You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.03.26 | বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি উৎসবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ২৬ মার্চ ১৯৭২ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি উৎসবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ  ২৬ মার্চ ১৯৭২  ঢাকা

আমার প্রাণপ্রিয় বীর বাঙালি ভাই ও বোনেরা,

 

প্রথম বর্ষপূর্তি উৎসব পালন

আমরা আজ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি উৎসব পালন করছি। এই মহান দিনে স্বাধীনতার অর্জনের পথে যে লক্ষ লক্ষ বীর শহীদ হয়েছেন তাদের জন্য গভীর বেদনা আপ্লুত মন নিয়ে আমার শোকাতুর দেশবাসীর সাথে পরম করুণাময়ের দরবারে মাগফেরাত কামনা করছি।

সেই সঙ্গে স্বাধীনতার সংগ্রামে গৌরবোজ্জ্বল ও অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য আমি মুক্তি বাহিনীর সকল অঙ্গ দল তথা বাংলাদেশ রাইফেলস,  পুলিশ,  বেঙ্গল রেজিমেন্ট,  সশস্ত্রবাহিনীর নির্ভিক  যুবক,  ছাত্র,  কৃষক,  মজদুর,  বুদ্ধিজীবী আর আমার সংগ্রামী জনসাধারণকে অভিনন্দন জানাই। তাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও একনিষ্ঠ আত্মদান অনাগত কালের ভাবি বাঙালিদের জন্যেও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তিপাগল জনতার চেতনাকে উদ্ভাসিত করবে। আমার প্রিয় দেশবাসী,  বিগত ২৫ বৎসর ধরে আপনারা ক্ষুধা,  বঞ্চনা,  অশিক্ষা,  সাম্প্রদায়িকতা,  স্বৈরতন্ত্র,  দারিদ্র এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

সাম্রাজ্যবাদী শোষকরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটা নিষ্ঠুরতম উপনিবেশে পরিণত করেছিলো। দুঃসহ ও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেও আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম।

পিষ্ট হতেছিলাম শোষণের জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়ে। দারিদ্রের ও অনাহারের বিষবাষ্পে যখন আমরা অকণ্ঠ নিমজ্জিত,  তখন তদানীন্তন পাকিস্থান শোষকরা আমাদের কষ্টর্জিত ৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলার কাজে মত্ত ছিলো। ন্যায় বিচার রোহিত করায় মৃত্যুর হিমশীতল কষ্ট আমাদের ওপর নেমে এসেছিলো। সমসাময়িক কালের নিষ্ঠুরতম স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ৩০ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে। আর তিন কোটি মানুষ হয়েছে সর্বশান্ত। এই সব কিছুই ঘটেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য।

আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই তখন দেখতে পাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ধূসর পাণ্ডুর জমিন। ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম,  ক্ষুধার্ত শিশু,  বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্ত পুরুষ। আমি শুনতে পারি সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ। নির্যাতিতা নারীর ক্রন্দন ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ।

আমাদের স্বাধীনতা যদি তাদেরকে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এঁদের মুখে হাসি ফোটাতে না পারে,  লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুষ্টি অন্ন,  মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা,  তাহলে সে স্বাধীনতা বৃথা,  সে আত্মত্যাগ বৃথা। আমাদের এই কষ্টর্জিত স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উৎসবের লগ্নে দাঁড়িয়ে আসুন আইজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি,  বিধ্বস্ত,  মুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো।

গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়,  সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফসল ভোগ করবে। এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের সুখী ও উন্নত জীবন পরিবেশের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আইজ আমাদের সামনে পর্বততুল্য সমস্যা উপস্থিত।

মহাসংকটের ক্রান্তিলগ্নে আমরা উপস্থিত হয়েছি,  বিদেশ ফেরত এক কোটি উদ্বাস্তু। স্বদেশের বুকে দুকোটি গৃহহারা মানুষ,  বিধস্থ কর্মহীন চালনা,  চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়,  নিশ্চল কারখানা,  নির্বাসিত বিদ্যুৎ সরবরাহ,  অসংখ্য বেকার,  অপরিমিত আরাজকতা,  বিশৃঙ্খলা,  বাণিজ্যিক সর্ব ব্যাবস্থা,  ভগ্ন সব সেতু ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ বন্দোবস্ত,  দারিদ্র,  খাদ্যভাব,  দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি।

  আকর্ষিত জমি এ সবকিছুই আমরা পেরেছি উত্তরাধিকারী সূত্রে; জনগণের গভীর ভালোবাসা,  আস্থা,  অদম্য সাহস,  অতুলনীয় ঐক্য,  এগুলিকে সম্বল করেই আমার সরকার এই মহাসংকট কাটিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে।

আমি আশা করবো ঐ যে আপনারা যেভাবে দুর্জয় সাহসে বুক বেধে এহিয়ার সামরিকতন্ত্রকে পরাভূত করেছিলেন,  গভীর প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে তেমনি বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করবেন। আমরা পুরাতন আমলের ছিন্ন ধ্বংসস্তুপের মধ্যে থেকে নূতন সমাজ গড়ে তুলবো।

ভাই ও বোনেরা,

হত্যা করেছে

আপনারা জানেন,  হানাদার পাকিস্তান বাহিনী আমাদের বাংলার রাইফেল ও পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্যকে হত্যা করেছে। আইনের শাসন কায়েম,  শান্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠনের অভাব,  বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

নূতন নিযুক্তের মাধ্যমে আমরা পুলিশ বিভাগকে সংগঠিত করেছি। এবং ইতিমধ্যেই সে সকল সমাজ বিরোধী দুষ্কৃতিকারী স্বাধীনতাউত্তর সুযোগ-সুবিধাদির অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দমন করে জনসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা ও (অস্পষ্ট) ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করেছি।

স্বাধিকারসূত্রে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন জাতির জন্য সম্পূর্ণ অনুপোযোগি একটি প্রাদেশিক প্রশাসনিক কাঠামো। এর কিছু কিছু আমলা,  উপনিবেশিক মানসিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছিলো না। তার এখনও বনেদি আমল আমলাতান্ত্রিক মনোভাবের প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।

আমরা তাদেরকে স্বাধীন জাতীয় সরকারের অর্থ অনুধাবনের জন্য উপদেশ দিচ্ছি এবং আশা করছি তাদের পশ্চাৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। এই সরকার নব রাষ্ট্র ও নূতন সমাজের উপযোগী করে সমগ্র প্রশাসন যন্ত্রকে পুনর্গঠন করতে চায়।

প্রস্তাবিত প্রশাসন কাঠামোকে জনগণ ও সরকারী কর্মচারিদের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টির পূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের সমস্ত মহকুমাগুলোকে জেলা পর্যায়ে উন্নত করার পরিকল্পনা নিয়েছি।

সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জ

বিশেষজ্ঞরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং শাসনতন্ত্র গণপরিষদের সামনে পেশ করা হবে। এই শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হবে জাতীয়তাবাদ,  গণতন্ত্র,  সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

৫৪টি বন্ধু রাষ্ট্র এ পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে।  উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য আমরা বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে উদার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।

বিশেষ করে ভারত আমাদের সুদিন ও দুর্দিনের প্রতিবেশী। সম্প্রতি মহান ভারতের মহান নেতা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে সফর করে গেছেন। এই শুভেচ্ছা সফরের প্রাক্কালে আমরা শান্তি ও বন্ধুত্ব ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এই চুক্তি দুই দেশের মেহনতি মানুষের শুভেচ্ছা,  সহযোগিতা,  বন্ধুত্ব এবং বন্ধনকে মজবুত করবে বলিয়া আমি আশা করি।

সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্যোগময় মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি সোভিয়েত রাশিয়া সফর করে এসেছি। যেখানে তাদের অকৃত্রিম আতিথেয়তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ বিপর্যস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের কাজে সর্বাধিক সার্বিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আমি পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জ,  গ্রেটব্রিটেন,  ফ্রান্স,  পশ্চিম জার্মানি,  অস্ট্রেলিয়া,  কানাডা,  জাপান,  স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলি এবং অন্যান্য বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ যারা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাদের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি জোট বহির্ভূত এবং সক্রিয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে রচিত। বৃহৎ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাইরে আমরা শান্তিকামী।

আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেহ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করবো কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিষ্কণ্টক এবং শর্তহীন। আমরা জাতীয় সর্বভৌমত্ব সব জাতির সমমর্যাদার নীতিতে বিশ্বাসী। আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করবে না এটি আমরা আশা করি।

দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানের শাসক বাংলাদেশের বাস্তবকে মেনে নিচ্ছে না। তারা ৫ লক্ষ নিরীহ বাঙালিকে সন্ত্রাস ও দুর্দশার মধ্যে আটকে রেখেছে। বিশ্বব্যাপী বিবেকসম্পন্ন মানুষ বিশেষ করে মি. ভুট্টোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হোক।

এই ইস্যুকে কোনক্রমেই যুদ্ধবন্দীদের সাথে সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না। কারণ তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যা অপরাধে অপরাধী। তারা মানবাধিকারকে লংঘন করেছে। আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে তাদের বিচার করতে হবে।

পাকিস্তানের সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের কাছে আমার আবেদন নুরেমবার্গ মামলার অসামিদের থেকেও নিষ্ঠুর ধরনের এই অপরাধীদের তারা জাতি বলে ভাববেন না। যারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা দেশে ফিরে এসেছে। সাহায্য পুনর্গঠন,  পুনবার্সনের জন্য আমরা কার্যকরী কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি। বিনামূল্যে ও ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ কিছুটা হয়েছে।

ছিন্নমূল মানুষের মাথা গোঁজবার মতো করে কয়েকদিনের জন্য অস্থায়ী বাসগৃহ তৈরির কাজ হাত দেওয়ার চেষ্টা হইতেছে। বিধবা,  অনাথ ও নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসনে পরিকল্পনাকে সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিক বিবেচনা করেছে। হানাদার পাকিস্তান বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে গেছে তাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে কয়েক বছর সময় লাগবে।

তবে বিপ্লবী সরকার আশা করছে যে ৩ বছর সময়ের মধ্যে এ কাজ সমাধা করা যাবে। বিপুল খাদ্য ঘাটতি আমাদের জন্য এক দুঃসহ অভিশাপ। কিন্তু আমি কাউকে না খেয়ে মরতে দিতে চাই না। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আশা করি ১০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আনতে পারবো।

আর ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ১০ লক্ষ টন আমদানি করার ব্যবস্থা করা হইতেছে। শাসনের কয়েক সপ্তাহ আমাদের জন্য বড় দুর্দিন।

দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়

আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী,  আপনারা ধৈর্য ধারণ করুন। উচ্চতম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাদ্য ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করা। হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মজুতদার,  চোরাকারবারি ও উচ্চাভিলাষীদের হুঁশিয়ার করতেছি তারা যেন নিরন্ন মানুষের মুখের রুটি নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে।

তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে। এ জন্য আমি জনগণের সাহায্যে এবং সহযোগিতা চাইছি। আমার সরকার আভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী এবং সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।

সমাজতন্ত্র (অস্পষ্ট) কথা নয়। আমার সরকার,  আমার পার্টি বৈজ্ঞানিক,  সমাজতান্ত্রিক,  অর্থনৈতিক প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এদেশের বাস্তবিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে পুরাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে।

শোষণ,  অবিচার মুক্ত নূতন সমাজ আমাদের গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে সম্পদের সামাজিকীকরণে পর্যায়ক্রমিক  শুভ সূচনা হিসেবে আমরা উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো জাতীয়করণ করছি।

ব্যাংকসমূহ,  বিদেশি ব্যাংকের শাখাসমূহ বাদে সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ,  বিদেশি সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ বাদে সকল পাটকল,  সকল বস্ত্র ও সুতা,  সকল চিনি কল,  আভ্যন্তরীণ উপকূলীর নৌযানের বিরাট অংশ।

১৫ লক্ষ টাকা মূল্যেও  সকল পরিত্যক্ত ও অনুপস্থিত মালিকানাভুক্ত সম্পত্তি,  বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ সিভিল কর্পোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে।

সমস্ত বহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহির্বাণিজ্যের বৃহৎ অংশকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি প্রতিভাবান ব্যক্তিদের আমি দেশ গড়ার এগিয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

সরকারি সেক্টরে কাজ করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। শিগগির একটি কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। তাতে এসব ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হবে।

এ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের সাথে বাঙালিদের মালিকানার স্বার্থ সরাসরি জড়িত যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সাবেক মালিক অথবা প্রধান কর্মকর্তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে তারা যেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়।

আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে আমরা যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি এগুলো সব দিক থেকে বাস্তব এবং জনসাধারণকে অবশ্যই এসব ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে তুলতে হবে।

বিপ্লব সাধন

বেসরকারি ক্ষেত্রে মাঝারি ও ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর আমাদের নীতির নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সরকারি নীতির মধ্য থেকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজ ন্যায্যভাবে চালানোর জন্য উৎসাহ দেয়া হবে।

আমি এমন একটা নীতি-নির্ধারণ করতে চাই যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারে। এই বলিষ্ঠ নিরীক্ষা চালানোর ব্যাপারে মেহনতি শ্রেণির কর্তব্যবোধের ওপর আমরা অনেকখানি নির্ভর করি। শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমান কাল ধরে যে পরস্পর বিরোধিতা রয়েছে আমাদের নতুন নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের থেকে অনেকখানি বিলুপ্ত হবে।

শ্রমিক-কর্মচারীদেরকে সর্বদা মালিকের সাথে বিরোধিতায় লিপ্ত থাকতে হবে না। বর্তমানে তাদের মালিক হলো বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। যারা মালিক ও ম্যানেজারদের হাতে নিঃস্বার্থে নিজেদের সম্পত্তি জমা রেখেছে।

আমি খুব শীঘ্রি শ্রমিক ইউনিয়নের একটি সভা আহ্বান করেছি। সেই সভায় শ্রমিক সংক্রান্ত সরকারি নীতি এবং আমাদের বিপ্লবী নীতিসমূহ বাস্তবায়িত করতে তাদেরকে যে পূর্ণ সহযোগিতা লাগবে এটা আলোচনা করবো।

এ ব্যাপারে পূর্ণ মতৈক্য পৌছানোর পরে আমি আশা করবো শণিক নেতারা আমার সরকার ও আমার সাথে একযোগে কাজ করবেন এবং এই বিপ্লবী নীতিসমূহ সরাসরি শিল্প এলাকায় কার্যকরী করবো।

তদুপরি শ্রমিকদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত করতে হবে। আমার ছাত্র ভাইয়েরা,  যারা মুক্তি সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন আমাদের বিপ্লবের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাদের কাজ করে যেতে পারেন।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার বিপ্লব সাধনের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরি করাসহ একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে।

পল্লির সংগঠন

আমাদের সমাজে চাষিরা হলো সবচেয়ে শোষিত ও নির্যাতিত এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্য আমাদের উদ্যোগের অবশ্যই তাদের পেছনে নিয়োজিত করতে হবে। সম্পদের স্বল্পতা থাকা সত্ত্বেও,  আমরা চাষিদের স্বল্পমেয়াদি সাহায্য দানের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।

২৫ বিঘার চেয়ে কম জমি যাদের আছে তাদের খাজনা চিরদিনের জন্য মওকুফ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিপূর্বের সমস্ত বকেয়া খাজনা মাফ করা হয়েছে। তাকাবি ঋণ বাবদ ১০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে এবং আরো ১৬ কোটি টাকার ক্যাশ বিতরণ করা হয়েছে।

লবণের ওপর থেকে কর তুলে দেয়া হয়েছে। সারা বছর ধরে সেচের কাজ চালানো,  উন্নতমানের বীজ বপন,  সার,  কীটনাশক ঔষধ চাষিকে পর্যাপ্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে পশ্চাতের বৈষম্য দূর করার জন্য পারিবারিক,  ব্যক্তিগত মালিকানা ১০০ বিঘায় আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও কমিয়ে আনা যায় কিনা চেষ্টা করেছে। এ অবস্থা মনে রেখে পল্লি এলাকায় ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে চেষ্টা করছে।

এর ফলে চাষিরা আধুনিক ব্যবস্থা শুরু করেছে এবং সমবায়-এর মাধ্যমে সহজ শর্তে দ্রুত ঋণ পাবে। এরই সাথে আমাদের উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন,  স্বল্প জমির অধিকারী চাষিদের জন্য ব্যাপক পল্লী সংগঠন গড়ে তোলা। এই সংগঠনের অংশ হিসেবে ১ লক্ষ ৩৬ হাজার টন খাদ্য বরাদ্দ হয়েছে।

এছাড়া টেস্ট রিলিফের অধীনে পল্লির সংগঠনের জন্য নগদ ১৬ কোটি টাকা দেয়া হয়ে গেছে। আমরা আমাদের এ উদ্যোগ বেকার যুবকদের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চাই।

শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো

এই সরকার নগরভিত্তিক গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্ক সচেতন। সেসব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যারা পাটচাষিদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন তাদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে।

আমি ইতিমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫০০ ডাক্তারকে নিযুক্ত করেছি। বাংলাদেশের মানুষে মানুষে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষ্যম্য –  সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থার সমতা আনতে হবে। উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বি বৈষ্যম এতদিন ধরে বিরাজ করছিল তা দূর করার ব্যবস্থা বের করার জন্য আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি।

আজ আমার আমরা বিংশ সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে বিভোর। একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে আমরা অটল। আমাদের সমস্ত নীতি,  আমাদের সমস্ত কর্ম প্রচেষ্টা এ কাজে নিয়োজিত হবে।

আমাদের দুর্গম পথ। এ পথ আমাদেরই অতিক্রম করতে হবে। আমার প্রিয় দেশবাসী,  লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের লাল অন্তরালে দাঁড়িয়ে আমরা আপনাদের কাছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবো না। আমি জীবনে কোনদিন প্রতিশ্রুতি কারও কাছে দেই নাই।

শত্রুরা বাংলাদেশকে শেষ করে দিয়ে গেছে। কিছুই রেখে যায় নাই। কী করে যে এই দেশ চলছে। সত্যই চিন্তা করলে আমি শিহরিয়া উঠি। তবে আমি আপনাদেরকে নির্দিষ্ট আশা দিচ্ছি শহীদের রক্ত বৃথা যেন না যায়।

বাংলাকে আমরা সোনার বাংলায় গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলার আগামী দিনের মায়েরা হাসবে,  শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবো। আপনারা নিশ্চয়ই আমার সাথে সহযোগিতা করবেন। ক্ষেত-খামার-কারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন।

কাজের মাধ্যমেই দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন সকলে মিলে সমবেত হয়ে আমরা চেষ্টা করি যেন সোনার বাংলা আবার হবে। সোনার বাংলা যেন আবার নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।

জয় বাংলা।

Reference:

পিপলস ভয়েস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র, সংগ্রামের নোটবুক

 

 

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ  ৪ জানুয়ারি ১৯৭১