You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রতিরোধ যুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ বাহিনী

সাক্ষাৎকারঃ মোঃ আসমত আলী আকন্দ
(১৯৭১ সালের পূর্বে রাজারবাগ পুলিস রিজার্ভ অফিসের প্রোসিডিং সেকশনে এ-এস-আই হিসেবে কর্মরত ছিলেন)
এস, আই অব পুলিশ, রমনা থানা, ঢাকা
১০-১-৭৪

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আমি রাজারবাগ রিজার্ভ অফিসে কাজ করছিলাম। আমাদের রিজার্ভ অফিসের বাইরে সহস্র বিক্ষুদ্ধ জনতা বড় বড় গাছ ও ইট পাটকেল দিয়ে ব্যারিকেড তৈরী করেছিলো। সন্ধ্যার সময় এ সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশের রিজার্ভ অফিস আক্রমণ করবে। এ সংবাদ শোনার পরে আমি রাত সাড়ে ন’টার সময় তেজগাঁও থানার কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তাকে ঢাকা সেনানিবাসে পাক হানাদারদের মনোভাব কি তা জানবার জন্য টেলিফোনে অনুরোধ করি। তিনিও পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ রিজার্ভ অফিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা শুনেছেন বলে জানান। এরপর আমি তেজগাঁও’এ আবার ফোন করে জানতে পারি যে, তখন পাক হানাদারদের প্রায় ৮০/৯০টি সশস্ত্র ট্রাক ও জীপ তাদের থানার রাস্তা ধরে রাজধানীতে প্রবেশ করতে তারা দেখেছেন। রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের উপর পাক হানাদারদের এমন উলঙ্গ হামলার সংবাদ শুনে আমাদের আরআই একেবারে হতবাক হয়ে যান। এরপর আমরা পুলিশের রিজার্ভ অস্ত্রাগার থেকে প্রয়োজন মত অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত প্রতিরোধ এবং প্রতিহত করার জন্য রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ অফিসের চারিদিকে পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করতে থাকি। আমরা পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে চারিদিকের পরিবেশ একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলি। আমরা বাইরে অনেক দূর থেকে পাক হানাদারদের বিক্ষিপ্ত গুলিবর্ষণের শব্দ শুনছিলাম। আমরা শুধু পজিশন নিয়ে শত্রুর অপেক্ষা করছিলাম। অয়ারলেস ও টেলিফোনের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

সারা শহর অন্ধকার, নীরব, নিথর ও নিস্তব্ধ। আনুমানিক মধ্যরাতে পাক হানাদারেরা প্রথম রাজারবাগ পুলিশ লাইনের হাসপাতাল গেট (দক্ষিন দিক) থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমরা তার পাল্টা জবাব দেই। এবং পাক পশুদের প্রাণপণ প্রতিহত করার চেষ্টা করি। ওরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ভারী অস্ত্র, শেল, কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমাদের উপর সাংঘাতিকভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমরা প্রথমে আত্মসমর্পণ করিনি এবং আত্মসমর্পণের মতো কোনো দুর্বলতাও দেখাই নি। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের উদাত্ত আহবান অনুযায়ী আমরা আমাদের যার হাতে যে অস্ত্র ছিলো তা দিয়ে সমস্ত পাক হানাদারদের প্রাণপণে প্রতিহত করার চেষ্টা করি। এবং এভাবে আমাদের সামান্য অস্ত্র নিয়ে পাক হানাদেরদের প্রাণপণ প্রতিরোধ ও প্রতিহত করে জীবনদান করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে যুদ্ধ করছিলাম। আমাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ওরা গভীর রাতে রিজার্ভ অফিসের উত্তর দিকে টিনশেড ব্যারাকে লাইট বোম ও পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিলো আমাদের এমন কতিপয় বীর সিপাহী নিদারুন ভাবে দগ্ধীভূত হয়ে শহীদ হন। অনেকে সাংঘাতিকভাবে আহত হয়ে সেখানেই মৃতবৎ পড়ে থাকেন। আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই প্রসারিত হতে থাকে এবং সমস্ত ব্যারাক পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। আমরা উপায়ন্তর না দেখে ছাদের উপর গিয়ে আত্মরক্ষা করতে থাকি। সেই সাথে পাক হানাদারদের প্রাণপণ প্রতিহত করা অব্যাহত রাখি। ব্যারাকের চারিদিকে আগুনের লেলিহান শিখায় আমরা বিন্দুমাত্র দমে যাইনি। আর আমাদের মনোবল কোনো সময়ই দুর্বল হয়ে পড়েনি। ওদিকে কামান, শেল আর ট্যাংকের গর্জন ও বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ চলছিলো। কামান ও শেলের প্রচণ্ড আঘাতে আমাদের কয়েকটি পাকা ব্যারাকের প্রাচীরঘেরা মটর ওয়ার্কশপ মাটিতে ধসে পড়ে। ফলে আমাদের সিপাহীরা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিজ নিজ সুবিধামতো স্থান গ্রহণ করে। চারিদিকে জ্বলন্ত আগুন, অবিরাম শেলিং ও কামানের গর্জনের মধ্যেও প্রাণপণে প্রতিরোধ করছিলো পাক পশুদের। আমাদের অনেক বীর সিপাহীকে প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হতে দেখেছি আমি স্বচক্ষে। এমনিভাবে পাক হানাদারদের প্রতিহত করতে করতে রাতের অন্ধকার কেটে যায়। ভোর হয়ে যায় এবং বেলা উঠে যায়। আমাদের গুলি প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায় দেখে আমরা আর কোনো উপায়ন্তর পাই না। ইতিমধ্যে পাক হানাদারদের হাজারো হুমকির মুখেও আমাদের মনোবল এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েনি। তারা ব্যারাকে ঢুকে আমাদের বন্দী করে এবং ছাদের উপর থেকে আমাদেরকে নিচে নামিয়ে এনে বুটের লাথি ও বন্দুকের বাট দিয়ে সজোরে এলোপাতারি আঘাত করতে শুরু করে। আকস্মাৎ এক হানাদার পাক পশু হাতের বন্দুক দ্বারা আমার মাথায় সজোরে আঘাত করলে আমার মাথা ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়তে থাকে। তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। তিন ঘন্টা পড়ে আমি জ্ঞান ফিরে পাই। উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমআই, এএসআই, হাবিলদার, সুবেদার, নায়েক, সিপাহীসহ আমরা প্রায় দেড়শত বীর যোদ্ধাকে পাক হানাদারদের হাতে বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ থেকে ২৯ শে মার্চ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়।

২৯শে মার্চ বিকাল সাড়ে চারটায় ঢাকার তৎকালীন পুলিশ সুপার জনাব ই.এ. চৌধুরী রাজারবাগে আমাদের পুলিশ লাইনে আসেন এবং পাক হানাদারদের মেজরের সাথে কথোপকথনের পর আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় “আব তুমলোগ চালা যাও, আয়েন্দা কাল ভোর ছ বাজে মিল ব্যারাকমে তোমলোগ রিপোর্ট করেগা, আওর উহাই তোমলোগ রাহেগা- ইদার হামলোগকা জোয়ান রাহেগা।”

————————————————————-

সাক্ষাৎকারঃ আঃ গনি তালুকদার
(১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের স্বাধীনতা সময় রাজারবাগ (রিজার্ভ) পুলিস লাইনে ওয়ারলেস অপারেটর ছিলেন)
অফিস সহকারী (পুলিশ), রমনা থানা, ঢাকা (সদর)
৯-১-৭৪

সিপাহী আব্দুল খালেক খালেক, মোজাম্মেল হক, মুখলেসুর রহমান, মির্জা মহিউদ্দিন এবং আরো অন্যান্য বন্ধু ও সহকর্মীসহ আমরা ২৫ শে মার্চ রাত দশটার সময় খাওয়া-দাওয়া করে ১৪ নং ব্যারাকে বসে ছিলাম। রাত পৌনে এগারোটার সময় ঢাকা পিলখানা ইপিআর হেড কোয়াটার থেকে টেলিফোনে পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ ও ইপিআর হেডকোয়াটার আক্রমনের সংবাদ পাই। টেলিফোনে ইপিআর হেডকোয়াটার থেকে আমাদের সশস্ত্রভাবে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য থাকতে বলা হয়। আমরা আমাদের ১৪ ব্যারাকে মোট পঞ্চাশজন সিপাহী এএসআই, হাবিলদার ও সাধারণ সিপাহী উপস্থিত ছিলাম। এসংবাদ দ্রুত রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের আরআই ও এসপি হেডকোয়াটারকে জানানো হয়। এ সংবাদ পেয়ে রিজার্ভ পুলিশের সকল অফিসার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই ডিউটিতে এসে সকল সিপাহী, সুবেদার, এএসআই, এসআই, হাবিলদার সবাইকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিতকরে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরী করেন এবং প্রত্যেক ডিউটিতে মোতায়েন করেন। তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সুপার মিঃ শাহজাহান ও আরআই মিঃ মফিজউদ্দিন আমাদের এই সশস্ত্র প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দান করেন।

পুলিশ সুপার ও আরআই উভয়েই শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যাবার জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দান করে নিজ নিজ দায়িত্বে চলে যান। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। আমরা সবাই সিপাহী, হাবিলদার, সুবেদার, এএসআই, এসআই, সবাই সশস্ত্রভাবে পজিশন নিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকি। এসময় অয়ারলেস এবং টেলিফোন সবকিছু অচল করে দেওয়া হয়েছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাইরে সহ ছাত্র-জনতা বড় বড় গাছ লাইটপোষ্ট, ইট-পাটকেল ফেলে ব্যারিকেট তৈরী করে। রাজারবাগে প্রবেশ করার পথে পথে বহু প্রশস্ত ড্রেন কাটা হয় হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য। এভাবে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ তৈরী করার মধ্য দিয়ে সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। পাক হানাদাররা রাত সাড়ে এগারোটার সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চারিদিক থেকে লাইট বোম মারতে মারতে অগ্রসর হয়। এরমধ্যে চলছিল বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ, কামান ও ট্যাংকের গর্জন। পাক হানাদার হামলার সাথে সাথে আমরা সবাই আমাদের সামান্য রাইফেল বন্দুক নিয়ে ওদের হামলার প্রাণপণ জবাব দিতে থাকি। ওরা আমাদের দৃঢ় মনোবল দেখে এরপর যুগপৎ কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমরা টিকতে না পেরে ক্রমে পিছু হটতে থাকি। আমাদের অধিকাংশ বীর যোদ্ধা লড়তে লড়তে শহীদ হন। অনেকে দারুণভাবে আহত হয়ে মৃতবৎ সেখানেই পড়ে থাকেন। আর অনেকে আহত দেহ নিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সমর্থ হন। পাক হানাদার পশুরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল ব্যারাকে লাইট বোমা ও প্রেট্রোল দ্বারা আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বহু আহত যোদ্ধা ঐ সকল ব্যারাকে আটকা পড়ে জলন্ত আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। আনুমানিক রাত তিনটার সময় অবিরাম গোলাবর্ষনের মধ্য দিয়ে আমি আমার অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করার জন্য ঢাকা শহরের বাইরে চলে যাই।

————————————————

সাক্ষাৎকারঃ শরীফ খান মোহাম্মদ আলী
(১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হাবিলদার মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন) আর্মড সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ
বিআরপি, রাজশাহী
৩-২-৭৪

