয়া হবে। ভাের অনুমান ৪.৩০টার দিকে তাদের ট্রাক ৩২ নম্বর সড়কে এসে পৌঁছালে তাদেরকে ট্রাক থেকে নামতে নির্দেশ দেয়। কমান্ডিং অফিসার তাদের নির্দেশ দিয়েছিল যেন ৩২ নম্বর রাস্তা দিয়ে কাউকে চলাচলের অনুমতি না দেওয়া হয়। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, আজানের পরে তিনি পূর্বদিকে গুলিবর্ষণের শব্দ শুনেছিলেন এবং এরপর তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, আপিলকারী এবং অন্যান্য অভিযুক্তরা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে।
৬৯০. পি.ডব্লিউ-২২ প্রাসঙ্গিক সময়ে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির একজন সিপাহি ছিলেন। তিনি বলেছেন যে, তিনি ১৪ আগস্ট রাত ১২টা পর্যন্ত নাইট প্যারেডে উপস্থিত ছিলেন। অনুমান রাত ২.৩০টার সময় কমান্ডিং অফিসার খােন্দকার আবদুর রশিদ আপিলকারী বজলুল হুদা এবং আরাে কয়েকজন কর্মকর্তাসহ সেখানে এসেছিল। মেজর রশিদ তাদেরকে বিশেষ দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছিল এবং প্রয়ােজনে তাদের গুলি চালাতে হতে পারে বলে জানিয়েছিল। নৈশ প্যারেড থেকে অস্ত্রসহ ৩২ নম্বর রােডে আসা এবং তিনি (সাক্ষী) আপিলকারীকে চিনতে পারা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-২১ প্রদত্ত সাক্ষ্য তিনি (এই সাক্ষী) সমর্থন করেছেন। আপিলকারী তাকে জেরা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
৬৮৮

৬৯১. সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণে আমি দেখতে পাই যে, ১৪ আগস্ট রাতে কুচকাওয়াজে আপিলকারীর উপস্থিতির বিষয়টি অকাট্য সাক্ষ্য দিয়ে প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং সেখান থেকে সহ-আসামিদের সাথে আপিলকারী ঘটনাস্থলে এসেছিল এবং শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দোতলায় যাওয়ার সময় তাকে দেখা গিয়েছিল, সেখানে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অন্যান্য সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
৬৯২. আপিলকারী মেজর এ কে এম মহিউদ্দীনের (ল্যান্সার) বিরুদ্ধে প্রণীত অভিযােগ প্রমাণ করার জন্য
প্রসিকিউশন পি.ডব্লিউ- ৪, ৫, ৭, ১১, ১২, ২১, ২২-কে পরীক্ষা করেছে। পি.ডব্লিউ-৪ বলেন যে, তিনি বজলুল হুদার সাথে এই আপিলকারীকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি এটিও বলেছেন যে, এই আপিলকারী তার ইউনিটের ফোর্সসহ গুলিবর্ষণ করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দোতলার দিকে এগিয়ে যায় এবং এরপর তারা বঙ্গবন্ধুকে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসে এবং তারা যখন সিঁড়িতে তখন ক্যাপ্টেন বজুলল হুদা এবং মেজর নূর বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে এই আপিলকারী এবং অন্যরা নীচে নেমে এসে দক্ষিণ দিকে চলে যায়। এই ঘটনার সাথে এই আপিলকারীর সম্পৃক্ততা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-৪ কর্তৃক প্রদত্ত সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশ জেরা করার সময় এই আপিলকারী চ্যালেঞ্জ করেনি। ফলে, আপিলকারী তার ফোর্সসহ হত্যাকাণ্ড সংঘটন সহজ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করেছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে অস্ত্রের মুখে নামিয়ে এনেছিল- সে মর্মে এই সাক্ষ্য অখণ্ডিত রয়ে যায়।
৬৯৩, পি ডবিউ-৫ পি. ডবিউ-৪-এর জবানবন্দিকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, এই আপিলকারী তার ফোর্সসহ গুলিবর্ষণ করতে করতে বাসভবনে প্রবেশ করেছিল। আপিলকারী এই বিষয়ে এই সাক্ষীর সাক্ষ্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি। সুতরাং, ঘটনাস্থলে আপিলকারীকে চিনতে পারা এবং এই হত্যাকাণ্ডে তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্পর্কে এই সাক্ষীর সাক্ষ্য অখণ্ডিত রয়ে গেছে।
৬৯৪. পি.ডব্লিউ ১১ এই আপিলকারীকে প্যারেডে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি বেসামরিক পােশাকে দুজন ব্যক্তিকে দেখেছিলেন যারা ১৪ আগস্ট রাত ১২টার দিকে এই আপিলকারীর অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল এবং সেই সময় আপিলকারী হুদাকে তার কাছে ডেকে নেয়। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেছেন যে, এই আপিলকারী সিভিল পােশাক পরিহিত ওই দুই ব্যক্তির জন্য আর্মি ড্রেসের ব্যবস্থা করেছিল। হুদার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে এই সাক্ষীর সাক্ষ্য পর্যালােচনার সময় আমি এই আপিলকারীর জড়িত থাকার বিষয় নিয়েও আলােচনা করেছি।
৬৯৫. পি.ডব্লিউ-১২ও এই আপিলকারীকে ১৪ আগস্ট প্যারেড গ্রাউন্ডে চিনতে পেরেছিলেন। তিনি বলেছেন যে, এই আপিলকারী সেনা কর্মকর্তাদের, যারা প্যারেড গ্রাউন্ডে ছিল, গাড়িতে ওঠার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। তারা ভাের ৪.৩০টার দিকে বালুরঘাট ক্যান্টনমেন্ট-রেলক্রসিং-মহাখালী রােড এবং ফার্মগেট হয়ে ছয়টি ট্রাকযােগে ধানমন্ডি রােড ৩২-এর সংযােগস্থলে আসে। তিনি (সাক্ষী) একই ট্রাকে আপিলকারীর সাথে ছিলেন। এই আপিলকারী তাদের সকলকে ৩২ নম্বর রােডের সংযােগস্থলে ট্রাক থেকে নামতে নির্দেশ দিয়েছিল এবং তারপরে তাদের ব্রিফ করেছিল যে, গুলিবর্ষণের শব্দ শুনে তারা যেন ভীত না হয়, কেননা তারা মেজর ডালিমের লােক এবং এরপরে এই আপিলকারী তার ফোর্সসহ ৩২ নম্বর রােডে প্রবেশ করে। ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে আপিলকারী তার ফোর্সসহ ৩২ নম্বর রােডে প্রবেশ করেছিল এবং ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে এই সাক্ষীর সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশ জেরার মাধ্যমে আপিলকারী চ্যালেঞ্জ করেনি। এই হত্যাকাণ্ডে আপিলকারী বজলুল হুদার জড়িত থাকার বিষয়টি বিবেচনা
৬৮৯

করতে গিয়ে আমি এই সাক্ষীর সাক্ষ্য বর্ণনা করেছি এবং সেজন্য এর পুনরাবৃত্তি এড়ানাের জন্য আমি তার সাক্ষ্যের পুনরুল্লেখ থেকে বিরত থাকছি। প্যারেড গ্রাউন্ডে এই আপিলকারীর উপস্থিতি এবং ঘটনার ঠিক ৮ আগ মুহূর্তে ৩২ নম্বর রােডে তার ফোর্সসহ প্রবেশের বিষয়ে প্রদত্ত জবানবন্দি এই সাক্ষী তার জেরায় পুনরায় নিশ্চিত করেছেন।
৬৯৬. মেজর বজলুল হুদার জড়িত থাকার বিষয় বিবেচনা করার সময় পি.ডব্লিউ-২১-এর জবানবন্দি আলােচনা কত করা হয়েছে যা সমর্থন করে পি.ডব্লিউ-২২ জবানবন্দি প্রদান করেছেন। তিনি (সাক্ষী) বলেছেন যে, তাকে তা পি.ডব্লিউ-২১ এবং অন্যান্য সেনাসদস্যর সাথে একটি খালের পাশে ৩২ নম্বর রােডে নামিয়ে দেওয়া সি হয়েছিল, কমান্ডার তাদের এটি লক্ষ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল যে, কোনাে বহিরাগত যেন ৩২ নম্বর রােড প্রবেশ করতে না পারে। এরপর তিনি (সাক্ষী) গুলিবর্ষণের শব্দ শুনতে পান এবং তিনি নায়েক নজরুল, সিপাহি খালেক এবং অন্যদের সাথে পূর্ব দিকে এগিয়ে যান এবং সেখানে তিনি দেখতে পান যে, আর্টিলারি ইউনিট এবং ল্যান্সার ইউনিটের সেনা কর্মকর্তারা একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, বাসভবনটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এরপর তিনি প্রহরীদের, কমান্ডার নজরুল, খালেক এবং অন্যদের সাথে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবে সব মৃতদেহগুলাে দেখতে পান। বাসভবন থেকে বেরিয়ে এসে গেটে দাঁড়িয়ে থাকা সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে করে কথা বলার পর তিনি জানতে পারেন যে, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং অন্য কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। এই আপিলকারী জেরার সময় এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশকে চ্যালেঞ্জ করেনি।
৬৯৭. সুতরাং, তার সাক্ষ্য অখণ্ডিত রয়ে গেছে। এ ক মাস)
৬৯৮. লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের বিষয়ে, প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণ করার জন্য পি.ডব্লিউ-১, ৪, ১১ এবং ১২-কে পরীক্ষা করেছিল। পি.ডব্লিউ-১ বলেছেন যে, ঘটনার সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে মেজর ফারুক রহমানকে দেখেছিলেন এবং পরিস্থিতি জানতে চাইলে মেজর বজলুল হুদা তাকে বলেছিল যে “all are finished.” এই সাক্ষী কর্তৃক আপিলকারীকে চিনতে পারা) সম্পর্কে দেওয়া জবানবন্দি জেরার সময় চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। সরকার
৬৯৯. পি.ডব্লিউ-৪ বলেছেন যে, ঘটনার সময় মেজর ফারুক একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের প্রধান ফটকের সামনে এসে পৌঁছায় এবং এ সময় মেজর নূর, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মহিউদ্দীন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা এবং অন্যরা সেখানে এসে তার সাথে কিছু সময় কথা বলেছিল। তিনি (সাক্ষী) মেজর ফারুককে শনাক্ত করেছেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, এর কিছু সময় পরে মেজর ফারুক ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাবকে ডেকে নিয়ে ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাকে মেজর ও – সুবেদার আবদুল ওয়াহাব জোয়ার্দারকে লেফটেন্যান্ট ব্যাজে সজ্জিত করে এবং এরপর তাদেরকে মেজর হুদা এবং লেফটেন্যান্ট জোয়ার্দার হিসেবে সম্বােধন করে। ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের করি বাসভবনের গেটে এই আপিলকারীর উপস্থিতির বিষয়ে এই সাক্ষীর বক্তব্যকে আপিলকারী কর্তৃক অস্বীকার করা হয়নি।
৭০০. পি.ডব্লিউ-১১ তার জবানবন্দিতে বলেছেন যে, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখের রাতের প্যারেডে তিনি টু আইসি মেজর ফারুককে দেখেছিলেন, যখন রিসালদার মােসলেহউদ্দিন তাকে স্যালুট দিয়েছিল। এই সাক্ষী এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন অভিমুখে সেনাদের অগ্রসর হওয়ার বিষয়টি বর্ণনা রিফ করেছেন। তিনি (সাক্ষী) বিস্তারিতভাবে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, মেজর
৬৯০

ফারুক একটি ট্যাঙ্কযােগে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে এসেছিল যখন মেজর মহিউদ্দীন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন হুদা, রিসালদার সারওয়ার এবং আর্টিলারি ইউনিটের অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা তার কাছে আসে অ তারা তার সাথে কিছু সময়ের জন্য কথা বলেছিল এবং এরপর মেজর ফারুক ট্যাঙ্কসহ চলে যায়। এই সাক্ষী উপস্থিত থাকা মেজর ফারুককে শনাক্ত করেছেন। মেজর ফারুককে প্যারেড গ্রাউন্ডে এবং ঘটনার সির সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে ট্যাঙ্কসহ চিনতে পারা সম্পর্কে এই সাক্ষীর প্রদত্ত জবানবন্দি চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।
৭০১. পি.ডব্লিউ-১১ কে সমর্থন করে পি.ডব্লিউ-১২ জবানবন্দি প্রদান করেছেন। এই সাক্ষী বলেছেন যে, তিনি
১৪ আগস্ট রাতের কুচকাওয়াজে মেজর ফারুক রহমান এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেখেছিলেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, মেজর ফারুক রহমান প্যারেড পরিদর্শন করেছিল এবং আরডিএম নাইট ক্লাস অনুসরণ করার নির্দেশনা দেয়। এরপর এই সাক্ষী প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে ৩২ নম্বর রােড অভিমুখে সেনাদের অগ্রসর হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। ঘটনাস্থলে পৌছানাের পরে কীভাবে তিনি গুলিবর্ষণের শব্দ শােনেন তা বর্ণনা করেছেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, তিনি সকাল ৭.১৪ টার সময় একটি ট্যাঙ্কসহ আপিলকারীকে দেখেছিলেন, যখন তিনি ৩২ নম্বর রােড থেকে মিরপুর রােডে আসেন। আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান সম্পর্কে প্রসিকিউশন পি.ডব্লিউ-১৪কে পরীক্ষা করেছে, যিনি বালুরঘাটে নৈশকালীন কুচকাওয়াজে তার উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন। করি পি.ডব্লিউ-১৪ বলেছেন যে, তিনি ১৪ আগস্ট রাতে বালুরঘাটে নৈশকালীন কুচকাওয়াজে উপস্থিত ছিলেন যেটি রাত ২.০০-২.৩০টার সময় শেষ হয়েছিল। সেই সময় তাদেরকে ফল-ইন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্যারেড গ্রাউন্ডে আসার পর তিনি (সাক্ষী) সেখানে মেজর ফারুক, মেজর মহিউদ্দীন এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং সাধারণ পােশাকধারী আরাে দুজনকে দেখেছিলেন। তাদের সাথে তিনি আর্টিলারি ইউনিটের কিছু কর্মকর্তা ও মেজর রশিদকেও দেখেছিলেন। মেজর ফারুক তাদের ফল-ইন করার নির্দেশ দিয়েছিল এবং তাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদনের জন্য তাদেরকে ফল-ইন করানাে হয়েছে। এরপর সাদা পােশাকধারী দুজন ব্যক্তিকে, একজন মেজর ডালিম এবং অন্যজন এই আপিলকারী মেজর শাহরিয়ার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল যে, তারা তাদের সাথে কাজ করবে এবং সৈন্যদের তাদের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। এরপরে তিনি (সাক্ষী) ট্যাঙ্কগুলির চলাচল এবং অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। ডিফেন্স এই সাক্ষীর এই বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি যে, এই আপিলকারী সাধারণ পােশাকে রাত ২.০০-২.৩০টার সময় বালুরঘাটে নাইট প্যারেডে এসেছিল বা মেজর ফারুক তার সাথে জওয়ানদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যখন তারা ফল-ইন অবস্থায় ছিল। নৈশকালীন কুচকাওয়াজে তার অংশগ্রহণ এবং তার পরিচয় সম্পর্কে এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশ অখণ্ডিত রয়ে গেছে। স্বীকৃত মতেই, এই আপিলকারী সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত/অবমুক্ত কর্মকর্তা ছিল এবং ১৯৭৫ সালের ১৪ | আগস্ট রাতে সেনাবাহিনীর নৈশ কুচকাওয়াজে তার উপস্থিত থাকার কথা ছিল না। বিজ্ঞ কৌসুলি যুক্তি দিয়েছেন যে, বালুরঘাটে তার উপস্থিত থাকার বিষয়ে পি.ডব্লিউ-১৪-এর জবানবন্দির অনুকূলে কোনাে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য নেই। (আপিলকারী) বালুরঘাটে তার উপস্থিতি সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১৪-র বক্তব্যকে অস্বীকার করেননি কেবল তা নয়, বরং তিনি পি.ডব্লিউ-১৪-র বক্তব্যের জবাবে কোড অব ক্রিমিনাল | প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারা অনুসারে তাকে পরীক্ষা করার সময়েও তার লিখিত কোনাে ব্যাখ্যাও দেননি, নাইট প্যারেডে এই আপিলকারীকে চিনতে পারা সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১৪ এবং ২৪-এর বক্তব্য, যা পি.ডব্লিউ-১৪ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে, সেটির মুখােমুখি করা সত্ত্বেও। তাছাড়া তিনি স্বীকারােক্তিমূলক
৬৯১

জবানবন্দিতে নাইট প্যারেডে তার উপস্থিত থাকার বিষয়টি তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বীকার করেছিলেন, যা আমি আগে আলােচনা করেছি। হত্যার সাথে জড়িত থাকার বিষয়টিও তিনি তার বিচারবহির্ভূত দোষ-স্বীকারােক্তিতে স্বীকার করেছেন। পি.ডব্লিউ-২০, ৩৭, ৪২ এবং ৪৭ কর্তৃক প্রমাণিত তার পরবর্তী আচরণগুলাে, যা অমি পরে আলােচনা করেছি, সেগুলাে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে ঘটনার সাথে তার জড়িত থাকার বিষয়টিকে পর্যাপ্তভাবে প্রমাণিত করেছে। আইনের এমন কোনাে বিধি নেই যে, একজন সাক্ষীর অসমর্থিত সাক্ষ্য গ্রহণ করা যায় না। সাধারণ নিয়ম হিসেবে, আদালত একক কোনাে সাক্ষীর সাক্ষ্যের উপরও নির্ভর করে অগ্রসর হতে পারে, যদি তা অসমর্থিতও হয়। আইন দ্বারা সমর্থনমূলক সাক্ষ্যের উপর জোর দেওয়া না হলে সমর্থনমূলক সাক্ষ্যের উপর জোর দেওয়া আদালতের পক্ষে উচিত হবে না, এমন সব ক্ষেত্র ব্যতীত যেখানে একক সাক্ষীর সাক্ষ্যের প্রকৃতি এমন যে, সেক্ষেত্রে সমর্থনমূলক সাক্ষ্যের উপর জোর দেওয়া উচিত, এবং যদি প্রশ্ন ওঠে যে, একক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে সমর্থনমূলক অন্য সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রয়ােজনীয় কি-না, তবে তা নির্ভর করে প্রতিটি মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতির উপর।
৭০২. লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) বিরুদ্ধে প্রণীত অভিযােগের সমর্থনে প্রসিকিউশন পি.ডব্লিউ-১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭, ২৯, ৩২, ৩৪ এবং ৩৫-কে পরীক্ষা করেছে। পি.ডব্লিউ-১৭ প্রাসঙ্গিক সময়ে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের নায়েক ছিলেন, যেখানে আপিলকারী পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। তিনি (সাক্ষী) ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে বালুরঘাটে নাইট প্যারেডে আপিলকারীর উপস্থিতির বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই সাক্ষী প্যারেড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। এই সাক্ষী বলেছেন যে, প্যারেডের পরে মেজর মহিউদ্দীন পাপা ব্যাটারি কামানের পিছনে দাঁড়িয়ে সুবেদার হাশেমকে ডেকে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। এরপরে হাশেম জওয়ানদের ডেকে নির্দেশনার কথা মনে করিয়ে দেয় এবং তাদেরকে ট্রাকে আরােহণের নির্দেশ দেয় এবং কুইবেক ব্যাটারি থেকে এই সাক্ষীসহ ৪/৫ বন্দুকধারীকে ডেকেছিল। এরপর হাশেম ট্রাকগুলােতে ৬টি কামান সংযুক্ত করে। এরপর কামান বােঝাই ট্রাকগুলাে রাত ৩.৩০-৪.০০টার সময় অগ্রসর হতে থাকে। তিনি (সাক্ষী) একই গাড়িতে মেজর মহিউদ্দীনের সাথে ছিলেন। ট্রাকগুলি ভাের ৪.০০টায় কলাবাগান এলাকায় পৌঁছেছিল এবং মেজর মহিউদ্দীনের নির্দেশ অনুসারে ৩২ নম্বর রােডে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এবং রক্ষীবাহিনী সদর দফতর লক্ষ করে কামান স্থাপন করা হয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে, মেজর মহিউদ্দীনের আদেশ অনুসারে তারা ৪ রাউন্ড কামানের গােলা নিক্ষেপ করেছিল এবং কিছু সময় পরে যখন সকালের আলাে দৃশ্যমান হয় তখন মেজর মহিউদ্দীনের আদেশ অনুসারে তারা কামানগুলি বন্ধ করে দেয় এবং সেগুলাে ট্রাকে সংযুক্ত করে ব্যারাকে ফিরে যায়। এই সাক্ষীকে জেরার সময় তার জবানবন্দির দোষসূচক অংশ এই আপিলকারী চ্যালেঞ্জ করেনি।
৭০৩. পি.ডব্লিউ-১৮ টু ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের আরেকজন সেনাসদস্য। তিনি বলেছেন যে, মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) তাদের ব্যাটারি কমান্ডার ছিল। তিনি ১৪ আগস্ট রাতের প্যারেড সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন, যেখানে এই আপিলকারী এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তি উপস্থিত ছিল। তিনি আরাে বলেছিলেন যে, রাতের প্রশিক্ষণ রাত ১২.৩০ থেকে ১.০০টা অবধি অব্যাহত ছিল এবং এই আপিলকারী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেছিল। এই সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১৭-এর সাক্ষ্যকে সমর্থন করে জবানবন্দি প্রদান করেছেন এবং বলেছেন যে, ভােররাত প্রায় ৩.৩০-৪.০০টার সময় আবুল কালাম তাদেরকে ফল-ইনের জন্য তৈরি করেছিল এবং সেই সময় ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এবং মেজর মহিউদ্দীন সেখানে এসেছিল। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের বলেছিল যে, তাদেরকে রক্ষীবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে
৬৯২

হবে এবং তাদেরকে গাড়িতে উঠার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) এরপর ধানমন্ডি অভিমুখে তাদের যানবাহনের অগ্রসর হওয়া সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন, যখন তিনি চার রাউন্ড গুলিবর্ষণের শব্দ শুনেছিলেন এবং তার কিছু সময় পরে মেজর মহিউদ্দীন তাদের কামান জড়াে করতে বলেছিল এবং তার নির্দেশ অনুসারে তারা গণভবনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। গণভবন পৌছানাের পরে মেজর মহিউদ্দীন গাড়ি থেকে নেমে এক ঘণ্টা পরে ফিরে এসে তাদেরকে নিউ মার্কেট হয়ে রেডিও স্টেশনে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
৭০৪. পি.ডব্লিউ-২১ টু ফিল্ড আর্টিলারি পাপা ব্যাটারির একজন সিপাহি ছিলেন। তিনি বলেন যে, মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। তিনি (সাক্ষী) নৈশ কুচকাওয়াজের বিষয়ে বর্ণনা করেছেন, যেখানে মেজর মহিউদ্দীন এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তি উপস্থিত ছিল। তিনি আরাে বলেন যে, ভােররাত প্রায় ৪.০০-৪.৩০টার সময় অস্ত্রসহ তাদের ট্রাক ৩২ নম্বর রােড অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল। এবং ৩২ নম্বর রােডে গিয়ে থামার পর কিছু সেনাসদস্যকে গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়েছিল আর তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যেন কেউ ৩২ নম্বর রােড দিয়ে চলাচল করতে না পারে। ডিফেন্স এই সাক্ষীর এই বক্তব্যকে কোনােভাবে চ্যালেঞ্জ করেনি।
৭০৫. পি.ডব্লিউ-২২, ২৪ এবং ২৫ বিমানবন্দর এলাকায় পাপা ব্যাটারির টু ফিল্ড আর্টিলারি ইউনিটের ১৪ আগস্ট নৈশ প্যারেড সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং তারা বলেছেন যে, সেখানে তাদের কমান্ডার মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) উপস্থিত ছিল। এই বিবৃতি এই আপিলকারী কর্তৃক অস্বীকৃত হয়নি। পি.ডব্লিউ-২৫ আরাে বলেছেন যে, কুচকাওয়াজের পরে মেজর ফারুক রহমান তাদেরকে ব্রিফ করেছিল।
৭০৬. পি.ডব্লিউ-২৭ও প্রাসঙ্গিক সময়ে মেজর মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) অধীনে পাপা ব্যাটারি টু ফিল্ড আর্টিলারির একজন সিপাহি ছিলেন। তিনিও মেজর মহিউদ্দীনের নির্দেশ অনুসারে অনুষ্ঠিত ১৪ আগস্ট রাতের নৈশ প্যারেড সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং তারপরে তার আদেশ অনুসারে, তিনি একটি গাড়িতে উঠেছিলেন এবং গাড়িটি যখন বালুরঘাটে এসে পৌছায় তখন মেজর মহিউদ্দীন তাদের বলেছিল যে, রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করতে পারে। এরপরে তিনি (সাক্ষী) একটি গাড়ির সাথে একটি কামান সংযুক্ত থাকতে দেখেছিলেন। অন্য গাড়িগুলােতেও কামান সংযুক্ত ছিল এবং এরপর তারা মহাখালী-ফার্মগেট-গ্রিন রােড-এলিফ্যান্ট রােড হয়ে কলাবাগান অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে কলাবাগানের কাছাকাছি স্থানে গাড়ি থেকে নামতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং মেজর মহিউদ্দীন তাদের বলেছিল কাউকে রাস্তায় চলাচল করতে না দিতে। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেছেন যে, সূর্য উঠলে সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি তাদেরকে গণভবনে নিয়ে যায় এবং সেখানে তিনি রেডিওতে মেজর ডালিমের কণ্ঠে শুনতে পেয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এই আপিলকারী এই ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ত থাকা সম্পর্কে এই সাক্ষীর প্রদত্ত সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশকে চ্যালেঞ্জ করেনি।।
৭০৭. পি.ডব্লিউ-২৯ দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি পাপা ব্যাটারি ইউনিটের আরেকজন সিপাহি ছিলেন। তিনিও বলেন যে, মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) পাপা ব্যাটারির কমান্ডার ছিল। তিনি (সাক্ষী) নাইট প্যারেড সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, রাত প্রায় ৩.৩০টার দিকে প্যারেড বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তাদেরকে বালুরঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে দেখতে পান যে, সেনাকর্মীরা যানবাহনগুলােতে অস্ত্র লােড করছে। তাদেরকে অস্ত্র লােড করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং এরপর তারা নগরী অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করে।।
৬৯৩

