This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খণ্ড)
বদরুদ্দিন উমর
প্রথম পরিচ্ছেদ
সূত্রপাত
১। গণ-আজাদী লীগ
১৯৪৭ সালের ৩রা জুন বৃটিশ-ভারতের সর্বশেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার রােয়েদাদ ঘােষণা করেন। এই ঘােষণার পর মুসলিম লীগের অল্পসংখ্যক বামপন্থী কর্মীদের উদ্যোগে জুলাই মাসে ঢাকায় ‘গণ-আজাদী লীগ’ নামে একটি ক্ষুদ্র সংগঠন গঠিত হয়। আশু দাবী কর্মসূচী আদর্শ’ এই নামে তারা একটি ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন এবং তাতে তাদের মধ্যে এক নতুন চেতনার উন্মেষ লক্ষিত হয়। প্রথমেই নিজেদের আদর্শ ও কর্মসূচীর যৌক্তিকতাস্বরূপ তারা ঘরোয়া ঘােষণা করেন : দেশের স্বাধীনতা ও জনগণের স্বাধীনতা দুইটি পৃথক জিনিস। বিদেশী শাসন হইতে একটি দেশ স্বাধীনতা অর্জন করিতে পারে; কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, সেই দেশবাসীরা স্বাধীনতা পাইল। রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনাে মূল্যই নাই যদি সেই স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে ; কারণ, অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতীত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব নয়। সুতরাং, আমরা স্থির করিয়াছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংরাম চালাইয়া যাইতে থাকিব। এতদুদ্দেশ্যে আমরা দেশবাসীর সম্মুখে আদর্শ ও কর্মসূচী উপস্থিত করিতেছি। পাকিস্তানে নাগরিক অধিকার অব্যাহত রাখা এবং সুদৃঢ় করার জন্যে এই ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানটির প্রচেষ্টা শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী না হলেও প্রথম উদ্যোগ হিসাবে উল্লেখযােগ্য। ঢাকাস্থ মুসলিম লীগ কর্মীদের অন্যতম প্রধান নেতা কমরুদ্দীন আহমদ গণ-আজাদী লীগের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। সেদিক থেকেও প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ। স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ একটি বিরাট গণপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ১৯ss সালেই তার সদস্য সংখ্যা দাড়ায় পাঁচ লক্ষেরও বেশী। কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষক মজুর নিম্নমধ্যবিত্তের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানগতভাবে মােটেই সচেষ্ট হয়নি। উপরন্তু তেভাগা আন্দোলন এবং সেই সংক্রান্ত বিলকে প্রাদেশিক পরিষদে বানচাল করার ক্ষেত্রে মুসলিমলীগের জোতদার শ্রেণীভুক্ত প্রভাবশালী সদস্যদের ষড়যন্ত্র সংগঠনের অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল মহলে যথেষ্ট হতাশার সঞ্চার করে। ১৯৪৭-৪৮ সাল পর্যন্ত অব্যাহত তেভাগা আন্দোলনে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের এক বিরাট শক্তিশালী অংশের প্রতিক্রিয়াশীল ‘ভুমিকার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির চরিত্রও উদঘাটিত হয়। গণ-আজাদী লীগের ম্যানিফেস্টোটি কোনাে শক্তিশালী সংগঠনের ঘোষণা ছিলােনা। সে ঘােষণা ছিলাে মুসলিম লীগ কর্মীদেরই একটি প্রগতিশীল অংশের আত্মসমালােচনা এবং আত্মোপলব্ধির ঘােষণা। এতে তারা আরও বলেন :
সত্যিকার পাকিস্তান অর্থে আমরা বুঝি, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। সুতরাং আমাদের এখন কর্তব্য এই নবীন পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুন্দৰভাবে গঠিত করা, এবং মানুষের মধ্যে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি আনয়ন করা।
যে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী আনয়ন করার কথা উপরোক্তৃত অংশে বলা হয়েছে সে দৃষ্টিভঙ্গী অনেকাংশে সমাজতন্ত্রমুখী। তবে এই ঘােষণা যে মুসলিম লীগ চিন্তার প্রভাব মুক্ত নয় তার প্রমাণও এর মধ্যে আছে। এ জন্যে আশু দাবী হিসাবে একদিকে বলা হচ্ছে “লাঙল যার জমি তার ভিত্তিতে জমির বিলিব্যবস্থা করিতে হইবে। তেভাগা বিল পাস করিতে হইবে এবং বিল পাস হইবার পূর্বে একটি অডিন্যান্স দ্বারা এই বিলটি চালু করিতে হইবে।”৪ এবং “বিন খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করিতে হইবে এবং জমির উপর হইতে সর্বপ্রকার মধ্যস্বত্ব লােপ করিতে হইবে।” অন্যদিকে আবার বলা হচ্ছে “মুসলমানদের জাকাত সৱকার সংগ্রহ করিতে পারেন। এই টাকা মুসলিম শিক্ষার জন্য খরচ করিতে পারা যাইবে। কারণ, জাকাতের টাকা সব খাতে খরচ করা যায় না।৬ এবং “মসজিদকে ভিত্তি করিয়া জনগণের নিরক্ষরতা দূরীকরণের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা যাইতে পারে।’ | গণ-আজাদী লীগের এই ঘােষণাটিতে শিক্ষা ও ভাষা বিষয়ে যে দাবী করা হয় সেটা এই জাতীয় ম্যানিফেস্টের মধ্যে এর পূর্বে দেখা যায়নি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের সামনে পেশ করার জন্যে ১৯৫৬ সালে যে খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেন তার মধ্যে শিক্ষার অধিকার সম্পর্কে অনেকগুলি গণতান্ত্রিক দাবীর উল্লেখ ছিলাে কিন্তু ভাষা বিষয়ক কোনাে দাবী তার মধ্যে উত্থাপিত হয়নি। আলােচ্য ঘােষণাটিতে কিন্তু মাতৃভাষা, শিক্ষার মাধ্যম এবং রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। যেমন : “মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করিতে হইবে”” এবং
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষাকে দেশের যথোপযোগী করিবার জন্য সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাংলা হইবে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।”১০ | বাংলা পূর্ব-পাকিস্তানের রাখা হবে এর দ্বারা গণ-আজাদী লীগের মুখপাত্রেরা কি বলতে চেয়েছিলেন তা খুব স্পষ্ট নয়। তবে ঘােষণাটির মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে তার মধ্যে যে সকল দাবী-দাওয়ার কথা আছে সেগুলি প্রায় সবই পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে। সারা পাকিস্তানে কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তাদের যেন কোনাে বক্তব্যই নেই। শুধু ভাষার প্রশ্নেই নয়, অন্যান্য সকল প্রশ্ন সম্পর্কে তাদের ঐ একই মনোভাব। ম্যানিফেস্টোটি এমনভাবে লিখিত যেন পূর্ব পাকিস্তান একটি সম্পূর্ণ পৃথক রাষ্ট্র, তার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক নেই। এর একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এই যে তখনো পর্যন্ত মুসলিম লীগ বাঙল। দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনাে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয়নি। কাজেই গণ-আজাদী লীগের মুখপাত্রদের হয়তাে ধারণা ছিলো যে পাকিস্তানের দুই অংশে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্রীয় একক হিসাবে মোটামুটি ভাবে গণ্য করা যেতে পারবে। গণ-আজাদী লীগের বৈঠক গুলি অনুষ্ঠিত হয় জিন্দাবাহার প্রথম গলিতে কমরুদ্দীন আহমদের বাসায়। মােহাম্মদ তােয়াহা, অলী আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ এবং কমরুদ্দীন আহমদ যৌথভাবে কিছুসংখ্যক কর্মীদেরকে একত্রিত করেন। এরা সকলেই মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন এবং স্বাধীনতার পর এদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি গঠনের চিন্তা করছিলেন। ট পরে আলোচিত ম্যানিফেস্টোটি সেই চিন্তারই ফল। নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়েই এই সংগঠনটির কাজকর্য সীমাবদ্ধ ছিলাে। ১৯৫০ সালের ফব্রুয়ারিতে সংগঠনটির নাম পরিবতিত হয়ে দাড়ায় সিভিল লিবার্টিস লীগ।১১
২। ডক্টর শহীদুল্লাহর অভিমত। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানগতভাবে কোনাে প্রতিবাদ কেউ করেনি। মুসলিম লীগ মহলেও এ নিয়ে কোনাে বিতর্কের সূচনা হয়নি। কিন্তু জিয়াউদ্দীন
আহমদের এই সুপারিশের অসারতা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এ প্রবন্ধে তিনি বলেন :
কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দীর অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে। ইংরেজী ভাষার বিরুদ্ধে একমাত্র যুক্তি এই যে ইহা পাকিস্তান ডােমিনিয়নের কোনো প্রদেশের অধিবাসীরই মাতৃভাষা নয়। উদুর বিপক্ষেও একই যুক্তি প্রযােজ্য। পাকিস্তান ডােমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন যেমন—পুষ, তু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, এবং বাংলা; কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই মাতৃভাষারূপে চালু নয়। যদি বিদেশী ভাষ। বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার পক্ষে কোনাে যুক্তি নাই । যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোনাে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবী বিবেচনা করা কর্তব্য।
এখানে একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উদুর দাবী বিবেচনার ক্ষেত্রে ডক্টর শহীদুল্লাহ ধর্মের প্রসঙ্গ একেবারেই উত্থাপন করেননি। এক শ্রেণীর লােকে উদুর সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন শুধু এই যুক্তিতে যে উদুর সাথে ইসলামের যোগাযােগ বাংলা ভাষার থেকে ঘনিষ্ঠ । শহীদুঃহি সাহেব এ ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করার প্রয়ােজন বােধ করেননি। তার মতে আরবী ভাষাই বিশ্বের মুসলমানদের জাতীয় ভাষা। সেই হিসাবে তিনি মনে করেন যে আরবী ভাষাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ধর্মীয় ভাষা হিসাবে উদুর কোনাে স্থান নেই। ডক্টর শহীদুল্লাহ তার প্রবন্ধটির শেষে বলেন :
বাংলা দেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উদু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ডাঃ জিয়াউদ্দীন আহমদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরােধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।
এই প্রবন্ধটির পর ডক্টর শহীদুল্লাহ ১৭ই পৌষ, ১৩৫৪ তকবীর পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা সমস্যা নামে আর একটি লেখা প্রকাশ করেন। এই লেখাটিতে তিনি বাংলা, আরবী, উ এবং ইংরেজী ভাষা সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানীদের নীতি কি হওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করেন। বাংলা সম্পর্কে তিনি বলেন : হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙালীর জন্য প্রাথমিক শিক্ষনীয় ভাষা অবশ্যই বাঙলা হইবে। ইহা জ্যামিতির স্বীকৃত বিষয়ের ন্যায় স্বতঃসিদ্ধ। উন্মাদ ব্যতীত কেহই ইহার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিতে পারে না। এই
বাঙলা হইবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা। আরবী সম্পর্কে তার অভিমত : মাতৃভাষার পরেই স্থান ধর্মভাষার, অন্ততঃ মুসলমানের দৃষ্টিতে। এই জন আমি আমার প্রাণের সমস্ত জোর দিয়া বলিব, বাঙলার ন্যায় আমরা আরবী চাই।সেদিন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম সার্থক হইবে, যে দিন আর সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হইবে।•••কিন্তু বর্তমানে আরবী পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি বৈকল্পিক ভাষা ভিন্ন একমাত্র রাষ্ট্রভাষা
রূপে গ্রহণের যথেষ্ট অন্তরায় আছে। উদু শিক্ষা সম্পর্কে ক্টর শহীদুল্লাহ বলেন :
পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের জনগণের মধ্যে যােগ স্থাপনের জন্য, যাহারা উচ্চ রাজকর্মচারী কিংবা রাজনীতিক হইবেন, তাহাদের জন্য একটি আন্তঃপ্রাদেশিক (inter-provincial) ভাষা শিক্ষা করা প্রয়োজন। এই ভাষা উচ্চ শিক্ষিতদের জন্য ইংরেজীই আছে। ইহা অনস্বীকার্য বাস্তৰ ব্যাপার (fict)। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে ইহা চলে না। তজ্জন্য উদুর আবশ্যকতা আছে। এইজন্য রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উচ্চ রাজকর্মচারী ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী প্রত্যেক নাগরিকেরই উন্ন শিক্ষা করা কর্তব্য।
ইংরেজাকে পাকিস্তানের অন্যতম ভাষারূপে চালু রাখার সপক্ষে তিনি নিম্নোক্ত অভিমত প্রকাশ করেন :
আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে দেখিতে চাই। তজ্জন্য ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান, ইতালীয়ান, বা রুশ ভাষাগুলির মধ্যে যে কোনাে একটি ভাষা আমাদের উচ্চ শিক্ষার পঠিতব্য ভাষারূপে গ্রহণ করিতে হইবে। এই সকলের মধ্যে অবশ্য আমরা ইংরেজীকেই বাছিয়া
লইব। ইহার কারণ দুইটি (১) ইংরেজী আমাদের উচ্চ শিক্ষিতদের নিকট সুপরিচিত ; (২) ইংরেজী পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা অধিক প্রচলিত আন্তর্জাতিক ভাষা। আমি এই ইংরেজীকেই বর্তমানে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে বজায় রাখিতে প্রস্তাব করি।১০
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর উপরােক্ত ভাষা বিষয়ক মন্তব্য এবং সুপারিশ গুলির মধ্যে অনেক জটিলতা এবং পরস্পরবিরােধিতা থাকলেও এগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ জটিলতা এবং পরস্পরবিরােধী চিন্তা তার মধ্যেই শুধু ছিলাে না। সমসাময়িক রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ এবং জনসাধারণের চিন্তার মধ্যেও এ জটিলতা এবং পরস্পরবিরােধিতা যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান ছিলাে।
৩। গণতান্ত্রিক যুব লীগ।
১৯৪৭ সালের ১১ই অগাস্টের পর কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হােটেলে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী ও ছাত্রের পূর্ব পাকিস্তানে তাদের পরবর্তী কর্তব্য এবং কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে সমবেত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আতাউর রহমান (রাজশাহী, ) কাজী মহম্মদ ইদরিস, শহীদুল্লাহ কায়সার, আখলাকুর রহমান প্রভৃতি। এ ব্যাপারে তাঁর অন্যান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গেও আলাপ আলােচনা করেন। এই সব আলােচনার পর স্থির হয় যে স্বাধীনতাউত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং তার উপযুক্ত সংগঠন গঠন করা প্রয়োভন।
এর পর উপরােক্ত রাজনৈতিক কর্মীরা ঢাকা এসে কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, তসদ্দক আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, নূরুদ্দীন আহমদ, আবদুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রভৃতির সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন। নোতুন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে একটি সম্মেলন আহ্বানের এয়ােজনীয়তা সম্পর্কে তারা সকলেই একমত হন এবং এ ব্যাপারে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী এবং অজিত বসুও এ ব্যাপারে যথেষ্ট আগ্রহশীল ছিলেন।
এই প্রাথমিক আলাপ আলােচনার পর নেতৃস্থানীয় কর্মীরা সারা পূর্ব বাঙলাকে কতকগুলি এলাকাতে ভাগ করে সেখানকার কর্মীদের সাথে সম্মেলন সংক্রান্ত বাপারে যােগাযােগ স্থাপনের জন্যে সফর শুরু করেন। এই
সফরের পর বেশ কিছু সংখ্যক কর্মী সম্মেলনে যােগদান করতে সম্মত হন এবং ১৯৪৭ সালের ২৪শে অগাস্ট ঢাকায় রাজনৈতিক কর্মীদের এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারিত হয়।
৩১শে জুলাই সম্মেলনের জন্যে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়। ককিলউদ্দীন চৌধুরী এবং শামসুল হক যথাক্রমে সেই কমিটির সভাপতি এবং সম্পাদক মনােনীত হন। সম্মেলনের জন্যে একটি খসড়া ম্যানিফেস্টো ৫ই অগাস্ট ম্যানিফেস্টো নির্বাচন কমিটিতে পেশ করার পর সামান্য পরিবর্তিত হয়ে সেটি গৃহীত হয়। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে মহম্মদ তােয়াহা, কমরুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, নজমুল করিম, অলি আহাদ, তসদ্দক আহমদ এবং তাজউদ্দীন আহমদের নাম উল্লেখযােগ্য। এই সভাতে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে ম্যানিফেস্টোটি মুসলিম লীগের অন্তর্গত একটি পৃথক পার্টির নামে প্রকাশ করা হবে।
সম্মেলন শুরু হওয়ার অল্প কয়েকদিন পূর্বে নানা অসুবিধার জন্যে সম্মেলনের তারিখ বিবর্তিত হয় কিন্তু জেলা প্রতিনিধিদেরকে সময়মতাে খবর দিতে না পারার জন্যে তারা অনেকে নির্ধারিত তারিখের পূর্বদিন অর্থাৎ ২৩শে অগাস্ট চা ‘উপস্থিত হন। এইসব কর্মীদের নিয়ে সেদিন ১৫০ মােগলটুলীর মুসলিম লীগ অফিসে কমরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। এই সভায় ত্রিপুরা, নােয়াখালী, বরিশাল, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা এবং উত্তর বাঙলার কয়েকটি জেলার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
মুসলিম লীগ সরকার এই সম্মেলনটিকে সরকার-বিরােধী রাজনৈতিক কর্মীদের সমাবেশ বলে ধরে নিয়েছিলেন। ফলে বহু চেষ্টা সত্ত্বেও বার লাইব্রেরী হল জাতীয় কোনাে জায়গায় এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের অনুমতি লাভ সম্ভব হয়নি। শুধু তাই নয়, অনুমতি পাওয়া গেলেও শহরের প্রতিকূল অবস্থার জন্যে সেখানে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভবপরও ছিলাে না। কাজেই শেষ পর্যন্ত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির ভূতপূর্ব ভাইস চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাত আহমদের বাসায় এই সম্মেলনের স্থান নির্ধারিত হয়।
এই সময়কার ছাত্র রাজনীতির কয়েকটি ঘটনা খুব উল্লেখযােগ্য কারণ সেগুলি আসন্ন সম্মেলনটির কর্মসূচী ইত্যাদির উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে।
দেশ বিভাগের পূর্বে নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগ নামে মুসলিম ছাত্রদের যে সংগঠন ছিলাে তার কিছুসংখ্যক সদস্য ১৯৪৭-এর অগাস্ট মাসে ঢাকায় চলে আসেন। কলকাতা থেকে আগত এই সমস্ত ছাত্রদের মধ্যে সে সময়
সকলেই ছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। ঢাকার ছাত্রদের মধ্যে সে সময় তাদের বিশেষ প্রভাব ছিলাে না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা পূর্ব পাকিস্তানে। নােতুন করে একটি সাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু এই ছাত্রদের মধ্যে শাহ আজিজুর রহমান ও শেখ মুজিবর । রহমানের নেতৃত্বে উপদলীয় ঝগড়ার ফলে পুরাতন ছাত্র সংগঠনকে অবলম্বন করে নােতুন একটা সংগঠন গড়ে তোলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ঢাকার ছাত্রদের মধ্যেও এই সময় নোতুন প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে নানা আলাপ আলােচনা শুরু হয়। নঈমুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় ছাত্রের। একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন। ছাত্র ফেডারেশন নামে একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান তখনাে পর্যন্ত ছিলাে, কিন্তু কমুনিস্টদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার জন্যে মুসলমান ছাত্রেরা সরাসরিভাবে তাতে যােগদানের পক্ষপাতী ছিলেন না।
উপরোল্লিখিত যে সমস্ত ছাত্রেরা অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা চিন্তা করছিলেন তাঁদের মধ্যেও আলাপআলােচনাকালে কিছু মতপার্থক্য দেখা দেয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার উপর জোর দিলেও অন্যের বাস্তব অবস্থার কথা বিবেচনা করে মনে করেন যে তখনাে পর্যন্ত পুরােপুরি। অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের জন্যে মুসলমান ছাত্রের প্রস্তুত ছিলাে না। কাজেই তারা প্রস্তাব করেন যে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগঠনের নাম ‘মুসলিম ছাত্র লীগ। রাখা হােক, কিন্তু কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানটিকে পরিশেষে একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কাজও অব্যাহত থাকুক। পাছে প্রতিষ্ঠানটিকে কমুনিস্ট প্রতিষ্ঠান বলে বিরোধী পক্ষীৰ ছাত্র এবং সরকার-সংশ্লিষ্ট মহল আক্রমণ করতে না পারে বিশেষ করে তার জন্যেই এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটি উত্থাপিত হয়। এই প্রাথমিক আলােচনা অবশ্য প্রকাশ্য সভায় কোনােদিন উখাপিত হয়নি, অত্যন্ত অল্প সংখ্যক উদ্যোগী এবং নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিলাে।১০ | এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানটি গঠনের উদ্দেশ্যে ৩১শে অগাস্ট ফজলুল হক হলে ঢাকা সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের একটি সভা আহ্বান করা হয়। ৩০শে অগাস্ট নাজির লাইব্রেরিতে একটি ঘরোয়া বৈঠকে নঈমুদ্দীন আহমদ, আজিজ আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রভৃতি পরদিনের সভাতে ‘মুসলিম’ শব্দটি
ব্যবহার না করার বিষয়ে একমত হন। স্থির হয় যে নঈমুদ্দন আহমদ প্রথমেই সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করবেন। সভাতে ঢাকা শহরের জন্যে একটি অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তও এই বৈঠকে প্রহণ করা হয়। | ৩১শে আগস্ট বিকেলের দিকে ছাত্রের সঙ্গে চলে ফজলুল হ হলে সমবেত হতে শুরু করেন। এই সময় তাহের, দলিল, লেস ও কে সাথে নিয়ে সালেক এব” তারপর নিজাম ও আলাউদ্দিনের নেতৃত্বে কলতাবাহারের কিছু সংখ্যক ছেলে সেখানে উপস্থিত হয়। তারা প্রকৃতপক্ষে সেকির সেই সভা পণ্ড করার উদ্দেশ্যেই হাজির হয়েছিলো। কাজেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সভা আরম্ভ হওয়ার কিছু পূর্বেই সালেক সভাপতির আসন অধিকার করে বসলাে। ফজলুল হক হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মােয়াজ্জেম চৌধুরী সভাপতি হিসাবে হাবিবুর রহমানের নাম প্রস্তাব করেন এবং তা যথারীতি সমথিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাবেক সভাপতির চেষ্টার পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করে। এর ফলে চারিদিকে হৈ চৈ এবং মারপিট শুরু হয় এবং প্রধানতঃ মালেকের প্রতিই সকলের দৃষ্টি পড়ে। হেদায়েত, ইসমাইল, মােয়াজ্জেম চৌধুরী এবং অন্যান্য ছাত্রের খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠে সালেককে ধরে দারুণভাবে মারপিট করে। গুণ্ডারও এইভাবে ছাত্রদের কাছে মার খেয়ে হেরে যাওয়ার উপক্রম হয়। সালেকের শরীর মাবের আঘাতে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। সে অবশেষে দৌড়ে পালিয়ে রেলওয়ে হাসপাতালের | কাছাকাছি একটি বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে।
| গুণ্ডা ছাত্রদেরকে বিতাড়িত করার পর হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সভার কাজ যথারীতি শুরু হয়। প্রথমেই সভার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন নঈমুদ্দীন আহমদ এবং পরে মােয়াজ্জেম চৌধুরী, মতিউর রহমান ও অন্যান্য কয়েকজন বক্তৃতা করে ‘গুণ্ডামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। সভা এইভাবে ঘণ্টাখানেক চলার পর শাহ আজিজদের দলভুক্ত ইব্রাহিম এবং সুলতান সভাস্থলে প্রবেশ করে সভাপতির সাথে সরাসরি বাগড়া শুরু করে। এর ফলে সভায় দারুণ হৈ চৈ আরম্ভ হয় এবং প্রভােস্ট মাহমুদ হােসেন সেখানে উপস্থিত হয়ে সকলকে | সভাস্থল ত্যাগ করতে অনুরোধ করেন। ঠিক এই সময়ে একটি ট্রাকে করে কলতাবাজার এলাকায় বেশ কিছুসংখ্যক গুণ্ডা ছোরা-ছুরি-রড ইত্যাদি নিয়ে ফজলুল হক হলের কম্পাউণ্ডে উপস্থিত হয়ে মােয়াজ্জেম, আজিজ আহমদ, খয়ের,
হেদায়েত প্রভৃতিকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। কিন্তু পুনর্বার মাহমুদ হােসেন | ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে গুণ্ডাদেরকে ধমকে হল থেকে তাড়িয়ে দেন। এই সমস্ত গণ্ডগােলের ফলে সেদিনকার সভায় যথেষ্ট ছাত্র সমাবেশ সত্ত্বেও ঢাকা শহর সাংগঠনিক কমিটি গঠন অথবা অন্য কোনাে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভবপর হয়নি। | ছাত্রদের হাতে মার খাওয়ার পর সালেক শহরের বিভিন্ন এলাকায় তার ক্ষত চিহ্নগুলি দেখিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করে এবং তার ফলে শহরের বহু লােকে ছাত্রদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা প্রচার করে যে নাজিমুদ্দীন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছাত্রেরা সভা করছিলাে এবং সেই সভা ভেঙে দিতে যাওয়ার জন্যে ছাত্রেরা সালেকের উপর হামলা করেছে। মােটকথা সেদিনকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরে বেশ কয়েকদিন উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।
যে ট্রাকটিতে চড়ে গুণ্ডারা ফজলুল হক হলে এসেছিলাে তাজউদ্দীন আহমদ তার নম্বর টুকে রেখেছিলেন ( B. G. D. 629) এবং খোঁজ নিয়ে তারা জানতে পারেন যে সেটি ছিলাে পূর্ব বাঙলা সরকারের সিভিল সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের। একথা জানার পর তাজউদ্দীন আহমদ, সামসুদ্দীন আহমদ, মােয়াজ্জেম চৌধুরী এবং আরও তিনজন ছাত্র ২রা সেপ্টেম্বর বেসামরিক সরবরাহ বিভাগের মন্ত্রী নুরুল আমীনের বাড়িতে গিয়ে সমস্ত ব্যাপারটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দাবী করেন। নূরুল আমীন কিন্তু ছাত্রদেরকে বলেন যে সিভিল সাপ্লাই বিভাগের কোনো কর্মচারীর ছেলে যদি ট্রাকটিকে ঐভাবে ব্যবহার করে থাকে তাহলে সে সম্পর্কে তার করার কিছু নেই। ছাত্রেরা তখন তাকে জানান যে ট্রাকের সঠিক নম্বর তাদের কাছে আছে, কাজেই তিনি অনায়াসে তার থেকে বের করতে পারেন কে প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তারপর তাকে শাস্তিদানের ব্যবস্থাও করতে পারেন। কিন্তু নূরুল আমীন শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো কিছুই করেননি। এ ব্যাপারে তার নিষ্ক্রিয়তার কারণ ছাত্রদের মধ্যে তাদের নিজেদের লােকরাই একাজ করেছিলাে এবং তিনি সেকথা জানতেন।৩.
যুব সম্মেলনের পরিবর্তিঅ তারিখ নির্ধারিত হয়েছিলো ৬ই ও ৭ই সেপ্টেম্বর। সরকার পক্ষীয় লােকেরা সম্মেলনটিকে পণ্ড করার জন্য নানা ব্যবস্থা অবলম্বন কৰে। ৫ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা আটটার দিকে ইব্রাহিম, ইরতিজা প্রভৃতি কয়েকজন মুসলিম লীগ অফিসের কাছাকাছি এবং অন্যান্য এলাকাতে সম্মেলনের বিরুদ্ধে ইস্তাহার বিলি করে গণ্ডগােল সৃষ্টির চেষ্টা করে। ৬ই সেপ্টেম্বরও তারা একটি ট্রাকে চড়ে সমস্ত শহর ঘুরে ইস্তাহার বিলি এবং সম্মেলনের বিরুদ্ধে নানা প্রকার ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকে।১৪
যুব সম্মেলনে সকল দলের সেই সব রাজনৈতিক কর্মীদেরকে বিশেষভাবে
আহ্বান করা হয়েছিলাে, যারা ছিলেন পার্লামেন্টারী রাজনীতির সাথে সম্পর্কহীন। কিন্তু এই সম্মেলনে প্রায় পাঁচশত জন১৫ কর্মী সমবেত হলেও বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সুহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত এবং অন্যান্য বামপন্থী কর্মীরা ছাড়া অন্য কেউ এতে যােগদান করেননি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে বেশ কিছু সংখ্যক হিন্দু প্রতিনিধি ও এই সম্মেলনে সমবেত হন। জেলাগুলির মধ্যে একমাত্র চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য সব জেলার প্রতিনিধিরাই সম্মেলনটিতে উপস্থিত ছিলেন। | ৬ই সেপ্টেম্বর দুপুর দুটো খান সাহেব আবুল হাসনাতের বাসায় তসন্দুক আহমদের সভাপতিত্বে সম্মেলন আরম্ভ হয়। সন্ধ্যে ছয়টার দিকে বিষয় নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয় এবং সেই কমিটির সভা ডাের তিনটে পর্যন্ত চলে। | ৭ই সেপ্টেম্বর সকাল ৯-৩০ মিনিটে সম্মেলনের কাজ আবার শুরু হয় এবং বিষয় নির্বাচনী কমিটির প্রস্তাবগুলি সবই একে একে শান্তিপূর্ণভাবে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবগুলি প্রধানতঃ ছিলাে গণদাবীর সন, খাদ্য সমস্যা এবং গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠন সম্পর্কে। এই দিন শামসুল হক সম্মেলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে আধ ঘণ্টার একটি বক্তৃতা দান করেন।১৮
কর্মী সম্মেলনের উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে সম্মেলনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গণদাবীর সনদের ভূমিকায় শামসুল হক বলেন :
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর কায়েদে আজম জিন্নাহ সাহেব বলিয়া ছিলেন যে, তিনি তাহার কাজ করিয়াছেন এখন যুবকদেরই এই দেশ গড়িতে হইবে। কর্মী সম্মেলনেরও উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি কর্মপন্থা স্থির করা যাইতে পূর্ব পাকিস্তানের সকল হিন্দু-মুসলমান যুবক বর্তমান অবস্থায় তাহাদের কর্তব্য বুঝিয়া আজাদ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুখী, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধিশালী
আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিতে অগ্রসর হইতে পারেন। তিনি আরও বলেন :
সম্মেলনের প্রস্তাব অনুযায়ী কর্মীদের মনের এই অাশবাণী পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ রাষ্ট্রগঠন পরিষদ, দেশের নেতৃবৃন্দ এবং জনসাধারণ সকলেরই
কাছে উপস্থিত করা হইবে।0 সম্মেলনের প্রধান উদ্দেশ্য সম্পর্কে শামসুল হক বলেন :
পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল একটি ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক যুব প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচী তৈয়ার করা এবং সারা দেশব্যাপী এই প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তােলার দায়িত্ব গ্রহণের জন্য কর্মীদিগকে উদ্বুদ্ধ করা।
উপরােক্ত উদ্দেশ্যেই যুব সংগঠনের ইস্তাহারখানা রচিত হইয়াছে। উহাতে বলা হইয়াছে যে, নবজাত শিশু পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সাহায্য করার জন্য দেশে। বহু যুব প্রতিষ্ঠান স্বভাবতই গড়িয়া উঠিবে সন্দেহ নাই, কিন্তু সকল যুবশক্তির মিলন না ঘটিলে কোনো রহং কাজই করা সম্ভব হইবে না। তাই যুব সংগঠনের ইস্তাহার যুবকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি সাধন ও পূর্ণ বিকাশের জন্য সাধারণ গণতান্ত্রিক নীতির উপর ভিত্তি করিয়াই রচিত হইয়াছে। কোনো বিশেষ বিতর্কমূলক সমস্যা ও তাহার সমাধানের অবতারণা ইহাতে করা হয় নাই এবং জনগণের মূলদাবীর সনদকেও সরাসরি যুব সংগঠনের ইস্তাহার বলিয়া বলিয়া গৃহীত
হয় নাই নাই। পূর্ব-পাকিস্তান কমী সম্মেলনে নিম্নলিখিত ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব গৃহীত হয় :
পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।২২
পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পক্ষ থেকে যুব-ইস্তাহার নামে একটি পৃথক ঘােষণা এই সম্মেলনে গৃহীত হয়। তাতে শিক্ষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে বলা হয় :
নিজের মাতৃভাষায় বিনা খরচে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা পাওয়ার মৌলিক অধিকার প্রত্যেক ছেলেমেয়ের রহিয়াছে এবং তাহা তাহাদের জন্য অতি প্রয়ােজনীয়। জাতীয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের
সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করিতে হইবে ।৩ এই ঘােষণাটিতে আরও বলা হয় :
যুবকদের সকল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার মূলনীতিকে সর্বদা প্রাধান্য দিতে হইবে এবং যুবকের কার্যে যাহাতে উত্তম সঙ্গীত, নাটক, সাহিত্য এবং ছবি উপভােগ করিতে ও বুঝিতে পারে তাহার সুযােগ দিতে হইবে। সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল্যবােধ বাড়াইবার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য এবং বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে প্রয়ােজনীয় সুবিধা দান করিতে হইবে। এই প্রয়ােজনে গড়িয়া-উঠা যুবকেন্দ্র এবং যুব সংগঠনকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য দান করিতেই হইবে।২৪
এছাড়া সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সম্পর্কে ইস্তাহারটিতে স্পষ্টভাবে দাবী করা হয় : রাষ্ট্রের অধীনস্থ বিভিন্ন এলাকার পৃথক পৃথক সাহিত্যও সংস্কৃতির বিকাশকে সরকার স্বীকার করিয়া নিবেন, জীবন এবং সংস্কৃতিকে গড়িয়া তুলিতে এইসব এলাকার সকল ব্যাপারে স্বায়ত্তশাসন মানিয়া লইতে হইবে।২৫
১৯৪৭ সালের ৬ই ও ৭ই সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত এই কর্মী সম্মেলনে একটি স্বতন্ত্র যুব প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুসারে প্রায় ২৫ জন সদস্য নিয়ে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের পূর্ব পাকিস্তান সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।২৬ এ সম্পর্কে আরও সিদ্ধান্ত হয় যে উপরােক্ত সাংগঠনিক কমিটি জেলা এবং অন্যান্য ইউনিটে প্রাথমিক কাজকর্ম শেষ করে ছয় মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যুবকদের একটি সম্মেলন আহ্বান করবে।
পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন এবং গণতান্ত্রিক যুব লীগ সম্পর্কিত কোনাে খবর তৎকালীন কোনাে সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি। সরকারী এবং সরকার-সমর্থক বেসরকারী হস্তক্ষেপই তার প্রধান কারণ। ছয় মাস পর নবগঠিত সংগঠনটির উদ্যোগে একটি বর্ধিত সম্মেলন আহ্বানের যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলাে সেটাও কার্যকরী হয়নি। বস্তুতঃপক্ষে গণতান্ত্রিক যুব লীগ যে উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে গঠিত হয়েছিলাে তা বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। সংগঠনটির পক্ষ থেকে ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগ’ নামে একটি বুলেটিন আখলাকুর রহমান এবং আতাউর রহমানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু মাত্র কয়েকটি সংখ্যা বের হওয়ার পরই তা বন্ধ হয়ে যায়।
এই কর্মী সম্মেলনের পর ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ই মার্চ, ১৯৪৮-এর মধ্যে কলকাতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে দেশবিদেশের বহু যুব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা যােগদান করেন। গণতান্ত্রিক যুব লীগের পক্ষে এই সময় শামসুল হক, আবদুর রহমান চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার, লিলি খান, লায়লা আরজুমান্দ বানু প্রভৃতি যােগদান করেন। মােহাম্মদ তােয়াহারও এই সম্মেলনে যােগদানের কথা ছিলাে কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি। শাহ আজিজুর রহমান এবং তার দলভুক্ত পূর্বতন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগের কিছু সদস্য এই সম্মেলনে যােগদানের চেষ্টা করলেও গণতান্ত্রিক যুব লীগের প্রতিনিধিরাই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল হিসাবে এই সম্মেলনে স্বীকৃতি লাভ করেন।২৯।
৪। তমদ্দন মজলিশের প্রাথমিক উদ্যোগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র এবং অধ্যাপকের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তমদ্দন মজলিস নামে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে আলাপ-আলােচনা সভাসমিতি ইত্যাদি ব্যাপারে প্রথম থেকেই বেশ কিছুটা সক্রিয় হয়। তারা ১৫ই সেপ্টেম্বর ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উদ? এই নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। তাতে লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মােতাহার হােসেন, কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ। তাছাড়া এই পুস্তিকাটির প্রথম দিকে তমদ্দুন মজলিসের পক্ষে ভাষা বিষয়ক একটি প্রস্তাব সংযােজিত হয়। সেটি লেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের অধ্যাপক এবং তমদ্দুন মজলিনের প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেম। নিচে সেই প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ উদ্ভূত হলাে :
১। বাংলা ভাষাই হবে : (ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন। (খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা। (গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা। ২। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দুটি—উদু ও বাংলা। ৩। (ক) বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা বিভাগের প্রথম ভাষা।
ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা একশজনই শিক্ষা করবেন। (খ) উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা বা আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা। যারা
পাকিস্তানের অন্যান্য অংশে চাকুরি ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হবেন তারাই শুধু ও ভাষা শিক্ষা করবেন। ইহা পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৫ হতে ১০ জন শিক্ষা করলেও চলবে। মাধ্যমিক স্কুলের উচ্চতর
শ্রেণীতে এই ভাষা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়া যাবে। | ইংরেজী হবে পূর্ব পাকিস্তানের তৃতীয় ভাষা বা আন্তর্জাতিক ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসাবে যারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চাকুরি করবেন বা যারা উচ্চতর বিজ্ঞান-শিক্ষায় নিয়ােজিত হবেন তারাই শুধু ইংরেজী শিক্ষা করবেন। তাদের সংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের হাজার করা ১ জনের চেয়ে কখনাে বেশী হবে না। ঠিক একই নীতি হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিতে ওখানের স্থানীয় ভাষা
বা উদু প্রথম ভাষা বাংলা দ্বিতীয় ভাষা আর ইংরেজী তৃতীয় ভাষার স্থান অধিকার করবে। শাসনকার্য ও বিজ্ঞান-শিক্ষার সুবিধার জন্য আপাততঃ কয়েক বৎসরের জন্য ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসনকাৰ চলবে। ইতিমধ্যে প্রয়ােজনানুযায়ী বাংলা ভাষার সংস্কার সাধন
করতে হবে। আবুল কাসেম রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে তার এই লেখায় বলেন যে ইংরেজরা একসময় জোর করে আমাদের ঘাড়ে ইংরেজী ভাষা চাপিয়ে দিয়েছিলাে। সেইভাবে কেবলমাত্র উর্দু অথবা বাংলাকে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করলে পূর্বের সেই সাম্রাজ্যবাদী অযৌক্তিক নীতিরই অনুসরণ করা হবে। তিনি উল্লেখ করেন যে কোনাে কোনাে মহলে সেই প্রচেষ্টা চলছে এবং তাকে প্রতিহত করার জন্যে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সর্বশেষে তমদ্দন মজলিসের পক্ষ থেকে তিনি দাবী করেন :
লাহের প্রস্তাবেও পাকিস্তানের প্রত্যেক ইউনিটকে সার্বভৌমত্বও স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কাজেই প্রত্যেক ইউনিটকে তাদের স্ব স্ব প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নির্ধারণ করবার স্বাধীনতা দিতে হবে।
পুস্তিকাটির অন্য দুজন লেখকের মধ্যে কাজী মােতাহার হােসেনের “রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা” নামক প্রবন্ধটিতে ভাষা সমস্যাকে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখার কিছুটা চেষ্টা আছে। তিনি তার প্রবন্ধে বাংলা ভাষার উন্নতি ও চর্চার ক্ষেত্রে মুসলমানদের ভূমিকা উল্লেখ করে বলেন :
মোগল যুগে বিশেষ করে আরাকান রাজসভার অমাত্যগণ, বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করেছেন। মুসলমান সভাকবি দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল বাংলা কবিতা লিখে অমর কীতি লাভ করেছেন। এদের ভাষা সংস্কৃত, আরবী, ফাসী, উর্দ প্রাকৃত প্রভৃতি নানা ভাষার শব্দ-সম্ভারে সমৃদ্ধ ছিল; কিন্তু এরা জোর করে কোনাে নিদিষ্ট ভাষা থেকে বিকট বিকট শব্দ আমদানী করতে চেষ্টা করেননি, তৎকালীন জনসমাজের নিত্য ব্যবহৃত বা সহজবােধ্য ভাষাতেই তারা কাব্য রচনা করে গেছেন।
এসব কথা বলার প্রয়ােজন হয়েছিলাে তার কারণ এক শ্রেণীর লােকের ধারণা অনুসারে বাংলা হিন্দুদের ভাষা কাজেই পরিত্যাজ্য এবং উর্দু ইসলামের
ভাষা কাজেই গ্রহণীয়। এই সমস্যার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন :
পূর্ব বাংলার মুসলমানদের আড়ষ্টতার আরও দুটি কারণ ঘটেছিল। প্রথমটি মাতৃভাষা বাংলার প্রতি অবহেলা, আর দ্বিতীয়টি ধর্মীয় ভাষার সম্পর্কিত
মনে করে উর্দু ভাষার প্রতি অহেতুক আকর্ষণ বা মােহ। এর ফলে যে অবস্থা দাড়িয়েছে তা হলাে : বাঙালী মুসলমানের সত্যিকার সভ্যতা বলতে যেন কোনাে জিনিসই নাই, পরের মুখের ভাষা বা পরের সেখান বুলিই যেন তার একমাত্র সম্পদ। স্বদেশে সে পরবাসী বিদেশীই যেন তার আপন। তাই তার উদাসীভাব, পশ্চিমের প্রতি অসহায় নির্ভর, আর নিজের প্রতি নিদারুণ আস্থাহীনতা পশ্চিমা চতুর লােকেরা এ অবস্থার পূর্ণ সুযোেগ গ্রহণ করেছে। তারা জানে যে, বৃহৎ পাগড়ী বেঁধে বাংলা দেশে এলেই এদের পীর হওয়া যায়, কমের পক্ষে মৌলবীর আসন গ্রহণ করে বেশ দু-পয়সা রােজগারের যােগাড় হয়। শহুরে দোকানদার যেমন করে গ্রাম্য ক্রেতাকে ঠকিয়ে লাভবান হতে পারে, এ যেন ঠিক সেই অবস্থা! বাস্তবিক বাঙালী মুসলমান বাঙালি বলেই শুধু পশ্চিমা কেন, পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণের সর্বভূতের কাছেই উপহাস ও শশাষণের পাত্র।
বিকৃত ধর্মীয় সংস্কার কিভাবে মানুষকে বিপথগামী করে সে বিষয়ে তিনি বলেন :
আমি উর্দু ভাষাকে নিন্দা বা অশ্রদ্ধা করি না, কিন্তু বাঙালী মুসলমানের উদুর মােহকে সত্যসত্যই মারাত্মক মনে করি। যখন দেখি, উর্দু ভাষায় একটা অশ্লীল প্রেমের গান শুনেও বাঙালী সাধারণ ভদ্রলােক আল্লাহের মহিমা বণিত হচ্ছে মনে করে ভাবে মাতােয়ারা, অথবা বাংলা ভাষায় ‘ রচিত উৎকৃষ্ট ব্ৰহ্মসঙ্গীতও হারাম বলে নিন্দিত, তখনই বুঝি এই সব অবােধ ভক্তি বা অবােধ নিন্দার প্রকৃত মূল্য কিছুই নাই।৬ কাজেই ডক্টর মোতাহার হােসেনের মতে বাংলা চর্চা ব্যতীত মুসলমানদের অন্য উপায় নেই :
এতদিন মুসলমান কেবল হিন্দুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত আরামে বসে বলেছেন যে হিন্দুরা বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানীভাবে ভরে দিয়েছে, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে ত তা চলবে না। এখানে ইসলামী ঐতিহ পরিবেশন করার দায়িত্ব মুখ্যতঃ মুসলমান সাহিত্যিকদেরই বহন করতে হবে। তাই
আর সময় এসেছে, মুসলমান বিজন পুথি-সাহিত্যের স্থলবর্তী বাংলাসুসাহিত্য সৃষ্টি করে মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয় স্থাপন করবেন; তবেই মাতৃভাষা সম্পূর্ণ সমৃদ্ধ হবে এবং ইসলামী ভাবধারা যথার্থভাবে জনসাধারণের প্রাণের সামগ্রী হয়ে তাদের দৈন্য ও হীনতাবােধ দূর করবে। উদুর দুয়ারে ধর্না দিয়ে আমাদের কোনাে কালেই যথার্থ লাভ হবে না।’
উপরােল্লিখিত উক্তিগুলি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও কাজী মােতাহার হােসেনের অন্য কতকগুলি অংশের বক্তব্য অধিকতর উল্লেখযােগ্য :
দারিদ্র্য দূর করতে হলে সামাজিক বৈষম্য দূর করা, বৈদেশিক শােষণ থেকে আত্মরক্ষা করা, এবং জাতীয় সম্পদ যাই থাক, শিল্প বাণিজ্যের সাহায্যে তার বিনিময়ের ব্যবস্থা করা একান্ত আবশ্যক। শুধু প্রভাব কিছুটা খর্ব হলেই হবে না-ইংরেজের স্থান যেন বৈদেশিক বা অন্য কোনাে প্রদেশীয় লােকে দখল করে না বসে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখা নিতান্ত প্রয়ােন। কুচক্রী লােকেরা যাতে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে, ভাষার বাধা সৃষ্টি করে নানা অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মানসিক বিকাশে বাধা না জমাতে পারে, সে বিষয়ে নেতৃবৃন্দ এবং জনসাধারণকে সজাগ থাকতে হবে। কাজেই, উকে শ্রেষ্ঠ ভাষা বা বনিয়াদী ভাষা বলে চালাবার চেষ্টার মধ্যে যে অহমিকা প্রচ্ছন্ন আছে তা আর চলবে না। নবজাগ্রত জনগণ আর মুষ্টিমেয় চা লিয়াত বা তথাকথিত বুনিয়াদি গােষ্ঠীর চালাকিতে ভূলবে না। বরং পূর্ব পাকিস্তানে সরকারী চাকুরি করতে হলে প্রত্যেককে বাংলা ভাষায় মাধ্যমিক মান পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় শিক্ষানবীশী সময়ের পরে অযােগ্য এবং জনসাধারণের সহিত
সহানুভূতিহীন বলে এরূপ কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হবে।” সর্বশেষে কায়েমী স্বার্থবাদীদেরকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন :
আমাদের দেশেও, নােতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে জনগণ প্রমাণ করবে যে তারাই রাজা—উপাধিধারীদের জনশোষণ আর বেশী দিন চলবে না। বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উদুকে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তােষ বেশী দিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে। জনমতের দিকে লক্ষ্য রেখে ন্যায়সঙ্গত
এবং সমগ্র রাষ্ট্রের উন্নতির সহায়ক নীতি ও ব্যবস্থা অবলম্বন করাই দূরদশী। রাজনীতিকের কর্তব্য।১০
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু?। পুস্তিকাটিতে আবুল মনসুর আহমদ ‘বাংলা ভাষাই হবে আমাদের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক তার দুই পৃষ্ঠার ছােট লেখাটির মধ্যে বলেন :
উদুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি ‘অশিক্ষিত ও সরকারী চাকুরির “অযােগ্য” বনিয়া যাইবেন। উনবিংশ শতশ’র মধ্যভাগে ফারসীর জায়গায় ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা করিয়া বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম শিক্ষিত সমাজকে রাতারাতি “অশিক্ষিত ও সরকারী কাজের অযােগ্য করিয়াছিল।১১
অর্থাৎ তার বক্তব্যের সরল অর্থ দাড়ায় এই যে ইংরেজরা সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ী যেমন ভারতবর্ষের মুসলমানদেরকে অযােগ্য করেছিলাে অনুরূপভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীরাও উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের উপর চাপিয়ে দিলে বাঙালীদেরকে অশিক্ষিত এবং অযোগ্য করার ষড়যন্ত্রে ঔর। লিপ্ত আছেন বলে মনে করাই যুক্তিসঙ্গত হবে।
প্রথম পর্যায়ে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের জন্ম এবং দ্রুত প্রসারের জন্যে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত অনেক উদুভাষী সরকারী কর্মচারী এবং পশ্চিম পাকিস্তানী আমলাদের বাঙালী বিরােধী মনোভাব এবং কার্যকলাপই অনেকাংশে দায়ী। উপরােল্লিখিত উক্তিগুলি থেকে একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বাধীনতা লাভের মাত্র একমাসেরও কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে তিক্ততা শুধু যে সৃষ্টি হয়েছে তাই নয়, যথেষ্ট বুদ্ধি লা করেছে। ভাষার প্রশ্নটি এক অংশের দ্বারা যে অপর অংশের উপর প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষ আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নের সাথে জড়িত সে চেতনাও এই স্তরে ভাষা বিষয়ক চিন্তা এবং আলােচনার মধ্যে উপস্থিত।
সম্প্রতি ভাষা অন্দোলন সম্পর্কে একটি প্রবন্ধে ফরিদ আহমদও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। তার মতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার আগ্রহ কারাে মধ্যে দেখা গেলাে না। উপরন্তু দেশের অবস্থা দেখে মনে হলাে যেন সাদা প্রভুদের স্থলে শুরু হলাে দেশীয় প্রভূদের এক নিশ্চিন্ত রাজত্ব। এই নােতুন প্রভূদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ স্বাধীনতা লাভের পথ থেকেই পুঞ্জীভূত হতে থাকলে এবং তার ফলে সরকারী আমলারা ক্রমশঃ জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকলেন।
এই সমস্ত সরকারী আমলারা উদুতে এবং ইংরেজীতে কথা বলতেন এবং তাদের প্রায় সকলের মাতৃভাষাই ছিলো উদু। কাজেই অতি সত্বর সাধারণ মানুষেরা এই সব কর্মচারীদেরকে বিদেশী বলে চিহ্নিত করলাে এবং তাদের ভাষা উদু ও পরিগণিত হলাে একটি বিদেশী ভাষা রূপে। | ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা-না উদু? নামে এই পুস্তিকাটি বেশ কপি বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। যাদের কাছে সেটা বিক্রি করার চেষ্টা হয়েছিলাে তাদের মধ্যে অধিকাংশই তখন ছিলেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে। শুধু শিক্ষিত জনসাধারণ নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সংখ্যক ছাত্রেরও অভিমত তাই ছিলাে। সেজন্যে তারা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে তেমন উৎসাহ দেখাননি। এমন কি মুসলিম হল, ফজলুল হক হল ইত্যাদি ছাত্রাবাসেও এ নিয়ে প্রথম দিকে কোনাে ছােট-খাট ঘরােয়া বৈঠকের আয়ােজন করাও ছিল কষ্টসাধ্য।
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে তমদ্দন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম ভাষা প্রশ্ন আলােচনা ও বিবেচনার জন্যে ফজলুল হক হলে একটি সাহিত্য সভার এক কন করেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন পূর্ব বাঙলা সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। সভাপতি ব্যতীত উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে যারা আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে কবি জসিমউদ্দীন, কাজী মােতাহার হোসেন, প্রাদেশিক মন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ আফজল এবং আবুল কাসেম অন্যতম। বক্তাদের মধ্যে সকলেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা এবং তার জন্যে উপযুক্ত আন্দোলন গঠনের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেন।
৫। ভাষার দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথম সভা
৫ই ডিসেম্বর, ১৯৪৭ ঢাকাতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়াকিং কমিটির সর্বশেষ বৈঠক বসে। ওয়ার্কিং কমিটির এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে উর্দুকে পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা করা হবে না। কমিটির সভাপতি মৌলানা আকরম খানকে এই মর্মে সংবাদপত্রে একটি ঘােষণা প্রকাশের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। | প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী বাসভবন বর্ধমান হাউসে এই বৈঠক চলাকালে বহুসংখ্যক ছাত্র এবং কয়েকজন শিক্ষক সেখানে উপস্থিত হয়ে বাংলাকে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে বিক্ষোভ
প্রদর্শন করেন। তাদের দাবী: সহানুভূতির সাথে বিবেচিত হবে, মৌলানা আকরম খানের থেকে এই আশ্বস লাভের পর বিক্ষোভকারীরা বর্ধমান হাউস পরিত্যাগ করেন।
ঐ দিনই তমদুন মজলিসের পক্ষ থেকে আবুল কাসেম এৰং আৰু, জাফর শামসুদ্দীন মৌলানা আকরম খানের সাথে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করেন। এই আলােচনার পর একটি প্রেস বিবৃতিতে আবুল কাসেম বলেন, আলােচনা প্রসলে মৌলানা আকরম খান তাদেরকে আশ্বাস দেন যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষাৰুপে বাংলা ছাড়া অন্য কোনােভাষাকেচাপােনােরচেষ্টা করলেপূর্ব পাকিস্তান বিদ্রোহ ঘােষণা করবে এবং তিনি নিজে সেই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেবেন।
এর পূর্বে করাচীতে একটি শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই সম্মেলনে অংশ গ্রহণের পর পূর্ব বাঙলা সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদ ই সন্ধ্যায় ঢাকা বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যা বলেন তার বিবরণ ৬ই ডিসেম্বরের মনিং নিউজে প্রকাশিত হয়। এই বিবরণ অনুসারে তারা বলেন যে শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ঐদিন মনিং নিউজে প্রকাশিত এবং এ. পি. আই. পরিবেশিত একটি খবরে বলা হয় যে, শিক্ষা সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফাঙ্কা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় নাই। পাকিস্তান সংবিধান সভাই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের মীমাংসা করবে।
শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৬ই ডিসেম্বর বেলা দুটোর সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের এক বিরাট সভা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং তমদুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রভাষার দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এই হলাে সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্রসভা। এই সভায় যারা বক্তৃতা করেন তাদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, আবদুর রহমান, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ. কে. এম. আহসান, এস আহমদ অন্যতম। ভাষা সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে বক্তারা। বক্তৃতা দেন এবং বাংলা ভাষাকে সাংস্কৃতিক দাসত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্রের বিষয় উল্লেখ করেন। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের বাঙালীকে খর্ব করার এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করার জন্য তারা শ্রোতৃমণ্ডলীর কাছে আহ্বান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফরিদ আহষ এই সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলিপেশ করেন এবং সেগুলি সর্বসম্মতিক্রমেগৃহীত হয় : | ১। বাংলাকে পাকিস্তান ভমিনিয়নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করা হােক।
২। রাষ্ট্রভাষা এবং লিংগুয়া ফ্রাংকা নিয়ে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য আসল সমস্যাকে ধামাচাপা দেওয়া এবং বাংলা ভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা।
৩। পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ফজলুল রহমান এবং প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার উর্দু ভাষার দাবীকে সমর্থন করার জন্যে সভা তাদের আচরণের তীব্র নিন্দা করছে।
৪। সভা ‘মর্নিং নিউজ’-এর বাঙালী বিরােধী প্রচারণার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছে এবং জনসাধারণের ইচ্ছার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনের জন্যে পত্রিকাটিকে সাবধান করে দিচ্ছে।
এক ঘণ্টাকাল এই সভা চলার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল সহকারে ছাত্রের। বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে সেক্রেটারিয়েট ভবনে উপস্থিত হন। সেখানে কৃষিমন্ত্রী মহম্মদ আফজল ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দেন এবং বাংলা ভাষার দাবাকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দান করেন। এর পর ছাত্রের প্রাদেশিক মন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনে উপস্থিত হলে মন্ত্রী তাদেরকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি বাংলার জন্য সংগ্রাম করবেন এবং একাজে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীত্ব পদে ইস্তাফা দেবেন। নূরুল আমীনের বাসভবন থেকে মিছিলটি হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবনে গমন করে। তিনিও বাংলার দাবী সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং কাজে ব্যর্থ হলে ইস্তাকা দেওয়ার কথা বলেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্য বলেন যে, হামিদুল হক প্রকৃতপক্ষে বাংলা ভাষার দাবীকে সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন এবং ছাত্রদের সাথে এই বিষয়ে তার অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়। যাই হােক, হামিদুল হক চৌধুরীর বাসভবন থেকে মিছিলটি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে উপস্থিত হয়। নাজিমুদ্দীন সে সময় অসুস্থ থাকায় তিনি ছাত্রদের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে তার অক্ষমতা জানান এবং লিখিতভাবে তিনি তাদেরকে বলেন যে, শরীর সুস্থ হওয়ার পর তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং পার্লামেন্টারী পার্টির মতামত না জানা পর্যন্ত তিনি ভাষার প্রশ্নে কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রকাশ করতে অক্ষম। ফরিদ
আহমদ। কিন্তু উল্লেখ করেছেন যে নাজিমুদ্দীন তাদের সাথে স্বাস্থ্যগত কারণে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলেও তারা সেকথা অগ্রাহ করে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য দাবী জানাতে থাকেন এবং পরিশেষে নাজিমুদ্দীনের ব্যক্তিগত সেক্রেটারী খাজা নসরুল্লাহ তাদেরকে জানান যে, তিনজনের একটি প্রতিনিধিদলের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করতে সম্মত হয়েছেন। এর পর ফরিদ আহমদ সহ তিনজনের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সাথে বেশ কিছুক্ষণ বিতর্কের পর তিনি একটি কাগজে লিখিতভাবে আশ্বাস দেন যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে তিনি চেষ্টা করবেন।১০ খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবন থেকে মিছিলটি মর্নিং নিউজের ঢাকা অফিসে গিয়ে কাগজের স্থানীয় প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করে ভাষা সম্পর্কে তাদের নীতি পরিহার করার দাবী জানান।
৬। করাচীর শিক্ষা সম্মেলন . ১৯৪৭-এর ই ডিসেম্বর মর্নিং নিউজে প্রাদেশিক মন্ত্রীহাবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদের শিক্ষা সম্মেলন সম্পর্কে যে বক্তব্য প্রকাশিত হয়, তার প্রতিবাদে হাবিবুল্লাহ বাহার ১১ই ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন :
কৰাচীতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলন সম্পর্কে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা থেকে দূরে থাকার ফলে আমার পক্ষে সর্বগুলি সংবাদপত্র দেখা সম্ভব হয়নি। মর্নিং নিউজে বড় বড় হেড লাইনে প্রকাশিত একটি বিবৃতিৰ প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছিলাে। সেই অনুসারে আমি এবং শিক্ষামন্ত্রী জনাব আবদুল হামিদ সাংবাদিকদের কাছে বলেছি যে সম্মেলনে উদুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। আমি তৎক্ষণাৎ এ. পি. আই.-এর মাধ্যমে ঘটনাটিকে অস্বীকার করে বলেছিলাম যে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সম্মেলনে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন সংবাদপত্রে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কার্যবিবরণী প্রকাশিত হওয়াতে আমার বিবৃতি সত্বেও বিভ্রান্তি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিলাে।
ডিসেম্বরের ১১ তারিখে আজাদে প্রকাশিত জনাব ফজলুর রহমানের বিবৃতির ফলে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি লাভ করেছে। জনসাধারণের অবগতির জন্যে আমি এ বিষয়ে একটি বিস্তৃত বিবৃতি প্রকাশ করবে স্থির করেছি। কিন্তু তাতে অনেক সময় লাগবে। ইত্যবসরে আমি ব্যাখ্যা
প্রসঙ্গে একথা বলতে চাই যে, সংশ্লিষ্ট সাবকমিটি পাকিস্তানের সমস্ত স্কুলে উদুকে একটি বাধ্যতামূলক ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়া এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় উত্তরােত্তরভাবে উদুতে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার জন্যে সুপারিশ করেন। কিন্তু হা• দ সাহেব, আমি এবং বাঙলার অন্যান্য প্রতিনিধি এতে সম্মত হইনি। আমরা অত্যন্ত জোরালােভাবে প্রতিবাদ করে বলেছিযেবাংলা ছাড়া অন্য কোনাে ভাষাকে বাংলাদেশ শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করবে না। আমরা একথাও বলেছি যে বাঙলাদেশের প্রাথমিক স্কুলগুলিতে উকে বাধ্যতামূলক ভাষা করা যেতে পারে না। দুই দিনব্যাপী। আলােচনার পর আমরা প্রতিনিধিদেরকে একথা ববাঝাতে সক্ষম হই এবং তার ফলে সাব কমিটির সুপারিশ বাতিল হয়ে যায়। সভাপতি কর্তৃক আনীত একটি প্রস্তাবের শেষে উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাঙ্ক। হিসাবে ঘােষণা করার কথা বলা হয়। লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা বলতে মতামত বিনিময়ের জন্যে একটি সাধারণ ভাষা বােৰনে হয়েছিলাে। রাষ্ট্রভাষা অথবা শিক্ষার মাধ্যমের সাথে তার কোনাে সম্পর্ক নেই। সংবিধান সভার কাছে সম্মেলন কোনাে সুপারিশ পেশ করেনি এবং ফজলুর রহমান সাহেবের বিবৃতিতে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম সম্পর্কে যে প্রস্তাবের উল্লেখ করা হয়েছে সেরকম কোনাে প্রস্তাবওসেখানেগৃহীত হয়নি। শিক্ষা সম্মেলনের সিদ্ধান্ত এবং ফজলুর রহমানের বিবৃতিকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাঙলায় উত্তেজনা সৃষ্টির ফলে সরকারী মহলে যথেষ্ট উদ্বেগের সঞ্চার হয়। এই কারণে ১৫ই ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা দফতর থেকে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে বলা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এই নিয়ে পূর্ব বাঙলায় সম্প্রতি যে আন্দোলন চলছে সে বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে আরও বলা হয় যে ফজলুর রহমানের বিবৃতির অনেক ভুল বিবরণ বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে এবং তাকে ভ্রান্তভাবে উদ্ধৃতও করা হয়েছে। এর পর প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ফজলুর রহমানের উদ্বোধনী বক্তৃতা থেকে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি দিয়ে তার আসল বক্তব্যকে জনসাধারণের সামনে উপস্থিত করার প্রচেষ্টা হয় :
শুধু শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে নয়, যে সংস্কৃতির তার বাহন সেই সংস্কৃতির প্রসারের জন্যেও পাকিস্তানে প্রাদেশিক ভাষাগুলির সর্বোচ্চ বিকাশের বাবস্থা আমাদের করা প্রয়ােজন। কিন্তু সেটা করার সময় আমাদের সাধারণ সংস্কৃতির ঐক্যকে আমরা বিসর্জন দিতে পারি না। এই ঐক্যকে
রক্ষা করার জন্যে আমাদের প্রয়ােজন একটি আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা এবং সেক্ষেত্রে উদুর দাবীকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা কর্তব্য।
এর পর উর্দুর দাবী সম্পর্কে নানা যুক্তির অবতারণা করে ফজলুর রহমান তাকে সারা পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাঙ্ক হিসাবে গ্রহণের সুপারিশ করেন। এ বিষয়ে শিক্ষা সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয় :
এই সম্মেলন উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাঙ্ক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ করছে। এই সভা আরও প্রস্তাব করছে যে উর্দুকে স্কুলে একটি বাধ্যতামুলক ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়া হােক কিন্তু প্রাইমারী স্কুলে কোন্ পর্যায়ে উর্দু শিক্ষা শুরু করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার প্রাদেশিক সরকারের হাতে অর্পণ করা হােক। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার মাধ্যম কি হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তও প্রাদেশিক সরকার গ্রহণ করবে।
কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের এই বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশিত শিক্ষা সম্মেলনের উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি একটু আগে উধৃত হাবিবুল্লাহ বাহারের বিবৃতির বক্তব্যের সাথে মােটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ না। প্রথমত, হাবিবুল্লাহ বাহার তাৰ বিবৃতিতে উল্লেখ করেছেন যে শিক্ষা সম্মেলনের একটি সাব-কমিটি উদুকে পাকিস্তানের সমস্ত স্কুলে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসাবে শিক্ষা দেওয়ার যে প্রস্তাৰ করেছিলাে, সে প্রস্তাব তার, শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের এবং বাঙলাদেশের অন্যান্য প্রতিনিধিদের প্রতিবাদ ও প্রচেষ্টার ফলে বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু শিক্ষা দফতরের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে প্রস্তাবটি বাতিল হয়নি, যথারীতি গৃহীত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ, হাবিবুল্লাহ বাহার বলেছেন যে সম্মেলন সংবিধান সভার কাছে কোনাে সুপারিশ করেনি। কিন্তু সরকারী বিজ্ঞপ্তিটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে সম্মেলন উর্দুকে পাকিস্তানের লিংগুয়া ফ্রাঙ্ক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যে সংবিধান সভার কাছে সুপারিশ পেশ করেছে। হাবিবুল্লাহ বাহারের বিবৃতির তারিখ ১১ই ডিসেম্বর এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের প্রেস বিজ্ঞপ্তি। তারিখ ১৫ই ডিসেম্বর। বিজ্ঞপ্তিটি প্রচারিত হওয়ার পর হাবিবুল্লাহ বাহারের কোনাে পালটা বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি।
৭। দুবৃত্তদের হামলা
৭ই ডিসেম্বর বিকেল ২-৩ মিনিটে রেল কর্মচারীদের একটি সভা অনুষ্ঠিত
হয়। ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি অসুস্থ থাকায় সভাপতিত্ব করার জন্যে ফজলুল হককে নিয়ে আসা হয় কিন্তু সমস্ত অবাঙালী কর্মচারী একযােগে তাতে আপত্তি করলে ফজলুল হক সভাপতির আসন পরিত্যাগ করে চলে যান। এর পর বেলা প্রায় পাঁচটা পর্যন্ত দারুন ঝগড়া-বিবাদ এবং মারামারির পর সমস্ত অবাঙালীকে সভাস্থল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নূরুল হুদার সভাপতিত্বে নোতুন করে সভার কাজ শুরু হয়।
এই সভা সম্পর্কে সেদিন ঢাকা শহরের লােকদের, বিশেষতঃ কুড়িদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয় যে, সভাটি আসলে ছিলাে হিন্দুদের সাথে মিলে ফজলুল হকের নেতৃত্বে একটি পাকিস্তানবিরােধী চক্রান্ত। তাছাড়া বাংলার মতাে একটি হিন্দু ভাষাকে উদুর পরিবর্তে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রের কথাও উল্লেখ করা হয়। এই সব প্রচারণার ফলে সেদিনই সিরাজউদ্দৌলা পার্কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হওয়াকালে কুটির। সেখানে উপস্থিত হয়ে চেয়ারে অগ্নিসংযােগ ও অন্যান্য হাঙ্গামার সৃষ্টি করে এবং সাধারণভাবে ছাত্রদের উপর তারা ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর ১২ই ডিসেম্বর কিছুসংখ্যক লােক বাস ও ট্রাকে চড়ে পলাশী ব্যারাক এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে উপস্থিত হয় এবং সরকারী কর্মচারী ও ছাত্রদেরকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল দুড়তে থাকে। কয়েক রাউন্ড গুলিও এ সময় তারা বর্ষণ করে। এই সংবাদ আগুনের মতাে সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্র এবং ঢাকার জনসাধারণও এই গুণ্ডামী বন্ধ করার জন্যে ইঞ্জিনীয়ারিং হােস্টেলে সমবেত হন। শুধু তাই নয়, তারা এর তকার দাবী করার জন্যে একটি মিছিল করে সেক্রেটারিয়েটের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই মিছিলটি শুধু ছাত্র মিছিল ছিলাে না। এতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অংশের এবং বিভিন্ন শ্রেণীর নাগরিকরাও বিপুল সংখ্যায় যােগদান করেছিলেন। বস্তুতঃ বাংলা ভাষার দাবীতে এ জাতীয় মিছিল এই সর্বপ্রথম।
ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদি পার হয়ে মিছিলটি প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের বাসভবনে উপস্থিত হয়। লুঙ্গী পরিহিত অবস্থায় মন্ত্রী মহােদয় তাড়াতাড়ি সমবেত ছাত্র-জনতার সাথে সাক্ষাৎ করেন।
গুণ্ডামীর প্রতিকারের জন্যে তার কাছে দাবী জানানো হয়। এ ছাড়া তাকে ডাকটিকিট, মনি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদি থেকে বাংলা ভাষা বর্জন সম্পর্কে
বলা হয় এবং উছুর সাথে বাংলাও যাতে এসব ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে তার কাছে সেই মর্মে দাবী জানানাে হয়। রাষ্ট্রভাষা নিয়েও মন্ত্রীর সাথে সকলের ভয়ানক তর্কবিতর্ক চলে এবং তার পর বিক্ষোভকারীরা মন্ত্রীকে তাদের সাথে সেক্রেটারিয়েটে যেতে বলেন। তিনি সেই লুঙ্গী পরিহিত অবস্থাতেই মিছিলের সাথে সেক্রেটারিয়েটে যেতে বাধ্য হন। মিছিলটি মন্ত্রীর বাসভবনে অবস্থানকালে কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারী তার বাগানের অনেক ফুল এবং গাছপালা নষ্ট করে দেয়।
| সেক্রেটারিয়েটে সেদিন কৃষিমন্ত্রী মহম্মদ আফজল ব্যতীত অন্যসব মন্ত্রীই অনুপস্থিত ছিলেন। তাদেরকে সে সময় ১৪ই ও ১৫ই ডিসেম্বরে আহত সারা ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সর্বশেষ অধিবেশনে যােগদানের জন্যে করাচী যেতে হয়েছিলাে।
| মিছিল গন্তব্যস্থলে পৌছানোর পূর্বেই সেক্রেটারিয়েটের সমস্ত গেট ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্বেও গেটের কাছে জনতা ছত্রভ
হয়ে কোনাে একটি উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে থাকে। এমন সময় আবদুল গণি রােড দিয়ে একটি গাড়িকে আসতে দেখে একজন সেটিকে থামায়। এবং তার উপর দাড়িয়ে দেওযাল ডিঙিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে প্রবেশ করে দ্রুতগতিতে বড় গেটটি ভেতর থেকে খুলে দেয়। এর ফলে মিছিলের জনতাকে আর গেটের বাইরে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। দলে দলে তারা সেক্রেটারিয়েটের ভেতরে প্রবেশ করে।
আবদুল হামিদ এবং সৈয়দ আফজলের অফিসের সামনে মিছিলটি উপস্থিত হলে কৃষি দফতরের সেক্রেটারী কাদরী পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ছাত্রদেরকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে মন্ত্রী সৈয়দ আফজলকে পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তাতে সম্মত না হয়ে ছাত্রদের সাথে আলাপ করে তাদেরকে বুঝিয়ে নিজের বক্তব্য বলার সিদ্ধান্ত নেন।
সৈয়দ আফজল দোতলা থেকে নিচে নেমে এসে ছাত্রদেরকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন যে বাংলা ভাষা তিনিও চান, কাজেই ছাত্রদের সাথে তার কোনাে বিরোধ নাই। আবদুল হামিদও সমবেত ছাত্ৰ-কর্মচারীদের সম্বােধন করে বাংলা ভাষার দাবী সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দেন। অল্পক্ষণ পর তদানীন্তন চীক সেক্রেটারী আজিজ আহমদকে সেখানে জোরপূর্বক হাজির করা হয় এবং তিনি বাংলা ভাষার যথাযােগ্য স্বীকৃতির জন্যে চেষ্টা করবেন ৰলে ছাত্র-জনতার কাছে প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হন। কিন্তু এসব সত্বেও
এত্তেজিত জনতা শান্ত হলাে না। শুধু তাই নয়, এ সময় তারা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে নানাপ্রকার অপমানসূচক ধ্বনি দিতে থাকে এবং এক পর্যায়ে সৈয়দ আফজলের দাড়ি ধরেও আকর্ষণ করে।১০ এ ছাড়া তারা উভয় মন্ত্রীকেই বাংলা ভাষার দাবী সমর্থন করবেন এবং সে কাজে ব্যর্থ হলে মন্ত্রীত্ব-পদে ইস্তাফা দেবেন, এই-মর্মে একটি লিখিত প্রতিশ্রুতিপত্রে স্বাক্ষর দান করতে বাধ্য করে।১১ | দুপুরের দিকে মিছিলটি সেক্রেটারিয়েটে ঢােকে কিন্তু চেঁচামেচি তর্কবিতর্কের মধ্যে দিয়ে বিকেল প্রায় চারটে হয়ে এলাে। ছাত্রদের দাবী হলাে গুণ্ডারা ছাত্রদের উপর কি অত্যাচার করেছে সেটা মন্ত্রী মহােদয়কে নিজে গিয়ে দেখে এসে তার উপযুক্ত প্রতিকার করতে হবে। অবশেষে একজন প্রস্তাব করলাে যে মিছিলটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের দিকে যাবে এবং মন্ত্রী আফজলকে তাদের সাথে যেতে হবে। শুধু তাই নয়, মন্ত্রী মহােদয়কে সেই মিছিল পরিচালনা করতে হবে। সৈয়দ আফজল এ প্রস্তাবের বিরােধিতা না করে বাধ্য হয়ে মিছিলে শরীক হতে সম্মত হন এবং পায়ে হেঁটে শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হােস্টেলে পৌছান। তিনি হােস্টেলের ভিতরে ঢুকে সব কিছু দেখে শুনে ছাত্রদের উপর যে অত্যাচার হয়েছে তার উপযুক্ত প্রতিবিধানের প্রতিশ্রুতি দেন।১২
কিন্তু ছাত্রেরা তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে দাবী করলেন যে তিনি যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চান সেটা আবার তাকে লিখিতভাবে স্বীকার করতে হবে। একথায় মন্ত্রী কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করার পর অবশেষে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে তিনিও চান একথা লিখে দিতে বাধ্য হন।
এর পর মহম্মদ আফজল সহ মিছিলটি পলাশী ব্যারাকের দিকে যায় এবং মগরেবের নামাজের পর সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনেকগুলি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলিতে গুণ্ডামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তাদের শাস্তি দাবী ছাড়াও বাংলা ভাষা তার যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করা হয়।১৪
গুণ্ডারা যে সমস্ত গাড়িগুলিতে চড়ে এসেছিলাে সেগুলির নম্বর পূর্বেই রাখা হয়েছিলাে। মন্ত্রী সেই গাড়ি এবং তাদের ড্রাইভারদেরকে হাজতে আটক করার জন্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ এবং ডি. আই. জি. ওবায়দুল্লাকে সস্থলেই আদেশ দেন।১৫
সেদিনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা শহরে প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। এ পর্যন্ত আশঙ্কা করা হয় যে উদু ও বাংলা সমর্থকদের মধ্যে হয়তাে
ছােরাছুরি নিয়ে দারুণ মারপিট হতে পারে। অবস্থা আয়ত্বে আনার উদ্দেতে মন্ত্রী সৈয়দ আফজল শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘােরার প্রস্তাব করেন এবং ফরি আহমদ ও অন্যান্য কয়েকজনকে নিয়ে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ঢাকার কতকগুলি এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে একমাত্র কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যানের বিশেষ প্রতিনিধি আবদুল ওয়াহাব তাদের সাথে ছিলেন।১৬
সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা যে এ ধরনের কোনাে মিছিল তৈরী করে সংগঠিতভাবে নিজেদেরই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে পারে এটা অনেকাংশে অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু তখনকার দিনে তাদের জীবন এবং মানসিক অবস্থার কথা স্মরণ করলে এ সবকিছুকেই সম্ভব মনে হবে।
উপরে বর্ণিত ঘটনার কিছু পূর্বে খুব সম্ভবতঃ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সরকারী বাসগৃহ ‘বর্ধমান হাউসে সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীদের একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল প্রবেশ করে। নীলক্ষেত ব্যারাকে তখন পানির দারুণ অভাব। তা ছাড়া দূষিত জল নিষ্কাশন, আবর্জনা পরিষ্কার ইত্যাদির কোনো ব্যবস্থা সেখানে না থাকায় নীলক্ষেতে এক দারুণ অস্বাস্থ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। নীলক্ষেতে বসবাসকারী সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা এ সবের প্রতিবাদে একদিন সকালের দিকে প্রধান মন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করেন। তাদের সকলের হাতে ছিলাে একটা করে বদনা, গাড় অথবা ঐ জাতীয় একটা কিছু। তারা সেগুলি হাতে নিয়েই চীৎকার করে তাদের অবস্থার প্রতিকারের দাবী জানাতে থাকেন। | চেঁচামেচির মধ্যে একজন জোরে চীৎকার করে বলেন যে তাদের দুরবস্থার আশু প্রতিকার না হলে নাজিমুদ্দীনকে তারা ‘আউঙ সান’ করবেন। এই ঘটনার কিছুকাল পূর্বে জুলাই মাসে আততায়ীর হাতে বর্মার প্রধানমন্ত্রী আউড সান এবং তার কয়েকজন সহকর্মী নিহত হন। কিন্তু নাজিমুদ্দীন এসবের কিছুই জানতেন না অথবা ঠিক সেই সময় ব্যাপারটি তার খেয়াল ছিলাে না। তিনি তার পার্শ্ববর্তী একজনকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আউঃ সান মানে কি?১৮
কিছুক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর প্রতিকারের আশ্বাস পেয়ে নীলক্ষেত ব্যারাকের সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীর বর্ধমান হাউস পরিত্যাগ করেন।
১২ই ডিসেম্বরের উপরােল্লিখিত ঘটনা সম্পর্কে পূর্ব বাঙলা সরকার সেদিন একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয় :
একটি ঘটনায় বিশ ব্যক্তি আহত, যার মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং অন্যদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এই গুজব প্রচারিত
হওয়ার পর আজ শহরে কিছুটা উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। জানা গেছে যে, সকালের দিকে কিছুসংখ্যক অজ্ঞাত ব্যক্তি একটি বাসে চড়ে প্রচার করে বেড়ায় যে, উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। পলাশী ব্যারাকের লােজন এবং আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রের। এই ঘােষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং উভয়পক্ষে হাতাহাতির ফলে উপরােল্লিখিত ব্যক্তিরা আহত হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে সেই এলাকায় পাহারা মােতায়েন করা হয়। এই ঘটনার পর শহরে অনেক ভিত্তিহীন গুজব ছড়াতে থাকে এবং কেউ কেউ বলে যে দু-তিন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। অপর একটি রিপোের্ট অনুসারে নাকি পুলিস গুলি ছুড়ে এবং জনতার উপর লাঠিচার্জ করে উপরােক্ত ব্যক্তিদের মৃত্যু ঘটায়। এই সমস্ত মিথ্যা গুজবের ফলে শহরে ভাসের সঞ্চার হয় এবং বিকেলের দিকে একটি মিছিল সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উত্তেজনা সত্ত্বেও অবস্থাকে সুকৌশলে এবং সংযমের সাথে আয়ত্তে আনা হয়। কৃষিমন্ত্রী মাননীয় সৈয়দ আফজল সাহেব এবং শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় আবদুল হামিদ সাহেব বিক্ষোভকারীদের সাথে সাক্ষাৎ করে শৃঙ্খলা মেনে চলার জন্যে তাদের কাছে আবেদন জানান। জনাব আবদুল হামিদ জোর দিয়ে বলেন যে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে তর্কের কোনাে অবকাশ নেই। কারণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছা অনুসারেই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। শ্রোতাদের উদ্দেশ করে সরকারের চীফ সেক্রেটারী তার বক্তৃতায় নােতুন রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা এবং আইন-কানুন মেনে চলার প্রয়ােজনীয়তার উপর বিশেষ জোর দেন। সকালের ঘটনার সাথে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও তিনি প্রতিশ্রুতি দেন। বিক্ষোভকারীরা শান্তিপূর্ণভাবে বক্তৃতা শােনন এবং মন্ত্রীদের থেকে এই আশ্বাস লাভের পর সেখান থেকে চলে যায়। সকালের ঘটনাটির এবং বিশেষ করে সেই ঘটনার প্ররােচণা কারা যুগিয়েছে সে সম্পর্কে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে। মনে হয় যে এই প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন ধরাবার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের যে সমস্ত শত্রুরা অহরহ সজাগ আছে তারাই এই ঘটনা সৃষ্টির জন্যে দায়ী।
উপরােক্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তিটিতে সেদিনকার ঘটনাবলীর বিশেষ বিশেষ অংশ চাপা দেওয়া থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা পর্যন্ত সমৰ কিছুই আছে।
জনতা শান্তভাবে চীফ সেক্রেটারী এবং মন্ত্রীদের বক্তৃতা শুনেছে এবং তার পর তারা শান্তভাবেই সেক্রেটারিয়েট ভবন পরিত্যাগ করে গেছে, এই কথা বলা হলেও বহু প্রত্যক্ষদশীর বিবরণ থেকে সে কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হয়। উপরন্তু বিজ্ঞপ্তিটির সর্বশেষ বাক্যে প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন ধরাবার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের যে সমস্ত শত্ৰু অহরহ সজাগ আছে তারাই এই ঘটনা সৃষ্টির জন্যে দায়ী এই কথা বলে সূক্ষ্মভাবে হিন্দুদেরকে সমস্ত ঘটনার জন্যে দায়ী করার প্রচেষ্টার মধ্যে সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতিই খুব সহজভাবে ধরা পড়ে। শুধু তাই নয়। পরবর্তী সময়ে ঘটনাটি সম্পর্কে কোনাে সত্যিকার তদন্ত না করা এবং সেদিনের ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বক্তব্য থেকে একই বিশ্বাসযােগ্য মনে হয় যে ঘটনাটির সাথে সরকারী মহলের, বিশেষতঃ আমলা গােষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যােগ ছিলাে।
১২ই ডিসেম্বর বিকেলে নঈমুদ্দীন আহমদ এবং শামসুদ্দীন আহমদ ). K. রেস্তোরাঁয় চা খেয়ে সামনের রাস্তায় নামমাত্র একদল গুণ্ডা নঈনুদ্দীন আহমদকে আক্রমণ করে এবং তার মাথায় লাঠির বাড়ি মারে। এর ফলে তার মাথা থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। তাকে নিয়ে শামসুদ্দীন আহমদ তাড়াতাড়ি ফজলুল হক হল এবং সেখান থেকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেদিন বিকেলেই এই ঘটনার প্রতিবাদে ফজলুল হক হলে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নঈমুদ্দীন আহমদকে হাসপাতালে ভতি করা নিয়ে বেশ গণ্ডগোল হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে নানা অজুহাতে তাকে সরাসরি ভর্তি করতে অসম্মত হলেও শেষে মন্টগােমারী সাহেবের প্রচেষ্টায় তেরো তারিখে সন্ধ্যার পর তাকে ওয়ার্ডে ভতি করা হয়। সেদিন সন্ধ্যার সময় তাজউদ্দীন আহমদ + দ লুল হক হল থেকে নঈমুদ্দীন আহমদের জন্যে খাবার নিয়ে তার ওয়ার্ডে উপস্থিত হলে সেখানে চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতউল্লাহকে নঈমুদ্দীনের বিছানার পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখেন। সেখানে দু’জন পুলিস সাবইন্সপেক্টর নঈমুদ্দীন আহমদের F. I. R. নিচ্ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ চী সেক্রেটারীর সাথে সেখানে পূর্বদিনের গুণ্ডামীসম্পর্কে কিছু অালােচনা করেন এবং আজিজ আহমদ গুণ্ডামী দমন করার ব্যাপারে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। কিন্তু এই আশ্বাস সবেও সেদিন রায়সাহেব বাজারে একটি মিছিল পরিচালনাকালে মিটফোর্ড স্কুলের তিন জন ছাত্র গুণ্ডাদের আক্রমণে মাহত হন। , ১৩ই ডিসেম্বর সেক্রেটারিয়েট কর্মচারীরা পূর্ণ হরতাল পালন করেন এবং
———-
বর্তমান নাম মাইরেস্তার
সেদিন থেকে, পনেরাে দিনের জন্যে ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়। চকবাজারে সেদিন ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহ যে সভা আহ্বান করেছিলেন ১৪৪ ধারার জন্যে তা বাতিল হয়ে যায়।২২ নবাব একটি প্রেস বিবৃতি মারফত বলেন যে পাকিস্তান অত্যন্ত সংকটময় অবস্থার মধ্যে আছে, কাজেই এসময়ে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অর্থ বিপদ ডেকে আন।। ভাষার প্রশ্নে তিনি বলেন যে সংবিধান সভা জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারাই গঠিত কাজেই ভাষার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তার উপরই অর্পণ করা উচিত।২৩ | ১৩ই ডিসেম্বর সেক্রেটারিয়েটে পূর্ণ হরতাল পালিত হওয়া এবং অন্যান্য কতকগুলি কারণে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ঢাকা শহরে একথা রাষ্ট্র হয় যে বহু সরকারী কর্মচারী রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন পক্ষ অবলম্বন করছেন। এ সম্পর্কে আলােচনার জন্যে ১৬ই তারিখে সেক্রেটারিয়েট এবং বিভিন্ন ভাইরেক্টরেটের সিনিয়র অফিসাররা একটি সভায় মিলিত হন। সেখানে সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে এ জাতীয় ভিত্তিহীন প্রচারণার নিন্দা করা হয়। তারা বলেন যে ভাষা প্রশ্ন অথব; শন্য কোনাে রাজনৈতিক প্রশ্নের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা জনগণের দ্বারাই নির্ধারিত হবে এবং সরকারী কর্মচারীরা সেই সিদ্ধান্তকে অনুগতভাবে কার্যকরী করবেন।২৪
ঐ দিনই মনিং নিউজে পূর্ব বাঙলা সরকারের ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন ডক্টর কুদরত-ই-খুদার সাথে ভাষার প্রশ্নে ১১ই ডিসেম্বর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত একটি প্রেস সাক্ষাৎকারের বিবরণ প্রকাশিত হয়। তাতে কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘কোনাে জাতির জীবনে অস্বাভাবিক কোনো জিনিসকে চাপিয়ে দেওয়া চলে না এবং সেটা উচিতও নয়। বাংলা অামাদের মাতৃভাষ।
১৭ই ডিসেম্বর করাচীতে পাকিস্তান সংবিধান সভার নিমকানুন নির্ধারণ কমিটি সভার সরকারী ভাষা হিসাবে উছ ও ইংরেজীকে সমমাদা দানের জন্য সুপারিশ করেন। তারা অবশ্য একথা উল্লেখ করেন যে, কোনাে সদস্য উপরোক্ত দুই ভাষাতে যদি নিজেকে ব্যক্ত করতে না পারেন তাহলে তিনি নিজের প্রাদেশিক ভাষাতেই বক্তৃতা দিতে পারবেন। অবশ্য এর জন্যে তাকে সভাপতির অনুমতি প্রার্থনা করতে হবে। কমিটি ঐদিন শুধু সংবিধান সভার নিয়মকানুন নির্ধারণ করলেও তারা সিদ্ধান্ত করেন যে বাজেট অধিবেশনের কয়েকদিন পূর্বে ঐ একই কমিটি গণপরিষদেরও নিয়ম কানুন নির্ধারণ করবেন।২৫
ডিসেম্বর মাসের নানা ঘটনার পর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা শহরে রাষ্ট্র হয় যে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকার গ্রেফতারী
পরােয়ানা জারী করেছেন। এই সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে নঈমুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, শফিউল আজম এবং ইক্লিয়ারিং স্কুলের কিছু সংখ্যক ছাত্র ৮ই জানুয়ারি সন্ধ্যায় বর্ধমান হাউসে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকারের সময় শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ এবং শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।২৬
৮। উর্দু সমর্থকদের তাত্ত্বিক বক্তব্য
১৯৪৭-এর ডিসেম্বরে করাচীর শিক্ষাসম্মেলনেরপর প্রকাশিত মর্নিং নিউজের একটি সম্পাদকীয় এবং সিলেটের কিছুসংখ্যক শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, সংস্কৃতিসেবী প্রভৃতির একটি স্মারকলিপিতে উর্দু সমর্থকদের তাত্বিক বক্তব্য মােটামুটি
স্পষ্টভাবে উপস্থিত করা হয়। এ দুইটির উল্লেখ সরকার পক্ষ ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং উৎকণ্ঠার পরিচয় লাভের জন্যে প্রয়ােজন।
মনিং নিউজ তাদের ১৭ই ডিসেম্বরের একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন : পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান প্রধান কথ্য ভাষা পুষ,তু, পাঞ্জাবী, ব্রাহমী ও সিন্ধী এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান কথ্য ভাষা বাংলা। প্রত্যেকটি গ্রুপই যদি নিজের ভাষাকে সরকারী ভাষা রূপে চালু করার জন্যে জোর দেয় তাহলে পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সহযােগিতা, ভাবের আদান-প্রদান এবং পারস্পরিক সম্পর্কের অবসান ঘটবে। যার সামান্য কিছু বুদ্ধি আছে সে কখনােই একথা বলতে পারে না যে একজন পাঠান অথবা পশ্চিম পাঞ্জাবী তার পরিবারের লােকজনের সাথে পাঞ্জাবীতে কথা না বলে উদুতে কথা বলবে। এই একই মন্তব্য সিন্ধী, বালুচ এবং বাঙালীর ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। ঢাকায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের করাচীতে গৃহীত সিদ্ধান্তকে এতে খারাপভাবে ব্যাখ্যা করার অর্থ এ ছাড়া আর কিছুই নয়।
উপরােক্ত বক্তব্যের মূল লক্ষ্য প্রাদেশিক মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার এবং আবদুল হামিদ। কারণ তারাই করাচী থেকে ফিরে এসে বিবৃতির মাধ্যমে সম্মেলনের সিদ্ধান্তসমূহের যে ব্যাখ্যা দেন, তার সাথে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের ব্যাপার বিন্দুমাত্র নাম ছিলাে না।
ইংরেজী ভাষা এবং তার ব্যবহার সম্পর্কে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় : আমাদের পূর্বতন শাসকদের ভাষা হিসাবে ইংরেজী দেশের সমস্ত অংশের লােকের আলাপ-আলােচনার মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হয়। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষ, এটা পূর্বেও ছিলাে এবং এখন পর্যন্ত আছে। এই ভাষাতেই দক্ষিণের লােক উত্তরের লােকের সাথে এবং পূর্বের লােক পশ্চিমের ভাইদের সাথে চিঠিপত্র বিনিময় করে। এখানেই শেষ নয়। একই ভাষাভাষী দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত লােক নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলােচনার সময় সাধারণতঃ ইংরেজীতেই কথা বলে। আমাদের সংবাদপত্র, আমাদের সাইন বােড় এবং আমাদের বিজ্ঞাপনসমূহ এখনাে ইংরেজীতেই প্রকাশিত হয়। সর্বোপরি আমাদের নেতারা এখনাে প্রেস কনফারেন্সে এবং প্রেসে বিবৃতি দেওয়ার সময় ইংরেজীতেই তা করে থাকেন। এই অবস্থা ততদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে যতদিন না আমরা বিদেশী আমলাতন্ত্র জোরপূর্বক আমাদের গলা দিয়ে যে পশ্চিমী ভাষাকে পার কছে তার পরিবর্তে নিজেদের এমন একটি ভাষাকে ব্যবহার করতে শিখবাে যার মধ্যে আমাদের চিন্তা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় থাকে।
উর্দুকে বাংলা ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যে পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক চক্রান্তের ফল, উর্দু ভাষা, যে পাকিস্তানের কোনাে অংশের ভাষা নয়, একটি বিদেশী ভাষা, এবং উর্দুর মাধ্যমে বাঙালীদের ‘চিন্তা, ঐভি ও সংস্কৃতির কোনাে পরিচয়ই যে পাওয়া যায় না একথা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারীদের কাছে যত স্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হোক না কেন, উছু সমর্থকরা কিন্তু সেগুলিকেই তাদের দাবীর অন্যতম প্রধান যুক্তি হিসাবে উপস্থিত করতে সব সময়েই আগ্রহশীল ছিলেন।
কাজেই পূর্ব যুক্তির জের টেনে উদুর সপক্ষে মনিং নিউজ বলেন : এ রকম একটা ভাষাই আমাদের হাতের কাছে আছে। সেটা হলাে উদু, যাকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লােকেরা নাম দিয়েছিলেন হিন্দুস্থানী। উপমহাদেশের অর্ধেকের বেশী লােক এই ভাষায় কথা বলে এবং সাধারণভাবে সকলেই তা বােঝে। এর থেকেও বেশী এই যে, পােট সাঈদ থেকে সাংহাই পর্যন্ত এই ভাষায় কথা বলা হয় এবং লােকে তা বােঝে। উদু একটি আন্তর্জাতিক ভাষার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে এবং এটা হলাে দুই ডােমিনিয়নের ‘লিংগুয়া ইণ্ডিকা’ যা আরবী এবং দেবনাগরী, এই দুই অক্ষরেই লেখা হয়। যদি তারা ইংরেজীকে চালু রেখে তাকে হিন্দুস্থানী
এবং পাকিস্তানীদের চিন্তার উপর রাজত্ব করতে না দেন, তাহলে, উৎসাহী মাতৃভাষাওয়ালাদের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিলে আন্তঃপ্রাদেশিক এবং আন্তঃডােমিনিয়ন সামাজিক, আধিমানসিক এবং বাণিজ্যিক লেনদেন এক অচল অবস্থায় এসে দাঁড়াবে।
এর পর পূর্ব বাঙলার অধিবাসীদের সংস্কৃতির বর্ণনা প্রসঙ্গে পত্রিকাটি মন্তব্য করেন :
পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের লােকদের সমস্যা দ্বিগুণ গুরুতর এবং গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দাসত্ব যথেষ্ট খারাপ কিন্তু বুদ্ধিগত দাসত্বের থেকে হীনতম ও ও নিম্নতম দাসত্ব আর কিছু নেই। বাঙালী পণ্ডিতদের মতে মুসলমানদের পৃষ্ঠপােষকতায় বাংলাদেশ যে ভাষা লাভ করে, সেটাই হিন্দু মুসলমান কবি ও লেখকদের হাতে পুথি সাহিত্য হিসাবে বিকশিত হয়। ইংরেজদের আগমন এবং ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে দেওয়ানী দানের পর এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়ে, যার ফলে এক শতাব্দীর স্বল্প পরিসরের মধ্যে শাসকেরা উপনীত হয় নিতান্ত দরিদ্র অবস্থায়। তাদের প্রভাবই যে শুধু বিনিষ্ট হলে তাই নয়, তারা আদ্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেললাে। ইংরেজী-জানা বুদ্ধিজীবীর। পাত্রী এবং বৃটিশ আমলাদের সাথে যােগাযােগের মাধ্যমে যে মিলের চাকা দ্রুততরভাবে ঘােরানাের কাজে লিপ্ত হলাে, সেই মিলই তাদেরকে গুড়িয়ে দিলাে। বাঙলাদেশের লােকের সাধারণ ভাষা ক্রমশঃ সংস্কৃত প্রভাবচ্ছিন্ন হলাে এবং মুসলমানেরা ‘ভদ্রলােক’ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যে সেই ভাষার ব্যাকবৈশিষ্ট্যকে গ্রহণ করলাে। এখানেই শেষ নয়। নিজের ঐতিহ্নের সাথে তার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হলাে এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিক দিয়েও সে হয়ে দাড়ালাে দো-আঁশলা।
এই ‘দো-আঁশলা সংস্কৃতির হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে পূর্ব বাঙলা মুসলমানরা কিভাবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে সে সম্পর্কে মুরুব্বীয়ানার ভঙ্গীতে উপদেশ দেওয়ার প্রচেষ্টায় সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় :
সেই পূর্ব অবস্থা ফিরে পাওয়ার একটা সুযােগ এখন তার সামনে উপস্থিত হয়েছে। নিজের মাতৃভাষা ভূলে যাওয়ার কথা কেউ তাকে বলছে না। করাচীতে তার যে সমস্ত শুভাকাধী মিলিত হয়েছিলেন, তারা একটা দূরদর্শী পরামর্শ হিসাবে তাকে সমস্ত জড়তা মুছে ফেলে মাথা উচু করে দাড়াতে বলেছেন। ইন্দোনেশিয়াকে বাদ দিলে পূর্ব বাঙলাই
পৃথিবীর মধ্যে মুসলমানদের সব থেকে বড় একটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। ইসলামের প্রতি সেই হিসাবে তার একটা কর্তব্য আছে। এ কাজ তার পক্ষে একা বিচ্ছিন্নভাবে থেকে বাংলার রসাস্বাদনের দ্বারা সম্ভব নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধ, বালুচ, পাঞ্জাবী, পুষ,তু ভাষী প্রভৃতি নাগরিকদের মন তাকে প্রথমে বুঝতে হবে এবং সেই সাথে নিজের অসুবিধার কথাও তাদেরকে বােঝাতে হবে। সকলের বোধগম্য একটি সাধারণ ভাষা ব্যতীত একাজ কিভাবে করা সম্ভব? আজ ইংরেজী সেই কাজ করছে। কিন্তু কতদিন পর্যন্ত? পাকিস্তানের লােকেরা যদি সত্যিই মুসলমান মতে কিছু করতে চায় তাহলে এখন থেকেই তাদেরকে সে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং নিজেদের রাষ্ট্রের জন্যে একটি ভাষা নির্বাচন করতে হবে। বাংলাভাষায় ইসলাম এবং ইসলামী ইতিহাসের উপর কোনাে বই-পুস্তক নেই বললেই চলে। আমরা এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে আজকের একজন। বিক্ষুব্ধ যুবক আগামী দিনে তার সন্তানরা যাতে আরও ভালাে মুসলমান হয় সেটাই চায়। যুবকেরা যাতে তাদের ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ববােধ করে সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং নিজেদের দায়িত্ব যাতে সাহস ও তাত্মবিশ্বাসের সাথে পালন করার জন্য প্রস্তুত হয়, তারও নিকে খেয়াল রাখতে হবে। তার পক্ষে আরবীতে লিখিত তথ্যের সাথে পরিচিত হওয়া খুৰ অসুবিধাজনক, কারসী তরজমাও তার পক্ষে বিরক্তিকর হবে। অন্যপক্ষে ইসলাম বিষয়ক এক বিশাল সাহিত্য উদুতে রয়েছে। বাঙলাদেশের মুসলমানরা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই উর্দু বলতে এবং বুঝতে পারে। তারা দিল্লী, আলীগড় অথবা লাখনৌ-এর লােকদের : চমৎকারভাবে উর্দুতে কথা বলতে না পারলেও প্রত্যেক মুসলমান শিশুই কোরাণের বর্ণমালার সাথে পরিচিত, কাজেই উর্দু শেখা তার পক্ষে সহজই হবে। করাচীর সিদ্ধান্তের তাৎপর্য এখানেই। এর মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের মুক্তি এবং গৌরবময় ভবিষ্যৎ নিহিত।
উপহােত সম্পাদকীয়টির মূল ব্যক্তব্য পূর্ব বাংলার মুসলমানরা এতােদিন হিন্দু সংস্কৃতির আওতায় ছিলাে এবং সেই আওতামুক্ত হয়ে নিজেদের সংস্কৃতি গঠন করতে হলে ইসলামী সংস্কৃতিই তার মূল অবলম্বন হওয়া উচিত। এবং ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্যে বাংলা ভাষা তাে নয়ই এমনকি আরবী, ফারসীও যথেষ্ট নয়। তার জন্যে আমাদেরকে দ্বারস্থ হতে হবে উর্দুর, কারণ বাঙলা দেশের মুসলমানেরা ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই উছু বলতে
এবং বুঝতে পারে। তা ছাড়া প্রত্যেক মুসলমান শিশু কোরাণের বর্ণমালার সাথে পরিচিত হওয়ার ফলে তাদের পক্ষে উর্দু শেখা কোনাে কঠিন ব্যাপার নয়। কাজেই, পূর্ব বাঙলার অধিবাসী, তােমরা উর্দুর জয়ধ্বনি করে !
পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে প্রেরিত স্মারকলিপিটিতে সিলেটের কিছুসংখ্যক নাগরিক উর্দুর সমর্থনে যে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেন তার সাথে মনিং নিউজের বক্তব্যের কোনাে মৌলিক তফাত নেই। কিন্তু তাদের বক্তব্যের সাম্প্রদায়িক ও মুৎসুদ্দি চরিত্র আরও স্পষ্টতর। বাংলা ভাষার দাবীতে যারা আন্দোলন করছিলেন, তাদের প্রতি কটাক্ষ করে স্মারক লিপিটিতে বলা হয় :
একদল লােক নিজেদেরকে বিরাট সাহিত্যিক, শিল্পী ও পণ্ডিত বলে জাহির করে উর্দুর বিরুদ্ধে দারুণ প্রচারণা শুরু করেছে। পূর্ব বাঙলার লােকেরা একটি জাতি, এই উদ্ভট ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা উর্দুকে জাতীয়তাবিৰােধী ও বিদেশী ভাষা হিসাবে বর্জন করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। সীমিত দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেশপ্রেমের মুখােশ পরে তারা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে চারিদিকে তােলপাড় আরম্ভ করেছে। জনমতের প্রতিনিধিত্ব করার ভাব দেখিয়ে তারা নিজেরাই বাংলার মতাে এমন এক ভাষার দাবী তুলেছে, যে-ভাষার একটি মুসলিম রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষার মর্যাদা লাভের মতাে যােগ্যতা একেবারেই নেই। মুসলিম সংস্কৃতির গৌরবময় ঐতিহ্-বাহী উর্দু ভাষাকে বর্জন করার এই নির্লজ্জ প্রচেষ্টা যে শুধু ধ্বংসাত্মক তাই নয়, তা পশ্চাদমুখী, নিন্দনীয় এবং সর্বোপরি সার্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। তারা যদি বাংলাকে একটি বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে চালু করা এবং উর্দুকে ইংরেজীর জায়গায় রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলতে তাহলে সেটা বােঝা যেত। কিন্তু বাংলার সমর্থকরা উর্দুকে পূর্ব বাঙলা থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় এবং আমাদের সুচিন্তিত মতানুসারে সেটা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের পক্ষে আত্মহত্যার শামিল।
তাদের এই বক্তব্যের সমর্থনে স্মারকলিপির স্বাক্ষরকারীরা কয়েকটি বিশেষ যুক্তির অবতারণা করেন যথা :
মুসলিম জাতির মহান স্রষ্টা স্যার সৈয়দ, হালী, ডক্টর ইকবালও অন্যান্যদের জাতীয় সাহিত্য থেকেই মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রেরণা এসেছিলাে। আমরা যদি জাতীয়তা-বিরােধী বলে উর্দুকে বর্জন করি, তাহলে আমরা
নিজেদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এবং নিজেদেরকেই অস্বীকার করবাে। এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা আমাদের মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিকে সম্পূর্ণভাবে বিনিষ্ট এবং আমাদের পৃথক সত্ত্বাকে ধ্বংস করবে। উদু এখনাে সেই প্রেরণা উদ্দীপক শক্তি, যা এই বিশাল উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমানকে একতাবদ্ধ করতে পারেপবিত্র কোরাণ এবং অন্যান্য ইসলামী সাহিত্য থেকে প্রেরণাপ্রাপ্ত উর্দু ভাষাকে অবহেলা করে আমরা যদি প্রধানতঃ রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ, বেদ এবং অন্যান্য সংস্কৃত সাহিত্য থেকে প্রেরণাপ্রাপ্ত বাংলা ভাষার দিকে যাই, তাহলে আমরা আমাদের জাতীয় সত্ত্বাকেই অস্বীকার করবাে। পৃথক সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গী দ্বারা গঠিত ভারতের মুসলমানদের পৃথক জাতিত্বের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের ধারণার জন্ম। ভারতীয় মুসলমানদের জাতীয় ভাষা এবং ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞান বিষয়ক সাহিত্যে সমৃদ্ধ উদুই পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার জন্যে সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ভাষা।
এই যুক্তির পর স্মারকলিপিটিতে বলা হয় যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে যারা ওকালতী করছেন তাদের মতের সাথে জনসাধারণের মতের কোনাে মিল নেই। উপরন্তু উর্দুর দাবী যারা করেছেন তারাই প্রকৃতপক্ষে জনমতের প্রতিনিধি। সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন, শর্ষিনায় অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কনফারেন্স, ২০ লক্ষ সিলেটবাসীর মুখপত্র যুগভেরী’, পূর্ব বাঙলার একমাত্র মুসলিম সাপ্তাহিক ‘আসাম হেরাল্ড’, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান প্রভৃতির উদু সমর্থনের কথাও তারা উল্লেখ করেন।
তাদের মতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা না করে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করলে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ঐক্যসূত্র বিচ্ছিন্ন হবে এবং তার ফলে পাকিস্তানী জাতীয়তা ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া তারা বলেন যে, রবীন্দ্রনাথনজরুল ইসলামের বাংলা ভাষায় প্রাদেশিক দেশপ্রেম’ প্রচার করা যায় কিন্তু কোনো সামরিক কাজকর্ম সে ভাষার মাধ্যমে সম্ভব নয়। বাংলা ভাষা বরকনের আলাপের উপযােগী হতে পারে কিন্তু তার মাধ্যমে বীরত্বব্যঞ্জক কিছু ব্যক্ত করা চলে না। বাংলার তুলনায় উছু একটা বীর্যপূর্ণ ভাষা এবং তার চরিত্রে পুরুষত্ব আছে !
উপরে উঞ্চত এবং আলােচিত স্মারকলিপিটির স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে
নিম্নলিখিত কয়েকজন উল্লেখযােগ্য :
আসাম সরকারের ভূতপূর্ব মন্ত্রী মুদাব্বির হােসেন ; নজমুল হােসেন, সভাপতি মুসলিম সাহিত্য সংসদ ; শামসুজ্জামান চৌধুরী, দর্শনের সিনিয়র অধ্যাপক ; আবদুল হাই, দর্শনের অধ্যাপক ; মিস বাহুল বার চৌধুরী। খায়রুন্নেসা খানম ; মৌলানা রাজিউর রহমান, সম্পাদক আসাম হেরাল্ড এবং যুগভেরী।
৯। ওয়ার্কার্স ক্যাম্প ও রশিদ বই সমস্যা
দেশভাগের পর আবুল হাশিম বর্ধমানে থেকে গেলেন এবং শই শহরাওয়াদীও ঢাকা এলেন না। তার ফলে মুসলিম লীগের নাজিমুদ্দীনবিরােধী বামপন্থী দলের কর্মীরা প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লেন। আবুল হাশিম মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে যখন নির্বাচন প্রার্থী হন তখন সুহরাওয়াদী তাকে সাহায্য করেননি। উপরন্তু ফজলুল হককেই প্রকারান্তরে সমর্থন করেছিলেন। এর ফলে তার এবং আবুল হাশিমের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেশ ভালােভাবে দেখা দেয়। মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদ ঘােষণার পর আবুল হাশিম জুন মাসের দিকেই তিন মাসের ছুটিতে যান এবং তার স্থানে হাবিবুল্লাহ বাহার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসাবে কাজ করতে থাকেন। | ‘ই অগাস্ট, ১৯৪৭, পূর্ব বাঙলার নেতা নির্বাচনের সময় আবুল হাশিম সুহাম্মাদীকে পার্টিগতভাবে কোনাে সাহায্য করেননি এবং অনেকটা তার ফলেই তিনি ৩৯৫ ভোটে নাজিমুদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। পূর্ব বাঙলা নােতুন সরকার স্থাপিত হওয়ার পর আবুল হাশিম, সুহরাওয়ার্দী, কেউ চাকাতে না থাকায় তাদের উপদলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে নাভিদ্দীনরা যথেষ্ট তৎপর ও সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের পুরাতন কমিটিগুলিকে ভেঙে দিয়ে মুসলিম লীগ পুনর্গঠনের প্রস্তুতি আরম্ভ হয়। এ কাজের জন্যে যে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় তার সভাপতি মনােনীত হন মৌলানা আকরাম খান। তিনি ছাড়াও এই কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ইউসুফ আলি চৌধুরী (মােহন মিঞা), নূরুল আমীন, আবদুল মােতালেব মালেক প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এই প্রাদেশিক কমিটি ব্যতীত প্রত্যেক জেলাতে নয় জন সদস্য বিশিষ্ট এক একটি অস্থায়ী কমিটি গঠন করা হয় এবং
সেখানেও একজন করে চেয়ারম্যান নিধুক্ত হন। | ‘বামপন্থী মুসলিম লীগ কর্মীরা যাতে নোতুন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কার্যে অংশ গ্রহণ করতে পারেন তার উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের উদ্দেশ্যে শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবর রহমান, মুশতাক আহমদ প্রভৃতি যৌথভাৰে ১৯৬৮-এর জানুয়ারিতে ঢাকা শহরে পুরাতন মুসলিম লীগ কর্মীদের একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। ওয়ার্কাস ক্যাম্প’ নামে অভিহিত এই সম্মেলন মুসলিম লীগের সাবেক অফিস ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে কয়েকদিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। ওয়ার্কস ক্যাম্প কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিলো না। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলাে মুসলিম লীগের বামপন্থীদের পক্ষে সাংগঠনিক কার্যে অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা। এজন্যে এই সম্মেলনে কোনাে কর্মকর্তা নির্বাচন করা হয়নি। মুসলিম লীগ যেহেতু সাম্প্রদার্ষিক প্রতিষ্ঠান এজন্যে পূর্ব বর্ণিত গণতান্ত্রিক যুব লীগের কর্মীরা সাধারণভাবে এই সম্মেলনে যােগদান করেননি। তবে কমরুদ্দীন আহমদ, শাম । . “ভৃতির মতো কেউ কেউ উভয় সম্মেলনেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন।
ওয়ার্কাস ক্যাম্পের সকল কর্মীই অবিভক্ত বাংলায় শহী-হাশিম ‘বামপন্থী উপদলের অন্তভুক্ত ছিলেন এবং তাদের ভয়ে আকরাম খান, নাজিমুদ্দীন, নূরুল আমীন প্রমুখ ‘দক্ষিণপন্থী উপদলীয় নেতারা রীতিমতাে শঙ্কিত থাকতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শহীদ সুহরাওয়াদী এবং আবুল হাশিম উভয়েই পশ্চিম বাঙলায় থেকে যাওয়ার মুসলিম লীগ রাজনীতিতে আবার আকরাম খান এবং খাজ। পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি স্থাপিত হয়। প্রায়-বিনষ্ট এই প্রভাব-প্রতিপত্তি আবার নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় আকরাম খান ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীদেরকে রশিদ বই দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন। পদ্ধতি হিসাবে ইতিপূর্বেই তারা স্থির করেছিলেন যে বিভিন্ন সাংগঠনিক কমিটির সদস্য ব্যতীত অন্য কাউকে রশিদ বই দেবেন না। এ ছাড়া এই কমিটিগুলি গঠন করার সময়েও তারা সবক্ষেত্রেই নিজেদের লােকদেরকে মনােনয়ন দান করেছিলেন।
কিন্তু তাদের এই মনােভাব সত্ত্বেও প্রায় একরকম জোর করেই ক্যাম্প কর্মীদের একটি প্রতিনিধিদল আকরাম খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই দলটিতে ছিলেন আতাউর রহমান, শামসুল হক, শেখ মুজিবর রহমান, মিসেস আনোয়ারা খাতুন, মােস্তাক আহমদ, কমরুদ্দীন আহমদ, সবুর খান, ফজলুল
কাদের চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। আকরাম খান এই প্রতিনিধিদলটিকে বলেন যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগকে পূর্বের মতাে এতাে বড়াে আকারে গঠন করার কোনো প্রয়ােজন নেই। এ ছাড়া তিনি ক্যাম্পের কর্মীদেরকে মুসলিম লীগ কর্মী হিসাবে বিবেচনা করতেই অস্বীকার করেন। | প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি মেলানা আকরাম খানের কাছ থেকে রশিদ বই পাওয়ার সরাসরি চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর কর্মীরা পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান অর্গানাইজার চৌধুরী খালিকুজ্জামানের কাছে এ ব্যাপারে সুপারিশের জন্যে পাঞ্জাব প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভূতপূর্ব সভাপতি মিঞা ইফতিখারুদ্দীনকে অনুরোধ করেন। ইফতিখারুদ্দীন জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাকা সফরে এলে মুসলিম লীগ কর্মীদের সাথে এ ব্যাপারে তার বিস্তৃত আলােচনা হয়। খালিকুজ্জামানের সাথে রশি বই সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ করতে তিনি সম্মত হন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার পর তার কাছ থেকে এ ব্যাপারে কোনাে সংবাদ পাওয়া যায়নি।
| ফেব্রুয়ারি মাসে মিঞা ইফতিখারুদ্দীন দ্বিতীয়বার ঢাকা আসেন। এবারও তার সাথে ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীরা মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্ম এবং রশিদ বই সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ আলােচনা করেন। এর পর পশ্চিম পাকিস্তান ফেরৎ গিয়ে ইফতিখারুদ্দীন খালিকুজ্জামানের সাথে রশিদ বই নিয়ে আলাপ করেন কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটি প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির আওতাভূক্ত এই অজুহাত দেখিয়ে খালিকুজ্জামান কোনাে ৫ কার হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃত হন। • | আকরাম খানকে রশিদ বই দেওয়ার ব্যাপার কোনােক্রমেই সম্মত করাতে সক্ষম না হয়ে অবশেষে কর্মীরা বুড়ীগঙ্গার অপর পারে জিঞ্জিরায় একটি সভা আহ্বান করেন। কিন্তু সরকারী অনুমতির অভাবে কোনাে সভা সেখানে অনুষ্ঠিত হয়নি।
এর পর কর্মীরা খান সাহেব ওসমান আলীর সহায়তায় নারায়ণগয়ে একটি কনভেনশন আহ্বানের চেষ্টা করেন। খান সাহেবকে সভাপতি করে একটি সম্বর্ধনা কমিটি গঠিত হয়। সভাটি নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলাে। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে সভা আরম্ভের পূর্বেই পুলিশ এবং পূর্ব পাকিস্তান রাইবেলের লােকজন এসে সভাস্থলে উপস্থিত হয় এবং তার যাতে সেখানে সভা করতে না পারে তার ব্যবস্থা করে। রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউটে সভা করতে অক্ষম হয়ে কর্মীরা নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়া ক্লাবে সমবেত হন।
প্রাথমিক রশিদ বইয়ের প্রশ্নটি আলােচনার জন্যে চৌধুরী খালিকুজ্জমানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাের প্রস্তাব এই সভাতে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে আতাউর রহমান খান এবং মিসেস আনােয়ারা খাতুন মনােনীত হন। তৎকালে কর্মীদের নিজেদের কোনাে সাংগঠনিক তহবিল না থাকার ফলে তারা প্রতিনিধিদলের যাতায়াতের ব্যয় বহনে সমর্থ ছিলাে না। কিন্তু আতাউর রহমান এবং আনােয়ারা খাতুন নিজেরাই তাদের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে সম্মত হলে তাদেরকেই প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে নির্বাচন করা হয়।১১
প্রতিনিধিদলটি করাচীতে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের সাথে সাক্ষাৎ করেন কিন্তু মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্মে অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে কর্মীদেরকে রশিদ বই দেওয়ার জন্যে আকরাম খানকে অনুরােধ করতে তিনি অস্বীকার করেন। ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীরা সকলেই সরকারবিরােধী এবং সেই হিসাবে তাদেরকে মুসলিম লীগের সাথে কোনাে সম্পর্ক রাখতে দেওয়া চলে না এই মর্মে খালিকুজ্জামান প্রতিনিধিদলটির কাছে মত প্রকাশ করেন।১২
মুসলিম লীগের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় অর্গানাইজারদের এই মনােভাব এবং আচরণের ফলে মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যথেষ্ট হতাশার সঞ্চার হয়। তারা। অনেকে এর থেকে সিদ্ধান্ত করেন যে মুসলিম লীগের সদস্য হিসাবে তাদের পক্ষে তৎকালীন অবস্থায় রাজনীতি করা আর সম্ভব নয়। কাজেই তার জন্যে একটি পৃথক প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজন। | মুসলিম লীগ সাংগঠনিক কমিটির উপরােক্ত কার্যকলাপ এবং নতুন রাজনৈতিক সংগঠন গঠন প্রসঙ্গে তৎকালীন দৈনিক ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ তার আত্মস্মৃতিতে নিম্নলিখিত মন্তব্য ব্যক্ত করেছেন :
সুতরাং পাকিস্তান হাসিলের সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম লীগের দরজা জনগণের মুখের উপর বন্ধ করিয়া দেওয়া শুধু রাজনৈতিক অপরাধ ছিল না, নৈতিক মরাল ও এথিক্যাল অপরাধও ছিল। তবু নেতারা শুধুমাত্র কোটারি স্বার্থ রক্ষার জন্য মুসলিম লীগকে পকেটস্থ করিলেন। এই কাজে তারা প্রথম অসাধুতার আশ্রয় নেন বাউলা বাটোয়ারা হইয়াছে এই অজুহাতে বাংলার মুসলিম লীগ ভাঙিয়া দিয়া। কাজটা করিলেন তারা এমন বেহায়া বেশরমের মতাে যে পাৱাৰ ভাগ হওয়া সত্বেও পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ ভাঙিলেন না। ফলে পক্ষপাতিত্ব-দোষে বামাল গ্রেফতার হইলেন। দ্বিতীয় অসাধু করিলেন তারা নিজেদের বাধ্য-অনুগত লােক দিয়া এডহক কমিটি গঠন
করিয়া। তৃতীয় অসাধু কাজ করিলেন নয়া মুসলিমলীগ গঠনের জন্য প্রাইমারী মেম্বারশিপের রশিদ বই বগলদাবা করিয়া। মুসলিম লীগ কর্মীদের পক্ষে জনাব আতাউর রহমান খাঁ ও বেগম আনওয়ারা খাতুন প্রথমে মওলানা আকরাম খাঁ ও পরে চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কাছে দরবার করিয়াও রশিদ বই পান নাই। তারা নাকি স্পষ্টই বলিয়াছিলেন, এখন তারা আর বেশ মেম্বর করিতে চান না। তাদের যুক্তি ছিল এখন শুধু গঠনমূলক কাজ দরকার। হৈ হৈ করিলে তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি হইবে। এসব কথা আমি কলিকাতা বসিয়া খবরের কাগজে পড়িয়াছিলাম। নিজের কাগজ ‘ইত্তেহাদে এই অদূরদর্শিতার কঠোর নিন্দা করিয়াছিলাম। বলিয়াছিলাম, যে-সব দেশে একদলীয় শাসন চালু আছে, সেখানেও রুলিং পাটির দরজা এমন করিয়া বন্ধ করা হয় নাই। লীগ-নেতৃত্বের এই মনোভাব ছিল অযৌক্তিক ও অবৈজ্ঞানিক। কায়েদে আজমের জীবনেই শাসকগােষ্ঠী ও তাদের সমর্থকরা এই নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন দেখিয়া আমার মনে কম ধাক্কা
লাগে নাই।১৩ কাজেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের উপরােক্ত আচরণের ফলে :
অগত্যা মুসলিম লীগ কর্মীরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রথমে নারায়ণগঞ্জে ও পরে টাঙ্গাইলে কর্মী-সম্মেলনী করিয়া নেতাদের কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং মুসলিম লীগের দরজা খুলিয়া দিতে দাবী করেন। নেতারা কর্ণপাত না করায় ১৯৪৯ সালে নিজেরাই মুসলিম লীগ গঠন করেন। সরকারী মুসলিম লীগ হইতে পার্থক্য দেখাইবার জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম রাখিলেন : জনগণের (আওয়ামী মুসলিম লীগ। ৪
১। প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
অক্টোবর মাসে ফজলুল হক হলের সাহিত্য সার পর তমদ্দন মজলিসের উদ্যোগেই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের কাছে রশিদ বিল্ডিং নামে একটি বাড়ি ছিলাে। সেটি এখন আর নেই, কিন্তু তখনকার সেই রসিদ বিল্ডি’-এর একটি কামরায় তমদুন মজলিসের অফিস অবস্থিত ছিলাে। সেখানেই তমদুন মজলিস এবং মুসলিম ছাত্র লীগের অল্প কয়েকজন কর্মীর উপস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদটি গঠিত হয় এবং তমদুন মজলিসের অন্যতম প্রধান সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
নূরুল হক ভূঞা তার আহ্বায়ক নির্বাচিত হন।
| পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মনি অর্ডার ফর্ম, ডাক টিকিট এবং মুদ্রায় শুধুমাত্র ইংরেজী ও উর্দু ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাংলার ব্যবহার এগুলি থেকে বাদ দেওয়ার ফলে পূর্ব বাঙলার জনসাধারণ ও শিক্ষিত মহলে যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিরুদ্ধ মনােভাবের সৃষ্টি হয়। এই সময় পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা, আরবী হরফে বাংলা লেখা ইত্যাদির সপক্ষে সভাসমিতি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে অনেক বিতর্কের অবতারণা করেন। বস্তুতঃ এই পর্যায়ে তিনিই ছিলেন সরকারের বাংলা-বিরােধী নীতির অন্যতম প্রধান মুখপাত্র।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার পরই ফজলুর রহমান ঢাকা আসেন এবং আবুল কাসেমসহ পরিষদের আরও কয়েকজন সদস্য মওলা সাহেবের (ফজলুল হক) নাজিরাবাজারের বাসায় ১৯৪৮-এর ১লা ফেব্রুয়ারি তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকারের সময় ফজলুর রহমানের সাথে সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয়-তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়া, পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাক টিকিট ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা স্থান না পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা করেন। আলােচনা পরিশেষে তুমুল বিতর্কে পরিণত হয়। এই বিতর্ককালে অবশ্য ফজলুর রহমান বলেন যে উপরােক্ত কয়েকক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি একেবারেই। ইচ্ছাকৃত নয়। নিতান্ত ভুলবশতঃই সেটা ঘটেছে। তিনি সে ভুল সংশােধনের আশ্বাসও প্রতিনিধিদলটিকে দান করেন।
এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদ ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন যে শুধু মুদ্রা, ডাক টিকিট ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষার বিষয়-তালিকা থেকেই বাংলাকে বাদ দেওয়া হয় নাই। এগুলি ছাড়া পাকিস্তানের নৌ-বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে লােক নিয়ােগের ক্ষেত্রেও উদু এবং ইংরেজীতে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। এর পর উক্ত সম্পাদকীয়তে বলা হয় :
মিঃ ফজলুর রহমান হয়ত এগুলিকে ভুল বলিয়া চালাইবার প্রয়াস পাইবেন। কিন্তু সব কয়টি ক্ষেত্রেই বাংলা ভাষাকে “ভূলে” বাদ দেওয়া হইয়াছে, একথা কে বিশ্বাস করিবে? বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক ও কর্মকর্তাদের পক্ষে এতবার একই ভুল করা কি করিয়াই সম্ভব। নিতান্ত “ভুল”ও বারে বারে পুনরাবৃত্তি কৰিলে যে তাহাই “শুদ্ধ হইয়া যায় সে খবর কি ফজলুর রহমান
সাহেবের জানা নাই। পাকিস্তানের মােট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের মাতৃভাষা ও পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষার অস্তিত্বের কথা যারা এইভাবে বার বার “ভুলিয়া যাইতে পারেন, তাদের পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানকে একদিন ভুলিয়া যাওয়া বিচিত্র নয়।
এর পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক জীবনের সম্পর্কের বিষয়ে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় :
রাষ্ট্রভাষার সওয়ালটা শুধু রাজকার্যের মাধ্যমের সওয়াল নয়, এর সাথে রাষ্ট্রের জনগণের উন্নতি, অবনতি, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রশ্নও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এইরূপ একটি নাজুক প্রশ্ন লইয়া ছেলেখেলা চলে না। কিন্তু দুঃখের সহিত আমরা লক্ষ্য করিতেছি যে, সেই ছেলেখেলাই যেন চলিতেছে। পাকিস্তানের মেজরিটির মাতৃভাষার বিরুদ্ধে যেন ব্যুরােক্র্যাটিক ষড়যন্ত্র চলিতেছে। নইলে অভিজ্ঞ ও দায়িত্বসম্পন্ন কর্মচারীদের পক্ষে এমন ‘ভুল’ বার বার দুহরানাে সম্ভব নয়। কিন্তু এই পুনরাবৃত্তি “ভুলই হউক আর মতলবই হউক, এর পরিণতি রাষ্ট্রের পক্ষে সমান বিষময়। কারণ রাষ্ট্রভাষার মতাে নাজুক প্রশ্নের বিচার করিতে গিয়া জনগণের সমষ্টিগত সুবিধা ও সেন্টিমেন্টকে উপেক্ষা করিলে চলিবে না। সুদ্ধমাত্র জনগণের মত লইয়াই এই প্রশ্নের সুষ্ঠু মীমাংসা হইতে পারে। গায়ের জোরে বা চালাকি করিয়া পাঁচ কোটি লােকের ঘাড়ে একটা ভাষা চাপান যাইবে না। চাপাইতে গেলে তা একান্তই অস্বাভাবিক হইবে। বিংশ শতাব্দীর জটিল পরিবেশে জাতীয় ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষার একমাত্র উপায় হইতেছে রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি অংশকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সমান অধিকার দেওয়া। ফজলুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের পর ফেব্রুয়ারি মাসেই সংগ্রাম পরিষদ, বাংলা ভাষার দাবী জ্ঞাপক একটি স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে এবং কয়েক হাজার স্বাক্ষরসহ সেটি সরকারের কাছে প্রেরিত হয়।
| এর পূর্বে ১৯৪৮-এর ১১ই জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের যানবাহন ও যােগাযােগ মন্ত্রী আবদুর রব নিশতার সফরের উদ্দেশ্যে সিলেটে উপস্থিত হন। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন এবং অফিস আদালতের ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার দাবী জানানাের জন্যে সিলেট মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আবদুস সামাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। একটি মহিলা প্রতিনিধিদলও সেই সময় আবদুর
ছিলাে কিন্তু এর পর তা ধীরে ধীরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। জানুয়ারি মাসেই পাবনার স্থানীয় সংবাদপত্র প্রতিনিধি সমিতির • এক সভায় বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করার দাবী জানানাে হয়। এ ছাড়া এই দাবীর ভিত্তিতে আন্দোলন গঠন করার জন্যেও তারা একটি স্বতন্ত্র প্রস্তাব গ্রহণ করেন।১৪ | ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সিলেটের কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে প্রেরিত একটি স্মারকলিপিতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। এতে যারা স্বাক্ষর দান করেন তাদের মধ্যে মহিলা মুসলিম লীগের জেলা কমিটির সভানেত্রী বেগম জোবেদা খাতুন চৌধুরী, সহ-সভানেত্রী সৈয়েদা শাহেরবানু, সম্পাদিকা সৈয়দা লুৎফুন্নেসা খাতুন, সৈয়েদ। নজিবুন্নেসা খাতুন এবং সিলেট রাজকীয় বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী রাবেয়া খাতুনের নাম উল্লেখযােগ্য।১৫
এই স্মারকলিপি প্রেরণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সিলেটের ইস্টার্ন হেরাল্ড পত্রিকায় ২৮শে ফেব্রুয়ারি একটি সম্পাদকীয় মন্তব্যে অন্যতম স্বাক্ষরকারিণী জোবেদা খাতুন এবং স্মারকলিপিটি সম্পর্কে কতকগুলি অশােভন ও বিরূপ উক্তি করা হয়। এই উক্তির প্রতিবাদে সাপ্তাহিক নওবেলালে ১১ই মার্চ স্মারকলিপির অন্যতম স্বাক্ষরদাত্রী সৈয়দ নজিবুন্নেসা খাতুনের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। তাতে তিনি বলেন যে নিজেদের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত দাবী পেশ করার জন্যেই তারা উপরোল্লিখিত স্মারক লিপি প্রধান। মন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং এ কাজ করায় পূর্ণ অধিকার তাদের আছে। তিনি আরও বলেন : যাহারা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী হইয়া মাতৃভাষার বিরুদ্ধাচরণ করেন তাহারা মাতৃভাষার বিশ্বাসঘাতক কু-পুত্র তুল্য। অনেকে আবার
বুঝিয়া, ধর্মের দোহাই শুনিয়া উদুর সমর্থন করেন। তাহাদের তত ঘােষ দেওয়া যায় না। কিন্তু যাহারা ধর্মের দোহাই দেন তাহাদের জিজ্ঞাসা করি যে উর্দু ভাষাভিজ্ঞ অপেক্ষা সিলেটের উছু অনভিজ্ঞ মুসলমানেরা ইসলাম ধর্মের অনুশাসন পালনে কোন্ অংশে হীন। বরং এ বিষয়ে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সিলেটের মুসলমানদের তহজীব ও তমন এক বিশিষ্ট স্থান লাভের অধিকারী বলিয়া অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মত প্রকাশ করিয়াছেন। আমাদের বক্তব্য ছিল যে উর্দু ভাষাভাষী অধিক
সংখ্যক শিক্ষয়িত্ৰী নিযুক্ত করিয়া পর্দানসীন মহিলাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অসম্ভব ফলে অল্প দিনের মধ্যে অল্প শিক্ষিত নারী জাতি অশিক্ষিতা হইয়া যাইবেন এবং স্বামী পুত্রের সহযােগিতা করিতে পারিবেন না। রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলার পরিবর্তে উর্দু হয়, তবে আমাদের মতাে অল্প শিক্ষিতা নারীদের জন্য উর্দু শিক্ষার কি ব্যবস্থা হইবে, তাহা আমাদের ধারণাতীত।
মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষাকল্পে সিলেটের মহিলাদের এই প্রচেষ্টা খুবই উল্লেখযােগ্য। তাদের এই প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে তমদ্দন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম মহিলা লীগের সভানেত্রী জোবেদা খাতুনের কাছে নিম্নলিখিত পত্র প্রেরণ করেন :
আজ সত্যি আমরা অভূতপূর্ব আনন্দ এবং অশেষ গৌরব অনুভব করছি। সিলেটের পুরুষরা যা পারেননি তা আপনারা করেছেন। উছু সমর্থনে সিলেটের কোনো কোনাে পত্রিকা যে জঘন্য প্রচার করছে আর সিলেটের কোনাে কোনো পুরুষরা স্মারকলিপি দিয়ে যে কলঙ্কজনক অভিনয় করেছেন ত। সত্যিই বোদায়ক। কিন্তু আপনাদের প্রচেষ্টা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনাদের প্রেরিত স্মারকলিপি আমাদের আশান্বিত করে তুলেছে। নিশতার সাহেবের সঙ্গে দেখা করেও আপনারা মাতৃভাষার প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। তমদ্দন মজলিস আজ আপনাদের অকৃত্রিম ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আপনাদের প্রচেষ্টা জয়যুক্ত হউক। আশা করি আপনাদের নিঃস্বার্থ কর্মচাঞ্চল্যে বাংলা ভাষা আন্দোলন আরাে সক্রিয়—আরাে প্রবল হয়ে উঠবে।
২৩শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮, পাকিস্তান গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন আহত হয়। এই অধিবেশনে যােগদান করার জন্যে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি নুরুল আমীন, হাবিবুল্লাহ বাহার, গিয়াসুদ্দীন পাঠান প্রমুখ করাচী রওয়ানা হওয়ার পূর্বে আবুল কাসেম এবং তমদুন মজলিস রাষ্ট্রভাষা সাবকমিটি ও মুসলিম ছাত্র লীগের এক প্রতিনিধিদল তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তারা পাকিস্তানের মুদ্রা, ডাক টিকিট, মনি অর্ডার ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা বাদ দেওয়ার প্রতি গণ-পরিষদের উপরােল্লিখিত সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সদস্যবৃন্দ প্রতিনিধিদলটিকে এ সম্পর্কে ভুল সংশােধনের আশ্বাস দেন।
ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে তমদ্দন মজলিস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলা ভাষার দাবীতে প্রথম সংগ্রাম পরিষদ তাদের ‘উদ্যোগেই গঠিত হয়। আন্দোলনের সাংগঠনিক দিকটির প্রতি লক্ষ্য রাখার
ফলে ভাষা আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক আলােচনাক্ষেত্র থেকে রাজনৈতিক আন্দোলনে উত্তীর্ণ করার ব্যাপারেও তাদের প্রচেষ্টা উল্লেখযােগ্য। | তমন মজলিসের এই ভূমিকার জন্যে বাংলা ভাষা বিবােধী সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্রগুলিতে সে সময় তাদের অনেক বিরূপ সমালােচনা হয়। এ কাগজগুলির মধ্যে মর্নিং নিউজ’, ‘পাসবান’ এবং সিলেটের সাপ্তাহিক ‘আসাম হেরাল্ড’ ও ‘যুগভেরী’র নাম উল্লেখ যােগ্য। কিন্তু ভাষা আন্দোলন বিরােধী পত্রিকাগুলি এ ধরনের সমালােচনা করলেও সাপ্তাহিক ‘ইনসাফ, ‘জিন্দেগী’ ও ‘দেশের দাবী’ এবং সিলেটের সাপ্তাহিক নওবেলাল’ পুরােপুরিভাবে এই আন্দোলনকে সমর্থন করে।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আজাদ পত্রিকায় বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। ১০ই জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধীনতা পত্রিকাতে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি পত্রে সেই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাে হয়। পত্রটি লেখেন হামিদা সেলিম (রহমান)। ইনি পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮-এর মার্চ মাসে যশাের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। পত্রটি নিম্নরূপ :
বাঙালী হিসাবে যেমন আমরা সমগ্র বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর আবী করেছিলাম, তেমনি আজ বাঙলা দেশের ভাষা হিসাবেও বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে দাবী করব না কেন? পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় ‘আজাদের পৃষ্ঠায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করার বিরুদ্ধে যুক্তি দেখে খুবই দুঃখ হয়। আমাদের বাঙালীর এতদিনের সাহিত্যকলা সবই কি আজ ভুলে যেতে হবে। কেমন করে আমরা ভুলে যাবে। মাননীয় আকরাম খায়ের লেখা কোরাণের তর্জমা, কেমন করে আমরা ভুলে যাবে তার রচিত মােস্তকা চরিত, কেমন করে আমরা ভুলবাে আমাদের নজরুলের গান? এই সাহিত্য কি আবার উছুতে তর্জমা হবে। শ্রদ্ধেয় আকরাম খাঁ কি আবার আমাদের জন্য তার কলম উদুর গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ করবেন। পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র। তাই তার ভাষা হবে জনগণের ভাষা। বাঙলার সাড়ে চার কোটি লােক যে ভাষায় কথা বলে, যে ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যে ভাষায় মনের ভাব ব্যক্ত করে সে ভাষা তাদের নিজস্ব ভাষা হবে না এও কি বিশ্বাস করতে হবে ? স্বাধীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার সাথে তাদের প্রাণের কোনাে যােগই থাকবে না, এ কি সত্য হবে?
কি আজাদের এই বিরােধিতা তেমন বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। ইত্তেহাদের মতাে জোরালােভাবে বাংলার দাবীকে স্বীকার এবং প্রচার না করলেও আজাদ অল্প দিনের মধ্যেই বাংলা ভাষার বিরােধিতা না করার সিদ্ধান্ত করে। এ প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি উল্লেখযোগ্য :
১৯শে অগাস্ট, ১৯৪৭ সন । কলিকাতার মৌলালির আজাদ অফিসে জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেবের টেবিলে বসে নতুন পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করছিলাম। এমন সময় তারই স্টাকের একজন এসে প্রশ্ন করলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার বিষয়ে আমাদের মত কি হবে ? ইত্তেহাদ তো বাঙলা ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।’ এডিটর সাহেব সামান্য কথা-বার্তার পর বললেন, ‘—দিন জানিয়ে যে আমাদেরও মত অনুরূপ ; তবে একটু ধীরে ধীরে আগান।১৮
আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সতর্ক পদক্ষেপের উপদেশ থেকে বোঝা যায় যে বাংলা ভাষার বিরােধিতার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলেও আজাদ ইত্তেহাদের মতাে জোরালাে ভূমিকা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলো না।
বস্তুতঃ বাংলা ভাষার দাবী, কিছুটা সমর্থন করলেও মার্চ মাসের ভাষা আন্দোলনের সময় আজাদ সর্বতােভাবে সরকারী পক্ষ অবলম্বন করে আন্দোলনের বিরােধিতা করে।
১১। কর্মী নির্যাতন
প্রথম পর্যায়ে বাংলা ভাষার আন্দোলন ছাত্র এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাে। কিন্তু একথাও সত্য যে বহু ছাত্র ও শিক্ষিত জনসাধারণ তৎকালে উদুর সপক্ষে ছিলেন। এই জাতীয় উদু সমর্থক এবং গুণ্ডাদের সহায়তায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের উপর বহুবার হামলা করে। পুরান ঢাকার কতকগুলি এলাকায় সে সময় বাংলা সমর্থক ছাত্রদের প্রবেশ প্রায় অসম্ভব ছিল। রায়সাহেব বাজার থেকে এই সময় একটি উদু সমর্থক মিছিল বের হয়ে ঢাকা কলেজ পৌছায় এবং অন্য একটি অনুরূপ মিছিল ফজলুল হক হল থেকে শামসুল হুদার পরিচালনায় বের হয়ে ঢাকা কলেজ পৌছায় এবং কলেজ প্রাঙ্গণে ( সিদ্ধিক বাজারে ) সমবেত হয়ে একটি সভা করে। সেই সভায় ভাষা আন্দোলনকে কুৎসিত ভাষায় নানাপ্রকার গালাগালি করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানানো হয়।
এই সময় ঢাকা রেল স্টেশনের কাছে ভাষা আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলের উপর গুণ্ডারা লাঠি চালায়। এই লাঠি চালানার ফলে কয়েকজন আহত হন। এ ছাড়া সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের তদানীন্তন সম্পাদক এবং তমদ্দন মজলিসের কর্মী মোহাম্মদ সিদ্দিকুলা কসাইটুলীর বলিয়াদী প্রেসে একটি ইস্তাহার ছাপাতে গিয়ে গুণ্ডাদের হাতে লাঞ্ছিত হন এবং তাকে সেখানে আটক করা হয়। আটক অবস্থা থেকে তিনি একজনের সহায়তায় মুক্তি লাভ করে তাড়াতাড়ি সে এলাকা পরিত্যাগ করেন। ১৯৫২ সালের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক কাজী গােলাম মাহবুবও এই সময় নাজিমুদ্দিন রােড়স্থ ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কাছে বাংলা ভাষা বিরােধী গুণ্ডাদের দ্বারা আক্রান্ত হন। বস্তুতঃ এ ধরনের গুণ্ডামী এবং ছাত্র নির্যাতনের উদাহরণ ছিল অসংখ্য।
ফরিদ আহমদ ভাষা আন্দোলনের এই পর্যায়ে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করা কালে একাধারে আইনের ছাত্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতি এবং ঢাকা সরকারী কলেজের ইংরেজীর অধ্যাপক ছিলেন। সরকারী কর্মচারী হিসাবে আন্দোলনে তার ভূমিকা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং ৬ই জানুয়ারি, ১৯৮-এ প্রাদেশিক চীক সেক্রেটারী আজিজ আহমদ সেক্রেটারিয়েটে নিজের অফিসে ফরিদ আহমদকে তার সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। আজিজ আহমদ এই সাক্ষাৎকারের সময় ফরিদ আহমদকে বলেন যে সরকারী কর্মচারী হিসাবে তিনি চাকরির নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করে সক্রিয় রাজনীতির সাথে জড়িত হয়েছেন। এজন্যে তিনি তাকে প্রথমে বরখাস্ত করবেন ভেবেছিলেন কিন্তু পরে অল্প বয়সের কথা বিবেচনা করে প্রথম বারের মতাে তিনি তাকে সাবধান করে দেওয়াই স্থির করেছেন। ফরিদ আহমদ উত্তরে তাকে বলেন যে কর্তব্য সম্পর্কে তিনি নিজের ধারণা অনুসারেই কাজ করেছেন কাজেই এ ব্যাপারে তিনি মােটেই অনুতপ্ত নন।
ঐ সাক্ষাৎকারের পর ফরিদ আহমদ ৮ই জানুয়ারি, ১৯৪৮, অফিসে গিয়ে বাংলাকে কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভাষা হিসাবে বাদ দেওয়া প্রতিবাদে চাকরিতে ইস্তফা দেন। এই প্রসঙ্গে দৈনিক ইত্তেহাদের সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ একটি সম্পাদকীয় লেখেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে ১৯৪৭ সালে ফরিদ আহমদের এই ভূমিকা সত্ত্বেও পরবর্তী মার্চ ১৯৪৮ এবং ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সাথে তাঁর কোনাে যােগাযােগই আর থাকেনি।
৫০
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। প্রথম রাজনৈতিক সংগ্রাম
১। গণ-পরিষদে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব
২৩শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮, পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে বিরােধী দল দুটি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রথম প্রস্তাবটিতে বৎসরে অন্তত একবার ঢাকায় পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিব্রেশন অনুষ্ঠানের দাবী জানানাে হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিলাে ভাষা বিষয়ক। এটিতে উদু এবং ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার দাবী উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। খুব সম্ভবতঃ গণ-পরিষদের কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি পেশ করা হয়নি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্যক্তিগতভাবেই তা করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লেখকের কাছে ১৯শে জুলাই, ১৯৬৮তে লিখিত একটি পত্রে বলেন :
“বাংলা ভাষা আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হইক ইহাই ছিল আমার প্রস্তাব! ইহা আমার পাটি প্রস্তাব ছিল বলে মনে হচ্ছে না।
কিন্তু ব্যক্তিগত হলেও কংগ্রেস দলের সমস্ত সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং কয়েকজন এর সপক্ষে বক্তৃতা দেন।
প্রথম সংশােধনী প্রস্তাবটি ২৪শে তারিখে আলােচিত হয় এবং তমিজুদ্দীন খান সেটির বিরােধিতা করার পর পরিষদ কর্তৃক তা বাতিল হয়ে যায়। ভাষা বিষয়ক দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আলােচিত হয় অধিবেশনের তৃতীয় দিন, ২৫শে ফেব্রুয়ারিতে। এই আলােচনাকালে গণ-পরিষদে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত এই প্রস্তাবটির বিরােধিতা করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বলেন :
এখানে এ প্রশ্নটা তােলাই ভুল হয়েছে। এটা আমাদের জন্যে একটি জীবনমরণ সমস্যা। আমি অত্যন্ত তীব্রভাবে এই সংশােধনী প্রস্তাবের বিরােধিতা করি এবং আশা করি যে এ ধরনের একটি সংশােধনী প্রস্তাবকে পরিষদ অগ্রাহ করবেন।
শুধু তাই নয়। প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের উদ্দেশ্যের সততার প্রতি কটাক্ষপাত করে তিনি আরও বলেন :
প্রমে এই প্রস্তাবের উদশ্য নির্দোষ বলি। মামি ভাবিয়াছিলাম। কি। বর্তমানে মনে হয় পাকিস্তানের অধিবাসীদের ম:1্য বিরোধ সৃষ্টি করা এবং একটি সাধারন ভাষার ঐক্যসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা হইতে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্য।
লিয়াকত আলী খানের এই সাম্প্রদায়িক বক্তব্য সম্ভব হয়েছিলো প্রধানতঃ এই কারণে যে পরিবনে মুসলমান সদস্যের সকলেই ছিলেন সরকারী মুসলিম লীগ দলভুক্ত এবং তার। দলগত ভাবে বাঙাল। অবাঙালা নির্বিশেষ সমস্বরে প্রস্তাবটির নিন্দা এবং বিরোধিতা করেছিলেন। অন্য পক্ষে প্রস্তাবটি বার। উথাপন এবং তার সমর্থনে বক্তৃতা করেন তারা সফল ছিলেন হি দু এবং কংগ্রেস দলভূক্ত।
গণ-পরিষদে কংগ্রেস দলের সেক্রেটারী রাজ চুনার চক্রবর্তী সংশোধনী প্রস্তাবটির সমর্থনে বলেন :
উদু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। পূর্ব বাঙলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তার উপর এখন তাদের ঘাড়ে একটা ভাষাও আবার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলো অন্যান্যদের উপর উচ্চশ্রেণীর অাধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্যে কোনো চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারী। ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজীকে যদি সে মর্যাদা দেওয়া হয় তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী।
মোহাজের এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী গজনফর আলী খান প্রস্তাবটর বিরােধিতা করে বলেন :
পাকিস্তানে একটি সাধারণ ভাষা থাকবে সে ভাষা হচ্ছে উহু। আমি আশা করি যে অচিরেই সমস্ত পাকিস্তানী ভাল ভাবে উহু শিক্ষা করে উদুতে কথাবার্তা বলতে সক্ষম হবে। উর্দু ভাষার সাথে ইসলামী সংস্কৃতির যোগ সম্পর্কে তিনি বলেন : উঃ কোনো প্রদেশের ভাষা না, তা হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতির ভাষা। এবং উর্দু ভাষাই হচ্ছে মুসলিম সংস্কৃতি। পরিষদের কংগ্রেস দলভুক্ত হিন্দু সংস্থার প্রতি কটাক্ষপাত করে তিনি বলেন :
বাঙলা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় এই বিতর্কের তাৎপর্য যে উপলব্ধি করে এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এতে আমি খুশী হয়েছি।
গজনফর আলী খানের এই শেষােক্ত বক্তব্যের ভিত্তি হচ্ছে বিতর্ককালে পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগ দলভুক্ত সদস্যদের আচরণ এবং বক্তৃতা। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরােধিতা করতে গিয়ে বলেন : পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ অধিবাসীরই এই মনােভাব যে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। খাজা নাজিমুদ্দীন ছাড়া গণ-পরিষদের সহ-সভাপতি তমিজুদ্দিন খানও ভাষা সংক্রান্ত সংশােধনী প্রস্তাবটির বিরােধিতা করে বক্তৃতা দেন।
২। সংবাদপত্রের সমালােচনা
প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের উপরােক্ত বক্তৃতা প্রসঙ্গে ২৭শে ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা ভাষা ও পাকিস্তান’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধে দৈনিক আজাদ মন্তব্য করন :
খাওয়াজা সাহেব কবে রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের গণভােট গ্রহণ করিলেন, তাহা আমরা জানি না। আমাদের মতে, তার উপরােক্ত উক্তি মােটেই সত্য নয়। আমরা বিশ্বাস কবি গণভােট গ্রহণ করিলে বাংলা ভাষার পক্ষে শতকরা ৯৯ ভােটের বড় কম হইবে না। এ অবস্থায় এমন গুরুতর ব্যাপারে তিনি (খাওয়াজা নাজিমুদ্দীন) এইরূপ একটি দায়িত্বহীন উক্তি করিয়া শুধু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থেরই ক্ষতি করেন নাই, এদেশবাসীর পক্ষে আপন প্রতিনিধিত্বের অধিকারের মর্যাদাকেও ক্ষুগ্ন করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মৌলিক স্বার্থকে এভাবে বিকাইয়া দেওয়া কি এতই সহজ?
ঐ একই দিনে দৈনিক ইত্তেহাদ ‘অবিশ্বাস্য’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের সমালােচনা প্রসঙ্গে বলেন :
এমন একটি নির্দোষ প্রস্তাব এবং যে প্রস্তাবের সহিত পাকিস্তানের তিনচতুর্থাংশ নাগরিকের মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িত তাহাকে বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রস্তাব অভিহিত করাতে এ প্রস্তাবটি অগ্রাহ করার পথ খােলাসা হইয়াছে বটে কিন্তু ন্যায় ও যুক্তির দরজা বন্ধ করা হইয়াছে।
এই সময় ইত্তেহাদ’ এবং ‘আজাদ’ পত্রিকা কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতাে। এ ছাড়া ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর, ‘স্বাধীনতা’ ইত্যাদিতে ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ে যে সব সংবাদ ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয় সেগুলি পূর্ব বাঙলার সরকারী মহলে যথেষ্ট বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এ ছাড়াও অন্যান্য কারণে সংবাদপত্র গুলির কিছু কিছু মন্তব্য উল্লেখযোগ্য।
২৭শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮, আনন্দবাজার পত্রিকা ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্র শীর্ষক নিম্নোক্ত দীৰ্ণ সম্পাদকীয়টি প্রকাশ করেন। পাকিস্তান গণ-পরিষদের অধিবেশনের প্রারম্ভ হইতে এ পর্যন্ত যাহা ঘটিয়াছে তাহাতে পাকিস্তানী গণতন্ত্রের পরিচয় বিশেষ করিয়াই পাওয়া যাইতেছে । পাকিস্তানের প্রধানতম অংশরূপে পূর্ব বঙ্গের এবং বিশেষ করিয়া পাকিস্তানী অধিবাসী হিন্দু, শিখ মাইনরিটির পক্ষে ইহা লক্ষ্য করিবার বিষয়। গণপরিষদের পরিচালনার বিধান রচনার জন্য আলােচ্য ৭০ টি প্রস্তাবের মধ্যে ৬৮টি মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় বিনা শালােচনাতেই গৃহীত হইয়াছে। মাত্র দুইটি উল্লেখযোগ্য সংশােধনী প্রস্তাব উঠিয়াছিল কিন্তু সে সংশোধন প্রস্তাব কট অবজ্ঞায় উপেক্ষিত হইয়াছে। সংশােধন প্রস্তাবের মধ্যে প্রধান দুইটি প্রস্তাবই পূর্ব বঙ্গের পক্ষ হইতে উত্থাপিত ; প্রথম প্রস্তাবে অসুগােধ করা হইয়াছিল যে বংসরে অন্তত একবার পূর্ব বঙ্গে ঢাকায় পাকিস্তান পরিষদের অধিবেশন হউক। প্রভাবটি হিন্দু সদস্য কর্তৃক উত্থাপিত এবং মুসলমান সদস্য কর্তৃক সমথিত। কিন্তু মিঃ জিন্নার শেলে পূর্ব বঙ্গের অন্যতম সদস্য মিঃ তমিজুদ্দিনকে ইহার প্রতিকূলতা করিতে হইয়াছে। ইহার পরদিন গণ-পরিষদে ভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। গণপরিষদের পরিচালনার বিধান যাহারা রচনা করিয়াছেন তাহারা বলেন যে পাকিস্তান গণ-পরিষদের আলােচনায় ইংরাজী বা উর্দু ছাড়া আর কোনাে ভাষা ব্যবহৃত হইতে পারিবে না। পূর্ববঙ্গের অন্যতম সদস্য যুক্ত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে সংশােধন প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন তাহা অখণ্ডনীয়। সমগ্র পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লােকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লােকেরই ভাষা বাংলা। সুতরাং পাকিস্তানের গণ-পরিষদের আলােচনায় বাংলাকে স্থানদান তাে করিতেই হইবে, বাংলাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকার করিয়া লওয়া উচিত। শ্ৰীযুক্ত দত্তের যুক্তি খণ্ডন করিবার উপায় ছিল না। সেইজন্য উর্দু পন্থী পাকিস্তানীরা
ইহার উপর কল্পিত উদ্দেশ্য আরােপ করিয়া ইহাকে হেয় করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। তাঁহাদের সুবিজ্ঞ বিবেচনায় ইহা মুসলমানদের মধ্যে ভেদ ঘটাইবার চেষ্টা। পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরা বাংলাভাষী খাটি বাঙালী। পাকিস্তানের লােকসংখ্যায় তাহারাই সর্বাধিক। এই অবস্থায় তাহাদের প্রতিনিধিরা যদি তাহাদের মাতৃভাষাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রে ও উহার গণপরিষদে সম্মানের সহিত বসাইবার চেষ্টা করিয়া থাকেন, তাহা তাহাদের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিকই হইয়াছে। কিন্তু পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিদিগের এই স্বাভাবিক ও সঙ্গত দাবী স্বীকার করিয়া লওয়া দূরে থাকুক, পাকিস্তানের অধিনায়ক ও তাহার সাঙ্গোপালগণ ইহার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিয়াছেন এবং অবজ্ঞার সহিত ইহা প্রত্যাখান করিয়াছেন। পূর্ববঙ্গের প্রতিনিধিদের উপর অসদুদ্দে আরােপ ছাড়া পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ আপনাদের এই অসঙ্গত আচরণের সমর্থনে আর একটি যুক্তি দিয়াছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মিঃ লিয়াকত আলী ঘােষণা করিয়াছেন যে পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র’ অতএব ইহার রাষ্ট্রভাষা বা গণ-পরিষদের আলােচনার ভাষা ‘মুসলিম রাষ্ট্রের ভাষা ছাড়া আর কিছুই হইতে পারে না; মিঃ লিয়াকত আলীর মতে উর্দুই হইল মুসলিম রাষ্ট্রভাষা। ভাষারও যে ধর্মভেদ ও সম্প্রদায় ভেদ আছে এরূপ কিম্ভুতকিমাকার যুক্তি এ পর্যন্ত কদাচিং শােনা গিয়াছে ; বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে রাষ্ট্রকে ধর্মের দ্বারা চিহ্নিত করিবার চেষ্টাই বাতুলতা। অহাতেও ক্ষান্ত না হইয়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভাষার উপর পর্যন্ত ধর্মের শীলমােহর লাগাইয়া দিতে চাহিতেছেন। ভাষার পরিচয় স্থান হিসাবেই হইয়া থাকে ও স্থান হিসাবেই ভাষার প্রাধান্য ঘটিয়া থাকে। ইহার সহিত ধর্মের সম্বন্ধ কোথা হইতে আসিল ? “মুসলমান রাষ্ট্র” হইলেই তাহার ভাষা উর্দু হইবে নে? তুরস্ক, আরব, পারস্য আফগানিস্তান মুসলমান-প্রধান এবং মুসলমান শাসিত রাষ্ট্র। তাহারা কি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিয়াছে, না প্রত্যেকের দেশীয় ভাষাকেই সেই মর্যাদা দিয়াছে ? এই পুরাতন মুসলমান শাসিত রাষ্ট্রসমূহ যদি স্ব স্ব দেশীয় ভাষাকেই গ্রহণ করিয়া থাকিতে পারে তাহা হইলে হঠাৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানই বা তাহা অগ্রাহ করিয়া একটি কৃত্রিম ভাষাকে সকলের উপর চাপাইতে চাহিতেছে কেন? বাংলাকে অগ্রাহ করিয়া উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে চালাইবার চেষ্টা কতদূর অসঙ্গত, অস্বাভাবিক ও গণতন্ত্র-বিরােধী একটু
বিশ্লেষণ করিয়া দেখিলেই তাহা বুঝা যাইবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্গত প্রদেশ ৫টি : পূর্ব বাঙলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান; ইহার মধ্যে পূর্ব বাঙলার ভাষা বাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা পাঞ্জাবী, সীমান্ত প্রদেশের ভাষা পুষ,তু, সিন্ধু প্রদেশের ভাষা সিন্ধী ও বেলুচিস্তানের ভাষা বেলুচি। ইহার মধ্যে একটিও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবার সৌভাগ্য লাভ করিল না। কিন্তু যাহা পাকিস্তানের কোনাে প্রদেশেরই ভাষা নহে তাহাকেই সকলের উপর চাপাইয়া দেওয়া হইল। ইহা যদি জবরদস্তি না হয় তাহা হইলে জবরদস্তি আর কাহাকে বলে? নিতান্ত দুঃখের বিষয় এই যে পূর্ব বাংলার মুসলমান সদস্যগণ এই জবরদস্তির নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছেন। মৌলানা আকরাম খাঁ একদিন শাসাইয়াছিলেন যে বাংলা ভাষার দাবী অগ্রাহ্ন হইলে তিনি বিদ্রোহ ঘােষণা করিবেন। কিন্তু পাকিস্তানের গণ-পরিষদের অধিবেশনে তাহাকে বাক্যস্ফুট করিতে দেখিলাম না। মিঃ লিয়াকত আলি খাঁ মহাশয়ের উক্তির প্রত্যুত্তরে একথা তিনি বলিলেন না যে মুসলমানী ভাষা বলিয়া যদি কোনাে ভাষার কল্পনাই করিতে হয় এবং তাহাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে হয়, তাহা হইলে পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলমান যে ভাষায় কথা কহে এবং যে ভাষা তাহাদের দানে সমৃদ্ধ সেই ভাষারই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়া উচিত। কিন্তু মিঃ জিন্নার অর্জনের সম্মুখে সে কথা বােধ হয় কাহার বলিবার উপায় ছিল না। চক্ষের উপর এই ব্যাপার দেখিয়াও পূর্ববঙ্গের জনসাধারণ ও পূর্ববঙ্গ আইনসভার স্যগণ যদি সতর্ক
হন, তা হইলে পাকিস্তানের প্রধানতম অংশ হইয়াও অচিরে পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের অনুগ্ৰহজীবীর পর্যায়ে নামিয়া দাড়াইতে হইবে। পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র বলিয়া ঘোষণা করিয়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মহাশয় হিন্দু ও শিখ মাইনরিটির অবস্থা তত শোচনীয় করিয়া তুলিলেন। কিন্তু এই হুমকির শাসন চলিতে থাকিলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব বাঙলার সকলের অবস্থাই অনুকম্পার যােগ্য হইয়া উঠিবে।
কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নাহ, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও মুসলিম লীগের অন্যান্য সদস্যদের ভূমিকা এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার সমালােচনা ও পর্যালােচনা প্রসঙ্গে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ২৭শে ফেব্রুয়ারি যে সুদীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন সেটিও অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য এই প্রবন্ধতে পুত্রিকাটি বলেন :
পাকিস্তানের বিধান পরিষদে মিঃ লিয়াকত আলী খানের উক্তিতে বাঙলাদেশে এবং তার বাইরে অনেকে আঘাত পেতে পারেন কিন্তু আমরা যে বিরাট কোনাে আঘাত পাইনি একথা স্বীকার করি। নিজের মনের কথা প্রকাশকালে এতাে চমৎকার অকপটতার পরিচয় দানের জন্যে আমরা তাকে ধন্যবাদ জানাই। অমুসলমানরা এখন নিশ্চিতভাবে বুঝে নিবে তাদের আসল অবস্থা কি। ভবিষ্যতে পাকিস্তানে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে এ সম্পর্কে মুসলমানরাও চিন্তা শুরু করবে। মিঃ লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের মধ্যে কোনো অপরিচ্ছন্নতা, দ্বিধা অথবা দ্ব্যর্থতা নেই। আমরা ধরে নিচ্ছি এ ক্ষেত্রে তিনি লীগ নেতৃত্বের সুবিবেচিত নীতিই অনুসরণ করেছেন। বুধবারে পাকিস্তান বিধান পরিষদে কার্য নির্বাহ সংক্রান্ত আইনের খসড়া নিয়ে বিতর্ক চলছিলাে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয় যে প্রত্যেক সদস্যকে হয় উছু নয় ইংরেজীতে পরিষদকে সম্বােধন করতে হবে। বিরােধী কংগ্রেস কর্তৃক এই প্রস্তাব সংশােধনের জন্য একটি পাল্টা প্রস্তাবে উদু ও ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও পরিষদের সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করার অনুরােধ জানানাে হয়। সংশােধনী প্রস্তাবটি যিনি পেশ করেছিলেন তিনি একথা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেন যে প্রাদেশিকতার বশবর্তী হয়ে তিনি প্রস্তাবটি উখাপন করেননি, করেছিলেন এজন্যে যে পাকিস্তানের জনসংখ্যার বিপুল অধিকাংশের কথ্য ভাষা বাংলা। এই কারণে তাকে যথাযােগ্য স্বীকৃতি দেওয়াই কর্তব্য। মিঃ লিয়াকত আলী খান তার আসন থেকে উঠে দাড়িয়ে সংশােধনী প্রস্তাবটির বিরােধিতা করেন। তিনি বলেন যে পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র। প্রত্যেক মুসলিম রাষ্ট্রের একটি মুসলিম ভাষা থাকা দরকার এবং উদু হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট মুসলিম ভাষা। বাঙলাদেশের মুসলমানরা এই বিস্ময়কর বক্তব্যকে মনে মনে কিভাবে হণ করেছেন আমরা জানি না কিন্তু সে যাই হােক সংশােধনী প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে গেছে। পাকিস্তানের পূর্ব সুবার দায়িত্ব প্রাপ্ত খাজা নাজিমুদ্দীনও মনে করলেন যে বিতর্ককালে তারও আবার কিছু একটা বলা দরকার। কাজেই পরিষদকে তিনি বললেন-কার অথরিটিতে সেকথা জিজ্ঞেস করার অধিকার আমাদের নেই —যে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লােকের মত হচ্ছে এই যে উদুই একমাত্র ভাষা যা পাকিস্তানের সাধারণ ভাষা হিসাবে গৃহীত হতে পারে। তিনি আরও বলেন যে বাংলাকে অন্যমত রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে কোনােই
যুক্তি নেই। কাজেই খাজা নাজিমুদ্দিনের মতানুসারে পাকিস্তানের অর্থ হলাে এই যে প্রতেক বাঙালী বাড়িতে, প্রতেক বাঙালী স্কুলে এবং প্রত্যেক বাঙালী আইন আদালতে প্রত্যেককে বাংলা বর্তন করে উছুতে কথা বলতে হবে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের উচ্চ পর্যায়ের চাকুরিতে যে সমস্ত লােক বহাল হয়েছে তাদের সাথে প্রদেশের ভাষা, আচার-আচরণ, রীতিনীতি এবং ঐতিহের কোনো সম্পর্ক নেই। শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে তারা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে। এবার সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মাধ্যমে নিজেদের পরিকল্পনাকে তারা এগিয়ে নিয়ে যাবে। পূর্ব বাঙলাকে দৃঢ় এবং নিশ্চিত ভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বহীন অংশে পরিণত করতে হবে। করাচী এবং কিছু পরিমাণে লাহাের সমস্ত কিছুর উপর কর্তৃত্ব করবে এবং খাজা নাজিমুদ্দিন ও তার বাংলাভাষী মন্ত্রীরা করাচী ও লাহোরের লোক জনের এজেন্ট হিসানে কাঙ্গ করে যাবেন। পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ যদি তাই চন তাহলে তা তারা পাবেন। কারণ তারা যে ধরনের সরকারের যোগ্য হবেন সেই ধরনের সরকারই তারা পাবেন কিন্তু এই পাকিস্তানের জন্যেই কি তার এত মাস ও বৎসর যাবং চীৎকার করে এসেছেন? এই কি সেই ইসলামী রাষ্ট্র যে সম্পর্কে এতদিন তাদেরকে অনেক রোমান্টিক কাহিনী বলা হয়েছে ? পাকিস্তানের জন্য কি তা হলে তাদেরকে আজ নিজেদের মাতৃভাষা ও বহু যুগের পুরাতন সাংস্কৃতিক দৃষ্টি ভঙ্গি বর্জন এবং সাধারণ লোককাহিনী, গান ও গাথার মাধ্যমে গঠিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সৌভ্রাতৃত্বের মহান ঐতিককে চিরদিনের জন্য পরিত্যাগ করতে হবে? এগুলির দ্বারা কায়েদে আজম মহম্মদ আলী জিন্নার উচ্চাকাক্ষা চরিতার্থ হতে পারে। আমরা মিঃ লিয়াকত আলী খানের রাজকীয় ভারসাম্য ও ধীরতার প্রশংসা করি কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র কোমাে সন্দেহ নেই যে আমাদের মুসলমান ভাইদের সামনে এক চরম বিপর্যয় উপস্থিত। মুসলমানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার জন্যে অথবা অভ্যন্তরীণ বিপ্লব ঘটানাের উদ্দেশ্যে আমরা একথা বলছি না। আমরা একথা বলছি যাতে করে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানরা পশ্চিমের সংকীর্ণ, ধর্মান্ধ এবং পরমত-অসহিষ্ণু জাতীয়তাবাদের খপ্পরে পতিত না হন। ভারতীয় ইউনিয়নে সকল নাগরিককে একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তত্ত্বের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য প্রকাশ করতে বলা যেমন বিপজ্জনক এবং অর্থহীন তেমনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনকর্তারা সেই
রাষ্ট্রের সকল মুসলমানকে একটি নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয় জীবন ব্যবস্থা বরাদ্দ করলে সেটাও হবে অনুরূপভাবে বিপজ্জনক এবং অর্থহীন। বহু শতাব্দী ধরে ভারতবর্ষের ইতিহাস এমন এক পথে বিকাশ লাভ করেছে যার যথার্থ তুলনা অন্য দেশের ইতিহাসের মধ্যে খুজলে সে প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। একথা বলার অর্থ প্রাদেশিক ঈর্ষা, এলাকাগত স্বাতন্ত্র্য অথবা সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতার ইন্ধন যােগাননা নয়। বাংলাভাষী সংখ্যাগুরুসহ অন্যান্য সকল মানুষের উপর পাকিস্তান যখন উছু চাপিয়ে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ তখন তার ফলে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে না পারলে বাঙালী মুসলমানরা পাকিস্তানের মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই অবস্থায় আমরা অসহায় এবং হতভাগ্য অমুসলমানদের সম্পর্কে কি বলবাে? তাদের দাবী-দাওয়া ইচ্ছাকৃতভাবে প্রত্যাখ্যাত, ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ নিন্দা সহকারে আগ্রহ এবং ক্ষীণকণ্ঠ প্রতিবাদ ধর্মান্ধ পাকিস্তানীদের প্রচণ্ড চীংকারে নিমজ্জিত! দৃঢ় ও কঠোরভাবে বিবেকের তোয়াক্কা না রেখে তাদেরকে শুধু যে একটি সম্পূর্ণ বিদেশী ভাষার দাসত্ব করতে বলা হচ্ছে তাই নয়, ইসলামী রাষ্ট্র এবং কোরাণ ও শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী যে আইন গঠিত হবে তার প্রতিও তাদেরকে ‘আনুগত্য প্রকাশ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। করাচীতে তাদের কণ্ঠস্বর অরণ্যে রোদনেরই মতো। নিজেদের পিতৃপুরুষের দেশ পূর্ব বাংলাতেও তাদের অবস্থা বিদেশী বহিরাগত এবং অনধিকার প্রবেশকারী অপেক্ষা ভাল নয়। ভারতবর্ষ বিভাগের সময় এবং তার পুর্বেও ইসলামী রাষ্ট্রের উপর জোর দেওয়াকে কেউ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সময় কিছুটা অতিবাহিত হওয়ার পর এ সম্পর্কে এখন আর আত্মপ্রসাদের কোনাে স্থান নেই। কায়েদে আজম জিন্না যখন ইসলামের কথা বলেন তখন তিনি বুঝেসুঝেই সেকথা বলেন। মিঃ লিয়াকত আলী খান দেখিয়ে দিয়েছেন যে ইসলামী রাষ্ট্র কি ধরনের হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে অমুসলমান সংখ্যালঘুদের অধিকার ও স্বার্থ সংক্রান্ত বহু আলােচিত নিরাপত্তার কথা অর্থহীন এবং তুচ্ছ বাগাড়ম্বর মাত্র। মিঃ লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের সরল অর্থ এই যে তারা যদি ইসলামী প্রভুত্ব এবং তার আনুসঙ্গিক সবকিছুর সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারে তাহলে তাদের স্থান হবে রাষ্ট্রের বাইরে। কায়েদে আজম জিন্নাহ, মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ কাউন্সিল এবং পূর্ব পাকিস্তান সুবায় মিঃ জিন্নার ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধিদের এই কি আসল অভিপ্রায় ?
৬০
আমরা একথা জানতে চাই। দেশের অবস্থা আজ কোথায় দাড়িয়েছে এ নিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমানরা নিশ্চয়ই একইভাবে চিন্তা করছেন।
১৯৪৮ সালের এই সময়ে কোনাে দৈনিক পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতাে না। যে কয়টি সাপ্তাহিক পত্রিকা তখন প্রকাশিত হতাে তার মধ্যে সিলেটের ‘নওবেলাল’ ছিলাে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। এই পত্রিকাটিতে ৪ঠা মার্চ তারিখে পাকিস্তান গণ-পরিষদের ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব এবং তার সম্পর্কে আলােচনা ও সিদ্ধান্তের উপর রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নের সাথে পূর্ব বাঙলার সাংস্কৃতিক জীবনের ও সাংঘাতিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের যোগসূত্রের কথা উল্লেখ করে তাতে বলা হয় : পাকিস্তান লাভ করিবার পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের ধারণা ছিল যে তাহাদের সংস্কৃতি, তহজিব, মদুন সকল অবস্থায়ই অক্ষুন্ন থাকিবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এলাকাধীন বিভিন্ন প্রদেশের অধিকাংশ বাসিন্দ। মুসলমান গতিকে, তাহাদের মধ্যে মহাবী একতা ছাড়? ভাষাগত বিষয়ে বিভিন্ন প্রদেশে নানাবিধ পার্থক্য রহিয়াছে তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। যদি এক ভাষার অধিপত্যে অন্য ভাষার প্রসার সংকুচিত হয় অথবা অন্য প্রদেশের সংহতি নষ্ট হইবার সূচনা দেখা যায় তাহা হইলে যে প্রদেশের ভাষার মর্যাদার হানি হইয়াছে তাহার প্রতি অবিচার করা হইবে।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সাথে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের তুলনা করে পত্রিকাটি বলেন :
সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের আমলেও গভর্নমেন্টের কারেন্সী নােটেও বাংলা ভাষার স্থান ছিল। পাকিস্তান সরকার বাংলাকে তুলিয়া ফেলিয়াছেন। পাকিস্তান সরকারের মনি অর্ডারের ফরম, ডাক টিকিট, পোেস্ট কার্ড ইত্যাদিতে বাংলার স্থান নাই। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর উক্তি সম্পর্কে নওবেলাল বলেন : এই প্রস্তাবের প্রসঙ্গে পাকিস্তানের উজিরে আজম জনাব লিয়াকত আলী যে অসংলগ্ন কথার অবতারণা করিয়াছেন তাহাতে বাস্তবিকই মর্মাহত হইতে হয়। তিনি বলিয়াছেন পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, তাই পাকিস্তানের ভাষা হইবে মুসলিমদের ভাষা উর্দু। এই সব অপরিণামদর্শী ভাষণের আলােচনাও এক দুঃখজনক ব্যাপার। তবে এই সব ঘােষণার প্রতিক্রিয়া যে মারাত্মক হইতে পারে সে সম্বন্ধে আমরা জনাব লিয়াকত আলী খানকে ভাবিয়া দেখিতে অনুরােধ করি।
খাজা নাজিমুদ্দিনের উক্তির সমালােচনা প্রসঙ্গে এতে বলা হয় ? এই প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের জনমতের উল্লেখ করিতে যাইয়া জনাব নাজিমুদ্দিন ও তমিমুদ্দিন খান যে সব অপ্রত্যাশিত মন্তব্য করিয়াছেন তার জন্য নিশ্চয়ই তাহাদিগকে একদিন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে। খাজা সাহেবের পারিবারিক ভাষা উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তাহাদের সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণ করিতে চায় এই তথ্য কোথায় আবিষ্কার করিলেন? গণ-পরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালী সদস্যদের উদ্দেশ্যে পত্রিকাটি বলেন: এইভাবে আপনার মাতৃভাষার মূলে যাহারা কুঠারাঘাত করিতেছেন, তাহারা কি একবার ভাবিয়াও দেখেন নাই যে ভাষার ভিতর দিয়াই জাতির আশাআকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, আদর্শ প্রভৃতি রূপ পাইয়া থাকে। ভাষা সম্পূর্ণ বিকাশ লাভ না করিলে জাতির মেরুদণ্ড গঠিত হইয়া উঠিতে পারে না। কোনাে এক বিশেষ প্রভাবে পড়িয়া তাহারা হয়ত আপনাদের অস্তিত্বের বিলােপ করিতে পারেন, তবে পূর্ব পাকিস্তানের চারি কোটি চল্লিশ লক্ষ লােক কিছুতেই তাহাদিগকে ক্ষমা করিবে না। কিছুতেই তাহারা তাহাদের মাতৃভাষা বাংলার অবমাননা সহ্ন করিবে না। তাই ইতিমধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধর্মঘট করিয়াছে এবং মিছিল সহকারে সর্বত্র বিক্ষোভ প্রদর্শন করিয়াছে। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণই নহে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়িয়া উঠিতেছে। এই গণবিক্ষোভ যখন পূর্ণ আত্মপ্রকাশ করিবে তখন এইসৰ নেতাদের আসনও টলটলায়মান হইয়া পড়িবে ।
সর্বশেষে পাকিস্তানের শান্তি এবং ঐক্য বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়।
তাই পূর্বাহ্নেই আমরা কর্তৃপক্ষ মহলকে অনুরোধ করিতেছি যদি পাকিস্তানের সংহতি, ঐক্য ও সর্বোপরি শান্তি বজায় রাখিবার জন্য তাহাদের মনে এতটুকু আগ্রহ থাকে তাহা হইলে অনতিবিলম্বে তাহাদের কর্মের সংশােধন করুন। পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমরূপে বাংলাকে গ্রহণ করুন। তাহা না হইলে স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হইতে থাকিবে যে পূর্ব পাকিস্তানের উপর যুক্ত প্রদেশ ও পশ্চিম পাঞ্জাবের লােকের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য বাংলাকে আস্তে আস্তে তার ন্যায্য আসন হইতে সরাইয়া ফেলা হইতেছে।
৩। সভা ও সাংগঠনিক উদ্যোগ
বাংলা ভাষাকে গণ-পরিগদের অন্যতম ভাষা করার দাবী অগ্ৰাহ হওয়ার সংবাদ ঢাকায় প্রকাশিত হওয়ামাত্র ছাত্র রাজনীতিক ও শিক্ষিত মহলে তীব্র প্রতিক্রয়ার সৃষ্টি হয়। উর্দুকে পূর্ব বাংলার অধিকাংশ লােক রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী, খাজা নাজিমুদ্দিনের এই উক্তিকে তার। সকলে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে বর্ণনা করেন। তারা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করিতে থাকেন যে গণ-পরিষদের মুসলিম লীগ দলীয় বাঙালী সদস্যেরা কোন্ হিসাবে বাংলা ভাষাকে পরিষদের অন্যতম ভাষা করার বিরুদ্ধে ভােট দিলেন।
গণ-পরিষদের বাংলা বিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ২৬শে ফ্রেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র সম্প্রদায় ধর্মঘট পালন করেন। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং স্কুলের ছাত্রেরা ক্লাস বর্জনের পর একটি মিছিল বের করে বাংলা ভাষার সমর্থনে নানা প্রকার শ্লোগান দিতে দিতে রমনা এলাকা প্রদক্ষিণ করে। এই মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে শেষ হওয়ার পর বিকেলের দিকে সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং তমদুন মজলিসের সম্পাদক আবুল কাসেম। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ, ফজলুল হক হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মােহাম্মদ তোয়াহা এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম গণ-পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং সেই প্রসঙ্গে গণ-পরিষদের মুসলিমলীগদলহুক্ত বাঙালী সদস্যদের আচরণ এবং উক্তিসমূহের তীব্র নিন্দা করে বক্তৃতা দান করেন। | বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্রসভায় পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের। বক্তৃতার তীব্র প্রতিবাদ করে, বাংলা ভাষাকে গণ-পরিষদের অন্যতম সরকারী ভাষা করার উদ্দেশ্যে একটি সংশোধনী প্রস্তাব আনার জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানিয়ে এবং এ সম্পর্কে পূর্ব বাঙলার মুসলমান সদস্যদের মনােভাব ও ঢাকা বেতারের মিথ্যা ও পক্ষপাতমূলক সংবাদ প্রচারের বিরুদ্ধে সর্বসম্মতিক্রমে কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রতিবাদ দিবস’ পালন করতে ছাত্র সমাজকে আহ্বান জানানাের জন্যে তমদ্দন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা সাবকমিটিকে অনুরােধ জানিয়ে এই সভায় একটি পৃথক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
গণ-পরিষদের সিদ্ধান্ত এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগের বাংলা বিরােধীকার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গঠন করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ, বিভিন্ন ছাত্রাবাস এবং তমদুন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে ২রা মার্চ ফজলুল হক হলে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সভা আহ্বান করা।
হয়। যারা এই সভায় উপস্থিত হন এবং আলােচনায় অংশ গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, রনেশ দাশগুপ্ত, আজিজ আহমদ, অজিত গুহ, আবুল কাসেম, সরদার ফজলুল করিম, শামসুদ্দীন আহমদ, কাজী গােলাম মহবুব, নঈমুদ্দীন আহমদ, তফজ্জল আলী, আলী আহমেদ, মহীউদ্দিন, আনােয়ারা খাতুন, শামসুল আলম, শওকত আলী, আউয়াল, মহম্মদ তােয়াহা, অলী আহাদ, শামসুল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার, লিলি খান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কমরুদ্দীন আহমদ।
ভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠু সাংগঠনিক রূপ দেওয়ার জন্যে এই সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটি সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হয় এবং গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুগ লীগ, তমদুন মজলিস, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল ইত্যাদি ছাত্রাবাস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ এদের প্রত্যেকটি থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি তার সদস্য হিসাবে মনােনীত হন। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসাবে মনােনীত হন শামসুল আলম। | এই সভায় সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের নাম আলােচনাকালে আবুল কাসেম অজিত গুহের নাম সদস্য হিসাবে রাখার বিরােধিতা করে বলেন অজিতবাবু হিন্দু কাজেই তার অন্তর্ভূক্তি আন্দোলনের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। অজিত গুহ এর প্রতিবাদ করে একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন এবং বলেন যে আন্দোলনের তাতে কোনাে অসুবিধা হবে না বরং সুবিধাই হবে। কারণ ভাষা আন্দোলন একটা গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং তাতে কোনো সাম্প্রদায়িক বিবেচনা স্থান পাওয়া উচিত নয়।
অজিত গুহ প্রগতিশীল লেখক সংঘের প্রতিনিধি হিসাবে এই সভায় যােগদান করেন। অজিত গুহের মতে আবুল কাসেম সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের অবতারণা করলেও তার আসল উদ্দেশ্য ছিলাে প্রগতিশীল লেখক সংঘকে সংগ্রাম কমিটির সাথে বাদ দেওয়া। শেষ পর্যন্ত অজিত গুহকে সংগ্রাম কমিটির সদস্য করা হয়নি।১০ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণের পর সভায় পাকিস্তান গণ-পরিষদের সরকারী ভাষার তালিকা থেকে বাংলা ভাষাকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদ হিসাবে ১১ই মার্চ সমগ্র পূর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়ে অপর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যে সাব-কমিটি গঠিত হয় তার কয়েকটি বৈঠকে ১১ তারিখের ধর্মঘট সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা হয়। এই
সাব-কমিটির দুই বৈঠক পর পর ৪ঠা এবং ৫ই মার্চ বিকেল পাঁচটায় ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত হয়।১২
১১ই মার্চের সাধারণ ধর্মঘটকে বানচাল করার উদ্দেগে দলিউর রহমান এবং মুখলেসুর রহমানের প্ররােচনায় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ নানাপ্রকার গণ্ডগােল সৃষ্টির চেষ্টা করেন। তাদের উদ্যোগে ই মার্চ কলেজ প্রাঙ্গণে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে কলেজের অধ্যক্ষও বক্তৃতা পান করেন।১৩
8। সিলেটে প্রতিক্রিয়াশীলদের হামলা
৮ই মার্চ সিলেট মদুন মজলিস এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে সিলেটের গােবিন্দ পার্কে একটি জনসভার আয়ােজন করা হয়। এই সভার উদ্দেশ্য ছিল নাজিমুদ্দীন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলাকে গ্রহণ করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার জন্যে তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া এবং অবিলম্বে তার এই প্রতিশ্রুতিকে কার্যে পরিণত করার দাবী জানান। সভাটিতে সভাপতিত্ব করেন আসাম প্রদেশিক মুসলিম লীগের প্রাক্তন সম্পাদক মাহমুদ আলী। সভার কাজ শুরু হওয়ার ঠিক পরেই কয়েন ‘লােক উছু পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হােক’ এই বলে চীৎকার করে ওঠে। পর মুহূর্তেই দুষ্কৃতকারীদের মধ্যে একজন সভাপতির চেয়ার দখল করে তাতে বসে পড়ে এবং আবদুল বারী ( ধলা) নামে গুণ্ডা প্রকৃতির এক ব্যক্তি টেবিলের উপর চড়ে আৰােল-তাবােল বক্তৃতা শুরু করে। এইভাবে আবদুল বারী এবং তার অন্যান্য সহযােগী গুণ্ডারা সভায় বাংলা ভাষার সমর্থকদেরকে বক্তৃতাদানে বাধা দিতে থাকে। শুধু তাই নয়। তারা সেই সাথে সভাপতি মাহমুদ আলী, নওবেলালের প্রধান সম্পাদক মােহাম্মদ আজরফ, পাকিস্তান মুসলিম লীগের সদস্য ও সিলেট তমদ্ন মজলিসের সম্পাদক দেওয়ান ওহিদুর রেজা এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মােহাম্মদ আবদুস সামাদকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছেড়ে এবং কয়েকজন ছাত্রকে প্রহার করে। এর পর তারা অধিকতর উগ্র মূর্তি ধারণ করে টেবিল চেয়ারে লাথি মারতে থাকে এবং একজন পাকিস্তানের পতাকা পর্যন্ত ছিড়ে ফেলে। গুণ্ডাদের এই আচারণে সমবেত জনসাধারণ খুব কুদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে তাদেরকে পাল্টা আক্রমণে উদ্যত হয়। পুলিস
উপস্থিত থাকা সত্বেও জামা আয়ত্বে আনা অসম্ভব হয়ে পড়লে সভাপতি তাড়াতাড়ি কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণের পর সভা ভঙ্গ করে দেন।
মূল সভা ভেঙে দেওয়ার পর উপরোল্লিখিত আবদুল বারীর সভাপতিত্বে অন্য একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় সিলেট মুসলিম লীগের নেতা আজমল আলী বক্তৃতার মাধ্যমে নানা মিথ্যা প্ররােচনার দ্বারা কিছু লােককে এমন উত্তেজিত করে তােলেন যে তারা গােবিন্দ পার্কের বাইরে এসে তমদ্দন মজলিসের সদস্য এবং মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের নেতা মকসুদ আহমদকে অমানুষিকভাবে প্রহার করে। এই প্রহারের ফলে তিনি মুছিত হয়ে পড়েন।
এই ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে উপরােল্লিখিত সভাটির আহ্বায়কঘয়, সিলেট তমদুন মজলিশের সম্পাদক দেওয়ান অহিদুর রেজা এবং সিলেট জেলা মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মােহাম্মদ আবদুস সামাদ একটি বিবৃতিতে বলেন :
আমরা আজাদ পাকিস্তানে প্রত্যেকের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ দান করিবার জন্য বহু যুগের দাসত্বের অবসান ঘটাইয়াছি। তাহা প্রমাণ করার সময় আসিয়াছে। কিন্তু আজ আমরা সিলেটবাসী অরাজকতার দৌরাত্ম্য আর কতদূর সহ করিব। তাই আমাদের নিবেদন, আপনারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে কোণঠাসা করিয়া অরাজকতাকে আর কত প্রশ্রয় দিবেন? আজ আমাদের জাতীয় সম্মান লাঞ্ছিত ও অপমানিত ২ এ প্রসঙ্গে বিবৃতিটিতে তারা আরও বলেন : সিলেটে গুণ্ডামির নরূপ বহুদিন হইতে সিলেটবাসী জনসাধারণের অসহ হইয়া উঠিয়াছে। জনাব নিশতার সাহেব যখন সিলেট পরিদর্শনে আসেন তখন আমরা গুণ্ডামীর বেপরােয়া নমুনা লক্ষ্য করিয়াছি-পাকিস্তান সরকার এই অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কোনাে প্রতিকার করেন নাই। তাই দিন দিন গুণ্ডা প্রভাব জনমতকে ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে ভয় দেখাইয়া গােলমাল সৃষ্টি করে ও অভদ্র ব্যবহার দ্বারা কণ্ঠরােধ করিতে চায়। আমরা ইহার আশু প্রতিকার দাবী করিতেছি।
গগাবিন্দ পার্কের ৮ই মার্চের এই ঘটনার প্রতিবাদে সিলেট জেলা মুসলিম মহিলা লীগ ১১ই মার্চ আর একটি সভা আহ্বান করেন। এই সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্যে সিলেটের বিক্ষুব্ধ নাগরিকরা যখন দলে দলে গােবিন্দ পার্কে সমবেত হচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম. ইসলাম চৌধুরী একটি আদেশ জারী করে সমগ্ন সিলেট জেলায় উন্ন
বাংলার প্রশ্নে সভা শােভাযাত্রার অনুষ্ঠান দুই মাসের জন্যে নিষিদ্ধ করেন।
| সিলেটের এই সকল ঘটনাবলী সম্পর্কে নাগরিক অধিকার’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে নওবেলাল বলেন :
যাহারা রাষ্ট্রের কল্যাণ চায় অথবা রাষ্ট্রের জন্য আত্মােৎসর্গ করিতেও প্রস্তুত যদি কোনাে রাষ্ট্রপতির কোনাে অবৈধ আচরণে বিরক্ত হইয়া সাধারণ সভায় অথবা প্রেসের মারফতে তাহাদের মত ব্যক্ত করিতে চায় কোনাে স্বাধীন দেশেই তাহাদের মতামতকে গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলা হয় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমাদের সিলেটে কোনাে পদস্থ ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনাে টুশ করিলেই একদল উগ্রপন্থী সাম্প্রদায়িক মতাবলম্বী লােক মারমুখী হইয়া উঠে। ন্যায়, সত্য ও রাজনৈতিক নীতির দিক দিয়া তাহাদের এই সকল কার্য যে নিতান্ত গহিত তাহা পুনর্বার বলিবার কোনো প্রয়ােজন নাই। এর পর সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় : এই সব অনাচারের মূল বিশ্লেষণ করিলে সহজেই ধরা পড়িৰে যে একদল প্রতিক্রিয়া লােকের ষড়যন্ত্রের ফলেই এই সব দুর্নীতি প্রশ্রয় পাইতেছে। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য কোনাে বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল প্রস্তাব উত্থাপন করিলেই ইহার প্রগতিশীল লােককে রাইশত্রুরূপে প্রচার করিতে আরম্ভ করে এবং যে কোনাে উপায়ে তাহাদের কণ্ঠরােধ করিবার প্রয়াস পায়। এই ফ্যাসিস্ট দলের প্রভাবে ও প্ররােচনাতেই সিলেটে নানাবিধ অনাচারের অনুষ্ঠান চলিতেছে। আমরা এদিকে পাকিস্তান সরকার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। বাংলা ভাষা আন্দোলনে সিলেটের জনসাধারণের মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক প্রতিরোধের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম থেকেই ছাত্র, সাংবাদিক, মহিলাকর্মী এবং জনসাধারণ দৃঢ়ভাবে এই আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন এবং ভাষা সংক্রান্ত সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের পুরােভাগে তাঁরা অবস্থিত থাকেন। তাদের এই প্রতিরােধের আর একটি উদাহরণ ১১ই মার্চ তারিখে ভাষা প্রশ্নের উপর সিলেটের আঠারােজন অত্যন্ত বিশিষ্ট নাগরিকের এক দীর্ঘ বিবৃতি। এই বিবৃতিটিতে তারা ঘােষণা করেন :
পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করিবার জন্য যদি জেহাদ করিতে হয় তাহা হইলে আমরাই সর্বাগ্রে ঝাপাইয়া পড়িব। পাকিস্তানের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রদেশের মুদ্নিক প্রগতি যাহাতে নষ্ট না হয় তার জন্যই বাংলা বা সিন্ধী প্রভৃতি ভাষার যথাযােগ্য স্থান দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।
উছু সমর্থকদের প্রচারণা সতর্কে তারা বলেন : পূর্ব পাকিস্তানে যাহারা উদুর সমর্থক এই সুযােগে তাহারা বাংলার সমর্থন কারীদের বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা প্রপােগাণ্ডা শুরু করিয়া জনমতকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। তাঁহাদের মুখে প্রায়ই শুনা যায়। যাহারা বাংলা ভাষার সমর্থক তাহারা পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট করিতে চায়। তাহারা পাকিস্তানের ঘাের শত্রু। তাহারা প্রায় সর্বত্রই প্রচার করিতেছেন উদু আমাদের মজহাবী ভাষা, উদুর বিরুদ্ধে কথা বলা মত্রোহিতারই নামান্তর। এর পরে সর্বশেষে জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন : আমরা পূর্ব পাকিস্তানবাসী জনসাধারণকে বাংলার ন্যায্য মর্যাদা আদায় করিতে আহ্বান জানাইতেছি। মনি অর্ডার ফর্ম ইত্যাদিতে বাংলার কোন স্থান না দিয়া কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার যে ভূল করিয়াছেন তাহা অনতিবিলম্বে সংশােধিত করিতে হইবে। বাংলাকে উর্দু এবং ইংরাজীর সাথে পাকিস্তান পার্লামেন্টের বিতর্কের অন্যতম ভাষারূপে গ্রহণ করিতে হইবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাগুলিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম ভাষারূপে স্থান দিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালতের ভাষারূপে বাংলাকে স্বীকার করিতে হইবে, পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষারূপে এখনই গ্রহণ করিতে হইবে। তাহা না হইলে পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক, তমুদুনিক, কৃষ্টিগত ও সরকারী চাকুরিক্ষেত্রে বহু দূর পিছাইয়া পড়িবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের নিকট এই আয়াসল আজাদী অর্থহীন হইয়া পড়িবে। কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের ধামাচাপা নীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে ক্রমশঃ নানাবিধ সন্দেহের সৃষ্টি হইতেছে। ইহাকে দূর না করিলে পাকিস্তানের সংহতি নষ্ট হইতে পারে।
ঐ একই দিনের নওবেলালে উদুর সমর্থনে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য আজমল আলী চৌধুরী একটি বিবৃতিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সমালোচনা এবং খাজা নাজিমুদ্দীনের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। তিনি বলেন :
মিঃ দত্ত ( ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত) সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করিবার সময় হয়ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন যে ভারতীয় রাষ্ট্রের গণ-পরিষদের ভাষারূপে দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হিন্দুস্থানী ভাষা গ্রহণ করা হইয়াছে। সেই হিন্দুস্থানী ভাষা গ্রহণ করার সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠদের কোনাে প্রশ্নই উঠে নাই। হিন্দুস্থানীকে প্রাধান্য দিবার প্রধানতম কারণ এই যে হিন্দুস্থানীয়,
সনে হিন্দু সংস্কৃতি ও হিন্দু ঐতিহ্যের যােগসূত্র বর্তমান। দেবনাগরী লিপির এখন মরণদশা উপস্থিত এবং অত্যন্ত সীমাবদ্ধ অঞ্চলে এই লিপির প্রচলন রহিয়াছে। ভারতীয় পরিষদে গৃহীত হিন্দুস্থানী কাহারও কথ্য ভাষা নহে। অপরদিকে ভারতের সাধারণ ভাষারূপে উদুর দাবী স্যার তেজ বাহাদুর সার মতাে লােকও স্বীকার করিয়াছেন। উর্দুকে ভারতীয় রাষ্ট্র অস্পষ্ট জ্ঞানে ত্যাগ করার একমাত্র কারণ এই যে উদুর মাঝে ইসলামী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্নের গন্ধ রহিয়াছে। ভারতের সর্বত্র এক ভাষার মাধ্যমে যখন একতা সৃষ্টির প্রয়ােজন হইল তখন ভারতীয় ডােমিনিয়নের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাষাভাষী লােক তাহাদের সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা ভুলিয়া গেল। অথচ সেই একই যুক্তি বলে উর্দুকে যখন পাকিস্তানের সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণ করার দাবী উঠিল তখন ইহাকে মহা ভুল বলিয়া আখ্যা দিলেন। আজমল আলী তার বিবৃতিতে পরিশেষে বলেন : পাকিস্তানের সংহতি ও সংস্কৃতিগত ঐক্য বজায় রাখিবার জন্য পাকিস্তান গণ-পরিষদে ইংরেজীর পরেই উর্দুকে ন্যায়সঙ্গত ভাবেই স্থান দেওয়া হইয়াছে। আমি পাক-গণ-পরিষদে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত আলােচনায় সাহসের সহিত তাহাদের অভিমত ব্যক্ত করার জন্য জনাব লিয়াকত আলী খান ও জনাব খাজা নাজিমুদ্দীনকে অভিনন্দন জানাইতেছি।
আজমল আলী তার বিবৃতিতে যে সব যুক্তির অবতারণা করেছেন সেগুলি শুধু তাঁর নিজস্ব নয়। বেশ কিছু সংখ্যক মুৎসুদ্দীস্থানীয় উ সমর্থকদের মতবাদকেই তিনি তাঁর বিবৃতিটিতে ব্যক্ত করেছেন। ১১ই মার্চের ঐ একই সাপ্তাহিকে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের প্রাক্তন সদস্য মতসি আলীও আরবী এবং উদুর সপক্ষে একই ধরনের একটি বিবৃতি প্রচার করেন।
৫। ১১ই মার্চের সাধারণ ধর্মঘট
১৩ই মার্চ রাত্রে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি সভা বসে। এই সভায় পরদিনের ধর্মঘটের বিস্তারিত কর্মসূচী সম্পর্কে আলােচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তখন পর্যন্ত ১১ই মার্চ ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা আৰী করা হয়নি কিন্তু পরদিন সে-রকম কোনাে পরিস্থিতির উদ্ভব হলে কর্মপন্থা কি হবে সে সম্পর্কে সভাটিতে আলোচনা হয়। এই আলোচনাকালে শামসুল
১৪৪ ধারা ভারী হলে তা ভ না করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু অলি আহাদ, আবদুল ওদুদ প্রভৃতি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দেন। এ সম্পর্কে কোনাে সঠিক সিদ্ধান্ত এই সভায় গৃহীত হয়নি। সরকার কর্তৃক শহরে ১৪৪ ধারা জারী না করার ফলে এ সিদ্ধান্তে গুরুত্বও খুব বেশী ছিলাে না। কাজেই মূল আলােচনা পরদিনের পিকেটিং সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্যেই মােটামুটিভাবে সীমাবদ্ধ থাকে।
১১ই মার্চের সাধারণ ধর্মঘটকে সম্পূর্ণভাবে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে ব্যাপকভাবে পরদিন পিকেটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কোন কোন জায়গায় কোন সময়ে পিকেটিং শুরু করা দরকার এবং কে কোন্ জায়গায় থেকে সেই পিকেটিং পরিচালনা করবে এই সভায় সেটা মােটামুটিভাবে স্থির করা হয়। ইডেন বিল্ডিং-এর প্রথম ও দ্বিতীয় গেট, রমনা পােস্ট অফিস, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাক, জেলা আদালত, হাই কোর্ট, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ ইত্যাদি স্থানে বিশেষ পিকেটিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পিকেটিং-এর জন্যে তিনটি পয়েন্ট ঠিক করা হয়-রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে ও পাশে দুই রেলওয়ে ক্রসিং-এ এবং আবদুল গণি রােডের দিক থেকে ওয়ার্কশপে প্রবেশের পথে। পিকেটিং চলাকালে কেউ কেউ গ্রেফতার হলে তাদের স্থান যাতে অনন্যরা নিতে পারে তার ব্যবস্থাও ঠিক হয়। এটা করা হয় এজন্যে যাতে একদল গ্রেফতার হওয়ার পর লােকের অভাবে পিকেটিং বন্ধ হয়ে না যায়।
১৯৪৮ সালের আন্দোলনের সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বিশেষ কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা থাকেনি। নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র হলের সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম এবং শামসুল আলম ব্যতীত অন্য কাউকে আন্দোলনে বিশেষভাবে অংশ গ্রহণ করতেও দেখা যায়নি। ফজলুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং মেডিকেল কলেজই এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলাে।
১১ই মার্চ খুব ভাের হতেই ছাত্রের পিকেটিং-এর জন্যে বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে পড়েন। রেলওয়ে ওয়ার্কশপে কাজ শুরু হতাে ভাের পাঁচটা থেকে। কাজেই ছাত্ররা তার পূর্বেই নির্ধারিত তিনটি পয়েন্টে পিকেটিং-এর জন্যে উপস্থিত হন। এ ছাড়া যে-যে এলাকায় যখন অফিস বসার কথা অথবা অফিসের জয়ে লােকজনের ঘর থেকে বের হওয়ার কথা (যেমন নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক) সেখানে ছাত্ররা সময়মতাে উপস্থিত হয়েছিলেন।’
কিছু নেতৃস্থানীয় লােকজন সেদিন গ্রেফতার হয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের সিদ্ধান্ত পুর্বেই নিয়ে বসেছিলেন এবং তাঁদের এই মনােভাবের কথা অনেকেরই জানা ছিলাে। কাজেই কর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ ঐ ধরনের নেতাদের কাছ কাছা পিকেটিং-এর সময় না থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তাদের কাছে থাকলে গ্রেফতারের সম্ভাবনা বেশী থাকতাে এবং তার ফলে অধিক সংখ্যক কর্মী গ্রেফতার হয়ে গেলে ধর্মঘট বানচাল হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেতে।
১১ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পূর্ণ ধর্মঘট হয়েছিলাে কিন্তু সকালের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় অথবা অন্য কোনাে জায়গায় কোনাে সভা অথবা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়নি। এর কারণ সাধারণ ধর্মঘটকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানাের সিদ্ধান্তের ফলে সকালের দিকে ছাত্রের পিকেটিং-এর উদ্দেশ্যে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন।
সেদিন সকালের দিকে রমনা ডাকঘরের সামনে যে সমস্ত ছাত্ররা পিকেটিংএর ঋন্যে গিয়েছিলেন পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে সামনের একটি গাছতলায় ঘিরে দাড়িয়ে থাকে। দলটিতে ছাত্রদের সংখ্যা ছিলাে তেরাে-চৌদ্দ। পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট গফুরও তখন রমনা ডাকঘরের সামনে উপস্থিত ছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যে মহম্মদ তোয়াহ। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাকে উদ্দেশ্য করে গফুর বলেন, দেখেন এরা কিভাবে পিকেটিং করছে। এর জবাবে তােয়াহা তাকে বলেন যে স্ট্রাইকের সময় পিকেটিং হবেই, সেটা খুব স্বাভাবিক। এই নিয়ে গফুরের সাথে মহম্মদ তােয়াহার তর্কাতর্কি চলাকালে সেখানে তাজউদ্দিন আহমদ এবং সরদার ফজলুল করিম উপস্থিত হন। তারা মহম্মদ তােয়াহার সাথে সামান্য কথাবার্তার পর রমনা ডাকঘর এলাকা পরিত্যাগ করেন। গফুরের সাথে ছাত্রদের বিশেষ করে তােয়াহার তর্কাতকি কিছুক্ষণ চলে এবং পরিশেষে বাড়াবাড়ি করলে কঠিন এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি ছাত্রদেরকে হুমকি দেখানাের চেষ্টা করেন। | হাই কোর্টের গেটের সামনে কিছু সংখ্যক ছাত্র পিকেটিং শুরু করে এবং উকিলদেরকে সেদিনের মতাে আদালতের কাজ বন্ধ রাখার জন্যে অনুরােধ এবং চাপ প্রয়ােগ করতে থাকে। এই সময়ে উকি ছাত্রদের সাথে নানা বাদপ্রতিবাদে প্রবৃত্ত হন এবং আদালতে উপস্থিত না হলে তাঁদের মক্কেলদের কত ক্ষতি হবে সেকথা ছাত্রদেরকে বােঝানাের চেষ্টা করেন। এই প্রসঙ্গে ফজলুল হক অমৃতবাজার পত্রিকার একজন প্রতিনিধির কাছে এক মৌখিক
বিবৃতিতে বলেন :
বেলা ১০-৩০ মিনিটের সময় আমি হাই কোর্টের গেটের সামনে উপস্থিত হই কিন্তু ছাত্রেরা সেখানে পিকেটিং করতে থাকার ফলে ভিতরে ঢুকতে অসমর্থ হই। ছাত্রদেরকে আমি বলি যে আমার প্রায় আটটি কেস কোর্টে আছে এবং আমার অনুপস্থিতিতে আমার মক্কেলরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু তাদেরকে এ ব্যাপারে কিছুতেই রাজী করাতে সক্ষম না হয়ে অবশেষে আমি বাড়ির দিকে রওয়ানা হই।১০
এই ঘটনাকালে পূর্ব বাঙলার তৎকালীন জেনারেল অফিসার কমান্ডিং আইয়ুব খান একটি পরিদর্শনের কাজ শেষ করে হাই কোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত সদ্য স্থাপিত বিভাগীয় সামরিক হেড কোয়ার্টারে যাওয়ার সময়ে ফজলুল হক এবং ছাত্রদের এই আলােচনা ও বিতর্ক লক্ষ্য করেন এবং পরবর্তীকালে তার প্রভু নয় বন্ধু নামক পুস্তকে এই ঘটনার মিথ্যা, বিকৃত ও বাহাদুরীপূর্ণ এক বর্ণনা দেন। বর্ণনাটি নিম্নরূপ : আমার মনে আছে একদিন একটি পরিদর্শনের কাজ শেষ করে আমি হাইকোর্ট ফেরত যাচ্ছিলাম। আমি দেখলাম ফজলুল হক আদালতের কাজে বাধা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাত্রদেরকে মাটির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বলছিলেন। আমি গাড়ির ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কি জন্য ঐসব করা হচ্ছিলাে। ফজলুল হক ‘আমাকে দেখেছিলেন এবং দেখার পর আমাকে তার রীতিমত ভীতিপ্রদ মনে হওয়ায় তিনি শান্তভাবে ছাত্রদেরকে সে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
শুধু ফজলুল হকই নয়, অন্যান্য অনেক উকিলরাও এই সময় তাদেরকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্যে ছাত্রদের সাথে আলােচনা এবং বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু তাতেও কোনাে ফল হয় না। এর পর ছাত্রদের উপর পুলিশ লাঠি চার্জ করলে উকিলরা তার প্রতিবাদে আদালত সেদিনের মতাে বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেন।১২ | ছাত্রেরা শুধু হাই কোর্টের সামনে নয়, সেক্রেটারিয়েটের সামনেও অফিস বর্জন করার জন্যে শ্লোগান দিতে থাকেন এবং পিকেটিং অব্যাহত রাখেন। পিকেটিং চলাকালে সেখানেও ছাত্রদের উপর লাঠি চার্জ করা হয়। অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎকারের সময় ফজলুল হক এই প্রসঙ্গে বলেন : হাই কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে সেক্রেটারিয়েটের কাছে আমি একদল ছাত্রকে দেখি। আমি তাদেরকে নানাভাবে বােঝাবার চেষ্টা করি এবং
তাদেরকে বাড়ি ফেরত যেতে অনুরােধ করি। এই সময় হঠাৎ একদল ছাত্রকে পুলিশ ধাওয়া করায় তারা দৌড়ে এসে আমি যেখানে দাড়িয়ে ছিলাম সেখানে হাজির হয়। আমি দেখলাম একদল পুলিশ আমার চতুদিকে যে ছাত্রেরা জড়ো হয়েছিলাে তাদেরকে মারপিট করতে শুরু করলাে। লাঠির একটা বাড়ি আমারও হাঁটুর উপর পড়ায় আমি খুব যন্ত্রণা অনুভব করি। এর পর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আমি ক্ষতস্থান ব্যাণ্ডেজ করিয়ে নিই। তবে আমার আঘাত তেমন গুরুতর ছিলাে না।১৩
১১ই মার্চ সকালের এই পিকেটিং-এর সময়ে ছাত্রেরা সেক্রেটারিয়েটের তাপখানা এবং আবদুল গণি রােডস্থ উভয় গেটের সামনেই সমবেত হয়েছিলেন। শামসুল হক, শেখ মুজিবর রহমান, অলি আহাদ প্রভৃতি কয়েকজন পিকেটিং করেন প্রথম গেটে ( আবদুল গণি রােড)। দ্বিতীয় গেটে (তােপখানা রােড) | পিকেটিং করেন কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী, বরকত এবং অন্য দুই জন। পিকেটিং চলাকালে শামসুল হকের সাথে পুলিশের অনেক তর্কবিতর্ক
হয়।১৪
| দ্বিতীয় গেটের সামনে শওকত আলীরা পিকেটিং শুরু করার পর কিছুসংখ্যক সেক্রেটারিয়েট কর্মচার সামনের গেট দিয়ে না ঢুকে পাশের একটা মসজিদের সাথে সংলগ্ন পাচিলের ফাক দিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে ঢুকতে শুরু করে। তখন দুজনকে দেখানে পিকেটিং-এর জন্যে মােতায়েন করা হয়। পিকেটিং চলা কালে দ্বিতীয় গেটে সার্জেন্ট রবার্টসন প্রথমে হাজির হন। ছাত্রদের সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করার পর তিনি অন্যত্র চলে যান। তারপর সেখানে উপস্থিত হন সিটি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট চ্যাথাম, ইন্সপেক্টর জেনারেল জাকির হােসেন এবং তার ডেপুটি ওবায়দুল্লাহ। তারা তিনজনে প্রথমে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে ঢােকেন। সে সময় তাদেরকে কেউ বাধা দান করেনি। তার মিনিট পাঁচেক পর তারা তিন জনেই আবার বের হয়ে এসে নিজেদের গাড়ি ভিতরে নিয়ে আবার হুকুম দেন। সে সময় শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহৰুৰ প্রভৃতি তাদেরকে বাধা দেন এবং গাড়ি ভিতরে যাতে কোনােমতে না নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। এই অবস্থায় পুলিশ সুপার চ্যাথাম কাজী গােলাম মাহবুব ও বরকতকে উদ্দেশ করে বলেন যে তাঁদের দুজনকেই গ্রেপ্তার করা হলাে। এর পর শওকত আলী গাড়ির সামনে পা লম্বা করে সােজা মাটিতে শুয়ে পড়ে গাড়িটির পথ রোধ করেন। তখন জাকির হােসেন ‘তােমাকেও গ্রেফতার করা হলাে’ এই বলে শওকত আলীর একটি হাত ধরে
ফেলেন। শওকত আলী তখন অন্য হাত দিয়ে গাড়ির সাদা চকচকে বাম্পারটিকে ধরেন এবং গাড়ির অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে তিনিও মাটির উপর হেঁচড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেন। সেই সাথে জাকির হােসেনকেও তিনি টানতে টানতে সাথে নিয়ে যান এবং প্রচুর গালাগালি বর্ষণ করতে থাকেন।
এর পর শওকত আলী কাজী গোলাম মাহবুব প্রভৃতিকে ওয়ায়েজ ঘাট কোতােয়ালীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তখন শামসুল হক, শেখ মুজিবর রহমান, অলি আহাদ এবং অন্যান্য অনেককে ইতিপূর্বেই গ্রেফতার করে আনা হয়েছিলাে। কিছুক্ষণ পর থানার ও. সি. সকলকে জিজ্ঞেস করলাে শওকত আলী এবং কাজী গােলাম মাহবুব কে? এই বিশেষ খোঁজের কারণ হলাে এই যে জাকির হােসেন তাদের দুজনের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে কোতােয়ালীতে ফোন করেছিলেন। তারা উভয়েই অভিযােগ অস্বীকার করা সত্বেও তাদেরকে বলা হয় যে তাদের বিরুদ্ধে বিশেষ ও নির্দিষ্ট অভিযোেগ আছে। কাজেই সেই অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। কোতোয়ালীতে খাওয়া দাওয়ার পর বেলা প্রায় চারটের দিকে শামসুল হক, মুজিবর রহমান, কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রভৃতি বহু কর্মীকে ঢাকা জেলখানায় স্থানান্তরিত করা হয়।১৬ ।
সকালের দিকে ছাত্রদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ইত্যাদির প্রতিবাদে বিকেল দুটো আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ। এই সভায় বক্তারা উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা দেন এবং একটি প্রস্তাবে ছাত্রদের উপর সেদিনকার পুলিশী জুলুমের কঠোর সমালােচনা ও প্রতিবাদ করেন। এ ছাড়া অন্য একটি প্রস্তাবে তারা পাকিস্তান সংবিধান সভার যে সকল পূর্ববঙ্গীয় সদস্য বাঙালীদের স্বার্থ রক্ষা করতে অক্ষম হন তাদের পদত্যাগও দাবী করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সভাশেষে ছাত্রেরা প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সাথে সাক্ষাতের জন্যে মিছিল সহকারে কার্জন হল হয়ে হাই কোর্টের সামনে উপস্থিত হলে পুলিশ আবার তাদেরকে বাধা দান করে। প্রথমে স্থির করা হয়েছিলো বিকেলেও সকালের মতাে সেক্রেটারিয়েটের তোপখানা গেট পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা হবে। কিন্তু পুলিশের কাছ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মিছিলটি উত্তরে আবদুল গণি রােডের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিল ইতিমধ্যে খুব বড় আকার ধারণ করে এবং তাকে সরাসরি বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করে।
পুলিশের অন্য গেট দিয়ে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে প্রবেশ করে ছাত্রদেরকে উত্তর দিকের গেটের সামনে বাধা দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়। মিছিলটি কিন্তু উত্তরের গেটে পৌছবার পূর্বেই গেট ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ছাত্রেরা সেক্রেটারিয়েটের গেটের সামনে উপস্থিত হয়ে ভেতরে ঢোকার জন্যে দাবী জানাতে থাকলে এক সময় পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট গফুর গেটের তালা খুলে তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং ছাত্রদেরকে তাড়া করে মার দেওয়ার জন্যে পুলিশদের উদ্দেশ্যে চীৎকার করে তার আদেশনামা জারী করেন। এর পর পুলিস এলােপাথাড়িভাবে ছাত্রদেরকে মারপিট শুরু করে। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য মহম্মদ তোয়াহার হাতে এই সময় একটি সাইকেল ছিলাে। সেই অবস্থাতেই পুলিশ তাকে লাঠি চার্জ করতে থাকে এবং বন্দুকের বাঁট দিয়ে তাকে আঘাত করে। এর পর তিনি তাদেরকে আক্রমণ করে তিনজনের হাত থেকে বন্দুক ছিনিয়ে নেন। বন্দুকের বেল্টগুলি পরে টান দেওয়ার ফলেই সেগুলি সহজে তার হাতে চলে আসে। তখন বেশ কিছুসংখ্যক পুলিশ বন্দুকগুলি উদ্ধার করার জন্যে তাকে ঘিরে ফেলে। অল্পক্ষণ পরই তিনি আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এবং পুলিশ সুপার গফুর দৌড়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে বন্দুক বেহাত হওয়ার জন্য কয়েকজন। পুলিশকে দু’তিন বাড়ি হান্টার মারেন। এর পর মহম্মদ তােয়াহার হাত থেকে বন্দুকগুলি তারা কেড়ে নেয়।২০
পুলিশের এই লাঠি চার্জের ফলে অনেক ছাত্র আহত হন এবং অল্পক্ষণ পরেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। এর পর ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ওবায়দুল্লাহ তােয়াহাকে ধরে সেক্রেটারিয়েটের মধ্যে নিয়ে যান। এবং সেখানে বেশ কিছুক্ষণ তাকে বসিয়ে রাখেন। সেই সময় ওবায়দুল্লাহ প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে টেলিফোনে জিজ্ঞেস করেন মহম্মদ তােয়াহাকে গ্রেফতার করা হবে কিনা। জবাবে খুব সম্ভবতঃ আহত অবস্থায় তাকে গ্রেফতারের বিরুদ্ধে মত দেওয়ায় একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে সেক্রেটারিয়েট থেকে তারা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে পাঠায় এবং সেখানে তাকে কয়েকদিন থাকতে হয়।
১১ই মার্চের এই ঘটনাবলী সম্পর্কে পূর্ববঙ্গ সরকারের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় ।
বাংলাকে কেন্দ্রের সরকারী ভাষা না করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আপনের উদ্দেশ্যে ১১ই মার্চ আহত সাধারণ ধর্মঘটকে কার্যকর করার জন্যে
আজ ঢাকাতে কিছু সংখ্যক অন্তর্ঘাতক এবং একদল ছাত্র ধর্মঘট পালন করার চেষ্টা করে। শহরের সমস্ত মুসলিম এলাকা এবং অধিকাংশ অমুসলিম এলাকাগুলি ধর্মঘট পালন করতে অসম্মত হয়। শুধুমাত্র কিছু কিছু হিন্দু দোকানপাট বন্ধ থাকে। শহরের এবং আদালতের কাজকর্ম সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলাে। রমনা এলাকায় অবশ্য ধর্মঘটকারীরা কিছু কিছু অকিসের লােকদেরকে কাজে যােগদানে বাধা নেয়। পিকেটিং কার উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এক একটি দল সেক্রেটারিয়েট, হাই কোর্ট এবং অন্য কতকগুলি অফিসের সম্মুখে সমবেত হয়। এদের মধ্যে অনেককে শান্তভাবে স্থান ত্যাগ করতে সম্মত করা গেলেও অন্যান্যেরা আক্রমণােস্থত হয়ে সেখানে অবস্থিত পুলিশ ও অফিস যােগদানে ইচ্ছুক কিছুসংখ্যক লােকজনের উপর ইটপাটকেল ছােড়ে এবং অন্যান্য হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে। এর ফলে পুলিশ লাঠি চার্জ করতে বাধ্য হয় এবং ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে। এক সময় দুবার বন্দুকের ফাকা আওয়াজ পর্যন্ত করতে হয়। বিক্ষোভ প্রদর্শন ও পুলিশ তৎপরতার ফলে মােট চৌদ্দ ব্যক্তি আহত হন এবং তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এদের মধ্যে কেউই গুরুতরভাবে অথবা গুলির আঘাতে আহত হননি। খানাতল্লাসীর ফলে যে সমস্ত প্রমাণাদি এখন সরকারের হস্তগত হয়েছে তার থেকে স্পষ্টই বােঝা যায় যে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যে হতবুদ্ধিতা সৃষ্টি করে পাকিস্তানকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে একটা গভীর ষড়ন্ত চলছে।
১১ই মার্চ কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক অমুসলমানদের দোকান বন্ধ ছিলাে এবং ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও পাকিস্তানকে খর্ব করা এই বক্তব্যের মাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তিটিতে সমগ্র আন্দোলনের একটা সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রচেষ্টা সহজেই লক্ষণীয়। এই প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক ‘নওবেলালের’ ঢাকাস্থ প্রতিনিধি প্রেরিত একটি চিঠিতে বলা হয় ?
