বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৬ই ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে সতর্ক হোন
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের উদ্বোধন হয়েছে গত পরশুদিন ৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান আকর্ষণ ছিল বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি ও তার ভাষণ। পাকিস্তান জন্মের পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যুত্থান পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির কোন প্রকাশ্য কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সুতরাং বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এই প্রথম প্রকাশ কংগ্রেসের গুরুত্ব অপরিসীম ও ঐতিহাসিক। বঙ্গবন্ধু উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের এ ভাষণে কংগ্রেসের গুরুত্ব অনুধাবন করে বলেছেন দীর্ঘ দিন ধরে অনেক দুঃখ কষ্ট ভোগ করার পর আপনারা যে প্রকাশ্য কংগ্রেস অনুষ্ঠানের সুযোগ পেয়েছেন তা গর্বের বিষয়। তিনি কংগ্রেসের আন্তরিকভাবে সাফল্য কামনা করেছেন।
বঙ্গবন্ধু দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে দৃপ্ত কন্ঠে পুনরায় ঘোষণা করেছেন- যত বাধা আর বিপত্তিই আসুক না কেন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবেই। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির উপস্থিত কর্মীদেরকে উদ্দেশ্য করে দেশের সমাজবাদী মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সমাজতন্ত্রের কত বড়ই দুর্গম। সে জন্যে সবাইকে কাজ করতে হবে এবং কল-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্যে ক্যাডারের আবশ্যকতাও তিনি উল্লেখ করেছেন। গণঐক্যজোট গঠন ও তার কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জাতির জনক অত্যন্ত আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। তিনি স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাওয়ার জোর আহ্বান জানান। দেশে অসংখ্য শ্রমিক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত বাস্তব ও সুস্পষ্ট একটি বক্তব্য রেখেছেন।
তার মতে দেশের শ্রমিকরা কাজ করতে আগ্রহী, কিন্তু এক শ্রেণীর নীতিভ্রষ্ট শ্রমিক নেতা ও অসৎ অযোগ্য প্রশাসকরা শ্রমিকদেরকে যথার্থ কাজের উৎসাহ দিচ্ছেনা। শ্রমিকদেরকে বিপথে পরিচালনার দরুন তারা দেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে বা তার সঙ্গে একাত্ম হতে পারছেনা। কৃষকদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি আশাবাদী। তিনি কমিউনিস্ট কর্মী ও দেশ প্রেমিক কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন আপনার দেশের অসহায় দুঃখী কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুন। এদেশের কল্যাণের জন্যে কৃষকদের যে আত্মোৎসর্গের মানসিকতা রয়েছে তাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে সহযোগিতা দিলে ও চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করলে কৃষি উৎপাদন আশাতীত বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।
এক শ্রেণীর সন্ত্রাসবাদীদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন— গলাকাটা বা রাতের অন্ধকারে সম্পদ লুট করলে বিপ্লব হয় না তাকে ডাকাতি বলা যায়। সন্ত্রাস সৃষ্টি করে বিপ্লব করার সংজ্ঞা অনেক পুরোন— আজ ওটা পঁচে গেছে। স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্র বানচালের ষড়যন্ত্র কেমন করে রুখতে হয় দেশবাসী তা জানে। বস্তুতপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আলোকে দেশের সকল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ও ছাত্রদলকে পরবর্তীকালের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। গণঐক্যজোট এ ব্যাপারে সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারে বলে বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করেছেন তা যেমন মূল্যবান তেমনি সুদূর অর্থবহ।
তারা হিসাব মেলাতে পাচ্ছেনা
তারা হিসাব মিলাতে পাচ্ছেন না। আসলে তাদের হিসাব মিলছে না। কোনদিনই তার হিসাব মিলাতে পারেন নি। পারবেনও না। গত দোসরা ডিসেম্বর সন্তোষে ভাসানী ন্যাপের জাতীয় কার্যকরী সংসদের যে সভা অনুষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে তাতে যে সব প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে আগামী ১৬ই ডিসেম্বর জাতীয় বিজয় দিবসের উৎসব বর্জনের।এর আগে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও অনুরূপ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। শেষোক্ত দলটি গত বছর এ দিনটি পালন করেনি। অন্যদিকে ডাকাতদলের সমবায়ে গঠিত সিরাজ সিকদারের গুপ্ত ঘাতকের দলও জাতীয় দিবসে হরতাল পালনের কথা বলেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে যে তারা সবাই একসূত্রে বাধা এবং কারোই কোন হিসেবে মিলছেনা- কে কি করবেন কিছুই ঠিক করে উঠতে পাচ্ছেন না।
