অলি আহাদ ১২১, কে,এম, দাস লেন, ঢাকা। | “প্রজাতন্ত্র দিবস যাহা নাকি পাকিস্তান দিবস তাহাতে অংশ গ্রহণ না করার প্রস্তাবে আমি মর্মাহত ও বিস্মিত। সংবিধানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে পাকিস্তান দিবসে অংশ গ্রহণ করা হইতে বিরত থাকার পর্যায়ে পর্যন্ত টানিয়া নেওয়া সমীচীন নয়। এই দুইটি ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। পাকিস্তান দিবস সারা বিশ্বেই পালিত হইবে। চল্লিশটিরও অধিক সংখ্যক দেশ হইতে এই দিবসে অংশগ্রহণের জন্য প্রতিনিধিবর্গ এখানে আসিতেছেন। এই অনুষ্ঠান হইতে পূর্ব পাকিস্তানের বিল্লি পাকিস্তানের আদর্শকে বিপর্যস্ত করিবে। তােমাদের প্রস্তাব পার্টির লক্ষ্যকেও বিপর্যস্ত করিবে। সাময়িক সুবিধার জন্য স্থায়ী আদর্শকে বিনষ্ট করিও না। ক্ষমতাই পাকিস্তান নয়, ইহা সাময়িক ব্যাপার। প্রজাতন্ত্র দিবস হইতেছে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠান-পার্টির অনুষ্ঠান নয়। এই অনুষ্ঠান হইতে তোমাদের বিরত থাকাটা মারাত্মক ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি করিতেছে এবং ইহাকে প্রজাতন্ত্রের বিরােধিতা হিসাবে চিহ্নিত করা হইতেছে যদিও প্রকৃতক্ষেত্রে কথার চাইতে কাজই বড়। সংবিধানের সংশােধন করা যাইতে পারে। প্রজাতন্ত্র দিবস একটি জাতীয় দিবস যা প্রতি বত্সরই উদ্যাপিত হইবে। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত গ্রহণ দুঃখজনক। প্রজাতন্ত্র দিবসকে এই প্রজাতন্ত্রের জন্মদিবস হিসাবে • পালন করার জন্য সত্যিকার দেশপ্রেমিক হিসাবে তােমাদের প্রতি আমার আবেদন রইল। বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য এবং এই দিবস উদযাপনে নির্দেশ জারি করার জন্য আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাই- উদযাপনকালে সংবিধানের বিরুদ্ধে তোমাদের বিক্ষোভ, জোরের সাথে প্রকাশ করিতে পার। এই বিষয়ে সবকিছুই এখন ঝুঁকির মুখে।
প্রজাতন্ন দিবস উদযাপন হইতেছে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান-দশীয় অনুষ্ঠান নয়। সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য ইহা এক উত্তম যুক্তি হইতে পারে।”
করাচী সদর নাইট পােস্ট ১৭-৩-৫৬, অলি আহাসি, আওয়ামী লীগ, সিম্পসন রোড।
“সােহরাওয়ার্দী অম্লান বদনে স্বীকার করিতে হইবে, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী ও জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র ৬ মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণীত ও গৃহীত হইয়াছিল এবং ১০ বৎসরে দেশ সর্বপ্রথম সংবিধান পাইয়াছিল। সংবিধান মােতাবেক গণপরিষদ অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় পরিষদে রূপান্তরিত হয়। শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক এক বিবৃতিতে গভর্ণর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে খাটি বাঙ্কালী” সার্টিফিকেট দিয়া পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করেন ও বিনিময়ে তিনি উর্দু ভাষী রাষ্ট্রপ্রধান ইস্কান্দার মীর্জা কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত হন। অথচ ইহা কাহার অজানা যে, শেরে বাংলার মত বিশাল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য গভর্ণর পদ ছিল তুচ্ছ। পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সংকট
পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যাভাবজনিত দুর্ভিক্ষ রােধকল্পে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট হইতে ৫০ কোটি টাকা আদায়ের দাবীতে মওলানা ভাসানী ৭ই মে (১৯৫৬) হইতে অনশন ধর্মঘট
আরম্ভ করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বসন্ত কুমার দাস ৭ই মে (১৯৫৬) নিম্নোক্ত লিপিতে মওলানা ভাসানীকে অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানঃ
বন্ত কুমার দাস এম,এল,এ, এমপি এডভােকেট, সুপ্রীমকোর্ট অব পাকিস্তান,
ঢাকা হাইকোর্ট
ঢাকা-৭৫/৫৬ ইং। আদাব পর নিবেদন এই, | মৌলানা সাহেব, আপনি অনশত গ্রহণ করিয়াছেন জানিতে পারিয়া খুবই উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িয়াছি। আপনি যে মহান উদ্দেশ্য নিয়া এই কঠিন ব্রত গ্রহণ করিয়াছেন, প্রতি আমার সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও আমি মনে করি যে, জাতির এই সংকট মুহূর্তে আপনার এই মুল্যবান জীবনকে এইভাবে বিপন্ন করিয়া জাতির ভবিষ্যতকেই বিপন্ন করিতেছেন। সেই জন্য আমার একান্ত অনুরােধ, আপনি এই অনশন হইতে বিরত হউন। আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে, আমাকে আগামীকাল সকালেই অন্যত্র যাইতে হইতেছে। নতুবা আমি আপনার নিকট উপস্থিত হইয়া আপনাকে এই ঐকান্তিক ‘অনুরােধ জ্ঞাপন করিতাম।
মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।
নিবেদক বসন্ত কুমার সি।।
পূর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সংকট ক্রমশঃই দুর্ভিক্ষের রূপ ধারণ করিতে থাকে। চতুর্দিকে ভূখা মিছিল। এমনি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ১৯ ও ২০শে মে (১৯৫৬) ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বিম্বিরাজনৈতিক দলের সমবায়ে ঐক্যবদ্ধ দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ আন্দোলন সংগঠিত করিবার প্রস্তাবের প্রশ্ৰেসংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুন্সিবুর রহমানের সহিত আমার প্রত্যক্ষ মতভেদ দেখা দেয় এবং শেখ সাহেবের তীব্র বিরােধিতার কারণে সর্বদলীয় খাদ্য আন্দোলন প্রস্তাবটি কাউন্সিল কর্তৃক বাতিল হইয়া যায়। অবশ্য পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ও বাগদান চুক্তি সংস্থা হইতে সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবীতে পেশকৃত আমার প্রস্তাব কাউন্সিল গ্রহণ করে। নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ইহাতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং আমাকে তলব করিয়া আমার নিকট হইতে কৈফিয়ৎ চনি। আমি হার নিকট মসজ্যিবাণী চক্রান্ত সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ১৯৫৩ সালের ময়মনসিংহ কাউন্সিল অধিবেশন হইতে পূর্বাপর ধারাবাহিক বিরােধী ভূমিকা উল্লেখ করিয়া নতশিরে দাঁড়াইয়া রহিলাম। সােহরাওয়ার্দী সাহেব বিদগ্ধ ব্যক্তি, আমার গুরুজল। সুতরাং তাহার কটু গম্ভব হজম করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। | সাংবিধানিক বিধান মােতাবেক মার্চ-এপ্রিল-এর স্থলে আর্থিক বসর জুন-জুলাই, হইতে প্রবর্তিত হয়। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর হইতে পর্ণরের সার্টিফিকেটক্রমে মুখ্য স্ত্রী আৰু
হােসেন সরকারই বাজেট বরাদ্দ পাস করাইয়া আর্থিক দায়-দায়িত্ব সমাধা করিতেছিলেন। অবশেষে রাষ্ট্রপ্রধান ইস্কান্দার মীর্জা ও প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলী গভর্ণর শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হককে ৩০শে আগস্টের মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহবানের নির্দেশ দান করেন। বিরােধীদলের অনাস্থা প্রস্তাব ভয়ে ভীত ও শংকিত মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ৩০শে আগট (১৯৫৬) গভর্ণর সমীপের্ত্যাহার ও আঁহার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টায় প্রতিরোজই ভুখা মিছিল চলিতেছিল। জনতা দিন দিন হইয়া উঠিতেছিল মারমুখি। বিস্ফোরণােনুষ এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ৪ঠা আগস্ট জিনজিরা এলাকা হইতে আপত এক বিরাট ভুখা মিছিল নদী অতিক্রম করিয়া ঢাকার চকবাজারে প্রবেশ করিলে, পুলিশ ভুখা জনতার উপর গুলী চালনা করে এবং পুলিশের গুলীতে অকুস্থলেই তিনজন নিহত হয়। বাজেট পেশ করিবার জন্য আহূত ১৩ই আগস্টের পরিষদের অধিবেশন পশুর শেরে বাংলা অত্যক্ত অযৌকিভাবে বন্ধ ঘােষণা করেন। শেরে বাংলা তর্ণীয় দল কৃষক শ্রমিক পার্টি নেতা আবু হােসেন সরকারের মন্ত্রীসকে বিরােধী দল আওয়ামী লীগের অনাস্থা প্রস্তাবের মুখে অবধারিত পরাজয় হইতে রক্ষা করিবার জন্যই যে এই অন্যায় পদক্ষেপটি গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা না, বলিলেও চলে। ইহার দরুনই হেসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ১৭ই আগস্ট ঢাকা অবস্থানকালে শাসক মহলের উদ্দেশে এই মর্মে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছিলেন যে, “History records that it is an axiom that unconstitutional conduct on the part of the rulers breeds unconstitutional reaction on the part of the people, If for the rulers there is dictatorship, for the people there is civil disobediencc.” অর্থাৎ ইতিহাসের সাক্ষ্য, ইহা একটি স্বতঃপ্রতীয়মান সত্য যে, শাসক মহলের অনিয়মতান্ত্রিক আচরণই জনতা কর্তৃক অনিয়মতান্ত্রিক পথে প্রতিহিংসা গ্রহণের কারণ। শাসক মহলের মন্ত্র একনায়কত্ববাদ হইলে, তদুত্তরে জনতার মন্ত্র হইবে আইন অমান্য।” সােহরাওয়ার্দীর উচ্চারিত সতর্কবাণীর অব্যবহিত পর পরই ২২শে আগস্ট রাষ্ট্রপ্রধান কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রীকে ৩০শে আগস্টের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন ডাকার নির্দেশ দেন।
৪ঠা সেপ্টেম্বর গভর্ণর শেরে বাংলার সরকার ভুখা মিছিলের উপর গুলীবর্ষণ করে এবং পুলিশের গুলীতে চারজনকে প্রাণ দিতে হয়। বিচলিত গভর্ণর শেরে বাংলা বাধ্য হইয়া প্রাদেশিক পরিষদে বিরােধী দল আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খানকে সরকার। গঠনে আহবান করেন। নিহতদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপনের জনা ও গুলীবর্ষণের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৫ই সেপ্টেম্বর এক বিরাট জঙ্গী মিছিল সমগ্র ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির জরুরী বৈঠকে গভর্ণর কর্তৃক সরকার গঠনের আমন্ত্রণ আলােচিত হয়। সংগঠনের সভাপতি মাওলানা ভাসানীকে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণে অনুরােধ জানানাে হইলে, তিনি সরকার গঠনের জন্য আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী দলের নেতা আতাউর রহমান খানকে দায়িত্ব দেন। ৬ই সেপ্টেম্বর জনাব আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রীদল, কৃষক শ্রমিক পার্টি (কফিল উদ্দিন চৌধুরী উপদল) সমবায়ে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ করান। পরবর্তীকালে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস, ইউনাইটেড প্রােগ্রেসিভ পার্টি ও (ধীরেন দত্ত গ্রুপ) আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারে যােগ দেয়। ভাসানীর অবদানঃ শেখ মুজিবের সাধারণ সম্পাদক পদ | মাওলানা ভাসানীর বর্ণনাতীত ও অপরিসীম ত্যাগ এবং কঠোর পরিশ্রমই আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ক্ষেত্রে শীর্ষস্থান দখলে সক্ষম করে। অত্যাচারী জালেম মুসলিম লীগ সরকারের আমলে শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক সরকারী চাকুরী এডভোকেট জেনারেল পদ গ্রহণ করেন। জনাব আতাউর রহমান খান স্বীয় ওকালতি পেশায় অধিকাংশ সময়ই মগ্ন ও স্বীয় পরিবার-পরিজনদের তত্ত্বাবধানে ব্যস্ত ছিলেন। অবসর মুহূর্তে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করিতেন। ফলে, সরকারী অত্যাচার, নির্যাতন, জেল-জুলুম, আর্থিক কষ্ট ভোগ সবকিছুই সহ্য করিতে হইত সর্বত্যাপী মওলানা ভাসানীকেই। মজলুম নেতার উপযুক্ত পার্শ্বচর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তরুণ নেতা শামসুল হক ও যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫২ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকাবস্থায় জনাব শামসুল হক মানসিক ভারসাম্য হারাইয়া ফেলেন ও মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত অবস্থায় কারামুক্তি লাভ করেন। জনাব শামসুল হক ১৯৫২ সালে কারান্তরাল থাকা বিধায় যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। কারামুক্তির পরও মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়া না আসায় ১৯৫৩ সালে ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ অধিবেশনে সভাপতি মাওলানা ভাসানীর অনুরােধক্রমে জনাব শামসুল হকের স্থলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। মানসিক ব্যাধি হইতে আরােগ্য লাভ না করায় রাজনৈতিক গগন হইতে জনাব হকের মত একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র খসিয়া পড়ে। ১৯৪৯ সালের ২৬শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকারের হীন কারসাজি জনাব শামসুল হককে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যপদ হইতে বঞ্চিত করিয়াছিল। অতঃপর ঘন ঘন কারা নির্যাতন তাহার স্বাভাবিক লীবনযাপন ব্যাহত করিতে থাকে এবং এইভাবেই একদিন মানসিক বিস্মৃতির অতল গহবরে তলাইয়া যান। অথচ এই তরুণ নেতা শামসুল হক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর ১৯৪৭ সালে যুব সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করিবার মহান দায়িত্বে উযুদ্ধ হইয়া পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ইউথ লীগ গঠন করিয়াছিলেন। অতঃপর তিনি বিরােধী দল গঠনের প্রয়ােজনীয়তায় মওলানা ভাসানীকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনে সর্বোতভাবে সক্রিয় সহবােপিতা দান করেন। ইহা অনস্বীকার্য যে, মজলুম নেতা পূর্বপাক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করিলে বলিষ্ঠ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের অভাবে মুসলিম লীগের চন্ডনীতির আঘাতে সংগঠনের সকল প্রচেষ্টাই বােধহয় দারুণভাবে অপমৃত্যু বরণ করিত। মাওলানা ভাসানী ছিলেন রাজনৈতিক দিগন্ধে এক দিক নির্দেশক ধ্রুবতারা’। পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এমন কোন শক্তি বা দল বা ব্যক্তি নাই, যিনি বা যারা কোন না কোন সময় ময়লুম নেতার ছায়ায় আশ্রয় গ্রহন করেন নাই । সংকটময় প্রতিকূল পরিস্থিতিও আবহাওয়ায় মজলুম।
নেতা- মওলানা ভাসানী সকল মত ও পথালী রাজনীতিকদের একমাত্র নিরাপদ ও নির্ভরশীল আশ্রয়স্থান ছিলেন বটে, তবে কেহই তাহার নির্দেশিত পথ বা নেতৃত্ব গ্রহণ করেন নাই। স্বীয় মত ও পথের অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হইলেই তাহারা অত্যন্ত নগ্নভাবে জাষ্ঠীয় নেতা মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করিতেন। যদিও খর প্রৌদ্রতাপে উত্যক্ত পথিকন সুশীতল ছায়া ভােগ করে, ‘তবুও স্বীয় স্বার্থবুদ্ধি প্রণােদিত ছায়াভােগী মানব সন্তানই ছায়া প্রদানকারী বটবৃক্ষ কর্তনে মােটেও ইতস্ততঃ করে না। জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীকেও বিভিন্ন সময়ে আশ্রয় গ্রহীতাদের আক্রমণের শিকারে পরিণত হইতে হইয়াছিল। বন্দী মুক্তির নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত | জনাব আতাউর রহমান খান মুখ্যমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াই কোন প্রকার টালবাহানা ছাড়াই ২১ দফা ওয়াদা মােতাবেক জননিরাপত্তা আইন বাতিল ঘােষণা করেন এবং বিনাবিচারে আটক সকল রাজবন্দীর মুক্তির আদেশ দেন। শুধু তাই নয়, ৮ই সেপ্টেম্বর (১৯৫৬) তিনি তাঁহার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ সমভিব্যাহারে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার ফটকে উপস্থিত হইয়া ৫৯ জন রাজবন্দীকে মুক্তিদান করিয়া তাহাদিগকে মুক্ত আবহাওয়ায় অভ্যর্থনা জানান। ইহা একটি নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত এবং এই ঘটনা বন্দীমুক্তির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে।
কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার | প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর ক্ষমতা খর্ব করিবার প্রয়াসে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ইঙ্গিতে সীমান্ত প্রদেশের কংগ্রেস নেতা ডাঃ খান সাহেবের প্রচেষ্টায় রিপাবলিকান পার্টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির অধিকাংশ সদস্যই রিপালিকান পার্টিতে যােগদান করেন। মুসলিম লীগ সদস্যদের অদ্ভুত আচরণে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলী মুসলিম লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর পদ হইতে পদত্যাগ করত। নেজামে ইসলাম পার্টিতে যােগদানের কথা ঘােষণা করেন।
চৌধুরী মােহাম্মদ আলী পদত্যাগ করিলে কেন্দ্রে জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রিপাবলিকান কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং ১২ই সেপ্টেম্বর জনাব সােহ্নত্রাওয়ার্দী ও তাহার মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করেন। জনাব সােহরাওয়ার্দীর ত্বরিত ব্যবস্থার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য সরবরাহ ত্বরান্বিত হয়। ইহার ফলেই পুর্ব পাকিস্তানের খাদ্য সংকট তথা দুর্ভিক্ষাবস্থা কৃতিত্বের সহিত মােকাবেলা করা সম্ভব হয়। আবু হােসেন সরকারের দলীয় সদস্যবর্গ ক্ষমতার উচ্ছিষ্টে গাড়ী, বাড়ী, পারমিট, লাইসেন্স, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারী খাস জমিজমা ইত্যাদি কজা করিবার মত জঘন্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন বিধায় দুঙিক্ষাখা মােকাবেলার দায়িত্ব বেমালুম ভুলিয়া গিয়াছিলেন। অতীব পরিতাপের বিষয় এই যে, মন্ত্রী মেম্বার হইবার পর পরই ঢাকার অভিজাত এলাকায় তাহাদের বাড়ীঘর হয়। স্বােপার্জিত আর্থিক সঙ্গতি থাকিলে মন্ত্রী-মেম্বার হইবার পূর্বে এই পর্বটি সমাধা হইতে বাধা কোথায়?
চীন মৈত্রী সমিতির তরফ হইতে ২৯শে ডিসেম্বর (১৯৫৬) ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে মহাচীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই-এর সম্বর্ধনা দান উপলক্ষে এক মনােজ্ঞ বিচিত্রানুষ্ঠানের আয়ােজন করি। সেই সুযােগে এই অনুষ্ঠানে প্রমানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই-এর সহিত আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়। অনুষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা, আমন্ত্রণ ইত্যাদির মােটামুটি দায়িত্ব পাকচীন মৈত্রী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরী আমার উপর ন্যস্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং সকল প্রকার অপ্রিয় কাজকর্মকলি আমাকেই সমাধা করিতে হইয়াছিল। গুলিস্তান হলে আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দের জন্য পূর্ব হতেই আসন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব হায়দার তাহার প্রভূসুলভ মানসিকতা নিয়ে বৈদেশিক দূতাবাসের প্রতিনিধিদের নির্ধারিত আসনে বসিয়া পড়েন। তাঁহাকে বার কয়েক বিনীত অনুরােধ জানাই। কিন্তু দাম্ভিকতার দরুন তিনি আসন ত্যাগ করিতে সম্মত হন না। তখন বাধ্য হইয়াই বেশ। কড়া মেজাজে তাঁহাকে আসন ত্যাগ করিতে আদেশ দেই। এইবার ভিজা বিড়ালের ন্যায় তাহাকে সেই আদেশ পালন করিতে হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজ্বন যে, পাক-চীন মৈত্রী সংস্থা (Pak-China Friendship Society) ১৯৫৬ সালের ২রা নভেম্বর টিচার্চ ট্রেনিং কলে হলে এক সভার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্থার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খান এ সম্পাদক ছিলেন। জনাব জহুর হােসেন চৌধুরী। সংস্থার প্রথম সভা বাংলা একাডেমীতে (বর্ধমান হাউস) ১৯৫৬ সালরে ১৩ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
সুয়েজ খাল জাতীয়করণ
| ২৬শে জুলাই (১৯৫৬) মিসরে প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্থনীতির প্রয়ােজনে নীল নদের উপর আসােয়ান বাঁধ নির্মাণের ব্যয় নির্বাহের কারণেই তাহাকে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করিতে হইয়াছিল। পূর্বাহ্নে স্বীকৃত হইয়াও পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক আসােয়ান হাইড্যাম নির্মাণকল্পে পুঁজি বিনিয়ােগে অস্বীকৃতি জানাইলে বাধ্য হইয়াই প্রেসিডেন্ট নাসের উপব্রোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, একশত তিন মাইল দীর্ঘ সুয়েজ খালটি ফরাসী নাগরিক ফার্ডিন্যান্ড দ্য লেসেপস ১৮৫৯ সালের ১লা এপ্রিল খনন শুরু করেন ও ১৮৬৯ সালের ১৭ই নভেম্বর উক্ত ফলে জাহাজ চলাচল রু হয়। ১৮৭৫ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডিক্সবেইলী মিসরের শাসনকর্তা খেলিব ইসমাইল হইতে চল্লিশ লক্ষ স্টালিং পাউন্ড মূল্যে সুয়েজ খালের শেয়ার ক্রয় করিয়া ইংগ-ফরাসী যৌথ মালিকানার সূত্রপাত করেন। তাই বৃটিশ ও ফরাসী সরকার ইসরাইলের সহায়তায় আন্তর্জাতিক নদীপথ সুয়েজ খালটির আয়ের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব রক্ষার বদমতলবে সুয়েঞ্জ খাল কোম্পানী জাতীয়করণের তিন মাসের মধ্যে মিসরের উপর সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে। ইসরাইল ২৯শে অক্টোবর (১৯৫৬) সিনাই উপদ্বীপ দখল করে বৃটেন ও ফ্রান্স ৩১শে অক্টোবর (১৯৫৬) মিসরের রাজধানী কায়রােতে বিমান হামলা ও বােমাবর্ষণ করে। মিসরের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী হামলার প্রতিবাদে ঢাকা শহর বিক্ষোভ মিছিলের শহরে পরিণত হয়। এমনকি ৩রা নভেম্বর (১৯৫৬)।
এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত ও উত্তেজিত জনতা পুরানাে পল্টনস্থ বৃটিশ ইনফরমেশন সার্ভিস ভবনটি অগ্নিসংযােগে ভস্মীভূত করিয়া দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্দার অস্তরাল হইতে ইংগ-ফরাসী শক্তিদ্বয়কে সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে তাহার কঠোর মনােভাব জানাইয়া দেয় এবং সােভিয়েট রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকিতা কক্ষে প্রকাশ্য চরমপত্রে ঘােষণা করেন যে, সশস্ত্র আক্রমণ বন্ধ না করিলে রাশিয়া পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইবে। বিশ্বজনমত ও এই দুই মহাশক্তিয়ের কঠোর মনােভাবের নিকট ইংগ-ফরাসী সরকারদ্বয় নতি স্বীকার করিয়া ১২ই নভেম্বর (১৯৫৬) সশস্ত্র হামলা প্রত্যাহার করিতে বাধা হয়। সংকটময় এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী এক অস্পষ্ট, অপরিচ্ছন্ন ও দ্বাৰ্থবােধক ভূমিকা গ্রহণ করেন। এমনকি সুয়েজ সমস্যার উপর ১২ই নভেম্বর দিল্লীতে আহূত কলম্বাে শক্তিসমূহের (Colombo Powers) সম্মেলনে আমন্ত্রণ গ্রহণ করা সত্ত্বেও ইরানের রাজধানী তেহরানে আহুত বাগদান প্যাক্ট কাউন্সিল সভায় যােগদানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাসহ তিনি তেহরান গমন করেন। ফলে জাতিসংঘ কর্তৃক সুয়েজ খাল এলাকায় প্রেরিতব্য ‘আন্তর্জাতিক পুলিশ ফোর্সে পাকিস্তান সৈন্য পাঠাইতে চাহিলে মিসর পাকিস্তানী সৈন্য গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী কায়রাে সফরের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুন নাসের অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত নীতি বস্তুতঃ আরব জাহানে পাকিস্তানকে বিরাগভাজন রাষ্ট্র পরিণত করে। এইদিকে দিল্লীতে আহূত কলম্বাে পাওয়ারস সম্মেলনে যােগদান না করায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান একঘরে হইয়া পড়ে। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর বিস্ময়কর এই ভূমিকা অগ্রাহ্য করিয়াই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান প্রকাশ্য বিবৃতির দ্বারা মিসরের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানান। মওলানা ভাসানী ৯ই নভেম্বরকে মিস দিবস’ হিসাবে ঘােষণা করেন ও আওয়ামী লীগ সরকার ‘মিসর দিবসকে সরকারী ছুটির দিন হিসাবে ঘােষণা জারি করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এই বিষয়ে ভিন্ন মত পােষণ করা সত্বেও অবস্থার চাপে উল্লিখিত কর্মসূচীর বিরোধিতা করা হইতে বিরত থাকেন। আওয়ামী লীগ ভাঙ্গনের সূচনা
বৈদেশিক নীতিকে কেন্দ্র করিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লগ ক্রমশঃ দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে। গদিতে আসীন হইবার পর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্রাজ্যবাদ বিরােধী ভূমিকা বিস্মৃত হইয়া মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতির সহিত একাত্মতা প্রকাশ করিতে থাকেন। পুর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রচার সম্পাদক যথাক্রমে মওলানা ভাসানী, আমি ও অধ্যাপক আবদুল হাই ১৯৫৩ সাল। হইতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্বপাক আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরােধী পররাষ্ট্র নীতির প্রতি অবিচল ও অটলভাবে অনুগত রহিলাম। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ শ্রম সম্পাদক ও পরিষদ সদস্য আবদুস সামাদ তাহার স্বভাবসুলভ দোদুল্যচিন্তার কারণে কখনও মন্ত্রীদের কাতারে কখনও সংগঠনের কাতারে ছিলেন।
উপ নির্বাচন
১৯৪৭ সাল হইতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের শুনা ৩৫টি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান না করিয়া গণতন্ত্রের অঙ্কুরােদগমনকালেই কুঠারাঘাত হানিয়া সর্বনাশের সূচনা করিয়া যান। তাই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি ২১ দফা ওয়াদার অন্তর্ভূক্ত করে।
নানুযায়ী ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াই আওয়ামী লীগ উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। উপনির্বাচন প্রাক্কালে খাদ্য সংকট নিরসনে ব্যর্থ হইয়া যুক্তফ্রন্ট মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকার পদত্যাগ করিলে তদস্থলে আতাউর রহমান খান দুর্ভিক্ষাবস্থায় ক্ষমতা গ্রহণ করেন ও প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর সহায়তায় অত্যন্ত দক্ষতার সহিত খাদ্য সংকট মােকাবেলা করেন। আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার কর্তৃক সফল খাদ্য সংকট সমাধানই ১০ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীর বিপুল ভােটাধিক্যে জয়ের অন্যতম কারণ। সংগঠন সভাপতি মাওলানা ভাসানী ৭টি উপনির্বাচন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনােনয়নের জন্য জনমত যাচাই করিবার নিমিত্ত শেখ মুন্সির রহমান, ইয়ার মোহাম্মদ খান ও আমাকে লইয়া তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করিয়া দিয়াছিলেন। উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পণতন্ত্রের ভিত্তি সদঢ় করিবার প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং এইভাবেই ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদল হিসাবে তাহাদের দেয় ২১ দফা ওয়াদার ২১তম ওয়াদাকে রক্ষা করে। যুব উৎসব | ১৯৫৭ সালের ৪ঠা হইতে ৭ই জানুয়ারী রংপুর শহরে পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগ যুব উৎসব উদযাপন করে। উক্ত যুব উৎসবে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রীসভার সদস্যবয় সর্বজনাব খরাত হোসেন, মশিউর রহমান ও মাহমুদ আলী অংশগ্রহণ করিয়া যুব সমাজের অনন্য প্রচেষ্টাকে উত্সাহদান করেন। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমিও যুব উৎসবে যােগ দেই। বিভিন্ন এলাকা হইতে আগত অসংখ্য যুব প্রতিনিধির সমাবেশ ও প্রাণচাঞ্চল্য আমাকে অভিভূত ও আত্মহারা করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ না করিয়া পারিতেছি না যে, ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ আমাকে কারান্তরালে থাকা অবস্থায়ই ইউথ স্টার’ সম্মানে ভূষিত করিয়াছিল। এই ধরনের উৎসব যুবকদের মন ও মানসিকতার উন্নতি ঘটায়, নির্মল করে ও তাহাদের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় করে। এতদ্বারা তাহাৱা নীতি ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, স্বীয় কর্মক্ষমতার প্রতি প্রত্যয় ও পরস্পরের প্রতি মমত্ববােধের শিক্ষা লাভ করে।
পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ১৯৫১ সালের ২৭শে ও ২৮শে মার্চ ঢাকায় দুই দিনব্যাপী অধিবেশনের মাধ্যমে গঠিত হয়। জন্মলগ্ন হইতেই পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নির্ভীক, সচ্চরিত্র, আত্মত্যাগী, আদর্শ নিষ্ঠা ও সংগ্রামী যুব সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। দলমত নির্বিশেষে যুব সমাজ পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের গণতান্ত্রিক মঞ্চে ধীরে ধীরে সংঘবদ্ধ হইতে থাকে। এইভাবেই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, মুসলিম লীগ, ছাত্র।
ফেডারেশন, বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, আত্মগােপনকারী কমিউনিষ্ট পার্টিও নির্দলীয় যুব কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তান যুব লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়। উপরোল্লিখিত সংগঠনগুলির যুবকৰ্মী শ্ৰণী স্ব স্ব সংগঠনের নেতৃত্বের সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী ও কোন কোন স্কুলে কায়েমী স্বার্থ প্রভাবান্বিত কার্যক্রমকে স্ব স্ব ধ্যান-ধারণা পরিপন্থী জ্ঞান করিত এবং প্রায়শঃ স্বীয় বিবেক ও নীতিজ্ঞানকে দলীয় শৃঙ্খলার যুপকাষ্ঠে বলি দিয়া দেশ ও জাতির চরম ক্ষতির কারণ হইত। উপরােক্ত কারণে যুবকৰ্মী শ্রেণী মর্মপীড়া ও বিবেক দংশনে হতােদ্যম হইয়া পড়িতেছিল ও প্রখর গণতান্ত্রিক চেতনা হারাইয়া ফেলিতেছিল। এহেন সংকটময় মুহূর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ” এক নব আশার সঞ্চার করে। ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রশ্নে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ, পাকিস্তান
মন্দুন মজলিস ও আওয়ামী লীগ প্রভাবাম্বিত গণসংগঠনের নেতারা আপােষকামিতার ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন, তদাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ২১ শে ফেব্রুয়ারী ও পরবর্তী দিনগুলিতে নির্ভীক, সগ্রামী ও সচেতন নেতৃত্ব না দিলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করিত না বরং করাচী শাসকচক্রেরই জয় সূচিত হইত। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কারণেই বাঙালী মন ও মানসিকতার স্বকীয় সত্ত্বাবােধ পুরাপুরি জাগ্রত হয়। বলাই বাহুল্য যে, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে জাগ্রত এই সত্ত্বাবােধই হইল বাংলাদেশের সৃষ্টির সূচনা এবং নব জাতীয়তার মৌলিক ভিত্তি।
পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগকে আপামর জনসাধারণের যুব সংগঠনে পরিণত করিবার ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কারারুদ্ধ হওয়ায় অতীব দুঃখের সহিত স্বীকার করিতে হয় যে, আমার সেই স্বপ্ন সফল হয় নাই। তাহাছাড়া তদানীন্তন আত্মগােপনকারী কমিউনিষ্ট পার্টি কর্তৃক যুবলীগের উপরে তাহাদের নেতৃত্ব, কর্মসূচী ও সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিবার অযৌক্তিক প্রবণতা ও প্রচেষ্টা সাধারণ যুৱশ্রেণীর মধ্যে তি ও সন্দেহের উদ্রেক করিয়াছিল। ফলে, ক্রমশঃ আপমির যুব সাধারণের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনে পরিণত হইবার সুযােগ ও শক্তি যুবলীগ হারাইয়া ফেলে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে যুবলীগ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত হয় ও আত্মগােপনকারী কমিউনিষ্ট পার্টির নির্দেশাবলী পালনের মুখপাত্র সংগঠনে পর্যবসিত হয়। তাই কারামুক্তির পর আমি কার্যতঃ যুবলীগের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করি। কেননা, যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ইহার জন্মলগ্ন হইতেই আমি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক যুব সমাজকে সংগঠিত করিবার প্রচেষ্টায় ব্রতী হইয়াছিলাম বটে কিন্তু এতদপ্রয়াসে কোন আন্তর্জাতিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করিবার আমি ঘাের বিদ্রোর্থী ছিলাম।
কাগমারী সম্মেলন
সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী কাগমারীতে ৭ ও ৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৫৭) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করেন। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন ছিল বিধায় উল্লেখিত অধিবেশনটি
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তদুপরি এই সময়ে বৈদেশিক নীতি বিশেষ করিয়া পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদন ও সামরিক চুক্তি সম্পাদনসমূহ যথা ‘দক্ষিণপূর্ব এশিয়া সামরিক চুক্তি সংস্থা ও বাগদাদ চুক্তি সংস্থার সদস্যভুক্তির প্রশ্নে মাওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর মতদ্বৈততা চরম আকার ধারণ করিয়াছিল বিধায় এই অধিবেশনের বিশেষ গুরুত্ব দেখা দিয়াছিল। ইতিপূর্বে ৯ই ডিসেম্বর (১৯৫৬) সলিমুল্লাহ মুসলিম হল মিলনায়তনে এক ছাত্র সভায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ালা সামরিক চুক্তির স্বপক্ষে জোরালাে বক্তব্য পেশ করেন। ইহা ছিল আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তির বিরােধী ভূমিকার পরিপন্থী। সােহরাওয়ার্দীর বাগদাদ চুক্তি সমর্থনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী তীব্র প্রতিবাদ জানাইলে অনাৰ সােহরাওয়ার্দী াহাকে (ওসমানী) পদত্যাগের নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এক সভা আহবান করা হয় এবং জনাব সােহরাওয়ার্দীর নির্দেশের পাল্টা জওয়াবে বাগদাদ চুক্তি সংস্থা হইতে সদস্যপদ প্রত্যাহার করিবার জন্য উক্ত সস্তা পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহবান জানায়। ১৩ই নভেম্বর (১৯৫৬) অনুষ্ঠিত সভায় পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বাগদাদ চুক্তিভুক্ত শক্তিবর্গের তেহরান সম্মেলনের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালােচনা করে এবং ১৯শে জানুয়ারী (১৯৫৭) করাচী আওয়ামী লীগ সম্পাদক বি,এম,কুটী পদত্যাগ করেন। এই সমস্ত ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে সংগঠন ‘আওয়ামী লীগ কতখানি সোচ্চার ছিল। অবশ্য অকুণ্ঠচিত্তে ইহাও স্বীকার করিতেই হইবে যে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর অনবদ্য কূটনীতির ফলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের সমর্থনে ২৪শে জানুয়ারী (১৯৫৭) জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গণভােটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের আহবান জানায় এই কুটনৈতিক সাফল্যের দরুনই জনাব সােহরাওয়ার্দী দেশের অভ্যন্ডর সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন পাইতেছিলেন।
নানাবিধ কারণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মী, সদস্য ও ভানুধ্যায়ীরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি আস্থা হারাইয়া ফেলিতেছিল। প্রথমতঃ প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত মার্কিন ঘেষা পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক জোটের লেজুড়বৃত্তি ছিল সংগঠনের সাধারণ কর্মীবৃন্দের মর্মপীড়ার কারণ । দ্বিতীয়তঃ ১৯৫৬ সালে প্রবর্তিত সংবিধানে ২১ দফা বর্ণিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত ধারা সংযােজিত না হওয়া। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীদার আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা সচেতন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও ছাত্র-যুব সমাজ খুবই আগ্রহের সহিত লক্ষ্য করিতেছিল। তৃতীয়তঃ ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত গঠনতন্ত্রের ৬৬ ধারা মোতাবেক শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী পদ গ্রহণ করায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদ ত্যাগ করা তাহরি জন্য অবশ্য পালনীয় ছিল। উক্ত ধারায় সুস্পষ্ট নির্দেশ ছিল যে, অন্যথায় এক মাস পরে উক্ত কর্মকর্তার পদ শূন্য বলিয়া অবশ্য গণ্য হইবে। উপরে বর্ণিত তিনটি বিষয়ই প্রধানতঃ সংগঠনের নিষ্ঠাবান কর্মীদিগকে বিচলত করিয়া তুলিয়াছিল। তদুপরি
১৯৫৬ সলের সেপ্টেম্বরে গদিতে আসীন হইবার পর হইতেই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভােগের দুর্দমনীয় লালসায় মন্ত্রীবর্গ স্বল্প সময়ের মধ্যে সংগঠনের গঠনতন্ত্র, সিদ্ধান্ত, নীতি ও আদর্শকে বিসর্জন দিয়া আওয়ামী লীগকে স্বেচ্ছাচারী মন্ত্রীচক্রের লেজুড়ে পরিণত করিবার যে কুটিল পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাতে কর্মী সমাজ উদ্বিগ্ন না হইয়া পারে নাই। সুতরাং কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের ইহাই বিবেচ্য বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছিল যে, কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রীসভার নির্দেশে আওয়ামী লীগ সংগঠন পরিচালিত হইবে কি না অর্থাৎ সংগঠন ক্রমশঃ মন্ত্রী আওয়ামী লীগে পরিণত হইবে, না আওয়ামী লীগের গঠনতম সিদ্ধান্ত, নীতি ও আদর্শের প্রতি অটল আনুগত্য প্রদর্শন করিয়া মন্ত্রীসভা আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসস্তায় পরিণত হইবে।
শেখ মুজিবের আক্রোশ।
এহেন পরিস্থিতিতে ৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৫৭) মওলানা আবুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সম্ভোষ মহারাজার নাটমন্দিরে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। মওলানা ভাসানীর বিশেষ আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দী ওয়ার্কিং কমিটির এই সভায় যােপদান করেন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা ও বাগদাদ চুক্তি সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবীতে ৭ ও ৮ই ফেব্রুয়ারীর কাউন্সিল অধিবেশনে প্রস্তাব গ্রহণ করা হইবে কি হইবে না- এই প্রশ্ন ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ৩৫ ১ ভােটে কোন প্রকার প্রত্মাব আনয়ন না করিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কেবলমাত্র আমি সামরিক চুক্তি বাতিল, সামরিক চুক্তি সংস্থা সমূহের সদস্যপদ প্রত্যাহার ও প্রয়ােজনবোেধ সংগঠনের সিদ্ধান্তের স্বার্থে মন্ত্রীসভার পদত্যাগের পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণে দৃঢ়মত প্রকাশ করি এবং ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমি একা ভােট দান করি। সংবাদটি মার্কিন ঘেষা দৈনিক ইত্তেফাকের ৮ই ফেব্রুয়ারীর (১৯৫৭) সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠার ফলাও করিয়া ছাপান হয়। কাউন্সিল অধিবেশনকে লক্ষ্য করিয়া পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ ও বৈদেশিক নীতি” নামে একটি ক্ষুদ্রাকার পুস্তিকা প্রকাশ করি। তন্মধ্যে ১৯৫৩ সালের ১৪ ও ১৫ই নভেম্বর ময়মনসিংহে, ১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩শে অক্টোবর ঢাকায় ও ১৯৫৬ সালের ১৯ ও ২০শে মে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সামরিক চুক্তি বিরোধী প্রস্তাবাবলী সন্নিবেশিত করি। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়র্দিী কর্তক সংগঠনে গুইত সুস্পষ্ট সিদ্ধাক্তের বিরুদ্ধাচরণ সম্পর্কে দেশবাসীকে অবহিত ও সজাগ হইবার আহবান জানাই। অতীব পরিতাপের বিষয়, সােহরাওয়ার্দী-ভাসানী বৈঠকে মওলানা ভাসানী পররাষ্ট্র বিষয়ে সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে কোন ক্ষৰ আনয়নে বিরত থাকিবার শর্তে সমঝােতা করেন। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে মওলানা ভাসানীর দ্ব্যর্থবােধক ভূমিকাই ইহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সাধারণ কর্মী ও সমর্থকবৃন্দের নিকট উচ্চস্থানীয় নেতৃবৃন্দের লীলাখেলা অনুধাবন কষ্টকর ফলশ্রুতিতে বহু ক্ষেত্রেই তাহাদের রাজনৈতিক জীবনের ঘটে অপমৃত্যু আর দেশবাসীর হয় হাড়ির হাল। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে। ইহ্য দিবালােকের মত প্রতিভাত ছিল যে, সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তিগুলি চীন-রাশিয়া প্রভৃতি।
কমিউনিষ্ট দেশগুলির বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হেফাজতের স্বার্থে নয়। কিন্তু ক্ষমতার নেশায় আত্মহারা মন্ত্রী-মেম্বারগণ সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্বকে যে কোন মূল্যে রক্ষার জন্য যেন বদ্ধপরকর ছিলেন। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত প্রশ্নে ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাধারণ সম্পাদক পদ ত্যাগে অনীহা সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সক্রিয় করিয়া তােলে। জাতীয়তাবাদী, প্রগতিশীল ও আদর্শনিষ্ঠ কর্মীর বিপুলাংশ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সদস্য। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খুঁটার ভূমিকায় অবতীর্ণ শেখ মুজিবুর রহমানের ক্রোধ স্বাভাবিকভাবেই তাহাদের উপরে নিপতিত হয়। তাই তিনি প্রস্তাব আনয়ন করিলেন যে, কোন সদস্য আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের যুগপৎ সদস্য থাকিতে পারিবে না। মওলানা ভাসানী এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করিয়া ওজস্বিনী ভাষায় কয়েক ঘন্টা বক্তৃতা করিলেন বটে, তবে প্রস্তাব গ্রহণ হইতে প্রতিক্রিয়াশীল মন্ত্রী-সমর্থকদের বিরত করিতে পারেন নাই । ভাসানীর আসসালামু আলাইকুম
| ৬ই ফেব্রুয়ারী ওয়ার্কিং কমিটির সভায় মওলানা সাহেব জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীত্ব রক্ষার প্রয়ােজনে সংগঠনের প্রতিষ্ঠিত পররাষ্ট্রনীতি বলি দিয়া সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তিনীতি গ্রহণ করিয়াছিলেন বটে, তবে পরদিন ৭ই ফেব্রুয়ারী কাউন্সিলের উদ্বােধনী অধিবেশনে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিয়াটো চুক্তি সংস্থা (SEATO) ও বাগদাদ চুক্তিসংস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কয়েক ঘন্টা জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। কিন্তু ফল কিছুই হয় নাই । পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ প্রসঙ্গে মস্তব্য করেন যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলে ও সামরিক-বেসামরিক চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে সংখ্যাসম্য নীতি পালিত
হইলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলিবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হইয়া যাইবে। স্মর্তব্য যে, ১৯৫৫ সালের ১৭ই জুন রােজ শুক্রবার অপরাহে ঢাকার পল্টন। ময়দানের জনসভায় সভাপতির ভাষণদানকালেও মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি সাবধানবাণী উচ্চারণ করিয়া ঘােষণা করেন যে, শােষণ-শাসনের মনােবৃত্তি ত্যাগ না করিলে পূর্ব পাকিস্তান আসসালামু আলাইকুম” বলিতে বাধ্য হইবে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান পৃথক হইয়া যাইবে। উক্ত মক্তব্য সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচীতে এক বিরূপ আলােড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল। আদান-প্রদানের রাজনীতি
‘বিষয় নির্বাচনী কমিটি সভায় সভাপতির আসন হইতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ আনিতে চাহেন যে, কাউন্সিল অধিবেশনে পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কিত আমার প্রস্তাবটি আমি উত্থাপন করিতে চাহি কি না? তদুত্তরে আমি বলি যে, “ওয়ার্কিং কমিটি ও বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে আমার প্রস্তাবাবলীর পক্ষে দ্বিীয় কোন সদস্যের সমর্থন অর্জন করিতে ব্যর্থ হইয়াছি, অতএব নিছক শক্তি পরীক্ষার জেদের বশবর্তী হইয়া কাউন্সিল অধিবেশনে আমি আমার প্রস্তাবাবলী উথাপন করিব না। আমার এই বক্তব্যের কারণ এই ছিল যে,
আমি জানিতাম, মজলুম নেতা মওলানা ভাসানীর অব্যবস্থিত চিত্ত ব্যর্থবােধক ভূমিকা ও পলায়নী মনােবৃত্তির কারণে এবং মন্ত্রীবর্গের ঐক্যবদ্ধ জোটের বিরুদ্ধে কাউন্সিল সভায় উপস্থিত সদস্যবৃন্দকে প্রস্তাবের পক্ষে প্রভাবান্বিত করিবার ব্যাপারে আমার একক প্রচেষ্টা শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইতে বাধ্য। অকপট মনে সাধারণ্যে স্বীকার করিতেই হইবে যে, আত্মগােপন অবস্থায়ও কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ কমরেড মনি সিংহ, কমরেড খােকা রায় ও কমরেড় সালাম জাতির সংকটময় মুহূর্তে নীতি-নির্ধারণে ও নীতি-নিষ্ঠা আওয়ামী লীগ সংগঠনে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে প্রভূত সহায়তা করিয়াছে।
যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত নেপথ্যে দেন-দরবার ও আদান-প্রদান রাজনীতি জয়লাভ করে এবং ভাসানী-মুজিব সমঝােতা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীর সংগঠন প্রশ্নে অর্থাৎ সাধারণ সম্পাদক পদে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে বহাল রাখিবার মত গঠনতন্ত্র বিরােধী পদক্ষেপ সংগঠনের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী অংশকে দ্বিারুণভাবে হতাশ করে। আর এইভাবেই মার্কিন কূটনীতির নিকট আওয়ামী লীগের সম্রাজ্যবাদ বিরোধী পদক্ষেপ সংগঠনের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী সামী অংশকে নিদারুণভাবে হতাশ করে এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী রাজনীতি পরাজয় বরণ করে। বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী রণপাঁয়তারার বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালে মহাচীনে অনুষ্ঠিত শাস্তি সম্মেলনের সক্রিয় অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও এবং ১৯৫৩-৫৬ইং সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ সত্ত্বেও কোন ক্ষমতালােভী রাজনীতিবিদ যে কিভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নীড়নকে পরিণত হইতে পারেন তাহার জ্বলন্ত উদাহরণ মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। এই বিষয়ে মন্ত্রী শেখ মুজিবকে সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ চীনের চিয়াং কাইশেক, দক্ষিণ কোরিয়ার সিং ম্যানরী, থাইল্যাণ্ডের সরিৎ থানারত ও ইরাকের নূরী আসসাঈদের মন্ত্র শিষ্য বলিলেও ভুল বলা হইবে না। ক্ষমতার রাজনীতির সীমাবদ্ধতা এইখানেই। এইখানেই নীতি, অর্শ, দর্শন সবকিছুই অপাংক্তেয় বা অবান্তর।
ভাসানীর হাঁ-না
| ৮ই ফেব্রুয়ারী সমাপ্ত কাউন্সিল অধিবেশনাস্তু আমি টাঙ্গাইল বড় বােনের বাড়ীতে চলিয়া যাই । সন্ধ্যার একটু পূর্বে আমি সন্তোষ (কাগমারী) আসি। দেখামাত্র শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে লােকের ভিড় হইতে এক পাশে ফুলবাগানের মধ্যে নির্জনস্থানে লইয়া একাস্তে প্রশ্ন করেন, “অলি আহাদ, পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে কোন প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে কি?” আমি তদুত্তরে গীরভাবে বলি, “না”। কথা প্রসঙ্গে অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জবানীতে অবগত হই যে, সংগঠনের সভাপতি মওলানা ভাসানী সাংবাদিকদের নিকট এক বিবৃতিতে ঘােষণা করিয়াছেন যে, কাউন্সিল অধিবেশন ১৯৬-এর মে অধিবেশনে হাত বৈদেশিক নীতিকে পুনরায় প্রস্তাবকারে সমর্থন দিয়াছে এবং মন্ত্রীই হউক বা পার্লামেন্ট সদস্যই হউক বা প্রাদেশিক পরিষদ সদসই হউক কেই প্রস্তাবের খেলাফ কাজ করিলে তাহার বিরুদ্ধে শাক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবার ক্ষমতাও কাউন্সিল ভঁহাকে দিয়াছে। আমার সুস্পষ্ট মনে
আছে, মওলানা ভাসানী উপরােক্ত মর্মে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিয়াছেন বটে, তবে তিনি বা অন্য কেহ আনুষ্ঠানিকভাবে কোন প্রস্তাব কাউন্সিল অধিবেশনে উত্থাপন করেন নাই। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবে তাহার এই অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ আমাকে বিস্মিত, বিমুঢ় ও হতবাক করিয়াছিল। বােধহয় ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে স্বীয় ভূমিকার গ্লানি মওলানা ভাসানীকে দংশন করিতেছিল এবং ইহা তাহার প্রায়শ্চিত্তেরই ব্যর্থ প্রয়াস মাত্র। অথচ মুহূর্তের জন্য তাঁহার চেতনায় উদিত হয় নাই যে, সংবাদপত্র পাঠক হয়ত তাহার বক্তব্যকে বিশ্বাস না করলেও সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করিবে না। কিন্তু কাউন্সিল অধিবেশনে অংশগ্রহণকারী ৮৯৬ জন সদস্যের পক্ষে তাঁহার দেয় এই খবর বা বিবৃতিকে সত্য মনে করিবার বাস্তব কোন হেতু নাই। ফলে, তাঁহার বিশাল ব্যক্তিত্বের মর্যাদা কি সদস্যদের নিকট ক্ষুন্ন হইবে না? সজ্ঞানে তিনি ইহা করিয়া থাকিলে দায়িত্ব তাঁহার, তবে অন্যের প্ররােচনায় করিয়া থাকিলে পরামর্শদানকারীগণ সংগঠনের অথবা দেশের যে কল্যাণকামী নহেন, তাহা দিবালােকের মত স্পষ্ট।
শেখ মুজিবুর রহমানের রিপাের্ট শ্রবণে আমার ইন্দ্রিয়ানুভূতি যেন লােপ পাইতেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীমহলই মওলানা ভাসানীর প্রায়শ্চিত্তানুভূতির সুযােগ গ্রহণ করিয়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় এই বৃদ্ধ নেতাকে এইভাবে অসত্যের আশ্র গ্রহণ করিতে হয়তাে প্ররােচিত করিয়াছে। কে না জানেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ও কেন্দ্রীয় সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও শক্তিতে ভীত সন্ত্রস্ত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা তাহার একান্ত বশংবদ শিল্পপতি সদরী ইস্পাহানীচক্র মারফত সােহরাওয়ার্দীর গণভিক্তির মূল খাটি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিধাবিভক্ত ও শহীদ-ভাসানীর নীতিগত মত-পার্থক্যের সুযােগে তাঁহাকে তাহার রাজনৈতিক দোসর মাওলানা ভাসানী হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার প্রচেষ্টায় রত রহিয়াছেন । যাহা হউক, মজলুম নেতার নাটকীয় আচরণের আলোচনা শেষ করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান প্রস্তাবচ্ছলে আমাকে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের সহিত আপােষআলােচনার উদ্দেশ্যে তাহার সহিত করাচী যাইতে অনুরােধ জানান। আমি তাহার প্রস্তাবের উত্তর ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর দিব বলিয়া এখনকার মত বিদায় নিলাম। চাকুরীর টোপ
পরবর্তীকালে মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের আবদুল গণি রােডস্থ সরকারী বাসভবনে আমি ও খুলনার মমিনউদ্দিন আহমদ তাহার সহিত আলােচনাকালে শেখ সাহেব আমাকে সােভিয়েট রাশিয়া বা যুক্তরাজ্যের ব্রেড কমিশনারের পদ বা পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র শিল্প করপােরেশন (East Pakistan Small Industry Corporation or EPSIC) এর চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। আমি সবিনয়ে ভঁহার প্রস্তাব গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানাই। ইহার কয়েকদিন পর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী নুরুর রহমান করাচী হইতে ঢাকা আগমন করেন ও আমার সহিত দেখা করিয়া প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর পক্ষ হইতে কলিকাতাস্থ ডেপুটি হাই কমিশনারের কূটনৈতিক পদ গ্রহণ করিতে অনুরােধ জানান। প্রস্তাবগুলির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ আমার নিকট সুস্পষ্ট ছিল-রাজনীতির অঙ্গন হইতে আমাকে অপসারণ। চাকুরী গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাইলে করাচীর মন্ত্রীমহল, ঢাকার মন্ত্রীমহল ও ঢাকার
দৈনিক ইত্তেফাক মহল আমার উপর বেজায় খাপলা হয়। শুরু হয় আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা। প্রচার চলিতে থাকে যে, আমি ভারত সরকারের এজেন্ট ও রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে জড়িত। সুতরাং আমার বিচার হওয়া উচিত। তদুরে সংশ্লিষ্ট কুচক্রীমহলকে পরিষ্কার ভাষায় জানাইয়া দিয়াছিলাম যে, মুসলিম লীগের নির্যাতনে আত্মসমর্পণ করি নাই। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর ধমকও শির নত করিবার কোন কারণ দেখা দেয় নাই। কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন
১৯৫৭ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী কাগমারীতে আফ্রো-এশীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ডঃ কুদরত-ই খুদা, ডঃ এস, হেদায়েত উল্লাহ, ডঃ ওসমান গণি, ডঃ শামসুদিন আহমদ, ডঃ নুরুল হুদা, ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ডঃ কাজী মােতাহার হােসেন, প্রফেসর এ,বি,এ, হালিম (ভাইস চ্যান্সেলর, করাচী বিশ্ববিদ্যালয়), ডঃ মাহমুদ হোসেন, ডঃ হাসান হাবাসী, ডঃ মমতাজ উদ্দিন আহমদ ও জনাব ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, ছারছ হইতে আগন্তু ভারতীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রফেসর হুমায়ুন কবীর, মিঃ তারা শংকর বন্দোপাধ্যায়, মিঃ। প্রবােধ সান্যাল, মিসেস রাধারাণী দেবী, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মিসেস সুফিয়া ওয়াদিয়া অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলন উপলক্ষে কায়েদে আযম’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হকিম আজমল খান, ও আরও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের নামে টাঙ্গাইল হইতে কাগমারী পর্যন্ত তােরণ নির্মাণ করা হয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়াদী অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি সমর্থন না করায় ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে নীতিগত মতভেদ দেখা দেওয়ায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীমহল এবং ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়া বেসামাল ও জঘন্য ভাষায় ইত্তেফাকের পৃষ্ঠায় বিশেষতঃ তদীয় লিখিত রাজনৈতিক মঞ্চে আমাদিগকে আক্রমণ করেন। ভাসানীর পদত্যাগ।
| কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের পর বিভেদের মেঘ আকাশে ক্রমশঃ ঘনীভূত হইতে থাকে। আওয়ামী লীগ দ্রুত দ্বিধাবিভক্তির পথে অগ্রসর হইতে শুরু করে, একাংশ পশ্চিমা শক্তির অন্যতম দোসর প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে সমর্থন জানায় ও অপরাংশ সামরিক চুক্তি বিরােধী ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির প্রবক্তা বৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে সমর্থন দেয়। সংগঠনের নির্ধারিত বক্তব্যের প্রতি দেশবাসী ও কর্মীবাহিনীর সজাগ দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার উদ্দেশ্যে আমি তদানীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় জনসভা ও কর্মীসভায় যােগ দিতে শুরু করি। উক্ত কর্মসূচী মােতাবেক ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত বারহাট্টা, বৈখরহাটী, নেত্রকোনাে ও আটপাড়ায় যথাক্রমে ৬, ৮, ১০ ও ১৭ই মার্চ আওয়ামী লীগ কর্মীসত্য ও জনসভায় বক্তৃতা দেই। ১৮ই মার্চ আমি কাগমারীতে (সন্তোষ) সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করি। মওলানা ভাসানী সংগঠনের সভাপতি পদ হইতে ইস্তফা দানের সিদ্ধান্ত আমাকে জানান। তিনি আমার কোন যুক্তিই শ্রবণ করিতে রাজী হন নাই। বরং তাঁহার পদত্যাগপত্রটি দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জহুর
হােসেন চৌধুরীর নিকট পৌছাইয়া দেওয়ার জন্য আমাকে আদেশ দেন। পদত্যাগ পত্রটি নিম্নরূপঃ
জনাব পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী সাহেব, ঢাকা।
আরজ এই যে, আমার শরীর ক্রমেই খারাপ হইতেছে এবং কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এইবার খুলিতে হইবে, তদুপরি আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রীসভার লীডার সদস্যদের নিকট আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব ২১ দফা ওয়াদা অনুযায়ী জুয়া, ঘােড়দৌড়, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারামী কাজ বন্ধ করিতে, সামাজিক ও ধর্মীয় বিবাহ বন্ধনের উপর ট্যাক্স ধার্য করা জনমত অনুযায়ী বাতিল করিতে আবেদন জানাইয়া ব্যর্থ হইয়াছি। ভয়াবহ খাদ্য সংকটেরও কোন প্রতিকার দেখিতেছি না। ২১ দফা দাবীর অন্যান্য দফা আহাতে অর্থব্যয় খুব কমই হইবে তাহাও কার্যকরী করিবার নমুনা না দেখিয়া আমি আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ হইতে পদত্যাগ করিলাম। আমার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করিয়া বাধিত করিবেন।
इंडि স্বা-মােঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী
কাগমারী ১৮/৩/৫৭
‘মারি অরি পারি যে কৌশলে | যদিও আদেশ অনুযায়ী পদত্যাগপত্রটি দৈনিক সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর নিকট পৌছাইয়া দিয়াছিলাম। তবে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকেও বিষয়টি জানাই। শেখ সাহেব আমাকে ভুল বুঝিলেন ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইলেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জেলায় কর্মী ও জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত সাম্রাজ্যবাদ ঘেঁষা পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধে সংগঠনে গৃহীত সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরােধী পররাষ্ট্রনীতি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করিয়া রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার আহবান জানাইতেছিলাম। তাই মার্কিন অনুচর মন্ত্রীমহল আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী খীগ সহ-সম্পাদক ফজলুর রহমান এবং সাফরউদ্দিন শেখ মুজিবুর রহমানের প্ররােচনায় আমার বিরুদ্ধে এক দরখাস্ত তাহার নিকট দাখিল করেন। দরখাস্তে বর্ণিত অভিযােগ শেখ সাহেব ৩০শে মার্চ (১৯৫৭) পূর্বপাক আওয়ামী লীগ সদর দফতরে (৫৬ সিম্পসন রােভ) আহুত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বিবেচনার জন্য পেশ করেন। অভিযােগের জবাবে আমি শেখ সাহেবকে আওয়ামী লীগ মন্ত্ৰীমন্ডলীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযােগ জনসমক্ষে খইতে আহবান ক্লালাই ও আওয়ামী লীগ মন্ত্ৰীমন্ডলী কর্তৃক সংগঠনের গৃহীত পররাষ্ট্র বিষয়ক ও পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবীর বরখেলাফ নীতি অনুসরণ পরিহার করিতে বলি। সকাল দশ ঘটিকার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। কোন প্রকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিয়াই সভা মুলতবী রাখা হয়। সন্ধ্যা আট ঘটিকায় পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে মুখ্যমন্ত্রীর কক্ষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী
জনাব আবুল মনসুর আহমদের সভাপতিত্বে ওয়ার্কিং কমিটির মুলতবী সভা আরম্ভ হয়। মজার ব্যাপার এই যে, এই সময়ে অসুস্থতা বিধায় আবুল মনসুর আহমদ দফতরে সরকারী কজি করিতে যাইতে পারিতেন না এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়ােজনে অবস্থান করিতেছিলেন, তথাপি আমাকে সংগঠন হইতে বহিস্কার করিবার জন্য কার্যকরী সংসদের সভায় যােগ দিতে বা সভাপতিত্ব করিতে কোন অসুবিধা বােধ করেন নাই। গরজ বড় বালাই। চতুর মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ পূর্বাহ্নে সমস্ত রিপাের্ট অবগত হইয়া বুঝিয়াছিলেন যে, সকাল বেলার অধিবেশনে আনীত অভিযােগ বলে আমাকে বহিষ্কার করা সম্ভব নয়। সুতরাং তিনি পিথ অবলম্বন করিলেন। দেখা গেল, ক্ষমতাসীনদের নিকট ন্যায়-অন্যায়, প্রাসঙ্গিক-অপ্রসংগিক ও বৈধ-অবৈধ কোন কিছুই বিবেচ্য নয়। পথের কাটা দূর করিতেই হইবে সুতরাং মারি অপ্তি পারি যে কৌশলে’। বলাই বাহুল্য যে, এইভাবে একপ্রকার গায়ের জোরেই আমাকে সংগঠন হইতে বরখাস্ত করা হইল। সভায় সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ আমাকে প্রশ্ন করেন, মওলানা ভাসানীর পদত্যাগপত্র সংবাদ সম্পাদক জহুর হােসেন চৌধুরীর নিকট দিলেন কেন? কাগমারীতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থার সদস্যপদ প্রত্যাহারের দাবীতে প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছিল কি? প্রত্যুত্তরে আমি বলিয়াছিলাম যে, উভয় প্রশ্নের সঠিক উত্তর কাগমারীতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভার সভাপতি মওলানা ভাসানীই দিতে পারেন। তঅন্য সভা মুলতবী রাখিতে হয় এবং পরবর্তী সভায় মওলানা ভাসানীর উপস্থিতি নিশ্চিত করিতে হয়। প্রশ্নোত্তরে বেকায়দায় পতিত হইলেও নব্য মার্কিনী দোসর মন্ত্রীশ্রেণীর প্রতিনিধি আবুল মনসুর আহমদ হাল ছাড়িবার পাত্র নহেন। হাল ছাড়িলে মার্কিন অনুচর মহলে মর্যাদা ক্ষুন্ন হইবে যে। তাই জওয়াব শুনিবার পর কালবিলম্ব না করিয়া সভাপতির। আসন হইতে স্বয়ং আবুল মনসুর আহমদ প্রস্তাব করিলেন যে, So “Mr Oli Ahad be suspended from the post of the Organising Secreatry”
অর্থাৎ অতএব “মিঃ অলি আহাদকে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হইতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হউক।” সর্বমোট ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে আমিসহ ৩০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলাম। ৩০ জনের মধ্যে ১৪ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন এবং নিম্নলিখিত ৯ জন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেন ও প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন।
১। ইয়ার মােহাম্মদ খান, এম,পি,এ, কোষাধ্যক্ষ, ২। আবদুল হাই, প্রচার সম্পাদক, ৩। জনাব আবদুস সামাদ, এম,পি,এ, শ্রম সম্পাদক, ৪। সেলিনা বানু, এম,পি,এ, মহিলা। সম্পাদিকা, ৫। দবিরউদ্দিন আহমদ, এম,পি,এ, সভাপতি, রংপুর জেলা আওয়ামী লীগ, ৬। হাবিবুর রহমান, এম,পি,এ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ, ৭। হাতেম আলী খান, এম,পি,এ, ৮। অধ্যাপক আসহাবউদ্দিন আহমদ, এম,পি,এ, ৯। আকবর হােসেন আখন্দ, এম,পি, সভাপতি, বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগ।
| রাত ১-৩০ মিনিটে সজ্জা ভঙ্গ হওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুজ্জোহা সভাস্থলে আসিয়া ফতুল্লা ঘাটে মওলানা ভাসানীর নৌকায় অবস্থানের খবর
আমাদিগকে জানান। আমরা কালবিলম্ব না করিয়া মওলানা ভাসানীর সহিত দেখা করিতে ঘাটমুখে রওয়ানা হই। মওলানা ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ ও আলােচনার পর শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা দেন। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্থানের পর মওলানা ভাসানী নারায়ণগঞ্জ নগর আওয়ামী লীগ সভাপতিকে ৩১শে মার্চ রোজ রবিবার জনসভা আহবান করিবার আদেশ দান করেন। আমি অবাক দৃষ্টিতে মওলানা ভাসানীর মুখপানে তাকাইয়া রহিলাম। আমি তাহাকে ওয়ার্কিং কমিটির সভা পুনঃ আহবান করিতে পরামর্শ দান করি এবং ওয়ার্কিং কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রীমহলের কারসাজিকে মােকাবেলা করিবার অনুরােধ জানাই। কিন্তু গঠনতান্ত্রিক পথে সমস্যার সমাধান না করিয়া তিনি নারায়ণগঞ্জ জনসভার মাধ্যমে সাংগঠনিক অন্যায় ক্রিয়াকলাপ প্রতিরােধ করিবার মত অদ্ভুত মানসিকতার পরিচয় দিলেন। ইহার সারমর্ম হইল, সংগঠনের ঐক্যের পথ পরিহার করিয়া বিচ্ছেদের দ্বার উন্মুক্ত করা। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ইহাই চাহিয়াছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাহারাই জয়ী হইল। মওলানা ভাসানী সংগঠনের সভাপতি। তিনি স্বয়ং ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহবান করিয়া সাংগঠনিক পদক্ষেপ নিতে পারিতেন। কি চমৎকার! বিচারক নিজেই বিচারপ্রার্থী। মওলানা ভাসানী সুস্থ নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হইলেন। চরম সমস্যাসঙ্কুল পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী সবসময় পলায়নী মনােবৃত্তির পরিচয় দিয়াছেন। ফলে দেশ, জাতি ও জনতা বঞ্চিত হইয়াছে তাহার সঠিক নেতৃত্বের সুফল হইতে। ‘শােকজ-নােটিশ | পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ক্রমশঃ মন্ত্ৰীমহলের কুক্ষিগত হয়। মওলানা ভাসানী উপায়ন্তর না দেখিয়া ১৮ ও ১৯শে মে বগুড়ায় কৃষক সম্মেলন আহবান করেন এবং খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১লা জুন হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করিবার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। তদানুযায়ী ১লা জুন হইতে ৭ই জুন অবধি “আত্মশুদ্ধির” নামে অনশনব্রত পালন করেন। মওলানা ভাসানী অনশব্রত পালনকালেই ৩রা জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আমাকে সংগঠন হইতে তিন বৎসরের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং ৩০শে মার্চ ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদত্যাগী ৯ জন সদস্যের স্কুলে নূতন ৯ জন সদস্য কো-অপট করিবার ব্যবস্থা হয়।
৩০শে মার্চ দিবাগত রাত্রে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাব ছিল নিম্নরূপঃ
“Whereas the general Secretary Sheikh Mujibur Rahman has brought certain-charges of indiscipline and disruptive activitics against Mr. Oli Ahad, Organizing Secreatary and whereas after long deliberations has come to the conclusion that a primafacie case has been made out that he has neglected to perform his duties and responsibilities as the organizing Secreatary, this committee hereby resolves that a notice to show-cause within 15 days why he will not be expelled from the organization or otherwise dealt with. The notice will be sent to Mr. Oli Ahad by registered
post. In the meantime Mr. Oli Ahad will remain under suspension as the Organizing Secretary of the party with immediate effect.
অর্থাৎ “যেহেতু সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান জনাব অলি আহাদের বিরুদ্ধে লাভস ও বিভেদাত্মক কার্যকলাপের কতিপয় অভিযােগ আনিয়াছেন, এবং যেহেতু দীর্থ আলাপ-আলােচনার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া গেল যে, জনাব অলি আহাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক অভিযোেগ (কেস) নির্ণীত হইয়াছে এবং যেহেতু ইহাও নির্ণীত হইয়াছে যে, সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে তিনি স্বীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিয়াছেন; সুতরাং এই কমিটি এতদ্বারা প্রস্তাব করিতেছে যে, তাহাকে কেন সংগঠন হইতে বহিস্কার করা হইবে না। বা অন্যভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না এই মর্মে পনের দিনের মধ্যে কারণ দর্শাইবার জন্য নােটিশ দেওয়া হউক। ননাটিশটি রেজিষ্টার্ড ডাকে জনাব অলি আহাদকে পাঠাইতে হইবে। ইতিমধ্যে সাংগঠনিক পদ হইতে তাৎক্ষণিক কার্যকারিতার সহিত জনাব অলি আহাদ সাময়িকভাবে কর্মচুত থাকিবেন।”
ইতিপূর্বে ২১শে মে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পদত্যাগী ৯ জন সদস্যের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয় এবং ৩রা জুন ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নিম্নলিখিত সদস্যবর্গকে কো-অপট করা হয়। যথাঃ | জসিমউদ্দিন আহমদ সভাপতি, সিলেট আওয়ামী লীগ; আমজাদ হােসেন, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ; মুজিবর রহমান, সভাপতি, রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ; দেওয়ান মহিউদ্দিন আহমদ, বগুড়া; রওশন আলী, সম্পাদক, যশাের জেলা আওয়ামী লীগ ও ডিস্ট্রি বাের্ড চেয়ারম্যান, শামসুল হক, ঢাকা; আজিজ আহমদ, নােয়াখালী এবং মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। ইহা ছাড়াও বৈঠকে নিম্নলিখিত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। যথা
আবদুল হামিদ চৌধুরী। – সাংগঠনিক সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী।
শ্ৰম সম্পাদক অধ্যাপক হাফেজ হাবিবুর রহমান – প্রচার সম্পাদক মিসেস মেহেরুন্নেসা খাতুন – মহিলা সম্পাদিকা
৫ই এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে শত অনুরােধ সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর সহিত অর্থপূর্ণ আলােচনা না হওয়া পর্যন্ত পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান। এবং আলােচনাকালে তিনি ১৯৫৫ সালের ২৬শে এপ্রিল আইন মন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক লিখিত ও দস্তখতকৃত অঙ্গীকারপত্রের কথা “আমি এতদ্বারা ঘােষণা করিতেছি যে, আমি যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা দাবী ও যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা কনস্টিটিউশন কনভেনশন মারফত শাসনতন্ত্রে স্বীকৃতির জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করি। যদি ইহাতে সক্ষম না হই, তবে মন্ত্রীত্ব হইতে পদত্যাগ করিব” স্মরণ করাইয়া দেন। মিনিট বুকে এই বৈঠকের বিবরণী লিপিবদ্ধ করা হয় নিদ্রভাবেঃ
“Maulana Bhashani has informmed the working committee that
he will withdraw his resignation letter after a discussion with Mr. Suhrawardy on different subject. Therefore the working committee defers decision on this matter and the meeting is adjourned. The General secretary is authorised to fix the date of the next meeting.”
অর্থাৎ মওলানা ভাসানী ওয়ার্কিং কমিটিকে এই মর্মে অবহিত করেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর সহিত বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনার পর তিনি তাঁহার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করিয়া নিবেন। সুতরাং ওয়ার্কিং কমিটি এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে এবং সভা মূলতবী করা হয়। পরবর্তী সভার তারিখ ধার্য করিবার জন্য সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেওয়া হয়।” | সংগঠন হইতে আমার বহিষ্কার, পদত্যাপী ৯ জন ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ও কর্মকর্তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ, সংগঠনের সভাপতি পদ হইতে মওলানা ভাসানীর পদত্যাগ পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি, ৩১শে মে মন্ত্রীপদ হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের পদত্যাগ ১লা জুন মওলানা ভাসানীর অনশন, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসন সেপ্টেম্বর অবধি বলবৎ রাখার সিদ্ধান্ত এবং ৩রা এপ্রিল পূর্ব পাকািন প্রাদেশিক পরিষদে মুন্না, পররাষ্ট্রবিষয়াদি, দেশরক্ষাকে কেন্দ্রীয় বিষয়ভুক্ত করিয়া পূর্ণ অঞ্চিলিক স্বায়ত্তশাসন দাবীতে প্রস্তাব গ্রহণের পটভূমিকায় ১৩ ও ১৪ই জুন ঢাকায় সাকিস্তান (পিকচার প্যালেস) ও গুলিস্তান সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। | কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী স্বীয় বক্তব্য পেশ করিবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অধিবেশন হল ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সাম্রাজ্যবাদী সামরিক চুক্তি বিরােধী ঐতিহ্য বিস্মৃত হইয়া সংগঠনের পূর্ব সিদ্ধান্ত নাকচকরতঃ জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রী থাকিবার প্রয়োজনে যুদ্ধজোটে জড়িত হওয়ার পররাষ্ট্রনীতি অনুমােদন করে। কাগমারী কাউন্সিল অধিবেশনের পর মার্কিন মহলে প্রধানমন্ত্রী বেকায়দায় পতিত হইয়াছিলেন। তাহা হইতে উদ্ধার লাভের জন্যই আওয়ামী লীগকে স্বীয় অতীত নীতি বিসর্জন দিতে হইল। আর এইভাবেই আওয়ামী লীগ পরিণত হইল নেতাসর্বস্ব দলে। দ্বিতীয়তঃ এইবারেও এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল যে, কেহ একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীপের সদস্য হইতে পারিবে না। সর্বপরি ১৪ই জুন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী ঘােষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হইয়াছে। মওলানা ভাসানী ও বহুসংখ্যক ভ্যাপী কর্মীর অতিকষ্টে গড়া আওয়ামী লীগে এইভাবেই নীতিজ্ঞানহীন রাজনীতির জয়যাত্রা সূচিত হইল। | পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে মতানৈক্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করে। কাউন্সিল সভায় মওলানা ভাসানীর নীতির পরাজয়ই চম উপসংহার নয়, যেমন কাগমারী। কাউন্সিল অধিবেশনের পর সংগঠনের সভাপতির ঘােষণায় আওয়ামী লীগ রাজনীতির শেষ কথা ছিল না । ঘড়যন্ত্রের রাজনীতির গুরু ঠাকুর ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বশংবদ প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার দাবার চালে দুই নেতাকেই পরাস্থ স্বীকার করিতে
হয়। আওয়ামী লীগ হয় দ্বিধাবিভক্ত।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্ম। | পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নেতৃবৃন্দের ১৩ ও ১৬ই জুন দুই দিনব্যাপী ঢাকা বৈঠকে জাতীয় ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তদানুযায়ী মওলানা ভাসানী ১৭ই জুন ঘােষণা করেন যে, আগামী ২৫ ও ২৬শে জুলাই (১৯৫৭) ঢাকায় নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মীসম্মেলন অনুষ্ঠিত হইবে। ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণকল্পে ১লা জুলাই ব্যারিস্টার শওকত আলী খানের সভাপতিত্বে জেলা বাের্ড হলে অনুষ্ঠিত কর্মীসভায় জনাব ইয়ার মােহাম্মদ খান চেয়ারম্যান ও জনাব মহিউদ্দিন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করিয়া ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট এক অভ্যর্থনা কমিটি গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের অন্যতম সদস্য রাজস্বমন্ত্রী জনাব মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে পরিচালিত পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ২১, ২২ ও ২৩শে জুলাই (১৯৫৭) তিনদিনব্যাপী বরিশাল টাউন হলে অনুষ্ঠিত সুপ্রীম (সর্বোচ্চ) কাউন্সিলের অধিবেশনে ঢাকায় আহূত নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মীসম্মেলনে যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। | মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ২৫শে জুলাইর সম্মেলন বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সহিত আরম্ভ হয়। পশ্চিম পাকিস্তান হইতে পাক-ভারত স্বাধীনতা। আন্দোলনের রূপকথার নায়ক সীমান্ত প্রদেশের লালকোঠা নেতা, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল
গফফার খান, পাঞ্জাবের জননেতা মিঞা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ, সিন্ধুর জননেতা ঝানু পর্লিামেন্টারিয়ান জি,এম, সৈয়দ, বেলুচিস্তানের ইংরেজ শাসকদের স খান আবদুস সামাদ আচাকাই, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী ও অন্যান্য জনবরেণ্য নেতা এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তাহারা সকলেই ন্যাশনাল পার্টির সদস্য। পশ্চিম পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে এই ন্যাশনাল পার্টির পচিশজন সদস্য ছিলেন এবং জি,এম, সৈয়দ ছিলেন উক্ত পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা। সম্মেলনকে বানচাল করিবার ব্যর্থ প্রয়াসে সল্পকারী শাসনতন্ত্রের প্রশ্রয় ও আশ্রয়ে চিরাচরিত হন পন্থায় আওয়ামী লীগ ভাড়াটিয়া গুন্ডা বাহিনী ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগের গুন্ডামীতে হতােদ্যমে ও নিরুৎহিত না হইয়া সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশপ্রেমিক বন্ধুগণ আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আরও সচেতন এবং আরও সজাগ হন। তাই শত বাধা-বিপত্তির ঝড় ও ঝঞাকে উপেক্ষা করিয়া সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সম্মেলনেই পঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধানতঃ পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাশনাল পার্টি, পূর্ব পাকিস্তানের মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আস্থাশীল আওয়ামী লীগ অংশ ও পাকিস্তান গণতন্ত্রীদল সমবায়ে গঠিত পাকিস্তানব্যাপী জাতীয় রাজনৈতিক দল।
সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠীর তুষ্টি বিধানের তাগিদে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও আতাউর রহমান সরকার পাকিস্তানের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে অপরাহ্নে পল্টন ময়দানে আহুত জনসভার উদ্যোক্তাদের উপর হিটলারী ঝটিকা বাহিনীকে লেলাইয়া দিয়া পাকিস্তান ফংসের প্রচেষ্টাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করিবার মহৎ কর্মটি সমাধা করেন। দেশপ্রেমের এতবড় অগ্নি পরীক্ষার মুহুর্তে কোন দেশপ্রেমিক পিছ পা হয়? আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান আদর্শ দেশপ্রেমিক বটে। উভয়ের যুগল প্রচেষ্টায় পাকিস্তান সেইসিন নিশ্চিত ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পায়। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অখন্ডত্ব বজায় রাখিবার ব্যাপারে তাহাদের। উভয়েরই এই জেহাদীপ্রেম নিশ্চিতভাবেই ভবিষ্যৎ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ থাকিবে। | পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের কাগমারী (সন্তােষ) অধিবেশনে পররাষ্ট্রনীতিকে কেন্দ্র করিয়া উদ্যুত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আত্মগােপনকারী ও নিষিদ্ধ কমউনিস্ট পার্টির গােপন (আন্ডার গ্রাউন্ড) নেতৃত্ব কমরেড মনিসিংহ, কমরেড খােকা রায়, কমরেড আবদুস সালাম ও অন্যান্যকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করিয়া তােলে। দীর্ঘকালের সংগ্রামী রানৈতিক অভিজ্ঞতাপ্রসূত প্রজ্ঞা ও ব্যাপক থিওরিটিকাল জ্ঞান বলে তাঁহারা সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাহারা তখনকার তুরিত গতিতে প্রবাহিত ঘটনাস্রাতের উপর স্ত্রী ও সতর্ক দৃষ্টি রাখিতেছিলেন। বােধহয় দিব্যচক্ষে অবলােকন করিতেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগকে দ্বিখন্ডিত করিয়া সংগ্রামী, সমাজ সচেতন, দেশপ্রেমিক, সৎ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী অংশকে সংগঠন হইতে বিচ্ছিন্ন করা হইতেছে এবং সেইমতে সামন্তবাদ, উঠতি পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অনুচর শ্রেণীর সুপরিকল্পিত সংকল্প ও চক্রান্ত বিভ্রান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযােগে সুচারুভাবে সমাধা হইতে যাইতেছে। অর্থাৎ গণমুখী আওয়ামী লীগ গণবিরােধী ক্যাম্পে পরিণত হইতেছে। স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিস্ট পার্টির আন্ডার গ্রাউন্ড নেতৃত্ব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বিধাবিভক্তি বােধ করিতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু তাহাদের সে চেষ্টা সফল হয় নাই। কমিউনিষ্ট পার্টির (ওভার গ্রাউন্ড) সহযােগী নেতা ও কর্মীদের ব্যক্তিগত কোন্দল ও প্রাধান্য লাভের প্রচেষ্টা, ঘৃণ্য ও পরোক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং নানা সন্দেহজনক উচ্চমহল হইতে আনুকুল্য লাক্তের লােভ, আত্মগোপনকারী কমিউনিষ্ট পার্টির সৎ ও অমূল্য পরামর্শদানের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। পররাষ্ট্র নীতিকে কেন্দ্র করিয়া ক্রমশঃ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে মতভেদ চরম আকার ধারণ করে এবং সর্বশেষে মতভেদ পথভেদের কারণ হইয়া দাঁড়ায়। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এই মতভেদ ও পথভেদেরই ফসল।
উল্লেখ্য যে, এই সময়ে মওলানা ভাসানী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ উভয়েই ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসারত ছিলেন। সেইখানেই আপােষ-আলোচনার কিছুটা সূত্রপাত হয়। আবুল মনসুর আহমদ আমার বিরুদ্ধে গৃহীত সাংগঠনিক শাস্তিমূলক বহিষ্কারাদেশের প্রত্যাহার ও পদত্যাগী ৯জন নেতাকে পুনর্বহাল করিবার ব্যাপারে একটি আপােষ-রফা প্রস্তাব দিয়াছিলেন। সাংগঠনিক দিক হইতে আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হউক, ইহা কখনও আমার কাম্য ছিল না। মওলানা ভাসানী ইহা জানিতেন। তাই আপােষ-রক্ষা প্রস্তাবাবলী আমার নিকট হইতে সযত্নে লুকাইয়া রাখেন সেই সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর প্রতি এত ক্রোধান্বিত ছিলেন যে, হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া জালেম ইস্কান্দার মীর্জার প্রেমে নিমজ্জিত হইয়া পড়েন এবং ইহার ফলে যে কোন সর্বনাশা পদক্ষেপ গ্রহণ। করিতে ইতস্ততঃ করেন নাই। ইহারই ফলশ্রুতি হইল আওয়ামী লীগের ভাঙ্গন। | দৈনিক ইওেফাক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আবির্ভাবকে বিষ নজরে দেখিতে লাগিল। পায়ের জ্বালা মিটাইবার প্রয়াসে মালিক-সম্পাদক জনগণের ভারত বিরােধী মনােভাবের সুযােগ নিয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ইংরেজী সংক্ষিপ্ত নাম এন,এ,পি, কে বিকৃত করিয়া Nehru Aided party অর্থাৎ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সাহায্যপ্রাপ্ত পার্টি সংক্ষেপে ন্যাপি আখ্যা দিয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে জনগণের নিকট হেয় প্রতিপন্ন করিতে সচেষ্ট হইয়া উঠিলেন। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর জিরাে থিওরীর গোড়া প্রচারক ইত্তেফাকের নিকট পরমতসহিষ্ণুতা ছিল অবিদিত ও অবাঞ্ছিত। তবে স্বীকার করিতেই হইবে যে, বিরােধী দলীয় মুখপত্রের ভূমিকায় ইত্তেফাক একদা অত্যন্ত সাহসের পরিচয় রাখিয়াছিল। যত বিপত্তি। ক্ষমতাসীন হইলেই! জিরাে থিওরীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় এই যে, ক্ষুদ্র ও অনুন্নত দেশগুলির বিশেষতঃ আরব জাহানের বন্ধুত্ব পাকিস্তানের রক্ষাকবচ নয়; একমাত্র মার্কিন বন্ধুত্বই ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীর সমস্যরি সমাধান দিতে পারে। অতএব দৈনিক ইত্তেফাকের মতে সামরিক চুক্তি ও সামরিক জোট বিরােধী বক্তব্য পাকিকান রাষ্ট্রের সর্বনাশের সূচনা করিবে। সােহরাওয়ার্দীর পদত্যাগঃ যুক্ত ও পৃথক নির্বাচন
প্রধানমন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দক্ষতার সহিত পাশ্চাত্য জগতের সমর্থন অর্জন করিতে সক্ষম হন। কাশ্মীর প্রশ্নে ভারত পাশ্চাত্য জগতের মােড়ল শক্তিসমূহের সমর্থন হারাইয়া ফেলে এবং একমাত্র সােভিয়েট রাশিয়ার ভেটো শক্তির আশ্রয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আত্মরক্ষা করিতে থাকে। আভ্যস্তরীণ ক্ষেত্রে বিশেষতঃ পশ্চিম পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তা অর্জন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ঈর্ষা ও জতির কারণ হইয়া দাঁড়ায় । ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ভীত সন্ত্রস্ত ইস্কান্দার মীর্জা ক্ষমতা হারাইবার ভয়ে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার শুরু করেন। রিপাবলিকান পার্টি ইস্কান্দার মীর্জার ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের উপর হইতে সমর্থন প্রত্যাহার করে। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নাই, এই অজুহাতে প্রেসিডেন্ট মীর্জা প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগ করিতে আহবান জানান। প্রথমতঃ সােহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করিতে অস্বীকার করেন ও প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংসদ অধিবেশন আহবান করিতে অনুরােধ জানান। কিন্তু ইস্কান্দার মীর্জা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ঝামেলা এড়াইবার উদ্দেশ্যে সােহরাওয়ার্দী ১১ই অক্টোবর (১৯৫৭) পদ্যাগপত্র দাখিল করেন। স্মর্তব্য যে, ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে একইভাবে বরখাস্ত করিয়াছিলেন। পরিষ্কাপের বিষয়, সেই দিন আইনজ্ঞ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় গভর্নর জেনারেলের এক্তিয়ার বহির্ভুত অন্যায় ও অবৈধ আদেশকে প্রকাশ্যে সমর্থন দান করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। সেই গোলাম মােহাম্মদের উত্তরাধিকারী ইস্কান্দার মীর্জার নিকট অনুরূপ আচরণই প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে পাইতে হইল। ইহাকেই বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। নীতিজ্ঞানহীন রাজনীতির ফল জাতির জন্য কখনও শুভ হইতে পারে না এবং হয়ও নাই। অতঃপর মুসলিম লীগ নেতা আই, আই, চুশ্রীগড় প্রধানমন্ত্ৰীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি হইলেন পাকিস্তানের যষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।
অবস্থার চাপে পাকিস্তান মুসলিম লীগ ১১ই অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে এবং এই মর্মে শঙ্কা প্রকাশ করে যে, পাকিস্তান মুসলিম জাহানে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ করিবার জন্য কেন্যাদূরন্ত মার্কিন বশংবদে পরিণত হইয়াছে। এইদিকে পৃথক নির্বাচন প্রথায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে রিপাবলিকান পার্টি চুক্তিবদ্ধ হওয়ায়, মুসলিম লীগ তাহাদের সহযােগিতায় কেন্দ্রে মন্ত্রীসভা গঠন করিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইহার ফল শুভ হইবে না উপলব্ধি করিতে পারিয়া রিপাবলিকান পার্টি নির্বাচন প্রথার উপর জনমত যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং একটি তথ্য নিরূপণ কমিটি (Fact Finding Committee) গঠন করে। তথ্য নিরূপণ কমিটির সদস্যরা ২রা ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে আগমন করেন। আওয়ামী লীগ একই তারিখে অর্থাৎ ২রা ডিসেম্বর যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও ৫ই ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে যুক্ত নির্বাচনের দাবীতে বিরাট জনসভার আয়ােজন করে। একই তারিখে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে প্রাক্তন মন্ত্রী শামসুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি (আবু হােসেন সরকার গ্রুপ), পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ও পাকিস্তান সােস্যালিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সভায় নিরাপত্তা পরিষদে আত্মরক্ষা করিতে থাকে। আস্করীণ ক্ষেত্রে বিশেষতঃ পশ্চিম পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর জনপ্রিয়তা অর্জন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ঈর্ষা ও জীতির কারণ হইয়া দাঁড়ায়। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ভীত সন্ত্রস্ত ইস্কান্দার মীর্জা ক্ষমতা হারাইবার ভয়ে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার শুরু করেন। রিপাবলিকান পার্টি ইস্কান্দার মীর্জার ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারের উপর হইতে সমর্থন প্রত্যাহার করে। জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সদস্যের সমর্থন নাই, এই অজুহাতে প্রেসিডেন্ট মীর্জা প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগ করিতে আহবান জানান। প্রথমতঃ সােহরাওয়াদী পদত্যাগ করিতে অস্বীকার করেন ও প্রেসিডেন্টকে জাতীয় সংসদ অধিবেশন আহবান করিতে অনুরােধ জানান। কিন্তু ইস্কান্দার। মীর্জা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ঝামেলা এড়াইবার উদ্দেশ্যে। সােহরাওয়ার্দী ১১ই অক্টোবর (১৯৫৭) পদত্যাগপত্র দাখিল করেন। স্মর্তব্য যে, ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মােহাম্মদ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনকে একইভাবে বরখাস্ত করিয়াছিলেন। পরিতাপের বিষয়, সেই দিন আইনজ্ঞ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় গভর্নর জেনারেলের এক্তিয়ার বহির্ভুত অন্যায় ও অবৈধ আদেশকে প্রকাশ্যে সমর্থন পান করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। সেই গোলাম মােহাম্মদের উত্তরাধিকারী ইস্কান্দার মীর্জার নিকট অনুরূপ আচরণই প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়াদাকে পাইতে হইল। ইহাকেই বলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। নীতিজ্ঞানহীন। ব্রহ্মনীতির ফল জাতির জন্য কখনও শুভ হইতে পারে না এবং হয়ও নাই। অতঃপর মুসলিম লীগ নেতা আই, আই, চুীগড় প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি হইলেন পাকিস্তানের যষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী।
অবস্থার চাপে পাকিস্তান মুসলিম লীগ ১১ই অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে এবং এই মর্মে শঙ্কা প্রকাশ করে যে, পাকিস্তান মুসলিম জাহানে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন জাতীয় স্বার্থ চরিতার্থ। করিবার জন্য কেতাদূরন্ত মার্কিন বশংবদে পরিণত হইয়াছে। এইদিকে পৃথক নির্বাচন প্রথায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে রিপাবলিকান পার্টি চুক্তিবদ্ধ হওয়ায়, মুসলিম লীগ তাহাদের সহযােগিতায় কেন্দ্রে মন্ত্রীসভা গঠন করিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইহার ফল শুভ হইবে না। উপলব্ধি করিতে পারিয়া রিপাবলিকান পার্টি নির্বাচন প্রথার উপর জনমত যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং একটি তথ্য নিরূপণ কমিটি (Fact Finding Committee) গঠন করে। তথ্য নিরূপণ কমিটির সদস্যরা ২রা ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে আগমন করেন। আওয়ামী লীগ একই তারিখে অর্থাৎ ২রা ডিসেম্বর যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও ৫ই ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন ময়দানে যুক্ত নির্বাচনের দাবীতে বিরাট জনসভার আয়ােজন করে। একই তারিখে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসে প্রাক্তন মন্ত্রী শামসুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি (‘আবু হােসেন সরকার গ্রুপ), পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেস ও পাকিস্তান সােস্যালিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সভায়
নিমল্লিখিতদের সমন্বয়ে সর্বদলীয় যুক্ত নির্বাচন সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়ঃ
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হােসেন সরকার (প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী), শামসুদ্দিন আহমদ, মাহমুদ আলী, অলি আহাদ, আবদুস সালাম (সম্পাদক, পাকিস্তান অবজারভার), জহুর হােসেন চৌধুরী (সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ), কাজী মােহাম্মদ ইদ্রিস (সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেহাদ)।
১১ই ডিসেম্বর (১৯৫৭) চুীগড় সরকার জাতীয় পরিষদে পৃথক নির্বাচনী বিল উত্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সর্বদলীয় যুক্ত নির্বাচন সংগ্রাম পরিষদ ১১ই ডিসেম্বরেই যুক্ত নির্বাচন দিবস পালন করে। জনমতের প্রবল চাপে রিপাবলিকান পার্টি যুক্ত নির্বাচন সমর্থন করিতে বাধ্য হয়। মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী পৃথক নির্বাচন প্রথার সমর্থক বিধায় প্রধানমন্ত্রীর পদ হইতে পদত্যাগ করেন এবং তদস্থলে মালিক ফিরােজ খান নূন নূতন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তান সফর
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় যােগ দিতে পেশওয়ারের পথে আমরা লাহাের যাত্রা করি এবং দলীয় নেতা মিঞা ইফতেখার উদ্দিনের আতিথ্য গ্রহণ করি। ওরা নভেম্বর (১৯৫৭) মাওলানা ভাসানী লাহােরে মুটীগেটে এক জনসভায় ভাষণ দান করেন। পেশওয়ারে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জাতীয় কমিটির সভায় পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলুপ্ত করিয়া সাবেক চারটি প্রদেশ পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশ অবিলম্বে পুনর্বহাল না করিলে আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব করেন সীমন্তি গান্ধী খান আবদুল গফফার খান। স্মর্তব্য যে, ১৭ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে প্রাদেশিক পরিষদে এক ইউনিট বিলুপ্তির প্রস্তাব গৃহীত হয়। পাঞ্জাবের মিয়া ইফতেখার উদ্দিন ও সংগঠনের সভাপতি মাওলানা ভাসানী স্বয়ং আইন অমান্য আন্দোলনের বিরােধিতা করিয়াছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মােজাফফর আহমদ ও মােঃ তােয়াহা পাঞ্জাবের মিঞা ইফতেখার উদ্দিনের সহিত কষ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া আইন অমান্য আন্দোলন সময়ােচিত নহে বলিয়া রায় দেন। তাহারা আরাে দাবী করেন যে, আইন অমান্য আন্দোলনের অজুহাতে সাধারণ নির্বাচন বানচাল করা হইবে এবং দেশে সামরিক শাসনের প্রবর্তন হইবে। আমি আইন অমান্য আন্দোলনের প্রতি জোর সমর্থন জানাই এবং মন্তব্য করি যে, জনতা আন্দোলনমুখর না হইলেই ক্ষমতবিলাসী উচ্চমহল সম্রাজ্যবাদী দোসরদের সহায়তায়। দেশে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিবে। মাওলানা ভাসানী ও অন্যান্য লােকদের অনুরােধে আন আব্দুল গফফার খান আমাকে আইন অমান্য আন্দোলন দাবী আপাততঃ স্থগিত রাখিবার অনুরোধ করেন। প্রস্তাবক স্বয়ং প্রস্তাব প্রত্যাহার করায় আমার নিপ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। পাঠান নেতা সরল বিশ্বাসেই তাহাদের আশ্বাসে বিশ্বাস করিয়াছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে নেতৃবৃন্দ চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন কিন্তু সেই অদূর ভবিষ্যৎ’ আর কখনও আসে নাই। শুধু তাই নয়, দলের শীর্ষ নেতা ঘটনাপ্রবাহে ইস্কান্দার মীর্জার ষড়যন্ত্র জালের ইচ্ছুক। শিকারে পরিণত হন ও দেশের জন্য সর্বনাশা ভবিষ্যৎ ডাকিয়া আনেন।
ন্যাপ প্রার্থীদের পরাজয়বরণ | পশ্চিম পাকিস্তান সফরান্তে ঢাকা পৌছিয়াই সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত বুড়িচংকসবা ও রংপুর জেলার অন্তর্গত মিঠাপুকুর-পীরগাছা উপনির্বাচনে যথাক্রমে আমাদের প্রার্থী। তমিয়ুল ইসলাম, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম ও আবদুল জলিলকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মনােনীত প্রার্থী হিসাবে শাসক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনী জােটাধিক্যে পরাজয়বরণ করিতে হয়। পরাজয়বরণ করিবার কারণ, জনপণ আওয়ামী লীপের প্রচারণায় বিশ্বাস করিয়াছিল যে, আমরা আল্লাহ বিরােধী কমিউনিস্ট প্রভাবান্বিত ভােট প্রার্থীল এবং হিন্দুস্থানের দালাল হিসাবে পাকিস্তান ধ্বংসের ভূমিকায় অবতীর্ণ। সীমান্তে পাচার বিরােধী অভিযান
সীমান্তে অস্বাভাবিক পাচারের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাইতে থাকে। জাতীয় অর্থনীতির প্রয়োজনেই সীমান্তে পাচার বন্ধ করিবার জন্য সেনাবাহিনী নিয়ােজিত করা হয়। এই ব্যবস্থা ‘ক্লোজ ডাের অপারেশন’ (Close Door Operation) নামে পরিচিতি লাভ করে। পাচার বন্ধ করিবার মহৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হইয়াই সরকার কতিপয় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নার অফিসার স্বীয় দায়িত্বজ্ঞান হারাইয়া লােভ-লালসার শিকারে পরিণত হয়। ভূত তাড়াইবার নিমিত্ত ব্যবহৃত সরিষাই ভূতের আস্তানায় পরিণত হওয়ার বহুল প্রচলিত গ্রাম্য প্রবচনটিই আওয়ামী লীগ কর্মীদের ব্যাপারে নির্মম সত্যের রূপ নেয়। তবে ইহার ব্যতিক্রমও ছিল। আমার জানার মধ্যে আখাউড়া-সীমান্তুে কত নােয়াখালী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুস সালাম সর্বপ্রকার লােভলালসার উর্ধ্বে থাকিয়াও প্রাণহানির চক্রান্ত উপেক্ষা করিয়া স্বীয় নির্মল চরিত্রের সাক্ষর রাখিয়া গিয়াছে। তাহার আপ্রাণ চেষ্টায় সীমাস্ক এলাকায় পাচার প্রায় বন্ধ হইয়া যায়। এইদিকে সেনাবাহিনীর পাচার বিরােধী কঠোর অভিযান সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের কঠোর সমালােচনার বিষয়ে পরিণত হয়। ইহা দুঃখজনক কিন্তু সত্য। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তােষণপ্রিয়তার কারণে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নগণ্যসংখ্যক প্রতিনিধিও স্বীয় জ্ঞাত ও অজ্ঞাত স্বার্থে পাচার বিরোধী কঠোর ব্যবস্থাকে প্রকাশ্য সমালােচনা করিতেও কুণ্ঠাবােধ করেন নাই।
শাহেদ আলীর মৃত্যু | পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা দেয়। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবর রহমানকে বাড়ী-গাড়ীসহ মােটা ভাতা নির্দিষ্ট করিয়া পাকিস্তান টি বাের্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেন এমনকি তিনি শেখ সাহেবকে দামী লিমুজিন গাড়ীও উপহার দেন। শুধু তাই নয়, তাঁহাকে শান্ত করিবার মানসে বিদেশে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসাবেও প্রেরণ করেন। কিন্তু সােভিয়েট রাশিয়া শেখ সাহেবকে উক্ত মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি
জানাইলে শেখ সাহেব জাতীয় পরিষদ সদস্যরূপে রাশিয়া মুখে রওয়ানা হন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীত্ব হইতে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের পদত্যাগের পর পরই পাকিস্তান সরকার শেখ সাহেবকে জেনেভা হইতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দান করেন। | নানা কারণ ও অজুহাতে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন পার্লামেন্টারী পার্টির একাংশ আওয়ামী লীগ দলীয় মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের বিরুদ্ধে উপদল গঠন করিবার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। মিঃ রসরাজ মন্ডলের নেতৃত্বে সিডিউল কাস্ট ফেডারেশন ভুক্ত’ কতিপয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, দ্বিতীয়তঃ উত্তরবঙ্গ প্রদেশের দাবীতে আওয়ামী লীগ দলীয় কতিপয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, তৃতীয়তঃ ক্লোজ ডাের অপারেশন’ (Close door Operation) -এর ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কংগ্রেস দলীয় কতিপয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আতাউর রহমান খান সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য উম্ম ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা ভাসানী ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একাংশও আতাউর রহমান খান মন্ত্রী সভার বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপনের পক্ষপাতি ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা লক্ষ্য করিয়া দ্বিধাবিভক্ত কৃষক-শ্রমিক পার্টি আভ্যন্তরীণ কোন্দল ভূলিয়া ঐক্যবন্ধ হয় এবং সৈয়দ আজিজুল হক খ্রীয় নেতৃত্বের দাবী ত্যাগ করিয়া পার্লামেন্টারী নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকারের নেত্ব আস্থা জ্ঞাপন করেন।
বিরােধী দলসমূহের ঐক্যবদ্ধ চাপ ও আওয়ামী লীগের অভ্যস্তরীণ কোন্দলে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান নিকট ভবিষ্যতে ভরাডুবির আশংকায় ৩০শে মার্চ গণ্ডর শেরে বাংলাকে প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশন মুলতবী রাখিবার আহবান জানান। বৈরী গভর্নর মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান সরকারের প্রতি অধিকাংশ অর্থাৎ সংখ্যাগুরু সদসের আস্থা নাই অজুহাতে তাঁহাকে পদচ্যুত করেন ও আবু হােসেন সরকারকে মন্ত্রীস গঠনের আহবান জাননি। নূতন মুখ্যমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করিবার অব্যবহিত পরই তাঁহার পরামর্শে গভর্নর প্রাদেশিক পরিষদ মূলতবী ঘােষণা করেন। এই দিকে জনবি সােহরাওয়ার্দীর অনুরোধে কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরােজ খান নূন ৩১শে মার্চ শেরে বাংলাকে গভর্নর পদ হইতে অপসারণ করেন এবং ১লা এপ্রিল প্রদেশের চীফ সেক্রেটারী অস্থায়ী গভর্নরের দায়িত্বভার গ্রহণ করিবার এক ঘন্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী আবু হােসেন সরকারকে পদচ্যুত করেন। পুনর্বার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জনাব আতাউর রহমান খান ৯ সদস্যবিশিষ্ট সরকার গঠন করেন। নীতিজ্ঞান বিবর্জিত ও ক্ষমতার লালসাসর্বস্ব এই রাজনীতির খেলা দেশবাসীকে হতবাক ও বিক্ষুব্ধ করে। ফলশ্রুতিতে সামরিক অভূত্থানের ক্ষেত্র প্রশস্ত হয় । দর্শকদের জন্য খেলা এইখানেই শেষ হয় বটে, কিন্তু পর্দার অন্তরালে খেলা অব্যাহত থাকে। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রচেষ্টায় পুনঃ দেশব্যাপী অবাঙ্গালী বিরােধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ৪ঠা জুন (১৯৫৮) করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ, কেন্দ্রীয় সামরিক-বেসামরিক চাকুরীতে পূর্ব পাকিস্তানীদের ন্যায্য অধিকার হইকে বঞ্চনার ঘােরতর ও গভীর অভিযোগ প্রকাশ্যে আনয়ন করেন। এইভাবেই ১৯৫৯ সালের মার্চের সাধারণ নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কড়ি অগ্রভাগেই আদায় করিয়া রাখিবার প্রয়াস পান। সত্যই ক্ষমতার রাজনীতির গতি কি বিচিত্র।
১৮ই জুন প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে তেত্রিশ সদস্যবিশিষ্ট ন্যাপ নিরপেক্ষ থাকিবার দরুন আতাউর রহমান খান সরকার সংখ্যাধিক্য হারাইয়া ফেলেন এবং ১৯শে জুন আৰু হােসেন সরকার পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। কিন্তু ২২শে জুন অনাস্থা ভােটে আবু হােসেন মন্ত্রীসভার পতন ঘটে। কেননা, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ভূক্ত পরিষদ সদস্যবর্গ মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে ভােট দিয়াছিল। ২৫শে জুন (১৯৫৮) পূর্ব পাকিস্তানে পুনরায় প্রেসিডেন্ট শাসন প্রবর্তিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিরােধী জনমত এত প্রবল ছিল যে, কেন্দ্রীয় সরকার এই ব্যাপারে তদন্তের জন্য আখতার হােসেনের নেতৃত্বে একটি ইনকোয়ারী কমিটি গঠন করিতে বাধ্য হন। ইনকোয়ারী কমিটি পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিয়ােগের পরামর্শ দেন। লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্যান্য রাজনৈতিক দল এক ইউনিট বিলােপ করিয়া সাবেক প্রদেশ গঠন করিবার দাবী করিতেছিল। | পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটি ৩০ ও ৩১শে মে (১৯৫৮) করাচীতে অনুষ্ঠিত সভায় ১৯৫৯ সালের প্রথমার্ধে সম্ভাব্য সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়ন দান কল্পে পার্লামেন্টারী বাের্ড গঠন করে। কমিটি পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খান সরকারকে সমর্থন দানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ সদস্যদের কঠোর সমালােচনাও করে। বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারী বাের্ড ঢাকা অধিবেশনে এই বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দিবে। কেন্দ্রীয় রাজস্বে নির্মিত রাজধানী করাচীকে পশ্চিম পাকিস্তান ভুক্তির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সভায় আমি একটি প্রস্তাব পেশ করি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমটি প্রস্তাবটি সুচতুরভাবে এড়াইয়া যায়। ইহারই প্রতিবাদে ১লা জুন (১৯৫৮) আমি উক্ত কমিটি হইতে পদত্যাগ করি। | কিছুকালের মধ্যেই মাওলানা ভাসানী বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যােগদানের নিমিত্ত স্টকহোম গমন করেন। স্টকহােম অবস্থানকালে মিসরের রাষ্ট্রদূত মাওলানা ভাসানীকে মিসর সফরের আমন্ত্রণ জানান। তদানুযায়ী মাওলানা ভাসানী মিসর গমন করেন ও প্রেসিডেন্ট নাসেরের সহিত আলােচনাকালে তিনি তাহাকে সমগ্র জনতার অকুণ্ঠ সমর্থনের বার্তা পেীছাইয়া দেন। প্রায় দুই মাস পর মাওলানা ভাসানী ১১ই সেপ্টেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিমধ্যে ২২শে জুলাই আতাউর রহমান খান পুনরায় মুখ্যমন্ত্রীর শপথ প্ৰহণ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের নবম সরকার গঠন করিয়াছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসের ৩০ তারিখ প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহুত হয়। সরকার দলীয় স্পীকার আবদুল হাকিমের সহিত মতবিরােধ দেখা দেওয়ায় ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীকে পরিষদের কার্য পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার মানসে স্পীকার আবদুল হাকিমের বিরুদ্ধে দেওয়ান মাহবুব আলী (ন্যাপ সদস্য) অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করেন এবং সরকার অনাস্থা প্রস্তাব সংখ্যাধিক্য জােটে গৃহীত হইয়াছে বলিয়া দাবী করেন। মজার ব্যাপার,