৭০৮. পি.ডব্লিউ-৩২ বলেন যে, তিনি মেজর মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) নেতৃত্বে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির একজন সিপাহি ছিলেন এবং ১৪ তারিখ রাতে নৈশ প্যারেডে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, এই আপিলকারী এবং অন্য অফিসারদের উপস্থিতিতে তাদের ইউনিটের সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয়েছিল। তিনি আরাে বলেছেন যে, রাত ৩.০০/৩.৩০টার দিকে তাদেরকে দ্বিতীয়বারের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয়েছিল যখন মেজর রশিদ এবং অন্য আসামিরা উপস্থিত ছিল। তখন মেজর রশিদের আদেশ অনুসারে তারা ট্রাকে উঠেছিলেন এবং সেই সময় নায়েক শামসুল ইসলাম তাকে গােলাবারুদ দিয়েছিলেন। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, ফজরের আজানের আগে তাদের ট্রাক যাত্রা শুরু করেছিল এবং যখন তারা তেজগাঁও বিমানবন্দরের পাশে পৌছান, তখন লেফটেন্যান্ট হাসান তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিল রাস্তায় কোনাে যানবাহন চলাচলের অনুমতি প্রদান না করতে। তিনি আরাে বলেন যে, এরপরে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মেজর মহিউদ্দীন এবং অন্যান্য সহ-আসামি এই ঘটনায় জড়িত। আপিলকারী এই সাক্ষীর বক্তব্য কোনােভাবে চ্যালেঞ্জ করেনি।
৭০৯. পি.ডব্লিউ-৩৪ বলেছেন যে, তিনি পাপা ব্যাটারির দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সুবেদার ছিলেন, যেখানে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) কমান্ডার। তিনি বলেন যে, ১৪ আগস্ট রাতের প্রশিক্ষণে তিনি উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের ইউনিট ছয়টি বন্দুক নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ি হয়ে নতুন বিমানবন্দরের দিকে অগ্রসর হয়েছিল এবং রাত প্রায় ১০.০০টার দিকে তিনি গান এরিয়ার কাছে মেজর মহিউদ্দীনের বন্দুকের গুলিবর্ষণের শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, রাত প্রায় ২.৩০টার দিকে তাদেরকে আবার সারিবদ্ধ করে দাঁড় করানাে হয়েছিল এবং তারপর তারা একটি গাড়িতে উঠে মহাখালী হয়ে সায়েন্স ল্যাবরেটরি অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল। সেখান থেকে তাদের গাড়ি উত্তর দিকে ঘুরিয়ে মিরপুর রােড ধরে যেতে থাকে এবং এরপর গাড়িটি একটি হ্রদের সামনে গিয়ে থেমেছিল। সেই সময় মেজর মহিউদ্দীন বন্দুকের পিছনে দাঁড়িয়েছিল। সেনাসদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল রাস্তা দিয়ে কাউকে যেন চলাচল করতে না দেওয়া হয়। ডিফেন্স প্রতিপক্ষ এই সাক্ষীর বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করেনি।
৭১০. পি.ডব্লিউ-৩৪-এর জবানবন্দি সমর্থন করে পি.ডব্লিউ-৩৫ সাক্ষ্য প্রদানকালে বলেন যে, তিনি পাপা ব্যাটারির দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সুবেদার মেজর ছিলেন, যেখানে মেজর মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) কমান্ডার। তিনি(সাক্ষী) ১৪ আগস্ট রাতের নৈশ প্রশিক্ষণ সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেন এবং বলেন যে, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর মেজর মহিউদ্দীনকে প্যারেডটি হস্তান্তর করেছিল। তিনি আরাে বলেন যে, এই ঘটনার চ পরে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে চেয়ে ফোর্সকে জিজ্ঞাসা করে জানতে ত পেরেছিলেন যে, মেজর মহিউদ্দীন এবং অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার সাথে জড়িত ছিল। ডিফেন্স এই সাক্ষীর বক্তব্য চ্যালেঞ্জ করেনি।
৭১১. নথিতে থাকা সাক্ষ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, আপিলকারী মেজর বজলুল হুদার বিরুদ্ধে ১৫ আগস্ট শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করা সম্পর্কে অখণ্ডিত সাক্ষ্য রয়েছে। পি.ডব্লিউ-১, ৪ এবং ৬ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী এবং তারা বলেছেন যে, মেজর বজলুল হুদা শেখ কামালকে গুলি করে হত্যা করেছে। পি.ডব্লিউ-৪ আরাে বলেন যে, মেজর বজলুল হুদা মেজর নূরকে সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করেছিল। এই তিনজন সাক্ষী ছাড়াও পি.ডব্লিউ-৫ ও ৭ ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তাকে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১১, ২১ এবং ২২ নাইট প্যারেডেও এই আপিলকারীকে দেখেছিলেন, যেখান থেকে সে অন্যদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল। সুতরাং, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, এই আপিলকারীর বিরুদ্ধে ১৯৭৫
৬৯৪

সালের ১৫ আগস্ট শেখ কামাল ও বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করা সম্পর্কে অখণ্ডিত সাক্ষ্য রয়েছে। সি পি.ডব্লিউ-৮ ও ১৫ও হত্যার ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তাদের বিচারবহির্ভূত স্বীকারােক্তিও প্রমাণ করেছেন। সুতরাং, হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকগণ তাকে হত্যার অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত করে অত্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
৭১২. লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান সম্পর্কে পি.ডব্লিউ-১১ এবং ১২ তাদের জবানবন্দিতে বলেন যে, নাইট প্যারেডে তারা তাকে চিনতে পেরেছিলেন, যেখান থেকে সে তার ফোর্স নিয়ে ধানমন্ডি অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল এবং পি.ডব্লিউ-১, ৪, ১১ তাকে ঘটনার সময়ে একটি ট্যাঙ্কসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দেখেছিলেন এবং সে মেজর হুদা, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর নূর এবং অন্যদের সাথে কথা বলছিল এবং যখন সে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু বিষয়ে নিশ্চিত হয় তখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছিল। এছাড়া পি.ডব্লিউ-১২ সকাল প্রায় ৭.১৫টার সময় তাকে মিরপুর রােডে দেখেছিলেন, যখন সে একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে ৩২ নম্বর রােড থেকে বেরিয়ে আসছিল। এই সব মৌখিক জবানবন্দি ছাড়াও পি.ডব্লিউ-১৫ এই আপিলকারীর বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি এবং পি.ডব্লিউ-৫১ তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রমাণ করেছেন। এই সাক্ষীদের বক্তব্য এবং দোষ স্বীকারােক্তি এটি পর্যাপ্তভাবে প্রমাণ করেছে যে, তিনিও এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন এবং হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকগণ কর্তৃক হত্যার সাথে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে প্রদত্ত সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণরূপে যৌক্তিক।
৭১৩. লেফটেন্যান্ট কর্নেল একেএম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) সম্পর্কে দেখা যায়, গুলিবর্ষণ করতে করতে বঙ্গবন্ধুর জি বাসভবনে প্রবেশের সময় তাকে পি.ডব্লিউ-৪ ও ৫ দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৪ আরাে বলেছেন যে, এই আপিলকারী যখন বঙ্গবন্ধুকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে আনছিল, তখন তিনি আপিলকারীকে দেখতে পান। I এবং এরপর মেজর বজলুল হুদা ও মেজর নূর বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করে। এই দুজন সাক্ষী ছাড়াও পি.ডব্লিউ-১১ তাকে ঘটনার সময় বা তার কাছাকাছি সময়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে দেখেছি, ন যখন সে ঘটনার ঠিক আগে ৩২ নম্বর রােডের প্রবেশ পয়েন্টে ট্রাক থেকে নেমে আসছিল, তখন | পি.ডব্লিউ-১২ তাকে দেখেছিলেন। এই সাক্ষীগণ ছাড়াও পি.ডব্লিউ-২১ ও ২২-কে যখন ৩২ নম্বর রােডের বা সংযােগস্থলে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখন তারাও তাকে দেখেছিলেন। দোষ স্বীকারকারী তিন আসামির দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং এই দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি নথিতে থাকা মৌখিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। পি.ডব্লিউ-১৫ও তার বিচারবহির্ভূত দোষ স্বীকারােক্তি প্রমাণ করেছে। অতএব, আমি দেখতে পাচ্ছি যে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকগণ সঠিকভাবেই এটি পেয়েছেন যে, সে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর ঘটনায় জড়িত ছিল।
৭১৪. ১৪ আগস্ট বালুরঘাটে নাইট প্যারেডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের উপস্থিতি পি.ডব্লিউ-১৪ ও ২৪ প্রমাণ করেছেন এবং ইতিমধ্যে আমি পি.ডব্লিউ-১৪, ২০, ৩৭, ৪২, ৪৬ ও ৪৭-এর [ সাক্ষ্য আলােচনা করে ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছি এবং তার পরবর্তী আচরণ যা তার দোষ সম্পর্কে সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিরূপণে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। তিনি কি এই ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি হত্যার সাথে তার জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে বিচার-বহির্ভূত স্বীকারােক্তিও দিয়েছেন। অন্য দুই আর দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী সহ-আসামিও তাদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক সক জবানবন্দিতে তাকে জড়িত করেছেন। উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এটি বলা যায় না যে, তাকে ক) নির্ভরযােগ্য এবং সমর্থনমূলক সাক্ষ্য ব্যতিরেকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
৬৯৫

৭১৫. পি.ডব্লিউ-১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৭, ২৯, ৩২, ৩৪ ও ৩৫ নাইট প্যারেডে আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) উপস্থিতি প্রমাণ করেছেন, যেখান থেকে তার ইউনিটের সেনারা কলাবাগান লেক সার্কাস খেলার মাঠে এসেছিল এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর লক্ষ করে কামান স্থাপন করেছিল। সাক্ষীরা এটি প্রমাণ করেছেন যে, তার নির্দেশ অনুসারে তার সেনারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এবং রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর লক্ষ করে কলাবাগান খেলার মাঠ থেকে চার রাউন্ড কামানের গােলা নিক্ষেপ করেছিল। তিনি এই সাক্ষীদের বক্তব্য অস্বীকার করেননি। নথিতে থাকা এই সব সাক্ষ্যের আলােকে এটি বলা যায় না যে, ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর ঘটনায় তাকে জড়িত করার জন্য নথিতে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য নেই। তিনি তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতেও তার জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। অন্য দুই দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী সহ-আসামিও তাদের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে তাকে জড়িত করেছিল এবং সেই দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি মৌখিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। এই সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও অন্যান্য প্রমাণের অস্পষ্টতা বিবেচনার ভিত্তিতে প্রথম বিজ্ঞ বিচারক এই ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা অবিশ্বাস করেছিলেন। বিজ্ঞ বিচারক এই পর্যবেক্ষণ প্রদান করে একটি মৌলিক ক্রটি করেছিলেন যে, নাইট প্যারেডে তার উপস্থিতি একটি সাধারণ রুটিন কাজ ছিল এবং অংশগ্রহণের এই কাজটি থেকে কোনাে ব্যতিক্রম অনুমান করা যায় না। ঘটনার সময় কলাবাগান মাঠে কামান স্থাপন করা এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ও রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর লক্ষ করে কলাবাগান মাঠে কামান স্থাপনের সময় তাকে চিনতে পারা এবং উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য তার সেনাদের কামানের গােলাবর্ষণের নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে তার অংশগ্রহণের পরেও বিজ্ঞ বিচারক কোনাে ব্যতিক্রম গ্রহণ করেননি। এক্ষেত্রে, সন্দেহ নেই যে, তিনি এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন এবং অন্য সহ-আসামিদের এই হত্যাকাণ্ড সংঘটনে সহায়তা করেছিলেন। ঘটনার সাথে তার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক অত্যন্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন।
৭১৬. এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, উপযুক্ত সব প্রসিকিউশন সাক্ষী হলেন ল্যান্সার এবং আর্টিলারি ইউনিটের সেনাকর্মী, যাদের সাথে আপিলকারী এবং অন্যান্য সহ-আসামি অফিসার হিসেবে যুক্ত ছিল। ডিফেন্স সাক্ষীদের সাথে তাদের কোনাে বৈরিতা বা সাক্ষীগণ কর্তৃক তাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন মামলার সমর্থনে সাক্ষ্য দেওয়ার কোনাে উদ্দেশ্য উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা (সাক্ষীগণ) নিরপেক্ষ বলে প্রতিভাত হয়, এমনকি আসামির প্রতি তারা দূরবর্তীভাবেও শত্রুভাবাপন্ন বলে প্রতীয়মান হন না। ডিফেন্স এমন কিছু তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে যা এই ইঙ্গিত দিতে পারে যে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল আসামিদের বিরুদ্ধে অসত্য বক্তব্য প্রদান করা। তাদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে ঐ সব সাক্ষীর সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশ। চ্যালেঞ্জ না করে তারা কার্যত হত্যার ঘটনায় তাদের অংশগ্রহণকে স্বীকার করেছে। তারা সকলেই নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযােগ্য সাক্ষী। তাদের সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যান করার কোনাে অকাট্য ভিত্তি নেই। হাইকোর্ট ডিভিশনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক এবং বিজ্ঞ দায়রা জজ তাদেরকে স্বাধীন এবং নির্ভরযােগ্য সাক্ষী হিসেবে বিশ্বাস করেছেন।
৭১৭. প্রথম বিজ্ঞ বিচারক মেজর বজলুল হুদা, মেজর এ কে এম মহিউদ্দীন আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে দোষী সাব্যস্ত করতে গিয়ে পি.ডব্লিউ-১, ৪, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ২২, ২৫-কে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু ঘটনার সাথে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদের (আর্টিলারি) সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিশ্বাস করেননি। কারণ পি.ডব্লিউ-১৬, ১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ৩২ ও ৩৫-কে অবিশ্বাস করা হয়েছে। তাদেরকে
৬৯৬

অবিশ্বাস করতে গিয়ে বিজ্ঞ বিচারক অসামঞ্জস্যপূর্ণ মতামত প্রদান করেছেন এবং তাদের মধ্য থেকেই কয়েকজনকে বিশ্বাস করেছিলেন, যখন অন্য চারজন আপিলকারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বিজ্ঞ বিচারকের পর্যবেক্ষণ “the presence of the convict with CO at parade was part of duty and that parade in the night of 14th August was held as per pre-existing practice as seen from the evidence of PWs 44 and 45” ঘটনার ভুল ধারণাপ্রসূত এবং পি.ডব্লিউ-৪৪ ও ৪৫-এর বক্তব্যের খণ্ডিত বিবেচনার ভিত্তিতে প্রদান করা হয়েছে। বিজ্ঞ বিচারক স্বীকৃত বিষয়টি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদ ১৪ আগস্ট রাতে নৈশকালীন প্যারেডের আয়ােজন করেছিল এবং ঐ নৈশকালীন প্যারেড চলাকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের অপরাধমূলক উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছিল এবং এই লক্ষ্যে তারা কোটে (kote) থেকে গােলাবারুদ নিয়েছিল, সেনানিবাস থেকে ভারী আর্টিলারি সরিয়ে নিয়েছিল, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আর্টিলারির সাথে সেনাদের নিয়ােজিত করা হয়েছিল এবং এরপর সেনাদের সাথে নিয়ে কয়েকজন অফিসার তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে গিয়েছিল এবং রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যা করেছিল যা আমি পূর্বেই আলােচনা করেছি। যদি এই আপিলকারীর নাইট প্যারেডে অংশগ্রহণ পূর্বনির্ধারিত অনুশীলনের একটি অংশ হয়ে থাকে, তবে কখন, কোথায় এবং কীভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রাষ্ট্রপতিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল সে বিষয়টি বিজ্ঞ প্রথম বিচারক কর্তৃক ব্যাখ্যাত হয়নি। বিজ্ঞ বিচারক এই বিষয়গুলােও ব্যাখ্যা করেননি যে, কেন অভিযুক্ত অফিসাররা অস্ত্র ও গােলাবারুদ নেওয়ার জন্য সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিল এবং কেন তারা প্যারেড শেষে দুটি ইউনিটকে একত্র করেছিল এবং কেন ১৫ আগস্ট রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত নাইট প্যারেডটি অব্যাহত ছিল এবং সর্বশেষ, কেন অফিসাররা ও সৈন্যরা প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে এসেছিল, যা পর্যাপ্তভাবে প্রমাণ করেছে যে, নাইট প্যারেডটি ছিল তাদের অপরাধমূলক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য পূর্বনির্ধারিত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের sheet-anchor।।
৭১৮. Nurul Islam 43 DLR (AD)6 মামলায় চারজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পি.ডব্লিউ-১, ৩, ৭ ও ৮-এর সাক্ষ্যের সুস্পষ্ট অসঙ্গতি এবং বৈপরীত্য, যা প্রসিকিউশন কেসের সত্যতাকে সন্দেহাবৃত করেছিল, তা বিবেচনা করার জন্য লিভ মঞ্জুর করা হয়েছিল। আপীল বিভাগ তাদের সাক্ষ্য মূল্যায়নপূর্বক এটি পান যে, তাদের উপর নির্ভর করা কঠিন এবং পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছিলেন যে, হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ দোষী সাব্যস্তকরণ ও সাজা বহাল রাখার ক্ষেত্রে এই প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের সাক্ষ্যের গুরুত্বপূর্ণ বৈপরীত্য বিবেচনা করেননি এবং এজন্য প্রসিকিউশনের মামলা অবিশ্বাস করে দোষী সাব্যস্তকরণ বাতিল করা হয়। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন অখণ্ডনীয় সাক্ষ্য প্রদান করেছে এবং ডিফেন্স প্রসিকিউশন সাক্ষীদের সাক্ষ্য প্রত্যাখ্যানের জন্য কোনাে অসঙ্গতি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সে কারণে বিজ্ঞ আইনজীবী কর্তৃক উল্লিখিত সিদ্ধান্তটি এই মামলায় প্রযােজ্য নয়।
৭১৯. Hazrat Ali 54 DLR 636 মামলায় এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয় যে, যখন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রসিকিউশন মামলার একটি বড় অংশের বিষয়টি সম্পর্কে সাক্ষীদের সাক্ষ্য আদালত কর্তৃক অবিশ্বাস করা হয়, তখন ঐ সাক্ষীদের সাক্ষ্য অন্য কোনাে সূত্র থেকে স্বতন্ত্র সমর্থন ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না। আমরা ঐ মামলায় ডিভিশনের পর্যবেক্ষণগুলোর সাথে দ্বিমত করি না। এই মামলার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞ আইনজীবী সাক্ষীদের সাক্ষ্যের মধ্যে এমন কোনাে অসামঞ্জস্য চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন যা প্রসিকিউশন মামলার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ক্ষেত্রে অবিশ্বাস করা যেতে পারে।
৬৯৭

৭২০. Muslihuddin [38 DLR (AD) 311] মামলায় মৃতের স্ত্রী মাজেদার (পি.ডব্লিউ-১) সাক্ষ্য, যা অন্য একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী পি.ডব্লিউ-৩ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছিল, সেটির উপর নির্ভর করে হত্যার অভিযােগে আপিলকারীদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তবে আপিল বিভাগ লক্ষ্য করেছিলেন যে, পি.ডব্লিউ-৩-কে পুলিশ ঘটনার অনেক পরে পরীক্ষা করেছিল এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে তার সাক্ষ্যকে অবিশ্বাস করেছিল। আপিল বিভাগ আরাে লক্ষ্য করেছিলেন, যে পি.ডব্লিউ-১ ঘটনার সময় কুঁড়েঘরে উপস্থিত ছিলেন, তবে তিনি অন্য সাক্ষীগণ কর্তৃক সমর্থিত হননি এবং এত সংখ্যক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তাদের কৃতকর্মের বিস্তারিত বর্ণনাসহ শনাক্ত করতে পারা সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল এবং এর ফলে তাকে। অবিশ্বাস করা হয়। আমি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছি যে, বিজ্ঞ আইনজীবী কেন এই সিদ্ধান্তটি উদ্ধৃত করেছেন। ঐ মামলায় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে যে
“In a criminal trial determination of a disputed fact is the main task before the Court and such determination is dependent upon consideration of answers given by prosecution witnesses in their cross-examination. Cross examination is therefore, indispensably necessary to bring out desirable facts of a case modifying the examination in chief or establishing the cross-examiner’s own case. The object of cross-examination is two-fold, to bring out the case of the party cross-examining and to impeach the credibility of the witness. In examination in chief the witness discloses only those facts which are favorable to the party examining him and does not disclose the necessary facts which go in favor of the other side. Cross examination in a criminal case aims at extraction of the facts which support the defense version which is very often sought to be supposed by the prosecution. The opponents can of course establish facts favorable to them by calling their own witnesses; but “there is something dramatic in proving one’s own case from the mouth of the witnesses of the opponent.”
৭২১. উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী সাক্ষীদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যের দোষসূচক অংশটি ডিফেন্স চ্যালেঞ্জ করেনি এবং সেহেতু তাদের সাক্ষ্য অখণ্ডিত থেকে যায়। সাক্ষীদেরকে জেরা করে ডিফেন্স তাদের অনুকূলে কোনাে বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সুতরাং, এই সিদ্ধান্তটি ডিফেন্সকে সহায়তা করার পরিবর্তে প্রসিকিউশন কেসকেই সহায়তা করে।
৭২২. Safdar Ali os. Crocon [5 DLR (FC) 107 (64)] মামলায় পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছে যে, ফৌজদারি মামলায় আদালতের কর্তব্য হলাে প্রসিকিউশন এবং ডিফেন্স কর্তৃক উপস্থাপিত সব সাক্ষ্য পর্যালােচনা করা। যদি সমগ্র সাক্ষ্য পরীক্ষা করার পরে আদালত এই মতামতে আসেন যে, আসামি কর্তৃক উত্থাপিত ডিফেন্স কেসের সত্যতা সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত সম্ভাবনা রয়েছে, এটি স্পষ্ট যে, তখন এই জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রসিকিউশনের সম্পূর্ণ মােকদ্দমায় প্রভাব রাখে। এই পরিস্থিতিতে, এই পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছে যে, অনুগ্রহ হিসেবে নয়, বরং অধিকার হিসেবে আসামি সন্দেহের সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবে। কারণ প্রসিকিউশন তার মামলাটি যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের উর্ধ্বে প্রমাণ করেনি। ফেডারেল কোর্ট কর্তৃক আইনের ভাষ্যের বিষয়ে আমি দ্বিমত করি না। এগুলাে ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার জন্য আইনের
৬৯৮

প্রতিষ্ঠিত নীতি। এই মামলার ক্ষেত্রে আমি দেখতে পাই যে, অভিযুক্তদের কর্তৃক উত্থাপিত ডিফেন্স ভার্সন প্রসিকিউশন কেসে প্রভাব রাখে না, বরং এটি প্রসিকিউশন কেসকে সমর্থন করে।
৭২৩. Movezuddin [31 DLR (AD) 37] মামলায় নিম্নরূপ পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে :
“We like to observe that the contradiction in the statement of a witness, either with his own statement or with the statement of another witness, is a task of appreciation of the evidence, and therefore, it is within the jurisdiction of the trial Court and the Court of appeal on fact, to deal with the question. No doubt there is a certain rule of prudence governing the case of contradicting statements. It is first to be seen whether the alleged statement is a discrepant statement or contradictory statement. The discrepant statement is one which is either irrelevant or incoherent, but it is not irreconcilable. A discrepant statement is not fatal to the credibility of a witness. A contradictory statement is one which is conflicting and is not reconcilable with other statements either of his own or any other witness. The question in such case is, that it is open to a Court of fact either to reject the whole evidence of a witness as untrustworthy or to reject the contradictory part as unreliable or to rely upon that portion, which in the opinion of the Court, fits in with other evidence and the facts and circumstances of the case.”
৭২৪. জনাব মামুন তার যুক্তি-তর্কে ঘটনাস্থলে মেজর বজলুল হুদার উপস্থিতি এবং সাক্ষীগণ কর্তৃক তাকে চিনতে পারা সম্পর্কিত সাক্ষীর সাক্ষ্যের কিছু অংশ সম্পর্কে যে অসামঞ্জস্য তুলে ধরেছেন সেগুলাে অগুরুত্বপূর্ণ প্রকৃতির এবং এগুলােকে অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য হিসেবে নেওয়া যায় না। বিজ্ঞ আইনজীবী সাক্ষীদের কোনাে পরস্পরবিরােধী বক্তব্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন, বরং মেজর বজলুল হুদার ওভার্ট অ্যাক্ট সম্পর্কে সাক্ষীদের প্রদত্ত দোষসূচক বক্তব্যকে জেরার সময় চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল কি না, সে বিষয়ে তিনি আদালতের প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।

ডিজিটাল সাক্ষ্য (Digital Evidence)
৭২৫. প্রসিকিউশন ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য এবং ১৯৭৬ সালের ৩০ মে প্রকাশিত দ্য সানডে টাইমস-এর একজন রিপাের্টারের কাছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানের প্রদত্ত বক্তব্যের ভিত্তিতে আপিলকারীদের বিরুদ্ধে অভিযােগ প্রমাণের চেষ্টা করেছে। মােঃ আজিজুল হক (পি.ডব্লিউ-৫৮) কর্তৃক দ্য সানডে টাইমস-এর ঐ ইস্যুটি প্রদর্শনী “X” হিসেবে আদালতে চিহ্নিত হয়েছে। এই সাক্ষী বলেছেন যে, তিনি যখন পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন তখন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের। অনুরােধে ম্যাগাজিনটির একটি কপি জনাব শফি-উল-আহমেদ, কাউন্সেলর, বাংলাদেশ হাই কমিশন, লন্ডন-এর মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন, যেখানে আপিলকারী সৈয়দ ফারুক রহমান ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর ঘটনায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি এইভাবে স্বীকার করেছিল যে, “I helped to kill Mujib, dare you put me on trial”. এই সাক্ষী ম্যাগাজিনটির সাথে প্রেরিত ফরওয়ার্ডিং চিঠিতে জনাব শফী-উল-আহমেদের স্বাক্ষর প্রমাণ করেছেন। বিচারিক আদালত ডিফেন্সের আপত্তি নােটসহ ম্যাগাজিনটি চিহ্নিত করেছিল। এই সাক্ষী আপত্তি সহকারে ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট যুক্তরাজ্যের গ্রানাডা
৬৯৯

ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশন কর্তৃক সম্প্রচারিত “World_in_Action” সিরিজের একটি ভিডিও-ক্যাসেটসহ Keith Robert Hopkins কর্তৃক ইস্যুকৃত একটি নােটারি সনদ প্রদর্শনী ৩২ হিসেবে চিহ্নিত করেন। নােটারি পাবলিক প্রত্যয়ন করেছিলেন যে, “events leading to the assassination of the late Sheikh Mujibur Rahman in Bangladesh in 1975 and the military coup d’etat following that assassination and that to the best of my knowledge, information and belief the said video cassette is an authentic copy of a television programme….. মােঃ বখতিয়ার হােসেন (পি.ডব্লিউ-৫৯) একজন স্থানীয় ভিডিও রেকর্ডার। তিনি সাক্ষ্য দেন যে, তিনি একটি ভিডিও ক্যাসেট প্রদর্শন করেছিলেন যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান Anthony Mascarenhas-এর কাছে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের সদস্যদেরসহ, শেখ মনি এবং সেরনিয়াবাতকে হত্যা করেছিল। তিনি ক্যাসেটটিকে প্রদর্শনী-১২ হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তিনি (সাক্ষী) বলেন যে, কেউ একজন তাকে ভিডিও ক্যাসেটটি দিয়েছিল। তিনি কীভাবে এটি পেয়েছিলেন এবং এটি মূল ক্যাসেট কিনা সেটি তিনি ব্যাখ্যা করেননি।
৭২৬. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, সানডে টাইমস-এর কপিটি সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী একটি ‘দলিল’, যেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ স্বীকার করেছে এবং দ্বিতীয়ত, ১৫ আগস্টের ঘটনাটি আমাদের ইতিহাসের একটি অংশ হওয়ায় আদালত এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৫৭ (১৩)-এর অধীনে ঘটনা সম্পর্কিত যে কোনাে বই বা দলিল জুডিশিয়াল নােটিশে নিতে পারেন যা ঘটনার সাথে প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল যুক্তি দিয়েছেন যে, যেহেতু আসামি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৪২ ধারার অধীনে পরীক্ষার সময় প্রতিবেদকের সাথে তার দেওয়া সাক্ষাৎকার অস্বীকার করেনি, সেহেতু এই ভিডিও-ক্যাসেটটিকে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৩ ধারা অনুযায়ী প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল আরাে যুক্তি দিয়েছেন যে, ভিডিও ক্যাসেটটিতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান নিজেকে বঙ্গবন্ধুর খুনি হিসেবে ঘােষণা করেছিল, যা সমর্থনমলক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। তার যুক্তির সমর্থনে বিজ্ঞ অ্যাটর্নি GS1 GTGT S Partap Singh vs. State of Punjab: AIR 1964 SC 72 478 Islamic Republic of Pakistan Os. Abdul Wali Khan 1976 PLD SC 57 মামলা উদ্ধৃত করেছেন।
৭২৭. আদালত এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫৭ ধারার অধীনে এমন কিছু বিষয় জুডিশিয়াল নােটিশে নিতে পারেন যা এতটা কুখ্যাত বা স্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত যে সেগুলাের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য কোনাে সাক্ষ্য অপ্রয়ােজনীয় বলে মনে করা হয়। এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫৭ ধারায় বর্ণিত বিষয়গুলির অস্তিত্ব নিয়ে যদি প্রশ্ন আসে তবে যে পক্ষ সেগুলাের অস্তিত্ব নিয়ে দাবি করে তখন সেই পক্ষ শুরুতেই তাদের দাবির সমর্থনে কোনাে প্রমাণ উপস্থাপন করবে। তাদের কেবল আদালতকে এটি জানানাে প্রয়ােজন যে, এই ঘটনাগুলির অস্তিত্ব রয়েছে বা নেই। যদি আদালতের নিজস্ব জ্ঞান এটি সহায়তা না করে, তখন অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। আদালত যদি এটি যথাযথ মনে করেন, তবে পক্ষগণকে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানাতে পারেন। আমার দৃষ্টিতে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান দ্য সানডে টাইমস-এর একজন প্রতিবেদকের কাছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনায় তার অংশগ্রহণ স্বীকার করে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫৭(১৩) ধারার অধীনে গ্রহণযােগ্য হবে না। ধারা ৮১ দলিলাদি যেমন : (ক) একটি সরকারি গেজেট, (খ) লন্ডন গেজেট, (গ) বাংলাদেশ গেজেট, (ঘ) যে কোনাে রাজ্য সরকারের গেজেট, (ঙ) একটি সংবাদপত্র বা জার্নাল ইত্যাদি সম্পর্কে সত্যতার অনুমান তৈরি করে। যদিও এই
৭০০

ধারার অধীনে দলিল হিসেবে চিহ্নিত একটি সংবাদপত্র বা জার্নালের সাথে সত্যতার অনুমান সংযুক্ত, এটি সেখানে বর্ণিত তথ্যাদির প্রমাণ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। উৎস সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত না হলে আমরা নিউজ আইটেমে বর্ণিত তথ্যগুলি জুডিসিয়াল নােটিশে নিতে পারি না, যেহেতু তা শ্রুত সাক্ষ্য। সংবাদপত্র বা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন কেবল শ্রুত সাক্ষ্য। এটি এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৭৮(২)-এ বিধৃত দলিলাদির মধ্যে একটিও নয়, যার দ্বারা একটি অভিযােগের সত্যতা প্রমাণিত হতে পারে। ৮১ ধারার অধীনে একটি ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনের সত্যতার অনুমান সেখানে রিপাের্টেড কোনাে ঘটনার প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
৭২৮. ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সাক্ষ্যের গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে যে পক্ষ কমপ্যাক্ট ডিস্ক (সিডি) বা ভিডিও-ক্যাসেট বা রেকর্ডকৃত কোনাে ব্যক্তির কোনাে বিবৃতি বা স্বীকারােক্তি বা কোনাে প্রাসঙ্গিক ঘটনা বা ঘটনাসম্পর্কিত কোনাে টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত কোনাে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করাতে চায়, তখন সে পক্ষকে অবশ্যই মূল কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা ভিডিও-ক্যাসেট বা টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করতে হবে। অনুষ্ঠানটির প্রযােজককে অবশ্যই অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ের তারিখ এবং স্থান উল্লেখ করে অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তুর সত্যতা প্রত্যয়ন করতে হবে। এই সম্পর্কিত সাটিফিকেট অবশ্যই অনুষ্ঠান প্রযােজক কর্তৃক স্বাক্ষরিত হতে হবে এবং তার স্বাক্ষর প্রমাণ করতে হবে। এই মামলায় এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। প্রসিকিউশন ভিডিও-ক্যাসেটটির মূল কপি উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং প্রযােজক ক্যাসেটটির সত্যতা প্রত্যয়ন করেননি।
৭২৯. ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ক্রাইম ল্যাবরেটরি ডিরেক্টরদের একটি সহযােগিতামূলক প্রচেষ্টার মাধ্যমে ডিজিটাল সাক্ষ্যসম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ডিজিটাল সাক্ষ্যসম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক ওয়ার্কিং গ্রুপকে International Organisation on Computer Evidence কর্তৃক পরিচালিত মানসম্মত প্রচেষ্টায় মার্কিনভিত্তিক উপাদানের উপর নির্ভর করে ইলেকট্রনিক ডিভাইসসহ ডিজিটাল সাক্ষ্য পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ এবং পরীক্ষার জন্য ক্রস-ডিসিপ্লিনারি গাইডলাইন এবং মান বিকাশের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। ডিজিটাল সাক্ষ্যের শুদ্ধতা এবং নির্ভরযােগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল সাক্ষ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরীক্ষা করা বা স্থানান্তর নিশ্চিত করার জন্য আইন প্রয়ােগকারী সংস্থা এবং ফরেনসিক সংস্থাগুলিকে অবশ্যই কার্যকর মানের সিস্টেম স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিভ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখতে হবে, নথিভুক্ত মান নিয়ন্ত্রণের নির্দেশিকাগুলি যথাযথ কেস রেকর্ড দ্বারা সমর্থিত হতে হবে এবং ব্যাপকভাবে গৃহীত পদ্ধতি, সরঞ্জাম এবং উপকরণ ব্যবহার করতে হবে।
৭৩০. এখন প্রশ্ন হলাে, যদি এই পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করা হয়, তাহলে ফৌজদারি বিচারে কোনাে ডিজিটাল সাক্ষ্য গ্রহণযােগ্য হবে কিনা এবং বিদ্যমান আইনের আওতায় তা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে কিনা। ফৌজদারি মামলার বিচারের পদ্ধতিটি কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরে স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছে। এখানে বিধৃত পদ্ধতিটি হলাে সাক্ষ্য রেকর্ড করার সময় অভিযুক্তের উপস্থিতি। ধারা ৩৫৩ সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি বিধৃত করেছে, যা নিম্নরূপ :
“353. Evidence to be taken in presence of accused-Except as otherwise provided, all evidence taken under chapters XX, XXII and XXIII shall be taken in the presence of the accused, or, when his personal attendance is dispensed with, in presence of the accused, or when his personal attendance is dispensed with, in presence of his Advocate.”
৭০১

৭৩১. এই ধারায় অভিযুক্তকে ব্যক্তিগত উপস্থিতি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিধান রয়েছে এবং এক্ষেত্রে অ্যাডভােকেটের উপস্থিতিতে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা যায়। অ্যাডভােকেটের উপস্থিতি অভিযুক্তদের উপস্থিতি বলে মনে করা হয়। দেখা যায় যে, শারীরিক উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। এটি ইঙ্গিত করে যে, এই ধারায় ব্যবহৃত ‘উপস্থিতি’ অভিব্যক্তিটি আসামির প্রকৃত শারীরিক উপস্থিতি অর্থে ব্যবহৃত হয় না। এই ধারাটি মার্কিন সংবিধানের ষষ্ঠ সংশােধনীতে নির্ধারিত কন্টেশন ক্লজের অনুরূপ। এই সংশােধনীর পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতগুলাে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে রেকর্ডকৃত সাক্ষ্য গ্রহণ করছেন না এই কারণে যে, ভিডিও কনফারেন্সিং কনফ্রন্টেশন ক্লজে’র শর্তগুলাে পূরণ করে না। ভিডিও কনফারেন্সিং একটি নতুন বৈজ্ঞানিক ডিভাইস, যা উন্নত দেশগুলাে কর্তৃক গৃহীত হয়েছে এবং যেখানে অভিযুক্তরা উপযুক্ত প্রশ্নের মাধ্যমে সাক্ষীকে জেরা করতে সক্ষম হবে। State of Maharashtra os. Dr Praful B Desai, (2003) 4 SCC 601 মামলায় ভারতের সুপ্রীম কোর্ট রায় দিয়েছেন যে, ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সাক্ষীর কাছ থেকে নেওয়া সাক্ষ্যগুলাে কোডের শর্তগুলাের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কমপ্যাক্ট ডিস্ক বা ভিডিও-ক্যাসেট বা কোনাে টেলিভিশন চ্যানেলে রেকর্ডকৃত কোনাে বক্তব্যের গ্রহণযােগ্যতার বিষয়ে যদি অভিযুক্ত তার বক্তব্য বা স্বীকারােক্তি অস্বীকার না করে, তবে তা দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে এই জাতীয় ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক সাক্ষ্য গ্রহণ করতে কোনাে অসুবিধা নেই। অভিযুক্ত যদি বিবৃতি বা স্বীকারােক্তি অস্বীকার করে, তবে তার সাক্ষ্যের গ্রহণযােগ্যতার বিষয়টি প্রচলিত সাক্ষ্য বিধির অধীনে দেখতে হবে। এভিডেন্স অ্যাক্টের ৩ ধারায় সাক্ষ্য’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যা নিম্নরূপ :
‘Evidence’ means and includes-
(1) all statements which the Court permits or requires to be made before it by a witness, in relation to matters of fact under enquiry; such statements are called oral evidence;
(2) all documents produced for the inspection of the Court, such documents are called documentary evidence.
এই ধারায় সংজ্ঞায়িত ‘দালিলিক সাক্ষ্য’, ইলেক্ট্রনিক রেকর্ড’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়। ভারতে ধারা ৩-এর উপধারা (২) নিম্নলিখিতভাবে সংশােধন করা হয়েছে :
(3) all documents including electronic records produced for the inspection of the Court; such documents are called documentary evidence.
৭৩২. সুতরাং, ভারতে সংশােধিত বিধানের অধীনে কোনাে সাক্ষ্য মৌখিক, দালিলিক এবং ইলেকট্রনিক রেকর্ড হতে পারে। এর অর্থ হলাে ফৌজদারি বিষয়গুলােতে কোনাে সাক্ষ্য ইলেকট্রনিক রেকর্ডের মাধ্যমে যেমন, ভিডিও-ক্যাসেট, কমপ্যাক্ট ডিস্ক এবং ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমেও হতে পারে। আমাদের দেশে এ সম্পর্কিত আইন নেই। এভিডেন্স অ্যাক্ট একটি পদ্ধতিগত আইন এবং একই সাথে একটি চলমান আইন। Francis Bennion Zuvi ‘Statutory Interpretation’-এ চলমান বিধি ব্যাখ্যা করার নীতিগুলি খুব সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যা নিম্নরূপ :
‘It is presumed parliament intends the Court to apply to an ongoing Act a construction that continuously updates its wordings to allow for changes since
৭০২

the Act was initially framed. While it remains law, it has to be treated as always speaking. This means that in its application on any day, the language of the Act, though necessarily embedded in its own time, is nevertheless to be construed in accordance with the need to treat it as a current law.’
‘That today’s construction involves the supposition that parliament was catering long ago for a state of affairs that did not then exist is no argument against that construction. Parliament, in the wording of an enactment, is expected to anticipate temporal developments. The drafter will foresee the future and allow for it in the wording.’
৭৩৩. National Textile Workers’ Union vs. PR Ramakrishnan : AIR 1983 SC 75 মামলায়
Bhagwati, j যে সংখ্যাগরিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা নিম্নরূপ:
‘We cannot allow the dead hand of the past to stifle the growth of the living present. Law cannot stand still; it must change with the changing social concepts and values. If the bark that protects the tree fails to grow and expand along with the tree, it will either choke the tree or if it is a living tree, it will shed that bark and grow a new living bark for itself. Similarly, if the law fails to respond to the needs of changing society, then either it will stifle the growth of the society and choke its progress or if the society is vigorous enough, it will cast away the law which stands in the way of its growth. Law must therefore constantly be on the move adapting itself to the fast-changing society and not
lag behind!
৭৩৪. প্রযুক্তিগত উন্নয়নগুলাে কীভাবে আইনি ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে রূপান্তর করছে তা মূল্যায়নের সময় এসেছে। নতুন প্রযুক্তির উত্থানের সাথে সাথে বিদ্যমান আইনগুলাে প্রয়ােগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং মাঝে মাঝে তাদের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন আইন তৈরি করার প্রয়ােজন হয়। নতুন প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণের প্রয়ােজনীয়তা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রযুক্তির সুবিধা বা বিকল্পভাবে এর অপব্যবহারের সুযােগ সম্পর্কে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উপলব্ধি দ্বারা উৎসাহিত হয়।
৭৩৫. অধ্যায় : The Validity-Reliability standard for Scientific Evidence’ in David H
Daye, David E. Bernstein & Jennifer L. Mnookin, The New Wigmore: A Treatise on Evidence-Expert Evidence-এ এটা বলা হয়েছে যে:
“The more dramatic impact of technology is however, unfolding in the domain of procedure. For instance, investigative agencies have increasingly come to rely on forensic techniques such as analysis of fingerprints, voice, handwriting, blood samples, DNA and other bodily substances for evidence gathering. Software is also used for reconstructing the images of suspects and aiding investigation. As newer technologies are introduced to assist
৭০৩

investigation agencies, it is important to not be blindly enthusiastic about their reliability. The use of scientific techniques holds immense promise in the criminal justice system, but before accepting each technique we must examine it critically in light of the constitutional rights granted to citizens and the requisite evidentiary standard.’
৭৩৬. ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার সামনে চ্যালেঞ্জগুলাে হলাে দ্রুত এবং কার্যকর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার সময় অভিযুক্তদের অধিকারের ভারসাম্য রক্ষা করা। ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে অপরাধীদের অপরাধ ও আচরণের উদীয়মান ধরনগুলাের মােকাবিলার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। এইভাবে আশা করা যায় যে, দেশে বিদ্যমান অচল আইন সংশােধন করা হবে এবং উপযুক্ত পর্যবেক্ষণের আলােকে সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রয়ােজনে নতুন উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হবে। যথাযথ আইনের অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই মামলায় প্রসিকিউশন দ্বারা উপস্থাপিত ডিজিটাল সাক্ষ্যগুলাে ব্যবহার করতে অক্ষম। পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আচরণ (Previous and subsequent conducts)
৭৩৭. এভিডেন্স অ্যাক্টের ধারা ৮, একটি বিধিবদ্ধ আকারে, সাক্ষ্য বিধি এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করে যে, যখন
বিষয়টি গােড়ার দিকে যায় তখন তা পুনর্বিবেচনার সাক্ষ্য সর্বদা অনুমােদিত হয়। প্রস্তুতি একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা, কোনাে ব্যক্তি যখন কোনাে বিশেষ কাজ করেছে বা করেনি, কাজটি সম্পাদনের জন্য সে কোনাে পদক্ষেপ নিয়েছিল কিনা তা জানতে, পূর্বপরিকল্পিত পদক্ষেপ অবশ্যই কেবল উদ্দেশ্য নয় বরং তা উপযুক্ত প্রস্তুতি। অপরাধে সংঘটনে প্রস্তুতি এবং পূর্বের প্রচেষ্টাগুলাে হলাে সংশ্লিষ্ট পক্ষের পূর্ববর্তী আচরণের উদাহরণ যা প্রাসঙ্গিক ঘটনাকে প্রভাবিত করে, তবে অন্য আচরণগুলােও কোনাে পক্ষ বা কোনাে পক্ষের এজেন্টের হােক না কেন, তা পূর্ববর্তী বা পরবর্তী হােক না কেন এবং কোনাে প্রাসঙ্গিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হােক না কেন, সেগুলােও গ্রহণযােগ্য। প্রস্তুতি’ অপরাধ সংঘটনের জন্য প্রয়ােজনীয় উপায় উদ্ভাবন বা ব্যবস্থা করাকে অন্তর্ভুক্ত করে। একটি নকশা বা পরিকল্পনার অস্তিত্ব সাধারণত পরবর্তীকালে পরিকল্পিত বা নকশাকৃত কাজটি করাকে নির্দেশ করে।
৭৩৮. পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আচরণের কার্যক্রম বা কার্যক্রমের সাথে প্রাসঙ্গিক কোনাে বিষয়ের যদি কোনাে সম্পর্ক থাকে, তবে তা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হতে হবে। প্রাসঙ্গিক আচরণ হলাে এমন আচরণ যা সরাসরি এবং তাৎক্ষণিকভাবে কোনাে প্রাসঙ্গিক ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং মধ্যবর্তী কোনাে কারণে কৃত কোনাে পদক্ষেপ এতে অন্তর্ভুক্ত হয় না, যেমন অন্য কোনাে ব্যক্তির প্রশ্ন বা পরামর্শ। সমসাময়িক আচরণের সাক্ষ্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা হিসেবে সর্বদা গ্রহণযােগ্য। পূর্ববর্তী সময়ে অভিযুক্তের মনের প্রকৃত অবস্থা কী ছিল তা বিচার করার জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং পরবর্তী ঘটনাগুলাে উল্লেখ করা যেতে পারে। যখন প্রসিকিউশন সাক্ষীর সাক্ষ্য দ্বারা অভিযুক্তের দোষ প্রতিষ্ঠা করে, তখন ঐরূপ পরবর্তী আচরণ অভিযুক্তের দোষ সম্পর্কে অতিরিক্ত প্রমাণ হিসেবে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এইরূপ পরবর্তী আচরণ অভিযুক্তের দোষ ক্ষালনমূলক আচরণ হতে পারে যা সমানভাবে গ্রহণযােগ্য। কারণ কোনাে স্বীকারােক্তি সেই ব্যক্তি কর্তৃক বা তার পক্ষ থেকে প্রমাণিত হতে পারে যদি এটি স্বীকারােক্তি ছাড়া অন্য কিছু হয়। Anant Lagu os. State of Bombay [AIR 1960 SC 500]. মামলায় Hidayatullah, J কর্তৃক এই পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল যে-
৭০৪

“A criminal trial, of course, is not an inquiry into the conduct of an accused for any purpose other than to determine whether he is guilty of the offense charged. In this connection, that piece of conduct can be held to be incriminatory which has no reasonable explanation except on the hypothesis that he is guilty. Conduct which destroys the presumption of innocence can alone be considered as material.”
৭৩৯. প্রসিকিউশন পি.ডব্লিউ-১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৭, ১৮, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৫, ২৭, ৩২, ৩৪, ৩৫, ৩৯ এবং ৪০-কে পরীক্ষা করে অভিযুক্ত আপিলকারীদের পূর্ববর্তী আচরণ প্রমাণ করেছে। পি.ডব্লিউ-১১ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার), এবং মেজর বজলুল হুদাকে নাইট প্যারেডে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১২ মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার), লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান এবং মেজর হুদাকে ১৪ আগস্ট রাতের নাইট প্যারেডে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৩ মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানকে চিনতে পেরেছিলেন। মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খানকে পি.ডব্লিউ-১৪ চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৭ ও ১৮ ১৪ আগস্ট রাতে প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)-কে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২১ ও ২২ প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং মেজর বজলুল হুদাকে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৩ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানকে প্যারেড গ্রাউন্ডে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৪ লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খানকে প্যারেড গ্রাউন্ডে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৫ নাইট প্যারেডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানকে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-২৭ কলাবাগানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)-কে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩২ নাইট প্যারেডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)-কে চিনতে পেরেছিলেন।
৭৪০. পি.ডব্লিউ-৩৪ কলাবাগানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)-কে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩৫ নাইট প্যারেড গ্রাউন্ডে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমানকে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩৯ নাইট প্যারেড গ্রাউন্ডে কর্নেল ফারুক রহমান এবং মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)-কে চিনতে পেরেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৪০ বলেছেন যে, ফারুক তাকে বলেছিল যে, তারা স্বৈরাচারী সরকার উৎখাত করতে চলেছে, কিন্তু সরকার উৎখাতের পরিবর্তে তারা রাষ্ট্রপতি এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে হত্যা করেছিল। আমি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযােগ বিবেচনা করার সময় তাদের সাক্ষ্য বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেছি। আপিলকারীরা সহ-আসামি এবং তাদের সৈন্যদের সাথে প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে মূল পয়েন্টগুলাে অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল, অস্ত্র এবং গােলাবারুদসহ সেনা মােতায়েন করে সেই মূল পয়েন্টগুলাে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল এবং তারপরে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করা হয়েছিল। তাদের উদ্দেশ্য বা নকশা এবং ক্রিয়াকলাপের ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং অভিযুক্তের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ একই কার্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ষড়যন্ত্র এবং ষড়যন্ত্রের সূত্রে সম্পাদিত কর্ম এক ও অভিন্ন কার্যসম্পাদন নির্দেশ করে। আপিলকারীদের এইরূপ আচরণ প্রাসঙ্গিক, যেটি তাদের দোষ ব্যতীত অন্য কোনাে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা প্রদান করে না।
৭০৫

