দি ডেইলি মিরর, ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জীবিত এবং মুক্ত
মিরর পত্রিকার সাংবাদিক জন পিলগার প্রতিবেদন করেন বাংলাদেশের জন্মের উপর, যে জাতি তার ঘাতকদের ফাঁকি দিয়েছে
কোলকাতা, সোমবার। পাঁচ মাস আগে আমি ভারত এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত পাড়ি দেই, এবং বাংলাদেশ নামক একটি দেশের অস্তিত্ব আছে এমন প্রতিবেদন পেশ করি; এবং জানাই বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষকে কিভাবে হত্যা করা হচ্ছে তারা স্বাধিকারের ইচ্ছা পোষণ করে বলে।
ঐদিন, মিরর পত্রিকার প্রচ্ছদে শিরোনাম ছাপা হয় “একটি জাতির মৃত্যু”। বাংলাদেশ, তখন মনে হয়েছিল, মৃতাবস্থায় জন্ম নিতে যাচ্ছে, কেননা ইতিমধ্যেই ৫,০০,০০০ মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, এবং ৭০,০০,০০০ মানুষ পালিয়ে গেছে ভারতে, যেখানে অগুনিত মানুষ মারা গেছে কলেরার মত বিভিন্ন রোগে।
তখন পশ্চিমা দেশের অধিবাসী আমরা পরোয়া করেছি খুব সামান্যই, আমরা দয়ার দান করেছি যতক্ষণ পর্যন্ত না ওদের দুঃসহ যন্ত্রণার কাহিনী আর তাৎক্ষনিক খবর নয়।
কিন্তু আসলেও, আমরা আমাদের ঔপনিবেশিক অতীতের এই বাক্সওয়ালাদের ব্যপারে আদতেই পরোয়া করিনি; আমরা পরোয়া করিনি বা বোঝার চেষ্টাও করিনি এই ঔপনিবেশিক অতীতের প্রতি তাদের বিদ্রোহকে; এবং এর উত্তরাধিকারী, পশ্চিম পাকিস্তানের স্বেচ্ছাচারী সামরিক শাসকেরা যাদের প্রায় কৌতুকপ্রদ বিভ্রম রয়েছে তাদের আর্য শ্রেষ্ঠতা নিয়ে যা নাৎসি জার্মানির সাথে তুলনীয়, এবং যাদের বাঙলা শাসন করার দৃঢ়সঙ্কল্পের মধ্যে গণহত্যার নীতিও ছিলো; আরো সঠিকভাবে বললে, একটি জাতির মৃত্যু।
আমি এখন বিবরণ পেশ করছি একটি জাতির জন্মের। বাংলাদেশ, ভারতীয় উপমহাদেশের সোনার বাঙলার ক্লাইভ, গত এক বছরে যে হারিয়েছে ১০,০০,০০০-এরও বেশী মানুষকে যুদ্ধ, ঘূর্ণিঝড় এবং অসুখে, এবং এখন সম্ভবত আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েও, বেঁচে আছে।
নৈতিক আন্দোলন
আজ সকালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ, পুরো মানব জাতির ২ শতাংশ যার অংশীভূত, স্বীকৃত হয়েছে ভারত সরকার কর্তৃক, যার সামরিক বাহিনী এইমুহূর্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাইশটি যুদ্ধক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে আক্রমণ করে যাচ্ছে।
আজ রাত এবং আগামীকালের মধ্যে অন্তত আরো এক ডজন অন্যান্য দেশ একে স্বীকৃতি প্রদান করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
এখানকার অন্যান্য সাংবাদিকদের মতো, যারা বাঙালীদের পাশাপাশি এখানে কাজ করেছেন, আমি বাংলাদেশের প্রতি আমার সমর্থন লুকানোর চেষ্টা করিনা, যেটি আমি মনে করি স্পেনের গৃহ যুদ্ধে যারা যুদ্ধ করেছিল এবং হেরেছে তাদের পর সবচাইতে নৈতিক জাতীয় আন্দোলন।
আমার এই অনুভূতি বাঙালীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা থেকে উদ্ভূত নয় যারা কিনা পৃথিবীর সবচে আকর্ষণীয় এবং হার না মানা মানুষদের মধ্যে অন্যতম, বরং এই জ্ঞান থেকে যে তাদের আজকের এই বিজয় – যা এখনো নিশ্চিত করা বাকি আছে এই যুদ্ধে ভারতের জয়ের মাধ্যমে – এসেছে আরোপিত এক দারিদ্র্য সত্ত্বেও যা মানব জাতির দুই-তৃতীয়াংশের জন্য বৈশিষ্ট্যসুচক, এবং আমাদের মতো পশ্চিমা দেশে অকল্পনীয়।
সাধারণত আমরা যারা পশ্চিমা দেশে থাকি, যারা পৃথিবীর সবচাইতে ধনী, নতুন জাতিদের, যারা গরীব, খুব দ্রুত একনায়কতন্ত্র এবং দুর্নীতির কবলে পড়তে দেখি।
ঠিক তাই ঘটেছে লাতিন আমেরিকাতে, কঙ্গোর মতো আফ্রিকার দেশে, এবং পশ্চিম পাকিস্তানে।
আমরা এই দরিদ্র জাতিগুলোর কাছে প্রচার করেছি, যাদের অস্তিত্বের উপর এমন সব হুমকি রয়েছে যা আমাদের ধারণারও বাইরে, যে প্রথমে তাদেরকে অবশ্যই ওয়েস্টমিনিস্টার বা ওয়াশিংটনের আদলে একটি সংসদীয় গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হবে, আমাদের আশীর্বাদ পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে, যা, খুব বেশী হলে, রাজনৈতিক সূত্র জড়িত ত্রাণই হবে।
শরণার্থী শিবির
কোনো ভাবে, বাংলাদেশ আমাদের ধাপ্পাবাজি ধরে ফেলেছে। যেভাবেই হোক গত ডিসেম্বর মাসে পূর্ব বঙ্গের ৯৮ শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র, এবং একজন মধ্যপন্থী মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য।
তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য ভোট দেয়নি, যারা হাজার মাইল দূরে রয়েছে; তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেই শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। এ কারণে, তারা গত মার্চ মাসে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর হাতে নিষ্পেষিত হয়েছিল।
তখন থেকে, কোন মানুষই, এমনকি ইহুদিরাও নয়, বাঙালীদের মতো এমন দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করেনি। যারা তাদের দেশে থেকে গিয়েছিল তারা মারা গেছে বলপ্রয়োগে বা না খেতে পেয়ে। যারা ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল তারা এমন এক যন্ত্রণার পথ পাড়ি দিয়ে শরণার্থী শিবিরগুলোতে পৌঁছেছে, তাদেরকে দেখে, মনে হচ্ছিল, তারা যেন আর মানুষ নেই।
ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী আক্রমণ করার আগেই গত নভেম্বরে এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে নিহত হয় দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মানুষ। বাঙলা এবং গাঙ্গেয় বদ্বীপ সবসময়ই ছিল এক ভৌগলিক কফিন।
এবং তারও অনেক আগে, ভারতের ক্লাইভ সোনার বাঙলাকে নিঃস্ব করেছে যাকে সে বর্ণনা করেছিল লুকায়িত “অশেষ ধনভাণ্ডার” হিসেবে এবং সেই সময়ের এক ইতিহাসবিদের ভাষ্যমতে, এমন এক সময় যখন কোলকাতায় বিশাল ঐশ্বর্য আহরণ করা হয়েছে সেক্ষণে ৩,০০,০০,০০০ মানুষকে হীনাবস্থার শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অবশেষে, ১৯৪৭ সালে, যুক্তরাজ্য বাঙলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এবং এর দারিদ্র্য নিশ্চিত করে, কেউ কেউ বলে, এক শতাব্দী বা তারচেয়েও বেশী সময়ের জন্য।
বাঙলা এবং ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর দেশের মানুষদের সম্বন্ধে লিখেছেনঃ “মানুষগুলোর শরীর কত ছোট, দুঃসহ যন্ত্রণার সময় তাদের শক্তি কি বিশাল”। কিন্তু এই অপরাহ্ণে আমার ট্যাক্সি যখন কোলকাতার সার্কাস এভিনিউয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণে ইতিহাসের কালিমা দূর হয়েছে।
হাতে হাত বেঁধে
এক মহল্লা দূরে থাকতেই আমি কয়েকশত বাঙালির গুঞ্জন এবং গানের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম (রাজনীতি এবং গানের ব্যপারে ওরা ওয়েলস প্রদেশের বাসিন্দাদের মতো) এবং আমি যখন সেখানে পৌঁছাই তারা একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে হাত বেধেঃ এবং অনেকেই কাঁদছিল (তাদের অনুভূতি প্রকাশে তারা ইহুদীদের মতো)।
একটি বেতার যন্ত্র থেকে খবর শোনা যাচ্ছিল যে, বহু শতাব্দী পরে, বাঙলা আজ আনুষ্ঠানিকভাবে এক দেশ হিসেবে স্বীকৃত। এর সমতুল্য হিসেবে আর একটি ঘটনার কথাই আমি চিন্তা করতে পারছি যেটি ছিল ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান।
দূতাবাসের বাগানে নির্বাসিত সংসদ সদস্যরা, স্যুট এবং সাদা সার্ট পরিহিত, দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তি বাহিনীর দাড়িওয়ালা তরুণদের সাথে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার যোদ্ধা। যে জাতীয়তাবাদ তারা প্রকাশ করছিল তা, তাদের মতোই, শান্ত। তারা এই জাতীয় সংগীতটি গাইছিলঃ
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি!
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রানে পাগল করে
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে
আমি কি দেখেছি মধুর হাসি
আমার সোনার বাংলা
আবর্জনা খোঁটা
এবং এরপর তারা কোলকাতার রাস্তায় নেমে আসে ব্রিটিশ রাজের সোনার বাংলার মাছিপড়া শবদেহের উপর পয়োনালীর পাশে পড়ে থাকা ছোট পুঁটলিগুলো যার কিছু ঘুমিয়ে বা অসুস্থ বা মৃত, এবং পাখির মতো আবর্জনা খুঁটে বেড়ানো শিশু, এবং ভিখারি এবং কুষ্ঠরোগী এবং এক বা দুইজন সাদাচামড়ার সাহেবদের পাশ কাটিয়ে।
বৃদ্ধ লোক এবং শিশুসমেত ছেঁড়া কাপড় পড়া নারী, এবং রাগী-চোখের তরুণ যুবকেরা দরজা এবং গলিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে এবং ট্রাম এবং বাস থেকে নেমে এসে যোগ দিচ্ছে তাদের মিছিলে, এবং চিৎকার করছে “জয় বাংলা”, যার মানে “বাঙালী জাতি দীর্ঘজীবী হোক”।
আমি যখন দুতাবাস ছেড়ে চলে আসি তখন আমার এক বন্ধু, মওদুদ আহমেদ, যে একজন অন্যতম সদস্য নতুন, সম্ভবত অসাম্প্রদায়িক এই সরকারের, চিৎকার করে আমাকে বলেঃ “তোমার মনে পড়ে তোমার ‘একটি জাতির মৃত্যু’-র কথা। দয়া করে ওদেরকে বোলো যে এখন একটি নতুন শিরোনামের প্রয়োজন দেখা দিয়েছেঃ একটি জাতির জন্ম”।