পরক্ষণেই সরকারী দলভুক্ত পিটার পল গােমেজ (কংগ্রেস) স্পীকার আবদুল হাকিমকে ‘পাগল’ ঘােষণা করিয়া একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং উক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। দেখিয়া শুনিয়া মনে হইতেছিল যেন পাগলামীর প্রতিযােগিতায় সবাই অবর্তীর্ণ; দেশ ও জাতি পেীণ । ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল পরিষদ অভ্যস্তরে দাঙ্গা। ২৩শে সেপ্টেম্বর দেশবাসী অধিবেশন নাটকের উপসংহার অবলােকন করেন ভারপ্রাপ্ত স্পীকার শাহেদ আলী পরিষদ অভ্যন্তরেই মারাত্মক ভাবে আহত হন এবং ২৬শে সেপ্টেম্বর (১৯৫৮) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২৪শে সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশন মূলতবী ঘােষণা করা হয় এবং ইহার যবনিকাপাত ঘটে ৭ই অক্টোবর দেশব্যাপী সামরিক শাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে। ইস্কান্দার মীর্জার অপসারণ
আওয়ামী লীগ ১৯৫৯ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পাকাপাকি বুঝাপড়ার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরােজ খান নূনের কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থনদানের প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করে। তদানুযায়ী ১৫ই ফেব্রুয়ারী (১৯৫৯) সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ধার্য হয়। ক্ষমতা পিপাসু আওয়ামী লীগ ২রা অক্টোবর কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় যােগ দেয় এবং দফক্স বন্টন বিষয়ে অসন্ত্র ও সুব্ধ আওয়ামী লীগ মন্ত্রীবর্গ ৭ই অক্টো (১৯৫৮) পদত্যাগ করে। ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা স্বীয় করাচী বাসভবনে প্রধানমন্ত্রী নুন ও তাঁহার মন্ত্রীদের মন্ত্রীসভার সদস্যবর্গকে এক পার্টিতে আমন্ত্রণ জানান। উপস্থিত আমন্ত্রিত মন্ত্রীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় মন্ত্রীবর্গও ছিলেন। ৭ই অক্টোবর মধ্যরাত্রিতেই ইস্কান্দার মীর্জা বিশেষ ঘােষণায় সমগ্র দেশব্যাপী সামরিক আইন ঘােষণা করেন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা বরখাস্ত করেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল করেন, সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘােষণা করেন ও সংবিধান রহিত করেন এবং সেনাধ্যক্ষ জেনারেল মােঃ আইউবখানকে প্রধান সামরিক শাসনকর্তা নিয়ােগ করেন।
সমগ্র পাকিস্তানব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সােহরাওয়ার্দী-গুরমানী সমঝােতা বা আঁতাত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে শঙ্কিত করিয়া তুলিয়াছিল। তাই প্রেসিডেন্ট মীর্জা নির্বাচন বানচাল করিবার ফিকিরে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেন। ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ ব্রহ্মদেশে সেনাপতি জেনারেল নে উইনের সামরিক ক্ষমতা দখল প্রেসিডেন্ট মীর্জাকে অভীষ্ট সিদ্ধির সহজ পথটি বালাইয়া দেয়। কালাত রাজ্যের শাসক মীর আহমদ ইয়ার খান কর্তৃক পাকিস্তান রাষ্ট্রে যােগ দেওয়ার ঘটনাকে অস্বীকার করিয়া কালাতের স্বাধীনতা ঘােষণা, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালে পরিষদে মারামারি ও হাতাহাতি এবং পরিষদের প্রাপ্ত পীকারের পরিষদ মিলনায়তনে আঘাতজনিত কারণে হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ, পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশকে ভাসিয়া সাবেক প্রদেশগুলি পুনবৰ্হালের জোর আন্দোলন ও প্রচেষ্টা, প্রাদেশিক পরিষদগুলিতে মন্ত্রীত্ব লােভে সীমাহীন নিম তৎপর, জাতীয় এবং প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা এবং তদসমর্থক পরিষদ সদস্য ও দলীয় কর্মীদের বলগাহীন দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ, ১৯৫৭ সালের ৯ই মে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে ই ভাঃ খান সাহেবের মৃত্যুবরণ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্তৃক সশয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত ইত্যাকার ঘটনা সমগ্র দেশে এক উজ্জ্বল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে। প্রলাল চক্ৰাক্ত রাজনীতির পাকা খেলােয়াড় প্রেসিডেন্ট মীর্জ ইহারই পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করেন। বলাই বাহুল্য, দেশে সামরিক শাসন জারি করিয়া স্বীয় ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ ছিল তাহার পূর্ব পরিকল্পিত। কেননা, প্রেসিডেন্ট মীর্জাই উপরােল্লিখিত ঘটনাবলীর নেপথ্য নায়ক। কিন্তু ইহা ভাপােরই নিমর্ম পরিহাস বলিতে হইবে যে, শেষ পর্যন্ত এই প্রেসিডেন্ট শীর্জাকেই ২৭শে অক্টোবর (১৯৫৮) জেনারেল আইউব খানের নিকট সমগ্র দায়িত্ব অর্পণ করিয়া দেশত্যাগী হইতে হয়। কে জানিত যে, রাজনীতিকিলদের দিকে নজর রাখিয়া একদা তিনি যে “While the going is good’ অর্থাৎ দেশত্যাগই শ্রেয়। বলিয়া বক্রোক্তি করিয়াছিলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে তাহা তাহারই বেলায় প্রযােজ্য হইবে।
যন্ত্রের শিরােমণিকে পাল্টা ষড়যন্ত্রই চরম আঘাত হানে। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে তাদানকালে বিরােধী দলীয় নেতা সরদার বাহাদুর খান এই চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাস করিয়াছিলেন যে, মার্কিন সরকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে দেশে সামরিক আইন জারি করিতে বাধ্য করে। অথচ ইস্কান্দার শীর্জার পদচুরি সময় মার্কিন সরকার নীরব দর্শক ছিলেন মাত্র। আবার সাধারণ নির্বাচন
নড়াল করিয়ায় ব্যাপারে ইস্কান্দার মীর্জায় প্রয়াসে মদদ জোলাইয়া সােহরাওয়ালরি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করিতেও মার্কিন সরকার সামান্যতম
রেন নাই। ইহাকেই বলে বড় পিরীত ৰাশির বাধা বিশ্বাসঘাতকতা ও হতাশাই অসম প্রেমকে ক্ষতবিক্ষত করে। মন যায়, জঙ্গি যায়, কুল যায় কি আরাকানের কৃপার দেখা পাওয়া যায় না। সহজ সরল চিন্তন সত্যটি নেতা সােহরাওয়ার্দী অনুধাবন করিতে ব্যর্থ হইয়াছিলেন। মার্কিন প্রেমে মশগুল হইয়া সােহরাওয়ার্দী আরব জাহান, মুসলিম জাহান ও তৃতীয় বিশ্বের কঠোর সমালােচনার পাত্রে পরিণত হইতেও দ্বিধা করে নাই। এমনকি স্বীয় জনগণের নিকটও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খুঁটি হিসাবে পরিচিতি অর্জন করিলেন। অদৃষ্ট্রের আরাে নির্মম পরিহাস এই সঙ্গেই লক্ষণীয়। তাহার হাতে গড়া শেখ মুজিবর রহমানকেও বাংলাদেশের অ্যুদয়ের নায়ক হওয়া সত্ত্বেও অরতীয় সরকারের সাফগােপাল নায়কের অবাকি পরিচয় লইয়াই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সামরিক অথানে ধরাধাম হইতে বিদায় নিতে হইয়াছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ
| প্রশ্ন উঠতে পারে, মার্ক যুক্তরাষ্ট্র উপরােল্লিখিত মারাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণে কেন সাহিত হইয়াছিল ? প্রথমতঃ পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খানের মার্কিন সম্রাজ্যবাদ বিরােধী প্রকাশ্য ভূমিকা ও পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলুপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্য এবং গফফার খান, কাইয়ুম খান, মমতাজ দৌলতানা, মি ইফতেখার শীল, আইউব গুরাে, জি, এম, সৈয়দের নেতৃত্বের সমঝোতায় ফলে ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য অম্ল নির্বাচনে মার্কিন যুক্ত ঘেঁা আওয়ামী লীগ নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ণীর বদলে মার্কিন বিরােধী শক্তি কর্তৃক পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থাৎ সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, সি ও বেলুচিস্তানে বিপুল ভােটে জয়ী
হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। দ্বিতীয়তঃ যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হওয়ায় ভারতবিরােধী ভূমিকার ফলে পুর্ব পাকিস্তানে শহীদ সােহরাওয়ার্দী পরিচালিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। উপরে বর্ণিত বাস্তব তথ্যাবলীর এই বিশ্লেষণই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পয় স্বার্থেন্দ্ৰিসিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। তাই জননেতা শহীদ সােহরাওয়ার্দীর চেয়ে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রতি জেনারেল আইউব খান ও ইস্কান্দার মীর্জাই মার্কিন স্বার্থে অধিক প্রিয় হইয়া উঠিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে জনাব সােহরাওয়ার্দী অনুসৃত পথ কন্টাকাপূর্ণ ও বিপজ্জনক ছিল। মার্কিন প্রভুর এই অভিপ্রায় ছাড়াও সেনাপতি মােঃ আইউব খান ও প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জার ক্ষমতা দখলের ব্যক্তিগত অভিলাষও কম ছিল না। স্বার্থান্ধ, দুর্নীতিপরায়ণ ও দুর্বলচিত্ত নেতৃত্ব এইভাবেই দেশ ও জাতিকে বৈদেশিক শক্তির ক্রীড়নকে। পরিণত করে। অর্থাৎ দেশ ও জাতি স্বনির্ভর না হইয়া পরনিক্স হয়।
আগেই বলিয়াছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক চুক্তি মােতাবেক পাকস্তানে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে অধিকারপ্রাপ্ত হইয়াছিল। ডুমণ্ডলীয় সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বার্থে এবং চীন-সােভিয়েট রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক শক্তি খর্বকরিবার প্রয়াসে বিশ্বের বিঅিঞ্চলে তাবেদার প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের আনুকূল্যে মার্কিন শক্তি এইভাবেই সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করিত। তুলানুসারে পেশওয়ারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মিত হয়। সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী এই সামরিক চুক্তি বিরােধী রাজনৈতিক নেতৃত্ব সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করিলে মার্কিন সরকারের ভূমন্ডলীয় পরিকল্পনা পাকিস্তানের মাটিতে প্রচন্ড মার খাইবার আশংকা ছিল। এই ব্যাপারে বিশেষভাবে শঙ্কিত মার্কিন কূটনীতি পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন বানচালের ভূমিকা গ্রহণ করে এবং তাঁহাদের বশংবদ ইস্কান্দার মীর্জা ও সেনাপতি আইউব খানকে সক্রিয় সহায়তার দ্বারা সামরিক আইন প্রবর্তন করিতে প্ররােচিত করে।
৪৭-৫৭ দশকের দুর্নীতি
১৯৪৭ হইতে ১৯৫৭ এই এক দশকের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার, আধা সামরিক সরকার ইত্যাদি অশাখিচুড়ী উত্থান-পতনের অবসান ঘটে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর মধ্যরাত্রির সামরিক অ্যুথানে। প্রতিনিধিত্বশীল সরকারে আস্থাশীল কায়েদে আযমের ইহলােক ত্যাগের অব্যবহিত পর হইতেই পাকিস্তানে ক্ষমতাপ্রসূত প্রাসদি রাজনীতির উদ্ভব হয়। ১৯৫১ সালে মেজর জেনারেল আকবর খানের ব্যর্থ সামরিক অভুথান উচ্চাভিলাষী গোষ্ঠীর সম্মুখে ক্ষমতা দখল ও কুক্ষিগত করণের নতুন দ্বার উন্মােচন করে। সামরিক-বেসামরিক আমলা সম্প্রদায় ও কায়েমী স্বার্থের রক্ষক প্রাসাদ রাজনীতিবিদ চক্র ক্রমশঃ বিদেশী শক্তির সাহায্যসহযােগিতায় ক্ষমতা লাভের বিনিময়ে সামরিক চুক্তির মাধ্যমে রাস্ত্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বিদেশী শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীনে তুলিয়া দিতে থাকে। ঘটনার বিবর্তনে এবং ক্ষমতাসীনদের। উত্থান-পতনে জনসাধারণ সরকার হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে এবং অসহায় নীরব দর্শকে পরিণত হয়। শাসন-শােষণই ছিল রাষ্ট্ৰীয় করধারদের ‘মূলমন্ত্র’। দুর্নীতি ছিল মন্ত্রী, মেম্বার ও সরকারী আমলাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাঁহারা অবৈধ পথে প্রচুর ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করিয়া যােগ্যতা ও সততার কি অমূল্য নিদর্শনই না ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন।
মুসলিম লীগ, যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-মেম্বার, নেতা-উপনেতা দেশসেবার বদৌলতে ঢাকায় স্ব-স্ব বাড়ী-ঘর নির্মাণে অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দেন। ধানমন্ডি এলাকায় আওয়ামী লীগ সদস্যদের নির্মিত ঘরবাড়ীসমূহ আওয়ামী লীগ কলােনি আখ্যা পায় । ইহা আওয়ামী লীগ সরকারের ‘অকৃত্রিম জনসেবার অতুলনীয় স্বাক্ষর বটে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নির্লজ্জ আচরণ সেক্রেটারিয়েটের মহাজন আমলাদিগকে তাঁহাদের অবাঞ্ছিত পদাংক অনুসরণ করিতে উৎসাহিত করে এবং আমলাগােষ্ঠী সংখ্যাধিক্য বিধায় লুটপাটের সিংহভাগ তাহারাই পায়। পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসভুক্ত সিভিল সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিস, ফাইনান্স সার্ভিস ইত্যাদির অন্তর্গত কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের শতকরা ৯৫ জন ছিলেন দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাহারা চাকুরীর প্রথম জীবনে ছিলেন ৩ শত হইতে ৫ শত টাকার বেতনভুক্ত কর্মচারী। অথচ প্রশাসনিক ক্ষমতার অপপ্রয়ােগ ও অপব্যবহার দ্বারা স্বীয় জীবন ভােগের উদগ্র বাসনায় চরম অসুদপায় অবলম্বনে তাহারা কোন সময়ই কুণ্ঠিত হন নাই এবং বিপুল অর্থোপার্জনের মাধ্যমে এই দেশে তাহারাই রামরাজত্ব কায়েম করিয়াছিলেন। ৩, ৪ অথবা ৫ বত্সরের চাকুরী জীবনে রাজধানী ঢাকা । অথবা বন্দর শহর চট্টগ্রাম বা খুলনার বুকে সুরম্য অট্টালিকা নির্মাণ বা কয়, শহরে, গ্রামেগছে জোতজমি ক্রয়, স্বীয় ব্যবহারের জনা গাড়ী য়ে, ঠাট বজায় রাখিবার অতিরিক্ত জিনিসপত্র যথার রেফ্রিজারেটর, দামী কার্পেট, ড্রইং রুম সেট, ডাইনিং হলসেট, সহধর্মিনীর। শাড়-গহনা ক্রয়, দেশে-বিদেশে স্বনামে-বেনামে ব্যাংক ব্যালান্সের মােহ তাহাদের পাইয়া বসিয়াছিল। ৩ শত, ৫ শত এমন কি হাজার দুই হাজার টাকা বেতনভােগী সরকারী কর্মচারীদের ক্লীবনে এইসব ছিল ৰূপকথার কাহিনীর ন্যায়। পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকার নগণ্যসংখ্যক সরকারী কর্মচারী ব্যতীত অধিকাংশের বেলায়ই ইহা ছিল অকাট্য সত্য। জীবন ও যৌবন ভােগের উন্মত্ত নেশায় তাহাদের সচেতন অপরাধ প্রবণতা জাতিকে দুর্নীতির অতল গহবরে নিমজ্জিত করে। এতদবর্ণিত জাতিদ্রোহী, সমাজদ্রোহী, নীতিদ্রোহী জীবশ্রেণীর বিরুদ্ধে যাহারা কণ্ঠকে সােচ্চার রাখিয়াছিলেন, তাহাদিগকে প্রশাসনিক ক্ষমতার দাপটের শিকার হইতে হইত ও পুনঃ পুনঃ কারাবরণ ছিল তাহাদের জন্য অবধারিত। মাওলানা ভাসানীর বিশাল ব্যক্তিত্বকেও বার বার কারা নির্যাতন ভােগ করিতে হইয়াছে। খােলাফায়ে রাশেদীন ইসলামী জীবনবােধ ও মূল্যবােধ বাস্তবায়নের স্বর্ণযুগ ছিল। মাওলানা ভাসানী সেই যুগের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। পক্ষান্তরে পাকিস্তানী শাসনদন্ডের নায়কবৃন্দ যথানওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান, গােলাম মােহাম্মদ, ইস্কান্দার মীর্জা, শহীদ সােহরাওয়ালা প্রমুখ ইসলামী জীবনাদর্শন নির্দেশিত জীবনবােধ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরুদ্ধে ছিলেন পর্বতপ্রমাণ বাধা। তাঁহাদের বক্তৃতা-ভাষণে একদিকে ইসলামী জীবনদর্শনের গভীর তাৎপর্য ও ব্যবহারিক জীবনে উহার রূপায়নের খই ফুটিত এবং অন্যদিকে তঁাহারাই আবার মাওলানাকে লুঙ্গীস ইসলামের শত্রু’ পাকিস্তানের শ” “ভারতের চর’ ইত্যাদি হীন আখ্যায়িত করিতে সামান্যতম ক্লেশ বােধ করেন নাই।
জাতীয় চরিত্রের অবক্ষযুকালে জনগণ আদর্শচ্যুত ও লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া আত্মশক্তি হারাইয়া ফেলে ও বহিঃশক্তির নিকট অবচেতন অবস্থায় আত্মসমর্পণ করে। আত্মিক শক্তির পরীতৰ ও অবলুপ্তির এই সন্ধিক্ষণেই ইস্কান্দার মীর্জা আইউব খানের অথানকে স্বাগত জানান। এবং এইভাবেই জনগণের সার্বভৌমত্বের অস্বীকৃতির উপর জেনারেল আইউব খানের একনায়কত্বের ভিত রচিত হয়।
‘৫৮ সালের সামরিক শাসন
গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ সর্বপ্রথম রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে অভিযান ঘোষণা করিয়াছিলেন। তাঁহারই পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আইউব খান ৭ই অক্টোবর (১৯৫৮) দিবাগত মধ্যরাত্রিতে সর্বময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। জেনারেল আইউব খান প্রধান সামরিক শাসনকর্তার দায়িত্বভার গ্রহণের কয়েকদিনের মধ্যেই পূর্ব পাকিস্তান সফরে ঢাকা আগমন করেন ও ঢাকা স্টেডিয়ামে এক বিশাল জনসভায় ভাষণদান কনে। অনস্বীকার্য যে, দুর্নীতির দরুণ লোকচোখে হেয় রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক অঙ্গন হইতে বিদায় দেওয়ার কারণে সামরিক অত্যুথানে
জনগণ সেই সময়ে আনন্দিত হইয়াছিল এবং জেনারেল আইউব খান সাধারণ লােকের প্রাণঢালা সমর্থনও লাভ করিয়াছিলেন। জেনারেল আইউব খান ঢাকা অবস্থানকালেই ২৪শে অক্টোবর (১৯৫৮) প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা জেনারেল আইউব খানকে ১২ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করেন এবং লেঃ জেঃ মুসাকে জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া প্রধান সেনাপতির পদ দান করেন। ২৭শে অক্টোবর সকাল ১০টায় জেনারেল আইউব খান প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। দিবা অবসানের কিয়ৎকালের মধ্যেই লেঃ জেঃ আজম খান, লেঃ জেঃ কে, এম, শেখ, লেঃ জেঃ ডবলিউ, এ, বাকী প্রেসিডেন্ট মীর্জার সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাহাকে পদত্যাগপত্র সহি করিতে বাধ্য করেন। পদত্যাগপত্র সহি করিয়া সস্ত্রীক লন্ডনের পথে রওয়ানা হইবার পূর্বকাল পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ কোয়াটা সার্কিট হাউসে ইস্কান্দার মীর্জী কালযাপন করিতে বাধ্য হন। | সামরিক শাসন প্রবর্তিত হইবার অব্যবহিত পরই গভর্নর সুলতানুদ্দিন আহমদের স্কুলে পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ জাকির হােসেন গভর্নরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং কালাবাগের নওয়াব পশ্চিম পাকিস্তানের গর্নর নিযুক্ত হন।
| সামরিক শাসন জারির কিছুকালের মধ্যে জাতীয় নেতা মাওলানা ভাসানীসহ শত শত দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হন। ১২ই অক্টোবর (১৯৫৮) মওলানা ভাসানী কারারুদ্ধ হইলেন এবং ১৯৫৯ সালের ৬ই অক্টোবর হইতে ১৯৬২ সালের ৩রা নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় সরকারী ভাড়া বাড়ীতে অন্তরীণ রহিলেন। তাহার রী ও সন্তানগণ সরকারী খরচে তাহার সহিত অবস্থান করিতেন। সাবেক দুর্নীতি দমনমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ১৯৫৮ সালের East Pakistan ActLXX II/38 -এর VA ও Act Il/47 এর 5 (2) ইত্যাদি দুর্নীতি দমন ধারা বলে ১২ই অক্টোবর (১৯৫৮) গ্রেফতার হন এবং
২০শে অক্টোবর কারান্তরালে অবস্থানকালেই বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্সের বলে তাহাকে নিরাপত্তা বন্দী করা হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের ৭ই ডিসেম্বর মুক্তিলাভ করেন। যদিও নিছ আদালত তাহার বিরুদ্ধে আনীত ৯টি মামলার মধ্যে ৮টি বাতিল করিয়া দিয়াছিল; তবুও ঢাণ জেলা ও সেসন জজ (পদাধিকার বলে সিনিয়র স্পেশাল জজ) এ, মওদুদ সাহেব ১২ই সেপ্টেম্বর (১৯৬০) তাঁহার দেয় রায়ে দুনীতির দায়ে অভিযুক্ত শেখ মুজিবর রহমানকে দােষী সাব্যস্ত করিয়া দুই বত্সর বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৫০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাস অতিরিক্ত কারাদন্ড প্রদান করেন। উক্ত সক্সির বিরুদ্ধে আপিল করিলে ঢাকা হাইকোর্ট সন্দেহের অবকাশ আছে’ যুক্তিতে বিশেষ অদিালতের রায়কে নাকচ ঘােষণা করে। | সামরিক শাসন প্রবর্তনের স্বল্পকালের মধ্যেই আমি চট্টগ্রাম বন্দরে ৫৭৭/এ, আলাপ ঠিকানায় চট্টগ্রাম নিবাসী ব্যবসায়ী শেখ নজমুল হকের সহিত পার্টনারশীপ ব্যবসা আরম্ভ করি। আমাদের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল এম, করপােরেশন সামরিক-বেসামরিক গােয়েন্দার ভয়ে আমাদের ব্যবসায়ী অফিসে ক্রেতা-বিক্রেতা আসিতে দ্বিধাবােধ করিত। আমায় পাব ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক কারণে অসুবিধা হইত কিন্তু তাহার এই সম্পন ছিলেন যে, কখনও ভুলক্রমেও ক্ষোভ প্রকাশ করিতেন না। আমি কৃতজ্ঞতার সহিত তাহাদের স্মরণ করি। ১৯৫৮ সালের (অক্টোবর) সামরিক শাসনের প্রথম পর্যায়ে ব্যবসায়ী শ্রেণীর উপর গজব নাজেল হইতে শুরু করে। সামরিক বিভাগীয় উর্দি পরিহিত নওজোয়ান বা অফিসারের আকস্মিক সাক্ষাতেও সাধারণ লােকের আত্মারাম খাচা ছাড়া হইত। এই ভয়ালু ‘পরিস্থিতিতে ছাপােষা ব্যবসায়ী শেখ নজমুল হক কর্তৃক আমাকে ব্যবসায়ীক পার্টনার করাটা যে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল আমি তাহা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করি। এই ব্যবসা পরিচালনাকালেই সরকার বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স বলে আমাকে ১৯৫৯ সালে আমার শ্রদ্ধেয়া জ্যেষ্ঠা ভগ্নির বাসা হইতে গ্রেফতার করিয়া চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে বন্দী করে।
পূর্ব পাকিস্তান সামরিক আইন শাসনকর্তা মেজর জেনারেল ওমরাও খানের প্রাইভেট সেক্রেটারী মেজর আনিসুজ্জামান সামরিক শাসনকর্তার আদেশে চট্টগ্রাম কারাগারে আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর মেজর আনিসুজ্জামান তাহার প্রতিপাদ্য বিষয়ের অবতারণা করিয়া বলেন, ‘সামরিক শাসন নির্দলীয় শাসন। কর্তৃপক্ষ আপনার সহযােগিতা কামনা করেন।’ তদরে তাহাকে স্পষ্ট ভাষায় জ্বালাইয়া দিলাম, সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সামরিক শাসন প্রবর্তন জনগণের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দীকালের যযন্ত্রেরই ফল। সুতরাং সামরিক কর্তৃপক্ষের সহিত সহযােগিতার প্রশ্ন অবান্তর। তদুপরি কারারুদ্ধ অবস্থায় কোন প্রকার আলােচনায় অংশগ্রহণ মর্যাদা হানিকর। আমার স্পষ্টাক্তিতে ক্ষুব্ধ ও নিরুৎসাহিত মেজর আনিসুজ্জামান বিষন্ন বদনে কারাগার কার্যালয় হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। অবশ্য মেজর সাহেব সহজে হাল ছাড়িবার পাত্র ছিলেন না। পরদিন চট্টগ্রাম জেলা কারাগার সুপারিন্টেনডেন্ট কাইয়ুমুদ্দিন সাহেব আমার সহিত দেখা করিয়া জানান, “আপনি আলােচনা করিতে সম্মত হইলে মেজর আনিসুজ্জামান পুনরায় আপনার সহিত জেল পেটে দেখা করিবেন। প্রত্যুত্তরে সুপারিন্টেনডেন্ট সাহেবকে স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া সামরিক ও মেলায়
দিয়াছিলাম, “বন্দী অবস্থায় সামরিক শাসনকর্তা প্রেরিত প্রস্তাব বিবেচনা করা দূরে থাকুক, আমি শুনিতেই রাজী নই।”
মাসাধিককাল পর আমি চট্টগ্রাম জেলা কারাগার হইতে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরিত হই। আইউবের স্টিমরোলার
জনগণের সার্বিক সার্বভৌম অধিকার হরণে প্রেসিডেন্ট আইউবের কৃতিত্বে অনুচর ও পরিষদবর্গ এতবেশী বিমুগ্ধ ও বিমােহিত হইয়া পড়িয়াছিল যে, মন্ত্রীসভার সহযােগিতায় তাহারা কিছুকালের মধ্যেই জেনারেল মােহাম্মদ আইউব খানকে ফিল্ড মার্শাল পদে অভিষিক্ত করেন। প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীই ছিল আইউবের ক্ষমতার মূল উৎস এবং সেনাবাহিনীর সহিত ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখিবার উপরই নির্ভরশীল ছিল তাহার প্রতি সেনাবাহিনীর আনুগত্য। পদাধিকার বলেই একজন ফিল্ড মার্শাল সেনাবাহিনীর সহিত আমৃত্যু সম্পর্ক রাখিতে পারেন। কালবিলম্ব না করিয়া ফিল্ড মার্শাল পদ গ্রহণের পূঢ় রহস্য সহজেই অনুধাবনীয়। । ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার পরপরই দুর্নীতি, কর্মবিমুখতা, অদক্ষতা ও শৃঙ্খলা বিরােধী আচরণের অজুহাতে আইউব খান সরকার পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের ১২ জন অফিসার, ৮৪ জন উচ্চপদস্থ প্রথম শ্রেণীর চাকুরে ও আড়াই হাজার নিম্নপদস্থ সরকারী কর্মচারীকে বরখাস্ত করেন। তদুপরি পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডিন্যান্স (P0.D0.) জারি করিয়া মন্ত্রী ও আইন পরিষদ সদস্যদের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। উল্লিখিত অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী বিচারে যদি কেহ ট্রাইব্যুনলি কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হন তাহা হইলে ইলেকটিভ বডিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী অপরাধী ব্যক্তি ১৯৬৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন নির্বাচনে প্রার্থী হইতে পারিবেন না। স্মর্তব্য যে, বিচারপতি আকরমের নেতৃত্বে গঠিত ট্রাইব্যুনালের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সর্বজনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবু হােসেন সরকার সকল অভিযােগ অস্বীকার করা সত্ত্বেও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা হইতে বঞ্চিত হন এবং জনাব আতাউর রহমান খান অর্ডিন্যান্সের শর্ত অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ মানিয়া লইয়া ট্রাইব্যুনাল মােকাবিলা করা হইতে অব্যাহতি লাভ করেন।
আগেই বলিয়াছি, সামরিক শাসন জারি হওয়ার সাথে সাথে কয়েক হাজ্জার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী কারাগারে নীত হইয়াছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে গ্রফতারকৃত রাক্সবন্দীদের উপর চালান হয় অকথ্য নির্যাতন। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির দফতর সম্পাদক জনাব হাসান নাসিরকে ১৯৬০ সালের ৮ই আগস্ট করাচী কারাগারে আটক করা হয়। নির্মমতম দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হইয়া কারারুদ্ধ অবস্থায় লাহাের দুর্গে ১৯৬০ সালের ১৩ই নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সীমান্ত প্রদেশে প্রায় তিন হাক্তার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী কারাবরণ করেন এবং বাক্সবন্দীদের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। কোয়েটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ৪শত জন বেলুটীকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় পায়ে দড়ি বাধিয়া টাঙ্গাইয়া রাখা হয় ও মাঝে মাঝে তাহাদের তড়িঘড়ি করা হয়। সিন্ধু প্রদেশের হায়দারাবন্দি কারাগারে
৭ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
| আইউব খান আয়কর ফাকিদাতা, বৈদেশিক মুদ্রা পাচারকারী ও সীমান্ত পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফলে এক কোটি আট লক্ষ স্টালিং বৈদেশিক মুদ্রা ও সমুদ্র তীর হইতে দুই টন স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের ভূমি ব্যবস্থা সংস্কার করিয়া জলসেচ সুবিধাপ্রাপ্ত জমির ক্ষেত্রে পাচশত একর ও জলসেচ ব্যবস্থাহীন জমির ক্ষেত্রে এক হাজার একর সর্বোচ্চ জমি মালিকানা নির্ধারণ করিয়া দেওয়া হয়। সরকারী বন্ডের বিনিময়ে জমিদারী উচেছদ ও বিনা খেসারতে জায়গীরসমূহের বিলুপ্তি ঘটানাে হয়। রাজধানী স্থানাঙ্কর, আস্থা ভােট গ্রহণ | প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খান সেনাবাহিনীর সহিত প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রাখিবার প্রয়াসে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজধানী করাচী হইতে সেনাবাহিনীর সাধারণ সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডিতে স্থানান্তরিত করেন। তাহার ক্ষমতা গ্রহণের পিছনে জনসাধারণের অনুমােদন আছে, ইহা বিশ্বকে বুঝাইবার নিমিত্ত প্রেসিডেন্ট ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সমগ্র পাকিস্তানে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং নির্বাচিত ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যদের নিকট হইতে ১৯৬০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী ‘আস্থা’ ভােট গ্রহণ করেন। সামরিক আইনবিধি অনুযায়ী ভোট দাতাগণের হা” বা ‘না’ বলার ক্ষমতা ছিল মাত্র এবং প্রেসিডেন্ট আইউব উক্ত ব্যবস্থাপনায় বিপুল ই সূচক আস্থাভােট আদায় করিতে সমর্থ হন। | খা” ভোট প্রাপ্তির পর ১৯৬০ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী দেশের সংবিধান প্রণয়নকল্পে বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে কনস্টিটিউশন কমিশন গঠন করা হয়। পূর্বপাক হাইকোর্টের এতঃ জেনারেল জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী (পরবর্তীতে হাইকোর্ট বিচারপতি ও ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) ও চট্টগ্রামের ও, আর, নিজাম উক্ত কমিশনের অন্যতম সদস্যবৃন্দ ছিলেন। কনস্টিটিউশন কমিশন ১৯৬১ সালের মে মাসে রিপাের্ট দাখিল করে। সেই রিপাের্ট মােতাবেক দেখা যায়, কমিশন ৬২৬৯ প্রশ্নোত্তর পায় ও ৫৫ জনের ইন্টারভিউ নেয়। সরকার পদ্ধতি, পার্লামেন্টারী পদ্ধ িপক্ষে শতকরা ২১.৩, গুরুতরভাবে সংশােধিত পার্লামেন্টারী পদ্ধতির পক্ষে শতকরা ২৯,৩ প্রেসিডেন্সিয়েল পদ্ধতির পক্ষে শতকরা ৪৭,৪ আর খিলাফত পদ্ধতির পক্ষে শতকরী ২, রাষ্ট্রকে ফেডারেল করিবার পক্ষে শকী ৫,৫ ও ইমিটায়ী করিবার পক্ষে শতকরা ৩৪.৫, শক্তিশালী কেন্দ্র (Strong Center) পক্ষে শতকরা ৬১.৫ ও দেশরক্ষা, বিদেশনীতি, মুদ্রা তিন বিষয় (Strong Center) পক্ষে শতকরা ৬১.৫ ও দেশরক্ষা, বিদেশনীতি, মুদ্রা তিন বিষয় কেন্দ্রীয় সরকার পক্ষে শতকরা ৩৮.৫, কমিশন রিপাের্ট অনুযায়ী ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ এক প্রত্বব্যঞ্জক সংবিধান দেশ ও জাতির উপর চাপাইয়া দেওয়া আইউবের উন্নয়নমূলক কাজ প্রেসিডেন্ট আইউব স্বীয় শাসন আমলে ভােটাধিকার প্রশ্নে মতামতদানের জন্য ‘ফ্রেঞ্চাইয়া কমিশন’, খাদ্য ও কৃষি সম্বন্ধে সুপারিশ করিবার জন্য ‘ফুড এন্ড এগ্রিকালচার কমিশন’, ভূমি ব্যবস্থার জন্য ল্যান্ড রিফরম কমিশন’, শিক্ষা বিষয়ে এডুকেশন কমিশন, চিকিৎসা সম্পর্কে ‘মেক্তিকেল রিফরমস কমিশন, বিজ্ঞান বিষয়ে সাইন্টিফিক কমিশন, সংবাদপত্র বিষয়ে প্রেস কমিশন, ব্যাংক বিষয়ে ক্রেডিট ইনকোয়ারী কমিশন’, ‘বিবাহ ও পারিবারিক বিষয়ে ‘মেরি এন্ড ফ্যামিলী লজ কমিশন, সরকারী চাকুরী বিষয়ে ‘পে এক সার্ভিসেস কমিশন, সামাজিক বিষয়ে ‘সােস্যাল ইভিন্স ইরিডিকেশন কমিশন, ফেডারেল রাজধানী সম্পর্কে ফেডারেল ক্যাপিটাল কমিশন”, দ্রব্য মূল্য বিষয়ে প্রাইস কমিশন’, সমুদ্র বাণিজ্য বিষয়ে মেরিটাইম কমিশন’, বস্ত্র শিল্প বিষয়ে টেক্সটাইল কমিশন’, পাট বিষয়ে জুট ইনকোয়ারী কমিশন, জাতীয় আয় বিষয়ে ন্যাশনাল ইনকাম কমিশন, খেলাধুলা ইত্যাদি সম্পর্কে স্পাের্টস, কালচার, ইউথ মুভমেন্ট এন্ড আর্টস ইনকোয়ারী কমিটি, সিনেমা বিষয়ক ‘ফিল্ম ইনকোয়ায়ী কমিটি”, আইন বিষয়ে ‘ল’ রিফরমস কমিশন, ইত্যাদি বিভিন্ন কমিশন ও কমিটি গঠন করেন এবং এই সবের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রকট সমস্যার সমাধান নির্ণয় মানসে দেশীয় ও বিদেশী মেধার সহায়তা গ্রহণ করেন। এইভাবে তাহার দ্বারাই দেশব্যাপী উন্নয়নের ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ক্রম বিকাশের দ্বার উনাক্ত হয়।
ইত্তেফাকের ঐতিহাসিক ভূমিকা
রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ছিল বিধায় জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যাবলী তুলিয়া ধরিবার মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। কিন্তু সামরিক শাসন কর্তাদের হামলার ভয়ে কোন পত্রিকা অবাধে সংবাদ ও মতামত প্রকাশ করিত না। এমনি নাঙুক স্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দৈনিক ইত্তেফাক দুঃসাহসের উপর র করিয়া সামরিক শাসনকে লেখার মারপ্যাচে সমালােচনা করিতে শুরু করে। অন্যান্য দৈনিক সংবাদপত্রগুলি সযত্নে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সমালােচনা এড়াইয়া চলিত। দৈনিক সংবাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আহমাদুল কবির স্বীয় । স্বভাবসুলভ পথেই সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের বশংবদ পাত্রে পরিণত হন এবং গভর্নর জাকির হােসেন কর্তৃক গঠিত শিঃ উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যপদ গ্রহণ করিয়া শীয় তরকির রাজপথ খােলাসা করিয়া লন। ইত্তেফাকের সমালােচনার আঁচড় সহ্য করিতে না পারিয়া সামরিক শাসনকর্তা সেই অন্ধকার যুগে আশার আলােকবর্তিকা ইত্তেফাক সম্পাদক নির্ভীক তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়াকে ১৯৫৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করেন এবং সামরিক আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারে তাহাকে দণ্ডাদেশ দেন। ভবিষ্যতে লেখনীতে সতর্কতা। অবলম্বন করিবেন এই মর্মে লিখিত আশ্বাস দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নির্দেশে সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হােসেন মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ইহা সর্বনবিদিত যে, কারামুক্তির পরও ‘মুসাফিরের লেখনীতে বিশেষ কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় নাই। দুষ্মনাম ‘মােসাফির লিখিত পােস্ট এডিটরিয়েল ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ জেল রাক্সবন্দীদের জন্য সঞ্জীবনী সুধাবৎ ছিল। ইহা স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কত্ববাদের বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তার সগ্রামের অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল। উক্ত প্রচেষ্টা নিসন্দেহে অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য প্রেরণায় উস হইয়া থাকিবে।
গভর্নর পদে আজম খান পূর্ব পাকিস্কানের সামরিক প্রধান এবং বেসামরিক গভর্নর-এর মধ্যে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়ােগে জটিলতা ও দ্ব নিরসনকল্পে জাকির হােসেনের স্থলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক উন্নয়নে পর লেঃ জেঃ আজম খানের আন্তরিকতা ও গতিশীল নেতৃত্ব বাঙ্গালী হৃদয়কে মুগ্ধ ও অভিভূত করে। আজম খানের বিদায় গ্রহণকালে তাহার কর্মক্ষমতা, সততা ও আন্তরিকতায় বিদ্ধ ও কৃতজ্ঞ বাঙ্গালী জাতি অশ্রুসিক্তনয়নে ও ব্যথাবিধুর হৃদয়ে তাহাকে বিদায় দেয়। ইহা এক মর্মস্পর্শী মুহুর্ত। উর্দুভাষী আজম খানের খাঁটি দেশপ্রেম ও বাঙ্গালী জাতির মহত্ব একই শ্রবণ হইতে উৎসারিত। মানবীয় গুণাবলীর ফরুধারা একই স্রোতস্বিনীর শাশ্বত স্রোত ধারায় প্রবাহিত হইয়া একই মহামানবের সাগরে লীন হইয়াছে। ইহাই সত্য, ইহাই সনাতন। ব্যতিক্রম মনুষ্য চরিত্রের বিকৃত রূপমত্রি। | ১৯৬০ সালের ১০ই ও ৩১শে অক্টোবর উপর্যুপরি দুইটি ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের ফলে বন্দর নগর চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। উক্ত দুর্যোগমুহূর্তে ত্রাণ তৎপরতায় পর্নর আজম খানের কর্মদক্ষতা, আন্তরিকতা ও সততা বাঙ্গালী মনপ্রাণকে বিস্ময়করভাবে অভিভূত করে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈমাত্রেয়সুলভ আচরণ ভারত-পাকিস্তান তিক্ত সম্পর্ক জন্মলগ্ন হতেই বিদ্যমান ছিল। কাশ্মীর সমস্যা উক্ত তিক্ত সম্পর্কে সহজতর হইতে দেয় নাই। ইহার সহিত যুক্ত সিন্ধুনদ পানি সমস্যা। পাকিস্তানে প্রবাহিত পানির উৎস ছিল ভারতভুক্ত কাশ্মীরে। পাকিস্তানে পানি সরবরাহ অব্যাহত রাখিবার উদ্দেশ্যে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পঞ্জিত জওয়াহের লাল নেহরু ও পাকিরনের প্রেসিডেন্ট আইউব খান ১৯৬০ সালের ১৯শে সেন্টের কাজীতে ‘দি ইন্ডাস ওয়াটার ট্রিটি বা সিন্ধুনদ পানি চুক্তি স্বাক্ষর করিয়া ভারত-পাকিস্তান সম্ভাব্য সংঘর্যের একটি জটিল কারণ নিরসন ঘটাইতে সমর্থ হন। উক্ত একই পথে পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতীয় সীমাকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ তথা ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানি প্রত্যাহার জনিত মারাত্মক সমস্যার সমাধান করা হয়তাে সম্ভব ছিল অথচ তাহা হয় নাই। ইহা না হইবার একমাত্র কারণ ছিল যে, তদানীন্তন শাসকবর্গের চোখে পশ্চিম পাকিস্তানই পাকিস্তান বলিয়া বিবেচিত হইত । অতএব ‘তাহাদের নিকট পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলী সমাধানই গ্রাধিকার পাইত। পশ্চিম পাকিস্তানে কৃষি উৎপাদন রক্ষা ও বৃদ্ধিকল্পে জলবদ্ধতা ও লবণাক্ততা মেকিাবেলা করিবার প্রয়ােজনে পাকিস্তান সরকার মার্কিন কারিগরি সাহায্যসহ পাঁচশত নব্বই কোটি টাকা ব্যয় করেন কি পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণের তেমন কোন ব্যবস্থা তাহারা গ্রহণ। করেন নাই। বৈমাত্রেয়সুলভ ব্যবহার আর কাহাকে বলে। আইউবের বৈদেশিক নীতি | বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোটে অঙ্গীভূত থাকিয়া প্রেসিডেন্ট আইউব কমিউনিস্ট রাশিয়ার সহিত ১৯৬১ সালের ৩রা এপ্রিল তৈলানুসন্ধান চুক্তি সম্পাদন করেন
এবং ১৯৬১ সালের ৩রা মে কমিউনিস্ট চীনের পাক-চীন সীমান্ত নির্ধারণ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এমন কি ১৯৬২ সালের ২৩শে মে কমিউনিস্ট চীনের অর্থনৈতিক সাহায্যদানের প্রস্তাবও পাকিস্তান সানন্দে গ্রহণ করে। পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী দুই বৃহৎশক্তি সােভিয়েট রাশিয়া ও মহাটীনের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়াস সত্ত্বেও পাকিস্তানের মাটিতে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশােয়ারের নিকট করবেটে স্থাপিত মার্কিন সামরিক বিমান টি বিদ্যমান ছিল। সােভিয়েট রাশিয়ার সামরিক শক্তি পর্যবেক্ষণ করিবার নিমিত্ত মার্কিন ইউ-২ বিমান ১৯৬০ সালের ১লা মে এই ঘাটি হইতেই উড্ডয়ন করে এবং সােভিয়েট ভূমিতেই সােভিয়েট সামরিক শক্তি কর্তৃক ভূপাতিত হয়। ইহার ফলে রাশিয়ার সহিত পশ্চিমা শক্তির সম্পর্ক এতই তিক্ত হয় যে, প্রধানমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নিকিতা ক্রুশ্চেভ ১৬ মে (১৯৬০) প্যারিসে অনুষ্ঠিতব্য রাষ্ট্রপ্রধান চতুষ্টয়ের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ার, সােভিয়েট রাশিয়ার প্রমানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চে, বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাকমিলান ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দ্য গলে) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। সােভিয়েট রাশিয়া প্রেসিডেন্ট আইউব খান সরকারকে স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেয় যে, দ্বিতীয়বার পাকিস্তানের মাটি হইতে অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হইলে বিশ্ব মানচিত্র হইতে পাকিস্তানকে চিরতরে মুছিয়ে দেওয়া হইবে। কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করিয়া বিশেষতঃ ১৯৬০ সালের নির্বাচনে ডেমােক্রেট পার্টি মনােনীত বিজয়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কর্তৃক ভারত ঘেঁষা নীতি অবলম্বনের আশংকায় শঙ্কিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইউব খান পররাষ্ট্র নীতিতে অত্যন্তু সতর্কতার সহিত ও অতি ধীরে মার্কিন তাবেদারী হইতে মুক্ত হইবার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। তদসত্ত্বেও ১৯৬১ সালের ১১, ১২ ও ১৩ই জুলাই প্রেসিডেন্ট আইউবের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে প্রকাশিত যুক্ত ইশতেহারে ১৯৫৯ সালের ৫ই মার্চ স্বাক্ষরিত চুক্তিতে ঘােষিত পাকিস্তানের অথত্ব ও স্বাধীনতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ নিহিত বক্তব্যের পুনরুল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানকল্পে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংয়ের মধ্যে কয়েক দফা ব্যর্থ আলােচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। | যাহা হউক, সামরিক শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরস্থিতি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে জোটবদ্ধ হইতে উৎসাহিত করে। প্রভূত্বব্যঞ্জক সরকারের অবসানের জন্য শহীদ সােহরাওয়ার্দী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সহিত আলাপ-আলােচনার সূত্রপাত করেন। ঘনব সোহরাওয়ার্দীর এক প্রচেষ্টায় উক্ত হইয়া প্রেসিডেন্ট আইউব খান ১৯৬২ সালের ৩০শে জানুয়ারী করাচীতে তাঁহাকে গ্রেফতার করেন। ১৯৬২ সালের ১৯শে আগস্ট জনাব সােহরাওয়ার্দী বন্দীশালা হইতে মুক্তি লাভ করেন। ছাত্র বিক্ষোভ
| জনাব সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১লা ফেব্রুয়ারী (১৯৬২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ও ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৬ ও ৭ই ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট ও বিক্ষোভের মুখে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা
করেন। ৬ই ফেব্রুয়ারী দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেনকে (মানিক মিয়া) আবার কারারুদ্ধ করা হয় এবং ৭ই ফেব্রুয়ারী শেখ মুজিবর রহমানও গ্রেফতার হন। তাঁহারা ছাড়াও জনাব আবুল মনসুর আহমদ (প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী) বন্দী হন। ছাত্র আন্দোলন দাবানলের ন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়ে। আইউব বিরােধী ছাত্র বিক্ষোভ প্রশমিত করিবার জন্য অসংখ্য ছাত্ররাঞ্জনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার করা হয় । | ১৯৬২ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলাকালে আমি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হাসপাতালে অসুস্থ ছিলাম । দুঃখের হইলেও বলিতে হয়, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ছাত্র কর্মীরা সামরিক সরকারের নিকট মুচলেকা সহি করিয়া কারামুক্তি গ্রহণ করে। উক্ত গর্হিত কাজের অন্যতম প্ররােচক ছিলেন রাজশাহী মােক্তার বার সদস্য ও ১৯৫৪ সালে নির্বাচিত আইন পরিষদ সদস্য ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা আতাউর রহমান। প্রসঙ্গতঃ ইহাও উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন প্রবর্তনকারী প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমান। কর্তৃক এই আতাউর রহমানই রাজশাহী জেলার গর্জর নিযুক্ত হইয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, জনাব আতাউর রহমান নিজেও ১৯৫১ সালে তদানীন্তন নূরুল আমিন সরকারের আমলে বন্ড বা মুচলেকা সহি করিয়া কারামুক্তি লাভ করিয়াছিলেন। নূতন সংবিধান নির্বাচন
ছাত্র আন্দোলনের ঢেউ কিছুটা স্তিমিত হইতেই ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান নতুন সংবিধান জারি করেন এবং সংবিধান মােতাবেক এপ্রিল মাসের ২৮ তারিখ জাতীয় পরিষদের নির্বাচন ও মে মাসের ৬ তারিখ প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রিদের চাপে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হইতে বিরত থাকেন অর্থাৎ নেতৃত্বদানের অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হন। ইহাতে আর যাহাই থাকুক, রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় যে ছিল না ইহা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। পক্ষান্তরে রাজনীতিবিদদের অপর একটি অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় প্রত্যক্ষ ক্ষমতাহীন জাতীয় পরিষদ মঞ্চ হইতেও দেশবাসীর বব যথার্থভাবে উপস্থিত করা যে সম্ভব হইয়াছে, তাহা এক ঐতিহাসিক সত্য। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সভাপতি তমিজুদ্দিন খান, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলী (বগুড়া), মশিউর রহমান, পাকিস্তান সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী রমিজুদ্দিন আহমদ, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুস সবুর খান, আবদুল মােনায়েম খান, পশ্চিম পাকিস্তানের সরদার বাহাদুর খান, সিন্ধুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্ৰীয় গােলাম আলী তালপুর ও কাজী ফজলুল্লাহ প্রমুখ এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিয়াছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাত নেঙ্গ যথা-পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন, আবু হােসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, মাহমুদ আলী, পীর মােহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিন্না) ১৪ই এপ্রিল (১৯৬২) আইউব সংবিধান ও তৎকালীন নির্বাচনে অংশ্রহণের বিরােধিতা করিয়া সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করেন। ২৮শে এপ্রিল যথারীতি জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ৮ই জুন রাওয়ালপিন্ডিতে নব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন
বসে। বিরােধী দলীয় সদস্য জনাব তমিজুদ্দিন খান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার এবং জনাব আফজাল চীমা ও আবুল কাসেম ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। পাক পিপলস গ্রুপ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও কতিপয় স্বতন্ত্র জাতীয় পরিষদ সদস্য ২৪শে নভেম্বর (১৯৬২) রাওয়ালপিন্ডিতে এক সভায় ঐক্যবদ্ধভাবে জাতীয় পরিষদে কাজ করিবার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬শে নভেম্বরের সভায় পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) নেতা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সর্দার বাহাদুর খান সম্মিলিত বিরােধীদলের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ওরা আগস্টের (১৯৬২) অনুষ্ঠিত সভায় এডভােকেট আফসার উদ্দিন আহমদকে আহবায়ক করিয়া এগার সদস্যবিশিষ্ট সাব কমিটি গঠন করা হয়। ৪ঠা আগস্ট জনাব আফসার উদ্দিন আহমদকে নেতা নির্বাচিত করিয়া পরিষদে ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক গ্রুপ গঠন করা হয়। একই তারিখে আইউব সরকারের সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে পিপলস ডেমােক্রেটিক গ্রুপ গঠিত হয়।
প্রেসিডেন্ট আইউবের জারিকৃত সংবিধান গ্রহণীয় ঘােষণা করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ৯ জন নেতা ২৪শে জুন (১৯৬২) নিম্নলিখিত এক যৌথ বিবৃতিতে সার্বজনীন ভােটাধিকারে নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের আহবান জানানঃ
1. Rule by Martial Law has at last been ended. The political gloom that enveloped the country for long 45 months has been partially lifted. Door of progress towards a democratic system to be in the process of opening; but democracy has yet to come. The Constitution promulgated by Field Marshal Ayub Khan only holds out a hope but does not usher it.
2. The main subject that agitates public mind deeply today is again the Constitution of the country. This was the main topic during the recent elections though the election was limited to a small section of the people. Practically every candidate pledged his support for getting a democratic Constitution. During the last weeks since election the volume of opinion for a workable Constituion has increased considerably.
3. We will be failing in our duty if we do not express ourselves on this vital question through the only means available to us, we believe, in this, we share the opinion held by most in the country.
4. The country can make real and abiding progress through the method of evolution and by changes peacefully brought about. This can happen only where free debate and free discussion are fully assured
A durable and abiding Constitution is the pre-condition for national consolidation and stability,
5. We are convinced that no durable constitution can be adopted unless it is framed by the direct Representatives of the people.
WE SAY SO BECAUSE
6. Whatever type of Constitution is drawn up, it has to be democratic both in form and spirit. In a democracy, sovereignty belongs to the people. All authority must emanate from the people. Anything to be stable and enduring must in the first palce by the expression of the will of the people, That will must be a collective will, an organised will, and such as is freely expressed without any let or hindrance, direct or indirect.
7. A Constitution is framed with a view that it endures the vicissitudes of time, for as long as human intelligence and foresight can see, capable of meeting all situations and contigencis as can be predicted. Each and every Constitution must have such basic qualities as would make it permanent. Such basic laws cease to be basic if there are stresses and strains within it which in time are bound to blow it to pieces.
8. To have he character and quality of permanence it has to be the expression of the will and judgement of the entire community. A set of laws possessing such character alone can evoke the emotional loyalty of this generation and generations to come. Such loyalty and emotion are its strongest buttres and its impregnable defence. A document which depends on external forces other than the will of the people will have no chance of popular support, when in jeopardy.
9. The present Constitution, lacks the basic strength stated above viz, popular consensus enshrined in basic laws framed by the peoples, Representatives entrusted with that mandate and this without reference to its other merits.
10. Besides, the present document is framed on a distrust of popular will, whatever be the justification put forward for that. A body of eighty thousand electors have been provided for as base of the system in a population of more than eighty million. The Assemblies created on the Vote of these electors have practically been given no power to decide anything. Nothing can be done by these bodies unless the President agrees. Whereas the President, after the initial start, can rule without any – agreement of the assembly, both in the legislative and in the executive
fields. Experiences of barely 3 weeks working have already demonstrated that the present scheme is unworkable unless it is radically remodelled and changed. It is impossible to expect any genuine co-operate on between the Government and the Assemblies on the present basis. The members will only be tempted to demonstrate their usefullness by turning to acute and extreme criticism of the Government as they have neither any power of shaping directly the policy of the Government nor its activities. The distrust will spread into the country rendering Government more unpopular, Men of ability and independance will hardly be attracted to join such Government, and Administration will completely pass into the dead and soulless hands of bureacieracy.
11. We therefore, urge that steps be taken to have special body elected as soon as possible to give the country a Constitution to make its acceptance unquestioned by the people.
With all the materials on the subject that have accumulated during the last 15 years, a Constitution can be hammered out as will be suitable and will meet the peculiar problems of this country, in the course of 6 months at the longest.
12. In the circumstances of the above recommendations we purposely do not enter into the question as to whether the Constitution to be so framed should be of the Presidential type or Parliamentary type. We are conscious that by far the largest volume of opinion is for the parliamentary form. The reasons are historical: our long association and experiences of the working of this system predisposes us to it.
13. Similarly we need hardly say much over question whether it should be federal for unitary in-character. This question is not very controversial either. More or less it is accepted by all shades or opinion, that has to be federal with a majority of subjects being with the units particuarly in view of our peculiar Geography.
14. The other buring topic to be dealt with is the growing imbalance in the economic progress in the two wings. We believe that there is not want of good will in the people of West Pakistan and East Pakistan for each other. Public men once entrusted with real responsibility is bound to rise above all narrowness and are sure to concentrate on developing the economy of the country as a whole giving greater attention to the
backward areas wherever they are.
15. All narrow and parochial interest that are responsible for the unequal progress of the two wings had free play as the people had very little say in the policy making of the state so long. Once public opinion can assert itself through their elected representatives all reactionary forces and vested interests will be in the retreat. Much of the disparities between the wings have arisen out of the fact that East Pakistan had rarely shared effective political power in the country’s policy making particularly on economic affairs and searely has or had a say in the executive organisations, responsible for carrying out these economic policy into practice. In fact since independence all political powers were concetrated into the hands of a small group of permanent services, here having been not one single general election in the country by which the people could have a say in the country’s affairs.
16. The next important for consideration is what needs be done during the interim period.
17. The good will generated by the lifting of the Martial Law needs to be further strengthened by further statesman like acts. The distance between the people and the organs of administration should not be allowed to grow. It is a great responsibility for the President Ayub and we have every hope that it is fully appreciated.
18. Pending the adoption of a permanent Constitution by the method proposed by us, the Government of the Country has to be carried to be on.
19. But even in the interim period some essential changes need be made in the document under which the Government is being carried on.
20. It is necessary that Fundamental Rights as enumerated in the 1956 Constitution be incorporated as such in the present Constitution, and made justiciable, instead of enumerating them as principles of lawmaking’ as in the present document.
21. These can be easily incorporated in the present document either by Presidential Order or through the Legislative process as provied for in the Constitution. What is more necessary is that the executive should trust the Assemblies brought under existence under this Constitution All temptation to fill the house with persons holding office of profit should be checked. Otherwise whatever little freedom the houses have,
11. will vanish. We should not forget that trust begets trust.
12. 22. All political prisoners detained without trial should be set at liberty to restore an atmosphere of confidence in the country and all penal actions regarding politicians should be done away with.
13. 23. Political parties are the very breath of representative democracies. As life without breath is unthinkable so this elective system without the disciplined parties is unworkable Party means discilpine. No representative body can function with a large body of individuals without any kind of ties binding them and controlling their conduct behaviour within and without. No obligation except that of self-interest will influence members of partyless houses. Finally regular periodic elections are a must in as much as it is the ultimate check on individuals as on parties against irresponsible conducts. So all obstacles against the growth of party should be done away with
14. Till democracy is ushered in however, we must think in terms of the National issues now facing the country as a whole. People from all walks of life, be a private citizen, a member of the profession or of the services must make their contributions jointly to its solution.
15. 24. Finally, we feel duty-bound to say that we are passing through very trying and unsettled times. It is not peculiar to us alone. We need all the organs of the state and the Nation to act in harmony, in full understanding and co-operation as a united people to be able to face all the unforeseen contingencies. Those in whose hands destiny has placed the fate of the country shoulder the greatest responsibility to bring about that unity and to lay the foundation of a Nation united on a firm and sound footing. Let us complete the task of Constitution making as quickly as posible and free ourselves from this controversy and concentrate on the nation buliding tasks as a united people determined to fulfil the destiny which is ours.
16. Sd-1. Nurul Amin
17. 2. Ataur Rahman Khan 3. Harnichal Hoq Chowdhury 4. Abu Hossain Sarker 5. Sheikh Majibur Rahman
18. 6. Yousuf Ali Chowdhury 7. Mahmood Ali 8. Syed Azizul Hoq 9. Moulana Pir Mohsen Uddin Ahmed
ইত্তেফাকের ঐতিহাসিক ভূমিকা
রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ছিল বিধায় জনগণের দুঃখ-দুর্দশা ও সমস্যাবলী তুলিয়া ধরিবার মাধ্যম ছিল সংবাদপত্র। কিন্তু সামরিক শাসন কর্তাদের হামলার ভয়ে কোন পত্রিকা অবাধে সংবাদ ও মতামত প্রকাশ করিত না। এমনি নাঙুক স্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দৈনিক ইত্তেফাক দুঃসাহসের উপর র করিয়া সামরিক শাসনকে লেখার মারপ্যাচে সমালােচনা করিতে শুরু করে। অন্যান্য দৈনিক সংবাদপত্রগুলি সযত্নে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সমালােচনা এড়াইয়া চলিত। দৈনিক সংবাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আহমাদুল কবির স্বীয় । স্বভাবসুলভ পথেই সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের বশংবদ পাত্রে পরিণত হন এবং গভর্নর জাকির হােসেন কর্তৃক গঠিত শিঃ উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্যপদ গ্রহণ করিয়া শীয় তরকির রাজপথ খােলাসা করিয়া লন। ইত্তেফাকের সমালােচনার আঁচড় সহ্য করিতে না পারিয়া সামরিক শাসনকর্তা সেই অন্ধকার যুগে আশার আলােকবর্তিকা ইত্তেফাক সম্পাদক নির্ভীক তফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়াকে ১৯৫৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করেন এবং সামরিক আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারে তাহাকে দণ্ডাদেশ দেন। ভবিষ্যতে লেখনীতে সতর্কতা। অবলম্বন করিবেন এই মর্মে লিখিত আশ্বাস দেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নির্দেশে সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হােসেন মুক্তি লাভ করেন। কিন্তু ইহা সর্বনবিদিত যে, কারামুক্তির পরও ‘মুসাফিরের লেখনীতে বিশেষ কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয় নাই। দুষ্মনাম ‘মােসাফির লিখিত পােস্ট এডিটরিয়েল ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ জেল রাক্সবন্দীদের জন্য সঞ্জীবনী সুধাবৎ ছিল। ইহা স্বৈরতন্ত্র ও একনায়কত্ববাদের বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্ত চিন্তার সগ্রামের অন্যতম দৃষ্টান্ত ছিল। উক্ত প্রচেষ্টা নিসন্দেহে অনাগত ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য প্রেরণায় উস হইয়া থাকিবে।
* অবশেষে সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়াছে। দেশের রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে। দীর্ঘ ৪৫ মাসকাল যে তমসা বিরাজ করিতেছিল, আজ তাহা আংশিক অপসারিত হইয়াছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পথে অগ্রগতির দ্বার উন্মুক্ত হইতে চলিয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে; কিন্তু সত্যিকারের গণতন্ত্র এখনও অনেক দূরে। ফিল্ড মার্শাল মােহাম্মদ আইউব খান যে শাসনতন্ত্র প্রবর্তন করিয়াছেন, উহাতে আশার আশ্বাস থাকিলেও উহার বাস্তব রূপায়ণের কোন লক্ষণ নাই । যে বিষয়টি আজ গণমনকে গভীরভাবে আলােড়িত করিতেছে, তাহা হইল- শাসনতন্ত্র। সমগ্র জনসংখ্যার সামান্য অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিলেও সাম্প্রতিক নির্বাচনের সময়ও এই শাসনতন্ত্রই ছিল সকলের মূল আলােচ্য বিষয়। প্রকৃত প্রস্তাবে প্রত্যেক প্রার্থীই একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কায়েমের পক্ষে তাঁহাদের নির্বাচনী ওয়াদা দিয়াছিলেন। নির্বাচনের পরবর্তী বিগত ৬ সপ্তাহে কার্যোপযােগী একটি শাসনতন্ত্রের পক্ষে জনমত আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। এমতাবস্থায় এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আমরা আমাদের মতামত ব্যক্ত না করিলে কর্তব্যের বেলা করা হইবে বলিয়া মনে করি এবং বিশ্বাস করি, এই মতামত ব্যক্ত করিতে পিয়া আমরা দেশবাসীর বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আশা-আকাংখারই প্রতিধ্বনি করিতেছি। বিবর্তন এবং শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের মাধ্যমেই কেবলমাত্র দেশের সত্যিকার ও সুষ্ঠু অগতি সাধিত হইতে পারে। অবাধ বিতর্ক ও আলােচনার পূর্ণ নিশ্চয়তা যেখানে আছে, কেবল সেখানেই তাহা সম্ভব।
এইকথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, স্থায়ী ও সহজে কার্যক্ষম শাসনতন্ত্রই জাতীয় সংহতি ও স্থায়িত্বের পূর্বশর্ত। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সত্যিকার গণপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক প্রণীত না হইলে কোন শাসনতন্ত্রই টেকসই হইতে পারে না। | আমাদের এই বক্তব্যের কারণ হইতেছে এই যে, যে ধরনের শাসনতন্ত্রই প্রণীত হউক।
কেন, পদ্ধতিগত ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্টের দিক দিয়া উহাকে গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হইতে হইবে। জনগণই দেশের সার্বভৌমত্বের অধিকারী ইহাই গণতন্ত্রের সার কথা। জনগণই হইবে সকল ক্ষমতার উৎস। এমতাবস্থায় কোন কিছুকে স্থায়ী ও সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপযােগী করিতে হইলে সর্বপ্রথমেই উহাকে জনগণের ইচ্ছানুযায়ী রূপ দিতে হইবে। এই ইচ্ছা হইবে সমষ্টিগত ও সুসংহত ইচ্ছা। এই ইচ্ছার স্বতাপূর্ত বিকাশের জন্য চাই প্রত্যক্ষ, পরােক্ষ সব রকমের প্রতিবন্ধকতামুক্ত অবধি পরিবেশ। | শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় নেতাদের লক্ষ্য থাকে, যাহাতে ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করিয়া সে শাসনতন্ত্র টিকিয়া থাকিতে পারে এবং মানুষের চিন্তা ও দূরদৃষ্টির সীমানার মধ্যে যা কিছু বাধাবিপত্তি ও সঙ্কট আসিয়া দাঁড়ায়, তাহার মােকাবেলায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করিতে পারে। সুতরাং স্থায়িত্ব অজের জন্য যা কিছু মৌলিক গুণেশ্বজেন, প্রত্যেক শাসনততেই সেগুলি থাকিতে হইবে। এই মৌলিক গুণগুলি আর মৌলিক থাকে না- যদি আভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কালক্রমে সেগুলি লণ্ডভণ্ড হইবার সম্ভাবনা থাকে।
শাসনতন্ত্রকে স্থায়িত্বের বৈশিষ্ট্য ও গুণসম্পন্ন হইতে হইলে উহাতে অবশ্যই সমগ্র
জাতির ইচ্ছা ও বিচারবুদ্ধির প্রতিফলন হইতে হইবে। কেবলমাত্র এই পদ্ধতিতে প্রণীত বিধানাবলীই আমাদের বর্তমান ও অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের মনে অকৃত্রিম আনুগত্য ও আবেগ জাগাইতে পারে। এই আনুগত্য ও আবেগই শাসনতন্ত্রের প্রধান অবলম্বন ও দুর্ভেদ্য কর্মবিশেষ। অপরপক্ষে, জনমতের ইচ্ছার উপর নির্ল্ডর না করিয়া বাহির হইতে চাপানাে কোন শাসনতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে কোন জনসমর্থন লাভ করিতে পারে না একই উদ্দেশ্যে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত গণপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক জনগণের ইচ্ছামাফিক প্রণীত না হওয়ায় বর্তমান শাসনতন্ত্রে উপরােল্লিখিত অন্তনিহিত মৌলিক শক্তিলি অবর্তমান। | তাহাছাড়া সংশ্লিষ্ট মহল হইতে যে কৈফিয়তই দেওয়া হউক না কেন, এইকথা সত্য যে, জনমতের প্রতি অবিশ্বাসের ভিত্তিতেই নয়া শাসনতন্ত্র প্রণীত হইয়াছে। দেশের জনসংখ্যা যেখানে ৮ কোটিরও বেশী সেখানে ছােটারধিকার দেওয়া হইয়াছে মাত্র ৮০ হাজার লােককে। এবং তাহারই ভিত্তিতে দেশে নির্বাচন অনুষ্টিত হইয়াছে। এমনকি এই নির্বাচকমণ্ডলীর ভােটে যে সব পরিষদ গঠন করা হইয়াছে, সেগুলিকে বাস্তবক্ষেত্রে কোন ক্ষমতাই দেওয়া হয় নাই। প্রেসিডেন্ট সম্মতি না দিলে এইসব পরিষদের কোন কিছুই করিবার ক্ষমতা নাই। অথচ, আইন প্রণয়ন ও শাসনক্ষেত্রে পরিষদের মতামত অগ্রাহ্য করিয়া বা তাহাদের সহিত একমত না হইয়াই প্রেসিডেন্ট দেশ শাসন করিয়া যাইতে পারেন। মাত্র ৩ সপ্তাহের অভিজ্ঞতা। হইতে এই কথাই প্রমাণিত হইয়াছে যে, আমূল পুনর্বিন্যাস ও পরিবর্তন ব্যতিরেকে নয়া শাসনতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে কাজের অনুপযােগী। এমতাবস্থায় বর্তমান ব্যবস্থার ভিত্তিতে সরকার ও পরিষদের মধ্যে সত্যিকার সহযােগিতার আশা বাতুলতামাত্র।
প্রত্যক্ষভাবে সরকারী নীতি অথবা ইহার কার্যকলাপ নির্ধারণের কোন ক্ষমতা না থাকায় সদস্যরা শুধুমাত্র সরকারের তীব্র ও চরম সমালোচনার মারফত নিজেদের যােগ্যতা প্রমাণ করিতে প্রলুব্ধ হইবেন। অবিশ্বাস দেশব্যাপী ছড়াইয়া পড়িয়া সরকারকে অধিকতর অপ্রিয় করিয়া তুলিবে। যােগ্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিরা এই ধরনের সরকারে যােগ দিতে আগ্রহবােধ করিবেন না। আর উহার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিপ্রাণ। আমলাতন্ত্রের হস্ত নস্তি হইবে। | সুতরাং দেশবাসী বিনাদ্বিধায় গ্রহণ করিবে- এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিবার জন্য যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিশেষ সংস্থা গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমির আহ্বান জানাইতেছি। | প্রত্যেক শাসনতন্ত্রতেই সেগুলি থাকিতে হইবে। এই মৌলিক গুণগুলি আর মৌলিক থাকে না। যদি আখীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কালক্রমে সেগুলি লঙ্কত হইবার সম্ভাবনা। থাকে।
দীর্ঘ ১৫ বৎসর যাবত শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে যা কিছু তথ্য সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা দ্বারা উর্বপক্ষে ৬ মাসের মধ্যেই এদেশের বিশেষ সমস্যার মােকাবেলা করতে সক্ষম। এমন একটি উপযুক্ত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা একান্তই অপরিহার্য।
উপরিউক্ত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে শাসনতন্ত্রটি প্রেসিডেন্সিয়াল না পার্লামেন্টারী
ধরনের হইবে, সে প্রশ্ন উত্থাপন হইতে আমরা ইচ্ছা করিয়াই বিরত থাকিতেছি। তবে এই ব্যাপারে আমরা সচেতন যে, জনমতের বৃহত্তম অংশই পার্লামেন্টারী ধরনের সরকারের পক্ষপাতি। ইহার কারণ ঐতিহাসিক। কেননা, পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকারের সহিত আমাদের দীর্ঘদিনের পরিচয় ও উহার রূপায়ণে বহুদিনের অভিজ্ঞতাই আমাদিগকে উহার অনুকূল করিয়া তুলিয়াছে। অনুরূপভাবে শাসনতন্ত্র ফেডারেলধর্মী হইবে, না ইউনিটারী-সে প্রশ্নেও বেশি কিছু বলিবার প্রয়ােজন করে না, বস্তুতঃ এই প্রশ্নটি তেমন একটা বিতর্কমূলক কিছু নহে। দেশের সর্ববাদীসম্মত অভিমতই হইল, দেশের বিচিত্র ভৌগােলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ বিষয়া ইউনিটের হাতে রাখার ব্যবস্থাসহ ফেডারেল শাসনতন্ত্র। কায়েমের পক্ষে। | আর যে একটি জ্বলন্ত সমস্যার প্রতিকারের ব্যবস্থা করিতে হইবে তাহা হইল অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে দেশের দুই অংশের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। আমরা বিশ্বাস করি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জুনসাধারণের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সদিচ্ছার কোন অভাব নাই। জনপ্রতিনিধিগণকে একবার সত্যিকার দায়িত্ব দেওয়া হইলে সকল সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠিতে তাহারা যে বাধ্য এবং সে অবস্থাতেও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে মনােনিবেশ করিয়া তাহারা সে দেশের অনুন্নত অঞ্চলগুলির প্রতি অধিকতর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিবেন, তাহাও সুনিশ্চিত। | বলাবাহুল্য, এতদিন ধরিয়া রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণে জনসাধারণের কোন কথা বলিবার সুযােগ না থাকায় সন্ঠীর্ণ ও শ্রেণীস্বার্থের হাতে দেশের দুই অংশের মধ্যে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হইতে পারিয়াছে। এক্ষণে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মারফত একবার যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনমত প্রতিষ্ঠা পায়, তাহা হইলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও কায়েমী স্বার্থের দিন যে ফুরাইয়া আসিবে- ইহাও সুনিশ্চিত। ইতিপূর্বে দেশের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে বিশেষ করিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান সত্যিকার রাজনৈতিক ক্ষমতায় শরীক হওয়ার সুযােগ কচিৎ পাইয়াছে। এমনকি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের নীতি বাস্তবায়নের দায়িত্ব যাহাদের হাতে, সেই সব প্রশাসনিক সংস্থার কার্য পরিচালনার ব্যাপারে প্রশ্ন তােলার কোন সুযোগও পূর্ব পাকিস্তানের ছিল না। বস্তুতঃ, এই সবই হইল দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির প্রধানতম কারণ। স্বাধীনতা উত্তর যুগে প্রকৃত প্রস্তাবে সব রাজনৈতিক ক্ষমতারই সমাবেশ ঘটিয়াছিল মুষ্টিমেয় সরকারী সরকারী অফিসারদের হাতে। তদুপরি আজ পর্যন্ত দেশে একটিও সাধারণ নির্বাচন না হওয়ায় রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে জনসাধারণ কথা বলার কোন সুযােগই পায় নাই।
এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালে কি করণীয়, তাহাই হইল পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এই প্রশ্নে আমরা বলিতে চাই, সামরিক শাসন প্রত্যাহৃত হওয়ার ফলে দেশে যে সদিচ্ছার সৃষ্টি হইয়াছে তাহাকে আরও জোরদার করিবার জন্য প্রয়ােজন রাজনীতিকসুলভ প্রজ্ঞার। দেশবাসী, সাধারণ ও সরকারী শাসনতন্ত্রের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর গড়িয়া উঠিতে দেওয়া আর চলিবে না। এই ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট আইউবের দায়িত্ব অপরিসীম এবং আমরা আশা করি, তিনি ইহার সারবত্তা সমাক উপলব্ধি করিবেন।
আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতি মতে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়া সাপেক্ষে দেশের সরকার পরিচালনার কাজও চালাইয়া যাইতে হইবে।
তদুপরি যে দলিলের বলে বর্তমান সরকারী কার্যাদি পরিচালিত হইতেছে, এই অর্ন্তবর্তীকালের জন্য তাহার কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করিতে হইবে। | ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অংশটিকে বর্তমান শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশ করিয়া জনসাধারণের মৌলিক অধিকারকে আদালতের একতিয়ারভুক্ত করিতে
| বস্তুতঃ এই মৌলিক অধিকারগুলি প্রেসিডেন্টের ফর্মান বলে অথবা শাসনতন্ত্রের বিধান মাফিক জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে সহজেই বর্তমান শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশ করা যাইতে পারে। সর্বোপরি যাহা প্রয়ােজন তাহা হইল, বর্তমান শাসনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী যে পরিষদ গঠিত হইয়াছে প্রতি শাসক কর্তৃপক্ষকে ‘আস্থাশীল হইতে হইবে। | তদুপরি লাভজনক নপদ বন্টন করিয়া ভাগ্যবান’ সদস্যদের দ্বারা পরিষদ গৃহ ভরাট করিবার আসক্তি বর্জন করিতে হইবে। অন্যথায় পরিষদের যেটুকুবা স্বাধীনতা আছে, তাহাও লুপ্ত হইবে। তুলিলে চলিবে না যে, বিশ্বাসেই বিশ্বাস বাড়ে। দেশে আস্থার ভাব হতে ফিরিয়া আসে তজ্জন্য বিনা বিচারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হইবে এবং রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে গৃহীত যাবতীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অবসান ঘটাইতে হইবে। _ রাজনৈতিক দলই হইল প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু। প্রাণবাহ্ ব্যতীত যেমন জীবনের অস্তিত্বে কল্পনা হইতে পারে না, তেমনি শৃঙ্খলাবন্ধ রাজনৈতিক দল ব্যতীত নির্বাচন পদ্ধতিও কর্মক্ষম হইতে পারে না। বিরাট কোন মানব গােষ্ঠীর সহিত কোন প্রকার সম্পর্কসূত্র
থাকিলে কোন প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনই চালু থাকিতে পারে না। রাজনৈতিক দল-বর্জিত পরিষদেও স্বার্থশিকার ব্যতীত অন্য কোন দায়িত্ববােধ সদস্যদের প্রভাবিত করিতে পারে না। এবম্বিধ পদ্ধতিতে নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচিত সদস্যের উপর নির্বাচকমণ্ডলীর আর কোন প্রভাবও থাকে না। এমতাবস্থায় দেশে রাজনৈতিক দল পড়িয়া উঠার পথে যা কিছু অগুরায়, উহার অবসান ঘটাইতে হইবে। | দেশে যতক্ষণ না সত্যিকার গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটিতেছে, ততক্ষণ আমাদিগকে সামগ্রিকভাবে দেশের সব ধরনের সমস্যাকে জাতীয় দৃষ্টিকোণ হইতে বিচার করিতে হইবে। জীবনের সর্বস্তর হইতে তাহা তিনি সাধারণ নাগরিকই ইউন, আর বুদ্ধিজীবী বা চাকুরীজীবীই হউন-সকলকে আজ সমবেতভাবে আগাইয়া আসিতে হইবে এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য। | উপসংহারে আমরা বলতে চাই যে, আজ এক বিরাট পরীক্ষার সম্মুখীন; স্থিরতাহীনতার মধ্য দিয়া সে আগাইয়া চলিয়াছে। এই ব্যবস্থা কেবল যে আমাদের নিকটই বিচিত্র ঠেকিতেছে, তাহা নহে।
রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে আজ প্রয়ােজন গভীর সম্প্রীতি, পূর্ণ সমঝোতা ও সহযােগিতা-আহাতে সংঘবদ্ধ একটি জাতি হিসাবে যেকোন অভাবিতপূর্ণ জরুরী অবস্থারও
আমরা মােকাবেলা করিতে পারি। যাঁহাদের হস্তে আজ দেশের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব বৰ্তাইয়াছে, এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং একটি সুষ্ঠু ও সুনিশ্চিত ভিত্তির উপর একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি পড়িয়া তুলিবার এই বিরাট দায়িত্ব আজ তাহাদেরকেই বহন করিতে হইবে।
আসুন, যতশীঘ্র সম্ভব আমরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ শেষ করিয়া এই বিতর্কের হাত হইতে নিজদিগকে মুক্ত করিয়া অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার দুর্জয় সংকল্প লইয়া একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে গঠনমূলক কাজে মনােনিবেশ করি।” বিবৃতিতে যাঁহারা স্বাক্ষর করেন তাঁহারা হইতেছেনঃ নূরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হােসেন সরকার, শেখ মুজিবর রহমান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া), মাহমুদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক ও মােহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া)।
(ঢাকা, ২৪শে জুন, ১৯৭২)।
৮ই জুলাই (১৯৬২) ঢাকার আউটার স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় ৯ নেতা সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনগণ কর্তৃক গণপরিষদ নির্বাচন এবং দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দ যথাশহীদ সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফার খান, আবদুস সামাদ খান আচার্জাই, আল্লামা মাশরেকীসহ বিনাবিচারে আটক সকল রাজবন্দীর অবিলম্বে মুক্তিদানের দাবী জানান। | পূর্ব পাকিস্তানে জনমতের ঢেউ এবং জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ অভ্যস্থরে বিরােধী দলীয় সদস্যদের ভূমিকা সমগ্র পাকিস্তানে রাজনৈতিক শূন্যতা অবসানের অপ্রতিরােধ্য আবেদন সৃষ্টি করে এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যের শুভ সূচনা ঘটায়। ঢাকা ও করাচী হইতে ন্যাশনাল ফ্রন্ট গঠনের আওয়াজ উঠে। ৯ই মে (১৯৬২) প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক জারিকৃত পলিটিক্যাল পার্টিস অর্ডিন্যান্স রাজনীতিবিদদের ঐকে আরও দৃঢ় হইতে সহায়তা করে। রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের ঐক্যে ভীত সন্ত্রস্ত প্রেসিডেন্ট আইউব খান জনতার ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করিবার মানসে ১৯৬২ সালের ১৪ই জুলাই রাজনৈতিক দল বিধি’ (Political parties Act) প্রণয়ন করেন। সেপ্টেম্বর মাসে করাচীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগ কনভেনশনে নির্দলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা প্রেসিডেন্ট আইউব খনি স্বয়ং চৌধুরী খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন) গঠন করেন ও উত্তরকালে ইহার নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন।
সােহরাওয়ার্দীর কারামুক্তি
| পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম স্রষ্টা ও পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মান্যবর হোসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ৩০শে জানুয়ারী (১৯৬২) গ্রেফতার ১৯শে আগস্ট (১৯৬২) কারামুক্তিকালে নিম্নলিখিত প্রেসনােটেই অবৈধ সেনাপতি বাক্সের জঘন্য চেহারা প্রতিস্থাত হয়। কারামুক্তির পর জনবরেণ্য নেতার সরকারী প্রেসনােটের প্রতিবাদে দেয় উত্তরও নিলে দেওয়া হইলঃ
The press Note of January 30 explaining the reasons of his arrest had said in part:
“It is already well known that Mr. Suhrawardy ever since the inception of pakistan had been for reasons of personal aggrandisement, indulging in activities which were of a highly prejudicial nature and it would not be unfair to say that in a large measure, he along with several others, was responsible for the predicament in which Pakistan found itself in the latter half of 1958. The role played by Mr. Suhrawardy and people of his ilk had virtually brought the country to the brink of major disaster and led to the revolution. With the consummation of the revolution the rot that had set in was stemmed-not only was it stemmed but positive gains were achieved in the course of the last three years and more. Throughout this period it has been the avowed policy of the Government not to victimise or punish any one for his past misdeeds even though they bordered on the criminal. And it was for this reason that even the politicians whose conduct had been scrutinsed by EBDO tribunals were treated generously. Mr. Suhrawardy was one of such persons.
But Mr. Suhrawardy misunderstood this generosity and as his ambitions knew no bounds be continued to indulge in activities prejudicial to the integrity and safety of Pakistan. It is a sad thought that a man of his inteligence and experience, instead of serving the country in the manner of a good patriot has taken it upon himself to play a destructive role. Even after the revolution Mr. Suhrawardy has openly associated with anti-Pakistan elements both within and outside the country.”
“It was in these circumstances that the Government have been reluctantly compelled to order the detention of Mr. Suhrawardy whose activities in the recent past have been fraught with such danger to the security and safety to Pakistan that one could fairly describe them as being treasonable.”
Following is the text of the Press Note issued by the ministry of Home Affairs:
Mr. H.S. Suhrawardy was detained under the Security of Pakistan Act, 1952 on January 30, 1962 as such a step was then considered
necessary to prevent him from acting in a manner prejudicial to the security of Pakistan.
“The Government is now satisfied that Mr. Suhrawardy will not henceforth participate in any disruptive activities.”
“It has, therefore, been decided to release him forthwith and an order of his release was accordingly been issued today August 19, 1962”.
Following is tbe text of the statement issued by former Prime Minister, Mr. H.S. Subrawardy, on his release from Karachi Central Jail after over six months of detention:
After giving praise to Allah and the holy Prophet (Peace be on him), I wish to thank all those people, who have been demanding my release, within the legislatures and outside particularly those, who had not believed the charges, that were levelled against me.
I hardly think it necessary to deny that I was attempting to disrupt East pakistan and thereafter planned to disrupt West pakistan, that I was not above taking money from enemy sources or that I was indulging in treasonable activities for those who know me and who know the services that I have rendere in the creation of Pakistan and perhaps the services which I rendered during the time I was the prime Minister of this country can not possibly be given credence to this.
Incidentally these allegations, which were published against me, had nothing to do, whatsoever, to the reasons given to me by the Central Government for my detention. These were entirely different and I need hardly to discuss them.
I thank my friends all the more because I had never the chance to deny these charges and yet from the very kind words that have been expressed on my behall, it would appear that it was not necessary for me to do so and the charges have not been believed.
During my detention, other people, too, were let loose to make foul charges against me. Thanks to the protection of Allah and his prophet (peace be on Him), my forefathers and respected parents, none of these appear to have been believed.
I was to thank particularly my student friends. May Allay bless them
and keep them on the right path and may they always serve the cause of truth and justice. I hug them and embrace them.
It is a foul charge against them that they are the tools of Subersieve elements. The students know their own mind very well and there is no need for any body outside their category to influence them.
At present, do not feel strong enough to make a long statement and deal with controversial matters which have arisen during the last few months. But I would like to say one thing just now, which I should expand later.
Please stop the campaign of Vilification and abusive language against the ‘discredited” politician. For four years there has been a campaign to discredit us. At the end of four years, it is those “discredited” politicians that the country is looking forward for a lead.
What is the point in carrying on this compaign further. As a matter of fact we have noticed that this campaign is backfiring. Let us now, if we want to serve the country start with constructive thinking instead of vitiating the atmosphere by vilification and abusive language.
In conclusion Mr. Suhrawardy hoped that other political workers now detained in Jail would also be released by the Government. | সমগ্র দেশব্যাপী রাজবন্দী মুক্তি আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ১৯৬২ সালের ১৯শে আগষ্ট মুক্তি দান করেন। কারামুক্তির পর চিকিৎসার জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। হাসপাতাল ত্যাগের পর জনাব সােহরাওয়ার্দী ৮ই সেপ্টেম্বর ঢাকা আগমন করেন। ঢাকা বিমান বন্দরে লক্ষ লােকের জনসমুদ্র সােহরাওয়ালাকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট
বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজের শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বাতিলের আন্দোলন ১৭ই সেপ্টেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনায় পরিণতি লাভ করে। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, আন্দোলন বা হৈ চৈ প্রসূত মনােভাবই ছিল শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট বিরােধী ছাত্র আন্দোলনের মূল কারণ। পেশাদার ছাত্র নেতৃবৃন্দ শিক্ষা কমিশন রিপাের্টের মত উত্তম রিপাের্টটির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হইয়া উঠিলে অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে এই রিপাের্ট বাতিল ঘােষিত হয় ও ১৯৬৩ সালে পরীক্ষার্থী ছাত্রদের বিনা পরীক্ষায় বি.এ, বি.কম, বি,এস,সি ডিগ্রী প্রদান করা হয়। এই ধরনের উট সিদ্ধান্তের বিস্ময়কর দিকটি হইতেছে পাঠ্য বিষয় কি হইবে, তাহার সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক ছাত্র-শিক্ষকগণ নয়। যেন রােগীই ডাক্তারকে প্রেসিক্রিপশন অর্থাৎ ঔষধ।
ও পথ্য বাতলাইয়া দিতেছে, কি হাস্যকর পরিস্থিতির শিকার আমরা। যাহা হউক, ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্র বিক্ষোভকালে পুলিশের গুলীতে কয়েকটি তাজা তরুণকে প্রাণ দিতে হয়। জানাব সােহরাওয়ার্দীর আহ্বানে কুলীবর্ষণের প্রতিবাদে ৭ই অক্টোবর সমগ্র পাকিস্তানে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। সংবিধানের গণতন্ত্রায়ন
কারামুক্তির পর জনাব সােহরাওয়ার্দী প্রারম্ভেই নয় নেতা’র বিবৃতির সহিত একাত্মতা ঘােষণা করেন। তবে সেই সাথে বাস্তবতার আলােকে ১৯৬২-র সাংবিধানিক পণতায়নের (Democratisation of the Constitution) সুনির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক পন্থাও তিনি দেশবাসীর নিকট পেশ করেন। ইহা নিঃসন্দেহে সােহরাওয়ার্দীর অশেষ বিচক্ষণতা ও বাস্তব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার নিদর্শন ছিল; কেননা প্রেসিডেন্ট আইউব খানের। প্রতি সংবিধান বাতিল করিয়া নির্বাচিত গণপরিষদ দ্বারা নূতন সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারে ৯ নেতার আহবান মােটও বাস্তবসম্মত ছিল না। জনাব সােহরাওয়ার্দীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নিম্নলিখিত স্বাক্ষরদানকারীগণ কর্তৃক সংবিধান গণতন্ত্রায়নের সংকল্প ঘােষিত হয়। | মাওলানা আবুল আলা মওদুদী, মাওলানা তােফায়েল মােহাম্মদ, জামায়াতে ইসলামী মাহমুদ আলী কাসুরী, সি,আর, আসলাম, ন্যাপ; কর্নেল আবুল হােসেন, রিপাবলিকান পার্টি, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমান, আবদুস ছালাম খান, খাজা খায়ের উদ্দিন, মােশতাক আহমদ গুরমানী, সাবেক গভর্নর পশ্চিম পাকিস্তান; মৌলঞ্জী গােলাম মােহাম্মদ, মেজর ইসহাক, চৌধুরী ফজল ইলাহী, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, মাহমুদ আলী, মােহাম্মদ সােলায়মান, সৈয়দ আজিজুল হক, ইউসুফ আলী চৌধুরী, সর্দার মাহমুদ খান, রাজা গােলাম নবী, মাহমুদুল হক ওসমানী, জয়েন উদ্দিন, আখতার উদ্দিন খান, মনজরুল হক, হায়দর বকস জাতেই, শেখ আবদুল মজিদ সিন্ধী, আলী ৰস খান তালপুর, ইউসুফ খাটক, গােলাম মোস্তফা ভুরঘুরি, সর্দার বাহাদুর খান, ফজলুর রহমান, আবুল কাসেম, মিগ্রা মােমতাজ দওলানা, গােলাম জিলানী খান, মােহাম্মদ হােসেন চাট্টা, জাতীয় পরিষদ সদস্য মােহাম্মদ ইউসুফ খাটক, জাতীয় পরিষদ সদস্য; সর্দার এম, আইয়ব, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য; আহমদ সৈয়দ কিমানী, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, সর্লার মােহম্মদ জাফরুল্লাহ, জেড, এইচ, লারী, জৈন নােরানী, সৈয়দ ইবনে হাসান, এম, এইচ, এ, পাজদার, ‘আগা গােলাম নবী পাঠান, কাজী ফয়েজুয়াহ, হাজ মাওলা বকস খসরু, গােলাম মােহাম্মদ খান, গোলাম আলী তালপুর, রাষ্ট্রীয় পরিষদ সদস্য, কাজী ফয়েজ মােহম্মদ, রসুল বকস তালপুর, মােহাম্মদ হানিফ সিদ্দিকী, এম, এ, খুরু, আলী গহর শুরু। আজম খানের পদত্যাগ
প্রেসিডেন্ট আইউব খানের সহিত মতবিরােধ দেখা দেয়ায় লেঃ জেঃ আজম খান পূর্ব পাকিস্তানের পর পদ হইতে ইস্তফা দেন। তদস্থলে জনাব গােলাম ফারুক এপ্রিল মাসে
(১৯৬২) গভর্নর হইয়া আসেন। কিছুকাল পর স্বাস্থ্যগত কারণে পর্নর গোলাম ফারুক পদত্যাগ করিলে প্রেসিডেন্ট আইউব ২৮-১০-৬২ ইং তারিখে তাহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মােনায়েম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করেন। ভাসানীর অনশন
| বন্দী জননেতা মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের বন্যাকবলিত দুর্গতদের জন্য ২৫ কোটি টাকা খয়রাতি সাহায্য, পাটের ন্যায্যমূল্য, মােহাজেরদের পুনর্বাসন ও কুল মিশনের রিপাের্টের ভিত্তিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থার দাবীতে ২৬শে অক্টোবর (১৯৬২) হইতে অনশন ধর্মঘট আরম্ভ করেন। তাঁহার স্বাস্থ্যের অবনতি দেখা দিলে ২৭শে অক্টোবর তাহাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় সর্বজনাব শহীদ সােহরাওয়ার্দী, নুরুল আমিন, আবু হােসেন সরকার, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, পীর মােহসেন উদ্দিন আহমদ (দুদু মিয়া), সৈয়দ আজিজুল হক, শেখ মুজিবর রহমান, মাহমুদ আলী, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ ২৯শে অস্ত্রোবর অনশনরত মাওলানা ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দেশের ও দশের স্বার্থে অনশন ভংগ করিতে তাহাকে অনুরােধ জানান এবং বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানীকে মুক্তি দানের জন্য সরকারের নিকট দাবী জানান। অবশেষে প্রবল প্রতিরোধ্য গণদাবীর মুখে সরকার ৩রা নভেম্বর (১৯৬২) মাওলানা ভাসানীর উপর হইতে সকল প্রকার বাধা-নিষেধ ও অন্তরীণাদেশ প্রত্যাহার করিতে বাধ্য হন। রাজবন্দী মুক্তি
| জনগণের চাপে জুন, জুলাই ও আগষ্ট মাসে (১৯৬২) বেশ কিছু সংখ্যক বিনাবিচারে আটক রাজবন্দীকে মুক্তিদান করা হয়। ১৩ই আগষ্ট পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নিরাপত্তা আইন সংশােধন করিয়া নিরাপত্তা বন্দীদের আটক পর্যালােচনা করিবার জন্য হাইকোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে একটি রিভিউ বাের্ড গঠনের আইন পাস করা হয়। এই সময়ে প্রাদেশিক পরিষদে বিরােধী দলীয় সদস্যদের একস্তি চাপ প্রয়ােপে ক্রোধানিত্ব অর্থময়ী, হাফিজুর রহমান সদর্পে ঘােষণা করিয়াছিলেন যে, অভ্যক বা পশিব অপরাধী ব্যতীত অন্য সকলকে মুক্তি দেওয়া হইয়াছে (Released all except the hardended criminals)। এককালে ইংরেজ শাসকের তাকেদার হাফিজুর রহমানের মুখে এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য আমাকে কারান্তরালে শুধু হতভম্বই করিয়াছে। এই প্রকার অপ্রত্যাশিত মন্তব্য শাসক মহলের বিকৃত মনােভাবগ্রসূত। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর এই ধরনের অসহিষ্ণু ও অন্যায় আচরণ এবং বক্তব্য যে রাষ্ট্রের স্বাচ্ছন্দ্য গতির সমূহ ক্ষতি করিয়াছে, তাহা বলাই বাহুল্য। চীন-ভারত সীমান্তঃ ক্রুশ্চেভের ভূমিকা
গণচীন পােড়া হইতেই চীন-ভারত সীমান্ত “ম্যাকমোহন লাইন” মানিয়া নিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া আসিতেছিল। উক্ত বিষয়ে মতান্তর ১৯৫৯ সাল হইতে ক্রমাগতভাবে তিক্ততার রূপ পরিগ্রহ করে এবং হিন্দি-চীনী তাই ভাই’ মধুর সম্পর্ক ১৯৬২ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর
উভয় দেশের মধ্যে সংঘর্ষে ৰূপান্তরিত হয়। বৃহৎ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে জোরদার করিবার জন্য সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহায়তাদানে অতি উৎসাহ প্রদর্শন করে। পক্ষান্তরে সােভিয়েট রাশিয়া চীনের সমমতাদর্শী হওয়া সত্ত্বেও ভারতের মত আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবীর যৌক্তিকতাকে উপেক্ষা করিতে পারে নাই । অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, মানব সভ্যতা বিধ্বংসী আণবিক অস্ত্রের মারাত্মক শক্তি সম্পর্কে সচেতন নিকিতা ক্রুশ্চেভ মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখিবার স্বার্থেই সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও ধনতান্ত্রিক বিশ্বের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান” নীতি অত্যন্ত নিষ্ঠার সহিত পালনে সচেষ্ট ছিলেন। ক্রুশ্চেভ কর্তৃক বিশ্ব যুদ্ধ সূত্রপাতের সামান্যতম কারণকেও উৎসাহ না দেওয়ায় অটল ছিল, ১৯৫১ সালে সােভিয়ে রাশিয়া গণটনিকে আদরদশী পদক্ষেপে উৎসাহ দেওয়া হইতে বিরত ছিল । মাওসেতুং যখন “সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা গােষ্ঠীকে কাগুজে বাঘ” (Paper Tiger) ও অন্যান্য অসার ভাষার কথা মালায় তুচ্ছ করিয়া সভ্যতা বিধ্বংসী আণবিক যুদ্ধের পটভূমিকা সৃষ্টির প্রচেষ্টায় লিপ্ত, ক্রুশ্চেন্ড তখন তাকে কাগুজে বাঘদের আণবিক দাঁত আছে, (Paper tiger have nuclear teeth) কথা করেন নাই। মানব সভ্যতার মহা সংকটময় মুহূর্তে ক্রুশ্চেভের মত ব্যক্তি সােভিয়েট রাশিয়া তথা বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরােভাগে ছিলেন বিধায় আণবিক যুদ্ধ অতি সতর্কতার সহিত এড়ানাে সম্ভব হইয়াছে। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেন হাওয়ারের সহিত ক্যাম্প ডেভিড়ে মিলিত হইয়া শক্তির আবহাওয়া সৃষ্টি করেন। আগামী দিনের ইতিহাসবেত্তাগণ কুশ্চতের এই পদক্ষেপের যথার্থতা লিপিবদ্ধ করিতে কার্পণ্য করিবেন না বলিয়া আমার বিশ্বাস। অবশ্য ইহার ফলে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়। বলাই বাহুল্য যে, মানবজাতি ও সভ্যতা সংরক্ষণ ও অগ্রযাত্রার একান্ত প্রয়ােজনেই কমিউনিষ্ট বিশ্বের এই দ্বিধাবিভক্তি ছিল এক ঐতিহাসিক অপরিহার্যতা (Historical imperative) কুশ্চেম্ভের বাস্তব বুদ্ধির আরেকটি নিদর্শন ১৯৬২ সালের ২৮শে অক্টোবর কিউবা হইতে আণবিক যুদ্ধাস্ত্র প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তু ঘোেষণ। এই সিদ্ধান্তু শুধুমাত্র দুর্বলতাপ্রসূত এই ঢালাও মন্তব্য কেবলমাত্র মানবপ্রেম বিবর্জিত ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর পক্ষেই করা সব। পক্ষান্তরে ইহা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তথা সভ্যতা বিধ্বংসী আণবিক সংঘর্ষ পরিহারে হ্রডের অনন্য ভূমিকা হিসাবেও চিহ্নিত হওয়ার সাবী রাখে। সবাই স্বীকার করিবেন, স্টালিন শাসনের হত্যা ও নিধনের ভাষাকে ক্রুশ্চেভ সােভিয়েট নাগরিকদের জীবনে, নিরাপত্তার ভাষায় রূপান্তরিত করিবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করিয়া গিয়াছেন। মানবাধিকারের ইতহাসেও যে নিরপেক্ষ মূল্যায়নে তাহার নাম যথাযথ মর্যাদার সহিত উচ্চারিত হইবে তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। স্মর্তব্য যে, ক্রুশ্চেভ ১৯৫৮ সালের ২৭শে মার্চ সােভিয়েট রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ক্ষমতার কোন্দলে পড়িয়া ১৯৬৪ সালের ১৪ই অক্টোবর তাহার পদত্যাগ করিতে হয়।
| গণচী সশস্ত্র বাহিনী কর্ক আন্তর্জাতিক সীমান্তু ম্যাকমােহন লাইন অতিক্রমকে ১৯৬২ সালের ১লা নভেম্বর দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিষ্ট পাটির জাতীয় কাউন্সিল ৬০-৩০ ভােটে দ্ব্যর্থহীনভাবে “ভারত আক্রমণ” ঘোষণা করে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পক্ষিত ওয়াহের লাল নেহেরু ইতিমধ্যে (২০শে নভেম্বর ১৯৬২ ইং) মার্কিন শক্তিদ্বয়ের সমীপে সাহায্য প্রার্থনা করেন।
এবং এর আগে ২২শে অক্টোবর (১৯৬২) জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আজাদী রক্ষার অগ্নি পরীক্ষায় দলমত-নির্বিশেষে সকল ভারতীয় নাগরিকের সাহায্য-সহায়তা কামনা করেন। টানভারত যুদ্ধে নেফা এলাকায় অর্থাৎ ভারতের উক্তর-পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিপর্যয়বরণ ও ছত্রভঙ্গ হওয়ার মত সংকটময় পরিস্থিতিতে ২৬শে অক্টোবর (১৯৬২) সমগ্র ভারতে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করা হয়। ইহার পর পরই ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির রাজনীতি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে এবং জ্যোতিবসু ও নামুদ্রিপদের নেতৃত্বে ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কসিট) নাম ধারণ করে। দেশ ও দেশের মাটির প্রতি এই ধরনের আনুগত্য নিবেদন এতকাল আন্তর্জাতিক কমিউনিষ্ট বিশ্বে অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয় ছিল। স্বীকৃত কমিউনিষ্ট প্রত্ন নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন বিভিন্ন কমিউনিষ্ট পার্টির জন্য অবশ্য করণীয়। ইহাই কমিউনিষ্ট আন্দোলনের নিয়ম-আইন ও ভিত্তি। ােঁড়িী ধর্মান্ধ ও কমিউনিষ্টদের মধ্যে মূলতঃ চারিত্রিক কোন প্রজে নাই। কিন্তু ভারে কমিউনিষ্ট পার্টির চেয়ারম্যান এস,এ, ডাংপের সুযােগ্য নেতৃত্ব এইভাবেই কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক নূতন ধারা সংযােজিত করে। ইহাই উত্তরকালে ফুলে ফুলে বিকশিত হই, “এককেন্দ্রীক কমিউনিষ্ট আন্দোলনকে বিভিন্ন দেশের মাটির নানান বাস্তব পারিপার্শ্বিকতাকে স্বীকার করিবার মত আবহাওয়া সৃষ্টি করিয়াছে এবং পরিণতিতে “বহু কেন্দ্রিক” কমিউনিষ্ট আন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠিয়াছে। ফলে উন্মোচিত হইয়াছে কমিউনিষ্ট বিশ্বে এক নব দিগন্ত। অবশ্য উল্লেখ্য যে, কমিউনিষ্ট বিশ্বের শিরােমণি সােভিয়েট রাশিয়া মতভেদ সত্ত্বেও প্রকাশ্যে গণটীনের পররাজ্য আক্রমণের ভুমিকাকে সমালােচনা করে নাই বা মতদ্বৈততা প্রকাশ করে নাই। অন্ধ অনুসরণে বন্ধ্যত্ব দেখা দেয়। তাই এই কথা স্বীকার করিতে হইবে, ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি সভ্যতার অগ্রযাত্রায় এইভাবেই এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করিয়াছে। আমি মনে-প্রাণেই বিশ্বাস করি যে, তর্ক-বিতর্কের গর্ভেই আবিষ্কৃত হইবে মানব সভ্যতার অগ্রাভিযানে সূও দিক-দর্শন। তাই মুক্তবুদ্ধির অনুসারী হিসাবে ভাৱতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির এই সাহসিক পদক্ষেপকে মুক্ত মনের অনিন্দন জানাতে সেইদিন আমার এতটুকু কুষ্ঠ জাগে নাই। কারামুক্তি
আগেই বলিয়াছি, নিরাপত্তা বন্দীদের মুক্তি বিবেচনার নিমিত্ত পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৩ই আগষ্ট প্রাদেশিক পরিষদে সংশােধনী বিধি অনুযায়ী পর্যালােচনা বাের্ড (Review Board) পঠন করেন। পর্যালােচনা বাের্ডে ব্যক্তিগত হাজিরা দেওয়ার প্রয়ােজনে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবর রহমান ও তাহার পত্নী প্রচুর খাদ্যদ্রব্যসহ, আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। তাঁহাদের সহৃদয়তায় আমি মুগ্ধ হইলাম। ইতিপূর্বে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালেই শেখ সাহেব আমাকে ১৯৬২’র সংবিধান (আইউব সংবিধান)-এর কপি পাঠাইয়াছিলেন। সে সম রাজশাহীতে জনাব সহরোয়ার্দী ও আতাউর রহমানের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় শেখ মুজিব বলেন যে আমাদের নেতা অলি আহাদ রাজশাহীর কারাগারে বন্দী অবিলম্বে তার মুক্তি চাই। সে দিনের মুজিব তাইয়ের এই কথায় কারাগারে আমার সম্পর্কে অনেকের উৎসাহ জাগে যারা আমাকে চিত্ৰতাে তারা আমাকে চিনলো- মােট
কথা কারাগারে আমার সম্মান অনেক বৃদ্ধি পােলাে । মুজিব ভাই ও ভাবীর রাজনৈতিক মতবাদ ও কর্মধারার সহিত আমার প্রভূত গড়মিল থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সময়ে আমার প্রতি তাহাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য আমাকে চিরকাল তাঁহাদের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। যাহারা রাজনৈতিক মত-বিরােধকে সামাজিক সম্পর্কেচ্ছেদের সােপান হিসাবে ব্যবহার করেন; এই ঘটনার উেেখ আশা করি তাহাদের চক্ষু উনিলিত হইবে, তাঁহারা অতঃপর ইহার অন্তর্নিহিত মূল্য ও তাৎপর্য অনুধাবনে সচেষ্ট হইবেন।
যাহা হউক, পর্যালোচনা বাের্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার ও সদস্য ছিলেন স্বরাষ্ট্রবিভাগীয় সেক্রেটারী আলী হাসান (সি,এস,পি)। পর্যলােচনাকালে বাের্ডের চেয়ারম্যানের সহিত জভেচ্ছা বিনিময়ান্তে হার উদ্দেশ্যে বলি যে, “My Lord, My Subrmission shall be against the heady & power drunk executives & if the detaining authority Home Secretary All Hassan talks, I shall immediately withdraw.”
