You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৭ই জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ৩রা মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

দেশবাসী বুলেট নয় ব্যালট চায়

ইতিহাসের এ চিরন্তন সত্যকে আবার নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিলেন জাতির জনক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের দেশের কতিপয় উল্লম্ফনকারী নাবালক অর্বাচীনদের যারা অস্ত্র-ঝনাৎ-এর হুমকি দিয়ে সরকার উৎখাতের এক অপচেষ্টায় মেতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সুখ ও শান্তি বিঘ্নিত করতে চাইতে তাদের।
বঙ্গবন্ধু এ হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন গত পরশু আমাদের জাতীয় সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম দিনে ভোলায় আততায়ীর গুলিতে নিহত সংসদ সদস্য জনাব মোতাহার উদ্দীন আহমেদের উপর আনীত এক শোক প্রস্তাবে ভাষণ দানকালে।
তিনি বলেন, অস্ত্রের ভাষায় কোনোদিনও কোনো জনপ্রিয় বা জনপ্রতিনিধি সরকার উৎখাত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে এর কোনো নজিরও নেই। বরং যারাই কখনো কোনো বহির্প্রলোভনে বা অপরিপক্ক চেতনাবোধে উদ্দীপত্ হয়ে কোনো জনপ্রিয় সরকার উৎখাতের অপচেষ্টায় মেতেছে, তারাই জনতার দাঁত-ভাঙা জবাব পেয়ে বেঘোরে নিজের অস্তিত্ব হারিয়েছে। কারণ, যে যতোই উল্লম্ফন দিক বা হা-হুংকার ছাড়ুক না কেন, সমস্ত ক্ষমতার উৎসই জনতা, অস্ত্র নয়।
তাই তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন যে, বাংলার শত সমস্যা জর্জরিত মানুষের শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশী জনের সজাগ রায়ের অনুমোদনে নির্বাচিত জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ সরকারকে কেউ যদি অপছন্দ করে বা কেউ যদি একে উৎখাত করতে বাসনা পোষণ করে থাকে, তবে তিনি তাদের সমস্ত সুসভ্য গণতান্ত্রিক বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা ‘নির্বাচন’ যুদ্ধের মাধ্যমে আসতে উপদেশ দেন।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচনে বাংলার জাগ্রত সংগ্রামী জনতা যদি তাদের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সরকারের বিরুদ্ধে রায় দান করে, তবে স্বেচ্ছায় আওয়ামী লীগ সমস্ত সরকারী ক্ষমতা থেকে সরে এসে ‘বাংলার আমানত’ জন-নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে সানন্দে তুলে দেবে।
কিন্তু অসভ্য রাজনীতি বা নির্মম অমানবিক অন্যায় নীতির বর্বরতম পদ্ধতি গুপ্তহত্যা বা রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যার মাধ্যমে কখনোই সরকার উৎখাত করা যায় না, কিম্বা, কোনো সর্বস্বীকৃত আদর্শও প্রতিষ্ঠিত করা যায়না। বরং এতে সর্বক্ষেত্রে সাধারণ নিরীহ জনজীবনের দৈনন্দিন শান্তি বিঘ্নিত হয়, যে জন্য জনতাও তার সমুচিত জবাব দিতে সব সময়েই প্রস্তুত থাকে। এসব শান্তি ভঙ্গকারী দুষ্কৃতিকারীরা কখনোই দেশের বা জনগণের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়, তাই তারাও জনতা-বিচ্ছিন্ন থেকে তিলে তিলে বিবেক দহনে দংশিত হয়।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে ফিল্ড মার্শাল আর জেনারেলদের মোকাবেলা করেছে। কিন্তু যেহেতু, আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যে উদগ্রীব ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেজন্যেই এ পর্যন্ত এ সহিষ্ণুতা দেখানো হয়েছে। কিন্তু সম্মুখ সমরে এসব গণবিরোধীদের এক মিনিটও টিকে থাকবার ক্ষমতা নেই বলে তিনি জানান।
তিনি গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত বিভিন্ন আওয়ামী লীগ কর্মীদের কয়েকজনের নামোল্লেখ করে বলেন যে, পাক আমলে বর্বর খান সেনারাও এদের গায়ে হাত উঠাতে পারেনি, অথচ, স্বাধীন দেশে এদের গায়ে কে হাত উঠালো সে বিষয়ে ভাবনার অবকাশ আছে।
বঙ্গবন্ধু নিহত সংসদ সদস্যের বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাগুণ আলোচনা করে সবশেষে মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
আমরাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আমাদের বিশ্বাস, বাংলার জাগ্রত মানুষও তার এ খেদোক্তি ও বাংলার বর্তমান নাজুক রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার অকাট্য বিশ্লেষণের উপর সম্পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করবে।
কারণ, আমরা সাধারণ মানুষ সবাই জানি, বঙ্গবন্ধুর সমস্ত বক্তব্যের পেছনেই একটা অকাট্য সত্য লুকিয়ে আছে। সত্যিই, আমাদের বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন কতিপয় সমাজবিরোধীর দৌরাত্ম্যে দারুণভাবে বিপর্যস্ত। এরা কখনোই আমাদের বা দেশের প্রকৃত বন্ধু হতে পারেনা। তাহলে তারা গোপন চোরাই পথে আমাদের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তা এমন গুপ্তহত্যা ও অপকর্মের মাধ্যমে বিঘ্নিত করতো না। যেখানে সরকার নিজেই বার বার বলছে যে, ‘আমাকে অপছন্দ হয়, ব্যালট বা নির্বাচনের মাধ্যমে আসো, কিন্তু বুলেট বা অস্ত্রের হুমকিতে নয়,’ সেখানে বার বার হুমকি কি এক পরোক্ষ দুর্বলতার পরিচায়ক নয়?
বাংলার মানুষ তার জীবনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সয়েছে, বহু রক্তও দিয়েছে। এখন সে আর কিছুই চায়না, চায় শুধু এক মুঠো শান্তি। আর সে শান্তি কখনোই অস্ত্রের ভাষায় অর্জন করা সম্ভব নয়, সে কথা সে আজ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। তাই কোনো রকমের মিথ্যে প্ররোচনা বা উস্কানিতে তারা আজ ভুলতে রাজী নয়। যেদিন অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল, সেদিন বাংলার মানুষ অস্ত্রের মুখে বুকের তাজা চাপ চাপ রক্ত ঢেলে দিয়েছে, কিন্তু আজ আর অস্ত্রের প্রয়োজন নেই, অস্ত্রের ভাষা সুদূরপরাহত। এ অস্ত্র ব্যবহৃত হবে শুধু বৈদেশিক আক্রমণের মুখে, দেশ প্রতিরক্ষায়।

আওয়ামী লীগের এ কাউন্সিল অধিবেশন জাতিকে নতুন আশ্বাস দিক

আগামীকাল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হচ্ছে। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান অধিবেশনের উদ্বোধন করবেন। আওয়ামী লীগ দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল। গত সাধারণ নির্বাচনে শতকরা প্রায় আশি ভাগ ভোট পেয়ে শতকরা সাতানব্বইটি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছিল। গণতান্ত্রিক বিশ্বে এ ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয়ের ইতিহাস বিরল। আমাদের মাতৃভূমিকে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তিদানের জন্যে আওয়ামী লীগ তার জন্মের পর থেকে সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। সবশেষে আওয়ামী লীগই দেশের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র নেতৃত্ব প্রদান করেছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন জন্ম লাভ করেছিলো তখন দেশে মুসলিম লীগের প্রতাপ ছিল সীমাহীন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উগ্রতার মুখে আওয়ামী লগের জন্ম ছিল অসাম্প্রদায়িক বক্তব্য নিয়ে। তৎকালের প্রতিষ্ঠাতা নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সুযোগ্য নেতৃত্বই সেদিন সংগঠনের দৃঢ়তা ও ব্যাপ্তি লাভে সহায়ক হয়েছিল। আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই আওয়ামী লীগ সংগঠন আজ বহু ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামের নেতৃত্বের দাবীদার। সর্বোপরি আওয়ামী লীগ আজ ধন্য বঙ্গবন্ধুর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে পেয়ে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এদেশের রাজনীতির একদিন মোড় ফেরানো সম্ভব হয়েছিল। দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা ছিল আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের ব্যাপকভাবে কাউন্সিল অধিবেশন হয়নি নানা কারণে। এই অধিবেশন সে তুলনায় স্বতন্ত্র। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু প্রতিনিধি এ অধিবেশনে ইতিমধ্যেই যোগদানের কথা ঘোষণা করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, জিডিআর, ভিয়েতনাম থেকেও প্রতিনিধিরা আসছেন। এ সকল বিদেশী প্রতিনিধিদের যোগদানের কারণে সম্মেলনের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে অপরিসীম। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের উল্লেখিত কাউন্সিলের গুরুত্ব প্রসার লাভ করেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বাস্তবায়নের নিমিত্তে আওয়ামী লীগকে এবারের কাউন্সিলে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। সর্বোপরি দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেভাবে ষড়যন্ত্র চলছে তা প্রতিরোধের জন্যে এবারের আওয়ামী লীগ কাউন্সিলকে নতুন প্রত্যয়ে সবকিছু পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
সম্প্রতি দেশের একটি হতাশ রাজনৈতিক দল যেভাবে হুমকি প্রদান করেছে তা অবশ্যই উল্লেখ্য বিষয়। একটি গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় বিদ্যমান থাকা অবস্থায় এহেন ন্যক্কারজনক অস্ত্রের হুমকি শুধু অন্যায়ই নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগেও এ ধরনের হুমকি অভিযুক্ত হতে পারে। সরাসরি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশের মতো মারাত্মক স্বীকোরোক্তিও তাদের রয়েছে। আমাদের সরকার এর বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থাই গ্রহণ করুন না কেন আসন্ন কাউন্সিল অধিবেশনের পরিপ্রেক্ষিতে তথাকথিত ঐ হতাশ রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ নিদারুণ সন্দেহজনক। এরা শুধু জাতীয় প্রতিক্রিয়াশীলদেরই মুখপাত্র নয়, আন্তর্জাতিক কোনো বিশেষ ষড়যন্ত্রেও এরা এজেন্ট। বিদেশী প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে এরা এমন কিছু করতে চায় যাতে করে বিশ্বজোড়া বঙ্গবন্ধুর খ্যাতি ও ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় এবং দেশের দুর্নাম হয়। জাতির সামনে এ ধরনের রাজনৈতিক দলগুলো একটি স্থায়ী শত্রু। বিগত এশীয় শান্তি সম্মেলনের সময়ও এমনি এক প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হুমকি প্রদান করেছিল, ভিয়েতনামের সংহতি দ্বীপ তারা ভেঙ্গেছিল। সেদিনও তাদের উদ্দেশ্য ছিল এশীয় শান্তি সম্মেলনে যোগদানকারী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সামনে বঙ্গবন্ধুর মহান ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তিকে ছোট করা, দেশের প্রতিষ্ঠিত সুনামকে হেয়প্রতিপন্ন করা। বস্তুতঃপক্ষে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার আজ বাংলার জনগণ হতে চলেছে। আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যত সংগ্রামী কর্মসূচী আমরা আশা করি। দেশের শত্রুর মোকাবেলার জন্যে একটি বাস্তব পদক্ষেপ আওয়ামী লীগ তার কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন বলেও দেশবাসী আশা করে। কেননা আমরা বিশ্বাস করি—আওয়ামী লীগ ও তার মহান নেতাই পারেন দেশের প্রগতিকে ত্বরান্বিত করতে—জাতিকে সুসংহত ও সুশৃঙ্খল করে গড়ে তুলতে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আসন্ন কাউন্সিল অধিবেশন জাতিকে একটি নবতর বাস্তব আশ্বাস প্রদান করুক এটাই আমাদের ঐকান্তিক কামনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!