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সকাল থেকে আমাদের পুলিশ লাইনে নীরব, নিস্তব্ধ ও থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। স্পেশাল আর্ম ফোর্স-এ আমার লাইনে রাত আটটায় বাইরের কর্তব্যরত সিপাহী বাদে আমি নাম ডাকার সময় মাত্র ত্রিশজন বাঙালি সিপাহীকে উপস্থিত পেয়েছি। আমি কোন অবাঙালি সিপাহীকেই লাইনে উপস্থিত পাইনি। ওরা সন্ধ্যার পরপরই আমার লাইন থেকে ডিউটি ত্যাগ করে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল তার কোনো হদিস পাইনি। নাম ডাকার সময় বিপুলসংখ্যক সিপাহীর এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ইতিহাসে আর ঘটে নি। ঢাকা জেলা রিজার্ভ লাইনের এ অবস্থা ছাড়া কেন্দ্রীয় লাইন থেকেও সেদিন সকল অবাঙালি সিপাহী তাদের পদস্থ অফিসারদের নির্দেশ ও মর্যাদা একেবারে উলঙ্গভাবে, পুলিশের ইতিহাসে এই প্রথম , অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে সম্মিলিতভাবে একযোগে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। অবাঙালি সিপাহীদের রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার পর আমরা আসন্ন বিপদের কথা বুঝতে পারি এবং আমার অধীন বাঙালি সিপাহীদের হাতে অস্ত্র দিয়ে পুলিশ লাইনের সকল প্রবেশপথে তাদেরকে কড়া প্রহরায় নিযুক্ত করি। পুলিশ লাইনের চারটি প্রবেশপথে চারজন হাবিলদারের সাথে ছয়জন করে সশস্ত্র সিপাহী মোতায়েন রাখি। আমি খুব চিন্তাযুক্তভাবে পুলিশ লাইনে টহলরত ছিলাম। আমি এক সময় দোতলা থেকে অস্ত্রাগারের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামছিলাম। এমন সময় অস্ত্রাগারের ভিতরের টেলিফোনটি বেজে উঠলে আমার কর্তব্যরত নায়েক চিৎকার করে আমাকে টেলিফোন ধরতে বলে। আমি দৌড়ে গিয়ে টেলিফোন ধরলাম। অস্ত্রাগারের সেই টেলিফোনে এক ভীতসন্ত্রস্ত কাঁদো কাঁদো কম্পিত কণ্ঠ চাপাচাপা অস্ফুট কণ্ঠে বলছিল “মিলিটারী হেডকোয়ার্টারে বহু সশস্ত্র আর্মি ট্রাক লাইন হয়ে দাড়িয়ে আছে। ওরা এখুনি রাজধানী আক্রমণ করতে যাচ্ছে।” সেই ভীত কণ্ঠ আরো বলেছিলো- “ওদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ই-পি-আর হেড কোয়ার্টার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইকবাল হল।“ এ কথা বলেই সেই কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেলো। “কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন ?“ আমি চিৎকার করে এসব প্রশ্ন করার সাথে সাথে টেলিফোনের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। সিপাহীরা টেলিফোনের এ মারাত্মক সংবাদ লাইনের সর্বত্র চীৎকার করে ছড়িয়ে দিচ্ছিলো। এ সংবাদে সকল সিপাহী অস্ত্রাগারের দিকে ছুটে এসে টেলিফোনের সংবাদ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। এ সময় আমি লাইনে বসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের তৎকালীন আর-আই মিঃ মফিজউদ্দীনের সাথে তার বাসায় টেলিফোনে যোগাযোগ করে ঢাকা সেনানিবাস থেকে ভেসে আসা পাক সেনাদের রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দিকে ধেয়ে আসার সংবাদ বিস্তারিত জানালে তিনি তৎকালীন পুলিশ সুপার ই,এ, চৌধুরী সাহেবকে সব কিছু জানাচ্ছেন বলে টেলিফোন ছেড়ে দেন। এদিকে আমার সিপাহীরা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনের চারশত বাঙালি বলছিলো “অস্ত্র দাও, অস্ত্র দাও। আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দাও, আমরা ওদের প্রতিরোধ করব, প্রতিহত করবো।