ষষ্ঠ অধ্যায়
সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত
লাহোর প্রস্তাব (২৩ মার্চ, ১৯৪০)—ফিরে দেখা
নেতিবাচকতা থেকে আশার আলােয় উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনা প্রায় বিরল। বছরের পর বছর অক্লান্ত ভাবে ভারত ভাগের বিষাক্ত চারা বুনেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুর্বল ব্রিটিশ শক্তি। তাদের নীতিই তাে ছিল ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’! কিন্তু আমরা, এ দেশের লােকেরাও কম যাইনি। আমরাও হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে দিনের পর দিন ইন্ধন জুগিয়েছি, বিষাক্ত চারা রােপণে কম উৎসাহ দেখাইনি। শেষ অবধি তাই দেশভাগ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।
মহম্মদ আলি জিন্না ১৯৩৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর এম আর এ বেগ তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। টানা ছয় বছর- ১৯৪০ সালের মার্চ মাস অবধি জিন্নার সঙ্গে কাজ করেছিলেন বেগ।
অবশ্য ‘৩৪ সালের আগেই বেশ কয়েক বার জিন্নাকে দেখেছেন বেগ। জিন্নার সঙ্গে তখন সরােজিনী নাইডুর মতাে কংগ্রেসের নেতানেত্রীরা। বেগ নিজেই জানিয়েছেন, কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে মুসলিম লিগ-প্রবক্তার দহরম মহরমের কথা জানতেন বলেই জিন্নার উর্বর সব আইডিয়া তিনি কোনও দিন ধর্তব্যে আনেননি!
সােজা কথায়, অন্যান্য সমর্থকদের মতাে বেগ কোনও দিন জিন্নার ভয়ে কাঁপেননি। লাহৌর প্রস্তাব তাঁর কাছে সাম্প্রদায়িক ঠেকেছিল, আর তখনই জিন্না-বেগ মনােমালিন্য। এর পর বেগ জিন্নার সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন, স্মৃতিকথায় সাফ জানিয়েছেন, “১৯৪০ সালে মার্চ মাসের মাঝামাঝি জিন্না লাহৌরের উদ্দেশে রওনা দিলেন। যাওয়ার। আগের দিন ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কিন্তু কথাবার্তায়, হাবেভাবে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেননি, এ বারেই উনি পাকিস্তান-প্রস্তাব আনতে যাচ্ছেন।”
প্রস্তাব আনা হল, কিন্তু শেষ অবধি দেশভাগ মেনে নেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে জিন্না নিজেও তখন দোটানায়। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে ভারত ভাগের সময়ের ভারতপ্রেমিক ব্রিটিশ আই সি এস পেন্ডেরেল মুনকে উদ্ধৃত করছেন বেগ, “ব্যক্তিগত ভাবে জিন্না লাহৌরে দু’এক জনকে বলেছিলেন, তাঁর এই পাকিস্তান-প্রস্তাব আসলে
২৪৫
রাজনীতির কৌশলমাত্র। তার বেশি কিছু নয়। ছয় বছর পরেই যে ভাবে লাহৌর প্রস্তাবের সীমারেখা থেকে সরে এসে কাটাছেড়া পাকিস্তানকে মেনে নিলেন জিন্না, সেটাই প্রমাণ করে, দেশভাগ ছিল তাঁর কাছে শুধুই কংগ্রেসের সঙ্গে দর কষাকষির রাজনৈতিক খেলা! আর, লাহোর প্রস্তাবের জল যে শেষ অবধি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, ১৯৪০ সালের সেই প্রাথমিক পর্বে কেউই বুঝতে পারেননি। পাকিস্তান হলেও ‘স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলির গড়ন, তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এ সব নিয়ে কেউই চিন্তাভাবনা করেননি। পরে এ সব নিয়ে আলােচনা হতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ঠিক কী রকম হবে তা নিয়ে জিন্না তখনও বিশেষ মুখ খােলেননি। ১৯৪৭ অবধিও ধন্দ ছিল, জিন্না ঠিক কী চাইছেন!”
অন্য দিকে গাঁধীও ভাবতেন, আর পাঁচ জন ভারতবাসীর মতাে মুসলিমদেরও স্বায়ত্তশাসন আর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার রয়েছে। বারে বারেই তিনি বলেছেন, “এখন আমরা যৌথ পরিবার। কিন্তু পরিবারের মধ্যে কেউ হাঁড়ি আলাদা করার কথা ভাবতেই পারে।” আর নেহরুর প্রতিক্রিয়া? সেখানে শুধুই বিস্ময়, “লাহৌরে মুসলিম লিগের পাকিস্তান-প্রস্তাবটাই যদি মানুষের মনের কথা হয়, ওঁদের সঙ্গে আমরা কাজ করব কী ভাবে!” আর ১৯৪২ সালে রাজাগােপালাচারির প্রস্তাব কংগ্রেসে যে ভাবে বিপুল ভােটে নাকচ হয়ে গেল, তা আরও আশ্চর্যের! রাজাগােপালাচারির বক্তব্য ছিল, মুসলিম লিগের সঙ্গে আলােচনার খাতিরে কংগ্রেস কোনও-না-কোনওভাবে মুসলিম বিচ্ছিন্নতা মেনে নেবে। মুসলিম বিচ্ছিন্নতা মানেটা যে কী, তা অবশ্য সে ভাবে পরিষ্কার জানানাে হয়নি।
রাজাসাহেব মাহমুদাবাদ আবার তাঁর কিছু স্মৃতি বইয়ে সাফ জানিয়েছেন, “আমি এক ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলতেই জিন্না রেগে যান। আমার বক্তব্য নাকচ করে বলতে থাকেন, লিগের মঞ্চ থেকে আমি যেন এই সব কথা একেবারে না বলি! তা হলে লােকে ভাববে, এ সব মহম্মদ আলি জিন্নার কথা। তিনিই আমাকে দিয়ে এ সব বলাচ্ছেন। আমিও জিন্নার সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাত চাইনি, তাই পরবর্তী দু’বছর নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং ও অন্যান্য সভাসমিতিতে যেটুকু দেখা হত, সেটুকুই সম্পর্ক!”[১]
দেশভাগের বাসনা থাকুক বা না-থাকুক, পরবর্তী কয়েক বছর ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে এ ভাবেই পাশা খেলা চলবে, পাশার দান গড়াতে গড়াতে ছয়টি ঘটনা পেরিয়ে। যাবে: ক্রিস মিশন (১৯৪২), ভারত ছাড়াে আন্দোলন (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর, ১৯৪২), লর্ড ওয়াভেলের ভাইসরয় হওয়া (জুন ১৯৪৩), সিমলা বৈঠক (সেপ্টেম্বর ১৯৪৪), দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি-ক্যাবিনেট মিশন (জুলাই ১৯৪৬), অন্তর্বর্তী সরকার (জুলাই ১৯৪৬)।
আর, ওয়াভেল থেকে মাউন্টব্যাটেন— শেষের তিন বছর শুধু মাহেন্দ্রক্ষণ নির্ধারণের খেলা। কখন আসবে সেই চূড়ান্ত বিনির্মাণের সময়? আমরা সবাই যে ভাবে একটা দেশকে ছিন্নভিন্ন করতে ছুটছিলাম, সেখানে অন্য রকম ইতিবাচক কিছু ঘটার সম্ভাবনা
২৪৬
আদপেই ছিল না!
ছয়টি মাইলফলকে নির্ধারিত, ঘটনাবহুল এই সময়পথেই এ বার আমাদের পরিক্রমা। সঙ্গে থাকছেন সেই মানুষেরা, যাঁদের হাতে তখন সমগ্র দেশের ভবিষ্যৎ।
পশ্চাৎপট
অজস্র ঘটনা সত্ত্বেও ‘ ক্রিপ্স মিশন’কে তখন আলাের রেখা মনে হচ্ছে। লােকের ধারণা, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের এ দেশে আসার অন্যতম কারণ, কয়েক বছর আগে ১৯৩৮ সালে নেহরুর ইংল্যান্ড সফর।
সে বার জুন থেকে অক্টোবর অবধি ইংল্যান্ডে ছিলেন নেহরু। তার মধ্যেই এক সপ্তাহান্তে ক্রিপসের গ্রামের বাড়ি ‘ফিলকিন্সে’ নেহরুর নেমন্তন্ন। কৃষ্ণ মেননকে সঙ্গে নিয়ে সেই নিমন্ত্রণ রাখতে গিয়েছিলেন জওহরলাল। অন্যান্য অভ্যাগতদের মধ্যে ছিলেন অ্যাটলি, আনিউরিন বিভান আর হ্যারল্ড ল্যাস্কি। লেবার পার্টি পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় এলে কী ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, তা নিয়ে সেখানে বেশ কিছুক্ষণ আলােচনা চলেছিল। অবশেষে ঠিক হল, সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে একটি ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’ গঠিত হবে। সেই ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’তে আলাদা করে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি থাকবেন। দেশীয় রাজ্য থেকেও সদস্যদের নির্বাচিত করা হবে। এই পরিষদ নিজস্ব সংবিধান তৈরি করামাত্র ব্রিটেনের সঙ্গে দেশীয় রাজন্যবর্গের চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। আর ক্রিপসের বাড়িতে এই আলােচনার পরে এক পক্ষকাল কাটতে-না-কাটতে নেহরু এক সভায় জানালেন, ভারতীয় ফেডারেশনের ধারণা এখন বিসর্জন দিতে হবে। তার বদলে ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’ই পথ।
ডােমিনিয়ন স্টেটাস নিয়েও এই সময়ে তুমুল বিতর্ক। ১৯২৬ সালেই অবশ্য লর্ড ব্যালফুর এই ‘স্টেটাস’-এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন, ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এবং ব্রিটিশ কমনওয়েস্থ অব নেশনস-এর সদস্যপদ খারিজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা। ব্রিটেনের সরকারি নীতি নিয়ে ক্রিস তখন এত বিরক্ত যে, ১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাসে তখনকার ‘পার্মানেন্ট আন্ডারসেক্রেটারি ফর ইন্ডিয়া’ স্যর ফাইন্ডলেটার স্টুয়ার্টকে এক নতুন প্রস্তাব দিয়ে ভারতে পাঠালেন। প্রস্তাব আর কিছুই নয়, সেই ডােমিনিয়ন স্টেটাস!
প্রস্তাবে বলা হল, ব্রিটেন অবিলম্বে তার প্রতিশ্রুতি পালন করবে। ভারতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি নিজস্ব সংবিধান রচনা করলেও মেনে নেবে ব্রিটেন। তবে এ ব্যাপারে পার্লামেন্টে আইন প্রণয়ন জরুরি, তাই একটু দেরি হতে পারে। ব্রিটিশ রাজের প্রতিশ্রুতি, যুদ্ধশেষেই এ ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় বিল আনা হবে। ঠিকঠাক সুযােগ পেলে তার আগেও!
২৪৭
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের ভাবনায় তখন প্রাদেশিক নির্বাচকমণ্ডলীর ওপর ভিত্তি করে অন্তত দুই হাজার সদস্যের এক ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’। দেশের সব নাগরিকের মধ্যে থেকেই সেখানে আনুপাতিক হারে উঠে আসবেন প্রতিনিধিরা।
ক্রিপস অবশ্য তাঁর ভাবনার ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’ই যে একমাত্র পথ, এমনটা কখনও ভাবেননি। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি যদি এই ‘অ্যাসেমব্লি’র গড়ন নিয়ে বিকল্প কোনও প্রস্তাব দেয়, তাতেও তাঁর আপত্তি নেই। ঠিক হল, নতুন পরিষদ যদি ব্রিটেনের সঙ্গে চিরস্থায়ী চুক্তি (ক্রিপস নিজে অবশ্য এ জাতীয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চাননি, তাঁর কাছে ১৫ বছরের চুক্তিই যথেষ্ট মনে হয়েছিল) করে, তা হলে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লির গরিষ্ঠসংখ্যক সদস্য যে সব সিদ্ধান্ত নেবেন, ব্রিটেন তা মেনে নেবে। গরিষ্ঠতার মাত্রাও ঠিক করে দেওয়া হল। প্রস্তাবের সমর্থনে চাই অন্তত তিন-পঞ্চমাংশ ভােট! আর দেশীয় রাজন্যবর্গ, সংখ্যালঘুদের প্রতি ব্রিটেন তার দায়িত্ব পালন করবে। ভারতের প্রতিরক্ষা, অর্থ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ আজকের মতােই পুরাে মাত্রায় বজায় রাখবে ব্রিটেন।[৫] এই যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একযােগে কাজ করে বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামােয় ভারতকে আরও বেশি স্বশাসন দেওয়াই তাে ব্রিটেনের উদ্দেশ্য!
ক্রিপসের প্রস্তাব কেন নেহরুর মনে সাড়া ফেলেছিল, ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে কেন স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিকেই তখন লেবার পার্টির সবচেয়ে অগ্রসর নেতা মনে হচ্ছিল, সে কথা জানতে এই তথ্যগুলি মাথায় রাখা জরুরি।
এক বেসরকারি সফরে ১৯৩৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ইলাহাবাদ পৌঁছেছেন ক্রিস, নেহরুর সঙ্গে আলােচনা করে প্রস্তাবটা আর এক বার এই সুযােগে ঝালিয়ে নেওয়া যাবে। নেহরুর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মনে হয়, প্রস্তাবটি তাঁর মনে ধরেছিল। কিন্তু সর্বজনীন ভােটাধিকারের বিষয়টি নিয়ে খুঁতখুঁতুনি থেকেই গিয়েছিল।
খুঁতখুঁতুনি, কেননা নেহরু জানতেন, দেশের প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের ভােটাধিকার মানে মুসলিম জমিদার এবং মধ্যবিত্তদেরও ভােটাধিকার। আর সেখানে মুসলিম সমাজ । ও শ্রেণিস্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন কোনও সিদ্ধান্ত লিগ নেতারা মেনে নেবেন না। অতএব নেহরুর পরিষ্কার যুক্তি, সর্বজনীন ভােটাধিকার হলে কংগ্রেসও সংখ্যালঘুদের মধ্যে থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করবে।
ডােমিনিয়ন স্টেটাস শব্দবন্ধেও জওহরলালের আপত্তি। এক দিকে পনেরাে বছরের চুক্তিসীমা নিয়ে তিনি সন্দিহান, অন্য দিকে তাঁর যুক্তি, সংখ্যালঘুদের কোনও সুবিধা দিতে গেলে তা আইনসভার নতুন সংবিধানের মধ্যে থেকেই দিতে হবে। গাঁধীজির সচিব মহাদেব দেশাইকে সে সময় নেহরু বলেওছিলেন, ক্রিপস সাহেবের প্রস্তাবটি ভাল। কিন্তু দু’তিনটি মারাত্মক ভুল রয়েছে। এই ১৯৩৯ সালে এসে নেহরু তেরাে বছর আগের মতাে গাঁধীর সঙ্গে সংঘাতে যেতে নারাজ। অন্য দিকে, ডােমিনিয়ন স্টেটাসে আর ভুলবে না ভারত, সে সময় পেরিয়ে গিয়েছে। ক্রিপস অবশ্য এত দিনে ভারতীয় সাম্প্রদায়িকতার জটিল চেহারাটা আঁচ করতে
২৪৮
পারছেন। জি ডি বিড়লার মতাে কংগ্রেস-সমর্থকও স্বীকার করছেন, ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক আইনসভা থেকে অকংগ্রেসি মুসলিমদের বাদ দিয়ে কংগ্রেস ভুল করেছিল।[৬] আর সেই ভুলের ফলেই উত্তরপ্রদেশে লিয়াকত আলি খানের মতাে নেতারাও মনে করেছিলেন, জন্মভূমি ভারতে তাঁরা বিচ্ছিন্ন। নিছক সাংস্কৃতিক রক্ষাকবচ নয়, তাঁরা চাইছিলেন রাজনীতিতেও সমান অধিকার। মুসলিম স্বার্থরক্ষায় ভেটো প্রয়ােগের অঙ্গীকার।
দুর্ভাগ্যবশত, ঘটনার ঘনঘটা এখানেও চিন্তাধারার স্রোতকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই আগেই সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্নের হেস্তনেস্ত চাইছিলেন জিন্না। কংগ্রেসের প্রাদেশিক সরকার নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা তখন দেশের মুসলিম আমজনতার মনের কথা। তাঁদের ধারণা, সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ছাড়া মুসলিমরা কোনও মতেই ‘সংখ্যাগুরুর অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে না। মােদ্দা কথা, বেশি ভােট পাওয়ার ভিত্তিতে প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম লিগ যােগ দেবে না।
আর এখানেই ঘটনাপ্রবাহ সেই দুঃখের মােড়ে বাঁক নিল। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়ে উঠল কংগ্রেস বনাম মুসলিম লিগের সংগ্রাম। আরও পরিষ্কার বলতে গেলে, হিন্দু বনাম মুসলিমদের সংঘাত। ব্রিটিশ রাজের পক্ষে অবশ্য এ এক আশীর্বাদ। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ, আর সেই সুযােগে ব্রিটিশরা এ বার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রান্তরে অখণ্ড মনােযােগ দিতে পারবে।
১৯৩৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ট্রেনে লাহৌরের উদ্দেশে রওনা হলেন ক্রিপস । রেলগাড়িতে তাঁর মাথায় নতুন চিন্তা, “প্রদেশগুলিকে এক সঙ্গে নিয়ে একটা ফেডারেশন! প্রদেশগুলির অবশ্য সেই ফেডারেশন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার অধিকার থাকবে, বর্তমান সীমা রদবদল করে প্রয়ােজনে নিজেদের হিন্দুপ্রধান বা মুসলিমপ্রধান প্রদেশে পরিণত করার অধিকারও থাকবে।”[৭] পরের দিন, ১২ তারিখ লাহৌরে পৌঁছে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী সিকন্দর হায়াত খানের সঙ্গে মুখ্যত সেই ব্যাপারেই আলােচনায় বসলেন ক্রিপস। সিকন্দরও একমত, “সংবিধান তৈরির আগে এই ফেডারেশন গড়া জরুরি।”
১৫ ডিসেম্বর বম্বেতে ক্রিপসের সঙ্গে জিন্নার বৈঠক। জিন্না সেখানে আবার বললেন, সংখ্যাগুরুরা এ দেশে যে ভাবে সংখ্যালঘুদের পদে পদে বেঁধে রাখে, তাতে ‘পাশ্চাত্য ধাঁচের গণতন্ত্র এখানে সম্ভব নয়। জিন্নার সাফ কথা, আগে ক্ষমতা কার হাতে, দেখতে হবে। ব্রিটেনকে যতদিন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে না বের করা যাচ্ছে, ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি’ গড়ার প্রশ্নই নেই। তাঁর প্রস্তাব, ‘মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেস বরং লিগকে মেনে নিক। প্রাদেশিক সরকারে মুসলিম প্রতিনিধিরাও থাকবেন, এবং আইনসভায় দুই-তৃতীয়াংশ মুসলিম সদস্য যদি কোনও প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি জানান, সেই বিল পাশ হবে না।”
এই বৈঠকেই আসন্ন ২২ ডিসেম্বরের মুক্তিদিবস নিয়ে জিন্নাকে প্রশ্ন করেছিলেন ক্রিপস। ২২ তারিখ প্রাদেশিক কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিদিবস পালনের ডাক
২৪৯
দিয়েছিলেন জিন্না। প্রশ্নোত্তর আর কথােপকথনের মধ্যেই ক্রিপস সে দিন জানতে পারলেন, জিন্না নেহরুর সঙ্গে বৈঠকে রাজি।
কিন্তু পর দিন নেহরুকে এই বৈঠকের কথা জানাতে গিয়ে ক্রিপস বুঝে গেলেন, বরফ বিন্দুমাত্র গলেনি। নেহরুর বক্তব্য, জিন্নাকে ওই মুক্তিদিবসের ডাক বাতিল করতে হবে। কিন্তু জিন্নার পক্ষে তা সম্ভব নয়। আর কংগ্রেসের পক্ষেও সেই বৈঠকের মানে দাঁড়াচ্ছে, জিন্নার কাছে নতিস্বীকার। মহম্মদ আলি জিন্নাকেই মুসলিমদের একমেবাদ্বিতীয়ম প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেওয়া! তালেগােলে বৈঠকটাই হল না।
এত দিনের ভারত সফরে ক্রিপস বুঝে গিয়েছেন, সমস্যার সমাধানে আরও কিছু সময় দিতে কংগ্রেসের আপত্তি নেই। সে কারণেই তাে প্রাদেশিক আইনসভা থেকে কংগ্রেস মন্ত্রীদের ইস্তফা। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য, মন্ত্রিত্বের চেয়ার থেকে নেমে আন্দোলনের পথে এসে নিজেদের গণভিত্তি আর জনসংযােগ বাড়ানাে। অন্য দিকে জিন্নার মুক্তিদিবস পালনের ডাক বুঝিয়ে দিচ্ছে, লিগ আর কংগ্রেসকে এক টেবিলে বসানােই সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু কংগ্রেস মুসলিমদের একচ্ছত্র প্রতিনিধি হিসেবে লিগকে স্বীকার করতে নারাজ, মুসলিম লিগও তাদের অবস্থান থেকে এক চুল সরবে না। ব্রিটেনকেই তাই হস্তক্ষেপ করতে হবে। দুই তরফের কাছে নিয়ে আসতে হবে গ্রহণযােগ্য প্রস্তাব।
আর সেখানেই সমস্যা। যুযুধান দুই ‘হেভিওয়েট’ দলকে আলােচনার টেবিলে বসাতে পারেন ভাইসরয় ‘স্বয়ং। কিন্তু লােকজনের সঙ্গে কথা বলে ক্রিপস বুঝে গিয়েছেন, ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে আদৌ ঠান্ডা মাথায় সেই আলােচনা চালাতে পারবেন। কি না, তা নিয়ে সকলেই ধন্দে। আরও একটা ব্যাপার! ভাইসরয়ের ‘এগজিকিউটিভ কমিটি’ তখনও ১৯১৯ সালের ‘ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী গঠিত হয়। কমিটিতে থাকেন ভাইসরয় নিজে। তিনিই ভারতীয় বাহিনির কম্যান্ডার-ইন-চিফ। থাকেন ভারতশাসনে অন্তত দশ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তিন ব্রিটিশ অফিসার। আর তিন জন ভারতীয়। ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেনের মন্ত্রিসভায় তখন স্যার স্যামুয়েল হাের (লর্ড প্রিভি সিল), স্যার জন সাইমন (অর্থসচিব) আর লর্ড হ্যালিফ্যাক্স (বিদেশসচিব)-এর মতাে বাঘা ব্যক্তিত্ব। এ দিকে ‘ফার্স্ট লর্ড অব অ্যাডমিরালটি’ চার্চিল তিন জনকেই সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের বামন মনে করেন। মনে করেন, ব্রিটেনের দুর্বল ভারতনীতির জন্য ওই তিন জনই দায়ী। স্বভাবতই লিনলিথগাে যখন তাঁর এগজিকিউটিভ কমিটির সদস্যসংখ্যা বাড়াতে চাইলেন, চার্চিল সাফ জানালেন, এই দলগুলির কাছে মাথা ঝোঁকালে চলবে না। এরা ব্রিটেনের বিপদে ঝােপ বুঝে কোপ মারতে চায়।[১০]
চেম্বারলেনের মন্ত্রিসভা অবশেষে ভাইসরয়ের প্রস্তাবে রাজি। কিন্তু তিনটি কথা প্রথমেই পরিষ্কার করে দেওয়া হল। এক, নীতি নির্ধারণে ভাইসরয়ের ক্ষমতাই থাকবে সর্বোচ্চ, সেখানে কোনও আপস চলবে না। দুই, ভারতে সেনাবাহিনী নামানাের ব্যাপারে ব্রিটেনের স্বাধীনতা কোনও ভাবেই ক্ষুন্ন হবে না। এবং শেষ তিন নম্বরে জানানাে হল, যুদ্ধের মধ্যে কোনও সাংবিধানিক প্রস্তাব নয়। যুদ্ধশেষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাশ। করানাে হবে এমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া যাবে না।
২৫০
লিনলিথগাে এ বার নতুন বৃহত্তর কর্মসমিতিতে কংগ্রেস এবং লিগের যােগ দেওয়া সুনিশ্চিত করতে চাইলেন। গাঁধী, রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং জিন্না তিন জনের সঙ্গেই কথা বলেছেন তিনি। কংগ্রেস আমতা-আমতা করে একটি শর্ত দিল। ব্রিটেন তা হলে প্রতিশ্রুতি দিক, যুদ্ধের পর ভারত তার নিজস্ব সংবিধান রচনা করতে পারবে। জিন্নার দাবি আরও লম্বা। কংগ্রেস যত দিন না লিগকে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার করছে, তিনি এতে যাবেন না! এত করেও ফের সেই অচলাবস্থা। লিনলিথগাের সিদ্ধান্ত, ‘দুই সম্প্রদায়ের একমত হওয়ার কোনও ভিত্তি বা দিশা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। না।[১১] এ ঘটনা ১৯৩৮ সালের অক্টোবরের।
১৯৪০ সালের ১০ জানুয়ারি বােম্বাইয়ের ওরিয়েন্ট ক্লাবে এক বক্তৃতায় লিনলিথগাে জানালেন, ব্রিটেনের লক্ষ্য ভারতকে ডােমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়া। কংগ্রেস, লিগ এবং দেশীয় রাজন্যদের প্রতিনিধিদের নিতে তিনি অবিলম্বে ভাইসরয়ের কর্মসমিতির আয়তন বাড়াচ্ছেন। বরফ গলার লক্ষণ দেখে গাঁধী এ বার লিনলিথগাের সঙ্গে বৈঠক করতে চাইলেন। স্থির হল, ৫ ফেব্রুয়ারি দু’জন বৈঠকে বসবেন।
ইতিমধ্যে জিন্নার সঙ্গে দেখা করে লিনলিথগাে কংগ্রেস-লিগ সমঝােতায় লিগের ন্যূনতম চাহিদাগুলি জেনে নিয়েছেন। জিন্নার শর্ত, প্রদেশগুলিতে কংগ্রেস-লিগ জোট সরকার গঠন করতে হবে। মুসলিম সদস্যরা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রাদেশিক আইনসভায় যে কোনও বিল আটকে দিতে পারবে। ‘বন্দে মাতরম্’ ঘােষণা পরিহার করতে হবে। আর সরকারি অফিসের ছাদে কংগ্রেসের পতাকা ওড়ানাে চলবে না।
এই অলক্ষুণে শর্তগুলি আর এক জায়গায় অযাচিত সাহায্য পেল। চার্চিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার পক্ষপাতী। তাঁর যুক্তি, ব্রিটিশ রাজের সৌজন্যে কয়েক বছর পর এ বার কংগ্রেসশাসিত প্রদেশগুলিতে ঠিকঠাক সরকারি কাজকর্ম চলছে। হিন্দু-মুসলিম সমঝােতারও ঘােরতর বিপক্ষে তিনি। “দুই তরফে এই জাতীয় ঐক্য বাস্তবে সম্ভব নয়। আর যদি বাস্তবায়িত হয়, দু’দল মিলেই আমাদের ঘাড়ধাক্কা দেবে।”[১২]
স্যর জন সাইমন ইতিমধ্যে আইনি ভাষায় জানালেন, “যত দূর না গেলেই নয়, তার বেশি এগােনাে ঠিক হবে না।”[১৩] চেম্বারলেনও যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, ভারত-সমস্যায় তাঁর ভবিষ্যৎদৃষ্টি আর চলছে না। লিনলিথগােও তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতে সায় দিয়ে জানালেন, “কংগ্রেসের পিছনে ছােটাছুটি করার চেয়ে বরং এখন কোনও সিদ্ধান্ত না নেওয়াই ভাল।”[১৪]
৬ ফেব্রুয়ারি গাঁধী-ভাইসরয় বৈঠক শেষ হল। এবং সেখানেও পুরাে ব্যাপারটা অমীমাংসিত থেকে গেল। লিনলিথগাে যে উদ্যোগই নিন না কেন, খাস ব্রিটেনে চার্চিল এবং সাইমন তখন কংগ্রেসের ঘাের বিরুদ্ধে। ১৩ ফেব্রুয়ারি সাইমন প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনকে জিন্নার অভিযােগ উদ্ধৃত করে জানালেন, “ভাইসরয় তাে মনে হয়, গাঁধীর কাছের লােক। সব সময় ওঁকে বােঝাতে থাকেন, লিগের সঙ্গে এই চুক্তি হল বলে!”[১৫] সাইমন চিঠিতে আরও বললেন, “দীর্ঘ দিন ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে
২৫১
আমরা যে বিপজ্জনক টালবাহানা চালাচ্ছি, তাতে এই সমালােচনাই প্রাপ্য।[১৬] দিনের পর দিন কংগ্রেসের দাবি মানতে মানতে লােকের এখন ধারণা, আমরা পিছু হঠছি। শেষে হয়তাে এ ভাবেই আমাদের ধ্বংস হয়ে যেতে হবে।”[১৭] চার্চিল চিঠিতে মন্তব্য জুড়ে দিলেন, সাইমনের সঙ্গে তিনি একমত। “গাঁধী এবং কংগ্রেসের পিছনে ছােটাটা ভাইসরয় যে ভাবে তাঁর কর্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন, ব্রিটিশ ক্ষমতা ধসে যেতে আর বাকি নেই। এই যুদ্ধের সময় ভাইসরয় কী করবেন, না-করবেন তা নিয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের ওঁকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া উচিত।”[১৮]
ইতিমধ্যে দেশ জুড়ে ঘটনা বয়ে যাচ্ছে তুরন্ত গতিতে। ১৯৪০ সালের ১৯ থেকে ২০ মার্চ রামগড়ে কংগ্রেস অধিবেশনে পাশ হল ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর প্রস্তাব। ঠিক হল, মুসলিমদের কোনও কোটা নয়। বরং ‘সর্বজনীন ভােটাধিকার’-এর ভিত্তিতে তৈরি হবে নতুন সংবিধান। অন্য দিকে ২৩ মার্চ মুসলিম লিগের লাহৌর অধিবেশনেও পাশ হয়ে গেল পাকিস্তান প্রস্তাব।।
বিদেশসচিবের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৩৯ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৪০ সালের মার্চ অবধি এই পাঁচ মাসে ভাইসরয় বা ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা কেউই ক্রিপসের প্রস্তাব নিয়ে নাড়াচাড়া করেননি। ভারতের নিজস্ব সংবিধান তৈরির জন্য লিগ এবং কংগ্রেস দুই শিবিরকে আলােচনার টেবিলে বসানাে। লিনলিথগাের বদলে অন্য কোনও কুশলী প্রশাসক দুই দলের অহি-নকুল সম্পর্ক সামলাতে পারতেন কি না, তা নিয়ে আলােচনা আজ নিস্ফল। তবে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে ক্রিপস চিন থেকে লেখা চিঠিতে নেহরুর কাছে বেশ দুঃখ করে জানিয়েছিলেন, “ভাইসরয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছিল, অবস্থার উন্নতি ঘটবে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যে এত বােকামি করে যাবে, কে জানত!”[১৯]
অগস্ট, ১৯৪০ প্রস্তাব
১০ মে, ১৯৪০। বিপন্ন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন উইনস্টন চার্চিল। সুদূর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতবর্ষ নয়, ইউরােপের মাটি থেকে নাৎসি জার্মানিকে ছারখার করাই তখন ব্রিটেনের একমাত্র মাথাব্যথা। ভারতের সমস্যা নিয়ে ক্রিস তখন নতুন ভারতসচিব লিওপােল্ড আমেরির সঙ্গে কথাও বলেছিলেন। যুদ্ধ-পরিস্থিতির মধ্যেই তখন ভারতের আকাশে আইন অমান্য আন্দোলনের মেঘ। এই সময়ে চাপ দিয়ে না আলােচনার মাধ্যমে, কোন পথে কংগ্রেসকে বাগে আনা যাবে? ক্রিপস নিজে অবশ্য সমঝােতা, আলাপ-আলােচনাতেই বিশ্বাসী। তাঁর বক্তব্য, নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষমতা ভারতের আছে। যুযুধান লিগ এবং কংগ্রেসকে আলােচনার টেবিলে বসাতে বরং ব্রিটিশরাজ দুই-তিন জন মধ্যস্থতাকারীকে ভারতে পাঠাতে পারে। ক্রিপস জোর দিয়ে
২৫২
জানালেন, ভারতের মতাে বিশাল দেশে মতামত এত বহুবিভক্ত যে বেশি দেরি করলে আগুন জ্বলবে। অবিলম্বে বরং চুক্তির রূপরেখা তৈরি করে কাজ শুরু করা উচিত।[২০]
আপাতত, ক্রিপসের অবদান এটুকুই। কেন না প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে, মে মাসেই চার্চিল ক্রিপসকে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে মস্কো পাঠিয়ে দিলেন। স্তালিনের রাশিয়া এই মহাযুদ্ধে ব্রিটেনের অন্যতম মিত্রশক্তি। সেখানে ব্রিটেনের দূত হিসেবে বামপন্থী ক্রিপস অবশ্যই সেরা বাছাই! কে জানে, নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে। জীবন-মরণ লড়াইয়ের এই সময়টায় স্তালিন ক্রিপস এবং ভারত সমস্যাকে কিছু দিনের জন্য আড়ালে পাঠাতে চেয়েছিলেন কি না!
মহাযুদ্ধের শুরুতে ব্রিটেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশে আর নতুন ঝঞ্ঝাট চায় না! বরং ভারতীয় জনগণ এবং নেতৃবৃন্দের সাহায্যই তার কাম্য। ২ জুন আমেরি লিনলিথগােকে জানালেন, ভারতীয়রা যদি যুদ্ধের পর কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লি গঠন করে, ব্রিটেন ভারতের নিজস্ব সংবিধান রচনার অধিকার মেনে নেবে। তবে, সেখানকার ব্রিটিশ সরকারের দায়িত্বও পরিষ্কার করে লিখতে হবে। লিনলিথগাে দোনামােনা করছিলেন, কিন্তু আমেরি তাঁকে বােঝালেন, যুদ্ধশেষে তিনি ভারতকে ‘ডােমিনিয়ন স্টেটাস’ দেওয়ার উদ্দেশে এগােচ্ছেন। চার্চিল এবং সাইমন রাজি না হলে যুদ্ধমন্ত্রকে লেবার দলের মন্ত্রীরা তাঁদের বােঝাবেন।
আমেরির প্রেরণায় লিনলিথগাে প্রস্তাব পাঠালেন। এবং ১২ জুলাই মন্ত্রিসভার অধিবেশনে চার্চিল যথারীতি সেই প্রস্তাব তুলােধােনা করলেন। উপনিবেশ-সচিব লর্ড লয়েডও জানালেন, হিন্দু-মুসলমানেরা একসঙ্গে মিলে ব্রিটেনের বিরােধিতা করবে এমন, কোনও প্রস্তাব মানা সম্ভব নয়। চার্চিল নিজে লিনলিথগােকে তার পাঠিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “যুদ্ধ যখন ব্রিটেনের দোরগােড়ায়, বহু দূরের ভারত নিয়ে পার্লামেন্ট এত সময় ব্যয় করবে কোন দুঃখে?”[২১] অস্বীকার করার উপায় নেই, ঘােরতর যুদ্ধপরিস্থিতিতেও লন্ডনে চার্চিলের মন্ত্রিসভা কয়েক ঘণ্টা ব্যয় করে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের চমৎকার নিদর্শন রেখেছিল।
লিনলিথগাে এ বার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে চার্চিলকে জানালেন, আমেরিই তাঁকে ভুল বুঝিয়েছিলেন। যা হােক, মন্ত্রিসভার আপত্তির দিকগুলি এখন তাঁর কাছে পরিষ্কার। অতএব, নতুন খসড়া প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন। নতুন প্রস্তাবে বলা হল, যুদ্ধশেষের এক বছরের মধ্যে ভারতকে ‘ডােমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়া হবে। ভারতীয়রা তাদের নিজস্ব সংবিধান রচনা করবে। তবে সেখানে ব্রিটেনের ভূমিকার কথা জোর দিয়ে বলতে হবে। আর হ্যাঁ, সংবিধানে চুক্তি-প্রসঙ্গ যথাসম্ভব বাদ দিতে হবে!
চক্তি-প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার এই শেষ শর্তটি মারাত্মক! কেন না, ডােমিনিয়ন স্টেটাস নিয়ে আলােচনায় প্রথম থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ব্রিটেন এবং ভারত দুই দেশই সমান মর্যাদা এবং অধিকার নিয়ে ডােমিনিয়ন-চুক্তিতে সই করবে। যা হােক, ২৫ জুলাই লিনলিথগাের পাঠানাে নতুন খসড়া লন্ডনে মন্ত্রিসভার কাছে এসে পৌঁছল। মন্ত্রিসভাকে ভুল বােঝানাের জন্য চার্চিল আমেরিকে ডেকে কড়া কথা শােনালেন।
২৫৩
আমেরির বুদ্ধিতেই তাে মন্ত্রিসভা আগের বার ভেবেছিল, স্বয়ং লিনলিথগাে-ই ভারতে বসে ডােমিনিয়ন স্টেটাস নিয়ে মাতামাতি করছেন! আমেরি আর লিনলিথগাের যাবতীয় চিঠিপত্র তাঁর মন্ত্রিপরিষদের কাছে প্রকাশ করার হুকুম দিলেন চার্চিল।
পাঁচ দিন পরে ৩০ জুলাই যুদ্ধ মন্ত্রক জানাল, ভারতের সংবিধান তৈরি নিয়ে এখনই কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধের পরে ভেবে দেখা যেতে পারে। ডােমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়ার সময়সীমা এড়িয়ে চার্চিল বললেন, যুদ্ধের পরে বরং সংবিধান তৈরির কাজে ব্রিটেনও ভারতীয় নেতাদের যথাসম্ভব সাহায্য করবে। ভারতের নিজস্ব সংবিধান তৈরির অধিকার, ডােমিনিয়ন স্টেটাস ঘােষণার সময়সীমা, চুক্তিতে ব্রিটেন এবং ভারতের সমান মর্যাদা, সব যেন কোথায় হারিয়ে গেল!
দিন কয়েক পরে ৮ অগস্ট ঘােষণা করা হল, ভাইসরয়ের প্রস্তাব বেশ যুক্তিসঙ্গত। ব্রিটেন ভবিষ্যতে ভারতকে ডােমিনিয়ন স্টেটাস দিতে চায়। আর এখন ভাইসরয়ের পরামর্শদাতা কাউন্সিলের আয়তন বাড়ানাে হচ্ছে। সেখানে সব দলের সদস্যদের নেওয়া হবে। আর যুদ্ধবিষয়ে ভাইসরয়কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আলাদা একটি কমিটি তৈরি করা হবে। আরও বলা হল, “ভারতের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্রিটিশ রাজ বদ্ধপরিকর। যে ধরনের সরকারই তৈরি হােক না কেন, অধিকাংশ মানুষ যদি তাকে অস্বীকার করেন, ব্রিটেন তাকে দায়িত্ব হস্তান্তর করবে না।”[২৩] পাকিস্তান প্রস্তাবের অব্যবহিত পরে ব্রিটিশ রাজের এই ঘােষণা মুসলিম লিগকে আরও তাতিয়ে দিল। অনেক পর্যবেক্ষকেরই মনে হয়েছে, পরবর্তী কালে দেশভাগের বীজ এই ১৯৪০ সালের ঘােষণাতেই উপ্ত ছিল।
প্রতিটি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল। এ আই সি সি সাফ জানাল, “ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার ইচ্ছে ব্রিটেনের নেই। পারলে ভারতকে চিরকালের জন্য শােষণে বেঁধে রাখতে চায় ব্রিটেন।” অতঃপর ভাইসরয়ের পরামর্শে মন্ত্রিসভা একমত, এই পরিস্থিতিতে ভাইসরয়ের পরামর্শদাতা কাউন্সিলের আয়তন বাড়িয়ে লাভ নেই।
মুসলিম লিগের গল্পটা অবশ্য অন্য। প্রথমে ভাইসরয়ের ঘােষণায় তাঁরা গভীর সন্তোষ প্রকাশ করলেন। লিনলিথগাের সঙ্গে এ ব্যাপারে আরও কথা বলার জন্য জিন্নাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। কিন্তু বড়লাটের সঙ্গে আলােচনার শেষে জিন্নাও এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। জিন্না চেয়েছিলেন, ভাইসরয়ের কর্মসমিতির ভারতীয় সদস্যদের মধ্যে যেন মুসলিম লিগের সদস্যই বেশি থাকেন। লিনলিথগােকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, “এখন। তাে কংগ্রেস আইন অমান্য নিয়ে ব্যস্ত। ফলে, সরকার চালাতে মুসলিম লিগ কাউন্সিলে যােগ দিতেই পারে। কিন্তু যে দিন পরিস্থিতি ঘুরে যাবে? কংগ্রেস আবার রাস্তার আন্দোলন থেকে ফিরে এসে কাউন্সিলে ঢুকতে চাইবে? তখন তাে লিগের মনে হবে, সরকার মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। কংগ্রেসকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি এড়াতে লিনলিথগাের কাছে একটি ‘রক্ষাকবচ’ চাইলেন জিন্না। ভাইসরয়ের কাউন্সিলে এখন মুসলিম লিগ যােগ দিলে চুক্তিতে পরিষ্কার লেখা থাকবে, মুসলিম লিগের সম্মতি ছাড়া ব্রিটিশরা পরবর্তী কালে কংগ্রেসের সঙ্গে চুক্তি করবে না। ভাইসরয় কাউন্সিলের অন্য
২৫৪
সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শের সময় চাইলেন। শেষ অবধি ১৯৪০ সালের ২৬ ডিসেম্বর মুসলিম লিগ ভাইসরয়ের কর্মসমিতি, যুদ্ধ-উপদেষ্টা কাউন্সিলে যাওয়ার দুটি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করল।
যুদ্ধের এই সময়টা ব্রিটেনকে সাহায্য করার ব্যাপারে নরমে-গরমে খেলে গিয়েছেন জিন্না। বলেছেন, যদিও সরকারে আধিপত্য না থাকলে মুসলিম লিগ কিছু করতে পারবে
, কিন্তু যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে ব্রিটেনের পক্ষে বিব্রতকরও কিছু ঘটাবে না তারা। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় মুসলিম লিগ সদস্যরা তাঁদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করবেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যদি লিগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়, লিগ-মন্ত্রীরাও সঙ্গে সঙ্গে পদত্যাগ করে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
কংগ্রেসকে কিন্তু অগস্ট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের মূল্য ভাল ভাবেই চোকাতে হল। এই প্রস্তাব মেনে নিলে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তারা অক্লেশে ফিরে আসতে পারত। কিন্তু সর্দার বল্লভভাই পটেল আর চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারি ছাড়া কংগ্রেসের আর কোনও নেতা এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন না। পটেল বম্বেতে এই প্রস্তাব নিয়ে অন্য নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করতে এলেও ভাইসরয়ের সঙ্গে বৈঠকে তিনি ডাক পাননি। দলের সমাজবাদী অংশের থেকে চাপ আসবে জেনেও পটেল খােলা মনে অগস্ট প্রস্তাব নিয়ে আলােচনায় রাজি ছিলেন। ভাইসরয় কিছু সংশােধন’ মেনে নিলে এই প্রস্তাবে তাঁর আপত্তি নেই। এই পরিস্থিতিতে বম্বেতে পটেল এবং ভাইসরয়ের বৈঠক হলে ফলপ্রসূ কিছু হয়তাে বেরিয়ে আসত। কিন্তু সে রকমটা ঘটেনি!
বস্তুত, পটেলকে যখন বৈঠকে আমন্ত্রণের চিঠি পাঠানাে হচ্ছে, সেই সময়েই মৌলানা আবুল কালাম আজাদের টেলিগ্রাম বড়লাটের অফিসে পৌঁছয়। কংগ্রেস সভাপতির পদাধিকারবলে মৌলানা আজাদও ওই বৈঠকে আমন্ত্রিত, কিন্তু টেলিগ্রামে তিনি সাফ জানাচ্ছেন, ৮ অগস্টের প্রস্তাবে তিনি উল্লেখ্য কিছু খুঁজে পাচ্ছেন না। ফলে অযথা আর বম্বেতে ভাইসরয়ের বৈঠকে যাবেন না। ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সচিব লেথওয়েট তখন সিদ্ধান্ত নিলেন, এই পরিস্থিতিতে বল্লভভাইকে আর আমন্ত্রণ না পাঠানােই ভাল! সব জেনে পটেল হতাশ, আলােচনার আরও একটা মােক্ষম সুযােগ ফস্কে গেল। এ দিকে আইন অমান্যের পারদ ক্রমেই চড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্রিটিশ অত্যাচার।
এ হেন পরিস্থিতি বেশি দিন চালানাে যাবে না, ফলে ১৯৪১ সালের ২২ মে লিনলিথগাে ভারতবাসীকে আরও একটি চমকপ্রদ ঘুমের বড়ি খাওয়ানাের চেষ্টা করলেন। জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে তিনি ভারতীয় সদস্যদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবেন। চার্চিলের দ্রুত প্রতিক্রিয়া, “এ ভাবে ভারতীয়দের সমর্থন কেনা যাবে না। যুদ্ধের অগ্রগতিও ঘটবে না। বরং নতুন বিতর্ক শুরু হতে পারে। লিনলিথগাে তবু চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। অবশেষে ১৯৪১ সালেই ভাইসরয়ের কর্মসমিতির আয়তন বাড়িয়ে দেওয়া হল। ভাইসরয় নিজে, স্বরাষ্ট্র, অর্থ এবং যােগাযােগ বিষয়ে তিন ব্রিটিশ অফিসারের পাশাপাশি এ বার থেকে থাকবেন আট জন ভারতীয়।
এই প্রথম ভাইসরয়ের পরামর্শ সভায় এত ভারতীয়, কিন্তু গােটাটাই সংখ্যাতত্ত্বের
২৫৫
ফাঁপা আশ্বাস। শাসনপদ্ধতি সেই এক, এবং ভারতীয় সদস্যদের হাতে কার্যকরী কোনও ক্ষমতা নেই। শান্তিশৃঙ্খলা, আর্থিক স্থিতি, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিষয়ে বরং সেই ভাইসরয়-ই শেষ কথা। নতুন ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ নামে যতই ভারিক্কি হােক না কেন, আসলে ফাঁপা উপদেষ্টা কমিটি ছাড়া আর কিছুই নয়।[২৪]
কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের আয়তন বাড়ানাে হলেও উইনস্টন চার্চিল যে তাঁর নিজের জায়গা থেকে এক চুলও সরেননি, সে কথা পরিষ্কার হয়ে গেল ১৯৪১ সালের রুজভেল্ট-চার্চিল আটলান্টিক চার্টারে। সনদের তৃতীয় ধারায় বলা হল, “কোন ধরনের সরকার থাকবে, তা ঠিক করা দেশের নাগরিকদের অধিকার।”[২৫] মার্কিন রাষ্ট্রদূত গাই ভিনান্ট-এর[২৬] কাছে এই চার্টার-বক্তৃতার আগাম খসড়া পাঠিয়েছিলেন চার্চিল। ভিনান্ট ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন, “ভারতের যদি এই অধিকার না থাকে, ব্রিটেনের ঘাড়ে সাম্রাজ্যবাদের কলঙ্ক আরও গভীরভাবে চেপে বসবে।”[২ ৭] কিন্তু চার্চিল তাঁর কথাও শুনলেন না। উল্টে ১৯৪১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর হাউস অব কমন্সে এক বক্তৃতায় জানালেন, “তিন নম্বর ধারাটি শুধুই নাৎসি জমানায় ব্যতিব্যস্ত ইউরােপীয় দেশগুলির জন্য। ভারত, বর্মা বা সাম্রাজ্যের অন্যান্য অংশের জন্য এই ধারা প্রযােজ্য নয়।”[২৮] তঁার মতে, নাৎসিবাদের হাত থেকে ইউরােপকে বাঁচানাে এক কথা, আর “ব্রিটিশ সম্রাটের অনুগত অঞ্চলে স্বশাসনের ব্যাপারটা আর এক কথা, দুটিকে মিশিয়ে ফেলার কোনও কারণ নেই।”[২৯] আটলান্টিক চার্টার নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চার্চিলের এই বক্তৃতা যথেষ্ট ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে এত দুস্তর পারাবারের অস্তিত্ব আগে কোনও দিন টের পাওয়া যায়নি।
ক্রিপস মিশন
চার্চিলের আটলান্টিক চার্টার বক্তৃতায় ভারতের মােহভঙ্গের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ-পরিস্থিতি অন্য দিকে ঘুরতে শুরু করল। ৯ সেপ্টেম্বরের ওই বক্তৃতার কয়েক সপ্তাহ পরেই পার্ল হারবার বন্দরে জাপানি বােমারু বিমানের আক্রমণে বিধ্বস্ত হল মার্কিন রণতরী ইউ এস এস আরিজোনা। এই ঝটিকা আক্রমণের ফলে দ্রুত গতিতে দুটো ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমত, বিপুল সামরিক শক্তি, প্রযুক্তি আর আর্থিক বলে বলীয়ান আমেরিকা মিত্রবাহিনিতে যােগ দিল। আমেরিকা নিজেও এ বার সরাসরি নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে। দ্বিতীয়ত, মহাযুদ্ধের রেশ এসে পৌঁছল এশিয়ার দোরগােড়ায়। আর তখনই জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে ভারত যে স্ট্র্যাটেজিগতভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে কারও বাকি থাকল না।
দুরন্ত গতিতে জাপানি ফৌজ তখন এগিয়ে চলছে, একের পর এক অঞ্চল তাদের আক্রমণে মুখ থুবড়ে মাটিতে। পার্ল হারবারের মাস দুয়েকের মধ্যে ১৯৪২ সালের
২৫৬
১৫ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনির কম্যান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল পার্সিভাল জাপানি সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। বর্মা, রেঙ্গুন সকলেই ঘাের বিপদের মুখে। জাপানি বাহিনির পরের লক্ষ্য তা হলে ভারত? ফিল্ড মার্শাল লর্ড অ্যালানব্রোক আক্ষেপ করে ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন, “সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার খাতিরেও এক ধরণের বিমার প্রিমিয়াম চোকাতে হয়। সেই প্রিমিয়াম না দেওয়ার ফল এখন আমাদের ভুগতে হচ্ছে।” ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্যাস্তের আঁচ অ্যালানব্রোকের ডায়রিতেই প্রথম টের পাওয়া গেল।
এ দিকে, সিঙ্গাপুরের পতনের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভারতে আর হাত গুটিয়ে বসে থাকার জো নেই। রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে ফের নতুন করে আলাপ-আলােচনা শুরু হল। যুদ্ধের মধ্যে ক্রিপসের প্রস্তাবটাই ভারতীয় সমস্যার সমাধায় একমাত্র গঠনমূলক, ঠিকঠাক রাস্তা দেখাচ্ছিল আঁচ করে পুরনাে সেই প্রস্তাব ফের ধুলাে ঝেড়ে বের করা। হল। পরিষ্কার, ইউরােপের যুদ্ধই তখনও ব্রিটেনের প্রথম লক্ষ্য! ভারত-সমস্যা অনেক পিছনে। তবে, চার্চিলের মহীরুহপ্রতিম ব্যক্তিত্বের পাশে ক্রিপস নেহাতই শিশু। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সর্বদলীয় এক কমিটি তাঁর প্রস্তাবকে ফের দিনের আলাের মুখ দেখতে সাহায্য করেছিল। ওই সর্বদলীয় কমিটির তরফে স্যার জর্জ শুস্টার ভারতসচিব আমেরিকে জানিয়েছিলেন, ভারত নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের টালবাহানা দেখতে দেখতে তাঁরা ক্লান্ত। সর্বদলীয় কমিটির বক্তব্য ক্রিপসের মতােই। ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগােকে তাঁদের আর্জি, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এক প্রতিনিধিদল ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে নতুন সংবিধান তৈরি নিয়ে এখনই আলােচনা শুরু করুক! লিনলিথগাে প্রথমে প্রস্তাবটা . উড়িয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু তার দিন কয়েকের মধ্যেই ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণ! বিভিন্ন তরফ দেখে বারংবার বলা হল, এই যুদ্ধে জিততে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া আর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ভারতই হতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। এক মাসের মধ্যে তিনটি ভিন্ন মহল থেকে চার্চিলকে এই কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল। তাঁর যুদ্ধমন্ত্রকে লেবার দলের সদস্যরা থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ভারতে নরমপন্থী নেতা স্যার তেজবাহাদুর সঞ, তিন জায়গা থেকে তখন একই কথা শুনছেন চার্চিল।
স্যর তেজবাহাদুর সপু অবশ্য অনেক আগে, ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে গাঁধী-জিন্নার সমঝােতা করানাের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু লাভ হয়নি। জিন্না নিজেকে মুসলিমদের মুখপাত্র হিসেবে দাবি করলেও সঙ্গত কারণেই গাঁধী ‘হিন্দুদের মুখপাত্র হিসেবে কোনও বৈঠকে বসতে চাননি। ইতিমধ্যে জাপানিরা ভারতের দরজায় পৌঁছে গিয়েছে, কাকিনাড়া, বিশাখাপত্তনম আর কলকাতার মাটিতে জাপানি বিমান থেকে বােমা আছড়ে পড়ল। অহেতুক ত্রাসের সঞ্চার ছাড়া সেই বােমাবর্ষণে লাভ কিছু হয়নি। কিন্তু মাদ্রাজ উপকূলের কয়েক মাইল দূরে যখন জাপানি যুদ্ধজাহাজ দেখা গেল, পরিস্থিতি বদলে গেল। মাদ্রাজের গভর্নর আর্থার অসওয়াল্ড জেমস হােপ তাঁর ব্রিটিশ কর্মীদের নিয়ে উটকামন্ড (অধুনা উটি) পালিয়ে গেলেন।
২৫৭
সিঙ্গাপুরে পরাজয়ের স্মৃতি তখনও সকলের মনে সতেজ। কাপুরুষের মতাে হােপের এই পলায়নবৃত্তিতে রেগে তৎকালীন কম্যান্ডার ইন চিফ লর্ড ওয়াভেল তাঁকে তার পাঠিয়ে যাচ্ছেতাই গালমন্দ করলেন। মহাত্মা গাঁধী কোনও দিনই দক্ষ সমর-বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। কিন্তু তিনিও বল্লভভাই পটেলকে লিখলেন, “সরকার ওড়িশা উপকূলে যে ভাবে সেনা জমায়েত করছে, মনে হয় পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য ওড়িশা।”[৩১] যুদ্ধই তখন সকলের মনােযােগের কেন্দ্রে।
১৯৪২ সালের ৪ মার্চ রুজভেল্টকে চার্চিল জানালেন, “যুদ্ধের পর ভারতকে ডােমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। দরকারে কমনওয়েথ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকারও ভারতের থাকবে। কিন্তু এই সঙ্কটমুহুর্তে এমন ঘােষণা করা উচিত কি না, তা নিয়েই আমাদের চিন্তা৷” তিনি আরও জানাচ্ছেন, কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই সে দেশের ১০ কোটি মুসলমানকে আমরা বিপদের মুখে ঠেলে আসব না। ওঁরা আমাদের ব্রিটিশ ফৌজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।[৩২] এবং শুধু মুসলমানদের কথা উল্লেখ করেই থেমে যাচ্ছেন না তিনি, “৪ কোটি অচ্ছুৎ-অস্পৃশ্য আর দেশীয় রাজ্যগুলির ৮ কোটি বাসিন্দা। এঁরা সকলেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। জাপানি আক্রমণের মুখে বিপন্ন ভারতকে তাই আমরা বিশৃঙ্খলার গর্তে ঠেলে দিয়ে আসতে পারি না।”[৩৩]
১০ মার্চ, ১৯৪২ ৩৪ রুজভেল্ট প্রস্তাব দিলেন, তা হলে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে ভারতে সাময়িক একটি সরকার তৈরি হােক। তাকেই অস্থায়ী ডােমিনিয়ন সরকার। হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। রুজভেল্টের বক্তব্য, “এ ভাবে হয়তাে নতুন দিন শুরু হবে। ভারতীয় জনগণ তাদের রাগ-হতাশা-তিক্ততা ভুলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অনুগত প্রজা হয়ে উঠবে।”[৩৫] পরের দিনই, ১১ মার্চ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে চার্চিল ভারতে ক্রিপস মিশন নিয়ােগের কথা ঘােষণা করলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের চাপ যে চার্চিলের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছিল, তা নিয়ে সংশয় নেই।[৩৬]
চার্চিলের যুদ্ধমন্ত্রকের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ দিল্লি পৌঁছলেন ক্রিস। ডােমিনিয়ন স্টেটাস বিষয়ে যুদ্ধমন্ত্রকের একতরফা প্রস্তাব নিয়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনায় বসাই তাঁর লক্ষ্য। আর প্রস্তাবের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় খোঁচা মারতে ছাড়লেন না পটেল, “কংগ্রেস এখন ব্রিটিশ দাদাদের সঙ্গে আলােচনা করতে যাবে কোন দুঃখে, যখন ছয় মাসের মধ্যে নতুন কোনও দাদা এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসতে পারেন!”[৩৭] নতুন দাদা মানে যে জাপানি দাদা, বুঝতে কারও বাকি নেই। পটেল ঠিকই আঁচ করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, চিন আর আমেরিকার চাপেই ব্রিটেন কিল হজম করতে বাধ্য হয়েছে। আর সেই কিল হজমের কারণেই ক্রি মিশন। আমদাবাদে এক সভায় পটেল পরিষ্কার বললেন, “ক্রিপস এ দেশে এসেছেন সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পরে। ব্রিটিশ শাসনের এখন ভারত থেকে কিছু নেওয়ার নেই, নতুন কিছু দেওয়ারও ক্ষমতা নেই!”[৩৮] ১৯৪০ সালে যে বল্লভভাই পটেলের মনে হয়েছিল, কংগ্রেসের একাংশ ক্রিপসের প্রস্তাব নিয়ে সমঝােতায় পৌঁছতে চায়, তার চেয়ে ইনি অনেক আলাদা। দু’বছরেই জল অনেক দূর বয়ে গিয়েছে! পটেল আর
২৫৮
গাঁধী স্থির করলেন, কংগ্রেসের তরফে আবুল কালাম আজাদ ক্রিপসের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। জওহরলাল, রাজাজি আর ভুলাভাই দেশাই আপাতত আড়ালেই থাকবেন। এই সময়ের খবরের কাগজ ঘাঁটলেই দেখা যাবে, ক্রিপস নয়া দিল্লিতে পৌঁছানাের তিন-চার দিন পরেও জওহরলাল ইলাহাবাদে। কিন্তু আলােচনা খানিক এগােনাের পর অবধারিতভাবে তিনিও এসেছেন বৈঠকে যােগ দিতে।
কংগ্রেস নেতৃত্ব তখন আরও একটি বিষয় ভেবেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, ব্রিটিশরা পরাজয়ের মুখে। জাপান অচিরে ভারত আক্রমণ করবে। তা হলে আর ক্রি প্রস্তাব মেনে অযথা ব্রিটিশের সঙ্গে সমঝােতা কেন? ‘হরিজন’ পত্রিকায় মহাদেব দেশাই লিখলেন, “ক্রিপসের প্রস্তাব আসলে মৃত শিশু প্রসবের মতাে। দিনের আলাে যখন সে প্রথম দেখল, দেহে আর প্রাণশক্তি অবশিষ্ট নেই।” গাঁধীর মনে হল, এই প্রস্তাব আসলে ধসে-যাওয়া ব্যাঙ্কে ‘পােস্ট-ডেটেড চেক’।[৩৯] যত টাকারই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হােক না কেন, কোনও দিন পাওয়া যাবে না। ক্রিপসের সঙ্গে বৈঠকের পরের দিনই তিনি ওয়ার্ধার আশ্রমে ফিরে যেতে চেয়েছেন, অবশেষে ওয়ার্কিং কমিটির অনুরােধে-উপরােধে আরও কয়েক দিন দিল্লিতে থাকতে রাজি হয়েছেন। কংগ্রেসের তরফে আবুল কালাম আজাদ অবশ্য বেশ কয়েক বার ক্রিপসের সঙ্গে দেখা করেছেন। ১৯৪২ সালের ২৯ মার্চ ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্ত নিল কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি। সিদ্ধান্ত ক্রিপসকে জানিয়ে দেওয়াও হল, কিন্তু এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের আগে এই প্রত্যাখ্যান জনগণকে জানানাে হয়নি। সেই সপ্তাহেই নেহরু ইলাহাবাদ থেকে দিল্লি এসে ফের রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলেন। এই যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা এবং দায়িত্ব নিয়ে আলােচনা শুরু, তৎকালীন ব্রিটিশ কম্যান্ডারইন-চিফ লর্ড ওয়াভেল, আজাদ এবং নেহরুর মধ্যে বৈঠকের বন্দোবস্ত করলেন ক্রিস। গাঁধী এবং পটেলের বিরােধিতা সত্ত্বেও ওয়ার্কিং কমিটির বেশির ভাগ সদস্য তখন নেহরুকে সমর্থন করছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রস্তাব হয়তাে তাঁরা মেনেও নিতেন। কিন্তু এই মেনে নেওয়ার মুখে আচম্বিতে প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলেন চার্চিল। প্রস্তাব যে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, তা চার বছর বাদে হাউস অব কমন্সের এক বিতর্কে পরিষ্কার। ১৯৪৬ সালের ১২ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে ভারতসংক্রান্ত এক বিতর্কে অংশ নিয়ে চার্চিল বলেছিলেন,[৪০]
“এই ভদ্রলােক যখন আমার সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ভারতে গিয়েছিলেন এবং ওঁকে কী ভাবে থামানাে হয়েছিল, তা আমার স্পষ্ট মনে আছে। (তুমুল হট্টগােল এবং চার্চিলের বিরক্তি)…আমি আর কিছুই বলতে চাই না।
স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস: সে সময় আমার আর মন্ত্রিসভার মধ্যে যে সব তথ্য আদানপ্রদান হয়েছিল, সে সব প্রকাশ করতে চান? তা হলে কিন্তু সব তথ্যই প্রকাশ করতে হবে।
চার্চিল: ঠিকই বলছেন। এই বিষয়টি আমি আর খোঁচাখুঁচি করতে চাই না।
২৫৯
ক্রিপস প্রস্তাবের ব্যর্থতা যে চার্চিলের মনােভঙ্গিতেই নিহিত ছিল, পরবর্তীকালে কর্নেল লুই জনসনের বক্তব্যেও তা পরিষ্কার, “ক্রিপস কিন্তু আন্তরিক ভাবেই সমস্যাটা মেটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর হাতে সঠিক ক্ষমতা থাকলে, ক্রিপস নেহরুর সঙ্গে বসে অক্লেশে সমস্যা কাটিয়ে ফেলতে পারতেন। কিন্তু দু’একটা ছােটখাটো গুরুত্বহীন সংশােধনী নিয়ে প্রস্তাব যখন সকলে প্রায় মেনে নেওয়ার মুখে, অবাক হয়ে দেখলাম, ক্রিস আমাকে বলছেন, চার্চিলের অনুমতি ব্যতিরেকে তিনি এই খসড়ার একটি লাইনও বদলাতে পারবেন না। চার্চিল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ক্রিপসকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর বক্তব্যই সব নয়। তিনি খসড়ায় এ দিক-ও দিক করতে চাইলে ভাইসরয় এবং কম্যান্ডার ইন চিফকেও একযােগে সে কথা জানাতে হবে। এই পরিবর্তনে তাঁদের আপত্তি নেই। লন্ডন প্রথম থেকেই চাইছিল, কংগ্রেস এই ক্রিপস মিশন প্রত্যাখ্যান করুক!২[৪১]
১৯৪২ সালের ১১ এপ্রিল২ ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার কথা রুজভেল্টকে জানিয়ে দিলেন চার্চিল। রুজভেল্ট সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাঠালেন, “এতে হাল ছাড়লে হবে না। ক্রিস বরং আরও কিছুদিন ভারতে থেকে শেষ চেষ্টা করুন।” চার্চিলের উত্তর: ক্রি ইতিমধ্যেই ভারত ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। চার্চিল বােধ হয় বােঝাতে চেয়েছিলেন, তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বে সাম্রাজ্য অটুট। সেখানে এতটুকু ছুরি-কাঁচি চালানাে যাবে না।
ক্রিস প্রস্তাবের খসড়াকারেরা সম্ভবত ভেবেছিলেন, মুসলিম লিগকে তাঁরা খুশি করতে পারবেন। কিন্তু লিগও এই প্রস্তাবে অনেক দুর্বলতা খুঁজে পেল। অসমে ৬০ শতাংশ মানুষই হিন্দু। ক্রিপস প্রস্তাব অনুযায়ী, তাঁরা ভারতে যােগ দেবেন। মানে, মুসলিম-অধ্যুষিত শ্রীহট্টও ভারতীয় ডােমিনিয়নে! প্রস্তাবে গণভােটের কথা বলা হয়েছিল। পঞ্জাবের গণভােটে হয়তাে পাকিস্তানের পক্ষে রায় যাবে, কিন্তু বাংলায় কী ঘটবে বলা মুশকিল। সেখানে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি এখন মুসলিম লিগের প্রকাশ্য বিরােধিতায়! এ সব ভেবেই মুসলিম লিগ খারিজ করে দিল ক্রিপস প্রস্তাব। কংগ্রেস এই প্রস্তাবে ‘যুদ্ধশেষের পরে’ কথাটি মানতে নারাজ। প্রস্তাবে প্রদেশগুলির সীমা রদবদল করে যে ভাবে প্রায় দেশভাগের ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে, সেখানেও তাদের স্পষ্ট আপত্তি। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের তখনও ধারণা, এ যুদ্ধে ব্রিটেন হারবেই!
এই সময়েই ওয়ার্কিং কমিটির অন্যতম সদস্য চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারি (রাজাজি) সরাসরি জানালেন, কংগ্রেস ভুল রাস্তায় খেলছে। রাজাজির বক্তব্য, যুদ্ধে ব্রিটেনকে সাহায্য না করা এবং মুসলিম লিগকে পাত্তা না দেওয়ার যে নীতি কংগ্রেস নিয়েছে, দুটোই সমান ভুল! তাঁর বক্তব্য, মুসলিমপ্রধান রাজ্যগুলিতে পৃথক সরকার তৈরি নিয়ে মুসলিমরা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, সেটাই মেনে নেওয়া যাক। দু’পক্ষে যদি এ নিয়ে সমঝােতা হয়, তা হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ রকম ‘ন যযৌ ন তহৌ’ হয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না।
মাদ্রাজ কংগ্রেস রাজাজির মত মেনে নিল। ১৯৪২ সালের ২৩ এপ্রিল সেখানে পাশ হয়ে গেল দুটি প্রস্তাব। এক, মুসলিমদের দেশভাগের দাবি এ আই সি সি মেনে নিক, সেই অনুযায়ী মুসলিম লিগের সঙ্গে তারা কথাবার্তা শুরু করুক। তারপর দু’তরফের
২৬০
সমঝােতায় দেশে তৈরি হােক অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার। দুই, মাদ্রাজের আইনসভা আবার পুনরুজ্জীবিত হােক। কংগ্রেস সদস্যরা আইনসভায় ফিরে যাক, মন্ত্রক তৈরিতে মুসলিম লিগকেও তারা আহ্বান জানাক। ছয় দিন পরে, ২৯ এপ্রিল ইলাহাবাদের এ আই সি সি অধিবেশনে রাজাজির দুটি প্রস্তাবই বেশির ভাগ সদস্যের বিরােধিতার জেরে খারিজ হয়ে যায়। এ আই সি সি জানাল, ‘দেশভাগের প্রস্তাব ভারতীয় জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। দেশীয় রাজ্য থেকে প্রদেশ…তামাম ভারত এই ভয়ঙ্কর প্রস্তাব মানতে নারাজ। রাজাজি অবশ্য দমলেন না। ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করলেন। ইস্তফা দিলেন তাঁর মাদ্রাজ বিধানসভার আসনেও। নির্দল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেই তাঁর মত এ বার জনতার দরবারে নিয়ে যাবেন তিনি। তাঁর পাশে এসে দাঁড়ালেন মাদ্রাজ আইনসভার আরও সাত সদস্য। তাঁরাও আইনসভায় ইস্তফা দিয়ে এসেছেন। রাজাজির পথই এ বার থেকে তাঁদের পথ !
এই বিশাল দেশে কংগ্রেস আর সকলের মুখপাত্র নয়। ভারতীয় ভূখণ্ডের এই বহুবিস্তৃত ভৌগােলিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক আবহে সব মতামত এক পাত্রে ধরা সম্ভব নয় বলেই।
প্রাদেশিক রাজনীতি
প্রদেশগুলি ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ভাবে সরব হয়ে উঠতে শুরু করেছে। অজস্র রাজনৈতিক ঘটনার ঘনঘটায় শেষ অবধি বাংলায় মৌলবি ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা পরাজিত হল। ১৯৪১ সালে ভাইসরয়ের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ তৈরিতে এই ঘটনাপ্রবাহের শুরু! ১৯৪০ সালের ৮ অগস্ট ভাইসরয়ের প্রস্তাবে এই পরিষদ তৈরির কথা বলা হয়েছিল। তার এক বছর পরে ৪১-এর জুলাই মাসে সেই প্রস্তাব কাজে পরিণত হতে শুরু করল। প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীদের ভাইসরয় এই পরিষদে যােগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁরাও নির্দ্বিধায় সেই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী। হিসেবেই তাঁদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ভাইসরয়, মুসলিম লিগের সদস্য হিসেবে নয়। মুসলিম লিগের মন্ত্রীরা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সরকারি কাজ চালিয়ে যাবেন, সরকারকে অযথা বিড়ম্বনায় ফেলবেন না এ রকম সিদ্ধান্ত লিগ আগেই নিয়েছিল। ফলে প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীদের মনেও কোনও সংশয় ছিল না।
ভাইসরয় এ বার জিন্নাকে ব্যাপারটা জানালেন। পরিষদে তিন জন মুসলিম প্রধানমন্ত্রী! পঞ্জাবের সিকন্দর হায়াত খান। বাংলার ফজলুল হক। আর অসমের স্যার মহম্মদ সাদাউল্লা। ভাইসরয় জিন্নাকে আশ্বস্ত করলেন, এই তিন জন থাকায় পরিষদে নিশ্চয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবিচারের মতাে কোনও ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু উল্টা বুঝিলি রাম। ব্যারিস্টার মহম্মদ আলি জিন্না আবার আইনি মারপ্যাঁচের ভাষায় বুঝলেন,
২৬১
মুসলিম প্রতিনিধি হিসেবেই ওই তিন জনকে নিয়ােগ করা হয়েছে। তা হলে কি তিনি আর মুসলিমদের একচ্ছত্র মুখপাত্র নন? চিঠিটা বম্বের গভর্নরের মাধ্যমে জিন্নার কাছে। পাঠানাে হয়েছিল। সেখানেও জিন্না অপমানিত বােধ করেছিলেন। গভর্নর কেন, মুসলিমদের মুখপাত্র হিসেবে তাে চিঠিটা তাে ভাইসরয়ের তাঁকে সরাসরি পাঠানাে উচিত ছিল ! যেমন ভাবা, তেমন কাজ! জিন্নার উদ্যোগেই ‘ডিসিপ্লিন ভঙ্গের অভিযােগে তিন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীকে শাে কজের নােটিস পাঠালেন মুসলিম লিগের তৎকালীন সম্পাদক। তিন জনকেই জানিয়ে দেওয়া হল, ১৯৪১ সালের ২৪ এপ্রিল বম্বেতে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাঁদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দল থেকে এ ভাবে হাত-পা বেঁধে দেওয়ায়, প্রায় বাধ্য হয়েই সিকন্দর হায়াত খান আর মহম্মদ সাদাউল্লা দু’জনে ভাইসরয়ের নিরাপত্তা পরিষদ থেকে ইস্তফা দিলেন। ফজলুল হকও তাই করলেন। কিন্তু তিনি আর একটু এগিয়ে খেললেন। ভাইসরয়ের নিরাপত্তা পরিষদের পাশাপাশি লিগের ওয়ার্কিং কমিটি থেকেও ইস্তফা দিলেন। তাঁর সে সময়ের চিঠিতে লিগ সভাপতির ‘স্বৈরাচারী মনােভাবের কথা লিখেছেন ফজলুল হক। জানিয়েছেন, জিন্না ডিসিপ্লিনের প্রশ্নটা এমন ভাবে উপস্থাপন করেছিলেন যে সেখানে বিরুদ্ধে ভােট দেওয়া মানেই জিন্নার বিরুদ্ধে অনাস্থা! মুসলিম লিগের সংকট এ ভাবেই মিটল, কিন্তু ফজলুল হকের আত্মসম্মানে এতটাই আঘাত লাগল যে তিনি মুসলিম লিগ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। আর রাজনৈতিক কূট চালে ফজলুল হক এই ইস্তফা দিলেন ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ। তার তিন দিনের মধ্যে বাংলা বিধানসভায় বাজেট পাশ হওয়ার কথা, নতুন আর্থিক বছর শুরু। ফজলুল হকের প্রত্যাঘাত ছিল এ রকমই ভয়ঙ্কর! বাংলা, সিন্ধুপ্রদেশ আর অসমে লিগের মধ্যে এ ভাবেই রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি চলছিল। পঞ্জাব অবশ্য এ সবে ঢােকেনি, নিস্পৃহ ভঙ্গিতে দূরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লিগ ছেড়ে ১৯৪১ সালে কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার সঙ্গে জোট বেঁধে শ্যামাপ্রসাদ-হক মন্ত্রিসভা গঠনের দাম ফজলুল হককে চোকাতে হল অন্য ভাবে। তাঁর মতাে জনপ্রিয় রাজনীতিককেও “পূর্ববঙ্গে গিয়ে কালাে পতাকা দেখতে হল।”৪৩ মাহমুদ হুসেন লিখছেন, “পাকিস্তান আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশি অবদান ১৯৪০ থেকে ৪৭-এর মধ্যে। ওই সময়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লিগ প্রথম প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ফজলুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে ঢাকা থেকে পাকিস্তান নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা বেরােতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ মুসলিম কর্মচারীরা অনেক সময় ভালবাসার টানেই নিখরচায় এই পত্রিকার নানা ঝক্কি সামলাতেন। সুকুমার সেন নামে প্রখ্যাত এক হিন্দু সাহিত্যতাত্ত্বিক ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’ নামে বাংলা সাহিত্যের নতুন এক ইতিহাসও লিখেছিলেন।”
২৬২
ভারত ছাড়াে: ১৯ এপ্রিল, ১৯৪২
ঘটনা এ বার দ্রুত গতিতে বাঁক নিতে শুরু করল। গাঁধীর ঘােষণা, ব্রিটেন উদ্যোগ না নিলে ভারতই এ বার পথ দেখাবে। ১৯৪২ সালের ১৯ জুন তিনি ‘হরিজন’ পত্রিকায় লিখলেন, “ভারত এবং ব্রিটেন দু’দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই ব্রিটেনের এ বার সময়মতাে, ধাপে ধাপে ভারত ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া উচিত।” খুব নিরুচ্চারে এ ভাবেই ‘ভারত ছাড়াে আন্দোলনের সূত্রপাত হল।
সপ্তাহ দুয়েক পরে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে ইলাহাবাদে এ আই সি সি আর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। বৈঠকে এ আই সি সি প্রস্তাব নিল, “বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপে যে ভারতে স্বাধীনতা আসতে পারে, এ ধরনের চিন্তাভাবনা কমিটি পরিহার করেছে। যে বিদেশি শক্তিই ভারতের মাটিতে মাথা গলানাের চেষ্টা করুক না কেন, তাকে প্রতিরােধ করতে হবে। আর ব্রিটিশ সরকার যখন ভারতীয় জনগণকে দেশরক্ষার জন্য সংগঠিত হতে দিচ্ছেন না, অহিংসা এবং অসহযােগের মাধ্যমেই ওই প্রতিরােধ ঘটানাে হবে।”[৪৪] প্রস্তাবে স্পষ্ট, এতদিন ব্রিটেনকে নিঃশর্ত সমর্থনের যে মনােভাব নিয়েছিলেন নেহরু, তা পরিত্যক্ত হল। এমনকী, জাপান ভারত আক্রমণ করলে তাকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিহত করার কথাও আর উঠবে না।
ইলাহাবাদ অধিবেশনের কয়েক মাস পরেই ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে ওয়ার্ধায় ‘ভারত ছাড়াে’ প্রস্তাব নিল কংগ্রেস। স্যর তেজবাহাদুর সঞ, ড. অম্বেডকর, স্যর সিকন্দর হায়াত খান, জিন্না, ব্রিটিশ লেবার পার্টি, এমনকী রাজাজিও কংগ্রেসের এই পদক্ষেপের সমালােচনা করতে ছাড়লেন না। অন্য দিকে, ভারত সরকার এই ঘটনায় তখন রীতিমতাে উদ্বিগ্ন। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হল, ওয়ার্ধা প্রস্তাবের জন্য কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বম্বে প্রদেশের গভর্নর স্যর রজার লুমলে কংগ্রেসের ওয়ার্ধা প্রস্তাবের কথা ফোনে ভাইসরয়কে জানিয়েছেন। আর সেই ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী সমিতির বৈঠক। সেই বৈঠকে সকলে একমত হয়ে জানিয়েছেন, এখনই কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের গ্রেফতার করতে হবে। দেশ জুড়ে কংগ্রেস নেতাদের কাউকে ছাড়া চলবে না!
সেই ধরপাকড়ের পর এক মাস কাটতে না কাটতে ‘৪২ সালের অগস্ট মাসে বম্বেতে মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। সেই বৈঠকে লিগ-সদস্যেরা কেউ কেউ মনে করেছিলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রিটিশ-বিতাড়নের এটিই মােক্ষম মাহেন্দ্রক্ষণ! ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের আগের দিন রাজাসাহেব মাহমুদাবাদ, এম এ এইচ ইস্পাহানি আর জামাল মিয়াঁ জিন্নার সঙ্গে দেখা করে সে কথা জানিয়েছিলেন। চৌধুরী খালেকুজ্জামানও প্রায় এক সুরে বলেছিলেন, ‘হিন্দু’দের সঙ্গে এ বার হাত মেলানাে যেতেই পারে। কিন্তু জিন্না দৃদ্ধ, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে মুসলিম লিগের এখন রাস্তায় নামা উচিত নয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসকে সমর্থন করা হবে
২৬৩
কি না, তা নিয়ে ওয়ার্কিং কমিটিতে প্রস্তাব পেশ করা হল। ইস্পাহানি, রাজাসাহেব মাহমুদাবাদ এবং নবাব ইসমাইল খান ভােটদানে বিরত থাকলেন। সিন্ধুপ্রদেশের জি এম সইদ অবশ্য ভােটদানে বিরত থাকার ব্যাপারটি মানতে পারেননি, তিনি ভােট দিলেন প্রস্তাবের বিপক্ষে।
মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটি, বিশেষত জিন্নার এই সিদ্ধান্তে মুসলিম লিগের লাভই হয়েছিল। তাদের নেতাদের সে সময়ে জেলে যেতে হয়নি, উল্টে কংগ্রেসের অনুপস্থিতিতে ১৯৪২ থেকে ৪৬-এর মধ্যে লিগের তুমুল বাড়বাড়ন্ত ঘটতে শুরু করল। আর, সঙ্কটমুহূর্তে রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে ইচ্ছাকৃত ভাবে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার কারণে কংগ্রেস বড়সড়াে ধাক্কা খেল। জিন্না বরং নিজেকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেকটাই ফাঁকা সময় পেয়ে গেলেন।
বাস্তব রাজনীতিতে, তখন কংগ্রেস আর ব্রিটিশ সরকার দুই প্রতিপক্ষই কানা গলিতে আটকে। কারও পক্ষে মােড় ঘােরার উপায় নেই। সরকারের বক্তব্য, কংগ্রেস যদি ভারত ছাড়াে আন্দোলন তুলে না নেয়, নেতাদের কাউকে ছাড়া হবে না। শাসনসংস্কার নিয়ে নতুন পদক্ষেপও আর নেওয়া হবে না। কংগ্রেসের দাবি, আগে নেতাদের ছাড়তে হবে। তারপর অন্য কথা! অন্য দিকে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কংগ্রেসের সােশালিস্ট নেতাদের উদ্যোগে তখন আন্দোলনের পারদ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পাল্লা দিয়ে সরকারের রােষও চড়তে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে, ফের অচলাবস্থা। ব্রিটিশ শক্তির কাছে তখন ইউরােপ, এশিয়া নির্বিশেষে যুদ্ধ-পরিস্থিতিই মুখ্য। জাপানের বিরুদ্ধে ভারত মিত্রশক্তির গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি, ফলে আমেরিকাও ‘যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপ’-এর কারণে কংগ্রেসের উপরে বিরক্ত। বাকি দুনিয়ার ওপর এই ঘটনা রীতিমতাে প্রভাব ফেলেছিল, এতদিন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের সহানুভূতি ছিল, তারাও নিজেদের দূরে সরিয়ে নিতে শুরু করেছিল। জওহরলাল ‘মিত্রশক্তিকে পূর্ণ সমর্থনের কথা ঠিকঠাক সব দিক বুঝেই বলেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়াে’ আন্দোলন সে দিন সময়কে চিনতে ভুল করেছিল।
ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাের আমল
ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাের উত্তরসূরিদের সবাইকে তিনটি বাধা টপকাতে হচ্ছিল। দেশের সংখ্যালঘু আর গরিষ্ঠদের মধ্যে সাম্যাবস্থা নিয়ে আসা; ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য যে ভাবে হুড়মড়িয়ে ভেঙে পড়ছে, তাতে ব্রিটিশ সিলমােহর লাগানাে; আর ভারতে রাজনৈতিক অগ্রগতি রুখতে সংখ্যালঘুদের ভেটোদানের অধিকার। স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশরা কী ভাবে চুপিসাড়ে অন্তর্ঘাত ঘটাচ্ছিল, সেই হিসেব নিলে দেখা যাবে লর্ড লিনলিথগাে তাঁর আগে-পরের সব বড়লাটকে ছাপিয়ে গিয়েছেন।
২৬৪
১৯৩৫ সালে ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া’ আইনের ফেডারেল অংশটি জিন্নাকে বরাবর চিন্তায় রেখেছিল। প্রাদেশিক সরকারের ধাঁচে ফেডারেল অংশে কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বের কথা বলেছিল ওই আইন। লর্ড লিনলিথগাে মুসলিম লিগ প্রতিনিধিদের দাবি মেনে ১৯৩৯ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঘােষণা করে দিয়েছিলেন, যুদ্ধ না-থামা অবধি। ফেডারেশনের ব্যাপারটি স্থগিত থাকবে। এক সপ্তাহ পরে ১৮ সেপ্টেম্বর জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ এই স্থগিতাদেশকে অভিনন্দন জানাল। তাদের আশা ছিল, পরে এই ফেডারেশন-স্কিম বর্জিত হবে।
অন্য দিকে যুদ্ধে ভারতের যােগদান নিয়ে কংগ্রেসের অবস্থান ব্রিটেনের রক্ষণশীল সরকার এবং লর্ড লিনলিথগােদের আমলাদের সকলকে ক্লান্ত করে তুলছিল। প্রত্যাশিত ভাবেই তাই বাংলা, অসম এবং সিন্ধুপ্রদেশে কংগ্রেসকে দুর্বল প্রতিপন্ন করে লিগকে শক্তিশালী করে তােলার চেষ্টা করছিল ব্রিটিশরা।
বাংলায় ফজলুল হকের জোট সরকার যেমন। ১৯৪৩ সালের মার্চ মাসে হক সাহেবকে পদত্যাগে বাধ্য করানাে হল। শ্যামাপ্রসাদ-হক সরকারের জায়গায় নাজিমুদ্দিনের লিগ মন্ত্রিসভাকে বসানাে হল। ফজলুল হক তাঁর আট সদস্যের মন্ত্রিসভার আয়তন বাড়াতে চেয়েছিলেন। দু’জন তফশিলি জাতির সদস্য মন্ত্রিসভায় আসবেন ঠিক হয়েছিল। বাংলার তৎকালীন গভর্নর সেটুকু অনুমতিও ফজলুল হককে দেননি। অথচ, সেই গভর্নরের সৌজন্যে নাজিমুদ্দিনকে ১৩ সদস্যের মন্ত্রিসভা গড়তে অনুমতি দেওয়া হল। ১৩ জন সচিব নিয়ােগেও সায় দেওয়া হল।
সিন্ধুপ্রদেশেও প্রায় এক ঘটনা। সেখানকার সরকারের নেতৃত্বে তখন জাতীয়তাবাদী নেতা আল্লা বক্স। ব্রিটেন ভারতের স্বাধীনতার দাবি মেনে না নেওয়ার প্রতিবাদে আল্লা বক্স তাঁর ‘খান বাহাদুর’ এবং ‘ও বি ই’ খেতাব সরকারকে ফিরিয়ে দেন। গভর্নর ১৯৪২ সালের অক্টোবর মাসে আল্লা বক্সকে বরখাস্ত করলেন, তাঁর পরিবর্তে আইনসভার লিগ নেতাকে সরকার গড়তে ডাকা হল।
অসমে নির্দল সদস্য রােহিনিকুমার চৌধুরীর দাবি ছিল, তিনি মন্ত্রিসভা গড়তে সক্ষম। উপযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রমাণও দেবেন। কিন্তু সেখানকার গভর্নর তাঁর কথায় পাত্তা না দিয়ে মুসলিম লিগকেই সরকার গড়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী সমিতিতে কিন্তু মুসলিম লিগও যােগ দেয়নি। পরবর্তী কালে কংগ্রেস কার্যনির্বাহী সমিতিতে এলেও লিগের গুরুত্ব অটুট রাখার যে দাবি মুসলিম নেতারা তুলেছিলেন, ভাইসরয় তা মেনে নেননি। ফলে, লিগের একটু সংশয় ছিলই। উপরন্তু সরাসরি ব্রিটিশের সঙ্গে হাত মেলাতে অনেক লিগ নেতাই ইতস্তত করছিলেন। তবে কংগ্রেসের ‘ভারত ছাড়াে আন্দোলনের বিরােধিতা করে সে সময় লিগ ব্রিটিশ সরকারকে ভালই সাহায্য করেছিল।
লর্ড লিনলিথগাের নীতি ছিল একটাই। যে সব প্রদেশে কংগ্রেস সরকার ইস্তফা দিচ্ছে, সেখানে মুসলিম লিগকে সরকার গড়তে সর্বতােভাবে সাহায্য করা। মহাযুদ্ধের সূচনায় কোনও প্রদেশেই লিগ সরকারের অস্তিত্ব ছিল না। অথচ ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে
২৬৫
লিনলিথগাের কার্যকালের মেয়াদশেষে দেখা গেল, চারটি প্রদেশে মুসলিম লিগের সরকার। বাংলা, অসম, সিন্ধু এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। এই অঞ্চলগুলি নিয়েই তাে লিগের পাকিস্তান তৈরির দাবি!
১৯৪৩ সালে আগা খাঁ প্রাসাদের কারাগারে গাঁধী অনশন শুরু করার পরে লিনলিথগাে তাঁর এই ন্যক্কারজনক নীতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেলেন। গাঁধীর অনশনের কারণে ভাইসরয়ের কার্যনির্বাহী সমিতি থেকে তিন জন সে বার ইস্তফা দিয়েছেন। তাঁদের জায়গায় ঝটিতি নতুন তিন সদস্যকে নেওয়া হল। কিন্তু তাতে কার্যনির্বাহী সমিতির চেহারাটা দাঁড়াল অদ্ভুত! ১৯৪৩ সালের ৮ মে ‘দ্য নিউ স্টেটসম্যান’ এবং ‘নেশন’ কাগজের মন্তব্য, “নতুন সদস্যদের পরিচিতি খুব একটা উজ্জ্বল নয়। কিন্তু কার্যনির্বাহী সমিতির চেহারাটা এ বারে নিশ্চয় মিস্টার জিন্নার কাছে মনােরম বােধ হবে। মুসলিম এবং হিন্দু সদস্যদের মধ্যে সাম্য বজায় রাখার যে দাবি তিনি এতদিন তুলছিলেন, কার্যক্ষেত্রে তা পূরণ হল। সংখ্যালঘুরা ভবিষ্যতে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে এটা তাদের নিজস্ব অধিকার ভাবতে পারে। ব্যাপারটি অদূর ভবিষ্যতে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।”
এই সময়েই ব্রিটিশরা নতুন এক তত্ত্ব খাড়া করল। নির্বাচনে জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার যে গণতান্ত্রিক রীতি সারা দুনিয়ায় চালু, তা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। হিন্দু এবং মুসলমানেরা সেখানে বিচ্ছিন্ন দুই সম্প্রদায়। এবং গণতন্ত্রের ন্যূনতম নিয়মটুকু নিয়েও দুই সম্প্রদায় কখনও একমত হতে পারে না। অতএব, মুসলিম সম্প্রদায়ের ‘আত্মনির্ধারণের অধিকার রয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বকে এই ভাবেই সাংবিধানিক ধড়াচূড়া পরানাে হল।
উইন্টারটন, আমেরি, জেটল্যান্ড থেকে চার্চিল অবধি দুদে রক্ষণশীল ব্রিটিশ নেতারা তখন এই তত্ত্বেই মগ্ন। ১৯৪১ সালের ১৮ নভম্বর আমেরি বক্তৃতা দিলেন, “ঠিকভুল জানি না। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি ধাঁচে প্রাদেশিক সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে মুসলিমরা একটি ব্যাপার স্পষ্ট বুঝে গিয়েছেন। তাঁরা ভারতে এমন কোনও কেন্দ্রীয় সরকারের গহ্বরে নিজেদের ঠেলে দিতে পারেন না, যেখানে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার। ভােটে নির্বাচিত হয়। প্রদেশের অভিজ্ঞতাই বুঝিয়ে দেয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে জেতা সেই সরকার কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের বিশ্বস্ত মুখপাত্র হওয়া ছাড়া আর কিছু করবে না।” কংগ্রেসে তখন বহু মুসলিম সদস্য, মুসলিমরা নিয়মিত দলের কার্যনির্বাহী পরিষদে থাকেন, সভাপতি পদেও নির্বাচিত হন। তবু ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে ‘হিন্দু’ তকমা লাগাতে ছাড়েনি।
অন্য দিকে, পাকিস্তানের চেহারাটা ঠিক কী রকম হবে, তখনও ঝেড়ে কাশেনি মুসলিম লিগ। ভৌগােলিক ভাবে পাকিস্তানের সীমানির্দেশ করতে নারাজ তারা। যে ভাবেই পাকিস্তানের সীমা আঁকা হােক না কেন, ভারতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েক লক্ষ মুসলিম ঠিকই রয়ে যাবেন! লিগ নেতারা জানতেন, “এক বার পাকিস্তানের সীমা নির্দেশ হয়ে গেলেই লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনসাধারণের কাছে আর সেই প্রস্তাবের আকর্ষণ থাকবে না। তাঁরা জেনে যাবেন, তাঁদের পিছনে ফেলে রেখেই তৈরি হচ্ছে ওই রাষ্ট্র।”
২৬৬
‘পাকিস্তান নামক ধারণাটি প্রথম থেকেই যুক্তির বাইরে। আস্তে আস্তে কিন্তু সেটিই হয়ে উঠল মুসলিম উদ্দীপনার শীর্ষবিন্দু। আর সেই উদ্দীপনা বজায় রাখতেই সরাসরি পাকিস্তানের সীমা নির্দেশ করা হল না, তাকে রেখে দেওয়া হল উজ্জ্বল আদর্শের এক চিন্তা হিসেবে।
বস্তুত, ১৯৪১ সালের ১৬ এপ্রিল রাজেন্দ্রপ্রসাদ লিগ সভাপতিকে ‘পাকিস্তান’ প্রস্তাবটি সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওই স্পষ্ট প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা হাতে পেলেই কংগ্রেস পাকিস্তান নিয়ে আলােচনা করবে, বলেছিলেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদ। কিন্তু জিন্না সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিলেন। তাঁর যুক্তি, কংগ্রেস আগে ভারতভাগের প্রস্তাবে ‘নীতিগতভাবে রাজি’ হােক। তারপর এ সব নিয়ে আলােচনা করা যাবে।
লিগের এই দুর্বোধ্যতাকেই তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছে ব্রিটিশরা। ক্ষমতায় যত দিন থাকার সম্ভাবনা ছিল, তত দিন ব্রিটিশরা সরাসরি পাকিস্তান-দাবির সঙ্গে। নিজেকে জড়ায়নি, কিন্তু পিছন থেকে মদত দিয়ে গিয়েছে। কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে রােখার জন্যই লিগের পাকিস্তান জুজুকে ব্যবহার করেছে ব্রিটিশ শক্তি।
আর, লিগও আস্তে আস্তে ব্যাপারটা বুঝে স্বমূর্তি ধারণ করল। ব্রিটিশের দুর্বলতা বুঝে শাইলকের মতাে তারাও এ বার নিজেদের ভাগের মাংসখণ্ডের জন্য চাপ দিতে শুরু করল। কিন্তু ব্রিটিশরা তখনও এই দাবির কাছে নতি স্বীকার করেনি। “নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতেই লিগের ব্রিটিশ সমর্থন দরকার ছিল। আবার সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরও লিগকে দরকার ছিল।” ফলে, দুই তরফের গােপন আঁতাত ঠিকই বজায় থেকেছে, শেষ অবধি ভারতীয় মানচিত্রে কাটাছেড়া করেই পাকিস্তান তৈরি হয়েছে।
আর তাই কলকাতার ইউরােপীয় মালিকানাধীন সংবাদপত্র ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর তৎকালীন সম্পাদক আর্থার মুর লিখেছিলেন, “অন্য কোনও সময়ে নয়, একেবারে যুদ্ধের মাঝপথে নিজস্ব সংবিধান তৈরির জন্য চাপ দেওয়াতেই ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছিল ভারতীয়রা।
ভাইসরয় ফিল্ড মার্শাল লর্ড ওয়াভেল
১৯৪৩ সালের অক্টোবরে শেষ হল লর্ড লিনলিথগাের কার্যকালের মেয়াদ। গাঁধী এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা জেলে থাকতে থাকতেই ভারত ছেড়ে স্বদেশে ফিরে গেলেন লর্ড লিনলিথগাে। তাঁর জায়গায় ভাইসরয় পদে এলেন ফিল্ড মার্শাল লর্ড ওয়াভেল। যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার কারণেই, ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ভারতীয় ফৌজকে আর পাঁচ জন ভাইসরয়ের চেয়ে ঢের ভাল চিনতেন লর্ড ওয়াভেল। দেশটাকেও অন্য ভাইসরয়দের তুলনায় অনেক ভাল জানা ছিল তাঁর। উপরন্তু ভাইসরয় পদে লর্ড
২৬৭
ওয়াভেলের দায়িত্ব নেওয়ার সময় যুদ্ধ-পরিস্থিতি অনেক বদলে গিয়েছে। মিত্রবাহিনী যে যুদ্ধজয়ের দিকে, বাচ্চা ছেলের কাছেও তত দিনে পরিষ্কার।
গাঁধীর শিষ্য এবং জীবনীকার প্যারেলাল ওয়াভেল সম্পর্কে লিখছেন, “মর্যাদাব্যঞ্জক, মহহৃদয় এক ব্যক্তিত্ব। বেশি কথা বলতেন না, যতটুকু বলতেন সােজাসাপ্টা। কোনও ধানাইপানাই নেই। ভারত নিয়ে তাঁর সদিচ্ছার অভাব ছিল না। ভারতকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনিও যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ভদ্রতা এবং কৃতজ্ঞতাবােধ এতটাই যে, বহু বার অন্যের দোষ নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়েছেন। যথার্থ সৈনিক মানসিকতা! কিন্তু সৈনিকের একরােখা মনােভাবের কারণেই তিনি আইনি এবং সাংবিধানিক ব্যাপারস্যাপারে খুব একটা পাত্তা দিতেন না। ওই রকম ইস্যু সামনে এলেই বিরক্ত হয়ে উঠতেন ওয়াভেল। এ দেশে ব্রিটিশ আমলারা তাঁর ওই ভালমানুষির অনেক সুযােগ নিয়েছে। ফল হয়েছে এক চরম ট্র্যাজেডি।[৪৫]
১৯৪৪ সালের ৬ এপ্রিল কারাবাস থেকে মুক্তি পেলেন গাঁধী। ততদিনে তাঁর শরীর। বেশ দুর্বল, ব্রিটিশরা সেই অশক্ত শরীরকে কারাগারে রেখে আর ঝামেলা বাড়াতে চায়নি। কারাবাসের এই কয়েক বছর দেশে যা যা ঘটে গিয়েছে, তার সঙ্গে গাঁধীর প্রত্যক্ষ যােগাযােগ ছিল না। তবু জেল থেকে বেরােনাের কয়েক দিন পরেই ‘৪৪ সালের ১৭ জুলাই জিন্নাকে চিঠি লিখে বৈঠকের প্রস্তাব দিলেন গাঁধী। চিঠিতে জানালেন, তিনি মুসলিমদের শত্রু নন। বরং জিন্নার বন্ধু। সারা দুনিয়ার মানবজাতির বন্ধু এবং অনুরাগী। জিন্না যেন এ বার তাঁকে নিরাশ না করেন! | গাঁধী জিন্নাকে গােটা চিঠিটাই লিখেছিলেন গুজরাতি ভাষায়। ভ্রাতৃত্ববােধের নতুন দিগন্ত খুঁজে চিঠিতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি এবং জিন্না দু’জনেই গুজরাতের সন্তান। সংবিধান এবং আইনি চালে অভিজ্ঞ জিন্না ইংরেজিতে উত্তর দিয়ে জানালেন এই ভাষায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করায় অনেক স্বচ্ছন্দ। ভুলভ্রান্তি কম হবে। জিন্ন জানালেন, আপাতত তিনি কাশ্মীরে যাচ্ছেন। ফেরার পর তাঁর বাড়িতে গাঁধী এলে কৃতজ্ঞ বােধ করবেন।
জিন্না জানতেন, আশ্রমে গাঁধীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলায় অসুবিধা আছে। বৈঠক চলার মধ্যে কিছুক্ষণ পরপর শিষ্যদের কেউ-না-কেউ এসে বিরক্ত করতে থাকেন। মুখ্যত এই কারণেই জিন্না আশ্রমে গিয়ে গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে চাননি!
২৬৮
গাঁধী-জিন্না বৈঠক (প্রথম পর্ব)
১৯৪২ সালের অগস্ট মাসে কংগ্রেস নেতাদের ধরপাকড়ের সময় থেকেই চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারি কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে সমঝােতা করানাের চেষ্টায় ছিলেন। ভারত ছাড়াে’ আন্দোলনে রাজাজির বিরােধিতার কথা জানা ছিল বলেই ব্রিটিশরা আর তাঁকে গ্রেফতার করেনি। রাজাজির তখনও দৃঢ়বদ্ধ ধারণা, মুসলিম অধুষিত এলাকার স্বশাসন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি মেনে নিলেই মুসলিম লিগ এসে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাবে। কিন্তু যুদ্ধ চলার সময়ে ব্রিটিশরা কোনও মতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। মহাত্মাজি জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই রাজাজি তাঁর প্রস্তাব পেশ করলেন। পরবর্তী কালে ‘রাজাজি ফর্মুলা’ নামে পরিচিত এই প্রস্তাবে পাঁচটি উল্লেখ্য দিক এ রকম… ১) মুসলিম লিগ দেশের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি মেনে নেবে। ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় একটি অন্তর্বর্তী সরকার তৈরিতে কংগ্রেসকে সাহায্য করবে। ২) যুদ্ধশেষে কংগ্রেস একটি কমিশন তৈরি করবে। ভারতের উত্তর পশ্চিম এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলির পুনর্বিন্যাস এবং সীমানা নির্ধারণে সাহায্য করাই হবে ওই কমিশনের কাজ। ৩) এই মুসলিম-অধ্যুষিত রাজ্যের বাসিন্দারা গণভােটে জানাবেন, তাঁরা ভারতের সঙ্গে থাকতে চান কি না! যদি বেশির ভাগ লােকেই অন্য এক সার্বভৌম রাষ্ট্র চান, সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হবে। ৪) এ ভাবে দেশভাগ ঘটলে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, যােগাযােগ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সমঝােতার চুক্তি সাধিত হবে। ৫) ব্রিটেন ভারতশাসনের যাবতীয় ক্ষমতা এবং দায়িত্ব হস্তান্তর করার পরই উপরােক্ত শর্তগুলি লাগু হবে।
গাঁধী প্রস্তাবে সায় দিতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি। আর তার সায় পেয়েই রাজাজি এই পাঁচ দফা ফর্মুলা নিয়ে জিন্নার সঙ্গে দেখা করলেন। জিন্না নাকচ করে দিলেন রাজাজির ফর্মুলা। মুসলিম লিগের ‘পাকিস্তান’ দাবির বিষয়ে এখানে কোনও উচ্চবাচ্য নেই যে! পরে লিগের বৈঠকে রাজাজির এই প্রস্তাবকে ‘ঘুণধরা, পােকায়-কাটা পাকিস্তান’ বলে বর্ণনা করেছিলেন জিন্না। কিন্তু সাময়িক ভাবে তিনি জানালেন, রাজাজি চাইলে লিগের কাউন্সিল বৈঠকে তিনি এই প্রস্তাব উত্থাপন করবেন।
রাজাজি ভালই জানতেন, জিন্নার সমর্থন না পেলে এই প্রস্তাবকে লিগের বৈঠকে পাঠিয়ে লাভ নেই। প্রস্তাবটি তা হলে আর মানুষের সামনে পৌঁছবে না, লিগ নেতাদের প্রত্যাখ্যান সেটিকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেবে। রাজাজি জিন্নার সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রসহ গােটা প্রস্তাবটি খবরের কাগজে প্রকাশ করে দিলেন। জিন্নাকে লিখলেন, “আমাদের ব্যক্তিগত কথােপকথন আপাতত এখানেই সমাপ্ত। এখন জনগণকে গােটা বিষয়টি জানানাে প্রয়ােজন।”
এ আই সি সি ‘ভারত ছাড়াে’ প্রস্তাব নেওয়ার চার দিন আগে, ১৯৪২ সালের ৪ অগস্ট গাঁধী নিজেও জিন্নার সঙ্গে সমঝােতার রাস্তা খুঁজলেন। মেকলাই নামে এক মুসলিম বন্ধুর মাধ্যমে জিন্নাকে জানালেন, “অবিলম্বে পূর্ণ স্বাধীনতার যে দাবি কংগ্রেস
২৬৯
তুলেছে, এবং অক্ষশক্তিকে রুখতে, চিন ও রাশিয়ার সাহায্যকল্পে স্বাধীন ভারত মিত্রবাহিনিকে তার জল, স্থল ও আকাশসীমা ব্যবহারের যে অঙ্গীকার করেছে, তা মুসলিম লিগ সর্বতাে ভাবে মেনে নিক। তা হলে ব্রিটিশ সরকার যদি মুসলিম লিগকেও ভারতশাসনের যাবতীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করে, কংগ্রেসের আপত্তি নেই। এবং মুসলিম লিগ যে ধরণের সরকারই গঠন করুক না কেন, কংগ্রেস বাধা দেবে না। বরং স্বাধীন দেশের পরিচালন ব্যবস্থায় সাহায্য করতে তারাও সেই সরকারে যােগ দেবে।”
জিন্না উত্তরে জানালেন, যে প্রস্তাব তাঁকে সরাসরি দেওয়া হয়নি, তা নিয়ে তিনি হ্যাঁ-না কিছু বলতে পারবেন না। গাঁধী এই পরিস্থিতিতে অবশ্যই জিন্নার সঙ্গে দেখা করতেন, কিন্তু কয়েক দিন বাদেই তাঁকে আচমকা কারাগারে যেতে হল। ১৯৪৩ সালে, গাঁধীর কারাবাসের সময়েও দিল্লিতে মুসলিম লিগের এক সভায় জিন্না জানালেন, গাঁধী যদি মুসলিম লিগের সঙ্গে সত্যিই সমঝােতায় আসতে চান, তিনিই সবার আগে গাঁধীকে অভ্যর্থনা জানাবেন। “মিস্টার গাঁধীর যদি এ রকম মনােবাসনা থাকে, আমাকে। সরাসরি লিখছেন না কেন? সরকার যত শক্তিশালীই হােক না কেন, আমাকে লেখা গাঁধীর চিঠি তারা আটকাবে, আমি বিশ্বাস করি না। মিস্টার গাঁধীর হৃদয়ে সত্যিই যদি পরিবর্তন এসে থাকে, আমাকে কয়েক লাইন লিখলেই হবে। মুসলিম লিগ সাহায্যের হাত বাড়াতে দ্বিধা করবে না।”
উত্তরে গাঁধী জিন্নার সঙ্গে বৈঠকে বসার আন্তরিক আগ্রহ জানালেন, “আপনার আমন্ত্রণে একটু কিন্তু-কিন্তু ভাব রয়েছে। আপনি নাকি বলেছেন, যদি হৃদয়ের পরিবর্তন ঘটে, তবেই আমি আপনাকে চিঠি লিখতে পারি! একমাত্র ঈশ্বরই মানুষের হৃদয়ের কথা জানেন। আমি যে রকম, আপনি আমাকে সে ভাবে গ্রহণ করলেই ভাল লাগবে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উত্তর খুঁজতে আপনি এবং আমি দু’জনে একসঙ্গে এ বার থেকে গ্রহণযােগ্য একটা উত্তর খুঁজি না কেন!”
জিন্না ব্রিটিশ সরকার সম্বন্ধে যা ভাবুন না কেন, বাস্তবে ব্রিটিশ সরকার গাঁধীর সেই চিঠি আটকেছিলেন। চিঠির বিষয়বস্তুটুকুই শুধু জিন্নাকে জানানাে হয়েছিল। আর তার পর থেকে জিন্নার প্রতিক্রিয়াও বদলে গেল। তিনি বলতে থাকলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উত্তর খোঁজা গােছের ধোঁয়াশা নয়, গাঁধী যেন আগে মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবি মেনে নেন। তারপর তাঁকে চিঠি লেখেন। “গাঁধী নিজে জেল থেকে মুক্তি চাইছেন। ফলে মুসলিম লিগ যাতে ব্রিটিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, এমন চাল খেলতে চাইছেন। আর সে জন্যই এই চিঠিটা লিখেছেন, বলেছিলেন জিন্না। তাঁর যাবতীয় ভরসা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকারের কঠোর সেন্সরশিপের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে। গিয়েছেন জিন্না। এবং সে বিষয়ে তিনি স্পিকটি নট!
জিন্নার মুখে কুলুপ, কেননা চিঠিটি আটকেও তার বিষয়বস্তু প্রকাশ করে দেওয়া। মুসলিম লিগ এবং ব্রিটিশ দু’তরফের পক্ষেই সুবিধাজনক হয়েছিল। কয়েক বছর পর ক্যাবিনেট মিশনের বৈঠকে জিন্না এ ভাবেই লর্ড ওয়াভেলের হাতে থাকা কংগ্রেসের এক চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে দরাদরি শুরু করেছিলেন। গােটা চিঠিটা হাতে না পাওয়া
২৭০
সত্ত্বেও ! তার ফলে অবশ্য সে বার জিন্নারই ক্ষতি হয়েছিল। পরবর্তী অধ্যায়ে যথাসময়ে সেই তথ্য জানা যাবে।
১৯৪৪ সালের ১৭ জুলাই ভােরে গাঁধী ‘ভাই জিন্না’কে চিঠি লিখে ‘ইতি আপনার ভাই গাঁধী’ বলে সই করলেন। গুজরাতি ভাষায় লেখা সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন “এক দিন মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য আপনাকে আমি জোরাজুরি করেছিলাম। আজ সেই মাতৃভাষাতেই এই চিঠি লিখছি। জেলে থাকার সময়েই আমি আপনাকে বৈঠকে বসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। জেল থেকে বেরােনাের পর অবশ্য আপনাকে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। আজ লিখছি। আপনার যেমন সুবিধা, সেই অনুযায়ী এক দিন দেখা করা যাক। তবে আমাকে ইসলাম বা ভারতীয় মুসলমানের শত্রু ভাববেন না। আমি আপনার কাছে, সমগ্র মানবজাতির কাছে অনুগত বন্ধুত্বের বাঁধনে বাঁধা। আমাকে হতাশ করবেন না।”
চিঠিটা ইচ্ছা করেই গুজরাতিতে লিখেছিলেন গাঁধী। অজস্র হিন্দু, পারসি এবং মুসলমানের মাতৃভাষা। আর পাকিস্তান-দর্শনে সেই ভাষার অস্তিত্বই তাে স্বীকার করা হয়নি। ‘ভাই জিন্না’র কাছ থেকে দ্রুত উত্তর পেয়ে গিয়েছেন গাঁধী। শ্রীনগরের ‘কুইন -এলিজাবেথ হাউসবােট থেকে ইংরেজিতে লেখা চিঠিতে প্রিয় মিস্টার গাঁধী’কে জিন্না জানালেন, অগস্ট মাসের মাঝামাঝি তিনি মুম্বইতে ফিরবেন। সে সময় গাঁধী মুম্বইয়ে তাঁর বাড়িতে এলে তিনি আনন্দিত বােধ করবেন।
গাঁধী-জিন্না বৈঠক (দ্বিতীয় পর্ব)
ব্রিটিশ রাজের নীতির কারণে, ১৯৪৪ সালের সেই সময়টায় ব্রিটিশ, কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ…তিন পক্ষই সাম্প্রদায়িকতা সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে পারছে না। প্রত্যেকেই কানা গলিতে ঘুরে মরছে। ব্রিটিশ রাজ মাথা না গলালে হয়তাে সমস্যা এই স্তরে থাকত না, হিন্দু-মুসলিম উভয়েই গ্রহণযােগ্য সমাধানে পৌঁছতে পারত। যে রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে গাঁধী-জিন্না বৈঠক, সেখানে জিন্নার ওপর মুসলিম লিগের ভেতরে-বাইরে তুমুল চাপ। সারা দেশই চায়, স্বাধীনতার লক্ষ্যে লিগ এ বার কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝােতায় পৌঁছাক। জনতার আশা, শীর্ষস্থানীয় দুই নেতার বৈঠক থেকে এ বার নিশ্চয় বেরিয়ে আসবে গ্রহণযােগ্য সমাধান। জনতার চাপ এতই যে, জিন্না তাঁর বহুদিনের পুরনাে অভ্যাস থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে গাঁধীকে ‘মহাত্মা নামে সম্বােধন করে জানালেন, “সারা দুনিয়া চায়, আমরা দু’জনে আলােচনায় বসি। এত দিনে সেটা ঘটছে, আমাদের সাহায্য করুন। অতীত ভুলে যান।”
জিন্না এবং গাঁধীর মনােভঙ্গি যাই হােক না কেন, তৃতীয় পক্ষ ব্রিটিশ রাজ কিন্তু এই আলােচনার সাফল্য চায়নি। হিন্দু-মুসলিম মিলনের সামান্যতম সম্ভাবনা দেখা
২৭১
গেলেও তারা সেটি প্রতিরােধ করতে চেয়েছে। আলােচনার প্রাক্কালে ভাইসরয়ের বার্তা এল, ব্রিটিশ সরকার যত সামান্য ক্ষমতা হস্তান্তরেই রাজি হন না কেন, তার আগে ‘গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে হিন্দু-মুসলিম সমঝােতা জরুরি। আর সেই প্রেক্ষিতেই। ‘লন্ডন টাইম’ পত্রিকার মন্তব্য, “মিস্টার গাঁধী এবং মিস্টার জিন্নার মধ্যে আলােচনা যত ফলপ্রসূই হােক না কেন, ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে বিন্দুমাত্র এগােবে না। আলােচনাকে সফল করতে হলে শােষিত ও নিপীড়িত শ্রেণীর উদ্বেগ, রাজন্যবর্গের দাবি ইত্যাদি বৃহত্তর স্বার্থের কথা দু’পক্ষকেই ভাবতে হবে।” ব্রিটিশ সংবাদপত্রের এই সব পরামর্শ আর দুরভিসন্ধিমূলক মন্তব্যে পরিষ্কার, গাঁধী-জিন্না বৈঠকের আড়ালে ব্রিটিশ শক্তি কী ভাবে কলকাঠি নাড়ছিল।
আসন্ন গাঁধী-জিন্না বৈঠকের কথায় হিন্দু মহাসভার সদস্যেরা তখন ক্ষুব্ধ। বম্বের রাস্তায় ‘খাকসার’ নামে মুসলিমদের একটি আধা-সামরিক সংগঠনও তখন রাস্তায় নেমে পড়েছে। কমিউনিস্টরাও গণতন্ত্রের স্বার্থে দুই নেতাকে একত্র হওয়ার আবেদন জানিয়ে রাস্তায় রাস্তায় মিটিং-মিছিল করছেন। নাৎসি জার্মানির বিরুদ্ধে রুশ সংগ্রামেই তাে কমিউনিস্ট গণতন্ত্রের পরিচয়।
ও দিকে শিখরাও আতঙ্কে। গাঁধী যদি মুসলিমদের পাকিস্তান দাবি মেনে নেন। পাল্টা হিসেবে তাঁরা পঞ্জাবের মধ্যে ‘শিখিস্থান’ নামে আলাদা এক স্বশাসিত রাষ্ট্রের দাবি তুললেন। তাঁদের যুক্তি, সম্পদের ভিত্তিতেই শিখিস্থানের সীমানা নির্ধারণ করা যাবে। সম্পদের ভিত্তিতে মানে, শিখদের পরিশ্রমে যে সব অনুর্বর জমিতে আজ সােনা ফলছে, যে উর্বর এলাকায় শিখদের জমি এবং স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ বেশি সেই সব অঞ্চল নিয়ে পৃথক দেশ। মুম্বই পুলিশ সতর্কতা হিসেবে নির্দেশ জারি করে জানাল, শহরের কিছু এলাকার রাস্তা এবং প্রকাশ্য স্থানে অহেতুক ভিড় মেনে নেওয়া হবে না। ওই সব রাস্তার আশপাশে যাঁরা থেকেন, এবং যাঁদের সেখান দিয়ে যাতায়াত করা নিতান্ত দরকার, তাঁরা ছাড়া অন্য কারও ওই এলাকায় অহেতুক প্রবেশ নিষিদ্ধ। পুলিশের এই নিষেধবার্তার পর জিন্না তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে জানালেন, “সাংবাদিকরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, বৈঠকে তাঁদের উপস্থিতি দরকার নেই। কষ্ট করে তাঁরা আমার বাড়িতে না এলে বাধিত হব। ফোটোগ্রাফার ও সিনেমার লােকেরা অবশ্য মিস্টার গাঁধীর পৌঁছনাের ছবি তুলতে পারেন।”
১৯৪৪ সালের ৯ জানুয়ারি বৈঠক শুরু। জিন্নার ১০ নম্বর মাউন্ট প্লেজেন্ট রােডের বাড়িতে ১৮ দিন ধরে বৈঠক চলল। বৈঠকের মাঝে ইদ উৎসব। সে দিন গাঁধী তাঁর পাওয়া মিষ্টি রুটি ৬ জিন্নাকে উপহার দিলেন। বৈঠকের মাঝে জিন্নার শরীরের ক্লান্তি দূর করতে তাঁর নিজস্ব ভেষজ চিকিৎসককেও জিন্নার কাছে পাঠিয়ে দিলেন গাঁধী।
প্যারেলাল তাঁর ‘দ্য ফাইনাল ফেজ’ গ্রন্থে সে দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন, ‘অতঃপর দু’জনের দেখা। হ্যান্ডশেক সেরে দু’জনেই পরম্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রথম সাক্ষাতে দু’জনের মধ্যেই নিখাদ আন্তরিকতা ছিল। জিন্না বাইরে এসে মহাত্মাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন, ফেরার পথেও তাঁকে এগিয়ে দিতে দিয়েছিলেন।
২৭২
ফটোগ্রাফারদের সামনে গাঁধীর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে ‘পােজ’ও দিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষকদের মনে হয়েছিল, বিদায়কালে জিন্না যে গভীর আবেগে গাঁধীর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন, সেখানে হাত মেলানাে ছাড়াও আরও অনেক নিঃশব্দ বার্তা রয়েছে। আদতে কিন্তু ওই হাত মেলানােটুকুই সব! প্রথম থেকেই জিন্না মহাত্মার প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছিলেন। শেষে অবশ্য হাল ছেড়ে বৈঠকে বসতে সম্মত হলেন।”
বৈঠক যত এগােতে লাগল, সত্যও প্রকট হতে শুরু করল। কায়েদ-এ-আজম কিছুই মেনে নিতে আসেননি। মানামানি নিয়ে আলােচনা করতেও আসেননি। তিনি পর্দা উঠিয়েছেন শুধু সংশয়ীদের আলাে দেখানাের জন্য। সেই আলােয় তাঁদের সংশয় দূর হােক, তাঁরাও যেন এ বার রাস্তা চিনে মহম্মদ আলি জিন্নাকে অনুসরণ করেন। “জিন্নার থেকে কী নিয়ে এলেন?” আশ্রমে ফেরার পর প্রশ্ন করা হয়েছিল গাঁধীকে। তাঁর উত্তর, “শুধুই ফুলের তােড়া।”
পরবর্তী কালে রাজাজিকে সেই সওয়া তিন ঘন্টা বৈঠকের গল্প শুনিয়েছিলেন গাঁধী। জীবনের সবচেয়ে হতাশাজনক অভিজ্ঞতা’, ‘যেন ধৈর্যের পরীক্ষা চলছিল…, ‘নিজের ধৈর্যক্ষমতায় নিজেই সে দিন অবাক হয়ে গিয়েছিলাম’ গােছের অনেক কথাই রাজাজিকে বলেছিলেন তিনি। প্যারেলালের জবানিতেই আমরা শুনতে পারি গাঁধীর সেই ক্ষোভের কথা, “তােমার (রাজাজির) পাঁচ দফা সূত্র নিয়ে ওঁর (জিন্না) তীব্র অনীহা, তােমার প্রতি বিরক্তি দেখে তখন আমি হতবাক। ভেবেছিলাম ওঁর সঙ্গে কথা বলে, তুমি নিজে খেটেখুটে ওই মীমাংসা-সূত্র তৈরি করেছ। তােমার প্রতি আমার শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু শুরুতেই উনি বললেন, তুমি ওঁর দাবি মেনে নিয়েছ। এ বার আমাকেও তা মানতে হবে। আমি বলললাম, রাজাজির মীমাংসা-সূত্রে আমার পূর্ণ। সমর্থন রয়েছে। গণভােটে পাশ হলে ওই মুসলিম রাষ্ট্রকে আপনি পাকিস্তান বলতেই পারেন। তখন লাহাের প্রস্তাবের কথা উঠল। আমি বললাম, ওই প্রস্তাব নিয়ে আমি বিশেষ কিছু জানি না। ফলে সেটি নিয়ে আমার পক্ষে কথা না বলাই বাঞ্ছনীয়। বরং রাজাজির প্রস্তাব নিয়েই আলােচনা করা যাক। সেখানে কোনও ভুলত্রুটি বা অসম্পূর্ণতা দেখে থাকলে আপনি স্বচ্ছন্দে আমাকে বলতে পারেন।”
“কথাবার্তার মাঝপথে আবার সেই পুরনাে ভূত জেগে উঠল। জিন্না হঠাৎ বলতে শুরু করলেন, আপনি তাে এখানে হিন্দু হিসেবে এসেছেন, হিন্দু কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন। আমিও উত্তর দিলাম, না, আমি হিন্দু হিসেবেও এখানে আসিনি। কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবেও আসিনি। আমি এসেছি ব্যক্তি হিসেবে। আপনি ব্যক্তি হিসেবেও আমার সঙ্গে আলােচনা করতে পারেন, আবার মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও। যেটা আপনার ইচ্ছা! যদি রাজাজির ফর্মুলা মেনে নেন, আপনারা দু’জনে আপনাদের সংগঠনের মুখােমুখি হবেন। ওই ফর্মুলা মেনে নেওয়ার জন্য আপনি মুসলিম লিগকে বােঝাবেন, রাজাজি কংগ্রেসকে। সে কারণেই রাজাজি আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন। তখনই আপনি এটা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।
২৭৩
এখন উপায় নেই, ফলে আপনাকে আর আমাকেই রাজাজির প্রস্তাব নিয়ে নতুন করে আলােচনায় বসতে হবে।
এ বার জিন্না বললেন, উনি লিগের সভাপতি। আমি যদি ব্যক্তিগত ভাবে এখানে এসে থাকি, কোনও সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব না করি, তা হলে আমার সঙ্গে আলােচনা করে ওঁর লাভ? ১৯৩৯ সালে আমাকে দেখে ওঁর যা মনে হয়েছিল, এখনও আমি নাকি ঠিক তাই! মুখ ফস্কে বেরিয়ে আসছিল, “হ্যাঁ, তাই। আর আপনার যখন মনে হয়, আমার সঙ্গে আলােচনা করে লাভ নেই, আমি চলে যাচ্ছি। কোনও মতে নিজেকে সামলে বললাম, কিন্তু অন্যকে বদলানাের ক্ষমতা তাে আপনার রয়েছে। আমি একই আছি, সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি তাে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারেন। আর সেই বদল ঘটাতে পারলে, আমি সর্বান্তঃকরণে আপনাকে সমর্থন করব। “জানি’, জিন্না উত্তরে বলল, “যদি আপনাকে বদলাতে পারতাম, আপনিই তাে আমার আলি হয়ে থাকতে পারতেন!
‘ওই মন্তব্যটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, পরে গাঁধী জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের পয়গম্বর তাঁর আলিকে খুঁজছেন।”
আপাতত, প্যারেলালের সাক্ষ্যে আবার ফিরে আসা যাক! দেখা যাক, সেই বৈঠকের কথা গাঁধী কী ভাবে সহকর্মী রাজাজিকে জানিয়েছিলেন…
“উনি (জিন্না) বললেন, পাকিস্তানের দাবি মেনে নিলে উনি দেশের সর্বত্র আমার সঙ্গে যাবেন। দরকারে জেলে যাবেন, বুলেটের সামনে বুক পেতে দেবেন। আমি বললাম, সে রকম হলে আপনার সঙ্গে আমিও থাকব। আপনি হয়তাে থাকবেন না, প্রত্যুত্তরে সটান বললেন জিন্না। আমিও বললাম, ‘এক বার সুযােগ দিয়েই দেখুন না !
“আমরা আবার তােমার পাঁচ দফা নিয়ে বসলাম। কিন্তু জিন্নার এখনই পাকিস্তান চাই, স্বাধীনতার পরে করব বললে চলবে না। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের স্বাধীনতাই। আমাদের লক্ষ্য,’ বলছেন জিন্না, ‘চলুন, এ নিয়েই আমাদের চুক্তি হােক। তারপর সেই সমঝােতা-চুক্তি পাশের জন্য সরকারকে চাপ দিই। আমি বললাম, এ জিনিস আমি করতে পারব না। দেশটাকে দু’ভাগ করার প্রস্তাব নিয়ে ব্রিটিশের কাছে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি যদি সেই বিভাজন চান, আপনাকে আটকানাে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনাকে কোনও কিছুতে বাধ্য করার মতাে ক্ষমতা আমার নেই, আর থাকলেও তা ব্যবহার করতাম না। উত্তরে জিন্না বললেন, ‘মুসলমানেরা পাকিস্তান চায়। লিগ মুসলিমদের প্রতিনিধি, আর সেই লিগ-ই পাকিস্তান চায়!’ উত্তরে আমি বললাম, ‘জানি, লিগ এ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম সংগঠন। সেই সংগঠনের সভাপতি হিসেবে আপনি যে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধি, তা মেনে নিতেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এ দেশের সব মুসলমানই কি পাকিস্তান চান? এলাকায় এলাকায় এ নিয়ে গণভােট করেই দেখুন না! উত্তরে জিন্নার যুক্তি, গণভােট? অমুসলমানেরা আবার এ নিয়ে ভােট দিতে যাবেন কোন দুঃখে?’ বললাম, “জনগণের একটা অংশকে
২৭৪
বঞ্চিত রেখে আপনি ভােট করতে পারেন না। তাঁদেরকেও আপনার সঙ্গে নিতে হবে। আর বেশির ভাগ মানুষই যখন পাকিস্তান চান, আপনার ভয় কিসের? কিরণশঙ্কর রায় আমাকে যে কথা বলেছিলেন, সেটাও জিন্নাকে বললাম। রায় বলেছিলেন, ‘দুঃস্বপ্ন যদি সত্যি হয়, আমরা বাঙালিরা সে দিন হয়তাে পাকিস্তানেই চলে যাব। কিন্তু প্লিজ, বাংলাকে ভাগ করবেন না। ঈশ্বরের দোহাই!’
‘সংখ্যাগরিষ্ঠ লােকে আপনার সঙ্গে থাকলে আপনি যা চান, তাই হবে। জিন্নাকে আরও বলেছি, ‘জানি, সেটা আপনার পক্ষে ভাল হবে না। সেটা মানতেও আমার যন্ত্রণা হয়। তবু যদি আপনি চান, তাই হবে। কিন্তু এক শর্তে। ব্রিটিশ এখানে থাকার। সময় ওই ভাগাভাগি চলবে না।’
এর পরই ফর্মুলার বিভিন্ন ধারা-উপধারা নিয়ে উনি আমাকে খুঁটিনাটি প্রশ্ন শুরু করলেন। বললাম, এ সব ব্যাখ্যা চাইলে এই ফর্মুলার স্রষ্টাকে এখানে নিয়ে আসাই কি সবচেয়ে ভাল নয় ?’ জিন্না সঙ্গে সঙ্গে সবেগে প্রতিবাদ করলেন, না, না। আমিও জিজ্ঞাসা করলাম, তা হলে এ ভাবে এত সওয়াল-জবাব করছেন কেন? উত্তরে জিন্না হাসলেন, ‘না, ঠিক সওয়াল-জবাব নয়। আসলে আমি তাে সারা জীবন আইন ব্যবসায় কাটিয়েছি, আমার কথার ধরনধারণ তাই আপনার কাছে আইনি সওয়াল বােধ হচ্ছে। এর পর জিন্নাকে ওই ফর্মুলা নিয়ে তাঁর আপত্তিগুলি আমি লিখতে বললাম। প্রথমে সেটাও চাননি, জিজ্ঞাসা করলেন, এমনটা করতেই হবে? আমিও উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ। সেটাই আমি চাইছি। এতক্ষণে তাঁকে কোনও কিছুতে রাজি করানাে গেল!
শেষে জিন্না বললেন, ‘চলুন, তা হলে সমঝােতায় আসা যাক! আমি বললাম, ‘আপনার মনে আছে তাে প্রথমেই আমি কী বলেছিলাম? সমঝােতা-চুক্তিতে পৌঁছানাের আগে আমরা দুজনে আলাদা হব না। জিন্না ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললেন। ওঁর মনে আছে। তখন আমি প্রস্তাব দিলাম, তা হলে আমাদের যৌথ বিবৃতিতে এই কথাটাও থাকুক। জিন্না বললেন, ‘সেটা না থাকাই ভাল। কিন্তু এ ব্যাপারে অলিখিত সমঝােতা রয়ে গেল। এই বৈঠকের আন্তরিক এবং হার্দ্য পরিবেশটাই আমরা লােকের কাছে তুলে ধরব।’ রাজাজি: আপনার কি মনে হয়, জিন্না একটা বােঝাপড়া চান? গাঁধীজি: এখনও নিশ্চিত নই। মনে হয় চান। রাজাজি: তা হলে আপনি ঠিক পারবেন। গাঁধীজি: হ্যাঁ, পারব, যদি ঠিকঠাক শব্দগুলাে মাথায় আসে!”
পরের দিন অবশ্য বৈঠক বসল না। জিন্না জানালেন, “আজ রমজানের একুশ দিন। রমজান মাসের এই ২১তম দিনটা মুসলিমদের কাছে পবিত্র।” জিন্নার এক প্রাক্তন সহকর্মী ঠোঁট টিপে হাসলেন, “তার চেয়ে আজ রবিবার, ছুটি চাই এমনটা বললেন না কেন! রমজানের থেকে রবিবারটাই তাে উনি ভাল বােঝেন।”
১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় আবার বৈঠক শুরু। জিন্নার বাড়িতে বৈঠকের মাঝেই সে দিন সন্ধ্যার আহার সারলেন গাঁধী। তাঁর টিফিন বাস্কেটে সে জন্যই এক বােতল গরম জল দেওয়া হয়েছিল। পরের দিনই তিনি সঙ্গীদের নির্দেশ দিলেন, এই গরম জল যেন আর
২৭৫
দেওয়া না হয়। লােকে ভাবতে পারে, মুসলিম বাড়িতে খেতে বসলে গাঁধীজি গঙ্গাজল বা ওই জাতীয় কিছু নিয়ে যান!
১২ সেপ্টেম্বর অবধি কায়েদ-এ-আজম গাঁধীকে দলে টানার চেষ্টা করলেন।। প্যারেলালের কাছ থেকে গাঁধীজির জবানিতেই সেই অভিজ্ঞতা শােনা যাক…
“পাকিস্তানের সরকার কেমন হবে, সে ব্যাপারে উজ্জ্বল এক ছবি আঁকার চেষ্টা করলেন জিন্না। বললেন, ওখানে থাকবে পূর্ণ গণতন্ত্র ! আমি জিন্নাকে মনে করিয়ে দিলাম, আগে উনিই তাে আমাকে বলেছিলেন, ভারতীয় পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র চলে না। জিন্না অবশ্য সে কথা মনে করতে পারলেন না। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কী বলছিলেন! আমি ওঁর বলা কথা ফের উদ্ধৃত করে জানালাম, মনে হয়, আপনি এ রকমই বলছিলেন। ভুলচুক হলে ধরিয়ে দেবেন। কিন্তু গােটাটা বিশদে বলার পর উনি আর কিছু বললেন না। জানালেন, হ্যাঁ, এমনটাই বলছিলেন। তবে সেটা গণতন্ত্র প্রসঙ্গে।
তারপরই ওঁর প্রশ্ন, আপনার কি মনে হয়, আমাদের ব্যাপারটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যা?’ বললাম, হ্যাঁ। না বললে উনি আবার আমাকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু বােঝাতে বসতেন। তার পর উনি বলে চললেন। সবটা আর এখানে আমি বলছি না। ওঁর কথা শেষ হলে একটাই প্রশ্ন করলাম। তা হলে শিখ, খ্রিস্টান, হরিজন ইত্যাদি সংখ্যালঘুদের অবস্থাটা পাকিস্তানে কী হবে! উনি বললেন, তাঁরাও পাকিস্তানের অংশ! তা হলে কি উনি যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর কথা বলতে চাইছেন? জিন্না বুঝতে পারলেন, ঘুরেফিরে আমি সেই এক দিকে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। সমগ্র পাকিস্তানের অংশ হিসেবেই ওঁরা স্বাগত। তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেকক্ষণ যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর সুবিধা বােঝালেন। বললেন, ‘এত কিছু সত্ত্বেও ওই সংখ্যালঘুরা যদি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী চান, সেটাও মেনে নেওয়া হবে। শিখদের গুরমুখী ভাষা স্বীকৃতি পাবে, তাঁদের আর্থিক অনুদানও দেওয়া হবে। জিজ্ঞাসা করলাম, তা হলে জাঠেরা?’ প্রথমে প্রায় ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তার পরে বললেন, ঠিক আছে। ওঁরাও যদি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী চান, মেনে নেওয়া হবে। জিজ্ঞাসা করলাম, তা হলে খ্রিস্টানেরা? ত্রিবাঙ্কুরের মতাে কোনও কোনও জায়গায় তাঁরাই সংখ্যায় বেশি। এবং সেখানে তাে খ্রিস্টানেরা একই যুক্তিতে নিজেদের শাসন চাইতেই পারেন। জিন্না বললেন, ওটা হিন্দুদের সমস্যা। আমিও পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, ত্রিবাঙ্কুর যদি পাকিস্তানে যায়?’ জিন্না বললেন, তাঁদেরও স্বশাসন দেওয়া হবে। নিউফাউন্ডল্যান্ডের উদাহরণ দিলেন উনি। বাকিটা আর বলার মতাে কিছু নয়। এর মধ্যেই উনি ঠিক কী চাইছেন, সেই আকাঙ্ক্ষাটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকে।
রাজাজি: দেখুন, কী চান উনি!
গাঁধীজি: সেটাই তাে করছি। ওঁকে দিয়েই বলানাের চেষ্টা করছি, এই পাকিস্তান ব্যাপারটার মাথামুণ্ডু নেই। তবে উনি তাে ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না। ঠিক আছে, আমারও তাড়া নেই। কিন্তু অসংলগ্ন, অসংজ্ঞাত এক পাকিস্তানে আমি সায় দেব বলেও উনি আশা করতে পারেন না।
২৭৬
রাজাজি: আপনার কি মনে হয়? জিন্না পাকিস্তানের দাবি ছেড়ে দেবেন? গাঁধীজি: সমঝােতা চাইলে ছাড়তে হবে। উনি সমঝােতা চান ঠিকই, কিন্তু শেষ অবধি কী যে চান, নিজেই বােধ হয় বুঝে উঠতে পারেন না। আমি ওঁকে দেখাব, একমাত্র তােমার ফর্মুলাটাতেই উনি রাজি হতে পারেন। সেটুকুই মেনে নেওয়া যেতে পারে।”
৯ থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর অবধি এই গাঁধী-জিন্না বৈঠক নিয়ে তুমুল আশাবাদ চলল, বিশেষত বাইরের লােকদের কাছে। তারপর ১৪ থেকে ১৯ তারিখের মধ্যে সেই সব আশার মুকুল আস্তে আস্তে ঝরে যেতে থাকল। ইদের বার্তায় কায়েদ-এ আজম ‘মুসলিম জাতির অগ্রগতির কথা বললেন। বললেন, আমাদের ‘মিল্লাত বা রাস্তায় যাঁরা নেই, তাঁরা আমাদের মুসলিম জাতির অগ্রগতি ধ্বংস করতে চান। এই সময় থেকেই বৈঠকের রেখচিত্র ক্রমশ নামতে নামতে ২৭ সেপ্টেম্বরের শেষ দিন একেবারে তলানিতে।
বৈঠকের গােটা সময় ধরে দুই তরফে অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছে। এ রকম হার্দ্য আলােচনায় যা অভূতপূর্ব! আলােচনা এবং চিঠি চালাচালি কখনও এক ধারায় মেলেনি, বরং দুটি আলাদা সমান্তরাল পথে, আলাদা ভাষায় চলেছে। “আপনারা কথাবার্তা চালাচ্ছেন কাছাকাছি আসার জন্য। আর চিঠি-লেখা চলছে সেই কাছাকাছি-আসাটা কখনওই ঘটবে না এমন আশঙ্কায়,” তীক্ষ্ণ মন্তব্য করেছিলেন রাজাজি!
গাঁধীর বক্তব্য ছিল, তাঁর সারা জীবনের ব্রত হিন্দু-মুসলিম মিলন। তাই মুসলিমরা চাইলে তিনি লিগের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বনিয়ন্ত্রণের দাবি মেনে নিতে রাজি। কিন্তু ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা না পেলে এই স্বশাসনের দাবি অর্থহীন। তাই লিগ ও অন্য সব সংগঠন প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে একযােগে মিলে। স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও জোরালাে করে তুলুন!
জিন্নার কাছে এটি অবশ্য ঘােড়ার আগে গাড়ি জুতে দেওয়ার মতাে! তাঁর বক্তব্য, স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে সকলে মিলে আন্দোলন হতেই পারে। তবে তার আগে লিগের পাকিস্তান প্রস্তাব নিয়ে সমঝােতা জরুরি। গাঁধীর পাল্টা বক্তব্য, “তৃতীয় পক্ষকে না হঠাতে পারলে যাবতীয় সমঝােতাই নিরর্থক। ব্রিটিশরা না সরলে হিন্দু-মুসলিম কোনও দিনই একত্রে শান্তিতে থাকতে পারবে না। কিন্তু ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যে, হিন্দু মুসলিমের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাস্তা খুঁজতে তিনি সব সময়েই রাজি। সেই কারণেই রাজাজির প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন তিনি। এ বার সেই প্রস্তাব অনুযায়ী কাজ শুরু করা যাক! কিন্তু কায়েদ-এ-আজমের আপত্তি অন্যত্র। রাজাজি মুসলিম লিগকে প্রথমে স্বাধীনতার দাবি মেনে নিতে বলছেন! “আমরা যদি সমঝােতায় আসি, যৌথ ভাবে স্বাধীন ভারতবর্ষ অর্জন করি, সেই স্বাধীন দেশে আমরা নিজেরাই সীমানা পুনর্নির্ধারণ, গণভােট এবং দেশভাগের কথা চিন্তা করব। অবশ্য গণভােটে বেশির ভাগ লােক দেশভাগ চাইলে, তবেই তা করা যাবে।” রাজাজির এই প্রস্তাবের দিকে জিন্নার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন গাঁধীজি, “এটাই কি স্বশাসনের নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না?”
২৭৭
জিন্না তখন আইনি যুক্তিতে রাজাজির প্রস্তাবের ফাঁকগুলি দেখাতে শুরু করলেন, “তা হলে সীমানা পুনর্নির্ধারণের কমিশন কে নিয়ােগ করবে? প্রস্তাব অনুযায়ী গণভােট কী ভাবে নেওয়া হবে, সেটাই বা কে স্থির করবে? গণভােটের ফল যাই হােক না কেন, সেটাকে কাজে পরিণত করবে কে?
গাঁধীজি: আমরা যদি এই বৈঠকে সে সব ঠিক না করি, তা হলে অন্তর্বর্তী প্রাদেশিক সরকারের দায়িত্বেই এগুলি ছেড়ে দেওয়া ভাল।
জিন্না আবার প্রশ্ন তুললেন, “এই অন্তর্বর্তী প্রাদেশিক সরকার কী ভাবে তৈরি হবে?”
গাঁধীজির উত্তর, “সে ব্যাপারে লিগ আর কংগ্রেসকে একমত হতে হবে। দু’দল একমত হলে তারপর অন্য সব দলকে নিয়ে আলােচনা।”
জিন্না এ হেন উত্তরে সন্তুষ্ট নন। তিনি গাঁধীর থেকে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চান। “এটা আপনার ফর্মুলা, ফলে আপনাকেই এ নিয়ে ভাবতে হবে,” বলছেন তিনি। গাঁধী জানালেন, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনও প্রস্তাব তাঁর হাতে নেই। তবে লাহৌর প্রস্তাবের সাপেক্ষে যদি জিন্নার মাথায় নতুন কোনও চিন্তা থাকে, তাঁরা সেটি নিয়ে আলােচনা করতে পারেন। আমার তাে মনে হয়, লাহোর প্রস্তাবেও অন্তর্বর্তী সরকারের কথা বলা হয়েছিল,” বলেছেন গাঁধী।
তা হলে গাঁধীজি লাহোর প্রস্তাব মেনে নিলেন না কেন? রাজাজির ফর্মুলায় লাহৌর প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়েছে বলে যদি তাঁর মনে হয়েই থাকে, শেষ অবধি খাতায়কলমে কেন মেনে নিলেন না সেই দাবি?
অসুবিধার কথাটা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন গাঁধী, ‘লাহৌর প্রস্তাব ছিল অস্পষ্ট, ঝাপসা। পাকিস্তান’ শব্দটা সেখানে ছিল না, ছিল না ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের অনুষঙ্গও। যদি ধর্মের ভিত্তিতেই লিগ পাকিস্তান চেয়ে থাকে, ‘প্যান ইসলাম’ বা ‘ইসলামিক মহাদেশ’ই কি তা হলে তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য? দুনিয়ার সব মুসলিম তাে একই সম্প্রদায়ভুক্ত! আর দুনিয়ার সব মুসলিম নয়, ভারতীয় মুসলিমদের জন্যই যদি লিগ পাকিস্তান চেয়ে থাকে, তাদের স্পষ্ট করে একটা কথা বােঝাতে হবে। ধর্ম ছাড়া আর কোথায় অন্যান্য ভারতীয়দের থেকে এক জন ভারতীয় মুসলিম আলাদা? তুরস্ক বা আরবের মুসলমানদের সঙ্গে সেই ভারতীয় মুসলমানের তফাতটা ঠিক কোথায়?”
জিন্নার উত্তর ছিল, ‘প্যান ইসলাম নিয়ে তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। লাহোর প্রস্তাবে যে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি সে কথাও মেনে নিচ্ছেন তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষায়, “ওই পাকিস্তান শব্দটি এখন লাহৌর প্রস্তাবের সমার্থক। আমরা বারংবার বলেছি, মুসলমান এবং হিন্দু আসলে দুই পৃথক জাতিসত্তা! সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, সাহিত্য, স্থাপত্য, নাম, নীতি, প্রথা, পঞ্জিকা, ইতিহাস সবেতেই মুসলমানেরা হিন্দুদের চেয়ে আলাদা। ফলে আমাদের পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্র চাই।” , “নিছক খালি চোখে যা দেখা যায়, সেটাই সব সময় স্বতঃসিদ্ধ হয় না,” বলেছেন গাঁধীজি। এবং তার পর ‘স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলির সমস্যা নিয়ে জিন্নাকে বােঝানাের
২৭৮
চেষ্টা করেছেন। দেশ ভাগ হলে তাে ভারত, পাকিস্তানের বদলে এই স্বাধীন রাজ্যগুলিরই লাভ! তারা তাে বাকি দেশে নতুন সমস্যা তৈরি করবে। কিন্তু জিন্না নাছােড়। তাঁর মতে, ভারতীয় সমস্যার সমাধান শুধু দেশভাগে। আর দেশীয় রাজ্যের সমস্যা? “স্বাধীনতার মূল্য ভারতকে চোকাতেই হবে!”
এই গাঁধী-জিন্না বৈঠকের সময়েই এত দিনের আবছা, অস্পষ্ট পাকিস্তান প্রস্তাব ক্রমেই রাখঢাক না রেখে মুখােস খুলেছে। আর সেই ভয়াবহতায় শিউরে উঠেছেন গাঁধী। “আপনি যে ভাবে যুক্তি সাজাচ্ছেন, ছবিটা ক্রমশ আমার কাছে আতঙ্কের হয়ে। উঠছে,” বৈঠকের এক সপ্তাহ পরে ১৫ সেপ্টেম্বর জিন্নাকে লিখছেন গাঁধী। এবং জানিয়েছেন, “কার্যক্ষেত্রে লাহোর প্রস্তাব যে ভাবে দেখতে পাচ্ছি, সারা দেশের ধ্বংস অনিবার্য।”
এ বার থেকেই ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে তিক্ততার সূত্রপাত। গাঁধী যে বলেছেন, তিনি বিশেষ কারও প্রতিনিধি নন, বরং তামাম ভারতীয় জনগণের প্রতিভূ, তা কায়েদএ-আজমের কানে বাড়াবাড়ি ঠেকছিল। গাঁধীর বক্তব্য, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয়দের যে অসহনীয় দুঃখে দারিদ্রে দিন কাটাতে হয়, সেটা অনুভব করেন দেখেই তিনি সমগ্র ভারতবাসীর প্রতিনিধি। অন্য দিকে কায়েদ-এ আজম গাঁধীকে যতই ‘মহৎ’ মনে করুন, সমগ্র ভারতবাসীর প্রতিভূ হিসেবে তিনি গাঁধীকে মনে করেন না। তাঁর ধারণা, মুখ্যত হিন্দু জনতার মধ্যেই গাঁধীর প্রভাব সীমাবদ্ধ। “আপনি হিন্দু ছাড়া আর কারও প্রতিনিধিত্ব করছেন না। আর এই সত্যি কথাটা যতক্ষণ না আপনার মাথায় ঢুকছে, আমার পক্ষে তাে কথা বলাই শক্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে,” বলেছেন জিন্না।
‘কিন্তু আমি সমগ্র ভারতবাসীর প্রতিনিধিত্ব করতে চাই, এটাই বা আপনি মেনে নিতে পারছেন না কেন?” গাঁধী জিন্নাকে প্রশ্ন করেছেন, “আপনিও কি এ ধরনের কিছু চান না? সমগ্র দেশবাসীর প্রতিনিধি হওয়ার উচ্চাশা পােষণ করেন না? উচ্চাশা পূর্ণ হবে কি না, সেটি অন্য বিষয়। কিন্তু প্রতিটি ভারতবাসীই কি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তার দেশবাসীর প্রতিভূ হয়ে উঠতে চায় না?”
জিন্না তখনও বুঝিয়ে চলেছেন, লাহোর প্রস্তাবের ‘মৌলিক নীতি ও ভিত্তি’ যেন গাঁধী মেনে নেন। গাঁধী জানালেন, এই প্রস্তাব বাস্তব কার্যক্ষেত্রে যতটা মানা সম্ভব, তা তাে, তিনি মেনেই নিয়েছেন। তা হলে ‘মৌলিক নীতি ও ভিত্তি প্রসঙ্গটি অবান্তর নয় কি? “আপনি যে ভাবে আমাকে দিয়ে লাহৌর প্রস্তাব সমর্থন করাতে চাইছেন, যে ভাবে সেটি ব্যাখ্যা করছেন ও সেই অনুযায়ী দাবি তুলছেন, তা আমি নিজেও মেনে নিতে পারি না। বাকি দেশবাসীরা মেনে নেবেন, এমন আশাও করি না, জিন্নাকে সটান বলেছেন তিনি। এবং তার পরেও বােঝানাের চেষ্টা করেছেন, “বেশ তাে, দ্বিজাতিতত্ত্ব নিয়ে আমরা না হয় একমত নই। কিন্তু স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতেও কি আমরা সমস্যার মােকাবিলা করতে পারব না?”
দ্বিজাতিতত্ত গাঁধী মেনে নেননি। তিনি মনে করেন, ভারতবর্ষ কখনওই দুই বা ততােধিক জাতির বাসভূমি নয়। বরং বহু সদস্যের মিলমিশে তৈরি এক পরিবার।
২৭৯
আর মুসলমানেরা সেই পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত। কোনও কোনও অঞ্চলে সংখ্যাধিক্যের কারণে তাঁরা ভারত ছেড়ে বেরিয়ে যেতে চাইতে পারেন, সেই অধিকার তাঁদের আছে। বারংবার তিনি জানিয়েছেন, “লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি যদি আলাদা করতে হয়, দেশভাগের ভয়ংকরতার কথা সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের জানাতে হবে। তারপর সেখানকার লােকে ভােটে যা বলবেন, মেনে নেওয়া হবে।” এমনও বলেছেন, দরকারে তিনি নিজে সারা দেশকে বােঝাবেন। বলবেন, কোনও অঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষ যদি আলাদা দেশ চান, ভারত স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে কথা মেনে নেওয়া হবে।
আর এ রকম কিছু ঘটলে গাঁধীর কাছে সেটি দেশভাগ নয়, ভাই-ভাই আলাদা হয়ে যাওয়া। একই পরিবারের দুই ভাই যদি একে অন্যের ওপর ধর্মত্যাগ বা অন্য কারণে বিরক্ত হয়, হাঁড়ি আলাদা হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু নিজেরা আলাদা হলেও দুনিয়ার কাছে তারা সেই ‘একই বাড়ির ছেলে। “দুই ভাই আলাদা হয়ে গেলেও তারা পরস্পরের শত্রু হয় না। দুনিয়া তাদের দুই জনকে ভাই-ভাই বলেই জানে।”
এ ভাবে দেশের দুই অংশ আলাদা হতে চাইলেও গাঁধীর প্রস্তাব, প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ যােগাযােগ, বাণিজ্য, সংখ্যালঘুদের অধিকার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সকলের ক্ষেত্রেই এক রকম থাকবে। কংগ্রেস এবং লিগ দুই তরফ এই প্রস্তাব মেনে এ বার পরস্পর বসে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। আর সেই আন্দোলনের গতিপথে কংগ্রেস কোনও প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচি নিলে, সেখানে লিগের যােগদান বিষয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সংগ্রামে যােগ দেওয়া, না-দেওয়া লিগের ইচ্ছা!
কিন্তু দেশভাগ নিয়ে জিন্না এ জাতীয় গণভােটে যেতে নারাজ! তিনি চান, স্বনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শুধু মুসলিমদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক! “আমরা আলাদা জাতি হিসেবেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চাইছি। আর আপনি তখন থেকে ভুল বুঝে যাচ্ছেন। ভাবছেন আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে, আলাদা রাজ্য। রাজ্য-টাজ্য নয়, হিন্দু এবং মুসলিম দুই পৃথক জাতির মধ্যে চুক্তিবলে এ বার থেকে দুটি আলাদা, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরি হবে। চলতি কোনও ভারতীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া-টাওয়া সেখানে অপ্রাসঙ্গিক,” বলেছেন জিন্না।
“এক দল ধর্মান্তরিত ও তাদের উত্তরসূরিরা দাবি করছে, পূর্বসূরিদের থেকে তারা পৃথক, আলাদা জাতি। ইতিহাসে এ জাতীয় কোনও উদাহরণ আমি দেখিনি, ১৫ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে জিন্নাকে লিখছেন গাঁধী, “ইসলামের অভ্যুদয়ের অনেক আগে থেকেই ভারতবর্ষ এক জাতি, এক প্রাণ। সেই ভারতীয় সন্তানদের একটি বৃহৎ অংশ আজ ধর্মান্তরিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জাতিগত ঐতিহ্য তাে এক। আপনি জাতির যে নতুন সংজ্ঞা দিচ্ছেন, তা মেনে নিলে ভবিষ্যতে এ জাতীয় আরও অনেক দাবি মানতে হবে। সমস্যার কুলকিনারা খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সাধারণ বিষয়ে জিন্না কী ভাবছেন, জানতে চেয়েছিলেন গাঁধী।
২৮০
কায়েদ-এ আজমের উত্তর, ‘পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুটি আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ছাড়া তাদের মধ্যে এই জাতীয় কোনও ‘সাধারণ সম্পর্ক থাকতে পারে না।
প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশের দুই পৃথক অংশের মধ্যে সন্তোষজনক চুক্তি হলে গাঁধী মুসলিম-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির আলাদা অস্তিত্ব স্বীকারে প্রস্তুত। কিন্তু জিন্নার বক্তব্য, আগে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র। তার পর দুই দেশ একমত হলে এই জাতীয় । চুক্তি। আর সে কথা শুনে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, “এ তাে বিয়ের আগেই বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাব!”
কী হবে, যদি দুটি আলাদা দেশের মধ্যে চুক্তি করার মতাে কোনও যৌথ বিষয় না থাকে? কী হবে যদি এক পক্ষ চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসে? জিন্নার উত্তর, “এ রকম ক্ষেত্রে দুনিয়ার সর্বত্র যা ঘটেছে, এখানেও তাই ঘটবে। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ।” সােজা কথায়, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের খাতিরেই জিন্না পাকিস্তানের স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। “চুক্তিবলে এই জাতীয় যুদ্ধ করার স্বাধীনতা দেওয়া যায় না,” বলেছিলেন গাঁধী। পরে তেজবাহাদুর সপুকে এক চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন, ঝগড়ার কারণে তিনি ভাইয়েভাইয়ে আলাদা হাঁড়ি মেনে নিতে পারেন। কিন্তু প্রতিটি ব্যাপারেই তাদের এমন রেষারেষি যে দু’তরফে শত্রুতা ছাড়া আর কিছু বাকি থাকছে না, এমনটা আমার কাম্য নয়।”
২২ সেপ্টেম্বর জিন্নাকে লিখে চিঠিতে গাঁধীর আক্ষেপ, “মনে হয়, আমরা বৃত্তপথে ঘুরে বেড়াচ্ছি, দুজনের কেউই এতটুকু অগ্রসর হতে পারছি না।” এবং পরের দিন, ২৩ সেপ্টেম্বর তাঁর আক্ষেপ আরও ভয়ংকর, “গতকালের কথােপকথনে মন এখনও বিস্বাদ হয়ে আছে।” ২৬ সেপ্টেম্বর আরও লিখলেন, কিছু চিন্তাভাবনাকে আপনি লাহৌর প্রস্তাবের মূলগত ভিত্তি ধরে আছেন। চাইছেন যে, আমিও সেগুলি মেনে নিই। কিন্তু আমার একটা কথা মনে হয়। আমাদের পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গির দূরত্ব যখন এত বেশি, লাহৌর প্রস্তাবের দাবিগুলি মেনে নেওয়া যাক। দু’পক্ষই তা হলে সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাবে।’
কিন্তু জিন্না অনড়, ‘আপনি বারংবার একটা কথাই বলছেন। আমরা দু জনে যদি সমাধানে পৌঁছতে পারি, আপনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে কংগ্রেস এবং দেশবাসীকে তা মেনে নিতে বাধ্য করবেন। আমি তাে গােড়া থেকে বলছি, ওটুকুই যথেষ্ট নয়!
গাঁধী ঠিকই ধরেছিলেন। পাকিস্তানের পয়গম্বর তাঁর আলিকে খুঁজছেন! “যদি আপনাকে এতটুকু নিজের পথে নিয়ে আসতে পারি ! হিন্দু ভারতের ওপর আপনার যে তুমুল প্রভাব, তাতে আমি লাভবানই হব,” বৈঠকের শুরুতে গাঁধীকে বলেছিলেন জিন্না। কিন্তু এত কিছু বলেও তিনি পাল্টা যুক্তি শুনতে নারাজ। তায় আবার সেই যুক্তি এমন এক জনের কাছ থেকে, যিনি স্বীকৃত কোনও প্রতিনিধি নন। “আমরা লাহৌর প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা করছি ঠিকই, কিন্তু আপনার প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটা একবারও উঠছে না। এখানে আপনি নিজের ক্ষমতায় প্রস্তাব দিচ্ছেন। কিন্তু যতক্ষণ না সেটা
২৮১
প্রতিনিধিস্থানীয় কারও কাছ থেকে আসছে, প্রস্তাব নিয়ে কথা বলার মানেই হয় না।”
“আমার পরনে প্রতিনিধিত্বের পােশাক রয়েছে কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর, মৃদু হেসে গাঁধীর উত্তর, “কিন্তু আপনি যদি নিজের যুক্তি খুঁজে না পেয়ে থাকেন, তার কারণ নিশ্চয় আমার প্রতিনিধিত্ব-ক্ষমতা না থাকা নয়।”
আলােচনা যখন ভেস্তে যাওয়ার মুখে, গাঁধী জানালেন, রাজাজির প্রস্তাব নিয়ে তাঁকে মুসলিম লিগ কাউন্সিলের সঙ্গে বসতে দেওয়া হােক! “অনুগ্রহ করে আমাকে আর প্রত্যাখ্যান করবেন না। প্রস্তাবটা আপনাদের কর্মসমিতিতে তুলুন, তাঁদের বােঝানাের অন্তত একটা সুযােগ আমাকে দিন। তাঁরাও যদি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, লিগের প্রকাশ্য অধিবেশনে এই প্রস্তাব তুলে ধরুন। যদি আপনি এই প্রস্তাব মেনে আমাকে অনুমতি দেন, আমি নিজেই লিগের প্রকাশ্য অধিবেশনে এই প্রস্তাব তুলে ধরব।”
বিকল্প প্রস্তাবও দিলেন গাঁধী। তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা! “পরস্পরকে বােঝানাের খাতিরে আমাদের যদি বাইরের কারও সাহায্য, পরামর্শ বা মধ্যস্থতা মেনে নিতে হয়, তা কি একেবারেই অবান্তর?”
কিন্তু জিন্নার কাছে দুটি প্রস্তাবের একটিও গ্রহণযােগ্য নয়। আপনি তাে অসাধারণ সব প্রস্তাব দিচ্ছেন! কাউন্সিলের বৈঠকে বা প্রকাশ্য অধিবেশনে শুধু লিগের সদস্য বা প্রতিনিধিরাই যােগ দিতে পারেন।”
২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৪। প্যারেলালের ডাইরিতে আবার ফিরে আসা যাক! গাঁধীজিন্না বৈঠকের অন্তিম পর্বের বিবরণে!
“সন্ধ্যা ৭টা ১০ নাগাদ ফিরে এসে বাপু রাজাজির সঙ্গে কথা বলতে বসলেন। তার পর প্রার্থনাশেষে আবার দু’জনের কথা। জিন্না বাপুর প্রস্তাব নিয়ে কথাই বলতে চাননি। বাপুর নাকি আলােচনায় বসার ক্ষমতা নেই, তিনি কারও আইনি প্রতিনিধিই নন! “এত ক্ষমতা, আত্মরক্ষার যুক্তি যখন তুলছেন, আপনি নিশ্চয় কোনও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার ভূত দেখছেন!” বাপুর এই কথার উত্তরে জিন্না বলেছেন, “না, সে রকম কিছু নয়। তবে কার্যক্ষেত্রে দু’পক্ষেরই তাদের সংগঠনের প্রতিনিধি হয়ে আসা উচিত।”
তার পরই জিন্না অগস্ট আন্দোলনের প্রসঙ্গে এলেন। বললেন, এতে নাকি মুসলিমদের ক্ষতি হয়েছে। গাঁধীজিও পাল্টা যুক্তি দিতে ছাড়লেন না, “আপনি নিজেই তাে জানেন, এই অভিযােগ কতটা ভিত্তিহীন! আপনার আইনি বুদ্ধিতে এটুকু নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, ভারত ছাড়াে প্রস্তাবটা ভারতশাসনের বিরুদ্ধে। সেখানে মুসলিমদের ক্ষতি গােছের প্রশ্ন তুলছেন কী ভাবে? দরকারে নিরপেক্ষ কোনও আইনজীবীর মতামত নিয়ে দেখুন, ওখানে মুসলিম-বিরােধী কথা আছে কি না!”
উনি (জিন্না) বললেন, অন্য আইনজীবীর কাছে যাওয়া-টাওয়ার ইচ্ছা তাঁর নেই। “যে বিষয়টা আমি নিজে জানি, তা নিয়ে অন্যের মতামত নিতে যাব কোন দুঃখে?” তখন নিজেই বললাম, ২ অক্টোবর আমার সেবাগ্রাম আশ্রমে থাকব, বলেছিলাম। আপনার অসুবিধা না থাকলে ৩০ সেপ্টেম্বর আমি এখান থেকে রওনা দেব, চার-পাঁচ
২৮২
দিন পরে ফিরে আসব। উনি বললেন, “অত দেরি ? তার চেয়ে বিষয়টা বরং এখানেই শেষ করে দেওয়া যাক! আমি মঙ্গলবারের মধ্যে সব কিছু (বৈঠকে তাঁদের পরস্পরের চিঠিপত্র) তৈরি করে ফেলব। আপনিও কপিগুলি দেখে নেবেন, আমিও তাই করব। এ বিষয়ে নির্দেশ তৈরি করাই ছিল, উনি সেটি পড়ে শােনালেন। আমি বললাম, এ নিয়ে কিছু বলার নেই। তবে একটা কপি পেলে আমিও দেখে নিতে পারতাম। উনি জানালেন, মঙ্গলবারের আগে তা হবে না। ঠিক আছে ছাড়া কী আর বলব? উনি তৃতীয় কোনও পক্ষের মধ্যস্থতা মানবেন না, নিজে কোনও খসড়াও পেশ করবেন না। শুধু অগস্ট প্রস্তাবের বিরােধিতা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত বারই যে বললেন, ওই প্রস্তাব তুলে নেওয়া উচিত !”
২৭ সেপ্টেম্বর সান্ধ্য প্রার্থনাসভায় জিন্নার সঙ্গে তাঁর বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার খবর জানালেন গাঁধীজি। জানালেন, যে আশা নিয়ে তিনি বৈঠকে গিয়েছিলেন, শেষ অবধি তা পূর্ণ হয়নি। কিন্তু হতাশায় তিনি ভেঙে পড়ছেন না। এই ব্যর্থতার ভস্মতূপের মধ্যে থেকেও তাে আশা জেগে উঠতে পারে। তিনি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, সাধারণ মানুষের খাতিরে জিন্নার দৃষ্টিভঙ্গি তিনি অনেক দূর অবধি মেনেও নিয়েছিলেন, কিন্তু কিছু হল না। কায়েদ-এ-আজমের দরজায় কড়া নাড়াটুকুই সার!
“আমার মনে হয়, জিন্নার মধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু উনি দিবাস্বপ্নে কুঁদ হয়ে আছেন। ভাবছেন, অস্বাভাবিক ভাবে দেশটাকে ভেঙে উনি ভারতবাসীর মনে সুখশান্তি নিয়ে আসবেন, পরে ‘নিউজ ক্রনি’ পত্রিকার সাংবাদিক গেন্ডারকে জানিয়েছিলেন গাঁধী। আর এক দল সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন, জিন্নার সঙ্গে তাঁর বৈঠক শেষ নয়। শুধু সাময়িক বিরতি। “আমি জানি, মিস্টার জিন্না মহৎ হৃদয়। আমরা অচিরে আবার একসঙ্গে মিলতে পারি। আপাতত, জনগণের উচিত পরিস্থিতি হৃদয়ঙ্গম করে একটা মতামতে আসা, এবং সেটা দিয়ে আমাদের দুজনের ওপরে চাপ তৈরি করা।” বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পরেও গাঁধী এ ভাবেই জিন্নার সঙ্গে সন্ধির রাস্তা খুঁজেছেন।
রাজাজির ফর্মুলা যে লিগের প্রস্তাব যত দূর সম্ভব মেনে নিয়েছে, তা নিয়ে গাঁধীর সন্দেহ ছিল না। স্বশাসিত মুসলিম অঞ্চলের নাম ‘পাকিস্তান’ হলেও যে তাঁর আপত্তি নেই, প্রথম থেকে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন গাঁধী। কিন্তু জিন্না আবার এই সব কথা লাহোর প্রস্তাবে অন্তর্ঘাত ঘটানাের চেষ্টা বলে ভাবছিলেন। ফলে, জিন্নার আপত্তিগুলিও বােঝার চেষ্টা করেছেন গাঁধী। লিগের স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র কি ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জিগির তােলার প্রয়াস নয়? মুসলিমপ্রধান অঞ্চলের পূর্ণ বিকাশ। যদি ভারতের মধ্যে আলাদা একটি স্বশাসিত একক তৈরির লক্ষ্য হয়, রাজাজির ফর্মুলা নিয়ে তা হলে সকলেই একমত হবেন। অন্য দিকে ভারতকে বিপাকে ফেলার জন্যই যদি পাকিস্তান তৈরির পরিকল্পনা হয়, রাজাজির ফর্মুলা সে ক্ষেত্রে কোনও সাহায্যই করতে পারবে না! জিন্নার একমুখী লক্ষ্য, তাঁর সততা এবং বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গাঁধী বরাবর শ্রদ্ধাশীল।
২৮৩
জিন্নার মতাে দেশপ্রেমিক নিশ্চয় ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে ইন্ধন দেবেন না। ভবিষ্যতে ভারতবর্ষ দুটি আলাদা অংশে ভেঙে গেলেও নিশ্চয় জিন্না এমন কিছু করতে চাইবেন না, যাতে অন্য অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে কারণেই তাে গাঁধী জিন্নার দরজায় কড়া নেড়েছেন, তাঁকে নিজের হাতের তাস দেখিয়েছেন। কোনও মানসিক দ্বন্দ্ব ছাড়াই জিন্নাকে মনের কথা প্রকাশে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
কিন্তু গােটাটাই প্রায় জুয়ার দান দেওয়ার মতাে! মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত বিচারপতি, উদারনৈতিক নেতা ড. এম আর জয়াকর দিন কয়েক পরেই গাঁধীকে লিখেছেন, “আপনার আর জিন্নার চিঠিপত্র থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার। জিন্না যে কোনও দিন নিজের দেশবাসীর বদলে ব্রিটিশের সঙ্গেই সমঝােতায় যেতে চাইবেন। ব্রিটিশের সঙ্গে দর-কষাকষিতে ওই ফর্মুলাটাই তিনি ব্যবহার করবেন। প্রয়ােজনে অন্য ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে সমঝােতায় আসতে গেলেও আপনার প্রস্তাব থেকেই শুরু করবেন।”
দেশভাগকে তিনি অঙ্গচ্ছেদ বলতেন। আর সেই ভারত-ভাগ রুখতে এটিই গাঁধীর শেষ একনিষ্ঠ প্রয়াস। ভারতীয় সীমান্তের দোরগােড়ায় তখন যুদ্ধ। জিন্না এবং গাঁধী কেউই আর যুবক নন। নাটকের মুখ্য চরিত্রদের সময় ক্রমে কমে আসছে। এখন প্রাণপাত চেষ্টায় ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা কিংবা ঘটনাকে ভেসে বেরিয়ে যেতে দেওয়া, এই দুটিই মাত্র পথ সামনে। গাঁধী চেষ্টা করেছিলেন। ভারতবর্ষকে এক রাখতে প্রাণপাত চেষ্টা করেছিলেন। সফল হননি। জনগণের আশার পারদ ঊর্ধ্বমুখী হতে হতে অবশেষে মাটিতে পড়ে ধূলিসাৎ হয়েছে। পরবর্তীকালে গাঁধীর এই শেষ প্রয়াস প্রায়ই সমালােচনার মুখে পড়েছে। কিন্তু এই চেষ্টা তাঁর কাছে শুধু রাজনীতি নয়। আরও বড় কিছু। তার নাম ধর্ম!
দেশাই-লিয়াকত চুক্তি
চারদিকে হতাশ অন্ধকারের এই পরিস্থিতিতে অচলাবস্থা কাটাতে শেষ অবধি আসরে নেমে পড়লেন আইনজীবী, কংগ্রেস নেতা ভুলাভাই দেশাই।
এত দিনে যুদ্ধ-পরিস্থিতি, ভারতীয় রাজনীতি সবই বদলে গিয়েছে। ভুলাভাই এবং কংগ্রেস দল সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় আইনসভা বয়কটের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করে আবার নিজেদের আসনে ফিরে এসেছেন। আইনসভায় মুসলিম লিগের নেতা লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে তখন ভুলাভাইয়ের ভাল বােঝাপড়া, দু’জনে মিলে ১৯৪৫ সালের সেই ফেব্রুয়ারি-মার্চে সরকারপক্ষের অনেক প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছেন। ভুলাভাই এবং লিয়াকত আলি…আইনসভায় দুই বিরােধী দলনেতার বােঝাপড়ায় স্থির হয়েছিল, তখনকার সাংবিধানিক রূপরেখার মধ্যে থেকেই কেন্দ্রে একটি অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি হবে। সেই সরকার গভর্নর জেনারেল’ আর ‘কম্যান্ডার ইন চিফ’ ছাড়া ভাইসরয়ের
২৮৪
কার্যনির্বাহী কাউন্সিলের অন্য সদস্যদের মনােনীত করবে। সদস্যদের সকলেই ভারতীয় হবেন। এবং কাউন্সিলে হিন্দু ও মুসলিম নেতাদের সংখ্যা হবে সমান। মােতিলাল সেতলবাদ ভুলাভাইকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতেন। তাঁর বয়ান: “গাঁধীকে ছেড়ে দেওয়া হলেও কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং অন্যান্য নেতারা অনেকে তখনও জেলে। ১৯৪৪ সালের শেষাশেষি এবং ‘৪৫ সালের শুরুতে হিন্দু-মুসলিম ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি অন্তর্বর্তী সরকার তৈরির ব্যাপারে ভুলাভাই ভাইসরয়ের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেন। জিন্নার ডান হাত, আইনসভায় লিগের দু’নম্বর নেতা লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে ভুলাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।”
সম্ভবত, ১৯৪৫ সালের জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি নিয়ে কথা হয়েছিল। ঠিক হল, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজই হবে বন্দি নেতাদের মুক্তি ঘােষণা। ভুলাভাইয়ের ওপর গাঁধীর আস্থা ছিল, সে সময় একাধিক বার ওয়ার্ধার আশ্রমে গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে গিয়েছেন ভুলাভাই। খসড়াপ্রস্তাব দেখে গাঁধী অনুমােদন দিয়েছেন, প্রস্তাবপত্রে নিজের হাতে ছােটখাটো দু একটি সংশােধনও করে দিয়েছেন। শেষ অবধি চূড়ান্ত প্রস্তাবের দুটি কপি তৈরি হল, লিয়াকত আলি খান এবং ভুলাভাই দেশাই দু’জনেই সেখানে সই করলেন। এই প্রস্তাব দেশাই-লিয়াকত আলি চুক্তি নামে খ্যাত।
স্বাক্ষরিত বয়ানে মালুম, লিয়াকত আলি সই করার আগে জিন্নার সঙ্গে প্রস্তাবটি নিয়ে আলােচনা করেছিলেন। এ দেশের সংবাদপত্রগুলিতে তখন এই চুক্তি নিয়ে অজস্র গুজব আর কল্পিত ভাষ্য। জনসাধারণকেও তখন প্রস্তাবের পুরাে বয়ান জানানাে হয়নি।
১৯৪৫ সালের জুন মাসে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির নেতারা মুক্তি পেলেন। তার পরই এই চুক্তি নিয়ে কংগ্রেস শিবিরে তুলকালাম। ভুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযােগ উঠল, তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। গাঁধীকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছেন। কংগ্রেসের ওপরতলার জনাকয়েক গুরুত্বপূর্ণ নেতা তখন রােজই সংবাদমাধ্যমে ভুলাভাইয়ের বিরুদ্ধে বিষ উগরে দিচ্ছেন। কয়েক দিন পরে গাঁধী মুখ খুললেন। তিনি স্পষ্ট জানালেন, ভুলাভাই তাঁর সঙ্গে কথা বলেই যা করার করেছেন। ভুলাভাইয়ের কাজে তাঁর পূর্ণ অনুমােদন ছিল। গাঁধীর বিবৃতি, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সমর্থন সত্ত্বেও অন্য কংগ্রেস নেতারা তখন ভুলাভাইয়ের ওপর খড়গহস্ত। ভুলাভাইয়ের এই চুক্তি করার ক্ষমতা নেই, তাঁর এই অযাচিত বােঝাপড়ায় কংগ্রেসের ক্ষতি ইত্যাদি ধুয়াে তুলে ওয়ার্কিং কমিটির মহামান্য অনেক নেতা প্রস্তাবটি নাকচ করে দিতে চাইলেন। সেতলবাদ অবশ্য জানাচ্ছেন, “ভুলাভাই গাঁধীকে জানিয়েই লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত বা অন্য কোনও কারণে ওয়ার্কিং কমিটির কিছু নেতা ভুলাভাইকে পছন্দ করতেন না। এই সুযােগে তাঁরা ভুলাভাইয়ের সম্মান ধুলােয় মিশিয়ে দেওয়ার রাস্তা নিলেন।” আরও খােলাখুলি ব্যাখ্যা করছেন তিনি, “কংগ্রেস সে সময় কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচনে নামার তােড়জোড় করছে। কিন্তু দলের ক্ষমতাসীন নেতারা একযােগে সিদ্ধান্ত নিলেন, ভুলাভাইকে মনােনয়ন দেওয়া
২৮৫
হবে না।” কার উদ্যোগে এই অবিচার? মহাত্মাই বা ভুলাভাই দেশাইকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন না কেন? মােতিলাল সেতলবাদ দেশাইয়ের হাতে লেখার প্রাথমিক খসড়া সযত্নে রেখে দিয়ে পরে প্রকাশ করেছিলেন, ১৯৪৫ সালের ৩ থেকে ৫ জানুয়ারির মধ্যে দেশাই খসড়াটি গাঁধীকে দেখিয়েছিলেন। গাঁধী নিজের হাতের লেখায় সেখানে কিছু সংশােধন ও পরিমার্জন সম্পন্ন করেছিলেন।
লিয়াকত আলি খান কোনওক্রমে এই সংকট কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে যােগ দেওয়ার জন্য তত দিনে স্যর সুলতান আহমেদ, ফজলুল হক এবং বেগম শাহনওয়াজের মতাে বড়মাপের নেতারা মুসলিম লিগ থেকে বহিষ্কৃত। লিয়াকত আলি খানের সমস্যা ছিল আরও গভীর। জিন্নাকে না জানানাে হলে এই অন্তর্বর্তী জোট সরকার নিয়ে তীব্র বিপাকে পড়তে পারতেন তিনি। প্রসঙ্গত, লিয়াকত আলি খান এবং ভুলাভাই দেশাই ব্যক্তিগত জীবনেও বন্ধু ছিলেন। পার্সি এবং উর্দু কবিতায় দেশাইয়ের আগ্রহই এই বন্ধুত্বের কারণ। লিয়াকত-ভুলাভাই চুক্তির খাতিরেই যে তাঁরা পরস্পরের কাছাকাছি এসেছিলেন, এমন নয়। খসড়া চুক্তিতে সই করেই লিয়াকত দক্ষিণ ভারত চলে গিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে জিন্নাকে তিনি এই খসড়া সইয়ের খবর দেওয়ার আগেই দেশাই চুক্তিটি প্রকাশ করে দেন। জিন্না বুঝতে পেরেছিলেন, এ নিয়ে তর্কের অবকাশ থাকতে পারে। কিন্তু লিয়াকতকে সাজা দেওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তা ছাড়া, জিন্না নিজেকে কংগ্রেসের থেকে আলাদা প্রতিপন্ন করার মােহেও লিয়াকতকে ছেড়ে দিয়ে থাকতে পারেন।
কংগ্রেসের সমর্থনের অভাবেই দেখেই লিয়াকত-দেশাই চুক্তি অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়। পরবর্তী কালে যমনদাস মেটা জানিয়েছিলেন, “কংগ্রেস সে দিন লিয়াকত-দেশাই চুক্তি সমর্থন করেনি বলেই পরে সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়েছিল।” মেটার মতে, জিন্নার সামনে সে দিন পাকিস্তানের রাস্তাটিই খােলা ছিল। কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগে সাম্য বজায় থাকলে জিন্নাও পরে হয়তাে পাকিস্তান আটকে দিতেন। কিন্তু সাম্য আর তখন কোথায় ? ভুলাভাই দেশাই অন্তর্বর্তী সরকারের যে খসড়া তৈরি করেছিলেন, আর পরে যা তৈরি হল, দুয়ের মধ্যে আকাশপাতাল ফারাক !
এ ভাবেই শেষের দিকে পথ যত সংকীর্ণ হয়ে এসেছে, খেলাশেষের উত্তেজনা যত লাগাম ছাড়িয়েছে, ব্রিটিশরা ক্রমশ তত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এবং, সাম্প্রদায়িকতা-প্রশ্নটি জটিল থেকে জটিলতর আবর্তে ঢুকে গিয়েছে। অন্ধকার ঘন থেকে ঘনতর হওয়ার মুহূর্তেও ভারতীয় রাজনীতি সেই একই প্রশ্নের বাঁকে মাথা কুটে মরেছে: সংখ্যাগরিষ্ঠকে ঠেকাতে রক্ষাকবচ কী হবে, ভারতীয় মুসলিমরা কী ভাবে নিজেদের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সত্তা নিয়ন্ত্রণ করবেন!
এই সব প্রশ্নের মুখােমুখি হয়ে মুসলিমরা তখন নিজস্ব পরিসর খুঁজছেন, খুঁজছেন তাঁদের আশ্বাস দেওয়ার মতাে এক নতুন ‘সিস্টেম। আদর্শগতভাবে সেই ‘সিস্টেম ভারতের মধ্যেই পাওয়া যেতে পারে। নিতান্ত অসম্ভব হলে ভারতের মানচিত্রের বাইরে অন্য পরিসর, অন্য সীমানা তৈরি করে নেবেন তাঁরা। উত্তরটা তা হলে কোথায় ছিল?
২৮৬
সবাইকে আশ্বাস দেওয়ার মতাে এক রাজনৈতিক কাঠামাে তৈরি? না কি, ‘সিস্টেম’এর কথাটা নিছক বলার জন্য বলা! সে দিনের আসল প্রশ্ন নিহিত ছিল মানুষের মনােভাবে!
বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতা পার হয়ে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, প্রতিটি সমাজের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সরকারি নীতি বা আইন কোনও দিনই বদলাতে পারে না সেই দৃষ্টি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বরং সেই সমাজগুলির পারস্পরিক বিশ্বাস আর সমঝােতা থেকেই উদ্ভূত হতে পারে আশ্বস্তকারী কোনও রাজনৈতিক সিস্টেম। আর, সেই ‘সিস্টেম’ খোঁজার রাস্তায় দেশের একাই চলার কথা। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংবেদনশীলতার ক্রমপরিবর্তন হতে থাকবে, এবং ভারতকে অটুট রাখা আদৌ সম্ভব কি না, সেই ক্রমপরিবর্তনের চরিত্রই তা নিশ্চিত করবে। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল বা অন্য কেউ বাইরে থেকে বড়জোর এক প্রশাসনযন্ত্র তৈরিতে সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বা সংবেদনশীলতা? সে তাে ভারতীয়দেরই নিজস্ব! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা? সে তাে ভারতীয়দেরই দায়িত্ব। উপনিবেশের বাইরে থেকেআসা প্রভুদের তাে সে দায় থাকতে পারে না। আমরা ভারতীয়রা কেন আদৌ দেশভাগ চেয়েছিলাম? দেশভাগের সেই ভয়ংকর ট্রাজেডির দিকে এ বার আমরা যত এগােতে থাকব, প্রশ্নটা ততই আমাদের কুরে কুরে খাবে, পালাবার পথ মিলবে না!….
তথ্যসূত্র
১. সি এইচ ফিলিস্ ও মেরি ডরিন ওয়েনরাইট সম্পাদিত, দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, পলিসিজ অ্যান্ড পারস্পেকটিভস ১৯৩৫-১৯৪৭, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড, লন্ডন, পৃ ৩৮৮।
২. সি আর অ্যাটলি, ‘অ্যাজ ইট হ্যাপেনড’; আর জি কুপল্যান্ড, ডায়রি: ১৯৪১-১৯৪২; নােটস অন মিটিংস অব ইন্ডিয়া কনসিলিয়েশন গ্রুপ সাবকমিটি মিটিং উইথ নেহরু, ১৪ জুলাই ১৯৩৮।
৩. নােটস অন মিটিংস অব ইন্ডিয়া কনসিলিয়েশন গ্রুপ সাবকমিটি মিটিং উইথ নেহরু, ১৪ জুলাই ১৯৩৮। এই ‘ইন্ডিয়া কনসিলিয়েশন গ্রুপ’টি ১৯৩১ সালে গাঁধীর উদ্যোগে ‘গ্রেট ব্রিটেন ও ভারতের মধ্যে পারস্পরিক বােঝাপড়ার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়।
৪. স্যার ফাইন্ডলেটার স্টুয়ার্টকে ক্রিপসের চিঠি, ২৪ নভেম্বর, ১৯৩৯ L/PO/252/16
৫. আর জে মুর, চার্চিল, ক্রিপস অ্যান্ড ইন্ডিয়া, ১৯৩৯-৪৫, ক্ল্যারেনডন প্রেস অক্সফোর্ড, ১৯৭৯, পৃ ৯-১০
৬. তদেব, ১৯৩৯-৪৫, পৃ ১১
৭. ক্রিপস ও জেফ্রি উইলসনের ডায়রি, ১৯৩৯-৪০; ১১ ডিসেম্বর ১৯৩৯, লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মরিস স্টকের সংগ্রহ থেকে
২৮৭
৮. ক্রিপস ও জেফ্রি উইলসনের ডায়রি, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৩৯।
৯. চার্চিল, ক্রিপস অ্যান্ড ইন্ডিয়া, পৃ ১৩
১০. ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত 59 (39) ৪, ২৫ অক্টোবর, ১৯৩৯
১১. চার্চিল, ক্রিপস অ্যান্ড ইন্ডিয়া, পৃ ২২।
১২. চার্চিল, ক্রিপস অ্যান্ড ইন্ডিয়া, পৃ ২৮
১৩. তদেব ।
১৪. জেটল্যান্ডকে লিনলিথগাের চিঠি, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০, জেটল্যান্ড সংগ্রহ, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, লন্ডন
১৫. চেম্বারলেনকে সাইমনের চিঠি, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০ প্রধানমন্ত্রীর অফিস ফাইল, পাবলিক রেকর্ড অফিস, লন্ডন
১৬. তদেব
১৭. তদেব।
১৮. চেম্বারলেনকে চার্চিলের চিঠি, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ফাইল, পাবলিক রেকর্ড অফিস, লন্ডন।
১৯. নেহরুকে ক্রিপসের চিঠি, ১৮ মার্চ ১৯৪০, জওহরলাল নেহরু সংগ্রহ, নেহরু মেমােরিয়াল লাইব্রেরি, নয়াদিল্লি।
২০. নােটস অন মিটিংস অব ইন্ডিয়া কনসিলিয়েশন গ্রুপ সাবকমিটি মিটিং ২৪ মে ১৯৪০
২১. ১৯৪০ সালের ১৬ জুলাই তারবার্তা-প্রাইভেট অফিস পেপার্স, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, লন্ডন
২২. যুদ্ধমন্ত্রকের বৈঠক ৩০ জুলাই ১৯৪০ WP (40) 295 ২২. তদেব।
২৩. ব্রিটিশ সরকারের প্রস্তাব, ৮ অগস্ট ১৯৪০
২৪. হাউস অব কমনস-এ লিয়ােপােল্ড অ্যামেরির ভাষণ, ১ অগস্ট, ১৯৪২
২৫. বিদেশসচিব কর্নেল হালকে গাই ভিনান্ট-এর চিঠি, ৪ নভেম্বর ১৯৪১; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্ক, কূটনীতিকদের ১৯৪১ সালের চিঠিপত্র
২৬, ব্রিটেনে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত
২৭. তদেব।
২৮. চার্চিল, ক্রিপস অ্যান্ড ইন্ডিয়া, পৃ ৪২
২৯. তদেব
৩০. স্যার জর্জ আর্নস্ট শুস্টার (১৮৮১-১৯৮২); ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলে ১৯২৮ থেকে ১৯৩৪ সাল অবধি অর্থসংক্রান্ত উপদেষ্টা
৩১. কাঞ্জি দ্বারকাদাস, টেন ইয়ার্স অব ফ্রিডম, বম্বে, পপুলার প্রকাশন, ১৯৬৮, পৃ ৬২
৩২. তদেব, পৃ ৬৩
৩৩. তদেব।
৩৪. তবে
৩৫. তদেব
২৮৮
৩৬. তদেব।
৩৭. তদেব, পৃ ৬৪
৩৮. তদেব, পৃ ৬৪
৩৯. তদেব, পৃ ৬৫
৪০. তদেব, পৃ ১৯৪-১৯৫
৪১. তদেব পৃ ৬৭
৪২. দেব।
৪৩. মাহমুদ হুসেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড দ্য পাকিস্তান মুভমেন্ট, সি এইচ ফিলিপস এবং মেরি ডরিন ওয়েনরাইট সম্পাদিত দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, পলিসিজ অ্যান্ড পার্সপেকটিভস, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন সিমিটেড, লন্ডন, ১৯৭০, পৃ ৩৭
৪৪. টেন ইয়ার্স অব ফ্রিডম, পৃ ৬৯।
৪৫. ওয়াভেলের সম্পর্কে মন্তব্য, প্যারেলাল, পৃ ২৭৬
৪৬. মােতিলাল সি সেতলবাদ, ল অ্যান্ড আদার রাইটিংস।
২৮৯
সপ্তম অধ্যায়
উত্তরাধিকারের লড়াই: ভিন্ন ভিন্ন পথ
সৈনিক ভাইসরয় ওয়াভেল: অক্টোবর ১৯৪৩ – মার্চ ১৯৪৭
লিনলিথগাের পরে ভারতের ভাইসরয় হিসেবে ফিল্ড মার্শাল ওয়াভেল-এর নিয়ােগ। ভারতবর্ষের শেষ ভাইসরয়ের ঠিক আগের ভাইসরয় তিনি। তার কার্যকালের সময়টি, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, কখনও স্থিতিশীল ছিল না। তার একটা কারণ, ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সঙ্গে ওয়াভেলের সম্পর্ক খুব মধুর ছিল না। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে থেকে ওয়াভেল কখনও প্রকৃত সহযােগিতা পাননি। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলিও ওয়াভেলের সঙ্গে সহযােগিতা করেননি। ওয়াভেল যখন ভারতের ভাইসরয়ের পদে নিযুক্ত হন, তখন ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে তৈরি এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন। ফলে, সেই সময় ভারতকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামানাের কোনও সুযােগ ছিল না। কিন্তু, জার্মানির পতনের পরেও ব্রিটেনের নবনির্বাচিত লেবার পার্টির সরকার ভারতের প্রশ্নটিকে প্রয়ােজনীয় গুরুত্ব দেয়নি। ওয়াভেলের ইচ্ছে ছিল, তিনি সেনাবাহিনীর কাজেই থাকবেন কিন্তু দেশের প্রয়ােজনে কিছু দিনের জন্য সে দায়িত্ব ছেড়ে অন্য দায়িত্ব গ্রহণ করতে তাঁর আপত্তি ছিল না। ১৯৪৩ সালের ২৪ জুন লেখা তার ডায়েরির পাতা তঁার তৎকালীন মানসিক দ্বন্দ্ব এবং তাকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন প্রশ্নের প্রমাণ দিচ্ছে:
আমি প্রায় সামরিক দায়িত্বের মতােই ভারতের ভাইসরয়ের পদটি গ্রহণ করেছিলাম। সামরিক ক্ষেত্রে যেমন যুদ্ধের সময় কোনও জায়গায় যাওয়ার আদেশ এলে বিনা প্রশ্নে, নিঃশর্তে সে আদেশ পালন করতে হয়, তেমন ভাবেই। আমার মনে হয়, এই দায়িত্বটিকে সামরিক মানসিকতা নিয়ে না দেখে রাজনৈতিক ভাবে দেখা উচিত ছিল এবং ভারত সংক্রান্ত নীতি আদতে কী হতে চলেছে, সে বিষয়ে ভাবা উচিত ছিল। আমার মনে হয়, দায়িত্ব নেওয়ার সময় আমি নিজস্ব কিছু শর্ত আরােপ করতে পারতাম,
২৯০
কারণ তখন উইনস্টনের এক জন যােগ্য লােকের খুবই প্রয়ােজন ছিল। যাই হােক, এখন আমার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, ততটা আমি অবশ্যই করব, যদিও সামনের পাঁচ বছরের কথা ভেবে আমি রীতিমতাে আতঙ্কিত- সময়টা hard to the mind and soft to the body’। ১৯৪৪ সাল এবং তার সমস্যাগুলি নিয়ে আমি ভাবছি না। খাদ্য, কয়লা বা মূল্যবৃদ্ধির সমস্যার গুরুত্ব কিছু কম নয়। বর্মা ফ্রন্টে যুদ্ধের বিশেষ কিছু অগ্রগতি হবে বলে আমার মনে হয় না। এবং, রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে কোনও পরিবর্তন হবে, তেমন আশাও নেই।[১]
ভাইসরয় পদে বসার জন্য ওয়াভেলের যােগ্যতা সম্বন্ধে পেন্ডেরেল মুন তার বই ওয়াভেল: দ্য ভাইসরয়’স জার্নাল’-এ যথার্থই লিখেছেন, “১৮৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির হাত থেকে ইংল্যান্ডের রানি ভারত শাসনের ভার নিয়ে নেওয়ার পরে ওয়াভেলই একমাত্র সেনাবাহিনীর লােক, যিনি ভারতের ভাইসরয় হয়েছেন; তিনি অভিজাত রাজপুরুষ ছিলেন না, কিন্তু উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান… যে পরিবারগুলি ব্রিটিশ রাজের ভিত্তি… ওয়াভেল এই শ্রেণির শ্রেষ্ঠ চারিত্রিক গুণগুলির প্রতীক ছিলেন… প্রথমেই তার সরকারি কাজের দায়িত্ব সম্বন্ধে গভীর বােধের কথা বলতে হয়; দ্বিতীয়ত তার সােজাসাপটা ভাব এবং সম্পূর্ণ সততা; তার পর, কঠিন কাজ করায় তার দক্ষতা এবং উৎসাহ। কিন্তু এ ছাড়াও তার একটা বিরল গুণ ছিল, যে গুণের কথা জওহরলাল নেহরুর ছােট বােন কৃষ্ণা নেহরু হাতিসিং উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন তিনি (ওয়াভেল) এক জন ভাল ভাইসরয় ছিলেন। বিবেকবান ছিলেন, তার সঙ্গে ‘মানবিক ছিলেন, অন্যের কথা, সমস্যা বুঝতে আগ্রহী ছিলেন… লর্ড ওয়াভেল ভারতে ওয়ারেন হেস্টিংস, মুনরাে, ম্যালকম, স্লিম্যান ও হেনরি লরেন্সের মতাে শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশ শাসকদের ধারা বজায় রেখেছিলেন, যাঁরা মানুষকে সম্মান করতেন…. তিনি মানুষের অনুভূতির প্রতি সহমর্মিতা রাখতেন, তাদের বােঝার চেষ্টা করতেন।” ভারতের ভাইসরয় হিসেবে ওয়াভেলের নিয়ােগ নিতান্তই যুদ্ধকালীন অবস্থার ‘স্টপ গ্যাপ’ ছিল। চার্চিল নিজেই এই কথা বলেছেন। অ্যান্টনি ইডেনের মতাে আর কারও কারও নামও এই প্রসঙ্গে আলােচিত হয়েছিল। তবে, বাস্তবে যা দাড়াল, তাতে ভারতের শেষের আগের ভাইসরয় হিসেবে লর্ড ওয়াভেলের কার্যকাল চার্চিলের ইচ্ছের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হল না, তিনি ‘স্টপ গ্যাপ’ও হলেন না, ‘রাবার স্ট্যাম্প’ও নয়।
ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব ছাড়াও ওয়াভেলের ওপর বেশ কয়েকটা বাড়তি বােঝা চেপেছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় বােঝাটি ছিল, ভারত, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সাধারণ ভাবে ভারতীয়দের সম্বন্ধে চার্চিলের একান্ত বিরাগ। ভারত এবং ভারতীয়দের সম্বন্ধে চার্চিলের অনমনীয় এবং প্রতিকূল মনােভাবের উদাহরণ অসংখ্য, কিন্তু ফিল্ডমার্শাল ওয়াভেলের ভারতের ভাইসরয় হিসেবে কার্যকালের গল্পে ঢােকার আগে চার্চিলের ভারত-বিরাগের দু’একটা গল্প বলে নিলেই যথেষ্ট হবে। আর, সে গল্প সবচয়ে
২৯১
ভাল ফুটে উঠেছে ওয়াভেলের নিজেরই ভাষায়। তার ডায়েরি কী বলছে, শােনা যাক:[২] চার্চিল সত্যিই ভারত এবং ভারত-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়কে ঘৃণা করতেন’[৩] এবং আমেরি যথার্থই লিখেছিলেন, “তৃতীয় জর্জ আমেরিকার উপনিবেশ সম্বন্ধে যতটা জানতেন, ভারত সম্বন্ধে চার্চিলের জ্ঞানের বহরও প্রায় সে রকমই ছিল।” আর এক জায়গায় ওয়াভেল বলেছেন, ভারত সম্বন্ধে চার্চিলের ধারণা এক জন “প্রাচীন ঘােড়সওয়ার হাবিলদারের মতাে আর তার সামরিক চিন্তাভাবনা বুয়র যুদ্ধের সময়কার।” কিন্তু ওয়াভেল ভারত সম্পর্কে তৎকালীন ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার উৎসাহের অভাবের জন্য তৈরি ছিলেন না। “আমি বুঝতে পারলাম, মন্ত্রিসভা ভারতের উন্নতির জন্য মুখে যে কথা বলে, আসলে সে কথাগুলােয় মােটেই বিশ্বাস করে না; এবং মন্ত্রিসভার কারওই প্রায় দূরদৃষ্টি বা রাজনৈতিক সাহস নেই।[৪] ওয়াভেল অনুমান যথার্থ ছিল যে, চার্চিল আসলে ভারতের প্রশ্নে রক্ষণশীল দলের মধ্যে একটি বিভাজনের আশঙ্কা করছিলেন, এবং তেমন বিভাজন হলে ব্রিটেনের রাজনীতিতে যুদ্ধকালীন জোটের এমনই ক্ষতি করত যে চার্চিলের সরকার পড়ে যেতে পারত। তা নিশ্চিত ভাবেই চার্চিলের কাম্য ছিল না । তা ছাড়াও, চার্চিলের ভারতনীতির যারা বিরােধী, তারাও যুদ্ধের সময়টুকুর জন্য তার নীতির বিরােধিতা করা স্থগিত রেখেছিলেন, কারণ তখন যুদ্ধজয়ের প্রশ্নটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার ফলে, দেশের রাজনীতিতে যুদ্ধকালীন ঐক্য বজায় রাখা ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। সব মিলিয়ে ওয়াভেল এমন। একটি সময় ভারতের ভাইসরয় হন, যখন ভারত সম্বন্ধে যে কোনও আলােচনার স্থান ছিল একেবারে পিছনের সারিতে। এই কারণেই, ভারতের দায়িত্ব নেওয়ার পরে প্রথম এক বছরে ওয়াভেল ভারতের পরিকাঠামােগত এবং সংবিধানসংক্রান্ত সমস্যার দিকে। নজরই দিতে পারেননি। কিন্তু যখন তিনি সেই কাজে হাত দিলেন, তখন তিনি কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে কোনও রকম আলােচনা এবং সমঝােতার অসম্ভাব্যতার বিষয়টির ওপর জোর দিলেন। চার্চিল বা তার মন্ত্রিসভা যে কথা বলেননি, ওয়াভেল তা-ই বললেন। তিনি যুদ্ধ-পরবর্তী সময়কে ‘অনুকূল মুহূর্ত হিসেবে দেখলেন। কারণ, তার মতে, “যুদ্ধবন্দিরা মুক্তি পাওয়ার পর, সেনাবাহিনী সরে যাওয়ার পর, অস্ত্র কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার পরের সময়টিই বিক্ষোভ দানা বাঁধার পক্ষে আদর্শ।”[৫]
ওয়াভেল ভারতে “বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামাের ভিতরেই ক্রিপস ঘােষণায় উল্লিখিত একটি অন্তর্বর্তী রাজনৈতিক সরকার (provisional political government) গড়ার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি তার মতামত প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। ওয়াভেল তঁার পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বললেন, তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটি ছােট সমাবেশে ডেকে সর্বসম্মত ভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের চেহারা ঠিক করবেন এবং, গভর্নরের আওতায় থাকা স্থানীয় সরকারগুলিকেও নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ করবেন। চার্চিল বাঁধা গতে উত্তর দেন: “বিষয়টি মাপে এত বড় যে তা নিয়ে মাথা ঘামানাের জন্য অবসর এবং যুদ্ধজয়ােত্তর শান্তির প্রয়ােজন।” ওয়াভেল হাল না ছেড়ে চাপ দিলেন। জোর দিয়ে বললেন, “গত কয়েক বছরে ভারতের প্রশ্নটিকে নিয়ে
২৯২
ভাবার জন্য এত ভাল সময় আর আসেনি।”[৬] এবং তিনি আমেরিকে জানালেন, তাঁর সুপারিশগুলি যদি জরুরি ভিত্তিতে বিবেচিত না হয়, তবে তিনি দেশে ফিরে মুখােমুখি বসে কথা বলার অনুমতি চাইবেন।
১৯৪৪ সালের ১৫ নভেম্বর ভুলাভাই দেশাই ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, ১৯৩৫ সালের সংবিধান অনুসারে জাতীয় সরকার গঠন করা হােক; এবং বর্তমান বিধায়কদের মধ্যে থেকেই সরকারের সদস্যদের বেছে নেওয়া হােক। এই পরামর্শের অবশ্যই দুটি পূর্বশর্ত ছিল: এক, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির কারাবন্দি সদস্যদের মুক্তি দিতে হবে, এবং দুই, গভর্নরের শাসনের অবসান ঘটাতে হবে। ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সহায়ক স্যর জর্জ অ্যাবেলের সঙ্গে পরবর্তী বৈঠকে দেশাই জানান যে এই জোট সরকারের বিষয়ে গাঁধী এবং জিন্না, দু’জনেই সম্মতি জানিয়েছেন। দেশাইয়ের কথা ইতিবাচক এবং আশাব্যঞ্জক মনে হওয়ায় ভাইসরয় ইংল্যান্ডের সরকারকে বিষয়টি জানান। তিনি দেশাইকে তার সঙ্গে মুখােমুখি আলােচনায় বসে প্রস্তাবটি নিয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণও জানান। ওয়াভেল লিখেছেন, “প্রস্তাবটি যেহেতু ভারতীয়দের পক্ষ থেকেই এসেছে, তাই আমার মনে হয়, পরিস্থিতি ইতিবাচক হতে পারে। এক সপ্তাহ বাদে, ১৯৪৫ সালের ২০ জানুয়ারি ওয়াভেল প্রস্তাবটিকে বিশদে বিবেচনা করার জন্য দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। দেশাই এই প্রস্তাবটির পিছনে যে সমর্থনের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তা ওয়াভেলের খুব একটা বিশ্বাসযােগ্য মনে হয়নি। বিষয়টি ভাল করে বােঝাও ওয়াভেলের উদ্দেশ্য ছিল। তবে, ওয়াভেল যে সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট করতে আগ্রহী ছিলেন তা বােঝা যায়, কারণ তিনি লন্ডনে তার করে জানিয়েছিলেন যে সরকার অনুমতি দিলে তিনি এ বিষয়ে জিন্নার সঙ্গে দেখা করতে চান। সরকার রাজি হল, কিন্তু কয়েকটি প্রশ্নও তুলল। সেই প্রশ্নের উত্তরে ওয়াভেল একটি ব্যক্তিগত বার্তায় লিখলেন, “ভারতের সমস্যার সমাধানের জন্য এত ভাল সময় দীর্ঘকালের মধ্যে আসেনি, এবং ভবিষ্যতেও যে আসবে, তার সম্ভাবনা কম। আমার মনে হয়, এখন খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, অথবা ক্রিপস ঘােষণায় ঠিক কী ছিল, তা নিয়ে না ভেবে, এই সময়ের সুযােগটি নেওয়া উচিত।”[৭] সরকার সম্মতি জানাল। কিন্তু জিন্না ব্যস্ত থাকায় দিল্লিতে আসতে পারলেন না। ওয়াভেল বম্বের গভর্নর স্যর জন কোলভিলকে বম্বেতেই জিন্নার সঙ্গে দেখা করে দেশাইয়ের প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা করার দায়িত্ব দিলেন। সেই বৈঠকে জিন্না আশ্চর্য ভাবে দেশাইয়ের সঙ্গে লিয়াকতের আলােচনার বিষয়টিই সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন। ওয়াভেল জিন্নার এই আচরণকে তার মিথ্যাচার ভাবলেন। জিন্না অবশ্য ওই বৈঠকেই জানিয়েছিলেন যে তিনি এই প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে রাজি, এবং মার্চের ৬ তারিখ তিনি যখন দিল্লিতে যাবেন, তখন প্রস্তাবটি নিয়ে কথা বলতেও সম্মত।[৮]
স্থির হল, ৭ মার্চ জিন্না দিল্লিতে ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করবেন। কিন্তু অসুস্থতার জ” জিন্না সে দিনও দেখা করতে পারলেন না। ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই বৈঠকটির গুরুত্ব কতটা ছিল, তা বােঝা যায় ওয়াভেলের কথা থেকে। ইংল্যান্ডের সরকার তাকে
২৯৩
লন্ডনে ডেকে পাঠিয়ে এই বিষয়ে আলােচনা করতে গড়িমসি করায় ওয়াভেল হতাশ হয়ে লেখেন, “দেশাই আর জিন্নার কারণে এই দেরি করার কোনও অর্থ আছে বলে আমার মনে হয় না। যে কারণে আমার দেশে গিয়ে এই আলােচনা করার কথা, সেই কারণটির গুরুত্ব দেশাইয়ের প্রস্তাব আসার অনেক আগেই স্বীকৃত হয়েছিল। আর, দেশাই বা জিন্না কী ভাবছেন, সেটা জানার চেয়ে ব্রিটেনের সরকার ঠিক কী ভাবছে, সেটা জানা আমার কাছে অনেক বেশি জরুরি।”[৯] দেশাইয়ের কাজের ধরন সৈনিক ভাইসরয়ের কাছে রীতিমতাে বিরক্তিকর ছিল, কারণ দেশাই এবং লিয়াকত নিয়মিত ভাবে অ্যাসেম্বলিতে সরকারকে পরাজিত করতেন। ওয়াভেল তার জার্নালে লিখেছেন, “দেশাই এবং লিয়াকত আমাকে এই কথাটি বােঝাতে চেষ্টা করছেন যে আমার উচিত এগজিকিউটিভ কাউন্সিল ভেঙে দিয়ে তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া। আমি খবর পেলাম যে দেশাই ইতিমধ্যেই তার বন্ধুবান্ধবদের মন্ত্রিত্ব দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আমি ঠিক করেছি, দেশ থেকে ঘুরে না আসা পর্যন্ত আর দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করব না।”১০ তার ইংল্যান্ড যাত্রার সরকারি ঘােষণা সম্বন্ধে ওয়াভেল খানিকটা চিন্তিত ছিলেন, কারণ তার মনে হচ্ছিল, এই ঘােষণাটি থেকে মনে হবে, তার ইংল্যান্ড যাত্রার সিদ্ধান্ত হঠাৎই করা হয়েছে, এবং তা-ও দেশাইয়ের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতেই। যাই হােক, ১৯৪৫ সালের ২২ মার্চ ওয়াভেল যখন ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হলেন, তার সঙ্গে তাঁর নিজের পরিকল্পনা এবং দেশাই-লিয়াকত প্রস্তাবের একটি কপি ছিল।
ইতিমধ্যে দুটি প্রদেশে মুসলিম লিগ সরকার তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাল: ১২ মার্চ ১৯৪৫-এ সীমান্তপ্রদেশে সর্দার ঔরঙ্গজেব খানের সরকার, আর ২৮ মার্চ বাংলায় খােজা। স্যর নাজিমুদ্দিনের সরকার। ১৯৩৯ সালের অক্টোবর মাসে কংগ্রেস হাইকমান্ডের যে। নির্দেশ অনুযায়ী তৎকালীন কংগ্রেসি মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেন, সেই আদেশ তখনও প্রত্যাহার করা হয়নি, কিন্তু সীমান্তপ্রদেশে বিকল্প মন্ত্রিসভা গড়ার চেষ্টা করার জন্য খানসাহেবকে বিশেষ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। বাংলায় যেহেতু কয়েক মাস পরেই নির্বাচন ছিল, তাই এই প্রদেশে কোনও সরকার গড়া সম্ভব হয়নি।
ওয়াভেলের ইংল্যান্ড সফরের প্রথম ন’সপ্তাহ ফলপ্রসূ হল না। তার প্রধান কারণ, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ক্রমাগত তাকে এড়িয়ে চলছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভয় ছিল, দেখা হলেই ওয়াভেল ভারতের বিষয়ে এমন সব কথা তুলবেন, যা তার (প্রধানমন্ত্রীর) পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওয়াভেলের চেষ্টার ফল মিলল, তিনি চার্চিলের বিরােধিতার প্রাচীর ভেদ করতে পারলেন। ১৯৪২ সালের অগস্টের পর এই প্রথম ভারতের সাধারণ মানুষের কথা আবার আলােচনার টেবিলে ফিরে এল এবং ভারত প্রসঙ্গে আলােচনা ও সমঝােতার পথ খুলল। কিন্তু, ওয়াভেল ক্রিপস। প্রস্তাবের যে স্বল্পমেয়াদি দিককে আলােচনায় ফিরিয়ে আনতে চাইছিলেন, তাতে সরকারি সিলমােহর পড়ার আগে ওয়াভেলকে আরও অনেকগুলি প্রশ্ন, আপত্তির বাধা পেরােতে হত। তার প্রস্তাব নিয়ে ইংল্যান্ডের সরকারি মহলে যে ঐকমত্য হল, তাকে। খুব বেশি হলে একটা সাময়িক বন্দোবস্ত বলা যেতে পারে।
২৯৪
এই ঐকমত্যের প্রধান কারণ দুটি। এক, ১৯৪৫ সালের জুন মাসে ইংল্যান্ডে যে নির্বাচনী প্রচার আরম্ভ হবে, তার থেকে ভারতের প্রশ্নটিকে দূরে রাখা; আর দুই, ওয়াভেল যে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ, একই সঙ্গে এই দুই পক্ষের সমর্থন জোগাড় করতে পারবেন না, সে বিষয়ে ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার প্রায় নিশ্চিত থাকা। এমনকী, যাঁরা ওয়াভেলের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাঁরাও আশঙ্কা করছিলেন যে প্রস্তাব মেনে এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের কোনও গঠনগত পরিবর্তন হলে তা প্রকতপক্ষে ভারতে ভাইসরয়ের ক্ষমতাকেই দুর্বল করবে এবং ‘অগণতান্ত্রিক, অ-প্রতিনিধিত্বমূলক মুষ্টিমেয় পার্টি-প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হবে। অ্যাটলি বললেন, কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের থেকে কিছু লােককে নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করা হােক, যার থেকে ওয়াভেল তাঁর কাউন্সিল বেছে নেবেন। ক্রিপস, এবং ইন্ডিয়া কমিটির কিছু সদস্যের মত ছিল; যদিও এগজিকিউটিভ কাউন্সিল নতুন ভাবে তৈরি হলে তাতে ভাইসরয়ের ক্ষমতা কমবে, কিন্তু কতটা ক্ষমতা কমবে, তা বিধিবদ্ধ ভাবে স্থির করে দেওয়া যায়। ওয়াভেল এই প্রস্তাবগুলির একটিও গ্রহণ করলেন না। তিনি মন্ত্রিসভার থেকে এই মর্মে অনুমতি আদায় করলেন যে তিনি (ওয়াভেল) তার পছন্দমতাে কাউন্সিল গঠন করতে পারবেন; পরিস্থিতি অনুযায়ী সেই কাউন্সিল ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতাও ওয়াভেলের হাতেই থাকবে।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, এই সময়ই পর পর এমন দুটো ঘটনা ঘটল যে ওয়াভেলের ভারতে ফেরা পিছিয়ে গেল। এক, ১৯৪৫ সালের ১৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মারা গেলেন, যার ফলে পনেরাে দিনের জন্য যাবতীয় কর্মসূচি এলােমেলাে হয়ে গেল। তার পরেই নাৎসি জার্মানি আত্মসমর্পণ করল এবং তার প্রেক্ষিতে ইউরােপে একটির পর একটি ঘটনা ঘটতে আরম্ভ করল। স্বভাবতই, এই প্রশ্নগুলিই তখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেল। এ দিকে, এই বিলম্বের ফলে ভারতে অসন্তোষ এবং অবিশ্বাস তৈরি হল। যদি ভাইসরয়ের বৈঠকের আগেই, মানে এপ্রিলের গােড়ায়, দেশে কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি দেওয়া হত, তা হলে হয়তাে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকত। কিন্তু এখন এই বিষয়ে অনর্থক অনুমান করে লাভ নেই। প্রায় আড়াই মাস পরে ওয়াভেল যখন ভারতে ফিরলেন, তখন সিন্ধপ্রদেশ এবং অসম ছাড়া বাকি সব ক’টি প্রদেশেই মুসলিম লিগের সরকার পড়ে গিয়েছিল। তাতে অবশ্য জিন্নার আত্মবিশ্বাসে টোল পড়ল না; তিনিই যে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের একমাত্র অধিকারী, এই কথাটি জিন্না সৃভূতপূর্ব জোরের সঙ্গে বলতে আরম্ভ করলেন।
২৯৫
প্রথম সিমলা সম্মেলন
ওয়াভেল ৪ জুন ১৯৪৫ ভারতে ফিরে এলেন। তিনি তার কার্যকালের গােড়া থেকে যে ধরনের সম্মেলন আয়ােজন করার কথা ভাবছিলেন, ১৪ জুন রেডিয়ােতে তেমনই একটি সম্মেলনের প্রস্তাব ঘােষণা করলেন। সেই ঘােষণার মূল কথা ছিল: ২৫ জুন ১৯৪৫ সিমলায় একটি সম্মেলন হবে, যে সম্মেলনে ভারতের সব রাজনৈতিক দলের মােট ২১ জন প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। এই সম্মেলনে নতুন এগজিকিউটিভ কাউন্সিলে কে কে থাকবেন, সে বিষয়ে আলােচনা হবে। নতুন এগজিকিউটিভ কাউন্সিলে যুদ্ধদফতরের দায়িত্বে থাকবেন ভারতের ভাইসরয় এবং কমান্ডার-ইন-চিফ। এই দু’জন বাদে কাউন্সিলের সব সদস্যই ভারতীয় হবেন। এত দিন পর্যন্ত বৈদেশিক সম্পর্কের বিষয়টি ভাইসরয় দেখতেন। এ বার থেকে এই দায়িত্বটিও কোনও এক ভারতীয় মন্ত্রীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। এই নতুন কাউন্সিল ভারতের প্রচলিত সংবিধান অনুসারেই কাজ করবে। প্রস্তাব করা হয়েছিল, অন্য সব ডােমিনিয়নে যেমন আছে, তেমনই ভারতেও এক জন ব্রিটিশ হাইকমিশনার নিয়ােগ করা হবে, যিনি ব্রিটেনের বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য স্বার্থ রক্ষা করবেন। লর্ড ওয়াভেল স্পষ্ট ভাষায় জানান যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন কোনও মতেই ভারতের সংবিধানগত বন্দোবস্তের পথে বাধা হবে না। এই নতুন এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের প্রধান দায়িত্বগুলি হবে: এক, জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ; দুই, ভারতের নতুন সংবিধানের রূপরেখা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসন পরিচালনা করা; এবং তিন, প্রক্রিয়াটিকে দ্রুততর করার নির্দিষ্ট পন্থা নির্ধারণ করা।
এক সাংবাদিক যখন গাঁধীর কাছে ভাইসরয়ের বেতার বক্তৃতা এবং সিমলা বৈঠকে তার আমন্ত্রণের বার্তা পৌঁছে দেন, তিনি (গাঁধী) তখন পুণের কাছের এক পার্বত্য শহর পাঁচগনিতে ছিলেন। সাম্প্রতিক অসুস্থতা থেকে তিনি তখনও সম্পূর্ণ সেরে ওঠেননি। গাঁধী তৎক্ষণাৎ ভাইসরয়কে টেলিগ্রাম করে জানান যে তিনি কোনও প্রতিষ্ঠানেরই প্রতিনিধিত্ব করেন না। এমনকী, ১৯৩৪ সালের পর থেকে তিনি কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য পদেও নেই। ভাইসরয় গাঁধীর যুক্তি মেনে নিয়ে কংগ্রেসের সভাপতির কাছে আমন্ত্রণবার্তা পাঠান। গাঁধী অবশ্য সিমলায় গিয়ে ভাইসরয়ের সঙ্গে দেখা করতে সম্মত হন এবং জানান, ভাইসরয় যত দিন চাইবেন, তিনি তত দিন সিমলায় থাকবেন।
ভাইসরয় তার বেতার ভাষণে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি এক বারও উচ্চারণ করেননি। কেবল তাই নয়, নতুন জাতীয় সরকারের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে তুলে আনেন একটি নতুন ধারণা: ‘বর্ণহিন্দু-মুসলমান সমতা’ (Caste-Hindu-Muslim Parity)। এই প্রসঙ্গে ভাইসরয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গাঁধী লেখেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমি কখনও এই ধারণার (বর্ণহিন্দু-মুসলমান সমতা) শরিক হতে পারব না। যদি আমি কংগ্রেসের মানসিকতা ঠিক ভাবে বুঝে থাকি, তা হলে কংগ্রেসও পারবে না। কংগ্রেসের সদস্যপদে হিন্দুদের প্রবল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও দলটি চির কালই বিশুদ্ধ ভাবে রাজনৈতিক
২৯৬
ছিল। আমি কংগ্রেসকে এই পরামর্শ দিতেই পারি যে তারা যেন সব অ-হিন্দু এবং অবশ্যই অ-বর্ণহিন্দু প্রার্থীকে মনােনীত করে।” গাঁধী আরও বলেন, “কংগ্রেস কখনও নিজের পরিচয়কে বর্ণহিন্দু বা অ-বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে মিশিয়ে দেয়নি, এবং কখনও তা করতেও পারে না, এমনকী স্বাধীনতা অর্জনের জন্যও নয়। কারণ, তা হবে একপেশে, অসত্য এবং আত্মঘাতী।” ভাইসরয় গাঁধীকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে সম্মেলনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা মানেই কোনও কিছু স্বীকার করে নেওয়া নয়। সম্মেলনের প্রতিনিধিরা অবশ্যই প্রস্তাবের ভাল-মন্দ নানা দিক আলােচনা করে, বিশ্লেষণ করে দেখবেন এবং প্রস্তাবটি গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের স্বাধীনতাও তাদের থাকবে। ভাইসরয়ের এই ব্যাখ্যার পরে কংগ্রেসের আর এই সমাবেশে যােগ দেওয়ায় কোনও সমস্যা থাকল না।
কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা বম্বেতে বৈঠকে বসলেন। প্রায় তিন বছর পরে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের বৈঠক হল। সিমলা সম্মেলনে আমন্ত্রিত কংগ্রেসের নয় জন প্রতিনিধির জন্য এই বৈঠকে ‘ইনমেন্ট অব ইনস্ট্রাকশন’ বা নির্দেশিকা নির্ধারিত হল। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এই কথাটিও আলােচনা হল যে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং কংগ্রেসের অন্যান্য কমিটিগুলি এখনও নিষিদ্ধ এবং সেই নিষেধাজ্ঞা “একটি বাধা এবং তা অবশ্যই গা-জোয়ারি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।” কংগ্রেস আরও বলল, “যে অসংখ্য কংগ্রেস কর্মী কারাবন্দি হয়ে আছেন, তারা এই সম্মেলনের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাড়াবেন। বেশির ভাগ কংগ্রেস নেতাই অত্যন্ত ভগ্নস্বাস্থ্যে জেল থেকে বেরিয়েছিলেন। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠককে এক ‘অসুস্থদের মিছিল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যাই হােক, ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত করল, ‘দল হিসেবে’ কংগ্রেসের এই সম্মেলনে যােগ দেওয়া উচিত। দলের যে প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যােগ দেবেন, ওয়ার্কিং কমিটি তাদের মনে করিয়ে দিল যে “দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিত্রশক্তির জয়ের অর্থ, ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সব উপনিবেশের মুক্তি, তা সে শাসক ব্রিটিশ হােক বা অন্য কেউ… ভারতের সম্পদ ব্যবহার করে অন্য কোনও দেশকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হবে না- এই কথাটি যেন সম্মেলনে স্বীকৃত হয়।
সম্মেলনে যােগ দিতে বম্বে থেকে সিমলা পর্যন্ত যাওয়ার ১১০০ মাইল পথে বিভিন্ন স্টেশনে অগণিত মানুষ কংগ্রেস নেতাদের দেখতে এলেন, তাদের উৎসাহ দিলেন। কংগ্রেসের এই নেতারা ৩৪ মাস পরে জেল থেকে মুক্তি পেলেন বলে তাদের স্বাগত জানাতেও জনতার ঢল নামল।
উষ্ণ দেশ ভারতে জুন উষ্ণতম মাস। ভাইসরয় ওয়াভেল গাঁধী এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতাদের জন্য এয়ার কুলার লাগানাে (তখনও এয়ার কন্ডিশনিং চালু হয়নি) কামরার ব্যবস্থা করার আদেশ দেন। গাঁধী অবশ্য এই সুবিধা নিতে অস্বীকার করেন।
ইউনাইটেড প্রেস অব আমেরিকার সাংবাদিক প্রেস্টন গ্রোভার গাঁধীর সঙ্গে একই ট্রেনে যাচ্ছিলেন। গাঁধীর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হয়ে গ্রোভার তাকে একটি চিরকুটে লিখে পাঠান, “এই দুপুরবেলাটুকু কংগ্রেসের এয়ার-কুলার লাগানাে কামরায় গিয়ে একটু
২৯৭
শুয়ে নিলে ভাল হত না? আপনি তাে গত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমােননি। পথে না ঘুমিয়ে ক্লান্ত অবস্থায় সিমলায় পৌছলে অসুবিধা হবে। আমেরিকায় আমরা বলে থাকি: গিভ ইয়ােরসেল্ফ আ ব্রেক।”
উত্তরে গাঁধী লিখে পাঠালেন, “আমার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু, এই প্রাকৃতিক গরমে আমি নিজেকে গলিয়ে নিতে চাই। এই গরমের পর তাে নিশ্চিত ভাবেই সিমলার শীতলতা আমায় অভ্যর্থনা জানাবে। আমি প্রকৃত ভারতের এই স্পর্শটুকু পেতে চাই।”
সিমলায় পৌছে দ্রুত স্নান, খাওয়া সেরে গাঁধী সরাসরি ভাইসরয়ের লজে পৌছলেন, ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করতে। ওয়াভেল জানালেন, তিনি চান যে গাঁধী সিমলা সম্মেলনে উপস্থিত থাকুন; কিন্তু গাঁধী রাজি হলেন না। গাঁধী তার নিজের অবস্থানে অনড় থাকলেন যে বর্তমান সম্মেলনের মতাে কোনও প্রতিনিধিত্বমূলক সম্মেলনে, প্রতিনিধি না হলে কোনও ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিত থাকা উচিত নয়, তা তিনি যতই গুরুত্বপূর্ণ হােন না কেন। গাঁধী জানালেন, তার পরামর্শের প্রয়ােজন হলে যত দিন সম্মেলন চলবে, তিনি তত দিন সিমলায় উপস্থিত থাকবেন, এমনকী অতিথি হিসেবে সম্মেলনেও উপস্থিত থাকতে পারেন। ভাইসরয় জানালেন, তিনি চান যে গাঁধী সিমলায় থাকুন। গাঁধী রাজি হলেন। পরে দেখা গেল, সম্মেলনে গাঁধীর অনুপস্থিতিতে জিন্না ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁর মতে, গাঁধী নিজেকে এই সম্মেলন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। প্রেস্টন। গ্রোভারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাঁধী বলেন, “জিন্না যদি আমাকে সম্মেলনে চান, তবে তিনি এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারেন। তেমনটা ঘটলে এই বার্তাই পৌছবে যে যাবতীয় বিরােধ এবং বাধা সত্ত্বেও তিনি সত্যিই একটি সমাধানসূত্র চান।”
লর্ড ওয়াভেল ভাল ভাবেই সম্মেলনের সূচনা করলেন। তিনি যথেষ্ট সাবধানে, বিচক্ষণতার সঙ্গে সম্মেলনের মূল কথাগুলি উপস্থাপিত করলেন। আমি আমার বেতার বিবৃতিতে বলেছিলাম যে প্রত্যেক পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড়তে হবে… এখনকার জন্য আমার নেতৃত্ব আপনাদের মেনে নিতে হবে… আমি এই দেশের স্বার্থের পক্ষে যা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, আমি এই সম্মেলনকে সে উদ্দেশ্যেই পরিচালনা করার চেষ্টা করব।” ওয়াভেলের বক্তব্যের এই অংশটিকে উদ্ধৃত করে গাঁধী বলেন, “ওয়াভেলের প্রকাশভঙ্গি সুন্দর এবং সম্মানজনক। এবং, তার মাধ্যমেই তিনি নিজেকে এই সম্মেলনের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন, হােয়াইট হলের প্রতিনিধি হিসেবে নয়।”
যে বিতর্কিত প্রশ্নগুলি এই সম্মেলনকে ভেস্তে দিতে পারে, তেমন কোনও বিষয়। ওঠার উপক্রম হলেই ভাইসরয় প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যেতে থাকলেন। জিন্না যখন তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কংগ্রেসকে একটি হিন্দু সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে আক্রমণ করলেন, ওয়াভেল এই কথাটি স্পষ্ট করে দিতে চাইলেন যে তিনি কখনও কংগ্রেসকে হিন্দু সংগঠন বলেননি, বা বলার চেষ্টা করেননি। সেই সংলাপের একটি অংশ:
ভাইসরয়: আমার প্রস্তাবে কোথাও এমন কোনও কথা নেই যা কংগ্রেসকে
২৯৮
শুয়ে নিলে ভাল হত না? আপনি তাে গত চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমােননি। পথে না ঘুমিয়ে ক্লান্ত অবস্থায় সিমলায় পৌছলে অসুবিধা হবে। আমেরিকায় আমরা বলে থাকি: গিভ ইয়ােরসেল্ফ আ ব্রেক।”
উত্তরে গাঁধী লিখে পাঠালেন, “আমার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু, এই প্রাকৃতিক গরমে আমি নিজেকে গলিয়ে নিতে চাই। এই গরমের পর তাে নিশ্চিত ভাবেই সিমলার শীতলতা আমায় অভ্যর্থনা জানাবে। আমি প্রকৃত ভারতের এই স্পর্শটুকু পেতে চাই।”
সিমলায় পৌছে দ্রুত স্নান, খাওয়া সেরে গাঁধী সরাসরি ভাইসরয়ের লজে পৌছলেন, ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করতে। ওয়াভেল জানালেন, তিনি চান যে গাঁধী সিমলা সম্মেলনে উপস্থিত থাকুন; কিন্তু গাঁধী রাজি হলেন না। গাঁধী তার নিজের অবস্থানে অনড় থাকলেন যে বর্তমান সম্মেলনের মতাে কোনও প্রতিনিধিত্বমূলক সম্মেলনে, প্রতিনিধি না হলে কোনও ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিত থাকা উচিত নয়, তা তিনি যতই গুরুত্বপূর্ণ হােন না কেন। গাঁধী জানালেন, তার পরামর্শের প্রয়ােজন হলে যত দিন সম্মেলন চলবে, তিনি তত দিন সিমলায় উপস্থিত থাকবেন, এমনকী অতিথি হিসেবে সম্মেলনেও উপস্থিত থাকতে পারেন। ভাইসরয় জানালেন, তিনি চান যে গাঁধী সিমলায় থাকুন। গাঁধী রাজি হলেন। পরে দেখা গেল, সম্মেলনে গাঁধীর অনুপস্থিতিতে জিন্না ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাঁর মতে, গাঁধী নিজেকে এই সম্মেলন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। প্রেস্টন। গ্রোভারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাঁধী বলেন, “জিন্না যদি আমাকে সম্মেলনে চান, তবে তিনি এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারেন। তেমনটা ঘটলে এই বার্তাই পৌছবে যে যাবতীয় বিরােধ এবং বাধা সত্ত্বেও তিনি সত্যিই একটি সমাধানসূত্র চান।”
লর্ড ওয়াভেল ভাল ভাবেই সম্মেলনের সূচনা করলেন। তিনি যথেষ্ট সাবধানে, বিচক্ষণতার সঙ্গে সম্মেলনের মূল কথাগুলি উপস্থাপিত করলেন। আমি আমার বেতার বিবৃতিতে বলেছিলাম যে প্রত্যেক পক্ষকেই কিছু না কিছু ছাড়তে হবে… এখনকার জন্য আমার নেতৃত্ব আপনাদের মেনে নিতে হবে… আমি এই দেশের স্বার্থের পক্ষে যা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, আমি এই সম্মেলনকে সে উদ্দেশ্যেই পরিচালনা করার চেষ্টা করব।” ওয়াভেলের বক্তব্যের এই অংশটিকে উদ্ধৃত করে গাঁধী বলেন, “ওয়াভেলের প্রকাশভঙ্গি সুন্দর এবং সম্মানজনক। এবং, তার মাধ্যমেই তিনি নিজেকে এই সম্মেলনের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন, হােয়াইট হলের প্রতিনিধি হিসেবে নয়।”
যে বিতর্কিত প্রশ্নগুলি এই সম্মেলনকে ভেস্তে দিতে পারে, তেমন কোনও বিষয়। ওঠার উপক্রম হলেই ভাইসরয় প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যেতে থাকলেন। জিন্না যখন তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে কংগ্রেসকে একটি হিন্দু সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে আক্রমণ করলেন, ওয়াভেল এই কথাটি স্পষ্ট করে দিতে চাইলেন যে তিনি কখনও কংগ্রেসকে হিন্দু সংগঠন বলেননি, বা বলার চেষ্টা করেননি। সেই সংলাপের একটি অংশ:
ভাইসরয়: আমার প্রস্তাবে কোথাও এমন কোনও কথা নেই যা কংগ্রেসকে
২৯৯
রকম সাম্প্রদায়িক বিভাজন থাকবে না। ফলে, মুসলিম মিগ যদি ‘হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন’ নিয়ে ধুয়াে তুলতে চায়, তা হলে সেই প্রচেষ্টা পালে হাওয়া পাবে না।
প্রস্তাবটিতে গাঁধীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একেবারে স্পষ্ট। প্রথম বার শুনলে নিতান্ত অবাস্তব, অসম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু, খতিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়, গাধী তার বিচক্ষণতার। পরিচয় দিয়ে ঠিক বিতর্কিত অংশটিকে এড়িয়ে গিয়েছেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি গাঁধীর যুক্তি মানতে সম্মত হল না। ব্যক্তিগত ভাবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বেশ কিছু সদস্য এবং কয়েক জন কংগ্রেস নেতা গাঁধীর প্রস্তাবের সঙ্গে একমত ছিলেন। কোনও এক প্রদেশের এক প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, “গাঁধীর বক্তব্য যথাযথ। কিন্তু, বর্ণহিন্দুদের জন্য সমতার তুলনায় কম প্রতিনিধিত্ব মেনে নিলে নির্বাচকমণ্ডলীর সামনে দাড়াব কী করে?”
২৯ জুন সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে ওয়াভেল জানালেন, যে হেতু সম্মেলনে উপস্থিত দলগুলি সরকারের গঠন এবং সদস্যসংখ্যা সম্বন্ধে কোনও ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি, তাই তিনি সরকার গঠনের দায়িত্বটি তার দফতরের ওপরেই ন্যস্ত করবেন। তিনি সম্মেলনে উপস্থিত সব দলের প্রতিনিধিদের জাতীয় সরকারে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের নামের তালিকা পাঠাতে অনুরােধ করেন। তিনি নিজে সেই তালিকায় কয়েকটি নাম | যােগ করবেন, এবং তার পর বিচার বিবেচনা করে, সব দলের সঙ্গে আলােচনা করে, একটি সর্বজনগ্রাহ্য তালিকা তৈরির চেষ্টা করবেন।
এই প্রস্তাবে জিন্না সম্মত হলেন না। তিনি জানতে চাইলেন, মুসলিম লিগ তার পছন্দের প্রার্থীদের নামের তালিকা পাঠালে ভাইসরয় কি সেই তালিকার সবাইকেই প্রার্থী হিসেবে মেনে নেবেন? ভাইসরয় জানালেন, তিনি এখনই তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি নন। চূড়ান্ত প্রার্থীতালিকা তৈরি করার অধিকার তার। কিন্তু, সম্মেলনে উপস্থিত দলীয় প্রতিনিধিদের সেই তালিকা দেখে তাকে মেনে নেওয়ার বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার থাকছেই। জিন্না ফের জানতে চাইলেন, কোনও একটি দল যদি তার তৈরি তালিকাকে প্রত্যাখ্যান করে, তবুও কি তিনি সেই তালিকা বজায় রাখবেন? উত্তরে ভাইসরয় জানান, কোন পরিস্থিতিতে তিনি কী করবেন, তা আগেভাগে জানানাে তার পক্ষে সম্ভব নয়। এর পর ভাইসরয় জিন্নাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন যে তিনি কি আদৌ তার তালিকা দিতে ইচ্ছুক? উত্তরে জিন্না জানান, তিনি এই সম্মেলনে ব্যক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। তালিকা তৈরি করার জন্য তার ভাইসরয়ের বক্তব্যটি লিখিত রূপে প্রয়ােজন। সেই লিখিত বক্তব্য তিনি ওয়ার্কিং কমিটির হাতে তুলে দেওয়ার পরেই তার পক্ষে তালিকার বিষয়ে চড়ান্ত ভাবে জানানাে সম্ভব হবে। ডিনাকে জানা যে তিনি ভাইসরয়ের বক্তব্যটি লিখিত আকারেই পাবেন।
তার পর সম্মেলন পনেরাে দিনের জন্য স্থগিত রাখা হল।
এই পনেরাে দিনের মধ্যে মুসলিম লিগ ছাড়া আর সব দল ভাইসরয়ের কাছে তাদের মনােনীত প্রার্থীতালিকা জমা দিল। ইউরােপিয়ান গ্রুপ আলাদা করে কোনও তালিকা না। দেওয়ার সিদ্ধান্ত করল। কংগ্রেস পনেরাে জনের তালিকা জমা দিল। তাদের যুক্তি ছিল, যত
৩০০
বেশি সংখ্যক সম্ভব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের জায়গা করে দেওয়ার জন্য ভাইসরয় এবং কম্যান্ডার-ইন-চিফ বাদে কাউন্সিলের মােট সদস্যসংখ্যা পনেরাে হওয়া উচিত।
অন্য দিকে, নামের তালিকা জমা দেওয়ার প্রসঙ্গে জিন্না লর্ড ওয়াভেলকে লিখলেন, “আপনি যে নামের তালিকা জমা দেওয়ার কথা বলেছেন, সেই প্রসঙ্গে জানাই… মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটি মনে করিয়ে দিতে চায় যে আপনার পূর্বসূরি লর্ড লিনলিথগাে যখন এ রকমই একটি প্রস্তাব করেছিলেন, মুসলিম লিগ তখন সেই প্রস্তাবের বিরে করেছিল। সেই বিরােধিতার কথা জানতে পেরে লর্ড লিনলিথগাে তার প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন এবং ভিন্নতর বিকল্পের কথা বলেন।” লর্ড লিনলিথগাে জিন্নাকে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪০ তারিখে যে চিঠি লেখেন, তাতেই এই উল্লিখিত বিকল্প প্রস্তাবটি ছিল। “আমি মনে করি, প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টি গভর্নর জেনারেলের উপরই নির্ভর করবে। তবে, মুসলিম লিগের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত প্রতিনিধিদের নামের তালিকা জমা না করে আমার (ভাইসরয়) সঙ্গে মুসলিম লিগের নেতার গােপন আলােচনার ভিত্তিকেই সেই দলের প্রতিনিধিদের নাম স্থির করা হবে।” জিন্না ভাইসরয়কে লেখেন, “ওয়ার্কিং কমিটি এই মত পােষণ করে যে… মুসলিম লিগের ক্ষেত্রে গত বার যে নিয়ম মানা হয়েছিল, এ বারও তা-ই মানা হােক।”
ওয়াভেল জিন্নার এই মতটি মানতে রাজি হলেন না। জিন্না তার উত্তরে লিখলেন, “কমিটির ইচ্ছানুসারে আমি আপনাকে জানাচ্ছি যে প্রস্তাবিত এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সমস্ত মুসলমান সদস্যকে মুসলিম লিগ থেকেই নির্বাচন করা হবে, আপনি এমন প্রতিশ্রুতি দিতে না পারায় কমিটি আশাহত হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে এ কথা জানাচ্ছি। যে এই পরিস্থিতিতে এগজিকিউটিভ কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্তির জন্য কোনও নাম পাঠানাে আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
১৪ জুলাই সম্মেলনের শেষ বৈঠকে ভাইসরয় জানান যে মুসলিম লিগ নামের তালিকা নং পাঠালেও তিনি এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের জন্য একটি খসড়া তালিকা তৈরি করেছেন। তার ধারণা, সেই তালিকাটি সকলের কাছেই গ্রহণযােগ্য হবে। কিন্তু, তালিকায় তিনি যে মুসলমান সদস্যদের নাম রেখেছিলেন, জিন্না সেই প্রার্থীদের মেনে নিতে অস্বীকার করলেন। তবে, ভাইসরয়কে অনুরােধ করা হলেও তিনি তার তৈরি তালিকাটি কংগ্রেস সভাপতি বা অন্য কোনও নেতাকে দেখাতে রাজি হলেন না। তিনি তার তালিকাটি সম্মেলনেও প্রকাশ করলেন না। শুধু ঘােষণা করলেন যে সম্মেলনটি তার লক্ষ্যে পৌছতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায় তঁার।
গাঁধী ভাইসরয়কে লিখলেন, “আমার ভাবতে খারাপ লাগছে, যে বৈঠকটি এত ভাল ভাবে, এত আশা জাগিয়ে আরম্ভ হয়েছিল, সেই বৈঠকটিও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হল। এবং, ব্যর্থ হল সেই পুরনাে কারণগুলাের জন্যই। এই ব্যর্থতার দায় আপনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন বটে, কিন্তু গােটা বিশ্ব বিষয়টিকে অন্য ভাবে দেখছে। ভারতীয়রা তাে বটেই।” বৈঠকের ব্যর্থতার কারণ কী, সে বিষয়ে গাঁধী আরও লিখলেন, “আমার সন্দেহ, এই ব্যর্থতার আসল কারণ হল, এখন যাঁদের হাতে ক্ষমতা, তারা সেই ক্ষমতা
৩০১
ছাড়তে অনিচ্ছুক, কারণ এত দিন যাঁরা তাদের বন্দি ছিলেন, ক্ষমতা এ বার তাঁদের হাতেই তুলে দিতে হবে।”
ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে যে জটিলতাগুলি ছিল, তা সমাধান করার প্রক্রিয়াটি যে এ ভাবে ব্যর্থ হল, তা সত্যিই দুঃখের। এবং, ব্যর্থতার কারণগুলাে পুরনাে। বর্তমান ক্ষেত্রে ভারতবাসী ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে ব্রিটিশ প্রস্তাব মেনে নিতে যতখানি খােলা মনে তৈরি ছিলেন, তেমনটা আগে কখনও হয়নি। ভাইসরয়ের আগের ঘােষণাগুলি থেকে দেশবাসীর ধারণা হয়েছিল, সত্যিই বােধ হয় নতুন কিছুর সুচনা হবে। দেশবাসীর মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগল, যদি যে কোনও ভাবে অগ্রসর হওয়ার জন্য কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের যৌথ সম্মতি সেই একটি জরুরি শর্ত হয়ে দাড়ায়, যদি মুসলিম লিগ সহযােগিতা না করলে ভাইসরয় তার প্রস্তাবটি নিয়ে আর না এগােন, তবে এই সর্বদলীয় সম্মেলনটি ডাকার কী অর্থ হয় ? তা হলে তাে শুধু কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের সভাপতিদের ডেকে গােপন বৈঠকে ফয়সলা করে নিলেই হয়ে যেত; তাতে অন্তত বাকি দলগুলির নেতাদের মৃত সৈনিকের ভূমিকায় অভিনয় করার বিড়ম্বনা সহ্য করতে হত না।
জিন্না একটি বিবৃতি দিয়ে ওয়াভেলের প্রস্তাবটিকে মুসলিম লিগের জন্য একটি ফঁদ’ ও ‘মৃত্যুর পরােয়ানা’ হিসেবে বর্ণনা করলেন। কারণ, তার মতে, যদি সরকারে অন্তর্ভুক্ত সব মুসলমান প্রার্থীই মুসলিম লিগের সদস্য হন, তবুও লিগ মন্ত্রিসভার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ আসন দখল করতে পারবে। জিন্না বললেন, সরকারে “সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাই… অবধারিত ভাবে… আমাদের বিরুদ্ধে ভােট দেবেন।” এর আগে জিন্না বলতেন, মুসলিম লিগ ভারতের সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, আর কংগ্রেস যে শুধু হিন্দুদের সংগঠন, তা-ই নয়, একেবারে বর্ণহিন্দুদের সংগঠন। আর এখন জিন্না বললেন, “ভারতের সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, যেমন তফশিলি জাতি, শিখ বা খ্রিস্টান ইত্যাদির উদ্দেশ্য কংগ্রেসের সঙ্গে অভিন্ন… তাদের লক্ষ্য এবং আদর্শ হল এক সংযুক্ত ভারত। জাতিগত এবং সংস্কৃতিগত ভাবে তারা হিন্দু সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। জিন্নার এই দু’টি বক্তব্য যে একই সঙ্গে সত্যি হতে পারে না, তা স্পষ্ট। কিন্তু এ কথাটি স্পষ্ট নয় যে ওয়াভেল যদি মন্ত্রিসভার সব মুসলিম সদস্যকে মুসলিম লিগ থেকে নির্বাচন করার দাবিটি মেনেও নিতেন, তবুও তার প্রস্তাবটি লিগের কাছে ‘ফঁদ’ অথবা ‘মৃত্যুর পরােয়ানা ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারত।
সিমলা সম্মেলনে কায়েদ-এ আজমের মনােভাবের গভীর বিশ্লেষণ করে ড. জয়াকর গাঁধীকে এক চিঠিতে লেখেন: “জিন্না তার যে ভাষণে ওয়াভেলের প্রস্তাবকে লিগের জন্য একটি ফঁদ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, সেটি পড়তে পড়তে আমার কাছে স্পষ্ট যে তার আশঙ্কা ছিল, তিনি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাটি যদি মেনে নেন… তা হলে, যে তিক্ততা এবং বিদ্বেষের ভিত্তিতে পাকিস্তান গড়ে ওঠার এবং টিকে থাকার কথা, রােজ এক সঙ্গে কাজ করতে হলে যে মসৃণ আদানপ্রদানের পরিবেশ তৈরি হয়, তাতে এই বিদ্বেষ ক্রমশ ফিকে হয়ে যাবে এবং মুসলমানরা বুঝতে পারবেন, এই বিদ্বেষের কোনও বাস্তব
৩০২
ভিত্তি নেই— তা কেবলমাত্র সন্দেহের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ফলে, পৃথক পাকিস্তানের দাবিটিও তার জোর হারাবে…। জিন্না ওয়াভেলের প্রস্তাবে সম্মতি জানানাের জন্য দুটি পূর্বশর্ত দেন, এবং জানতেন, এই দুটি শর্ত পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। শর্তগুলি হল: এক, পাকিস্তানের বিষয়ে আশ্বাস এবং দুই, ভারতে অন্য সব গােষ্ঠীর সঙ্গে মুসলমান ভােটের সমতা। বর্ণহিন্দু-মুসলমান সমতার যে দাবি জিন্না তুলেছিলেন, তা স্বীকৃত হওয়ার পর নিজের স্বভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি তার দাবির পরিধি বিস্তৃত করলেন— এ বার তিনি ভারতের অন্য সব জনগােষ্ঠীর সঙ্গে মুসলমানদের সমতা দাবি করলেন, অর্থাৎ মুসলমানদের জন্য ৫০ শতাংশ আর অবশিষ্ট ভারতের জন্য বাকি ৫০ শতাংশ। অঙ্কের এক অসামান্য ভুল— সাতাশকে তিয়াত্তরের সমান বলে দাবি করা! জিন্না স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ব্যস্ত নন এবং এই স্বাধীনতার জন্য তিনি এমন চড়া মূল্য দাবি করছেন যাতে স্বাধীনতাই শেষ পর্যন্ত প্রায় মূল্যহীন হয়ে পড়ে।”
সিমলা সম্মেলনের একটাই ফল হল: বর্ণহিন্দু-মুসলমান সমতার সূত্রটি ভারতের বাস্তব রাজনীতির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল এবং ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের নীতিটির পােশাকি মুখ তৈরি হল। দুঃখজনক ভাবে, ঘটনাটি ঘটল একেবারে স্বাধীনতার দোরগােড়ায় পৌঁছে। এই সম্মেলনের সময় একটি রচনা তৈরি করা হল, যা পরবর্তী কালের ক্যাবিনেট মিশনের আলােচনার সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হয়ে উঠল, কারণ এই রচনায় যা লেখা হয়েছিল এবং ক্যাবিনেট মিশনের সময় ইংরেজ প্রশাসন যে অবস্থান নিয়েছিল, দুইয়ের মধ্যে একটি অনিশ্চিত মধ্যস্তরের ব্যবধান ছিল।
গাঁধীর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর ফ্রান্সিস সেয়ার মন্তব্য করেন, “আপনি নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। যে অচলাবস্থা কাটাতে ওয়াভেলের প্রচেষ্টাটি অন্তত সৎ ছিল।” গাঁধী মন্তব্য করেন, “একটা সৎ প্রচেষ্টা তাে সৎ ভাবেই শেষ হওয়া উচিত ছিল।”
২৯ জুন যখন সিমলা সম্মেলন পনেরাে দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়, আর ১৪ জুলাই যখন ফের সম্মেলন আরম্ভ হয়, এর মধ্যবর্তী পক্ষকাল সময়ে ঠিক কী ঘটেছিল? কেন ১৪ জুলাইয়ের সম্মেলনে ওয়াভেল বলেন যে তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে? পনেরাে দিন পরে পণ্ডিত নেহরু লন্ডন থেকে একটি চিঠি পেলেন। সেই চিঠিতে লেখা হয়েছিল, “এটা এখন জানা গিয়েছে যে ওয়াভেলের প্রচেষ্টা আসলে ভারতে নির্বাচনের একটি প্রয়ােজনীয় অংশ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছিল। আর, জিন্নাকে বাদ দিয়ে সরকার গড়ার অবধারিত বিকল্পটিকে না বেছে বৈঠক ব্যর্থ ঘােষণা করার সিদ্ধান্তটি ওয়াভেল লন্ডনের নির্দেশে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমেরি একেবারে শেষ সময়ে ওয়াভেলকে তার করেন, এবং যেহেতু মুসলিম লিগ নতুন এগজিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে কোনও রকম সহযােগিতা করছে না, তাই আমেরি ওয়াভেলকে বিষয়টি নিয়ে আর এগােতে বারণ করেন। অনুমান করা যায়, আমেরি ওয়াভেলকে বলেছিলেন যে যেহেতু ২৫ জুলাই ব্রিটেনে পার্লামেন্টের নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবে, তাই এই সময় চার্চিল,
৩০৩
আমেরিকা বা ব্রিটিশ প্রশাসনের পক্ষে ওয়াভেলকে কোনও নির্দিষ্ট পরামর্শ বা নির্দেশ দেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে, ভারতে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হােক। আমেরির সিদ্ধান্তটি যুক্তিসঙ্গতই ছিল। এই সিদ্ধান্ত সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতা নিশ্চিত করে দেয়, কারণ লন্ডন থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশ না পেলে ভাইসরয়ের পক্ষে একা কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কার্যত অসম্ভব ছিল।
কিন্তু, এ ছাড়াও সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতার আরও কারণ ছিল। এবং, সেই কারণ অনেক বেশি মৌলিক। ক্রিপস মিশন-পরবর্তী পর্যায়ে ভারতীয় রাজনীতিতে যে পরিবর্তন হয়েছিল, সেই পরিবর্তনগুলি সিমলা বৈঠকের ব্যর্থতার পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। বক্তব্যের ইতিবাচকতা এবং সময়, দু’দিক থেকেই ওয়াভেলের প্রস্তাবটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাবেও জিন্নার বিরােধিতা ক্রিপস-মিশন পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের স্পষ্ট প্রমাণ। ক্রিপস মিশনে যে হিন্দ এবং মুসলমানের সমান প্রতিনিধিত্বের কথা বলা হয়েছিল, তা ভারতীয় রাজনীতিতে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অপ্রত্যাশিত চেহারা নেয়। এই বক্তব্যটি কার্যত জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বকে এক ধরনের বৈধতা দেয়। এবং, এখান থেকেই জিন্নার এই দাবিটি তৈরি হয় যে, নতুন এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের সব মুসলমান সদস্যকেই মুসলিম লিগ থেকে বেছে নেওয়া উচিত, কারণ মুসলিম লিগ একাই এই ‘ভারতীয় মুসলমান জাতি’র প্রতিনিধিত্ব করে। এই দাবিটি নিশ্চিত ভাবেই অতিরঞ্জিত। এবং, এই দাবিটি ভারতীয় রাজনীতির মঞ্চের উপর এক অসম্ভব চাপ তৈরি করে, এবং কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থানকে ক্ষুদ্রায়িত করে। অন্য সব দাবি মেনে নেওয়ার পরে জিন্নাকে কেন কংগ্রেসের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়ে ভেটো প্রয়ােগ করার অধিকার দেওয়া হবে? এই কারণেই পঞ্জাবের গভর্নর স্যর বার্ট্রান্ড গ্ল্যান্সি জিন্নার দাবিকে ‘হাস্যকর’ বলে বর্ণনা করেছেন, কারণ তখন শুধু সিন্ধু । এবং অসম প্রদেশেই (তাও এক দুর্বল জোটের ভিত্তিতে) লিগের সরকার টিকে ছিল।
অন্য দিকে, পঞ্জাবের ক্ষমতায় থাকা ইউনিয়নবাদীরাও একই রকম সংশয়ে ভুগছিলেন। তাদের প্রশ্ন ছিল কংগ্রেসই বা হঠাৎ কী ভাবে এমন রাজনৈতিক মাহাত্ম্য অর্জন করতে পারে? মুসলিম লিগ যতটা জোরের সঙ্গে দেশের সব মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করে, কংগ্রেসও তত জোরেই সব ভারতীয়র প্রতিনিধিত্বের দাবি করে। জিন্নার দাবিটি, নিশ্চিত ভাবেই ধােপে টেকার মতাে ছিল না, এবং তা ক্রমাগত প্রশ্ন এবং বিরােধের সম্মুখীনও হয়েছে। কিন্তু, কংগ্রেসের সব ভারতীয়ের প্রতিনিধিত্বের দাবিটিও ভিত্তিহীন ছিল। বেশির ভাগ ভারতীয় মুসলমান যে দলকে সমর্থন করেননি, সেই দলটি কী ভাবে সব ভারতীয়র প্রতিনিধিত্ব করার দাবি করতে পারে? কিন্তু, মুসলিম লিগের বিন্দুমাত্র সমর্থন ছাড়া ওয়াভেলের পক্ষেও এগজিকিউটিভ কাউন্সিলকে নতুন করে ঢেলে সাজানাে সম্ভব ছিল না। চার্চিল ওয়াভেলের সিমলা সম্মেলনের প্রস্তাবে এই আশ্বাসের ভিত্তিতেই রাজি হয়েছিলেন যে এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের পুনর্গঠন | সব দলের সম্মতির ভিত্তিতেই হবে, এবং সেই সম্মতির পিছনে সম্প্রদায়গত সমতার সূত্রটি বজায় থাকবে। যদিও তত দিনে অ্যাটলি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, কিন্তু
৩০৪
এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের অ-প্রতিনিধিত্বমূলক, বা আংশিক প্রতিনিধিত্বমূলক চরিত্রের কথা ভেবে প্রধানত হিন্দু কংগ্রেসের’ এগজিকিউটিভ কাউন্সিল (এবং মন্ত্রিসভা) তিনি মেনে নেবেন না। যদি রাজনৈতিক দলের নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য প্রয়ােজনীয় জোটে একমত হতে না পারেন, বা হন, তবে তাদের দাবিকে নির্বাচনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়াই একমাত্র উপায়। এই নির্বাচন কিছু দিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হল।
ভারতীয় রাজনীতি থেকে কংগ্রেসের অনুপস্থিতির অলীক বছরগুলিতে মুসলিম লিগ একটি বৃহৎ সর্বভারতীয় দলের মর্যাদা পেয়ে যায়; তা ছাড়াও সে সময় ভারতের বেশ কয়েকটি প্রদেশে মুসলিম লিগের সরকার ছিল। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে মুসলিম লিগের প্রধান কৃতিত্বগুলি ছিল: বেশ মজবুত একটা পার্টি মেশিনারি তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে জোরদার রাজ্য সংগঠন গড়ে তােলা, একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করা, জাতীয় স্তরে মজবুত ক্যাডারবাহিনী গড়ে তােলা, এবং সম্ভাব্য পাকিস্তানের জন্য শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা করার জন্য, এবং সমন্বয়ের জন্য কমিটি তৈরি করা। যে কোনও মাপকাঠিতেই এটা যথেষ্ট লাভ। ওয়াভেল জিন্নার মুসলিম জাতিরাষ্ট্রের দাবি, এবং সেই দাবি না মানা হলে যাবতীয় অগ্রগতির পথে রুদ্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ওয়াভেলের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু, তত দিনে যে কোনও আলােচনার টেবিলে তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বের কথাটিকে কায়দা করে ব্যবহার করে জিন্না ভারতীয় রাজনীতিকে কার্যত কংগ্রেস। এবং মুসলিম লিগ, দুটি মেরুতে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এবং, এর মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতির মেরুবিভাজন সম্বন্ধে ব্রিটিশদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়। জিন্নার অবস্থানের ফলেই ভারতীয় মুসলমানরা রাজনীতির ময়দানে এমন একটি জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন, যা নিছক জনসংখ্যার পাটীগণিতের অঙ্কে কখনও সম্ভব হত না।
ক্রিপস মিশনের সময়ে জিন্না মুসলিম লিগের কেন্দ্রীয় সরকারে যােগ দেওয়ার বিষয়ে সম্মত ছিলেন। কিন্তু, স্মরণে রাখা প্রয়ােজন, সে সময় মুসলিম লিগ ছিল নিছকই একটি বিরােধী দল। পরবর্তী সময়ে যে মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলিকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জিন্না জানান, তখন তার একটিতেও মুসলিম লিগ সরকার ছিল না। এই অঞ্চলের মুসলমান জনতা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত চাইবেন না, এই নিশ্চয়তা সেই সময় জিন্নার ছিল না। কিন্তু, কেবলমাত্র পাকিস্তানের ধারণাটিই, কোনও নির্দিষ্ট ভৌগােলিক পরিসীমা ছাড়াই, জিন্নার পক্ষে এই সম্প্রদায়ের সমর্থন নিশ্চিত করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ক্রিপস মিশন ব্যর্থ হওয়ার পরে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হল, তা জিন্নাকে একটা অমূল্য তিন বছরের মেয়াদ উপহার দিল মুসলিম লিগের সংগঠন দৃঢ় করার জন্য, সংগঠনের সাম্প্রদায়িক সমর্থনের ভিত্তি আরও মজবুত করার জন্য, লিগের প্রভাবকে গভীরতর করার জন্য। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫, এই তিন বছরে ভারতীয় রাজনীতির ছবিটিও অনেকখানি বদলে গেল। এই সময়ে মুসলিম লিগ মুসলমান-প্রধান সিন্ধু, বাংলা এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ-এ শাসনক্ষমতায় আসে। এমনকী, হিন্দু-প্রধান অসমেও মুসলিম লিগ সরকার গড়ে। এর মধ্যে উত্তর
৩০৫
পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং অসমে এর আগে কংগ্রেস সরকার ছিল। জিন্না পাকিস্তানের জন্য যে প্রদেশগুলি দাবি করেছিলেন, তার মধ্যে একমাত্র পঞ্জাবই এখনও পর্যন্ত তার আয়ত্তাধীন হয়নি। যদি তিনি পঞ্জাবের রাজনৈতিক দখল নিতে পারতেন, তা হলে। জিন্না সম্ভবত ওয়াভেলের পরিকল্পনাটি মেনে নিতেন। কিন্তু তা হলেও, জিন্না নিশ্চিত ভাবেই স্থানীয় স্তরে নির্বাচনের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে ক্রিপস-এর দেওয়া ‘অফার’এর তুলনায় বেশি কিছু চাইতেন। এখন জিন্না ভারতের সব মুসলমান-প্রধান প্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানালেন, এবং তাও, একান্ত বাধ্য হলে, গণভােটের মাধ্যমে।
এই তিন বছর কংগ্রেসের প্রায় সব প্রথম সারির নেতা কারাবন্দি, ফলে রাজনৈতিক ভাবে অসহায় অবস্থায় ছিলেন। এর প্রভাব নিশ্চিত ভাবেই কংগ্রেসের দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর পড়েছিল। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি প্রভাব পড়েছে ভারতীয় রাজনীতির ওপর। কংগ্রেস নেতাদের কারাবাস ভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথটি বদলে দেয়। এই সময় জিন্নার ধারণা হয়, মুসলিম লিগের সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধারণা’-র আরও একটি ফল: জিন্না বুঝতে পারেন, পৃথক মুসলমান রাষ্ট্রের দাবিটি আর সরিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। যাই হােক, ১৯৪৬ সালে লেবার পার্টির ক্যাবিনেট মিশনের সময় মুসলিম লিগের ফুলিয়ে ফাপিয়ে তােলা দাবিটি ধরা পড়ে গেল, কারণ লিগ যে পৃথক মুসলমান রাষ্ট্রের দাবি তুলেছিল, তা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলমান জনসংখ্যার দুটি রাজ্য, পঞ্জাব এবং বাংলার মুসলমান-প্রধান অঞ্চল ছাড়া আর কোথাও ধােপে টেকেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, মুসলমানদের দল হিসেবে মুসলিম লিগের উত্থান পঞ্জাব এবং বাংলার ভাগ হওয়ার ভবিতব্যটিকেও এক রকম নিশ্চিত করে দেয়। চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক ভারতের অদ্ভুত ছবিটি এই রকমই ছিল, বিশেষত ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার পর।
১৯৪২ সালে ক্রিপস-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা ভারতীয় রাজনীতিকদের একটি বড় ভুল ছিল। বস্তুত, এই প্রত্যাখ্যানটি দেশ ভাগের ওপর অনেকখানি প্রভাব ফেলেছে। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটির সন্তোষজনক উত্তর খোঁজার পথে ক্রিপস মিশন ব্রিটেনের লেবার সরকারের একটি বড় উদ্যোগ ছিল: কিন্তু সে স্বাধীনতা প্রশ্নাতীত ভাবে অখণ্ড ভারতের। ব্রিটেনের কনজারভেটিভ পার্টি (এবং ভারতীয়রাও, হিন্দুমুসলমান দু’তরফেরই) সেই উদ্যোগটিকে অসফল করে ভারতে কেন্দ্রীয় জাতীয় সরকারের প্রশ্নটিকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করে দিল; প্রাদেশিক রাজনীতিতে কংগ্রেস বহুলাংশে জমি হারাল; জিন্না কার্যত ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন। “মুসলিম লিগ যে প্রদেশগুলিকে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে দাবি করছিল, একটি বাদে সেগুলির সবক’টিকেই সাংবিধানিক ভাবে দখল করার ফলে মুসলিম লিগের ভিত্তি আরও মজবুত হল। ক্রিপস-এর যুদ্ধকালীন প্রস্তাব কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের যৌথ সহযােগিতায় কেন্দ্রীয় জাতীয় সরকার গড়ার কথা বলেছিল। ওয়াভেল পরবর্তী সময়ে মেনে নিয়েছিলেন যে ক্রিপস-এর সেই প্রস্তাব
৩০৬
কার্যকর হলে দেশ ভাগের প্রবণতাটি হয়তাে রােধ করা যেত। সময়ের কী অদ্ভুত পরিহাস, লেবার পার্টি যখন শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনে ক্ষমতায় এল, তখন ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রথম পরিকল্পনাটি কার্যকর করার আর কোনও উপায়ই রইল না। সাত বছর আগে। ক্রিপস-এর বাড়িতে নেহরুর সঙ্গে আলােচনার পরে যে উদ্যোগটি গৃহীত হয়েছিল, ১৯৪৫ সালে পৌছে তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। ভারতের সমস্যা, বা আরও স্পষ্ট ভাবে বললে, ভারতের সমস্যাগুচ্ছ সমাধানে অ্যাটলির ভিন্ন কোনও পথ বেছে। নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়ল।
১৯৪৫ সালে লেবার পার্টি ব্রিটেনে নির্বাচনে জয়ী হল, ক্লেমেন্ট অ্যাটলি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। ভারতে একটি প্রত্যাশা তৈরি হল যে এর ফলে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি দ্রুততর হতে পারে। ১৯৪৫-এর অগস্টে জাপানের আত্মসমর্পণের ফলে এই প্রত্যাশার পালে আরও হাওয়া লাগল। কিন্তু, একই সময়ে আরও এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটল, যা ভারতের প্রত্যাশার পক্ষে বিশেষ অনুকূল ছিল না। পরবর্তী কয়েকটি মাস অবিভক্ত ভারতের অসহায় নাগরিকদের ওপর আরও এক দফা ভুল সিদ্ধান্তের বােঝা চাপিয়ে দেওয়ার সাক্ষী হয়ে থাকল।
জিন্না ব্রিটেনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে প্রকাশ্যে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। অবশ্য, তিনি এই সময় লিগের ওয়ার্কিং কমিটির একটি বৈঠক ডাকেন এবং সে বৈঠকে সরকারে ভারতে যত শীঘ্র সম্ভব নির্বাচন আয়ােজন করার দাবি সরকারের কাছে পেশ করার মর্মে একটি প্রস্তাবও পাশ করিয়ে নেন। গােটা দেশের মুসলমান সমাজ যে অবিভক্ত ভাবে লিগের পিছনে আছে, নির্বাচনের মাধ্যমে এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করাই জিন্নার কাছে এই সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তখন বিভিন্ন প্রদেশের আইনসভায় মুসলিম লিগের প্রতিনিধির সংখ্যা জিন্নার ভারতের সব মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করার দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। এই অসঙ্গতি নিয়ে লিগের বিরােধী দলগুলি বিধানসভায় যে কোনও বিতর্কেই সরব হত।
সিমলা সম্মেলনের পরের দু’মাসে সরকারের সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের, অথবা কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও কোনও আলােচনা হল না। কংগ্রেস প্রাদেশিক বিধানসভাগুলিতে ক্ষমতায় ফিরতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করতে ইতস্তত করছিল। কংগ্রেস নেতাদের আশা ছিল, সিমলা সম্মেলনের পরে ওয়াভেল নিজেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করবেন। কিন্তু, যেহেতু ওয়াভেলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অন্য রকম কোনও চুক্তিই কংগ্রেসের হয়নি, ফলে ভাইসরয় বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেস নেতাদের কাছে। নিজের মনােভাবও প্রকাশ করলেন না, কোনও পদক্ষেপও গ্রহণ করলেন না। তার পর, ১৯৪৫-এর অগস্টে ওয়াভেল নবনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে আলােচনা করতে ইংল্যান্ডে গেলেন, ফিরলেন এক মাস পরে, সেপ্টেম্বরে। কিছু দিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইনসভায় নতুন নির্বাচন ঘােষিত হল। একই সঙ্গে ঘােষিত হল যে এই নির্বাচনের পরেই ভারতের স্বশাসনের উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ করা হবে, সংবিধান রচনার জন্য কমিটিও গঠন করা হবে। এই সময় কংগ্রেসের পক্ষে প্রাদেশিক
৩০৭
আইনসভায় ক্ষমতা দখল করার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। ফলে, এই নির্বাচনও কংগ্রেসের ‘ফসকে যাওয়া সুযােগ’-এর খাতায় সংযােজিত হল। কংগ্রেস নেতারা যদি সিমলা সম্মেলনের পরেই ভাইসরয় ওয়াভেলের সঙ্গে দেখা করে দাবি জানাতেন যে, প্রাদেশিক গভর্নর তাদের বরখাস্ত করে কারাবন্দি করার আগে তারা যে প্রদেশগুলির আইনসভায় নির্বাচিত সরকার চালাচ্ছিলেন, সেই প্রদেশগুলির শাসনাধিকার তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হােক, ওয়াভেলের পক্ষে সেই দাবি অস্বীকার করা মুশকিল হত। বস্তুত, ওয়াভেল এবং গভর্নর কোলভিল১২ এই প্রস্তাবটিকে সম্ভবত স্বাগত জানাতেন। কিন্তু, কংগ্রেস নেতারা যে পথে হেঁটে অভ্যস্ত, সিমলা সম্মেলনের পরে তারা সেই প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পথেই ফিরে যান। ভারতের বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা তারা বিবেচনা করেননি। কংগ্রেস নেতাদের এই আচরণে ওয়াভেল খানিকটা বিরক্ত হন, এবং এই আচরণকে রাজদ্রোহমূলক হিসেবেই দেখেন। তার পরই ১৯৪৫ সালের অগস্টে গভর্নর্স কনফারেন্স-এ সব প্রাদেশিক আইনসভা ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর কিছু দিন বাদেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। ভারতের পক্ষে এই নির্বাচন নিশ্চিত ভাবেই কিছু দুর্ভাগ্য বহন করে এনেছিল।
১৯৪৬-এর নির্বাচন
১৯৪৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৬ সালের মার্চের শেষ দিকে ক্যাবিনেট মিশনের ভারত সফর পর্যন্ত সময়কালে ভারত-ব্রিটিশ রাজনৈতিক উদ্যোগ বিশেষ এগােয়নি। ভারত অপেক্ষা করছিল, দেশের রাজনৈতিক সম্প্রদায় নিশ্চিত ভাবেই ঘুমিয়ে পড়েনি। নির্বাচন ঘােষিত হওয়ার পরেই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভিন্ন বিতর্ক আরম্ভ হল। এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভারতের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভরশীল ছিল। মুসলিম লিগ স্থির করল, এই নির্বাচনে তাদের প্রচারের কেন্দ্রে একটিই মাত্র প্রশ্ন থাকবে পাকিস্তান। জিন্না ভারতের সব মুসলমানের কাছে ব্যক্তিগত ভাবে আবেদন করে বললেন, কোন কেন্দ্রে কে প্রার্থী, সে হিসেব না করে তারা যেন সব প্রার্থীকে সামগ্রিক ভাবে মুসলিম লিগের প্রতিনিধি ভেবে ভােট দেন। জিন্না আরও বললেন, এই প্রার্থীদের ভােট দেওয়ার অর্থ পাকিস্তানের জন্ম।
প্রথমেই কেন্দ্রীয় আইনসভার ভােট। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে এই নির্বাচনের ফলাফল ঘােষিত হল। মুসলিম লিগ সব মুসলিম আসনে নব্বই শতাংশের ওপর ভােট পেয়ে জয়ী। কংগ্রেস হিন্দু (অর্থাৎ, সাধারণ) আসনে ভাল ফল করল: ৬২টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস ৫৭টিতে জয়ী। মুসলিম লিগ ভারতীয় মুসলমানদের সর্বাত্মক প্রতিনিধিত্ব করে বলে জিন্না যে দাবি করতেন, সেই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াইটি মুসলিম লিগ বেশ ভাল ভাবে জিতল। তার পর, জিন্নার ডাকে গােটা দেশের
৩০৮
মুসলমান সমাজ ১৯৪৬ সালের ১১ জানুয়ারিকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করল।
এর পর বিভিন্ন প্রদেশের নির্বাচন।[১৪] উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বাদে প্রতিটি প্রদেশেই মুসলিম লিগ ফের সফল হল। নির্বাচনের ফলাফল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করল: দেশের মুসলমান ভােটদাতারা মুসলিম লিগের পিছনে আছেন। এই কথাটি নির্বাচনের ফলাফলে প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল। পঞ্জাবে অন্য দলের নির্বাচিত চার প্রতিনিধি নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর মুসলিম লিগে যােগ দিলেন। সীমান্ত প্রদেশ বাদে আর সব প্রদেশেই মুসলিম লিগ যে আসনগুলিতে প্রার্থী দিয়েছিল, তার নব্বই শতাংশ আসনে জিতল। মুসলিম লিগ এই কথাটি প্রশ্নাতীত ভাবে প্রমাণ করল যে ভারতীয় মুসলমানদের সমর্থন দ্বিধাহীন ভাবে তাদের দিকে। নির্বাচন-প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরেই ফের পাকিস্তানের প্রশ্নে রাজনৈতিক লড়াই আরম্ভ হল। এ বার সেই লড়াইয়ে জোর এবং তিক্ততার পরিমাণ আগের চেয়ে ঢের বেশি।
নির্বাচনের পরে স্বভাবতই মন্ত্রিসভা গঠনের প্রশ্ন উঠল। এই পর্যায়ে নতুন জটিলতা তৈরি হল— ক্ষমতার শরিক হওয়ার জটিলতা। কী ভাবে আইনসভায় ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়া হবে? এই প্রশ্নটিকে সরিয়ে রাখার কোনও উপায় ছিল না।
নির্বাচনী ফলাফলের পাটীগণিত এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করল: যে প্রদেশে মুসলিম লিগ মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনের নব্বই শতাংশে জয়ী হয়েছে, সেই রাজ্যেও লিগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। শুধুমাত্র সংরক্ষিত আসনের ফলাফলের ভিত্তিতে আইনসভায় গরিষ্ঠতা লাভ করা যাবে, এমন সংখ্যক আসন নির্বাচনে সংরক্ষিত হয়নি। লিগের পক্ষে ঘটনাটি নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক ও বিরক্তিকর, তাদের ফের সেই বিরােধী আসনেই বসতে হল। সিন্ধু এবং বাংলায় গভর্নর একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সরকার গঠন করতে ডাকা হবে বলে সিদ্ধান্ত করলেন। এই দুই প্রদেশেই মুসলিম লিগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা পেয়েছিল। কিছু দিনের মধ্যেই বাংলা প্রদেশে জোট মন্ত্রিসভা শপথ নিল। পঞ্জাবের গভর্নর স্যর বাট্রাম গ্ল্যান্সি ‘একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল’-এর নীতি থেকে সরে গেলেন। তিনি প্রথমে মুসলিম লিগকে সরকার গঠনের জন্য ডাকতে দেরি করলেন। তার পর, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে মুসলিম লিগের নেতাদের না ডেকে তিনি বললেন, ” মুসলিম দলের নেতারা মুসলিম লিগের সঙ্গে জোট গড়তে আদৌ আগ্রহী হবেন কি না, সে বিষয়ে তার সংশয় আছে। তিনি মুসলিম লিগকে সরকার গঠন করতে ডাকার পরিবর্তে প্রথমে ইউনিয়নিস্টদের সরকার গড়তে উৎসাহ দিলেন, এবং পরে কংগ্রেস ও অকালি দলের জোট সরকার গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিলেন। এই দুটি দলের হিন্দু ও শিখ মিলিয়ে মােট ৮৪ জন সদস্য ছিল। এদের সঙ্গে ১২ জন ইউনিয়নিস্ট মুসলমান প্রতিনিধি যােগ দিলেন। তাদের মুসলমান স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’-র দায়ে অভিযুক্ত করা হতে পারে, এই ঝুঁকি প্রতিনিধিদের ছিলই। এই হিসেব যখন চলছিল, তখন পঞ্জাবের আইনসভায় মােট সদস্যসংখ্যা ছিল ১৭৫।[১৫]
একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মুসলিম লিগের নেতা হিসেবে মামদোত-এর নবাব ইফতিকার
৩০৯
হুসেন খানকে[১৬] সরকার গড়তে প্রথমেই আমন্ত্রণ না জানানাের সিদ্ধান্তটি গ্ল্যান্সির তরফে পদ্ধতিগত ভাবে এবং সাংবিধানিক ভাবে একটি বিরাট ভুল ছিল। তিনি নবাব খানকে সরকার গড়তে ডাকলে কী হত, সে বিষয়ে এখন আর অনুমান করে বিশেষ লাভ নেই, কিন্তু এই কথাটি মনে রাখা ভাল যে ক্ষমতা চির কালই খুব আকর্ষণীয় বস্তু, এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া গােটা বিশ্বের রাজনীতিকদের চরিত্রগত লক্ষণ। একটি গােষ্ঠী চির দিনই বিশ্বাস করত যে গােটা পৃথিবী তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। গ্ল্যান্সির ভুলের ফলে তাদের সন্দেহ আরও খানিক পােক্ত হল। যাঁরা মনে করতেন নির্বাচনের এই ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পােস্ট’ পদ্ধতি ভারতে শিকড় গাড়লে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার ষােলাে কলা পূর্ণ হবে, গ্ল্যান্সির এই ভুল তাদের সন্দেহকে দৃঢ়তর করল। এই ঘটনাটি নিশ্চিত ভাবেই আরও খানিক তিক্ততার সৃষ্টি করল। এর ফলে মুসলিম লিগের পাকিস্তানের দাবি আরও দৃঢ়তর হল, জিন্না আরও শক্তিশালী হলেন, দুই সম্প্রদায় এবং দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটল।
উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ (১৯৪৫-৪৬)
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের শহরাঞ্চলে মােট মুসলমান ভােটের এক শতাংশেরও কম কংগ্রেসের ঝুলিতে জমা হল (অবশ্য, গ্রামাঞ্চলের মুসলমান ভােটে কংগ্রেসের ভাগ বেশি ছিল)। কিন্তু তাতেও প্রদেশ কংগ্রেসের অসংবেদনশীল আচরণের কোনও পরিবর্তন ঘটল না। এই নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের মুসলমানপ্রধান আসনগুলিতে কংগ্রেসের পরাজয় প্রশ্নাতীত ছিল, তার সঙ্গে গড়মুক্তেশ্বরের মতাে অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনাও ঘটল, তবুও উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসের নীতি বদলাল না। গড়মুক্তেশ্বরের দাঙ্গার ভয়াবহতার গুরুত্ব যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ এই দাঙ্গার সময়টি। নােয়াখালি ও বিহারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঠিক পরেই গড়মুক্তেশ্বরের দাঙ্গাটি ঘটল। দাঙ্গার ঘটনায় দৃশ্যতই আহত গাঁধী মন্তব্য করলেন, “যদিও কংগ্রেসের নিচু তলায় মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান বা অন্য সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ আছেন, এবং কংগ্রেস সেই কথাটি বড় গলায় উল্লেখও করে, তবু কায়েদ-এ আজম জিন্না কংগ্রেসকে যে হিন্দুদের দল বলে উল্লেখ করেন, এই দাঙ্গাগুলি তার সেই বক্তব্যকেই যাথার্থ্য দিল।” গড়মুক্তেশ্বরের ঘটনা কংগ্রেসের কাছে আরও একটি কারণে। উল্লেখযােগ্য: এই দাঙ্গার সময়ই আইনসভায় কংগ্রেসের স্থানীয় প্রতিনিধি, অন্যান্য কংগ্রেস কর্মী, এমনকী, কংগ্রেস-ভাবাপন্ন সংবাদমাধ্যমের আচরণও জনসমক্ষে এল। কংগ্রেসের জাতীয় মুখপত্র, দ্য ন্যাশনাল হেরাল্ড-এ লেখা হল, নােয়াখালির গণহত্যার প্ররােচনাতেই গড়মুক্তেশ্বরের ঘটনা ঘটেছে। দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি এবং বিচ্ছেদের এই মুহূর্তটি আরও একটু মন
৩১০
দিয়ে বােঝা প্রয়ােজন, কারণ এই প্রশ্নটিই তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এইচ এম সিরভাই বলেছেন, “গণতন্ত্র মানে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সরকার নয়, গণতন্ত্র মানে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর সম্মতির ভিত্তিতে শাসন। যে তত্ত্ব শুধু সংখ্যার ওপর নির্ভর করে,[১৭] সে তত্ত্ব সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর আধিপত্য রােধ করতে পারে না, সরকারে সংখ্যালঘুর মতামত প্রকাশের সুযােগ ও তার যথাযথ সম্মানের ব্যবস্থাও করতে পারে না। এবং, এখানে সংখ্যালঘু মানে শুধু সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘু নয়, রাজনৈতিক সংখ্যালঘুও বটে। সুতরাং, এই মুহূর্তটিতে দাড়িয়ে আমরা বরং দিল্লির দিকে নজর ফেরাই, যেখানে মৌলানা আজাদ মহাত্মা গাঁধীকে ২ অগস্ট ১৯৪৫ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে এই জটিল পরিস্থিতির একটি ব্যক্তিগত সমাধানসূত্র জানিয়েছেন।
এই চিঠিটি এবং গাঁধীর উত্তর, দুটোই ইভান জেনকিন্স বাজেয়াপ্ত করেন এবং ওয়াভেলের সেক্রেটারি অ্যাবেল-এর কাছে ২৫ এবং ২৮ অগস্ট পাঠিয়ে দেন। এই দুটো চিঠির পুরােটা পড়াই সবচেয়ে ভাল। ট্রান্সফার অব পাওয়ার’-এ (ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ১৫৫-১৫৭) চিঠি দুটো যেমন আছে, পুরােটাই এখানে তুলে দিচ্ছি।
৬৮
সার ই জেনকিন্স টু মিস্টার অ্যাবেল, টেলিগ্রাম, ওয়াভেল পেপারস,
পলিটিক্যাল সিরিজ,
জুলাই – সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫
জরুরি
গােপনীয়
২৫ অগস্ট, ১৯৪৫।
নং ১৩৯৪-এস। জেনকিন্স হইতে অ্যাবেলের প্রতি। আমি বাজেয়াপ্ত করা চিঠির পরিকল্পনাটি দেখলাম। আজাদ বলছেন, মুসলিম লিগের বাইরে যে মুসলমান সংগঠনগুলি আছে, সেগুলিকে নিজেদের মধ্যে সম্পূর্ণ ভাবে সংগঠিত হতে হবে এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্বন্ধে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছােতে হবে। অতঃপর কংগ্রেস সেই সিদ্ধান্তে সম্মত হবে। এবং মুসলমান সংগঠনগুলির পাশে দৃঢ় ভাবে দাঁড়াবে।
২…..মুসলমানরা ভীত। এবং তাদের ভয় দূর করার একমাত্র উপায় হল এমন একটা পরিকল্পনা রচনা করা, যাতে তারা নিরাপদ বােধ করেন। একক সরকার গঠন করার যে কোনও প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। দেশভাগও ব্যর্থ হবে, এটা মুসলমানদের স্বার্থবিরুদ্ধ। এক জন ভারতীয় মুসলমান হিসেবে আজাদ দেশভাগকে পরাজয় বলেই মনে করেন এবং তার সঙ্গে একমত হতে পারেন না।
৩১১
৩…..স্মারক এই মূল ধারণাটি ব্যক্ত করে যে
ক) ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান চরিত্রগত ভাবে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রীয় হবে এবং তার প্রতিটি অংশ সম্পূর্ণ ভাবে স্বশাসিত হবে। এই ব্যবস্থায় একমাত্র সর্বভারতীয় বিষয়গুলিই কেন্দ্রের বিবেচনাধীন হবে এবং তা সংবিধানস্বীকৃত সব প্রাদেশিক অঞ্চলের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত হবে।
খ) প্রতিটি অংশকে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভক্ত হওয়ার অধিকার দিতে হবে।
গ) কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক, উভয় স্তরেই সম্মিলিত নির্বাচকমণ্ডলী (joint electorate) থাকবে। এই সংযুক্ত নির্বাচকমণ্ডলী যাতে দেশের জনসংখ্যার যথার্থ প্রতিফলন ঘটায়, তার জন্য সংরক্ষণ ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ) যত দিন পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সন্দেহ সম্পূর্ণ মিলিয়ে না যায় এবং যত দিন
শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মতামতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে, তত দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং প্রশাসনে হিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যার সমতা বজায় রাখতে হবে।
ঙ) এমন একটি নীতি স্থির করতে হবে, যার মাধ্যমে এক বার কোনও হিন্দু ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান হলে পরের বার কোনও মুসলমান এই পদ পাবেন।
৪……
৫. স্মারকের শেষে আমাদের হিন্দু বন্ধুদের অনুরােধ করা হয়েছে যাতে তারা “ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানে মুসলমানদের অবস্থানের প্রশ্নটি সম্পূর্ণ ভাবে তাদের ওপর ছেড়ে দেন।”
৭৬
সার ই জেনকিন্স টু মিস্টার অ্যাবেল, টেলিগ্রাম, ওয়াভেল পেপারস,
পলিটিক্যাল সিরিজ,
জুলাই – সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫
৩১২
জরুরি
গােপনীয়
২৮ অগস্ট, ১৯৪৫
নং ১৪২০-এস। জেনকিন্স হইতে অ্যাবেলের প্রতি। ২৫ অগস্ট তারিখে আমার টেলিগ্রাম নং ১৩৯৪-এস। ১৬ অগস্ট আজাদকে লেখা গাঁধীর বাজেয়াপ্ত চিঠি থেকে যা জানা গিয়েছে:
আপনার চিঠি পেয়ে আমি আপনাকে এই টেলিগ্রামটি করি: “আমার মতে আপনার চিঠিটা প্রকাশ করা উচিত নয়। বিস্তারিত লিখছি।”
আপনার চিঠি পড়ে আমার মনে হয়নি যে আপনি হিন্দুদের সম্বন্ধে লিখছেন। আপনার মনে যা-ই থাকুক, তা আপনার চিঠিতে প্রতিফলিত হয়নি। তবে নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনি যদি চান, তবে যখন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তখন আমরা এই চিঠির বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা। করব। সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে আপনি যা-ই বলতে চান, ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলােচনা না করে তা বলা উচিত হবে না। আমার মতে আপাতত চুপচাপ থাকাই উচিত হবে। দল আপনার সঙ্গে আলােচনা করেই নিজস্ব মত। প্রকাশ করতে পারে। তাদের সেই অধিকার আছে। তাছাড়াও, এটা তাদের কর্তব্য। আপনার মতের সঙ্গে আমার মতের পার্থক্য রয়েছে……সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়েই গভীর ভাবে ভাবনাচিন্তা করার প্রয়ােজন রয়েছে। আমি তাড়াহুড়াে করে কিছু করার পক্ষপাতী নই।
ব্যাগে প্রতিলিপি আসছে। এটি আমাদের পক্ষে বিশেষ উৎসাহব্যঞ্জক নয়। সার জন কোলভিল দেখেছেন।[১৮]
মৌলানা নিশ্চিত ভাবেই যন্ত্রণা থেকে চিঠিটা লিখেছিলেন। তিনি পাকিস্তানের ধারণাটাকে ‘মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থী বলে প্রত্যাখান করেছিলেন, উল্লেখ করেছিলেন পাকিস্তানের দাবিটি ভুল। কিন্তু, আজাদ এ কথাও উল্লেখ করেছিলেন যে, মুসলমানদের ভীতি এবং আশঙ্কা প্রকৃত, এবং তা দূর করা প্রয়ােজন। সেই কারণেই মৌলানা ভারতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে প্রস্তাব করেন: “যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার কেবল কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি দেখবে; প্রতিটি সাংবিধানিক অংশের ভারত থেকে বিচ্যুত হওয়ার অধিকার থাকবে, (সেই প্রেক্ষিতে); কেন্দ্রীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় এগজিকিউটিভে সংরক্ষণের মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সমতা রক্ষা করা হবে।”[১৯] নথি অনুযায়ী গাঁধী মৌলানা সাহেবের এই অভিমত জনসমক্ষে প্রকাশ না করতে অনুরােধ করেন, অন্তত যত ক্ষণ তারা সাক্ষাতে এই বিষয়টা নিয়ে আলােচনা না করেন। এই ঘটনাক্রমে পরবর্তী পর্যায়ে ফের ফিরে আসব, কিন্তু একটা কথা এখানে স্পষ্ট: এই পর্যায়ে একটি নতুন উদ্যোগের প্রয়ােজন পড়ল। সেই উদ্যোগটিই ক্যাবিনেট মিশন।
৩১৩
ক্যাবিনেট মিশন
১৯৪৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন-এ প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলি একটি মিশন ঘােষণা করলেন। সেই মিশনের প্রধান তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া লর্ড পেথিক লরেন্স। মিশনের অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন বাের্ড অব ট্রেড-এর স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং ফার্স্ট লর্ড অব অ্যাডমিরালটি এ ভি আলেকজান্ডার। ব্রিটেন থেকে ভারতে আসা সব ক’টি সরকারি মিশনের মধ্যে এই মিশনটিই ‘উচ্চতম’। মিশনের উদ্দেশ্য ছিল: সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির চাপে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটি যাতে স্তব্ধ না হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করা; বিবদমান সম্প্রদায় দুটির মধ্যে কোনও সমঝােতাসূত্র খুঁজে বার করা; এবং উভয়পক্ষের সম্প্রতিক্রমে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার শেষ চেষ্টা করা। মিশনটি একটানা সাড়ে তিন মাস ভারতে ছিল। এই মিশন ভারতে যে কোনও রকম আলােচনা করার অধিকারী ছিল এবং এর পিছনে ব্রিটেন সরকারের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য ভারতীয় নেতারা নীতিগত এবং পদ্ধতিগত ভাবে কোনও সর্বসম্মত অবস্থানে উপনীত হতে পারেন, তা নিশ্চিত করাও এই মিশনের লক্ষ্য ছিল।
২৪ মার্চ ১৯৪৬ ক্যাবিনেট মিশন নতুন দিল্লিতে পৌঁছল। সার তেজ বাহাদুর সপু লিখছেন, “জিন্না দাবি করেছিলেন, সংবিধান তৈরির জন্য দুটি পৃথক গােষ্ঠী তৈরি করা হােক। আমি এই দাবির ঘােরতর বিরােধী ছিলাম এবং একটিই গােষ্ঠী নিয়ােগের কথা বলেছিলাম। স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস স্বীকার করেছিলেন যে মাঝে মাঝে মুখ বাঁচানাের ব্যবস্থা করা জরুরি হয়ে পড়ে এবং একটি চিঠির উত্তরে তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, তিনি জিন্নার মুখ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব করেন, সংবিধান রচনা করার জন্য একটাই গােষ্ঠী গঠন করা হােক, কিন্তু সে গােষ্ঠী দুই ভাগে বিভক্ত হােক। এক দল হিন্দুস্থানের বিষয়বস্তু খতিয়ে দেখুক এবং তার কেন্দ্র নির্দেশ করুক। অন্য দল পাকিস্তানের বিষয়গুলি নির্ণয় করুক এবং তার কেন্দ্র নির্দেশ করুক। পর পর দুটি দল একত্রিত হয়ে প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ইত্যাদি বিষয়গুলি আলােচনা করুক। আমি উল্লেখ করলাম যদি তখনও এ দুটি পৃথক কেন্দ্রের মধ্যে মতবিরােধের সৃষ্টি হয়, তবে তা সমাধান করার মতাে কোনও শক্তিই অবশিষ্ট থাকবে না এবং তথাকথিত মহাকেন্দ্র কিছুই করতে পারবে না।” দৃশ্যতই, ক্যাবিনেট মিশনের কাজটা সহজ ছিল না। তেজ বাহাদুর সপুর মতাে উদারপন্থীরাও একটা প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে মেনে নিতে তৈরি ছিলেন না।
লিগ এ বার দাবি করতে আরম্ভ করল যে মুসলমান-প্রধান প্রদেশগুলােকে সম্পূর্ণ স্বশাসনের অধিকার দিতে হবে। জিন্নার সঙ্গে আলােচনার সময়ে ক্যাবিনেট মিশন তাকে জানাল, যে হেতু কেবলমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, তাই ‘সাংবিধানিক আইন ও আচরণবিধি অনুসারে দুটি কেন্দ্র তৈরি করা সম্ভব নয়। নিরাপত্তার প্রশ্নেও যে একটি কেন্দ্র থাকাই বাঞ্ছনীয়, মিশন কর্তারা জিন্নাকে সে কথাও
৩১৪
বলেন। মিশনের সঙ্গে তার দ্বিতীয় সাক্ষাতে ১৬ এপ্রিল ১৯৪৬-এ জিন্না বললেন, ‘ভারতের ঐক্য একটা গল্পকথা মাত্র।” এর আগেও তিনি ক্রিপসকে জানিয়েছিলেন, যে মুসলমানদের জীবনযাত্রা এবং জীবন সম্বন্ধে ধারণা হিন্দুদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং ‘ভারত ভাগ’ ছাড়া এই সমস্যার কোনও সমাধান সম্ভব নয়।
এই আলােচনা যখন চলছে, তখন জিন্না মুসলিম লিগের আইনসভার সদস্যদের একটা বৈঠক ডাকলেন এবং সেই বৈঠকে ‘স্বাধীন পাকিস্তানের দাবি’-তে দলের সদস্যদের সম্মতি আদায় করে নিলেন। কংগ্রেস যদিও ত্রিস্তরীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােকে মেনে নিতে সন্মত ছিল না, কিন্তু (এখন) বুঝতে পারল ভারতীয় সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রীয় হতেই হবে, এবং প্রদেশগুলিকেও অধিকতর স্বশাসনের অধিকার দেওয়া ভিন্ন উপায়ান্তর নেই অন্য দিকে, মুসলিম লিগ একটি সম্পূর্ণ পৃথক, সার্বভৌম পাকিস্তানের দাবি জানাল এবং সে দাবির স্বীকৃতিস্বরূপ দুটি পৃথক সংবিধান-রচনা গােষ্ঠী দাবি করল। এতগুলি পরস্পর-বিরােধী লক্ষ্যই ক্যাবিনেট মিশনের সামনে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াল এবং ‘মিশনের প্রাথমিক কর্তব্যই হল ব্যর্থ না হয়ে বাধাগুলিকে অতিক্রম করা।”
শ্রীনগরে (জম্মু ও কাশ্মীর) একটি সংক্ষিপ্ত সফর সেরে মিশন ২৪ এপ্রিল দিল্লিতে ফিরল। দিল্লির হাওয়ায় তখন গুজব ছড়িয়েছে, গরমে অতিষ্ঠ হয়ে মিশন কোনও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। কিন্তু, মিশন কোনও সিদ্ধান্তই ঘােষণা করল না। কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ নেতাদের কাছে সিমলায় আয়ােজিত সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ গেল। সম্মেলনে ‘মিশনের সদস্যদের চিন্তাভাবনা আলােচিত হবে এবং সেই আলােচনার মাধ্যমে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে।” কংগ্রেস এবং লিগের চার জন করে সদস্য সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন বলে স্থির হল।।
সিমলায় কংগ্রেসের যে চার জন প্রতিনিধি গেলেন, তাদের মধ্যে মৌলানা আজাদ ও বাদশা খান ছিলেন। এই দু’জনকে পাঠানাের পিছনে স্পষ্ট রাজনৈতিক কারণ ছিল। এর মাধ্যমে কংগ্রেস প্রমাণ করল যে, জিন্না যে নিজেকে সর্বভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করেন, সেই দাবিটি আসলে সারবত্তাহীন এবং এই প্রশ্নে কংগ্রেস কখনও নিজের অবস্থান থেকে সরে আসবে না।
৫ মে ১৯৪৬, দ্বিতীয় সিমলা সম্মেলনে কংগ্রেস প্রতিনিধিরা যখন ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, তখন তাদের সামনে ভারতীয় সংবিধান রচনার গােষ্ঠী সম্বন্ধে একটি প্রস্তাব পেশ করা হল। প্রস্তাবটি মুখ্যত স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-এর মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। প্রস্তাবটির কোনও ‘ভাল নাম না পাওয়া যাওয়ায় একে গ্রুপিং বা ‘বর্গ ব্যবস্থা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রস্তাবটির যাবতীয় বাহুল্য হেঁটে ফেলে যদি শুধু তার সার কথাটুকুও ধরা যায়, তা হলেও বলতেই হয়, প্রস্তাবটি ভয়ঙ্কর রকম জটিল। প্রস্তাবটির অবাস্তব জটিলতার সহজতম প্রমাণ: যে দিন প্রস্তাবটি প্রথম পেশ করা হল, সেই ৫ মে ১৯৪৬ থেকে ৬ ডিসেম্বর লন্ডনে অ্যাটলির সভাপতিত্বে হওয়া চূড়ান্ত সম্মেলন পর্যন্ত কখনও এই প্রস্তাবটি সম্বন্ধে ঐকমত্যে পৌছনাে সম্ভব হয়নি। প্রস্তাবটির মূল বক্তব্য এই রকম:
৩১৫
১) ব্রিটিশ-ভারত এবং দেশীয় রাজ্য নিয়ে সর্বভারতীয় ইউনিয়ন গঠন করা হবে এবং তা বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যােগাযােগের বিষয়গুলি দেখবে।
২) ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি বর্গে ভাগ করা হবে। বর্গগুলি হল:
(বর্গ ক) মাদ্রাজ, বম্বে, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং ওড়িশা
(বর্গ খ) পঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বালুচিস্তান
(বর্গ গ) বাংলা এবং অসম ।
৩) ভারতের সংবিধান কার্যকর হওয়ামাত্র প্রতিটি বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলির সেই বর্গ ছেড়ে অন্য বর্গে যােগ দেওয়ার অধিকার থাকবে। দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রতিটি বর্গের প্রদেশগুলি তাদের পছন্দমতাে কিছু বিষয়কে বর্গের বিবেচ্য বিষয় হিসেবে বেছে নেবে এবং বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশ সেই বিষয়গুলি নিয়ে আলােচনা করতে বাধ্য থাকবে। অবশিষ্ট বিষয়গুলি এবং ক্ষমতা প্রতিটি প্রদেশের নিজস্ব বিচার্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
৪) প্রতিটি বর্গের (ক, খ এবং গ) জন্য একটি বর্গীয় গণপরিষদ গঠন। করা হবে। বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি প্রদেশের আইনসভার সদস্যরা এই বর্গীয় গণপরিষদে তাদের মনােনীত প্রতিনিধিদের পাঠাবেন।।
৫) বর্গীয় গণপরিষদ বর্গীয় এবং প্রাদেশিক সংবিধান চূড়ান্ত করার পরে কোনও প্রদেশের বর্গ পরিবর্তনের অধিকার থাকবে। কিন্তু তার জন্য প্রাদেশিক আইনসভায় সেই পরিবর্তনের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের। সমর্থন প্রমাণ করতে হবে।
৬) প্রাদেশিক ও বর্গীয় সংবিধান চূড়ান্ত হওয়ার পরে সব ক’টি বর্গের বর্গীয় গণপরিষদ ভারতীয় রাষ্ট্রের ৩২ জন প্রতিনিধির সঙ্গে একত্রে বসে সর্বভারতীয় সংবিধান রচনা করবে। এই সংবিধান বিভিন্ন সর্বভারতীয় প্রশ্ন, যেমন, মৌলিক অধিকার, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ইত্যাদি বিচার করবে এবং এই সংবিধান সমগ্র দেশে প্রযােজ্য হবে।
৭) কেন্দ্রীয় গণপরিষদে এই প্রস্তাবটি পাশ করানাের জন্য উপস্থিত। প্রতিনিধিদের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন আবশ্যক হবে।
এই সম্মেলন উপস্থিত প্রতিনিধিদের মনােভাব এবং ইচ্ছে প্রকাশ্যে আনল। কংগ্রেস কোনও ভাবেই এই কথাটি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না যে জিন্না একাই সব ভারতীয় মুসলমানের প্রতিনিধিত্ব করেন। অন্য দিকে, জিন্না ঠিক এই কথাটি প্রতিষ্ঠা করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে সম্মতি জানান। জিন্নার তরফে এটি এক বিরাট বিবেচনার পরিচায়ক, কারণ এর মাধ্যমে
৩১৬
একেবারে পরাজয় স্বীকার করে না নেওয়া হলেও সার্বভৌম পাকিস্তানের দাবিকে জিন্না স্পষ্টতই অনেক লঘু করে ফেললেন। অবশ্য, খুব তাড়াতাড়িই তিনি বুঝতে পারলেন, ক্যাবিনেট মিশন তার এই মহানুভবতার যথেষ্ট দাম দিচ্ছে না। জিন্নার মনােবাসনা ছিল, তার আচরণের প্রতিদান হিসেবে কংগ্রেস বৰ্গীকরণ প্রসঙ্গে দলীয় নীতি থেকে সরে আসবে। কংগ্রেস তাতে রাজি ছিল না। স্বভাবতই জিন্না প্রত্যাশা করেছিলেন, এই ক্ষেত্রে ক্যাবিনেট মিশন মধ্যস্থতার কাজ করবে। সিমলা সম্মেলনে এটি একটি নির্ণায়ক মুহুর্ত ছিল। জিন্না এবং নেহরু একটি ঐকমত্যের এত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন যে তাদের দু’জনকে আলাদা ভাবে কথা বলার সুযােগ করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের । বৈঠক হল, কিন্তু সেই বৈঠকে কোনও ফল হল না। জিন্না কেন্দ্রীয় সরকার মেনে নিতে রাজি ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেসের কথামত একটিমাত্র কেন্দ্রীয় গণপরিষদ মানতে তার আপত্তি ছিল। কংগ্রেস আবার এটা মানতে রাজি ছিল না যে প্রতিটি বর্গের আলাদা গণপরিষদ এবং এগজিকিউটিভ থাকবে। এই বিষয়গুলি, জিন্নার মতে, যে কোনও বর্গের জরুরি শর্ত।
একই সময়ের আরও তিনটি আলােচনার দিকে আমাদের নজর দেওয়া প্রয়ােজন। ৬ মে ১৯৪৬ তারিখে মৌলানা আজাদ নিজের এবং সহকর্মীদের তরফে পেথিক লরেন্সকে একটি চিঠি লিখলেন। ১৯৪৫ সালের অগস্টে আজাদ গাঁধীকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন, এবং যার উত্তরে গাঁধী সেই চিঠিটির বক্তব্য জনসমক্ষে না আনার জন্য আজাদকে অনুরােধ করেন, আজাদের বর্তমান চিঠির শেষ অনুচ্ছেদটি আগেকার চিঠির বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। বর্তমান চিঠিটিতে আজাদ লিখলেন, ভারতের প্রতিটি সম্প্রদায়ের মন থেকে শঙ্কা এবং সন্দেহ দূর করার জন্য এমন কোনও পন্থা অনুসরণ করা উচিত হবে না যা গণতন্ত্রের মূল নীতিগুলির পরিপন্থী।” এই বক্তব্য মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ এবং সমতার নীতির প্রত্যাখ্যানের কথা স্পষ্ট ভাবে বলে। তিন দিন পরে পেথিক লরেন্সকে লেখা আর একটি চিঠিতে (এ বার কংগ্রেসের তরফে) মৌলানা তার দলের আপত্তির কথা উল্লেখ করে লেখেন: “আমরা গণপরিষদ এবং এগজিকিউটিভে দুটি সম্পূর্ণ অসম গােষ্ঠীর মধ্যে সমতা নীতির বিরােধী। এটি ন্যায্য নয় এবং এই সিদ্ধান্তের ফলে ভবিষ্যতে সমস্যার সৃষ্টি হবে। এই জাতীয় নীতির মধ্যে বিরােধ এবং অবাধ উন্নতির ধ্বংসের বীজ নিহিত থাকে। যদি এই বিষয়ে বা এ রকম আর কোনও বিষয়ে কোনও চুক্তি না করতে হয়, তা হলে আমরা বিষয়টি নিয়ে আলােচনায় রাজি।”[২১] এর এক দিন আগে, ৮ মে, গাঁধী ক্রিপস-কে লেখা একটি চিঠিতে সমতা নীতি সম্পর্কে তার আপত্তির কথা স্পষ্ট ভাবে জানান: “ছয়টি হিন্দু-প্রধান প্রদেশ এবং পাঁচটি মুসলমানপ্রধান প্রদেশের মধ্যে সমতা বজায় রাখার যা সুবিধা, অসুবিধা তার তুলনায় বহু গুণ বেশি।” কী ভাবে “নয় কোটি (মুসলমান) ও উনিশ কোটি হিন্দুর সঙ্গে সমতা বজায় রাখা সম্ভব? এই পরিকল্পনাটি পাকিস্তানের দাবির চেয়েও খারাপ৷” কেন্দ্রীয় আইনসভা এবং বিচারবিভাগ জনসংখ্যার ভিত্তিতে গড়ে তােলার প্রস্তাব দেওয়া হল।[২২] সিমলা সম্মেলন থেকে উল্লেখযােগ্য কোনও সিদ্ধান্তই পাওয়া সম্ভব হল না।
৩১৭
সম্মেলনটি অসফল ভাবেই শেষ হল। তার পর ১৬ মে ১৯৪৬ তারিখে ক্যাবিনেট মিশন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করল। মিশনের মতে, এই শ্বেতপত্রটিই “ভারতে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়াটি দ্রুত আরম্ভ করার জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা।”[২৩] ক্যাবিনেট মিশন এবং ভাইসরয়, উভয় পক্ষই মত প্রকাশ করলেন, ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের কিছু প্রাথমিক নীতি মেনে চলা উচিত। পাকিস্তান প্রসঙ্গে উপরােক্ত শ্বেতপত্রে লেখা হল: আমাদের পক্ষে ব্রিটিশ সরকারের কাছে এই প্রস্তাবটি দেওয়া সম্ভব নয় যে বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের হাতে যে শাসন ক্ষমতা আছে, তা দুটি সম্পূর্ণ পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া হােক। মিশনের সদস্যরা এবং ভাইসরয় এই সিদ্ধান্তে পৌছতে বাধ্য হয়েছেন যে সার্বভৌম পাকিস্তানের সৃষ্টি, তা আকারে ছােট বা বড় যা-ই হােক না কেন, ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার কোনও গ্রহণযােগ্য সমাধান করতে পারে না।[২৪]
ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ মে ১৯৪৬ তারিখের বিবৃতির মধ্যে দুটি পরিকল্পনা নিহিত ছিল— একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা’, আর একটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাগুলির মাধ্যমে মিশন পাকিস্তানের দাবিটি প্রত্যাখ্যান করল এবং একটি গণপরিষদবিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মাধ্যমে ভারতের প্রস্তাবিত সংবিধান রচনার কথা বলল। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় মিশন ভারতের প্রদেশগুলিকে তিনটি বর্গে বিভক্ত করার কথা বলল: হিন্দু-প্রধান প্রদেশের বর্গ; মুসলমান-প্রধান প্রদেশের বর্গ এবং পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের প্রদেশগুলি অর্থাৎ বাংলা এবং অসমের বর্গ। প্রতিটি বর্গের। নিজস্ব আইনসভা এবং শাসনবিভাগ থাকবে। প্রতিটি প্রদেশ বা কোনও প্রাদেশিক বর্গের ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে সামিল না হওয়ার অধিকার থাকবে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় অবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হল।
প্রস্তাবিত আইনসভা, ত্রিস্তরীয় বর্গব্যবস্থার চরিত্র এবং কর্মপ্রক্রিয়া ও অন্তবর্তী সরকারে প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে মতবিরােধ দেখা দিল। কংগ্রেসের মতে, অন্তবর্তী সরকার একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হওয়া উচিত। মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে একমত হল না। ত্রিস্তরীয় বর্গব্যবস্থা যদি আবশ্যক হয়, তবে কংগ্রেস সেই ব্যবস্থাটিকে মানতে সম্মত হল না; অন্য দিকে, মুসলিম লিগের কাছে এই ব্যবস্থা একটি জরুরি শর্ত। অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস ‘সমতা’-র নীতি মানতে রাজি হল না; মুসলিম লিগ সেই নীতি অনুযায়ী সরকার গঠনের দাবি জানাল।
ক্যাবিনেট মিশন মার্চ মাস থেকে ভারতে ছিল। শ্বেতপত্রে প্রকাশিত এই পরিকল্পনা ক্রমশ তৈরি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে জিন্নার সামনে দু’টি বিকল্প পথ খােলা রইল: ১) তিনি যদি সমগ্র পঞ্জাব, বাংলা এবং অসমকে তঁার মুসলিম উপ-যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হিসেবে চান, তা হলে তাকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্র (সে কেন্দ্রের ক্ষমতা যতই সীমিত হােক না কেন) মেনে নিতে হবে; ২) তিনি যদি ভারত-ভাগ ও সার্বভৌম পাকিস্তানের দাবিতে অনড় থাকেন, তা হলে তাকে ‘কাটছাঁট করা পাকিস্তানই মেনে নিতে হবে।। ১৬ মে-র বিবৃতিটি চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশ করার আগে তাতে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ
৩১৮
পরিবর্তন করা হয়েছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাবটি ছিল বাংলা প্রদেশের গভর্নর স্যর ফ্রেডরিক বারােস-এর, ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে ‘বর্গ (গ্রুপ) থেকে বিযুক্ত হওয়ার অধিকার সম্বন্ধে। এই পরিবর্তনের ফলে কংগ্রেস খানিকটা সন্দিহান হয়ে উঠল; দলের ধারণা হল, এই পরিবর্তনের ফলে অসমের সিদ্ধান্তগ্রহণের স্বাধীনতা খর্ব করা হল। ওয়াভেলকে লেখা ৯ মে ১৯৪৬ তারিখের চিঠিতে ফ্রেডরিক বারােস লিখলেন:
“আমি বুঝতে পারছি, প্রাদেশিক ও বর্গীয় সংবিধান তৈরি হয়ে যাওয়ার পরই প্রদেশগুলিকে বর্গ পরিবর্তনের অধিকার দেওয়ার প্রকৃত কারণ সংবিধান রচনাকালে ক্ষুদ্র প্রদেশগুলির স্বার্থ রক্ষা করা; কিন্তু এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে এই ক্ষমতাটি না দেওয়া হলে বাংলার মুসলমানরা সামগ্রিক ভাবে এই প্রস্তাবটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে এবং অসমের ভৌগােলিক কারণেই এই কথাটি বিশ্বাস করা কঠিন যে প্রদেশটি আদৌ কখনও এই বিযুক্তির অধিকারটি প্রয়ােগ করতে পারবে। সেই কারণেই আমি ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদের শেষ চারটি বাক্য বর্জনের পক্ষপাতী।”
বাংলার গভর্নরের দৃষ্টান্তটি অনুসরণ করেই এই অনুচ্ছেদটিতে পরিবর্তন সাধিত হল এবং স্থির করা হল, নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হওয়ার পরেই একমাত্র বিযুক্তির অধিকারটি প্রয়ােগ করা যাবে। ১০ মে ১৯৪৬, ক্যাবিনেট মিশনের। বৈঠকে বারােস-এর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। কিন্তু তার আগে এই বিষয়ে অসমের গভর্নরের। সঙ্গে আলােচনা করা হয়নি। বৈঠকের নথি শুধু বলছে: “১৯ (ছয়) নম্বর অনুচ্ছেদটি সংশােধিত হল। এই কথাটি সভায় স্বীকৃত হয় যে কোনও বর্গ থেকে বিযুক্তির সিদ্ধান্তটি নতুন সংবিধানের অধীনে নির্বাচিত নতুন আইনসভা দ্বারা গৃহীত হতে হবে। এই কথাটি উল্লেখ করা জরুরি নয় যে কোনও প্রদেশ বিযুক্ত হয়ে কোন বর্গের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। এই বিষয়টি আলােচনার উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত।” ১৬ মে তারিখে প্রকাশিত বিবৃতির ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে এই পরিবর্তন বিবৃতিটিকে কংগ্রেসের পক্ষে সম্পূর্ণ অগ্রহণযােগ্য করে তুলল। পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টিই বিভিন্ন দলের মধ্যে বিরােধের প্রধান কারণ হয়ে দাড়াল।[২৫]
ব্রিটেনের লেবার পার্টির তরুণ সাংসদ উডরাে ওয়্যাট ১৯৪৬ সালের মে মাসের শেষ দিকে জিন্নার সঙ্গে দেখা করতে সিমলা পৌছলেন। জিন্নাকে দেখে ওয়্যাটের মনে হল “তিনি চাপের মধ্যে আছেন, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণও আগের তুলনায় কম।” তার মনে হল, জিন্না “মুসলিম লিগ ওয়ার্কিং কমিটি ও দলের সর্বভারতীয় কাউন্সিলের মুখােমুখি হতে ইতস্তত করছেন।” জিন্নার সঙ্গে আলােচনায় ওয়্যাটের ধারণা হল, তিনি ১৬ মে তারিখের বিবৃতিতে প্রকাশিত প্রস্তাবটিকে অসম্ভব মনে করছেন। কিন্তু, যে হেতু তিনি প্রমাণ করতে চান যে তিনি এই প্রস্তাবটিকে মেনে দেখতে রাজি, তাই তিনি পাকিস্তান গঠনের প্রথম ধাপ হিসেবে এই প্রস্তাবটিতে সম্মতি জানাতে প্রস্তুত। ৬ জুন ১৯৪৬ তারিখে তিনি মুসলিম লিগকে প্রস্তাবটিকে সম্মতি জানাতে রাজি করালেন।
১৬ মে-র প্রস্তাবের অনেক আগেই অন্তর্বর্তী সরকার সম্বন্ধে ওয়াভেল চিন্তাভাবনা করেছিলেন। তিনি প্রাথমিক ভাবে ১২ জন সদস্য নিয়ে সরকার গঠন করার কথা
৩১৯
ভাবছিলেন… মুসলিম লিগের পাঁচ জন, “কংগ্রেস থেকে এক জন তফশিলি জাতিভুক্ত সদস্য সহ পাঁচ জন, এক জন শিখ এবং আরও এক জন।”[২৬] এই মুহূর্ত থেকে যে ভাবে ঘটনা এগােতে থাকল, তাতে জিন্নার ‘সমতা নীতি’ ক্রমশ গুরুত্ব হারাল। প্রতিটি চিঠি, প্রতিটি বৈঠক এই পথে আরও এক ধাপ করে এগােতে থাকল। শেষ পর্যন্ত ২৯ জুলাই, ১৯৪৬ মুসলিম লিগ ১৬ মে-র বিবৃতিটি প্রত্যাখ্যান করল। সেই সময় কেউ কি অনুমান করতে পেরেছিল, ঠিক এক পক্ষকাল করে কী অপেক্ষা করে আছে? অপেক্ষা করে ছিল কলকাতায় ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে, ১৬ অগস্ট ১৯৪৬।
৩ জুন ১৯৪৬ ওয়াভেল ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবটি নিয়ে জিন্নার সঙ্গে দু’বার আলােচনায় বসেন। সকাল দশটার প্রথম বৈঠকে, যেখানে ওয়াভেল ও ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যদের সঙ্গে জিন্না বৈঠকে বসেছিলেন, সেই বৈঠকের আলােচনার রেকর্ড নীচে দেওয়া হল:
…জিন্না জানালেন, সব কিছু ঠিকঠাক চললে তিনি ৭ জুন তাঁর নামের তালিকাটি দেবেন। ভাইসরয়ের মনে হয়েছিল, জিন্না তার দলের সদস্যদের ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে রাজি করানাের চেষ্টা করবেন। ভাইসরয় জানান যে তিনি সরকারি ভাবে কোনও আশ্বাস দিতে পারবেন না, তবে তার ব্যক্তিগত ধারণা, লিগের সদস্যরা প্রস্তাবটি মেনে নিলে তাদের ক্ষতি হবে না….. জিন্না প্রশ্ন তােলেন, এই পরিস্থিতিতে মুসলিম লিগকে কি অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিতে ডাকা হবে, এবং মন্ত্রিসভায় তাদের যথেষ্ট জায়গা দেওয়া হবে? ভাইসরয় উত্তরে জানান যে, তিনি জিন্নাকে আশ্বাস দিতে পারেন যে মুসলিম লিগকে মন্ত্রিসভায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হবে। জিন্না ভাইসরয়কে এই ‘আশ্বাস’-গুলি লিখিত ভাবে দিতে অনুরােধ করেন, কারণ তার মতে, তাতে দলের ওয়ার্কিং কমিটিকে বােঝাতে সুবিধা হবে। স্থির হয়, ভাইসরয় জিন্নাকে একটি চিঠি লিখবেন। মধ্যাহ্নভােজনের পর সেই চিঠি মিশনের সদস্যদের বিবেচনার জন্য পেশ করা হবে। (এই আলােচনার সময় স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস সম্ভবত উপস্থিত ছিলেন না)।
বিকেল চারটের সময় যখন ওয়াভেল ফের জিন্নার সঙ্গে বৈঠকে যােগ দেন, তাঁদের আলােচনা প্রধানত এই আশ্বাসগুলিকে কেন্দ্র করেই ঘুরল। ওয়াভেল জিন্নাকে আশ্বাসগুলি দেখালেন। বৈঠকের সরকারি নথি থেকে উদ্ধৃত করছি:
ফিল্ড মার্শাল ভাইকাউন্ট ওয়াভেল হইতে মিস্টার অ্যাবেলের প্রতি ৩ জুন
৩২০
এই চিঠিগুলি ফাইলে রাখা প্রয়ােজন। আমি দুটি চিঠিই জিন্নাকে দেখিয়েছি। মনে হল, তিনি সন্তুষ্ট। চূড়ান্ত গােপনীয়
ওয়াভেল (স্বাঃ)
৩ জুন ১৯৪৬ তারিখে জিন্নাকে দেওয়া মৌখিক আশ্বাসসমূহ আপনি বৈঠক চলাকালীন আমায় যে বিষয়টি বলেছিলেন, আমি সে সম্বন্ধে ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যদের সঙ্গে আলােচনা করেছি। এই আলােচনাপ্রক্রিয়া ফলপ্রসূ না হলে মিশন ঠিক কী করবে, সে বিষয়ে আপনাকে কোনও লিখিত আশ্বাস দেওয়া মিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু মিশনের তরফে আমি আপনাকে ব্যক্তিগত ভাবে আশ্বস্ত করতে পারি যে দুটি দলের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করার কোনও ইচ্ছে আমাদের নেই। যদি একটি দলও আমাদের প্রস্তাবে সম্মত হয়, তবে পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে যত দূর সম্ভব, আমরা এই পরিকল্পনাটিকে বাস্তবায়িত করতে তত দূর যাব। কিন্তু আমরা আশা রাখি, দুটি দলই সম্মত হবে।
আমি জানি, আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে পারি। তাই আপনাকে অনুরােধ করব, এই আশ্বাসটির কথা জনসমক্ষে ঘােষণা করবেন না। যদি প্রয়ােজন হয়, তা হলে দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের বলুন যে এ বিষয়ে আপনি সন্তুষ্ট হয়েছেন।
এনক্লোজার ২ টু নং ৪০
অফিস অব ক্যাবিনেট ডেলিগেশন, দ্য ভাইসরয়জ হাউস, নিউ দিল্লি
যদি দুটি দলের একটিও আমাদের প্রস্তাবে রাজি হয়, তা হলে আমরা যত দূর সম্ভব এই পরিকল্পনাটিকে অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করব। যথাসময়ে বাস্তব পরিস্থিতির প্রয়ােজনে হয়তাে বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রয়ােজন হবে, কিন্তু যত দূর সম্ভব মূল প্রস্তাবটিকে কার্যকর করাই আমাদের লক্ষ্য হবে। (এই নােটটিতে কোনও তারিখ বা স্বাক্ষর নেই, কিন্তু স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস সম্ভবত নােটটি দেখেছেন)[২৮]
৪ জুন ১৯৪৬ তারিখে মুসলিম লিগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসল। সেই বৈঠকে ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্য, ইস্পাহানি, একটি যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তুললেন। তিনি বললেন, লিগ ১৬ মে-র বিবৃতিতে প্রকাশিত প্রস্তাবটি মেনে নেওয়ার পর যদি কংগ্রেস প্রস্তাবটি মানতে অস্বীকার করে, তা হলে কী হবে? তা হলে মুসলিম লিগের
৩২১
পাকিস্তানের দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রবল সমালােচনার সম্মুখীন হবে। ঠিক এই প্রশ্নটিতেই জিন্না ওয়াভেলের থেকে লিখিত আশ্বাস চেয়েছিলেন, কিন্তু লিগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত সে আশ্বাস এসে পৌছােয়নি। ওয়াভেলের প্রশাসনিক দলের ভয় ছিল, লিগের দাবি মেনে এমন লিখিত আশ্বাস দিলে কংগ্রেস অসন্তুষ্ট হতে পারে।
১৬ মে তারিখের প্রস্তাবটি বিবেচনা করার জন্য ৬ জুন ১৯৪৬ কাউন্সিল অব অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ-এর বৈঠক বসল। বৈঠকের পর কাউন্সিল ভাইসরয়ের সঙ্গে পরবর্তী আলােচনা চালানাের জন্য জিন্নাকে মনােনীত করল এবং তাকে তার বিবেচনা অনুযায়ী যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার দেওয়া হল। জিন্না এই বৈঠকেই খুব জোর দিয়ে বললেন, “আমি আপনাদের ক্রিপস-এর প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ দিয়েছিলাম। আমিই সিমলা সম্মেলনের প্রস্তাবটি গ্রহণ না করতে বলেছিলাম। কিন্তু আমি ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরামর্শ দিচ্ছি না। আমি আপনাদের বলছি, এই প্রস্তাবটিতে সম্মত হােন।” বলা বাহুল্য, লিগ কাউন্সিল জিন্নার কথা মেনে নিল।
ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবটি মেনে নেওয়ার পর, নিজেকে আরও এক বার আশ্বস্ত করার জন্যই জিন্না ৮ জুন তারিখে ওয়াভেলকে একটি চিঠি লিখে ফের লিখিত আশ্বাসের দাবি করলেন। এ বারও আশ্বাসের মূল প্রশ্নটি সমতার। জিন্না লিখলেন, “আপনার পূর্ব-অনুমতিক্রমে আমি ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের আপনার আশ্বাসের কথাটি জানিয়েছিলাম। তাদের ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার পিছনে এই আশ্বাসের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।… ৬ জুন তারিখে কাউন্সিল অব অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ-ও এই প্রস্তাবে তাদের সম্মতি জানিয়েছে। এই বৈঠকেও আমি আপনার আশ্বাসের কথার উল্লেখ করেছিলাম।”
অন্তর্বর্তী সরকারে সমতা বজায় রাখার দাবিতে (অর্থাৎ, পাঁচ জন লিগ সদস্য, পাঁচ জন কংগ্রেস সদস্য) জিন্না অনড় রইলেন। কিন্তু ওয়াভেলের ধারণা ছিল, বাংলা ও অসমের প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লা এবং নিজামুদ্দিন যেহেতু সরকার চালানাের প্রশ্নে কংগ্রেসের ওপর নির্ভরশীল, তাই শেষ পর্যন্ত জিন্নাকে নিজের অবস্থান নরম করতেই হবে। তা ছাড়াও, লিয়াকত আলিও মন্ত্রিত্বের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ওয়াভেলের তাই ধারণা। হল, চাপের মুখে জিন্না তার নামের তালিকা পাঠাতে বাধ্য হবেন। কিন্তু, জিন্না সেই তালিকা পাঠালেন না। বরং, জিন্না তাকে জানালেন: “কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত নিজেদের সিদ্ধান্ত জানায়নি। এই পরিস্থিতিতে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব বা মন্ত্রিত্বের প্রশ্নগুলাে। আলােচনা করা সমীচীন নয় বলেই আমি মনে করি।”[২৯]
ভাইসরয় কংগ্রেসের সঙ্গে সমতার প্রশ্নটি নিয়ে আলােচনা করছিলেন। কিন্তু সেই আলােচনার কোনও ফল হল না। ১৫ জুন ১৯৪৬ ভাইসরয় ওয়াভেল জিন্নাকে জানালেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামাে সম্বন্ধে কংগ্রেসের সঙ্গে একটি সমঝােতায় পৌছনাের যে প্রচেষ্টাটির কথা তিনি জিন্নাকে বলেছিলেন, তা ব্যর্থ হয়েছে। ক্যাবিনেট
৩২২
মিশনের সদস্যরা এবং ওয়াভেল ভবিষ্যতের কর্মপদ্ধতি সংক্রান্ত একটি বিবৃতি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত করেছেন।” [৩০]
১৬ জুন ১৯৪৬ তারিখের বিবৃতিতে ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে যা জানা গেল: মােট ১৪ জন ব্যক্তিকে (আগেকার পরিকল্পনার ১২ জনের চেয়ে দুই জন বেশি) অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানাে হবে। এই প্রস্তাবটি গৃহীত হলে ভাইসরয় ২৬ জুন নাগাদ এই সরকার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু যদি দুটি প্রধান দলের একটি বা দুটিই এই প্রস্তাবে আপত্তি জানায়, তা হলেও ভাইসরয় অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলেই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।[৩১]
১৬ জুন তারিখে প্রকাশিত বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে যে মূল নীতি গৃহীত হল, তা চরিত্রগত ভাবে এক মাস পূর্বে (১৬ মে) তারিখে প্রকাশিত বিবৃতিটির মূল নীতি সংক্রান্ত বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, কিন্তু এই বিবৃতিটিকে কোথাও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সম্মতির কথা বলা হল না। তা হলে কেন জিন্নার সঙ্গে বৈঠকে (যার বিবরণ ইতিপূর্বেই উদ্ধৃত করা হয়েছে) মিশনের সদস্যরা দুই দলের সম্মতির ওপর জোর দিয়েছিলেন, এবং কেবলমাত্র লিগকে নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাবে অসম্মত হয়েছিলেন? কারণটি সহজবােধ্য। এই প্রস্তাবে রাজি হলে ইতিমধ্যেই রেগে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগােষ্ঠীর আরও বিরাগভাজন হতে হত। এবং, ওয়াভেলের পক্ষে এই কথাটি স্পষ্ট ভাবে বলা সম্ভব ছিল না।
১৮ জুন ১৯৪৬ আরও একটি সমস্যা তৈরি হল। ওয়াভেল কংগ্রেসের যে সদস্যদের অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক হিন্দু ব্যক্তির পরিবর্তে ডক্টর জাকির হুসেনকে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকারে পাঠাতে চাইল। জিন্নার সঙ্গে তার আলােচনায় ওয়াভেল এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন। ওয়াভেল লিখছেন, “আমি জিন্নাকে আজ সকালে আজাদ এবং নেহরুর সঙ্গে আমার আলােচনার কথা বললাম। বসুর পরিবর্তে মহতাবের অন্তর্ভুক্তির প্রসঙ্গে তিনি কোনও মন্তব্য করলেন না। কিন্তু আমি যখন তাকে জানালাম যে কংগ্রেস এক জন হিন্দুর পরিবর্তে সরকারে ডক্টর জাকির হুসেনের অন্তর্ভুক্তি চাইছে, জিন্না বললেন যে এই প্রস্তাব কোনও ভাবেই গ্রহণযােগ্য নয়। জিন্নার সঙ্গে যত ক্ষণ আলােচনা হল, তিনি বারে বারেই এই প্রসঙ্গে ফিরে আসছিলেন। তিনি হুসেনকে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ হিসেবে বর্ণনা করলেন এবং বললেন, যদি তিনি এই অন্তর্ভুক্তি মেনে নেন, তা হলে তার আর কোথাও মুখ দেখানাের উপায় থাকবে না।” ২৫ জুন ১৯৪৬ যখন তৎপর্যপূর্ণ বৈঠকটি বসল, এই প্রসঙ্গটি জিন্না এবং ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যদের মধ্যে একটি বিরাট বাধা তৈরি করল।[৩২]
জিন্না ফের সমতার দাবিটি তুললেন। ১৯ জুন ১৯৪৬ তারিখে তিনি ওয়াভেলের কাছে পাঁচ জন মুসলমান, পাঁচ জন হিন্দু, এক জন শিখ এবং এক জন ভারতীয় খ্রিস্টানের দাবি জানালেন। জিন্না তার চিঠিতে নতুন দিল্লিতে তাঁকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথাটি মনে করিয়ে দিলেন এবং জানালেন যে সেই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তিনি লিগ কাউন্সিলে বক্তব্য পেশ করেছেন। জিন্নার মতে, কাউন্সিলের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হবে:
৩২৩
“(তা হলে) কেন এর ভিত্তিটি বদলে পাঁচ জন মুসলিম লিগ সদস্য, পাঁচ জন কংগ্রেস সদস্য এবং অন্য তিন জন হয়ে গেল? তা হলে কি জিন্না ওয়াভেলকে এই কথাটি জানাননি যে এমন কোনও পরিবর্তন হলে সে বিষয়ে জিন্নাকে ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলােচনা করতে হবে, প্রয়ােজনে কাউন্সিলের আর একটি বৈঠক ডাকতে হবে? যে ভাবে মুসলিম লিগ দলকে সরকারি ভাবে কিছু না জানিয়ে পাঁচ জন সদস্যকে অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দেওয়ার জন্য সরাসরি আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে, তাতে জিন্না এবং লিগ কাউন্সিল বিস্মিত। ….. “কেনই বা কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম লিগের সমতা-র নীতিটি বিসর্জন দিয়ে মুসলিম লিগ ও ‘বর্ণ-হিন্দুদের মধ্যে সমতা তৈরি করা হয়েছে? এবং কেন এই সমতাকে আরও বিঘ্নিত করার জন্য জগজীবন রামের নাম তফসিলি জাতিভুক্ত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যখন তিনি আগে থেকেই কংগ্রেসের সদস্য?” জিন্নার মতে, এই সিদ্ধান্তগুলির ফলে অন্তর্বর্তী সরকারে মুসলমানদের অনুপাত সামগ্রিক ভাবে বিঘ্নিত হয়েছে এবং কংগ্রেসের তুলনায় গােষ্ঠী হিসেবেও মুসলিম লিগ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু এই পর্যায়েও জিন্না অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিতে অস্বীকার করেননি। ওয়াভেলকে লেখা ১৯ জুন ১৯৪৬ তারিখের চিঠিতেও তিনি মন্ত্রিত্ববণ্টনের পদ্ধতি সম্বন্ধে আলােচনা করেছেন।[৩৩]
অস্বীকার করার উপায় নেই, পরিস্থিতি ক্রমেই জিন্নার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। জিন্নার চিঠির উত্তরে ওয়াভেল লেখেন, “আপনিও নিশ্চয়ই মানবেন যে একটি দলের স্বার্থ অপর দলের স্বার্থবিরােধী, এমন দুটি দলকে কোনও একটি প্রশ্নে মতৈক্যে আনার জন্য কোনও প্রক্রিয়া আরম্ভ করা হলে, প্রক্রিয়াটি ঠিক যে ভিত্তিতে আরম্ভ হয়, একেবারে সেই ভিত্তিতেই শেষ না-ও হতে পারে। এবং আপনি জানেন, আমি আপনাকে কখনও এই আশ্বাস দিইনি যে এই প্রক্রিয়াটি কোনও বিশেষ ভিত্তিতে উপনীত হবে।”[৩৪] এর আগের একটি চিঠির উত্তরে ওয়াভেল জিন্নাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, “যদি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন না পাওয়া যায়, তা হলে এই অন্তর্বর্তী সরকার সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে কোনও বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না।” ওয়াভেল জানান যে তিনি কংগ্রেস সভাপতি মৌলানা আজাদকেও এই কথাটি বলেছেন এবং আজাদ এই বিষয়টির গুরুত্ব স্বীকার করেছেন।
এর পরেই ওয়াভেলের কাছে এসে পৌছল কংগ্রেস সভাপতি আজাদের লেখা চিঠি, এবং কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির গৃহীত প্রস্তাব: দুটিই ২৫ জুন ১৯৪৬ তারিখে। এবং, এই দুটি নথি পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ এলােমেলাে করে দিল। কংগ্রেস সভাপতির চিঠি এবং ওয়ার্কিং কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবের অংশবিশেষ নীচে উদ্ধৃত করা হল।
৩২৪
মৌলানা আজাদ হইতে ফিল্ড মার্শাল ভাইকাউন্ট ওয়াভেলের প্রতি
২৫ জুন ১৯৪৬
আমাদের পক্ষে সাময়িক ভাবেও কোনও সমতা নীতি মেনে নেওয়া সম্ভব নয়… অন্তর্বর্তী সরকারে পনেরাে জন সদস্যই থাকা প্রয়ােজন।
এই তালিকাটির (অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার গঠনের জন্য) একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এতে এক জনও জাতীয়তাবাদী মুসলমানের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আমাদের মতে, এই ভুলটি খুবই বড়। আমরা তালিকায় থাকা কোনও এক জন কংগ্রেস প্রতিনিধির পরিবর্তে এক জন মুসলমান প্রার্থীর নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলাম। আমাদের মনে হয়েছিল, আমাদের দলের কোনও প্রার্থীর নাম পরিবর্তন করা হলে ততে অন্য কোনও পক্ষের আপত্তি থাকার কোনও কারণ থাকতে পারে না। বস্তুত, আমি যখন মুসলিম লিগের মনােনীত প্রার্থীতালিকায় থাকা এক ব্যক্তির বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানিয়েছিলাম যে উল্লিখিত ব্যক্তি কিছু দিন পূর্বেই সীমান্ত প্রদেশে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন, এবং জানিয়েছিলাম যে আমাদের মতে ওই ব্যক্তির সম্ভাব্য প্রতিনিধিতালিকায় অন্তর্ভুক্তির কারণ শুধুমাত্র রাজনৈতিক, আপনি আমায় উত্তরে লিখেছিলেন, “আমি যেমন কংগ্রেসের প্রার্থীতালিকার বিষয়ে মুসলিম লিগকে আপত্তি করার অধিকার দিতে পারি না, ঠিক তেমনই মুসলিম লিগের পাঠানাে প্রার্থীতালিকার বিষয়ে আমি কংগ্রেসকে আপত্তি জানানাের অধিকার দিতে পারি না। প্রার্থীর দক্ষতাই একমাত্র বিবেচ্য।” আমরা কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগেই আপনার ২২ জুন তারিখের চিঠিটি আমার কাছে এসে পৌঁছােয় এবং সেই চিঠির বক্তব্যে আমরা বিস্মিত। আপনি সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোনও খবরের ভিত্তিতে এই চিঠিটি লিখেছিলেন। আপনি লিখেছিলেন কংগ্রেস এই অন্তর্বর্তী সরকারে তার প্রতিনিধিদের মধ্যে কোনও মুসলমান নেতার নাম অন্তর্ভুক্ত করলে আপনি বা ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যরা সেই দাবি মেনে নিতে তৈরি নন। এই সিদ্ধান্তটি একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত বলেই বােধ হচ্ছে। আপনার এই বক্তব্যটি আপনার পূর্ব-উদ্ধৃত বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। আপনার এই বক্তব্য অনুযায়ী, কংগ্রেস তার নিজের প্রতিনিধিদের মনােনয়নের স্বাধীনতাটুকুও পাবে না।
জিন্না যখন সংখ্যালঘুদের তালিকায় তফশিলি জাতিভুক্তদের যােগ করেছিলেন, তখন আপনারা দৃশ্যতই তাতে আপত্তি করেননি। আমরা এই মতামতকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করি এবং তফশিলি জাতিভুক্তদের হিন্দু সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে জ্ঞান করি।
৩২৫
আপনি পাঁচ নম্বর প্রশ্নের উত্তর জানিয়েছিলেন, “যদি দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন না পাওয়া যায়, তা হলে এই অন্তর্বর্তী সরকার সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে কোনও বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে না। আপনি এ-ও বলেছিলেন যে আপনি এই বক্তব্যটি কংগ্রেস সভাপতিকে জানিয়েছেন এবং তিনি আপনার বক্তব্যের গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে আমি জানাতে চাই যে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি গণপরিষদের প্রেক্ষিতে এই বক্তব্যে নীতিগত সম্মতি জানিয়েছিলাম এবং কোনও অন্তর্বর্তী সরকার যদি সেই আইনসভার প্রতি দায়বদ্ধ হয় এবং সে সরকারে প্রতিনিধিত্ব যদি দেশের বড় সম্প্রদায়গুলির জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়, তবে এই নীতি সেই অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য হতে পারে। কিন্তু কোনও অন্তর্বর্তী সরকার যদি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিত্তিতে গঠিত হয়, সে ক্ষেত্রে এই নীতি অপ্রযােজ্য।
আমার কমিটি অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে আপনি আপনার ১৬ জুন ১৯৪৬ তারিখের বিবৃতিতে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছিলেন, আমার দল সে বিষয়ে আপনার সঙ্গে কোনও রকম সহযােগিতা করতে পারছে না।
১৬ মে ১৯৪৬ তারিখের বিবৃতিতে আপনি সংবিধান রচনার জন্য একটি গােষ্ঠী গঠনের বিষয়ে যে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, সে সম্পর্কে জানাই: এ বিষয়ে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে ২৪ মে ১৯৪৬ একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে এবং বিভিন্ন আলােচনা এবং চিঠিপত্রে আমরা এই। প্রস্তাবের বিচ্যুতিগুলির দিকে নির্দেশ করেছি। এই বিবৃতির বেশ কিছু অংশকে কংগ্রেস কী ভাবে দেখছে, আমরা তা-ও জানিয়েছি। আমরা। আমাদের বক্তব্যে স্থির থেকেও আপনার প্রস্তাবটি স্বীকার করছি এবং আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছনাের জন্য আপনার প্রস্তাব অনুসারে কাজ করতে রাজি আছি। কিন্তু, এই কথাটিও উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে গণপরিষদ যথাযথ কাজ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারটি সন্তোষজনক ভাবে গঠিত হওয়া প্রয়ােজন।[৩৫]
এনক্লোজার টু নং ৬০৩
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাব, তারিখ ২৫ জুন ১৯৪৬
কংগ্রেস যে স্বাধীনতা অর্জনকে নিজের লক্ষ্য বলে জ্ঞান করে, তা হল: একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনবিশিষ্ট সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র, যা বিশ্বের সব দেশের থেকে সম্মান আদায় করবে, যেখানে প্রদেশগুলিকে সর্বাধিক স্বশাসনের অধিকার দেওয়া হবে এবং সব দেশের নারী-পুরুষের
৩২৬
সমান অধিকার থাকবে। প্রস্তাবটিতে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ক্ষমতাকে যে ভাবে সীমিত করা হয়েছে এবং যে ভাবে প্রদেশগুলির বর্গীকরণের কথা। বলা হয়েছে, তাতে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামােটি দুর্বল হয়ে পড়বে এবং এই প্রস্তাবটি উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বা অসমের মতাে কয়েকটি রাজ্য এবং কিছু সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠী, বিশেষত শিখদের স্বার্থবিরােধী। কমিটি এই প্রস্তাবটিকে প্রত্যাখ্যান করছে।
১৬ জুন তারিখের বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার সম্বন্ধে যে প্রস্তাবটি প্রকাশিত হয়েছে, তার বেশ কয়েকটি বিচ্যুতি কংগ্রেসের পক্ষে তাৎপর্যপূর্ণ। ২৫ জুন কংগ্রেস সভাপতি ভাইসরয়কে যে চিঠিটি লেখেন, তাতে কয়েকটি বিচ্যুতির উল্লেখ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অবশ্যই ক্ষমতা, কর্তৃত্ব এবং দায়িত্ব থাকতে হবে। যদি আইনত না-ও হয়, এই সরকারকে বস্তুত পূর্ণ স্বাধীনতার পথ সুগম করার জন্য একটি স্বাধীন সরকারের মতােই কাজ করতে হবে। এই সরকারের সদস্যরা কেবলমাত্র দেশের মানুষের কাছেই দায়বদ্ধ হবেন, কোনও বৈদেশিক শক্তির কাছে। নয়। এই অন্তর্বর্তী সরকার, বা কোনও সরকার গঠনের জন্যই কংগ্রেস তার জাতীয় চরিত্রটি বর্জন করতে পারে না, বা কোনও কৃত্রিম, অন্যায় সমতাকে মেনে নিতে পারে না, বা কোনও সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠীর ভেটো। মেনে নিতে পারে না। ১৬ জুন তারিখের বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, কমিটি সেই প্রস্তাব স্বীকারে অসমর্থ।
অবশ্য কমিটি সিদ্ধান্ত করেছে যে স্বাধীন, সংযুক্ত ও গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধান রচনার জন্য কংগ্রেস প্রস্তাবিত সাংবিধানিক আইনসভায় যােগ দেবে।
যদিও কংগ্রেস গণপরিষদে যােগ দিতে মনস্থ করেছে, ওয়ার্কিং কমিটির মতে যত শীঘ্র সম্ভব, একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ও দায়িত্বশীল অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা জরুরি।[৩৬]
এই চিঠির তাৎক্ষণিক ফল হল, ২৫ জুন তারিখেই ক্যাবিনেট মিশনের সদস্য ও ওয়াভেলের সঙ্গে জিন্নার বৈঠক। এই বৈঠকটির তার বিশেষ ইতিবাচক সুরে বাঁধা ছিল না । বৈঠকের শুরুতেই কংগ্রেসের ১৬ মে তারিখের বিবৃতিটি স্বীকার করার আন্তরিকতা নিয়ে জিন্না প্রশ্ন তুললেন। এর পর সেক্রেটারি অব স্টেট ১৯ জুন তারিখে ওয়াভেলকে লেখা জিন্নার চিঠিটি প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেওয়ার জন্য জিন্নাকে দায়ী করলেন। ২৫ জুন ১৯৪৬ তারিখের দুর্ভাগ্যজনক বৈঠকটিতে কোনও লাভ হল না। পরের দিন ক্যাবিনেট মিশন ও ওয়াভেল একটি বিবৃতি দিয়ে জানালেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটি আপাতত স্থগিত রাখা হল।
৩২৭
পাশাপাশি ওয়াভেল ও ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যরা জিন্নাকে স্পষ্ট ভাবে জানালেন যে তারা গণপরিষদের নির্বাচনের পূর্বনির্ধারিত সময়সীমা বজায় রাখতে চান। জিন্না এই নির্বাচনটি পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বার বার জোর করছিলেন। সংবিধান রচনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা— এই দুটি জিন্নার কাছে একটি সামগ্রিক পরিকল্পনার অঙ্গ ছিল। ফলে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরিকল্পনাটিকে স্থগিত রেখে গণপরিষদের নির্বাচনের পরিকল্পনাটি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে তার আপত্তি ছিল।[৩৭] জিন্নার এই প্রস্তাবটিও ভাইসরয় গ্রাহ্য করলেন না।
ক্যাবিনেট মিশনের ব্যর্থতার দায়ভার দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ওয়াভেলের ঘাড়ে পড়ল। দুর্ভাগ্যজনক, কারণ ১৬ মে তারিখের বিবৃতিটি প্রকাশ করার আগেই ওয়াভেল বলেছিলেন, দুটি দলের একটি যদি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তা হলে কী করা হবে, সে বিষয়ে আগে থেকেই আলােচনা করে নেওয়া হােক। তিনি তার ব্যক্তিগত সচিব জর্জ অ্যাবেলের সঙ্গে এ বিষয়ে প্রকাশ্যেই আলােচনা করেছিলেন। যদি মুসলিম লিগ অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিতে সম্মত না হয় এবং ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেসকে নিয়েই সরকার গঠন করতে রাজি হয়, তা হলে যে সমস্যা তৈরি হতে পারে, সে বিষয়ে ওয়াভেল নিখুঁত ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। ওয়াভেল আশঙ্কা করেছিলেন, কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের বিরােধের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাড়াবে সমতার প্রশ্নটি এবং এই ক্ষেত্রে ক্রিপস ও পেথিক লরেন্সের অবস্থান কী হবে, সে বিষয়ে ওয়াভেল নিশ্চিত ছিলেন না। ওয়াভেলের মনে হয়েছিল, এই দু’জন কংগ্রেসের প্রতি এমনই অনুকূল ছিলেন যে দলটির বিরুদ্ধে কোনও অবস্থান নেওয়া এঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। ওয়াভেল তার ডায়েরিতে এই দু’জনের কংগ্রেস-প্রীতির বিষয়ে যথেষ্ট কড়া মন্তব্য করেছেন।
২৫ জুন জিন্নার সঙ্গে বৈঠকের আগে ক্রিপস ওয়াভেলকে স্পষ্ট ভাবে জানান যে কংগ্রেস ১৬ মে তারিখের বিবৃতিটি প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু, কার্যক্ষেত্রে ক্রিপস ঠিক উল্টো কাজটি করলেন। তিনি কংগ্রেসকে প্রস্তাবটি মেনে নেওয়ার জন্য বােঝাতে আরম্ভ করলেন, এবং তাতে যে কংগ্রেসের লাভ হবে, তা-ও স্পষ্ট করতে আরম্ভ করলেন। পেথিক লরেন্সও একমত ছিলেন। ফলে, জিন্নার সঙ্গে বৈঠকে ওয়াভেল চূড়ান্ত অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়লেন। ওয়াভেলের নিরপেক্ষ ভাবনার ওপর কংগ্রেসের প্রতি এই সহনুভূতি এমনই ছাপ ফেলেছিল যে তিনি একে একটি ‘অসৎ গ্রহণযােগ্যতা বলে বর্ণনা করেন।
কিন্তু, ওয়াভেল তার মতামত থেকে সরে আসেননি। ২৬ জুন যখন ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যরা কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন, তখনও ওয়াভেল কংগ্রেসের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করার পক্ষেই জোর দেন। এই বৈঠকে তার হতাশা এমন পর্যায়ে পৌঁছােয় যে তিনি পদত্যাগ করার কথা ভাবতে আরম্ভ করেন। তার পক্ষে এই কথাটি মেনে নেওয়া কঠিন ছিল যে ক্যাবিনেট মিশনের কিছু সদস্য নিজের দায়িত্বের প্রতি সম্পূর্ণ সৎ ছিলেন না। বস্তুত, ২৯ জুন ব্রিটেনে ফিরে যাওয়ার সময়
৩২৮
ক্রিপস তার সঙ্গে দেখাও করেননি, ভদ্রতার খাতিরেও নয়।
ক্যাবিনেট মিশন মুসলিম লিগকে একা সরকার গঠন করার সুযােগ দিল না। তার ফলে আমদাবাদে ফের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আরম্ভ হল। বম্বের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মােরারজি দেশাই যখন ঘটনাস্থলে যাওয়ার আগে গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন, গাঁধী তাকে বললেন, “ওখানে যাওয়ার সময় নিরাপত্তার জন্য একমাত্র ঈশ্বরের ওপরই নির্ভর করতে হবে, কোনও পুলিশ বা মিলিটারির সাহায্য নেওয়া চলবে না।” যদি প্রয়ােজন হয়, তা হলে “এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুনে প্রাণ দিতে হবে, যেমন দিয়েছিলেন গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী। কানপুরের জাতীয়তাবাদী ‘দৈনিক প্রতাপ’-এর এই তরুণ সাংবাদিক এক শান্তি প্রক্রিয়ার শরিক হিসেবে ১৯৩১ সালে কানপুরের হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা নিবারণ করতে গিয়ে নিহত হন।
কংগ্রেসের নবনির্বাচিত সভাপতির সাক্ষাৎকার
১৬ জুন তারিখের বিবৃতির প্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া জটিলতার ফলে কোনও সমঝােতার সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকল। (২৫ জুন তারিখের) কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাব এবং ক্যাবিনেট মিশনের অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটিকে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলল। এই পরিস্থিতিতে ১০ জুলাই ১৯৪৬ জওহরলাল নেহরু একটি সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য এর চেয়ে খারাপ সময় খুঁজে বার করা দুষ্কর ছিল। মেনে নেওয়া মুশকিল যে নেহরু জানতেন না যে এই সময় এর রকম একটি সাংবাদিক সম্মেলন বা সাক্ষাৎকারের ফল কী হতে পারে। ঠিক এই কারণেই এই সাংবাদিক সম্মেলনের কিছু অংশ হুবহু তুলে দেওয়া প্রয়ােজন:
সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকার, বম্বে, ১০ জুলাই ১৯৪৬, ১১ জুলাই ১৯৪৬-এর ‘দ্য হিন্দু থেকে:
একটি প্রশ্নের উত্তরে জওহরলাল নেহরু বলেন— এ কথা সত্যি যে গণপরিষদে যােগ দিতে সম্মত হওয়ার ফলে সেখানে প্রতিনিধিদের।
নির্বাচনের প্রক্রিয়াটিতে আমাদের আগে থেকেই সম্মতি জানাতে হচ্ছে। সেই গণপরিষদে আমরা কী করব, তা স্থির করার পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের আছে। আমরা কোনও বিষয়েই কাউকে কোনও প্রতিশ্রুতি দিইনি। কেউ কোনও বিষয়ে পূর্বাহে কোনও প্রতিশ্রুতি না দিলেও পরিস্থিতির চাপে স্বভাবতই দু-একটি বিষয় মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। একটি বড় সম্ভাবনা হল, যে ভাবেই বৰ্গীকরণের চেষ্টা হােক না কেন,
৩২৯
প্রকৃতপক্ষে কোনও বৰ্গীকরণ হবে না। ক বর্গ নিশ্চিত ভাবেই কোনও বর্গীকরণের বিপক্ষে মত দেবে। বাজি ধরার ভাষায় বলতে গেলে, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বৰ্গীকরণের বিরুদ্ধে মত দেওয়ার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ। এখানেই খ বর্গের দৌড়ও শেষ। অসম বাংলার সঙ্গে এক বর্গে থাকতে চাইবে না, তার সম্ভাবনাই বেশি; যদিও আমি বলতে পারব না প্রাথমিক পর্যায়ে এই প্রদেশের সিদ্ধান্ত কী হবে, কারণ এই প্রদেশে দু’পক্ষেরই পাল্লা সমান ভারী। তবে, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত কোনও বৰ্গীকরণ হবে না, কারণ কোনও পরিস্থিতিতেই অসম তা মেনে নেবে না। অতএব, বুঝতেই পারছেন, যে দিক থেকেই চেষ্টা করা। হােক, বর্গীকরণ ব্যাপারটা দাড়াবে না।”
প্রশ্ন: বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষা কী ভাবে এই বর্গীকরণের বিরুদ্ধে কাজ করবে?
জওহরলাল নেহরু: প্রথমত, এক মুসলিম লিগ ছাড়া গােটা দেশই এই বর্গীকরণের বিরুদ্ধে। সুতরাং, এই প্রশ্নে মুসলিম লিগ একা.. অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য কারণে পঞ্জাবের সঙ্গে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুপ্রদেশ, দুটি রাজ্যের বর্গীকরণের বিরুদ্ধেই যথেষ্ট আপত্তি আছে। অর্থাৎ, এমনকী সিন্ধু প্রদেশের মুসলমানরাও পঞ্জাবের সঙ্গে বর্গীকরণের বিরুদ্ধে… দুটি প্রদেশই (উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং সিন্ধুপ্রদেশ) পঞ্জাবের তলায় চাপা পড়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে।
প্রশ্ন: কেন্দ্রে অন্তর্বর্তী জাতীয় সরকার কবে তৈরি হবে?
জওহরলাল: আপাতত আমরা গণপরিষদের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। আছি।
প্রশ্ন: বম্বেতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ কাউন্সিলের আসন্ন বৈঠক থেকে কী আশা করছেন?
জওহরলাল: কংগ্রেস যাই করুক, তার লক্ষ্য একটি নতুন পরিস্থিতি তৈরি করা। আমরা অন্যের তৈরি করা পরিস্থিতিতে নিজেদের কার্যপদ্ধতি স্থির করি না। আমার ভাবতে ভাল লাগছে যে মুসলিম লিগ বুঝতে পেরেছে, আমরা একটা নতুন পরিস্থিতি তৈরি করেছি। আমরা ভবিষ্যতে আরও অনেক নতুন পরিস্থিতি তৈরি করব। আমাদের মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞাসা করা হয় যে লিগ এটা করলে আপনারা কী করবেন, লিগ ওটা করলে আপনারা কী করবেন। যখন প্রকৃত পরিস্থিতি তৈরি হবে, তখন আমরা বিবেচনা করে দেখব, সেই পরিস্থিতিতে কী করা যায়।
৩৩০
এমন বিপজ্জনক সময়ে এই জাতীয় বক্তব্যে যা ক্ষতি হওয়ার, হল। ১৬ মে তারিখের বিবৃতি এবং সেই বিবৃতিতে সর্বদলীয় সম্মতির ফলে যে সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল, তা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হল। স্বভাবতই, এই বিবৃতির ফলে জিন্না কংগ্রেসের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আরও সন্দিহান হয়ে পড়লেন। এবং, তার ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে যে কোনও সহযােগিতার প্রশ্নেই জিন্না তার বিরােধিতায় আরও অনড় হলেন। জিন্না লিগের অবস্থান পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন, তিনি প্রস্তাবিত প্রকল্পটিকে সমর্থন করছিলেন, এবং তার ফলে বর্গীকরণের ভিত্তিতে যেটুকু ক্ষমতা পাওয়া যেত, তার বিনিময়ে তিনি কার্যত সার্বভৌম পাকিস্তানের দাবিটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। অন্য দিকে, নেহরুর বক্তব্য ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ ছিল। পরিস্থিতি আরও খারাপ হল, যখন নেহরু নিজের ভুল বুঝতে পারলেন না, বুঝলেন না যে চুপ করে থাকলেই অনেক বেশি লাভ হত, বা তার বক্তব্যের ফলে ভারত সংক্রান্ত ব্যবস্থার প্রক্রিয়ার প্রচুর ক্ষতি হল। তা ছাড়াও, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে প্রস্তাবটি স্বীকার করে নিয়েছে, তাকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়ার এক্তিয়ার নেহরুর ছিল না। এবং, যখন সম্পূর্ণ পরিস্থিতির একটি সমাধান দেখা যাচ্ছে, সেই পরিস্থিতিতে নেহরু কেন এই পথে হাঁটতে গেলেন, যুক্তি দিয়ে তা বােঝাও যায় না। ফলে শুধু আর একটি সংকটের জন্ম হল।
কংগ্রেসের বিদায়ী সভাপতি মৌলানা আজাদ নেহরুর সাংবাদিক সম্মেলন সম্বন্ধে বললেন, “কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ইতিহাসের মােড় পাল্টে দেয়। এই সাংবাদিক সম্মেলন তেমনই একটি ঘটনা।”৩৮ আজাদ আরও বললেন, “নেহরু বলেছেন যে কংগ্রেস নিজের ইচ্ছেমতাে ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাটি বদলে নিতে পারে। এই কথাটি বলা উচিত হয়নি।” আজাদ বললেন, “জিন্না ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাটি মেনে নিয়েছেন, কারণ তার সামনে আর কোনও বিকল্প ছিল না।” নেহরুর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় জিন্না বললেন, ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যদের এবং ভাইসরয়ের আচরণে বিশ্বের দরবারে যে বার্তাটি পৌছচ্ছে, তা হল, কংগ্রেস মিশনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটি মেনে নিয়েছে। কোনও সংশয়ের সুযােগ না রেখে এই ধারণাটি দূর করা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও সরকারের দায়িত্ব।” জিন্না আরও বলেন, “মিশনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটি যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, নেহরুর বক্তব্য তার সম্পূর্ণ বিপরীত।” জিন্না হুমকি দেন যে জুলাই-এর শেষে লিগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পুরাে পরিস্থিতি ফের বিবেচনা করে দেখা হবে। পরিস্থিতি বলছিল, অদূর ভবিষ্যতে কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে বিরােধ তীব্র হতে চলেছে। এমনকী, বল্লভভাই পটেলও বললেন, নেহরুর বক্তব্য আসলে তার ছেলেমানুষি আবেগ’-এর ফল।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল, কিন্তু হিন্দু-মুসলমান সমতা বা কংগ্রেসের মুসলমান প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রশ্নগুলি বাধা হিসেবে থেকেই গেল। তার ১০ জুলাই তারিখের সাংবাদিক সম্মেলনে নেহরু স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে জিন্না যে । ভাবে বৰ্গীকরণের বিষয়টিকে দেখছে, বা ১৬ মে তারিখের বিবৃতিতে বিষয়টিকে যে ভাবে দেখা হয়েছে, কংগ্রেস তা মানবে না। কংগ্রেসের এই প্রত্যাখ্যান এবং মুসলিম
৩৩১
লিগের রাজি হওয়ার ফলে ভাইসরয় কি (১৬ মে-র বিবৃতি অনুযায়ী) কেবলমাত্র মুসলিম লিগের প্রতিনিধিদের নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে বাধ্য ছিলেন না? এই প্রশ্নটি এবং এই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটি ‘কিছু দিনের জন্য স্থগিত রাখার বিষয়টিই রাজনৈতিক বিরােধের মূল প্রশ্ন হয়ে উঠল।
তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পরে ওয়াভেল জিন্নাকে জানালেন, যত দ্রুত সম্ভব, তিনি সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে তৈরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে অন্তর্বর্তী জোট সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চান। ওয়াভেল কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সভাপতিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলােচনায় বসার জন্য জিন্নাকে তার সঙ্গে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ও গােপনীয় ভিত্তিতে সহযােগিতা করতে অনুরােধ করেন। ওয়াভেল জানালেন, এই অন্তর্বর্তী সরকারে মােট ১৪ জন সদস্য মনােনীত হবেন। তার মধ্যে এক জন তফসিলি জাতিভুক্ত প্রতিনিধিসহ কংগ্রেস থেকে মােট ছ’জন প্রতিনিধি থাকবেন, মুসলিম লিগের প্রতিনিধির সংখ্যা হবে পাঁচ। ভাইসরয় নিজে অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে বাকি তিন জন প্রতিনিধিকে মনােনীত করবেন, এবং এই তিন জনের মধ্যে এক জন শিখ থাকবেন। ভাইসরয় জানান, এক দলের মনােনীত প্রার্থী সম্বন্ধে আপত্তি করার অধিকার অপর দলের থাকবে না। একমাত্র ভাইসরয়ই প্রয়ােজন হলে কোনও প্রতিনিধির মনােনয়ন বাতিল করতে পারবেন। অন্তর্বর্তী সরকারে প্রতিনিধিত্বের ৬:৫:৩ অনুপাত সমতার তত্ত্বটিকে কার্যত বাতিল করে দিল। এবং মুসলিম লিগ অন্তর্বর্তী সরকারে মুসলমান। প্রার্থী মনােনয়নের বিষয়ে যে একচেটিয়া অধিকার দাবি করছিল, ভাইসরয়ের এই সিদ্ধান্তে তা-ও নাকচ হয়ে গেল। সমতা-নীতি বাতিল, কংগ্রেসের দৌলতে বর্ণীকরণের প্রস্তাবটিও বাতিল, আর মুসলমান প্রতিনিধির ওপর একচেটিয়া অধিকারও নাকচ: সব মিলিয়ে জিন্নার পক্ষে ভাইসরয়ের এই প্রস্তাবে সম্মত হওয়া খুবই দুষ্কর হল।” অতএব, মুসলিম লিগ কাউন্সিল ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করল।
পরিস্থিতি ক্রমশ নেতিবাচক হচ্ছিল, এ দিকে ঘটনার গতিও কিন্তু থেমে রইল না। সেক্রেটারি অব স্টেট-এর নির্দেশে ভাইসরয় নেহরুকে কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন, নেহরু সঙ্গে সঙ্গেই সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। ২৪ অগস্ট দিল্লি থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানানাে হল, নতুন তৈরি হওয়া এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৬ দায়িত্ব গ্রহণ করবে। মুসলিম লিগ আগে একাধিক বার একক ভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি জানিয়েছিল। প্রতি বারই সেই দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এ বার কংগ্রেসকে একা অন্তর্বর্তী সরকার গড়তে দেওয়ায় দেশের মুসলমান সমাজে তার তীব্র প্রতিক্রিয়া হল। জিন্না ভাইসরয় ওয়াভেলের কড়া সমালােচনা করলেন। যে দিন কংগ্রেস দায়িত্ব গ্রহণ করল, সে দিন গােটা দেশ জুড়ে মুসলমানরা কালাে পতাকা ওড়ালেন।[৪২]
১৮ জুলাই ১৯৪৬ তারিখে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং পেথিক লরেন্স আরও এক বার জোর দিয়ে বললেন, ব্রিটেনের সরকার ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ মে তারিখের বিবৃতি অনুসারেই পদক্ষেপ করবে। জিন্না এই আশ্বাসে বিশেষ কান
৩৩২
দিলেন না। ইংরেজরা ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পর সংখ্যালঘুদের কী অবস্থা হবে, জিন্না তা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, “কংগ্রেস কি আবার তার নীতির পরিবর্তন করে নেহরু যে কথাগুলি বলেছিলেন, তাতে ফিরে যাবে না?” ২৭ জুলাই বম্বেতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগ কাউন্সিলের বৈঠকের উদ্বোধনী ভাষণে জিন্নার বক্তব্যের সুর রীতিমতাে তিক্ত ছিল। জিন্না ফের পাকিস্তানের দাবি তােলেন। মুসলিম লিগ কাউন্সিলের এই বৈঠকেই ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাটি লিগ সরকারি ভাবে প্রত্যাখ্যান করে এবং পাকিস্তানের দাবি আদায়ের পন্থা হিসেবে ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর পথে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়।[ ৪৪]
জিন্না এবং ভবিষ্যৎ, উভয়ের জন্যই এই মুহূর্তটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমন একটা কথা ভেবে নেওয়া সম্ভব যে জিন্না এত দিন ধরে যে সাংবিধানিক পথে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলছিলেন, তা প্রকৃতপক্ষে একটি রাজনৈতিক চাল ছিল, কারণ গণসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের যে প্রক্রিয়া, তার নেতৃত্বের মঞ্চটি সম্পূর্ণত গাঁধী এবং কংগ্রেসের দখলে ছিল। এই পর্যন্ত এসে জিন্নার সাংবিধানিক ভিত্তিতে স্বাধীনতা অর্জনের রাজনীতির যুগটি শেষ হল; তার এবং মুসলিম লিগের কাছে যে প্রশ্নগুলি গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্রশ্নগুলিতে কংগ্রেস ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করায় জিন্নার বিরক্তিও স্পষ্ট হয়ে উঠল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি, তঁার পাকিস্তান আদায়ের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পৌঁছনাের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার শ্লথ গতি, এর সব ক’টিই জিন্নার রাজনৈতিক রূপান্তরের পিছনে প্রভাব ফেলল ও শেষ পর্যন্ত ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর দাবিতে রূপ নিল। জিন্না স্বীকার করলেন, তার দাবিটি অসাংবিধানিক, কিন্তু দাবিটি যে অহিংস নয়, তা মানতে রাজি হলেন না। যদিও ডিরেক্ট অ্যাকশন-এর জন্য গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল যে আন্দোলনটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে, জিন্না খুব ভাল ভাবেই জানতেন, এই থরােথরাে আবেগের বিস্ফোরণের পটভূমিকায় এমন একটি আন্দোলন শেষ পর্যন্ত তীব্র হিন্দু বিদ্বেষের জন্ম দেবে। দুঃখজনক ভাবে, ঠিক এটাই ঘটল। ১৬। অগস্ট ১৯৪৬, ডিরেক্ট অ্যাকশনের দিন, শুধু কলকাতাতেই ৬,০০০ মানুষের প্রাণ। গেল। আহত হলেন আরও ১৫,০০০ মানুষ। এই ঘটনার প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষ প্রভাব ভয়ঙ্কর হল; পরের কয়েকটা দিন ভারত অজস্র মৃত্যুর সাক্ষী হল। বিহার, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, বম্বে এবং আরও অনেক জায়গায় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ভয়ঙ্কর আগুন ছড়িয়ে পড়ল।
৩৩৩
ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে, ১৬ অগস্ট ১৯৪৬: কলকাতার দাঙ্গা
কলকাতার দাঙ্গা বিভিন্ন রূপে এক বছর ধরে চলল, ১৯৪৬ সালের ১৬ অগস্ট থেকে স্বাধীনতার দিনটি পর্যন্ত। জিন্না ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর ডাক দেওয়ার আগে থেকেই, ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে, মাঝে মাঝেই দাঙ্গার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। এই প্রাথমিক সংঘাতগুলি চরিত্র সাম্প্রদায়িক ছিল না ঠিকই, কিন্তু তা একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছিল। যেমন, ১৯৪৫ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতায় ৫০০ ছাত্র একটি মিছিল বের করেছিলেন। তাদের নেতারা ওই দিনটিকে আই এন এ দিবস হিসেবে উদ্যাপন করতে আদেশ দিয়েছিলেন। অবধারিত এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে ছাত্ররা মিছিল করে নিষিদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন; পুলিশ বাধা দিল; সংঘর্ষে এক ছাত্রের প্রাণহানি হল। পরের দিন গােটা শহর জুড়ে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চলল। এর পাশাপাশি ওই দিনই পুরসভার কর্মীরা ধর্মঘটের ডাক দিলেন, ফলে শহরের জীবন একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। কিন্তু, অন্য সব কিছুর মতােই, এই ঘটনাটিও, ঘটতে পারল ঠিকই।
১৯৪৬ সালের গােড়া থেকে শহরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে আরম্ভ করে। ১১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ফের বিক্ষোভ দেখালেন, এ বার আই এন এ-র বিচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এ বার এই জটিল বিষয়টির সঙ্গে আরও একটি জটিলতা যুক্ত হয়েছিল, আই এন এ-র এক মুসলমান অফিসারের কোর্ট মার্শাল। ১১ ফেব্রুয়ারির ছাত্রবিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ ছাত্রই মুসলমান ছিলেন। তারা বিক্ষোভের মধ্যেই প্রশ্ন তুললেন, কেন আই এন এ-র অন্যান্য হিন্দু অফিসারদের অপেক্ষাকৃত লঘু শাস্তি দেওয়া হলেও এই মুসলমান অফিসারকে এমন চরম দণ্ড দেওয়া হল। এই প্রতিবাদের পিছনে নিশ্চিত ভাবেই অন্য গল্প ছিল। মুসলমান ব্যবসায়ীদের দোকান বন্ধ হয়ে গেল, মুসলিম লিগের পতাকা হাতে অনেকে রাজপথে নামলেন। এই বিক্ষোভ কিছু ক্ষণের মধ্যেই হিংসাত্মক বিশৃঙ্খলায় পরিণত হল। হতাহতের সংখ্যা নভেম্বরের তুলনায় বাড়ল, সাম্প্রদায়িক সংঘাতও আগের বারের তুলনায় বেশি দিন ধরে চলল। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতৃত্ব এই ঘটনাটিকে নিজের নিজের মতাে করে ব্যাখ্যা করলেন। কংগ্রেস নেতৃত্বের মতে, “শহরের কিছু গুণ্ডা ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ পরিস্থিতির দখল নেওয়ার ফলেই এই ঘটনা ঘটল।” মুসলিম লিগের কাছে এই ঘটনাটি নিজেদের বাহুবলের প্রমাণ। অভিযােগ, মুসলিম লিগের অন্যতম নেতা এইচ এস সােহরাওয়ার্দি, যিনি আর কিছু দিন পরেই প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, তিনি নাকি প্রথমে এই ঘটনায় উসকানি দেন। এবং পরে প্রত্যক্ষ ভাবে দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেন।
যখন লিগ ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছিল, তখন কলকাতা অন্য একটি সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। যে দিন ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর প্রস্তাব গৃহীত হল। (২৯ জুলাই ১৯৪৬), ঘটনাচক্রে সে দিন পরিবহণ, শিল্প এবং সরকারি কর্মচারীদের এক দিনের ধর্মঘটে কলকাতা অচল হয়ে গিয়েছিল। এই সাধারণ ধর্মঘটের পাশাপাশি
৩৩৪
রাজ্য জুড়ে ডাক দফতরের ১৬০০০ কর্মীর ধর্মঘট চলছিল, তারা ২১ জুলাই থেকে কাজ বন্ধ রেখেছিলেন। এর ওপর ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্কের কর্মীরা আরও একটি ধর্মঘটের ডাক দিলেন। এই সবক’টি ধর্মঘট, এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার জন্য উন্মুখ কিছু মানুষ মিলে কলকাতা কার্যত একটি জতুগৃহে পরিণত হয়েছিল।
১৯৪৬ সালের ১৪ অগস্ট-এর আগেই জওহরলাল নেহরু ভাইসরয়ের প্রস্তাবে। সম্মত হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে মনস্থ করলেন। তার পর ১৫ অগস্ট নেহরু বম্বেতে জিন্নার সঙ্গে এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে এবং দেশে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে। আলােচনায় বসলেন। এই সময় যে অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনায় ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র তাৎপর্য অনেক বেশি হতে চলেছে, সেই পূর্বানুমানের কোনও প্রমাণ নেহরু ও জিন্নার চিঠিপত্রেও নেই, তাদের বৈঠকেও নেই। বেশ কিছু ঘটনা এই একই সময় ঘটছিল। জিন্না ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘােষণা করছিলেন, নেহরু শুধুমাত্র অন্তর্বর্তী। সরকার গঠনের চিন্তাতেই মগ্ন ছিলেন, ভাইসরয় আশা করছিলেন, হয়তাে কোনও ভাবে উভয় পক্ষের বিরােধ মিটে যাবে। গাঁধী তখন সেবাগ্রামে, তার মহাকাব্যিক জীবনের একেবারে শেষ লগ্ন’ সেটি। যে কংগ্রেসকে গাঁধী দশকের পর দশক ধরে নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই পটেলের হাতে নেতৃত্বের ভার তুলে দিয়েছিলেন, দুঃখজনক ভাবে, সেই দলেই তিনি এই পর্যায়ে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন এবং কোণঠাসা হয়ে পড়ছিলেন। মনে হতেই পারে, কোনও এক কু-শক্তি সবার অলক্ষ্যে ১৬ অগস্টের পটভূমিকা রচনা করছিল। ভাইসরয়, সরকার, বিরােধীপক্ষ, সংবাদমাধ্যম, কেউই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের ব্যাপকতার আঁচ পাননি। তারা দেখতে পাননি, বহু দিন ধরে মানুষের ভিতরে জমে থাকা অসন্তোষের আগুন কী ভাবে বাইরের আইনশৃঙ্খলার পর্দাটাকে পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে। তারা দূর থেকে ভয়ঙ্কর গর্জন শুনতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা এমন ভাবে নিষ্ক্রিয় থাকলেন, যেন কোনও দৈব । শক্তি তাদের হাত-পা বেঁধে রেখেছিল। জাতীয় বিপর্যয়ের সম্ভাবনার দরজা তাদের কিছু সিদ্ধান্তের ফলেই খুলে গিয়েছিল; যখন সত্যিই সেই বিপর্যয় নেমে এল, তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার সাধ্য তাদের ছিল না।
গণহত্যার ঘটনাবলি দুঃখজনক। কিন্তু, দিল্লিতে যে নেতারা ক্ষমতা হস্তান্তরের যুদ্ধ লড়তে ব্যস্ত ছিলেন, এই গণহত্যার ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়া আরও বেশি দুঃখজনক এবং ক্ষমার অযােগ্য। নেহরু দেশের প্রথম স্বাধীন সরকার (তা সে যতই অন্তর্বর্তী সরকার হােক) গড়ার ভাবনায় এমনই মশগুল ছিলেন যে কলকাতার এই ভয়াবহ ঘটনাক্রম প্রায় তার নজর এড়িয়ে গেল। দাঙ্গা আরম্ভের খবর পেয়ে সাংবাদিকরা যখন। নেহরুকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই ঘটনা তার অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরিকল্পনার ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারে কি না, নেহরু উত্তরে বললেন, “কলকাতায় কিছু খারাপ লােক বদমায়েশি করছে, তার জন্য আমাদের পরিকল্পনা কোনও ভাবেই বদলাবে না।”[৪৬] শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস নেতৃত্ব যখন কলকাতার দাঙ্গার ভয়াবহতা সত্যিই বুঝতে পারল, তখন ক্ষণমাত্র দেরি না করে তার সম্পূর্ণ দায় বাংলার মুসলিম লিগ প্রধানমন্ত্রীর
৩৩৫
ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল। অবশ্য, দায় প্রধানমন্ত্রীর অবশ্যই ছিল। তার পর যখন কলকাতার অলি গলি রাজপথ জুড়ে দাঙ্গার ভয়াবহ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ল, তখন আরম্ভ হল একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার নির্লজ্জ খেলা। ১৯৪৬-এর অগস্টের দাঙ্গার পরে ১৯৪৭-এর মার্চে কলকাতায় ফের দাঙ্গা হল— সাম্প্রদায়িক হানাহানির ভয়ঙ্কর রােগ এই শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বাঁধল। রােগটা মারাত্মক ছোঁয়াচে। ফলে, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে এই রােগ দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ল। বীভৎসতার যে কোনও শেষ থাকতে পারে, বিশ্বাস করা ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠল।
এই বীভৎসতা কি আগে থেকেই আঁচ করা সম্ভব ছিল? ক্যাবিনেট মিশন যখন ইংল্যান্ডে ফিরে গেল, মুসলিম লিগের নেতাদের ধারণা হল, তাদের কারচুপি করে ঠকানাে হয়েছে। যে হেতু অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়াটি স্থগিত রাখা হল, জিন্না দাবি করেছিলেন যে গণপরিষদের নির্বাচনও সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখা হােক। তার এই দাবিটিও যখন প্রত্যাখ্যাত হল, তখন জিন্না অভিযােগ করলেন, ক্যাবিনেট মিশন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আট নম্বর পরিচ্ছেদকে ক্যাবিনেট মিশন যে ভাবে ব্যাখ্যা করেছে, জিন্না তাকে ‘চুড়ান্ত অসৎ এবং বােধহীন’ বলে বর্ণনা করলেন। সম্পূর্ণ ঘটনায় জিন্না যে ভাবে অপমানিত হলেন, তাতেও প্রায় কোনও মহলেই তার প্রতি বিশেষ সঁহানুভূতি তৈরি হল না; অনেকেই বললেন, জিন্না স্বখাতসলিলে ডুবেছেন। এই সময় একমাত্র গাঁধীই তার পাশে দাড়িয়েছিলেন। গাঁধী বললেন, “জিন্নার সঙ্গে এই আইনগত বিষয়ে এই রকম ব্যবহার করা ক্যাবিনেট মিশনের অনুচিত হয়েছে।” আরও বললেন, “জিন্না এক জন বিশিষ্ট ভারতীয় এবং একটি মহৎ সংগঠনের স্বীকৃত নেতা।”
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তার সব দাবি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ২৯ জুলাই মুসলিম লিগ কাউন্সিলের বৈঠকে ১৬ মে তারিখের বিবৃতির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এই সময়েই লিগ সার্বভৌম পাকিস্তানের দাবি আদায়ের জন্য এবং যখন যে ভাবে প্রয়ােজন লড়াই করার জন্য মুসলমান সম্প্রদায়কে সঙঘবদ্ধ করার জন্য ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র ডাক দেয়। এই সময়েই ১৬ অগস্ট ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ হিসেবে ঘােষণা করা হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় সে দিন দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখানাে হবে।
‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পরই বৈঠকের সমাপ্তি ভাষণে প্রবল করতালির মধ্যে জিন্না ঘােষণা করলেন, “আজ আমরা সাংবিধানিক পন্থাকে বিদায় জানাচ্ছি।” এবং তার পরই বললেন, “অনেক প্রচেষ্টার পরে আজ আমাদের হাতে একটি পিস্তল আছে, এবং আমরা তা ব্যবহার করতে তৈরি।”
৩১ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিন্না তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করলেন। তিনি বললেন, ইংরেজ এবং কংগ্রেস, উভয় পক্ষের হাতেই অস্ত্র আছে, ইংরেজদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, আর কংগ্রেসের হাতে গণসংগ্রামের হুমকি। এই পরিস্থিতিতে লিগের মনে হয়েছে যে পাকিস্তানের দাবি আদায়ের সংগ্রামের জন্য তাদেরও নিজেদের মতাে করে
৩৩৬
তৈরি হওয়া প্রয়ােজন। জিন্না ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র পরিকল্পনা ভেঙে বলতে রাজি হলেন না। বললেন, “আমি এখনই এই বিষয়ে বলার জন্য তৈরি নই।” যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, আন্দোলনটি অহিংস হবে, না কি এতে হিংসার ভূমিকা থাকবে, জিন্না উত্তরে বললেন, “আমি এখানে নৈতিকতা আলােচনা করতে আসিনি।”
২৯ জুলাইয়ের প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত করার জন্য মুসলিম লিগ এর পর একটি কাউন্সিল অব অ্যাকশন গঠন করল। এই কাউন্সিলের সব বৈঠকই বন্ধ দরজার আড়ালে হত। কিন্তু, কী ভাবে সংগ্রামের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা মুসলিম লিগের কাগজ। বিশদে ব্যাখ্যা করে প্রচার করত, এবং লিগের কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা কঠিন ছিল না। মুসলমানদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এই রমজান মাসেই ৩১৩ জন। আরব মুসলমান বিধর্মীদের বিরুদ্ধে প্রথম খােলা লড়াইয়ে নেমেছিলেন এবং সেই লড়াইয়ে জয় লাভ করেছিলেন। ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র বিশেষ প্রার্থনার জন্য একটি লিফলেট ছাপা হয়েছিল। তাতে ঘােষণা করা হয়েছিল, যে দশ কোটি ভারতীয় মুসলমান ‘দুর্ভাগ্যবশত হিন্দু এবং ব্রিটিশদের ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে, তারা এই রমজান মাসেই জেহাদ আরম্ভ করবে। উন্মুক্ত তরবারি হাতে জিন্না দাড়িয়ে আছেন, এমন একটি ছবি দিয়ে আরও একটি লিফলেট ছাপা হল, যাতে লেখা, “আমরা মুসলমানরাই এক সময় রাজা ছিলাম, আমরাই রাজত্ব করতাম। তৈরি হােন, হাতে তরবারি তুলে নিন…. ‘ওরে বিধর্মী!… প্রবল হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসের আর বেশি দেরি নেই!
এই সময় বাংলা প্রদেশে মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভার প্রধান শহিদ সােহরাওয়ার্দি। মুসলিম লিগ ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পরেই তিনি ঘােষণা করলেন, কেন্দ্রে কংগ্রেস অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করলে বাংলার বিদ্রোহের তীব্রতা আরও বাড়বে। বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনও রাজস্ব দেওয়া হবে না। কেন্দ্রের সঙ্গে কোনও রকম সম্পর্ক না রেখে বাংলা একটি স্বাধীন প্রদেশ হিসেবে কাজ করবে।
‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র চরমতম পরিণতি ঘটল কলকাতায়, অগস্টের ১৬ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে। ১৫ তারিখ রাত থেকেই সশস্ত্র মুসলমানদের দল কলকাতার। রাস্তায় টহল দিতে আরম্ভ করল। তাদের চিৎকারে রাতের স্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছিল বার বার। ১৬ তারিখ সকাল থেকেই কলকাতার আকাশ মেঘলা, কিন্তু বিকেল পর্যন্ত বৃষ্টি নামল না। ভাের থেকেই মুসলমান গুণ্ডারা শহরের দখল নিল, শহরের বিভিন্ন প্রান্তে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেল। লাঠি, বর্শা, ভােজালি হাতে মুসলমানদের একটা মিছিল হাওড়া থেকে কলকাতায় বড় মিছিলে যােগ দেওয়ার জন্য রওনা দিল। হাওড়া ব্রিজের ওপর সামরিক বাহিনী এই মিছিলটিকে আটকাল। তাদের যাবতীয় অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হল। সেই অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য দুটি ট্রাকের প্রয়ােজন হল।
কিন্তু, তাতে বিশেষ কিছু লাভ হল না। বিকেলের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ময়দানে মুসলিম লিগের সমাবেশে সােহরাওয়ার্দি সভাপতিত্ব করলেন। সেই সমাবেশ থেকে ফেরার পথে উন্মত্ত জনতা যে সাধারণ মানুষ তাদের হরতালে যােগ দেননি, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার আরম্ভ করল। তাদের দোকান লুঠ করা হল; দোকানের জিনিসপত্র টান
৩৩৭
মেরে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হল; গাড়ি, ট্রামে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হল; পথচারীদের মারধাের করা হল, এমনকী ছুরিও মারা হল। সব অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা, যানবাহন স্তব্ধ হয়ে গেল। রাস্তায় শুধু দেখা গেল, উগ্র চেহারার, সশস্ত্র মুসলিম লিগ সমর্থকে ভরা কিছু লরি আর জিপ চলছে, সেই সমর্থকরা পাকিস্তানের স্লোগান দিচ্ছে, আর দাঙ্গায় প্ররােচনা দিচ্ছে।
কিম ক্রিস্টেন ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এ লিখলেন, “আমি যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতাল। দেখেছি, কাজেই বীভৎসতার চেহারা আমি চিনি। কিন্তু যুদ্ধের এই রকম চেহারা কখনও দেখিনি।”১৪ ‘দ্য স্টেটসম্যান’-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে লেখা হল, “এটি দাঙ্গা নয়। এই বীভৎসতাকে বর্ণনা করার জন্য মধ্য যুগের ইতিহাস থেকে একটি শব্দ ধার করা প্রয়ােজন: Fury বা প্রমত্ততা। তা-ও ‘প্রমত্ততা’ কথাটি শুনলে মনে হয়, ঘটনাটি স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু এই প্রমত্ততার পিছনে নিশ্চিত ভাবেই সংগঠন এবং উদ্যোগ রয়েছে। আট ফুট লম্বা লাঠি হাতে যে গুণ্ডারা গণহত্যায় নেমেছে, এই লাঠি তারা রাস্তার ধারে কুড়িয়ে পেয়েছে বা বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে, এ কথা ধরে নেওয়া মুশকিল। আমরা ইতিমধ্যেই লিখেছি যে অন্য কারও পক্ষে যখন গাড়ি বা পেট্রোল পাওয়া প্রায় অসম্ভব, তখন এই গুণ্ডাবাহিনী খুব সহজেই এগুলাে জোগাড় করতে পেরেছে। প্রভাব তৈরি করার জন্য যে শহরের বাইরে থেকে লােক নিয়ে আসা হয়েছিল, এই কথাটি এখন আর শুধু অনুমান নয়।১৫ এই প্রসঙ্গেই এই কাগজে প্রকাশিত ‘ডিসগ্রেস অ্যাবাউন্ডিং শিরােনামে এক প্রবন্ধে লেখা হল:
ভারতের ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাংলা প্রদেশের রাজধানী ক্ষতবিক্ষত— আমরা মনে করি, এই দাঙ্গা প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লিগের রাজনৈতিক পেশিপ্রদর্শন— কেবলমাত্র বিরােধী পক্ষই নয়, মুসলিম লিগের সাম্প্রদায়িক আচরণ দেখে যে কারও পক্ষেই এই জাতীয় অনুমান করা সম্ভব মুসলিম লিগ নেতারা সাম্প্রতিক কালে এই নিয়ে দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন যে এই সময় একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফল ভাল হবে,
কি খারাপ… কলকাতাকে যে ভাবে রক্তাক্ত করে ফেলা হল, তা এক প্রবল লজ্জা। বাংলার সরকার মুখ্যত মুসলিম লিগের সরকার। এই সরকারের অর্জন করা লজ্জায় আজ সারা দেশেই মুসলিম লিগের সম্মান। মাটিতে মিশে গিয়েছে।
কলকাতা থেকে ফিরেই, ২৭ অগস্ট ওয়াভেল গাঁধী এবং নেহরুর সঙ্গে দেখা। করলেন। “আমি সবেমাত্র কলকাতা থেকে ফিরলাম”, ওয়াভেল বললেন, “সেখানে । যা দেখলাম, আমি তাতে স্তম্ভিত।”৪৭ এর পর তিনি এই নৃশংসতার বিশদ বিবরণ দেন। ওয়াভেল স্বীকার করেন “এক জন ইংরেজ হিসেবে ভারতীয় রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপের বিচার করার অধিকার তার নেই। যদিও, তিনি এই ঘটনার, এবং
৩৩৮
রাজনৈতিক দলগুলির নামে বাইরে থেকে ফেলে দেওয়া এই বর্বরতার কঠোর নিন্দা করেন।” কিন্তু “যত দিন তিনি ভারতের ভাইসরয় হিসেবে আছেন’’, ওয়াভেল বলেন, তাঁর মতে “এই জাতীয় বর্বরতার পুনরাবৃত্তি আটকাতে তাকে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে…. এক জন ইংরেজ এবং এক জন সভ্য মানুষ হিসেবে তার পক্ষে এই জাতীয় বর্বরতা সহ্য করা দুষ্কর। যদি তিনি হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায়ের মানুষকে সঙঘবদ্ধ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা না করেন এবং তাদের এই কথাটি না বােঝাতে পারেন যে এক সঙ্গে চলাই স্বাধীনতা অর্জনের এক মাত্র নিশ্চিত পথ, তবে তিনি নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হবেন।”[৪৮]
লেনার্ড মােসলে এই বৈঠকের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। ওয়াভেলও তার ডায়েরিতে এই বৈঠকের কথা লিখেছেন। তার লেখার সুর অনেক শান্ত, কিন্তু লেখায় তার যন্ত্রণা স্পষ্ট। ‘দ্য ভাইসরয়স জার্নাল’-এর সম্পাদক পেন্ডেরেল মুন ওয়াভেলের লেখার আগে যােগ করেছেন: “ভি পি মেনন-এর মতে, ওয়াভেল কলকাতা থেকে ফেরার পর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং নীতিতে স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, কংগ্রেস এবং লিগের মধ্যে যদি খুব তাড়াতাড়ি কেনও সমঝােতা না হয়, তা হলে কলকাতায় যে বীভৎস ঘটনা ঘটেছে, দেশ জুড়ে তার পুনরাবৃত্তি হবে। কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদে যােগ দেওয়ার বিষয়ে নিজামুদ্দিন তাকে লিগের যে মনােভাবের কথা বলেন, ওয়াভেল তাতেও যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছিলেন। এই বিষয়গুলির ফলেই ওয়াভেল গাঁধী এবং নেহরুকে গণপরিষদ বিষয়ে এমন একটি বিবৃতি দেওয়ার জন্য অনুরােধ করেন, যাতে মুসলিম লিগ নেতৃত্ব সন্তুষ্ট হয়। তার এই প্রচেষ্টা অবশ্য সফল হয়নি।” এই প্রসঙ্গে ওয়াভেলের ডায়েরির পাতা থেকে সম্পূর্ণ উদ্ধৃতি দেওয়া প্রয়ােজন, কারণ কলকাতার দাঙ্গার প্রেক্ষিতেই দেশ ভাগের ঘটনাটি ত্বরান্বিত হয়।
২৭ অগস্ট; আমি মনস্থ করলাম যে বর্গীকরণ বিষয়ে কংগ্রেসের মনােভাব ঠিক কী, সাংবিধানিক আইনসভায় তা স্পষ্ট করে বলার জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বকে রাজি করাব, কারণ লিগের সঙ্গে সহযােগিতার পথে এই প্রশ্নটি একটি বড় প্রতিবন্ধক। তাই আমি গাঁধী ও নেহরুকে বিকেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বললাম… বৈঠকটি খুব ফলপ্রসূ হল না। ওই বৃদ্ধ [গাঁধী] রীতিমতাে আইনি প্যাচপয়জার কষার মেজাজে ছিলেন। আর নেহরু লিগের বিরুদ্ধে অসম্ভব ঘৃণা পােষণ করেন। আমি তাদের বললাম, ভারতে শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটাই উপায় আছে। তার জন্য গণপরিষদে দাড়িয়ে তাদের বিবৃতি দিতে হবে যে তারা এই কথাটি মেনে নেবেন যে ক্যাবিনেট মিশন যে ভাবে প্রদেশগুলিকে বর্গে ভাগ করেছিল, নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রদেশগুলিকে সেই বর্গেই থাকতে হবে। আমি বললাম যে এই বিষয়টির ফয়সলা না হওয়া পর্যন্ত আমি গণপরিষদের অধিবেশন ডাকার
৩৩৯
দায়িত্ব নেব না। আমি তাদের যে বিবৃতিটি দিতে বলছি, তার একটি খসড়া তাদের হাতে তুলে দিলাম। [তাতে লেখা] ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে কংগ্রেস ১৬ মে ১৯৪৬ তারিখের বিবৃতির এই বক্তব্যটি মেনে নিতে তৈরি যে প্রদেশগুলিকে যে ভাগে বা বর্গে ভাগ করা হবে, ১৬ মে ১৯৪৬ তারিখের বিবৃতির ১৯ (৭) নম্বর অনুচ্ছেদে বিধৃত পরিকল্পনাটি নতুন আইনসভা বিবেচনা করে দেখার আগে, নতুন সংবিধান চালু হওয়ার আগে এবং প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে প্রদেশগুলি সেই বর্গ বা ভাগ থেকে বিযুক্ত হতে পারবে না।”[৪৯]
গাঁধী মিশনের বিবৃতির ব্যাখ্যা নিয়ে আইনি প্রশ্ন তুললেন। আমি বললাম যে আমি আইনের ছাত্র নই, এক জন সাধারণ মানুষ। আমি জানি, মিশনের বিবৃতির মূল বক্তব্য ঠিক কী। এবং, মিশনের পরিকল্পনার একেবারে মূল কথাই হল আবশ্যক বৰ্গীকরণ।
কিছু ক্ষণ তর্কবিতর্ক চলল। নেহরু তার মধ্যে খুবই রেগে গেলেন। গাঁধী বললেন, যদি রক্তগঙ্গা বওয়াই জরুরি হয়, তবে অহিংসা সত্ত্বেও তা-ই ঘটবে। আমি বললাম, তার মুখে এই কথা শুনে আমি খুবই বিস্মিত। যাওয়ার সময় তারা ফর্মুলা সঙ্গে নিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তারা এটি মেনে নেবেন বলে আমার মনে হয় না।
২৮ অগস্ট: সকালে গাঁধীর থেকে একটি চিঠি পেলাম। অত্যন্ত প্রতিশােধপরায়ণ একটি চিঠি। গাঁধীর দাবি, চিঠিটিকে লন্ডনে তার করে পাঠাতে হবে। তার ‘রক্তগঙ্গা বওয়ার কথায় আমি যে বিস্ময় এবং অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলাম, নিশ্চিত ভাবেই তার প্রভাব। তার এই আচরণ থেকে আমি বুঝতে পারছি, আমি এত দিন ধরে যে সন্দেহটি করতাম, অর্থাৎ গাঁধীর এই অহিংসার বাণী এবং তার এই সাধুসুলভ আচরণ আসলে তার নিজস্ব চরিত্র নয়, ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার অস্ত্রমাত্র, সেই সন্দেহটি ঠিক। এটা সম্পূর্ণ যুদ্ধঘােষণার মতাে। ভাবছিলাম, আমার তত্ত্বাবধায়ক পরিষদের শেষ বৈঠকটি কি আজই হয়ে গেল? যাই হােক, পরে নেহরুর লেখা একটি চিঠিও পেলাম। তাতে শান্তি সম্মেলন ও ইউ এন ও অ্যাসেম্বলিতে প্রতিনিধিদের নামের তালিকা দেওয়া আছে। দেখে মনে হল, কংগ্রেস এখনও সরকারে যােগ দিতে চায়।
৩৪০
গাঁধীর চিঠির বয়ান এই রকম:
২৮ অগস্ট, ১৯৪৬
প্রিয় বন্ধু,
আমি এই চিঠিটি অনেক ভাবনাচিন্তার পর এক জন বন্ধু হিসেবে লিখছি।
গত কালের বৈঠকে আপনি বেশ কয়েক বার উল্লেখ করেছেন যে আপনি ‘এক জন সাধারণ মানুষ, এক জন সৈনিক’, আপনি আইন জানেন না। আমরা সবাই সাধারণ মানুষ, তবে সবাই হয়তাে সৈনিক নই, আর কেউ কেউ আইনটাও জানি। আমি বিবেচনা করি, কলকাতার ভয়ঙ্কর ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। প্রশ্ন হল, সেটা কী ভাবে সবচেয়ে ভাল ভাবে করা যায়।
গত কাল সন্ধেয় আপনি যে ভাষায় কথা বলছিলেন, তা ভয়ঙ্কর।
আপনি যখন রাজার প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন, তখন আপনি নিজেকে শুধুমাত্র এক জন সৈনিক ভাবতে পারেন না। আপনি আইনকেও অবজ্ঞা করতে পারেন না, অন্তত নিজেদের তৈরি আইনকে তাে নয়ই।
প্রয়ােজন হলে আপনাকে আপনার বিশ্বস্ত কোনও আইন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে। আপনি আমাকে এবং পণ্ডিত নেহরুকে যে ফর্মুলাটি দিয়েছেন, কংগ্রেস তা ব্যবহার করতে সম্মত না হলে আপনি গণপরিষদ গঠন করবেন না বলে হুমকি দিয়েছেন। প্রকৃত ঘটনা যদি তা-ই হয়, তা হলে আপনি ১২ অগস্ট তারিখে যে ঘােষণাটি দিয়েছিলেন, তা করা আপনার উচিত হয়নি। কিন্তু, তা যখন করা হয়েই গিয়েছে, তখন আপনার একটি বিকল্প মন্ত্রিসভা গড়ার কথা চিন্তা করা উচিত, যে মন্ত্রিসভার ওপর আপনার পূর্ণ আস্থা থাকবে। যদি ভারতের অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এ দেশে ব্রিটিশ সামরিক শক্তিকে মজুত রাখতে হয়, তা হলে আপনার অন্তর্বর্তী সরকারের আর কোনও গুরুত্ব থাকে না। ভারতে যারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে চলেছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কংগ্রেস ব্রিটিশ শক্তির সাহায্য নিতে পারে না। সম্প্রতি বাংলায় যে। হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, তার প্রেক্ষিতে কংগ্রেসকে যদি এমন কোনও পথ মেনে নিতে বলা হয়, যা কংগ্রেসের মতে ভুল পথ, তবে কংগ্রেস সেই দাবি মেনে নেবে, এমন আশা করা সমীচীন নয়। এক বার এই জাতীয় চাপের কাছে মাথা নােওয়ালে ভবিষ্যতে এমন হিংসাত্মক ঘটনার সম্ভাবনা আরও বাড়বে। উভয় পক্ষেরই প্রতিশােধস্পৃহা আরও বাড়বে, ভবিষ্যতে এ রকম কোনও ঘটনা ঘটলে দু’তরফই আরও ভয়ঙ্কর ভাবে একে অন্যের ওপর ঝাপিয়ে পড়তে চাইবে। এবং, এর সব কিছুই ঘটবে ভারতে সামরিক গর্বে গরীয়ান এক বিদেশি শক্তির উপস্থিতির কারণে।
৩৪১
আমি এক জন হিন্দ অথবা এক জন মুসলমান হিসেবে এই কথাগুলি। বলছি না। আমি এই কথাগুলি শুধুমাত্র এক জন ভারতীয় হিসেবে বলছি। আমি যত দূর জানি, কংগ্রেস আপনার বা অন্য যে কোনও ইংরেজের তুলনায় হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায়কেই বেশি চেনে বলে দাবি করতে পারে। সুতরাং, যে কংগ্রেস সরকারের কথা আপনি ঘােষণা করেছেন, তাকে যদি সম্পূর্ণ ভাবে বিশ্বাস না করতে পারেন, তবে আপনার সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়ােজন। এ কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। দয়া করে সম্পূর্ণ চিঠিটি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পাঠাবেন। ভবদীয়,
এম কে গাঁধী (স্বাঃ)
শুতে যাওয়ার ঠিক আগেই নেহরুর লেখা একটি চিঠি পেলাম। কিন্তু মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে, সেই ভয়ে চিঠিটি আর খুললাম না।
২৮ অগস্ট: যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম, নেহরুব চিঠিটি ততটা খারাপ নয়। মনে হল, আমি যা-ই বলি না কেন, কংগ্রেস কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদে যােগ দেবে। আমি নেহরুর চিঠির উত্তরে লিখলাম, বিষয়টি আইনের নয়, বাস্তব রাজনীতির। আমি সেক্রেটারি অব স্টেটস-এর কাছ থেকে প্রায় আতঙ্কিত একটি টেলিগ্রাম পেলাম। তিনি লিখেছেন, আমি যেন কংগ্রেসের বিষয়ে তাড়াহুড়াে করে কোনও সিদ্ধান্ত না নিই।
পেন্ডেরেল মুন এর পরে লিখেছেন, “ওয়াভেল বৰ্গীকরণ বিষয়ে কংগ্রেসকে যে প্রশ্নাতীত বিবৃতি দিতে অনুরােধ করেছিলেন, নেহরু তাঁর চিঠিতে সেই অনুরােধটি প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান যে কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তাকে এমন ভাবে ব্যাখ্যা করেছে যে, পরিকল্পনাটির মধ্যে যে অসঙ্গতি আছে, তা দূর হয়ে যায়… তাদের মতে প্রাদেশিক স্বশাসন একটি প্রাথমিক ব্যবস্থা এবং কোনও প্রদেশ কোনও বর্গ তৈরি করবে কি না বা তাতে যােগ দেবে কি , সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার প্রতিটি প্রদেশের আছে। ব্যাখ্যা সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন থাকলে তা নিয়ে ফেডারেল কোর্ট-এ যাওয়া যেতে পারে।”
ওয়াভেলের এই প্রচেষ্টায় কোনও লাভ হল না। সম্ভবত, অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ, উভয় পক্ষই নিজের অবস্থানে অনড় রইল। মানুষ ঘটনাক্রমকে চালনা করার বদলে ঘটনাক্রমই এ বার মানুষকে চালনা করতে আরম্ভ করল।
৩৪২
তথ্যসূত্র
১. স্যর পেন্ডেরেল মুন (সম্পাদিত), ওয়াভেল— দ্য ভাইসরয়’স জার্নাল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩ ২. তদেব, ২৭ জুলাই, ১৯৪৩, পৃ ১২
৩. আর জে মুর, চার্চিল, ক্রিপস অ্যান্ড ইন্ডিয়া, ১৯৩৯-১৯৪৫, ক্ল্যারেনডন প্রেস, অক্সফোর্ড, ১৯৭৯, পৃ ১৪০ * ৪. স্যর পেন্ডেরেল মুন (সম্পাদিত), ওয়াভেল— দ্য ভাইসরয়’স জার্নাল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩, ৭ ও ৮ অক্টোবর, ১৯৪৩, পৃ ২২-২৩
৫. চার্চিলকে ওয়াভেল, অক্টোবর ১৯৪৪, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পঞ্চম খণ্ড
৬. আমেরিকে ওয়াভেল, ১ ডিসেম্বর ১৯৪৪, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পঞ্চম খণ্ড, ২৬০
৭. স্যর পেন্ডেরেল মুন (সম্পাদিত), ওয়াভেল— দ্য ভাইসরয়’স জার্নাল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩, পৃ ১১০-১১১-১১২
৮, তদেব, পৃ ১১৪
৯, তদেব, পৃ ১১৫-১১৬
১০. তদেব, মার্চ ১০, ১৯৪৫
১১. ফিল্ড মার্শাল ভাইসরয় ওয়াভেলকে আমাের, ১২ জুলাই ১৯৪৫, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পঞ্চম খণ্ড, পৃ ১২৩৬-১২৩৯
১২. ডেভিড জন কোলভিল, ফাস্ট ব্যারন ক্লিডসমুয়ের পিসি জিসিআইই (১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪-৩১ অক্টোবর ১৯৫৪) বম্বের গভর্নর হন, এবং ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সেই পদে থাকেন। ১৯৪৫, ১৯৪৬ এবং ১৯৪৭ সালে তিনি ভারতের ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল পদে কাজ করেন। ভারত থেকে দেশে ফেরার পর তাকে ল্যানার্কশায়ার কাউন্টির ব্রেডউডে ব্যারন ক্লিডসমুয়ের পদ দেওয়া হয়। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত তিনি বিবিসি-র গভর্নর ছিলেন।
১৩. ওয়াভেল— দ্য ভাইসরয়’স জার্নাল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩।
১৪. ১৯৪৫ সালের ১০ ডিসেম্বর মনােনয়ন পত্র জমা দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচন-প্রক্রিয়াটি আরম্ভ হয় এবং তা ২০ এপ্রিল ১৯৪৬ তারিখে সম্পূর্ণ হয়।
১৫. পঞ্জাব: আইনসভায় মােট আসনসংখ্যা: ১৭৫। (পরিসংখ্যানটি শাে কুয়াজিমা, পােস্ট ওয়র আপসার্জ অব ফ্রিডম মুভমেন্ট অ্যান্ড ১৯৪৬ প্রভিনশিয়াল ইলেকশন ইন ইন্ডিয়া, এপ্রিল ১৯৯২, পৃ ২৬৮ থেকে গৃহীত।)
১৬. মামদোত-এর নবাব ইফতিকার হুসেন খাঁ (১৯০৬-১৯৬৯) স্যর শাহ নওয়াজ খাঁ-র পুত্র। ১৯৪২ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যােগ দেন। তিনি পিতার উত্তরসূরি হিসেবে মুসলিম লিগের প্রাদেশিক সভাপতি ও ফিরােজপুর সেন্ট্রালের আইনসভার প্রতিনিধি হন। তিনি ১৯৪৫-৪৬-এর নির্বাচনের আগে ও পরে খিজিরের বিরােধী ছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে দলকে দিয়ে খিজিরকে প্রত্যাখ্যান করাতে সমর্থ হন। দেশভাগের পরে ১৯৪৭-৪৮ সালে তিনি পশ্চিম পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই তার দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে মতবিরােধ হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালে তিনি দল ত্যাগ করে জিন্না মুসলিম লিগ গঠন করেন।
৩৪৩
১৭. এইচ এম সারাভাই, পার্টিশন অব ইন্ডিয়া: লেজেন্ড অ্যান্ড রিয়ালিটি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি, ২০০৫
১৮. ট্রান্সফার অব পাওয়ার ১৯৪২-৭, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ ১৫৫-১৫৭, দ্য পােস্ট ওয়র ফেজ: ১ অগস্ট ১৯৪৫-২২ মার্চ ১৯৪৬ (৬৮ মিস্টার অ্যাবেল-এর উদ্দেশে স্যর জেনকিনস-এর টেলিগ্রাম, ওয়াভেল পেপারস, পলিটিক্যাল সিরিজ জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৪৫, পৃ ৬৫-৭) হার। ম্যাজেস্টিস স্টেশনারি অফিসের জন্য ইংল্যান্ডে মুদ্রিত, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৬
১৯. ট্রান্সফার অব পাওয়ার, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ ১৫৫-১৫৭, ১৭২
২০. তদেব, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৪৩৩-৪৩৪।
২১. তদেব, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৪৭৬-৪৭৯
২২. তদেব, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৪৬৬
২৩. কাঞ্জি দ্বারকাদাস, টেন ইয়ারস অব ফ্রিডম, পপুলার প্রকাশন, বম্বে, ১৯৬৮, পৃ ১৭৯।
২৪. তদেব
২৫. ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল মুভমেন্ট, মধু লিমায়ে, পৃ ৩০৮
২৬. শের মহম্মদ গারেওয়াল (সম্পাদিত), জিন্না-ওয়াভেল করেসপন্ডেনস ১৯৪৩-৪৭, রিসার্চ সােসাইটি অব পাকিস্তান, ইউনিভার্সিটি অব পঞ্জাব, লাহৌর, ১৯৮৬।
২৭. ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৭৮৪-৭৮৫
২৮. তদেব, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৭৮৫-৭৮৬
২৯. জুন ১২, ১৯৪৬, কিউ এ পি, ফাইল নং ১৪, পৃ ১, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৮৮৫
৩০. কিউ এ পি, ফাইল নং ১৪, পৃ ৫, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৯৪৫
৩১. পরিচ্ছেদ ৮, যেটি ওয়াভেল ১৬ জুন ১৯৪৬ তারিখে প্রকাশ করবেন বলে তাড়াতাড়িতে বিবেচনা করেন, তাতে এই উল্লেখটি আছে। পরবর্তী কালে যখন ক্যাবিনেট মিশনের সদস্যরা অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে সময় চান, তখন জিন্না এই প্রসঙ্গে ওয়াভেলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযােগ আনেন।
৩২. ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, নং ৫৬২, পৃ ৯৭১
৩৩. কিউ এ পি, ফাইল নং ১৪, পৃ ১৪-১৭, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৯৭৪৯৭৭।
৩৪. কিউ এ পি, ফাইল নং ১৪, পৃ ৩৩-৩৪এ, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, পৃ ৯৮৮-৯৮৯।
৩৫. ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, পৃ ১০৩২-১০৩৬
৩৬. তদেব, পৃ ১০৩৬-১০৩৮
৩৭. কিউ এ পি, ফাইল নং ১৪, পৃ ৫৮, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, সপ্তম খণ্ড, পৃ ১০৭৭
৩৮, কাঞ্জি দ্বারকাদাস, টেন ইয়ারস অব ফ্রিডম, পপুলার প্রকাশন, বম্বে, ১৯৬৮, পৃ ১৮২
৩৯. এ পি আই-কে দেওয়া জিন্নার সাক্ষাৎকার, হায়দরাবাদ ডেকান, জুলাই ১৩, ১৯৪৬
৪০. কিউ এ পি, ফাইল নং ২০, পৃ ৯, ১০, ১১, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, অষ্টম খণ্ড, পৃ ৯৮-৯৯
৩৪৪
৪১. দি ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার, ১৯৪৬, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ ২২৮
৪২. স্টিফেনস, তদেব, পৃ ১০৭ ৪৩, ২৭-২৯ জুলাই ১৯৪৬ কাউন্সিল বৈঠকে বসেছিল
৪৪. অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ কাউন্সিলের ২৯ জুলাই ১৯৪৬ তারিখের ঘােষণাপত্রের বয়ান।
৪৫. য়াহিদ আহমেদ সম্পাদিত, দ্য নেশনস ভয়েস— স্পিচেস, স্টেটমেন্টস, ইন্টারভিউজ অব জিন্না, পৃ ২০৯-২১৪
৪৬. ১৯৪৬ সালের ১৮ অগস্ট তারিখে দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় নেহরুর উদ্ধৃতি
৪৭. লেনার্ড মােসলে, লাস্ট ডেজ অব রাজ
৪৮. তদেব
৪৯. ওয়াভেল— দ্য ভাইসরয়’স জার্নাল, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭৩, পৃ ৩৪
৩৪৫
অষ্টম অধ্যায়
আলােচনার ঘূর্ণিপাক
জিন্না-র মতাে জেদি মানুষকে নিয়ে খুব মুশকিল। মুসলিম লিগ-এর ভেতরে এত দিনে তিনি একক, অবিসংবাদী নেতা। তিনি যা বলেন, সেটাই হয়। আজাদ কিংবা গফফর খান-এর মতাে জাতীয়তাবাদী নেতা, জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেও যাঁদের প্রভাব খুবই সীমিত, তাঁদের সঙ্গে যখনই জিন্নাকে আলাপ-আলােচনায় বসতে বলা হয়, অবধারিত ভাবে তিনি বিরক্ত হন। মনে করেন, হয়তাে সঙ্গত ভাবেই— এ সব করে আসলে তাঁকে ছােট করার চেষ্টা চলছে। তার উপর গাঁধী, নেহরু, পটেল, কংগ্রেসের এই ত্রিমূর্তি তাে ছিলেনই। সুতরাং ক্যাবিনেট মিশনের দৃষ্টিকোণ থেকে, এক দিকে জিন্না একা, অন্য দিকে কংগ্রেস নেতারা সব এক সঙ্গে। কংগ্রেস নেতাদের কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়াটা অনেক বেশি কঠিন কাজ। ‘ভাইসরয়’স জার্নাল’-এ আমরা এমন অনেকগুলি ঘটনার কথা জানতে পারি যেখানে ক্যাবিনেট প্রতিনিধিরা সকলের সঙ্গে কথা বলার সুযােগ না পেয়েই কংগ্রেস নেতৃত্বের মতামত মূল্যায়ন করতে বসে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এঁদের মধ্যে গাঁধীই সবচেয়ে সমস্যাজনক, কখন যে কী বলবেন তার আঁচ পাওয়া ভার। ওয়াভেল-এর ডায়রিতে বার বার গাঁধীকে নিয়ে তাঁর অসহিষ্ণুতার কথা উঠে এসেছে। এই জন্যই, ভারতের একটিমাত্র কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণপরিষদ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে গাঁধীর ভূমিকা ঠিক কী ছিল, সেটা আর এক বার তলিয়ে দেখা উচিত।
ওয়াভেল তাঁর ডায়রি-তে লিখছেন:
মে ৬, ১৯৪৬: সন্ধে সাড়ে সাতটায় উনি (গাঁধী) এলেন… সকলের (ক্যাবিনেট ডেলিগেশন) পক্ষেই সেটা একটা বিরাট ধাক্কা। গফফর খান এবং পটেল, যে দুই জন বিক্ষুব্ধ নেতার সঙ্গে গাঁধী তখন বসবাস করছেন, তাঁদের মতটাই সম্পূর্ণ ভাবে তাঁর মত হয়ে গেছে… হয় আমাদের কেবল কংগ্রেসি মতটাই গ্রহণ করতে হবে, নয়তাে জিন্নার দৃষ্টিভঙ্গি মেনে নিতে
৩৪৬
হবে; দু-এর মধ্যে কোনও সমঝােতা অসম্ভব। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনার কথায় গাঁধীর কোনও হেলদোল দেখা গেল না। সম্ভবত উনি পটেল-এর তত্ত্ব বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, আমরা নিজেরা শক্ত থাকলে মুসলিমরা কোনও ঝামেলা করবে না।
প্রায় পনেরাে দিন পর পরের বক্তব্যটি পাচ্ছি:
মে ১৯, ১৯৪৬ ক্রিপস আমাকে খুব সংক্ষেপে জানালেন গাঁধীর সঙ্গে তাঁর সাত ঘণ্টা ধরে কী কী কথাবার্তা হয়েছে… ওঁরা (ক্যাবিনেট মিশন) তখন গাঁধীর একটা চিঠি দেখালেন, প্রাদেশিক গ্রুপ ভাঙার জন্য কংগ্রেসের প্রয়াসের প্রথম সেই চিঠি৷৷ আমাদের নিজেদের অবস্থান ও বক্তব্যে (১৬ মে) দৃঢ় না থাকতে পারার জন্যই ডেলিগেশনকে এ ভাবে নতি স্বীকার করতে হল; সাত ঘণ্টা গাঁধীর সঙ্গে কাটানাের পর এই দাঁড়াল মােট ফল। এক জন ধুরন্ধর, অসৎ রাজনীতিকের চেষ্টায় গােটা পরিকল্পনাটা ধসে গেল।
মে ২০, ১৯৪৬- তিনি (লর্ড পেথিক লরেন্স) তখনই গাঁধীর আর একটি চিঠি হাতে পেলেন এবং আমাদের পড়ে শােনালেন। গাঁধীর সত্যিকারের চরিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়ায় তাঁদের তিন জনকেই (ক্যাবিনেট ডেলিগেশন) এত ধাক্কা খেতে দেখলাম, এমনটা আর আগে দেখিনি। ক্রিপস আর তাঁর সেক্রেটারি একেবারে যেন ভেতর থেকে নড়ে গেলেন। আর আলেক্সান্ডারের প্রতিক্রিয়া জন বুল যখন একেবারে কট্টর জাতীয়তাবাদী হয়ে যান, তার অবস্থাটা প্রায় সে রকম।
তার পরেই আসে ভাইসরয়’স জার্নাল-এর সম্পাদক পেন্ডেরেল মুন-এর ব্যাখ্যা। ক্রিপস এবং সেক্রেটারি অব স্টেট-এর সঙ্গে আলােচনায় গাঁধী যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন, যার ভিত্তিতে ক্রিপস নাকি তাঁকে বােঝাতে পেরেছিলেন, এই দ্বিতীয় চিঠিটিতে গাঁধী সেগুলােই আবার বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। স্পষ্টতই গাঁধীকে কিছুই বােঝানাে যায়নি। সেক্রেটারি অব স্টেট-এর মতে, গাঁধীর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যা আলােচনা হয়েছিল, তার কোনও ছায়াই এই চিঠিতে নেই, এবং তিনি এ বার নিশ্চিত যে ডেলিগেশন-এর অন্যান্য সদস্যরা ছাড়া গাঁধীর সঙ্গে এখন কারও দেখা করা উচিত নয়, অন্তত একটা কোনও সাবধানবার্তা ছাড়া সেটা করা যাবে না। আলেক্সান্ডার বললেন, তাঁদের বক্তব্যের ভিত্তিতে কোনও আলােচনা হােক, গাঁধী স্পষ্ট ভাবেই সেটা চাইছেন । (গাঁধীর) এই চিঠি ডেলিগেশন-এর অবস্থানকেও প্রবল ভাবে বিকৃত করছে। আমি এই অধ্যায়ে আগেই বলেছি যে, স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-কে ১৯৪৬ সালের ৮ মে-তে
৩৪৭
লেখা একটি চিঠিতে গাঁধী ‘গ্রুপিং ব্যবস্থা’র প্রবল সমালােচনা করেন। বদলে, তিনি জনসংখ্যার ভিত্তিতে একটা কেন্দ্রীয় আইনসভা আর মন্ত্রিসভা চান।
জুন ১১, ১৯৪৬ – পেথিক লরেন্স গাঁধীর সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব। আলেকজান্ডার কিন্তু তীব্র ভাবে তাঁর বিরােধিতা করেন। এও বলেন যে যদি পেথিক লরেন্স বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেন সে ক্ষেত্রে তিনি সােজা দেশে ফিরে যাবেন… জর্জ আবেল এর মধ্যে বার্তা নিয়ে এলেন যে গাঁধী আমার সঙ্গে দেখা করতে খুব ইচ্ছুক, আলেকজান্ডারেরও তাতে কোনও আপত্তি নেই, … উনি (গাঁধী) বললেন, কোনও একটা সমঝােতায় পৌঁছনাের জন্য তিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে আছেন, এও মেনে নিলেন যে কোয়ালিশন ছাড়া উপায় নেই। বললেন, কংগ্রেসই হােক আর লিগই হােক, সংখ্যা নিয়ে ভাবার কোনও মানে হয় না, তিনি কেবল চান, দু’পক্ষ থেকেই যাঁরা থাকবেন তাঁরা যেন সবচেয়ে যােগ্য হন।
পরিহাস এটাই যে, ১৯৪৬ সালের ১৩ জুন, ক্যাবিনেট ডেলিগেশন এবং ভাইসরয়ের কাছে পটেল খবর পাঠালেন যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব খারিজ করতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি পাঁচ মিনিটেরও কম সময় নিয়েছে। সেই ১৩ জুন-ই গাঁধী ভাইসরয়ের কাছে যে চিঠি পাঠালেন, তাতে দেখা গেল সম্পূর্ণ অন্য একটা সুর: “আপনাদের ঠিক করে নিতে হবে কোন ঘােড়াটি আপনারা বেছে নেবেন। যত দূর আমি বুঝি, দুটি ঘােড়ায় একই সঙ্গে সওয়ার হওয়া একেবারে অসম্ভব। হয় কংগ্রেসের দেওয়া নামগুলি গ্রহণ করুন, নয়তাে লিগের নামগুলিই মেনে নিন। ঈশ্বরের দোহাই, দয়া করে কোনও বিদঘুটে জগাখিচুড়ি বানানাের চেষ্টা করবেন না, সে রকম কিছু করলে দেশে একটা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।”
জুন ১৯, ১৯৪৬ – সুধীর ঘােষ এবং রাজাগােপালাচারির কাছ থেকে খবর পাওয়া গেল যে গাঁধীর মতের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি অন্তর্বর্তী সরকারে কোনও জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাকে না রাখার সিদ্ধান্তই নিয়েছে … মনে হল অবস্থার একটু উন্নতি হচ্ছে … বল্লভভাই। নাকি এই জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতার বিষয়টিতে গাঁধীর বিরুদ্ধতা করেছেন। নেহরু কাশ্মীরে চলে গেছেন।
জুন ২০, ১৯৪৬ – পরিস্থিতি আবার হাতের বাইরে চলে গেল, গাঁধীর কারণেই। … উইড্রো ওয়্যাট তখন একটি বার্তা নিয়ে এলেন … তিনি বললেন যে রাজাগােপালাচারি তাঁকে জানিয়েছেন যে গাঁধীর চাপে কংগ্রেস কালকের সিদ্ধান্ত পাল্টেছে, ইঞ্জিনিয়ারের নাম তালিকা থেকে
৩৪৮
সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, কেননা তিনি এক জন সরকারি চাকুরে, এবং সেই জায়গায় আজাদকে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে … আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম দুটি প্রস্তাবই সম্পূর্ণ অগ্রহণযােগ্য, আজাদকে নিয়ে আসলে অবধারিত ভাবে জিন্নার অস্বীকৃতির পথটিই নিশ্চিত করা হতে চলেছে।
(স্যার এন পি ইঞ্জিনিয়ার অবশ্য কোনও সরকারি চাকুরে নন। ওই সময়ে তিনি সরকারি একটি পদে বহাল ছিলেন: ভারতীয় সেনাবাহিনীর অ্যাডভােকেট জেনারেল এর পদ।)
১৬ মে-র চুক্তিটি নিয়ে এত আলাদা রকমের ব্যাখ্যা তৈরি হল, এবং তার ভিত্তিতে কংগ্রেস এবং লিগ এমন ভাবেই পরস্পরের থেকে বহু দূরে সরে গেল যে ক্যাবিনেট মিশন ব্যর্থ হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকল না। ভাইসরয়ের জার্নাল থেকে জানা যায়, গাঁধী আর নেহরু যাতে লিগের সঙ্গে কোনওমতে একটা বােঝাপড়ায় আসেন, তার জন্য ওয়াভেল কতখানি গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ফলও তাঁকে পােয়াতে হয়েছিল। ক্যাবিনেট মিশন সম্বন্ধে ওয়াভেল-এর নােট থেকে কিছুটা এখানে উদ্ধৃত না করে পারছি না। ওয়াভেল নিজে লেখক। ইতিহাসবােধও যে তাঁর যথেষ্ট, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁর নােট থেকে আমি যেটুকু উদ্ধৃত করছি, তার থেকে যথেষ্ট ভাল বােঝা যায়, ঠিক কী নৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে তিনি এবং ক্যাবিনেট মিশন তাঁদের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৪৬ সালের ২৫ জুন ওয়াভেল যা লিখেছিলেন, তার কিছুটা রইল এখানে:
১৬ মে-র চুক্তি নিয়ে কংগ্রেস তাদের নিজেদের যে ব্যাখ্যা তৈরি করেছে, তা নিয়ে তারা যদি আইনগত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চেষ্টা করে, তা হলে যে কী ঘটতে পারে, সে বিষয়টা আমি আলােচনা করেছিলাম, ক্যাবিনেট মিশন তা মনে রাখবে। আমার বক্তব্য: এই চুক্তি কোনও আইনি দলিল নয়, সুতরাং এর যা ব্যাখ্যা, তা আসলে নির্ভর করছে যাঁরা এটা তৈরি করেছেন, তাঁদের মনােগত উদ্দেশ্যের উপরে। আমি তাই স্যর স্ট্যাফোর্ড। ক্রিপস-কে বলেছিলাম যে ভারত ছাড়ার আগে ক্যাবিনেট মিশন যেন কাগজে কলমে স্পষ্ট করে লিখে রেখে যায়, যাঁরা এই চুক্তি তৈরি করেছেন, তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ঠিক কী ছিল। যাতে কখনও যদি এই কাগজপত্র আদালতে যায়, সে ক্ষেত্রে এই সব প্রমাণ সেখানে আমি, দাখিল করতে পারব।
তবে স্যর স্টফোর্ড ক্রিপস যে কাগজ তৈরি করলেন, তার মর্মার্থ আমার। ঠিক বােধগম্য হয়নি। আমি যা বুঝেছি, সেটা হল ইনি মনে করেছেন যে এই চুক্তিকে আইনগত ভাবে চ্যালেঞ্জ জানানাে যেতে পারে, এর নতুন ব্যাখ্যাও
৩৪৯
দেওয়া যেতে পারে। উনি এমনও প্রস্তাব করেছেন যে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা গণ-পরিষদ এই চুক্তির ব্যাখ্যার জন্য একটি কমিটি তৈরি করতে পারে। এক জন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি এটা ঠিক বুঝিনি। এবং, অন্য কোনও কমিটি বা গােষ্ঠী এসে আমাদের স্পষ্ট উদ্দেশ্যকে আবার নতুন ভাবে ব্যাখ্যা করবে, সেটাও আমার গ্রহণযােগ্য ঠেকেনি।
শরৎকালীন শান্তি আলােচনা
কলকাতা দাঙ্গার পর থেকেই একের পর এক নৃশংস বর্বরতার ঘটনা ঘটতে লাগল। যে নামগুলি এখন আমাদের সকলের স্মৃতিতে গেঁথে গেছে, সেই নােয়াখালি, বিহার, গড়মুক্তেশ্বরে এক এক করে সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং প্রতিহিংসার বন্যা বয়ে গেল, কিছুতেই থামানাে গেল না। এমন একটা সময়ে, যখন দেশভাগের ট্র্যাজেডিও স্পষ্ট এক সম্ভাবনা হয়ে দেখা দিচ্ছে, আর কোনও সমঝােতার ভাবনাও নেহাত পণ্ডশ্রম বলে বােধ হচ্ছে, গাঁধী এবং জিন্না আরও এক বার মিলিত হলেন। কোনও ভাবে কংগ্রেসলিগ বােঝাপড়া হয় কি না, তার চেষ্টা করতে। খুঁটিনাটি পর্যালােচনার বার বর্তাল নেহরু এং জিন্নার উপরে; ভােপালের নবাব-সাহেবের এক পক্ষকালের ক্রমাগত প্রচেষ্টায় । অন্তত এটুকু লাভ হল। ১৯৩৮ সালে মে মাসে সুভাষ বসুকে যা উপলব্ধি করতে হয়েছিল, ১৯৪৫-এর অগস্ট মাসে মৌলানা আজাদ যে ভাবে ভারতের মুসলিমদের একক প্রতিনিধিত্বের অধিকার আছে একমাত্র লিগেরই, সে কথা মেনে নেওয়ার কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, এ বার সে রকম গাঁধীর পালা, নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত একটি বাস্তবকে মেনে নেওয়া যে— লিগের পিছনেই রয়েছে ভারতের মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন। একমাত্র এই মৌলিক বিষয়টি গাঁধী মেনে নেওয়ার পরেই ৫ অক্টোবর জিন্না নেহরুর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন। রাজনীতির নিজস্ব অপভাষায় যাকে গাঁধী-জিন্নার ‘ফরমুলা’ বলা হয়, সেটাই দাঁড়াল এই বৈঠকের মূল আলােচ্য: “কংগ্রেস চ্যালেঞ্জ না করে এক রকম স্বীকারই করছে যে মুসলিম লিগ এখন ভারতের মুসলিমদের এক বিশাল অংশের একমাত্র প্রতিনিধি গােষ্ঠী। এবং তার ফলে, গণতান্ত্রিক নীতি অনুসারে, ভারতের মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নাতীত অধিকার তাদেরই। কিন্তু কংগ্রেস নিজেদের মতাে করে যাদের নিজেরা প্রতিনিধি বলে মনােনীত করবে, সে বিষয়ে অন্য কারও মত দেওয়ার অধিকার কংগ্রেস কিছুতেই মেনে নেবে না।”[১]
৭ অক্টোবর আবার তাঁরা দু’জন (নেহরু এবং জিন্না) দেখা করলেন। এক সপ্তাহ পর, ১৪ অক্টোবর, আলােচনা ব্যর্থ বলে ঘােষিত হল। আবার সেই চিরপরিচিত কাহিনি। ‘সেটলমেন্ট’-এর বৃহত্তর প্রশ্নটি নানা ছােটখাটো পদ্ধতিগত প্রশ্নের কুয়াশায় হারিয়ে গেল। নেহরু নিজে সেগুলিকে সংক্ষেপে যে ভাবে বললেন:
৩৫০
গাঁধীর ‘ফরমুলা
তফশিলি জাতি এবং সংখ্যালঘুদের সদস্যদের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব এই মুহুর্তে লিগ গ্রহণ করছে না।
তফশিলি জাতি ছাড়া অন্য সংখ্যালঘু আসনে শূন্যতা তৈরি হলে তার কী ব্যবস্থা হবে।
সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের প্রধান বিষয় বলে যেগুলি পরিচিত, সেগুলির সমাধান কী ভাবে হবে।
উপ-রাষ্ট্রপতি পদ এক এক বার এক এক দলের প্রার্থী পাবেন কি না।[২]
নেহরু অবশ্য এই ফরমুলা’ যে ভাষায় প্রকাশ করা হয়েছিল, সে বিষয়ে খুশি ছিলেন না। এর প্রয়ােজন নিয়ে তাঁর মনে কোনও দ্বিধাবােধ ছিল না, কিন্তু তাঁর মতে, এই ‘ফরমুলা’র আদৌ কোনও প্রয়ােজনই ছিল না। সমস্যাটা যে একেবারে সমাধানের অতীত, তা নয়, যদি বৃহত্তর কারণে কোনও সমঝােতা করতেই হতাে, তা হলে যে খুব সাংঘাতিক বিপর্যয় উপস্থিত হতাে, সে রকম তাঁর মনে হয়নি।
জিন্নার কাছে, গাঁধীর সঙ্গে যে ‘ফরমুলা’ হয়েছে, তার আর কোনও অদলবদল গ্রহণযােগ্য নয়। এটাই মূল সেটলমেন্ট-এর ভিত্তি, গাঁধী এতে সই করেছেন, জিন্না স্বীকৃতি দিয়েছেন। নেহরুকে লেখা ৭ অক্টোবরের চিঠিতে জিন্না যখন বিষয়টি আবার করে পুনরাবৃত্তি করছেন, জিন্না আরও একটি দরকারি কথা তুললেন যা কংগ্রেস মানতে রাজি নয়: আরও যে পাঁচটি আসন তাঁদের জন্য সংরক্ষিত, মুসলিম লিগ অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিলে সেখানে তাঁদের পছন্দের কোনও মুসলিম নেতাকে বসাতে হবে। অথচ, ‘ফরমুলা অনুযায়ী কংগ্রেস তার নিজের সদস্যদের মধ্য থেকেই প্রতিনিধিদের মনােনীত করবে। তা হলে কেন জিন্না চিঠিতে বিষয়টি এ ভাবে তুলতে গেলেন? চিঠির ‘সংযােজন’ অংশে, নেহরুর বিবেচনার জন্য আটটি বিষয় রাখা হয়েছিল: ফরমুলার মূল জায়গাটা কি তাতে ক্রমেই ধোঁয়াটে হয়ে গেল, নাকি একেবারে বােঝাপড়ার নাগালের বাইরে চলে গেল? – সৌভাগ্যক্রমে, তাঁরা আবারও দেখা করলেন, যে দিন নেহরুকে চিঠি লিখলেন জিন্না, সেই ৭ অক্টোবরেই। কিন্তু এই বৈঠকেও কোনও ফল হল না। নেহরু আর তাঁর কংগ্রেসি সতীর্থদের কাছে পুরাে পরিকল্পনাটাই এত দিনে অগ্রহণযােগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। জিন্নার সঙ্গে তাঁর ৫ অক্টোবরের বৈঠকের প্রসঙ্গ তুলে নেহরু বললেন যে তাঁদের বৈঠক কোনও ‘স্বীকৃত ফরমুলা’র ভিত্তিতে হয়েছিল বলে তাঁর জানা নেই। প্রত্যাশিত ভাবেই, নেহরুও খুবই চাইছিলেন যাতে কংগ্রেস তার নিজের সংরক্ষিত আসনে কোনও মুসলিমকে নিয়ােগ করে। জিন্নাকে লেখা ৮ অক্টোবরের চিঠিতে, তিনি অন্য আর একটি অনুচ্ছেদের কথা বললেন, যেটা ওই ফরমুল য় ছিল, কিন্তু জিন্না ওই বিষয়টি নিয়ে একেবারেই কোনও কথা বলেননি। এবং সেটা কাগজে
৩৫১
কলমেই প্রমাণিত।[৫] কংগ্রেস সংরক্ষিত আসনে মুসলিম প্রতিনিধি নিয়ােগের গুরুতর প্রশ্নটিতে তিনি লিখিত ভাবে জানালেন যে, ৭ অক্টোবরের বৈঠকে নেহরুর সঙ্গে তাঁর সে বিষয়ে কথা হয়ে গিয়েছিল। তাঁর মতে, ‘স্বীকৃত ফরমুলা থেকে বিচ্যুতির এটাও আর একটি নিদর্শন।[৬] নেহরু উত্তরে বললেন, জিন্নার চিঠিতে বেশ কিছু ‘অসত্য তথ্য রয়েছে।
যে ফরমুলায় গাঁধী সই করেছিলেন, নেহরু ও কংগ্রেস নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত তা খারিজ করে দিলেন। জিন্না-নেহরু কথােপকথন ব্যর্থ হলে, এবং সেই কথােপকথন প্রকাশিত হয়ে পড়লে, গাঁধী কিন্তু কোনও মন্তব্য করলেন না। কেননা, এখন বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া গাঁধীই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বুঝতে পারছিলেন, কী হতে যাচ্ছে। মােহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, ভারতের মাটিতে জন্মগ্রহণ করা সেই মানুষটি, যিনি মনে করতেন তাঁর শরীরের সমস্ত কোষ ভারতের মাটির ঋণে ভরা, তিনিই সে দিন দেখতে পাচ্ছিলেন কী বিশাল দুর্ভাগ্য নেমে আসছে আমাদের ওপর। আর কেউ দেখেননি। আশ্চর্যের কিছু নেই যে তাই সে দিন তিনিই একেবার চুপ করে রইলেন। সত্যি বলতে কী, এটাই ছিল ভারতকে টুকরাে টুকরাে হওয়া থেকে বাঁচানাের জন্য জিন্নার কাছে তাঁর শেষ আর্তি। একটাই কথা শেষ পর্যন্ত আমাদের মতাে মানুষের মনে বার বার ঘুরে ঘুরে ধাক্কা দিয়ে যায়: ভাঙনের জন্য কেনই বা সে দিন এত অসম্ভব তাড়া করছিলেন আমাদের নেতারা ? নেহরু যতটা বলেছিলেন, ব্যাপারটা যদি তত স্পষ্ট, স্বচ্ছই হবে, তা হলে আজও কী নিয়ে আমরা ভেবে ভেবে মরছি?
অ্যাটলি-ওয়াভেল-জিন্না-নেহরু কনফারেন্স, লন্ডন, ডিসেম্বর ৩-৬, ১৯৪৬
কিন্তু এর পরও কংগ্রেস আর লিগের কাছে নিজেদের বিরােধিতা কমানাের আবার একটা সুযােগ এল। প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি লন্ডনে একটি বৈঠক ডাকলেন ১৯৪৬ সালের ৬ ডিসেম্বর। বাস্তবিক, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রিসভার দিক থেকে সমাধানে পৌঁছনাের এটাই শেষ প্রয়াস। ভারতকে বিভাজন থেকে বাঁচানাের জন্য নয়, আসলে ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অপসরণের পদ্ধতিটাকে শান্তিপূর্ণ করার জন্যই যে প্রশাসনিক ভাবনা চলছিল, তার জন্যই এই চেষ্টা। প্রধানত দুটো কারণে এই চেষ্টা করা হল।
প্রথমত, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় যতই এগিয়ে আসছিল, ব্রিটিশদের কাছে। আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নটা ততই জরুরি হয়ে উঠছিল। তা ছাড়া, আইনের দিক থেকে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দিক থেকেও কখনও স্পষ্ট হয়নি, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে কোন নেতৃত্বের হাতে এই ক্ষমতা দেওয়া হবে। এটা হল দ্বিতীয় কারণ।
কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে একটি মূল বিতর্কের জায়গা হল প্রদেশগুলিকে যােগ না
৩৫২
দেওয়ার অধিকার দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্নটি। লিগের বিপরীতে গিয়ে কংগ্রেস তখন বলতে চায় যে, তারা ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যদি এই ‘ব্যাখ্যাটি তাতে থাকে যে, একেবারে গােড়ার কোনও প্রদেশ তার যে গ্রুপে যাওয়ার কথা, তাতে যােগ দিতে না চায়। লিগের মতে, এই ব্যাখ্যার ফলে গােটা প্ল্যান’-টিই। বরবাদ হয়ে যায়, এত দিনের এত আলােচনা সম্পূর্ণ অবান্তর হয়ে পড়ে। লিগ যুক্তি দিল: যদি ধরা যাক, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে যদি ড. খান সাহেবের সরকার গ্রুপ এ-তে যােগ দিতে অসম্মত হয়, এবং অসমের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গােড়াতেই গ্রুপ সি থেকে পেরিয়ে যেতে চায়, মিশন পরিকল্পনা অনুযায়ী লিগের আর কী বিকল্প হাতে থাকে ? লিগের ভয়, তাদের যদি এই পরিস্থিতি নিয়ে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে যেতে হয়, সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন আটকানাের কোনও উপায়, কিংবা (লিগের পক্ষে) একটা গ্রহণযােগ্য সংবিধান তৈরির সম্ভাবনা, আর তাদের হাতে থাকবে না।
কংগ্রেসের কাছে এই পরিকল্পনার ব্যাখ্যার জন্য এর রচয়িতাদের মনােগত উদ্দেশ্যের আর এক বার পুনরাবৃত্তিটাই জরুরি হয়ে দাঁড়াল। ১৯৪৬ সালের ৬ ডিসেম্বর লন্ডনে রানির সরকার (HMG) ঘােষণার মাধ্যমে সেটা পাওয়াও গেল। বােঝা গেল, এর থেকে মুসলিম লিগের অবস্থানের প্রতি সমর্থনের ইঙ্গিত মিলছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাপারটাকে চুক্তিতে পরিণত করতে হলে এখনও কিছু পথ হাঁটা বাকি। লন্ডন বৈঠকে সে পথে কিছুটা এগােনাে গেল। প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করলেন, উপস্থিত ছিলেন স্যর পেথিক লরেন্স, স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, নেহরু, জিন্না, লিয়াকত আলি খান আর সর্দার বলদেব সিংহ। সেখানে যা যা বক্তব্য পেশ হল, পুরােটাই ইতিহাসের স্বার্থে সংরক্ষণযােগ্য, কেননা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ এই সময় থেকে অনেকাংশে এর উপরেই নির্ভর করবে। এখানে তার থেকে সামান্য কিছু অংশ দেওয়া হল। ৪ ডিসেম্বর এবং ৬ ডিসেম্বরের দুটি বৈঠকই আমাদের জন্য উল্লেখযােগ্য।
ইন্ডিয়ান কনফারেন্স ইন লন্ডন, পেপার আই সি এল (৪৬)২
এল/পি অ্যান্ড জে/১০/১১: এফএফ ৭৭-৮১
রেকর্ড অব মিটিং হেল্ড ইন জ্য সেক্রেটারি অব স্টেট’স রুম অ্যাট দি ইন্ডিয়া অফিস, ৪ ডিসেম্বর ১৯৪৬ (সকাল ১০.৩০)।
গােপনীয়
উপস্থিত ব্যক্তিগণ: লর্ড পেথিক লরেন্স (সভাপতি), স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, মি. আলেকজান্ডার, ফিল্ড মার্শাল ভিসকাউন্ট ওয়াভেল, পণ্ডিত নেহরু, মি. টার্নবুল, মি. অ্যাবেল (সেক্রেটারিদ্বয়)
ভাইসরয়ের বক্তব্য অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার-এর ক্যাবিনেট মিটিং-এ কোনও সংঘর্ষ উপস্থিত হয়নি। পণ্ডিত নেহরু বলেছেন, মুসলিম সদস্যরা
৩৫৩
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃত হন। ভাইসরয় মনে করিয়ে দেন যে, মি. লিয়াকত আলি খান দেখা করতে চাইলে পণ্ডিত নেহরুও কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে দেখা করেননি। উত্তরে পণ্ডিত নেহরু বলেন, মি. লিয়াকত আলি খান তাঁকে অপমান করেছিলেন, সেই জন্যই তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করার স্পৃহা বােধ করেননি। অন্তর্বর্তী সরকারের একেবারে প্রথম দিনে ভাইসরয়ের বাড়ির বাইরে নেহরু মুসলিমদের কাছে কেবল অপমানিতই হননি, রীতিমতাে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। দুটো গ্রুপে অন্তর্বর্তী সরকার চালানাে অসম্ভব ছিল। যদি সেই চেষ্টা করা হত, মুসলিম লিগ। সব সময়েই ভােটে হেরে যেত, আর বিতর্কিত বিষয়গুলি সব ক্যাবিনেট পর্যন্ত গিয়েই উঠতে পারত না। এমনকী খুব সম্প্রতি, ইন্ডিয়া অফিসের সাহায্য নিয়ে দুই জন লিগ প্রতিনিধি আমেরিকায় গিয়ে ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ফোরাম’-এ বিষময় বক্তৃতা দিয়ে এসেছেন।
দফতরহীন মন্ত্রী যিনি, তিনি বললেন যে দেশের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায়, মন্ত্রিরা পার্টি হিসেবে কাজ করেন না। ক্যাবিনেটের সাব-কমিটি তৈরি করে নিয়ে কাজ সারা হয়। পণ্ডিত নেহরু সেই শুনে বললেন তিনি মুসলিম লিগকে তাদের দাবি ছেড়ে দিতে বলছেন না, কিন্তু তাঁর মনে হচ্ছে, কোনও একটা সর্বজনগ্রাহ্য পথ বার করার ব্যাপারে লিগের প্রচেষ্টার খামতি আছে।
তার পর আসল গােলমেলে সমস্যা গ্রুপিং নিয়ে আলােচনা শুরু হল।। পণ্ডিত নেহরু আক্ষেপ করলেন, লিগের কাগজগুলিতে সরকার বিষয়ে অত্যন্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন সব কথাবার্তা লেখা হচ্ছে, অথচ লিগ নিজেও কিন্তু সরকারেরই অংশ। স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস সেই শুনে জানতে চাইলেন, নেহরু কি মনে করেন যে তিন-ধাপবিশিষ্ট প্রশাসন তৈরি হলে তার কোনও সুরাহা হতে পারে? নেহরুর উত্তর: ১৬ মে-র প্রস্তাব যেহেতু কংগ্রেসের মনােমত হয়নি, তাও তাঁরা তা স্বীকার করেছেন কেবল এই ভেবে যে প্রস্তাবের মধ্যে যথেষ্ট আলাপ-আলােচনার সুযােগ ছিল, এবং কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির উপর কোনও বাধানিষেধ আরােপ করা হয়নি। যথেষ্ট সংখ্যক মানুষের সমর্থন থাকলেই যে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারার স্বাধীনতা এমনই একটা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত। তিনধাপবিশিষ্ট প্রশাসনের প্রস্তাবটি করাই হয়েছিল এই ভেবে যাতে যদি সংশ্লিষ্ট প্রদেশগুলি ও তার মানুষেরা এটা চান, তবেই তা গঠিত হবে। এর মধ্যে যদি গ্রুপ ব্যবস্থার প্রস্তাব থাকে তা হলে কংগ্রেস তা পুরােই স্বীকার করে নেবে, তবে কংগ্রেস কিন্তু এখনও অন্য পক্ষদের বােঝাতে আগ্রহী যে গ্রুপ ব্যবস্থাটা মােটেই সুবিধের নয়। অবশ্য, ফেডারেল কোর্ট বা যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের সিদ্ধান্তটি কংগ্রেস সমর্থন করে। অনেক
৩৫৪
আলােচনার পরও এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনাে সম্ভব হল না।
সমাপ্তি অধিবেশনের রিপাের্ট বরং অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এবং তথ্যপূর্ণ।
রেকর্ড অন মিটিং অ্যাট ১০ ডাউনিং স্ট্রিট, ৬ ডিসেম্বর ১৯৪৬, অ্যাট ফোর পি এম
গােপনীয়
উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ: মি. অ্যাটলি (সভাপতি), লর্ড পেথিক লরেন্স, স্যার এস ক্রিপস, মি. আলেক্সান্ডার, ফিল্ড মার্শাল ভিসকাউন্ট ওয়াভেলি, মি. টার্নবুল (সেক্রেটারি)
স্টেটমেন্ট বাই হিজ ম্যাজেস্টি’জ গভর্নমেন্ট।
পণ্ডিত নেহরু, মি. জিন্না, মি. লিয়াকত আলি খান ও সর্দার বলদেব সিং-এর সঙ্গে সরকারের আলােচনার সমাপ্তিতে পৌঁছনাে গেল। পণ্ডিত নেহরু, সর্দার বলদেব সিং কালই ভারতে ফিরে যাচ্ছেন। আলােচনার উদ্দেশ্য ছিল কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সব সদস্য দলের অংশগ্রহণ ও সহযােগিতা। কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনাের লক্ষ্য ছিল না, বিশেষ করে এই জন্য যে ভারতের যে প্রতিনিধিরা এসেছেন, তাঁরা তাঁদের সহকর্মীদের জিজ্ঞেস না করে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
আলােচনায় দেখা গেল, প্রধান সমস্যা হচ্ছে ক্যাবিনেট মিশনের ১৬ মে প্রস্তাবের ১৯ (৫), ১৯ (৮) নম্বর অনুচ্ছেদ নিয়ে। এই অনুচ্ছেদ দুটির বক্তব্য:
১৯ (৫) অনুচ্ছেদ: “উক্ত বিভাগগুলি প্রতিটি বিভাগের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশগুলির জন্য প্রাদেশিক সংবিধান তৈরির পথে এগােক। প্রদেশগুলির জন্য কোনও গ্রুপ ব্যবস্থা ও গ্রুপ কনস্টিটিউশন গ্রহণ করা হবে কি না, আর যদি হয়, সে ক্ষেত্রে গ্রুপ কোন কোন প্রাদেশিক বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখার অপেক্ষা রাখে। অনুচ্ছেদের সাব-ক্লজগুলি ভাল করলে দেখলে বােঝা যাবে, প্রদেশগুলিকে একটি বিশেষ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকারও দেওয়া হয়েছে।”
১৯ (৮) অনুচ্ছেদ: “নতুন সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনা এক বার চালু হলে, কোনও প্রদেশ যে গ্রুপে আছে, সেটাতেই থাকার কিংবা সেটা। থেকে বেরিয়ে আসার অধিকার তার থাকবে। নতুন সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের পরই প্রাদেশিক আইনসভাকে এই ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া হবে।”
ক্যাবিনেট মিশন কিন্তু আগাগােড়া মনে করেছে যে অন্য কোনও বােঝাপড়া না
৩৫৫
থাকার ফলে, প্রতিটি বিভাগের সিদ্ধান্তই সেই বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত দ্বারাই নির্ধারিত হবে। মুসলিম লিগ সে বিষয়ে একমত। কংগ্রেসের বক্তব্য অন্য। তাদের বক্তব্য: স্টেটমেন্টের প্রকৃত অর্থ আসলে এই যে প্রদেশগুলিই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, কোন গ্রুপে তারা থাকবে, কিংবা কোন সংবিধান তারা গ্রহণ করবে।
‘হিজ ম্যাজেস্টি’জ গভর্নমেন্ট বা ব্রিটিশ রাজ অনেক আইনি পরামর্শ নিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ১৬ মে-র প্রস্তাবে যা বলা হয়েছে, ক্যাবিনেট মিশনের উদ্দেশ্যও একেবারে ঠিক তা-ই। স্টেটমেন্টের এই অংশটি তাই ১৬ মে-র প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত অর্থ বলেই ধরে নেওয়া কর্তব্য, যাতে ‘হিজ ম্যাজেস্টি’জ গভর্নমেন্ট তার পার্লামেন্টের কাছে যে প্রস্তাব পেশ করতে চলেছে, তাতে ভারতীয় জনসাধারণকে। তাদের নিজেদের সংবিধান তৈরির জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে। সুতরাং, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সব দলের স্বীকৃতি পাওয়াটা তাদের চোখে অত্যন্ত জরুরি হয়ে ওঠে।
স্পষ্টতই, ১৬ মে-র প্রস্তাবের ভিন্ন বিশ্লেষণও সম্ভব। ব্রিটিশ রাজ তাই আশা করছিল যে মুসলিম লিগ কাউন্সিল যদি কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে অংশগ্রহণ করে, তা হলে কংগ্রেসের মতাে তারাও মানবে যে ফেডারেল কোর্টকে প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করতে দেওয়া উচিত, এবং দুই পক্ষেরই তা গ্রহণ করা উচিত।
ব্রিটিশ রাজ কংগ্রেসকেই প্রথমে অনুরােধ জানাল, যাতে ক্যাবিনেট মিশনের। পরিকল্পনা মেনে নিয়ে মুসলিম লিগকে তাদের মত পরিবর্তনের সুযােগ দেওয়া হয়। ক্যাবিনেট মিশনের লক্ষ্য বারংবার পরিষ্কার করে বলে দেওয়া সত্ত্বেও যদি কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি মনে করে যে ফেডারেল কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া উচিত, যত শীঘ্র সম্ভব তা করা দরকার। ফেডারেল কোর্টের বক্তব্য না জানা অবধি কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সব রকম অধিবেশনই বন্ধ রাখাও দরকার।
সর্বমতৈক্য ছাড়া কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির সাফল্যের কখনওই কোনও সম্ভাবনা ছিল না। যেখানে দেশের এক বিরাট অংশের জনতার প্রতিনিধিত্ব রাখা সম্ভব হয়নি, এমন কোনও অ্যাসেম্বলির মাধ্যমে সংবিধান তৈরি করে গােটা দেশের উপর, দেশের অনিচ্ছুক অংশের উপরেও তা চাপিয়ে দেওয়া – সে কংগ্রেস যা-ই বলুক না কেন, – ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে তা সম্ভবই ছিল না।
স্টেটমেন্ট পড়ে শােনানাের পর জিন্না জানতে চাইলেন, ব্রিটিশ রাজ প্রস্তাবটির যা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, ফেডারেল কোর্ট যদি তার থেকে আলাদা কিছু সিদ্ধান্ত করে, সে ক্ষেত্রে কী হতে পারে। দফতরহীন মন্ত্রী যিনি, তিনি বললেন, সরকারকে তা হলে সেই অবস্থান মেনে নিতে হবে। জিন্না বললেন, কিন্তু ফেডারেল কোর্ট যা-ই বলুক না কেন, মুসলিম লিগ কিন্তু সেটা মানতে বাধ্য থাকতে পারে না। তাঁর মনে হচ্ছিল যে, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি একটা বড় হিন্দু ভােটের মাধ্যমে বিষয়টা ফেডারেল কোর্টের কাছে পাঠিয়ে দেবে, এবং তার মাধ্যমে মুসলিম লিগের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। মুসলিম লিগ সে জন্য আগে থেকেই এর থেকে নিজেকে আলাদা করে রাখতে চাইল। তা ছাড়া, মুসলিম
৩৫৬
লিগের তরফে তিনি তাে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, দেশে ফিরে গিয়ে তাে তাঁকে এ বিষয়ে কাউন্সিলের সঙ্গে আলােচনা করতে হবে। সুতরাং তাঁর পক্ষ থেকে, ব্রিটিশ সরকারকে অনেক ধন্যবাদ, প্রস্তাবটি নিয়ে এত আলােচনার জন্য।
পণ্ডিত নেহরু বললেন, কংগ্রেস অবশ্যই বিষয়টি ভেবে দেখবে, স্টেটমেন্ট পড়ে দেখতে কিছুটা সময় লাগবে বলে এখনই কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানাে যাচ্ছে না। তবে এ প্রসঙ্গে কতগুলি বিষয় তিনি উল্লেখ করতে চান।
যেমন, তাঁর মতে, এই স্টেটমেন্টটি আসলে ১৬ মে-র স্টেটমেন্ট-এর সংশােধিত রূপ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১৬ মে প্রস্তাবকে তা ছাড়িয়ে চলেও গেছে। কংগ্রেস কিন্তু এই প্রস্তাব ধরেই আগাগােড়া এগিয়েছে। ক্যাবিনেট মিশন এবং ভাইসরয় নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ওঁরা যা বলছেন, কংগ্রেসও সে কথাই বলে আসছে। অথচ এখন বলা হচ্ছে যে, কোনও সংশােধনই নাকি করা হবে না। ফলে কংগ্রেস এখন খানিক বিপাকে পড়ে গেছে, কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বুঝতে পারছে না।
নতুন প্রস্তাবটিতে ১৯(৫) এবং ১৯(৮) অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত হয়েছে, কিন্তু ১৬ মে প্রস্তাবের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদটি নেই। অথচ সবটা মিলিয়ে পড়লে কিন্তু অর্থটা দাঁড়ায় অন্য, ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদটি আলাদা করে পড়লে যা অর্থ দাঁড়ায়, তার থেকে নিশ্চিত ভাবে ভিন্ন।
প্রধানমন্ত্রী বললেন, কীসের ভিত্তিতে এই মতামত দেওয়া হল, তা তিনি বােঝেননি। ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক নীতিগুলি ব্যাখ্যা করে, আর ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ সংবিধানে যে সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হল, কী ভাবে তা কার্যকর করা যাবে, সেই বিষয়ে আলােচনা করে। দুটো বেশ আলাদা জিনিস বলে তাঁর মনে হয়, এবং যে নীতিগুলি একটি ক্ষেত্রে প্রযােজ্য হচ্ছে, সেগুলিই যে সর্বদা অন্য ক্ষেত্রেও প্রয়ােগ করা সম্ভব, তা না -ও হতে পারে। কিন্তু পণ্ডিত নেহরু বলছেন যে, কংগ্রেস মনে করে দুটি অনুচ্ছেদ একসঙ্গে বিচার করলে ভিন্ন অর্থ বােঝা যায়। ব্রিটিশ রাজের যে কোনও স্টেটমেন্টই কংগ্রেসকে খুব ভাল করে অনুধাবন করতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর কিন্তু মত এই যে, বর্তমান স্টেটমেন্টটি কেবল ১৬ মে-র আলােচিত বিষয়গুলির মধ্যেই আবদ্ধ রয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন না, কংগ্রেসের কোনও ব্যাখ্যা যদি প্রস্তাবটিকে পাল্টে না দিতে পারে, তা হলে ব্রিটিশ রাজের কোনও ব্যাখ্যা কেন প্রস্তাবটির পরিবর্তন বলে গণ্য হবে। নেহরু জবাব দিলেন, ব্রিটিশ রাজ যেহেতু প্রস্তাবটির রচয়িতা, কংগ্রেস নয়, তাই রাজের ব্যাখ্যার মূল্য আর কংগ্রেসের ব্যাখ্যার মূল্য কখনওই এক হতে পারে না।
নেহরু বললেন, তিনি অবশ্য জানেন না যে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির মত এ | বিষয়ে ঠিক কী। সাধারণ ভাবে, এই ধরনের কোনও কমিটির উপর খুব বেশি বাইরের।
চাপ থাকলে তার ভেতরের সহযােগিতার সম্ভাবনা যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন গ্রুপ। এবং প্রদেশের বক্তব্য ইতিমধ্যেই বেশ জোরের সঙ্গে প্রচারিত হয়েছে। যেমন, শিখদের পক্ষ থেকেই বেশ জোরালাে বক্তব্য বেশ করা হয়েছে, কংগ্রেসেরও নিজের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে। জিন্না এবং লিয়াকত আলি খানকে তিনি আশ্বাস দিতে চান যে দুই
৩৫৭
পক্ষের দিক থেকে সম্মানজনক কোনও একটা অবস্থানে আসতে তাঁরাও খুবই ব্যস্ত, কেননা বাকি জীবনটা এই নিয়েই কাটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে তাঁদের কারও নেই। আর, দেশের এক অংশ অন্য অংশের উপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে, এ রকমও তিনি বা তাঁরা ভাবতে পারছেন না। তিনি নিজে কোনও দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি আগে থেকে ভেবে নিয়ে এগােতে চান না, কিন্তু অন্যরা অকারণে তেমনটা ভেবে নিয়েই এগােচ্ছেন বলে তাঁর ধারণা। এমন সম্ভাবনা থেকেই যায় যে বড় সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে আরও বড় সমস্যায় উপনীত হতে হল। এক দিক দিয়ে এটা ঠিক যে ভারতের নানা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই এই সংঘর্ষ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তিনি এও মনে করেন যে ভারতীয়দের যদি স্বাধীন ভাবে ভাবা ও কাজ করার অধিকার দেওয়া না হয়, তা হলে আরও বড় সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। ভারতীয়দের নিজেদেরই ভাবতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এবং সেই সিদ্ধান্তের ফলাফল বহন করতে হবে।
ব্রিটিশ রাজকে এই সাধু উদ্যোগের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে নেহরু তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন।
নেহরু যা বলেছেন, তার ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর তিনটি মন্তব্য আছে বলে জানা গেল। প্রথমত, তিনি মনে করেন না যে ১৬ মে প্রস্তাবের সঙ্গে কোনও কিছু সংযােজিত করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বর্তমান প্রস্তাবটিকে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির উপর বাইরের চাপ প্রয়ােগের প্রয়াস বলে মেনে নিতে তিনি একেবারেই নারাজ। ব্রিটিশ সরকার প্রথম থেকেই ভারতীয়দের মধ্যে আলােচনার মাধ্যমে কোনও একটি মতৈক্যে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, সর্বজনসম্মত কাঠামাে হিসেবে যা ইতিমধ্যেই গৃহীত হয়েছে, তা ছাড়া আর কোনও কিছুই কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির উপর জোর করে চাপানাে হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন না। এবং, একটা কোনও সর্বজনস্বীকৃত কাঠামাে ছাড়া যে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়, তাতেও সন্দেহ করা যায় না।
সর্দার বলদেব সিংহ বললেন, এই নতুন প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে শিখদের অবস্থান আরও দুর্বল করে তুলল। গ্রুপ বি-র মধ্যেই যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােট নেওয়া হবে, প্রাদেশিক ভােট হবে না, তাতে চার শিখ প্রতিনিধির প্রভাব যতখানি হওয়ার কথা ছিল, তার থেকে অনেকটা কমে যাবে। এর ফলে যে শিখদের এই অন্তর্বর্তী সরকারে যােগ দিতে এবং ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করতে অনেক কষ্টে রাজি করা হয়েছিল, তারা সঙ্গত ভাবেই বিরক্ত হয়ে উঠবে। তিনি এমন ভয়ও পেলেন যে ফেডারেল কোর্ট এখন ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে একমত হয়ে একই পথে চলবে, এবং শিখদের তার ফলে এমন পদক্ষেপও নিতে হতে পারে যাতে তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা ব্যক্তিগত ভাবে অত্যন্ত অস্বস্তিজনক অবস্থায় পড়বেন। যাই হােক, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিকে অন্তত এক বার একটা সুযােগ দেওয়ার জন্য তিনি তাঁর জাতিকে যথাসাধ্য বােঝানাের চেষ্টা করবেন।
বাের্ড অব ট্রেড-এর প্রেসিডেন্ট বললেন যে এই প্রস্তাব কোনও ভাবেই আগেকার ১৬৬ নম্বর সার্বিক সিদ্ধান্তটিকে বিরুদ্ধতা করছে না। শিখদের সঙ্গে সহযােগিতা করতে যে সব দলই যথেষ্ট আগ্রহী, এ বিষয়ে তাঁর গােড়া থেকেই কোনও অনিশ্চয়তা নেই।
৩৫৮
লিয়াকত আলি খান বললেন, তাঁর নেতা জিন্না যা বলেছেন, তিনি তার সবটাই সমর্থন করেন। মুসলিম লিগ সব সময়েই চেয়েছে, সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান তৈরি হােক সহযােগিতাপূর্ণ পরিবেশে। ব্রিটিশ মন্ত্রীরা এ বিষয়ে যে ধৈর্য ও ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তিনি কৃতজ্ঞ বােধ করছেন। তিনি আশা করেন, ভারত শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ পথেই স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে।
সেক্রেটারি অব স্টেট বললেন, তিনি আশা করেন যে ভারতীয় নেতারা এই নতুন প্রস্তাবটিতে খােলা মনে বিচার করে দেখবেন। কোনও পক্ষপাতদুষ্ট মন নিয়ে এই প্রস্তাব রচিত হয়নি। সব দলের প্রতি আস্থা রেখে এটি তৈরি হয়েছে। ক্যাবিনেট মিশন প্রথম থেকে যা যা বলে এসেছে, তার থেকেও আলাদা কিছু এতে নেই।
যে দফতরহীন মন্ত্রী ছিলেন, তিনি ভারতীয় প্রতিনিধিদের এত দুর আসার জন্য বহু। ধন্যবাদ জানালেন— বললেন যে ১৬ মে এবং ২৫ মে প্রস্তাবে যা ছিল, তার থেকে কোনও কিছু পাল্টানাে হয়নি এই সভার প্রস্তাবে।
বাের্ড অব ট্রেড-এর প্রেসিডেন্ট-এর মতে, যদি সহযােগিতার ভাব বজায় থাকে, তা হলে সমস্যার সমাধান কিছু কঠিন কাজ নয়। তাঁর মনে হয়েছে, আসল সমস্যাটা পারস্পরিক সন্দেহ, বছরের পর বছর জুড়ে যা বেড়ে উঠেছে। সেই বিরুদ্ধতার ভাবটি যদি কোনও ভাবে সহযােগিতার ভাবে রূপান্তরিত করা যায়, সে ক্ষেত্রে সমস্যাগুলাে সহজেই দূর করা যাবে। হিজ এক্সেলেন্সি বড় লাট বললেন, যবে থেকে তিনি তাঁর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, তিনি সব পক্ষকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন, এবং যথাসাধ্য সে কাজটা চালিয়েই যাবেন। তাঁর একান্ত আশা, এখান থেকে কোনও একটা সর্বস্বীকৃত সিদ্ধান্তের দিকে এগােনাে যাবে।
এই সব প্রথাগত বিনিময়ের পর, ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাকে বাঁচানাের শেষ সুযােগটি পরিত্যক্ত হল।
১৯৪৬ সালের ৬ ডিসেম্বর, ব্রিটিশ রাজের যে প্রস্তাবটি প্রকাশিত হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল একটি আইনগত সিদ্ধান্তের উপর। পরিকল্পনাটিকে একটা স্পষ্ট অর্থ দেওয়ার জন্যই এই প্রয়াস করা হয়। এরই প্রেক্ষিতে, নেহরু ১৬ মে-র প্রস্তাবের একটা আলাদা মাত্রা দেওয়ার কথাটি তুলেছিলেন, যাতে মনে হয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিকে জানানাে হচ্ছে যে তার সীমারেখাটা ঠিক কোথায় টানা আছে। এর জন্যই সরকারের প্রস্তাব মানতে তাঁর এত অনীহা। এর পরই অ্যাটলি-র ব্যর্থ প্রত্যুত্তর এবং তার পর নেহরুর দিল্লি প্রত্যাগমন, একতরফা ভাবে সংবিধান তৈরির প্রচেষ্টা। মুসলিম লিগ সুতরাং, অ্যাসেম্বলিতে যােগদান থেকে বিরত থাকল, নিজেদের পৃথক কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির দাবি জানাল। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই মৃত ধরে নেওয়া হল: যেটা মােটেই অবধারিত ছিল না, দুর্ভাগ্যক্রমে শেষ পর্যন্ত সেটা-ই ঘটল, আটকানাে গেল না, পাকিস্তান সত্যিকারের বাস্তব হয়ে উঠল। উপসংহার হিসেবে নয়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই আমাদের মনে রাখা উচিত কংগ্রেসের মধ্যে সেই সময় আরও যে যে মতগুলি ছিল, সেগুলির কথা। তাতে বােঝা সম্ভব বয়ােজ্যেষ্ঠ কংগ্রেস নেতারা
৩৫৯
তখন ঠিক কী ভাবছিলেন। স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস-কে লেখা সর্দার বল্লভভাই পটেলের একটি চিঠি:
যখন বােঝা গেল যে দুই পক্ষই হিংসার আশ্রয় নিতে প্রস্তুত, এমনকী নরম-মনােভাবাপন্ন হিন্দুরাও দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে জঙ্গি মুসলিমের মতাে একই হিংস্রতার সঙ্গে অপরকে আক্রমণ করতে পারে, তখন আপনি সেখানে (লন্ডন, ডিসেম্বর, ১৯৪৬) লিগ বৈঠক আহ্বান করলেন। যে-ই একটা বােঝাপড়ার সময় এল, জিন্না আমন্ত্রণটি পেলেন, এবং মুসলিমদের আবারও বােঝাতে সমর্থ হলেন যে তিনি গণ্ডগােল, দাঙ্গা, হিংসা ঘটানাের মাধ্যমে সহজেই তাঁর দাবি আদায় করতে পারেন।
আমি এটুকুই বলব যে, যখন মুসলিম লিগ ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ ঘােষণা করল, কিংবা ১৬ অগস্ট কলকাতায় শক্তি প্রদর্শনের সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হল, সেই সময় যদি শক্ত ভাবে অবস্থার সামাল দেওয়া যেত, দেশজোড়া এই বিপুল অপচয়, প্রাণ ও সম্পত্তির এই বিশাল রক্তক্ষয়ী অপচয় রােধ করা যেত। এখানে ভাইসরয় অবশ্য সে কথা মনে করেন। না, এবং ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’-এর পর তাঁর প্রতিটি কাজেই তিনি মুসলিম লিগকে সমর্থন দিয়ে আসছেন, তাদের দাবি মেনে খামােখা। তাদের মাথায় তুলেছেন।
আপনার ব্যাখ্যা থেকে এও পরিষ্কার যে বাংলার মুসলিমরাই অসমের সংবিধানও স্থির করে দিতে পারে। বিস্ময়কর। আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে এমন একটা প্রস্তাব অসমের হিন্দুদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব? বিশেষ করে যখন ইতিমধ্যেই বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, জোরপূর্বক বিবাহের মতাে এত অসংখ্য ঘটনা ঘটে গেছে? আপনার প্রস্তাবের এইটুকু অংশের জন্যই যে কতটা ক্ষোভ ও ক্রোধ তৈরি হয়েছে, তার ধারণাও আপনার নেই। যদি আপনি মনে করেন যে অসমকে সত্যিই বাংলার আধিপত্য মেনে নিতে হবে, এই ভ্রান্তি থেকে যত শীঘ্র আপনি বেরিয়ে আসতে পারেন, ততই ভাল। যে শিখদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে বলে আমরা সকলেই একমত, তাদের সন্তোষের জন্যই বা কী করা হয়েছে এই প্রস্তাবে? অসমের সংবিধান যদি এমন ভাবে তৈরি করা হয় যাতে অসমের গ্রুপ ছেড়ে বেরিয়ে আসা একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে আপনার প্রস্তাবে আর কোন সম্ভাবনা বাকি থাকল?[৭]
৩৬০
১৯৪৬ সালের ৭ ডিসেম্বর নেহরু ভারতে ফিরে এসে ৯ ডিসেম্বরের কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির উদ্বোধনী অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে। মুসলিম লিগ এই অধিবেশেন এবং পুরাে অ্যাসেম্বলি-ই, বয়কট করল। ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরের শেষ দিকে, পটেল শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন যে “অ্যাটলিকে বিশ্বাস না করে এবং তাঁর বােঝাপড়ারপ্রস্তাবটি মেনে না নিয়ে কংগ্রেস খুব বড় ভুল করেছে।[৮]
১৯৪৬-এর ৯ ডিসেম্বর, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির বৈঠক বসল, এক আশ্চর্য অবাস্তব পরিস্থিতিতে। এ এক বিরাট ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। কেননা এই অধিবেশন বসল ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিকে পা ফেলার জন্য, অর্থাৎ এক অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিকে, অথচ মুসলিম লিগের প্রতিনিধিদের চেয়ারগুলি সেই বৈঠকে রইল সম্পূর্ণ খালি! একটা ছােট সেশন-এর পর অ্যাসেম্বলি-র অধিবেশন মুলতুবিও হয়ে গেল, কোনও বিশেষ ঘটনা ঘটল না, কেবল নেহরু ঘােষণা করলেন, ভারত স্বাধীন হতে চলেছে। কোনও ভােটাভুটি? হল না!
কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির জন্ম উপলক্ষে লর্ড পেথিক লরেন্স নেহরুকে সংবর্ধিত করতে একটা তার পাঠাবেন ভাবছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাঠালেন না। তাঁর আশঙ্কা হল, এমন একটা কিছু পাঠালেই “জিন্না প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, … এবং যার থেকে নেহরু আবার প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে আরও কতগুলাে লম্বা বক্তৃতা দিয়ে ফেলবেন, আর সব মিলিয়ে এমন ভয়ানক কাণ্ড হবে যে সে আর বলার নয়।” “কেউ কি নেহরুকে বলতে পারেন না যে জিন্না আর চার্চিলের কথার উত্তর দিতে গিয়ে আর বক্তৃতা না দিতে? এঁরা ঝামেলা পাকানাের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছেন, আর নেহরু তাঁদের প্রতিটি কথাকেই গুরুত্বপূর্ণ ধরে নিয়ে উত্তর দিতে গিয়ে এঁদের হাতে নাচছেন।” পেথিক-লরেন্সএর অসহায় প্রশ্ন: “কংগ্রেস কেন এই গ্রুপিং নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছে? অসমের কী হবে, সেটা নিয়ে এত না ভেবে কেন ওঁরা কাজটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলছেন না? এ সব ব্যাপার পরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে নেওয়া যেত। এত কিছু করার আছে যে এই সব ছােট ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানােটা সম্পূর্ণ বােকার মতাে সময় নষ্ট করা হচ্ছে।” [৯]
এই মন্তব্যের মধ্যে কি ভাবার মতাে কিছু তা হলে থেকে গেল ? ছােট ছােট ডিটেলএর দিকে মন দিতে গিয়ে আমরা কি তা হলে গুরুত্বপূর্ণ কাজটার দিকেই মন দিচ্ছিলাম না ? এই মন্তব্য কেবল এক জন বয়ােজ্যেষ্ঠ, শান্তিকামী শুভানুধ্যায়ীর কাছ থেকে তীব্র আবেগের প্রকাশই নয়, এক ভারতবন্ধুর স্বাভাবিক আশঙ্কারও প্রকাশ, যদিও সেই সময়কার চ্যালেঞ্জগুলাের মােকাবিলা করার পক্ষে যথেষ্ট জোর হয়তাে তাঁর ভাবনায় ছিল না।
আর এক গুরুত্বপূর্ণ লেবার ক্যাবিনেট সদস্য বেভান-ও কিন্তু মােটের উপর একই ধরনের কথা বলেছিলেন, আরও অনেক জোরের সঙ্গে: “সন্দেহ নেই, অতীতে ব্রিটিশই এই দেশে সাম্প্রদায়িক শত্রুতা তৈরি করেছিল। হিন্দু মুসলিমের মধ্যে যে বিরােধ ছিল, তার পূর্ণ সুযােগ নিয়েছিলাম আমরা। সেই বিরােধিতাকে কাজে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা এখন অতীত। এখন লেবার সরকার এসে আপনাদের স্বশাসনের অধিকার
৩৬৩
দিতে চায়, আপনারা নিতে চান না। এত নির্বোধ হবেন না, গ্রহণ করুন এই সুযােগ। জিন্নার সঙ্গে বােঝাপড়া করে নিন, তার পর আমাদের আরও অনেক কিছু করার আছে, থাকবে।” বেভানকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে নেহরু লন্ডনে থাকার সময়ে তিনি তাঁকে এ কথা বলেছিলেন কি না, বেভানের তীক্ষ্ণ প্রত্যুত্তর: “আমি কেমন করে তাঁর সঙ্গে দেখা করব? আসার মুহূর্ত থেকেই নেহরু ফিরে যেতে ছটফট করছেন।”[১১] এই ভাবেই শেষ হল ১৯৪৬ সাল। দুর্ভাগ্যতাড়িত ১৯৪৭ এল আমাদের দোরগােড়ায়।
উনিশশাে সাতচল্লিশের সেই তিক্ত শেষাঙ্ক
দুর্ভাগ্যতাড়িত ১৯৪৭ এসে পৌঁছল যখন, ভারতের রাজনীতির আকাশ তখন দুই সম্প্রদায় এবং দুই প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের ভয়ঙ্কর পরস্পর-বিরােধিতা আর আক্রমণমুখিতার কালাে মেঘে আচ্ছন্ন। বছরটায় যে কী ঘটতে চলেছে, কী ভাবে যে এই বছর শেষ হতে চলেছে, কারও কোনও ধারণা নেই, সবাই কেবল অনিশ্চয়তা এবং এক অজানা আশঙ্কায় ভাসমান।
১৯৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি, মুসলিম লিগ ওয়ার্কিং কমিটি করাচি বৈঠকে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করল, যার মূল উপজীব্য, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি-র গঠন এবং পদ্ধতি। ব্রিটিশ রাজকে অনুরােধ জানানাে হল যাতে ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে, সরকারি ভাবে সেটা জানিয়ে দেওয়া হয়, কেননা ‘কংগ্রেস সেই পরিকল্পনা মেনে নেয়নি’, শিখ সম্প্রদায় কিংবা তফসিলি জাতিগুলিও মেনে নেয়নি। প্রত্যুত্তরে, কংগ্রেস সরকার থেকে লিগ সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করল। ১৫ ফেব্রুয়ারি সর্দার পটেল এও বললেন যে, লিগ যদি পদত্যাগ না করে, কংগ্রেস তা হলে প্রতি-আক্রমণমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে। আর তা যদি হয়, তা হলে যে দেশে মারাত্মক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, সে বিষয়েও সাবধান করলেন তিনি।[১২]
কয়েক দিন আগের একটি ঐতিহাসিক ঘটনায় পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯৪৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, ফিল্ড মার্শাল লর্ড ওয়াভেল তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন: “দ্বিপ্রহরিক আহারের পরেই বিশেষ বার্তাবাহক-সহযােগে প্রধানমন্ত্রীর একটি চিঠি এসে পৌঁছল, যাতে লেখা আছে যে এক মাসের নােটিসে আমাকে এই পদ ছেড়ে দিতে হবে। খুব ভদ্রতাসম্মত ভাবে ব্যাপারটা করা হল, এমন বলা চলে না। নিজের ব্যক্তিগত জার্নালে ওয়াভেল এইটুকুই লিখেছিলেন ভাইসরয়ের পদ থেকে তাঁ, সরে যাওয়ার বিষয়ে। অথচ বিষয়টি কিন্তু তাঁর নিজের জীবনে একটা বিশেষ ক্ষণ, তাঁর ভবিষ্যৎ অবস্থান নির্ধারণ করার পক্ষে। ওয়াভেলের প্রতিক্রিয়া যেন এক কর্তব্যনিষ্ঠ নিরাবেগ সৈনিকের প্রতিক্রিয়া: জীবনের ওঠাপড়া সমান ভাবে গ্রহণ করার তাঁর এই প্রয়াস প্রায় অসংবেদনশীলতার পর্যায়ে পড়ে।
৩৬৪
১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হাউস অব কমনস-এ ভারতের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ঘােষণার জন্য একটি শ্বেতপত্র দাখিল করলেন। সেই অবকাশে অ্যাটলি জানালেন; “ব্রিটিশ সরকার চেয়েছেন, শাসনক্ষমতা সেই প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হােক যাঁরা ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের সব দলের অনুমােদনপ্রাপ্ত, এবং সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। দুর্ভাগ্যক্রমে, এই মুহূর্তে এমন কোনও প্রতিষ্ঠান, এমনকী সংবিধান তৈরি হওয়ার আশাও দেখা যাচ্ছে না। এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক, খুব বেশি দিন আর তা টানা উচিত হবে না। ব্রিটিশ সরকার পরিষ্কার করে জানাতে চান যে তাঁদের স্পষ্ট লক্ষ্য ১৯৪৮ সালের জুন মাসের আগে যে করেই হােক ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপগুলি নেওয়া।” এ দিনই তিনি জানালেন যে লর্ড ওয়াভেল-এর উত্তরাধিকারী, পরবর্তী ভাইসরয় হতে চলেছেন লর্ড লুইস মাউন্টব্যাটেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে পার্লামেন্টের বিরােধীরা সমালােচনামুখর হয়ে উঠলেন। তাঁদের মতে, নির্ধারিত তারিখটি বড় বেশি তাড়াতাড়ি, এত হুড়ােহুড়ি করতে গেলে বিরাট গােলযােগ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। ক্যাম্পবেল জনসন লিখেছেন, হাউস অব লর্ডস-এ “সিকি শতাব্দী ধরে ব্রিটিশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত বহু তারকা তখন নিজেদের মধ্যে আলােচনা করছেন, লর্ড টেম্পলউড-এর মন্তব্য যে “নির্ধারিত তারিখটি ভারতের মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা, ভারতের শান্তি-সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যের বিরােধিতা নিয়ে বিতর্কে মেতেছেন। লর্ড টেম্পলউড-এর কাছ থেকে আসা এই মন্তব্য খুবই গুরুতর এবং হাউস অব লর্ডস-এ তা সরকার পক্ষকে রীতিমতাে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিল। বলা হল যে, এই দৃষ্টিভঙ্গি নিলে ‘অখণ্ড ভারতের জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যের প্রতি কিছুতেই এগােনাে সম্ভব নয়। “যতক্ষণে লর্ড লিস্টওয়েল সরকার পক্ষে প্রথম দিনের বিতর্কের সমাপ্তি ঘােষণা করলেন, বিভাজন ও বিতর্ক এড়িয়ে সর্বস্বীকৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছনাের আশা তত ক্ষণে লুপ্ত।” তখন “ভারত বিষয়ে বিশেষ ভাবে অভিজ্ঞ বলে পরিচিত লর্ড হ্যালিফ্যাক্স-এর বিশেষজ্ঞসুলভ মতের ভিত্তিতেই শেষ পর্যন্ত স্থির হল, লর্ডরা তাঁদের মতবৈষম্যের রেকর্ড রাখবেন না। ব্রিটিশ ভারতের পরিস্থিতি বিষয়ে। এটাই হ্যালিফ্যাক্স-এর শেষ মহাকৃতিত্ব।” দলীয় মতামত কিংবা শৃঙ্খলার অনেকটা বাইরে গিয়ে তিনি বললেন, “আমি যেটুকু জানি তাতে বলতে পারি, অন্য বিষয়গুলি ঠিকই হােক ভুলই হােক, এই পদক্ষেপটি সম্পূর্ণ ভুল.. কিন্তু ঘটনা হল, ভারতবর্ষের জন্য এখন যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হােক না কেন, প্রতিটিই হবে অত্যন্ত বিপজ্জনক, অত্যন্ত সংঘর্ষপূর্ণ। সুতরাং সব বিরােধিতা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে যে, ব্রিটিশ রাজ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কারণ আমি কোনও ভাল সমাধান দেখতে পাচ্ছি না। ব্যর্থতা, হতাশা আর আশঙ্কার চোটে হাউস থেকে যদি ভারত-বিষয়ে কেবলই নিন্দামূলক কথা বলা হয়, তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হতে পারে না।”
অ্যালান ক্যাম্পবেল জনসন এও লিখেছেন, কেমন করে “লর্ড স্যামুয়েল পরে
৩৬৫
আমাকে বললেন হাউস অব লর্ডস-এ এ যাবৎ যে বক্তৃতাসমূহ তিনি শুনেছেন, তার মধ্যে এটাই শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। এর প্রভাব যে কী তীব্র হয়েছিল সেটা স্পষ্ট হবে যদি মনে রাখা যায় যে, বক্তৃতার আগে বহুসংখ্যক লর্ড যদিও স্থির করে ফেলেছিলেন যে তাঁরা সরকারের বিপক্ষে ভােট দেবেন, কিন্তু টেম্পলউড-এর কাছে হ্যালিফ্যাক্স-এর হাউসকে বিভক্ত হতে না দেওয়ার সনির্বন্ধ অনুরােধ শুনে তাঁরা অনেকেই মত পরিবর্তন করলেন।” শেষটা তাই সম্পূর্ণ উল্টে গেল। মতামতের স্রোত অন্য দিকে ঘুরে গেল, এবং টেম্পলউড নিজের মত না ছাড়লেও আস্তে আস্তে তাঁর প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলেন।
তার পর ‘৪৭ সালের ৫ মার্চ, কমনস-এ বিতর্ক শুরু হল। লেখাপত্র থেকে বােঝা যায়, কী বিরাট ঘটা হয়েছিল সেশনটিতে। দুই দিনের এই বিতর্ক আরম্ভ হতে সকলের কাছেই পরিষ্কার হয়ে গেল, কী বিপুল গুরুত্বপূর্ণ এই সেশন। ক্রিপস সর্বদাই অত্যন্ত যত্নে যুক্তিশৃঙ্খলিত বক্তৃতা দেন, ঠিক তেমনটাই এখানেও বললেন, বিষয়টিতে তাঁর দখল ও মতের প্রাবল্য প্রতি ছত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
“… বহু কষ্টে ক্রিপস বােঝানাের চেষ্টা করলেন যে ১৯৪৮ সালের পর প্রশাসনিক ভাবে এবং সামরিক ভাবে ভারতে থাকা কত অসম্ভব। তা ছাড়া অবশ্য উনি আর সময়সীমা নিয়ে বেশি জোরাজুরি করেননি, এবং লর্ড ওয়াভেল-এর প্রসঙ্গই উত্থাপন করেননি। সেটা অবশ্যই দুর্ভাগ্যজনক। ফিরতি পথের পথিক ভাইসরয়ের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের তীব্র মতান্তর নিয়ে যে গুজব এমনিতেই রটছিল, সেটাই আবার সমর্থিত হল এই ঘটনায়।”
“পর দিন, ৬ তারিখ, যখন চার্চিল বক্তৃতা দিতে ফিরলেন, ক্যাম্পবেল রেকর্ড অনুযায়ী বহু-প্রত্যাশিত আতসবাজির খেলা শুরু হল সেই সময়ে। চার্চিল কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তাঁর অভ্যস্ততায় একেবারে স্থির থেকে গিয়েছেন, আমাদের সময়কার অন্য সমস্ত বিষয়ের থেকে ভারতের বিষয়টিতেই তিনি আগাগােড়া সবচেয়ে দৃঢ়তা এবং জেদের পরিচয় দিয়েছেন।”
“১৯৪২-এর ক্রিপস মিশন দিয়ে তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন। সেই সময় যদিও প্রস্তাবটি একেবারেই গ্রহণযােগ্য হয়নি, হাউসে উভয় পক্ষই কিন্তু তখনও সেই মিশনের সুরেই নিজেদের বেঁধে রেখেছেন, এবং পরবর্তী ঘটনাবলিকে সেই প্রস্তাবের নীতির থেকে বিচ্যুতি হিসেবে দেখেছেন।” শেষ অবধি তাঁর বক্তৃতায় ওয়াভেল-এর উল্লেখ পাওয়া গেল, যদিও সে উল্লেখ খুব একটা মধুর নয়। “ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল বরখাস্ত হয়েছেন। তাঁর হয়ে এখানে আমার কিছু বলার নেই। এই সময়ে সরকার যা কিছু ভুলভ্রান্তি করেছে, ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় তিনিই সে সবের মুখপাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তবে চার্চিল এও। বললেন যে তিনি জানেন না “কেন ওয়াভেলকে এই পরিস্থিতিতে সরিয়ে দেওয়া হল, ফিরে আসার পর হয়তাে তাঁর কাছ থেকে কোনও মন্তব্য পাওয়া যাবে।”
নতুন ভাইসরয় বিষয়েও চার্চিল তাঁর বিখ্যাত ব্যঙ্গোক্তিচ্ছটা নিয়ে এলেন। “ভারত যে কেবল বিভক্ত হতে চলেছে তাই নয়, খণ্ডিত এবং এলােমেলাে ভাবে খণ্ডিত হয়ে যেতে বসেছে।.. ভারতের এই রাজনৈতিক শ্রেণির কাছে আমাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য
৩৬৬
আমরা বেছে নিয়েছি কিছু খড়ের পুতুল মানুষকে, কয়েক বছর পরেই ইতিহাস থেকে যাঁরা পুরাে মুছে যাবেন। সরকারের এই সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই পনেরাে মাসের সীমার মধ্যে নতুন ভাইসরয়ও অথর্ব হয়ে থাকবেন, এবং এই পদটি, এই প্রয়ােজনও তার মধ্যে বিলােপ করে দেওয়া হবে।” আর শেষে সেই শ্মশানের সিদ্ধান্ত: “অনেকেই ব্রিটেনকে তার শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করেছেন, কিন্তু কেউ তাকে নিজের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি।…. কিন্তু, অন্তত যেন আমরা, – লজ্জাজনক পলায়ন বা ত্বরিত আত্মবিলােপের মাধ্যমে অন্তত যেন আমরা এই লজ্জা, এই দুঃখের বােঝাকে আর না বাড়িয়ে তুলি।” কী অসাধারণ, অবিস্মরণীয়, গিবনস-সুলভ একটি বক্তৃতা, কিন্তু কী অসম্ভব রকমের ভ্রান্ত সেই বক্তৃতার বক্তব্যসমূহ! | প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির শান্ত যুক্তিনিষ্ঠ বক্তৃতা এবং লেবার পার্টির জোরদার সমর্থনের মাধ্যমে প্রস্তাবটি হাউস অব কমনস-এও পাশ হয়ে গেল। ভারতের স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭ পাশ হয়ে গেল ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই।
ঘটনাপ্রবাহ এ বার দ্রুত ঘনাতে আরম্ভ করল, অবধারিত দুর্ভাগ্যপ্রবাহের দিকে। ধ্বংস ও মৃত্যুর বার্তাবাহক দেশভাগ প্রবল গতিতে এগিয়ে আসতে লাগল ভারতের দিকে। অখণ্ড ভারতের সবচেয়ে বড় সমর্থকরাও গত কয়েক বছরের নিরবচ্ছিন্ন রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসে বলতে শুরু করলেন, দেশভাগ ছাড়া আর গতি নেই। স্বাভাবিক ভাবেই, বহু অবাস্তব, কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত সব প্রস্তাব আসতে শুরু করল। ১৯৪৭ সালের ৪ মার্চ সর্দার পটেল কাঞ্জি দ্বারকাদাসকে নিজের মত লিখে জানিয়েছিলেন, [১৩] “আপনার মতাে আমি কোনও অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভাবছি না। আগামী জুনের মধ্যে সংবিধান প্রস্তুত হয়ে যাবে, এবং লিগ যদি পাকিস্তানের ব্যাপারে বেশি জোর দেয় তা হলে একমাত্র উপায় থাকবে বাংলা আর পঞ্জাবের দ্বিখণ্ডীকরণ। ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ ছাড়া পঞ্জাব বা বাংলার গােটা প্রদেশকে ওরা নিতে পারবে না। ব্রিটিশ সরকার এই দেশভাগ মেনে নেবে বলে আমার মনে হয় না। সুতরাং, শেষ পর্যন্ত, সকলেই বুঝবে যে শাসনক্ষমতাভার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দলের হাতে তুলে দেওয়াই একমাত্র বুদ্ধির কাজ। তারা যদি এতে না রাজি হয়, তা হলেও তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দেশবিভাগ পাচ্ছে না। তাই দিল্লির মতাে শক্ত কেন্দ্রের অধীনে অবশিষ্ট দেশ এবং সেই কেন্দ্রের অধীনে পূর্ব বাংলা ও পঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তানের একাংশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাবই একমাত্র সম্ভবপর প্রস্তাব, যেটা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।”
চোখ খুলে দেওয়ার মতাে চিঠি: কত ভুলই না তাঁরা ভাবছিলেন! এত কিছু ভাবার পর, এই প্রথম তিনিও কিন্তু পঞ্জাব ও বাংলার দ্বিখণ্ডীকরণ-সহ দেশভাগের সম্ভাব্যতা মেনে নিলেন। মাউন্টব্যাটেন ভারতে পা রাখার মাত্র তিন সপ্তাহ আগে এই চিঠিটি লেখা, যাতে প্যাটেল সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ভাবে আশা করছেন যে ব্রিটিশ দেশভাগ মেনে। নেবে না। চার দিন পর, ১৯৪৭-এর ৮ মার্চ, জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই পটেলের পূর্ণ সমর্থনে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একটি প্রস্তাব পাশ করে, যাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এও বলা হল:
৩৬৭
“পঞ্জাবের এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাবলি প্রমাণ করে দেয় যে হিংসা ও জবরদস্তি দিয়ে কোনও সমাধানে পৌঁছনাে যাবে না। সবচেয়ে কম জবরদস্তির পথটিই বেছে নিতে হবে। তার অর্থ এই যে পঞ্জাবকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে, যাতে প্রধানত মুসলিমসংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি প্রধানত অমুসলিম অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওয়ার্কিং কমিটি • এই সমাধানসূত্রকে স্বাগত জানাচ্ছে, কেননা একমাত্র এর মাধ্যমেই সব সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষিত হবে, সংঘর্ষ, আতঙ্ক, পারস্পরিক অবিশ্বাস কমবে। কমিটি পঞ্জাববাসীকে আন্তরিক অনুরােধ জানাচ্ছে এই হিংস্র হানাহানি বন্ধ করার জন্য, এবং এই দুর্ভাগ্যজনক সমাধান মেনে নেওয়ার জন্য যেখানে কোনও বড় দলের কাছে কাউকে নতি স্বীকার করতে হবে না, সংঘর্ষের কোনও কারণ ঘটবে না।”[১৪]
নেহরু এর আগেই পঞ্জাবকে তিন টুকরাে করার কথাও উল্লেখ করেছিলেন, “যাতে একটি মুসলিম অংশ, একটি শিখ অংশ এবং একটি মিশ্রবসতিপূর্ণ অংশ থাকবে।” নেহরু ভেবেচিন্তেই এই প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন। হয়তাে তিনি ভেবেছিলেন, এমন অবাস্তব একটা প্রস্তাব আসলে জিন্নার প্রস্তাবকেই অসম্ভব করে তুলবে।
যে তারিখে এই প্রস্তাব কমিটি নিল, সেটার মধ্যেও একটা দুর্ভাগ্য আছে। গাঁধী তখন বিহারে আর্ত মানুষদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মৌলানা আজাদ তখন অসুস্থ, অনুপস্থিত। পটেল ও নেহরু ভালই জানতেন যে এই দুই ব্যক্তি উপস্থিত থাকলে এই প্রস্তাবে আপত্তি জানাতেন। বস্তুত, তিন সপ্তাহ পর, গাঁধী এক চিঠিতে নেহরুর কাছে। জানতে চাইলেন এই প্রস্তাব নেওয়ার কারণ কী।[১৫] পটেলকেও তিনি একই সঙ্গে এই প্রস্তাব ব্যাখ্যা করে জানাতে লিখলেন। পটেলই প্রথম উত্তর দিলেন: “পঞ্জাবের প্রস্তাবটি আপনাকে ব্যাখ্যা করে বােঝানাে মুশকিল। বহু ভাবনাচিন্তার পরই এটি গৃহীত হয়েছে। তাড়াহুড়াে করে কিংবা পুরােটা না ভেবে মােটেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আমরা আগে থেকেই জানি যে আপনার এতে মত নেই। কিন্তু অবশ্যই আপনার নিজস্ব মতটি জানানাের অধিকার তাে রইলই।” নেহরুর উত্তর এল এক দিন পর, কিন্তু সে উত্তর আরও ধোঁয়াটে: “পঞ্জাব বিভাগের প্রস্তাবটি স্বভাবতই আমাদের আগেকার আলােচনা থেকেই উদ্ভূত।[১৬]
কংগ্রেস দলের অবস্থান, চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে এই প্রস্তাবটি একটি বিশাল পরিবর্তন সূচিত করে। মাউন্টব্যাটেন তত দিনে ভাইসরয় হয়ে এসেছেন। এই প্রস্তাবের মধ্যে দেশভাগের প্রস্তাবটি মেনে নেওয়ার প্রাথমিক ইঙ্গিত পেয়ে আনন্দিত মাউন্টব্যাটেন পটেলকে তৎক্ষণাৎ ডেকে পাঠান। ইতিমধ্যে দেশভাগের বিরুদ্ধে জওহরলাল নেহরুর আপত্তিও অনেকটাই কমে এসেছে। মাউন্টব্যাটেন আসার (১৯৪৭ সালের ২০ মার্চ) এক মাসের মধ্যে, দেশভাগের এত কালের তীব্র বিরােধী নেহরু দেশভাগের অন্যতম বড় প্রবক্তায় পরিণত হলেন।
জিন্নার যে দ্বিজাতিতত্ত্ব ভারতের ভূগােল-সমাজ-রাজনীতির ধ্বংসের প্রধান কারণ, সেই নীতিকে এই প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে স্বীকার করে নিল। মাত্র ত্রিশ বছর আগে যে
৩৬৮
কংগ্রেস বাংলা-বিভাগেরও তীব্র বিরােধিতা করেছিল, সেই কংগ্রেসই যে এখন গােটা ভারতের বিভাজনের প্রস্তাব গ্রহণ করল, এও কম আশ্চর্যের নয়। আর একটি প্রস্তাবে মুসলিম লিগের প্রতিনিধিদের মনােনীত করতে বলা হল, যে প্রতিনিধিরা কংগ্রেস প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলিত হবেন, “বর্তমান পরিস্থিতিকে বােঝার জন্য, এবং সেই পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।”[১৭] এই দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ঐতিহাসিক। পরিহাসের মতাে প্রথম প্রস্তাবের লেজুড় হয়ে এল। যতই মনে হােক যে এমনকী এই পর্বেও যদি জিন্না কংগ্রেসের আমন্ত্রণটি ভেবে দেখতেন, একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যেত: কী লাভ এতে? তা ছাড়া, জিন্না ইতিমধ্যে কংগ্রেসের ক্যাবিনেট মিশন-সংক্রান্ত দ্বিচারিতায় এতটাই তিক্তবিরক্ত হয়ে উঠেছেন যে তিনি বিনাবাক্যব্যয়ে কংগ্রেসের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিলেন। ১৯৪৭ সালের ২১ এপ্রিল, নেহরু খােলাখুলি জানিয়ে দিলেন, “যাঁরা পাকিস্তান চান, তাঁরা তা পাবেন”, কিন্তু শর্ত এই যে ভারতের অন্যান্য অনিচ্ছুক অংশগুলিকে কোনও ভাবেই জোর করা যাবে না পাকিস্তানে যােগ দেওয়ার জন্য।[১৮] এই শর্তটির বিশেষ অর্থ বােঝা যায় না। কেন নেহরু এটা করতে গেলেন ? যদি না গ্রুপিং-এর আতঙ্ক তাঁকে এতটাই গ্রাস করে থাকে যে, যে কোনও ক্ষেত্রে তিনি এই সম্ভাবনার বিষয়টি আটকে দিতে চেয়ে থাকেন। |
ভারত-বিভাগ ইতিমধ্যেই একটি স্বীকৃত নীতি, এ বার তাকে বাস্তবে প্রয়ােগ করার বিষয়টি সামনে উঠে এল। ছােটখাটো বিষয়গুলি এ বার নির্ধারণ করার পালা: কী ভাবে, কখন এই বিভাগ সম্পাদন করা যাবে। বিভাজনরেখাটি কোথা দিয়ে যাবে, তাও কেউ জানে না, কারও কোনও ধারণাই নেই কোথায় সেটা থাকা উচিত। ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে ২৮ এপ্রিল বললেন, “আমাদের প্রস্তুত থাকা উচিত, দেশকেই যে কেবল ভাগ করা হবে তা নয়, প্রদেশগুলিকেও প্রয়ােজনে ভাগ করতে হতে পারে।”[১৯]
২ মে লর্ড ইসমে এবং জর্জ অ্যাবেল ভারতবিভাগের প্রথম মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা বহন করে নিয়ে গেলেন লন্ডনে। ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানেরই একটি পরিমার্জিত রূপ পাওয়া গেল এই ড্রাফট প্ল্যানে, যেখানে এক বারে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, পার্টির নেতাদের ইচ্ছা বা স্বীকৃতি ব্যতিরেকেই, এবং দৃঢ় শক্তিশালী কেন্দ্রের বদলে তৈরি হবে একটি দুর্বল যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্র।
ব্যঙ্গনাট্যের মতাে সব ঘটনা ঘটতে লাগল তার পর। ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে যেন একটা হাস্যকৌতুক আরম্ভ হয়ে গেল। ইসমে এবং এবেন যখন লন্ডনে, সেই সময়ে ভাইসরয়ের উপদেষ্টা ও রিফর্মস কমিশনার ভি পি মেনন স্মরণ করছিলেন সিমলায় ভাইসরয়ের প্রাসাদে পটেলের সঙ্গে তাঁর এক আলােচনার কথা।[২০] সে আলােচনার বিষয় ছিল ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার অবাস্তবতার পরিমাণ। “আমি পটেলকে বললাম তিনি বরং স্বীকার করে নিন যে জিন্নার পাকিস্তানের দাবির পিছনে প্রভাবশালী ব্রিটিশ ব্যক্তিদের সমর্থন আছে, এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ এই যে, তাঁর পিছনে এমনকী ভারত্নের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তাদেরও সম্পূর্ণ সমর্থন আছে।…[২১] মেননও পরে
৩৬৯
ভাইসরয়কে বললেন “উনি আমাকে বলেছেন যে ক্ষমতা হস্তান্তর যদি ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর ভিত্তিতে হয়, সে ক্ষেত্রে উনি দেখবেন যাতে কংগ্রেস তা গ্রহণ করে। পটেলের উপস্থিতিতে মেনন তখন একটা পরিকল্পনা ছকে ফেললেন এবং বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট-এর কাছে তা পাঠিয়ে দিলেন, যদিও উল্লেখ করলেন না যে পটেল সেই দলিল আগেই দেখেছেন এবং বক্তব্যে স্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে পটেল আর কিছু জানতে পারেননি পরবর্তী কালে, কিন্তু মাউন্টব্যাটেন নাকি “মেননের কাছে এই ঘটনার কথা শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।”[২২]
১৯৪৭ সালের ১০ মে, নেহরু তখনও সিমলায়— মাউন্টব্যাটেন তাঁর সঙ্গে মেননের এই পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলতে এলেন। সেই দলিলের সরলতা এবং গুরুত্ব বিষয়ে ভাইসরয় তখন নিশ্চিত, প্রস্তাবগুলি তাঁর কাছে এতই সহজসরল লেগেছে যে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ১৯৪৮-এর জুন অবধি অপেক্ষা করার অর্থই তিনি বুঝতে পারছেন না। ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা স্বীকৃত হলেই এ বার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আরম্ভ করা যায়। নেহরু তাঁর সঙ্গে একমত হলেন কি না, কিংবা একমতের ভাব দেখালেন কি না, সেটা অবশ্য পরিষ্কার নয়।
এর পরের ধাপ হল, ফরমুলাটিকে সরকারি ভাবে গ্রহণ করা। কিন্তু যেহেতু ইসমেবাহিত আরও একটি পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই ব্রিটিশ মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত, এটা করার কিছু সমস্যাও ছিল। ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে তার উপরেই মাউন্টব্যাটেন ভরসা রাখছিলেন বেশি। তা হলে খামােখা মেনন পরিকল্পনার ব্যাপারে তিনি এতটা উৎসাহ দেখালেন কেন? খুবই ছেলেমানুষি কাজ হয়েছিল সেটা, বিপদ বাড়িয়ে দেওয়ার মতাে ছেলেমানুষি। আর ঠিক সেই বিপদই ঘটল তার পর।
মাউন্টব্যাটেন-এর নিজের পরিকল্পনা, ইসমে যেটা নিয়ে ব্রিটেন গিয়েছিলেন, লন্ডন থেকে তা ১০ মে তারযােগে ফেরত এল, কোনও কিছুই তাতে পাল্টানাে হয়নি। সেই সন্ধেয় নৈশাহারের পর, আবেগের বশে মাউন্টব্যাটেন নেহরুকে সেই তারটি দেখিয়ে ফেললেন, যিনি পুরােটা পড়ে একেবারে হতচকিত হয়ে পড়লেন। এমন একটি অর্ধস্বীকৃত’ পরিকল্পনা সমর্থন করার চেষ্টাই করলেন না। সিমলা ও লন্ডনের মধ্যে প্রবল গতিতে যােগাযােগ শুরু হল এর পর। অ্যাটলিকে পাঠানাে মাউন্টব্যাটেনের একটি তারে লেখা হল: “যে ড্রাফট প্ল্যান আপনি পাঠিয়েছেন, সেটা তবে বাতিল হল। পরের পরিকল্পনার জন্য প্রস্তুতি নিন।”[২৩] ১৯৪৭-এর ১১ মে সন্ধে ছটার মধ্যে, মেনন তাঁর ড্রাফট প্ল্যানের খসড়া শেষ করে ফেললেন, সেই সন্ধেতেই নেহরু সেটা পেয়ে সমর্থনও করে দিলেন। মেননের বােধহয় চার ঘণ্টাও লাগল না, বিকল্প খসড়া করে ভবিষ্যৎ ভারতের (এবং পৃথিবীরও) চেহারাটা পাল্টে দিতে। যে প্রশ্নটা স্বভাবতই মনে উদয় হয়, সেটা ভাবাও অস্বস্তিকর: ভারতের ঐক্যের প্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙেচুরে দিতে কি এতটুকু সময়ই তা হলে যথেষ্ট? ১৮ মে, মাউন্টব্যাটেন ও মেনন লন্ডনের দিকে যাত্রা করলেন। ইসমে এবং অ্যাবেল ইতিমধ্যেই সেখানে। তাঁদের কাছে তখনও নিজেদের পরিকল্পনাই বেশি পছন্দসই। কিন্তু অ্যাটলি এবং তাঁর মন্ত্রিসভা মেনন পরিকল্পনাটিই বেশি পছন্দ করলেন।[২৪]
৩৭০
গাঁধী-জিন্না বৈঠক
প্রায় শেষ বারের মতাে গাঁধী এবং জিন্না ৬ মে পরস্পরের মুখােমুখি বসলেন দিল্লিতে। প্রতি বারই যেমন ঘটেছে, এ বারেও তাঁরা শেষ করলেন চূড়ান্ত দ্বিমত নিয়ে। গাঁধীর অনুমােদন-স্বাক্ষরসহ জিন্নার একটি লিখিত রিপাের্ট অনুযায়ী, “আমরা দুটি বিষয়ে আলােচনা করলাম। একটি হল, ভারতকে ভেঙে পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান দুটি দেশ তৈরি করা। মি, গাঁধী দেশভাগের নীতিটিই মানতে রাজি নন। তাঁর মতে দেশভাগ এখনও অবশ্যম্ভাবী নয়। আর আমি মনে করি, পাকিস্তান কেবল অবশ্যম্ভাবীই নয়, বস্তুত ভারতের রাজনৈতিক সমস্যার একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান। দ্বিতীয় বিষয় হিসেবে আমরা। আলােচনা করলাম একটি চিঠি, যাতে আমরা দু জনেই দেশবাসীর কাছে অনুরােধ জানালাম শান্তি বজায় রাখতে। আমরা দু জনেই এই সিদ্ধান্তে এলাম যে আমাদের নিজের নিজের কাজের ক্ষেত্রে যতটুকু যা করার আমরা করে যাব যাতে আমাদের অনুরােধ রক্ষিত হয়।”[২৫]
কৌশলগত ভাবে স্তরে স্তরে ক্ষমতা হস্তান্তর হলে তা নিশ্চিত ভাবে দেশে হিংসার বাড়াবাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হত, যে ভয়ঙ্কর বাড়াবাড়ি শেষ পর্যন্ত দেশভাগের আগে, দেশভাগের সময়, এবং দেশভাগের পরবর্তী কালে ভারতকে প্রত্যক্ষ করতে হল। কিন্তু সেই ভাবে হস্তান্তর সম্ভব হল না। মাউন্টব্যাটেন আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভারত বিভাগের বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে তােলপাড় হতে শুরু করল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন, মুসলিম লিগ, কংগ্রেস এবং অকালি দল, সকলেই স্বীকার করল যে ভারতকে কয়েক ভাগে ভাগ করতে হবে। স্যর চিমনলাল সেতলবাদ আগে যা বলেছিলেন, এই সূত্রে আবার তা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল: “ভারতের এই বিভাজন … যে অনিঃশেষ সংঘর্ষ ও হিংসার সূচনা করতে চলেছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তা প্রবাহিত হয়ে চলবে।”[২৬] স্যর চিমনলাল অবশ্য এই বিভাজনের প্রধান দায়টা চাপিয়েছিলেন কংগ্রেসের দ্বিচারিতার উপরেই, ক্যাবিনেট মিশনের গ্রুপিং ফরমুলার প্রেক্ষিতে যে ভাবে তারা। এলােমেলাে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তার উপরে।
ক্যাবিনেট মিশনের শেষ পর্বের খেলা এ বার: সব দান চালা হয়ে গেছে, বাের্ডও শেষ বারের মতাে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে। এ বার কেবল অখণ্ড স্বাধীন দেশের উপর যবনিকা টেনে দেওয়ার পালা। এই অন্তিম অঙ্কে ফিরতি-মুখী ব্রিটিশ এবং তাদের অস্তমিত সাম্রাজ্যের সমস্যা বিরাট: দেশের অভ্যন্তর থেকেই যে দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে, তাকে রূপ দিয়ে চূড়ান্ত করে ফেলা। এই পর্বে ব্রিটিশরা নিজের স্বার্থের কারণেই ব্যাপারটাকে যতটা সম্ভব সুষ্ঠু শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে চাইছিল, সন্দেহ নেই, কিন্তু যদি বিশৃঙ্খল ভাবেই তা ঘটে, তাতেও কুছ পরােয়া নেই। মােট কথা, সম্পূর্ণ মাৎস্যন্যায় শুরু হওয়ার আগে এ দেশ থেকে বেরােতেই হবে, সেটাই একমাত্র কথা। চার দিকে একটা আতঙ্কের আবহাওয়া, যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর যে আতঙ্ক নিয়ে পিছটান দিতে হয়, সেই রকম। যুদ্ধধ্বস্ত ‘বিলায়েতে’[২৭] অবসরের শীতলতায় ফিরে গিয়েও হয়তাে
৩৭১
অবস্থা খুব সুখের হবে না, কিন্তু সে সব পরে দেখা যাবে, কিন্তু যে ভারত রক্তাক্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে বসেছে, সেখান থেকে পালাতেই হবে। কোহিনুর’[২৮] তখনও রাজশিরস্ত্রাণের শােভা, কিন্তু আগের মতাে জৌলুস তার আর নেই, তার সমস্ত পবিত্রতা আর সৌন্দর্য আজ অতীত। সাম্রাজ্য নিজেই আজ যেন একটা বােঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, অতীতের বােঝা। ভারত থেকে ব্রিটিশ অপসারণের সিদ্ধান্ত তাই সাম্রাজ্যের যুগ থেকে যুগান্তরে উপনীত হওয়া: বিংশ শতাব্দী সেটাই সম্ভব করল।
মহম্মদ আলি জিন্না যিনি আর কয় দিন পরেই নতুন পাকিস্তানের কায়েদ-ই আজম হবেন, তাঁর পক্ষে এ এক বিরাট যাত্রার শেষ প্রান্ত: হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের হােতা থেকে সে যাত্রা তাঁকে পাকিস্তানের প্রধান স্থপতি বানিয়ে দিয়েছে। তবে তিনিও কিন্তু তাঁর রাজনীতি-জীবনের শেষ কোঠায় পৌঁছেছেন, জীবনের শেষ প্রান্তে। এই শেষের কালে এ বার আমরা তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলব। তবে তারও আগে একেবারে চূড়ান্ত অন্তিম মুহূর্তটা আমাদের দেখে নেওয়া দরকার। এখন সময়, প্রত্যাগত যােদ্ধা ভারতের ভাইসরয় ফিল্ড মার্শাল লর্ড ওয়াভেলকে বিদায় জানানাের।
লর্ড ওয়াভেল-এর অপসারণ
১৯৭৩ সালে পেন্ডেরেল মুন ওয়াভেল-এর জীবনী লিখতে গিয়ে বলেন:
‘ওয়াভেল ব্রিটিশ সরকারকে বলেন শাসনাবসানের একটি নির্দিষ্ট তারিখ স্থির করতে, এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে অপসরণের জন্য প্রস্তুত হতে। যখন তিনি বুঝতে পারলেন, আশা করা হচ্ছে যাতে সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা একটা তৈরি করা যায়, এবং তা যদি না করা যায় সে ক্ষেত্রে পশ্চাদপসরণই শ্রেষ্ঠ পথ, তখন তিনি নিজের বক্তব্যকে আরও জোর দিয়ে প্রকাশ করতে লাগলেন। তাঁর অপসারণের সিদ্ধান্তের পিছনে এটা নিশ্চয়ই একটা বড় কারণ। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার অবশ্য একটি তারিখ নির্ধারণ করল, এবং ওয়াভেল যে কথাটি এত দিন ধরে বলে আসছিলেন, সেই সাহসী, বলিষ্ঠ সিদ্ধান্তের পুরাে কৃতিত্বই নিজের কাঁধে স্থাপন করল।”
চাকা এ বার পুরােটা ঘুরে গেল। অ্যাটলি ও তাঁর মন্ত্রিসভা এখন সমালােচিত হচ্ছেন। ‘পরাজয়পন্থী হিসেবে, যে ‘লজ্জাজনক, অসম্মানজনক পশ্চাদপসরণ’-এর কথা তুলে অ্যাটলি অন্যায় ভাবে ওয়াভেল-এর সমালােচনা করেছিলেন, তার দায় এখন তাঁদের নিজেরই। ওয়াভেল কিন্তু এই লজ্জাজনক প্রস্থান এড়ানাের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালের ৩০ মে-তেও ওয়াভেল ব্রিটিশ রাজকে জানান, “আমরা যদি ভারত। থেকে সত্বর আমাদের শাসন, প্রভাব এবং ক্ষমতা সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি, তা হলে যে পরিস্থিতি উদ্ভূত হবে, দমননীতি চালানাের থেকে আমাদের জাতীয় চেতনা এবং ঐতিহ্যের প্রতি তা অনেক বেশি নির্দয় হবে। এমন কিছু ঘটানাের পক্ষে আমি মত দিতে
৩৭২
পারি না। যদি ভারতীয়দের শান্তিপূর্ণ ভাবে সংবিধান তৈরি করতে রাজি করা না যায়, সে ক্ষেত্রে দমন এবং পলায়ন, এর মাঝামাঝি কিছু পথ আছে কি না, সেটাই আমাদের এখন ভাবা দরকার।”[২৯]
এই মাঝামাঝি পথটিই হল তাঁর ‘ব্রেকডাউন প্ল্যান। ১৯৪৬-এর ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর অন্যান্য মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময়ে ওয়াভেল পরিষ্কার চারটি পথের কথা বলেন তাঁদের, যে পথগুলি ব্রিটিশ সরকারের সামনে তখনও খােলা: (ক) দমননীতি, যে পথ তিনি নিজেই খারিজ করে দিয়েছেন, (খ) আবার নতুন করে আলাপ আলােচনা, যা বর্তমানে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে, (গ) কংগ্রেসকে সংখ্যাগরিষ্ঠের দল বলে মেনে নেওয়া। “এটিও খুব সম্মানজনক পথ বলে আমি মনে করি না। ভারতের ব্রিটিশ শাসন সে ক্ষেত্রে বিরাট অমর্যাদার সঙ্গে শেষ হবে, কংগ্রেসের হাতে দেশ ছেড়ে দিয়ে লজ্জাজনক পলায়নের নমুনা হয়ে থাকবে।” (ঘ) ভারত থেকে অপসরণের একটি দিন ঘােষণা করা ‘ব্রেকডাউন প্ল্যান’-এ যে প্রস্তাব করা হয়েছিল।
তত দিনে বড্ডই দেরি হয়ে গেছে। লেবার গভর্নমেন্ট-এর পক্ষে লর্ড ওয়াভেল-এর এই ক্রম-অপসরণ নীতি মানার পরিস্থিতি তখন আর নেই। অথচ এই নীতি মানলে কিন্তু পলায়ন-পরবর্তী হত্যালীলা অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব হতাে। অ্যাটলি ভারতের ভাইসরয়ের এই অসম্মানজনক অপসরণের পক্ষে যে যুক্তি দেন, তা একেবারেই ধােপে টেকার মতাে নয়। তা ছাড়া, পরিহাস এই যে শেষে মাউন্টব্যাটেন-এর প্রস্তাব অনুযায়ী লেবার গভর্নমেন্টও ভারত থেকে দ্রুত অপসরণই চাইতে শুরু করে।
ভাইসরয় হিসেবে ওয়াভেল যে কাজগুলি শেষ পর্বে করে যান, তার মধ্যে একটি হল ব্রিটিশ সম্রাটকে তাঁর চূড়ান্ত রিপাের্টটি পাঠানাে। ১৯৪৭-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি তা প্রেরণ করেন। ২১ মার্চ তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিয়ােতে নিজের প্রস্থানবার্তা ঘােষণাও করেন। এই দুটি দলিলই সম্পূর্ণ আকারে পড়ে নেওয়ার মতাে। প্রথমটি হল, ভাইসরয় হিসেবে তাঁর ভারতবাসের সময়ের একটি নিরপেক্ষ, বিশ্লেষণাত্মক সারাংশ। রেডিয়াের ঘােষণাটি হল একটি অত্যন্ত সুলিখিত, মনােগ্রাহী বিদায়বাণী— ভারতের উদ্দেশে, ভারতের জনসাধারণ ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে, যে দুই সমাজের প্রতি তিনি ছিলেন গভীর ভাবে স্নেহশীল।
৩৭৩
তথ্যসূত্র
১. ওয়াহিদ আহমদ (সম্পাদিত), অ্যানােটেটেড স্পিচেস, স্টেটমেন্টস, ইন্টারভিউস অ্যান্ড মেসেজেস অব জিন্না, কায়েদ-এ-আজম অ্যাকাডেমি, ২০০১, পৃ ৩২১-৩২২
২. তদেব, পৃ ৩১৯।
৩. তদেব, পৃ ৩২ ৩
৪. তদেব, পৃ ৩২৪
৫. তদেব, পৃ ৩২ ৬
৬. তদেব, পৃ ৩২৯।
৭. এইচ ডি শর্মা (সম্পাদিত), ১০০ বেস্ট লেটার্স, ১৮৪৭-১৯৪৭, হার্পার কলিনস ইন্ডিয়া, ২০০০, পৃ ৩৯৬-৩৯৯
৮. প্যাটেল কাঞ্জি দ্বারকাদাসকে এ কথা জানান ১৯৪৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর-এ আমদাবাদের। একটি বৈঠকে। কাঞ্জি দ্বারকাদাস, টেন ইয়ার্স অব ফ্রিডম, বম্বে, পপুলার প্রকাশন, ১৯৬৮, পৃ ২০১
৯. তদেব, পৃ ১৯৭
১০. তদেব, পৃ ১৯৯।
১১. তদেব।
১২. তদেব, পৃ ২০৫।
১৩. তদেব, পৃ ২০৭-২০৮
১৪. তদেব, পৃ ২০৯-২১০।
১৫. তদেব, পৃ ১৯৭, ২১৬
১৬. মার্চ ২০-২৫, ১৯৪৭, কালেক্টেড ওয়ার্কস অব মহাত্মা গাঁধী, পৃ ১২৪-১২৫
১৭. টেন ইয়ার্স অব ফ্রিডম, পৃ ২১০
১৮. তদেব, পৃ ২১১
১৯. তদেব, পৃ ২১১
২০. লেনার্ড মােসলে, লাস্ট ডেজ অব দ্য রাজ
২১. তদেব
২২. তদেব
২৩. ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দশম খণ্ড, পৃ ৭৭
২৪. দুটির মধ্যে পার্থক্য মােটের উপর এই রকম: ১) উপস্থাপনায় পার্থক্য। নেহরুর মতে বর্তমান কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি মুল ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার অনুসারী, এবং যে কোনও নতুন কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি হল বিরুদ্ধবাদীদের আখড়া। ২) ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান-এ যেমনটি বলা হয়েছিল, সেই অনুযায়ী আইনসভার প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নেবেন: এই অংশটি সরিয়ে দেওয়া হল। ৩) বর্তমান কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে থাকা কিংবা নতুন কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠন করা সম্ভব হবে। কিন্তু দু-এর থেকেই আলাদা হয়ে থাকার সম্ভাবনা এখানে সম্পূর্ণ বাদ গেল।
২৫. টেন ইয়ার্স অব ফ্রিডম, পৃ ২১১-২১২
৩৭৪
২৬. তদেব, পৃ ২১৩
২৭. ‘বিলায়েত’ একটি উর্দু শব্দ, ইংরেজিতে যার মােটের উপর অর্থ দাঁড়ায় ‘বিদেশি’! উনিশ শতকে শব্দটির মানে ছিল কেবলই ‘গ্রেট ব্রিটেন, পরে অর্থের পরিসরটি বেড়েছে।
২৮, কোহ-ই-নূর হীরা, ওজন ১০৮.৯৩ ক্যারাট, গােলাকৃতি অপূর্বকর্তিত হীরকখণ্ড। চতুর্দশ শতক থেকে এর বিশ্বাসযােগ্য ইতিহাস জানতে পারা সম্ভব। মালওয়া-র রাজাদের সম্পত্তি এই হীরক ক্রমে বাবরের হাতে পড়ে, যিনি ১৫২৬ সালে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। পরের দুই শতকে, এই হীরক মুঘল বাদশাহদের অন্যতম মহামূল্যবান সম্পত্তি হিসেবে রক্ষিত ছিল। ১৭৩৯ সালে পারস্যের নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করেন, মুঘলদের সব সম্পত্তি তাঁর দখলে চলে যায়। নাদির শাহ যখন হীরাটি দেখেছিলেন, শােনা যায় তিনি বলে উঠেছিলেন “কোহ-ইনূর, অর্থাৎ যেন এক আলাের পর্বত। লুণ্ঠনের বহু প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে পারস্যের রাজভাণ্ডারেই এই হীরা ছিল। শেষে, এক পারসিক রাজা সেটি চুরি করে শিক দরবারে এসে উপস্থিত হন, রণজিৎ সিং, পঞ্জাবকেশরী’, সেটি নিয়ে নেন, পরিধান করেন। লাহাের রাজকোষে সেটি কে রাখা হয়। শিখ যুদ্ধের পর, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই হীরা যুদ্ধের লুঠ হিসাবে অর্জন করে ১৮৪৯ সালে, এবং শেষ পর্যন্ত কোম্পানির ২৫০তম জন্মশতবার্ষিকীতে রানি ভিক্টোরিয়ার হাতে সেটি তুলে দেয়।
২৯. ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দ্বাদশ খণ্ড, পৃ ৭৩৪-৭৩৫
৩৭৫
নবম অধ্যায়
ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন-এর সময়কাল:
ব্রিটিশ রাজ-এর অবসান
২৩ মার্চ ১৯৪৭ – ১৫ অগস্ট ১৯৪৭
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কঠিন বছরগুলােয় চার্চিলের ইম্পিরিয়াল জেনারেল স্টাফ-এর প্রধান ফিল্ড মার্শাল লর্ড অ্যালানব্রুক তাঁর ‘ওয়র ডায়েরিজ ১৯৩৯-৪৫’-এ সেই সময়কার প্রধান কুশীলবদের অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর কলমে ফুটে ওঠা মাউন্টব্যাটেন চরিত্রটির ছবিটি লেখকের শব্দের ব্যাপারে মিতব্যয়িতা, ধারালাে নজর আর বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক: “মহারানি ভিক্টোরিয়ার নাতি মাউন্টব্যাটেন ১৯৩৪ সালে তাঁর নিজের জাহাজের (যার নাম যথার্থ ভাবেই ছিল ‘ডেয়ারিং’) অধিনায়ক হয়ে ওঠেন। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ ‘এইচ এম এস কেলি’-র ক্যাপ্টেন হন। আঠারাে মাস, সমুদ্রে থাকাকালীন জাহাজ এক বার প্রায় উল্টে যেতে বসে, আর এক বার একটা ডেস্ট্রয়ারের সঙ্গে ধাক্কা লাগান তিনি, এক বার মাইন আক্রমণে পড়েন, দু’বার টর্পেডাের আঘাত সামলান এবং অবশেষে শত্রুবিমান হানায় তাঁর জাহাজ ডােবে…। তিনি চিফ অব কম্বাইন্ড অপারেশনস (CCO) থাকাকালীনই ডিয়েপ আক্রমণের সেই ক্ষতিকর অঘটনটি ঘটে, যার কিছুটা দায়িত্ব তাঁর ওপরও বর্তায়… তিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দায়িত্বে (SEAC) নিযুক্ত হন। সেখানে বেশ কিছু সক্ষম সহযােগীর কল্যাণে তিনি ব্রিটিশ বাহিনীকে জয়ী করতে পারেন। বিতর্কিত মালয় আক্রমণেও তিনি ছিলেন। সেখানে আক্রমণকারী সৈন্যরা চোরাবালিতে কোমর পর্যন্ত ডুবে যায়— যুদ্ধ শেষ ঘােষিত হয়ে যাওয়ার ফলে (মােট ক্ষয়ক্ষতি) আর বাড়েনি…”।
“ভারতের ভাইসরয় হিসেবে তাঁর দিনগুলি ছিল একই রকমের নাটকীয়,” অ্যালানব্রুক লিখে চলেন, “মন্টগােমারিকে বাদ দিলে, তিনিই বােধহয় ঊর্ধ্বতন ব্রিটিশ সেনানায়কদের মধ্যে নিজের বিজ্ঞাপন দিতে সবচেয়ে বেশি দক্ষ ছিলেন, জনপ্রিয়তা কী করে বাড়াতে হয়, সে বিষয়ে তাঁর একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল… এই ক্ষমতার
৩৭৬
সব চেয়ে ভাল প্রমাণ হল কেলি জাহাজটির ডুবে যাওয়ার ওপরে নির্মিত চলচ্চিত্র, ‘কেলি, ইন হুইচ উই সার্ভ’ ছবিটি। এই ছবিতে নােয়েল কোয়ার্ড মাউন্টব্যাটেন সাজেন, আর মাউন্টব্যাটেন ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ১২ বার দেখেন।”[১] অ্যালানব্রুকের এই একই বইয়ে ওয়াভেলকে বর্ণনা করা হয় এই ভাবে, “… দারুণ, সম্ভবত একটু অতিরিক্ত বুদ্ধিমান জেনারেল… মিতভাষী চরিত্রের দিক থেকে ডগলাস হেগ-এর ছাঁচে তৈরি এক সেনানায়ক।” ‘কনফেশনস অফ অ্যান অপটিমিস্ট’ বইটিতে উড্রো ওয়্যাট মাউন্টব্যাটেন ভারতের পথে রওনা হওয়ার আগে তাকে দেখার স্মৃতির কথা লেখেন, তখন মাউন্টব্যাটেন ভারতে ‘পৌঁছে কী পরা উচিত, তাই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ওয়্যাট লিখছেন,
“ওরা সকলেই একটু বামপন্থী। তাই নয় কি? দিনের বেলার উপযােগী সাধারণ পােশাকই কি আমার পরা উচিত নয়? জিজ্ঞেস করলেন মাউন্টব্যাটেন। আমি বললাম, “না না, আপনি শেষ ভাইসরয়, আপনি রাজপরিবারের সদস্য। আপনি অবশ্যই আপনার পুরাে জমকালাে ইউনিফর্মটি পরবেন, আপনার সব পদকগুলাে দেখাবেন, আর পুরােদস্তুর জাঁকজমক সহ ওদের সামনে নিজেকে পেশ করবেন। তা না হলে ওরা অপমানিত হবে। তখন তিনি খুব খুশি হলেন। তিনি ঠিক তা-ই করেছিলেন, তাতে সবাই আগ্লাদিত হয়েছিল।”[২]
এইচ. ভি. হডসন মাউন্টব্যাটেনের ভাইসরয় থাকাকালীন সময়ের বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যে, “মাউন্টব্যাটেনের বিষয়ে প্রথম কথাই হল যে, তিনি নিজের টিকিট নিজেই কেটেছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ সালের ঘােষণাটি তিনি স্বকণ্ঠে করেননি, কিন্তু তার প্রতিটি শব্দ তাঁকে জানিয়েই ঠিক করা হয়েছিল। এই গােটা ঘােষণাটিই উঠে এসেছিল ১৯৪৬ সালের শেষের দিকে মাউন্টব্যাটেন ও অ্যাটলির মধ্যে একটা আলােচনা থেকে, যখন অ্যাটলি তাঁকে ভারতে গিয়ে ব্রিটিশ-রাজকে কার্যত গুটিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন।”
একই রকম গুরুত্বপূর্ণ, মাউন্টব্যাটেন তাঁকে দেওয়া বিশেষ ক্ষমতার মধ্যে লিখিয়ে নিয়েছিলেন যে, যদি জুন ১৯৪৮-এর মধ্যে কোনও সংবিধান তৈরি না হয়, তবে ব্রিটিশ সরকারকে ভেবে দেখতে হবে যে, সামগ্রিক ভাবে গােটা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার জন্য কোনও কেন্দ্রীয় সরকার, অথবা কোনও কোনও অঞ্চলের জন্য ইতিমধ্যে কার্যকর প্রাদেশিক সরকার, অথবা ভারতবাসীর পক্ষে সর্বাধিক সুবিধাজনক এ রকম অন্য যে কোনও উপযুক্ত পন্থায় ক্ষমতার হস্তান্তর করা যায় কি না। প্রায় সব ধরনের সম্ভাবনার জন্য তৈরি এ রকম একটা বিকল্পের তালিকা থেকে নিঃসন্দেহেই মনে হয় যে, তাঁর এ দেশ ছাড়ার একটা দিন ধার্য করাই ছিল। এ ছাড়াও এ ভাবে সব বিকল্পের ঘােষণার মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান তৈরি হওয়ার সম্ভাবনাকে যেন একটা খােলাখুলি অনুমতি দিয়ে দিলেন।
জিগলার মাউন্টব্যাটেনের ভারত আগমন ও নেহরুর প্রতিক্রিয়ার কথা স্মরণ করেছেন। “একটা গল্প আছে যে, মাউন্টব্যাটেন যে কর্তৃত্বময় ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা
৩৭৭
বলতেন, তাতে নেহরু গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং তিনি ভারতে আসার কিছু দিন পর নেহরু তাঁকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি নিজস্ব সিদ্ধান্ত কার্যকর করার স্বাধীন ক্ষমতা (plenipotentiary powers) প্রাপ্ত ? মাউন্টব্যাটেন (উত্তরে বলেন) ‘ধরুন সেই ক্ষমতা যদি আমার থাকে, তাতে কী লাভ? নেহরু জবাব দেন, ‘কেন? তা হলে সবাই যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন, আপনি সফল হবেন, মাউন্টব্যাটেন নিজের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতা সম্পর্কে নেহরুকে যা-ই বলে থাকুন না কেন, এই ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়নি। জিগলার নিজেই দেখিয়েছেন, যদি ‘plenipotentiary powers’ মানে হয় দেশে সরকারকে না জানিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতা (সত্যিকারের কোনও মানে থাকতে হলে তাে এ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না), তবে মাউন্টব্যাটেন সে রকম কোনও ক্ষমতা ব্যবহার করেননি, বরং তিনি নিজের পরিকল্পনার খসড়া লন্ডনে জমা দিয়েছিলেন এবং যখন তাতে কিছু অদলবদলের প্রয়ােজন হল, তখন লন্ডন উড়ে গিয়ে নিজের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
কিন্তু অকুস্থলে উপস্থিত প্রতিনিধি হিসেবে নিজের উদ্যোগে কাজ করার স্বাধীনতা মাউন্টব্যাটেনকে দেওয়া হয়েছিল, যে ক্ষমতা ওয়াভেলকে দেওয়া হয়নি। অ্যাটলি সরকার, সাধারণ ভাবে, যা মাউন্টব্যাটেন চেয়েছেন, তাই দিয়েছেন। কারণ, তাঁরা ভারত ছাড়তে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, ভারতকে ‘খালি করে দেওয়া’ তখন তাঁদের কাছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছিল।
মাউন্টব্যাটেনের গুণমুগ্ধ জীবনীকার, জিগলার এই শেষ ভাইসরয়ের একটা শব্দচিত্র এঁকেছেন, “তাঁর ত্রুটিগুলােও ছিল বিশাল মাপের। তাঁর অহঙ্কার, যদিও শিশুসুলভ, ছিল দানবিক, তাঁর উচ্চাশা লাগামহীন। সত্য, যা হয়েছে, তাকে তিনি দ্রুত যা হওয়া প্রয়ােজন, তাতে রূপান্তরিত করতে পারতেন। তিনি নিজের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানাের জন্যে ইতিহাসকে নতুন করে লেখার চেষ্টা করতেন, সে জন্য তথ্যকে তুচ্ছ করতে তার দ্বিধা ছিল না।…”
এটা দুঃখজনক যে, ভারতের শেষ ভাইসরয় নিজের সাফল্যকে বাড়িয়ে দেখানাের জন্যে সত্যকে বদলে দেওয়া পছন্দ করতেন। জিগলারের লেখায় ফুটে ওঠা ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের ছবি বেশ অস্বস্তিকর। কারণ, শেষ ভাইসরয় হিসেবে তাঁর ওপরেই অবিভক্ত ভারতের কোটি কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষমতা ন্যস্ত হয়েছিল। তখন ভারতের ভবিষ্যৎ ছিল এমন এক জন মানুষের হাতে, যিনি সত্য আর মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে জানতেন না, এই বােধ তাই এত গভীর অস্বস্তি তৈরি করে। “মুক্ত কূটনীতি, যত দূর সম্ভব, মেনে চলা হত… তবু এই খােলামেলা ভাবের পেছনে। কিছু দূর পর্যন্ত ছলচাতুরি এমনকী প্রতারণাও বাদ যায়নি। তাঁর দু’জন পূর্বসূরির পক্ষেই এটা অভাবনীয় ছিল। মাউন্টব্যাটেন ভাল ভাবেই জানতেন যে, তাঁর পরামর্শদাতাদের কারও কারও মতে তাঁর কৌশল মাঝে মাঝে অনৈতিক হয়ে উঠত। কিন্তু, তিনি মনে করতেন যে, হাতসাফাই যুক্তিযুক্ত। প্রত্যক্ষ মিথ্যাকে বর্জন করা ভাল, কিন্তু পরােক্ষ মিথ্যা গ্রহণযােগ্য। তাঁর ডেপুটি প্রাইভেট সেক্রেটারি, ইয়েন স্কট, স্মরণ করেন কী ভাবে
৩৭৮
ভাইসরয় একটা কর্মপদ্ধতির কথা বলার পর স্কট আর অ্যাবেল-এর অভিব্যক্তি লক্ষ করেন, এবং বলেন, “আমি জানি, তােমরা কী ভাবছ। ওয়াভেল হলে এই কাজ কখনও করতেন না। বেশ, আমি ওয়াভেল নই, আমি করব।”[৩]
অ্যালানব্রুক আর জিগলারের এই লেখাগুলাে থেকে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের যে ছবি ফুটে ওঠে, তাতে দেখি যে, “তিনি নিজের গৌরবের জন্যে সত্যের থেকে মিথ্যার বেশি” ভক্ত ছিলেন। আমরা যদি এই ছবি মেনে নিই তবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিহাসে সাক্ষীর ভূমিকায় তাঁর বিশ্বাসযােগ্যতাও কিন্তু বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাঁর নিজের আর অন্যদের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয়। নিরপেক্ষ অনুসন্ধান আর তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সেটা গ্রহণযােগ্য থাকে না। তাঁর নিজের এই দানবিক অহঙ্কার সম্পর্কে জানার পর, আমি আর তিনি বা তাঁর লােকেরা অন্যদের সম্পর্কে যা লেখেন, সেটা সহজে মেনে নিতে পারি না। যেমন, জিন্নার অহঙ্কার নিয়ে তাঁর বক্তব্য।
শেষ ভাইসরয় খুবই বিনয়ের সঙ্গে তাঁর নিজের কাজের ধরন বর্ণনা করে আমাদের জানাচ্ছেন, “আমি উঠে পড়ে লাগলাম। মনে হতে পারে, তিনি নিজের কাজের কথা বলছেন, কিন্তু যেহেতু মানুষটি মাউন্টব্যাটেন, তিনি আসলে সে সময়ের মুখ্য ভারতীয় চরিত্রদের কথাই বলছেন। তাঁর নিজের কথায়, “লােককে ঠিক কাজ করতে রাজি করার ব্যাপারে আমার বিশাল আত্মবিশ্বাস নিয়ে (আমি নেমে পড়লাম), এই কারণে নয় যে, আমি প্রেরণা দেওয়াতে খুব দক্ষ, কিন্তু এই কারণে যে, আমি যে কোনও জিনিসকে খুব কাম্য বলে উপস্থাপিত করতে পারি।” বিস্ময়ে আমাদের বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, যত ক্ষণ না মাউন্টব্যাটেন পরে আবার বলেন, “জিন্নার সংকল্প ভাঙার জন্য যা যা কৌশল জানি, সব প্রয়ােগ করলাম, যত ভাবে আবেদন করতে পারা যায় করলাম, কোনও কাজ হল না। এমন কোনও যুক্তি ছিল না, যা তাঁকে তাঁর পাকিস্তান গঠনের শক্তিশালী স্বপ্ন। থেকে সরাতে পারত।” মহম্মদ আলি জিন্না হয়তাে একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যাঁকে তিনি ‘ঠকাতে পারেননি, কিন্তু ভারতের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে জিন্নার প্রায়-অনন্য গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি দেশে লেখেন, “এটা পরিষ্কার যে, এই মানুষটির হাতেই গােটা পরিস্থিতির চাবিকাঠি।…” তবুও আমরা যখন এই সব গােপন আলােচনার নথিপত্র । দেখি, মাউন্টব্যাটেনের নিজের মুখে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা তাঁর কাউকে রাজি করানাের বিশেষ ক্ষমতার খুব কম প্রমাণই পাওয়া যায়— সে ক্ষমতা যদি তার থাকবেই, তা হলে এমন এক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির ক্ষেত্রেই তিনি সেই ক্ষমতা বিশেষ যত্ন নিয়ে প্রয়ােগ। করবেন, সেটাই তাে প্রত্যাশিত। প্রথম সাক্ষাৎকারেই একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, যা আর কোনও দিন কাটেনি। মাউন্টব্যাটেনের মনে হয়েছিল জিন্না “শীতল, উদ্ধত এবং তাঁর ব্যবহার অবজ্ঞাপূর্ণ।” অবাক লাগে যে, ‘মালিকা ভিক্টোরিয়া’-র নাতি বা ও রকম একটা কিছু যে মানুষ তার মুখােমুখি হয়ে কায়েদ আর কী রকম ব্যবহারই বা করতে পারতেন? ‘ট্রান্সফার অফ পাওয়ার’-এ বর্ণিত,[৬] ২৭ মে ১৯৪৭, চার্চিলের সঙ্গে মাউন্টব্যাটেনের
৩৭৯
সাক্ষাৎকার, ঘটনার পরম্পরাবহির্ভুত ভাবে হলেও এখানে উল্লেখ্য। গােড়াতেই চার্চিল মাউন্টব্যাটেনকে জিজ্ঞেস করেন, “এই বছরেই ক্ষমতার হস্তান্তর হলে ডােমিনিয়নএর স্বীকৃতি মেনে নেবেন, এই রকম চিঠি (তিনি) নেহরুর কাছ থেকে পেয়েছেন কি না ।” এই সাক্ষাৎকারটি স্মরণ করে মাউন্টব্যাটেন লিখছেন, “আমি ইতিবাচক উত্তর দিলাম এবং যােগ করলাম যে, আমি একটি প্রতিলিপি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়েছি। আমি এও উল্লেখ করলাম যে, এ রকম একটা লিখিত প্রতিশ্রুতি আমি মি. জিন্নার কাছ থেকে পেতে ব্যর্থ হয়েছি। (এই শুনে) মি.চার্চিল খব বিস্মিত হয়ে বললেন, মাই গড, তিনি তাে এমনই এক জন মানুষ, ব্রিটিশ-সাহায্য ছাড়া যাঁর চলে না। আমি দেখালাম যে, মি. জিন্নার কার্যপদ্ধতি যুক্তি দিয়ে বােঝা অসম্ভব, এবং তিনি যদি ডােমিনিয়নের স্বীকৃতি মেনে নেওয়া নিয়ে মন স্থির করতে অস্বীকার করেন, তবে আমার কর্তব্য সম্পর্কে একটা পরিষ্কার নির্দেশ প্রয়ােজন। আমি বললাম যে, তবে মি. জিন্নাকে আমরা জানাব যে, হিন্দুস্তানের জন্য আমরা ডােমিনিয়ন হিসেবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিকে এ বছর এগিয়ে যাব এবং পাকিস্তান (পরবর্তী কালে) যে কোনও সময়ে ডােমিনিয়নের স্বীকৃতি মেনে নেওয়ার সুযােগ পাবে। তিনি আমাকে বললেন যে, কনজারভেটিভ পার্টি এই শর্তে আইন প্রণয়ন করতে রাজি নাও হতে পারে, এবং প্রকৃত প্রস্তাবে তাঁকে হয়তাে এই সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করতে হবে। আমি তখন তাঁকে প্রশ্ন করলাম যে, জিন্না যদি আপসবিমুখ হন, তা হলে আমি কী করব।” মাউন্টব্যাটেনের কথায়, চার্চিল নাকি অনেক ক্ষণ ভাবলেন, তার পর বললেন, “গােড়ায় ভয় দেখাবে, সব ব্রিটিশ অফিসারদের সরিয়ে নেবে। ওদের ব্রিটিশ অফিসারবিহীন সামরিক ইউনিট দেবে। এটা ওদের কাছে পরিষ্কার করে দেবে যে, ব্রিটিশ-সাহায্য ছাড়া পাকিস্তান চালানাে কতটা অসম্ভব ব্যাপার।”[৭]
এই বর্ণনাটি পরিষ্কার ভাবেই দুটো প্রচলিত ধারণাকে প্রশ্ন করে— সিরভাই যেমন অকাট্য যুক্তিসহ মন্তব্য করেছেন, প্রথমত এই ধারণা যে, ব্রিটেনের হিতৈষী লেবার সরকার তার হৃদয়ের মহত্ত্ব আর স্বাধীনতার প্রতি ভালবাসার জন্য ভারতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটিয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ওয়াভেল, যিনি ব্রিটিশ সরকারের ওপর একটা নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে ভারত ছেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিবৃতি দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন, ছিলেন এক জন ‘পরাভববাদী। আমরা দেখেছি, যখন জানা গেল যে, ওয়াভেল ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, মৌলানা আজাদ ওয়াভেল কী ভাবে ভারতের সেবা করেছেন, সে বিষয়ে উজ্জ্বল প্রশস্তি করেন, এবং অ্যাটলির সরকারকে কাপুরুষতার জন্য তিরস্কার করেন, যে কাপুরুষতার জন্য ভারতকে দেশভাগের দাম দিতে হয়েছিল, ছয় লক্ষ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল এবং দেড় কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু হয়ে দুঃখকষ্টে পড়তে হয়েছিল।
ওয়াভেল ও মাউন্টব্যাটেন “বাস্তবে মানসিকতা ও কাজের ধরনে সম্পূর্ণ আলাদা। ছিলেন, যেন তাঁরা আলাদা প্রজাতির…” মাউন্টব্যাটেনের ছিল লােকদেখানাে ব্যক্তিত্ব, ওয়াভেল সংযত, চিন্তাশীল এবং অন্তর্মুখী। যেমন খােলাখুলি তাঁর ডায়েরিতে তিনি লিখছেন, “মন্টির (ফিল্ড মার্শাল মন্টগােমারি) মতাে আমি আমার জ্ঞান সম্পর্কে
৩৮০
অতটা বিশ্বাস উৎপাদন করতে পারিনি…” (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৬)। ওয়াভেল ছিলেন। ভিতর থেকেই বিনয়ী, অমায়িক ও সৎ। মাউন্টব্যাটেনের নিয়ােগ সম্পর্কে তাঁর নিজের প্রতিক্রিয়া নিয়ে তিনি লিখছেন, “নিঃসন্দেহে তিনি এই কাজটায় আমার চেয়ে যােগ্যতর হবেন।” ওয়াভেল ছিলেন এক জন লেখক, জীবনীকার, ঐতিহাসিক, যে গুণাবলি মাউন্টব্যাটেনের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। তাঁর জার্নাল-এ, ওয়াভেল একটা মজার লেখা লিখেছেন, যাতে দু’জনের চরিত্রের মূল পার্থক্যগুলাে ফুটে ওঠে।
ডিসেম্বর ৭, ১৯৪৩। এম বি (মাউন্টব্যাটেন) নৈশাহার করলেন। আমাদের। কাছে একটা সিনেমা ছিল, ক্যাসাব্লাঙ্কা, সেন্টিমেন্টাল থ্রিলার টাইপের একটা ছবি। অন্যদের মনে হল ভালই লাগল। কিন্তু আমার মনকেও। টানেনি, আবার শিহরনও জাগেনি, পরে এম বি-কে সে কথা বললাম। তিনি খুব ফিল্মভক্ত এবং শুনে একেবারে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। তিনি নাকি রােজ একটা করে ছবি দেখেন, উপন্যাস পড়ার চেয়ে কত সহজ। আর চটপট হয়, তিনি বললেন। কিন্তু আমি খুব কমই নভেল পড়ি’ আমি বললাম। “তা হলে অবসর বিনােদনের জন্য কী পড়াে তুমি? তােমার লেখা থেকে তাে বােঝা যায় যে, তুমি কিছু কিছু পড়াে।'(!), আমি বললাম যে, আমি উপন্যাসের চেয়ে জীবনী আর কবিতাই বেশি পড়ি। কিন্তু, তােমার গানের ছবি ভাল লাগে না?’ ‘না। আমি বােধহয় খুব সঙ্গীতপ্রেমী নই। কিন্তু মিউজিকাল ভাল লাগার জন্য তাে তােমার সঙ্গীতপ্রেমী হওয়ার দরকার নেই। ও তাে মজার গান আর নাচ।’ তিনি। এখনও কত তরুণ, আর আমার মনে হল, তিনি ভাবলেন আমি ফিল্ম। -পছন্দ করা একটা গােমড়ামুখাে।
ওয়াভেল কবিতা ও শিল্পকে জীবনের মূল চালিকা শক্তি বলে মনে করতেন। তাঁর চরিত্র, ব্যক্তিত্ব আর কর্মপদ্ধতির উৎস ছিল এই বিশ্বাস। তিনি সবার কাছ থেকে সন্ত্রম ও সম্মান আদায় করে নিতেন। মাউন্টব্যাটেনের এ রকম কোনও শিকড় ছিল না। যখন তিনি বিশাল কোনও ঘটনারও অংশীদার হতেন, তখনও কিন্তু তিনি ডুবে থাকতেন নিজেতেই, নিজের বাস্তব বা কল্পিত মহত্ত্ব আর রাজরক্ত। কিন্তু এগুলাে তাে ক্ষণস্থায়ী সম্পদ। অ্যাটলি ওয়াভেল সম্পর্কে যা বলেছিলেন, খুব কম লােকেই তা মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কে বলবে: “তােমার সেই উঁচু মূল্যবােধ, যার ওপর ভিত্তি করেই তুমি সব সময় কাজ করেছ, এটা (তােমার টেলিগ্রাম) তার সঙ্গে সুসমঞ্জস।[৮]
দায়িত্বভার নেওয়ার পরে পরেই মাউন্টব্যাটেন মুখ্য ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করা শুরু করলেন। প্রথম সাক্ষাৎ, ১ এপ্রিল, ১৯৪৭ ছিল মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে, যিনি নতুন ভাইসরয়কে হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ নিয়ে তাঁর বক্তব্য বললেন। তিনি ব্রিটিশকে এর জন্য দায়ী করেননি, কিন্তু বলেন যে, তাদের ‘ভাগ করে শাসন করার নীতি এই
৩৮১
উত্তেজনাকে জিইয়ে রেখেছে এবং তাঁর পূর্বসূরিদের সচেতন ভাবে বােনা বীজের ফসল এ বার ভাইসরয়কে তুলতে হবে। তিনি আমাকে বলেন, মাউন্টব্যাটেন লিখছেন, “যাই হােক না কেন, সত্যটাকে দেখতে হবে এবং সেই অনুসারে কাজ করতে হবে।”
এই মিটিং-এই গাঁধীজি তাঁর বিস্ময়কর সেই প্রস্তাব দেন, যে জিন্নাকে প্রধানমন্ত্রী। করে একটা অবিভক্ত ভারতের, সরকার তৈরি করা হােক। মাউন্টব্যাটেন পেপার্স-এ ঘটনাটি এই ভাবে নথিবদ্ধ হয়েছে: “শেষে তিনি আমাকে যে সমাধানের পথ নিতে বলছেন, তার প্রথম সংক্ষিপ্তসার দিলেন: মি. জিন্না এবং মুসলিম লিগের সদস্যদের কেন্দ্রীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য ডাকা দরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেমন ভাইসরয়ের অধীনে কাজ করে, এই সরকারও তেমনই করবে। কংগ্রেস বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার ফলে সমস্যা দেখা দিলে তার সমাধান হবে এই যে, কংগ্রেস যে কর্মসূচি নিতে চায়, সেটা তারা নিতে পারবে। বলা বাহুল্য, এই সময় এই কথা শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম। আমি প্রশ্ন করলাম, মি. জিন্না এই রকম একটা প্রস্তাবে কী বলবেন? উত্তর হল, যদি তাঁকে বলেন যে, আমি এই প্রস্তাবের জনক, তা হলে তিনি বলবেন, ধূর্ত গাঁধী! তখন আমি বললাম, তা হলে কি ধরে নেব, মি. জিন্নাই ঠিক? তিনি জোরের সঙ্গে বললেন, আমি পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে এই কথা বলছি। যাই হােক, আমি গাঁধীর কাছ থেকে অনুমতি নিলাম যে, এর পর নেহরু আর আজাদ যখন আমার কাছে। আসবেন, তখন আমি পুরাে গােপনীয়তা বজায় রেখে তাঁদের সঙ্গে এই নিয়ে আলােচনা। করব।” গাঁধীর সঙ্গে আলােচনা এই দিনই শেষ হল না। ২ এপ্রিল, ১৯৪৭-ও প্রায় দু’ ঘণ্টা ধরে চলল। মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন, এই নিয়ে গাঁধীর “পেছনে লেগেছিলাম এই বলে যে, আসলে তিনি একটা কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার গড়তে চেয়েছিলেন, যার হাতে আমি ক্ষমতা তুলে দেব, জিন্নার কাছে প্রাথমিক প্রস্তাবটা আসলে একটা কৌশল। তিনি (আবার) জ্বলন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে আশ্বাস দিলেন যে, এই ধারণা এত দূরই ভুল যে, তিনি আমার হয়ে এই দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পালন করতে রাজি আছেন। প্রথমে তিনি কংগ্রেসের ওপর প্রভাব খাটিয়ে তাদের দিয়ে এটা মেনে। নেওয়াবেন, তার পর গােটা দেশ ঘুরে ভারতের মানুষকেও এই সিদ্ধান্তে সম্মত করবেন। তাঁর আন্তরিকতা আমার বিশ্বাস উৎপাদন করল। আমি সে কথা তাঁকে বললামও। তিনি এতে(ও) একমত হলেন যে, আমি এই পরিকল্পনা নিয়ে নেহরু এবং আজাদের সঙ্গে আলােচনা করব।” ফলে এই আলােচনা চলল এবং “শেষে তিনি বললেন যে, এই নিয়ে তিনি কৃপালনির সঙ্গেও আলােচনা করতে চান। তিনি পূর্ণ গােপনীয়তার চূড়ান্ত প্রয়ােজন নিয়ে একমত হলেন, বিশেষ করে, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে। তিনি প্রশ্ন করলেন। যে, আমি এই পরিকল্পনায় সম্মত বলে আমাকে উদ্ধৃত করতে পারেন কি না। আমি বললাম যে, তিনি খুব বেশি হলে বলতে পারেন যে, আমি এতে খুব আগ্রহী, কিন্তু এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করার আগে আমার অন্য কয়েক জন নেতার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি দরকার যে, তাঁরা একে রূপায়ণযােগ্য মনে করেন।”
৩৮২
গাঁধীকে ‘কজা করার পর মাউন্টব্যাটেন যে কথা একটু স্থূল ভাবেই লিখেছেন, এ বার ভাইসরয়ের কাজ হল সেই মানুষটির সঙ্গে দেখা করা যার হাতে গােটা পরিস্থিতির চাবিকাঠি। মাউন্টব্যাটেনের স্মৃতিকথায় এই সমান মাপের অহং-এর মালিক মানুষটির, মহম্মদ আলি জিন্নার ক্ষেত্রে মাউন্টব্যাটেনের মনােহারিণী শক্তি পুরাে ব্যর্থ না হলেও তাঁর সহজাত সুযােগসন্ধানী ক্ষমতা কিন্তু অতটা কার্যকর হয়নি। জিন্না ভাইসরয়কে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনও বােঝাপড়া বা আদানপ্রদানে আসেননি। জিন্না ছিলেন সর্বোচ্চ মানের আইনবিদ। “তিনি সাংবিধানিক আইনের ধারালাে যুক্তিগুলােকে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে ব্যবহার করতে পারতেন, আবার খুব দুর্বল একটা মামলাকেও কী করে সুকৌশলে জিতে নিতে হয়, সেটাও জানতেন।” “এ কথা নিয়ে জল্পনাকল্পনা করা যেতেই পারে যে, ভাইসরয় যদি গােড়া থেকেই নেহরুর স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যের তুলনায় জিন্নার পাকিস্তান তৈরির উদ্দেশ্যকে কম ঠিক আর গ্রহণযােগ্য মনে না করতেন, তবে ঘটনার বাঁক কোন দিকে যেত। কারণ, দুই দলই সমান ভাবে তাঁর প্রাপ্ত বিশেষ ক্ষমতার এক্তিয়ারে ছিল।” অন্য ভাবে বললে, যদি মাউন্টব্যাটেন “মুসলিম লিগের নেতার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে না গিয়ে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত করার চেষ্টা করতেন, তা হলে পরিস্থিতি পাল্টাতেও পারত।
এই ঘটনাগুলাে ঘটে ৫ ও ৬ এপ্রিল, (চার্চিলের সঙ্গে তাঁর বর্ণিত সাক্ষাৎকারের এক মাস আগে)। নিঃসন্দেহে মাউন্টব্যাটেন প্রচুর উৎসাহ আর দ্রুততার সঙ্গে এগােচ্ছিলেন। তখনকার ভারতীয় মঞ্চে যে মুখ্য চরিত্ররা সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মতামত সংগ্রহ করতে যথেষ্ট সময় ব্যয় করছিলেন। মাউন্টব্যাটেনের লেখা এই মিটিং-এর বর্ণনা খানিকটা ঝাঁঝালাে মন্তব্য দিয়েই শুরু হয়, “খানিকটা সময় এক জন চায়ের আসরের নিমন্ত্রণকত্রীর মতাে ব্যবহার করার পর, তিনি বললেন যে, তিনি ঠিক কতটুকু মেনে নিতে রাজি, সেটা আমাকে বলতেই এসেছেন।” এই শুনে মাউন্টব্যাটেন আপত্তি করে বললেন,
আমি এই পর্যায়ে সেটা শুনতে রাজি নই। প্রথম সাক্ষাতের উদ্দেশ্য হল আমরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ করব। আধ ঘণ্টা ধরে তিনি আমার আলাপচারিতার প্রচেষ্টার জবাব দিলেন এক-দু’অক্ষরের শব্দ ব্যয় করে। কিন্তু, সাক্ষাৎ শুরু হওয়ার দেড় ঘণ্টা পরেই তিনি রঙ্গরসিকতা করছিলেন, এবং গত রাতে (৬ এপ্রিল যখন তিনি নৈশভােজে এলেন। আর রাত বারােটার পরেও আধ ঘণ্টা থেকে গেলেন,) বরফ সত্যিই গলে। গিয়েছিল। আমরা সব বিষয়েই কথা বললাম। আমি পরিষ্কার বললাম যে, ব্রিটিশ সরকারকে কোন সমাধানের কথা বলব, সে বিষয়ে আমি এখনও মন স্থির করিনি। এবং এই মুহূর্তে আমি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। কিন্তু, আমি বুঝিয়ে বললাম যে, আমার নীতি হল সবার সঙ্গে কথা বলার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সিদ্ধান্ত নেওয়া। তাড়া না করার ব্যাপারে তিনি একমত হলেন, এবং মেনে নিলেন যে, যদিও গােটা ভারত একটা দ্রুত
৩৮৩
সিদ্ধান্ত চাইছে, সেই সিদ্ধান্তটা যথাযথ হওয়া দরকার। আমি যােগ দিলাম যে, তখন আমার যা মনে হচ্ছিল, কী করার সেটাই শুধু ততটা নয়, কী করে ঠিক সময় সেটা করা যায় সেটাই বিবেচ্য। (এটা তাঁর উদ্দেশ্যের একটু আশ্চর্য আর বিপজ্জনক সংজ্ঞা: ফলটা জরুরি নয়, কাজের গতিই সব।)
মি. জিন্না দাবি করলেন যে, কেবল একটাই সমাধান, দেশটার ওপর ‘সার্জিকাল অপারেশন। তা না হলে গােটা ভারত ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি এই বলে উত্তর দিলাম যে, আমি এখনও মন স্থির করিনি, আর উল্লেখ করলাম যে, সার্জিকাল অপারেশনের আগে তাে ‘অ্যানেস্থেসিয়া’ লাগবে।
এই নথিপত্রে অনেক ধরনের খুঁটিনাটি আছে, যার সবটাই আমাদের জন্য জরুরি নয়। যদিও, এই নথিপত্রে গাঁধীর সঙ্গে ১৯৪৪-এর সেপ্টেম্বরে তাঁর চিঠি আদানপ্রদান ও আগেকার আলােচনা বিষয়ে জিন্নার মতামতের কথা আছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর জিন্না জোর দিয়েছিলেন, যে মুসলমানদের পক্ষ থেকে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুখপাত্র’, তিনি আরও বলেন যে, তিনি একটা সিদ্ধান্ত নিলে সেটা বলবৎ হবেঅথবা যদি মুসলিম লিগ সেটা সমর্থন না করে, তিনি পদত্যাগ করবেন, আর সেটাই হবে মুসলিম লিগেরও অবসান। কিন্তু, কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের ব্যাপারে সেটা সত্যি নয়। তাদের পক্ষ হয়ে কোনও এক জন কেউ নেই। গাঁধী খােলাখুলিই বলেছেন যে, তিনি কারও প্রতিনিধিত্ব করেন না তিনি কেবল তাঁর প্রভাব খাটানাের চেষ্টা করতে পারেন- তাঁর প্রচুর ক্ষমতা কিন্তু কোনও দায়িত্ব নেই। নেহরু আর পটেল কংগ্রেসের মধ্যে আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি- কেউই গােটা দলের হয়ে একটা সামগ্রিক উত্তর দিতে পারবেন না।” জিন্না এও বলেন যে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠন নিয়ে যখন অচলাবস্থা সৃষ্টি হল, তখন তিনি জানিয়েছিলেন, যদি কংগ্রেস তার সমর্থক কোনও মুসলমানকে ওই সরকারে অন্তর্ভুক্ত করে, মুসলিম লিগ যােগদান করবে না। জিন্নার সন্দেহ ছিল যে, কংগ্রেসের এই বিষয়ে জোর দেওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ ছিল এটাই প্রমাণ করা যে, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ নয়। গাঁধীর সঙ্গে ৪৮ ঘণ্টা আলােচনার পর, একটা ফরমুলা তৈরি হয়েছিল যে, কংগ্রেস প্রকাশ্য ভাবে স্বীকার করবে যে, মুসলিম লিগ ভারতীয় মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রতিনিধি, তখন তিনি (জিন্না) এই সরকারে এক জন কংগ্রেস সমর্থক মুসলমানকে যােগদানের অনুমতি দেবেন। গাঁধী এই ফরমুলায় সম্মত হয়েছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস দল এটিকে বাতিল করে দেয়। গাঁধী তখন তাঁর সম্মতি প্রত্যাহার করেন এবং বলেন যে, তিনি একটা ‘হিমালয়প্রমাণ ভুল’ করেছিলেন। জিন্না জোর দিয়ে বলেন, এ থেকেই প্রমাণ হয় যে, “কেবল গাঁধীর কথাই নয়, তাঁর স্বাক্ষরও মূল্যহীন।” (জিন্না যে হিমালয়প্রমাণ ভুল-এর কথা বলছেন, সেটির একটা ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। জিন্নার মতে, গাঁধী এই সম্মতিটি দিয়ে ভুল করেননি। তাঁর
৩৮৪
আসল ভুল এই যে, তিনি ভেবেছিলেন, কংগ্রেসে তাঁর প্রধান অনুগামীরা, নেহরু আর পটেল, তাঁর কথা মানবেন। তাঁরা মানেননি।)
জিন্না কংগ্রেস নেতাদের আবেগপ্রবণতার কথা বলে দেখান যে, যত ক্ষণ ব্রিটিশদের বিতাড়নের প্রশ্ন ছিল, তত ক্ষণ এর প্রয়ােজন ছিল, কিন্তু (এখন) আর নেই। জিন্না এও অভিযােগ করেন যে, কংগ্রেস নেতারা সব সময়েই তাঁদের অবস্থান পাল্টে চলেছেন। তাঁরা এখন ব্রিটিশদের হাতে যে ক্ষমতা, তার গােটাটার উত্তরাধিকার চান। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁরা সব কিছু করতে পারেন- এমনকী ডােমিনিয়নের স্বীকৃতিও মেনে নিতে পারেন, যাতে ভারতের একটা অংশ মুসলমানদের হাতে চলে না যায়।
এর পর আমরা কিছুটা বিস্তারিত ভাবে ‘র্যাডক্লিফ অ্যাওয়ার্ড’-এর আলােচনা করব। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের এই অধ্যায় নিয়ে, অবিভক্ত ভারতের শেষ ক’টা মাস। নিয়ে, যে সময়ে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল, বহু মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন, তা নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। আবার কেন সেই বিশাল বিশ্বাসঘাতকতা, ব্রিটিশদের সেই লজ্জাজনক পলায়ন, সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যার বীভৎসতা, আকাশে বাতাসে সেই কান্না, কেন সেই স্মৃতি আবার ফিরিয়ে আনা? আমরা র্যাডক্লিফ প্রস্তাব বিশ্লেষণ। করব, কারণ এর পরিণাম সুদীর্ঘস্থায়ী, ষাট বছর ধরে স্বাধীন দেশ হিসেবে ভারত আর পাকিস্তানের পথ চলার ওপর ছায়া ফেলে আজও চলমান। এই র্যাডক্লিফ প্রস্তাব তাে। জিন্নার আলাদা দেশ চাওয়া, আর কংগ্রেসের সেটা মেনে নেওয়ারই ফল।
র্যাডক্লিফ কমিশনস ও সীমান্ত নির্ধারণ
নতুন সীমান্তগুলাে নির্ধারণ করার দায়িত্ব যে মানুষটির ওপর ন্যস্ত হল, সেই স্যর (পরে ভাইকাউন্ট) সিরিল জন র্যাডক্লিফ (১৮৯৯-১৯৭৭) গ্রেট ব্রিটেনের এক জন বিশিষ্ট নাগরিক। কিন্তু প্রায় দায়িত্বজ্ঞানহীন তাড়াহুড়াের মধ্যে সীমান্ত নির্ধারণের সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে এবং ক্ষমার অযােগ্য ভাবে দেরি করে ১৯৪৭ সালের ১৭ অগস্ট সেগুলি ঘােষণা করে তিনি এক জন অত্যন্ত বিতর্কিত চরিত্র হয়ে ওঠেন। | ব্রিটেনের চ্যান্সারি বারে এক জন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন র্যাডক্লিফ, তাঁর আইনি সাফল্য ও পসার ছিল চমকপ্রদ, কিন্তু সেটা শুধুই ব্রিটেনে। ভারতে তিনি ছিলেন একেবারেই এক জন অপরিচিত আগন্তুক। ১৯৪১ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, তথ্যমন্ত্রকে ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে কাজ করাই ছিল তাঁর একমাত্র প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা।
সীমান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে র্যাডক্লিফের নিয়ােগ নিয়ে যদি কোনও বিশেষ বিতর্ক তৈরি না হয়ে থাকে, তবে তার একমাত্র কারণ হল যে, ব্রিটিশ ভারতে নাগরিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে এক জন ‘সীমিত উৎসাহের বিশেষজ্ঞের চেয়ে এক
৩৮৫
জন আত্মবিশ্বাসী নবিশকে নিয়ােগ করার প্রথা চালু ছিল, যদিও, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি দেশে সীমান্ত নির্ধারণ করার কাজটা খুব একটা বিদ্বজ্জনসুলভ কাজ ছিল না। মাউন্টব্যাটেনের কাছে র্যাডক্লিফের নাম সুপারিশ করেছিলেন লর্ড লিস্টোয়েল, যিনি র্যাডক্লিফকে ‘অত্যন্ত সৎ মানুষ’, আইনের দুনিয়ায় প্রসিদ্ধ এবং বিস্তৃত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বলে মনে করতেন। র্যাডক্লিফ নিঃসন্দেহে এই সব কিছুই ছিলেন, কিন্তু ভারত তাঁর কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত, তিনি এখানে আগে কখনও আসেননি, এমনকী কেবল ঘুরতেও না। এর জটিল সমাজ, ভূগােল বা ভাষা সম্পর্কে তাঁর কোনও জ্ঞান ছিল না। তবুও মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে তিনিই এই বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন্ত দেশটি কেটে টুকরাে করলেন। এই পরামর্শ যে, র্যাডক্লিফ পূর্ব ভারত ও পশ্চিম ভারত, এই দুটি কমিশনেরই চেয়ারম্যান হােন, এসেছিল জিন্নার কাছ থেকে। মাউন্টব্যাটেন চটপট এই পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং আরও বললেন যে, এক জন চেয়ারম্যান হলে তিনি সঠিক ভাবে দুই সীমান্তে লাভক্ষতিগুলাের সামঞ্জস্য বিধান করতে পারবেন। এই যে বােঝাপড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ‘লাভ-ক্ষতি’-র তাস হাতে রাখা- এটা পরিষ্কার ভাবে মাউন্টব্যাটেনকে চিনিয়ে দেয়। পথ ছিল দুটো: হয় সীমান্ত কমিশনের নীতিগুলাে অপরিবর্তনীয় এবং কাজের কতগুলাে মাপকাঠি হিসাবে নির্ধারণ, অথবা কোনও রাজনৈতিক সংস্থা, যেটা নানান বােঝাপড়া, দেওয়া-নেওয়ার মধ্যে দিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নমনীয়, তেমন কিছু গঠন। কিন্তু কোনওটাই করা হল না। আলােচনার মধ্যে দিয়ে, সমঝােতার মধ্যে দিয়ে কর্তব্যপালন করার দায়িত্বপ্রাপ্ত একটা রাজনৈতিক সংগঠন পাওয়া গেল না। মাউন্টব্যাটেনের এই চটজলদি সমাধানের মনােভাব একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না। এই ধরনের চিন্তাধারার ফলেই পরবর্তী দিনে এত নিষ্ঠুর আর অনপনেয় সমস্যা দেখা দিল।
এ ছাড়া, দেশবিভাগের কাজটা সদ্য-গৃহীত অথবা একটা পুরনাে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রশাসনিক রূপায়ণ ছিল না। এমনও ছিল না যে, ব্রিটিশ ভারতের ‘নিরপেক্ষ প্রশাসকরা’ অরাজনৈতিক এবং পক্ষপাতহীন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ভারত-ভাগের কাজটা সুসম্পন্ন করেছিলেন। সে কথা বলাটা রাজনীতি ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্কের স্থল অতিসরলীকরণ হবে। কারণ, এই দুটি এলাকা কখনও পরস্পর সম্পর্কহীন হতে পারে না, যতই আমরা সব সময়েই ভুল করে সেটা ধরে নিই, এবং মাঝে মাঝে প্রচার করার চেষ্টাও করি।
জিন্না রাষ্ট্রপুঞ্জের সুপারিশে নিযুক্ত তিন জন অ-ভারতীয়কে নিয়ে গঠিত কমিশনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু সেক্রেটারি অব স্টেট, আর্ল অব লিস্টোয়েল তাতে রাজি হননি। তিনি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের ভয় পেয়েছিলেন, তা ছাড়া রাষ্ট্রপুঞ্জে আবেদনের মানে দাঁড়াবে ব্রিটিশের অক্ষমতা— এই আশঙ্কাও ছিল। কংগ্রেসও জিন্নার প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছিল, নেহরু ভয় পেয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রপুঞ্জে গেলে অকারণ দেরি হয়ে। যাবে। (ইতিহাসের পরিহাস যে, পরবর্তী কালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই একই নেহরু, হুড়ােহুড়ি করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে, মাউন্টব্যাটেনের জোরাজুরিতে জম্মু-কাশ্মীর
৩৮৬
সংক্রান্ত একটি বিষয় রাষ্ট্রপুঞ্জে পাঠান।) পরিবর্তে, নেহরু প্রস্তাব দেন যে, প্রতিটি কমিশনে এক জন আলাদা চেয়ারম্যান ও চার জন সদস্য থাকবেন, যাঁদের মধ্যে লিগ দুজনকে এবং কংগ্রেস দুজনকে মনােনীত করবে। এঁরা সবাই বিচারব্যবস্থার সম্মানিত প্রতিনিধি হবেন এবং নিজেদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। মাউন্টব্যাটেন প্রথমে জিন্নার প্রস্তাবে মত দিয়েছিলেন, লিস্টোয়েলকে বলেছিলেন যে, ব্যক্তিগত ভাবে রাষ্ট্রপুঞ্জে আবেদন করার চেয়ে ভাল কোনও প্রস্তাব তিনি ভাবতে পারছেন না। [১২] কিন্তু, যেই নেহরু তাঁর অমত ব্যক্ত করলেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘুরে গেলেন, যে রকম তিনি প্রায়ই করতেন। নেহরুর প্রস্তাব মাউন্টব্যাটেনের কৌশলের পক্ষে বেশি ভাল হল, কারণ এর মানে দাঁড়াল যে, এতে কমিশনের একটা ভারতীয় চেহারাও হল, আবার বাস্তবে অ-ভারতীয় চেয়ারম্যানের হাতেই কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থেকে গেল। এই চেয়ারম্যানকে নিয়ােগ করার ক্ষমতা ছিল পুরােপুরিই ভাইসরয়ের হাতে।
সীমান্ত কমিশনের সদস্যরা রাজনৈতিক দলগুলাে দ্বারা মনােনীত হওয়ার ফলে এই কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর দলীয় স্বার্থের প্রভাব পড়েছিল। কংগ্রেস গােড়ায় র্যাডক্লিফের নিয়ােগের ব্যাপারে আপত্তি জানায়, কিন্তু পরে সুর নরম করে এর নীতি আর কাঠামাে দুটিই মেনে নেয়। এই প্রসঙ্গে ৩ অগস্ট, ১৯৪৭ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে লেখা জনৈক মেজর শর্ট-এর একটি চিঠি উল্লেখযােগ্য: “সব চেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় হল,” তিনি লিখছেন, “সাধারণের বিশ্বাস যে, র্যাডক্লিফ (মাউন্টব্যাটেনের) নির্দেশ অনুযায়ী সীমান্ত নির্ধারণ করবেন। এই ধারণাটা সত্যিই ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যে, ভারতীয়রা হিজ এক্সেলেন্সিকে (মাউন্টব্যাটেনকে) যাই বলুন না কেন, এখানে বাস করি বলে আমি জানি যে, ভারতীয়দের এই বিশ্বাস টলানাে যাবে না। যার মানে হল- থাক, আপনিই সিদ্ধান্তটা বুঝে নিন না।”[১৪] এখন প্রমাণ করা যায় যে, এই ভয়টা অমূলক ছিল না। মাউন্টব্যাটেন হয়তাে নিয়মিত ভাবে সীমান্ত বিষয়ক সিদ্ধান্তের সব খুঁটিনাটিগুলি নির্ণয় করেননি। কিন্তু এর মূল দিকগুলাের ওপর নিঃসন্দেহে তাঁর প্রভাব ছিল।
এ বার ১২ জুন তারিখে মাউন্টব্যাটেনকে লেখা নেহরুর এই চিঠি।১৫ পঞ্জাব ও বাংলার জন্য সীমান্ত ভাগের বিষয়ে সীমান্ত কমিশনের প্রস্তাবিত নির্দিষ্ট পরিধি তালিকা সংযুক্ত করে নেহরু লিখছেন, “আপনি লক্ষ করবেন যে, এগুলি খুবই সরল এবং সংক্ষিপ্ত… এটা সীমান্ত কমিশনের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভাল… সীমান্ত কমিশনের কাজ মানেই সেটা দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হওয়ার কথা (কেন? আমি কিছুতেই এই প্রশ্নটা সংবরণ করতে পারছি না যে, কেন দ্রুত গতিতে সম্পন্ন হওয়ার কথা?) আমরা যদি বিষয়টাকে এই স্তরে জটিল করে তুলি,” নেহরু লিখছেন, “কাজটা প্রলম্বিত হবে আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা পিছিয়ে যাবে। (কোনটা বেশি খারাপ, ‘দেরি হওয়া’, নাকি এত মৃত্যু আর যন্ত্রণা আটকানাের চেষ্টা?) আমি মনে করি যখন দুটো রাষ্ট্র তৈরি হয়ে যাবে, এই দুটি রাষ্ট্র সীমান্তের ভিন্ন রূপ বা অদলবদল নিয়ে পারস্পরিক আলােচনায় আসবে, যাতে একটা সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছনাে যায়।”
৩৮৭
প্রায় অবিশ্বাস্য রকম অবাস্তব আর অতিসরল কথা। একটা দেশ অনতিক্ৰমণীয় মতবিভেদের জন্য ভাগ হয়ে যাচ্ছে, এমন সমস্ত জটিল সমস্যা, যেগুলাে আজও টিকে আছে, তা হলে কোথা থেকে আর কী ভাবে সীমান্তের ‘ভিন্ন রূপ আর অদলবদল’ নিয়ে আর পারস্পরিক আদানপ্রদান হবে? নেহরু এটাও ভয় পেয়েছিলেন যে, প্রস্তাবিত সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের মতামত নিতে গেলে প্রক্রিয়াটা দীর্ঘ হয়ে যাবে। “পুরাে কাজটাই যদি সীমান্ত কমিশনের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়,” নেহরু মনে করলেন, “তা হলে তাদের কাজটা ভারী আর লম্বা হয়ে যাবে। তাই আমরা চাই যে, বিষয়গুলােকে যথা সম্ভব পরিষ্কার আর সহজ রাখা হােক…”
দুটো বিশেষ এলাকার কথা অবশ্য উল্লেখ করা হল… “সিন্ধু প্রদেশের থরপকর জেলা আর বিহারের পূর্ণিয়া জেলা… বিহারের মতাে একটা নতুন প্রদেশ যদি ভাগ হয়, তবে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে… আর, তা ছাড়া এ রকম কিছু আবার একটা গণভােট ছাড়া সম্ভব হবে না। এই সব কিছুরই মানে দাঁড়াবে জটিলতা আর দেরি… তাই থরপকরের ক্ষেত্রে, এটি সিন্ধু প্রদেশের একটা জেলা, এবং একে তারই একটা অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে (একটা তাড়াহুড়াে করে নেওয়া অর্বাচীন ও চিন্তাহীন সিদ্ধান্ত, এর ফলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু রাজপুতকে ভারতের বাইরে বার করে দেওয়া হল…) আমি মনে করি, এই প্রশ্ন এ সময়ে এ ভাবে তােলা উচিত নয়, আমি তাই থরপকর (একটা বিরাট সংকেতপূর্ণ ভুল) বা পূর্ণিয়ার কথা সীমান্ত কমিশনের নির্দিষ্ট পরিধিতে উল্লেখ করিনি।”
নেহরু অসম্ভব কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করে এগােচ্ছিলেন যে, সীমান্ত কমিশনের কাজটা হ্রস্বতম সময়ের মধ্যে করা দরকার, যাতে ক্ষমতার হস্তান্তর ঝটপট হতে পারে। দ্রুত হস্তান্তরই ছিল তাঁর কাম্য, বাস্তববাপযােগী, সমস্যাহীন, ন্যায়সম্মত সীমান্ত নয়। আর, একেবারে বিচার-বিবেচনাহীন ভাবে তিনি এই ধরনের কথা বললেন যে, একটা সাময়িক, জোড়াতালি দিয়ে তৈরি সীমান্ত নির্ধারিত হলেও “সীমান্তের ভিন্ন রূপ বা অদলবদল নিয়ে দুই দল পরে সমঝােতা করে নেবে।” দূরদৃষ্টির এতটা অভাব যেন অকল্পনীয়। মাউন্টব্যাটেন যে নেহরুর সঙ্গে একমত হলেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। তিনি তাড়ায় ছিলেন। মনে হয়, তাঁরা ‘জনগণ’কে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতেন না, জরুরি ছিল গতি এবং ক্ষমতা। নেহরু প্রস্তাব দিলেন, সীমান্ত কমিশনকে নির্দেশ দেওয়া হােক যে, মুসলমানপ্রধান আর অমুসলমানপ্রধান পাশাপাশি জায়গাগুলাে চিহ্নিত করে, সেই ভিত্তিতে দুই বাংলার সীমান্ত নির্ণয় করে দিক। মাউন্টব্যাটেন আবার নেহরুর এই প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। সীমান্তটা যে একটা কাজ চালানাের জন্য করে দেওয়া ব্যবস্থার বেশি কিছু নয়, এই ধারণার প্রভাব র্যাডক্লিফের ওপরেও পড়েছিল। তাঁর নামে নামাঙ্কিত এই কমিশনের কাজে এই তাড়াহুড়াের ছাপ স্পষ্ট। আর, নেহরুও কোনও দিন আর এর চেয়ে বেশি সাফ সাফ কবুল করবেন না যে, যে-পদ্ধতিতে এই পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণের চেষ্টা হয়েছে, সেটা মােটেও সন্তোষজনক নয়। এ সত্ত্বেও এই শেষ বারের মতাে নেহরু সাধারণ মানুষের ইচ্ছা জানার জন্য
৩৮৮
আর কোনও অনুসন্ধানের কথা বলবেন। জওহরলাল নেহরুর লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে লেখা আর একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। পটভূমিকা একই ধরনের। “.৫) আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, সিন্ধুর একটি হিন্দু রাজপুতপ্রধান এলাকার জন্য একটা ছােট পরিবর্তন প্রয়ােজন।.৬) আমি ধরে নিচ্ছি যে, সিলেট আর বালচিস্তান নিয়ে সিদ্ধান্ত বাংলা ও পঞ্জাবে মূল সিদ্ধান্তগুলাে নেওয়ার পরে নেওয়া হবে। এই সিদ্ধান্তগুলাে পরবর্তী সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হবে।”[১৬]
১৯৪৭ সালের মে মাসে নেহরু সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে যা বলছেন, আর পরবর্তী দিনে যা বলছেন, তাতে মতামতের বিশাল পার্থক্য। সিলেট নিয়ে তাঁর নীতিও পরবর্তী দিনে খুব পরিষ্কার হয়ে ওঠেনি। এটা খুবই দুঃখের যে, তাড়া, ভ্রান্ত অগ্রাধিকার, ভৌগােলিক ধারণা না থাকা এবং এই বিশাল অঞ্চলগুলির সামাজিক বিস্তার, তার নানান মিশ্রণ আর বাস্তব সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানের অভাব সত্ত্বেও এত তাড়াহুড়াে করে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। কাজটা এমন ভাবে করা হল, যাতে আমাদের সমস্যাগুলােও বহু গুণ বেড়ে গেল এবং কোনও ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানও হল না। মূল সমস্যা, অর্থাৎ ‘সাম্প্রদায়িক সমস্যাটা রয়েই গেল, বরং আগের চেয়ে আরও বেড়ে উঠল। তবে আমরা আদৌ বিভক্ত হলাম কেন? এটা কেবল একটা তােলার জন্য ভােলা প্রশ্ন নয়, এটাই কেন্দ্রীয় প্রশ্ন।
যদিও মাউন্টব্যাটেন র্যাডক্লিফকে তাঁর নিজের কাজের পরিধি নির্ণয়ের ক্ষমতা দিয়েছিলেন, বাস্তবে ভাইসরয় নিজেই সেটা ছকে দেন। যেমন, বাংলার সীমান্ত কমিশনের সদস্যদের মধ্যে সিলেট নিয়ে তাঁদের কর্তব্যের পরিসর নিয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। কমিশনের দু’জন সদস্যের মত হয়েছিল যে, সংলগ্ন জেলা বলতে অসমের সব জেলাগুলােকেও বাংলার সঙ্গে যুক্ত বােঝায়, যদিও সেগুলাে সিলেটের সংলগ্ন নয় এবং তার ফলে কমিশনকে এই জেলাগুলির মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলােকেও চিহ্নিত করতে হবে এবং পূর্ববঙ্গের ভাগ দিতে হবে। অন্য দু’জন সদস্য মনে করলে যে, কেবলমাত্র অসমের যে জেলাগুলাে সিলেটের সংলগ্ন, এবং তার মধ্যেও আবার। ওই জেলাগুলাের মুসলমানপ্রধান অঞ্চলগুলাে নিয়েই কমিশনের ভাবা উচিত এবং সিলেটের মুসলমান এলাকাগুলাের সঙ্গে সেগুলােকে পূর্ববঙ্গের ভাগে দেওয়া উচিত। র্যাডক্লিফ মাউন্টব্যাটেনের কাছে যে সিদ্ধান্ত চাইলেন, সেটা হল যে, “যদি এই দুটো মতের বিষয়ে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তবে আমার, কিছুটা দ্বিধার সঙ্গে হলেও, দ্বিতীয় মতটাই গ্রহণ করা উচিত। আমার মনে হয়, আমাদের কাজের নির্দিষ্ট পরিধিতে ব্যবহৃত শব্দগুলাের স্বাভাবিক অর্থ এবং ৩ জুন, ১৯৪৭-এর বিবৃতির ১৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে এই মত বেশি খাপ খায়। আমার এও মনে হয় যে, সিলেটে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষে গণভােটের কারণে সিলেটের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোনও যােগ নেই, এমন সব জেলা, যারা আবার ভৌগােলিক প্রতিবেশীও নয়, তাদেরও পূর্ববঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এটা অসঙ্গত। প্রশ্নটা অবশ্য এখনও খােলা, আর তাকে যা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, কমিশন সেটুকুই পালন করতে চায়। আমি মনে করি, আমার জানা দরকার
৩৮৯
যে, এই বিষয়ে আমাকে আর কোনও নির্দেশ দেওয়া হবে কি না, যাতে আমি বিষয়টা নিয়ে বিতর্কের নিরসন ঘটাতে পারি। আমার মনে হয় না, এই সংযােজনের ফলে আমাদের কাজের নির্দিষ্ট পরিধির কোনও আপত্তিকর পরিবর্তন হবে। যদি আমাকে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়, তবে সেটা যথা সম্ভব সত্বর দিলে ভাল হয়, সিলেট নিয়ে বৈঠক যেহেতু সােমবার ৪ অগস্ট শুরু হবে আর আমাকে ওদের সােমবার, ৪ তারিখের মধ্যে কোনও একটা সিদ্ধান্ত দিতে হবে।”
পরবর্তী কালে র্যাডক্লিফের ব্যক্তিগত সচিব ক্রিস্টোফার বাের্ম জানান যে, মাউন্টব্যাটেন র্যাডক্লিফকে পঞ্জাবের সীমান্ত বদলে ফিরােজপুর তহসিলকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য করেন। যদিও, এত সময় পার হয়ে গেছে যে, এই বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা কঠিন, তবু বােম যে এ কথা বলেছেন, তাতেই কমিশনের তথাকথিত নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ জাগে।
কমিশনের ক্ষমতা কিন্তু তার সদস্যদের দেওয়া হয়নি। ভাইসরয়ের কাছে রিপাের্ট যেত চেয়ারম্যানের রিপাের্ট হিসেবে। সদস্যদের সম্পর্কে বা তাঁদের কাছ থেকে কোনও রিপাের্ট যেত না। বিচারক মহম্মদ মুনির (সীমান্ত কমিশনের এক জন সদস্য) বলেন যে, এতে তাঁদের নিয়ােগের শর্তাবলি লঙ্ঘিত হয়েছিল। এর ফলে ভারতের স্বাধীনতা বিলে একটি সংশােধন আনা হয়, যাতে চেয়ারম্যানের রিপাের্টটিকে কমিশনের রিপাের্টে পরিবর্তিত করা যায়। বিচারক মুনির মনে করেন, এর ফলে কমিশনের সদস্যরা এক একটি রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবে পরিগণিত হতেন। এই সীমাবদ্ধতার ফল ছিল যে, এক জন সদস্য চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করতে পারতেন না, বা তাঁর “রুলিং’-এ বাধা দিতে পারতেন না। একটা দেশের নিয়তির ভারপ্রাপ্ত, সীমান্তের একমাত্র নির্ধারক হয়ে ওঠা এই চেয়ারম্যান শেষ পর্যন্ত নানান চাপের শিকার হলেন, আর এই সবের মধ্যে দিয়ে যাদের জীবন চিরকালের মতাে বদলে গেল, অবিভক্ত ভারতের সেই নাগরিকরা এ সব কিছুই জানতে পারলেন না।
প্রশাসকদের সব পরামর্শের বিরুদ্ধে গিয়ে দ্রুততার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। এ সম্পর্কে সব চেয়ে স্পষ্ট সতর্কবাণী এসেছিল পঞ্জাবের তৎকালীন রাজ্যপাল, স্যর ইভান জেনকিনস-এর কাছ থেকে। তিনি সবচেয়ে ক্ষতিকর সম্ভাবনার ভয়টিই পেয়েছিলেন। ১১ জুলাই ১৯৪৭ তাঁর পরিস্থিতি মূল্যায়ন রিপাের্টে তিনি সরাসরি । এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সতর্ক করে দেন এই বলে:
সর্বোচ্চ স্তরের সরকারি প্রশাসন বাস্তবে ভেঙে গেছে। শেষ আঘাত হেনেছে দেশভাগের নীতি, এই নীতি পেশাদার সিভিল সার্ভেন্টদের নিচু স্তরের রাজনীতিক করে তুলেছে। এক জন অমুসলমান আই সি এস। অফিসারও পশ্চিম পঞ্জাবে দায়িত্ব নিতে রাজি নন। এবং কেবল এক জন। মুসলমান অফিসার পূর্ব পঞ্জাবে যেতে রাজি। ঘৃণা এবং সন্দেহ এখন একেবারে প্রকাশ্য।
৩৯০
দেশভাগের কাজ সত্যই খুব ধীরে চলছে। পার্টিশন কমিটির মিটিংগুলাের সঙ্গে সামনে যুদ্ধ দেখতে পাওয়া শান্তি কমিটির মিটিং-এর খুব মিল। যা সময় আছে, তাতে দেশভাগ নিয়ে একটা পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব হবে। আর, যদিও বা আমরা ১৫ অগস্ট পর্যন্ত বিশৃঙ্খলা ঠেকিয়ে রাখতে পারি এবং তার পর নতুন সরকারগুলাে নিজেদের চালাতে পারে, তবুও ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। নাগরিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে কিছু জিনিস কয়েক দিনে বা সপ্তাহে সুষ্ঠু ভাবে করে ফেলা যায় না। আর, ‘নিশ্চল’ থাকার নির্দেশ (যার অধিকাংশই দলগুলাে ভাল মনে মেনে নেবে না)। প্রশাসনের সমস্যা ঠিক মেটায় না।
সীমান্ত কমিশনের চেয়ারম্যান ১৪ জুলাই পর্যন্ত আসবেন না। তাঁর সহকর্মীরা পঞ্জাব সরকারকে একটা বিশাল প্রশ্নপত্র ধরিয়ে দিয়েছেন, যার উত্তর, খুব তাড়াতাড়ি হলেও, ২০ জুলাইয়ের আগে তৈরি হবে না। এর পর সব তথ্য পড়তে হবে আর বিশেষ মানচিত্রে নথিবদ্ধ করতে হবে। আর, যদি রাজনৈতিক দলগুলাের কথা শুনতে হয় (তারা খুবই প্রসিদ্ধ উকিলদের নিয়ােগ করেছে), ১৫ অগস্টের মধ্যে রিপাের্ট কী করে তৈরি হবে, বােঝা মুশকিল।
যদি কমিশন ১৫ অগস্ট-এর মধ্যে রিপাের্ট করে, তবে একটা অশান্তি হবে। কারণ, মুসলমান ও শিখরা রিপাের্ট নিয়ে খুশি নয়।
যদি কমিশন ১৫ অগস্টের মধ্যে রিপাের্ট না করে, তবে অশান্তি হবে। কারণ, শিখদের ‘জাতীয় সীমান্ত’ পছন্দ হয়নি।
ছবিটা তাই, এক কথায়, একেবারেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়, তবে আমরা কেবল এগিয়ে যেতে আর কী হয় সেটা দেখতে পারি।
এই মূল্যায়নটি দেখিয়ে দেয়, মাউন্টব্যাটেনের নাগরিক শাসন সম্পর্কে বাস্তবজ্ঞান তাে ছিলই না, নৌবাহিনীর বাইরে সামরিক বিষয় সম্পর্কে ধারণাও, নাগরিক শাসন বিষয়ের মতাে অতটা কম না হলেও, সীমিত ছিল এবং ভুল প্রয়ােগের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হচ্ছিল। এই ধরনের নানান বার্তা, যার মাত্র একটির মাত্র একটুখানি দেখানাে হল, ভাইসরয়ের ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে নির্ভীক এবং পরিষ্কার পরামর্শের উদাহরণ। কিন্তু এ সবও কোনও কাজে আসেনি। | পঞ্জাব রাজ্যপাল ইভান জেনকিনস-এর মতাে পরামর্শদাতাদের কথায় কান দেওয়া হয়নি। মাউন্টব্যাটেনের দেশভাগের গােটা কৌশলটাই ছিল কাউকে থামার বা ভাবার সময় না দিয়ে দ্রুত গতিতে দায়টা সেরে ফেলা। কংগ্রেস নেতারা দ্রুত দেশভাগের ব্যবস্থার ভুয়াে স্বল্পমেয়াদি লাভের প্রলােভনে পড়েছিলেন। তাঁরা অন্ধ ভাবে সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন। যে দারুণ তাড়ায় দেশভাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ও রূপায়িত হল, তার কথা বলতে গিয়ে মৌলানা আজাদ বলেন, “প্রায় সবাই যে সিদ্ধান্তটাকে
৩৯১
ভুল মনে করত, সেটা নিতে এত তাড়া করা হল কেন? যদি ভারত সমস্যার যথাযথ সমাধান ১৫ অগস্টের মধ্যে পাওয়া না যেত, তা হলে ভুল ঠিকানা নিয়ে আর পরে তা নিয়ে দুঃখ করা কেন? আমি বার বার বলেছিলাম যে, একটা ঠিক সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা প্রয়ােজন। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার বন্ধু আর সহকর্মীরা আমাকে সমর্থন করেনি। তাদের এই অদ্ভুত অন্ধত্বের কারণ হিসেবে আমি কেবল একটা ব্যাখ্যাই পাই যে, ক্রোধ আর হতাশা তাদের দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিয়েছিল। হয়তাে একটা তারিখ-আসক্তি- ১৫ অগস্ট এক ধরনের মােহিনীশক্তি দিয়ে | ওদের মাউন্টব্যাটেন যা বলেন, তাই মেনে নিতে সম্মােহিত করেছিল।”[২০]
র্যাডক্লিফের সিদ্ধান্তগুলাে ১২ অগস্ট, ১৯৪৭-এ তৈরি ছিল। ১৪ অগস্ট পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ঠিক সময়ই। কিন্তু, মাউন্টব্যাটেন র্যাডক্লিফের ওপর তাঁর প্রভাব খাটিয়ে সিদ্ধান্ত ঘােষণা ১৩ অগস্ট, ১৯৪৭ পর্যন্ত পিছিয়ে দিলেন। তত ক্ষণে তিনি করাচি রওনা হয়ে গেছেন। পাকিস্তান জন্ম নিল ১৪ অগস্ট, ভারত জন্ম নিল ১৫ তারিখ। এই নতুন দেশ দুটির কেউই জানত না, তাদের সীমান্ত কোথায়, কোথায় সেই দাগ, যে-দাগ ধরে এ বার হিন্দু আর মুসলমানদের আলাদা হয়ে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হল ১৭ অগস্ট। এবং যে আশঙ্কা করা হয়েছিল (এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল); সেই রকম ভয়াবহ ফল হল। মাউন্টব্যাটেন তাঁর কম্যান্ডার-ইন-চিফ অচিনলেক-এর অভিজ্ঞ প্রশাসনিক উপদেশও উপেক্ষা করেছিলেন। অচিনলেক বলেছিলেন, “সীমান্ত-সিদ্ধান্ত তৈরি হয়ে গেছে, সেটা সবাই জানার পরও দেরি করা হলে, নানান গুজব ছড়াবে এবং ক্ষতিকর পরিণাম হবে।”[২১] আবারও, তাতে কোনও লাভ হয়নি। কারণ, ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছিল পুরােপুরি অস্পষ্ট সীমান্ত ধারণার ভিত্তিতে। যে তাড়াহুড়াে করে র্যাডক্লিফ লাইন টানা হয়েছিল, সেটা সম্পূর্ণ ভাবে এবং শােকাবহ ভাবে ভুল প্রমাণিত হল। এই তাড়া কোনও সুস্থায়ী সীমান্ত পেছনে রেখে যায়নি। রেখে গেছে অনন্ত, চিরস্থায়ী দ্বন্দ্ব।
মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে একযােগে নেহরু আর জিন্নারও দাবি ছিল যে, র্যাডক্লিফের কাজ ১৫ অগস্ট শেষ করতে হবে। র্যাডক্লিফ তাঁর কাজ জমা দিলেন ১২ অগস্ট। তার পর মাউন্টব্যাটেন, যেন বুদ্ধিটা পরে মাথায় এসেছে, এ ভাবে, তাঁকে বললেন, ঘােষণাটা ১৫ অগস্টের পরে করতে। ক্লান্ত র্যাডক্লিফ, যেন ফাঁদে পড়া, ভারত থেকে পালাতে ব্যস্ত, সে প্রস্তাব ‘সােজাসুজি নাকচ করে দিলেন। তা সত্ত্বেও মাউন্টব্যাটেন ১৬ অগস্ট পর্যন্ত ঘােষণাটি প্রকাশ করলেন না। তিনি সরকারি ভাবে ভারতীয় ও পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে এটি আলােচনা করলেন, যদিও, বেসরকারি ভাবে তিনি অনেক আগেই নেহরুকে এটি দেখিয়ে নিয়েছিলেন। ১৭ অগস্ট প্রথম সিদ্ধান্তগুলি সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হল। কখন এটি ধীরে ধীরে জেলা আর তারও নীচে গিয়ে পৌঁছল, যেখানে সত্যি জমির ওপর এর দাগ পড়ল, আজ সেটা জানা অসম্ভব। কিন্তু, ভারত তার আগেই কার্যকর ভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ঘােষণার বেশ কিছু দিন আগেই উদ্বাস্তু মানুষের সুদীর্ঘ সারি পথ চলছিল। এই তাড়াহুড়াের সীমান্ত যে কত
৩৯২
অবর্ণনীয় অপরাধের জন্ম দিল, কত যে দুরারােগ্য ব্যাধি তৈরি করল! কে এই নিষ্ঠুর মানুষ যে জ্বলন্ত কলম দিয়ে আমার মাতৃভূমির বুকে নিস্পাপ রক্তের গভীর দাগ টেনে দিল- কবিরা হতাশায় আক্ষেপ করলেন।[২২]
কংগ্রেস ও দেশভাগ পরিকল্পনা
রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর ‘স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম’ বইটিতে লিখেছেন যে, “দলের নেতাদের কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে মাউন্টব্যাটেন নিশ্চিত হলেন যে, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানের ওপর ভিত্তি করে কোনও সর্বগ্রাহ্য সমাধানে পৌঁছনাের কোনও সম্ভাবনা নেই। এবং সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ অবশ্যম্ভাবী।” তিনি পটেল ও নেহরু দু’জনকেই বােঝাতে সক্ষম হলেন এবং ধীরে ধীরে কংগ্রেস নেতারা এই মতের দিকেই ঘুরলেন। আজাদ, মােসলে এবং আরও অনেকে এই কারণে পটেল ও নেহরু দু’জনকেই দুষেছেন এবং ভারতের দুভার্গ্যজনক দেশভাগের জন্য দায়ী করেছেন। কিন্তু পটেল ও নেহরুকে দোষী ঠাওরানাের আগে এবং তাঁদের ‘ধূর্ত মাউন্টব্যাটেনের চতুর চালের শিকার’ হিসেবে দেখার আগে মনে রাখাটা ভাল যে, কংগ্রেস কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ ভাবে পাকিস্তানকে স্বীকার করে নিয়ে ১৯৩৪, ১৯৪২, ১৯৪৫ এবং মার্চ ১৯৪৭-এ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গাঁধী ও নেহরু দেশভাগের প্রশ্নটিকে খুবই সম্ভব বলে দেখেছিলেন।
এই পটভূমিকায় ৩ জুন ১৯৪৭, ব্রিটিশ সরকার ভারত ভাগ ঘােষণা করল, এই ঘােষণায় প্রভাবিত হয়ে নেহরু ক্ষমতার চুড়ান্ত হস্তান্তরের জন্য একটি দিন ঠিক করার ঘােষণাকে ‘প্রাজ্ঞ ও সাহসী’ বলে বর্ণনা করলেন, যার ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।[২৩] এই ভাবে ভারতের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ওয়াভেল ও ক্যাবিনের মিশনের কঠোর প্রচেষ্টা, যার মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের একটা ভূমিকাও ছিল, এ বার অর্থহীন বলে চিহ্নিত হয়ে উঠছিল। পেন্ডেরেল মুন যেমন ঝাঁঝালাে ভাবে বলেন, “পাকিস্তান, …একটা পােকায় কাটা (দাবি) নিশ্চিত সত্য হয়ে উঠল,” তিনি আরও জুড়ে দেন, “এতে জিন্নার অল্পই পরিতৃপ্তি হল; তিনি এখনও ছ’টি পূর্ণ প্রদেশের পাকিস্তান চাইছিলেন। তবু আদৌ পাকিস্তান পাওয়া, একটা সার্বভৌম, একটু কর্তিত হলেও একটি মুসলিম রাষ্ট্র, এটাই জিন্নার জন্য একটা বিস্ময়কর জয় ছিল, এ জয় একটা অবশ্যম্ভাবী ঐতিহাসিক ঝোঁকের ফল নয়, এক জন একক মানুষের কঠোর প্রতিজ্ঞার পুরস্কার। কেবল জিন্নাই ফজলুল হক, সিকন্দার ও খিজরকে বাগে আনতে পেরেছিলেন, এবং তাঁদের পাকিস্তানের দাবির প্রতি বিরােধিতা সত্ত্বেও (জিন্না) বাংলা ও পঞ্জাবের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে এই দাবিতে সামিল করতে পেরেছিলেন। এমন অন্য কোনও মুসলিম নেতা ছিলেন না, যিনি এই চেষ্টাটাও করতে পারতেন,
৩৯৩
সফল হওয়া তাে পরের কথা। জিন্নার ব্যক্তিগত জেদের জন্যই পাকিস্তান রূপ পেতে চলেছিল।”
আই সি এস-এর ভূতপূর্ব পদাধিকারী মঙ্গত রামের মূল্যায়নে অবশ্য ভিন্ন সুর: এটা যােগ করা অবশ্য প্রয়ােজনীয় যে ভারতীয়রা, ব্যতিক্রমহীন ভাবে যুদ্ধোত্তর ব্রিটিশ সরকারের আন্তরিকতাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত এবং এখনও দেখে- ক্রিপস, পেথিক লরেন্স, অ্যাটলি- অখণ্ড ভারতের লক্ষ্যে তাঁদের প্রচেষ্টাকে শ্রদ্ধা করে। পাকিস্তান তৈরি হওয়াতে তাঁরা যেন ইতিহাসের এক ফাঁদে বন্দি হয়ে গেলেন, যে ইতিহাসের কিছুটা তাঁদের পূর্বপুরুষরাই গড়েছিলেন। মুসলমানরা আর ‘নেটিভ স্টেট’গুলাে ব্রিটিশ শাসনের সুরক্ষার জন্য ঢেউ আটকানাের বাঁধ হয়ে উঠল। তাই মুন-এর এই উদাহরণ (পুরােপুরি) মেনে নেওয়া যায় না যে “এক জন ব্যক্তি ইতিহাসের ধারাকে প্রভাবিত করছে; কারণ জিন্না ছাড়া পাকিস্তান হত না… আমি এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই। আমার নিজের ধারণা কিছুটা আলাদা: সেটা হল, জিন্না একা নন, ব্রিটিশ, মুসলামন এবং অ-মুসলমান ভারতীয়রা (হিন্দু ও অন্যরা) এঁদের মিশ্রণই পাকিস্তান তৈরি করেছিলেন।”[২৪] ‘কে আসল দায়ী’, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
তখনকার দিনে ওই ঘটনাবলির ওপর একটি মননশীল প্রবন্ধ লিখেছিলেন উদারপন্থী বিচারক চিমনলাল সেতলবাদ। যিনি বলেন যে, “ভারতের দেশভাগ পারস্পরিক শুভেচ্ছা আর বােঝাপড়ার ভিত্তির ফলে ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট সব দলই এর জন্য দায়ী। একটি দলের (কংগ্রেস) দুর্বল আর দ্বিধাদীর্ণ মনােভাবের জন্য ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা খতম হয়ে গেল।” তিনি আরও বলেন, “স্বাধীন ভারতের প্রার্থিত বরটি তাদের কোলে। এসে পড়েছিল, কিন্তু রাজনৈতিক জ্ঞানের অভাবে তারা এটিকে নিজেদের নাগালের বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল।”
“১৯৪৭-এর আগের বছরগুলিতে ভারত যে রকম দ্রুত ভাবে দেশভাগের দিকে এগােচ্ছিল, সেটা নিয়ে পড়তে গিয়ে কেউ অবাক না হয়ে পারবে না যে, কী দুর্বল ভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ১৯৩৯ সালে তার পূর্ববর্তী দুই দশক ধরে অর্জিত নিজের রাজনৈতিক উদ্যোগ আর ক্ষমতার অবস্থান হারিয়ে ফেলল। পরবর্তী দিনে নিজের ভাগ্য ফিরিয়ে এনে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করায় তার ব্যর্থতা প্রায় একই রকম আশ্চর্যজনক। কংগ্রেসের এই ভেঙে পড়াই মুসলিম লিগ ও পাকিস্তানের পথ খুলে দিল, ” তিনি লিখে চলেন, স্পষ্ট রাগ আর অচ্ছেদ্য যুক্তি দিয়ে।
“১৯৩৯ সাল পর্যন্ত অর্জিত সাফল্য আর সম্ভাবনার নিদর্শনের প্রেক্ষিতে দশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশভাগ মেনে নেওয়া এবং তার পাশাপাশি এই স্বীকৃতি যে জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লিগ প্রতিনিধিত্বমূলক মুসলিম দল হয়ে উঠেছে, একটা ভয়াবহ পরাজয়, অপমানজনক, প্রায় অবিশ্বাস্য ও গ্রহণযােগ্য নয়। তবু এটা বাস্তব যে, ওই দশ বছরের মধ্যে ভারত ভাগ হয়ে গেল আর পাকিস্তান জন্ম নিল। সবচেয়ে গোঁড়া কংগ্রেসকর্মীর পক্ষেও জিজ্ঞাসা করে থাকা সম্ভব নয় যে, গােলমালটা কী হল?”
