You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের অর্থনীতি

জামসেদুজ্জামান

 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক  অবস্থাকে সঠিক বিশ্লেষণ করতে গেলে সর্ব প্রথম সমগ্র বিষয়টাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে নিতে হবে। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাথমিক ও প্রধান বিষয় টি হচ্ছে খাদ্য পরিস্থিতি।

বাংলাদেশের খাদ্য ও সামরিক সরবরাহ মন্ত্রণালয়ের হিসাব থেকে জানা যায়, ১৯৭৪ সালের জন্য মাথাপিছু গড়ে দৈনিক ১৫.৫ আউন্স হিসাবে খাদ্য (চাল এবং আটা) প্রয়োজন ১২৪.০০ লক্ষ্য টন। আশা করা যায়, দেশী উৎপাদন দাঁড়াবে ১১৮.০০ লক্ষ টন যার মধ্যে খাদ্য হিসাবে পাওয়া যাবে ১০৬.০০ লক্ষ টন। সুতরাং সহজ হিসাব অনুসারে খাদ্য ঘাটতি দাড়াচ্ছে ১৮.০০ লক্ষ টন। খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য ২২.০০ লক্ষ টন আমদানির স্বীদ্ধান্ত রয়েছে যার মধ্যে ৫.০০ লক্ষ টন আগামীর জন্য সংরক্ষণ করা হবে। অথচ এপ্রিম মাসের সমাপ্তি পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে আমদানি হয়েছে মাত্র ৩.৭৪ লক্ষ টন।

এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে জানা যায়, বাঙ্গালদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার আরোও অবনতি ঘটেছে। ১৩ টি জেলার সাধারণ চালের মূল্য বেড়েছে, যদিও ৬ টি জেলায় কিছু কমার নিদর্শন পাওয়া যায়। যেটুকু কমেছে তাও অর্থনৈতিক কারণে বলে মনে হয় না, বরং সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপে শুভ পরিণতি মনে করা চলে।

দেশের সাধারণ চালের গড় সর্বনীম্ন খুচড়া মূল্য মণ প্রতি টাকা ৪.১৩ বেড়ে ১২৭.০৯ টাকা দাড়িয়েছে। গত বছর মণ প্রতি মূল্য ছিলো ৯৬.৮২ টাকা। মধ্যম ধরণের চাল ৯.৪১ টাকা বেড়ে ১৪০.০০ টাকা হয়েছে।

মূল্য পরিস্থিতি

মাথা পিছু আয় তো নয়ই, হাইজ্যাক চোরাচালানী আর ব্যাংক লুট ছাড়া মানুসের আয় বাড়েনি। অথচ মূল্যবৃদ্ধি প্রলয় থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন পথই আমাদের অর্থনীতি করতে পারেনি। মানুস মাত্রই যখন দুরাবস্থায় পড়ে, তখন এ অবস্থার মোকাবেলা করতে সে এতোই ব্যস্ত থাকে যে, অবস্থার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত দুরাবস্থা যে কতই গভীর ছিলো তা বুঝতে পারে না। আমরা অর্থনীতির এ প্রলয় ঝড়ে এখনও প্রকাশ্যে কেও বুঝতে পারছি না কি গভীর দুর্ভীক্ষে আমরা ভুগছি। যদি কোন দিন অর্থনীতির উন্নতি হয় সেদিন আজকের কথা ভেবে অবাক হব যে, আমরা কি মরণ দূর্ভীক্ষের গ্রাসে দিন কাটিয়েছিলাম।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মূল্যবৃদ্ধি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে মূল্য হ্রাস বলে কোন শব্দই নেই। যা কিছু হ্রাস হয়েছে তা সাময়িক অথবা জোর করে, যার ফলে আবার তা বেড়ে গেছে। উদাহরণ স্বরূপ সামরিক প্রচেষ্টার ব্যার্থতার কথায় অনুলেক্ষ্যই শ্রেয়। আমরা ১ নং তালিকা থেকে অতি প্রয়োজনীয় কয়েকটি দ্রব্যের ভয়ংকর মূল্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করতে পারি। খাদ্য সমস্যাই যে দেশে এতো প্রকট সে দেশের বাসস্থান সমস্যা না থাকা উচিৎ। শিক্ষা বা অন্যান্য সমস্যার প্রশ্নই ওঠে না।

মূল্যবৃদ্ধির কারণ বিশ্লেষণের আয়তন এ প্রবন্ধে সীমানায়  নেয়। শুধু এতটুকুই বলা যায়, মূল্য হ্রাস ঘটানো কোন জোর জবরদস্তির ব্যাপার না, এটি একটি অর্থনৈতিক প্রকৃয়া। প্রকৃতপক্কে মূল্য হ্রাস ঘটাতে হলে সে পথেই প্রচেষ্টা চালাতে হবে। মজুরদারী কালো বাজারি রা মূল্য বৃদ্ধির প্রথম বা প্রধান কারণ নয়। তারা মূল্য বৃদ্ধি করতে পারে কিন্ত তা অত্যন্ত সাময়িক সময়ের জন্য। দীর্ঘকালীন মূল্য বৃদ্ধি তাদের আয়ত্তের বাইরে। কেননা তারা এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সমুদ্রের মাছ মাত্র। সমুদ্রকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের নেই।

মূল্য বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে অর্থ বৃদ্ধি। অর্থ বৃদ্ধির তালে তাল মিলিয়ে উৎপাদন বেড়ে চললে অর্থনীতির হয়ত কল্যাণই হয়। কিন্তু শুধু অর্থ বৃদ্ধি ঘটলে সমস্ত অর্থনৈতিক কাঠামোতে তা ঘুণের মতই কাজ করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধুই শুনেই ধরেনি সঙ্গে সঙ্গে চলেছে পচনকৃয়া বা উৎপাদন হ্রাস বা বন্ধ। পচনের ঘুণ উভয়ই এই দারুল দূভিক্ষের মূল কারণ।

উৎপাদন হ্রাসের একটি অন্যতম উৎস হচ্ছে জাতীয়কৃত কারখানা। যেখানে প্রশাসন রয়েছে জরাগ্রস্ত, ব্যক্তিগত স্বার্থের পতাকা সেখানে সমুন্নত। অভিজ্ঞতা শূন্য। জাতীয়করণের মহান আদর্শ ধূলায় লুণ্ঠিত। তাই এসব প্রতিষ্ঠান একদিকে  বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলোর কাছ থেকে অধিকতর ঋণ নিয়ে মুদ্রাস্ফ্রিতি ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে উৎপাদন হ্রাস থেকে মূল্যমানকে বাড়িয়েছে আরোও বেশি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে মূদ্রা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে সরকারী নীতি এবং প্রতিষ্ঠান সমূহ। আর উৎপাদন কমিয়েছে সরকারী কলকারখানা সমূহ। সুতরাং মূক্য বৃদ্ধির জন্য একমাত্র সরকারী ব্যবস্থায় দায়ী। মুনাফা খোর বা মজুতদারই সেখানে মূখ্য নয়। অনেকে যুক্তি দেখান যে, কাচামালের অভাব এবং কার্যকরী চাহিদার অভাবের জন্য উৎপাদন হ্রাস হতে বাধ্য। এ যুক্তি ধোপে টেকে না। এই জন্য যে, আমদানী প্রকৃয়ার সরকারী অকার্যকারীতার জন্যই কাচামালের এ অভাব।

অবশ্য আমাদের এ কথা স্বীকার করে নিতেই হবে যে, জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠানসমূহ ইদানিং কিছু উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে যদিও স্বাধীনতার পুর্বের তুলনায় তা নগণ্য।

মূদ্রা পরিস্থিতি

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস মুদ্রাবৃদ্ধির ইতিহাস। ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মুদ্রার সংখ্যা যেখানে ছিল ৩৮৭.৫০ কোটি টাকা, সেখানে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে প্রায় ৩০০% ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৮২৭.২৭ কোটি টাকা। যেহেতু উৎপাদন বৃদ্ধি শূন্য শূন্য (সামান্য উন্নতি ও গড় অবনতি যোগ বিয়োগ করলে গেল উৎপাদন শূন্য)। সেহেতু এই ৩০০% মুদ্রা বৃধির ফল নিশ্চয় মূল্যবৃদ্ধি। যার নিদারুণ কষাঘাত পড়েছে সাধারণ মানুসের উপর। ১৯৬৯ সাল থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত গড় বার্ষরিক মুদ্রাবৃদ্ধির হার ছিল ২০%, যেখানে স্বাধীনতার প্রথম বছর (১৯৭২ এর জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর) বৃদ্ধি পায় ৭০% এবং ১৯৭৩ সালের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি পায় ১৭%।

 

টেবিলঃ মুদ্রা বৃদ্ধির কারণ সংক্রান্ত তালিকা (কোটি টাকায়)

সময় খাতের নাম
ব্যক্তিগত খাত গণ খাত সময় আমানত সরকারী ফিসকাল কার্যাকালাপ বিদেশী খাত বিবিধ কারণ মোট
জানুয়ারী, ১৯৭৪ (-) ৪.৭০ (-) ৬.১৯ (-) ১৯.৮৯ (+) ২৯.৭১ (-) ৮.৯৭ (+) ১১.৮৯ (+) ১.৮৫
ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৪ (+) ৩.৮০ (+) ১১.৭৩ (+) ৩.৫৬ (+) ৪.৮১ (-) ১০.৭৫ (-) ১৪.৯৭ (-) ১.৭৯
মার্চ, ১৯৭৪ (-) ১.৫২ (+) ০.১৫ (-) ৩.৫৪ (+) ১.৪৯ (+) ১৯.১৬ (+) ৪.৪৭ (+) ২০.২১
এপ্রিল, ১৯৭৪ (+) ১৯৫ (+) ০৩৪ (-) ৮.৭৫ (+) ৯.২৩ (-) ১৪১০ (+) ৯.৭৯ (-) ১.৫৪
মোট (-) ০.৪৪ (+) ৬.০৩ (-) ২৮.৬২ (+) ৪৫.২৪ (-) ১৪.৬৬ (+) ১১.১৮ (+) ১৮.৭৩

উৎসঃ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত “সিলেক্টেড ইকোনমিক ইনডিকেটরস”

১৯৬৯ সালের অথবা তার পূর্বের বৃদ্ধির পেছনে কেনীসীয় মুদ্রাবৃদ্ধি এবং উন্নতির কোন আদর্শ হয়ত কিছুটা হলেও কাজ করেছিল কেননা তখন উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেত। স্বাধীনতার প্রথম বছর যুদ্ধক্লান্ত অর্থনীতির পুনর্জীবনের জন্য হয়ত কিছুটা মুদ্রাবৃদ্ধি সয়ে নেয়া যায় কিন্তু বর্তমানের এই মুদ্রাস্ফ্রীতি এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের ঘণ্টা ধ্বনী শোনাচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

গত ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ১৮.৭৩ কোটি টাকার যে মুদ্রার বৃদ্ধি ঘটেছে তার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে সরকারী কার্যকালাপ। ৬.০৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে গণ খাত এবং সরকারী ফিসকাল কার্যাকালাপের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৫.২৪ কোটি টাকা। বিবিধ কারণ ছাড়া অন্যান্য অর্থ বৃদ্ধির কারণগুলির কোনটিই অর্থ বৃদ্ধি তো ঘটাইই নি, উপরন্তু অর্থ সংকোচের সাহায্য করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, অর্থ বৃদ্ধির মূল কারণ সরকার।

টেবিলঃ মুদ্রা সরবরাহ তালিকা

সময় মুদ্রা সংখ্যা কোটি টাকায় % বাৎসরিক মুদ্রা বৃদ্ধির পরিমাণ
১৯৬৯ জুন ৩৪২.৩২
১৯৭০ জুন ৩৫৯.১০ ৪.৯০
১৯৭১ জুন ৪৮১.০২ ৩৩.৯৫
১৯৭২ জুন ৪৮৫.৭০ ০.৯৭
১৯৭৩ জুন ৬৯৬.০৩ ৪৩.৩০
১৯৭৪ জানুয়ারী ৮১০.১৫
১৯৭৪ ফেব্রুয়ারী ৮০৮.৬০
১৯৭৪ মার্চ ৮২৮.৮১
১৯৭৪ এপ্রিল ৮২৭.২৭
১৯৭৪ জুন ৮১৬.৭৮
১৯৭৪ সেপ্টেম্বর ৮২০.৮৭

উৎসঃ ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বুলেটিন’ ও ‘সিলেক্টেড ইকোনমিক ইনডিকেটর’ থেকে

উৎপাদন পরিস্থিতি

স্বাধীনতার পূর্ব কালীন সংগ্রামে সমগ্র উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতইগ্রস্থ হয়। সামগ্রিক উৎপাদন ব্যাহত এবং সংকোচিত হয়। তদানিন্তন সামরিক সরকার আত্নসমর্পণের পূর্বে অবশিষ্ঠ সব কিছু বিনষ্ট করে দেবার উদ্দেশ্যে বাদবাকি ক্ষতি করে।

স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে দুস্কৃতকারীগণের সহযোগিতায় অনেকেই অবশিষ্ট কলকারখানার প্রয়োজনীয় যন্ত্রাদী চুরি করে বাকি শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতাকে ধ্বংস করে।

একদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপর্যস্থ অন্যদিকে কলকারখানার কংকাল নিয়ে বাংলাদেশ জন্মগ্রহণ করে। আশা করা গিয়েছিল, জাতীয়করণের ফলে দেশের এ দূরাবস্থার লাঘোব হবে। নতুন কলকারখানা গরে উঠবে, জাতীয়করণের সোনার কাঠির স্পর্শে জেগে উঠবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন।

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ব্যাক্তিগত ও দলীয় স্বার্থহীন মানোসিকতা ও লোভ এবং প্রশাসনিক অযোগ্যতার ফলে উৎপাদন পূর্বের পর্যায়ে তো ফিরে আসেই নি বরং কমে গেছে। একদিকে উৎপাদন বৃদ্ধির সরকারী অক্ষমতা অন্য দিকে সরকারী মূদ্রাস্ফ্রীতির নীতি জন্ম দিয়েছে এক ভয়ংকর মূল্য বৃদ্ধির দুর্যোগ।

টেবিলঃ সার্বিক উৎপাদন পরিস্থিতি

দ্রব্যাদি পরিমাণ সময় কাল
জানুয়ারী, ১৯৭৩ জানুয়ারী, ১৯৭৪ এপ্রিল, ১৯৭৪ আগস্ট, ১৯৭৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪
চাল (সাধারণ) সের ২.১২ ২.৮৭ ৩.৮৭ ৪.৭৫ ৬.৫০
আটা সের ১.০০ ১.১২ ২.২৫ ৩.০০ ৪.৫০
মশুর ডাল সের ৩.০০ ৬.০০ ৫.০০ ৫.৫০ ৫.৫০
আলু সের ০.৮৭ ২.০০ ১.৭৫ ৩.০০ ৩.০০
মাছ (রুই) সের ৮.০০ ১২.০০ ১২.০০ ১৬.০০ ১৪.০০
মাংস সের ৯.০০ ১২.০০ ১১.০০ ১৪.০০ ১৪.০০
সরিষার তেল সের ১৩.০০ ১৬.০০ ২০.০০ ৩০.০০ ৩৬.০০
জ্বালানী কাঠ মণ ১৪.০০ ১৫.০০ ১৭.০০ ২০.০০ ২০.০০
কেরোসিন গ্যালন ৬.০০ ৭.০০ ৭.০০ ৮.৭৫ ৮.৫০
লং ক্লথ গজ ১২.০০ ১৪.০০ ১৪.০০ ১৪.০০ ১৪.০০
সাবান (কাপড় কাচা) সের ৪.৫০ ৬.০০ ১২.০০ ১২.০০ ১৬.০০

উৎসঃ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত “সিলেক্টেড ইকোনমিক ইনডিকেটরস”

আমরা উৎপাদন হ্রাসের একটি তালিকা পেশ করতে পারি। যেখানে সিগারেট, দেশালয় ও চা ব্যাতিত অন্যান্য সমস্ত তথ্যাদি জাতীয়কৃত শীল্প প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত। তালিকায় বিয়োগ চিহ্ন দ্বারা দেখানো হয়েছে উৎপাদন ১৯৬৯-’৭০ এর তুলনায় ১৯৭৩-’৭৪ ৩ শতকরা কতভাগ কমেছে এবং যোগ চিহ্ন দ্বারা দেখানো হয়েছে কত ভাগ বেড়েছে। এ তালিকা লক্ষ্য করলে আমরা সহজেই বুঝতে পারব, উৎপাদন দূরাবস্থা কোন স্তরের।