“ শেষ পর্যন্ত অস্ত্রাগারের সামনে দাঁড়িয়ে আমার হাবিলদার সহকর্মীরা বুকফাটা চীৎকারে রাজারবাগ কাঁপিয়ে তুলে বলছিলো “আমাদের হাতে অস্ত্র দাও, আমরা লড়বো, লড়তে লড়তে মরবো, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করবো ঐ বেঈমানদের বিরুদ্ধে কিন্তু পিছু হটবো না, হটবো না।“ এরপর আমি রিজার্ভ ইন্সপেক্টর সাহেবের বাসায় গিয়ে তাকে না পেয়ে আমাদের ফোর্সের সুবেদার আবুল কাসেমকে এ সংবাদ জানালে তিনি লাইনে ছুটে আসেন। এর পরপরই আমাদের আরআই সাহেব পুলিশ সুপার ই,এ চৌধুরীর সাথে আলাপ –আলোচনা করে লাইনে এসে বলেন, “তোমরা ওদের রুখতে পারবে না কোনো প্রকারেই, দেখো আমাদের নীরব থাকাই ভালো।“
কিন্তু তখন নীরব থেকে প্রাণ বাঁচাবার কোনো উপায় ছিলো না। পুলিশ লাইনের সকল বাঙালি সিপাহীই তখন অস্ত্র নিয়ে ওদেরকে প্রাণপণ প্রতিরোধ করার জন্য ব্যাকুল ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। সিপাহীরা বলছিলো, “আর-আই সাহেব আপনি অস্ত্রাগার খুলে দিন, আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিন, আমরা ওদের প্রতিরোধ করবো।“ এরপর আর-আই সাহেব অস্ত্রাগারের চাবি দিয়ে দিলে বাঙালি সিপাহীরা সবাই পাগলের মতো অস্ত্রাগারে প্রবেশ করে যার যার প্রয়োজন মতো রাইফেল ও গুলি হাতে তুলে নেয়। এ সময় চারিদিক থেকে হাজারো জনতা রাজারবাগ পুলিশ লাইনে প্রবেশ করে আমাদের অস্ত্রাগার থেকে বিনা বাধায় অস্ত্র নিয়ে যায়। এসময় আমাদের অফিসাররা বাইরে কর্তব্যরত ছিলেন। এ সময় সুবেদার ফোর্স আবুল কাসেম, আর-ও হাফিজুর রহমান, সার্জেন্ট মূর্তজা হোসেন, সুবেদার আবুল হাশেম, নায়েক মোহাম্মদ আলী (ফুটবল খেলোয়াড়) সবাই সশস্ত্রভাবে আমাদের সিপাহীদের সাথে মরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তৈরী ছিলেন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিয়ে সমস্ত সিপাহী লাইনের চারিদিকে মাটিতে শুয়ে, ছাদের উপর বসে থেকে, দাঁড়িয়ে থেকে, গাছের আড়ালে থেকে পজিশন নিয়ে পাক পশুদের অপেক্ষায় ছিলো। সেদিন হাবিলদার তাজু আহমেদ, হাবিলদার আবুল হোসেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফুটবল খেলোয়াড় নায়েক মোহাম্মদ আলী, হাবিলদার আতাউর রহমান, সিপাহী মোহাম্মদ আলী, আরও কতিপয় হাবিলদার, নায়েক ও সিপাহী এবং কেন্দ্রীয় পুলিশ ফোর্সের সুবেদার খলিলুর রহমান মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করে সবার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ লাইনের সবাইকে এ প্রতিরোধে বীরের মতো নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওদের সকলকে সালাম।