১১ই মার্চের এত বড় ঘটনার পর পূর্ব বঙ্গ সরকার যে প্রেস নােট বাহির করেন তাহা পড়িলেই বুঝা যায় প্রকৃত সংবাদকে ব্ল্যাক আউট করার জন্য সরকার চেষ্টা করিয়াছেন। প্রেসনােটে বলা হয় মাত্র কতিপয় বিভেদসৃষ্টিকারী রাষ্ট্রের দুশমন, এই ধর্মঘটে যােগ দিয়াছিল। শহরের সমগ্র মুসলিম এলাকা ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করিতে অস্বীকার করে অর্থাৎ সরকারের মতে মুষ্টিমেয় কম্যুনিস্ট এবং কতিপয় হিন্দু ধর্মঘটে অংশ নিয়াছিল। অথচ
কে না জানে ধর্মঘটকে সফল করিয়া তুলিবার জন্য ঢাকার প্রত্যেকটি মুসলমান ছাত্র পুলিশের গুলি ব্যায়নেট ও লাঠির সম্মুখে বুক পাতিয়া দিয়াছিল। অথচ সরকারের মতে মুসলমানরা এই আন্দোলনে যােগ দেয় নাই। প্রচারণার কি অপূর্ব নমুনা! ১১ই মার্চের ধর্মঘটের দিনে ধর্মঘটী ছাত্রদের পিছনে একদল গুস্তাকে লেলিয়ে দেওয়া হয় এবং তারা অনেকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কয়েকটি অফিসের সামনে পিকেটিংরত ছাত্রদেরকে ভয় দেখাতে থাকে। এদেরই একাংশ পরে শহরের একটি পুস্তকের দোকান লুঠ করে। অপর এক অংশ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে পিকেটিংরত ছাত্রদের উপর হামলা চালায়। কিন্তু তারা শুধু ছাত্রদেরকে আক্রমণ করেই ক্ষান্ত না হয়ে কলেজের অধ্যাপক আহসান হাবীবকেও আঘাত করে।২৫
সেদিনের ধর্মঘটে ছাত্রদের সাথে বেশ কিছুসংখ্যক সেক্রেটারিয়েট এবং রেল কর্মচারীও যােগদান করেন এবং তার ফলে ঢাকাতে কিছুক্ষণের জন্যে অত্যন্ত গীশিক রেল ধর্মঘটও হয়।২৬ রেলওয়ে ওয়ার্কসপে ধর্মঘটের জন্যে পিকেটিং করার সময় ছাত্রদের সাথে একবার পুলিশের স’ঘর্ষ ঘটে এবং সে সময় কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়।২৭
১১ই মার্চের ধর্মঘট শুধুমাত্র ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিলাে না। পূর্ব বাঙলার প্রায় সর্বত্র ঐদিন ছাত্রেরা পূর্ণ ধর্মঘট পালন করেন। রাজশাহীতে সরকারী কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধতার জন্যে ছাত্রদের মধ্যে কিছু বিক্ষোভ এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয় কিন্তু পূর্ণ হরতাল পালন করার পর তারা ভুবনমােহন পার্কে ভাষার দাবীতে একটি সভার অনুষ্ঠান এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান চিহ্নিত ব্যাজ বিক্রি করেন। ঢাকা ব্যতীত অন্যান্য জায়গায় মােটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে এই ধর্মঘট পালিত হলেও যশাের ছিলো সেদিনের আর একটি ব্যতিক্রম। | যশাের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন আলমগীর সিদ্দিকী এবং হামিদা সেলিম (রহমান)। সভাপতি ছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি ডক্টর জীবনরতন ধর। সদস্যদের মধ্যে হাবিবুর রহমান, অনন্ত মিত্র, মসিউর রহমান প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। ১১ই মার্চ যশােরে মমিন গার্লস স্কুল ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেকটি স্কুল ও কলেজে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। মুসলিম একাডেমী, সম্মিলনী (হিন্দু ছেলেদের স্কুল ), জেলা স্কুল ইত্যাদিতে ধর্মঘটের পর মিছিল বের হয়। এই সময় মােমিন গার্লস স্কুলে ধর্মঘট না
হওয়ার সংবাদ পৌছালে সমগ্র মিছিলটি সেখানে উপস্থিত হয়ে বিট করে বেরিয়ে আসার জন্য ছাত্রীদেরকে আহ্বান করতে থাকে এবং তার ফলে দারুন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ হরতালের সম্পূর্ণ বিপক্ষে ছিলেন এবং কিছু সংখ্যক ছাত্রীরাও সেই দলে ছিলাে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নােমানীর মেয়েও ছিলাে ঐ দলভুক্ত এবং সে সক্রিয়ভাবে অন্য সকলকে ধর্মঘট করতে বাধা দিতে থাকে। এই সময় হামিদা সেলিম তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেওয়াতে তার একটি দাত ভেঙে যায় এবং তার ফলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত মােমিন গার্লস স্কুলের মেয়েরাও ধর্মঘটে যােগদান করে।
এর পর সমগ্ন মিছিলটি যশাের কলেকটরেটের সামনে উপস্থিত হয় এবং ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে থাকে। এই সময় এক পর্যায়ে পুলিশ তাদেরকে বাধা দিতে শুরু করলে বিছুসংখ্যক ছাত্র উত্তেজিত হয়ে উঠে ডাবের খােশা ইত্যাদি পুলিশের দিকে ছুড়তে থাকে। এর ফলে পুলিশের মধ্যেও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং প্রথমে তারা লাঠি চালায় ও পরে ভয় দেখানাের জন্যে বন্দুকের ফাকা আওয়াজ করে। এর পরই ছাত্র মিছিলটি একেবারে ছত্রভ হয়ে পড়ে।
এই ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন বিকেলের দিকে যশােরে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং শহরে দারুণ সরকার-বিরােধী উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। সংগ্রাম পরিষদের এক গােপন বৈঠকে সেদিন সন্ধ্যাতেই অনিদিষ্টকালের জন্যে ছাত্র ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য অবস্থার অবনতি লক্ষ্য করে এর পর নিজেরাই কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ করে দেন।
৬। ১১ই মার্চের নির্যাতনের প্রতিবাদ
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের কনভেনার নঈমুদ্দীন আহমদ ১২ই মার্চ সংবাদপক্ষে একটি বিবৃতির মাধ্যমে এগারাে তারিখের সরকারী জুলুমের প্রতি বাদ করেন। বিবৃতিটিতে বলা হয় যে দেশের শতকরা ৬৮ ভাগ মানুষের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন দমন করার জন্যে নাজিমুদ্দীন সরকার ফ্যাসিস্ট নীতি অবলম্বন করেছেন। নিরীহ ছাত্রদের উপর তারা গুলি চালিয়েছেন, লাঠি চাজ করেছেন এবং তাদের অনেককে গ্রেফতার করেছেন। যে সমস্ত যুবক ও ছাত্রেরা বৃটিশ বেয়ন্ত্রেটের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সরকার তাদের
উপর উৎপীড়ন করতেও দ্বিধাবােধ করেনি। বিবৃতিটিতে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই সব দমনমূলক ব্যবস্থার মুখে ভীতসন্ত্রস্থ না হয়ে ছাত্রেরা বাংলাকে তাদের রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করতে সক্ষম হবে। পূর্ব পাকিস্তানের সকল ছাত্রছাত্রীদেরকে ভাষা আন্দোলনে যােগদানের জন্যেও তিনি এই বিবৃতির মাধ্যমে আহ্বান জানান। | নঈমুদ্দীন আহমদের এই বিবৃতিতে ১১ই মার্চের বিভিন্ন ঘটনাবলীতে আহত ও পুলিশ কর্তৃক ধৃত ছাত্রদের একটা হিসাবও দেওয়া হয়। সেই হিসাব মতাে আহতের সংখ্যা-২০; গুরুতরভাবে আহত-১৮; ধুত ( এদের মধ্যে অনেককে পরে ছেড়ে দেওয়া হয়) এবং জেলবন্দী—৬৯।
অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান পরিবেশিত একটি সংবাদে জানা যায় যে ২১ই মার্চের সরকারী নির্যাতনের প্রতিবাদে পরনি সকালের দিকে জগন্নাথ কলেজে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা চলাকালে বেলা সাড়ে বারােটার দিকে প্রায় একশােন লােক বাইরে থেকে এসে সভার লোকদের উপর ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। এর ফলে দলিউর রহমান নামে একত্তন ছাত্র আহত হয়। ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান বি. দাশগুপ্ত গুণ্ডাদেরকে বাধাদান করতে গেলে তার উপরেও তারা হামলা চালায়।
এ ছাড়াও ১২ই মার্চ ঢাকাতে কতকগুলি বিক্ষিপ্ত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। দুই ব্যক্তিকে কমুনিস্ট সন্দেহে লােহার রড দ্বারা আঘাত করা হয়। রমনা এলাকা মােটামুটিভাবে শান্ত থাকলেও সেক্রেটারিয়েটের সামনে অবাধ যাতায়াত সেদিন বন্ধ থাকে এবং সশস্ত্র প্রহরীরা সমস্ত এলাকাটিকে পাহারা দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার আশেপাশের এলাকায় মিছিল বের করে পুলিশী জুলুম ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
১২ তারিখের সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি বিবৃতি মারত ফজলুল হক পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সকল সদস্যের প্রতি পদত্যাগের আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে পরিষদ কর্তৃক ১১ তারিখের ঘটনাবলীর বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থা না হলে সরাসরি প্রতিবাদ জ্ঞাপনের জন্যে ব্যবস্থাপক সভার সমস্ত সদস্যের পদত্যাগ করা উচিত। পুলিশ কর্তৃক নিরীহ ছাত্রদের উপর উৎপীড়নের প্রতিবাদে তিনিই সর্বপ্রথমতার সদস্যপদ ত্যাগ করবেন বলেও এই বিবৃতিটিতে তিনি ঘােষণা করেন। কিন্তু প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভা উপনােক্ত মর্মে কোনাে ব্যবস্থা অবলম্বন না করা সত্বেও ফজলুল হক সহ
ব্যবস্থাপক সভাৰ কোনাে সদস্যই ১৯৪৮ সালে পদত্যাগ করেননি। | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং শহরের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ১২ই মার্চ পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ই তারিখের পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয় কারণ ঐদিনটি ছিলাে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার তারিখ । ছাত্রেরা ধর্মঘটের পর সেদিন। গােগান দিতে দিতে শহরের বিভিন্ন এলাকা মিছিল সহকারে প্রদক্ষিণ করে।
১৩ই মার্চের একটি সরকারী ঘােষণা অনুযায়ী কলকাতা থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা এবং স্বাধীনতার আমদানী পূর্ব বাঙলায় নিষিদ্ধ করা হয়। এই আদেশ অনুসারে সেদিন তেজগাঁও বিমান বন্দরে উপরােক্ত সংবাদপত্রগুলির কপি পৌছালে পুলিশ তৎক্ষণাৎ সেগুলিকে হস্তগত এবং বাজেয়াপ্ত করে।
১৪ই মার্চ তারিখেও পূর্ব বাঙলার সর্বত্র ধর্মঘট পালন করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশাের, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ইত্যাদি শহরে ছাত্রেরা বিপুল উদ্দীপনার সাথে ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করে।
১৫ই মার্চ পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলাে। এই অধিবেশনে যােগদানের জন্যে প্রদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবস্থাপক সভার সদস্যেরা ঢাকাতে উপস্থিত হন এবং মুসলিম লীগ পরিষদ, দলের একটি সভা ১৪ তারিখে বেলা ৩-৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের বাসভবন বর্ধমান হাউসে শুরু হয়। এই সভা চলাকালে সেখানে বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র রাত্রি প্রায় নয়টা পর্যন্ত সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং ১১ তারিখে ধৃত ছাত্রদের মুক্তিদান এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানান। পার্লামেন্টোরী পার্টির এই সভায় ১১ই মার্চের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তৃত আলােচনা হয়।
৭। চুক্তি স্বাক্ষর পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার প্রথম অধিবেশন
মুসলিম লীগ পালমেন্টারী পার্টির অন্তর্ভুক্ত নাজিমুদ্দীন-বিরােধী উপদলে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য এই সময় ভাষা আন্দোলনের সুযােগে নাজিমুদ্দীনের সাথে আপােষ মীমাংসার মাধ্যমে কিছু সুবিধা আদায়ের জন্যে কথাবার্তা চালাতে থাকেন। | ১৪ তারিখে সকাল নয়টার দিকে মহম্মদ তােয়াহা এবং তাজউদ্দিন আহমদ
তফজ্জল আলীর বাসায় তার সাথে দেখা করতে যান। তাদের উদ্দেশ্য ছিলাে নাজিমুদ্দীনের সাথে সংগ্রাম পরিষদের যে চুক্তির কথা আলােচিত হচ্ছিলাে তার সম্পর্কে সরকার পক্ষের মনোভাব কি সেকথা জিজ্ঞেস করা। তফজ্জ্বল আলী কিন্তু তাদেরকে দেখেই উৎসাহের সাথে ইংরাজীতে বলে ওঠেন, ‘তােমরা দুজন মন্ত্রী এবং একজন রাষ্ট্রদূত পাচ্ছে।’ একথা শুনে মহম্মদ তোয়াহা বিস্ময়ের সাথে তাকে বলেন, বলছেন কি? আমরা কি আন্দোলন করছি মন্ত্রী করার জন্যে? আমরা এখন জানতে এসেছি সংগ্রাম পরিষদের সাথে চুক্তি সম্পর্কে আলােচনা কখন শুরু হবে। | তজ্জল আলী এবং অন্য কয়েকজন যে মন্ত্রী হওয়ার জন্যে ভেতরে ভেতরে ষড়যন্ত্র করছিলেন সাধারণ কর্মীদের সে সম্পর্কে কোনাে ধারণা ছিলাে না। কিন্তু এই ঘটনার পর তারা স্পষ্টভাবে আন্দোলনে তাদের ভূমিকা উপলৰি করেন। তাষা আন্দোলনের সাথে কিছু যােগাযোগ রক্ষা করে তারা নাজি মুদ্দীনকে একথা বােঝাচ্ছিলেন যে আন্দোলনের ভঁরাই প্রকৃত নেতা কাজেই তাদের সাথে একটা আপােধ মীমাংসা হলে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়া যাবে।
সেদিন সকালের ঘটনার পর কিছুসংখ্যক কর্মী নিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ প্রভৃতি খাজা নসরুল্লাহ বাসভবন দিলখুশায় মহম্মদ আলীর সাথে এ ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনার জন্যে উপস্থিত হন। নেতাদের মধ্যে অন্যান্যেরাও সেখানে ছিলেন এবং তারা সকলেই প্রতিশ্রুতি দেন যে ব্যক্তিগত স্বার্থের গুন্যে তাঁরা নাজিমুদ্দীনের সাথে কোনাে অপােষের মধ্যে যাবেন না।
সেদিন অর্থাৎ ১৪ তারিখে সন্ধ্যা বেলায় ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত সংগ্রাম কমিটির বৈঠকে মহম্মদ তােয়াহা এই বিষয়টির উল্লেখ করেন। আনোেয়ারা খাতুন এম. এল. এ, সেই সময় আইনের ছাত্রী হিসেবে সংগ্রাম কমিটির সেই সভাতে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সাথে তফজ্জল আলীদের যােগাযােগ ছিলো। তিনি বস্তুতঃপক্ষে তাদের গ্রুপেরই সদস্য ছিলেন। সেজন্যে মহম্মদ তোয়াহা সেই সভাতে আনোয়ারা খাতুনকে বলেন যে পার্লামেন্টারী পার্টির লােকজনের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় সংগ্রাম কমিটির সভায় তার উপস্থিতি বাহনীয় নয়। কাজেই তিনি যেন আর কমিটির কোনাে বৈঠকে ভবিষ্যতে যােগ না দেন। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সাধারণ সভাতেও উপরােক্ত বিষয় সম্পর্কে আলােচনা হয় এবং পার্লামেন্টারী পাটির লােকজনের সুবিধাবাদীতার সাথে ভাষা আন্দোলনের সম্পর্ক ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে আনোয়ারা খাতুনকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংগ্রাম কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
১৪ই মার্চ সংগ্রাম কমিটির সভায় পরদিন সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মহম্মদ তােয়াহা এবং তাজউদ্দীন আহমদ এই সিদ্ধান্তের উপর বিশেষ ভাবে জোর দেন। ১৫ই মার্চ পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার সর্বপ্রথম অধিবেশন আহুত হয়েছিলাে। সেদিক থেকে ধর্মঘটের সিদ্ধান্তটি ছিলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই সেই ধর্মঘটকে সফল করার জন্যে কর্মীরা সব রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্দেশ্যে কর্মীদেরকে টঙ্গী এবং কুমিটোলাতে রেল ধর্মঘটের জন্যে পাঠানাে হয়। মেডিকেল কলেজের হাউস সাজেন ডক্টর করিমকে দেওয়া হয় অ্যাম্বুলেন্সের দায়িত্ব। পুলিশী নির্যাতনের কথা চিন্তা করেই অ্যাম্বু লেন্সের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া সেটিকে কর্মীদের যাতায়াতের কাজে ব্যবহার করার কথাও তারা বিবেচনা করেন।
১৫ই মার্চ সকালের দিকে বৃষ্টি শুরু হয় এবং তার ফলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মীরা হল এবং অন্যান্য জায়গা থেকে সময়মতাে উপস্থিত হতে পারেননি। এই অবস্থা দেখে মহম্মদ তােয়াহা এবং তাজউদ্দীন প্রথমে হলের ছাত্রদের একত্রিত করেন এবং তারপর রমনা পােস্ট অফিস থেকে নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাক পর্যন্ত বিভিন্ন পিকেটিং পােস্ট-এ কর্মীদেরকে মােতায়েন করেন। ডক্টর করিম এর পর তার অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি এবং লােকজন নিয়ে জগন্নাথ হােস্টেল এবং আগা মসী লেনের মেসে গিয়ে সেখান থেকে কর্মীদের নিয়ে আসেন।’
১৫ তারিখের ধর্মঘটে সেক্রেটারিয়েট এবং রমনা এলাকার অন্যান্য অফিসের বাঙালী কর্মচারীরা যােগদান করেন। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে রেলকর্মচারীরাও ধর্মঘটে যােগ দেন। পিকেটারদেরকে দলে দলে বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং বেলা প্রায় বারােটার সময় মেডিকেল হাসপাতালের গেটের সামনে পুলিশ কঁদুনে গ্যাস ছাড়ে।
১৫ই মার্চ মহম্মদ আলী এবং খাজা নসরুল্লাহ সকাল আটটার দিকে কমরুদ্দীন আহমদের বাসায় উপস্থিত হয়ে তাকে বলেন যে নাজিমুদ্দীন সেদিন বেলা সাড়ে এগারোটার সময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে ভাষা প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা করতে চেয়েছেন। এই খবর পাওয়ার পর সাড়ে দশটার সময় ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি জরুরী বৈঠক ডাকা হয়। সেই বৈঠকে নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবটি বিবেচনার পর সাক্ষাতের বিষয়ে তার একমত হন এবং প্রান মন্ত্রীর সাথে তাদের আলােচনার ধারা সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলেন। চুক্তির শর্তগুলি আলোচনার জন্যে কমরুদ্দীন আহমদ যে প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করেন সেটিও এই বৈঠকে আলােচিত এবং মােটামুটি
ভাবে অনুমােদিত হয়।১০ , রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সদস্য প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সাথে আলােচনার জন্যে পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা মতাে ‘বর্ধমান হাউসে সাড়ে এগারােটার সময় উপস্থিত হন। এদের মধ্যে আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। নাজিমুদ্দীন প্রস্তাব করেন যে প্রাদেশিক সরকারের চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ সেই আলােচনাকালে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা তাতে সম্মত না হওয়ায় আজিজ আহমদকে বাদ দিয়েই আলােচনা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। এর ঠিক পরই কিছুক্ষণের জন্যে খাজা নাজিমুদ্দীন অনুপস্থিত থাকেন এবং তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারী খাজা নসরুল্লাহ সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সাথে চা পান ও গল্প-গুজব করতে থাকেন। খুব সম্ভবতঃ চীক সেক্রেটারী আজিজ আহমদের সাথে তাড়াতাড়ি পরামর্শের প্রয়ােজন বােধ করায় নাজিমুদ্দীনকে ‘বর্ধমান হাউসে’র বাইরে অথবা টেলিফোনে আলাপের জন্য অন্য কোনো পৃথক ঘরে যেতে হয়। সেটাই তার মধ্যবর্তী অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে সংগ্রাম পরিষদের দুই-একজন শস্য উল্লেখ করেন।১৩
প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে সংগ্রাম পরিষদের এই আলোচনা বৈঠকে তুমুল বিতর্ক এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সংগ্রাম পরিষদ চুক্তির যে শর্তগুলি পেশ করেন তার মধ্যে কতকগুলি স্বীকার করতে সম্মত হলেও অন্য কতকগুলির ক্ষেত্রে প্রথমে তিনি তার সুস্পষ্ট অসম্মতি জ্ঞাপন কসন। সংগ্রাম পরিষদকে তিনি বলেন যে বাংলাকে পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ঘােষণা করতে তার কোনাে আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সুপারিশ করে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভায় কোনাে প্রস্তাব উত্থাপন করতে তিনি কোনােক্রমেই রাজী নন। কারণ রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেটা প্রাদেশিক পরিষদের দ্বারা নির্ধারিত হবে না। বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতেয়ারভুক্ত এবং সংবিধান সভার মাধ্যমে তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক। ইত্তেহাদ, আনন্দবাজার পত্রিকা, স্বাধীনতা, অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর ইত্যাদি কাগজের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে নাজিমুদ্দীন বলেন যে পত্রিকাগুলি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সুপারিশ করার ফলে তাদের উপর। নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে একথা ঠিক নয়। নিষেধাজ্ঞা জারীর মূল কারণ।
ভাবে অনুমােদিত হয়।১০ , রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজন সদস্য প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সাথে আলােচনার জন্যে পূর্ব নির্ধারিত ব্যবস্থা মতাে ‘বর্ধমান হাউসে সাড়ে এগারােটার সময় উপস্থিত হন। এদের মধ্যে আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, নঈমুদ্দীন আহমদ, নজরুল ইসলাম, আজিজ আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। নাজিমুদ্দীন প্রস্তাব করেন যে প্রাদেশিক সরকারের চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ সেই আলােচনাকালে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা তাতে সম্মত না হওয়ায় আজিজ আহমদকে বাদ দিয়েই আলােচনা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। এর ঠিক পরই কিছুক্ষণের জন্যে খাজা নাজিমুদ্দীন অনুপস্থিত থাকেন এবং তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারী খাজা নসরুল্লাহ সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সাথে চা পান ও গল্প-গুজব করতে থাকেন। খুব সম্ভবতঃ চীক সেক্রেটারী আজিজ আহমদের সাথে তাড়াতাড়ি পরামর্শের প্রয়ােজন বােধ করায় নাজিমুদ্দীনকে ‘বর্ধমান হাউসে’র বাইরে অথবা টেলিফোনে আলাপের জন্য অন্য কোনো পৃথক ঘরে যেতে হয়। সেটাই তার মধ্যবর্তী অনুপস্থিতির কারণ হিসাবে সংগ্রাম পরিষদের দুই-একজন শস্য উল্লেখ করেন।১৩
প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের সাথে সংগ্রাম পরিষদের এই আলোচনা বৈঠকে তুমুল বিতর্ক এবং উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সংগ্রাম পরিষদ চুক্তির যে শর্তগুলি পেশ করেন তার মধ্যে কতকগুলি স্বীকার করতে সম্মত হলেও অন্য কতকগুলির ক্ষেত্রে প্রথমে তিনি তার সুস্পষ্ট অসম্মতি জ্ঞাপন কসন। সংগ্রাম পরিষদকে তিনি বলেন যে বাংলাকে পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা, আদালতের ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ঘােষণা করতে তার কোনাে আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সুপারিশ করে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভায় কোনাে প্রস্তাব উত্থাপন করতে তিনি কোনােক্রমেই রাজী নন। কারণ রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেটা প্রাদেশিক পরিষদের দ্বারা নির্ধারিত হবে না। বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতেয়ারভুক্ত এবং সংবিধান সভার মাধ্যমে তারাই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক। ইত্তেহাদ, আনন্দবাজার পত্রিকা, স্বাধীনতা, অমৃতবাজার পত্রিকা, যুগান্তর ইত্যাদি কাগজের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে নাজিমুদ্দীন বলেন যে পত্রিকাগুলি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সুপারিশ করার ফলে তাদের উপর। নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে একথা ঠিক নয়। নিষেধাজ্ঞা জারীর মূল কারণ।
বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন , হইবে। ৪। এপ্রিল মাসে ব্যবস্ত ক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে প্রদেশের সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরেজী উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার সূলে সরকারী ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দান করা হইবে। ৫। আন্দোলনে যাহারা অংশ গ্রহণ করিয়াছেন তাহাদের কাহারাে বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না। ৬। সংবাদপত্রের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে। ৭। ২১শে ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাঙলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে। ৮। সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলােচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।
চুক্তিপত্রটি স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে আবুল কাসেম, কমরুদ্দীন আহমদ প্রভৃতি জেলখানায় উপস্থিত হয়ে ভাষা আন্দোলনে বন্দীদেরকে চুক্তিপত্রটি দেখান। শামসুল হক, মুজিবর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব প্রভৃতি চুক্তির শর্ত গুলি দেখার পর তার প্রতি তাদের সমর্থন ও অনুমোদন জ্ঞাপন করেন। এর পর সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা আবার বর্ধমান হাউসে ফিরে আসেন এবং সরকারের পক্ষে প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দীন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমদ চুক্তিপত্রটিতে স্বাক্ষর দেন।১৯ | দুপুর একটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সেদিন একটি সাধারণ সভার পর ছাত্রের মিছিল সহকারে সেখান থেকে বের হয়ে পরিষদ ভবনের সামনে উপস্থিত হয়। পরিষদ ভবনের উল্টো দিকেই ছিলাে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এলাকা। ছাত্রেরা প্রধানতঃ সেখানেই একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন।
এই সময় পর্যন্ত চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার সংবাদ সাধারণভাবে প্রচার করা হয়নি। কিন্তু ছাত্র জনতার ক্রমবর্ধিত উত্তেজনা লক্ষ্য করে আবুল কাসেম তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টায় চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। এর সাথে সাথেই চতুর্দিক থেকে সকলে তাকে ঘেরাও করে গালাগালি বর্ষণ করতে থাকলে তিনি চুক্তির শর্তগুলি তাদেরকে চীৎকার করে শোনাবার চেষ্টা করেন।
কিন্তু নাজিমুদ্দীনের সাথে চুক্তি সম্পাদনের কথায় সকলে এতো বেশী উত্তেজিত হয়ে ওঠে যে আবুল কাসেমের কথায় কর্ণপাত না করে তারা তার বিরুদ্ধেও মারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় তােয়াহা প্রভৃতি কয়েকজন সেখানে তাড়াতাড়ি উপস্থিত হয়ে তাদেরকে শান্ত করার জন্যে বলেন যে চুক্তিটি চূড়ান্ত কিছুই নয়। সেটাকে কেন্দ্র করে আলােচনার সূত্রপাত হয়েছে মাত্র। সরকার যদি তাদের ভাষা বিষয়ক দাবী স্বীকার করতে অস্বীকার করে তাহলে আন্দোলন তারা চালিয়ে যাবেন। এই ঘােষণার পর জনতা তাদের প্রতি শাস্তভাব ধারণ করলেও বিক্ষোভ প্রদর্শন থেকে বিরত হলাে না। তারা দাবী করতে থাকলাে যে স্বয়ং নাজিমুদ্দীনের কাছ থেকে তারা চুক্তি সম্পর্কে শুনতে চায়। কিন্তু নাজিমুদ্দীন তাদের সামনে উপস্থিত না হওয়ায় বিক্ষোভ তাদের অব্যাহত থাকলাে। আন্দোলনকে অব্যাহত রাখার জন্যে ঘটনাস্থলেই সংগ্রাম কমিটির নেতাদেরকে পরদিন ১৬ই মার্চ পুনরায় সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানাতে হয়।২৩
৮। পরিষদের অভ্যন্তরে
পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পূর্বেই পরিষদ ভবনের সামনে ছাত্রের একত্রিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। অধিবেশনের শুরুতেই আবদুল করিম এবং নজমুল হক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিষদের স্পীকার এবং ডেপুটি
স্পীকার নির্বাচিত হন। তাদের উভয়ের নামই মুসলিম লীগ পার্লামেন্টোরী পার্টির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়।
পরিষদের অন্য কাজ শুরু হওয়ার পূর্বে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাইরে ছাত্রদের উপর কোনো অত্যাচার হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে জানতে চান। এরপর প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়ের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দীন বলেন যে সংগ্রাম পরিষদের সাথে বৈঠকে ব্যস্ত থাকার ফলে পরিষদ ভবনে উপস্থিত হতে তার বিলম্ব ঘটেছে। সরকার এবং সংগ্রাম কমিটির মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর তিনি বন্দীদের মুক্তির জন্যে আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন যে সংগ্রাম পরিষদের সাথে তার এই মর্মে কথাবার্তা হয় যে চুক্তি সম্পাদনের পর তারা সেক্রেটারিয়েট এবং পরিষদ ভবনের দিকে আর আসবে
। তাই চুক্তি সত্ত্বেও তারা আবার পরিষদ ভবনের সামনে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। নাজিমুদ্দীন বলেন
যে চুক্তি অনুসারে তিনি সেক্রেটারিয়েট এবং পরিষদ ভবন ছাড়া অন্য সব জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করেছেন। তবে পরিষদ ভবনের সামনে ঠিক সেই মুহূর্তে কি ঘটছে সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। প্রধান মন্ত্রীর এই প্রাথমিক বিবৃতির পর প্রতাপচন্দ্র গুহ রায় তার কাছে জানতে চান যে ১১ই মার্চের ঘটনা সম্পর্কে তিনি পরিষদে সেদিন কোনো বিবৃতি দান করবেন কিনা। এর জবাবে নাজিমুদ্দীন বলেন যে সে সম্পর্কে আলোচনা পালমেন্টারী পার্টিতে হয়ে গিয়েছে এবং তার উপর বিবৃতিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই তা নিয়ে অধিক অালোচনা তিনি ভালাে মনে করেন না।
এই সময় প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়, মনােরঞ্জন ধর প্রভৃতি বাইরে ছাত্রদের উপর কোনো পুলিসী অত্যাচার হচ্ছে কিনা সেটা দেপে আসার জন্যে চাপ দিতে থাকেন এবং তার ফলে পরিষদের ভেতরে দারুণ গণ্ডগোল ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু স্পীকার সকলকে শান্ত হয়ে প্রধান মন্ত্রীর বক্তব্য শোনার জন্যে অনুরােধ করায় অবস্থা অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং নাজিমুদ্দীন সংগ্রাম কমিটির সাথে আলোচনা সম্পর্কে পরিষদের সামনে নিম্নলিখিত রিপাের্ট পেশ করেন :
যে সমস্ত দল গুলি এই আন্দোলন শুরু করেছে তাদেরকে নিয়ে গঠিত সংগ্রাম কমিটির সাথে সকাল থেকে আমি আলােচনা করছিলাম। আলােচনার লে আমাদের মধ্যে একটা বােঝাপড়া হয়। এর পর তাদেরকে জেলখানায় গিয়ে যারা যেখানে আছে তাদের সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়। তারা সেখান থেকে ফিরে আসার পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। যারা জেলে আছে তাদের সকলের মুক্তির জন্যে আমি আদেশ দিয়েছি। তারা আমাকে সমস্ত পুলিশ প্রত্যাহার করতে বলেছে। আমি পরিষদ ভবন এবং সেক্রেটারিয়েট ব্যতীত অন্য সব জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করতে বলেছি। পুলিশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাদেরকে আমি আশ্বাস দিয়েছি এবং সেই মর্মে আদেশও দেওয়া হয়েছে। কাজেই পরিষদের সামনে তাদের আর আসা উচিত নয়। পরিষদের সামনে ছাড়া তারা যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে। তারা রমনা অথবা অন্য যে কোনাে জায়গায় যেতে পারে। কি ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা এখানে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে কেন? আমার কাছেই চুক্তির একটি কপি আছে। সেক্রেটারিয়েট এবং পরিষদের সামনে ছাড়া অন্য সব জায়গা থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে সংগ্রাম কমিটিকে তারা বর্জন করেছে। এ ছাড়া আর কি হতে পারে আমি কিছুই জানি না।
প্রধান মন্ত্রী এই পর্যন্ত বলার পর পরিষদে আবার হট্টগােল শুরু হয়। তখন তিনি আটদফা চুক্তিটি সম্পূর্ণ পাঠ করে তাদেরকে শােনান।
এর পর ডক্টর মালেক পুলিশ প্রত্যাহার সম্পর্কে প্রধান মন্ত্রীর বক্তব্যের উল্লেখ করে বলেন যে তার আশ্বাস সত্বেও তিনি নিজে দেখে এসেছেন যে পুলিশের স্থানে মিলিটারী মােতায়েন করা হয়েছে। এর উত্তরে নাজিমুদ্দীন বলেন যে মিলিটারী প্রথম থেকেই সেখানে মােতায়েন করা ছিলাে এবং পুলিশ অন্যান্য জায়গা থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ ছাড়া কাউকে আর গ্রেপ্তার করা অথবা কারাে কাজে বাধাও দেওয়া হয়নি। তাদের সাথে এই ব্যবস্থা হয়েছিলো যে তারা পরিষদ ভবন এবং সেক্রেটারিয়েট ছাড়া অন্য যে কোনাে জায়গাতেই অবাধ ঘােরাফেরা করতে পারবে।
প্রধান মন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার পূর্বেই পৰিষদে আবার তুমুল হট্টগােল শুরু হয় এবং অনেকেই প্রধান মন্ত্রীকে বাইরে গিয়ে সচক্ষে অবস্থা দেখে আসার। জন্যে দাবী জানাতে থাকেন।
এই গণ্ডগােল চলাকালে মহম্মদ আলী বলেন যে নিশ্চয়ই নোতুন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা এখানে আসতে চায় কারণ এটাই। একমাত্র জায়গা যেখানে জনসাধারণ তাদের দাবী পেশ করতে পারে। কাজেই পরিষদের উচিত ব্যাপারটিকে ভালোভাবে বিবেচনা করা। প্রধান মন্ত্রী। নিজে বাইরে গিয়ে স্বচক্ষে অবস্থা দেখে আসুন তা তিনি চান না। তিনি চান যে পরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছ থেকে জানুন তারা কি চায় এবং তাদের অভিযোগ গুলির মীমাংসা কিভাবে করা সম্ভব।
এই পর্যায়ে মসিউদ্দিন আহমদ বলেন যে পুলিস অফিসার গফুরের গুন্যে সংগ্রাম কমিটির সাথে প্রধান মন্ত্রীর চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। গফুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢুকে সেখানে মহিলা ছাত্রীদের উপর কাদুনে গ্যাস ছুড়েছে। কাজেই যে চুক্তি হয়েছিলাে তা নষ্ট হয়ে গেছে এবং তার ফলেই বাইরে বিক্ষোভ শুরু। হয়েছে। সমস্ত ব্যাপারটির জন্যে তিনি গফুরকে দায়ী করেন।
১৫ই মার্চ সকালের দিকে প্রধান মন্ত্রী ছাত্রদের উত্তেজনা এবং মনােবলের কথা। চিন্তা করে পূর্ব বাঙলার অফিসার কমাণ্ডি জেনারেল আবুল খানকে তলব করেন। আয়ুব খান হাজির হলে তাকে প্রধান মন্ত্রী পরিষদ ভবনের চতুর্দিকে ফৌজ। মােতায়েন করে ছাত্রদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে পরিষদ সদস্যদেরকে রক্ষা করার। জন্যে অনুরোধ করেন। আয়ুব খান তার রাজনৈতিক আত্মজীবনীতে বলেছেন যে প্রথমে তিনি প্রধান মন্ত্রীর এই অনুবােধ অগ্রাহ্ন করা স্থির করেছিলেন কিন্তু।
নাজিমুদ্দীন তাঁকে মন্ত্রীত্ব সংকটের কথা বলায় তিনি অবশেষে সরকারের পতন রােধ করার উদ্দেশ্যে তার প্রস্তাবে সম্মত হন। এর পর মেজর পীরজাদার অধীনে একটি পদাতিক কোম্পানী পরিষদ ভবনের কাছাকাছি মোতায়েন করা হয়। ডক্টর মালেক এই কোম্পানীটিকে দেখেই পরিষদ ভবনের কাছে মিলিটারী অবস্থানের উল্লেখ করেন।
পরিষদের মধ্যে ফজলুল হক, আনোয়ারা খাতুন এবং অন্যান্যেরা প্রধান মন্ত্রীকে বাইরে গিয়ে অবস্থা সচক্ষে দেশে আসার জন্যে ক্রমাগত দাবী জানাতে থাকেন। এই সময় একবার অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থায় আনোয়ারা খাতুন বলেন :
গত ১১ই মার্চ তারিখে যা হয়েছে, তা হয়েছে। আজ পুলিশ মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছে, গলা টিপে মেরেছে, তার প্রতিকার চাই। ঐ সমস্ত চোরামি এখানে চলবে না। আমরা চাই প্রধান মন্ত্রী সেখানে গিয়ে দেখে আসুন। ১০
আনোয়ারা খাতুনকে সমর্থন করে শামসুন আহমদ বলেন যে পুলিশ মেয়েদের গায়ে গা হাত তুলেছে তপন এই মুহূর্তে সকলের পদত্যাগ করা উচিত।
এর পর স্পীকার বিকেল ৪-৫ মিনিট পর্যন্ত পরিষদ, মুলতুবী ঘােষণ। করেন।
পরিষদের কাজ আবার শুরু হলে মহম্মদ আলী নােতুনভাবে প্রস্তাব করেন যে ঘটনা যেহেতু পবিম্ব ভবনের সামনে ঘটেছে সেজন্যে পরিষদের স্পীকারের উচিত পরিষদের কয়েকজন সদস্য এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েকজনকে নিয়ে তার নিজের কামরায় একটা বৈঠকে মিলিত হওয়া। এর দ্বারা তাদের সত্যকার অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যাবে এবং বােকা যাবে অভিযােগগুলির প্রতিবিধান করা কতদূর এবং কিভাবে সম্ভব।১২ | মহম্মদ আলীর এই প্রস্তাব সম্পর্কে পরিষদের অভিমত জিজ্ঞাসা করলে হামিদুল হক চৌধুরী স্পীকারকে বলেন যে অল্পক্ষণের মধ্যেই সমস্যার একটা কিছু সমাধান হবে কারণ প্রধান মন্ত্রী পরিষদের বাইরে গিয়ে নিজে ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। যে কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।
পরিষদের অভ্যন্তরে সদস্যদের চাপে এবং বাইরের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের ফলে নাজিমুদ্দীন পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে পরিষদ ভবনেই নিজের অফিসে সংগ্রাম পরিষদের কয়েকজনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু এই আলােচনা
সত্বেও বাইরের বিক্ষোভ শান্ত হয় না। তারা নাজিমুদ্দীন সরকার এবং পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্যে নানাপ্রকার ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকেন এবং পরিষদ ভবনের এলাকা পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করে। এই বিক্ষোভ চলাকালে মাঝে মাঝে ফজলুল হক, মহম্মদ আবী, তফজ্জল আলী, নেলী সেনগুপ্তা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, খাজা নসরুল্লাহ, আবদুল মালেক প্রভৃতি পরিষদ সদস্যেরা বাইরে এসে ছাত্র এবং অন্যান্য বিক্ষাভকারীদের সাথে কথা বলেন এবং বাংলা ভাষার দাবীর সপক্ষে মত প্রকাশ করেন।১৪
| সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভকারীরা স্থান ত্যাগ না করায় ‘আইব খান নিজে পরিষদ ভবনে উপস্থিত হন এবং ভি. আই. জি. ওবায়দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন তিনি ছাত্রদের কিরুদ্ধে উপযুক্ত পুলিশী ব্যবস্থা অবলম্বন করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন। আইয়ুব খানের বর্ণনা অনুসারে এর উত্তরে ওবায়দুল্লাহ তাকে বলেন যে তিনি আদেশ করলে ওবায়দুল্লাহ সে কাজ করতে পারেন কিন্তু রাজনীতিবিদের জন্যে ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নিতে তিনি রাজী নন। এর কারণ জিজ্ঞেস করায় ওবায়দুল্লাল আইয়ুব খানকে বলেন তিনি ছাত্রদের মারপিট করে তাড়িয়ে দিলে তারা পরদিন তার বিরুদ্ধে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সমস্ত দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে। তারা নিজেরা এ ব্যাপারে কোনাে দায়িত্বই গ্রহণ করবে না। কাজেই লিখিত আদেশ ছাড়া মৌখিক আদেশে ওবায়দুল্লাহ ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।১৫ | এরপর আইয়ুব খান পরিষদের ভিতরে গিয়ে প্রধান মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বলেন যে সন্ধ্যে হয়ে আসছে এবং ছাত্রেরাও ক্রমশঃ তাদের কোম্পানীর নিকটবর্তী হচ্ছে। নাজিমুদ্দীন তখন জানতে চান কি উপায়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব। আইয়ুব তখন তাকে পরিষদের অধিবেশন মুলতুবী করিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যেতে উপদেশ দেন। এতে নাজিমুদ্দীন বলেন যে তিনি একটা গুরুত্বপূর্ণ। বক্তৃতা তখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেননি কাজেই তার পক্ষে তৎক্ষণাৎ বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। একথা বলার ঠিক পরেই তিনি নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আইয়ুব খানকে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেন। পাঁচ মিনিট পর নাজিমুদ্দীন পরিষদের অধিবেশন সেদিনের মতাে মুলতুবী রাখার ব্যবস্থা করে বাইরে এলে আইয়ুব খান মেজর পীরজাদাকে প্রধান মন্ত্রীর গাড়িটি পরিষদ ভবনের পেছন দিকে নিয়ে আসার জন্যে বলেন। এর পর আইয়ুব এবং পীরজাদা উভয়ে মিলে প্রধান মন্ত্রীকে জগন্নাথ হলের পুরাতন রান্নাঘরের
ভেতর দিয়ে পার করে গাড়ি চড়িয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।১৬
প্রধান মন্ত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে পরিষদ ভবনের বাইরে ছাত্রদের কাছে গিয়ে আইয়ুব খান বলেন যে ‘পাখী উড়ে গেছে। এই কথা শুনে সকলে উচ্চৈস্বরে হেসে ওঠে, এব আবহাওয়া অনেকখানি হাল্কা হয়ে যায়। এর পর ফজলুল হক এবং মহম্মদ আলী বাইরে এসে ছাত্রদের সাথে কথাবার্তা শুরু করলে আইয়ুব মহম্মদ আলীর কঁাধে টোকা দিয়ে তাকে বলেন, আপনি কি একটা বুলেট খাওয়ার অপেক্ষায় আছেন? এতে মহম্মদ আলী রুষ্ট হয়ে আইযুবকে বলেন, আপনি অভদ্র ব্যবহার করছেন। আইয়ুব খান এর পর মহম্মদ আলীকে রুঢ় ভাষায় বাড়ি ফেরত যেতে বলেন।১৭ | সেদিন আইয়ুব খান মহম্মদ আলীর সাথে যে ব্যবহার করেছিলেন তার প্রতিবাদে মহম্মদ আলী তার বিরুদ্ধে নাজিমুদ্দীনের কাছে নালিশ করেন। এর ফলে নাজিমুদ্দীন আইয়ুব খানকে ডেকে পাঠিয়ে মহম্মদ আলীর সাথে গণ্ডগােল মিটিয়ে নিতে বলেন। আইয়ুব খান লিখেছেন যে নাজিমুদ্দীন তাঁকে এক্ষেত্রেও মন্ত্রী সংকটের দোহাই দেন। মহম্মদ আলীকে এর পর ‘বর্ধমান হাউসে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আইয়ুব খান তখন তাকে বলেন যে তিনি যা করেছেন তা নিতান্তই ঠাট্টাচ্ছলে কাজেই সেটাকে তার গুরুত্ব দেওয়া উচিত
হয়নি।
৯। বন্দীমুক্তি ও পরবর্তী বিক্ষোভ
১৫ই মার্চ সন্ধ্যার দিকে ভাষা আন্দোলনে বন্দী ছাত্রদেরকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে জেল গেটে হাজির করা হয়। সেই সময় তাদের মুক্তির জন্যে বহু লােক বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। জেল গেটে বন্দীদেরকে হাজির করার পর এক জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জাকির হােসেন শওকত আলী এবং কাজী গোলাম মাহবুবের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে অভিযোগ করায় তাদের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন ছাড়াও একটা স্বতন্ত্র মামলা দাড় করানাে হয়েছিলাে। কাজেই ভাষা আন্দোলনের বন্দীদের মধ্যে তারা গণ্য না হওয়ায়, বন্দীদের মুক্তির আদেশ আসেনি। রণেশ দাশগুপ্তকে নিয়েও সেই একই সমস্যা দেখা দেয়। অন্য সকলে যদি এদেরকে জেলে রেখে বেরিয়ে আসতে সম্মত হতেন তাহলে গণ্ডগােল হতাে না। কিন্তু এই তিনজনকে বাদ দিয়ে একজনও জেল পরিত্যাগ করতে সম্মত না হওয়ায় দারুণ উত্তেজনা এবং হট্টগােলের সৃষ্টি হলাে। প্রধান মন্ত্রীর
সাথে এ নিয়ে মহম্মদ তোয়াহা টেলিফোনে আলাপ করে অবস্থার গুরুত্ব তাকে বােঝানাের পর উপরােক্ত তিনজনসহ সকলেরই মুক্তির আদেশ দিতে তার বাধ্য হন। এর পরমুক্তি প্রাপ্ত কর্মীদেরকে একটি ট্রাকে চড়িয়ে শহরের মধ্যে ঘােরানাের পর ফজলুল হক হলে সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই তাদের জন্য একটি সম্বর্ধনার আয়ােজন করা হয়।
১৫ই মার্চ ফজলুল হক হল থেকে মুজিবর রহমান এবং শওকত আলী ১৫ • | নম্বর মােগলটুলীতে গিয়ে সেখানেই রাত্রি যাপন করেন। পরদিন খুব সকালে তারা আবার ফজলুল হক হলে কেৱত গিয়ে ছাত্রদেরকে একটি প্রতিবাদ সভার জন্যে একত্রিত করার চেষ্টা করতে থাকেন।
এই সভা পূর্ব দিনের পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে হলেও মুসলিম লীগ পার্ল’মেন্টারী পাটির নাজিমুদ্দীন-বিরােধী উপদলের লােকেরা তার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করেন। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলাে মন্ত্রীসভাকে আন্দোলন ও বিক্ষোভের দ্বারা বিপর্যস্ত করে নিজেদের জন্যে কিছু বিশেষ সুবিধা আদায় করা। ১১ই তারিখে মুজিবর রহমান, শওকত আলী প্রভৃতিরা গ্রেফতার হওয়ার পর সেনিই তফজ্জল আলী তাদের সাথে সাক্ষাৎ করে অনেক কান্নাকাটি করেন। এর কারণ ১৪ই তারিখে পরিষদের স্পীকার নির্বাচনের কথা ছিলে এবং তিনি ভেবেছিলেন মুসলিম লীগের ছাত্রকর্মীদেরকে দিয়ে নিজের সমর্থনে নাজিমুদ্দীনের উপর চাপ দিলে তারা তফজ্জল আলীকেই শেষ পর্যন্ত স্পীকার পদে মনােনয়ন দিতে বাধ্য হবেন। পার্লামেন্টারী পাটির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের গ্রেফতারের পর তার সে আশা ব্যর্থ হয়। | ১৪ই তারিখ সন্ধ্যায় বর্ধমান হাউসে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী। পটর সভাতে পরদিন পরিষদে স্পীকার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে আবদুল করিম এবং ত কল আলার নাম প্রস্তাব করা হয়। তঙ্কল আলী সেই নির্বাচনে কাবদুল করিমের কাছে ২০/২৫ ভােটের ব্যবধানে পরাজিত হন। মহম্মদ আলীর নেতৃত্বধীনে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী উপদলের সাথে নাজিমুদ্দীনের তখন পর্যন্ত কোনো চুড়ান্ত আপােষ সম্ভব হয়নি এবং তাকে সম্ভব করার জন্য ছাত্রদের সাহায্যে মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে তারা নোতুনভাবে বিক্ষোভের ব্যবস্থা করেন।’ পূর্বদিনের পুলিশী জুলুমের ফলে সে কাজ সহজেই সম্ভব হয়েছিলাে।
| ১৬ই মার্চ সকালে নয়টার দিকে ফজলুল হক হলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম | পরিসদের একটি বৈঠকে পূর্বদিন প্রধান মন্ত্রীর সাথে সম্পাদিত চুক্তির কয়েকটি | স্থান সংশোধনের পর দুপুরের দিকে সেই সংশোধনী প্রস্তাব সাধারণ ছাত্র
সভায় পেশ করে তাদের অনুমােদন লাভেরও সিদ্ধান্ত হয়।
১৬ তারিখে সকালের দিকে নাজিমুদ্দীন তফজ্জল আলীর মাধ্যমে সং গ্রাম কমিটির কাছে জানতে চান যে চুক্তি সত্বেও আন্দোলন অব্যাহত আছে কেন? তিনি তাে চুক্তি অনুসারে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করেছেন কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক আন্দোলন প্রত্যাহারের যে ‘অলিখিত চুক্তি তাদের সাথে হয়েছিলাে তার। সে অনুসারে কাজ করছেন না কেন! তজ্জল আলী ফজলুল হক হলে এসে সংগ্রাম কমিটির কমরুদ্দীন ‘আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দিন আহমদ প্রভৃতির সাথে এ নিয়ে আলাপ করেন। তাকে সং •াম কমিটির পক্ষ থেকে নাজিমুদ্দীনকে বলতে বলা হয় যে ‘আন্দোলনের উপর তাদের সম্পূর্ণ হাত নেই। আন্দোলন এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যেখান থেকে সহজে তা হঠাৎ প্রত্যাহার করা কারো পক্ষেই সম্ভবপর নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ সভার নির্ধারিত সময়ের কিছু পূর্বেই বেলা দেড়টার সম।শেখ মুজিবর রহমান কালো শেরওয়ানী এবং জিন্না টুপী পরিহিত হয়ে একটি হাতলবিহান চেয়ারে সভাপতির অসন অধিকার করে বসেন।১০ সেই সভায় তার সভাপতিত্ব করার কোনো কথা ছিলাে না। কারণ ঢাকার তৎকালন ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে তার ভূমিকা ছিলাে নিতান্ত নগণ্য। কিন্তু এ সবেও তিনি নিজেই সেই সভায় সভাপতিত্ব করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং নির্ধারিত সময়ের পূবেই সভাপতির-চেয়ার দখল করেন। সভার প্রথম দিকেই সকলে ফজলুল হক হলের বৈঠকে গৃহতি নিম্নলিখিত সংশোধনী প্রস্তাবলি গৃহীত হয় :
১। ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায় পুলিশী বাড়াবাড়ি সম্পর্কে তদন্তের জন্য সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক অনুমােদিত এবং সরকারী ও বেসরকারী সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি নিয়ােগ করিতে হইবে। ২। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মযাদা দানের সুপারিশ করিয়া প্রস্তাব গ্রহণের উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্য পূর্ব বাংলা পরিষদের অধিবেশন চলাকালে একটি বিশেষ দিন নির্ধারণ করিতে হইবে। ৩। সংবিধান সভা কর্তৃক তাহার। উনােক্ত সংশোধনী প্রস্তাবগুলি অনুমোদন করাইতে অসমর্থ হইলে সংবিধান সভার এবং পূর্ব বাংলা মন্ত্রীসভার সদস্যদিগকে পদত্যাগ করিতে হইবে।
উপরোক্ত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হওয়ার পর আলী আহমদের মাধ্যমে সেটি প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। প্রস্তাব গ্রহণের পর
মুজিবর রহমান অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযােগ না দিয়ে নিজেই বক্তৃতা শুরু করেন। সেই এলােপাথাড়ী বক্তৃতার সারমর্ম কিছুই ছিলাে না। অল্পক্ষণ এইভাবে বক্তৃতার পর তিনি অন্য কাউকে বক্তৃতার সুযােগ না দিয়ে হঠাৎ, ‘চলাে চলাে অ্যাসেমী চলাে’ বলে শ্লোগান দিয়ে সকলকে মিছিল সহকারে পরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্যে আহ্বান জানান।১৫ সেদিনকার পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী মিছিলের কোনাে কথা ছিলাে না। কিন্তু এই হঠাংঅদ্ভুত পরিস্থিতির পর মিছিলকে বন্ধ করা কারাে পক্ষে সম্ভব হলাে না। কাজেই ছাত্রেরা সরকার বিরােধী এবং বাংলা ভাষার সমর্থনে নানা প্রকার ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হলাে।
ইনিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ এবং পরিষদ ভবনের নিকটবর্তী চৌমাথার কাছে মিছিলটি পৌছালে পুলিশ তাদেরকে বাধা দান করে। এর পর ছাত্রেরা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তারের বেড়া পার হয়ে কলেজ এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সেখানেই অবস্থান করে নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীত্বের পদত্যাগ দাবী এবং পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে ধ্বনি দিতে থাকে।১৬। | অধিবেশন চলাকালে বাইরে দারুন হট্টগােল হচ্ছিলাে। এই সময় ভেতরে থেকে কোনো কোনাে সদস্য মাঝে মাঝে বের হয়ে এসে ছাত্রদের কাছে মুখ দেখিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের এই আচরণের কারণ ছিলাে রাস্তায় নেমে ছাত্রদের হাতে যাতে মারধাের খেতে না হয় তার ব্যবস্থা করা। এই সময়ে হাতিয়ার মৌলানা আবদুল হাই একবার উপরের ব্যালকনীতে দাড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গীতে ছাত্রদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, “চালাও চালাও, আমরা আছি’ ইত্যাদি। ১৭। | পরিষদ ভবনের পূর্ব গেটে এই সময়ে ছাত্রেরা গিয়ে কিছু সংখ্যক পরিষদ, সদস্যকে মারপিট ও গালাগালি শুরু করে। এদের মধ্যে নাজিমুদ্দীন-বিরােধী উপদলীয় সদস্যেরাও কেউ কেউ ছিলেন। এই খবর শওকত আলী প্রভৃতির কাছে পৌছানোর পর পূর্ব গেটে এমন নোতুন কর্মীদেরকে মোতায়েন করা হয় যারা তাদের সমর্থক পরিষদ সদস্যদেরকে চিনতেন।১৮
সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিষদ ভবনের সামনে ছাত্রদের এই বিক্ষোভ চলতে থাকলাে এবং তাদের মধ্যে সেই এলাকা পরিত্যাগ করার কোনাে লক্ষণ দেখা গেলাে না। এর ফলে পরিষদ সদস্য থেকে শুরু করে স্পীকার, ডেপুটি স্পীকার এবং মন্ত্রীসভার সদস্যেরা সকলে অধিবেশন শেষ হওয়ার তিন ঘণ্টা পর পর্যন্ত তাদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকেন। এই পর্যায়ে হামিদুল হক চৌধুরী পরিষদ ভবনের
সিড়ির উপর দাড়িয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহকে উদ্দেশ করে বলেন যে তার উচিত ছাত্রদেরকে গুলি করা। হামিদুল হকের এই কথা শুনে শওকত আলী প্রত্যুত্তরে তাকে অত্যন্ত কঠিন ‘লৌকিক ভাষায় গালাগালি করে পরিষদ, ভবনের বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে বলেন।
এভাবে ছাত্রদের উত্তেজনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া এবং অবস্থা পুলিশের আয়ত্বের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহমতুল্লাহ শামসুল হককে ডেকে বলেন যে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছাত্রেরা যদি পরিষদ ভবন এলাকা পরিত্যাগ করে না যায় তাহলে তাদের উপর লাঠিচার্জ করা হবে। শামসুল হক তখন তাকে বলেন যে আরো কিছু বেশী সময় প্রয়ােন কারণ এত বিরাট জনতাকে বুঝিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখান থেকে সরানাে সম্ভব নয়। শামসুল হক এই কথা বলার সাথে সাথেই পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে এবং চতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায়। গফুরের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী এর পর এলােপাথাড়ীভাবে লাঠিচার্জ, কঁদুনে গ্যাস এবং বন্দুকের ফাকা আওয়াজ দিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করব জন্যে সর্বপ্রকার চেষ্টা চালায়। এর ফলে উনিশজন আহত হন কিন্তু তাদের মধ্যে শওকত আলীর অবস্থাই ছিলাে সব থেকে গুরুতর। | লাঠিচার্জ শুরু হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্যদের মতাে শওকত আলীও দৌড়াতে থাকেন। এ সময় তার পেছনে একটি পাঞ্জাবী পুলিশও তাকে ধরার জন্যে তার পিছনে পিছনে দৌড়াতে শুরু করে। সে শওকত আলীর খুব নিকটেই ছিলাে এবং নিজের হাতের ডাণ্ডা দিয়ে তার শরীরে মাঝে মাঝে আঘাত করছিলাে। এইভাবে দৌড়তে দৌড়তে তিনি যখন মেডিকেল কলেজের গেটের (বর্তমান শহীদ মিনার) কাছে পৌছান তখন পুলিশটি তার পুরো হাতের উপর খুব ভোরে একটা লাঠির বাড়ি দেয় এবং তার ফলে শওকত আলী মুছিত হয়ে মাটির উপর পড়ে যান। এ সময়ে পলাশী ব্যারাকের কর্মচারীরাও সব কাছাকাছি ছিলেন। তারা নারায়ে তুকরি’ ধ্বনি তুলে তার দিকে এগিয়ে আসেন। পরে শওকত আলীকে সেখান থেকে তুলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিষদ ভবন ছাড়া মেডিকেল কলেজের গেটের সামনেও পুলিশ সেদিন কঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
এর পর ‘বলিয়াদী হাউসে’ নাজিমুদ্দীন-বিরােধী উপলীয় সদস্যদের একটি সভা বসে। সেখানে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ এবং শামসুদ্দীন আহমদ শওকত আলীর উপর পুলিশী আক্রমণের বিষয়ে তাদেরকে বিস্তারিতভাবে খবর দেন।২৩
রাত্রি সাড়ে এগারােটা থেকে সংগ্রাম পরিষদের একটি বৈঠক শুরু হয় এবং
তা দুটো পর্যন্ত চলে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে পুলিশী জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ৭ই মার্চ ধর্মঘট এবং সভা হবে, কিন্তু কোনাে মিছিল বের হবে না। ৪
১৭ই মার্চ ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মঘট পালিত হয়। এরপর বেলা ১২-৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র ফেডারেশনের কয়েকজন সদস্য সংগ্রাম কমিটিতে তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করায় সভাতে বেশ গণ্ডগােলের সৃষ্টি হয়। সভাতে সেদিন যারা বক্তৃতা দেন তাদের মধ্যে শামসুল হক অন্যতম। কায়েদে আজমের ঢাকা আগমন উপলক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে হরতাল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভা সেদিন শেষ হয় বেলা ২-৩৩ মিটিটে।
১৭ই মার্চ বিকেলে নঈমুদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন কমরুদ্দীন আহমদের বাসায় তার সাথে দেখা করতে যান। কমরুদ্দীন আহমদ একটি সভায় যােগদানের উদ্দেশ্যে পূর্বদিন সিরাজগঞ্জ চলে যাওয়ায় তার সাথে তাদের দেখা হয়নি। এর পর একটি রিকসা চড়ে ফজলুল হক হলের দিকে ফেরত আসার পথে তারা নাজিরাবাজারের ফুলতলা মেদের কাছাকাছি পৌছালে তিনটি বাসের মধ্যে সালেক, ইব্রাহিম প্রভৃতিকে তারা তাদের দলবলসহ সেখানে দেখতে পান এবং তারাও তাদের দু’জনকে হঠাৎ ঐ অবস্থায় দেখে আক্রমণ করে। ঘটনাচক্রে মতি সর্দারও সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তার সহায়তায় নঈমুদ্দীন আহমদৰা গুণ্ডাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পান।২৬
পূর্ব বাঙলা পরিষদের তৃতীয় দিনের অধিবেশন শান্ত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ঘােষণা করেন যে প্রাদেশিক সরকার তৎকালীন শিক্ষা নীতি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং নোতুন নীতিকে চূড়ান্ত রূপ দানের জন্যে তারা শিক্ষাবিদ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে উপযুক্তভাবে পরামর্শ করবেন। তিনি আরও ঘােষণা করেন যে এক বৎসরের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্সকে বাতিল করে তারা নােতুন অর্ডিন্যান্স প্রণয়ন করবেন।
১৭ই তারিখে পরিষদের অধিবেশন চলাকালে মুসলিম লীগ দলীয় একজন সদস্য দাবী করেন যে পরিষদে কাজকর্ম বাংলা ভাষাতে চালানাে উচিত। এর জবাবে স্পীকার আবদুল করিম বলেন যে ভাষার প্রশ্নটি পরিষদের দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে। তবে তার পূর্বে সদস্যেরা নিজেদের ইচ্ছেমতাে যে কোনাে ভাষায় বক্তৃতা দান করতে পারবেন।
১১ই মার্চের ছাত্র ধর্মঘটের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্যে যশােরে ১৪৪ ধারা জারী করা হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলন, বিক্ষোভ এবং তার সাথে প্রতিক্রিয়াশীলদের গুণ্ডামী সবকিছুই সেখানে অব্যাহত থাকে। শহরে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় বেশ কিছুসংখ্যক অবাঙালী মোহাজেরদের অবস্থানের ফলে। অবস্থা আরও জটিল আকার ধারণ করে। ১৮ই মার্চ এই অবাঙালী মােহাজের ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সন্ধ্যার দিকে রেলওয়ে স্টেশনে কিছু সংখ্যক নিরীহ লােকজনের উপর হামলা চালায়। এ বিষয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে নিম্নলিখিত পত্র দেন :
যশোর হইতে প্রাপ্ত বিভিন্ন রিপাের্ট এবং দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিরতি হইতে ইহা স্পষ্ট যে ১১ই মার্চ অর্থাৎ যে দিন হইতে ছাত্রের। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার উদ্দেশ্যে ধর্মঘট পালন করে সেই দিন হইতে যশাের শহরে ক্রমাগত অরাজকতা বিরক্ত করিতেছে। ইহা ১৮ই মার্চ চরম পর্যায়ে উপনীত হয়। খবরে প্রকাশ যে সেদিন বলসংখ্যক আলী মুসলমান লাঠি এবং অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইয়া শহরে প্রবেশ করে। পুলিশ তাহাদিগকে বাধা দান করিলেও তাহাদের মধ্যে কাউকে গ্রেতার করে না অথবা যে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তাহাদের নিকট ছিলাে তাহা কাড়িয়া নেয় না। ঐ একই দিনে বৈকাল প্রায় ছয়টার সময় তাহাদের একটি বিরাট দল রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত হইয়। নির্বিচারে বহু লােককে আক্রমণ করে। ইহার ফলে ১৬ ব্যক্তি আহত হইয়াছে বলিয়া খবর পাওয়া গিয়াছে। তাহাদের অধিকাংশই অমুসলমান। আরও জানা গিয়াছে যে ঐ এলাকার লােকজনদের মধ্যে হ্রাস সঞ্চারের উদ্দেশ্যে এই সব কাজ অবাঙালী মুসলমানরাই করিয়াছে এবং তাহার ফলে বহু হিন্দু নারী ও শিশু শহর পরিত্যাগ করিয়া যাইতেছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একজন অবাঙালী মুসলমান। বাংলা। ভাষা আন্দোলনের প্রতি তাহার কোনাে সহানুভূতি নাই এবং সেই হিসাবে তিনি এই সংঘর্ষে একটি বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন। অপরাণাদিসকে কঠিন শাস্তি প্রদান করা উচিত। এ ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত হক্ষেপ প্রয়োজন। য•ি দেখিতে পাওয়া যায় যে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট সত্যিই এই ঘটনার সহিত জড়িত তাহা হইলে তাহাকে অবিলম্বে বদলার ব্যবস্থা করা উচিৎ। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই পত্রটি তিনি নিজে ২৬শে মার্চ পূর্ব বাং? ‘দ
পাঠ করে শােনান। প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে তদন্ত করেছেন কিনা এবং কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন সে বিষয়েও তিনি তার কাছে জানতে চান।৩০
নাজিমুদ্দীন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রশ্নের জবাব দান কালে বলেন যে ১১ই তারিখ থেকে যশােরে অরাজকতা বিরাজ করার কথা বিরােধীদলের নেতা স্বীকার করেছেন। এই অরাজকতা কথা দুর করে সেখানে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে স্থানীয় অফিসাররা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তিনি আরও বলেন যে দুর্ভাগ্যবশতঃ ১৮ই তারিখে বিরাট সংখ্যক বিহারীরা যশাের শহরে প্রবেশ করে। পুলিশ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাদেরকে সরিয়ে নে এবং তারা চলে যায়। এর পর অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে রেলওয়ে স্টেশনের উপর তারা আক্রমণ করে বসে। এই লােকদের কেন গ্রেফতার করা হয় নি সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তদন্তের আশ্বাস দেন। এ ছাড়া তিনি বলেন যে ১৮ তারিখের পর যশােরে কোনাে ঘটনা ঘটেনি এবং অবস্থা সম্পূর্ণ আয়ত্বাধীন। কিন্তু এসব সত্বেও তাকে একথা স্বীকার করতে হয় যে যশোর শহরে তখনাে পর্যন্ত দারুণ ভয়ভীতি ও উত্তেজনা বিরাজ করছিলাে। তিনি এই ভীতি ও উত্তেজনা দূর করার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টারও আশ্বাস দেন।৩১ | ১৭ তারিখে রাত্রি নয়টার দিকে ফজলুল হক হলের হাউস টিউটর মাজহারুল হকের কামরায় সংগ্রাম কমিটির একটি বৈঠক বসে এবং তা প্রায় এগারােটা পর্যন্ত চলে।
পরদিন সকাল নয়টায় মাজহারুল হকের কামরায় পুনরায় সংগ্রাম কমিটির বৈঠক বসে। তাতে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কমিটির বক্তব্যের উপর একটি বিবৃতির খসড়া তৈরী করা হয়। এ ছাড়া সেই বৈঠকে কায়েদে আক্রমকে সম্বৰ্ধনা জ্ঞাপন করার উদ্দেশ্যে একটি ছাত্র সম্বর্ধনা কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেদিন বিকেলে ফজলুল হক হলে মহম্মদ তােয়াহার কামরায় তিনি এবং তাজউদ্দিন আহমদ ১৬ই মার্চের ঘটনাবলীর উপর একটি ব্যাখ্যামূলক বিবৃতির খসড়া প্রস্তুত করেন।৩৩
তৃতীয় পরিচ্ছেদ। পুর্ব বাঙলায় কায়েদে আজম
১। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে শহীদ সুহরাওয়াদী পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচনে নাজিমুদ্দীনের কাছে পরাজিত হন। এর পর নাজিমুদ্দীন যথারীতি ঢাকাতে পূর্ব বাউলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করে নিজের মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের নাম গভর্নরের কাছে পেশ করেন। এই মন্ত্রীসভাতে নাজিমুদ্দীন তার উপদলের বাইরের কোনাে মুসলিম লীগ সদস্যকে গ্রহণ করেননি। এর ফলে বিভাগ-পূর্ব কালের নাজিমুদ্দীনবিরোধী সদস্যের নোতুন পরিস্থিতিতে ও একটি উপদল হিসাবে কাজ করতে থাকেন। শুধু তাই না। তারা নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভার পতন ঘটানোর জন্যে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা সত্ত্বেও যথাসাধ্য চেষ্টা করে যান। | প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন এই উপদলটিকে যে শুধু মন্ত্রীসভার আসন থেকেই বঞ্চিত করেছিলেন তা নয়। তিনি এবং মৌলানা আকরাম খান অন্যান্যদের সহযােগিতায় তাদেরকে ও তাদের সমর্থকদেরকে মুসলিম লীগ সংগঠনের বাইরে রাখতেও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। ওয়ার্কাস ক্যাম্পের লােকজনদেরকে রশিদ বই দিতে অস্বীকৃতি এবং প্রদেশে ও জেলায় জেলায় নিজেদের ইচ্ছেমতো সাংগঠনিক কমিটি গঠন করাও তাদের এই কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিলাে।
খাজা নাজিমুদ্দীনের সুহরাওয়াদী ভীতির মতো আকরাম খানের ছিলো ভাসানী ভীতি। তিনি মনে করতেন মৌলানা ভাসানী প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে এলে তার সভাপতিত্ব রক্ষা করা দুঃসাধ্য হবে। এই চিন্তা থেকে তিনি সিলেট জেলা মুসলিম লীগ এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ উভয় ক্ষেত্রেই ইচ্ছেমতাে ভাঙাচোরা এবং রদবদল করেন। | বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়াকিং কমিটিকে ভেঙে দিয়ে সেই কমিটির পূর্ব বঙ্গীয় সদস্য এবং আসাম মুসলিম লীগ ওয়াকিং কমিটির সিলেটীয় সদস্যদের নিয়ে একটি নােতুন পূর্ব বাঙলা মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির প্রথম এবং একমাত্র বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ঢাকাতে। সে সময় দেখা যায় যে প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটিতে মৌলানা ভাসানী, মাহমুদ আলী,
দেওয়ান মহম্মদ আজরফ, দেওয়ান আবদুল বাসেত প্রভৃতি সহ প্রায় আটজন সিলেটের প্রতিনিধিত্ব করেন। ওয়ার্কিং কমিটিতে এদের উপস্থিতি আকর খানের পছন্দ না হওয়ায় তিনি সেই প্রাদেশিক কমিটিকে ভেঙে দেন। এর পর তিনি একটি নোতুন সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেন যার মধ্যে পূৰ্বোল্লিখিত পুরাতন সদস্যদের একজনকেও না রেখে মুনাওয়ার আলীকে সিলেটের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে মনােনীত করা হয়।
এই নােতুন কমিটিতে আকরাম খান এবং মুনাওয়ার আলী ব্যতীত অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, আবদুল্লাহেল বাকী, আহমদ হােসেন, আবদুল মােতালেব মালেক, নূরুল আমীন, আসাদউল্লাহ এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী। আকরাম খান এই কমিটির চেয়ারম্যান এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী ও আসাদউল্লাহ দুজনেই যৌথভাবে সেক্রেটারী মনােনীত হন। এই কমিটি গঠিত হয় কায়েদে আজমের পূর্ব বাঙলা সফরের পর। | সিলেট জেলা সাংগঠনিক কমিটির চেয়ারম্যান মনােনীত হন মাহমুদ আলী। ১৯৪৮-৪৯ সালের মধ্যে তারা ব্যাপকভাবে মুসলিম লীগের সদস্য সংগ্রহ করেন। সিলেট লীগের এই উদ্যোগে আশান্বিত হয়ে আকরাম খান বেআইনীভাবে কতকগুলি অপ্রাসঙ্গিক কারণ দেখিয়ে তাদের খেলা সাংগঠনিক কমিটিকেও ভেঙে দেন এবং মামুদ আলীকে বাদ দিয়ে নােতুনভাবে অন্য একটি কমিটি গঠন করেন। | নোতুন প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটিতে সুহরাওয়াদী সমর্থক ডক্টর মালেক এবং আহমদ হােসেনকে রাখলেও জেলা সাংগঠনিক কমিটি গুলির উপর নিজেদের পূর্ণ কতৃত্ব রাখার ফলে মুসলিম লীগের দরজা পূর্ববর্তী সুহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম সমর্থক উপদলীয় লােকদের জন্যে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আকরাম খানের সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী পরবর্তী সময়ে স্বীকার করেন যে আকরাম খান সুহরাওয়ার্দী গ্রুপের লােকজনদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে তাদের প্রতি অবিচার করেছিলেন। কিন্তু তিনি আবার একথাও বলেন যে তারা অর্থাৎ নাজিমুদ্দীন-আকরাম খান উপদলের লােকেরা, সে কাজ করেছিলেন অনেকটা প্রতিহিদসামূলক ভাবে। সুহরাওয়ার্দী দেশভাগের পূর্বে যখন মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা গঠন করেন তখন তিনি নিজেদের উপদলের বাইরে কাউকে তাতে স্থান দেননি। কাজেই পূর্ব বাঙলায় নােতুন মন্ত্রীসভা গঠনকালে নাজিমুদ্দীন সুহরাওয়াদী অনুসৃত পথ
১০০
ধরেই তাঁর নিজের উপদলের মধ্যে থেকেই মন্ত্রীসভার প্রতিটি সদস্য নির্বাচন করেছিলেন। আকরাম খানেরও এ ব্যাপারে উদ্বেগ কম ছিলাে না। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মধ্যে আবুল হাশিমের সাংগঠনিক দক্ষতা ও তৎপরতার ফলে আকরাম খান সংগঠনগতভাবে সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা হয়েছিলেন। মৌলানা ভাসানীকে পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজের সাথে যুক্ত করে তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি হতে দিতে নিতান্তই নারাজ ছিলেন। কাজেই সে সম্ভাবনাকে রােধ করার জন্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের ক্ষেত্রে তিনি কোনাে ত্রুটি রাখেননি। | মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পাটি এবং মুসলিম লীগ সংগঠনের মধ্যে এই উপদলীয় কার্যকলাপের প্রভাব থেকে ছাত্র রাজনীতি মুক্ত ছিলাে না। দেশ ভাগের পূর্বে মুসলিম ছাত্র লীগের মধ্যে আবুল হাশিম ও নাজিমুদ্দীনের সমর্থকরা দুই উপদলে বিভক্ত ছিলেন। সে সময় সুহরাওয়ার্দীর থেকে আবুল হাশিমের প্রভাবই ছাত্রদের মধ্যে অনেক বেশী শক্তিশালী ছিলাে। কিন্তু দেশভাগের পর আবুল হাশিম বর্ধমানে থেকে যাওয়ায় তার সমর্থক ছাত্রদের একটি প্রভাবশালী অংশ সুহরাওয়ার্দী সমর্থক পূর্ব বাউলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী উপদলের সাথে যুক্ত হয় এবং অন্য একটি অংশ বামপন্থী রাজনীতির সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথম দলের মধ্যে শেখ মুজিবর রহমান, শওকত আলী, নূরুদ্দীন আহমদ, সালেহ আহমদ, মােয়াজ্জেম হােসেন প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। দ্বিতীয় দলের মধ্যে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলী আহাদ প্রভৃতি। ছাত্রদের যে উপলটি নজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করতাে তার মধ্যে শাহ আজিজুর রহমান, আনােয়ার হােসেন প্রমুখ ছিলেন নেতৃস্থানীয় ।
ছাত্র লীগের উপরােল্লিখিত উপদলগুলির মধ্যে শেখ মুজিবর রহমানের উপদলের সাথেই মুসলিম লীগ পালামেন্টারী পার্টির সুহরাওয়াল সমর্থক উপদলের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ সংযােগের ফলে তারা একযােগে কিছু কিছু কাজ করেন। এবং তার ফলে পালমেন্টারী উপদলটির সুবিধাবাদী রাজনীতির পথই প্রশস্ত হয়। খাদ্য আন্দোলন এবং ভাষা আন্দোলনের সময় অবশ্য আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী ছাত্রদের সাথে সাধারণভাবে মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী প্রমুখ উপদলীয় নেতাদের একটা কার্যকরী সম্পর্ক কিছুদিনের জন্যে স্থাপিত হয় এবং তারা অনেকে তাদের উপদলীয় বৈঠকেও মাঝে মাঝে যােগদান করেন।১০
২৩শে ডিসেম্বর, ১৯৪৭ বেলা ৩-৩০ মিনিটে ‘বলিয়াদী হাউসে’ পালামেন্টারী উপদলের এই জাতীয় একটি বৈঠক হয়। এতে পার্লামেন্টারী পার্টির বাইরের অনেক কর্মীও উপস্থিত থাকেন : মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী, ডক্টর মালেক প্রভৃতি ব্যবস্থাপক সভার ১৬ জন সদস্য ব্যতীত অন্য যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবর রহমান, শওকত আলী, শামসুজ্জোহা, আসলাম, আবদুল আউয়াল, আজিজ আহমদ, মহিউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, কফিলউদ্দীন চৌধুরী, কাদের সর্দার এবং মতি সর্দারের নাম উল্লেখযোগ্য।
পরদিন মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভাতে খাদ্য সমস্যা, পাট সমস্যা, ইত্তেহাদ, মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী প্রভৃতিদের মাইনে ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনার সিদ্ধান্ত হয়। নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীত্ব অপসারণের সম্ভাবনার প্রশ্নও এই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত থাকে এবং সেই প্রসঙ্গে বিকল্প মন্ত্রীত্ব র নেতৃত্বে গঠিত হবে কর্মীরা তাঁর নাম জানতে চান। পার্লামেন্টারী পার্টির নেতারা এই প্রশ্নের জবাব পরবর্তী সােমবার অর্থাৎ ২২শে ডিসেম্বর সঠিকভাবে তাদেরকে জানাতে পারবেন এই মর্মে আশ্বাস দেন।১২
বৈঠকটি রাত্রি ৮টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এর পর একটি মােটরগাড়িতে চড়ে তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী, মুজিবর রহমান এবং মহিউদ্দীন পলাশী ব্যারাক, সলিমুল্লাহ হল, নীলক্ষেত ব্যারাক, ফজলুল হক হল, ইভিনিয়ারিং হােস্টেল এবং নিমতলী মেসে ‘ইত্তেহাদ’ কাগজ বিতরণ করেন।১৩ ‘ইত্তেহাদ’ এই সময় নাজিমুদ্দীন বিরোধী উপদলটিকে সমর্থন এবং বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে পূর্ব বাঙলা মন্ত্রীসভার নিষ্ক্রিয়তার সমালােচনা করতো। এ জন্যে তখন ইভেহাদকে সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সময় লোক মারফৎ বড় বড় প্যাকেটে নিয়মিতভাবে ইত্তেহাদ ঢাকাতে আসতো এবং ছাত্রেরা তা মাঝে মাঝে বিতরণ করতেন।১৪ ‘ ২১শে ডিসেম্বর সকালে নাজিমুদ্দীনের সভাপতিত্বে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির প্রথম বৈঠক বসে। এতে ১১৬ জনের মধ্যে মন্ত্রীসহ ৮ জন সদস্য উপস্থিত থাকেন। স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচনের জন্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার বৈঠক আহ্বান করার জন্যে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিকেল ৪টা থেকে পার্লামেন্টারী পার্টির দ্বিতীয় দফা বৈঠক শুরু হয় এবং বরিশালের মহিউদ্দীন আহমদ নয়।
সেই বৈঠক চলাকালে অসদস্য কিছুসংখ্যক ছাত্র, কর্মী এবং নেতারাও উপস্থিত থাকেন। এদের মধ্যে কমরুদীন আহমদ, মুজিবর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ শওকত আলী, অলী আহাদ পভৃতির নাম উল্লেখযোেগ্য : খাদ্য সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনাকালে এই সময় মন্ত্রীত্ববিরোধী মনােভাব চরমভাবে ব্যক্ত হয়। কনট্রোল এবং কর্ডন প্রথা তুলে নেওয়ার জন্যে বিরোধীপক্ষয়েরা দারুণভাবে চাপ দিতে থাকেন এবং এ নিয়ে ভােটাভুটির কথাও ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের খাদ্য মন্ত্রীর আসন্ন সরুর পর্যন্ত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে সকলে একমন হন।১৬ | এর পরদিন সকাল ৯টায় স্টপদলীম পরিষদ সদস্যের ত জল আলীর জয়নাগ রোডস্থ বাসাতে নিকেদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে একটি আলােচনা সভায় মিলিত হন। এই সভার সিদ্ধান্ত মতো ডক্টর মালেক শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে ঢাকাতে এসে তাদের দলের নেতৃত্ব ‘ণ এবং নাজিমুদ্দন মীসভাকে অপসারণের ক্ষয়ে মামন্ত্রণ জানানোর উদ্দেশে কলকাত’ যান।১৮
কর মালেক হরাওয়ার্দীকে বলেন যে তিনি য*ি *কস্তান আসতে ইচ্ছে করেন তাহলে পনই তার উপযুক্ত সময় কারণ তৎকালীন অবস্থা তাঁদের পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল। সংঃ ওয়া সমস্ত কথা শোনার পরও ঢাকা আসতে সম্মত হলেন না। তিনি ইতিপূর্বে পূর্ব বাংলায় না সব সিদ্ধান্ত নেওয়াই এর কারণ। সুহরাওয়ার্দীর সাথে এই আলোচনাকালে ডক্টর মালেকের সাথে নওগাঁয়ের পরিসন সদস্য সিরাজুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। উপলীয় পালমেন্টারী পার্টি নেতৃত্বের প্রসঙ্গে সুহরাওয়া। তাদের নিজেদের মধ্যেই। একজনকে নেতা নির্বাচন করে নেওয়ার পরামর্শ দেন।১৯।
কলকাতা থেকে ঘুরে এসে ডক্টর মালেক মহম্মদ আলী এবং তঞ্চল আলীকে সুহরা ওম্মাদীর সাথে তার আলাপের বিষয়ে জানালে তারা উভয়েই তাকে পুরােপুরি বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন। পরে সিরাজুল ইসলামও। ডক্টর মালেকের কথা সঠিক বলে তাদেরকে জানালে তারা শেষ পর্যন্ত সুহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব সম্পর্কে আশা ত্যাগ করেন। মহম্মদ আলী এ ব্যাপারে ঢাকা থেকে সুহরাওয়ার্দীর সাথে টেলিফোনেও আলাপ করেছিলেন।২০।
সুহরাওয়াদী প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর নেতা নির্বাচন উপদলটির পক্ষে এক বিরাট সমস্যার আকারে দেখা দিল। মহম্মদ আলী, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া) প্রভৃতির কথা বিবেচিত হলেও এদের মধ্যে কারাে প্রতি সকলের তেমন আস্থা ছিলাে না। পার্লামেন্টারী পার্টির মধ্যে তখন ফজলুল হকের
সমর্থক ছিলেন মাত্র চার পাঁচজন : কাজেই সেদিক থেকে তাকে নির্বাচন করারও অসুবিধে ছিলাে।
সুহরাওয়াদীর ঢাকা না আসার সিদ্ধান্ত, নেতা নির্বাচনে অক্ষমতা ইত্যাদির পর পালামেন্টারী উপদলটির নেতৃবৃন্দ নাজিমুদ্দীন মন্ত্রীসভাকে অপসারণের চিন্তা বর্জন করে তার উপর চাপ দিয়ে একটা আপােষরকায় উপনীত হওয়ার জন্যে তৈরী হন এবং সর্বতোভাবে সেই চেষ্টা করতে থাকেন। ভাষা আন্দোলনকে তারা এই উদেশ্যেই ব্যবহারের চেষ্টা করেন।
এর পর থেকে নাজিমুদ্দীনের বিরুদ্ধে উপলীয় রাজনীতিতে সস্ক্রিয় থাকলেও মহম্মদ আলী, তফজ্জল আলী প্রভৃতি নেতারা কায়েদে আজমের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকতেন এবং নাজিমুদ্দীনও তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে কায়েদে আজমের কাছে নিয়মিতভাবে অভিযােগ উপস্থিত করতেন। প্রথম পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠকের পর তাদের বিরুদ্ধতার কথা জানিয়ে নাজিমুদ্দীন কায়েদে আজম এবং লিয়াকত আলীর সাথে ঢাকা থেকে টেলিফোনযােগে আলাপও করেন।
ভাষা আন্দোলন ভালােভাবে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করার পূর্ব পর্যন্ত উপদলীয় নেতারা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্র এবং অন্যান্য কর্মীদের সাথে যােগাযােগের জন্যে মাঝে মাঝে সফর করতেন। এই উদ্দেশ্যে রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের দ্বারা একবার আমন্ত্রিত হয়ে নঈমুদ্দন আহমদ এবং তজ্জল আলী ৩১শে জানুয়ারি সেখানে পৌছান। রাশাহীতে ইতিপূর্বেই ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছিলো। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী হত্যার পর শোকসভা অনুষ্ঠানের জন্য ১৪৪ ধারা তুলে নেওয়ায় তক্রল আলী এবং অন্যান্যের ভুবনমােহন পার্কে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে সমর্থ হন।
এর পরই নরসিংদীতে পুরানাে কিছু কৃষক কর্মীরা একটি সভার আয়োজন করেছিলেন এবং সেই সভায় মহম্মদ আলীর সভাপতিত্ব করার এবং ডক্টর মালেক, তফজ্জল আলী, কমরুদ্দীন আহমদ প্রমুখ কয়েকজনের বক্তৃতা দানের কথা ছিলাে : নিধারিত দিনে সকাল দশটার সময় অর্থাৎ ট্রেন ছাড়ার কিছু পূর্বে মহম্মদ আলী নরসিংদী না যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে কমরুদ্দীন আহমদকে খবর দেন। এর কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে কায়েদে আজমের কাছে এই মর্মে অভিযােগ করা হয়েছে যে তারা জমিদারী উচ্ছেদের জন্যে আন্দোলন করছেন এবং কায়েদে আজম এ জাতীয় কর্মসূচীকে রাষ্ট্রদ্রোহী বিবেচনা করায় তার পক্ষে কৃষক সভাটিতে যাওয়া আর সম্ভব নয়।২৪
তফজ্জল আলী বলেন যে মহম্মদ আলীর সিদ্ধান্ত জানার পরও তিনি নরসিংদী যাওয়ার কর্মসূচী পরিবর্তন না করে পূর্ব কথামতো সেখানে যান এবং যথারীতি বক্তৃতা করেন। কিন্তু কমরুদ্দীন আহমদ এ প্রসঙ্গে বলেন যে নরসিংদী পৌছাবার পূর্বে মহম্মদ আলীর মত পরিবর্তনের বিষয়ে তফল আলা কিছু জানতেন না। সেখানে উপস্থিত হয়েই তিনি তার কাছে সেকথা জানতে পারেন এবং ভীতিবশতঃ সভায় কোনাে বক্তৃতা দিতে অস্বীকার করেন।৬
নাজিমুদ্দীন-বিরোধী উপটির মূল সমস্যা ছিলাে এই যে রাতিগতভাবে তাদের কোনাে পৃথক সত্তা না থাকায় মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করার কোনাে ক্ষমতা তাদের ছিলাে না। এবং মুসলিম লীগের মধ্যে নাজিমুদ্দীন কায়েদে আজমের প্রিয় পাত্র থাশয় উপদলীয় রাজনীতিতেও তাঁদের বিশেষ কোনাে ভবিষ্যৎ তারা দেখেননি। সুহরাওয়ার্দীর অবর্তমানে এই পরিস্থিতি রীতিমতাে ঘােরালাে আকার ধারণ করে। এই অবস্থাতে আপােষের পথকেই তারা বেছে নেন এবং মন্ত্রীসভার স্থান লাভ এবং অন্যান্য উপযােগী চাকরির জন্যে নাজিমুদ্দীনের উপর উপদলীয় চাপ প্রয়ােগ করতে থাকেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় তারা নাজিমুদ্দীনকে ক্রমাগত বলেন যে আন্দোলন তঁাদের নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে কাজেই তাদের সাথে একটা উপযুক্ত মীমাংসায় উপনীত না হলে আন্দোলন থামার কোনাে সম্ভাবনা নেই। তাদের এই দাবীকে নাজিমুদ্দীন কায়েদে আজমের কাছে মুসলিম লীগ ও রাষ্ট্রবিরােধী কাযকলাপ বলে প্রমাণের চেষ্টা করলেও পরিশেষে তিনিও তার সাথে একটা অপােষ রক্ষা করে গণ্ডগােলের হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের চেষ্টা করেন।
ভাষা আন্দোলন চলাকালে ১৩ই মার্ট খাক্তা নসরুল্লাহর বাড়ি ‘দিলখুশায় উভয়পক্ষের আপােষ মীমাংসার জন্যে একটি আলােচনা বৈঠক বসে। তাতে মন্ত্র সভার পক্ষে উপস্থিত থাকেন নাজিমুদ্দীন একা। অন্যপক্ষে থাকেন মহম্মদ আলী, তজ্জল আলী, এবং ডক্টর মালেক। এই বৈঠকে নাজিমুদ্দীনের সাথে উপদলীয় নেতাদের একটা মিটমাটের কথা হয়। কিন্তু নাজিমুদ্দীনকে তারা বলেন যে আপােষ মীমাংসাকে পুরোপুরিভাবে কার্যকরী করতে হলে ছাত্রদেরকে
বাড়িটি এখন ভেঙে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে যে স্থানে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বিল্ডিং প্রাচী হােটেল ইত্যাদি আছে দিলখুশা সেখানেই অবস্থিত ছিলাে। বাড়িটির সমগ্র কম্পাউণ্ডের নাম ছিলাে মতিঝিল। বর্তমান মতিঝিল এলাকার নামের উৎপত্তি সেখান থেকে।
জেল থেকে মুক্তিদান এবং ভাষার দাবীকে স্বীকৃতি দিতে হবে। নাজিমুদ্দীন মােটামুটিভাবে তাতে সম্মত হলেও এ বিষয়ে কোনাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সেদিন সম্ভব হয়নি।২৭ | এই আপােষ আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতেই তফজ্জল আলী পরদিন সকালে তার বাড়িতে ভােয়াহা এবং তাজউদ্দীন আহমদকে বলেন যে তারা অর্থাৎ ছাত্রেরা খুব সম্ভবতঃ দুইজন মন্ত্রী এবং এবং একজন রাষ্ট্রদূত পাচ্ছেন। তজ্জল আলীর এই উক্তিতে ছাত্রদের মধ্যে দারুণ বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং তারা সংগ্রাম পরিষদের থেকে আনােয়ারা খাতুন এম. এল. এ.-কে সেদিনই লুল হক হলে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন এব’ ১৫ই তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ সভায় তা কার্যকরী করেন। এ ছাড়া ১ তারিখেই তারা বেশ কয়েকজন দিলখুশাতে গিয়ে পালামেন্টারী নেতাদের আপােষ মীমাংসা এবং সুবিধাবাদীত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ছাত্রদের এই অবস্থা দেখে মহম্মদ আলী এবং অন্যান্য নেতারা তাদেরকে আশ্বাস দেন যে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য তারা নাজিমুদ্দীনের সাথে কোনো অপােষের মধ্যে যাবেন না।
| নাজিমুনের সাথে ১৩ই মার্চর আলোচনা সত্ত্বেও উপদলীয় নেতারা তঙ্কল আলীকে স্পকার পদে মনোননের জন্যে পার্লামেন্টারী পার্টিতে দাড় করাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১১ই মার্চ বিকেল ৩.৩০ মিনিটে ‘বমান হাউসে পালামেন্টারী পার্টির সভা শু হলে সেখানে তাবদুল করিম এবং ‘ত? সল আলীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। আবদুল করিম প্রায় বিশ-পচিশ ভোটের ব্যবধানে তফজ্জল আলীকে পরাজিত করে পরদিন স্পকার পদে নির্বাচনের জন্যে মুসলিম লীগ পালামেন্টারী পার্টি কর্তৃক মনোনীত হন। সেদিনের সভায় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা হয় এবং আলােচনা চলার সময় রাত্রি প্রায় ৯টা পর্যন্ত ছাত্রের। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, পার্লামেন্টারি পার্টির মধ্যে উপদলীয় কার্যকলাপ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাদেশিক সরকার পূর্ব বাঙলায় কায়েদে আজমের উপস্থিতি প্রয়ােজনীয় মনে করেন এবং তাকে যথাশীঘ্র পূর্ব বাঙলা আগমনের জন্যে আমন্ত্রণ জানান। কিছুদিন থেকেই কায়েদে আজমের এই সফরের কথা। আলােচিত হচ্ছিলাে কিন্তু এবার তাড়াতাড়ি তার সঠিক তারিখ নির্ধারণ করে। ১৯শে মার্চ তার ঢাকা আগমনের কথা ঘােষণা করা হলাে।
২। কায়েদে আজমের ঢাকা আগমন ও রেসকোর্সের বক্তৃতা
১৯শে মার্চ বিকেলে কায়েদে আজম তেজগা বিমান বন্দরে পৌঁছান। হাজার হাজার লােক তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বিমানবন্দরে সমবেত হয় এবং অসংখ্য লোেক রেসকোর্সের ময়দান থেকে তেজগাঁ পর্যন্ত পথের দুই * শে দুই পাশে তার দর্শন লাভের উদ্দেশে অপেক্ষা করতে থাকে।
| কিন্তু কায়েদে আজম রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দেখে পার্শ্ববর্তী জনতা ,কানাে ধ্বনি দেয় না। ছাত্রদের অনেকের মধ্যে তার এই সফরের বিষয়ে কিছুট। উৎসাহের অভাবও দেখা যায়। ভাষা আন্দোলনকালে পুলিশ অত্যাচারই তার প্রধান কারণ ছিলাে।
বিমান বন্দরের পথে এবং শহরের মধ্যে কায়েদে আজমের আগমন উপলক্ষ্যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এবং সিরাজউদ্দৌলা, মীরমদন, মোহনলাল প্রভৃতির নামে তোরণ প্রস্তুত করে সেগুলিকে নানাভাবে সুসজ্জিত করা হয়। কিন্তু সেনি বিল দিকে বৃষ্টিপাতের ফলে সেগুলি অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়। কয়েলে আজমের গানে সন্ধ্যার পর শহরে বিস্তৃত আলোকসজ্জা এবং অধিক রাত্রি পর্যন্ত বাজি পােড়ানোর ব্যবস্থা হয়।
২১শে মার্চ ঢাকাব নাগরিকেরা রেসকোর্সের ময়দানে কয়েলে আমকে সমর্ধনা জ্ঞাপনের মনে করেন। ৫-১৫ মিনিটে কাকে আমি উপস্থিত হওয়ার পর সম্বর্ধনা কমিটির সভাপতি নবাব হাবিবুল্লাহ একটি মানপত্র পাঠ করেন। এর পর কায়েদে আজমেব বক্তৃতা শুরু হয়। প্রায় এক ঘণ্টাকাল বক্তৃতার মধ্যে ভাষার প্রশ্ন এবং ভাষা অন্দোলন সম্পর্কে *** নানা বউ ব্য তিনি সুস্পষ্ট ভাষার ব্যক্ত করেন। | ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য এব” আন্দোলনকারীদের চরিত্র সম্পর্কে শ্ৰোতৃমণ্ডলীকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন : কিন্তু আমি একথা আপনাদের বলতে চাই যে আমাদের মধ্যে নানা বিদেশী এজেন্সীর অর্থ সাহায্যপুষ্ট কিছু লোক আছে যারা আমাদের সংহতি বিনষ্ট করতে বদ্ধপরিকর। তাদের উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানকে ধ্বংস করা। আপনারা সাবধান হয়ে চলুন আমি তাই চাই ; আমি চাই আপনারা সতর্ক থাকুন এবং আকর্ষণীয় শ্লোগান ও বুলির দ্বারা বিভ্রান্ত না হন। তারা বলছে যে পাকিস্তান ও পূর্ব বাঙলা সরকার সর্বতোভাবে আপনাদের ভাষাকে ধ্বংস করতে চায়। মানুষের পক্ষে এর থেকে বড় মিথ্যা ভাষণ আর কিছু হতে পারে না। সােজাসুজিভাবে আমি একথা আপনাদেরকে
বলতে চাই যে আপনাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক কমিউনিস্ট এবং বিদেশীদের সাহায্যপ্রাপ্ত এজেন্ট আছে এবং এদের সম্পর্কে সাবধান না হলে আপনারা বিপদগ্রস্থ হবেন। পূর্ব বাঙলাকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা তারা পরিত্যাগ করেনি এবং এখনাে পর্যন্ত সেটাই তাদের লক্ষ্য। পাকিস্তানে ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার বিরােধিতা করতে গিয়ে তিনি বলেন :
পাকিস্তান এবং বিশেষ করে আপনাদের প্রদেশ এখন পর্যন্ত যে সমস্ত বিপদের সম্মুখীন সে সম্পর্কে আবার আমি সুস্পষ্ট ভাষায় আপনাদের সাবধান করে দিতে চাই পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করতে না পেরে, পরাজয়ের দ্বারা বাধাগ্রস্থ ও হতাশ হয়ে পাকিস্তানের শত্রুরা এখন পাকিস্তানী মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির দ্বারা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার দিকে মনােযােগ দিয়েছে। প্রাদেশিকতার উস্কানী দানের মাধ্যমেই তাদের এই প্রচেষ্টাকে তারা অব্যাহত রেখেছে। যে পর্যন্ত না এই বিষকে আপনারা রাজনীতি থেকে বর্জন করছেন, সে পর্যন্ত আপনারা নিজেদেরকে একটা সত্যিকার জাতি হিসাবে গঠন করতে সক্ষম হবেন না। আমরা বাঙালী, পাঞ্জাবী সিন্ধী, বেলুচী, পাঠান ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। ইউনিট হিসাবে সেগুলির অবশ্য একটা অস্তিত্ব আছে। কিন্তু আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করি : চৌদ্দশাে বছর পূর্বে আমাদেরকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিলাে আমরা কি তা ভুলে গেছি ? আমার মতাে আপনারা সকলেই এখানে বহিরাগত। বাংলা দেশের আদি অধিবাসী কারা? যারা এখন এদেশে বাস করছে তার। নয়। কাজেই আমরা বাঙালী বা সিন্ধী বা পাঠান বা পাঞ্জাবী’ একথা বলার প্রয়ােজন কি। না, আসলে আমরা সকলেই হলাম মুসলমান।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যে পূর্ব বাঙলার জনসাধারণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত একথা অস্বীকার করে তিনি মন্তব্য করেন :
একথা আমি পূর্বেই বলেছি যে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ভাষার প্রশ্ন তােলা হয়েছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রীও একটি সদ্য প্রকাশিত বিবৃতিতে যথার্থভাবেই একথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর সরকার এদেশের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য রাজনৈতিক অন্তর্ঘাতক অথবা তাদের এজেন্টদের যে কোনো চেষ্টাকে কঠিনভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমি খুশী হয়েছি। বাংলা এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হবে ক্লিা সেটা এই
প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা স্থির করবেন। আমার কোনাে সন্দেহ নেই যে যথাসময়ে এই প্রদেশের অধিবাসীদের ইচ্ছানুসারেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে। উদুকে রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি দেওয়ার চেষ্টায় তিনি বলেন : আমি সুস্পষ্ট ভাষায় আপনাদেরকে জানাতে চাই যে আপনাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে কোনাে রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হবে এ কথার মধ্যে কোনাে সত্যতা নেই। কিন্তু আপনার, এই প্রদেশের অধিবাসীরাই, চুড়ান্তভাবে স্থির করবেন আপনাদের প্রদেশের ভাষা কি হবে। কিন্তু একথা আপনাদেরকে পরিস্কারভাবে বলে vেওয়া দরকার যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উই, অন্য কোনো ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনাদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু। একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা ছাড়া কোনো জাতিই এক সূত্রে গ্রথিত হয়ে কার্যনির্বাহ করতে পারে না। অন্য দেশের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। অতএব, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উহু। কিন্তু আমি পূর্বেই বলেছি, এ প্রসঙ্গ পরে আসবে।
কায়েদে আজম জিন্নাহর উপরোক্ত বক্তব্যের অর্থ এই পাড়ায় যে পূর্ব বাংলার সরকারী ভাষা বাংলা হবে কিনা সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। বাংলা অথবা উদু যাই হােক সেটা তারা নিজেরাই স্থির করতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষকে কোনাে স্বাধীনতা দেওয়া যেতে পারে না। শুধু তাই নয়, সে স্বাধীনতা যদি কেউ দাবী করে তাহলে সে নিশ্চিতভাবে রাষ্ট্রের শত্রু। কাজেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার তিনি পূর্ব বাংলার, এমনকি সারা পাকিস্তানের অনসাধারণের উপর ছেড়ে না দিয়ে সে দায়িত্ব নিজেই ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেছিলেন। এবং তার সেই সিদ্ধান্তের কেউ বিরোধিতা করলে তাকে তিনি ধরে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহীতা ও অন্তর্ঘাতী গৃহশত্রুতার শামিল বলে। এজন্যে উর্দু ভাষা সম্পর্কে উপরােক্ত বক্তব্যের পরই তিনি আবার ঘােষণা করেন :
আমি আবার আপনাদেরকে বলছি, রাষ্ট্রের দুষমনদের ফাদে পড়বেন না। দুর্ভাগ্যবশতঃ আপনাদের মধ্যে ঘরােয়া শত্রুরা আছে এবং আমাকে দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে তারা বাইরের থেকে অর্থ সাহায্যপ্রাপ্ত মুসলমান। কিন্তু তারা একটা মস্ত ভুল করছে। আমরা ভবিষ্যতে অন্তর্ঘাতকদেরকে আর কিছুতেই সহ্য করবে না। আমরা আমাদের রাষ্ট্রে বিশ্বাসঘাতক
ঘােয় শত্রুদেরকে সই করবে না। এসব যদি যা করা না হয় তাহলে আমি নিশ্চিত যে আপনাদের সরকার এবং পাকিস্তান সরকার এই বিষাক্ত শক্তিকে নির্দয়ভাবে দমন করার জন্য কঠিনতম ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।”
এর পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন করে বলেন যে মুসলীম লীগই শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও পাকিস্তান হাসিল করেছে কাজেই সকলেরই মুসলিম লীগে যােগদান করা উচিত। অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাকে ধ্বংসাত্মক হিসাবে বর্ণনা করে মুসলীম লীগ বিরােধীদেরকে তিনি রাষ্ট্রের শত্রু হিসাবে চিত্রিত করেন। এই প্রসঙ্গে রেস কোর্সের বক্তৃতায় তিনি কতকগুলি শ্লোগান দেন :
মুসলিম লীগ অ’নাদের হাতে একটি পবিত্র আমানতের মতাে। এই পবিত্র আমানতকে আমাদের দেশের ও জনগণের কল্যাণের জিম্মাদার হিসাবে আমরা রক্ষা করবাে, না রক্ষা করবাে না? আমরা যা অর্জন করেছি তাকে ধংস করা অথবা আমরা যা লাভ করেছি তা দখল করার উদ্দেশ্যে যাদের অতীত সন্দেহাতীত নয় এ জাতীয় লােকদের নেতৃত্বে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দল কি খাড়া করতে দেওয়া হবে? এই প্রশ্ন আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করছি। আপনারা কি পাকিস্তানে বিশ্বাস করেন ? (হ্যা, হ্যা বলে চীংকার) পাকিস্তান অর্জন করে কি আপনারা সুখী হয়েছেন? (হা, ই, বলে চীৎকার) পূর্ব বাঙলা অথবা পাকিস্তানের অন্য কোনাে অংশ ভারতীয় ইউনিয়নে চলে যাক এটা কি আপনারা চান ? (না, না) আপনারা যদি পাকিস্তানের খেদমত করতে চান, যদি আপনারা পাকিস্তানকে গঠন করতে চান, যদি আপনারা পাকিস্তানের সংস্কার করতে চান তাহলে আমি বলবাে যে প্রতিটি মুসলমানের সামনে একটিমাত্র সৎ পথই খােলা আছে তা হলাে মুসলিম লীগে যােগদান করে নিজের , সাধ্যমতাে পাকিস্তানের খেদমত করা। কোনাে রকম বিদ্বেষ অথবা শুভেচ্ছার অভাবের জন্যে নয়, তাদের অতীত কার্যকলাপের জন্যেই ব্যাঙের ছাতার মতো যে পার্টি গুলি গজিয়ে উঠছে সেগুলিকে সন্দেহের চোখে দেখা হবে।১০
কায়েদে আজম জিন্নাহ খুব সম্ভবত: ঢাকা এবং যশােরের বাঙালী-অবাঙালী উত্তেজনা ও সংঘর্ষ এবং পার্লামেন্টারী রাজনীতিকদের সুবিধাবাদীত্বের উল্লেখ করে তার বক্তৃতার এক পর্যায়ে বলেন :
আমাকে জানানাে হয়েছে যে এই প্রদেশের কোনাে কোনাে অংশে
অবাঙালী মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটা মনােভাব বর্তমান আছে। এই প্রদেশের এবং পাকিস্তা। রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি হয়ে। এ সম্পর্কে আমি শুনেছি যে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা প্রশাসনকে বিব্রত করার উদ্দেশে ছাত্র সম্প্রদায়কে ব্যবহার করেছে।
কায়েদে আজমের বক্তৃতায় ভাষা সম্পর্কে তার বিবিধ মন্তব্য এবং আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ঘন ন সতর্ক ও সাবধান বাণী উচ্চারণ করার সময় মাঝে মাকে শ্রোতাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু কিছু বিক্ষুব্ধ কথা বার্তা শােনা যায়।১২ ময়দানের কোনো কোনাে এলাকায় উদুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে একথা শােনার পর মৃদু ‘না, না’ ধ্বনি উখিত হয়। কিন্তু মােটামুটিভাবে সেই বিরাট জনসমুদ্র শান্তভাবেই কায়েদে আজমের বক্তৃতা শােনে। | মুসলিম লীগ ও উদুর স্বপক্ষে মতামত ব্যক্ত করার ফলে ছাত্র সমাজ, এমনকি জনসাধারণের ও একাংশ কায়েদে আজমের বিরুদ্ধে কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তার অাশা করেছিলাে যে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান এবং পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা হিসাবে নাজিমুদ্দীন সরকারের আন্দোলনকালীন নির্যাতনমূলক কার্যকলাপকে সমর্থন করবেন না। কিন্তু কায়েদে আজম সে রকম কোনো নিরপেক্ষতা রক্ষা না করে সােজাসুজি আন্দোলনকারীদেরকে অন্তর্ঘাতক, রাষ্ট্রশত্রু, দেশদ্রোহী ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করে তাদের উপর অত্যাচারকে সমর্থন এবং ভবিষ্যতেও তাদেরকে কঠোরতম শাস্তি দানের বথা ঘােষণা করায় অনেকেই খােলাখুলিভাবে তার সমালােচনায় মুখর হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় কোনাে কোনাে স্থানে তার সম্মানে নির্মিত গেট আকভাবে ভেঙ্গে দিয়ে এবং তার ছবি ছিড়ে তারা তার বিবিধ মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।১৫।
প্রথম অবস্থায় মনে হয়েছিলাে যে উছু সমর্থক ছাত্রেরা বিভিন্ন হলের মধ্যে কায়েদে আজমের বক্তৃতার সুযােগ নিয়ে হয়তাে মারপিট ও গুণ্ডামী করতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে রকম কিছুই হয়নি। উপরন্তু বাংলা বিরােধী যে সমস্ত ছাত্রেরা পূর্বে অন্য ছাত্রদের বিছানা এবং অন্যান্য আসবাবপত্র পুড়িয়ে দিতাে তাদের কয়েকজনের বিছানাপত্রই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা সমর্থক ছাত্রেরা পুড়িয়ে ফেলে এবং তাদের কয়েকজনকে ধরে মারপিটও করে। এর কারণ কায়েদে আজমের বক্তৃতায় নাজিমুদ্দীন সরকারের সপক্ষে তার বক্তব্য এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় মনােভাব। রেস কোর্সের বক্তৃতার
পর ছাত্রদের মধ্যে কায়েদে আজমের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অনেকাংশে দূর হয় এবং তার ফলে বাংলার প্রতি সমর্থনও বৃদ্ধি পায়।১৬
৩। কায়েদে আজমের সমাবর্তন বক্তৃতা
২৪শে মার্চ সকালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কায়েদে আজমের সম্মানে একটি বিশেষ সমাবর্তন উৎসবের আয়ােজন করেন। আমন্ত্রণ গ্রহণ করার সময় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ডক্টর মাহমুদ হাসানকে কায়েদে আজম বলেন যে সময়ের অভাবে লিখিত বক্তৃতা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় কাজেই তিনি নিজের বক্তব্য ছাত্রদের সামনে মৌখিকভাবেই বলবেন।
কার্জন হলে আয়ােজিত এই সমাবেশ শৃঙ্খলা, কর্তব্য রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা বাস্তব অসুবিধা ইত্যাদির উল্লেখ করার পর কায়েদে আজম জিন্নাহ ভাষা আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে রাষ্ট্রশনের কার্যকলাপ সম্পর্কে তার বক্তব্য আবার উপস্থিত করতে গিয়ে বলেন :
ইদানিং আপনাদের প্রদেশের উপর অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে আক্রমণ চালানাে হচ্ছে। আমাদের শত্রুরা—দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে তাদের মধ্যে এখনাে কিছু সংখ্যক মুসলমান আছে—পাকিস্তানকে দুর্বল করে এই প্রদেশকে পুনরায় ভারতীয় ডােমিনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে সক্রিয়ভাবে প্রাদেশিকতার উস্কানী দিতে নিযুক্ত হয়েছে। যারা এই খেলা শুরু করেছে তার বােকার স্বর্গে বাস করছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও তারা তাদের চেষ্টা থেকে বিরত হবে না। এই রাষ্ট্রের মুসলমানদের সংহতিকে খর্ব করে জনগণকে আইন ভঙ্গ করতে প্ররোচিত করার জন্য প্রত্যহ মিথ্যা প্রচারণার বন্যা বইছে। আমি দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে আপনাদের প্রধানমন্ত্রী পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পরও আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ সাম্প্রতিক ভাষা বিতর্কের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছেন। অন্যান্য উপায়ের মতাে একটা প্রাদেশিকতার বিষয় এই প্রদেশের মধ্যে সযত্নে ঢুকিয়ে দেওয়ার একটা সূক্ষ্ম উপায়। এটা কি আপনাদের কাছে বিসদৃশ মনে হয় না যে ভারতীয় প্রেসের এক অংশ যাদের কাছে পাকিস্তানের নাম পর্যন্ত একটা অভিশাপের মতাে, তারাই ভাষার বিতর্কের প্রশ্নে আপনাদের যথার্থ অধিকার আদায়ের অন্য আজ উঠে পড়ে লেগে গেছে। এটা কি তাৎপর্যপূর্ণ নয় যে অতীতে যারা মুসলমানদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অথবা আপনাদের আত্ম
নিয়ন্ত্রণের মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে তারাই আজ আকস্মিকভাবে আপনাদের অধিকার রক্ষার নাম করে ভাষার প্রশ্নে আপনাদেরকে সরকারের বিরুদ্ধতা করার জন্যে উস্কানী দিচ্ছে। এই সব পঞ্চম বাহিনী সম্পর্কে আমি আপনাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছি। এর ঠিক পরই রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন : আমি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আমার বক্তব্য আবার বলছি। এই প্রদেশের সরকারী কাজের জন্য এই প্রদেশের লোকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো যে কোনাে ভাষা ব্যবহার করতে পারে। যথাসময়ে এবং এই প্রদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সুচিন্তিত মতামতের মাধ্যমে তাদের ইচ্ছানুসারেই এই প্রশ্নের মীমাংসা হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশের যােগাযােগের ভাষা হিসাবে একটি ভাষা থাকবে। এবং সে ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনাে ভাষা নয়। কাজেই স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু যা এই উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ মুসলমানের দ্বারা পুষ্ট হয়েছে, যা পাকিস্তানের এক থেকে অন্য প্রাপ্ত প সকলেই বােঝে এবং সর্বোপরি যার মধ্যে অন্য যে কোনো প্রাদেশিক ভাষার থেকে ইসলামী সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্ন বাস্তবরূপ লাভ করেছে এবং যে ভাষা অন্যান্য ইসলামী দেশগুলিতে ব্যবহৃত ভাষার সর্বাপেক্ষা কাছাকাছি।
কায়েদে আজমের বক্তৃতার এই পর্যায়ে অর্থাৎ ‘উদুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এই ঘােষণামাত্র হলের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র ‘না, না বলে চীৎকার করতে থাকেন। কায়েদে আজম তঁার সমাবর্তন বক্তৃতায় উদুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে একথা যে উল্লেখ করবেন সেটা ছাত্রেরা নিশ্চিতভাবে ধরে নিয়েছিলেন। কাজেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্যেও তারা আগে থেকেই প্রস্তুত হয়েছিলেন। যারা তার বক্তব্যের বিরুদ্ধে চীৎকার করে প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের মধ্যে আবদুল মতিন, এ. কে. এম. আহসান প্রভৃতি নাম উল্লেখমােগ্য।
প্রতিবাদের সময় কয়েক মুহূর্ত নিশ্চপ থাকার পর কায়েদে আজম তার | বক্তৃতা আবার শুরু করেন :
ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে উদুকে যে বিতাড়িত করা হয়েছে এমনকি উদু বর্ণমালার সরকারী ব্যবহারও যে সেখানে বন্ধ করা হয়েছে এটা সম্পূর্ণ | তাৎপর্যহীন নয়। জনগণকে উত্তেজিত করার জন্য যারা ভাষার বিতর্ককে ব্যবহার করছে এসব ঘটনা তাদেরও অত্যন্ত ভালােভাবে জানা আছে।
আন্দোলনের কোনাে যুক্তিই এক্ষেত্রে ছিলাে না কিন্তু এটা স্বীকার করা তাদের মতলব হাসিলের পক্ষে সহায়ক হতাে না। এই বিতর্ককে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য এই রাষ্ট্রের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। বস্তুতঃ এ কাজের জন্য তারা খােলাখুলিভাবেই অবাঙালী মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা উদ্রেকের যথেষ্ট চেষ্টা করছে। আপনাদের প্রধানমন্ত্রী করাচী থেকে ফিরে এসে ভাষা বিতর্কের উপর বিবৃতি মারফত এ প্রদেশের জনগণকে তাদের ইচ্ছানুসারে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ব্যবহারের অধিকার দেওয়ার কথা বলার পর আন্দোলনের আর কোনাে পথ খােলা নেই দেখে তারা তাদের কৌশল পরিবর্তন করলাে। তারা এর পর বাংলাকে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানালাে এবং একটি মুসলিম রাষ্ট্রের সরকারী ভাষা হিসাবে উদুর স্বাভাবিক দাবী অনস্বীকার্য দেখে বাংলা এবং উদু দুই ভাষাকেই তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তুললাে। এ সম্পর্কে কোনাে ভুল করা চলবে না। এই রাষ্ট্রে বিভিন্ন অংশগুলি একত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়ােজন একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং আমার মতে একমাত্র উছুই হতে। পারে সেই ভাষা।
কেস কোর্সের বক্তৃতা এবং এই একই সমাবর্তন বক্তৃতার প্রথম দিকেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা কায়েদে আজম যেখানেই বলেছেন সেখানেই তিনি সেটাকে একটা ঘােষণার মতাে প্রচার করেছেন। কিন্তু এই প্রথম তিনি উদুর উল্লেখ করতে গিয়ে অপেক্ষাকৃত মৃদু ভাষা প্রয়ােগ করে বললেন, ‘আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা। কায়েদে আজমের বক্তব্য এবং বাচনভঙ্গীর এই আকস্মিক পরিবর্তনের কারণ সমাবর্তন সমাবেশে ছাত্রদের প্রতিবাদ। পুনর্বার প্রতিবাদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কাতেই এই পরবতী পর্যায়ে তিনি উদুর দাবীকে নিজের বক্তিগত অভিমত হিসাবে উপস্থিত করতে চেষ্টা করেন।
কিন্তু তা সত্বেও রাষ্ট্রশক্রদের উল্লেখ করে তিনি আবার বলেন : রাষ্ট্রকে ধ্বংস এবং সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের দুষমন ও কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদরা যে কৌশল গ্রহণ করেছে সে সম্পর্কে আপনাদেরকে সাবধান করার জন্যই আমি এ বিষয়ে এত বিস্তারিতভাবে আলােচনা করলাম। আপনাদের মধ্যে যারা জীবন শুরু করতে যাচ্ছেন তাদের এ জাতীয় লােকজন সম্পর্কে সাবধান থাকা প্রয়ােজন।
যাদেরকে এখনাে কিছুদিন পড়াশােনা করতে হবে তাদের উচিত কোনাে রাজনৈতিক পার্টি অথবা স্বার্থপর রাজনীতিকের আরা নিজেদের ব্যবহৃত
হতে দেওয়া।
এর পর ছাত্রদের উদ্দেশে আবার তিনি পর পর কতকগুলি সাবধান বাণী | উচ্চারণ করেন :
প্রথমত, আমাদের মধ্যে পঞ্চম বাহিনী সম্পর্কে সাবধান থাকুন। দ্বিতীয়ত, স্বার্থপর লােকদের সম্পর্কে সতর্ক থাকুন কারণ তারা নিজেরা সাঁতার কাটার জন্য আপনাদেরকে ব্যবহার করতে ইচ্ছুক। তৃতীয়তঃ, রাষ্ট্রের সত্যিকার নিঃস্বার্থ ও একনিষ্ঠ খাদেম, যারা সর্বতােভাবে জনগণকে সমর্থন করে এবং তাদের সেবা করতে ইচ্ছুক তাদেরকে চিনতে শেখা দরকার। চতুর্থতঃ, মুসলিম লীগ পার্টিকে শক্তিশালী করুন কারণ তা আপনাদের সেবায় নিয়ােজিত থেকে এক মহৎ ও গৌরবময় পাকিস্তান গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। পঞ্চমতঃ, মুসলিম লীগ পাকিস্তান অর্জন ও প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেই পবিত্র আমানতের হেফাজতকারী হিসাবে পাকিস্তানকে গড়ে তােলা মুসলিম লীগেরই কর্তব্য। যষ্ঠত, আমাদের সংগ্রামের সময় যারা অনেকে নিজেদের কড়ে আঙুলটি পর্যন্ত নাড়েনি, এমনকি নানাভাবে আমাদের বিরুদ্ধতা করেছে এবং পদে পদে সবরকম বাধাবিপত্তি সৃষ্টি করেছে এবং যাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের শত্রু শিবিরে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে তারা এখন এগিয়ে এসে নানা আকর্ষণীয় স্লোগান ও বুলি আওড়াতে পারে এবং আপনাদের সামনে নানা প্রকার আদর্শ ও কর্মসূচী হাজির করতে পারে। কিন্তু তাদেরকে এখনাে নিজেদের আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে হবে এবং মনের মধ্যে কোনাে সত্যিকার পরিবর্তন এসেছে কিনা সেটা প্রমাণ করার জন্য ব্যাঙের ছাতার মতাে নােতুন নােতুন পাটি গঠন না করে মুসলিম লীগকে সমর্থন এবং তাতে যােগদান করতে হবে।
৪। রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সাথে সাক্ষাৎকার | ২৪শে মার্চ সন্ধ্যা ৬-৩০ মিনিটে কায়েদে আজম রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের একটি প্রতিনিধিদলকে সাক্ষাৎ দান করেন। এই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয় চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদের বাসভবনে। কায়েদে আজম তার ঢাকা সফরকালে সেখানেই অবস্থান করছিলেন। সেই বাড়িটি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের
পর পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবন এবং আইয়ুব খানের শাসনকালে বহু সংস্কার ও সম্প্রসারণের পর প্রেসিডেন্টের সরকারী বাসভবনে পরিণত হয়।
এই সাক্ষাতের সময় কর্ম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দিন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, আজিজ আহমদ, অলী আহাদ, নঈমুদ্দীন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম।
আলােচনার প্রথমেই কায়েদে আজম রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্যদেরকে বলেন যে নাজিমুদ্দীনের সাথে তাদের যে চুক্তি হয়েছে সেটাকে তিনি স্বীকার কবেন না কারণ নাজিমুদ্দীনের থেকে জােরপূর্বক সেই চুক্তিতে সই আদায় করা হয়েছে। এর প্রমাণ হিসাবে তিনি বলেন যে আট দফা চুক্তির মধ্যে প্রত্যেকটি দফাতেই নাজিমুদ্দীনকে কি করতে হবে তাই বলা হয়েছে কিন্তু অন্য পক্ষের কর্তব্য সম্পর্কে কোনােই উল্লেখ নেই। চুক্তি কখনাে একতরফা হয় না, সর্বতােভাবে তা একটা দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার। কিন্তু আটদফা চুক্তি স্পষ্ট প্রমাণ। করে যে তা এক পক্ষের সুবিধার জন্যে করা হয়েছে এবং চুক্তিতে স্বাক্ষর জোরপূর্বকই আদায় করা কয়েছে। এবং সেই অনুসারে চুক্তিটি সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। এবং অগ্রাহ। | কর্ম পরিষদের সদন্ঠেরা সহৃদয়তাপূর্ণ মনােভাব নিয়েই কায়েদে আজমের। সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু গোড়াতেই তার এই আক্রমণাত্মক কথায় তাদের মনে সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির ফলে ঘরের আবহাওয়া সম্পূর্ণভাবে পাল্টে গেলাে। এবং ভাষার প্রশ্ন নিয়ে সাধারণভাবে কায়েদে আজমের সাথে তাদের তর্কাতকি শুরু হয়ে পরিশেষে তা ঘোরতর ঝগড়ায় পরিণত হলাে। প্রথমেই মহম্মদ তােয়াহা তঁাকে সরাসরি বলেন যে তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চান। এর উত্তরে কায়েদে আজম বলেন যে তিনি তাদের কাছে রাজনীতি শিক্ষা করতে আসেননি।
কায়েদে আজমের প্রধান বক্তব্য ছিলাে এই যে পাকিস্তানে একাধিক রাষ্ট্র। ভাষা হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। তাছাড়া একাধিক রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটিকে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন বলেও বর্ণনা করেন। সেই পর্যায়ে মহম্মদ তােয়াহা তাকে বলেন যে কানাডা, সুইজারল্যাণ্ড প্রভৃতি দেশে দুই বা ততােধিক রাষ্ট্রভাষা আছে কাজেই প্রশ্নটি মােটেই নজিরবিহীন নয়। কায়েদে আজম কি ঐ সমস্ত দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষার কথা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। এতে তােয়াহা তাকে বলেন যে একাধিক রাষ্ট্রভাষার কথা
একটি ঐতিহাসিক সত্য কাজেই সেই সত্যকে তিনি কিভাবে অস্বীকার করতে পারেন। এর উত্তরে কায়েদে আজম উম্মার সাথে বলেন যে তিনি ইতিহাস পাঠ করেছেন, তিনি এসব কথা জানেন। তার এই জবাব শুনে অলী আহাদ বলেন যে তিনিও ইতিহাস পড়েছেন এবং তিনি জানেন যে কায়েদে আজম ইতিহাসকে বিকৃত করছেন মাত্র। শুধু তাই নয়। এর পর অলী আহাদ কায়েদে আজমকে ব্যঙ্গ করে বলেন যে তিনি শুধু ইতিহাসই জানেন তা নয়, তিনি বস্তুতঃপক্ষে একথাও জানেন যে কায়েদে আজম পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং ইংলণ্ডের রানীর কাছে তার অপসারণের জন্যে তারা আবেদন জানাতে পারেন।১০
অলি আহাদের উপরােক্ত কথায় কায়েদে আজম রীতিমতাে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং অলি আহাদ ও সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যদেরকে উচ্চকণ্ঠে বকাবকি করতে থাকেন। এর ফলে ঘরের মধ্যে একটা দারুন হৈ চৈ পড়ে যায়। এই পর্যায়ে কায়েদে আজমের মিলিটারী সেক্রেটারী গণ্ডগােল আশঙ্কা করে কাছাকাছি জায়গা থেকে তাড়াতাড়ি এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু পরে অবস্থা আশঙ্কাজনক কিছু নয় বুঝে তিনি আবার ভেতরের দিকে চলে যান। এই তর্কাতর্কির মধ্যে একবার ফতেমা জিন্নাহ চায়ের তদারক করার জন্যে ঘরের মধ্যে অল্পক্ষণের জন্যে আসেন।১৩ | ইসলাম, রাষ্ট্রভাষা, শৃঙ্খলা ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অপ্রীতিকর আলােচনার মধ্যে দিয়ে মগরেবের নামাজের সময় হয়ে এলাে। শামসুল হক তখন কায়েদে আজমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এবার নামাজের সময় হয়েছে কাজেই কিছু ক্ষণের জন্যে আলােচনা স্থগিত রাখা হােক। শামসুল হকের এই কথায় কায়েদে আজম ভয়ানক বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কারণ তিনি মনে করলেন যে তিনি নামাজ পড়েন না এটা জেনেই ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বিব্রত এবং অপদস্থ করার জন্যেই নামাজের প্রস্তাব করা হয়েছে। আসলে কিন্তু শামসুল হক সে সময় নিয়মিত নামাজ পড়তেন এবং সেই নিয়ম রক্ষার জন্যেই তিনি নামাজ পড়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কায়েদে আজম এই প্রস্তাবে বাহত: বিরক্তি বােধ করলেও তার বিরুদ্ধে কোনাে মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন এবং নামাজের বিরতি দেওয়ার প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর এই এড়িয়ে যাওয়ার মনােভাব লক্ষ্য করে শামসুল হক দ্বিগুণ উৎসাহে নামাজের বিরতির কথা বারবার বলায় ঘরের মধ্যে এক দারুণ অপ্রীতিকর অবস্থার উদ্ভব হয়।
নানা উত্তেজনা সত্বেও কায়েদে আজম এবং রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিতর্ক ৭-১৫ মিনিট পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শামসুল হকের নামাজ পড়ার প্রস্তাবের ফলে আলােচনার মধ্যে অন্য জাতীয় জটিলতার সৃষ্টি না হলে ত। হয়তাে আরাে কিছুক্ষণ স্থায়ী হতে।
এই সাক্ষাৎকারের সময় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে কায়েদে আজমের কাছে নিম্নলিখিত স্মারকলিপিটি পেশ করা হয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মুসলমান যুবকদের লইয়া গঠিত এই কর্মপরিষদ মনে করেন যে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। হওয়া উচিত। কারণ প্রথমতঃ তাহারা মনে করেন যে, উহা পাকিস্তানের সমগ্র জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের ভাষা এবং পাকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র হওয়ায় অধিকাংশ লােকের দাবী মানিয়া লওয়া উচিত। দ্বিতীয়তঃ আধুনিক যুগে কোনাে কোনাে রাষ্ট্রে একাধিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গৃহীত হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ নিম্নোক্ত কয়েকটি দেশের নাম করা যায় : বেলজিয়াম (ফ্লেমিং ও ফরাসী ভাষা), কানাডা (ইংরেজী ও ফরাসী ভাষা), সুইজারল্যাণ্ড (ফরাসী, জার্মান ও ইতালীয় ভাষা), দক্ষিণ আফ্রিকা (ইংরেজী ও আফ্রিকার ভাষা), মিসর (ফরাসী ও আরবী ভাষা)। এতদ্ব্যতীত সােভিয়েট রাশিয়া ১৭টি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করিয়াছে। তৃতীয়ত, এই ডােমিনিয়নের সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে একমাত্র বাংলা ভাষাই রাষ্ট্রভাষাই স্থান অধিকার করার পক্ষে উপযুক্ত। কারণ সম্পদের দিক বিবেচনায় এই ভাষাকে পৃথিবীর মধ্যে সপ্তম স্থান দেওয়া হয়েছে। চতুর্থতঃ, আলাওয়াল, নজরুল ইসলাম, কায়কোবাদ, সৈয়দ এমদাদ আলী, ওয়াজেদ আলী, জসিমউদ্দিন ও আরাে অনেক মুসলমান কবি ও সাহিত্যিক তাহাদের রচনাসম্ভার দ্বারা এই ভাষাকে সমৃদ্ধিশালী করিয়াছেন। পঞ্চমত, বাংলার সুলতান হুসেন শাহ, সংস্কৃত ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্বেও এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার পর্যায়ে উন্নীত করিয়াছিলেন এবং এই ভাষার শব্দ সম্পদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ পারসিক ও আরবী ভাষা হইতে গৃহীত। উপসংহারে আমরা বলিতে চাই যে, যে কোনাে পূর্ণ গণতাহিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের কয়েকটি মৌলিক অধিকার আছে। কাজেই যে পর্যয় না আমাদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয় সে পর্যন্ত বাংলা ভাষার জন্য এই আন্দোলন চালাইয়া যাওয়া হইবে।
কায়েদে আজমের কাছে প্রদত্ত এই আকলিপিটিতে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা ভাষার দাবী উপস্থিত করা হলেও তার মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রভাৰ সহজেই লক্ষণীয়। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির সপক্ষে যুক্তিস্বরূপ তারা কেবল কেবলমাত্র কয়েকজন মুসলমান কবি সাহিত্যিকের রচনার উল্লেখ করেছেন। তারা আরও বলছেন যে মুসলমান সুলতান হুসেন শাহ বাংলা ভাষার পৃষ্ঠ পােষকতা করেছেন এবং বাংলা ভাষার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ শব্দই আরবী ফারসী। শতকরা ৫০ ভাগ না হলেও বাংলা ভাষাতে আরবী ফারসী শব্দ প্রচুর আছে, মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের রচনায় বাংলা ভাষা যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং সুলতান হুসেন শাহ বাংলা ভাষার উন্নতির প্রাথমিক পর্যায়ে তার পৃষ্ঠপােষকতা করেছিলেন, এ সবই সত্য। কিন্তু তবু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যৌক্তিকতা হিসাবে অন্যান্য বিবেচনার উপর গুরুত্ব না দিয়ে এগুলির উপর গুরুত্ব দেওয়া এবং রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের একমাত্র মুসলমান যুবকদের দ্বারা গঠিত এই কথার মাধ্যমে কর্মপরিষদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর ‘কছুটা পরিচয় পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে যে সব ছাত্র এবং অছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতারা ছিলেন তারা মাত্র কয়েকমাস পূর্বেও মুসলিম লীগ রাজনীতির সাথে ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা সর্বপ্রথম একটি সত্যকার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলন মূলত একটি অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন হলেও রাতারাতি কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তিত হয়নি এবং সেটা সম্ভবও ছিলাে না। সমস্যাটিকে সেইভাবে দেখা খুবই স্বাভাবিক। উপরন্তু কর্ম-পরিষদের মধ্যে আবুল কাসেমের মতাে কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন যাঁদের দৃষ্টিভঙ্গী ছিলাে পুরােপুরি সাম্প্রদায়িক। এই কারণে স্মারকলিপিটি সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবমুক্ত হয়নি। | দ্বিতীয়তঃ আরবী ফারসী শব্দ, মুসলমান সাহিত্যিকদের রচনা এবং হুসেন শাহের পৃষ্ঠপােষকতার উল্লেখ সরকার এবং প্রতিক্রিয়াশীল মহলের বাংলা বিরােধী প্রচারণাকে খণ্ডন করার জন্যেও কিছুটা প্রয়ােজন হয়েছিলাে। বাংলা ভাষার সাথে ইসলামের যে কোন সম্পর্ক নেই, বস্তুতঃ সে ভাষা যে ইসলামী সংস্কৃতিবিরােধী এই প্রচারণায় বাংলা ভাষা বিরােধীরা অত্যন্ত মুখর হয়েছিলাে। এর ফলেই হয়তাে বাংলা ভাষার সাথে মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা স্মারকলিপিটিতে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়।
কর্মপরিষদ কেবলমাত্র মুসলমান’ যুবকদের দ্বারা গঠিত এ বক্তব্যের চরিত্র
পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক হলেও অন্যান্য যুক্তিগুলি সম্পূর্ণ গুরুত্বহীন নয়। কিন্তু তা সত্বেও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে অন্যান্য বহু যুক্তি ছিল যেগুলি গণতান্ত্রিক কর্মী ও নেতারা কায়েদে আজমের সামনে সরাসরি উপস্থিত করতে পারতেন। প্রকৃতপক্ষে তারা সেটা করা থেকে বিরত থাকেন। এর ফলে তারা সাম্প্রদায়িক বুক্তিকে সাম্প্রদায়িক যুক্তির দ্বারাই মােটামুটিভাবে খণ্ডন করার চেষ্টা করেন। তত্বগতভাবে অন্য কোনাে সুই বক্তব্য তারা এই স্মারকলিপিটির মধ্যে উপস্থিত করতে সক্ষম হননি।
৫। ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে আলােচনা
| ঢাকা অবস্থানকালে প্রতিনিধিস্থানীয় ছাত্রদের সাথে সাক্ষাতের জন্যে কায়েদে আজম ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সেই অনুসারে বিভিন্ন ছাত্রাবাসের প্রভােস্টদের মাধ্যমে ছাত্রাবাসগুলির সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদেরকে এই সাক্ষাৎকারের কথা বলা হয়। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের সহসভাপতিও এই সাক্ষাৎকারের জন্যে আমন্ত্রিত হন। ২০শে মার্চ কায়েদে আজমের সাথে এই ছাত্র প্রতিনিধিদলটি চীফ সেক্রেটারীর বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন।
প্রত্যেকের সাথে পৃথকভাবে পরিচিত হওয়ার পর কায়েদে আজম সকলকে জিজ্ঞেস করেন সেই অবস্থায় তিনি ছাত্রদের জন্য কি করতে পারেন। মহম্মদ তােয়াহা এর জবাবে তাকে বলেন যে ইচ্ছে করলে তিনি একটি ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা দিতে পারেন। কায়েদে আজম বলেন এ বিষয়ে তিনি চিন্তা করে দেখবেন।
পনেরাে-বিশ মিনিটকাল স্থায়ী এই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোনাে আলােচনা কোনাে পক্ষ থেকেই উত্থান করা হয়নি। কায়েদে আজম ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকের কুশল জিজ্ঞাসা করেন এবং অত্যন্ত মামুলী কিছু কথাবার্তার পর তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাড়ান। এই সময় মহম্মদ তােয়াহা তার হাতে ইংরেজীতে লিখিত একটি স্মারকলিপি দিয়ে বলেন, ‘ভাষা সমস্যার উপর এটি একটি স্মারকলিপি। আপনি এটি পড়ে দেখবেন।’ কায়েদে আজম আরকলিপিটি হাতে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দেন কিন্তু সে বিষয়ে কোনাে মন্তব্য করেন না। এই স্মারকলিপিটিই রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে আবার তার হাতে ২৪শে মার্চ তারিখে দেওয়া হয়।
ঘর ছেড়ে সকলে কিছুটা বাইরে আসার পর কায়েদে আজমের মিলিটারী সেক্রেটারী হঠাৎ দৌড়ে এসে মহম্মদ তােয়াহাকে বলেন যে অন্য সকলে চলে যাক কিন্তু তােয়াহা এবং নজরুল ইসলাম যেন তৎক্ষণাৎ কায়েদে আজনের সাথে আর একবার দেখা করেন। মিলিটারী সেক্রেটারীর এই কথা শুনে তারা দুজনে ভেতরে গিয়ে দাড়াতে কায়েদে আজম তাদেরকে বললেন যে সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে একটা ভুল হয়ে গেছে। তিনি শুধু মুসলমান ছাত্রদের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন, হিন্দু ছাত্রদের সাথে নয়।’
প্রত্যেক ছাত্রাবাসের সহ-সভাপতি এবং সম্পাদককে কায়েদে আজমের সাথে সাক্ষাতের জন্যে আমন্ত্রণ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ ছাত্রাবাসের দুইজন হিন্দু ছাত্র প্রতিনিধিও সেদিন অন্য ছাত্রদের সাথে গিয়েছিলেন। ছাত্রদের সাথে কায়েদে আজম যে সব বিষয়ে আলােচনা করতে চেয়েছিলেন সেগুলি তিনি হিন্দু ছাত্রদের সামনে আলােচনার জন্যে মােটেই প্রস্তুত ছিলেন
এবং তার জন্যে সাক্ষাৎকারের সময় বিশেষ কোনাে আলোচনা না করে অল্পক্ষণ পরেই সাক্ষাতকার তিনি শেষ করে দেন।
মহম্মদ তােয়াহা কায়েদে আজমের কথা শুনে তাকে বলেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিভিন্ন ছাত্রাবাসে থাকে এবং বার্ষিক নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। সেই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে হিন্দু ছাত্রদের জগন্নাথ ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিরাও ছিলেন।
কায়েদে আজম তথন তােয়াহাকে বলেন যে সেই জাতীয় কোনাে ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে তিনি আলােচনা করতে চাননি। তিনি চান মুসলিম ছাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সাথে ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে কিছু আলাপ আলােচনা করতে।১০ তােয়াহা তখন তাকে বলেন যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ সেই জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং তাদের প্রতিনিধিদের সাথে তিনি আলাপ করতে পারেন। এই কথায় কায়েদে আজম বলেন যে তাদের সাথেই আলােচনা করা দরকার। তােয়াহা তাঁকে জানান যে মুসলিম ছাত্র লীগ প্রকৃতপক্ষে দুইভাগে বিভক্ত। কায়েদে আজম তখন তােয়াহা এবং নজরুল ইসলামের ঠিকানা লিখে রাখেন এবং বলেন যে দুই অংশের ছাত্র সংগঠনের সাথেই তিনি সাক্ষাৎ করবেন।
শাহ আজিজুর রহমানরা সেই সময় নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ নামে একটি স্বতন্ত্র ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মােটামুটিভাবে কলকাতা থেকে আগত বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের নাজিমুদ্দীন
সমর্থক উপদলীয় নেতৃফে আতাত ছিলাে। সেই হিসাবে ঢাকায় ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে তার বিশেষ কোনাে প্রভাব ছিলাে না। কিন্তু সে প্রভাব না থাকলেও পার্লামেন্টারী রাজনীতির সাথে তাদের যথেষ্ট যােগাযােগ ছিলাে।
কায়েদে আজম এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাথে ২২শে মার্চ সাক্ষাৎ করেন। এই দলটিতে তখন শাহ আজিজুর রহমান ব্যতীত দেলাওয়ার হােসেন, লুৎফর রহমান, সুলতান হােসেন খান, আবদুল মালেক এবং মাজহারুল কুদ্সও উপস্থিত ছিলেন। কায়েদে আজম তাদের সাথে ছাত্র ঐক্য এবং অন্যান্য বিষয়ে আলাপ করেন এবং পুনরায় তাদের সাথে দেখা করবেন একথা জানান।১২
এর পর কায়েদে আজমের মিলিটারী সেক্রেটারী মহম্মদ তােয়াহাকে চিঠি দিয়ে জানান যে তিনি তাদের সাথে ২৩শে মার্চ সাক্ষাৎ করতে চান। চিঠিতে তােয়াহাকে অনুরােধ করা হয় তিনি যেন অন্য আর একজন ছাত্র প্রতিনিধিকে তার সাথে নিয়ে আসেন।১৩ সেই কথামতাে তােয়াহা আলোচনার জন্যে মিলিটারী সেক্রেটারীর কাছে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদের নাম পাঠান।১৪ শাহ আজিজুর রহমানও মহম্মদ তােয়াহার মতাে মিলিটারী সেক্রেটারীর চিঠি পান এবং তার দলভুক্ত মাজহারুল কুন্দুসের নাম দেন।১৫
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতিনিধিদের সাথে কায়েদে আজমের এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২৩শে
মার্চ।১৬
| এই আলােচনাকালে কায়েদে আজম ছাত্রদেরকে বলেন তার সারমর্ম এই যে তিনি মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে বিভেদের পরিবর্তে একতা চান। তিনি বলেন যে আৱাহ যদি পাকিস্তানকে রক্ষা না করতেন তাহলে পাকিস্তানের জন্ম দিবসেই তার সমগ্র কাঠামাে ভেঙে পড়ত। পাকিস্তান একটি শিশু রাষ্ট্র কাজেই তাকে রক্ষা করতে হলে আভ্যন্তরীণ ঐক্য সব থেকে বড় প্রয়ােজন। রাষ্ট্র গঠন করার জন্য ছাত্রদেরকে সব রকম আন্দোলন ও সংগঠনের সামনে থাকতে হবে এবং সে কাজ তাদেরকে করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। এই উদ্দেশ্য সফল করার কন্যে প্রয়ােজন দুই ছাত্ৰপ্ৰতিষ্ঠানকে ভেসে একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমস্ত মুসলমান ছাত্রের একতাবদ্ধ হওয়া।
কায়েদে আজমের উপনােক্ত বক্তব্য শােনার পর তােয়াহা এবং নঈমুদ্দীন তাকে বলেন যে ছাত্র ঐক্য তারাও চান কি যে কোন ঐক্য প্রচেষ্টার পূর্বে
দেখা দরকার আগে যে সাংগঠনিক ঐক্য ছিলাে তাতে ভাঙন ধরলে কি কারণে। সেটা জানলে দুটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান কিভাবে সম্ভব হলে তাও পবিষ্কার ভাবে বােঝা যাবে। এর জবাবে কায়েদে আজম তাদেরকে বলেন, ঠিক আছে তােমরা চিন্তা করাে। আমি পরে আবার তােমাদের সাথে দেখা করব।১৮
এর পর ছাত্র প্রতিনিধিদেরকে কায়েদে আজম আলােচনার জন্যে আবার ডেকে পাঠান। এই সাক্ষাৎকার ঘটে ৩৪শে মার্চ বিকেল ৫-৩০ মিনিট থেকে শুরু করে প্রায় এক ঘণ্টা। ঐদিন শাহ আজিজের সাথে ছিলেন মাজহারুল কুস কিন্তু মহম্মদ তােয়াহার সাথে নঈমুদ্দীনের পরিবর্তে ছিলেন বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরী। পূর্বে যে প্রবেশ পত্র দেওয়া হয়েছিলাে তাতে তােয়াহা এবং নঈমুদ্দীনের নাম লেখা ছিলাে। নইমুদ্দীনের পরিবর্তে আবদুর রহমান চৌধুরী যে তােয়াহার সাথে যাবেন একথা পূর্বে তাদেরকে জাননোে হয়নি। কাজেই আবদুর রহমান চৌধুরীর প্রবেশপত্রের জন্য কিছুক্ষণ বিলম্ব হয়।২০
এইবার কায়েদে আজম প্রথমে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দুই দলের সাথে আলাপ করলেন। এবং পরে দুই দলই একত্রিত করে নিয়ে বসলেন। তােয়াহা এবং আবদুর রহমান আলােচনা প্রসঙ্গে তাকে বললেন যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সংগঠন হিসাবে বিশেষ কোনাে অস্তিত্বই নেই। এর নেতারা সকলেই বিভিন্ন অফিসে চাকরি করে। তাদের দলভুক্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগের শেষ সভাপতি শামসুল হুদা চৌধুরী নিজে এখন রেডিও পাকিস্তানের কর্মচারী। অন্যদেরও সেই অবস্থা কাজেই ঐ সংগঠনের সত্যিকার কোনাে অস্তিত্ব নেই। তােয়াহাদের এই যুক্তিকে খণ্ডন করার জন্য শাহ আজিজুর রহমানও তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযােগ উত্থাপন করেন।২২
এই সমস্ত আলােচনার মধ্যে কায়েদে আজম এক পর্যায়ে বলে ওঠেন, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ সংগঠন হিসাবে মৃত। তােমরা সকলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগে যােগদান করে একত্রে একটা সংগঠন গড়ে তােলদা। এরপর এই নতুন সংগঠনকে আশীৰ্বাদ জানিয়ে তিনি একটা বাণীও দেন। তাতে তিনি বলেন যে এই সংকটময় মুহূর্তে ঐক্যের প্রয়ােজনই সব থেকে বেশী। এ ছাড়া তিনি উপস্থিত চারজন নেতাকে দিয়ে একটি ছােট ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। তাতে বলা হয় যে তারা সকলে মিলিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের মধ্যে কাজ করে যাবেন।
ছােট ঘষণাটি স্বাক্ষরিত হয়ে গেলেও কায়েদে আজম নিজের বাণী সংবাদ পত্রের মাধ্যমে প্রচার করতে নিষেধ করেছিলেন। চূড়ান্তভাবে সমস্ত কিছু ঠিকঠাক করার পরই তিনি সেটাকে সংবাদপত্রে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। | কাগজটিতে স্বাক্ষর দেওয়ার পরও শাহ আজিজুর রহমান কায়েদে আজমকে বার বার বলতে থাকেন যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের নেতা এবং কর্মীরা যদি কায়েদে আজমকে বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করা বন্ধ রাখেন তাহলে সকলের সাথে মিলিতভাবে কাজ করে যেতে তাদের কোনাে আপত্তি নেই। শাহ আজিজের এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে অভিহিত করে তােয়াহা বলেন, ‘আমাদের কায়েদে আজমকে কেউই বিশ্রী ভাষায় গালাগালি করছে না’। এইসব তর্কাতকির মুখে কায়েদে আজম ছাত্রদেরকে বলেন, “তোমাদের কায়েদে আজমকে কেউ গালাগালি দিলে তিনি কিছুই মনে করবেন না।২৫
| ছাত্রদের সাথে কায়েদে আজমের ২১শে তারিখের সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ হয়। এর ঠিক পরেই তিনি রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের প্রতিনিধিদেরকে সাক্ষাৎ দান করেন।
কায়েদে আজম ২৫শে মার্চ চট্টগ্রাম যান এবং ২৭ তারিখে সেখান থেকে ঢাকা ফিরে আসেন। সেইি তিনি ছাত্রদেরকে বৈঠকের জন্যে আবার ডেকে পাঠান। শাহ আজিজুর রহমান, মাজহারুল কুদ্দস, মহম্মদ তােয়াহা এবং আবদুর রহমান চৌধুরী এই চারজনই চীক সেক্রেটারীর বাসভবনে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হন।২৬ | শাহ আজিজুর রহমান সেদিন তাঁর সাথে দৈনিক আজাদ এবং অন্যান্য পত্রিকার অনেকগুলি কপি নিয়ে গিয়েছিলেন।২৭ শাহ আজিজ বলেন যে তারা আজাদের যে কপিগুলি নিয়ে গিয়েছিলেন সেগুলিতে তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কিত অনেক রিপাের্ট ছাপা হয়েছিলাে এবং সেগুলি তারা কায়েদে আজমকে দেখাতে চেয়েছিলেন। তােয়াহা এবং আবদুর রহমান চৌধুরী কিন্তু বলেন যে আজাদের কপিগুলি শাহ আজিজেরা নিজেদের কার্যকলাপের রিপাের্ট দাখিল করার জন্যে নিয়ে যায়নি। তারা সেগুলি নিয়ে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ এবং তার নেতৃস্থানীয় কর্মীদের কমিউনিস্ট প্রমাণ করার জন্যে।
কিছুদিন পূর্বেই ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে কলকাতাতে যে দক্ষিণ-পূর্ব। এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে একটি প্রতিনিধিদল যায়। তাতে তােয়াহারই নেতৃত্ব করার কথা ছিলাে কিন্তু বিশেষ অসুবিধার জয়ে শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে সম্মেলনে যােগদান সম্ভব হয়নি। তার পরিবর্তে
আবদুর রহমান চৌধুরী দলটির নেতৃত্ব করেন। শাহ আজিজের। সম্মেলনে যােগদান করলেও তাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলাে আবদুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন এপটিকে।৩২ সেই হিসাবে কলকাতার কাগজগুলিতে তাদের সম্পর্কে রিপোর্ট এবং তাদের ছবি ছাপা হয়েছিলাে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসও ঐ একই সময়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় এবং তার সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। এজন্যে সাধারণভাবে সেই সম্মেলনকে এবং বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলকে আক্রমণ করে আজাদে অনেক কিছু ছাপা হয়। শাহ আজিজের কায়েদে আজমকে এই সমস্ত রিপাের্ট এবং ছবি দেখিয়ে তার কাছে পূর্ব পাকিস্তান মুললিম ছাত্র লীগ এবং তার নেতৃস্থানীয় কর্মীদেরকে কমিউনিস্ট এবং তাদের সাথে আঁতাতকারী বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। তাদের এই প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত বিফল হয়নি।
২৭শে মার্চের এই সাক্ষাৎকারের সময় কায়েদে আমি প্রথমে শাহ আজিজুর রহমান এবং মাজহারুল কুদ্সকে আলােচনার জন্যে ভেতরে ডেকে নিয়ে যান। শাহ আজিজরা তাদের কাগজপত্রের বাণ্ডিলসহ কায়েদে আজমের সাথে বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান ও আলােচনা করেন।৩৪
শাহ আজিজের কায়েদে আজমের সাথে আলাপ শেষ করে বাইরে আসার পর মহম্মদ তােয়াহা এবং আবদুর রহমান চৌধুরীকে ভেতরে ডাকা হয়। এবার কিন্তু কায়েদে আজম আর তঁাদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন না। তার মিলিটারী সেক্রেটারী তাদের কাছে এসে বললেন, আপনারা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারার জন্যে কায়েদে আজম দুঃখ প্রকাশ করেছেন’।৩৫ | শাহ আজিজুর রহমান এবং মাজহারুল কুদ্স কতৃক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগকে কমিউনিস্ট প্রতিষ্ঠান হিসাবে চিহ্নিত করার চেষ্টা এবং ২৫শে তারিখে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় কায়েদে আজমের সাথে তােয়াহা এবং অন্যান্যদের বিতর্ক এই দুই কারণে তিনি তােয়াহা এবং মুসলিম ছাত্র লীগের প্রতি নিজের মনােভাব পরিবর্তন করে মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত হন। মুসলিম লীগ পালমেন্টারী পার্টির কিছু লােকজন এবং লীগদলীয় অন্যান্য নেতাদেরও এ ব্যাপারে একটি সক্রিয় ভূমিকা ছিল।৩৬ | এর পূর্বের সাক্ষাৎকারের সময় তিনি যে বাণী দিয়েছিলেন সে সম্পর্কে সংবাদপত্রে কিছু প্রকাশ না করার জন্যে কায়েদে আজম অনুরােধ করেছিলেন,
কি আবদুর রহমান চৌধুরী সে অনুরোধ শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেননি। তিনি সংবাদপত্রে এই মর্মে একটি বিবৃতি দেন যে কায়েদে আজম ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে আশীর্বাদ জানিয়েছেন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র লীগকেই স্বীকৃতি নিয়েছেন। কাজেই সকলের উচিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগে যোগদান করে ছাত্র ঐক্যকে শক্তিশালী করা।