অর্থাৎ ক্ষমতা মদমত্ত ‘আমলাদের বিরুদ্ধেই আমার বক্তব্য উপস্থাপিত করিব। এই অবস্থায় আমাকে আটককারী স্বরাষ্ট্র সেক্রেটারী আলী হাসান যদি একটি কথাও উচ্চারণ করেন, তাহা হইলে আমি তৎক্ষণাৎ অংশগ্রহণ করা হইতে বিরত থাকিব।” যাহা হউক, বিচারপতি সাত্তারই সর্বক্ষণ একাকী বিভিন্ন প্রশ্নে আমার সহিত আলাপ-আলােচনা চালাইয়া যান। অতঃপর ৬ই ডিসেম্বর (১৯৬২) বৃস্পতিবার আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে মুক্তি লাভ করি।
রাজনৈতিক দলিলাদি বিনষ্ট | সামরিক শাসন প্রবর্তনের কিছুকাল পর আমি একটি ট্রাংক ভর্তি রাজনৈতিক বিভিন্ন দলিলপত্র আমার অগ্ৰজতুল্য শ্রদ্ধেয় আবদুর রউফ সাহেবের বাসায় জমা রাখি। পরিতাপের বিষয়, কারামুক্তির পর ট্রাংকটি আনিতে গিয়া অবগত হই যে, পুলিশী হামলার অনর্থক চিন্তায় ভীত-সন্ত্রস্ত রফ ভাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে কাগজপত্রগুলি অগ্নি সংযােগে বিনষ্ট করিয়া ফেলিয়াছেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রামে গ্রেফতার হওয়ার পর আমার অঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ডঃ আবদুল করিমের বাসায় কয়েকবার খানা তল্লাশি করা হইয়াছিল। তাই, তাহার বাসায় রক্ষিত রাজনৈতিক দলিলপত্রগুলিও এক আত্মীয়ের বাসায় স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, উল্লিখিত এই আত্মীয়টিও সামরিক আইনের ভয়ে শংকিত হইয়া এইসব কাগজপত্রও অগ্নিদাহ করেন। তবে আমার স্নেহময়ী বড় বােন রওশন আখতার হার নিকট রক্ষিত আমার কাগজপত্রগুলি যক্ষের ধনের ন্যায় আঁকড়াইয়া রাখেন এবং কারামুক্তির পর আমাকে সকল কাগজপত্র বুকাইয়া দেন; ইহার ফলেই আজ আমার পক্ষে দলিল নির্ভর ঘটনারাজি বর্ণনা সম্ভব হইতেছে। আপার স্বামী জনাব মতিউর রহমান সাহেব ছিলেন চট্টগ্রাম বন বিভাগের ডেপুটি কনজারভেটর অব ফরেষ্টস। কারা মুক্তির পর
| কারামুক্তির পর শেখ মুজিবর রহমানের সহিত আমার রাজনৈতিক বিস্তারিত আলাপআলােচনা হয়। আমরা উভয়ই জেনারেল আইউব খানের একনায়কত্ববাদের বিরুদ্ধে
জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নীতিগত, কৌশলগত ও সাংগঠনিকগত দিক লইয়া আলােচনা করি। এই সময়ে মফঃস্বল সফরান্তে ঢকি প্রত্যাবর্তনের নির্দিষ্ট দিবসে শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে অভ্যর্থনা জানাইবার জন্য শেখ মুজিবর রহমান ও আমি ঢাকা ফুলবাড়িয়া ষ্টেশনে যাই। ট্রেন হইতে অবতরণ করিয়াই জনাব সােহরাওয়ার্দী উপস্থিত সকলের সহিত শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আমার দিকে তাকাইয়া তরল হাস্যে মন্তব্য করেন, “তোমাকে ছাড়িয়াছে। গভর্নর মােনায়েম খান ঠিক করেন নাই। তদুত্তরে আমিও হাস্যরসের অবতারণা করিয়া বলি “স্যার, আপনাকেও মুক্তি দিয়ে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ভাল করেন। নাই। কেননা আপনি তাে গণতন্ত্রের দাবীতে গােটা দেশের জনগণকে ক্ষেপাইয়া তুলিয়াছেন।” ইহার পর ষ্টেশনের বারান্দায় দাঁড়াইয়া তিনি উচ্চস্বরে অভিযােগ জানাইলেন, “মার্কিনীরা আমার জন্য গাড়ী পাঠায় নাই সে? কি করিয়া যাইবাে—-কথা বলিবার সাথে সাথে দুষ্ট ও মিষ্টি হাসি দিয়া আমার দিকে তাকাইলেন। বুঝিলাম, লক্ষ্য আমি। উত্তরে আমি বলিলাম, স্যার, সােভিয়েট রাশিয়ার কর্ণধার নিকিতা ক্রুশ্চেভ ও কিউবার একনায়ক ফিডেল কেন্ট্রাকে সামাল দিতে গিয়া প্রেসিডেন্ট কেনেডির প্রাণ ওষ্ঠাগত, ‘তাই আপনার গাড়ীর কথা তুলিয়া গিয়াছেন। এইভাবে তরল পরিহাস্যোজ্জ্বলে আমার মনের কোনে পুঞ্জীভূত সঙ্কোচ কাটাইয়া উঠিবার ব্যাপারে তিনি আমাকে সংগােপনে সহায়তা করিতেছিলেন। মনে পড়ে, আওয়ামী লীপের কর্মী থাকাকালে ১৯৫৫ সালে জনাব সােহরাওয়ার্দীকে করাচীর পথে আমরা তেজপাণ্ড বিমান বন্দরে বিদায় জানাইতে গিয়াছিলাম। জনাব সােহরাওয়ার্দী আমার সাংগঠনিক সফরসূচী জানিতে চাহেন ও আর্থিক অনটনের কাহিনী শুনিয়া চট্টগ্রামের জনাব আমীর হােসেন দোভাষকে জাকিয়া বলেন, “অলি আহাদকে টাকা দিও।” “I can say every pic will be rightly spent He is honest to the pie”. আত্রে উল্লেখ্য যে, ১৯৬৩ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন সাহেবের কাকরাইলের বাসায় না সােহরাওয়ার্দী ব্যারিষ্টার ডঃ কামাল হােসেনের নিকট যে উচ্ছসিত প্রশংসার ভাষায় আমার পরিচিতি তুলিয়া ধরিয়াছিলেন, তাহাতে আমি নিজেই লজ্জিত হইয়া পড়ি। উপরের দুইটি ঘটনা সােহরাওয়ার্দীর বিরাট মনের পরিচয় বহন করে। ইহা কেবল সােহরাওয়ার্দীর পক্ষেই সম্ভব ছিল; কেননা, তিনি ছিলেন পরশ্রীকাতর বাংগালী চরিত্রের ব্যতিক্রম।
এইস্থলে অন্য একটি ঘটনা উল্লেখের লােভ সম্বরণ করিতে পারিতেছি না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা অপরাহ্ন চারটায়। ঢাকায় অবস্থানরত নেতা সোহরাওয়ার্দীকে সভায় সময়মত (Punctually) উপস্থিত হইতে পুনঃপুনঃ স্মরণ করাইয়া আমি ঐ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান তাহার নিকট হইতে পূর্বাহ্ন বিদায় গ্রহণ করি। স্মরণ করাইবার কারণ, বাংগালী নেতাদের সময় নাই । আর আমার নিজের গর্ব আছে, আমি ঘড়ির কাটায় কাঁটায় চলি। যদিও নেতা যথাসময়ে সভায় হাজির হইবেন বলিয়া কথা দিয়াছিলেন, তবুও চিরাচরিত অভ্যাসবশতঃ তাঁহার সেই কথায় বিশেষ আস্থা স্থাপন করি নাই; অথচ আমি নিজেও নির্ধারিত সময় ‘অপরাহ্ন চার ঘটিকায় আওয়ামী লীগ সদর দফতর ৫৬ নং সিম্পসন রােডে যাই নাই। কিন্তু জনাব সােহরাওয়ার্দী নির্ধারিত
চার ঘটিকায় সভায় যােগ দিতে অফিসে আসেন। আমরা কেহই তখন উপস্থিত হই নাই। সার্কস্কিন স্যুট পরিহিত সােহরাওয়ার্দী অফিস পিয়ন শামসুর ময়লা দড়ির খাটিয়ায় দিব্যি দিবা-নিন্দ্রায় আত্মসমর্পণ করিলেন। বেশ কিছু পরে উপস্থিত হইয়া শেখ মুজিবর রহমান ও ‘আমি অফিস বারান্দায় ফুলস্যুট পরিহিত ঘুমন্তু সােহরাওয়ার্দীকে দেখিয়া মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিলাম। পিয়নের ময়লা খাটিয়ায় এইভাবে অবলীলায় নিদ্রা যাওয়া একমাত্র কর্মবীর সােহরাওয়ার্দীর পক্ষেই সম্ভব। মানুষের আর্থিক সংকটে সােহরাওয়ার্দী হাইকোর্ট মামলায় সদ্য উপার্জিত অর্থের শেষ কপর্দক পর্যন্ত এক মুঠায় বিলাইয়া দিয়া পরক্ষণেই স্বীয় চলিবার টাকার জন্য ঋণ করিতে দ্বিধা করেন নাই। বাংগালী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীবৃন্দ সােহরাওয়ার্দী উপার্জিত টাকা কিভাবে লুট করিয়াছে, তাহাও দেখিয়াছি।
| সােহরাওয়ার্দী কর্মীদের সহিত আদর্শিক সম্বন্ধের চাইতে ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপর বেশী গুরুত্ব দিতেন; তাই কর্মীর সহিত সম্পর্কোচ্ছেদে তিনি বিচলিত হইতেন ও মনে আঘাত পাইতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা বৃহৎ শক্তির সহিত সামরিক জোটে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্ব ও বিশ্বশান্তি বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করিয়া আমি সােহওয়ার্দী অনুসৃত পররাষ্ট্র নীতির বিরুদ্ধাচরণ করিলে তিনি এই আঘাত পান যে, ঢাকার জগন্নাথ হলে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের বারান্দায় আমার প্রথম দর্শনেই মন্তব্য করেন “You have stabbed me in the back” অর্থাৎ “তুমি পিছন হইতে আমাকে ছুরিকাঘাত করিয়াছ।” ব্যথায় আমার মুখমণ্ডল বিবর্ণ হইয়া গেল। কিছুতেই বুঝাইতে পারি নাই যে, ইহা আমার সৎ আদর্শিক মতভেদ, সংগঠন কর্তৃক গৃহীত ও অনুসৃত নীতিরই আমি প্রতিধ্বনি করিয়াছি মাত্র। বিষয়টি সােহরাওয়ার্দী আবেগজনিত দৃষ্টিতে দেখিয়াছেন; তাই এই ব্যাপারে তিনি ভাবাবেগপ্রসূত মন্তব্য করিয়াছেন। আদর্শও বড়, ব্যক্তি সম্পর্কও বড়, কোনটি কোন চরিত্রে প্রাধান্য লাভ করিবে, তাহা দৃষ্টিভঙ্গীর উপর নিরশীল। | ঢাকা ফুলবাড়িয়া ষ্টেশন হইতে আমরা জনাব সােহরাওয়ার্দীর সহিত দৈনিক ইত্তেফাকের মালিক সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হােসেনের কাকরাইলস্থ বাসভবনে গমন করি। জনাব সােহরাওয়ার্দী তথায় অবস্থান করিতেন। প্রেসিডেন্ট আইউবের ব্যক্তি শাসন বিরােধী গণআন্দোলনের প্রকৃতি ও পতিধারার উপর আলােকপাত করিবার উদ্দেশ্যে তাহার সহিত পুনরায় দেখা করিবার নির্দেশ দিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী আমাকে বিদায় দিলেন। নির্ধারিত সময়ে তাহার সহিত দেখা করিলে তিনি স্বীয় উদ্যোগে নিজস্ব দৃষ্টিভংগীতে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দান করিয়া মন্তব্য করেন যে, রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবন ও পৃথক পৃথক রাজনৈতিক সভা সমিতি অনুষ্ঠান বিভিন্ন দলের মধ্যে ক্রমশঃ অন্তৰ্ভস্থ সৃষ্টি করিবে ও
সংগঠনকে নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণে রাখিতে ব্যর্থ হইবে। ফলে ঘটনার বিবর্তনে জেনারেল আইউব খানের একনায়কত্ব বিরােধী সংগ্রাম পারস্পরিক অবাঞ্ছিত কলহ-বিবাদে পর্যবসিত হইবে। ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির এক অংশ ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করিয়া দিয়াছে। অন্তরীণ হইতে মুক্তি পাওয়ার পর মওলানা ভাসানীও সহযােগিতা করিতেছেন না। কেহ কেহ সংবিধান বাতিলের দাবী তুলিয়াছেন। বলপূর্বক
আইউব খানকে উৎখাত ব্যতীত ইহা সম্ভব নহে। সুতরাং সবল ও অপ্রতিরােধ্য জনমতের চাপের দ্বারাই সংবিধানের গণতন্ত্রায়ন সঙ্ক করিয়া তুলিতে হইবে। এই প্রসঙ্গেই ১৯৬২-র সংবিধান মােতাবেক অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে অংশ্রহণ না করাকে রাজনৈতিক ভুল বলিয়া সােহরাওয়ার্দী মত প্রকাশ করেন। ইউনাইটেড অপজিশন পার্টি
| জাতীয় পরিষদে সদ্য নির্বাচিত সদস্যগণ (বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তান হইতে নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ) জনাব মশিউর রহমানকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করিয়া ইউনাইটেড অপজিশন পাটি গঠন করেন। অবশ্য জনাব রমিজউদ্দিন আহমদ, জনাৰ নাসরুপ্লাহ খান স্ব স্ব গ্রুপের নেতা ছিলে । ইউনাইটেড অপজিশন পার্টি ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) জাতীয় পরিষদে একযােগে কাজ করিবার নিমিত্ত Combined Opposition party পঠন করে। সর্দার বাহাদুর খান, জনাব মশিউর রহমান, জুনাব কামরুজ্জামান কমবাইন্ড অপজিশন পার্টির যথাক্রমে শীতার, ডেপুটি লীডার ও সেক্রেটারী নির্বাচিত হন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জাতীয় পরিষদের অভ্যন্তরে কমবাইন্ড অপজিশন পার্টির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।
পরিতাপের বিষয়, সর্বজনাব ফজলুল কাদের চৌধুরী, মােহাম্মদ আলী (বগুড়া), আবদুস সবুর খান, আবদুল মােনায়েম খান, অহিদুজ্জামান প্রমুখ ওয়াদা ভংগ করিয়া প্রেসিডেন্ট আইউব খানের সরকারে মন্ত্রীপদ গ্রহণ করেন। ফলে, সামরিক শাসকের একনায়কত্ববাদ বিরােধী আন্দোলন কিছুটা দুর্বল হয়।
শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সহিত আলােচনার পর পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলীর সঙ্গে সংগঠনের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে সন্তোষ গমন করি। আমরা সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর একমত হওয়া সত্ত্বেও জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনাব সােহরাওয়ার্দী ও তঁাহার যৌথনেতৃত্বে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের প্রস্তাব মওলানা ভাসানী প্রত্যাখ্যান করেন। তাহার অস্বীকৃতি আমি সহজভাবে মানিয়া লইতে পারি নাই। কারণ আমার মনে পড়ে, ১৯৫৮ সালের মে মাসে করাচীতে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির সভা চলাকালে মওলানা সাহেব মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে না। তাহার এই উক্তি ছিল প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার শীর্জার সহিত যােগাযােগপ্রসূত। সুতরাং বর্তমানে তঁাহার সােহরাওয়ার্দী বিদ্বেষী মনােভাবই উক্ত যােগাযোগ বা আঁতাতেরই জের বলিয়া মনে করিবার কারণ ছিল। নেতাদের এইরূপ মনােভাবই দেশ ও জাতির সর্বনাশের কারণ হয়। মওলানা ভাসানী অবশ্য এই বৈঠকেই ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টে জনাব মাহমুদ আলী ও হাজী মোহন দানেশকে নি সংগঠনের প্রতিনিধি মনোনয়ন
জাতীয় পরিষদ অভ্যন্তরে ও বাহিরে প্রবল জনমতের চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট আইউব খান জনাব সােহরাওয়ার্দীর সহিত আলােচনা করিবার জন্যে তাহার উপদেষ্টা লেঃ জেঃ
ডব্লিউ, এ, বাকীকে প্রেরণ করেন। করাচীর নিজস্ব বাস ভবনে অনুষ্ঠিত এই আলােচনা বৈঠকে লেঃজেঃ বাকীর এক প্রশ্নের জওয়াবে জনাব সােহরাওয়ার্দী মন্তব্য করেন যে, ধারাবাহিক সংশােধনী দ্বারা সংবিধান সংশােধন করা হইলে ১৯৬২ সালের এই সংবিধান মূল চরিত্রই হারাইয়া ফেলিবে এবং সংশােধিত সংবিধানটি ১৯৫৬ সালের সংবিধানের রূপ গ্রহণ করিবে। জেনারেল বাকার নিকট হইতে এই বৈঠকে আলােচনার রিপাের্ট লাভের পর আইউব খান দ্বিতীয়বার আলােচনার উৎসাহ হারাইয়া ফেলেন। স্বাধীন বাংলার আওয়াজ
কারামুক্তির পর অত্যন্ত সতর্কতার সহিত লক্ষ্য করিতেছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-যুব সমাজে ও রাজনৈতিক অংগনে স্বাধীন বাংলার আওয়াজ একটি সােচ্চার আওয়াজে পরিণত হইয়াছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কার্যকলাপে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল) সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিন ২৭শে নভেম্বর (১৯৬২) রাত্রিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় ভাষণদানকালে মন্তব্য করেন, “During the last five years that I have been in Dacca people from all sections of East pakistan have called on me mostly my friends, colleagues and co-workers & it has pained me to learn that a whispering campaing among a large section of people is going on contemptating secession……. Unfortunately this idea is also finding support amongst every small section of west pakistan. The other day at a dinner party a very high official from west Pakistan told me what is the harm if we have confederation”? | অর্থাৎ “পাঁচ বৎসরকাল ঢাকায় অবস্থানকালে বিভিন্ন স্তরের লোকজন যাহার অধিকাংশই আমার বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মী আমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন। তাহাদের নিকট হইতে আমি জানিতে পারিয়া ব্যথিত হইয়াছি যে, বৃহৎ জনগােষ্ঠীর মধ্যে বিচ্ছিন্ন হইবার ব্যাপারে কানাঘুষা চলিতেছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ পশ্চিম পাকিস্তানীদেরও একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ এই মতের সমর্থক। সম্প্রতি এক নৈশভােজে পশ্চিম পাকিস্তানের একজন অতি উচ্চপদস্থ কর্মচারী আমাকে বলেন যে, কনফেডারশন গঠন করিলে ক্ষতি কি?” | ১৯৬৩ সালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত মার্কিন সাহায্য হইতে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ পূর্বাহ্নেই নির্দিষ্ট করিয়া দেওয়া হইবে। ইহার ফলে পূর্ব পাকিস্তানীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের চাইতে অধিকতর সহানুভূতিশীল মনে করিবার ইন্ধন পাইয়া গেল। সুকৌশলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ণ। পাকিস্তানী জনতাকে উস্কানি পান করাই ছিল উপরােক্ত মন্তব্যের লক্ষ্য। প্রেসিডেন্ট আইউব এই সময়ে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব চীন-সােভিয়েটের সহিত ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোটের প্রতি উৎসাহ হারাইয়া ফেলেন। কেন্দ্রীয় সরকারকে বেকায়দায় ফেলিবার জন্যই মালি সরকার নানাভাবে প্রচেষ্টা চালাইতে থাকে। এই প্রচেষ্টায় শেখ মুজিবর রহমান দাবার ঘুটি হইতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবােধ করেন নাই। শক্তিশালী দোসর হিসা
যােগ দেয় দৈনিক ইত্তেফাক। পক্ষান্তরে আইউব সরকার কর্তৃক পনঃ পুনঃ লাঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের সংহতি, একাত্মতা ও অবত্ব রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। কোন প্রকার প্রলােভন বা প্ররােচনা তাহাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিচলিত করিতে পারে নাই।
১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আবদুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদি অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহার গ্রেফতার হইয়াছিলেন।
এমনি বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক শূন্যতায় “৯ নেতার ঐতিহাসিক বিবৃতির সূত্র ধরিয়া জনাব সােহরাওয়ার্দী ১৯৬২’র সংবিধান ‘গণতন্ত্রায়নের আওয়াজ তােলেন এবং পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনৈতিক নেতা, কর্মী এবং জনতাকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করিবার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেন; কিন্তু বিধিবাম! অচিরেই সােহরাওয়ার্দী অসুস্থ হইয়া পড়েন এবং চিকিৎসার উদ্দেশ্যে গঞ্জন পমন করেন। নাৰ সােহরাওয়াদালন পমনে জাতীয় গণতাকি ফ্রন্টের রাজনৈতিক তৎপরতা স্তিমিত হইয়া পড়ে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতৃবৃন্দ তখন কিছুটা সক্রিয় ছিলেন যেমন, জুলাই মাসে (১৯৬৩) চট্টগ্রাম জেলা বন্যাকবলিত হইয়া পড়িলে তাহারা সাহায্য ও পুর্নবাসন কাজে কিছুটা তৎপরতা দেখান।
টাঙ্গাইল-বাসাইল উপ নির্বাচন | টাঙ্গাইল-বাসাইল উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিবার প্রয়াসে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, সাবেক আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও অপুনরুজ্জীবিত মুসলিম লীগ অংশ এবং মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর ২৩শে আগষ্ট (১৯৬৩)-এর সম্মিলিত বৈঠকে জান্তীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আসন্ন উপনির্বাচন সুষ্ঠুভাবে তত্ত্বাবধানের জন্য আমাকে আহ্বায়ক নিয়ােগ করিয়া সাত সদস্যবিশিষ্ট এক “নির্বাচন সমন্বয় কমিটি গঠন করে এবং উপরে বর্ণিত রাজনৈতিক সংস্থাগুলি সম্মিলিত বিরােধী দল নামে উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নেয়। টাঙ্গাইল-বাসাইল প্রাদেশিক পরিষদ উপনির্বাচনে প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নেতৃত্বে পরিচালিত মুসলিম লীগ (কনভেনশন) প্রার্থী ছিলেন করটিয়ার জনাৰ বায়জিদ খান পন্নী ও সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রার্থী ছিলেন টাঙ্গাইলের বােদা বকস। সরকারী প্রার্থী প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করিয়া মৌলিক গণতন্ত্রীদের (নির্বাচনী কলেজ) ছােটে নির্বাচিত হন। পূর্বাহ্নে বিচক্ষণ সােহরাওয়ার্দী লন্ডনের রােগশয্যা হইতে সতর্কবানী উচ্চারণ করিয়া সংবাদপত্রে এই মর্মে বিবৃতি দিয়াছিলেন যে, “Going will be heavy” অর্থাৎ যাত্রাপথ হইবে বন্ধুর। এই সময়ের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পে, ওয়ার্কস প্রােগ্রামের নামে যে বিপুল অর্থ মৌলিক গণতন্ত্রী অর্থাৎ ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের দেওয়া হইয়াছিল ইহার একটি উল্লেখযােগ্য অংশ তাহাদের পকেটহইয়া পড়ে। এই অবস্থায় ? সরকার মনােনীত প্রার্থী এইসব মৌলিক গণতন্ত্রীর ভােটে নির্বাচিত হওয়াটাই স্বাভাবিক এবং হইয়াছিল তাহাই।
এনডি, এফ-এর দুর্বলতা
স্বাস্থ্যগত কারণে জনাব সােহরাওয়ার্দীর বিদেশ অবস্থানকালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রিয়তার সুযােগে মাওলানা ভাসানী নিজের সংগ্রামী ঐতিহ্য ও আদর্শবােধ ত্যাগ করিয়া প্রাসাদ কুচক্রীদের কবলে পতিত হন। এই ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমটির সদস্যদ্বয় জনাব মহিউদ্দিন আহমদ ও আহমাদুল কবীর। লাহোরের ব্যাখ্রিষ্টার মিয়া মাহমুদ আলী কাসুরীর বাসবনে প্রেসিডেন্ট আইউব খানের মিলিটারী সেক্রেটারী ব্রিগেডিয়ার পীরজলার সহিত তাহাদের গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। উহাতে আইউব-ভাসানীর গােপন আঁতাতের ভিত রচিত হয়। কিসের বিনিময়ে উক্ত দুই ভদ্রলােক এবং মাওলানা ভাসানী জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে এইভাবে ছুরিকাঘাত করিয়াছিলেন ভবিষ্যৎ ইতিহাস সে বিষয়ে সাক্ষী দিবে। আইউব-ভাসানী দূতদের গােপন মিলনের প্রত্যক্ষ ফসল ১৯৬৩ সালের ২২শে জুন রাওয়ালপিন্ডিতে আইউব-ভাসানী সাক্ষাৎকার। বলাই বাহুল্য যে, প্রেসিডেন্ট আইউব খানের একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারের সংগ্রামকে নস্যাৎ করিবার উদ্দেশ্যেই এই দুই উদ্যোক্তা ডাসানী-আইউব সাক্ষাক্তারের ব্যবস্থা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পরিষদে বিরােধী দলীয় সােঙ্গার কণ্ঠ জনাব মশিউর রহমান প্রেসিডেন্ট আইউব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিমকের মর্যাদা রক্ষার জন্য পর্দার অন্তরালে নাটের শুরুর ভূমিকা পালন করিতে থাকেন। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পরবর্তী রাজনৈতিক ভূমিকায় ক্রমবিকাশ উপরােক্ত তিক্ত সত্যের ফলশ্রুতি মাত্র। উত্তরকালে জনাব মশিউর রহমান গর্বের সহিত একই দালালীর ভুমিকা অবৈধ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ও অবৈধ প্রেসিডেন্ট সেনাপতি লেঃ জেঃ জিয়াউর রহমানের কালেও পালন করিয়াছিলেন। | ভাসানী-আইউব সাক্ষাৎকারে অব্যবহিত পরই ৩০ ও ৩১শে আপষ্ট এবং ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী সংগঠন পুনরুজ্জীবনের পক্ষে জোরালাে বক্তব্য পেশ করেন এবং চক্রান্তকারীরা তাহাকে জোর সমর্থন জানান। কিন্তু পূর্বাহ্নে ২৮ ও ২৯শে আগষ্ট ৩৮, লিয়াকত এভিনিউ (জনসন রােড) ঢাকায়, দুই দিবসব্যাপী বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে জোরদার করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিল। তাই কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় আমি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পুনরুজ্জীবনের
ব্র বিরােধীতা করি। সভায় শেষ পর্যন্ত আমাদের বক্তব্যই গৃহীত হয় এবং জাতীয় পণতান্ত্রিক ফ্রন্টকে শক্তিশালী করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ঐক্যের এই পথকে বিঘ্নিত করিবার প্রয়াসেই মাওলানা ভাসানী পল্টনে আহুত জনসভায় এক জোরালাে বক্তৃতা দিলেন এবং এই বতা মঞ্চ হইতে পাটির অভিমত না নিয়াই এককভাবে ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচী ঘােষণা করিলেন।
১৯৬৩ সালের ১লা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট আইউব খানের সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হিসাবে মাওলানা ভাসানী নয়া চীনের প্রজাতন্ত্র দিবসে অংশগ্রহণ করেন। প্রতিনিধিদলের
অন্যান্য সদস্য ছিলেনঃ সর্বজনাব মশিউর রহমান, সদস্য জাতীয় পরিষদ; আখতার উদ্দিন আহমদ, সদস্য জাতীয় পরিষদ; ডঃ জাবেদ ইকবাল, শওকত আলী, বার-এট-ল, কায়সার আহমদ, পি,এফ, এস (পাকিস্তান ফরেন সার্ভিস) ও জেনারেল হাবীবউল্লাহ। চীন সফর হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়াই মাওলানা ভাসানী তাহার ঘােষিত আইন অমান্য আন্দোলন বাতিল ঘােষণা করেন এবং আইউব সরকারের প্রতি সমর্থনদানের জন্য জনগণের প্রতি আহব্বান জানাইতে থাকেন। ইহাই ব্যক্তিপূজা রাজনীতির অভিশাপ। সোহরাওয়ার্দীর তিরােধান। | শেখ মুজিবর রহমান করাচী-পিত্তিতে সরকারী উচ্চ মহলের দোসর পুঁজিপতি শ্রেণীর একটি বিশেষ অংশের অবাঞ্ছিত প্রভাবে আইউব বিরােধী ঐক্য সংস্থা ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ঐশ্বকে জোরদার করিবার প্রয়াস পরিত্যাগ করেন। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব লইয়া তিনি জনাব সােহরাওয়ার্দী সমীপে লন্ডন পর্যঙ্ক গমন করেন। বিচক্ষণ সােহরাওয়ার্দী অদৃষ্টি বলেই শেখ মুজিবর রহমানের প্রস্তাবের আড়ালে করাচী-পিণ্ডি কুচক্রী মহলের কুসং চেহারাগুলি অবলােকন করিতে পারিয়াছিলেন। তাই জনগণের সার্ভভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সম্রামে একনিষ্ঠ সােহরাওয়ার্দী তাহার রোগ শয্যাপার্থে দণ্ডায়মান শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং জাতীয় গণতাষিক ফ্রন্টকে শক্তিশালী করিবার ব্যাপারে তাহাকে নির্দেশ দান করেন। ইহা সহজেই অনুমেয় যে, শেখ মুজিবর রহমান নির্দেশটি দুষ্টচিত্তে গ্রহণ করিতে পারেন নাই। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, ইহার কিছুকাল পরেই হৃদরোগে আক্রান্ত জাতির কারী ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর লেবাননের রাধানী বৈরুতের কন্টিন্যান্টাল হােটেলে আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী বিবর্জিত পরিবেশে পরলােকগমন করেন। ৭ই ডিসেম্বর সকাল ১১-৫০ মিঃ সােহরাওয়ার্দীর মৃতদেহসহ বিমানকরাচী বিমান বন্দরে অবতরণ করে। করাচীর শােকাকুল জনতা কর্তৃক অনুষ্ঠিত জানাযায় ইমামতি করেন মাওলানা আবদুস সাত্তার নিয়াজী। দাফনের জন্য পরের দিন অর্থাৎ ৮ই ডিসেম্বর সকাল ১০-১৭ মিঃ শবাধারবাহী বিমানটি ঢাকা (তেজগীও) বিমান বন্দরে অবতরণ করিলে লক্ষ লক্ষ লােকাভিভূত ও বিগলিত জনতা এক অবিস্মরণীয় মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা করে। ইহা কেবল উপলব্ধি করা যায়, বর্ণনা করা যায় না। “সোহরাওয়ার্দী নাই” কঠিন সত্যটি গ্রহণ করিয়াই ঢাকার রেসকোর্সে পীর মােহসেন উদ্দিন আহমেদের ইমামতিতে জুনসন্ত্র জানাযা নামাজ আদায় করে এবং অপরাহ্ন ২-৩০ মিঃ ঢাকা হাইকোর্টের পার্শ্ববর্তী জমিনে তাহাকে দাফন করা হয়। পরিতাপের বিষয়, তাহার নশ্বর দেহকে ঢাকার মাটিতে শায়িত রাখিয়া তাহার উত্তরসূরীগণ তাঁহার গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণাকে অবমাননা করিতে বিন্দুমাত্রও বিবেক দংশনবােধ করে নাই। গণতন্ত্রের মানসপুত্র বলিয়া অভিহিত সােহরাওয়ার্দীর প্রতি ব্যঙ্গ আর কাকে বলে! | একনায়কত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জনাব সােহরাওয়ার্দী ছিলেন একমাত্র নির্ভরশীল কাপ্তারী। সােহরাওয়ার্দী জনগণকে ক্ষমতার মূল উত্স মনে করিতেন। তাই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁহার রাজনীতির মূলমন্ত্র।
রাষ্ট্রীয় বা জীবন-দর্শনে বিভিন্ন বিষয়ে তাহার দৃষ্টিভঙ্গী ও আমাদের অনেকের দৃষ্টিভঙ্গীতে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য ছিল; তবে, তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অন্তঃশঙ্কিপ্রসূত এবং কখনই উহা ষড়যন্ত্র বা চক্রাপ্রসূত ছিল না। রাজনৈতিক শূন্যতা
সােহরাওয়ার্দীর তিরােধান জাতিকে সম্বিৎহারা করিয়াছে; কিন্তু বাঁছাইয়াছে আইউবমুজিব চক্রান্তের রাজনীতিকে। শেখ মুজিব কালবিলম্ব না করিয়াই স্বৰূপে আত্মপ্রকাশ করিলেন এবং অদৃশ্য হস্তের আংগুলী হেলনে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমাইলেন। ভঁর পশ্চিম পাকিস্তান সফরের উদ্দেশ্য ছিল সুস্পষ্ট। উল্লেখ্য যে, পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি নওয়াবজাদা নসরুগ্নাহ খান, পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মিঞা মাহমুদ আলী কাসুরী ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা খাজা মােহাম্মদ সফদর ২১শে জানুয়ারী এক যুক্ত সাংবাদিক সম্মেলনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের সংবাদ প্রকাশ করেন। ইহারও আগে ২৬, ২৭ ও ২৮শে জানুয়ারী (১৯৬৩) করাচী বৈঠকে দশ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হইয়াছিল । উক্ত বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবের দায়ে মে মাসে (১৯৬৩) ঐ সদস্যদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরােধী মামলা দায়ের করা হয়। এইভাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে জাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট যখন জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠায় যুগপৎ আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার প্রচেষ্টায় নিয়ােজিত, ঠিক তখনই শেখ মুজিবর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান গমন করেন। এবং আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করিবার উৎসাহ দেন। ফল যাহা হইবার তাই হইল; পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হইল। ঢাকা ফিরিয়া ২৫শে জানুয়ারী (১৯৬৪) শীয় বাসভবনে (৬৭৭, ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা, সড়ক নম্বর৩২) শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সম্পাদক এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃশের এক যুক্তসভা আহ্বান করেন এবং উক্ত সভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে নভেম্বর মাসে (১৯৬৩) অনুষ্ঠিত অনুরূপ সভায় আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবনের দাবী উঠিয়াছিল । কিন্তু আগেই বলিয়াছি, জনাব সােহরাওয়ার্দী লন্ডনে উপস্থিত শেখ মুজিবকে স্পষ্টজাবে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত না করিবার নির্দেশ দিয়াছিলেন। ব্যর্থ মনােরথ শেখ মুজিবর রহমান লণ্ডন হইতে ফিরিয়া সােহরাওয়ার্দীর বক্তব্য নেতৃবৃন্দকে জানাইবার জন্য ৭ই ডিসেম্বর (১৯৬৩) জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে (৫০০-এ, ধানমণ্ডি আ/এ, সড়ক নং- ৭) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করেন; কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর আকস্মিক ইকোলের কারণে এই সজ্জা মুলতবী হইয়া যায়। | আমি ও আবদুস সামাদ কারান্তরালে আটক থাকাকালেই পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাংগঠনিক কমিটি আওয়ামী লীগের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াই ২৮ ও ২৯শে ফেব্রুয়ারী ও ১লা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে দল পুনরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এইভাবেই কুক শ্রমিক পার্টি ব্যতীত অন্য সকল রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবত করি জাতীয় সেই সংকটকালে
নেতৃবৃন্দ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সামকেই দুর্বল করেন। কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আইউব যাহা চাহিয়াছিলেন- এইভাবেই নেতৃবর্গের অবিমৃষহকারিতায় অর্থাৎ নিজ নিজ দল পুনরুজ্জীবনের আইউবের সেই আকাংখাই পূর্ণ হইয়াছিল এবং পরিণতিতে আইউবের প্রভুত্বব্যঞ্জক শাসন ব্যবস্থা হইয়াছিল আরও দৃঢ়।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা
কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাংগা শুরু হইলে ঢাকায় উহার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। দাংগা প্রতিরােধকল্পে ঢাকার সর্বস্তরের নাগরিকই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ঢাকা প্রেক্লাবে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র,কমী, আইন পরিষদ সদস্য, আইন ও সাংবাদিকদের এক যৌথ সভায় দাংগা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করা হয়। গভর্নর মােনায়েম খান ও কনভেনশন মুসলিম লীগ “দাংগা প্রতিরােধ কমিটির তাৎপরতাকে সুনজরে দেখেন নাই। দাঙ্গা কবলিতদের পুনর্বাসনের প্রশ্নে প্রশাসনিক যন্ত্রের কর্মশিথিলতা আমাদিগকে মর্মাহত করিতে এবং কোন কোন স্থলে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সহিত তর্কবিতর্ক ও বচসা এড়ান যাইত না। গরীব হিন্দু কুমারদের বসতি এলাকা রায়েরবাজার দাংগায় বিধ্বস্ত হইয়াছিল। আমি, জুনাব আবদুস সামাদ এবং গুজিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী ওই এলাকায় সাহায্য ও পুনর্বাসন কাজে ব্যাপৃত থাকাকালে উগ্র মেজাজী প্রশাসনিক কর্মকর্তার সহিত কথা কাটাকাটি হয়। ক্ষমতা প্রদর্শনের নেশায় উনাৰ উক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তার অভিলাষেই ২৭শে জানুয়ারী (১৯৬৪) প্রাদেশিক সার্কিট হাউসে অবস্থানরত আমার প্রাণপ্রতিম অনুজ মােহাম্মদ আমিরুজ্জামান, সি,এস,পি’র কামৱা হইতে নিরাপত্তা আইনে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে প্রবেশ করিবার পর জনাব আবদুস সামাদের গ্রেফতারের খবর পাই। যাহা হউক, আমরা উভয়েই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ২৬ সেলের বাসিন্দা হইলাম। আমাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২৮শে জানুয়ারী কুমিল্লা জেলা হইতে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব সুলতান আহমদ প্রাদেশিক পরিষদে মূলতবী প্রস্তাব আনয়ন। করেন।
আমি ও আবদুস সামাল দল পুনরুজ্জীবনের ঘাের বিরােধী ছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত যতটা নীতিভিত্তিক ছিল, ততটা বাস্তবধর্মী ছিল না। কর্মী বাহিনীর সমর্থন বিবর্জিত নীতি বা আদর্শের বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা সফল হয় না। বৈঠকী রাজনীতিতে অভ্যস্ত ও অন্যের কর্মক্ষমতায় ব্ৰিত জাষ্ঠীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতারা মরহুম সােহরাওয়ার্দীর গতিশীল নেতৃত্বে সৃষ্ট
ম্ভাবনাময় পণ আন্দোলনের প্রতি প্রকারান্তরে বিশ্বাসঘাতকতাই করেন এবং দেশের ভবিষ্যতকে অনিবার্য সর্বনাশের দিকে ঠেলিয়া দেন। ‘আব্বার ইঞ্জেকাল। | ১৯৬৪ সালের ২৯শে জুলাই শ্রদ্ধেয় আব্বাজান ইন্তেকাল করেন। আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী। আব্বাজানের অন্তিম শয্যায় তাহার পার্শে উপস্থিত থাকিবার অনুমতি গভর্নর মােনায়েম খান সরকার দেন নাই। বিদেশী ইংরেজ সরকার আমলেও প্রিয়জনের
লােগ এবং মৃত্যুশয্যা পার্শ্বে উপস্থিত থাকিবার জন্য প্যারলে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হইত। করাচী হইতে প্রকাশিত ইংরেজী দৈনিক ডন’ পাঠে মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক ঘটনাটি জানিতে পারি । কি দুর্বহ যাতনা, কি দুঃসহ বেদনা, ভাষায় তাহা ব্যক্ত করা যায় না। শুধুমাত্র ভুক্তভােগীই তাহা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে পারে। জেল জীবনের ঐ কঠিন মুহূর্তগুলিতে নিরাপত্তা বন্দী শেখ ফজলুল হক (মনি) আমার পাশে পাশেই থাকিত ও আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিত। দেহভাজন মনির কোমল হৃদয়ের আন্তরিকতা আমার স্মৃতিকোটরে চিরসজীব থাকিবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ
১৯৬৪ সালের ২২শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিতব্য কনভােকেশন উপলক্ষে সম্ভাব্য গােলযােগ সৃষ্টির বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে শেখ ফজলুল হক মনিকে সরকার নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করেন। কনভােকেশনে গােলযােগের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিদ্রোক্ত ছাত্রদের বিরুদ্ধে বর্ণিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যথাঃ শেখ ফজলুল হক (মনি)ও আসমত আলী এম, এ, ডিগ্ৰী বাতিল; কে, এম, ওবায়দুর রহমান, এ,কে, বদরুল হক, রাশেদ খান মেনন ও সৎগতি আলম- পাঁচ বৎসরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার, হায়াৎ হােসেন, আনােয়ারুল হক চৌধুরী, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, আনােয়ার আলী হায়দার খান, শহীদুল হক-৩ বত্সরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার, গিয়াসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মনসুরুদ্দিন আহমদ, জকি আহমদ, আবদুল করিম, সৈয়দ মতিয়ুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক মিল্লা, সিরাজুল আলম খান, কাজী মােজাম্মেল ইসলাম, আতিকুর রহমান, হুমায়ুন কবীর, কামালউদ্দিন সিকদার ও ফেরদৌস আহমদ কোরেশী– দুই বৎসরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার।
| উল্লেখ্য যে, জাকী আহমদ ও আহমদ ফারুকের রীট আবেদনক্রমে ঢাকা হাইকোর্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ছাত্র বহিষ্কারাদেশ নাকচ ঘােষরা করিয়াছিলেন। বলাই বাহুল্য যে, জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এন,এস,এফ) সমগ্র দেশে গভর্নর মােনায়েম খানের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে কাজ কন্বিত ও শিক্ষাঙ্গনে ছত্রি নামধারী এনএস, এফ গুপ্তাবাহিনী সর্বপ্রকার অনাচার ও অসৎ কর্মের হােতা ছিল (যেমন ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ৪ খলিফা নুরে আলম সিদ্দিকী, শাহাজাহান সিরাজ, আ,স,ম আবদুর রব ও আবদুল কুদুস মাখনের নেতৃত্বাধীন ছাত্র লীগ)। ১৯৬৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডঃ আবু নসর মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা মামলায় ঢাকা হাইকোর্টে জিতিলে অদৃশ্য হস্কের ইংগিতে জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন গুপ্তারা ঐদিনই তাঁহাকে নির্মমভাবে প্রহার করে । ইহার অব্যবহিত পর পরই বিষাক্ত পরিবেশ হইতে মুক্তিলাভ মানসে সম্মানীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক দেশ ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সভায় ইহারই প্রতিবাদ করিবার অপরাধে ডঃ আবদুল মতিন চৌধুরী ইকবাল হল প্রভােষ্ট পদ হইতে অপসারিত হন। ঘটনার বিবর্তনের কি নির্মম পরিহাস যে, ডঃ আবদুল মতিন চৌধুরী ১৯৭৩-৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদে
অধিষ্ঠিত থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অরাজকতা, নৈরাজ্য, মারামারি, কাটাকাটি, চরিত্রহীনতা, কথায় কথায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার সর্বোচ্চ সীমায় পেীছে। শিক্ষার পরিবেশকে দেওয়া হয় চিরবিদায়, ছাত্র-শিক্ষক ভূলিয়া যায় যে, বিশ্ববিদ্যালয় তপােবন বিশেষ নিরীহ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্র সম্প্রদায় মুষ্টিমেয় অস্ত্রধারীর অশুভ শিকারে পরিণত হইয়া পড়ে। তাহাদের “মুত্র নং অধ্যয়নং তপঃ” প্রয়াস অংকুরেই বিনষ্ট হয়। দাংগা প্রতিরােধের দায়ে মামলা
‘দাংগা প্রতিরােধ কমিটি কর্তৃক দাংগা প্রতিরােধের আহ্বান জানাইয়া “পূর্ব পাকিস্তান রুধিয়া দাঁড়াও” শিরোনামে একটি বিজ্ঞাপন ছাপানাে ও বিলানাে হয়। ১৯৬০ সালের প্রেস পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের ২ ধারার ‘গ’ উপধারার নির্দেশ মােতাবেক বিজ্ঞাপনে প্রকাশক ও মুদ্রাকরের নাম ছিল না। তাই বর্ণিত অর্ডিন্যান্সের ৫০, ৫২(১) (২) মােতাবেক ১৯৬৪ সালের ৩০শে এপ্রিল সর্বজনাব হামিদুল হক চৌধুরী, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, ডঃ আলীম আল-রাজী, তফাজ্জল হােসেন, সম্পাদক দৈনিক ইত্তেফাক, জহুর হােসেন চৌধুরী, সম্পাদক দৈনিক সংবাদ, মাহমুদ আলী, মাহবুবুল হক, অলি আহাদ, কে, এম, ওবায়দুর রহমান, আলী আকসাদ ও অন্যান্যের বিরুদ্ধে ঢাকা (দক্ষিণ) মহকুমা প্রশাসকের এজলাশে গভর্নর মােনায়েম খান সরকার মামলা রুজু করেন। দীর্ঘ পাঁচ বৎসরকাল এই মামলা লইয়া টানাটানির পর ১৯৬৯ সালের ৫ই এপ্রিল সরকার মামলা প্রত্যাহার করে। এইভাবেই রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করা হয়।
কারামুক্তি
জনাব সামাদ আমার বহু পূর্বেই কারামুক্তির ব্যবস্থা করিয়া আমাদের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। এমতাবস্থায় জনাব মাহমুদ আলী আমার মুক্তি দাবী করিয়া ঢাকা হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের করেন। বিচারপতি, এ,এম, চৌধুরী ও বিচারপতি আবদুল্লাহ সমবায়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে শুনানীর প্রারম্ভেই সরকার পক্ষীয় কৌসুলী সৈয়দ মাহমুদ হােসেন আদালতকে জানান যে, সরকার আমাকে মুক্তিদানের সিদ্ধান্ত নিয়াছেন, তাই পূর্বাহ্নে প্রাথমিক শুনানীতেই আমার পক্ষে প্রদত রুল খারিজ হইয়া যায় এবং আমি ১৪ই সেপ্টেম্বর মুক্তি লাভ করি। ঐদিনই আমার প্রাণপ্রতিম অনুজ মােহাম্মদ আমীরুজ্জামানের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। পাত্রী জনাব নুরুল আমিনের কন্যা হাসিনা। ‘৬৫-এর নির্বাচন।
১৯৬৫ সালের ২রা জানুয়ারী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দিবস ধার্য হয়। ইহার পর মার্চে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন ও এপ্রিলে প্রাদিশেক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান স্থির হয়। আইউবী সংবিধানে প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদ সদস্য ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত হওয়ার বিধান ছিল না। পক্ষান্তরে প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকার জনগণ কর্তৃক নির্বাচক মণ্ডলী পাঁচ বৎসরের জন্য নির্বাচিত হইবে এবং এই নির্বাচক মাঞ্জলী প্রেসিডেন্ট,
জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরষদ সদস্যবর্গকে নির্বাচিত করিবে। নির্বাচক মণ্ডলীই ইউনিয়ন কাউন্সিল পরিচালনার দয়িত্বপ্রাপ্ত হইবে। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যগণ সাধারণতঃ “মৌলিক গণতন্ত্রী” নামে অভিহিত। সরকারী ওয়ার্কস প্রোগ্রামের অর্থ ইউনিয়ন কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্যয় করিবার পরিকল্পনা এবং দেয় অর্থের অডিট ব্যবস্থা সরকারী বেয়ালীপনার উপর নির্ভরশীল থাকায় ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যবর্গ তথা নির্বাচক মণ্ডলী দ্বারা সরকার মনােনীত প্রার্থীগণ স্বাভাবিকভাবেই অধিক ভােটে নির্বাচিত হইবার সুযােগপ্রাপ্ত হন।
| মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম ও নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী প্রতিনিধিবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার সংকল্পে ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দিনের বাসভবনে ২০শে জুলাই (১৯৬৪) চার দিবসব্যাপী বৈঠকে ৯ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে সম্মিলিত বিরােধী দল (Combined Opposition Parties) গঠন করেন। এবং ২৪শে জুলাই (১৯৬৪) এতদুমর্মে সাধারণ্যে ঘােষণা প্রকাশ করেন। ১৭ ও ১৮ই সেপ্টেম্বর করাচী বৈঠকে এই সম্মিলিত বিরােধী দল পাকিস্তান রাইস্রষ্টা কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সহোদর মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী মনােনীত করেন। ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট উক্ত মনােনয়নকে স্বাগত জানায় ও সমর্থন করিবার প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করে। মােহতারেমার মনােনয়ন সমগ্র দেশে অভূতপূর্ব। উদ্দীপনার সঞ্চার করিল। মােহতারেমার জনসভাগুলি স্বমূর্ত জনসমুদ্রে পরিণত হইতে – লাগিল। ঢাকা হইতে চট্টগ্রাম গমনকালে পথে পথে স্টেশনে স্টেশনে উদ্বেলিত লক্ষ লক্ষ জনতার সম্বর্ধনার দৃশ্য শাসককুলের হৃদকম্প সৃষ্টি করে। কিন্তু নির্বাচনে যাহা হইবার তাহাই হয়, নির্বাচক মণ্ডলীর দ্বারা জেনারেল আইউব খানই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ ও আইউব খান যথাক্রমে ১৮৪২৪+১০২৪৪ ও ২১০১২+২৮৯২১ ভােট পান। মার্চ মাসে (১৯৬৫) অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ ও এপ্রিল মাসে (১৯৬৫) অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে সরকারী মুসলিম লীগ (কনভেনশন) মনােনীত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রার্থীরাই জয়লাভ করেন। যাহা হউক, পূর্ব পাকিঙ্কান হইতে সর্বজনাব নূরুল আমিন, শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান, মাহমুদ আলী ও আবুল কাসেম প্রমুখ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নির্বাচিত হন। নির্বাচিত সংস্থা (অযােগ্য) আদেশ ১৯৫৯ (Elective bodies disqualification orderl959) মােতাবেক ছয় মাসের অধিক নিরাপত্তা বা নিবর্তনমূলক আইনে কারাবাস হইলে ৫ বৎসরের জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া আইনতঃ নিষিদ্ধ ছিল। সে কারণেই আমি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে পারি নাই। কেননা ১৯৬৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর মুক্তির আগেকার সাড়ে সাত মাসের কারাবাস ছাড়াও ১৯৫১ হইতে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ‘আমাকে জেলে বিনাবিচারে আটক থাকিতে হইয়াছিল। সে হিসাবে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আমার জন্য নির্বাচন নিষিদ্ধ ছিল।
জাতীয় পরিষদে সম্মিলিতহাবে কাজ করিবার নিমিত্ত বিরোধীদল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (National Democratic Front)
সম্মিলিত বিরােধীদল (Combined Opposition Party) গঠন করেন এবং জনাব নূরুল আমিন, শাহ আব্দুর রহমান ও কামরুজ্জামান যথাক্রমে উহার নেতা, উপনেতা ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ
কাশ্মীর বিরােধ উপলক্ষে ১৯৪৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। যাহা হউক, জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট-এর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও নিরাপত্তা পরিষদের সময়মত হস্তেক্ষেপের ফলে নিরাপত্তা পরিষদের ২০শে সেপ্টেম্বর গৃহীত নির্দেশ মােতাবেক ২২/২৩শে সেপ্টেম্বর জেয়ত্রি ৩ ঘটিকায় যুদ্ধ বিরকি আদেশ কার্যকর হয়। ইতিমধ্যে ১৯শে সেপ্টেম্বর সােভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আলেক্ষ্মী কোলিগিন সরাসরি আলােচনার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মােহাম্মদ আইউব খানকে মঞ্চে আমন্ত্রণ জানান।
প্রকাশ, পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর সহায়তায় বেসরকারী মেজাহেদ বাহিনী ১ সেপ্টেম্বর ভারত কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত কাশর রাজ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মাধ্যমে কাশ্মীরীদের ব্যাপক মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করাই ছিল ইহার উদ্দেশ্য। ইহারই পরিণতিতে পাকিস্তানের উপর ভাৱত হামলা চালায়। এই ঘটনার আর একটু নেপথা পটভূমি রহিয়াছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও জেনারেল আইউব খানের ধারণা হয় যে, মেহতারেমা। ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থন তাহার চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জন করিবার নেশায় কাশ্মীরকে পাকিস্তানভুক্ত করিবার প্রচেষ্টায় তিনি লিপ্ত হন। জনসমর্থনহীন শাসকরা আন্তরীণ সংকট উত্রাইবার জন্য এবং সঙ্কট হইতে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সাইবার উদ্দেশ্যে এই ধরনের সর্বনাশা ঝুঁকি গ্রহণে মােটেও কুণ্ঠাবােধ করেন না। আইউব সরকারের অতি উৎসাহী পদক্ষেপে স্পষ্টতঃ পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার আশংকা দেখা দেয়। তাই মহর্টিীল জেনেভায় ভারীয় ও মার্কিন
ব য়কে স্পষ্টভাষায় সতর্ক করিয়া দেয় যে, যদি পূর্ব পাকিস্তান আক্রান্ত হয় বা পাকিস্তানের কোন বড় শহরের পতন। ঘটে তাহা হইলে নিরপেক্ষ নীতি বৰ্জন করিয়া চীন যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে বাধ্য হইবে। চীনের এই সতর্কবাণী নিঃসন্দেহে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ও জাদ্দিসংঘের মোড়লদিগকে প্রবান্বিত कविग्नानि ।
ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের পটভূমিকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রয়ের অমীমাংসিত সমস্যাবলী সমাধানের সন্ধানে ও সৎ প্রতিবেশীসুলত পারস্পরিক সম্পর্কোন্নয়নের প্রয়াসে বৃহৎ শক্তিস্বয়। মার্কিন যুক্সট্র ও সোভিয়েট রাশিয়া উদ্যোগ গ্রহণ করে। আগেই বলিয়াছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতিক্রমে সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইউব খানকে দ্বিপাক্ষিক আলােচনার জন্য সােভিয়েটভূমিতে আমন্ত্রণ জালাইয়াছিলেন। গুলদিয়ায় ভারত-পাকিস্তান সরকার প্রধানদ্বয় ৪ঠা জানুয়ারী হইতে ১০ই জানুয়ারী (১৯৬৬) অবধি তাসখন্সে দ্বিপাক্ষিক আলােচনায় মিলত হন এবং সফল আলোচনার পর ১০ই জানুয়ারী এক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করেন। ইহাই তাসখন্দ ঘোষণপির নামে পরিচিত। তাসখন্দেই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পরলােকগমন করেন। বিশ্বের জন্য ইহা ছিল অত্যন্ত মর্মাল্কিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। ইতিপূর্বে মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিনডন বি জনসনের অমিশ্রণক্রমে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ১৪ ও ১৫ই ডিসেম্বর দুই দিনব্যাপী সফরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমন করিয়াছিলেন। আলোচনায় ইন্দো-পাকিস্তানের অমীমাংসিত সমস্যাবলী শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের ইঙ্গিত সম্বলিত এক যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর। | পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টা “তাসখন্দ ঘােষণাপত্রের” ঘাের বিরােধী ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী জনমতও মােটামুটিভাবে তাসখন্দ ঘােষণাপত্রের প্রতিকূলে ছিল। জনমতের প্রতিধ্বনি করি পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিকবৃন্দ তাসখন্দ ঘােষণাপত্রের বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহােরে এক সম্মেলন আহবান করেন। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতা জনাব নুরুল আমিনও লাহাের সম্মেলনকে লক্ষ্য করিয়া ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধ বিরােধী মনােভাব প্রকাশ কৱেন এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও শাসনতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনের আহবান জানান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান লাহাের সম্মেলনে যােগ দেন এবং পাকিস্তানের সাংবিধানিক সমাধানকষ্টে কতিপয় প্রস্তাব উত্থাপনের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। এই প্রস্তাবলি পরবর্তীকালে বিখ্যাত ছয় দফা কর্মসূচী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। ছয় দফা | ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ অবসানের পর ও যুক্তরাষ্ট্র সফরের মধ্যবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট আইউব খান পূর্ব পাকিস্তানে আসেন এবং গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহিত এক বৈঠকে মিলিত হন। পাক-ভারত যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় রাজধানী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। এখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ফলে এই দেশ রক্ষার দায়িত্বভার পড়িয়াছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উপর। ইত্যকার তথ্য ও বক্তব্য মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, চাকুরীজীবী সম্প্রদায়কে বিশেষভাবে আলােড়িত করে। বলা আবশ্যক যে, ১৯৪৭ সাল হইতে নানা কারণে পূর্ব পশ্চিম পাস্তান তথা বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালীর মধ্যে মানসিক দূরত্ব জন্ম নিয়াছিল এবং তাহাই উভয় অংশের মধ্যে সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছিল বিচ্ছিন্নতার আবহাওয়া। তদুপরি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানী জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যকরী ক্ষমতার কোন অবকাশ ১৯৬২ সালের সংবিধানে না থাকায়, বাঙ্গালী মনে যে ক্ষোভ জমা হইয়াছিল, তাহারই অভিব্যক্তি ঘটে নিয়ে প্রদও সাত দফা” রচনায়। প্রেসিভেট আইউব খান কর্তৃক আহুত নেতৃবৈঠকে ইংরেজীতে লিখিত দফাগুলি উত্থাপন করিবার জন্য রচয়িতাদের পক্ষ হইতে জনাব খায়রুল কবীর পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনকে প্রদান কক্লেন। সেইদিন আমি ঘটনাচক্রে নুরুল আমিন সাহেবের সহিত তাহার বাসভবনে পূর্ব হইতেই আলােচনায় রত ছিলাম। সেই দিনই উক্ত কপিটি আমি নুরুল আমিন সাহেবের নিকট হইতে শুবিষ্যৎ রেফারেন্সের জন্য লইয়া আসি। সেই আলােচনা বৈঠকেই খাবরুল কবীর সাহেব হইতে আমি অবগত হই যে,
তাহার আমন্ত্রিত সব নেতাকেই ইহার কপি দিয়াছেন। এই কপিতে বর্ণিত যা অফার নিম্নাংশ ও সাত নং দফা বাদ দিয়া যাহা অবশিষ্ট থাকে তাহাই শেখ মুজিবর রহমানের ছয় দফা। এবং পরবর্তীকালে তিনিই এই ছয় দফার প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত লাভ করেন। উল্লেখ্য যে, সেদিন নূরুল আমিন সাহেবের বাসভবনেই আমি জনাব খায়রুল কবীরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম ইহা কাহার রচনা? জওয়াবে তিনি বলেন যে, সর্ব মহলের প্রায় ৫০ ব্যক্তি সম্মিলিতভাবে ইহা রচনা করিয়াছেন। সেদিন এই ব্যাপারে আমার মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় নাই। কিন্তু পরবর্তীকালে ছয় দফা আন্দোলনের ঘটনাবলীতে অমাির নিকট প্রতীয়মান হইয়াছিল যে, ইহার নেপথে (ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, (খ) আন্তর্জাতিক ইনী কারসাজি তাে ছিলই, (গ) গরত সরকারের গােপন হক ইহাতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা প্রদান করিয়াছিল। আপেই উল্লেখ করিয়াছি যে, শেখ মুজিব লাহের কনফারেন্সে ছয় দফা উথাপনের ব্যর্থ প্রয়াস পান।
১১ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়া শেখ মুজিবর রহমান তাহার লাহোর সম্মেলন ত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করেন এবং লাহাের সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের বিবেচনাৰ্থে দেয় তাহার ছয় দফা সাংবাদিকদের নিকট প্রকাশ কগেন। ১৯শে মার্চ (১৯৬৬ইং) পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ গুয়ার্কিং কমিটি ৬ দফাকে সাংগঠনিক কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করে এবং ২০শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় অনুমােদিত হয়। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, শেখ মুজিব প্রদত্ত ৬ দফা সংবাদ পত্র প্রকাশ না করতে সর্ব জনাব আবুল মুনসুর আহমদ, আহাউর রহমান খান ও মানিক মিয়া একমত হন এবং সে মতে মানিক মিয়া তার পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে তা প্রকাশ করেননি। প্রকাশ করে ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুর পার সম্পাদিত দৈনিক আওয়াজে।
যাহা হউক, আমি এখানেজনাব খায়রুল কবীর প্রদত্ত ও কনাৰ নুরুল আমিনের নিকট হইতে প্রাপ্ত সাত দা” এবং শেখ মুজিবর রহমান প্রদস্তু ছয় দফার পূর্ণ চিত্র পাঠকবর্গের যেমতে পেশ করিতেছিঃ শেখ মুজিবর রহমান প্রদত্ত ৬ দফা
In view of the experiences gathered during the 17 days war with India some rethinking for East pakistan from the constitutional point of view is necessary, keeping in view the practical aspects of administration for the welfare of the people of this province. It is evident that the people of East Pakistan’s determination to keep the country as a whole saved the two parts of Pakistan from disintergration which could have taken place during this period of extraodinary emergency
The main object of this brief note is to make an earnest effort to continue to keep the two parts of Pakistan united as one political entity. With this object, the following suggestions are made:
এন ডি এফ-এর ৭ দফা।
এই সময় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পরিহার করিয়া একনায়কত্ববাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করিবার জন্য আমি জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে থাকি। আইউব খান ৮ই মার্চ জাতীয় পরিষদে প্রদত্ত বক্তব্যে ফেডারেল ও পার্লামেন্টারী সরকার পদ্ধতির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। ইহারই প্রতিবাদে পাক-ভারত যুদ্ধোত্তর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সমস্যাবলীর সাংবিধানিক সমাধানকল্পে আমরা জাতীয় ফ্রন্টের এক অংশ জনাব আতাউর রহমান খানের মাধ্যমে ১০ই মার্চ (১৯৬৬) এক সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করি এবং দেশবাসীর বিবেচনার জন্য সাত দফা পরিকল্পনা প্রকাশ করি। জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট বহু বাক-বিতন্ডার পর ৩০শে এপ্রিল (১৯৬৬) জনাব নূরুল আমিনের ইস্কাটনস্থ বাসভবনে অনুষ্ঠিত কমিটির বৈঠকে স্বয়ং নুরুল আমিন, মাহমুদ আলী (সিলেট), আবদুস সামাদ (সিলেট), ইউসুফ আলী চৌধুরী ও সৈয়দ আজিজুল হকের তীব্র বিরােধিতার মুখেও এই সাত দফাকে অনুমােদন করেন। নিচ্ছে সাত দফা পরিকল্পনা দেওয়া হইলঃ (a) Constitutional arrangements should be remodelled and the
country reverted to federal system both in theory and practice. Parliamentary form of Government should be reintroduced vesting all powers in the parliament which should be directly elected by adult franchise. The two Regions must have full Regional Autonomy with DEFENCE, FOREIGN AFFAIRS
(POLITICAL) CURRENCY (MINTING) in the centre. (b) The federal structure should include a sub-federation of former
provinces of Sind, Baluchistan, N.W.F.P. and West Punjab with such territorial readjustment as may reconstitute the area now West pakistan into four cultural and linguistic units. The question of one unit needs to be re-examined in consultation with the people of West pakistan particularly of the affected
provinces of that area. (c) On account of sheer distance between East & West Pakistan
there is total immobility of labour and capital between them so that Economic forces generated in one wing hardly produce any effect on the other. Pakistan therefore, is IPSOFACTO a two Economy State, although the pattern of economy is the same. As
such the economy of the country should be remodeled. (d) Effective steps should be taken to remove disparity between two
৭ই জুনের প্রস্তুতি
দেশের আনাচে কানাচে ছয় দফার বাণী পেীছাইয়া দেওয়ার প্রয়াসে শেখ মুজিবর রহমান বিভিন্ন জেলা সদরে আয়ােজিত জনসভায় ভাষণ দিতে লাগিলেন। ক্ষিপ্ত গভর্নর মােনায়েম খান বক্ততার কোন কোন অংশকে আপত্তিকর নির্ধারিত করিয়া পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারায় বিচারের জন্য তাঁহাকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তৃতার জন্য খুলনা হইতে ঢাকা আগমন পথে ২১শে এপ্রিল যশাের জেলা শহরে গ্রেফতার, যশাের দায়রা জজ কর্তৃক জামিন মঞ্জুর; ময়মনসিংহে বক্তৃতার অপরাধে পুনঃ সিলেট জেল গেটে গ্রেফতার এবং ময়মনসিংহ দায়রা জজ কর্তৃক জামিন মধুর প্রাপ্ত হন। এইভাবেই শেখ মুজিবর রহমানের পুনঃপুনঃ গ্রেফতার এবং দৈনিক ইত্তেফাককে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার-অভিযান পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশ্রেণীর শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি মহলে তীব্র আলােড়ন ও যুগান্তকারী আবেদন সৃষ্টি করে। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে আয়ােজিত জনসভায় পার্শ্ববর্ত শিল্প এলাকা হইতে সহস্র সহস্র মেহনতি শ্রমিক যােগদান করে এবং ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবর রহমানকে পাটের মালায় ভূষিত করে। পাটকল শ্রমিক শ্রেণী হইতে আওয়াজ শুনা যায় আপোষহীন সংগ্রামের। নারায়ণগঞ্জ জনসভা হইতে প্রত্যাবর্তনের পরই ১৯৬৫ সালে দেশরক্ষা আইনের ৩৪ ধারায় ঢাকায় স্বীয় বাসভবন হইতে ৮ই মে রাত্রিতে শেখ মুজিবর রহান গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারী মুক্তির আদেশ পান বটে তবে কারাগার ফটকে তঁাহাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম ও প্রধান আসামী হিসাবে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ই মে (১৯৬৬) ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
| এই দিকে পূর্ব পাকিস্তান ভুলিলীগ সভাপতি মাজহারুল হক বাকী: ময়মনসিংহ জিলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক রফিকউদ্দিন ভুইয়া ও শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান সক্রিয় কর্মসূচী নিতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে চাপ দিতে থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগ ৭ই জুন (মঙ্গলবার) সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ হরতাল পালনের ডাক দেয়। এই সময়ে চটকল শ্রমিক ফেডারেশন, মােঃ তােয়াহার নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন; আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদ পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার বিল্লি শিল্প এলাকায় হরতাল বিরােধী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ব্যতিক্রম ছিল পাকিস্তান মদুর ফেডারেশন (ইস্ট জোন)। এই সংগঠন ৪ঠা জুনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কোনপ্রকার সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিয়া “অবস্থাভেদে ব্যবস্থা গ্রহণ নীতি অবলম্বনে শাখা কমিটিগুলি নির্দেশ দান করে। আমার ধারণা, ইহার দ্বারা ৬ দফা দাবীতে আহূত হরতাল কর্মসূচী বহুভাবে উপকৃত হয়। মজনুর ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত আঞ্চলিক তেজপীও ট্রেড ইউনিয়ন এসােসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রুল আমীন ইয়া ৫ই জুন কার্যকরী কমিটির সভা আহবান করেন। শাখা সংগঠন সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান হরতাল
পালনের বিরুদ্ধে রায় দিলেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন ইয়া ৬ই জুন তেজগাঁও আঞ্চলিক শাখাভুক্ত প্রত্যেক ইউনিয়ন হইতে দুইজন প্রতিনিধি সম্বলিত এক সম্প্রসারিত শ্রমিক বৈঠক আহবান করেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবর রহমান বিরােধী বক্তব্য। বুলিলেও অবশেষে রাত্রি দেড় ঘটিকায় আইউব-মােনায়েম সরকারের গুম এবং কলকারখানার মালিক শ্রেণীর অত্যাচারের প্রতিবাদে ৭ই জুন রােজ মঙ্গলবার হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শ্রমিকদের মুজিব বিরােধী মনােভাবের কারণ অবশ্য ছিল। ১৯৫৬ ৫৭ সালে শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে শেখ মুজিবর রহমান শ্রমিকদের দাবীনামা গ্রহণের পরিবর্তে হাৰিব ম্যাচ ফ্যাক্টরীর শ্রমিক প্রতিনিধিসহ শ্রমিকদিগকে পুলিশ মারফত ট্রাকে করিয়া জয়দেবপুর জঙ্গলে ছাড়িয়া দিবার ব্যবস্থা করেন। ৭ই জুনের ঘটনাবলী
৭ই জুন ঢাকা শহরে হরতালের প্রথম বেলায় বিশেষ কোন সক্রিয় সাড়া জাগাইতে পারে নাই। কিন্তু সমগ্র পরিস্থিতির মােড় ঘুরিয়া যায় তেজগাঁও শিল্প এলাকার মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া। সকাল ৮ ঘটিকার দিকে তেজগায়ে অবস্থিত কোহিনুর কেমিক্যাল কোঃ (
তিত) ও হক ব্রাদার্স কোঃ সম্মুখস্থ রাজপথের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত একটি চায়ের দোকানে ধর্মঘটী শ্রমিক দল চা-নাস্তা গ্রহণকালে একজন শ্রমিক সাইকেলে হুথায় আসিলে দোকানে উপবিষ্ট শ্রমিকদের একজন সাইকেলের হাওয়া হাড়িয়া দেয়। এমনি আপােষী দৃশ্যে হাসি-কৌতুকের হিল্লোড় বহিয়া যায়। হঠাৎ হরিষে বিষাদ সৃষ্টি করে একটি পুলিশ জীপের আগমন। পুলিশ জীপে আগত পুলিশ শ্রমিকদিগকে লাঠিপেটা আরম্ভ করে, শুরু হয় পাল্টা শ্রমিক প্রতিরোধ। অসহিষ্ণু পুলিশের রিভলবারের গুলীতে তিনজন শ্রমিক গুলীবিদ্ধ হয়। উক্ত গুলীবিদ্ধ তিনজনের মধ্যে সিলেট জেলা নিবাসী বেঙ্গল বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের শ্রমিক মনু মিয়া ঘটনাস্থলে শাহাদৎবরণ করেন। | উক্ত হৃদয় বিদারক ঘটনার পর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহস্র সহস্র শ্রমিক লাঠি হাতে মিছিল সহকারে পথে বাহির হইয়া পড়ে। মিছিল তেজগাঁও রেলওয়ে ক্রসিং অতিক্রমকালে উত্তর দিক হইতে আগত ট্রেনকে পথিমধ্যে থামাইয়া দেয়।ট্রেনটি পুনঃ চালাইবার চেষ্টা করিলে উহা লাইনচ্যুত হইয়া যায়। ঘটনার অব্যবহিত পরই পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর সশস্ত্র বাহিনী রেল লাইনের পশ্চিম দিক হইতে রেল লাইনের পূর্ব দিকে অবস্থানরত শ্রমিক মিছিল ছল কারবার প্রয়াসে কয়েক রঙ ফাকা গুলী ছোড়ে। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে নােয়াখালী জেলা নিবাসী আজাদ এনামেল এন্ড এলােমিনিয়াম কারজানার | ছাঁটাইকৃত শ্রমিক আবুল হােসেন পায়ে গুলীবিদ্ধ হয়। ইহাতে উত্তেজিত হইয়া আহত আবুল হােসেন বীরদর্পে দাঁড়াইয়া সশর বাহিনীকে তাহার বক্ষে গুলী করিতে আহবান জানায়। পুলিশের উদ্যত রাইফেলের নির্মম গুলী তাহার বৃক্ষকে বিদির্ণ করে। এইভাবেই ধরাশায়ী শহীদ আবুল হােসেন স্বীয় তপ্ত লােনিতে মুক্তি সংগ্রামের মৃত্যুঞ্জয়ী ডাক লিখিয়া পেলেন। এই জানেই পুলিশের পরবর্তী গুলীতে আরও ৫ জন শ্রমিক আহত হয়। প্রায় দুপুর ১২-৩০ মিঃ এই নগ্ন দমননীতি ও পাইকারী শ্রমিক-হত্যার প্রতিবাদে জারিকৃত ১৪৪ ধারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য
করিয়া লাঠি হস্তে অকুতােভয় শ্রমিক জনতার মিছিল ধীর গভীর পদক্ষেপে তেজগাঁও হইতে পাক মােটর এলাকা, হােটেল শাহবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট, কমিশনার্স অফিস (বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) অর্থাৎ সেগুন বাগিচার মােড়ে উপস্থিত হয়। মিছিল পল্টন ময়দান মুখে অগ্রসর হইতে চেষ্টা করিলে সশস্ত্র পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনী বাধাদান করে। বাধাপ্রাপ্ত জঙ্গী মিছিলটি হাইকোর্ট অভিমুখে রওয়ানা হয়। সময় তখন অপরাহ্ন দুই কি আড়াইটা। মিছিলের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বেষ্টনি লক্ষ্য করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ মিছিলকারীগণকে কার্জন হল প্রাঙ্গনে সমবেত হইবার আহবান জানায়। অপরাহ্ন চার ঘটিকায় পল্টনে আহুত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাহাকেও না দেখিয়া বিহবল, হতাশ ও উদ্বিগ্ন মনে শ্রমিকপণ হইয়া স্ব-স্ব পথে তেজপা অভিমুখে যাত্রা করে। প্রত্যাবর্তনকারী শ্রমিকদের ১শত ৫০ জনকে পুলিশ রমনা থানা, পাক মােটর, হােটেল শাহবাগ ও অন্যান্য স্থান হইতে গ্রেফতার করে। পরে ৯ই জুন রাত্রে সান্ধ্য আইন জারি করিয়া তেজগাঁওয়ের নাখালপাড় হইতে ৬০ জন শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। ‘৭ই জুন ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব
নারায়গণগঞ্জ শহরে ৭ই জুন হরতাল উপলক্ষে কয়েক স্থলে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ ঘটে। সর্বশেষ বােস কেবিনের নিকট জনতা রেলওয়ে ওয়াগন জুট করিবার চেষ্টা নিলে পুলিশের গুলীতে ৬ জন মৃত্যুবরণ করে। কুদ্ধ জনতা নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। তেজগাঁও, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলীতে নিহত হইবার সংবাদে উত্তেজিত লক্ষাধিক শ্রমিক-জনতা পোস্তগােলা, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ হইতে যাত্রাবাড়ী পৌছিলে সশস্ত্র পুলিশ ও ই,পি, আর বাহিনী বাধা দান করে। কর্তৃপক্ষ জনতাকে জানায় যে, ঢাকার পল্টন ময়দানে কোন জনসভা হইতেছে না। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য শ্রমিক নেতা সায়েদুল হক, নূর মােহাম্মদ ও শফি সহ ৫ জনকে ঢাকার পল্টন ময়দানে পাঠানাে হয়। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ যাত্রাবাড়ী প্রত্যাবর্তন করিয়া জনশুন্য পল্টন ময়দানের রিপাের্ট দিলে শােভাযাত্রীগণ ঢাকা গমন কর্মসূচী বাতিল করেন। এইভাবে ই,পি, আর ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সময়ােপযােগী পদক্ষেপ আসন্ন প্রলয়কা হইতে পরিস্থিতিকে রক্ষা করে। উলেখ্য যে, ৭ই জুন দুপুর নাগাদ ঢাকা শহরের হরতাল ও জনসভা সম্পর্কে আলােচনা করিতে আমি স্ব উদ্যোগে পুরানা পল্টন আওয়ামী লীগ অফিসে গমন করিয়াছিলাম। তথায় মিজানুর রহমান চৌধুরী, মিসেস আমেনা বেগম, এ,কে, রফিকুল হােসেন, গাজী গােলাম মােস্তফা ও সিরাজুল আলম খানের সহিত আমার আলােচনাও হইয়াছিল। ৭ই জুন তেজশাখ এবং নারায়ণগঞ্জে পুলিশের কালীবর্ষণের সংবাদে ঢাকা শহর স্তঙ্কিত হইয়া পড়ে। হরতাল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। উৎসুক জনতা পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গকে দেখিতে চায়। আমি বার বার যােগাযােগ করিয়াও তাহাদিগকে পল্টন ময়দানে লইয়া যাইতে সমর্থ হই নাই। বােধহয় গভর্নর মােনায়েম খানের ভয়াল মূৰ্তি কল্পনানেত্রে তাহাদিগকে অদৃশ্য স্কুল হইতে শাসাইতেছিল। তাই ৭ই জুন সরকারী হিসাবে ১০জন নিহত হওয়া সত্বেও নেতৃবৃন্দ কোন প্রতিবাদ কর্মসূচী ঘােষণা করেন নাই । ৬ দফা দাবী প্রতিষ্ঠার প্রথম
পর্যায় এই অভিযানের (৭ই জুনের কর্মসূচীর) সাফল্য ও গৌরব তেজগাঁও, পােস্তগােলা নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা ও আদমজী নগর শিল্পাঞ্চলের সমৗ , নির্ভীক ও সরল শ্রমিক শ্রেণীর অবশ্য প্রাপ্য। ইতিপূর্বে আর কখনও এত ব্যাপক ও সংঘবদ্ধভাবে শ্রমিক শ্রেণী রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নাই।
পাকিস্তান জন্মলগ্ন হইতে কেন্দ্রীয় সরকারের গণতন্ত্র বিরােধী, প্রভূত্বব্যঞ্জক ও বাঙ্গালী বিদ্বেষী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানীদের মনের দিগন্তে পুঞ্জীভূত রােষ ধীরে ধীরে শাসকচক্রের অজান্তে ও অগােচরে প্রলয়য়ী রূপ ধারণ করিতেছিল। ইহারই অসংগঠিত ও স্বতঃফুর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই জুন। ঐতিহাসিক যুগ সন্ধিক্ষণের যুগ পরিবর্তনকারী অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামের নির্ভীক অজেয় অশ্রণী সেনা মেহনতি শ্রমিক শ্রেণী শত্রুকে চিহ্নিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল। অদূর ভবিষ্যতে শাসক শ্রেণীর বিস্তর হাঁকডাক ও দম্ভের শােচনীয় পরাজয়ের সংকেতধ্বনি ছিল ৭ই জুনের আন্দোলন ॥১৩ই মে (১৯৬৬) পল্টন ময়দানের জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহিরুদ্দিন আহমদ তাহার ভাষণে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া বলিয়াছিলেন, মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানকল্পে কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর চৌদ্দ দফা প্রত্যাখ্যান করায় ভারত দ্বিখন্ডিত হয়, দ্রুপ ৬ দফা দাবী গ্রহণে পাকিস্তানী শাসকবর্গ ব্যর্থ হইলে পূর্ব পাকিন এক দফা দাবী করিবে।” ইত্তেফাক বন্ধ
| ৬ দফা আন্দোলন প্রচারে নিয়াজিত দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেনকে ১৫ই জুন গ্রেফতার করা হয়। ১৬ই জুন দৈনিক ইত্তেফাকের ভ্রাযন্ত্র দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে বাজেয়াপ্ত এবং দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দৈনিক ইত্তেফাক বাজেয়াপ্তকরণ আদেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় ঢাকা হাইকোর্ট সরকারী আদেশের বিরুদ্ধে রায় দিলে সরকার অর্ডিন্যান্সে প্রয়ােজনীয় সংশােধন করিয়া পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে দৈনিক ইত্তেফাকের মুদ্রাযন্ত্র দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে পুনরায় বাজেয়াপ্ত করে। উল্লেখ্য যে, এই ৭ই জুনের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে বেশীর ভাগ আওয়ামী লীগ নেতাই গ্রেফতার হন। নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হইবার পর মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা নিযুক্ত হয় । তাহার কঠোর পরিশ্রম ৬ দফাকে গণভিত্তি দিতে সমর্থ হয় এবং প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগের পতাকা সমুন্নত থাকে।
| এইদিকে এক ব্যক্তি শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হইতে সমগ্র দেশকে মুক্ত করিবার উদ্দেশ্যে ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ঐকাস্তিক বাসনায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এ জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঐক্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত ৩০শে এপ্রিলের (১৯৬৭) সভায় নিম্নলিখিত্ত ব্যক্তিবর্গের সমবায়ে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট গঠিত হয়ঃ
৭ই জুনের প্রস্তুতি
দেশের আনাচে কানাচে ছয় দফার বাণী পেীছাইয়া দেওয়ার প্রয়াসে শেখ মুজিবর রহমান বিভিন্ন জেলা সদরে আয়ােজিত জনসভায় ভাষণ দিতে লাগিলেন। ক্ষিপ্ত গভর্নর মােনায়েম খান বক্ততার কোন কোন অংশকে আপত্তিকর নির্ধারিত করিয়া পেনাল কোডের বিভিন্ন ধারায় বিচারের জন্য তাঁহাকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তৃতার জন্য খুলনা হইতে ঢাকা আগমন পথে ২১শে এপ্রিল যশাের জেলা শহরে গ্রেফতার, যশাের দায়রা জজ কর্তৃক জামিন মঞ্জুর; ময়মনসিংহে বক্তৃতার অপরাধে পুনঃ সিলেট জেল গেটে গ্রেফতার এবং ময়মনসিংহ দায়রা জজ কর্তৃক জামিন মধুর প্রাপ্ত হন। এইভাবেই শেখ মুজিবর রহমানের পুনঃপুনঃ গ্রেফতার এবং দৈনিক ইত্তেফাককে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার-অভিযান পূর্ব পাকিস্তানে সর্বশ্রেণীর শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি মহলে তীব্র আলােড়ন ও যুগান্তকারী আবেদন সৃষ্টি করে। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জে আয়ােজিত জনসভায় পার্শ্ববর্ত শিল্প এলাকা হইতে সহস্র সহস্র মেহনতি শ্রমিক যােগদান করে এবং ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবর রহমানকে পাটের মালায় ভূষিত করে। পাটকল শ্রমিক শ্রেণী হইতে আওয়াজ শুনা যায় আপোষহীন সংগ্রামের। নারায়ণগঞ্জ জনসভা হইতে প্রত্যাবর্তনের পরই ১৯৬৫ সালে দেশরক্ষা আইনের ৩৪ ধারায় ঢাকায় স্বীয় বাসভবন হইতে ৮ই মে রাত্রিতে শেখ মুজিবর রহান গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারী মুক্তির আদেশ পান বটে তবে কারাগার ফটকে তঁাহাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম ও প্রধান আসামী হিসাবে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৩ই মে (১৯৬৬) ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
| এই দিকে পূর্ব পাকিস্তান ভুলিলীগ সভাপতি মাজহারুল হক বাকী: ময়মনসিংহ জিলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক রফিকউদ্দিন ভুইয়া ও শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান সক্রিয় কর্মসূচী নিতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে চাপ দিতে থাকেন। ফলে আওয়ামী লীগ ৭ই জুন (মঙ্গলবার) সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ হরতাল পালনের ডাক দেয়। এই সময়ে চটকল শ্রমিক ফেডারেশন, মােঃ তােয়াহার নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন; আফতাব আলী, ফয়েজ আহমদ পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার বিল্লি শিল্প এলাকায় হরতাল বিরােধী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ব্যতিক্রম ছিল পাকিস্তান মদুর ফেডারেশন (ইস্ট জোন)। এই সংগঠন ৪ঠা জুনের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে কোনপ্রকার সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করিয়া “অবস্থাভেদে ব্যবস্থা গ্রহণ নীতি অবলম্বনে শাখা কমিটিগুলি নির্দেশ দান করে। আমার ধারণা, ইহার দ্বারা ৬ দফা দাবীতে আহূত হরতাল কর্মসূচী বহুভাবে উপকৃত হয়। মজনুর ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত আঞ্চলিক তেজপীও ট্রেড ইউনিয়ন এসােসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক রুল আমীন ইয়া ৫ই জুন কার্যকরী কমিটির সভা আহবান করেন। শাখা সংগঠন সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান হরতাল
পালনের বিরুদ্ধে রায় দিলেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমীন ইয়া ৬ই জুন তেজগাঁও আঞ্চলিক শাখাভুক্ত প্রত্যেক ইউনিয়ন হইতে দুইজন প্রতিনিধি সম্বলিত এক সম্প্রসারিত শ্রমিক বৈঠক আহবান করেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবর রহমান বিরােধী বক্তব্য। বুলিলেও অবশেষে রাত্রি দেড় ঘটিকায় আইউব-মােনায়েম সরকারের গুম এবং কলকারখানার মালিক শ্রেণীর অত্যাচারের প্রতিবাদে ৭ই জুন রােজ মঙ্গলবার হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শ্রমিকদের মুজিব বিরােধী মনােভাবের কারণ অবশ্য ছিল। ১৯৫৬ ৫৭ সালে শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে শেখ মুজিবর রহমান শ্রমিকদের দাবীনামা গ্রহণের পরিবর্তে হাৰিব ম্যাচ ফ্যাক্টরীর শ্রমিক প্রতিনিধিসহ শ্রমিকদিগকে পুলিশ মারফত ট্রাকে করিয়া জয়দেবপুর জঙ্গলে ছাড়িয়া দিবার ব্যবস্থা করেন। ৭ই জুনের ঘটনাবলী
৭ই জুন ঢাকা শহরে হরতালের প্রথম বেলায় বিশেষ কোন সক্রিয় সাড়া জাগাইতে পারে নাই। কিন্তু সমগ্র পরিস্থিতির মােড় ঘুরিয়া যায় তেজগাঁও শিল্প এলাকার মর্মান্তিক ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া। সকাল ৮ ঘটিকার দিকে তেজগায়ে অবস্থিত কোহিনুর কেমিক্যাল কোঃ (
তিত) ও হক ব্রাদার্স কোঃ সম্মুখস্থ রাজপথের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত একটি চায়ের দোকানে ধর্মঘটী শ্রমিক দল চা-নাস্তা গ্রহণকালে একজন শ্রমিক সাইকেলে হুথায় আসিলে দোকানে উপবিষ্ট শ্রমিকদের একজন সাইকেলের হাওয়া হাড়িয়া দেয়। এমনি আপােষী দৃশ্যে হাসি-কৌতুকের হিল্লোড় বহিয়া যায়। হঠাৎ হরিষে বিষাদ সৃষ্টি করে একটি পুলিশ জীপের আগমন। পুলিশ জীপে আগত পুলিশ শ্রমিকদিগকে লাঠিপেটা আরম্ভ করে, শুরু হয় পাল্টা শ্রমিক প্রতিরোধ। অসহিষ্ণু পুলিশের রিভলবারের গুলীতে তিনজন শ্রমিক গুলীবিদ্ধ হয়। উক্ত গুলীবিদ্ধ তিনজনের মধ্যে সিলেট জেলা নিবাসী বেঙ্গল বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের শ্রমিক মনু মিয়া ঘটনাস্থলে শাহাদৎবরণ করেন। | উক্ত হৃদয় বিদারক ঘটনার পর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সহস্র সহস্র শ্রমিক লাঠি হাতে মিছিল সহকারে পথে বাহির হইয়া পড়ে। মিছিল তেজগাঁও রেলওয়ে ক্রসিং অতিক্রমকালে উত্তর দিক হইতে আগত ট্রেনকে পথিমধ্যে থামাইয়া দেয়।ট্রেনটি পুনঃ চালাইবার চেষ্টা করিলে উহা লাইনচ্যুত হইয়া যায়। ঘটনার অব্যবহিত পরই পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর সশস্ত্র বাহিনী রেল লাইনের পশ্চিম দিক হইতে রেল লাইনের পূর্ব দিকে অবস্থানরত শ্রমিক মিছিল ছল কারবার প্রয়াসে কয়েক রঙ ফাকা গুলী ছোড়ে। এমতাবস্থায় আকস্মিকভাবে নােয়াখালী জেলা নিবাসী আজাদ এনামেল এন্ড এলােমিনিয়াম কারজানার | ছাঁটাইকৃত শ্রমিক আবুল হােসেন পায়ে গুলীবিদ্ধ হয়। ইহাতে উত্তেজিত হইয়া আহত আবুল হােসেন বীরদর্পে দাঁড়াইয়া সশর বাহিনীকে তাহার বক্ষে গুলী করিতে আহবান জানায়। পুলিশের উদ্যত রাইফেলের নির্মম গুলী তাহার বৃক্ষকে বিদির্ণ করে। এইভাবেই ধরাশায়ী শহীদ আবুল হােসেন স্বীয় তপ্ত লােনিতে মুক্তি সংগ্রামের মৃত্যুঞ্জয়ী ডাক লিখিয়া পেলেন। এই জানেই পুলিশের পরবর্তী গুলীতে আরও ৫ জন শ্রমিক আহত হয়। প্রায় দুপুর ১২-৩০ মিঃ এই নগ্ন দমননীতি ও পাইকারী শ্রমিক-হত্যার প্রতিবাদে জারিকৃত ১৪৪ ধারা নিষেধাজ্ঞা অমান্য
করিয়া লাঠি হস্তে অকুতােভয় শ্রমিক জনতার মিছিল ধীর গভীর পদক্ষেপে তেজগাঁও হইতে পাক মােটর এলাকা, হােটেল শাহবাগ, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট, কমিশনার্স অফিস (বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) অর্থাৎ সেগুন বাগিচার মােড়ে উপস্থিত হয়। মিছিল পল্টন ময়দান মুখে অগ্রসর হইতে চেষ্টা করিলে সশস্ত্র পুলিশ ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বাহিনী বাধাদান করে। বাধাপ্রাপ্ত জঙ্গী মিছিলটি হাইকোর্ট অভিমুখে রওয়ানা হয়। সময় তখন অপরাহ্ন দুই কি আড়াইটা। মিছিলের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর বেষ্টনি লক্ষ্য করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ মিছিলকারীগণকে কার্জন হল প্রাঙ্গনে সমবেত হইবার আহবান জানায়। অপরাহ্ন চার ঘটিকায় পল্টনে আহুত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কাহাকেও না দেখিয়া বিহবল, হতাশ ও উদ্বিগ্ন মনে শ্রমিকপণ হইয়া স্ব-স্ব পথে তেজপা অভিমুখে যাত্রা করে। প্রত্যাবর্তনকারী শ্রমিকদের ১শত ৫০ জনকে পুলিশ রমনা থানা, পাক মােটর, হােটেল শাহবাগ ও অন্যান্য স্থান হইতে গ্রেফতার করে। পরে ৯ই জুন রাত্রে সান্ধ্য আইন জারি করিয়া তেজগাঁওয়ের নাখালপাড় হইতে ৬০ জন শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। ‘৭ই জুন ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব
নারায়গণগঞ্জ শহরে ৭ই জুন হরতাল উপলক্ষে কয়েক স্থলে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ ঘটে। সর্বশেষ বােস কেবিনের নিকট জনতা রেলওয়ে ওয়াগন জুট করিবার চেষ্টা নিলে পুলিশের গুলীতে ৬ জন মৃত্যুবরণ করে। কুদ্ধ জনতা নারায়ণগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। তেজগাঁও, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ ও পুলিশের গুলীতে নিহত হইবার সংবাদে উত্তেজিত লক্ষাধিক শ্রমিক-জনতা পোস্তগােলা, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ হইতে যাত্রাবাড়ী পৌছিলে সশস্ত্র পুলিশ ও ই,পি, আর বাহিনী বাধা দান করে। কর্তৃপক্ষ জনতাকে জানায় যে, ঢাকার পল্টন ময়দানে কোন জনসভা হইতেছে না। সত্যতা যাচাইয়ের জন্য শ্রমিক নেতা সায়েদুল হক, নূর মােহাম্মদ ও শফি সহ ৫ জনকে ঢাকার পল্টন ময়দানে পাঠানাে হয়। শ্রমিক নেতৃবৃন্দ যাত্রাবাড়ী প্রত্যাবর্তন করিয়া জনশুন্য পল্টন ময়দানের রিপাের্ট দিলে শােভাযাত্রীগণ ঢাকা গমন কর্মসূচী বাতিল করেন। এইভাবে ই,পি, আর ও পুলিশ কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সময়ােপযােগী পদক্ষেপ আসন্ন প্রলয়কা হইতে পরিস্থিতিকে রক্ষা করে। উলেখ্য যে, ৭ই জুন দুপুর নাগাদ ঢাকা শহরের হরতাল ও জনসভা সম্পর্কে আলােচনা করিতে আমি স্ব উদ্যোগে পুরানা পল্টন আওয়ামী লীগ অফিসে গমন করিয়াছিলাম। তথায় মিজানুর রহমান চৌধুরী, মিসেস আমেনা বেগম, এ,কে, রফিকুল হােসেন, গাজী গােলাম মােস্তফা ও সিরাজুল আলম খানের সহিত আমার আলােচনাও হইয়াছিল। ৭ই জুন তেজশাখ এবং নারায়ণগঞ্জে পুলিশের কালীবর্ষণের সংবাদে ঢাকা শহর স্তঙ্কিত হইয়া পড়ে। হরতাল স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়। উৎসুক জনতা পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গকে দেখিতে চায়। আমি বার বার যােগাযােগ করিয়াও তাহাদিগকে পল্টন ময়দানে লইয়া যাইতে সমর্থ হই নাই। বােধহয় গভর্নর মােনায়েম খানের ভয়াল মূৰ্তি কল্পনানেত্রে তাহাদিগকে অদৃশ্য স্কুল হইতে শাসাইতেছিল। তাই ৭ই জুন সরকারী হিসাবে ১০জন নিহত হওয়া সত্বেও নেতৃবৃন্দ কোন প্রতিবাদ কর্মসূচী ঘােষণা করেন নাই । ৬ দফা দাবী প্রতিষ্ঠার প্রথম
পর্যায় এই অভিযানের (৭ই জুনের কর্মসূচীর) সাফল্য ও গৌরব তেজগাঁও, পােস্তগােলা নারায়ণগঞ্জ, ডেমরা ও আদমজী নগর শিল্পাঞ্চলের সমৗ , নির্ভীক ও সরল শ্রমিক শ্রেণীর অবশ্য প্রাপ্য। ইতিপূর্বে আর কখনও এত ব্যাপক ও সংঘবদ্ধভাবে শ্রমিক শ্রেণী রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নাই।
পাকিস্তান জন্মলগ্ন হইতে কেন্দ্রীয় সরকারের গণতন্ত্র বিরােধী, প্রভূত্বব্যঞ্জক ও বাঙ্গালী বিদ্বেষী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানীদের মনের দিগন্তে পুঞ্জীভূত রােষ ধীরে ধীরে শাসকচক্রের অজান্তে ও অগােচরে প্রলয়য়ী রূপ ধারণ করিতেছিল। ইহারই অসংগঠিত ও স্বতঃফুর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই জুন। ঐতিহাসিক যুগ সন্ধিক্ষণের যুগ পরিবর্তনকারী অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামের নির্ভীক অজেয় অশ্রণী সেনা মেহনতি শ্রমিক শ্রেণী শত্রুকে চিহ্নিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল। অদূর ভবিষ্যতে শাসক শ্রেণীর বিস্তর হাঁকডাক ও দম্ভের শােচনীয় পরাজয়ের সংকেতধ্বনি ছিল ৭ই জুনের আন্দোলন ॥১৩ই মে (১৯৬৬) পল্টন ময়দানের জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহিরুদ্দিন আহমদ তাহার ভাষণে সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া বলিয়াছিলেন, মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানকল্পে কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর চৌদ্দ দফা প্রত্যাখ্যান করায় ভারত দ্বিখন্ডিত হয়, দ্রুপ ৬ দফা দাবী গ্রহণে পাকিস্তানী শাসকবর্গ ব্যর্থ হইলে পূর্ব পাকিন এক দফা দাবী করিবে।” ইত্তেফাক বন্ধ
| ৬ দফা আন্দোলন প্রচারে নিয়াজিত দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেনকে ১৫ই জুন গ্রেফতার করা হয়। ১৬ই জুন দৈনিক ইত্তেফাকের ভ্রাযন্ত্র দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে বাজেয়াপ্ত এবং দৈনিক ইত্তেফাক প্রকাশনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দৈনিক ইত্তেফাক বাজেয়াপ্তকরণ আদেশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় ঢাকা হাইকোর্ট সরকারী আদেশের বিরুদ্ধে রায় দিলে সরকার অর্ডিন্যান্সে প্রয়ােজনীয় সংশােধন করিয়া পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনে দৈনিক ইত্তেফাকের মুদ্রাযন্ত্র দি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসকে পুনরায় বাজেয়াপ্ত করে। উল্লেখ্য যে, এই ৭ই জুনের ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে বেশীর ভাগ আওয়ামী লীগ নেতাই গ্রেফতার হন। নেতৃবৃন্দ কারারুদ্ধ হইবার পর মহিলা সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা নিযুক্ত হয় । তাহার কঠোর পরিশ্রম ৬ দফাকে গণভিত্তি দিতে সমর্থ হয় এবং প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আওয়ামী লীগের পতাকা সমুন্নত থাকে।
| এইদিকে এক ব্যক্তি শাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি হইতে সমগ্র দেশকে মুক্ত করিবার উদ্দেশ্যে ও জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার ঐকাস্তিক বাসনায় পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এ জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ঐক্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত ৩০শে এপ্রিলের (১৯৬৭) সভায় নিম্নলিখিত্ত ব্যক্তিবর্গের সমবায়ে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট গঠিত হয়ঃ
৮। শেখ আবদুল আজিজ ১৯। তাজউদ্দিন আহমদ ২০। আফজাল হােসেন ২১। জাকিরুল হক। ২২। মহিবুস সামাদ ২৩। মােহমিদুল্লাহ
(খুলনা) (ঢা ) (যশােহর) (চট্টগ্রাম) (সিলেট) (নােয়াখালী)
ভূট্রার অপসারণ
ইত্যবসরে বিনাশর্তে পাক-ভারত যুদ্ধ অবসান বিরােধী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুয়োকে প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নির্দেশে ১৯৬৬ সালের ১৮ই জুন চিকিৎসার অজুহাতে পদত্যাগ করিতে হয়। ইতিপূর্বে তাহাকে পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কনভেনশন) সাধারণ সম্পাদক পদ হইতে অপসারণ করা হইয়াছিল। গণভােট অনুষ্ঠান মারফত কাশ্মীর সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা ও তাসখন্দ শান্তিচুক্তি সম্পাদনের খেলাফে স্থির সংকল্প আপোষহীন বিরােধিতার দরুন জনাব ভুয়ো পশ্চিম পাকিস্তানী জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হইয়া উঠেন। সােভিয়েট রাশিয়া ও কমিউনিস্ট চীনের সহিত সম্পর্কোন্নয়নের জন্য জনাব ভুট্টোর বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রগতিশীল ও সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী উদীয়মান ও ক্রমবর্ধিষ্ণু বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ হইতে অপসারিত হইবার পর ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে জনৰ দুয়ো পাকিস্তান পিপলস পার্টি নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ শেষে পশ্চিম পাকিস্তানীদের ধূমায়িত বিক্ষোভ আইউব বিরােধী খাতে প্রবাহিত হয় এবং ইহাই রূপান্তরিত হয় ভুয়োর রাজনৈতিক মূলধনে। এন, ডি, এফ-এর নিষ্ক্রিয়তা
ইতিমধ্যে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), নেজামে ইসলাম পার্টি নির্মা ক্ষমতালােভী নেতৃত্বসর্বস্ব দলে পরিণত হয়। যুৰ-ছাত্র-শিক্ষক সাধারণের বিশেষ কোন সমর্থন উক্ত দলগুলির পিছনে ছিল না। তদুপরি এই দলগুলি নিজেরাও প্রেসিডেন্ট আইউব খানের ভান্ডার ভয়ে নিষ্ক্রিয় হইয়া বৈঠকী রাজনীতিতে মশগুল ছিল। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি আইউবের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন সংগঠিত করিবার ছিল বিরােধী। মােজাফফর আহমদ পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একাংশ জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন একটি কর্মীসর্ব মার্কসবাদীদল হিসাবে বিরাজ করিতেছিল। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী অন্ধ ও গোঁড়া ভাবধারার ধারক ও বাহক। এই সময়ে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ জন সমর্থিত, যুব ছাত্র সম্প্রদায় সমর্থিত ও সাধারণ শ্রমিক শ্রেণী সমর্থিত সংগ্রামী সংগঠনে পরিণত হয়। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান কোটায় ও প্রাদেশিক পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থীরা প্রায় সব কয়টি আসনে নির্বাচিত হন। ফলে পরিষদের অভ্যন্তরে ও বাহিরেও আওয়ামী লীগ একমাত্র সংগঠিত দল হিসাবেই রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়। এইদিকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচী বিচ্ছিন্নতাবাদী, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি পরিপন্থী বলিয়া উর্ধ্বতন মহল উচ্চস্বরে চিৎকার করিতেছিল। তাই, সরকার আওয়ামী লীগকে নেক নজরে নহে বরং বিষ নজরে দেখিত। | জাষ্ঠীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নিক্রিয় ভীরু ভূমিকা আমাদিগকে (আতাউর রহমান খান, নুরুর রহমান, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, মফিজুল ইসলাম, দেওয়ান সিরাজুল হক, আবুল মনসুর আহমদ এবং আমি) অত্যন্ত চিন্তিত করিয়া তােলে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত। এই কারণে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সরপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী ও আবদুল মােমেন, রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, কে, এম, ওবায়দুর রহমান, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক, মাজহারুল হক বাকী, সিরাজুল আলম খান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রুপে আমাদের সঙ্গে আলােচনা করিছেন। তাহাদের মতে ৭ দফা অর্থাৎ দুই অর্থনীতির প্রবক্তাদের সহিত তাহাদের মূলতঃ কোন পার্থক্য নাই। অতএব আওয়ামী লীগ মঞ্চ হইতেই ঐক্যবদ্ধভাবে সকলের কাজ করা শ্রেয় ও বিধেয়। আমাদের প্রস্তাব ছিল, প্রথমে পি, ডি, এম ভুক্ত আওয়ামী লীগ, ইহার পর অপুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগ ও তাহার পর জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মীদের পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগভুক্ত করা। আওয়ামী লীগের (৬ দফা) প্রস্তাব ছিল ১৯৬৪ সাল পূর্বেকার সাংগঠনিকরূপে ফিরিয়া যাওয়া। উভয় প্রস্তাব তেমন কোন তফাৎ ছিল না, কিন্তু ব্যক্তি নেতৃত্ব নিশ্চয়তা না পাওয়ায় এবং কারান্তরালে যাওয়ার ভয়ে নেতা আতাউর রহমান খান সম্মত হন নাই। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামী নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত রহিয়া পেল। | ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানে নেতৃবৃন্দের সহিত কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন; কিন্তু আইউব খানের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক বা আইন অমান্য কোনপ্রকার আন্দোলন করিবার মত মানসিকতা তাহাদের ছিল না। আইউব খান তাহা জানিতেন, তাই তিনি তাহাদের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। এইদিকে সরকার হইতে বিতাড়িত ফজলুল কাদের চৌধুরী আমাদের সহিত রাজনৈতিক আলােচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন; কিন্তু কোন প্রকার কার্যকর অংশগ্রহণ হইতে বিরত থাকেন-কারণ জেল-ভীতি। আগরতলা ষড়যন্ত্র। | এমনি হবুদ্ধিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৯৬৭ সালের মধ্য ডিসেম্বর ঢাকা নগয়ে জোর গুজব ছড়াইয়া পড়ে যে, পূর্ব পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয় কাঠামাে হইতে বিচ্ছিন্ন
করিবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকিবার অপরাধে লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন ও তাঁহার কতিপয় সহচরকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। সকল জল্পনা-কল্পনা ও গুজবে অসান ঘটাইয়া সরকার ৬ই জানুয়ারী (১৯৬৮) এক প্রেসনােটে ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনের প্রথম সচিবের (ফার্ট সেক্রেটারী) যােগসাজশে রাষ্ট্রবিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকিবার অপরাধে ১৮ জন সামরিক, বেসামরিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারের সংবাদ জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। পুনঃ ১৮ই জানুয়ারী (১৯৬৮) এক সরকারী প্রেসনোেট ঘােষণা করা হয় যে, রাষ্ট্রদ্রোহী ষড়যন্ত্রে জড়িত শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হইয়াছে। আগেই বলিয়াছি, শেখ সাহেব ১৯৬৬ সালের ৮ই মে হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে আটক ছিলেন। ১৭ই জানুয়ারী (১৯৬৮) দিবাগত গভীর রাত্রে (আনুমানিক রাত ১টায়) শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হইতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্থানান্তরিত করা হয়।
২১শে এপ্রিল (১৯৬৮) প্রেসিডেন্ট এক অর্ডিন্যান্স জারি করিয়া পাকিস্তান পেনাল কোডের ১২১ ক খ ১৩১ ধারায় দোষীদের বিচার করিবার নিমিত্ত বিশেষ আদালত গঠনের ব্যবস্থা করেন। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার এক আদেশ বলে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এস, এ, রহমান, ইস্ট পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি মুজিবর রহমান ও বিচারপতি মামুল হাকিমের সময়ে বিশেষ আদালত গঠন করেন এবং অন্য এক আদেশ বলে কেন্দ্রীয় সরকার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টকেই বিচার হিসাবে ঘােষণা করে। ৬ই জন (১৯৬৮) গেজেট ঘােষণা করা হয় যে, ১৯শে জুন ঢাকা ক্যান্টমেন্ট সিগন্যাল মেস প্রাঙ্গণে বিশেষ আদালতে বিচার আরম্ভ হইবে। মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পূর্ব ঘােষণা অনুযায়ী ১৯শে জুন হইতে নিম্নলিখিত ৩৫ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা আরম্ভ হয়।
১। শেখ মুজিবুর রহমান, ২। লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন, ৩। স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, ৪। এল, এস, সুলতানুদ্দিন আহমদ, ৫। এল, এস, সি, ডি, আই, নয় মােহাম্মদ, ৬। আহমদ ফজলুল রহমান, সি, এস, পি, ৭। ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ, ৮। প্রাক্তন করপােরাল আবুল বশার মােহাম্মদ আবদুস সামাদ, ৯। প্রাক্তন হাবিলদার দলিল উদ্দিন, ১০। ফ্লাইট সার্জেন্ট মােহাম্মদ ফজলুল হক, ১১। খন্দকার রুহুল কুদ্স, সি, এসপি, ১২। ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, ১৩। বিধান কৃষ্ণ সেন, ১৪। সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, ১৫। প্রাক্তন হাবিলদার ক্লার্ক মুজিবর রহমান, ১৬। প্রাক্তন ফাইট সার্জেন্ট মােহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, ১৭। সার্জেন্ট জহুরুল হক, ১৮। প্রাক্তন, এ, টি, মােহাম্মদ খুরশীল, ১৯। খান এম, শামসুর রহমান সি, এস, পি, ২০। হাবিলদার এ, কে, এম, শামসুল হক, ২১। হাবিলদার আজিজুল হক, ২২। এস, এ, সি, মাহফুজুল বারী, ২৩। সার্জেন্ট শামসুল হক, ২৪। মেজর শামসুল আলম, ২৫। ক্যাপ্টেন মােঃ আবদুল মােতালেব, ২৬। ক্যাপ্টেন এম, শওকছ আলী, ২৭। ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা, ২৮। ক্যাপ্টেন এ, এন, এম, নূরুজ্জামান, ২৯। সার্জেন্ট আবদুল