আমরা চারিদিকে ছড়িয়ে পজিশন নিচ্ছিলাম ওদের প্রতিরোধ করার জন্য। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। টেলিফোনে এক ভীতসন্ত্রস্ত কম্পিত বাঙালি সিপাহী কণ্ঠ বলছিলো, “ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ফাঁড়ি থেকে বলছি। একশত সশস্ত্র আর্মি ট্রাক রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে।“ এরপরই আরেক বাঙালি পুলিশের কণ্ঠ টেলিফোনে ভেসে আসলো, সেই মার্জিত কণ্ঠ বলছিলো, ”তেজগাঁ থানার সামনে দিয়ে সশস্ত্র আর্মি ট্রাক রাজধানীর দিকে এগোচ্ছে।“ এরপর আমাদের ওয়ারলেসে এক পুলিশ কণ্ঠ বলে উঠল, “ময়মসিংহ রোড থেকে টহলরত অফিসার বলছি, পাক আর্মির বহু ট্রাক রমনা রেসকোর্স মাঠে জড়ো হয়েছে।“ কিছুক্ষণ পরই দেখলাম পাক পশুর একটি দল হাতে স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান নিয়ে সশস্ত্রভাবে চোরের মতো টিপে টিপে পা ফেলে আমাদের ব্যারাকের দিকে গুলি বর্ষণ করে। সাথে সাথে আমাদের রাইফেল গর্জে ওঠে। ওদের গুলিবর্ষণের জবাব দেই আমরা সম্মিলিতভাবে। পাক পশুদের প্রথম অগ্রগামী দলের কিছু সেনা মারা যায়। রাস্তায় ওদের লাশ পড়ে থাকে। অবশিষ্ট পাক পশু বিপদ বুঝতে পেরে সেই অন্ধকারে আবার চোরের মতো পিছু হটে যায়। এ ঘটনা ঘটে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনের দক্ষিণ- পূর্ব কোনে হাসপাতালের দিক থেকে অবিরাম শেলিং করতে থাকে পাক পশুরা। এরপর তারা উম্মত্তের মতো শেলিং করতে থাকে আমাদের পুলিশ লাইনের বিল্ডিং- এর উপর, উত্তর – পূর্ব কোণ থেকে। এভাবে তারা অবিরাম শেলিং করতে করতে পুলিশ লাইনের পূর্ব দিক থেকে ঢুকে পড়ে আমাদের এলাকার অভ্যন্তরে। আমাদের রাইফেলধারী বাঙালি পুলিশ প্রহরী তখন প্রাণপণ প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল পাক পশুদের অবিরাম শেলিং- এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমাদের বহু সিপাহী পুলিশ লাইনের পূর্ব দিকে ওদের প্রাণপণ প্রতিরোধ করতে করতে শহীদ হন। অবশিষ্ট সিপাহীরা রাইফেল নিয়ে পিছু হটে আমাদের ব্যারাকের বিভিন্ন নিরাপদ জায়গায় পজিশন নিয়ে ওদের প্রতিরোধ করতে থাকে। আমাদের সিপাহীদের প্রতিরোধ ও দৃঢ় মনোবলের সম্মুখে ওরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের পুলিশ লাইনের পূর্ব দিকের ব্যারাকে লাইট-বোম বৃষ্টির মত বর্ষণ করতে করতে ভিতরে প্রবেশ করছিল। ওদের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের ব্যারাকের চারদিকে আগুন ধরে যায়, অস্ত্রাগারের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে যায়। দোতলার দেওয়ালগুলো ভেঙ্গে পড়তে থাকে আস্তে আস্তে। ওরা আমাদের আওতার বাইরে থেকে শেলিং করছিল, আর লাইট বোম মারছিল। আমাদের পুলিশ লাইনের একেবারে অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে তখনও সাহস পায়নি। রাত আনুমানিক আড়াইটার সময় ওরা মরিয়া হয়ে আমাদের ব্যারাকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল। অবিরাম শেলিং হচ্ছিল, আগুনের ভয়ংকর ফুলকি নিয়ে লাইট- বোমগুলি একের পর এক পড়ছিল আমাদের দিকে। চারিদিকে আমরা ট্যাংক ও কামানের কান ফাটা ভীষণ গর্জন শুনছিলাম। পাক পশুরা এভাবে অজস্র শেলিং ও কামানের গোলাবর্ষণ করতে করতে আমাদের আওতার ভিতরে এসে গেলে আমাদের সিপাহীদের রাইফেলগুলো আবার গর্জে ওঠে। পশুদের কতিপয় আমাদের বীর নায়েক বিখ্যাত ফুটবলার খেলোয়াড়ের নেতৃত্বে, আমাদের সিপাহী কায়েস, সাত্তার, হাফিজ, নায়েক আঃ সুবহানের রাইফেলের গুলিতে মাটিতে পড়ে যায়। আর অবশিষ্ট পশুর দল পিছু হটে যায়। আমাদের বীর সিপাহীরা অবিরাম প্রতিরোধ করে যচ্ছিল, প্রাণপণে ব্যারাকের সেই জ্বলন্ত আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বীর সিপাহীরা বীরবিক্রমে প্রতিহত করছিল। উম্মত্ত সেনাদের অগ্রগতিকে রুখে দিচ্ছিল নির্ভিকভাবে। আগুন ক্রমে ক্রমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উত্তর দিকের ব্যারাকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আগুনের লেলিহান শিখায় সেই ধেয়ে আসা ভস্মের মধ্যে আমাদের কতিপয় বীর সিপাহী প্রতিরোধ সৃষ্টি করার সময় অকস্মাৎ আটকা পড়ে নিদারুন ভাবে শহীদ হন। আর অবশিষ্ট সিপাহী আগুন ও শেলিং –এর মুখে আস্তে আস্তে পিছু হটতে হটতে আমাদের প্রধান বিল্ডিং- এর দিকে আসতে থাকে- আমাদের বীর সিপাহীরা তখনও প্রতিরোধ করে যাচ্ছিল বীর বিক্রমে। মাইক্রোফোনে ওদের উম্মত্ত গর্জন শুনছিলাম, “তোমলোগ সারেন্ডার করো, হাতিয়ার দে দাও, নাই তো খাতাম কার দিওঙ্গা, তামা হও যায়েগা।“

আমাদের বীর সিপাহীরা ওদের মিথ্যা ভাঁওতায় কান না দিয়ে প্রাণপণ প্রতিরোধ করছিলো ওদের। কিন্তু আমাদের বীর সিপাহীরা ও আমাদের সকলের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমাদের অস্ত্রাগারেও তখন প্রবেশ করার উপায় ছিলো না। সেখানে ওরা গোলাবর্ষণ করছিলো উম্মত্তভাবে। আমি উপায়ন্তর না দেখে পিছু হটতে হটতে পুলিশ লাইনের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ঘোড়ার আস্তাবলের পিছনের রাস্তা দিয়ে আমিনবাগের মধ্যে দিয়ে চলে এসে প্রাণ বাঁচাই। এরপর আমি গ্রামের দিকে গিয়ে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

Source: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড

ভিডিও লিংক

এখানে ক্লিক করুন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!