তাই যদি না হবে, তবে ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভাসানী ন্যাপ ওই সিদ্ধান্তটি নেনই বা কি করে। বিশেষ করে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য যে মওলানা ভাসানী কোলকাতা গিয়েছেন বলে দাবি করছেন, সেই মওলানা ভাসানী কি কারণে জাতীয় মুক্তি দিবসটিকে অবমাননা করার সিদ্ধান্তে সম্মত হতে পারেন? এতে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে মওলানা সায়েব আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে স্যাবোটাজ করার জন্যই কলকাতায় গিয়েছিলেন। সেখানে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে এখন প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে দেশে একটা বিশৃংখলা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। কিন্তু কি বলে লোকজনকে জামাতে পারবেন সেই হিসাব মেলাতে পাচ্ছেন না বলেই একবার ভারত বিরোধী প্রচারণা, আবার সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর এবং এক্ষণে জাতীয় মুক্তি দিবসকে অবমাননার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। জাসদের প্রশ্নেও তাই। এদের অধিকাংশই স্বাধীনতা-বিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত ছিল। দু’একজন যাও বা দায়ে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, দেশ স্বাধীন হবার পরে অতিমাত্রায় উচ্চভিলাষী হবার ফলে প্রতিক্রিয়াশীল খপ্পরে পড়ে ওই একই পথ অবলম্বন করছে। আর ‘ডাকাত বা গুপ্ত ঘাতকদের দেশ-জাতি-ধর্ম নেই। গোলযোগ- বিশৃঙ্খলা আর গুপ্তহত্যাই তাদের ধর্ম। কাজেই জাতীয় দিবসের গুরুত্ব বা মর্যাদা বোঝার ক্ষমতা কোথায় তাদের? জনগণ এদের ঘৃণার চোখেই দেখে এবং দেখবেও।
অপরদিকে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী দেশের সব কটি দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, ছাত্র-শ্রমিক-যুব-কৃষক ও সামাজিক সংগঠনই সাংগঠনিক ভাবে তো বটেই, বাংলাদেশ গণ ঐক্যজোট কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বেও জাতীয় দিবস পালনকল্পে পাঁচদিন ব্যাপী কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে এবং দেশের সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই এই কর্মসূচি গুলোর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এগুলোর সার্বিক বাস্তবায়নে এগিয়ে আসছেন।এমতাবস্থায় আজীবন নিজেদের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত ও ব্যর্থ সাইনবোর্ড সর্বস্ব কোন দল যদি জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান বর্জনের মত কোন ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজ করে তবে তাতে দেশবাসীর হাসির খোরাকই জুটবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
ডেমারেজের বহর কমাতে হবে
বন্দরে জাহাজ নোঙ্গর করে। সেই জাহাজে বিদেশ থেকে আমদানি করা রকমারি মালামাল আসে। জাহাজ থেকে মাল নামানো হয়। কিন্তু তারপর? যারা মালামাল আমদানি করেন, তারা মাল আসার সঙ্গে সঙ্গে তা খালাস করেন না। অতি প্রয়োজনীয় মালামাল বন্দরের যেটারে বন্দী হয়ে থাকে। আমদানিকারকরা বিলম্বে যখন মাল খালাস করতে যান, তখন কড়ায় গণ্ডায় বন্দর কর্তৃপক্ষকে ডেমারেজ চার্জ দিতে হয়। ডেমারেজ চার্জ হিসেবে আমদানিকারকরা যে অর্থ গচ্চা দেন তা শেষাবধি পণ্য মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে খেসারতটা দিতে হয় আমার আপনার মত ক্রেতাসাধারণকেই। অর্থাৎ আমদানিকারকদের গড়িমসি কিংবা খেয়াল খুশির ফলেই যে বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যদ্রব্যের মূল্য আকাশচুম্বী হয়, তাতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ রকম হয়? আমদানীকারকরা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াও যে সরকারী আমলাদের গাফিলতি এক্ষেত্রে অনেকটা দায়ী এ কথা কেউ সহজে স্বীকার করতে চাইবেন না। এর ফলে ডেমারেজ চার্জ দেয়াটা একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। এই অশুভ ও ক্ষতিকর নিয়মের শিকারে পরিণত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। তাই আজ স্বাভাবিক কারণেই বিদেশী পণ্যদ্রব্যের মূল্য আকাশ ছোয়া হয়ে উঠেছে। এ বছরের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এ দীর্ঘ আট মাস ধরে সি আই শীট, কাঁচা তুলো, তুলো জাত দ্রব্য, সিমেন্ট, ঔষধ সহ অন্যান্য বহু মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে ছিল।
এই সব মালামাল বিলম্বে খালাস করতে গিয়ে বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশনকে এক কোটি বিশ লাখ ঊনত্রিশ হাজার নয় শ’ সাতান্ন কোটি তেত্রিশ পয়সা ডেমারেজ চার্জ দিতে হয়েছে। এপ্রিল থেকে জুলাই মাসের মধ্যে টিসিবি যে ডেমারেজ চার্জ দিয়েছে তা আরো ভয়াবহ। জানা গেছে, ওই ক’মাসে ৯৩ কোটি ৮১ লাখ ২০ হাজার ২শ ১৬ টাকা ডেমারেজ চার্জ দিয়েছে টিসিবি। চলতি বছরের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টিসিবি ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ ৭৫ হাজার ৫শ’ ১৭ টাকা ডেমারেজ চার্জ দিয়েছে। বিলম্বে মাল খালাসের জন্য শুধু টিসিবি নয়, অন্যন্য আমদানীকারকদেরকেও এই রকম বিরাট টাকার অংক খেসারত দিতে হচ্ছে। এবং তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশের সাধারণ ক্রেতাদের। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দর থেকে দশ দিনের মধ্যে মাল খালাসের নির্দেশ দিতে বাধ্য হন। টিসিবি প্রদত্ত ডেমারেজ চার্জের হিসেব দেখে মনে হচ্ছে, খাজনার চেয়ে বাজনাই বেশী। বিদেশী পণ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য হওয়ার পেছনে তাই এধরনের ডেমারেজ চার্জের বহর যাতে কোন ক্রমেই না বাড়ে সেদিকে সকল আমদানীকারকদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক