You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

পূর্ব বাঙলার একমাত্র অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল ছাত্র ফেডারেশন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটির সাথে কমিউনিস্ট পার্টির ঘনিষ্ঠ সংযােগের ফলে মুসলমান ছাত্রেরা সাধারণভাবে তার সাথে জড়িত হওয়ার বিরােধী ছিলাে। কাজেই প্রগতিশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তার যে প্রভাব ছিলাে তা দারুণভাবে কমে আসে।
কিন্তু ছাত্র ফেডারেশনে যােগ দান করতে অনিচ্ছুক হলেও অল্পসংখ্যক ছাত্র অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষপাতী ছিলেন এবং তারা সেই ধরনের একটি অ-কমিউনিস্ট অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান গঠনের চিন্তা করছিলেন। এই সময় ‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস র্যালী’ বা ‘পাকিস্তান ছাত্র সংঘ’ নামে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন গঠনের চেষ্টা হয়। মহম্মদ গােলাম কিবরিয়াকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে এর জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং সেই কমিটি প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য, কর্মসুচী এবং গঠনতন্ত্রের একটি খসড়া ১৯৪৯-এর জানুয়ারির দিকেই প্রকাশ করেন।
এই খসড়াটিতে অন্যান্য ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে বলা হয় যে সেগুলির প্রত্যেকটিই কোনাে না কোনাে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। তাছাড়া তারা প্রত্যেকেই কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র, সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি আদর্শের প্রচারক। সেই হিসাবে বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানগুলি ছাত্রদের মধ্যে নানাপ্রকার অস্বচ্ছ চিন্তার সৃষ্টি করছে। | একটি নােতুন ও স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাতে আরও বলা হয় :
আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলির সাথে অসম্পর্কিত একটি স্বাধীন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠানের অনুজ্ঞামূলক প্রয়ােজনীয়তার উপর জোর দিয়ে শেষ করা যায় না। বস্তুতঃপক্ষে ছাত্র আন্দোলনকে সঠিক নেতৃত্ব দানের জন্য বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে একটি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের সপক্ষে অনেকেই জোরালােভাবে মতপ্রকাশ করেছে। পাকিস্তান এখনাে একটা গঠনমূলক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। যাচ্ছে এবং একমাত্র পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদই বিভিন্ন লােকজন, সম্প্রদায় এবং শ্রেণীকে একটি সংগঠনের মধ্যে একত্রিত করতে পারে। আচ্ছন্নতা ও নিক্রিয়তা কাটিয়ে উঠতে ছাত্রেেক তা দারুণভাবে উক্ত করবে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ নয়, পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদই পশ্চিমী
জাতীয়তার উগ্র চরিত্র থেকে মুক্ত থাকতে পারে। জনসাধারণের আর্থিক ও সামাজিক মুক্তির জন্য তার একটা সমাজতান্ত্রিক বক্তব্য থাকবে। ‘পাকিস্তান স্টুডেন্টস ঝালীর উপরােক্ত এবং অন্যান্য বক্তব্যের মধ্যে বহু জটিলতা এবং অস্বচ্ছতা থাকলেও অসাম্প্রদায়িক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রাথমিক উদ্যোগ হিসাবে তা উল্লেখযােগ্য। এই খসড়াটিতে উর্দু এবং বাংলা এই উভয় ভাষাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলা হয়। প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে বাংলাকে অবিলম্বে চালু করার দাবীও তাতে জানানো হয়। | এই প্রতিষ্ঠানটির আহ্বায়ক মহম্মদ শােলাম কিবরিয়া অলি আহাদকে তাতে যােগদানের জন্যে অনুরােধ জানান। অলি আহাদ প্রথম দিকে কিছুটা উৎসাহ প্রকাশ করলেও কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দিন, তোয়াহা এবং ডক্টর করিমের পরামর্শ মতাে তিনি ‘স্টুডেন্টস্ র্যালীর সাথে জড়িত না হওয়ার সিদ্ধান্ত করেন।
বাক্তিগতভাবে অনেক ছাত্র অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করলেও একমাত্র ছাত্র ফেডারেশন ছাড়া এই পর্যায়ে অন্য কোনাে অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান ছিলাে না। অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও নানা গণতান্ত্রিক দাবীর ভিত্তিতে ছাত্র ফেডারেশন এই সময়ে অন্যান্য ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সহযােগিতায় সভা অনুষ্ঠানের চেষ্টা করলেও সুবিধাবাদী ছাত্র নেতৃত্ব এবং ছাত্রদের সাম্প্রদায়িক সংস্কারের জন্যে তার সাফল্য ছিলাে খুবই সীমিত। | রাজশাহীতে ছাত্র ফেডারেশনের আবুল কাসেম এবং অন্য কয়েকজন ছাত্রের বহিষ্কার এবং ঢাকা ও প্রদেশের অন্যত্র বহু ছাত্রের উপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ৮ই জানুয়ারি, ১৯৪৯, ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস উদ্যাপনের আহ্বান জানানাে হয়। ঢাকা কলেজে আংশিক ধর্মঘট হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন পূর্ণ ধর্মঘট হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে বেলা ২টার সময় মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবর রহমান, দবিরুল ইসলাম প্রভৃতি বক্তৃতা দেন। ছাত্রদের দাবীসমূহ বিবেচনা করে সেগুলিকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে সরকারকে এক মাসের সময় দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রথম দিনের এই ধর্মঘট সত্ত্বেও পরবর্তী পর্যায়ে এই আন্দোলন বিশ্ব বিদ্যালয়ের সুবিধাবাদী ছাত্র নেতৃত্বের ‘আপােষ’ মনােবৃত্তির ফলে আর অগ্রসর হতে পারেনি।
১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশন ময়মনসিংহের হাজং চাষীদের
উপর গুলি বর্ষণ ও চাষী হত্যার প্রতিবাদে একটি ছাত্রসভা আহ্বান করে। একদল ছাত্র সেই সভাটিকে ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে পূর্বপ্রস্তুতি অনুসারে সেখানে উপস্থিত হয়। মহম্মদ বাহাউদ্দিনের সভাপতিত্বে সভা আরম্ভ হওয়ার পরই তাদের মধ্যে একজন ‘সভা কে আহ্বান করেছে এই কথা জানতে চেয়ে সভাপতির হাত ধরে টান দিয়ে তাকে নীচে নামিয়ে আনে এবং অন্য একজন সভাপতির চেয়ারটিকে বেলতলার পাশের পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেয়। এর পর সেই ছাত্র গুণ্ডাদল নির্বিচারে উপস্থিত ছাত্রদের উপর কিল, চড়, ঘুষি মেরে সভাটিকে সম্পূর্ণভাবে পণ্ড করে।
ছাত্র ফেডারেশন খুব সক্রিয় না হলেও সেই জাতীয় একটি প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব স্বীকার এবং সহ করতে প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রস্তুত ছিলােনা। এজন্যেই তাদের উপর সে সময় প্রায়ই নানা প্রকার হামলা হতে দেখা যেত। ১৪ই মার্চ তারিখে একদল গুণ্ডা সিলেটে ছাত্র ফেডারেশনের অফিসের উপর হামলা করে এবং সেই জাতীয় হামলা বন্ধ করার ব্যবস্থার জন্যে ছাত্র ফেডারেশনের সম্পাদক সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন।
৩। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন-কর্মচারী ধর্মঘট | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম বেতনের কর্মচারীরা কতকগুলি দাবী দাওয়ার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সাথে অনেকদিন আলাপ আলোচনার পর তাদের দুরবস্থার প্রতিকারের অন্য কোনো উপায় না দেখে এক মাসের নােটিশে ৩রা মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করেন।
ধর্মঘটের প্রস্তুতির বিভিন্ন স্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ছাত্র প্রতিষ্ঠানের, বিশেষতঃ ছাত্র ফেডারেশন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের কর্মীদের সাথে কর্মচারীরা ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন এবং তাদের সমর্থন, উৎসাহ এবং সহযােগিতা ধর্মঘটের ক্ষেত্রে তাদেরকে অনেকাংশে পরিচালিত করে।
নিম-কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ৩রা মার্চ ছাত্রেরাও ক্লাস বর্জন করেন। এর পর ৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বান এবং উদ্যোগে পূর্ণ ছাত্রধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা ১২-৩০ মিনিটে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ছাজেরা স্থির করেন যে কর্মচারীদের দাবী-দাওয়া কর্তৃপক্ষ যতদিন না স্বীকার করেন ততদিন পর্যন্ত তারা সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত রাখবেন। তার পর সেই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম-কর্মচারী ও
ছাত্রদের ধর্মঘট পরিচালনার ভার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কর্ম পরিষদের উপর অর্পণ।
করা হয়। | বেলা ২-৩০ মিনিটের সময় এই সভা শেষ হলে ছাত্রের ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ির সামনে মিছিল সহকারে উপস্থিত হন এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। সে সময় ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছাত্রদের জানান যে সেদিন বিকেল পাঁচটায় বিশ্ববিদ্যালয় একজিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠক বসলে তিনি তাদেরকে ধর্মঘট ইত্যাদির বিষয় অবহিত করবেন। | একজিকিউটিভ কাউন্সিল সেইদিনকার বৈঠকে ছাত্রদেরকে নিম-কর্মচারী ধর্মঘটে অংশ গ্রহণকারী বলে ঘােষণা করে তাদের বিরুদ্ধে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের হুমকি দেন।৬ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই হুমকি সম্পর্কে আলােচনার জন্যে ছাত্র কর্মপরিষদের একটি সভায় কর্তৃপক্ষের হুমকির নিন্দা এবং ছাত্রদের মনােভাব ব্যাখ্যা করে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মুসলীম ছাত্র লীগের আবদুর রহমান চৌধুরী তার নকল ভাইস-চ্যান্সেলারের কাছে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন কিন্তু তিনি তার সে দায়িত্ব পালন না করায় সেটি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছায়নি। কয়েকদিন পর কর্ম-পরিষদের এক সদস্য এ বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করলে আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন যে ইতিমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে কাজেই সেটা তখন আর কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়ার কোনাে অর্থ
নেই।
ধর্মঘটকে শক্তিশালী করার আশায় সাধারণ ছাত্রেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেরানীদের সহানুভূতি লাভের আশায় তাদের অফিসের দরজায় যখন পিকেটিং করছিলেন সে সময়ে আবদুর রহমান চৌধুরী নিজে পিকেটারদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে আনেন। পরদিন ছাত্রসভায় তাকে এ বিষয়ে খােলাখুলিভাবে প্রশ্ন করা হলে তিনি অবশ্য ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। | ৯ই মার্চ বেলা ১২-৩০ মিনিটে আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি সভা হয়। তাতে স্থির করা হয় যে ছাত্রেরা মিছিল করে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়িতে যাবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে ধর্মঘটী নিম্ন-কর্মচারীদের দাবীদাওয়া স্বীকার করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়িতে অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে সভার পর ছাত্রের। মিছিল সহকারে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে উপস্থিত হন। কিন্তু সেখানে রাত্রি ৯-৪৫ মিনিট পর্যন্ত
অপেক্ষা করেও একজিকিউটিভ কাউন্সিল অথবা ভাইস-চ্যান্সেলারের কাছ থেকে কোনাে লিখিত প্রতিশ্রুতি অথবা আশ্বাস পাওয়া গেল না।১২ বেলা পাঁচটার দিকে ভাইস-চ্যান্সেলর, কোষাধ্যক্ষ, ডক্টর পি. সি. চক্রবর্তী, রেজিস্ট্রার প্রভৃতি ছাত্রদের সাথে দেখা করে এই মর্মে তাদেরকে একটা মৌখিক আশ্বাস দেন যে অদূর ভবিষ্যতে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সভায় তারা ব্যপারটি আলােচনার জন্যে প্রস্তাব করবেন।১৩ মুসলিম ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ কর্তৃপক্ষের এই মৌখিক আশ্বাসে মােটামুটিভাবে সন্তুষ্ট হয়ে সেদিন দুপুরের ছাত্রসভার সিদ্ধান্তের বরখেলাফ করে ছাত্রদেরকে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবন পরিত্যাগ করতে পরামর্শ দিলেন।১৪
পরদিন অর্থাৎ ১০ই মার্চ বেলা বারােটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র এবং নিম্ন-কর্মচারীদের একটি যৌথ সভা হয়।১৫ সেই সভায় ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ কর্তৃপক্ষের কথা বিশ্লেষণ করে সকলকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেন যে ছাত্র এবং ধর্মঘটীরা প্রকৃতপক্ষে জয়লাভ করেছেন কাজেই এর পর তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করা উচিত।১৬ কর্মপরিষদের বিশিষ্ট সদস্য দবিরুল ইসলাম ধর্মঘটী কর্মচারীদের কাছে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আবেদন জানালেন এবং ওজখিনী ভাষায় তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে কর্তৃপক্ষ তাদের অঙ্গীকার রক্ষা না করলে ছাত্রেরা তাদের বুকের রক্ত দিয়ে ধর্মঘটীদের দাবীদাওয়া আদায় করে দেবেন। ছাত্র নেতাদের এই বক্তৃতা ও প্রতিশ্রুতির পর নিম-কর্মচারীরা তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বেলা ১টার সময় নিজ নিজ কাজে যোগদান করতে যান।১৭
কিন্তু ধর্মঘটীদের ধর্মঘট প্রত্যাহার ও কাজে যােগদানের সিদ্ধান্ত সত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে কাজে যােগ দিতে বাধা দেন। সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে এবং পরদিন সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রচার করে ভাইসচ্যান্সেলর বলেন যে ১০ই মার্চ বেলা ১১টার মধ্যে কর্মচারীদের কাজে যােগদানের কথা ছিলাে। তারা ঐ সময়ে কাজে যােগদান না করায় তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। পরদিন থেকে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মতাে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ রাখার কথাও তিনি ঘােষণা করেন। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব দিন ভাইস-চ্যান্সেলরের সাথে ছাত্রদের আলাপের সময় বেলা ১১টার মধ্যে কর্মচারীদের কাজে যােগদানের কোনাে কথাই হয়নি।
কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সাথে তাদের মৌখিক চুক্তি ভঙ্গ করার পর ছাত্র কর্ম
পরিষদ সেদিনই একটি বৈঠকে মিলিত হন এবং নােতুন পরিস্থিতিতে পূর্ব নির্ধারিত পথেই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া স্থির করেন। রাত্রি ১টায় সেদিন ফজলুল হক হলের ছাত্রদের একটি সভা হয় এবং তাতে দবিরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদ পরিস্থিতির উপর বক্তৃতা দেন। রাত্রি ১১-৩০ মিনিট পর্যন্ত সভাটি স্থায়ী হয় এবং তাজউদ্দিন আহমদ ও রুহুল আমীনকে কর্মপরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।২০
ফজলুল হক হলের এই সভা ভঙ্গ হওয়ার পর সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে রাত্রি ১টায় কর্মপরিষদের একটি বৈঠক বসে। প্রায় এক ঘণ্টাকাল স্থায়ী এই বৈঠকে সামগ্রিকভাবে নােতুন পরিস্থিতির পর্যালােচনা করা হয়।
প্রথম থেকে শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঘটনাবলীর বর্ণনা দিয়ে ১১ই মার্চ কর্নপরিষদের পক্ষ থেকে তারা একটি বিবৃতি তৈরী করেন এবং সেটি সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন বিকেল ৪টায় ঢাকা হলের মিলনায়তনে একটি সভা বসে এবং ঢাকা ও ফজলুল হক হলের ছাত্রের মিলিতভাবে মিছিল করে বিফেল ৫.৩০ মিনিটে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে উপস্থিত হয়ে তার কাছে বিভিন্ন দাবী উত্থাপন করেন। কিন্তু ভাইস-চ্যান্সেলর তাদের কোনাে আশ্বাস দিতে অস্বীকার করায় তারা সন্ধ্যা ৭-৩০ মিঃ তার বাসভবন এলাকা ছেড়ে হলে ফিরে আসেন।২৩ সেদিন রাত্রেই ১০টা থেকে ৩-৩০ পর্যন্ত সলিমুল্লাহ হলে কর্ম-পরিষদের একটি দীর্ঘ বৈঠক বসে।২৪ ইতিমধ্যেই কর্তৃপক্ষ হল বন্ধ করার সিদ্ধান্তও ঘােষণা করেন।২৫ | ১২ই মার্চ সকাল ৯টায় সমস্ত হলের ছাত্রদের এক মিলিত মিছিল বের হয়।’ সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রেরা তাতে ৯-৩০ মিনিটে যােগ দেয় এবং মিছিলটি তার পর ভাইস-চ্যান্সেলরের বাসভবনে উপস্থিত হলে দেখা যায় যে গৃহকর্তা তার পূর্বেই গৃহত্যাগ করে বেরিয়ে গেছেন। সেই অবস্থায় মিছিলটি নিয়ে শহর। ঘােরার সিদ্ধান্ত হয় এবং লালবাগ, চকবাজার ইসলামপুর, সদরঘাট, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার হয়ে মিছিলটি ফজলুল হক হলের সামনে এসে বেলা ১টায় শেষ
হয়।২৬
বিকেল ৫টায় ঢাকা হলের ছাত্রেরা হল-ছাত্রদের একটি সভায় স্থির করেন যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডাইনিং হল বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও তারা নিজেরা তা চালিয়ে যাবেন। এর পর সন্ধ্যা ৬টায় সলিমুল্লাহ হলে ছাত্র কর্মপরিষদের এক বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে পরবর্তী কর্মপন্থা সম্পর্কে আলােচনা চলাকালে একজন বক্তা পরিষ্কারভাবে বলেন যে ছাত্রেরা তখন আর সংগ্রামের
জন্যে প্রস্তুত নয়, তাদের বিশ্রাম প্রয়োজন। এর পর উপমােত নেতৃস্থানীয় কর্মীটি অন্য কাউকে কথা বলার সুযােগ না দিয়ে সভা ভঙ্গ করে দেন। | ১২ মার্চ ছিলাে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন। সেদিন সকালের ছাত্র মিছিলের পর বিকেলের দিকে কিছু সংখ্যক ছাত্র, পরিষদ ভবনের সামনে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবী হরফ চাই না’ ইত্যাদি ধ্বনি উথাপন করে দলবদ্ধভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই বিক্ষোভকারী ছাত্রদের মধ্যে থেকে সৈয়দ আফজাল হােসেন, মৃণালকান্তি বাড়ী, বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনসারী, আবদুস সালাম এবং এ. কে. এম. মুনিরুজ্জামান চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে বিশেষতঃ আরবী হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভট প্রধানতঃ ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।
পরদিন ১৩ই মার্চ ঢাকা হলের একটি সভায় খুব অল্পসংখ্যক ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালে হলে থাকার সপক্ষে মত দেন। সেদিনই বেলা ১টার পর সলিমুল্লাহ হলে কর্ম-পরিষদের আর এক বৈঠক বসে। তাতে স্থির হয় যে অধিকাংশ ছাত্র হল ছেড়ে চলে গেলে সকলকেই তারা হল ত্যাগ করতে বলবেন।৩০ ১৪ তারিখে সকাল ৯টায় ঢাকা হল প্রাঙ্গণে তাজউদ্দিন আহমদ প্রভৃতি অল্প সংখ্যক ছাত্র একত্রিত হয়ে স্থির করেন যে সকলে হল ত্যাগ করে চলে যাওয়ার জন্যে যেভাবে তৈরী হয়েছে তাতে তাদের পক্ষেও আর হলে থাকা সঙ্গত নয়। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে এর পর তারা সকলেই হল ত্যাগ করেন। | নিম্নকর্মচারী এবং ছাত্র ধর্মঘটের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল’ বলেন :
দেশ বিভাগের পর বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রগণ অপরিসীম। ক্ষতিগ্রস্থ হইয়াছেন তাহা সকলেই অবগত আছেন। অনেক আন্দোলনের পরও কর্তৃপক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার উল্লেখযােগ্য কোনাে উন্নতিই করেন নাই। বর্তমান মহার্যের দিনে নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির দাবী যে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত তাহা সকলেই স্বীকার করিবেন। ছাত্ররা স্বভাবতঃ আশাবাদী হইয়া থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দুরবস্থা তাহাদের প্রাণে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সমবেদনা ও সহানুভূতির উদ্রেক করিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ছিল অবিলম্বে তাহাদের ন্যায্য দাবীদাওয়া মানিয়া লওয়া এবং এই আর্থিক অনটনগ্ৰস্ত দারিদ্র পীড়িত কর্মচারীগণ যাহাতে নিশ্চিন্তে জাতির খেদমতে আত্মনিয়ােগ করিতে পারে
তাহার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া। কিন্তু তাহার বদলে কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করিয়া দেওয়াই সমীচীন মনে করিয়াছেন। একেবারে বন্ধ করিয়া দিলেই সব লেটা চুকিয়া যাইত। নয় কি ?৩২ ৩ থেকে ১৪ই মার্চ পর্যন্ত নিম্নকর্মচারী ও ছাত্র ধর্মঘটের উপর একজন প্রত্যক্ষদশী ছাত্র আন্দোলনের গলদ কোথায়? নামে একটি বিস্তৃত আলােচনা ২৪শে মার্চের নওবেলালে প্রকাশ করেন। সমসাময়িক ছাত্র আন্দোলনের পর্যালােচনা হিসাবে তার কয়েকটি অংশ উল্লেখযােগ্য। আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণভাবে মন্তব্য করতে গিয়ে তাতে বলা হয় :
জনগণ ভুলপথে সজ্ঞানে চলে না, ভুলপথে তারা পরিচালিত হয় এটা গণআন্দোলনের বেলায় যেমন সত্য, ছাত্র আন্দোলনের বেলায়ও তেমনই সত্য। সুতরাং আন্দোলনের যারা পরিচালক তাদের মনােবৃত্তি, তাদের আদর্শ ও তাদের কর্মদক্ষতার উপরই আন্দোলনের ফলাফলসম্পূর্ণ নির্ভর করে। হীন স্বার্থপর মনােবৃত্তি দ্বারা যে আন্দোলন পরিচালিত হয় তাহা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইতে বাধ্য। গত বৎসরের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও এরূপ মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। বর্তমান বৎসরের আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ বিচার করিলেও ঐ একই মনােবৃত্তির স্বরূপ প্রকাশ পায়। অবশ্য পর্দার অন্তরালে নেতৃত্বের ধােকাবাজির যে অভিনয় চলে তার স্বরূপ অনেক সময়ই সর্বসাধারণের চোখে পড়ে না। সদিচ্ছায় অনুপ্রেরিত বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মীরাই ঐ অভিনয়ের বাস্তব রূপ প্রমাণ করতে পারেন। আলােচ্য আন্দোলনের সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের সহিত পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছে বলেই আমি এ আন্দোলনের পূর্ণ বিশ্লেষণের একান্ত প্রয়ােজন বােধ করছি।
এই প্রারম্ভিক মন্তব্যের পর কয়েকজন ছাত্রনেতার ভূমিকা সম্পর্কে উপরােক্ত সমালােচক বলেন :
৫ই মার্চ ছাত্রসভায় যে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাহার পিছনেও নেতাদের এক হীন মনােবৃত্তির আভাষ ছিল। কিন্তু ছাত্র সমাজ তা বুঝতে পারেনি। সদিচ্ছায় অনুপ্রেরিত হয়েই তারা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের বিশিষ্ট নেতা নঈমুদ্দীন আহমদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের প্রস্তাবে সায় দেয়। তারা বুঝতে পারেনি যে ঐ সকল নেতাদের হতভাগ্য কর্মচারীদের প্রতি কোনাে সত্যিকার দরদ ছিল না। প. প. মু. ছাত্র লীগের আবদুল রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবর রহমান, মৌলবী
205
গােলাম হায়দার প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এই সিদ্ধান্তের পূর্বেধর্মঘটী কর্মচারীদের সঙ্গে যে অভিনয় করেন তাহা ছাত্র সাধারণের কাছে সম্পূর্ণ গােপন করে যান। হতভাগ্য কর্মচারীদের প্রতি কিছুমাত্র সহানুভূতি থাকলেও তারা ধর্মঘটের পূর্বক্ষণে মির্জা গােলাম হায়দারকে একতাবদ্ধ কর্মচারীদের মধ্যে প্রেরণ করতেন না যাতে তাদের একতা ঐ সঙ্কটমুহূর্তে ভেঙে পড়ে। সৌভাগ্যের বিষয় মির্জা গােলাম হায়দারের এই অপচেষ্টা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয় এবং কর্মচারীদের কাছে মির্জা গােলাম হায়দারের মুখােশ ধরা পড়ে। এর পর এই মার্চের ধর্মঘট সম্পর্কে পর্যালােচনাটিতে আরও বলা হয় : Lower Grade Employees’ Union-এর পরিচালনাধীনে কর্মচারীদের একতার বন্ধন দৃঢ় হতে দৃঢ়তর হয়ে দাড়াল এবং তারা ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। তখন নিজেদের মান বাঁচাবার জন্য পূর্ব পাঃ মুঃ ছাঃ লীগের তথাকথিত নেতৃবৃন্দ ৫ই মার্চ ছাত্রসভার আয়ােজন করেন। তাদের সহানুভূতিসূচক বক্তৃতাগুলির পেছনে লুক্কায়িত ছিল এক হিংসাবৃত্তি তারা চেষ্টা করছিলেন যে সমস্ত উৎসাহী কর্মী-কর্মচারীদের একতাবদ্ধ করায় মনােনিবেশ করেছিলেন তাদের সর্বনাশ সাধন করতে। এসব ব্যাপার তারা ছাত্র সাধারণকে জানতে দেননি। সাধারণ ছাত্রদের থােকা দিয়ে তারা একটা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ভূয়া প্রস্তাব গ্রহণ করান। ভূয়া প্রস্তাব এজন্য বলছি যে, কোনাে কর্মপন্থা ভিন্ন অনিদিষ্টকালের ধর্মঘট চলতে পারে না। নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের সম্বন্ধে কোনাে কর্মপন্থা দেননি। এই প্রস্তাবের কুফল দুদিন পরেই বেশ ভালভাবেই প্রকাশ পায়। কর্মপন্থার অভাবে সাধারণ ছাত্রগণের মধ্যে শিথিলতা আসে এবং তারা আন্দোলন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন মনােভাব পােষণ করতে থাকেন। নেতারাও তাইই চেয়েছিলেন।
১ই মার্চ সাধারণ সভায় ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ধর্মঘটীদেরকে কাজে যােগদান করতে বাধা দেওয়ার কারণ হিসাবে তাতে বলা হয় :
তার পর ভাইস-চ্যান্সেলর ধর্মঘটী কর্মচারীদের ধ্বংস সাধনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে গভর্নমেন্টেরও অনুমােদন ছিল। ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনের সময় ছাত্রদের দূরে রাখাই সরকারের স্বার্থের অনুকুল। তা ছাড়া বর্ণমালা নিয়েও ছাত্র আন্দোলনের আশঙ্কা তারা করছিলেন।
তাই দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী ও তিস্ট্রাক্ট ম্যাজিস্ট্রেট একাধিকবার ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে গুপ্ত বৈঠক করছেন।
আন্দোলনের শেষ পর্যায়ের ঘটনাবলী সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে উপরােক্ত প্রত্যক্ষদর্শী বলেন :
আন্দোলনের শেষ দিকে আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এক হীন যড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। ভাইস-চ্যান্সেলরের সঙ্গে কথা-বার্তায় আবদুর রহমান চৌধুরীর তােষামােদি মনােবৃত্তি সাধারণ ছাত্রদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে। আবদুর রহমান চৌধুরী কেবল তােষামোেদ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি নিজে কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ করেছিলেন কর্তৃপক্ষ যেন কঠোর হস্তে কয়েকজন আন্দোলনকারী ছাত্রকে দমন করেন। এই নেতৃবৃন্দের স্বরূপ আরও ভালভাবে প্রকাশ পেল, যখন দেখা গেল যে সাধারণ একটা অর্ডারের উপর ছাত্ররা দলে দলে হল ছেড়ে চলেছে তখন নেতৃবৃন্দ তাকে রােখবার কোনাে ব্যবস্থা করছেন না। বরং সকল ছাত্ররা যাহাতে চলিয়া যায় তাহার ব্যবস্থা করিতে তথাকথিত নেতারা ব্যস্ত ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ নেতৃবৃন্দের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে তাউদ্দিন আহমদের ডায়েরীতেও একটি উল্লেখ আছে। ১৪ই মে, ১৯৪৯ তারিখে তাজউদ্দিন আহমদ তার ডায়েরীতে লেখেন :
(আজ) তােয়াহা সাহেব এসেছিলেন সন্ধ্যে ৮টায় এবং তার পর আমার কামরায় এসেছিলেন নঈমুদ্দীন সাহেব। নঈমুদ্দীন সাহেবের বিশ্বাসঘাতকতার পর এই তার প্রথম আবির্ভাব। আমরা রাত্রি ১১টা পর্যন্ত আলাপ করলাম।
২৯শে মার্চ সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের কাছে ভাইস-চ্যান্সলরের প্রদত্ত রিপাের্টে বলা হয় যে ছাত্রের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছিলাে এবং ধর্মঘটীরা কাজে যােগদান করতে এসেছিলাে। কিন্তু তিনি তাদেরকে অনুমতি দেননি। তার এই সিদ্ধান্তের কারণ তাদের যােগদান শর্ত সাপেক্ষ ছিলাে।৩৩ ভাইস-চ্যান্সেলরের এই বক্তব্য তার ১১ই তারিখে প্রচারিত বিবৃতির বক্তব্যের বিরােধী কারণ তাতে তিনি বলেছিলেন যে, ধর্মঘটকারীরা কাজে যােগদান করতে অসম্মত হওয়ায় তাকে বাধ্যতা-বশতঃ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই পরস্পরবিরােধী এবং মিথ্যা অভিযােগের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কর্মপরিষদ ৪ঠা এপ্রিল সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয় :
প্রদেশের বিভিন্ন জায়গা হইতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান পরিস্থিতি অনিবার জন্য অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করিয়া আমাদিগকে বহু সহানুভূতিসূচক পত্র পাঠাইতেছেন। আমরা এই মনে করিয়া চুপ করিয়া থাকা বানীয় মনে করিয়াছিলাম যে, ইতিমধ্যেই কর্তৃপক্ষ সকলের পক্ষে সম্মানজনক ও গ্রহণযােগ্য মীমাংসায় উপনীত হইতে পারিবেন। কিন্তু ভাইস-চ্যাসেলরের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের নিকট প্রদত্ত বিবৃতি, যাহা ২৯শে মার্চ তারিখে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা এমদ এক নূতন পরিস্থিতির সৃষ্টি করিয়াছে যে, আমাদিগকে নূতনভাবে বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করিতে হইতেছে। কোনাে নিরপেক্ষ ব্যক্তি যদি ভাইস-চ্যান্সেলরের ১১ই এবং ২৯শে মার্চ তারিখের বিবৃতি দুইটি বিশদভাবে পাঠ করেন তাহা হইলে দেখিতে পাইবেন যে, একই ব্যক্তির মুখ দিয়া একই ঘটনা সম্বন্ধে দুইটি পরস্পর বিরােধী বিবৃতি প্রকাশিত হইয়াছে। ১১ই তারিখে তিনি বলেন যে, যেহেতু ধর্মঘটকারীরা কাজে যােগদান করে নাই, সেই হেতু অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করিয়া দেওয়া ছাড়া তাহার কোনাে গত্যন্তর ছিল না। ২৯শে মার্চ তিনি স্বীকার করেন যে ছাত্র ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়াছিল এবং ধর্মঘটীরা কাজে যােগদান করিতে আসিয়াছিল। কিন্তু তিনি তাহাদের অনুমতি দেন নাই, যেহেতু তাদের যােগদান শর্তসাপেক্ষ ছিল কিন্তু প্রকৃত ঘটনা এই যে, ছাত্র এবং ধর্মঘটী কর্মচারীরা পূর্ব রাত্রে এক্সিকিউটিভ কাউন্দিলের সভ্যদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অনুসারে ১০ই তারিখ বিনাশর্তে উভয়েই ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়াছিল। ২৯শে তারিখে ভাইসচ্যান্সেলর যাহা স্বীকার করিলেন, ১১ই তারিখে তিনি তাহা গােন করিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করা সম্বন্ধে দুইটি বিবৃতিতে সম্পূর্ণ দুইটি কারণ দর্শাইয়াছেন।
এর পর ছাত্রদের সম্পর্কে ভাইস-চ্যান্সেলরের অভিযােগ প্রসঙ্গে কর্মপরিষদ বলেন :
প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়াই ছাত্ররা এবং ধর্মঘটী কর্মচারীরা বিনাশর্তে ধর্মঘট প্রত্যাহার করিয়াছিল স্থগিত রাখে নাই। ভাইসচ্যান্সেলর অনুযােগ করেন যে, ছাত্ররা তাদের নিকট এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করিয়াছিল যাহা বিশ্ববিদ্যালয় মানিয়া লইতে পারে নাই। আমরা পুনরায় ইহা পরিষ্কারভাবে বলিতে চাই যে ছাত্র ধর্মঘটকালীন একমাত্র
মীমাংসাকার হিসাবেই কাজ করিয়াছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক প্রসঙ্গে কর্মপরিষদ বলেন :
শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ক হইতেছে ভক্তির এবং স্নেহের । দুর্ভাগ্যবশতঃ সেই সম্পর্ক তিক্ততায় পর্যবসিত হইয়াছে। ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে মধুর সম্পর্ক, সেটা যদি নষ্ট হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের যাহা মহান এবং ভাল তাহাই নষ্ট হইয়া যায়। ছাত্রদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ৯ই মার্চ বিকেলের আলােচনায় ধর্মঘটীদের দাবী-দাওয়ার স্বীকৃতি এবং ধর্মঘট প্রত্যাহারের সম্পর্কে যে মৌখিক চুক্তি হয় পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বরখেলাফ করেন। তৎকালীন অবস্থা এবং ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে দুই কারণে কর্তৃপক্ষ ধর্মঘটী কর্মচারী ও ছাত্রদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করেন। তাঁদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিলো ছাত্রদের থেকে ধর্মঘটীদেরকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের সাথে পৃথক ভাবে লোচনা করা। ছাত্রদের অবর্তমানে নিম্ন-কর্মচারীরা স্বাভাবিকভাবেই অনেক দুর্বল হয়ে পড়বে এবং সেই অবস্থায় তাদের সাথে একটা উপযুক্ত বােঝাপড়ার সুবিধে হবে। প্রকৃতপক্ষে তাই ঘটেছিলাে। কারণ ছাত্রদের অনুপস্থিতিতে একজন ব্যতীত অন্য সব কর্মচারীরাই ধর্মঘট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা অন্যায় হয়েছে স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের দেওয়া কতকগুলি শর্ত—যেমন ইউনিয়ন না মানা, ভবিষ্যতে ধর্মঘট না করা ইত্যাদি~-সই করে কাজে যােগদান করে।৩৫
কতৃপক্ষের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিলাে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলার সময় ছাত্রের যাতে ঢাকাতে না থাকে তার ব্যবস্থা করা।
আরবী হরফ প্রবর্তনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মধ্যে তখন বেশ উত্তেজনা বিরাজ করছিলাে। কাজেই প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৮-এর মতো ছাত্র বিক্ষোভ যাতে আবার না ঘটে তার জন্যে কর্মচারী ধর্মঘটের সুযােগে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ছাত্রদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আকস্মিক চুক্তিভঙ্গ এবং কাজ শুরু করতে ইচ্ছুক নিম্ন-কর্মচারীদেরকে কাজে যােগদান করতে বাধাদানের সেটাই ছিলাে প্রধান কারণ।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এদের মধ্যেও ৬ জনকে ৪ বৎসরের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার, ৫ জনকে ১৫ টাকা হিসাবে এবং ১ জনকে ১০ টাকা হিসাবে জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া তারা শান্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ করারও সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, তারা আরও স্থির করেন যে ১৭ই এপ্রিলের মধ্যে অভিভাবকদের মধ্যস্থতায় সৎচরিত্র সম্পর্কিত সার্টিফিকেট দাখিল না করলে তাদেরকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে।৩৬ এদের মধ্যে অনেকেই এই ধরনের সার্টিফিকেট দাখিল করে এবং জরিমানা দিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আপােষ করেন।
কর্তৃপক্ষের এই আচরণের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যাল ছাত্র কর্ম-পরিষদ ১৭ই
দবিরুল ইসলাম ( অস্থায়ী আহ্বায়ক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ), আবদুল হামিদ (এম. এ. ক্লাস), অলী আহাদ (বি. কম. ক্লাস) আবদুল মান্নান (বি. এ. ক্লাস), উমাপতি মিত্র (এম. এসসি. পরীক্ষার্থী) সমীরকুমার বসু (এম. এসসি. ক্লাস) এই ৬ জনকে ৪ বৎসরের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
বিভিন্ন হল থেকে যাদেরকে বহিষ্কার করা হয় তাঁদের নাম : আবদুর রহমান চৌধুরী (সহ-সভাপতি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও আইন বিভাগের ছাত্র), জালালউদ্দিন আহম্মদ (এম. এ. ক্লাস), দেওয়ান মহবুব আলী ( আইন বিভাগের ছাত্র, আবদুল মতিন (এম. এ. ক্লাস), আবদুল মতিন খ চৌধুরী (আইন বিভাগের ছাত্র), আবদুর রসিদ ভুইয়া (এম. এ. ক্লাস), হেমায়েত উদ্দীন আহমদ ( বি. এ. ক্লাস), আবদুল মতিন খাঁ (এম. এ. পরীক্ষার্থী ), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (এম. এ. ক্লাস) সৈয়দ জামাল কাদেরী (এম. এসসি. ক্লাস), আবদুস সামাদ (এম. কম. ক্লাস), সিদ্দিক আলী (এম. এ. ক্লাস), আবদুল বাকী ( বি. এ. ক্লাস) জে. পানবিশ (এম. এসসি, ক্লাস) অরবিন্দ বসু (সহ-সভাপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন এবং আইন বিভাগের ছাত্র)।
পনেরাে টাকা হিসাবে যাদের জরিমানা করা হয় তাদের নাম : শেখ মুজিবর রহমান (আইন ক্লাসের ছাত্র), কল্যাণ দাসগুপ্ত (এম. এ. ক্লাসের ছাত্র এবং সাধারণ সম্পাদক ঢাকা হল), নঈমুদ্দীন আহমদ (আহ্বায়ক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ) নাদিরা বেগম (এম. এ. ক্লাসের ছাত্রী), আবদুল ওয়াদুদ ( বি. এ. ক্লাসের ছাত্র)। এ ছাড়া লুল বিলকিস বানু নামে আইন বিভাগের একজন ছাত্রীর দশ টাকা জরিমানা হয়।
210
| এপ্রিল অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় খােলার পর থেকে সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানান।
| বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুসৃত নীতি ও কর্মপন্থার সমালােচনা করে ১৪ই এপ্রিল ‘নওবেলাল’ মন্তব্য করেন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আগামী ১৭ই এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খুলিবার নির্দেশ দিয়াছেন। কিন্তু জানা গিয়েছে যে, পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্র লীগের উদ্যোগে ১৭ই তারিখ হইতে আবার ধর্মঘট শুরু করার সিদ্ধান্ত হইয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের উপর যে অন্যায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন তাহার প্রতিবাদ স্বরূপ এই ধর্মঘট শুরু হইবে। ছাত্রগণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নতম কর্মচারীদের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়া বিগত ৩রা মার্চ হইতে ধর্মঘট শুরু করেন এবং এই অপরাধেই কর্তৃপক্ষ উপরােক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন নতুন নয়। ইতিপূর্বে আরও বহুবার এমনকি ব্রিটিশ আমলেও অনুরূপ আন্দোলন হইয়া গিয়াছে। কিন্তু বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ন্যায় মধ্যযুণীয় প্রথায় ছাত্রদের বহিষ্কৃত করা হয় নাই। তাহাদের জানা উচিত, যে কারণে ছাত্র ধর্মঘট বা অন্দোলন সংঘটিত হয় তাহার প্রতিকার না করিয়া আন্দোলনকারীদের উপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করিলে কোনো সুফল লাভ হইতে পারে না। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর হইতে অবিলম্বে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করিয়া তাহাদের ধর্মঘট করার কারণ দূর করিতে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানাইতেছি।
৪। আন্দোলনের নােতুন পর্যায়
নিম্ন-কর্মচারী ঘর্মঘটে অংশ গ্রহণের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ ১৭ই এপ্রিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ধর্মঘট ঘােষণা করে।
প্রায় দু-হাজার ছাত্রছাত্রী সেদিন বেলা বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার পর সেখানে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্বৈরাচারী নীতির তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। সরকারের দালালী করার উদ্দেশ্যে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের কয়েকজন নেতা
সভায় কিছু গণ্ডগােলের চেষ্টা করলেও সাধারণ ছাত্রেরা তাদেরকে দালাল হিসাবে সহজেই চিহ্নিত করে।
১৭ তারিখে সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ও রমনার বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র পুলিশ মােতায়েন করা হয় এবং তারা ছাত্রদেরকে নানাভাবে ভয় দেখানাের চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সভা শেষ হওয়ার পর পুলিশের অবস্থান সত্ত্বেও ছাত্রেরা বিরাট এক মিছিল সহকারে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়িতে উপস্থিত হয়। ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে সাক্ষাতের জন্যে তারা তার কাছে বহুক্ষণ ধরে অনুরােধ জানানাে সত্ত্বেও তিনি ছাত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করতে শেষ পর্যন্ত কিছুতেই রাজী না হওয়ায় ১৭ তারিখেই রাত নয়টায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতির পর্যালােচনা এবং নােতুন কর্মপন্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যের সাধারণ ছাত্রেরা একটি সভায় মিলিত হয়। পূর্ববর্তী কর্মপরিষদের সন এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের দুজন বিশিষ্ট নেতা নঈমুদ্দীন আহমদ ও আবদুর রহমান চৌধুরী ইতিপূর্বে কতৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করায় তাদেরকে বাদ দিয়ে সেই সভায় নােতুনভাবে একটি কর্মপরিষদ গঠিত হয়।
রাত দশটা পর্যন্ত ভাইস-চ্যান্সেলর ছাত্রদের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করায় নােতুন কর্ম পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে দশ-পনেরাে জন ছাত্র ভাইসচ্যান্সেলরের বাড়িতে সারারাত অবস্থান ধর্মঘট করে।
১৮ই এপ্রিল ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রেরা ধর্মঘট পালন করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের গেটে সকাল থেকেই পিকেটিং শুরু হলেও সেদিন বিজ্ঞান, বাণিজ্য এবং আইনের ছাত্রেরা সকলেই ক্লাসে যােগ দে। মূল কলাভবনে ধর্মঘট হলেও অল্পসংখ্যক ছাত্র সেখানেও ক্লাস করে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে একটি বিরাট মিছিল বের হয়ে সকালের দিকে শহর প্রদক্ষিণ করে এবং বেলা তিনটের দিকে মেডিকেল হােস্টেলের ব্যারাক এবং ইঞ্জিনিয়ারিং হােস্টেলের ভেতর দিয়ে ঢুকে ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পুলিশ সে সময় তাদেরকে বাধা দেওয়া সত্বেও কোনাে ঘটনা সৃষ্টি না করেই ছাত্রেরা ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়িতে প্রবেশ করতে সমর্থ হয়। সেখানে গিয়ে তারা অবস্থান ধর্মঘটীদের সাথে যােগদান করে।১০ | ভাইস চ্যান্সেলারের বাসভবনে বিকেল ৫-৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠক বসে। সেই সময় ইব্রাহিম খান, ওসমান গণি, আবদুল হালিম, ডক্টর টি. আহমদ, পি. সি. চক্রবর্তী এবং মিজানুর রহমান ছাত্রদের সাথে একটা আলােচনার সূত্রপাত করেন। প্রথম দিকে কিছুটা
আশার সঞ্চার হলেও শেষ পর্যন্ত রাত দুটোর সময় তা ব্যর্থ হয়। এর পর প্রায় তিরিশজন ছাত্র ভাইস-চ্যান্সেলরের বাড়ির প্রাঙ্গণে সারারাত অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয় ১২ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদ ২০শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘট ঘােষণা করে।১৩
১৯শে এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ধর্মঘট অথবা পিকেটিং হয় নি।১৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত এলাকায় সেদিন সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বেলা নিটের সময় ডিস্ট্রক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এবং পুলিশ সুপারিনটেণ্ডেট বহুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিশ সাথে নিয়ে ভাইসচ্যান্সেলরের বাড়িতে হাজির হন ৫ এবং কিছুক্ষণ পর অবস্থান ধর্মঘটত সাতআটজন ছাত্রকে গ্রেফতার করেন।১৬
১৮ তারিখের ঘােষণা অনুসারে ২০শে এপ্রিল ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট শুরু হয়। সকালের দিকেই পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের গেটের সামনে থেকে অনেক ছাত্রকর্মীকে গ্রেফতার করে। অন্যান্য জায়গাতেও কর্মীরা পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হয়।১৭
পুলিশের বাধা সবেও বেলা দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে এক বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় পুলিশ জুলুমের নিন্দা করে ছাত্রেরা প্রস্তাব গ্রহণ করে। ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর উপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারাদেশ সরকারী দমন নীতিরই যে একটি বীভৎস রূপ বক্তৃতার মাধ্যমে একথাই সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং সেজন্যে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রতিকার দাবীর উদ্দেশ্যে তারা মিছিল সহকারে সেক্রেটারিয়েটের দিকে, অগ্রসর হয়।১৯
| ঢাকা হলের কাছে এই মিছিলটির উপর পুলিশ বেপরোয়াভাবে লাঠি চালিয়ে এবং কঁদুনে গ্যাস ছুড়ে সকলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর ছাত্রছাত্রীরা আবার একত্রিত হয়ে মিছিল করে এবং সেক্রেটারিয়েটের দক্ষিণ গেটের কাছে উপস্থিত হয়। পুলিশ সেখানে তাদের পথ রােধ করে। দুই ঘণ্টা। সেখানে দাড়িয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টার পর ছাত্রেরা যখন জোরপূর্বক পুলিশ কর্ডন ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তখন পুলিশের নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের উপর অবিরাম লাঠি চালায় এবং কঁদুনে গ্যাস ছােড়ে। এর ফলে বেশ কয়েকজন গুরুতরভাবে আহত হওয়ার পর তাদেরকে চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।২২
কিন্তু এত উৎপীড়ন ও নির্যাতনের পরও ছাত্রছাত্রীরা আবার একত্রিত হয়ে
বেলা তিনটের দিকে মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ছাত্রঐক্য জিন্দাবাদ’, ‘জুলুমবাজী চলবে না’, ‘হাজার লােকের ভাত মারা চলবে না, ‘মজুর কৃষক ছাত্র ভাই ভাই’, ইত্যাদি ধ্বনি ২৩ দিতে দিতে নাজিরাবাজার, মানসী, নবাবপুর, সদরঘাট, পটুয়াটুলি, ইসলামপুর, চক, জেল গেট, বেগম বাজার, ট্রেনিং কলেজ রােড হয়ে আরমানীটোলা ময়দানে জমায়েত হয়। সেখানে সমবেত জনসাধারণের সামনে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিভিন্ন ছাত্ৰবক্তারা সমগ্র পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বােঝায় এবং কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণের পর পুলিশ জুলুমের প্রতিবাদে পরদিন আবার ধর্মঘট ঘােষণা করে।২৪ | সেদিন অলি আহাদকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের সামনে এবং মতিন, এনায়েত করিম ও নিতাই গাঙ্গুলীকে সেক্রেটারিয়েট গেটের সামনে গ্রেফতার করে। খালেক নওয়াজ, আজিজ আহমদ, বাহাউদ্দিন সকালের দিকেই গ্রেফতার হন। এ ছাড়া আরাে অনেককে গ্রেফতার করে দূর দূর জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।২৫
আরমানীটোলা ময়দানে সমাবেশে ২১শে এপ্রিল ধর্মঘট ঘােষণা সত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনাে পিকেটিং হয়নি। তবে ছাত্রদের মধ্যে ক্লাস করার উৎসাহও সেদিন তেমন ছিলাে না। বিকেলের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ছাত্রেরা একটি মিছিল বের করে সেক্রেটারিয়েটের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে কারােনেশন পার্কে উপস্থিত হয় এবং সেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠান করে।৬
২২ তারিখে ঢাকা হল ছাত্রদের একটি সভায় ৬ জনকে নিয়ে একটি কর্মপরিষদ গঠিত হয়। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক ধর্মঘট হয়। ফজলুল হক হলের দুই চারজন ছাত্র ছাড়া অন্য কেউই সেদিন ক্লাসে যােগদান করেনি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কর্মপরিদের ভুল ব্যবস্থাপনার জন্যে সেদিন কোনাে বিক্ষোভ মিছিল ইত্যাদি সম্ভব হয়নি। ২৭
ছাত্র কর্মপরিষদ ২৫শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্যে ছাত্রকর্মীরা শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে বােগাযােগ স্থাপন করেন। কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্রের বিরােধিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং সরকারের দমনমূলক ব্যবস্থা সত্বেও ধর্মঘটের প্রস্তুতি অব্যাহত থাকে এবং জনসাধারণ ছাত্রদের আহ্বানে উৎসাহের সাথে সাড়া দেন। এর ফলে সরকার গণ্ডগােল আশঙ্কার অজুহাতে সমগ্র রমনা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারী করে।২৮
পূর্ব বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪৯ সালের ২৫শে এপ্রিল একটি
গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্ন। এই দিনই সর্বপ্রথম ছাত্রদের সাথে বৃহত্তর জনসাধারণের সত্যিকার রাজনৈতিক সংযােগ স্থাপিত হয় এবং ছাত্রজনতা সম্মিলিতভাবে স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও নানা প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করে।
২৫শে এপ্রিল ঢাকা শহরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। নীলক্ষেত ও | পলাশী ব্যারাকের সরকারী কর্মচারীরা বেলা ১২-৩০ মিনিট পর্যন্ত অফিস না গিয়ে এবং চক থেকে শুরু করে ইসলামপুর, পাটুয়াটুলি, নবাবপুর পর্যন্ত সমস্ত দোকানপাট ও বাস রিক্সা পর্যন্ত বন্ধ রেখে সেদিন এক ঐতিহাসিক ধর্মঘটে সমগ্র ঢাকা শহর ছাত্রছাত্রীদের সাথে মিলিত হয়। এই ধর্মঘটের জন্যে শহরে ছাত্রদেরকে পিকেটিং করতে হয়নি। পিকেটিং সেনি করেছে সাধারণ শ্রমিক ও দোকান কর্মচারীরা। নির্যাতিত ছাত্রদের থেকে শহরের উৎপীড়িত জনসাধারণ ও শ্রমিক কর্মচারীদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তকে সম্পূর্ণভাবে বানচাল করে ২৫শে এপ্রিল বস্তুতপক্ষে পূর্ব বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসে রচনা করেছিলাে এক নােতুন দিগন্ত।
বেলা ১২টা থেকে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘটী ছাত্রছাত্রীরা দলে দলে আরমানীটোলা ময়দানে সমবেত হতে থাকে এবং ১টার সময় সেখানে তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে৩০ একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সেই সভায় ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তােলে ‘ফ্যাসিস্ট নীতি ধ্বংস হােক’ ‘পুলিশ জুলুম চলবে না’ ১৪৪ ধারা বাতিল করাে’ বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার কর’, ‘ছাত্র বন্দীদের মুক্তি চাই।’৩১ | সভা শেষ হওয়ার পর আরমানীটোলা ময়দান থেকে সেক্রেটারিয়েটের | উদ্দেশ্যে একটি বিরাট মিছিল সহকারে হাজার হাজার ছাত্র এবং জনসাধারণ বিভিন্ন ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত করে বেগমবাজার, জেলগেট, চকবাজার, মােগলটুলী, ইসলামপুর, সদরঘাট, নবাবপুর হয়ে অবশেষে স্টেশন রােডে উপস্থিত হয়। সারা পথে অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এসে মিছিলে যােগদান করায় ইতিমধ্যে মিছিলের কলেবর অনেকখানি স্ফীত হয়। কিন্তু তা সত্বেও নাজিরাবাজার রেলওয়ে ক্রসিং পার হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হলাে না। গাড়ি বােঝই সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী সেখানে তাদের পথ রােধ করলাে।৩২ | পুলিশের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মিছিল এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ছাত্র জনসাধারণও তখন বদ্ধপরিকর হলাে। ব্যারিকেড ভাঙতে হবে’, ১৪৪ ধারা | মানব না’ ইত্যাদি ধ্বনি তুলে তারা পুলিশ কর্ডন ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার
215
চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠি চালনা করে ও কঁদুনে গ্যাস ছুড়ে মিছিলটিকে সেখানে ছত্রভঙ্গ করে দিলাে।৩৩
এরপর নাজিরাবাজার রেল ক্রসিং এলাকা পরিত্যাগ করে সকলে নবাবপুর ক্রসিংএর সামনে উপস্থিত হয় কিন্তু লেখানেও পুলিশবাহিনী কর্ডন সৃষ্টি করে তাদেরকে বাধা দেয় এবং সেই পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করতে অসমর্থ হয়ে ছাত্রেরা। রাস্তার উপরেই বসে পড়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে। সশস্ত্র পুলিশ তপন নিরস্ত্র শােভাযাত্রাকারীদের উপর নির্দয়ভাবে অবিরাম লাঠি ঢালনার দ্বারা তাদের মধ্যে অনেককে জখম করে দেয়। সাধারণ পথচারী এবং নবাবপুর এলাকার ঔষধপত্রের দোকানগুলির মধ্যেকার কর্মচারীরা পর্যন্ত সেদিন পুলিশের মারধাের ও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি।৪ ‘পল ফার্মেসী’ নামে একটি ওষুধের দোকানে কয়েকন আশ্রয় গ্রহণ করে। একজন পাঞ্জাবী হাবিলদারকে নিয়ে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর দোকানটিতে ঢুকে ৫ : ৭ : কুিকে অমানুষিকভাবে মারধাের করে। ২৫শে এখিলের নন, ঘনার সং সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের মধ্যে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয় ৩৬ | পুলিশের এই নির্যাতনের পরও ছানার মধ্যে হতাশার পরিবর্তে দে’ দেয় নােয়ন উদ্দীপনা এবং ছাত্র সাধারণ ঐক্য জিন্দাবাদ’ ‘খুদ আতপ চলবে। না’, ‘ভাত কাপড় শিক্ষা চাই’ ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে তারা নবাবপুর রোড দিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে সমবেত হয়। ভিক্টোরিয়া পার্কের সেই সভায় জনসাধারণ দলে দলে যোগদান করে এবং বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রদের প্রতি তাদের ঐক্য ও সংহতির কথা ঘোষণা করে। অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে একটিতে পরদিন প্রতিবাদ ধর্মঘট এবং করােনেশন পার্কে সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই পর্যায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা ও ব্যাপকতা ধীরে ধীরে কমে আসে। ২৬শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘট এবং সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ক্রমাগত-ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ২৭শে এপ্রিল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে নিয়মিতভাবে ক্লাস শুরু হয়। এরপর ছাত্র কর্মপরিষদ পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্যে মাঝে মাঝে বৈঠকে মিলিত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমুহে ধর্মঘটের আহ্বান জানায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আন্দোলনের পূর্বাবস্থা আর কিরে আসে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন
অঞ্চলে ধর্মঘট ও সভাসমিতি হয় এবং ছাত্র সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে পুলিশ। জুলুমের প্রতিবাদ করে।৩৯ | মার্চ-এপ্রিলের ছাত্র আন্দোলন করার ক্ষেত্রে পার্লামেন্টারী রানীতির ভূমিকা প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক ‘সৈনিকের নিজস্ব সংবাদদাতার একটি রিপাের্টে বলা হয় :
তখন ছাত্রদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল যে এই অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পিছনে পামেলারী রাজনীতি কাজ করছে। ১১ই মার্চ থেকে পূর্ব বাংলা আইন পরিষদের অধিবেশন শুরু হলাে। ঐদিনই একদল ছাত্র বালা ভাষায় ‘আরবী হরক প্রচলনের প্রতিবাদ জানিয়ে পরিষদের রাস্তায় শােভাযাত্রা করে এবং ফলে কিছু ধরপাকডও হয়। ঠিক এক বৎসর আগে ঐদিনই তমদ্দন মজলিসের ঐতিহাসিক বাংলা ভাষার আন্দোলন শুরু হয় এবং তখন ছাত্র সমাজ পরিষদের সপে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং এমন কি সরকারকে পরিষদ রক্ষর শুন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছিল। এবার যদিও পরিষদ গৃহের চতুর্দিকে পুরাে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা হয়েছে তবুও ছাত্রদের বিশ্বাস করা যায় না?!) তাই সবচেয়ে ভাল উপায় হলাে আইন পরিষদের
অধিবেশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের রাজধানী থেকে *ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তমদুন মজলিসের এই জাতীয় বক্তব্য অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। ১৯৪৭-৪৮ সালে আন্দোলন যে পর্যন্ত সাংস্কৃতিক গণ্ডীর মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ ছিলাে সে পর্যন্ত অন্যান্য রাজনৈতিক গােষ্ঠীর সাথে তারাও উল্লেখযােগ্যভাবে উদ্যোগী হয়। ভাষা আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক থেকে রাজনৈতিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রেও তমদুন মজলিসের প্রাথমিক প্রচেষ্টা উল্লেখযােগ্য। কিন্তু ১১ই মার্চ, ১৯৪৮-এর পর থেকে ভাষা আন্দোলনে তাদের গুরুত্ব অন্যান্যদের তুলনায় ক্রমশঃ এবং দ্রুত কমে আসে। কাজেই ১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনকে কোনাে ক্রমেই ‘তমন্দুন মজলিসের আন্দোলন’ অথবা কোনাে বিশেষ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গােষ্টীর আন্দোলন, হিসাবে অভিহিত করা চলে।
কিন্তু তমদুন মজলিসের পত্রপত্রিকা এবং অধ্যাপক আবুল কাসেম লিখিত ও প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের উপর বিভিন্ন পুস্তিকা এই জাতীয় বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় পরিপূর্ণ। পূর্ব বাঙলার ভাষা-আন্দোলনকে যথার্থভাবে বােঝার জন্যে এইসব বক্তব্য ও প্রচারণা সম্পর্কে যথােচিতভাবে সাবধান হওয়ার প্রয়ােজন নিতান্ত অপরিহার্য। ব. উ.
সরিয়ে রাখা। এই বিশ্বাস আরাে প্রবল হােল যখন অনার্স এম.এ. পরীক্ষার্থী ছাত্রদের পর্যন্ত হল থেকে একপ্রকার জবরদস্তি করে বের করে দেওয়া হলাে।••• তাছাড়া ছাত্রদের শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারেও নাকি অল্পস্বল্প রাজনীতি ঢুকেছে। যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী শান্তি পেয়েছে তাদের অনেকেই নাকি ধর্মঘট ব্যাপারে একেবারেই জড়িত ছিলাে না, এমনকি কয়েকজন ধর্মঘটের পূর্ব । থেকেই রাজধানীর বাইরে ছিলাে।
এ সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে ১৭ই এপ্রিল, নিম্নলিখিত মন্তব্য করেন : বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন আছে যারা বিভিন্ন ঘটনায় কোনাে অংশ গ্রহণ করেনি। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে অন্য ব্যাপারের জের টেনে তাদের বিরুদ্ধে এইভাবে প্রতিশােধ নেওয়া হচ্ছে।
২৮শে এপ্রিল সাপ্তাহিক নওবেলাল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচার’ নামে | একটি সম্পাদকীয় লেখেন। তাতে তারা বলেন :
নিম্নতম কর্মচারীদের অতি সংগত দাবীর প্রতি সহানুভূতি জানাইবার জন্যই ছাত্ররা ধর্মঘট করে। ছাত্রদের এই সহানুভূতি প্রদর্শন মােটেই অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সকল দেশেই ছাত্ররা চিরকাল প্রতিবাদ জানাইয়া আসিয়াছে। ছাত্ররা সাধারণতঃ আদর্শবাদী। সকলপ্রকার অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা উচু করিয়া দাড়ানােই তাদের স্বভাব ধর্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারেও যদি তাহাই ঘটিয়া থাকে তাহাতে আর আশ্চর্য হইবার কি আছে? স্বল্পবেতন কর্মচারীদের দাবীর যৌক্তিকতা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। অতএব তাহাদের উচিত ছিল এই দাবী পূরণ করার সমস্ত ব্যবস্থা করা। তাহা না করিয়া তাহারা নিলজ্জভাবে ন্যায়নিষ্ঠ ছাত্রদের প্রতি দমননীতি প্রয়ােগ করিতে ব্যস্তহইয়া পড়িলেন। এক স্বাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য ইহার চেয়ে লজ্জার ব্যাপার আর কি হইতে পারে? তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খেদমতে আমাদের আরজ তাহারা যেন মিথ্যা আত্মমর্যাদা-বােধ পরিহার করিয়া বান্তবদশী পরিচালকদের মতে, ছাত্রদের আদর্শবাদীতার প্রতি নজর রাখিয়া সমস্যার উপযুক্ত সমাধান
করিয়া তাহাদের বর্তমান স্বৈরাচারমূলক দমন নীতি প্রত্যাহার করেন। মার্চ-এপ্রিলের ছাত্র আন্দোলনে যে সমস্ত ছাত্র গ্রেফতার হন তাদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের অস্থায়ী আহ্বায়ক দাবিরুল ইসলামের পক্ষে হাই কোর্টে হেবিয়াস কৰ্পাসের আবেদন করা হয় ৪১ এবং শহীদ সুহরাওয়াদী সেই কেস পরিচালনা করেন।৪২ হােবিয়াস কর্পাস আবেদন পেশ করার সময় সুহরাওয়ার্দী হাইকোর্টকে বলেন যে দবিরুল ইসলামের উপর আটক আদেশ অযৌক্তিক। তিনি মন্ত্রীসভার বিরােধী হতে পারেন কিন্তু মন্ত্রীসভার । বিরােধিতার অর্থ রাষ্ট্রবিরােধিতা নয়। কাজেই সেই অভিযোগে কোনাে ব্যক্তিকে নিরাপত্তা আইনে বন্দী করা চলে না।
দাবিরুল ইহলামকে ১৮ই জানুয়ারি ১৯৫• বিনাশর্তে মুক্তি দান করা হয় এবং তার কয়েকদিন পূর্বে রাজশাহীর আতাউর রহমান ও খুলনার মহম্মদ একরাম মুক্তি লাভ করেন। ৪৪
সপ্তম পরিচ্ছেদ। পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান
১। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ
১৯৩৬ সালের পূর্বে বাঙলাদেশে মুসলিম লীগের কোনাে উল্লেখযােগ্য সংগঠন ছিলাে না। কায়েদে আজম ইংলণ্ড থেকে ফেরার পর কলকাতায় আসেন এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মতাে বাংলাদেশেও মুসলিম লীগ গঠনে সচেষ্ট হন। ১৯৩৬ সালে ইস্পাহানীর বাসভবনে কিছু সংখ্যক মুসলমান নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনার পর তিনি ঢাকার নবাব হাবিবুল্লাহকে সভাপতি করে একটি প্রাদেশিক কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি অল্পকাল পরেই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের মুখে আবার মৌলানা আকরাম খানের সভাপতিত্বে নােতুনভাবে গঠিত হয়। সভাপতি আকরাম খান এবং সম্পাদক হােসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে এই প্রাদেশিক কমিটি ১৯৪৩-এর নভেম্বর পর্যন্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাজকর্ম পরিচালনা করে।
১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম লীগ মহলে কিছু উৎসাহ উদ্দীপনার সঞ্চার হলেও সাংগঠনিক দিক থেকে প্রাদেশিক লীগ তখনও অত্যন্ত দুর্বল ছিলাে। সে সময় শুধু বাংলাদেশের জেলাসমূহে মুসলিম লীগের যে কোনাে কমিটি ছিলাে না তা নয়, এমনকি কেন্দ্র কলকাতায় তাদের কোনাে পরিচালিত অফিসঘর পর্যন্ত ছিলাে না। সাংগঠনিক তহবিল বলতে কিছু না থাকার ফলে কোষাধ্যক্ষ হাসান ইস্পাহানী এবং তার মতাে দু-চারজন ধনী মুসলিম লীগ সমর্থকের সাহায্যের উপরই তাদেরকে নির্ভর করতে হতো। মােটামুটিভাবে বলা চলে যে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাধারণ জনপ্রিয়তা কিছুটা বৃদ্ধিলাভ করলেও প্রাদেশিক ও জেলা পর্যায়ে সংগঠন বলতে তার কিছুই ছিলাে না। | মুসলিম লীগ শ্রেণীগতভাবে ছিলাে একটি সামন্ত-বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান। কংগ্রেসের চরিত্রও তাই ছিলাে। উনিশশাে চল্লিশের দিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলন জোরদার হওয়ার সাথে সাথে নিম্ন মধ্যবিত্ত প্রভাব অবশ্য অত্যন্ত দ্রুত মুসলিম লীগের মধ্যে অনুভূত হতে থাকে। এই সময় বামপন্থী শক্তিসমূহের নােতুন শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে অন্যদিকে আবার সাম্প্রদায়িক প্রভাবওক্রমশঃ বৃদ্ধিলাভ করে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে
| এই দুই স্রোতের ক্ষিপ্রতার মুখে বাঙলাদেশের মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যে সুত্রপাত হয় সাংগঠনিক চেতনার। এই সন্ধিক্ষণেই ১৯৪৩ সালের ৬ই নভেম্বর প্রাদেশিক কাউন্সিলের সভায় আবুল হাশিম বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এই নির্বাচনের পর আবুল হাশিম বাংলাদেশে মুসলিম লীগকে উপযুক্তভাবে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিস্তৃত সফরসূচী তৈরী করে তিনি প্রত্যেক জেলায় জেলায় কর্মীদের সাথে ব্যক্তিগত যােগাযােগ স্থাপন করেন এবং মুসলমান যুবকেরা তার এই সাংগঠনিক তৎপরতায় আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। ১৯৪৪-এর প্রথম দিকে তিনি নারায়ণগঞ্জে একটি ছাত্র সম্মেলনে সভাপতিত্ব করতে আসেন এবং তার পর সেই বৎসরই তার উদ্যোগে ৯ই এপ্রিলে ঢাকার ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একটি শাখা অফিস স্থাপিত হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তানােতর রাজনীতির ইতিহাসে এই শাখা অফিসের গুরুত্ব অসামান্য। ঢাকার এই অফিসকে কেন্দ্র করেই ১৯৪৪-৪৭-এ সমগ্র পূর্ব বাঙলায় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনসহ মুসলিম লীগ সংগঠনের অন্যান্য কাজ পরিচালনা করা হয় এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী কয়েক বৎসর এই অকিসকে অবলম্বন করেই এখানকার বিরােধী রাজনৈতিক শক্তি ক্রমশঃ সংগঠিত হয়।
মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্ম এবং সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাদেশিক এবং জেলা সংগঠনগুলিতে নােতুন মধ্যবিত্ত ও সামন্ত স্বার্থের একটা সংঘর্ষ ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে। মুসলিম লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে অভিজাত উদার ও জোতদার প্রভাব বেশ থাকলেও মুসলমান মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক উত্থানের ফলে সে প্রভাবের প্রতাপ ক্রমশঃ কমে আসে। পূর্ব বাঙলার মুসলিম লীগের মধ্যে ঢাকার নবাববাড়ি-কেন্দ্রীক সামন্ত-প্রভাব খর্ব করার ক্ষেত্রে ১৫০ নম্বর মােগলটুলীর যুবকদের ভূমিকা তাই অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য। সমগ্র বাঙলাদেশে মুসলিম লীগ সংগঠনের চরিত্র কিভাবে পরিবর্তিত হলাে তা বােঝার জন্যে এই যুবকদের রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি ও তৎপরতার পর্যালােচনা একান্ত অপরিহার্য।
সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনে যে সমস্ত মুসলমান যুবকেরা রাজনীতিগত ভাবে এগিয়ে আসেন তারা ধীরে ধীরে প্রাদেশিক সম্পাদক আবুল হাশিমের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকেন। মুসলিম লীগের মধ্যে সামন্ত আভিজাত্যের প্রাধান্য খর্ব করার ক্ষেত্রে তাদের প্রথম বিজয় সূচিত হয় ঢাকা জেলা মুসলিম
লীগের নির্বাচনে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে খাজা নাজিমুদ্দীন, খাজা শাহাবুদ্দীন, সৈয়দ আবদুস সেলিম, সৈয়দ সাহেব আলম প্রভৃতি খাজা পরিবারের লােক জনদেরকে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত করে মানিকগঞ্জের আওলাদ হােসেনকে সভাপতি এবং মুন্সীগঞ্জের শামসুদ্দীন আহমদকে সম্পাদক করে একটি নােতুন জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়। এর পর থেকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ এবং সমগ্র বাংলাদেশের লীগ সংগঠনে খাজা পরিবার-কেন্দ্রিক অভিজাত এবং অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল নেতৃত্বের পরিবর্তে এক নােতুন নেতৃত্ব ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে এবং এই অগ্রগতির সাথে সাথে প্রাদেশিক সম্পাদক আবুল হাশিমের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা এবং ক্ষমতাও প্রভূতভাবে বৃদ্ধি পায়।
প্রাদেশিক লীগের সম্পাদক হিসাবে আবুল হাশিম সর্বপ্রথম একটি খসড়া ম্যানিফেস্টো প্রচার করেন। ঢাকা থেকে জেলা সম্পাদক শামসুদ্দীন আহমদ কর্তৃক প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোটির মুখবন্ধে বলা হয় :
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ মনে করে যে এই পূর্বাঞ্চলের জনসাধারণের জীবন ও অবস্থার সাথে সম্পর্কিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক নীতি কি হবে সে কথা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করার সময় এখন উপস্থিত হয়েছে। এ ধরনের একটা নকশা যে শুধুমাত্র পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকেই উদবুদ্ধ করতে সহায়ক হবে তাই নয়। এর দ্বারা মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সম্পর্কে সংস্কারাচ্ছন্ন ও আশঙ্কান্বিত লক্ষ লক্ষ অমুসলমানদের অন্তরেও আস্থা উপলব্ধির সৃষ্টি হবে। দেশবাসীর সামনে এই ম্যানিফেস্টো পেশ করার সময় বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ আশা করে যে এটিকে তারা শুধু আগামীদিনের স্বাধীনতার সনদ হিসাবেই নয়, আজকের সংগ্রামের পথনির্দেশ হিসাবেও গ্রহণ করবেন। উপরােক্ত ম্যানিফেস্টোটিতে সংবিধান সভা সম্পর্কে বলা হয় : পূর্ব পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব জনগণের মধ্যে নিহিত থাকবে। সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত সংবিধান সভা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করবে।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এই দলিলটিতে যে কর্মসূচী প্রচারিত হয় তা খুবই উল্লেখযোগ্য। কারণ এগুলির মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে এক নােতুন আন্দোলনের সাথে কিছুটা পরিচিত হওয়া যায়। আলােচ্য কর্মসূচীর কয়েকটি ধারা নীচে উল্লিখিত হলাে :
৩। আইনের ক্ষেত্রে সমতা : আইনের ক্ষেত্রে সমতা নীতি হিসাবে স্বীকৃত ও প্রযােজ্য হবে। ন্যায় বিচারকে করা হবে সহজ ও তরান্বিত। রাষ্ট্রবিরােধী অপরাধমূলক আইন এবং বিনা বিচারে আটক রাখার প্রথা উচ্ছেদ করা হবে। সকল বিচারাধীন বন্দীকে হেবিয়াস কর্পাসের নিরাপত্তার আশ্রয় মুক্তভাবে দান করা হবে। বিচার বিভাগকে করা হবে শাসন বিভাগ থেকে বিযুক্ত। ৪। নাগরিক অধিকার : বাক স্বাধীনতা এবং লেখা, আন্দোলন, মেলামেশা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত ও কার্যক্ষেত্রে প্রযােজ্য হবে। একমাত্র জনসাধারণের সতর্ক দৃষ্টিই এই স্বাধীনতার অপব্যবহারের খবরদারী করবে। ৬। শ্রমের স্বাধীনতা : সকল সমৰ্থ ব্যক্তিদের কাজ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। শ্রেণী, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল পুরুষ ও নারীকে সমান সুযােগ সুবিধা দান করা হবে। নারীদের বিশেষ অক্ষমতা ও প্রয়ােজনসমূহের প্রতি দৃষ্টি রেখে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে। নিল নি শ্রমের ফল ভােগ করার অধিকার প্রত্যেকেরই থাকবে। ৭। শিক্ষার অধিকার : শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রে হাতে ন্যস্ত থাকবে এবং তা প্রত্যেক পুরুষ ও নারীর জন্য হবে বাধ্যতামূলক, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক হবে, মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ব্যাপকভাবে উৎসাহ দেওয়া হবে। এবং উচ্চ শিক্ষাকে করা হবে সস্তা ও সহজলভ্য। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হবে। দেশের কারিগরি ও শিল্পক্ষেত্রে পশ্চাদপদত্বের পরিপ্রেক্ষিতে পেশাগত ও কারিগরি ও শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হবে এবং উচ্চ গবেষণা ও তার বিভিন্ন প্রয়ােগের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকারের সুযােগ সুবিধা দান করা হবে।১০। ৯। একচেটিয়া স্বার্থের উচ্ছেদ : সকল থানাপ্রাপ্তিমূলক স্বার্থের উচ্ছেদ করা হবে। যানবাহনসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ শিল্প অবিলম্বে জাতীয়করণ করা হবে। সকল একচেটিয়া স্বার্থ, বিশেষতঃ পাটের একচেটিয়া স্বার্থ অবিলম্বে উচ্ছেদ করা হবে।১১ ১০। শ্রমিকের অধিকার : শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী ও মহার্ঘভাতা প্রচলিত অবস্থানুযায়ী নিশ্চিত করা হবে। দুটি সংক্রান্ত আইনসহ আট ঘণ্টা দিন প্রবর্তন করা হবে। রাষ্ট্র সকলের জন্য বেকারত্ব বীমা ও বার্ধক্য
এ বইয়ের ২য় পৃষ্ঠায় ভূলবশতঃ বলা হয়েছে যে ম্যানিফেস্টোটিতে ভাষা বিষয়ক কোনাে দাবী উত্থাপন করা হয়নি। ব. উ.
ভাতা নিশ্চিত করা হবে এবং নারী শ্রমিকদের জন্য মাতৃকল্যাণ ও শিশুদের নার্সারীর ব্যবস্থা রাখবে। শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ হওয়া, সভাসমিতি করা ও ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত অন্যান্য সর্বপ্রকার কাজকর্ম এবং যৌথ দরকষাকষির জন্য ধর্মঘটের অধিকার থাকবে।১২ ১১। কৃষকদের অধিকার : কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা ও সর্বপ্রকার খাজনার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বিধান করা হবে। সর্বপ্রকার অন্যায়মূলক কর উচ্ছেদ করা হবে। রাষ্ট্র সমবায় পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ করবে এবং কৃষকেরা যাতে তাদের কৃষিজাত দ্রব্যসমূহের ন্যায্য মূল্য লাভ করতে পারে সেজন্যে সমবায় বিক্রয় ব্যবস্থার প্রতি উৎসাহ দান করবে। রাষ্ট্র বিশাল আকারে সেচ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে যাতে করে দেশের কোনাে অঞ্চলে কৃষকেরা চাষ আবাদের উপযুক্ত সুযােগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয়।১৩ ১২। কারিগরদের অধিকার : রাষ্ট্র শিল্পায়নের কাজে আত্মনিয়োেগ করবে কিন্তু তা সত্ত্বেও গ্রাম্য কারিগরি শিল্পসমূহের প্রতিও উপযুক্ত দৃষ্টি দেওয়া হবে। কারণ তাদের উন্নতির দ্বারা সাধারণভাবে সমগ্র গ্রামের অধিকতর কল্যাণ সাধিত হবে। এজন্যই রাষ্ট্র বিভিন্ন গ্রাম্য কারিগরি শিল্পকে প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য, প্রয়ােজনমতাে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান, কাচা মাল সরবরাহ এবং উৎপন্ন দ্রব্যের বিক্রয় ব্যবস্থাকে সংগঠিত করবে।১৪
ম্যানিফেস্টোটির এ পর্যন্ত উদ্ধৃত অংশের থেকে একথাই মনে হবে যে সেটি একটি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ কর্মসূচী। কিন্তু মুসলমান ও অমুসলমান সংখ্যালঘুদের অধিকার সম্পর্কে ম্যানিফেস্টোটিতে যা বলা হয়েছে তাতে মুসলমান ও অমুসলমান সংখ্যালঘুদের কতকগুলি নিদিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের উল্লেখ থাকলেও মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অভিভাবকের ভূমিকা নির্দেশ করার ফলে তার সামগ্রিক গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেকাংশে খর্ব হয়েছে। মুসলিম লীগের সাধারণ কাঠামাের কথা বিবেচনা করলে অবশ্য সহজেই বোঝা যাবে যে তার মধ্যে মুসলমানদের এই ভূমিকা নির্দেশ অস্বাভাবিক ছিলাে না। পাকিস্তান যে ইসলামী রাষ্ট্র হবে একথা কিন্তু ম্যানিফেস্টোটির কোনাে স্থানেই উল্লেখ করা হয়নি। মুসলমানদের অধিকার সম্পর্কে ১৪ ধারায় শুধু বলা হয়েছে :
মুসলমান সমাজে শরিয়তের আইনকানুন যাতে প্রযুক্ত ও পালিত হয় তার প্রতি দৃষ্টি রাখা হবে মুসলিম লীগের কর্তব্য। ইসলামের নৈতিক মূল্য পুনরুখিত ও ইসলামী নীতিসমূহ অনুসরণ করা হবে। ইতিহাস, লােকগীতি,
শিল্প ও সঙ্গীতের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তানে ইসলামী সংস্কৃতির যে বিকাশ শত শত বছর ধরে ঘটেছে তাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টাকে বিশেষভাবে উৎসাহ দান ও জনপ্রিয় করা হবে।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরােধিতা ও ধর্মীয় আনুগত্যের যে আপাতঃ সমন্বয় সাপিত হয়েছিলাে তারই পরিচয় পাওয়া যায় ম্যানিফেস্টোটির শেষ দুই অনুচ্ছেদে : ইসলাম তার অনুসরণকারীদের কাছে সাম্য ও স্বাধীনতার যে নীতি প্রচার করে তার দ্বারা উদবুদ্ধ হয়ে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ মানবতার মুক্তির জন্য চূড়ান্ত সংগ্রাম যাতে আর বিলম্বিত না হয় তার জন্য সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সকল দল ও ব্যক্তিকে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানাচ্ছে। দেশবাসীর সামনে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নিজের ভূমিকাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে গিয়ে আবুবকরের বিখ্যাত নীতি অনুসারেই চলার চেষ্টা করে : ‘আমি যদি সঠিক হই, আমাকে অনুসরণ করো। আমি ফণি ভুল করি, আমাকে সংশােধন কর। এই নীতির উপর নির্ভর করেই বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সর্বস্তরের দেশবাসীর কাছে আবেদন জানাচ্ছে, যাতে তারা এগিয়ে আসেন এবং সমবেত শক্তি দ্বারা এ প্রচেষ্টার কামিয়াবীর মাধ্যমে এই সােনার দেশ পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে রক্ষা করেন।১৬
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কর্তৃক প্রকাশিত এই খসড়া ম্যানিফেস্টোটি সমগ্ন প্রাদেশিক লীগের সমর্থন লাভ করেনি। এমনকি এই দলিল প্রচারের কোনাে অধিকার আবুল হাশিমের নেই কাজেই তা প্রচারের জন্যে তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাগত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হােক এই মর্মে শহীদ সুহরাওয়াদী পর্যন্ত প্রাদেশিক লীগ সভাপতি আকরাম খানকে একটি পত্র দেন। সেই পত্রটি আকরাম খান আবার আবুল হাশিমের অবগতির জন্যে তার কাছে পাঠান।১৭
এ ছাড়া সামন্ত প্রভাবাধীন দক্ষিণপন্থী মহলেও ব্যাপারটি নিয়ে আবুল হাশিম এবং তাদের বামপন্থী’ উপদলের বিরুদ্ধে দারুণ এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা সত্বেও একথা বলা চলে যে ১৯৪৩ সালের পর থেকে মুসলিম লীগের পতাকাতলে যে নােতুন যুব সম্প্রদায় ও সাম্রাজ্যবাদবিরােধী জনসাধারণ দলে দলে সমবেত হয়ে মুসলিম লীগকে তাদের সমর্থন দান করতে

225
বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন এই ম্যানিফেস্টোটিতে তাদের আশা আকাথাই বিশেষভাবে প্রতিফলিত ও প্রতিধ্বনিত হয়েছিলাে। বস্তুতপক্ষে এই দলিলটিকে কেন্দ্র করেই আবুল হাসিমের নেতৃত্বে বাঙলাদেশের মুসলিম যুব সম্প্রদায় নিজেদেরকে আদর্শগত ও সংগঠনগতভাবে সুসংহত করেন।
এখানে লক্ষ্য করার বিষয় এই যে সুহরাওয়ার্দী, এবং বিশেষ করে আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের বামপন্থী শক্তি নাজিমুদ্দীন ও সাধারণভাবে খাজা পরিবারের নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে গুরুতরভাবে আঘাত করতে সক্ষম হলেও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সামন্ত স্বার্থের প্রতাপকে তারা উপযুক্তভাবে খর্ব ও পরাভূত করতে সক্ষম হয়নি। শুধু তাই নয়, উপরােক্ত ম্যানিফেস্টোতে উল্লিখিত কোনাে কোনাে কর্মসূচীকে নিজেদের মন্ত্রিত্ব থাকাকালে বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টাকে তারা সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা প্রদান করেছে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিতে তেভাগা বিলের পরিণাম এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
| শহীদ সুহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিম তাে বটেই এমনকি ফজলুর রহমান প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী নাজিমুদ্দীন উপদলভুক্ত বিশিষ্ট কয়েকজন নেতারও জমি অথবা জমিদারীতে বিশেষ কোনাে ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিলাে না। কাজেই সাধারণ নির্বাচনের পর ১৯৪৭ সালে সুহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে রাজস্ব সচিব ফজলুর রহমান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে শশাধিত বাঙালী কৃষকদেরকে কিছুটা রেহাই দেওয়ার জন্যে তেভাগা বিল প্রণয়ন করেন এবং তা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিতে যথারীতি পেশ করা হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভার এই উদ্যোগ সত্ত্বেও উত্তর বাংলার কিছু সংখ্যক শক্তিশালী জোতদারদের নেতৃত্বে পার্লামেন্টারী পার্টির মধ্যে সামন্তশক্তি এমন চাপ সৃষ্টি করে যে আত্মরক্ষার্থে মুসলিম লীগ মন্ত্রিত্ব সেই বিল প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু মুসলিম লীগের শ্রেণীগত পরিচয় যে এই প্রথম উদ্ঘাটিত হলাে তাই নয়। এর পূর্বেও প্রতিষ্ঠানগতভাবে মুসলিম লীগের সামগ্রিক শ্রেণী চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় তখনই যখন আলােচ্য মানিফেস্টোটির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল লীগ মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে সেটিকে ওয়ার্কিং কমিটিতে তাে বটেই এমনকি প্রাদেশিক কাউন্সিলেও আলােচনার জন্যে পেশ করা সম্ভব হয় না। তথাকথিত বামপন্থী উপদলের অন্যতম প্রধান নেতা হওয়া সত্ত্বেও আবুল হাশিমের সাথে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব এবং ম্যানিফেস্টোটির নীতিসমূহের প্রতি পূর্ণ আস্থার অভাবে সুহরাওয়াদীও সেটি প্রাদেশিক
কাউন্সিলে উত্থাপনের ব্যাপারে বিরােধিতা করেন। এর ফলে সাধারণভাবে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে এই কর্মসূচীর পেছনে বিরাট সমর্থন থাকলেও প্রাদেশিক কাউন্সিলে তাকে পাস করিয়ে নেওয়ার মতাে প্রয়ােজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা “বামপন্থী’দের ছিলো না। | শুধু তাই নয়। তেভাগা আন্দোলনকে দমনের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগ সরকার কৃষকদেরকে জেলে পুরে, তাদেরকে উত্তর বাঙলার বিভিন্ন জায়গায় গুলি করে হত্যা করে যে নির্মম নির্যাতন তাদের উপর চালিয়েছিলাে সেটা একমাত্র তাদের শ্রেণী শত্রুদের দ্বারাই সম্ভব।
মুসলিম লীগকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে মুসলমান যুব সম্প্রদায়ের উদ্দীপনা এবং অসংখ্য কর্মীর অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও এই সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানটির শ্ৰেণীগত চরিত্র সাধারণ কর্মীদের কাছে ধীরে ধীরে উদঘাটিত হতে শুরু করে। তেভাগা বিলের ক্ষেত্রে আবুল হাশিমের মধ্যেও উৎসাহের যে অভাব দেখা যায় তাকে শুধু নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে অনিবার্য নিস্ক্রিয়তা বলে অভিহিত কর, চলে না। এখানেও শ্রেণী চরিত্রের প্রশ্নই সত্য অর্থে প্রাসঙ্গিক। ম্যানিফেস্টোর মধ্যে কৃষকদের অধিকারের উল্লেখ এবং তেভাগা আন্দোলনের মুখে তেভাগা বিল প্রণয়নে তার উৎসাহ থাকলেও সেই বিলকে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টিতে পাস করিয়ে নেওয়ার জন্যে যে পরিশ্রম ও সাংগঠনিক তৎপরতার প্রয়ােজন ছিলাে আবুল হাশিম তার জন্যে কোনাে উৎসাহ অথবা তাগিদ অনুভব করেননি। তেভাগা বিলের পরিণতি নিশ্চিত জেনেও তেভাগার রাজনীতি’র সপক্ষে মুসলিম লীগের ‘বামপন্থী মহলে এবং সামগ্রিকভাবে দেশে একটা আন্দোলন গঠনের চিন্তাও তার মধ্যে আসেনি।
বস্তুতঃপক্ষে ১৯৪৩ সালের নভেম্বরের পর থেকে ১৯৪৭ সালে তেভাগা বিল প্রত্যাখ্যাত হওয়া পর্যন্ত এই পর্যায়টিই গণপ্রতিষ্ঠান হিসাবে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সব থেকে গৌরবময় অধ্যায়। এর পর সুত্রপাত হয় সামগ্রিকভাবে মুসলিম লীগ নেতৃত্বের প্রতি সত্যিকার বামপন্থী অনাস্থার। মুসলিম লীগের মধ্যে আবুল হাশিমের সাংগঠনিক এবং আদর্শগত নেতৃত্বের সর্বোচ্চ বিকাশ এই পর্যায়েই ঘটে। এর পর থেকে তার চিন্তার মধ্যে রক্ষণশীল প্রভাব ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দেয় এবং অগাস্ট ১৯৪৭-এর পর তার রাজনৈতিক চিন্তা এমন এক পথ ধরে অগ্রসর হতে থাকে যার ফলে ১৯৬৫ সালের দিকে সাধারণ মানুষের কাছে তার তুলনায় শহীদ সুহরাওয়ার্দী তাে বটেই, এমনকি খাজা নাজিমুদ্দীনকেও মনে হয় বামপন্থী!
আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন যুব সম্প্রদায় যেভাবে একত্রিত হয়েছিলেন সেটা একদিক দিয়ে স্বাভাবিক হলেও প্রগতিশীল রাজনীতিক্ষেত্রে তা অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলাে। মুসলমান যুবকদেরকে সত্যিকার প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে ১৯৪৭-এর পর তাদেরকে নােতুন নেতৃত্বদানের যে সম্ভাবনা ছিলাে ধর্মীয় রাজনৈতিক চিন্তার ফলে তার পক্ষে সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি।
এর ফলে যারা ইতিমধ্যে মুসলিম লীগের মধ্যে এসেছিলেন তাদের বিপুল অধিকাংশই পরবর্তীকালে রাজনীতির প্রগতিশীল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহকেই জোরদার করেন। কাজেই আবুল হাশিমের প্রাথমিক রাজনৈতিক চিন্তা এবং সাংগঠনিক শক্তির মধ্যে যে সম্ভাবনা ছিলাে তা গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন যুবকদেরকে মুসলিম লীগের অন্তর্গত চরম রক্ষণশীলদের দুর্গকে অনেকাংশে ধ্বংস করতে সমর্থ হলেও মুসলিম যুব সম্প্রদায়কে সত্যিকার বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনৈতিতে উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থ হয়নি। উপরন্তু তাদের অনেকেই সেই পথ থেকে বিচ্যুত করে মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত করে পরিশেষে তাদেরকে করেছিলাে হতাশাচ্ছন্ন ও বিভ্রান্ত।
কিন্তু মুসলমান যুব সম্প্রদায়ের এই রাজনৈতিক পরিক্রমাকে আবার কোনােক্রমেই অস্বাভাবিক বলা চলে না। ব্যাপকভাবে গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী আন্দোলনে অংশ গ্রহণের প্রাথমিক পর্যায় হিসাবে তৎকালীন অবস্থায় সাধারণভাবে তাদের এই ভূমিকা শুধু স্বাভাবিক নয়, প্রয়ােজনীয়ও ছিলাে। এর ফলে দেখা যায় যে অল্পসংখ্যক হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঠিক পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগের এই ‘বামপন্থী’ উপদলভুক্ত যুবকরাই পূর্ব বাঙলায়, বিরােধীশক্তিকে সংহত ও সাংগঠনিক রূপ দান করেন। এবং অতি অল্প সংখ্যক হলেও তাদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যিকার বামপন্থী রাজনীতি গঠনকার্যে সচেষ্ট হন।
| ২। মােগলটুলীর শাখা অফিস
১৯৫০ নম্বর মােগলটুলীতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের যে শাখা অফিস স্থাপিত হয় কলকাতার সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ১৯৪৭-এর অগাস্ট মাসের পরও তাকে কেন্দ্র করে আবুল হাশিম-সুহরাওয়ার্দী উপদলের,
কর্মীরা মােটামুটি একত্রিত থাকেন। এই অফিসটি ঢাকাতে অবস্থিত থাকলেও সারা পূর্ব বাঙলায় নাজিমুদ্দীন সরকার বিরোধী যুবকেরা রাজনীতিক্ষেত্রে তাকেই অবলম্বন করে নিজেদের প্রাথমিক কাজকর্ম পরিচালনা করেন।
যে সমস্ত কর্মীরা মোগলটুলীর এই শাখা অফিসটিকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলায় নতুন রাজনীতি গঠন চিন্তায় নিযুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে শামসুল হক, কমরুদন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, শওকত আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান, শামসুজ্জোহা, মহম্মদ আলমাস, মহম্মদ আউয়াল এভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তী সময়ে শেখ মুজিবর রহমান এবং অন্যান্য কয়েক জন ও কলকাতা থেকে আসার পর সেই রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন।
মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদ ঘােষিত হওয়ার পর ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে কমরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে উপরােল্লিখিত কর্মীদের মধ্যে কয়েকজন গণ আজাদী লীগ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গঠন করে। সে বছরই অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে ১৭ ৩ নম্বর মোগলটুলীকে কেন্দ্র করে গণতান্ত্রিক যুব লীগ গঠনের সাংগঠনিক কাজ কর্ম পরিচালিত হয়। এর পরবর্তী সময়ে ঢাকার ছাত্র আন্দোলন এবং বিবিধ রকম গণ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই কর্মীদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
মোগলটুলীর অফিসকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের যে সমস্ত কর্মীরা একত্রিত ছিলেন তাদের মধ্যে নানাপ্রকার রাজনৈতিক চিন্তা এলেও মুসলিম লীগ থেকে সরাসরি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ইচ্ছা তাদের অধিকাংশের মধ্যেই ছিলাে না। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম লীগকে নােতুনভাবে সংগঠিত করে তার মধ্যেই নিজেদের শক্তিকে সংহত করতে চেয়েছিলেন। এ জন্যেই শামসুল হক এবং শেখ মুজিবর রহমান ওয়াকাস ক্যাম্প নামে অভিহিত মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহ্বান করে রশিদ বই দেওয়ার জন্যে আকরাম খানের উপর চাপ প্রয়ােগের চেষ্টা করেছিলেন। আকরাম খান কিন্তু ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীদেরকে লীগবিরােধী রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদেরকে রশিদ বই দিতে অস্বীকার করেন। | ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীদের প্রতি আকরাম খানের এই আচরণই প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম লীগের বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। ক্ষুদ্র উপদলীয় ও ব্যক্তি স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সাংগঠনিক সমস্যাকে বিচার করলে তিনি সহজেই উপলব্ধি করতেন যে ১৫০ নম্বর মােগলটুলীকে ঘিরে যে কর্মী গােষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিলাে তারাই ছিলাে মুসলিম লীগের সত্যিকার সম্পদ, তিনি যাদেরকে
নিয়ে নােতুনভাবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠন করতে চলেছিলেন তারা নয়। আবুল হাসিমের ভয়ে সহ আকরাম খান কিন্তু তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে দেখেছিলেন যে পূর্বোক্ত কর্মীদেরকে সাংগঠনিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযােগ দিলে তারা পরিশেষে তার নেতৃত্বের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাড়াবে। এই চিন্তা থেকেই তিনি তাদেরকে মুসলিম লীগের আওতার বাইরে রাখতে সচেষ্ট হন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি যুবকর্মীদেরকে পাকিস্তানবিরােধী আখ্যা দিতেও দ্বিধা বােধ করেননি, যদিও পাকিস্তান অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের পরিশ্রম ও অবদান তার থেকে কোনাে অংশেই কম ছিলাে না।
আকরাম খানের এই নীতি পূর্ব বাঙলা মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির যারা পুরােপুরি সমথিত হয়েছিলাে। কারণ সেখানে নাজিমুদ্দীনের ছিলাে সুহরাওয়ার্দী ভীতি। নাজিমুদ্দীন এবং তার উপদলের লােকজনেরা পূর্ব বাংলায় সুহরাওয়ার্দীর আগমনকে দারুণ বিপজ্জনক মনে করতেন এবং সেজন্যে মােগলটুলীর কর্মীরা যাতে মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্মের সাথে যুক্ত হতে না পারে সেদিকেও তাদের লক্ষ্য কম ছিলাে না। | মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে এই অবস্থা সৃষ্টির ফলে বলিষ্ঠ কর্মীর অভাবে তার সম্প্রসারণ ও শক্তিবৃদ্ধি তাে হয়ইনি উপরন্তু সমগ্র প্রতিষ্ঠানটিই ধীরে ধীরে পার্লামেন্টারী পার্টির লেজুড়ে পরিণত হয়েছিলাে। এই লেজুড়-বৃত্তি ১৯৪৯-এর এপ্রিল মাসে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের পক্ষে এক দারুণ বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৯ পর্যন্ত মােগলটুলীর অফিসকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগের যুব কর্মীরা মােটামুটিভাবে একত্রিত থাকেন। এই সময়ে তারা অবশ্য একটি নােতুন সংগঠনের জন্যে নানা প্রকার উদ্যোগ গ্রহণ ও চিন্তা ভাবনা উপেক্ষা করেননি। নােতুন সংগঠনটি সাম্প্রদায়িক হবে, না অসাম্প্রনায়িক; তার রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচী কি হবে; ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে তারা কিভাবে অগ্রসর হবেন; পার্লামেন্টারী পার্টির সুহরাওয়ার্দী-সমর্থক উপদলের স্বার্থে কতখানি যােগাযােগ রাখা সঙ্গত হবে ; এই সব বিষয়ে তাঁরা নিজেদের বৈঠকে প্রায়ই আলােচনা করতেন। এই বৈঠকগুলি মােগলটুলী ছাড়াও অধিকাংশ সময় কমরুদ্দীন আহমদের জিন্দাবাহার লেনস্থ বাসা এবং চাষহারা-নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলীর বাসায় অনুষ্ঠিত হতাে। এই বৈঠকগুলির সাথে কমরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, শামসুজ্জোহা, আলমস,
230
আউয়াল প্রভৃতি বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মােগলটুলীতে একত্রিত কর্মীরা ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনীতির বিভিন্ন খাতে নিজের কাজকর্মকে পরিচালনা করলেও একথা নিসন্দেহে বলা চলে যে পরবর্তীকালে সামগ্রিকভাবে তারা পূর্ব বাংলার রাজনীতির উপর অনেকখানি প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হন।
৩। টাঙ্গাইল উপনির্বাচন | ভাসানীর মৌলানা আবদুল হামিদ খান পূর্ব বাঙলায় আসার পর ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল দক্ষিণ (মুসলিম) কেন্দ্র থেকে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনের পর করােটিয়ার জমিদার খুররম খান পী ভাসানীর নির্বাচনকে অবৈধ ঘােষণা করার জন্যে আবেদন জানান। সেই আবেদনের ভিত্তিতে প্রাদেশিক গভর্নর উপরােক্ত নির্বাচন বাতিল করে দেন। তা ছাড়া নির্বাচনে ব্যয়ের হিসাবে দাখিল না করার অপরাধে মৌলানা ভাসানী, খুররম খান পন্নী প্রভৃতি চারন ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কোনাে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না এই মর্মে তাদের উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞাও জারী করা হয়।
১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইল দক্ষিণ মুসলিম) কেন্দ্রে প্রাদেশিক সরকার নােতুন করে আবার নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। এই খবর শােনার পর ১৫• মােগলটুলীতে মােস্তাক আহমদ, শওকত আলী, শামসুল হক, কমরুদ্দীন আহমদ, নবাবজাদা হাসান আলী প্রভৃতি মিলে শামসুল হককে মুসলিম লীগের বিরােধী প্রার্থী হিসাবে দাড় করানাের সিদ্ধান্ত নেন। এর পর অন্যান্য সকলেই মােটামুটি ভাবে এ ব্যাপারে একমত হন কিন্তু তবু নির্বাচনের ব্যাপারে সাবধান হওয়ার জন্যে নারায়ণগঞ্জের ওসমান আলীর বাসায় এক বৈঠকে শওকত আলী, শামসুজ্জোহা, প্রভৃতি ১৫০ নম্বরের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা স্থির করেন যে মুসলিম লীগ যদি শামসুল হককে মনোনয়ন দেয় তাহলে তারা তাকে সমর্থন তাে করবেনই
উপরন্তু অন্য একজনকে তার পরিবর্তে দাড় করিয়ে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধাচরণ করবেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শামসুল হকই মুসলিম লীগ বিরােধী প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি মনােনয়ন দেন খুররম খান পন্নীকে।
কিন্তু ইতিপূর্বে প্রাদেশিক সরকারের জারীকৃত নিষেধাজ্ঞা অনুসারে ১৯৫০ সালের পূর্বে আইনতঃ কোননা কেন্দ্রেই নির্বাচন প্রার্থনার অধিকার খুররম খানের ছিলাে না। এই অসুবিধা দূর করার জন্যে গভর্নর বিশেষ ক্ষমতা বলে কেবলমাত্র মুসলিম লীগ প্রার্থী খুররম খানের বিরুদ্ধে নির্বাচন সংক্রান্ত | নিষেধাজ্ঞাটি প্রত্যাহার করেন। ভাসানী এবং অর দুইনের বিরুদ্ধে সে নিষেধাজ্ঞা অবশ্য পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বলবৎ থাকে।
নূরুল আমীন সরকারের এই চরম অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নিলঞ্জ দলীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে সমগ্র প্রদেশে কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। 7 মুসলিম লীগ নেতৃত্ব এবং প্রতিষ্ঠানটি সামগ্রিক চৰিত্ৰও এই অদৃষ্টপূর্ব সরকারী সিদ্ধান্তের ফলে জনসাধারণের কাছে উদ্ঘাটিত হয়। এই প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক নওবেলাল ‘একটি দৃষ্টান্ত’ নামে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন :
মুসলিম লীগ গণতান্ত্রিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়াই জনসাধাৰণ জানিত এবং সেই জন্য তাহাদের সমর্থনও দান করিয়াছেন। কিন্তু মুসলিম লীগের বর্তমান অগণতন্ত্রী নীতির ফলে জনসাধারণ যদি তাহাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে, তাহা হইলে দায়িত্ব কাহার হইবে? জনসাধারণের-না দলীয় স্বার্থে যাহারা গণতন্ত্রের ন্যায়নীতিকে জলাবলি দিয়া ফ্যাসিস্ট নীতি অবলম্বন করিয়াছেন তাহাদের? এই প্রশ্নের জবাবের ভার আমরা গণতন্ত্রে দৃঢ়বিশ্বাসী পূর্ব পাকিস্তানের কোটি কোটি জনগণের উপর ছাড়িয়া দিতেছি। দেশের সত্যিকারের কোনাে উন্নতিমূলক পরিকল্পনা সামনে লইয়া যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আগাইয়া যায় না তাহার পক্ষে এইরূপ ফ্যাসিস্ট নীতি অবলম্বন করা ছাড়া কি উপায় আছে? পাকিস্তান লাভের পর মুসলিম লীগের কর্তব্য ছিল জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি হিসাবে সদ্য জাগ্রত এক জাতির সামনে রাষ্ট্রগঠনমূলক পরিকল্পনা লইয়া আগাইয়া আসা। কিন্তু মুসলিম লীগ সে কৰ্তব্য মােটেই পালন করে নাই। বরং দলীয়, উপলায় স্বার্থ নিয়া কোন্দল করিতেই রত রহিয়াছে। এমতাবস্থায় জনসাধারণ যদি মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারাইয়া ফেলে তাহা হইলে কাহাকে দায়ী করা যাইবে?
টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থী খুরম খানের বিরুদ্ধে শামসুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থীরূপে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘােষণা করেন। তার | এই সিদ্ধান্ত মুসলিম লীগ সরকারের বিরােধী মহলে সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়ার
সৃষ্টি করে এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই শামসুল হককে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। এ ব্যাপারে ১৫০ নম্বর মোগল’ব পার্টি হাউস’কে কেন্দ্র করে যে কর্মীদল তখনাে পর্যন্ত মােটামুটি একত্রিত ছিলেন তারাই সব থেকে সংগঠিত এবং ব্যাপকভাবে শামসুল হকের পক্ষে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। মোস্তাক আহমদই ছিলেন এই নিশাচনের মূল সংগঠনক। তা ছাড়া অন্য যারা এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নেন তাদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, নারায়ণগঞ্জের শামসুজ্জোহা, মহম্মদ আলমাস, মহম্মদ আউয়াল এবং শওকত আলী, আজিজ আহমদ, হজরত আলী প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। | নির্বাচনী সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে বিরােধী পক্ষের অর্থাভাব বেশ কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করে। আলমাস নারায়ণগঞ্জ এলাকা থেকে ৫০০ টাকা তােলেন। তা ছাড়া চেম্বার অব কমার্সের সাখাওয়াৎ হােসেন ৫০ টাকা, আতাউর রহমান খান ৫০ টাকা, কাদের সর্দার ১৫০ টাকা দেন। অন্যান্যদের থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে সর্বসাকুল্যে নির্বাচনের জন্যে কর্মীরা প্রায় ১৩০০ টাকা তুলতে সমর্থ হন।৬ মুসলিম লীগের বিপুল অর্থ-সামর্থ্যের তুলনায় শামসুল হকের এই অবস্থা রীতিমতাে আশঙ্কাজনক ছিলাে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অর্থাভাব নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন কোনাে প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে পারেনি।
স্থানীয় স্কুল এবং করােটিয়া কলেজের বহুসংখ্যক ছাত্র শামসুল হকের নির্বাচনী সংগ্রামে খুব মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। তারা অর্ধভুক্ত অবস্থায় এবং পায়ে হেঁটে নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যাপক সরকার বিরােধী প্রচারণা চালায় এবং সরকারী সভা-সমিতিতে দলে দলে উপস্থিত হয়ে সেগুলিকে বিবােধীদলের সভায় পরিণত করে। এই ধরনের তিন-চারটি সভায় প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে শামসুল হকও সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে চ্যালেঞ্জ দেন এবং তাদের গণবিরােধী নীতি সমুহের তীব্র সমালােচনার দ্বারা সেখানে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভের সৃষ্টি করেন। | নির্বাচনকালে খুররম খানের স্ত্রী তার স্বামীর বিরুদ্ধে শামসুল হকের পক্ষে প্রচারণায় অংশ গ্রহণের জন্যে বিরােধীদলের কাছে প্রস্তাব পাঠান। কিন্তু তারা তার সেই প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর পর বেগম পন্নী নিজেই একটি ইস্তাহার প্রচার করে তাকে তার স্বামীর ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রতি দোষারােপ করেন ও ভোটারদেরকে খুররম পন্নীর পক্ষে ভােট না দেয়ার জন্যে আবেদন জানান।
এই নির্বাচনের সময় পূর্ব পাকিস্তানের মুসলীম লীগ সভাপতি মৌলানা আকরাম খান, সম্পাদক ইউষফ আলী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমীন | ভােটারদের উদ্দেহে নিয়ােক্ত আবেদন১০ প্রচার করেন ?
লাখােমােজাহেদের ত্যাগ ও কোরবাণীর ফলে আমরা পাকিস্তান লাভ করিয়াছি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মােসলেম রাষ্ট্র আমাদের পাকিস্তান। পাকিস্তানের গঠনতন্ত্র আইনকানুন তৈরী হইতেছে ইসলামী শরিয়ত মােতাবেক। এই নূতন রাষ্ট্রের শিশু অবস্থায় একে কত বিপদ—কত মছি বতের সম্মুখীন হইতে হইতেছে। কত জানী দুষমন শৈশবেই ইহাকে নষ্ট করিবার চেষ্টা করিতেছে। ভারতের দশকোটি মুসলমান মােসলেম লীগের ঝাণ্ডার নীচে একযােগে কাজ করিয়াছিল বলিয়াই আমরা পাকিস্তান হাসিল করিতে পারিয়াছিলাম। পাকিস্তান হাসিলের জন্য মােসলেম সংহতি ও মােসলেম লীগের যতখানি দরকার ছিল আজ পাকিস্তানকে গড়িয়া তুলিবার দরকার তার চেয়েও বেশী। কায়েদে আজম বারে বারে বলিয়াছেনপাকিস্তানকে মজবুত করিতে হইলে মােসলেম লীগকে মজবুত করিতে হইবে। এন্তেকালের কিছু দিন আগে তিনি ঢাকায় বক্তৃতায় ও মােসলেম লীগের দুষমনদের সম্বন্ধে আপনাদের সতর্ক করিয়াছেন, এবং মােসলেম লীগকে শক্তিশালী করিবার জন্য আকুল আহ্বান জানাইয়াছেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ইছলামী শরিয়ত মােতাবেক যে আইনকানুন তৈরী করিতেছেন, তা চালু করিতে হইলে প্রাদেশিক আইন সভারও মুসলমান সদস্যদিগকে একদিন একমত হইয়া মােসলেম লীগের ভিতর থাকিয়া কাজ করিতে হইবে। আপনারা জানেন দক্ষিণ টাঙ্গাইল হইতে আগামী ২৬শে এপ্রিল পূর্ব বঙ্গ আইন সভার উপ-নির্বাচন হইবে। এইবার এই আসনের জন্য মােসলেম লীগের তরফ হইতে নমিনেশন পাইয়াছেন কবরীটিয়ার স্বনামধন্য চাদ মিয়া সাহেবের নাতি খুররম খা পন্নি। পাকিস্তান রাষ্ট্রকে রক্ষা করিলে হইলে—মজবুত করিতে হইলে—আপনাদের কর্তব্য হইবে এক বাক্যে মােসলেম লীগের সাইকেল মার্কা বাক্সে ভােট দেওয়ার। মোসলেম লীগে ও মােসলেম জামাতে ভাঙ্গন ধরাইবার জন্যে পাকিস্তান লাভের আগে যেমন চেষ্টা হইয়াছে এখনও সেই রকম চেষ্টা হইতেছে। বন্ধুর বেশে আসিয়া অনেকে মােসলেম লীগের ও মােসলেম লীগ প্রাথীয় বিরুদ্ধে অনেক কিছুই বলিবে। আপনি যদি মােসলেম রাষ্ট্রকে মজবুত দেখিতে চান দুনিয়ায় পাকিস্তানের ও মােসলেম জাতির ঝাণ্ডা চলন্ত হােক এ যদি আপনার
কামনা হয় আপনি নিশ্চয়ই লীগ প্রার্থী খুররম খাঁ পল্পির জন্য মােসলেম লীগের সাইকেল মার্কা বাক্সেভােট দিবেন। মনে রাখবেন এভােট মােসলেম লীগ ও পাকিস্তান দৃঢ় করিবার জন্য। আশা করি অন্য বারের ন্যায় এবারও আপনারা মােসলেম লীগকে সমর্থন করিয়া মােসলেম জমাত কায়েদে আজম ও পাকিস্তানের মর্যাদা রক্ষা করিবেন। ‘টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচন’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে দৈনিক আজাদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন
দুইজন প্রার্থী বর্তমানে এই আসনের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেছেন বলিয়া জানা গিয়াছে। এই দুইজনের মধ্যে জনাব খুররম খান পন্নী সাহেব লীগের মনােনয়ন লাভ করিয়াছেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী জনাব শামসুল হক সাহেব দুই বৎসর আগে তদানীন্তন প্রাদেশিক লীগ সেক্রেটারী জনাব আবুল হাশেমের অনুবর্তী হিসাবে লীগের প্রচার কার্যে নিযুক্ত ছিলেন। আশা করা গিয়াছিল যে, লীগ কর্মী হিসাবে শেষােক্ত প্রার্থী জনাব শামসুল হক সাহেব লীগ মনােনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থী জনাব খুররম খান পন্নীর অনুকূলে নির্বাচন-বৰ হইতে সরিয়া দাড়াইবেন। কিন্তু তাহা হয় নাই। তিনি লীগের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করিয়াছেন এবং লীগ মনােনয়ন অগ্রাহ্ করিয়া লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাড়াইয়াছেন। এটি খুবই দুঃখজনক ব্যাপার, সন্দেহ নাই। লীগের নিয়ম-শৃঙ্খলা লীগ। কর্মী বলিয়া পরিচিত এক ব্যক্তি ভাঙ্গিবেন, পূর্ব পাকিস্তানের সত্যকার লীগারদের কাছে তাহা এতদিন অভাবনীয় ব্যাপারই ছিল ”
শৃঙ্খলা ভঙ্গের যে অভিযােগ সম্পাদকীয়টিতে করা হয়েছে সে অভিযােগ, বস্তুতঃ প্রযােজ্য ছিলাে সংবাদপত্রটির মালিক এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মৌলানা আকরাম খান এবং মুসলিম লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের ক্ষেত্রে। তারাই মুসলিম লীগকে কুক্ষিগত করে তাদের উপদলের বাইরের কোনাে কর্মী অথবা নেতা যাতে প্রতিষ্ঠানে ঠাই পেতে না পারেন তার জন্যে সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তাদের এ ধরনের নানা কীতিকলাপের পর মুসলিম লীগের প্রতি আস্থার অভাব ছিলাে খুবই যুক্তিসঙ্গত ও স্বাভাবিক। সে সম্পর্কে কোনাে কিছু উল্লেখ না করে আজাদের উক্ত সম্পাদকীয়টিতে ভােটারদেরকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে আবার বলা হয় :
আমরা অবশ্য শামসুল হক সাহেবের এই লীগ-বিদ্রোহিতায় বিস্মিত হই। নাই। তিনি আগেও যত না ছিলেন সত্যকার লীগমনা কমী তার চাইতে
বেশী ছিলেন আবুল হাশেম সাহেবের অন্ধভক্ত-শিষ্য। জনাব আবুল হাশেমের হটকারিতাপূর্ণ কীতি-কলাপের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের, বিশেষ করিয়া লীগারদের পরিচয় যথেষ্টই আছে, কাজেই সে সম্পর্কে এখানে পুনরালোচনা অনাবশ্যক। সেই আবুল হাশেম সাহেবের অন্ধ ভক্ত-শিষ্য হটকারিতার বশবতী হইয়া লীগ-নির্দেশ অমান্য করিয়া বসিবেন, তাতে বিস্ময়ের বিষয় আর কি থাকিতে পারে। টাঙ্গাইলের ভােটারদের কাছে আমাদের আরজ : এখনো পূর্ব-পাকিস্তান সর্বাংশে বিপদমুক্ত হয় নাই, এখনাে বাহিরের শত্রুদল পাকিস্তানের নামনিশানা মুছিয়া ফেলার জন্য সুযােগের অপেক্ষায় ওৎ পাতিয়া আছে এবং পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে অন্তবিরােধ ও ভাঙ্গন সৃষ্টির মধ্য দিয়াই যে সে
যােগ আসিবে, ইহারা তাহা জানে। কাজেই আমরা ভােটারদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করি : সাধু সাবধান।
নির্বাচনে শামসুল হক বিপুল ভােটাধিক্যে জয়লাভ করেন। কিন্তু আজাদে এই জয়কে ‘অল্প সংখ্যক ভােটে” বলিয়া অভিহিত করার চেষ্টা হয়। সংবাদপত্রটির সেই একই সংখ্যায় আবার একথাও বলা হয় যে ভােটের সঠিক সংখ্যা এখনও জানা যায় নাই।১২ | নির্বাচন শেষ হওয়ার ঠিক পরই একটি ঘটনায় মােহন মিঞা, শাহ আজিজুর রহমান, সােলায়মান ও আলাউদ্দীনের সাথে জড়িত হয়ে পড়ার জন্যে শামসুল হক, মােস্তাক আহম্মদ এবং টাঙ্গাইলের একজন স্থানীয় ব্যক্তি বদিউজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। যে যুবক পুলিশ অফিসারটি তাদেরকে গ্রেফতার করেন তিনি জানান যে তাদের জামিনে মুক্তি লাভের কোনাে সম্ভাবনা নেই। কারণ তাদেরকে যাতে জামিন না দেওয়া হয় সেই মর্মে ঢাকা থেকে নির্দেশ এসেছে। এই খবর দেওয়ার সাথে তিনি শামসুল হক ও মােস্তাক আহম্মদকে উপদেশ দেন মােহন মিঞা, শাহ আজিজুর রহমান এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করতে ।১৩
সেই অনুসারে অগ্রসর হয়ে শামসুল হক পক্ষ পাল্টা মামলা দায়ের করার পরে সেই পুলিশ অফিসারটি মহকুমা হাকিম খুরশিদ আলমের বাসার উপস্থিত হন। সেখানে তখন মােহন মিঞা এবং অন্যান্যরা অতিথি হিসাবে অবস্থান করছিলেন। মহকুমা হাকিমকে পুলিশ অফিসারটি পাল্টা মামলার কথা জানান এবং মােহন মিঞাদেরকে ঐ একই কারণে গ্রেফতার করার প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করেন। এর উত্তরে মহকুমা হাকিম মোহন মিঞাদেরকে
জামিন দিতে নির্দেশ দিলে পুলিশ অফিসারটি তাকে জানান যে অন্যদেরকে একই ধরনের মামলায় জামিন না দেওয়ায় নির্দেশ আছে কাজেই সেই নির্দেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত অন্যদেরকে জামিন দেওয়া সম্ভব হবে না। এর পর অন্য উপায় না দেখে মহকুমা হাকিম সকলকেই জামিন নেওয়ার নির্দেশ দেন। সেই মামলা কয়েক বছর ধরে চলে এবং শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের একটা আপােষের মাধ্যমে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়।১৪
নির্বাচনে জয় লাভের পর ৮ই মে শামসুল হক ঢাকা পৌঁছাবেন এই সংবাদ পাওয়ার পর শওকত আলী, কমরুদ্দীন আহম্মদ, আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান প্রভৃতি সকলে মিলে তাকে সম্বর্ধনা জানানাের ব্যাপারে উদ্যোগী হন। কিন্তু কাদের সর্দার তাতে সম্মত না হয়ে আতাউর রহমানকে বলেন যে ঢাকাতে সে রকম কোনাে অনুষ্ঠানের প্রয়ােজন নেই। যা করতে হয় টাঙ্গাইলেই করা উচিত। একথা শুনে আতাউর রহমান স্থির করেন যে বেশী হাঙ্গামা না করে তারা কয়েকজন স্টেশনে গিয়ে শামসুল হককে নিয়ে আসবেন।
এই সময় মুসলিম লীগের গুণ্ডারাও মাজেদ সর্দারের নেতৃত্বে শামসুল হকের সম্বর্ধনার চেষ্টা করবে এই মর্মে তাদেরকে শাসাতে থাকে। এই সংবাদ পেয়ে শওকত আলী, কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান প্রভৃতি ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়িতে উপস্থিত হন এবং উপরােক্ত পরিস্থিতির মােকাবেলার উপায় সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলােচনা শুরু করেন। এই আলােচনা চলাকালে লতিফুর রহমান নামে একজন এ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাড়িতে তার সাথে দেখা করতে যান। ক্যাপ্টেন শাহজাহানের সাথে লতিফুর রহমানের বিশেষ বন্ধুত্ব ছিলাে। তিনি সবকিছু শােনার পর তাদেরকে এই মর্মে আশ্বাস দেন যে মাজেদ সর্দার তার অধীনে ঠিকাদারী করেন, কাজেই তিনি তাকে ধমক দিয়ে এই সর গুণ্ডামীর মধ্যে না যাওয়ার জন্যে বলে দেবেন। লুতিকর রহমান তার কথা রেখেছিলেন এবং তাঁর নির্দেশমতাে মাজেদ সর্দার শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনােপ্রকার গণ্ডগোল সৃষ্টি থেকে বিরত হন। শুধু তাই নয় মাজেদ সর্দার স্বীকারও করেন যে তাকে টাকা দিয়ে গণ্ডগােল সৃষ্টির জন্যে বলা হয়েছিলাে।
এর পর শামসুল হকের সম্বর্ধনার জন্যে যথারীতি সব ব্যবস্থা করা হয়। রেলওয়ে স্টেশন থেকে মিছিল সহকারে তাকে নবাবপুর রােড দিয়ে নিয়ে গিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে সকলে সমবেত হওয়ার পর সেখানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫
টাঙ্গাইল নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দৈনিক আজাদ আবার
একটি সুদীর্থ সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এই সম্পাদকীয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর মধ্যে শুধু যে মুসলিম লীগ সমর্থক একটি পত্রিকার মতামতই ব্যক্ত হয় তা নয়, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রাদেশিক সরকারের অন্তও তাতে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন’ শীর্ষক এই সম্পাদকীয়টিতে১৬ বলা হয় :
টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে লীগ মনােনীত প্রার্থী হারিয়া গিয়াছেন। ইহা মােসলেম লীগ নির্বাচনের ইতিহাসে এক অভিনব এবং অভাবিতপূর্ব ব্যাপার। কোনাে সাধারণ নির্বাচনের সময় যদি কোনাে একজন লীগ প্রার্থীর পরাজয় ঘটে, তবে তাকে এতখানি গুরুত্ব না দিলেও চলে। কারণ, তখন লীগের নির্বাচন জয়ের প্রচেষ্টা একই সঙ্গে বহুদিকে ছড়াইয়া দিতে হয়। কিন্তু একটা উপনির্বাচনের পরাজয়ের সময় একই ধরনের কৈফিয়ত দিয়া অব্যাহতি লাভ করা যায় না। তার পর বিভক্ত ও অবিভক্ত বাংলার লীগের ইতিহাসে কোনাে পরিষদীয় উপনির্বাচনে লীগ প্রার্থীর আর কোনাে দিন পরাজয় ঘটে নাই। জাতির আশা আকাঙ্খার প্রতীক এবং জাতির এক মাত্র বলিয়া বহুকীর্তিত লীগের ভাগ্যে এই কলঙ্ক স্পর্শ অত্যন্ত শােচনীয় ঘটনা। এক হিসেবে একে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রধান মর্মান্তিক ব্যাপার বলিয়া চিরকাল বেদনা এবং ক্ষোভের সাথে দেশের মানুষ স্মরণ করিবে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, কেন এইরূপ ঘটনা ঘটিল। পূর্ব বাঙলার লীগের বহু কষ্টে অজিত গৌরব আজ কেন এইভাবে কলঙ্কমলিন হইল ? এ প্রশ্ন আজ পূর্ব পাকিস্তানের কল্যাণকামী মানুষ মাত্রেই জিজ্ঞাসা না করিয়া পারেন না। আমাদের মনে হয় এ প্রশ্নের সদুত্তর পাইতে হইলে বহুদূরে যাইবার কোনাে দরকার নেই। একটু তলাইয়া দেখিলেই, একটা সত্য সকলের নিকট পরিষ্কার হইয়া যাইবে যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লীগের জীবন ও কার্যে এরূপ কতকগুলি ব্যাপার সংঘটিত হইয়াছে, যার ফলে লীগ তাহার জনপ্রিয়তা এবং আবেদনের অনিবার্যতা অনেকখানি হারাইয়া ফেলিয়ছে। পাকিস্তান আনিতে হইবেলীগের সে অতীত আবেদন আজও আর নাই, যদিও পাকিস্তান রক্ষা করিতে হইবে—এ আবেদন আজও অর্থপূর্ণ। কায়েদে আজমের অতুলনীয় নেতৃত্ব আজ আর নাই; যদিও কায়েদে আজমের অসমাপ্ত কাজের ভার তার স্বনামধন্য অনুসারী নেতাদের ঝতে পড়িয়াছে—পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত এবং
কায়েদে আজ পরলােকগত হওয়ার পর পাকিস্তানকে রক্ষা ও জনগণের ইচ্ছাকে অভিব্যক্তি দেওয়ার দায়িত্ব আজও লীগের : তবু সে দায়িত্ব আজ যথাযথ পালিত হইতেছে না। লীগের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং লীগ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারের ক্ষমতার লােভে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে, যাতে লীগের কার্যে ত্রুটি-বিচ্যুতি এবং গলা দেখা দিতেছে। জনগণের মােকাবেলা করে বিশেষভাবে আজ লীগ, কিন্তু সর্বব্যাপী ক্ষমতা পরিচালনা করে সরকার। সরকারের প্রভাব লীগের কার্যকলাপকে আজ সর্বত্র প্রভাবান্বিত করিতেছে—মায় উপনির্বাচনের প্রার্থী মনােনয়নের ব্যাপারে। ফলে নিজেদের বিশেষ ত্রুটি ও বিচ্যুতিরই নয়, সরকারী কাজের পাপের বােঝাও লীগকে সমানভাবে বহন করিতে হইতেছে। মােসলেম লীগ আজ সর্বত্র সরকারী ইচ্ছা ও অনিচ্ছার বাহন হইয়া দাড়াইয়াছে, জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছার লীগ আর বাহন নয়। এরই দরুন লীগ আজ জনপ্রিয়তা হারাইতে বসিয়াছে। যেদিন হইতে লীগ সরকারী ইচ্ছার প্রতিচ্ছবিতে পরিণত হইয়াছে সেদিন হইতে তার কার্যকলাপে যথেচ্ছাচার ও দোষ ত্রুটি নানাদিক হইতে আত্মপ্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। টাঙ্গাইলে লীগ প্রার্থী মনােনয়নেও ইহা লক্ষিত হইয়াছিল। জনমতের মুখ না চাহিয়া সরকারী মহলের ইচ্ছার জয়ই এক্ষেত্রে হইয়াছিল। আমরা কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলে লীগের জয়ই কামনা করিয়াছিলামকিন্তু মনােনয়নের ব্যাপারে যে প্রকাণ্ড ভুল হইয়াছিল, তা আজ না বলিয়া উপায় নাই। বেশ বুঝা গেল, বহুদিন হইতে বহু ব্যাপারে অনাচার চরমে উঠিয়াছিল এবং তাহাই জনসাধারণের ধৈর্যের বাধ হিড়িয়া দিয়াছে। এ সত্যই টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনের ভিতর দিয়া ঘােষিত হইল। টাঙ্গাইলের এই পরাজয় লীগের পরাজয় নিশ্চয়ই; কিন্তু ইহা এক হিসাবে সরকারের উপর অনাস্থা। নির্বাচনী প্রচার কার্যে পাঁচজন মন্ত্রীর উপস্থিতিও তার ফলাফলকে প্রভাবান্বিতও করিতে পারিল না—ঘটনার ইঙ্গিত আজ সকলকে গভীর ভাবে ভাবিয়া দেখিতে হইবে। টাঙ্গাইলের পরাজয়কে এক প্রকাণ্ড বিপদ সংকেত বলিয়া সকলকে আজ গ্রহণ করিতে হইবে। লীগের বিরুদ্ধে উত্তোলিত বিদ্রোহের পতাকা একদিন সমগ্র পাকিস্তানকে আচ্ছন্ন করিবে কিনা, লীগ এবং পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন ও বিধ্বস্ত হইবে কি না, একথাও হয়ত এখন হইতেই চিন্তা করিতে হইবে। শুধু চিন্তা নয়, আজ ইহা সকল লীগপন্থীকে চন্মিলনের সাহায্য করুক—ইহাই আমাদের প্রার্থনা।
আমাদের পাপ কোথায়, গলদ কোত্থানে তারই ক্ষমাহীন সন্ধান ও কঠোর প্রতিকারের সঙ্কল্প আজ প্রত্যেক লীগস্থীকে ১ হণ করিতে হইবে। চামরার সঙ্কট-সঙ্কেত যদি আজ ইহা হইতে গ্রহণ করিতে না পারে তবে আমাদের বিষয়কে কেউ ঠেকাইতে পরিবে না। লীগকে সকল দুর্বলতা, সকল প্রভাব এবং পতন অলনের হাত হইতে মুক্তি দানের অনিবার ইচ্ছা আজ জাতির মনে জাগিয়া উঠুক। লীগ পুনরায় তােক সত্যিকারের জনগণের প্রতিষ্ঠান এবং লীগ আজ আবার পরিচালনা করুক সরকারকে। লীগের ভিতর আবার শিখার মতাে আলিয়া উঠুক জাতির ইচ্ছাশক্তি। এবং তারই সাথে পূর্ব মহিমায় লীগের প্রতিষ্ঠা হােক জনগণের মনে। আজাদের উপরােক্তৃত সম্পাদকীয়টিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি আকরাম খানকে বাঁচিয়ে শুধুমাত্র প্রাদেশিক সরকারের উপর দোষারােপ করা হয়। সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনের উপর একটি প্রবন্ধে ৬ই মে, ১৯৪৯, সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ নিম্নলিখিত মন্তব্য করে : টাঙ্গাইলের সবচেয়ে জাঁদরেল প্রভাবশালী জমিদার, ঘাঁর পূর্ব পুরুষ কলেজ ও অন্যান্য মহান প্রতিষ্ঠান করেছেন তাকে সামান্য একজন নিঃস্ব কর্মী পরাজিত করেছেন–সুতরাং জমিদারী বা তালুকদারী শাসন যে চলবে না তা বলাই বাহুল্য। আজাদ বলেছে, এ নির্বাচন সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে। আমরা বলি এ নির্বাচন সভাপতিসহ লীগ নেতাদের প্রতি দৃঢ় অনাস্থা জানিয়েছে। আরও জানিয়েছে—বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদই জনগণ চায়।•••শোনা যায় চাটগাঁ উপনির্বাচনে লীগ প্রার্থীর নিশ্চিত পরাজয় হবে জেনেই লীগ কর্তৃপক্ষ নির্বাচন ঘােষণা করছেন না। কিন্তু এভাবে কতদিন আত্ম বা স্বার্থ রক্ষা করা চলবে? টাঙ্গাইল নির্বাচন লােকের চোখ খুলে দিয়েছে। এখন সরকারী প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাড়াতে বা ভােট দিতে কেউ দ্বিধা বা ভয় করবে না। টাঙ্গাইলে মন্ত্রীরাও গিয়েছিলেন সরকারী টাকা খরচ করেই। কিন্তু যে লীগ মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে ছাত্র-কৃষক-মজুরের জিন্দাবাদে সকল স্থান মুখরিত হত, সে মন্ত্রীরাও সেখানে দারুণভাবে অপমানিত, ও অপদস্থ হয়েছেন। শুধু তাই নয় মন্ত্রীদের সব কয়টি সভাই শামসুল হকের মিটিং-এ পরিণত হয়েছে।
নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু শামসুল হককে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। মৌলানা ভাসানীর মতাে তার বিরুদ্ধেও একটি নির্বাচনী মামলা দায়ের করা হয়। প্রাদেশিক সরকার বিচারপতি
240
আমীনউদ্দীন আহমদ, এনায়েতুর রহমান এবং শহরউদ্দীনকে নিয়ে একটি বিশেষ ট্রাইবুনালের গঠন করেন এবং সেই ট্রাইবুনালের উপর নির্বাচন মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হয়। ট্রাইবুনাল তাদের প্রথম বৈঠকেই স্থির করেন যে মামলাটির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচিত প্রতিনিধি শামসুল হক ব্যবস্থাপক সভায় আসন গ্রহণ করতে পারবেন না।
| একটি নির্বাচনী ইস্তাহারকে ভিত্তি করে টাঙ্গাইল নির্বাচনে শামসুল হকের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করানাে হয়। মৌলানা ভাসানী আসাম থেকে চলে আসার পর ময়মনসিংহের টাঙ্গাইল মহকুমার কাগমারী গ্রামে বসবাস আরম্ভ করেন এবং টাঙ্গাইল থেকেই পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচন বাতিল হওয়ার পর বন্ধু-বান্ধব ও মুরিদদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে তিনি আসাম প্রদেশের ধুবড়ী শহরে উপস্থিত হলে আসাম সরকার মার্চ মাসের মাঝামাঝি তাকে গ্রেফতার করে। টাঙ্গাইলের দ্বিতীয় উপনির্বাচনের সময় ভাসানী ধুবড়ী জেলে অবস্থান করছিলেন। হজরত আলী নামে শামসুল হক সমর্থক একজন কর্মী সেখানে ভাসীনীর সাথে সাক্ষাৎ করে শামসুল হকের সপক্ষে একটি ইস্তাহারে তার স্বাক্ষর নিয়ে আসেন। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ভাসানীর স্বাক্ষরযুক্ত সেই ইস্তাহার বিলির ব্যবস্থা আরম্ভ হলে কমরুদ্দীন আহমদ প্রভৃতি তৎক্ষণাৎ সেগুলি বিলির ব্যবস্থা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে ছাপা ইস্তাহারগুলি নষ্ট করে দেন। কিন্তু তার পূর্বেই বেশ কিছু সংখ্যক ইস্তাহার নির্বাচনী এলাকায় বিলি হয়ে গিয়েছিলাে। ইস্তাহারটিতে ভাসানীর স্বাক্ষরের ফ্যাক্সিমিলি পর্যন্ত ব্লক করে দেওয়া হয়েছিলাে।১৮
ইস্তাহারটির বিলি বন্ধ করার নির্দেশ সত্ত্বেও তার কপি মুসলিম লীগ কর্মী ও সরকার পক্ষীয় লোকদের হস্তগত হয়। এবং নির্বাচনের ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পর এই মর্মে তারা শামসুল হকের নির্বাচন বাতিলের আবেদন করে যে নির্বাচনে তিনি ভাসানীর স্বাক্ষর জাল করে জয়লাভের উদ্দেশ্যে অসং পন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা আরও বলে যে মৌলানার স্বাক্ষরযুক্ত ইস্তাহার যখন জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত হয়নি তখন সেই ইস্তাহার যে নিতান্তই জাল সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
এই নির্বাচনী মামলা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে এবং শহীদ সুহরাওয়ার্দী ট্রাইবুনালের সামনে শামসুল হকের পক্ষে সেই মামলায় আবির্ভাবের উদ্দেশ্যে ঢাকা আসেন। এই সময় ১৯শে জুলাই, ১৯৫০, প্রাদেশিক সরকারের
নির্দেশে স্বরাষ্ট্র দফতরের সেক্রেটারী তাঁকে জানান যে ঢাকায় অবস্থানকালে। তাকে নিজের কার্যাবলী ইলেকশান ট্রাইবুনালের ব্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ঢাকা শহরের বাইরে তিনি অন্য কোনাে জায়গায় যেতে। অথবা কোনাে জনসভাতে বক্তৃতা দান করতে পারবেন না। ট্রাইবুনালের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২৮শে জুলাইয়ের মধ্যে তাকে পূর্ব বাঙলা পরিত্যাগ করতে হবে। এবং সরকারের এইসব নির্দেশ অমান্য করলে তাঁকে গ্রেফতারও করা প্রয়ােজন হতে পারে। প্রাদেশিক সরকারের এই। নির্দেশপত্র পাওয়ার পর সুহরাওয়াদী সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের কাছে বলেন। যে তিনি পাকিস্তানের উন্নতি ও মঙ্গল কামনা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান। সরকার গণতন্ত্রের মূলনীতিকে কেন যে উপেক্ষা করে চলেছেন তার কারণ উপলব্ধি করতে তিনি অক্ষম।২০।
বৎসরাধিককাল টাঙ্গাইল নির্বাচনী মামলা চলার পর তার রায় বের হয়। এবং শামসুল হকের নির্বাচনকে ট্রাইবুনাল বাতিল ঘােষণা করেন।
এই নির্বাচনের পর পাকিস্তান দেশীয় রাজ্য মুসলিম লীগের সভাপতি মনজুর আলম করাচীতে এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন যে পূর্ব বাঙলার। একটি উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীর পরাজয় খুবই অর্থপূর্ণ। মুসলিম লীগ যে আর সকল মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করে না এই নির্বাচনই তা প্রমাণ। করেছে। সাংবাদিক বৈঠকটিতে মনজুর আলম পাকিস্তান গণপরিষদ, প্রাদেশিক আইন সভা ও মুসলিম লীগের নােতুন নির্বাচন দাবী করেন। | প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে লীগ প্রার্থীর শােচনীয় পরাজয়ের পর পূর্ব বাংলার বহু এলাকাতে উপনির্বাচনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিলেও ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে নূরুল আমীন সরকার পরাজয়ের আশঙ্কায় অন্য কোনাে এলাকাতেই উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেননি।
৪। মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ সংকট
মুসলিম লীগ সংগঠনকে ব্যক্তিগত ও উপদলীয় স্বার্থে কুক্ষীগত রাখার ফলে তার মধ্যে যে আভ্যন্তরীণ সংকট শুরু হয় টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ঘটে তার প্রথম বহিঃপ্রকাশ। পুরাতন পরীক্ষিত কর্মী এবং নােতুন উৎসাহী। লােজনের অভাবে মুসলিম লীগ সংগঠনগতভাবে নিতান্ত দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সরকারী কীর্তিকলাপের বােয় ভারাক্রান্ত হয়ে সেই সংকট এক তীব্র
আকার ধারণ করে।
এই অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী সংবাদপত্র মারফৎ জানান যে ১৮ই এবং ১৯শে জুন বিকেল ৩টায় কার্জন হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই সভায় আলােচ্য বিষয় হিসাবে উল্লিখিত হয় : (১) গত সভার কার্য বিবরণীর অনুমােদন, (২) সাধারণ সম্পাদকের রিপোের্ট, (৩) কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থা, (৪) দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা (৫) সংগঠন এবং (৬) বিবিধ। এ ছাড়া কোনাে সদস্য যদি কোনাে প্রস্তাব উত্থাপন করতে ইচ্ছুক হন তাহলে তাকে নিজের প্রস্তাব পরবর্তী ১৫ই জুনের পূর্বে ১৭৬ নং নবাবপুর রােডে কেন্দ্রীয় লীগ অফিসে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্যে অনুরােধ জানানাে হয়। | লীগ কাউন্সিলের এই সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে প্রাদেশিক সভাপতি আকরাম খান কাউন্সিল এবং ওয়ার্কিং কমিটিতে বিবেচনার জন্যে তার পদত্যাগ পত্র দাখিল করেন। টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে সরকারী লীগ | প্রার্থীর শােচনীয় পরাজয়ের পর আকরাম খানের সংবাদপত্র আজাদ যে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন তার মধ্যেই মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ সংকটের কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। প্রাদেশিক সভাপতির পদত্যাগ প্রতিষ্ঠানটির এই সংকটেরই যে অনিবার্য পরিণতি পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশনে তা ভালােভাবে প্রমাণিত হয়। | ১৮ই জুন অর্থাৎ কাউন্সিলের অধিবেশন শুরু হওয়ার দিনে দৈনিক আজাদ ‘কাউন্সিলের অধিবেশন’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন। তাতে প্রথমদিকে সম্মেলনের সাফল্য কামনা এবং ‘লীগের দুষমনদের’ | কার্যকলাপের উপর মন্তব্য প্রকাশের পর সভাপতির পদত্যাগ সম্পর্কে বলা| বলা হয় :
প্রসঙ্গতঃ এখানে জনাব মৌলানা মােহম্মদ আকরাম খাঁ সাহেবের পদত্যাগপত্রের কথাও আলােচিত হওয়ার যােগ্য মনে করি। সুদিনে দুদিনে | লীগের জন্মদিন হইতে জনাব মৌলানা সাহেব লীগের সাথে যুক্ত আছেন, এবং কখনও সৈনিক হিসাবে এবং কখনও তার অগ্রভাগে দাড়াইয়া সংগ্রাম করিয়া আসিয়াছেন। সুতরাং তার প্রাদেশিক লীগ সভাপতির পদত্যাগের অর্থ লীগের সাথে তার বিযুক্তি নয় মােটেই। তার সাহায্য সহানুভূতি এবং সেবা হইতে লীগ কখনও বঞ্চিত হইবে না, হইতেও পারে না। তিনি
ধীরভাবে বিবেচনা করিয়া আজ পদত্যাগের যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাতে লীগের অকল্যাণকর কিছুই তিনি কামনা করেন নাই। হয়ত লীগের অধিকতর কল্যাণের জন্যই তা তিনি করিয়াছেন। তিনি হয়তাে মনে করেন সভাপতি হিসাবে লীগের সেবা করার চাইতে লীগের সাথে সাধারণভাবে সংশ্লিষ্ট থাকিয়া তিনি লীগের অধিকতর সেবা করিতে পারিবেন। কাজে কাজেই তার এ সিদ্ধান্তকে আমরা অভিনন্দিতই করিতেছি।
আকরাম খানের পদত্যাগপত্র এবং এবং আজাদের এই সম্পাদকীয় মন্তব্য সত্বেও কাউন্সিলের অধিবেশন এবং তার পরবর্তী পর্যায়ের ঘটনাবলী’ থেকে শুধু একথাই বিশেষভাবে প্রমাণিত হয় যে আকরাম খান সত্য অর্থে প্রাদেশিক লীগ সভাপতির পদ পরিত্যাগ করতে মােটেই আগ্রহী ছিলেন না। কাউন্সিলের সভায় লীগের সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে তুমুল বাকবিতণ্ডা ও গণ্ডগােলের সম্ভাবনা তিনি পূর্বেই অনুমান করেছিলেন এবং সেই সভায় সভাপতিত্ব করতে গিয়ে সাধারণ সদস্যদের মােকাবেলা করার সাহস তার ছিলাে না। এ কারণেই পদত্যাগ পত্র দাখিল করে সেই দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে পশ্চাৎ যার দিয়ে আবার সভাপতির পদে বহাল হওয়ার ষড়যন্ত্রের মধ্যেও তিনি কোনাে ত্রুটি রাখেননি। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ইতিহাসে তার এই পদত্যাগপত্র দাখিলের ব্যাপারটি কোনাে নােতুন কথা ছিলাে না। অবস্থা বুঝে একাধিকবার তিনি সে কাজ করেছিলেন এবং সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার পর সভাপতির পদে পুনর্বহালও হয়েছিলেন।
আজাদের পূর্বোক্ত সম্পাদকীয়টির বক্তব্য আকরাম খানের পদত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলাে না। মুসলিম লীগের আভ্যন্তরীণ অন্যান্য সংকট সম্পর্কে তাতে বলা হয় :
নূতন করিয়া পাকিস্তানে লীগ গঠিত হইতেছে। কিন্তু গড়িয়া উঠিতে না উঠিতেই লীগের ভিতর ভাঙ্গনও ধরিয়াছে। সীমান্ত, পশ্চিম পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর লীগেও নানারূপ বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছে, এবং বাহির হইতে দেখিলে পূর্ব পাকিস্তানকে যদিও খুব শান্ত এবং সংহত দেখা যায়, তথাপি এখানেও ভিতরে গােলমাল আছে। ফলে এখানে লীগ ও লীগের গভর্নমেন্ট জনপ্রিয়তা হারাইতে বসিয়াছে। পরিস্থিতির এই ক্রমবর্ধমান অবনতিকে রােধ করিতে হইবে। একাধিক সাম্প্রতিক ঘটনায় ইহা প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে যে, আজ আত্মশুদ্ধির নির্মম ব্যবস্থা অবলম্বন না করিলে দেশবাসীর অসন্তোষ ক্রমেই ব্যাপক হইতে ব্যাপকতর হইয়া উঠিবে এবং পরিণামে
লীগ ও লীগের মন্ত্রিসভার ধবংসই হয়তাে অনিবার্য হইয়া উঠিবে। আমরা অতীতে একাধিকবার এজন্য লীগ ও মন্ত্রিসভাকে লক্ষ্য করিয়া সতর্ক বাণী উচ্চারণ করিয়াছি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে স্বীকার করিতে হইবে যে, আমাদের সতর্কবাণীর বাঞ্চিত প্রতিক্রিয়া হয় নাই। যাহােক অতীতের ব্যাপার ঘটাইয়া কোনাে লাভ নাই। এবারকার লীগ কাউন্সিল ঘদি আত্মশুদ্ধির ব্যবস্থা করিতে পারেন, তবেই আত্মরক্ষার পথ আবিষ্কার হবে।
প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভায় যােগদানের উদ্দেশ্যে ১৮ই জুন ঢাকা উপস্থিত হলে এ. পি. পি.-র প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামান বিভিন্ন বিষয়ে তার মন্তব্য ব্যক্ত করেন। মুসলিম লীগের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন যে অতীতে তাদেরকে বহু বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সে বাধা তারা উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভবিষ্যতেও নানা বাধা বিপত্তিকে সেইভাবেই অতিক্রম করতে হবে। যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার বলে মুসলমানরা পাকিস্তান অর্জন করেছে তার দ্বারাই তারা ভবিষ্যতে রাষ্ট্রের ঐক্য রক্ষা করবে।
টাঙ্গাইলের উপনির্বাচন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আসল ব্যাপার সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলেন যে, মুসলিম লীগ জনগণের আস্থা হারিয়েছে একথা ঠিক নয়। কেন্দ্রে ও প্রদেশে মুসলীম লীগ সরকারের একদলীয় শাসন অব্যাহত আছে এবং সরকার সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সর্বত্র জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে মুসলমানদের ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য একই এবং এ দুটোকে পৃথক করা চলে না। এ প্রসঙ্গে মুসলীম লীগের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার একটি উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে জমিদার ও রায়তের মধ্যেকার সম্পর্ক নির্ধারণের জন্যে ইতিপূর্বে মুসলিম লীগ কর্তৃক একটি কৃষি কমিটি নিযুক্ত হয়েছে।
আলােচনার উপসংহারে খালিকুজ্জামান বলেন যে মুসলিম লীগ ও শাসনযন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যে এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ নীতি নির্ধারণের কাজে মুসলীম লীগের উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণের উদ্দেশ্যে শাসন যন্ত্রের রাজনৈতিক বিভাগসমূহের সাথে লীগের উপদেষ্টা কমিটিসমূহের ঘনিষ্ঠ যোগাযােগ রক্ষার ব্যবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয়।
১৮ই জুন, মঙ্গলবার, বিকেল ৩টার সময় কার্জন হলে এক উত্তেজনাময় পরিবেশের মধ্যে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। সেই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান লীগের সহ-সভাপতি
245
মৌলানা আবদুলা হিল বাকী। চারশাের বেশী কাউন্সিল সদস্যের মধ্যে প্রায় নিশো জন সভায় যােগদান করেন। চৌধুরী খালিকুজ্জামান সেদিন উপস্থিত ছিলেন।’
সভাস্থলে সাংবাদিকদেরকে প্রবেশ করতে না দেওয়ার জন্যে প্রথম দিকেই গণ্ডগােল শুরু হয়। সাংবাদিকদের প্রতি এই মনােভাবের কারণ সম্পর্কে সাধারণ সদস্যেরা কৈফিয়ৎ দাবী করলে সভাপতি তাদের জানান যে প্রাদেশিক লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক সাম্প্রতিক প্রস্তাবানুযায়ী এজাতীয় সভায় সাংবাদিকদেরকে প্রবেশ না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সদস্যেরা কিন্তু এই জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে মঞ্চে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ এবং অন্যান্যদের সাথে এক বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হন। এইভাবে কয়েক ঘণ্টা আলােচনার পর সাংবাদিকদেরকে সভাগৃহে প্রবেশ করতে দেওয়ার প্রস্তাবটি ভােটে দেওয়া হলে বিপুল ভােটাধিক্যে তা গৃহীত হয়। প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভােট পড়ে মাত্র ১২টি।১০
এরপর সাংবাদিকেরা সভাগৃহের ভেতরে প্রবেশ করেন। কিন্তু আসরের নামাজের সময় হওয়ায় সভা কিছুক্ষণের জন্যে মূলতবী থাকে। নামাজের পর আবার কাজ আরম্ভ হলে প্রথমে যুগ্ম-সম্পাদক শাহ মহম্মদ আজিজুর রহমান বিগত অধিবেশনের কার্যবিবরণী পাঠ করেন এবং তা যথারীতি গৃহীত হয়। এর পর প্রাদেশিক লীগ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী তার লিখিত রিপাের্ট পেশ করেন।১২ | রিপাের্টটিতে তিনি বলেন যে লীগ ওয়ার্কিং কমিটি পাকিস্তান থেকে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে ব্যবস্থাপক সভার পরবর্তী অধিবেশনেই জমিদারী প্রথা বিলােপ করার জন্যে প্রাদেশিক সরকারকে অনুরােধ জানিয়েছেন।
টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয়ের সত্যিকার গুরুত্বকে ঢাকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন যে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ৪টি এবং কেন্দ্রীয় গণ-পরিষদের ২টি আসনে উপ-নির্বাচন হয়েছে। তার মধ্যে ৪টিতে লীগ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া গণ-পরিষদের নির্বাচনে লীগ প্রার্থী শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করে জয়লাভ করেছেন বলেও তিনি কাউন্সিলকে জানান।
এর পর টাঙ্গাইলের পরাজয় প্রসঙ্গে কৈফিয়ৎ স্বরূপ তিনি বলেন যে তাঁদের নিজেদের কিন্তু গাফিলতি, জয়লাভের নিশ্চয়তা এবং প্রতিপক্ষের সুযােগ-সুবিধা
প্রাচুর্যই সেই বিপর্যয়ের কারণ! লীগ সম্পাদকের রিপাের্টে উপনির্বাচনটি সম্পর্কে উপরােক্ত মন্তব্য যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন সেকথা বলাই বাহুল্য।
ইউসুফ আলি চৌধুরী তার রিপাের্টে এর পর বলেন যে পাকিস্তানকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হলে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে মুসলিম লীগের পশ্চাতে সকল শক্তি নিয়ােগ করে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, সাম্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে মুসলমানদের মধ্যে একতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর একতা হ্রাস পেয়েছে বলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি উপস্থিত কাউন্সিলরদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে মুসলিম লীগই মুসলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্বাস, ঐক্য ও শৃঙ্খলা হচ্ছে তাদের লক্ষ্য।
সাধারণভাবে এসব কথা বলার পর লীগ সম্পাদক কতকগুলি অসুবিধার ব্যাপারে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তার মধ্যেই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান ও সরকারের দ্বন্দ্ব ও আভ্যন্তরীণ সংকটের পরিচয় উদ্ঘাটিত হয়। | সাংগঠনিক অক্ষমতার বিষয় উল্লেখ করতে গিয়ে ইউসুফ আলী চৌধুরী বলেন যে এদেশিক লীগ সম্পাদক হিসাবে নিজের কর্তব্য তিনি সন্তোষজনকভাবে সম্পাদন করেছেন এ দাবী করার ক্ষমতা তার নেই। প্রতি পদক্ষেপে তাকে নানা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলেও তিনি জানান। সরকারী সহায়তা ছাড়া কোন বাড়িঘর পাওয়া সম্ভব নয় এবং সেই সহযােগিতার অভাবে তার পক্ষে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিসঘর পর্যন্ত স্থাপন সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লীগের তহবিল একেবারে শূন্য বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এর পর সর্বশেষে তিনি সরাসরিভাবে মুসলিম লীগ ও সরকারের মধ্যে সহযোগিতার অভাব প্রসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে সহযােগিতার অভাব সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করা চলে না যে সরকার মুসলিম লীগের সৃষ্টি এবং তাকে জনপ্রিয় রাখার দায়িত্ব সরকারকে অবশ্যই পালন করতে হবে।
জনগণ থেকে মুসলিম লীগ ১৯১৯ সালেই কতখানি বিচ্ছিন্ন প্রাদেশিক লীগ সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী প্রকৃতপক্ষে তার উপরােক্ত রিপাের্টে তারই একটি সঠিক ও সুস্পষ্ট হিসাব দাখিল করেন। এবং এই বিচ্ছিন্নতার চিত্র কউন্সিল অধিবেশনের পরবর্তী পর্যায়ে অধিকতর স্পষ্টভাবে উদ্ঘাটিত হয়। | প্রাদেশিক সম্পাদক তার রিপাের্ট পেশ করার পর বহু সদস্য কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে সেগুলির উত্তর দাবী করেন। সেই সব প্রশ্নের মধ্যে প্রাদেশিক সভাপতি আকরাম খানের পদত্যাগের কারণ,
প্রাদেশিক লীগের গঠনতন্ত্র রচিত না হওয়ার কারণ, টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের সর্বশক্তি নিয়ােজিত না হওয়ার কারণ, মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বাের্ড গঠিত না হওয়ার কারণ, পূর্ব পাকিন্তান থেকে ভারতে ড্রাম চালান দেওয়া সম্বন্ধে ট্রাইবুনাল নিযুক্ত না হওয়ার কারণ ইত্যাদি উল্লেখ যােগ্য। এ ছাড়া আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন হলো ভাল কাজ করলে কর্মীদেরকে কমিউনিস্ট আখ্যা দেওয়া হয় কেন ? লীগ এম. এল. এ.-রা দুর্নীতির আশ্রয় নেয় কেন? ইস্পাত ড্রাম নিয়ে জনৈক মন্ত্রী যে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন তার তদন্ত হয় না কেন? টাঙ্গাইলের অযৌক্তিক নমিনেশন দেওয়ার জন্যে দায়ী কে? জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্যান্য সরকারী কর্মচারীদের লীগ সদস্য অপমান করে কেন? বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথা রহিত হয় না কেন?১৪
সাধারণ সদস্যবৃন্দের উপরােক্ত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে লীগ কর্তৃপক্ষ, বিশেষতঃ অধিবেশনের সভাপতি মৌলানা বাকী প্রশ্নগুলির জবাবদানের ব্যাপার সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক ‘গণতান্ত্রিক উপায় উদ্ভাবন করেন। তিনি কোনাে সদস্যকে প্রশ্ন করতে বাধা দেওয়া তাে দূরের কথা প্রত্যেককেই যথেচ্ছভাবে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করায় প্রশ্ন করতে করতে মগরিবের নামাজের সময় উপস্থিত হয়।১৫ এর ফলে সদস্যের প্রশ্নের বােঝা খালি করা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ সময়ের অভাবে সেদিন সেগুলির জবাব দান স্থগিত রেখে পরদিন সে বিষয়ে আলােচনা হবে বলে ঘােষণা করেন।১৬
এরপর প্রত্যেক জেলা থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সর্বসম্মতিক্রম। একটি বিষয় নির্বাচনী কমিটি গঠিত হয়। জেলা প্রতিনিধি ছাড়াও প্রাদেশিক লীগের কর্মকর্তারা পদাধিকার বলে সেই কমিটির সদস্য হন।১৭ । | এই কমিটি গঠিত হওয়ার পর সভাপতি ঘােষণা করেন যে চৌধুরী খালিকুজ্জামান বিশ্বের মুসলিম দেশসমূহের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে বক্তৃতা করবেন। ইতিমধ্যে সভাগৃহে একথা প্রচারিত হয় যে মৌলানা আকরাম খানকে আবার পশ্চাদার দিয়ে প্রাদেশিক লীগের সভাপতির পদে বহাল করার জন্যে কর্তৃপক্ষ মহল তৎপর | ড্রাম চালান দেওয়ার ব্যাপারে তৎকালীন অর্থ দফতরের মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী জড়িত ছিলেন। সে সময়ে তার বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হয় এবং লীগ বিরােধীরা সেগুলি টাঙ্গাইল নির্বাচনের সময়েও প্রচারণার কাজে লাগান।
হয়েছেন এবং খালিকুজ্জামান সেই উদ্দেশ্যে সম্মেলনের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবেন। | এর ফলে কাউন্সিলারদের মধ্যে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং উপরােক্ত ঘোষণার পর কয়েকজন সদস্য বক্তৃতা মঞ্চের উপর উঠে দাবী করেন যে চৌধুরী খালিকুজ্জামানের বক্তৃতার পূর্বেই প্রাদেশিক লীগ সভাপতি মৌলানা আকরাম খানের পদত্যাগ সম্পর্কে আলােচনা করতে হবে। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কয়েকজনসদস্য আপত্তি জ্ঞাপন করলে কার্জন হলের মধ্যে তুমুল হট্টগােলের সৃষ্টি হয়। কোনাে প্রকার শৃঙ্খলা রক্ষা না করে বহু সদস্য বক্তৃতামঞ্চে আরােহণ করে সচীৎকারে বক্তৃতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। অবস্থা আয়ত্বে আনার উদ্দেশ্যে সভাপতি আবদুল্লা হিল বাকী কিছু বলার চেষ্টা করলে একজন সদস্য তার সামনে থেকে মাইক সরিয়ে নেন। অপর একজন পূর্ববর্তী সদস্যের এই আচরণে আপত্তি জানালে গণ্ডগােল আরও বৃদ্ধিলাভ করে।
গােলমালের মধ্যে কয়েকজন সদস্য মঞ্চের উপর থেকে নীচে পড়ে যান। করকটি ফুলের টবও মেজের উপর পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়। এই পরিস্থিতিতে উত্তেজিত অবস্থায় সমবেত কাউন্সিলাররা প্রায় সকলেই নিজেদের আসন থেকে উঠে দাড়ান এবং সভাগৃহে এক দারুণ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। অবস্থা কোনে, ক্রমেই আয়ত্বের মধ্যে আনতে সমর্থ না হয়ে সভাপতি পরনি পর্যন্ত সভা মূলতুবী ঘােষণা করেন।২২
কাউন্সিলের অধিবেশন সেদিনের মতাে মূলতুবী ঘােষিত হওয়ার পর সন্ধ্যাবেলা শতাধিক সদস্য কার্জন হল প্রাঙ্গণে একটি প্রতিবাদ সভায় মিলিত হন।২৩ এদের মধ্যে বরিশাল জেলা লীগ সম্পাদক মহীউদ্দীন আহমদ, বরিশাল জেলা বাের্ডের সদস্য শাহজাহান চৌধুরী, মহম্মদ ওয়াসেক, মাহবুবুল হক প্রভৃতি লীগ নেতারাও ছিলেন।২৪ সমবেত সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে সভার জন্যে যে সমস্ত ভলান্টিয়ার জড়ো করা হয়েছিলাে তাদের অনেকেই ছিলাে গুণ্ডা প্রকৃতির এবং হলের ভিতর গণ্ডগােলের সময় তারাই বরিশালের মহীউদ্দীন আহমদ ও শাহজাহান চৌধুরীকে ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। গুণ্ডাদের সাহায্যে সভা আয়ত্বে রাখার ক্ষেত্রে লীগ নেতা ও মন্ত্রীদের ভূমিকা সম্পর্কেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। সভা আরম্ভ হওয়ার পর বক্তারা আলোচনা প্রসঙ্গে সেখানে বলেন যে গুণ্ডাকৃতির লোকের ভলান্টিয়ার করা এবং লীগ সদস্যদেরকে তাদের দ্বারা অপমাণিত করা মুসলিম লীগের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।২৫
অনেকে এই সব কথায় উত্তেজিত হয়ে কাউন্সিলের পৰবৰ্তী অধিবেশন বর্জন করার প্রস্তাব আনেন।২৬ কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতিপয় কাউন্সিল সদস্যের অন্যায় ও অভদ্র কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণ এবং পরদিন সভায় যােগদান করে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর প্রতিবাদ সভার কাজ শেষ হয়।
পরদিন রবিবার ১৯শে জুন বেলা ১০টায় অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার কথা ছিলাে। সেই অনুসারে নির্ধারিত সময়মতাে প্রায় একশাে জন কাউন্সিলার কার্জন হল প্রাঙ্গণে সমবেত হন এবং বহুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে শােনা যায় যে কোনাে এক অজ্ঞাত কারণে কর্তৃপক্ষ সভার সময় বেলা ১-৩০ মিঃ পর্যন্ত পিছিয়ে দিয়েছেন।৩০
কিছু সংখ্যক কাউন্সিলার এবং সাংবাদিক সমবেত সদস্যদের সাথে আলাপআলােচনা প্রসঙ্গে বলেন যে পূর্বদিনের মতাে সেদিনকার অধিবেশনে আর কোনাে গণ্ডগােল হবে না। নেতারা যা বলবেন এবার সেই মতাে কাজ হবে। এর কারণ হিসাবে তারা উল্লেখ করেন যে পূর্ব রাত্রিতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ, মন্ত্রীবর্গ, আকরাম খান ও নবাববাড়ির নেতাদের মধ্যে গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমস্ত রাত্রি নেতাদের মােটর-ট্যাক্সী অলিতে-গলিতে গিয়ে প্রত্যেক সদস্যকে ‘ঠাণ্ডা করেছে। তার উপর সেদিন বিকেলেই প্রাদেশিক সম্পাদক ইউসুফ আলী চৌধুরী কাউন্সিলারদেরকে এক চা চক্রে আপ্যায়িত করার ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং এত কিছুর পর লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে আর কোনাে প্রতিবাদের সম্ভাবনা নেই একথা ধরে নেওয়াই স্বাভাবিক।৩১
এই সব আলােচনা চলাকালে সদস্যের সমালােচনা প্রসঙ্গে আরও অনেক কিছু বলেন। একজন মন্তব্য করেন যে যারা বেশী উত্তেজিত অবস্থায় লাফালাফি করছে তাদের মধ্যে অনেকেই দুনীতিপরায়ণ। একজনের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে অন্য একজন বলেন যে মন্ত প্রগতিশীলের অভিনয় করলেও আসলে তিনি কালােবাজারীতে সিদ্ধহস্ত। অন্য একজন বলেন যারা গণ্ডগােল করছে আসলে তারা কিছুই নয়, কেরােসিন তেল বা টিনের পারমিটের আশ্বাস পেলে তারা সকলেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে শতকরা নব্বইজন জমিদার, জোতদার, ব্যবসায়ী। সুতরাং হাওয়া কোনদিকে বইবে তা সহজেই অনুমান করা চলে।৩২ | দ্বিতীয় দিন সভায় কাজ কিন্তু বেলা ১-৩০ মিনিটেও শুরু করা হয় সম্ভব হয়নি। সভাপতি মৌলানা বাকী সময়মতাে উপস্থিত হলেও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের

250
অনুপস্থিতির কারণে সভার কাজ আরম্ভ হতে আরও দেড় ঘন্টা বিলম্ব ঘটে। এই বিলম্বের ফলে সমবেত কাউন্সিলর নানা বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করলেও সভার কাজ শান্তিপূর্ণভাবেই শুরু হয়।৩৩
প্রথমেই সভাপতি আবদুল্লা হিল বাশী একটা ছোেট বক্তৃতা দেন। এই প্রসঙ্গে তিনি কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদে প্রকাশিত পূর্বদিনের অধিবেশনের রিপাের্টের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে তার একাংশ পাঠ করে শােনান এবং বলেন যে পত্রিকাটি বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে কাউন্সিল অধিবেশন সম্পর্কে বিকৃত বিবরণ পরিবেশন করেছে।৩৪ প্রেস প্রতিনিধিদের উপস্থিতি নিয়ে অধিবেশনে পূর্বদিনের বিতর্ক প্রসঙ্গে ইত্তেহাদের উপরােক্ত বিবরণটিতে বলা হয় :
অধিকাংশ সদস্য প্রেস প্রতিনিধিকে বৈঠকে উপস্থিত হইতে দিবার দাবী। জ্ঞাপন করেন। কতিপয় মন্ত্রী ও সভাপতি মওলানা আবদুল্লাহ আল বাকী সাহেব আবেদন করেন যে এই বৈঠকে অনেক গােপনীয় বিষয় আলােচনা হইবে এবং দোষ-ত্রুটি পৃথিবীর বহু জনগণের সম্মুখে প্রকাশিত হইয়া পড়িবে ইহা আপনাদের বুঝা উচিত।২৫
উপরােক্ত বিবরণটি পাঠ করার পর তা সত্য কিনা সেকথা তিনি কাউন্সিলারদেরকে জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে তারা সকলে বলেন যে বিবরণটি সম্পূর্ণ মিথ্যা কোনাে মন্ত্রী বা সভাপতি কেউই তাঁদের কাছে উপরােক্ত মর্মে আবে করেননি। আবদুল্লা হিল বাকী এর পর বনে যে ইত্তেহাদের বিবরণের অপর অংশে বলা হয়েছে যে সদস্যেরা মঞ্চ আক্রমণ করেন এবং তাদের দ্বারা চেয়ার টেবিল চূণীকৃত হয়। কাউন্সিল সদস্যের সেই বিবরণকেও মিথ্যা বলে সভাপতির সাথে একমত হন !৩৬
উল্লিখিত বিবরণসমূহ অল্পকিছু পরিবতিত অবস্থায় দৈনিক আজাদ সাপ্তাহিক ‘নওবেলাল এবং সাপ্তাহিক ‘সৈনিকে প্রকাশিত হয়। কাজেই ‘ইত্তেহাদের’ বিবরণ সম্পূর্ণ মিথ্যা মনে করার কোনাে কারণ নেই। এখানে উল্লেখযােগ্য হলাে দ্বিতীয় দিনের অধিবিশনে কাউন্সিলারদের নমনীয় মনােভাব। সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার এবং আকরাম খানের পদত্যাগ পত্র বিবেচনার প্রশ্ন নিয়ে পূর্বদিন যারা তুমুল হট্টগােল সৃষ্টি করে পরিশেষে তাকে মারামারিতে পরিণত করেছিলেন তারাই সেই ঘটনাসমূহের বিবরণকে মাত্র পরদিনই সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণােদিত বলে স্বীকার করলেন এ ব্যাপারে যতই আশ্চর্যজনক হােৰু অকারণঘটিত নয়। তা হলাে পূর্ব রাত্রিতে লীগ কতৃপক্ষ, মন্ত্রীবর্গ ও লীগ
সভাপতির সাংগঠনিক তৎপরতারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
আবদুল্লা হিল বাকী তার বক্তৃতা শেষ করে পাকিস্তান মুসলিম লীগ সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামানকে ভাষণ দেওয়ার জন্যে আহ্বান করেন। কিন্তু তার পূর্বে তিনি ঘােষণা করেণ যে খালিকুজ্জামানের বক্তৃতার সময় সংবাদিকদেরকে সভাগৃহ পরিত্যাগ করতে হবে। তিনি বলেন যে পাকিস্তান লীগ সভাপতি এবং কাউন্সিলারদের ইচ্ছানুসারেই সেই সিদ্ধান্ত করা হয়েছে। পূর্বদিন যে কাউন্সিলাররা সাংবাদিকদেরকে সভাগৃহে উপস্থিত রাখার জন্যে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে দারুণ বাকবিতণ্ডা ও বিতর্ক চালিয়েছিলেন পরদিন তারা প্রাদেশিক লীগ সভাপতির এই ঘােষণার কোন প্রতিবাদ করা তাে দূরে থাকুক শান্তভাবে তার প্রতি নিজেদের সমর্থনই জ্ঞাপন করেছিলেন !৩।।
কাউন্সিলারদের পক্ষ থেকে কোনাে প্রতিবাদ না হওয়ায় আবদুল্লা হিল বাকী সাংবাদিকদেরকে সভাগৃহ ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন এবং তাঁরা সেই নির্দেশ অনুসারে সভাগৃহ পরিত্যাগ করেন। এর পর তারা অধিবেশনের সভাপতির কাছে প্রেরিত এক স্মারকলিপিতে তাদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। তাতে তারা বলেন যে চৌধুরী খাজিকুজ্জামানের বক্তৃতার সময় সাংবাদিকদেরকে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হবে না একথা পূর্বাহ্নে তাদেরকে জানানাে উচিত ছিলাে। প্রথমে সংবাদিকদেরকে উপস্থিত থাকার জন্যে অনুমতিপত্র প্রদান করে পরে আবার তাদেরকে সভাকক্ষ ত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া মােটেই সমীচীন হয়নি। লীগ কর্তৃপক্ষের এই আচরণে সাংবাদিকগণ দুঃখ প্রকাশ করেন। | চৌধুরী খালিকুজ্জামান তার বক্তৃতায় কাশ্মীর, আফগানিস্তান এবং অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অবস্থা সম্পর্কে বিশেষভাবে আলােচনা করেন। তিনি বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ বৃটিশ ও আমেরিকার তল্পিবাহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এই সব রাষ্ট্রের জনগণ মুষ্টিমেয় লােকের শশাষণের কবলে পড়ে স্বাধীনতার আস্বাদ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন যে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণকে শােযণকারী ‘বে’ ও ‘পাশা’দের কবল থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব পাকিস্তানী জনসাধারণকেই গ্রহণ করতে হবে। এই ভাষণে লীগ সভাপতির বক্তব্য প্রায় সম্পূর্ণভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ‘জনগণের শশাষণ’ এবং তাদেরকে মুক্ত করার বিবরণ ও আবেদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দেশীয় কোনাে সমস্যা সম্পর্কে কোনাে বক্তব্যই তিনি লীগ কাউন্সিলারদের সামনে পেশ করার প্রয়ােজন বােধ করেননি।
খালিকুজ্জামানের এই ভাষণের উপর সাপ্তাহিক নওবেলাল চৌধুরী সাহেবের ভাষণ’ নামে একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয়৪০ প্রকাশ করেন। সেই সম্পাদকীয়টির উপসংহারে বলা হয় ?