৭৪১. পি.ডব্লিউ-৮, ৯, ১২, ১৫, ১৬, ২০, ২৩, ২৪, ৩৭, ৪২, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৯ ও ৬০ আপিলকারীদের পরবর্তী আচরণের সমর্থনে জবানবন্দি প্রদান করেছেন। পি.ডব্লিউ-৮ বলেছেন যে, কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমানের নির্দেশ অনুসারে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অবস্থা সম্পর্কে রিপাের্ট করতে দুজন অফিসারসহ তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়েছিলেন এবং গেটে মেজর নূর ও মেজর বজলুল হুদা তাদের রিসিভ করেছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেন যে, মেজর বজলুল হুদা হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি স্বীকার করেছিল যা আমি পূর্বেই আলােচনা করেছি। পি.ডব্লিউ-৪৫-এর নির্দেশে পি.ডব্লিউ-৯ ১৫ আগস্ট রাত ৩টার দিকে ওই বাসভবনে বিরাজমান অবস্থা জানার জন্য যান। তখন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটে মেজর বজলুল হুদা তাকে রিসিভ করেছিল। এই সাক্ষী আরাে বলেছেন যে, মেজর মহিউদ্দীনের তদারকিতে হেলিকপ্টারযােগে বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় পাঠানাে হয়েছিল। পি.ডব্লিউ-১২ বলেছেন যে, ১৫ আগস্ট সকাল ৭.১৫টায় লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান যখন একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে ৩২ নম্বর রােড থেকে মিরপুর রােডের দিকে আসছিল তখন তিনি তাকে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৫ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা এবং মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার)-কে ঘটনার দিন বিকাল ৪.০০টায় বঙ্গভবনে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-১৬ যখন ১৫ আগস্ট সকালে সাংহাই রেস্টুরেন্ট, কলাবাগান, মিরপুর রােডের সামনে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিলেন, তখন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানকে একটি জিপে দেখেছিলেন। এরপরে তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি)-কে তার বাহিনীসহ দেখতে পান। পি.ডব্লিউ-২০ ঘটনার পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং অন্যান্য অফিসারকে বঙ্গভবনের অভ্যন্তরে দেখেছিলেন।
৭৪২. পি.ডব্লিউ-২৩ বলেছেন যে, ঘটনার পরে তিনি ইউনিটে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান এবং মেজর মহিউদ্দীন আহমেদকে (ল্যান্সার) দেখেননি এবং তিনি শুনেছিলেন যে, হত্যাকাণ্ডের পরে তারা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিল। পি.ডব্লিউ-২৪ বলেছেন যে, মন্ত্রী সেরনিয়াবাত এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পরপরই তিনি মেজর ডালিম, মেজর নূর, মেজর শাহরিয়ার এবং অন্যান্য আসামিকে রেডিও স্টেশনে প্রবেশ করতে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৩৭ বলেছেন যে, ঘটনার পরে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার এবং অন্যান্য আসামিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল ৭:০০টায় রেডিও স্টেশনের স্টুডিও-২-এ খােন্দকার মােশতাকের বক্তব্য প্রস্তুত করতে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৪২ সঙ্গতিপূর্ণ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে, তিনি ১৫ আগস্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং ফারুক রহমানকে রেডিও স্টেশনে পেয়েছিলেন, যেখানে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানরা রেডিওর মাধ্যমে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে এসেছিলেন। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেছেন যে, ১৫ আগস্ট সকাল ১১:০০টায় তিনি যখন কর্তপক্ষের নির্দেশ অনুসারে ৩২ নম্বর রােডে ভিকটিমদের ছবি নেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন তখন তিনি সেখানে মেজর বজলুল হুদা ও মেজর নূরকেও দেখতে পান। তিনি আরাে বলেছেন যে, ১৫ আগস্ট বিকেলে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কক্ষে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান, মেজর মহিউদ্দীন আহমেদ (ল্যান্সার) এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৪৪ বলেছেন যে, ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের হত্যার সাথে জড়িত অফিসাররা ১৯৭৫ সালে ব্যাংককে অবস্থান করছিল। ‘সিপাহী বিপ্লব’ (সশস্ত্র বিপ্লব ঘটেছিল ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ; মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান
৭০৬

একচ্ছত্র অধিপতি হন এবং ক্ষমতা গ্রহণের পরে তিনি ১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বরের হত্যার সাথে জড়িত অফিসারদের বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করে প্রত্যাবাসন করেছিলেন। এই বিবৃতি প্রমাণ করে যে, ৩ নভেম্বরের ঘটনার পর ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অফিসাররা এ দেশ ছেড়ে ব্যাংককে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি (সাক্ষী) আরাে বলেছেন যে, ঐ অফিসাররা জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছিল এবং অতঃপর তাদেরকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। এরপর তারা পলাতক হিসেবে বিদেশে বসবাস করছিল। আপিলকারীরা এই সাক্ষীর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেনি।
৭৪৩. পি.ডব্লিউ-৪৫ বলেছেন যে, তিনি বঙ্গভবনে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মেজর বজলুল হুদা, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক আহমেদ এবং অন্যান্য সহ-অভিযুক্তকে দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৪৬ বলেন যে, ১৫ আগস্ট বেলা ৩.৩০টায় তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতির আসনে উপবিষ্ট মােশতাক আহমেদের পাশে বসা দেখেছিলেন। পি.ডব্লিউ-৪৭ লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) এবং মেজর বজলুল হুদাকে ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেখেছিলেন। তিনি আরাে বলেছেন যে, ৩ নভেম্বরের ঘটনার পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল রশিদ এবং অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ব্যাংককের উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছিল। এই অফিসাররা জুনিয়র আর্মি অফিসার এবং তাদের কয়েকজনকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ারসহ অপসারণ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি হত্যার সাথে জড়িত না থাকলে তাদের এ জাতীয় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল না। এই ঘটনাগুলাে ইঙ্গিত করে যে, তারা এই ঘটনায় জড়িত ছিল। পি.ডব্লিউ-৪৪ ও ৪৭-এর সমর্থনমূলক সাক্ষ্য রয়েছে যে, আপিলকারীরা এবং অন্যান্য অভিযুক্ত ব্যক্তি ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫-এর ঘটনার পরে দেশ ছেড়ে ব্যাংককে আশ্রয় নিয়েছিল। এটিও একটি স্বীকৃত সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর খােন্দকার মােশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। নথিতে সমর্থনমূলক সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, বঙ্গভবনে খােন্দকার মােশতাকের সঙ্গে আপিলকারীদের এবং অন্য আসামিদের দেখা গিয়েছিল। প্রসিকিউশন কেস অনুসারে, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা হিসেবে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য খােন্দকার মােশতাককে রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিল, যদিও সংবিধান অনুসারে তার দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা ছিল না। ঘটনার পরে রেডিও স্টেশন এবং বঙ্গভবনে আপিলকারীদের উপস্থিতি এবং ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ঘটনার পর যখন খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তখন তাদের যৌথভাবে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্পর্কে প্রসিকিউশন কেসকে এই মর্মে সমর্থন করেছিল যে, তারা হত্যার বিচারের মুখােমুখি হওয়ার ভয়ে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আপিলকারীদের যৌথভাবে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ঘটনার সাথে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয় একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা। এছাড়া তাদের ঐভাবে যৌথভাবে দেশ ছাড়ার অন্য কোনাে কারণ ছিল না। এটিও একটি প্রাসঙ্গিক ঘটনা যে, এই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগকেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দিয়ে বিদেশি দূতাবাসে পদায়ন করা হয়েছিল। তারা এই ঘটনাগুলাে অস্বীকার করেনি। পি.ডব্লিউ-৪৯ বলেছেন যে, ১৫ আগস্ট মেজর ডালিম রেডিও স্টেশনে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধানদের দেওয়া বক্তব্য সম্প্রচারের পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন। পি.ডব্লিউ-৬০ সেনা সদর দফতরের ১৫ আগস্ট, ১৯৭৬ তারিখের এক স্মারকপত্র মূলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৮ জুন, ১৯৭৬ তারিখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণের বিষয়টি প্রমাণ করেছেন।
৭০৭

৭৪৪. প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পি.ডব্লিউ-২৪-কে অবিশ্বাস করেছেন এই যুক্তিতে যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমানের পক্ষে জেরা চলাকালীন তিনি বলেছিলেন যে, যেহেতু তিনি সেরনিয়াবাতের বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন, সেহেতু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পুলিশের ভাষ্যমতে মামলায় তাকে অভিযুক্ত করা হবে- এই আশঙ্কায় তিনি এইরূপ বক্তব্য দিয়েছেন। দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক অবশ্য এই কারণে তাকে বিশ্বাস করেছিলেন যে, তার সম্পূর্ণ বক্তব্য পর্যালােচনা করার পর এটিই প্রতীয়মান হয়েছিল যে, তিনি সাজেশনটি অস্বীকার করছেন কিন্তু বিজ্ঞ দায়রা জজ অসাবধানতাবশত তার বক্তব্য ইতিবাচক (পজিটিভ) অর্থে রেকর্ড করেছিলেন। তবে, তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীনের (আর্টিলারি) পক্ষে করা জেরায় প্রায় অনুরূপ সাজেশন অস্বীকার করেছিলেন। এই সাক্ষীর সত্যতা সম্পর্কিত মতামতের পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তার সাক্ষ্যকে পুরােপুরি নতুন করে মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছি। এই সাক্ষী ঘটনার ২২ বছরেরও বেশি সময় পরে ১৯৯৭ সালের ১৯ অক্টোবর তারিখে আদালতে হাজির হয়েছিলেন। এবং এই বিলম্বিত পর্যায়ে তার পক্ষ থেকে সেরনিয়াবাতের হত্যা মামলায় জড়িত হওয়ার কোনাে আশঙ্কা পােষণ করার কারণ নেই, যেহেতু মামলাটি অনেক আগেই দায়ের করা হয়েছিল। তিনি পুলিশের সামনে নয়, আদালতে এই বিবৃতি দিয়েছিলেন। উপযুক্ত বিবেচনায়, আমি দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারকের মতামতের সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত যে, বিজ্ঞ দায়রা জজ অনিচ্ছাকতভাবেই সাজেশনটি পজিটিভ অর্থে রেকর্ড করেছিলেন, যদিও তিনি (সাক্ষী) সাজেশনটি অস্বীকার করেছিলেন।
৭৪৫. প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পি.ডব্লিউ-৪৬ কর্তৃক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর বজলুল হুদা এবং বঙ্গভবনে অন্য অভিযুক্তদের তার কর্তৃক চিনতে পারার বিষয়টি অবিশ্বাস করেছিলেন এই যুক্তিতে যে, সাক্ষ্য-প্রমাণে এমন কিছু ছিল না যে, তিনি (সাক্ষী) আগে থেকেই তাদেরকে চিনতেন। বিজ্ঞ বিচারকের এই পর্যবেক্ষণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ, কারণ বিজ্ঞ বিচারক নিজেই রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে বঙ্গভবনে এই আপিলকারীদের উপস্থিতি সম্পর্কে ভিন্ন মত পােষণ করেছিলেন এবং বিরূপ অনুমান করেছিলেন যে, যেহেতু তারা জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা, সেহেতু বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিত থাকতে পারার কথা নয়। পি.ডব্লিউ-১৫ এবং ৪৭ও বলেছেন যে, তারা তাদেরকে বঙ্গভবনে দেখেছিলেন। সুতরাং, দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক যথাযথভাবে | এই সাক্ষীকে বিশ্বাস করেছেন।
৭৪৬. তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক পি.ডব্লিউ-৬০-কে, যিনি বিদেশি দূতাবাসগুলিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আত্তীকরণ ও নিযুক্তির বিষয়সংক্রান্ত সাক্ষ্য প্রদর্শনী-১০/৫, ৩৫, ১০/৫/এ হিসেবে প্রমাণ করেছেন, অবিশ্বাস করেছেন এই কারণে যে, এই আত্তীকরণ ও নিয়ােগকে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করা যায় না এবং এই জাতীয় নিযুক্তির কারণে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনাে বিরূপ অনুমান করা যায় না। তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক এই বিষয়টি বিবেচনা করতে ভুল করেছিলেন যে, নথিতে এই মর্মে অখণ্ডিত সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, জিয়াউর রহমান খােন্দকার মােশতাক আহমেদের নিকট থেকে ক্ষমতা দখলের পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের আত্তীকরণ করা হয় এবং বেশির ভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসগুলােতে পদায়ন করা হয় এবং যদি তারা এই ঘটনায় জড়িত না থাকত, তবে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকৃত হওয়ার কোনাে কারণ ছিল না, তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল অপসারিত অফিসার। পি.ডব্লিউ-৪৪ এবং ৪৭ এটি প্রমাণ করেছেন যে, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ক্ষমতায় আসার পরে তারা জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্তৃক আত্তীকৃত হয়েছিল এবং ৩ নভেম্বর সন্ধ্যায় যখন খােন্দকার মােশতাক আহমেদ খালেদ মােশাররফ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন, তখন তারা দেশত্যাগ করেছিল। অভিযুক্তরা এই ঘটনাগুলাে অস্বীকার করেনি। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ৩ নভেম্বর দেশ
৭০৮

থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের নিয়ােগের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে এবং মধ্যবর্তী সময়ে খালেদ মােশাররফ ক্ষমতায় ছিলেন। তৃতীয় বিজ্ঞ বিচারক পি.ডব্লিউ-৪৪, ৪৫ এবং ৪৭-এর সাক্ষ্যের যথাযথ মূল্যায়ন না করে পি.ডব্লিউ-৬০-কে অবিশ্বাস করেছেন। যদি এই সাক্ষীদের সাক্ষ্য একত্রে বিবেচনা করা হয়, তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পরে তার কর্তৃক পুরস্কৃত করা হয়েছিল- এটি ছাড়া আর কোনাে অনুমান গ্রহণ করা যায় না।।
৭৪৭. এই সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে এটি প্রমাণিত হয় যে, আপিলকারীগণ এবং অন্য সহ-অভিযুক্তরা তাদের পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে নৈশ কুচকাওয়াজের আয়ােজন করেছিল এবং তারপর তারা ট্যাঙ্ক, কামান এবং অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত সেনাদের নিয়ে সেনানিবাস থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রােডে অবস্থিত বাসভবনের অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে হত্যা করেছিল এবং হত্যাকাণ্ডের পর তারা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর প্রধানগণকে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতি আনুগত্য জানাতে এবং খােন্দকার মােশতাক আহমেদকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। তারপর তারা বঙ্গভবনে অবস্থান করেছিল, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ এবং রেডিও স্টেশন পাহারায় রেখেছিল যেন কেউ তাকে উৎখাত করতে না পারে। তারা রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল, যদিও তারা ঐরূপ রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য গণ্য ছিল না। লেফটেনেন্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান ছিল একজন বহিষ্কৃত কর্মকর্তা, কিন্তু তাকে নৈশ কুচকাওয়াজে দেখা গিয়েছিল এবং তারপর তাকে ১৫ আগস্ট ভােরে রেডিও স্টেশনে দেখা গিয়েছিল। নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও তাকে অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গে উপস্থিত থাকতে দেখা গিয়েছিল। কিছু অভিযুক্ত মৃতদেহগুলাে দাফনের ব্যবস্থা করেছিল। এই সব পরিস্থিতি এটা যথার্থভাবে প্রমাণ করেছে যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। অভিযুক্তদের এই আচরণগুলাে এভিডেন্স অ্যাক্টের ৮ ধারার অধীন প্রাসঙ্গিক এবং তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য অধিকতর প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। অভিযুক্ত আপিলকারীদের এই সব পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আচরণ তাদের দোষ নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং এগুলােকে অবস্থাগত বা পরিস্থিতিগত সাক্ষ্য হিসেবেও গ্রহণ করা যেতে পারে। এই সাক্ষ্যসমূহ সব সন্দেহের উর্ধ্বে এটা যথার্থভাবে প্রমাণ করেছে যে, এই আপিলকারীগণ এবং অন্যান্য দোষী সাব্যস্ত আসামিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, এবং হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ কর্তৃক তাদেরকে দোষী সাব্যস্তকরণের সিদ্ধান্ত এবং মৃত্যুদণ্ড
বহাল রাখার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ছিল।
৭৪৮. এখন হত্যার অভিযােগের প্রসঙ্গে আসা যাক। বিজ্ঞ আইনজীবীগণ নিবেদন করেন যে, আপিলকারীদের বিরুদ্ধে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীন অভিযােগের সমর্থনে কোনাে আইনগত সাক্ষ্য বিদ্যমান নেই। জনাব খান সাইফুর রহমান যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, আপিলকারী মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি) কর্তৃক কলাবাগান খেলার মাঠে কামানসহ সেনা মােতায়েনের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের কোনাে যােগসূত্র নেই। সুতরাং, তাকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে অবৈধভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। জনাব খান সাইফুর রহমান আরাে বলেন যে, যদি সংঘটিত অপরাধটি বিদ্রোহ হিসেবে প্রমাণিত হয় তবে তা একটি সামরিক অপরাধ। সেক্ষেত্রে ৩৪ এবং ৩৮ ধারাগুলাে এ মামলায় কোনােভাবে প্রযােজ্য হবে না। জনাব আবদুর রাজ্জাক খান যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, লেফটেনেন্ট কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান ঘটনাস্থলে বা এর কাছাকাছি স্থানে উপস্থিত ছিল না এবং কোনােরূপ প্রকাশ্য কাজ বা
৭০৯

অন্যান্য অভিযুক্তদের সাথে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার অংশগ্রহণের বিষয়টির অনুপস্থিতিতে তাকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্তকরণ সম্পূর্ণ অবৈধ এবং ভিত্তিহীন। জনাব খান আদালতের সামনে জোরালােভাবে এই যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, আপিলকারী শাহরিয়ার রশিদ খানকে পেনাল কোডের ৩৪ ধারার আওতাধীন করতে হলে তার কোনাে ওভার্ট অ্যাক্ট বা কোনাে প্রকাশ্য কাজ যা ঘটনাটির সাথে সম্পর্কিত তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেটি এইরূপ ইঙ্গিত প্রদান করতে পারে যে, হত্যাকাণ্ডটিতে তিনি অন্যান্য অপরাধীর সাথে পূর্বপরিকল্পিতভাবে অংশ নিয়েছিলেন। বিজ্ঞ আইনজীবী আরাে উপস্থাপন করেন। যে, ঘটনার পর ১৫ আগস্ট আনুমানিক ভাের ৬.০০টায় দাপ্তরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে তিনি রেডিও স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন এবং এজন্য তাকে হত্যাকাণ্ডের অভিযােগে দায়ী করা যেতে পারে না।
৭৪৯. উত্থাপিত বিষয়গুলাে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত প্রদানের পূর্বে, আমি ৩৪ ধারাটির সঠিক উদ্দেশ্য নিয়ে আলােচনা করতে চাই, যা পেনাল কোডের ৩৫ এবং ৩৮ ধারার সাথে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। ধারাগুলাে নিয়ে। বর্ণিত হলাে :
“34. When a criminal act is done by several persons, in furtherance of the
common intention of all, each of such persons is liable for that act in the same manner as if it were done by him alone.
35. Whenever an act, which is criminal only by reason of its being done with a criminal knowledge or intention, is done by several persons, each of such persons who joins in the act with such knowledge or intention is liable for the act in the same manner as if the act were done by him alone with that knowledge or intention.
38 Where several persons are engaged or concerned in the commission of a criminal act, they may be guilty of different offenses by means of that act.”
৭৫০. এ বিধানগুলাে পাঠ করলে দেখা যায় যে, ৩৪ এবং ৩৫ ধারাগুলাে চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে; অন্যদিকে ৩৮ ধারাটি শুধু ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা তুলে ধরেছে। ৩৪ ধারাটি তখনই প্রযােজ্য হয় যখন। একটি অভিন্ন অভিপ্রায় বিদ্যমান থাকে এবং সকলের অভিন্ন অভিপ্রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি অপরাধমূলক কর্ম সংঘটিত হয়, যা সকলকে সমানভাবে দায়ী করবে। ৩৫ ধারাটির অধীনে প্রত্যেক অভিযুক্ত অপরাধমূলক কাজের জন্য দায়ী হতে পারে যদি দেখা যায় যে, ঐ অপরাধমূলক কাজ সংঘটনে তার জ্ঞান বা উদ্দেশ্য ছিল। অতএব, দুজন ব্যক্তি যদি তৃতীয় একজন ব্যক্তিকে মারধর করে, যেখানে তাদের একজনের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিটির মৃত্যু ঘটানাে এবং অন্যজনের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিটিকে মারাত্মকভাবে আঘাত করা, সেখানে কোনাে সাধারণ অভিপ্রায় নেই এবং সেক্ষেত্রে অপরাধগুলাে হবে
ভিন্ন ভিন্ন।
৭৫১. এরূপ হবে না যদি অপরাধটি একটি অভিন্ন অভিপ্রায় নিয়ে সংঘটিত হয় অথবা প্রত্যেক অভিযুক্তের প্রয়ােজনীয় অপরাধমূলক অভিপ্রায় বা জ্ঞান থাকে। ৩৮ ধারাটি একই রকম কাজ থেকে উদ্ভূত ভিন্ন মাত্রার দায়বদ্ধতার বিষয় তুলে ধরেছে। নিম্নবর্ণিত উদাহরণটি এ বিষয়টিকে পরিষ্কার করে :
‘ক’ উগ্র প্ররােচনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ‘ঙ’-কে আক্রমণ করে। তার এই আক্রমণে ‘ঙ’ নিহত হলে সেটা শুধু culpable homicide not amounting to murder হবে। ‘ঙ’-এর প্রতি ‘খ’-এর বিদ্বেষ থাকায়
৭১০

এবং ‘ঙ’-কে হত্যা করার জন্য ‘খ’-এর অভিপ্রায় থাকায়, ‘খ’ বিনা প্ররােচনায় ‘ঙ’-কে হত্যার কাজে ‘ক’-কে সাহায্য করে। এখানে ‘ক’ ও ‘খ’ উভয়েই ‘ঙ’-কে হত্যার কাজে জড়িত থাকলেও, ‘খ’ খুনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবে এবং ‘ক’ শুধু culpable homicide-এর অপরাধে দোষী হবে।
৭৫২. ৩৪ ধারার অধীনে অপরাধমূলক অভিপ্রায় হলাে একটি সুনির্দিষ্ট অপরাধমূলক কাজ সংঘটনের জন্য অপরাধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অভিন্ন মানসিক ঐক্য। যদি কোনাে ব্যক্তি এইরূপ অভিন্ন নকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সহযােগিতা করে, তাহলে সেই ব্যক্তি তার অন্য সহ-শরিকগণ, যারা প্রকৃতপক্ষেই অপরাধটি সংঘটন করেছে, তাদের মতাে একইভাবে পরিকল্পিত অপরাধটি সংঘটনের জন্য দায়ী হবে, যেন সে একাই অপরাধটি সংঘটন করেছে। ৩৪ ধারাটির সারমর্ম হচ্ছে, ব্যক্তিকে অবশ্যই অপরাধ সংঘটনস্থলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে। এর পাশাপাশি অপরাধটিতে তার প্রকৃত অংশগ্রহণ থাকতে হবে, যা পরােক্ষ প্রকৃতিরও হতে পারে, যেমন, সব আসামির অভিন্ন অভিপ্রায় বাস্তবায়নে সহযােগিতার উদ্দেশ্যে এবং যখন সময় আসবে তখন তার ভূমিকা পালনের প্রস্তুতি নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অথবা ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা।
৭৫৩. এখন এই নীতিগুলােকে বর্তমান মামলার ঘটনার ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করা যাক। আমরা ইতােমধ্যে দেখেছি যে, এই আপিলকারীগণ নৈশ কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিল এবং তাদের উদ্দেশ্য পূরণ ও বাস্তবায়নের জন্য এই নৈশ কুচকাওয়াজের আয়ােজন করা হয়েছিল। তারা অফিসারদের কমান্ডে থাকা জওয়ানদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেমন, রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তর, বিডিআরের সদর দপ্তর, রেডিও স্টেশন, মিন্টু রােড এবং ৩২ নম্বর রােডে মােতায়েন করেছিল। রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরের গেটে এবং বিডিআরের গেটে সেনা মােতায়েন করা ছিল সাহায্যের আহ্বানে, যদি এই আধাসামরিক বাহিনীগুলাের সদস্যরা রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করতে আসে তাহলে তাদেরকে প্রতিরােধ করা, যা ছিল তাদের পূর্বপরিকল্পনার একটা অংশ। রেডিও স্টেশনে সেনা মােতায়েন করা হয়েছিল এই জন্য যে, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী, রাজনৈতিক কর্মী অথবা অন্য কোনাে উৎস থেকে তৎকালীন সরকারের পক্ষে কোনাে ব্যক্তি সাহায্য চাইলে তা প্রতিরােধ করা। রাষ্ট্রপতিকে রক্ষার জন্য মন্ত্রিগণ কর্তৃক জনগণ বা অন্য কোনাে বাহিনীকে জড়াে করলে তা প্রতিরােধ করার জন্য মিন্টু রােডে সেনা মােতায়েন করা হয়েছিল। অভিযুক্তের আচরণ এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থাদি থেকে ষড়যন্ত্রটির অস্তিত্ব এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনুমান করতে হবে। যে ঘটনাগুলি প্রমাণিত হয়েছে সেগুলাের সমন্বয়ে এমন ঘটনাবলির চেইন তৈরি হয়েছে যা থেকে একমাত্র এই অপ্রতিরােধ্য সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী এবং অপরাধের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার অনুমান ছাড়া ভিন্ন কোনাে অনুমান করা অসম্ভব [1977 SCC (Cri) 1004]। ঘটনার পূর্ববর্তী, ঘটনার সময়কার এবং ঘটনার পরবর্তী অবস্থাদি ঘটনাটিতে অভিযুক্তের সম্পৃক্ততা নির্ধারণের জন্য প্রমাণ করা যেতে পারে। Nalini case [(1999) 5 SCC 253] মামলাটিতে বিচারপতি ওয়াদহা [Wadha, J] বলেছেন যে, ষড়যন্ত্রের জন্য অপরাধমূলক দায়বদ্ধতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি বিদ্যমান ষড়যন্ত্রের প্রতি কমবেশি পরােক্ষ সমর্থন থাকতে হবে। বিজ্ঞ বিচারক নিম্নবর্ণিতভাবে এ বিষয়ে আইনের অবস্থান তুলে ধরেন :
“One who commits an overt act with knowledge of the conspiracy is guilty. And one who tacitly consents to the object of conspiracy and goes along with other conspirators actually standing by while others put the act into effect, is guilty though he intends to take no active part in the crime.”
৭১১