৬। কায়েদে আজামের বিদায়বাণী ও পূর্ব বাঙলা সফরের ফলাফল
পূর্ব বাঙলা সফর শেষে করাচী রওয়ানা হওয়ার প্রাক্কালে কায়েদে আজম পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশ্যে রেডিও পাকিস্তানের মাধ্যমে ২৮শে মার্চ একটি বিদায় বাণী প্রচার করেন। তাতে অন্যান্য বক্তব্যের সাথে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন এবং আন্দোলন সম্পর্কিত বিষয়ে তিনি যে অভিমত ব্যক্ত করেন তার মধ্যে নােতুনত্ব থাকলেও তার দৃষ্টিভঙ্গী ও চিন্তার পরিধির সাথে পরিচয় লাভের জন্য পুনরুক্তি হলেও তা নিঃসন্দেহে উল্লেখযগ্য :
এক শ্রেণীর লােকের মধ্যে নব-অর্জিত স্বাধীনতাকে যথেচ্ছাচারের অধিকার হিসাবে দেখার একটা দুঃখজনক প্ৰৰণতা আমি লক্ষ্য করছি। একথা সত্য যে বিদেশী রাজত্বের অবসানের পর জনগণই এখন তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রেতা। শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যে কোনাে সরকার বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। তার অর্থ আবার এই নয় যে সাধারণের ভােটে নির্বাচিত সরকারের উপর এখন যে কোনাে একদল লােক নিজের ইচ্ছাকে বেআইনী ভাবে চাপিয়ে দিতে পারবে। সরকার এবং তার নীতি প্রাদেশিক বিধান সভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভােটের রা পরিবর্তিত হতে পারে। শুধু তাই নয়। সরকারের পক্ষে এক মুহূর্তের জন্য ঐ জাতীয় উচ্ছল ও দায়িত্বজ্ঞানহীন লােকদের দলবদ্ধ গুণ্ডামী এবং রাজত্ব সহ না করে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই অবস্থার মােকাবেলা করা উচিত। এক্ষেত্রে আমি বিশেষভাবে ভাষার বিতর্কের কথা ভাবছি যেটা এই প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে অযথা অনেক উত্তেজনা ও সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থাকে আয়ত্বে না আনলে এর ফলাফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। এ প্রদেশের সরকারী ভাষা কি হওয়া উচিত সেটা আপনাদের প্রতিনিধিরাই স্থির করবেন। কিন্তু এই ভাষার বিতর্ক আসলে প্রদেশিকতার বৃহত্তর বিতর্কের একটি দিক। আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে আপনারা একথা নিশ্চয় উপলব্ধি
করেন যে পাকিস্তানের মতাে একটি নবগঠিত রাষ্ট্র, যার দুই অংশ পরম্পর থেকে অনেকখানি দূরে, যেখানে সকল অংশের সকল নাগরিকের মধ্যেকার একতা এবং সংহতি, তার প্রগতি, এমনকি অস্তিত্বের জন্যেও অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়। মুসলিম জাতির ঐক্যের মূর্তরূপই হলাে পাকিস্তান এবং সেইভাবেই তা বজায় থাকবে। মুসলমান হিসাবে সেই ঐক্যকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। আমরা যদি প্রথমে নিজেদেরকে বাঙালী, পাঞ্জাবী সিন্ধী ইত্যাদি মনে করে শুধু প্রসঙ্গক্রমে নিজেদেরকে পাকিস্তানী মনে করি তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হতে বাধ্য। মনে করবেন না এটা একটা দুর্বোধ্য কথা : এই সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদের শত্রুরা খুবই সচেতন এবং আমি আপনাদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলতে চাই যে তারা ইতিমধ্যেই একাজে ব্যস্ত রয়েছে। আমি আপনাদেরকে সােজাজি জিজ্ঞেস করবাে : যে সমস্ত ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্থা ও প্রেসের মুখপত্র সর্বতােভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করেছিলাে তারাই যখন পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের ন্যায়সঙ্গত দাবী’র প্রতি তাদের বিবেকের সমর্থন জানাতে আসে তখন সেটাকে আপনাদের কাছে একটা অণ্ডও ব্যাপার বলে কি মনে হয় না? একথা কি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে বােঝা যায় না যে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাকে রােধ করতে অক্ষম হয়ে এই সমস্ত সংস্থাগুলি বর্তমানে প্রতারণাপূর্ণ প্রচারণার মাধ্যমে মুসলমান ভাইদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে ভেতর থেকে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। আমি চাই যাতে আপনারা প্রাদেশিকতার এই হলাহল, যা আমাদের শত্রুরা আমাদের রাষ্ট্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চায়, তার সম্পর্কে সতর্ক থাকুন।
কায়েদে আজমের পূর্ব বাঙলা সফরের অন্যতম প্রধান ফল পূর্ব বাঙলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির অন্তরে অবসান। ঢাকায় অবস্থানকালে কায়েদে আজম মহম্মদ আলীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলাপ করেন এবং তাঁকে বার্মায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তফজল আলী, আবদুল মালেক প্রভৃতির সাথে মন্ত্রীত্ব ইত্যাদির প্রশ্ন নিয়ে কোনাে সরাসরি আলাপ না হলেও তাদের সাথে একটা আপােষ রফায় উপনীত হওয়ার জন্যে খাজা নাজিমুদ্দীনকে তিনি নির্দেশ দেন।
মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সদস্যদের সাথেও তিনি মিলিত হন এবং সেই সমাবেশে ভাষণ দান করতে গিয়ে বলেন যে তারা যেন নিজেদেরকে বাঙালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী ইত্যাদি মনে না করে এটি পাকিস্তানী হিসাবে
রাষ্ট্রের ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে মনােনিবেশ করেন। পার্লামেন্টারী পার্টির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানাের জন্য তিনি সকলের কাছে আবেদন করেন। সেই প্রসঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোনাে অভিযােগ থাকলে সেটি। সরাসরিভাবে তাকে জানানাের জন্যে তিনি সদস্যদেরকে উপদেশ দেন।
এই সময় ডক্টর মালেক কায়েদে আজমকে জিজ্ঞেস করেন যে ব্যবস্থাপক সভায় সরকারী লােকদেরকে খােলাখুলিভাবে প্রশ্ন করে বিব্রত করা চলে কিনা। এর উত্তরে তিনি বলেন যে সে জাতীয় আচরণ শৃঙ্খলা বহির্ভূত এবং সেই হিসাবে তা কিছুতেই অনুমােদন করা যায় না। ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, পার্লামেন্টারী পার্টিতে ঐক্যের উপর গুরুত্ব দান এবং সর্বোপরি পার্টির অভ্যন্তরীণ কলহ মিটিয়ে নেওয়ার জন্যে নাজিমুদ্দীনের প্রতি নির্দেশের ফলে মহম্মদ আলী বার্মায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের পদ এবং ডক্টর মালেক এবং তফজ্জল আলী প্রাদেশিক সরকারে মন্ত্রীত্বের পদ লাভ করেন। পার্লামেন্টারী উপদলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এইভাবে গদীনশীন হওয়ার ফলে মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারী পার্টিতে অভ্যন্তরীণ গােলযােগের মােটামুটি অবসান ঘটে এবং তার ফলে নাজিমুদ্দীন সরকারের শক্তি অনেকখানি বৃদ্ধি লাভ করে। এই শক্তি বৃদ্ধির প্রভাব এপ্রিল মাসে প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলাকালে নাজিমুদ্দীন সরকারের আচরণের মধ্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। | উর্দু ও ইংরেজীর সাথে বাংলাকেও জাতীয় পরিষদের সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করার ফলে পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এই আন্দোলনের ফলে প্রাদেশিক সরকার রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিদের সাথে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হন যে তারা প্রাদেশিক পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করবেন। এই চুক্তির ফলে ভাষা আন্দোলনের সাফল্য অনেকখানি নিশ্চিত মনে হওয়ায় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন।
, কায়েদে আজম জিন্নাহ এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার মাত্র চারদিন পর চাকা সফরে আসেন এবং তার দুই দিন পর ২১শে মার্চ তারিখে রেস কোর্সের সম্বর্ধনা সভায় ভাষা আন্দোলন এবং প্রাদেশিক সরকার ও রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের মধ্যেকার চুক্তিকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন যে উর্দু ব্যতীত অন্য কোনাে ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবী। করার অধিকার পাকিস্তানের কোনাে নাগরিকের নেই। শুধু তাই নয়, সে দাবী
কেউ উত্থাপন করলে একথা নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া চলে যে সেই ব্যক্তি রাষ্ট্র শ, ভারতের পােষ গুপ্তচর এবং সেই হিসাবে নাগরিক অধিকারের অযােগ্য। কাজেই তাকে কঠোর হস্তে দমন করা রাষ্ট্রের পক্ষে একটা অপরিহার্য কর্তব্য।
কেবল মাত্র রেস কোর্সের বাতেই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ভাষণে, বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের সাথে আলাপ-আলােচনায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিদায় বাণীতেও তিনি ঐ একই বক্তব্যের পুনরুক্তি করেন। তার এই আচরণ সত্বেও পূর্ব বাঙলায় ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সালে নােতুনভাবে শুরু করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বিরােধী নানা উক্তি এবং পূর্ব বাংলার জনসাধারণের বিভিন্ন দাবী-দাওয়াকে প্রাদেশিকতা আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্যের আহ্বান সত্ত্বেও কায়েদে আজমের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং তার প্রতি সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধাই এই পর্যায়ে নােতুন আন্দোলন গঠনের পক্ষে ছিলো মস্ত বাধাস্বরূপ। এই অবস্থার পরিপূর্ণ সুযোগ নিতে পূর্ব বাঙলার প্রাদেশিক সরকার কোনাে গাফিলতি করেনি।
কিন্তু নিজের ব্যগিত জনপ্রিয়তাকে কায়েদে আজম জিন্নাহ আন্দোলন দমন করার কাজে ব্যবহার করতে সমর্থ হলেও তার বিভিন্ন প্রকার উক্তির ফলে ছাত্র এবং জনসাধারণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা অনেকখানি কমে আসে। শুধু রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবেই নয়, পাকিস্তান আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা হিসাবেও পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের গণতান্ত্রিক দাবী-দাওয়াকে তিনি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে বিচার করবেন সকলে তাই আশা করেছিলাে। কিন্তু তিনি তাদের সে আশা পূর্ণ না করায় প্রথম পর্যায়ে একটি নিদারুণ হতাশার ভাব স’কে আচ্ছন্ন করে এবং তার ফলে প্রায় সকলেই আন্দোলনের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
কায়েদে আজম ঢাকা পরিত্যাগ করার পর রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে আন্দোলনের পর্যালােচনাকালে ছাত্র লীগ এবং তমন্দুন মজলিসের সদস্যেরা নিজেদের সংগঠনের কৃতিত্বের উপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করেন। তমদ্দন মজলিস আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে, বিশেষতঃ যখন তা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাে তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কিন্তু মার্চের প্রথম দিক থেকে আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করার সাথে সাথে তমদ্দন মজলিসের গুরুত্ব এবং তাদের নেতৃত্বের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। এই পরবর্তী পর্যায়ে গণতান্ত্রিক যুব লীগ এবং সাধারণ ছাত্র সমাজই আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
আন্দোলনের সময় মন মজলিসের শামসুল আলম এবং মুসলিম ছাত্র লীগের নঈমুদ্দীন আহমদ যৌথভাবে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বায়কের কাজ করেন। এই দুজনের মধ্যে শামসুল আলমের কাছেই পরিষদের খাতাপত্র এবং অন্যান্য রেকর্ড থাকতাে। কর্মপরিষদের এই বৈঠকে শামসুল আলম আহ্বায়কের পদে ইস্তফা দেন। কারণ তার মতে আন্দোলন তখন এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলাে যাতে করে সত্যিকার কিছু করার জন্যে প্রয়ােজন ছিলাে একটি নােতুন কর্মপরিষদ। পুরাতন পরিষদ তার মতে সেদিক থেকে ছিলাে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত।১০ | সেই বৈঠকেই শামসুল আলম মহম্মদ তােয়াহার কাছে সমস্ত কাগজ্ঞপত্র বুঝিয়ে দেন এবং তারপর এম. এস.সি. শেষ বর্ষের ছাত্র আবদুল মান্নান অস্থায়ীভাবে আহ্বায়কের কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে মনােনীত হন।
১৩০
চতুর্থ পরিচ্ছেদ। নাজিমুদ্দীন সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা ১। ব্যবস্থাপক সভায় খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী প্রস্তাব
৬ই এপ্রিল, ১৯৪৮, মঙ্গলবার বেলা তিনটের সময় পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার যে অধিবেশন বসে তাতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন বাংলাকে সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার জন্যে নিম্নলিখিত প্রস্তাব পেশ করেন : | (ক) পূর্ব বাংলা প্রদেশে ইংরাজীর স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে
| গ্রহণ করিতে হইবে; এবং (খ) পূর্ব বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে যথাসম্ভব
বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশ স্কলারদের মাতৃভাষা। এর পর ব্যবস্থাপক সভায় কংগ্রেস দলের নেতা বসন্তকুমার দাস স্পীকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে পূর্বদিন পরিষদের নেতা খাজা নাজিমুদ্দীন একটি নােটিশ মারফত জানিয়েছিলেন যে তিনি সেদিন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন, কিন্তু তার প্রস্তাবের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনােকিছু উল্লেখ করেননি। তিনি আরও বলেন যে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটিকে সরকারী প্রস্তাব বলেই মনে হয় এবং সেটা সরকারী দলের অনুমােদনও নিশ্চয় লাভ করেছে। বসন্তকুমার দাস প্রস্তাবটি বিবেচনার জন্যে সময় প্রার্থনা করে বলেন যে এ বিষয়ে সংশােধনী প্রস্তাব ‘আনার অধিকার তাদের আছে এবং তার পূর্বে মূল সরকারী প্রস্তাবটি তাদের পাটি মিটিং-এ আলােচিত হওয়া প্রয়ােজন। | বিরোধী দলীয় নেতার এই বক্তব্যের পর খাজা নাজিমুদ্দীন তার প্রস্তাবের উপর আলােচনা পরদিন মূলতুবী রাখতে সম্মত হন। এর পর স্পীকার আবদুল করিম বলেন যে মুলতুবী প্রস্তাবের সংখ্যা দুই-একটি হলে কোনাে অসুবিধা হবে
। কিন্তু সংখ্যা যদি তার থেকে বেশী হয় তাহলে যারা সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করতে চান তারা যেন পরদিন বেলা তিনটের মধ্যে সেগুলি দাখিল করেন।
৮ই এপ্রিল বৃহস্পতিবার বেলা তিনটের সময় পরিষদের কাজ শুরু হয়। অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ে প্রাথমিক আলােচনার পর স্পীকার আবদুল করিম | + মূল সরকারী প্রস্তাব এবং পরবর্তী সংশােধনী প্রস্তাবগুলি সবই পরিষদে ইংরাজীতে পেশ করা হয়।
ফল্পেকে ভাঙ্গা বিষয়ক সংশােধনী প্রস্তাবগুলি পেশ করতে অনুরোেধ জানান। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন তখন বলেন যে পরিষদের সামনে পূর্বে যে প্রস্তাব তিনি উপস্থিত করেছেন তার শেষ বাক্যে কলার’-এর কালে ছাত্র শটি তিনি সংযােজন করতে চান।
২। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাব
প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের উপরােক্ত বক্তব্যের পর বিরােধীদলীয় সদস্য বীরেন্দ্রনাথ দত্ত সরকারী প্রস্তাবের উপর নিম্নলিখিত সংশোধনী প্রস্তাবটি পেশ করেন :
১। এই পরিষদের অভিমত এই যে(ক) বাংলা পূর্ব বাঙলা প্রদেশের সরকারী ভাষারূপে গৃহীত হইবে; (খ) পূর্ব বাঙলা প্রদেশে ইংরেজীর স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য আন্ত
ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। (গ) পূর্ব বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা। ২। এই পরিষ আরও মনে করে যে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র
ভাষা হওয়া উচিত; এবং ৩। এই পরিষ পাকিস্তান সরকারের নিকট সুপারিশ করে যে(ক) সর্বপ্রকার নােট ও টাকা পয়সা, টেলিগ্রাফ, পােস্টকাড, ফর্ম, বই
ইত্যাদি ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস, রেলওয়ে এবং পাকিস্তান সরকারের অন্য সর্বপ্রকার সরকারী ও আধা-সরকারী ফর্মে অবিলম্বে
বাংলা প্রচলন করা হউক ; (খ) কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে মােগ
দানের জন্য সকল প্রকার প্রতিযগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যম এবং
অন্যতম বিষয় হিসাবে বাংলা প্রবর্তন করিতে ; এবং ৪। এই পরিষদ সংবিধান সভার সকল সদস্যকে অনুরােধ জানাইতেছে
এবং পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের নিকট বিশেষভাবে আবেদন করিতেছে যাহাতে তাহারা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার জন্য সর্বপ্রকার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন
করেন। ধীরেনাথ ও তার প্রস্তাবটিকে পাঠ করার পরই সে সম্পর্কে কয়েকজন
শদ আপত্তি উথাপন করেন। প্রথমেই আবদুল বারি চৌধুরী বলেন যে ধীরেননাথ দত্তের উত্থাপিত সংশােধনী প্রস্তাবটি বাস্তবপক্ষে মূল প্রস্তাবের পরিবর্তে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রস্তাব। কাজেই সেটি সংশােধনী প্রস্তাব হিসাবে কোনােমতেই বিবেচিত হতে পারে না। শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ বলেন যে প্রস্তাবটি সংশােধনী প্রস্তাবের আকারে কখনােই আসতে পারে না কারণ তাতে এমন কতকগুলি বিষয়ের উল্লেখ আছে যেগুলির উপর প্রাদেশিক সরকারের কোনাে এখতেয়ার নেই। তাকে সমর্থন করে অর্থ দফতরের মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী বলেন যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রাবটি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পরিশের আকারে একটি নােতুন প্রস্তাব হিসাবে আসতে পারে অন্য হিসাবে নয়, কারণ তার মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ের উল্লেখ আছে সেগুলি প্রাদেশিক সরকাবের আওতা বহির্ভূত।
উপরােক্ত সমালােচনার জবাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন যে সরকারী প্রস্তাবটিতে বাংলা ভাষাকে শুধু পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা করার কথা বলা হয়েছে কিন্তু তার প্রস্তাবে তিনি বাংলা ভাষাকে এই প্রদেশের মাতৃভাষা এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলেছেন। তাঁর সেই মূল প্রস্তাব যদি না নেওয়া হয় তাহলে সংশােধনী প্রস্তাব দেওয়ার কোনাে অর্থ হয় না।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন বলেন : এটি একটি স্বীকৃত নীতি যে প্রাদেশিক সরকাবের এলাকা বহির্ভূত কোনাে বিষয়ে প্রাদেশিক পবিষদে প্রস্তাব উত্থাপন কবা চলে না, তার জন্যে গভর্নরের কাছে সবাসরি বক্তব্য পেশ করতে হয়। স্যার, অনার হয়তাে স্মরণ আছে যে আগেকার দিনে কেন্দ্রীয় সরকারের এখতেয়াবভূক্ত কোনাে বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বক্তব্য পেশ করতে হলে গভর্নয়ের মাধ্যমে সেটা করার একটা নির্ধারিত পদ্ধতি ছিলাে। যে সমস্ত বিষয়গুলি প্রাদেশিক, একমাত্র সেগুলিই এখানে আলােচিত হতে পারে। এই প্রস্তাবটির যা বিষয়বস্তু তাতে করে এর একমাত্র আলােচনাক্ষেত্র সংবিধান সভা। সেই হিসাবে গভর্নরের মাধ্যমে একটা আবেদন ব্যতীত অঙ্গ কোনােভাবে বিষয়টি তিনি এখানে আলােচনা করতে পারেন না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই সংশােধনী প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে খাজা নাজিমুদ্দীন ব্যবস্থাপক সভার এখতেয়ার এবং নির্ধারিত নীতির উল্লেখ করেন। এ প্রসলে একজন অভিজ্ঞ সংসদীয় রাজনীতিক হিসাবে তিনি পূর্ববর্তী বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক লভার আইন-কানুন সম্পর্কেও স্পীকারের মাধ্যমে পরিষদকে স্মরণ করিয়ে দেন।
এক্ষেত্রে নীতি বিষয়ে তিনি যাই বলুন রাষ্ট্রভাষা কর্ম-পরিষদের সাথে তিনি যে ৮ দফা চুক্তি সম্পাদন করেন তার তৃতীয় দফা অনুসারে তিনি এই মর্মে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হন যে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার পরবর্তী অধিবেশনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সুপারিশ করে তিনি একটি সরকারী প্রস্তাব উত্থাপন করবেন। এই চুক্তিপত্রটি তিনি ১৫ই মার্চ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভায় পাঠ করে শােনান। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবটিতে ৮দফা চুক্তি বহির্ভূত কোনাে বক্তব্য ছিলাে না। বিতর্কের পরবর্তী পর্যায়ে কয়েকজন সদস্য চুক্তির এই দিকটি সম্পর্কে উল্লেখ করলেও কর্ম-পরিষদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময় নাজিমুদ্দীনের এই নীতিজ্ঞান বিলুপ্ত হয়েছিলাে কেন এ সম্পর্কে প্রশ্ন করে তাকে কেউই খুব বেশী বিব্রত করেননি। উপরন্তু প্রস্তাবটি মূল প্রস্তাবকে ছাড়িয়ে গেছে এবং তা প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত এই বলে স্পীকার সংশােধনী প্রস্তাবটিকে অগ্রাহ্য করায় এ বিষয়ে বিশেষ কোনাে উচ্চবাচ্য না করে করে সকলেই স্পীকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেন। শুধু তাই নয়। এই স্বীকৃতির পরও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাবটি প্রাদেশিক সরকারের আওতা বহিভূত এই কথার পুনরুক্তি করে আবদুস সবুর খান এবং শামসুদ্দীন আহমদ খোন্দকার পরিষদের সময় নষ্ট করেন।
প্রথম সংশােধনী প্রস্তাবটি নাকচ হওয়ার পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিয়ােল্লিখিত দ্বিতীয় প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন :
১। এই পরিষদের অভিমত এই যে(ক) বাংলা পূর্ব বাংলা প্রদেশের সরকারী ভাষারূপে গৃহীত হইবে; (খ) পূর্ব বাঙলা প্রদেশে ইংরাজীর স্থলে বাংলা প্রবর্তনের জন্য অতি
ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। (গ) পূর্ব বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে শিক্ষার মধ্যেম হইবে বাংলা। ২। এই পরিষদ পাকিস্তান সরকারের নিকট সুপারিশ করে যে(ক) সর্বপ্রকার নােট ও টাকা-পয়সা, টেলিগ্রাফ, পােস্টকার্ড, ফর্ম, বই
ইত্যাদি ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস, রেলওয়ে টিকিট এবং পাকিস্তান সরকারের অন্য সর্বপ্রকার সরকারী ও আধা-সরকারী ফর্মে
অবিলম্বে বাংলা প্রচলন করা হউক; (খ) কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিসে এবং সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীতে
যােগানের জন্য সকল প্রকার প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্য এবং অন্যতম বিষয় হিসাবে বাংলা প্রবর্তন করিতে হইবে।
এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটিকেও খাজা নাজিমুদ্দীন প্রাদেশিক সরকারের এলাকা বহির্ভূত হিসাবে বিবেচনার অযােগ্য বলে বর্ণনা করেন। একথার পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তৎক্ষণাৎ অন্য একটি সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করতে উদ্যত হন। তার এই অবস্থা দেখে হামিদুল হক চৌধুরী বলে ওঠেন যে ধীরেনবাবু তার প্রস্তাবগুলির দোষত্রুটি সম্পর্কে পুরােপুরিভাবে অবহিত কাজেই তিনি আসল সংশােধনী প্রস্তাবটির দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে আসছেন।১০। . ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এর পর তার তৃতীয় এবং শেষ সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন :
১। এই পরিষদের অভিমত এই যে(ক) বাংলা পূর্ব বাঙলা প্রদেশের ভাষারূপে গৃহীত হইবে। খ) দুই বৎসরের মধ্যে পূর্ব বাংলা প্রদেশে ইংরাজার স্থলে বাংলা
প্রবর্তনের জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হইবে। ‘গ) পূর্ব বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব উত্থাপন পদ্ধতি থেকে একটা স্পষ্ট বােঝা যায় যে প্রস্তাবটি সম্পর্কে হামিদুল হকের বক্তব্য আংশিকভাবে সত্য। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম প্রস্তাবটি তিন অংশে বিভক্ত। এই তিন অংশকে তিনি এমনভাবে সাজিয়েছিলেন যাতে প্রথমবার সেটির বিরুদ্ধে আপত্তি উঠলে শেষ অংশকে তিনি বাদ দিতে পারেন। এবং দ্বিতীয় প্রস্তাবের ক্ষেত্রে আপত্তি উঠলে দ্বিতীয় অংশটিকে বাদ দিয়ে প্রথম অংশটি আবার উত্থাপন করতে তাঁর কোনাে অসুবিধা না হয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের তিন দফা প্রস্তাব এবং তার পরবর্তী পর্যায়ে কংগ্রেস দলীয় সস্যদের একের পর এক সংশােধনী প্রস্তাব পেশের ধারা এটাই প্রমাণিত হয় যে তাদের প্রস্তাবগুলি প্রত্যাখ্যাত হবে একথা তারা পূবেই ধরে নিয়েছিলেন এবং সেই হিসাবে নাজিমুদ্দীন সরকারের সাথে ভাষার দাবী নিয়ে দরাদরি করার জন্যেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ধাপে ধাপে তার
নতম প্রস্তাবের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এদিক থেকে বিচার করলে প্রস্তাবটি ত্রুটিপূর্ণ এই উপলব্ধি থেকে আলােচ্য প্রস্তাবটি তিন দফায় পেশ করা হয়েছিলাে, হামিদুল হকের এই যুক্তির ভ্রান্তি সহজেই বােঝা যাবে। | প্রস্তাবটি পাঠ করার পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরিষদে একটি ব্যাখ্যামূলক বক্তৃতা দেন। বাংলাকে যথাশীঘ্র দেশের শিক্ষা ও সরকারী কাজকর্মের ভাষা হিসাবে প্রচলনের যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন :
এখন কথা হচ্ছে যে প্রস্তাব এই House-এ উত্থাপিত হয়েছে সে প্রস্তাবে কতদিনের ভিতর বাংলা ভাষা আমাদের official-language হবে তার
উল্লেখ নাই। আমাদের কথা হচ্ছে অতি শীয় তা করা দরকার। কারণ যদি অতি শীঘ্র তা করা না হয়, যদি তার ভিতর dead line পড়ে যায় তাহলে ১•• বৎসরেও বাংলাভাষা এখানকার প্রাদেশিক ভাষার স্থান লাভ করতে পারবে না। সেজন্য আমি বলছি যত শীঘ্র হয় তার ব্যবস্থা করুন যাতে আমরা বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণভাবে প্রাদেশিক ভাষায় পরিণত করতে পারি। বর্তমানে আর্জি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সব কিছুই ইংরাজীর Throughতে হয়ে আসছে। এখন হতে ইংরেজী বাদ দিয়ে বাংলা করতে হবে। অনেকে বাংলা ভাল জানেন, লিখতে পড়তে পারেন, অথচ Court কাছারীর কোনাে কাজের জন্য তাদের ইংরেজী জানা লােকের উপর নির্ভর করতে হয়। বাংলা হলে এই সব অসুবিধাগুলি দূর হতে পারে। আর একটা কথা, নিজের ভাষা আয়ত্ব করা সহজ কিন্তু পরের ভাষা ইংরাজী আমরা যতই বুঝি বা বলি আমার অভিজ্ঞতা হতে বলতে পারি যে নিজের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় মনের ভাব ঠিক-ঠিক ব্যক্ত করা যায় না। আমি একজন উকিল হিসাবে একথা বলতে পারি যে উকিল ও বিচার কর্তারাও মাতৃ ভাষায় বক্তৃতা ও রায় দানের ব্যবস্থা হলে ভালভাবে কাজ করতে পারবেন। স্কুল কলেজে শিক্ষার ভিতর দিয়ে বাংলাকে গড়ে তুলতে হবে। কাজেই বাংলা ভাষার উন্নতি ও পরিপুষ্টির জন্য একটি Committee গঠন করতে হৰে যেরূপ পশ্চিমবঙ্গে গঠিত হয়েছে। যদি এ বিষয়ে ভাল ব্যবস্থা অবলম্বিত
হয় তাহলে ১০ বৎসরে কেন ১৫ বৎসরেও কোনাে উন্নতি হবে না। কাজে কাজেই ইংরেজী থেকে যাবে।১২
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন :
জনগণের দাবী যে প্রাদেশিক ভাষা নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। জনগণের এই দাবীর পিছনে একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। ‘আমরা যে রাষ্ট্র গঠন করছি এই রাষ্ট্রের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান ২ হাজার মাইল। রাষ্ট্রের এক অংশের সঙ্গে অপর অংশের ব্যবধান ২ হাজার মাইল এমন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা দুইটি করাই সঙ্গত। প্রকৃত প্রস্তাবে পাকিস্তানের দুই unit-এর মধ্যে এক unit-এর ভাষা পুরাপুরি বাংলা আর এক unit-এ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, পশ্চিম পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কোনােটির ভাষার কোনােটির সঙ্গে মিল নেই। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের ৪ কোটি অধিবাসীর ভাষাকে তারা তাদের unit-এর রাষ্ট্রভাষা
দাবী করলে অন্যায় বলা যায় না। প্রথম যখন এ বিষয়ে কথা উঠেছিল। তখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী সাহেব বলেছিলেন একটা agreement হচ্ছে যাতে বাংলাকে এই প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা করা হয়। তিনি আরও জানান যে এটা পাকিস্তান মীসভাকে জানান হবে ও ব্যবস্থা করা হবে। মুসলিম লীগ পক্ষের সভ্য মিঃ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী এই প্রস্তাব এনেছিলেন যে বাংলা ভাষা প্রাদেশিক ভাষা হবে ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে। এই agreement-এর উপর আমি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলাম কিন্তু সে প্রস্তাব অগ্রাহ্ন হয়েছে। আপনারা জানেন প্রকৃত প্রস্তাবে আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন তা শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের official language করবার জন্য। আমাদের উজিরে আজমের সেই প্রস্তাব আনা উচিত ছিলাে।১৩
এব পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ফেব্রুয়ারি মাসে গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনে ভাষা সম্পর্কিত বিতর্কের উল্লেখ করে বলেন : ‘আপনারা জানেন এটা সৰ্ববাদী সম্মত যে প্রকৃত প্রস্তাবে বালা ভাষাই এখানকাব রাষ্ট্রভাষা। আমাদেব Constituent Assemblyতে এই প্রস্তাব আমি গত অধিবেশনে উত্থাপন কবেছিলাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেব সেটা সংশােধন করে নেবেন এইটাই ছিল আমার অভিপ্রায়। আমাদের দেশের শিক্ষিতের শতকরা ৬০ জনের বেশী লােক বাংলা ভাষায় পড়তে পাবে অথচ ইংরাজী জানে না, উছু জানে না, এই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী সাহেব ব্যবস্থা কব বলেছিলেন। আমি অামাদেব প্রধানমন্ত্রী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করছি যে তার কি ব্যবস্থা করা হয়েছে। Post card-এ বাংলা নাম নাই, noney order form -এ বাংলার নাম নাই, Telegraph-এ বাংলার নাম নাই, Railway ticket-এ বাংলার নাম নাই। আমি জিজ্ঞাসা করি বাংলা দেশের কত লোেক বাংলা ছাড়া অন্য ভাষা বােঝে। উজিরে আজমের বােঝা উচিত ছিল যে currencyতে বাংলা না থাকলে সাধারণ লােকের কত অসুবিধা হয়। Railway ticket নিয়েও কম অসুবিধা হবে না। একজন অজ্ঞ লােক যে উছু জানে না এমন লােকের সংখ্যা এখানে খুব বেশী। তাদের অসুবিধার কথা একটু চিন্তা করুন।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার বক্তৃতার শেষে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে পরিষদের কাছে নিম্নলিখিত ভাষায় আবেদন করেন :
এই সংশােধনী প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে জনগণের নিজেদের আমি প্রতিনিধি মাত্র। এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করলে জনসাধারণের যথেষ্ট কষ্টের ও অসুবিধার লাঘব হতে পারত। এগুলি Central Subject বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। Provincial Administration-এর উপর যা এসে পড়েছে তার উপর Province-এর জনগণের একটা দাবী আছে। এই সব প্রশ্ন উত্থাপন করলে উজিরে আজম ও মন্ত্রীবর্গ নানা কথা বলে থাকেন। আমি আপনাদের কাছে জানাতে চাই এটা সমর্থন করুন বা না করুন এটাই জনগণের দাবী। আমি পাকিস্তানের অধিবাসী হিসাবে এবং পাকিস্তানের প্রতি আমার আনুগত্য আছে বলে আমি এই অসুবিধার কথা পাকিস্তান পরিষদে পেশ করেছিলাম। আমার এর ভিতর অন্য কোনাে উদ্দেশ্য ছিল
। এটা আমার দাবী বলে মনে করি বলেই এই প্রশ্ন আমি উত্থাপন করেছিলাম। আমরা পাকিস্তান গ্রহণ করেছি বলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উপর আমাদের একটা দাবী রয়েছে। ৭ কোটি বাঙালীর মধ্যে ৪ কোটির উপর পাকিস্তানে রয়েছে। তাদের রাষ্ট্রভাষা বাঙলা হওয়া যুক্তিসঙ্গত এইজন্য আমি এই দাবী উপস্থিত করেছিলাম। আমি আশা করি মন্ত্রীমণ্ডলী এবং জনগণের প্রতিনিধি যারা আছেন তারা জনগণের এই দাবী সমর্থন করবেন এবং নিজেরাই এই প্রস্তাব করবেন। শুধু বাংলায় বক্তৃতা করলে চলবে না। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।১৫
বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে প্রস্তাব উত্থাপনকালে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপন করে ধারেন্দ্রনাথ দত্তের কিছু বলা প্রয়ােজন হয়েছিলো তার কারণ গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনের বিতর্ক থেকে শুরু করে কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল সংবাদপত্র, মুৎসুদ্দাদের স্মারকলিপি, কায়েদে আজমের বক্তৃতা এবং প্রাদেশিক পরিষদের বিতর্কে ভাষা আন্দোলনকে হিন্দুদের দ্বারা প্ররােচিত এবং অন্তর্ঘাতমূলক বলে সব সময়েই অভিহিত করা হয়েছিলাে। অবশ্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই আনুগত্য প্রকাশের পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে এই সাম্প্রদায়িক এবং উদ্দেশ্যপ্রণােদিত মিথ্যা প্রচারণা যে বন্ধ হয়েছিলাে তা নয়। বস্তুতঃ এর কোনাে প্রভাবই সরকারী মহলের পরবর্তী সমালােচনার মধ্যে প্রতিফলিত হয়নি। এবং তা না হওয়ারই কথা।
৩। অন্যান্য সংশােধনী প্রস্তাৰ
ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তৃতার পর সিলেটের মুনাওয়ার আলী একটি সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করার সময় স্পীকার তাকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি তার প্রস্তাবগুলি লিখিতভাবে দাখিল করেছিলেন কিনা। জবাবে মুনাওয়ার আলী বলেন যে তিনি পূর্বদিন কয়েকটি সংশােধনী প্রস্তাব লিখিতভাবে দাখিল করেছিলেন এবং অন্য একটির নােটিশও দিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন যে তিনি আশা করেছিলেন তার প্রস্তাবগুলি মুসলিম লীগ পালমেন্টারী পার্টি মিটিং-এ আলােচিত হবে কিন্তু বস্তুতঃপক্ষে তা হয়নি। কাজেই এখন যদি তার নেতা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন তাঁকে অনুমতি দেন তাহলে তিনি পরিষদে তার সংশােধনী প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে পারেন। মুনাওয়ার আলীর এই কথার পর পরিষদে তুমুল হাস্যধ্বনির মধ্যে স্পীকার তাকে বলেন, আপনি দেখছি নিজের প্রস্তাব পেশ করার পরিবর্তে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। এর পর মুনাওয়ার আলী আর কোনো উচ্চবাচ্য না করে তার সংশােধনী প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিক ভাবে পেশ করা থেকে বিরত হন।
স্পীকারের নির্দেশমতাে বিনােচন্দ্র চক্রবর্তী এর পর নিম্নলিখিত সংশােধনী প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন : ।ক। পূর্ব বাঙলা প্রদেশের সকল অফিস এবং আদালতে ইংরাজীর | পরিবর্তে বাংলা সরকারী ভাষা হিসাবে গৃহীত হইবে; এবং (খ) পূর্ব বাঙলায় বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে বাঙালীদের শিক্ষার মাধ্যম হইবে বাংলা।
বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তী তার সংশােধনী প্রস্তাবটি পাঠ করার পর বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে তিনি যেভাবে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি। পরিষদের সামনে উপস্থিত করেছেন তাতে তাদের মনে যথেষ্ট আশঙ্কার সঞ্চার হয়েছে। তিনি মন্ত্রীসভার উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে তাদের সন্দেহের অবসান ঘটানাের জন্যে নাজিমুদ্দীনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি সরকারী প্রস্তাবে ‘যথাসম্ভব’ কথাটির প্রতি বিশেষভাবে জোর দিয়ে বলেন যে এই ধরনের একটা অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যে সরকার যে কোনাে আত ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন সে ভরসা তাদের নেই। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সরকারী মনােভাবই যে তাদের এই আশঙ্কার মূল কারণ একথাও তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
এই বাংলা ভাষার আন্দোলন অধিবেশন হবার পূর্ব হতে যখন আরম্ভ করা
হয়েছিল তখন আপনারা জানেন যে সকল যুবক ও নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনের পুরােভাগে ছিলেন তাঁরা ছিলেন সকলেই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এবং মুক্ত নাগরিক হিসাবে সম্পূর্ণভাবে এটা সমর্থন করবার ইচ্ছা আরও অনেকে প্রকাশ করেছিলেন। আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকে নানা দিক বিচার করে এর সঙ্গে যােগ দিতে পারি নাই। তাদের আমরা কোনাে সাহায্য করি নাই তবুও তাদের নিন্দার ভাগ করা হয়েছে। যদি আমরা সর্ব সম্প্রদায় এই আন্দোলনকে আরও সাহায্য করতাম তাহলে আন্দোলন আরও বড় হয়ে উঠত। তথাপিও প্রধানমন্ত্রী মহাশয় ঘােষণা করেছিলেন এই আন্দোলনের পিছনে অনেকের দূরভিসন্ধিমূলক সম্পর্ক ছিল।
বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির ষড়যন্ত্রের বিষয়ে উল্লেখ করে বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তী বলেন :
আপনারা জানেন এই বাংলা ভাষার প্রচলনের বিরুদ্ধে অনেক গােপন ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং যারা এই পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল তারা কেবল মাত্র এটা নিজেদের মধ্যে আবদ্ধ রাখে নাই সরকারী কর্মচারীদেরও প্রভাবান্বিত করেছিল এবং এই যুক্তিসঙ্গত আন্দোলন যারা করেছিল তাদেরও নির্যাতন ভােগ করতে হয়েছিল। এর দায়িত্ব কাহারও নিজের একার নয় সমস্ত দলের ও নেতার প্রতি দায়িত্ব রয়েছে। আমরাখবরের কাগজে দেখেছি (১লা এপ্রিল) যে এই প্রদেশের ভাষা বাংলা হবে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করবার যে কথা হয়েছিল তা করা হবে না এটাই লীগ দলের সভায় স্থির হয়েছে।
কায়েদে আজম জিন্নাহর পূর্ব বাঙলা সফরের পর ভাষা সম্পর্কে পূর্ব বাঙলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির ৩১শে মার্চ তারিখে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে কেন্দ্রের কাছে সুপারিশের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত হয়। কায়েদে আজম কর্তৃক বাংলার দাবীকে অস্বীকার এবং উর্দু ই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়ার যােগ্য এই ঘােষণার পর পার্লামেন্টারী পার্টি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে প্রাদেশিক পরিষদে কোনাে সরকারী প্রস্তাব উত্থাপন করার পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করে। বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তীর বক্তৃতায় তিনি এই ঘটনারই উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদ, শিক্ষা সেক্রেটারী ফজলে আহমদ কৰিম ফজলী প্রভৃতি আমলাদের খােলাখুলি বাংলা বিরােধিতার কথা ভাষা আন্দোলনের সময় কারাে অজানা ছিলাে না। সরকারী কর্মচারী হওয়া সত্বেও তারা ভাষা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে অনেক সময় সক্রিয় এবং সরাসরিভাবে তাদের মতামত বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্ত করেন। এ
বিষয়ে সরকারী নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা খুব উল্লেখযােগ্য ছিলাে।
এসব সমস্যার প্রতি লক্ষ্
য রেখে বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তী তার বক্তৃতার শেষে বলেন :
আজ যদি নাগরিক অধিকার ও সুখ সুবিধার ক্ষেত্রে বাংলার স্বাতন্ত্র রােধ করা হয় তাহলে আমরা কোনাে কাজে অগ্রণী না হয়ে সকলের পিছনে পড়ে থাকবে। আর পাকিস্তানের এই অংশে দুর্গতি বেড়েই চলবে এবং পাকিস্তানের উন্নতিকর কাজে জনগণের মনােবল ক্ষুন্ন হবে। পাকিস্তান শাসনকার্যে যে সব কর্মচারীর প্রয়ােজন হবে আর অধিকাংশ সংখ্যানুপাতে বাংলা থেকেই নেবার প্রয়ােজন হবে এবং সকল কাজে লােক সংখ্যারই অনুপাতে ও দায়িত্বে বাংলার স্থান থাকবে এটা আমরা দেখতে চাই। আমাদের দায়িত্ব বিরাট, কর্তব্য মহান, সেই কর্তব্য ও দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়ার কারণ সত্যই অনুধাবন করতে পারি না। যুক্তিসঙ্গত কোনাে কারণ থাকলে না হয় বুঝতে পারতাম কিন্তু তা কিছুই দেখি না। ইংরাজীর কোনােই প্রয়ােজন নাই এখন বাংলার প্রয়ােজন এত বেশী এবং তা কথায় বলে শেষ করা যায় না। বাংলা এ প্রদেশের ভাষা হবেই এটা অবশ্য খুব আনন্দের কথা। আজ আর বাংলাকে অবহেলা করলে চলবে না। আমরা যাতে ঠিকমতাে আমাদের দায়িত্ব পালন করি সেই আলােচনাই করব। নেতৃস্থানীয় যারা আছেন তাদের এ বিষয়ে অগ্রণী হতে হবে কিন্তু দুঃখের বিষয় নেতৃস্থানীয় যা তারা এ বিষয়ে অবহেলা করেছেন। সমস্ত পাকিস্তানে বাংলা যাতে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্থান পায় তার জন্য আমাদের চেষ্টা করা উচিত। বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তী বক্তৃতার এই পর্যায়ে আবদুস সবুর খান তাকে বাধা দিয়ে স্পীকারকে বলেন যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রথম সংশােধনী প্রস্তাবকে উত্থাপন করতে না দিয়ে তিনি পরিষদ ভাষা বিষয়ক আলােচনার গণ্ডী প্রকৃতপক্ষে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যাচ্চে যে তিনি সে বিষয়ে সদস্যদেরকে যথেচ্ছ আলােচনার সুযােগ দান করছেন। এর পর তিনি সদস্যদেরকে কেবলমাত্র প্রাদেশিক ভাষা সম্পর্কেই নিজেদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে অনুরােধ জানান। বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে তিনি অভিযােগ করেন যে তিনি নিজের বক্তৃতায় পাকিস্তানের এলাকা বহির্ভূত বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। | সমগ্ৰ ৰক্তৃতাটি শেষ দিকে নাগরিক অধিকারও সুখ-সুবিধার ক্ষেত্রে বাঙলার
স্বাস্থ্য রক্ষার কথা ছিল। এ কারণেই সবুর খান বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তীর বক্তৃতা সম্পর্কে উপরােক্ত অভিযােগ করেন। অন্যথায় সমগ্র বক্তৃতার মধ্যে পাকিস্তানের এলাকা বহির্ভূত অন্য কোনাে বিষয়ের বিন্দুমাত্র উল্লেখ ছিলাে না।
সবুর খানের আপত্তি উত্থাপনের পর স্পীকারের নির্দেশ অনুযায়ী বিনােদচন্দ্র চক্রবর্তী সামান্য দুই এক কথা বলে তার বক্তৃতা শেষ করেন। | স্পীকার আবদুল করিম এর পর সদস্যদেরকে বলেন যে তারা যেন সেই সব সংশােধনী প্রস্তাবগুলি প্রথমে পেশ করেন যেগুলি মূল সরকারী প্রস্তাবটির প্রতিকল্প। সেগুলি আলােচনার পর অন্য সংশােধনী প্রস্তাবগুলি উত্থাপন করার জন্যে তিনি তাদেরকে অনুরােধ করেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে স্পীকারকে বলেন যে সমস্ত সংশােধনী প্রস্তাবগুলি উত্থাপিত হওয়ার পর তিনি সেগুলির জবাব দিতে চান। স্পীকার তার এই | প্রস্তাবে আপত্তি না করায় একে একে অন্য সংশােধনী প্রস্তাবগুলি পেশ করা হয়। | বিনােচন্দ্র চক্রবর্তীর পর আবদুল বারী চৌধুরী যে সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন তার মধ্যে দুই একটি সামান্য শব্দগত পরিবর্তন ব্যতীত উল্লেখযোেগ্য কিন্তু ছিলাে না। তবে প্রস্তাবটি পরিষদে পাঠ করার পর ইংরেজীতে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দানকালে তিনি বলেন উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে কোনাে প্রকার সন্দেহ প্রকাশ না করে তিনি শুধু একথা বলতে চান যে সরকারী প্রস্তাবটি খুব অস্পষ্ট এবং অনিদিষ্ট। বাংলা যে পূর্ব বাংলার সরকারী ভাষা হবে তা প্রস্তাবটি থেকে ভালভাবে বােঝা যায় না। তাতে শুধুমাত্র এটুকুই | বলা হয়েছে যে ভবিষ্যতে কোনাে এক সময়ে ইংরাজীকে তুলে দিয়ে তার স্থানে বাংলাকে পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা করা হবে। | আবদুল বারী চৌধুরীর পর প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী যে সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন তার মধ্যে তিনিও সরকারী প্রস্তাবের মধ্যে যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে দিতে বলেন। তিনি অন্যান্য কয়েকটি সংশােধন ছাড়াও প্রস্তাবটির (খ) ধারার পর নিম্নলিখিত ধারাটি যােগ দেওয়ার প্রস্তাব করেন : | (গ) এই পরিষদ, আরও মনে করে যে (১) পাকিস্তান রাষ্ট্রের মুদ্রা,
টেলিগ্রাফ এবং ডাক সংক্রান্ত যাবতীয় জিনিস যেমন পােস্টকার্ড, ফর্ম, বই ; রেলওয়ে টিকিট এবং অন্যান্য সরকারী ও আধা-সরকারী ফর্মে বাংলার ব্যবহার অবিলম্বে চালু করিতে হইবে এবং (২) কেন্দ্রীয় সিভিল সার্ভিস এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সমস্ত প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যম এবং অন্যতম বিষয় হিসাবে বাংলা প্রবর্তন করিতে হইবে।
এবং গ(১) ও গ(২) ধারা সম্বলিত প্রস্তাবটির এই অংশ যাহ’তে পাকিস্তান সরকার কার্যকর করিতে পারেন সেই উদ্দে েতাহাদিগকে এ বিষয়ে অবগত করাইবার জন্য পূর্ব বাংলা সরকারের নিকট অনুরােধ জানাইতেছে।
প্রস্তাবটির পাঠ শেষ হওয়ার পর আবদুল বারী চৌধুরী বলেন যে সং. শােধনী প্রস্তাবটি কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভূক্ত এবং সেই হিসাবে সেটিকে অগ্রাহ্য করা উচিত। এখানে উল্লেখযােগ্য যে প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ীর পূর্বে তিনি নিজের সংশােধনী প্রস্তাবের উপর বক্তৃতা প্রসঙ্গে সরকারী প্রস্তাবটিকে ‘অস্পষ্ট এবং অনিদিষ্ট’ বলে বর্ণনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবটি অস্পষ্ট ছিলাে এজন্যে যে তার মধ্যে কিভাবে, কোথায় এবং কতদিনের মধ্যে বাংলা পূর্ব বাঙলার সরকারী ভাষা হিসাবে প্রবর্তিত হবে সে সম্পর্কে কোনাে উল্লেখ ছিলাে না। এই সমস্ত কথাই যখন প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী তার প্রস্তাবটিতে উল্লেখ করলেন তখন আবদুল বারী চৌধুরী সেগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকারের আওতাভুক্ত এই কথা বলে আবার তার বিরােধিতা করলেন।
আবদুল বারী চৌধুরীর এই আপত্তির জবাবে এবং প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ীর সংশােধনী প্রস্তাবের সমর্থনে কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা বসন্তকুমার দাস বলেন যে প্রস্তাবিত (গ) ধারাটি কিছুতেই অগ্রাহ্য করা চলে না কারণ প্রস্তাটির প্রথম অংশে বলা হচ্ছে যে বাংলা হবে প্রদেশের সরকারী ভাষা এবং সেই হিসাবে প্রথম অংশটি থেকেই (গ) ধারাটি সরাসরিভাবে এসেছে। তিনি আরও বলেন যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হােক এ বক্তব্য তারা এই প্রস্তাবটিতে পেশ করেননি। তারা শুধু একথাই বলেছেন যে ম এবং অন্যান্য সব কিছুতে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করা হােক। বাংলা এই প্রদেশের সরকারী ভাষা হবে তার অর্থই হলো এই প্রদেশের সাধারণ মানুষ যাতে মুদ্রা ইত্যাদির উপর লেখা বুঝতে পারে তার ব্যবস্থা করা। সেজন্যেই এই প্রদেশের যে মুদ্রা ব্যবহৃত হবে তাতে বাংলাতে সব কিছু লেখা থাকা দরকার। পাকিস্তান সরকার যাতে সে ব্যবস্থা করতে পারেন তার জন্যেই তাদেরকে এ বিষয়ে অবহিত করার উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক সরকারকে অনুরােধ জানানাে হয়েছে। কাজেই সংশােধনী প্রস্তাবটি সম্পূর্ণভাবে প্রাসঙ্গিক।১০
শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদ এর পর বলেন যে বসন্তবাবু নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেননি যে প্রস্তাবটিতে ‘বাংলাকে অবিলম্বে সকল প্রকার মুদ্রায় ব্যবহার করা হােক একথা বলা হয়েছে। এবং যে রকম কোনাে প্রস্তাব তারা কিছুতেই গ্রহণ করতে পারেন না।
বসন্তকুমার দাস এর জবাবে বলেন মন্ত্রী মহােদয়েরও উচিত প্রস্তাবটির শেষের দিকে কি আছে সেটা দেখা। কারণ সেখানে প্রস্তাবটিকে পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠিয়ে সেটি কার্যকর করার জন্যে তাদেরকে অনুরোধ জানানাে হয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও মন্ত্রী আবদুল হামিদ বলেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত ইংরেজী shall’ কথাটি প্রস্তাবে আছে ততক্ষণ সেটিকে বাধ্যতামূলক বলেই নিতেই হবে।১৩
এর পর বসন্তকুমার দাস বলেন নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবটিতে ‘সরকারী ভাষা কথাটি অত্যন্ত অস্পষ্ট। তার অর্থ অনেক কিছুই হতে পারে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী পরিষদে কোনাে ব্যাখ্যাও উপস্থিত করেননি। কাজেই প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ীর সংযােজিত ধারাটি তার বক্তব্যের একটি অনুসিদ্ধান্ত মাত্র।১৪ স্পীকার শেষ ধারাটি সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে সংশােধন প্রস্তাবটির (গ) (১) এবং (গ) (২) অংশটি যাতে পাকিস্তান সরকার কার্যকর করতে পারেন সেজন্যে তাদেরকে সে বিষয়ে জানানাের উদ্দেশ্য তাতে শুধু পূর্ব বাঙলা সরকারকে অনুরােধ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছা করলে তা কার্যকর করতেও পারেন, না করতেও পারেন। এটা একটা অনুরােধ মাত্র। এর মধ্যে কোনাে বাধ্যতা নেই। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দীন তার এই বক্তব্যের বিরােধিতা করে বলেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কোনাে সুপারিশ করতে হলেই সেটা গভর্নকের মাধ্যমে করতে হবে। পরিষদে সাধারণভাবে কোনাে প্রস্তাব পাস করে তা করা যাবে না।১৬
বিতর্কের এই পর্যায়েনাজিমুদ্দীন আবার এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করায় বসন্তকুমার মাস তাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সাথে যে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাতে তিনি নিজেই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই বিষয়ে সুপারিশ করতে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু নাজিমুদ্দীন বিরােধীদলের নেতার এই বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ করে আবার বলেন যে সুপারিশ করতে হলে তা গভর্নরের মাধ্যমেই করতে হবে।
প্রভাসচত্র লাহিড়ীর সংশােধনী প্রস্তাবের উপর কিছুক্ষণ এই বিতর্কের পর তিনি নিজের প্রস্তাবটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন :
আমার মনে হচ্ছে কিছুদিন আগে যখন ভাষা সমস্যা নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল সেই সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী মহাশয় একটা agreement পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন তাতে আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম। এখন যে প্রস্তাব উপস্থিত হয়েছে তাতে দেখছি agreement-এর অনেক কথা প্রস্তাবের
ভিতর নেই। আমি এই জিনিসই পরিষ্কার করে প্রকাশ করতে চাই। Official language of the province of East Bengal, in all offices of Government and semi-Government institutions • and in all Courts, including the High Court of the Province,
এখন যে সমস্ত গতর্নমেন্ট Institutions ও অফিস আছে এবং semiGovernment Institution 72-District Board, Municipality • এসব জায়গায়ও বাংলা ভাষা প্রচলিত হােক এইজন্য semi-Government
কথাটি যােগ করতে বলছি। এবং High Court ও অন্যান্য court-এ বাংলা ভাষা প্রচলন করতে হবে কিন্তু High Court-এর order না হলে অন্যান্য Court-এ হতে পারে না। High Court থেকে যদি অন্যান্য Court-এ direction দেয় তাহলে সেখানে বাংলা ভাষায় রায় লেখা ইত্যাদি হতে পারে। (b) Clause-এ আছে as far possible যার বাংলায় অর্থ হয় যথাসম্ভব–আমি এই কথাটি উঠিয়ে দিতে চাই। এবং তার পরে একটি alternative প্রস্তাব আছে যেপ্রদেশের ভিতর যেখানে অবাঙালী ছাত্রের সংখ্যা বেশী সেখানে তাদের মাতৃভাষা গ্রহণ করা হবে আমি এই কথাটা বা এ জায়গাটা amend করতে চাই। এতে দেখা যাচ্ছে কোনো Institution-এ যদি tnajority ছাত্রদের ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা হয় এবং সেখানে যদি অল্প সংখ্যক বাঙালী ছাত্র থাকে তাহলে তাদের শিক্ষার কোনাে ব্যবস্থা হবে না। যাতে উভয়ের শিক্ষা হয় তার ব্যবস্থা করা হােক।
প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ীর পর যতীন্দ্রনাথ ভদ্র তার সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে পূর্ববর্তী প্রস্তাবগুলির থেকে নােতুন কোনাে কথা বলা হয়নি। কয়েকটি শব্দ পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছিলাে মাত্র। তার এই সংশােধনী প্রস্তাবের উপর বক্তৃতা প্রসঙ্গে যতীন্দ্রনাথ ভদ্র বলেন :
এই resolution খুব আশাপ্রদ হলেও এর ভিতর যে একটি কথা as far as possible আছে সেটি বাদ না দিলে অনেক অসুবিধা আসবে। ঐ as far as possible কথার ধূম্রজালে অনেক কিছু লুকায়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ হওয়া অহেতুক নয় তাই আমি প্রস্তাব করছি যে ঐ as far as possible-এর জায়গায় immediately কথা লাগান হােক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয় এর এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে কোনাে আপত্তির কারণ থাকতে পারবে না এবং এটা ঠিক কাজই করা হবে। এই বাংলা দেশে
১৪৫
অবাঙালী আসবে না বা থাকবে না তা আমি বলছি না। কিন্তু যেখানে শতকরা ১০ জন বাঙালী সেখানে বাংলা ভাষা না করার কোনাে যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। সেইজন্য আমি আশা করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয় আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন।২০
এর পর অমূল্যচন্দ্র অধিকারী এবং সুরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত যথাক্রমে তাদের সংশােধনী প্রস্তাব পেশ কবেন। তাদের প্রস্তাবগুলিকে মােটামুটিভাবে পূর্ববর্তী প্রস্তাবগুলির পুনরুক্তিই বলা চলে। সুরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত তার সংশােধনী প্রস্তাবে বাংলাকে পূর্ব বাঙলার সরকারী ও শিক্ষার ভাষা হিসাবে ১৯৪৮-এর জুন মাসের মধ্যে প্রচলনের কথা বলেন। অমূল্যচন্দ্র অধিকারী তার প্রস্তাবটি পাঠ করার পর কোনাে বক্তৃতা দেননি। সুরেশচন্দ্র দাসগুপ্ত তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি পরিষদে উত্থাপন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনকে অভিনন্দন জানিয়ে তার পর বলেন :
কিন্তু বাংলা ভাষাকে আমরা যাতে তার যথাযােগ্য স্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি এইজন্য বলছিলাম প্রস্তাবের মধ্য হতে as far as possible কথাটি তুলে দিন। এর দুইটি কারণ রয়েছে। একটি হচ্ছে ইংরাজীর কোনাে কথা আমরা আনব না। কোনােদিন বাংলা ইংরাজীর সমান পর্যায়ে আসবে তা আমরা বিচার করব না, তাহলে মাতৃভাষার অবহেলা করা হবে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যে English will be replaced by Bengali এমন কোন কথা প্রস্তাবে থাকবে না। এই প্রকারের কথায় ভয় হয়। অনেক লােক এদেশে আসে বাইরে হতে তারা এই সুযােগে বাংলা শিখবে না। মাইনে নেবে এ দেশ হতে আর এদেশের ভাষাকে অবহেলা করবে। রাষ্ট্রের সকল প্রয়ােজনীয় কাজে বাংলার প্রচলন করতে হবে, আদালতে বাংলার প্রচলন করতে হবে স্কুলে বাংলার প্রচলন করতে হবে, আইন বাংলা ভাষায় তৈরী করতে হবে। আমরা চাই যাবতীয় কিছু বাংলা ভাষায় করে দেওয়া হােক এবং তা as far as possible নয় যত শীঘ্র সম্ভব করুন।
সুরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের এই বক্তৃতার পর গােবিন্দলাল ব্যানার্জি একটি সংশােধনী প্রস্তাবে এক বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষা প্রচলনের কর্মসূচীকে কার্যকর করার প্রস্তাব করেন। প্রধানমনীর প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন : ‘ যে প্রস্তাব তিনি এনেছেন তাতে মনে সন্দেহ জাগছে তাই এটা সংশােধন করে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ করছি যে এক বৎসর্ষের মধ্যে
বাংলা ভাষার প্রচলন হবে তার চেষ্টা করতে হবে। এ সম্পর্কে আমাদের আরও একটি সন্দেহ জাগছে এবং তাতে গভর্নমেন্টের কাজের অসুবিধা থেকে যাবে এইজন্য বলছি যে সরকারী কর্মচারীদের ভিতর অনেক nonBengali officer আছেন তারা যে দেশের সেবা করছেন সেই দেশের ভাষাও তাদের শিখতে হবে। তা না হলে অনেক অসুবিধা হবে। কারণ আমাদের দেশের একটি ভাষাকে নিদিষ্ট ভাষায় পরিণত করতে হবে অবশ্য বাংলা ভাষার সাথে অন্য ভাষাও থাকবে। আর একটি কথা রাষ্ট্রনীতির দিক হতে আমরা স্বাধীন হয়েছি কিন্তু পাকিস্তানের অধিবাসী আজ পর্যন্ত তার তাৎপর্য ভাল করে উপলব্ধি করতে পারছে না। যারা পাকিস্তান অর্জন করেছে তারা কতকগুলি জিনিস আজও বুঝতে পারছে
। তা শুধু আইনেই লেখা রয়েছে। যে দেশে তাদের জন্ম যে ভাষায় তারা ছােট বেলা হতে কথা বলতে শিখেছে সেই ভাষাকে যদি তারা নিজেদের ভাষারূপে গ্রহণ করবার অধিকার না পায় তাহলে তারা স্বাধীনতার কি অর্থ বুঝবে। সেইজন্য আমার সংশােধনী প্রস্তাব যে এক বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রচলন করার ব্যবস্থা করা হােক।২২
গােবিন্দলাল ব্যানার্জির এই বক্তৃতার পর আহমদ আলী মৃধা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের (ক) ধারার শেষে ‘এবং যত শীঘ্র বাস্তব অসুবিধাগুলি দূর করা যায় তত শীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে’ এই অংশ যােগ দেওয়ার কথা বলে একটা সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন।২৩ প্রস্তাবটি কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশেষ কতকগুলি অসুবিধার উল্লেখ করে তিনি বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন :
বিজ্ঞানে বাংলা ভাষায় বই লিখতে এখনও অনেক সময়। ডাক্তারী পড়তে ইংরেজী ছাড়া উপায় দেখা যায় না। ইঞ্জিনিয়ার ইংরাজীতে পড়ে, ইংরাজীতে ভাবে, ইংরাজীতে গড়ে, ইংরাজীতে ভাঙে, বাংলায় এইসব করতে হবে। দেখুন ঐ ঘড়িটি উহার ‘ডায়ালে’ লিখতে হবে বাংলায় ১, ২, ৩। তবে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হবে। বিভিন্ন জগদ্দল পাথর আমাদের বুকের উপর থেকে নেমে গেলে আমরা মানুষ হয়ে দাড়াতে পারবাে। ধীরেনবাবুর সবুর হয় না? এইসব বাধা যতদূর সম্ভব দূর না করে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যায় না। এই বলে আমার সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করছি। আমি আশা করি আমাদের নেতা এটি গ্রহণ করবেন।
আহমদ আলী মৃধার পর রাজেন্দ্রনাথ সরকার একটি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে সেই প্রসঙ্গে বলেন :
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয় সময় উপযােগ এই প্রস্তাব এনেছেন বলে তিনি ধন্যবাদাহঁ। কিন্তু এই প্রস্তাব যেভাবে আমাদের সামনে আনা হয়েছে তাতে অনেক অসুবিধা আছে। আমরা জানি বাংলা ভাষার মধ্যে বই রকম শব্দ আমরা গ্রহণ করেছি-মন্ত্রী মহাশয় বললেন বাংলা ভাষা আরও অনেক শব্দ হজম করেছে এবং এখনও অনেক করতে হবে। সত্যই আমাদের ভাষার মধ্যে অনেক ইংরাজী, আরবী, উর্দু, ফাসী ও অন্যান্য ভাষা এসে পড়েছে। সেগুলি ব্যবহার করা আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সেইজন্য বলছি এই প্রস্তাব যদি সমর্থিত হয় তাহলে গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে কোনাে কার্যকরী প্রস্তাব ঘােষণা করা হােক।২৫
এর পর মনােরঞ্জন ধর তার সংশােধনী প্রস্তাবে ডাক টিকিট, মুত্র রেলওয়ে টিকিট, সরকারী ফর্ম ইত্যাদিতে বাংলা ব্যবহারের জন্য পাকিস্তান সরকারের সাথে আলােচনার জন্যে পূর্ব বাঙলা সরকারকে অনুরােধ জানান এবং সেই সাথে মূল প্রস্তাবটি থেকে যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে দেওয়ারও প্রস্তাব করেন :২৬
মনােরঞ্জন ধরের পর মুদাব্বের হােসেন চৌধুরী একটি সংশোধনী প্রস্তাবে পূর্ববতী সংশােধনী প্রস্তাবগুলির মতই যথা সম্ভব’ তুলে দেওয়ার কথা বলেন। এ ছাড়া তিনি আরও প্রস্তাব করেন যে পূর্ব বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা, উর্দু অথবা ছাত্রছাত্রীদের মাতৃভাষা। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজের বক্তৃতায় বলেন যে ৫১৯ এই সংখ্যাধিক্য একটা ভয়ানক অনিশ্চিত ব্যাপার সেই জন্যে তিনি অধিকাংশ কথাটি তার সংশােধনী প্রস্তাব থেকে বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন যে মণিপুরী চা বাগানগুলিতে তিনি সেখানকার ছাত্রদের মাতৃভাষায় তাদেরকে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা দেখেছেন। তিনি সেই ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার বিরােধী। ঢাকাতেও কোনাে কোনাে অঞ্চলে উদু ব্যবহৃত হয়।২৭
এই কথা বলার সময় পরিষদে ‘না, না’ ধ্বনি ওঠে। এর পূর্বেও মুদাব্বের হােসেন যখন ইংরেজীতে তার বক্তৃতা শুরু করেন তখন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাকে বাংলাতে তার বক্তব্য পেশ করার জন্যে বলায় কিছুটা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। | এর পর আবদুল বারী চৌধুরী তার সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপনের পর একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য কিছু ছিলাে না। আবদুল বারী চৌধুরীর সংশােধনী প্রস্তাবটিই সেদিনকার পরিষদে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবের উপর সর্বশেষ সংশােধনী প্রস্তাব। এর পর সরকারী প্রস্তাবের কয়েকটি দিক এবং সাধারণভাৰে ভাষা প্রশ্নের উপরে পরিষদের
কয়েকজন তাদের বক্তব্য পেশ করেন। সর্বশেষ সংশােধনী প্রস্তাবটির পৰ পূর্ণেন্দুবিশাের সেনগুপ্ত খুব সংক্ষেপে দুই এক কথা বলার পর শামসুদ্দীন আহমদ ইংরেজীতে তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। পরিষদে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি উত্থাপনের জন্যে নাজিমুদ্দীনকে অভিনন্দন আপনের পর তিনি বলেন যে রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে প্রধানমন্ত্রী যে আটদফা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলেন সেই চুক্তির শর্তগুলি তার প্রস্তাবে কয়েকটি স্থানে পরিবর্তন করা হয়েছে। সেই চুক্তির চতুর্থ ধারায় ছিল প্রধানমন্ত্রী পরিষদে একটি সরকারী বিল উত্থাপন করবেন। শামসুদ্দীন আহমদের এই কথার প্রতিবাদ করে নাজিমুদ্দীন বলেন যে, তিনি যা বলছেন তা সঠিক নয়। মােদাব্বের হােসেন প্রধানমন্ত্রীকে এই যুক্তিতে সমর্থনের চেষ্টা করেন যে পরিষদের বাইরে কার সাথে কি চুক্তি হয়েছে সেটা পরিষদে আলােচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না। প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী তখন . তার জবাবে বলেন যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাদের অবগতির জন্যে পরিষদে চুক্তিটি পাঠ করে শুনিয়েছিলেন।৩০ | এই বিতর্কের পর শামসুদ্দীন আহমদ আবার তার বক্তৃতা শুরু করেন। বাংলাকে যথাশীঘ্র কি ভাবে পূর্ব বাঙলায় চালু করা সম্ভব সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
১৯৪৯ সালের জানুয়ারি অথবা ঐ ধরনের কোনাে তারিখ থেকে মাট্রিকুলেশন পর্যায় পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতে হবে এই মর্মে আগামীকালই আমরা শিক্ষা বিভাগকে নির্দেশ দিতে পারি। স্যার, আমি মনে করি যে সমস্ত জিনিসটি যখন পরিষদের সামনে আনা হয়েছে তখন সেটা পরিষ্কার করে নেওয়া এবং এ ব্যাপারে একটা লক্ষ্য-তারিখ নির্ধারণ করা উচিত।৩১
এর পর শামসুদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীকে যথাসম্ভব’ কথাটি মূল প্রস্তাব থেকে প্রত্যাহার করে নিতে অনুরােধ করেন। তিনি বলেন যে পূর্ব বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হবে’ প্রস্তাবটির পাঠ এই রকম হওয়া দরকার। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারী প্রস্তাবের এই ধারার শেষ অংশের সাথে তার কোনাে ঝগড়া নেই বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। কোনাে প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষা উর্দু অথবা বাংলা হলে সেইভাবে তাদেরকে শিক্ষা দানের অসুবিধার কথা উল্লেখ করলেও তিনি প্রস্তাবের সেই অংশের বিরােধিতা থেকে বিরত থাকেন। প্রস্তাবটি থেকে যথাসম্ভব’ কথাটি তুলে নিলে অনেক ‘ভুল’ বােঝাবুঝি, হতবুদ্ধিতা এবং বিতর্কের অবসান হবে
একথা বলার পর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে পরিষদের সামনে প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের বক্তৃতা শেষ করেন।
শামসুদ্দীন আহমদের বক্তৃতার এই অংশের সাথে প্রথম অংশের বক্তব্যের গরমিল সহজেই লক্ষণীয়। প্রথমদিকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের অভিযােগ উত্থাপন করলেও শেষের দিকে তিনি চুক্তি রক্ষার জন্যেই তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ! | এর পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার পরিষদে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি দীর্ঘ এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা দেন। প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জ্ঞাপন ব্যতীত তার বক্তৃতায় পরিষদে উত্থাপিত সরকারী ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবটি সম্পর্কে তিনি তেমন কোনাে আলােচনাই করেননি। তার সেদিনকার বক্তৃতা পাঠ করলে মনে হয় তিনি যেন পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলােচনার জন্যে না বাড়িয়ে বাংলাভাষা বিষয়ক একটি সাহিত্য সভায় সভাপতির ভাষণ প্রদান করছেন। অবশ্য এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলার সরকারী ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলনের কতকগুলি বাস্তব দিক সম্পর্কে তার বক্তৃতার শেষের দিকে আলােচনা করেন। মূল প্রস্তাবের উপর বিশেষ কোনো বক্তব্য পেশ না করলেও বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি সেদিন যে সব কথা বলেন তার কোনাে কোনাে অংশ ভাষাবিষয়ক কতকগুলি সাধারণ প্রশ্নের সাথে সম্পকিত এবং সেই হিসাবে তার উল্লেখ প্রয়ােজন। বাংলা ভাষা চর্চার প্রথম পর্যায়ে তার প্রতি হিন্দু মুসলমান শাস্ত্রকার এবং নবাব বাদশাহদের মনােভাব সম্পর্কে আলােচনা করে তিনি দেখাতে চান যে বাংলা বস্তুতঃপক্ষে মুসলমানদের দ্বারা গঠিত ভাষা। হিন্দুদের হাত থেকে উদ্ধার করে তারাই তাকে নবজীবন দান করে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন : ইসলাম গণতান্ত্রিক ধর্ম, বিপ্লবী ধর্ম, এইজন্য ইসলামের অনুসারীরা