চৌধুরী সাহেব মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলির অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হইয়া অপরকেও সেই সম্বন্ধে সচেতন করাইবার যে সাধু প্রয়াস পাইয়াছেন সেই জন্য আমরা তাহাকে জানাই মোবারকবাদ ! জনাব চৌধুরী সাহেবের ভাষণের ‘স্বেচ্ছাতন্ত্রের অবসান’, ‘নির্যাতিত মানবাত্মার মুক্তি’, ‘স্বাধীন, সুখী, গণতন্ত্রী সরকার গঠনের আহ্বান পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে যতখানি সাড়া জাগাইবার কথা ততখানি আলােড়ন আনিতে পারে নাই—আনিতে পারে না। অতি ক্ষোভের সহিত এই কথা না বলিয়াও আমরা পারিতেছি না, চৌধুরী সাহেবের এই ভাষণে কোথায় যেন ফাক–কোথায় যেন আন্তরিকতার অভাব রহিয়াছে। এক মধুর স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গিয়াছে বাস্তবের রূঢ়তায়। এই স্বপ্নের আবেশ হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও আর আসিবে না—তাই যেন চৌধুরী সাহেব আর এক স্বপ্নের মধুরতায় জনসাধারণকে টানিয়া লইতে প্রয়াস পাইয়াছেন। লীগ কাউন্সিলের তিন তিনটি দিন অধিবেশনের পরেও জনসাধারণের জীবন ধারণের সমস্যার সমাধানের ঘাের ব্যর্থতা আমাদের চিন্তাধারাকে এই গতিপথে পরিচালিত করিতেই বাধ্য করে। চৌধুরী সাহেব লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনের ব্যর্থতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হইয়া প্রতিনিধিদের মনকে অন্যপথে পরিচালনা করিবার উদ্দেশ্যেই সুচতুরভাবে যেন এই প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়া ভগ্নতরীকে কোনােরূপে তীরে ভিড়াইয়া রাখিবার চেষ্টা করিয়াছেনলীগ কাউন্সিলের অধিবেশনের প্রহসনের উপর কোমল, মধুর যবনিকা টানিবার চেষ্টা করিয়াছেন। জীবন যাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন সমস্যার চাপে জনসাধারণের নাভিশ্বাস উপস্থিত হইয়াছে তাহাদের একটির মাত্র সমাধান করিলেও বা সমাধানের ইঙ্গিত দিলেও চৌধুরী সাহেবের ভাষণ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে করিত উদ্বেলিত যে নির্যাতিত মুসলিম জনসাধারণের জন্য চৌধুরী সাহেবের আহ্বান তাহারা একান্ত আগ্রহে চাহিয়া রহিত পাকিস্তানের প্রতি। চৌধুরী সাহেবের ভাষণ গণতন্ত্রী মনকে উদ্বুদ্ধ ও আনন্দিত করিলেও সে আনন্দ নিঃসংশয় নহে, সংশয়ে সে আনন্দ মান। এখানেই চৌধুরী সাহেবের ভাষণের ব্যর্থতা। খালিকুজ্জামানের বক্তৃতার পর তুমুল বাকবিতণ্ডার মধ্যে আবদুল মােনেম
খান কর্তৃক উত্থাপিত সরবরাহ বিভাগ সম্বন্ধীয় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে সরবরাহ বিভাগের তিনটি শাখা-সংগ্রহ, চলাচল ও বণ্টন, উঠিয়ে দিয়ে সেগুলিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রে কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসা এবং সরবরাহ বিভাগ যথাশীঘ্র তুলে দেওয়ার জন্যে সুপারিশ করা হয়। প্রস্তাবটির সমালােচনা করে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন এবং অর্থমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী বক্তৃতা দেন। হামিদুল হকের বক্তৃতার সময় কাউন্সিলারদের মধ্যে অনেক ঘন ঘন বাধা সৃষ্টি করেন। প্রাক্তনমন্ত্রী শামসুদ্দীন আহমদ একটি সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করার পর কাউন্সিলারদের ভােটে তা বাতিল হয়ে যায়। সেদিনের অধিবেশন মধ্যরাত্রিতে শেষ হয়।
শেষ পর্যন্ত আকরাম খানের পদত্যাগপত্র কাউন্সিল অধিবেশনে আলােচিত হয়নি। প্রাদেশিক লীগ ওয়াকিং কমিটি কেন্দ্রীয় লীগ সভাপতি খলিকুজ্জামানের উপর সে বিষয়ে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পণ করেন। সেই অনুসারে খালিকুজ্জামান ১৯শে জুনের অধিবেশনে কাউন্সিলারদেরকে জানান যে, যে সব কারণে আকরাম খান পদত্যাগ করেছেন সে সম্পর্কে উপযুক্ত অনুসন্ধান করে ‘ তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কাউন্সিল অধিবেশনের পর খালিকুজ্জামান তার অনুসন্ধান কার্ব শেষ করেন এবং তিনি ঢাকা পরিত্যাগের পূর্বেই আকরাম খানের পদত্যাগপত্র যথায়ীতি প্রত্যাহার করা হয়।
| প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের অধিবেশন তৃতীয় দিন, ২৩শে জুন, বেলা দশটায় ডিস্ট্রক্ট বাের্ড হলে আরম্ভ হয়। ৪৪ এই সভায় বহুসংখ্যক প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলির মধ্যে রমজান মাসে সর্বপ্রকার নাচগান, সিনেমা ও মদ্যপান নিষিদ্ধ করা, নােতুন শাসনতন্ত্র রচনা করা,অতি শীঘ্র পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা, পরিষদে উপস্থাপিত জমিদারী ক্রয় বিল আইনে পরিণত করা দাবী জ্ঞাপক প্রস্তাবসমূহ উল্লেখযোগ্য।৪৫ শেষােক্ত প্রস্তাবের এক সংশোধনী প্রস্তাবে বিনা খেসারতে আগামী ১৯৫০ সালের মধ্যে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সুপারিশ করা। হয় কিন্তু সেই সংশােধনী প্রস্তাবটি ৬০৯ ভােটে কাউন্সিলাররা বাতিল করে দেন।৪৬
পাকিস্তানের সর্বপ্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান মুসলিম লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিলের তিনদিনের এই অধিবেশনের পর সদস্যদের অনেকেরই মন হতাশায় আচ্ছন্ন হয় এবং তারা খােলাখুলিভাবে অন্তরের এই ভাব পরস্পরের কাছে ব্যক্ত কনে।৪৭
৫। নােজ গার্ডেনের মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন | মৌলানা ভাসানী ধুবড়ী জেল থেকে মুক্তি লাভের পর ঢাকা এসে আলী আমজাদ খানের বাসায় কয়েকদিন অবস্থান করেন। সেই সময় তিনি ঢাকার রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে অনেককেই তাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন। আলােচনা প্রসঙ্গে শওকত আলী প্রমুখ ১৫ নম্বর মােগলটুলীর কয়েকজন কর্মী তাকে একটি কর্মী সম্মেলন আহ্বানের এবং তার জন্যে উপযুক্ত প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
আলী আমজাদ খানের বাড়িতে এই আলােচনার পর ১৫ • নম্বর মােগলটুলীতে একটি কর্মী বৈঠক আহ্বান করা হয়। তাতে এমন কয়েকজন এসে, উপস্থিত হন যাদেরকে বৈঠকে যােগদানের জন্যে কোনাে আমন্ত্রণ জানানাে হয়নি। এদের মধ্যে কুষ্টিয়ার শামসুদ্দীন আহমদ এবং চেম্বার অব কমার্সের সাখাওয়াৎ হােসেনের নাম উল্লেখযােগ্য। সাখাওয়াৎ হােসেন টাঙ্গাইল নির্বাচনের জন্যে ইতিপূর্বেই কিছু অর্থ সাহায্যও করেছিলেন। | বৃহত্তর কর্মী সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসাবে সেই বৈঠকে মৌলানা ভাসানী আলী আমজাদ খানকে সভাপতি এবং ইয়ার মুহম্মদ খানকে সম্পাদক করে একটি অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করেন। কিন্তু বৈঠকটিতে বহু অবাঞ্ছিত ব্যক্তির উপস্থিতিতে এমনিতেই কয়েকজন নেতৃস্থানীয় কর্মীর মধ্যে রীতিমত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে শওকত আলী ছিলেন অন্যতম। তিনি বৈঠকের আলােচনা এবং অভ্যর্থনা কমিটির অবস্থা দেখে ভয়ানক বিরক্ত হয়ে উপরের তলায় চলে যান এবং সম্মেলনটির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেন। এই মানসিক অবস্থায় তার সাথে উপদের ঘরে খােন্দকার আবদুল হামিদের দেখা হয়। তিনি শওকত আলীকে বলেন যে এ ব্যাপারে রাগারাগি না করে স্থিরভাবে নীচে গিয়ে নিজের বক্তব্য স্পষ্টভাষায় এবং সােজাখুজি পেশ করা দরকার।
খােন্দকার আবদুল হামিদের পরামর্শ মতাে শওকত আলী এর পর নীচে গিয়ে উপস্থিত সকলকে এবং বিশেষ করে মৌলানা ভাসানীকে বলেন যে অভ্যর্থনা কমিটি যেভাবে তৈরী হয়েছে তাতে অভ্যর্থনা হয়তাে হবে কিন্তু সম্মেলন হবে না। প্রসঙ্গটিকে আবার এইভাবে উত্থাপন করার পর অনেকেই শওকত আলীর কথার তাৎপর্য উপলব্ধি করেন এবং শেষ পর্যন্ত মৌলানা ভাসানীকে সভাপতি, ইয়ার মহম্মদ খানকে সম্পাদক এবং মুস্তাক আহমদকে অফিস সম্পাদক করে অন্যান্যদের সহ একটি নােতুন কমিটি গঠিত হয়।
255
সেই সময় ১৫০ নম্বর মােগলটুলীয় কর্মীদের মধ্যে শওকত আলী ছিলেন অত্যন্ত উদ্যোগ। তিনি দবিরুল ইসলামের মামলা পরিচালনার জন্যে শহীদ সুহরাওয়ার্দীকে ট্রাককলযােগে ঢাকা আসার জন্যে অনুরােধ জানান এবং তার অনুরোধ মতাে শহীদ সুহরাওয়ার্দী জুন মাসে ঢাকা এসে ক্যাপ্টেন শাহজাহানের ‘নূরজাহান বিল্ডিং বাসায় এগারাে দিন অবস্থান করেন। মামলা শেষ হওয়ার পর সুহরাওয়াদী কলকাতা ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলায় শওকত আলী তাকে বলেন যে তাড়াতাড়ি কলকাতা ফেরত না গিয়ে তার ঢাকাতেই থাকা উচিত। কারণ ঢাকাতে না থেকে শুধু যাওয়া আসা করলে তার দ্বারা কোনাে সমস্যার সমাধান হবে না। সুহরাওয়াদ এর উত্তরে শুধু তাদেরকে মুসলিম লীগ রাজনীতি বর্জন করে তার পরিবর্তে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আওয়ামী লীগের মতাে আওয়ামী লীগ নামে একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের পরামর্শ দেন। সুহরাওয়ার্দীর এই পরামর্শ মতাে শওকত আলীর মৌলানা ভাসানীর সাথে নােতুন রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যাপারে আলাপ আলােচনা করেন।
২৩শে এবং ২৪শে জুন, ১৯৪৯, মৌলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে গঠিত অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষ থেকে সারা পূর্ব বাঙলা প্রদেশের মুসলিম লীগ কর্মীদের এক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। অন্য কোনাে সুবিধাজনক জায়গা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত কাজী বশীরের (হুমায়ুনের) আমন্ত্রণে তার স্বামীবাগস্থ বাসভবন ‘রােজ গার্ডেনে’ সম্মেলনের স্থান নির্দিষ্ট হয়।
সম্মেলনের প্রস্তুতি চলাকালে মৌলানা ভাসানী ১৫০, মোগলটুলীতে অবস্থান করছিলেন। ২০শে জুনের দিকে মুস্তাক আহমদ এবং অন্যান্যেরা খবর পান যে সম্মেলনের পূর্বে সরকার ভাসানীকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করছেন। এই সংবাদ পাওয়ার পরই মোস্তাক আহমদ কাজী বশীরের সাথে পরামর্শ করে শওকত আলীর সহায়তায় সেই রাত্রেই মৌলানা ভাসানীর গায়ে একটা কম্বল জড়িয়ে ঘােড়ার গাড়িতে করে তাকে রােজ গার্ডেনে পৌছে দেন এবং সম্মেলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানেই থাকেন। | ২৩শে জুন বিকেল তিনটে থেকে রােজ গার্জেনের দোতলার হল ঘরে সম্মেলন শুরু হয়। তাতে প্রায় আড়াইশাে থেকে তিনশশ কর্মী উপস্থিত হন। সম্মেলন সেদিন সন্ধ্যা রাত্রি পর্যন্ত চলে।
প্রথম অধিবেশনে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন : শামসুল হক, আবদুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হােসেন, আনােয়ারা খাতুন,
আলী আহমদ খান, খােলকার মুস্তাক আহমদ, শওকত আলী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শামসুদ্দীন আহমদ (কুষ্টিয়া) আতাউর রহমান খান, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আলী আমজাদ খান, ইয়ার মহম্মদ খান। এ ছাড়া মৌলানা মহম্মদ আরিফ চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহ-সভাপতি মওলানা শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদক মৌলানা এয়াকুব শরীক এবং ঢাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরীর মালিক আবদুর রশিদের নামও উল্লেখযােগ্য। রেলওয়ে শ্রমিক প্রতিষ্ঠান, ছাত্র প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য নানা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও এই সম্মেলনে যােগদান করে।১০ | ফজলুল হকও সেদিন অল্প কিছুক্ষণের জন্যে সম্মেলনের প্রথমদিকে উপস্থিত থাকেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দেন। তাতে তিনি জনগণের চরম দুর্ভোগ এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকটের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে ক্ষুধিত জনগণকে সংঘবদ্ধ করার জন্যে যুব-সমাজ এবং লীগ কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়া উচিত। পরিষদের যে সমস্ত সদস্য দলীয় প্রভাবের চাপে বিভিন্ন গণদাবীকে আইন সভায় উখাপন করতে অক্ষম, জনমতের চাপ সৃষ্টি দ্বারা তাদেরকে নিজেদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা উচিত বলেও তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। সর্বশেষে জনগণের পক্ষে সংগ্রামের জন্যে নিজের প্রস্তুতির কথা ঘােষণা কবে তিনি সম্মেলন কক্ষ পরিত্যাগ করেন। | সেদিনকার সভায় বক্তৃতা ছাড়াও শামসুল হক পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ সম্মেলনে বিবেচনার জন্য মূলদাবী’ নামে পুস্তিকা আকারে ছাপা বক্তব্যে কর্মসূচী বিষয়ক কতকগুলি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার এই প্রস্তাব সমূহই সম্মেলনের পর সামান্য পরিবর্তিত অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম খসড়া ম্যানিফেস্টো রূপে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়।১২
সুদীর্ঘ আলােচনার পর পূর্ব প্যকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে নােতুন একটি সংগঠনের মধ্যে লীগকে গণ-প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুনর্গ ঠন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ ছাড়া আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম নরনারীকে লীগের সভ্য হিসাবে গণ্য করা হবে। তার জন্যে তাদেরকে কোনাে চদা দেওার প্রয়ােজন হবে না। প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানেরা শুধু একটা ‘ক্রীডে’ স্বাক্ষর দিলেই তারা নােতুন প্রতিষ্ঠানের সভ্যরূপে বিবেচিত হবেন।১৩
বিভিন্ন জেলা থেকে আগত প্রতিনিধি স্থানীয় কর্মীদের এই সম্মেলনে অনেকগুলি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেগুলির মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোেগ্য হলাে বিনা খেসারতে অবিলম্বে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ, প্রাপ্ত বয়স্কদের
ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন, মন্ত্রীমণ্ডলীর বিবিধ কার্যকলাপ তদন্তের জন্যে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা, কারারুদ্ধ ছাত্র নেতাদের মুক্তি, ছাত্রদের উপর থেকে শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার, অবিলম্বে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, বিক্রয়কর প্রত্যাহার। এ ছাড়া খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিশেষ প্রস্তাবে দাবী করা হয় যে, খাদ্য সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে সরকারী উদ্যোগে একটি সর্বদলীয় খাদ্য সম্মেলন আহ্বান, প্রাদেশিক, জেলা মহকুমা ও ইউনিয়ন খাদ্য কমিটি গঠন এবং অবিলম্বে খাদ্য অভিযান শুরু করা হােক। লেডী সম্পর্কে যে সব সরকারী অন্যায় ও অবিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছিলাে সেগুলির প্রতিকারের জন্যেও বিশেষভাবে দাবী জানানাে হয়।১৪
২৩শে তারিখের অধিবেশনের শেষ পর্যায়ে মৌলানা ভাসানী সাংগঠনিক কমিটি সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে বলেন যে প্রত্যেক জেলা এবং প্রতিষ্ঠান থেকে একজন করে প্রতিনিধি কমিটিতে রাখা দরকার। তার এই প্রস্তাবে কর্মীদের মধ্যে অনেকেই এই বলে আপত্তি করেন যে, সেভাবে কমিটি গঠিত হলে তা এত বড় হবে যে তার মাধ্যমে কোনাে সাংগঠনিক কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্ভব হবে না।১৫
এই সমস্ত আলােচনার পর সকলে মৌলানা ভাসানীকে অনুরােধ করেন তিনি যেন নিজে কমিটির নাম স্থির করে আধ ঘণ্টার মধ্যে তাদেরকে সেই নামগুলি জানান। এইভাবে অনুরুদ্ধ হয়ে ভাসানী পরামর্শের জন্যে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে একটি ঘরের মধ্যে ঢােকেন এবং কিছুক্ষণ পর বাইরে এসে প্রায় ৪০ জন নিলে গঠিত একটি কমিটি প্রস্তাব করেন। সেই কমিটিতে মৌলানা ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সম্পাদক এবং শেখ মুজিবর রহমান ও খােন্দকার মুস্তাক আহম্মদ যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে প্রস্তাবিত হন। ভাসানীর প্রস্তাবিত সেই কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে অনুমােদিত হয়।১৬ | সম্মেলনের পরদিন সকালে ভাসানী শওকত আলীকে বলেন যে কমিটির মধ্যে তিনি, শামসুল হক, মুজিবর রহমান, মুস্তাক আহমদ সকলেই ১৫০ মােগলটুলীর লােক একথা বলে অনেকেই তাদের সমালােচনা করছে। শওকত আলী তাকে এর জবাবে বলেন যে তাতে কোনাে ক্ষতি হবে না, তবে অসুবিধা হবে আজেবাজে লােক নিয়ে গঠিত ৪০ জনের বড়ো কমিটি নিয়ে। এর উত্তরে মৌলানা ভাসানী আবার তাদেরকে বলেন যে বড়াে কমিটিতে কোনাে অসুন্ধি হবে না। তিনি ঘন ঘন কমিটির বৈঠক ডাকবেন এবং তাতে পর পর তিনবার অনুপস্থিত থাকলেই যে কোনাে সদস্যকে বাদ
দিয়ে দেওয়া হবে। কমিটির গঠন নিয়ে এর পূর্বে শওকত আলীর শামসুল হকের সাথে আলাপ করেন।১৭।
২৪শে তারিখে বিকেল ৫-৩০ মিঃ মৌলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আরমানীটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সর্বপ্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এবং তাতে প্রায় চার হাজার মানুষ উপস্থিত থাকেন। সভা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে কালু মিঞা, আলাউদ্দীন, ইব্রাহীম প্রভৃতি মুসলিম লীগের লােকদের নেতৃত্বে একদল গুণ্ডা সভা ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে হাজির হয়ে কিছু চেয়ার টেবিল চুরমার করে কিছুক্ষণের মধ্যেই তাড়াতাড়ি উধাও হয়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সভার কাজ বিঘ্নিত না হয়ে সমবেত জনতার মধ্যে মুসলিম লীগ বিরােধী মনােভাবের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।১৮
৬। শামসুল হকের প্রস্তাব এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম
ম্যানিফেস্টো পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্যে শামসুল হক “মুলদাৰী’ নামে একটি ছাপা পুস্তিকাতে লিপিবদ্ধ তার বক্তব্য পাঠ করেন। পুস্তিকাটির মুখবন্ধের প্রারম্ভে তিনি বলেন :
১৯১৯ সনের ২৩শে ও ২৪শে জুন তারিখে ঢাকায় অনুষ্ঠিত “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন” মনে করে যে, সব কালের সব যুগের, সব। দেশের যুগ প্রবর্তক ঘটনাবলীর ন্যায় লাহাের প্রস্তাবও একটা নূতন ইতিহাসের সৃষ্টি করিয়াছে। বিরুদ্ধ পরিবেশে মানবের দেহ, মন ও মস্তিষ্কের উন্নতি ও পূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। মানুষ পরিবেশের দাস একথা আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করেন। বিরুদ্ধ পরিবেশে পূর্ণ ইসলামিক মনােভাব এবং সমাজ বিধান গড়িয়া তােলা সম্ভব নয়। ভারতের মুসলমানগণ বহু শতাব্দীর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হইতে এই মহা সত্য উপলব্ধি করিয়াই বিরুদ্ধ পরিবেশে বা দারুল হরবের পরিবর্তে ইসলামিক পরিবেশ বা দারুল ইসলাম কায়েম করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র হইলেও শুধু মুসলমানের রাষ্ট্র বা শুধু মুসলমানের জন্য প্রতিষ্ঠিত করিবার এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা ও শিক্ষা প্রভাবান্বিত ইসলাম-বিরােধী সাম্রাজ্যবাদী, ধনতান্ত্রিক ও আত্মকেন্দ্রিক পরিবেশ গড়িয়া তুলিবার ইচ্ছা তাহাদের ছিল না।
এই সম্মেলনের কিছুদিন পূর্বে ১৯৪৮ সালে শামসুল হক বর্ধমানে গিয়ে আবুল হাশিমের বাড়িতে কয়েক সপ্তাহ অবস্থান করেন এবং তার Creed of Islam নামক পুস্তকের প্রথম খসড়ার তিলিখনের পর তার একটি অনুলিপি তৈরী করে সেটি সাথে নিয়ে ঢাকা আসেন। সেই অনুলিপিকে ভিত্তি করে। ‘বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে ইসলাম নামে তিনি একটি পুস্তকও রচনা করে তা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া সেই সময় আবুল হাশিম তার অনুরােধে পূর্ব পাকিস্তানে একটি নােতুন পার্টির ম্যানিফেস্টোর খসড়াও তাকে প্রস্তুত করে দেন। | শামসুল হকের লিখিত ‘মূলদাবীর মধ্যে আবুল হাশিমের তত্বগত চিন্তার প্রভাব সহজেই লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ :
রব বা স্রষ্টা হিসাবেই সৃষ্টির বিশেষ করিয়া সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের সাথে আল্লার সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বস্তুতঃ রব বা স্রষ্টা, পালন বা পােষণকর্তা হিসাবে, বিশ্ব ও সৃষ্টিকে ধাপের পর ধাপ, স্তরের পর স্তর, পরিবর্তনের ভিতর দিয়া কতকগুলি স্থায়ী ও সাধারণ ক্রমবিকাশ ও ক্রমােন্নতির নিয়মানুসারে এক অবস্থা হইতে অপর অবস্থার ভিতর দিয়া ধীরে ধীরে কিন্তু সুনিশ্চিতরূপে চরম সুখ, শান্তি ও পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে আগাইয়া নিবেন। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গীতে আল্লাহ শুধু মুসলমানের নয়— জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র মানবের। রবই আল্লার সত্যিকার পরিচয়। রব হিসাবে রবুবিয়া বা বিশ্ব-পালনই তার প্রথম ও প্রধান কাজ। সুতরাং দুনিয়ার উপর আল্লার খলিফা বা প্রতিভূ হিসাবে মানব এবং খেলাফত হিসাবে রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান কাজ ও কর্তব্য হইল আল্লার উপায় ও পদ্ধতি অনুসারে বিশ্বের পালন করা এবং জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের সামগ্রিক সুখ, শান্তি, উন্নতি, কল্যাণ ও পূর্ণ। বিকাশের জন্য চেষ্টা, সাধনা ও সংগ্রাম করা। মুসলিম লীগ সম্পর্কে শামসুল হক পুস্তিকাটিতে বলেন : নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনও দল বিশেষের প্রতিষ্ঠান ছিল না ; ইহা ছিল ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনগণের জাতীয় প্লাটফর্ম বা মঞ্চ। ইহার উদ্দেশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের মূল নীতিগুলিকে কাকরী করিয়া তুলিতে হইলে প্রয়ােজন নােতুন চিন্তাধারা, নােতুন নেতৃত্ব এবং নতুন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি ও কর্মসূচী এবং মুসলিম লীগকে মুসলিম জনগণের সত্যিকার জাতীয় প্ল্যাটফর্ম মঞ্চ হিসাবে গড়িয়া তােলার।•••
260
কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান পকেট লীগ নেতৃবৃন্দ উপরােক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ না করিয়া তাহাদের নিজেদের কায়েমী স্বার্থ এবং প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য লীগের মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা ভাঙাইয়া চলিয়াছেন। এই উদ্দেশ্যেই তাহারা মুসলিম লীগকে দলবিশেষের প্রতিষ্ঠান করিয়া ফেলিয়াছেন। শুধু তাই নয় মানবের প্রতি আশীর্বাদ স্বরূপ ইসলামকেও ব্যক্তি, দল ও শ্রেণী বিশেষের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যায় এবং অসাধুভাবে কাজে লাগান হইতেছে। কোনও পাকিস্তান প্রেমিক এমন কি মুসলিম লীগের ঝানু কর্মিগণ পর্যন্ত নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে কোনােরূপ প্রশ্ন উত্থাপন করিতে অথবা প্রস্তাব করিতে পারে না। কেহ যদি এইরূপ করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহাদিগকে পাকিস্তানের শত্রু বলিয়া আখ্যাত করা হয়।
আলােচ্য মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে নােতুন দল গঠনের উদ্যোগ সত্ত্বেও সেই দলের নেতৃবৃন্দ যে মূলতঃ মুসলিম লীগের ‘আদর্শ ইত্যাদির প্রভাব বিন্দুমাত্র উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হননি তার পরিচয় শামসুল হকের সাংগঠনিক বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় :
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন মনে করে যে মুসলিম লীগকে এইসব স্বার্থান্বেষী মুষ্টিমেয় লােকদের পকেট হইতে বাহির করিয়া সত্যিকার জনগণের মুসলিম লীগ হিসাবে গড়িয়া তুলতে হইলে, মুসলিম লীগকে সত্যিকার শক্তিশালী মুসলিম লীগ বা মুসলিম জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চে পরিণত করিতে হইলে প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমকে ইহার সদস্য শ্রেণীভুক্ত করিতে হইবে, অন্যথায় মুসলিম লীগকে পাশ্চাত্য সভ্যতা, গণতন্ত্র ও সাংগঠনিক নীতি প্রভাবান্বিত দলবিশেষের পার্টি বলিয়া ঘােষণা করিয়া অপরাপর সবাইকে সাধ্যমতাে দল গঠন করিবার সুযােগ-সুবিধা ও অধিকার দিতে হইবে। মুসলিম লীগের ভিতর প্রত্যেক ব্যক্তি, দল ও উপদরের স্বাধীন মতামত আদর্শ, নীতি ও কর্মসূচী ব্যক্ত এবং তার পিছনে সংঘবদ্ধ হইবার অধিকার দিতে হইবে। তদুপরি ছাত্র, যুবক, মহিলা, চাষী, ক্ষেত মজুর, মজদুর প্রভৃতি শ্রেণী সংঘ গড়িয়া তুলিবার স্বাধীনতা থাকিবে।
শামসুল হকের উপরােক্ত বক্তব্য থেকে মনে হয় মুসলিম লীগকে একটি পার্টি হিসাবে গঠনের পরিকল্পনা তার চিন্তার মধ্যে তখন ছিলাে না। তিনি মুসলিম লীগকে একটি ব্যাপক গণফ্রন্ট হিসাবে গঠন করার চিন্তাই করেছিলেন।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁর যারা লিখিত এবং প্রচারিত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে তিনি এই চিন্তা বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি দল হিসাবে গঠন করার কথাই ঘােষণা করেন।
‘মূলনীতি’তে অবশ্য শামসুল হক বস্তুতপক্ষে একটি পার্টি ম্যানিফেস্টোর খসড়াই পেশ করেন। এই খসড়া ম্যানিফেস্টোর সাথে আবুল হাশিম কর্তৃক প্রচারিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লিগের খসড়া ম্যানিফেস্টোর সাদৃশ্য সহজেই লক্ষণীয়। সামান্য সংশােধিত হয়ে মূলনীতির অন্তর্গত এই খসড়াটিই পরবর্তীকালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম খসড়া ম্যানিফেস্টোরূপে প্রকাশিত এবং প্রচারিত হয়। | ‘মূল দাবী’তে উত্থাপিত প্রস্তাবগুলিতে বয়স্কদের ভােটাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমতা, ধর্মের স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার, দেশরক্ষার অধিকার, বৈদেশিক নীতি, মানুষের সমান অধিকার, কাজ করার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, নারীর অধিকার ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্র এবং কৃষি-পুনর্গঠন ও শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে যা বলা হয় তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ সম্পর্কে তাতে বলা হয় : ১। পাকিস্তান খেলাফত অথবা ইউনিয়ন অব পাকিস্তান রিপাবলিক ২টিশ কমনওয়েলথের বাহিরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্রহইবে। ২। পাকিস্তানের ইউনিটগুলিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ব অধিকার দিতে হইবে। ৩। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লার প্রতিভূ হিসাবে জনগণের উপর ন্যস্ত থাকিবে। ‘ ৪। গঠনতন্ত্র হইবে নীতিতে ইসলামী গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।৬ কৃষি-পুনর্গঠন প্রস্তাবে বলা হয় : ১। জমিদারী প্রথা ও জমির উপর অন্যান্য কায়েমী স্বার্থ বিনা খেসারতে উচ্ছেদ করিতে হইবে। ২। সমস্ত কৰ্ষিত ও কৃষি উপযােগী ‘অকর্ষিত জমি কৃষকদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে। ৩। তাড়াতাড়ি অর্ডিনান্স জারী করিয়া তেভাগা’ দাবী মানিয়া লইতে হইবে। ৪। রাষ্ট্রের তত্বাবধানে অবিলম্বে সমবায় ও যৌথ কৃষিপ্রথা প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।•••
৫। নিম্নলিখিত বিষয়ে কৃষকদের অবিলম্বে সাহায্য করিতে হইবে; (ক) সেচ ব্যবস্থার সুবিধা ও সার প্রস্তুতের পরিকল্পনা। (খ) উন্নত ধরনের বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি। (গ) সহজ ঋণ দান ও কৃষি ঋণ হইতে মুক্তি। (ঘ) ভূমি-করের উচ্ছেদ না হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভূমিকর শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কমান। (ঙ) ভূমি-করের পরিবর্তে কৃষি-আয়কর বসানাে। (চ) খাদ্য শস্য প্রভৃতি জাতীয় ফসলের সর্বনিম্ন ও সর্ব-উপ দর নির্ধারণ করিয়া দিতে হইবে এবং পাটের সর্বনিম্ন দর বাঁধিয়া দিতে হইবে। (ছ) খাদ্যশস্যের ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকা উচিত। পাট ব্যবসা ও বুনানীর লাইসেন্স রহিত করিতে হইবে। (জ) সকল রকমেরসমবায়সমিতিগুলিকে সাহায্য ও উৎসাহ দিতে হইবে। ৬। কালে সমস্ত ভূমিকে রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে এবং সরকারের অধিনায়কত্ব ও তত্ত্বাবধানে যৌথ ও সমবায়
কৃষি প্ৰথা খুলিতে হইবে। | দেশীয় শিল্পকে নানা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে মূল দাবীতে নিম্নলিখিত কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয় :
১। প্রাথমিক শিল্পগুলিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে যেমন—যুদ্ধশিল্প, ব্যাঙ্ক, বীমা, যানবাহন, বিদ্যুৎ সরবরাহ, খনি, বন-জঙ্গল ইত্যাদি ; এবং অন্যান্য ছােটখাট শিল্পগুলিকে পরিকল্পনার ভিতর দিয়া সরাসরি রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে আনিতে হইবে। ২। পাট ও চা শিল্পকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে এবং পাট ও চা ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকিবে। ৩। কুটির শিল্পগুলিকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিতর দিয়া বিশেষভাবে সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে। ৪। বিল, হাওর ও নদীর উপর হইতে কায়েমী স্বার্থ তুলিয়া দিয়া সরকারের কতৃত্বাধীনে মৎস্যজীবীদের মাঝে যৌথ উপায়ে বণ্টন করিয়া দিতে হইবে—এবং সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৎস্যের চাষ ও মৎস্য ব্যবসার পত্তন করিতে হইবে। শািরী বিভাগের দ্রুত উন্নয়ন করিয়া এই সমস্ত বিষয়ে শিক্ষা প্রসার করিতে হইবে ও উন্নত ধরনের গবেষণাগার খুলিতে হইবে।
৫। শিল্প ও ব্যবসায়ে ব্যক্তিগত একচেটিয়া অধিকার থাকিবেনা। ৬। বৃটিশের নিকট হইতে স্টার্লিং পাওনা অবিলম্বে আদায় করিতে হইবে এবং তাহা দ্বারা যন্ত্রপাতি ক্রয় করিতে হইবে ও শিশু প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিতে হইবে। ৭। দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করিবার ভার রাষ্ট্র গ্রহণ করিতে হইবে। ৮। সমস্ত বৃটিশ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করিতে হইবে। ৯। শিল্পে বৈদেশিক মূলধন খাটানাে বন্ধ করিতে হইবে। ১০। শিল্পে মুনাফার হার আইন করিয়া বাধিয়া দিতে হইবে।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোর অনুকরণেই শামসুল হকের প্রকাশিত এই মূল দাবীর খসড়াটিও সর্বশেষে নিম্নোক্ত আহবান জানায় :
মানবতার চুড়ান্ত মুক্তি সংগ্রাম যাতে বিলম্বিত না হয়, সেজন্য জনতাকে তাহাদের সমস্ত ব্যক্তিগত এবং দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়ে এক কাতারে সমবেত হইতে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আবেদন জানাইতেছে। সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের ফোস-ফোস শব্দ আজ সমাজের আনাচে-কানাচে সর্বত্র শােনা যাইতেছে—সেই ফোস ফোস শব্দই যেন এই যুগের সঙ্গীত। আমাদের কওমী প্রতিষ্ঠান এই সরীসৃপদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাইয়া তাহাদের বিষদাত উৎপাটন করিতে বদ্ধপরিকর। হজরত আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) বলিয়াছিলেন : “যদি আমি ঠিক থাকি, তবে আমাকে অনুসরণ কর, আমি যদি ভ্রান্ত হই তবে আমাকে সংশােধন কর। সেই অমর আদর্শকেই সামনে ধরিয়াই কওমী প্রতিষ্ঠান সমস্ত দেশবাসীকে সমতালে আগাইয়া আসিতে আহ্বান জানাইতেছে; আসুন আমরা কোটি কোটি নর-নারীর সমবেও চেষ্টায় গণ-আজাদ হাসিল করিয়া সােনার পূর্ব পাকিস্তানকে সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়িয়া তুলি।
আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে ১৫০ নম্বর মােগলটুলীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্বেও সেখানকার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মধ্যে অনেকেই এই নােতুন সংগঠনটির সাথে যুক্ত না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগের সাম্প্রদায়িক চরিত্রই তার প্রধান কারণ। সে সমস্ত নেতৃস্থানীয় কর্মীরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে কমরুদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমদ প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য।
অষ্টম পরিচ্ছে। আরবী হরফ প্রবর্তনের বড়
১। ফজলুর রহমানের উদ্যোগ | উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলা ভাষা বিরােধী চক্রান্ত সীমাবদ্ধ ছিলাে না। বাংলাকে ধ্বংস করার অন্যতম উপায় হিসাবে তারা বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের উদ্যোগ ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু করেছিলেন। বাঙলাদেশের প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমানই ছিলেন এই হরফ পরিবর্তন প্রচেষ্টার ‘দার্শনিক এবং মূল প্রবক্তা। | নানা বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষার হরক পরিবর্তনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ক্রমাগতভাবে প্রচার করেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি এবং জনগণের মধ্যে অর্থপূর্ণ ঐক্য রক্ষা ও সুদৃঢ় করার জন্যে পাকিস্তানের সকল ভ। যার অক্ষর এক হওয়া উচিত। সিন্ধী, পুষ,তু, পাঞ্জাবী ইত্যাদির হরফ আরবীর মতো অথবা অনেকাংশে সেই রকম। কাজেই সেখানে বিশেষ কোনাে অসুবিধা নেই। যত অসুবিধা বাংলার ক্ষেত্রে। কারণ বাংলা ভাষার অক্ষর দেবনাগরী থেকে উদ্ভুত এবং তার সঙ্গে আরবী হরফের কোনাে সাদৃশ্য নেই। কাজেই বাংলার ক্ষেত্রে পরিবর্তনটা একেবারে মৌলিক। কিন্তু তা হলেও আরবী অক্ষর প্রচলন ব্যতীত বাংলাভাষীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানবাসীর যথার্থ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য সম্ভব নয়। সেদিক দিয়ে এই পরিবর্তন অবশ্য প্রয়ােজনীয়। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হলেও আরবী হরক প্রবর্তনের এই ষড়যন্ত্র ভালভাবে দানা বাঁধে ১৯৪৯ সালে।
২৭শে ডিসেম্বর, ১৯৪৮, করাচীতে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনের উদ্বােধনী ভাষণে পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব ফজলুর রহমান পাকিস্তানের শিক্ষাকে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করেন এবং বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন যে তার দ্বারা আঞ্চলিক ভাষাগুলির সংরক্ষণের কাজ সাধিত হবে। এছাড়া আরবী বর্ণমালা পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের শিক্ষাগত সামঞ্জস্য বিধানেও সহায়তা করবে।
আরবী হরফ সম্পর্কে নিজের এই বক্তব্য ফজলুর রহমান ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯-এ পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের পেশােয়ারে অনুষ্ঠিত একটি সভায়
২৬৫
আরও বিষদভাবে পেশ করেন।
সহজ এবং দ্রুত যে হরফের মারফত ভাষা পড়া যায় সেই হরফই সব চাইতে ভাল। কোন হরটা ভাল তাহা ঠিক করার পূর্বে একবার বিভিন্ন প্রদেশের হরফের বিচার প্রয়ােজন। সিন্ধু ভাষা হইতেছে সিন্ধী কিন্তু তার হরক আরবী। পশ্চিম পাঞ্জাবের ভাষা উর্দু হইলেও তার হরফ ‘নাসতালিক। পূর্ববঙ্গের ভাষা ও হরফ দুই বাংলা। কিন্তু সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ভাষা পুষ,তু হইলেও বহুলাংশে আরবী। বাংলায় বহু সংযুক্ত অক্ষর-এর স্বরবর্ণের নানা চিহ্ন থাকায় উহা টাইপ রাইটিং বা সর্ট হাণ্ডে ব্যবহার করা যায় না। নাসতালিক হরফ সম্বন্ধেও অসুবিধা। ঐ অবশিষ্ট হরসমূহের মধ্যে আরবীই সহজ এবং টাইপ রাইটিংয়েও ব্যবহার করা যাইতে পারে। রােমান হরকের ন্যায় ইহার যােলটি মূলরূপ আছে। সুতরাং দ্রুত লিখন ও পঠনের পক্ষে সুবিধাজনক বলিয়া আরবীকেই পাকিস্তানের হরক করা উচিত। আমাদের দেশবাসীর শতকরা মাত্র দশ ভাগ লেখাপড়া জানে এবং অবশিষ্ট ৯০ ভাগ লিখিতে বা পড়িতে পারে
। হরফ আরবীই হউক বা আর যাহা হউক তাহাতে তাদের কিছু যায় আসে না। তবে সহজ হরক প্রবর্তিত হইলে দেশের নিরক্ষরতা দূর করার পথ সুগম হইবে। ফজলুর রহমানের উপরােক্ত বক্তব্যকে মােটামুটি চার ভাগে বিভক্ত করা চলে। (ক) যে হরকের মাধ্যমে যত সহজে ও তাড়াতাড়ি পড়া যায় সেই অক্ষর তত ভালাে। (খ) বাংলায় বহু সংযুক্ত অক্ষর ইত্যাদি থাকায় টাইপ রাইটারে এবং শর্ট কাণ্ডের কাজে তা ব্যবহারের অসুবিধা। (গ) এ সব দিক দিয়ে আরবী হরই সর্বাপেক্ষা সহজ এবং উপযােগী। (ঘ) আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ নিরক্ষর কাজেই তাদেরকে আরবী হরফে শিক্ষা দিলে জনগণের নিরক্ষরতা দূর করা বহুলাংশে সহজ হবে। আরবী হরফের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন সহজতর হবে এই যুক্তি পূর্বে অনেক ক্ষেত্রে উল্লেখ করলেও এই বক্তৃতার মধ্যে তার কোনাে উল্লেখ নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই শেষােক্ত বক্তব্যটির উপর পরবর্তীকালে অনেক বেশী গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
বাংলা ভাষায় আরবী প্রবর্তনের পক্ষে ফজলুর রহমানের উদ্যোগ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য হলেও অন্যান্য বাঙালী মন্ত্রী এবং আমলাদের কৃতিত্বও এক্ষেত্রে কম ছিলাে না। এমনকি হাবিবুল্লাহ বাহার পর্যন্ত বাংলাতে আরবী হরফ প্রবর্তনের
প্রভাবকে ‘বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে বিচার করার পরামর্শ দিয়ে এ ব্যাপারে ভাবাবেগের দ্বারা বাঙালীদেরকে চালিত না হওয়ার পরামর্শ দান করেন।
১৯৪৮ সালে ফজলুর রহমান সৈয়দ আলী আহসান এবং অন্যান্য কয়েকজনের সাথে মওলা সাহেবের বাসায় আরবী হরফ প্রবর্তন সম্পর্কে আলােচনা করেন। আলী আহসান তাকে বলেন যে পরিকল্পনাটির সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্যে ডক্টর শহীদুল্লাহই সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ব্যক্তি। কাজেই তাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এর পর ফজলুর রহমান সরাসরি ডক্টর শহীদুল্লাহর সাথে কোনাে যােগযােগ না করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মাহমুদ হাসানকে দিয়ে তাঁর কাছে একটা চিঠি দেন। সেই চিঠিতে মাহমুদ হাসান ডক্টর শহীদুল্লাহকে লেখেন যে সরকার সিদ্ধান্ত করেছেন পাকিস্তানকে ইসলামী মতে গঠন করতে এবং সেই উদ্দেশ্যে তারা বাংলা ভাষায় আরবী অক্ষর প্রবর্তন করতে চান। এবং এর জন্যে তার সাহায্য পেলে তারা উপকৃত হবেন। | ডক্টর শহীদুল্লাহ মাহমুদ হাসানের এই চিঠির কোনাে উত্তর না দিয়ে চিঠিটির সারমর্ম প্রেসের কাছে প্রকাশ করেন এবং তা কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়। এর কিছুকাল পরে ১৯৪৯-এর ১৫ই রিসেম্বর ঢাকাতে শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলে সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর তাদের সম্মানার্থে নিজের বাসভবনে একটি চা-চক্রের আয়ােজন করেন। মাহমুদ হাসান এবং ডক্টর শহীদুল্লাহ উভয়েই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ করে হাসান ডক্টর শহীদুল্লাহকে বলেন যে তিনি আসলে দেশদ্রোহী। তা না হলে সরকার থেকে তার কাছে একটা জরুরী ব্যাপারে পত্র দিলে যথাস্থানে তার উত্তর
দিয়ে প্রেসের কাছে, বিশেষতঃ বিদেশী প্রেসের কাছে তিনি কখনই তার বিবরণ প্রকাশ করতে পারতেন না। ডক্টর শহীদুল্লাহ এর জবাবে বলেন যে তার চিঠির উত্তর দেওয়ার কোনো প্রয়ােজন তিনি বােধ করেননি এবং প্রেসের লােকেরা তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করায় তিনি তাদেরকে সেটা জানিয়ে দিয়েছেন।
প্রাদেশিক শিক্ষা দক্ষতরের সেক্রেটারী ফজলে আহমদ করিম ফজলী ছিলেন বাংলাতে আরবী হরফ প্রবর্তনের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। তিনি এবং ফজলুর রহমান উভয়ে চট্টগ্রামের মৌলানা জুলফিকর আলীকে দিয়ে ‘হুরুফুল কোরান সমিতি’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে আরবী হরফ বাংলাতে প্রবর্তনের আন্দোলন গঠনের চেষ্টা করেন। ঐ প্রচেষ্টার সাথে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ওসমান গণি এবং আরমানীটোলা ইস্কুলের ‘মৌলভী
মৌলানা আবদুর রহমান বেখুদও যুক্ত ছিলেন। জুলফিকর আলী পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটির উর্দু হরফ সাব কমিটির সদস্যও মনােনীত হয়েছিলেন এবং সেই হিসাবে মূল কমিটির কাছে বাংলা ভাষায় উছু হরফ প্রবর্তনের সুপারিশও তিনি করেন।’
এ সম্পর্কে পূর্ব বাঙলার শিক্ষা বিভাগের প্রাক্তন ডিরেক্টর আবদুল হাকিম বলেন :
জনৈক বাঙালী উষীর সাহেবের নিজের উছু জ্ঞান সম্পর্কে ঢাকাতে কিছু কিছু হাস্যোদ্দীপক কিংবদন্তী শ্রুত হয়। ইনি কেন্দ্রের সর্বশক্তিমান উর্দু মহলে বাহবা পেতে চেয়ে বাংলা ভাষাকে “হরুফুল কুরআন” দ্বারা সুশােভিত করবার জন্য তাঁর উদগ্র আকাঙ্ক্ষাকে কার্যকরী করতে চেয়েছিলেন। এজন্য বই-পুস্তক প্রকাশনার জন্য বার্ষিক ৩৫ হাজার টাকার একটা কেন্দ্রীয় মঞ্জুরীও তিনি পূর্বোক্ত প্রাদেশিক শিক্ষা সেক্রেটারীর হাতে দেবার ব্যবস্থা করেন। এদিকে শিক্ষা সেক্রেটারী পূর্বে চাটগাঁয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে তথাকার জনৈক স্কুল-মৌলবীকে হাত করেছিলেন। মৌলবী সাহেব বৃদ্ধ ও নিতান্তই ভাল মানুষ। তিনিই “হুরুফুল কুরআন” নামের উদ্ভাবক ও এ বিষয়ে কতগুলি বই-পুস্তকের রচক। তিনি তার সরল, কিন্তু ভ্রান্ত বিশ্বাস মতে মনে করতেন যে মুসলমানদের জন্য শুধু “হুরুফুল কুরআন” হবে একমাত্র লিখন পদ্ধতি; তাদের অন্য কোনাে হরফ শেখবার দরকার নেই। তিনি একদিন আমাকে এ বিষয়ে কিছু উপদেশ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। শিক্ষা-বিভাগীয় সেক্রেটারী এই ব্যক্তির “হুরুফুল কুরআন” পরিকল্পনা সম্পর্কে বেনামে ইংরেজী ভাষায় পুস্তিকা প্রচার করে অবুঝ বাঙালীদেরকে বােঝাতে চেয়েছিলেন যে একমাত্র “হুরুফুল কুরআনই আমাদের পূর্ব বাঙলার ভাষা সমস্যা সমাধান করবে। এই পরহেজগার, নিঃস্বার্থ কিন্তু একাদশদশী বাঙালী মৌলবীকে সামনে রেখে বাংলা ভাষা নিধন ব্রতে পূর্বোক্ত চক্র অগ্রসর হতে থাকে। এই চক্রের বিরােধিতা করার জন্য তৎকালীন বাঙালী শিক্ষা ডিরেক্টর (ডি.পি.আই.) নানা বাহানায় প্রদেশের বাইরে স্থানান্তরিত হন এবং তার স্কুলে জনৈক উর্দুভাষী অবাঙালীকে। ডিরেক্টর করা হয়। ফজলুর রহমান. উ. ফজলে আহমদ করিম ফজলী-ব. উ. উত্তর প্রদেশের ফজলুর রহমান , উ,
এই শেষােক্ত ব্যক্তির হঠাৎ অকাল মৃত্যু ঘটে বাংলা-ভাষা-আন্দোলনকালে (১৯৫২ ফেব্রুয়ারি) হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার ফলে। তার পর আমি কয়েকদিনের জন্য ঐ পদে বসি। তখন তার পরিত্যক্ত কাগজ-পত্রের ভেতর দেখা গেল যে তিনি প্রাদেশিক সরকারকে একটি প্রস্তাবে বলেছিলেন যে বাঙালী মুসলমানদের ভাষা উদুরই একটি রূপান্তর মাত্র এবং উছু হরফে লিখলে ইহা উছু বলেই মনে হবে।
২। কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
১৯০৯ সালের গােড়ার দিকেই কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড বাংলা ও ‘তন্যান্য প্রাদেশিক ভাষা আরবী হরফে লেখার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ পেশ করেছেন বলে একটি খবর প্রচারিত হয়। পূর্ব বাংলা ব্যবস্থাপক সভার অধিবেশন চলাকালে ২৯শে মার্চ মনােরঞ্জন ধর পরিষদে এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এর জবাবে মন্ত্রী একটি লিখিত বিবৃতিতে বলেন যে, শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড পূর্ব বাঙলা অথবা অন্য কোনাে প্রাদেশিক সরকারের কাছে অনুরূপ কোনাে প্রস্তাব বা সুপারিশ পেশ করেন নাই।
সরকারীভাবে প্রাদেশিক মন্ত্রী আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়ষন্ত্রকে অস্বীকার করলেও সে বিষয়ে ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্দেহের অবসান ঘটেনি। এই সন্দেহের মূল কারণ প্রশ্নটি শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের বিবেচাধীন ছিলাে। আরবী হরফকে কেন্দ্রীয় শিক্ষা দপ্তরের মাধ্যমে বাঙালীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ছাত্র সম্প্রদায় এবং জনসাধারণকে সাবধান করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের ‘ভাষা কমিটির পক্ষ থেকে নঈমুদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রদান করেন :
পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত গত বছরের প্রস্তাবটি উর্দু চাপানাের চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়েছিল। আর একই পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবকে বাতিল করতে পারে না। ভবিষ্যতে নব নির্বাচিত পরিষদও এ প্রস্তাবকে নাকচ করবার সাহস করবে না। কাজেই উদুর জন্য সামনের দুয়ার যখন রুদ্ধ তখন আরবী বর্ণমালার জিগীর তুলে পশ্চাৎ দুয়ার দিয়ে উছু প্রবর্তনের চেষ্টা হচ্ছে এবং পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ও বাংলা ভাষাকে খতম করৰার ষড়যন্ত্র চলছে। যখনই আলেম সমাজ আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়েছেন তখনই এরা নীরবতা অবলম্বন করেছেন। আরবীকে
বাধ্যতামূলক বিতীয় ভাষা করার ব্যাপারেও এদের মুখে কথা নেই। সে জিনিসটা পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের মনে সবচেয়ে বেশী আলােড়নের সৃষ্টি করেছে সেটা হচ্ছে এই যে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত লােকের হার শতকরা ১২ থেকে ১৫ জন; কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৫ জনেরও কম। আরবী বর্ণমালার দোহাই দিয়ে শতকরা এই ১৫ জন শিক্ষিতকে কলমের খোচায় অশিক্ষিতে পরিণত করবার চেষ্টা চলেছে। এমনিভাবে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকারও ইংরেজী প্রচলন করে ভারতের আরবী-পারশী শিক্ষিত মুসলমানকে কলমের এক খোঁচায় অশিক্ষিতে পরিণত করবার ষড়যন্ত্রে সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। আরবী বণমালা প্রচলিত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিতের হার ঠিকই থাকবে। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিতের হার শতকরা ১৫ থেকে নেমে আসবে নগণ্য ভগ্নাংশে। শিক্ষক অভাবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান অবস্থাতেই অচল অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। এমতাবস্থায় সমস্ত শিক্ষিত সম্প্রদায় অশিক্ষিত বলে পরিগণিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের গােটা শিক্ষা ব্যবস্থাই বানচাল হয়ে যাবে। কাজেই তােগলকী’ প্ল্যানের উদ্যোক্তাদের আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে আরবী বর্ণমালার ধুয়া তুলে গত বছরের ভাষা প্রস্তাবকে নাকচ করার ষড়যন্ত্রকে আমরা কোনােমতেই সহ করে নেৰ না। এর পর ভাষা সংস্কার কমিটি প্রসঙ্গে নঈমুদ্দীন আহম্মদ বলেন : আফসােসের বিষয় পরিষদের এ সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্য গত তের মাসের মধ্যে সরকারের তরফ হইতে কোনাে চেষ্টা হয় নাই। অন্ততঃ চার বার ভাষা সংস্কার কমিটি গঠনের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছে এবং জনাব মওলানা মহম্মদ আকরাম খাঁ সাহেব প্রত্যেকবারেই এ সংবাদ অস্বীকার করিয়াছেন। প্রকাশ শিক্ষা দফতর হইতে ভাষা সংস্কার কমিটি নিয়ােগ সম্পর্কীয় ফাইলটা গত বার মাস নিখোজ থাকে এবং আজও নাকি তাহা পাওয়া যায় নাই। বর্তমান বাজেট অধিবেশনের পূর্ব মুহূর্তে ভাষা সমস্যা বিশেষ করিয়া বর্ণমালা সম্পর্কীয় আন্দোলন যখন দানা বাঁধিয়া উঠিতে শুরু করে ঠিক সেই সময় উহা বন্ধ করার জন্যই একটা কমিটির নাম প্রচার করা হয়। সত্যিকার ভাষাবিদদের বাদ দিয়া যিনি বাংলা ভাষার জন্য জেহাদ করিতে চাহিয়া পরে চুপ করিয়া গিয়াছেন তাহাকেই সভাপতি এবং জনৈক উদ, সমর্থককে কমিটির সেক্রেটারী নিযুক্ত করা
২৭০
হইয়াছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে চক্ষু ও ক্ষত চিকিৎসকও আছেন। কমিটিতে দুইজন ভাষাবিদকে অবশ্য লওয়া হইয়াছে, সম্ভবতঃ সে শুধু লােক দেখানাের জন্যই। আমরা দ্বিধাহীন ভাষায় জানাইয়া দিতে চাই যে আরবী বর্ণমালার ধূয়া তুলিয়া গত বছরের ভাষা প্রস্তাবকে নাকচ করার চেষ্টা, ছাত্র সম্প্রদায় ও জনসাধারণ বরদাস্ত করিবে না।
এর পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন-কর্মচারী ধর্মঘট শুরু হওয়ার ঠিক পরই ফজলুল হক হল মিলনায়তনে ৪ঠা মার্চ বিকেল ৪-৩০ মিঃ পূর্ব পাকিস্তানের হরফ সমস্যা এবং সােজা বাংলা প্রবর্তন সম্পর্কে তমদ্দন মজলিসের সাহিত্য শাখার উদ্যোগে একটি আলােচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত স্থায়ী সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রহমান খান। ‘সােজা বাংলা’র উপর ডক্টর শহীদুল্লাহ একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। এর পর আলােচনা করেন কাজী মােতাহার হােসেন এবং সৈনিক সম্পাদক শাহেদ আলী। চাটগাঁ সরকারী কলেজের অধ্যাপক কেরদৌস খানের লেখা একটি ইংরেজী পুস্তিকার সহজ বাংলা অনুবাদ পাঠ করে সকলকে শােনান। পরিশেষে সভায় বাংলা ভাষার হরফ নির্ধারণের দায়িত্ব সত্যিকার ভাষা বিশেষজ্ঞদের উপর ছেড়ে দেওয়ার দাবী জানিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দাসূচক একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
পূর্ব বাঙলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের প্রতিবাদ জ্ঞাপনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরাও এ ব্যাপারে সুষ্ঠুভাবে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন এবং ১৯৬৯-এর এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে হরফ প্রশ্ন সম্পর্কে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড ও বর্ণমালা বিবেচনার বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এই স্মারকলিপিটিতে তারা বলেন :
আমরা মনে করিতেছি যে, আরবী হরফ প্রণয়ন প্রচেষ্টার দ্বারা পৃথিবীর ষষ্ঠ স্থানাধিকারী বিপুল ঐশ্বর্যময়ী ও আমাদের জাতীয় জীবনের গৌববের ঐতিবাহী বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর হামলা করা হইতেছে। পাকিস্তানের জাতীয়তার ভিত্তি দৃঢ়তর করিতে, জাতীয় সংস্কৃতিকে অগ্রগামী করিতে এবং দুনিয়ার অন্যান্য জাতির সহিত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় ইহাকে আত্মনির্ভরশীল ও সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে অগ্রসর হইয়া বাংলার মতাে একটি আঞ্চলিক প্রগতিশীল ভাষা,
সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর এই প্রকার নির্বোধ আক্রমণকেবলমাত্র আমাদের জাতীয় জীবনের বন্ধাত্ব এবং পশ্চাগতিই টানিয়া আনিবে না বরং ইহার অপমৃত্যুই ডাকিয়া আনিবে। এতএব সংস্কার মােহ এবং স্বার্থশূন্য দৃষ্টিতে আমরা আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ এবং জাগ্রত জনসাধারণকে বিষয়টি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ হইতে ধীর ও স্থির মস্তিষ্কে বিবেচনা করিয়া সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে আরজ জানাইতেছি। নিঃসন্দেহে বাংলায় আরবী হরফ প্রণয়ন যে জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনের অগ্রগতিকে চিরতরে রুদ্ধ করিয়া দিবে তাহার স্বপক্ষে আমরা নিম্নলিখিত বৈজ্ঞানিক ও পক্ষপাতশূন্য যুক্তি উপস্থাপিত করিতেছি : * পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষাগুলির জন্য আরবী হরফের যে সুপারেশ করিয়াছেন একমাত্র বাংলার উপরই তাহার আঘাত তীব্র এবং ব্যাপকভাবে পড়িবে। পাঞ্জাবী, সিন্ধী, ব্রাহুই, বেলুচী, পুতু এবং বাংলা-পাকিস্তানের এই প্রাদেশিক ভাষাগুলির মধ্যে একমাত্র বাংলাই সাহিত্য সম্পর্কে ভাব ঐশ্বর্যে, প্রকাশভঙ্গীর ঔৎকর্ষে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম। অন্যান্যগুলির সাহিত্যে কোনাে চর্চা নেই এবং বর্তমানে এই মৃতকল্প ভাষাগুলি উদুহরকেই লিখিত হইতেছে। কাজেই হরক পরিবর্তনের আঘাত পাকিস্তানের সর্বপ্রধান এবং অধিক সংখ্যক লােকের ভাষা বাংলার উপরই পড়িবে। অনভিজ্ঞ এবং মুখ লােকেই শুধু বলিতে পারে হরফ পরিবর্তনে ভাষার কোনাে ক্ষতি-বৃদ্ধি নাই। পাকিস্তানের প্রদেশগুলির এবং মুসলিম দেশগুলির সাংস্কৃতিক ঐক্যের অজুহাত কি হরক পরিবর্তনের প্রধান যুক্তি। কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপায় কি হরক? ইহা যাহার। বলে, হয় তাহারা কিছুই বুঝে না, না হয় লােককে ভুল বুঝাইবার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক ভূইফোড়েরা বা সাংস্কৃতিক অপগণ্ডের দল হরফকে ঐক্যের উপায় মনে করিতে পারে, কিন্তু সাংস্কৃতিক ঐক্যের উপায় পারস্পরিক সাংস্কৃতির প্রতি দরদ। পাকিস্তানের সংস্কৃতি যদি সর্বাঙ্গীন বিকাশ এবং পরিপূর্ণ উৎকর্ষ লাভ করে তাহা হইলেই মাত্র অন্যান্য মুসলিম দেশগুলির শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া সাংস্কৃতিক ঐক্যের পথ পরিষ্কার করিতে পারে। পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল, প্রতিটি শহর, গ্রাম যদি পরিপূর্ণভাবে আত্মপ্রকাশ করিতে পারে তবেই পাকিস্তানের সুস্থ সবল সর্বাত্মক সংস্কৃতি গড়িয়া উঠিতে পারে। কিন্তু অবাহনীয় জেল এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের বশবর্তী
হইয়া যদি পাক-বাঙলার আত্ম-সংস্কৃতির উৎকর্যের পথ বন্ধ করা না হয়, তাহা হইলে পাকিস্তানের সামগ্রিক সংস্কৃতিকেই আঘাত করা হইবে, মুসলিম জাহানের ঐক্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হইবে,।। পাক-বাঙলার শতকরা ৯৫ জন অশিক্ষিত লােকের মধ্যে দ্রুত শিক্ষা বিস্তারের প্রয়ােজন। বহুসংখ্যক শিক্ষিত লােককে এই কার্যের জন্য অগ্রসর হইতে হইবে। কিন্তু বাংলা হর পরিবর্তনের মধ্য দিয়া পাক-বাঙলার শিক্ষিত সমাজকে অশিক্ষিতের শ্রেণীতে পরিণত করার চক্রান্ত সকল হইলে কে তাহাদিগকে শিক্ষা দান করিবে? এ পর্যন্ত যে লক্ষ লক্ষ পুস্তক বাংলা ভাষায় ছাপা হইয়াছে কে কবে সেগুলিকে আরবী হরকে রূপান্তরিত করিবে? হরক পরিবর্তনের পশ্চাতে আছে শিক্ষা বিস্তারকে ব্যাহত করিবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। হরক পরিবর্তনের মধ্য দিয়া পাক-বাউলার শিক্ষিত সমাজের উপরও ঘৃণিত আঘাত নামিয়া আসিতেছে। হর পরিবর্তনের বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিশাহারা শিক্ষিত সমাজ সৃষ্টির অনুপ্রেরণাকে স্থায়ীরূপ দান করিতে পারিবে না। আজাদীর মধ্য দিয়া লব্ধ পাক-বাঙলার নূতন জীবন চেতনাকে যদি হরফ পরিবর্তনের অছিলায় ব্যর্থ করিয়া দেওয়া হয় তাহা হইলে পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি হইবে। আঞ্চলিক প্রভুত্ব লাভের দুরাকাঙ্খা এমনিভাবে পাকিস্তানের শত্রুতা করিতে যাইতেছে। পাকবাঙলার মনে নূতন পরাধীনতার আশঙ্কাকে কায়েম করিয়া তুলিতেছে। সংস্কারমুক্ত মন লইয়া মুক্তির আলােকে বিচার কবিয়া দেখা যায়।
এর পর বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা নিজের বক্তব্যকে আরও সরাসরি ‘ভাবে উপস্থিত করার উদ্দেশ্যে বলেন :
(১) বাংলাকে আরবী হরফে লিখিতে হইলে নূতন যে প্রতীকগুলি গ্রহণ করিতে হইবে, তাহা শিখিবার জন্য একজন আরবী জানা লােকের যে পরিমাণ শ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রয়ােজন, তাহা অপেক্ষা অনেক কম শ্রম অধ্যবসায়ে বাংলা হরক শিক্ষা করা সম্ভব। (২) কাজেই কোরান তেলাওয়াতের জন্য আরবী হরফ শিখিতে হয় বলিয়া আরবী হরকে বাংলা লিখিত হইলে লােকের শ্রম লাঘব হইবে তাহা বলা চলে না। (৩) লিখন পঠনে আরবী হরক বাংলা হরফ হইতে অধিক সময় লয়। (৪) বাংলা হরফকে অতি সহজে টাইপ লিখাে-টাইপ প্রভৃতির উপযােগী
করিয়া লওয়া যাইতে পারে। আরবী হরফে তাহা সম্ভব নহে। (৫) ন শিক্ষার্থীর পক্ষে আরবী হরফ (বাংলা ধ্বনি-তত্বের অনুযায়ী) শিক্ষা অপেক্ষা বাংলা হরফ শিক্ষা সহজ। (৬) হরফ পরিবর্তনের ভিতর শিক্ষার দ্রুত প্রসার ব্যাহত হইবে। (৭) পাক বাঙলার শিক্ষিত লােকের উপর যে আঘাত আসিবে, তাহাতে সারা পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পুষ্টি অবাঞ্ছনীয়ভাবে ব্যাহত হইবে। (৮) বাংলাভাষার সর্বাঙ্গীণ পরিপুষ্টি ও উন্নত বাচনভঙ্গীর সহিত হরক পরিবর্তনের মধ্য দিয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িলে পাক-বাঙলার ভাষা-সাহিত্যবিজ্ঞান প্রভৃতির গভীর ভাব প্রকাশের অনুপযােগী হইয়া পড়িবে। (৯) বাংলাকে আরবী হরফে লিখিলেই উহার সহিত আরবী হরক জানা লােকের পরিচয় স্থাপিত হইবে না।
উপরােক্ত বক্তব্য পেশ করিবার পর স্মারকলিপিটির শেষে তারা নিম্ন লিখিত দাবী উত্থাপন করেন :
এই সকল বিবেচনা করিয়া, পাকিস্তানকে সম্পদ ও সংস্কৃতিতে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র হিসাবে দেখিতে চাই বলিয়া আমাদের দাবী অন্ধ সংস্কার ও ক্ষুদ্র স্বার্থের উধে উঠিয়া হরফ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হইবে। বাংলা হরফকে পরিবর্তন করা চলিবে না। পাক-বাঙলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির উপর কসাইয়ের মতাে ছুরি চালনা করা চলবে না। পাক-বাঙলার তাহজীব ও তমদুনকে পাকিস্তানের সামগ্রিক তমদ্দনের একটি সবল অংশ হিসাবে গড়িয়া উঠিবার সুযােগ দিতে হইবে। শিক্ষা বিস্তারকে সহজতর করিতে হইবে। আমরা আশা করি পাকিস্তানের শিক্ষা উপদেষ্টা বােঙ আমাদের দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়া পাকিস্তানের ঐক্য এবং উন্নতির প্রতি তাহাদের নিষ্ঠার পরিচয় দিবেন।
বাংলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের স্মারকলিপি প্রেরণের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ সীমাবদ্ধ ছিলো না। বিভিন্ন সভা-সমিতির মাধ্যমেও তারা শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটির নানা সুপারিশের বিরুদ্ধাচরণ করেন। ১ই ডিসেম্বর, ১৯৪৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী সংসদের কার্যকরী পরিষদের এক সভায় আরবী হরফে বাংলা ভাষা লিখিবার তীব্র বিরােধিতা করা হয়। সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে বলা হয় যে, আরবী হরকে বাংলা ভাষা লিখিবার পরিকল্পনা পূর্ব বাঙলার জনসারণের উন্নতির একান্ত পরিপন্থী। ঐরূপ
পরিকল্পনা যাতে কখনই কার্যকরী না হয় তার জন্য প্রস্তাবটিতে পূর্ব বাঙলা সরকারের কাছে আবেদন জানানাে হয়।
সে দিনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা একটি পৃথক সভায় আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবের বিরােধিতা করে একটি প্রস্তাবে দাবী জানান যে পরবর্তী ১৪ই থেকে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের যে অধিবেশন হবে তাতে বাংলা ভাষার হরক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত যেন গৃহীত না হয়।
১১ই ডিসেম্বর বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রাঙ্গণে এক ছাত্র সভায় আরবী হরকে বাংলা লেখার প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলােচনা হয়। সভায় বিভিন্ন বক্তা উক্ত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়ার পর একটি প্রস্তাবে তারা বলেন যে আরবী হরক প্রবর্তিত হলে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে নিরক্ষরতা বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে শিক্ষা ও রাজনীতি ক্ষেত্রে পূর্ব বাঙলার অপমৃত্যু ঘটবে। এ সম্পর্কে তারা ব্যবস্থা-পরিষদের সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ ছাড়া অন্য একটি প্রস্তাবে বাংলার বিরুদ্ধে উদুর প্রচার কার্যের প্রতিবাদ কবা ইডেন কলেজের দু-জন ছাত্রীকে উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ শাস্তি দেওয়ার যে হুমকি দেখান তারও নিন্দা করা হয়।
ঐ একই দিনে ইকবাল হলের ছাত্রবৃন্দ একটি সভায় আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। আরবী হরফে বাংলা লেখা হলে সাধারণ ভাবে সমগ্র পাকিস্তানে এবং বিশেষভাবে পূর্ব বাঙলায় অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হবে এই মর্মে সভায় মত প্রকাশ করা হয়। জাতির সাংস্কৃতিক ও ব্যবহারিক উন্নতির স্বার্থে আরবী হরফে বাংলা পরিকল্পনা পরিত্যাগ করে। বাংলা হরক ভাষা সাহিত্য ও শিক্ষাকে যুগােপযােগী করে তোলার জন্যে এই সভার গৃহীত একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মহলকে অনুরােধ জানানো হয়।
একটি ছাত্র প্রতিনিধি দল ১১ই ডিসেম্বর পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থা পরিষদের সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে বাংলা হরফের পক্ষ সমর্থনের জন্যে অনুরােধ জানান। এই সাক্ষাৎকারের পর জানা যায় যে অধিকাংশ পরিষদ সদস্যই। আরবী হরকে বাংলা লেখার বিরােধী।১০ শুধু ছাত্র সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের কর্মসূচীকে সীমাবদ্ধ না রেখে ছাত্রের এই সময় আরবী হরফ প্রচলনের বিরােধিতা করে বিভিন্ন এলাকায় জনসারণের স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেন। | বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ছাড়া জগন্নাথ কলেজ, ইডেন কলেজ প্রভৃতি শিক্ষায়তনগুলিতেও আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। শুধু ঢাকা শহরেই নয়, প্রদেশের অন্যান্য স্থানেও এই ধরনের
২৭৫
বহু সভা-সমিতির খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত সভাগুলিতেই আরবী হরফ প্রচলনের প্রচেষ্টা থেকে বিরত হওয়ার জন্যে শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের কাছে তারা দাবী জানান। | ঢাকা এবং প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরবী হরফ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভের ফলে সে সম্পর্কে পূর্ব বাঙলা সরকার ১৪ই ডিসেম্বর একটি প্রেসনােট১৩ জারী করে তাতে বলেন যে বাংলা ভাষা বাংলা হরফে লেখা হবে, না আরবী হরফে লেখা হবে সেটা পূর্ব বাঙলার জনসাধারণই তাদের স্বাধীন মতামতের দ্বারা নির্ধারণ করবে। পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের অধিবেশনে এ সম্পর্কে কোনাে আলােচনাই অনুষ্ঠিত হবে না। প্রেস নােটটিতে আরও বলা হয় ?