৭৫৪. তারা প্রমাণ করেছিল যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) কামানসহ ৩২ নম্বর রােডের কাছে অবস্থিত কলাবাগান খেলার মাঠে নিয়ােজিত ছিল, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে রেডিও স্টেশনে প্রেরণ করা হয়েছিল, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান রক্ষীবাহিনী এবং বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে দৃষ্টি রাখার সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার), মেজর বজলুল হুদা, মেজর নূরকে কিছু সৈন্যসহ মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন তথা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
৭৫৫. আপিলকারী এবং সহ-আসামিদের কৃতকর্মগুলাে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রটির গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার অভিন্ন অভিপ্রায়টি কোনােরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তা করা হয়েছিল। এ বিষয়ে কোনাে বিরােধ নেই যে, মেজর বজলুল হুদা এবং মেজর মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) প্রত্যক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। তাদের মধ্যে বজলুল হুদা গুলি করে শেখ কামাল এবং রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছিল। তার কাজটি পেনাল কোডের ৩০২ ধারাকে আকৃষ্ট করে, কিন্তু তাকে পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তার দোষী সাব্যস্তকরণ ৩০২ ধারার অধীনে মূল অপরাধের জন্য রূপান্তরিত করা যাবে না।
৭৫৬. মেজর একেএম মহিউদ্দীন (ল্যান্সার) রাষ্ট্রপতিকে হত্যায় সহযােগিতার জন্য তাঁকে নিচে নামিয়ে আনে। সে হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। যদিও লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারুক রহমান মূল হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেনি, কিন্তু হত্যাকাণ্ডটি সংঘটনের সময় একটি ট্যাঙ্ক নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের গেটের সামনে তার উপস্থিতি ছিল ঐকমত্যের অংশ, যা ছিল সব আসামির অভিন্ন অভিপ্রায় বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। একইভাবে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন (আর্টিলারি) ট্রপস এবং কামানসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল, যাতে কেউ যদি রাষ্ট্রপতিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে তবে তাকে যেন প্রতিরােধ করা যায়, এবং এভাবে সহ-আসামি মেজর বজলুল হুদা, মেজর একেএম মহিউদ্দীন এবং অন্যদের সহযােগিতা করেছিল, যেন তাদের সকলের অভিন্ন অভিপ্রায়টি বাস্তবায়িত হয়। এই লক্ষ্যে সে চারটি কামানের গােলাও বর্ষণ করেছিল, যেন অন্যরা বুঝতে পারে যে, যদি প্রয়ােজন হয়, সময়মতাে আরাে গােলাবর্ষণ করতে প্রস্তুত। আসামিদের এই কর্মকাণ্ড সন্দেহাতীতভাবে এটাই নির্দেশ করে যে, তারা ষড়যন্ত ছিল এবং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের হত্যার অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অপরাধে তারা দোষী। Constructive liability-র নীতির উপর ভিত্তি করে তাদের অপরাধ প্রমাণ করা যায়। কেননা তারা সকলের অভিন্ন অভিপ্রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হত্যাকাণ্ডটিতে অংশ নিয়েছিল। স্বীকত মতে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না। ঘটনার সময় রেডিও স্টেশনে নিয়ােজিত ছিল। উপরে বর্ণিত মতে, তার দায়িত্বও ছিল বেতার মাধ্যমে কেউ যদি কোনাে সাহায্য চেয়ে কোনাে বার্তা দিতে চায় তবে তাকে প্রতিরােধ করা। এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছে, তার কাজটি পেনাল কোডের ৩৪ ধারাকে আকৃষ্ট করবে কি না। কেননা ঘটনাস্থলে শারীরিকভাবে তার উপস্থিতি ছিল না। হাইকোর্ট ডিভিশনের বিজ্ঞ বিচারকগণ এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, অন্য আসামিদের সাথে তাদেরও সাধারণ অভিপ্রায় ছিল, যদিও তার অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ ছিল না। এটি ছিল পরােক্ষ এবং এই পরােক্ষ অংশগ্রহণও ৩৪ ধারাকে আকৃষ্ট করেছে। প্রথম বিজ্ঞ বিচারক পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন যে, “তাছাড়া নৈশ কুচকাওয়াজ এবং রেডিও স্টেশনে উপস্থিত থাকাটা ছিল উক্ত ঐকমত্যের অংশ, যে ঐকমত্যটি রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবনে ঘটনাটি সংঘটনের উদ্দেশ্যে অন্যান্য সহ-আসামিকে নিয়ে করা হয়। আনুমানিক ভাের ৪.৩০/৫.০০টার দিকে বেতার কেন্দ্রে তার উপস্থিতির বিষয়টি দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারকও লক্ষ করেছেন। এবং একই মতামত ব্যক্ত করেছেন। বিজ্ঞ বিচারকগণ সিদ্ধান্তে আসতে গিয়ে Barendra Kumar Ghose
৭১২

vs Emperor, AIR 1925 PC 1, Shocekantiah Ramayya Muni Palli, vs State of Bombay AIR 1955 SC 287, Takaram Gonapat vs State of Maharashtra AIR 1974 SC 514, Ramaswami vs State of TN, AIR 1976 SC 2027, Abdur Rahman Mandol vs State, 29 DLR (SC) 247, Bangladesh vs Abed Ali, 36 DLR (AD) 234, Abdus Samad @AKM Abdus Samad vs State 44 DLR (AD) 233 এবং Stateos Tajul Islam 48 DLR 305 মামলাগুলাে বিবেচনা করেছিলেন।
৭৫৭. উপরে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ৩৪ ধারাটির সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অপরাধমূলক কাজে অংশগ্রহণ। এইরূপ অংশগ্রহণ সর্বক্ষেত্রেই শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকার মাধ্যমে হতে হবে তা নয়। অভিন্ন অভিপ্রায় বলতে একযােগে কাজ করাকে বােঝায়। এই ধারার অধীনে একটি অপরাধমূলক কাজ সংঘটনের জন্য সকলের অভিন্ন অভিপ্রায় থাকতে হবে। যারা এ অভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সহযােগিতা করবে, তারা সকলে সমভাবে দায়ী হবে। সুতরাং, অভিন্ন অভিপ্রায় হলাে একটি অপরাধ সংঘটনের জন্য, যা সংঘটিত হয়েছে, একটি অভিপ্রায় এবং প্রত্যেক আসামির এরূপ অভিপ্রায়ে অংশগ্রহণ থাকতে হবে। বরেন্দ্র কুমার ঘােষ মামলায়, প্রিভি কাউন্সিলের লর্ডশিপস ধারাটিতে বর্ণিত নীতিগুলাে। স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ঐ মামলাটিতে তিনজন ব্যক্তি একজন ডাকপিয়নকে গুলি করেছিল। এদের মধ্যে একজন ছিল আপিলকারী বরেন্দ্র কুমার। সে স্বতন্ত্র পােশাক পরেছিল, যার মাধ্যমে তাকে শনাক্ত করা গিয়েছিল। অন্য অপরাধীরা ঘরের ভিতরে ছিল এবং আরাে একজন ব্যক্তি অন্যদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, যা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল। এ ব্যক্তি অন্যদের নিকটে দাঁড়িয়ে থাকলেও সে ছিল উঠানের ঠিক দ্বারপ্রান্তে। এ ব্যক্তি অস্ত্রে সজ্জিত ছিল, কিন্তু সে গুলি করেনি। বরেন্দ্রর ডিফেন্স কেস ছিল এই যে, সে ঘরের বাইরে ছিল, উঠানে দাঁড়িয়ে ছিল এবং অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত ছিল। এই পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যে, সে গুলিবর্ষণকারী দলের একজন হিসেবে উপস্থিত ছিল, নাকি সে এর কমান্ডার ছিল বা পাহারাদার বা রক্ষাকর্তা ছিল, এর কোনাে বিশেষ গুরুত্ব এ মামলাটিতে নেই। সে কেনই-বা ঘটনাস্থলে ছিল এবং কেন সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়নি, এ বিষয়ে সে কিছু বলেনি; এমনকি সে উঠানে তার সঠিক অবস্থানটিও তুলে ধরেনি। মাননীয় বিচারপতিগণ তার দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখতে গিয়ে নিম্নবর্ণিতভাবে ৩৪ ধারার পরিধি ব্যাখ্যা করেছেন :
“By section 33 a criminal act in section 34 includes a series of acts and, further act includes omission to act, for example, an omission to interfere in order to prevent a murder being done before one’s very eyes. By section 37, when any offense is committed by means of several acts whoever intentionally cooperates in the commission of that offense by doing any one of those acts, either singly or jointly with any other person, commits that offense. Even if the appellant did nothing as he stood outside the door, it is to be remembered that in crimes as in other things “they also serve who only stand and wait.” By section 38 when several persons are engaged or concerned in the commission of a criminal act, they may be guilty of different offenses by means of that act. Read together, these sections are reasonably plain. Section 34 deals with the doing of separate acts, similar or diverse, by several persons; if all are done in furtherance of a common intention, each person is liable for the result of them all, as if he had done them himself for “that act” and “the act” in the latter part
৭১৩

of the section must include the whole action covered by “a criminal act” in the first part, because they refer to it.”
৭৫৮. সুতরাং, ৩৪ ধারাটির মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অপরাধে অংশগ্রহণের উপাদান, এরূপ অংশগ্রহণ সকল মামলার ক্ষেত্রে শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে হতে হবে এমনটা নয়। Jai Krishna Das Monohardas Besi vs State of Bombay, AIR 1960 SC 889 মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট যে মামলাগুলোতে অপরাধীর ঘটনাস্থলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকা অপরিহার্য এবং যে মামলাগুলােতে এরূপ উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তা নেই, বরং অনুরূপ বা পৃথক কাজের মাধ্যমে অপরাধে অংশগ্রহণই তাকে ধারাটির আওতাধীন করবে, সেই মামলাগুলাের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছে :
“But the essence of liability under section 34 is to be found in the existence of a common intention animating the offenders leading to the doing of a criminal act in furtherance of the common intention and presence of the offender sought to be rendered liable under section 34 is not, on the words of the statute, one of the conditions of its applicability. As explained by Lord Summer in Barendra Kumar Ghose vs. Emperor, 52 In App 40 atp.52 (AIR 1925 PC 1 at p.7), the leading feature of section 34 of the Indian Penal Code is ‘participation in action’. To establish joint responsibility for an offence, it must of course be established that a criminal act was done by several persons; the participation must be in doing the act, not merely in its planning. A common intention- a meeting of minds- to commit an offence and participation in the commission of the offence in furtherance of that common intention invites the application of section 34. But this participation need not in all cases be by physical presence. In offences involving physical violence, normally presence at the scene of offence of the offenders sought to be rendered liable on the principle of joint liability may be necessary, but such is not the case in respect of other offences where the offence consists of diverse acts which may be done at different times and places.” (emphasis added)
৭৫৯. এই মতগুলো Ramaswami Ayyangar’s (AIR 1976 SC 2027)মামলাতেও নিম্নবর্ণিতভাবে অনুমােদিত হয়েছে :
The contention is fallacious and cannot be accepted. Section 34 is to be read along with the preceding section 33 which makes it clear that the “act” spoken of in section 34 includes a series of acts as a single act. It follows that the words “when a criminal act is done by several persons” in section 34, may be construed to mean “when criminal acts are done by several persons.” The acts committed by different confederates in the criminal action may be different but all must in one way or the other participate and engage in the criminal
৭১৪

enterprise, for instance, one may only stand guard to prevent any person coming to the relief of the victim or to otherwise facilitate the execution of the common design. Such a person also commits an “act” as much as his co-participants actually committing the planned crime. In the case of an offense involving physical violence, however, it is essential for the application of section 34 that the person who instigates or aids the commission of the crime must be physically present at the actual commission of the crime for the purpose of facilitating or prompting the offense, the commission of which is the aim of the joint criminal venture. Such presence of those who in one way or the other facilitate the execution of the common design, is itself tantamount to actual participation in the ‘criminal act.’ The essence of section 34 is simultaneous consensus of the minds of persons participating in the criminal action to bring about a particular result. Such consensus can be developed at the spot and thereby intended by all of them.” (emphasis added)
৭৬০. Shocekantiah Ramayya Munipalli vs State of Bombay (AIR 1955 SC 287) মামলায় নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল :
“The essence of section 34 that the person must be physically present at the scene of occurrence coupled with actual participation which, of course can be of a passive character such as standing by a door, provided that is done with the intention of consisting in furtherance of common intention of them all and there is a readiness to play his part in the prearranged plan when the time comes for him to act.” (emphasis given)
৭৬১. পাচ সদস্যবিশিষ্ট এই কোর্টের বেঞ্চটিও Abdur Rahman Mondal’s [29 DLR (SC) 247] মামলায়
একই মতামত প্রদান করেছিল, যা নিম্নরূপ :
“The common intention to bring about a particular result may well develop on the spot as between a number of persons. All that is necessary is either to have direct proof of prior concert or proof of circumstances which necessarily lead to that inference or the incriminating acts must be incompatible with the innocence of the accused and incapable of explanation on any other reasonable hypothesis. Further, it is the essence of section 34 that the person must be physically present at the actual commission of the crime.” (emphasis added)
৭৬২. বিজ্ঞ দ্বিতীয় বিচারক Rasool Bux vs State 22 DLR (SC) 297 মামলাটিও বিবেচনা করেছিলেন। এ মামলায় বরেন্দ্র ঘােষ মামলাটিতে গৃহীত মতামত অনুমােদিত হয়েছে। ঐ মামলাটিতে আসামি লাল বক্স এবং রসুল বক্স, প্রয়ােজনে বলপ্রয়ােগ করে, মােসাম্মত রােশনাকে তার পিতার বাড়ি থেকে অপহরণের পরিকল্পনা করেছিল। তাদের দুজনই মারাত্মক অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। যখন উঠানে তাদের উপস্থিতি পাওয়া
৭১৫

যায় তখন তারা তাদের মূল পরিকল্পনাটি পরিত্যাগ করে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, প্রয়ােজনে তাদের সাথে থাকা অস্ত্র ব্যবহার করে হলেও। এবং এ উদ্দেশ্যে তাদের বহনকৃত অস্ত্রগুলাে ব্যবহার করতেও প্রস্তুত ছিল।
৭৬৩. এ মামলার ঘটনাগুলাে বিবেচনা করে সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি (H Rahman, CJ) তাঁর নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন :
“There is no doubt that to bring a case within the ambit of section 34, PPC it is necessary that some overt act or acts must be established to lead to the inference that the participators in the crime acted in pre-concert or under some prearranged plan but this does not mean that every participant in the crime must be shown to have committed the same kind of act. It is sufficient to show that they joined together in the commission of a particular act, for then they must all be deemed to have intended the natural and inevitable consequences of that act even if some of them did nothing but merely helped by their presence the commission of the act.” (emphasis added)
৭৬৪. Tajul Islam (48 DLR 305) মামলায় ডিভিশন অভিযােগের সমর্থনে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক উপস্থাপিত সাক্ষ্য থেকে পেয়েছেন যে, বাদশা তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছিল যে, সে বিরজা রানীর দ্বিতীয় পুত্রের পা চেপে ধরেছিল এবং আসামি ইনু তাকে দা দিয়ে কেটে দু ভাগে ভাগ করেছিল। দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী অন্যরা বলেছিল যে, অপরাধটি (হত্যাকাণ্ড) সংঘটনের উদ্দেশ্যে তারা বিরজার বাসায় গিয়েছিল এবং হয় নৌকায়, নতুবা বিরজার প্রতিবেশীদের দরজার সামনে, নতুবা বিরজার বাসার দিকে যে রাস্তাটি গিয়েছে সেখানে পাহারায় ছিল, অনুমান করা যায় যদি কেউ অপরাধ
সংঘটনে বাধা দিতে আসে তবে তাকে প্রতিরােধ করার জন্য। ৭৬৫. মামলার ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন :
“In an offense involving physical violence, normally presence at the scene of the occurrence of the offender sought to be rendered liable on the principle of joint liability is necessary such is not the case in respect of other offenses where offense consists of adverse acts which may be done at different time and place.”
৭৬৬. সুতরাং, প্রিভি কাউন্সিল থেকে ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতগুলাে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এটাই ব্যক্ত করেছে যে, শারীরিক সহিংসতা জড়িত রয়েছে এমন অপরাধগুলাের ক্ষেত্রে ৩৪ ধারাটি আকৃষ্ট করতে হলে অপরাধীকে অবশ্যই অপরাধটি সংঘটনে সহযােগিতার জন্য ঘটনাস্থলে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হবে। অপরাধী যদি কিছু না-ও করে, কিন্তু শুধু উপস্থিত থেকে অপরাধটির সংঘটনে সহযােগিতা করে, তাহলেও তাকে যৌথ দায়বদ্ধতার নীতির উপর ভিত্তি করে দায়ী করা হবে। অপরাধটিকে এই ধারার আওতায় আনতে হলে এটি দেখাতে হবে যে, অপরাধমূলক কাজে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের একটি নির্দিষ্ট পরিণতি পাওয়ার জন্য মানসিক ঐকমত্য ছিল এবং এইরূপ ঐকমত্য ঘটনাস্থলেও সৃষ্টি হতে পারে।
৭১৬

৭৬৭. Noor Md Yusuf Momin vs State of Maharastra, AIR 1971 SC 885 মামলাটি বিচারিক
আদালত মােঃ ত্বকী হাজী হুসেইন মােমিনকে ৩০২ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করেন এবং আপিলকারীসহ তিনজন আসামিকে খালাস প্রদান করেন। খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে বােম্বে হাইকোর্ট খালাসের আদেশটি বাতিল করেন এবং আপিলকারী ও অন্য দুই আসামিকে ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০বি এবং ৩০২ ধারার সাথে পঠিতব্য ৩৪ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করেন। আপিলকারীকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২/১০৯ ধারার অধীনেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং পৃথকভাবে দুটি অভিযােগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাস্থলে আপিলকারীর শারীরিক উপস্থিতির কোনাে প্রশ্নাতীত সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকায়, সুপ্রীম কোর্ট তাকে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাধারণ অভিপ্রায় শেয়ার করার বিষয়ে সন্দেহের সুবিধা (benefit of doubt) প্রদান করেন এবং নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করে ৩০২/৩৪ ধারার অধীন অভিযােগ থেকে তাকে খালাস প্রদান করেন :
“From the evidence it seems highly probable that at the time of the actual murder of Mohd. Yahiya the appellant was either present with other three co-accused or was somewhere nearby. But this evidence does not seem to be enough to prove beyond reasonable doubt his presence at the spot in the company of the other accused when the murder was actually committed… we are, therefore, inclined to give to the appellant the benefit of doubt in regard to the charge under section 302 read with section 34, IPC.”
৭৬৮. আমি এ বিষয়টির উপর আর কোনাে সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করছি না। উপরে উল্লিখিত পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী একাধিক ব্যক্তি একই সাথে একজন ব্যক্তিকে আঘাত করতে পারে এবং তাদের প্রত্যেকের একই উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যেমন, হত্যা করার উদ্দেশ্যে তারা প্রত্যেকে পৃথক পৃথকভাবে মারাত্মক আঘাত হানতে পারে এবং তবু তাদের কাউকে যে কোনাে একজনের কাজের জন্য প্রতিনিধিত্বমূলক দায়বদ্ধতার (vicarious liability) উপর ভিত্তি করে দায়ী করা হবে না। একই বা অনুরূপ অভিপ্রায়কে সাধারণ অভিপ্রায়ের সাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। একইভাবে, এটি মনে রাখতে হবে যে, শারীরিক সহিংসতার কোনাে অপরাধের জন্য কোনাে ব্যক্তিকে প্রতিনিধিত্বমূলক দায়বদ্ধতার নীতির উপর ভিত্তি করে দায়ী করতে হলে ঘটনাস্থলে তার শারীরিক উপস্থিতি দেখাতে হবে। কারণ অভিন্ন অভিপ্রায়ের সারমর্মই হচ্ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নে ঐকমত্য থাকতে হবে।
৭৬৯. শারীরিক সহিংসতা জড়িত নেই- এমন অপরাধের ক্ষেত্রে ৩৪ ধারার প্রয়ােগ সম্পর্কে Tukaran Ganput
(AIR 1974 SC 514) মামলায় ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। আপিলকারী তুকারাম গণপতসহ অন্যান্য আসামির বিরুদ্ধে মামলা ছিল যে, তারা একটি কোম্পানির গুদাম থেকে গুদামের দরজা ভেঙ্গে কয়েক বান্ডিল কপার তার চুরি করে এবং একটি লরিযােগে তারগুলাে সরিয়ে নেয় যা একটি ওয়েট-বিজে এসে থেমেছিল, যেখানে বিক্রয়ের জন্য দালালেরা উপস্থিত ছিল। ঘটনাস্থলে আপিলকারীর উপস্থিতির কোনাে সাক্ষ্য-প্রমাণ ছিল না। নিমের আদালতগুলাের এই সমান্তরাল সিদ্ধান্ত ছিল যে, যে গুদাম থেকে চুরি হয়েছিল সেই গুদামঘরের নকল চাবিগুলাে কারখানা থেকে হারিয়ে গিয়েছিল এবং তা আপিলকারীর দখলে পাওয়া গিয়েছিল; আপিলকারী ওয়েট-ব্রিজে উপস্থিত ছিল। আপিলকারী কেন তার দখলে নকল চাবি ছিল, কেনইবা সে ওয়েট-ব্রিজে ছিল- এ বিষয়ে কোনাে ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারেনি। এই ঘটনার
৭১৭

পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রীম কোর্ট সাধারণ অভিপ্রায়ের নীতির উপর ভিত্তি করে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করে আপিলকারীর দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখেছেন :
“Mere distance from the scene of crime cannot exclude culpability under section 34 which lays down the rule of joint responsibility for a criminal act performed by a plurality of persons. In Barendra Kumar Ghosh vs. King Emperor (1924) 52 IA 40=(AIR 1925 PC 1) the Judicial Committee drew into the criminal net those ‘who only stand and wait.’ This does not mean that some form of presence, near or remote, is not necessary, or that mere presence without more, at the spot of crime, spells culpability. Criminal sharing, overt or covert by active presence or by distant direction, making out a certain measure of jointness in the commission of the act is the essence of section 34. Even assuming that presence at the scene is a prerequisite to attract section 34 and that such propinquity is absent, section 107 which is different in one sense, still comes into play to rope in the accused. The act here is not picking the godown lock but housebreaking and criminal house trespass. This crime is participated in by those operating by remote control as by those doing physical removal. Together operating in concert, the criminal project is executed. Those who supply the duplicate key, wait at the weighbridge for the break-in and bringing of the booty and later secrete the keys are particeps criminis. And this is the role of accused No. 2 according to the Courts below. Could this legal inference be called altogether untenable?”
৭৭০. যৌথ দায়বদ্ধতার নীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সুপ্রীম কোর্ট এই পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন যে, অপরাধ সংঘটনস্থল থেকে নিছক দূরত্বে থাকা, একটি অপরাধমূলক কাজ সংঘটনের ক্ষেত্রে আসামিদের পেনাল কোডের ৩৪ ধারার অধীনে দোষ থেকে অব্যাহতি দেয় না, যা একটি অপরাধমূলক কাজ সংঘটনের ক্ষেত্রে আসামিদের যৌথ অভিপ্রায় নিয়ে আলােচনা করে। বিজ্ঞ বিচারকবৃন্দ এই সিদ্ধান্তের পক্ষের যুক্তিগুলাে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং বর্তমান মামলায় এটিকে প্রয়ােগ করেছেন, যদিও বর্তমান মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতির বিবেচনায় এটি প্রযােজ্য নয়। হাইকোর্ট ডিভিশন আইনের যে নীতি বর্ণনা ও বিবেচনা করেছেন সেটি নিয়ে আমার বিরােধ নাই এবং এগুলাে প্রতিষ্ঠিত নীতি। আসামিকে পেনাল কোডের ৩৪ ধারার আওতাধীন আনতে হলে প্রসিকিউশনকে ঘটনাস্থলে আসামির শারীরিক উপস্থিতি প্রমাণ করতে হবে। কেননা শারীরিক সহিংসতা জড়িত রয়েছে এমন অপরাধ সংঘটনের সাধারণ অভিপ্রায় ঘটনাস্থলেই গড়ে ওঠে। এমনকি এটা যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ৩৪ ধারাটি লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়, তবে এটা তাকে খুব সামান্যই সাহায্য করবে। কেননা যে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রটি করা হয়েছিল সেটির উদ্দেশ্য সাধনকল্পে তার অংশগ্রহণ প্রসিকিউশন কর্তৃক প্রমাণিত হয়েছে।
৭৭১. ১২০ক ধারায় সংজ্ঞায়িত ষড়যন্ত্র এবং ৩৪ ধারার অধীনে সাধারণ অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করার মধ্যে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য পার্থক্য নেই। পূর্বটির ক্ষেত্রে অপরাধের সারমর্ম হচ্ছে আইন লঙ্ঘনের একটি
৭১৮

