You dont have javascript enabled! Please enable it!

ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
৪ জানুয়ারি ১৯৭১
রমনা গ্রিন, ঢাকা।

“বাংলার মানুষ বিশেষ করে ছাত্র এবং তরুণ সম্প্রদায়কে আমাদের ইতিহাস এবং অতীত জানতে হবে। বাংলার যে ছেলে তার অতীত বংশধরদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে না সে ছেলে সত্যিকারের বাঙালি হতে পারে না। আজো বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস রচিত হয় নি। নতুন করে বাঙালির ইতিহাস রচনা করার জন্যে দেশের শিক্ষাবিদদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি। এই ইতিহাস পাঠ করে যেন বাংলার ভবিষ্যৎ বংশধররা তাদের গৌরবময় অতীতের পরিচয় পেয়ে গর্ব অনুভব করতে পারে এবং মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে। অতীতে বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করার সুপরিকল্পিত চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমার মুখের ভাষাকে কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, আরবি হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা করা হয়েছে, হরফ-সংস্কার, ভাষা-সংস্কার, বানানসংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা আন্দোলন করে তা রুখেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের কথা ভাবা যায় না। কিন্তু এর উপর বারবার হামলা এসেছে। ভেবে অবাক হতে হয়, কাজী নজরুলের কবিতার শব্দ পরিবর্তন কম হয়েছে? গানের শব্দ বদল করে রেডিওতে গাওয়া হয়েছে। তারা মুসলমান করিয়েছেন। এ অধিকার তাদের কে দিল?

নির্বাচনের ফলাফলই বলে দিচ্ছে বাঙালি, বাঙালি হিসেবেই বেঁচে থাকবে, কেউ তা রুখতে পারবে না। এবারকার নির্বাচনে বাংলাদেশ জনগণ তাদের রায়ের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছে যে, বাংলাদেশের সম্পদ বাঙালির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার আর কোনো মতেই দাবিয়ে রাখা বিগত ২৩ বছর ধরে একটানা শোষণ ও অবিচারের ফলে বাঙালিরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ এই অন্যায় মেনে নিতে পারে না। জনগণের স্বাধীনতার ফলভোগকে নিশ্চিত করার জন্যে আওয়ামী লীগ শেষপর্যন্ত লড়ে যাবে। ষড়ন্ত্রকারীরা শেষ হয় নি, তারা এখোনো আছে। তাদের চক্রান্তে সহজে ক্ষমতা হস্তান্তরিত নাও হতে পারে। কায়েমি স্বার্থবাদী মহলের সকলের উস্কানির মুখেও তোমাদের একতাবদ্ধ থাকতে হবে। তোমাদের সংগ্রামের ঐতিহ্য বজায় রেখে তোমরা ঝিমিয়ে পড়ো না, ঘুমিয়ে যেয়ো না। আস্তে চল, নীতি নিয়ে চল, কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা এখোনো সচল, রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেতা, নীতি, সংগঠন ও আত্মত্যাগ- এই চারটি বিষয়ে একনিষ্ঠ থেকে এগিয়ে যেতে হবে। দেশে যদি বিপ্লবের প্রয়োজন দেখা দেয়-তবে সে বিপ্লবের ডাক আমিই দিব। যদি ৬-দফা আদায়ের সংগ্রামকে ষড়যন্ত্র করে ব্যর্থ করে দেয়া হয়, তবে কয়-দফা দিতে হবে তাও আমার জানা আছে। অতিবিপ্লবী কয়েকটা স্লোগান বা রাতের অন্ধকারে আকস্মিকভাবে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বিপ্লব হয় না। বিপ্লবের উদ্ভব হয় মাটি থেকে এবং এর একটা বিশেষ অবস্থা ও ধাপ রয়েছে।
আজো বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হয় নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাঙালির গৌরবময় ভূমিকাকে চাপা দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিকে পর্যন্ত উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়েছে। স্বাধীনতার জন্যে বাংলার হাজার হাজার ছেলে আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছে, বাংলার বহু সন্তান ফাঁসির মঞ্চে ঝুলেছে, চট্টগ্রামের পাহাড়ে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছে। সিপাহী বিদ্রোহ ব্যারাকপুর থেকে শুরু হয়েছিল। সেদিন বাঙালিদের কেউই বেঈমানী করে নি। বড় নেতাদের দেশের লোকেরাই বেইমানী করেছিল। তিতুমীর বাঁশের কেল্লা বানিয়ে সংগ্রাম করে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানের ইতিহাসে তাঁর উল্লেখ নেই। তাদের বীরত্ব ও ত্যাগ-তিতিক্ষার গাথা-ভিত্তিক ইতিহাস রচনার জন্যে শিক্ষাবিদদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এইবার আর তারা ব্যান করতে পারবে না। যদি ব্যান করার চেষ্টা করে তবে আমরাই তাদের ব্যান করে দেব। তোমরা আত্মকলহে লিপ্ত হয়ো না। আজ ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে একতার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। একই একতা অক্ষুণ্ণ না থাকলে ৬ দফার সংগ্রাম দুর্বল হয়ে পড়বে। ছাত্রলীগের মতো বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান ভেঙে যেতে পারে এমন কিছু করোনা।”

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!