বাংলা ভাষায় আরবী হরফ চাপাইয়া দেওয়ায় ব্যবস্থা করা হইতেছে এবং এই উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের ঢাকা অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইতেছে—এইরূপ মিথ্যা গুজব রটাইয়া এক বিশেষ মহলের লােকেরা ঢাকার ছাত্র সমাজের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছে তৎপ্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। কিন্তু শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের সভায় এ সম্পর্কে কোনাে আলােচনাই হইবে না। কাজেই বাংলা ভাষার উপর কোনাে হরফ চাপাইয়া দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। বাংলা ভাষা বর্তমান চালু হরফে লিখিত হইবে, কি আরবী হরকে লিখিত হইবে প্রদেশবাসীর স্বাধীন মতামতের দ্বারাই তাহা নির্ধারিত হইবে। যে সকল লােক স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ছাত্র সমাজকে কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিতেছে, তাহাদের এই সকল ভিত্তিহীন গুজবে বিভ্রান্ত না হইবার জন্য সরকার এতদ্বারা ছাত্রগণকে সতর্ক করিয়া দিতেছেন।
কিন্তু এই সরকারী প্রেসনােট প্রকাশিত হওয়ার দিনই পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ঢাকায় শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের বৈঠকে এক বক্তৃতায়১৪ ইসলামী নীতির ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন এবং জাতীয়ভাষা উদুর সর্ববিধ উন্নতি সাধনের জন্যে দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানান। ইসলামী শিক্ষা প্রবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন :
ইসলামের নীতি যে কোনাে দৃষ্টিভঙ্গী হইতে পরীক্ষা করিলে ইহার সহিত আধুনিক যুগের সর্বাধিক উন্নত বােধশক্তির নিখুত মিল দেখা যাইবে। সুতরাং বিশ্বের নব বিধান প্রতিষ্ঠার কাধে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ইসলামের নীতি ও আমাদের শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে সংযােগ স্থাপন করিতে হইবে।
বর্তমানে অবিলম্বে যে সমস্যার সমাধান করা আমাদের একান্ত প্রয়ােজন তাহা হইতেছে উৎকৃষ্টভাবে ইসলামের নীতির ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা।
উর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষারূপে বর্ণনা করে তার উন্নতি সাধন সম্পর্কে ফজলুর রহমান বলেন :
উদুর দ্রুত উন্নতির জন্য ব্যাপক অভিযান প্রয়ােজন। পল্লী অঞ্চলে প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, জনপ্রিয় সাহিত্য সৃষ্টি, অভিধান রচনা, এবং বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল শব্দের অনুবাদ প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসাবে একান্ত অপরিহার্য। সিন্ধু ব্যতীত পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বত্র উদুর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হইয়া থাকে। শিক্ষার মাধ্যমিক অবস্থায় সিন্ধু ও পূর্ব পাকিস্তানে বাধ্যতামূলকভাবে উছু শিখিতে হইবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে ইংরেজীর স্থলে উদুর মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার প্রশ্নটি ইহার সহিত জড়িত। শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের বিভিন্ন বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তেও এ সম্পর্কে মতবিরােধ রহিয়া গিয়ছে। এই কারণে সরকারও এই প্রশ্নটি সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করিতে পারেন নাই। এতদুপরি, কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসসমূহের কার্য পরিচালনার জন্য উর্দুকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে। উদুর সমস্যা সমাধানের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড একটি কমিটি গঠন করুন এই আমার অভিমত। প্রাদেশিক সরকারও উর্দু ভাষার জন্য উৎসাহ ও উদ্দীপনার সহিত কাজ করিবেন বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।
ঐ একই দিনে শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের বৈঠকের উদ্বোধনকালে পূর্ব বাঙলার গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বাের্ন বলেন যে শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত। পাকিস্তানে সাধারণ ভাষা হিসাবে উদু প্রত্যেক সরকারী এবং বেসরকারী বিদ্যালয়ে অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণী হইতে উধর্বতন শ্রেণীতে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষণীয় ভাষা হওয়া উচিত।
১৬ই ডিসেম্বর ঢাকাতে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে পাকিস্তান শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের তৃতীয় অধিবেশন শেষ হয়। শিক্ষা বাের্ডের এই তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত বৈঠকসমূহে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কোনাে আলাপ আলােচনার সূত্রপাত না হলেও উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের উপায় উদ্ভাবনের জন্যে বাের্ড একটি উচ্চ ক্ষমতাশালী কমিটি নিয়ােগের সুপারিশ করেন। যেহেতু উর্দুতে সরকারী ও ব্যবসায় সংক্রান্ত কার্যাবলী পরিচালনার
জন্যে এ জাতীয় শব্দাবলীর প্রয়ােজন সেজন্যে উল্লিখিত কমিটি উছু অভিধান ও বিশ্বকোষ প্রণয়ন এবং বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় ও টেকনিক্যাল শৰাবলীর উন্ন প্রতিশব্দও তৈরী করবেন।
এর পর অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের ষড়যন্ত্র হিসাবে তারা শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের এই অধিবেশনে বলেন যে যদি কোনাে ছাত্র তার মাতৃভাষার হরফে লিখিত পুস্তকাদি পাঠে আপত্তি করেন তাহলে তার সেই আপত্তিকে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে।১৬
উর্দু ভাষার সর্বাঙ্গীন উন্নতির জন্যে ফজলুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৫০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ড কর্তৃক একটি কমিটি যথারীতি গঠিত হয়।১৭ ১৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত এই কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন বাবায়ে উ’ ডক্টর আবদুল হক।
৩। কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক আরবী হরফ প্রচলনের উদ্যোগ
কেন্দ্রীয় শিক্ষা দফতরের উদ্যোগে ১৮ই এপ্রিল, ১৯৫০, থেকে পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন জেলায় মােট ২টি কেন্দ্রে আরবী হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়। সরকারী মহলের সূত্রে জানা যায় যে প্রত্যেক শিক্ষা কেন্দ্রে ২৫ থেকে ৩৫ জন ছাত্র শিক্ষা গ্রহণ করতে আৰম্ভ করেছে এবং ছয় মাসকাল তারা ঐ সব কেন্দ্রে শিক্ষা লাভে নিযুক্ত থাকবে।
১৯৪৯ সালে প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষা দান পরিকল্পন। খাতে কেন্দ্রীয় সরকার মােট ৩৫ হাজার টাকা মঞ্জুর করেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে সেই টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে তারা এই খাতে ব্যয় বরাদ্দ করেন ৬৭ হাজার ৭৬০ টাকা। এই সমস্ত টাকাই অবশ্য পূর্ব বাঙলার ক্ষেত্রে খরচ হয় আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের প্রচেষ্টায়। প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ীভাবে গৃহীত পাঠ্য তালিকানুযায়ী কেন্দ্রীয় খরচে তারা আরবী হরফে বাংলা বই ছাপান এবং সেই সমস্ত বই বিনামূল্যে ছাত্রদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া আরবী হরফে বাংলা পাঠ্য পুস্তক রচনাকারীদেরকে পুরস্কার দান করা হবে এই মর্মে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিও প্রচার করা হয় । | আরবী হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষা দানের এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে পূর্ব বাঙলা ভাষা সংস্কার কমিটির সদস্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন :
এছলামী ভাবধারায় উছু বিশেষ সমৃদ্ধিশালী। কাজেই পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মাতৃভাষা যাহাই হউক না কেন, উর্দু শিক্ষার মারফত তাঁহারা বিশেষ লাভবান হইবেন। কিন্তু উ হয়ফের সাহায্যে বাংলা শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করিয়া অর্থ অপব্যয়ের কি মানে থাকিতে পারে? আশ্চর্যের কথা এই যে, উহার সহিত পূর্ব বঙ্গ সরকারের কোনাে সম্পর্ক নাই। এই অর্থহীন ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার এক লক্ষ টাকা ব্যয়। করিবেন। আমার আশঙ্কা হয়, উহা বন্ধ করা না হইলে সরকারী টাকা অপব্যয় করা হইবে।
এর পূর্বেই সেপ্টেম্বর মাসে মৌলানা আকরাম খানের সভাপতিত্বে গঠিত পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটি তার চুড়ান্ত রিপোের্ট বাংলা ভাষায় আরবী হয় প্রচলন অন্ততঃ বিশ বৎসর স্থগিত রাখার জন্যে সুস্পষ্টভাবে সুপারিশ করেন। ডক্টর শহীদুল্লাহ তাঁর বিবৃতিতে এই সুপারিশের প্রতিও সরকার এবং জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান কিন্তু সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলনের উদ্যোগ অব্যাহত রাখেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ১১ই অক্টোবর, ১৯৫০, কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট অধ্যাপক রাজকুমার চক্রবর্তীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষা কেন্দ্রগুলির জন্যে ইতিমধ্যে প্রায় ৩১ হাজার টাকা ব্যয় করেছেন। তিনি আরও বলেন যে উপদেষ্টা বাের্ডের সুপারিশ অনুযায়ী আরবী হরফে লিখিত বাংলা ভাষায় শিক্ষা দান পরিকল্পনার যে কাজ শুরু হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার তা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে কাজ চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের একজন স্থায়ী অফিসারকে স্পেশাল অফিসার হিসাবে নিযুক্ত করেছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ব বাঙলা সরকারের শিক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন সেক্রেটারীকে তত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার একটি স্ট্যাণ্ডিং কমিটিও গঠন করেছেন।
ফজলুর রহমান এ প্রসঙ্গে দাবী করেন যে উপরােক্ত শিক্ষা কেন্দ্রগুলি প্রাপ্ত বয়স্কদেরকে আরবী হরফে বাংলা ভাষা শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি করে চলেছে এবং জনসাধারণের কাছে অত্যন্ত পরিচিত হয়ে উঠছে। এর প্রমাণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন যে সরকারী সাহায্য ব্যতিরেকে স্থানীয়
জনগণের প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে ৩৭টি অনুরূপ বেসরকারী প্রতিষ্ঠান জন্মলাভ করেছে।
এর প্রায় এক বছর পর পূর্ব বাঙলা সরকার আরবী হরফে শিশুদেরকে শিক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯শে সেপ্টেম্বর তারা জানান যে পূর্ব বাঙলায় মুসলমান শিশুদেরকে প্রাথমিক অবস্থায় আরবী হরফের মাধ্যমে তারা শিক্ষাদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট জেলা অফিসারদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নােতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী শিশুরা ১ম এবং ২য় শ্রেণীতে আরবী অক্ষর পরিচয় শিক্ষা করবে এবং ৩য় শ্রেণীতে তাদেরকে আমপারা (কোরানের প্রথম পাঠ) শিক্ষা দেওয়া হবে।
এ ছাড়া প্রদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে ২৩ জন সদস্য নিয়ে প্রাদেশিক সরকার পূর্ব বাঙলা শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি’ নামে একটি কমিটি নিয়ােগ করেন। মৌলানা আকরাম খান এই কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশের পরিবর্তিত অবস্থা ও ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পুনর্গঠনের কাজে সরকারকে পরামর্শ দানই এই কমিটি নিয়ােগের উদ্দেশ্য বলে নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে জানান হয়।
এই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার মাত্র কয়েকদিন পরই শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটির সভাপতি মৌলানা মহম্মদ আকরাম খান ২৪শে সেপ্টেম্বর এক বিবৃতি প্রসঙ্গে আরবী হরফে শিশুদেরকে শিক্ষাদানের সরকারী উদ্যোগে বিস্ময় প্রকাশ করে তার প্রতিবাদে বলেন :
প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে প্রথম শ্রেণী হইতে বালকবালিকাদিগকে আরবী রক শিক্ষাদান এবং চতুর্থ শ্রেণী হইতে উদু অবশ্য পাঠ্য বিষয় হিসাবে প্রবর্তন করার জন্য পূর্ব পাকিস্তান সরকার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন বলিয়া এ. পি. পি. যে খবর পরিবেশন করিয়াছেন তাহা দেখিয়া আমি বিস্মিত হইয়াছি। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক সরকার পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি নামক একটি ব্যাপক শক্তিসম্পন্ন কমিটি গঠন করেন। প্রদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক মাদ্রাসা এবং মহিলা ও সংখ্যালঘুদের শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা সম্পর্কে পরামর্শ দান করার জন্যই এই কমিটি গঠন করা হইয়াছিল। প্রদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। সদস্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ডের সভাপতি, আলীয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল খান
২৮০
বাহাদুর জিয়াউল হক, শামসুল উলেমা মওলানা আবু নাসের ওয়াহিদ ও মওলানা জাফর আহমদ ওসমানীর নাম অন্যতম। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এই কমিটি প্রাদেশিক সরকারের নিকট প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে সােপারেশ করিয়াছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পৰ্কীয় অন্যান্য বিষয়ের চূড়ান্ত সােপারেশও ১৯৫১ সালের জুন মাসে প্রাদেশিক সরকারের নিকট পেস করা হইয়াছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ কি জন্য জানি না, এই সােপারেশ সরকার জনসাধারণের • খেদমতে প্রকাশ করেন নাই। কি জন্য এই সােপারেশ করা হয় নাই তাহা সরকারই ভালভাবে জানেন। ইহা প্রকাশ করা হইলে প্রদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে কমিটি যে সােপারেশ করিয়াছেন, প্রদেশসী তাহা প্রত্যক্ষ জানিবার সুযােগ লাভ করিতে পারিতেন। উপরোক্ত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কমিটির সভাপতি হিসাবে সরকারের সাম্প্রতিক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পৰ্কীয় সিদ্ধান্ত এবং কমিটির প্রকৃত অবস্থা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে কর্তব্য বলিয়া আমি মনে করি। যথাযােগ্য বিবেচনা ও কমিটির সদস্যবর্গের ব্যাপক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত বহু প্রশ্নের উত্তর হিসাবে প্রাপ্ত জনগণের মতামতের উপর নির্ভর করিয়া যে সব সােপারেশ করা হইয়াছে, ইহার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে প্রকাশ করা হইল : (ক) প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা শিক্ষা দেওয়া উচিত হইবে না। প্রাথমিক পর্যায়ে কেবলমাত্র মাতৃভাষা শিক্ষা দেওয়ার নীতি সর্বজনস্বীকৃত। এই নীতি ১৯৪৭ সালে কেন্দ্রীয় শিক্ষা সচিব জনাব ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে করাচীতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত হইয়াছিল। উপরন্তু পাকিস্তানের শিক্ষা সম্বন্ধীয় পরামর্শ বাের্ডও এই নীতি স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। (খ) আরবী বর্ণমালা শিক্ষাদান এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে কোরান ও দীনিয়াত শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা তৃতীয় শ্রেণী হইতে কায়েম করা উচিত। পঞ্চম শ্রেণী হইতে আরবী শিক্ষা দান সম্পর্কীয় সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত হইতে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, গভীরভাবে বিবেচনার পর গৃহীত কমিটির সােপারেশ সরকার কর্তৃক সরাসরি বাতেল এবং উপরে উল্লিখিত দুইটি অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের নির্দেশকে বরখেলাপ করা হইয়াছে। প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে সরকারী উদ্যোগে গঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও
চালানো হবে বলে সেই সভায় একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।
স্টেট ব্যাঙ্কের গভর্নর জাহিদ হােসেনও আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন এবং তার এই প্রস্তাব সিন্ধু আইন পরিষদের সদস্য এবং সিন্ধু আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর সৈয়দ আকবর শাহ কর্তৃক সমর্থিত হয়। এই প্রসঙ্গে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন যে আরবী ভাষা প্রবর্তন করলে মুসলিম জাহানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হবে এবং তার ফলস্বরূপ রাজনৈতিক দিক দিwে এ দেশ লাভবান হবে।
এর পর ১৯৫১ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি করাচীতে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে ইসমাইলী সম্প্রদায়ের নেতা আগা খান বলেন যে আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হলে আরব জাহান, উত্তর আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ যােগাযােগ স্থাপিত হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন :
আমি খেয়ালের বশে কোনাে কিছু বলিতেছি না। আমি যাহা বলিতেছি তাহ। জনসাধারণের এক বিরাট অংশের নিকট অপ্রিয়। কিন্তু তবুও দুনিয়ার মুসলমানদের সম্মুখে আমার মতামত প্রকাশ না করিলে আমার কর্তব্য অসমাপ্ত থাকিবে এবং এছলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হইবে। আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার এই সব প্রস্তাব অবশ্য পাকিস্তানের কোনাে অংশেই তেমন কোনাে সমর্থন লাভ করে নাই। তবে এই দাবী ইসলামী সংস্কৃতির বিকাশের প্রশ্নের সাথে জড়িত থাকায় তা পরােক্ষভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু এবং বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রবর্তনের দাবীকে কতকগুলি মহলে জোরদার করে।
বিভিন্ন মহলে আরবীকে রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয় তার বিরােধিতা করে পাকিস্তান বৌদ্ধ লীগের সেক্রেটারী রবীন্দ্রনাথ বর্মী ১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১, এক বিবৃতি দেন। কিন্তু এক্ষেত্রে আরবীর প্রতিবাদ করে ক্ষান্ত না হয়ে তিনি উদুর সমর্থনে ওকালতিও করেন :
পাকিস্তান মােছলেম লীগ কাউন্সিল সম্প্রতি এক প্রস্তাবে আরবীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করিবার জন্য সােপারেশ করিয়াছেন। পাকিস্তানের স্রষ্টা মরহুম কায়েদে আজম এই ঢাকা শহরে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে, উই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে। কারণ ইংরেজী ভাষার পর উপ-মহাদেশের অধিকাংশ লােকে উর্দু ভাষা সহজে বুঝিতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের কোথাও আরবী ভাষায় কথাবার্তা বলা হয় না। পাকিস্তানের সংবাদপত্র এবং সাময়িক পত্রাদিও উর্দুতে প্রকাশিত
হয়। আমাদের মনে হয় আরবীর পরিবর্তে উহু রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।
সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির পক্ষে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ওকালতি নিতান্তই অস্বাভাবিক। একদিকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যা লাভের ভয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবী করার অক্ষমতা এবং অন্যদিকে আরবীর মতাে একটি সম্পূর্ণ বিদেশী ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা রূপে গ্রহণ করার বিপদ এ দুইয়ের ফলেই খুব সম্ভবতঃ রবীন্দ্রনাথ বর্মীর উদু সমর্থন। কিন্তু কারণ যাই হােক অমুসলমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন প্রতিনিধির পক্ষে এ জাতীয় বক্তব্য পেশ যে চরম সুবিধাবাদ ও মেরুদণ্ডহীনতার পরিচায়ক সে বিষয়ে সন্দেহের বিন্দুমাত্র কারণ নেই।
নবম পরিচ্ছেদ ॥ পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটি ১। পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটির প্রতিষ্ঠা
‘পূর্ব বাঙলায় প্রচলিত বাংলা ভাষা প্রমিতকরণ ও সহজাকরণ ও সংস্কারের প্রশ্ন পরীক্ষার উদ্দেশ্যে ই মার্চ, ১৯৯৯, পূর্ব বাঙলা সরকার পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটি’ নামে একটি কমিটি স্থাপন করেন। ঐ একই সরকারী প্রস্তাবে (পূর্ব বাঙলা সরকার প্রস্তাব নং ৫৯০ ইডেন) নিম্নলিখিতভাবে কমিটির শর্ত নির্দেশ করা হয় :
(1) পূর্ব বাঙলার জনগণের ভাষা (বাংলার ব্যাকরণ, বানান ইত্যাদি সহ ) সহজীকরণ, সংস্কার ও প্রমিতকরণের প্রশ্ন বিবেচনা করিয়া সে বিষয়ে সুপারিশ করা। (২) যে সমস্ত বিদেশী টেকনিক্যাল এবং অন্যান্য শব্দের পরিভাষা উপরোক্ত ভাষায় নেই সেগুলির জন্য নোতুন শব্দ ও ফ্রেজ কিভাবে গঠন করা যায় এবং সেগুলিকে কিভাবে যতদূর সম্ভব অনুবাদ করা যায় তার উপায় নির্দেশ করা। (৩) উপরােক্ত ভাষাকে কিভাবে পাকিস্তান এবং বিশেষ করে পূর্ব বাঙলার প্রতিভা ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায় সে বিষয়ে কমিটি অন্য যা কিছু প্রয়োজনবােধ করেন সেই অনুসারে পরামর্শ দান।
মৌলানা আকরাম খানের সভাপতিত্বে সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত এই কমিটির সদস্যদের নাম নীচে উল্লিখিত হলাে :
১। মৌলানা মহম্মদ আকরাম খান—সভাপতি ২। হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, প্রাদেশিক মন্ত্রী। ৩। ডক্টর আবদুল মােতালেব মালিক, প্রাদেশিক মন্ত্রী। ৪। ডক্টর মােয়াজ্জেম হােসেন, ভাইস-চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৫। মৌলানা আবদুল্লাহ আল বাকী, এম. এল. এ. ৬। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।। আবুল কালাম শামসুদ্দীন, এম. এল. এ. সম্পাদক, দৈনিক আজাদ ৮। সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল, ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল
অব পুলিস, পূর্ব বাঙলা সরকার, ঢাকা।
২৮৫
১। মীজানুর রহমান, ডেপুটি সেক্রেটারী, শিক্ষা বিভাগ, পূর্ব বাঙলা
সরকার ১০। মাজউদ্দিন আহম্মদ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, মুরারীচাদ কলেজ, সিলেট ১১। শইখ শরাফউদ্দিন, অধ্যক্ষ ইসলামী ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ১২। এ. কিউ. এম. আদমউদ্দিন, অধ্যাপক, ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট
কলেজ, নওগাঁ, রাজশাহী ১৩। মৌলভী জুলভিকার আলী, স্বত্বাধিকারী, আলাবিয়া প্রেস, চট্টগ্রাম ১৪। গণেশচন্দ্র বসু, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৫। মােহিনীমােহন দাস। ১৬। গােলাম মুস্তাফা, হেড মাস্টার-সেক্রেটারী
উপরােক্ত সদস্যরা ছাড়াও বিভিন্ন পর্যায়ে নিম্নলিখিত ব্যক্তিদেরকে কমিটির সদস্য করা হয় :
১। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যক্ষ বাংলা বিভাগ, রাজশাহী কলেজ ২। আবদুল মজিদ, পূর্ব বাঙলা সরকারের বাংলা অনুবাদক ৩। অজিতকুমার গুহ, অধ্যাপক জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা
কমিটির কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে কমিটির মধ্যে আরও কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়। গােলাম মােস্তফা সেক্রেটারী হিসাবে কাজ করতে অক্ষম হওয়ায় তার পরিবর্তে ইসলামী ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যক্ষ শইখ শরফুদ্দীন ৯ই মে, ১৯৪৯, সেক্রেটারীর পদে নিযুক্ত হন। এর পর শইখ শরাফুদ্দীনের স্থানে চট্টগ্রামের বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক নজমুল হােসেন চৌধুরী সেক্রেটারী নিযুক্ত হন। তিনি ২১শে মে, ১৯৪৯, নােতুন পদে যােগদান করে সে বছরই ৩০শে জুন অবসর গ্রহণ করেন। এর পর শিক্ষা বিভাগের আবু সাঈদ মাহমুদ ১৯শে জুলাই, ১৯৫৯, পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটির সেক্রেটারীরূপে কার্যভার গ্রহণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যান। এ ছাড়া শিক্ষা বিভাগের আহমদ হােসেনকে অংশকালীন সেক্রেটারী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।
১৯৪৯-এর ডিসেম্বর মাসে ডক্টর মালেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হিসাবে করাচীতে চলে যান এবং তার স্থানে বেসামরিক বিভাগের মন্ত্রী সৈয়দ মুহাম্মদ আফজল কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।
গণেশচন্দ্র বসু কমিটির প্রথম বৈঠকে উপস্থিত থাকার পর আর সদস্য হিসাবে থাকতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় ১৯৫০-এর মে মাসে তার ব্যানে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হরনাথ পালকে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এর পর হরনাথ পালও কমিটির সদস্য হিসাবে থাকতে অনিচ্ছা প্রকাশ করায় ঢাকার জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিতকুমার গুহ ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন।৬।
গােলাম মােস্তফা পর পর কমিটির অনেকগুলি বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ার জন্যে তার পরিবর্তে বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদকে ১৯৫০-এর জুন মাসে কমিটির সদস্য নিযুক্ত করা হয়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। মােহিনীমােহন দাসের মৃত্যুর পর তার স্থানে ১৯৫০-এর মার্চ মাসে কমিটির সদস্য নিযুক্ত হন পূর্ব বাঙলা সরকারের তফশিলী শিক্ষার স্পেশাল অফিসার। অম্বিকাচরণ দাস।
কবি গােলাম মােস্তফার সাথে পূর্ব বাঙলা কমিটির সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে পূর্ব বাঙলা সরকারের প্রাক্তন শিক্ষা ডিরেক্টর আবদুল হাকিম বলেন :
কবি এই সময় একটা শক্তিশালী বাংলা ভাষা বিরােধী মিচক্রের সান্নিধ্যে এসে তাদের বেড়াজালে আটকা পড়বার মতাে হয়েছিলেন। চক্র নানাছলে রটাতে চেষ্টা করছিল যে এত বড় জনপ্রিয় বাঙালী কবিও তাদের। সাথে রয়েছেন এবং বাংলা ভাষাকে উদু হরফে লিখবর প্রস্তাবে রাজী। হয়েছেন। কবি যে ভাষা সংস্কার কমিটির সেক্রেটারী ছিলেন তদ্বারা উক্ত। মতের পরিপােষক সুপারিশ করাবার জন্য ঐ চক্র থেকে পীড়াপীড়ি শুরু হয়। কবিকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন তারা কখনই বিশ্বাস করতে পারতেন
যে তিনি বাংলা ভাষা বিরােধী উক্ত চক্রের সঙ্গে সহযােগিতা করে তাদের কার্যসিদ্ধির সহায়ক হতে পারেন।১০
এ সম্পর্কে ভাষা কমিটির অন্যতম সদস্য এবং গােলাম মােস্তফার পরবর্তী সেক্রেটারী শইখ শরাফুদ্দীন বলেন :
আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত না হলেও কুরআন মজিদ পাঠ ও তরজমা উপলক্ষে আরবী ভাষার প্রতি তিনি বিশেষভাবে ঝুকে পড়েন। এমন কি তিনি বাংলা ভাষাতেও আরবী ব্যবহারের বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন। এই কারণে কেউ কেউ তাকে বাংলায় আরবী হরফের উদ্যোক্তা এডুকেশন। সেক্রেটারী ফজলী সাহেবের ধামাধরা বলে বিদ্রুপ করতেন। কিন্তু তারা। বােধহয় জানেন না যে, প্রকৃত ব্যাপারটি এর বিপরীত। কারণ গােলাম। মােস্তফা সাহেবকে পূর্ববঙ্গ ভাষা কমিটির সেক্রেটারী নিযুক্ত করার। পরপরই ফলজী সাহেবের সঙ্গে মতবিরােধের ফলেই তিনি ঐ কমিটির
সেক্রেটারী পদ ত্যাগ করেন। এমন কি এই উপলক্ষে তার আসল সরকারী চাকরি হেডমাস্টারী পদেও ইস্তফা দিয়ে তিনি নিবিষ্টভাবে সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হন।
উপরােক্ত দুইজনের বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে কবি গােলাম মােস্তফা আরবী হরফ প্রবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের সাথে বহুভাবে সহযােগিতা করেছিলেন। কিন্তু একথাও আবার সত্য যে ভাষা কমিটির সেক্রেটারী হিসাবে কর্তৃপক্ষ মহলের সাথে তার একটা মতানৈক্য ঘটে, যার ফলে তিনি সরাসরি ইস্তা না দিলেও কমিটির বৈঠকগুলিতে যােগদানে বিরত থাকেন এবং সেজন্যে পরিশেষে কমিটির সদস্যপদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গণেশচন্দ্র বসু এবং হরনাথ পালও যে কমিটির সাথে একমত হতে না পারার জন্যে তার থেকে বিদায় গ্রহণ করেন সে বিষয়েও কোনাে সন্দেহ নেই। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ বাংলা ভাষাকে ইসলামী করার এবং বাংলা ভাষায় আরবী অক্ষর প্রবর্তনের নানা প্রচেষ্টার তােলপাড়ের মধ্যে অমুসলমান হিসাবে কমিটির আবহাওয়া তাদের পক্ষে রীতিমতাে অস্বস্তিকরই ছিলাে।
২২শে ও ২৩শে জুন, ১৯৪৯, মৌলানা আকরাম খানের সভাপতিত্বে পূর্ব বাঙলা ব্যবস্থাপক সভার কমিটি রুমে ভাষা কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২২ তারিখে অনেকগুলি প্রশ্নের উপর বিস্তারিত আলােচনার পর স্থির হয় যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের মতামত সংগ্রহের জন্যে একটি প্রশ্নমালা প্রস্তুত করে সেটিকে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা দরকার। এর পর দিনের বৈঠকে প্রশ্নমালাটির একটি খসড়া পেশ করা হয় এবং সেটি বহুক্ষণ আলােচনার পর পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত অবস্থায় গৃহীত হয়।
২। কমিটির কার্যপ্রণালী
| ২৩শে জুন যে প্রশ্নমালাটি কমিটির দ্বারা গৃহীত হয় সেটি প্রাদেশিক ব্যবস্থা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় সংবিধান সভার সদস্য ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কোর্টের সদস্য ; ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ডের সদস্য ও কর্মচারী ; সেক্রেটারিয়েট ও শিক্ষা ডাইরেক্টরেটের কর্মচারী; সকল জেলা ও বিভাগীয় কর্মচারী, মাদ্রাসা ও কলেজের অধ্যক্ষ; সমস্ত সরকারী মাধ্যমিক স্কুল এবং কয়েকটি বাছাবাছা বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল; সমস্ত জেলা বাের্ড, লােকাল
বাের্ড, জেলা স্কুল বাের্ড ও মিউনিসিপ্যালিটি; এবং সকল শিক্ষাবি সাহিত্যিক এবং গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে মতামতের জন্যে পাঠানাে হয়। | সর্বমােট ১২০০ কপি প্রশ্নমালা উপরােক্ত ব্যক্তিদের কাছে পাঠানাে হয়। এবং তার মধ্যে ৩০৪ জন সেগুলি ফেরত পাঠিয়ে তার মাধ্যমে কমিটিকে নিজেদের মতামত জানান। এই উত্তরগুলির সারাংশ তৈরী করে একটি ছােট পুস্তিকা ছাপা হয় এবং পর্যালােচনার জন্যে কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
এছাড়া রেডিও পাকিস্তান এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রশ্নমালাটি প্রচার করা হয় এবং জনসাধারণকে সে সম্পর্কে তাদের মতামত কমিটির কাছে পাঠানাের জন্যে তারা অনুরােধ জানান। এর ফলে সংবাদপত্রে ও সাময়িক পত্রিকাদিতে কিছু বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং কমিটি এই ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধের মতামতও বিবেচনা করেন। অনেকে সরাসরিভাবে কমিটির কাছে লিখিতভাবে তাদের মতামত জানান। কমিটি তাদের রিপাের্টে এ প্রসঙ্গে তিনজনের নাম উল্লেখ করেন : ইব্রাহীম খা, ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বাের্ডের সভাপতি ; ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ; এবং আবদুল মজিদ, পূর্ব বাঙলা সরকারের বাংলা অনুবাদক ও রেজিস্ট্রার অব পাবলিকেশন। | কমিটি রিপাের্টে বলেন যে তারা তাদের মতামত গঠনের ক্ষেত্রে অনেকগুলি বইপত্রের দ্বারাও উপকৃত হন। এ সমস্ত বইয়ের লেখকদের মধ্যে কতকগুলি নাম তারা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। যেমন : ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল, ফিরদৌস খান, মৌলভী জুলফিকার আলী, হেকমতী হুরুদে’র লেখক জাফর আলী। এ ছাড়া ‘Farsight ছদ্মনামে লিখিত একটি রচনা এবং তন্দুন মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত অপর একটি পুস্তিকার কথাও উল্লেখ করেন।
৩। ভাষা কমিটির বৈঠক
২৩শে জুন, ১৯৪৯, ভাষা কমিটির বৈঠকে কয়েকজন সদস্য বলেন যেসরকার ভাষা কমিটির যে শর্ত নির্দেশ করেছেন তাতে হরক পরিবর্তনের কোনাে কথা নেই এবং সেই হিসাবে হরক পরিবর্তনের সম্পর্কে আলােচনা কমিটির এখতেয়ার বহিভূত। কিন্তু অন্যেরা বলেন যে সংস্কার এবং সহজীকরণের কথা যখন
বলা হয়েছে তখন তার মধ্যেই হরফের প্রশ্নও এসে যেতে পারে এবং সেটাও বিবেচনা করা দরকার। কিছুক্ষণ এ বিষয়ে আলােচনার পর সভাপতি আকরাম খান এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেন যে সরাসরি হরফের কথা উল্লিখিত না হলেও হরফের প্রশ্নটি পূর্ব বাংলার লােকের প্রতিভা ও সংস্কৃতির সাথে জড়িত, কাজেই সেটি কমিটির আলোচনার এখতেয়ারভুক্ত।
এ সময় একজন সদস্য জানতে চান যে কমিটির কাজের সাথে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ জড়িত আছে কিনা। এর উত্তরে সভাপতি বলেন যে শর্তনির্দেশের ১ এবং ৩ ধারায় পূর্ব বাঙলার জনগণ” এই ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে কাজেই সংখ্যালঘুরাও তার অন্তর্গত। এই প্রশ্ন খুব সম্ভবতঃ গণেশচন্দ্র বসু উথাপন করেন এবং মৌলানা আকরাম খানের ব্যাখ্যায় তাঁর সন্দেহভঞ্জন না হওয়ায় তিনি কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট থাকতে নিজের অসম্মতির কথা তাদেরকে জানান। এই বৈঠকের পর তিনি কমিটির কোনো পরবর্তী বৈঠকে আর যোগদান করেননি।
১৯৫০-এর ১০ই মার্চের বৈঠকে অনেকেই অনুপস্থিত ছিলেন কাজেই সেদিন বিশেষ কোনাে আলোচনা হয়নি। তবে মোটামুটি ভাবে তারা স্থির করেন যে ভাষা সমস্যার বিভিন্ন দিক বিস্তারিতভাবে বিবেচনার জন্যে কয়েকটি সাব কমিটি গঠন করা প্রয়ােজন। | ৩রা মে কমিটির তৃতীয় বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে স্থির হয় যে হরক পরিবর্তনের প্রশ্নে রােমান হরফের কথা বিবেচনার কোন প্রয়ােজন নেই। এক্ষেত্রে উর্দু হরফই প্রাসঙ্গিক। কাজেই উদু হরক এবং সহজীকৃত বাংলা হরফের মধ্যেই আলােচনা সীমাবদ্ধ রাখা দরকার। | হরক প্রশ্নের উপর অনেক আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে সহজীকৃত বাংলা হরফ অথবা উদুহর প্রবর্তনের প্রশ্নটি আপাততঃ স্থগিত রেখে এই দুই হরফের উপযোগিতা প্রথমে পরীক্ষা করে দেখা দরকার। তার জন্যে উপরােক্ত দুই হরফের অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের উপর বিস্তৃতভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়ােজনের উপরেও তারা গুরুত্ব আরোপ করেন।
এই পর্যায়ে কয়েকজন সদস্য উল্লেখ করেন যে উছু হরকের মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার একটা পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। কাজেই সে বিষয়ে নোতুনভাবে আর কিছু করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আলােচার,পর কমিটি স্থির করেন যে কেন্দ্রীয় সরকার যে পরীক্ষা কার্য হাতে নিয়েছেন তার নির্ভরতা যাচাই করার জন্যে তারা যে অবস্থায় এবং যে
২৯০
বিষয়গুলি নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছেন সেই বিষয়গুলি নিয়েই আৱাে পরীক্ষা। চালানাে দরকার।
এই সিদ্ধান্তের পর ডক্টর শহীদুল্লাহ প্রস্তাব করেন যে এই জাতীয় পরীক্ষা। শুধু উহু এবং সহজীকৃত বাংলা হরফে না চালিয়ে প্রচলিত বাংলা অক্ষরেও চালানাে দরকার। তার প্রস্তাব অন্য কোনাে সদস্য সমর্থন না করায় সেটি বাতিল হয়ে যায়।
সেদিনের বৈঠকে কমিটি বাংলা ভাষার সংস্কার ও সহজীকরণের জন্যে একটি সাব-কমিটি নিযুক্ত করেন। সেই কমিটিতে থাকেন-মৌলানা আকরাম খান (সভাপতি), হাবিবুপ্তাহ বাহার, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল, অজিতকুমার গুহ, ডক্টর এনামুল হক এবং আবদুল মজিদ।
| ১৯শে ও ২০শে অগাস্ট ভাষা কমিটির চতুর্থ বৈঠকে আরাে দুটি সাব-কমিটি গঠিত হয়। বিদেশী শব্দ বাংলায় শব্দান্তরিত করার জন্যে যে সাব-কমিটি তঁারা গঠন করেন তাতে থাকেন ; মৌলানা আকরাম খান (সভাপতি), আবুল হাসান ইসমাইল, শইখ শরফুদ্দীন, এ. কিউ. এম. আদিম উদ্দীন এবং আবু সাঈদ মাহমুদ (কনভেনর)। উহু হরফ সাব কমিটির সদস্য থাকেন : মৌলানা আকরাম খান (সভাপতি), শইখ শরফুদ্দীন, এ. কিউ. এম. আদমউদ্দীন, জুলফিকর আলী এবং আবু সাঈদ মাহমুদ (কনভেনর)।১০
১৯শে সেপ্টেম্বর ভাষা কমিটির পঞ্চম বৈঠকে হরক প্রশ্নের উপর কতকগুলি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে কমিটি উদুহরক সাব-কমিটির রিপাের্টটি আলােচনা করেন। সাব কমিটির রিপাের্টতে বলা হয় :
সুতরাং যেহেতু আরবীতে কোরান পাঠ সকল মুসলমানের জন্যে বাধ্যতামূলক ও সেই হিসাবে প্রস্তাবিত প্রাথমিক শিক্ষা স্কীমে পাঠ্যতালিকাভুক্ত এবং বাংলা ও উর্দু (উর্দু হচ্ছে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা) উভয় ভাষাই প্রস্তাবিত মাধ্যমিক স্কীমে উদুভাষী ও বাংলাভাষী শিশুদের জন্যে অবশ্য পাঠ্য বিষয় এবং যেহেতু সহজীকৃত অবস্থাতেও বাংলা হরফ একাধিক হরফের ভার লাঘব করবে না উপরন্তু চিরকালের জন্যে আমাদের জনগণের উপর একটা নিপ্রয়ােজনীয় এবং গুরুতর বােঝা চাপিয়ে দিবে—তাই হরফ, বানান ও ব্যাকরণের মধ্যে বাস্তবতঃ যতখানি সম্ভব ঐক্য বিধান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই হিসাবে উঃ হরফ সাব-কমিটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে সুপারিশ করছে বাংলা হরফের পরিবর্তে উদু (অর্থাৎ ফারসী ও উর্দু।
অক্ষর সংঘােজিত আরবী হরফ) ব্যবহার অৰ প্ৰয়ােজনীয়।
এ ছাড়া নিজেদের মূল সুপারিশকে কার্যকরী করার জন্যে তারা যে পথ নির্দেশ করেন তার মধ্যে বিভিন্ন স্থানে উছু হরফে লেখা বই পড়তে শেখানাের জন্তে শিক্ষকদের শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন এবং মুদ্রক, প্রকাশক ও সংবাদপত্র মালিকদের কাছে উছু হরফ চালু করার আবেদন উল্লেখযােগ্য।১২
উচ্ছ ভাষা সাব কমিটির উপরোক্ত সুপারিশগুলি আলােচনার পর ভাষা কমিটি খুব দৃঢ়ভাবে অভিমত প্রকাশ করেন যে সে পর্যায়ে বাংলা ভাষায় উর্দু হরফ প্রবর্তন বাঞ্ছনীয় অথবা সম্ভব কোনােটিই নয়। এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিতে গিয়ে তারা বলেন :
(ক) সহজীকৃত ও সংস্কারপরবতী অবস্থায় বাংলা হরফ যে রূপ নেবে তাতে সেটা উদু অথবা অন্য যে কোনাে হরফ থেকে পড়া, লেখা, ছাপান অথবা টাইপের কাজের পক্ষে অনেক সহজ হবে। (খ) বাংলা শব্দের উচ্চারণের মধ্যে যে বিশেষত্ব আছে তা উছু হরফের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। (গ) বাংলাতে উছু হরফ গ্রহণ করলে বিগত ৫০ বছরের বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ ঐতিহের সাথে ভবিষ্যৎ বংশধরদের সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে ছি হবে। বাংলা সাহিত্যের বিশাল সম্পদ, যার একটা বড়াে অংশ মুসলিম সাহিত্যিক, কবি ও চিন্তাবিদদের দ্বারা গঠিত, উছু হরফে রূপান্তরিত করা এবং সেটা ছাপার ব্যবস্থা করা এক দারুণ কঠিন ব্যাপার। (ঘ) উছু হরফের আস্ত প্রবর্তন প্রদেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে এবং সেই হিসাবে সেটা শিক্ষার প্রগতির পক্ষে হয়ে দাড়াবে ভয়াবহু। এর দ্বারা যে শুধু যাবতীয় পাঠ্যপুস্তক নােতুন হরফে রূপান্তরিত করার প্রয়ােজন দেখা দিবে তাই নয়। এই প্রয়ােজন মেটানাে প্রায় অসম্ভব এবং তা প্রদেশের সাধ্যের বাইরে। শুধু তাই নয়, এতে করে ••• প্রাথমিক শিক্ষকদের (যারা উদু হরফের সাথে পরিচিত নয় ) মধ্যে শতকরা ৯০ জন বেকারে পরিণত হবে। তাদেরকে নােতুনভাবে শিক্ষা দেওয়া অথবা তাদের পরিবর্তে অন্যদেরকে নিয়ােগ করা সম্ভব হবে না এবং তাতে করে শতকরা ৯টি স্কুল বন্ধ হয়ে যাবে। এ ছাড়া লেখক, বইপুস্তক রচয়িতা, সাংবাদিক, মূদ্রক, কম্পােজিটর প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের লোকের রুজি-রােজগারএরফলে বন্ধ হবে এবং প্রদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে তা ডেকে আনবে বিলা।
এই সব কারণে তারা বাংলা ভাষায় উছু হক প্রবর্তন না কার পারিশ করেন। শইখ শনাক্ষীন এই সুপারিশের বিরােধিতা করায় এ্যাট ভােটে দেওয়া হয়। মৌলানা আকরাম খানসহ আটজন সদস্য প্রস্তাবের সপক্ষে ভােট দেন। বিরােধিতা করেন শইখ শরাফুদ্দীন এবং জুলফিকার আলী। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে শইখ শরফুদ্দীন নিজের বক্তব্য পৃথকভাবে রেকর্ড করেন।
কমিটি এর পর অবশ্য উর্দু ভাষার প্রচলনের জন্যে যথেষ্ট গুরুত্ব আরােপ করে একটি পৃথক প্রস্তাব নেন, যাতে তারা বলেন যে স্কুলে মাধ্যমিক পর্যায় খেকে বাধ্যতামূলকভাবে উর্দু শিক্ষার প্রবর্তন করা দরকার। এই প্রসঙ্গে উর্দু ভাষার সংস্কারের প্রয়ােজনের কথাও অবশ্য তারা উল্লেখ করেন।
১৯শে সেপ্টেম্বরের এই বৈঠকে ভাষা সংস্কার সাব-কমিটির রিপাের্টও আলােচিত হয় এবং সে বিষয়ে ভাষা কমিটি তাদের প্রস্তাবে সাব-কমিটির সুপারিশগুলিকে অনুমােদন করেন। সেগুলিকে কার্যকরী করার জন্যে সরকারের কাছে তারা নিজেরাও কতকগুলি বিশেষ সুপারিশ জানান।১৬
| বাংলা ভাষা, বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা বর্ণমালা, বানান পদ্ধতি ও হরক নােতুন টেকনিক্যাল ও বিদেশী শব্দ বাছাই এবং বিদেশী শব্দের শব্দান্তকরণ ইত্যাদি বিষয়ে কমিটি অনেক রকম সুপারিশ করে।
ভাষা সংস্কার সাব-কমিটির রিপাের্টটিকে প্রায় হুবহু অনুমােন করে সর্বত্র সহজ বাংলার দ্রুত প্রচলনের জন্যে তারা প্রাদেশিক সরকারকে ভালােভাবে তাগিদ দেন।” ‘সাধু ভাষা’ ও ‘চলিত ভাষা আধুনিক বাংলার এই দুই ঢংকেই স্বীকৃতি দেন। কিন্তু সেই স্বীকৃতি অনেকাংশে শর্তাধীন এবং সেই শর্তগুলি হলাে নিম্নরূপ :
১। পূর্ব বাঙলায় প্রচলিত সরল শব্দবিন্যাস ও সহজ বাক্যরীতির ব্যবহার দ্বারা ভাষায় সংস্কৃত প্রভাব যথাসম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে; ২। মুসলিম লেখকদের প্রকাশভঙ্গী ও ভাবসমূহ ইসলামী আদর্শের সাথে stricty confirm করা উচিত, এবং ৩। পূর্ব বাঙলায় সাধারণভাবে ব্যবহৃত শব্দ idiom, phrase, বিশেষত পুথি ও বহুল প্রচলিত সাহিত্যে যেগুলি ব্যবহৃত হয় সেগুলি ভাষাতে আরও স্বাধীনভাবে প্রবর্তন করতে হবে।
উপরিনির্দেশিত নিয়মকানুন অনুসারে কিভাবে বাক্য রচনা করতে হবে সাব কমিটির রিপাের্টে তার কতকগুলি উদাহরণ দেওয়া হয়। উদাহরণগুলি নীচে উর্ধত করা হলাে :
(ক) অরণ্য, বিহঙ্গম-কাকলীতে মুখরিত ও নিঝরণীর কলনাদে নন্দিত
-পাখীর গানে ও ঝরনার গানে বন গমগম করিতেছে। .. (খ) তিনি যাবতীয় বিষয় আনুপূর্বিক অবগত হইয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন
– তিনি সবকিছু আগাগােড়া শুনিয়া তাজজব হইলেন। (গ) যতদিন পৃথিবীতে জীবন ধারণ করিব, ততদিনে তােমায় বিস্তৃত হইব না- তােমাকে সারা জীবন মনে রাখিব। (ঘ) আমি তােমায় জন্ম-জন্মান্তরেও ভুলিব না = আমি তােমায় কেয়ামতের দিন পর্যন্ত ভুলিব না। (ঙ) হে কায়িদ-ই-আজম, আমরা তোমার পদে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নিবেদন করি= কায়িদ-ই-আজম, আমরা তোমায় মন-প্রাণে সম্মান করি আর তােমায় সালাম জানাই। (চ) মাসের পরিসমাপ্তিতে ঋণ শোধ করি=মাস কাবারিতে দেনা (কাজ) আদায় করিব। (ছ) আমায় দুটো ভাত দাও আমায় চারটা ভাত দাও। (জ) হিল্লোলিত সমীরে তরঙ্গিনী আন্দোলিত হইতে লাগল লীলুয়া বাতাসে নদী নাচিতে লাগিল।
উপরােক্ত উদাহরণগুলি যে কত যান্ত্রিকভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ এই যে সংস্কৃত প্রভাবিত বলে যে বাক্যগুলি উল্লেখ করা হয়েছে সে রকম বাক্য এখন কেউ ব্যবহারই করে না। এমনকি পশ্চিম বাংলার হিন্দু সাহিত্যিকেরা পর্যন্ত সে রকম ভাষার ব্যবহার এখন তো করেনই না। বরং তার ব্যবহার হিন্দুরা বহু দিন পূর্বেই বাদ দিয়েছেন। কাজেই সাব কমিটি এক্ষেত্রে কতকগুলি কাল্পনিক উদাহরণ ইচ্ছামতভাবে গঠন করে সেগুলিকে সহজ করার আপ্রাণ চেষ্টায় চলতি শব্দ এবং দু-চারটে আরবী ফারসী শব্দ আমদানী করে ভাষায় বিপ্লব সৃষ্টি করছেন বলে যে দাবী করেছেন তার কোনাে সত্যিকার ভিত্তি নেই। উপরন্তু যারা সাহিত্য রচনা করবেন তাদের উপর হুকুমদারী করার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে কমিটির অধিকাংশ সদস্য নিজেদের মুসুন্দী চরিত্র সমগ্র রিপাের্টটির মধ্যে খুব ভালভাবেই জাহির করেছেন।
বিভিন্ন পর্যায়ে ভাষা কমিটির বৈঠকগুলিতে যে সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেগুলিই সুপারিশ হিসাবে সরকারের কাছে পেশ করা হয়। কমিটির অধিকাংশ সুপারিশের সাথেই শইখ শরাফুদ্দীনের মতানৈক্য ঘটায় মূল
রিপোর্টটির সাথে নিজের অভিমতও তিনি রেকর্ড করেন এবং সেটিও কমিটির রিপাের্টের সাথে সরকারের কাছে পেশ করা হয়। শইখ শরাফুদ্দীন তার সুপারিশে অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে বলেন যে দেশের বিপুল সংখ্যক লোেক আরবী হরফে বাংলা লেখার পক্ষপাতী কাছেই আরবী হরফ প্রচলনের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তার সাথে প্রাদেশিক সরকারের উচিত ঘনিষ্ঠভাবে সহযােগিতা করা। তিনি আরও বলেন যে উদু যেহেতু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা তাই সকল পাকিস্তানীকেই উছু শিখতে হবে। | ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৫০, পূর্ব বাঙলা ভাষা কমিটি তাদের মূল রিপাের্টকে চূড়ান্ত আকার দেন এবং তাতে নিম্নলিখিত সদস্যেরা স্বাক্ষর প্রদান করেন :
১। মহম্মদ আকরাম খান ২। আবদুল্লাহ আল-বাকী ৩। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ৪। সৈয়দ মহম্মদ আফজল ৫। হবিবুল্লাহ চৌধুরী ৬। মীজানুর রহমান ৭। সৈয়দ আবুল হাসনাত মহম্মদ ইসমাইল ৮। অজিতকুমার গুহ ৯। এ. কিউ. এম. আদমউদ্দীন ১০। আবুল কালাম শামসুদ্দীন ১১। শামসুন্নাহার মাহমুদ ১২। শইখ শরাফুদ্দীন—অনৈক্যমূলক নােটসহ।২৩
যে দিন ভাষা কমিটির রিপাের্টটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয় সেদিনই সেটি কমিটির সভাপতি মৌলানা আকরাম খান কর্তৃক পূর্ব বাঙলা সরকারের শিক্ষা দফতরের সেক্রেটারীর কাছে প্রেরিত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাদেশিক সরকার সেটিকে জনসাধারণের অবগতির জন্যে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। কমিটি ভাষা সংস্কার ইত্যাদি প্রশ্নে বহু প্রতিক্রিয়াশীল সুপারিশ পেশ এবং অনাবশ্যক প্রশ্নের অবতারণা সত্বেও তারা আরবী হরফ প্রচলন ইত্যাদির বিরুদ্ধে দৃঢ় মত পােষণ করেন।
ভাষা কমিটি স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিলাে আরবী হরফ প্রচলনের পক্ষে একটা সুপারিশ আদায় করা। ফজলে আহমদ করিম ফজলী এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ায় তারা ভাষা কমিটির অন্য সুপারিশ

২৯৫
গুলির প্রতি কোনাে গুরুত্ব আরােপের প্রয়ােজন আর বােধ করেননি। উপর সেই রিপাের্টকে চেপে রেখে তার সুপারিশের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব বাঙলায় আরবী হরফ প্রচলনের উদ্দেতে সরকারীভাবে এর পরও তাদের উদ্যোগ তঁারা অব্যাহত রাখেন।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন কায়েম হওয়ার পরই সর্বপ্রথম ভাষা কমিটির এই রিপাের্ট ১৯৫৮ সালেই প্রকাশিত হয়। পূর্বে যে কারণে সরকার রিপাের্টটি প্রকাশ করেননি, ঠিক সেই কারণেই আইয়ুব সরকার সেটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
পূর্বে আরবী হরফ প্রচলন সম্ভব না হওয়ায় সরকার রিপাের্টটি প্রকৃতপক্ষে বাতিলই করে দেন। কিন্তু আইয়ুবের সময়ে আরবী হরফ প্রচলনের প্রশ্ন উত্থাপন ছিলাে একেবারেই অসম্ভব। কাজেই সেই কারণে বিপাের্টটি তাদের পক্ষে চাপা দেওয়ার কোন কারণ ছিলাে না। তারা সেটির অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল সুপারিশগুলিকে সেই পর্যায়ে কার্যকরী করার প্রতিই ছিলেন অধিকতর আগ্রহী এবং সেই আগ্রহের ফলেই তারা রিপাের্টটিকে তাড়াতাড়ি প্রকাশ করে দেন।
আইয়ুবের স্বৈরাচারী শাসনকালে পূর্ব বাঙলার সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন হামলা এসেছিলাে ভাষা কমিটির রিপাের্টের উপর গুরুত্ব প্রদান ছিলাে তারই প্রথম পদক্ষেপ।
দশম পরিচ্ছেদ। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ও
পরবর্তী পর্যায়
১। মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদ ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। | ভারতীর কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে রণনীতি ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয় সেগুলি ভারত ও পাকিস্তান উভয় অংশেই কমিউনিস্ট পার্টির পরবর্তী ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সেই হিসাবে এই কংগ্রেসের তাৎপর্য পাক-ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসেও খুব উল্লেখযােগ্য।
কিন্তু দ্বিতীয় কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তসমূহ এবং তার পরবর্তী পর্যায়ের কমিউনিস্ট কার্যকলাপের চরিত্র সম্পর্কে কোনাে সুষ্ঠু আলােচনা উপমহাদেশের তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট মহলের পর্যালােচনাকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। এর প্রধান কারণ দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্তসমূহ একদিকে দেশীয় রাজনীতিতে পরিবর্তন এবং অন্যদিকে আন্তর্জাতিক, বিশেষতঃ সােভিয়েট ও যুগােঙ্গাভ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্রদের রচনা এবং বক্তব্য এই উভয়ের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছিলাে।
৩রা জুন, ১৯৪৭, মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদ ঘােষিত হওয়ার পর জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বােম্বাইয়ে একটি বৈঠকে মিলিত হন। সেখানে মাউন্টব্যাটেন বােয়েদাদ, ভারতীয় বুর্জোয়া, নেহরু ইত্যাদি প্রশ্ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার পর তারা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। | মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদের সমালােচনা প্রসঙ্গে তারা বলেন যে সত্য অর্থে তা ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তিকে টিকিয়ে রাখাই এক নিশ্চিত চক্রান্ত। সেই হিসাবে সমগ্ৰ পরিকল্পনাটি ভারতীয় জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এই কারণে মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে তারা নেহেরু সরকারের সমালােচনাও করেন। কিন্তু এসব সত্বেও তারা একই প্রস্তাবে আবার একথাও বলেন যে সব দোষ ত্রুটি সত্বেও পরিকল্পনাটি ভারতে গণতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট পদক্ষেপ। এই বিবেচনা অনুসারে তারা নেহৰু সরকারকে তাদের সমর্থন জ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত নেন।
ভারতীয় সামন্ত স্বার্থ এবং বৃহৎ ব্যবসার সাথে যােগাযােগের মাধ্যমে বৃটিশ সরকার কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে একথা স্বীকার করা সত্বেও কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের প্রস্তাবে বলেন যে এই দক্ষিণপন্থীরা আসলে কংগ্রেসের মধ্যে তুলনায় অনেকখানি। দুর্বল। কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলির মধ্যেও তারা তেমন প্রভাবশালী নয়। কাজেই কংগ্রেসের বামপন্থীদের সাথে সহযােগিতার মাধ্যমে তারা তাদের গণতান্ত্রিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সহায়তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটি একটি প্রস্তাবে বলেন :
গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রকে গড়ে তােলার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি সগর্বে জাতীয় নেতৃত্বের সাথে পুরােপুরি সহযােগিতার মাধ্যমে ভারতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করবে।
কমিউনিস্ট পার্টি একথাও মনে করে যে ভারতবর্ষে কোনাে গণতান্ত্রিক কর্মসূচীকে কার্যকরী করতে হলে কংগ্রেস লীগের অন্তর্গত বামপন্থী এবং অন্যান্য প্রগতিশীল শক্তিসমূহের ঐক্যজোটের মাধ্যমেই তা সম্ভব। | ঐক্যের উপর এই গুরুত্ব আরােপের ফলে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি বস্তুতপক্ষে বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি তাদের পূর্ব গুরুত্বকে অনেকখানি খর্ব করেন। কিন্তু তৎকালীন সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে অবশ্য তাদের এই ঐক্য প্রস্তাবের তাৎপর্য কিছুটা বােঝা যাবে। | সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ক্রমশঃ অবনতির ফলে হিন্দু-মুসলমান এবং অন্যান্য সম্প্রদায় ও গােষ্ঠীর পারস্পরিক ঐক্য সে সময়ে যে কোনাে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে হয়ে দাড়ায় অপরিহার্য। পার্টির নেতা ও কর্মীদের চিন্তা এই পরিস্থিতির দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। দ্বিতীয় কংগ্রেসে পার্টির নীতির একটি আত্মসমালােচনামূলক পর্যালােচনায় ভালচন্দ্র বিশ্বক রণদীতেও একথা স্বীকার করেন।
মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদ এবং নেহরু ও কংগ্রেসের সাথে সহযােগিতার প্রশ্নে বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির রজনী পাম দত্তও একটি প্রবন্ধে কেন্দ্রীয় কমিটির বক্তব্যের অনুরূপ মত প্রকাশ করেন। তিনিও যথারীতি উপরােক্ত রােয়েদাদের সমালােচনা করার পর তাকে গণতন্ত্রের পথে দৃঢ় পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করে তৎকালীন অবস্থায় কংগ্রেসের সাথে সহযােগিতার পরামর্শ দেন। শুধু তাই নয়। মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে নেহেরু সরকারকে
দোষারােপ করা থেকে পর্যন্ত তিনি বিরত থাকেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বনে যে পূর্ববর্তী পর্যায়ের তীক্ষ্ণ বিরােধের পরিবর্তে তখন কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পাটি উভয়ের মধ্যেই একটা গণতান্ত্রিক কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে একত্রে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ অনুভূত হচ্ছিলো। সর্ব ভারতের গণতান্ত্রিক ঐক্য, আথিক ও সামাজিক দাবীসমূহ পূরণ, ভূমি সংস্কার, শিল্প জাতীয়করণ ও পরিকল্পিত শিল্পোন্নয়ন। ইত্যাদি একমাত্র সেই যৌথ এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার দ্বারাই সম্ভব বলেও তিনি প্রবন্ধটিতে তার মত প্রকাশ করেন। মােটামুটিভাবে বলা চলে যে রঙনী পাম দত্ত আলােচ্য প্রবন্ধটিতে যা কিছু বলেন তার মধ্যে নেহরু সরকারকে একটি প্রগতিশীল সরকার হিসাবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা খুবই স্পষ্ট। | রজনী পাম দত্তের এই প্রবন্ধের মধ্যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্গত সংস্কারপন্থীরা নিজেদের বক্তব্যের সপক্ষে সমর্থন লাভ করেন এবং তাদের পথ যে নির্ভুল একথা চিন্তা করে নিশ্চিন্ত হন। সােভিয়েট অথবা অন্য কোনাে দেশী পার্টির সুস্পষ্ট নির্দেশ অথবা বক্তব্যের অভাবে নিজেদের অস্ত নীতির প্রতি। তাদের আস্থাও স্বভাবতঃই বৃদ্ধি পায়।
কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেস লীগের সাথে একত্রে স্বাধীনতা দিবস পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ১৫ই অগাস্টকে ‘জাতীয় উৎসবের দিন হিসাবে ঘােষণা করে কংগ্রেস লীগভূক্ত এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক কর্মীদের সাথে এ ব্যাপারে সহযােগিতার নির্দেশ দেয়। নবগঠিত কংগ্রেস-লীগ সরকারের প্রতি সমর্থন অবশ্য তৎকালীন জরুরী অবস্থায় কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার প্রাক্কালেই পাঞ্জাবে বিস্তৃত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাকে আয়ত্বে আনার জন্যে কংগ্রেস লীগ এবং প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠানসমূহের সহযােগিতা হয় অপরিহার্য। কমিউনিস্ট পার্টি সেই দাঙ্গাকে নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ এবং তার তনুচরদের চক্রান্ত বলে বর্ণনা করে। এবং বলে যে সেই চক্রান্তকে দ্রুত নিশ্চিহ্ন করতে হলে তা প্রগতিশীল শক্তি সমূহের পারস্পরিক সহযােগিতার। মাধ্যমেই সম্ভব। এ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির তদানীন্তন সম্পাদক পূরণচন্দ্র যােশী অক্টোবর ১৯৪৭-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলেন : | জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় ১৫ই অগাস্ট দেশ জুড়ে আনন্দের বান ডেকে ছিলাে—১৫ই অগাস্ট আমাদের দেশের জনগণের সম্মুখে এক নতুন স্বাধীন
জীবনের সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে। কিন্তু ১৫ই অগাস্টের পর ঠিক দুই সপ্তাহের মধ্যেই আবার পাঞ্জাবের আকাশে যে কালাে ভয়ঙ্কর মেঘ দেখা
দিয়েছে তাতে করে সমস্ত জাতিই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে।•••১০ কারা এই আগুন জালিয়েছে। কারা আমাদের দেশের মানুষের মন বিৰিয়ে তুলেছে আমাদের সকলের সেকথা জানা দরকার। পাহাৰ আজ আমাদের সমস্ত জাতির পক্ষে মদ অভিশাপ। এ অভিশাপ থেকে আমাদের সকলের শিক্ষা নিতে হবে। পাঞ্জাবের দাঙ্গার ভিত্তি স্থাপন করেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা এবং তাদেরই
অনুচরেরা আগুন জালিয়েছে। আজ এর সুযােগে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল . শক্তিগুলি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে পাকিস্তান ও ভারতীয় ইউনিয়ন উভয় রাষ্ট্রেই। এখন দুটি রাষ্ট্রকে অপদস্থ ও চ্যালেঞ্জ করে চলেছে তারা ; দুটি রাষ্ট্রকেই প্রতিক্রিয়াশীল করে গড়ে তুলতে চাইছে।১২ ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রকেই অপদস্থ করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ পাঞ্জাবের দাঙ্গাকে ব্যবহার করতে চায়। দেখাতে চায় শাসনব্যবস্থা চালাবার যােগ্যতা আমাদের নেই।৩
সর্বশেষে যােশী ভারত এবং পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রে প্রগতিশীল দল ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে দাঙ্গার বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিকদের ঐক্য জোট গঠন এবং সাধারণ ভাবে জাতীয় সরকারকে সক্রিয় সমর্থন জ্ঞাপনের আহ্বান জানান :
ভারতীয় ইউনিয়নের ভিতর আমরা যারা দেশকে ভালবাসি, প্রগতির জন্য দাড়াই, গণতন্ত্রের সংগ্রামের জয় সংগ্রাম করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, আমাদের সকলের কর্তব্য হল সাম্প্রদায়িকতার প্রেতশক্তিগুলাের বিরুদ্ধে, পাঞ্জাবের রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ এবং আকালী বাহিনীর বিরুদ্ধে, অন্যান্য প্রদেশে যে সমস্ত শক্তি প্রতিহিংসার আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জনগণকে জাগিয়ে তােলা। পাকিস্তানের ভিতর প্রগতিশীল লীগপন্থীদের ওপর আমরা আস্থা রেখেছি, তারা সমস্ত জনপ্রিয় শক্তিগুলির সহযােগিতায় নূনপন্থীদের সাথে মােকাবেলা করবেন, মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডকে নিরস্ত্র করবেন, এবং ধর্মের অসং জিগীরের বিরুদ্ধে পীরদের সতর্ক করবেন।••• পাঞ্জাবের ঘটনায় আমাদের এখনি হশিয়ার হয়ে যাওয়া দরকার। প্রদেশের বাইরে প্রত্যেকটি জনপ্রিয় সংগঠনের কর্তব্য-জাতীয় সরকারকে পূর্ণভাবে সমর্থন করা, পাঞ্জাবকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপণ সাহায্য পাঠান। এবং নিজেদের এলাকায় শান্তি অক্ষুন্ন রাখার জন্য মিলিত প্রচেষ্টায় সর্বশক্তি নিমােগ করা।
৩০০
এই শিক্ষাই আমাদের পাঞ্জাবের ঘটনা থেকে নিতে হবে—এই সঙ্কল্পই ঘােষণা করতে হবে নতুন করে।
পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে দাঙ্গা রােধ করার জন্যে যে ঐক্যের প্রয়ােজন দেখা দেয় তার ফলেই যােশ এবং অপরাপর সংস্কারপন্থী কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে কংগ্রেস লীগ সরকারকে সাধারণভাবে সমর্থনের আহ্বান জানানাে সহজ হয়। এবং সেই প্রয়ােজনের তাগিদে কমিউনিস্ট পার্টির অন্তর্গত বামপন্থীরাও স্বাধীনতা-উত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী জাতীয় সরকারের সাথে নিজেদের সম্পর্ক যথাযথভাবে নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেই যােশর পক্ষে সম্ভব হয় জাতীয় সরকারকে পূর্ণভাবে সমর্থনের কর্মসূচীর সপক্ষে পার্টির নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। দ্বিতীয় কংগ্রেসে রণদীভে পার্টি নীতির পর্যালােচনাকালে একথা উল্লেখ করেন।১৫ | কংগ্রেস লীগ সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি স্বাধীনতার অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত অনুসৃত তাদের সমস্ত কর্মসূচীকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দেয়। বাঙলাদেশে তেভাগা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের এই ভূমিকা উল্লেখযােগ্য। ১৯৪৬ সাল থেকেই দুই-তৃতীয়াংশ ফসলের দাবীতে বর্গাদারের বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষতঃ দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, যশাের, খুলনা অর্থাৎ প্রধানতঃ উত্তর বাঙলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এক শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে তােলে। ফসল ভাগের এই সংগ্রাম জোতদার ও সরকারের প্রতিরােধকে অতিক্রম করে ক্ষেত্র প্রস্তুত করে চলেছিলাে এক বৈপ্লবিক কৃষক আন্দোলনের। কিন্তু সেই আন্দোলনকে ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে কমিউনিস্ট পার্টি প্রত্যাহার করে নিলাে। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ভবানী সেন তাই কৃষকদের প্রতি আবেদন জানিয়ে নভেম্বর মাসে বললেন যে গত বছরের মতাে এ বছরে তারা যেন কোনাে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে না যান। কারণ নােতুন সরকারকে ‘আইনের মাধ্যমে তার প্রতিশ্রুতি পালনের একটা সুযোেগ দেওয়া দরকার।১৬ | এর পূর্বে সেপ্টেম্বর ১৯৪৭-এ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা কমিটির পক্ষে মধু ব্যানার্জি কর্তৃক ১৫ নং কোর্ট হাউস স্ট্রীট থেকে প্রকাশিত ‘পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ’ নামে একটি পুস্তিকাতে ভবানী সেন অবশ্য বলেন :
গত বৎসর লীগ মন্ত্রিমণ্ডলী নির্মম অত্যাচার দ্বারা • লক্ষ ভাগ-চাষীর তে-ভাগা আন্দোলন দমন করিয়াছেন।
সরকারী সশস্ত্র বাহিনী যে ধান জোর করিয়া বর্গাদারের বাড়ি হইতে লইয়া | জোতদারের গোলায় তুলিয়া দিয়াছে সেই ধান এখন চোরাবাজারে। সরকারী সরবরাহ বিভাগের গুদামও । অথচ এখন আর সরকারী সশস্ত্র বাহিনী জোতদারের গােলা হইতে সে ধান সরকারী সরবরাহ বিভাগের গুদামে আনিতেছে না, আর ঠিক সেই জন্যই পূর্ব বঙ্গের জেলায় জেলায় দুর্ভিক্ষের দ্রুত পদধ্বনি শােনা যাইতেছে। পাকিস্তান যদি এমনিভাবে জমিদার জোতদারের পক্ষপুটে আবদ্ধ থাকে তাহা হইলে উহাকে গােরস্থানে পরিণত করিতে দেরী লাগিবে না। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণকে বাঁচিতে হইবে এবং স্বাধীন মানুষের মতােই বাচিতে হইবে। এরূপভাবে বাঁচা সম্ভব যদি হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তানকে জমিদার জোতদারের পক্ষপুট হইতে মুক্ত
করিয়া জনগণের স্বাধীন পাকিস্তানে পরিণত করেন।১৭। | পণ্ডিত নেহরুর প্রতি মোহগ্রস্ত হওয়ার ফলেই কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কার-পন্থী নেতৃত্ব জাতীয় সরকার এবং কংগ্রেস লীগ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও নানা বিভ্রান্তিকর বক্তব্য উপস্থিত করেন। তারা বস্তুতঃপক্ষে নেহরু এবং ভারতীয় বুর্জোয়ার মধ্যে একটি গুণগত পার্থক্য কল্পনা করে নেহরুর প্রগতিশীল হাতকে জোরদার করার উদ্দেশ্যে নিজেদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে উদ্যোগী হন। এজন্যে নেহরুকে তারা ‘জনতার কণ্ঠ’ আখ্যায় ভূষিত করেন এবং পণ্ডিত নেহরু থেকে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পর্যন্ত যুক্ত ফ্রন্ট’ গঠনের প্রস্তাব দেন।১৯ | যােশীর নেতৃত্বে এই পর্যায়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মনে করেছিলেন যে নেহেরুর সাথে বামপন্থী ঐক্যজোটের মাধ্যমে তারা ভারতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের যথার্থ অগ্রগতি সাধন করতে সক্ষম হবেন। এখানেও রজনী পাম দত্তের তত্ত্বগত বক্তব্য এবং পরামর্শ তাদের চিন্তাকে অনেকাংশে গঠন করে।
কিন্তু এক্ষেত্রে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এবং | তাদের উপদেষ্টা বৃটিশ পাটির রজনী পাম দত্ত যখন নেহরু এবং তাঁর সরকারকে | সমর্থনের মাধ্যমে ভারতে গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে জোরদার করার চিন্তা করছিলেন তার কয়েক মাস পূর্বে সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি নেহরুকে ‘ধনী ব্যক্তি এবং তার সরকারকে প্রতিক্রিয়াশীল’ আখ্যা দিয়ে তৎকালীন অবস্থায় | ভারতীয় বুর্জোয়ার ভূমিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত | হয়েছিলো। শুধু সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি নয়, যুগােশ্লাভ এবং কমিনকর্মের নেতারাও উপনীত হয়েছিলেন অনুরূপ সিদ্ধান্তে।
অধিকতর বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে উপরোক্ত সিদ্ধান্তের খবর অনেকদিন পর্যন্ত ভারতীয়দের কাছে ছিলাে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত।
২। সোভিয়েট এবং যুগোশ্লাভি পার্টির মুখপাত্রদের বক্তব্য | মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদ ঘােষিত হওয়ার পর দিয়াকভ ‘নিউ টাইমস’-এ প্রকাশিত ‘ভারতে নূতন বৃটিশ পরিকল্পনা’ নামে একটি প্রবন্ধে সমগ্র পরিকল্পনাটির কঠোর সমালােচনা করেন। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবটি আসলে ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখারই একটি সুপরিকল্পিত চক্রান্ত। সেই চক্রান্তের কাছে নতি স্বীকার করে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ বতঃপক্ষে সাম্রাজ্যবাদের সাথে একটা আপােষ রফায় উপনীত হয়েছেন এবং ভারতীয় বৃহৎ ব্যবসাই তাদেরকে এই আপোষের দিকে পা বাড়াতে বাধ্য করেছে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ এবং উপমহাদেশের বৃহং ব্যবসা দেশীয় বাজারকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বিপ্লবকে বানচাল করতে উদ্যোগী হয়েছে।
কংগ্রেস লীগের প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র সম্পর্কে প্রবন্ধটিতে স্পষ্ট অভিমত সত্ত্বেও দিয়া কিন্তু ভারতীয় পার্টিকে সরাসরিভাবে মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদের বিরুদ্ধে কোনাে আত কর্মপন্থা নির্ণয়ের পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত হন। সেদিক থেকে বিচার করলে দেখা যাবে যে এই পর্যায়ে সোভিয়েট মতামত ছিলাে অনেকাংশে দোদুল্যমান, তার মধ্যে নির্দেশজ্ঞাপক অথবা নিশ্চিত সিদ্ধান্তসূচক কোনাে বক্তব্য ছিলাে না।
কিন্তু এর পর জুলাই মাসে এশিয়া সম্পর্কে সোভিয়েট বিশেষজ্ঞ ই. জুকভ ‘ভারতীয় পরিস্থিতি প্রসঙ্গে’ নামে এক প্রবন্ধে নেহেরু সরকারের চরিত্র সম্পর্কে আরও সুস্পষ্টভাবে সোভিয়েট পার্টির মতামত ব্যক্ত করেন। তাতে সােজাসুজি বলা হয় যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয় বৃহং বুর্জোয়া অর্থাৎ একচেটিয়া পুঁজির প্রতিনিধি ছাড়া আর কিছুই নয় এবং মাউন্টব্যাটেন রােয়েদাদকে স্বীকার করে কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে প্রতিক্রিয়াশীলদেরই দলভুক্ত হয়েছে। জুকভ তার প্রবন্ধে আরও বলেন যে বৃহৎ বুর্জোয়ারা বৃটিশের থেকে জনগণকেই বেশী ভয় করে। সেজন্যে তারা পূর্ণ স্বাধীনতার পরিবর্তে পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে একটি মাঝামাঝি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে।
জুকত অবশ্য একথাও বলেন যে কংগ্রেস লীগ উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই কিছু
কি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল কর্মী আছেন ধারা বৃহৎ বুর্জোয় নিয়মিত সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে প্রস্তত হৰেন। পাকিস্তান প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব এবং মুসলিম জনগণের কাছে পাকিস্তানের অর্থ এক নয়। সাধারণ মুসলমানেরা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা হিসাবেই পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছে। | জুভ শ্রমিক শ্রেণীর উপর গুরুত্ব আরােপ করে বলেন যে তৎকালীন ভারতীয় সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাই সব থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। তাদের তুলনায় কৃষকেরা অনেক বেশী অনগ্রসর। কারণ অশিক্ষা, বর্ণপ্রথা এবং সামন্তবাদের অবশেষসমূহের চাপে তাদের মধ্যে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মােটামুটিভাবে বলা চলে যে জুকভ তার প্রবন্ধে সাম্রাজ্যবাদ এবং তার সহযােগী সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে একটা নির্দিষ্ট রণনীতি গ্রহণের প্রস্তাব করেন। এবং সেই রণনীতি অনুসারে ভারতে নেহরু সরকার এবং পাকিস্তানে মুসলিম লীগ সরকারের উপর আক্রমণ হয়ে পাড়ায় অবধারিত।
নেহরুকে বৃহৎ বুর্জোয়ার প্রতিনিধি হিসাবে চিহ্নিত করে সােভিয়েট মুখপাত্রেরা সকলেই নেহেরু এবং তাঁর সরকার সম্পর্কে একটি সাধারণ কর্মপন্থা নির্দেশ করতে সমর্থ হতেও সামগ্রিকভাবে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্পর্কে তাঁরা কোনাে সুস্পষ্ট নীতি তখনাে পর্যন্ত নির্ধারণ করতে পারেননি। কিন্তু প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তার সমাধান ব্যতীত নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে বাস্তবক্ষেত্রে কর্মসূচী প্রণয়ন ও তাকে সঠিকভাবে কার্যকর করা সম্ভব ছিলাে না।
এই অসুবিধা দূর করার জন্যে ইতিপূর্বে সােভিয়েট বিশেষজ্ঞরা ১৯৪৭-এর জুন মাসে বিজ্ঞান একাডেমীর এক বিশেষ অধিবেশনে ভারতীয় পরিস্থিতি পর্যালােচনার উদ্দেশ্যে মিলিত হন। মূল আলােচনার সূত্রপাত করে সেখানেও জুত তার উপরােক্ত বক্তব্য উপস্থিত করেন। দিয়া ও ব্যালারুশেভিচ দুজনেই সেই বক্তব্যের বিরােধিতা করে বক্তৃতা দেন। তারা দুজনেই বলেন যে নেহরু সরকার শুধুমাত্র বৃহৎ বুর্জোয়ারই প্রতিনিধিত্ব করে তাই নয়, তার মাঝারি বুর্জোয়াদেরও প্রতিনিধি। এই মাঝারি বুর্জোয়াদেরকেও তারা প্রতি ক্রিয়াশীল হিসাবে চিহ্নিত করেন। | ব্যালারুশেভিচ বলেন যে ভারত বিভাগ ভারতীয় বুর্জোয়া ও জমিদারদের সাথে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের একটা বােঝাপড়ারই প্রত্যক্ষ ফল। যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা কংগ্রেসের নেতৃস্থানে থেকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেছিলাে তারাই অবশেষে সমগ্র ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীকে নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদের শিবিরে চলে গেছে। দিয়াকভ ও | ব্যালাসেভিচ উভয়েই বলেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় কংগ্রেস লীগের
প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতকেই জোরদার করে এবং তার ফলে নানাদিক দিয়ে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের অনেক সুবিধা করে দেয়।
কিন্তু পরস্পরের এই মতানৈক্য থাকলেও জুভের মতাে ব্যালবুশেভিচও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রমিক শ্রেণীর উপর গুরুত্ব আরােপ সত্ত্বেও কৃষকের ভূমিকাকে খুব ছোট করে দেখেন। তিনি বলেন যে একমাত্র সেই সমস্ত ক্ষেত্রেই কৃষকেরা সব থেকে বেশী সক্রিয় যেখানে তাদের সাথে শহরের শ্রমিকদের একটা প্রত্যক্ষ যােগ আছে। কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে ব্যালারুশেভিচের এই বক্তব্য যে তেলেঙ্গানা এবং উত্তর বাঙলার শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে মােটেই প্রযােজ্য নয় সেকথা বলাই বাহুল্য। শুধু তাই নয় ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় পরিস্থিতির এই পর্যালােচনা সভায় দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা এবং উত্তর বাংলার কৃষক আন্দোলনের কোনাে উল্লেখই তারা প্রয়োজন মনে করেননি।
ব্যালাবুশেভিচ তার বক্তৃতার শেষে ঘােষণা করেন : ভারতের মেহনতী জনগণ ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণী এবং তাদের পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পূর্ণ স্বাধীনতা, সামন্তবাদের অবশেষসমূহ নিশ্চিহ্ন এবং জনগণতন্ত্রের জন্যে সাম্রাজ্যবাদ, বুর্জোয়া শ্রেণী এবং ভূমি মালিকদের বিরুদ্ধে এক দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা করছেন।
পর্যালােচনা ক্ষেত্রে জুকভের সাথে মত-পার্থক্যের ফলে দিয়াকভ ও ব্যালবুশেভিচের নির্দেশিত রণনীতির মধ্যেও অনেক পার্থক্য দেখা দেয়।
সেই অনুসারে জুভের তুলনায় তাঁরা নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে অধিকতর | চরমপন্থী কর্মসূচীর পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
ভারতীয় পরিস্থিতি আলােচনার ক্ষেত্রে চীনের অভিজ্ঞতা অথবা মাও সেতু | এর চিন্তাধারার উপর কোনাে গুরুত্ব আরােপ তাে দূরের কথা তার কোনাে
উল্লেখ পর্যন্ত তারা কেউ করেননি। | ভারতীয় কমিউনিজমের পরবর্তী লক্ষ্য ভারতে জনগণতান্ত্রিক সরকার | প্রতিষ্ঠা একথা সােভিয়েট বিশেষজ্ঞরা ঘােষণা করলেও জনগণতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে তাদের মধ্যেও যথেষ্ট মতবিরোেধ ছিলাে। অন্যান্য দেশীয় কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যুগােভ পার্টি অবশ্য সরাসরিভাবে জনগণতন্ত্রের বিরােধিত
305
করে এবং সেজন্যে কৃষি বিপ্লবের রণনীতিকে তারা মনে করেন | সর্বাংশে ভ্রান্ত।
ইউরােপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তরকালে প্রতিষ্ঠিত জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতে সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী রণনীতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ বিদেশী পুজি এবং তার সহযােগী দেশীয় বৃহৎ বুর্জোয়া এবং বৃহৎ সামন্ত শক্তির বিরুদ্ধেই সেখানে গৃহীত হয় ব্যাপক রাজনৈতিক কর্মসূচী। সেই হিসাবে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বুর্জোয়া অথবা সমাজতান্ত্রিক নয়, সে দুইয়ের মধ্যবর্তী এক পরিবর্তনশীল পর্যায়।
১৯৪৭ সাল থেকেই বুগােশ্লাভ পার্টির মুখপাত্রেরা জনগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের বক্তব্য উপস্থিত করেন। তাতে তারা বলেন যে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে একটি মধ্যবর্তী অবস্থা হিসাবে না দেখে আরও জঙ্গী কর্মসূচীর মাধ্যমে বুর্জোয়া ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একই সূত্রে গ্রথিত কবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে হবে। কাজেই যুগােগাভ তাত্ত্বিকেরা শুধুমাত্র একচেটিয়া পুঁজি এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কর্মসূচীকে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে একটি চরম সংগ্রামের পথে চালনা করতে বলেন। সেজন্যে তারা বুর্জোয়া শ্রেণীর সমস্ত প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে এক সর্বাত্মক বৈপ্লবিক কর্মসূচী নির্ধারণের পরামর্শ দেন।
জনগণতন্ত্রের সমালােচনা প্রসঙ্গে যুগােশ্লাভ মুখপাত্রেরা কেবলমাত্র পূর্ব ইউরােপের জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রেই তাঁদের আলােচনা সীমাবদ্ধ রাখেননি। কমিনকর্মের বৈঠকে তারা এ বিষয়ে ফরাসী ও ইটালিয়ান উভয় পার্টিকেই আক্রমণ করেন। জানুয়ারি ১৯৪৭-এ যুগােশ্লাভ কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্রে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে এডওয়ার্ড কার্দেজ ঘােষণা করেন যে উপনিবেশগুলিতে ‘জাতীয় বুজোয়া’ সর্বক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়াশীল, বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের মুৎসুদ্দী, কাজেই উপনিবেশগুলিতে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে সফল করতে হলে অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির সাথে বুর্জোয়া শ্ৰেণীকেও সম্পূর্ণভাবে পরাজিত না করে তা সম্ভব নয়। এবং এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন শুধুমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের পথেই সম্ভব। | তত্ত্বগত দিক থেকে কার্দেজের এই বক্তব্য এবং ১৯৪৭-এর জুন মাসে অনুষ্ঠিত সােভিয়েট বিশেষজ্ঞদের সভায় ব্যালারুশেভিচ ও দিয়াকভের বক্তব্যের কোনাে মৌলিক প্রভেদ নেই। সে প্রভেদ তাঁদের ক্ষেত্রে দেখা দেয় রণনীতি
ও পদ্ধতির প্রশ্নে। কাজে যেখানে সরাসরিভাবে সমগ্ৰ ৰুজোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলেন সােভিয়েট বিশেষজ্ঞেরা সেখানে প্রশ্নটিকে রেখে দেন অনেকাংশে অমীমাংসিত।
৩। নেহরু সম্পর্কে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নােতুন সিদ্ধান্ত
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামার ফলে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির চরমপন্থীরা অল্প সময়ের জন্যে যােশর আপােষপন্থী সংস্কারবাদী নেতৃত্বের কাজে নতি স্বীকার করলেও সে অবস্থার অবসান ঘটতে বিলম্ব হয়নি। যােশর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব সত্বেও বামপন্থীদের বক্তব্য প্রথম দিকেও পার্টির মধ্যে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে। স্বাধীনতা উৎসবের মধ্যেও তাই রণদীতে পার্টি মুখপত্র “পিপলস এঞ্জ’-এর পাতায় নেহরু সরকারের দক্ষিণপন্থী ও আপােষমুখী। চরিত্র সম্পর্কে সকলকে হুশিয়ার করে দিয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করেন। শুধু তাই নয়, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র “কমিউনিস্ট-এর পাতায় অগাস্ট মাস থেকেই যুগােশ্লাভ পার্টি নেতাদের প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক উন্নয়নের সমস্যাবলী : ‘একটি মার্ক্সবাদী বিশ্লেষণ’ এই নামে এডওয়ার্ড কার্দেজের একটি লেখা তাঁর পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন। বুর্জোয়া শ্রেণী সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরভুক্ত হয়েছে প্রবন্ধটিতে কার্দেজের এই বক্তব্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থীদের জঙ্গী মনােভাবকে অধিকতর জোরদার করে। এর ফলে তারা নেহরু সরকারের প্রতি আনুগত্যের নীতি রিহারের জন্যে ক্রমশ অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন।
কিন্তু শুধু আন্তর্জাতিক বক্তব্যই যে কমিউনিস্ট পার্টির বামপন্থীদের নােতুন রণনীতি গ্রহণ ও সাংগঠনিক রদবদলের প্রেরণা যুগিয়েছিলাে তা নয়। আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির পরিবর্তন এক্ষেত্রে ছিলাে অধিকতর প্রভাবশীল। যােশীর ‘আনুগত্যে’র নীতিকে প্রথম থেকেই পার্টির অসংখ্য সদস্য স্বীকার করে নিতে পারেননি। বহুদিনের সংগ্রামী প্রস্তুতি এবং তেলেঙ্গানা ইত্যাদির অভিজ্ঞতার পর তারা যে সময় নােতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের চিন্তা করছিলেন। সে সময় তাদের কাছে আপােষের রাজনীতি প্রথম থেকেই মনে হয়েছিলাে| ঘটনাপ্রবাহের সাথে সামঞ্জস্যহীন। | ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতি ক্ষেত্রে কংগ্রেসের তৎপরতার ফলে এই অবস্থা
বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। তারা কমিউনিষ্ট প্রভাবিত নিখিল ভারত ট্রেত ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রভাবকে খর্ব করার উদ্দেশ্যে, ভারতীয় জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস নামে একটি নােতুন সংস্থা খাড়া করে এবং তার ফলে পার্টির কর্মীরা ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে ভয়ানক অসুবিধার সম্মুখীন হন। সেখানে কংগ্রেসের প্রভাবকে ঠেকিয়ে রাখার জন্যে অধিকতর জঙ্গী কর্মসূচীর প্রয়ােজন অনুভূত হয়, কিন্তু পার্টির আপােষ ও আনুগত্যের নীতি হয়ে দাড়ায় সেদিক দিয়ে মস্ত বাধাস্বরূপ। সেই বাধাকে অতিক্রম করার জন্যে পার্টির মধ্যে আভ্যন্তরীণ চাপ ক্রমশঃ দারুণভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ভারতীয় রাজনীতিতে নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেসের যে প্রগতিশীল ভূমিকার কথা যযাশী বিবৃত করেছিলেন কংগ্রেস বস্তুতঃ সে ভূমিকা পালনে প্রথম থেকেই ব্যর্থ হয়। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারত সরকারের একটা আঁতাতের প্রস্তুতিও চলতে থাকে প্রথম থেকেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে যােশর বিরুদ্ধে পার্টির অভ্যন্তরে বিক্ষোভ দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং তাকে ‘পেটি বুর্জোয়া সংস্কারবাদী’ ইত্যাদি বলে অভিহিত করে সম্পাদকের দায়িত্বশীল পদ থেকে অপসারণের জন্যে সাধারণভাবে দাবী ওঠে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে রণদীভে এবং অন্যান্য চরমপন্থীরা অবস্থার এই পরিবর্তনকে রণনীতি ও সাংগঠনিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হন।
১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে পােল্যাণ্ডে কমিনফর্মের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানে জাদভ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। সাম্রাজ্যবাদের তৎকালীন ভূমিকা বর্ণনা প্রসঙ্গে উপনিবেশগুলিতে তারা যে সংকট সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করে চলেছে তিনি তার উল্লেখ করেন। ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েৎনাম ইত্যাদি দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদীরা ধ্বংস করার চেষ্টায় কিভাবে লিপ্ত হয়েছে তিনি তার ভাষণে তারও বর্ণনা দেন। জানভ আরও বলেন যে ‘ভারত ও চীনকে সাম্রাজ্যবাদের আওতাভুক্ত এবং নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে সাম্রাজ্যবাদ তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেরশক্তিকে খাটো করে এবং শত্রুর শক্তিকে বড়ো করে দেখা শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে একটা বিপজ্জনক ব্যাপার বলে তিনি উপনিবেশ অঞ্চলের শ্রমিক পার্টিগুলিকে সাবধান করে দেন এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটা দৃঢ় প্রতিরােধ আন্দোলন গঠন ও পরিচালনার জন্যে সংশ্লিষ্ট কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের প্রতি আহ্বান জানান।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও জানভ তার বক্তৃতায় উপনিবেশগুলিতে বুর্জোয়া শ্রেণীকে
সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল হিসাবে বর্ণনা করে তার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা সরাসরিভাবে উল্লেখ না করে কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী লক্ষ্য অনুসরণের পরামর্শ দেন। | কমিনফর্মের এই অধিবেশনে কার্দেজ তার ভাষণে ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে একই সূত্রে গ্রথিত করে এমন এক অখণ্ড রণনীতি নির্ধারণের প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করেন যা বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সামগ্রিকভাবে পরিচালিত হবে। কার্দেজের এই ভাষণ এবং তার সাথে যুগােশ্লাভ কমিউনিস্ট পাটির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মার্শাল টিটোর মূল রিপাের্টটিও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র কমিউনিস্ট’-এ প্রকাশিত হয়।
একদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কংগ্রেসের আক্রমণাত্মক ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের জীবক্তব্যসমূহের প্রভাবে বােশর নেতৃত্ব এক দারুণ সংকটের সম্মুখীন হয়। নেহরু সরকারের অনুগত বিরােধিতার পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির এক প্রভাবশীল অংশ রণদীভের নেতৃত্বে নােতুনভাবে পার্টির মধ্যে নিজেদেরকে সংহত করতে সচেষ্ট হন।
এই সময় কমিউনিস্ট পরিচালিত নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের নেতা শ্রীপত অমৃত ডাঙ্গে ওয়ালড, ফেডারেশন অব ট্রেড ইউনিয়ন-এর অধিবেশনে যােগদানের উদ্দেশ্যে প্রাগ, যান এবং সেখান থেকে পূর্ব ইউরােপ এবং সােভিয়েট ইউনিয়ন সফরের পর ভারতে ফিরে আসেন। সফরকালে ভারতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে তার সাথে কমিনফর্ম ও সােভিয়েট পার্টির নেতাদের আলাপ আলােচনা হয়। এবং সম্ভবতঃ তারা ভাতে টিটোপন্থী নীতি অনুসরণকে পরােক্ষ অনুমােন দান করেন। এ সম্পর্কে সঠিক ও নিশ্চিতভাবে কিছু জানা না গেলেও রজনী পাম দত্ত এই প্রসঙ্গে ডাঙ্গেকে ভারতে ‘টিটোপন্থী প্রভাবের অন্যতম প্রধান ধারক হিসাবে আখ্যায়িত করেন।
১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বােম্বাইয়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির এক অধিবেশন বসে। তার ঠিক এক সপ্তাহ পূর্বে বােম্বাই প্রদেশের কংগ্রেসী সরকার পার্টির মুখপত্র “পিপলস এজ’-এর উপর অনেক রকম নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলােচনাকালে চরমপন্থীদের আর সুবিধা হয় এবং তারা রণদীভের নেতৃত্বে যােশর ‘অনুগত বিরোধিতার নীতি ও কর্মসূচীকে দারুণভাবে আক্রমণ করেন।
অধিবেশনে যােশীর আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব বজায় থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে
পাটি কর্মসূচীর মধ্যে আমূল পরিবর্তনের সপক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারা তাদের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলেন যে সারা দুনিয়া দুটি পরস্পর বিরােধী শিবিরে বিভক্ত হয়েছে এবং নেহরু সরকার বৃহৎ বুর্জোয়া প্রভাবে ইদ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের তাবেদার ব্যতীত আর কিছুই নয়। সেই হিসাবে যােশ এবং রজনী পাম দত্তের সমালােচনা প্রসঙ্গে তারা বলেন যে কংগ্রেসের মধ্যে প্রগতিশীল দলগুলির কাজকর্ম এবং গণচাপের মাধ্যমে নেহরু সরকারকে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী নীতি অনুসরণে বাধ্য করার নীতি সুবিধাবাদেরই নামান্তর। কাজেই সেই সরকার এবং তার মূল ভিত্তি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সামগ্রিক সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্যে তারা পার্টির সদস্যদের আহ্বান জানান। | নেহরু এবং বৃহৎ বুর্জোয়াকে ভারতীয় জনগণের শত্রু হিসাবে নির্দেশ করা সত্বেও এই পর্যায়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একমাত্র যুগােশ্লাভ পাটি ব্যতীত অন্য কোনাে পার্টি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামের পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
৪। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস
কেন্দ্রীয় কমিটির উপরােক্ত বােম্বাই অধিবেশনে নেহরু এবং ভারতীয় বুর্জোয়া সম্পর্কে পার্টি একটা নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় ও সামগ্রিক ধনতন্ত্র বিরােধী রণনীতির অনুমােদন এবং প্রয়ােজনীয় সাংগঠনিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে এক কংগ্রেস আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্বেই রণদীভে এবং অন্যান্য চরমপন্থীরা কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রাধান্য লাভ করেন এবং পাটির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে যােশী সমর্থকদেরকে অপসারণ করতে তৎপর হন। ডিসেম্বর মাসের অধিবেশনে কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টি সভ্যদের জন্যে একটি রাজনৈতিক রিপাের্টের খসড়া তৈয়ীর উদ্দেশ্যে একটি সাব-কমিটি গঠন করেন। এ ছাড়া কংগ্রেসের সামনে পেশ করার জন্যে কেন্দ্রীয় কমিটি নােতুন সদস্যদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন।
রাজনৈতিক, রিপাের্টটির উপর আলােচনা এবং কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্রাদেশিক কমিটি নিজেদের সম্মেলন আহ্বান করেন। রাজনৈতিক রিপাের্টের খসড়া রচনা থেকে প্রাদেশিক সম্মেলন পর্যন্ত সবকিছুই
310
অতি অল্পকালের মধ্যেই দ্রুতভাবে সম্পন্ন হয় এবং ডিসেম্বর মাসের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশনের মাত্র আড়াই মাস পরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮, কলকাতাতে মিলিত হয়। | ‘পিপলস এজ’-এর রিপাের্ট অনুযায়ী ১১৯ জন নির্বাচিত প্রতিনিধির মধ্যে ৬৩২ জন কংগ্রেসে উপস্থিত হন। এদের মধ্যে ৫৬৫ জন ছিলেন সার্বক্ষণিক কর্মী অর্থাৎ প্রধানতঃ পার্টি সংগঠক। তেলেঙ্গানা থেকে ৭৫ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হতে পারেন মাত্র চার-পাঁচজন। অস্ট্রেলিয়া, বর্ষা, সিংহল এবং যুগােশ্লাভিয়ার প্রতিনিধিরাও এই কংগ্রেসে উপস্থিত থাকেন। বৃটিশ অথবা সােভিয়েট পার্টি দ্বিতীয় কংগ্রেসে কোনাে প্রতিনিধি পাঠাননি।
| কংগ্রেসে অস্ট্রেলিয়া, বর্ষা এবং সিংহলের প্রতিনিধিরা মােটামুটিভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা অবলম্বন করলেও যুগােশ্লোভ পার্টির প্রতিনিধি ভাদিমির দেদিয়ের এবং রাদোভেন হকোভিক উভয়েরই ভূমিকা সেখানে ছিলাে খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধনতন্ত্রবিরােধী রণনীতির অধীনে সমসূত্রে এ থিত গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে নিজেদের বক্তব্য তারা কংগ্রেসে এত বলিষ্ঠভাবে উথাপন ও আলােচনা করেন যাতে করে সকলের মনে এই ধারণা সৃষ্টি হয় যে তারা কমিনফর্মের পূর্ণ অনুমােদনক্রমে তা করছেন। অস্ট্রেলীয় পাটির প্রতিনিধি শাকী যুগােশ্লাভদের এই পরামর্শ সম্পর্কে কোনাে আপত্তি করেননি। এবং কোনাে দিক থেকে সেই বক্তব্যের কোনাে বিরােধিতা না হওয়ায় ভারতীয় পার্টির মধ্যে টিটোপন্থী রণনীতি অপ্রতিহত প্রধান্য লাভ করে। এখানে সব থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে মাও সেতুঙ-এর তত্ত্বগত চিন্তা অথবা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অনুসৃত রণনীতির কোনাে উল্লেখই সেখানে কেউ প্রয়ােজন মনে করেননি।
যুগােশ্লোভদের তাত্ত্বিক বক্তব্যের সাথে রণদীভের পূর্ব পরিচয় ছিলাে এবং প্রধানতঃ তার উপর ভিত্তি করেই তিনি নিজের বক্তব্যকে দাড় করিয়েছিলেন। কংগ্রেসে যুগােশ্লাভ প্রতিনিধিদের উপস্থিতি ও সক্রিয় ভূমিকা রণদীভের হাতকে অনেকখানি বেশী শক্তিশালী করে এবং প্রথম থেকেই তিনি কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন। | খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবের উপর রণদীভে যে রিপোের্ট পেশ করেন সেটাই কংগ্রেসের পরবর্তী আলােচনার দিক নির্ণয় করে। আলােচ্য রিপাের্টটিতে তিনি বলেন যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে একজোট হওয়ার ফলে সােভিয়েট ইনিয়নের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক
শিবিরের সাথে তারা এক অখণ্ড দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে। কাজেই জনগণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্যে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের রণনীতিকে একই সঙ্গে গ্রথিত করে পার্টিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম করে যেতে হবে। তার জন্যে প্রয়ােজন হবে সামগ্রিকভাবে ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপুল জনগােষ্ঠীকে সংগঠিত ও পরিচালনা করা। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে রণবীতে শ্রমিক কৃষক পেটি বুর্জোয়া এবং প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে এক ‘জনগণতান্ত্রিক মাের্চা গঠনের প্রস্তাব করেন। | তেলেঙ্গানার অভিজ্ঞতাকে যােশী তার চিন্তার মধ্যে প্রধান্য দেওয়া তাে দূরের কথা নিজের সংস্কারবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে সে বিষয়ে তিনি ছিলেন উদাসীন। রণদীতে কিন্তু তার রিপাের্টে তেলেঙ্গানার অভিজ্ঞতার উপর জোর দিয়ে বলেন যে ভারতীয় রাজনীতিক্ষেত্রে তা একটা ‘গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আজ তেলেঙ্গানার অর্থ কমিউনিস্ট এবং কমিউনিস্টের অর্থ তেলেঙ্গানা’।
কংগ্রেসের বক্তাদের মধ্যে রণদীভের পরই ভবানী সেনের নাম উল্লেখযােগ্য। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেস-লীগ সরকারের সাথে সহযােগিতার উদ্দেশ্যে তিনি বাঙলাদেশে তেভাগা আন্দোলন স্থগিত রাখার পরামর্শ দেওয়া সত্বেও ১৯৪৮-এর ফ্রেব্রুয়ারি-মার্চে তিনি হয়ে দাড়ান চরমপন্থী রাজনীতির অন্যতম মুখপাত্র ! | রণনীভের বক্তব্যকে আরও বিশদভাবে বর্ণনা করে তিনি কংগ্রেসে এক দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। তাতে ১৯১২ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত পার্টি অনুসৃত ‘জাতীয়তার নীতি’কে বর্জন করে বলা হয় যে তৎকালীন অবস্থায় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার কোনাে একটি বিশেষ জাতির সমগ্র জনগণের দ্বারা অজিত হওয়া সম্ভব নয় ; সত্যিকার আত্মনিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে হলে শ্রমিক শ্রেণী ও তার মিত্রদের বৈপ্লবিক সংগ্রামের মাধ্যমেই তা সম্ভব। কাশ্মীর সম্পর্কে তাদের পূর্ব অনুসৃত নীতির সমালােচনাকালে তিনি বলেন যে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি সমর্থন করে পার্টি এক মস্ত ভুল করেছিলাে। ভবানী সেনও এই প্রসঙ্গে তেলেঙ্গানার উল্লেখ করে বলেন যে আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে সংগ্রামের সত্যিকার পথ হচ্ছে তেলেঙ্গানার পথ।
এ ছাড়া সমগ পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে বিপ্লবের প্রয়ােজনীয়তার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন :
এ প্রশ্নের সত্যিকার সমাধান যুদ্ধক্ষেত্রে। তেলেঙ্গানার বীর জনগণ
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের মহান উদাহরণের দ্বারা শুধুমাত্র দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে কি ঘটবে তাই দেখায় না, ভারত ও পাকিস্তানের সত্যিকার ভবিষ্যতের কি হবে সেটাও দেখিয়ে দেয়। সেই পথেই বিজয়ী জনগণকে স্বাধীনতা ও সত্যিকার গণতন্ত্র অর্জনের জন্যে এগিয়ে যেতে হবে।
রণদীতে, ভবানী সেন প্রভৃতির বক্তৃতার পর তেলেঙ্গানা আন্দোলনের সপক্ষে কংগ্রেসের মনোভাব এত প্রবল হয়ে ওঠে যে তারা সেই আন্দোলনের সমর্থনে একটি পৃথক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। মূল রিপাের্ট গুলি পঠিত হওয়ার পর যােশী এক আত্ম-সমালােচনামূলক বক্তৃতায় নিজে সমস্ত দোষ-ত্রুটি স্বীকার করে বলেন যে তিনি কাপুরুষতা’, ‘পেটি বুর্জোয়া দোদুল্যমানতা’, ‘আমলাতান্ত্রিক মনোভাব এবং দক্ষিণ সংস্কারবাদী চিন্তার দ্বারা নানা প্রকার বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে প্রকৃতপক্ষে পার্টির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছেন।১০ | বিদায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি নোতুন কমিটি নির্বাচনের জন্যে যে মনোনয়ন দেন তাতে পুরাতন কমিটির বহু সদস্যের সাথে যােশীর নামও ছিলো। কিন্তু যােশীর কার্যকলাপের সমালােচনা এবং তার নিজের আত্মসমালোচনামূলক বক্তৃতা তার বিরুদ্ধে কংসের প্রতিনিধিদের মনে এরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিলাে যে কেন্দ্রীয় কমিটির মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে একমাত্র হােশই নির্বাচনে পরাজিত হন। এর পরই নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি রণদীভেকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত করে নােতুন রাজনীতিকে কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে প্রয়ােজনীয় সাংগঠনিক নেতৃত্ব স্থাপন করেন। | কংগ্রেসের অধিবেশনে নােতুন নেতৃত্ব একটি সজনৈতিক থিসিস’ পেশ করেন এবং সেই থিসিসের উপর এক দীর্ঘ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী খসড়া সম্পর্কে পার্টির অভ্যন্তরে নানা আলোচনার সময় সেটিকে অনেকাংশে পরিবর্তিত করলেও কংগ্রেসে তার উপর আরও অনেক মুল তুবী প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। রাজনৈতিক থিসিসটির উপর আলােচনা শেষ হওয়ার পর সেটিকে অপরিবর্তিত অবস্থায় গ্রহণ করার জন্যে রণদীভে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানান এবং তাদের আলোচনার আলােকে সেটিকে সংশোধন করার জন্যে কেন্দ্রীয় কমিটিকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তার সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। | এই রাজনৈতিক থিসিসটিতেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নােতুন রণনীতি ও কর্মসূচী ঘােষিত হয়। বৈপ্লবিক পরিস্থিতির পর্যালােচনা প্রসঙ্গে তাতে বলা হয় যে ভারত সশস্ত্র বিপ্লবের পর্যায়ে আছে এবং সেই বিপ্লবকে সফল
করার জন্যে সর্বাত্মক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া প্রয়ােজন। এই বৈপ্লবিক সংগ্রামের মাধ্যমেই ভারতে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ একই সাথে সাধিত হবে। তার জন্যে পার্টিকে শ্রমিক, কৃষক, পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীকে ধনতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত ও পরিচালনা করা প্রয়ােজন। নেহরু সরকার প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় বুর্জোয়ারই প্রতিনিধি, কাজেই সংগ্রামী জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মাধ্যমে সেই সরকারকে আক্রমণ করতে হবে। কংগ্রেসের অধিবেশন চলাকালে কেন্দ্রীয় কমিটি নিজেদের একটি পৃথক প্রস্তাবে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এর পরই সেখানে সরাসরিভাবে বলেন যে ‘জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অর্থ সর্বহারার একনায়কত্ব ব্যতীত অন্য কিছুই নয়। কাজেই নেহরু সরকারের বিরুদ্ধে তাদের বৈপ্লবিক সংগ্রাম অত্যাসন্ন।১৩। | যুগােশ্লাভ পার্টির পরামর্শ শুধু যে ভারতীয় পার্টিকে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমসূত্রে গ্রথিত করার টিটোবাদী নীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলাে তাই নয়। পরবর্তী অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে বার্মা, মালয়, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশেও সেই একই নীতির অনুসরণে এক সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ প্রায় ঐ সময় থেকেই শুরু হয়। বার্মা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক থাকিন থান টুন ব্যক্তিগত ভাবে দ্বিতীয় কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি কংগ্রেসে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বার্মায় আসন্ন বিপ্লবের ইঙ্গিত দিয়ে বলেন যে ইদ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যদি গৃহযুদ্ধ বাধাতে চায় তাহলে তাদেরকে গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে। এর পর তিনি বলেন,“কমরেডগণ, মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে ১৯৪৮ সাল একটি চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরেই দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে মুক্তি আন্দোলনের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।১৪ | দ্বিতীয় কংগ্রেসের ঠিক পূর্বেই কলকাতায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই সম্মেলনে ভারত, পাকিস্তান, বার্মা, মালয়, ভিয়েৎনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন এবং উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিরা যােগদান করেন। সােভিয়েট প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত থাকেন। এ ছাড়া দ্বিতীয় কংগ্রেসে যােগদানের জন্যে আগত যুগােশ্লাভ প্রতি নিধিরাও সেই সময় কলকাতাতে সমবেত হন। অনেকে মনে করেন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বিপ্লবের পতাকা তােলার সত্যিকার নির্দেশ মস্কো থেকেই এসেছিলাে এবং এই যুব সম্মেলনেই সেই নির্দেশ সংশ্লিষ্ট পাটিসমূহের কাছে তারা পৌছে দিয়েছিলেন। যােশ অবশ্য পরবর্তীকালে প্রকাশিত তার একটি বিবৃতিতে বলেন যে দ্বিতীয় কংগ্রেসে যুগােশ্লাভ প্রতিনিধিরা ব্যক্তিগতভাবে যে
রণকৌশলের পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই অনুসারেই কেন্দ্রীয় কমিটি তেলেঙ্গানায় কৃষক বিপ্লব পরিচালনা করে।১৫
৫। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ সহ কোনাে প্রতিষ্ঠানই আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। কমিউনিস্ট পাটিরও তখনাে পর্যন্ত কোনাে পূর্ব পাকিস্তান কমিটি ছিল না।
সেপ্টেম্বর মাসে ভবানী সেন, আবদুল্লাহ রসুল এবং মনসুর হাবিব ঢাকা আসেন এবং কােননশন পার্কে একটি জনসভায় বক্তৃতা দেন। এই সফরের সময়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন তাঁদের তিন জনকেই সাক্ষাতের জন্যে আমন্ত্রণ জানান এবং সরকারের সাথে তারা সহযােগিতা করে যাবেন বলে আলােচনাকালে নাজিমুদ্দীন আশা প্রকাশ করেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান সরকারের সাথে সহযােগিতার নীতিই তারা অনুসরণ করে চলেছিলেন। সেই হিসাবে নাজিমুদ্দীনের সাথে ভবানী সেন প্রভৃতির আলাপ মােটামুটি সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়েছিলাে। | দ্বিতীয় কংগ্রেসের পূর্বে আবদুল্লাহ রসুল এবং মনসুর হাবিব আবার ঢাকা আসেন। আবদুল্লাহ রসুল সে সময় ঢাকাতে মােটামুটি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্যে বাসাও ঠিক করেছিলেন। মুজাফফর আহমদও সেই সময় ঢাকাতে আসেন এবং রথখােলায় ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সীর দোকান ও অফিস ঘর উথােধন করেন।
দেশভাগের পর সরকারী কর্মচারীদেরকে চাকরির এলাকা বেছে নেওয়ার যে সুযােগ দেওয়া হয় তার ফলে পার্টির অনেক অসুবিধা হয়ে পড়ে। পূর্ব বাঙলায় বিপুল অধিকাংশ পার্টি সভ্য ছিলেন ‘হিন্দু। তাঁদের মধ্যে অনেকেই নান। পারিবারিক অসুবিধার জন্যে পশ্চিম বাঙলায় যেতে বাধ্য হন। কিন্তু পার্টির পক্ষে আসল অসুবিধা দেখা দেয় অন্য দিক থেকে। পূর্ব বাঙলার অধিকাংশ লােকই মুসলমান এবং পাটি সভ্যদের অধিকাংশ ‘হিন্দু’ হওয়ার ফলে খােলাখুলি কাজের ক্ষেত্রে তারা বহু অসুবিধার সম্মুখীন হন। সেই অসুবিধা আংশিকভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় মুসলমান পার্টি সভ্যের পশ্চিম বাঙলা থেকে পূর্ব বাঙলায় আসার প্রয়ােজন দেখা দেয়। আবদুলাহ রসুল এবং মনসুর হাবিব পূর্ব বাঙলায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
315
কিন্তু আবদুল্লাহ রসুল অল্প কিছুদিন থাকার পরই আবার কলকাতা ফিরেন।
দ্বিতীয় কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি একটি পৃথক সংগঠন হিসাবে কাজ করে যাবে। পুরাতন পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে দ্বারা পাকিস্তান অংশের মধ্যে পড়লেন তারা কলকাতাতেই বসে সাজ্জাদ জাহীরকে সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠন করেন। এছাড়া বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটিকে ভেলে দিয়ে তার স্থানে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলার জন্যে পৃথক কমিটি গঠিত হয়। | কার্যক্ষেত্রে নিখিল পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান পার্টির তেমন কোনাে সাংগঠনিক সম্পর্কে ছিলাে না। তার মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে কিছুটা যােগাযােগ রক্ষা হতাে মাত্র।
যদিও ১৯৫৪ সালের পূর্ব পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব পাকিস্তানে বেআইনী ঘােষিত হয়নি তবু দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর স্থির হয় যে অল্প কিছু সংখ্যক কর্মী ও নেতা প্রকাশ্যে কাজ করলেও অধিকাংশই গােপন কাজে আত্মনিয়ােগ করবেন । সেই হিসাবে এর পর থেকে পার্টির অধিকাংশ কর্মী আত্মগােপন করে থাকেন। এদের মধ্যে দুই-একজন ব্যতীত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সব সদস্যই ছিলেন।
১৯৪৮-এর মার্চ মাসে কোর্ট হাউস স্ট্রীট এবং কাপ্তেন বাজারে যথাক্রমে পার্টির শহর ও কেন্দ্রীয় অফিস খোলা হয়। প্রকাশ্য কাজের যতটুকু সুযােগ সুবিধা ছিলাে সেটা ব্যবহারের জন্যেই উপরােক্ত অফিস দুটি চালু রাখা হয়। কানে বাজারে পার্টি অফিসের পাশেই পূর্ব পাকিস্তান রেল রােড ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের অফিসও স্থাপিত হয়। এই ইউনিয়নটি তখন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন ছিলাে।’
১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ১২ই মার্চ মুসলিম লীগের গুণ্ডারা কাপ্তেন বাজার এবং কোর্ট হাউস স্ট্রীটে অবস্থিত পাটির প্রাদেশিক ও শহর অফিস আক্রমণ করে। কিছু বইপত্র ব্যতীত অন্য কোনাে কাগজপত্র সেখানে
থাকায় আসবাবপত্র এবং বইগুলি তছনছ করে তারা চারিদিকে ছড়িয়ে দেয়। ১৩ই মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত এবং ধরনী রায়কে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু ভাষা আন্দোলনে অন্যান্য বন্দীদের সাথে তারা দুজনেও ১৫ই তারিখে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। এর পর ঢাকা শহরে পাটির দুটি অফিসই আবার চালু করা হয়।
জুন মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কাৰ্যসূচী নির্ধারিত হয় এবং সেই কাৰ্যসূচীকে প্রকাশ্যভাবে ঘােষণা করার উদ্দেশ্যে ৩০শে জুন তারা
১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এখানেই ন্যাশানাল আওয়ামী পার্টি অফিস ছিলাে।
করােনেশন পার্কে একটি জনসভায় সিদ্ধান্ত নেন। এই সভার পূর্বে সাত দিন পথ সভা ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচারকার্য চালিয়ে যাওয়া হয়। অন্যান্যদের মধ্যে মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম প্রভৃতি চোঙ্গা নিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় বক্তৃতা এবং শ্লোগান দিয়ে ৩০শের সভাকে সাফল্যমণ্ডিত করার উদ্দেশ্যে প্রচারকার্য চালান।১০ | ৩০শের জুন করােনেশন পার্কে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সভাপতিত্ব করেন মুনীর চৌধুরী। রণেশ দাশগুপ্ত এবং সরদার ফজলুল করিম এই দুই জনের বক্তৃতা দেওয়ার কথা স্থির হয়। আরও স্থির হয় যে সরদার ফজলুল করিম সাধারণ কাৰ্যসূচী আলােচনা প্রসঙ্গে স্থানীয় সমস্যার উপর বিস্তৃত আলােচনা করবেন এবং রণেশ দাশগুপ্ত বলবেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও সাম্রাজ্যবাদের ভূমিকা সম্পর্কে।১২
প্রায় এক হাজার লােকের উপস্থিতিতে সভা আরম্ভ হয়। এই সময় শাহ আজিজুর রহমানও তার দলবল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। শুরু থেকেই শ গুগোলের আশঙ্কায় সভার মধ্যে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকে। প্রথম বক্তা সরদার ফজলুল করিম তার বক্তৃতা আরম্ভ করার অল্প কিছুক্ষণ পর থেকেই শাহ আজিজের দল সভাপতির কাছে একের পর এক চিরকূট পাঠিয়ে নানারকম প্রশ্নের উত্তর দাবী করতে থাকেন এবং মাঝে মাঝে চীৎকার করে বাধা দানের চেষ্টাও করেন। রণেশ দাশগুপ্ত তার বক্তৃতায় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলােচনা ছাড়া পাকিস্তানের কমনওয়েথ, ত্যাগের প্রয়ােজনীয়তার কথাও বলেন।
পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ম্যানিফেস্টোটি সভাতে সরাসরি পাঠ করা হয়নি। কিন্তু সেই কাৰ্যসূচীকে দুজন বক্তাই নি’দের বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করে সকলকে বােঝন। কথা ছিলাে তাদের দুজনের পর মুনীর চৌধুরী বক্তৃতা করবেন। কিন্তু সভায় শাহ আজিজুর রহমানদের কার্যকলাপের ফলে পরিস্থিতি বেশ আশঙ্কাজনক মনে হওয়ায় তারা এর পর তাড়াতাড়ি সভা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেন। কাজেই মুনীর চৌধুরী সভাপতি হিসাবে দুই এক কথা সাধারণভাবে বলার পর সেদিনকার মতাে তারা সভার সমাপ্তি ঘােষণা করেন।১৪ | এই ঘােষণার পরই শাহ আজিজেরা চীৎকার করে সভা ভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের বক্তব্য পেশ করার দাবী করেন এবং তার পরই কিছু ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে যায়। এই গণ্ডগােয়ের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির লােকেরা সভাস্থল পরিত্যাগ করে তাদের অফিসের দিকে চলে যান। কারণ মুললিম লীগ গুণ্ডাদের যারা তাদের অফিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তারা সভাস্থল ত্যাগ করার পর শাহ আজিজেরা ময়দান দখল করে কিছুক্ষণ কমিউনিস্ট পার্টিকে নানা গালাগালির পর নিজেদের সভা শেষ করেন।১৫
| ৩০শে জুন করােনেশন পার্কের সভার পর সন্ধ্যার দিকে প্রায় এক হাজার লােক কোর্ট হাউস স্ট্রীটের পার্টি অফিস ঘেরাও করে আক্রমণ চালায় এবং তাদের সাথে অফিসের লােকেদের প্রায় আধঘণ্টাব্যাপী তুমুল খণ্ডযুদ্ধ হয়। বিনয় ব, অমূল্য সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম ছাড়াও প্রায় জনকুড়ি যুবক তখন অফিসের মধ্যে ছিলেন। এই মারামারি ও গণ্ডগােলের সময় প্রধান মন্ত্রী নাজিমুদ্দীন ‘শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে দুইজন পুলিশ পাঠিয়ে দেন।১৭ পার্টি সভ্যেরা বেশ কিছুক্ষণ সেই আক্রমণ প্রতিহত করার পর গুণ্ডারা স্থান ত্যাগ করে এবং সেবারের মতাে পার্টি অফিসের ভেতরে প্রবেশ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।১৮ | এই পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনী ঘােষণা করার কোনাে পরিকল্পনা সরকারের ছিলাে না। কিন্তু অন্যান্য উপায়ে এবং নির্যাতনের মাধ্যমে পার্টির কাজে সর্বতােভাবে বাধা প্রদানের সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করেছিলেন ও সেই সিদ্ধান্তকে কার্যকর করতে তাদের চেষ্টা এবং উদ্যোগের ত্রুটি ছিলাে না।
‘ই জুলাই রণেশ দাশগুপ্ত এবং ধরনী রায়কে গ্রেফতার করা হয়। এর পরই মােটামুটিভাবে সকলকে খােলাখুলি কাজ বন্ধ করে গােপনীয়তা রক্ষা করে চলার সিদ্ধান্ত নেন। | দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য সংখ্যা ছিলাে প্রায় দশ-বারাে হাজার। কিন্তু এই সংখ্যা মার্চের পর থেকেই দ্রুত কমে আসতে থাকে। পূর্বে ঢাকা শহরে এবং পার্টির বিভিন্ন জেলা অফিসগুলিতে ছাত্র এবং কর্মীদের যে ভীড় দেখা যেতে পরবর্তী পর্যায়ে তাও পাতলা হয়ে আসে এবং অল্প দিনের মধ্যেই তাদের সংখ্যা হয়ে দাড়ায় নগণ্য।২১
এর কারণ দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত নােতুন রণনীতি এবং পরবর্তী রণকৌশলের ভিত্তিতে পার্টি যে কাৰ্যসূচী গ্রহণ করেছিলােতাকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে পাটি সভ্য এবং দরদীদের উপর যে দায়িত্ব বাস্তবতঃ অর্পিত হয় অথবা অর্পিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় তা পালনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও মনােবলের অভাব। বহুদিন যাবৎ সংসদীয় আন্দোলনের সাথে সংগিষ্ট থাকার ফলে পার্টি সভ্যেরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্যে উচিতমতােভাৰে
প্রস্তুত ছিলেন না। এই অবস্থা আরও ঘােতর আকার ধারণ করে তাদের অধিকাংশের শ্রেণীগত দুর্বলতার জন্যে। পেটিবুর্জোয়া আধিপত্যের ফলে সভ্য হওয়াও তখন তেমন কঠিন ছিলাে না এবং সেই সুযােগে এমন অনেকে পাটির মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে সমর্থ হন যাঁদের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনাে বৈপ্লবিক সম্ভাবনাই ছিলাে না। প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত থেকে পেটি বুর্জোয়া আত্মপ্রসাদ এবং জনপ্রিয়তার জন্যেই তারা পার্টির সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। কাজেই সত্যকার সংগ্রাম এবং সশস্ত্র বিপ্লবের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতাে অবস্থা তাদের ছিলাে না। এদের মধ্যে অধিকাংশই প্রথম দিকে উধাও হন এবং অনেকে কোনাে প্রকারে মুখ রক্ষা করে পাটির সাথে সম্পর্ক ছেদের উপায় অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকেন।
৬। জননিরাপত্তা আইন ও সরকারী দমননীতি
শুধু কমিউনিস্ট পার্টি নয়, সামগ্রিকভাকে সমস্ত বিরােধীদলকে দমনের উদ্দেশ্যে সরকার জননিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য বহু নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই নির্যাতন অবশ্য প্রধানতঃ কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়।
সরকারের এই দমননীতির বিরুদ্ধে অন্যান্য মহল তাে দূরের কথা এমনকি সরকারের অনুগত সংবাদপত্র দৈনিক আজাদ’ পর্যন্ত প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়। ১১ই মার্চ ১৯৪৯ তারিখের দৈনিক আজাদের এক সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় :
আমাদের কর্তৃপক্ষকে জানাইয়া দিতে চাই যে, আতঙ্কগ্রস্ততা ও দমননীতির উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল না হইয়া তার দেশ হইতে দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও সামাজিক ভেদবৈষম্য দূর করিবার কাজকে তরান্বিত করুন। ইহা করিতে পারিলেই পাকিস্তানে কমিউনিজমের প্রবেশের দূরতম এবং ক্ষীণতম সম্ভাবনাও চিরদিনের জন্য দূর হইয়া যাইবে।
কেবলমাত্র সরকারই নয়, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা ভাবনায় অভ্যস্ত কিছু সংখ্যক ব্যক্তিও দমনমূলক ব্যবস্থার পক্ষে খােলাখুলিভাবে তাদের মত প্রকাশ করেন। এ সম্পর্কে নওবেলালের ১৭ই মার্চ, ১৯৪৯ তারিখের ‘একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয় :
আজ জনসাধারণের মধ্যে এক শ্রেণীর লােক যাহারা কঠোর দাননীতি
চালাইয়া যাইবার জন্য সরকারকে চাপ দিতেছেন তাহারা প্রকৃতপক্ষে কমিউনিজমের কাজ আগাইয়া দিতেছেন। তাঁহারা যদি সত্য সত্যই কমিউনিজম বিরােধী হইয়া থাকেন তাহা হইলে তাহাদের উচিত দেশের প্রধান প্রধান সমস্যা যথা—শিক্ষা সমস্যা, খাদ্য সমস্যা—মানুষ মানুষের মতাে বাঁচিয়া থাকিবার সমস্যা ইত্যাদির আশু এবং উপযুক্ত সমাধান করিবার জন্য সরকারকে বাধ্য করা। ১৯৪৯-এর মে মাসে পূর্ব বাঙলা সরকার চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তানের নিকট থেকে ৩০০০ টাকা জামানত তলব এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উত্তেজনামূলক সম্পাদকীয় ও সংবাদ প্রকাশের ওপর সেন্সরশীপ জারী করেন। এ ছাড়া ঐ একই মাসে ঢাকায় ইংরেজী সাপ্তাহিক “ইস্টার্ন স্টারের ওপরও তারা ১৯৪৬ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বলে সংবাদ ও সম্পাদকীয় প্রকাশের পূর্বে সেগুলি সরকারকে দেখানাের জন্যে তাদের ওপর এক নির্দেশ জারী করেন। | এই দুই পত্রিকার ওপরই উপরােক্ত নিষেধাজ্ঞা জারীর পর অনেক প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার সেই নিষেধাজ্ঞাগুলিকে প্রত্যাহার করার কোন ব্যবস্থা না করে সেগুলিকে বহাল রাখেন। এই সরকারী মনােভাব ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নওবেলাল ১৯৪৯-এর ২রা জুন সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন :
সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সকল স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানই প্রতিবাদ জানাইয়া অবিলম্বে এই আদেশ প্রত্যাহার করিবার জন্য সরকারকে অনুরােধ জানাইয়াছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার তাহাদের আদেশ বলবত রাখিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদপত্রের সংখ্যা পাকিস্তানের অন্য প্রদেশের তুলনায় খুবই অল্প। এই প্রদেশে শক্তিশালী সংবাদপত্র যাহাতে ত্বরিত গড়িয়া ওঠে সরকারের উচিত ছিল সে ব্যবস্থা করা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকার তার বিপরীত পন্থাই অবলম্বন করিতেছেন। দেশের জাগ্রত জনমত তাহা কোনােমতেই অনুমােদন করিতে পারে না এবং করেও নাই। জনমতের প্রতিধ্বনি করিয়া আমরা সরকারকে আরও একবার অনুরােধ করিব—আপনাদের আদেশ প্রত্যাহার করুন।
২রা জুন, ১৯৪৯-এর নওবেলাল-এ প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায় যে চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান’-এর সম্পাদক জনাব আবদুস সালাম তার পত্রিকার বিরুদ্ধে সরকারী দমননীতির প্রতিবাদে ১লা জুন থেকে অনশন শুরু
320
করেন। শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানেও পশ্চিম পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইন ও পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে এবং সেই প্রতিবাদে মুসলিম লীগের নেতারা পর্যন্ত শরীক হন। ১৯৪৯-এর অক্টোবর মাসে পশ্চিম পাঞ্জাব প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলের পরবর্তী অধিবেশনে প্রাদেশিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ ইকবাল চীমা পশ্চিম পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইন এবং পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিনান্স বহিত করার জন্যে এক প্রস্তাবের নােটিশ দেন। | সে সময় পশ্চিম পাব প্রাদেশিক লীগের কাউন্সিল সদস্য মােহাম্মদ আবদুল্লাহ খানকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধেও চীমা ও লাহাের মুসলিম লীগের সভাপতি জাফরুল্লাহ পৃথক পৃথক বিবৃতিতে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন। | পশ্চিম পাঞ্জাব সাংবাদিক সংঘের কার্যকরী কমিটিও জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স-এর তীব্র নিন্দা করে এক প্রস্তাব নেন এবং তাতে ভঁরা ঐ অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করার জন্যে পাকিস্তানের সাংবাদিকদের কাছে আবেদন জানান।
এ ছাড়া ১৩ই অক্টোবর, তারিখে লাহােরে এক বিরাট জনসভায় পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে এক প্রস্তাব পাস করা হয়। সেই প্রস্তাবে বেগম শাহ নওয়াজ মালিক ফিরােজ খান মুন, খান ইফতেখার হােসেন খান ( মামদোত), মিঞা মমতাজ দৌলতানা, প্রভৃতি পাকিস্তান বিধান সভার সদস্য এবং মুসলিম লীগের পাণ্ডা ব্যক্তিরাও স্বাক্ষর দান করেন। এই প্রস্তাবটিতে তারা বলেন :
দেশের মধ্যে এমন কোনাে অবস্থার সৃষ্টি হয় নাই যাহার জন্য এই যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা আবার নােতুন করিয়া গ্রহণ করিবার কোনাে প্রয়ােজনীয়তা আছে। স্বাধীনতা অর্জনে দেশবাসী আশা করিয়াছিল যে নাগরিক অধিকার অক্ষুন্ন থাকিবে। কিন্তু সরকার দেশবাসীর আশা ভঙ্গ করিয়া এই “ফ্যাসিস্ট” ব্যবস্থা আবার নূতন করিয়া দেশের উপর চাপাইয়া দিতেছেন।
জননিরাপত্তা আইনের বলে সরকার সংবাদপত্র সম্পাদক থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কর্মী পর্যন্ত সকলকে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু করে। সংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহও এই সরকারী হামলার শিকারে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রগতি লেখক সংঘকে সরকার একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঘােষণা
করে তার বিরুদ্ধে নানা প্রকার দমন ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেন এ সম্পর্কে ১৩ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ করাচীর লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ছাত্র, যুবক ও কৃষকদের এক সভায় প্রগতি লেখক সংঘকে সরকার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে যে ঘােষণা করেছিলেন তা বাতিল করার জন্যে দাবী জানানাে হয়। উক্ত সভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে তারা সরকারের এই ঘােষণাকে শুধু সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক কার্যাবলীর উপর আক্রমণ বলে অভিহিত করেন। | ৭ই এপ্রিল, ১৯৫০, করাচীতে পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদকদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে প্রতিনিধি উপস্থিত থাকেননি। সম্মেলনে পাকিস্তান সরকারের জননিরাপত্তা আইন সম্পর্কে সভ্যদের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা চলে। এবং সেখানে •রকার কর্তৃক জননিরাপত্তা আইনের প্রয়ােগ সংবাদপত্রের উপর যাতে না হয় সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। কিন্তু সম্মেলন সেই প্রস্তাব অগ্রাহ করায় পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের সাতজন সম্পাদক অধিবেশন গৃহ পরিত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে ২৭শে এপ্রিল নওবেলাল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয়তে বলেন :