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি হাবিবুল্লাহ বাহারের যে একটা সত্যিকার দরদ ও ভালবাসা ছিলাে তা অনস্বীকার্য। প্রাদেশিক মন্ত্রীদের মধ্যে যে দু-তিন জন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কথা চিন্তা করতেন এবং সে ব্যাপারে সহায়তা করতে ইচ্ছুক ছিলেন তাদের মধ্যে বাহার সাহেব নিঃসন্দেহে ছিলেন অগ্রগণ্য। কিন্তু তা সত্বেও মন্ত্রীত্বের প্রতি তার দুর্বলতাও ছিলাে অনস্বীকার্য। এই বিবিধ দুর্বলতার দোটানায় পড়ে ইচ্ছাসত্ত্বেও বাংলাভাষার আন্দোলনে তিনি পরিপূর্ণভাবে কখনাে শরীক হতে পারেননি। এ ব্যাপারে তার দােদুল্যমানতা ও দ্বৈত আনুগত্য ব্যবস্থাপক সভায় তার এই বক্তৃতার মধ্যে সুস্পষ্ট।
স্বাভাবিকভাবেই জনগণের ভাষা বাঙলাকে বাজারে আসন দিয়েছিলেন। শাহী দরবারে বাংলা ভাষা যখন মজলিস জমিয়ে বসেছিল সে সময় এদেশের শাস্ত্রকাররা রামায়ণ বা পুরাণের অনুবাদক বা অনুবাদে তাের জন্য রৌরব নরকের ব্যবস্থা দিচ্ছিলেন। কবি কাশীদাস মহাভারতের প্রতি অধ্যায়ের শেষে “মন্তকে বাঁধিয়া ব্রাহ্মণের পদরজঃ কহে কাশীদাস বলে ব্রাহ্মণের বন্দনা করলেও এতটুকু সহানুভূতি পাননি তাদের কাছ থেকে। বরং ভট্টাচার্য মহাশয়েরা প্রবাদ বাক্য তৈরী করেছিলেন “কৃত্তিবেসে কাশীদেশে আর বামুন ঘেসে এই তিন সর্বনেশে” বলে। শুধু তাই নয় শ্রদ্ধেয় দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে পূর্ব বঙ্গ থেকে যে সব গীতি কথা ও পল্লীগান সংগৃহীত হয়েছে, যেগুলাে সাহিত্যের অত্যুজ্জ্বল মণি, বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাওয়ার যােগ্য বলে প্রশংসা পেয়েছে রমা বলার মতাে। আধুনিক সাহিত্য-রসিকদের কাছ থেকে, সেগুলােও সম্পূর্ণ বর্জিত হয়েছিল হিন্দু শাস্ত্রকারদের দ্বারা। কারণ কবির এই অপূর্ব সৃষ্টি শান্ত্রের অনুশাসন মনোন, লােকাচার ও সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে তুলেছে বিদ্রোহের ‘আওয়াজ। এসব গানে নেই ঠাকুর দেবতা ভগবানের প্রতি ভক্তির কথা। এতে আছে ইতর গাতি নায়কের কথা,কুমারী কন্যার স্বেচ্ছাবর গ্রহণের কথা, ভিন জাতির নায়ক-নায়িকার প্রেমের কাহিনী। শাস্ত্রকারের বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে যে সাহিত্যের ভিত্তিপত্তন হয়, যে ভাষা ছিল গণ-মানসের বাহন তা যে গােড়া থেকেই মুসলিম নবাব, আমীর বাদশাহদের সমর্থন লাভ করবে তা স্বাভাবিক। আল সেই ভাষা যে নবজাত পূর্ব পাকিস্তানের আইন সভায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করবে তা আরও স্বাভাবিক ইংরেজীতে যাকে বলে in the fitness of things. গৌড়ের দরবারে বাংলা ভাষার আদি কবি কৃত্তিবাস, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস যখন মর্যাদা লাভ করেছিলেন তখন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের সমর্থন এরা পাননি। আনন্দের বিষয় আজ ব্রাহ্মণ, অব্রাহ্মণ, হিন্দু, মুসলিম, তপসিলী, খৃষ্টান সকলের সমর্থন পাচ্ছে জননী বঙ্গভাষা। বিরােধের সুর শােনা যাচ্ছে না আজকের এই সভায় কোনাে দিক থেকেই “অষ্টাদশ-পুরাণানি রামস্ত চরিতালি চ। ভাষায়াং মানবং শ্রদ্ধা রৌরবং নরকং গচ্ছে।” বলে বাংলা ভাষার সেবকদের ঘাঁরা অভিসম্পাত করছিলেন তাদের সুযােগ্য বংশধর বন্ধুবর গােবিন্দলাল ব্যানার্জি, গণেন ভট্টাচার্যি আজ আমাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন তাদের ধন্যবাদ।৩২
স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের বক্তৃতার এই অংশের মূল বক্তব্য হলাে এই যে বাংলা আসলে মুসলমানদের ভাষা, তারাই হিন্দুদের বিয়ােধিতা সত্বেও এর পরিচর্যা করে এসেছে কাজেই মুসলমানরা তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান করবে সেটাই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়। তিনি বাংলাকে পূর্ব বাঙলার রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগে আজ শরীক হওয়ার জন্যে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিষদ সদস্যদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এই বক্তৃতারই অত্র তিনি আবার বলেন :
যে ভাষা ছিল গণ-মানসের বাহন তা যে গােড়া থেকেই মুসলিম নবাব, আমীর বাদশাহদের সমর্থন লাভ করবে তা স্বাভাবিক। আজ সেই ভাষা | যে নবজাত পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করবে ‘তা আরও স্বাভাবিক।
এই সমস্ত কথার মাধ্যমে হাবিবুল্লাহ বাহার কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস এবং সমগ্র ভাষা আন্দোলনের চরিত্রকে বিকৃত করার অদ্ভুত প্রচেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। প্রথমত, সাহিত্যের ইতিহাসকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে উনিশ এবং বিশ শতকে হিন্দু সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষা চর্চা ও সাধনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। হুসেনশাহী আমল থেকে এক লাফে খাজা নাজিমুদ্দীনের রাজত্বে পৌঁছে গিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে হিন্দুদের উদ্যোগ ও সহযােগিতাকে তিনি একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা বলে চিত্রিত করার যে চেষ্টা করেছেন তা হাস্যকর হলেও তাৎপর্যপূর্ণ।
হুসেন শাহী আমলে বাংলা ভাষার চর্চাকে উৎসাহ দান করা হয়েছিলাে এজন্যে নয় যে বাংলা ভাষা ছিল গণ-মানসের বাহন কাজেই স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম নবাব, আমীর বাদশাহরা তাকে সমর্থন করেছিলেন। তারা বাংলা চর্চার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বাঙলাদেশের হিন্দু ক্ষাত্রশক্তিকেই আঘাত করতে চেয়েছিলেন। মুসলমান সুলতানেরা বাঙলাদেশে রাজত্ব স্থাপন করলেও বিদেশী হিসাবে এদেশের সাথে তাদের কোনাে সংযােগ ছিল না। সংস্কৃতচর্চাকারী হিন্দু অভিজাত সমাজের বিরুদ্ধে নানাভাবে সংগ্রাম করে তারা এদেশে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করার যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বাংলা চর্চায় উৎসাহদান ছিল তারই একটি। সেই সময় হিন্দু অভিজাতদের ভাষা ছিল সংস্কৃত। কাজেই তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে বাংলার বিরােধিতা করেছিলেন এবং শাস্ত্রকাররা এ ব্যাপারে যথারীতি এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সহায়তা করতে। প্রকৃতপক্ষে মুসলমান বাদশাহরা যে কারণে বাংলা ভাষার উন্নতিতে কিছুটা উৎসাহ দান করেছিলেন সেই একই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক কারণে হিন্দু
অভিজাত ও শান্তাররা তার বিরােধিতা করেছিলেন। তার মধ্যে গণ-মানস’, ‘গণ-আর্থ’ ইত্যাদির কোনাে প্রশ্নই ছিল না। | যে নবাব বাদশাহরা মুসলমান হওয়ার জন্যে শত শত বছর পূর্বে বাংলা ভাষা চর্চায় উৎসাহদান করেছিলেন তাদের বংশধর খাজা নাজিমুদ্দীন বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা পান করার প্রস্তাব করায় হাবিবুল্লাহ বাহার তাকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে বর্ণনা করেছেন। একথা অনস্বীকার্য যে তার এইসব উক্তি সদ্য সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করে বাংলা ভাষা কিভাবে খাজা নাজিমুদ্দীনের দ্বারা পূর্ব বাউলা ব্যবস্থাপক সভায় সরকারী ভাষা হিসাবে প্রস্তাবিত হলাে সে বিষয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি করে।
এর পর ভারতীয় ইতিহাসে ভাষার ক্ষেত্রে অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্রের ভূমিকা সম্পর্কে নিম্নোক্ত বক্তব্য উপস্থিত করে তিনি নিজের পূর্ব বক্তব্যকে জোরদার করার চেষ্টা করেন :
ভারতের ইতিহাস অভিজাততন্ত্র আর গণতন্ত্রের বিরােধের ইতিহাস। আদি যুগে অভিজাত ঋষিদের ভাষা ছিল বৈদিক ভাষা, আর লৌকিক ভাষা ছিল নগণের ভাষা। এই দুই ভাষার বিরােধে লৌকিক ভাষার জয় হল। নিরুপায় হয়ে অভিজাততন্ত্রীরা লৌকিক ভাষাকে সংস্কৃত করে নিল। জনসাধারণ তখন ব্যবহার করতে লাগল লৌকিক ভাষা পালী। বিল্পবী বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতায় পালী হয়ে উঠলাে ঐশ্বর্যশালী। পরের যুগে পালী হল অভিজাত ভাষা, লৌকিক ভাষা হ’ল প্রাকৃত। পালীকে হারিয়ে জনগণের ভাষা প্রাকৃত চললএগিয়ে। এর পর প্রাকৃতকে পরাস্ত করে জনগণের ভাষা অপভ্রংশ থেকে জন্ম নিল বাংলা, হিন্দী, গুজরাতী, আসামী, উড়িয়া, মারাঠি ও বন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা। অভিজাততন্ত্র আর গণতন্ত্রের এ লড়াই এখনাে শেষ হয়নি। এ সংগ্রাম চলছে এখনাে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বংশধরেরা বাংলাকে এখনাে বেঁধে রাখতে চাচ্ছেন সংস্কৃতের শৃঙ্খলে। আর জনগণের ভাষা পেতে চাচ্ছে সাহিত্যের মর্যাদা। বাংলা ভাষা যখন রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা পেতে চলেছে সে সময় জনগণের ভাষা আমাদের কাছে স্বীকৃতি পাবে কিনা, এ প্রশ্ন নূতন করে আমাদের সামনে দেখা দিয়েছে। আমরা গণতন্ত্রের সমর্থক। এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের দিতে পারা উচিত সহজেই। জনগণের ভাষাকে সাহিত্যের ভাষায় রূপায়িত করাই হবে
আমাদের নীতি। লৌকিক বৈদিককে, পালী সংস্কৃতকে প্রাকৃত পালীকে অপভ্রংশ প্ৰকৃতকে যেমন করে হারিয়ে দিয়ে মাথা উচু করে দাড়িয়েছিল তেমনিভাবে গণভাষা ও গণসাহিত্য সংস্কৃত ঘেষা অভিজাত সাহিত্যকে ঠেলে ফেলে মাথা উচু করে দাড়াক—এই হবে আমাদের আকাংখা।৩৩
অভিজাততন্ত্র এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ভারতীয় ইতিহাসে ভাষার লড়াইয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে হাবিবুল্লাহ বাহার তার এই অংশের বক্তব্যকে যে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছেন সেটাও সদ্য সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের বিকৃত ব্যাখ্যা এবং ভাষা বিতর্কের প্রকৃত তাৎপর্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আর একটি উদাহরণ। এই অংশের শেষে তিনি সংস্কৃত ঘেষা অভিজাত সাহিত্যকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পূর্ব বাঙলায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন যে সংস্কৃত ঘেষা অভিজাত সাহিত্য বিরােধী নয়, উর্দুকে পূর্ব বাঙলার উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে একটা গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এই গুরুত্বপূর্ণ কথার কোনাে উল্লেখ তার বক্তৃতায় নেই। তার বক্তব্য থেকে মনে হয় ভাষা আন্দোলন হিন্দু অভিজাতদের সংস্কৃত ভাষার বিরুদ্ধে খাজা নাজিমুদ্দীন এবং তার মন্ত্রীসভার অন্যান্য ‘গণতন্ত্রের সমর্থকদের বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। | ভারতীয় ইতিহাসের অন্যান্য পর্যায়ের মতাে এই পর্যায়েতেও যে ‘অভিজাতদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রীয় এবং অন্যান্য কারণে বাংলাভাষী পাকিস্তানীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার ফলেই ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ এবং তার পরিণতি হিসাবেই যে খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকারী প্রস্তাব একথার উল্লেখ হাবিবুল্লাহ বাহারের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতার কোথাও নেই।
এরপর হাবিবুল্লাহ বাহার বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আরবী ফারসী প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা করেন এবং এইসব ভাষার কত প্রকার শব্দ বাংলা ভাষার নিজস্ব হয়ে গেছে তার একটা তালিকা পেশ করেন। বাংলা ব্যাকরণের উপর কতকগুলি শব্দ কিভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
বাংলা ব্যাকরণেও মুসলমান প্রভাব কম নয়। খাের’ (গাঁজাখাের ইত্যাদি শব্দে) দার’ (ঠিকাদার ইত্যাদি শব্দে), ‘দান’ (পিকসান ইত্যাদি শব্দে এবং গিরি (গুরুগিরি ইত্যাদি শব্দে) তদ্ধিত প্রত্যয়ের কাজ করছে। ভট্টাচার্য পণ্ডিতের আপত্তি সত্বেও ধনদৌলত’, ‘গরীব-কাঙাল’, ‘হাটবাজার’, ‘জিনিসপত্র’, ‘লজ্জা সরম’, ‘চালা’ ‘চতুর’, ‘কাণ্ড’, ‘কারখানা, ‘লােক’, ‘লঙ্কর’, ‘খানা খন্দক’, ‘শাকসবজি’, ‘বড়’, ‘তুফান’, ‘মুটে
‘মজুর’, ‘হাসি, ‘খুসি প্রভৃতি যুগ্ম শৰে সংস্কৃত, আরবী, ফারসীর সনে যেমন গলাগলি করে চলেছে তেমনি হিন্দু মুসলিম হাত ধরাধরি করে সৃষ্টি করেছে বাংলা সাহিত্য।৩৪ ‘হিন্দু মুসলিম হাত ধরাধরি করে সৃষ্টি করেছে বাংলা সাহিত্য একথা এখানে এবং অন্যত্র দুই-একবার স্বীকার করলেও হাবিবুল্লাহ বাহারের সমগ্র বক্তৃতার সত্যিকার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলাে এই যে মুসলমানরাই বাংলা সাহিত্যের বর্তমান উন্নতির কৃতিত্বের মুখ্য দাবীদার। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মুসলমান কবি সাহিত্যিকদের দান অনস্বীকার্য এবং তাদের কাব্য ও সাহিত্য চর্চা যে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে নূতন শব্দ এবং চিন্তাধারার দিক দিয়ে অনেকাংশে সমৃদ্ধ করেছে তাতেও কোনাে সন্দেহ নেই। কিন্তু হাবিবুল্লাহ বাহার এই সত্যকে তার ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচারের কোনাে চেষ্টা না করে কোনো কোনাে প্রখ্যাত হিন্দু সমালােচক এবং ঐতিহাসিকের সাম্প্রদায়িক পথ অনুসরণ করেই তার আগাগোড়া বক্তব্যকে একটা বিকৃত সাম্প্রদায়িক চরিত্র দান করেন। পূর্ব বাঙলায় সাহিত্যিকদের সাহিত্য কর্ম কি ধরনের হবে সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন :
আদি বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে দেবতার লীলা-খেলাকে কেন্দ্র করে । দেবভূমি থেকে বাংলা সাহিত্যকে মাটির পৃথিবীতে নামিয়েছেন মুসলমান। এর পর বহুদিন বাংলা সাহিত্যের কারবার ছিল রাজরাজড়া নিয়ে। ধীরে ধীরে উজির পুত্র, কোটালপুত্র, সওদাগর পুত্র স্থান পেয়েছে এখানে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র মধ্যবিত্ত সমাজে সাহিত্যকে নামিয়ে এনেছেন। বাঙলার বিরাট জনসমাজ এখনাে সাহিত্যে স্থান পায়নি। আজ পাকিস্তানবাদী সাহিত্যিকের কাজ হবে-রিক্ত সর্বহারাকে সাহিত্যে স্থান দেওয়া। এদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করা। এক কথায় সত্যিকারের গণ- সাহিত্য সৃষ্টির সাধনা হবে আমাদের সাধনা।৩৫
এক্ষেত্রে তার পক্ষে পাকিস্তানী সাহিত্যিকের পরিবর্তে পাকিস্তানবাদী সাহিত্যিকদের উপর এদেশের সাহিত্যকে গণ-মুখী করার দায়িত্ব অর্পণ করার আবেদন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে তার এই সমস্ত সাধারণ বক্তব্যের পর তিনি বর্ণ মালা এবং ব্যাকরণ সংস্কার সম্পর্কে নিজের অভিমত পরিষদে ব্যক্ত করেন :
বাংলা অক্ষর সংস্কার সম্পর্কে আমাদের কোনাে সংস্কার দিয়ে চালিত হলে চলবে না। বাংলায় আরবী বর্ণমালা চালান যায় কিনা, এ বিষয়ে কোনাে
–
১৫৫
কোনাে মহলে আলােচনা চলছে। এক সময় বাংলা আরবী অক্ষরে লেখা হ’ত তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমার কাছে আলাওলের পদ্মাবতীয় কয়েকখানি হাতে লেখা পুথি আছে। বইখানি আরবী অক্ষরে লেখা (মাননীয় মিঃ হাবিবুল্লাহ সাহেব এই সময় পুথিখানি সকলকে দেখান) বাংলায় আরবী অক্ষরের প্রবর্তন হলে যদি আমাদের সুবিধা হয়, ছাপা টাইপরাইটার ইত্যাদি ব্যাপারে আরবী অক্ষর অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত বলে প্রমাণ হয়, নিশ্চয়ই আমরা এ অক্ষর গ্রহণ করব। শুধু Sentiment-এর বশবর্তী হয়ে কিছু করা নিশ্চয়ই সমীচীন হবে না বাংলায় রােমান বর্ণমালা প্রবর্তনের প্রস্তাবও রয়েছে আমাদের সামনে। এ সম্পর্কেও ভাবা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে আমরা এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক মনােবৃত্তি দিয়ে যেন চালিত হই।৩৬
বৈজ্ঞানিক মনােবৃত্তির নামে বাংলা অক্ষর বর্জন করে আরবী অক্ষর এবং অন্যথায় রােমান হরফ বিবেচনার প্রস্তাবকে হাবিবুল্লাহ বাহার এ ক্ষেত্রে যুক্তিসাত বলে দেখাতে চেয়েছেন। শুধু তাই নয়। আরবী অক্ষরের প্রতি তার পক্ষপাতিত্বকেও তিনি গােপন করেননি। খােলাখুলিভাবে তার বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রদর্শনের জন্যে আলাওলের একটি পুথি নিয়ে এসে সেটি সকলকে দেখাবার চেষ্টাও তিনি করেন। রোমান অক্ষরের কথা তিনি প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করলেও নিজের বক্তৃতার মধ্যেই তিনি আরবী অক্ষর সম্পর্কে একথা স্বীকার করেছেন যে, এ বিষয়ে কোনাে কোনাে মহলে আলােচনা চলছে।’ এই মহলটি হল পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা দফতর। আরবী অক্ষর প্রবর্তনের চেষ্টায় তাদের কার্যকলাপ এর পরও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
হাবিবুল্লাহ বাহার তার এই সব গুরুত্বপূর্ণ উক্তির মাধ্যমে নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উপস্থিত করার পর এই কথা বলে তার বক্তৃতা শেষ করেন :
আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই নূতন আবহাওয়ায় আমরা সন্ধান পাব জাতির শাশ্বত প্রাণধারার। আমরা সহজভাবে সাড়া দিতে পারব বিশ্বসংস্কৃতির আবেদনে। নবলব্ধ আজাদীর অপূর্ব প্রাণশক্তি এনে দেবে আমাদের মানস ও মনকে অফুরন্ত উদ্যম ও তেজ। এই উদ্যম এই প্রাণচঞ্চলতা থেকে জন্ম নেবে নূতন যুগের নূতন সাহিত্য। এই নূত্র সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে আজকের এই রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব নানাদিক থেকেই হবে সহায়ক।৩৭ হাবিবুল্লাহ বাহারের বক্তব্য যাই-হােক ভাষা ও বাচনভঙ্গীর প্রসাদগুণে
তার বক্তৃতার সময় পরিষদে একটা গুৰুগীয় আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়। সেই আবহাওয়াকে চুরমার করে এর পরই আবদুস সবুর খান বীরেন্দ্রনাথ দত্তের সমালােচনা প্রসঙ্গে বলেন যে ধীরেনবাবু তার সংশােধনী প্রস্তাৰে immediately কথাটার উপর বড় জোর দিয়েছেন এবং বক্তৃতা দেওয়ার সময় প্রাদেশিকতার গণ্ডী ছাড়িয়ে গােটা পাকিস্তানকে নিয়ে আলােচনা করেছেন যদিও প্রস্তাবে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের কথাই আছে। এর পর তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে জিজ্ঞাসা করেন তিনি সংবিধান সভায় এ সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করেননি কে? এ ছাড়া ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাব করেছেন বাংলা ভাষাকে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রভাষায় স্থান দেওয়ার। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয় ধীরেনবাবু তা ভালভাবেই জানেন। ভারতেও হিন্দী রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃত হলেও সেখানে তাকে সেইভাবে চালু করা একই কারণে বিলম্বিত হচ্ছে।
সবুর খানের প্রশ্নের জবাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন : প্রথম কথা হচ্ছে যে কেন্দ্রীয় পরিষদের নিয়ম অনুসারে সেখানে ইংরাজীতেই সকল কাজকর্ম হয়ে থাকে। তৎসত্বেও আমি বাংলায় বলতে চেষ্টা করেছিলাম সেকথা যারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন তারা জানেন। আমি ইংরাজা জানা একজন উকিল একথা তমিদ্দন সাহেব ও কায়েদে আজম জানেন। সে ক্ষেত্রে ইংরাজী না জানার অজুহাতে অন্য ভাষার ব্যবহার করতে পারি না। তাই আমাকে বাংলা বলার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করার পর ইংরাজীতে বলতে হয়েছিল।৩৯
সংবিধান সভা ও গণ-পরিষদে ভাষা বিষয়ক যে নীতি নির্ধারিত হয়েছিল সে অনুসারে ইংরাজী এবং উছু ব্যতীত অন্য কোনাে ভাষা সেখানে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। কোনো সদস্য এই দুই ভাষার একটিও না জানলে শুধুমাত্র সে ক্ষেত্রেই অন্য ভাষায় বক্তৃতার অনুমতি ছিল। এই নীতি অনুসারে ইংরেজী জানা উকিল হিসাবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার উপায় ছিল না। | খাজা নাজিমুদ্দীন কিন্তু এসব প্রশ্ন সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ধীরোথ দত্তের কথার প্রতিবাদে বলে ওঠেন, সেটা ঠিক নয়। আপনি যদি ইংরেজীতে কথা বলতে না পারেন তাহলে আপনি বাংলা বলতে পারেন।’৪০ | সবুর খানের প্রশ্ন এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে নাজিমুদ্দীনের এই বক্তব্য নিতান্তই অর্থহীন এবং হাস্যকর। খুব সম্ভবত তাঁর এই অদ্ভুত উক্তির আসল কারণ বাংলাতে পেশ করা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তব্য
তার পক্ষে সঠিকভাবে বােঝা সম্ভব হয়নি।
এই ঘটনার পর মহম্মদ আবদুল হাকিম বিক্রমপুরী, আবদুল মমিন এবং নূরুল হােসেনখান পরিষদে বক্তৃতা করেন। আবদুল মমিন বলেন যে পরিষদে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের যে সমালােচনা হয়েছে তাতে মনে হয় তারা চান আলাউদ্দীনের প্রদীপের মতাে রাতারাতি সব পরিবর্তন করে দিতে। যারা বাংলা সম্বন্ধে এত কথা বলেন তারা নিজেরাই ইংরেজীতে প্রশ্ন করেন বলেও তিনি অভিযােগ করেন। এ প্রসঙ্গে নূরুল হােসেন খান শামসুদ্দীন আহমদের বক্তৃতার উল্লেখ করে বলেন যে তিনি বাংলা ভাষার একজন মস্ত ধ্বজাধারী হওয়া সত্বেও ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবের উপর নিজে বক্তৃতা করেছেন ইংরাজীতে। এর থেকেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে এদেশে বাংলা প্রচলনের জন্য যথেষ্ট সময় প্রয়ােজন।৪১
৪। বিতর্কের জবাবে নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতা | এর পর ভাষা বিষয়ক সরকারী প্রস্তাবের উত্থাপক প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন তার প্রস্তাবের উপর বিতর্কের জবাব দিতে ওঠেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশটির কতকগুলি সমালােচনা সত্ত্বেও মূল প্রস্তাবটির বিষয় পরিষদে সম্পূর্ণ মতৈক্য লক্ষিত হয়েছে। একটি সমালােচনা হয়েছে ‘যথাসম্ভব’কে কেন্দ্র করে এবং অপরটি হয়েছে তারিখ নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে। এই দুই সমালােচনাকে বিবেচনা করে তিনি আহমদ আলী মৃধার ১৬ নম্বর সংশােধনী প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে পরিষদকে জানান। তিনি বলেন যে সংশােধনী প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করার পর মূল প্রস্তাবের প্রথম অংশের পাঠ দাড়াবে নিম্নরূপ :
পূর্ব বাংলা প্রদেশে ইংরাজী স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হইবে; এবং যত শীঘ্র বাস্তব অনুবিধাগুলি দূর করা যায় যত শীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে।
সংশােধনী প্রস্তাবটিকে গ্রহণ করার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে খাজা নাজিমুদ্দীন বলেন :
আমি সংশােধনী প্রস্তাবটি রহণ করেছি এজন্য যে প্রথমতঃ ইংরাজীর স্থান বাংলা কত দিনে নিতে পারবে সে বিষয়ে কোনাে নিশ্চয়তা নেই। কতকগুলি বাস্তব অসুবিধা যে আছে সেকথা অস্বীকার করা যায় না।
উদাহরণস্বরূপ এই পরিষদে অধিকাংশ বক্তৃতা বাংলাতে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা ইতিমধ্যেই একটা পদক্ষেপ নিয়েছি কিন্তু স্যার, একাধিকবার আপনি নিজেই বাংলা বক্তৃতা রেকর্ড করা নিয়ে নানা অসুবিধার দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে সদস্যেরা ইংরাজীতে তাদের বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। সুতরাং, স্যার, আপনি সহজেই কল্পনা করতে পারেন যে এ রকম একটা ছােট জায়গাতেও আমরা এমন বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছি যার ফলে আমি নিশ্চত যে এখানে বাংলা বক্তৃতার রিপাের্ট তৈরী করতে অনেক বেশী সময় লাগছে। কাজেই প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন না করে যদি সমগ্র প্রশাসন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা প্রবর্তন করে দেওয়া হয় তাহলে সেটা খুব অসুবিধাজনক ব্যাপার হবে। আমি ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি যে বাংলা ভাষায় টাইপ করার জন্য টাইপরাইটারের কোনাে ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেই এবং আমাদের নথিপত্র এবং অন্যান্য রেকর্ড টাইপ করার ক্ষেত্রে এটা এক বাস্তব অসুবিধা। কাজেই স্যার, এ বিষয়ে অসুবিধা আরও বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং আমি জোর দিয়ে বলছি যে এই প্রস্তাবকে এখনি কার্যকর করার পক্ষে আমাদের কি কি অসুবিধা আছে সেগুলি বিবেচনার জন্য এখনই একটি কমিটি নিয়ােগ করা এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে অসুবিধাগুলিকে দূর করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলা যাতে ইংরাজীর স্থান নিতে পারে তার উপায় বের করার জন্য আমাদের পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। খাজা নাজিমুদ্দীনের প্রস্তাবে যথাসম্ভব’ কথাটি ব্যবহাষের জন্যে পরিষদে যে সমালােচনা হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি বলেন :
স্যার, প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশে যথাসম্ভব এই কথাটির উপর অনেক সমালােচনা হয়েছে। আমরা যে প্রস্তাব এখন পাস করাতে যাচ্ছি সেটা যে একটা সরকারী প্রস্তাব এবং সেটাকে যে আপনারা এখনই কার্যকর করতে চান একথা আমি পরিষদকে বিবেচনা করতে বলবাে। অবস্থা যা আছে সেইভাবে তাকে যদি আমরা রেখে দিই তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বাংলার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার প্রস্তাবটিকে কার্যকর করা সম্ভব হবে না। কারণ তার জন্য বাংলাতে লিখিত বই পুস্তক নেই। এমনকি মফাসসিলের ইন্টারমিডিয়েট এবং বি.এ. কলেজগুলির জন্যও বাংলায় কোনাে বই নেই। এবং সে কারণেই আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এখনই বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে
গ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমরা যদি যথাসৰ কথাটি প্রস্তাব থেকে বাদ দিই তার অর্থ দাড়াবে এই যে প্রস্তাবটি পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে পরিণত হবে। এই কাজ করা কি সম্ভব? আমার মনে হয় একজন বক্তা, মােদাব্বের হােসেন চৌধুরী
উল্লেখ করেছিলেন যে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে ফিকাহ’হাদিস এবং অন্যান্য ধর্মীয় বইপত্রগুলি সমস্ত বাংলাতে তরজমা করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রস্তাবটিকে কিভাবে কার্যকর করা যাবে। আপনাদেরকে কিছু ফাক রাখতেই হবে অন্যথায় লােকে বলবে যে প্রস্তাবটিকে কার্যকর করা যায়
একথা ভালভাবে জানা সত্ত্বেও ব্যবস্থাপক সভার মতাে একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান কিভাবে এরকম একটি প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারলাে। বিলম্ব করার চেষ্ঠা সম্পর্কে কোনাে প্রশ্ন ওঠে না কারণ ব্যবস্থাপক সভা তাে রয়েছেই এবং যখনই আমরা সমবেত হবে তখনই আমরা কতদূর কি করেছি সে সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবে এবং আমাদেরকে তার কৈফিয়ও দিতে হবে। কাজেই ‘যথাসম্ভব’ কথাটি ইংরাজীর বদলে বাংলা প্রচলনে বিলম্ব ঘটানাের উদ্দেশ্যে বসান হয়েছে এই সন্দেহ সঠিক নয়। শুধুমাত্র কতকগুলি দূরপনেয় অসুবিধার জন্য আপনাদেরকে কিছু ফাক রাখতেই হবে কারণ বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাত্ৰাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে প্রচলনের মতাে অবস্থা সৃষ্টি না হওদ্মা পর্যন্ত ইংরেজীকে চালু রাখা ব্যতীত উপায় নেই।
এর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষা’ নিয়ে প্রস্তাবটির দ্বিতীয় অংশের যে সমালােচনা হয়েছে সে সম্পর্কে নাজিমুদ্দীন পরিষদকে বলেন :
এই সমালাে প্রসঙ্গে আমার মালনীয় বন্ধুরা সুযোগমতাে একথা ভুলে গেছেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতাে এমন জায়গা আছে যেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষা বালা নয়। তা ছাড়া ময়মনসিংহে যে এলাকাগুলিতে গারাে এবং হাজংরা বাস করে সেখানকার অধিবাসীদের মাতৃভাষাও বাংলা নয়। এই সব এলাকাতে যদি বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাৰে প্রচলন করা হয় তাহলে তাদের কি হবে? আমাদের শিক্ষাবিদদের মতানুসারে ছাত্রদেশ্বকে তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়াই লৰ ” থেকে সহজ। যেহেতু পূর্ব বাঙলার শতকরা ৯ জন বাংলায় কথা বলে সেজন্য আমরা বাংলাকে এখানে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে রাখার প্রস্তাব
—
১৬০
করেছি। এই নীতিকে যদি আপনারা মেনে নেন তাহলে যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয় তাদের জন্যও আপনাদেরকে উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। মুদাব্বের হােসেন চৌধুরী তার একটি সংশােধনী প্রস্তাবে বলেছেন যে
খ্যার কথা বিবেচনা না করে যে সমস্ত স্কুলে উর্দুভাষী ছাত্রছাত্রী আছে সেখানে উদুর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা আমাদেরকে অবশ্যই রাখতে হবে। এটাও আবার সম্ভব নয়। ধরা যাক কোনাে একটি স্কুলে ২, ৫ অথবা ৭ জন ছাত্র আছে যাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়। ৫, ৬ অথবা ২০ জন ছাত্রকেও তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের বিশেষ ব্যবস্থা শুধু যে অসুবিধাজনক তাই নয় সেটা খুব ব্যয়সাধ্যও বটে। যেখানে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৫১ জন ছাত্র উর্দুভাষী সেখানে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা আপনাদেরকে অবশ্যই করতে হবে। তার অর্থ এই নয় যে শতকরা ৪৯ জনকেও উর্দু শিখতে হবে। আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করবাে যাতে ছাত্রদেরকে তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমেই আমরা শিক্ষাদান করতে পারি। কাজেই আপনারা যদি সােজ ‘যথাসম্ভব’ কথাটিকে বাদ দেন তাহলে তার অর্থ এই হবে যে হয় আপনি সেটা করতে বাধ্য থাকবেন অথবা বাধ্য থাকবে না। কাজেই আমার মনে হয় যথাসম্ভব’ কথাটি রাখা দরকার।
এর পর প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন বিরােধীদলের সহকারী নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তৃতার উত্তর দেন। তিনি বলেন যে এ ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট ইতস্ততঃ বােধ করছেন এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বক্তৃতার সময় তিনি যেমন কোন গণ্ডগােল করেননি তেমনি তার বক্তৃতার সময়ও বিরােধীদলের নেতা এবং তার পার্টিও কোনাে গণ্ডগােল করবেন না, তিনি সেই আশা করেন। নাজিমুদ্দীন ঝলেন যে অন্যেরা তাকে ভুল বুঝুন সেটা তিনি চান না তবে একথা সত্য যে ভাষা সংক্রান্ত যে প্রস্তাবটি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপন করেছেন সেটা উত্থাপন করা চলে না একথা জানা সত্ত্বেও বিরােধীদলের সহকারী নেতা সে প্রস্তাব জোরপূর্বক উত্থাপন করেছেন। নিজের বক্তব্যকে আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন :
মিঃ দত্তের বক্তৃতার মুখ্য বক্তব্য হলাে পাকিস্তানের ভাষা বিষয়ক বিতর্ক। তার বক্তৃতায় যে দু-তিনটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি সম্পর্কেই আমি বলতে চাই। একটি হচ্ছে ভা, মনি অর্ডার ফর্ম এবং অন্যান্য জিনিস সংক্রান্ত। এই পরিষদের অন্য কোনাে সদস্য যদি এই প্রশ্ন উত্থাপন করলে
তাহলে আমার অভিযােগের কি থাকতাে না। কিন্তু আমার মনে হয় মিঃ দত্তের এই প্রশ্ন উত্থাপনের কোনাে অধিকার নেই। কারণ সংবিধান সভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তাকে বলেছিলেন যে এখানে ঐ সমস্ত জিনিসের ব্যবস্থা করা হবে। আবার তিনি মনি অর্ডার ফর্ম, টেলিগ্রাফ ফর্ম, মুদ্রা ইত্যাদির প্রশ্ন তুলেছেন। এ ব্যাপারে একটা নিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল এবং তাকে বলা হয়েছিল যে এ সম্পর্কে ইতিমধ্যে নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন আবার তােলা হয়েছে।
এই পর্যায়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নাজিমুদ্দীনের বক্তৃতায় বাধা দিয়ে বলেন যে প্রশ্নটি তিনি উত্থাপন করেছেন এজন্যে যে মনি অর্ডার ফর্মে তা এখনাে করা হয়নি। এর উত্তরে নাজিমুদ্দীন বলেন যে পরিষদে এই সব প্রশ্ন ওঠার বহু পূর্বেই সেগুলি ছাপা হয়েছিলাে। এ বিষয়ে তাকে নিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া সত্বেও প্রশ্নটি তিনি আবার নােতুন করে তুলেছেন। | এর পর বিভিন্ন সার্ভিসে পরীক্ষার মাধ্যম হিসাবে বাংলা প্রচলনের বিষয়ে তিনি বলেন :
এদিক থেকে এই মর্মে আর একটি প্রশ্ন তােলা হয়েছে যে আমরা যদি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করি তাহলে আমাদের ছেলেদের পক্ষে বিভিন্ন সার্ভিসে সুযােগ পাওয়া সম্ভব হবে না। স্যা, এটা একটা দারুণ ভুল কথা। যে কোনাে জায়গায় গিয়ে উই বলুন তারা আপনাকে বুঝতে পারবে না। সি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান যান, সেখানকার শতকরা ৯৯ জন ভালভাৰে উছু বুঝতে পারবে না। পাঞ্জাবের গ্রামগুলিতেও দেখবেন সেই একই অবস্থা। কাজেই এদিক দিয়ে অন্যান্যদের তুলনায় বাঙালীদের অহুবিধা বেণ হবে না। স্বেীয় সার্ভিসগুলির ক্ষেত্রে আমাদের কোটা সংরক্ষিত হবে। কেন্দ্রীয় সার্ভিসের সব পৰীক্ষা হবে ইংরাজীতে এবং সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, উদুর মতাে বাংলাও সেই পরীক্ষার একটি বিষয় হিসাবে থাকবে। আমাদের ছেলেদের তুলনামূলক ভাবে কোনাে অসুবিধা হবে না। তাদের অংশ সংরক্ষিত থাকবে এবং ইনশাল্লাহ বিভিন্ন সার্ভিসে তারা তাদের ন্যায্য অংশই পাৰে।৬
কেন্দ্রীয় সার্ভিসে পূর্ব বাঙলার সংরক্ষিত অংশ কত সে সম্পর্কে খয়রাত হােসেনের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন যে সে বিষয়ে তথনাে পর্যন্ত কোনাে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। এর পর রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ১৫ই মার্চের চুক্তি প্রসাটি তিনি উত্থাপন করেন :
ভাষায় এই প্রশ্নটি মিম এবং তাঁর পার্টির কয়েকজন সা এখানে উপন করেছেন। তাঁরা ১৫ই মার্চের সেই তারিখটি এবং আমি যে চুক্তি করেছিলাম, তা মনে রেখেছেন। কিন্তু ২১শে মার্চ অথবা ২৫শে মার্চ যা ঘটেছিলাে তার সবইি তারা ভুলে গেছেন। তারা পাকিস্তানের প্রতি অনুগত, তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি অনুগত, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান যা বলেন তার কিছুই তাদের মনে থাকে না। একটা নােতুন সংবিধান যে হয়েছে সেকথাও তারা স্বীকার করেন না।
খাজা নাজিমুদ্দীন এই পর্যন্ত বলার পর পরিষদে হট্টগােল শুরু হয়। চীৎকার থেমে যাওয়ার পর নাজিমুদ্দীন আবার তার বক্তৃতা শুরু করেন ?
পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান কায়েদে আজম বলেছেন এই প্রশ্নটি আপনাদেরকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেবে। আমি আপনাদেরকে তার এ কথাটি বিবেচনা করতে বলেছি। তার মতে এই প্রশ্নটি ঠিক নয় এবং আমাদের আলােচনা করাও উচিত নয়। এই হলাে তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশ। পাকিস্তানের মঙ্গল কিসের মধ্যে নিহিত সেটা অন্ত যে কোনাে ব্যক্তির থেকে কায়েদে আজই যে বেশ বােঝেন একথাও আমি তাদেরকে বিচার করিতে বলি। যে ব্যক্তি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ও গঠন করেছেন তিনি বলছেন যে রাষ্ট্রের স্বার্থেই তা করা হচ্ছে। শিশুর মায়ের থেকে শিশুর প্রতি আপনাদের দরদ যদি বেশী হয় তাহলে আমার বলার কিছু নেই (হাততালি)। আপনাদের নিশ্চয় গঠনতান্ত্রিক অধিকারই আছে, গণতান্ত্রিক অধিকার আছে এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছু অধিকার আছে কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত পাকিস্তানী হিসাবে আপনাদের কোনাে কর্তব্য আছে কিনা তা আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই। রাষ্ট্রপ্রধান যখন বলেছেন যে এটা রাষ্ট্রকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিয়ে তার কল্যাণকে বিপদগ্রস্থ করবে তখন অন্য লােকেরা • কি চিন্তা করবে সেটা আমি তাদেরকে বিবেচনা করতে বলি। শুধুমাত্র নিজেদের মতামত ব্যক্ত করার গঠনতান্ত্রিক অধিকারের জন্য আপনারা একটা বিতর্কমূলক বিষয়ের অবতারণা করতে চান। এবং এই প্রশ্নটি এখানে আনার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। আমি নিজের মতামত ব্যক্ত করতে চাই না। পরিষদের উপরই আমি তা ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু, স্যার, আমি সব সময়েই কাজে বিশ্বাস করি, কথায় নয়। কাজটাই আসল কথা। কিন্তু এই ভাষার প্রশ্নটি যে এখানে আনা হয়েছে সেটা আমার পক্ষে একটা দুর্ভাগ্যের বিষয়।
নাজিমুদ্দীনের এই অদ্ভুক্তিপূর্ণ বক্তৃতা শেষ হয় পর বিবােধীদলের নেতা বসন্তকুমার দাস বলেন যে প্রধানমন্ত্রী তার প্রস্তাবটি উত্থাপনের সময় পৰিষদে কোনাে বক্তৃতা করেননি। এবং তার ফলেই এতাে হতবুদ্ধিতার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যদি প্রথমেই ব্যাখ্যা করে বলতেন কেন তিনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জনে পাকিস্তান সরকারের কাছে সুপারিশ করে প্রস্তাব উত্থাপন করেননি, তাহলে এতাে অসুবিধা সৃষ্টি হতাে না। কাজেই তার উচিত ছিলাে বিষয়টি পরিষদের সামনে ভালােভাবে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া। সেটা করলে কোনাে সংশােধনী প্রস্তাব উথাপনেরও আর প্রয়ােজন হতাে না।১০ | বসন্তকুমার দাসের এই বক্তব্যের পর স্পীকার তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে। সেই অবস্থায় তারা তাদের সংশােধনী প্রস্তাবগুলি প্রত্যাহার করবেন কিনা। এর উত্তরে বিরােধীদলের পক্ষ থেকে বসন্তকুমার দাস তাকে জানান যে তারা। সেগুলি প্রত্যাহার করবেন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ইতিপূর্বেই তার বক্তৃতায় আহমদ আলী মৃধার সংশােধনী প্রস্তাবটি গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সেই অনুসারে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি এর পর পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় : (ক) পূর্ব বাঙলা প্রদেশে ইংরেজী স্থলে বাংলাকে সরকারী ভাষা
হিসাবে গ্রহণ করা হইবে; এবং যত শীয় বাস্তব অসুবিধাগুলি
দূর করা যায় তত শীঘ্র তাহা কার্যকর করা হইবে। (খ) পূর্ব বাঙলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে শিক্ষার মাধ্যম হইবে
‘যথাসম্ভব’ বাংলা অথবা প্রতিষ্ঠানগুলির অধিকাংশ স্কলারদের
মাতৃভাষা। রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সাথে ১৫ই মার্চ সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করার যে যৌক্তিকতা দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিরােধীদলীয় হিন্দু সদস্যদের বিরােধিতা বন্ধ করলেন অ যে কোনাে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পক্ষেই অত্যন্ত মারাত্মক। একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করাকে রাষ্ট্রস্বার্থ বিরােধী বলে ঘােষণা করা একদিকে যেমন চরম ব্যক্তিশাসনের পরিচায়ক তেমনি আবার সেই ঘােষণাকে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শিরােধার্য করে সে বিষয়ে মন্ত আলােচনা বন্ধ রাখার হুমকিও সেই ব্যক্তিশাসনেরই অনিবার্য পরিণতি। আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাঙলায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবী উত্থাপিত হয়েছিলাে এবং যে দাবীকেপ্রদেশের প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছিলেন তা তিনি কায়েদে আজমের দোহাই
পেড়ে অস্বীকায় তাে করলেনই এমনকি যারা সে বিষয়ে পরিষদে আলােচনার সূত্রপাত করলেন তাদেরকে তিনি পরােক্ষভাবে রাষ্ট্রবিরােধী বলে অভিহিত করতেও দ্বিধাবােধ করলেন না। আন্দেলনের মুখে চুক্তি সম্পাদন এবং আন্দোলনের পর পরিস্থিতি পরিবর্তনের সুযােগে সেই চুক্তি ভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ব বাঙলার প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তা এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু শুধু প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন এই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। পার্লামেন্টারী উপদলের যে সমস্ত নেতারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতা হিসাবে নাজিমুদ্দীনের কাছে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করে মন্ত্রীত্ব ইত্যাদি পদ আদায়ের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন তাদের বিশ্বাসঘাতকতা অধিকতর উল্লেখযােগ্য। মহম্মদ আলী, তফজল আলী, ডক্টর মালেক প্রভৃতি এই উপদলভূক্ত নেতৃবৃন্দ পরিষদে ভাষা প্রশ্নের উপর বিতর্ককালে একটি বাক্য উচ্চারণ করেননি। তাদের এই মৌন ভূমিকার কারণ ইতিমধ্যেই তারা প্রাদেশিক সরকারের সাথে আপােষ-আলােচনার মাধ্যমে বিক্রীত হয়েছিলেন। তাদের মন্ত্রীত্ব ও রাষ্ট্রদূতের পদ সম্পর্কে তাদেরকে নিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া হয়েছিলাে।
উপরােক্ত পার্লামেন্টারী নেতৃবৃন্দ ভাষা আন্দোলনের সদ্ব্যবহার করার পর পূর্ব বাঙলা মুসলিম লীগের মধ্যে সুহরাওয়ার্দী সমর্থক উপদলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তাদের এক অংশ সরকারী মুসলিম লীগের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং অপর অংশ যােগদান করে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগে ।
পঞ্চ পৰিলে। তাৰা আন্দোলন-উত্তর ঘটনাপ্রবাহ-১৯৪৮ ১। সাধারণ অসন্তোষ ও সরকারী নীতি
মার্চ মাসের ভাষা আন্দোলনের পর ছাত্রদের কর্মতৎপরতা কিছুদিনের জঙ্গে কমে এলেও পূর্ব বাঙলার সামগ্রিক পরিস্থিতি নানা প্রকার আর্থিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যারা ক্রমশঃ পরিবর্তিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের মতাে ব্যাপক কোনাে ছাত্রবিক্ষোভ না ঘটলেও এ সময়ে ছাত্রেরা নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সাধারণভাবে পূর্ব বাঙলার নানা সমস্যা সম্পর্কে অনেকখানি সচেতন হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তিগত ও সংগঠনগতভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও আর্থিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়। এই পর্যায়েই শিক্ষা সংক্রান্ত দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে ঢাকাতে সর্বপ্রথম সংঘটিত হয় ব্যাপক ছাত্রী ধর্মঘট।
ছাত্র আন্দোলন ছাড়াও এ সময়ে সরকারী কর্মচারীদের ধর্মঘট এবং বিক্ষোভও উল্লেখযােগ্য। ব্যাপক খাদ্যাভাব ও দুভিক্ষ, জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি, আমলাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচার এবং চাকরিগত নানা অসুবিধার তাড়নায় জনসাধারণ ও সেক্রেটারিয়েট কর্মচারী থেকে শুরু করে পুলিশ কনস্টেবল পর্যন্ত সকলেই সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সংগঠিতভাবে তাদের কাছে নিজেদের দাবীদাওয়া পেশ করে। এবং সেগুলি আদায়ের জন্যে ধর্মঘটের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধের চেষ্টা, গ্রেফতার, বহিষ্কার আদেশ ইত্যাদির মাধ্যমে মতামতের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকার খর্বের সরকারী চেষ্টা নিয়মিত ভাবে শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে আমলাদের স্বতঃপ্রণােদিত উদ্যোগ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। উচ্চপদস্থ আমলারা শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করেই ক্ষান্ত না থেকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে নানাভাবে জাহির করার প্রচেষ্টা করে এবং তার ফলে ক্ষমতাশীন মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় কিছু কিছু ব্যক্তির সাথেও তাদের রেষারেষি এবং সংঘর্ষ দেখা দেয়। এই অবস্থায় মৌলান। ভাসানী, শামসুল হক প্রভৃতির নেতৃত্বে মুসলিম লীগকে পুনর্গঠনের শেষ চেষ্টা হিসাবে এপ্রিলওমে মাসে টাঙ্গাইল ও নারায়ণগঞ্জে শীগ কর্মীসভাঅনুষ্ঠিত হয়।
রাজনীতি তেমন সংগঠিত রূপ পরিগ্রহ না করলেও দেশের এই সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যে একদিকে শুরু হয় মুসলিম লীগের অন্তও অবক্ষয় এবং অন্যদিকে সরকার বিরােধী রাজনৈতিক দল ও আলােশন গঠনের বিবিধ
উদ্যোগ। ১৯৪৮-এর এই পর্যায়ে পূর্ব বাঙলায় সাধারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সর্বস্তরের জনগণের চেতনার সাথে সাধারণ পরিচয়ের উদ্দে নীচে কয়েকটি নির্বাচিত ঘটনা ধারাবাহিকভাবে উল্লিখিত হলাে।
(ক) কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীরা ঢাকাতে ৮ই এপ্রিল বিভিন্ন দাবীতে ধর্মঘট শুরু করেন। এই ধর্মঘট ১৮ দিন স্থায়ী হওয়ার পর তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ২৬শে এপ্রিল কাজে যােগ দেন। সরকারী কর্মচারীরা এর পূর্বে বিভিন্ন বিক্ষোভে অংশ গ্রহণ এবং ভাষা আন্দোলনের ধর্মঘটে যােগদান করলেও এই সর্বপ্রথম তারা নিজেদের আর্থিক ও অন্যান্য দাবীদাওয়ার ভিত্তিতে সংগঠিতভাবে ধর্মঘটকে আঠারাে দিন অব্যাহত রাখেন। | (খ) ঢাকার মেডিকেল ছাত্রেরা কতকগুলি দাবীদাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন। কর্তৃপক্ষ সেগুলি স্বীকার করতে সম্মত না হওয়ার ৩৬ জন ছাত্র ১৮ই এপ্রিল থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অনশনকারী ছাত্রেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে জনস্বাস্থ্য বিভাগের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের বাসভবনের সামনে এবং সার্জেন জেনারেল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের অফিসের সামনে কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। অবশেষ তাদের সমস্ত দাবীদাওয়া কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার পর ২৭শে এপ্রিল তাঁরা নিজেদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন।
(গ) নতুন বিক্রয় কর ধার্যের বিরুদ্ধে ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যত্র জনসাধারণ ও দোকানদারদের মধ্যে তীব্র প্রক্রিয়া দেখা দেয়। বিক্রয় কর সম্পর্কিত সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২৬শে এপ্রিল ঢাকাতে পূর্ণ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। বিকেলের দিকে আরমানীটোলা ময়দানে মওলানা দীন মহম্মদের সভাপতিত্বে একটি বিরাট জনসমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদও বক্তৃতা করেন। সভায় কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তার মধ্যে একটি বিশেষ প্রস্তাবে বিক্রয় কর সম্পর্কে সরকারী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার জন্যে সরকারকে অনুরােধ করা হয়। সরকার তাতে সম্মত না হলে ১৫ইমে থেকে উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে বলে সরকারকের্তারা সাবধান করে দেন।
(ঘ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ৩০শে এপ্রিল সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ অফিসে নওবেলালের প্রধান সম্পাদক মহম্মদ আজরফের সভাপতিত্বে সিলেটের সাংবাদিকের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় তারা নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেন। | কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার কাগজের দুষ্প্রাপ্যতার দরুন পূর্ববঙ্গের সাপ্তাহিক
পত্রিকাগুলিকে বন্ধ করার জন্য যে আদেশ করিয়াছেন বলিয়া জানা গিয়াছে তাহাতে সিলেটের সাংবাদিকদের এই সভা অত্যন্ত শক্ষিত হইয়াছে। এই আদেশের ফলে জনমতকে নিতান্ত অগণতন্দ্রীয়ভাবে রুদ্ধ করা হইয়াছে এবং যাহারা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ সংবাদিকতার দ্বারা জীবিকার সংস্থান করিতেছিলেন তাহাদিগকে বেকার শ্রেণীতে পরিণত করা হইয়াছে। রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য যাহাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা পুনর্বার বহাল হয় এবং এতগুলি লােক বেকার না হইয়া পড়ে এই উদ্দেশ্যে এই সভা প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারকে অবিলম্বে এই আদেশ প্রত্যাহার করার দাবী জানাইতেছে। বর্তমানে যে সব সংবাদপত্র প্রকাশিত হইতেছে তাহাদিগকে চালু রাখিবার জন্য উপযুক্ত ছাপার কাগজ সরবরাহ করিবার জন্য এই সভা উভয় সরকারের নিকট দাবী জানাইতেছে।
পূর্ব বাঙলা সরকারের ডেপুটি ইনসপেক্টর জেনারেলের আদেশক্রমে নওবেলালের প্রকাশনা ১৯৪৮-এর ১৩ই সেপ্টেম্বর থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
(৬) অল্পকাল পূর্বে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার পর শহীদ সুহরাওয়ার্দী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা এবং পূর্ব বাঙলা থেকে সংখ্যালঘুদের প্রস্থান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে প্রদেশ সফরের জন্যে ঢাকা উপস্থিত হলে ৩রা জুন তাকে জননিরাপত্তা আইনের ১• ধারা বলে অন্তরীণ করা হয়। পূর্ব বাঙলা সরকার এক ইস্তাহারে বলেন যে সে সময় পূর্ব বাঙলাতে এমন কোনাে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় নাই যার জন্যে সাম্প্রদায়িক সাম্প্রীতি বিস্তারের উদ্দেশ্যে সুহরাওয়াদীর সফরের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা আছে। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতির জন্যে ইতিমধ্যে যা কিছু করণীয় সরকার তা করেছেন কাজেই তার সফরের আসল উদ্দেশ্য প্রদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। সুহরাওয়ার্দীর সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য পূর্ব বাঙলাকে পশ্চিম বাংলা অর্থাৎ ভারতের সাথে যুক্ত করা এই মর্মেও সরকারী ইশতাহারটিতে অভিযােগ করা হয়। তাতে বলা হয় যে সুহরাওয়ার্দী তার সফরসূচী বাতিল করে প্রদেশ ত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করলেই তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। তিনি প্রাদেশিক সরকারের কাছে অনুরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করার পর তাকে মুক্তি দান করা হয় এবং তিনি কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন।’
• এখানে উল্লেখযােগ্য যে এই সময়ে শহীদ সুহরাওয়ার্দী পাকিস্তান গণ-পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন।
(চ) ৩০শে জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নানা অব্যবস্থা এবং শিক্ষা সমস্যা সম্পর্কে আলােচনার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুর রহমান চৌধুরী। প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্যে আবদুর রহমান চৌধুরীকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে একটি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। | এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের একটি স্মারকলিপিতে বলা হয় যে উত্তরােত্তরভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব দিক দিয়ে অবনতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। স্মারকলিপিটিতে অব্যবস্থার কারণসমূহ উল্লেখ করার পর তার প্রতিকারকল্পে নিম্নলিখিত দাবীসমূহ উত্থাপন করা হয় ।
১। বেতনের হার বৃদ্ধি করিতে হইবে, প্রারম্ভিক বেতন বর্তমানের ১৫ টাকা হইতে বৃদ্ধি করিয়া ২৫০ টাকা করিতে হইবে। ২। অধ্যাপকগণের প্রতি বাধ্যতামূলক অবসর লাভের বয়স বৃদ্ধি করিয়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় ইহা ষাট বৎসর করিতে হইবে। ৩। নিয়ােগ ও পদোন্নতির সময় পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি বা সাম্প্রদায়িকতা চলিবে না। ৪। অবিলম্বে শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ অধ্যাপক নিয়ােগ করিয়া বর্তমানের শুন্যপদ পূরণ করিতে হইবে। ৫। অধ্যাপকবৃন্দের অভাব-অভিযােগ অবিলম্বে পূরণ করিতে হইবে। ৬। যাহারা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন তাহাদিগকে রাখিবার জন্য অবিলম্বে ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে
হইবে।
(ছ) দেড় মাস কাল বেতন না পাওয়ার ফলে বহু পুলিশ কনস্টেবল ১৪ই জুলাই ধর্মঘট এবং সারা ঢাকা শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সন্ধ্যার দিকে অবস্থা আয়ত্বে আনার জন্যে সরকার সামরিক বাহিনী তলব করেন এবং তারা লালবাগ পুলিশ লাইনে ধঘটী পুলিশদেরকে ঘেরাও করে। এই সময় সশস্ত্র পুলিশ ও সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গুলি বিনিময়ের ফলে দুইজন পুলিশ নিহত এবং নয়জন আহত হয়।
(জ) ২০শে অগাস্ট রাজশাহীতে একটি জনসভায় বক্তৃতাপ্রসঙ্গে পূর্ব বাউলার অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প সচিব হামিদুল হক চৌধুরী বলেন যে বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী উচ্ছেদ করলে সেটা হবে ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ।
এবং এই হস্তক্ষেপের ফলে সমগ্র অর্থনৈতিক জীবনে ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন যে কমিউনিজমের সাথে ইসলামের কোনাে সমঝােতা হতে পারে না। কাজেই কমিউনিস্টদের সম্পর্কে সকলের হুশিয়ার থাকা প্রয়ােজন।
(ঝ) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব বাঙলা সফরের উদ্দেশ্যে ১৮ই নভেম্বর তেজগা বিমান বন্দরে উপস্থিত হলে প্রাদেশিক মন্ত্রীপরিষদের সদস্য, সরকারী কর্মচারী, সাংবাদিক এবং এক বিরাট জনতা তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে সেখানে সমবেত হয়। প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা পনের উদ্দেশ্যে ঢাকার মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠিত হয়। এই অভ্যর্থনা কমিটির সদস্য এবং সাংবাদিকবৃন্দ সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা নানাভাবে অপমানিত ও উপেক্ষিত হন। এই এসজে অভ্যর্থনা কমিটি ও সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে ‘আমলাতন্ত্রী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা হয়।১৩
অভ্যর্থনা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সাহেবে আলম তার বিবৃতিতে বলেন : অভ্যর্থনা কমিটি গত কয়েক দিন ধরিয়া শাহী অভ্যর্থনার আয়ােজন করিতেছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে বিমান ঘাঁটিতে উপস্থিত হইলে তাহাদিগকে সশস্ত্র প্রহরীদের পশ্চাতে থাকিতে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাইবার জন্য মন্ত্রীমণ্ডলী এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাই সম্মুখের সারিতে ছিল। অভ্যর্থনা কমিটির অজ্ঞাতসারেই মন্ত্রী এবং উপদস্থ কর্মচাৰীদিগকে বিশেষ প্রবেশপত্র দেওয়া হয়। সরকারী ব্যবস্থা এমন অদ্ভুত হয় যে, পূর্ব পাকিস্থান মােসলেম লীগের সভাপতি, অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান, সম্পাদক এবং সংবাদপত্র প্রতিনিধিদিগকে সশস্ত্র রক্ষীরা একস্থান হইতে অন্যস্থানে তাড়াইয়া বেড়াইতেছিল।১৪
(ঞ) ১৯শে নভেম্বর অর্থাৎ উপরােক্ত ঘটনার পরদিন পূর্ব বাঙলা সাংবাদিক সংঘের এক বিশেষ অধিবেশনে তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে প্রধান মন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জাপনের সময় যে অব্যবস্থা ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায় তার। সমালােচনা প্রসঙ্গে খায়রুল কবীর (আজাদ), গােলাম আহমদ (পাসন, কাজী শায়খুল ইসলাম (জিন্দেগ) এবং আরও কয়েকজন সাংবাদিক বলেন যে ‘পূর্ব বঙ্গের মীমণ্ডলী এবং সরকারী কর্মচারীগণের উচিত সংবাদপত্রের প্রতি তাঁহাদের গাষি উপলব্ধি করা।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে নিয়লিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খাঁর তেজগাঁও বিমান ঘটিতে উপস্থিতির সময় পূর্ব বঙ্গ সরকারের চীফ সেক্রেটারীর আমন্ত্রণক্রমে বিমান ঘাঁটিতে উপস্থিত বিশিষ্ট সাংবাদিকগণের প্রতি মিঃ ডি. এন. পাওয়ার, মিঃ নর্টন জোন্স ও অন্যান্য সরকারী কর্মচারীরা যে অপমানসূচক আচরণ প্রদর্শন করিয়াছেন, পূর্ব বঙ্গ সাংবাদিকসংঘের এই সভা তাহার তীব্র নিন্দা করিতেছে। এই সভা গতকল্যকার ব্যাপার সম্পর্কে আজাদ, জিন্দেগী ও পাসনে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি পূর্ব বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী জনাব নূরুল আমীনের দৃষ্টি আকৰ্ষণ করিতেছে এবং এইরূপ অভিমত পােষণ করিতেছে যে, সরকারী কর্মচারীদের এই আচরণ দ্বারা সাংবাদিকগণের সর্বদেশ স্বীকৃত অধিকার ও সুবিধাদির উপর অন্যায় হস্তক্ষেপ করা হইয়াছে।১৫ (ট) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ২০শে নভেম্বর পল্টন ময়দানে বিরাট এক জনসমাবেশে বক্তৃতা দানকালে বলেন :
আপনারা কখনই মনে এ ধারণার স্থান দিবেন না যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবর্গ ও তথাকার জনসাধারণ আপনাদের প্রগতি, সমৃদ্ধি ও হেফাজত সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাহারা আপনাদের পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের খেদমতের জন্য সদা সর্বদাই মনে প্রাণে হাজির আছেন।১৬
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপােষকতামূলক মনােভাবের পরিচয় এই বক্তব্যের মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্ট। তাছাড়া হেফাজতকারী হিসাবে পাকিস্তানের নেতৃবর্গ না বলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবর্গের উল্লেখও এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এরপর বাঙালীদের প্রাদেশিকতার নিন্দা করে তিনি বলেন :
আজকাল নানাপ্রকার ধ্বনি শােনা যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তানের এক শ্রেণীর লােকের মধ্যে উগ্র প্রাদেশিকতার মনােভাব সৃষ্টি হইয়াছে। আপনাদিগকে স্মরণ রাখিতে হইবে যে, প্রকৃত মুসলমান কখনও তাহার চিন্তাধারাকে প্রাদেশিকতার সঙ্কীর্ণ গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ রাখিতে পারে না। পাঞ্জাবী, বাঙালী, সিন্ধী, পেশােয়রী, পাঠান প্রভৃতির মধ্যে বৈষম্যের চিন্তা অন্তর হইতে মুছিয়া ফেলিতে হইবে। এছলামে ভেদাভেদের কোনাে স্থান নাই। আমরা পাঞ্জাবী, বিহারী, সিদ্ধি কিংবা পেশােয়রী যাহাই হই না কেন আমাদিগকে সর্বদা স্বরণ রাখিতে হইবে যে, আমরা পাকিস্তানী (হর্ষধ্বনি)।১৭
| ঠে) সম্রাট ষষ্ঠ জজে কন্যা এলিজাবেথের পুত্র সন্তান প্রসব উপলক্ষে অন্যান্য সরকারী ভবনের সাথে রাজশাহী কলেজেও পাকিস্তান পতাকার সাথে বৃটিশের ইউনিয়ন জ্যাক উত্তোলন করা হয়। এর ফলে ছাত্রেরা দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা সাম্রাবাদ ধ্বংস হােক’, ‘কমনওয়েলথ ছাড়তে হবে’ ইত্যাদি ধ্বনি সহকারে জোরপূর্বক কলেজ ভবনে উত্তোলিত ইউনিয়ন জ্যাক নীচে নামিয়ে তা বিনষ্ট করে।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর রাজশাহী সফরকালে তাকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে রাজশাহীর ছাত্রেরা শােভাযাত্রার ব্যবস্থা করেন কিন্তু ২১শে নভেম্বর কর্তৃপক্ষ সেই শােভাযাত্রাকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ছাত্র প্রতিনিধিদের ডেপুটেশনের অনুমতিও তাঁরা বাতিল করে দেন। কতৃপক্ষের এই সব আচরণের ফলে ছাত্রদের মধ্যে বিক্ষোভ অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তারা একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করে। পুলিশের উপস্থিতিতে এই মিছিলটিকে গুণ্ডাদল লাঠি ও ছােরার সাহায্যে আক্রমণ করে এবং তার ফলে ২৫ জন আহত হন। সেই রাত্রে রাইফেল ও রিভলভারধারী পুলিশদল কলেজ হােস্টেল ঘেরাওপূর্বক হােস্টেলের মধ্যে ব্যাপক খানাতল্লাশী চালায়। কোনাে পরােয়ানা ছাড়াই দুইজন ছাত্রকে পুলিশ গ্রেফতার করে এবং পরে তারাসহ মােট তিনজন ছাত্রকে রাজশাহী শহর থেকে বহিষ্কার করা হয়।
| (ভ) ২৭শে নভেম্বর লিয়াকত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি ছাত্রসভায় ভাষণ দেন। এই উপলক্ষে তাকে একটি মানপত্র দেওয়ার বিষয় আলােচনার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ভাইস চ্যান্সেলর সুলতান উদ্দিন আহমদ পূর্ব সন্ধ্যায় জগন্নাথ হলে এক ছাত্র সভা আহ্বান করেন। এই সভায় প্রধানমন্ত্রীকে প্রদত্ত মানপত্রটিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীর অন্তভুক্তির প্রস্তাব করা হলে প্রতিনিধিদের মধ্যে এ বিষয়ে গুরুতর মতভেদ দেখা দেয়। এবং তার ফলে শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটিকে ভােটে দিতে হয়। অধিকাংশ ছাত্র প্রস্তাবটির সপক্ষে ভােট দেওয়ায় সেটি গৃহীত হওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধি সভাকক্ষ পৰিত্যাগ করে। পরদিন বিকেলে নির্ধারিত সময়ে অস্থায়ী ভাইস চ্যান্সেলর সুলতান উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সভার কাজ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিয়নের সম্পাদক গােলাম আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মানপত্রটি পাঠ করেন। লিয়াকত আলী তার ভাষণ দানকালে মানপত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয়ের উপরই প্রধানত নিজের বক্তব্যকে সীমাবদ্ধ রাখেন; কিন্তু ভাষা প্রশ্ন সম্পর্কে কোনাে
নির্দিষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন না।
১৭ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের একটি বৈঠক বসে। আজিজ আহমদ, আবুল কাসেম, শেখ মুজিবর রহমান, কমরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, আনসার এবং তাজউদ্দীন আহমদ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর আসন্ন পূর্ব বাঙলা সফরকালে তাকে রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং সেই স্মারক লিপিটির খসড়া তৈরীর ভার অর্পিত হয় কমরুদ্দীন আহমদের উপর।৩ | কমরুদ্দীন আহমদ কায়েদে আজমকে ২৪শে মার্চ তারিখে প্রদত্ত আর লিপির ভিত্তিতে একটি নূতন স্মারকলিপি তৈরী করে সেটি লিয়াকত আলীর ঢাকা অবস্থানকালে সরাসরি তার কাছে পাঠিয়ে দেন। লিয়াকত আলী এই স্মারকলিপিটির কোনাে প্রাপ্তি স্বীকার করেননি এবং রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের সাথে তার কোনাে সাক্ষাৎকারই ঘটেনি।২৪ ছাত্রদের প্রদত্ত স্মারকলিপিটির মতাে এক্ষেত্রেও তিনি রাষ্ট্রভাষা প্রশ্ন সম্পর্কে কোনাে মন্তব্য প্রকাশ অথবা আলােচনা অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকেন।
২। ঢাকা শহরে ব্যাপক ছাত্রী বিক্ষোভ
ইডেন ও কমরুন্নেসা গার্লস স্কুল একত্রীভূত করার প্রতিবাদে এই দুই স্কুল ও ইডেন কলেজের প্রায় পাঁচশত ছাত্রী ১৫ই নভেম্বর ধর্মঘট করার পর বেলা দুটোর সময় প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উপরােক্ত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একত্রীভূত হওয়ার পর কমরুন্নেসা স্কুলের স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি সরকারের কাছে হস্তান্তরিত করা হয় এবং উভয় প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরাই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে। কমরুন্নেসা স্কুলের বরখাস্ত শিক্ষয়িত্রীদের পুনর্নিয়ােগ, গরীব ছাত্রীদের জন্যে অধিকসংখ্যক বৃত্তি এবং ছাত্রীদের যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত করার জন্যেও তারা দাবীজানায়। বিক্ষোভকারিণী ছাত্রীরা প্রাদেশিকশিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করে কিন্তু তিনি মফস্বলে সফররত থাকায় তারা সেক্রেটারিয়েট থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে উপস্থিত হয়। | প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন চারজন ছাত্রী প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং সেই সাক্ষাৎকালে তিনি তাদেরকে বলেন যে মাত্র মাস কয়েক পূর্বে
‘কমলাে গার্লস স্কুলের কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষা বিভাগের সাথে যথােপমুক্ত আলাপআলােচনার পর ইজেন স্কুল ও কমলা লকে একত্রিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কাজেই সংশ্লিষ্ট সরকারী বিভাগ এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে পুনরায় এ ব্যাপারে আলােচনা না করা পর্যন্ত উলিখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটিকে পৃথক করার নােতুন আদেশ তিনি দিতে পারেন না। কমরুন্নেসা স্কুলের বরখাস্ত শিক্ষয়িত্রীদের পুনর্নিয়ােগ সম্বন্ধে অবশ্য নুরুল আমীন বলেন যে তাদের মধ্যে যাদের উপযুক্ত বােগ্যতা আছে তাদেরকে নােতুন স্কুলে শিক্ষকতার কাজে নিয়ােগ করা হবে। তবে এ বিষয়ে শিক্ষা দফতরের সাথে আলােচনার পূর্বে তিনি কোনাে প্রতিশ্রুতি দিতে সরাসরি অস্বীকার করেন এবং শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাতের জন্যে ছাত্রীদেরকে উপদেশ দেন। | ১৫ই তারিখে ছাত্রী বিক্ষোভ সম্পর্কে সৈনিক আজাদে নিয়লিখিত মন্তব্য প্রকাশিত হয় :
পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা-সঙ্কট সম্বন্ধে আমরা ইতিপূর্বে কয়েকবার মন্তব্য করিয়াছি। অবস্থা কতদূর চরমে উঠিয়াছে, তাহা ১৫ই নভেম্বর তারিখের ঢাকার ছাত্রীবিক্ষোভ হইতেই অনুমিত হয়। ছাত্রীদের এত বড় মিছিল ইতিপূর্বে ঢাকায় দেখা যায় নাই। নিতান্ত দায়ে না পড়িলে যে ছাত্রীরা বাহির হয় নাই, এ কথা সহজেই উপলরি করা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পরে এক বৎসরের অধিককাল চলিয়া গিয়াছে। এ পর্যন্ত ইভেন বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য প্রয়ােজনীয় গৃহ ও শিক্ষয়িত্রী যােগাড় করা কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব হয় নাই। যে-সকল বিকুইজিশন করা বিরাট বাড়িগুলি বর্তমানে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ব্যবহৃত হইতেছে, তাহার যে-কোনাে এটায় সহজেই এই বিদ্যালয়ের জন্যে স্থান করা যাইত। অন্যান্য অভিযােগ এই যে, বর্তমান দুই স্কুলে মিলাইয়া যে এক হাজারের মতাে ছাত্রী আছে, তাহাদের বসিবার উপযুক্ত বেঞ্চি প্রভৃতিও নাই, পড়াইবার জন্যে শিক্ষায়িত্ৰী তাে নাই-ই। দীর্ঘ এক বৎসরের এই অকর্মণ্যতা শিক্ষা বিভাগের যােগ্যতার সাক্ষ্য দেয় না। উজিরে আম জনাব নূরুল আমিন শিক্ষা বিভাগের আসহাবে-কাহাফী নিদ্রা ভাঙাইবার কোন ব্যবস্থা করিবেন কি?
