You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.11.08 | তাজউদ্দীনের পদত্যাগের পর বিচিত্রার আর্টিকেল - ২ - সংগ্রামের নোটবুক

তাজুদ্দিনের বিদায়

 

মন্ত্রীসভার শীর্ষস্থানীয় সদস্য জনাব তাজউদ্দীনের বিদায় আকস্মিক ঘটনা নয়। দেশের বর্তমান দূর্ভিক্ষাবস্থা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি সব কিছুর জন্যেই যে তিনি একাই দায়ী এ অভিযোগ আমরা করবো না। আমরেয়া বিস্মিত হই তখনই যখন দেখি আওয়ামী লীগ মন্ত্রিপরিষদ সভায় থেকেও তিনি সরকারের একজন কঠোর সমালোচক হিসেবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়েছেন। অথচ বার বার তার দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়েছেন। মন্ত্রীত্বের থেকে সরকারের সমালোচনা করার স্ববিরোধী মনোভাব তার বিদায় সম্পর্কে সাধারণ লোককে সচেতন করেছিল। হয়তো আরো কিছুদিন তিনি মন্ত্রীত্বে থাকতে পারতেন। মন্ত্রিসভা থেকে তার বিদায় দুঃখজনক কিন্তু অপ্রত্যাশিত নয়।

আমরা আশা করেছিলাম, তিনি তার পদত্যাগ সম্পর্কে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকবেন। আমরা তাকে কিছু প্রশ্ন করার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। সেটা যখন আপাতত হচ্ছে না, তখন বিচিত্রার মাধ্যমেই জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ সমীপে আমরা আমাদের বক্তব্য রাখছি। আশা করি তিনি আমাদের বক্তব্য অনুধাবন করবেন। জনাব তাজউদ্দিন, আপনি অবশেষে মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আপনাকে পদত্যাগ করতে বলেছ্বেন। গত চার বছরে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সব গুলো পদই আপনি বিভিন্ন সময়ে অলংকৃত করেছিলেন। যুদ্দের সময় আপনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। যুদ্ধের নয় মাস এবং আরো এক মাস আপনি এই পদে আসীন ছিলেন। ৭২ সালের ১২ ই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু যখন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিলেন, তখন আপনাকে অর্থ ও পরিকল্পনা দপ্তরের ভার দেওয়া হলো। ৭৩ সালের মার্চে পরিকল্পনা থেকে আপনাকে অব্যাহতি দিয়ে পাট দপ্তরের দায়িত্বও দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তিকালে এই দপ্তর  থেকেও আপনাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। মন্ত্রী সভার এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে আপনি জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য কি কি কাজ করেছেন সে সম্পর্কে হিসাব নেবার সময় এখন এসেছে। বিশেষ করে দেশের এই সংকট মুহূর্তে আপনার পদত্যাগ কে কেন্দ্র করে বাঞ্চিত ও অবাঞ্ছিত প্রচুর গুজোব বাজারে ছড়াচ্ছে।

পার্লামেন্টারী গণতান্ত্রীক ব্যবস্থায় মন্ত্রিসভ্য রদবদল, কোন মন্ত্রীর বিদায়, অপসারণ বা পদত্যাগ নতুন কোন ঘটনা নয় কিছুদিন আগেও ভারতের মন্ত্রি সভাইও ব্যাপক রদবদল হয়েছে। তবে ঘটনা অভাবনীয় না হলেও ক্ষেত্র বিশেষে স্বাভাবিকতার তারতম্য ঘটে। ভারতীয় মন্ত্রীদের পদত্যাগ বা দপ্তরের পুনর্বন্টন সম্বন্ধে আমরা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করি না। আপনার পদত্যাগও বাঙ্গালদেশের সংবাদপত্রেও তেমন কোন চাঞ্চল্যকর সংবাদ হিসাবে আত্নপ্রকাশ করে নি। কিন্তু ভারত্রীয় পত্র পত্রিকায় আপনার পদত্যাগের সংবাদ হেড লাইন হয়েছে। প্রচুর সম্পাদকীয়, উপ সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে। অনেক জায়গায় সূক্ষনভাবে বঙ্গবন্ধুকে ও কটাক্ষ করা হয়েছে।  যার ফলে আপনার পদত্যাগের বিষয়টি গুরুত্বহীন হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্ব অর্জন করতে চলেছে। আপনার সাম্প্রতিক নিরাবতাকে অনেকে আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস হসাবে আখ্যায়িত করেছে। তাই গুরুত্বপূর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও কিছু ঘটনা সম্পর্কে আমাদের ভাবতে হচ্ছে এবং সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

জনাব তাজউদ্দিন, আপনাকে আমরা প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাই না। বিনিত ভাবে আপনার দায়িত্ব পালোন সম্পর্কে আমাদের ধারণা আপনাকে জানিয়ে রাখতে চাই। আপনি যখন মুজিব নগরে বাঙ্গালদেশের প্রধানমন্ত্রী, তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশ সরকার তখন যা কিছু করেছেন সকল প্রশংসা ও নিন্দা আপনারই প্রাপ্য। কারণ আপনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ভারত সরকারের সঙ্গে তখন বাংলাদেশ সরকারের সস্পর্ক ছিলো অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। ভারত বাংলাদেশের ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রিয় দিয়েছিলো, মুক্তিযোদ্ধাদের সব সামরিক সাহায্য দিয়েছে। ভারতের সাথে আপনার তথা তৎকালীন সরকারের এই সম্পর্ক পরবর্তিকালে আরোও নিবিড় হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, এ সময় মুজিব নগর সরকারের কার্যকলাপ সম্পর্কে দেশবাসী সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল নন। বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় পরে সব কিছু জেনেছেন, তবু এ দেশের জনগণ এটা আশা করেছিল যে, আপনি অস্থায়ী সরকারের কার্যকালাপ সম্পর্কে দেশবাসীকে অব্যাহতি করবেন। আপনি যেটা করেননি এর ফলে দেশবাসীর মনে পড়ে  বিভিন্ন সময়ে যে প্রশ্ন গুলো জেগেছিলো এদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করেছিল। মওলানা ভাসানী মুজিব নগর সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি যখন স্বাধীনতার পরে ভারতের সাথে গোপন চুক্তি বাতিল কর বলে বক্তৃতা আর বিবৃতির ঝড় তুললেন, তখনও আপনি কিছু বলেন নি। এই নিরাবতার পরিণাম সম্পর্কে আপনি সচেতন ছিলেন না, এ কথা কোন মূর্খও ভাবতে যাবে না। মূলতঃ ভারত বিরোধী প্রচারণার সূত্রপাত ঠিক এভাবেই হয়েছিল। ৭২ এর ১২ ই জানুয়ারীর পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর সরকার এদেশে কায়েম হয়েছে। মুজিব নগর মন্ত্রী সভার রদবদল করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন উদ্যোগে ভারতের সঙ্গে মৈত্রি স্থাপন করেছে। পরবর্তিকালে বঙ্গবন্ধুর জন্যই বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ’৭২ এর ১২ ই জানুয়ারীর আগে যা ঘটেছে সবকিছুর দায়িত্ব আপনারিই।

বঙ্গবন্ধু আপনাকে প্রধান মন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে অর্থ ও পরিকল্পনা দপ্তরের ভার দিয়েছিলেন। একটি সদ্য স্বাধীন প্রাপ্ত দেশে যা সবিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আপনি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের জাদরেল অর্থনীতিবিদরা ছিলেন এই কমিশনের সদস্য। কলকারখানা জাতীয়করণ, সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহের সঙ্গে সম্পর্ক ছে দকরে সমাজতন্ত্রী শিবিরে মিত্র অনুসন্ধান করার মত বহু বৈপ্লবিক স্বিদ্ধন্ত আপনি নিয়েছিলেন। জাতীয়করণের ক্ষেত্রে আপনার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গী সরকারের সমাজতান্ত্রী অর্থনীতির ভিত্তিকে কতটুকু শক্তিশালী করেছে সেটা অন্যত্র আলোচনা করা যাবে। তবে এই মৌলিকত্ব সম্পর্কে কেও অভ্যস্ত ছিলেন না বলে কলকারখানা পরিচালনা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটেছে। যার অনিবার্য পরিণতি ভয়ংকর মুদ্রা স্ফীতি এবং বর্তমানের মনন্তর। আপনার মুদ্রা রাক্ষস শুধু জাতীয় অর্থনীতিকেই গ্রাস করেনি, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমুর্তিও ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।

আপনি গত ৩ বছরে যে বাজেট গুলি তৈরি করেছেন, তার কোনটাই লক্ষ্য অর্জন করতে পারে নি। বরং দেশবাসীর দুর্দশা আরোও বাড়িয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে বলেই কমিশনের সদস্যরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরান চত্বরে পুরান কাজে ফিরে গেছেন। আপনি নিশ্চয় আপনার স্বপক্ষে প্রচুর যুক্তি রেখেছেন কিন্তু যুক্তি বা তথ্য যখন বাস্তব বর্জিত হয়, তখন যে তার কোন মূল্যই থাকে না। এটা আপনার বার্ষিক বাজেটগুলো এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ইউঢোপিয়ানের চিন্তাগুলো ভালোমতই প্রমাণ করেছে।

জনাব তাজউদ্দিন, কিছু সময়ের জন্য পাট দপ্তরের ভারও আপনি নিয়েছিলেন। ভারতের সঙ্গে যৌথ পাট কমিশনের উদ্দ্যগক্তাও আপনি যার উদ্ধেশ্য ছিল বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশ ও ভারতের পাটের  বাজার অনুসন্ধান ও সম্প্রসারণ করা। ভারতের উদ্ধেশ্য পুরোপুরি সফল হলেও বাংলাদেশের উদ্দেশ্য যে কি ছিল, তা এখন ভেবে দেখার বিষয়। বাংলাদেশের উন্নত মানের ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এ বছর বাজারের অভাবে সাড়ে নয় লাখ বেল পাট গুদামে পরে থাকবে। এ বছর রপ্তানীর লক্ষ ছিলো সাড়ে উনত্রিশ লাখ বেল। সে ক্ষেত্রে রপ্তানী হচ্ছে ২০ লাখগ বেল। বাংলাদেশের পাটের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্য আপনাকে জবাব দিতে হবে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ২০ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে এর জন্য বন্যাকে দায়ি করলেও বাজার কেন ক্রমশ্য সংকুচিত হয়েছে এটা সহজে বোধগম্য হতে চায় না। বিরোধী রাজনীতিক দলগুলো যখন এধরনের ব্যররথতার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করে তখন আপনি দায়িত্ব এড়িয়ে বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেন।

আপনার পদত্যাগের সংবাদে ভারতীয় পত্র পত্রিকা গুলো মর্মাহত হতে পারে, পরক্ষ ভাবে বঙ্গবন্ধু কে কটাক্ষ করতে পারে, কিন্তু আমরা তা পারিনা। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে যখন আপনাকে পদত্যাগ করতে হয় তখন কেও বিন্দু মাত্র বিচলিত হয় না। বরং অনেকেই এই ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন যে, বাংলাদেশ এখন হয়ত স্বনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হবে। আপনি চেয়েছিলেন, ক্ষমতাই থেকে বৈরী মনভাব দেখিয়ে সরকারের ব্যর্থতার বোঝা অন্যের কাধে চাপিয়ে রেহাই পাবেন। কিন্তু তা হয় না। বাংলাদেশ ব্যাসেস হিসাবে আপনার কৃতি স্বাক্ষর হয়ে থাকবে। আপনাকে আমরা তাই অশ্রু স্বজল চোখে বিদায় দিতে পারছি না। বরং ভারমুক্তির জন্যই কৃতিজ্ঞতা জানায়। আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আমরা জানি না। আপনি হয়ত প্রাক্তন মন্ত্রী মতিউর রহমানের মতন বিক্ষোভ মিছিল কিংবা কোন ভুক্ষা মিসিলের নেতৃত্ব দিতে পারেন। তিনি সে রকম মন্ত্রীদের সম্পত্তির হিসাব চেয়েছেন আপনিও সে রকম কোন বিদ্রহী কোন দাবী ছুড়ে দিতে পারেন। জনাব মতিউর রহমান ভুল করেছিলেন। শ্রমিক নেতা আব্দুল মান্নানের সাথে জনাব মতিউরের বিপ্লবী মুখোস নগ্নভাবে ছিড়ে ফেলেছেন। আপনি যথেষ্ট বিচক্ষণ। আপনার বুদ্ধিমত্তার উপর এখনও অনেকেই অবিচল আস্থা রয়েছে। তাই আমরা সঙ্গত কারণেই আশা করতে পারি, জনাব মতিউরের মতই কোন হঠকারী কাজ আপনি প্রকাশ্যে করবেন না। আপনার অতীত কার্যাকালাপ অনুযায়ী আমরা ধরে নিতে পারি, আপনী গোপন কাজেই বেশি উৎসাহী। সবশেষে আপনাকে সবিনয়ে জানিয়ে রাখি, দেশবাসী ক্রমশ্য সচেতন হচ্ছে। কোন গোপনিই যে চিরদিন গোপন থাকতে পারে না সেটা আপনার মত বিচক্ষণ ব্যক্তি যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবেন ততই দেশের জন্য মঙলদায়ক হবে। বিপ্লবের মুখোস আসনের থেকেও মুখে পক্ত করা যায় না। মুখোস মুখোসিই, ওটা খসে পড়বেই।

আপনি নিজের পতন কে বিপ্লবের বাণির বিনিময়েও আটকাতে পারেন নি।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1974.11.08-bichitra2.pdf” title=”1974.11.08 bichitra2″]