সম্প্রতি করাচীতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনের অধিবেশন হইতে লাহােরের কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক সম্মেলনের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া বাহির হইয়া আসিয়াছেন। পাকিস্তান সরকারের জননিরাপত্তা আইনের কবল হইতে সংবাদপত্র ও সাংবাদিগকে অব্যাহতি দিবার জন্য যে প্রস্তাব করা হইয়াছিল তাহা সম্মেলনে অগ্রাহ হইয়া যাওয়ায়ই তাহারা এই পন্থা অবলম্বন করিতে বাধ্য হইয়াছেন। এই আইন অনুযায়ী সরকার কোনাে কারণ না দর্শাইয়াই যে কোনাে সময়ে যে কোনাে সংবাদপত্র বন্ধ করিয়া দিতে বা যে কোনাে সংবাদপত্র সম্পাদককে কারা প্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষেপ করিতে পারেন। দেশে জরুরী অবস্থাধীনে এই ধরনের আইনের প্রয়ােজনীয়তা থাকিতে পারে কিন্তু সাধারণ অবস্থায় এইরূপ বিশেষ ক্ষমতার ব্যবস্থাকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের নামান্তর ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না।
করাচীর সংবাদপত্র সম্পাদক সম্মেলনে সাতজন সম্পাদক যে প্রস্তাব আনেন তাতে জননিরাপত্তা আইন বাতিলের কোনাে দাবী ছিলাে না। আইনটি যাতে সংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য না হয় এই ছিলাে তার সুপারিশ। কিন্তু এই
সুপারিশও সম্পাদকদের নিজেদের দ্বারাই অগ্রাহ হয় ! | পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন জননিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়ােগের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি দিলেও কার্যক্ষেত্রে তা পালন করা হয় নাই। ঐ সম্পর্কে ঢাকার অন্যতম ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজার্ভার’ মন্তব্য করে :
এই ধরনের প্রতিশ্রুতির কোনো অর্থই হয় না। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কাইয়ুম মন্ত্রিসভা, মন্ত্রিসভার রদবদল সম্পর্কে এক সংবাদ প্রকাশ করার জন্যে সরহদ’ পত্রিকার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানেও এইরূপ বা ইহার চেয়েও নগণ্য কারণে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করিয়াছেন। সমগ্র পাকিস্তান জুড়িয়া এবং বিশেষ করিয়া উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পূর্ব পাকিস্তানে বিশিষ্ট মুসলিম লীগ পন্থীদের পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ফেলিয়া বিনা বিচারে আটক রাখা হইয়াছে এবং হইতেছে।
পূর্ব বাঙলার কথা উল্লেখ করে ঢাকার কুখ্যাত ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ’ পর্যন্ত ১৮ই এপ্রিল, ১৯৫৩, এক সম্পাদকীয়তে লেখে :
এখানে কর্তৃপক্ষ জনকল্যাণমূলক সমালােচনা সহ করিতেও প্রস্তুত নহেন। প্রাদেশিক প্রেস কনসালটেটিভ কমিটির এগারজন সদস্যের মধ্যে চারিজনই সরকারী কর্মচারী। এই কমিটিকে জিজ্ঞাসা না করিয়াই সম্পাদকদেরকে গ্রেফতার করা হইতেছে। জামানত তলব দেওয়া হইতেছে। এবং সংবাদপত্র বন্ধ করা হইতেছে।
সরকার জননিরাপত্তা আইনের বলে একের পর এক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং পত্রিকা সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলা চালায়। সরকারের সাথে সামান্য মতবিরােধ পর্যন্ত তারা দমন করতে বদ্ধপরিকর হয়ে নির্বিচারে তাদের দমননীতি প্রয়ােগ করে। শুধু ঢাকা, লাহাের এবং অন্যান্য বড়াে শহর থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র পত্রিকার উপরই তাদের এই হামলা সীমাবদ্ধ ছিলাে না। মফস্বলের সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলির মধ্যে বহুসংখ্যক পত্রিকাই সরকারের জননিরাপত্তা আইনের কবলে পড়ে। ফেনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক “সংগ্রাম” সম্পাদক ফয়েজ আহমদ এই আইনে গ্রেফতার হওয়ার পর ২রা নভেম্বর, ১৯৫৩, “দুর্ভাগা সাংবাদিক’ নামে একটি সম্পাদকীয়তে নওবেলাল বলেন :
জনাব আহমদ ‘নিরাপত্তা আইন’-এর কবলে পড়িয়াছেন। আমরা প্রকাশ আদালতে তাহার সুবিচার চাই। যদি সরকার জনমতের ধার ধারি
থাকেন—দোষী হইলে নিশ্চয়ই আহমদ সাহেব শান্তি বরণ করিয়া নিবেন নির্দোষী হইলে তাঁহার মুক্তি চাই।‘পূর্ব পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সংঘ’ একবার সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন সরকার কি তাহার অলঙ্ঘনীয় দোষের কথা তাহাদিগকে অবহিত করাইবেন? ‘নিখিল পাকিস্তান সংবাদপত্র সম্পাদক সঙ্ঘের’ স্ট্যাণ্ডিং কমিটির রীতি অনুযায়ী। সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে অভিযােগগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার করিয়া। দেখুন। কোথায় সম্পাদক সাহেব রাষ্ট্রদ্রোহিতা করিয়াছেন? বৃটিশ আমলের তৈরী একজন কর্মচারীর খেয়ালের বলেই কি এমনিভাবে সাংবাদিকেরা। জননিরাপত্তার নামে কার। প্রাচীরের অন্তরালে থাকিবেন?—আমরা। সত্যকারের বিচার চাই।—নির্দোষীর মুক্তি চাই।
কমিউনিস্ট পার্টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বেআইনী ঘােষণা না করলেও জননিরাপত্তা আইনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের দ্বারা পাইকারী হারে কমিউনিস্টদেরকে গ্রেফতার করে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এর ফলে বহু পাটি সদস্য আত্মগােপন করেন এবং অনেকে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। নিশ্চিন্ত জীবন গঠনে নিযুক্ত হন।
৭। জেল নির্যাতন ও অনশন ধর্মঘট
বৃটিশ আমলে রাজ বন্দীদের জন্যে ১৯৪০ সালের যে Security Prisoners Rules ছিলাে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর East Bengal Special Powers Ordinance পাস করার সময় সেটাকে বাতিল করা হয়। এর পর থেকে রাজবন্দীদেরকে পূর্বের মতাে মর্যাদা না দিয়ে জেলা শাসক ইচ্ছেমতাে। তাদেরকে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত করে রেখে যখন যা খেয়াল সেই অনুসারে তাদের সাথে ব্যবহার করতেন। এই ক্ষমতা জেলা শাসকদেরকে আইনগত ভাবেই দেওয়া ছিলাে। একথা ১৯৪৯-এর ৫ই এপ্রিল পূর্ব বাঙলা পরিষদে রাজবন্দীদের অনশন সম্পর্কে একটি বিতর্ক চলাকালে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন আহমদের পক্ষ থেকে কাজী আবুল মাসুদ স্বীকার করে বলেন যে রাজবন্দীদের মধ্যে কাকে দ্বিতীয় শ্রেণী এবং কাকে তৃতীয় শ্রেণী দেওয়া হবে সেটা সম্পূর্ণভাবে জেলা শাসকের হাতেই ন্যস্ত আছে।
ঐ একই বিতর্কের সময় মন্ত্রী মুকিজউদ্দীন আহমদ বলেন যে প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর বন্দীদের মধ্যে আসলে তেমন কিছুই তফাত নেই। প্রথম শ্রেণীর
বশীরা অন্যদের থেকে সাক্ষাৎকারের এবং চিঠিপত্র লেখালেখির সুযােগ বেশ পান। কিন্তু খাদ্য এবং অন্যান্য ব্যাপারে এ দুই শ্রেণীর মধ্যে কোনাে তফাত নেই। অন্যদিকে মন্ত্রী আবার একথাও স্বীকার করেন যে Security Prisoners Rules বাতিল হওয়ার পর রাজবন্দীদেরকে সুযােগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে কোনাে বাধা-ধরা নিয়ম ছিলাে না। তারা সেক্ষেত্রে পূর্বোক্ত বাতিলকৃত Security Prisoners Rules-কে অনেকাংশে অনুসরণ করেই বিশেষ বিশেষ অবস্থায় নিজেদের করণীয় স্থির করতেন। কিন্তু পূর্বের Rules সমূহ এ ব্যাপারে পুরােপুরি অনুসরণ করা হতাে না।
Jail Code অনুসারেই তাদের সুযােগ-সুবিধা মােটামুটি নিয়ন্ত্রিত হতে এবং সেখানে রাজবন্দীদের কোনাে পৃথক ব্যবস্থার কথা যে ছিলাে না একথাও মুফিজউদ্দীন স্বীকার করেন।
মন্ত্রী মুফিজউদ্দীনের এই বিতর্ককালীন উক্তিগুলাে থেকেই একথা প্রমাণিত হয় যে রাজবন্দীদেরকে কি ধরনের সুযােগ-সুবিধা দেওয়া হবে এবং তাদের সাথে কি ধরনের ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে কোনাে নির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছিলাে না। এর অনেকখানি তাই জেলা শাসকের খামখেয়ালী এবং ইচ্ছে-অনিচ্ছের ওপরই নির্ভর করতাে। আইনের অবর্তমানে জেলা শাসক ছাড়া জেলার জেল সুপারিনটেন্টে এবং জেলের অন্যান্য কর্মকর্তারাও অনেক সময় ইচ্ছামতােভাবে রাজবন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার করতে দ্বিধাবােধ করতাে না।
তৎকালীন রাজবন্দীদের থেকে জানা যায় যে সে সময় রাজবন্দীদের কোনাে মর্যাদাই দেওয়া হতাে না। প্রথম দিকে জেল ভাতা, প্ৰীক্ষা দেওয়ার অনুমতি, খবরের কাগজ ইত্যাদির কোনাে ব্যবস্থা ছিলাে না। আইনতঃ তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদী না হলেও পরের দিকে তাদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীদের খাদ্য দেওয়া হতাে, নিজেদের কাপড়ের পরিবর্তে জেলের কুর্তা পরতে হতাে এবং সন্ধ্যের পর তাদের ঘরে বাতি দেওয়া হত না।
জেলের অভ্যন্তরে এই নির্যাতন ছাড়াও ১৯৪৯-৫০ সালে রাজবন্দীদের অনশনের আর একটি প্রধান কারণ এই অনশন ধর্মঘট সম্পর্কে তৎকালীন পার্টির সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী। এর সাথে প্রথম দিকে রণদীভে থিসিসের কোনাে প্রত্যক্ষ যােগ না থাকলেও তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই সে সময় অনশনকে বৈপ্লবিক সংগ্রামের একটি পদ্ধতি হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিলাে যে জেলের মধ্যে নিজেদের অধিকার নিয়ে সংগ্রাম শুরু করলে জেলের বাইরে যারা আছেন তারা এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হবেন এবং তার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম
325
সামগ্রিকভাবে অনেকখানি এগিয়ে যাবে। রণদীভে থিসিস পুরােপুরিভাবে প্রয়ােগ করার নির্দেশ আসার পর এই লাইনকে আরও জোরালােভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তখন জেলখানার কয়েদীদেরকেও অনশনের দিকে টেনে এনে তাদেরকেও বিপ্লবের দিকে চালনা করার চেষ্টা চলতে থাকে।
এ সময় সাধারণ কয়েদীদেরকে এইভাবে অনশনের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করার নীতির বিরুদ্ধে অনেকে জেলের মধ্যেই বক্তব্য পেশ করেন। তারা বলেন যে এই কয়েদীরা প্রধানতঃ লুনপেন প্রলেটারিয়েট। এই লুনপেন লেটারিয়েটদেরকে দিয়ে কোনাে বিপ্লব হতে পারে না, বিশেষ করে জেলের মধ্যে। এই বক্তব্য যারা দেন তাদেরকে সংস্কারপন্থী আখ্যা দিয়ে তাদের সমালােচনাকে অগ্রাহ্ন করা হয়।
পূর্ব বাঙলায় জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয় তখন ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষতঃ পশ্চিম বাঙলাতেও, জেলের মধ্যে অনশন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। সেখানেও অনশন ধর্মঘটকে সংগ্রামের একটা পদ্ধতিহিসাবে স্বীকার করে নিয়ে তার দ্বারা ব্যাপক জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। সেই হিসাবে দমদম, আলীপুর ইত্যাদি কেন্দ্রীয় কারাগারগুলিতে অনশন ধর্মঘটকে তাঁরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর জবাবে পশ্চিম বাঙলা সরকার কর্তৃক দমদম এবং আলীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে এই সময় রাজবন্দীদের ওপর অকথ্য এবং নির্মম নির্যাতন চালানাে হয়। | ১৯৪৯ সালের গােড়ার দিকেই সর্বপ্রথম অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং পূর্ব বাঙলার সমস্ত জেলাগুলিতে একই সময় সেই ধর্মঘট শুরু করার জন্যে বিভিন্ন জেলের সাথে যােগাযােগ স্থাপনের চেষ্টা চলতে থাকে। এই যোগাযোগ প্রধানতঃ বদলীকৃত কয়েদীদের মাধ্যমেই স্থাপিত হতাে।
যােগাযােগ মােটামুটিভাবে স্থাপিত হওয়ার পর ঢাকা এবং রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারসহ পূর্ব বাঙলার সমস্ত জেলগুলিতে কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা ১১ই মার্চ, ১৯৪৯ থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন।
ঢাকা জেলে সে সময় প্রায় ১০০ জন রাজবন্দী ছিলেন। তাদের পক্ষ থেকে রণেশ দাশগুপ্ত জেল কর্তৃপক্ষকে ধর্মঘটের নােটিশ দেন। এই সময় একজন পাঞ্জাবী I.M.S. (ইণ্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিস) ছিলাে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিজন্ম। সে প্রথমে রণেশ দাশগুপ্তের নােটিশের জবাবে তাদেরকে পাল্টা নােটিশ পাঠিয়ে জানায় যে তাদের অনশন ধর্মঘট সম্পূর্ণ বেআইনী।
নােটিশ যখন রণেশ দাশগুপ্তের কাছে সার্ভ করতে আসে তখন অন্যান্য পুনপেন লেটারিয়েট : ভবঘুরে সর্বহারা
সকলে তাকে ঘিরে ধরেন এবং নােটিশটা না নেওয়াই স্থির করেন। এর পর নােটিশ সার্ভ করবার জন্যে তারা রণেশ দাশগুপ্তকে জেল গেটে নিয়ে যায়। সেখানেও তিনি সেটি নিতে অস্বীকার করায় তারা জোর করে তার হাতে নােটিশটি দিয়ে দেয়।
এর পর উপরােক্ত আই. জি. প্ৰিজন্স নিজে জেলখানায় এসে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করে তাদের বলে যে, তারা দেশদ্রোহী, দেশপ্রেমিক নন। তারা এখন আর ইংরেজদের কারাগারে নেই। কাজেই কোনাে রকম বিবেচনা তাদের প্রতি করা হবে না। এর পর সে উপস্থিত রাজবন্দীদের জিজ্ঞেস করলে তারা তাদের অনশন ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে রাজী আছেন কিনা। এর জবাবে সকলেই না, না, বলে চীৎকার করে আই. জি.কে তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন।১০ | ঢাকা জেলে ১১ই মার্চ, ১৯৪৯, সকাল থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু হলে ৪৯ জন। সেই ধর্মঘটে শরীক হন। সেই দিন সন্ধ্যাবেলাতেই এদের মধ্যে ৪ জন অনশন ত্যাগ করেন। ১২ই মার্চ আরও ৩ জন এবং তার পর আরও ৩ গুন। অনশন ত্যাগ করেন।
| এই সময় জেল কর্তৃপক্ষ এবং সরকারী লােকজন ঘন ঘন অনশন ধর্মঘটীদের। সাথে আলাপ-আলোচনা করতে আসতেন এবং তাদের দাবী মেনে নেওয়া হবে। ইত্যাদি মৌখিক আশ্বাস দিয়ে তাদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিতে বলতেন।১২ ধর্মঘটীদের মধ্যেও কেউ কেউ এই সময় অনেকখানি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং কর্তৃপক্ষের এইসব আশ্বাসের ওপর আস্থা রেখে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়ার সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। এই অবস্থা ছাড়াও তিন র দিনের মধ্যে দশ ধর্মঘটী ইতিমধ্যেই নিজেদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনশন ত্যাগ করায় ধর্মট পরিস্থিতির অনেকখানি অবনতি ঘটে। কাজেই শেষ পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৫ই মার্চ বাকী । ৩৯ জন ধর্মঘটী অনশন ত্যাগ করেন।১৩
অনশন ধর্মখটের সময় জেলের মধ্যে গিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য সরকারী কর্মচারীরা ধর্মঘটীদের দাবীদাওয়া মেনে নেওয়া সম্পর্কে যে সমস্ত আশ্বাস দিয়েছিলেন সেগুলির কোনােটিই কার্যকর করা হয়নি। উপরন্তু এ প্রসঙ্গে পূর্ব বাঙলা বিধান পরিষদে এক বিতর্ককালে ই এপ্রিল মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন ঘােষণা করেন যে ঢাকা জেলের অনশন ধর্মঘটীদেরকে কোনাে রকম আশ্বসই দেওয়া হয়নি এবং তারা বিনাশর্তে তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছেন।
মৌখিক আশ্বাস যতই দেওয়া হােত আইনতঃ এবং লিখিত কোনাে বােঝপড়া দুই পক্ষে হয়নি, কাজেই মন্ত্রীর এই উক্তি। অনশন ধর্মঘটীরা যে বিনাশর্তে তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করেছিলেন তা সত্যি। সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করে তাদের থেকে অধিকার আদায় করার মতাে মনােবল এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা। তারা ধর্মঘটীদের নিজেদের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারেননি। কাজেই ঢাকা জেলে প্রথম ধর্মঘটটি ১১ই মার্চ থেকে ১৫ই মার্চ পর্যন্ত মাত্র ৪ দিন স্থায়ী হয়।
সরকার রাজবন্দীদের এই দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে ধর্মঘটের ঠিক পরেই। তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। পূর্বে যেটুকু অধিকার এবং সুযােগ-সুবিধা তাদের ছিলাে সেগুলি প্রায় সবই এর পর তারা হরণ করে। প্রথমেই তারা ব্যবস্থা করে রাজবন্দীদের একত্রে রাখার পরিবর্তে তাদের পৃথক সেলে রাখার। তারা ঘােষণা করলাে যে এর পর থেকে তাদেরকে আর। রাজবন্দীর মর্যাদা কোনােক্রমেই দেওয়া হবে না। সেই অনুসারে রাজবন্দীদের থেকে তাঁদের জামা কাপড় কেড়ে নিয়ে তারা তাদেরকে সাধারণ কয়েদীদের জন্যে বরাদ্দকৃত ডুরেকাটা কয়েদীদের পােশাক পরাতেও চেষ্টা করলাে। এ ছাড়া চৌকি, মশারী ইত্যাদি ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া
হলাে।১৫
| ঢাকা জেলে এই ধর্মঘট মাত্র ৪ দিন স্থায়ী হলেও রাজশাহী কেন্দ্রীয় । কারাগারে প্রথম ধর্মঘট আরও অনেক বেশীদিন স্থায়ী হয়। কিন্তু প্রায় ৩৮ দিন ধর্মঘটের পর সেখানেও অবশেষে কর্তৃপক্ষের সাথে কোনাে বােঝাপড়া। ব্যতীতই ধর্মঘট ভেঙে পড়ে। ধর্মঘট ভেঙে পড়ার পর সেখানেও রাজবন্দীদের থেকে ঢাকা জেলের অনুকরণে সমস্ত অধিকার ও সুযােগ-সুবিধা কেড়ে নেওয়া।
হয়।১৬
কেন্দ্রীয় কারাগার দুটি ব্যতীত অন্যান্য জেলগুলিতেও প্রথম অনশন ধর্মঘটের পরিণতি মােটামুটি একই রকম হয়। তবে ঢাকার তুলনায় অন্যান্য জেলে ধর্মঘট কিছুটা বেশীদিন স্থায়ী হয়।
রংপুর জেলে ধর্মঘট চলার সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার জেল পরিদর্শন। করে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করেন। তিনি তাদেরকে বলেন যে নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্বেই তিনি আলাপ করতে এসেছেন এবং ঢাকা গিয়ে অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথে আলাপ-আলােচনা করে তিনি তারযােগে তাদেরকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন। ইতিমধ্যে তিনি রাজবন্দীদেরকে অনশন প্রত্যাহার করতে অনুরােধ জানান। ধর্মঘটীরা তাকে বলেন যে তাঁদের অন্ততঃ ডিভিশন প্রিজনার।
হিসেবে গণ্য করতে হবে এবং দশ দিনের মধ্যে সেই সিদ্ধান্ত তাদেরকে জানিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় দশদিন পর তারা তাদের ধর্মঘট আবার শুরু করবেন।
হাবিবুল্লাহ বাহারের সাথে উপরােক্ত আলাপ আলােচনা এবং দশ দিনের মধ্যে মন্ত্রী কর্তৃক নিজেদের সিদ্ধান্ত রাজবন্দীদেরকে জানানাের শর্তে রংপুর জেলের অনশন ধর্মঘটীরা ১৫ দিন ধর্মঘটের পর তাদের অনশন ত্যাগ করেন। | কিন্তু হাবিবুল্লাহ বাহারের প্রতিশ্রুত টেলিগ্রাম রাজবন্দীদের কাছে এলাে না। নয় দিন কেটে যাওয়ার পর আবার অনশন ধর্মঘটের প্রস্তুতি শুরু হলাে। কিন্তু সে ধর্মঘট আর সম্ভব হলাে না। কারণ দশম দিন সকালে অনেককে রংপুর জেল থেকে অন্যত্র বদলী করে দেওয়া হলাে। এর মধ্যে অমূল্য লাহিড়ী ও সুধীন ধরকে যেতে হলাে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং মারুফ হােসেন ও মুখলেসুর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে যেতে হলাে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
প্রথম অনশন ধর্মঘট এইভাবে ব্যর্থ হওয়ার পর ১৯৪৯-এর মে মাসে দ্বিতীয় দফা ধর্মঘট শুরু হয়।২০ এবার শৃঙ্খলার ব্যাপারে আগের থেকে অনেক বেশী। কড়াকড়ি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। সকলকে বলে দেওয়া হয় যে পাটি সিদ্ধান্ত ছাড়াই কেউ যদি অনশন ভঙ্গ করেন তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ পাটি থেকে বহিষ্কার করা হবে। কাজেই সমস্ত জায়গায় খবর দেওয়া হলাে যে মরে গেলেও কেউ নিজের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে অনশন ভঙ্গ করতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না কর্তৃপক্ষ দাবী-দাওয়া মেনে নিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অনশন ধর্মঘটে সকলকে অটল থাকতে হবে। | ঢাকা জেলে দশ দিন পর্যন্ত কাউকে নাক দিয়ে খাওয়াতে চেষ্টা করেনি। কিন্তু দশদিন পর প্রত্যেকেই খুব দুর্বল হয়ে পড়ার জন্যে কেউই আর উঠতে পারতাে না। সেই অবস্থায় জেল কর্তৃপক্ষ নাক দিয়ে তাদেরকে খাওয়াতে শুরু করে।
এই অনশন ধর্মঘট চলাকালে ১লা জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সরকারী জুলুমের প্রতিবাদে এবং ধর্মঘটীদের সমর্থনে একটি সভার অনুষ্ঠান করেন।২২
২৪ দিন এইভাবে অনশন ধর্মঘট চলার পর মন্ত্রী মুফিজউদ্দীন আহমদ এবং ফকির আবদুল মান্নান ও মনােরঞ্জন ধর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করে তাদেরকে আশ্বাস দেন যে তাদের সমস্ত দাবী-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তারা অনশন ধর্মঘটীদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্যেও
অনুরােধ করেন। এবং আবার এই আশ্বাস এবং অনুরােধের ওপর ভিত্তি করে। ঢাকা জেলের ধর্মঘটীরা তাদের অনশন ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। | রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দ্বিতীয় ধর্মঘট স্থায়ী হয় ৪১ দিন। সেখানে এই ধর্মঘটের সময় অনশন ধর্মঘটীদের প্রত্যেককে আত্মহত্যা প্রচেষ্টার অভিযােগে জেল কর্তৃপক্ষ এক বৎসর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেন। এর ফলে তাদের সকলকে ঘানি, তঁত ইত্যাদিতে তারা সাধারণ কয়েদীদের মতাে কাজে লাগিয়ে দেয়। এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ফলে নূরুল আমীন সরকারের আমলে রাজবন্দীরা বিভিন্ন চাকীতে কাজ করতে থাকেন।২৪
ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অন্যান্য জেলা কারাগারগুলিতে দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘট চলার সময় অনশন ধর্মঘটত রাজনৈতিক নিরাপত্তা বন্দীদের সম্পর্কে পূর্ব বাঙলা সরকার এক প্রেস নােটে বলেন :
ভারত বিভক্ত হওয়ার পূর্বে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের হাত হইতে দেশ রক্ষা করিবার জন্য তৎকালীন রাজবন্দীগণ আত্মত্যাগ করিতেন বলিয়া ঠাহ।দিগকে দেশ-সেবক ও আত্মত্যাগী হিসাবে পরিগণিত করা হইত এবং সেই জন্যই তাহাদিগকে জেলে পদমর্যাদা ইত্যাদি দেওয়া হইত। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজনৈতিক পঞ্চম বাহিনীর দল নবলব্ধ পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধ্বংস করিবার মানসে তৎপর হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং তাহাদিগকে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহী বলিয়া বিবেচনা করেন। অতএব সরকারের মতে বর্তমানের রাজনৈতিক বন্দীরা কোনাে পদমর্যাদা বা অন্য প্রকার সুবিধা লাভ করিতে পারেন না।২৫
এই সরকারী প্রেস নোটের সমালােচনা প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক নওবেলাল মন্তব্য করেন :
রাষ্ট্রদ্রোহীদের ফাসী কাষ্ঠে ঝুলানই উচিত এবং কে রাষ্ট্রদ্রোহী আর কে নয় উপযুক্ত কোর্টই তাহা বিচার করিবার অধিকারী—সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ নিশ্চয়ই নহে। আর সাম্রাজ্যবাদী আমলের যে যুক্তি দেখান হইয়াছে তাহা একটু চিন্তা করিয়া দেখিলে সরকার নিজেই দেখাইতেন না বলিয়াই আমরা বিশ্বাস করি। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস করিবার জন্য যাহারা সংগ্রাম করিয়া রাজবন্দী হইয়াছিলেন তাহাদিগকে আদর করিয়া সাম্রাজ্যবাদী সরকার বন্দীশালায় পদমর্যাদা দান করিত তাহা সত্যই এক হাস্যাস্পদ ব্যাপার।২৬ কিন্তু শুধু মে মাসের দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘটের সময় উপরােক্ত সরকারী

330

প্রেস নােটই নয়। পরবতী অনশন ধর্মঘটের সময় পূর্ব বাঙলা বিধান পরিষদে এক বিতর্ককালে প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন বলেন :
আমি একথ নাতে চাই যে স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে নিরাপত্তা বন্দীদের কাজকে স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা হতাে। এখানে তখন একটি বিদেশী শাসন ছিলাে এবং যারা স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে তাদেরকে দেশপ্রেমিক হিসাবে বিবেচনা করা হতাে। আমরা এখন পাকিস্তান অর্জন করেছি, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কাজেই এখন যারা আমাদের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে চেষ্টা করে এবং যারা দেশে পাকিস্তান বিরােধী মনােভাব সৃষ্টি করতে চেষ্টা করে তাদেরকে দেশপ্রেমিক হিসাবে বিবেচন করা হয় না। তাদেরকে বিবেচনা করা হয় রাষ্ট্রের দুশমন হিসাবে। কাজেই বৈদেশিক শাসনের থেকে তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা যে সুযােগ-সুবিধা পেতে এই পরিবতিত পরিস্থিতিতে যখন দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তখন সেগুলি তারা আর পাওয়ার আশা করতে পারে না।২৭
উপরোল্লিখিত প্রেস নােট এবং “স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের পূর্ব বঙ্গীয় মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য পাকিস্তানের সমগ্র রাষ্ট্রীয় কাঠামাের চরম প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র এবং জনগণ ও রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর তাদের নির্যাতনের মাত্রাকে নগ্নভাবেই চিত্রিত করে।
দ্বিতীয় ধর্মঘট শেষ হওয়ার পর ঢাকা জেলে দেবপ্রসাদ এবং নাদেরা বেগম বাইরে থেকে রাজবন্দী হিসাবে আসেন। তাদের মাধ্যমে নােতুন রণদীতে লাইন বাস্তবায়ন সম্পর্কে জেলের ভেতরকার কমিউনিস্ট রাজবন্দীরা কিছুটা অবহিত হন। এবং তার পর জেলকে কেন্দ্র করে প্রতিরােধ ও বিদ্রোহ গঠন করার সিদ্ধান্ত আবার নােতুনভাবে নেওয়া হয়। এর পরই তারা শুরু করেন তৃতীয় পর্যায়ের অনশন ধর্মঘট।
এই সময় সাধারণ কয়েদীদের দাবী-দাওয়া নিয়ে কিছুটা আন্দোলনেরও সিদ্ধান্ত হয় এবং সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তারা জেলের মধ্যে মারামারি করার সিদ্ধান্তও নেন। এই সিদ্ধান্ত অবশ্য শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। | তৃতীয় অনশন ঘর্মঘট ঢাকায় শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে এবং তা ৪০ দিন স্থায়ী হয়। এই ধর্মঘট কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পর শেষ হয় এবং এবার রাজবন্দীরা নিজেদের পৃথক পৃথক সেল থেকে পূর্বের মতাে আবার একত্রে থাকার জন্যে ওয়ার্ডে ফিরে আসেন।৩০ রাজশাহীতে এই তৃতীয়
ধর্মঘট স্থায়ী হয় ৪৫ দিন।৩১
তৃতীয় ধর্মঘটের পর জেল-নিয়ম ভঙ্গ করবার জন্যে ঢাকা জেলে দেবেশ ভট্টাচার্য ও নারায়ণ বিশ্বাসসহ কয়েকজনের বিচার হয়। রাজবন্দীরা এর পর নিজেদের উকিলের পরামর্শমত হাজিরা দিতে অপারগ বলে জেল কর্তৃপক্ষকে জানান। এর ফলে রনেশ দাশগুপ্তসহ কয়েকজনকে হাজিরা দিতে হলাে না এবং সে সেজন্যে তারা কোনাে মেয়াদী সাজাও পেলেন না।৩২
| কিন্তু নাদেরা বেগমের বিরুদ্ধে জেল নিয়ম ভঙ্গ করা ইত্যাদি অভিযােগ আনার পর ৩০শে নভেম্বর জেল গেটে একজন সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বিচারের জন্যে তাকে হাজির করা হলাে। এই বিচারের সময় নাদেরা বেগম কোনাে প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করে বিচারক সাব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটকে নিজের জুতাে ছুড়ে মারেন। এই ঘটনার পর নাদেরা বেগমের চুলের মুঠি ধরে তাকে মারতে মারতে জেল গেট থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।৩৩ | নাদেরা বেগমকে এইভাবে মহিলা ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার সময় ওয়ার্ডের ভেতরে অন্যান্য মহিলা কয়েদীরা বােতল, কাচের গাস ইত্যাদি ছুড়ে জেলের ওয়ার্ডারদের মারতে শুরু করেন। মারপিট ছাড়াও এর অন্য কারণও ছিলাে। মহিলা ওয়ার্ডে মেয়ে ওয়ার্ডার ছাড়া কেবলমাত্র জমাদার ও জেলার ব্যতীত অন্য কোনাে পুরুষের ঢােকার নিয়ম ছিলাে না। কাজেই পুরুষ ওয়ার্ডাররা যখন নাদেরকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ভেতরে ঢােকালাে তখন তারা খুব বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে ওয়ার্ডারদের আক্রমণ করলেন। এই আক্রমণের সাথে সাথে তারা শ্লোগান দিতে থাকলেন।৩৪
এই ঘটনা যখন ঘটে তখন রাজবন্দীরা জেলখানার মধ্যেভলি খেলছিলেন।৩৫ মহিলা ওয়ার্ডের গােগান এবং আর্ত চীৎকারে তৎক্ষণাৎ খেলা পরিত্যাগ করে তারাও শ্লোগান দিতে শুরু করলেন। এর পর পুলিশ খেলার মাঠেই রাজবন্দীদের ওপর লাঠি চার্জ শুরু করে তাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে ওয়ার্ডের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাে। ইতিপূর্বে পাগলা ঘণ্টা দিয়ে জেল কর্তৃপক্ষ অনেক পুলিশ হাজির করে ফেলেছিলাে। তারা বললাে রাজবন্দীরা এর পর বেশী গণ্ডগােলের চেষ্টা করলে তারা তাদের ওপর গুলি চালাবে।৩৬
এই পরিস্থিতিতে জোর করে একটা কিছু করতে অর্থাৎ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে কেউ রাজী ছিলাে না। তাছাড়া পাগলা ঘন্টা দিয়ে ওয়ার্ড ঘিরে ফেললেও অতিরিক্ত জেলার মাখলুকুর রহমানের প্রচেষ্টার ফলে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত গুলি না চালানাের সিদ্ধান্ত নেয়।
এর পরদিন রাজবন্দীদের পক্ষ থেকে সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে অনশন ধর্মঘটের নােটিশ দেওয়া হয়। অনেকেই এবার বললেন যে বারবার অনশন করে কোনাে লাভ হচ্ছে না, উপরন্তু ক্ষতিই নানাভাবে বাড়ছে। তার চেয়ে এবার শেষবার শেষ পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়া দরকার। সিদ্ধান্তও এবার সেই অনুসারে নেওয়া হলাে। রাজবন্দীরা নিজেদের দাবী-দাওয়া কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়ে বললেন যে তাদের প্রত্যেকটি দাবী মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তারা কোনাে মতেই অনশন ত্যাগ করবেন না।
এই অনশন ধর্মঘটের দাবীগুলি মুখ্য মন্ত্রী নূরুল আমীন পূর্ব বাঙলা বিধান পরিষদের সামনে ১৯৪৯-এর ১৭ই ডিসেম্বর উল্লেখ করেন। তার উল্লিখিত দাবীগুলি হলাে :
১। সকল নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বন্দীদেরকে বিনাশর্তে এবং তৎক্ষণাৎ মুক্তিদান। ২। অন্যথায় ব্যবস্থা করতে হবে :
(১) খাদ্যের জন্যে প্রতিদিন ৩–৪ টাকার। (২) খাট, তােষক, হাড়িবাসন এবং আসবাবপত্র ছাড়াও ২৫০ টাকা
প্রাথমিক ভাতা। (৩) মাসে ৫০ টাকা ব্যক্তিগত ভাতা।
বিচার না হওয়া পর্যন্ত গ্রেফতারের তারিখ থেকে প্রত্যেক নিরাপত্তা বন্দীর ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদেরকে প্রতি মাসে
১০০ টাকা হারে পারিবারিক ভাতা দিতে হবে। (৩) প্রত্যেক সপ্তাহে চারটি চিঠি বাইরে পাঠাননা, দুই সপ্তাহ অন্তর
সাক্ষাৎকার, উপযুক্ত থাকার জায়গা, খেলাধুলার ব্যবস্থা
ইত্যাদি সুবিধা। (৬) হাজং এবং অন্যান্য বিচারাধীন রাজনৈতিক বন্দীদেরকে প্রথম
ডিভিশনের নীচে না রাখা। অন্য সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য দ্বিতীয় ডিভিশনের মর্যাদা। উন্নত খাদ্য ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, দৈনিক খবরের কাগজ, পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা চালু, উন্নততর জীবনযাপন, সরকারী খরচায় ধূমপানের ব্যবস্থা, ওয়ার্ডে রেডিও বানাে এবং নির্দেশিত সমস্ত খবরের কাগজ ও পত্র-পত্রিকা সেন্সার না করে
| দেওয়া এবং সেলে রেডিও বানাে৪০ | এই দাবীগুলি পরিষদে পড়ে শােনানাের সময়েই নূরুল আমীন পরিষদকে জানান যে তাদের মতে অনশনরত রাজবন্দীরা রাষ্ট্রের শত্রু, কাজেই তাদের এই সব দাবী স্বীকার করে নেওয়া তার সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে জেলের নিয়মকানুনসমূহ তারা আবার পুনর্বিবেচনা করে দেখবেন এ সম্পর্কে কতদূর কি করা তাদের পক্ষে সম্ভব।
২রা ডিসেম্বর অনশন ধর্মঘট শুরু হলে রাজবন্দীরা জেল কর্তৃপক্ষকে জানান যে তারা কোনাে মতেই এবার ওয়ার্ড ছেড়ে সেলে যাবেন না। কিন্তু পর পর কয়েকবার দীর্ঘ অনশনের পর তাদের সকলেরই স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিলাে এবং সে কারণে ধর্মঘটের পঞ্চম দিনেই তারা সকলে খুবই কাহিল হয়ে পড়েন। এই দুর্বল অবস্থায় তাদেরকে জোর করে সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। অ্যান্টি সেল নামে কথিত ছয়টি সেল খুবই খারাপ ছিলাে। এই বিশেষ সেলগুলিতে মারুফ হােসেন, সত্য মৈত্র, সিরাজুর রহমান এবং শিবেন রায়কে রাখা হয়। সেলের মধ্যে এই সময় রাজবন্দীদেরকে দাতের মাজন, বিছানাপত্র ইত্যাদি ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কোনাে জিনিসই নিতে দেওয়া হয় না।
অনশনের ষষ্ঠ দিনে অর্থাৎ সেলে পাঠানাের পরই পাঞ্জাবী ওয়ার্ডার দিয়ে রাজবন্দীদেরকে জোর করে খাওয়ানাে শুরু হলাে। যে সমস্ত বাঙালী ওয়ার্ডারেরা তাদেরকে খাওয়াতে আসততা তারাও ছিলাে ভয়ানক বদমাশ। এই খাওয়ানোর সময় তারা বুকের ওপর চড়ে নাকের মধ্যে দিয়ে জোর করে খাবার ঢুকিয়ে দিতাে৪৩।
৮ই ডিসেম্বর এইভাবে জোর করে বুকের ওপর চড়ে খাওয়াতে যাওয়ার সময়ই ফুসফুস ছিদ্র হয়ে গিয়ে রাজবন্দী শিবেন রায় শহীদ হন। জোর করে তার নাকের মধ্যে রড ঢুকিয়ে দেওয়াতে রডটি শিবেন রায়ের ফুসফুস ভেদ করে যায় এবং তিনি রক্ত বমি করতে থাকেন। সে সময় জেলের মধ্যে এক সেলের সাথে অন্য সেলের যােগাযােগের কোনাে উপায় ছিলাে না। তাছাড়া ফুসফুস ছিদ্র হয়ে গিয়ে দারুণভাবে অসুস্থ এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ায় চীৎকার করে কাউকে ডাকাডাকি করাও শিবেন রায়ের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় সেলের মধ্যে রাত্রিকালে তার মৃত্যু ঘটে।৪৪ | ৯ই ডিসেম্বর খুব সকালে জেলের লােকজন এসে শিবেন রায়ের মৃতদেহ যখন সরিয়ে নিয়ে যায় তথন সে দৃশ্য দেখে মারুফ হােসেন, সত্য মৈত্র, সিরাজুর রহমান প্রভৃতি চীৎকার করে শ্লোগান দিতে থাকেন। এই
শ্লোগানের শব্দে অন্য সকলে জেগে ওঠেন এবং ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরে তারা দারুণভাবে উত্তেজিত হন।৪৫।
অনশনরত রাজবন্দীদের এই উত্তেজনা দেখে ৯ই ডিসেম্বর সারা দিন জেলখানার কোনাে লােক তাদের সেলগুলাের ভেতরে আসতে সাহস করেনি। সেদিন দারুণ শীত পড়েছিলাে। সেজন্যে তারা কয়েদীদেরকে দিয়ে তােষক, কম্বল ইত্যাদি সেলের দরজার সামনে পাঠিয়ে দিলাে।৪৬
শিবেন রায়ের মৃত্যু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন প্রাদেশিক পরিষদে ১৭ই ডিসেম্বর নিম্নলিখিত বিবৃতি দেন :
কুষ্টিয়া সাব-জেলে আটকবন্দী জনৈক শিবেন্দ্রমােহন রায়কে ১৬ই নভেম্বর, ১৯৪৯, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলী করা হয়। তিনি ১৯৪৯-এর ২রা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অনশন ধর্মঘটে যােগদান করেন এবং ৯ই ডিসেম্বর, ১৯৪৯ রাত্রিকালে মারা যান। যেদিন থেকে উক্ত রাজবন্দী অনশন ধর্মঘটে যােগ দেন সেদিন থেকেই তিনি চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন এবং তাকে জাের-জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়। পােস্ট মর্টেম পরীক্ষার পর ডাক্তারের মত হচ্ছে ব্রঙ্কো-নিউমােনিয়া ঘটিত স্বাভাবিক কারণেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। এর পরদিন যথারীতি স্থানীয় হিন্দু সৎকার সমিতির দ্বারা উক্ত নিরাপত্তা বন্দীর মৃতদেহের সৎকার করা হয় এবং তারযোগে বন্দীর পিতাকেও খবর দেওয়া হয়।৪৭
নূরুল আমীনের এই বিবৃতির পর বিরােধীদলের নেতা বসন্তকুমার দাস মুখ্য মন্ত্রীর কাছে জানতে চান যে মৃত্যুর পূর্বে শিবেন রায়ের ব্রঙ্কো-নিউমােনিয়া ধরা পড়লাে না কেন? অনশন শুরু হয়েছিলাে ২রা ডিসেম্বর এবং তিনি মারা গিয়েছিলেন ৯ই ডিসেম্বর। এজন্যে ব্রঙ্কো-নিউমােনিয়ার ব্যাপারটিকে “খুবই অদ্ভুত” বলে বর্ণনা করে যে পরিস্থিতিতে শিবেন রায়ের মৃত্যু ঘটেছে তার ওপর বসন্ত দাস একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করেন।
বসন্তকুমার দাসের প্রশ্ন ও দাবীর জবাবে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন বলেন : এই ব্রঙ্কো-নিউমােনিয়া পূর্বে কেন ধরা পড়েনি এ সম্পর্কে তদন্ত করার জন্যে বিরােধী দলের নেতা আমাকে বলছেন। এখন প্রশ্ন হলাে এই যে প্রত্যেককেই এটা বুঝতে হবে যে এই সমস্ত ব্যক্তিরা এত উশৃঙ্খল ও বেপরােয়া যে কোনাে ডাক্তারকে তারা নিজেদের দেহ স্পর্শ করতে দেয় , তাদের কি অসুখ হয়েছে সেটা বের করার জন্যে কোনাে স্টেথসকোপ ব্যবহার করতেও তারা দিতে চায় না। এই ব্যক্তিদেরকে জোর করে
335
খাওয়াতে হয় এবং ওষুধপত্রও তাদেরকে দিতে হয় জোর করেই। কাজেই তারা যদি নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা উপলব্ধি না করে, যদি তাদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে হিতাহিত জ্ঞান আনা এবং এবং তাদের প্রয়ােজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার অন্য কোনাে উপায় আমি দেখি না। সরকার তাদেরকে সব সময়েই খাদ্য এবং প্রয়ােজনমতাে। ঔষধপত্র দিতে ইচ্ছুক কিন্তু এই সমস্ত ব্যক্তিরা সহযােগিতা করতে রাজী নয়। সুতরাং আমি আশা করি তাদের প্রতি যাদের দর আছে তারা যেন বাইরে থেকে এই ব্যক্তিদেরকে উপদেশ দেন যাতে তারা ঔষধ অথবা খাদ্য গ্রহণ করতে অস্বীকার না করে।
শিবেন রায়ের ব্রঙ্কো-নিউমােনিয়া সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের এই মিথ্যা তথ্যের ভিত্তি, অন্ততঃ তাঁর নিজের কথামততা, জেল ডাক্তারের পােস্ট মর্টেম রিপাের্ট। কিন্তু এই রিপোের্টর ব্যাপারটিও কতদূর সত্য সে বিষয়ও কোনাে নিশ্চিন্ত প্রমাণ নুরুল আমীন দাখিল করতে পারেননি।
অন্যদিকে ঢাকা জেলের অন্যান্য অনশনরত রাজবন্দীরা, যাদের সাথে দুদিন আগে পর্যন্ত শিবেন রায় একই ওয়ার্ডে একত্রে ছিলেন, তারা কেউই তার ব্রঙ্কো-নিউমােনিয়া হওয়ার কথা বলেন না। অন্যদের মতো শিবেন রায়ও সেদিক দিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থই ছিলেন। ৭ই ডিসেম্বর তাদের সকলকে পৃথক পৃথক সেলে বদলী করে দেওয়ার পর তাদের প্রত্যেককেই জোর করে খাওয়াতে চেষ্টা করা হয়। এবং সেই সময়েই নাকের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া রডে ফুসফুস ছিদ্র হয়ে যাওয়ার ফলেই শিবেন রায়ের মৃত্যু ঘটে। | এই সত্য ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্যে নূরুল আমীনকে এক ঝুড়ি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অনেক বানানাে কথা পরিষদের সামনে বলতে হয়। কিন্তু তৎকালীন পরিষদের বিতর্ক এবং পরবর্তীকালে তৎকালীন অনশন ধর্মঘটীদের জবানীতে জানা যায় যে, শিবেন রায়ের মৃত্যু সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের উপরােক্ত বক্তব্যকে কেউই বিশ্বাস করেননি। তাঁকে তাঁর যােগ্য মর্যাদাই সকলে দিয়েছিলেন। | আর একটি ঘটনা এক্ষেত্রে খুবই উল্লেখযােগ্য এবং এর মাধ্যমেই তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের শয়তানী ও ভাওতাবাজীর পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া যাবে। | ই জানুয়ারি, ১৯৫০, কলকাতার পত্রিকা “দৈনিক সত্যযুগ” এই অনশন সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশ করে তাতে বলে যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে
অনশন ধর্মঘটীদের মধ্যে ৬ই জানুয়ারি দুই জনের মৃত্যু ঘটেছে।
এই সংবাদের প্রতিবাদে পূর্ব বাঙলা সবকারের জেল মন্ত্রী মুকিজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে নিম্নলিখিত বিবৃতি দেন :
৬ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম হইতে প্রেরিত বলিয়া ৭ই জানুয়ারি কলিকাতার বাংলা দৈনিক “সত্যযুগে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ হইয়াছে। এই সংবাদে বলা হইয়াছে যে, ঢাকা কেন্দ্রীয় জেলে অনশন ধর্মঘটীদের মধ্যে দুইজন ৬ই জানুয়ারি তারিখে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। এই সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।৫০
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অনশন ধর্মঘটীদের মধ্যে ৯ই ডিসেম্বর এক জনের মৃত্যু ঘটে। কাজেই মৃতের সংখ্যা এবং মৃত্যুর তারিখ এ দুই বিষয়েই “সত্যযুগের সংবাদের মধ্যে ভুল ছিলাে। কিন্তু তার থেকে আরও বেশী লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে কুখ্যাত জেলমন্ত্রী “এই সংবাদ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে যে ভাবে সংবাদপত্রে উপরােক্ত বিবৃতিটি দেন তব্দে কায় কেন্দ্রীয় কারাগারে কারো মৃত্যু আদৌ ঘটেছে তা মনে হয়
। এই বিবৃতির মাধ্যমে শিবেন রায়ের মৃত্যুর ঘটনাকে সম্পূর্ণভাবে ধামাচাপ। দেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে তৎকালীন ধোকাবাজ মুসলিম লীগ সরকারের সত্যিকার চরিত্র ভালভাবেই ধরা পড়ে।
শিবেন রায়ের মৃত্যুর পর সিভিল সাজেন মহম্মদ হােসেন নিজে এসে রাজবন্দীদেরকে বলেন যে তখন থেকে তিনি নিজে সব কিছুর তদারক করবেন এবং কোনাে গােলযােগ যাতে না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে জোর করে অনশন ধর্মঘট:‘রকে খাওয়ানাের সময় সেলগুলিতে কোনাে ডাক্তার উপস্থিত থাকতাে না, ওয়ার্ডারদের সহায়তায় জেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সে কাজ করতে। অথচ এ ব্যাপারে ইতিপূর্বে ডাক্তারের উপস্থিতিকে একটি নিয়ম হিসেবে মেনে চলা হতাে।
| ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এই অনশন ধর্মঘট ৫৮ দিন স্থায়ী হয়। এর পূর্বে সরকারের পক্ষ থেকে ফকির আবদুল মান্নান এবং অন্যান্য কর্মচারীরা এসে আবার আলাপ-আলােচনা শুরু করে। ৫২ নূরুল আমীন ইতিমধ্যে কিছুটা দুর্বল হয়ে এসেছিলেন কাজেই বাধ্য হয়ে তিনি রাজবন্দীদের কিছু কিছু দাবী-দাওয়া স্বীকার করে নিতে রাজী হলেন।
কিন্তু সেক্ষেত্রে একটি প্রধান অসুবিধা হলাে এই যে রাজবন্দীদেরকে মােটামুটি দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা হলাে। যারা কৃষক শ্রমিক শ্রেণীভূক্ত
তাদেরকে দেওয়া হলাে “খ” বিভাগ এবং যারা পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীভুক্ত তাদেরকে দেওয়া হলাে “ক” বিভাগ। এই শ্রেণী বিভাগের ফলে অসুবিধা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত তাদেরকে এই শর্ত স্বীকার করে নিতে হয়। অন্যথায় ৫৮ দিন অনশনের পর কানাে আর বেঁচে থাকা সম্ভব হতাে না। কাজেই সেই পর্যায়ে বিভিন্ন সেল থেকে এসে সকলে একত্রিত হয়ে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন।৫৩
পুরুষ রাজবন্দীদের এই সিদ্ধান্ত প্রথম দিকে মহিলারা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তারা উপরােক্ত শর্তে অনশন প্রত্যাহার করতে রাজী ছিলেন না। কিন্তু মহিলাদের এই আপত্তি অগ্রাহ করে পুরুষ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে পুরুষরা যখন ধীরে ধীরে দুধ পান করতে থাকেন তখনাে মহিলারা নিজেদের ওয়ার্ডে এ ব্যাপারে অটল থাকেন। পরে পুরুষদের সমবেতভাবে অনশন ভঙ্গ করার খবর তাদের ওয়াতে পৌছালে তাঁরাও নিজেদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করে দুধ পান করেন। রাজশাহীতে এই চতুর্থ অনশন ধর্মঘট স্থায়ী হয় ৬১ দিন।৫ | ধর্মঘটের পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রায় ২৫ জন রাজবন্দীকে প্রদেশের অন্যান্য জেলে বদলী করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ফণি গুহও ছিলেন। তিনি গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালে। চতুর্থ অনশন ধর্মঘটের ফলে ফণি গুহের নাড়ী ছিদ্র হয়ে যায় এবং ময়মনসিংহে বদলী হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই সেখানে তার মৃত্যু ঘটে। | খুলনা জেলে বিষ্ণু বৈরাগকে ১৯৫০ সালে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এ সময় জেল কর্তৃপক্ষ পাগলা ঘন্টা বাজিয়ে একটা জরুরী পরিস্থিতির মহড়া দিয়ে আসল ঘটনাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।
ঢাকা ও রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এবং অন্যান্য কারাগারে বিভিন্ন পর্যায়ে যারা অনশন ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করেন তাদের নাম : অমূল্য লাহিড়ী বাবর আলী, গায়ীসউল্লাহ সরকার, শিবেন ভট্টাচার্য, খবিরুদ্দীন, পি. রায়, আমিনুল ইসলাম, অজয় ভট্টাচার্য, শীতাংশু মৈত্র, ভূজেন পালিত, বিজন সেন, ডােমারাম সিংহ, কম্পম সিংহ, সুখেন ভট্টাচার্য, হানিফ শেখ, দোলায়ার হােসেন, আবদুল হক, আনােয়ার হােসেন, সুধীন ধর, মনসুর হাবিব, হাজী দানেশ, নুরুন্নবী চৌধুরী, শফিউদ্দীন আহমদ, আবদুশ শহীদ, শিবেন রায়, কমণীয় দাশগুপ্ত, নগেন সরকার, তকিউল্লাহ, জ্ঞান চক্রবর্তী, ফণি গুহ, সরদার ফজলুল করিম, নাসিম আহম্মদ, নাদেরা বেগম, নলিনী দাস,
মারুফ হােসেন, আনন্দ দেব, কালীপদ সরকার, আশুতােষ ভট্টাচার্য, অজিত নন্দী, সত্য মৈত্র, সিরাজুর রহমান, লুৎফর রহমান, দিলীপ সেন, হীরেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সুধীর মুখার্জী, গনেন্দ্রনাথ সরকার, কৃষ্ণবিনােদ যায়, মহম্মদ রশিদউদ্দীন, সুধীর সান্যাল, সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য, আরােরাম সিং, প্রিয়ব্রত দাস, শ্যামাপদ সেন, ফটিক রায়, সদানন্দ ঘােষ, প্রসাদ রায়, নাসিরুদ্দীন আহমদ, লালু পাণ্ডে, খবির শেখ, সতীন্দ্রনাথ সরকার, নূরুন্নবী, অনিমেষ ভট্টাচার্য।
৮। পূর্ব বাঙলার বিভিন্ন এলাকায় কৃষক সংগ্রাম
১৯৪৮-এ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর থেকে ১৯৫০-এর প্রথম দিক পর্যন্ত পূর্ব বাঙলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অনেক খণ্ড খণ্ড কৃষক সংগ্রাম ও বিদ্রোহ ঘটে। কিন্তু এই খণ্ড বিদ্রোহ ছাড়াও ময়মনসিংহ জেলার হাজং প্রধান এলাকায় কৃষক সংগ্রাম একটানাভাবে কয়েক বছর চলে এবং শুধু পূর্ব বাঙলাতেই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষে, এই সংগ্রামের কথা ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পাক-ভারতের যে সমস্ত এলাকায় তখন বিপ্লবী সংগ্রাম দানা বাধে তার মধ্যে দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানাই ছিলাে সব থেকে উল্লেখযােগ্য। এবং এই তেলেঙ্গানার পরই উল্লেখযােগ্য ছিলাে ময়মনসিংহের নেকোণা মহকুমার সুসং-দুর্গাপুরের হাজং প্রধান এলাকা।
সেখানে মণি সিংহ এবং নগেন সরকারের নেতৃত্বে কৃষক বাহিনী এক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে নিজেদেরকে খুব ভালভাবে সংগঠিত করে। এইভাবে তারা দীর্ঘ দিন ধরে স্থানীয় জোতদার, মহাজন এবং সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও প্রতিবােধ আন্দোলন গঠন করতে এবং তাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। ফলে তখন মণি সিংহের নাম পাক-ভারতীয় উপমহাদেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজংদের সংগ্রাম অন্য এলাকার কৃষক শ্রমিকদেরকেও সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হতে সাহায্য করে।
হাজং কৃষকরা ছাড়াও সে সময় সিলেট এবং খুলনা, যশাের, রাজশাহী প্রভৃতি উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলাতেও কৃষকরা সংগঠিতভাবে শশাষক ও শাসকদের বিরুদ্ধে অনেক ছােটখাট বিদ্রোহ করেন। তার মধ্যে একটির কথা
* অনশন ধর্মঘটীদের পূর্ণ তালিকা দেওয়া এখানে সম্ভব হলাে না। * এ সম্পর্কে অন্যত্র বিস্তৃতভাবে আলােচনা করা হবে।
এখানে উল্লেখ করা হলাে। | ১৮ই অগাস্ট, ১৯৪৯, তারিখে সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার এলাকার সানেশ্বরে কমিউনিস্ট পরিচালিত কৃষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষের সময়ে কৃষকরা লাঠি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে পুলিশের গুলির সামনে এগিয়ে যান। পুলিশ এই কৃষকদের ওপর ৪২ রাউন্ড গুলি ছােড়ে এবং তার ফলে ৬ জন কৃষক নিহত হন এবং ৩ জন মহিলাসহ ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। , সিলেট জেলার এই অঞ্চলে সানেশ্বর, নিহারী, উলুরী ইত্যাদি ছয়-সাতটি গ্রামকে কমিউনিস্টরা একটি ঘাটি এলাকা হিসাবে গড়ে তােলেন। এই গ্রামগুলি বড়লিখা বিয়ানীবাজার থানা থেকে প্রায় সাত-আট মাইল দূরে অবস্থিত। রাস্তাঘাটের সুবিধা না থাকায় গ্রামগুলি অন্য এলাকা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্নই বলা চলত। এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন দাস, নমশূদ্র গােত্রের লােক। এই এলাকায় সুরত পাল, তকণ মুম্ভা প্রভৃতি কয়েকজনের নেতৃত্বে প্রায়ই সভা-সমিতি হতাে এবং সেই সব সভা-সমিতিতে কমিউনিস্ট পাটির পতাকা কাস্তে হাতুড়ীওয়ালা লাল ঝাণ্ডা উড়তে দেখা যেতাে।
১৪ই অগাস্ট এই ধরনের একটি সভায় যখন তারা পাকিস্তান পতাকার পরিবর্তে লাল ঝাণ্ডা ওড়ায় তখন তা কিছুসংখ্যক মুসলমান গ্রামবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তারা বিয়ানীবাজার থানায় পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ গ্রামবাসীর মনােবল এবং সংগঠিত শক্তির মােকাবেলা করতে না পেরে প্রথমে গ্রামে না ঢুকে বাইরে থেকেই ফিরে যায়।
এর পর ১৬ই অগাস্ট বহুসংখ্যক সশস্ত্র পুলিসসহ সিলেটের ডি. এস. পি. এবং জেলা শাসক খান সাহেব আবদুল লতিকের সানেশ্বর রওয়ানা হওয়ার খবর পেয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকার মুসলিম লীগ সমর্থক ও কর্মীরা অন্যান্য লােকজন এবং স্থানীয় আনসার বাহিনীকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে সানেশ্বর বাজারে মিলিত হয়। সেখানে পৌছে তারা দেখে যে বাজারের পশ্চিম দিকের মাঠে কিছুসংখ্যক লােক লাঠি হাতে দাড়িয়ে আছে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে থেকে দলে দলে আরও অনেক লাঠি হাতে এগিয়ে এসে বাজারের কাছে সেই মাঠে এসে জড়াে হচ্ছে। গ্রামের পাশে যে ছােট নদীটি ছিলাে তার পাশেও অনেক লােককে দ্রুতগতিতে জমা হতে দেখা যায়। পশ্চিমের মাঠে কৃষকদের সংখ্যা অনেকখানি বৃদ্ধি পাওয়ার পর পুলিশ বাহিনী এবং মুসলিম লীগ সমর্থক জনতা আক্রমণের আশঙ্কা করে। এই অবস্থায় পুলিশের লােকজন রাইফেল হাতে
340
কৃষকদের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে এবং বিদ্রোহী লাইন থেকে ঘন ঘন “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” ইত্যাদি ধ্বনি ওঠে।
এর পর ডি, এস. পি. নিজে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে হাতের লাঠি ইত্যাদি ফেলে দিয়ে বিদ্রোহীদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। কিন্তু এর উত্তরে তারা পুলিশের কাছে তাদের রাইফেল ফেলে দেওয়ার দাবী জানান। এর পর ডি. এস. পি. কিছুটা পিছিয়ে এসে রাইফেলের দুটি ফাকা আওয়াজ করেন এবং তার পর বিদ্রোহীরা পুলিশের দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে আসেন। এই সময় পুলিশের অগ্রবর্তী দল থেকে প্রথম কৃষক বিদ্রোহীদের ওপর গুলি ছােড়া হয়।
এর পর পুলিশের গুলি বর্ষণের মাত্রা বাড়ে এবং সামান্য সংঘর্ষের পর বিদ্রোহীরা অনেকেই নিহত এবং আহত হন। বিদ্রোহী বাহিনীও এই আক্রমণের ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পুলিশ মুসলিম লীগ কর্মীদের সহায়তায় আহত ও পলায়মান অনেক কৃষককে ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার করে। যারা সেদিন গ্রেফতার হন তাদের মধ্যে কয়েকজন মহিলাও ছিলেন। আহত এবং বন্দী কৃষকদেরকে এর পর বাহাদুরপুর আনসার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।’
এই ঘটনার পর ১৯শে অগাস্ট স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতারা বাহাদুরপুর কাম্পে হাজির হয়ে জেলা শাসক খান সাহেব আবদুল লতিফের সাথে আলাপআলােচনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহীদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে “উদবুদ্ধ করার ব্যবস্থা হয়।
এ প্রসঙ্গে লাউতার স্থানীয় জমিদার শ্যামাপদর উদ্যোগ খুবই উল্লেখযােগ্য। মুসলিম লীগ কর্মী ও পুলিশের সহযােগিতায় এই জমিদারটি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদেরকে আত্মসমর্পণ করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার পর বহু সংখ্যক গ্রামবাসী ধীরে ধীরে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।
একই সাথে স্থানীয় মুসলিম লীগ কর্মীবৃন্দ এবং সামন্ত স্বার্থের খুটি উপয়ােক্ত হিন্দু জমিদার শ্যামাপদর উচ্চ প্রশংসা করে আরজ আলী নামে উত্তর সিলেট মুসলিম লীগের একজন সহ-সভাপতি সানেশ্বরের ঘটনা সম্পর্কে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলে :
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে এই ব্যাপারে মুসলিম লীগ ও জনসাধারণ যে কর্তব্য নিষ্ঠার পরিচয় দিয়াছেন তাহার ফল সুদূর প্রসারী বলিয়াই মনে হয়। শ্যামাপদবাবু যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া এই শান্তি কাজে সাহায্য করিয়াছেন তাহাও প্রশংসনীয়।১০
সানেশ্বরের এই ঘটনার পরই স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ নিজেদের উদ্যোগে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সেই তদন্তের রিপাের্ট সরাসরিভাবে সরকারের কাছে পেশ করা হয়।
পূর্ব বাঙলার অন্যান্য যে সমস্ত এলাকায় এ ধরনের কৃষক বিদ্রোহ হয় সেগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে খুলনা জেলার ধানিমুনিয়া, ডুমুরিয়া, শােহর জেলার নড়াইল থানার বড়ের দুর্গাপুর, চাঁদপুর এবং সদর থানার এগারােখান ইউনিয়ন ; এবং রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার নাচোল থানা।
৯। নাচোল কৃষক বিদ্রোহ ও পরবর্তী নির্যাতন
রাজশাহী জেলার নবাবগঞ্জ মহকুমার নাচোল অঞ্চলে বহু সংখ্যক সাঁওতাল কৃষকের বাস। এই সাঁওতালদেরকে ইলা মিত্র, অনিমেষ লাহিড়ী আজহার হােসেন এবং ইলা মিত্রের স্বামী হাবােল মিত্র স্থানীয় জোতদায়ী মহাজনী এবং অন্যান্য শশাষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে থাকেন।
১৯৫০ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে আমন ধান কাটার সময় এই সাতাল কৃষকরা স্থির করেন যে চলতি প্রথা মতাে তারা জোতদারের ইচ্ছামতাে তাদের ঘরে ফসল তুলতে দেবেন না, ফসলের ন্যায্য অংশ তারা নিজেরাই জোর করে নিজেদের ঘরে তুলবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে সমগ্র এলাকার কৃষকদেরকে, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সাঁওতাল, ইলা মিত্র এবং অন্যান্যরা সংঘবদ্ধ হয়ে ফসল তােলার জন্যে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। এই আহ্বান অনুসারে স্থানীয় কৃষকরা ৫ই জানুয়ারি দলে দলে সমবেত ও ঐক্যবদ্ধভাবে ফসল তুলতে উদ্যোগী হন।
স্থানীয় জোতদাররা এই উদ্যোগে আতঙ্কিত হয়ে থানায় খবর পাঠানাের পর নাচোল থানার ভারপ্রাপ্ত দারােগা ভকিজউদ্দীন তিনজন কনস্টেবলসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। | সমবেত সাঁওতাল জনতা পুলিশের এই উপস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং তারা কৃষকদেরকে কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে সেই উত্তেজনা ক্রমশঃ তীব্র আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত এই উত্তেজনা এত বেড়ে ওঠে যে কারাে পক্ষেই জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা সব হয় না এবং পুলিশ তাদের পর গুলি বর্ষণ করে একজন পাতালকে হত্যা করে। এর পর নাভাল এ. এস. আই. সহ অন্য তিনজন কনস্টেবলকে বলী করে তাদের আইফেল ঝেড়ে নেন এবং
পরে তাদেরকে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে ফেলেন।
থানার দাবােগা এবং কনস্টেবলদের নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর পেয়ে রাজশাহী জেলা শাসক এবং পুলিশ সুপার একদল সশস্ত্র পুলিশসহ দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং স্থানীয় সাঁওতাল ও কৃষকদের উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করেন। মৃত চারজন পুলিশের লাশ তারা স্থানীয় কিছু লােকের সহায়তায় মাটি খুঁড়ে বের করেন এবং রাজশাহী সদরে পাঠিয়ে দেন। এবং তার পরই শুরু হয় হয় তাদের আসল অত্যাচার।
পুলিশ সমস্ত এলাকার প্রতিটি কৃষক বাড়ির মধ্যে ঢুকে নারী-শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে নির্মমভাবে তাদেরকে মারপিট শুরু করে। বহু নারীকে তারা ধর্ষণ করতে পর্যন্ত দ্বিধা বােধ করে না। পুলিশ হত্যার উপযুক্ত প্রতিশােধ নেওয়ার জন্যে তারা শুধু এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের খোঁজ খবরের জন্যে তারা আরও বিস্তৃত এলাকা জুড়ে কায়েম করে একটা ত্রাসের রাজত্ব।৪
নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা পরস্পরের থেকে এরপর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে হাবল মিত্ৰ হেঁটে সীমান্ত পার হয়ে সােজা পশ্চিম বাঙলা চলে যান। আজহার হােসেন এবং অনিমেষ লাহিড়ী কয়েকদিন পর আজহার হােসেনের বাড়িতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। বদরপুর গ্রামে সাঁওতালদের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার সময়ে চিত্ত চক্রবর্তীকে পুলিশ ৮ই জানুয়ারি গভীর রাত্রিতে গ্রেফতার করে। ঐ একই দিন পুলিশের অত্যাচারে নাচোল এবং নবাবগঞ্জ পরিত্যাগ করে ট্রেনযােগে পলায়নের সময় একদল সাঁওতাল রাজশাহীর কাছাকাছি গ্রেফতার হন। | ইলা মিত্র নিজে দুই দিন আত্মগােপন করে থাকার পর ই জানুয়ারি ট্রেনযােগে এলাকা পরিত্যাগের জন্যে সঁওতাল স্ত্রীর বেশে রোহনপুর রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুমের সামনে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকেন। এই সময় নেতাদের খবরাখবরের জন্যে চারিদিকে অসংখ্য গােয়েন্দা নিযুক্ত করা হয় এবং রােহনপুর স্টেশনের ওপরেও তারা কড়া নজর রাখে। ইলা মিত্রের চেহারা বেশ এবং হাবভাব সব কিছুর মধ্যে একটা বেমানান ভাব ও অসামঞ্জস্য স্থানীয় পুলিশের সন্দেহ উদ্রেক করে। তাকে অল্প জিজ্ঞাসাবাদের পরই তার পরিচয় সম্পর্কে তাদের আর কোনাে সন্দেহ থাকে না এবং তার পর তারা তাকে নাচোল থানায় হাজির করে।
শুধুইলা মিত্ৰকেই নয়, এর মধ্যে শত শত সাঁওতালকে নাচোল হাজতে
গ্রেফতার করে তাদের সকলকে একটা ছােট ঘরের মধ্যে খাদ্য এবং পানীয় ছাড়াই আটকে রাখা হয়। অন্যদেরকে হাত পা বেঁধে বাইরে তারা ফেলে রাখে এবং সকলকেই পুলিশ কনস্টেবলরা প্রায় সারাক্ষণই নির্মমভাবে মারধাের করতে থাকে। ক্ষুধা তৃষ্ণায় এবং অমানুষিক প্রহারের ফলে প্রায় ২৪ জন সাঁওতাল নাচোল থানা হাজতেই মৃত্যুমুখে পতিত হন।১০ | নবাবগৰে যখন তাদেরকে স্থানান্তরিত করা হয় তখনও তাদের ওপর অত্যাচার সমানে চলতে থাকে এবং সেখানেও বহু সংখ্যক সাওতাল মারা যান। এর পর সাঁওতাল রাজবন্দীদের পুরাে দলটিকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সেখানে অত্যাচার তাদের ওপর অব্যাহত থাকে। রাজশাহীতেও একটি ছােট ঘরের মধ্যে বিনা চিকিৎসায় রেখে আধপেটা খাইয়ে এবং ক্রমাগত অত্যাচার করে অনেককে তারা হত্যা করে।
নাচোল থেকে রাজশাহী জেলের অভ্যন্তরে পর্যন্ত প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে ইলা। মিত্র এবং এই সঁওতালরা যে শুধু পুলিশের দ্বারাই নির্যাতিত নিগৃহীত হয়েছেন তাই নয়, স্থানীয় জনসাধারণ এবং জেলের অন্যান্য সাধারণ কয়েদীরা পর্যন্ত তাঁদের প্রতি অত্যন্ত নির্দয় ব্যবহার করেছে। পাকিস্তান বিরােধী, হিন্দুস্থানের বাহিনী এবং শত্রুপক্ষের লােক এই সরকারী প্রচারণার দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত এবং মুসলিম লীগের লােকজনের দ্বারা উত্তেজিত হয়ে এই মৃত্যু পথযাত্রী দেশপ্রেমিক সাঁওতালদেরকে তারা খাওয়ার পানি পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রে স্পর্শ করতে দেয়নি।
৭ই জানুয়ারি ইলা মিত্রকে রােহনপুর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে গ্রেফতারের পরদিন তাকে নাচোল থানা হাজতে নিয়ে গিয়ে তার ওপর পুলিশ যে চরম অত্যাচার করে পাকিস্তানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত তার তুলনা নেই। ইসলামী রাষ্ট্রের নুরুল আমীন-লিয়াকত আলী সরকারের এই নির্যাতনের চিত্র রাজশাহী কোর্টে নিজের জবানবন্দীতেই বর্ণনা করেছিলেন। নীচে সেই জবানবন্দীটি হুবহু তুলে দেওয়া হলাে :
সাঁওতালদের ওপর এই অত্যাচারের ব্যাপারে আমি নবাবগঞ্জের অনেক স্থানীয় লােকজনের সাথে আলাপ করেছি।-ব. উ.
* এই জবানবন্দীটি কোনাে সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হওয়ায় ইস্তাহারের আকারে ছাপিয়ে ১৯৫০ সালের গােড়ার দিকে সেটি পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিলি করা হয়েছিলাে। ইস্তাহারটির একটি ছবি এই বইয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেসটির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। বিগত ৭.১.৫• তারিখে আমি রোহনপুরে গ্রেফতার হই এবং পরদিন আমাকে নাচালে নিয়ে যাওয়া হয়। যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে মারধাের করে এবং তারপর আমাকে একটা পেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সবকিছু স্বীকার
করলে আমাকে উলঙ্গ করে দেওয়া হবে এই বলে এস. আই. আমাকে হুমকি দেখায়। আমার যেহেতু বলার মতাে কিছু ছিলাে না, কাজেই। তারা আমার সমস্ত কাপড়-চোপড় খুলে নেয় এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গভাবে সেলের মধ্যে আমাকে বন্দী করে রাখে। আমাকে কোনাে খাবার দেওয়া হয়নি, একবিন্দু জল পর্যন্ত না। সেদিন সন্ধ্যেবেলাতে এস. আই.-এর উপস্থিতিতে সেপাইরা তাদের বন্দুকের। বাট দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে শুরু করে। সে সময়ে আমার নাক দিয়ে প্রচুর রক্ত পড়তে থাকে। এর পর আমার কাপড়-চোপড় আমাকে ফেরত দেওয়া হয় এবং রাত্রি প্রায় বারােটার সময় সেল থেকে আমাকে বের করে সম্ভবতঃ এস. আই.এর কোয়াটারে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে এ ব্যাপারে আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম না। যে কামরাটিতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে স্বীকারােক্তি আদায়ের জন্যে তারা নানারকম অমানুষিক পদ্ধতিতে চেষ্টা চালালাে। দুটো লাঠির মধ্যে আমার পা দুটি ঢুকিয়ে চাপ দেওয়া হচ্ছিলাে এবং সে সময় চারিধারে যারা দাড়িয়েছিলাে তার বলছিলাে যে আমাকে পাকিস্তানী ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। এই নির্যাতন চলার সময় তারা একটা রুমাল দিয়ে আমার মুখ বেঁধে দিয়েছিলাে। জোর করে আমাকে কিছু বলাতে না পেরে তারা আমার চুলও উপড়ে তুলে ফেলছিলাে। সিপাইরা আমাকে ধরাধরি করে সেলে ফিরিয়ে নিয়ে গেলাে কারণ সেই নির্যাতনের পর আমার পক্ষে আর হাটা সম্ভব ছিলাে না। সেলের মধ্যে আবার এস. আই. সেপাইদেরকে চারটে গরম সেদ্ধ ডিম আনার হুকুম দিলাে এবং বললাে, “এবার সে কথা বলবে”। তারপর চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোরপূর্বক ধরে চিতকরে করে শুইয়ে রাখলে এবং একজন আমার যৌনঅঙ্গের মধ্যে একটা গরম সিদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দিলাে। আমার মনে হচ্ছিলাে আমি যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলাম এর পর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। ১৯১৫ তারিখে সকালে যখন আমার জ্ঞান হলাে তখন উপরােক্ত
345
এস, আই, এবং কয়েকজন সেপাই আমার সেলে এসে তাদের বুটে করে আমার পেটে লাথি মারতে শুরু করলাে। এর পর আমার ডান পায়ের গােড়ালীতে একটা পেরেক ফুটিয়ে দেওয়া হলাে। সে সময় আধা অচেতন অবস্থায় পড়ে থেকে আমি এস. আই.-কে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম : আমরা আবার রাত্রিতে আসছি এবং তুমি যদি স্বীকার না করে তাহলে সিপাইরা একে একে তােমাকে ধর্ষণ করবে। গভীর রাত্রিতে এস. আই. এবং সিপাইরা ফিরে এলাে এবং তারা আবার সেই হুমকি দিলাে। কিন্তু আমি যেহেতু তখনাে কিছু বলতে রাজী হলাম না তখন তিন-চার জন আমাকে ধরে রাখলাে এবং একজন সেপাই সত্যি সত্যি আমাকে ধর্ষণ করতে শুরু করলাে। এর অল্পক্ষণ পরই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। পরদিন ১.১.৫• তারিখে যখন জ্ঞান ফিরে এলাে তখন আমি দেখলাম যে আমার দেহ থেকে দারুণভাবে রক্ত ঝরছে এবং আমার কাপড়-চোপড় রক্তে সম্পূর্ণভাবে ভিজে গেছে। সেই অবস্থাতেই আমাকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হলাে। নবাবগঞ্জ জেল গেটের সিপাইমা জোর ঘুষি মেরে আমাকে অভ্যর্থনা জানালাে। সে সময় আমি একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায় ছিলাম। কাজেই কোর্ট ইন্সপেক্টর এবং কয়েকজন সিপাই আমাকে একটা সেলের মধ্যে বহন করে নিয়ে গেলাে। তখনাে আমার রক্তপাত হচ্ছিলাে এবং খুব বেশী জর ছিলাে। সম্ভবতঃ নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালের একজন ডাক্তার সেই সময় আমার আর দেখেছিলেন ১০৫ ডিগ্রী। যখন তিনি আমার কাছে আমার দারুণ রক্তপাতের কথা শুনলেন তখন তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে একজন মহিলা নাসের সাহায্যে আমার চিকিৎসা করা হবে। আমাকে কিছু ওষুধ এবং কয়েক টুকরাে কম্বলও দেওয়া হলো। ১১.১.৫০ তারিখে সরকারী হাসপাতালের নার্স আমাকে পরীক্ষ। করলেন। তিনি আমার অবস্থা সম্পর্কে কি রিপাের্ট দিয়েছিলেন সেটা আমি জানি না। তিনি আসার পর আমার পরনে যে রক্তমাখা কাপড় ছিলাে সেটা পরিবর্তন করে একটা পরিষ্কার কাপড় দেওয়া হলাে। এই এই পুরাে সময়টা আমি নবাবগঞ্জ জেলের একটি সেলে একজন ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিলাম। আমার শরীরে খুব বেশী বর ছিলাে, তখনাে আমার দারুণ রক্তপাত হচ্ছিলাে এবং মাঝে মাঝে আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। ১৬১.৫০ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় আমার সেলে একটা স্ট্রেচার নিয়ে আসা
হলাে এবং আমাকে বলা হলাে যে পরীক্ষার জন্যে আমাকে অন্য জায়গায় যেতে হবে। খুব বেশী শরীর খারাপ থাকার জন্যে আমার পক্ষে নড়াচড়া সম্ভব নয় একথা বলায় লাঠি দিয়ে আমাকে একটা বাড়ি মারা হলাে এবং স্ট্রেচারে উঠতে আমি বাধ্য হলাম। এর পর আমাকে অন্য এক বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলাে। আমি সেখানে কিছুই বলিনি কিন্তু সেপাইরা জোর করে একটা সাদা কাগজে আমার সই আদায় করলাে। তখন আমি আধাঅচেতন অবস্থায় খুব বেশী জ্বরের মধ্যে ছিলাম। যেহেতু আমার অবস্থা । ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিলাে সেজন্যে পরদিন আমাকে নবাবগঞ্জ সরকারী হাসপাতালে পাঠানাে হলাে। এর পর যখন আমার শরীরের। অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হলাে তখন আমাকে ২১.১.৫০ তারিখে নবাবগঞ্জ থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে সেখানকার জেল হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হলাে। কোনাে অবস্থাতেই আমি পুলিশকে কিছু বলিনি এবং উপরে যা বলেছি তার বেশী আমার আর বলার কিছুই নেই।
ইলা মিত্র রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলী হওয়ার পরই খুলনার এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুই বাংলাতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজশাহী জেলের মধ্যেও তার প্রভাব বিস্তৃত হয়। এর ওপর আর এক উপসর্গ জোটার ফলে জেলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অনেকখানি বেশী অবনতি ঘটে।
নাচোলে সাঁওতাল কৃষকদের সাথে সংঘর্ষে যে এ. এস. আই-টি নিহত হয় তার স্ত্রী এই সময় প্রত্যেক দিন রাজশাহী জেল গেটে এসে বহুক্ষণ ধরে নিয়মিত ভাবে বসে থাকতাে এবং হিন্দু ও সাঁওতালদেরকে গালাগালি করে কঁদতে কাদতে নাচোলের ঘটনা সম্পর্কে নানাপ্রকার ভূল কাহিনী এবং বিকৃত তথ্য বিবৃত করত। এ সবের দ্বারা সে জেলের সেপাই এবং বিশেষ করে কয়েদী ও অন্যান্য কর্মচারীদের এ কথাই বােঝাতে চাইতাে যে হিন্দুরা একজোট হয়ে মুসলমান হত্যা করেছে। কাজেই তার প্রতিশােধ নেওয়া দরকার। এই সাম্প্রদায়িক প্রচারণা এবং উত্তেজনা বৃদ্ধির ব্যাপারে মান্নান নামে রাজশাহীর তৎকালীন জেলার সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করতাে এবং নিহত দারােগার স্ত্রীটিকেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ দিতে।১৪
ইলা মিত্রকেও এই সময় মাঝে মাঝে জেল গেটে নিয়ে গিয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় হাজির করা হতাে এবং কয়েদীদেরকে দেখিয়ে তারা বলতাে, “তােমরা
রানী মাকে দেখাে। ইনি আবার রানী হয়েছিলেন। ১৫ | এই সমস্ত কারণ মিলে জেলের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটে যে হিন্দু রাজবন্দীরা তখন নিজেদের ওয়ার্ডের বাইরে বের হতে পারতেন
। ঘরের সামনে সামান্য একটু বেড়ানাের যে সুযােগ ছিলাে সেটাও তাদের জন্যে এইভাবে বন্ধ হয়ে গেলাে।১৬ | এই অসহ্ন অবস্থা পরিবর্তনের জন্যে রাজবন্দীরা তখন ১৫ দিনের নােটিশ দিয়ে মুখ্য মন্ত্রী নূরুল আমীনের কাছে একটা মেমােরেণ্ডাম দেন। তাতে বলা হয় যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যদি বন্ধ করা না হয় তাহলে তারা সেই অবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে অনশন ধর্মঘট করতে বাধ্য হবেন। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নূরুল আমীনের কাছ থেকে কোনাে জবাব না পেয়ে ১৯৫৮ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের রাজবন্দীরা আবার অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। সেই ধর্মঘট চলার নবম দিনে অর্থাৎ ১০ই ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর জেলা শাসক রাজবন্দীদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে বলেন, “আপনারা নিশ্চিন্ত হােন। আমরা অবস্থা পরিবর্তনের ব্যবস্থা করছি। এর পর তারা পূর্বোক্ত নিহত এ. এস. আই.-এর স্ত্রীর জেল গেটে আসা বন্ধ করে দিলাে এবং সেই সাথে জেলার মান্নানও তার বিকৃত সাম্প্রদায়িক বক্তব্য জাহির করা থেকে বিরত
হলাে।
নাচোলের ঘটনাবলী এবং তার পরবর্তী নির্যাতনের কাহিনী তৎকালীন কোনাে সংবাদপত্রে তাে প্রকাশিত হয়ইনি, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন প্রাদেশিক বিধান পরিষদে সে সম্পর্কে কোনাে আলােচনা পর্যন্ত হতে দেননি। | প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, গােবিন্দলাল ব্যানার্জী এবং মনােহর ঢালী এ ব্যাপারে কতকগুলি মুলতুবী প্রস্তাবের নােটিশ স্পীকারকে দিয়েছিলেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩, বিধান পরিষদে তারা এই মুলতুৰী প্রস্তাবের নােটিশের সম্পর্কে স্পীকারকে প্রশ্ন করেন। স্পীকার এই মুলতুবী প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে দেওয়ার ব্যাপারে খুব বেশী গররাজী ছিলেন না কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন সেট উত্থাপনের বিরােধিতা করায় তিনি শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যান।
নূরুল আমীন তার বিরােধিতার যুক্তি দিতে গিয়ে বলেন যে একজন ভার প্রাপ্ত অফিসার এবং তিনজন কনস্টেবলের মৃত্যু সম্পর্কিত ব্যাপারটি কোর্টের বিচারাধীন, কাজেই সে সম্পর্কে কোনাে আলােচনা পরিষদে হতে পারে না।
এর জবাবে প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী বলেন যে তিনি পুলিশ অফিসারের হত্যার • সাঁওতালরা ইলা মিত্রকে রানী বলতে। ব. উ.
ব্যাপার আলােচনা করতে চান না। তিনি আলােচনা করতে চান ঘটনার পরবর্তী পর্যায়ে ঐ এলাকায় পুলিশ ও মিলিটারীর নির্যাতনের ব্যাপার।২০ নূরুল আমীন কিন্তু তার পূর্বোক্ত যুক্তি আঁকড়ে থেকে বলেন যে মূল ঘটনাকে বাদ দিয়ে পরবর্তী ঘটনার আলােচনা সম্ভব নয়, মূল ঘটনার প্রসঙ্গ আলােচনার মধ্যে এসেই পড়বে। কাযেই সে ধরনের কোনাে বিতর্ক সেই অবস্থায় পরিষদে সম্ভব নয়।
বিরােধী দলের নেতা বসন্তকুমার দাস, নূরুল আমীনের এই যুক্তির বিরোধিতা করে বলেন যে হত্যার পর পুলিশ, মিলিটারী, ই. পি. আর. এবং আনসাররা ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে। তঁাদের অভিযােগ হলাে এই যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে তারা জনসাধারণের ওপর দারুণভাবে অত্যাচার করেছে। এটা মূল ঘটনা থেকে একটি পৃথক ব্যাপার এবং সেই হিসেবেই তার। সেটিকে আলোচনা করতে চান।২২
এর পর পরিষদের স্পীকার, শিক্ষা মন্ত্রী আবদুল হামিদ এবং অন্যান্যেরা নুরুল আমীনের সুরে সুর মিলিয়ে ক্রমাগতভাবে মুলতুবী প্রস্তাবগুলি আলােচনার বিপক্ষে নানা রকম কুযুক্তি দিতে থাকেন এবং মূল ঘটনাকে বাদ দিয়ে কোনাে আলোচনা এ ব্যাপারে সম্ভব নয় এই যুক্তিকেই খুঁটি হিসেবে আঁকড়ে ধরেন।২৩
আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে পরিষদ সদস্যেরা বিভাগ-পূর্ব ভারতীয় এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক বিধান পরিষদে এ ধরনের ঘটনায় আলােচনার পূর্ব উদাহরণ উল্লেখ করেন কিন্তু তাদের কোনােটিই নাচোলের ঘটনার সাথে তুলনীয় নয় বলে নূরুল আমীন এবং স্পীকার স্পষ্ট রায় দেন।২৪
এক পর্যায়ে মােরন ধর প্রশ্ন তােলেন যে পুলিশ অফিসার এবং কনস্টেবলের মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাটির ওপর পুলিশী তদন্ত চলছে তার অর্থ এই নয় যে সেটি কোর্টে বিচারাধীন আছে। পুলিশ তদন্ত এবং কোর্টের সামনে বিচার এক জিনিস নয়। ব্যাপারটি যে সত্যি সত্যিই কোর্টের বিচারাধীনের উপযুক্ত প্রমাণ দাখিলের জন্যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনকে আহ্বান জানান। কিন্তু অনুগত স্পীকার নুরুল আমীনকে সে রকম কোনাে বিপদের মধ্যে না ফেলে সরাসরি বলেন যে তিনি নূরুল আমীনকে এ ব্যাপারে কোনাে প্রমাণ দাখিল করার কথা বলতে পারেন না। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য তাকে মানতেই হবে।২৫ এইভাবে কিছুক্ষণ বিতর্ক চলার পর অবশেষে স্পীকার রায় দেন যে নাচোলের ঘটনা ও পুলিশ নির্যাতনের ব্যাপারে তিনি কোনাে মুলতুবী প্রস্তাব উত্থাপন করতে ও বিতর্ক অনুষ্ঠিত হতে দেবেন না।
এইভাবেই সংবাদপত্র, এমনকি প্রাদেশিক বিধান পরিষদেরও টুটি টিপে নূরুল আমীন সরকার নাচোলের অসংখ্য সাঁওতালের নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সমগ্র এলাকায় লুঠতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ এবং নানা ধরনের নির্মম নির্যাতনের ঘটনাবলীকে জনসাধারণের থেকে লুকিয়ে রেখে নিজেদের “ভত্র” চেহারাকে দেশের সামনে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় কোনাে ত্রুটি রাখলাে না!
১। রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলিবর্ষণ ও রাজবন্দী হত্যা
১৯৪৯ সালের মে-জুন মাসে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে দ্বিতীয় অনশন ধর্মঘটের পর ‘আত্মহত্যার অভিযােগে অনশনকারীদেরকে এক বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সে সময় রাজবন্দীদেরকে বিভিন্ন চাকীতে সাধারণ কয়েদীদের সাথে কাজ করতে হতাে। এই কাজের মাধ্যমে তাদের সাথে রাজবন্দীদের যােগাযােগ বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
সাধারণ কয়েদীদেরকে তখন বৃটিশ আমলের বন্দোবস্ত অনুসারেই নানারকম অতিরিক্ত নির্যাতন সহ করতে হতাে। জেল কর্তৃপক্ষও তাদেরকে পণ্ড হিসেবেই গণ্য করা করত এবং গরুর পরিবর্তে তাদেরকেই সরষে মাড়া ঘানিতে জুড়ে খাটিয়ে নিতাে। উপযুক্ত সহানুভূতি এবং সহযগিতার অভাবে তারা এ সব কিছুই মুখ বুঝে সহ্ন করতাে এবং কোনাে ব্যাপারেই প্রতিবাদের সাহস পেতাে না। | রাজবন্দীদেরও যখন তাদের সাথে ঘানি ইত্যাদি বিভিন্ন চাকীতে জুড়ে দেওয়া হলাে তখন তাদের সহানুভূতি এবং সহযােগিতার আশ্বাস পেয়ে তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ববােধ এবং প্রতিবাদ ও প্রতিকারের আকাকা অনেকখানি জাগ্রত হলাে। তারা ধীরে ধীরে এ সব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলােচনা করতে থাকলাে। এবং প্রশ্ন তুললাে পাকিস্তান হওয়ার পরও জেলের মধ্যে মানুষ দিয়ে ঘানি টানাবে কেন? এতে মারপিট হবে কেন ? খাওয়া-দাওয়ার এতাে অসুবিধা থাকবে কেন? তামাক খাওয়া বেআইনী থাকবে কেন? ইত্যাদি।
এই সব আলাপ আলােচনা অনেকখানি অগ্রসর হওয়ার পর এবং রাজবন্দীদের সক্রিয় সহযােগিতার ফলে সাধারণ কয়েদীরা কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের দাবী পেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মনসুর-ই হাবিব এবং আরাে দুই একজন মিলে তাদের দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে একটি মেমােণ্ডামের খসড়া তৈরী করেন এবং সেটি সাধারণ কয়েদীদের পক্ষ থেকে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হয়।
350
জেল কর্তৃপক্ষ তাদের এই মেমােরাণ্ডামৈ কর্ণপাত না করায় তারা এই এপ্রিল ১৯৫৩, থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করে। তাদের অনশনের সমর্থনে রাজবন্দীরাও এই এপ্রিল থেকে অনশন ধর্মঘটে শরীক হন।
অনশন শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর কয়েদীদের মধ্যে অনেকে ধর্মঘট ছেড়ে দেয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রায় এক হাজার কয়েদী ধর্মঘটে অটল থাকে।
| ধর্মঘটের পঞ্চম দিন অর্থাৎ ৯ই এপ্রিল ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিন্স আমীর হােসেন রাজশাহী জেল পরিদর্শন করতে আসে এবং ধর্মঘট কয়েদীদের সাথে দেখা করে তাদেরকে অনশন পরিত্যাগ করতে বলে। কিন্তু ধর্মঘটীরা দাবী না মেনে নেওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে রাজী হয় না।
এর পর আমীর হােসেন এগারাে-বাবাে তারিখের দিকে রাজবন্দীদের সাথে দেখা করে তাদেরকে যে সাধারণ কয়েদীদের ধর্মঘট তাদের জন্যেই সম্ভব হচ্ছে কাজেই তারা ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেই অন্যান্য কয়েদীরা তাদের ধর্মঘটও প্রত্যাহার করে নেবে। সেই বিবেচনায় ইন্সপেক্টর জেনারেল রাজবন্দীদেরকে ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে অনুরােধ জানায়। কিন্তু রাজবন্দীদের পক্ষ থেকে ধৰ্মঘট প্রত্যাহারের কোনাে প্রশ্নই ছিলাে না, কাজেই তারা আমীর হােসেনকে পরিষ্কারভাবে নিজেদের অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। সুতরাং রাজবন্দীসহ সাধারণ কয়েদীদের অনশন ধর্মঘট অব্যাহত থাকে।
এই সময় ইন্সপেক্টর জেনারেল আমীর হােসেন জেল সুপারিনটেছেন্টকে নির্দেশ দেয় রাজবন্দীদের মধ্যে পনেরাে-ষােল জনকে বিচ্ছিন্ন করে অন্যত্র অর্থাৎ ১৪নং কনডেড, সেলে সরিয়ে দিতে। এই ১৪নং ছিলাে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের সেল। | আমীর হােসেনের এই নির্দেশের বিরুদ্ধে রাজবন্দীদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়। তারা কেউই খাপরা ওয়ার্ড থেকে সরে গিয়ে উপরােক্ত কুখ্যাত সেলে বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে রাজী ছিলেন না। কাজেই তারা নিজেদের মধ্যে তখন আলােচনা করে স্থির করেন যে তারা ঐ সেলে কিছুতেই যাবেন না।
মাত্র একজন রাজবন্দী, গণেন সরকার এই সিদ্ধান্ত খােলাখুলিভাবে পুনর্বিবেচনা করার কথা বলেছিলেন। যশােরের ফরওয়ার্ড ব্লক মার্কিস্ট পার্টির সদস্য হীরেন সেন বিরােধিতা না করলেও সকলকে সাবধান করে বলেছিলেন। যে সেই সিদ্ধান্তের পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। এই মারাত্মক পরিণতি” বলতে তিনি লাঠি চার্জ পর্যন্তই আশঙ্কা করেছিলেন।
১৪ই এপ্রিল ইন্সপেক্টর জেনারেল আমীর হােসেন রাজবন্দীদের সকলকে
এবং সাধারণ কয়েদীদের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধিকে জেল গেটে হাজির করে। সেখানে সে কয়েদীদেরকে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বলায় তারা অবাৰ দেয় : আগে দাবী মেনে নাও, পরে ধর্মঘট প্রত্যাহার।১২
১৫ই এপ্রিল তারা আবার সকলকে জেল গেটে উপস্থিত করলাে এবং ধর্মঘটীদের দাবী মােটামুটিভাবে মেনে নেওয়ার কথা জানিয়ে বললাে : মানুষ নিয়ে আর ঘানি টানানাে হবে না। সরকারী পয়সায় তামাক দেওয়া সম্ভব হবে না, তবে যারা নিজের পয়সায় তামাক যােগাড় করতে পারবে তাদেরকে তামাক খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। এ ছাড়া মারপিট ইত্যাদিও বন্ধ করা হবে।১৩
রাজশাহী জেলের ফুটবল মাঠের মধ্যে সেদিনই বিকেল বেলা ইন্সপেক্টর জেনারেল অব প্রিন্স আমীন হােসেন জেলের প্রায় ২৫০০ কয়েদীকে হাজির করে তাদের সামনে এক বক্তৃতা দিয়ে বললাে তারা যেন কমিউনিস্টদের সম্পর্কে হশিয়ার থাকে।১৪
ফুটবল মাঠের এই মিটিং শেষ হওয়ার আগেই খাপরা ওয়ার্ডে রাজবন্দীদের লক আপ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্ধ্যের পর আমীর হােসেন তালা খুলে ওয়ার্ডের ভেতরে এসে রাজবন্দীদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাে : বাইরে আপনারা বিপ্লব করছেন। জেলের ভেতরেও এই সব কাণ্ড করলেন। এর প্রতিকুল আপনাদেরকে পেতে হবে।
১৫ই এপ্রিলের পর এলাে ২৪শে এপ্রিল। ঐ সকাল ৯টার দিকে জেল সুপার বিল তার সাপ্তালিক পরিদর্শনের জন্যে আসে। সুপারিনটেন্টে বিলের সাথে জেলের ডাক্তার, জেলার মান্নান, দু-জন ডেপুটি জেলার, হেড ওয়ার্ডার প্রভৃতি আরও কয়েকজন ছিলাে।১৬ এর পূর্বেই খাপরা ওয়ার্ডে রাজবন্দীদের চা খাওয়া শেষ হয়েছিলাে এবং ১৪ নম্বর সেলে বদলী ইত্যাদি নিয়ে হানিফ শেখ, মনসুর হাবিব, আবদুল হক, প্রভৃতি নিজেদের মধ্যে আলােচনা করছিলেন।
সুপার বিল খাপরা ওয়ার্ডের বারান্দায় দাড়িয়েই রাজবন্দীদের সাথে আলাপ শুরু করে। সে সময় জেল ইউনিটের সেক্রেটারী আবদুল হক তাদের পক্ষ থেকে তাকে বলেন যে তারা প্রতিদিন দুবেলা একইভাবে কুমড়াের ঘাট আর খেতে পারবেন না। কাজেই জেল কর্তৃপক্ষকে তাদের খাদ্যতালিকা পরিবর্তন করতে হবে।
এর উত্তরে বিল তাদেরকে বলে যে তারা হচ্ছেন ক্রিমিন্যাল, কাজেই যা
তাদেরকে দেওয়া হচ্ছিলাে তাই যথেষ্ট। তার বেশ তাদেরকে আর কিছু দেওয়া সম্ভব নয়। কনভেম, সেলে যাওয়ার ব্যাপারেও সুপার বিলকে তারা বলেন যে সেখানে যেতে তাদের আপত্তি আছে।
এই ভাবে কথা কাটাকাটি হতে হতে এক পর্যায়ে বিল তার হাতের ছড়ি তুলে বন্দীদের মধ্যে একজনকে মারতে ওঠে। সে সময় তাদের মধ্যে একজন তার ছড়িসমেত হাত ধরে ফেলেন এবং টেনে তাকে বারান্দা থেকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। এই সময় সাধারণভাবে আলাপরত অবস্থায় দুজন ডেপুটি জেলারও ঘরের মধ্যে ছিলেন। যাই হােক জেল সুপার বিলকে ঘরের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বারান্দায় দাড়ানাে জেলার মান্নান হইসিল বাজিয়ে দেয়। ঘরের মধ্যে এই সময় একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয় এবং বন্দীদের হাত ছাড়িয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই ৰিল এবং অন্যেরা দৌড়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়ে। দুজন ডেপুটি জেলার অবশ্য ভিতরেই আটকে পড়েন। এর পরই তারা পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় এবং তাদের সেপাইরা জানলার ফাক দিয়ে বন্দুক গলিয়ে ঘরের মধ্যে অবস্থিত রাজবন্দীদের ওপর ৬০ রাউণ্ড গুলি ক্রমাগতভাবে বর্ষণ করে।২০
বিল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এবং হুইসিল ও পাগলা ঘণ্টা বাজানাের সাথে সাথেই রাজবন্দীরা চৌকি, নারকেলের ছােবড়ার গদি ইত্যাদি খাড়া করে নিজেদের ঘরের দরজা যথাসাধ্য বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু গুলির ধাক্কায় প্রায় তৎক্ষণাৎ তারা প্রত্যেকেই এধার-ওধার ছিটকে পড়েন এবং নিজের নিজের আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনাে আশ্রয়ই নিরাপদ ছিলাে না। কাজেই তাঁরা প্রত্যেকেই লিবিদ্ধ হন এবং ঘরের মেঝে তাদের রক্তে ভিজে লাল হয়ে ওঠে। একমাত্র শফিউদ্দীন আহমদই প্রস্রাবের জন্যে রাখা একটি ড্রাম উল্টে তার মধ্যে আশ্রয় নেওয়ায় তার শরীরেই সরাসরিভাবে গুলির কোনাে আঘাত লাগেনি।২২ খাপরা ওয়ার্ডের মধ্যে দুজন ডেপুটি জেলার আটকা পড়েছিলেন তাদের মধ্যেও একজন গুলিতে আহত হন। | গুলিতে প্রথমেই মারা যান হানিফ শেখ। তার পর আনােয়ার হােসেন। মাথায় গুলি লেগে তার মাথাটা সম্পূর্ণভাবে চুরমার হয়ে যায়।২৪ | তারপর ঘরের মধ্যে একের পর এক মারা যান সুখেন ভট্টাচার্য, দেলওয়ার এবং সুধীন ধর। সুধীন ধর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তার সহজ ভাব পরিত্যাগ করেননি। গগুগােল শুরু হওয়ার সময়েই তিনি তাড়াতাড়ি একটা বিড়ি
| ধৰিয়ে বলেন, “সবাই আর লম্বা বিড়ি ধরাও। আজ আর কারাে ক্ষে নেই।” এর অল্পক্ষণ পরেই গুলিতে তিনি নিহত হন।২৫ | গুলি বর্ষণ শেষ হওয়ার পর পুলিশের ঘরের মধ্যে ঢুকে দুইবার লাঠি চার্জ করে। একজন রাজবন্দী তৃষ্ণার চোটে অস্থির হয়ে পানি পানি বলে চীৎকার করলে জেলার মান্নান একজন সেপাইকে দিয়ে তার মুখে প্রস্রাব করিয়ে দেয়। এই অবস্থায় তারা পড়ে থাকার সময় রাজশাহীর পুলিশ পার একদল সশস্ত্র পুলিশ সাথে নিয়ে খাপরা ওয়ার্ডে হাজির হন।২৬।
এর পূর্বে পাগলা ঘণ্টা দেওয়ার পর জেলার মান্নান ও বিল তাকে টেলিফোনে জানায় যে রাজবন্দীরা খাপরা ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ কয়েদীদেরকে সঙ্গে নিয়ে জেল গেট ভেঙে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। কাজেই তারা তাকে যত শীষ সম্ভব সশস্ত্র পুলিশ দল নিয়ে জেলখানায় উপস্থিত হতে বলে। জেলখানায় উপস্থিত হয়ে পুলিশ সুপার কিন্তু গুন্তিত হয়ে পড়েন। যে দৃশ্য তিনি খাপরা ওয়ার্ডে এসে দেখেন তা তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি। নিহত এবং আহত রাজবন্দীদেরকে রক্তগঙ্গার মধ্যে পড়ে থাকতে দেখে এবং জেল সুপার জেলারের মিথ্যা রিপাের্ট দেওয়ার এতে তিনি তাদের দুজনকেই দাশ গালাগালি করেন এবং গ্রেফতার করতে চান। পরে অবশ্য তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়নি। | সেই পুলিশ সুপারের বাড়ি ছিলাে হায়দরাবাদ (দক্ষিণ)। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি রাজবন্দীদের ওপর এই নির্যাতন ও নৃশংস গুলি বর্ষণ দেখে ঘটনাস্থলেই বলেছিলেন যে | যুদ্ধের সময় তিনি অনেক মৃত্যু দেখেছিলেন কিন্তু অসহায় লােকদেরকে ঘরের মধ্যে এভাবে গুলি করে মারার কোনাে নজির তার জানা নেই। | গুলি বর্বণ বন্ধের পর যারা আহত অবস্থায় রক্তগঙ্গা মেঝেতে পড়ে থাকলেন তাদের মধ্যে ছিলেন কম্পম সিংহ, বিজন সেন, মনসুর হাবিব, নুরুন্নবী চৌধুরী, আবদুল হক, ভূজেন পালিত, অমূল্য লাহিড়ী, বাবর আলী, আবদুশ শহীদ, আমিনুল ইসলাম প্রভৃতি ৩১ জন রাজবন্দী। এদের মধ্যে কম্পম | সিংহ এবং বিজন সেনের অবস্থাই ছিলাে সব থেকে সংকটাপন্ন। | কি অবস্থা যতই সংকটাপন্ন হােক আহতদের চিকিৎসার কোনাে ব্যবস্থা
করে তাদেরকে তারা প্রায় সারাদিন খাপরা ওয়ার্ডের মধ্যেই ফেলে রাখলাে। বহু ঘন্টা পরে আহতদেরকে চিকিৎসার নাম করে একবার জেল গেটে তারা দিয়ে গেলাে। সে সময় জেল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে রাজশাহী সদর হাসপাতালে
নিয়ে যাওয়ার একটা চিন্তা করছিলাে কিন্তু পরে “নিরাপত্তা ব্যবস্থার অসুবিধাঘটিত কারণে জেল গেট থেকেই ঐ অবস্থায় তাদেরকে আবার ফিরিয়ে। নিয়ে জেল হাসপাতালেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেই রাত্রেই বিনা চিকিৎসায় জেলের মধ্যে বিজন সেন এবং কম্পম সিংহের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর পূর্বে দিনাজপুর তেভাগা আন্দোলনের বীর যােদ্ধা কম্পম সিংহ আহত কমরেডদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, যারা বেঁচে থাকবে তাদেরকে বলা লাল ঝাণ্ডার সম্মান রেখেই আমরা মারা গেলাম।৩০ | খাপরা ওয়ার্ডে গুলি বর্ষণের ফলে যে সাতজন শহীদ হন তাদের প্রত্যেকেরই লাশ পুলিশ গােপনে সরিয়ে ফেলে এবং আত্মীয়-স্বজনকে এ ব্যাপারে কোনাে খবর না দিয়ে সেগুলি গুম করে দেয়।
বিনা চিকিৎসায় বহুক্ষণ পড়ে থাকায় এবং পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত। চিকিৎসার অভাবে আহতদের সকলেরই অতিরিক্ত নানা উপসর্গ দেখা দেয়। এর মধ্যে নুরুন্নবী চৌধুরীর পায়ে গ্যাংগ্রীন হয়ে যাওয়ার ফলে তার একটি পা কেটে বাদ দিতে হয়। | জেল হাসপাতালে চিকিৎসা শেষ হওয়ার পরও কর্তৃপক্ষ প্রায় আড়াই বছর এই রাজবন্দীদেরকে পূর্বোল্লিখিত ১৪নং কনডেমড সেলেই তার কাটার বেড়ার মধ্যে আটকে রেখে নিজেদের জেদ এবং গণতান্ত্রিক ও ইসলামী ন্যায়নীতিকে বজায় রেখেছিলাে।
১। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির উপর এও সেতুঙ ও চীনা
লাইনের প্রভাব ১৯৩৮-এর ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নােতুন পার্টি সম্পাদক রণদীভের সাথে অন্ধ পার্টি সেক্রেটারিয়েটের আভ্যন্তরীণ মতবিরােধ ও দ্বন্দ্ব অনেকখানি সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে। অন্ধ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ, বিশেষতঃ এস.এ. ডাঙ্গেও এই সময় রণদীভে লাইনেই বিরােধিতা শুরু করেন।
ছয় মাসের মধ্যে ভারতে বিপ্লব আসন্ন এই বক্তব্য এবং ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে তাদের অনুসৃত রণকৌশলের বিরুদ্ধে অজয় ঘােষ জেল থেকে দুটি চিঠি পাঠিয়ে প্রতিবাদ জানানাের জন্যে রণদীতে এই সময় তাকে বহিষ্কারের হুমকি দেখান।
355
কি ডালে, অজয় ঘােষ প্রভৃতির সমালােচনার তুলনায় অঞ্জ পাটিক বক্তব্য ও সমালােচনা ছিলাে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং তেলেঙ্গানায় সশস্ত্র কৃষক আন্দোলনের অগ্রগতির ফলে তাদের বক্তব্য হুমকি দিয়ে বাতিল করার ক্ষমতাও প্রকৃতপক্ষে রণদীভের ছিলাে না। এই সময় তেলেঙ্গানার পাটির সাথে অঞ্জ পার্টির খুব ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিলাে এবং অন্ধ্র পার্টির নেতা রাজেশ্বর রাওই ছিলেন তেলেঙ্গানা কৃষক সংগ্রামের সর্বপ্রধান প্রবক্তা।
হায়দরাবাদের নলগােণ্ডা ও ওয়ারাল এই দুই জেলাতে কমিউনিস্টরা নিজেদের সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করে সমগ্র এলাকাটিকে মুক্ত এলাকা হিসেবে গঠন করতে থাকেন। গ্রামের পর গ্রামে তারা গ্রাম্য “সােভিয়েট স্থাপন করে পুরাতন জমিদার জোতদারদের তাড়িয়ে দিয়ে ও হত্যা করে সে সব জায়গায় নােতুন জমি বন্দোবস্ত করেন। নিজামের কর্মচারীদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে পার্টির নেতৃত্বেই তারা নিজেদের এলাকার আর্থিক জীবন এবং রক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকেন। ঠিক এই সময়েই অর্থাৎ ১৯৪৮-এর গােড়ার দিকেই তেলেঙ্গানা এবং অন্ধে মাও সেতুঙ-এর প্রভাব বিস্তৃত হতে শুরু করে এবং অন্ধ সেক্রেটারিয়েট তাদের নােতুন বক্তব্য বিবেচনা জন্যে তা পার্টির সামনে উত্থাপন করেন।
১৯৪৮-এর জুন মাসে অন্ধ পাটি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে একটি চিঠিতে ঘােষণা করেন যে মাও সেতুঙ-এর নয়া গণতন্ত্রকে ভারতের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়ােজন। এ সম্পর্কে তারা যে রণনীতির প্রস্তাব করেন তাতে সমগ্র কৃষক সম্প্রদায়কে (গ্রামীণ বুর্জোয়া ও ধনী কৃষক সহ) শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে একতাবদ্ধ করে তাদেরকে চীনা লাইন অনুসারে গেরিলা যুদ্ধে নিয়ােজিত করার কথা বলা হয়।
অন্ধ সেক্রেটারিয়েট সে সময়ে কেবলমাত্র বৃহৎ বুর্জোয়া ও বৃহৎ জমিদারদেরকেই সত্যিকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে মনে করেন। মধ্যে কৃষকদেরকে তারা মনে করেন বিপ্লবের দৃঢ় মিত্র এবং ধনী কৃষকদেরকে মনে করেন নিরপেক্ষ ও ক্ষেত্রবিশেষে বিপ্লবের দোদুল্যমান মিত্র।
এই শ্রেণী বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে তারা নিজেদের মতামতের সংক্ষিপ্ত সারাংশ দিতে গিয়ে বলেন :
ক্ল্যাসিক্যাল রুশ বিপ্লবের সাথে আমাদের বিপ্লবের অনেক দিক দিয়ে তফাত এবং চীন বিপ্লবের সাথে অনেক বেশী সাদৃশ্য। আমাদের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ ধর্মঘট, সাধারণ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের মুক্তির সম্ভাবনা
নেই। এখানে যা ঘটবে তা হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন প্রতিবােধ ও কৃষি বিপ্লবের আকারে সুদীর্ঘ গৃহযুদ্ধ এবং তার পরিণামে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের দ্বারা রাজ নৈতিক ক্ষমতা ৮।৬
রণদীভের “অত্যাসন্ন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বক্তব্যের সাথে এই বক্তব্যের বিরােধিতা খুবই স্পষ্ট। অন্ধ সেক্রেটারিয়েটের উপবােক্ত বক্তব্যকে খণ্ডন করার চেষ্টায় রণদীভে পার্টির তাত্ত্বিক মুখপত্র “কমিউনিস্টে” জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি, এবং জুন-জুলাই সংখ্যায় পর পর চারটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।’
এই প্রবন্ধগুলির মধ্যে “জনগণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম” নামে চতুর্থ প্রবন্ধটিতে তিনি বলেন যে, “রুশ বিপ্লবের পুরাে অভিজ্ঞতাই ভারতের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে প্রযােজ্য” এবং রুশ ইতিহাসই হচ্ছে ভারতের আদর্শ।
এই প্রবন্ধটিতেই মাও সে তুঙকে আক্রমণ করে এবং একমাত্র কমিনফর্মের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে রণদীভে বলেন :
প্রথমেই একথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা দরকার যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন এবং স্ট্যালিনকেই মার্ক্সবাদের উৎস হিসেবে স্বীকার করেছে। এর বাইরে তারা কোনাে নােতুন উৎস আবিষ্কার করেনি। তাছাড়া এমন কোনাে কমিউনিস্ট পাটি নেই যারা মাও-এর দ্বারা নির্মিত বলে কথিত নয়া গণতন্ত্রের তথাকথিত তত্ত্বের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছে এবং তাকে মার্ক্সবাদের একটা নােতুন সংযােজন বলে স্বীকার করেছে। এটাও খুব অদ্ভুত যে ইউরােপে নয় পার্টির (কমিনফর্ম) কনফারেন্সে মার্কসবাদের এই নােতুন সংযােজন সম্পর্কে কোনাে উল্লেখ করা হয়নি।
কিন্তু এ সব সত্ত্বেও তেলেঙ্গানার সংগ্রাম এবং অন্ধ পার্টি সেক্রেটারিয়েটের বক্তব্যকে গ্রাহের মধ্যে না এনে রণদীভের উপায় ছিলাে না। কারণ একমাত্র তেলেঙ্গানাতেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একটা সত্যিকার সংগ্রাম এই সময়ে পরিচালিত হচ্ছিলাে এবং অন্ধ সেক্রেটারিয়েটই সে সময় ছিলাে এই সংগ্রামের পাটি গত মুখপাত্র।
ভারত সরকার কতৃক হায়দরাবাদ দখলের পর অবশ্য তেলেঙ্গানার এই সংগ্রামে অনেক বিপর্যয় ঘটে এবং পরিশেষে তা বহুধাবিভক্ত হয়ে ছােট ছােট খণ্ড আক্রমণ ও আন্দোলনে পরিণত হয়।
সােজিয়েট অ্যাকাডেমিশিয়ানদের একটি সভায় “নয়া গণতন্ত্রকে সারা এশিয়ায়। জতে একটা নীতি হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে ঘােষণা করা হয়। জুত তার উদ্বােধনী বক্তৃতায় পূর্ব ইউরােপীয় এবং চীনা তত্বের সাদৃষ্ঠের ওপর খুব জোর দেন এবং বলেন যে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও প্রাচ্যের জনগণতন্ত্রের সাথে পশ্চিমা জনগণতন্ত্রের মৌলিক চরিত্রের মধ্যে কোনাে তফাত নেই। রণ। কৌশলের ক্ষেত্রে জুকভ ভারত ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সর্বত্র সশস্ত্র বিদ্রোহকে সমর্থন জানিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীন, মালয়, বার্মা, ও চীনের বিদ্রোহের সাথে “ভারতের কৃষক অভ্যুত্থানের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে এই এই সংগ্রামসমূহ প্রমাণ করে যে এই সব এলাকায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম একট। “নােতুন এবং উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।১০
ভারতের ওপর মুল রিপাের্টটি পেশ করেন ব্যালারুশেভিচ। চীনা রণনীতি ও রণ-কৌশল ভারতে কিভাবে প্রয়ােগ করতে হবে এ বিষয়ে তিনি একটি বিস্তৃত বিবরণ দেন। তাতে তিনি বলেন যে মধ্য বুর্জোয়াদের একটি অংশকে বিপ্লবের সহযাত্রী” হিসেবে পাওয়া যাবে। ভারতের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ জাতিসত্ত্বাসমূহ এবং বুর্জোয়াদের যে অংশটির স্বার্থ বিদেশী পুজির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তিনি সেগুলিকেই এক্ষেত্রে চিহ্নিত করেন। জুডের মতাে ব্যালারুশেভিচও ভারতে সশস্ত্র সংগ্রামকে অভিনন্দন জানান এবং ভারতে জনগণতন্ত্র কায়েমের প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে তেলেঙ্গানার আন্দোলনের প্রশংসা করেন। এ ছাড়া তিনি তাকে “কৃষিবিপ্লবের অগ্রদূত” এবং মুক্তি আন্দোলনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ব” হিসেবেও উল্লেখ করেন। এই পথকেই ভারতের পথ বলে ঘােষণা করে ভারতীয় কমিউনিস্টদেরকে তা নিষ্ঠার সাথে অনুসরণের জন্যে তিনি আহ্বান জানান। এভাবেই বস্তুতপক্ষে মাও সেতুঙ-এর তত্ত্বের দ্বারা উক্ত অন্ধ সেক্রেটারিয়েটের কর্মসূচীই সােভিয়েট বিশেষজ্ঞ ও সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা এই পর্যায়ে স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়।১২
এশীয় ও অস্ট্রেলীয় দেশগুলির ট্রেড ইউনিয়নসমূহের কনফারেন্স উপলক্ষে ১৯৪৯-এর নভেম্বর মাসে যখন এশীয় পার্টির প্রতিনিধিরা পিকিং-এ সমবেত হন তখনই তাদেরকে চূড়ান্তভাৰে এই নােতুন লাইন সম্পর্কে অবহিত করা হয়। চীনা নেতা লিউ শাও চী তার উদ্বোধনী ভাষণে ঘােষণা করেন যে চীনা বিপ্লব যে পথ ধরে অগ্রসর হয়েছে সেই পথ ধরেই জাতীয় মুক্তি ও অনগণভরে জয়ে সংগ্রামের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঔপনিবেশিক এবং আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলিকে অগ্রসর হতে হবে। এশীয় দেশগুলির জন্যে সশস্ত্র বিপ্লবকেই তিনি সংগ্রামের
মূল রূপ” বলে মন্তব্য করেন। ভিয়েতনাম, বার্মা, ইন্দোনেশীয়া, মালয় ও ফিলিপাইনের গৃহযুদ্ধের উল্লেখ করে তিনি বলেন যে সেই সব দেশের পাটিসমূহ সম্পূর্ণ সঠিকভাবেই কাজ করছে। ভারতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে সেখানেও মুক্তির জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছে। সর্বশেষে লিউ শাও চী সমবেত ভেলিগেটদের কাছে এই মর্মে আহ্বান জানান যাতে তারা প্রত্যেকেই নিজেদের দেশের বিশেষ বিশেষ অবস্থায় সংগ্রামের নির্দিষ্ট রূপ” সম্পর্কে আলােচনা করেন। ভারতের কোনাে প্রতিনিধি পিকিং-এর সেই সম্মেলনে উপস্থিত না থাকায় ভারতীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনাে বিশেষ আলােচনা হয়নি এবং ভাত সম্পর্কে কোনাে নির্দিষ্ট রণকৌশলগত পরিকল্পনার সিদ্ধান্তও সেখানে নেওয়া হয়নি।১৩।
১২। কমিনফর্ম থিসিস ও ভারতীয় পার্টির নেতৃত্বে রদবদল | অনুন্নত এশীয় দেশগুলির জন্যে চীনা পার্টি অনুসৃত কর্মসূচী অনুমােদন করে কমিনফর্মের মুখপত্রে “Mighty Advance of the National Liberation Movement in the Colonial and Dependent Countries’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তবে এই প্রবন্ধে চীনা বিপ্লবের অনেক প্রশংসা করে অন্যান্য অনুন্নত দেশগুলির জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রে তার প্রচণ্ড তাৎপর্যের বিষয় উল্লেখ করা সত্ত্বেও পিকিং-এ পূর্বোক্ত ট্রেডইউনিয়ন সম্মেলনে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন মুখপাত্র লিউ শাও চীর বক্তব্যকে অনেকাংশে তারা পরিবতিতও করেন। লিউ শাও চী বলেছিলেন যে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পথ “বিভিন্ন ঔপনিবেশিক ও নির্ভরশীল অনুন্নত দেশেরই পথ। কিন্তু কমিনফর্মের মুখপত্রে বলা হয় যে চীনা লাইন “অনেক ঔপনিবেশিক ও নির্ভরশীল দেশের পথ। চীনা মুখপাত্র যেখানে বােঝাতে চেয়েছেন “সমস্ত”, কমিনফর্মের মুখপাত্ররা সেখানে বলেছেন “অনেক”। এর অর্থ হলাে এই যে অনুন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে চীনা লাইনের সার্বিক প্রয়ােগের ওপর কমিক জোর না দিয়ে তার সাধারণ প্রয়ােগের কথা উল্লেখ করেন। ভারতের প্রশ্নে কমিনফর্মের এই প্রবন্ধে বলা হয় যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে চীন এবং অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তাদের কর্মসূচী নির্ধারণ করতে হবে। For a Lasting Peace, For a People’s Democracy.
পূর্ববর্তী রুশ মুখপাত্রেরা যেখানে সশস্ত্র উপায়ে ক্ষমতা দখলের কথা বলেছিলেন সেখানে কমিনফর্ম এক্ষেত্রে সশস্ত্র সংগ্রামের কোনাে উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন।
এইভাবে কমিনফর্ম ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা ভারতের ক্ষেত্রে তৎকালীন পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে রণদীভের পক্ষে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে টিকে থাকা আর কিছুতেই সম্ভব হলাে না। বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বগত মুখপত্রে এই সময় ভারতীয় পরিস্থিতি” নামে একটি প্রবন্ধ ছাপা হওয়া সত্বেও বৃটিশ অথবা অন্য কোনাে বৈদেশিক কমিউনিস্ট পার্টিই রণদীভের বক্তব্যকে সমর্থন
করায় তার পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে এবং ১৯৫০-এর মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বৈঠকে পুরাতন কমিটি রণদীভেকে সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ করে নিজেকে নােতুনভাবে গঠন করে এবং তার মধ্যে অন্ধের সদস্য থাকেন চারজন। এই নােতুন কমিটি অন্ধ সেক্রেটারিয়েটের রাজেশ্বর রাওকে ভারতীয় কমিনিস্ট পার্টির নােতুন সম্পাদক নির্বাচিত করে রণদীভে লাইনকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেন।
এর পর পাটির তাত্ত্বিক মুখপত্র ‘কমিউনিস্ট’-এর সম্পাদকীয় পরিষদকে নােতুনভাবে সংগঠিত করা হয় এবং তার পরবর্তী সংখ্যাতেই তারা রণদীভের লাইনকে “বামপন্থী বিচ্যুতি” ও “পুরোদস্তুর ট্রীপন্থী থিসিস” বলে অভিহিত করেন। এ ছাড়া সম্পাদকীয় পরিষদ উনত্রিশতম বার্ষিকী উপলক্ষে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে একটি অভিনন্দন পাঠিয়ে তাতে বলেন যে, “ঔপনিবেশিক দুনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিসমূহ চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে তাদের আদর্শ হিসেবে মনে করে।”
১৩। কমিনফর্ম থিসস ও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি
কমিন থিসিসে পাকিস্তান, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তান, সম্পর্কে কোনাে নির্দিষ্ট বক্তব্য না থাকলেও পাকিস্তানী ও ভারতীয় পরিস্থিতির মধ্যে কোনাে মৌলিক অথবা উল্লেখযোেগ্য পার্থক্য না করায় উভয় ক্ষেত্রের জন্যে তাঁরা একই কর্মসূচীকে পরােক্ষভাবে অনুমােদন করেন। এজন্যেই ভায়তীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের সিদ্ধান্তসমূহ সাধারণভাবে যেমন পূর্ব পাকিস্তানের
* Communist Review
360
ক্ষেত্রে প্রযােজ্য ছিলাে তেমনি পরবর্তী কমিনফর্ম থিসিসও প্রযােজ্য ছিলাে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে।
পূর্ব পাকিস্তানে রণদীভে থিসিস যে সব কারণে ব্যর্থ হয় তার মধ্যে প্রধান কয়েকটিকে এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :
১। পূর্ব বাঙলার শ্রেণীবিন্যাস এবং দেশভাগের ঠিক পরবর্তী পর্যায়ে “পাকিস্তানের প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গীকে সঠিকভাবে বােঝর অক্ষমতা। এবং এই অক্ষমতার ফলে পূর্ব বাঙলার বৈপ্লবিক পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে বােঝার ব্যাপারে তাদের পুরােপুরি ব্যর্থতা।
২। পার্টির আন্দোলন এবং ছােটখাট অ্যাকশন মূলতঃ অমুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাে। এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত তাদের কার্যকলাপকে অনেকাংশে সাম্প্রদায়িক ভেবে তার থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখেন। সরকারী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রচারণাও এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে ভুল ধারণার সৃষ্টি করে। কিন্তু পার্টির পক্ষ থেকে উপযুক্ত প্রচার ও কাৰ্যসূচীর মাধ্যমে তাদের এই ধারণা পরিবর্তন করা সন্তোষজনকভাবে সম্ভব হয়নি। এর ফলে বৃহত্তর জনগণের স্বার্থের সাথে পার্টির রাজনীতি ও রণকৌশলের সম্পর্ককেও তারা তুলে ধরতে সক্ষম হননি। | ৩। গ্রামাঞ্চলে যে সব ছােটখাট অ্যাকশনের মধ্যে তারা গিয়েছিলেন তার নেতৃত্ব ছিলাে সব সময়েই পেটি বুর্জোয়াদের হাতে। এর ফলে অ্যাকশনের মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ের নিতান্ত অভাব ছিলাে। সে জন্যেই অ্যাকশনের পরবর্তী পর্যায়ে রণে ভঙ্গ দেওয়ার প্রবণতা তাদের মধ্যে অনেক বেশী দেখা দেয়।
৪। জেলখানা হচ্ছে শ্রেণীশত্রুর সবলতম ঘাঁটি। সেই ঘাঁটির মধ্যে তারা প্রায় সর্বশক্তিমান। সেখানে বিপ্লব সমাধা চেষ্টা অথবা শত্রুর সাথে একটা সরাসরি বােঝাপড়ার কাৰ্যসূচী ছিলাে নিতান্ত ভুল। শত্রুর এই সবলতম ঘাঁটিতে শত্রুকে আঘাত করতে গিয়ে সংগঠনের দিক থেকে পার্টি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫। অনশন প্রকৃতপক্ষে গান্ধীবাদী ও সংস্কারবাদী প্রভাবের ফল। একদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের রণনীতি এবং অন্যদিকে জেলখানার মধ্যে অর্থনৈতিক দাবী এবং ঐ জাতীয় অন্যান্য সুযােগ সুবিধার জন্যে অনশন, এ দুইয়ের মধ্যে ছিলাে সামঞ্জস্যের একান্ত অভাব। এর দ্বারা তাদের চিন্তার অপরিচ্ছন্নতা এবং কর্মকৌশলের মূলগত ভ্রান্তিই ধরা পড়ে।
৬। জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিক্রি হয়ে জেলখানার মধ্যে অনশন এবং নানা অ্যাকশনের ফলে বিপুল সংখ্যক পার্টিকর্মী ও নেতাদের মনােৰল একেবারে ভেজে পড়ে এবং তার ফলে তাদের মধ্যে আসে চরম হতাশা। এই অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে পরবর্তী পর্যায়ে তাদের অধিকাংশই সশস্ত্র বিপ্লব অথবা অ্যাকশনের চিন্তাকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে কেবলমাত্র গণসংগঠনের মধ্যে নিজেদের কাজকে সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন। পার্টির নীতি এবং কৌশলও সেই অনুসারে নির্ধারিত হয়। | চীনা কমিউনিস্ট পার্টির উপদেশ ও কমিনফর্যের নোতুন সিদ্ধান্ত এবং পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নানা ব্যর্থতার পর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও তাদের রণনীতি ও কার্যসূচী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। এবং এই সিদ্ধান্ত পাটিগতভাবে গৃহীত হয় ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জেলার নির্ধারিত প্রতিনিধিদের একটি কনফারেন্সে।
এই কনফারেন্সের পর পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গণসংগঠন ও গণসংযােগের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরােপ করে এবং এই কর্মসূচীকে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে পরবর্তী পর্যায়ে আওয়ামী লীগ প্রভৃতির মধ্যে উপদলীয় কাজ এবং যুব লীগ প্রভৃতি গণসংগঠনের মধ্যে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এইভাবে তারা প্রথম পর্যায়ে জনগণ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ এবং পরবর্তী পর্যায়ে সশস্ত্র সংগ্রামের নীতিকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে পেটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিকে ঝুকে পড়ে।
এই দুই ঝোকই ছিলাে একই সংশােধনবাদী বিচ্যুতির বিবিধ প্রকাশ । প্রথম পর্যায়ে জনগণ থেকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে গণসংগঠনের অর্থনীতিবাদী ও সংস্কারবাদী কাৰ্যসূচীর বেড়াজালে আটকা পড়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রায় বিলুপ্তির পথে এগিয়ে দেন। এবং এই অবস্থা কাটিয়ে উঠে সঠিক রণনীতি ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করতে তাদেরকে পরবর্তী পর্যায়ে দীর্ঘদিন ধরে অনেক নােতুন নােতুন অভিজ্ঞতা ও আভ্যন্তরীণ সংকট উত্তীর্ণ হতে হয়।
২১. ৭. ১৯৭০
362

Previous