১৫ই তারিখ থেকে ইভেন ও কমরুন্নেসা স্কুলে ছাত্রী ধর্মঘট অব্যাহত থাকে। ২৪শে নভেরও ছাত্রীরা পূর্ব দিনগুলির মতাে ফুলের প্রধান প্রবেশ দ্বারে পিকেটিং এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভে ফলে চুলের সামনে
পুলিশ মােতায়েন করা হয়। কিন্তু এসব সৰেও যতনি কর্তৃপক্ষ ইতেন ফুলকে পৃথক ভবনে স্থানান্তরিত না করেন ততদিন পর্যন্ত তারা শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘােষণা করে।
কমরুন্নেসা ও ইভেন স্কুলের ছাত্রীদের অভাব অভিযােগ এবং নানা অসুবিধার প্রতি স্কুল কর্তৃপক্ষের উদাসীন মনােভাবের তীব্র নিন্দা করে ২৪শে তারিখে প্রিয়নাথ হাই স্কুলের ছাত্র ও শিক্ষকদের একটি সম্মিলিত সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তারা ধর্মঘটী ছাত্রীদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি আপন করে অন্য একটি পৃথক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। | কমরুন্নেসা ও ইডেন স্কুলের ছাত্রী ধর্মঘট চলাকালে ১৮ই নভেম্বর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্ররাও তাদের নিজস্ব দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে ধর্মঘট শুরু করার প্রস্তুতি নেয়। এই উদ্দেতে কলেজের সংগ্রাম পরিষদ নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রচার করেন :
পুনঃ পুনঃ আবেদন ও ডেপুটেশন সত্বেও পূর্ব বাংলা সরকার ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের দাবী দাওয়ার প্রতি ঔদাসীন্য প্রকাশ করায় কলেজ ছাত্রলীগ আগামী ২১শে নভেম্বর মােমবার সকাল সাতটা হইতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চালাইয়া যাইবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া পূর্ব বাউলা সরকারকে নােটিশ দিয়াছেন।। উক্ত নােটিশে বলা হয়, সরকার সিদ্দিক বাজারের আবর্জনাময় ও অসুবিধাজনক পরিবেশে কলেজকে খার জন্য জেদ করায় এবং কলেজকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করিতে অহেতুক বিলম্ব করায় ও বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করিতে অস্বীকার করায় ছাত্রগণ ধৈর্যের চরম সীমায় উপনীত হইয়াছে। ছাত্রগণ আর সরকারের মিষ্টবাক্যে ভুলিতে প্রস্তুত নয়। তাহারা দাবী করিতেছে যে সরকার বর্তমানে প্রাক্তন ভাই-চ্যান্সেলরের আদি বাড়িটি কলেজের জন্য ছাড়িয়া দিল, কলেজকে বর্তমান সেসন হইতে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত করুন, বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করার ও উক্ত বিভাগের সাথে সংwিষ্ট শিক্ষকদের বাকী বেতন অবিলম্বে মিটাইয়া দিন ও ছাত্রাবাসগুলিতে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। উক্ত দাবী অমান্য করা হইলে ছাত্রগণ আগামী ২১শে নবেম্বর মােমবার সকাল সাতটা হইতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘট ও প্রয়ােজনৰােধে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিতে বাধ্য হইবে।
এর পর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ৫৭৫ জন ছাত্রের মধ্যে প্রায় ৫০০ ছাত্র ২০শে নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ধর্মঘট শুরু করে। এঘট
—
১৭৫
ছলেরা কলেজের প্রধান প্রবেশ করে রাখে। এর পর তারা সম্মিলিত ভাবে মিছিল সহকারে সেক্রেটারিয়েট ভবনের সামনে উপস্থিত হলে পুলিশ তাদেরকে বাধা দান করে। এইভাবে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর মিছিলটি শহরের বিভিন্ন অঞ্চল প্রদক্ষিণ করে।’
২৩শে নভেম্বর ঢাকাইন্টারমিডিয়েট কলেজের একটি ছাত্র-প্রতিনিধিদল পূর্ব বাঙলা সরকারের শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলীর কাছে কয়েকটি দাবী পেশ করে কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে দাবীদাওয়ার প্রতি কর্ণপাত না করায় ছাত্রেরা ধর্মঘটের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ছাত্রদের দাবীগুলি নিম্নরূপ : ১। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ বস্তি এলাকা হইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ভাইস চ্যান্সেরের গৃহে স্থানান্তরিত করিতে হইবে। ২। কলেজটিকে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করিতে হইবে। ৩। ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করিতে হইবে। ৪। কলেজের ছাত্রাবাসের অসুস্থ ছাত্রগণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করিতে হইবে। | ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন ২৫শে নভেম্বর বেলা সাড়ে এগারােটার সময় ছাত্রদের একটি বিরাট মিছিল শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসবভনের সামনে সমবেত হয়। সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রী বেরিয়ে আসুন’, ‘আমাদের দাবী মানতে হবে, ‘ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনি দিতে থাকলে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাদেরকে জানানাে হয় যে অসুস্থতার জন্যে তিনি তাদের সাথে দেখা করতে তখনকার মতাে অক্ষম। একথা শোনার পর ছাত্রেরা তাঁকে অল্পক্ষণের জন্যে বারান্দায় বাড়িয়ে তাদের দাবী পাওয়ার কথা শুনতে অনুরােধ করে। নূরুল আমীন কিন্তু তাদের সে অনুবােধ রক্ষা করতে অসম্মতি জানানাের পর ছাত্রেরা বিক্ষুব্ধ অবস্থায় ‘বর্ধমান হাউস’ পরিত্যাগ করে নানাপ্রকার ধ্বনি সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে মিছিল ভঙ্গ করে। | এর পূর্বে সকাল দশটায় ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রাঙ্গণে এক সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয় :
(ক) আজাদ কাশ্মীর গভর্নমেন্ট ও তাহার যুদ্ধরত মােজাহেদগণের প্রতি আমরা আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি এবং প্রয়ােজনবােধে তাহাদিগকে সকল প্রকার সাহায্য করিতে প্রস্তুত আছি। (খ) আমরা কমরুন্নেসা ও ইডেন গার্লস স্কুলের ধর্মঘট ছাত্রীদের প্রতি আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি প্রকাশ করিতেছি এবং তাহাদের
অভিযােগের সুরাহা করিতে কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানাইতেছি। (গ) ২৬শে নভেম্বরের ভিতর আপকলিপি পেশ করা হউক। সরকার আমাদের দাবী পূরণ না করিলে বাধ্য হইয়া ২৭শে নভেম্বর শনিবার হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিব।১০
সরকারী ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে ১৬শে নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সেন্ট লি একোমডেশন কমিটির আহ্বায়ক মহম্মদ আবদুল ওদুদ সংবাপত্রে বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন :
আমরা বিশ্বাস করি, ঢাকা ইন্টারের ছাত্রদের ন্যায্য সংগ্রামের পাশে কেবল ঢাকার ছাত্রসমাজ কেন, গােটা ছাত্রসমাজ আসিয়া ঐক্যবদ্ধভাবে দাড়াইবে। আমরা জানি, কোটি কোটি লােকের রাজধানী ঢাকায় একটি মাত্র সরকারী কলেজের উত্তম পরিবেশ, ছাত্র ও অধ্যাপকদের সকল প্রকার সুযােগ-সুবিধা-বিশিষ্ট প্রথম শ্রেণীর কলেজ পনর্গঠনে ছাত্রদের সত্যিকার সহযােগিতার ঐকান্তিক ইচ্ছা ও ন্যায়সঙ্গত দাবী রুটির দাবীর চাইতে কম জোরালাে নহে বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুন্দর পাকিস্তান গঠনে অপরিহার্য।
১৫ই নভেম্বর থেকে ইডেন ও কমরুন্নেসা স্কুলের ধর্মঘট ২৫শে তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে এবং স্কুল এলাকায় পুলিশ বাহিনীকেও মােতায়েন রাখা হয়। ধর্মঘটী ছাত্রদের সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্রেরা সংবাদপত্র প্রতিনিধিদেরকে জানায় যে তাদের দাবী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত তারা সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। পরবর্তী শনিবার ২৭শে নভেম্বর সকাল নয়টায় কমরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীদের একটি জরুরী সভাও সেদিন আহ্বান করা হয়।
২৬শে তারিখে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রেরা সকাল ৮টায় কলেজ হােস্টেল ও বেলা ১২টায় কলেজ প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে সভা করে এবং দৃঢ়তার সাথে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা নেয়। পূর্ব সন্ধ্যা পর্যন্ত সরকারের কাছে প্রেরিত চরমপত্রের কোনাে জবাব না পাওয়ার ফলে ২৭শে নভেম্বর তারিখে ছাত্রদেরকে আবার কলেজ প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ায় জন্যে আহ্বান জানানাে হয়।১৩
ইডেন-কমরুন্নেসার ছাত্রী সংগ্রাম পরিষদও ছাত্রদেরকে সেদিন সকাল নয়টায় স্কুল প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার জন্যে অনুরােধ করে।
| ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ইডেন-কমরুন্নেসা স্কুলের সংগ্রাম পরিষদ এক যুক্ত বিবৃতিতে জানান যে, ইডেন কমরুন্নেসার শত শত ছাত্রী শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সরকার তাদের দাবীর প্রতিকারের কোনাে
ব্যবস্থা করেন নাই। ঢাকা ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রদের দাবীও অনুরূপভাবে উপেক্ষিত হওয়ার ফলে তারা ২৭শে নভেম্বর থেকে আমরণ অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। শিক্ষার প্রতি সরকারের চরম উদাসীনতার প্রতিবাদে যুক্ত বিবৃতিটিতে সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে তারা, ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানান। তারা ২৭শে তারিখে মিছিল সহকারে ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদেরকে বেলা বারােটায় সাধারণ প্রতিবাদ সভায় যােগদানের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার জন্যে অনুরােধ করেন।
ধর্মঘটী ছাত্রছাত্রীদের সংগ্রামকে সমর্থন করে ২৭শে নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রীসংঘ এবং নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রচারিত হয়।১৬।
২৭শে নভেম্বর ঢাকাতে ধর্মঘটী ছাত্রছাত্রীদের সমর্থনে সাধারণ ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং সারা শহরের ছাত্রছাত্রীরা বেলা দুটোর সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে নিজেদের দাবী সম্পর্কে আলােচনা এবং সরকার ও কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।১৭। | ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত ইভেন-কমরুন্নেসার ধর্মঘট অব্যাহত রাখায় ১লা ডিসেম্বর প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন তাদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে ক্লাসে যােগদানের জন্যে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি১৮ মারফত আবেদন জানান। বিবৃতিটিতে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ এবং ইডেন-কমরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘট সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন :
ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের কিছুসংখ্যক ছাত্র ধর্মঘট করিয়া কলেজে যাওয়া বন্ধ করিয়াছে এবং তাহাদের কেহ কেহ কলেজে যােগদানে ছাত্রদের উপর বলপ্রয়োেগও করিতেছে জানিয়া আমি ব্যথিত হইয়াছি। যে সময় জাতির জন্য একতা এবং নিয়মানুবর্তিতা একান্ত অপরিহার্য, ঠিক সেই সময়ে তাহাদের এই আচরণ আরও বেদনাদায়ক। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাহাদের অভিযােগ সম্বন্ধে তদন্ত করিয়া দেখিয়াছি তাহাদের ধর্মঘটের
পশ্চাতে কোনাে যুক্তিই নাই। এবং
তরুণ মুসলিম ছাত্রীদের রাস্তায় রাস্তায় প্যারেড করিয়া বেড়ান অত্যন্ত অসম্মানজনক এবং অশােভ। ইহা মুসলিম ঐতিহ্নের পরিপন্থী। পাকিস্তানে আমাদের, বিশেষ করিয়া নারীদের মধ্যে ইসলামিক তমন অনুসৃত হওয়া উচিত। আমি একান্তভাবে আশা করি যে, ছাত্রীরা এ
বিষয়ে অবহিত হইবেন এবং ভবিষ্যতে অনুরূপ কার্য হইতে বিরত থাকিবেন। কারণ ইহাতে মুসলিম জনসাধারণ অত্যন্ত অস্বস্তি বােধ করেন। . নুরুল আমীন তার বিবৃতিতে আগামী দুই বৎসয়ের মধ্যে কলেজের স্থানাভাব দূর করা, সেটিকে উচ্চ শ্রেণীতে উন্নীত করা, সেখানে বাণিজ্য বিভাগকে স্থায়ী করা ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের উল্লেখ করেন। এর পর তিনি আবার কলেজ স্কুলের ধর্মঘটী ছাত্রছছাত্রীদের ধর্মঘটের অযৌক্তিকতা প্রসঙ্গে প্রথমে ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র এবং পরে ইডেন-কমরুন্নেসার ছাত্রীদেরকে উদ্দেশ করে বলেন :
শিক্ষকদের অগ্রিম বেতন, ভবিষ্যৎ উন্নতির আশা, চাকুরির শর্তাশর্ত সম্পর্কে ছাত্রেরা যে অভিযােগ করিয়াছে, ‘প্রকৃত অবস্থার সহিত তাহার কোনােই সামঞ্জস্য নাই। এ বিষয়টি চাকুরিদাতা এবং গ্রহীতার মধ্যে চাকুরির এক সাধারণ শর্তের অন্তর্ভূক্ত। সুতরাং অধিক বিলম্ব না করিয়া ধর্মঘট প্রত্যাহার করতঃ পড়াশোনায় মনােনিবেশ করিবার জন্য আমি ধর্মঘট
ছাত্রদের প্রতি আবেদন জানাইতেছি। এবং
কমরুন্নেসা সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের ধর্মঘটী ছাত্রীদের প্রতিও আমি অনুরূপ আবেদন করিতেছি। কমরুন্নেসা স্কুলের কর্তৃপক্ষের পরামর্শক্রমেই কমরুন্নেসা এবং ইডেন বালিকা বিদ্যালয় একত্রিত করা হয়। দুইটি বিদ্যালয়ের বর্তমান মিলিত ছাত্রীসংখ্যা বিভাগ-পূর্বকালীন কমরুন্নেসা বিদ্যালয়ের ছাত্রী সংখ্যা অপেক্ষাও কম। সরকার নারী শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দান করেন। ছাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে স্কুল এবং কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হইবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতে ছাত্রছাত্রীদের ধর্মঘটের অযৌক্তিকতা এবং সুদূরপ্রসারী সরকারী পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বললেও তাদের শিক্ষা এবং আবাসিক জীবনের নানা অসুবিধা সম্পর্কে তেমন কোনাে বক্তব্য তাতে ছিলাে না। যাই হােক বিবৃতির মাধ্যমে তার এই আবেদনের পূর্বেই ছাত্রদের কতকগুলি দাবী-দাওয়া স্বীকার করে নেওয়ায় ৩০শে নভেম্বর দুপুর থেকে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রেরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে। যে সাতজন ছাত্র পঞ্চাশ ঘণ্টা উপবাস ছিলাে তারাও তাদের অনশন ভঙ্গ করে।
| সরকারী ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্রদের ধর্মঘট অবসান এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ছাত্রীদের ধর্মঘট ‘মুসলিম ঐতিহের পরিপন্থী’ এ কথা ঘােষণার পরও ইডেন
কমরুন্নেসার ছাত্রীরা তাদের ধর্মঘট ভ না করায় শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদও সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতিতে বলেন যে সরকার মেয়েদের শিক্ষা বিস্তারের সুবিধা পান করতে সর্বদাই প্রস্তুত। এ ব্যাপারে তাদের অতিরিক্ত সুবিধাদানের সত্যিকার প্রয়ােজন দেখা দিলে সরকার তা তাদেরকে দেবেন না ছাত্রীদের এরূপ আশঙ্কা করা উচিত নয়। বিবৃতিটিতে তিনি আরও বলেন যে কমরুন্নেসা স্কুলের ন্যায়সঙ্গত অভাব-অভিযােগগুলি সরকারের বিবেচনাধীন আছে।
এর পর কর্তৃপক্ষ ছাত্রীদের দাবী আংশিকভাবে স্বীকার করে নেওয়ায় ৬ই ডিসেম্বর ছাত্রী সংগ্রাম পরিষদ ইডেন-কমরুন্নেসার প্রায় তিন সপ্তাহকাল স্থায়ী ধর্মঘটের অবসান ঘােষণা করে।
৩। পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন
প্রাদেশিক স্বাস্থ্য মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম একটি সাহিত্য সম্মেলনের ব্যবস্থা হয়। এই সম্মেলনের জন্যে যে অভ্যর্থনা সমিতি গঠিত হয় তাতে হাবিবুল্লাহ বাহার সভাপতি এবং অধ্যাপক অজিত গুহ ও সৈয়দ আলী আশরাফ উভয়ে সম্পাদক মনােনীত হন। দৈনিক আজাদ’ অফিসেই অভ্যর্থনা সমিতির বৈঠকগুলি অনুষ্ঠিত হয়।
৫ই ডিসেম্বর, রবিবার, অভ্যর্থনা সমিতির একটি সভায় স্থির হয় যে ৩১শে ডিসেম্বর, ১৯৪৮ ও ১লা জানুয়ারি, ১৯৪৯ তারিখে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনের বিভিন্ন শাখা এবং শাখা সভাপতি সম্পর্কে বৈঠকটিতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অভ্যর্থনা—হাবিবুল্লাহ বাহার মূল—ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কাব্য-জসিমুদ্দীন শিশু সাহিত্য—বেগম শামসুন্নাহার ভাষা বিজ্ঞান—আবুল হাসনাৎ ইতিহাস-অধ্যক্ষ শরফুদ্দীন পুথি সাহিত্য ও লােক সংস্কৃতি-ত্রিপুরাশঙ্কর সেন শাস্ত্রী। বিজ্ঞান—ডক্টর এস. আর. খাস্তগীর। চিকিৎসৰিজান-ডক্টর আবদুল ওয়াহেদ শিক্ষা অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ
১৮০
ই ডিসেম্বর অভ্যর্থনা সমিতির বৈঠকে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১লা জানুয়ারি একটি ‘তাহজীব অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটির আয়ােজনের জন্যে হাবিবুল্লাহ বাহার, সৈয়দ আলী আহসান, নজির আহমদ, শামসুল হুদা, আবদুল আহাদ, আমিরুজ্জামান, আব্বাস উদ্দিন আহমদ, বেদারুদ্দীন আহমদ, মমতাজ আলী খান, লায়লা আরজুমন্দ বানু, মােহম্মদ কাসেম, ফররুখ আহমদ, আবদুল কাইউম, ফতেহ লােহানী, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মুজীবর রহমান খাঁ, কাজী মােতাহার হােসেন, আসাদুজ্জামান খা, মােহাম্মদ সােলায়মান এবং খায়রুল বীরকে নিয়ে একটি কমিটি গঠিত হয়। অনুষ্ঠান লিপি ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি ঠিক করার জন্যে ১৭ই ডিসেম্বর বেলা ৩-৩০ মিনিটে ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে উপরােক্ত অনুষ্ঠান কমিটির একটি বৈঠক বসে এবং তাতে অনুষ্ঠান সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপার সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা হয়।
সাহিত্য সম্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে ঢাকা প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের একটি বৈঠকে এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্বে লনের উদ্দেশ্য প্রগতি সাহিত্য বিরােধী এবং প্রকৃত গণতন্ত্র ও গণসাহিত্যের পরিপন্থী। সেই অনুসারে তারা একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেন যে, অতঃপর লেখক সংঘের কোনাে সদস্য আসন্ন পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সাথে কোনাে প্রকার সহযােগিতা করবেন না।
লেখক সংঘের উপরােক্ত ঘােষণাটি ২৯শে ডিসেম্বর ‘আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং তার ফলে সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক অজিত গুহ একটা জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। লেখক সংঘের সাথে তার যােগাযােগ বরাবরই খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাে এবং ৩রা ডিসেম্বর সংঘের এক সাধারণ সভায় তাঁকে নতুন বৎসরের জন্যে তার সভাপতিও করা হয়। অন্যান্যদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী সম্পাদক এবং আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন ও আলাউদ্দীন আল আজাদ যুগ্ন সহকারী সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। সাহিত্য সম্মেলন বর্জন করার সিদ্ধান্ত সংঘের যে বৈঠকে নেওয়া হয় তাতে অজিত গুহ ব্যক্তিগত ভাবে অনুপস্থিত ছিলেন এবং তাঁকে সেখানে উপস্থিত থাকার জন্যে কোনাে খবরও দেওয়া হয়নি।
| বস্তুতপক্ষে সম্মেলন বর্জন করার সিদ্ধান্ত অজিত গুহের বিরুদ্ধে একটা শৃঙ্খলাগত ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্যেই গৃহীত হয়। সম্মেলনের প্রস্তুতি বেশ কিছুদিন থেকেই চলে আসছিলাে এবং অজিত গুহ তার অভ্যর্থনা সমিতির
সম্পাদক হিসেবেও কয়েক সপ্তাহ ধরে কাজ করে আসছিলেন। কাজেই সম্মেলন সম্পর্কে লেখক সংঘ পূর্বেই একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারতাে। কিন্তু তারা তা নেয়নি। এর কারণ বর্জন সংক্রান্ত তাদের প্রস্তাবটির একটা পূর্ব ইতিহাস ছিলাে যেটিকে বাদ দিয়ে সেই সিদ্ধান্তের সত্যিকার অর্থ ও তাৎপর্য বােঝা যাবে না। | রবীন্দ্র গুপ্ত নামে ভবানী সেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মার্কসবাদী’তে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথকে প্রগতি বিরােধী সাহিত্যিক হিসাবে চিত্রিত করেন। সেই হিসাবে প্রগতিশীল সাহিত্যিকদের রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জন করা একটি বৈপ্লবিক দায়িত্ব এই মর্মেও তিনি প্রবন্ধটিতে অভিমত প্রকাশ করেন। তার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে পশ্চিম বাংলার সুধী ও সাহিত্যিক মহলে ১৯৪৮ সালে এক দারুণ বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সুশােভা সরকার, গােপাল হালদার প্রভৃতি ভবানী সেনের রবীন্দ্রনাথ বর্জনের প্রস্তাবের বিরােধিতা করে লেখালেখি করেন এবং তারা ছাড়াও অন্যান্যদের মধ্যে এই বিতর্ক বেশ ব্যাপক আকার ধারণ করে। | ১৯৪৮-এর শেষের দিকে এই বিতর্কের ঢেউ পূর্ব বাঙলায়, বিশেষতঃ ঢাকাতেও, এসে পৌছায় এবং লেখক সংঘের অধিকাংশ সদস্যদের মধ্যেই রবীন্দ্রবিরােধী বক্তব্যই প্রাধান্য লাভ করে। মােটামুটিভাবে বলা চলে যে রবীন্দ্রনাথ প্রগতিবিরােধী কাজেই তাকে সেই হিসাবে বর্জন করার সিদ্ধান্ত লেখক সংঘে নীতিগতভাবে স্বীকৃত হয়। মুনীর চৌধুরী, আখলাকুর রহমান, আবদুল্লাহ আলমুতী প্রভৃতি এই রবীন্দ্রবিরােধিতার পুরোভাগে ছিলেন। এখানেই অজিত গুহের সাথে তাদের সরাসরি বিরােধ বাধে। কারণ অজিত গুহ রবীন্দ্রনাথকে প্রগতি বিরােধী সাহিত্যিক হিসাবে স্বীকার করতে অথবা কে বর্জন করতে সম্মত ছিলেন না।
প্রথমদিকে এই বিতর্ক লেখক সংঘের সংস্যদের মধ্যে মােটামুটিভাবে সীমাবদ্ধ থাকলেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একটি সাহিত্য সভায় তা একটা সাধারণ বিতর্কে পরিণত হয়। এই সাহিত্য সভাটিতে হলের প্রভােস্টের সভাপতিত্বে ডক্টর শহীদুল্লাহ এবং অন্যান্যেরা আলাচনায় যােগদান করেন।
লেখক সংঘের সদস্য আখলাকুর রহমান এই সভায় অংশ গ্রহণকালে তাদের রবীন্দ্রবিরােধী বক্তব্যের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতাটি থেকে
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার, দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
এই অংশটি উদত করে বলেন যে কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ বস্তুতঃ সামালবাহী ইংরেজের ভারত অধিকারকে সমর্থন জানিয়েছেন এবং সেই হিসাবে সাহিত্যক্ষেত্রে তার ভূমিকা মূলতঃ প্রতিক্রিয়াশীল। তিনি তীব্র ভাষায় রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র-সাহিত্যের বিরুদ্ধে এ ধরনের আরও অনেক কিছু বলেন।
আখলাকুর রহমানের এই বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সভাপতি অজিত গুহ তার উপরােক্ত বক্তব্যের বিরােধিতা করেন এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্যান্য উদ্ধৃতি দিয়ে তার সাহিত্যের প্রগতিশীল ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ডক্টর শহীদুল্লাহও আখলাকুর রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বক্তৃতা দেন।
সলিমুল্লাহ হলের এই সাহিত্য সভার পর লেখক সংঘের অভ্যন্তরে অজিত গুহের বিরুদ্ধে দারুণ বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং লেখক সংঘের সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও জনসাধারণের সামনে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভুল বক্তব্য হাজির করার জন্যে তারা তার বিরুদ্ধে একটা শৃঙ্খলাগত ব্যবস্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেন। সেই। সিদ্ধান্তকে কার্যকর প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে তারা পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য। সম্মেলনকে মাত্র দুই দিন পূর্ব আকস্মিকভাবে বর্জন করার প্রস্তাব করেন।
পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন বর্জন করার সপক্ষে লেখক সংঘের সিদ্ধান্ত আকস্মিক হলেও তার সঙ্গত কারণও অবশ্য ছিলাে-সম্মেলনটি সর্বতােভাবে সরকারী উদ্যোগে আয়ােজিত হওয়ার স্বভাবতঃই তার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রাধান্য ছিলাে অনস্বীকার্য।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সম্মেলনটিকে দুদিন পূর্ব বর্জন করার সিদ্ধান্তের মলে অভ্যর্থনা সমিতির সম্পাদক হিসাবে অজিত গুহ শেষ পর্যন্ত তাতে যােগদান করাই স্থির করেন। তবে তার এই সিদ্ধান্তের অন্যতম কারণ ছিল এই যে তিনি ইতিমধ্যে সঠিকভাবে একথা জেনেছিলেন যে লেখক সংঘের সদস্যেরা তাকে সংঘ থেকে বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। কাজেই সংঘের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের সম্মেলন বিরােধী প্রস্তাব অনুযায়ী সম্মেলন বর্জন করতে তিনি নিজেকে বাধ্য মনে করেননি।১০ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর সংঘের নির্দেশ অমান্য করে তাতে যােগদানের অভিযােগে সম্মেলনের পরেই অজিত গুহকে প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
৩১শে ডিসেম্বর, শুক্রবার বিকেল ২-৩০ মিঃ কার্জন হলে বিপুল জনসমাগমের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপত্বি করেন ভক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। মৌলানা আবদুর
রহিমের কোরান পাঠের এ সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। তারপর কবি গােলাম মােস্তফা নবজাগ্রত রাষ্ট্রের নব চেতনা এবং সাহিত্য সাধনার ভবিষ্যৎ ও সাহিত্যিকদের কর্তব্য সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ভাষায় আলােচনা করেন। বেদায়উদ্দীন, বিমলচন্দ্র রায়, শেখ লুৎফর রহমান প্রভৃতি রেডিও পাকিস্তানের শিল্পীবৃন্দ আবদুল আহাদের পরিচালনায় নাজির আহমদ রচিত “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” নামে একটি গান পরিবেশন করেন।১২ | তারপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি হাবিবুল্লাহ বাহার ভাষণে শাহী জমানার ঢাকা ও পূর্ব বাংলার শিল্পী, সাহিত্য ও স্থাপত্যের বিস্তারিত আলােচনা করেন। এই আলােচনার উপসংহারে তিনি বলেন :
এ দেশের সাহিত্যের ইতিহাস শাস্ত্রকার ও অভিজাতদের সঙ্গে জনগণে বিরােধের ইতিহাস। এ বিরোধে বারে বারে জনগণের জয় হয়েছে। জনগণের ভাষা বাংলাকে শাস্ত্রকাররা বর্জন করেছিলেন। তখন সেই ভাষা সাম্যবাদী ও গণতন্ত্রী পাঠান সুলতান ও আমীর ওমরাদের সমর্থন পেয়েছিলাে। এই জন্যই দেখি : কৃত্তিবাস, বিদ্যাপতি থেকে আরম্ভ করে আদিমযুগের হিন্দু কবিরা এদের বন্দনা করেছেন কৃষ্ণের অবতার বলে। শুধু সমর্থন নয় রামায়ণ-মহাভারতের সঙ্গে অসংখ্য আরবী ফারসী গ্রন্থের অনুবাদ করেছেন মুসলিম সাহিত্যিকরা। এখনাে মুসলিম কবিদের লেখা প্রায় দশ হাজার পুঁথি বঙ্গ সাহিত্যের জয় ঘােষণা করছে। বঙ্গ সাহিত্য পুষ্টিলাভ করেছে স্থানীয় ও মুসলিম তাহজিব-তমনের সংঘাতের ফলে। এই সংঘাতেরই ফলে জন্ম হয়েছে শ্ৰচৈতন্যের ও চৈতন্য পরবর্তী সাহিত্যের যার প্রাণবাণী সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।” ইসলামী বিপ্লব বাঙলায় সম্পূর্ণ হয় নাই নানা কারণে। তা সত্ত্বেও ইসলাম এখানে যেটুকু প্রভাব বিস্তার করেছে, তারই ফলে দেখি বাঙালী ভারতের অন্য প্রদেশের চেয়ে বেশী গণতন্ত্রী, বেশী সাম্যবাদী, বেশী বিপ্লবী। ইংরেজ আগমনের পরে আবার হয় সংস্কৃতির সংঘাত। এ দেশীয় মুসলিম ও ইউরােপীয় সংস্কৃতির সম্মেলনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জন্ম। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি যতখানি হয়ে থাকুক, এ সাহিত্যের বিরাট ক্রটি। এই যে, এর সঙ্গে ছিলাে না গণমানসিকতার যােগ। এ ছিল মধ্যবিত্ত
সমাজের সাহিত্য যাকে বলা যায় শহরে সাহিত্য। * এই জাতীয় বক্তব্য হাবিবুল্লাহ বাংলা ব্যবস্থাপক সভায় বাংলা ভাষা সম্পর্কে আললাচনাকালে ইতিপূর্বে পেশ করেছিলেন। এই বইয়ের ১৫০-৫৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।
আজ আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। পূর্ববঙ্গে জন্ম হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের। শহর থেকে দূরে স্বাধীনতার আবহাওয়ায় তৈরী হবে আমাদের নূতন যুগের মূল সাহিত্য। এতদিন বাংলা সাহিত্যে জনগণের জীবন প্রতিফলিত হয় নাই। এবার তাই হবে, নৃত্ন পাকিস্তানী সাহিত্যে আমরা দেখতে পাব ঐ সব মানুষের জীবনের ছবি, যারা মাটিতে ফলায় সােনা, পদ্মা-মেঘনা, সাগর-মহাসাগরে দেয় পাড়ি, ধানের ক্ষেতে বাজায় বাঁশী। এ সাহিত্য দেশের দুঃসাহসী জনগণের সাহিত্য। পাকিস্তানের সােনার কাঠির স্পর্শে আজ পূর্ববঙ্গে জাগছে কবি, জাগছে শিল্পী, জাগছে নূতন যুগের সাহিত্যিক। শক্তিধর সৃষ্টিধর্মী শিল্পীর পদধ্বনি শােনা যাচ্ছে। আজিকার সমবেত সাহিত্যিকদের মধ্য দিয়ে সেই অনাগত শিল্পীকে জানাই খােদ আমদেদ।১৩
ডক্টর শহীদুল্লাহ মূল সভাপতি হিসাবে তার ভাষণে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। জাতীয় সাহিত্য সম্পর্কে তিনি বলেন : স্বাধীন পূর্ব বাংলার স্বাধীন নাগরিকরূপে আজ আমাদের প্রয়ােজন হয়েছে সর্ব শাখায় সুসমৃদ্ধ এক সাহিত্য। এই সাহিত্যে আমরা আজাদ পাকনাগরিক গঠনের উপযুক্ত প্রয়ােজনীয় বিষয়ের অনুশীলন চাই। এই সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোনাে জাতি জাতীয় সাহিত্য ছেড়ে বিদেশী ভাষায় সাহিত্য রচনা করে যশস্বী হতে পারেনি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গােড়ার দিকেই পারস্য আরব কর্তৃক বিজিত হয়েছিল, পারস্য আরবের ধর্ম নিয়েছিল, আরবী সাহিত্যের চর্চা করেছিল। কিন্তু তার নিজের সাহিত্য ছাড়েনি। হরক সমস্যা সম্পর্ক তিনি বলেন : কিছুদিন থেকে বানান ও অক্ষর সমস্যা দেশে দেখা দিয়েছে। সংস্কারমুক্ত ভাবে এগুলির আলােচনা করা উচিত এবং তার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পরামর্শ সমিতি গঠন করা আবশ্যক। যারা পালী, প্রাকৃত ও ধ্বনি তত্ত্বের সংবাদ রাখেন, তারা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাংলা বানান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক, সুতরাং তার সংস্কার দরকার। স্বাধীন পূর্ব বাংলায় কেউ আরবী হরফে, কেউ বা রােমান অক্ষরে বাংলা লিখতে উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলার শতকরা ৮৫ জন যে নিরক্ষর, তাদের মধ্যে অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের জন্য কি চেষ্টা হচ্ছে ? যদি পূর্ব বাংলার বাইরে বাংলা দেশ না থাকতত আর যদি গােটা বাংলা দেশে মুসলমান ভিন্ন অন্য সম্প্রদায় না
থাকত, তবে এই অক্ষরের প্রশ্নটা এত সঙ্গীন হত না। আমাদের বাংলা ভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। কাজেই বাংলা অক্ষর ছাড়তে পারা যায় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও মুসলিম জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার প্রয়ােজনীয়তা আমরা স্বীকার করি। তার উপায় আরবী হরফ নয় ; তার উপায় আরবী ভাষা। আরবী হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে আমাদিগকে বঞ্চিত হতে হবে। অধিকন্তু আরবীতে এতগুলি নতুন অক্ষর ও স্বরচিহ্ন যােগ করতে হবে যে বাংলার বাইরে তা যে কেউ অনায়াসে পড়তে পারবে তা বােধ হয় না। ফলে যেমন উর্দু ভাষা না জানলে কেউ উছু পড়তে পারবে না, তেমনি হবে বাংলা।১৫ শিক্ষা এবং অনুশীলনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
আমরা পূর্ব বাঙলার সরকারকে ধন্যবাদ দেই যে তারা বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করে বাংলা ভাষার দাবীকে আংশিকরূপে স্বীকার করেছেন। কিন্তু সরকারের ও জনসাধারণের এক বিপুল কর্তব্য সম্মুখে রয়েছে। পূর্ব বাঙলা জনসংখ্যায় গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, আরব, পারস্য, তুকি প্রভৃতি দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই সােনার বাঙলাকে কেবল জনে নয়, ধনে ধান্যে, জ্ঞানে গুণে, শিল্প বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোনাে সভ্য দেশের সমকক্ষ করতে হবে। তাই কেবল কাব্য ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দর্শন, ইতিহাস, ভূগােল, গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনােবিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল বিভাগে বাংলাকে উচ্চ আসন দিতে হবে। তার জন্য শিক্ষার মাধ্যমে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় আগাগােড়া বাংলা করতে হবে।৬ এর পর আবার উদু শিক্ষার উপরও জোর দিতে গিয়ে তিনি বলেন : আজাদ পাকিস্তানে আমাদের অবিলম্বে শিক্ষা তালিকার সংস্কার করতে হবে। এই নূতন তালিকায় রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে স্থান দিতে হবে। যারা এতদিন রাষ্ট্রভাষা রূপে ইংরেজির চর্চা করেছে, তাদের উছু শিখতে কি আপত্তি থাকতে পারে? মূল সভাপতির ভাষণে ভক্টর শহীদুন্নাহর উপরােক্ত বক্তব্যসমূহ ছাড়াও তার বক্তব্যের যে অংশটি সর্বাপেক্ষা গুরুতর বিতর্কের সৃষ্টি করে তা হলাে :
আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশ সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোনাে আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব কথা। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালীত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙি-দাড়িতে ঢাকৰার জোটি নেই।১৮
ডক্টর শহীদুল্লাহর ভাষণ এবং প্রথম অধিবেশনের অন্যান্য লেখাগুলি পড়া শেষ হওয়ার পর পূর্ব বাঙলা সরকারের শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলী সৈয়দ আলী আহসানকে বলেন যে তিনি শ্রোতাদেরকে উদ্দেশ করে বাংলাতে কিছু বলতে চান। হাবিবুল্লাহ বাহার এ ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহিত বােধ না করলেও শেষ পর্যন্ত সম্মত হন।১৯ | ফজলী বক্তৃতা দিতে উঠে প্রথমেই বলেন, “আজ এখানে যে সমস্ত প্রবন্ধগুলি পড়া হলো সেগুলি শােনার পর আমি ভাবছি আমি কি ঢাকাতে আছি না কলকাতায়। কজলী তার বক্তৃতায় ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে পশ্চিম বাঙলার বাংলা ভাষার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলার সংযােগ থাকার কোনাে কারণ নেই। কমিউনিস্টদের একটি জিনিস তার খুব পছন্দ বলেও তিনি উল্লেখ করেন–কমিউনিস্টরা মনে করেন যে সকল দেশের কমিউনিস্ট পরস্পরের সাথী এবং ভাই। কাজেই সে অবস্থায় পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের সাথে এবং তাদের ভাষার সাথে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের ভাষার যােগ কোথায় ? এইসব মন্তব্য ছাড়াও তিনি সভাপতি ডক্টর শহীদুল্লাহর অভিভাষণের অনেক সরাসরি সমালােচনাও কনে।
ফজলী অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন এবং তার বক্তৃতা শেষ হওয়ার কোনাে লক্ষণ না দেখে হাবিবুল্লাহ বাহার সভা চলাকালে সভাপতির সমালােচনা কর উচিত নয়, এই বলে ফজলীকে তার বক্তৃতা শেষ করতে বলেন। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই অনুরোধ সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী তার বক্তৃতা শেষ করতে সম্মত হলেন না। শুধু তাই নয়, পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী তার কিছু সমর্থকও সেই সভাস্থলে উপস্থিত ছিলাে, যারা হাবিবুল্লাহ বাহারের উপর এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ফজলীকে বক্তৃতা করতে দেওয়ার জন্যে চীৎকার করে।
এর পর ফজলী আরও অল্পক্ষণ বক্তৃতা করে আবােল-তাবােল অনেক কিছু বলায় হাবিবুল্লাহ বাহার ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং তাকে মিথ্যাবাদী’ ইত্যাদি বলে তৎক্ষণাৎ বক্তৃতা শেষ করতে বলেন। এই পর্যায়ে প্রাদেশিক
মন্ত্রী এবং তাঁর দফতরের সেক্রেটারীর মধ্যে খােলখুলিভাবে তর্কবিতর্ক এবং অশালীন মন্তব্য বিনিময় হয়। অবস্থা প্রায় আয়ত্বের বাইরে যাওয়ার উপক্রম হলে অজিত গুহ এবং আলী আহসান মাইকের কাছে গিয়ে ফজলীকে মাইক ছেড়ে সভামঞ্চ থেকে নীচে নামতে বলেন। এতে ফজলী অজিত গুহের উপর খুব কষ্ট হন। কিন্তু আলী আহসান আবার তাঁকে এই বলে মঞ্চ ত্যাগ করতে বলেন যে তিনি সভাস্থলে আর কিছুক্ষণ থাকলে ছাত্রদের হাতে তার মার খাওয়ার সম্ভাবনা।২৪
মঞ্চের উপর উদ্ভূত পরিস্থিতির ফলে ইতিমধ্যে সাধারণ শ্রোতারাও ফজলীর উপর ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানাপ্রকার ব্যাঙ্গাত্মক ধ্বনি দিতে থাকে। সেই অবস্থায় বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলী সভাস্থলে উপস্থিত লোেকজনের বিপুল করতালির মধ্যে কুদ্ধচিত্তে সভাস্থল পরিত্যাগ করেন। | ফজলীর উপরােক্ত আচরণে হাবিবুল্লাহ বাহার তার প্রতি ভয়ানক কষ্ট এবং অসন্তুষ্ট হন। সম্মেলন শেষ হওয়ার পরই তিনি চীফ সেক্রেটারী আজিজ আহমদকে বলে তাকে স্বাস্থ্য দফতরের সেক্রেটারীর পদ থেকে অপসারণ করে অন্য একজনকে সেই পদে নিযুক্ত করেন।২৬ ফজলী অবশ্য অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারীর পদে যথারীতি বহাল থাকেন।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ১লা জানুয়ারি ‘আজাদে’ সম্মেলনের উপর একটি সম্পাদকী প্রকাশিত হয়। সম্পাদকীয়টিতে সম্মেলনের সম্পর্কে অত্যন্ত বিরূপ আলােচনার সংবাদ পেয়ে ৩১শে ডিসেম্বর রাত্রেই হাবিবুল্লাহ বাহার আজাদ অফিসে গিয়ে আবুল কালাম শামসুদ্দীনের সাথে দেখা করে সেটা বাতিলের চেষ্টা করেন। কিন্তু আজাদ অফিসে সম্পাদকের দেখা না পেয়ে এবং অন্যত্র সন্ধান করেও ব্যর্থ হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছু করতে অক্ষম হন। কাজেই সম্পাদকীয়টি যথারীতি ১লা জানুয়ারি প্রকাশিত হয় এবং তাতে আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন ডক্টর শহীদুল্লাহের সমালােচনা প্রসঙ্গে বলেন :
সভাপতি তার ভাষণের এক স্থানে বলিয়াছেন, “আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশী সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোনাে
আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালীদের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, তা মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি লুঙি-দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।”
অখণ্ড ভারতের যুক্ত বাঙলায় সাহিত্যিক অভিভাষণে এমন কথা অনেকেই বলিয়াছেন বটে; কিন্তু বিভক্ত ভারতের দ্বিখণ্ডিত বাঙলায় পাকিস্তানী পরিবেশে এই শ্রেণীর কথা শুনিতে হইবে, একথা ভাবা একটু কঠিন ছিল বৈ কি। তা ছাড়া কোনাে হিন্দু লেখক নয়, একেবারে স্বয়ং ডক্টর শহীদুল্লাহ “মা প্রকৃতির” এমন স্তব গাহিবেন, এক থাই বা কে ভাবিতে পারিয়াছিল।
উপরােক্ত সম্পাদকীয়টিতে আর বলা হয় যে ডক্টর শহীদুল্লাহ তার ভাষণে ইসলামী ভাবধারা আমদানীর কোনো প্রয়ােজন বােধ করেননি। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ডক্টর শহীদুল্লাহ এক মৌখিক ভাষণে আজাদের সম্পাদকীয়টির জবাব দিতে গিয়ে বলেন যে ইসলাম সম্পর্কে কোনাে কথা বলার অধিকার দৈনিক পত্রিকাটির অপেক্ষা তারই বেশী। কাজেই এ বিষয়ে তাদের মন্তব্য অনধিকার চর্চা ব্যতীত কিছুই নয়।
দ্বিতীয় দিনের অধিবশেনে সম্মেলনে একটি কার্যকরী সংসদ গঠনের প্রস্তাব আনা হয়। এই প্রস্তাবে অন্যান্যের ছাড়া হাবিবুল্লাহ বাহার, শামসুন্নাহার মাহমুদ, সৈনু আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফের নাম ছিলাে। কার্যকরী সংসদ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি উত্থাপন করার পর অধ্যাপক আবুল কাসেম তার প্রতিবাদ করেন। এর পর আরও কয়েকজন তার সাথে প্রতিবাদে যােগ দেন। তাদের বক্তব্য ছিলাে এই যে বাঙলার প্রগতিবাদী তরুণ লেখক এবং ঢাকার বাইরের অনেক নামজাদা সাহিত্যিককে তার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবাদের ফলে হাবিবুল্লাহ নিজেই প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করেন। দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে ব্যবস্থাপক সভায় বাংলাকে পূর্ব বাঙলার রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলাে তাকে কার্যকরী করার জন্য আবুল কাসেম একটি প্রস্তাব করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে সে প্রস্তাব গৃহীত হয়। | ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে কি দেখিলাম এই শিরােনামায় আকালী চৌধুরী কতৃক লিখিত প্রত্যক্ষদর্শীর একটি বিস্তৃত বিবরণ ৯ই জানুয়ারি ১৯৪৯-এর সাপ্তাহিক ‘সৈনিকে প্রকাশিত হয়। বিবরণটির কয়েকটি অংশ উল্লেখযােগ্য। সম্মেলন সম্পর্কে সাধারণভাবে মন্তব্য করতে গিয়ে তাতে বলা হয় : পুরা একটি বছর এত ঢােল শহরতের পর সম্মেলনে যা পরিবেশন করলেন তা বহু কষ্টে পর্বতের মূষিক প্রসবের মতােই হয়েছিলাে। গিয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে কিন্তু সেখানে না পেলাম পূর্ব পাকিস্তানকে আর না পেলাম পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যকে। ঢাকার বাইরে যে
পূর্ব পাকিস্তান আছে তা বােধহয় সম্মেলনের উদ্যােক্তারা মনেই করেননি। ডক্টর শহীদুল্লাহর ভাষণে বিক্ষুব্ধ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণটিতে বলা হয় ? মূল সভাপতি পতিপ্রবর শহীদুল্লাহ সাহেব তাে তবু নূতন কথা কিছু আমাদের নিয়েছেন-মুসলমানের চেয়েও বেশী সত্য আমরা বাঙালী, প্রকৃতি মা যেন আমাদের চেহারায় ছাপ মেরে দিয়েছেন, টিকি টুপিতে, আমাদের ফরখ, করবে কি করে।-নূতন কথাই বটে, মিস্টার জিন্নাহ আর তার চেলা-কেলাদের এই এতদিনকার পুরােনাে দুই জাতিত্বের রক্তক্ষয়ী চীংকারের পর এবং পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরও মুসলমানের চাইতে আমাদের বাঙালী পরিচয়টাই খাটি সত্য এর চেয়ে অভিনব কথা আর কি হতে পারে? পূর্ব পাকিস্তানের সম্মেলনের প্রধান পুরােহিতের যােগ্য কথাই বটে।
এর পর আজাদের সম্পাদকীয় সমালােচনা এবং ডক্টর শহীদুল্লাহর জবাবের জের টেনে বিবরণদাতা বলেন : কিন্তু এত বড় পণ্ডিত ব্যক্তির সমালােচনা করতে যাবাে না—এ ব্যাপারে ভয়ও আছে যথেষ্ট। নিতান্ত অর্বাচীনের মতাে কোনাে একটা দৈনিক সভাপতি সাহেবের খুঁত ধরতে গিয়েছিলাে, বলতে চেয়েছিলাে আমাদের সাহিত্যিক পিতামহ এই সভাপতি সাহেব দাদুর গল্পের মতােই সাহিত্যের অনেক পুরানাে কাহিনী আমাদের শুনিয়েছেন। নূতন কিছু শুনতে পারেননি। সভাপতি সাহেব তার মুখের মতােই উত্তরই দিয়েছেন—এসব তিনি ভয় করবেন কেন! এরকম সমালােচনা কত তার পায়ের তলা দিয়ে গড়ায়। শুধু তাই নয়, দৈনিকটি যে বলেছিলাে ডক্টর সাহেব আমাদের সাহিত্যে ইসলামী ভাবধারা আমদানীর কোনাে প্রয়োজন অনুভব করেননি এ নাকি তার অনধিকার চর্চা। আমরাও স্বীকার করি। চোরের মুখে ধর্মের কাহিনী।
সম্মেলন আয়ােজনের ক্ষেত্রে সরকারী মহলের উদ্যোগ এবং প্রথম দিনের অধিবেশনে হাবিবাহ বাহার ও ফজলীর ক্রুদ্ধ বাক্য বিনিময় সম্পর্কে বিবরণটির প্রাথমিক অংশটি উল্লেখযােগ্য :
দ্বিতীয় অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার আগে কে একজন বলছিলাে—এটা তাে ইডেন বিন্ডিং সম্মেলন। ভদ্রলােকের অজ্ঞতা দেখে হেসেছিলাম—এখন আবার হাসলাম। বােকার তৃতীয় হাসি, অর্থাৎ এখন বুঝে হাসলাম। সম্মেলনের উদ্যোক্তাগণ সাহিত্য সম্মেলনের আয়ােজনে সাহিত্যিকদের না ছেকে বড় বড় সরকারী কর্মচারীদের সহযগিতাই কামনা করেছেন বেশ
করে, এই বােধহয় ছিল ভলােকটির ইশারা। কথাটা আমাদের আগেই বুঝা উচিত ছিলাে। প্রথম দিনের অধিবেশনে ইডেন বিন্ডিং-এর বিশিষ্ট কর্মচারী শিক্ষা বিভাগের সেক্রেটারী অবাঙালী এফ. এ. করিম সাহেবকে বাংলা ভাষায় তমদ্দন সঙ্গন্ধে বলতে দিয়ে পরে স্বভাবতঃ বক্তৃতাটা কিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলে সভাপতির অপেক্ষা না করেই বাহার সাহেব যে ভাবে ভদ্রলোককে ধমক দিয়েছিলেন ( আর নিজেও ধমক খেয়েছিলেন) তাতে ইডেন বিল্ডিং-এর কথাটা মনে হওয়া উচিত ছিলাে আমাদের তখন। কিন্তু উজিরে সেক্রেটারীতে বেধে গেলাে মুরগীর লড়াই। ব্যাপারটা দেখতে উপভােগ্য হয়েছিলাে মন্দ নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরাজিত, আর বাহার সাহেবের কাছে প্রেরণা পেয়ে হাজার হাজার লােকের হাততালির মধ্যে অপমানিত ও বিতাড়িত ভদ্রলােকের জন্যে সহানুভূতিতে প্রাণটা এতই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাে যে তখন আর কিছু ভাববারই অবসর ছিলাে
। এবার কথাটা বুঝলাম, আর এও বুঝলাম উজির সাহেবানদের সেক্রেটারীরা তাদেরকে ঘােড়াই কেয়ার করে থাকেন।
১৯৪৯ সালের এই সাহিত্য সম্মেলন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ডক্টর শহীদুল্লাহ ১৯৫৪ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেন :
১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্টে বহু দিনের গােলামীর পর যখন আজাদীর সুপ্রভাত হল, তখন প্রাণে আশা জেগেছিল যে এখন স্বাধীনতারমুক্ত বাতাসে বাংলা সাহিত্য তার সমৃদ্ধির পথ খুঁজে পাবে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর ঢাকায় যে সাহিত্য সম্মিলনীর অধিবেশন হয়েছিল, তাতে বড় আশাতেই বুক বেঁধে আমি অভিভাষণ দিয়েছিলুম। কিন্তু তারপর যে প্রতিক্রিয়া হয়, তাতে হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলুম, স্বাধীনতার নূতন নেশায় আমাদের মতিচ্ছন্ন করে দিয়েছে। আরবী হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবী পারসী শব্দের অবাধ আমদানি, প্রচলিত বাংলা ভাষাকে গঙ্গাতীরের ভাষা বলে তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা প্রচলনের খেয়াল প্রভৃতি বাতুলতা আমাদের একদল সাহিত্যিককে পেয়ে বসল। তারা এই মাতলামিতে এমন মেতে গেলেন, যে প্রকৃত সাহিত্য সেবা যাতে দেশের দশের মঙ্গল হতে পারে, তার পথে আবর্জনা ভূপ দিয়ে সাহিত্যের উন্নতির পথ কেবল রুদ্ধ করেই খুশিতে ভূষিত হলেন না, বরং এটি সাহিত্য
সেবীদিগকে নানা প্রকারে বিড়ম্বিত ও বিপদগ্রস্ত করতে আদা-জল খেয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলেন। তাতে কতক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর উস্কানি দিতে কসুর করলেন না। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র এবং অন্যান্য পশ্চিমবঙ্গের কবি ও সাহিত্যিক গণের কাব্য ও গ্রন্থ আলােচনা, এমন কি বাঙালী নামটি পর্যন্ত যেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়ষন্ত্র বলে কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন। কেউ এতে মিলিত বঙ্গের ভূতের ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আবল-তাবল বতে শুরু করে দিলেন এবং বেজায় হাত-পা ছুড়তে লাগলেন। করাচীর তাবেদার গত লীগ গভর্নমেন্ট বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতির জন্যে কিছু করা দুর থাক, বাঙালী বালকের কচি মাথায় উদুর বােঝা চাপিয়ে দিলেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আরবী হরফে বাংলা ভাষা লেখার এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টায় সহযােগিতা করেছেন। এইরূপ বিষাক্ত আবহাওয়ায় ১৯৪৮ সালের পরে আর কোনােও সাহিত্য সম্মেলনের আয়ােজন সম্ভবপর হয়নি। আজ জনপ্রিয় পূর্ব বাংলার গভর্নমেন্টের আশ্রয়ে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এক সর্বদলীয় সাহিত্য সম্মেলনের আযােজন করেছি।
১৯৪৮ সালের পর ১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে এবং ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় সাহিত্য। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তবে ১৯৪৮-এর পর ১৯৫৪ সালেই ঢাকাতে সর্বপ্রথম সাহিত্য সম্মেলন হয়।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগতি ১। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ | পূর্বতন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্র লীগ নেতৃত্বের বাংলা ভাষার বিরােধিতা এবং চরম সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকার জন্যে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে একটা তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। সেই অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্র একটি নােতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনে ১৯৪৮-এর প্রথম দিকেই উদ্যোগী হন। | নিজেদের মধ্যে কিছু প্রাথমিক ঘরােয়া আলােচনার পর প্রদেশের ছাত্রদের প্রতি একটি নােতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের আহ্বান জানিয়ে ১৯৪৮-এর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি আবেদন’ নামে একটি সাকুলার প্রচার করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে সাকুলারটি একটি উল্লেখযােগ্য দলিল। প্রথমেই সাধারণ ছাত্রদের সহযগিতা কামনা করে তাতে বলা হয় : ছাত্র সমাজের অভূতপূর্ব ত্যাগ ও কর্মপ্রেরণা দ্বারাই আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি। এই শিশু রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার ব্যপারেও আমাদেরই প্রধান ও সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিতে হইবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পর হইতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণ যে সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন তার আত সমাধানের জন্যে সুষ্ঠু ছাত্র ৭.শালন একান্ত প্রয়ােজনীয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এ ব্যাপারে পূর্বতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান “মুসলিম ছাত্র লীগ” আমাদের নিরাশ করিয়াছে। বর্তমানে নির্জীব ও অকর্মণ্য এই প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে আমরা যাহা চাহিয়াছি, তাহার কিছুই পাই নাই। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির গড়িয়া তুলিবার জন্য ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন একান্ত প্রয়ােজনীয় এবং এই ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করিবার জন্য “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ” নামে একটি নূতন ছাত্র প্রতিস্থান গঠনে সহায়তা করিবার জন্য আমরা আপনাদের সহযােগিতা কামনা করি।
নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজনীয়তা এবং যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সাকুলারটিতে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করে বলা হয় :
প্রশ্ন উঠিতে পারে পূর্বতন “মুসলিম ছাত্র লীগের পরিবর্তে নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান কেন? আমাদের মনে হয় নিম্নোক্ত কারণগুলি এই প্রস্তাবিত নৃত্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষে যথেষ্ট : (১) ছাত্র লীগের বাৎসরিক সাধারণ নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সর্বশেষ অধিবেশন হইয়াছিল ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়াতে। তার পর গত চার বৎসরে ছাত্র লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলের অন্ততঃ ৮টি অধিবেশন হওয়া বাধ্যতামূলক থাকা সত্ত্বেও একটি অধিবেশনও ডাকা হয় নাই। (২) বার বার রিকুইজিশন নােটিশ দেওয়া সত্ত্বেও সেক্রেটারী কাউন্সিলের অধিবেশন আহ্বান করিতে ও নূতন নির্বাচনের ব্যবস্থা করিতে অস্বীকার করিয়াছেন (কিন্তু দলবাজী করিবার জন্য ঢাকায় যুব-সম্মেলন করিয়াছেন)। (৩) চারি বৎসর পূর্বে গঠিত ছাত্র লীগের কর্ম পরিষদের সদস্যদের প্রায় সকলেরই ছাত্র জীবনের অবসান হওয়া সত্বেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির মানসে তাহারা গদি আঁকড়াইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। (৪) ভূতপূর্ব ছাত্র লীগের কর্মকর্তারা দলীয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করিয়া মন্ত্রিগণের হাতে ক্রীড়া পুত্তলির অভিনয় করিতেছেন। (৫) মুসলিম লীগ বিভক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও ছাত্র লীগ বিভক্ত হয় নাই (বাংলা দেশ পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে বিভক্ত হওয়ার পর “নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগ” আর থাকিতে পারে না)। (৬) বর্তমানে উদ্ভূত জরুরী সমস্যাগুলির সমাধান করিতে এবং ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করিবার ব্যাপারে ছাত্র লীগের কর্মকর্তারা লজ্জাহীন নিক্ষিয়তা প্রদর্শন করিয়াছেন। (৭) তথাকথিত ছাত্র নেতাদের ছাতনীতি বিরােধী কার্যকলাপ ও প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙাইয়া চাকুরি সংগ্রহের প্রচেষ্টা ছাত্র সমাজে গভীর হতাশা ও বিক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে। (৮) জনকয়েক ছাত্র নেতার বাংলা ভাষা বিরােধী কার্যকলাপ এবং ঢাকার বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের সক্রিয় কর্মপন্থা এবং গুণ্ডামী ছাত্র ও জনসাধারণের মাঝে ছাত্র লীগের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার করিয়াছে। (৯) এই কর্মকর্তারা নিজেরাও কিছু করিতেছেন না। পক্ষান্তরে কেহ কিছু করিবার জন্য আগাইয়া আসিলে নেতৃত্ব খােওয়া যাইবার ভয়ে তাহাদের বাধা দিতেছেন। এ বিষয়ে উত্তরবঙ্গ ছাত্র সম্মেলন (রাজশাহী) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন (কলিকাতা) সম্পর্কে মিঃ আজিজুর রহমানের বিবৃতি প্রণিধানযােগ্য। (১০) তদুপরি ছাত্র লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই ছাত্র লীগ বাতিল হইয়া গিয়াছে।
প্রশ্ন উঠিতে পারে পূর্বতন “মুসলিম ছাত্র লীগের পরিবর্তে নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান কেন? আমাদের মনে হয় নিম্নোক্ত কারণগুলি এই প্রস্তাবিত নৃত্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষে যথেষ্ট : (১) ছাত্র লীগের বাৎসরিক সাধারণ নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের সর্বশেষ অধিবেশন হইয়াছিল ১৯৪৪ সালে কুষ্টিয়াতে। তার পর গত চার বৎসরে ছাত্র লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলের অন্ততঃ ৮টি অধিবেশন হওয়া বাধ্যতামূলক থাকা সত্ত্বেও একটি অধিবেশনও ডাকা হয় নাই। (২) বার বার রিকুইজিশন নােটিশ দেওয়া সত্ত্বেও সেক্রেটারী কাউন্সিলের অধিবেশন আহ্বান করিতে ও নূতন নির্বাচনের ব্যবস্থা করিতে অস্বীকার করিয়াছেন (কিন্তু দলবাজী করিবার জন্য ঢাকায় যুব-সম্মেলন করিয়াছেন)। (৩) চারি বৎসর পূর্বে গঠিত ছাত্র লীগের কর্ম পরিষদের সদস্যদের প্রায় সকলেরই ছাত্র জীবনের অবসান হওয়া সত্বেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির মানসে তাহারা গদি আঁকড়াইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। (৪) ভূতপূর্ব ছাত্র লীগের কর্মকর্তারা দলীয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করিয়া মন্ত্রিগণের হাতে ক্রীড়া পুত্তলির অভিনয় করিতেছেন। (৫) মুসলিম লীগ বিভক্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও ছাত্র লীগ বিভক্ত হয় নাই (বাংলা দেশ পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তানে বিভক্ত হওয়ার পর “নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগ” আর থাকিতে পারে না)। (৬) বর্তমানে উদ্ভূত জরুরী সমস্যাগুলির সমাধান করিতে এবং ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করিবার ব্যাপারে ছাত্র লীগের কর্মকর্তারা লজ্জাহীন নিক্ষিয়তা প্রদর্শন করিয়াছেন। (৭) তথাকথিত ছাত্র নেতাদের ছাতনীতি বিরােধী কার্যকলাপ ও প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙাইয়া চাকুরি সংগ্রহের প্রচেষ্টা ছাত্র সমাজে গভীর হতাশা ও বিক্ষোভের সঞ্চার করিয়াছে। (৮) জনকয়েক ছাত্র নেতার বাংলা ভাষা বিরােধী কার্যকলাপ এবং ঢাকার বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করিবার আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের সক্রিয় কর্মপন্থা এবং গুণ্ডামী ছাত্র ও জনসাধারণের মাঝে ছাত্র লীগের প্রতি ঘৃণার সঞ্চার করিয়াছে। (৯) এই কর্মকর্তারা নিজেরাও কিছু করিতেছেন না। পক্ষান্তরে কেহ কিছু করিবার জন্য আগাইয়া আসিলে নেতৃত্ব খােওয়া যাইবার ভয়ে তাহাদের বাধা দিতেছেন। এ বিষয়ে উত্তরবঙ্গ ছাত্র সম্মেলন (রাজশাহী) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন (কলিকাতা) সম্পর্কে মিঃ আজিজুর রহমানের বিবৃতি প্রণিধানযােগ্য। (১০) তদুপরি ছাত্র লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই ছাত্র লীগ বাতিল হইয়া গিয়াছে।
পক্ষান্তরে বাধ্যতামূলক ফ্রি প্রাইমারী শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা, বিনা খেসাতে জমিদারী ও বর্গাদার প্রথার উচ্ছেদ, নানাবিধ কারিগরি শিক্ষার সুবন্দোবস্ত, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শিক্ষার সুবন্দোবস্তের জন্য সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, ডাক্তারী ও ধাত্রীবিদ্যা প্রসারের জন্য উন্নত ধরনের নূতন কারিকুলামের দাবী, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মুনাফাকারীর ও চোর কারবারীর সমূলে বিনাশ এবং ইসলামী ভাবধারায় শিক্ষা প্রসারের জন্য আমাদের এই প্রস্তাবিত নব প্রতিষ্ঠান কাজ করিয়া যাইবে।
সর্বশেষে তারা প্রত্যেক জেলা ও মহকুমায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠনের জন্যে ছাত্র সাধারণের কাছে আবেদন করেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রাদেশিক পর্যায়ে নােতুন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচিত জেলা প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বানের কথাও উল্লেখ করেন।
সাকুলাটির দুটি পাদটিকার মধ্যে একটিতে বলা হয় যে বিভিন্ন স্বার্থের হস্তক্ষেপের ফলে বাংলা ভাষা সম্পর্কে ছাত্রদের দাবী পাকিস্তানের উধর্বতন কর্তৃপক্ষ মহলের কাছে যথােপযুক্তভাবে উপস্থিত করা সম্ভব হয় নাই। এ বিষয়ে কায়েদে আজম এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর কাছে ভাষা বিষয়ক দাবীর বিবরণসমূহ সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে অনুরােধ করা হয়। দ্বিতীয় পাদটিকাতে স্বাক্ষরকারীরা যথাশীঘ্র নিজ নিজ জেলায় সাংগঠনিক কাজের উদ্দেশ্যে কর্মীদের সাথে সংযােগ স্থাপন করবেন বলে সাধারণভাবে সকলকে জানানাে হয়।
সার্কুলাটিতে “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ অস্থায়ী অর্গানাজিং কমিটির” নিম্নোক্ত সদস্যবৃন্দ স্বাক্ষর দান করেন :
নাইমউদ্দিন আহমদ বি. এ. অনার্স কনভেনর (রাজশাহী), আবদুর রহমান চৌধুরী বি. এ. (বরিশাল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা), আবদুল কুদ্স চৌধুরী বি.এ. অনার্স ( চট্টগ্রাম), শেখ মুজিবর রহমান বি. এ. (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ বি. এ. (নােয়াখালী), আবদুল আজিজ এম. এ. (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নুরুল আলম বি. এ. (মােমনশাহী, আবদুল মতিন বি. এ. (পাবনা), দবিরুল ইসলাম বি. এ. (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর) আলী আহাদ (ত্রিপুরা), নওয়াব আলী (ঢাকা), আবদুল আজিজ (খুলনা), নুরুল কবীর (ঢাল সিটি)। সাংগঠনিক কমিটির এই সার্কুলার প্রচারিত হওয়ার পর তার সদস্যেরা
অন্য কিছুসংখ্যক কর্মীদের সাথে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেসময় নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে গঠন করার প্রশ্ন ওঠে। শেখ মুজিবর রহমান এবং তার সঙ্গীরা মহম্মদ তোয়াহা এবং অলি আহাদের অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। অলি আহাদ উপরোদ্ধত সাকুলারে সই দেওয়া সত্বেও এই পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে আর কোনো সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেন। শেখ মুজিবর রহমান বলেন, যে মুসলিম, শব্দটির একটা বিরাট মূল্য আছে কাজেই ত খনাে পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের উপযুক্ত সময় আসেনি। এই মতবিরোধের কলে তোয়াহা এবং অলি আহাৰ নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা স্থির করেন। পাবনার আবদুল মতিন সে সময়ে তাদের দুজনকে ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিতে অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যে থেকে তাকে একটা অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা চালাতে অনুরােধ জানান। কিন্তু এই ধরনের কৌশলকে তোয়াহা এবং অলি আহাদ মনে করেন মচ এবং পরিত্যাজ্য। শুধু তাই না। মতিনের এই সব কথাবার্তা তারা দুজনে খুব অপছন্দ করেন। এবং তাকে বলেন যে তিনি তখনাে পর্যন্ত পেটি বুর্জোয়া সংস্কার থেকে মুক্ত হননি। এই বৈঠকের পর তোয়াহা এবং অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাথে আর কোনাে সম্পর্ক না রাখলেও আবদুল মতিন এই নোতুন সংগঠনটির মধ্যে থেকেই কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। | এর পর নঈমুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে উপরোক্ত যে কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটি নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানঠকে গঠন করতে উদ্যোগী হয়। ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে নঈমুদ্দীন আহমদের বহিষ্কারের পর মুসলিম ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় অর্গানাইজিং কমিটি পুনর্গঠিত হলেও প্রতিস্থানটির প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন ১৯৪৯-এর সেপ্টেম্বরের পূর্বে অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাহলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় এবং এলাকাগত কমিটি গুলির নেতৃত্বে এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির সদস্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে।
* অলি আহাদ সাহেবের মত বৈঠকটি হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১২ নং কামরায়। কিন্তু পাবনার আবদুল মতিন সাহেবের মতানুসারে সেট অনুষ্ঠিত হয় ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে।
পূর্ব বাঙলার একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল ছাত্র ফেডারেশন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সংযােগের ফলে মুসলমান ছাত্রেরা সাধারণভাবে তার সাথে জড়িত হওয়ার বিরােধী ছিলাে। কাজেই প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তার যে প্রভাব ছিলাে তা দারুণভাবে কমে আসে।
কিন্তু ছাত্র ফেডারেশনে যােগ দান করতে অনিচ্ছুক হলেও অল্পসংখ্যক ছাত্র অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষপাতী ছিলেন এবং তারা সেই ধরনের একটি অ-কমিউনিস্ট অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান গঠনের চিন্তা করছিলেন। এই সময় ‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস র্যালী’ বা ‘পাকিস্তান ছাত্র সংঘ’ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গঠনের চেষ্টা হয়। মহম্মদ গােলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে এর জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সেই কমিটি প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য, কর্মসুচী এবং গঠনতন্ত্রের একটি খসড়া ১৯৪৯-এর জানুয়ারির দিকেই প্রকাশ করেন।
এই খসড়াটিতে অন্যান্য ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে বলা হয় যে সেগুলির প্রত্যেকটিই কোনাে না কোনাে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। তাছাড়া তারা প্রত্যেকেই কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি আদর্শের প্রচারক। সেই হিসাবে বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি ছাত্রদের মধ্যে নানাপ্রকার অস্বচ্ছ চিন্তার সৃষ্টি করছে। | একটি নােতুন ও স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাতে আরও বলা হয় :
আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলির সাথে অসম্পর্কিত একটি স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের অনুজ্ঞামূলক প্রয়ােজনীয়তার উপর জোর দিয়ে শেষ করা যায় না। বস্তুতঃপক্ষে ছাত্র আন্দোলনকে সঠিক নেতৃত্ব দানের জন্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের সপক্ষে অনেকেই জোরালােভাবে মতপ্রকাশ করেছে। পাকিস্তান এখনাে একটা গঠনমূলক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। যাচ্ছে এবং একমাত্র পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদই বিভিন্ন লােকজন, সম্প্রদায় এবং শ্রেণীকে একটি সংগঠনের মধ্যে একত্রিত করতে পারে। আচ্ছন্নতা ও নিক্রিয়তা কাটিয়ে উঠতে ছাত্রেেক তা দারুণভাবে উক্ত করবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ নয়, পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদই পশ্চিমী
জাতীয়তার উগ্র চরিত্র থেকে মুক্ত থাকতে পারে। জনসাধারণের আর্থিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য তার একটা সমাজতান্ত্রিক বক্তব্য থাকবে। ‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস ঝালীর উপরােক্ত এবং অন্যান্য বক্তব্যের মধ্যে বহু জটিলতা এবং অস্বচ্ছতা থাকলেও অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ হিসাবে তা উল্লেখযােগ্য। এই খসড়াটিতে উর্দু এবং বাংলা এই উভয় ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে বাংলাকে অবিলম্বে চালু করার দাবীও তাতে জানানো হয়। | এই প্রতিষ্ঠানটির আহ্বায়ক মহম্মদ শােলাম কিবরিয়া অলি আহাদকে তাতে যােগদানের জন্যে অনুরােধ জানান। অলি আহাদ প্রথম দিকে কিছুটা উৎসাহ প্রকাশ করলেও কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দিন, তোয়াহা এবং ডক্টর করিমের পরামর্শ মতাে তিনি ‘স্টুডেন্টস্ র্যালীর সাথে জড়িত না হওয়ার সিদ্ধান্ত করেন।
বাক্তিগতভাবে অনেক ছাত্র অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলেও একমাত্র ছাত্র ফেডারেশন ছাড়া এই পর্যায়ে অন্য কোনাে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান ছিলাে না। অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও নানা গণতান্ত্রিক দাবীর ভিত্তিতে ছাত্র ফেডারেশন এই সময়ে অন্যান্য ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সহযােগিতায় সভা অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলেও সুবিধাবাদী ছাত্র নেতৃত্ব এবং ছাত্রদের সাম্প্রদায়িক সংস্কারের জন্যে তার সাফল্য ছিলাে খুবই সীমিত। | রাজশাহীতে ছাত্র ফেডারেশনের আবুল কাসেম এবং অন্য কয়েকজন ছাত্রের বহিষ্কার এবং ঢাকা ও প্রদেশের অন্যত্র বহু ছাত্রের উপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ৮ই জানুয়ারি, ১৯৪৯, ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস উদ্যাপনের আহ্বান জানানাে হয়। ঢাকা কলেজে আংশিক ধর্মঘট হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন পূর্ণ ধর্মঘট হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে বেলা ২টার সময় মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবর রহমান, দবিরুল ইসলাম প্রভৃতি বক্তৃতা দেন। ছাত্রদের দাবীসমূহ বিবেচনা করে সেগুলিকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে সরকারকে এক মাসের সময় দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রথম দিনের এই ধর্মঘট সত্ত্বেও পরবর্তী পর্যায়ে এই আন্দোলন বিশ্ব বিদ্যালয়ের সুবিধাবাদী ছাত্র নেতৃত্বের ‘আপােষ’ মনােবৃত্তির ফলে আর অগ্রসর হতে পারেনি।
১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশন ময়মনসিংহের হাজং চাষীদের
উপর গুলি বর্ষণ ও চাষী হত্যার প্রতিবাদে একটি ছাত্রসভা আহ্বান করে। একদল ছাত্র সেই সভাটিকে ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পূর্বপ্রস্তুতি অনুসারে সেখানে উপস্থিত হয়। মহম্মদ বাহাউদ্দিনের সভাপতিত্বে সভা আরম্ভ হওয়ার পরই তাদের মধ্যে একজন ‘সভা কে আহ্বান করেছে এই কথা জানতে চেয়ে সভাপতির হাত ধরে টান দিয়ে তাকে নীচে নামিয়ে আনে এবং অন্য একজন সভাপতির চেয়ারটিকে বেলতলার পাশের পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয়। এর পর সেই ছাত্র গুণ্ডাদল নির্বিচারে উপস্থিত ছাত্রদের উপর কিল, চড়, ঘুষি মেরে সভাটিকে সম্পূর্ণভাবে পণ্ড করে।
ছাত্র ফেডারেশন খুব সক্রিয় না হলেও সেই জাতীয় একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব স্বীকার এবং সহ করতে প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রস্তুত ছিলােনা। এজন্যেই তাদের উপর সে সময় প্রায়ই নানা প্রকার হামলা হতে দেখা যেত। ১৪ই মার্চ তারিখে একদল গুণ্ডা সিলেটে ছাত্র ফেডারেশনের অফিসের উপর হামলা করে এবং সেই জাতীয় হামলা বন্ধ করার ব্যবস্থার জন্যে ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন।
৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন-কর্মচারী ধর্মঘট | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম বেতনের কর্মচারীরা কতকগুলি দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে অনেকদিন আলাপ আলোচনার পর তাদের দুরবস্থার প্রতিকারের অন্য কোনো উপায় না দেখে এক মাসের নােটিশে ৩রা মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করেন।
ধর্মঘটের প্রস্তুতির বিভিন্ন স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্র প্রতিষ্ঠানের, বিশেষতঃ ছাত্র ফেডারেশন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের কর্মীদের সাথে কর্মচারীরা ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন এবং তাদের সমর্থন, উৎসাহ এবং সহযােগিতা ধর্মঘটের ক্ষেত্রে তাদেরকে অনেকাংশে পরিচালিত করে।
নিম-কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ৩রা মার্চ ছাত্রেরাও ক্লাস বর্জন করেন। এর পর ৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বান এবং উদ্যোগে পূর্ণ ছাত্রধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা ১২-৩০ মিনিটে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ছাজেরা স্থির করেন যে কর্মচারীদের দাবী-দাওয়া কর্তৃপক্ষ যতদিন না স্বীকার করেন ততদিন পর্যন্ত তারা সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত রাখবেন। তার পর সেই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম-কর্মচারী ও
পক্ষান্তরে বাধ্যতামূলক ফ্রি প্রাইমারী শিক্ষার ব্যাপক ব্যবস্থা, বিনা খেসাতে জমিদারী ও বর্গাদার প্রথার উচ্ছেদ, নানাবিধ কারিগরি শিক্ষার সুবন্দোবস্ত, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শিক্ষার সুবন্দোবস্তের জন্য সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গঠন, ডাক্তারী ও ধাত্রীবিদ্যা প্রসারের জন্য উন্নত ধরনের নূতন কারিকুলামের দাবী, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, মুনাফাকারীর ও চোর কারবারীর সমূলে বিনাশ এবং ইসলামী ভাবধারায় শিক্ষা প্রসারের জন্য আমাদের এই প্রস্তাবিত নব প্রতিষ্ঠান কাজ করিয়া যাইবে।
সর্বশেষে তারা প্রত্যেক জেলা ও মহকুমায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অস্থায়ী সাংগঠনিক কমিটি গঠনের জন্যে ছাত্র সাধারণের কাছে আবেদন করেন এবং পরবর্তী সময়ে প্রাদেশিক পর্যায়ে নােতুন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাচিত জেলা প্রতিনিধিদের একটি সম্মেলন আহ্বানের কথাও উল্লেখ করেন।
সাকুলাটির দুটি পাদটিকার মধ্যে একটিতে বলা হয় যে বিভিন্ন স্বার্থের হস্তক্ষেপের ফলে বাংলা ভাষা সম্পর্কে ছাত্রদের দাবী পাকিস্তানের উধর্বতন কর্তৃপক্ষ মহলের কাছে যথােপযুক্তভাবে উপস্থিত করা সম্ভব হয় নাই। এ বিষয়ে কায়েদে আজম এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর কাছে ভাষা বিষয়ক দাবীর বিবরণসমূহ সরাসরি পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে অনুরােধ করা হয়। দ্বিতীয় পাদটিকাতে স্বাক্ষরকারীরা যথাশীঘ্র নিজ নিজ জেলায় সাংগঠনিক কাজের উদ্দেশ্যে কর্মীদের সাথে সংযােগ স্থাপন করবেন বলে সাধারণভাবে সকলকে জানানাে হয়।
সার্কুলাটিতে “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ অস্থায়ী অর্গানাজিং কমিটির” নিম্নোক্ত সদস্যবৃন্দ স্বাক্ষর দান করেন :
নাইমউদ্দিন আহমদ বি. এ. অনার্স কনভেনর (রাজশাহী), আবদুর রহমান চৌধুরী বি. এ. (বরিশাল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা), আবদুল কুদ্স চৌধুরী বি.এ. অনার্স ( চট্টগ্রাম), শেখ মুজিবর রহমান বি. এ. (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ বি. এ. (নােয়াখালী), আবদুল আজিজ এম. এ. (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নুরুল আলম বি. এ. (মােমনশাহী, আবদুল মতিন বি. এ. (পাবনা), দবিরুল ইসলাম বি. এ. (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর) আলী আহাদ (ত্রিপুরা), নওয়াব আলী (ঢাকা), আবদুল আজিজ (খুলনা), নুরুল কবীর (ঢাল সিটি)। সাংগঠনিক কমিটির এই সার্কুলার প্রচারিত হওয়ার পর তার সদস্যেরা
অন্য কিছুসংখ্যক কর্মীদের সাথে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেসময় নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে গঠন করার প্রশ্ন ওঠে। শেখ মুজিবর রহমান এবং তার সঙ্গীরা মহম্মদ তোয়াহা এবং অলি আহাদের অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। অলি আহাদ উপরোদ্ধত সাকুলারে সই দেওয়া সত্বেও এই পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে আর কোনো সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত নেন। শেখ মুজিবর রহমান বলেন, যে মুসলিম, শব্দটির একটা বিরাট মূল্য আছে কাজেই ত খনাে পর্যন্ত অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের উপযুক্ত সময় আসেনি। এই মতবিরোধের কলে তোয়াহা এবং অলি আহাৰ নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা স্থির করেন। পাবনার আবদুল মতিন সে সময়ে তাদের দুজনকে ছাত্র প্রতিষ্ঠানটিতে অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যে থেকে তাকে একটা অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা চালাতে অনুরােধ জানান। কিন্তু এই ধরনের কৌশলকে তোয়াহা এবং অলি আহাদ মনে করেন মচ এবং পরিত্যাজ্য। শুধু তাই না। মতিনের এই সব কথাবার্তা তারা দুজনে খুব অপছন্দ করেন। এবং তাকে বলেন যে তিনি তখনাে পর্যন্ত পেটি বুর্জোয়া সংস্কার থেকে মুক্ত হননি। এই বৈঠকের পর তোয়াহা এবং অলি আহাদ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সাথে আর কোনাে সম্পর্ক না রাখলেও আবদুল মতিন এই নোতুন সংগঠনটির মধ্যে থেকেই কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। | এর পর নঈমুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে উপরোক্ত যে কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটি নোতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠানঠকে গঠন করতে উদ্যোগী হয়। ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে নঈমুদ্দীন আহমদের বহিষ্কারের পর মুসলিম ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় অর্গানাইজিং কমিটি পুনর্গঠিত হলেও প্রতিস্থানটির প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন ১৯৪৯-এর সেপ্টেম্বরের পূর্বে অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাহলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় এবং এলাকাগত কমিটি গুলির নেতৃত্বে এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির সদস্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে।
* অলি আহাদ সাহেবের মত বৈঠকটি হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১২ নং কামরায়। কিন্তু পাবনার আবদুল মতিন সাহেবের মতানুসারে সেট অনুষ্ঠিত হয় ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে।