You dont have javascript enabled! Please enable it!

“শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়” – বাংলাদেশ গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
১০ এপ্রিল ১৯৭২
ঢাকা

The first session of the Constituent Assembly of Bangladesh was held at 10th April 1972. The father of the nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman delivered his historic speech on this occasion. In this post we publish the full text of his speech for our readers, as well as a video clip from Associated Press. Lots of inspiring words were there that is still relevant for the developmental process of building this new nation.

 

(সেদিনের ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করুন)

চেয়ারম্যান নির্বাচন ও শপথ গ্রহণ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী): এই পরিষদ স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার মনোনীত না হওয়া পর্যন্ত পরিষদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করার জন্য এবং পরিষদের অন্যান্য দায়িত্ব পালন করার জন্য পরিষদ সদস্যদের মধ্যে প্রবীণতম পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে মনোনীত করছি।’ (মনোনীত সভাপতির আসন গ্রহণের পর জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন) জনাব সভাপতি ও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। আমি, আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, দৃঢ় প্রত্যয়ের সহিত শপথ করছি যে, আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করব এবং আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করতে যাচ্ছি, তা সততার সঙ্গে পালন করব।

(সমবেতভাবে সদস্যবৃন্দের শপথ গ্রহণ)
(সমবেতভাবে সদস্যবৃন্দের শপথ গ্রহণ)

জনাব সভাপতি ও আপনারা সবাই আমার সঙ্গে শপথ গ্রহণ করুন – ‘আমি (নিজ নিজ নাম বলুন) দৃঢ় প্রত্যয়ের সহিত শপথ গ্রহণ করছি যে, আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণ করব এবং আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করতে যাচ্ছি, তা সততার সঙ্গে পালন করব।’
(শপথ গ্রহণ সমাপ্ত) ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা শপথপত্রে স্বাক্ষর করে নিজ নিজ স্থানে রেখে দিন।

কার্যপ্রণালী বিধি প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী): জনাব সভাপতি সাহেব, আমি একটি বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমার মনে হয় একটি বিতর্কমূলক জিনিস নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, যার জন্য একটু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমরা যে আজকে এই এসেম্বলীতে বসেছি, এই গণপরিষদে বসবার জন্য একটি কার্যপ্রণালী বিধি দরকার। তা না হলে সদস্যরা এখানে বসবেন কি করে? তাই রাষ্ট্রপতি একটি অস্থায়ী কার্যপ্রণালী বা কার্যবিধি আমাদের দিয়েছেন। এখন এই হাউস থেকে সাব-কমিটি গঠন করা হবে, যার সামনে সেটা পেশ করা হবে এবং সেখানে সুন্দরভাবে এর উপর একটা কার্যপ্রণালী বিধি স্থির করা হবে। এখন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে যে অস্থায়ী কার্যপ্রণালী বিধি এই হাউসে পেশ করা হয়েছে, তাতে আপনাদের অনুমোদন প্রয়োজন। যে পর্যন্ত হাউস কমিটি এই পরিষদের কার্যপ্রণালী বিধি স্থির না করবেন, সে পর্যন্ত কাজ চালাবার জন্য একটি বিধানের প্রয়োজন আছে। এর দরকার আছে এই জন্য যে, আপনারা সদস্য হিসাবে যাতে এখানে বসতে পারেন। আমি বুঝতে পারি না এর মধ্যে এত আলোচনার কী আছে। আমি আশা করি আর সময় নষ্ট না করে আপনারা অস্থায়ী কার্যপ্রণালী বিধি গ্রহণ করবেন।

শোক-প্রস্তাব:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও স্পীকার সাহেবের অনুমতি নিয়ে আমি একটা শোক-প্রস্তাব উত্থাপন করতে চাই। জনাব স্পীকার সাহেব, “বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করে বাংলার যে লক্ষ লক্ষ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের মহান আত্মার প্রতি এই পরিষদ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে এবং তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে যে সমস্ত মাননীয় পরিষদ সদস্য তাঁদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে উজ্জীবিত করেছেন, সেই সমস্ত স্মরণীয় ও বরণীয় বীর সহকর্মী সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এই পরিষদ শোক জ্ঞাপন করছে। মাননীয় পরিষদ সদস্য জনাব আমিনুদ্দিন, জনাব আমজাদ হোসেন, জনাব মসিউর রহমান, জনাব নজমুল হক সরকার, জনাব আব্দুল হক, ডাক্তার জিকরুল হক, জনাব সৈয়দ আনোয়ার আলী ও জনাব এ. কে. সরদার মুক্তি সংগ্রাম চলাকালে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁরা ছাড়াও গত নির্বাচনের পর পরই জনাব আহমদ রফিক গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তির শিকারে পরিণত হন এবং চট্টগ্রামের বীর সন্তান ও আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জনাব এম. এ. আজিজ ইন্তেকাল করেন। এই সমস্ত সংগ্রামী নেতার বিদেহী আত্মার সাথে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শহীদ ভাই-বোনেরা, যারা দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আত্মবলি দিয়েছেন ও ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তাঁদের জন্য এই পরিষদ তাদের আত্মদানের গৌরবময় স্মৃতিকে চিরকাল স্মরণ রাখবে এবং এই পরিষদকে তাদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম চিরকাল অনুপ্রাণিত করবে। এই পরিষদ তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।”
আমি আশা করি সকলে এক মিনিট দাড়িয়ে নীরবতা পালন করবেন। জনাব স্পীকার সাহেব, আপনি এক মিনিট তাদের আত্মার জন্য মাগফেরাত কামনা করবেন।

(সদস্যরা দাড়িয়ে মোনাজাত করেন এবং জনাব স্পীকার মোনাজাত পরিচালনা করেন।)

স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কীয় প্রস্তাব:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে আমি আজ কয়েকটা বিষয় এখানে আলোচনা করতে চাই। আজ আমরা এখানে গণপরিষদের সদস্য হিসাবে বসবার সুযোগ পেয়েছি। আমরা আজকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পেরেছি এবং বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা যে আজ বাংলাদেশের সার্বভৌম গণপরিষদের সদস্য হিসাবে কাজ করতে পারছি, সে সুযোগ এ দেশের জনসাধারণ তাদের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক দিন থেকে শুরু হয়। জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, ত্রিশ লক্ষ ভাই-বোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসাবে নিশ্চয়ই তাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করব এবং মনে রাখব। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে রক্ত যেন বৃথা না যায়। রক্ত দিয়েছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই-বোন, নিরীহ জনসাধারণ। রক্ত দিয়েছে এ দেশের কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীরা, রক্ত দিয়েছে এ দেশের জনগণ, রক্ত দিয়েছে সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা, রক্ত দিয়েছে পুলিশ, রক্ত দিয়েছে ভূতপূর্ব ই.পি.আর., রক্ত দিয়েছে আনসাররা, মোজাহেদরা। রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙালি, এমনকি সরকারী কর্মচারীরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খান সেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে, তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায় নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পশু সেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ায় আর কোথাও নাই।

আজ তাদের কথা আমরা স্মরণ করছি, স্মরণ করতে হয় আমার সহকর্মী সভ্যবৃন্দের কথা, যারা সেই গত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁদের অনেককেই বন্দী করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে – তাঁদের নামও ঐ প্রস্তাবে রয়েছে যে প্রস্তাব আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদে পেশ করেছি। তাছাড়া এই দেশের জানা অজানা লক্ষ লক্ষ লোক, আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য যারা আমাদের এই সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন, দলমত নির্বিশেষে যাঁরা স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাঁদের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। জনাব স্পীকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সঙ্গে সঙ্গে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরি করতে হবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আজ আমরা যে সংবিধান দেব, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তারা। দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। জনাব স্পীকার সাহেব, জাতির কাছে আমাদের একটা কর্তব্য রয়েছে, একটা বিরাট কর্তব্য আছে। আমি আমার বক্তৃতা বড় করতে চাই না। কিন্তু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্য যারা সংগ্রাম করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের সেই ইতিহাস আজ এখানে পর্যালোচনা না করলেও চলবে। কিন্তু বিশেষ কয়েকজন নেতার কথা স্মরণ করছি, যারা গণতন্ত্রের পূজারী ছিলেন; যেমন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী, শেরে-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, বর্বর পাক বাহিনীর হাতে নিহত ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। আর কলম দ্বারা সংগ্রাম করেছেন সেই জনাব তোফাজ্জল হোসেন – আমাদের মানিক ভাই। এঁদের কথা শ্রদ্ধার সাথে আমরা স্মরণ করতে চাই। স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যারা জীবন দিয়েছেন, যাঁরা কারাগারে জীবন কাটিয়েছেন। গণতন্ত্রকে এ দেশে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যারা সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাদের ইতিহাস যদি লেখা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা জানতে পারবে না এই সংগ্রামের পিছনে কারা ছিলেন। গত বছর নির্বাচন হল। সেই নির্বাচনের পূর্ব থেকেই আমাদের জানা ছিল যে, বাংলাদেশ জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদেরকে কলোনী এবং বাজার করে রাখতে চায়। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত করছিল, আমাদের নাগরিক অধিকারের উপর আঘাত করে আমাদেরকে কলোনী করে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের সংগ্রাম তখন থেকেই চলছিল। আমরা জানতাম সংগ্রামকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে সংগ্রাম এগিয়ে আজ চরম সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। ২৫শে মার্চ তারিখের ইতিহাস আপনাদের জানা আছে। সেইদিন বর্বর পাক হানাদার বাহিনী কোন আইন-কানুন মানে নাই। কোন সভ্য দেশে তাদের কাজের তুলনা পাওয়া যায় না। প্রত্যেক সভ্য দেশে যুদ্ধের একটা নিয়ম আছে। কোনরূপ ওয়ার্নিং না দিয়ে অতর্কিতে কাপুরুষের মত বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে, দুধের বাচ্চাকে পর্যন্ত হত্যা করে তারা এক জঘন্য লীলায় মেতে উঠেছিল। অর্ডার দিয়েছিল আওয়ামী লীগের লোক, যাকে পাও, তাকেই হত্যা করো, কোনরূপ দয়া-মায়া নাই। তাদের জঘন্য কাজ-কারবারের এমন সমস্ত ইতিহাস আমাদের হাতে আছে, যা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। আমাদের হাতে একজন জেনারেলের দস্তখত করা কাগজ ধরা পড়েছে। তাতে আছে লুটপাট কর। এমনকি পাশবিক অত্যাচারের কথাও আছে। বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র সাত কোটি বাঙালির উপর কুকুরের মত লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ ঘোষণা করত, তবে আমরা সেই যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারতাম। কিন্তু তারা অতর্কিতে ২৫শে মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে। দেশবাসী জানেন একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা হাওয়ার উপর থেকে হয় নাই। যদি কোন নির্দেশ না থাকত, তবে কেমন করে একই সময়ে, একই মুহূর্তে সব জায়গায় সংগ্রাম শুরু হলো? এখন যদি আমি ভারত সরকারের বিষয়ে না বলি, তাহলে অন্যায় করা হবে। আমার দেশের জনসাধারণ যখন প্রাণভয়ে ঘর বাড়ি ছেড়ে, ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পায়ে হেঁটে ভারতবর্ষে যায়, তখন ভারতের জনসাধারণ তাদেরকে বুকে টেনে নেয়, ভারতের জনসাধারণ, পশ্চিম বঙ্গের জনসাধারণ, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং আসামের জনসাধারণ, বিশেষ করে, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। কারণ তাঁরা আমাদের জনসাধারণকে বুকে টেনে নিয়েছেন। স্মরণ করি ভারতের সেনাবাহিনীর ঐ সমস্ত জোয়ানদের, যাঁরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করেছে। আমি স্মরণ করি রাশিয়ার জনসাধারণ ও সরকারকে, যাঁরা নিশ্চিতভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। তাঁরা প্রকাশ্যে আমার গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং বাংলাদেশে ধ্বংসলীলা করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। স্মরণ করি গ্রেট বৃটেনের জনসাধারণকে, পশ্চিম জার্মানীর জনসাধারণকে, জাপানের জনসাধারণকে, এমনকি আমেরিকার জনসাধারণকে, যাঁরা আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। যাঁরা যাঁরা সমর্থন করেছিলেন, তাঁদের সকলকে আমাদের এই গণপরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। এমনকি জাতিসংঘে রাশিয়া তিনটি ভেটো দিয়েছিল; তা না হলে সেখানে যে ষড়যন্ত্র চলছিল, তাতে বাংলাদেশের অবস্থা কী হতো, তা বলতে পারি না। যে সমস্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশ আমাদেরকে সমর্থন দিয়েছিল, বিশেষ করে, পোল্যান্ড, তাদের প্রত্যেককে এবং তাদের জনসাধারণকে আমি এই পরিষদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাতে চাই এবং স্মরণ করতে চাই।

জনাব স্পীকার সাহেব, এসব কথা বলতে গেলে ভাষা আসে না, মানুষ ভাবপ্রবণ হয়ে যায়। সেজন্য এগুলি বলা আমার পক্ষেও কষ্টকর; কারণ, আমি ভাবপ্রবণ হয়ে যাই। আমরা দেখতে পাই আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের অত্যাচার করা হয়েছে এবং আমাদের হাজার হাজার ছেলে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্য কিছুই করতে পারি নাই। আমাদের বাংলার গ্রাম-কে-গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমাদের ধন-সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে, রাস্তাঘাট ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সী নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এরকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তাঁরা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন, সেজন্য তাঁদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। আর যে সমস্ত দল আমাকে সমর্থন করেছে তাদেরকেও আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিতে চাই এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই।

জনাব স্পীকার সাহেব, আমাদের সামনে আজকে বিশেষ কর্তব্য হলো জাতিকে একটা সংবিধান দেওয়া এবং যত তাড়াতাড়ি হয়, সেই সংবিধান দিবার চেষ্টা করা হবে। আমার সহকর্মী ভাইয়েরা, যাঁরা এখানে উপস্থিত আছেন, আপনার মাধ্যমে তাঁদের সবাইকে বলে দিতে চাই যে, আপনারা গাছতলায় বসে যুদ্ধ করেছেন, না খেয়ে যুদ্ধ করেছেন, পরনের কাপড়ও ছিল না। আমার সহকর্মীদের আত্মীয়-স্বজনের উপর অত্যাচার করা হয়েছে; তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেম্বারদের যে অধিকার পাওয়ার আছে, সে অধিকার পুরাপুরি দেবার ক্ষমতা আমার নেই। যদি মাইক্রোফোন বিদেশ থেকে আনবার চেষ্টা করতাম, তাহলে তিন মাস সময় লাগত, অনেক দেরী হয়ে যেতো। এই এসেম্বলী-ভবন যে অবস্থায় ছিল, তাতে মাত্র ৩০০ মেম্বারের বসার জায়গা ছিল; আজকে সেখানে ৪৫০ জন বসেছেন। যদি এই এসেম্বলী-ভবনও না থাকত, তবে গাছতলায় বসেও আমার মেম্বাররা সংবিধান রচনা করতেন -এই সুনিশ্চিত আশ্বাসটুকু দিতে পারি। আজকে আমাদের জনগণ কী অসুবিধায় আছে। তাদের থাকার মত ঘর নেই; আমরা কিছু দিতে পারছি না; মানুষ কষ্ট করছে। হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে; তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। অর্থ নাই, জনসাধারণকে সুবিধা করে দিতে পারছি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন – আপনার কাছে আবার বলছি – যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হলো সংবিধান তৈরী করা। আমরা প্রোগ্রাম অনুযায়ী আগামীকাল আবার বসব। শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করব তা নয়; দলমতনির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একট সুষ্ঠ সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইব। এই সংবিধানে মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে। আমরা গত তেইশ বছরে কী দেখেছি – শাসনতন্ত্রের নামে অশাসনতন্ত্র, জনগনের নিরাপত্তার নামে ‘মার্শাল-ল’, জনগণের দাবী আদায়ের নামে প্রতারণা। আর বাংলাদেশের কথা উঠলেই “হিন্দুস্থানের দালাল” এই ধরনের কথা সারা জীবন শুনে আসছি। সে সব যাতে এদেশ থেকে উঠে যায়, সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এবং সে বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।

জনাব স্পীকার সাহেব, আপনি এই পরিষদের স্পীকার হয়েছেন। আবার আপনাকে জানাতে চাই যে, আমরা একটা গণমুখী সংবিধান তৈরী করতে চাই এবং সেই সঙ্গে এই আশ্বাস দিতে চাই যে, আপনি যতক্ষণ নিরপেক্ষ থাকবেন, আমাদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। আপনার কর্তব্যটুকু আইন ও আপনার বিবেক অনুযায়ী এবং পার্লামেন্টারী কনভেনশন মেনে নিয়ে পালন করবেন এই আশা করি। আপনি কোন্ দল বড়, কোন্ দল ছোট, তা দেখবেন না; কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বিচার ও ইনসাফ করবেন। আমার দলের পক্ষ থেকে আপনাকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা জানাব।

এখানে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, নজরুল ইসলাম সাহেব তা পড়েছিলেন, আবার সংশোধন করে তা পেশ করা হবে। আপনার মাধ্যমে আমার সদস্য ভাইদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি এবং আপনাকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারপর এসেম্বলীর কর্মচারীরা রাতদিন পরিশ্রম করে এত তাড়াতাড়ি যে এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন, সেজন্য তাঁদেরকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কারণ, আমি জানি তাঁরা মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে খুব পরিশ্রম করে এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন। তারপর আমি ধন্যবাদ জানাই এই রিপোর্টারদেরকে, এখানে যাঁরা কাজ করছেন। তাঁরা যেন পরিষ্কার, সুন্দর করে রিপোর্ট তৈরী করেন, তাতে ভুল-ভ্রান্তি যেন না হয়; কারণ, এটা একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে; এই ইতিহাস যেন নষ্ট না হয়। এই কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

জনাব স্পীকারঃ এই হাউসের সামনে যে প্রস্তাব ছিল তা সংশোধনের পরে যে আকারের হয়েছে, আমি তা পড়ে শোনাচ্ছি। সংশোধিত প্রস্তাব হচ্ছেঃ

“বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, বীরাঙ্গনা, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙালিরা, সাবেক ই.পি.আর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও রাজনৈতিক নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আজকের দিনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটে যথাযথভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদ সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁদের স্মরণ করছে।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিবনগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল এই সঙ্গে এই গণপরিষদ তাতে একাত্মতা প্রকাশ করছে।
স্বাধীনতা সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সঙ্গেও এ পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।

এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করছে।”

এই প্রস্তাবের পক্ষে যারা আছেন, তারা ‘হা’ বলবেন ……
সদস্যগণঃ (সমস্বরে) “হাঁ”।
(‘না’ কেউ বলেন নাই)

জনাব স্পীকারঃ এই প্রস্তাব গৃহীত হলো।
জনাব নুরুল হকঃ জনাব স্পীকার সাহেব, আমাদের ৪ লক্ষের উপর বাঙালি এখনও পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরতে পারে নাই। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিকট তাদের সম্বন্ধে জানতে চাই। আমি এই হাউসের মাধ্যমে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, যাতে পাকিস্তানে আটকে-পড়া বাঙালিরা অনতিবিলম্বে দেশে ফিরে আসতে পারে এবং সে সম্বন্ধে সর্ব প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আমার অনুরোধ এ সম্বন্ধে এই হাউসে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হোক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ জনাব স্পীকার সাহেস, নুরুল হক সাহেব যে কথা বলেছেন, তার উত্তরে আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি যে, পাকিস্তানে যে ৪ লক্ষের অধিক বাঙালি আটকে পড়ে আছে, তাদের বিষয়ে আমরা সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছি। বাঙালি পাকিস্তানের আবদার আমাদের দিক দিয়ে সমস্ত দুনিয়ার রাষ্ট্র প্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করা… করা হয়েছে এবং চেষ্টা হচ্ছে তাদের ফিরিয়ে আনার জন্য। এই রকমের অনেক প্রশ্নই আছে এবং এ সম্বন্ধে চেষ্টার ত্রুটি কেউই করছে না। সরকার বারবার এটাকে বলেছে, সভা-সমিতিতে বলেছে, ফরেন এফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে, জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি সমস্ত দেশে প্রধান… রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে আমি চিঠি পাঠিয়েছি যে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি যাতে তারা পাকিস্তানের সরকারের কাছে প্রস্তাব করেন এবং আমার লোক যাতে ফেরত দেয়, এও বলেছি যে তাদের যারা এখানে থাকবার চায় না তাদেরও আমি ফেরত দিতে রাজি আছি। তবে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হবে। এইটা নিয়ে পাকিস্তান খেলছেন। কিন্তু আমার যারা পশ্চিম পাকিস্তানে আছে তারা যুদ্ধ অপরাধী নয়। তারা সেখানে কাজ করতে ছিলেন, তাদের সঙ্গে এদের একভাবে বিচার করা চলে না। সে জন্যই আমরা দাবি করেছি যে আমাদের লোক যারা আছে ফেরত দ্যাও, তোমাদের যারা এই বাংলাদেশে আছে আমরা ফেরত দিচ্ছি, কিন্তু যুদ্ধ অপরাধী… জঘন্য যুদ্ধ অপরাধী যারা, যারা এদেশে পাশবিক অত্যাচার করেছে, লুট করেছে, হত্যা করেছে এবং যারা দুনিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ল আইন মানে নাই তাদের এখানে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হবে এবং আমি আশা করি মেম্বার সাহেবদের একটা কথা মনে রাখা দরকার যে প্রস্তাব আনার আগে পার্টির কাছে আলোচনা করেই প্রস্তাব আনবেন। ভবিষ্যতে এটাই আশা করি, এটাই নিয়ম। না হলে পার্টির শৃঙ্খলা নষ্ট হয়।

আমি আশা করি স্পিকার সাহেব, যে আমাদের আজকের এজেন্ডা এইখানেই শেষ।

Reference:
বঙ্গবন্ধুর অডিও ভাষণ, পিপলস ভয়েস, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান

বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!