দৃশ্যমান ঐকমত্য থাকতে হবে, সাধারণ অভিপ্রায় অনুযায়ী কোনাে অবৈধ কাজ সংঘটিত না হলেও। অন্যদিকে, ৩৪ ধারার অধীন অপরাধটির মূল উপাদান হচ্ছে সব অপরাধীর সাধারণ অভিপ্রায় অর্জনের লক্ষ্যে একটি অপরাধমূলক কাজ সংঘটন করার ইচ্ছা, যেখানে অপরাধমূলক আচরণের অভিন্নতা থাকতে হবে এবং তা এমন একটি ঘটনার জন্ম দেবে যার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তি এমনভাবে দায়ী হবে যেন সে একাই অপরাধটি সংঘটন করেছে। যখন একটি হত্যাকাণ্ড সংঘটনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়, তখন ৩৪ ধারার সাহায্য নিয়ে কোনাে দোষী সাব্যস্তকরণের প্রয়ােজনীয়তা নেই। কেননা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন অভিপ্রায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেই অভিন্ন অভিপ্রায়টি সাধনকল্পে যা কিছু বলা হয়, করা হয় বা লেখা হয়, তখন এগুলাের সব কিছুই অন্য সব আসামির বিরুদ্ধে প্রাসঙ্গিক হবে। যখন প্রত্যেক আসামি কর্তৃক সুনির্দিষ্ট কাজগুলাে সম্পাদিত হয়, যা তাদের অভিন্ন। অভিপ্রায়কে প্রমাণিত করে, তখন এ কাজগুলাে প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে গ্রহণযােগ্য হবে। যদিও একজন আসামির কোনাে কাজ বা আচরণ, অন্য একজন আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না, কিন্তু এই নীতিটির একটি ব্যতিক্রম এভিডেন্স অ্যাক্টের ১০ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, যা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। যদি এরূপ বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি থাকে যে, পেনাল কোডের ১২০ক ধারা অনুযায়ী দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একত্রে একটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাহলে আসামিদের একজন দ্বারা কৃত কর্মের প্রমাণ অন্য সব আসামির বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে।
৭৭২. ১২০ক ধারা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে। এই ধারায় বিধৃত রয়েছে যে, দুই বা ততােধিক ব্যক্তি যদি কোনাে অপরাধমূলক কাজ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করে, তাহলে সেই ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কোনাে ওভার্ট অ্যাক্ট না থাকলেও, ষড়যন্ত্রটি নিজেই একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। দ্বিতীয় অংশটিতে বেআইনি কাজ বা বেআইনি নয় এমন একটি কাজ বেআইনি উপায়ে করার ষড়যন্ত্র নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে। তবে এইরূপ ষড়যন্ত্র কোনােভাবেই অপরাধে সহায়তার বা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অপরাধ সৃষ্টি করবে না, যদি না ষড়যন্ত্রের ঐকমত্যটি ছাড়াও আরাে কিছু কাজ ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে করা হয়। সুতরাং, এটি পরিষ্কার যে ১২০ক ধারাটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের একটি সম্প্রসারিত সংজ্ঞা প্রদান করে, যার মাধ্যমে যে কাজগুলাে ১০৭ ধারার অধীনে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সহায়তা হিসেবে বিবেচিত হবে না | সেগুলােকেও অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। পেনাল কোডে এইরূপ ষড়যন্ত্রের শাস্তির কোনাে সুস্পষ্ট বিধানের উল্লেখ না থাকলেও ১২০বি ধারাটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের শাস্তির বিষয় বিধৃত করেছে।
৭৭৩. অপরাধ সংঘটনের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণে সহায়তার ক্ষেত্রে যে শাস্তি সেই একই শাস্তি আরােপের বিধান ১২০বি ধারার উপধারা (১)-এ রাখা হয়েছে। এই ধারাটি অপরাধ সংঘটনে সহায়তার অপরাধটি সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে ১০৭ ধারার যে সীমাবদ্ধতা সেটিকে পূরণ করার জন্যই প্রণীত হয়েছে। ১০৭ ধারাটি দ্বিতীয়ত’ এটি বিধৃত করেছে যে, কোনাে ব্যক্তি কোনাে কাজে সহায়তা দান করেছে বলে বিবেচিত হবে, যদি সেই ব্যক্তি এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে কাজটি সম্পাদনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং সেই ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কোনাে কাজ বা বেআইনি বিচ্যুতি সংঘটিত হয়। কোনাে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা প্রদান ক্ষেত্র মতে ১০৯ এবং ১১৬ ধারার অধীনে শাস্তিযােগ্য, অপরাধটি যদি সংঘটিত না হয়; কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, কোনাে ষড়যন্ত্র অ্যাবেটমেন্ট হিসেবে পরিগণিত হবে না যদি কোনাে কাজ বা অবৈধ বিচ্যুতি ষড়যন্ত্র অনুসারে না হয়ে থাকে। সুতরাং, ১২০বি ধারাটি প্রথমত যে শ্রেণির মামলাগুলােকে অন্তর্ভুক্ত করে তা হলাে যেখানে একটি গুরুতর অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, কিন্তু ষড়যন্ত্র। অনুযায়ী কোনাে কাজ বা অবৈধ বিচ্যুতি সংঘটিত হয়নি। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় যে, ১০৭ ধারার দ্বিতীয় অংশের অধীনে বর্ণিত সহায়তার অপরাধ এবং ১২০ক ধারার অধীনে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অপরাধের
৭১৯

মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যটি হচ্ছে, প্রথমটির ক্ষেত্রে কতিপয় ব্যক্তির একত্র হওয়া অথবা তাদের মধ্যকার একটি ঐকমত্যই যথেষ্ট নয়। ষড়যন্ত্র অনুসারে এবং যে কাজের জন্য ষড়যন্ত্র করা হয়েছে তা করার জন্য কোনাে কাজ বা অবৈধ বিচ্যুতি সংঘটিত হতে হবে। অপরদিকে পরবর্তী অপরাধটির ক্ষেত্রে নিছক ঐকমত্যই যথেষ্ট, যদি ঐকমত্যটি একটি অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। যদি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র অনুযায়ী ষড়যন্ত্রকারীগণ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটন করে, তাহলে তাদের মধ্যে কেউ কেউ এ অপরাধগুলােতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ না নিলেও, সব ষড়যন্ত্রকারীই এ অপরাধগুলাের জন্য সমভাবে দায়ী হবে। এটা প্রমাণ করাটা আবশ্যক নয় যে, প্রত্যেক ব্যক্তি যারা ষড়যন্ত্রটির পক্ষ, তাদের প্রত্যেকেকেই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যটি সাধনকল্পে কোনাে প্রকাশ্য কাজ করতে হবে। যা প্রয়ােজনীয় উপাদান তা হলাে ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে অপরাধ সংঘটনের একটি ঐকমত্য। যেহেতু, প্রকৃতিগতভাবেই ষড়যন্ত্র গােপনে রচিত হয়, সেহেতু এরূপ অপরাধের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় না এবং এ কারণে বেশির ভাগ মামলায় বিদ্যমান পারিপার্শ্বিক বা অবস্থাগত সাক্ষ্য থেকে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সংঘটন সম্পর্কে বৈধ অনুমান গ্রহণ করা যায়।
৭৭৪. Noor Md Yusuf Momin (Supra) মামলাটিতে ৩৪, ১০৭ এবং ১২০বি ধারাগুলাের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলাে আলােচনা করা হয়েছে। এটি বলা হয়েছে যে, পেনাল কোডের ৩৪ ধারাটি অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে যৌথ দায়বদ্ধতা (joint liability) ব্যাখ্যা করেছে। এখানে কোনাে অপরাধমূলক কাজের জন্য যৌথ দায়বদ্ধতার নীতি বিধৃত করা হয়েছে। এইরূপ দায়বদ্ধতার মূল বিষয় হচ্ছে একটি সাধারণ অভিপ্রায়ের অস্তিত্ব। অভিন্ন অভিপ্রায় বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি অপরাধ সংঘটনে অংশ নেওয়া হলে তখন এ ধারাটি প্রযােজ্য হয়। অপরদিকে, যদি অপরাধে সহায়তাকারী যে অপরাধটি সংঘটনে সহায়তা করে, সেটির সংঘটনের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত না-ও থাকে, কিন্তু অপরাধটির সংঘটনে প্ররােচনা দেয়, অথবা এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে মিলিত হয়ে অপরাধটি সংঘটনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এবং সেই ষড়যন্ত্র অনুযায়ী কোনাে কাজ বা অবৈধ বিচ্যুতি সংঘটিত হয়, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে সে কোনাে কাজ করে কিংবা বেআইনিভাবে কোনাে কাজ করা থেকে বিরত থেকে অপরাধটির সংঘটনে সহযােগিতা করে, সেক্ষেত্রে তা পেনাল কোডের ১২০বি ধারার অধীনে অভিযােগ হবে। ১৯১৩ সালে পেনাল কোডে ৫-ক অধ্যায়টি যুক্ত করার মাধ্যমে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রকে একটি স্বতন্ত্র অপরাধে পরিণত করা হয়েছিল। বিচারপতি আইডি ভুয়া (ID Dua, J) সুপ্রীম কোর্টের হয়ে নিম্নবর্ণিত পর্যবেক্ষণ প্রদান করেছেন :
“Criminal conspiracy postulates an agreement between two or more persons to do, or cause to be done, an illegal act or an act which is not illegal, by illegal means. It differs from other offenses in that mere agreement is made an offense even if no step is taken to carry out that agreement. Though there is close association of conspiracy with incitement and abetment the substantive offense of criminal conspiracy is somewhat wider in amplitude than abetment by conspiracy as contemplated its very nature is generally hatched in secret. It is, therefore, extremely rare that direct evidence in proof of conspiracy can be forthcoming from wholly disinterested quarters or from utter strangers. But, like other offenses, criminal conspiracy can be proved by circumstantial evidence. Indeed, in most cases proof of conspiracy is largely inferential though the inference must be founded on solid facts. Surrounding
৭২০

circumstances and antecedent and subsequent conduct, among other factors, constitute relevant material. In fact, because of the difficulties in having direct evidence of criminal conspiracy, once reasonable ground is shown for believing that two or more persons have conspired to commit an offense then anything, done by anyone of them in reference to their common intention after the same is entertained becomes, according to the law of evidence, relevant for proving both conspiracy and the offenses committed pursuant thereto.”
৭৭৫. যে অপরাধটি সংঘটনের জন্য ষড়যন্ত্রটি করা হয়েছিল সেটি সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পরও আসামিকে ষড়যন্ত্রের অভিযােগে পৃথকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে কী না এ বিষয়ে জনাব আবদুর রাজ্জাক খান প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। IR 1961 SC 1241-9 patrocinio State of Andhra Pradesh vs Kandinalla Subbaiah মামলাটির বিবেচ্য বিষয় ছিল- সহায়তার (abetment) পরিণতিতে সংঘটিত কোনাে অপরাধ যখন ষড়যন্ত্র অনুসারে সংঘটিত হয়ে থাকে, তখন ষড়যন্ত্রে সহায়তাকারীকে প্রকৃত বা মূল অপরাধটির জন্য বিধৃত শাস্তি প্রদান করা যাবে কী না। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট নিম্নবর্ণিতভাবে এ বিষয়টি নিয়ে যুক্তি প্রদান করেছেন :
“Conspiracy to commit an offense is itself an offense and a person can be separately charged with respect to such a conspiracy. There is no analogy between section 120B and section 109 IPC. There may be an element of abetment in a conspiracy; but conspiracy is something more than an abetment. Offenses created by sections 109 and 120B, IPC are quite distinct and there is no warrant for limiting the prosecution to only one element of conspiracy, that is, abetment when the allegation is that what a person did was something over and above that. Where a number of offenses are committed by several persons in pursuance of a conspiracy it is usual to charge them with those offenses as well as with the offense of conspiracy to commit those offenses. ”
৭৭৬. AIR 1963 SC 1850-্রএ প্রতিবেদিত State of Andhra Pradesh vs Cheemalapati Ganeswara Rao মামলাটিতে একই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। এটা বলা হয়েছিল যে, ষড়যন্ত্রের অপরাধটি একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অপরাধ এবং ষড়যন্ত্র অনুযায়ী অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হলেও, ষড়যন্ত্রের জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের দায়বদ্ধতার বিষয়টি অপসৃত হতে পারে না। প্রণীত মূল পেনাল কোডে ‘ষড়যন্ত্র কোনাে অপরাধ ছিল না। ১২০বি ধারাটি, যা অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রকে শাস্তিযােগ্য করেছে, তা ১২০ক ধারাটির সাথে ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯১৩ (১৯১৩ সালের ৮ নম্বর আইন)-এর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছিল। ১২০ক ধারাটি ষড়যন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং ১২০বি ধারাটি ষড়যন্ত্রের শাস্তির বিধান বিধৃত করেছে।
৭৭৭. ১২০ক ধারায় সংজ্ঞায়িত অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র কোনাে অবৈধ কাজ বা অবৈধ নয় এমন একটি কাজ অবৈধ উপায়ে করার ঐকমত্য নিয়ে আলােচনা করে। ১২০বি ধারামতে, যে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বা দুই বছর বা তার অধিক মেয়াদের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত একটি অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্রের অংশীদার, সে একইভাবে দণ্ডিত হবে যেন সে ঐ অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেছে, যদি না ঐরূপ
৭২১

ষড়যন্ত্রের জন্য শাস্তির সুস্পষ্ট বিধান পেনাল কোডে বিধৃত থাকে। বিচারপতি জে আর মধুকর (J R Mudholkar, J) সুপ্রীম কোর্টের হয়ে নিম্নবর্ণিত যুক্তি প্রদান করেছেন :
“Criminal conspiracy was, however, not an unknown thing before the amendment of the Indian Penal Code in 1913. But what the amendment did was to make that conspiracy itself punishable. The idea was to prevent the commission of crimes by, so to speak, nipping them in the bud. But it does not follow that where crimes have been committed the liability to punishment already incurred under section 120B by having entered into a criminal conspiracy is thereby wiped away. No doubt, as already stated, where offenses for committing which a conspiracy was entered into have actually been committed it may not, in the particular circumstances of a case, be desirable to charge the offender both with the conspiracy and the offenses committed in pursuance of that conspiracy. But that would be a matter ultimately within the discretion of the Court before which the trial takes place.”
৭৭৮. AIR 1994 SC 2420-এ প্রতিবেদিত Suresh Chandra Bahri os Gurbachan Singh মামলাটিতে সুরেশ বহরি বচন এবং রাজপাল শর্মাকে পেনাল কোডের ৩০২ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল; অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র অনুযায়ী তিনজন ব্যক্তিকে হত্যার জন্য তাদেরকে ৩০২/১২০বি ধারার অধীনেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুজনকে ২০১ ধারায় অধীন সাক্ষ্য-প্রমাণ বিলােপ সাধনের অপরাধেও দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। পাটনা হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি বহাল রেখেছিলেন। সুপ্রীম কোর্টে যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছিল যে, ষড়যন্ত্রটিতে গুরবচন এবং রাজপালের ষড়যন্ত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতার কোনাে প্রত্যক্ষ ও আইনগত প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং গুরবচনের বিরুদ্ধে অপরাধে অংশগ্রহণের কোনাে প্রমাণ নেই। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, পরিস্থিতি বা অবস্থাগত সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে ৩০২/১২০বি ধারার অধীনে আসামির দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রাখার সময় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের জন্য এরূপ দোষী সাব্যস্তকরণ করা যাবে কী না, সুপ্রীম কোর্ট তা বিবেচনা করেছেন। এটা বলা হয় যে, পেনাল কোডের ১২০ক ধারাটি অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করে। এই ধারামতে, যদি দুই বা ততােধিক ব্যক্তি (১) একটি বেআইনি কাজ কিংবা (২) যে কাজটি বেআইনি নয় এমন একটি কাজ বেআইনি উপায়ে করার জন্য অথবা কাজটি যাতে সম্পন্ন হয় সেজন্য সম্মত বা একমত হয়, তাহলে অনুরূপ সম্মতি বা ঐকমত্যকে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বলে। তবে শর্ত থাকে যে, একটি অপরাধ সংঘটনের ঐকমত্য বা সম্মতি ব্যতীত অন্য কোনাে ঐকমত্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বলে বিবেচিত হবে না, যদি না ঐরূপ ঐকমত্য ছাড়া কোনাে কাজ ঐরূপ ঐকমত্যের এক বা একাধিক অংশীদার কর্তৃক সম্পন্ন হয়। সুতরাং, ১২০বি ধারাটিতে দ্রুত চোখ বুলালে দেখা যায় যে, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র বলতে এমন একটি ঐকমত্যকে বােঝায় যার মাধ্যমে দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটি অবৈধ কাজ বা অবৈধ নয় এমন একটি কাজ অবৈধ উপায়ে করতে সম্মত হয়। অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অপরাধটির মূল উপাদান হচ্ছে একটি অপরাধ সংঘটনের ঐকমত্য। যেখানে ঐকমত্যটি এমন একটি কাজ সংঘটনের উদ্দেশ্যে করা হয়, যা নিজেই একটি অপরাধ। সেক্ষেত্রে প্রসিকিউশন কর্তৃক ওভার্ট অ্যাক্ট প্রমাণ করার প্রয়ােজনীয়তা নেই। কেননা এরূপ পরিস্থিতিতে ঐরূপ ঐকমত্যের বিষয়টি প্রমাণ করলেই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত
৭২২

হয়ে যায়। অন্য কথায়, পেনাল কোডের ১২০বি এবং ১২০ক(২) ধারার অধীন যে ষড়যন্ত্রের অভিযােগ করা হয়েছে তা যদি কোনাে গুরুতর অপরাধ সংঘটনের উদ্দেশ্যে করা হয়, সেক্ষেত্রে আসামিগণের মধ্যে কেবল এরূপ অপরাধ সংঘটনের নিছক ঐকমত্যই তাদেরকে ১২০বি ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট এবং আসামি বা তাদের মধ্যে যে কোনাে একজন কোনাে ওভার্ট অ্যাক্ট করেছে তা প্রমাণ করার প্রয়ােজনীয়তা নেই। বিচারপতি ফাইজান উদ্দিন (Faizan Uddin. I) এ বিষয়ে পূর্বের সব সিদ্ধান্ত বিবেচনা করে নিম্নবর্ণিত যুক্তিগুলাে তুলে ধরেন :
“The provisions in such a situation do not require that each and every person who is a party to the conspiracy must do some overt act towards the fulfillment of the object of conspiracy, the essential ingredient being an agreement between the conspirators to commit the crime and if these requirements and ingredients are established the act would fall within the trapping of the provisions contained in section 120B since from its very nature a conspiracy must be conceived and hatched in complete secrecy, because otherwise the whole purpose may frustrate and it is common experience and goes without saying that only in very rare cases one may come across direct evidence of a criminal conspiracy to commit any crime and in most of the cases it is only the circumstantial evidence which is available from which an inference giving rise to the conclusion of an agreement between two or more persons to commit an offense may be legitimately drawn.”
৭৭৯. সুতরাং, ষড়যন্ত্রের অপরাধ সৃষ্টি করতে হলে, প্রথমত দুই বা ততােধিক ব্যক্তির ষড়যন্ত্রটিতে একত্র হতে হবে; দ্বিতীয়ত ঐ ষড়যন্ত্র অনুসারে একটি কাজ বা অবৈধ বিচ্যুতি সংঘটিত হতে হবে। এটার প্রয়ােজনীয়তা নেই যে, যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই অপরাধটি সংঘটন করে, তার সাথে অপরাধে সহায়তাকারীর যােগসাজশ থাকতে হবে। এটা যথেষ্ট, যদি সে যে ষড়যন্ত্রটির পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে, সেটিতে লিপ্ত হয়। সুতরাং দেখা যায় যে, প্রত্যেক ষড়যন্ত্রকারী অভিন্ন অভিপ্রায়টি অর্জনের লক্ষ্যে তাদের সমন্বিত এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় তার পৃথক ভূমিকা পালন করে। আসামিদের নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রত্যেক পরিস্থিতি পৃথকভাবে বিবেচনা না করে, সকল প্রমাণিত পরিস্থিতির সম্মিলিত প্রভাব বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। প্রত্যেক ষড়যন্ত্রকারী এ বিষয়ে অবগত যে, ষড়যন্ত্রটিতে তার একটি ভূমিকা পালন করার আছে, যদিও ষড়যন্ত্রটির সমস্ত গােপনীয় বিষয় বা অভিন্ন অভিপ্রায়টি বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত সমস্ত উপায় সম্পর্কে তার ধারণা না-ও থাকতে পারে। ষড়যন্ত্রকারীদের অভিন্ন অভিপ্রায়টি হলাে একটি অভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করা। জনাব আবদুর রাজ্জাক খান পরিশেষে যুক্তি প্রদর্শন করেন যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের কাজটি হত্যাকাণ্ডে সহায়তার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যা পেনাল কোডের ১০৯ ধারার অধীনে শাস্তিযােগ্য। তার যুক্তির সমর্থনে, তিনি Md. Shamsul Hoque 0s State, 20 DLR 540, Anor Kutaar Takur vs State, 40 DLR (AD) 147, Hazrat Ali vs State, 44 DLR (AD) 51 978 Dharam Pal vs State of Haryana,(1978) 4 SCC 440 মামলাগুলাে উদ্ধৃত করেন। AIR 1938 Mad 130-প্রতিবেদিত উল্লিখিত মামলায় শামসুল হকের মামলায় গৃহীত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল, যা 8 DLR 48-এ প্রতিবেদিত মামলায়ও অনুসরণ করা হয়েছিল। Madras case-এ পর্যবেক্ষণ প্রদান করা
৭২৩

হয়েছিল যে, যখন দুই বা ততােধিক ব্যক্তি একটি অপরাধ সংঘটন করেছে বলে অভিযােগ করা হয়, তখন যে ব্যক্তি মূল অপরাধটি সংঘটনের জন্য দায়ী, তাকে অপরাধটি সংঘটনের অভিযােগে অভিযুক্ত করা হবে; অন্যদিকে, যে ব্যক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অপরাধটির সংঘটনে সহায়তা করেছে, তাকে ১০৯ ধারার অধীনে ষড়যন্ত্রের অপরাধে অভিযুক্ত করতে হবে। AIR 1938 Mad 130-এ প্রতিবেদিত মামলায় উল্লিখিত পর্যবেক্ষণগুলাে Kandinala Subbaiah-এর মামলায় (AIR 1961 SC 1241 paras 7 and 8) বাতিল করা হয়েছিল। Anor Kumar Takur মামলার ঘটনাবলি এবং আইনের নীতিসমূহ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ঐ মামলাটিতে আসামিরা ৩০২/৩৪ ধারার অধীনে দণ্ডনীয় অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছিল, এবং এই আদালত সাক্ষ্য পর্যালােচনায় এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, “২-৪ নম্বর আপিলকারীর নন্দলালকে হত্যা করার নিজস্ব কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না, বিশেষত, যখন সে গভীর রাতে মধ্যস্থতার উদ্দেশ্যে তাদের অনুরােধে এগিয়ে যাচ্ছিল।” Hazrat Ali-র মামলাটিতে, আপিল বিভাগ সাক্ষ্য-প্রমাণাদি মূল্যায়নের পর এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, হযরত আলী জহুরা খাতুনের হত্যায় সহযােগিতা করেছিল এবং তাকে ৩০২/৩৪ ধারার পরিবর্তে ৩০২/১০৯ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। Dharam Pal মামলাটিতে এটা পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল যে, অভিন্ন অভিপ্রায়ের অস্তিত্ব প্রত্যেক মামলার ঘটনা এবং অবস্থাদির উপর নির্ভর করে এবং কোনােরূপ তথ্যাদির অনুপস্থিতিতে “মূল অপরাধী কর্তৃক সংঘটিত প্রতিটি অপরাধের জন্য সঙ্গী বা সঙ্গীদের ন্যায়সঙ্গতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না।” এই মামলাগুলাে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং বর্তমান মামলার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। সাক্ষ্য আইনের নীতিসমূহ, যা ইতােমধ্যে উপরে আলােচিত হয়েছে, সেগুলাের সার্বিক বিবেচনায় আমি হাইকোর্ট বিভাগের সিদ্ধান্তের সাথে সম্পূর্ণ একমত যে, আপিলকারীগণ এবং অন্যান্য দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তারা তাদের হত্যা করে এবং আরাে তিনজন নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যার মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্যটি বাস্তবায়ন করে। যখন কোনাে মামলায় এরূপ একটি ঐকমত্য থাকে যেটির উদ্দেশ্য একটি অপরাধমূলক কাজ সংঘটন করা, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষ যদি প্রত্যেক ষড়যন্ত্রকারী কর্তৃক সম্পাদিত প্রকাশ্য কাজ প্রমাণ করতে ব্যর্থও হয়, তবে নিছক ঐকমত্যটি প্রমাণ করার মাধ্যমেই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে এবং প্রত্যেক আসামি কর্তৃক সম্পাদিত প্রকাশ্য কাজ প্রমাণের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা নেই। অন্য কথায়, এরূপ পরিস্থিতিতে, ষড়যন্ত্রের পক্ষভুক্ত প্রত্যেক আসামির ষড়যন্ত্রটির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কোনাে না কোনাে প্রকাশ্য কাজ করতে হবে, এমনটির প্রয়ােজনীয়তা নেই। এই মামলাটিতে যদিও ষড়যন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে হত্যাকাণ্ডের অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে; শুধু ষড়যন্ত্রের অপরাধটির জন্য ষড়যন্ত্রকারীদের দায়বদ্ধতা অপসৃত হতে পারে না। যখন প্রত্যেক আসামির কৃত সুনির্দিষ্ট কাজ প্রমাণিত হয় এবং তাদের সাধারণ অভিপ্রায় প্রমাণিত করে, তখন তা প্রত্যেক এবং অন্য সব আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযােগ্য হবে। Nalini [(1999) 5 SCC 253] মামলাটির আসামিরা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে উৎখাত করার যে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল সেটির সদস্য ছিল। আসামিদেরকে ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০২/১২০খ ধারার অধীনে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্ট তাদের দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখেছিলেন। একইভাবে, Kehar Singh (AIR 1988 SC 1883) মামলাটিতে নিরাপত্তারক্ষীগণ কর্তৃক ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যার জন্য কেহার সিং, বলবীর সিং এবং সাওয়ান্ত সিংকে ৩০২ ধারার সাথে পঠিতব্য ১২০বি ধারার অধীনে এবং অন্যান্য অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্ট দুজন অপরাধীর দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখেছিলেন। Suresh Chandra Bahri (AIR 1994 SC 2420) মামলাটিতে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট
৭২৪

পেনাল কোডের ৩০২/১২০বি ধারার অধীনে তিনজন আসামির দোষী সাব্যস্তকরণ বহাল রেখেছিলেন। নথিতে থাকা সাক্ষ্যসমূহ এবং উপরে আলােচিত আইনের নীতিসমূহ বিবেচনা করে, আমার মতামত হচ্ছে যে, আপিলকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ (আর্টিলারি), মেজর একেএম মহিউদ্দীন আহমেদ এবং মেজর বজলুল হুদার দোষী সাব্যস্তকরণ পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ এবং ১২০খ ধারার পরিবর্তে ৩০২ ধারার সাথে পঠিতব্য ১২০বি এবং ৩৪ ধারার অধীনে হতে হবে, এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে পেনাল কোডের ৩০২/১২০বি ধারার অধীন দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। তদনুসারে তাদেরকে দোষী সাব্যস্তকরণ সংশােধিত হলাে।
শান্তি অনুমোদন (Confirmation of sentence)
৭৮০. যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে যে, যেহেতু আপিলকারীগণ দীর্ঘ সময় ডেথ সেলে (মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জন্য নির্ধারিত সেল) রয়েছে, সেহেতু ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপিলকারীদের প্রতি আরােপিত দণ্ড হ্রাস করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা উচিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনাব খান সাইফুর রহমান Nurul Hoque Kazi os State 7 BLC (AD) 52 মামলাটির উদ্ধৃত করেন। বিজ্ঞ আইনজীবী আবদুল্লাহ আল-মামুন। যােগ করেন যে, মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘােষিত হয়ে যাওয়ার পর শাস্তিটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ বিলম্ব অমানবিক শাস্তি এবং তা নিপীড়নের নামান্তর এবং সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বিধৃত মৌলিক অধিকারের লঙ্ন। বিজ্ঞ আইনজীবীর মতে, এই অনুচ্ছেদটির অধীনে কোনাে ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না, এবং আপিলকারীদের দুর্ভোগ বিবেচনা করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হ্রাসপূর্বক তাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা উচিত। এই বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞ আইনজীবী Pratt 0s Attorney-General for Jamaica,(1993) 4 ALL ER 768, Henfield vs Attorney-General of Commonwealth of Bahamas, 3 WIR (PC) 1079 478 Guerra os Baptiste (1995) 4 ALL ER 583 মামলাগুলাে উদ্ধৃত করেছেন।
৭৮১. জ্যামাইকাতে খুনের অভিযােগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ভ্যাটের (Pratt)। দোষী সাব্যস্তকরণের কয়েক দিনের মধ্যে তিনি লিভ টু আপিল আবেদন দায়ের করেন। সহযােগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব ও অন্য কিছু কারণে লিভ আবেদন দুই বছর বিলম্বে জ্যামাইকার আপিল আদালতে শুনানি হয়। আপিল ফর লিভ না-মঞ্জুর হলেও দণ্ড কার্যকরের কোনাে তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়নি। জ্যামাইকায় বিদ্যমান বিধিতে প্রিভি কাউন্সিলের জুডিসিয়াল কমিটিতে আপিলের কঠোর সময়সীমা বিধৃত রয়েছে এবং এখানে আরাে বলা হয়েছে যে, দণ্ড কেবল ততদিন স্থগিত থাকবে, যতদিন তা আবশ্যক। আবার জ্যামাইকার সংবিধান মােতাবেক বিচারিক আদালতের বিচারকের কাছ থেকে মামলার একটি লিখিত প্রতিবেদন এবং নথি প্রিভি কাউন্সিলে পেশ করার আশ্যকীয়তা ছিল। ভ্যাট আপিল আদালতের রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিতভাবে জানতে চেয়েছিলেন, কী কারণে তার লিভ ফর আপিল না-মঞ্জুর হয়েছিল। এরপর এটি দেখা গিয়েছিল যে, কোনাে কারণ দেখানাে হয়নি, ভুল কাগজপত্র দাখিল করা হয়েছিল। এদিকে দণ্ডিত ব্যক্তি ইন্টার আমেরিকান হিউম্যান রাইটসে তার দণ্ড হ্রাসকরণের জন্য আবেদন করেছিলেন। এরপর তিনি ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কমিটিতে আবেদন করেন। কমিটি কর্তৃক অভিযােগটি খতিয়ে দেখার পূর্বে এই সংস্থা জ্যামাইকাকে দণ্ড কার্যকর না করতে অনুরােধ করলেও ইত্যবসরে জ্যামাইকান প্রিভি কাউন্সিল তাতে সম্মত না হওয়ার সুপারিশ করেছিল। এরপর অভিযুক্ত তার দণ্ডাদেশের বিষয়ে গভর্নর জেনারেলের স্থগিতাদেশও লাভ করেছিল। এভাবে দণ্ড কার্যকরে সময়ক্ষেপণ
৭২৫

হয় প্রায় ১২ বছর। এই প্রেক্ষাপটে প্র্যাট সংবিধানের ২৫(১) অনুচ্ছেদের অধীনে সাংবিধানিক প্রতিকারের জন্য আবেদন করে দাবি করেছিলেন যে, এই সুদীর্ঘ বিলম্বের পর তার দণ্ড কার্যকর হলে তা “would be inhuman punishment or other treatment” এবং সেহেতু তা হবে সংবিধানের ১৭(১) ধারার ব্যত্যয়। প্রিভি কাউন্সিল তার এই প্লি গ্রহণ করেন এবং নিম্নবর্ণিত কারণে তার দণ্ড যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে হ্রাস করেছিলেন :
“Prolonged delay in carrying out a sentence of death after that sentence had been passed could amount to inhuman punishment or other treatment contrary to section 17 (1) of the Jamaican Constitution irrespective of whether the delay was caused by the shortcomings of the State or the legitimate resort of the accused to all available appellate procedures. A State that wished to retain capital punishment had to accept the responsibility of ensuring that execution followed as swiftly as practicable after sentence, allowing a reasonable time for appeal and consideration of reprieve and, if the appellate procedure enabled the prisoner to prolong the appellate hearings over a period of years, the fault was to be attributed to the appellate system that permitted such delay and not to the prisoner who took advantage of it.”
৭৮২. হেনফিল্ড (Henfield) মামলায় খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। কমনওয়েলথ অব দ্য বাহামাস-এর আপিল আদালত তার আপিল না-মঞ্জুরপূর্বক দণ্ড কার্যকর করার ওয়ারেন্ট জারি করেন। এরপর জুডিসিয়াল কমিটি থেকে তিনি দণ্ড কার্যকর সংক্রান্ত স্থগিতাদেশ লাভ করেন। জুডিসিয়াল কমিটি কর্তৃক তার লিভ পিটিশন খারিজ হয়। তারপর, যে সময় পর্যন্ত তাকে দণ্ড কার্যকরের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয় তা প্রকারান্তরে অমানবিক শাস্তি যা কমনওয়েলথ অব দ্য বাহামাস-এর সংবিধানের ১৭ (১) অনুচ্ছেদের পরিপন্থি- এইরূপ ঘােষণার প্রার্থনায় তিনি বাহামাস সুপ্রীম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। সুপ্রীম কোর্ট অবধি প্রসিডিং নিষ্পত্তিতে প্রায় ৫ বছর বিলম্ব হয়েছিল। এরপর দণ্ড কার্যকরের ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছিল। দোষী সাব্যস্ত আসামি এরপর আপিল দায়েরের অনুমতি চেয়ে জুডিসিয়াল কমিটিতে আবেদন করেন, একই কারণে যে, “inhuman or degrading punishment or other treatment”. প্রিভি কাউন্সিল প্র্যাট-এর মামলাটি অনুসরণ করে মৃত্যুদণ্ডের সাজা হাসপূর্বক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে পর্যক্ষেণে বলেন
“they therefore reviewed the relevant considerations, at pp. 34-35, and concluded that in any case in which execution was to take place more than five years after sentence there would be strong grounds for believing that the delay was such that execution thereafter would constitute inhuman punishment contrary to section 17 (1)”.
৭৮৩. গুয়েরা (Guerra) মামলায় মে, ১৯৮৯-এ ত্রিনিদাদ ও টোবাগােয় খুনের দায়ে আসামি দোষী সাব্যস্ত এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। পরে তিনি সুপ্রীম কোর্টে লিভ টু আপিলের জন্য আবেদন করেন। আপিলকারীকে শুনানির জন্য নথির সারসংক্ষেপ পাওয়া যায় ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু সাক্ষ্যের ভাষ্য লিখনে বিচারকের বেশ বিলম্ব হয়েছিল এবং ১৯৯৩ সালের মে মাসে সেগুলাের প্রাপ্যতা
৭২৬

বিষয়ে আপিলকারীর আইনজীবীকে জানানাে হয়নি। অবশেষে ১৯৯৩-এর অক্টোবর মাসে আপিলটির শুনানি হয়েছিল এবং নভেম্বরে তা না-মঞ্জুর হয়। শুধু তাই নয়, প্রিভি কাউন্সিল বরাবর আবেদনকারীর লিভ টু আপিলের আবেদনও না-মঞ্জুর হয়েছিল এবং পরদিন তার দণ্ড কার্যকরের জন্য ধার্য হয়। আপিলকারী এরপর একটা সাংবিধানিক মােশন (constitutional motion) দাখিল করে দাবি করেন। যে, ওয়ারেন্ট মােতাবেক ঠিক পরের দিন তার দণ্ড কার্যকর হবে তার মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। শুনানি অন্তে এই মােশন না-মঞ্জুর হয়েছিল। এরপর তিনি প্রিভি কাউন্সিলে আপিল করেন, যেখানে তিনি যুক্তি দেখান যে, মৃত্যুর প্রতীক্ষায় নির্জন প্রকোষ্ঠে ৪ বছর ১০ মাস অবস্থানের পর বিলম্বিত দণ্ড কার্যকর হচ্ছে। যা “cruel and unusual punishment” এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগাের সংবিধানের ৫(২)(বি) ধারার লঙ্ঘন এবং তার দণ্ড কার্যকরে ১৭ ঘণ্টার নােটিশ দেওয়াটাও ছিল তার সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন। কমন ল জুরিসডিকশনের অধীনে ‘ডিউ প্রসেস অব ল’-এর নীতি প্রয়ােগ করে প্রিভি কাউন্সিল দণ্ড হ্রাসপূর্বক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছিলেন এবং প্র্যাট (Pratt) মামলার নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে। যা বলা হয় তা নিম্নরূপ :
“Where a person was sentenced to death in a common law jurisdiction, execution was required to be carried out by the state as swiftly as practicable after sentence, allowing a reasonable time for appeal and consideration of reprieve, since under the common law a long delayed execution was not in accordance with the due process of law. In Trinidad and Tobago such an execution, if not stayed, would constitute a cruel and unusual punishment contrary to section 5 (2) (b) of the constitution and would not be in accordance with the due process of law under section 4 (a) of the constitution.”
৭৮৪. এই নীতিগুলাে আমাদের আদালতের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। ডিউ প্রসেস অব ল’ এই অভিব্যক্তিটি ‘ল’ অব দ্য ল্যান্ড’-এর সমার্থক যা ম্যাগনা কার্টার সুবিখ্যাত ঊনত্রিশতম অধ্যায়ে ঘােষিত হয়েছে এবং সেখানে বর্ণিত হয়েছে, “no freeman shall be taken, or imprisoned, or disseized, or outlawed, or banished, or in any way destroyed, nor will the king pass upon him or commit him to prison, unless by the judgment of his peers or the law of the land.” মার্কিন সংবিধানের পঞ্চম ও চতুর্দশ সংশােধনীতে এই নীতিটি গৃহীত হয়েছে। সংবিধানের এই সংশােধনী without due process of law নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অস্বীকারকে (deprivation) বারিত করেছে। ধারণার সারমর্ম হলাে ন্যায়পরায়ণতা ও স্বেচ্ছাচারিতার পরিহার করা। এই নীতিগুলাে জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগাে এবং বাহামার আদালতে অনুসৃত হয়ে থাকে। আমাদের সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতা বিজড়িত মামলায় আমেরিকার ‘ডিউ প্রসেস ক্লজ’-এর মতােই ন্যায্য প্রক্রিয়া (fair procedure) সুনিশ্চিত করেছে। আর এই ন্যায্যতার (fairness) ধারণাটি প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিস’-এর নীতিতে বিধৃত রয়েছে। আলােচনার খাতিরে মার্কিন বা ক্যারিবিয়ান সিদ্ধান্তগুলাে হয়তাে আনুষঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু আমাদের আইনকানুন, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও মূল্যবােধের সযত্ন নিরীক্ষা ব্যতিরেকে ঐ আদালতগুলাে কর্তৃক নির্ধারিত মানদণ্ড আমাদের আদালতগুলােয় প্রয়ােগ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, নিছক বিলম্ব মৃত্যুদণ্ড হ্রাসকরণে কোনাে আইনি অজুহাত নয়। সে মর্মে আমাদের উচ্চ আদালতের অভিন্ন সিদ্ধান্ত রয়েছে।
৭২৭

৭৮৫. যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সুপ্রীম কোর্টের Furman os. State of Georisea, Nos. 69-5003, 69-5030 and 69-5031 মামলায় নৃশংস এবং উকট সাজা (cruel and unusual punishments)’ নিরােধক অষ্টম সংশােধনী লঙ্ঘনের কারণে বিচারপতিদের অনুরােধ করা হয়েছিল মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাখ্যান করার জন্য। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতানুসারে বিজ্ঞ বিচারকগণ মৃত্যুদণ্ডাদেশ বাতিল করলেও, অষ্টম সংশােধনীর মাধ্যমে সকল। অপরাধ বা পরিস্থিতি নির্বিশেষে সব ক্ষেত্রেই যে মৃত্যুদণ্ড রহিত (prohibited) করেছে এমন অভিমত বিচারপতি ব্রেনান ও বিচারপতি মার্শাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামত প্রদানকারী তিনজন বিচারপতি যথা ডগলাস, স্টুয়ার্ট এবং হােয়াইট-এর সঙ্গে গ্রহণ করেননি। আমাদের সংবিধানে ঐরূপ অষ্টম সংশােধনীর অনুরূপ বিধান নেই। তাছাড়া ‘ডিউ প্রসেস অব ল’-এর নীতি প্রয়ােগে আমেরিকান সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের চর্চিত স্বাচ্ছন্দ্যের মতাে আমরা যৌক্তিকতা পরীক্ষার বিষয়টি প্রয়ােগ করি না। অপরাধের জন্য আইনে নির্ধারিত সাজাসংক্রান্ত বিষয়টি আমাদের দেখতে হয়। প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের এখানে মৃত্যুদণ্ডের মতাে সাজা রয়েছে। কাজেই এটিকে অস্বাভাবিক বলার সুযােগ নেই। আমাদের সংবিধান এটিকে আইনের অধীনে সাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।।
৭৮৬. বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল নিবেদন করেন যে, আপিল শুনানি শেষ করতে বিলম্ব রাষ্ট্রের তরফে তাে নয়ই, বরং তা অভিযুক্ত-আপিলকারীদের অবহেলার কারণে হয়েছে। আরাে নিবেদন করা হয় যে, দুজন আপিলকারীসহ বেশির ভাগ আসামি বিচার চলাকালীন এবং হাইকোর্ট ডিভিশনে দণ্ড নিশ্চিতকরণের সময় পলাতক ছিল এবং এর ফলে তাদের অনুপস্থিতিতে রেফারেন্সটির শুনানির জন্য প্রলম্বিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। নথি পরীক্ষায় দেখেছি যে, আপিলগুলাে এবং হাইকোর্ট ডিভিশনে রেফারেন্স নিষ্পত্তিতে আপিলকারীগণের পক্ষ থেকে কোনাে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এই আদালতেও তারা আশু শুনানিকল্পে কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। রাষ্ট্রপক্ষই বিষয়গুলাের শুনানি নির্ধারণে পুনঃ পুনঃ প্রার্থনা করেছিল এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে আপিল শুনানির নিমিত্তে একটা বেঞ্চ গঠন করে দেওয়া হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে বিলম্বটি রাষ্ট্রের কোনাে অবহেলার জন্য ছিল না। যেহেতু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিরা ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য কোনাে পদক্ষেপ নেয়নি, সেহেতু তারা এটি দাবি করতে পারে না যে, তারা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে বিলম্বের কারণে “নিপীড়ন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণের শিকার হয়েছে। কাজেই আমি বিজ্ঞ কৌসুলিদের উত্থাপিত বক্তব্যের মাঝে কোনাে মেরিট দেখছি না। সাধারণত এই আদালত দণ্ড প্রদান প্রশ্নে হাইকোর্ট ডিভিশনের অনুশীলিত বিবেচনায় (discretion) হস্তক্ষেপ করে না, যদি না এটি দেখা যায় যে, হাইকোর্ট ডিভিশন দণ্ড আরােপের ক্ষেত্রে স্বীকৃত নীতিগুলাে অগ্রাহ্য করেছে যা ন্যায়বিচারকে ব্যর্থ করে। বিজ্ঞ দায়রা জজ মৃত্যুদণ্ড আরােপের যৌক্তিকতা দেখিয়েছেন। এই পর্যবেক্ষণ প্রদান করা হয়েছে যে, ঘটনার পর আসামি আপিলকারীগণ দেশে এবং বিদেশে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়েছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। ঘটনাটি ছিল একটি বর্বর ঘটনা। তারা নির্মমভাবে দুজন নবপরিণীতা নারী এবং একজন ১০ বছরের কমবয়সী শিশু এবং বঙ্গবন্ধু-পত্নী যারা কোনােভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না, তাদেরকে হত্যা করেছে এবং এতদ্বারা তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে। ব্যক্তিবিশেষ নয়, এই হত্যাকাণ্ড ছিল সমগ্র জাতির জন্যই এক আঘাত ও দুর্ভাগ্য এবং পরিণতি অবগত থেকেই সুপরিকল্পিত উপায়ে অভিযুক্ত আসামিরা এই জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেছে। এজন্য তারা দণ্ড আরােপের ক্ষেত্রে বিশেষ কোনাে অনুকম্পা পেতে পারে না।
৭৮৭. বিজ্ঞ দায়রা জজ আইনি বিধানাবলি বিবেচনায় রেখেছেন এবং দণ্ড আরােপে যথার্থভাবেই সুবিবেচনা প্রয়ােগ করেছেন। দণ্ড বহাল রাখতে গিয়ে দ্বিতীয় বিজ্ঞ বিচারক পর্যবেক্ষণে বলেছেন, “১১ জন নিরপরাধ ব্যক্তিকে নির্মমভাবে ও নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের তখনকার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর
৭২৮

রহমান নির্মম চক্রান্তের লক্ষ্য হয়েছিলেন এবং কতিপয় ক্রোধােন্মত্ত সেনা কর্মকর্তা, যাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল বহিষ্কৃত, তাদের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছিলেন। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে তিনজন নারী এবং একজন বালকসহ ১০ ব্যক্তিও হত্যার শিকার হয়েছিলেন। যে নির্মম ও নির্দয়ভাবে তাদেরকে হত্যা করা হয় তা বিবেচনায় দণ্ড হাসের কোনাে অবকাশ নেই। ফলে অভিযুক্তদের কেউই দণ্ডবিষয়ক নমনীয়তা পাওয়ার হকদার নয়।” দেখা যাচ্ছে যে, বিজ্ঞ বিচারক আইনের শর্তাবলি সম্পর্কে সচেতন এবং সে মােতাবেক আইনসঙ্গত যুক্তি দেখিয়ে দণ্ড বহাল রেখেছেন।
৭৮৮. এবারে আমরা মৃত্যুদণ্ড আরােপে আইনি বিধানগুলাে বিবেচনা করব। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৭ (৫) ধারায় বিধৃত বিধানটি নিম্নরূপ :
“(5) if the accused is convicted of an offense punishable with death or, in the alternative, with imprisonment for life or imprisonment for a term years, the Court shall in its judgment state the reasons for the sentence awarded.”
৭৮৯. এই বিধান বলে যে, মৃত্যুদণ্ড বা স্বল্প দণ্ড আরােপ প্রত্যেক মামলার ঘটনার নিরিখে আদালতের সুবিবেচনার (discretion) উপর নির্ভরশীল এবং দণ্ড আরােপের কারণ উল্লেখ করতে হবে। আদালত মূলত বিচারাধীন অপরাধের ঘটনা ও পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখেন এবং এটি স্থির করেন যে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আরােপের জন্য কোনাে অ্যাগ্রেভেটিং বা মিটিগেটিং অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে কিনা। ভারতে ১৯৭৩ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৬৭(৫) ধারাটি পুনঃপ্রণীত করা হয়েছে। ৩৫৪(৩) ধারায় সমান্তরাল যে বিধানটি বিধৃত হয়েছে তা নিম্নরূপ :
“section 354 (3) when the conviction is for a sentence punishable with death or, in the alternative, with imprisonment for life or imprisonment for a term of years, the judgment shall state the reasons for the sentence awarded, and in case of sentence of death, the special reason for such sentence”.
৭৯০. নতুন এই বিধানের অধীনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এখন একটি বিধি এবং কেবল কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে বিশেষ কারণ উল্লেখে মৃত্যুদণ্ড আরােপ করা যেতে পারে। আমাদের দণ্ড প্রদান পদ্ধতি ভারতের পদ্ধতি থেকে একেবারেই ভিন্ন। ভারতে কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কারণ প্রদর্শনপূর্বক আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড আরোপ করা হয়েছে। Jagmohan Singh vs. State of UP, : MANU/SC/0139/1972 : AIR 1973 SC 947 মামলায় দণ্ড আরােপের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে, দণ্ড প্রদান। প্রক্রিয়া এবং দণ্ড আরােপ সম্পর্কিত ৩০২ ধারা ভারতীয় সংবিধানের ১৪ ও ১৯ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে, দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে অপরাধের সকল অ্যাগ্রেভেটিং ও মিটিগেটিং অবস্থাদির ভারসাম্যের পর বিচারককে বিস্তৃত বিবেচনার এখতিয়ার আইন দিয়েছে যা তার কর্তৃক অনুশীলিত হয় এবং কোনাে আইন একজন নাগরিকের জীবনকে অস্বীকার করতে পারে না, যদি না তা জনস্বার্থে যৌক্তিক হয়। আরাে নিবেদন করা হয় যে, মৃত্যুদণ্ডকে সরাসরি অযৌক্তিক কিংবা জনস্বার্থে নয় বলে গণ্য করা যায় না। ১৪ অনুচ্ছেদ আমাদের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের অনুরূপ এবং ১৯ অনুচ্ছেদকে আমাদের সংবিধানের ২৯, ৩৬, ৩৭ এবং ৩৮ অনুচ্ছেদের সম্মিলিত রূপ বলা যেতে পারে। Bachan Singh vs. State of Punjab AIR 1980 SC 898 মামলায় বৃহত্তর একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ কর্তৃক জগমােহনের মামলাটি পুনর্বিবেচিত হয়েছিল। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে, ১৯৭৩ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারায় বিধৃত দণ্ডদান প্রক্রিয়া সংবিধানের ১৪, ১৯ ও ২১ অনুচ্ছেদের পরিপন্থি।
৭২৯

ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ আমাদের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদের অনুরূপ। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুযায়ী এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, দণ্ড প্রদান প্রক্রিয়া সংবিধানের ১৪, ১৯ ও ২১ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে না। বলা হয় যে, প্রদেয় দণ্ড নির্ধারণে বা বিশেষ কারণ থাকা বা না থাকার বিষয়টি নির্ধারণে আদাল অবশ্যই অপরাধ ও অপরাধী উভয়ের প্রতি যথােচিত মনােযােগ প্রদান করতে হবে। অ্যাগ্রেভেটিং এবং মিটিগেটিং ফ্যাক্টরের গুরুত্ব পরিমাপের বিষয়টি মামলার ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতার উপর নির্ভর করে।
৭৯১. জগমােহন সিংয়ের মামলায় এটি বলা হয়েছে যে, ভারতে এই গুরুদায়িত্ব বিচারকদের উপর বর্তায় এবং এক শতাব্দীর অধিককাল ধরে তারা ভারতীয় পেনাল কোডের আওতায় তা পালন করে আসছেন। ভারতে ফৌজদারি আইন ব্যবস্থার গােড়ায় দণ্ড প্রদানের মান নিরূপণে অনুপযােগিতা নিহিত রয়েছে, যা শাস্তির মাত্রা নির্ধারণে বিচারকদের দিয়েছে অতি বিস্তৃত সুবিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা। দণ্ড প্রদানবিষয়ক সেই বিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা উচ্চ আদালত কর্তৃক কারেক্টেড হওয়ার যােগ্য। সীমিত মান যা মডেল জুডিশিয়াল কোডে করা হয়েছিল তা নির্ধারণ ফলপ্রসূ হবে না। স্বীকৃত নীতিমালার আলােকে বিচারিক সুবিবেচনার প্রয়োগ শেষ বিচারে অভিযুক্তের জন্য এক নিরাপদ সম্ভাব্য সুরক্ষা। আরাে বলা হয়েছে যে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানে বিচারকদের অনিয়ন্ত্রিত ও খেয়ালি বিবেচনা সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদের ব্যত্যয়- এই যুক্তিতে কোনাে সারবত্তা নেই। আইন সাজা প্রদানে বিচারককে বিস্তৃত বিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা দিয়ে থাকে, যা অপরাধের অ্যাগ্রেভেটিং ও মিটিগেটিং পরিস্থিতির ভারসাম্যের পর তার কর্তৃক প্রয়ােগ করতে হবে। তবে এটি বলাটা অসম্ভব যে, যেহেতু একটি মামলার ঘটনা ও অবস্থাদি থেকে অন্য মামলার ঘটনা ও অবস্থাদি অভিন্ন না হওয়ায় সেখানে আদৌ কোনাে বৈষম্য থাকবে। বিচারপতি পালেকার সুবিবেচনা প্রয়ােগ করতে গিয়ে নিমােক্ত যুক্তি তুলে ধরেছেন :
“A large number of murders is undoubtedly of common type. But some at least are diabolical in conception and cruel in execution. In some others where the victim is a person of high standing in the country, society is liable to be rocked to its very foundation. Such murders cannot simply be whisked away by finding alibis in the social maladjustment of the murderer. Prevalence of such crimes speaks, in opinion of many, for the inevitability of death penalty not only by a way of deterrents, but as a token emphatic disapproval by the society”.
৭৯২. আদালতের discretion প্রয়ােগের ক্ষেত্রে মিটিগেটিং অবস্থাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে : (ক) তীব্র মানসিক বা আবেগতাড়িত উত্তেজনায় অপরাধটি সংঘটিত হয়েছিল; (খ) অভিযুক্তের বয়স- অভিযুক্ত অল্পবয়সী বা বয়ােবৃদ্ধ হলে সে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে না; (গ) অব্যাহত সামাজিক হুমকি সৃষ্টি করতে পারে অভিযুক্ত কর্তৃক এমন সহিংস অপরাধমূলক কাজ না ঘটানাের সম্ভাবনা; (ঘ) মামলার ঘটনা ও পরিস্থিতির আলোকে আসামি বিশ্বাস করেছিল যে, অপরাধটি সংঘটনে সে নৈতিকভাবে যৌক্তিক ছিল; (ঙ) অভিযুক্ত অন্যের চাপে বা প্রভাবে কাজ করেছিল, এবং (চ) অভিযুক্তর অবস্থা থেকে দেখা যায় যে, সে মানসিক বৈকল্যে আক্রান্ত ছিল এবং ঐরূপ বৈকল্য তার কর্মের ক্রিমিনালিটি অনুধাবনে ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। জগমােহন মামলায় সাজা হ্রাসকরণে (in mitigation of punishment) নিম্নবর্ণিত পরিস্থিতি বিবেচিত হয়েছে : (১) দুরভিসন্ধির অনুপস্থিতি; (২) প্ররােচনা; (৩) আত্মরক্ষা; (৪) কিছু ঘনিষ্ঠজনের প্রতিরক্ষা; (৫) আত্মরক্ষার সীমালঙ্ঘন; (৬) হুমকির কাছে নতি স্বীকার; (৭) হুকুমের আনুগত্য; (৮) মাদকোন্মত্ততা; (৯) অপ্রাপ্তবয়স্কতা।।
৭৩০

৭৯৩. বচন সিংয়ের মামলায় তিনজন ব্যক্তিকে খুনের দায়ে ৩০২ ধারার অধীনে বচন সিংকে দোষী সাব্যস্তক্রমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। তার এই দণ্ড পাঞ্জাব হাইকোর্ট কর্তৃক অনুমােদিত হয়েছিল। তার স্পেশাল লিভ ফর আপিল একটা ডিভিশন বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে। “নিম্ন আদালতগুলাে কর্তৃক সাব্যস্তকৃত ঘটনাবলি মৃত্যুদণ্ড আরােপের জন্য ১৯৭৩ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারার আওতায় ‘বিশেষ কারণ’ (special reasons) হিসেবে বিবেচিত হবে কি না”- এটি বিবেচনার নিমিত্তে লিভ মঞ্জুর করা হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ ৩০২ ধারায় বিধৃত খুনের দায়ে মৃত্যুদণ্ড এবং কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারায় উল্লিখিত দণ্ডদান প্রক্রিয়ার সাংবিধানিক বৈধতা সম্পর্কে সিদ্ধান্তের জন্য মামলাটি একটা সাংবিধানিক বেঞ্চে প্রেরণ করেছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সুপ্রীম কোর্ট নিমােক্ত পর্যবেক্ষণ প্রদানপূর্বক মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন :
“(c) the normal rule is that the offence of murder shall be punished with the sentence of life imprisonment. The Court can depart from that rule and impose the sentence of death only if there are special reasons for doing so. Such reasons must be recorded in writing before imposing the death sentence.
(d) While considering the question of sentence to be imposed for the offence of murder under section 302, Penal Code, the Court must have regard to every relevant circumstance relating to the crime as well as the criminal. If the Court finds, but not otherwise, that the offense is of an exceptionally depraved and heinous character and constitutes, on account of its design and the manner of its execution, a source of grave danger to the society at large, the Court may impose the death sentence.”
৭৯৪. Machhi Singh os. State of Punjab, AIR 1983 SC 957 মামলায় দণ্ডদান প্রসঙ্গে জগমােহন মামলাসহ আরাে কতিপয় মামলা বিবেচনান্তে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট নিম্নবর্ণিত মতে এটি বিন্যস্ত করেছেন যে, কোন কোন ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড আরােপিত হতে পারে :
“When the victim of murder is (a) an innocent child who could not have or has not proved even an excuse, much less a provocation, for murder, (b) a helpless woman or a person rendered helpless by old age or infirmity, (c) when the victim is a person vis-a-vis whom the murderer is in a position of domination or trust, (d) when the victim is a public figure generally loved and respected by the community for the services rendered by him and the murder is committed for political or similar reasons other than personal reasons.”
৭৯৫. ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী হত্যা মামলায় ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারার অধীনে মৃত্যুদণ্ড বহাল কালে Nalini (1999) 5 SCC 253 মামলায় বিচারপতি ডি পি ওয়াধা বলেন :
“A former prime minister of the country was targeted as this country had entered into an agreement with a foreign country in exercise of its sovereign
৭৩১

powers. Rajiv Gandhi, being the head of the Government at that time, was signatory to the Accord which was also signed by the head of the Government of Sri Lanka. The Accord had the approval of Parliament. It was not that Rajiv Gandhi had entered into the Accord in his personal capacity or for his own benefit. Though we have held that object of the conspiracy was not to commit any terrorist act or disruptive activity, nevertheless murder of a former Prime Minister for what he did in the interest of the country was an act of exceptional depravity on the part of the accused, an unparalleled act in the annals of crime committed in this country. In a mindless fashion not only was Rajiv Gandhi killed but along with him others died and many suffered grievous and simple injuries. It is not that the intensity of the belt bomb strapped on the waist of Dhanu was not known to the conspirators as after switching on the first switch on her belt bomb Dhanu asked Sivarasan to move away. Haribabu was so keen to have close up pictures of the crime that he met his fate in the blast itself. We are unable to find any mitigating circumstance not (sic) to upset the award of sentence of death on the accused.”
৭৯৬. ইন্দিরা গান্ধী হত্যা মামলা তথা Kehar Singh-এর মামলায় (AIR 1988 SC 1883) ১৯৭৩ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৩৫৪(৩) ধারার প্রেক্ষাপটে চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আরােপ বিষয়ে একই ধরনের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। ভারতের সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক কেহার সিং এবং সাওয়ান্ত সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখতে গিয়ে বিচারপতি জি এল ওজার (GL Oza, J) মন্তব্য ছিল নিম্নরূপ :
“The person killed is a lady and no less than the Prime Minister of this country who was the elected leader of the people. In our country we have adopted and accepted a system wherein change of the leader is permissible by ballot and not by bullet. The act of the accused not only takes away the life of a popular leader but also undermines our system which has been working so well for the last forty years. There is yet another serious consideration. Beant Singh and Satwant Singh are persons who were posted on the security duty of the Prime Minister. They are posted there to protect her from any intruder from any attack from outside and therefore if they themselves resort to this kind of offense, there appears to be no reason or no mitigating circumstance for consideration on the question of sentence. Additionally, an unarmed lady was attacked by these two persons with a series of bullets and it was found that a number of bullets entered her body. The manner in which she mercilessly attacked these two persons on whom the confidence was reposed to give her protection repels any consideration of reduction of sentence. In this view of the matter, even the conspirator who inspired the persons who actually acted does not deserve any leniency in the matter of sentence. In our opinion, the
৭৩২

sentence awarded by the trial Court and maintained by the High Court appears to be just and proper.”
৭৯৭. A. Khair os. State, 44 DLR (AD) 225 মামলায় আমাদের আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেন যে, কেবল বিলম্বই দণ্ড হ্রাসকরণে কোনাে extenuating circumstance নয়। এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ নিম্নরূপ :
“Delay by itself in the execution of sentence of death is by no means an extenuating circumstance for commuting the sentence of death to imprisonment for life. There must be other circumstances of a compelling nature which together with delay will merit such commutation. We find no compelling extenuating circumstance in this case and therefore, find no ground whatsoever to interfere.”
৭৯৮. আমাদের বিধান অনুসারে মৃত্যুদণ্ড আরােপ করা হবে নাকি হবে না- সেই বিষয়ে আদালত মামলার ঘটনাবলির আলােকে সুবিবেচনা প্রয়ােগের এখতিয়ার রাখেন এবং মৃত্যুদণ্ড আরােপের ক্ষেত্রে আদালতকে যুক্তি প্রদর্শন করতে হবে। চরম দণ্ড আরােপের সময় আদালতকে এটি মনে রাখতে হবে যে, ঐরূপ সুবিবেচনা প্রয়ােগ করার জন্য কোনাে মিটিগেটিং অবস্থা রয়েছে কিনা। জগমােহন মামলায় বিশ্লেষিত মতে আদালতের সুবিবেচনা প্রয়ােগে উদ্ভূত মিটিগেটিং অবস্থাদি কোনাে সংশয় ছাড়া প্রাসঙ্গিক অবস্থা, যা দণ্ড নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
৭৯৯. এ বিষয়ে কোনাে অস্বীকৃতি নেই যে, আপিলকারীগণ এবং অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ কেবল দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেনি, তারা পুরাে পরিবারকে হত্যা করেছিল। ঘটনার শিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জনগণের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। দেশের জনগণের ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য তার সংগ্রাম ছিল অনন্য দেশপ্রেম। পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক শাসনের ধূর্ত দখলদারিতা থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ছিল দেশপ্রেমের এক বিরল দৃষ্টান্ত, জনগণ যেখানে দেশে-বিদেশে ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘােষিত সুস্পষ্ট আহ্বানে লড়াই করেছে। কেবল সমর-নির্দেশনা নয়, ঐতিহাসিক এই ভাষণে প্রাণিত হয়েছিল জনতার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রগাঢ় প্রত্যয়। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে তিনি ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আর ছয় দফা সনদের মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছেন সুকৌশলে। ছয় দফাই পরবর্তীকালে স্বাধীনতার দাবিতে এক দফায় পরিণত হয়ে ওঠে, বঙ্গবন্ধু সেখান থেকে আর পিছু হটেননি। পরিণামে আমরা অর্জন করি স্বাধীনতা। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এমন একজন নেতাকে হত্যা করেছে, যিনি আর কেউ নন, তিনি জাতির পিতা। তারা এমনকি রাষ্ট্রপতির শিশুপুত্র, যার বয়স ছিল দশ বছরের কম, তাকেও রেহাই দেয়নি। তার নির্মম এই হত্যায় জাতি স্তম্ভিত-বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কেন তারা তিনজন নারীকে হত্যা করেছিল সেটির কোনাে ব্যাখ্যা ছিল না। একটি শিশু ও তিনজন নিস্পাপ নিরস্ত্র নারীকে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত করেছে। তারা বাসভবনে অবস্থানরত প্রায় পুরাে পরিবারের প্রাণসংহার করেছিল। নিরপরাধ মানুষগুলােকে কেন হত্যা করা হয়েছিল- সে বিষয়ে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে কোনাে ব্যাখ্যা নেই। আদিম উন্মত্ততাই হতে পারে অভিযুক্তদের নৃশংসতার যথার্থ উপমা। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রমাণ করেছে যে, রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করা নয়, তাদের চক্রান্তের লক্ষ্য ছিল গােটা পরিবারের প্রাণসংহার করা এবং তা ছিল অভিযুক্তদের উৎকট ভ্রষ্টাচার, দেশের অপরাধ সংঘটনের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। সকল অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণের
৭৩৩

সাক্ষ্য না থাকলেও এটি মনে রাখতে হবে যে, অধিষ্ঠিত রাষ্ট্রপতিকে হত্যার জন্য সকল অভিযুক্ত ব্যক্তি উদ্দেশ্য সাধনকল্পে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। সম্মিলিতভাবে সমন্বিত কর্মকাণ্ড ছাড়া এই বেআইনি উদ্দেশ্য সাধিত হতাে না। সবার সমর্থন ব্যতিরেকে বেআইনি উদ্দেশ্যের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন সম্ভবপর ছিল না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সকল ষড়যন্ত্রকারী, যারা অপরাধ সংঘটনে প্রকৃত অংশগ্রহণ করেছিল ও কর্মকাণ্ড করেছিল, তাদের কেউই দণ্ড আরােপ সম্পর্কে কোনাে নমনীয়তার উপযুক্ত নয়। অপরাধ সংঘটনে বর্বরতা বিবেচনায় আপিলকারীগণ ও অন্য সহ-অভিযুক্তরা দণ্ড আরােপে কোনাে নমনীয়তা পাবে না। আপিলকারীগণ দণ্ডহাসকরণের জন্য কোনাে উপশমক পরিস্থিতি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
আপিলকারীদের প্রতি আরােপকৃত দণ্ড এই আদালত কর্তৃক হস্তক্ষেপযােগ্য নয়। কাজেই তাদের দণ্ড আমি বহাল করছি।

বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি

উপস্থিত আপীল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ :
বিচারপতি জনাব মােহাম্মদ ইমান আলী
বিচারপতি জনাব হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী
বিচারপতি জনাব আবু বকর সিদ্দিকী
বিচারপতি জনাব মােঃ নূরুজ্জামান
বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান

উপস্থিত হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ :
বিচারপতি জনাব মুহাম্মদ আবদুল হাফিজ
বিচারপতি জনাব সৈয়দ রেফাত আহমেদ
৭৩৭

বিচারপতি জনাব মােঃ আশফাকুল ইসলাম
বিচারপতি জনাব মােঃ রইস উদ্দিন
বিচারপতি জনাব মােঃ ইমদাদুল হক আজাদ
বিচারপতি জনাব মােঃ আতাউর রহমান খান
বিচারপতি জনাব সৈয়দ মােহাম্মদ জিয়াউল করিম
বিচারপতি জনাব মােঃ রেজাউল হক
বিচারপতি জনাব শেখ আবদুল আউয়াল
বিচারপতি জনাব এস. এম. এমদাদুল হক
বিচারপতি জনাব মামনুন রহমান
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব
বিচারপতি জনাব এ. কে. এম. আব্দুল হাকিম
বিচারপতি জনাব বােরহান উদ্দিন
বিচারপতি জনাম মােঃ মঈনুল ইসলাম চৌধুরী
বিচারপতি জনাব এম. ইনায়েতুর রহিম
বিচারপতি নাইমা হায়দার
বিচারপতি জনাব মােঃ রেজাউল হাসান
বিচারপতি জনাব এফ. আর. এম. নাজমুল আহসান
বিচারপতি জনাব কৃষ্ণা দেবনাথ
বিচারপতি জনাব এ. এন. এম. বসির উল্লাহ
বিচারপতি জনাব আবদুর রব
বিচারপতি জনাব মােঃ আবু জাফর সিদ্দিকী
বিচারপতি জনাব জাহাঙ্গীর হােসেন
বিচারপতি জনাব শেখ মােঃ জাকির হােসেন
বিচারপতি জনাব মােঃ হাবিবুল গনি
বিচারপতি জনাব গােবিন্দ চন্দ্র ঠাকুর
বিচারপতি জনাব শেখ হাসান আরিফ
বিচারপতি জনাব জে. বি. এম. হাসান
বিচারপতি জনাব মােঃ রুহুল কুদুস
বিচারপতি জনাব মােঃ খসরুজ্জামান
বিচারপতি জনাব ফরিদ আহমেদ
বিচারপতি জনাব মােঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার
বিচারপতি জনাব মােঃ আকরাম হােসেন চৌধুরী
৭৩৮

বিচারপতি জনাব মােঃ আশরাফুল কামাল
বিচারপতি জনাব কে. এম. কামরুল কাদের
বিচারপতি জনাব মােঃ মজিবুর রহমান মিয়া
বিচারপতি জনাব মােস্তফা জামান ইসলাম
বিচারপতি জনাব মােহাম্মদ উল্লাহ
বিচারপতি জনাব মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার
বিচারপতি জনাব এ. কে. এম. সাহিদুল হক
বিচারপতি জনাব সহিদুল করিম
বিচারপতি জনাব আবু তাহের মােঃ সাইফুর রহমান
বিচারপতি জনাব মাহমুদুল হক
বিচারপতি জনাব মােঃ বদরুজ্জামান
বিচারপতি জনাব জাফর আহমেদ
বিচারপতি জনাব কাজী মােঃ ইজারুল হক আকন্দ
বিচারপতি জনাব মােঃ শাহিনুর ইসলাম
বিচারপতি জনাব কাশেফা হােসেন
বিচারপতি জনাব খিজির আহমেদ চৌধুরী
বিচারপতি জনাব রাজিক আল জলিল
বিচারপতি জনাব ভীষ্মদেব চক্রবর্তী
বিচারপতি জনাব মােঃ ইকবাল কবির
বিচারপতি জনাব মােঃ সেলিম
বিচারপতি জনাব মােঃ সােহরাওয়ারদী
বিচারপতি জনাব মােঃ আবু আহমেদ জমাদার
বিচারপতি জনাব এ. এস. এম. আব্দুল মােবিন
বিচারপতি জনাব মােঃ মােস্তাফিজুর রহমান
বিচারপতি জনাব ফাতেমা নজীব
বিচারপতি জনাব মােঃ কামরুল হােসেন মােল্লা
বিচারপতি জনাব এস এম কুদুস জামান
বিচারপতি জনাব মােঃ আতােয়ার রহমান
বিচারপতি জনাব খিজির হায়াত
বিচারপতি জনাব শশাঙ্ক শেখর সরকার
বিচারপতি জনাব মােহাম্মদ আলী
বিচারপতি জনাব মহি উদ্দিন শামীম
৭৩৯

বিচারপতি জনাব মােঃ রিয়াজ উদ্দিন খান
বিচারপতি জনাব এস. এম. মনিরুজ্জামান
বিচারপতি জনাব আহমেদ সােহেল
বিচারপতি জনাব সরদার মােঃ রাশেদ জাহাঙ্গীর
বিচারপতি জনাব খােন্দকার দিলীরুজ্জামান
বিচারপতি জনাব কে. এম. হাফিজুল আলম
বিচারপতি জনাব মুহম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম
বিচারপতি জনাব শাহেদ নূরউদ্দিন
বিচারপতি জনাব মােঃ জাকির হােসেন
বিচারপতি জনাব মােঃ আখতারুজ্জামান
বিচারপতি জনাব মােঃ মাহমুদ হাসান তালুকদার
বিচারপতি জনাব কাজী ইবাদত হােসেন
বিচারপতি জনাব কে এম জাহিদ সারওয়ার
বিচারপতি জনাব এ. কে. এম. জহিরুল হক
বিচারপতি জনাব কাজী জিনাত হক
৭৪০

আলােচ্য বিষয়
১. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশতবার্ষিকীতে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।
২. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিচার বিভাগের করণীয় সম্পর্কে আলােচনা।

আলােচনা
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব সৈয়দ মাহমুদ হােসেন এর বক্তব্য :
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। তিনি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন পঁচাত্তরের পনেরাে আগস্ট ঘাতকদের গুলিতে নিহত বঙ্গবন্ধ এবং বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতন নেছা মজিবসহ তার পরিবারের নিহত সদস্যবৃন্দ এবং পনের আগস্টে শাহাদাত বরণকারী অন্যান্য শহিদগণকে। আরও স্মরণ করেন মুক্তিযুদ্ধে নিহত ত্রিশ লক্ষ শহিদ, সম্ভ্রম হারানাে দুই লক্ষ মা-বােন এবং কারা অন্তরালে নিহত চার জাতীয় নেতাসহ সকল বীর মুক্তিযােদ্ধাদের। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে জাতির পিতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে অনুষ্ঠিত এই বিশেষ ফুল কোর্ট সভায় উপস্থিত সকল মাননীয় বিচারপতিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন, নিঃসন্দেহে এ দিনটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। শােষণ ও বঞ্চণামুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই স্বপ্ন থেকেই জাতির পিতা সংবিধানে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিচার বিভাগের উপর বঙ্গবন্ধুর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমাদের আরও সচেষ্ট হতে হবে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট উদ্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় ছিল স্বল্প খরচে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে দেশে আইনের শাসন এবং সুবিচার নিশ্চিত করা। তিনি অন্যায়ের কাছে কখনাে মাথা নত করেননি বলেই তাঁর জীবনের উল্লেখযােগ্য একটা সময় তাঁকে কারাগারের অন্তরালে কাটাতে হয়েছে। আদর্শ ও মূল্যবােধ থেকে তিনি কখনাে এক পা-ও পিছু হটে আসেননি। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কীভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হয়, কীভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়, কীভাবে শােষিত-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। বঙ্গবন্ধু একটি কার্যকর বিচারব্যবস্থা চেয়েছিলেন। ভার্চুয়াল আদালত কার্যকর বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাঁর স্বপ্নকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারির সময় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে ভাচুয়াল পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আপিল বিভাগে মােট মামলা ছিল ২৩ হাজার। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আপিল বিভাগ বিচারিক কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি করায় বর্তমানে আপিল বিভাগে মামলার সংখ্যা ১৫ হাজারে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগও উল্লেখযােগ্যসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করেছে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের বিজ্ঞ আইনজীবীগণ নিজ নিজ চেম্বার/বাসায় অবস্থান করে খুব সহজে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে শুনানিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন।
৭৪১

এমনকি বিজ্ঞ আইনজীবীগণ বিদেশে অবস্থান করেও শুনানিতে অংশগ্রহণ করছেন। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন তাঁর আন্তরিক প্রয়াসে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০’ প্রণীত হয়। তাঁকে সার্বক্ষণিক সহযােগিতা করার জন্য তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিবৃন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুনানির কারণে কোনও সময়ক্ষেপণ না করে শুনানি সম্পন্ন করা যাচ্ছে। করােনা মহামারির মধ্যে আদালত এর স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়ায় ঐ সময়ে মামলা নিষ্পত্তির হারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর থেকে বেরিয়ে এসে কীভাবে বেশিসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তি করা যায় সেই বিষয়ে সবাইকে দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তখনই বাস্তবায়িত হবে যদি বিচারকগণ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে।। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে দ্রুত। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হলে দ্রুততার সাথে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। ন্যায়বিচার। প্রতিষ্ঠার শেষ ভরসাস্থল হিসেবে বঙ্গবন্ধু বারংবার বিচার বিভাগের প্রতি আস্থা রেখেছেন। জাতির দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ১৯৭২ সালে যে অনন্যসাধারণ সংবিধান তিনি অতি স্বল্প সময়ে জাতিকে উপহার দিয়েছিলেন, তাতে সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠা ও বিচারকগণের স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনার বিধান সন্নিবেশিত হয়েছিল। তিনি মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা দেয়ার বিধান সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছিলেন। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর এই বিশেষ ক্ষণে আগামী ছয় মাস সকল বিচারপতিগণকে মামলা নিষ্পত্তি বৃদ্ধি করার জন্য তিনি অনুরােধ করেন। সুবিচার নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ে দেশের বিচারপ্রার্থী জনগণের মামলা নিষ্পত্তি করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। বিচারকগণ সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন মর্মে প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তিনি বক্তব্য সমাপ্ত করেন।

আলােচক মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ
আপিল বিভাগ :
মাননীয় বিচারপতি জনাব মােহাম্মদ ইমান আলী, মাননীয় বিচারপতি জনাব হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, মাননীয় বিচারপতি জনাব আবু বকর সিদ্দিকী, মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ নূরুজ্জামান, মাননীয় বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান।

হাইকোর্ট বিভাগ :
মাননীয় বিচারপতি জনাব সৈয়দ রেফাত আহমেদ, মাননীয় বিচারপতি জনাব এস. এম. এমদাদুল হক; মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ মঈনুল ইসলাম চৌধুরী, মাননীয় বিচারপতি জনাব এম. ইনায়েতুর রহিম, মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ রেজাউল হাসান, মাননীয় বিচারপতি জনাব এফ. আর. এম. নাজমুল আহাসান; মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ আবু জাফর সিদ্দিকী, মাননীয় বিচারপতি জনাব জাহাঙ্গীর হােসেন, মাননীয় বিচারপতি জনাব শেখ হাসান আরিফ, মাননীয় বিচারপতি জনাব জে. বি. এম. হাসান; মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ রুহুল কুদুস, মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ খসরুজ্জামান, মাননীয় বিচারপতি জনাব ফরিদ আহমেদ, মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার, মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ আশরাফুল কামাল, মাননীয় বিচারপতি জনাব আবু তাহের মােঃ সাইফুর রহমান, মাননীয় বিচারপতি জনাব কাজী মােঃ ইজারুল হক আকন্দ, মাননীয় বিচারপতি জনাব খিজির আহমেদ চৌধুরী, মাননীয় বিচারপতি জনাব মােঃ আবু আহমেদ জমাদার।
৭৪২

সিদ্ধান্ত
আলােচনান্তে সর্ব সম্মতিক্রমে নিমােক্ত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় :
১. জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে ২১ জুন ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ বেলা ০৩.০০ ঘটিকা হতে ০৬.১০ ঘটিকা পর্যন্ত Video Conference-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হােসেনের সভাপতিত্বে এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের উভয় বিভাগের মাননীয় বিচারপতিগণের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই বিশেষ ফুল কোর্ট সভা-স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালি জাতির স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পরম শ্রদ্ধায় উৎসর্গ করা হচ্ছে।
২. মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের আখরে লেখা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহের আলােকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারিক দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিগণ দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। বঙ্গবন্ধুর আকাঙ্ক্ষা ছিল দ্রুততম সময়ে ও স্বল্প খরচে বিচার সম্পন্ন করা- সে লক্ষ্যে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী দ্রুততার সাথে ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তির প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং বিচারব্যবস্থার সময়ােপযােগী সংস্কার করতে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে।
৪. বঙ্গবন্ধুর প্রত্যয় ছিল মায়ের ভাষা, রাষ্ট্র ভাষা বাংলাকে আদালতে প্রতিষ্ঠা করা; বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সে লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। ৫. এই ফুল কোর্ট সভার কার্যবিবরণী ও ধারণকৃত একটি ভিডিওচিত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে প্রেরণ করা হবে।
৬. এই ফুল কোর্ট সভার ধারণকৃত একটি ভিডিওচিত্র বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট জাদুঘর/আর্কাইভে সংরক্ষণ করা হবে।
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধান বিচারপতি সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে সভার সমাপ্তি ঘােষণা করেন।

বিচারপতি জনাব সৈয়দ মাহমুদ হােসেন
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি
৭৪৩
—X—

Previous