দ্রবাদি একক ১৯৬৯ – ’৭০ এর তুলনায় ১৯৭৩ – ’৭৪ সালে উৎপাদনের % পরিবর্তন
পাটজাত দ্রব্য টন (-) ১৫
হেসিয়ান টন (-) ২৭
স্যাকিং টন (-) ২৪
অন্যান্য টন (+) ৮১
তুলাজাত কাপড় হাজার গজ (+) ৩২
তুলার সুতা হাজার পাউন্ড (-) ১৪
কাগজ টন (-) ৪৩
নিউজ প্রিন্ট টন (-) ২৬
সিগারেট লক্ষ কাঠি (-) ৩৩
ম্যাচ হাজার গ্যাস বাস্প (-) ৫২
সিমেন্ট টন (-) ৩
স্টিল টন (+) ৩৬
ইউরিয়া টন (+) ১৯১
চিনি টন (-) ৫
পেট্রোলিয়ামজাত (-) ৬২
চা হাজার পাউন্ড (-) ৯

উৎসঃ প্লানিং কমিশনের ‘নির্ধারিত অর্থনৈতিক নিদ্দেশক’ জুলাই ১৯৭৪ থেকে।

জীবনযাত্রা পরিস্থিতি

ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ জীবন যাত্রার খরচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গত এপ্রিল মাসে তা ১১.০৯ পয়েন্ট (১৯৬৯ – ’৭০ = ১০০) বেড়ে ২৭৮.২৪ পয়েন্টে দাড়িয়েছে। খাদ্যের খরচ ১৬.০৯ পয়েন্ট বেড়ে হয়েছে ২৮৮.১৩, বস্ত্র ওম পাদুকায় ১৩.০২ পয়েন্ট বেড়ে হয়েছে ৩৮৯.১০। জ্বালানী ও আলোকায়নের খরচ কমতে দেখা যায় ৬.১৩ পয়েন্ট, ফলে খরচ দাড়াচ্ছে ২৭৯.০০ পয়েন্ট। ২ নং তালিকায় এ সম্পর্কে আমরা আলোকপাত করতে পারি।

টেবিলঃ ঢাকা শহর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন যাপনের খরচ

সময় ১৯৫৫ – ’৫৬ = ১০০ হিসাবে ১৯৬৯ – ’৭০ = ১০০ হিসাবে
জানুয়ারী, ১৯৭২ ২০৮.৬২
      জুন, ১৯৭২ ২৪৪.৮০
ডিসেম্বর, ১৯৭২ ৩১৬.৯৭
জানুয়ারী, ১৯৭৩ ৩১৭.৮৫
      জুন, ১৯৭৩ ৩৬১.৪৬
ডিসেম্বর, ১৯৭৩ ৪২৬.৪৩ ২৪৪.২৯
জানুয়ারী, ১৯৭৪ ৪৩৪.৫৭ ২৪৯.৬৩
      মার্চ, ১৯৭৪ ৪৭০.৩৩ ২৬৭.১৫
   এপ্রিল, ১৯৭৪ ৪৮৭.৪৭ ২৭৮.২৪
       মে, ১৯৭৪ ২৮৪.৪৪
      জুন, ১৯৭৪ ৩০৩.৭১
   জুলাই, ১৯৭৪ ৩১৬.১০
   আগস্ট, ১৯৭৪ ৩৫২.৩৮

উৎসঃ বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্টাটিসটিকস।

 

 

 

বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতি

বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য বিশেষ করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ঘাটতি পূরণের কাজে আমদানীর জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের একমাত্র পথ। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের মুদ্রার কোন সম্মানও নেই, নেই স্বীকৃতি। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে আমাদের কেনাবেচা।

এই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় সব টাই আসে পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে। ১৯৭৩ – ’৭৪ সালে কাচাপাট থেকে বঈদেশিক মুদ্রা আয় করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল ১১৫.০০ কোটি টাকার সমান। যেখানে ১৯৭২-’৭৩ সালে আয় হয়েছিল ১০৪.৭০ কোটি টাকা। আপাতত দৃষ্টিতে এ বছরের আয় যদিও গত ১৯৭২-’৭৩ এ অর্থ বছরের চেয়ে বেশি কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে আদতে তা নয়। কেননা ইতিমধ্যে মুদ্রার মূল্যমান প্রকৃতপক্ষে কমে গেছে। সুতরাং এই ১১৫.০০ কোটি টাকা আর আগের বছরের ১১৫.০০ কোটি টাকার সমান নয়, বরং কম।

কাচা পাট দিয়ে ইতিমধ্যে আমাদের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়েছে ১০৮.৮১ কোটি টাকা ১৯৭৪ সালের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত।

পাট জাত দ্রব্য থেকে ১৯৭৩-’৭৪ অর্থ বছরের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনা নির্ণয়করা হয়েছে ১৬০.০০ কোটি টাকা। যেখানে ১৯৭২-’৭৩ এ হয়েছিল ১৩৯.৫০ কোটি টাকা। ১৯৭৪ সালের ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত প্রকৃত আয় হয়েছে ১৮১.৬৫ কোটি টাকা। গত বছর ঐ সমসাময়িক সময়ে অর্জিত হয়েছিল ১৬৯.৬৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া বৈদেশিক বাজারে চায়ের চাহিদা বেড়েছে বলে আশা করা যাচ্ছে যাতে উল্লেখযোগ্য অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এর আন্তর্জাতিক হিসাব বুলেটিনে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রার ভয়ংকর ভাটার টান। প্রতি সপ্তাহে বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাঙ্গালদেশের আর কোন স্থান থাকছে তো নাই বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব বিপদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে।

টেবিলঃ বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ (কোটি টাকায়)

 

সময় পরিমাণ
 ডিসেম্বর, ১৯৭১ শূন্য
       জুন, ১৯৭২ ১১০.৫০
 ডিসেম্বর, ১৯৭২ ২১৬.৭১
       জুন, ১৯৭৩ ১২৫.৩৪
সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ ১৫১.৫১
 ডিসেম্বর, ১৯৭৩ ১১৬.১৫
    এপ্রিল, ১৯৭৪ ৬৬.৫৭
        মে, ১৯৭৪ ৪৩.৫২
       জুন, ১৯৭৪ ৯১.২৫
সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪ ৪৪.৫২

উৎসঃ ‘বাংলাদেশ ব্যংক বুলেটিন’ ও একই প্রতিষ্ঠানের সিলেকটেড ইকোনমিক ইনডিকেটর।

অর্থের মান

অর্থনীতিতে অর্থের মান হিসাব করা যায় দু’ভাবে। অভ্যন্তরিণ বাজারে ও আন্তর্জাতিক বাজারে এর মূল্য এতোতাই হিসাব করে। অভ্যন্তরিণ বাজারে অর্থের মূল্য দুই তৃতীয়াংশ  থেকে তিন চতুর্থাংশ কমে গেছে। অর্থাৎ পূর্বের ১ টাকার মূল্য এখন ৩৫ পয়সা থেকে ২৫ পয়সায় ওঠানামা করছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার মান অত্যন্ত বেশি ওঠানামা করছে। ১৯৭২-’৭৩ সালে এর অবস্থা খুবই সংগিন ছিল। সীমান্তের চোরাচালানি এবং পূজি পাচারের ফলশ্রুতি হিসাবে দেখা দিয়েছিল এ দারুণ দুরাবস্থা। ১ ডলার সমান বাংলাদেশি টাকা ১৯৭২ সালের জুলায় মাসে ছিল ১১.৫০ টাকা, সেপ্টেম্বরে হয় ১৩.০০ টাকা, অক্টোবরে ১৫.০০  টাকা। ১৯৭৩ এর জানুয়ারীতে হয় ১৫.৫০ টাকা এবং মার্চে ১১.৪০ টাকা। ১৯৭৩ এর জুলায়-আগস্টের পর থেকে টাকার এই দুরাবস্থা কিছুতা সুস্থতার দিকে যেতে আরম্ভ করে। অর্থনীতিবিদগণ এর কারণ আবিষ্কারের মগ্ন হন এবং দেখতে পান, আমন ফসল ভালো হওয়া সীমান্তের ওপারে যে বিপুল পরিমাণ চাল পাচার হয়ে যায় তারি ফলশ্রুতি হিসাবে টাকার মানের এ উন্নতি।

আমরা সম্পূর্ণ তথ্য নীচের তালিকা থেকেও পেতে পারি। এতে ভারতীয় মুদ্রার সাথে দেশীও মুদ্রার তুলনাও দেখানো হয়েছে।

তারিখ এক ডলার সমান বাংলাদেশী টাকা ভারতীয় একশত টাকা সমান বাংলাদেশী টাকা
   জুলাই, ১৯৭২ ১১.৫০ ১০৯.৫২
অক্টোবর, ১৯৭২ ১৫.০০ ১৫৬.২৫
জানুয়ারী, ১৯৭৩ ১৬.৫০ ১৬৫.০০
   এপ্রিল, ১৯৭৩ ১৩.০০ ১৪৪.৪৪
   জুলাই, ১৯৭৩ ১৪.৮০ ১৭১.৬৯
অক্টোবর, ১৯৭৩ ১১.২০ ১২৭.২৭
ডিসেম্বর, ১৯৭৩ ১১.৪০ ১২০.০০

উৎসঃ ডলারের হিসাবটি ‘নিউজ উইক’ থেকে। ভারতীয় মুদ্রার মান ওই একই

পত্রিকায় প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে হিসাব করে বের করা।

 

মোট জাতীয় উৎপাদন, মুদ্রাস্ফীতি এবং সামগ্রিক উন্নয়ন পরিস্থিতি

ডঃ এ, এম এ রহিম মুদ্রাস্ফীতি সংক্রান্ত* এক প্রবন্ধে বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি মেপেছেন মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) তথ্যাদি থেকে। ১৯৬৯-‘৭০ সালে মোট জিডিপি ছিল ২৯২১৬ মিলিয়ন টাকার পরিমাণ। ১৯৭২- ’৭৩ সালে ঐ উৎপাদন ১৯৬৯ – ’৭০ ন্সালের মূল্যমান দিয়ে হিসাব করলে দাঁড়ায় ২৫৫৭৩ মিলিয়ন টাকা। প্রায় ১৪% অধঃপাত। ১৯৭২ – ’৭৩ সালের মূল্যমানে ১৯৭২ – ’৭৩ এর মোট অভ্যন্তরিণ উৎপাদন হয় ৫১৩৬৩ মিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ ঐ সময় ব্যাবধানে প্রায় ১০০% মূল্যমান বৃদ্ধি পেয়েছিল। ডঃ রাহিম লেখেন, মুদ্রার বৃদ্ধির যদি শূন্য থাকত তবুও ঐ সময় মূল্যমান ১৪% বাড়ত। মুদ্রা বৃদ্ধি ১৯৭৩ এর আগস্ট পর্যন্ত বেড়েছে ৮৩ %। তার সঙ্গে দ্রব্যাদির উৎপাদন কমেছে ১৪%, সুতরাং অর্থনিতিবদরা মনে করেন মূল্যবৃদ্ধি পাবে ওই সময়ে ১০৯%।

* (বাংলাদেশ ব্যাংক বুলেটিনে প্রকাশিত প্রবন্ধ, ‘সাম আসপেক্ট অফ ইনফ্লাশন থওরীজ ইন দি কনটেক্সট অব বাংলাদেশ)

* ২ ওই একই প্রবন্ধ থেকে।

টেবলঃ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (১৯৫৯-’৬০ সালের মূল্য অনুসারে)

বছর জিডিপি (মিলিয়ন টাকা) মাথা পিছু জিডিপি (টাকা)
১৯৪৯ – ’৫০ ১২৩৭৪ ২৯৩
১৯৬৬ – ’৬৭ ১৮৭৩৪ ২৯০
১৯৬৯ – ’৭০ ২২৩১৭ ৩১৬
১৯৭২ – ’৭৩ ১৯৫৩৫*

 

উৎসঃ জনাব আজিজুর রহমান খানের ‘দি ইকোনমী অব বাংলাদেশ’ বই থেকে।

তারকা চিহ্নটি হিসাব করে নেওয়া।

পরের লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1974.11.08-bichitra1.pdf” title=”1974.11.08 bichitra1″]

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!