জলিল, ৩০। মােহাম্মদ মাহবুবুদ্দিন চৌধুরী, ৩১। ফাষ্ট লেঃ এম, এস, এম, রহমান, ৩২। প্রাক্তন সুবেদার এ, কে, এম, হলি ইসলাম, ৩৩। মােহাম্মদ আলী রেজা, ৩৪। ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দিন আহমদ, ৩৫। ফাক্ট লেঃ আবদুর রউফ। | মামলার বিবরণ প্রকাশে আদালত সংবাদপত্রগুলিকে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করে। শেখ মুজিবর রহমান আগরতলা মামলার প্রধান আসামী ছিলেন। প্রখ্যাত আইনজীবী আবদুস সালাম খান শেখ সাহেবের মামলা পরিচালনা করেন এবং সরকার পক্ষে পরিচালনা করেন প্রাক্তন বৈদেশিকমন্ত্রী ব্যারিস্টার মনজুর কাদের, এডভােকেট টি, এইচ, খান, গ্রুপ ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আসলাম, এডভােকেট করাচী, এ, আলীম এডভােকেট, ঢাকা ও খান বাবর, এডভােকেট, লাহাের।
আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে মিথ্যা মামলা বলিয়া গােড়া হইতেই কানাঘুষার আন্দোলন শুরু করে। সাংগঠনিক শক্তির বলে এই প্রচার মােটামুটি কার্যকর বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছিল। তাই, ঢাকা নগরে বিভিন্ন সভায় মিছিলে, ‘জাগগা জাগাে বাঙ্গালী জাগাে” আওয়াজ উঠে। জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ বইতে থাকে। যুব সম্প্রদায় যখন এইভাবে মাঠে এক ব্যক্তির শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত, তখন হুক্কাসেৰী বৈঠকী রাজনীতির অড়ি পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট (পি, ডি, এম,) আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করিবার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে, অথচ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে কোন প্রকার সক্রিয় আন্দোলন বা কর্মসূচী গ্রহণে বিরত থাকে। নিম্নলিখিত দলিল আগরতলা মামলার বাস্তবতা প্রমাণ করে
জনাব ফয়েজ আহমদ একটি বই লিখেছেন। নাম আগরতলা মামলা, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ। প্রকাশক মফিজুল হক। এই বইটির শেষ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত পৱিশিষ্ট৭’ নীচে হুবহু উদ্ধৃত করা হলাে। আগরতলায় শেখ মুজিব সম্পর্কে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী।
১৯৬৩ ইং আমার ভাই এম এল এ শ্রী উমেশলাল সিং সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে ১০ জন ত্রিপুরার পালম জিলার খােয়াই মহকুমা দিয়া আগরতলায় অামার অগিরতলায় বাংলােম রাত্রি ১২ ঘটিকায় আগমন করেন। প্রাথমিক আলাপআলোচনার পর আমার বাংলাে বাড়ি হইতে মাইল দেড়েক দূরে ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীর বাড়িতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর মুজিবুর ভাইয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহের সাথে দেখা করি। আমার সাথে ছিলেন শ্রী শ্রীরমণ, চীফ সেক্রেটারী। তাকে (শ্রীরমণকে) ভাঙারিয়ার বিদেশ সচিবের রুমে রাখিয়া প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। তিনি মুজিবুর রহমানকে ত্রিপুরায় থাকিয়া প্রচার করিতে সম্মত হন নাই। কারণ চীনের সাথে লড়াইয়ের পর এতাে বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হন নাই। তাই ১৫ দিন থাকার পর তিনি (শেখ মুজিব) ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। সোনামুড়া পশ্চিম ত্রিপুরারই এক মহকুমা
কুমিল্লার সাথে সংলগ্ন। শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
শ্রী শচীভ্রলাল সিংহ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী
ত্রিপুরা নেতৃবৃন্দের সহিত আলােচনা
এই পরিস্থিতিতে ৮ই অক্টোবর (১৯৬৮) জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে আমরা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা) এর সৈয়দ নজরুল ইসলাম-ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, মিজানুর রহমান চৌধুরী-ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, মিসেস আমেনা বেগম মহিলা সম্পাদিকা, আবদুল মান্নান ও আবুল কালাম, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) কোষাধ্যক্ষ, মহিউদ্দিন আহমদ ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের আতাউর রহমান খান, নুরুর রহমান ও আমি। আগামীদিনের আন্দেলনের নীল-নকশা প্রণয়নকল্পে এক বৈঠকে মিলিত হই। আমরা পি, ডি, এম-এর সিদ্ধান্ত পুংখানুপুংখভাবে আলােচনা করি। আমি স্পষ্ট ভাষায় পি,ডি এম-এর সিদ্ধান্তের সহিত দ্বিমত প্রকাশ করি। | ৯ই অক্টোবর (১৯৬৮) প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদের বাড়ীতে আলােচনার সিদ্ধান্ত অনুসারে আমি ও জনাব নুরুর রহমান ১০ই অক্টোবর টাঙ্গাইলে পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিং) সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সহিত সাক্ষাৎ করি। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা রাজনৈতিক আলােচনায় আমরা ঐকমত্যে পেীছি যে, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠাকল্পে অবিলম্বে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া অপরিহার্য। দল মত নির্বিশেষে ঐক্যই সকল সগ্রামের পূর্বশর্ত। সাধারণ নির্বাচন ঘােষণার পূর্বেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে গণ আন্দোলন আরম্ভ করিবার এবং আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণের প্রস্তাব করেন মওলানা ভাসানী। খাজনা বন্ধের মত উগ্র কর্মসুচীকে সাফল্যমণ্ডিত করিতে যে সাংগঠনিক শক্তির প্রয়ােজন তাহা বর্তমানে নাই বিধায় সরকারী দমননীতি অংকুরেই আন্দোলনকে বানচাল করিয়া দিবে বলাতে মওলানা বলেন যে, সামরিক বাহিনীতে আইউব খানের পূর্ব প্রতিপত্তি নাই, এমন কি জেনারেল হামিদ ও জেনারেল ইয়াহিয়া খান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী ব্যবহারে সম্মত হইবেন না। মওলানা আরাে বলেন যে, এইসব বিষয়ে তাহার যােগাযােগ আছে; সুতরাং তিনি মনে করেন, গণ আন্দোলনের পর ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচনে বিরােধী শিৰি জয়লাভ করিবে এবং প্রেসিভেন্ট নির্বাচনে আমাদের জয় অবধারিত।
দিবালােকের ন্যায় স্পষ্ট হইয়া গেল যে, সশস্ত্র বাহিনীর এক অংশের আইউব বিরােধী মনােভাবের উপর নির্ভ করিয়া মওলানা ভাসানী এখন স্বচ্ছন্দে গণ-আন্দোলনে যােগ দিতে পারেন, কেননা তাহাতে বিপদ কম। উপসংহারে ন্যাপ (মস্কো)-এর সহিত আলােচনায় বসিতে রাজী কিনা জানিতে চাইলে মওলানা বলেন যে, ঐক্যের খাতিরে
সহযােগিতা করিতে তিনি প্রস্তুত আছেন।
যাহা হউক, আমাদের নিকট দেয় প্রতিশ্রুতি মােতাবেক মওলানা ভাসানী ঢাকা আসিলেন বটে; কিন্তু ১৩ই অক্টোবর (১৯৬৮) জনাব সাঈদুল হাসানের বাসভবনে জনাব নুরুর রহমান, দেলদার আহমদ ও আমার সহিত আলােচনাকালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে (মস্কো) প্রস্তাবিত সংগ্রাম পরিষদে গ্রহণ করিতে অস্বীকৃতি জানাইলেন। রাত ৯টায় জনাব আবুল মনসুর আহমদের বাসভবনে আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, নূরুর রহমান, দেলদার আহমদ, জমির উদ্দিন আহমদ ও আমি পুনরায় মওলানা ভাসানীর সহিত বৈঠকে মিলিত হই। আলােচনায় নিন্ন বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে উপনীত হই।
‘নির্বাচনী কলেজ নির্বাচনকে সরকার গঠন পদ্ধতির উপর গণভােট হিসাবে গণ্য করা হইবে। আমরা তাই আসন্ন নির্বাচনী কলেজ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিব। ইহার পর প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ইলেকটরেল কলেজ অংশগ্রহণ করিবে
। আওয়ামী লীগ (৬ দফা) এর সহিত ঐকফ্রন্ট গঠনে মওলানা ভাসানী সবিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মিসেস আমেনা বেগম ও মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদের সহিত এতদমর্মে বৈঠকে বসিবার জন্য তাহাদের ঠিকানা পর্যন্ত চাহিলেন। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাইয়া দিলেন যে, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) সহিত ঐকফ্রন্ট গঠনে তিনি অপারগ। কিন্তু এতদসত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হইল না। ঐকফ্রন্ট গঠনের চূড়ান্ত মুহূর্তে আমাদিগকে কিছুই জানিতে না দিয়া মওলানা ভাসানী ঢাকা ত্যাগ করিলেন। মনে হয়, পিকিং লবী আইউব বিরােধী আন্দোলন অর্থাৎ প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের সংগ্রামে সায় দিতে পারে নাই। তাই, চূড়ান্ত মুহূর্তে আমাদের সকল প্রয়সি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল। কমিউনিষ্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত
১৯৫৬ সাল হইতে চীন-সােছিয়েট মত বিরােধ চলিয়া আসিতেছিল। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে আহূত বিশ্ব কমিউনিষ্ট পার্টি সম্মেলন খসড়া কমিটির বৈঠকের দিনই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভাঙ্গনের দিন বলিয়া কমিউনিস্ট চীন ৩০শে জুলাই লিখিত এক চিঠিতে সােভিয়েট ইউনিয়নকে জানায়। ইহার অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে বিভিন্ন দেশে কমিউনিষ্ট পার্টি পিকিং গ্রুপ ও মস্কো গ্রুপে বিভক্ত হইয়া পড়ে। কমিউনিস্ট চিন্তাধারার প্রভাবান্বিত ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে আহূত বার্ষিক সম্মেলনে জনাব রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ইকবাল হলের ছাদে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন সম্মেলনে বেগম মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো) গঠিত হয়।
মঙ্কো-পিকিং মতদ্বৈততায় এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও দ্বিখণ্ডিত হয়; মস্কোপন্থী ন্যাপ নেতৃবৃন্স কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করিবার দাবীতে সংগঠনের সভাপতি মওলানা ভাসানীকে রিকুইজিশন পত্র বা অধিযাচন পত্র দেয়। সভাপতি মওলানা ভাসানী রিকুইজিশন পত্রের কোন উত্তর না দিয়া রংপুরে। কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠান করেন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মস্কো সমর্থক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেনসহ অন্যান্য নেতাকে সংগঠন হইতে বহিস্কার করেন। মস্কোপন্থী ন্যাপ নেতৃবৃন্দ ১৯৬৮ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী ঢাকায় অনুষ্ঠিত কাউন্সিল সভায় মােজাফফর আহমদকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল অধিবেশনের পূর্বে ৮ই ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী ও খন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস আমার বাসভবন ৭ নং কলেজ ট্রীটে আমার সহিত দেখা করেন এবং ন্যাপে যােগ দিতে অনুরােধ জানান। আমি উত্তরে তাঁহাদিগকে বলিয়াছিলাম, কমিউনিষ্ট প্রভাবান্বিত সংগঠনে জাতীয়তাবাদী ও গণতন্ত্রীদের যােগ দিবার কোন ভিত্তি নাই। ইতিপূর্বে জনাব আতাউর রহমান খান ও নুর রহমান সাহেবকে স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দিয়াছিলাম যে, ন্যাপ নেতৃবৃন্দের সহিত আমার আদর্শগত মৌলিক মতভেদ আহে, অতএব কোন ন্যাপ গ্রুপের সহিত আমার যােগ দিবার প্রশ্নই উঠে না। ভলগ-ইয়াংসি নদীতে বৃষ্টি হইলে ঢাকার বুড়িগঙ্গার পাড়ে পাড়াইয়া আমার ছাতা খুলিবার সবিশেষ কারণ নাই। ন্যাপের সহিত আলোচনা সুতরাং তখনকার মত আর অগ্রসর হয় নাই। ছাত্র শক্তির বিভক্তি | ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে পাকিস্তান ছাত্র শক্তি ঘােষণাপত্র ও আন্দোলনের কর্মসূচী সংশােধনের প্রশ্নে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে দ্বিধাবিভক্ত হয়। আনিসুর রহমানকে সভাপতি এবং মােজাফফর হােসেন পন্টুকে সাধারণ সম্পাদক করিয়া একটি কমিটি এবং ফজলুল হককে সভাপতি ও মােহাম্মদ হোসেন খানকে সম্পাদক করিয়া অপর একটি কমিটি গঠিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের পরিস্থিতি
পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাধারণভাবে শান্ত ছিল। তবে আকস্মিক দমকা হাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হইয়া প্রেসিডেন্ট আইউব খানের ক্ষমতার মসনদকে লণ্ডভণ্ড করিয়া তাহাকে রাজনৈতিক অঙ্গন হইতে চিরতরে বিদায় দেয়। এক ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী ক্ষমতালােজ্জীদের জন্য ইহা এক জ্বলন্ত সতর্ক দৃষ্টান্ত।
. উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে অবস্থিত লাঞ্চিকোটালে ছিল বিদেশ হইতে পাচারকৃত মালের বাজার। রাওয়ালপিন্ডি গর্জন কলেজের ৭০ জন ছাত্র কর্তৃক লান্ডিকোটাল হইতে বিদেশী মাল ক্রয় সংক্রান্ত অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া ছাত্র ও প্রশাসন কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরােধ বাঁধে। উল্লেখ্য, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের ক্রয়কৃত বিদেশী মাল বাজেয়াপ্ত
করিয়াছিল। এই বিবােধই অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ছাত্র-প্রতিবাদ আন্দোলন হইতে অপ্রতিরােধ্য গণ-আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সূচনা হইতে পরিস্থিতির সুযােগ গ্রহণের নিমিত্ত ছাত্রদের পক্ষাবলম্বন করেন। ৭ই নভেম্বর ছাত্র-জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলীবর্ষণ করে এবং পুলিশের গুলীতে রাওয়ালপিন্ডিতে আবদুল হামিদ নিহত হন। ফলে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে গণ-আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে। এমনি অবস্থায় ১০ নভেম্বর (১৯৬৮) পেশোয়ার জনসভায় ভাষণদানকালে প্রেসিডেন্ট আইউব খানের জীবন নাশের ব্যর্থ প্রচেষ্টা হয়। ইহার জওয়াবে আইউব খান ১৩ই নভেম্বর (১৯৬৮) জুলফিকার আলী। ভুট্টোকে গ্রেফতার করেন। আন্দোলনের নূতন দিক
এই সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান এমনিতেই বিক্ষুব্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানের এই ছাত্র আন্দোলনের সহিত একাত্মতা প্রকাশ করা হইবে কি হইবে না, এই প্রশ্নে সবাই দ্বিধান্বিত। এমনি অস্বস্তিকর সন্ধিক্ষণে মওলানা ভাসানী মঞ্চে উপস্থিত হইলেন। জনাব আবদুস সেলিমের নেতৃত্বে পরিচালিত ঢাকা বেবী ট্রাক্সি ইউনিয়ন কর্তৃক ৬ই ডিসেম্বর হরতাল দিবসের অপরাহ্নে আহুত পল্টন ময়দানের জনসভায় মওলানা ভাসা প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন এবং জনসভার পর মওলানা ভাসানীর পরিচালনায় এক বিক্ষোভ মিছিল গভর্নর হাউসে গমন করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ লাঠিচার্জ করিয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করিয়া দেয়। পুলিশী হামলার প্রতিবাদে ৭ই ডিসেম্বর (১৯৬৮) ঢাকায় ও সমগ্র পাকিকানে ৮ই ডিসেম্বর হরতাল পালনের আহবান জানানাে হয়। ৮ই ডিসেম্বর হরতাল পালনকালে পুলিশের গুলীতে সিলেটে জনাব আবদুল হামিদ শাহাদতবরণ করেন।
, মওলানা ভাসানী কর্তৃক সৃষ্ট অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ৩০শে ডিসেম্বর (১৯৬৮) হাতিয়াদিরায় পুলিশের গুলীতে ৩ জান নিহত হন ও নড়াইলেও পুলিশ গুলী চালনা করে। এইভাবেই ক্রমে ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানে এক অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো), ছাত্র ইউনিয়ন (পিকিং) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ এগার দফা প্রণয়ন করে এবং আন্দোলনের ডাক দেয়। আইউব-মােনায়েম সরকার সমর্থক জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) ১৯৬৮-৬৯ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র সংসদের নির্বাচনে তৎকালীন মােহসীন হল, জিন্নাহ হল ও ঢাকা হল সংসদের শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ এবং ফজলুল হক হল সংসদের সাধারণ। সম্পাদকের আসনসহ উল্লেখযােগ্য সংখ্যক আসন দখল করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদ (ঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা ডাকসুর (DUCsU) সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান (এন, এস, এফ) এগার দফা কর্মসূচীর অন্যতম প্রণেতা ছিলেন। ফলে, এগার দফা কর্মসূচীকে সমর্থন জানাইয়া তাহার মুল ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন দলীয় বিভিন্ন হল সংসদের সহ-সভাপতি ও…
আসাদুজ্জামানের বক্ষ বিদীর্ণ করে। সমগ্র ঢাকা নগর ক্ষণিকের তরে মূহ্যমান হইয়া পড়ে। ইহার পর সম্বিত ফিরিয়া পাওয়া ঢাকা নগরবাসী সমগ্র দেশকে নতুন দিশার সন্ধান দেয়। শহীদ আসাদের তপ্ত শােণিতকণা সামী ছাত্র আন্দোলনকে আপােষহীন গণ অভুথানে রূপান্তরিত করে। এইদিন পুলিশের সহিত সংঘর্ষে আরাে ৩ জন আহত হয়। | শহীদ আসাদুজ্জামানের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হইতে ছিনাইয়া নিতে ব্যর্থ হইয়া ছাত্র-জনতা ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিল্ডিং সম্মুখে শােকসভা করে, কালাে পতাকা উত্তোলন করে, এক মিনিট নীরবে দন্ডায়মান হইয়া শােক প্রকাশ করে এবং ঢাকা নগরে প্রভাত হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাধারণ হরতাল ঘােষণা করে। ২১ শে জানুয়ারী অপরাহ্ন এক ঘটিকায় পল্টন ময়দানে এ, এম, আসাদুজ্জামানের গায়েবানা। নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ইহার পর নগ্নপলে মৌন মিছিল ঢাকার বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করিয়া শহীদ মিনারে উপস্থিত হয় এবং শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত শােকসভায় পুনরায় ঢাকা শহরে সাধারণ হরতাল পালনের আহবান জানায়। উল্লেখ্য যে, ২১শে জানুয়ারী সাধারণ হরতাল পালনকালে ঢাকা ইডেন গার্লস কলেজের সম্মুখে ও ঢাকা নিউ মার্কেট এলাকায় জনতার উপর পুলিশ গুলী চালায়। ২৯ জন আহত হয় এবং ৫৯ জন। গ্রেফতার হয়। প্রসঙ্গতঃ ইহাও উল্লেখ্য যে, অপরাহ্ন ১ ঘটিকায় পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদের গায়েবানা নামাজে জানাযায় লক্ষাধিক লােকের সমাগম হইয়াছিল। নামাজ আদায়ের পূর্বে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আসাদুজ্জামানের মৃত্যু উপলক্ষ্যে ২২শে, ২৩শে ও ২৪ শে জানুয়ারী ‘শােককাল’ (Mourning Period) হিসেবে ঘােষণা করে। এবং এই লােককালে নিমােক্ত প্রােগ্রাম ঘােষণা করে।
২২শে জানুয়ারী-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও কাল পতাকা উত্তোলন, কালব্যাজ ধারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনে অপরাহ্ন ১২-৩০ মিনিটে পায়েবানা নামাজে জানাযা।
২৩শে জানুয়ারী-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও কালাে পতাকা উত্তোলন এবং কালােব্যাজ ধারণ, সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবন বটতলা হইতে মশাল। মিছিল।
| ২৪শে জানুয়ারী-প্রদেশব্যাপী হরতাল। পূর্ব পাকিস্তান বনুদ | গায়েবানা নামাজে জানাযার পর ১৪৪ ধারাকে উপেক্ষা করিয়া জনসমুদ্রের পােক মিছিল শহরের রাজপথ প্রদক্ষিণে নির্গত হয়। শােক মিছিলে শেখ মুজিবুর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, খান মােহাম্মদ আলী ওয়ালী খান ও মনি সিং সহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দাবী ও আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের গগনবিদারী নিতে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকপত হইয়া ওঠে। দাবী ধ্বনিত হয় এগার দফা মানার।
২২শে জানুয়ারী ঢাকায় পুলিশের গুলীর প্রতিবাদে করাচী, রাওয়ালপিন্ডি, লাহাের, হায়দারাবণ, পেশােয়ার, মুলতান, শিয়ালকোট ও লায়ালপুরে ধর্মঘট, মিছিল, সভা ও গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি ২১ শে জানুয়ারী লাহােরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ৮ দফার সমর্থনে ১২ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) সমগ্র পাকিস্তান ব্যাপী হরতাল পালনের আহবান জানায়।
সর্বদলীয় ছাত্র সগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ঘােষিত সাধারণ হরতাল ২৪শে জানুয়ারী এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে। মিছিলের পর মিছিল চলিতে থাকে। রাজধানী ঢাকার রাজপথ ছাত্র, শ্রমিক-মধ্যবিত্ত জনতার পদভারে প্রকম্পিত হইয়া উঠে। এমন একটি দুর্জয় মিছিল সেক্রেটারিয়েটের পার্শ্ববর্তী রাজপথে অগ্রসর হওয়াকালে সংঘর্ষ বাধে আইউব-মােনায়েম খাঁর গদী রক্ষায় নিয়ােজিত সশস্ত্র বাহিনীর সহিত। তাহাদের নিষ্ঠুর বুলেটে নিহত হয় নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র কিশাের মতিউর রহমান মল্লিক, মকবুল, রুস্তম আলী ও অসনাক্ত একজন এবং আহত হয় ১৫ জন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইমারজেন্সী ওয়ার্ড হইতে শহীদ মকবুল ও রুস্তম আলীর মৃতদেহ বলপূর্বক ছিনাইয়া আনা হয় এবং ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করিয়া লক্ষ জনতার শােক মিছিল পল্টন ময়দানে যথারীতি নামাজে জানাযা আদায়ের পর শহীদানের লাশসহ গী মিছিলটি ইকবাল হলে গমন করে। মারমুখী বিদ্রোহী জনতা সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত পাকিস্তান ট্রাষ্ট সংবাদপত্র দৈনিক পাকিস্তান’ ও ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ ভবনে অগ্নি সংযােগ করে। জনতার এই আপােষহীন সগ্রামকে দমন করিবার জন্য শেষ অবলম্বন স্বরূপ সেনাবাহিনী তলব করা হয়। রাত ৮টা হইতে ২৪ ঘণ্টার জন্য জারি করা হয় কারফিউ। ঢাকা হইতে বহির্গামী ট্রেন সার্ভিস, আভ্যন্তরীণ বিমান সার্ভিস ও ঢাকা-করাচী টেলি কমিউনিকেশন বাতিল হইয়া যায়। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট হয় অচল অবস্থা।
| এইভাবেই জালেমশাহী খতমে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অগ্নিশপথে উজ্জীবিত বিদ্রোহী বংগসন্তান গুলী-গােলা ও সান্ধ্য আইনের প্রাচীরকে চুরমার করিয়া আইউবের নতমুখে বিদায় গ্রহণ অবধি দুঃশাসনের প্রতিরােধ আবেষ্টনিকে আঘাতে আঘাতে বিধ্বস্ত করিয়া চলে। অজেয় জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার অবিরাম আঘাতে পর্যন্ত আইউব সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে করাচী, খুলনা, নারায়ণগঞ্জে: সান্ধ্য আইন বর্ধিত করে ঢাকা নগরীতে। সান্ধ্য আইন অমান্য করিয়া তেজগাঁও এলাকাধীন নাখালপাড়ার বিক্ষুব্ধ শ্রমিক শ্রেণী সরকারী নরহত্যা অভিযানের বিরুদ্ধে ‘২৫শে জানুয়ারী জংগী মিছিল বাহির করিলে সেনা বাহিনীর নির্মম গুলীতে বরিশাল নিবাসী তেজগাঁও চৌধুরী কেমিক্যালস ওয়ার্কস-এর কর্মচারী জনাব ইসহাকের সহধর্মিনী আনােয়ারা বেগম কন্যাকে স্তন্যদানকালে শাহাদৎবরণ করেন। তেজগাও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আবদুল লতিফ প্রাণ দেন সেনাবাহিনীর বুলেটে; আহত হয় ১২ জন।
শােককালের কর্মসূচী।
ছাত্রদের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ রবিবার (২৬-১-৬৯) হইতে তিন দিনব্যাপী “শােককাল’ পালনের আহবান জানায়। শােককালে কালাে পতাকা উত্তোলন ও কালাে ব্যাজ ধারণ-এর প্রােগ্রাম ঘোষণা করা হয় এবং ছাত্র সমাজ ও জনগণের ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর আন্দোলন পরিচালনার নিমিত্ত ঘােষণা করা হয় নিম্ন নির্দেশাবলীঃ | (১) প্রত্যেক জিলা, মহকুমা, থানা, গ্রাম, মহল্লা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক এলাকায় ছাত্র সমাজের উদ্যোগে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা, শৃংখলা ও সংঘবদ্ধভাবে সংগ্রাম পরিষদগুলির মাধ্যমে আন্দোলন পরিচালনা করা ও নিম্ন কমিটি উচ্চতর কমিটির সহিত সংযােগ রক্ষা করিয়া চলা, (২) জনগণকে সংগঠিত করা, (৩) গণ-অভুত্থানি গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া দেয়া, (৪) সর্বত্র সুশৃংখল সেল্মসেবক বাহিনী গঠন করা, (৫) শৃংখলা রক্ষা করা, সর্বপ্রকার সরকারী উস্কানির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা, (৬) বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গােত্রের মধ্যে সৌহার্দ্য ও শান্তি বজায় রাখা এবং এইভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ায় সহায়তা করা, (৭) স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক বিজ্ঞাপন, পােটার, পথসভা, মাইক প্রচার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে বহুল প্রচারাভিযান চালানাে, (৮) কেন্দ্রীয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশাবলী বিনা বাক্যব্যয়ে সর্বদাই পালন করা।
উপরে বর্ণিত নির্দেশাবলী দ্বারা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সরকার বিরােধী গণ-ভ্রান্দোলনকে পুরাপুরিভাবে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আনয়ন করে। ইহা দ্বারা পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক কমিটি অব এ্যাকশান অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। তরুণের ডাক ছিল এগার দফা বাস্তবায়ন আর বয়ােবৃদ্ধ নেতৃত্বের আহবনি ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ইহাতে বয়ােবৃদ্ধ নেতৃত্বের প্রতি তরুণ ছাত্র সমাজের পূর্ণ অনীহার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট হইয়া উঠে। ইহার পিছনে অপরিপক্ক তরুণ ছাত্রনেতৃবৃন্দের নেতৃত্বাভিলাষও কাজ করিয়াছে। ইহার ফলে, ইতিহাসই রায় দিয়াছে, জনগণের মংগল হইয়াছে, না সর্বনাশ হইয়াছে। অনুন্নত দেশগুলিতে আদর্শহীন, দুর্নীতিপরায়ণ ও গণ-বিরােধী নেতৃত্বই এইরূপ অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। দেশপ্রেমিক, ত্যাগী ও পরিপক্ক ভারতীয় নেতৃত্ব ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা সরকার বিরােধী আন্দোলনকে কিভাবে অহিংস শান্তিপূর্ণ খাতে প্রবাহিত করিয়া গণসচেতনতা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তাহা ছাড়া ভারতের এই একই নেতৃত্ব ১৯৭৭ সালের মার্চ-এর নির্বাচনে প্রমাণ করিয়াছে, বাঞ্ছিত শান্তিপূর্ণ পথে কিভাবে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব পরিবর্তন করিতে হয়।
যাহা হউক, ঐদিকে পিণ্ডি, লাহাের, পেশােয়ার, হায়দরাবাদ ও করাচীর বিদ্ৰোহানল সমগ্ন পশ্চিম পাকিস্তানে দাবানলের ন্যায় ছড়াইয়া পড়ে। গণতন্ত্রের দাবীতে একনায়কত্বের প্রতিবাদে, জুলুমের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন ক্রমশঃ পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন মফঃস্বল শহরে ব্যাপ্তি লাভ করে। এইদিকে শশীককালের কর্মসূচী পালনকালে ২৬ শে জানুয়ারী (১৯৬৯) রবিবার ঢাকা, ডেমরা ও নারায়ণগঞ্জে ৪ জন নিহত হয় ও
১৬ জন আহত হয়। আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিব্রত সরকার ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও করাচীতে পুনরায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে। কিন্তু ২৭শে জানুয়ারী (সােমবার) করাচী ও লাহাের শহরে গণআন্দোলনের বৈপ্লবিক ভূমিকায় ভীত-সন্ত্রস্ত সরকার বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় সেনাবাহিনী তলব করিয়া বসে। গণবিদ্রোহের জোয়ার।
করাচীতে সশস্ত্র বাহিনীর বুলেটের আঘাতে ৬ জন শাহাদাত্বরণ করে। ২৭ শে। জানুয়ারী (১৯৬৯) জাতীয় পরিষদের ঢাকা অধিবেশনে ঢাকায় সান্ধ্য আইন ও হত্যাকাণ্ডের উপরে পরিষদ সদস্য মােখলেসুজ্জামানের উত্থাপিত মূলতবী প্রস্তাব পরিষদ
শীকার নাকচ করিয়া দেন। এইদিন ঢাকা, খুলনা ও নারায়ণগঞ্জে এবং ২৮শে জানুয়ারী (১৯৬৯) করাচী ও লাহােরে পুনরায় সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। লাহােরে পুলিশের তরীতে ২ জন শাহাদৎবরণ করে এবং করাচীতে ১ হাজার লােককে গ্রেফতার করা হয়। পেশােয়ার ও বরিশালে আন্দোলনের ঢেউ জনতা ও সশস্ত্র বাহিনীর সংঘর্ষের রূপ পরিগ্রহ করে। আন্দোলনের চতুর্থ দিনে পেশােয়ারের জনতাকে দমন করিতে ব্যর্থ হইয়া কর্তৃপক্ষ সেখানে ২৮শে জানুয়ারী (১৯৬৯) সেনাবাহিনী তলব করে এবং বরিশালের বুকে বিপ্লবী জনতার ৯ জন পুলিশ, ই, পি, আর ও সশস্ত্র বাহিনীর বুলেটের আঘাতে আহত হয়। | ২৯ শে জানুয়ারী (১৯৬৯) গুজরানওয়ালা শহরে পুলিশের গুলীতে ৩ জন নিহত ও ১০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। অবস্থা আয়ত্তে আনার প্রয়াসে কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী, তলব করে এবং সান্ধ্য আইন জারি করে। ডেরা ইসমাইল বা শহরে পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে আহত হয় ৬ জন। এইদিকে পূর্ব পাকিস্তানের ঝালকাঠি বর-শহরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া মিছিল বাহির হয়। মিছিল ছত্রভঙ্গ করিবার চেষ্টায় পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ অতঃরপর ফাঁকা গুলীবর্ষণ করে। ৩০শে জানুয়ারী (১৯৬৯) ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত জাজিরা থানা সদরে পুলিশ মিছিলকারীদের উপরে গুলীবর্ষণ করে এবং সেই গুলীতে ১ জন নিহত ও ৪ জন আহত হয়।
ঢাকা শহরের অবস্থার উন্নতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ৩১শে জানুয়ারী (১৯৬৯) হইতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করে। প্রচণ্ড দমননীতির মােকাবেলায় আন্দোলন সাময়িকভাবে স্তিমিত হইয়া উঠিলে সমগ্র দেশে শুরু হয় গ্রেফতারের হিড়িক। ৩১শে জানুয়ারী (১৯৬৯) শুক্রবার আমাকে আমার ৭ নং কলেজ স্ট্রীট, ধানমণ্ডি বাসভবন হইতে গ্রেফতার করা হয় ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধি বলে বিনাবিচারে আটক করা হয়। | করাচী, লাহাের, পিন্ডি, পেশােয়ার, হায়দরাবাদ, কোয়েটা, ঢাকা, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম অর্থাৎ এক কথায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিটি জনপদ যখন গণবিদ্রোহের জোয়ারে উত্তাল, প্রতিটি রান্সপথ যখন লক্ষ জনতার মিছিলের পদভারে প্রকম্পিত, আত্মাধিকার আদায়ে দৃঢ় সংকল্প জনতার সুপ্ত আগ্নেয়গিরি ভিসুবিয়াসের
আকস্মিক বিস্ফোরণে এক ব্যক্তির শাসন রক্ষায় নিয়ােজিত পুলিশ, আধা সামরিক বাহিনীর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, গুলীগােলা ও গ্রেফতার ইত্যাদি যখন অকেজো প্রায়, অর্থাৎ আইউব শাহীর মসনদ যখন টলটলায়মান সেই অবস্থায় ৫ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) প্রেসিডেন্ট আইউব খান রাওয়ালপিন্ডি হইতে লাহাের বিমান বন্দরে অবতরণ করিয়া সাংবাদিকদের নিকট প্রকাশ করিলেন যে, বর্তমান সমস্যাবলী সমাধানের উদ্দেশ্যে তিনি ১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের সহিত রাওয়ালপিন্ডিতে এক বৈঠকে মিলিত হইবেন। সাংবাদিকদের তিনি আরাে জানাইলেন যে, ইতিমধ্যে বিভিন্ন নেতাকে আমন্ত্রণ জানাবার জন্য তিনি বিরােধী দলীয় নেতা নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খানকে অনুরােধ জানাইয়াছেন। নওয়াবজাদার নিকট প্রেরিত প্রেসিডেন্ট আইউবের সেই অনুরােধ পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ
Nawabzada Shahib,
In the course of my broadcast on the 1st of January 1969. I said that I along with my colleagues would like to have the first opportunity to meet the repersentatives of the opposition parties to mutually discuss the political problems which are agitating the people’s mind & to seek their assistance in finding solutions thereto, I am therefore, requesting you convenor of Democratic Action Committee to invite on my behalf whomsoever you like to attend a conference in Rawalpindi on the 17th of February, 1969 at 10. a. m. if this is suitable & convenient to you. I am suggesting this date because before that I expect to be in East Pakistan but I shall be available to discuss any preliminarics in Dhaka should that be considered necessary by you.
I shall be very happy indeed if you & such representatives of the opposition parties as you may nominate would accept the invitation. I shall also be happy if you and your colleagues would stay in Rawalpindi as my guests during the conference.
In view of the public interest in the matter I feel that communication should be made available to the press for publication at the earliest possible opportunity
I am sure you will have no objection to this. With kind regards.
Yours sincerely,
Singned, Field Marshall Mohammad Ayub Khan
নওয়াবজাদা সাহেব, ১৯৬৯ সালের ১লা জানুয়ারী জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আমি বলিয়াছিলাম যে,
আমি ও আমার সহকর্মীবৃন্দ বিরােধী দলসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দের সহিত প্রথম সুযােগেই জনগণের মনে বিরাজমান সমস্যাবলী সম্পর্কে আলােচনাপূর্বক এইগুলি সমাধানে উপনীত হওয়ার জন্য মিলিত হইতে চাই। ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির আহবায়ক হিসাবে আমি আপনাকে এই মর্মে অনুরােধ জানাইতেছি যে, যদি আপনার নিকট উপযােগী বিবেচিত হয়, তাহা হইলে আগামী ১৭ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) সকাল ১০টায় রাওয়ালপিন্ডিতে এক সম্মেলনে যােগদান করিবার জন্য আপনার পছন্দমাফিক ব্যক্তিবর্গকে আমার পক্ষ হইতে দাওয়াত করিবেন। আমি উক্ত তারিখের কথা বলিতেছি এই কারণে যে, সম্ভবতঃ ইহার পূর্ব পর্যন্ত আমার পূর্ব পাকিস্তানে থাকার কথা। কিন্তু যদি আপনার নিকট প্রয়ােজন অনুভূত হয়, তাহা হইলে আমি যে কোন প্রাথমিক আলােচনা করিবার জন্য ঢাকায় প্রস্তুত থাকিব।
যদি আপনি ও আপনার মনােনীত বিরােধীদলীয় প্রতিনিধিবৃন্দ এই দাওয়াত গ্রহণ করেন, তাহা হইলে আমি অত্যান্ত সুখী হইব। আমি আরও সুখী হইব যদি আপনি ও আপনার সহকর্মীরা সম্মেলন চলাকালে আমার মেহমান হিসাবে রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থান করেন।
জনস্বার্থের খাতিরে আমি মনে করি এই পত্রখানি, যত শীঘ্র সম্ভব সংবাদপত্রে প্রেরণ কন্যা প্রয়ােজন। আমি নিশ্চিত যে, এই প্রস্তাবে আপনার কোন আপত্তি নাই।
| শ্রদ্ধান্তে
আপনার বিশ্বস্ত স্বাঃ ফিল্ড মার্শাল মােহাম্মদ আইউব খান
আলােচনার পরিবেশ
আলােচনায় অনুকূল আবহাওয়া সৃষ্টির মানসে ৬ই ফেব্রুয়ারী মধ্যরাত্রি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ হইতে সৈন্য বাহিনী ও ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ছাত্র-পুলিশ হাংগামা রোধকল্পে লাহাের শহরে সৈন্য বাহিনী তলব করা হয়। ঢাকায় ৬ই ফেব্রুয়ারী ‘কালাে দিবস’ (ব্ল্যাক ডে) পালন করা হয়। গাড়িতে, বাড়িতে, দোকানে, অফিসে, শরীরে কালাে পতাকা ও কালাে ব্যাজ সরকারী জুলুমের প্রতিবাদ জানাইতেছিল। ঢাকা যেন কালাে পতাকা আর কালাে ব্যাজের নগরীতে পরিণত হয়। ঢাকা এবং লাহােরের ছাত্রদের বিভিন্ন দাবীতে সভা, শােভাযাত্রা নগর জীবনকে যেমনি উত্তেজনাময় করিয়া রাখে ঠিক তেমনি আবার ১৭ই ফেব্রুয়ারী গােলটেবিল বৈঠককে কেন্দ্র করিয়া নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান, শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী ও ডেমােক্রেটিক একিশন কমিটির নেতৃবৃন্দের ঢাকায় আলোচনা রজিনৈতিক মহলে ব্যক্তির অবিইণ্ডিয়া সৃষ্টি করে। এমনি দ্বিধাদ্বজনিত পরিস্থিতিতে ৮ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) দৈনিক ইত্তেফাকের ছাপাখানা নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেসের বাজেয়াপ্তকরণ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। রাজনৈতিক সমঝােতার পথে ইহা ছিল নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সঠিক পদক্ষেপ।
রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী গ্রেফতারের প্রতিবাদে, রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে আগতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের ও ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবীতে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিক করিয়া লক্ষ জনতার মিছিল প্রত্যহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার প্রদক্ষিণ করিত। এমনি একটি দিন ৯ই ফেব্রুয়ারি। অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত মরণজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত লক্ষ ইনসানের মিছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সদর ফটক ও বিভিন্ন পার্শ্বস্থ দেওয়াল ভাঙ্গায় উদ্যত হইলে চিরাচরিত প্রথানুযায়ী আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ না করিয়া বিচক্ষণ জেলার নির্মল বাবু কম্পিত পদে ১০ নং সেলে উপস্থিত হন ও ভীত-শঙ্কিতকণ্ঠে সংক্ষেপে মারাত্মক পরিস্থিতি উদ্ভবের আশংকা প্রকাশ করেন এবং আমাকে জেলগেটে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করিতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। আমার সেল-মেট বন্ধুবর জনাব তাজউদ্দিন আহমদ শােনামাত্র আমাকে কালক্ষেপ না করিয়া জেলগেটে যাইতে বাধ্য করেন। জেলগেটের লােহার শিকের অবলম্বণে কিছুদূর আরােহণ করিয়া আমি প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী, অনর্গল বক্তৃতা দানের ফলে সমগ্র পরিস্থিতি আয়ত্বের মধ্যে আসে এবং কারাগার প্রাচীরে যাহারা আরােহণ করিয়াছিল তাহারাও নামিয়া পড়ে। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব জেলার নির্মল বাবু যদি আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা প্রার্থনা করিতেন, তাহা হইলে হাজার হাজার মিছিলকারীর রক্তে কালাে পীচের রাজপথ শাব্দিক অর্থেই রক্ত গঙ্গায় পরিণত হইত; জেলগেট ও জেলের দেওয়াল চুরমার হইয়া যাইত। এবং পরিণতিতে চোর-ডাকাত সবাই জেলমুক্ত হইয়া সমাজ জীবনকে বিষাক্ত করিয়া তুলিত, গােল টেবিল বৈঠকের কোন প্রশ্নই উঠিত না। নির্মল বাবুর মত এই ধরনের কর্মকর্তা বড় একটা দেখা যায় না। প্রশাসন তাহাকে যথাযথ পারিতােষিক দ্বারা যথােপযুক্ত মর্যাদা দিয়াছে কিনা জানি না। হয়ত দেয় নাই। কারণ ক্ষুদ্রমনা, পরশ্রীকার মাথা ভারী প্রশাসনের পক্ষে না দেওয়াই স্বাভাবিক। | রাতে আমার কারামুক্তির আদেশ আসে। আমি মুক্তি আদেশ প্রত্যাখ্যান করি এবং সঙ্গে অন্য দুইজন সদ্য কারামুক্তি আদেশপ্রাপ্ত জনাব সিরাজুল হােসেন খান এবং এডভােকেট মুজিবর রহমান আমার বক্তব্যের সহিত একাত্মতা প্রকাশ করেন। আমাদের দাবী ছিল, দেশরক্ষা বিধি বলে বা নিরাপত্তা আইনে আটক সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিলেই আমরা কারামুক্তি মানিব; নতুবা নয়। আমাদের অভিনব আন্দোলন পদ্ধতিতে কারাগারের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল মওলানা ওবায়দুল্লাহ বড় বেকায়দায় পড়েন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ইতিমধ্যেই জাতীয় পরিষদের সদস্য আফাজউদ্দিন ফকীয় জেলগেটে আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং স্বরাষ্ট্র সচিবের তরফ হইতে সকল রাজবন্দীদের মুক্তির নিশ্চয়তা দান করেন। পরিশেষে জেলার নির্মল বাবুর কাকুতি-মিনতিতে বন্ধুবর রাজউদ্দিন আহমদ, ওবায়দুর রহমান, ছাত্রনেতা আনিসুর রহমান ও জিয়াউদ্দীন খান আমাকে ১০ নং সেলে ডাকাইয়া নেয় এবং মুক্তিপত্র সই করিতে বলেন। তাহাদের অনুরােধে মুক্তিপত্র সই করি এবং রাত দুইটার পর আমরা কারাগার ত্যাগ করি।
১৬ই ফেব্রুয়ারী রাত ১২টায় দেশরক্ষা আইন তুলিয়া লওয়ার কারণে ১৭ই ফেব্রুয়ারি দেশরক্ষা আইনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক সকল রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হইলেও জুনাব আনিসুর রহমানকে ১৭ই ফেব্রুয়ারী সকাল ৮টায় দেশরক্ষা আইনে আটকাদেশ হইতে মুক্তি দিয়া জেলগেটে পুনরায় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। | পশ্চিম পাকিস্তানের লাহাের, করাচী, পিণ্ডি ও পেশােয়ারে ছাত্র জনতার আন্দোলন সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ও নিরত্র মিছিলকারীদের মধ্যে অহরহ সংঘর্যের কারণে পরিণত হয়। রাজবন্দী জুনাব জুলফিকার আলী ভূট্টোর রীট পিটিশন শুনানীর উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট কর্তৃক বিচারপতি মুশতাক আহমদ ও বিচারপতি মােহাম্মদ গুল দ্বারা গঠিত স্পেশাল বেঞ্চ ১০ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখের রায়ে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার অবধি লারকানায় স্বীয় বাসভবনে তাহাকে আটক রাখিবার নির্দেশ দান করেন। ২৪ শে জানুয়ারী (১৯৬৯) ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন শুরু হইয়াছিল তাহা ১২ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) তারিখে মূলতবী ঘােষণা করা হয়। মূলতবী দিবসে দলীয় প্রধান মওলানা ভাসানীর নির্দেশে সর্বজনাব মশিউর রহমান, আরিফ ইফতেখার (লাহােৱ), মুজিবুর রহমান চৌধুরী (রাজশাহী) জাতীয় পরিষদের বিদায়ী অধিবেশনে সদস্য পদ হইতে ইস্তফাদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন এবং সর্বজনাব এ,এইচ, এম, কামরুজ্জামান, ইউসুফ আলী, এ, বি, এম, নূরুল ইসলাম ও মিজানুর রহমান চৌধুরী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের নিকট ইস্তফাপত্র দাখিল করেন। উদ্দেশ্য, ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটিভুক্ত অঙ্গদলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যগণকে একত্রে সদসাপদ হইতে ইস্তফা দানে উদ্ভুদ্ধ করা। যাহা হউক, ২৫শে মার্চ (১৯৬৯) সামরিক আইন জারি করিয়া জাতীয় পরিষদের বিলুপ্তি ঘােষণার কারণে ইস্তফাদান প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব পায় নাই।
১২ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফা) ওয়ার্কিং কমিটি ডেকোক্রেটিক এ্যাকশন কমিটিতে প্রেরিত স্বীয় প্রতিনিধিবর্গকে এই মর্মে নির্দেশ দেয় যে, ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি ঘােষিত ৮ দফা কর্মসূচী ৩ হইতে ৮ (অর্থাৎ ৬টি) কর্মসূচীগুলি (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার যাহার অন্তর্ভুক্ত) বাস্তবায়িত . করিয়া সরকার স্বীয় আন্তরিকতা প্রমাণ করিলেই যেন ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক আহূত গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দেয়, নতুবা নয়।
আন্দোলনের প্রচণ্ডতায় বিহ্বল ও দিশেহারা আইউব সরকার লাহাের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলসমূহ বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার (১৩ই ফেব্রুয়ারি হইতে ১৫ই ব্রুেয়ারী) বন্ধ ঘােষণা করে। এইদিকে বন্দী জুলফিকার আলী ভূট্টো জরুরী অবস্থা
প্রত্যাহারের দাবীতে ১৪ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) হইতে অনশন ধর্মঘট করিবার হুমকি দেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারী জনাব ভুট্টোকে বন্দীদশা হইতে মুক্তি দেয়া হয় এবং ১৭ই ফেব্রুয়ারী হইতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হয়। ১৪ই ফেব্রুয়ারী পল্টনে সভা | ডেমােক্রেটিক একশন কমিটি ৮ দফা দাবীর সমর্থনে ও জুলুমের প্রতিবাদে ১৪ই। ফেব্রুয়ারী সমগ্র দেশব্যাপী সাধারণ হরতাল ঘােষণা করে এবং একই দিবসে ছাত্রদের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ও ১১ দফা দাবীর সমর্থনে ও জুলুমের প্রতিবাদে সাধারণ হরতাল ঘােষণা করে। সভায় সংগ্রাম পরিষদের একই হরতাল দিবসের একই কর্মসূচী ঘােষিত হয় এবং একই পল্টন ময়দানে হরতাল দিবসে উভয় গ্রুপের জনসভা আহবান
১১ দফা বনাম ৮ দফা আন্দোলনের বরণে জননেতাদের প্রতি সাধারণ যুবসমাজ ও ছাত্র সমাজের অবিশ্বাস, অবজ্ঞা ও অনীহরি নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় । অপরাহ্ন তিন ঘঠিকায় বিশাল জনসমুদ্রে সভাপতিত্ব করিবার জন্য বৃদ্ধ নেতা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জনাব নুরুল আমিনের নাম প্রস্তাব করিতেই সভার মঞ্চ ও সভা হইতে তরুণ শ্রেণী প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠে। কোন সুস্থ ও রাজনৈতিক বক্তব্যই শ্রবণ করিতে তরুণ সমাজ প্রস্তুত ছিল না। ধীরে। ধীরে, ক্রমে ক্রমে, ধাপে ধাপে, সমগ্র আন্দোলনের পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ছাত্রদের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ কবলিত হয়। উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে অঙ্গীভূত করিয়াই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা প্রণীত হইয়াছিল এবং ১১ দফা দাবীকে কেন্দ্র করিয়াই সমগ্র আন্দোলন ছাত্র নেতৃত্বে পরিচালিত হইতেছিল। সেই সাথে আরগতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামী শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবমূর্তিও দিন দিন গগনচুখি হইয়া উঠিতেছিল। এইভাবেই অবশেষে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি প্রায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবীতে পরিণত হয়। যাহা হউক, পল্টনের ঐ সভায় ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা তােফায়েল আহমদ, আওয়ামী লীগের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা আমেনা বেগম, সদ্য কারামুক্ত (১২ই ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯) আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মােজাফফর আহমদ বক্তৃতা করেন। অর্থাৎ ৮ দলীয় ডেমােক্রেটিক কিশন কমিটির অন্য ৬ দশীয় কোন নেতাকেই সেইদিন বক্তৃতা করিতে দেওয়া হয় নাই। তবে আমার দৃঢ়মত ছাত্রনেতৃবৃন্দ ইচ্ছা করিলেই উক্ত সড়াকে ছাত্র ও জননেতৃবৃন্দের যৌথ সভায় পরিণত করিতে পারিতেন। পল্টন ময়দানে এই বিশাল বৈপ্লবিক জনসভাটির অসহিষ্ণু, ভাববগপ্রসূত কার্যধারা দেশ ও দেশবাসী কতটুকু মঙ্গল ও কল্যাণের কারণ হইয়াছে, ভবিষ্যৎ ইতিহাসই ইহার রায় দিবে। তবে এই ঘটনাপ্রবাহ আমার মত আন্দোলনমুখী মানুষকে
পীড়া দিয়াছে নিঃসন্দেহে। | ১৪ই ফেব্রুয়ারী সাধারণ হরতাল পালন উপলক্ষে সৃষ্ট হাংগামায় করাচীতে ২ জন ও লাহােরে ২ জন নিহত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনিবার প্রয়োজনে প্রশাসন হায়দরাবাদ, করাচী ও লাহােরে সেনা বাহিনী তলব করে। ৮টি দলের সমন্বয়ে ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটি সাধারণভাবে ভাসা ভাসা সমর্থনপুষ্ট ছিল কিন্তু জনসাধারণ জুলফিকার আলী ভুট্টোকেই প্রেসিডেন্ট আইউব বিরােধী রাজনীতি ও গণআন্দোলনের প্রধান ব্যক্তি হিসাবে জ্ঞান করিত অর্থাৎ সরল ভাষায় একমাত্র অনপ্রিয় নেতারূপে জনাব ভূট্টো রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হন। সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু।
দেশবাসী যখন প্রাণ দিতেছে, জখম হইতেছে, নির্বিচারে পুলিশের জুলুম মােকাবিলা করিতেছে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবী করিতেছে এবং দেশের রাজনৈছিক ও সাংবিধানিক সংকট উত্তরণ মানসে প্রেসিডেন্ট আইউব যখন নেতৃবৃন্দের সহিত গােলটেবিল বৈঠকে বসিতে যাইতেহেন ঠিক এমনি মুহুর্তে ও অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। ১৫ই ফেব্রুয়ারী প্রত্যুষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদ্বয় ফ্লাইট সার্জেট রুল হক ও সার্জেন্ট জহলে হক প্রাতঃকৃত করিতে যাইবার পথে প্রহরারত সৈন্য প্রহরীর গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হন এবং সরকারি ঘােষণা মােতাবেক রাত ৯টা ৫ মিনিটে সার্জেন্ট জহুরুল হক কমবাইড মিলিটারী হসপিটালে শাহাদৎ বরণ। করেন। ১৬ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) ভােরবেলা সার্জেন্ট জহুরুল হকের লাশ তাহার ভাইয়ের এলিফ্যান্ট রােডের বাসায় লইয়া যাওয়া হয়। সহস্র সহস্র দর্শনার্থী অত্যন্ত শৃংখলার সহিত কাতারে দাঁড়াইয়া শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। অপরাহ্ন ২-৩০ মিনিটে শহীদের লাশসহ শােক মিছিল শহরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণের পর পল্টন ময়দানে নামাজে জানাযা আদায় করে এবং অপরাহ্ন ৩-৩০ মিনিটে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হককে আজিমপুর গােরস্থানে দাফন করা হয়।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু সংবাদে সমগ্র শহর যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করে। উত্তেজিত অথচ চরম মর্মাহত জনতা বিভিন্ন দিক হইতে শােক মিছিলসহ বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করিতে থাকে। এই অবস্থায় পুলিশের গুলি, লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবহারের প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত জনতা বাংলা একাডেমীর পার্শ্ববর্তী গভর্নমেন্ট গেষ্ট হাউস, আগা মাসীহ লেনে অবস্থিত প্রাদেশিক মুসলিম লীগের (কনভেনশন) সদর দফতর ভবন, নওয়াব হাসান আসকারী ও আইউব মন্ত্রিসভার ইনফরমেশন ও ব্রডকাস্টিং মন্ত্রী খান্স শাহাবুদ্দীনের বাসভবন, ওয়ার্কার্স মন্ত্রী (প্রাদেশিক) মং সুর সরকারী বাসভবন, প্রাদেশিক মন্ত্রী সুলতান আহমদের সরকারী বাস ভবনে অবস্থিত মিনিয়েলস কোয়ার্টার ও একটা মােটর গাড়ীতে অগ্নিসংযােগ করে। এবম্বিধ পরিস্থিতিতে শহরে স্বাভাবিক জীবন যাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হয় এবং অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনিবার প্রচেষ্টায় শহরে সেনা
গাড়ী ও অকট্রয় পােষ্ট আক্রমণ করে ও অগ্নিসংযােগ করে। পুলিশের কঁদানে গ্যাস ব্যবহার ও লাঠিচার্জের ফলে ১৩ জন আহত হয় এবং ১৮ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। চট্টগ্রাম বন্দর নগরীতেও শাসক কনভেনশন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের বাড়ির ও প্রতিষ্ঠানগুলিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বার বার অগ্নিসংযােগ করিতে প্রচেষ্টা চালায়। জেলা প্রশাসক পরিস্থিতি আয়ত্বে রাখিবার তাগিদে ১৪৪ ধারা জারি করে ইপিআর বাহিনীকে তলব করেন এবং ঈদুল আজহা ও শহীদ দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ১৮ই ফেব্রুয়ারী হইতে চট্টগ্রাম শহরের সকল স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘােষণা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের করাটী ও অন্যান্য শহরে জনতার আপােষহীন সংগ্রামের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করিবার ব্যর্থ প্রয়াসে প্রশাসন কর্তৃপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্রের যথেস্থা ব্যবহার করিয়া ২ জনকে হত্যা করেন। পরিশেষে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনিবার জন্য শহরে সেনাবাহিনীকে তলব করা হয়। ডঃ জোহার মৃত্যু
১৭ই ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) পুলিশ ও মিছিলকারীদের সংঘর্ষে উক্ত তিক্ত অবস্থার পুনরাবৃত্তি আশংকায় ১৮ই ফেব্রুয়ারী পূর্বাহ্নেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের রিডার প্রক্টর ডঃ শামসুজ্জোহা, কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট প্রহরা দিতে থাকেন। অপরাপর অধ্যাপক কাক্সলা পেটে প্রহরারত ছিলেন। উদ্দেশ্য, ছাত্রবৃন্দ যেন মিছিলসহ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ছেষ্টা করিতে না পারে। যাহা হউক, অধ্যাপকবৃন্দের এই আন্তরিক প্রয়াস ত্বও এবং সেনাবাহিনীর গাড়ী বা সেনা বাহিনী তলব না করিবার বিষয়ে পূর্বাহ্নেই ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত চুক্তি থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ সেনাবাহিনী পুর্ণ পাড়ী ছুটিয়া আসে এবং কোনরূপ সতর্কবাণী উচ্চারণ না করিয়াই গুলিবর্ষণ শুরু করে। দিশাহারা অবস্থায় ডঃ কসিমুদ্দিন মােল্লার সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয় এবং ডঃ শামসুজ্জোহা বেয়নেটের আঘাতে গুরুতরভাবে আহত অবস্থা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নীত হইবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সরকারী প্রেসনােটের ভাষ্য অনুসারে লেফটেন্যান্টের গুলিতে ডঃ জোহার নিহত হওয়ার কথা বলা হইয়াছিল। ছাহা সত্য নয় বরং বেয়নেট চার্জের ফলেই তার মৃত্যু ঘটে। এইরূপ নাজুক পরিস্থিতিতে প্রশাসন কর্তৃপক্ষ যদি ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে বিচক্ষণতা ও ধৈর্যের সহিত পরিস্থিতি মােকাবিলা করিতে ব্যর্থ হন, তাহা হইলে দেশ ও দশের চরম ক্ষতি হইয়া যায় এবং এই ধরনের ক্ষুদে গরম মাথাওয়ালা প্রশাসন কর্তৃপক্ষের কারণেই সম সরকার জনতার মৃণার পাত্রে পরিণত হয়।
| সিন্ধান্ত ছিল, ৩ জন করিয়া মিছিল বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বাহির হইবে এবং বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করিবে। গুলিবর্ষণ ও শিক্ষক হত্যার কারণে পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন হয়। শুরু হয় মারমুখী জনতার মিছিলের উত্তাল তরঙ্গ, লংঘিত হয় ১৪৪ ধারার সমস্ত নিষেধাজ্ঞা। প্রশাসন কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি বেগতিক দেখিয়া ১৮ই ফেব্রুয়ারী অপরাহ্ন ২-৩০ মিনিটের মধ্যে রাজশাহী শহরে সান্ধ্য আইন জারি করেন। ডঃ জোহার মৃত্যুর খবরে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এক অব্যক্ত শােকের ছায়া নামিয়া আসে। নােয়াখালী
ও কুষ্টিয়ায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ আয়ত্বে আনিবার প্রচেষ্টায় পুলিশ গুলি চালায়। নােয়াখালীতে ৩ জন ও কুষ্টিয়ায় ১ জন নিহত হয়। কারফিউ না থাকিলে ঢাকার পরিস্থিতি সেনাবাহিনীও আয়ত্বে আনিতে পারিত কিনা, সন্দেহ। যে অমানুষিক ও বর্বরােচিত পন্থায় পাশবিক শক্তি ডঃ জোহাকে হত্যা করিয়াছে তাহা সমগ্ন পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও বিবেকের উপরে হানিয়াছে দারুণ কশাঘাত। কোন রক্তমাংসের দেহ এই ঘটনাকে কিছুতেই বিনা প্রতিবাদে শাস্তভাবে গ্রহণ করিতে পারে না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালসহ প্রায় প্রত্যেকটি জেলা শহর, মহকুমা শহর এমন কি থানা সদর পর্যন্ত বিভিন্ন পতাকাতলে ডঃ জোহার মর্মান্তিক মৃত্যুর প্রতিবাদে মুখর হইয়া
মতাবস্থায় বাগীর ঘারে আঘাত হানা ত্যাগের মূর্তপ্রতীক ২১শে ফেব্রুয়ারীর শহীদ দিবস। স্বৈরাচারী শক্তির সাথে জনতার সংঘর্ষ হয় খুলনা ও পাবনা জেলাতে। রক্তয়াংগ ২১শে ফেব্রুয়ারী আবার বাংগালী সন্তানের প্রার্থী হয় এবং খুলনা ও পাবনায় যথাক্রমে ৮ জন ও ২ জন শহীদের বুকের শােণিতে পুনর্বার অবগাহন করে ২১শে ফেব্রুয়ারী। এই রক্তদান বৃথা যায় নাই। এক ব্যক্তির শাসন প্রবর্তক, জনতার সার্বভৌমত্ব ছিনতাইকারী, দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইন মােতাবেক দেয় গুয়াদী ভংগকারী প্রেসিডেন্ট আইউব খান এই ২১শে ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী না হইবার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন এবং ২২শে ফেব্রুয়ারী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহৃত হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তবৃন্দ মুক্তি পান। ঢাকায় সংগ্রামী লক্ষ লক্ষ জনতা ‘তাহাদের স্বতঃস্ফূর্ত সম্বর্ধনা জানায় অপরাহ্নে অনুষ্ঠিত পল্টন জনসভায় । লক্ষণীয় যে, শেখ মুজিবুর রহমান এই জনসভায় উপস্থিত হন নাই, অধিকন্তু সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি তােফায়েল আহমদ একক ও বিচ্ছিন্নভাবে ২৩শে ফেব্রুয়ারী অপরাহ্ন ২ ঘটিকায় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিবুর রহমানকে গণ-সম্বর্ধনা দানের কর্মসূচী ঘােষণা করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত সদ্যমুক্ত অন্যদের সম্পর্কে কোন বক্তব্য নাই। এইভাবেই ষড়যন্ত্র মামলার সকল কৃতিত্ব ও ত্যাগ তিতিক্ষার নৈবেদ্য ও জনপ্রিয়তা সুচতুর শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক মূলধনে পরিণত হয়। মামলার প্রকৃত ত্যাগী অভিযুক্ত লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হোসেনের সকল ভূমিকা একপাশে পড়িয়া রহিল- আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শিরােপা এককভাবে কুক্ষিগত করিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, জন কয়েক যুব নেতার বদৌলতে তিনি ভূষিত হইলেন বঙ্গবন্ধু উপাধিতে। কাহার প্রাপ্য কে আত্মসাৎ করে? রাজনীতির চানক্যাল কি ইহাকেই বলে? আসলে, লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হােসেন ছিলেন পূর্ণ। পাকিস্তানকে স্বাধীন করিবার গােপন আন্দোলনের প্রকৃত নায়ক। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন উক্ত আন্দোলন লক্ষ্যের বন্ধু ও সমর্থক মাত্র। গােল টেবিল বৈঠক।
যাহা হউক, ২৬শে ফেব্রুয়ারী রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিতব্য গোল টেবিল বৈঠকে
যােগদানের সিদ্ধান্ত শেখ মুজিব পূর্বাহ্নেই রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় ঘােষণা করিয়াছিলেন। ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির ১৬ জন প্রতিনিধি, প্রেসিডেন্ট আইউব খানের নেতৃত্বে ১৫ জন, নির্দলীয় এয়ার মার্শাল আসগর খান, বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মাের্শেদ ২৬শে ফেব্রুয়ারী সকাল ১০-৩০ মিনিটে রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউসে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণকল্পে গােল টেবিল বৈঠকে মিলিত হন। ৪০ মিনিটব্যাপী বৈঠকের পর ঈদুল আযহা উপলক্ষে বৈঠক ১০ই মার্চ সকাল ১০ ঘটিকা পর্যন্ত মুলতবী রাখা হয়। লেঃ জেঃ আজম খান রাওয়ালপিন্ডিতে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও বৈঠকে যােগ দেন নাই। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো করাচীর এক সভায় কিছু অসংলগ্ন উক্তি প্রসংগে প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে পদত্যাগ করিয়া জাষ্ঠীয় পরিষদের শীকার আবদুল জব্বার খানের নিকট দায়িত্ব বুঝাইয়া দেওয়ার আহবান জানান। তাহার প্রস্তাব মতে, জাতীয় পরিষদের স্পীকার উক্ত দায়িত্বভার প্রাপ্তির পর প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করিবেন এবং নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ দেশের নূতন সংবিধান রচনা করিবে। উল্লেখ্য যে, জনাব ভুট্টো ইতিপূর্বেও বৈঠকে যােগদানের পূর্বশর্ত হিসাবে ১৮ই ফেব্রুয়ারী (১৯৬৯) করাচী প্রেসক্লাৰে বক্তৃতায় গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের নিমিত্ত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন। এবং কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য নিজস্ব ১০ দফা দৰী ঘােষণা করিয়াছিলেন। পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন জ্বালাও পােড়াও’ আন্দোলনের মুখপাত্র, পিকিং-এর নির্দেশে আইউব সরকারের খুঁটি। সুতরাং গঠনমূলক কাজে সহায়তা প্রদান তাহার পক্ষে ছিল অসম্ভব। প্রকৃতপক্ষে তাহার ও তাহার দলের সরকার বিরােধী বিশেষ কোন কার্যকর ভূমিকা ছিল না, মৌখিক বুলি বা সংবাদপত্রে গা বাঁচানাে বিবৃতিই ছিল ভঁহাদের একমাত্র অবদান। মুলতবী গােল টেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবের ভাষণ :
১০ই মার্চ মুলতবী গােল টেবিল বৈঠকে বাংলার কন্ঠস্বর শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ নিম্নে দেওয়া হইল।
Mr. President & Gentlemen,
The nation today is experiencing a crisis which has shaken its very foundations. For all of us who love the nation and recall the sacrifices which were made to create Pakistan, this is a time of grave anxiety. In order to resolve the crisis, it is imperative that its nature should be understood and its causes identified. Nothing would be more casstrophic than the failure to come to grips with the basic issues which underline the upheaval which has taken place in the country. These issues have been evaded for twenty one years. The moment has a arrived for us to face them squarely. I am
convinced that comprehensive solution must be found for our problems, for clearly the situation is too grave for palliatives and half-measures. What is at stake is our survival.
Is is this conviction that obliges me to expound a comprehensive solution to our basic problems. If the demands that have been expressed by different sections of the people are carefully examined, it will be seen that there are three basic issues which underlie them. The first is that of deprivation of political rights and civil liberties. The second is the economic injustice suffered by vast majority of the people, comprising workers, peasants, low and middle income groups, who have had to bear the burden of the costs of development in the form of increasing inflation while the benefits of such development are increasingly concentrated in the hands of a few families, who in turn are concentrated in one region. The third is the sense of injustice felt by the people of East Pakistan, who find that under the existing constitutional arrangements their basic interests have consistently suffered in the absence of effective political power being conferred upon them. The former minority provinces of West Pakistan feel similarly aggrieved by the present constitutional arrangements.
The issue of deprivation of political rights finds expression in the 11point programme of the Students of East Pakistan, as also in the 6-point programme of the Awami League, as a demand for the establishment of a Parliamentary Democracy, based on the principle of the supremacy of the legislature, in which there is representation of all units on the basis of population, and to which representatives are directly elected by the people on the basis of universal adult franchise.
The issue of economic injustice is reflected in the 11-point programme in the form of clearly formulated demands for re-organisation of the economic and educational system of the country. The 6-point programme of my party clearly recognises the need for redical cconomic re-organisation, and the demand for regional autonomy, as outlined in it, is insisted upon as an essential pre-condition for economic re-organisation and the implementation of effective economic programmes.
The issue of justice for the different regions and units of Pakistan is the basis of the demand for the establishment of a Federation providing for full regional autonomy, as embodied in the 6-point programme as also in the 11point programme, This is also the bassis of the demand for dismemberment of onc Unit and the establishment of a Sub-Federation in West Pakistan
The Democratic Action Committe has held detailed deliberations regarding these grave and challenging national issues. There has always been complete unanimity in the Democratic Action Committee on the imperative necessity of effecting the following constitutional changes :
(a) The establishment of a federal parlimentary democracy. (b) The introduction of a system of direct elections based on universal
adult franchise. A consensus has also been apparent among the members of the Committee on the following matters (a) The dismemberment of One Unit and the establishment of a Sub
Federation in West Pakistan (b) Full regional autonomy being granted to the regions.
The Committee further agreed that its members should be at liberty to present furhter proposals, which in their view were essential for achiving an effective and lasting solution of the problems that are at the root of the present crisis.
Since we are here for the very purpose of seeking to find such and effective and lasting solution. I have felt it my bounden duty to press before this Conference with all earnestness that every one sitting at this table should realise that constituional changes to provide for representation on the basis of population in the Federal Legislature as well as for the granting of full regional autonomy, as outlined in the 6-point programme, are essential for achieving a strong, united and vigorous Pakistan.
I would like to state that the Awami League is a party of the freedomfighters for Pakistan. Its founder, Huseyn Shaheed Suhrawardy is indeed one of the founders of Pakistan. I recall with some pride that under his leadership, my colleagues and I were in the vanguared of the struggle for Pakistan. Such proposals as I am presenting before the Conference are based on the conviction that they are absolutely essential in order to preserve and indeed to strengthen Pakistan.
The demand for representation in the Federal Legislature to be on basis of population stems from the first principle of democracy, viz., “one man, one vote”. In the national forum, as envisaged in the 6-point scheme, only national issues would arise for consideration. The representatives would, therefore, be called upon to deal with matters from a national point of view and hence the voitng would not be on a regional basis. Further, national
political parties would be representated in the Federal Legislature, which would ensure that voting would be on a party, and not on regional basis. Indeed the experience of the lest twentyone years bears out the fact that voting in the National Assembly has invariably been on party basis, It is the principle of party in representation of each wing, which is based on the false premise that representatives in to Federal Legislature are likely to vote on a regional basis. It is thus the party principle that places and unjustified emphasis on regionalism as a factor in national politics. The entire historical experience of the last twentyone years fully bears out the facts that East Pakistan has always subordinated its regional interest to the over-riding national interest, not withstanding the fact that it had the majority of the population. It should not be necessary to recall that in the first Constituent. Assembly East Pakistan had 44 representatives as against 28 from West Pakistan; yet this majority was never used to promote any regional interest. Indeed, six West Pakistanis were elected to the Constituent Assembly from East Pakistan. Despite being a majority, East Pakistan accepted the principle of party not only in representation in the legislature but also in other organs of the Sate. It is painful to record that party so far as representation in the Legislature was concerned, was promptly implemented, but the benefit of party in representation in the other organs of the State, including the civil, foreign and defence servies, was never extended to East Pakistan. East Pakistan had even acquiesced in the Federal Capital as well as all the Derence head-quarters being located in West Pakistan. This meant that the bulk of the expenditure on defence and civil administration, amounting to about Rs. 270 crores, or over 70% of the central budget is made in West Pakistan. Should our West Pakistani brethern persist in refusing us representation on a population basis in the Federal legislature, East Pakitanis will feel constrained to insist on the shifting of the Federal Capital and the Defence headquarters to East Pakistan
It would be a positive step toward cementing the relations belween the two wings of Pakistan if our West Pakistani brethern were to affirm their confidence in their East Pakistani brethern by not opposing the demand for representation in the Federal Legislature on the basis of population. Such a step would pay rich dividend by way of building up mutual confidence and trust between the people of East and West Pakistan.
The adoption of the Federal Scheme presented in the 6-point programme is an essential pre-requisite for the achievement of a political
solution for the problems of the country. I would reiterate that the spirit underlying the 6-point programme is that Pakistan should present itself to the community of the nations as one single united nation of one hundred and twenty million people. This object is served by the Federal Government being entrusted with the three subjects of Defence, Foreign Affairs and Currency. It is the same objective of having a strong and vigorous Pakistan that requires that due regard be paid to the facts of geography by granting full regional autonomy to the regions in order to enable them to have complete control in all matters relating to economic management.
I cannot too strongly emphasise the imperative necessity of removing economic injustices, if we are to put our society back on an even keel. The 11-point programme of the students for which I have expresed support contains proposals regarding the re-ordering of the economic and education system. These demands stem from the basic urge for the attainment of economic justice.
I would, however, like at this time to confine myself to outlining the constitutional changes, which are necessary for the attainment of economic justice, between man and man and between region and region.
The centralisation of economic management has steadily aggravated the existing economic injustices to the point of crisis. I need hardly dilate on the subject of the 22 families, who have already achieved considerable notoriely both at home and abroad on account of the concentration of wealth in their hands resulting from their ready access to the corridors of power. Monopolies and cartels have been created and a capitalist system has been promoted, in which the gulf between the privileged few and the suffering multitude of workers and peasants has been greatly widened. Gross injustices have also been inflicted on East Pakistan and the monirity provinces of West Pakistan
The existence of per capita income disparity between East and West Pakistan is known to all. As early as 1959-60, the Chief Economist of the Planning Commission estimated that the real per capita income disparity between East and West Pakistan was 60%. The Mid-plan Review made by the Planning Commision and other recent documents show that the disparity in real per capita income has been steadily increasing and therefore, would be much higher than 60% today. Underlying such disparity, is the disparity in general economic structure and infrastructure of the two regions, in the rates of employment, in facilities for education, and in medical and welfare
services. To give just a few examples, power generating capacity in West Pakistan is 5 to 6 times higher than in East Pakistan; the number of hospital beds in 1966 in West Pakistan was estimated to be 26,200, while that in East Pakistan was estimated to be 6,900; between 1961-1966, only 18 Polytechnic Institutes were established in East Pakistan as against 48 in West Pakistan. Further, the disparity in the total availability of resources has been even higher. More than 80% of all foreign aid has been utilized in West Pakistan in addition to the net transfer of East Pakistan’s foreign exchange earnings to West Pakistan. This made it possible for West Pakistan over 20 years to import Rs. 3109 crores worth of goods against the total export earnings of Rs. 1337 crore, while during the same period East Pakistan imported Rs 1210 crore worth of goods as against its total earnings of Rs. 1650 crore. All these facts underline the gross economic injustice which has been done to East Pakistan. There has been a failure to discharge lo constitutional obligation to remove disparity between the provinces in the shortest possible time. The Annual Report on disparity for the year 1968 placed before the National Assembly records that disparity has continued to increase.
The centralisation of economic management has thus failed miserably to meet the objective of attaining ecnomic justice. It has failed to meet the constitutional obligation to remove economic disparity between region and region. Instead, therefore, of persisting in centralized economic management which has failed to deliver the goods, we should adopt a bold and imaginative solution to this challenging problem The Federal Scheme at the Six-point programme, is in my view, such a bold and imaginative solution.
It is in essence a scheme for entrusting the responsbitity for economic managment to the regions. The proposal is born of the conviction that this alone can effectively meet the problems, which centralised economic management has failed to overcome. This unique geography of the country. resulting in lack of labour mobility, as well as the different levels of
development obtaining in the different regions, requires that economic management should not be centralised.
The specific proposal embodied in the Six-point Programme with regard to currency, foreign trade, foreign exchange earnings and taxation are all designed to give full responsibility for economic management to the regional Governments. The proposals with regard to currency are designed to provent flight of capital and to secure control over monetary policy. The
proposals regarding foreign trade and foreign exchange are desigened to ensure that the resources of a region are available to that region and to ensure it to obtain the maximum amount of foreign exchange resources for development purposes. The proposal regarding taxation is designed to ensure control by the regional governments over fiscal policy, without in any way depriving the Federal Government of its revenue requirements.
The substance of these proposals are as follows: (a) With regard to currency, measures should be adopted to prevent
Night of capital from one region to another and to secure control over monetary policy by the regional governments. This can be done by adoption of two currencies or by having one currency with a separate Reserve Bank being set up in cach region, to control monetary policy, with the State Bank retaining control over certain defined matters. Subject to the above arrangements,
Currency would be a Federal subject. (b) With regard to foreign trade and aid, the regional Governments
should have power to negotiate trade and aid, within the frame work of the foreign policy of the country, which shall be the
responsibility of the Federal Ministry of Foreign Affairs. (c) The foreign exchange carnings of each region should be
maintained in an account in cach Regional Reserve Bank and be under the control of the regional Government; the Federal requirements from the two regional accounts on the basis of an
agreed ratio. (d) With regard to taxation, it is proposed that the power of tax levy
and collection should be left to the regional Governments, but the Federal Government should he empowered to realise its revenue requirements from levies on the regional Governments. It should be clearly understood that it is not at all contemplted that the Federal Government be left at the mercy of the regional
Governments for its revenue needs. I would emphasize that there would be no difficulty in devising appropriate constitutional provisions whereby the Federal Government’s revenue requirements could be mel, consistently with the objective of ensuring control over fiscal policy by the regional Governments. The scheme also envisages that there would be just representation on a
population basis of persons from cach part of Pakistan in all Federal services, including Defence Services.
If these principles are accepted, the detailed provisions can be worked out by a Committee consisting of experts, to be designated by both parties.
This scheme holds cnormous promise of removing the canker of economic injustice from the body politic of Pakistan while at the same time removing the mistrust and frustration which centralised economic management has fostere over the years. I am confident that the people of West Pakistan would give their whole-hearted support to this scheme.
I urge the participants in this Conference to come forward with open minds and with large hearts, in spitit of fraternity and national solidarity, to adopt the Federal Scheme presented above, as the only means of overcoming what has been one of the most formidable problems conforming the country, i.e., that of the attainment of economic justice. No source had fed the current crisis more than the sense of economic injustice. Let us remove it; let us tackle problems at their source. Any attempt to avoid coming to grips with these basic problems will jeopardise our very survival.
Neither Almighty Allah nor history will forgive us if at this time of national crisis we fail to rise to the occasion to adopt bold solutions in order to restore the fromidable problems which have created a national crisis. This is a great opportunity, and one which may not pesent itself again, to face our national problems squarely. We must, Therefore, strain every nerve to agree upon and implement the required solutions. Let us strive together to lift our beloved Pakistan out of the tragic situation in which she is placed, and to lay the constitutional foundations for a real, living. Federal Parliamentary Democracy, which will secure for the people of Pakistan full political economic and social justice. Only thus can a strong and united Pakistan face the future with hope and confidence. The 10th March, 1969.
PAKISTAN ZINDABAD.
* ১০ই মার্চ অনুষ্ঠিত মুলতবী গােল টেবিল বৈঠকে ৮ দলীয় ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির আহবায়ক নওয়াবজাদা নাসরুল্লাহ খান কমিটির পক্ষ হইতে দুইটি দাৰী উত্থাপন করেন : (১) আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ ফেডারেল পার্লামেন্টারী পদ্ধতি সরকার; (২) প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটে আইন পরিষদ নির্বাচন। ১০ই মার্চ হইতে ১৩ই মার্চ পর্যন্ত রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রেসিডেন্ট গেস্ট হাউসে গোল টেবিল বৈঠক চলে এবং ১৩ই মার্চ গােল টেবিল বৈঠকের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট আইউব খান নিম্নবর্ণিত ২টি দৰী গ্রহণ করেন :
(১) প্রাক্ত বয়স্কদের ভােটে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন এবং (২) ফেডারেল পার্লামেন্টারী সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন।
ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির সভায় প্রেসিডেন্ট আইউব খানের এওয়ার্ড বা রায় বিবেচনার পর কমিটির লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার প্রেক্ষিতে ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির বিলুপ্তি ঘােষণা করা হয়। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগের (৬ দফা) সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বাহ্নেই ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছিলেন এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মস্কো) প্রতিনিধি ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির সভায় যােগদান করেন নাই। বৈঠকের পর
এয়ার মার্শাল আসগর খান একই দিন ১৩ই মার্চ (১৯৬৯) রাওয়ালপিণ্ডিতে আহূত সাংবাদিক সম্মেলনে জাস্টিস পাটি নামে স্বীয় রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। ১৩ই নভেম্বর (১৯৬৮) জুলফিকার আলী ভুয়োর গ্রেফতারের পর গণআন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকল্পে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান ১৭ই নভেম্বর (১৯৬৮) হইতে রাজনীতিতে অবতরণ করেন। আগেই উল্লেখ করিয়াছি যে, ৭ই নভেম্বর (১৯৬৮) রাওয়ালপিণ্ডিতে হাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে ছাত্রদের মৃত্যুতে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধিয়া উঠে; এবং ইহারই ক্রমব্যাপ্তি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানকে গ্রাস
| শেখ মুজিবর রহমান রাওয়ালপিণ্ডি গােল টেবিল বৈঠকে অংশহণের পর ১৪ই মার্চ ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করিলে জনতা তাহাকে বীরােচিত সম্বর্ধনা দান করে। বিমানবন্দরে তিনি ঘোষণা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ সমর্থন করিলে প্রেসিভেন্ট আইউব আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব পাকিস্তানের দাবী মানিতে বাধ্য হইতেন। শেখ সাহেব আরাে মন্তব্য করেন যে, সর্বজনাব হামিদুল হক চৌধুরী, মাহমুদ আলী, ফরিদ আহমদ ও আবদুস সালাম খান অদ্যবধি বিগত ২২ বসর যাবৎ একই খেলায় মাতিয়া আছেন। অসামঞ্জস্যপূর্ণ ক্রিয়াকলাপের প্রেক্ষিত্রে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি হইতে অবসর গ্রহণ করা বিধেয় বলিয়াও তিনি মস্তব্য করেন। ১১ দফা আন্দোলন পরিচালনাকারী সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমানকে সমর্থন করিত এবং তাহাদেরই প্রত্যক্ষ প্রয়াসের ফলেই শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব পাকিস্তানে এক নেতার মর্যাদা পান। প্রসঙ্গত ইহাও অনস্বীকার্য যে, ঘটনার আৰণ্ঠনে সমগ্র বাংগালী জনতাই শেখ সাহেবকে বিনা প্রশ্নে নেতারূপে বরণ করিয়াছিল। অতএব ব্যক্তি-আক্রোশ মিটাইবার মতলবে বিমান বন্দরে লক্ষ জনতার সামনে উপরােক্ত নেতাদের নাম প্রকাশ তাহার আদৌ নেতাসুলভ কাজ হয় নাই। ইহা প্রকারান্তরে উপরোক্ত নেতাদের বিরুদ্ধে জনতাকে উকাইয়া দেওয়া ছাড়া আর কিছুই
ছিল না। | শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিমান বন্দরের বক্তৃতার ফলে গভর্নর পদ হইতে মােনায়েম খানের অপসারণ ঘটে। বােধহয় ঐ কারণেই প্রেসিডেন্ট আইউব খান প্রফেসর নূরুল হুদাকে ২১শে মার্চ গভর্নর পদে নিয়ােগ করেন এবং জনাব হুদা ২৩শে মার্চ (১৯৬৯) তারিখে গভর্নর হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে ১৫ই মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান জেনারেল মুসার স্থলে জনাব ইউসুফ হারুনকে পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর পদে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।
বলা নিষ্প্রয়ােজন যে, ইতিমধ্যে দেশের এবং সমাজ জীবনের সর্বত্র জ্বালাও, পােড়াও, ঘেরাও আন্দোলন শুরু হইয়া গিয়াছিল এবং হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ, ধর্মঘট পর্যবসিত হইয়াছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে। প্রশাসনে আইন-শৃঙ্খলা বলিয়া কিছুই ছিল না; এমন কি দেশে কোন সরকার আছে বলিয়া মনে হইত না। বস্তুতঃ সেই সময়ে এইভাবেই ক্রমে ক্রমে উদ্ধৃংখলতা সমাজ জীবনের একমাত্র নিয়ামক শক্তি হইয়া পড়ে; জীবন মূল্যবােধ দ্রুত ধ্বংসের সম্মুখীন হয়; শান্তিপূর্ণ নাগরিক জীবনযাপন প্রচেষ্টা পরিণত হয় বাতুলতায়। সেক্রেটারিয়েটে হরতাল, শ্রমিকদের হরতাল, সরকারী বিভিন্ন বিভাগে হরতাল, শিক্ষক-ছাত্র হরতাল, শিল্প কারখানায় হরতাল, ট্রেনে, বাসে বিনা টিকিটে ভ্রমণ, আবার অসহিষ্ণু, দাংগা-হাংগামায় পারদর্শী রাজনৈতিক কর্মী কর্তৃক বিপক্ষীয় দলীয় নেতা ও কর্মীদের উপর নগ্ন হামলা ইত্যাদি অবাধে চলিতে থাকে। ১৬ই মার্চ পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্গত শাহীওয়াল রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষারত তেজগাম ট্রেনে ভ্রমণকালে মওলানা ভাসানীর উপর হামলা চালান হয়। ২৩শে মার্চ (১৯৬৯) ভােরবেলা ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ বাড়ীর নিকট হইতে আওয়ামী লীগ কর্মীবৃন্দ কর্তৃক জী, কন্যার চোখের সামনে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা মাহমুদ আলীকে জোরপূর্বক অপহরণ করিয়া ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ১৯ নং সড়কে অবস্থিত এক স্টুডিওতে আটক করা হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে কি বলিবে না, তাহাকে দিয়া। এক অংগীকারপত্রেও বলপূর্বক সহি করানাে হয়। এইসব ঘটনায় আমার মতাে আন্দোলনমুখী মানুষেরও স্নায়ুমন্ডলী ভীষণভাবে পীড়িত হইতে থাকে। বস্তুতঃ যে রাজনীতিবিদ তথা রাজনৈতিক দল পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা কখনাে তাহাদের লক্ষ্য হইতে পারে না; ক্ষমতাই হয় তাদের একমাত্র সর্বোচ্চ লক্ষ্য। তাহাদের নিকট দেশ ও জাতি গৌণ, ক্ষমতাই মুখ্য। ক্ষমতার জনাই তাহাদের আদর্শের বুলি; নীতি ও আদর্শের জন্য ক্ষমতা নয়। আইউবের পদত্যাগ। | এমনি উচ্ছংখল সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ সত্য জীবনযাপন অসম্ভব হইয়া উঠায় জেনারেল আইউব খান দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করিবার মনস্থ করেন। কিন্তু তদানীন্তন সেনাবাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খান তাঁহাকে স্পষ্ট ভাষায় জানান যে, সামরিক শাসন জারি করিতে হইলে,
তাহা করিবে সেনাবাহিনী। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এই বক্তব্যের প্রচ্ছন্ন ইংগিত কি, তা আইউব বুঝিতে পারিলেন। তাই জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা লিপ্সা মিটাইবার প্রয়ােজনে ক্ষমতা হস্তান্তরের অপরিহার্যতায় প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইউব খান ২৪শে মার্চ (১৯৬৯) তারিখে নিম্নলিখিত পত্রে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে রই পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করিবার অনুরোধ জানান।
President’s House, Rawalpindi, 24th March, 1969 My dear General Yahhya,
It is with profound regret that I have come to the conclusion that all civil administration & constituttional authority in the country have become ineffective. If the situation continues to deteriorate at the present alarming rate all economy, life, indeed the civilised existence will become impossible.
I am left with no option but to step aside & leave it to the Defence Forces of Pakistan which today represent the only effective & legal instrument to take full control of the affairs of this country. They are by the grace of God in a position to retrieve the situation and to save the country from utter chaos and total destruction. They alone can restore sanity and put the country back on the road to progress in a civil and constitutional manner.
Restoration and maintenance of full democracy according to the fundamental principles of our faith and the needs of our people must remain our ultimate goal. In that lies the salvation of our people who are blessed with the highest qualities of dedication and vision and who are destined to play a glorious role in the world.
It is most tragic that while we were well on our way to happy and prosperous future, we plunged into an abyss of senseless agitation. Whatever name may have been used to glorify it, the time will show that this turmoil was deliberately created by well tutored and well backed elements. They made it impossible for the government to maintain any semblance of law and order or to protect the civil liberities, life & property of the people.
Every single instrument of administration and every medium of expression of saner public opinion was subjected to inhuman pressure. Dedicated but defenceless government functionaries were subjected to ruthless public criticism or blackmail. The result is that social & cthical norms have been destroyed & instruments of Govt. have become inoperative & ineffective.
The economic life of the country has all but collapsed. Workers and labourers are being incited and urged to commit acts of lawlessness and brutality. While demands of higher wages, & amenities are being extracted under threat of violence, production is going down. There has been serious fall in cxports and I am afraid the country may soon find itself in the grip of serious inflation.
All this is the result of the reckless conduct of those who acting under the cover of a mass movement struck blow at the very roots of the country during the last few months. The pity is that a large number of innocent but gullible people become victims of their evil design.
I have served my people to the best of my ability under all circumstances. Mistakes there must have been but what has been achieved and accomplished is not negligible. There are some who would like to undo all that I have done and even that which was done by the government before me. But the most tragic &heartrending thought is that there are elements at work which would like to undo even what the Quaid-E-Azam had done namely the creation of Pakistan.
I have exhausted all possible civil and constitutional means to resolve the present crisis. I offered to meet all those regarded as the leaders of the people. Many of them came to a conference recently but only after I had fulfilled all their preconditions. Some declined to come for reasons best known to them. I asked these people to evolve an agreed formula. They failed to do so inspite of days of deliberations. They finally agreed on two points and I accepted both of them. I then offered that the unagreed issues should be referred to the representatives of the people after they had been elected on the basis of direct adult franchise. My argument was that the delegates in the conference who had not been elected by the people could not arrogate to themselves the authority to decide all civil and constitutional issues including those on which even they are not agreeing among themselves.
I thought I would call the National Assembly to consider the two agreed points but it soon becamc obvious that this would be an exercise in futility. The members of the Assembly are no longer free agents & there is no likelihood of the agreed two points faithfully adopted. Indeed members are being threatened & compelled either to boycott the session or to move such amendments as would liquidate the central government, make the maintenance of the Armed Forces impossible, divide the economy of the
country and break up Pakistan into little bits and pieces. Calling the Assembly in such chaotic conditions can only aggravate the situation. How can any one deliberate coolly and dispassionately on fundamental problems under threat of instant violence?
It is your legal and constitutional responsibility to defend the country not only against external agression but also to save it from internal disorder and chaos. The nation expects you to discharge this responsibility to preserve the security and integrity of the country and to restore normal social, economic and administrative life. Let peace and happiness be borught back to this anguished land of 120 million people. I believe you have the capacity, patriotism, dedication and imagination to deal with the formidable problems facing the country. You are the leader of a force which enjoys the respect and admiration of the whole world. Your colleagues in the Pakistan Air Force and in the Pakistan Navy-many are men of honour and know that you will always have their full support together the Armed Forces of Pakistan must save Pakistan from disintegration
I should be grateful if you would convey to every soldier, sailor & airman that I shall always be proud of having been associated with them as their supreme Commander.
They must know in this grave hour, they have to act as the custodians of Pakistan. Their conduct and actions must be inspired by the principles of Islam and by the conviction that they are serving the interests of their people.
It has been a great honour to have served the valiant and inspired people of Pakistan for so long a period. May God guide them to move towards greater prosperity and glory.
I must also record my great appreciation of your unswerving loyalty. I know that patriotism has been a constant source of inspiration for you all your life. I pray for your success and for the welfare and happiness of my people. Khuda Haliz.
Yours sincerly
Sd/-M. A. Khan General A. M. Yahya Khan H. Pk. HG. C-in-C Army General Head Quarters
(অনুবাদ)
প্রেসিডেন্ট ভবন | রাওয়ালপিন্ডি
২৪শে মার্চ, ১৯৬৯ প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,
গভীর বেদনার সাথে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, দেশে সমস্ত বেসামরিক প্রশাসন ও শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব কার্যকারিতা হারাইয়া ফেলিয়াছে। যদি বর্তমানের আশংকাজনক গতিতে অবস্থার অবনতি ঘটিতে থাকে তাহা হইলে সভাভাবে র্জীবন ধারণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে।
ক্ষমতা ত্যাগ করিয়া দেশরক্ষা বাহিনীর কাছে ক্ষমতা প্রত্যর্পণ করা ছাড়া আমার কোন বিকল্প নেই। বর্তমান সময়ে দেশের পূর্ণ কর্তৃত্ব গ্রহণের জন্য দেশরক্ষা বাহিনীই একমাত্র কার্যকর ও আইনানুগ প্রতিষ্ঠান। খােলা চাহেত অবস্থার পরিবর্তন সাধনপূর্বক পরিপূর্ণ বিশূলা ও ংসের হাত হইতে দেশকে রক্ষা করিবার ক্ষমতা তাহাদের রহিয়াছে। একমাত্র তাহারাই দেশে সুস্থতা ফিরাইয়া আনিতে পারে এবং বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশকে অগ্রগতির পথে ফিরাইয়া নিতে পারে। | আমাদের বিশ্বাসের মৌলিক নীতিমালা এবং আমাদের জনগণের প্রয়ােজন মােতাবেক পূর্ণ গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইহা বজায় রাখাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ইহার মধ্যেই আমাদের জনগণের মুক্তি নিহিত। আত্মোৎসর্গের শ্রেষ্ঠতম গুণাবলীসমৃদ্ধ আমাদের জনগণের পৃথিবীতে একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালনের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রহিয়াছে।
| ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, যখন আমরা সুখী ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হইতেছিলাম তখনই আমরা কান্ডজ্ঞানহীন বিক্ষোভের শিকারে পরিণত হই। ইহাকে গৌরবান্বিত করিবার জন্য যে নামই ব্যবহার করা হইয়া থাকুক না কেন, সময়ে প্রমাণিত হইবে যে, এই বিক্ষোভ ইচ্ছাকৃতভাবে সেই সমস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সৃষ্ট হইয়াছে যাহাদিগকে বিপুলভাবে প্রণােদিত করা হইয়াছে এবং মদদ যােগান হইয়াছে। আইন ও শৃঙ্খলার ন্যূনতম চিহ্ন বজায় রাখা কিংবা নাগরিক স্বাধীনতা এবং জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ তাহারা অসম্ভব করিয়া তুলিয়ছে। প্রশাসনের প্রতিটি অঙ্গ এবং সুস্থ জনমত প্রকাশের প্রতিটি মাধ্যমের উপর অমানবিক চাপ প্রয়ােগ করা হয়। ত্যাগী মনােভাবাপন্ন অথচ নিরাপত্তাহীন সরকারী প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণের ক্রুর সমালােচনা অথবা ব্ল্যাকমেইলের শিকারে পরিণত হয়। ফলে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবােধগুলি বিনষ্ট হইয়া পড়ে এবং সরকারী যন্ত্র কার্যকারিতা হাৱাইয়া ফেলে। দেশের অর্থনৈতিক জীবন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়া গিয়াছে। আইন-বহির্ভূত এবং নৃশংস কাজ করিবার জন্য কর্মচারী ও শ্রমিকদিগকে উত্তেজিত
করা হইতেছে। একদিকে সন্ত্রাসের হুমকির মুখে অধিক পারিশ্রমিক, বেতন ও সুযােগ সুবিধা আদায় করা হইতেছে অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাস পাইতেছে। রফতানী ক্ষেত্রে মারাত্মক অবনতি ঘটিয়াছে এবং আমার আশংকা অতিসত্বরই দেশ মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির কবলে নিপতিত হইবে।
এইসব হইতেছে ঐ সমস্ত ব্যক্তিদের নৈরাজ্যমূলক আচরণের ফল যাহারা গত কয়েক মাস ধরিয়া গণআন্দোলনের নামে দেশের ভিত্তিমূলে একটির পর একটি আঘাত হানিতেছে। দুঃখের বিষয়, বিপুল সংখ্যক নির্দোষ লােক এই অসৎ পরিকল্পনার শিকারে পরিণত হইয়াছে।
সকল অবস্থার মধ্যে আমি আমার ক্ষমতা অনুযায়ী দেশবাসীর খেদমত করিয়াছি। অবশ্য যথেষ্ট ভুলভ্রান্তি রহিয়াছে কিন্তু যাহা অর্জন করা হইয়াছে তাহাও নগণ্য নয়। এমন অনেকে আছেন যাহাৱা আমি যাহা করিয়াছি এমনকি পূর্বতন সরকার যাহা করিয়াছে তাহাকে ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে। কিন্তু সবচাইতে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক চিন্তা হইল যে, এমন অনেকে এখন ক্রিয়াশীল রহিয়াছে যাহারা কায়েলে আযমের অবদান অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টিকেও ব্যর্থ করিয়া দিতে চাহিবে।
বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য আমি সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক পন্থা প্রয়ােগ করিয়াছি। যাহারা জনগণের নেতা হিসাবে পরিচিত তাহাদের সহিত মিলিত হইবার প্রস্তাব দিয়াছি। সম্প্রতি তাহাদের অনেকে একটি কনফারেন্সে যোেগ দিয়াছিলেন তখনই যখন আমি তাহাদের সকল পূর্বশর্ত পূরণ করিয়াছিলাম। কয়েকজন উক্ত কনফারেন্সে যােগ দিতে অস্বীকার করিয়াছেন; এই অস্বীকৃতির কারণ তাহাদেরই ভাল জানা। একটি সর্বস্বীকৃত ফর্মুলা উদ্ভাবন করিবার জন্য আমি তাহাদিগকে বলিয়াছিলাম। কয়েকদিনের আলােচনা সত্ত্বেও তাহারা উহা করিতে পারেন নাই। শেষ পর্যন্ত তাহারা দুইটি বিষয়ে একমত হইয়াছিলেন এবং আমি ঐ দুইটি বিষয়ই গ্রহণ করিয়াছিলাম। ভারপরে আমি প্রস্তাব দিয়াছিলাম, যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য হয় নাই সেইগুলি প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে যখন জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হইয়া আসিবেন তখন তাহাদের বিবেচনার জন্য পেশ করা হইবে। আমার যুক্তি ছিল- এই কনফারেন্সে উপস্থিত প্রতিনিধিবৃন্দ যাহারা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন নাই তাহারা সকল বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক বিষয় ও নিজেদের মধ্যে যে সমস্ত বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই সেইগুলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দাবী করিতে পারেন না। | যে দুইটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিবেচনার জন্য জাতীয় পরিষদ আহবান করিবার কথা আমি চিন্তা করিয়াছিলাম কিন্তু ইহা স্পষ্ট হইয়া উঠিল যে, ইহা নিরর্থক প্রচেষ্টা। পরিষদের সদস্যরা আর স্বাধীন প্রতিনিধি নন এবং যে দুইটি বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেইগুলি বিশ্বস্ততার সহিত গৃহীত হয় এমন কোন সম্ভাবনা নাই। প্রকৃতপক্ষে পরিষদ সদস্যদেরকে এই মর্মে হুমকি প্রদানেও বাধ্য করা
হইতেছে যাহাতে হারা হয় অধিবেশন বয়কট করেন অথবা এমন সংশােধনী প্রস্তাব আনয়ন করেন যাহাতে কেন্দ্রীয় সরকার বিলুপ্ত হইয়া যায়, সশস্ত্র বাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ অসম্ভব হইয়া পড়ে, দেশের অর্থনীতি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া পড়ে এবং পাকিস্তানি ছােট ছােট খন্ডে বিভক্ত হইয়া পড়ে। এমন একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিষদ আহবান করিবার অর্থই হইতেছে পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করিয়া তােলা।
শুধু বিদেশী আগ্রাসনই নয় বরং অভ্যন্তরীণ গােলযােগ ও বিশৃঙ্খলা হইতে দেশকে রক্ষা করিবার আইনগত ও শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব আপনার। জাতি আশা করে, দেশের নিরাপত্তা ও অখন্ডতা বজায় রাখা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপনি এই দায়িত্ব পালন করিবেন। ১২ কোটি মানুষের এই বিক্ষুব্ধ দেশে শান্তি ও সুখ ফিরিয়া আসুক। আমি বিশ্বাস করি, দেশের বর্তমান কঠিন সমস্যা মােকাবেলা করিবার মতাে ক্ষমতা, দেশপ্রেম, ত্যাগী মনােভাব ও প্রজ্ঞা আপনার রহিয়াছে। আপনি এমন এক বাহিনীর নেত্ত যার সমগ্র বিয়ে সম্মান রহিয়াছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর আপনার সহকর্মীদের অনেকেই সম্মানিত ব্যক্তি এবং আমি জানি, আপনি সর্ব সময়েই তাঁহাদের সমর্থন পাইবেন। পাকিস্তান সস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই বিচ্ছিন্নতার হাত হইতে পাকিস্তানকে রক্ষা করিতে
| প্রতিটি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকের নিকট আপনি এই কথা পৌছাইয়া দিবেন যে, তাহাদের সুপ্রীম কমান্ডার হিসাবে তাহাদের সহিত সম্পর্কিত হওয়াতে আমি গর্বিত। সেই জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব। | তাহাদের জানা উচিত, বর্তমান সংকটাপন্ন মুহূর্তে তাহাদিগকে পাকিস্তানের রক্ষক হিসাবে কাজ করিতে হইবে। তাহাদের আচরণ ও কাজ ইসলামের নীতিমালা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার মনােবৃত্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত হইতে হইবে। দীর্ঘকাল ধরিয়া পাকিস্তানের সাহসী ও অনুপ্রাণিত জনগণের খেদমত করিতে পারিয়া আমি পরম সম্মানিত বােধ করিতেছি। আল্লাহ জাহাদিগকে অধিকতর অগ্রগতি ও গৌরবের পথে পরিচালিত করুন।
আপনার দ্বিধাহীন আনুগত্যের কথাও আমি পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করিতেছি। আমি জানি, আপনার সমগ্র জীবনে দেশপ্রেমই হইতেছে সর্বময় প্রেরণার উৎস। আমি আপনার সাফল্য এবং আমার দেশবাসীর কল্যাণ ও সুখের জন্য দোয়া করি। খােসা হাফেজ।
আপনার বিশ্বস্ত স্বা- এম, এ খান
ইয়াহিয়ার আগমন
ফিল্ড মার্শাল আইউব খানের পত্র প্রাপ্তির পর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া
খান ২৫শে মার্চ (১৯৬৯) সন্ধ্যা ৭-১৫ মিনিটে সমগ্র দেশে সামরিক আইন জারি করেন; সংবিধান বাতিল করেন, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ বিলুপ্ত ঘােষণা করেন, গভর্নর ও মন্ত্রীদের স্ব-স্ব পদ হইতে অপসারণ করেন এবং সমগ্র দেশকে দুইটি সামরিক আইন অঞ্চলে বিভক্ত করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানকে মার্শাল ল’ জোন ‘এ’ ও পূর্ব পাকিস্তানকে মার্শাল ল’ জোন ‘বি’ করা হয়। লেঃ জেঃ আতিকুর রহমান ও মেজর জেনারেল মােজাফফর উদ্দিনকে যথাক্রমে জোন ‘এ’ ও জোন ‘বি’-এর সামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। | জেনারেল ইয়াহিয়া ২৬শে মার্চ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে, দেশবাসীকে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিবর্গ কর্তৃক সংবিধান প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। | স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠ, ফিল্ড মার্শাল আইউব খান ইস্তফা দিলেন কেন এবং সাংবিধানিক পথে বেসামরিক সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরিত করিলেন না কেন? আমার স্পষ্ট মত, প্রেসিডেন্ট আইউব খানের ক্ষমতার মূল উৎস (পাওয়ার বেস) ছিল সেনাবাহিনীর ছাউনী, জনতা নয়। অতএব উচ্চাভিলাষী সামরিক জেনারেলরা রাত্রীয় ক্ষমতা সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিদের নিকট হস্তান্তরের ঘাের বিরােধী ছিলেন। ক্ষমতাপিপাসু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীদের প্রচন্ড চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট আইউব খানকে ক্ষমতা ত্যাগ করিতে হয়; এবং সামরিক জান্তার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হয়। আমার আরও অভিমত, আইউবের ক্ষমতা হস্তান্তরের পশ্চাতে নিয়লিখিত কার্যকারণসমূহ সক্রিয় ছিল। যথা| (১) জাতীয়, আন্তর্জাতিক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী বশংবদ, (২) ক্ষমতাভিলাসী সামরিক-বেসামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারী, (৩) বিদেশী অর্থপুষ্ট ক্ষমতাপিপাসু রাজনীতিবিদ, (৪) পরস্পর বিবাদমান ক্ষমতাপিপাসু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং (৫) দিল্লীচক্রের বশংবদ ও অখণ্ড ভারত সমর্থকবৃন্দের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ। উহারাই প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে প্রভুত্বব্যঞ্জক আইউব সরকারের জুলুম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশবাসীর পুঞ্জীভূত রােষের পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করিয়া সমগ্র দেশে অরাজকতার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। প্রেসিডেন্ট আইউব খান যুক্তি শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্রতী না হইয়া যদি জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সংসদ ও সরকার গঠনে প্রয়াসী হইতেন, তাহা হইলে ঘটনাপ্রবাহ নিঃসন্দেহে ভিন্ন হইতে পারিত। অন্ততঃ লেলিহান অগ্নিশিখায় দেশ ও জাতিকে নিক্ষেপ করিয়া অকস্মাৎ তাহাকে বিদায় নিতে হইত না, যেই লেলিহান শিখায় পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া গেল, সেই লেলিহান শিখায় দেশ ও জাতিকে তেমনি মর্মান্তিক পরিণতির সম্মুখীন হইতে হইত না।
৩১শে মার্চ প্রক্লামেশন (ঘঘাষণা) অনুযায়ী প্রধান সামরিক আইন শাসনকর্তা জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা ৭-১৫ মিঃ হইতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যতটুকু মনে পড়ে, জেনারেল
লাহাের আলােচনা অসমাপ্ত রহিল। ১১ই মে লহরি হইতে আমরা পেশােয়ার গমন করি। পেশোয়ারে জনাব আতাউর রহমান খান ও এয়ার মার্শাল আসগর খানের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বৈঠক হয়। বৈঠকে জনাব নূরুল আমিন ও অন্যান্যের সহিত রাজনৈতিক একাত্মতা গড়িয়া তুলিবার জন্য এয়ার মার্শাল প্রস্তাব দেন। | পেশােয়ারে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সর্দার আবদুর রশিদ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নেতা খান আবদুল ওয়ালী খানের সহিতও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মত-বিনিময় হয়।
পেশােয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিওলজীর প্রফেসর ডঃ আহমদ হাসান দানী আমাদের সহিত আলােচনাকালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভৌগােলিক অবস্থান ও বিচ্ছিন্নতা বনাম রাত্রীয় সংহতির আলােকপাত করিতে গিয়া মন্তব্য করেন যে, ইতিহাসের গতিতে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত দুইটি সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র পরিণত হইবে।
সীমান্ত নেতা খান আবদুল ওয়ালী খানের সহিত বৈঠকেও ইহার একটি চমক্কার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই যে, যেমন পাঞ্জাব কুচক্রী মহলের স্বার্থে একদিন চারটি প্রদেশের বিলুপ্তি ঘটাইয়া এক ইউনিট অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ গঠন করা হইয়াছিল, ঠিক তেমনি কোন কোন স্বার্থান্বেষী মহল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করিবার প্রয়াসে দলিল তৈরী করিতেছে। ১৩ই মে পেশােয়ার হইতে রাওয়ালপিন্ডি পেীছি। রাওয়ালপিন্ডিতে নওয়া-ই-ওয়াকত সস্পাদক হামিদ আখতারের সহিত মতবিনিময় হয়। জাস্টিস পার্টি সদস্য অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার রাজা সকল রাজনৈতিক আলাপআলােচনার ইন্তেজাম করেন। তিনি বড় অতিথিপরায়ণ, বয়স আট, কিন্তু অত্যন্ত কর্মঠ।
| ১৪ই মে, সন্ধ্যা ৭-৩০ মিঃ পুনরায় লাহাের এবং ১৫ই মে লাহোর হইতে বিমানে করাচী পেীছি। ১৫ই হইতে ২০শে মে অবধি আমরা করাচী অবস্থান করি এবং করাচীতে আমরা জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তনয়া মিসেস আখতার সােলায়মান; পাকিস্তান মুসলিম লীগ নেতা হাসান এ শেখ, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ আলী শাহ, ‘জিয়ে-সিন্দ’ আন্দোলনের নেতা ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান জিএম সৈয়দ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহিত মত-বিনিময় করি। ১৭ই মে আমরা সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী হায়দরাবাদ সফরে যাই এবং জনাব কেবি জাফরের আতিথা গ্রহণ করি।
২০শে মে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহিত জনাব আতাউর রহমান খান ও আমার তিন ঘন্টাব্যাপী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক বিষয়ে আলাপআলােচনা হয়। দুই অর্থনীতি, সমাজতন্ত্র, দেশ রক্ষানীতি, এক ইউনিট বাতিল ও করাচী। ফেডারেল এলাকা ঘােষণা প্রশ্নে আমাদের মধ্যে মােটামুটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
আলােচনা প্রসঙ্গে জনাব ভুট্টো হইতে আমরা অবহিত হই যে, ১৯৬৯ সালের ১০ই মার্চ পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর
সহিত তাহার নিম্নোক্ত ত্রি-বিষয়ে সমঝােতা হইয়াছে ;
১) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের স্বীকৃত দাবীর ভিত্তিতে জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা; ২) পাকিস্তানের আদর্শের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া সমাজতন্ত্র কায়েম এবং ৩) সর্বপ্রকার বিদেশী স্বার্থ বিলুপ্তি, সর্বপ্রকার উপনিবেশবাদ, নয়া
উপনিবেশবাদের বিরােধিতা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা, কেন্দ্রীয় চুক্তি
সংস্থা ও সকল সামরিক চুক্তি হইতে সদস্যপদ প্রত্যাহার। আলােচনায় ইহাও জানিতে পারি যে, মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কার্যকলাপের সহিত একমত হইতে না পারায় জনাব ভুট্টো উপরে বর্ণিত সমঝােতা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানীর সহিত দূরত্ব বজায় রাখিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন।
করাচীতে প্রবাসী বাঙ্গালীদের সহিত আলােচনার জন্য আমি করাটীর ড্রিগ রােডে গমন করি। বাঙ্গালী প্রবাসীদের ধারণায় শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দেলনে আমাদের শরীক হওয়া উচিত, ইহার অন্যথা করিবার অর্থ বাঙ্গালী স্বার্থে আঘাত হানা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী কুচক্রী শাসক-শােষকের হাত প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে জোরদার ।
পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানাসীর একটি মাত্র প্রশ্ন, পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব ও সংহতি, বজায় থাকিবে কি থাকিবে না। অখণ্ডত্ব ও সংহতি বজায় রাখিবার খাতিরে তাহারা প্রচলিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের ঘাের বিরােধী; অর্থাৎ শশাষণ-শাসনের যন্ত্র অবিকল থাকিবে। অন্য কথায় সমগ্র দেশের অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারীদের যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হইয়াছে, সেই বাস্তব সত্যকে অম্লানবদনে স্বীকৃতি দিয়া সমস্যা-সংকট নিরসনের জন্য কুসংস্কার বর্জিত বদ্ধমূল ধারণামুক্ত জ্ঞানালােকসম্পন্ন উক্ত চিন্তা প্রণােদিত প্রজ্ঞা প্রদর্শনে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদরা পুরাপুরিভাবেই ব্যর্থ হইয়াছেন। ইহাই আমার তিক্ত ও দৃঢ় মত । বক্তঃ একই ভিটায় সমঝােতার সহিত দুই ভাইয়ের সহঅবস্থানের উচ্চ মন ও হৃদয় পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের ছিল না।
পশ্চিম পাকিস্তানে সমগ্র সফরই জাস্টিস পার্টির নেতৃবৃন্দ ও কর্মীবৃন্দের সতর্ক ও আন্তরিক তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। করাচী জাস্টিস পার্টির চেয়ারম্যান মিসেস সাদী জমিরের আন্তরিকতা, অতিথিপরায়ণতা ও সেবা আমাদিগকে অত্যন্ত মুগ্ধ করে। করাচীতে যেমনি দলীয় মহলে ছেমনি করাচীবাসীর মধ্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন।
এরপর এয়ার মার্শাল আসগর খানের নেতৃত্বে জাস্টিস পার্টির একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আগমন করেন। হােটেল শাহবাগে অবস্থান করেন, প্রাথমিক আলােচনার জন্য জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে জনাব নূরুর রহমান, ইকবাল আনসারী খান, ফেরদৌস আহমদ কোরেশী, আনিসুর রহমান ও আমি হােটেল শাহবাগে উক্ত প্রতিনিধি দলের সহিত বৈঠকে বসি। তাহাদের সম্মানে ১৬ই জুন হোটেল পূর্বাণীতে জনাব
আতাউর রহমান খান এক নৈশভােজের আয়ােজন করেন। দুই নেতা এয়ার মার্শাল আসগর খান ও আতাউর রহমান খান আমাদিগকে অর্থাৎ সর্বজনাব মোখলেছুজ্জামান খান, নূরুর রহমান ও আমি (পূর্ব পাকিস্তান) এবং আবু সৈয়দ আনােয়ার ও মঞ্জুর বশীর (পশ্চিম পাকিস্তান)কে আলােচনার জন্য মনােনীত করেন। তদানুযায়ী আমরা ২০শে জুন জনাব মােখলেছুজ্জামান খানের বাসভবনে মিলিত হই এবং জনাব আতাউর রহমান খানের সাত দফা ও our approach to Pakistan’s political problem৪-এ আমাদের লিখিত বক্তব্য পুংখানুপুংখপে আলােচনা করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের সেই আলােচনা ফলপ্রসূ হয় নাই। পক্ষান্তরে আসগর খানের সহিত পি.ডি.এম নেতৃবৃন্দের মতৈক্য প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তাহারা সম্মিলিতভাবে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত কনভেনশনে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি গঠিত হয়। অবশ্য রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ আসগর খান কনভেনশনের অব্যবহিত পরে নব গঠিত পি,ডি,পি হইতে পদত্যাগ করেন এবং এককভাবে পাকিস্তান ছাহরিকএ-ইসতেকলাল টি গঠন করেন। | দুখজনক হইলেও ইহা স্বীকার করিতে হয় যে, ভারত হইতে আগত অবাঙ্গালী মােকাজের শ্রেণী স্থানীয় বাসিন্দাদের সহিত একাত্ম হইতে পারে নাই। ফলে স্থানীয়দের সহিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাহাদের তিক্ততা এত বৃদ্ধি পায় যে, অবশেষে ঢাকায় বাংলা ভাষাভাখী ও উর্দু ভাষাভাষীদের মধ্যে দাদা বাঁধে। রক্তাক্ত দাঙ্গা বন্ধ করিবার মানসে আমরা, তাজউদ্দিন আহমদ • (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ), খন্দকার মােশতাক আহমদ (সহসভাপতি, ঐ), মােজাফফর আহমদ (সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি), সৈয়দ আলতাফ হােসেন (সাধারণ সম্পাদক, ঐ), পীর হাবিবুর রহমান (ঐ, ন্যাপ), নূরুর রহমান (ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগ) ও আমি (ঐ), জনাব আতাউর রহমান খানের বাসভবনে ৩রা নভেম্বর এক সভায় মিলিত হই। সভা হইতে আমরা গভর্নমেন্ট হাউসে গমন করি এবং প্রাদেশিক গভর্নর রিয়ার এডমিরাল আহসানকে শাস্তি বজায় রাখিবার জন্য প্রাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে অনুরােধ জানাই।
উল্লেখ্য যে, এই বাঙ্গালী অবাঙ্গালী দাঙ্গার পিছনে ইন্ধন যােগাইয়াছিল সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষ করিয়া আওয়ামী লীগের একটি অতি উৎসাহী অবিবেচক অংশের রাজনীতি। তখনকার দিনে একমাত্র আওয়ামী লীগই বাঙ্গালী জনতার ব্যাপক আস্থাভাজন ছিল এবং আওয়ামী লীগের পিছনে বাঙ্গালী জনতার সার্বজনীন সমর্থনের মূলেও ছিল এই অবাঙ্গালী বিদ্বেষ ও তুলসম্পর্কে সর্বগ্রাসী প্রচারণা। ইয়াহিয়া-মুজিব আঁতাত।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত আঁতাতের ফলে ৩০শে মার্চ ঘােধিত আইনগত কাঠামাে আদেশের বিরুদ্ধে
কোন প্রকার সক্রিয় আন্দোলন সম্ভব হয় নাই। পক্ষান্তরে এই আঁতাতের দরুন সরকারও ৬ দফাভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারণায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা অবলম্বন
করিয়া স্বীয় ঘােষিত আইনগত কাঠামাে আদেশের পরিপন্থী কাজ করিতে দ্বিধা করেন নাই। বস্তুতঃ এই ব্যাপারে সরকার স্পষ্টতঃ দ্বিমুখী নীতিই অনুসরণ করিয়াছিলেন। হয়তাে এইভাবেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান উক্ত ছককাটা রাজপথে শেখ সাহেবের সহিত ক্ষমতা ভাগাভাগি করিবার ও ভােগ করিবারই চিন্তা করিয়াছিলেন। কেননা ইহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগের ৬ দফা’ ও আইনগত কাঠামাে আদেশ ছিল পরস্পর পরিপন্থী।
ন্যাশনাল প্রােগ্রেসিভ লীগ।
ন্যাশনাল প্রােগ্রেসিভ লীগ নূতন সংগঠন। সর্বস্তরে পরিচিত নয় বিধায় এই সংগঠনের মাধ্যমে একক আন্দোলন করা সম্ভব ছিল না। তাই আমি পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মওলানা ভাসানীর সহিত ২০শে এপ্রিল (১৯৭০) ঢাকায় সাক্ষাৎ করি । আলােচনার পর তিনি কয়েকদিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাইবার অভিমত প্রকাশ করেন; কিন্তু সেই চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাইবার প্রয়ােজন বাকী জীবনে বােধ করেন নাই। আমাদের অনেক নেতারই মুখ ও পেটের মধ্যে এই ধরনের গরমিল বলিয়াই কি দেশ কি জাতি পুনঃপুনঃ জুলুমের শিকার হইয়াছে; এবং দেশ ও জাতির অমানিশা বা দুঃখ রজনী কখনও কাটে নাই। এই সময়ে খুলনার খালিশপুর শিল্প এলাকার শ্রমিকদের জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা জনাব আশরাফ হােসেন ও জনাব আবদুল বাতেনকে গ্রেফতার করিয়া খুলনা জেলা কারাগারে আটক করিলে মজদুর ফেডারেশনের খুলনা আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে হাজার হাজার শ্রমিক খুলনা জেলা কারাগার ঘেরাও করে। ঘেরাও ২৩ ঘন্টা অতিক্রম করিবার পর পরিস্থিতি হঠাৎ মােড় নেয় এবং ৩১শে মে ভাের রাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও শ্রমিকদের মধ্যে অপ্রীতিকর সংঘর্ষ হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে বহু শ্রমিক আহত হয়। উদ্ভুত তিক্ত পরিস্থিতি সরেজমিনে তদন্তের জন্য আমি খুলনা গমন করি। যাহা হউক, আমার উপস্থিতি শান্তরূপ ধারণে সহায়ক হয়। বেসামরিক জেলা কর্তৃপক্ষ অনেকটা নমনীয় মনােভাব গ্রহণ করিলেও সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ব্রিগেডিয়ার সাহেব জানান যে, একমাত্র সামরিক আইন প্রশাসকই সামরিক বিধি মামলা প্রত্যাহার করিতে পারেন। শ্রমিক এলাকায় শান্ত আবহাওয়া সৃষ্টির প্রয়াসেই আমরা সামরিক, বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে গ্রেফতারী পরোয়ানা প্রত্যাহার করিয়া নিউজপ্রিন্ট পেপার মিলস যথারীতি চলুি করিতে অনুরােধ করি।
সামরিক শাসনের আওতায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পটভূমিকায় ১লা ও ২রা আগস্ট (১৯৭০) ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগের জাতীয় মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন দলীয় ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র অনুমােদন করে। ন্যাশনাল প্রোগ্রেসিভ লীগের
নাম পরিবর্তন করিয়া ন্যাশনাল লীগ রাখা হয়। জনাব আতাউর রহমান খান ও শাহ আজিজুর রহমান যথাক্রমে পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং জনাব আতাউর রহমান ও আমি যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হই। কিন্তু ২রা আগস্ট বৈকালিক সমাপ্তি অধিবেশনে জনাব আতাউর রহমান খান কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই দলীয় কর্মকর্তাদের নাম প্রস্তাব। করিলে সাধারণ কাউন্সিল অধিবেশনে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। প্রস্তাব সমর্থনের প্রয়ােজনীয়তা উপেক্ষা করিয়াই জনাব আতাউর রহমান খান তাহার গঠিত কর্মকর্তা তালিকা গৃহীত ঘােষণা করিয়া মঞ্চ হইতে অবতরণ করেন ও প্রস্থান করেন। একটু ধৈর্ব, একটু সহনশীলতা, একটু নমনীয়তা, একটু বিচক্ষণতা ও একটু প্রজ্ঞা প্রদর্শন করিলেই সমস্যার মীমাংসা তৎক্ষণাৎ হইয়া যাইত। উত্তরকালে সংগঠনটি ছিন্নভিন্ন হইত না, দ্বিধাবিভক্ত হইত না, সংগঠনে তিক্ততা ও কোন্দল দেখা দিত না এবং দেশ অতি প্রয়ােজনীয় পরি রাজনীতির নেতৃত্ব পাইতে পারিত। নেতারা তাহা করিবেন কেন? সবাই আপন আপন স্তরে এক একজন ক্ষুদে হিটলার যে। আমরা বাঙ্গালী, পরশ্রীকাতরতা আমাদের বাঙ্গালী চরিত্রের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ, আমরা সর্বদাই ব্যক্তি নেতৃত্ব, ব্যক্তি প্রাধান্য ও ব্যক্তি পূজার আকাকী, তাই ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোন্দলই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই নীতি ও আদর্শপ্রসূত কার্যক্রমের অবস্থান বহুক্রোশ দূরে। নীতি-আদর্শের পার্থক্য মত ও পার্থক্য সৃষ্টি করে এবং ইহাই স্বাভাবিক। কেতাৰে, বাক্যে, বুলিতে আমাদের মুখে নীতি আদর্শের খই ফোটে; কিন্তু ব্যক্তি জীবনে যেমন, গােষ্ঠী জীবনেও তেমনি ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ একমাত্র লক্ষ্য হইয়া থাকে। ইহা দুঃখজনক কিন্তু নির্মম সত্য। বাংলা মজলুর ফেডারেশনের ভূমিকা। | ১৯৬৪ সালে জনাব এ, আর, সুন্যামত ও দেওয়ান সিরাজুল হককে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, জনাব আশরাফ হােসেন, রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও এজাজ আহম্মদকে সহ-সম্পাদক এবং আনিসুর রহমানকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে পাকিস্তান। মজনুর ফেডারেশন ইস্ট জোন পঠন করা হয়। এই সংগঠনটি প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এই সংগঠনের নেতা জনাব আশরাফ হােসেন ও আনিসুর রহমানের নেতৃত্বে খুলনীয়, আবদুল বাতেন-এর নেতৃত্বে মংলা পপাটে, আমিনুর রহমান (মল্লিক), গােলাম মােস্তফা (বাটুল), রেজাউল হক সরকার (নার) নেতৃত্বে উত্তরবঙ্গে, জনাব রুহুল আমিন ভূইয়া, আনসার হােসেন (ভানু) নেতৃত্বে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে, আঃ জলিলের নেতৃত্বে ডেমরা শিল্পাঞ্চলে, দেওয়ান সিরাজুল হক, ফজলুর রহমান খাঁ, মােঃ সেলিম হােসেন, আলী আকবর, আজিজুল হক মুক্তর নেতৃত্বে সড়ক পরিবহন শিল্পে গভর্নর মােনায়েম খানের বাড়ী ঘেরাওসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় নেতৃবৃন্দের মুক্তি আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ৭ই জুনের আন্দোলন, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন, জঙ্গী রূপ ধারণ করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে এই সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ত্যাগ অপরিসীম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রশ্নে জাতীয় লীগ দ্বিধা-বিভক্ত হলে এই সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের আগ্রহে কুমিল্লা টাউন হলে জাতীয় লীগের সম্মেলনে বাংলা জাতীয় লীগ’ নামকরণ করা হয়। বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলা মজদুর ফেডারেশন ও ফরােয়ার্ড স্টুডেন্ট ব্লক সমন্বয়ে বাংলা মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করে। মুক্তি ফ্রন্টের অনেক ইপিআরটিসির অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর লােকেরা অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সরকারের আহ্বানে সামরিক বাহিনীতে পুনরায় যােগদান করে। ২৫শে মার্চের রাত্রে ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে ১৮ জন জোয়ান প্রাণ হারায়। কুমিল্লা মুক্তি ফ্রন্টের কর্মী শিব নারায়ণ দাসের তৈরি পতাকা ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রথম কুমিল্লা ইপিআরটিসির ডিপাের সামনে আবদুস সালাম, আবদুর রশিদ, আলী আজগর ও শিবনারায়ণ দাসের নেতৃত্বে উত্তোলন করে। যাহা পরবর্তীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকার পল্টন ময়দানে আ,স,ম, আবদুর রব-এর নেতৃত্বে উত্তোলিত হয়। কুমিল্লা মুক্তি ফ্রন্টের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের জানুয়ারীর তৃতীয় সপ্তাহ থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া ডিগ্রী কলেজের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন হাবিলদার জনাব আবদুস সালামের নেতৃত্বে ইউটিসির রাইফেল দ্বারা মুক্তি পাগল ছাত্র শ্রমিক যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যার ফলে ২৫শে মার্চ কাল রাত্রে ঢাকার সাথে একই সঙ্গে কুমিল্লা ইপিআরটিসি বর্তমান বিআরটিসি ডিপােতে ভিক্টোরিয়া কলেজ ডিগ্রি হােস্টেল, মজদুর ফেডারেশন অাঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আবদুর রশিদ এর বাসায় পাক বাহিনী হামলা করে।
এই আবদুস সালাম-এর নেতৃত্বে পলায়নরত কুমিল্লার রাজনৈতিক ছাত্র-শ্রমিক ও জনগণের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের বক্স নগর ক্যাম্পের কার্যক্রম শুরু হয়। এর প্রাথমিক অর্থ যােগান দিয়াছিল কুমিল্লা ইপিআরটিসি’র শ্রমিকরা এবং ইপিআরটিসির ডিপোতে রক্ষিত শ্রমিকদের সব পােষাক ক্যাম্পে নেওয়া হয়। সেই পােষাকের অনুকরণে পরবর্তীতে মুক্তি যােদ্ধাদের জলপাই রংয়ের পোষাক তৈরী করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ভারতীয় সৈন্যদের লুটপাটে প্রথম বাধা দিয়াছিল খুলনার মজদুর ফেডারেশনের নেতা আশরাফ হােসেনসহ মুক্তি যুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল ও মেজর জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে যাহা দেশবাসীর স্মরণ থাকা দরকার। | দেশ স্বাধীন হবার পর অশালীদের বাড়ী, পাড়ী ও কল-কারখানা দখলের হিড়িক পরে যায়। অন্যদিকে মজদুর ফেডারেশনের উদ্যোগে প্রথম শহীদ স্মরণী ট্রাই’ গঠন করা হয়। যাহাতে মজদুর ফেডারেশনের নেতৃত্বে শ্রমিক সংগঠনগুলি অবাঙ্গালীদের সম্পদ এনে জড় করে। পরবর্তীতে সরকার মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করে বলেছিল, যে অবাঙ্গালীদের সকল সম্পদ মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে আনা হবে। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় শহীদ স্মরণী ট্রাস্টের সম্পদ মুক্তিযােদ্ধা ট্রাস্টে নেওয়া হলেও আওয়ামী নেতাদের দখলকৃত সম্পদ ব্যক্তি নামেই রয়ে গেল।
অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার পর বুক ভরা আশা নিয়ে জাতি যাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের
দায়িত্ব দিয়াছিল। তাদের প্রণীত সংবিধানে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করণ, লাল বাহিনী গঠন, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণসহ বাকশাল গঠনের প্রতিবাদ করেছিল। মজদুর ফেডারেশন, যার ফলে শেখ মজিবুর রহমান সরকারের সন্ত্রাসীরা ফেডারেশনের ১০৮ বিসিসি রােডের অফিস জোরপূর্বক দখল করে ও দেওয়ান সিরাজুল হক সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বলে প্রায় ২ শতাধিক ইপিআরটিসির শ্রমিক-কর্মচারীকে চাকুরী চ্যুত করে। ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে শতাধিক চটকল শ্রমিক ইউনিয়ন ধর্মঘট করে। উক্ত ধর্মঘটের সমর্থনে বাংলা মজদুর ফেডারেশন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, জাতীয় শ্রমিক জোট ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে সভা আহবান করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় মজদুর ফেডারেশন নেতা দেওয়ান সিরাজুল হকের গ্রেফতারের সংবাদে নেতৃবৃন্দগণ সভায় উপস্থিত না হয়ে বাকশালে যােগদানের প্রতিযােগিতায় নেমে পরে। দেওয়ান সিরাজুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দরা ‘৭৫-এর শেষ ভাগে মুক্তি লাভ করে। নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড়
যাহা হউক, আগষ্ট মাসে বন্যা দেখা দেওয়ায় নির্বাচন তারিখ পিছাইয়া দেওয়া হয়। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন তারিখ ৫ই ও ২২শে অক্টোবরের স্থলে যথাক্রমে ৭ই ডিসেম্বর ও ১৭ই ডিসেম্বর পুনঃনির্ধারিত হয়। আমরা সর্বপ্রকার তিক্ততা ভুলিয়া গিয়া সংগঠন ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অবর্তীর্ণ হই। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিবাত্যা ও জলােচ্ছ্বাসে হাতিয়া, সন্দ্বীপ, ভোলা ইত্যাদি সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় ২০ লক্ষ অধিবাসীর প্রাণহানি ঘটে এবং অজস্র গবাদি পশু, ঘরবাড়ী, আসবাবপত্র, জমি-জিরাতের হানি হয়। ইতিপূর্বে ১৮৭৬-এর নভেম্বর মাসের মহাবিংসী ঘূর্ণিবাত্যা ও জলােচ্ছাসে সমুদ্র উপকূলবর্তী ২ লক্ষ লােকের প্রাণহানি ঘটিয়াছিল। মহাচীন প্রজাতন্ত্র সফরান্তে রাওয়ালপিন্ডির পথে ঢাকা আগমন করিলেও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাতাবি এলাকা পরিদর্শন হইতে বিরত থাকেন। এবং গান এস,এম আহসানকে কতিপয় উপদেশ দিয়া রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে ঢাকা ত্যাগ করেন। ইহাতে বাঙ্গালী মন আরও তিক্ত ও বিষাক্ত হইয়া পড়ে। আওয়ামী লীগ সুচতুরভাবে ইহাকেই নির্বাচনী প্রচারণায় অত্যন্ত দক্ষতা ও কার্যকারিতার সহিত ব্যবহার করে। উল্লেখ্য যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দলই সমন্বরে নির্বাচন পিছাইবার আওয়াজ তুলিয়াছিল। কারণ, অবশ্যই বাতাবি হতভাগ্য মানব সন্তানদের প্রতি দরদ ছিল না। নির্বাচনী হালে পানি পাওয়ার ব্যাপারটাই ছিল প্রকৃত কিন্তু অব্যক্ত কারণ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ভীত সন্ত্রস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ২৩শে নভেম্বর ঢাকায় পল্টন ময়দানের আহূত জনসভায় মওলানা ভাসানী ‘স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ প্রকাশ্যে উত্থাপন করেন। বলাই বাহুল্য যে, ১৯৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক আহূত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের গােল টেবিল বৈঠকের ব্যর্থতার পর পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর হৃদয়ে শেখ মুজিবের সার্বজনীন শ্রদ্ধা, আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন এবং একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দরুন অনেকটা বেকায়দায় পতিত হইয়াই ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা হাসিলের উদ্দেশেই মওলানা ভাসানী আশ্বিকভাবে এই স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তানের দাবী তুলিয়াছিলেন অথচ এই মওলানা ভাসানীই ১৯৬২ সালের কারামুক্তির পর এক ব্যক্তির শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করিয়া পাক-চীন সম্পর্কোন্নয়নের একদিক যে অন্ধ চিন্তায় প্রেসিডেন্ট আইউব খান সরকারের পিছনে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সমর্থন যােগাইয়া গিয়াছে। আইউবের পতনের পর ইহা তাহার নয়া মূর্তি। এইদিকে তিনিই ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে খুলনায় অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কাউন্সিল অধিবেশনে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন না পিছাইলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া রাখিয়াছিলেন। ১২ই নভেম্বর (১৯৭০) উপকূল এলাকায় ও দ্বীপাঞ্চলে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার অজুহাতে নির্বাচন বানচাল বা স্থগিত রাখিবার উদ্দেশ্যে যাহারা সােচ্চার ছিলেন সেইসব নেতা যথা পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের ডেপুটি লীডার শাহ আজিজুর রহমান, পূর্ব পাক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-এর সভাপতি পীর মােহসীন উদ্দিন আহমদ, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রাক্তন সদস্য এ.এস.এম সােলায়মান, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও ১৯৬২-৬৫ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের ডেপুটি লীডার মশিউর রহমান ও আরাে অনেকে সাধারণ ভােটদাতাদের নিকট যথার্থই হালে পানি পাইতেছিলেন না। তাহারা ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের নামে ভিরমীও বাইতেন। মওলানাকে কেন্দ্র করিয়া তাহারাই হঠাৎ বিপ্লবী ভূমিকায় অবতীর্ণ হইলেন। তাহারাই মওলানা ভাসানীর স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান দাবীর ছত্রছায়ায় সন্তা বাজীমাত করিবার উন্মাদনায় মওলানা ভাসানী কর্তৃক আহূত ২৩শে নভেম্বর (১৯৭০), ৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৭০) ও ১০ই জানুয়ারী পল্টন জনসভায় ও ৯ই জানুয়ারী (১৯৭১) সন্তোষ জাতীয় সম্মেলনের আসর জমাইয়াছিলেন। যখন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়, তখন পূর্ব পাক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সাধারণ সম্পাদক জনাব মশিউর রহমান ভারত ভূমিতে গমন করিয়াছিলেন বটে তবে মুক্তিযুদ্ধ যখন মধ্যগগনে, বাঙ্গালীরা পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন মরণপণ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত, জনাব মশিউর রহমান মুক্তিযুদ্ধকে পিছন হইতে ছুরিকাঘাত করিবার মানসে ডাৱত ডুমি হইতে চলিয়া আসে ও আগস্ট মাসে (১৯৭১) পাক হানাদার বাহিনীর নিকট আশ্রয় গ্রহণ করে ও রংপুর ডিস্ট্রি কাউন্সিল সভায় পাকিস্তানের অখগুত্বের পক্ষে রাজনৈতিক সমাধানের আওয়াজ তুলেন। পরবর্তীকালে ৪ঠা সেপ্টেম্বর (১৯৭১) ঢাকায় শান্তিনগর বাসভবনে সাংবাদিক সম্মেলন করে পাকিস্তান স্ত্রীয় অখন্ডতা ও রাজনৈতিক সমঝােতার পক্ষে ওকালতি করে পাক হানাদার বাহিনীর ঘনােরঞ্জনে প্রয়াসী হয় আর জনাব শাহ আজিজুর রহমান জাতিসংঘে পাক সরকার ডেলিগেশনে ডেপুটি লীডার নিযুক্ত হইয়া পাক-ট্রীয় অখন্ডত্ব বজায় রাখিবার পক্ষে ও বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধে জোরালাে বক্তব্য রাখেন ইহাই হইল নেচরিত্র। স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করিবার লক্ষ্যে সকাল-বিকাল মত পরিবর্তন করেজাতি, রাষ্ট্র, জনগণ, আদৰ্শনীতি তাহাদের চিন্তা-চেতনায় কত গৌণ। ঘূর্ণিবাত্যা বিধ্বস্ত এলাকা সফরের পর শেখ মুজিৰ ২৬শে নভেম্বর ঢাকায় প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানাইয়াছি, স্বাধীনতার নয়।” এইদিকে নির্বাচন বয়কটের প্রশ্নে দ্বিমত সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে আমি সভাপতি অতািউর রহমান খানের তাগিদে ৪ঠা ডিসেম্বর (১৯৭০) পল্টন জনসভায় যােগ দিয়াছিলাম।
পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খান ২৮শে নভেম্বর জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতে স্বীয় নাম প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেন এবং ২৯শে নভেম্বর সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তিনি ন্যাশনাল লীগ মনােনীত প্রার্থীদিগকেও আঞ্জীয় পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করিতে অনুরােধ জানান। আমার নির্বাচনী এলাকা ব্রাক্ষণবাড়িয়া-সরাইল-নাছিরনগর হইতে ২৯শে নভেম্বর ঢাকায় পেীছিয়া ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় দলীয় সভাপতি আতাউর রহমান খানের এই বিবৃতি পাঠে আমি হতভম্ব হইয়া পড়ি। তৎক্ষণাৎ তাহার ধানমন্ডি বাসভবনে দেখা করিয়া আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া প্রকাশকালে তাঁহাকে বলি যে, তঁাহার ঘােষিত সিদ্ধান্ত সংগঠনের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী, অনিয়মতান্ত্রিক ও অবিবেচনাপ্রসূত। প্রথমতঃ সংগঠনের পার্লামেন্টারী বাের্ড, ওয়ার্কিং কমিটির সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ব্যতীত নির্বাচনে অংশগ্রহণ হইতে বিরত থাকিবার অধিকার সংগঠনের সভাপতির একার নাই; দ্বিতীয়ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখের মাত্র সাতদিন বাকী। সুতরাং মনােনীত প্রার্থীদের মতামত গ্রহণ ব্যতীত এইরূপ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ অন্যায়। তৃতীয়তঃ আমি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। আমার সহিত আলােচনা করা অপরিহার্য ছিল। আমি তাহাকে ইহাও বলি যে, এ ধরনের ব্যক্তি-রাজনীতির অভিশাপ সমগ্র সংগঠনকে পােহাইতে হইবে। ব্যক্তি পূজার রাজনীতি আমরা করি না এবং একার সিদ্ধান্তই পার্টির সিদ্ধান্ত হইতে পারে না। যদিও আজ দলীয় ঐক্যের খাতিরে আমি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইতে আমার নাম প্রত্যাহার করিতেছি, তবে ভবিষ্যতে সাংগঠনিক ফোরামে ব্যক্তি-প্রধান রাজনীতির সুরাহা করিতে সচেষ্ট থাকি। | সবাই জানেন, গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতিতে বিরােধী দলীয় ভূমিকা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন। আতাউর রহমান খানের বিবৃতিতে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন বর্জনের আহবান ছিল না। তাই ন্যাশনাল লীগ মনােনীত প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে আর কালবিলম্ব না করিয়া আমি ঢাকা ত্যাগ করি। পরিতাপের বিষয়, সংগঠনের সভাপতি আতাউর রহমান খান ইংরেজী দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারের ১৬ই ডিসেম্বরের সংখ্যায় প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ঘােষণা করেন যে, প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কোন ন্যাশনাল লীগ মনােনীত প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতেছেন না। বলা অনাবশ্যক যে, পূর্বের মতই এই ঘােষণাও ছিল সাংগঠনিক গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ইহা ছিল বকুতঃ সংগঠনকে দ্বিখন্ডিত করিবার এক প্রকাশ্য উস্কানী। বাংলা জাতীয় লীগ। | নীতিজ্ঞানবর্জিত নেতৃত্বের খপর হইতে সংগঠনকে মুক্ত করিবার তাগিদে ১৯৭১ সালের ১০ই জানুয়ারী কুমিল্লায় বাংলা ন্যাশনাল লীগের বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করি। অধিবেশন বঙ্গবাসীদের নব জাগ্রত জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশকে স্বাগত জানায় ও জনমানুষের নবচেতনার প্রতিধ্বনি করিয়া দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে :
“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
| কে বাঁচিতে চায়” এই দেশে জাতীয়তাবাদের চেতনার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটিতে থাকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর হইতেই। এবং এই জাতীয়তাবাদী চেতনার রেশ ধরিয়া পাকভারত সশস্ত্র সংঘাত, আশীর্বাদপুষ্ট বরপুত্রদ্বয় জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চলে এক জনপ্রিয় ‘ব্যক্তিসত্ত্বারূপে আবির্ভূত হন। আগেই বলিয়াছি, ১৯৬৫ সালের পাক-স্যারত যুদ্ধবিরতি ও তাসখন্দ শান্তিচুক্তি বিরােধী প্রচণ্ড গণ-অসন্তোষই পশ্চিম পাকিস্তানে জনাব ভুট্টোর
একক ব্যক্তি জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি ছিল এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালে – যথােপযুক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অবর্তমানে ও অভাবে পূর্ব পাকিস্তানীদের অসহায় জনিত ক্ষোভ ও লাহাের প্রস্তাবভিত্তিক স্বাধিকারের ক্রমবর্ধমান অপ্রতিরােধ্য গণদাবীই নিরবচ্ছিন্ন সরব কষ্ঠ শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তার দৃশ্যমান কারণ ছিল। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ আসনে যথাক্রমে শেখ মুজিব পরিচালিত আওয়ামী লীগ ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পরিচালিত পিপলস পার্টির একচেটিয়া বিজয় ছিল উপরােক্ত বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থারই ফলশ্রুতি। লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ মনােনীত কোন প্রার্থী পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পিপলস পার্টি মনােনীত কোন প্রার্থী পূর্ব পাকিস্তানের কি জাতীয় পরিষদে কি প্রাদেশিক পরিষদের কোন আসনে জয়লাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। অর্থাৎ কোন দলই জাতীয় বা নিখিল পাকিস্তান পার্টির মর্যাদা অর্জন করিতে পারে নাই। ইহার দরুনই ক্ষমতালােজ জুলফিকার আলী ভুট্টোর মুখ হইতে এই মন্তব্য উচ্চারিত হইতে পারিয়াছিল যে, পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামী লীগের ও পশ্চিম পাকিস্তানে পিপলস পার্টির নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হউক এবং কেন্দ্রের সরকার গঠনের ফর্মুলা বাহির করা হউক।
আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে ১৬৭টি আসন লাভ করে। অপর দুইটি আসনে নির্বাচিত হন পি,ডি,পি প্রধান জনাব নুরুল আমিন এবং রাজা ত্রিবিদ রায়। প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ ২৬৬টি আসন লাভ করে। অপর ১২টি আসনে পি ডি পি-২ নেজামে ইসলাম-১, জামায়াতে ইসলামী-১, ন্যাপ (মস্কো)-১, স্বতন্ত্র ৭টি আসনে জয়লাভ করে। | আওয়ামী লীগ ৩রা জানুয়ারী (১৯৭১) বিজয় দিবস ঘােষণা করে। বিজয় দিবস। উপলক্ষে ঢাকা রেসকোর্সে লক্ষ লক্ষ লােকের সমাবেশে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ টিকেটে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যবৃন্দের ৬ দফা বাস্তবায়নের প্রকাশ্য শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগের সেই শপথনামাটি নিয়ে প্রদত্ত হইল :
In the name of Allah the merciful and Almighty. In the name of the brave martyrs and fighters who heralded our initial victory by laying down their lives and undergoing the utmost hardship and repression, in the name of the peasnts workers, students, toiling masses and the people of all classes of this country, we the newly elected members of the National and Provincial assemblies do hereby take oath that we shall dovote all our energy to honour the over whelming support and instinted confidence the people of this country have reposed in the programme and the leadership of Awami League in the National General election.
That we shall remain whole heartly faithful to the people’s mandate on the Six point and Eleven point Programmes and that we shall strive to the best of our ability to reflect both in the constitution and in day-to-day praptice the principles of autonomy based on the Six point Formula & Eleven point Programme.
That we shall remain absolutely loyal to the aims, objects and programmes of the Awami League and that we undertake to eliminate permanently extreme political, economic and social differences that exist between region & region and between man and man and struggle relentlessly to lay the foundation of a society free from exploitation so that injustices yield place to justice and fairplay.
That we shall build up a massive resistance movement against any quarter or evil force that may try thwart our line of action behind wheih the people have their support & we sholl remain ever prepared for an uncompromising struggle for the establishment of nights of the common
man.
May Allah help us in our endeavour.
Joy Bangla –Joy Pakistan.
নিম্নে উক্ত শপথনামার বনুবাদ দেয়া হইল ;
করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার নামে, বীর শহীদান ও যােদ্ধাদের নামে যাহারা স্বীয় জীবন বিসর্জন করিয়া ও অশেষ দুঃখ ও নির্যাতন স্বীকার করিয়া আমাদের প্রাথমিক বিজয় নিশ্চিত করিয়াছে, কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-মেহনতি জনতা ও এই দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের নামে আমরা নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা এতদ্বারা শপথ গ্রহণ করিতেছি যে, জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও কর্মসূচীর প্রতি যে ব্যাপক সমর্থন ও অবিচল আস্থা জ্ঞাপন করিয়াছেন তাহার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য আমাদের সকল শক্তি নিয়োজিত করিব।
আমরা সর্বোতভাবে ৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচীর প্রতি, জনগণের ম্যান্ডেটের প্রতি বিশ্বস্ত থাকিব এবং উভয় কর্মসূচীকে শাসনতন্ত্রে প্রতিফলিত করিতে এবং ৬ দফা ও ১১ দফা কর্মসূচীভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের নীতিমালাকে দৈনন্দিন কর্মে প্রতিফলিত করিতে আমাদের সক্ষমতা নিয়ােগ করিব।
আমরা আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর প্রতি পরিপূর্ণভাবে অনুগত থাকিব এবং বর্তমানে অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান রহিয়াছে তাহা দূর করিব, এবং এমন একটি শােষণমুক্ত সমাজের ভিত্তি স্থাপনে সংগ্রাম করিব যেখানে অন্যায়ের পরিবর্তে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়।
| আমাদের কর্মসূচী যাহার প্রতি জনগণের সমর্থন রহিয়াছে তাহাকে বানচাল করিবার জানা যদি কোন মহল ও দুট-শক্তি তৎপর হয়, তাহা হইলে আমরা তাহাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়িয়া তুলিব এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আপােষহীন সংগ্রামের জন্য আমরা সদা প্রস্তুত থাকিব। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টায় সহায় হউন।
জয় বাংলা-জয় পাকিস্তান। উল্লেখ্য যে, এই অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় ভাষণ সমাপনান্তে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় পাকিস্তান’ ধ্বনি দ্বারা বাঙ্গালীর দাবী-দাওয়া আদায়ের অঙ্গীকার ঘােষণা করেন। ইয়াহিয়ার কালক্ষেপণ ।
নির্বাচনােত্তরকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সন্দেহজনক উদ্দেশ্যে পিন্ডি, ঢাকা, লারকানা পদচারণা করিয়া তাহার মূল কর্তব্য ও তাঁহার দেয়া আইনগত কাঠামোের আদেশ মােতাবেক ১২০ দিনের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানে অনর্থক কালক্ষেপণ করিতেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১১ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন এবং ১২ ও ১৩ই জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত সাক্ষাৎ এবং ১৪ই জানুয়ারী ঢাকা ত্যাগকালে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা ও ১৯৭০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর করাচীতে, ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারী লারকানায়, ১৯৭১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী
রাওয়ালপিন্ডিতে, ২৬শে ফেব্রুয়ারী ইয়াহিয়া-ভুট্টো পুনঃপুনঃ সাক্ষাৎ ছিল পরবর্তীকালের ঘটনারাজীকে অনভিপ্রেত খাতে প্রবাহিত করিবার অপপ্রয়াসমাত্র। স্বীয় উদ্যোগে ইয়াহিয়া খানের এই ব্যক্তিগত কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করিবার বিশেষ কারণ আর কিছুই ছিল না, ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট পদপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান। ক্ষমতা লেডিই তদানীন্তন সামরিক বাহিনীর অধিনায়কের কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করি, দেশপ্রেমও নয়, কর্তব্যবােধ বা নৈতিকতাবােধও নয়।
এইদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদলসহ ১৯৭১ সালের ২৭শে জানুয়ারী সাংবিধানিক বিষয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আলোচনা করিবার নিমিত্ত ঢাকা আগমন করেন এবং ৩০শে জানুয়ারী ঢাকা ত্যাগ করেন। পরিতাপের বিষয়, উভয় নেতার ব্যক্তিগত খামখেয়ালীপনা ও অহমিকাবােধই তাহাদের ২৭, ২৮ ও ২৯শে জানুয়ারী তিন। দিবসব্যাপী আলােচনাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে।
ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থবাদী মহল সংবিধান প্রণয়ন বানচালে অত্যন্ত তৎপর হইয়া উঠে। সংবিধান প্রণয়নে গণপরিষদের সহজাত সার্বভৌম অধিকার অস্বীকার করিয়া জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো অদ্ভূত ও ইতিপূর্বে অশ্রুত এক । থিওরী আকস্মিকভাবে ঘোষণা করেন এবং বলেন, “Three bastions of Power Awami League, Peoples party and Army”, অর্থাৎ ক্ষমতার তিনটি খুঁটি- আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি এবং সৈন্য বাহিনী। ইহার সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, বেতনভুক সরকারী কর্মচারী, সামরিক বাহিনী সংবিধান রচনায় ও রাত্রীয় ক্ষমতা বিন্যাসে সংশ্লিষ্ট। এইভাবেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কর্তৃক গণপরিষদ অধিবেশন আহবানে অহেতুক কালক্ষেপণ, স্বউদ্যোগে ব্যক্তিগত কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ, জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক সংখ্যাধিক্য গণপরিষদ সদস্যদের সংবিধান গ্রহণে অস্বীকৃতি ও আকস্মিকভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে ভবিষ্যৎ সংবিধানের রূপরেখা নির্ধারণে জড়িত করিবার উদ্দেশ্যপ্রণােদিত প্রস্তাব, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক আইনগত কাঠামাে আদেশের খেলাফে আওয়ামী লীগকে সাধারণ নির্বাচনে ৬ দফা দাবীর উপর রায় দানে নির্বাচকমন্ডলীকে আহবানের সুযােগ দান, রাজনৈতিক বিবর্তনের বিভিন্ন দিক কালের ঘটনা স্রোতেরই এক নীরব সাক্ষী। বিমান ছিনতাই।
এক অনিশ্চিত ও সংকটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিত্তিতে দেশ যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখনই ঘটনা প্রবাহের এক নূতন অথচ অশুভ ও সর্বনাশা দিক উন্মোচিত হইল। ১৯৭১ সালের ৩০শে জানুয়ারী ‘গঙ্গা নামীয় এক ভারতীয় ফকার ফ্রেন্ডশীপ বিমান জন্ধু বন্দরে অবতরণকালে দুইজন কাশ্মীরী স্পাই মােঃ হাশেম কোরেশী ও মােঃ আশরাফ ছিনতাই করে। তাহারা নিজদের জম্মু ও কাশ্মীর ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্য বলিয়া দাবী করে এবং ছিনতাইকৃত বিমানটিকে লাহাের বিমান বন্দরে অবতরণ করিতে বাধ্য করে।
ছিনতাইকারীগণ আরও দাবী করে যে, ভারত সরকার ৩৬ জন আটক কাশ্মীর মুক্তিযােদ্ধাদের মুক্তি দিলে ফকার বিমানটি ভারতকে ফেরত দেওয়া হইবে। ভারত দাবী মানিতে অস্বীকৃতি জানাইলে ছিনতাইকারীরা ২রা ফেব্রুয়ারী (১৯৭১) বিমানটি লাহাের বিমান বন্দরে ডিনামাইট দ্বারা ধ্বংস করে। প্রণিধানযােগ্য ঘােষণা আসে ভারতীয় কাশ্মীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গোলাম মােহাম্মদ সাদিকের নিকট হইতে। তিনি জানান, মােহাম্মদ হাশেম কোরেশী (ছিনতাইকারীর অন্যতম একজন ডবল এজেন্ট এবং ভারতীয় কাশ্মীর সরকার কয়েক মাস পূর্বেই ছিনতাই পরিকল্পনা কোরেশীর নিকট হইতেই জ্ঞাত হইয়াছিলেন, কিন্তু ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের এক এজেণীর আশ্রয়ে থাকায় কাশ্মীর সরকারের পক্ষে ছিনতাইকারী কোরেশীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় নাই।
| ৩১শে জানুয়ারী ঢাকা হইতে প্রত্যাবর্তনকালে লাহাের বিমান বন্দরে অবতরণ করিয়া জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিনতাইকারী মােহাম্মদ হাশেম কোরেশীর সহিত আলোচনা করেন। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের মধ্যে নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সে সময়ে জনাব ভুট্টোর এই ধরনের বলিসুলত অভিনয় বিশেষ ক্ষতির কারণ হইয়া দাঁড়ায়।
উল্লেখ্য যে, ভারত তার বিমান ধ্বংসের প্রতিবাদে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ২রা ফেব্রুয়ারী হইতে পাকিস্তানের সমস্ত বেসামরিক যাত্রীবাহী বিমান ভারতীয় আকাশ পথে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াত বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। তাই অনেরে ধারণা ছিল এই যে, ছিনতাই নাটক সুপরিকল্পিত এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র ধ্বংসের জন্য সথ রাত তরতায় বৃহত্তর যড়যন্ত্রমূলক নাটকের অন্যতম অংশমাত্র।
ছিনতাইকারী মােহাম্বল হাশেম কোরেশী যে একজন ডবল এজেন্ট ছিলেন, ভারতীয় কাশ্মীরের মন্ত্রী মােহাম্মদ সাদেকের সেই বক্তব্য আগেই উল্লেখ করিয়াছি। ছিনতাই নাটকটিই পাকিস্তানের নাত্মক রাজনৈতিক পরিস্থিষ্টিতে দুই অঞ্চলের মধ্যে দ্রুত বিমান যােগাযােগ অবসানের অজুহাত সৃষ্টি করে। ঐদিকে উক্ত সমস্যা সমাধানকল্পে তুঙ্গীয় পক্ষের মধ্যস্থতা গ্রহণের পাকিস্তানী প্রস্তাবও ভারত সরকার প্রত্যাখ্যান করে। ইহা আর যাহাই হউক, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সহায়ক ছিল না। ওরা ফেব্রুয়ারী আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ছিনতাইকৃত বিমান ধ্বংসের ঘটনাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলিয়া আখ্যা দেন। পক্ষান্তরে পিপলস পার্টি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিনতাইকৃত বিমান ধ্বংসকে সমর্থন করেন। উভয় নেতার বিবৃতিই ছিল যথেষ্ট রহস্যপূর্ণ। আরাে রহস্যপূর্ণ ছিল ভুট্টোর ১৩ই ফেব্রুয়ারীর বিবৃতি। বিবৃতিতে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড হকি কাপ টুর্নামেন্টে ভরিষ্ঠীয় হকি টীমের অংশগ্রহণে বিরােধিতা করেন। তদুপরি ১৩ই ফেব্রুয়ারীর বিবৃতিতে মওলানা ভাসানী কর্তৃক এই ঘটনায় স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবীর যথার্থতা খুঁজিয়া বাহির করিবার প্রয়াস ভারত সরকারকে সুপরিকল্পিত সুদুর লক্ষ্যমুখে অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হইতে উৎসাহিত করে।
যাহা হউক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অনেক টালবাহানা ও গড়িমসির পর এবং জনাব জুলফিকার আলী ভুট্রোর সহিত ১২ই ফেব্রুয়ারী (১৯৭১) আলোচনাক্রমে এক ঘোষণীয় ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় আহবান করেন। সাড়ে সাত কোটি বঙ্গবাসীর মুখপাত্র হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ইতিপূর্বেই প্রেসিডেন্টকে ১৫ই ফেব্রুয়ারীর মধ্যে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের অনুরােধ জানাইয়াছিলেন। | প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহবানের পরপরই পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবহাওয়া ক্রমশঃ উত্তপ্ত হইতে থাকে। ১৫ই ফেব্রুয়ারী পেশােয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেন যে, জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের পূর্বে কোন প্রকার সমঝােতা ও বােঝাপড়া না হইলে পিপলস পাটি ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দিবে না। তিনি একই সাংবাদিক সম্মেলনে আরােও ঘােষনা করেন যে, বিমান ছিনতাই প্রশ্নে পাক-ভারত যুদ্ধংদেহী অবস্থা ও ৬ দফা গ্রহণ না করিবার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পিপলস পার্টির সদস্যবর্গ ঢাকায় গমন করিলে তাহারা জল হােস্টেজে পরিণত হইবে। ১৭ই ফেব্রুয়ারী করাচীতে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব ভুয়া জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যােগদানের পূর্বে সবার আগে আওয়ামী লীগের সহিত সমঝােতা প্রয়ােজন বলিয়া পুনঃ মত প্রকাশ করেন। | এইভাবেই ক্ৰমে ক্ৰমে জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক কর্মধারায় পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত পিপলস পার্টির পিছনে সংহত হইতে থাকে। এমনি অবস্থায় ৮৮ সদস্যবিশিষ্ট পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যােগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। চতুর্দিকে যখন তুলকালাম কান্ড, তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আহবানে রাওয়ালপিন্ডিতে ভুট্টো-ইয়াহিয়া এক সাক্ষাৎকার হয়। প্রেসিড়েন্ট ইয়াহিয়ার সহিত সাক্ষাৎকারের অব্যবহিত পরেই সাংবাদিকদিগকে অনাব ভুঠো জানান যে, মুদ্রা, বৈদেশিক বাণিজ্য ও কর সম্পর্কে প্রকৃত বা মৌলিক মীমাংসা সম্ভব হইলেই সংবিধান রচনায় পিপলস পার্টি অংশগ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছে। তিনি আরো দাবী করেন যে, পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তান অর্থাৎ সমগ্র দেশের এক-অর্ধাংশের প্রতিনিধি। তিনি এই
মর্মে আরাে দাবী করেন যে, ভারতীয় সৈন্য সমাবেশ পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তেই • হইয়াছে, পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে নয়।
করাচীতে ওয়েস্ট পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ম্যানেজমেন্ট প্রাঙ্গণে জনাব জুলফিকার আলী ভুট্রোর সভাপতিত্বে ২০শে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত পাকিস্তান পিপলস পার্টি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের দুই দিবসব্যাপী পার্লামেন্টারী কনফারেন্সের প্রথম দিবসের অধিবেশনেই ৬ দফা ভিত্তিক সংবিধান বনাম পিপলস পার্টির ভূমিকা সংক্রান্ত বক্তব্যের প্রশ্নে সদস্যবৃন্দ পার্টি চেয়ারম্যানের নিকট সানন্দে পদত্যাগপত্র জমা দিতে সম্মত হন। পদত্যাগের এই হুমকির পটভূমিকায় বােধহয় ১৮ই ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান
ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য অধিবেশনকে পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যবৃন্দের জন্য ‘কসাইখানা’ আখ্যা দিলেও ৩রা মার্চ ঢাকা অধিবেশনে অংশগ্রহণ করিবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত ৩৫ জন সদস্য ঢাকা আগমন করেন। স্মর্তব্য, নির্বাচন কমিশন ১৪ই ফেব্রুয়ারীর এক ঘােষণায় জাতীয় পরিষদে ১৩ জন নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ২রা মার্চ ধার্য করেন এবং ১লা মার্চ ঢাকায় রিটার্নিং অফিসার সমীপে নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার জন্য ইচ্ছুক প্রার্থীদিগকে আহনি।
পরিষদ অধিবেশন স্থগিত বাংলাদেশ বিক্ষুব্ধ | ১৫ এবং ১৬ই ফেব্রুয়ারী ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যবৃন্মেয় মুক্ত সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলীয় লক্ষ্য অর্জনে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয় এবং শেখ মুজিবর রহমান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ পার্লামেন্টারী পার্টির লীডার ও ডেপুটি লীডার নির্বাচিত করা হয়।
ইঞ্জিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচীর রদবদলের জন্য সরাসরিভাবে দাবী উত্থাপন করে। ইহার উত্তরেই বােধহয় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ২৪শে ফেব্রুয়ারী দলীয় সদর দফতরে সাড়া আছুত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন যে, ৬ দফা প্রশ্নে কোন প্রকার রদবদল সক্ষম নয়। তিনি আরাে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের উপর ৬ দফা বাধ্যতঃ গ্ৰহণীয়ও নয় বরং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহ পারস্পরিক প্রয়ােজন ও স্বার্থে যে কোন প্রকার সাংবিধানিক ব্যবস্থা উত্তাবনু করিতে পারে। | শেখ মুজিবুর রহমানের উপরােক্ত ঘােষণা ইহাই প্রমণ করে যে, শেখ সাহেব রাস্ত্রীয় ও জাষ্ঠীয় ভিত্তিতে পাকিস্তানের সামগ্রিক সাংবিধানিক সমস্যা সমাধানে আগ্রহান্বিত ছিলেন না। বলাই বাহুল্য যে, বিগত ২৩ বৎসরের ক্ষমতার লড়াই-এর ইহাই ছিল অবশ্যঞ্জাবী বিষময় ফলশ্রুতি। | বােধহয়, ২৮শে ফেব্রুয়ারী লাহােরে অনুষ্ঠিত ভুট্টোর জনসভার দাবীর প্রেক্ষিতেই ১লা মার্চ, অপরাহ্ন ১টা ৫ মিঃ-এর বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবী ঘােষণা করেন। জাতীয় পরিষদ মূলতবী ঘােষণায় হতচকিত ঢাকাবাসী স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট টেস্ট ম্যটি দর্শক কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়; ঢাকা হটিকেটি বার এসােসিয়েশন ও ঢাকা জেলা এসােসিয়েশনের প্রতিবাদ মিছিল রাস্তায় নামে; ছাত্র সম্প্রদায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হইতে রাজপথে নামিয়া আসে; বিভিন্ন শিল্প এলাকা হইতে শ্রমিকরা দলে দলে মিছিল সহকারে রাজধানী ঢাকা মুখে যাত্রা করে; সকল সিনেমা হল বন্ধ হইয়া যায়। এইসব বিক্ষোভ মিছিলের স্রোত হােটেল পূর্বাণীর দিকে
অগ্রসর হইতে থাকে। হােটেল পূর্বাণীতে তখন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারী পার্টির সভা চলিতেছিল। মিছিলকারীরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ উঠায়, “পাকিস্তানের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন কর। বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা কর।” শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী জনতার উদ্দেশ্যে তাহার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘােষণার প্রতিবাদে ২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক সাধারণ হরতাল পালনের আহবান জানান। এইভাবে সেইদিন সারাদিন ধরিয়া মিছিলে মিছিলে চাকা নগরী প্রকম্পিত হইতে থাকে; অফিস-আদালত পরিত্যক্ত হয়; আইনজীবীরা পথে নামিয়া আসেন, দোকানপাট বন্ধ, সর্বত্র বিদ্রোহবহ্নি। পল্টন ময়দানে স্বতঃস্ফূর্ত বিরাট জনসমাগমে আগামীদিনের গণআন্দোলনের ডাক দেয় আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ। ২রা মার্চ ঢাকা নগরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এই ২রা মার্চেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতলি উত্তোলন করেন। সবুজ জমিনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত এই পতাকাটি উত্তরকালে মানচিত্র বাদ দিয়া রাষ্ট্রীয় পতাকার মর্যাদা পায়। | পরিস্থিতিকে আয়ত্তে রাখিবার প্রয়ােজনে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১লা মার্চ এক আদেশ বলে প্রদেশগুলিতে নিয়ােজিত সামরিক শাসনকর্তাকেই বেসামরিক গর্জার পদে নিয়ােগ করেন আর্থাৎ দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটাইয়া সামরিক বাহিনীই দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস,এম আহসান অনতিবিলম্বে সামরিক শাসন কর্তা লেঃ জেঃ সাহেবজাদা এম, ইয়াকুব খানের নিকট দায়িত্বভার দিয়া পূর্ব পাকিস্তান হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। ২রা মার্চ ঢাকায় প্রতিবাদ হরতাল পালনকালে বুলেটের আঘাতে ২ ব্যক্তি শাহাদৎবরণ করে এবং অনেকেই আহত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ এক বিবৃতিতে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবী করেন এবং নিম্ন কর্মসূচী ঘােষণা করেন। (ক) ৩রা মার্চ হইতে ৬ই মার্চ পর্যন্ত ভাের ৬টা হইতে ২ ঘটিকা পর্যন্ত প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট, (খ) ৩রা মার্চ জাতীয় শােক দিবস পালন এবং (গ) ৩রা মার্চ ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠানের পর অপরাহ্ন চার ঘটিকায় পল্টন ময়দান হইতে শেখ সাহেব কর্তৃক মিছিল পরিচালনা। শেখ সাহেব আরাে ঘােষণা করেন যে, ‘রেডিও-টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে আমাদের বক্তব্য প্রকাশ না করিলে বাঙ্গালী কর্মচারীরা সহযােগিতা করিতে অঙ্গীকৃতি জানাইবে।’ ঘােষণায় ইহাও বলা হয় যে, ৭ই মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঘােষণা করিবেন।
পরিস্থিতি মোকাবিলা করিবার প্রয়াসে সামরিক কর্তৃপক্ষ পৌরসভা এলাকায় রাত্রি ৮টা হইতে ভাের ৭টা পর্যন্ত এবং ৩রা মার্চ সন্ধ্যা ৭টা হইতে ভাের ৭টা পর্যন্ত সাক্ষ্য আইন জারি করেন। কিন্তু তথাপি সান্ধ্য আইন অমান্য করিয়াই মিছিল ব্যারিকে পূর্ণোদ্যমে চলিতে থাকে; বিদ্রোহী জনতা অকাতরে প্রাণ দিতে থাকে। সান্ধ্য আইন
জারির এই বিষময় ফল প্রত্যক্ষ করিয়াই কর্তৃপক্ষ ৪ঠা মার্চ হইতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করেন। বাংলা জাতীয় লীগের প্রচেষ্টা
এইদিকে লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যৌথ সংগ্রাম পরিষদের দাবীতে বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলা মজদুর ফেডারেশন ও ফরওয়ার্ড ইভেন্টস ব্লকের এক বিরাট জঙ্গী মিছিল ঢাকা নগরের বিভিন্ন রাজপথ প্রদক্ষিণ করে। অবশ্য আওয়ামী লীগ কর্মীরা উক্ত যৌথ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের দাবীকে সুনজরে দেখে নাই। ৩রা মার্চ সকাল দশ ঘটিকায় দেওয়ান সিরাজুল হক ও এম,এম, আনােয়ার ও আমার সমবায়ে গঠিত এক প্রতিনিধি দল বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত তাহার ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে এক আলােচনা বৈঠকে মিলিত হই। আলোচনায় জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও মনসুর আলী অংশগ্রহণ করেন। আমরা বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে শেখ সাহেবের সমীপে নিম প্রস্তাবাবলী পেশ করি ; (১) জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত সংক্রান্ত প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া
খানের ঘােষণাকে উপেক্ষা করিয়াই আওয়ামী লীপ দলীয় ১৬৭ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আগত সদস্যবর্গের আজই ঢাকায় সংবিধান প্রণয়নকল্পে যথারীতি অধিবেশনে মিলিত হওয়া উচিত এবং যথাশীঘ্র সংবিধান প্রণয়ন করিয়া উহা মােতাবেক জনপ্রতিনিধিগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সামরিক আইন শাসনকর্তা প্রেসিডেন্ট জেনারেল
ইয়াহিয়া খানকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহবান জানান উচিত। (২) প্রেসিডেন্ট এই আহবান অস্বীকার করিলে অস্থায়ী সরকার ঘােষণা করা ও
জাতিসংঘের সাহায্য প্রার্থনা করা প্রয়েজিন। (৩) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সমবায়ে কনফেডারেশন গঠন। (৪) উপরে বর্ণিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জনতার ঐক্য সুদৃঢ় করিবার মানসে
সংগ্রামী জনতার মাের্কা গঠন। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও জনাব মনসুর আলী পরিকল্পনাটি বাস্তব নহে বলিয়া মন্তব্য করেন। শেখ সাহেব বলেন, এই প্রস্তাব অনুসারে কাজ করিলে সরকার সেনাবাহিনীর দ্বারা আন্দোলন দমাইয়া ফেলিবে। যাহা হউক, পরবর্তী ঘটনাবলীই প্রমাণ করিয়াছে যে, আমাদের প্রস্তাবসমূহ সঠিক ছিল কি-না এবং আমাদের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করিবার পরেও সেনাবাহিনীর দমন চলিয়াছিল কি-না। | প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, আলােচনার ফঁাকে এক পর্যায়ে ২রা মার্চ তাঁর বাসভবনে নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি, ফরিল্যান্ডের সাথে তার যে বৈঠক হয় সেই বৈঠকের প্রসঙ্গে মুজিব ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য-সহযােগিতা পাওয়া যাবে কিনা? এ ব্যাপারে কোন আলােচনা হয়েছে
কিনা? মুজিব ভাই উত্তরে বললেন, “মার্কিন মুত্র খালাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করবে না। তবে নভেম্বরে মার্কিন সিনেটে হয়তাে প্রসঙ্গটি আলােচনা হতে পারে সে ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির জন্য পটুয়াখালী অথবা সেন্ট মার্টিন যে কোন একটি দ্বীপ তারা চায় আমি তাদের সরাসরি না বলে দিয়েছি। এরকম বলা একমাত্র মুজিব ভাইয়ের মতাে সাহসী লােকের পক্ষেই সম্ভব।
মুজিব ভাই কিন্তু আত্মসমর্পণ করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইংগিতেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার সম্পূর্ণ গ্যারান্টি দেয়ার ফলেই তিনি নিখিধাক্স ২৫শে মার্চ পাক বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন।
আবার গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব।
৩রা মার্চ অপরাহে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পল্টনের বিরাট জনসমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং সরকারের নিকট (১) অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) সশস্ত্র বাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন ও (৩) জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর দাবী করেন। এবং ৪ঠা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান নিম্নলিখিত নির্দেশ জারি করেন ;
কর্মচারীদের বেতন পরিশােধের নিমিত্ত সরকারী, বেসরকারী অফিস অপরাহ্ন ২৩০ হইতে ৪-৩০ মিঃ পর্যন্ত খােলা থাকিবে, ১৬ শত টাকার অর্থের চেক পরিশােধের জন্য ব্যাংকসমূহ অপরাহ্ন ২-৩০ মিঃ হইতে ৫-৩০ মিঃ পর্যন্ত কাজ করিবে; স্টেট ব্যাংক কর্তৃক অথবা অন্য কোন প্রকারে বাংলাদেশের বাহিরে টাকা প্রেরণ করা যাইবে না। ইহার আগের দিন অর্থাৎ এরা মার্চেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংকট উত্তরণ প্রচেষ্টায় নিম্নলিখিত পার্লামেন্টারী পার্টি নেতৃবর্গকে ঢাকায় এক গােল টেবিল বৈঠকের আহবান জানান ।
(১) শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ; (২) জুলফিকার আলী ভুট্টো, পাকিস্তান পিপলস পার্টি; (৩) খান আবদুল কাইউম খান, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইউম); (৪) মিঞা মােহাম্মদ মমতাজ দৌলতানা, কাউন্সিল মুসলিম লীগ; (৫) মাওলানা মুফতি মাহমুদ জমিয়তুল উলেমায়ে ইসলাম (হাজারভী); (৬) খান আবদুল ওয়ালী খান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী); (৭) মাওলানা শাহ আহমদ নুরানী, জমিয়তুল উলেমায়ে পাকিস্তান; (৮) জনাব আবদুল গফুর আহমদ, জামায়াতে ইসলামী; (৯) মিঃ মােহাম্মদ জামাল কুৱেকা, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কনভেনশন); (১০) জনাব নুরুল আমিন, পাকিস্তান সেমােক্রেটিক পার্টি: (১১) মেজর জেনারেল আমালদার, উপজাতীয় এলাকা হইতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিনিধি (১৯) মালিক জাহাঙ্গীর খান, উপজাতীয় এলাকা হইতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিনিধি।
শেখ মুজিবুর রহমান গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব ঘৃণাওরে প্রত্যাখ্যান করেন। জনাব নুহুল আমিনও গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী সংখ্যাগুরু জনতার আস্থাভাজন নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাবকে স্বাগত জানান।পল্টনে বাংলা জাতীয় লীগের জনসভা
| ৩রা মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত আলােচনাকালে আমরা সর্বদলীয় সগ্রাম পরিষদ ও মুক্তি ফৌজ গঠনের প্রস্তাব রাখিয়াছিলাম। আমাদের প্রস্তাবের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের অনীহা লক্ষ্য করিয়া, সমগ্র পরিস্থিতির আলােকে বাংলা জাতীয় লীগের দৃষ্টিভঙ্গিতে করণীয় আশু কর্তব্য নির্দেশ করিবার উদ্দেশ্যে আমরা ১৯৭১ সালের ৬২ মার্চ অপরাহ্নে ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে এক জনসভা আহবান করি। পল্টন ময়দানে আমাদের সংগঠনের নামকরণ করি বাংলা জাতীয় লীগ’। এই জনসভাতে সভাপতির ভাষণদানে আমি এই মার্চ রেসকোর্সে অনুষ্ঠিতব্য জনসভায় বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা করিবার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আহবান জানাই এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে সর্বশক্তি নিয়ােগের প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাস দান করি। গভর্নর পদে টিক্কা খান
১০ই মার্চ আহূত গােল টেবিল বৈঠকের প্রতি বাংলার নেতার অনমনীয় মনােভাব লক্ষ্য করিয়া ৬ই মার্চ এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। ৭ই মার্চ অপরাহ্ন তিন ঘটিকায় লক্ষ লক্ষ লােকের পদভারে প্রকম্পিত রেসকোর্স ময়দিনে মুহুর্মুহু ধ্বনি ও করতালির মধ্যে স্বাধীন বাংলার পতাকা শােভিত মঞ্চ হইতে স্বাধীন বাংলার নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান নষ্ঠ প্রথমবারের মতাে ঘােষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
স্বৰ্তৰ যে, একই দিবসে অর্থাৎ ৭ই মার্চ লেঃ জেঃ সাহেবজাদা এয়াকুবের স্থলে কঠোরমনা লেঃ জেঃ টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তা বেসামরিক গভর্নর পদে নিযুক্ত ইয়া ঢাকায় আসেন। ঢাকায় আগমনের পরই লেঃ জে টিকা খান বিমানে রেসকোর্স ময়দানের জনারণ্য পর্যবেক্ষণ করেন। বােধহয় ভীতি প্রদর্শনের প্রয়াসে রেসকোর্সের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সশস্ত্র বাহিনীকে মােতায়েন রাখা হয়। | ইতিপূর্বে ১লা মার্চ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্ৰীয় ছাত্র সসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন সমবায়ে চার সদস্যবিশি স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছত্রি সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীপের উক্ত এক পদক্ষেপের ফলে স্বাভাবিকভাবেই ১১ দফা দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সমি পরিষদের বিলুপ্তি ঘটে।
শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ
“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সকলে জানেন এবং বােঝেন আমরা আমাদের জীবন দিয়া চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর আমার ভায়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত ! হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের সময় বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভােট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেমব্লি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরী করবে এবং এ দেশের ইতিহাসকে আমরা গড়ে তুলবাে। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলছি, বাংলাদেশের করুণ ইতিহাস, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস- এই রক্তের মুমু মানুষের করুণ আর্তনাদ, এদেশের করুণ ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে আইউব আঁ মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর আমাদের গােলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইউব খার পতনের পরে ইয়াহিয়া এলেন। ইয়াহিয়া খান সাহেব বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হোল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করেছিলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারী তারিখে আমাদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, রাখলেন দুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সা হবে। আমি বললাম ঠিক আছে, আমরা এসমব্লিতে বসবাে। আমি বললাম, এসেমরির মধ্যে আলােচনা করবাে- এমনকি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনের মধ্যেও যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা মেনে নেব।
ভুট্টো সাহেব এখানে ঢাকা এসেছিলেন, আলােচনা করলেন। বলে গেলেন, আলােচনার দরজা বন্ধ নয়, আরাে আলােচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আমরা আলােচনা করলাম- আলাপ করে শাসন তৈরী করবাে সবাই আসুন, বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরী করবে। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বার যদি আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেমরি। তিনি বললেন যে, যে যাবে তাদের মেয়ে ফেলে দেওয়া হবে, যদি কেউ এসেমব্লিতে আসে পেশােয়ার থেকে রাষ্টী পর্যন্ত সব জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেমঞ্জি চলবে আর হঠাৎ মার্চের ১ তারিখ এসেমব্লি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেমব্লি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাবাে। ভুট্টো বললেন, যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হােল, দোষ দেওয়া হলাে বাংলার মানুষের, দোষ দেওয়া হােল আমাকে। দেশের মানুষ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হােল। আমি বললাম, আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র পেয়েছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করবার জন্য, আজ সেই অস্ত্র আমার দেশের গরীব দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধেতার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু- অমিরা বাঙ্গালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে, কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, আপনি দেখুন। তিনি বললেন, আমি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকবাে। আমি বলেছি, কিসের এসেমব্লি বসবে, কার সঙ্গে কথা বলবে? আপনারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলবাে? পাচ ঘন্টার গােপন বৈঠকে সমস্ত দোষ তারা আমাদের উপর, বাংলার মানুষের ওপর দিয়েছেন। দায়ী আমরা। * ২৫ তারিখে এসেমব্লি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। ১০ তারিখে বলেছি, রক্তে পাড়া পিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে, এসেমব্লি খােলা চলবে না। সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইড্রো করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকের ভিতরে ঢুকাতে হবে। যে ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তাদের তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, তারপর বিবেচনা করে দেখবাে আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারবাে কি পারবাে না। এর পূর্বে এসেমব্লিতে আমরা বসতে পারি না।
আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিতে চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সে জন্য যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলাে আছে সেগুলাে হরতাল কলি থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ী, রেল চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দফতর, ওয়াপদা কোনকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা পিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেওয়া না হয়, এরপর যদি ১টি গুলি চলে, এরপর যদি আমার লােককে হত্যা করা হয় তােমাদের কাছে অনুরােধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং
জীবনের তরে রাস্তাঘাট, যা যা আছে সবকিছু। আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবাে, আমরা পানিতে মারবাে। সৈনােরা, তােমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকে, তােমাদের কে কিছু বলবে না কিন্তু আর তোমরা গুলি করার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না।।
আর যে সমস্ত লােক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগ থেকে বন্দুর পারি সাহায্য করতে চেষ্টা করবাে। যারা পারেন আওয়ামী লীগ অফিসে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর ৭ দিন হরতালে শ্রমিক ভাইয়েরা যােগদান করেহে, প্রত্যেক শিল্পের মালিক তাদের বেতন পেীছে দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হয়ে ততদিন ওয়াপদ ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হােল- কেউ দেবেন না। অনুন, মনে রাখুন, শক্র পিছনে ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি কৰে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু, মুসলমান যারা আছে তারা আমাদের ভাই, বাঙ্গালী, অবাঙ্গালী- তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন কর্মচারীরা, রেডিও যদি আমাদের কথা না শােনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, তাহলে টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘন্টা ব্যাংকগুলাে খােলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনে পত্র নিতে পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বাংলাদেশের নিউজ বাইরে পাঠানাে চলবে। এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা চলছে বাঙালীরা বুঝে সুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলুন। এবং আমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। যখন রক্ত দিয়েছি রক্ত আরাে দেবাে। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম অামাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।
জয় বাংলা। জয় পাকিস্তান।
উল্লেখ্য যে, ৭ই মার্চের জনসভাতেই ২৫শে মার্চে আহুত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যােগদান প্রসলে শেখ মুজিব নিজে শর্তাবলী আরােপ করেন :
(ক) সামরিক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে। (খ) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে হইবে। (গ) হত্যার তদন্ত করিতে হইবে। (ঘ) জনপ্রতিনিধিগণের হন্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হইবে।
তিনি ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানান, উপরােক্ত শর্তাবলী পূরণ না হইলে “শহীদের কাচার মাড়াইয়া ২৫শে মার্চ আহূত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যাইব না।”
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পতাকা উত্তোলিত হইতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সেই দিন ঢাকার ঘরে ঘরে স্বাধীন বাংলার পতাকা শােভা পাইতেছিল। সংক্ষেপে বলিতে গেলে, পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে চলিয়া যায়। | এইদিকে ঘটনার প্ৰেতি দ্রুত প্রবাহিত হইতে লাগিল। পরিস্থিতির জটিলতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তাহার অঘােষিত উপদেষ্টা ও সামরিক জান্তার সদস্যবৃন্দ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, লেঃ জেঃ এস,জি,এম,এম পীরজাদা, লেঃ জেঃ আকবর খানের পরামর্শে ১৯৬৯ সালের ৫ই আগষ্টে গঠিত বেসামরিক মস্ত্রিসভা ১৯৭১ সালে বিলুপ্ত করেন (১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৯৭১)। ১লা মার্চ গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস,এম আহসানের স্থলে সামরিক শাসনকর্তা লেঃ জেঃ ইয়াকুব খানকে বেসামরিক গল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এই মার্চ দুদ্র ও নক্সম মেজাজী লেঃ জেঃ ইয়াকুব খান সাহেবজাদার স্থলে কঠোরমনা লেঃ জেঃ টিক্কা খানকে যুগপৎ সামরিক শাসনকর্তা ও বেসামরিক গভর্নর পদে নিয়োগ করেন। রাজনৈতিক দিকপাল রাষ্ট্র F ACT 4095 “Poltics is too serious a matter to be left with the Generals” অর্থাৎ “রাজনীতি এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, ইহা জেনারেলদের দায়িত্বে ছাড়িয়া দেওয়া যায় না। এই স্কুলে প্রণিধানযােগ্য। উক্ত মস্তুবের যথার্থতা প্রমাণের জন্যই যেন পাকিস্তানী সামরিক জান্তা অচিরেই রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে সমর দ্বন্দে পরিণত করে।
উল্লেখ্য যে, এই সময়ে জনতার প্রতিরােধ-ঐক্য ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতিমন্ডলীকেও প্রভাবান্বিত করিয়াছিল। প্রধান বিচারপতি বি,এ সিদ্দিকী (বদিউদ্দিন আহমদ সিদিকী) নবনিযুক্ত গভর্নর লেঃ জেঃ টিকা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া আওয়ামী লীগ পরিচালিত অসহযােগ আন্দোলনে শরীক হন।
| পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক শাসনকর্তা ১৩ই মার্চ এক আদেশ বলে সামরিক বিভাগে কর্মরত বেসামরিক কর্মচারীদের ১৫ই মার্চ যথারীতি কাজে যােগ দিতে নির্দেশ দেন। নির্দেশে ইহাও বলা হয় যে, ইহার অন্যথা হইলে অর্থাৎ কাজে যােগ না দিলে কেবল চাকুরী হইতেই বরখাস্ত করা হইবে না, উপরন্তু সামরিক আদালতের বিচারে সর্বোচ্চ দশ বসর সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হইবে। | ইহার পাল্টা জবাবে বেসামরিক প্রশাসন ঢালু রাখিবার স্বার্থে ১৪ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫টি নূন বিধি জারি করেন এবং তদানুযায়ী ১৫ই মার্চ হইতে পরবর্তী দিবসগুলি বেসামরিক প্রশাসনযন্ত্র উহার নির্দেশিত বিধি মােতাবেক দেশের প্রশাসন কার্যপরিচালনা করিতে থাকে।
এই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটে জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইবার আশংকায় জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট জাতিসংঘ কর্মচারীদিগকে পূর্ব
পাকিস্তান হইতে অপসারণের অনুমতি প্রদান করেন। শেখ মুজিব ১৯শে মার্চ। সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিবৃতিতে ইহার প্রতিবাদ করিয়া মন্তব্য করেন যে, কর্মচারী অপসারণের মাধ্যমেই জাতিসংঘের দায়িত্ব সমাপ্ত হয় না। বাংলাদেশে যে গণহঙ্গা চলিতেছে, তাহাতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমির সমুবীন বলিয়াও শেখ মুজিব এই বিবৃতিতে মন্তব্য করেন। ইয়াহিয়া-ভুট্রোর ঢাকা আগমন
রাজনৈতিক সংকট নিরসনকল্পে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ই মার্চ ঢাকা আগমন করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত ১৬ই মার্চ আড়াই ঘন্টা, ১৭ই মার্চ এক ঘন্টা, ১৯শে মার্চ এক ঘন্টা তিরিশ মিনিট, ২০শে মার্চ দুই ঘন্টা দশ মিনিট, ২১শে মার্চ এক ঘন্টা তিরিশ মিনিটব্যাপী কয়েক দফা রাজনৈতিক বৈঠকে মিলিত হন। মুজিবইয়াহিয়ার আলােচনার আলােকে প্রেসিডেন্ট হাউস হইতে ঢাকা সফরের আমন্ত্রণ পাইয়া। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুয়ো ১৫ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদলসহ ২১শে মার্চ ঢাকা আগমন করেন। এবং ২১শে মার্চ হইতে ২৪শে মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক ও ত্রিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২২শে মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের ঐকমত্য অনুসারে প্রেসিডেন্ট ২৫শে মার্চে আহত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন।
উল্লেখ্য যে, এই মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনায় তিন মাসের জন্যে নিম্নলিখিত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। যথা :
১। সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২। বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হস্তে ক্ষমতা হস্তাস্কর, ৩। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট পদে বহাল থাকিবেন, ৪। দেশ রক্ষা, বৈদেশিক নীতি (বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যতীত দ্রা ও পুঁজি পাচার নিষিদ্ধকরণসহ) ছাড়া বাকি সময়। ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের হাতে থাকিবে, ৫। তিন মাস অতিক্রান্ত হইলে প্রত্যেক অঞ্চলের জাতীয় পরিষদ সদস্যবর্গ সংবিধান রচনাকারে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গী স্থিরীকরণের নিমিত্ত পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হইবেন। তৎপর সংবিধান সমস্যাবলীর সর্বগ্রাহ্য সমাধান নির্ধারণকল্পে সদস্যবর্গ যুক্ত বৈঠকে মিলিত হইবেন। | এই সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত রূপদানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের তরফ হইতে সর্বজনাব তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ডঃ কামাল হােসেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ হইতে এম,এম আহমদ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, বিচাপতি এ, আর কর্নেলিয়াস, লেঃ জেঃ পীরজাদা ও লেঃ কঃ এম,এ হাসান ১৯শে মার্চ, ২৩শে মার্চ ও ২৪শে মার্চ বৈঠকে মিলিত হন। ২৫শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এতদসংক্রান্ত চূড়ান্ত ঐকমত্যের বিষয় ঘােষণার কথা ছিল।
২৫শে মার্চের কালােরাত্রি | কিন্তু সকলই গরল ভেল। খুব সম্ভব পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোই ইয়াহিয়া-মুজিব প্রণীত ঐকমত্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং ফলে ২৫শে মার্চ কালাে রাত্রিতে জাতিকে বিভক্ত করিবার পথে এক অশুভ চক্রের পদচারণা শুরু হয়, এবং রচিত হয় এক নির্মম কালো ইতিহাস। | এই কালাে ইতিহাসের জঘন্যতম ও নির্মম ভূমিকা পালনের অসৎ উদ্দেশ্যে অতিসন্তর্পণে ও সংগােপনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঢাকা অবস্থান ও আলােচনার ছদ্মাবরণে সর্বাত্মক সামরিক প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়। আলোচনার ফলাফল জানার জন্য দেশবাসী যখন উদ্বিগ্রচিত্তে ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছিল, আশানিরাশার ঠিক সেই মুহুর্তেই ২৫শে মার্চ (১৯৭১) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সহিত বৈঠকের পর ভুট্টো সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে বলেন যে, “অবস্থা অত্যন্ত সংকটপূর্ণ।
| প্রকাশ, সন্ধ্যার মধ্যেই নাকি শেখ মুজিব জানিতে পারেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, খান ঢাকা ত্যাগ করিয়াছেন। বস্তুতঃ জনতার নেতা ও স্বাধীন বাংলা সংগ্রামের অন্যতম, অধিনায়ক হিসাবে পরিচিত শেখ মুজিব সেদিন কি নির্মমভাবেই না বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হইয়াছিলেন প্রতারক ও চানক্যরূপী সমর নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়ার কূট-কৌশলের মারপ্যাচে।
সেদিন রাত ৯-৩০ মিনিটে বাংলা জাৰ্তীয় লীগের সদর দফতর হইতে আমি পূর্বদেশের প্রখ্যাত কলামিষ্ট জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাসায় যাই। তাহার সহিত অবস্থার আলােচনা-পর্যালােচনার পর স্বীয় বাসভবন মুখে রওয়ানা হই। যাত্রাপথে বিভিন্ন মােড়ে মােড়ে ব্যারিকেড রচনা করিতে দেখিতে পাই ভয়ার্ত অথচ সংকল্পে অটল জনতাকে। উদ্বিগ্ন ও উদগ্রীব জনতা স্থানে স্থানে আমার গাড়ী থামাইয়া পরিস্থিতি জানিতে চায়। আমি তখনও অনাগত হামলা সম্পর্কে কিছুই ওয়াকিফহাল ছিলাম না। পথিমধ্যে সর্বত্র ব্যারিকেড়, উদ্বিগ্ন জনতার ভিড়। আঁচ করিলাম, সংঘর্ষ অত্যাসন্ন এবং বােধহয় সর্বশেষ ফল সুখের নয়।
| বাসায় পৌছিয়াই জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীকে টেলিফোন করি এবং পথে পথে ব্যরিকেড ও উৎকণ্ঠিত জনতার সহিত আলােচনার বিষয়বস্তু তাহাকে জানাই। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মিরপুর রোডের উপর সাঁজোয়া বাহিনীর গাড়ীর আওয়াজ ও অহরহ গুলির শব্দ শুনিতে পাই এবং টেলিফোনে জনাব চৌধুরীকে সে খবরও জানাই। রাত ১২টার দিকে পুনরায় জনাব চৌধুরীর সহিত আলাপ করিবার নিমিত্ত টেলিফোনের রিসিভার উঠাইয়া বুঝিলাম টেলিফোন বিকল। চারিদিকে তখন মুহুর্মুহু রকেট, মর্টার, মেশিনগান ও কামানের আওয়াজ, চতুর্দিকে আগুনের লেলিহান শিখা ও গপনচুছি অন্ধকার ধোঁয়া। রতির কখনও বিছানায় কখনও বারান্দায়, কখনও ছাদে গভীর উৎকণ্ঠার সহিত পায়চারি করিতে থাকি। রাত্রি তিন ঘটিকার দিকে মাইকে ঘােষণা শুনিতে পাই, সামরিক শাসনকর্তা ঢাকা নগরে
শেখ মুজিবের গ্রেফতারবরণ | পাকিস্তানী সামরিক শাসকবর্গ ২৫শে মার্চের অপারেশনের নাম দিয়াছিল “অপারেশন সার্চ লাইট”। তদানীন্তন ঢাকাস্থ পাকিস্তানী সামরিক হেড কোয়ার্টারের জনসংযােগ কর্মকর্তা লেঃ কঃ সিদ্দিক সালেক রচিত “Witness to surrender” নামক গ্রন্থে এই অপারেশনের পূর্ণ নীল নকশা বিবৃত হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্ট-২ এবং ১৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছে যে, নিম্নোক্ত ১৬ জন ও অন্যান্য রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত কবিরার জন্য আর্মি হেড কোয়ার্টার তাহাদের এজেন্সীকে নির্দেশ প্রদান করে ;
১) শেখ মুজিবুর রহমান ২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৩) তাজউদ্দিন আহমদ ৪) এম,এ,ঞ্জি ওসমানী ৫) সিরাজুল আলম খান ৬) আবদুল মান্নান ৭) আল্লার রহমান খান ৮) প্রফেসর মােজাফফর আহমদ ৯) অলি আহাদ। ১০) মিসেস মতিয়া চৌধুরী ১১) ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১২) ফয়জুল হক ১৩) তোফায়েল আহমন ১৪) নূরে আলম সিদ্দিকী ১৫) আবদুর রউফ ১৬) আবদুল কুদুস মাখন এবং অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ।
হানাদার বাহিনীর হামলার খবর পূর্বাহ্নে জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ কাল রাত্রিতে স্বীয় বাসভবনে অবস্থান করিবার মনস্থ করেন। পাকি হানাদার বাহিনী ভঁহার ধানমন্ডির ৩২নং রােডস্থ বাড়ী ঘেরাও করিলে শেখ সাহেব বিনাবাক্য ব্যয়ে ধরা দিলেন। শেখ মুজিবের মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণই ছিল আপামর দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাবা। বিস্ময়-বিমূঢ় দেশবাসী শেখ সাহেবের সংকট মুহূর্তে ভিন্ন আচরণে হইল বিভ্রান্ত ও হতবাক। জেনারেল মিঠার আদেশ ছিল শেখ সাহেবকে জীবিত বন্দী করিবার এবং তাহাই হইল। উপরে উল্লেখিত অন্য কাহাকেও গ্রেফতার করিতে পাক হানাদার বাহিনী সেই কৃষ্ণ রাত্রে ব্যর্থ হয়। তাই আজও আমরা জীবিত।
গ্রেফতারের পর শেখ সাহেব আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে কালাে রাত্রি যাপন করেন, ২৬শে মার্চ হকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে (Fla slate Floue) স্থানান্তরিত করা হয় এবং ২৮শে মার্চ বিমানযােগে শেখ সাহেবকে করাচী নিয়া যাওয়া হয়। | চতুর্দিকে গুজব ছিল শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেছে। ইহা মিথ্যা প্রমাণ করিবার জন্যই ২রা এপ্রিল (১৯৭১) করাচী বিমান বন্দরে তােলা ছবি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ছাপানাে হয় এবং তাহাকে ময়নওয়ালী কারাগারের বন্ধু প্রকোষ্ঠে বন্দী করিয়া রাখা হয়।
এইভাবে সমঝােতার নামে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতা ও লজ্জাকর কাপুরুষােচিত ভূমিকায় অভিনয় করেন। পাছে এই গণহত্যা অভিযান, লােমহর্ষক ধর্ষণকাহিনী ও গহসাহের এবং ধ্বংসযন্ত্রের কাহিনী ফাঁস হইয়া যায়, তাই হােটেল ইন্টারকন্টিন্যান্টালে ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে প্রথমে আটক করা হয় এবং
শেখ মুজিবের গ্রেফতারবরণ | পাকিস্তানী সামরিক শাসকবর্গ ২৫শে মার্চের অপারেশনের নাম দিয়াছিল “অপারেশন সার্চ লাইট”। তদানীন্তন ঢাকাস্থ পাকিস্তানী সামরিক হেড কোয়ার্টারের জনসংযােগ কর্মকর্তা লেঃ কঃ সিদ্দিক সালেক রচিত “Witness to surrender” নামক গ্রন্থে এই অপারেশনের পূর্ণ নীল নকশা বিবৃত হইয়াছে। উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্ট-২ এবং ১৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হইয়াছে যে, নিম্নোক্ত ১৬ জন ও অন্যান্য রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত কবিরার জন্য আর্মি হেড কোয়ার্টার তাহাদের এজেন্সীকে নির্দেশ প্রদান করে ;
১) শেখ মুজিবুর রহমান ২) সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৩) তাজউদ্দিন আহমদ ৪) এম,এ,ঞ্জি ওসমানী ৫) সিরাজুল আলম খান ৬) আবদুল মান্নান ৭) আল্লার রহমান খান ৮) প্রফেসর মােজাফফর আহমদ ৯) অলি আহাদ। ১০) মিসেস মতিয়া চৌধুরী ১১) ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ১২) ফয়জুল হক ১৩) তোফায়েল আহমন ১৪) নূরে আলম সিদ্দিকী ১৫) আবদুর রউফ ১৬) আবদুল কুদুস মাখন এবং অন্যান্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ।
হানাদার বাহিনীর হামলার খবর পূর্বাহ্নে জ্ঞাত হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ কাল রাত্রিতে স্বীয় বাসভবনে অবস্থান করিবার মনস্থ করেন। পাকি হানাদার বাহিনী ভঁহার ধানমন্ডির ৩২নং রােডস্থ বাড়ী ঘেরাও করিলে শেখ সাহেব বিনাবাক্য ব্যয়ে ধরা দিলেন। শেখ মুজিবের মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণই ছিল আপামর দেশবাসীর প্রত্যাশা ও আকাবা। বিস্ময়-বিমূঢ় দেশবাসী শেখ সাহেবের সংকট মুহূর্তে ভিন্ন আচরণে হইল বিভ্রান্ত ও হতবাক। জেনারেল মিঠার আদেশ ছিল শেখ সাহেবকে জীবিত বন্দী করিবার এবং তাহাই হইল। উপরে উল্লেখিত অন্য কাহাকেও গ্রেফতার করিতে পাক হানাদার বাহিনী সেই কৃষ্ণ রাত্রে ব্যর্থ হয়। তাই আজও আমরা জীবিত।
গ্রেফতারের পর শেখ সাহেব আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে কালাে রাত্রি যাপন করেন, ২৬শে মার্চ হকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে (Fla slate Floue) স্থানান্তরিত করা হয় এবং ২৮শে মার্চ বিমানযােগে শেখ সাহেবকে করাচী নিয়া যাওয়া হয়। | চতুর্দিকে গুজব ছিল শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেছে। ইহা মিথ্যা প্রমাণ করিবার জন্যই ২রা এপ্রিল (১৯৭১) করাচী বিমান বন্দরে তােলা ছবি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ছাপানাে হয় এবং তাহাকে ময়নওয়ালী কারাগারের বন্ধু প্রকোষ্ঠে বন্দী করিয়া রাখা হয়।
এইভাবে সমঝােতার নামে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিশ্বাসঘাতকতা ও লজ্জাকর কাপুরুষােচিত ভূমিকায় অভিনয় করেন। পাছে এই গণহত্যা অভিযান, লােমহর্ষক ধর্ষণকাহিনী ও গহসাহের এবং ধ্বংসযন্ত্রের কাহিনী ফাঁস হইয়া যায়, তাই হােটেল ইন্টারকন্টিন্যান্টালে ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে প্রথমে আটক করা হয় এবং
২৬শে মার্চ (১৯৭১) পাঠাইয়া দেওয়া হয় বিমানযােগে ঢাকার বাহিরে।
পশ্চিম পাকিস্তানের গীয়ানওয়ালী কারাগারে আটক থাকাকালে আগস্ট মাসে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েট রাশিয়া ও ভারতসহ বিঘ্নি দেশের অবিরাম প্রচেষ্টা ও জাগ্রত বিশ্ববিবেকের চাপে পাক-সরকারের পক্ষে শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের প্রাণনাশ করা সম্ভব হয় নাই। শেখ সাহেব নেতৃবৃন্দকে ঢাকা ত্যাগ করে গা-ঢাকা দেওয়ার পরামর্শ দিলেও আন্দেলনের খাতিরে নিয়ে আত্মগােপন করেন নাই কেন? ১৯৪৯ সালের অক্টোবর ব্যতীত অতীতেও গণ-আন্দোলনের প্রয়োজনে শেখ সাহেব কথনও আত্মগোপন করেন নাই। দেখা গিয়াছে, সকল আন্দোলনের সূচনা মুহূর্তে স্বগৃহে অবস্থান করিয়াই তিনি গ্রেফতারবরণ করিতেন। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রয়ােজনে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য আলােচনায় বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবরের উপস্থিতির অপরিহার্যতা সন্দেহের অবকাশ রাখে না। প্রকাশ, মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ ফারল্যান্ড শেখ সাহেবের সহিত তাহার বাসঊবনে দেখা করিয়া তাহার জীবনের নিরাপত্তায় মার্কিন সাহায্যের নিশ্চয়তা দিয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, ২১শে জুন এস,এস পন্থা ও এস,এস সুন্দরবন অত্র বােঝাই বিষয়ে সিনেট সাব কমিটি অন রিফিউজি’র নিকট সাক্ষাদানকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি এসিসট্যান্ট সেক্রেটারী মিঃ ক্রিস পান যাহা বলিয়াছিলেন, তাহা রাজনৈতিক সমাধানকল্পে পাকিস্তানের সহিত আলােচনার ইঙ্গিত বহন করে। বােধহয় এই কারণেই বন্দী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকায় অবস্থানকারী পরিবারের ব্যয় বহনকয়ে পাক সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে প্রতি মাসে ১৫০০ (পনের শত টাকা) করিয়া মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। নিউজ উইকের সিনিয়র এডিটর আর ডি বােরচগ্রেভের (Arnand de Brochgrave) সহিত এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই মর্মেও আভাস দিয়াছিলেন যে, “জাতি দাৰী করিলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিবেন।” ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক
প্রসঙ্গত ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক সম্পর্কে দু’একটি কথা না বলিলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হইবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই ছাত্র সংগঠনটির অবদান অনস্বীকার্য নয়, অত্যন্ত পৌরবােম্বলও বটে। সরকারী অর্থানুকুল্যে প্রকাশিত ১৪ খন্ডের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলসহ মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা অনেক গ্রন্থেও স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ছাত্র সংগঠনটির নানাবিধ সাহসী ভূমিকার কথা উল্লেখ রহিয়াছে। | ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক প্রতিষ্ঠা লাভ করে উনিশ’শ একাকুরের ১৭ই ফেব্রুয়ারী। বস্তুতঃ বাংলা ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রশক্তির একদল মেধাবী ও সম্ভাবনাময় তরুণের সমন্বয়ে গােড়াপত্তন ঘটে এ সংগঠনটির। তােপখানা রােডের দোতালায় (বর্তমান হােটেল সম্রাট) এক অনাড়ম্বর ছাত্র সমাবেশে এই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। সে সমাবেশে জনীৰ লুর রহমানকে সভাপতি জনাব সৈয়দ ওয়াজেদুল করিমকে
সাধারণ সম্পাদক ও জনাব মােঃ এহসানুল হক সেলিমকে সাংগঠনিক সম্পাদক করিয়া ৩১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। অন্যান্য নির্বাহী সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সর্বজনাব সিরাজুল ইসলাম, চৌধুরী মােহাম্মদ ফারুক, ফোরকান আহমদ, সাহনেওয়াজ খান, আলতাফ হােসেন, চৌধুরী সাইদুর রেজা মানিক, মমাশাররফ হােসেন খান (মালেক) ও মীর্জা সফিকুল ইসলাম প্রমুখ। ‘৭১-এর ১লা মার্চ হইতে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযােগ আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলিতে তাহাদের উচ্চকিত “মুক্তিফৌজ গঠন কর বাংলাদেশ স্বাধীন কর” এ বুলন্স আওয়াজ সারা বাংলায় এক অভূতপূর্ব শিহরণ জাগায়। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি লগ্নে স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত ফরওয়ার্ড টুডেন্টস ব্লক যে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করে তার সার্বিক নেতৃত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জনাব মােঃ এহসানুল হক সেলিম।
স্বাধীনতা যুদ্ধে এই সংগঠনের প্রত্যেকেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এর মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হইতেছে এই সংগঠনের সভাপতি লুৎফর রহমান ফরিদপুরে পাক বাহিনীর সহিত সম্মুখ যুদ্ধে ধূত হইয়া নিগৃহিত হন এবং পরবর্তীতে শাহাদত বরণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কোন ছাত্র সংগঠনের কেয় সভাপতির স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়া শহীদ হওয়ার গৌৱৰ একমাত্র ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকেরই। উপরন্তু ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক-এর সবাই মুক্তিযুদ্ধে কোন কোনভাবে নিগৃহিত হইয়াছেন।
স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পর ‘৭২ এর ১৪ই জানুয়ারীতে ফরওয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে “স্বাধীনতা বরণ উৎসব পালন করে। বর্ণাঢ্য সেই অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এক বিশাল ছাত্র জনসভাও অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ বিশেষ পরদিন বাংলাদেশ বেতারেও প্রচার করা হয়। সেই অনুষ্ঠানের আলোচনা সভায় বক্তাগণ স্বাধীন বাংলার তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে দেশ থেকে অনতিবিলম্বে ভারতীয় সৈন্য ভারতে ফেরৎ পাঠানাের ব্যবস্থা করা এবং ভারতের সাথে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের কোন গোপন চুক্তি হইয়াছে কিনা, হইয়া থাকিলে তা প্রকাশের দাবী জানান। সেই সভায় বক্তাগণ সরকারের প্রতিটি ভালো কাজে সহযােগীতা এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী যে কোন কার্যক্রমের কঠোর বিরােধীতা করিবার ঘােষণা প্রদান করেন। | স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হইয়াছিলেন জনাব চৌধুরী মােহাম্মদ ফারুক- পরবর্তীতে ১৯৭৩ এর ডিসেম্বরে। সংগঠনের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি সভাপতি ও জনাব আ.হ.ম আবদুল বাতেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একতরফাভাবে ভারত কর্তৃক ফারাক্কার পানি প্রত্যাহার, ২৫ সালা ভারত-বাংলা দাসত্ব চুক্তি, ভারত্তের সহিত সম্পাদিত সকল গোপন ও অসমচুক্তি বাতিলের আন্দোলনসহ মুজিব বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে এ ছত্রি সংগঠনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসিকতাপূর্ণ। নেতাদের আত্মগোপন।
২৭শে মার্চ সকাল ৮টায় সাক্ষ্য আইন কিছুক্ষণের জন্য শিথিল হইবার পর পরেই বাংলা মজদুর ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান সিরাজুল হক ইপিআর টিসি’র গাড়ী লইয়া আমার ৭নং কলেজ স্ট্রীট ধানমন্ডি বাসভবনে আসেন। আমি তাঁহার সহৃদয়তায় বিমােহিত ও কৃতজ্ঞ। দেওয়ান সাহেবের গাড়ী লইয়াই আমি সহােদরা বােন সুফিয়া ও তাহার সন্তানদিগকে রেলওয়ে অফিসার্স বাংলাে হইতে ঢাকার এলিফ্যান্ট রােডে উর্দুভাষিনী মিসেস রাজিয়া বেগমের হেফাজতে পৌছাইয়া বিদায় গ্রহণ করি। রেলওয়ে অফিসারদের বাংলােগুলিতে বাঙ্গালী পরিবারের উপরে নামিয়া আসিয়াছিল নারকীয় পরিস্থিতি। সতর্ক সাহসী ও সহৃদয় মিসেস রাজিয়া বেগম ১৯৭১ সালের ভয়াবহ নয়টি মাস আমার বােনের পরিবারের যুবক-যুবতী ও শিশু-সন্তানদের, বােনের স্বামী রেলওয়ে অফিসার কফিলউদ্দিন আহমদ ও বােনকে আশ্রয় দান করিয়া ইজ্জত ও প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন। তাহার নিকট আমরা চিরকৃতজ্ঞ। ভারত হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া আমিও ভঁহার আবাসস্থলে আত্মগােপন অবস্থায় জীবন যাপন করিয়াছি।
২৭শে মার্চ ভাের ৮ ঘটিকা হইতে অপরাহ্ন ৪ ঘটিকা পর্যন্ত এবং ২৮শে মার্চ ভাের ৭টা হইতে দ্বি-প্রহর ১২টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হয়। পরে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা করিয়া সান্ধ্য আইন শিথিলের মেয়াদ অপরাহ্ন ৫টা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় এবং পরবর্তী দিবসগুলিতে সান্ধ্য আইন আরাে শিথিল করা হয়।
ঢাকায় বাঙ্গালী পুলিশ বাহিনী ও গােয়েন্দা কর্মচারীরা তখন পলাতক। অতএব বাঙ্গালী গোয়েন্দা কর্মচারীর অবর্তমানে সাহসী রাজনৈতিক কর্মীর পক্ষে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার সহিত যোগাযােগ রক্ষা করা কঠিন ছিল না। তাই আমরা শাহজাহানপুরে দেওয়ান সিরাঙ্কুল হকের বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হইয়া উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনা করিয়া প্রতিরােধ সংগ্রাম সংগঠিত করিবার এবং প্রতিরােধ শক্তি মংহত করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
বলাই বাহুল্য যে, সরকারী রােষ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপর ছিল প্রচন্ড। তাই আত্মগোপন ছাড়া তাহাদের উপায় ছিল না। সন্ধ্য-আইন শিথিল হইবার সঙ্গে সঙ্গে নগরবাসী প্রায় সকলেই পরিবার-পরিজনসহ ঢাকা ত্যাগে উদ্যোগী হন। এইসব পলায়নপর কাফেলার অন্তর্ভুক্ত নারী ও শিশু সন্তানের চরম কষ্ট স্বচক্ষে না দেখিলে অনুধাবন করা যাবে না। যানবাহন নাই, সম্বল স্বীয় পদযুগল, নিজ নিজ শিরে বাক্সপেটরা, কাখে দুধের শিত। তবু চলিতে হয় জান-মাল-ইজ্জতের তাগিদে। কেহ কেহ দেশ ছাড়ার ব্রতী হইয়াই ভিনদেশের অচেনা পরিবেশে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করে। এই কাহিনী লিখা সম্ভব নয়। কারণ, তখনকার দৃশ্য বর্ণনা করিবার জন্য ভাষার উপর যে দখল থাকা দরকার, তাহা আমার নাই। এমনি কাফেলার সঙ্গী হইয়া পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি নেতা জনাব মনসুর
আলীসহ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের যুবক সদস্য ডাঃ আবু হেনা নদী পাড়ি দেন এবং অপরর্তীরে জিঞ্জিরা পথে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব কামরুজ্জামানের সহিত তাহাদের মােলাকাত হয়। তাঁহারা একই সঙ্গে কলাতিয়ার জনাব রতন সাহেবের বাড়ীতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। পূর্বাহে ঐ বাড়ীতে শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং রাত্রে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদুস মাখনও আশ্রয় সন্ধানে ঐ বাড়ীতে আসেন। | রাত্রির আলােচনা বৈঠকের সিদ্ধান্ত মােতাবেক সর্বজনাব মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মনি, তােফায়েল আহমদ ও ডাঃ আবু হেনা ৪ঠা এপ্রিল ভারতের পথে সারিয়াকান্দি পৌছেন। পরিবার-পরিজনের জন্য বিচলিত মনসুর আলী স্পীডবােটযোগে সিরাজগঞ্জ যাত্রা করেন। সারিয়াকান্দি হইতে ৪ঠা এপ্রিল (১৯৭১) বগুড়া পৌছিয়া জীপযােগে সর্বনাব কামরুজ্জামান, শেখ ফজলুল হক মনি, তােফায়েল আহমদ ও ডাঃ আবু হেনা পাক-হিলি সীমান্ত অতিক্রম করিয়া ভারতীয় হিলিতে প্রবেশ করেন এবং তথা হইতেই ওই এপ্রিল (১৯৭১) কলিকাতা পেীছেন। প্রকাশ, তাহারা নাকি পূর্ব ব্যবস্থা মােতাবেক ভবানীপুর এলাকার ডাঃ রাজেন্দ্র রােডের ২৬ নং বাড়ীতে পৌছান এবং তথায় তাহাদের অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। ঐ বাড়ীতে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শ্ৰী ভূ ভূষণ রায় এই নামে বরিশাল জেলা নিবাসী সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থা পরিষদের সদস্য শ্রী চিত্তরঞ্জন সুতার স্ত্রী-পুত্র ও কয়েকজন সহকর্মীসহ বাস করিতেন। প্রকাশ, তিনিই ভারত সরকার ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে যােগসূত্র হিসাবে কাজ করিতেন এবং ভারত সরকারই তঁাহাকে এ বাড়ীর ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছিলেন। | এই সময় কলিকাতায় খবর আসে যে, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম যথাক্রমে মােহাম্মদ আলী, রহমত আলী ছদ্মনামে দিল্লীতে অবস্থান করিতেছেন। উহাৱা ২ এপ্রিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত আলােচনা বৈঠকে মিলিত হন। উল্লেখ্য যে, তাহারা উভয়েই ৩০শে মার্চ বনগাঁয় পৌছিয়াছিলেন। তাহাদের পরিচয় পাওয়া মাত্র বিএসএফ-এর একজন মেজর তাহাদিগকে স্যালুটদানের পর বিওপিতে (Border out post) লইয়া গিয়া যথারীতি আদর-আপ্যায়ন করেন। ইহা জনাব তাজউদ্দিন-এর ১৮ই মার্চ প্রেরিত ম্যাসেজ যথাস্থানে পৌছিবার ফল। ওই রাত্রিতেই দিল্লী হইতে তাহাদের উদ্দেশ্যে হেলিকপ্টার পাঠান হয়। তাহারা দিল্লীর পথে যাত্রা করেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭২-এর ১৪ই মার্চ সাংবাদিক সম্মেলনের এক পর্যায়ে উপরোক্ত তথ্য সরবরাহ না হয়।
পরবর্তী তথ্য হইতে ইহাও জানা যায় যে, যশােহর হইতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য মােশাররফ আলী সর্বপ্রথম দিল্লী গমন করেন ও ভারতীয় সরকারের সহিত যােগাযোগ স্থাপন করেন।
অস্থায়ী সরকার
যাহা হউক, কলিকাতায় দলীয় নেতৃবৃন্দের সহিত আলোচনার পর জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম পুনঃ দিল্লী গমন করেন এবং ৫ শু ৬ই এপ্রিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহিত দুই দিবসব্যাপী আলােচনায় ভারতবাংলাদেশ সহযােগিতার ভিত রচিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযােগিতার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, জনাব তাজউদ্দিন আহমদের এই দিল্লী অবস্থানকালেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী পদে তাহার অধিষ্ঠিত হইবার ঘােষণা টেপ রেকর্ডিং করা হয়। ভারত সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আনিবার জন্য ডাঃ আবু হেনাকে ময়মনসিংহ প্রেরণ করেন। ডাঃ আবু হেনা গাৱাে এলাকাভুক্ত গারােবােদা হইয়া ময়মনসিংহ যান। ৮ই এপ্রিল জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লী হইতে কলিকাতায় ফিরিয়া আসেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহের অন্তর্গত গারাে হিলের ঢালু হইয়া ভারতে প্রবেশ করতঃ তুরাতে অবস্থান করিতেছেন- এই খবর পাইয়া জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ও শেখ ফজলুল হক মনি শিলিগুড়ি রওয়ানা হইয়া যান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে লইয়া কলিকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। এইভাবে ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন পথে যেসব নেতা কলিকাতা পৌছেন, তাঁহাদের মধ্যে সর্বজনাব মনসুর আলী, কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, মিজানুর রহমান চৌধুরী ও অধ্যাপক ইউসুফ • আলী উল্লেখযােগ্য। ভারত সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর বিএসএফ-এর কলিকাতা হেড অফিসে অবস্থানের ব্যবস্থা করেন। ভারত সরকারের এবদি তৎপরতার অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল সুস্পষ্ট অর্থাৎ যাহাতে ভারত সরকারের অভীষ্ট সিদ্ধি অর্থাৎ পাকিস্তানকে বিভক্ত করিবার মােক্ষম সুযােগ হাতছাড়া না হয়। অনেক বাক-বিতন্ডার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মােশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, কামরুজ্জামানকে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হিসাবে ঘােষণা করিয়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন হয়।
১নং ক্যামাক স্ট্রীটে এম.এল.এ হােস্টেলে (ব্যবস্থাপক পরিষদ সদস্য ডুবন) জনাব কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে পুর্ব পাকিস্তান হইতে আগত ৭৬ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সর্বজনমান্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মােশতাক আহমদ, তাজউদ্দিন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে উপদেষ্টা করা হয়। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ সভায় উপস্থিত ছিলেন না। অধ্যাপক ইউসুফ আলী সভার কার্যবিবরণী ও প্রস্তাব লিপিবদ্ধ করেন।
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সহিত দিল্লীতে আলােচনাকালে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ।
আমি জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যােগাযােগ রক্ষা করিতাম এবং মাঝে মাঝে তাহার অভয়দাস লেনের বাসায় রাত্রিযাপন করিতাম। তঁাহার বাসায় রাত্রিযাপন করিতে গিয়া তাহারই রেডিও সেটে ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে ‘স্বাধীন বাংলার ঘােষণা শুনিতে পাই। চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্র। হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশাহারা, হতভম্ব, সম্বিতহারা ও মুন্থিতপ্রাণ বাংগালী জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িবার আহবান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াই-এর সংবাদ । ফলে সর্বত্র উচ্চারিত হয় মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পছনের সংকল্প, আওয়াজ উঠে- জালেমের নিকট আত্মসমর্পণ নয়, আহবান ধ্বনিত হইতে থাকে আত্মপ্রতিষ্ঠার, প্রতিরােধ শক্তিকে সুসংহতকরণের । এইভাবেই সেদিন জাতি আত্মসম্বিৎ ফিরিয়া পায় এবং মরণপণ সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়ে। | যাহা হউক, জনাব আনিসুজ্জামানের রিপাের্ট শুনিবার পর আমি ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত সাক্ষাতের আশা ত্যাগ করিয়া আগরতলায় যাওয়ার মনস্থ করি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত করি এবং বিভিন্ন গ্রুপে বাংলা জাতীয় লীগ কর্মীদিগকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ছড়াইয়া পড়িবার নির্দেশ দান করি। স্থানীয় পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করিয়া স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দিবার ও দলমতনির্বিশেষে প্রতিরােধ শক্তিকে সুসংহত করিবার আহবান জানাই। ঢাকা নগরীকে যােগাযােগ রক্ষার কেন্দ্রস্থল ঘােষণা করি। আমরা মুক্তি সংগ্রামের একটি দলীয় কর্মসূচী প্রণয়ন করি এবং কর্মীদের উদ্দেশ্যে উহার মাধ্যমে যথাযথ নির্দেশ দিয়া সবাইকে মুক্তি সংগ্রামের মূল প্রতিরােধ শক্তি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত যােগাযােগ করিবার নির্দেশ দেই। এইভাবে সবকিছু ঠিকঠাক করিয়া দিয়া আমি ৩রা এপ্রিল আগরতলার পথে ঢাকা ত্যাগ করি। জনাব গাফফার চৌধুরীর আমাদের সহিত যাইবার কথা ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণে তিনি নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা করিতে পারেন নাই।
যাত্রা পথে দেওয়ান সিরাজুল হক ও আমি ডেমরা ও নরসিংদী অতিক্রম করিয়া নবীনগর পৌছি এবং নবীনগরে আমার বড় ভাইয়ের শ্বশুর জনাব আমীর আলী খান সাহেবের বাড়ীতে রাত্রিযাপন করিয়া ৪ঠা এপ্রিল ভাের লঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাই। সেখানে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য লুৎফল হাই সাহুর সহিত উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ আলােচনা হয়। মেজর খালেদ মােশাররফ তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্ত এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যুহের সিপাহসালার।
এরপর আমি ও দেওয়ান সিরাজুল হক আখাউড়া যাই এবং আখাউড়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এম,এ, তাহেরের আতিথ্য গ্রহণ করি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া হইতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য আলী আজম ভূঁইয়া আগরতলায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের পক্ষ হইতে ৮ই এপ্রিল আমাদের সহিত রাজনৈতিক আলােচনা করিবার
জন্য আখাউড়া আসেন এবং আমরা এম,এ, তাহেরের বাসভবনে আলােচনা বৈঠকে মিলিত হই। বৈঠকে আমরা নিম্নলিখিত ঐকমত্যে পৌছি :
১। ভারতীয় সৈন্যকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার দেওয়া হইবে না। ২। মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর ভারতীয় হিন্দু বাংগালীদের বাংলাদেশে প্রবেশাধিকার
| দেওয়া হইবে না। ৩। লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী সার্বভৌম ও স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠন। পূর্ব | পাকিস্তান ভারতভুক্ত অংশ হইবে না। ৪। মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পর দেশে কোন ফৌজি শাসন কায়েম হইবে না।
জনাব আলী আযম ভূঁইয়ার সহিত আলােচনার পর আমি পুনরায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রত্যাবর্তন করি। ১৪ই এপ্রিল অপরাহ্ন তিন ঘটিকার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিমান হামলা। হয়। ১৫ই এপ্রিল ভোরে পুনরায় পাক বিমান বাহিনীর হামলা চলিল। বিমান হামলার পর আমি ও দেওয়ান সিরাজুল হক পুনরায় আখাউড়া পথে ব্রাক্ষণবাড়িয়া ত্যাগ করি। পরে আমরা আখাউড়া হইতে সীমান্ত গ্রাম চাঁদপুরে আশ্রয় গ্রহণ করি এবং এইভাবে। প্রস্তুতি গ্রহণ করি যাহাতে প্রয়ােজন দেখা দিলে আত্মরক্ষার কারণে যেন ত্বরিত ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারি। পাক হাওয়াই হামলায় পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ও বেঙ্গল আমি বিনা যুদ্ধে ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গােপনাঘাট, উজানীসার ও আজমপুর হইতে পশ্চাদপসরণ করে এবং অনায়াসেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাক বাহিনীর করায়ত্ত হয় ।
সীমান্তগ্রামগুলি পাক বাহিনীর বিষদৃষ্টিমুক্ত নয় এই আশংকায় ও সীমান্তের অপর পাড়ে সরকারের নিকট হইতে বাস্তব সাহায্যের আশায় ও মুক্তিকামী সহযােগী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহিত ঐক্যবদ্ধ কর্মপন্থা নির্ধারণকল্পে আমরা পরিশেষে সীমান্ত অতিক্রম করিয়া আগরতলায় পৌছি। ভারতের অভিজ্ঞতা | আগরতলায় লক্ষ্য করি, আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও সমর্থক ব্যতীত অন্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা ও কর্মীদের অবস্থা অত্যন্ত শশাচনীয়। তবে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দলগুলির সংকট চরম ও বর্ণনাতীত ছিল। আওয়ামী লীগ প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দল ছিল না, ইহা ছিল বরং ক্ষমতা লিলু, নীতি বিবর্জিত রাজনৈতিক কর্মীদের সমাবেশ মাত্র। তাই বলিয়া আওয়ামী লীগে যে কিছুসংখ্যক আদর্শবাণী নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন না, তাহা নহে, তবে তাহারা ছিলেন ব্যতিক্রম। | কমিউনিষ্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও তাহাদের গণ-সংগঠন কর্মীদের আহার ও বাসস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারৰ্তীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কো বা পিকিং)। আমরা জাতীয়তাবাদী দলগুলি তাহাদের সহযােগী মুক্তিযােদ্ধা দল, সেই বােধটুকু তাহাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় নাই। তাহারা ছিল আত্মার্ধগত প্রাণ, আত্মবিলীনগত প্রাণ নহে। মন্তব্যটি কটু নাইলেও নির্মম সত্য। | আগরতলায় আমি স্বল্পবেতনভুক সরকারী কর্মচারী বাবু সুধীরচন্দ্র ঘােষের বাড়ীতে আতিথ্য গ্রহণ করি। মহপ্রাণ সুধীর বাকুর আতিথেয়তা ও অমায়িক ব্যবহার আমার স্মৃতিপটে চিরজাগরুক থাকিবে। তাহারই বাসভবনে জনাব সিরামুল আলম খান ও জনাৰ আ স ম আবদুর রবের সহিত মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা হয়। তাহারা আমার সহিত নীতিগতভাবে একমত হলেও বাস্তবে ১৬ই ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের মহড়া দিয়াছেন, কিন্তু বাংলার মাটিতে দাঁড়াইয়া মাতৃভূমির মুক্তির জন্য পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েন নাই। তাহারা উভয়েই পৃথক পৃথক আলােচনায় আমাকে কলিকাতার অস্থায়ী সরকার প্রধান জাজউদ্দিন আহমদের সহিত দেখা করিবার প্রস্তাব দিলে আমি তাহাদিগকে বলি, প্রথমতঃ আমার বুঝা দরকার, জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ভারতের ক্রীড়নক শক্তি কি না, দ্বিতীয়তঃ ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হইবে, নাকি বঙ্গসন্তানরাই বঙ্গের স্বাধীনতা পরিচালনা করিবে। যদি ভারতীয় সৈন্য সশরীরে যুদ্ধে অংগ্রহণ করিয়া বাংলাদেশের মাটিকে পাক বাহিনীমুক্ত করে, তাহা হইলে কার্যক্ষেত্রে আমরা ভারতের ক্রীড়নক রাষ্ট্রই পরিণত হইব। তৃতীয়তঃ আওয়াম লীগের নেতৃত্ব বাংলা জাতীয় লীগের মতাে সহযােগী স্বাধীনতা কামী দলগুলির সহিত যুক্তভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করিতে সম্মত আছে কি না? চতুর্থতঃ এখানকার অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছে আপনাদের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক নহে। চতুর্থ মন্তব্যের উত্তরে আ স ম আবদুর রব দৃঢ়তার সহিত বলিলেন, ভারত সরকার জানেন, আমাদের শক্তি আছে কিনা। তাই ভারত সরকার আমাদিগকে পৃথকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় বাস্তব সাহায্য দিবে, এই মর্মে আমরা (সিরাজুল আলম গ্রুপ) আশ্বাস পাইয়াছি।* কথা প্রসঙ্গে তিনি আমার সহিত এই বিষয়েও একমত হইলেন যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত করিতে হইবে। সিরাজুল আলম খান তখন কলিকাতা রওয়ানা হওয়ার পথে। তিনি বলিলেন যে, কলিকাতায় অবস্থানরত অস্থায়ী সরকারের সহিত আমার বক্তব্য সম্পর্কে আলােচনা করিয়া আমাকে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের মাধ্যমে ফলাফল জানাইবেন। সিরাজুল আলম খান কলিকাতা গেলেন বটে, তবে প্রতিশ্রুতি মােতাবেক কোন উত্তর আমাকে কথনও পাঠান নাই। সেইদিন আমি যে আশংকা প্রকাশ করিয়াছিলাম, পরবর্তীকালে হইয়াছেও ‘তাহাই। ভারত নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতেই পাকিস্তানের অভ্যুদয় লগ্ন হইতে পাকিস্তান ধ্বংসের চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়ােগ অব্যাহত রাখিয়াছে আর আমরা আমাদের নিজস্ব প্রয়ােজনে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা চাহিয়াছি। ইহা শুধু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নয়, অনুধাবনের বিষয়।
যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত বাংলা জাতীয় লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এম.এম. আনােয়ারের উদ্যোগে আগরতলা এসেম্বলি মেম্বার রেস্ট হাউসে আমার ও আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মালেক উকিলের মধ্যে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর এক দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অমির প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পূর্ব মুহুর্ত অবধি কোন নির্দেশ দান করেন নাই। এইদিকে মুজিব-ইয়াহিয়ার মার্চ-এর আলােচনার সূত্র ধরিয়া কনফেডারেশন প্রস্তাবের ভিত্তিতে সমঝােতার আলােচনা চলিতেছে। জনাব মালেক উকিল আমাকে ইহাও জানান যে, তিনি এই আলােচনার ফলাফল সম্পর্কে আশাবাদী। প্রসঙ্গত ইহাও উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে আমি সর্বজনাব আবদুল মালেক উকিল, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল হান্নান চৌধুরী, আলী আজম, খালেদ মােহাম্মদ আলী, লুস্থুল হাই সাঙ্গু প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতার সহিত বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে আলােচনাকালে নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা বা লক্ষ্য সম্পর্কে কোন নির্দেশ দিয়াছিলেন কিনা, জানিতে চাহিয়াছিলাম। তাহারা সবাই স্পষ্ট ভাষায় ও নিঃসঙ্কোচে জবাব দিলেন যে, ২৫ মার্চ পাক বাহিনীর আকস্মিক অতর্কিত হামলার ফলে কোন নির্দেশ পান কিংবা পরামর্শ দান নেতার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। অথচ স্বাধীনতা উত্তরকালে বানােয়াটভাবে বলা হয় যে, তিনি পূর্বাহ্নেই নির্দেশ প্রদান করিয়াছিলেন। শুধু তাহাই নয়, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৭ই এপ্রিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে ঘােষণা করেন যে, তিনি নির্দেশনাম জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীকে পাঠাইয়াছিলেন। কথিত সেই নির্দেশনামটি নিম্নরূপ :
DECLARATION OF WAR OF INDEPENDENCE |
BY BANGABANDHU SK. MUJIBUR RAHMAN A historic message from Bangabandhu Sk. Mujibur Rahman conveyed to Mr. Zahur Ahmed Chowdhury on 25th March, 1971 at 11.30 hours immediately after crack-down of Pak Armay.
“Pak army suddenly attacked E.P.R. base at Pilkhana, Rajarbagh Police line and killing citizens, Streets battles are going on in every street of Dacca, Chittagong. I appeal to the nations of the World for help. Our freedom fighters are gallantly fighting with the enemies to free the motherland. I appeal and order you all in the name of Almighty Allah to fight to the last drop of blood to liberate the country. Ask Police, E.P.R; Bengal Regiment and Ansar to stand by you and to fight. No compromise, Victory is ours. Drive out the last enemy from the holy soil of motherland. Convey this message to all Awami League leaders, workers and other patriots and lovers of freedom. May Allah bless you.
“Joy Bangla”
Sk. Mujibur Rahman (This message was communicated from Teknaf to Dinajpur and to
friendly countries through some vessels which were anchored at Bay of Bengal near Chittagong by Mr. Zahur Ahmed Chowdhury)
পাক বাহিনীর আক্রমণের অব্যবহিত পর রাত সাড়ে ১১টায় (২৫শে মার্চ, ১৯৭১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক জনাব জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট প্রেরিত একটি ঐতিহাসিক বাণী : (অনুবাদ) | “পাক বাহিনী আকস্মিকভাবে পিলখানাস্থ ইপিআর বেইজ এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করিয়াছে এবং নাগরিকদের হত্যা করিতেছে। ঢাকা চট্টগ্রামে প্রতিটি রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলিতেছে। আমি সাহায্যের জন্য বিশ্বের জাতিসংঘের প্রতি আবেদন জানাইতেছি। মাতৃভূমিকে মুক্ত করিবার জন্য আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শক্রর সহিত বীরের মতাে যুদ্ধ করিতেছে। আমি সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার নামে দেশকে মুক্ত করিবার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালাইয়া যাওয়ার জন্য আপনাদের প্রতি আবেদন জানাইতেছি এবং নির্দেশ প্রদান করিতেছি। পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আনসারদের আমাদের পাশে দাঁড়াইয়া যুদ্ধ করিবার জন্য নির্দেশ প্রদান করুন। কোন আপােষ নাই, বিজয় আমাদেরই হইবে। | মাতৃভূমির পবিত্র মুক্তিকা হইতে শেষ শত্ৰুটিকেও বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপিয়াসী ব্যক্তিদের নিকট এই বাণী পৌছাইয়া দিবেন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হউন।
জয় বাংলা
শেখ মুজিবুর রহমান উপরে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাক্ষ্য অনুসারেই শেখ মুজিবুর রহমানের এই দাবী যে বিতর্কের উর্ধ্বে নয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র” গ্রন্থাবলীতে প্রকাশিত বার্তাটি হচ্ছে এটাই হয়তাে আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আহবান জানাচ্ছি, আপনারা যেখানেই আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে দখলদার বাহিনীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রতিরােধ করুন। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি হইতে বহিষ্কার এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। উপরােক্ত বক্তব্যটিই হুবহু ভারতীয় বৈদেশিক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত “বাংলাদেশ ডকুমেন্টসেও পূর্বাহ্নে ছাপা হয়। অবশ্য একথা সত্য যে, সেইদিন আমার মতাে কোটি কোটি উৎকণ্ঠিত বাঙ্গালীপ্রাণ উল্লিখিত অনুরূপ একটি নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বাধীনতার কোন ঘােষণা দেন নাই তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭১-এর ৬ই নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভাষণ দেন সে ভাষণে। সেই ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন,
…The cry for Independence (of Bangladesh) arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He (Mujib) himself, so far as I know has not ask for Independence even now…. | “স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠে (বাংলাদেশের) শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর তার আগে নয়। আমি যদূর জানি আজো পর্যন্ত শেখ মুজিব স্বাধীনতা দাবী করেননি।” | পক্ষান্তরে সেই অন্ধকার ও সংকটময় মুহূর্তে ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র হইতে ভাসিয়া আসিয়াছিল একটি নির্ভয় বীরদপী বিদ্রোহী কণ্ঠ। এই কণ্ঠই সেইদিন লক্ষ কোটি বাঙ্গালীকে দিয়াছিল অভয়বানী, ডাক দিয়াছিল মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার প্রয়ােজনে রক্তক্ষর্মী সম্রামে অংশগ্রহণ করিতে । কণ্ঠটি বেঙ্গল আর্মি মেজর জিয়াউর রহমানের । উক্ত ঘোষণার অংশ বিশেষ হইল :
“I major Ziaur Rahman head of the provisionery revoletionary Government of Bangladesh do hereby proclaim and declare the Independence of Bangladesh…. and also appeal to the all Democratic socialist and other countries of the world to immediate recognise our country Bangladesh. …. Insha Allah victory is ours.”
“প্রিয় দেশবাসী,
আমি মেজর জিয়া বলছি। এতদ্বারা আমি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি…
বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও অপরাপর রাষ্ট্রসমূহকে অনতিবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি।… ইনশা আল্লাহ জয় আমাদের সুনিশ্চিত।”
পরবর্তীতে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংশাধিত ঘােষণাটি নিম্নরূপ :
I major Ziaur Rahman on behalf of our great Leader Bangabandhu Sheikh Mujibar Rahman supreem commander and head of the provisionery Revoletionary Govt of Bangladesh do hereby proclaim and declare the Independence of Bangladesh. …
| সময়ােপযােগী নেতৃত্বদানের ব্যর্থতা ঢাকির জানাই পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান অসত্যের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া নির্দেশ প্রদানের একটি ঘােষণা পত্র ছাপাইয়া সাধারণ্যে বিলি করিয়াছিলেন। ইহা না করিয়া তাহার উচিত ছিল সময়োপযােগী অবদানের জন্য মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বীকৃতিদান, ইহা হইত নেতাসুলন্ত আচরণ। তাহার মানসিকতার কারণেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাভাবিকভাবেই তাহা করিতে ব্যর্থ হন। ইহা অতীৰ পরিতাপ এবং দুঃখের বিষয়। যাহা হউক, মেজর জিয়ার বলিষ্ঠকণ্ঠস্বর সেইদিন বাংগালী জাতিকে স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল কবির সেই অভয় বাণী : *উদয়ের পথে শুনি কার বাণী
ভয় নাই ওরে ভয় নাই; নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান
ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।” এই ভাবেই মেজর জিয়ার সেই ঘােষণা বাংগালী জাতির ধমনীতে সেইদিনের সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে জোগাইয়াছিল ঐশ্বরিক শক্তি; মনে-প্রাণে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছিল দৃঢ়প্রত্যয়, অম্মিবিশ্বাস ও আত্মিসম্মানবোধ। ফুলকথা, সেইদিন বাংগালীকে নিজস্ব সায় আত্মস্থ ও বলীয়ান করিবার জন্যই যেন মেজর জিয়ার আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। | শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা আন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে আপামর জনতার সার্বিক গণ-আন্দোলনে পান্তরিত করেন এবং এইভাবেই তিনি বাংগালী জনতার একচ্ছত্র ও অবিসংবাদিত নেতার আসনে আসীন হয়। ২৫শে মার্চ (১৯৭১) মধ্যরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের খবর পূবেিহ্ন সুন্নাত হইয়াও তিনি দুদমুহর্তে জাতির মরণপণ সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক হওয়া সত্ত্বেও থেস্থায় স্বীয় বাসভবনে অবস্থান করিয়া হানাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। ইতিহাস সচেতন মাত্রই জ্ঞাত যে, ১৯৪২ সালের আগস্টের অহিংস আন্দোলনের মহাপ্রাণ মহাত্মা গান্ধী ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়’ (Quit India) আন্দোলনের ডাক দিলে কারারুদ্ধ গান্ধী পন্থী লােকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ হাজারীবাগ কারাগার হইতে পলায়ন করিয়া সশরীরে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তদ্রপ শাসক ফরাসীদের বিরুদ্ধে আলজিরিয়ার মুক্তিযুদ্ধে সশরীরে নেতৃত্বদানের উদ্দীপনায় বিপ্লবী আহমদ বেনবেল্লাহ কারাগার হইতে পলায়ন করেন। গ্রেফতারী পরােয়ানা জ্ঞাত হওয়ার পর দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৬২ সালে গােপনে দেশ ত্যাগ করে আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদী রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ার জন্য সভা-সমিতি করেন। এমনকি লন্ডনে জনমত গড়ার জন্য আত্মগােপন অবস্থায় তাহার বক্তব্য দিতে সাহসী ভূমিকা পালন করেন। অতঃপর আত্মগোপন অবস্থায় দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। আমরা দেশবাসী পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশরীরে সেনাপতি চাহিয়াছিলাম- পাক হানাদার বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ চাই নাই । তথাপি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বিশাল সাংগঠনিক শক্তির কারণেই দেশবাসী তাহার নামেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণে কুণ্ঠাবােধ করে নাই। প্রসঙ্গ চট্টগ্রাম বেতার মারফত স্বাধীনতার ঘােষণা ও মেজর জিয়া | স্বাধীনতা যুদ্ধ হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয় কিংবা হঠাৎ করে রেডিওতে ভেসে আসা কোন এক ব্যক্তির ঘােষণায় সারাদেশের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়লাে এমনও নয়। একটি দেশের একটি জাতির, স্বাধীনতা সংগ্রাম দীর্ঘদিনের প্রস্তুতিরই ফসল। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাত-আত্মত্যাগ আর আত্মাহুতির বিনিময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট গড়ে উঠে। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা-বঞ্চন, আন্দোলন-সংগ্রাম আর জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের চরম পরিণতিরই ফলশ্রুতি। ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতেই পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙালী শাসক-শােষকগােষ্ঠী নিজেদেরকে ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে আসীন রাখার মানসে ছলে বলে কৌশলে আমাদেরকে তাদের পদানত রেখে কখনো ইসলামের নামে কখনাে গণতন্ত্রের নামে বিভিন্ন ভাবে তাদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রাখে। আমাদের ভাষা সংস্কৃতি ও কৃষ্টির উপর চালায় আগ্রাসন। এরই সূচনা হয় ১৯৪৮ সালে আমাদের মাতৃভাষার উপর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। এরপর রক্তস্নাত ‘৫২-এর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর নির্বাচনে এ অঞ্চলে মুসলিম লীগের ভরাডুবির মাধ্যমে যুফ্রন্টের বিপুল বিজয়, ‘৬২-এর আইউবী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ‘৬৬-এ শেখ মুজিবের ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর ১১ দফা আন্দোলন তথা আইউব শাহীর বিরুদ্ধে গণঅভুত্থান, ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে ৬ দর পক্ষে এদেশের মানুষের ম্যান্ডেট। স্বায়ত্তশাসন, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। ‘৫৫ এবং ‘৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম, ‘৭০-এ নির্বাচন বর্জন করে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ঘােষণা, ‘৭০-এর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে নিয়মমাফিক ক্ষমতা হস্তান্তর না করে চক্রান্তের আশ্রয় গ্রহণ— সবকিছু মিলিয়ে ২৩ : বছরের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর বেদনাই মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি করে। ২৫শে মার্চের কালাে রাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালীর উপর পাক বাহিনীর নগ্ন হামলার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সারাদেশে একই আওয়াজ- মুক্তিফৌজ গঠন করাে বাংলাদেশ স্বাধীন করাে” ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে এদেশের সর্বস্তরের মানুষ তখন স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত।
অবস্থা এমন দাড়ায় সমস্ত বেসামরিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে শেখ মুজিবের হাতে। সমস্ত দলমত ছাপিয়ে শেখ মুজিব হয়ে যান একচ্ছত্র নেতা। স্বাধীনতার প্রশ্নে দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী বিজয়ী দলের নেতা হিসাবে শেখ মুজিবকে মেনে নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামের একছত্র নেতা হিসাবে জাতীয় স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে। ২৫শে মার্চ কালাে রাত্রির পর চট্টগ্রামেও সঙ্গত কারণেই বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ছিল। ২৬শে মার্চ বেলা ২টায় চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ. হান্নান দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহবান জানিয়ে একটি ঘােষণা দেয়। যে কোন কারণেই হােক সেটি অনেকের গোচরীভূত হয়নি। পরে নেতৃবৃন্দ দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করা এবং দেশবাসীর মনে সাহস সঞ্চারের লক্ষ্যে সেনাবাহিনীর একজন বালী অফিসার দিয়ে বেতারে একটি ঘােষণা প্রদানের পরিকল্পনা করে। তুকালীন ইপিআর-এর দায়িত্বে নিয়ােজিত ক্যাপটেন রফিক বাংগালীদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার হিসেবে ৮ম ইষ্ট বঙ্গেল
হতভম্ব হয়ে পড়েন। পরে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী জনাব এ.কে, খান সাহেব তার বাসভবনে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে নিজ হাতে মেজর জিয়ার মাধ্যমে শেখ মুজিবের পক্ষে ঘােষণার জন্য সংশােধিত ঘােষণাটি লিখে দেন। | এই সংশােধিত ঘােষণাটি মেজর জিয়া সেদিনই ২৭শে মার্চ সন্ধ্যে ৭-৩০ মিঃ ইংরেজীতে পাঠ করেন এবং কিছুক্ষণ পর পর পুনঃ পুনঃ প্রচারিত হতে থাকে। অবশ্য এর মধ্যে এই ঘােষণার বাংলা অনুবালও প্রচারিত হতে থাকে। ঘোষণাটি নিম্নে উচ্চত করা হলাে :
“I Major Ziaur Rahman on behalf of our great leader, the supreeme commander of Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, do here by proclaim and declare the Independence of Bangladesh, and that the government headed by Bangabandhu Sheik Mujibur Rahman has already been formed. It is further proclaimed that Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman is the sole leader of the elected representitives of Seventy five millions people of Bangladesh and the Government headed by him is the only legilimate government of the people of the independent sovereign state of Bangladesh which is legally and constitutionaly formed and is worthy of being recognised by all the government, of the world. I therefor reppeal on behalf of our great leader Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman to the governments of all the Democratic, Socialist and other countries of the world specially the big powers and the Nighbouring countries to recognise the legal government of Bangladesh and take effective steps to stop immediately the awful genocide that has been curried on by the army of occupation from Pakistan. To dub out the legally elected representitive of the majority of the peoples as secessionist is a crude joke and contradiction to truth which should be fool none. The guiding princeple of the new state will be first Neutrality. Second peace and third friendship to all and enimity to none. May Allah help us. Joy Bangla.”
এটাই হলাে জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার ইতিহাস। বিভিন্ন স্থান থেকে এ ধরনের ঘােষণা এসেছে যেমন কুষ্টিয়া থেকে ইপিআর-এ দায়িত্বে নিয়ােজিত ক্যাপটেন অবুি ওসমান চৌধুরী, গাজীপুর থেকে তকালীন মেজর সফিউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তিতাস গ্যাসের মাইক্রোওয়েভ এর মাধ্যমে মেজর খালেদ মােশাররফ। তবে ওই সব ঘােষণাকে ছাপিয়ে জিয়ার ঘোষণাই বেশী সাড়া জাগিয়েছে এ কারণে যে, কালুরঘাট ট্রান্সমিশন কেন্দ্রটি ১০ কিলােওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল। এ কারণে এর ব্যপ্তি ছিল বেশী। জিয়াউর রহমানের ঘােষণাটি তৎকালীন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত
দেশবাসীকে নূতন করে সাহস আর আত্মবিশ্বাসের অভয়বাণী শুনিয়ে ছিল এবং নবউদ্যোমে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার প্রেরণা যুগিয়ে ছিল। এতে কিন্তু জিয়ার কোন একক কৃতিত্ব নাই- এটা মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা আর কার্যক্রমের মধ্যে একটি। পরে জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার হিসাবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন এবং যুদ্ধোত্তর কালে বীরত্বের জন্য বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হন এবং শেখ মুজিব শাসনামল ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডিপুটি চীফ অব স্টাফ এর দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। তার বাহিনীর নাম ছিল ‘জেড ফোর্স’। ২৫ থেকে ২৭শে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রামে ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে তৎকালীন ক্যাঃ রফিক, ক্যাঃ মীর শওকত আলী, লেঃ অলি আহমদ, ল্যাঃ শমসের মুবিন চৌধুরী, ক্যাঃ সুবেদ আলী ভূঁইয়ার অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান।
আজাদীর রক্তক্ষয়ী সঞ্চগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অবদান ছিল বর্ণনাতীত। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা করে সৈয়দ আব্দুস শাকের, মােস্তফা আনােয়ার, রেজাউল করিম চৌধুরী, রাশেদুল হাসান, আবুল কাসেম (সাপ), আমিনুর রহমান, বেলাল আহমদ, সরফুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও কাজী হাবিবুদ্দিন বাংলা মায়ের এই দশজন দামাল ছেলেই ২৬শে মার্চ কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ও রিসেপশন কেন্দ্র এবং ‘অগ্রবাদ ব্রজ কাস্টিং স্টেশন দখল করেন। ৩০শে মার্চ কারখাট বেতার ভবনে পাক বাহিনী বােমা বর্ষণ করিলে তাহারা ১ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারসহ গীর অরণ্যে প্রবেশ করেন। ৩রা এপ্রিল হইতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণোদ্যমে চালু হয়।
২৯শে মার্চ উক্ত বেতার কেন্দ্র হইতে ঘােষণা করা হয় যে, শেখ মুজিব মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গেই আছেন, নেতৃত্ব দিতেছেন এবং সংঘর্ষে জেনারেল টিকা খান। নিহত হইয়াছেন। উক্ত ঘােষণা দেশবাসীর মনে বর্ণনাতীত সাহস সঞ্চার করে। ভারত গমনকালে হাটে-মাঠে, ঘাটে সংবাদটি প্রত্যেকের মুখে মুখে আমি স্বকর্ণে শুনিয়াছি এবং পাক বেতার কেন্দ্রের বিপরীত সত্য ঘােষণা কেহ সেই দিন বিশ্বাস করে নাই। স্বজাতি বেতার কেন্দ্রের ঘােষণার প্রতি যে কি অবিচল আস্থা স্বীয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতীত উহা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বাংগালী জাতির বদ্ধমূল ধারণাকে বিনষ্ট করিবার প্রয়াসেই পাকিস্তান সরকার করাচী বিমান বন্দরে বসা অবস্থায় বন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের ছবিসহ গ্রেফতারের খবর ২রা এপ্রিল পাকিস্তান অবক্সারভার পত্রিকায় প্রকাশ করে। ইহাই পরে ১৫ই এপ্রিল দৈনিক পূর্বদেশে ছাপা হয়। আগরতলায় পুলিশী হয়রানি
আগরতলা হইতে রওয়ানা হইয়া সােনামােড় শহরে টেকসী হইতে অবতরণ করিলে আমাকে থানায় যাইতে অনুরােধ জানানাে হয়। থানায় জিজ্ঞাসাবাদের পর থানার অফিসার-ইন-চার্জের বাসভবনে আমার রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা হয় অর্থাৎ ভাবে পরােক্ষ ক্রিয়ায় আমাকে পুলিশী হেফাজতে আটক রাখা হয়। পরদিন ভাের ৮ ঘটিকায় ভারতীয় দেশরক্ষা বিভাগীয় সিকিউরিটি অফিসার ক্যাপ্টেন ঘোষ প্রায় দুই ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর আমার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করেন। মনে হইল, তাহাদের মানের রোগ কিছুটা প্রশমিত হইয়াছে। তবে, অমিার দৃঢ় ধারণা দিল যে, আমার মতো স্পষ্টভাষী স্বাধীনচেতা জাতীয়তাবাদীদের জন্য ভারত ভূমিতে কোন আশ্রয় নাই; আশ্রয় রহিয়াছে তাহাদের অর্থে পােষা মেরুদন্ডহীন আওয়ামী লীগ মার্কা জাতীয়তাবাদীদের, তাহাদের জন্যই সর্বত্র অবারিত স্থায়।
আগরতলার বাংগালী হিন্দুদিগকে পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংগালীর মরণপণ সংগ্রামে উৎফুল্ল মনে হইয়াছে। ইহা সর্বানী সত্য যে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সীমান্তের ওপারের বংগভাষাভাষী হিন্দুদের নৈতিক, আর্থিক ও বাস্তব সমর্থন অর্থাৎ সর্বাত্মক সহায়তা ছিল অতুলনীয়। কিন্তু যখনই আমরা বাংলা ভাষাভাষী সকলে ঐক্যবদ্ধ হইয়া বৃহত্তর বাংগালী জাতির জন্য বৃহত্তর স্বাধীন সার্বভৌম বঙ্গদেশ রাষ্ট্র গঠন মর্ম। প্রস্তাবের অবতারণা করিয়াছি, তখন কেহ কেহ সরাসরি প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন, কেহ অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া মূল আলােচনার মােড় ঘুরাইয়া দিয়াছেন। ঘনিষ্ঠ মেলামেশা, ভাবের গভীর আদান-প্রদান এবং সর্বোপরি বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণের ফলে নিঃসন্দেহে এবং স্থির নিশ্চিত হইলাম যে, সীমান্ত পরপারের বঙ্গ ভাষাভাষী হিন্দুদের নিকট বৃহৎ ভারতীয় রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব প্রকৃতই গর্বের বস্তু। | তাহারা যতটা বাংগালী তাহার চাইতে অধিক ভারতীয়। ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণেই বােধহয় বঙ্গ ভাষাভাষী হিন্দুদের চিন্তা ভিন্নরূপ। অবাংগালীর শােষণ তাহারা স্বীকার করেন; কিন্তু বাংগালীর সত্ত্বা বিকাশের সংগ্রামে ‘তাহারা আগ্রহী নহেন। পূর্ববংগ, পশ্চিমবংগ, আসাম, মেঘালয় ও পার্বত্য ত্রিপুরা এক সমৃদ্ধশালী বৃহত্তর এলাকা এবং উক্ত গােটা এলাকাই বংগ ভাষাভাষী অধ্যুষিত। ভাষা, সংস্কৃতি, রক্ত ও ভৌগােলিক অবস্থান যদি স্বাধীন রাষ্ট্রের ভিত্তি হয়, তাহা হইলে স্বাধীন ও সার্বভৌম বৃহত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দাবী একান্ত স্বাভাবিক। সুতরাং কালের যাত্রায় এই দাবী উথিত হইবার বিরুদ্ধে সীমান্ত পরের বাঙ্গালীদের বাস্তব ও মনস্তাত্ত্বিক বাধা কোথায়? | স্বৰ্তব্য, বাংগালী হিন্দু জনতাই সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে উদ্ভুদ্ধ হইয়া ১৯৪৭ সালে “বােস-সােহরাওয়ার্দীর উথাপিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পরিকল্পনাকে আঁতুড় ঘরেই হত্যা করে। যে মজ্জাগত ধ্যান-ধারণায় তাহারা সেইদিন আত্মবলির রাজপথ অবলম্বন করিয়াছিল, একদিন না একদিন ভারতে অবস্থানরত বংগ ভাষাভাষী হিন্দু জনতা নিজেদের সেই ভুল উপলব্ধি করিবে এবং বৃহত্তর স্বাধীন বংগদেশ প্রতিষ্ঠায় ব্রর্তী হইবে, এই বিশ্বাস ও প্রীতি লইয়া সেইদিনের অপেক্ষায় রহিলাম।
ঢাকা প্রত্যাবর্তন | ভারত ভূমিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের দৌরাত্ম্যে মনে হইত যে, আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নাই। আমরা সংগ্রামের প্রেরণায় ভারত ভূমিতে গিয়াছিলাম, প্রাণ বাঁচাইতে যাই নাই, ব্যবসা করিতে যাই নাই, ব্যাংক লুটের টাকা সমিলাইতে যাই নাই, অসৎ কর্মে লিপ্ত হইতে যাই নাই। দুটের টাকায় জীবনভােগ করিতে যাই নাই, হােটেল রেস্তোরাঁয় বিলাস জীবন-যাপন করিতে যাই নাই, দয়ার ভিক্ষা চাহিতে যাই নাই, সর্বোপরি কাহারাে সহিত ঝগড়া করিতেও যাই নাই। আমাদের ঝগড়া-বিবাদ জালেম জেনারেল ইয়াহিয়া সরকারের বিরুদ্ধে, অত্যাচারী পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে। তাই পাক-বাহিনী কবলিত কোটি কোটি বাংগালীদের সহিত সমভাবে মানসিক ও প্রয়ােজনবােধে দৈহিক নির্যাতন সহ্য করিবার দৃঢ় সংকল্প লইয়া আমি, সহকর্মী এহসানুল হক সেলিম ও কবিরসহ মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করি এবং ঢাকায় আত্মগােপন জীবনযাপন শুরু করি। আমরা আগরতলা হইতে প্রত্যাবর্তনকালে ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজের সন্নিকটে আসিয়া দেখি যে, ব্রিজটি ভাংগা । কবিরই কিছুদিন পূর্বে ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন ও অন্যান্যের সহায়তায় ব্রিজটি বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে উড়াইয়া দিয়াছিল। উল্লেখ্য যে, পরবর্তীকালে ঢাকার মালিবাগের মােড়ে সশস্ত্র মােকাবেলায় পাক-বাহিনীর গুলিতে কবির শাহাদৎবরণ করে। বলতে ভুলিয়াছি যে, ভারতে অবস্থানরত আশ্রয় গ্রহণকারী বাংলা জাতীয় লীগ নেতৃবৃন্দ সর্বজনাব দেওয়ান সিরাজুল হক, আশরাফ হােসেন, এম,এম, আনােয়ার ও পরিমল সাহা গণপ্রজাত বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন এবং ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম-সূচী গ্রহণের অনুরােধ জানাইয়াছিলেন, অবশ্য ফল বিশেষ কিছু হয় নাই। দেশে অবস্থানকারী বাংগালীদের অবদান
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে ১৫ই ডিসেম্বর এই সময়টা ছিল পূর্ব পাকিস্তানবাসী বাংগালীদের জন্য মহাসংকটকাল, মহাদুর্ভোগকাল ও মহাত্যাগের কাল। এই সময়ে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের বাড়ীঘর কোন কোন ক্ষেত্রে ভষ্মীভূত হইয়াছে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাজেয়াপ্ত হইয়াছে। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যা ৭টায় বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন এবং আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশবাসীর জান-মাল ইজ্জতের কোন প্রকার নিরাপত্তা ছিল না। যখন তখন গ্রেফতার, পাশবিক ও দৈহিক অত্যাচার ও নির্যাতন ভোগ। ছিল ভাগ্যলিপি। সীমান্ত পারে ভারত ভূখন্ডে আশ্রয়প্রার্থী কয়েক লক্ষ শরণার্থী ব্যতীত বাকী সাত কোটি নিরস্ত্র বাংগালী ছিল কার্যতঃ সশস্ত্র হিংস্র পাক বাহিনীর হাতে বন্দী। তাহারাই পাক বাহিনীর জুলুম সহ্য করিয়াছে; তাহারাই মুক্তিযােদ্ধাকে আহার, আশ্রয় ও অন্যান্য সাহায্য দিয়াছে। তাহারা আত্মবিসর্জন দিয়াছে; কিন্তু শত্রু সেনার নিকট
আত্মসমর্পণ করে নাই। ভাগ্যের কি পরিহাস, ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অত্যুদয়ের পর মৃত্যুঞ্জয়ী এই জনতাই মুহূর্তের মধ্যে ভারতে আশ্রয়-প্রার্থী শরণার্থীদের দৃষ্টিতে পাক-বাহিনীর সহযােগীরূপে অভিযুক্ত হয় এবং এক পলকে পরিণত হয় এক অকুত শ্রেণীতে। আরাে পরিতাপের বিষয়, ১৬ই ডিসেম্বরের পরে অনুষ্ঠিত অত্যাচার, অবিচার, লুটপাট, খুন, রাহাজানী ও মান-ইজ্জত এবং সতীত্ব হরণ ১৬ই ডিসেম্বরের আগেকার সময়ের মতই সমভাবে গ্রামজীবন ও বাংগালী জন-জীবনকে বিষাক্ত করিয়া তােলে। ভারত হইতে প্রত্যাগত মুষ্টিমেয় শরণার্থীই ছিল ইহার জন্য দায়ী। ইতিহাসের কি নির্মম শিক্ষা; ফরাসী বিপ্লবের কি মর্মন্তুদ পুনরাবৃত্তি। আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া পাক-ভারত যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র বাংলা ভাষাভাষী পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর উর্দুভাষী পাক-বাহিনীর হামলা ও ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ ছিল একাধারে পাকিস্তানী উর্দুভাষী কায়েমী স্বার্থ চক্র, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী কুচক্রী মহল এবং পাক-চীন ও পাক-সােভিয়েত বন্ধুত্বের ক্ষিপ্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবালী মহলের বহুমুখী সাঁড়াশি অভিযানের সহিংস ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও প্রতিফল। | জুলাই মাস হইতে জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উত্থান্ট সহানুভূতিশীল মনােভাবপ্রসূফ যে সব প্রস্তাব দিয়া আসিতেছিলেন, কূটবুদ্ধি ইন্দিরা গান্ধীর বিরােধিতার ফলে সেইগুলি ব্যর্থ হয়। ফলে জাতিসংঘের ২৬তম সাধারণ পরিষদ অধিবেশনের প্রস্তাবানুযায়ী অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাক-ভারত সীমান্ত এলাকায় জাতিসংঘ প্রহরী নিয়ােগের প্রচেষ্টা বানচাল হইয়া পড়ে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পরিকল্পনা মােতাবেক ২৪শে অক্টোবর (১৯৭১) যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বৃটেন ও পশ্চিম জার্মানীর সমর্থন কুড়াইবার মানসে ভ্রমণ করেন ও রাষ্ট্রনায়কদের সহিত সাক্ষাৎ করেন। পূর্বাহ্নে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে যে কোন অবস্থা মােকাবেলার চিন্তায় সােভিয়েট রাশিয়ার সহিত ৯ই আগষ্ট (১৯৭১) শান্তি মৈত্রী ও সহযােগিতা চুক্তি (TREATY OF PEACE, FRIENDSHIP & CO-OPERATION) নামে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ২১শে নভেম্বর ‘বয়রা এলাকায় পাক-বাহিনী সম্মিলিত ভারতীয় ও মুক্তি বাহিনীর নিকট পরাজয়বরণ করেন। তাহাদের’তেরটি ট্যাংক ও চারটির মধ্যে তিনটি সেবর জেট ভারত ভূমিতে ধ্বংস হয়। ক্ষিপ্ত ইহিয়া খান ২৩শে নভেম্বর দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘােষণা করেন। ২৬শে নভেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সংকটজনক পরিস্থিতি হইতে ত্রাণ লাভের আশায় পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষের প্রস্তুতি নেন। তিনি হয়ত আশা করিয়াছিলেন যে, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ফলে ভারত কর্তৃক মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য সহায়তাদান বন্ধ হইবে। ১৯শে জুলাই লন্ডনের ফিনানসিয়াল টাইমস প্রতিনিধির সহিত এক সাক্ষাঙ্কারে জেনারেল ইয়াহিয়া খান হুমকি দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের কোন অংশ বিদ্রোহীদের ঘাঁটি নির্মাণকল্পে
দখল করা হইলে পূর্ণ যুদ্ধ ঘােষণা করা হইবে। ৪ঠা আগষ্ট করাচী টেলিভিশন ঘোষণায়ও তিনি একই উক্তি করেন। উল্লেখ্য যে, পূর্ব পাকিস্তানকে দেখানাের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের পদক্ষেপ সম্পর্কে লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান পত্রিকায় মিঃ পিটার প্রেসটন ২৯শে মার্চ (১৯৭১) এক রিপাের্টে মন্তব্য করেছিলেন, “It is an act of a mindless sergeant Major” অর্থাৎ ইহা নির্বোধ বা ধীশক্তিহীন সার্জেন্ট মেজরের কাজ। বস্তুতঃ ঘটনাপ্রবাহ মিঃ প্রেসটনের মন্তব্যের যথার্থতাই প্রমাণ করে। ভারতীয় সামরিক হামলা
ইন্দিরা গান্ধীর ভুল চাল অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর রাত্রে পাকিস্তান ভারতের উপর অতর্কিত বিমান আক্রমণ করিলে পাক-ভারত যুদ্ধ বাধে। ইহা সত্য নহে। নিম্নবর্ণিত বক্তবাই সত্য- Henry Broaudon of the Sunday Times ছাহার “The Retreat of American Power” (>>90) CE FACE- “The Indian Cabinet On April 28 (’71) had secretly decided to prepare for the possibility of war” বক্তব্যের অকাট্য প্রমাণিক সমর্থন পাওয়া যায় Major General Sukhwant Sing, তৎকালীন Deputy Director, Military Operations at Army HeadQuarters কর্তৃক লিখিত ও ১৯৮০ সালে প্রকাশিত “The Liberation of Bangladesh 42 CC “The Army was asked to take over the guidance of all aspects of guerilla warfare on April 30, 1971.”
ভারতের পক্ষে যুদ্ধ পরিচালনায় সর্বাধিনায়ক Field Marshal Sam Manekshaw বােম্বেতে এক জনসভায় ১৯৭৭ সালের ১৬ই নভেম্বর প্রকাশ করেন যে, ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর ইন্দো-পাক যুদ্ধের ৯ মাস পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী CABINET MEETING-এ উপস্থিত হইতে তলব করেন। ক্যাবিনেট সড়ায় তাহাকে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আঘাত হানার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু Field Marshal আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে সময় প্রার্থনা করে। . International Commission of Jurists তদন্তের সিদ্ধান্ত যে, ১৯৭১ সালের ২১শে নভেম্বর ভারতীয় সাঁজোয়া বাহিনী পূর্ব পাকিস্তান ভূমিখন্ডে ঢুকিয়া পড়ে- সেইদিন হইতেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আরম্ভ হয়- ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর নয় । তখনি পাকিস্তান অবস্থায় বিপাকে মরিয়া হইয়া ভারতের উপর বিমান হামলা করিতে বাধ্য হয়।
মাত্র কিছুদিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং ইহারই ফলে পূর্ব পাকিস্তান পাক বাহিনীর অারি হইতে মুক্ত হয়। বিশ্ব মানচিত্রে অত্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের।
ইতিপূর্বে ৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন। উল্লেখ্য যে, ১লা জুন।
মিঃ ফণীভূষণ মজুমদারের নেতৃত্বে মিসেস নূরজাহান মুর্শেদ ও শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন সমবায়ে গঠিত তিন সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টারী প্রতিনিধিদল ভারতীয় পার্লামেন্ট সেন্ট্রাল হলে অনুষ্ঠিত ভারতীয় পার্লামেন্টের উভয় পরিষদের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য আকুল আবেদন জানাইয়াছিলেন। কিন্তু তখন ভারত সরকার অপেক্ষা করিবার নীতি গ্রহণ করিয়া বিষয়টি এড়াইয়া গিয়াছিল। অবশ্য ইতিপূর্বে ৩১শে মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সহিত একাত্মতা ঘােষণা করিয়া সর্বপ্রকার সাহায্য দানের সংকল্প প্রকাশ করে এবং ১লা ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী পূর্ব পাকিস্তান হইতে পাক সৈন্য প্রত্যাহারের দাবী জানান। প্রকাশ, মুক্তির নয় মাস সশ্রামে ১০৪৭ জন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারায়, ৩ হাজার ৪৭ জন আহত হয় ও ৮৯ জন নিখোঁজ হয়।
বলা অনাবশ্যক যে, ভারতীয় বাহিনীর এই ত্যাগ আমরা কৃতজ্ঞতার সহিত স্মরণ করি। এবং বলিবার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতীয় বাহিনী সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ না হইলে বাংলাদেশ অচিরেই ভিয়েতনামে পরিণত হইত আর মুক্তিবাহিনী কয়েক যুগ অবিরাম সংগ্রাম করিয়াও দেশকে পাক বাহিনী-মুক্ত করিতে পারি কিনা সন্দেহ। সতরাং ইহাও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে যে, ১৯৭১ সালের সেই ভয়াল কালাে। দিনগুলিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতীয় জনগণ সম্ভাব্য ঝুঁকি সত্ত্বেও যুদ্ধে অবতীর্ণ হইয়া বাংলাদেশকে পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত করিবার চেষ্টা না করিলে অত্র এলাকার বংগভাষী মাত্রই হয়তাে নগণ্য সংখ্যক উর্দু ভাষাভাষী ও তাহাদের নগণ্য সংখ্যক স্থানীয় সমর্থকদের সেবাদাসে পরিণত হইত। সুতরাং কৃতজ্ঞ বংগ ভাষাভাষী আপামর জনগণ গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে রাজধানীর রাজপথে ১৬ই ডিসেম্বর ও ইহার পরবর্তী কয়েকদিন ভারতীয় নাগরিক ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যে যত্রতত্র স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক ও প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করিয়াছে তাহা বিস্ময়কর কিছু ছিল না। বাংগালী মজলুম জনপণ ১৯৭১-এর মার্চ হইতে ডিসেম্বর নয় মাসে যখন প্রায় নজদেহ, কুঅপৃষ্ঠ, অতিমাত্রায় শ্রান্ত-ক্লান্ত ও অসহায়, বাংগালীর ফরিয়াদে যখন সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার আরশ পর্যন্ত কাঁপিতেছিল, তখনই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংগালী জাতির মুক্তিদাতার ভূমিকাই গ্রহণ করেন।
অবশ্য ইহা বলাও সত্যের অপলাপ হইবে যে, একমাত্র মহান পরার্থপরতা বা মানবাধিকার নীতিতে উথুদ্ধ হইয়াই ভারত পাক হানাদার বাহিনী বিতাড়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়াছিল। বরং আন্তর্জাতিক শক্তিতে পরিণত হইবার প্রবল আকাংখা এবং জাষ্ঠীয় স্বার্থ চরিতার্থ করিবার মানসেই ভারত সেইদিন অত্র ধরিয়াছিল। সুতরাং ইহার পরিণতি কি দাঁড়াইতে পারে, সেই চিন্তাও সেইদিন অনেকের মাথায় ছিল। বাংলাদেশের অভূদয়ের পর বাংলাদেশ সরকারের মেরুদন্ড, শক্তি, দক্ষতা ও দেশপ্রেমের গভীরতার। উপরই নির্ভর করিবে যে, ভারতীয় বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী শ্রেণী এই দেশকে একচেটিয়া লুটপাট ও শােষণের যাঁতাকলে পরিণত করিতে সক্ষম হইবে কি হইবে না।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাক বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ নিয়াজী ঢাকার রেসকোর্সে দেশরক্ষা বাহিনীর যৌথ কম্যান্ড প্রতিনিধিদ্বয় ভারতীয় সেনা বিভাগের লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরােরা ও বাংলাদেশ দেশরক্ষা বাহিনীর এ কে খন্দকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করিলে পাক দেশরক্ষা বাহিনীর ৭৫ হাজার ও বেসামরিক ১৮ হাজার যুদ্ধবন্দীকে ভারত ভূমিতে স্থানান্তরিত করিয়া তথায় আটক রাখা হয়। যে দলিলের মাধ্যমে এই আত্মসমর্পণ সংঘটিত হইয়াছিল তাহা নিম্নে দেওয়া হইল:
TEXT OF INSTRUMENT OF SURRENDER The PAKISTAN Eastern Command agree to surrender all PAKISTAN Armed Forces in BANGLADESH to Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA, General Officer Commanding-in-Chief of the Indian and Bangladesh force in the Eastern Theatre. This surrender includes all PAKISTAN Land, Air and Naval forces as also all paramilitary forces and civil armed forces. These forces will lay down their arms and surrender at the places where they are currently located to the nearest regular troops under the command of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA.
The PAKISTAN Eastern Command shall come under the orders of Lieutenant General JAGJIT SINGH AURORA as soon as this instrument is signed. Disobedience of orders will be regarded as a breach of the surrender terms and wail be dealt with in accordance with the accepted laws and usages of war. The decision of Licutenant General JAGJIT SINGH AURORA will be final, should any doubt arise as to the meaning or interpretation of the surrender terms. Lieutenant General Jagjit Singh Aurora gives a solemn assurance that personnel who surrender shall be treated with the dignity and respect that soldiers are entitled to in accordance with the provisions of the GENEVA convention and guarantees the safety and wellbeing of all Pak Military and Paramilitary forces who surrender. Protection will be provided to foreign nationals, ethnic minorities and personnel of West Pakistan origin by the forces under the command of Lieutenant General Jagjit Singh Aurora.
JAGJIT SINGH AURORA AMIR ABDULLAH KHAN NIAZI Lieutenant General
Lieutenant General General Officer Commanding in Chief Martial Law Administrator Indian and Bangladesh Forces
Zone B and Commander in the Eastern Theatre
Eastern Command (Pakistan) 16. December, 1971
16, December, 1971
অর্থাৎ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল অফিসার কমান্ডিং লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অনােরর নিকট বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল পাকিস্তানী সৈন্যের আত্মসমর্পণ করিতে সম্মত হইতেছে। পাকিস্তান স্থল, বিমান ও নৌ এবং প্যারামিলিটারী ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী এই আত্মসমর্পণের অন্তর্ভুক্ত। এই বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার পরিচালনাধীন নিকটবর্তী সামরিক বাহিনীর নিকট অস্ত্র জমা দিবে। এই পত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার পরিচালনাধীন হইবে। এই আদেশের লংঘন আত্মসমর্পণের শর্ত লংঘন বলিয়া বিবেচিত হইবে এবং প্রতিষ্ঠিত আইন ও যুদ্ধনীতি অনুসারে ইহার বিচার হইবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ বা ব্যাথ্যর ব্যাপারে কোন সন্দেহ উথিত হইলে লেফটেন্যন্ট জেনারেল অগক্সিৎ সিং অরােরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইবে।
| লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা এই মর্মে আশ্বাস প্রদান করিতেছেন যে, জেনেভা কনভেনশনের নিয়মাবলী অনুযায়ী আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের সহিত সম্মানজনক আচরণ করা হইবে এবং আত্মসমর্পণকারী সকল পাকিস্তান সামরিক প্যারামিলিটারী বাহিনীর নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা হইবে। জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা পরিচালনাধীন বাহিনী সকল বিদেশী নাগরিক নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যক্তিবর্গের রক্ষণাবেক্ষণ করিবে। স্বাঃ জগজিৎ সিং অরােরা
স্বাঃ আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী লেফটেন্যান্ট জেনারেল
লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চীফ
মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও
জোন-বি এবং কমান্ডার বাংলাদেশ বাহিনী
পূর্বাঞ্চলীয় কম্যান্ড (পাকিস্তান) ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১।
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণ প্রশ্নে
| বাংলাদেশের মাটিতে পাক সেনাবাহিনী মুক্ত করিবার নীতিগত কারণ ছাড়াও ভারত নিজস্ব কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবর্তীর্ণ হয়। প্রথমতঃ ভারত দ্বিখন্ডিত হইয়া পাকিস্তানী রাষ্ট্রের অভূদিয় হইয়াছিল। অখন্ড ভারত বিশ্বাসী ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সুযােগের অপেক্ষায় ছিল কখন সাফল্যের সহিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের বিলােপ ঘটানাে যায়। পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলোপ না হইলেও বরং তাহার রাষ্ট্রীয় অংগচ্ছেদের সুবর্ণ সুযোগই ১৯৭১ সালের এক মহাক্ষণে ভারতের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়। দ্বিতীয়তঃ ১৯৬২ সালের শেষার্ধে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় চীন-ভারত যুদ্ধ প্রমাণ করিয়াছিল যে, চীন-ভারত বৈরীত ও চীন-পাকিস্তান মৈত্রীর পটভূমিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব ভারতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ। ইহার
অবশ্যম্ভাবী কার্যকারণেই ভারতকে বিপুল অর্থ ব্যয়ে আসাম-নেফা সীমান্তে দেশরক্ষা ব্যবস্থা গড়িয়া তুলিতে হয়। তৃতীয়তঃ আসাম, সীমান্তবর্তী নাগাভূমি, মিজোরাম প্রভৃতি ভারতীয় পার্বত্য এলাকাবাসী স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত। পূর্ব পাকিস্তান এই সকল পার্বত্য উপজাতীয় বিদ্রোহী গেরিলা বাহিনীর মুক্তচারণ ভূমি ও আশ্রয়স্থল। চতুর্থতঃ পূর্ব পাকিস্তানের বর্ধনশীল পাট শিল্প বিশ্ববাজারে ভারতীয় পাট শিল্পকে কোণঠাসা করিয়া ফেলিয়াছে। পঞ্চমতঃ ভারতীয় বর্ধিষ্ণু শিল্প কারখানার শিল্পজাত দ্রব্যের নিরাপদ বাজার অন্বেষণ।
উপরােক্ত কারণেই ৩১শে মার্চ (১৯৭১) ভারতীয় পার্লামেন্ট উভয় পক্ষের যুক্ত সভায় বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে সর্বোতভাবে সাহায্য-সহায়তা দানের প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করে। সেইকথা আগেই বলিয়াছি, ইহা ছিল ২৭শে মার্চ ‘৭১-এ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভারতীয় পার্লামেন্টে উদ্বেগ প্রকাশের প্রতিধ্বনি মাত্র। পূর্ব পাকিস্তান হইতে শরণার্থীদের অবাধে ভারতভূমিতে আশ্রয় গ্রহণে জরিত সরকার সীমান্ত অতিক্রমণে কোন প্রকার বাধা দেয় নাই। ভারীয় মন্ত্রীর (শ্রম ও পুনর্বাসন) লােকসভায় প্রদত্ত তথ্যানুসারে মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থীদের সাহায্যের ৩২৬ কোটি টাকা খরচের মধ্যে আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ ছিল সর্বসাকুল্যে ৩৬,৭৭ কোটি টাকা, বাকি ২৮৯,২৩ কোটি টাকা ভারত সরকার ব্যয় করে। পাক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দু সম্প্রদায়মুক্ত করার প্রচেষ্টার ফলে ১৬ই আগস্টের মধ্যে ভারতে ৫৯.৭১ লক্ষ হিন্দ ৫.৪১ লক্ষ মুসলমান ও ৪৪ হাজার অন্যান্য সম্প্রদায় ভুক্ত শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল। অবশ্য পাকিস্তান সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ লক্ষ ২ হাজার ৬২৩ ব্যক্তি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে। পাক জংগী সরকারের হয়ত ধারণা ছিল, ইহার ফলে বাতুত্যাগী হিন্দুরা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাংগার সূত্রপাত করিবে এবং ইহারই অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান মুক্তিযােদ্ধা ও শরণার্থীরা ভারত ত্যাগ করিতে বাধ্য হইবে ও অভ্যন্তরে মুসলিম বাসিন্দারা হিন্দু ও ভারত বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করিবে আর ইহারই ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অঙ্কুরেই জনসমর্থন হারাইয়া ফেলিবে। অকপট মনে বলিতে হইবে, ভারতীয় জনতা ব্যাপকভাবে সুস্থ রাজনৈতিক চেতনা ও মানবিকবােধের বিল নিদর্শন স্থাপন করে। সাম্প্রদায়িক দুস্কৃতিকারীদের যে কোন অপচেষ্টা সাধারণ ভারতবাসী অত্যন্ত সতর্কতা ও ক্ষিপ্রতার সহিত স্তব্ধ করিয়া দেয়। ইহা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ মস্তুব্য, কাহারাে সমর্থন-অসমর্থনের অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত হওয়ার পশ্চাতে
বস্তুতঃ ভারতের জনসাধারণের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। ডারীয় প্রভাবশালী উচ্চ মহলে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থে পাকিস্তান অখন্ডিত বা বিখন্ডিত হইবার ঔচিত্যের প্রশ্নে মতভেদ ছিল। ভারতীয় ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিস এন্ড এনালাইসিস’-এর মতানুসারে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থে পাকিস্তান দ্বিখন্ডিত ছিল অপরিহার্যভাবে প্রয়োজনীয়।
১৯৭১-এর মার্চ হইতে ডিসেম্বর অবধি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পদক্ষেপগুলি ধারাবাহিকভাবে বিশ্লেষণ করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, তিনি পাকিস্তান দ্বিখন্ডনের পক্ষে ছিলেন। উল্লেখ্য, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিখন্ডনের বিরুদ্ধে ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৯৬৯-এর আগস্টে ২২ ঘন্টা মেয়াদী পাকিস্তান সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করিতে পাক সরকারকে অনুরােধ করে। ফলে পাক-মার্কিন সম্পর্কোন্নয়ন দেখা দেয়। চীন-মার্কিন বলয়ের এই প্রভাব অকার্যকর করিবার মানসেই ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং ও সােভিয়েট রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁন্দ্রে ঘোমিকো দিল্লীতে ৯ই আগস্ট (১৯৭১) ২০ সাল। রুশ-ভারত। “শাক্তি, বন্ধুত্ব ও সহযােগিতা” (কার্যতঃ সামরিক চুক্তি সম্পাদন করেন। ১৯৬৯ সালের মে মাসে পাকিস্তান সফরকালে সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাক-চীন বন্ধুত্বের প্রতি বিরূপ মনােভাব প্রকাশ করেন এবং পাক-সােভিয়েত ও পাক-চীন বন্ধুত্ব সমান্তরালভাবে ও সমভাবে চলিতে পারে না বলিয়া নছিয়ত করেন। পাক সরকার অবশ্য উপরােক্ত প্রতিপাদ্যের প্রতি দৃঢ়ভাবে দ্বিমত প্রকাশ করিয়াছিলেন। পাকিস্তানের দ্বিখশ্চিত হওয়াটা বােধহয় তাহারই ফল। এইদিকে আন্তর্জাতিক প্রভাবশালী দেশগুলির সরকারী মত প্রভাবান্বিত করিবার প্রয়াসে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ২০ হইতে ২১শে সেপ্টেম্বর রাশিয়া সফর করিলেন এবং ৬ই অক্টোবর হইতে ১৩ই নভেম্বর বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী ইত্যাদি সফর করিয়া পশ্চিমা শক্তিগুলির কার্যকরি হস্তক্ষেপ বন্ধের নিশ্চয়তা বিধান করিলেন। শুধু তাই নয় সফরান্তে মিসেস গান্ধী ইহার পরেও ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন অবধি জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিক্রিয়াগুলি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে মােকাবিলা করিলেন। পাক-ভারত সীমান্ত এলাকায় উভয় রাষ্ট্র সশস্ত্র সংঘর্ষের সম্বাবনা এড়াইবার জন্য পারস্পরিক সৈন্য প্রত্যাহার প্রস্তাবের জওয়াবে ৩০শে নভেম্বর ভারতীয় রাজ্যসভায় বক্তৃতাকালে মিসেস গান্ধী স্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করিলেন যে, বাংলাদেশ হইতে পাক-বাহিনী প্রত্যাহার করিলে তিনি পূর্ব সীমান্ত হইতে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করিতে সম্মত আছেন। ইহার নিশিতার্থ বাংলাদেশ পাকিস্তানের অঙ্গ নহে। অন্যথায় ৩রা ডিসেম্বর হইতে ১৬ই ডিসেম্বর পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষ ও বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অ্যুদয় ছিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর রাজসভায় ৩০শে নভেম্বর ঘােষণার স্বতঃসিদ্ধ পরিণতি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংগচ্ছেদ অভিযান নিচ্ছিদ্র করিবার প্রয়াসে ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের ব্যয়ভার যথাসম্ভব নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করেন। একই উদ্দেশে তিনি জনপ্রতিনিধি, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের বেতন, ভাতা ও বাসস্থানের সম্ভাব্য ব্যবস্থা করিলেন, অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ব্যয়ভার গ্রহণ করিলেন; আবার চীন সমর্থক জননেতা ও দললির উপর কড়া পুলিশী নজর রাখিলেন। এইভাবেই বাংলাদেশের অভূদয় নাটিকার সফল যবনিকাপাতের মাধ্যমে
১৯৬২ সালে মহাচীনের হন্তে পরাজয় ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের নিকট নাকানিচুবানি খাইবার কালিমা মুছিয়া ভারত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের স্বীকৃতি মােতাবেক মেজর পাওয়ার’ অর্থাৎ বড় শক্তিতে উন্নীত হইল। বাংলাদেশের অ্যুদয় : ঐতিহাসিক পটভূমি
বাংলাদেশ নিজস্ব কারণে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রথমতঃ ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে বংশীয় প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হকের প্রস্তাবক্রমে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলির সমবায়ে ভারতীয় উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে দুইটি মুসলিম প্রধান স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করিবার পরিকল্পনা ছিল। ইহাই পরবর্তীকালে ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব হিসাবে খ্যাত হয়। দ্বিতীয়তঃ প্রাসাদচক্রের রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের আবর্তে পাকিস্তান গণতন্ত্রের মূল বক্তব্য জনগণের সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ জনগণের রায়ে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের নীতি বিসর্জন দেয়। তৃতীয়তঃ রাষ্ট্র পরিচালনায় অর্থাৎ শাসন ক্ষমতায় পূর্ব পাকিস্তানী বংগ ভাষাভাষীদের কার্যকর অনুপস্থিতি বাংগালী মন-প্রাণকে বিষাক্ত ও বিদ্রোহী করিয়া তােলে। পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয়, ভারত হইতে আগত মােহাজের, সরকারী সামরিক-বেসামরিক কর্মচারী, রাজনীতিবিদ, পুঁজিপতি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী শ্রেণী ও বহিরাগত অর্থাৎ আফ্রিকা ইত্যালি হইতে আগত অবাংগালী শিল্পপতি ব্যবসায়ী শ্রেণীর । মধ্যে আভ্যন্তরীণ স্বার্থগত কলহ ও অন্তর্ষন্দু বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানী বাঙ্গালীদের উপর নিরঙ্কুশ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখিবার প্রয়াসে তাহার ছিল ঐক্যবদ্ধ ও বদ্ধপরিকর। পাকিস্তান সামরিক বিভাগে বরাদ্দ অর্থের উপর সৈন্য বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের প্রশ্নাতীত একচেটিয়া সর্বময় ক্ষমতা ছিল। বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ের অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বাজেটের সিংহভাগের উপর পার্লামেন্টের বা জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কোন প্রকার অর্থপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল না। শাসকচক্রের স্বার্থে দেশ শাসিত হইত এবং জনগণ পরিণত হইয়া পড়িয়াছিল নেপথ্যের বন্ধুতে। সংখ্যাধিক্য হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানীগণ পর্যবসিত হইয়াছিল শাসিতের শ্রেণীতে। জনগণের সার্বভৌমত্ব হরণকারী এই প্রাসাদ চক্রেরই মদদগার হিসাবে যুক্ত হয় সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন শক্তি। তাই (ক) ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে একচেটিয়া জয়লাভ করিয়াও সরকার গঠনের কিছুকালের মধ্যে শেরে বাংলা ফজলুল হকের মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত হইতে হয়। (খ) ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ভাষণদানকালে প্রকাশ্য জনসভায় নিহত হন। (গ) ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বেআইনিভাবে বরখাস্ত হন। (ঘ) ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে বেআইনিভাবে গণপরিষদ বাতিল ঘােষিত হয়। (৩) ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর সেনাপতি জেনারেল আইউব খান সামরিক শাসন জারি ও সর্বময়
গদিতে আসীন হইবার চিন্তা দিবাস্বপ্ন মাত্র। তাই তিনি সময়ক্ষেপ না করিয়া ২০শে ডিসেম্বর ঘােষনা করিলেন “পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে বিরােধীদলীয় আসন গ্রহণ। করিতে প্রস্তুত নহে।” এমনকি ক্ষমতার গরজে ও কায়েমী স্বার্থের প্ররােচণায় তিনি দুই প্রধানমন্ত্রীর থিউরী প্রচার করিতেও কুণ্ঠিত হইলেন না। সামরিক চক্র ইহার সুযােগ গ্রহণ করে। সামরিক চক্র জনগণের নির্বাচিত আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে পারস্পরিক রাজনৈতিক কলহের সম্ববহার করিতে এবং সেই উদ্দেশ্যে বিভিন্নভাবে কায়েমী স্বার্থবাদীদের মারফত ইন্ধন দানেও কসুর করে নাই। সােনার ডিম প্রাপ্তির লােতে ক্ষমতালােভী সামরিক জান্তা হাঁসের উপর এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিল- সেই হাঁস অর্থাৎ পাকিস্তান অস্তিত্ব হারাইল এবং সামরিক জান্তা শিরকুলমণি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সােনার ডিম অর্থাৎ ক্ষমতা হারাইলেন। ভাগ্যে বন্দীজীবন। পাকিস্তান অংগন্ধেদের বিনিময়ে ক্ষমতা পিপাসু জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা পাইলেন। ক্ষমতার সিংহভাগ ভােগী পাঞ্জাবী কায়েমী স্বার্থ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দুঃস্বপ্ন হইতে মুক্তি পাইল। বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবের জনসংখ্যা ৫৩% অর্থাৎ সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান প্রভৃতি প্রদেশের মােট জনসংখ্যারও অধিক। সুতরাং বােধগম্য কারণেই অতঃপর পাকিস্তানে (সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান) এক ব্যক্তি এক ভোট নীতির গণতন্ত্র প্রবর্তনে পাঞ্জাবী কায়েমী স্বার্থ মহল পোড়া সমর্থক হইতে দ্বিধা করিবে না। বরং তাহাদের শ্লোগান হইবে যে, গণতন্ত্রই পাকিস্তানের রক্ষা কবচ- কেননা I suits them well! অর্থাৎ ইহাই তাহাদের ভাল মানায়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার এক ব্যক্তি এক ভোট গণতান্ত্রিক নীতি সংখ্যাগুরু বাংলাদেশের মােকাবিলায় পাঞ্জাবকে অত্যন্ত বেকায়দায় ফেলিয়াছিল। পাঞ্জাববাসীদের দেশপ্রেম ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখন্ডড়ের বিশ্বাস ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ অন্যান্য প্রদেশগুলির উপর লুণ্ঠন ও আধিপত্য বজায় রাখা সম্বব, নতুবা স্বার্থের খাতিরে পাকিস্তান ও ইসলাম বিসর্জন দিতে পাঞ্জাবীদের এতটুকু বাধিতনা। স্বীয় হীনউদ্দেশ্য চরিতার্থ করিতে সিন্ধু প্রদেশের জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ও সীমান্ত প্রদেশের জেনারেল ইয়াহিয়া খান সর্বনাশা ভূমিকা গ্রহণ করেন। ভবিষ্যৎ ইতিহাসে এই দুই ব্যক্তিই এই মর্মান্তিক কলঙ্কজনক ও বিয়ােগান্তক নাটকের দুরাচার নরাধম (Villain) হিসাবে চিত্রিত হইবেন। উপনির্বাচনী প্রহসন ও শান্তি কমিটি
১৯৭০ সালে ঐতিহাসিক লাহাের নগরে পাকিস্তান ন্যাশনাল প্রােগ্রেসিভ লীগ ও অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খানের নেতৃত্বে জাস্টিস পার্টির প্রতিনিধিদের মধ্যে যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহাতে ভৌগােলিক কারণে পাকিস্তান দুই অর্থনীতির রাষ্ট্র” এই যুক্তি গ্রহণে জাস্টিস পার্টির প্রতিনিধিদল অস্বীকৃতি জানায় এবং ইহার মধ্যে তাহারা বিচ্ছিন্নতাবাদের গন্ধ আবিষ্কার করেন। জওয়াবে তখন তাহাদিগকে বলিতে বাধ্য হইয়াছিলাম যে, পাকিস্তান যদি পৃথক হইয়া যায় তাহা হইলে ক্রমশঃ পাঠান, বেলুচ ও
মাওলানা সিদ্দিক আহমদ ৫। আবুল কাসেম ৬। ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া) ৭। মাওলানা সৈয়দ মােহাম্মদ মাসুম ৮। আবদুল মতিন ৯। আবদুল খালেক ১০। ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন ১১। পীর মােহসেন উদ্দিন (দুদু মিয়া) ১২। এ.এস.এম সােলায়মান ১৩। এ,কে, রফিকুল হােসেন ১৪। আতাউল হক খান ১৫। তােমাহা বিন হাবিব ১৬। মেজর অফিসার উদ্দীন ১৭। ইয়াহিয়া বাওয়ানী ১৮। হাকিম ইরতিজাউর রহমান খান আকুন-জাদা ১৯। সাত্তার কারওয়াদিয়া ২০। আবু আহমদ শাহ এবং ২১। মােহাম্মদ ভাই। | ১১৬ নং বড় মগবাজার, ঢাকা-২, শান্তি কমিটির সদর দফতর স্থাপিত হয়। শাস্তি কমিটি যে কেবল মুক্তিবাহিনী বা বাংলাদেশ সমর্থকদের দমনে ব্যস্ত ছিল, তাহা নহে, পাক সেনাবাহিনীর অকথ্য পাশবিক অত্যাচার ও লুণ্ঠন হইতেও দেশবাসীকে রক্ষা করিতে আপ্রাণ সচেষ্ট ছিল; উভয় বাস্তবতাকে স্বীকার করাই হইবে সত্য ভাষণ। শেষ রক্ষা হইল না। এমনকি বিশ্ব ব্যাংক প্রতিনিধি মিঃ পিটার কারপিল কর্তৃক সরেজমিনে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের রিপাের্টের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমতঃ অশান্ত অবস্থা নিরসন, দ্বিতীয়তঃ ভারত হইতে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন এই শর্তন্বয় পূরণ না হওয়া অবধি এইড টু পাকিস্তান কনসটিটিয়াম ২১শে জুন (১৯৭১) “প্যারিস বৈঠকে” কোন প্রকার সাহায্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, মূলধন নিয়ােগের যথাযথ পরিস্থিতি অবিদ্যমান। অন্যদিকে দুই মহাবন্ধু বৃহৎ শক্তি আমেরিকা ও গণপ্রজাতন্ত্রী মহাচীনের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এবং ৭ই ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি ও অখন্ডত্বের পক্ষে ১০৪ ভােট জোগাড় হইয়াছি সত্য কিন্তু পাক-ভারত স সংঘর্ষের মুহূর্তে (ডিসেম্বর ১৯৭১) মহাচীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাস্তব ও কার্যকর সহায়তাদানে বিরত থাকে। উল্লেখ্য যে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ১১টি ভােট বিপক্ষে যায়, ১০টি রাষ্ট্র ভােটদানে বিরত ছিল। মহাটীন ৬, ১১ ও ১২ই এপ্রিল (১৯৭১) এবং ৫, ১৯ ও ২৭শে নভেম্বর (১৯৭১) পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষার সংগ্রামে দৃঢ়ভাবে পাশে থাকিবার প্রতিশ্রুতি দিলেও এবং কলখিয়া ব্রডকাস্টিং সিস্টেমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাকিস্তান আক্রান্ত হইলে হস্তক্ষেপ করিবার অভিমত উচ্চকণ্ঠে প্রকাশ করিলেও ডিসেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানকে একাই যুদ্ধ করিতে হইয়াছে। ৫ই নভেম্বর (১৯৭১) জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধি দল মহাচীন গমন করে। তৎকালীন অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীপে ফি পাকিস্তানকে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সমর্থন দানের প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আপােষ রফারও পরামর্শ দেন। মহাচীন পিকিং হইতে আগাগোড়া বাস্তব সাহায্যদানের লম্বা চওড়া প্রতিশ্রুতি ঘােষণা করিলেও, কার্যক্ষেত্রে তাহাদের সকল প্রতিশ্রুতি কথার তুবড়িতে পরিণত হয়। বাস্তবে কিছুই হয় নাই। বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালােরাত্রিতে পাক বাহিনীর অতর্কিত হামলা ৬ দফা
ভিত্তিক সাংবিধানিক দাবীকে স্বাধীনতার দাবীতে রূপান্তরিত করে। অবস্থাদৃষ্টে পূর্ব পাকিস্তানী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ভারতীয় সাহায্য প্রার্থনা বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে খন্ড-বিখন্ড করিবার সুবর্ণ সুযােগ হিসাবেই অপেক্ষমান ভারতীয় নেতৃবৃন্দের এইভাবেই কালের প্রবাহে, ঘটনাস্রাতে আকস্মিক মােড় পরিবর্তনের ফলে পূর্বে বর্ণিত ভারতীয় নিজস্ব কারণ ও বাংলাদেশের নিজস্ব কারণ একই ঘটনাস্রাতে লীন হইয়া বাংলাদেশের অত্যুদয় ঘটায়। আমি ভারতের অভিসন্ধি সম্বন্ধে সর্বদাই সন্দিগ্ধ ছিলাম। ভারত বৃহৎ দেশ, তাহার প্রয়োজনও বৃহৎ। ছােট ছােট দেশ বড় বড় দেশের স্বার্থে। উচ্ছন্নে যাইতে বাধ্য হয়। কেবলমাত্র দৃঢ়চেতা সৎ সাহসী নেতাই কোন ছােট দেশকে বৃহৎ দেশের ছােবল হইতে রক্ষা করিতে পারেন। সিকিম রাজ্য ও কাশ্মীর রাজ্যের দুর্বল নেতৃত্ব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ব্যর্থ হইয়া দেশ দুইটিকে বৃহৎ ভারতীয় রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর নেতা ১৯৫৪-৫৮ সালের মধ্যে বিশেষতঃ ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক একচেটিয়া বিজয়ের পর নিজেদের কার্যকলাপের দ্বারা প্রমাণ করিয়াছেন যে, নীতি, অদির্শ, সততা তাহাদের মুখের বুলি মাত্র চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ নহে, অর্থাৎ বুকের বুলি নহে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অক্টোবর মাসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সাথে প্রতিরক্ষা, পররাত্র, প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্য সমঝোত্রী বিষয়ে ৭ দফা গােপন চুক্তি সম্পাদন করে। সুতরাং সেই গােপন চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ। কাগজে কলমে বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পাইলেও কার্যক্ষেত্রে ভারতের বশংবদ রাষ্ট্রে পরিণত । হইবে, তাহা আর বিচিত্র কিা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সরকার ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভূদয় হওয়া সত্ত্বেও ভারতের মাটি হইতে ঢাকায় পদার্পণ করে ২০শে ডিসেম্বর। ইহা এক অভাবনীয় ও অচিন্তনীয় ঘটনা। শুধু তাই নয়, স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করিয়াই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সরকার ১লা জানুয়ারী (১৯৭২) এক আদেশ বলে বাংলাদেশের মুদ্রামান শতকরা ৬৬ ভাগ হ্রাস করেন। উল্লেখ্য যে, এই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের মুদ্রামান ছিল ভারতীয় মুদ্রামান হইতে বেশী। তাজউদ্দিন সরকার এক ঘােষণায় দুই মুদ্রামানের বিনিময় হারের সমতা আনিতে চাহিয়াছিলেন বটে, কিন্তু ফল দাড়াইল অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি এবং জনজীবনে আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য । দ্বিতীয়তঃ ভারতীয় ও বাংলাদেশ অর্থনীতিদ্বয়কে পরস্পর সম্পূরক ঘােষণা করা হয় এবং এতদিন যাবত ভারতে পাট বিক্রির উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তাজউদ্দিন সরকার ১৯৭২-এর ১লা জানুয়ারী হইতে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। | তাজউদ্দিন সরকারের উক্ত ঘােষণা অর্থনীতির মূল সত্যকে অস্বীকার করা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বিশ্ব বাজারে ভারত ও বাংলাদেশ পাট, চা, চামড়া বিক্রির ব্যাপারে পরস্পরের প্রতিযােগী। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা ৯০ ভাগ উপার্জন ছিল কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের উপর নির্ভরশীল। আবার ভারত ওবাংলাদেশ স্ব-স্ব বস্ত্র শিল্পের প্রয়োজনে বিদেশ হইতে কাঁচামাল, তুলা আমদানী করে। উভয় রাষ্ট্রকে বিশ্ব বাজার হইতে স্ব-স্ব প্রয়ােজনে খাদ্য ক্রয় করিতে হয়। মুদ্রামানের হ্রাস উহার উপরে প্রচন্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এক কথায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আশ্বনাশা নীতি দেশের অর্থনীতিকে ভাংগিয়া চুরমার করিয়া দেয়। তৃতীয়তঃ ভারতীয় সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস হইতে মুদ্রিত বাংলাদেশের নােটের সংখ্যা সরকার কর্তৃক ঘােষিত সংখ্যা হইতে অনেক অধিক বলিয়া জনসাধারণের মধ্যে একটা ধারণার সৃষ্টি হয়। তাহাদের এই ধারণা বদ্ধমূল হয় ভারতের মুদ্রিত নােট অচল বলিয়া। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর মুজিব সরকারের এক অভিনব ও বিস্ময়কর ঘােষণীয়। এই ঘােষণায় বলা হয় যে, ভারতে মুদ্রিত নােট দুই মাস যাবত বদল করা যাইবে। ইহার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যে কোন সাধারণ চোখে ধরা পড়িতে বাধ্য। এইভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রকট মুদ্রাস্ফীতির অভিশাপের শিকারে পরিণত হয়। চতুর্থতঃ চরম বিস্ময়কর ঘটনা পরিলক্ষিত হয় বাংলাদেশের বাজারে। কেনা-কাটায় ভারতীয় মুদ্রার অবাধ প্রচলন শুরু হয়। ভারতীয় সৈন্য, ভারতীয় ব্যবসায়ী, ছারছীয় সাধারণ নাগরিক বাংলাদেশের বাজার হইতে দুর্লভ বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রীত বিদেশী পণদ্রব্য ও দেশীয় মাছ, আলু, ডিম, মােরগ, হাঁস, রসুন, মরিচ ইত্যাদি কয়েকশত কোটি টাকার দ্রব্য ভারতীয় মুদ্রায় অবাধে ক্রয় করিয়া ভারতে লইয়া যায়। আবার বিভিন্ন কলকারখানা হইতে শত শত কোটি টাকার মেশিনপত্র ও যন্ত্রপাতির খুচরা অংশ, কাঁচামাল ভারতের মারােয়াড়ী শিল্পপতি ব্যবসায়ীরা পাচার করিয়া লইয়া যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে বহু রাষ্ট্র বৈদেশিক রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ সাহায্য সহায়তায় স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে; কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীয় কাগজী নােটের বিনিময়ে অর্থাৎ । বিনামূল্যে সংঘবদ্ধ প্রতারণার দ্বারা লুটপাট করিয়া সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্রকে এইভাবে নিঃস্ব করিবার নির্মম নজীর আর কোথাও নাই। বাংলার মাটিরই সন্তান ছিলেন তাজউদ্দিন। অথচ তাহার সরকার ভারতীয় কাগজী মুদ্রা বেআইনীভাবে চালু হইতে বাধা দেয় নাই। দেশ বিক্রি আর কাহাকে বলে? পঞ্চমতঃ ৯৩০০০ যুদ্ধ বন্দী বাংলাদেশ হইতে যে দামী দ্রব্য লুট করিয়া আত্মসাৎ করিয়াছিল ভারতীয় সেনা বাহিনী যুদ্ধ বন্দীদের নিকট হইতে সেইগুলি ছিনাইয়া লইয়াছে; আত্মসাৎ করিয়াছে ও ভারতে স্বীয় পরিবারপরিজনের নিকট পাঠাইয়া দিয়াছে। তদুপরি যুদ্ধবন্দীগণ যুদ্ধের নয় মাসে (১৯৭১ মার্চ হইতে ডিসেম্বর) বাংলাদেশের নাগরিকদের নিকট হইতে যে বিপুল পরিমাণ পাকিস্তানী মুদ্রা বিভিন্নভাবে অর্জন করিয়াছিল; ভারতীয় সৈন্যরা সেই কাড়ি কাড়ি টাকা দ্বারা বাংলাদেশ হইতে মাল ক্রয় করতঃ ট্রাকে ভর্তি করিয়া স্বদেশে প্রেরণ করিয়াছে। একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের দুষ্প্রাপ্য সম্পদ বন্ধুত্বের নামাবলীর আড়ালে এইভাবে বাংলাদেশ বিভিন্ন সামরিক ছাউনী হইতে (Military Cantonment) ভারতে স্থানান্তরিত করিবার প্রতিবাদে তাজউদ্দিন সরকার টু শব্দটি পর্যন্ত করেন নাই। * ‘ভারতীয় দৈনিক সংৰাপত্র “অমৃতবাজার-এর ১২ই মে (১৯৭৪) সংখ্যার রিপাের্ট
অনুসারে ভারত সরকার দুই হইতে আড়াই শত রেলওয়ে ওয়াগন ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশ সরকারের অনুরােধক্রমে স্থানান্তরিত করিয়াছে। অথচ ১৯৭৩ সালের ১১ই বলাই বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ স্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেন যে, ভারতে কোন অস্ত্রশস্ত্র পাচার হয় নাই; বা লইয়াও যায় নাই। ১৯৭৪ সালের ১৭ই জুন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রকাশ করেন যে, ভারতে স্থানান্তরিত অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশকে ফেরত দেওয়া শুরু হইয়াছে। দুই মন্ত্রীর এই দুই বক্তব্যের মধ্যে বিরােধিতা লক্ষণীয়। দেশ ও জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা অরি কাহাকে বলে? আর কাহাকেই বা বলা হয় সাক্ষী গােপাল সরকার? স্বর্ণের ভরি ১৭১ টাকা মানে স্থানান্তরিত অস্ত্রশস্ত্রের মুল্য যদি ৪৫০ কোটি টাকা হয়, তাহা হইলে স্বর্ণভরি ১০০০ টাকা মানে উক্ত অস্ত্রশস্ত্রের মূল্য প্রায় ২৭০০ কোটি টাকা হয়। তদুপরি মহাচীন কর্তৃক নির্মিত জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী হইতে অন্ত্র নির্মাণ যন্ত্রপাতি ভারতে স্থানান্তরের অভিযােগ উথিত হয়। আমরা বাংলা জাতীয় লীগ উপরােক্ত বক্তব্যগুলি জনসাধারণ্যে তুলিয়া ধরি এবং দিল্লীর দাসত্ব হইতে মুক্তি লাভের আকাংখায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হইয়া ‘আজাদ বাংলা’ আন্দোলন গড়িয়া তুলি। ভারতের সহিত গোপন চুক্তি
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রশাসনিক, সামরিক, বাণিজ্যিক, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা বিষয়ে একটি সাদা গোপন সমঝোতা চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তিগুলাে নিম্নরূপঃ ১. প্রশাসনিক বিষয়ক যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে শুধু
দ্বারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়ােজিত থাকতে পারবে। বাকীদের শুন্য
জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দ। ২. সামরিক বিষয়ক বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ভারতীয়
সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতিবছর এ সম্পর্কে পুনরীক্ষণের জন্য দু’দেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত
হবে। ৩, বাংলাদেশের নিজস্ব সেনাবাহিনী বিষয়ক বাংলাদেশের নিজস্ব কোন
সেনাবাহিনী থাকবে না। অভ্যন্তরীণ আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য
মুক্তিবাহিনীকে কেন্দ্র করে একটি প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠন করা হবে। ৪, ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ বিষয়ক সম্ভাব্য ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে
অধিনায়কত্ব দেবেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান। এবং যুদ্ধকালীন সময়ে
মুক্তি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়কত্বে থাকবে। ৫, বাণিজ্য বিষয়ক ! খােলা বাজার ভিত্তিতে (open market) চলবে দু’দেশের
বাণিজ্য। তবে বাণিজ্যের পরিমাণের হিসাব নিকাশ হৰে বহর ওয়ারী এবং
যার যা প্রাপ্য সেটা স্টার্লিং এ পরিশােধ করা হবে। ৬, পররাষ্ট্র বিষয়ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের সংগে বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রশ্নে
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সংগে যােগাযােগ রক্ষা করে চলবে এবং যতদুর পারে ভারত বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সহায়তা
দেবে। ৭, প্রতিরক্ষা বিষয়ক বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিষয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করবে
ভারত। গােপন চুক্তি প্রসঙ্গে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকার ?
… বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিবনগর সরকারের সাথে ভারত যে ৭ দফা গােপন চুক্তি করে সে ব্যাপারে জুনাব মাসুদুল হক রচিত “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে “র” এবং সি.আই.এ” শীর্ষক গ্রন্থে মুক্তি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দিল্লীতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র দূতের দায়িত্ব পালনকারী জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী পরবর্তীতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিদের সভাপতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ জাতীয় সংসদের স্পীকার ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর প্রদত্ত জনাব চৌধুরীর-এ সাক্ষাৎকারের সংশ্লিষ্ট অংশ উক্ত গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ১৬৩ থেকে ১৬৬ পৃষ্টা হুবহু নীচে তুলে ধরা হলাে :
প্রশ্ন ও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে যে গােপন সাত দফা চুক্তি করে, প্যারামিলিশিয়া বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা কি সেই সাত দফার মধ্যেই একটি? রক্ষীবাহিনীই কি এই প্যারামিলিশিয়া বাহিনী?
হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী । ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভারত সরকারের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এক লিখিত চুক্তিতে পাই নয়-গ্রিমেন্টে আসেন। এই চুক্তি বা এগ্রিমেন্ট অনুসারে দু’পক্ষ কিছু প্রশাসনিক, সামরিক ও বাণিজ্যিক সমঝােতায় আসেন। প্রশাসনিক বিষয়ে তা হলাে যারা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, শুধু তারাই প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে নিয়ােজিত থাকতে পারবে। বাকীদের চাকুরীয়ত করা হবে এবং সেই শূন্য জায়গা পূরণ করবে ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। স্বাধীনতার পর বেশ কিছু ভারতীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেও গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব) এসে তাদেরকে বের করে দেন।
সামরিক সমঝোতা হলাে : বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করবে (কতদিন অবস্থান করবে তার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় না)। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাস থেকে আরম্ভ করে প্রতিবছর এ সম্পর্কে পুনরীক্ষণের জন্য দুদেশের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের নিজস্ব কোন সেনাবাহিনী থাকবে না।
যে, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশ পাকিস্তান সৈন্যমুক্ত হয় মাত্র। কিন্তু স্বাধীনসার্বভৌম হয় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারীতে। যেদিন শেখ মুজিব পাকিস্তান জেল থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা আসেন। বস্তুতঃ শেখ মুজিব ছিলেন প্রকুত সাহসী এবং খাটি জাতীয়তাবাদী।
(স্বাক্ষর) হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী,
২৭ ডিসেম্বর ১৯৮৯ পরবর্তীকালে এই সাতটি চুক্তি স্বল্প পরিমার্জিতরূপে ১৯৭২ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকার বুকে বংগভবনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান স্বাক্ষরিত ২৫ সালা বন্ধুত্ব সহযােগিতা ও শান্তি চুক্তি’ তে মহাসমারােহে সন্নিবেশিত করা হয়। বাংলা জাতীয় লীগ ইহাকে দাসত্ব চুক্তি’ বলিয়া আখ্যায়িত করে। উপরােক্ত দেশীয় স্বার্থ বিরােধী ও স্বজাতিদ্রোহী নীতি অবলম্বন ও অবাধ লুটতরাজ প্রতিরােধে অনীহা প্রদর্শন একমাত্র সাক্ষীগােপাল সরকারের পক্ষেই সম্ভব। দেশীয় স্বার্থ ও দেশীয় সম্পদকে বন্ধু রাষ্ট্রের ছােবল হইতে সংরক্ষণে চরম ব্যর্থতার সন্তোষজনক কোন জওয়াব তাজউদ্দিন আহমদ কিংবা শেখ মুজিবর রহমানের কূটতর্ক ভাণ্ডারে ছিল কি?
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হইতে বিশ মাইলের মধ্যে অবস্থিত এলাকায় অবাধ বাণিজা প্রচলনের মানসে ২৭শে মার্চ (১৯৭২) সীমান্ত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন মুজিব সরকারের ইতিহাসে আরেকটি কলঙ্কময় অধ্যায়। এই চুক্তি কি সর্বনাশই না। সাধন করিয়াছে জাতীয় অর্থনীতিতে। আরাে ন্যাক্কারজনক অধ্যায় সংযােজিত হয় শেখ মুজিবর রহমান যখন ১৯৭৪ সালের ১৬ই মে দিয়ী শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের। অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বেরুবাড়ী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পদযুগলে নৈবেদ্য হিসাবে অর্পণ করেন। ইহার প্রতিবাদে যখন গণ-আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করিতেছিলাম সেই সময়ে ১৯৭৪ সালের ৩০শে জুন মুজিব সরকার আমাকে কারারুদ্ধ করে। মুজিবের অভিশপ্ত ও সর্বনাশা নেতৃত্ব হইতে বাংলাদেশ মুক্তি পায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। এই দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে সংযােজিত হয় এক নবতর অধ্যায়। এই নবতর অধ্যায় সৃষ্টিকারী ১৫ই আগস্টের প্রকৃত নায়ক কর্নেল আবদুর রশীদ ও লেঃ কঃ ফারুকের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকিবে। এই ১৫ই আগষ্টের সামরিক অভুথানে সপরিবারে নিহত হন শেখ মুজিব এবং এই দিনই রেডিও এবং টেলিভিশন হইতে নব-নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে গােটা জাতির পক্ষ হইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বুলন্দ আওয়াজ উচ্চারণ করেন। গােটা দেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচে। নূতন করিয়া শুরু হয় নরতর। পথযাত্রা। ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার প্রসঙ্গে জে, এন, দীক্ষিতের সাফাই
| ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব জে, এন, দীক্ষিত ৪-৭-৯৫ ইং INDIAN EXPRESs পত্রিকায় তার লিখিত নিবন্ধে প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন যে ভারতীয় সেনাবাহিনী যেন অন্ততঃ এক বৎসর বাংলাদেশে অবস্থান করে কিন্তু ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশংকায় উপরােক্ত প্রস্তাব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেঃ জেনারেল জগজিৎসিংহ অরােরা এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে নিখিল চক্রবর্তীর এক প্রশ্নোত্তরে বলেন, “ভারতীয় বাহিনীর ইষ্টার্ণ হেডকোয়ার্টার ছিল কলিকাতায়। ঢাকা অভিমুখে মার্ক করার আগে আমরা ঢাকায় কতদিন থাকব সেটা নিয়ে ভাবলাম । আমি ঢাকায় আমাদের অবস্থানের সময়সীমা নির্ধারণ করেছিলাম তিন মাস। আমরা ঢাকায় তিন মাস থাকব। এটা এই জন্যেই ঠিক করেছিলাম যে যদি আমরা এর বেশী থাকি আমরা আর লিবারেশন আর্মি হিসাবে অভিনন্দিত না হয়ে অপেশন আর্মি (দখলদার বাহিনী) হিসাবে চিহ্নিত হব। তাই আমরা ৩ মাসের বেশী থাকিনি।” (দৈনিক ইনকিলাব-১২-৩-৯৪ ইং) উপরােক্ত উক্তিগুলিই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দাৰী সত্য নহে। অথচ এটি নিছক ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিজেদের এবং সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিন গংদের পক্ষে সাফাই ছাড়া অন্য কিছু নয়। যুদ্ধোত্তর পাকিস্তান
যুদ্ধ চলাকালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনাব নূরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অংগচ্ছেদের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২০শে ডিসেম্বর (১৯৭১) পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু সদস্যবৃন্দের নির্বাচিত সংসর্পীয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর হতে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। জনাব নূরুল আমিন পশ্চিম পাকিস্তানেই ইন্তেকাল করেন এবং করাচীতে কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমাধি পাশ্বেই
হাতে সমাধিস্থ করা হয়। জনাব নুরুল আমিনের পক্ষে ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয় যে, কায়েদে আযমের পার্শ্বেই তিনি অন্তিম শয্যায় শায়িত আছেন।
ক্ষমতা হস্তান্তরকালে জেনারেল ইয়াহিয়া বন্দী শেখ মুজিবর রহমানকে যাসী দেয়ার পরামর্শ দেয়। উত্তরে ক্ষমতাগ্রহণকারী জুলফিকার আলী ভূট্টোর উক্তি প্রণিধানযােগ্য “If I kill Mujib, not a single West Pakistani will ever come home মুজিবকে হত্যা করিলে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী আর দেশে আসিতে পারিবে না।” ৯৩০০০ যুদ্ধবন্দী ও কয়েক হাজার পাকিস্তানী বেসামরিক কর্মচারীবৃন্দ বাংলাদেশে 101 “Partition & After Math-Memoirs of an Ambasador by kewal singh
L.C.S.-Foreign secretary-Govt. of India.
জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের কিয়ৎ কালের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগার হইতে মুক্তি দিয়া এক গৃহে অন্তরীণ করেন এবং ৩রা জানুয়ারী করাচীতে অনুষ্ঠিত জনসভায় দেয় ভাষণ অনুসারে ৮ই জানুয়ারী (১৯৭২) শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিদান করিয়া বাংলাদেশে প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জনাব ভুট্টোর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাক্ষ্য বহন করে। ১৯৭১ সালের ১১ই আগষ্ট নাকি গােপন সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তির পর শেখ মুজিবর রহমান ৮ই জানুয়ারী (১৯৭২) অপরাহ্ন ১২টা ৩৫ মিঃ লণ্ডন বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। তথায় একদিন অবস্থানের পর ১০ই জানুয়ারী বৃটিশ সরকার প্রদত্ত রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট” বিমানযােগে ঢাকার পথে ভারত সরকার কর্তৃক দিল্লীতে আয়ােজিত সম্বর্ধনা উপলক্ষে শেখ মুজিব সকাল ৮-৩০ মিনিটে কয়েক ঘণ্টার জন্য পালাম বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ভি, ভি, গিরি ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাহাকে পালাম বিমান বন্দরে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহিত মত-বিনিময় ও দিল্লী সম্বর্ধনা সমাপনের পর অপরাহ্ন ১টা ৪২ মিনিটে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানেই শেখ মুজিব ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। নেতার প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিমান বন্দর হইতে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) পর্যন্ত দীর্ঘপথ লােকে লােকারণ্য হয়। তেজগা বিমান বন্দর হইতে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত মাত্র ৪ মাইল পথ ট্রাকযােগে অতিক্রম করিতে ২ ঘণ্টারও অধিক সময় লাগে। স্বচক্ষে অবলােকন না করিলে জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত অকৃত্রিম শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসার গভীরতা অনুধাবন করা অসম্ভব। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব; ছিল আগেকপ্রসূত; এই দৃশ্য অবিস্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক।
| সেইদিন তার সম্মানে রেসকোর্স ময়দানে আয়ােজিত সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলেন যে, “আমি একজন মুসলমান। মৃত্যু আমার একবারই হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ …।” তঁার সেদিনের সেই সাহসী ও সময়ােপযােগী সুস্পষ্ট উচ্চারণ বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তিকে মজবুত করতে নতুন মাত্রা যােগ করে। প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ মুজিব
১১ই জানুয়ারী (১৯৭২) টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। রিসিভার তুলিয়া একটি অতি পরিচিত কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম। কণ্ঠস্বরটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের। কলেজ জীবন হইতে বন্ধুত্ব; কিন্তু কলিকাতায় প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আমাদের মত ভিন্ন দলীয় জাতীয়তাবাদীদের সহিত শােভনীয় আচরণ প্রদর্শন করেন নাই। যাহা হইক,
টেলিফোনে তাজউদ্দিন কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর আমাকে বলেন, শেখ সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন করিবার সিদ্ধান্ত লইয়াছি ও প্রস্তাবও করিয়াছি। কারণ তিনি যে কেনি পদেই বহাল থাকুন না কেন, তাহার ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালিত হইবে। শেখ সাহেবের মানসিক গড়ন তুমিও জান; আমিও জানি। তিনি সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্থ। অতএব ক্ষণিকের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পার্লামেন্টারী কেবিনেট পদ্ধতির প্রশাসন প্রহসনে পরিণত হইবে। তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকিলে নিয়মতান্ত্রিক নামমাত্র দায়িত্ব পালন না করিয়া মনের অজান্তে কার্যতঃ ইহাকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির প্রশাসনে পরিণত করিবেন। এইদিকে প্রেসিডেন্ট পদে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে নির্বাচনের কথা ভাবিতেছি। তােমার মত কি?
তদুত্তরে তাঁহাকে বলি “তােমার সিদ্ধান্ত সঠিক। নামমাত্র প্রেসিডেন্টের ভূমিকা পালন শেখ সাহেবের শুধু চরিত্র বিরুদ্ধ হইবে না; বরং উহা হইবে অভিনয় বিশেষ। কেননা, ক্ষমতার লােভ তাহার সহজাত।” তাজউদ্দিন টেলিফোনের অপর প্রান্তে সশব্দে হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “আমি জানিতাম, মৌলিক প্রশ্নে তােমার আমার মধ্যে। মতভেদ হইবে না।। | ১২ই জানুয়ারীর এক ঘােষণীয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করিলেন বটে; কিন্তু উত্তরকালে ঘটনা প্রবাহে বন্ধুবর তাজউদ্দিনের সদিচ্ছার শেষ রক্ষা হইল না। ভারত-বাংলা দাসত্ব চুক্তি
| প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের আমন্ত্রণক্রমে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৭ই মার্চ (১৯৭২) ঢাকা সফরে আসেন। লক্ষ লক্ষ জনতা তাহার আন্তরিক অভ্যর্থনা জানায়। ১৯শে মার্চ উভয় প্রধানমন্ত্রী যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করেন ও ২৫ বৎসর মেয়াদী “বস্তুত, সহযােগিতা ও শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। আমাদের বাংলা জাতীয় লীগের দৃষ্টিতে চুক্তিটি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব খর্বকারী সামরিক চুক্তি অন্য কথায় দাসত্ব চুক্তি ছাড়া কিছুই ছিল না। ১৯৫৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানি অনুরূপ পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করিয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সে। সময়ে এই পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র বিরােধিতা করে। কিন্তু ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হইবার পর সােহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবর রহমান, আতাউর রহমান খান, মানিক মিয়া (সম্পাদক, ইত্তেফাক) প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির গোড়া সমর্থকে পরিণত হন। সেই শেখ মুজিবুর রহমানই পুনরায় ক্ষমতার মােহে ভারতের সহিত ২৫ সালা দাসত্ব চুক্তি তথা সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করিলেন। লক্ষণীয় যে, পুনঃ পুনঃ অভিযােগ সত্ত্বেও মুজিব-তাজউদ্দিন ভারতের সহিত গােপন চুক্তি অস্বীকার করিতেন, ঠিক যেমন পার্ক-মার্কিন সামরিক চুক্তির সর্বনাশা গোপন।
ধারাগুলি পাক-সরকার প্রকাশ্যে উচ্চকণ্ঠে পুনঃপুনঃ অস্বীকার করিতেন।
Treaty of Friendship, Co-operation and Peace between the People’s Republic of Bangaldesh
and the Republic of India Inspired by common ideals of peace, secularism, democracy, socialism and nationalism.
Having struggled together for the realisation of these ideals and cemented ties of friendship through blood and sacrifices which led to the triumphant emergence of a free, sovereign and independent Bangladesh,
Determined to maintain frateral and good neighbourly relations and transform their border into a border of eternal peace and friendship.
Adhering firmly to the basic tenets of non-alignment, peaceful co-existence, mutual co-operation, non-interference in internal affairs and respect for territorial integrity and sovereignty,
Determined to safeguard peace, stability and security and to promote progress of their respective countries through all possible avenues of mutual co-operations,
Determined further to expand and strengthen the existing relations of friendship between them,
Convinced that the further development of friendship and cooperation meets the national interests of both States as well as the interests of lasting peace in Asia and the world.
Resolved to contribute to strengthening world peace and security and to make efforts to bring about a relaxation of International tension and the final elemination of vestiges of colonialism, recialism and imperialism,
Convinced that in the present-day world international problems can be solved only through co-operation and not through conflict or confronation,
Reaffirming their determination to follow the aims and principles
The people’s Republic of Bangladesh, on the one hand, and the Republic of India, on the other, have decided to conclude the present Treaty,
Article: 1
The High Contracting Parties, inspired by the ideals for which their respective peoples struggled and made sacrifices together, solemnly declare that there shall be lasting peace and friendship between their two countries and their peoples. Each side shall respect the independence, sovereignty and territorial integrity of the other and refrain form interfering in the internal affairs of the other side.
The High Contracting parties shall further develop and strengthen the relations of friendship, good-neighbourliness and all-round cooperation existing between them, on the basis of the abovementioned principlies as well as the principles of equality and mutual benefit.
Article : 2
Being guided by their devotion to the principle of equality of all peoples and states, irrespective of race or creed, the High Contracting parties condemn colonialism and recialism in all their forms and manifestations and reaffirm their determination to strive for their final and complete elemination.
The High Contracting parties shall co-operate with other states in achieving these aims and support the just aspirations of peoples in their struggle against colonialism and racial discrimination and for their national liberation.
Article :3
The High Contracting parties reaffirm their faith in the policy of non-alignment and peaceful co-existence, as important factors for easing tension in the world, maintaining international peace and security and strengthening national sovereignty and independence.
Article : 4
The High Contracting Parties shall maintain regular contacts with each other on major international problems affecting the interests of both States, through meetings and exchanges of views of at all levels.
Article : 5
The High Contracting Parties shall continue to strengthen and widen their mutually advantageous and all-round co-operation in the economic, scientific and technical fields. The two countries shall develop mutual co-operation in the fields of trade, transport and communications between them on the basis of the principles of equality, mutual benefit and the most favoured nation principle.
Article : 6
The High Contracting Parties further agree to make joint studies and take joint action in the fields of flood control, river basin development and the development of hydro-electric power and irrigation.
Article : 7
The High Contracting parties shall promote relations in the fields of art, literature, education, culture, sports and health.
Article: 8
In accordance with the ties of friendship existing between the two countries each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not enter into or participate in any military alliance directed against the other party.
Each of the High Contracting Parties shall refrain from any aggression against the other party and shall not allow the use of its territory for committing any act that may cause millitary damage to or constitute a threat to the security of the other High Contracting Party.
Article : 9
Each of the High Contracting Parties shall refrain from giving any assistance to any third party taking part in an armed conflict against the other party. In case either Party is attacked or threatened with attack, the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultations in order to take appropriate effective measures to eleminate the threat and thus ensure the peace and security of their countries.
Article: 10
Each of the High Contracting Parties solemnly declares that it shall not undertake any commitment. secret of open, toward one or more states which may be incompatible with the present Treaty.
Article: 11
The present Treaty in signed for a term of twenty-five years, and shall be subject of renewal by mutual agreement of the High Contracting Parties.
The Treaty shall come into force with immediate effect from the date of its signature.
Article : 12
Any differences in interpreting any article or articles of the present Treaty that may arise between the High Contracting Partics shall be setled on a bilateral basis by peaceful means in a spirit of mutual respect and understanding,
Done in Dhaka on the Nineteenth Day of March, Nineteen Hundred and Seventy two. (Sheikh Mujibur Rahman)
(Indira Gandhi) Prime Miniser
Prime Minister For the People’s Republic of Bangladesh For the Republic of India.
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের মধ্যে মৈত্রী, সহযােগিতা ও শান্তি চুক্তি
শান্তি, ধর্মনিক্ষেপ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের একই আদর্শে ‘অনুপ্রাণিত হয়ে,
এই আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য একযােগে সংগ্রাম এবং রক্তদান ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার ফলশ্রুতি হিসেবে মুক্ত, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় অ্যুদয় ঘটিয়ে,
সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সপ্রতিবেশীসূলভ সম্পর্ক রক্ষায় এবং উভয় রাষ্ট্রের সীমান্তকে চিরস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্বের সীমান্ত হিসেবে রুপান্তরিত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে, নিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান, পারস্পরিক সহযােগিদ্য, অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান প্রদর্শনের মূলনীতিসমূহের প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল থেকে,
শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা রক্ষার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এবং সম্ভাব্য সকল প্রকারের পারস্পারিক সহযােগিতার মাধ্যমে স্ব-স্ব দেশের অগ্রগতি সাধনের জন্য,
উভয় দেশের মধ্যে বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরাে সম্প্রসারণ ও জোরদার করার জন্য দৃঢ় সংকল্প হয়ে, | এশিয়া তথা সমগ্র বিশ্বের স্থায়ী শান্তির স্বার্থে এবং উভয় রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের খাতিরে বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযােগিতা আরো সম্প্রসারণের ব্যাপারে স্থিরবিশ্বাসী
বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করার উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমন এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবৈষম্য ও সাম্রাজ্যবাদের অবশেষসমূহ চূড়ান্তভাবে নির্মল করার জন্য প্রচেষ্টা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে,
| আজকের বিশ্বে আন্তর্জাতিক সমস্যাসমূহের সমাধান শুধুমাত্র সহযােগিতার মাধ্যমে সম্ভব, বৈরীনীতি বা সংঘাতের মাধ্যমে নয়- এ ব্যাপারে স্থিরনিশ্চিত হয়ে, | জাতিসংঘ সনদের নীতিমালা ও লক্ষ্যসমূহ অনুসরণের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা পুনরুল্লেখ করে এক পক্ষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অন্য পক্ষে ভারতীয় সাধারণতন্ত্র বর্তমান চুক্তি স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
অনুচ্ছেদ ও এক
চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয়পক্ষ, স্ব স্ব দেশের জনগণ যে আদর্শের জন্য। একযোগে সংগ্রাম এবং ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মর্যাদার সঙ্গে ঘােষণা করছে যে, উভয় দেশ ও সেখানকার জনগণের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ও বন্ধুত্ব বজায় থাকবে। একে অন্যের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখগুত্বের প্রতি
সম্মান প্রদর্শন করবে এবং অপরের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ উপরে উল্লেখিত নীতিমালার ভিত্তিতে এবং সমতা ও পারস্পারিক লাভজনক নীতিসমূহের ভিত্তিতে উভয় দেশের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ। সুপ্রতিবেশীসূলভ ও সার্বিক সহযােগিতার সম্পর্কের আরাে উন্নয়ন ও জোরদার করবে।
অনুচ্ছেদ ও দুই
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল রাষ্ট্র ও জনগণের প্রতি সমতার নীতিতে আস্থাশীল থাকার আদর্শে পরিচালিত হয়েই চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ সর্বপ্রকারের ও ধরণের উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের নিন্দা করছে এবং ডাকে চূড়ান্তভাবে ও সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য প্রচেষ্টা চালানাের ব্যাপারে তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কথা পুনরুল্লেখ করছে।
চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ উপরােক্ত অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সহযােগিতা করবে এবং উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্য বিরােধী সশ্রম এবং জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে জনগণের ন্যায়সংগত আশা আকাঙ্খার প্রতি সমর্থনদান করবে।
অনুচ্ছেদ : তিন।
চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং জাৰ্তীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা জোরদার করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে জোট নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রতি। তাদের আস্থার পুনরুল্লেখ করছে।
অনুচ্ছেদ ? চার
উভয় দেশের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রধান প্রধান আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী নিয়ে মুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ সকল স্তরে বৈঠক ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে নিয়মিত যােগাযােগ রক্সা করবে।
অনুচ্ছেদ ও পাঁচ
চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী ক্ষেত্রে পারস্পারিক সুবিধাজনক ও সার্বিক সহযােগিতা জোরদার ও সম্প্রসারিত করে যাবে। উভয় দেশ সমতা ও পারস্পারিক সুবিধার নীতির ভিত্তিতে এবং সর্বাধিক সুবিধানের নীতি অনুযায়ী (Most favoured nation policy) বাণিজ্য, পরিবহন ও যােগাযােগের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযােগিতা প্রসারিত করবে।
অনুচ্ছেদ হয়
বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী অববাহিকার উন্নয়ন এবং জলবিদ্যুৎ শক্তি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়নের ক্ষেত্রে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণে চুক্তিকারী। উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ একমত হয়েছে।
অনুচ্ছেদ সাত
চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ও খেলাধূলার ক্ষেত্রে সম্পর্ক প্রসারিত করবে।
অনুচ্ছেদ ও আট
দুইটি দেশের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুযায়ী চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষের প্রত্যেকে মর্যাদার সঙ্গে ঘোষণা করছে যে তারা একে অন্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত কোন সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না বা অংশগ্রহণ করবে
| যুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ একে অন্যের উপর আক্রমণ থেকে নিবৃত্ত থাকবে এবং তাদের এলাকায় এমন কোন কাজ করতে দেবে না যা চুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন কোন পক্ষের সামরিক ক্ষতির কারণ হতে পারে বা কোন পক্ষের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অনুচ্ছেদ নয়। | মুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষের কোন এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তিকারী প্রত্যেকে এতদউল্লেখিত তুৰ্তীয় পক্ষকে যে কোন সাহায্য প্রদানে বিরত থাকবে। এছাড়া যে কোন পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হবার ভীতি দেখা দিলে এই ধরনের ভীতি নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চুক্তিকাত্ৰী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষ সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক আলােচনায় মিলিত হয়ে নিজেদের দেশের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং শান্তি স্থাপন। সুনিশ্চিত করবে।
অনুচ্ছেদ : দশ।
চুকিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন উভয় পক্ষের প্রত্যেকে মর্যাদার সংগে ঘােষণা করছে যে, এই চুক্তির সঙ্গে অসামাঞ্জস্য হতে পারে এ ধরনের গােপন অথবা প্রকাশে এক অথবা একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে কোন প্রকার অঙ্গীকার করবে না।
অনুচ্ছেদ ও এগারো | এই যুক্তি পচিশ বছরের মেয়াদের জন্য স্বাক্ষরিত হলাে এবং মুক্তিকারী উচ্চমর্যাদসম্পন্ন উভয় পক্ষের পারস্পরিক সম্মতিতে চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই চুক্তি সহি হবার দিন থেকে কার্যকরী হবে।
অনুলেঃ বায়ো।
এই চুক্তির কোন একটি অখবা একাধিক অনুচ্ছেদের বাস্তব অর্থ করবার সময় মুক্তিকারী উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের মধ্যে কোন মতপার্থক্য দেখা দিলে তা পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সমঝােতার মনােভাবের উপর ভিত্তি করে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে দ্বিপাক্ষিক আলােচনায় নিস্পত্তি করতে হবে।
ঢাকায় সম্পাদিত। তারিখ উনিশে মার্চ, উনিশ শ বাহাত্তর সাল। (শেখ মুজিবুর রহমান)
(ইন্দিরা গান্ধী) প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পক্ষে
ভারত সাধারণতন্ত্রের পক্ষে। ভারত-বাংলাদেশ ‘বন্ধুত্ব, সহযােগিতা ও শান্তি চুক্তির প্রকাশ্য ধারাগুলি পাঠ করিলেই পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির ধারাগুলির কথা অামার অরণে আসে। তাই ২০শে মার্চ চটগ্রাম জিলা জাতীয় লীগ কর্মী সম্মেলনে ও ২২ শে মার্চ অপরাহে চটগ্রাম জাতীয় লীগ কর্তৃক আহত লালদীঘি ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় আমি উক্ত চুক্তিকে “দাসত্ব-চুক্তি” বলিয়া অভিহিত করি এবং ইহার বাতিল দাবী করি। ইহার কয়েক দিনের মধ্যেই ২৭শে মার্চ (১৯৭২) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অবাধ বাণিজ্য চুক্তি নামে আরেকটি অসম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমাদের আশংকাই সত্য হইল। তাই আমরা বাংলা জাতীয় লীগ দিল্লীর দাসত্ব মােচনের দাবীতে “আজাদ বাংলা দােলনের ডাক দেই। ভারতীয় শক্তি ও বাংলাদেশে ভারতীয় সেবাদাস মহল আমাদের বিরুদ্ধে, নানাপ্রকার অবারুিত পন্থা গ্রহণ করে। এমনকি জীবন নাশের হুমকি প্রদর্শন করে; আমাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আজাদ বাংলা’ আন্দোলন সমগ্র দেশে ব্যাপ্তি লাভ করে। সে সময়ে ভারতের বিরুদ্ধে এবং ভারতের আশ্রিত মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে জনমঙ্গকে আশা ও ভাষাদানের পরিণতিতেই সংঘটিত হয় ১৫ই আগষ্টের অভুথান, এই অভুথানের মাধ্যমেই শুরু হয় বাংলাদেশের সত্যিকার জয়যাত্র। ফলশ্রুতিতে ২৪শে আগস্ট (১৯৭৫) আমি কারাগার হইতে মুক্তিলাভ করি। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ী ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশের সংগে সংগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত একাকার হইয়া যায়। বিনা অনুমতিতে বা বিনা দলিলেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় জনতার পণ্যের স্রোত প্রবাহিত হইতে থাকে। বাংলাদেশ বাস্তবে ভারতের বাজারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ হইতে লক্ষ লক্ষ গাইট পাট অবাধে সীমান্ত পারের পাটকলগুলির চাহিদা মিটাইতে আরম্ভ করে। ভারতীয় পাটকলগুলির পূর্ণোদ্যমে দুই-তিন শিফটে কাজ চালু হইয়া যায়। এমনকি বাংলাদেশের পাট-লােপাটি করিয়া ভারত নূন করিয়া বিদেশে কাঁচা পাট রফতানী শুরু করিয়া দেয়। স্মর্তব্য, কাঁচা পাটের অভাবে ইতিপূর্বে ভারতীয় পাটকলগুলি অতিকষ্টে এক শিফটে। কাজ করিত এবং ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাক-ভারত বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হইয়া যাওয়ায় ভারতকে বাধ্যতঃ সিংগাপুরের মাধ্যমে প্রতি বৎসর ১০ হইতে ১৫ লাখ বেল পাকিস্তানী উচ্চমানের পাট চড়ামূল্যে ক্রয় করিতে হইতে। পাক কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-মুখর শেখ মুজিবর রহমান পাট রফতানীর মাধ্যমে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানেরই একাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয়ের বিরুদ্ধে আদা-জল খাইয়া সােচ্চার ছিলেন। অথচ তাহারই শাসনামলে ভারত অবাধে বাংলাদেশের পাটি
লুণ্ঠন করিয়া চলিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশী কাঁচা পাট রফতানী দ্বারা ভারত নিয়মিতভাবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করিয়া চলিল। অথচ শেখ মুজিব টু শব্দটি উচ্চারণ করিলেন না। ইহা কোন্ স্বার্থের বিনিময়ে কিংবা কোন্ বিশেষ কারণে? তিনি কি জাত ছিলেন না যে, ভারতের পাটশিল্পজাত পণ্য রফতানী প্রসূত অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের মাত্র ১৫% হইতে ১৭%; কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি কাচাপাট ও পাটশিল্পজাত পণ্য রফতানী আয়ের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল? কি মাহেন্দ্রক্ষণেই না বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, আর কি মাহেন্দ্রক্ষণেই না ভারত অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে, এই সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি ছাড়পত্র বলেই বাংলাদেশের (ক) বিদেশ হইতে সাহায্যপ্রাপ্ত পণদ্রিব্য (খ) ইউরােপ, আমেরিকা ও জাপান হইতে উন্নতমানের আমদানীকৃত পণ্যদ্রব্য (গ) বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য ও আমদানীকৃত চাউল ও অন্যান্য সামগ্রী (ঘ) বাংলাদেশের প্রােটিন সমৃদ্ধ ডিম, নদীনালার মাছ, জমির শাক-সবৃজি, তরি-তরকারী, গৃহপালিত হাঁস-মােরপ, গরু, বকরি () সােনা-রূপা, তামা, ছােট খাট কল-কারখানা, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ সীমান্তের অপর পর ভারতে অবাধে পাচার হইতে থাকে। অপরপক্ষে একই পথে ভারত হইতে আসিতে থাকে তামাক, মসলা প্রতি অনাবশ্যক পণ্য। শুধু তাই নয়, একইভাবে বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে ভারতীয় শিল্পজাত পণ্য দ্রব্যের বাজারে পরিণত হয়। আর ইহারই পরিণতিতে সম্পদে ক্রম-নিঃস্ব বাংলাদেশ অবশ্যম্ভাবী ভাবেই নিপতিত হয় মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতির কবলে।
একদিকে মওলানা ভাসানীর সোচ্চার কণ্ঠ এবং অন্যদিকে আমাদের বাংলা জাতীয় লীগের আন্দোলনের ফলে সমগ্র বাংলাদেশ ক্রমশঃ অবাধ বাণিজ্য চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হইয়া উঠে। মুজিব সরকার পরিশেষে জনমতের চাপে পড়িয়াই ১৯৭৩ সালে অবাধ সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি স্কুপিত রাখিতে বাধ্য হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে কালাে টাকায় পরিচালিত সীমান্ত বাণিজ্য সংঘবদ্ধ চোরাচালানের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে; সর্বনাশা দুর্নীতি অনুপ্রবেশ করিয়াছে জাৰ্তীয় জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর চরিত্রহীনতা জীবনের ও জীবন যাপনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হইয়া পড়িয়াছে। সীমান্তে অবাধ চোরাচালানের সমালােচনার জওয়াবে বাংলাদেশ রাইফেলস প্রধান বিগ্রেডিয়ার চিত্তরঞ্জন দর অকস্মাৎ বেসামাল উক্তি করেন যে, সীমান্ত চোরাচালান সম্পূর্ণ বন্ধ (dead stop) হইয়াছে এবং ছাৱত-বিরােধীরাই চোরাচালান সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা করিতেছে।” যদিও বিগ্রেডিয়ার চিত্তরঞ্জনের অন্যায় মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকা সীমান্ত চোরাচালানের উপর তথ্যমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করিয়াছে; ইত্তেফাকের কলামিষ্ট লুক-তাহার স্থান-কাল-পাত্র’ কলামে বিগ্রেডিয়ার চিত্তরঞ্জনকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ প্রদান করিয়াছেন এবং এমনকি আওয়ামী লীগের কোন কোন সংসদ সদস্য অবিচ্ছিন্ন চোরাচালানের বিরুদ্ধে সরব কণ্ঠে নিন্দমুখর হইয়া উঠিয়াছিলেন তথাপি বিগ্রেডিয়ার চিত্তের বিরুদ্ধে দিল্লীশ্বরের ভয়ে মুজিব সরকার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন
নাই। | এইদিকে ১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ মিল, ফ্যাক্টরী, কল-কারখানাগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত ঘােষণা করা হয়। দলীয় ও অযােগ্য লােকদের পরিত্যক্ত মিল-কারখানাগুলির প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। সুযােগ পাইয়া নগণ্য সংখ্যক ব্যতিক্রম ব্যতীত সাধারণ শ্রমিক নেতা ও মাতব্বর ধরনের শ্রমিক ও মিল কারখানার প্রশাসকবৃন্দ লুটপাটের অবাধ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সর্বত্র আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানি, সরকারের অমার্জনীয় মৌন সম্মতি, ক্ষেত্র বিশেষে আওয়ামী লীগারদের সহযােগিতা এবং অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসকদিগকে দালাল আইনে ভীতি প্রদর্শন এবং সর্বোপরি প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা ইত্যাকার বহু কারণেই সামগ্রিক উৎপাদন ধসিয়া পড়ে। এককথায় দেশ তীব্র বেগে ধাবিত হইতে থাকে মরহুম ডঃ মাজহারুল হক্সে ভাষায় “রসভিলের পানে।” জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুজিবর রহমানের কিছু ঐতিহাসিক কার্যক্রম ঃ
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী মুজিব ভাই স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই জাতীয় স্বার্থে কতিপয় যুগান্তকারী কার্যক্রম গ্রহণ করেন যেমন—
ভারতের সাথে প্রবাসী সরকারের গোপন বাণিজ্যিক সমঝােতা চুক্তি অনুযায়ী স্বাধীনতার পর পরই খােলা বাজার ভিত্তিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় । দু’দেশের সীমান্তের ৩ মাইল খুলে দেয়া হয়। শেখ মুজিব তা বন্ধ করে দেন।
প্রশাসনিক গোপন সমঝােতা অনুযায়ী যশোহর, কুষ্টিয়া ও পাবনা ইত্যাদি জেলায় ভারতীয় কিছু কর্মকর্তা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ত্ব গ্রহণের জন্য ইতিমধ্যে এসে পৌছেছিলেন ও অন্যান্য স্থানেও আসার প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু মুজিব ভাই তাদের ফেরৎ পাঠালেন এবং অন্যদের আসা বন্ধ করলেন। দেশীয় অফিসার যাহারা ভারতে যেতে পারেননি বা যাননি এবং যাহারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন তাহাদের সকলকে বহাল রেখেই প্রশাসন চালানাের নির্দেশ দিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানের এই সিন্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী ও ঐতিহাসিক। তিনি যদি সেদিন এই সিদ্ধান্ত কঠোরভাবে বাস্তবায়ন না করতেন তাহলে আমাদের যে সমস্ত অফিসার ‘৭১ এ ভারতে যায়নি তারা সবাই ডিসমিস হতেন। বাঙ্গালী মুসলমানদের শতকরা ৯৫ ভাগ চাকুরী হারাতেন। শূন্যস্থান পূরণ করতাে ভারতীয় অফিসাররা। তারাই আমাদের প্রশাসনের নিয়ন্তা হতাে ফলশ্রুতিতে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব কতটুকু থাকতাে তা সহজেই অনুমেয়। তবে আমাদের সামরিক বেসামরিক প্রশাসনের যাহারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য জান্নতে গিয়েছিলেন ইতিমধ্যে তাহাদের চাকুরীতে ২ বৎসরের জেষ্ঠতা প্রদান করা হয়। যা ছিল ঘােরতর অন্যায়। কেননা যাহার পাকবাহিনীর প্রশাসন হেড়ে দেশ ছেড়েছিলেন তাহারা বিবেকের তাড়নাই তাহা করেছিলেন। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দিতেই তাহা করেছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সর্বোচ্চ ত্যাগের আদর্শের মহিমায় তাহারা মুক্তি
সংগ্রামের রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কোন পুরস্কার, কোন বিনিময় কিংবা প্রাপ্তির জন্য নয়। এই ত্যাগের মহিমাকে কোন কিছুর বিনিময়ে ছােট করা অন্যায় ও অনৈতিক। অথচ ২ বসর সিনিয়রিটির নামে এটি করে ত্যাগের মহিমায় ভাস্কর ভবিষ্যৎ ইতিহাসে ওই প্রাপ্তি নিজের কাছেই নিজেকেই ছােট করে দেয়। আর এই কাজটি করেছে দিল্লীশ্বরী ইন্দিরা গান্ধীর বংশবদ বাংলাদেশ সরকারের অল্পী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ফলে দেশে কোন আদর্শ বা চরিত্র নাই, লােভের হুতাশনে অজি দেশের শিক্ষা, প্রশাসন, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি লণ্ডভণ্ড। | স্বাধীনভর পর সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেয় বাংলাদেশে ভারতীয় সৈনাের অবস্থান। শেখ মুজিব ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ১০ই জানুয়ারী দেশে ফেরার প্রাক্কালে লঞ্চন হয়ে দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে অবতরণের পর দিল্লীতে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহিত মতবিনিময়ের এক পর্যায়ে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে দেশ হতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের সময় জানতে চান এবং অনতিবিলম্বে সৈন্য প্রত্যাহারের অনুরােধ জানান। এতে ইন্দিরা গান্ধী কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও সময় মতাে প্রত্যাহার করা হবে বলে তাকে আশ্বস্ত করতে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি মাসে কোলকাতা সফরে গিয়ে শেখ মুজিব ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলােচনাকালে দেশ হতে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে পীড়াপিড়ি করে ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক জেনারেল মানেকশকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দিনক্ষণ ঠিক করতে নির্দেশ প্রদানে বাধ্য করেন। এক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী জেনারেল মানেকশ কে নির্দেশ দিলেন তার বাংলাদেশ সফরের পূর্বেই যেনাে সেনা প্রত্যাহারের কাজ শুরু করা হয়। সে মতাে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাহারের কাজ শুরু হয়। ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য এক ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এটা শেখ মুজিবের মতাে দৃঢ়চেতা সাহসী নেতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। এজন্য জাতি তাঁর কাছে চিরকৃতন্ম।
পাক সেনাবাহিনীর ৯৩,০০০ যুদ্ধবন্দী সেনা সদস্যের পাকিস্তানে ফেরত নিতে ভারতের সাথে পাকিস্তানের আলোচনার সময় শেখ মুজিব এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অপরাধে বিচার দাবি করেন। এবং বাংলাদেশের সম্মতি ছাড়া তাদের পাকিস্তান ফেরত পাঠানাের বিরােধীতা করেন। পাকিস্তান দাবি করে যে তাহারা ভারতীয় কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বাংলাদেশ কমান্ডের কাছে নয়। প্রশ্নোত্তরে শেখ মুজিব বললেন ভারতীয় কমান্ড নয় যৌথ কমান্ডের কাছে।
এদিকে ১৯৭২ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদের ব্যাপারে গণচীন তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে ফলে বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভ অনিশ্চিত হয়ে পক্ষে। ইতিমধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভূট্টোর মধ্যে শিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
শেখ মুজিব ‘৭৩ সালের অক্টোবর জাপান সফরে যান। সেখানে তিনি চীন সম্পর্কে
বলতে গিয়ে বলেন, “চীন মহান দেশ। চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক সুদীর্ঘকালের তাদের কাছে সৌভ্রাতৃত্ব আর সৌহার্দ্যমূলক আচরণই আমরা আশা করবাে। কিন্তু বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে চাইলে আমরা মাথা নত করবাে না। এই সময় চীনের সাথে আমাদের সম্পর্কোন্নয়ন অতীব জরুরী ছিল এবং দক্ষ ও সুদূর প্রসারী দুরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের মাধ্যমেই তা সম্ভব ছিল।
১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ইসলামী সম্মেলন। বাংলাদেশকে এতে অংশগ্রহণ করানাের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানে নিতে আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট হরারী বুমেদীন তার নিজস্ব বিমান ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন। সকলেই দ্বিধান্বিত। তখনও পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নাই। তাজউদ্দীন গং পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ইসলামী সম্মেলনে শেখ মুজিবের যােগদানে সম্মত নয়। সমঝােতা চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সাথেও কথা বলতে হয়। তাই তাহারা শেখ মুজিবকে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলােচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে বললে-শেখ মুজিব রাগান্বিত হয়ে তাজউদ্দীনকে বললেন, “আমি কাহারে বংশবদ নই, অামার দেশের সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে। আমি ইসলামী সম্মেলনে যােগ দিতে পাকিস্তান যাবাে।’ অবশেষে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। অতঃপর ভারতের সাথে কথা না বলেই শেখ মুজিব ইসলামী সম্মেলনে যােগ দিতে পাকিস্তানের লাহােরে চলে গেলেন। বাংলাদেশ ওআইসি সদস্যপদ লাভ করে। পরবর্তীতে ‘৭৪ সালেই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশ আসেন। অন্যদিকে চীন জাতিসংঘে তার প্রদত্ত ভেটো প্রত্যাহার করে নেয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এটা শেখ মুজিবের কূটনৈতিক সাফল্যেরই ফলশ্রুতি। এটা সম্ভব হয়েছে তার চরিত্রের দৃঢ়তা ও বৈপ্লবিক গুণাবলীর কারণে। তিনি যদি ইসলামী সম্মেলনে না যেতেন, পাকিস্তানের স্বীকৃতি না পেতেন, চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন না করতেন তাহলে জাতিসংঘে চীন তার ভেটো ক্ষমতা, প্রয়ােগ অব্যাহত রাখতে আর বিরুদ্ধ থাকা মুসলিম দেশগুলােও আমাদের সমর্থন দিতাে
। জাতিসংঘে আমাদের সদস্যপদ লাভ শুধু বিলম্বিতই হতো। গােপন সমঝোতা চুক্তির বাধ্যবাধকতায় দেশ পরিচালনায় তাজুদ্দিনের সাথে তার চরম মতদ্বৈততার কারণেই তাজউদ্দিনকে তার মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হন। শুধু মন্ত্রী সভাই নয় পরবর্তীতে বাকশাল গঠনেও দেখা যায় বাকশালের সদস্যপদও তাকে দেয়া হয়নি।
প্রসঙ্গ বেগম মুজিব ?
মুজিব সহধর্মীনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের সম্মানিত ভাৰী। তার ত্যাগ-তিতিক্ষা-প্রজ্ঞা আর কষ্ট সহিষ্ণুতা অতুলনীয়। রাজনৈতিক কারণে মুজিব ভাই বছরের পর বছর কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাগারের বাইরের জীবনও ছিল আন্দোলন সগ্রাম আর সংগঠন নিয়ে ব্যপৃত। অন্যদিকে ভাবী সংসার চালানাে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে শুরু করে দেশের রাজনৈতিক গতিবিধি আর দলের নেতাকর্মীদের
খোঁজ-খবর রাখতেন। প্রয়ােজনে উপদেশ দিতেন বুদ্ধি দিতেন। দুর্যোগে দুর্বিপাকে কখনাে তিনি মুষড়ে পরতেন না। সাহস হারাতেন না। বুদ্ধিমতি ও সাহসী এই মহিয়সী নারী নেপথ্যে থেকে এদেশের রাজনীতিতে অনেক অবদান রেখেছেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। অনেক কষ্ট স্বীকার করেছেন। অনেক দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। বিশেষ ক্ষেত্রে সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কোন সিদ্ধান্ত নিতে মুজিব ভাইকে সহযােগিতা করেছেন। অনেক সময় তাকে প্রভাবিতও করেছেন।
| আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিৰ ছাই ক্যান্টনমেন্টে বন্দী। দেশের উত্তলি-উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জেনারেল আয়ুবের মসনদ টলটলায়মান। সে সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে আয়ুব খান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক গােলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। শেখ মুজিবকে প্যারােলে মুক্তি দিয়ে প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত রাখার প্রস্তাব করা হলাে এবং ইত্তেফাক সম্পাদক তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া, আতাউর রহমান খান, আবুল মুনসুর আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ আয়ুবের দেয়া প্যারােলে মুক্তি প্রস্তাব মেনে নিলেন। যদিও গণদাবী ছিল ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের। বেগম মুজিব কিন্তু প্যারােলে মুক্তি নিয়ে গােলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের ঘাের বিরোধী ছিলেন। তিনি ছুটে এলেন আমার কাছে। আমাকে তিনি বললেন যে মামলা প্রত্যাহার না হলে প্যারােলে মুক্তি নিয়ে গােল টেবিলে যাওয়া ঠিক হবে না। তিনি সেটা চান না। তিনি এ ব্যাপারে আমার মত জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম আমি আপনার সাথে একমত এবং আরাে বললাম যে আপনি কি মুজিব ভাইকে ক্যান্টনমেন্টে এই খবর পাঠাতে পারবেন। তিনি বললেন, পারবেন। আমি ভাবীকে বললাম আমার কাজ আমি করবাে আপনি মুজিব ভাইকে একথাটি জানিয়ে দিন আর এক্ষুণি আপনি তােফায়েল আহমদসহ ছাত্রলীগের সংগ্রামরত নেতৃবৃন্দের সাথে দেখা করুন এবং তাদেমকে এ ব্যাপারে বলুন। প্রয়ােজনে আপনি ইকবাল হলে চলে যান। ভাবী সে সময় এ ব্যাপারে যা যা তার পক্ষে করণীয় সব কিছুই করেছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে মুজিব ভাইয়ের নিকটও যথারীতি খবর পাঠিয়ে দিলেন। এমনকি তিনি মুজিব ভাইকে এমনও বলে দিয়েছিলেন যদি প্যারোলে মুক্তিতে রাজী হল তাহলে তার সাথে চিরদিনের মতাে সম্পর্ক ছিন্ন হবে। এর পরবর্তী ইতিহাস সকলের জানা। নেপথ্যে থেকে ভাবী এমনি অনেক কঠোর ভূমিকা পালন করেছেন যা নাকি যে কোন মূল্যায়নে সঠিক ছিল। অনেক ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনে Turing point হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সন্তানসন্ততিসহ অবরুদ্ধ এই ঢাকা শহরে স্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় দীর্ঘ নয় মাস অতিবাহিত করেন। ২৫ শে মার্চ ‘৭১ রাত্রিতে দেশের পরিস্থিতি যখন দ্রুত অবনতিশীল সে সময় মুজিব ভাই ভাবীকে ডেকে বললেন, ‘শেনি হাসিনার মা দেশের পরিস্থিতি ভালাে নয়। জানি না কপালে কি আছে? আমার যদি কিছু হয় খােকা রইল সে তােমাদের দেখানা করবে। মুজিব ছাই গ্রেফতার। হয়ে যাবার পর মুজিব ভাইয়ের আপন ফুফাতো ভাই একমাত্র এই মুমিনুল হক খােকা সেই দুঃসহ দিনগুলােতে নিজের জীবন বাজী রেখে ভাবী ও তাঁর সন্তানদের পাশে
ছিলেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য শেখ জামালের ভারতে চলে যাওয়ার কারণে তাকে বধ্যভূমিতে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আল্লাহর অশেষ রহমতে খােকা বেচে যনি। দুঃখের দিনে সুদিনের স্বজনেরা পাশে থাকে না। এ সত্যটি ভাবী মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। ২৫ শে মার্চ কালাে রাত্রির পর ধানমণ্ডর ৩২ নং বাসা ছেড়ে সন্তানসন্ততিসহ প্রথমে মালীবাগ পরে মগবাজার এভাবে এ বাসা ও বাসা করে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরমধ্যে শেখ কামাল ভারতে চলে গেলে তিনি উতলা হয়ে পড়লেন। উপায়ন্তর না দেখে তিনি কামালের খোজে খােকাকে ধানমখীতে তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার পুত্র আনোয়ার হােসেন মঞ্জুর বাসায় পাঠান। ছাতেই যত গন্ডগােল হয়ে গেলাে। খােকাকে নিয়ে মন্ধু ও তার মা বেগম মানিক মিয়াসহ মগবাজারের যে বাসায় ভাবী থাকতেন সে বাসায় হাজির। পরবর্তী অধ্যায়- মরুর বাসায় আইএসআই প্রধান মেজর জেনারেল ওমরের সাথে থােকার সাক্ষাতের ব্যবস্থা। পরিণতিতে পাক বাহিনীর ঠিক করে দেয়া ধানমন্ডীর ১৮ নং সড়কের বাসায় তাদের প্রহারাধীনে ছাৰী তাঁর সন্তানাদিসহ ১৯৭১ এর বিজয় দিবস তৎপরবর্তী ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী মুজিব ভাই এর টাকা প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত সেই বাড়ীতেই অন্তরীণ ছিলেন। এই যে ভাবী তার সন্তান সন্ততিসহ পাক বাহিনীর পাহারাধীন বাড়ীতে নজরবন্দী অবস্থায়, স্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে ছিলেন এটাই সুহৃদ মন্ধু ও মধুর মার খেলা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৬ই ফিসেম্বর ‘৭১ বিজয় দিবসে রেসকোর্স ময়দানে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও ১৮ নং সড়কে যে বাসায় ভাবী থাকতেন সে বাসা থেকে পাকিস্তানী সেনা প্রহরা প্রত্যাহার না হওয়াতে ভাৰীসহ পরিবারের সকলের জীবন আশংকা দেখা দেয়। এরই মধ্যে ভারতীয় সেনা বাহিনীর মেজর তারা সেখানে আসলেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের সেখান থেকে সরে না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন ৪ জলে যেতে বললে। পাক সেনারা ১ ঘণ্টা সময় চাইল। কিন্তু মােমিনুল হক খােকা তাদের দুরিঅভিসন্ধি আঁচ করতে পেরে মেজর তারাকে অনুরােধ করলেন তিনি যেনাে তাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তার ভয় ছিল যদি মেজর তারা চলে যায় সে সুযােগে পাক সেনারা তাদের সকলকে নিমিষে হত্যা করে ফেলবে। মেজর তারাও ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তিনি পাক সেনাদেরকে তার উপস্থিতিতেই সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করে। মুজিব ভাই দেশে আসার পর ভাবী এ প্রসঙ্গটি তাকে বলেন এবং মেজর তারার প্রতি কৃতজ্ঞতা বােধে তাকে বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। স্বস্ত্রীক মেজর তার বাসায় এলে ভাবী মিসেস তারাকে একটি হীরার নেকলেস উপহার দেন আর থােকা মেজর তারাকে একটি ওমেগা ঘড়ি উপহার দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বেগম মুজিবের সেই দুঃসহ দিনগুলাে সম্পর্কে মােমিনুল হক খােকা লিখিত ‘অন্তরালে স্মৃতি সমুজ্জল : বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার ও আমি’ বইটি পড়লে বিস্তারিত জানা যাবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের কারাজীবন
নানা বানােয়াট, ভুল, বিভ্রান্তিকর জনরব ও অতি উৎসাহীদের মিথ্যা-প্রচারণা
অপমােদনের জন্য সরকারী দলিলসহ আমার জানামতে সঠিক তথ্য নিম্নে দেওয়া হইল :
Confidential Government of the People’s Republic of Bangladesh. Office of the D.I.G. of Prisons, Dacca Division, Central Jail Dacca. Memo No. SB dated
1974 To, The Inspector-General of Prisons, Bangladesh, Dacca.
Subject : Background materials on the prison life of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, the Prime Minister of Bangladesh.
Reference : Your Memo No. 258/Con-5/74 dt. 2-7-74.
In obedience to your memo, under reference I am to submit a detailed report regarding detention of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman as per records available in Dacca Central Jail. 1. He was committed to Dacca Central Jail on 1-1-1950 under
section 18(2) B.P.S.O. VII of 1946. 2. Convicted on 12-9-1950 to R.I. for three months under
section 147 P.P.C. and was transferred to Gopalganj Sub Jail on 26-10-50 to answer a charge and was again readmitted to Dacca Central Jail on 30-8-51 on transfer from Faridpur Dist. Jail as per G.O. No. 1036-H.S. dated 21-3-51 and was
retransferred to Faridpur Dist. Jail on 15-2-1952. 3. He was again committed to Dhaka Central Jail on 31-5-1954
in connection with Kotwali P.S Case No 33 (3) 53 u/s 7 (1) 3 by the S.D.O. (S), Dacca and became a security prisoner on 18-8-1954 asper G.O. No. 2577-H.S dt. 12-7-1954 and under G.O. No. 3302-H.S. dt.3-8-1954 and was released on 18-12
1954 under G.O.No. 145 (PY/54 dated 18-12-11954. 4. Again he was committed to Dacca Central Jail on 12-10-1958
as an under trail prisoner in connection with SA of E. Pak. Act. LXX-1V/58 and u/x. 5(2) of Act 11/47 by the S.D.O. (S),
4. Sk. Mujibur Rahman again arrested on the night of 25th
March 1971 and released from Mianwali Jail, Pakistan on 8th January 1972. He suffered imprisonment for a period of about 8 years Since 1948 to 1972 before taking over as the President of Bangladesh.
বঙ্গানুবাদ
| গােপনীয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঢাকা বিভাগীয় কারা পরিদর্শক-এর কার্যালয় ঢাকা বিভাগ,
| কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা।
अडि
মহা কারা পরিদর্শক ঢাকা, বাংলাদেশ
বিষয় : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাজীবন সংক্রান্ত তথ্যাবলী।
সূত্র : আপনার স্মারক নং ২৫৮ -৫৭৪ তাং ২-৭-৭৪
সূত্রে বর্ণিত আপনার স্মারক মােতাবেক ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রাপ্ত রেকর্ডের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডিটেনশন সংক্রান্ত একটি বিশদ রিপাের্ট পেশ করিতেছি : ১। ১৯৪৬ সালের বি.পি,এস,ও VII ধারার সেকশন ১৩(২)-এর অধীনে ১-১
১৯৫০ সালে তাহাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয়। ২। ১২-৯-১৯৫০ সালে ১৪৭ পি.পি.সি, সেকশনের অধীনে তাহাকে তিন মাসের
কারাদণ্ড দেওয়া হয় এবং একটি অভিযােগের জবাব দেওয়ার জন্য ২৬-১০৫০ গােপালগঞ্জ সাব জেলে বদলী করা হয় এবং ৩০-৮-৫১ তারিখে জিও নং ১০৩৬ এইচ,এস তাং ২১-৩-৫১ মোতাবেক ফরিদপুর ডিট্রি জেল হইতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয় এবং ১৫-২-১৯৫২ তারিখে আবার
ফরিদপুর ডিষ্ট্রি জেলে বদলী করা হয়। ৩। আবার ৩১-৫-১৯৫৪ তারিখে ৭(১) ধারার অধীনে পি,এস কেইস নং ৩৩
(৩) ৫৩-এর কারণে ঢাকার মহকুমা অফিসার (সাউথ) কর্তৃক তাহাকে আবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয় এবং জিও নং ২৫৭৭ এইচ,এস ভাং ১২-৭-১৯৫৪ এবং জি,ও নং ৩৩০২ এইচ এস তাং ৩-৩
১৯৫৪ অনুযায়ী নিরাপত্তা বিন্দী হন এবং জি,ও নং ১৪৫ (পি), ৫৪ তাং
১৮-১২-১৯৫৪ অনুযায়ী ১৮-১২-১৯৫৪ তারিখে মুক্তি পান। ৪। আবার ই পাক এ্যাক্ট LXX-I/৫৮-এর এক এবং এই l/৪৭-এর
সেকশন ৫(২)-এর অধীনে ঢাকা মহকুমা অফিসার (সাউথ) কর্তৃক ১২-১০১৯৫৮ তারিখে তাহাকে বিচারাধীন আসামী হিসাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয় এবং ১৯৫৮ সালের স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্সের অধীনে ২০-১০-১৯৫৮ তারিখে নিরাপত্তা বন্দী হন এবং জি,ও নং ৯৪৯ এইচএস
তাং ১৭-১২-১৯৫৯ মােতাবেক ১৭-১২-১৯৫৯ তারিখে মুক্তি লাভ করেন। ৫। আবার জি,ও নং ২৫৪ এইচ,এস তাং ২৭-২-৬২ এবং জি,ও নং ৫১২
এইচ.এস তাং ৩১-২-৬২ মােতাবেক এবং ১৯৫৮ সালের ই,পি,এ,ও এর অধীনে তাহাকে ৭-২-৬২ তারিখে নিরাপত্তা বন্দী হিসাবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করা হয় এবং জিও নং ১১৫৯ তাং ১৮-৬-৬২ মোতাবেক
১৮-৬-৬২ ঢারিখে মুক্তি দেওয়া হয়। ৬। আবার ১৯৬৫ সালের ৩১ ডি.পি.আর-এর অধীনে ৮-৫-৬৬ তারিখে তাহাকে
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করা হয়। ২৭-৪-৬৭ তারিখে ১৯৪৫ সালের ৪৭ (৫) জি.পি.আর ও ১৯৬৫ সালের রুলস ৩২-এর অধীনে জি,আর নং ১৩৯৩/৬৬ অধীনে জেলখানার অভ্যন্তরে তাহার বিচার হয় এবং ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট জনাব আফতাবউদ্দীন আহমদ উহাকে ১ মাস ৩ দিনের সাধারণ কারাগণ্ড দেন। ১-৬-১৯৬৭ তারিখে তিনি মুক্তি পান। ১৭-১-৬৮ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন এবং তেল গেট হইতে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের ব্যাপারে তাঁহাকে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
স্বাক্ষর ডিআইজি প্রিজন
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার।
উপরে বর্ণিত তথ্যাবলীর সহিত নিতথ্যাবলী যােগ করিতে হইবে
১। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ গ্রেফতার ও কারামুক্তি ১৫ই মার্চ ১৯৪৮ইং।। ২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন বেতনভুক কর্মচারী ধর্মঘটকে সক্রিয় সমর্থনের
অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ছাত্র বহিষ্কারের প্রতিবাদে আন্দোলন করিবার কারণে শেখ মুজিবর রহমান ১৯শে এপ্রিল ১৯৪৯ইং তারিখ গ্রেফতার হন ও বােধহয় (আমার স্মৃতিভ্রম যদি না হইয়া থাকে) ২৭শে জুন।
(১৯৪৯) মুক্তি পান- অর্থাৎ ২ মাস ৯ দিন কারাবাস করেন। ৩। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হইয়া ১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারী
গ্রেফতার হন এবং ঐ মামলা প্রত্যাহার করিবার পর ঢাকা সেনানিবাস হইতে
২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে মুক্তি পান। ৪। শেখ মুজিবুর রহমান ২৫শে মার্চ ১৯৭১ সালের দিবাগত রাত্রে পুনরায়
গ্রেফতার হন এবং ১৯৭২ সালের ৮ই জানুয়ারী পাক সরকারের মীয়ানওয়ালী
কারাগার হইতে মুক্তি পান। ১৯৪৮ সাল হইতে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে সর্বমােট প্রায় ৮ বৎসর তিনি কারাজীবন ভােগ করেন। কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত্বকরণ
১৯৭২ সালের ২৬শে মার্চ কলমের এক খোঁচায় দেশের যাবতীয় কলকারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করা হইল। পূর্ব হইতে কোন ইনভেন্টরী তৈয়ার না করিয়া প্রশাসকদের তত্ত্বাবধানে মিল-কলকারখানার পরিচালনার দায়িত্বভার দেওয়া হইল। অবশ্য পূর্বেই পরিত্যক্ত মিল-কলকারখানাগুলিতে প্রশাসক নিযুক্ত করা হয় । এইদিকে আবার রাষ্ট্রায়ত্ত করিবার পর কোন কোন মিল-কারখানার মালিকদের তাহাদের স্ব স্ব মিলের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। তথাকথিত মুক্তিযােদ্ধা নামধারী শ্রমিকদের অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং সাবেক অভিজ্ঞ ও দক্ষ প্রশাসকদিগকে দালাল আখ্যা দান ও ভীতি প্রদর্শন মিল কারখানার ব্যবস্থাপনাকে প্রহসনে পরিণত করে এবং সামগ্রিক উৎপাদনসমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অধিকাংশ কলকারখানাই অযােগ্য প্রশাসক ও শ্রমিক নেতৃত্বের যােগসাজশে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়। অবশ্য ইহাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং কলকারখানা ধ্বংসের জন্য ভারতীয় মারােয়াড়ী গােষ্ঠী সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নানাভাবে লিপ্ত, তখন শেখ মুজিব এবং তাহার সরকার ত্যাগী, সচেতন ও সজাগ দেশপ্রেমিক শক্তিকে সুসংহত ও সুসংগঠিত না করিয়া সর্বনাশা সন্তা বুলির অাশ্রয়ে আসর বাজীমাৎ করিবার তালে ছিলেন। আর ছাই অন্যকিছু বিবেচনা ও বাস্তবতা বিচার না করিয়াই জাতীয় শিল্প ও অর্থনীতিকে কলমের এক বোঁচায় ধ্বংসের মুখে ঠেলিয়া দিতে তাহারা এতটুকু কুষ্ঠিত হন নাই। ভারতীয় অভিজ্ঞ নেতৃত্ব জাহাদের শিল্প-কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করিবার মত সর্বনাশী পথ বেল মাড়ায় নাই, তাহা অনুধাবন করিবার মত ধীশক্তি শেখ মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগের কোন নেতার ছিল না। তদুপরি ছিল রুশপন্থীদের উস্কানি। ফলতঃ মুজিব সরকারের চরম অবিমৃষ্যকারিতাই দেশের সমগ্র অর্থনীতিকে লণ্ডভণ্ড করিয়া ফেলে। কথায় বলে, দেবদূতগণ যেখানে যাইতে সাহস পায় না মূর্খরা তড়িঘড়ি করিয়া সেখানে প্রবেশ করে। জেনারেল ওসমানীই সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেনকোন বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযােগ নাই।
গণপ্রজাতন্ত্রী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর ১২ই এপ্রিল ১৯৭১-এর পূর্বাহ্ন হতে বঙ্গবীর ওসমানীকে মুক্তিবাহিনী গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে
আইন-আদালত পর্যন্ত যথেচ্ছ ব্যবহৃত হইবার ফলে, আইন-কানুন ও প্রশাসনিক সদুদ্দেশ্য ও নিরপেক্ষতার উপর দেশবাসী ক্রমশঃ আস্থা হারাইয়া ফেলে। যেখানে আইনের শাসনের ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস, সেখানেই অবক্ষয়ের সূত্রপাত। আর কোথাও একবার অবক্ষয়ের সূত্রপাত হইলে ছাহা সমাজের বিভিন্ন স্তরে অলক্ষ্যে বিস্তৃতি লাভ করে। শান্তি ও স্বস্তি, স্থিতি ও সমৃদ্ধি হয় অপসৃয়মান। নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে বাংলাদেশে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্ৰীয়জীবন, মূল্যবোেধ ও চরিত্র এক কথায় সর্বস্তরে এই অবক্ষয়ের দৌরাত্মই পরিলক্ষিত হইত। প্রশাসন কর্মচারীরা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশংকায় সর্বক্ষণ শ্ৰীয়মান থাকিতেন। রাষ্ট্রপতি আদশে ৯” সরকারী কর্মচারীদের সকল ক্ষমতা, নৈতিক ও চারিত্রিক দৃঢ়তা, কর্ম উদ্যোগ ও উদাম অপহরণ করিয়া নিয়াছিল। ফলে গােটা প্রশাসন ব্যবস্থাই নতজানু প্রশাসনে পর্যবসিত হইয়া পড়িয়াছিল। আওয়ামী লীগের অবিবেচক রাজনৈতিক পদক্ষেপ। | রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামাজিক অশান্তি হ্রস বা দূরীকরণ দেশ ও জাতি গঠনের পূর্বশর্ত। হিন্দু মহাসভা ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘাের বিরােধী ছিল। অতীত ভূমিকার সূত্র ধরিয়া পাকিস্তান সরকার হিন্দু মহাসভা কিংবা পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসকে নিষিদ্ধ করে নাই অথবা পাকিস্তান প্রতিটা বিরােধী ভূমিকার কারণে কাহাকেও কারাগারে নিক্ষেপ করে নাই। অথচ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে অপরিণামদর্শী বাংলাদেশ সরকার মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পাকিস্তান। ডেমােক্রেটিক পার্টি, জামায়াতে ইসলামী প্রভৃতি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাবিরােধী রাজনৈতিক, দলকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। রাজনৈতিক মতভেদ প্রসূত অতীত ভূমিকার দরুণ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে দালাল আইনে আটক করা হয়। অন্যদৃষ্টি ও দূরদৃষ্টির অভাবই উক্ত অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপের জন্য দায়ী। ভারত-ফেরত শরণার্থী ও অস্ত্রধারীরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে অবস্থানকারী কোটি কোটি মানুষের বিরুদ্ধে দালালীর অভিযোেগ আনে এবং স্বীয় ব্যক্তিগত, পরিবারগত ও গােষ্ঠীগত হীন-স্বার্থ চরিতার্থ করিবার অপপ্রয়াসে গ্রাম-গ্রামান্তরে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। ফলে জনতা হইয়া পড়ে হতোলাম, নিরাশ ও হতাশ। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি
এইদিকে জীবনযাত্রার নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য মুজিব সরকারের ভ্রান্ত নীতির দরুণ সাধারণ ক্রেতার আয়ত্বের বাহিরে চলিয়া যায়। এক টাকার গামস্থার দাম হয় সাত টাকা। পাঁচ টাকার শাড়ীর দাম হয় পয়ত্রিশ টাকা। তিন টাকার লুংগি পনের টাকা বা কুড়ি টাকা, দশ আনা বা বার আনা সেরের চাউল হয় দশ টাকা। আট আনা সেরের আটা ছয়-সাত টাকা। দুই আনা সেরের কাঁচা মরিচ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। তিন-চার টাকা সেৱেৱ শুকনা মরিচ আশি-নব্বই টাকা। আট আনা সেরের লবণ চল্লিশ-পঞ্চাশ
টাকা। পাঁচ টাকা সেরের সরিষার তৈল তিরিশ-চল্লিশ টাকা। সাত টাকা সেরের নারিকেল তৈল চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা। এক টাকা সেরের মুসুরির ডাল আট-নয় টাকা । সাত টাকার লাল ত্রিশ-চল্লিশ টাকা। ছয় টাকার কোদাল তিরিশ টাকা। একশত সাতচল্লিশ-দেড়শত টাকা ভরি স্বর্ণ নয়শত-এক হাজার টাকা। পনের টাকার কাফনের কাপড় আশি-নব্বই টাকা। দেড় টাকার কাপড় কাচা সাবান আট-নয় টাকা অর্থাৎ এক কথায় জীবনযাত্রার সার্বিক সংকট মানুষকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে।
মুদ্রাস্ফীতি ও কালাে টাকা মুজিব সরকারের ব্যর্থতার কারণে ভয়াবহ আকার ধারণ করিয়াছিল আর উহাই হইয়া দাঁড়াইয়াছিল সর্বগ্রাসী দূর্নীতির মূল। দুর্নীতি দমন আইন ও বিধি ছিল বটে; কিন্তু তাহা যেন সর্বক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। মুজিব সরকারের শাসনদৃষ্টে যে কাহারও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, শাসক, শাসকের অনুগ্রহভাজন ও বিত্তবানদের জন্য একপ্রকার এবং শাসিত জনতা ও বিত্তহীনদের জন্য অন্য প্রকার-দেশে এই দুই প্রকার আইন প্রচলিত। তাই পূর্বেবর্ণিত কারণে শঙ্কিত, সর্বক্ষণ দ্বিধাগ্রস্ত, সংশয়াপন্ন ও আড়ষ্ট প্রশাসন যন্ত্র কালাে টাকায় বিত্তবান, আওয়ামী লীগ দলীয় ব্যক্তি, সশস্ত্র বেসরকারী বাহিনী ও জাহাদের আশ্রয়পুষ্ট এবং উপর তলার আশীর্বাদপুষ্ট অথছ জঘন্য অপরাধ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়ােগে ইতস্তুতঃ করিত; পারতপক্ষে আইন প্রয়োগে বিরত থাকিত। ফলে আইন-শৃঙ্খলা ও প্রশাসন যন্ত্র এমন কি আইন-আদালত পর্যন্ত অকেজো হইয়া পড়িয়াছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর এই সময়ে কয়েকটি বাক্যাংশে চমৎকারভাবে এই চরম সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির ইংগিত প্রদান করিয়াছিলেন। যথা Frightening flight of capital বা ভয়াবহ মুদ্রা পাচার; Production failure বা উৎপাদান ব্যর্থতা; exessive supply of money বা অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহ এবং Absence of law and order- বা আইন শৃংখলার অভাব। যাহা হউক, এই সময়ের ঘটনারাজির পর্যালােচনা স্পষ্ট ইংগিত দেয় যে, শেখ মুজিবের আমলে দুদীয় সরকারের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্যোদয় সত্ত্বেও অমানিশার ঘোের কাটে নাই; অবহেলায় সুবর্ণ সুযােগ অতিবাহিত হইয়াছে; একটি রক্তক্ষয়ী বিপ্লব-প্রসূত মহাভ্যাগ বৃথা গিয়াছে। কলঙ্কময় অধ্যায় ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠা।
আগেই বলিয়াছি, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হইয়াছিল।
গণপরিষদ ১৯৭২ সালের ১৪ই ডিসেম্বর গৃহীত সংবিধানটি সত্যায়ণ (authenticate) করে। গৃহীত এই সংবিধান মােতাবেক ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ সংসদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পরিতাপের বিষয় নির্বাচন অবাধও হয় নাই, সুইও হয় নাই। নির্বাচন পরিচালনায় পূর্তগালের সালাজার, স্পেনের ফ্রাঙ্কো আর বাংলাদেশের শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে গুণগত কোন পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয় নাই।
১৯৭৩-এর মার্চের এই সাধারণ নির্বাচনে প্রশাসনিক ক্ষমতার মারাত্মক অপব্যবহার, চরম দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ, মিডিয়া কু, দলীয় বাহিনীর যথেস্থ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও ঢালাও হুমকির সহায়তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসন দখল করেন। সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল জঘন্য কারসাজি, কারচুপি আর মিডিয়া কু’র মাধ্যমে উলট-পালট করিয়া তাহাদের অনুকূলে কজা করে। আমি যেখানে ২৬ হাজার ভােটের ব্যবধানে নিশ্চিত জয়ের পথে তখন বেতার ও টেলিভিশন-এর মাধ্যমে আমাকে ১০ হাজার ভােটে পরাজিত ঘােষণা করা হয়। পরে আমি ঢাকায় ফিরে এলে শেখ মুজিব টেলিফোনে আমাকে বলেন- “কিরে অলি আহাদ, ইলেকশনে পাস করলি না? ইহা তাহার দ্বারা সাংবিধানিক গণত, নীতি ও আদর্শ তথা ঘােষিত রাষ্ট্ৰীয় আদর্শসমূহ লংঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ। ইহার ফলে, সাংবিধানিক নিয়মতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গবনা সম্বন্ধে জনমনে মরাত্মক সন্দেহের উদ্রেক হয়। বকুতঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সর্বগ্রাসী উট ক্ষমতালােভ ও তজ্জন্য রত্রীয় ক্ষমতার জঘন্য অপব্যবহারের মানসিকতা দেশ ও জাতিকে এক চরম বিপর্যয়ের মুখে নিক্ষেপ করে। এইসব পরিদূটে দেশী পত্রপত্রিকাগুলিতে তাে বটেই ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধকালীন অবস্থায় যে সব বিদেশী পত্র-পত্রিকা বাংলাদেশের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন ছিল তাহারাও মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা ও সমালােচনামুখর তথ্যপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ করিতে থাকে। এবং এই সবই শাসকগােষ্ঠীর নাভিশ্বাসের কারণ হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কঠোর সমালােচনার পটভূমিকায় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠাকল্পে শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারী সংবিধানের ৪র্থ সংশােধনী বলে দেশে একদলীয় শাসন প্রবর্তন করেন এবং ২৫ শে জানুয়ারীতে ৫ বৎসরের জন্য নিজেই একনায়কসুলভ শাসন পদ্ধতির প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন। ইহার ফলাফল অবশ্যই শুভ হয় নাই। এক সামরিক অ্যুথানে ১৪ই আগষ্ট দিবাগত রাত্রে শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে পরিবারপরিজনসহ নিহত হন। এই সামগ্রিক ঘটনাবলী শরণ গ্রাইয়া দেয় মধুসুধন দত্তের অমর কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’-এর সেই খেদোক্তি । “নিজ কর্মদোষে হায় মজাইলা কনকলঙ্ক, রাজী মজিলা আপনি”। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়াস
উল্লেখ্য যে, শাসক আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সাধারণ নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়ার তাগিদে আমরা বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং), শ্রমিক কৃষক সমাজবালী দল, বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি নির্বাচনী সমঝোতায় পৌছি। স্বাভাবিকভাবেই ঐক্য প্রয়াসের মূল মধ্যমণি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই সময়ে অসুস্থতার দরুণ তাহাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে অবস্থান করিতে হইতেছিল। ইহার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান একদিন তঁাহার সহিত
সাক্ষাৎ করেন। রােগমুক্তির পর মাওলানা ভাসানী হাসপাতাল ত্যাগ করিলেন বটে, তবে বিরােধী দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি আর অংশ্রহণ করেন। নাই। দুয়ে রহস্যেঘেরা তাহার এই নির্লিপ্ততা। অবশ্য সবকিছু দেখিয়া শুনিয়া বলিতেই হয় যে, যদিও তিনি ছিলেন বিদ্ৰোধী দলীয় রাজনীতির অন্যতম দিকপাল ও জাতীয় নেতা, তথাপি ৬০ দশকে সামরিক একনায়ক জেনারেল আইউবের প্রতি ৭০ দশকে গণতন্ত্র বিধ্বংসী শক্তি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের প্রতি তিনি যে দুর্বলতা প্রদর্শন করিয়াছিলেন তাহা জনগণের সার্বভৌমত্ব তথা নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চরম ক্ষতি সাধন করিয়াছে।
প্রসঙ্গতঃ ইহাও উল্লেখ্য যে, সাধারণ নির্বাচনে যথেচ্ছ দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ ও ঢালাও কারচুপির অভিযােগে সকল রাজনৈতিক দল শেখ মুজিবর রহমান ও তাহার সরকারকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন করিলেও ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় কোন ভূমিকা গ্রহণ করেন নাই। আমরা বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি মেজর এম, এম, জলিল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) ডাইস চেয়ারম্যান ডঃ আলীম-আল রাজী ও সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ এবং বাংলাদেশ জাতীয় লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খানের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির প্রতিবাদে প্রত্যক্ষ গণআন্দোলনের প্রস্তাব করি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় নেতৃবৃন্দ নীতিগতভাবে মৌলিক একাত্মতা প্রকাশ করিলেও বাস্তবে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার সংগ্রামে গণআন্দোলন সৃষ্টির প্রস্তাবের । পরিপ্রেক্ষিতে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করিয়া নীরব ভূমিকা পালন করেন। যুগে যুগে রাজনৈতিক দলগুলির নীতিবিগর্হিত সচেতন নিক্রিয় ভূমিকাই দেশে দেশে ডিক্টেটরী শাসকদের পথ সুগম করে এবং ইহাই ডিক্টেরদের মূলধন।
সাধারণ নির্বাচনের পর এপ্রিল মাসে (১৯৭৩) প্রাণপ্রতিম কনিষ্ঠ সহােদর আমিরুজ্জামান, সি, এস, পি’র আমন্ত্রণক্রমে আমি নেপালের রাজধানী কাঠমুৎ গমন। করি। অনূজ আমিরুজ্জামান জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ। কাঠমুন্ডু অবস্থানকালেই শেখ মুজিব সল্পকার আমার দ্বারা সম্পাদিত “সাপ্তাহিক ইত্তেহাসের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না,’ এই মর্মে কারণ দর্শাইতে আদেশ জারি করে (১৯৭৩ সালের ২রা মে)। উক্ত খবর প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে আমি ঢাকা অভিমুখে রওয়ানা হইবার ব্যবস্থা গ্রহণ করি এবং ১৬ই মে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি।
ভাসানীর অনশন এবং
ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়াই অবগত হই যে, খাদ্য ও দ্রব্যমূল্য হ্রাসের দাবীতে মাওলানা ভাসানী “আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করিয়াছেন। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি অফিসে অনশনরত মওলানা ভাসানীর শয্যা
মেডিক্যাল বাের্ড আরও বলেছে যে, আজ সকাল ৯টায় তিনি কোলাপস করে গিয়েছিলেন, তার শরীরের তাপমাত্র ৯৬ ডিগ্রিতে নেমে গিয়েছিল। তার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হয়েছিল। এমতাবস্থায় আমরা মওলানা ভাসানীর মতাে জাতীয় অমূল্য সম্পদ একজন সংগ্রামী নেতার জীবনাশংকায় বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা মওলানা সাহেবকে গােটা জাতির পক্ষ থেকে অনশন ধর্মঘট ভংগ করার জন্য অনুরোধ জানাই এবং এই প্রতিশ্রুতি তাকে প্রদান করি, যে দাবীর ভিত্তিতে এবং যে লক্ষ্যকে সম্মুখে রেখে তিনি অনশন ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন সে দাবী ও লক্ষ্যকে আদায় করার জন্য আমরা আপােষহীন সংগ্রাম করে যাবাে। বর্তমানে গণবিরোধী ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে উৎঙ্খাত করার জন্য মেহনতি জনতাকে সঙ্গে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবাে। এবং নিম্ন-স্বাক্ষরকারী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিবৃন্দ সর্বসম্মতিক্রমে মওলানা সাহেবের দাবী এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান স্বৈরাচারী শাসক গােষ্ঠীকে এক আপােষহীন লড়াই-এর মাধ্যমে উৎখাত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করছি। আমরা সর্বজন শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেবকে উক্ত আন্দোলনের স্বার্থেই অনশন ধর্মঘট প্রত্যাহার করার জন্য অনুরােধ জানাচ্ছি। জাতি তার সেবা ও নেতৃত্ব চায়।” উক্ত যৌথ বিবৃষ্টিতে স্বাক্ষরকারীগণ হলেন। ১। মেজর এম, এ, জলিল ২। অলি আহান । ৩। আমেনা বেগম ৪। দেবেন শিকদার ৫] আবুল বাশার ৬। মিসির আহমদ ভূইয়া ৭। মোখলেসুর রহমান ৮। অমল সেল। ৯। হামলার আকবর খান রনাে ১০। আবদুস সােবহান। | ১১। আ স ম আবদুর রব ১২। আতাউর রহমান খান ১৩। সৈয়দ রিয়াজুল হোসেন।
অপরাহ্নে ন্যাপ কর্তৃক আহূত পল্টন ময়দানে জনসভার উপর আওয়ামী লীগ গুপ্তারা হামলা করে জনসভার প্যান্ডেল তছনছ করিয়া দেয়, সভায় উদ্যোক্তা ও বক্তাদের মারধর করে। প্রতিশ্রুতি মােতাবেক সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে বিল্লি দলীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত না হওয়া সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী অনশন ভঙ্গ করেন।
| রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সাংগঠনিক শক্তির সঠিক ও বাস্তব মূল্যায়নে ব্যর্থতার দরুণ মওলানা ভাসানীর এই আমরণ অনশন ধর্মঘট সফল হয় নাই। মাত্র কিছুকাল পূর্বে মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা শাসক আওয়ামী লীগ প্রার্থীবর্গকে প্রত্যক্ষভাবে না হইলেও পরােক্ষভাবে নির্বাচন বিজয়ে প্রচুর সহায়তা করিয়াছিল। সাধারণ নির্বাচনে নিজস্ব এই সন্দেহজনক ভূমিকার কারণেই হয়ত তিনি স্বীয় বিবেক দংশনে জর্জরিত হইতেছিলেন। তাই দুই মাসের মধ্যে সরকার বিরােধী ভূমিকায় অভিনয়ে অবতীর্ণ হইতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু পুর্বেহে যথাযথ প্রকুষ্ঠি গ্রহণ না করিয়াই আমরণ অনশন ধর্মঘটের ন্যায় চরম সিদ্ধান্ত ঘােষণর ফলে তাঁহার সেই ভূমিকা। অসম্পূর্ণ থাকিয়া গেল।
যাহা হউক, সময় গড়াইয়া যাইতে থাকে। আমরাও প্রতি পদক্ষেপে বৃহত্তর
আন্দোলনের প্রস্তুতি চালাইয়া যাইতে থাকি। এবং অতঃপর ২৫ সালা ভারত বাংলাদেশ দাসত্ব চুক্তি, সর্বপ্রকার গােপনচুক্তি ও সমঝােতা এবং অন্যান্য অসম চুক্তি বাতিল করিয়া প্রকৃত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ কায়েমের দাবিতে আমরা বাংলা জাতীয় লীপের পক্ষ হইতে ১৯৭৩ সালের ২৩শে ডিসেম্বর সমগ্র দেশব্যাপী “আজাদ বাংলা” দিবস পালনের ডাক দেই। ঠিক সেই সময়ে, আমার শ্রদ্ধেয় অজ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊীন ও প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ডঃ আবদুল করিম ১৯৭৩ সালের ২২ শে ডিসেম্বর হৃদরােগে আক্রান্ত হইয়া অকালে ও অপ্রত্যাশিতভাবে পরলােকগমন করেন। তাহার অন্তর্ধানে কেবল অপত্য স্নেহ হইতেই বঞ্চিত হইলাম
; হারাইলাম আমার কর্মজীবনের দিক-দিশারী, বিজ্ঞ-বিদগ্ধ দার্শনিক গুরুজন, স্নেহের আধার ও কড়া অভিভাবককেও। আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্তি সত্ত্বেও শ্বশত জীবনদর্শন ও মূল্যবােধই তাহার জীবন-যাত্রার অঙ্গীভূত বৈশিষ্ট্য ছিল। গুরুজনকে শ্রদ্ধা, কনিষ্ঠজনকে স্নেহ, বন্ধুজনকে ভালবাসা, সত্যনিষ্ঠা, স্পষ্টবাদিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, স্বহস্তে গৃহকর্ম পালন ইত্যাদি গুণ ছিল তাহার চাত্রিক ভূষণ। যাহা হইক, ঈহার জানাযা হইতে ফিরিয়া আসিয়া আমি পল্টন ময়দানে জনসভায় যােগদান করি। উল্লেখ্য যে, ১৭ই মার্চ (১৯৭৪) জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল পল্টন ময়দানের জনসভা হইতে এক জঙ্গী মিছিলসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করে। মিছিলকারী ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধে এবং অকুস্থলেই জাসদ সভাপতি মেজর এম এ জলিল, সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব ও অন্যান্যের নিবর্তনমূলক আটক আইনে গ্রেফতার করা হয়। বলিতে ভুলিয়াছি, ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিবর্তনমূলক আটক আইন পাসের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা। বাংলা জাতীয় লীগ ২৪ শে সেপ্টেম্বর (১৯৭৩) এক প্রকাশ্য জনসভা অনুষ্ঠান করি এবং উহা প্রত্যাহারের দাবী করি । এইভাবেই দেশের থমথমে পরিবেশে আমাদের এই প্রয়াস কিছুটা সাড়া জাগাইতে সক্ষম হয়। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ক্ষীণ আভাস পরিলক্ষিত হইতে থাকে। এই সময়ে দেশের সার্বিক অবস্থা মূল্যায়নের পর সমগ্র দেশব্যাপী গণআন্দোলন করিবার মানসে ১৪ই এপ্রিল (১৯৭৪) আমরা বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলা জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় শীগ, জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশের কমিউনিও পাট, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল একত্রে নিয়ে বর্ণিত ৪ দফা প্রণয়ন করি এবং মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের আহবান জানাই। দফা ৪টি এই১। (ক) রাজনৈতিক বীর মুক্তি, রাজনৈতিক কারণে হুলিয়া, গ্রেফতারী
পরােয়ানা ও মিথ্যা রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার। (খ) বিশেষ ক্ষমতা আইন, রক্ষীবাহিনীর আইন, রাষ্ট্রপতির ৮ ও ১ নং
আদেশ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দমন আইন ও শ্রমিক দমন আইন বাতিল।
২। (ক) রক্ষীবাহিনী বাতিল করে উপযুক্তভাবে তাহাদের পুনর্বাসনকরণ। | (খ) দেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি সাধন ও সকল
নাগরিকের জানমাল ও ইজ্জতের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান। ৩। (ক) গ্রাম ও শহরের সর্বত্র খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের
প্রয়ােজনীয় রেশনিং ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যমূল্য
জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনয়ন। (খ) সকল প্রকার দুর্নীতি, চোরাচালান, মুনাফাখােরী, লাইসেন্স
পারমিটবাজি দমন, অসদুপায়ে অর্জিত বা বে-আইনীভাবে দখলকৃত
ধন-সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান। এবং ৪। বাংলাদেশের শিল্প ব্যবসাসহ সামগ্রিক অর্থনীতিকে বিদেশী আগ্রাসন ও
আধিপত্য থেকে মুক্তকরণ এবং জাতীয় স্বার্থে সার্বভৌমত্ব বিরােধী সকল বৈদেশিক চুক্তি বিশেষ করে ভারতের সাথে সকল পােপন ও অসম চুক্তি
বাতিলকরণ। আমরা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করিয়া নিম্নোক্ত দলীয় প্রতিনিধিবৃন্দ সমবায়ে একটি সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করি।
প্রতিনিধিবৃন্দরা হলেন। জনাব মশিউর রহমান
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (পিকিং) ডঃ আলিম-আলু-রাজি জনাব নূরুর রহমান (বিকল্প সদস্য) জনাব অলি আহাদ
বাংলা জাতীয় লীগ। কাজী জওয়াহেরুল ইসলাম জনাব আনসার হােসেন ভানু (বিকল্প) জনাব আতাউর রহমান খান
বাংলাদেশ জাতীয় লীগ মিসেস আমেনা বেগম হাজী মােহাম্মদ দানেশ
জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন জনাব সিরাজুল হােসেন খান জনাব আব্দুল ওয়াদুদ খন্দকার (বিকল্প) খান সাইফুর রহমান
শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল জনাব মোখলেছুর রহমান জনাব রুহুল আমিন জনাব নাসিম আলী
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি।
সেপ্টেম্বর (১৯৭৪) প্রদত্ত রায়ে মাননীয় বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ও মাননীয় বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী কর্তৃক গঠিত সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ ২৫শে জুন জারিকৃত ১৪৪ ধারা আদেশকে অবৈধ, বাতিলযােগ্য, এক্তিয়ার বহির্ভুত ও সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার পরিপন্থী বলিয়া ঘােষণা করেন এবং মাননীয় বিচারপতিদ্বয় আমাকে মামলার খরচ বাবদ ১৫ টি স্বর্ণমােহর তুল্য অর্থ প্রদানের জন্য সরকারের প্রতি নির্দেশ দান করেন। সরকার উক্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে আপীল করে এবং রায়ের কার্যকারিতা মূলতবী রাখিবার আবেদন জানায়। মাননীয় বিচারপতিদ্বয় সরকারকে আপীল করিবার অনুমতি দেন বটে তবে রায়ের কার্যকারিতা মূলতৰী আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। মুজিব সরকারের কারাগারে আটক থাকাকালে আমি সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় উক্ত রায় পাঠ করি। পুনরায় গ্রেফতার | আগেই উল্লেখ করিয়াছি যে, ঐক্যফ্রন্টের বৈঠকে ৩০ শে জুন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করিয়া জনসভা করিবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে ক্ষিপ্ত মুজিব সরকার সর্বদলীয় ঐকফ্রন্টের ১৩ জন সদস্যের মধ্যে সর্বজনাব মশিউর রহমান, নুরুর রহমান ও আমাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করিয়া কারাগারে আটক করে এবং সর্বদলীয় ঐকফ্রন্টের চেয়ারম্যান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে গ্রেফতার করিয়া টাঙ্গাইলের সন্তোষে তাহার নিজ বাসভবনে অন্তরীণাবন্ধ করে।
১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি মওলানা ভাসানীকে সন্তোষে গৃহবন্দী করা হয়। অশীতিপর বৃদ্ধ নেতা ভাসানী গৃহবন্দী অবস্থায়ই আন্দোলনের ডাক দেন।
তাং ১৭/৭৪ আমি গৃহবন্দী আন্দোলন চালাইয়া যাও প্রিয় দেশবাসী,
হিন্দুস্তান আর রাশিয়ার চক্রান্ত এইবার নতুন মােড় নিয়েছে। শেখ মুজিবকে দিয়া আমাকে সন্তােষের ঘরে গৃহবন্দী করা হইয়াছে। ৫০০ পুলিশ ও রক্ষীবাহিনী মােতায়েন করিয়া আমার স্বাধীনতা হরণ করা হইয়াছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বলিতে এতটুকু ছিল এইবার তাহাও হারাইতে বসিয়াছে।
কিন্তু হন্তাশ হইবার কিছু নাই যদি জালেমের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন চালাইয়া যাইতে পারেন। আমার আকুল আহবান দুর্বার গণআন্দোলন চালাইয়া যান। শত্রুর মােকাবিলা করুক। তাহাদের স্বপ্নসাধ চিরদিনের জন্য ধূলায় মিশাইয়া দিন। আল্লাহ আপনাদের সহায়। নিশ্চয়ই সত্যের জয় অনিবার্য।
মােঃ আবদুল হামিদ খান ভাসানী
আমাদের গ্রেফতারের পর আইন অমান্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দান দূরে থাকুক, এমনকি কোন কোন নেতা সাংবাদিক সম্মেলনে আমাদের নাম উচ্চারণ করিতেও সাহস পান নাই- মুক্তির দাবির তাে কথাই উঠে না। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলা জাতীয় লীগ নেতৃবৃন্দ ও ফরােয়ার্ড টুডেন্টস কভুক্ত বৃন্দ এই আন্দোলনে অত্যন্ত তৎপর ছিল। | আমাদের গ্রেফতারের পর সরকারী প্ররােচনায় ও স্বীয় চামড়া রক্ষার গরজে সর্বদলীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত অঙ্গদলগুলি অতঃপর স্ব স্ব পতাকা তলে পৃথক পৃথক রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ আরম্ভ করে। এইখানেই গণধিকৃত মুজিব সরকারের জয় ও নিপীড়িত জনতার পরাজয় সূচিত হয়। ৩০শে জুন আমাকে গ্রেফতার করিবার পর বাংলা জাতীয় পীপ কেন্দ্রীয় কমিটির এক জরুরী সভা ঐদিনই ৬৩, বিজয়নগরস্থ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আনিসুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক করিবার সিন্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে বাংলা জাতীয় লীগের উদ্যোগে ১৭ই নভেম্বর পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ থাকে যে, শেখ মুজিবের শাসনামলে এবং পল্টন ময়দানের ইতিহাসে ইহাই সর্বশেষ বিরােধী দলীয় জনসভা। ইহার পর পল্টন ময়দানে আর কোন জনসভা হইতে পারে নাই। তাই ২৮শে ডিসেম্বর জারি হয় সমগ্র দেশব্যাপী ‘জরুরী আইন’। ১৯৭৫ সালের ২৫ শে জানুয়ারী চীফ হুইপ শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনের সংশােধন বিল ১১ মিনিটের মধ্যে ২৯৪ জন পার্লামেন্ট সদস্যের ছােটে সংবিধানের ৪র্থ সংশােধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারী কেবিনেট ফরম প্রেসিডেন্সিয়াল ফরমে রূপান্তরিত হয় এবং শেখ মুজিবর রহমান হন ৫ বৎসরের জন্য ১৯৮০ সাল অবধি নিরশ ক্ষমতার অধিকারী অনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও একদলীয় রাজনীতির সর্বেসর্বা। এবং ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত সংসদের মেয়াদ ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বর্ধিত হইল। সর্বদলীয় ঐকষ্টেভুক্ত অধিকাংশ অঙ্গদলের অদূরদর্শিতা, সংকীর্ণতা, ব্যক্তি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কোন্দল এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বালসূলভ হঠকারী মনােবৃত্তিই শাসক মুজিব এবং তাহার আওয়ামী লীগকে সর্বনাশা পথে অগ্রসর হইতে প্রত্যক্ষ-পরােক্ষভাবে উৎসাহ এবং সাহস যােগাইয়াছে এবং এই কারণে এইভাবেই এক নদী রক্তের বিনিময়ে জনগণ যে পার্লামেন্টারী পদ্ধতি ও কেবিনেট ফরম ও বহুদলীয় রাজনীতির ধরন অর্জন করিয়াছিল নিরঙ্কুশ ক্ষমতালােভী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান কলমের এক খোঁচায় তাহা উড়াইয়া দিয়া একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছিলেন। বিচারপতি শাহাবুদ্দিনের প্রণিধানযােগ্য মন্তব্য
• সুপ্রীম কোর্টে বিচারপতি মাননীয় শাহাবুদ্দিন আহমেদ (১৯৯১ সালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও বিগত ২২.৭.৯৬ ইং তারিখ হইতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি) আনোেয়ার হােসেনের মামলায় ৪র্থ সংশােধনী সম্পর্কে নিম্নলিখিত মন্তব্য দেশবাসীর জন্য খুবই প্রণিধানযােগ্য।
The Supreme Court in Anwar Hossain’s case has discussed this aspect. An extract from to the judgement of Shahabuddin Ahmed (as his Lordship then was) is quoted; “The trump-card of the learned Atty. Gen. is that some of the past Amendments of the Constitution destroyed its basic structures and disrupted it on several occasions. It is true that such mishaps did take place in the past. The Constitution Fourth Amendment Act, dated 25 January 1975, changed the Constitution beyond recognition in many respects and in place of a democratic Parliamentary form of Government or the basis of multiple party system a Presidential form of Government authoritarian in character on the basis of a single party was brought about overnight thereby. Fundamental rights to form free association was denied. all political parties except the Government party were banned and members of Parliament who did not join this party lost their seats though they were elected by the people. Fredom of the press was drastically curtailed; Independence of the Judiciary was curded by making the Judges liable to removal at the wish of the Chief Executive, appointment, control and discipline of the subordinate Judiciary along with Supreme Court’s power of superintendence and control of subordinate courts were taken away from the Supreme Court and vested in the Government, the change was so drastic and sudden; Friends were bewidered. Enemise of the Liberation had their revenge and the Critics said with glee that it is all the same whether damage to democracy is caused by democratically elected persons or by undemocratic means like military coup.
“Within a short time came the first Martial Law which lasted four years. By Martial Law Proclamation Orders the Constitution was badly mauled on 10 times. Secularism one of the Fundamental State principles, was replaced by ‘Bismillah-er-Rahman-Ar-Rahim’ in the Constitution and Socialism was given a different meaning. Surpeme Court, one of the symbols of national unity was bifureated for about two years and then was restored. All these structural changes were incorporated in and ratified, as the Constitution Fifth Amendment Act. 1979.”
In spite of these vital changes from 1975 by destroying some of the basic structures of the Constitution nobody challenged them in court after revival of the Constitution : Consequently they were accepted by the people and by their acquiescence have become part of the Constitution.”
(১৭,৩,৯১ইং তারিখে বাংলাদেশ অবজারভার-এ প্রকাশিত জনাব এন, আই, * fe hot 1)
শেখ মুজিবের ভন্ডামী।
ক্ষমতালােভী শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রাশিয়া ও ভারতের সেবাদাস আওয়ামী লীগ, মস্কো ন্যাপ ও মনি সিংয়ের কমিউনিস্ট পার্টি সময়ে এক যে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠিত হইয়াছিল, এইভাবেই তাহা মােলকলায় পূর্ণ হয়। শেখ মুজিব ইহাকেই নির্লজ্জ ভাষায় দ্বিতীয় বিপ্লব আখ্যা দেন। ঠিক যেমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তান সৈনাধ্যক্ষ জেনারেল আইউব খান নিরস্ত্র দেশবাসীর বিরুদ্ধে স্বীয় ক্ষমতাভকে “বিপ্লব অাখ্যা দিয়াছিলেন এবং ক্ষমতা লাভের দিবস ২৭শে অক্টোবরকে ‘বিপ্লব দিবস’ ঘােষণা করিয়াছিলেন। কৌতুকের বিষয় ভিয়েৎনাম দিবসে আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশকালে ন্যাপ (মস্কো) ও কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কো) সমর্থক বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৭৩ সালের ১লা জানুয়ারী ইউএসআইএস (UNITED STATES INFORMATION SERVICE) অফিস সম্মুখে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে মতিউল ইসলাম ও আবদুল কাদের নামে ছাত্র ইউনিয়নের ২ জন কর্মী নিহত হয়। উক্ত নৃশংস ঘটনার প্রতিবাদে ২রা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (Dhaka University Central Student Union-DtcSU)-এর সহ-সভাপতি ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের প্রস্তাবক্রমে মার্কিন সম্রাজ্যবাদের দালাল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর নুহমানকে বঙ্গবন্ধু হিসেবে সম্বোধন না করে শুধু শেখ মুজিবুর রহমান হিসেবে ডাক্তার এবং শেখ মুজিবকে ‘ডাকসু’ কর্তৃক দেয় আজীবন সদস্য পদ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উপরােক্ত উত্তেজিত মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম শেখ মুজিবকে প্রদত্ত ‘ডাকসু’র আজীবন সদস্য পদের সনদপত্রটি ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে ফেলে। অন্যদিকে ৩রা জানুয়ারী ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় নুরে আলম সিদ্দিকী ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে হুমকি দিয়ে বলেন যদি তারা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে উচ্চকিত কটুক্তি প্রত্যাহার না করে এবং ডাকসু’ আজীবন সদস্যপদ পুনর্বহাল না করে হলে এর সমুচিত জবাব দেয়া হবে।
পরবর্তীতে ৪ঠা জানুয়ারী টেলিভিশনে দেখা গেল শেখ মুজিবের সাথে ডাকসু সহসভাপতি মােজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের হাস্যোজ্জ্বল ছবি। তারা তাদের সমস্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের কৃতকর্মের জন্য মাফ চেয়ে “ডাকসু’ আল্লীবন সদস্যপদ পুনর্বহাল করে। এই আপােসের দূতিয়ালী করেন তথাকথিত বামপন্থী কমরেড মনি সিং গং। অষ্টীতের মতো পরবর্তীতে সরকারের সাথে সহযােগী শক্তি হিসেবে কাজ করে। ভষ্যিতেও যে এরকম আপােসকামী কার্যক্রম করবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
উল্লেখ্য যে, ১৯৭৫ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে ২৮শে অক্টোবর (১৯৭০) জাতির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানের রেডিও-টেলিভিশনে দে ভাষণের নিম্নলিখিত অংশ এই প্রসঙ্গেই বিশেষ স্মরণযােগ্য ও প্রণিধানযােগ্য :
তদানীন্তন ক্ষমতাসীন দল (পাকিস্তান মুসলিম লীগ) সমগ্র দেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, সেই হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানাের জন্যই আমাদের মহান নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ভাবেই আমরা পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আপােষহীন সংগ্রাম শুরু করি।” (২৯শে অক্টোবর, ১৯৭০, দৈনিক পাকিস্তান দ্রষ্টব্য)। | এই উস্কৃতির পর মন্তব্যের কোন প্রয়ােজন আছে কি? নেতারা দেশবাসীকে শােনান এক, আর করেন আরেক, মর্মন্তুদ হইলেও ইহা নিরেট সত্য। মনে পড়ে পাকিৱান গণপরিষদে জনাব আবুল কাসেমের প্রস্তাব ছিল বিশ বত্সরের জন্য মুসলিম লীগকে একমাত্র রাজনৈতিক দল ঘােষণা করা হউক এবং আরও মনে পড়ে এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তদানীন্তন আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যের কি তীব্র প্রতিবাদ ও কী ভীষণ গলাবাজি। সবই আজ অতীত ইতিহাস। তবে কেউ ভুলে, কেউ ভুলে না। বাকশাল গঠন | যাহা হউক, জনগণ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ক্ষমতালােভী শেখ মুজিবুর রহমান তাহার পুতুল সংসদের সহায়তায় সকল রাজনৈতিক দল বাতিল ঘােষণা করিয়া ১৯৭৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের আদেশ জারি করেন। ১৯৭৩ সালের ২৯শে মে আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মস্কো) ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো) ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠন করিয়াছিল। বাকশাল গঠনের মূল প্ররোচনা ছিল ত্রিদলীয় ঐক্যজোটের। তদানুযায়ী ১, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ২, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ৩. বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, ৪, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ৫, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, ৬, বাংলা জাতীয় লীগ, ৭, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস, ৮, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ৯, জাতীয় গণতন্ত্রী দল, ১০. আঙ্গীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন, ১১, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, ১২. ইউনাইটেড পিপলস পাটি, ১৩, কমিউনিস্ট পার্টি এবং ১৪, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদীদলকে বাতিল ঘােষণা। করা হয়। এবং ১৯৭৫ সালের ২০শে মে বাংলা জাতীয় লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মস্কো), বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ও ইউনাইটেড পিপলস পার্টি অফিস তালাবদ্ধ করা হয়। শেখ সাহেব ইহাতেও ক্ষান্ত হইলেন না। নিজ শাসন পাকাপােক্ত করিবার হীন উদ্দেশ্যেই তিনি সকল সংসদীয় সদস্যকে ২৫শে এপ্রিলের মধ্যে বাকশালে যােগ দির ফরমান জারি করেন। অন্যথায় সংসদ সদস্যপদ বাতিল । বিরােধী সাংসদ জননেতা আতাউর রহমান খান ২৫শে এপ্রিল সাংবাদিক সম্মেলনে বাকশালে যােগদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিলেও আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্যদ্বয় জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মঈনুল হােসেন সংসদ সদস্যপদ ত্যাগ করা শ্রেয় মনে করেন। ৬ই জুন (১৯৭৫) জারিকৃত এক ফরমান বলে প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত
ব্যক্তিদের দ্বারা কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন; | ১, চেয়ারম্যান শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট; ২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাইস প্রেসিডেন্ট; ৩, প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী সেক্রেটারী জেনারেল; ৪, আবদুল মালেক উকিল- স্পীকার; ৫. খন্দকার মােশতাক আহমদ-মন্ত্রী; ৬. আবুল হাসনাত মােহাম্মদ কামরুজ্জামান মন্ত্রী: ৭, মােহাম্মদুল্লাহ- মন্ত্রী; ৮, আবদুস সামাদ আজাদমন্ত্রী। ৯, অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী মন্ত্রী; ১০. শ্রী ফনীভূষণ মজুমদার-মন্ত্রী; ১১, উঃ কামাল হােসেন মন্ত্রী; ১২. মােহাম্মদ সােহরাব হােসেন মন্ত্রী; ১৩, আবদুল মান্নান মন্ত্রী; ১৪. আবদুর রব সেরনিয়াবাত মন্ত্রী; ১৫.শ্রী মনােরঞ্জন ধর মন্ত্রী; ১৬, আবদুল মমিন- মন্ত্রী; ১৭, আসাদুজ্জামান খান- মন্ত্রী; ১৮, মােঃ কোরবান আলী-মন্ত্রী; ১৯. ডঃ আজিজুর রহমান মন্ত্রী; ২০, ডঃ মােজাফফ আহমদ মন্ত্রী; ২১, তোফায়েল আহমদ-Special Assistant To the president; ২২. শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন-চীফ হুইপ; ২৩, আবদুল মমিন তালুকদার-প্রতিমন্ত্রী; ২৪, দেওয়ান ফরিদ গাজী- প্রতিমন্ত্রী: ২৫. প্রফেসর নূরুল ইসলাম চৌধুরী- প্রতিমন্ত্রী; ২৬. তাহের উদ্দিন ঠাকুর-প্রতিমন্ত্রী; ২৭. মােসলেম উদ্দিন খান প্রতিমন্ত্রী; ২৮, মােঃ নূরুল ইসলাম মঞ্জুর-প্রতিমন্ত্রী; ২৯, কে এম ওবায়দুর রহমান-প্রতিমন্ত্রী; ৩০, ডঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল-প্রতিমন্ত্রী; ৩১, রিয়াজুদ্দিন আহমদ প্রতিমন্ত্রী; ৩২. মােঠ বয়েতুল্লাহ-ডেপুটি স্পীকার; ৩৩, খন্দকার রুহুল কুদুস-প্রেসিডেন্ট এর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারী; ৩৪, জিলুর রহমান সেক্রেটারী; ৩৫. মহিউদ্দিন আহমদ; ৩৬, শেখ ফজলুল হক মনি-সেক্রেটারী; ৩৭, আবদুর রাজ্জাক-সেক্রেটারী; ৩৮, শেখ শহীদুল ইসলাম; ৩৯, আনােয়ার চৌধুরী; ৪o, বেগম সাজেদা চৌধুরী এমপি; ৪১. বেগম তসলিমা আবেদ এমপি; ৪২, আবদুর রহিম এমপি, দিনাজপুর; ৪৩, আবদুল আওয়াল এমপি, রংপুর; ৪৪, সূক্ষর রহমান এমপি, রংপুর; ৪৫. এ কে এম মুজিবর রহমান এমপি, বগুড়া; ৪৬, ডঃ মফিজ চৌধুরী এমপি, বগুড়া; ৪৭, ডাঃ আলাউদ্দিন এমপি, রাজশাহী; ৪৮, ডাঃ আসহাবুল হক এমপি, কুষ্টিয়া; ৪৯, আজিজুর রহমান আক্কাস এমপি, কুষ্টিয়া; ৫০, রওশন আলী এমপি, যশােহর; ৫১, শেখ আবদুল আজিজ এমপি, খুলনা; ৫২. সালাউদ্দিন ইউসুফ এমপি, খুলনা; ৫৩, মাইকেল সুশীল অধিকারী, খুলনা; ৫৪, কাজী আবুল কাসেম এমপি, পটুয়াখালী; ৫৫, মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদ এমপি, ফরিদপুর; ৫৬. শামসুদ্দিন মােল্লা এমপি, ফরিদপুর ৫৭. শ্রী গৌরচন্দ্র বালা, ফরিদপুর; ৫৮. গাজী গোলাম মােস্তফা এমপি, ঢাকা নগর; ৫৯, শামসুল হক এমপি, ঢাকা; ৬০, শামসুজ্জোহা এমপি, ঢাকা; ৬১. রফিকুদ্দিন ভূইয়া এমপি, ময়মনসিংহ; ৬২, সৈয়দ আহমদ, ময়মনসিংহ; ৬৩, শামসুর রহমান খান এমপি, টাইল; ৬৪, নুরুল হক এমপি, নােয়াখালী” ৬৫. কাৰ্জী জহিরুল কাইয়ুম এমপি, কুমিল্লা; ৬৬, ক্যাপ্টেন সুজাত আলী এমপি, কুমিল্লা; ৬৭, এম,আর, সিদ্দি এমপি, চট্টগ্রাম; ৬৮, এম.এ ওয়াহাব এমপি, চট্টগ্রাম; ৬৯ শ্ৰী চিত্তরঞ্জন সুতার এমপি; ৭০, সৈয়দা রাজিয়া বানু এমপি; ৭১. অতািউর রহমান খান এমপি, ধামরাই; ৭২. খন্দকারজাতীয় যুবলীগ।
তােফায়েল আহমদ জাতীয় ছাত্রলীগ
শেখ শহীদুল ইসলাম এবং নিম্নোক্তদের দ্বারা কার্যকরী সংসদ গঠন করেন;
১. শেখ মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যনি, ২ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৩, এম মনসুর আলী- সেক্রেটারী জেনারেল, ৪, খন্দকার মােশতাক আহমদ, ৫, আবুল হাসনাত মােঃ কামরুজ্জামান, ৬. আবদুল মালেক উকিল, ৭. অধ্যাপক ইউসুফ আলী, ৮. শ্রী মনােরঞ্জন ধর, ৯, উঃ মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, ১০, শেখ আবদুল আন্সিন্স, ১১, মহিউদ্দিন আহমদ, ১২, গাজী গােলাম মােস্তফা, ১৩, জিলুর রহমান-সেক্রেটারী, ১৪, শেখ ফজলুল হক মনি- সেক্রেটারী, ১৫, আবদুর রাজ্জাক- সেক্রেটারী। | পক্ষান্তরে রাজনীতিবিদ, সমর নায়ক, শ্রমিক ও অন্যান্য সংগঠন ও সংস্থা, সরকারী-আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান এমন কি শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক মহলগুলোতেও বাকশালে যােগদানের হিড়িক পড়িয়া যায়। এইসৰ সুবিধাৰাধী ব্যক্তি বা পোষঠী পতাকা লইয়া ফুলের মালাসহ দলে দলে শেখ মুজিবের চরণ পূজা করিবার নিমিত্ত তাহার নিকট গমন করে। এমন কি এক শ্রেণীর মা-বােনও বাদ যায় নাই। ইহাদের এই ব্যক্তি পূজার মানসিকতায় উৎসাহী হইয়া শেখ মুজিব একদলীয় শাসন টেকসই করিবার নিমিত্ত যে কোন ধরনের সমালােচনার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করিবার অসৎ প্রয়াসে ১৯৭৫ সালের ১৬ই জুন সংবাদপত্র (ডিক্লারেশন বাতিল) অর্ডিন্যান্স জারি করেন। এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমের চারটি দৈনিক ব্যতীত সকল দৈনিক পত্রিকা বাতিল ঘােষণা করা হয়। অর্ডিন্যালে ১৭ই জুন (১৯৭৫) হইতে সারা বাংলাদেশে দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, দৈনিক বাংলা এবং দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস- এই চারটি দৈনিক প্রকাশের কথা ঘােষণা করা হয়। জনাব নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, জনাব ওবায়দুল হক, শেখ ফজলুল হক মনি ও জনাব এহতেশাম হায়দার চৌধুরী যথাক্রমে দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলাদেশ টাইমস ও দৈনিক বাংলার সম্পাদক নিযুক্ত হন। | সরকার আরাে ১২২টি সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার ডিক্লারেশন বহাল রাখে। আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইত্তেহাদসহ বদিবাকী সাপ্তাহিক, মাসিক শু সাময়িকীর ডিক্লারেশন বাতিল ঘােষণা করা হয়। ৯ জন সম্পাদকের বাকশালে যােগদান | বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্যপদের জন্য যে সব সম্পাদকগণ আবেদন করিয়াছিলেন তাহা হইলেন :১. জনাব ওবায়দুল হক, সম্পাদক, বাংলাদেশ অবজারভার; ২. জনাব আনােয়ার হােসেন মঞ্জু, সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক; ৩, শামসুল হুদা, সম্পাদক, মর্নিং নিউজ; ৪. জনাব জাওয়াদুল করিম, প্রধান সম্পাদক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস); ৫. জনাব নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, সম্পাদক,
মোঃ ইলিয়াস; ৭৩, শ্রী মং সুং (King of Manikchar : Chittagong Hill Tracts); ৭৪, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (ন্যাপ); ৭৫, আতাউর রহমান (ন্যাপ), রাজশাহী: ৭৬. সৈয়দ আলতাফ হােসেন (ন্যাপ); ৭৭, পীর হাবিবুর রহমান (ন্যাপ); ৭৮, মোঃ ফরহাদ (সিপিবি); ৭৯, বেগম মতিয়া চৌধুরী (ন্যাপ); ৮০, হাজী মােঃ দানেশ (জ্বাগমুই); ৮১, হােসেন তৌফিক ইমাম-সেক্রেটারী, ক্যাবিনেট এফেয়ার্স ডিভিশন; ৮২. নূরুল ইসলাম-সেক্রেটারী ফরেন ট্রেইড; ৮৩, ফয়েজউদ্দিন আহমদ-সেক্রেটারী, স্বরাষ্ট্র; ৮৪, মাহবুবুর রহমান, সেক্রেটারী এস্টাবলিশমেন্ট; ৮৫, আবদুল খালেক-Secretary to the Vice President; ৮৬. মুজিবুল হক-সেক্রেটারী দেশরক্ষা; ৮৭, আবদুর রহিম-Secretary to the President; ৮৮, মঈনুল ইসলাম-সেক্রেটারী, Works, Housing & Urban Development; ৮৯। সৈয়দুজ্জামান সেক্রেটারী প্ল্যানিং ৯০, আনিসুজ্জামান-সেক্রেটারী, কৃষি; ১১. ডঃ এ সাত্তার-Secretary to the President; ৯২, আবু তাহের সেক্রেটারী ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার; ৯৩, আলহােসাইনী-সেক্রেটারী পাওয়ার; ৯৪, এ সামসি-সেক্রেটারী, যােগাযােগ; ৯৫, ডঃ আবুল হােসেন-সেক্রেটারী, স্বাস্থ্য; ৯৬, মতিয়ুর রহমান-চেয়ারম্যান, টিসিবি; ৯৭, মেজর – জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ Chief of Staff. Bangladesh Army; ৯৮, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার Chief of staff, Bangladesh Air Force; ৯৯, কমােডর এম এইচ খান Chief of Staff. Bangladesh Navy; ১০০, মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান Director General of Bangladesh Rifles; ১০১, এ কে নাজিরুদ্দিন আহমদ গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক: ১০২, ডঃ আবদুল মতিন চৌধুরী ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ১০৩, ডঃ মাজহারুল ইসলাম- ভাইস চ্যান্সেলর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; ১০৪, ডঃ এনামুল হক ভাইস চ্যান্সেলর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ১০৫. এটিএম সৈয়দ হােসেন- এ্যাডিশনাল সেক্রেটারী এষ্টাবলিশমেন্ট ডিভিশন; ১০৬, নূরুল ইসলাম- আই,জি,পি; ১০৭, ডঃ নীলিমা ইব্রাহীম; ১০৮, ডাঃ নূরুল ইসলাম- ডিরেক্টর পিজি হাসপাতাল; ১০৯, ওবায়দুল হক-এডিটর, বাংলাদেশ অবজারভার; ১১০. আনােয়ার হােসেন মঞ্জ- এডিটর, ইত্তেফাক; ১১১. মিজানুর রহমান- চীফ এডিটর বিপিআই; ১১২. মনােয়ারুল ইসলাম- Joint Secretary President’s Secretariate; ১১৩, ব্রিগেডিয়ার এ,এন,এম, নূরুজ্জামান- ডিরেক্টর, জাতীয় রক্ষী বাহিনী; ১১৪, কামরুজ্জামান সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি; ১১৫, ডাঃ মাজহার আলী কাদীসভাপতি, বাংলাদেশ চিকিৎসক সমিতি।
নিম্নোক্ত অঙ্গ সংগঠন গঠন করা হয় : জাতীয় কৃষক লীগ সাধারণ সম্পাদক ফণীভূষণ মজুমদার জাতীয় শ্রমিক লীগ
অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী জাতীয় মহিলা লীগ
বেগম সাজেদা চৌধুরী।
দৈনিক বাংলা; ৬. জনাব এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ; ৭ জনাব শহীদুল হক, কার্যনির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ টাইমস ও দৈনিক বাংলার বাণী; ৮. জনাৰ বজলুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, দৈনিক সংবাদ; ৯. জনাব মিজানুর রহমান, সম্পাদক, অধুনালুপ্ত বিপিআই। প্রথম আবেদনকারী সাংবাদিকবৃন্দ
ইকবাল সােবহান চৌধুরী, অবজারভার; শামসুল হক আলীনুর, পূর্বদেশ হামিদুজ্জামান, বাসস; মাহবুবুর রহমান রুশাে, পিপল; মােহাম্মদ মতিউর রহমান, এনা; জাহাঙ্গীর হােসেন, বাসস; শফিকুল আলম কাজল, আজাদ; খায়রুল আনাম, ইত্তেফাক; আবদুল্লাহ এম হাসান, বাংলাদেশ টাইমস; আমিনুর রহমান, মর্নিং নিউজ; মােঠ নিজামউদ্দিন, ঐ; আমিনুল ইসলাম, ঐ; মােহাম্মদ একরামূল হক লােদী, ঐ; রফিকুল হক, পূর্বদেশ; এ এইচ এম মােয়াজ্জেম হােসেন, অবজারভার; সৈয়ল ইয়াহিয়া বখত, পূর্বদেশ; আতিকুর রহমান, ঐ মতিউর রহমান, মর্নিং নিউজ; খােন্দকার মনিরুল আলম, বাংলাদেশ টাইমস; হােসেন কামাল, ঐ; জগলুল আহমদ চৌধুরী, বাসস; আলমগীর মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ টাইমস; ফখরুল আবেৰ্দীন দুলাল, বাংলার বাণী; সৈয়দ রেদওয়ানুর রহমান, পূর্বদেশ; আজমল হােসেন খাদেম, ঐ; শাহনূর খান, ঐ; খন্দকার ফজলুর রহমান, বাংলাদেশ অবজারভার; মজিদুর রহমান বিশ্বাস, পূর্বদেশ আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী, ঐ; আবদুল মজিদ কামালী, ঐ: শহীদ এনায়েত উল্লাহ, ঐ; আবুল কাশেম, ঐ; জহিরুল হক চৌধুরী, ঐ; মােহাম্মদ আবুল কালাম, ঐ; এ এন এম গােলাম রহমান, ঐ; মােহাম্মদ আবদুল মতিন, ঐ; সালাহ উদ্দিন চৌধুরী, ঐ; সালেহ আহমদ, বাংলার বাণী; আমীন আহমদ চৌধুরী, বাংলাদেশ টাইমস; ওয়াহিদুর রশীদ মুরাদ, বাংলার বাণী; সাদেকুল হক, ঐ; আশরাফ খান, ঐ; আবদুল মান্নান সরকার, ঐ হালিমুর রশীদ, ঐ; মােহাম্মদ নুরুল ইসলাম, ঐ; মওলা চৌধরী, পূর্বদেশ; আনওয়ার আহমদ, ঐ; আমিনুল ইসলাম, ঐ; খলিলুর রহমান, অবজারভার; আনওয়ার হোসেন, ঐ; সৈয়দ এনায়েত হােসেন, চিত্রালী; অহিদুর রহমান, পূর্বদেশ; আবুল হােসেন নকিব, ঐ; লুৎফুর রহমান, ঐ; মােহাম্মদ শফিকুদ্দীন আহমদ, ঐ; আবদুল মােত্তালেব, ঐ; মােহাম্মদ আবদুস সাত্তার, ঐ; আবদুল আষ্টয়াল, দৈনিক বাংলা; এ টি এম শামসুল আলম, ঐ; ইসহাক চাখারী, ঐ; খােন্দকার মােহসিনউজ্জামান, মর্নিং নিউজ; মােয় শামসুল হক জাহিদ, ঐ; আবুল আহসান আহমেদ আলী, ঐ; মােহাম্মদ নজরুল ইসলাম, বাসস; সৈয়দ মুস্তাফিজুর রহমান, ঐ; সৈয়দ মাহমুদ, ঐ; সদরুল হাসান, বাংলাদেশ টাইমস; মােহাম্মদ কামরুজ্জামান, দৈনিক বাংলা; আবদুল হালিম চৌধুরী, পূর্বদেশ, রফিকুর রহমান, বাংলার বাণী; এস এম জহুরুল আলম, বাসস; মােঃ মওসানুজ্জামান, ঐ; মােজাম্মেল হােসেন, বাংলাদেশ অবজারভার; ফারুক কাজী, বাংলার বাণী; রহমান জাহাঙ্গীর, দি পিপল; ইউসুফ পাশা, পূর্বদেশ; গোলাম সারওয়ার,
ইত্তেফাক, বাহাউদ্দিন আহমদ, সদস্য ডিইউজে; লাল ভাই, মর্নিং নিউজ; মােহাম্মদ। জহীরুল হক, কোষাধ্যক্ষ, জাতীয় প্রেসক্লাব; এম আকিল খান, পিপল; আজিজ মিসির, জাষ্ঠীয় প্রেসক্লাবের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ কে এম তবিবুল ইসলাম, বাসস; সৈয়দ আহমদ জামান, ঐ; মােহাম্মদ এরশাদুল হক, ঐ; আবদুল হালিম চৌধুরী, পূর্বদেশ; এম সাজ্জাদুল করিম, ঐ; রঞ্জন কিশাের চৌধুরী, শেখ আবদুল মজিদ, পূর্বদেশ; ফরিদ উদ্দিন আহমদ, ঐ চৌধুরী মাজহারুল হক, ঐ; সলিমুল্লাহ, ঐ; এম আবু ইউসুফ, ঐ; সাবির উদ্দিন আহমদ, ঐ; আবদুল মান্নান, ঐ; ফরহাদ হােসেন, সংবাদ; সৈয়দ আখতার ইউসুফ, ইত্তেফাক, কে জি মােস্তফা, জনপদ; শামসুল ইসলাম আলমাজী, দৈনিক বাংলা; রশীদ তালুকদার, সংবাদ; মােকাদ্দেস আলী, অবজারভার গােলাম মাওলা, দৈনিক বাংলা; বাদল নাগ, মর্নিং নিউজঃ শফিকুল করিম, বাসস; শরিফুল আলম, পিপল; বাৰু আনসারী, দৈনিক বাংলা মােহাম্মদ আশরাফ আলী, মর্নিং নিউজ, মােহাম্মদ মহিউদ্দিন, ঐ; নূরুদ্দিন আহমদ, ঐ; মনিরুজ্জামান, ঐ; আবু বকর সিদ্দিক, পূর্বদেশ; মােঃ খলিলুর রহমান, ঐ; কে এম জাফরুল্লাহ, ঐ; গােলাম হাক্কানী খান, ঐ মােঃ শামসুদ্দিন ভূঁইয়া, ঐ; মােঃ ইউনুস মজুমদার, ঐ; জোসেফ আইজাক, অবজারভার; এস এফ মকবুল আহমদ, ঐ; মােঃ নাসিরুল আলম, ঐ; মােঃ শাহাজাহান মজুমদার, ঐ; ফজলে রশিদ, ঐ; সৈয়দ মাহবুব আলম, সংবাদ: হােসেন তওফিক চৌধুরী, পূর্বদেশ; বুদ্ধদেব মুখার্জী, অবজারভার; মােঃ সিরাজুল ইসলাম, মর্নিং নিউজ: সৈয়দ আহমদ, ঐ; সােহরাব হােসেন, ঐ; মােঃ হাবিলউদ্দিন, ঐ; আবু-আল সাইদ, সংবাদ; এস এন এম আয়াতউল্লাহ, সংবাদি; নােমান চৌধুরী, আজাদ; সুলতান আহমদ, ঐ; আবদুল মান্নান হাওলাদার, ঐ; আতিয়ার রহমান, ঐ; মােঃ ফজলুর রহমান, ঐ; এম মহিউদ্দিন শেখ, ঐ; মােয়াজ্জেম হােসেন বুলু, অবজারভার; আবদুস সাত্তার, বাংলার বাণী; আবুল খায়ের, ঐ; মােঃ আবদুর রব, মর্নিং নিউজ, খােন্দকার এ রাজজাক, ঐ; এ এন এম লুৎফর রহমান, বাংলাদেশ টাইমস; শফিকুল কবির, ইত্তেফাক; শীলুব্রত বড়ুয়া, ঐ; ফিরােজ আহমদ, ঐ; খােন্দকার রফিকউদ্দিন আহমদ, ঐ রকিবুদ্দিন, ঐ; শাজাহান রেজা, ঐ; এ টি এম শফিউল্লাহ, ঐ; জাহান আরা বেগম, বাংলার বাণী; আহমদ ফজল সিদ্দিকী, বাংলাদেশ টাইমস; এ এম মোফাজ্জল, বাংলাদেশ টাইমস; আবদুল মাজেদ চৌধুরী, বাংলার বাণী; মনজুর কাদের, বাংলাদেশ অবজারভার আবদুল মতীন, পূর্বদেশ; ধীরেন বােস, অবজারভার; এ এস এম এ খালেক, ঐ; এলাহী বক্স, মর্নিং নিউজ; রহমত আলী, মর্নিং নিউজ; আনোয়ার আলী চৌধুরী, ঐ; মােহাম্মদ ওয়াহিদুল ইসলাম, ঐ; সুফিয়া সুলতানা, ঐ; আনওয়ারা বেগম, ঐ; সৈয়দা শাহানা বেগম, ঐ; আমিনুল ইসলাম, বাসস; এন কে আলম চৌধুরী, ঐ; এম এ মােহামমেন, ঐ; জহরুল ইসলাম, এনা; মােহাম্মদ তােগলক খান, ঐ; শামসুদ্দীন আহমদ চারু, ইত্তেফাক; বজলুর রহমান, ঐ; মােহাত্মা গাজীউর রহমান, বাসস; হাসান শাহরিয়ার, ইত্তেফাক; মােহাম্মদ কামরুজ্জামান, দৈনিক বাংলা; আবদুল হাদী, ইত্তেফাক; আসফউদ্দৌলা, ঐ; এ এন এমবদরুদ্দীন, ঐ; নূরুল ইসলাম বরিন্দি, ঐ; মহিদুল ইসলাম, ঐ; জাকারিয়া মিলন, ঐ আবু সুফিয়ান, ঐ; শরীফ আবদুল কুদুস, ঐ; প্রশান্ত ভােলাল, ঐ; আবুল কালাম আজাদ, ঐ; মীর আফতাবউদ্দীন আহমদ, ঐ; সিরাজুল হক, ঐ; রাহাত খান, ঐ; মাহফুজ আলম, বাংলাদেশ টাইমস; র ইসলাম, পূর্বদেশ; কাজী হাসান হাবিব, ঐ; মেহেরুন্নেসা, ঐ সৈয়দ কামরুজ্জামান, মর্নিং নিউক্স; নূরুজ্জামান চৌধুরী, পূর্বদেশ শহীদুজ্জামান খান, অবজারভার; জহিরুল আলম, ইত্তেফাক; মােজাম্মেল হক, বাসস এহসানুল করিম হেলাল, ঐ; শামসুদ্দীন আহমদ, ঐ; জিয়াউল হক, পূর্বদেশ; গাজীউল হাসান খান, এনা; শামসুদ্দীন আহমদ, ঐ; আবদুল খালেক ভূঁইয়া, বাংলাদেশ টাইমস; মাহবুবুল আলম, ঐ; মেজবাহউদ্দীন আক, ঐ; বজল আহমদ, বাসস; এ ই বি রেজা, বাংলাদেশ টাইমস; মৃণাল কৃষ্ণ রায়, ঐ; এ বি এম রুস্তুম আলী, মর্নিং নিউজ; এ এফ এম গোলাম রাব্বানী, ঐ; আবদুল হাকিম, বাংলার বাণী, মােহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক, ঐ; শামসুল ইসলাম, মর্নিং নিউজ; মােহাম্মদ নওয়াব আলী, ঐ; আনিসুর রহমান, পূর্বদেশ; শহিবিউদ্দীন ভূইয়া, ইত্তেফাক; সুলতান আহমদ, ঐ; এ এ এম ফখরুদ্দীন, মর্নিং নিউজ; শেহাবউদ্দীন আহমদ, এনা; জাহিদুজ্জামান ফারুক, ইত্তেফাক: এ এফ এম হাবীবুর রহমান, বাসস; রােকনুজ্জামান খান, ইত্তেফাক এবং এ কে এম জামালষ্টদ্দীন, মর্নিং নিউজ। পরবর্তীতে যাহারা আবেদন করেন।
খালেদা এদিব চৌধুরী, পূর্বদেশ, শাজাহান আলী, আজাদ, শাহ সৈয়দ রেহান উল্লাহ, ইত্তেফাক, তােফাজ্জল হােসেন, ঐ; হাবিবুর রহমান মিলন, ঐ; জি, এম, স্বপন, আজাদ, হােসনে আরা বেগম, ঐ; মিসেস সায়েদা খুদসিয়া হাসান, ইত্তেফাক, মােহাম্মদ লুৎফর রহমান, ঐ; সৈয়দ সিরাজুল কবির, এনা; মোহাম্মদ নুর জালাল, সংবাদি; আবদুল মােমিন, ঐ; সুদর্শন চট্টোপাধ্যায়, হাসমতুল হক, ঐ; বাবুলাল সাহা, ঐ; শহীদুল ইসলাম, ঐ; শান্তিময় বিশ্বাস, ঐ; মােহাম্মদ নূরুল আলম, ঐ; স্বপন দত্ত, ঐ; বিলােল রঞ্জন সেন কর্মকার, ঐ; হাবিবুল্লাহ রানা, ঐ; আবদুর রহমান, ঐ; মােহসিন খায়রুল আনাম, ঐ; হাসান আলী, ঐ; তােজাম্মেল আলী, ঐ; আবুল হাসনাত, ঐ; বাসুদেব ধর, ঐ; বেবী মওদুদ, ঐ; জীবন চৌধুরী, আবুল হাশিম, ঐ; কাজী জাফরুল ইসলাম, ঐ রুহুল আমীন, ঐ; মােহাম্মদ আতাউর রহমান বাদল, ঐ; মজিবুর রহমান বাদল, ঐ; সুবীর চৌধুরী, ঐ; কাজী আনােয়ারুল ইসলাম, ঐ; চপল বাশার, ঐ; রেজাউল হক সবােজ, ঐ; আহসান হামিদ, ঐ; মােহাম্মদ আবদুর রব, ঐ; রওশনআরা জলি, ঐ; আমানউল্লাহ সরকার, ঐ; আবদুল মজিদ, ঐ; বিজন কুমার চক্রবর্তী, ঐ; মিজানুর রহমান, ঐ; অজয় বড়ুয়া, ঐ; কামদা প্রসাদ ভৌমিক, ঐ; জি এম ইয়াকুব, ঐ; ওয়াসিলউদ্দীন, ঐ; হাফিজউদ্দিন আহমদ, ঐ; এম, বশির আহমদ, ঐ; শ্রী সন্তোষ গুপ্ত, ঐ; সৈয়দ শাজাহান, বাংলাদেশ টাইমস, মােহাম্মদ আমিনুল হক, ঐ: আশরাফুল আলম, ঐ; মােহাম্মদ বজলুল হক, ঐ; মােহাম্মদ সামশের তাবরেজ (মিন্টু), ঐ; মােহাম্মদ
শাজাহান আলী, ঐ; শামিম আহমেদ নাদিম, ঐ; মােহাম্মদ মােজাম্মেল হক, ঐ; খন্দকার আলী আশরাফ, দৈনিক বাংলা; সৈয়দ মর্তুজা আলী, বাংলাদেশ অবজারভার; চট্টগ্রাম, আতাউর রহমান, বাসস; ওবায়দুল হক কামাল, জনপদ; মােহাম্মদ খালেদুর রহমান, দৈনিক বাংলা; এ ওয়াদুদ ফরিদী, বাংলার বাণী, আবদুল করিম, ঐ; মােঃ আবিদুর রহমান, ঐ; কাজী নজরুল ইসলাম, ঐ; মােঃ আমজাদ হােসেন, বাংলাদেশ টাইমস, মােঃ আবু তাহের, ইত্তেফাক; মােঃ নাজিমুল হক, ঐ শাহিন রেজা নূর, ঐ; আবদুর রশিদ, ঐ; ইয়াসিন আহমদ, ঐ; এম, এ, সােবহান, ঐ; ইমদাদুল হক, ঐ; আঃ রহমান খান, জনপদ; খলিলুর রহমান শরিফ, ঐ; বদিরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, ঐ; আবদুল ওহাব, ঐ; আসাদুজ্জামান খান, বাংলাদেশ টাইমস; নাজিমউদ্দিন মানিক, বাংলার বাণী; বিনয় কুমার দাস, ঐ; মতিউর রহমান, ঐ; আবদুস সালাম, ঐ; সৈয়দ মােস্তফা হােসেন, ঐ খন্দকার তােজাম্মেল হােসেন, ঐ রকিব সিদ্দিকী, ঐ; মমতাজউদ্দন আহমদ, এনা; শাহ আলম, গণকণ্ঠ, ঐ; আনােয়ার হোসেন, সংবদি; গিয়াসউদ্দিন আহমদ মজুমদার, এনা; আবদুল মান্নান, পূর্বদেশ; হাফিজ আহমদ, ঐ; নুরুল ইসলাম, ঐ; (সভাপতি সাংবাদিক ইউঃ চট্টগ্রাম); মােহাম্মদ ঈসা, মর্নিং নিউজ; মােঃ আজিজুল হক, ঐ; আব জাফর শেখ, ঐ; মােঃ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ অবজারভার; আজিজ আহমদ, ঐ; মােঃ আমির হােসেন, ঐ; মােঃ নূরুল হুদা, ঐ; মাসুকুল হক, ঐ; মােঃ মফিজুল্লাহ, ঐ; মােঃ রফিকুল ইসলাম, ঐকাজিমউদ্দিন আহমদ, ঐ; মােঃ আতিকুল্লাহ, ঐ; মাইকেল, ঐ: খন্দকার আবুল হাসনাত, ঐ; মাহমুদুল হক চৌধুরী, ঐ; এম রিয়াজউদ্দিন আহমদ, ঐ; মােঃ আবুল হােসেন, ঐ; শেখ শহীদুল ইসলাম, ঐ; আবদুল গোফরান, ঐ; তাজুল ইসলাম চৌধুরী, ঐ; মােঃ আশরাফ আলী, ঐ; মােঃ সিদ্দিকুল্লাহ, ঐ; আঃ হাই, এ ফজলুল বারী চৌধুরী, ঐ; আঃ মতিন, ঐ; মদন সাউ, ঐ; মােঃ ইউসুফ হােসেন, ঐ; মােঃ মফিজুর রহমান, বাংলার বাণী; আঃ করিম মােল্লা, ঐ; মােঃ আঃ রহমান, ঐ কাজী রাশিদুল হক পাশ, ঐ; শেখ গােলাম মােস্তফা, ঐ; মতিউর রহমান, ঐ; ফাতেমা আনসারী, আজাদ; কাজী মােঃ বক্স, বাংলাদেশ টাইমস; আমির খসরু, বাংলার বাণী: হামিদুর রহমান, ঐ; হেদায়েত উদ্দিন খান, জনপদ; আমানুল্লাহ কবির, বাংলাদেশ টাইমস, মােঃ মােকাররম হােসেন, বাসস; হাসানুজজামান খান, ঐ; এম শাহরিয়ার, ঐ; হোসাইনুজজামান চৌধুরী, ঐ; মােঃ মাসুম, ঐ; আনিস আহমেদ, ঐ; কাজী মাকসুদুল হাসান, ঐ; মােঃ হাসিবুর রহমান, ঐ; শহীদুল ইসলাম, ঐ; এস এ মাকসুদ, ঐ; ডি পি বড় য়া, ঐ; আ স ম হাবিবুল্লাহ, বাসস (অবৈতনিক সম্পাদক জাতীয় প্রেসক্লাব); নাজির আহমদ, বাসস, চট্টগ্রাম; সৈয়দ শফিকউদ্দিন আহমদ, দৈনিক স্বাধীনতা, চট্টগ্রাম; শেখ আফতাব উদ্দিন, দৈনিক দেশবাংলা, চট্টগ্রাম; আঃ রাজ্জাক চৌধুরী, দৈনিক পূর্বদেশ; আঃ রহিম, বাংলাদেশ অবজারভার; মােস্তফা তরিকুল আলম, বাংলাদেশ টাইমস; মােঃ মােজাফফর হােসেন, ঐ; এ বি এম কামালউদ্দিন শামীম, পূর্বদেশ; মােঃ তোয়াহা খান, সংবাদ; রণেশ দাশ গুপ্ত, ঐ; মােঃ মুটরিব, দি পিপল; নজরুল ইসলাম বুলবুল, জনপথ; জামালউদ্দিন হায়দার, গণকণ্ঠ; হারুনুর রশিদ খাঁন, সংবাদ হােসেন নুর আলম, এনা; সৈয়দ ইকবাল, ঐ; মােঃ সিরাজউদ্দিন, ঐ; শাহাবুদ্দীন আহমদ, ঐ; কাজী নেসারউদ্দিন আহমদ, জনপদ; শাহাদৎ হােসেন বাবুল, ঐ; মােঃ আবদুল হাই, ঐ; আফতাবউদ্দিন আহমদ, ঐ; মােঃ নূরুল ইসলাম মােড়ল, বাংলার বাণী; আতাউল মালেক, জনপদ; মােঃ রমজান আলী; ফেরদৌস উদ্দিন রহমত-ই খুদা, ঐ; মােজাম্মেল হক, ঐ। | অতঃপর বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাকশালে যােগদান সমগ্র জাতির জন্য এক বিন্দু বিস্ময়। আতাউর রহমান খানের বাকশালে যােগদান
২৫শে এপ্রিল (১৯৭৫) জনাব আতাউর রহমান খান সংবাদপত্রে প্রকাশাথে নিমােক্ত বিবৃতির মাধ্যমে বাকশালে যােগদানের কথা দেশবাসীকে জানান । | “দেশের একমাত্র জাতীয় দল কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে আমি যােগদান করিয়াছি। আমার মনে হয়, এই ব্যাপারে দেশবাসী বিশেষতঃ আমার সহকর্মীদের নিকট একটি কৈফিয়ত দেওয়া আমার কর্তব্য। তাহাদের মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, আমি রাজনীতিতে একটি অভিনব পন্থা গ্রহণ করিয়াছি। পস্থাটি দৃশ্যতঃ অস্তিনৰ সত্য; কিন্তু এই পন্থা আমি হঠাৎ গ্রহণ করি নাই। আমি দীর্ঘদিন ভাবিয়া-চিত্তিয়া করিয়াছি। তাহা ছাড়া সহকর্মীদের অনেকের সঙ্গে আলােচনা করিয়াছি। কিন্তু সকলের সঙ্গে আলাপ করিতে পারি নাই। তাহাদের সকলকেই আমার বর্তমান চিন্তাধারার সাথী করিবার উদ্দেশ্যেই এই বিবৃতি দিতেছি।
পন্থাটি একান্তভাবেই রাজনীতিক, রাজনীতির শেষ কথা প্রথমে দেশবাসী এবং পরিণামে মানব জাতির কল্যাণ। এই কল্যাণের প্রথম কথা জনগণের আর্থিক সুখসমৃদ্ধি। ইহা ব্যতীত জনগণের স্বাধীনতা অর্থবহ হইতে পারে না। সুখ-সমৃদ্ধির প্রথম শর্ত শান্তি ও শৃংখলা। শান্তি-শৃংখলার পূর্বশর্ত জনগণের সার্বিক ঐক্য, জনগণের ঐক্য ব্যতিরেকে শান্তি-শৃংখলা ও জনগণের উন্নক্তি কোন সরকারের একক চেষ্টায় সার্থক হইতে পারে না। আমাদের দেশে এই গণ ঐক্যের প্রয়ােজনীয়তা আরও বেশি এই জন্য যে, আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছি। সকলেই জানেন, সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা স্বাধীনতা অর্জিত হইলে অর্থনীতি বিধ্বস্ত ও শান্তি-শৃংখলা বিপর্যস্ত হওয়া স্বাভাবিক। দেশবাসীর জমাট বাঁধা ঐক্যই কেবল দেশকে এই সংকট হইতে উদ্ধার করিতে পারে। এই ঐক্য প্রতিষ্ঠা বিভিন্ন উপায়ে হইতে পারে। কিন্তু আমাদের শাসনতান্ত্রিক সংবিধান একটি বিশেষ-পথ নির্দেশ করিয়াছে। জনগণের প্রত্যক্ষ নির্বাচিত সার্বভৌম পার্লামেন্ট একটি মাত্র জাতীয় দলের বিধান করিয়াছে। দেশের এই বাহিত শান্তি-শৃখলা আনিতে হইলে জনগণকে বিশেষতঃ তাহাদের নেতৃবৃন্দকে দেশের আইন, মানিয়া চলিতে হইবে। আইন-কানুনের মধ্যে আবার সাংবিধানিক আইনই সর্বোচ্চ।
এই পরিস্থিতি লইয়া আমি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহিত
বহুবার আলাপ করিয়াছি। আমি আরও উপলব্ধি করিয়াছি যে, তাহার এই ঐক্য প্রচেষ্টা আন্তরিক এবং এই কাজে সকল দল ও নেতার সহযােগিতা তিনি একান্তভাবে কামনা করেন। আমার আরাে প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, দেশকে এই সংকট হইতে উদ্ধার করিবার উদ্দেশ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তরিকভাবেই তিনি আগ্রহশীল। এই অবস্থায় এই কাজে প্রেসিডেন্ট-এর সহযােগিতা করা সকল দেশ-প্রেমিকের বাঞ্ছনীয়। দেশের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিতে কোন সচেতন নাগরিকের পক্ষে নীরব দর্শক ও শুধুমাত্র সমালােচকের ভূমিকা পালন করা উচিত নয়। বরঞ্চ তার রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাইয়া সরকারের সহিত সক্রিয় সহযােগিতা করাই কর্তব্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই কর্তব্যবােধে অনুপ্রাণিত হইয়াই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছি। | আমাদের সমস্যা অনেক, তবে তাহার সমাধানও নিশ্চয়ই আছে। সেই সমাধানের সন্ধানে জাতীয় ঐক্যবদ্ধ চেষ্টায় আমার এই শেষ বয়সে যথাশক্তি লইয়া আমি আত্মনিয়ােগ করিতে চাই। জনগণকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী মর্যাদাবান এবং সম্মানিত জাতি হিসাবে দেখিয়া যাওয়াই আমার জীবনের একমাত্র কামনা। এই সাংবাদিক সম্মেলন আয়ােজন করিবার জন্য বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ-এর সকল নেতা এবং কর্মীবৃন্দকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি। তাহাদের অনেকেই আমার প্রিয়জন ও পুরাতন সহকর্মী এবং নবাগতরা সবাই আমার স্নেহের পাত্র। আমি যে মহান উদ্দেশ্যে জাতীয় দলে যােগদান করিলাম সে উদ্দেশ্য সফল। করিবার জন্য সকলের পারস্পরিক সাহায্য ও সহযােগিতা আমার একান্তভাবে কাম্য।
উপস্থিত জাতীয় সম্মানিত সাংবাদিক প্রতিনিধিবৃন্দ এই অনুষ্ঠানে যােগদান করিবার জন্য যে কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আপনাদের সহযােগিতা ও সহমর্মিতা লাভ করিয়াছি। আশা করি, ভবিষ্যতেও আপনাদের সহযােগিতা আমাকে সঠিক পথে দেশের কাজ করিয়া যাইতে সহায়তা করিবে।” | এখানে উল্লেখ্য যে, আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয় জাতীয় সংসদের যে সমস্ত সদস্যবৃন্দ জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে (বাকশাল) এখনও যােগদান করেন নাই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৭ খ ধারার ৫ উপধারা মােতাবেক প্রেসিডেন্ট তাহাদের উক্ত দলে যােগদানের শেষ তারিখ ২৫শে এপ্রিল (১৯৭৫) ধার্য করিয়াছেন।”
প্রসংগত আরও উল্লেখ্য যে, জনাব আতাউর রহমান খান জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন।
হাজী দানেশসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বাকশালে যােগদানের আবেদন
বাকশালে যোগদানকালে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ সাবেক এমএলএ হয় হাজী মােহাম্মদ
দানেশ, জনাব আবদুল করিম ও জেনারেল আইউব-এর অ্যুত্থানের যে ৫ ই জগন্নাথ ক্ষমতাহীন জাতীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আবদুল হক সাহেবদের বিবৃতি ;
মহাননেতা বঙ্গবন্ধু,
“জাতীয় জীবনের এক সংকট সন্ধিক্ষণে আপনার দ্বিতীয় বিপ্লবের ঘােষণা দেশের জনগণের মধ্যে একটি নূতন আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়াছে, এটা এখন অত্যন্ত স্পষ্ট যে, জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তি দ্বিতীয় বিপ্লবের সঠিক বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত।
সার্বিক অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রয়াস গ্রহণের এই শুভলগ্নে মতামত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগ সর্বাধিক প্রয়ােজনীয়। আমরা একমাত্র জাষ্ঠীয় গণতান্ত্রিক পার্টি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগে যােগদানের অনুমতি চাহিতেছি, যেহেতু আমাদের এই প্রতীতি হইয়াছে যে, আপনার দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচীর মাধ্যমেই কেবল জাতীয় আশা-আকাংখার বাস্তবায়ন সম্ভব।
আমাদেরকে পার্টির সদস্যপদ প্রদান করিয়া আপনার মহান নেতৃত্বে জাতিকে সেবা করার অনুমতি দিয়া বাধিত করিবেন।” জেলা গভর্নর নিয়ােগ।
| ২৩শে জুন (১৯৭৫) সারা দেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করিয়া ১৬ই জুলাই তারিখে ৬১ জন গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। গভর্নরদের মধ্যে ছিল ৩৩ জন সংসদ সদস্য, ১৩ জন বেসামরিক অফিসার, ১ জন সামরিক অফিসার এবং বাকী ১৪ জনের মধ্যে ছিল জনসাধারণের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেমন আইনজীবী, উপজাতীয় নেতা, প্রাক্তন এমসিএ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তি। গরদের তালিকা নিম্নে দেয়া হইল ।
১। এডভোকেট জহিরুল ইসলাম, প্রাক্তন এম সি এ | কক্সবাজার ২। জনাব মােহাম্মদ খালেক এমপি
চট্টগ্রাম ৩। জনাব জাকিরুল হক চৌধুরী
চট্টগ্রাম (উত্তর) ৪। জনাব মং সু প্রু চৌধুরী বােইমং প্রধান বান্দরবান বান্দরবান ৫। জনাব মং সুং রাজা মানিকছড়ি
খাগড়াছড়ি ৬। জনাব এ এম এ কাদের জেলা প্রশাসক, পার্বত্য চট্টগ্রাম ৭। জনাব থাকা আহামল এমপি
ফেণী ৮। জনাব আবদুর রশিদ এমপি
লক্ষ্মীপুর ৯। জনাব নূরুল হক এমপি।
নােয়াখালী ১০। অধ্যাপক খোরশেদ আলম এমপি
কুমিল্লা ১১। জনাব আলী আজম এমপি
ব্রাহ্মণবাড়িয়া
১২। জনাব আবদুল আউয়াল এমপি
চাঁদপুর ১৩। জনাব মােস্তফা আলী এমপি।
হবিগঞ্জ ১৪। জনাব নূরুল আহমদ জেলা প্রশাসক, বরিশাল মৌলভীবাজার ১৫। জনাব মােহাম্মদ রশিদুল হক জেলা প্রশাসক, সিলেট সিলেট ১৬। জনাব আবদুল হাকিম চৌধুরী এমপি
সুনামগঞ্জ ১৭। জনাব আবদুস সাত্তার জেলা প্রশাসক, পটুয়াখালী। কিশােরগঞ্জ ১৮। জনাব জুবেদ আলী এমপি
নেত্রকোনা ১৯। রফিকুদ্দিন ভূঁইয়া এমপি
ময়মনসিংহ ২০। জনাব আবদুল হাকিম এমপি
জামালপুর ২১। জনাব আনিসুর রহমান এমপি
শেরপুর। ২২। জনাব আবদুল কাদের সিদ্দিকী।
টাঙ্গাইল ২৩। জনাব এম এ তাহের তৎকালীন সচিব, ভূমি সংস্কার ঢাকা মেট্রো) ২৪। জনাব আশরাফ আলী চৌধুরী সাবেক এম সি এ
ঢাকা ২৫। জনাব মােহাম্মদ শামসুল হক সাবেক এম সি এ ২৬। জনাব আফতাব উদ্দিন ভূইয়া এমপি,
নরসিংদী ২৭। জনাব এম, নুরুজ্জামান পরিবহন কমিশনার
মানিকগঞ্জ ২৮। জনাব শামসুদ্দীন মােল্লা এমপি
ফরিদপুর ২৯। জনাব আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী
রাজবাড়ী ৩০। জনাব আবদুর রেজা খান এমপি
মাদারীপুর ৩১। জনাব এ এইচ এম মোফাজ্জল করিম জেলা প্রশাসক, কুষ্টিয়া গােপালগঞ্জ ৩২। জনাব এস আর খান, সংস্থাপন বিভাগ
नी ৩৩। জনাব আমির হােসেন এমপি।
ঝালকাঠি ৩৪। জনাব আমিনুল হক চৌধুরী এডভােকেট
বরিশাল ৩৫। জনাব এনায়েত হােসেন খান এমপি
পিরােজপুর ৩৬। জনাব শাহাজাদা আবদুল মালেক খান এমপি
পটুয়াখালী ৩৭। জনাব এম শফিকুর রহমান জেলা প্রশাসক, রাজশাহী। বরগুনা ৩৮। জনাব আবদুল লতিফ খান এডভােকেট, সাবেক এমসিএ বাগেরহাট ৩৯। কর্নেল মােহাম্মদ আনােয়ারউল্লাহ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। খুলনা ৪০। কাজী মঞ্জুর-ই-মওলা, জেলা প্রশাসক, বগুড়া সাতক্ষীরা
৪১। জনাব রওশন আলী এমপি
यएगी। ৪২। খােন্দকার আবদুল হাফিজ এমপি
নড়াইল ৪৩। জনাব কে এম এ আজিজ এমপি
ঝিনাইদহ ৪৪। জনাব লুৎফুল্লাহিল মজিদ, জেলা প্রশাসক, নােয়াখালী। মাগুরা ৪৫। জনাব আবদুর রউফ চৌধুরী এমপি।
কুষ্টিয়া ৪৬। জনাব এম ফাইজুর রাজ্জাক জেলা প্রশাসক, ফরিদপুর চুয়ান্ডাঙ্গা ৪৭। জনাব মহিউদ্দিন আহামদ এমপি
মেহেরপুর ৪৮। অধ্যাপক আবু সাঈদ এমপি
পাবনা ৪৯। জনাব মােতাহার হােসেন তালুকদার
সিরাজগঞ্জ ৫০। জনাব এ কে মজিবুর রহমান এমপি
বহুড়া ৫১। জনাব কাসিমউদ্দিন আহামদ এমপি
জয়পুরহাট ৫২। জনাব নাজিবুর রহমান এডভােকেট
দিনাজপুর ৫৩। জনাব এম ফজলুল করিম এমপি
ঠাকুরগাঁও ৫৪। জনাব এম আবদুর রউফ এমপি
নীলফামারী ৫৫। জনাব এ.কে.এম জালালউদ্দিন জেলা প্রশাসক, ময়মনসিংহ রংপুর ৫৬। জনাব লুর রহমান, এমপি
গাইবান্ধা ৫৭। জনাব শামসুল হক এমপি
কুমি ৫৮। জনাব শংকর গােবিন্দ চৌধুরী প্রাক্তন এম সি এ
নাটোর ৫৯। জনাব আতাউর রহমান।
রাজশাহী ৬০। জনাব মােহাম্মদ আবদুল জলিল এমপি
নওগা ৬১। জনাব ডঃ এ এ এম মিসবাহুল হক এমপি
নবাবগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সর্বব্যাপক অবাধ দুর্নীতি, রাহাজানি, ডাকাতি, ছিনতাই, লুণ্ঠন, পাচার, গুম, খুন, দেশবাসীকে অতিষ্ট করিয়া তােলে। সরকারের ব্যর্থ প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক পলিসি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভারতীয় অর্থনীতির যােগানদার অর্থনীতিতে পরিণত করে, দেখা দেয় এক বিশ্বয় ফুল। পণদ্রব্যের মূল্য ক্রেতা সাধারণের আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যায়। ক্ষেতে-খামারে, কল-কারখানায়, উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হয়। কলে-কারখানায় কাঁচা পাটের গুদামে শুরু হয় অগ্নি সংলােপ ও স্যাবােটে। সর্বত্র দেখা দেয় ভােগ্যপণ্যের তীব্র অভাব, ১৯৭৪ সালের শেষার্থে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মৃত্যুবরণ করে অসংখ্য দেশবাসী। বিরােধী কণ্ঠকে বিনাবিচারে আটক করিবার নিমিত্ত বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন ও ইহার যথে
ব্যবহারে পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হইয়া শেখ মুজিব দেশব্যাপী ১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর জরুরী অবস্থা ঘােষনা করেন এবং তদানুসারে জরুরী আইন প্রণয়ন করা হয়। একইভাবে নিজ বুদ্ধির দোষে, নিজকর্ম দোষে শেখ মুজিব ও তাহার অাওয়ামী লীগ সমগ্র বাংগালী নেতার দুশমনে পরিণত হইতে থাকেন। যে শেখ মুজিব ১৯৬৯-৭০৭১-৭২ সালে ছিলেন বাংগালীর নয়নমণি তিনিই ১৯৭৩-৭৪ সালে রূপান্তরিত হইলেন বাংগালীর চক্ষুশূলে। একদা যিনি ছিলেন জনতার কাতারে তিনি ক্ষমতা ও কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখিবার অদম্য স্পৃহায় ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী সংবিধানে ৪র্থ সংশোধনী সংযােজন দ্বারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া এক দলের একনেতা হিসাবে রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হইলেন। তাহার নিজস্ব ক্ষমতার লােভ, একশ্রেণীর মেরুদন্ডহীন নেতা ও রাজনৈতিক কর্মী, নীতিজ্ঞানহীন বুদ্ধিজীবী ও চরিত্রহীন টেন্ডলের যােগসাজশে বাংলার সর্বত্র নগরে, বন্দরে, কলকারখানায়, গ্রামে-গঞ্জে, ক্ষেতে-খামারে দিল্লীর দাসেৱা আওয়াজ উঠাইতে থাকে- ‘এক নেতা এক দেশ-বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ।’ ১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক পটপরিবর্তন
এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ ও অমানিশার অবসান ঘটে বাংলা মায়ের সাতটি সন্তানের দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায় । মৃত্যুঘন্টা বাজে মুজিবী জালেমশাহীর। উদয় হয় অরুণ রাঙ্গ প্রভাত। অকুতােভয় এই সাতটি দামাল সন্তান যেন বাংলাদেশের সাত কোটি মুক্তিপাগল বাঙ্গালীর আশা-আকাংখার সাক্ষাৎ প্রতিনিধি। এক এক কোটির প্রতিনিধি যেন এক একজন। ইহারা হইতেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৭ জন অফিসার লেঃ কর্নেল রশীদ, লেঃ কঃ ফারুক, মেজর পাশা, মেজর হুদা, মেজর মহিউদ্দিন এবং পদচ্যুত মেজর ডালিম ও মেজর শাহরিয়ার। সেইদিন যেমন আপামর বাংগালী জনতা তাহার্দিগকে কৃতজ্ঞতাভরে হৃদয় নিংড়ানাে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন জানাইয়াছিল, তেমনি স্বাধীনচেতা বাঙ্গালী মাত্রই চিরকাল এই ৭ জন তরুণকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাইবে। বস্তুতঃ জাতীয় নেতৃত্বের অবিমৃষ্যকারিতা ও বিজাতীয় দাসত্বের শৃংখল হইতে মুক্তি পাওয়ার সূর্য সম্ভাবনা হিসাবেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট চিরকাল পরিগণিত হইবে। আজাদী পাগল বাংগালীর জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ১৫ই আগস্ট সত্যিই এক অনন্য দিবস। ইহা ছিল কার্যতঃ দিল্লী ও দিল্লীর দাসত্বের অশুভ শৃংখল মােচনের প্রথম পদক্ষেপ ও শুভ সূচনা। শেখ মুজিবের গৃহে প্রাপ্ত সম্পদ
৩০শে অক্টোবর (১৯৭৫) দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ মােতাবেক সাবেক প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নং সড়কে অবস্থিত ব্যক্তিগত বাসভবনে প্রাপ্ত সম্পদের বিবরণ ; ১। হীরা, মুক্তা, প্লাটিনাম ও স্বর্ণালঙ্কার- ৭ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা
বাংলাদেশী মুদ্রায় নগদ ৯৪ হাজার ৪ শত ৬১ টাকা,
২। ব্যক্তিগত মােটর গাড়ী- ৩টা, ৩। বৈদেশিক মুদ্রা- ১৭ হাজার ৫ শত টাকা, ৪। বিদেশী রাষ্ট্র প্রদত্ত ১ লক্ষ টাকার উপহার, ৫। বাতিলকৃত শতকী নােট- ৬ শত ২১ খানা, ৬। ১টি ভারী মেশিনগান, ২টি হালকা মেশিনগান, ৩টি এস,এম.জি, ৪টি
স্টেনগান, ৯০টি আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৬০টি গ্রেনেডসহ গােলাবারুদ
ইত্যাদি। শেখ হাসিনার দিল্লীতে আশ্রয় | নিহত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা ও তার স্বামী বৈজ্ঞানিক ডঃ ওয়াজেদ আলী মিয়া ও তাহাদের সন্তানদ্বয় পশ্চিম জার্মানীতে অবস্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের মারফত ভারতীয় রাজধানী দিল্লীতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া ২১শে আগস্ট (১৯৭৫) চলিয়া আসে। দিল্লীতে ৭ বৎসর অবস্থানের পর ১৯৮১ সালে ১৭ই মে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চেয়ারম্যান হিসাবে মা-বাবা-ভাই-বােনের মেঘেরা পরিবেশহারা ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করে। নিধুর রাজনৈতিক জগৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক স্নেহ-মায়া-মমতা-ভালবাসাকে সহ্য করে না ইহাই অকাট্য সত্য ও নির্মম বাস্তব। ভাসানীর অভিনন্দন : ভারতের প্রতিক্রিয়া
১৫ই আগস্ট বিপ্লবকে মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক পদক্ষেপ আখ্যায়িত করিয়া অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন আর ভারতীয় সরকারী মুখপত্র আগষ্ট পরিবর্তন সম্পর্কে বলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তনের গতিধারার প্রতিক্রিয়া আমাদের উপর না হওয়ার কোন অবকাশ নাই, কিন্তু এইগুলাে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলিয়া অভিমত প্রকাশ করেন।
(১৭-৮-৭৫, বাংলাদেশ টাইমস)। ইমাম মদিনীর ওয়ালাইকুম আসসালাম
| ১৫ই আগষ্ট শুক্রবার জুমার নামাজ আদায়কালে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের ইমাম মদিনী সাহেব বলেন যে, আমাদের প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ দেশবাসীকে আসসালামু আলাইকুম বলেছেন আমি প্রতুত্তরে তাকে ওয়ালাইকুম আস্সালাম জানাই।
অন্যদিকে নিরীশ্বরী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পুনরায় অন্ত্র বলে ঢাকায় ক্ষমতায় বসাইয়া দিবে প্রত্যাশায় ৪০ জনের অধিক সংসদ সদস্য ও টাংগাইলের গভর্নর কাদের সিদ্দিকী সীমান্ত অতিক্রম করিয়া ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। হায় আশা কুহকিনী।
১৫ই আগস্ট (১৯৭৫) খন্দকার মােশতাক আহমদ অভূথিনি ও পরিবর্তনের
অগ্রদূতদের অনুরােধে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং জাতীয় জীবনের সেই ঝঞাসঙ্কুল উত্তাল তরঙ্গে শক্ত ও সুনিপুণ হতে রাষ্ট্রীয় তরণীর হাল ধরেন।
১৫ আগস্ট খন্দকার মােশতাকের ভাষণ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা,
এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঠিক ও সত্যিকারের আকাংখাকে বাস্তবে রূপদানের পূত-পবিত্র দায়িত্ব সামগ্রিক ও সমষ্টিগতভাবে সম্পাদনের জন্য পরম করুণাময় অলিহিতায়ালী ও বাংলাদেশের গণমানুষের দোয়ার উপর ভরসা করে রাষ্ট্রপতি হিসাবে সরকারের দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। বাংলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বজ্রকঠিন দায়িত্ব সম্পাদনের পথ সুগম করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীজের মতো অকুতভয় চিত্তে এগিয়ে এসেছেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, নৌ-বাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী সরকারের প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্য ও আস্থা প্রকাশ করেছেন। এরা সবাই একযােগে কাজ করে যাচ্ছেন।
৩০ লক্ষ বীর শহীদানের পূত রক্ত এবং দু’লক্ষ মা-বােনের পবিত্র ইজতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাংলার সংগ্রামী মানুষকে নতুন জীবনের আস্বাদ ও সন্ধান দেবে এবং স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সুখী ও সমৃদ্ধ জাতি হিসাবে বিশ্ব দরবারে আমরা মাখা উচিয়ে দাড়াবাে, এই ছিলাে আমাদের লক্ষ্য ও কামনা। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বন্ধুদেশের অনেকেরই আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। কিন্তু বিগত দীর্ঘকাল দেশের ভাগ্য উন্নয়নের কোনাে চেষ্টা না করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা এবং সেই ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে রাখার ষড়যন্ত্রের জাল রচনা করা হয়েছিল। এই উদ্দেশ্যে নিরবচ্ছিভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দাবার চাল চালা হয়েছে এবং দেশবাসীর ভাগ্য উন্নয়নকে উপেক্ষা করে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অন্যকে বঞ্চিত করে একশ্রেণীর পৃষ্ঠপােষকদের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত করা হয়েছে। কতিপয় ভাগ্যবানের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টায় জনগণের জীবনে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান অগ্নিমূল্য অসহনীয় হয়ে পড়ে। দেশের শিল্প, বিশেষ করে পাটশিল্প ধ্বংসের মুখে। অর্থনৈতিক অবস্থা এমন এক পর্যায়ে এসে পৌছায়, যেখানে বাংলার সর্বশ্রেণীর মানুষ দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অর্থনৈতিক নির্যাতনের অসহায় শিকারে পরিণত হয়।
একটি বিশেষ শাসকচক্র গড়ে তােলার লােলুপ আকাংখায় প্রচলিত মূল্যবােধের বিকাশ ও মানুষের অভাব-অভিযােগ প্রকাশের সম্মত পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। এই অবস্থায় দেশবাসী একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অব্যক্ত বেদনায় তিলে তিলে
নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। | দেশের শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন সর্বমহলের কাম্য হওয়া সত্ত্বেও বিধান অনুযায়ী। তা সঞ্চৰ না হওয়ায় সরকার পরিবর্তনের জন্য সামরিক বাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী পরমতম নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করে দেশবাসীর সামনে সম্ভাবনার এক স্বর্ণদ্বার উন্মােচন করেছেন। এখন দেশবাসী সকল শ্রেণীর মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্রুত নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নে নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোরতর পরিশ্রম করতে হবে।
সর্বপ্রকার কলুষ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। দেশে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মানুষ যাতে মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে জন্য সমাজে মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। | দেশপ্রিয় সকল নাগরিককে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সর্বাবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ মুসলমান, হিন্দু, খৃষ্টান, বৌদ্ধ প্রভৃতি সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রীতি ও সম্প্রীতি অটুট রাখতে হবে। সমাজের প্রতি স্তরে প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে সকলকে সেই অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। শাস্তি ও শখলার সঙ্গে দেশবাসীকে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালু রাখতে হবে। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সমতা ও সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবােধ ও প্রত্যেক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা এবং একে অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অব্যাহত থাকবে। সরকার জোটনিরপেক্ষ নীতি সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করে যাবেন।
আমাদের সরকার জাতিসংঘ সনদ ও নীতিমালার প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। দ্বিপাক্ষিক বা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের সম্পর্ক নির্ধারণকারী সকল চুক্তি ও সায় সম্পর্কে সরকার মর্যাদাশীল থাকবে। | বর্ণবাদ, বর্ণবৈষম্যবাদ, উপনিবেশবাল এবং নয়া উপনিবেশবাদ বিরােধী আমাদের নীতি অব্যাহত থাকবে। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ এবং জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অটুট থাকবে। এইসব মাের্চার সর্বপ্রকার তৎপরতার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সহযােগিতা ও শরীকানা অব্যাহত থাকবে। বিশ্বশান্তি ও আন্তর্জাতিক সহযােগিতা দৃঢ়তর করার প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখবাে। এখনাে পর্যন্ত যাদের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হয়নি, সেইসব দেশের সঙ্গেও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইনশাল্লাহ আমরা সচেষ্ট হবাে। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়’- এই নীতির রূপরেখার মধ্যে আমরা শান্তি ও প্রগতির পথে আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবাে।
সরকার বিশেষভাবে উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা নিচ্ছে। ইসলামী সম্মেলন, কমনওয়েলথ রাষ্ট্রসমূহ, জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন ও বৃহৎ
শক্তিসমূহের সঙ্গে এই সরকার ঘনিষ্ঠতর এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। সরকার ইসরাইলের কবল থেকে আরব পুণ্যভূমি পুনরুদ্ধারের জন্যে আরব ভাইদের ন্যায়সংগত সংগ্রামে ও ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য দাবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছে। | প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দিতে চাই যে, কোনপ্রকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা সামাজিক কলুষতার সঙ্গে এই সরকারের কোন আপােষ নাই। আমাদের সামনে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন এক অভূতপূর্ব সুযােগ। সেই সঙ্গে আপনাদের সামনে রয়েছে বিরাট চ্যালেঞ্জ।
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আসুন আমরা পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার কাছে কায়মনােবাক্যে এই মােনাজাত করি, তিনি যেন আমাদের সহায় হন এবং তাঁর অপার করুণায় আমাদের সঠিক পথে চালিত করেন। খোদা হাফেজ। মােশতাকের মন্ত্রিসভা
প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ সমবায়ে তাহার সরকার গঠন করেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মােহাম্মদ উল্লাহসহ ১০ জন কেবিনেট মিনিস্টার হইলেন;
১. আবু সাঈদ চৌধুরী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী: ২, প্রফেসর ইউসুফ আলী, পরিকল্পনামন্ত্রী; ৩, বাবু ফণীভূষণ মজুমদার, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী; ৪. জনাব সোহরাব হোসেন, পূর্ত ও নগর উন্নয়ন; ৫. জনাব আবদুল মান্নান, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা; ৬, বাবু মনােরঞ্জন ধর, আইন, পার্লামেন্টারী বিষয়ণী ও বিচার; ৭, দুজনাৰ আবদুল মমিন, কৃষি ও খাদ্য; ৮, জনাব আসাদুজ্জামান খান, বন্দর, জাহাজ ও আভ্যন্তরীণ জলযান: ৯, ডঃ আজিজুর রহমান মল্লিক, অর্থ; ১০, ডঃ মােজাফফর আহমদ, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক, করিশ্মীর গবেণী ও আণবিক শক্তি।
১১ জন স্টেট মিনিস্টার হইলেন;
১. দেওয়ান ফরিদ গাজী, বাণিজ্য, পেট্রোলিয়াম ও খনিজ; ২. মােমেনউদ্দিন আহমদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ ও বিদ্যুৎ ৩, প্রফেসর নুরুল ইসলাম চৌধুরী, শি; ৪, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, বিমান, পর্যটন, ভূমি, প্রশাসন ও সংস্কার; ৫. জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, ইনফরমেশন, ব্রডকাস্টিং, লেবার, স্যোসাল ওয়েলফোর, কালচারেল এফেয়ার্স ও স্পাের্টস; ৬. জনাব মােসলেমউদ্দিন খান, পাট; ৭. জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, যােগাযােগ ও রেলওয়ে; ৮. কে এম ওবায়দুর রহমান, ডাক, তার ও টেলিফোন; ৯, ডাঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, সাহায্য ও পুনর্বাসন; ১০. জনাব রিয়াজউদ্দিন আহমদ, বন, মৎস্য ও পশু; ১১. সৈয়দ আলতাফ হোসেন, যোগাযোগ, রােভস, হাইওয়েজ ও রেজিস ট্রান্সপাের্ট।
হাজী দানেশের অভিনন্দন | ৪ঠা সেপ্টেম্বর (১৯৭৫) হাজী মােহাম্মদ দানেশ এক বিবৃতিতে দেশে যেভাবে এক ব্যক্তির শাসন প্রতিষ্ঠিত হইতে চলিয়াছিল উহা নস্যাৎ করিয়া দেওয়ার জন্য দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মূলােচ্ছেদের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা এবং ঘােষিত পররাষ্ট্রনীতির জন্য খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকার নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যােগ্য। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জনগণের প্রতি সরকারী আহবান সমর্থন করিয়া বর্ষিয়ান নেতা সরকারের প্রতি তাহার পূর্ণ সহযােগিতার কথা ঘােষণা করেন। হাজী দানেশ বলেন, সমগ্র জাতির সক্রিয় সহযােগিতার মাধ্যমেই পৰ্বপ্ৰমাণ সমস্যার সমাধান করা যাইতে পারে এবং দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশেই উহা সম্ভব।
উল্লেখ্য, এই হাজী মােহাম্মদ দানেশই জেঃ আইউব-এর সামরিক শাসনকালে আইউব-এর অনুরক্ত, একদলীয় বাকশালের শাসন আমলে বাকশাল সদস্য, জেঃ জিয়ার সামরিক শাসনগর্ভে জন্ম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সদস্য, আবার লেঃ জেঃ এরশাদ-এর সামরিক শাসন গর্ভে জন্ম জাতীয় সংসদ ও বাংলাদেশে সামরিক কর্তাদের দলীয় সদস্য হইতে এতটুকু বিবেক দংশন বােধ করেন নাই। জনাব আতাউর রহমান খানও একই ধারায় বাকশালে, সামরিক শাসক জেঃ জিয়ার দোসর হওয়ার কার্যক্রমে ব্রত হন এবং সামরিক শাসক জেঃ এরশাদ-এর প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন- কি বিচিত্র ও অনুকরণীয় নেতৃ চরিত্র!
অ্যুত্থানের মূল সুরকে রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক ও জনজীবনে রূপদানের মহৎ উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রপতি খন্দকার মােশতাক আহমদ ১৯৭৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ তথা একদলীয় রাজনীতি আইন বাতিল করেন। ইতিপূর্বে ১৯৭৫ সালের ২৮শে আগষ্ট ৬১টি জেলার গভর্নর নিযুক্তি আদেশ বাতিল করেন। ২২শে আগস্ট (১৯৭৫) এক প্রশাসনিক আদেশে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদকে সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতঃ মুল মালিকের নিকট হস্তান্তর করিয়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ২২শে আগস্টেই তিনি রাষ্ট্রপতি আদেশ ৯ (পি, ও, ৯) বাতিল করেন ও সরকারী কর্মচারীদের মনে নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস পান। সর্বোপরি ৩ অক্টোবরের বেতার ভাষণে তিনি ইহাও ঘোষণা করেন যে, আগামী ১৫ই আগস্ট (১৯৭৬) হইতে দেশব্যাপী রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শুরু হইৰে। ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৭৭) তারিখে সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিক্তিতে মূতম সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। তিনি ইহাও ঘােষণা করেন যে, সকল রাজবন্দীর বিনাশর্তে মুক্তি প্রদান করা হইবে এবং অতঃপর রাজনৈতিক কারণে কাহারাে বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি করা হইবে না। এইভাবেই বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠন, বহুদলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা, মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রবর্তন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নব অধ্যায় সূচিত হয় খন্দকার মোশতাক আহমদের বলিষ্ঠ
নেতৃত্বে ও সিদ্ধান্তে। বস্তুতঃ খন্দকার মােশতাক আহমদের ৩রা অক্টোবরের ঘােষনা ছিল এক কথায় ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার সুমহান আদর্শের প্রতি অবিচল। আস্থা ও বিশ্বাসেরই প্রতিধ্বনি। ৩রা নভেম্বর
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বিপ্লবী অ্যুত্থানের পাল্টা জবাৰে ৩রা নভেম্বর (১৯৭৫) মুক্তিযুদ্ধকালে ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে দিল্লী-মস্কো আখ্যায়িত সামরিক অ্যুথানে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ সরকারের পতন ঘটায়। দিল্লী-মস্কো ৰশংবদ সাক্ষী গােপাল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ক্ষমতায় পাকা-পােক্তভাবে আসীন হওয়ার প্রয়াসকালেই ৬ই নভেম্বর দিবাগত রাত্রে দেশপ্রেমিক জর্তিীয়তাবাদী সিপাহী-জনতার অ্যুত্থান হয় এবং অদ্যুখানকালে পলায়নের সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ পথিমধ্যে শেরেবাংলা নগরে নিহত হন। | ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতা সফল অভূত্থানের পর প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মােহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক-এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অবশ্য ইতিপূর্বে নিহত ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ নিজেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক-এর দায়িত্ব গ্রহণ করে ও প্রধান বিচারপতি আৰু সাদত মােহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে মনােনীত করে। ৬ই নভেম্বরে সায়েমের ভাষণ
প্রিয় দেশবাসী,
আসসালামু আলাইকুম। আজ এক সংকটময় মুহূর্তে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জনগণের সহযােগিতার উপর দৃঢ় আস্থা রাখিয়া আমি রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছি।
দেশের স্বাধীনতা এবং আপামর জনসাধারণের ও আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী-সমৃদ্ধিশালী জীবন নিশ্চিত করার জন্য যে লক্ষ লক্ষ ডাই ও বােনেরা আত্মাহুতি দিয়াছেন এবং জীবন বিপন্ন করিয়াছেন, আজ সর্বান্তঃকরণে তাহাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করিতেছি। যে আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হইয়াছিলাম, স্বাধীনতার প্রায় দীর্ঘ চার বত্সর পরেও তাহার আশানুরূপ বাস্তবায়ন হয় নাই। ফলে জনসাধারণ আজও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত। তাহাদের মনে হতাশা ও নিরাপত্তাবােধের অভাব। দেশের সাধারণ মানুষের এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রভূত আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ প্রতিফলিত হয় নাই।
| আমরা বর্ণবলি, বর্ণবৈষম্যবাদ এবং নয়া উপনিবেশবাদ বিরােধী নীতি অনুসরণ করিয়া যাইব। ইসলামী সম্মেলন, জোটনিরপেক্ষ ও কমনওয়েলথ সম্মেলনের সংগে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযােগিতা বজায় থাকিবে। বিশ্বশান্তি এবং আন্তর্জাতিক
সহযােগিতা দৃঢ়তর করিবার প্রচেষ্টায়ও আমরা সক্রিয় থাকিব। এখনাে পর্যন্ত যে সব রাষ্ট্রের সহিত আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় নাই, সে সব দেশের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমরা প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব। ‘সকলের। প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়’- এই প্রতিপাদাই হইবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মূল ভিত্তি।
আমরা উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব। একই সাথে আমরা আমাদের নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরাে জোরদার করিবার লক্ষ্যে নিষ্ঠাবান থাকিব এবং বৃহৎ শক্তিসমূহের সঙ্গে আমাদের সরকার ঘনিষ্ঠতর বন্ধুত্বপূর্ণ সহযােগিতা চালাইয়া যাইবে। | ইসরাইলের কবল হইতে পবিত্র আরবভূমি পুনরুদ্ধানের জন্য এবং আরব ভাইদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম ও ফিলিস্তিনী জনগণের ন্যায্য দাবী প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের প্রতি আমরা আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রাখিব।
পরিশেষে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়ন এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধানে আপনাদের সর্বাত্মক সহযােগিতা কামনা করি। ইনশাআল্লাহ, অমিরা সফলকাম হইব।।
খোদা হাফেজ,
বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।” খালেদ মােশাররফের পদোন্নতি ও জিয়ার পদত্যাগ
৪ঠা নভেম্বর (১৯৭৫) প্রেসিডেন্টের এক বিশেষ ঘােষণায় বলা হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বীর উত্তম পিএসপি’কে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর পূর্বাহ্ন হইতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করিয়া চীফ অব আর্মি স্টাফ নিয়ােগ করা হইয়াছে। একই দিনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম পিএসসি পদত্যাগ করায় তিনি তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইয়াছেন।
৩রা নভেম্বর অদ্যুথানের নায়ক ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ কর্তৃক আটক সেনাপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দীদশা হইতে ৭ই নভেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত হইয়া পুনরায় সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়ার পদত্যাগের আদেশ বাতিল
এতদ্বারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বি.ইউ, পি,এস,সি-এর পদত্যাগ গ্রহণ সম্পর্কিত ৩রা নভেম্বর (১৯৭৫)-এর আদেশটি বাতিল করা হইল। শুক্রবার ঢাকায় সরকারীভাবে এই ঘােষণা করা হয়। ফলশ্রুতিতে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ বি, ইউ,পি,এস,সি-এর চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসাবে নিয়ােগ এবং তাহার মেজর জেনারেল হিসাবে উন্নীত হওয়া সংক্রান্ত আদেশটিও বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।
৩রা নভেম্বর অচ্যুত্থানের পর প্রধান বিচারপতি আবু সাদত মােহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ কর্তৃক নিযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও পুনরায় ৭ই নভেম্বর সফল সিপাহী-জনতার অভুত্থানের পরও রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত রহিলেন। ৭ই নভেম্বরে জিয়ার ভাষণ
নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে ঘােষণা করিয়া ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ইং জােরে রেডিও বাংলাদেশ হইতে জাতির উদ্দেশ্যে প্রণয় এক ভাষণে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেন :
| প্রিয় দেশবাসী- আস্সালামু আলাইকুম- আমি মেজর জেনারেল জিয়া বলিতেছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, আনসার এবং অন্যানাের অনুরােধে আমাকে সাময়িকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চীফ মার্শাল ল এডমিনিস্ট্রেটর ও সেনা বাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে হইয়াছে। এই দায়িত্ব ইনশাল্লাহ আমি সুষ্ঠুভাবে পালন করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।
আপনারা সকলে শান্তিপূর্ণভাবে যথাস্থানে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করুন।
দেশের সর্বত্র অফিস-আদালত, যানবাহন, বিমানবন্দর, মিল-কালখানাগুলি পূর্ণভাবে চালু থাকিবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হউন।
খােদা হাফেজ,
বাংলাদেশ-জিন্দাবলি। * বলা দরকার ৭ই নভেম্বর এর সেনা অভুথানের মধ্য দিয়ে সেনা সদস্যরা তাকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করেন। তিনি বেতার ভাষণে নিজেই নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। তখনাে আবু সাদাত মােঃ সায়েম দেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। একই দিনে প্রেসিডেন্ট সায়েম জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান এবং উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়ােগ দেন। উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে জিয়াউর রহমান প্রথমে নিজেকে দেশের সরকার প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই জিয়াউর রহমানই পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে অনুষ্ঠিতব্য দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে প্রেসিডেন্ট সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন এবং তাঁর। মনের গহনে লালিত দীর্ঘদিনের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন। ৭ই নভেম্বরে মােশতাকের ভাষণ
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আসসালামু আলাইকুম। অজি বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর বীর সৈনিকরা,
বিডিআর, পুলিশ ও আনসার বাহনীর বীর সদস্যরা, জনসাধারণ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুবক, সকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখার জন্য যে অভূতপূর্ব বিপ্লব সংঘটিত করেছেন তা দেখে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় আমার চিন্তু আজ আবেগআপু এবং এই বীরদের প্রতি আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাই। একমাত্র পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার অনন্তু ঐশী শক্তির সফল প্রয়ােগের মাধ্যমেই এই বিপ্লবের ইতিহাস রমনী সব বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার কাই আমি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে শুকরিয়া আদায় করি । আজকের বিপ্লবের সকল নায়কদের প্রতি অভিনন্দন জ্ঞাপন করি।
এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছ থেকে আমি ও আমার স্বল্পকালীন সরকার অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট থেকে ২রা নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যমান সরকার যে সহানুভূতি পেয়েছে, মানুষ হিসেবে আমাদের সীমাবদ্ধ প্ৰষ্টার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে এর চাইতে বেশী কিছু দাবী আমার নেই। আমাদের সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য আপনাদের সার প্রতি সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাচ্ছি। | গত ২রা নভেম্বর থেকে আজকের দিন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দেশে বিদ্যমান সে সম্পর্কে আপনারা ওয়াকিফহাল আছেন। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি আলােচনা করতে চাই না। কারণ, এই পরিস্থিতি আজকের বিপ্লবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত রচনা করেছে। এবং সকলের সঙ্গে জাতীয় সত্ত্বাকে আপন মহিমায় বিধৃত করেছে। জাতীয় সত্ত্বার এই মহিমাকে কর্মে প্রয়ােগের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন শক্তিকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠন এবং সমাজকে কলুষমুক্ত করাই এই মুহূর্তের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের গ্রহণযােগ্যতা সম্পর্কে যেমনি জনগণের মধ্যে মতৈক্য থাকা উচিত, তেমনি জনগণ নিৰ্বিধায় গ্রহণ করতে পারে সরকারের গঠনপদ্ধতি এমনি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসীর কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের জন্য আমার কাছে প্রতার্ত নাৰী আসা অব্যাহত রয়েছে। আপনাদের প্রাণঢালা ভালােবাসা ও বিশ্বাসের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাদের বিশ্বাস বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের কর্ণধার হিসেবে আঞ্জ এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন যিনি হবেন সম্পূর্ণ নির্দলীয় এবং অরাজনৈতিক। এইসব শর্তাদি পালনের জন্য দেশের প্রধান বিচারপতি বর্তমানে যেভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আছেন তাই শােভন ও সুন্দর বলে আমি মনে করি। বিচারকের বিচক্ষণতা ও নিরপেক্ষতা দিয়ে তিনি জাতিকে তার নির্ধারিত কক্ষপথে পরিচালিত করতে পারবেন আশা করাটা নিঃসন্দেহে অপ্রত্যাশা নয়। তাই আমি আজ কে এই জাতীয় দায়িত্ব পালন করতে অনুরােধ জ্ঞাপন করেছি। | যে দায়িত্ব মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে দিয়েছিলেন, সে দায়িত্বের পরিমণ্ডল আমি অতিক্রম করেছি। তথাপি দেশের নগণ্য সেবক হিসেবে আমি আপনাদের সঙ্গেই আছি। কর্মী হিসেবে যেখানেই প্রয়োজন থাকবে ইনশাআল্লাহ আমি নিশ্চয় কর্মের মাধ্যমে সেখানে দেশবাসীর সঙ্গে উপস্থিত থাকবে। দেশবাসীর দোয়া ও আল্লাহর রহমত ছাড়া
আমার আর কিছুই কাম্য নেই।
আমার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর সংকটকালীন এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পরিসমাপ্ত হয়েছে। দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী এই কর্মবীর যা করেছেন তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
আমার প্রিয় ভাই ও বােনেরা,
আমাদের দেশ ছােট কিন্তু জাতি বড়। এর প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে হায়েনার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তি ও সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায়। আবার এর প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। কলে-কারখানায় পেশী নিংড়ানাে শ্রমে সর্বাপেক্ষা বেশী উৎপাদন করতে হবে। অতঃপর পরস্পরকে সুখী ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টায় সকলকে এক জাতীয় মহাপ্রয়াসে নিয়ােজিত হতে হবে নিবেদিত চিত্তে। | আজকের বিপ্লবে যেভাবে প্রতিজন সিপাহী এবং নাগরিক সিপাহসালারের ভূমিকা
রছেন, তেমনি সামনের প্রতিটি দিনেই আপনাদের সচেতনতাকে চির সজীব রাখতে হবে। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা আমাদের সহায় হােন।
খােদা হাফেজ,
বাংলাদেশ-জিম্মাবাদ। ৭ই নভেম্বরে সায়েমের ভাষণ
“বিসমিল্লাহের রাহমানের রাহীম। প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, আস্সালামু আলাইকুম।
গতরাতে আপনাদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে কি পরিস্থিতিতে আমাকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে, তার কিছুটা আভাস আমি দিয়েছি। প্রেসিডেন্টের পদে। খন্দকার মােশতাক আহমদের পুনর্বহাল হওয়ার পক্ষে স্বতাপূর্ত দাবী সত্ত্বেও তারই অনুরােধক্রমে আমি প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছি। খন্দকার মােশতাক আহমদের দেশব্যাপী জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের যে মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তা যে কোন উন্নয়নশীল দেশে বিরল এবং সেই দেশের জনগণের জন্য গর্বের বিষয়।
আমার গতরাতের ভাষণে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং সরকার পরিচালনার পদ্ধতি সম্পর্কে আমি কিছুটা আলােকপাত করেছি। দেশে আইনের শাসন, নিরপেক্ষ প্রশাসন এবং অবাধ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা সম্পর্কেও আমি গতাতে আপনাদের অবহিত করেছি।
গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণের প্রচেষ্টার সাথে সাথে আমাদেরকে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। কেননা, আমাদের
জনগণের দারিদ্র্য এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের আর কোন পথ নেই। এ জন্যে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন, বলার সাথে কঠোর পরিশ্রম করা, কলেকারখানায়, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং একই সাথে অধিক পণ্যসামগ্রী রফতানীর মাধ্যমে অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্যও প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এভাবেই আমরা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম হব।
সুখী এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে আমাদের সর্বশ্রেণীর জনগণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এ উদ্দেশ্যে যথাযথ সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমাদের ছাত্র এবং যুব সমাজকে গঠনমূলক কর্মোদ্যমে অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং তাদের সৃজনী প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালনার জন্য আমরা কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দেশে সামরিক আইন প্রশাসন কাঠামাে গঠন করা হয়েছে। | এই কাঠামােতে প্রেসিডেন্ট স্বয়ং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবেন। এতে তিনজন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকবেন। তারা হচ্ছেন, সেনাবাহিনী প্রধান, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, নৌ-বাহিনী প্রধান কমােডর মােশাররফ হােসেন খান। এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তােয়াব। দেশের চারটি বিভাগে চারজন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক থাকবেন।
জননেতাদের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হবে। এই পরিষদ, জনগণের আশা-আকাক্ষা সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করবেন এবং পরামর্শ দিনে।
সরকারী নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব বেসামরিক কর্মকর্তাদের উপর ন্যস্ত থাকবে।
| আমি ঘােষণা করছি যে, শুধু রাজনৈতিক আদর্শগত কারণে যে সব জননেতা আটক আছেন, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়া হবে।
পরিশেষে আমি আশা করব যে, নতুন কর্তব্যবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা সততা ও আন্তরিকতার সাথে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করে যাবে, বর্তমান সুযােগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করব। শুধু এর মাধ্যমেই ন্যূনতম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা বাতি অগ্রগতি সাধনে সফলকাম হতে পারি।
আপনাদের সার্বিক সহযােগিতায় ইনশাল্লাহ আমরা অচিরেই আমাদের অতীষ্ট লক্ষ্যে পৌছুতে সক্ষম হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
খােদা হাফেজ, বাংলাদেশ-জিন্দাবাদ।
suf TC4C -166YE ’90 91 (Proclamation)
GOVERNMENT OF THE PEOPLES REPUBLIC OF BANGLADESH MINISTRY OF LAW, PARLIAMENTARY AFFAIRS AND JUSTICE
(Law and Parliamentary Affairs Division). Notification Dacca, the 8th November 1975
No. 774-Law- The following Proclamation made by the President of the Peoples Republic of Bangladesh, on the 8th November, 1975 is hereby published for general information:
PRESIDENT’S SECRETARIAT PROCLAMATION The 8th November, 1975
Where as the whole of Bangladesh has been under Martial Law since the 15th day of August, 1975; AND WHEREAS Khandaker Moshtaque Ahmed. Who placed the country under Martial Law, has made over the office of President of Bangladesh to me and I have entered upon that Office of 6th day of November, 1975.
AND WHEREAS in the interest of peace order security, progress, prosperity and development of the country. I deem it necessary to keep in force the Martial law proclaimed on the 15th August, 1975; AND WHEREAS for the effective enforcement of Martial Law it has become necessary for me to assume the powers of Chief Martial Law Administrator and to appoint Deputy Chief Martial Law Administrators and to make some modifications in the proclamation of the 20th August, 1975;
NOW, THEREFORE, I, Mr. Justice Abu Sadat Mohammad Sayem, President of Bangladesh, do hereby assume the power of Chief Martial Law Administrator and appoint the Chief of Army Staff Major General Ziaur Rahman B.U. Psc… as Deputy Chief Martial Law Administrator and declare that
(c) Parliament shall stand dissolved and be deemed to be so dissolved with effect from the 6th day of November, 1975 and general elections of Members of Parliament shall be held before the end of February, 1977;
(d) The presons holding office as Vice-President, Speaker, Deputy Speaker, Ministers, Ministers of State, Deputy Ministers and Whips, immedeately before this Proclamation, shall be deemed to have ceased to
hold office with effect from the 6th day of November, 1975.
A.M. SAYEM
President
AND
Chief Martial Law Administrator জাসদের হঠকারিতা
১৯৭২ সালের ৩০শে অক্টোবর জেনারেল ওস্তানের প্ররােচণায় গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নাকি ৭ই নভেম্বর অ্যুথানে সামরিক বাহিনীর একাংশের সহিত সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিল বিধায় সামরিক বাহিনীর সহিত অ্যুত্থানে জড়িত অতি উৎসাহী কয়েকজন ট্যাঙ্কসহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক আ স ম আবদুর রবসহ জাসদ নেতৃবৃন্দকে ৮ই নভেম্বর কারামুক্ত করে। তাহাদের এই হঠকারী অতি বিপ্লবী ভূমিকার কারণে জনমনে ভীতি সঞ্চার হয়। বাধ্য হইয়া সরকার ২৩শে নভেম্বর (১৯৭৫) জাসদের মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব এবং কর্নেল তাহেরসহ নেতৃবৃন্দকে পুনঃগ্রেফতার করে ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখে। ইহার পাল্টা জবাবে জাসদ প্রেরিত এক সশস্ত্র স্কোয়াড বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে ভারতীয় হাই কমিশন অফিস প্রাঙ্গণ হইতে অপহরণ করিবার (Kidnap) এক দুঃসাহসিক ব্যর্থ প্রচেষ্টা নেয়।
আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করিয়া একটি বিবৃতি প্রদান করি। পত্রিকায় প্রকাশিত বিবৃতিটি নিয়ে দেওয়া হইল;
“ভারতীয় হাই কমিশনার মিঃ সমর সেন যে ঘটনায় শরীরে আঘাত পাইয়াছেন, ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনে আজ সকালে সংঘটিত উক্ত ঘটনা সম্পর্কে জানিতে পারিয়া আমরা মর্মাহত হইয়াছি।”
“আমরা একদল লােকের এহেন কাপুরুষােচিত ও জঘন্য অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করিতেছি। ঘটনাটি দৃশ্যতাই রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির পরিচায়ক এবং বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই ইহা করা হইয়াছে।”
“ভারতীয় হাই কমিশনারের উপর পরিচালিত আক্রমণ প্রতিহত করিবার ক্ষেত্রে কর্তব্যরত বাংলাদেশ পুলিশ ও রক্ষীদের উপযুক্ত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আমরা প্রশংসা করি।”
“আমরা আশা করি যে, সরকার কর্তৃক গৃহীত আত কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সকল মহল কর্তৃক প্রশংসিত হইবে।”
উপরােক্ত যুক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন সর্বজনাৰ অতািউর রহমান খান, তােফাজ্জল আলী, উঃ আলিম-আল-রাজি, মশিউর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান, অধ্যাপক মােজফফর আহমদ, আসাদুজ্জামান খান, কাজী জাফর আহমদ, অলি আহাদ ও রাশেদ খান মেনন। (ইত্তেফাক ২৭/১১/৭৫) | ১৫ই আগষ্ট দুঃসাহসিক অ্যুথানের মাধ্যমে যে সূর্যসেনারা ভারতীয় নাগপাশ হইতে মুক্ত হওয়ার স্বর্ণদ্বার খুলিয়া দিয়াছিল তাহারা ৩রা ও ৭ই নভেম্বর অদ্যুত্থানের কারণে অধিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষ হইতে একই পারিতোষিক পেয়েছে- ভিনদেশ লিবিয়ায় নির্বাসন জীবনযাপন। কি অদ্ভুত ভাগ্যের লিখন। কি অদ্ভুত কৃতজ্ঞতা জ্ঞান।
জেল হত্যা
প্রসঙ্গত উল্লেখ করিতে হয় যে, ১৫ই আগস্টের বিপ্লবী পট-পরিবর্তনের পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী, মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রী কামরুজ্জামানসহ অন্যান্যকে গ্রেফতার এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। পরিতাপের বিষয় ১৯৭৫ সালের ২রা ও ৩রা নভেম্বর মধ্যবর্তী রাত্রিতে কারাগারে নৃশংসভাবে উপরােক্ত চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ইহা সুস্থ ব্যক্তির কল্পনার অঙ্গীত- বিপ্লবী সিরাজ সিকদারকে গ্রেফতারের পর পুলিশ প্রহরাধীন আটক থাকাকালে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এই ধরনের হত্যাকান্ড হিটলারের জার্মানীতে ও স্ট্যালিনের রাশিয়াতে অহরহ হইয়াছে- সভ্য সমাজে যাহা চিন্তাও করা যায় না। মােশতাকের নেতৃত্ব
আমরা বাংলা জাতীয় লীগের পক্ষ হইতে দিল্লীর দাসত্ব মােচনের দাবীতে সমগ্র দেশে ‘আজাদ বাংলা’ আন্দোলনের সূচনা করিয়াছিলাম এবং সর্বপ্রকার প্রতিকুলতার ‘মােকাবেলায় জেল, জুলুম, দৈহিক অত্যাচার ও প্রাণনাশের হুমকিকে তােয়াক্কা না করিয়া আজাদ বাংলা আন্দোলনকে শক্তিশালী করিবার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাইয়াছিলাম। ১৫ই আগষ্ট খন্দকার মােশতাক আহমদ দিল্লীর দাসত্ব মােচনের যে বলিষ্ঠ ও দৃঢ়তাব্যঞ্জক অভিমত ব্যক্ত করিয়াছিলেন, তাহা আজাদ বাংলা আন্দোলনের মর্মবাণী হইতে মোেটও পৃথক নয়।
উল্লেখ্য যে, খন্দকার মােশতাকের এই দৃঢ়তা দিল্লীর মসনদে অধিষ্ঠিত শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সকল কারসাজিকেও ব্যর্থ করিয়া দিয়াছে। শুধু তাই নয়, তাঁহার নেতৃত্বে ঐক্য ও ঈমানের মন্ত্রে দীক্ষিত ৭ কোটি বঙ্গ সন্তান অত্যন্ত শৃংখলার সহিত জাতীয় জীবনের সকল অমূলক, অকল্যাণ ও অশুভ প্রভাব-প্রতিপত্তিকে মুছিয়া ফেলিতেও সচেষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। জাতীয় জীবনের আভ্যন্তরীণ এই কল্যাণ প্রয়াস বহির্বিশ্বেও সমভাবে অভিনন্দিত হইয়াছে। ইহার প্রত্যক্ষ সুফল, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা জনবহুল ও তৃতীয় বিশ্বশক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই ৩০শে আগষ্ট (১৯৭৫) তঁাহার বার্তায় বলিয়াছিলেন, “গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকারের পক্ষ হইতে সসম্মানে আপনাকে জানাইতেছি যে, চীন সরকার আজ হইতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেছে। আমি নিশ্চিত যে, আমাদের দুই দেশের জনগণের চিরাচরিত বন্ধুত্ব দৃঢ়ভাবে বৃদ্ধি পাইবে।”
উল্লেখ্য যে, চীনের অভিযােগ ছিল, শেখ মুজিব এবং তাহার সরকার দিল্লীর পুতুলমাত্র এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। তাই মুজিব আমলে অনবরত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নাই। এইদিকে আরব জাহানের তথা মুসলিম জাহানের মধ্যমণি সউদী আরবও একই কারণে দিল্লীর দাস মুজিব সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানাইয়া আসিতেছিল। কিন্তু খন্দকার মােশতাক আহমদ দেশের দায়িত্বভার গ্রহণের পর পরই ১৬ই আগষ্ট সউদী আরবের বাদশাহ খালেদ বাংলাদেশকে কেবল স্বীকৃতিই দেন নাই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডত্ব বজায় রাখিবার ব্যাপারে সউদী আরবের পক্ষ হইতে সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদানেরও আশ্বাস দেন। স্বল্পতম সময়ের জন্য হইলেও খন্দকার মােশতাক আহমদের এই দক্ষ ও যােগ্য নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশকে দিল্লীর দাসত্ব শৃংখল হইতে মুক্ত করিবার ব্যাপারে তাঁহার অন্তিরিক ও বলিষ্ঠ প্রচেষ্টা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকিবে।
একগুচ্ছ ঐতিহাসিক চিঠি
(রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রচুর সংখ্যক চিঠি গ্রন্থাকারের হেফাজতে রহিয়াছে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব হিসাবে যাহার মূল্য অনেক। সেই সকল চিঠির সামান্য কিছু সংকলিত হইলাে। স্থানাভাবে সকল চিঠি মুদ্রণ সম্ভব হইলাে না ।