দি ডেইলি মিরর, লন্ডন, ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১
যে যুদ্ধ বিশ্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ
আজকে ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র মুখ্য সত্যটি, মনে হচ্ছে, যুক্তরাজ্যে এসে পৌঁছেনি। সত্যটি হোলো যে পাকিস্তান, ভারত নয়, পুরো পশ্চিম এশিয়াকে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে অতি-সরলিকরন করা এর অভিপ্রায় নয়, আবার ভারতের সাম্প্রতিক সকল কার্যকলাপকে উপেক্ষা করাও নয়।
কিন্তু শাস্তিযোগ্য পর্যায়ের অনবহিত এবং বিপদজনক একটি অভিমত যুক্তরাজ্যে তৈরি হচ্ছে বলে মনে হয় যেটি বলছে ভারত হচ্ছে “হামলাকারী”।
এই অভিমতের বিপদজনক দিক হচ্ছে, যে এটি গত ৮ মাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীকে আমলে না নিয়ে, ভারতকে একঘরে, বন্ধুবিহীন করে দেবে, শান্তি প্রতিষ্ঠার যা কিছু উপায় ভারতের কাছে আছে তা কেড়ে নেবে, এবং এমন এক যুদ্ধ ঘটতে সাহায্য করবে যেটিতে সম্পৃক্ত থাকবে চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া।
যদি এরকম একটি অভিমত কে শক্তিসঞ্চয় করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে জাতিসংঘ, এবং এমনকি হয়তো যুক্তরাজ্য সরকারও, এক পাকিস্তানী জান্তার পক্ষে মধ্যস্ততা করতে বাধ্য হবে যারা হত্যা করেছে, মার্চ মাস থেকে, হয়তো ১০,০০,০০০ মানুষকে।
আমরা আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসটি সঠিক ভাবে জেনে নিই। মার্চ মাসে, ফিল্ড-মার্শাল ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সেনাপতিরা নিষ্পিষ্ট করে পূর্ব পাকিস্তানের, বর্তমানে বাংলাদেশ, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে।
তখন থেকে, তারা একটি পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে পূর্ব বাঙলার ৭,৫০,০০,০০০ মানুষের উপর।
তারা তালিকা ধরে হাজার হাজার নির্বাচিত রাজনীতিক, শিক্ষক, ছাত্র, চিকিৎসক এবং ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছে।
একই সময়ে, তারা তাদের মূলত পাঞ্জাবী অধ্যুষিত সৈন্য বাহিনীকে একের পর এক পাশবিক অত্যাচার চালানর সুযোগ করে দিয়েছে।
তারা যুবকদের রক্ত ঝড়িয়েছে। তারা প্রকাশ্যে পুরুষদের খোজা করেছে। তারা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং হত্যা করেছে এবং ধর্ষণ করেছে।
তাদের এই সন্ত্রাস এতটাই বিস্তৃত ছিল যে ১,১০,০০,০০০ মানুষ পালিয়ে ভারতে চলে আসে, যাদের বেশিরভাগই এখন বর্ণনাতীত যন্ত্রণা পোহাচ্ছে।
যারা পালিয়ে যেতে পারেনি, তারা হয়তো খাদ্য এবং ত্রাণ না পাওয়ার আতঙ্কে আছে অথবা এই অপরাধের ব্যাপ্তি উপলব্ধি করা থেকে বিরত রয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানে অস্ত্রের সরবরাহ বজায় রয়েছে, এবং বাণিজ্যও তাই।
ইতিমধ্যে, ফিল্ড মার্শাল ইয়াহিয়া খান, যাকে দেখলে গিলবার্ট ও সুলিভান অপেরার রানী ভিক্টোরিয়ার আমলের কোন নাটকের কোন চরিত্রের কথা মনে পড়তো যদিনা সে এতোটা ক্ষমতাশালী হোতো, সপ্তাহর পর সপ্তাহ ধরে ভারতকে জ্বালাতন করছে সীমান্ত এলাকায় বেসামরিক জনগণ এবং শরণার্থীদের উপর গোলাবর্ষণের আদেশ দিয়ে।
এগারো দিন আগে, ভারত, যার রাজস্বভাণ্ডার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তার প্রতিবেশী দেশের শরণার্থীদের দেখভাল করতে গিয়ে, এবং পশ্চিমা সরকারগুলোর কাছে যার সাহায্যের আবেদন বড়জোর ঘৃনাভরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, সিদ্ধান্ত নেয় যে সে আর সহ্য করবে না।
সে সীমান্তে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ শুরু করে যাতে করে বাংলাদেশের গেরিলা যোদ্ধারা উৎকৃষ্টতর পাকিস্তানী অস্ত্রের বিরুদ্ধে কিছুটা সুবিধা পায়।
এটি পুরোপুরি সফল হয়নি, কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারত সংযত থেকেছে। নিশ্চয়ই, আর কোনো আধুনিক নেতা ইন্দিরা গান্ধীর মতো সংযম দেখাননি।
এর পর থেকে, পাকিস্তানী গোলাবর্ষণ আরো বেড়ে গেছে, এবং বৃহস্পতিবারে, তিনটি পাকিস্তানী জেট বিমান ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশের একটি বিমান ঘাঁটিতে বোমা বর্ষণ করে, এতে পাঁচজন নিহত এবং পঁয়তাল্লিশজন আহত হয়।
একই সময়ে, পাকিস্তান আবেদন জানায় জাতিসঙ্ঘ আরোপিত “যুদ্ধ-বিরতি”-এর জন্য, এটা জেনে যে জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপ তাদেরকে বাংলাদেশের উপর তাদের সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে সাহায্য করবে, একই সাথে বাঙালী জনতার উপর শাসন বজায় রাখতেও।
ভারত, তাদের বাহিনীকে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে, এখন আক্রমণকারী দেশের ভুমিকায় পতিত হবে।
মিসেস গান্ধী মাত্রই বলেছেনঃ “যদি কোনো দেশ মনে করে যে আমাদেরকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে আখ্যা দিয়ে, তারা আমাদেরকে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ভুলে যেতে চাপ প্রয়োগ করতে পারবে, তাহলে সেই দেশটি তাদের নিজস্ব বোকার স্বর্গে বসবাস করছে”।
“সেই সময় বিগত হয়েছে যখন চামড়ার রঙের শ্রেষ্ঠতার ভিত্তিতে কোনো জাতি তিন বা চার হাজার মাইল দূর থেকে ভারতীয়দেরকে যা খুশি তাই করার আদেশ দিতে পারতো, ভারত বদলে গেছে এবং এটি এখন আর অসভ্য জাতির দেশ নয়”।
যুদ্ধ বা শান্তির সিদ্ধান্ত এখন আর মিসেস গান্ধীর উপর নির্ভরশীল নয়। এই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে সেইসব সরকারের উপর যারা এখন পাকিস্তানী সেনাপতিদের সমর্থন করে এবং তাদের কথা শোনে।
যদি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে এমন এক যুদ্ধ ঘটতে পারে যাতে শুধু ভারত এবং পাকিস্তানই সম্পৃক্ত থাকবে না, এ এমন এক যুদ্ধ হবে যা কেউ চায়নি।