উনি এই ভাবেই এগােন এবং লেখেন যে, “অন্তর্বর্তী সরকারে কাজ করার পর
৩৯৪
নেহরুর হতাশাজনক অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যেখানে তিনি ব্রিটিশ আধিকারিক আর লিগ মেম্বারদের মধ্যে একটা মানসিক আঁতাত লক্ষ করেন।”
বি আর নন্দ, তাঁর প্রবন্ধ ‘নেহরু, দি ইন্ডিয়ান কংগ্রেস অ্যান্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, ১৯৩৫-৪৭’-এ উল্লেখ করেছেন যে, নেহরু আর পটেল দেশভাগে মত দিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা ক্ষমতার জন্য মরিয়া ছিলেন। নেহরু ‘অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলার দিকে দ্রুত এগিয়ে চলাটা রােধ করাকেই আশু সমস্যা হিসেবে দেখেছিলেন। ফিরে দেখলে মনে হয় কংগ্রেস-এর দেশভাগ মেনে নেওয়াটা তখন যতটা আকস্মিক ঘটনা বলে মনে হয়েছিল, ততটা হয়তাে নয়। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের লাহাের অধিবেশনে পাকিস্তান সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পর থেকে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, এটা তারই চূড়ান্ত রূপ। গাঁধী এই দ্বি-জাতি তত্ত্বের এবং জীবন্ত ভারতের ব্যবচ্ছেদের বিরােধিতা করেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও ১৯৪০-এর এপ্রিলের মতাে অত আগেই তিনি লিখেছিলেন, “বাকি ভারতের অভিলাষের প্রতি ভারতের আট কোটি মুসলমানের আনুগত্য অর্জনের কোনও অহিংস পন্থা আমি জানি না, বাকিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা যতই শক্তিশালী হােক না কেন। বাকি ভারতের মতাে মুসলমানদেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের সমানাধিকার থাকা প্রয়ােজন। বর্তমানে আমরা একটা যৌথ পরিবার। যে কোনও সদস্যই আলাদা হতে চাইতে পারে।”
দু’বছর পরে ক্রিপস প্রস্তাবের বিষয়ে নেওয়া প্রস্তাবে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একই মনােভাব ব্যক্ত করে বলে, “কোনও একটি এলাকার মানুষকে তাদের প্রচারিত এবং প্রতিষ্ঠিত ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতীয় ইউনিয়নে থাকতে বাধ্য করার কথা ভাবা যায় না।” লিগের প্রচার এবং সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রভাবে দেশভাগের বিষয়ে কংগ্রেসের অবস্থান ধীরে ধীরে নরম হয়ে আসছিল। ১৯৪৪ সালে গাঁধী জিন্নার সঙ্গে তাঁর আলােচনায় কেবল দেশভাগের মূলনীতিটিই গ্রহণ করেননি, সীমান্ত নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়েও আলােচনা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে কংগ্রেস অনেক আত্মানুসন্ধানের পর, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান ও তার ঢিলেঢালা ত্রিস্তরীয় কাঠামাে, ও একটি কেন্দ্রীয় সরকার, যার কাছে ভারতীয় উপমহাদেশের অখণ্ডতা বজায় রাখার ক্ষমতা বা রসদ না থাকাটাই সম্ভাব্য ছিল, মেনে নেয়। আর এই ভাবে কংগ্রেস ভারত ভাগ সংগঠিত করল: এক জন সদস্যও দাঁড়িয়ে উঠে বললেন না যে, “ভারতের ভৌগােলিক ঐক্যের বিষয়ে কোনও সমঝােতা হবে না।”
৩৯৫
১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ জন, সারা ভারত জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশন
মাউন্টব্যাটেনের ভারত ভাগ পরিকল্পনা নিয়ে আলােচনার জন্য ২ জুনের ঘােষণা অনুসারে ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ জুন, দিল্লিতে এ আই সি সি-র বিশেষ অধিবেশন ডাকা হল। এই সভায় প্রস্তাবিত দেশভাগের বিরুদ্ধে অনেক কণ্ঠ শােনা গিয়েছিল। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সিন্ধু প্রদেশের চৌথরাম গিদোয়ানি, যিনি এই প্রস্তাবকে “জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লিগ অনুসৃত হিংসা ও ব্ল্যাকমেলের রাজনীতির কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ” বলে বর্ণনা করলেন। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে অন্য যাঁরা কথা বললেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন পুরুষােত্তমদাস টন্ডন, যিনি শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটির বিরােধিতা করে গিয়েছিলেন। আবেগ-ভরা কণ্ঠে তিনি প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁর উদ্বেগ ভাগ করে নেন: “এই প্রস্তাব দুর্বলতা ও হতাশার হয়ে ওকালতি। নেহরু সরকার মুসলিম লিগের সন্ত্রাসের কৌশলে ভীত হয়ে পড়েছে, দেশ ভাগের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মানে হবে বিশ্বাসঘাতকতা আর আত্মসমর্পণ। আমাদের অখণ্ড ভারতের সাধের স্বপ্ন। জলাঞ্জলি দেওয়ার চেয়ে আমরা বরং আরও কিছু দিন ব্রিটিশ শাসন সহ্য করি। আমরা কোমর বেঁধে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হই, যদি প্রয়ােজন হয় তবে ব্রিটিশ আর মুসলিম লিগ, দুইয়েরই বিরুদ্ধে, আর দেশের সংহতিকে রক্ষা করি।” টন্ডনের বক্তৃতা যে বিশাল করতালি পেল, তাতে কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে একটা হুঁশিয়ারি পৌঁছল। এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় বাকি সব মতামতের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল লােহিয়া আর জয়প্রকাশ নারায়ণের মত। লােহিয়ার নিজের কথায়, “আমাদের দু’জনকে বাদ দিলে, মহাত্মা গাঁধী আর আবদুল গফর খান ছাড়া আর এক জনও একটা দেশভাগের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলল না।”
মৌলানা আজাদ দু’দিনের সভার পুরাে সময়টাই একটা চেয়ারে বসে রইলেন। যে ছােট্ট ঘরটায় আমাদের সবাইকে ঠাসা হয়েছিল, তার এক কোণে অগুন্তি সিগারেটে টান দিয়ে চললেন, একটা কথাও বললেন না। তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। লােহিয়া লিখছেন, “কিন্তু তিনিই একমাত্র দেশভাগবিরােধী, এটা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা তাঁর বােকামি হচ্ছিল। তিনি কেবল এই মিটিং-এই চুপ করে ছিলেন তাই নয়, বিভক্ত ভারতে মন্ত্রী হিসেবেও এক দশক বা তারও বেশি ধরে কাজ করলেন।” “আমি বলতে পারি,” লােহিয়া আরও বলছেন, “এবং বুঝতেও পারি যে, তিনি দেশভাগ নিয়ে অখুশি হয়েছিলেন এবং নিজের মতাে করে ঘরােয়া আড্ডা বা আলাপে এর বিরােধিতা করতেন। কিন্তু এ এমন বিরােধিতা যে, যার বিরােধিতা করছি, তার কাজ করতেই আপত্তি করছি না। বিরােধিতা আর পক্ষে কাজ করার এক আশ্চর্য মিলন, এমন এক বিবেক, যেটা হয় দারুণ প্রাজ্ঞ অথবা দারুণ নমনীয়। মৌলানা আজাদের বিবেকের দিকটা অনুসন্ধান করলে ভাল হয়, কারণ আমার মাঝে মাঝেই সন্দেহ হয় যে, প্রাজ্ঞতা আর নমনীয়তা একসঙ্গেই থাকে।” কেবল মৌলানা আজাদই লােহিয়ার কাছ থেকে এমন ঘটনার পরে পরেই তিরস্কার পেলেন তাই নয়, লােহিয়ার নজর অন্যদের ওপরেও পড়েছিল। এর
৩৯৬
পর উনি কংগ্রেস প্রেসিডেন্টকে নিয়ে পড়লেন।
“আচার্য কৃপালনি এই সভাগুলােতে একটা করুণ চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। এই সময়ে তিনি কংগ্রেস দলের সভাপতি ছিলেন। তিনি ঘুমন্ত ভাবে বসে থাকতেন, কাত হয়ে পড়তেন। বিতর্কের কোনও একটা সময়, মহাত্মা গাঁধী ক্লান্ত কংগ্রেস সভাপতির প্রসঙ্গ তােলেন আর আমি গভীর বিরক্তিতে তাঁর হাত নাড়িয়ে দিই। তিনি তখন বলেন যে, তাঁর সাংঘাতিক মাথা ধরেছে। তাঁর দেশভাগ বিরােধিতা নিশ্চয়ই আন্তরিক ছিল, কারণ এটা ব্যক্তিগতও ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্লেশের মুহুর্তেই স্বাধীনতা সংগ্রামের এই সংগঠনকে বার্ধক্য আর ক্লান্তির রােগ ধরেছিল।”
“খান আবদুল গফফর খান দুটো মাত্র বাক্য বললেন। তিনি দুঃখপ্রকাশ করলেন যে, তাঁর সহকর্মীরা দেশভাগের পরিকল্পনা মেনে নিয়েছেন। একটা ক্ষুদ্র অনুগ্রহ হিসেবে তিনি তাঁদের অনুরােধ করলেন, যদি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকার গণভােটে যদি ভারতে যােগদান অথবা পাকিস্তানে যােগদানের দু’টি বিকল্পের সঙ্গে স্বাধীনতার বিকল্পটিও যােগ দেওয়া যায়। তিনি আর একটি শব্দও কখনও বলেননি। তিনি নিশ্চয়ই এতটাই ব্যথিত ছিলেন। তাঁর সমাজবাদী সহকর্মীদেরও ছাড় দিলেন না লােহিয়া।
“জয়প্রকাশ নারায়ণ এক দফায় দেশভাগের বিরুদ্ধে কয়েকটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু নির্দিষ্ট মন্তব্য করেন এবং সভার বাকিটা নিশ্ৰুপ থাকেন। কেন? ওয়ার্কিং কমিটি যে ভাবে দেশটাকে টুকরাে করার কাজটা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে কি তিনি বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছিলেন? না কি তাঁর মনে হয়েছিল যে, নেতৃত্ব দেশভাগ মেনে নিতে এত জেদের সঙ্গে একজোট হয়েছে তাদের সামনে চুপ করে থাকাটাই বেশি বুদ্ধিমানের কাজ? তাঁর চরিত্র সম্ভবত কোনও কোনও পর্যায়ে সুস্থ প্রতিক্রিয়া জানানাের আর অধিকাংশ সময় বাস্তববুদ্ধির পরিচয় রাখার খুব বিরক্তিকর একটা মিশ্রণ, সন্দেহ নেই। যে জন্য আমার প্রায়ই ওঁর ওপর রাগ হয়।”
লােহিয়া অবশ্য আত্মসমীক্ষাতেও ক্ষুরধার। “দেশভাগের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ ছিল মুখর, নাছােড়বান্দা ধরনের, কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই যথেষ্ট গভীর ছিল না। এখন আমি তাতে কতগুলাে কৃত্রিম স্বর মনে করতে পারি। আমার প্রতিবাদে তাে আর পাহাড় সরে বসত না, সেটা কেবল এক জন বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তিহীন স্বাধীনতা সংগ্রামীর সুস্থ প্রতিবাদ হিসেবেই নথিবদ্ধ হত। তা সত্ত্বেও আমার মতাে এক জন লােক যার কোনও স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপার ছিল না, তার কাছ থেকেও একটা প্রকৃত গভীর প্রতিবাদের অভাব প্রমাণ করে যে, সাধারণ মানুষ এবং তাদের এক জন হিসেবে আমিও কতটা দুর্বলতা আর ভয়ের গহুরে পড়েছিলাম। আমার প্রতিবাদের কয়েকটা দিক দেখানাের সুযােগ আমার হতে পারে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, এই সভায় মহাত্মা গাঁধীর মতদান।” লােহিয়া এর পরে এই সভায় এই মহান মানুষটির সেই দলের প্রতি কার্যত উচ্চারিত শেষ শব্দগুলির বিশদ বিবরণ দেন, যে দলকে তিনি তৈরি করেছিলেন, রূপ দিয়েছিলেন, দেশ জুড়ে সংগঠিত করেছিলেন, আর সর্বোপরি স্বাধীনতার আদর্শে উদ্দীপ্ত করেছিলেন। লােহিয়া স্মরণ করেন: “এই সভায় গাঁধীজির বলা দু’টি কথা আমি তুলে আনতে চাই।
৩৯৭
তিনি নেহরু আর সর্দার পটেলের দিকে মৃদু অনুযােগ আনেন যে, তাঁরা নিজেরা সমর্থন করে ফেলার আগে এই দেশভাগের পরিকল্পনার বিষয়ে তাঁকে জানাননি। গাঁধীজি এ কথাটা শেষ করার আগেই নেহরু খুব আবেগ দিয়ে বলতে শুরু করেন যে, তিনি তাঁকে পুরাে অবহিত রেখেছিলেন। মহাত্মা গাঁধী যখন আবার বললেন যে, তিনি দেশভাগের পরিকল্পনার কথা জানতেন না, তখন নেহরু তাঁর আগের কথাটায় একটু বদল ঘটালেন। তিনি বললেন যে, নােয়াখালি এত দূর, আর তিনি এই পরিকল্পনার বিশদ বিবরণ না দিয়ে থাকলেও গাঁধীজির কাছে দেশভাগ নিয়ে লিখেছিলেন।”
এর পর লােহিয়া বিচারে প্রবৃত্ত হন: “আমি গাঁধীজির ভাষ্যটিই গ্রহণ করব, নেহরুরটি নয়। কে-ই বা তা করবে না? নেহরুকে মিথ্যাবাদী বলে বাতিল করার দরকার নেই। প্রশ্নটা হল যে, নেহরু ও সর্দার পটেল এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করে বসার আগে মহাত্মা গাঁধী দেশভাগের পরিকল্পনাটির বিষয়ে জানতেন কী জানতেন না। নেহরু কিছু ফালতু চিঠি প্রকাশ করতে পারেন, যেগুলাে তিনি হয়তাে মহাত্মা গাঁধীকে লিখেছিলেন, যাতে হয়তাে কিছু কল্পিত আর অকিঞ্চিৎকর তথ্য ছিল। সেটা যথেষ্ট নয়। গােটা ব্যাপারটায় পরিষ্কার ভাবেই একটা লুকোচুরির ব্যাপার আছে। নেহরু এবং পটেল নিশ্চিত ভাবেই নিজেরা ঠিক করেছিলেন যে, দলিলটা পাকাপােক্ত হওয়ার আগে গাঁধীকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই।”
নেহরু আর পটেলের দিকে ঘুরে তাঁদের মুখােমুখি হয়ে গাঁধী তাঁর কথাটি বললেন। “তিনি চান যে কংগ্রেস তার নেতাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিকে সম্মান করুক। তিনি তাই কংগ্রেসকে বলবেন, দেশভাগের নীতি মেনে নিতে। নীতিটা মেনে নেওয়ার পর কংগ্রেসের উচিত এর রূপায়ণ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া। এক বার কংগ্রেস আর মুসলিম লিগ দেশভাগ মেনে নেওয়ায় ব্রিটিশ সরকার আর ভাইসরয়কে সরে দাঁড়াতে বলা উচিত। দেশভাগ যৌথ ভাবে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের করা উচিত, তৃতীয় কোনও পক্ষের উপস্থিতি ছাড়াই।”
লােহিয়ার মতে এটা ছিল একটা দারুণ সুকৌশলী চাল। এই সাধুপুরুষ যে একই সঙ্গে এক জন চতুর কৌশলীও ছিলেন, এই নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে, কিন্তু এই সুন্দর আর চতুর প্রস্তাবটা এত দিনেও নথিবদ্ধ হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
সীমান্ত গাঁধীর বড় দাদা ড. খান সাহেবই প্রথম এই প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ অবাস্তব বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। আর কারও এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করার দরকারই হল না। ফলে এটা আলােচনায় উঠল না। আমি খান সাহেবের সঙ্গে তর্ক করে বললাম যে এই প্রস্তাবের অবাস্তবতাটাই এর আসল আকর্ষণ, আর যদি জিন্না আর কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা ব্রিটিশ সাহায্য ছাড়া দেশভাগে অপারগ হন, তাতে ভারত হারবে না। কিন্তু এই প্রতিবাদে কান দেবে কে? প্রস্তাবটা চতুর ছিল, কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব স্বাধীনতার শ্য হিসেবে সংহতিকে ত্যাগ করতে বদ্ধপরিকর, সেই নজরে এই প্রস্তাবের কোনও বাস্তবসম্মত অর্থই নেই। মানে হত, যদি গাঁধীজি তাঁর প্রস্তাবটির পক্ষে একটি আন্দোলনের সম্ভাবনা তৈরি করতেন।
৩৯৮
‘কংগ্রেসের ত্রিমূর্তি’-র দিকে ফিরে লােহিয়া বলছেন, “নেহরু ও পটেল মহােদয়দ্বয় এই সভায় গাঁধীর প্রতি আপত্তিকর ভাবে আক্রমণাত্মক ছিলেন। এঁদের। সঙ্গে আমার তীক্ষ্ণ বাদানুবাদ হয়, যার কয়েকটা আমি (এখন) বলব। তখন এবং এখনও যেটা বিস্ময়কর মনে হয়, যদিও এখন আমি এটা একটু বেশি বুঝতে পারি, সেটা হল এই দুই প্রিয় শিষ্যের তাঁদের শিক্ষকের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত রূঢ় ব্যবহার। সেটায় যেন একটা মানসিক ভারসাম্যহীনতার ছাপ ছিল। তাঁরা যেন কিছু একটা করবেন বলে মন স্থির করেছিলেন, আর যখনই তাঁদের মনে হচ্ছিল গাঁধীজি তাঁদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরা হিংস্র ভাবে চিৎকার করছিলেন।”
এই এ আই সি সি অধিবেশনে লােহিয়ার সঙ্গে নেহরু আর পটেলের তীব্র বাক্যবিনিময় ঘটে। পটেল লােহিয়াকে বলেন দেশভাগের পর কী হবে, সে সব নিয়ে কথাবার্তা ভুলে যেতে। তখন উনি জিন্নার সঙ্গে ‘ডাণ্ডা’র ভাষায় কথা বলবেন। জবাবে লােহিয়া বলেন যে, তিনি বহু বছর ধরে সর্দারের তলােয়ারের ভাষা শুনে আসছেন, এ বার ভবিষ্যতে তবে ডাণ্ডার ভাষা শুনতে হবে। তিনি আরও জুড়ে দেন– “আপনি যদি ভারতের স্বাধীনতার জন্য জেনারেল হিসেবে লড়ে থাকেন, তবে আমরাও সেপাই হিসেবে লড়েছি।”
মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাব-বিষয়ক সিদ্ধান্তে একটা মত প্রকাশিত হয়েছিল যে, দ্বিজাতিতত্ত্বের একটা নিন্দা থাকুক। নেহরু যে খসড়াটি এনেছিলেন তাতে এ বিষয়ের কোনও উল্লেখ ছিল না। লােহিয়া তাই প্রস্তাবটিতে একটা সংশােধনের দাবি তােলেন, গাঁধী তাঁকে সমর্থন করেন। এই সংশােধন জোরালাে ভাবে বলেছিল: “ভূগােল এবং পর্বতমালা এবং সমুদ্র ভারতকে সে আজ যেমন, তেমন করে তৈরি করেছে। কোনও মানব শক্তি সেই রূপকে বদলাতে পারে না বা তার অপরিবর্তনীয় নিয়তির পথে বাধা দিতে পারে না। ভারতের যে ছবিকে আমরা যত্নে লালন করতে শিখেছি, আমাদের মনে ও হৃদয়ে সে থাকবে আর ভারতে দুই জাতির মিথ্যা মতাদর্শ সবার দ্বারা ধিকৃত ও বাতিল হবে।”
এই প্রস্তাবটি সংশােধন-সহ ওয়ার্কিং কমিটিতে গৃহীত হয়। কিন্তু লােহিয়া যখন এই সংশােধনটি আনেন আর গাঁধী তাঁকে সমর্থন করেন, নেহরু রেগে গিয়ে বলেছিলেন যে, তাঁরা জিন্নার মতে প্রভাবিত আর সর্বক্ষণ তাঁর সঙ্গে তর্ক করছেন। “যে লােকেরা সব সময়ই পরস্পরের গলা কাটার চেষ্টা করছে তাদের আর ভাই বলার কী কারণ?” তিনি প্রশ্ন করেন। তাতে লােহিয়া উত্তর দেন, “আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। ৩০০ থেকে ৪০০ হাজার মার্কিনি বা তারও বেশি দু’পক্ষে মারা গিয়েছিল, তাতেও তাে তারা ভাই-ই থেকে গেছে।” এই গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে গাঁধী কার্যকর ভাবে হস্তক্ষেপ করেন এবং দেশভাগ প্রস্তাবটা এ আই সি সি-তে অনুমােদন করিয়ে নেন। গাঁধী যেন হৃদয় থেকে আর হতাশা থেকে কথা বলছিলেন, যখন তিনি বলেন, এই স্তরে এ আই সি সি যদি মাউন্টব্যাটেনের দেশভাগ পরিকল্পনা গ্রহণ করার ব্যাপারে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, দুনিয়া তবে কী ভাববে?
৩৯৯
এই বাতিল করে দেওয়ার ফল হবে নতুন নেতা খুঁজে বার করা, যাঁদের আবার নতুন ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করতে হবে এবং সরকার চালানাের মতাে দক্ষ হতে হবে। বর্তমান মুহূর্তে দেশে শান্তি বজায় রাখা খুব জরুরি। কংগ্রেস আগাগােড়াই পাকিস্তানের বিরােধিতা করে এসেছে; কিন্তু কখনও কখনও কিছু কিছু সিদ্ধান্ত, যত অপছন্দেরই হােক না কেন, গ্রহণ করতে হয়।[২৫] (দেবনাগরী লিপিতে দণ্ড, যার আক্ষরিক অর্থ লাঠি, তা আসলে একটি যতি চিহ্ন। এর রূপটি হল একটি উল্লম্ব দাগ।) ।
দেশভাগ রাজেন্দ্রপ্রসাদ কেন মেনে নিয়েছিলেন, সেটা হয়তাে পরের অংশটি থেকে বােঝা যাবে: “উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ওয়ার্কিং কমিটি এবং বিশেষ করে তার যে সদস্যরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ছিলেন, দেশভাগের পরিকল্পনায় সায় দিয়েছিলেন… কারণ তাঁরা দেশের তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা দেখছিলেন যে দাঙ্গা একটা দৈনিক ঘটনা হয়ে উঠছিল, এবং হতেই থাকবে বলে মনে হচ্ছিল, এবং সরকার এগুলাে আটকাতে অপারগ ছিল, কারণ মুসলিম লিগের মন্ত্রীরা সর্বত্র বাধা দিচ্ছিলেন… ফলে প্রশাসন চালানাে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। আমরা ভাবলাম যে দেশভাগ মেনে নিয়ে আমরা অন্তত যে অংশটা আমাদের দিকে থাকবে, সে দিকটা আমাদের মত অনুযায়ী চালাতে পারব, দেশের বৃহত্তর অংশে আইন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারব, আর এমন ভাবে সংগঠিত করতে পারব যে, আমরা সবচেয়ে ভাল ভাবে তার সেবা করতে পারব। আমাদের সেই জন্য দেশ ভাগ মেনে নেওয়া ছাড়া আর পথ ছিল না।” | যে কারণগুলাে নেহরুকে শেষ পর্যন্ত দেশভাগ মেনে নিতে রাজি করেছিল, সে বিষয়ে লেনার্ড মােসলের দ্বারা লিপিবদ্ধ তাঁর নিজের বক্তব্যই আমাদের কাছে আছে, মােসলে লিখছেন:
পণ্ডিত নেহরু তাঁর জীবনীকার মাইকেল ব্রেশারকে বলেন (১৯৫৬। সালে, ভারতের দেশভাগ মেনে নেওয়ার কারণ হিসেবে); ‘আমার মনে হয় যে, এক দিকে ঘটনাগুলাের চাপ আর একটা অনুভূতি কাজ করছিল, যে, আমাদের পুরনাে পথে এগিয়ে আর আমরা এই অচলাবস্থা বা এই জালটা থেকে বেরােতে পারব না, পরিস্থিতি ক্রমশ আরও আরও খারাপ হতে লাগল। আরও মনে হতে লাগল যে, ওই পটভূমিকায় যদি আমরা ভারতের স্বাধীনতা পাই, সে ভারত হবে খুব দুর্বল, একটা যুক্তরাষ্ট্র, যার অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলাের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা। একটা বৃহত্তর ভারতের সব সময় সমস্যা থেকে যাবে, সারাক্ষণ বিচ্ছিন্নতাবাদী টান থাকবে। আর এ ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা পাওয়ার আর কোনও উপায় ছিল না, অদূর ভবিষ্যতে। তাই আমরা সেটা গ্রহণ করলাম আর বললাম, একটা শক্তিশালী ভারত গড়া যাক। যদি অন্যরা সেই দেশে থাকতে না চায়, তা হলে কেন আর কী করেই বা আমরা তাদের জোর করব?’
৪০০
কিন্তু রমেশচন্দ্র মজুমদার যেমন বলেছেন, ১৯৬০ সালের মােসলের সঙ্গে একটি কথােপকথনে নেহরু সত্যের আরও কাছে এসেছিলেন, যখন তিনি বলেন:
সত্যটা হল এই যে, আমরা ক্লান্ত ছিলাম, আর আমাদের বয়সও বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের মধ্যে খুব কম জনই আবার জেলে যাওয়ার । সম্ভাবনাটা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। আর আমরা যদি আমরা যেমন চেয়েছিলাম, তেমন একটা অখণ্ড ভারতের দাবি তুলতাম, স্বাভাবিক ভাবেই জেল আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমরা পঞ্জাবে আগুন জ্বলতে দেখছিলাম, আর প্রতিদিন হত্যার কথা শুনছিলাম। দেশভাগের পরিকল্পনা একটা রাস্তা দেখাল, আমরা সেটা নিয়ে নিলাম।
নেহরু এর পর যােগ দেন: “কিন্তু গাঁধী যদি আমাদের মানা করতেন, তবে আমরা লড়াই চালিয়ে যেতাম, অপেক্ষা করে যেতাম৷ তা হল না, আমরা মেনে নিলাম। আমরা ভেবেছিলাম যে, দেশভাগ হবে স্বল্পস্থায়ী, পাকিস্তানকে আমাদের কাছে ফিরে আসতে হবে। আমরা কেউ ভাবিনি যে, খুনােখুনি আর কাশ্মীর সংকট সম্পর্কটা কত দূর তিক্ত করে তুলবে।” এই বিবৃতিগুলাে কিছুটা আলাদা হলেও ‘স্ব-বিরােধ’ নয়, এতে ‘অনেকটাই সত্য আছে।
নেহরুর মতাে গাঁধীও শেষ পর্যন্ত কেবল পাকিস্তানের সম্ভাবনাই নয়, অবশ্যম্ভাবিতা স্বীকার করেছিলেন। হরিজন’-এ তিনি ১৯৪২ সালে লিখেছিলেন যে, যদি মুসলমানদের। সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দেশভাগ চায়, তবে তাদের দেশভাগ পাওয়া উচিত।” আর ১৯৪৪ সালে এরই ভিত্তিতে তিনি জিন্নার সঙ্গে বাস্তবিকই আলাপ আলােচনা শুরু করেছিলেন। তবু যখন সেই সিদ্ধান্তের চুড়ান্ত মুহূর্তটা এল, তিনি ১৯৪৭ সালের ৩ মার্চ মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করার আগে আজাদকে বললেন, “কংগ্রেস যদি দেশভাগ মেনে নেয়, তবে।
সেটা হবে আমার মৃতদেহের ওপর। আমি যত দিন জীবিত থাকব, আমি কখনও ভারত ভাগে রাজি হব না। আর, যদি আমি আটকাতে পারি, কংগ্রেসকেও রাজি হতে দেব না।” আজাদের কথা অনুসারে, মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর গাঁধীর মনে একটা বড় পরিবর্তন এসেছিল। গাঁধী “আর তত জোরের সঙ্গে এটার (দেশভাগ) বিরুদ্ধে কথা বললেন না, আর সর্দার পটেল যে সব যুক্তি ইতিমধ্যেই ব্যবহার করেছেন, সেগুলাে পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করলেন। দু’ঘণ্টা ধরে আমি ওঁর সঙ্গে তর্ক করলাম, কিন্তু তাঁর ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারলাম না।”
রাজেন্দ্রপ্রসাদের কথায়, “মহাত্মাজি ভয় পেয়েছিলেন যে (দেশভাগ) মেনে নেওয়ার ভয়াবহ ফল হবে… কিন্তু যখন উনি বুঝলেন যে, প্রশাসনের দায়িত্বে যারা আছে তারা বুঝতে পেরেছে যে এই ভাবে আর চালানাে যাচ্ছে না, হয় দেশভাগ নয় লিগের সঙ্গে খােলাখুলি যুদ্ধ আসন্ন, তখন তিনি ঠিক করলেন চুপ করে যাবেন আর কোনও ভাবে দেশভাগের বিরােধিতা করবেন না।”
৪০১
নেহরু, যিনি দ্বিতীয় দিন কথা বললেন, জোরের সঙ্গে বললেন, বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি কাজ হল একটা জোরদার কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করে অরাজকতা আর বিশৃঙ্খলার দিকে দ্রুত ভেসে যাওয়াটা আটকানাে। তিনি বললেন, মুসলিম লিগের কাছে আত্মসমর্পণ করার কোনও প্রশ্ন নেই। কংগ্রেস সব সময়েই কোনও এলাকাকেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে জোর করে সংযুক্ত করে রাখার বিরােধী। এটা বলা ভুল যে, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ভয় পেয়েছে আর তাই আত্মসমর্পণ করেছে, যদিও এটা বলা ঠিক যে, তারা চার দিকের উন্মত্ততায় গভীর ভাবে বিচলিত। নির্দোষ নাগরিকদের হত্যার চেয়ে দেশভাগ ভাল। নেহরুর পরে সর্দার বল্লভভাই পটেল এক জোরালাে বক্তৃতায় ৩ জুন-এর পরিকল্পনায় তাঁর পূর্ণ সমর্থন জানালেন। ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা আরও ভাল ছিল বলে আজাদ যে মত দিয়েছিলেন, তিনি তার সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করে বললেন যে, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানটি অন্তর্বর্তী সরকারের গত ন’মাসের অভিজ্ঞতার আলােয় পর্যালােচনা করার পর তিনি একেবারেই দুঃখিত নন যে ১৬ মে-র বিবৃতিটি বাতিল হয়ে গেছে। যদি সেটা গৃহীত হত, গােটা ভারত পাকিস্তানের মতাে হত। এখন ভারতের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আছে, যেটাকে তাঁরা তাঁদের মতাে করে উন্নত করতে পারবেন, এবং তাঁদের প্রতিভা অনুযায়ী শক্তিশালী করে তুলতে পারবেন। লিগ বাকিটার উন্নতিসাধন করতে পারে।
কংগ্রেস সভাপতি আচার্য কুপালনি এই বলে সমাপ্তি টানলেন: “হিন্দু ও মুসলমান গােষ্ঠীগুলি জঘন্যতম হিংসায় পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার উৎসবে মেতেছে… আমি একটা কুয়াে দেখেছি, যেখানে মহিলা ও তাদের শিশুরা, সব মিলিয়ে ১০৭ জন, নিজেদের সম্মান বাঁচানাের জন্য ঝাঁপ দিয়েছিল। আর একটি জায়গায়, একটি পূজাস্থানে পুরুষরা একই কারণে তাদের ৫০ জন মেয়েকে মেরে ফেলে। আমি হাড়ের স্তুপ দেখেছি একটি বাড়িতে, যেখানে আক্রমণকারী জনতা ৩০৭ জন মানুষকে, বেশির ভাগই নারী ও শিশু, তাড়া করে নিয়ে যায়, বন্দি করে ও তার পরে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। এই সব বীভৎস অভিজ্ঞতা অবশ্যই বিষয়টির প্রতি আমার মনােভাবকে প্রভাবিত করেছে। কোনও কোনও সদস্য অভিযােগ করেছেন যে, আমরা ভয় পেয়ে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছি, আমি এই অভিযােগের সত্যতা স্বীকার করব, কিন্তু যে অর্থে এটি করা হয়েছে সেই অর্থে নয়। যে সব জীবন হারিয়ে গেছে তাদের জন্য ভয় নয়, বিধবাদের বুকফাটা হাহাকারের জন্য নয়, অনাথদের ক্রন্দনের জন্য নয়, অথবা বহু পুড়ে যাওয়া বাড়ির জন্য নয়। ভয় এটাই যে, আমরা যদি এটাই চালিয়ে যাই, পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করে আর অবমাননার পাহাড় চাপিয়ে দিয়ে, আমরা ক্রমে নরখাদকতা কিংবা আরও খারাপ কিছুর দিকে এগিয়ে যাব। প্রতিটি নতুন সাম্প্রদায়িক যুদ্ধে, আগের লড়াইয়ের নিষ্ঠুরতম ও কুৎসিততম হিংসাটাই প্রথা হয়ে উঠছে।”
এই স্তরেও কেউ জানত না যে, এই প্রাচীন দেশটি ঠিক কী ভাবে বিভক্ত হয়েছে, অথবা সীমান্তটা ঠিক কোথায়, এমনকী শেষ অবধি সেটা কোথায় হতে পারে। ভারতে আর পাকিস্তানে বহু লক্ষ মানুষের আর্তনাদে আকাশ ভরল। ব্যক্তিগত বেদনা ভাষা
৪০২
পেল (এখনও পায়) কবিতা, নাটক আর স্মৃতিকথায়। ক্ষতিটা কেবল ব্যক্তিগত স্তরে ছিল না, কেবল পঞ্জাব বা বাংলাতেও সীমাবদ্ধ ছিল না। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে একটা আলাদা ও বিশিষ্ট একক হিসেবে গড়ে ওঠা ভৌগােলিক আর অর্থনৈতিক সমাজ, প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐক্য, টুকরাে টুকরাে হয়ে গেল। এই প্রাচীন দেশের সাংস্কৃতিক সমন্বয়কে উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ভাবে ভেঙে টুকরাে করে দেওয়া হল।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল
১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই লিয়াকত আলি খান একটি চিঠিতে মাউন্টব্যাটেনকে লেখেন যে, জিন্না তাঁর মন স্থির করে ফেলেছেন, এবং মাউন্টব্যাটেনকে অনুরােধ করেছেন যে, তিনি যেন “বিধিসম্মত ভাবে রাজার কাছে মহম্মদ আলি জিন্নাকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিয়ােগের সুপারিশ পাঠান।” এই চিঠিতে এই আশাও প্রকাশ করা হয় যে, মাউন্টব্যাটেন ভারতের গভর্নর জেনারেল থেকে যাবেন।
এই ঘটনাটি সামগ্রিক ভাবে জানায়, যেটা দুর্ভাগ্যজনক এবং কখনও হওয়া উচিত হয়নি, যে মাউন্টব্যাটেন সত্যিই একসঙ্গে দুটি দেশের গভর্নর জেনারেল। থাকার চেষ্টা করেছিলেন, যে দু’টি দেশ তখন ‘ভূমিষ্ঠ হচ্ছে। এটা স্বতঃগ্রাহ্য যে একটি ডােমিনিয়নের সাংবিধানিক প্রধান সেই ডােমিনিয়নের মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন, সেটাই হবে তাঁর পদ ও সিলমােহরের উৎস। একাধিক স্বাধীন ডােমিনিয়ন যখন নিজের পথে, নিজস্ব নীতি ও প্রকল্প অনুযায়ী চলে, তখন তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হতেই পারে। তখন এক জন সাংবিধানিক প্রধান, যিনি একই সঙ্গে দু’টি ডােমিনিয়নেরই প্রধান, একটা অসম্ভব পরিস্থিতিতে পড়বেন, কারণ তাঁর দুই সরকার তাঁকে পরস্পরবিরােধী পরামর্শ দিতেই পারে। এই বিষয়ের ওপর আইনজ্ঞরা বলেছেন: (এই) ব্যাখ্যা যে জিন্নার সুপার-গভর্নর-জেনারেল-এর পরামর্শকে কার্যকর করার একমাত্র উপায় হল দু’টি দেশের জন্য এক জন সাধারণ গভর্নর জেনারেল নিয়ােগ করা— এটা কুযুক্তি।
মাউন্টব্যাটেন এর পর ক্রিপসকে একটি চিঠিতে লিখলেন, “আমার কাছে গােপন খবর হল যে, মি. জিন্না যে পথ নিচ্ছেন, তাতে তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুচররা আর পরামর্শদাতারা ভীত হয়ে উঠেছেন। এটা প্রায় অবিশ্বাস্য যে, এক জন মানুষের অহং এত দুরারােগ্য হতে পারে, যাতে এ এক্ষুনি ‘হিজ এক্সেলেন্সি’ হয়ে ওঠার জন্য তার নিজের ভবিষ্যৎ ডােমিনিয়নের জন্য প্রয়ােজনীয় বাস্তব সুবিধাগুলােকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারে, আট মাস পরে যখন এমনিতেই সে এই শিরােপাটি পেত। জওহরলাল নেহরু এই মতটি মানেন, কিন্তু বল্লভভাই পটেল জিন্নার উদ্দেশ্যকে আরও অশুভ হিসেবে দেখেন, আর ভাবেন যে তিনি ভারতীয় ডােমিনিয়নের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত দুরভিসন্ধি নিয়ে এক
৪০৩
ধরনের ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব তৈরি করতে চান। একটাই সন্তোষজনক বিষয় হল যে, জিন্না আমাকে যুগ্ম প্রতিরক্ষা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতে বলেননি, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মুসলিম লিগ প্রেস নতুন ব্যবস্থাটিকে স্বাগত জানাবে।”
এই ধরনের পক্ষপাতিত্বে ভরা মতামত থেকে তথ্যকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। বিষয়টির ওপর জিন্নার মতামতের বিরােধিতার জন্য ভি পি মেননের কথা উদ্ধৃত করেও লাভ নেই। আর জিন্না না মাউন্টব্যাটেন, অহং-এর রােগ কার বেশি কঠিন ছিল, সেটাও বলা মুশকিল। গভর্নর জেনারেল-এর বিষয় নিয়ে লর্ড ইসমে আর জিন্নার মধ্যে ২৪ জুলাই ১৯৪৭ সালে যে আলােচনা হয়, এবং যা মাউন্টব্যাটেনকে তাঁর চিফ অব স্টাফ জানিয়ে দেন, সেটা বেশ মােক্ষম:[২৬]
প্রথমত, জিন্না একেবারে শেষ মুহূর্তে ঘােষণা করেন যে, তিনি নিজে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল-এর পদটি নিতে চান। এর ফলে ভাইসরয় চুড়ান্ত অস্বস্তিতে পড়েন, এবং ইংল্যান্ডে সব ধরনের রাজনীতিপন্থীদের মধ্যেই জিন্নার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। দ্বিতীয়ত, ভাইসরয় বিশেষ করে জিন্নাকে বলেছিলেন, তাঁর সংবাদপত্রগুলি যেন এই নিয়ে ঢাক না । পেটায় যে, ভারতবর্ষ এক জন ইউরােপীয় গভর্নর জেনারেল পাবে আর পাকিস্তান পাবে তাদের নিজের এক জন নাগরিক। জিন্না এটা করবেন বলে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু সেই উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয়নি। ‘ডন’ ঠিক। সেটাই করেছিল, যেটা মাউন্টব্যাটেন তাদের করতে না বলছিলেন।
প্রথম বিষয়টি সম্পর্কে তিনি (জিন্না) প্রতিবাদে বলেন যে, তিনি প্রথম থেকেই বিরােধিতা করেছিলেন… তিনি সব সময়েই নিশ্চিত ছিলেন… ওটা কাজ করত না। আমি বললাম যে, আমরা জিন্না কী বলেছেন, তাই নিয়ে অভিযােগ করছি না, কিন্তু তিনি যে এটা বলার জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন, তাই নিয়ে বলছি। আমি ওঁকে মনে করিয়ে দিলাম যে, স্যর এরিক মেলভিল এবং আমি মি. লিয়াকত আলি খানকে জুনের গােড়ার দিকে বলেছিলাম, যত শীঘ্র সম্ভব জিন্নাকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মনােনয়নে রাজি করাতে। তখনই যদি তিনি পরিষ্কার ভাবে বলতেন যে, তিনি নিজেই গভর্নর জেনারেল হতে চান, অনেক ভুল বােঝাবুঝি আর সমস্যা এড়ানাে যেত। জিন্না বলেই চললেন যে, তিনি। কখনওই ভাইসরয়কে এ রকম কোনও ইঙ্গিত দেননি, যে এক জন যৌথ গভর্নর জেনারেল মেনে নেবেন, আর (কাজেই) এই আলােচনা চালিয়ে গিয়ে লাভ নেই। এর পর তিনি মুসলিম লিগের সংবাদপত্রের বিষয়টির কথা তুললেন। তিনি বললেন যে, তিনি তাঁর কথা রেখেছেন এবং মুসলিম সংবাদপত্রগুলি কোনও ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেনি, যতক্ষণ না কংগ্রেসি। সংবাদপত্রগুলি জিন্নাকে প্রথমে এক জন যৌথ গভর্নর জেনারেল মেনে
৪০৪
নেওয়ার জন্য ও পরে প্রতিশ্রুতিভঙ্গের জন্য আক্রমণ শুরু করে। এটা একটা অসহনীয় রকমের মিথ্যা অভিযােগ, যার জবাব দেওয়া দরকার ছিল। আমি বললাম যে, আমি লন্ডনে ছিলাম, আর উল্লিখিত লেখাগুলাে দেখিনি, তাই আমি এই আলােচনা চালানাের জায়গায় নেই।
আমাদের আলােচনার এই অস্বস্তিকর বিষয়বস্তু সত্ত্বেও আগাগােড়াই পরিবেশটা কিন্তু সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল।
জিন্না যখন বিদায় নিচ্ছিলেন, তিনি থামলেন, আমার কাঁধে হাত রাখলেন আর খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন, আমি আপনাকে অনুরােধ করছি, ভাইসরয়কে এই ভরসা দিতে যে আমি ওঁর আর আপনার বন্ধু, আজ এবং চিরদিন। উনি যেন আমাকে আমার কাজ দিয়ে বিচার করেন, কথা দিয়ে নয়।[২৭]
এই ভাবে একটা মহান আর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ চলতে থাকে, যে ঘটনায় মাউন্টব্যাটেন এতই বিচলিত হয়ে পড়েন যে, তখন ভারতে যে ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে চলেছিল, তার মধ্যে তিনি তাঁর প্রধান স্টাফ অফিসারকে ‘হােয়াইট এনসাইন’-এর মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির ‘নিষ্পত্তি করার ভার দেন। এর পর ষাট বছর পার হয়ে গেলেও ভারত আর পাকিস্তানকে দিয়ে যাওয়া মাউন্টব্যাটেনের উত্তরাধিকার হিসেবে এই সব নথিপত্র আবার পড়লে হতাশ লাগে যে এই সব তুচ্ছ বিষয়, বাঁধা রীতিনীতি আর সব কিছুর ওপরে মাউন্টব্যাটেনের চিন্তাকে দখল করেছিল, যখন অমানবিক ঘটনাবলি দেশটাকে অবশ করে দিচ্ছিল, শহর গ্রামে অবিরাম ভাবে হানা দিচ্ছিল মৃত্যু, মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তুলছিল।
আর এই ভাবে মহম্মদ আলি জিন্না শেষ অবধি সেই দেশ ছাড়লেন, যে দেশ তাঁকে বড় করেছিল। “… ৭ অগস্ট আহসান, নৌবাহিনীর এ ডি সি, কুমারী জিন্না আর কায়েদকে নিয়ে আমরা দিল্লি থেকে করাচি উড়ে এলাম, মাউন্টব্যাটেনের সাদা ডাকোটায়। তাঁকে বিদায় জানাতে মুষ্টিমেয় কিছু লােক গিয়েছিলেন।” লিখছেন হেক্টর বােলিথাে, তাঁর ‘কোয়েস্ট অব জিন্না’ বইটিতে।
বাড়ি ছাড়ার আগে জিন্না বিমানে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে একটা বেতের ঝুড়ি ভর্তি দলিল দিয়েছিলেন। টেক অফ করার আগে উনি ছবি। তােলাতে গেলেন, কিন্তু কথা বলেননি। রানওয়ে দিয়ে চলার সময় উনি একটাই কথা বললেন, বিড়বিড় করলেন, ‘ব্যস, শেষ হয়ে গেল। তার মানে, আমার মনে হয়, ভারতের মাটিতে সংগ্রামের সমাপ্তি।
বরাবরের মতােই ওঁর পােশাক ছিল নিখুঁত। সাদা শেরওয়ানি আর তাঁর জিন্না টুপি, কালাে চশমা। কুমারী জিন্না সামনে বসেছিলেন, আমি কায়েদ-এর উল্টো দিকে বসেছিলাম। তাঁর হাতে অনেক খবরের
৪০৫
কাগজের একটা বান্ডিল ছিল, যেটা তিনি তক্ষুনি পড়তে শুরু করলেন আর গােটা উড়ান ধরেই পড়ে গেলেন। কেবল এক বার তিনি কথা বললেন, আমাকে কয়েকটা কাগজ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এগুলাে পড়তে চাও?’
চার ঘণ্টার একটা যাত্রায় এই ছিল তাঁর একমাত্র কথা- এইটুকুই তিনি বললেন এমন এক সময়, যে কয়েকটি ঘণ্টা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। হিসেবে বর্ণিত হতে পারে।।
আমরা করাচি পৌঁছলাম সন্ধেবেলায়। আমরা যখন মৌরিপুরের দিকে পৌঁছলাম, জিন্না নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন হাজার হাজার মানুষ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের মধ্যে অনেক মহিলাও বালির ওপর দাঁড়িয়ে আছেন তাকে স্বাগত জানাতে।
তখনও তাঁর অভিব্যক্তির কোনও পরিবর্তন হল না এবং তিনি একটা কথাও বললেন না। তিনিই বিমান থেকে প্রথম নামলেন, তাঁর পিছনে কুমারী জিন্না। সব মুসলমান নেতারা তাঁর অপেক্ষায় ছিলেন, তাঁদের কয়েক জনের সঙ্গে তিনি করমর্দন করলেন, তার পর মােটর গাড়িতে উঠে গেলেন।
হাজার হাজার মানুষ জয়ধ্বনি দিচ্ছিল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদএ-আজম জিন্দাবাদ। তবুও তিনি আনন্দের কোনও প্রকাশ দেখালেন না। তিনি খুব ক্লান্ত ছিলেন আর গভর্নমেন্ট হাউসে ঢুকলেন, প্রথম বারের মতাে, একটিও কথা না বলে। দু’তিন দিন পর তিনি তাঁর আবাস ওই । বাড়ির বাঁ দিক থেকে সরিয়ে ডান দিকে নিয়ে গেলেন।
মহম্মদ আলি জিন্না দিল্লি ছেড়ে করাচি আর নির্মীয়মাণ পাকিস্তানের দিকে চলে গেলেন ৭ অগস্ট ১৯৪৭। এর পর উনি কোনও দিন আর ভারতে আসেননি। পরের দিন পটেল তখনকার কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমব্লিতে বললেন, “ভারতের শরীর থেকে বিষ দূর করা হয়েছে, আমরা এ বার এক এবং অবিভাজনীয়। তােমরা সমুদ্র বা নদীর জলকে ভাগ করতে পারাে না। মুসলমানদের শিকড়, ধর্মীয় পবিত্র স্থান আর কেন্দ্র এখানে রয়েছে। আমি জানি না পাকিস্তানে তাঁরা কী করতে পারবেন, তাঁদের ফিরে আসতে খুব বেশি দিন লাগবে না।…”[২৮]
এই ভারতে ফিরে আসার কথা বার বার উচ্চারিত হয়ে পাকিস্তানের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠল। টিকে যাওয়া, পাকিস্তান হয়ে থাকাটাই একটা সর্বব্যাপী লক্ষ্য হয়ে উঠল, এবং ‘সাফল্য মাপা হতে শুরু হল ‘এখনও টিকে আছে’– এ রকম একটা সীমিত পরীক্ষা দিয়ে। পরবর্তী দিনে ভাইপাে বি কে নেহরুর সঙ্গে কথায়, প্রধানমন্ত্রী নেহরু বলেন, একটু বিষাদময় ভাবেই, “দেখা যাক কত দিন ওরা আলাদা থাকে।” এই ধরনের কথা পাকিস্তানের সজাগ পর্যবেক্ষকরা নজরে আনেন, আর তার পর শুধু .
৪০৬
পাকিস্তান হয়ে থাকাটাই, তা নেহরু বা পটেলের মতাে ভারতীয় নেতারা যা-ই বলুন না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্র হিসেবে সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ সূচক, একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠল।
দেশভাগের দৃশ্যগুলাে আবার ফুটে উঠলে আমরা দেখি যে, ‘সমতাকে বাতিল। করা হয়েছিল, নিঃসন্দেহে তার কারণ ছিল, তবু একটু বাস্তববাদী চিন্তা দেখাত যে এক বার যখন ভারত ও পাকিস্তান আলাদা দেশ হয়ে উঠল (এবং শেষ পর্যন্ত তা বাস্তব হল), তখন তাদের আলাদা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ, দুই সার্বভৌম রাষ্ট্র হয়ে। ওঠা, রাষ্ট্র-সমাজে তাদের সমান মর্যাদা দিল। এটা তাদের একটা মর্যাদার সমতা দিল। কারণ, তখন পাকিস্তান সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে ভারতের ‘সমান’ সম্মানের অধিকারী। কিন্তু এটা তত্ত্বে ঠিক হলেও প্রয়ােগে পুরােপুরি সম্ভবপর নয়, তাই দেশভাগ-উত্তর পর্যায়ে এই অসাম্য (সমতার অভাব) একটি বিভাজক দ্বন্দ্বের বিষয় হয়ে ওঠে। ভি পি মেনন মন্তব্য করেন, “জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা তাঁদের ধর্মাবলম্বীদের জন্য যে নিরাপত্তা ও রক্ষাকবচগুলি দাবি করলেন, সেগুলি এতই বেশি যে, এর ফলে চিরকালের মতাে একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি নির্মাণ অসম্ভব হয়ে উঠত।”[২৯] এক বার যখন ঐক্যবদ্ধ ভারতে কংগ্রেস ‘সমতা’র ধারণাকে বর্জন করেছিল, আশঙ্কা হল যে প্রয়ােগেও তারা সেটা বর্জন করবে। এটা কোনও আইনি বা সাংবিধানিক ভাবে প্রযােজ্য বিষয় না হলেও দেশভাগ-উত্তর ভারত পাকিস্তানের সম্পর্কের ওপর একটা সাধারণ ধারণার পরিমণ্ডল হয়ে ঝুলে রইল।
আর একটি কারণ, যেটি কংগ্রেসকে দেশভাগ, মেনে নেওয়ার দিকে গিয়েছিল, এখানে উল্লেখ করা দরকার। বলা হয়েছিল যে, অন্তর্বর্তী সরকার মিলেমিশে কাজ করেনি আর একটা মন্ত্রিসভা হিসেবে কাজ করেনি। যদিও নেহরু একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হয়েও, কার্যক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই কাজ করেছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে লিয়াকত আলি খানের নঞর্থক ভূমিকা সংকটটাকে গভীরতর করে তুলেছিল, কারণ তিনি প্রকল্পগুলিকে ইচ্ছে করে ভেস্তে দিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার এই কারণেও ব্যর্থ হয়েছিল যে নেহরু ‘কার্যত ডােমিনিয়ন ক্যাবিনেটের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা দাবি করছিলেন, মুসলিম লিগের নেতারা প্রচণ্ড ভাবে এই দাবির বিরােধিতা করেন, আর ব্রিটিশ সরকারও এই দাবি (বাস্তবে) কখনও মানেননি।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭৩৭
যদি ধরে নিই যে দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই সেটা মেনে নিয়েছিল, তা হলে ক্ষমতা হস্তান্তরের দিনটাকে এমন ভয়ানক তাড়াহুড়াে করে ১৯৪৮ সালের জুন থেকে প্রথমে ১৯৪৭ সালের অক্টোবর, তার পর ১৯৪৭
৪০৭
এর ১৫ অগস্ট-এ এগিয়ে আনার যৌক্তিকতা কী? বিদায়ী ভাইসরয়ের উত্তরটা আমার খুব হাল্কা আর অপমানজনক মনে হয়। মাউন্টব্যাটেনের ওপর লেখা একটা বইয়ে আমরা পড়ি যে, মাউন্টব্যাটেন এই বইয়ের লেখকদের বলেছেন, “নির্ধারিত দিনটা আমি এমনিই বেছে নিয়েছিলাম। আমি একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এই দিনটা বাছি। আমি দেখিয়ে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে, গােটা ঘটনাটার নিয়ন্ত্রক আমিই। ওরা যখন প্রশ্ন করল আমরা দিন স্থির করেছি কি না, আমি বুঝলাম তারিখটা কাছের হতে হবে। আমি তখনই পুরােটা ঠিক করিনি। আমি ভাবলাম সেটা অগস্ট বা সেপ্টেম্বর হওয়া দরকার। তখনই আমি ১৫ অগস্ট তারিখটা বললাম। কেন? কারণ ওটা ছিল জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকী।”[৩২] এই ভাষ্যের সংবেদনশীলতার অভাব। আমাদের যেন অবশ করে দেয়, মাউন্টব্যাটেনের এই অসতর্ক মিথ্যাবাদন কী ভয়াবহ, একটি দুর্বিষহ, অভূতপূর্ব মর্মন্তুদ অধ্যায়ের প্রতি কী চটুল তাঁর এই মনােভাব।
এই বিবৃতিটিকে পাশে ঠেলে দিলে চলবে না। কারণ, এটা পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও ঘটনার আবছা স্মৃতি থেকে উঠে আসা বিবরণ নয়। ১৫ অগস্ট নতুন দিল্লিতে যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হচ্ছিল, লর্ড মাউন্টব্যাটেন তখন জাপানের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর বিজয়ের দ্বিতীয় বার্ষিকী সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে একটি রেডিয়াে ভাষণে বলেছিলেন, দু’বছর আগে আজকের দিনে, আমি পটসডাম কনফারেন্স থেকে সবে ফিরেছি আর ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে আছি, যখন জাপানের আত্মসমর্পণের খবর এল। আজ আমি যখন আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, তখন আজ রাতে দিল্লিতে আমরা আর একটি মুহূর্ত উদ্যাপন করছি, যেটি পৃথিবীর ভবিষ্যতের জন্য কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়— ভারতের স্বাধীনতা দিবস।
১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট যে জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বছর ছিল, সেটা মাউন্টব্যাটেনের জন্য ব্যক্তিগত সংযােগের বিষয় হতে পারে। কিন্তু সেটা তাঁর বর্তমান। দায়িত্বের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিষয়বহির্ভূত এবং অপ্রাসঙ্গিক, সেই দায়িত্ব ছিল “ন্যূনতম রক্তক্ষয় ও দুর্গতি ঘটিয়ে ক্ষমতার হস্তান্তর।” মাউন্টব্যাটেন বুঝেছিলেন, যে দিনটি তিনি ধার্য করেছিলেন, সেটি প্রভূত রক্তক্ষয় ও দুর্গতির জন্যই তাঁকে সমালােচনার মুখে ফেলেছে। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৈরি একটি অফিশিয়াল রিপাের্টে তাঁর জুড়ে দেওয়া উপসংহার অংশের ১৭ নং পরিচ্ছদে তিনি ১৫ অগস্ট তারিখটি বেছে নেওয়ার পাঁচটি কারণ দেখান; এই কারণগুলির কোনওটিই জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকীর কথা উল্লেখ করেনি।[৩৩] কখন তা হলে মাউন্টব্যাটেন অর্ধসত্য বলছিলেন, অথবা কখন তিনি অমনােযােগী ছিলেন? তাই এই ভীতিপ্রদ প্রশ্নটা আমাদের গ্রাস করে: মাউন্টব্যাটেন কি তবে ভারতের দেশভাগকেও কপটতা অভ্যাসের অনুশীলনে পরিণত করেছিলেন?
৪০৮
তথ্যসূত্র
১. ফিল্ড মার্শাল লর্ড অ্যালানব্রুক, ওয়র ডায়েরিজ, লন্ডন, ২০০১, পৃ XIV
২. উড্রো ওয়্যাট, কনফেশন অব অ্যান অপটিমিস্ট, কলিনস, লন্ডন, ১৯৮৫, পৃ ১৬২
৩. এইচ এম সিরভাই, পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, লেজেন্ড অ্যান্ড রিয়ালিটি, অক্সফোর্ড, ২০০৫, পৃ ১১৯।
৪. তদেব
৫. সালিম কুরেশি (সম্পাদিত), জিন্না, দ্য ফাউন্ডার অব পাকিস্তান, পৃ ১৫ ও ১৬
৬. দশম খণ্ড, পৃ ৯৪৫
৭. দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দশম খণ্ড, ২২ মার্চ – ৩০ মে, ১৯৪৭, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ১১৯
৮. সিরভাই, পৃ ৯৭।
৯. এইচ ভি হডসন, দ্য রােল অব লর্ড মাউন্টব্যাটেন, সি এইচ ফিলিপস ও মেরি ডােরিন ওয়েনরাইট সম্পাদিত দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া: পলিসিস অ্যান্ড পার্সপেকটিভস ১৯৩৫-১৯৪৭ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, লন্ডন, পৃ ১২১
১০. জিন্না ও মাউন্টব্যাটেন-এর কথােপকথনের (২৩ জুন, ১৯৪৭) প্রতিলিপি, দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, একাদশ খণ্ড, নং ৩১১, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ৫৮০
১১, ভারতীয় ক্যাবিনেটের স্পেশাল কমিটির বৈঠক, ২৬ জুন, ১৯৪৭, দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, একাদশ খণ্ড, নং ৩৫৪, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ৬৫০
১২. লিস্টোয়েলকে লেখা মাউন্টব্যাটেন-এর চিঠি, ৯ জুন, ১৯৪৭, দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, একাদশ খণ্ড, নং ১২০, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ২২৬
১৩, স্যর স্টাফোর্ড ক্রিপস-এর ব্যক্তিগত সহযােগীদের মধ্যে উড্রো ওয়্যাট ছাড়া ব্রিটিশ লেবার পার্টির এম পি মেজর শর্টকে শিখ সংক্রান্ত বিষয়ে এক জন বিশেষজ্ঞ বলে গণ্য করা হত।
১৪. দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দ্বাদশ খণ্ড, নং ৩২৬, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ৪৯২ ১৫.তদেব, একাদশ খণ্ড, নং ১৫৮, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ২৯২
১৬. তদেব, দশম খণ্ড, নং ৪৫৬, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ৮৪৩
১৭. স্যর জর্জ অ্যাবেলকে লেখা স্যর সিরিল র্যাডক্লিফ-এর চিঠি, দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দ্বাদশ খণ্ড, নং ৩১৮, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ৪৮৩
১৮, ক্রিস্টোফার বােম-র বিবৃতি, পরিশিষ্ট IV, আনসার হুসেন খান, দ্য রিডিসকভারি অব ইন্ডিয়া, আ নিউ সাব-কন্টিনেন্ট, সঙ্গম, লন্ডন, ১৯৯৫
১৯. দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দ্বাদশ খণ্ড, নং ৮১’র সংশ্লিষ্ট অংশ, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ১১৭
২০. মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, ওরিয়েন্ট লংম্যান, নয়াদিল্লি, ১৯৫৯, ১৯৮৮, পৃ ২২৬ .
২১. অচিনলেক-এর নােট, ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭, ১৫. দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দ্বাদশ খণ্ড, নং ৪৮৬, ইংল্যান্ড, ১৯৮১, পৃ ৭৩৪
৪০৯
২২. সর্দার জাফরি’র ‘খুন কি লকীর’ কবিতার আয়েষা জালাল কৃত রূপ
২৩. স্যর পেন্ডেরেল মুন, দ্য ব্রিটিশ কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডােমিনিয়ন অব ইন্ডিয়া, দ্বিতীয় ভাগ, (১৮৫৮ – ১৯৪৭), ইন্ডিয়া রিসার্চ প্রেস, নয়াদিল্লি, প্রথম সংস্করণ, ১৯৯৯, পৃ ১১৬৭
২৪. তদেব, পৃ ১১৯৪ -১১৯৫
২৫. অবসরপ্রাপ্ত আই এ এস অফিসার ভি সুন্দরম-এর আনসাং আর এস এস হিরােজ অব পার্টিশন ডে’জ, দ্বিতীয় ভাগ থেকে http://www.newstodaynet. com/ 2() () 6sud/ ( 6 jul/1807ss1.htm ওয়েবসাইটে উদ্ধৃত অংশ
২৬. মাউন্টব্যাটেন পেপার্স, ভাইসরয়ের সাক্ষাৎকার নং ১৬৮, ২৪ জুলাই ১৯৪৭, অপরাহু ৫-১৫ মি.
২৭. দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, দ্বাদশ খণ্ড, ৮ জুলাই ১৫ অগস্ট ১৯৪৭।
২৮. এইচ এম সিরভাই, পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, লেজেন্ড অ্যান্ড রিয়ালিটি, অক্সফোর্ড ২০০৫, পৃ ১৩৫
২৯. তদেব, পৃ ১৩৭
৩০. তদেব, পৃ ১৩৯
৩১. তদেব, পৃ ১৩৯
৩২. তদেব।
৩৩. তদেব, পৃ ১৩৮-১৩৯
৪১০
দশম অধ্যায়
পাকিস্তানের জন্ম – স্বাধীনতা: কায়েদ-এর শেষ যাত্রা
প্রতিষ্ঠাতা কায়েদ-এ আজম-এর সঙ্গ নিয়ে এ বার আমরা চলে যাব সেই সময়ে, যখন পাকিস্তান নামক দেশটি সবে জন্ম লাভ করছে। ১৯৪৭ সালের ৭ অগস্ট, শেষ বারের মতাে জিন্না ভারত ছেড়ে চলে গেলেন করাচির উদ্দেশে, যাওয়ার আগে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই শান্তি বজায় রাখার আর্জি জানিয়ে গেলেন, ভারতের সাফল্য ও উন্নতি কামনা করে গেলেন।
সকলেই ধরে নিয়েছিল যে পাকিস্তানে কায়েদ-এ-আজম তাঁর জীবনের শেষ স্টেশনে এসে পৌঁছেছেন। প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে, এই পাকিস্তানই কি আমরা চেয়েছিলাম? সেই সময়কার কয়েকটি বক্তব্য পড়লে সে সময়ের মানসিক জটিলতাগুলি বােঝা যায়। গভর্নর জেনারেল-এর তদানীন্তন সামরিক সচিব মেজর জেনারেল শহিদ হামিদ তাঁর আত্মকথা ‘সংকটের আলাে-আঁধার: ভারত বিভাগের দিনগুলির এক ব্যক্তিগত স্মৃতি রােমন্থন’-এ সেই সময়কার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। লিখেছেন:
১৩ অগস্ট ১৯৪৭ করাচিতে উৎসবের মেজাজ। কিন্তু শয়ে শয়ে যে সমস্ত সাংবাদিক ও অভ্যাগত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দেখতে এসে পৌঁছেছেন, তাঁদের থাকার জায়গা খুবই কম। আমার শ্যালক, ভারতের পাবলিক রিলেশনস অন জেনারেল হেড-কোয়ার্টার্সের ডিরেক্টর কর্নেল মজিদ মালিক এখন পাকিস্তান সরকারের তথ্য-দফতরের প্রধান সচিব, অথচ তাঁর সে কী হেনস্থা। সব সাংবাদিকেরই অবস্থা সঙ্গিন। পাকিস্তান বলে কোনও রাষ্ট্র নেই, রাতারাতি সেটা তৈরি হবে। তাই কোনও সরকারি অফিস বিল্ডিং নেই, কোনও মন্ত্রক নেই, অফিস আসবাব কিংবা কাগজ-কলমের ব্যবস্থাটুকুও নেই। একটা টাইপরাইটারের কথা ভাবাও বিলাসিতার পর্যায়ে। পুরােটাই নৈরাজ্য। … ভাইসরয় আশা করছিলেন, ১৩ অগস্টের মধ্যে করাচি একটা পুরােপুরি কার্যকর রাজধানী শহর হিসেবে প্রস্তুত হয়ে যাবে রাজার প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য।
গভর্নর-জেনারেল-এর বাড়িতে একটা ব্যাঙ্কোয়েট-এর আয়ােজনই ছিল প্রথম
৪১১
অনুষ্ঠান। সেখানে মােটামুটি পঞ্চাশ জন অভ্যাগত আমন্ত্রিত ছিলেন। দমচাপা পরিবেশ, কায়েদ-এ আজম ছােট একটি বক্তৃতা দিলেন। মনে হয়, সেই একটি সময়েই তিনি হিজ ম্যাজেস্টি ইংল্যান্ডের সম্রাটের প্রতি সম্মানজ্ঞাপনা করলেন। উল্টো দিকে, মাউন্টব্যাটেন রাজার শুভেচ্ছাবাণী জানানাের পর একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, এমন অনুষ্ঠানে যে ধরনের বক্তৃতা একেবারেই মানায় না। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিনি এ কথাও তুললেন যে লােকে অনেক সময়েই প্রশ্ন করে কেন তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখটি এগিয়ে আনলেন। ছেলেমানুষি হাসি হেসে তিনি বললেন যে, ব্রিটিশরা বলে, কোনও বাচ্চাকে সাইকেল শেখানাের সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে তাকে একটা পাহাড়ের চুড়ােয় নিয়ে যাওয়া, সাইকেলের সিটে বসানাে, এবং ঢাল বরাবর তাকে ঠেলে দেওয়া। যতক্ষণে নীচের সমতলে সে নেমে আসবে, সাইকেল চড়তে শেখা তার হয়ে গেছে…’
যেমন ভাবা হয়েছিল, ব্যাঙ্কোয়েট তার চেয়ে বেশিক্ষণ চলল। তার পর বাগানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, প্রায় হাজারখানেক অতিথির জন্য।
কায়েদ-এ আজম চুপচাপ, একা। আমি ওঁর কাছে গেলাম, কিছু না বলে পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।… চেহারাটা বেশ দুর্বল, ক্লান্ত, চিন্তিত। কেন যেন বুঝতে পারছিলাম যে উনি চাইছেন এই অনুষ্ঠান যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়। মাউন্টব্যাটেনের কিন্তু যাওয়ার কোনও ইচ্ছে আছে বলে মনে হচ্ছিল না, যথারীতি অতিথিদের মনােরঞ্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। … আর স্বভাবতই, যত, ক্ষণ না রাজার প্রতিনিধি চলে যাচ্ছেন, তত ক্ষণ কায়েদ-এ আজমও যেতে পারেন। না।
তিনি যখন তাঁর এডিসি-কে ডেকে বললেন তিনি অনেক সহ্য করেছেন, এ বার মাউন্টব্যাটেনকে বাড়ি যেতে বলতে, আমি খুব একটা দূরে ছিলাম না। বেচারি এডিসি কী করা উচিত বুঝতে না পেরে আমার কাছে উপদেশের জন্য এগিয়ে এল। আমি বললাম, কায়েদ যা বলেছেন, মাউন্টব্যাটেনকে গিয়ে ঠিক সে কথাই বলতে। সাহস। দেওয়ার জন্য বললাম যে আমিও সঙ্গে যাব। আমরা মাউন্টব্যাটেনের দিকে এগিয়ে গিয়ে একেবারে আক্ষরিক ভাবে ওই কথাই বললাম। তিনি খানিক অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘অবশ্যই এত দেরি হয়ে গেছে আমার বােঝা উচিত ছিল, মি. জিন্না নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। কায়েদ-এর কাছে গিয়ে তিনি ক্ষমা চেয়ে তিনি বিদায় নিলেন। কী একটা দিনই না গেল!
১৪ অগস্ট ১৯৪৭ এ দিন সকাল থেকেই প্রবল ব্যস্ততা। তার মধ্যেই মাউন্টব্যাটেন সাত তাড়াতাড়ি আর এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। কায়েদ-এর কাছে খবর পাঠালেন যে দিল্লির গােয়েন্দা দফতর এক গােপন পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছে। যখন কায়েদ করাচির মধ্য দিয়ে তাঁর রাজকীয় যাত্রা করবেন, সে সময়ে তাঁর গাড়ির দিকে একটি বােমা ছােড়া হবে। তিনি কায়েদকে ওই যাত্রা বাতিল করতে বললেন। কায়েদ তাতে রাজি হলেন
৪১২
তখন মাউন্টব্যাটেন বললেন, তা হলে তাঁরা একটা বন্ধ গাড়িতে যাবেন। আবারও কায়েদ তাতে কান দিলেন না।
গােটা রাস্তাটা ধরে প্রবল উল্লাস, হই হই। দেখার মতাে দৃশ্য, ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। বহু দিনের স্বপ্ন সফল হতে চলেছে, নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হতে চলেছে। কায়েদ-এ আজম-এর নাম সকলের মুখে মুখে, সঙ্গে আল্লাকে ধন্যবাদ। … ফেরার পথে মাউন্টব্যাটেন তাঁর সঙ্গীদের বললেন যে জিন্না নাকি বেশ আশঙ্কিত ছিলেন, দুই হাঁটু চেপে ধরে বসে কেঁদেও ফেললেন এক বার, ওঁকে মাউন্টব্যাটেনের একেবারেই ভাল লাগেনি। মিস জিন্নাকেও তাঁর কেমন যেন ‘অদ্ভুত মহিলা বলে মনে হয়েছে।
(এ সব নিয়ে কোনও মন্তব্য করা অসম্ভব, মেজর জেনারেল শহিদ হামিদ যা লিখেছেন তা ঠিক কি না সেটা নির্ণয় করাও কঠিন, তবে এর থেকে মাউন্টব্যাটেনকে অনেকটাই বােঝা যায়।)
ক্রিস্টোফার মিচেল-এর তৈরি জিন্না-বিষয়ক ফিল্মটিতে একটি খুব উল্লেখযােগ্য দৃশ্য আছে। গভর্নর জেনারেল জিন্না এবং মাউন্টব্যাটেন একই লিমুজিনে করে উৎসবের মধ্য দিয়ে চলেছেন, দ্বিতীয় জন রয়াল নেভি-র ইউনিফর্ম-পরিহিত, মেডেল-শােভিত দৃপ্ত চেহারায়। কায়েদ-এ-আজমের পরনে এত দিনে-বহুপরিচিত সেই একই পােশাক, তিনি ক্লান্ত, চুপচাপ। কিছুটা একটেরে ভাবে বসে আছেন তিনি, আর মাউন্টব্যাটেন হাত নাড়ছেন, যথাবিধি মানুষের অভিনন্দন গ্রহণ করছেন। জিন্না সবই দেখছেন, কিন্তু হঠাৎ যেন এত দিনের সব ক্লান্তি, অসুস্থতা, চার পাশের গরম ভারী হাওয়া তাঁকে ঘিরে ধরেছে। অথচ তিনি কায়েদ-এ আজম, তিনিই এখন পাকিস্তানের প্রথম পুরুষ, মাউন্টব্যাটেন যতিচিহ্নমাত্র।
পাকিস্তান নির্মাণের মাত্র তেরাে মাসের মধ্যে কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিনা, স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল দেহরক্ষা করলেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের পিছনে যে অনুপ্রেরণা ছিল, তাও যেন চলে গেল। ফলে তাঁর জন্মের পরে পরেই, শিশু-রাষ্ট্রটি আদর্শের দিক দিয়ে, নৈতিকতার দিক দিয়ে সম্পূর্ণ অনাথ হয়ে পড়ল, সেই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ধাক্কা এখনও পাকিস্তান কাটিয়ে উঠতে পারেনি, এখনও জিন্নার উপযুক্ত কোনও উত্তরাধিকারী আসেননি। কায়েদ-এ-আজমের শেষ যাত্রার একটি অসাধারণ বিবরণ পাই আমরা ড. ইলাহি বক্সের লেখা থেকে।
৪১৩
কায়েদ-এর শেষ যাত্রা (১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮)
ডা. ইলাহি বক্স ছিলেন জিন্নার ব্যক্তিগত চিকিৎসক। কায়েদ-এ-আজম, তাঁর শেষের কয়েকটি দিন’ নামে একটি অসামান্য স্মৃতিচারণা লিখে গেছেন তিনি। শেষ দিকে জিন্না তাঁর ক্ষয়রােগে বিধ্বস্ত শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য জিন্না জিয়ারাত গিয়ে ছিলেন, যেখান থেকে তাঁর শেষ যাত্রার কথা লিখেছেন ইলাহি বক্স। তিনি লেখেন:
“সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, অ্যাম্বুল্যান্স ও নার্স মৌরিপুর বিমানক্ষেত্র থেকে আমাদের সঙ্গ নেবে, শুনে আশ্বস্ত হলাম। সাড়ে বারােটা বাজে, অথচ একটার সময়ে আমাদের রওনা হওয়ার কোনও প্রস্তুতিই তখনও দেখা যাচ্ছে না। শেষ অবধি গােছানাে শেষ হল একটা কুড়িতে। আমি কায়েদ-এ-আজমকে জানাতে গেলাম, মিস জিন্না সে ভারটা আমাকেই দিয়েছিলেন। তাঁর ঘরে ঢুকে তাঁকে সালাম জানালাম, আমার দিকে অল্প একটু হাসলেন তিনি। খুব দুর্বল, বিধ্বস্ত লাগছিল তাঁকে, চোখে কেমন যেন ঘােলাটে চাহনি। দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে তিনি একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলেন, বসলাম। তার পর নীচের এই কথােপকথন: ‘স্যর, আপনি কি করাচি যেতে চান? ‘হ্যাঁ। ‘স্যর, আপনি কি আজই যেতে চান? ‘আপত্তি নেই। ‘বিমানে যাওয়ার জন্য আমরা তৈরি, আপনি কি তা হলে কয়েক মিনিটের মধ্যে রওনা হতে পারবেন?
কায়েদ-এ-আজম মাথা নেড়ে একটু দুর্বল গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে।
বিরাট হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। কিন্তু এটাও না ভেবে পারলাম না, কেন উনি আগেকার সব আপত্তি ভুলে গিয়ে করাচি যেতে রাজি হলেন? শারীরিক অবস্থা তাঁর কতটাই খারাপ সেটা তাে ওঁকে বলা হয়নি, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই নিজেই সব আশা হারিয়ে ফেলে নিজের জন্মভূমিতে ফিরবার জন্য মন ঠিক করে ফেলেছেন। মিস জিন্নার কাছে গিয়ে বললাম কায়েদ-এ-আজম এখনই রওনা হতে রাজি। কয়েক মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুল্যান্সে তাঁকে উঠিয়ে দেওয়া হল। মিস জিন্না আর নার্স উল্টো দিকের আসনে। বসলেন, আর আমি লেফটেনান্ট মাজহারের সঙ্গে সামনে, ড্রাইভারের পাশে।
অ্যাম্বুল্যান্স যেই চলতে শুরু করল, উপলব্ধি করলাম, কত গুরুতর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। মনের মধ্যে নানা রকম উল্টোপাল্টা চিন্তার সঙ্গে আল্লাকে বলতে শুরু করলাম যেন কায়েদ-এ-আজম-এর এই যাত্রা নিরাপদ হয়। প্রার্থনার পর একটু শক্ত হয়ে যাত্রাকালীন কী কী প্রয়ােজন হতে পারে সেগুলাে গােছাতে শুরু করলাম। গভর্নর জেনারেল-এর বিমানটি যেন সূর্যের আলােয় রূপােলি পাখির মতাে দেখাচ্ছে। দুটোর সময় এরােড্রোমে পৌঁছলাম। স্ট্রেচারে করে যখন তাঁকে প্লেনে ওঠানাে হচ্ছে,
৪১৪
উপস্থিত কর্মীরা সব স্যালুট জানাল। আমাদের অবাক করে দিয়ে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রতি-স্যালুট করলেন।”
সেপ্টেম্বর। বর্ষা আস্তে আস্তে বিদায় নিচ্ছে। দুপুর দুটো। গরমের দিক দিয়ে সম্ভবত দিনের সবচেয়ে খারাপ সময়টা। ডা. ইলাহি বক্স লিখছেন:
“প্লেনের মধ্যে বেশ গরম। মিস জিন্না, ড. মিস্ত্রি, নার্স সকলেই ফ্রন্ট কেবিনে, আমি মি. আমিন ও লেফটেনান্ট মাজহারের সঙ্গে পরের কেবিনে। প্লেন ছাড়ার কয়েক মিনিট পর, ড, মিস্ত্রিকে দেখলাম কেবিন থেকে বেরিয়ে আসছেন। আমার বুকটা ছাঁত করে উঠল। তিনি অবশ্য আমাকে চিন্তামুক্ত করে বললেন যে মিস জিন্না তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, দরকার পড়লে ডেকে পাঠাবেন। আমার সামনে একটি আসনে তিনি বসলেন, এবং ঘুমিয়ে পড়তে একেবারেই সময় নিলেন না। সাত হাজার ফুট উপরে আমরা তখন, কাচের জানলা দিয়ে নীচে দেখি কোয়েটা পর্বতমালা দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ মাঝের দরজাটা খুলে গেল, মিস জিন্না এসে বললেন, নার্স এয়ারসিকনেস-এ দম হারিয়ে ফেলছেন, আর তাঁর ভাই (জিন্না) ওঁর কাছ থেকে অক্সিজেন নিতে পারছেন না। ওই কেবিনে গেলাম, তাঁর নাড়ি দেখলাম, দেখলাম বেশ নিয়মিত, ভাল। সায়ানােসিস-এর জন্য নখ দেখলাম। আশ্বস্ত হওয়ার পর অক্সিজেনের ব্যাপারটা দেখতে শুরু করলাম। অক্সিজেন মাস্ক তাঁর মুখের কাছে নিয়ে যেতেই তিনি হাতটা ঠেলে দিলেন, শান্ত ভাবে বােঝালাম যে, যাতে ওঁর কোনও ক্ষতি না হয় তার জন্যই মাস্কটা জরুরি, তাতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ওটা পরাতে দিলেন। আমার বসার কোনও জায়গা ছিল না, কিন্তু দুটো কেবিনের মধ্যে সিঁড়িতে বসে গেলাম, দরজার দিকে। পেছন করে। কায়েদ-এ আজম পাঁচ মিনিট মতাে অক্সিজেন নিলেন, তার পর আবার • ওটা খুলে ফেলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু যত বার আমি তাঁর সঙ্গে কথা বললাম, প্রতি বার তাকালেন, হাসলেন, আমাকে মাস্কটা ঠিক করে দিতে অনুমতি দিলেন। কয়েক মিনিট পর পর নাড়ি দেখতে থাকলাম, নখের সঙ্গে আমার নখের তুলনা করলাম। তিনি অস্থির হয়ে পড়ছিলেন, কম্বলটা পা দিয়ে ঠেলে দিচ্ছিলেন, মিস জিন্না সঙ্গে সঙ্গে আবার তাঁকে ঢেকে দিচ্ছিলেন। কুড়ি মিনিট এ ভাবে অস্বস্তির সঙ্গে বসে থেকে মনে হল, একটু ঠিক করে বসা দরকার। মিস জিন্না আমার অসুবিধে দেখতে পাচ্ছিলেন, নিজেই বললেন গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে, তিনিই তত ক্ষণ অক্সিজেন দেবেন। কোয়েটায় তিনি বেশ ভালই কাজটা করছিলেন, সুতরাং আমি নিশ্চিন্তে আমার কেবিনে চলে গেলাম। সবাই গভীর নিদ্রামগ্ন, নাক ডাকছে, কেবল লেফটেনান্ট মাজহারকে দেখাচ্ছে খুব দুর্বল, শুকনাে।
আসার পর কয়েক মিনিটও হয়নি, মিস জিন্না আবার এসে বললেন, আমাকেই যেতে হবে অক্সিজেন দিতে, তাঁর ভাই তাঁকে দিতে দিচ্ছেন না। আমি গেলাম, আরও মিনিট কুড়ি অক্সিজেন দিলাম। তত ক্ষণে আমরা পাহাড় ছাড়িয়ে এসে নেমেছি চার-পাঁচ
৪১৫
হাজার ফুটের কাছাকাছি। আর অক্সিজেন দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে হল না, কেবিনে চলে গলাম। যাত্রার সবচেয়ে কঠিন অংশটা পেরিয়ে গেছে, জানলার বাইরে। তখন সিন্ধুপ্রদেশের বন্যাকবলিত অঞ্চল। প্রকৃতি যে আমাদের শিশু-দেশটির প্রতি কত নির্দয়, সেই কথা ভাবছিলাম।”
আরও কঠিন সময় তখন সামনে।
করাচিতে
‘বিকেল সওয়া চারটের সময়ে আমরা মৌরিপুর বিমানবন্দরে নামলাম। মাথা থেকে যেন একটা বিরাট ভার নেমে গেল। প্লেন থেকে বার হতে হতেই দেখলাম গভর্নর জেনারেল-এর সামরিক সচিব কর্নেল নােলস একটি অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও কোনও নার্স চোখে পড়ল না। বেশ গরম, তবে জোর হাওয়াও দিচ্ছে, ভ্যাপসা নয়। কায়েদ-এ আজমকে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাম্বুল্যান্স-এ তােলা হল, মিস জিন্না এবং কোয়েটা থেকে আসা নার্সটি অ্যাম্বুল্যান্স-এ বসলেন, ডা. মিস্ত্রি এবং আমি গভর্নর জেনারেল-এর ক্যাডিল্যাক গাড়ি অনুসরণ করে চললাম। আমাদের পিছনে একটি ট্রাকে মালপত্র, অনুচর-ভৃত্য ইত্যাদি। খুব কম স্পিডে গাড়ি চলতে লাগল গভর্নর জেনারেলের বাড়ির দিকে, প্রায় ৯-১০ মাইল দূরে। চার মাইল মতাে যাওয়ার পরই অ্যাম্বুল্যান্সটি হঠাৎ থেমে গেল। কী হয়েছে বােঝার জন্য নেমে অ্যাম্বুল্যান্সের কাছে পৌঁছতে বুঝলাম ইঞ্জিনের ব্রেকডাউন। ড্রাইভার আশ্বাস দিয়ে বলল এক্ষুনি সে ঠিক করে ফেলবে, কিন্তু কুড়ি মিনিট ধরে চেষ্টার পরও সেটা ঠিক হল না। মিস জিন্না। সামরিক সচিবকে ঠেলে পাঠালেন আর একটা অ্যাম্বুল্যান্স নিয়ে আসতে। ডা. মিস্ত্রিও সঙ্গে গেলেন। অ্যাম্বুল্যান্সের ভেতরটা খুব দমবন্ধ গরম, নার্স আর ভৃত্যরা সমানে হাওয়া করে গেলেও জিন্না বেশ ঘামছেন। বড় গাড়িটাতে তাঁকে নিয়ে আসা যায় কি
ভাবছি, কিন্তু গাড়িতে তাে আবার স্ট্রেচার ঢােকানাে যাবে না, আর উনি এত দুর্বল যে সিটে সােজা ভাবে ওঁকে বসানােও যাবে না। তা ছাড়া, ঘামে তাঁর জামাকাপড় এমন ভাবেই ভিজে গেছে যে বাইরের হাওয়ায় নিয়ে আসাটাও বিপজ্জনক। নাড়ি পরীক্ষা করে ভয় পেয়ে গেলাম, নাড়ি বেশ দুর্বল, অনিয়মিত হয়ে আসছে। দৌড়ে গিয়ে ট্রাক থেকে গরম চা-ওয়ালা একটা থার্মোফ্লাস্ক নিয়ে এলাম। মিস জিন্না তাঁকে তাড়াতাড়ি একটা কাপে করে চা দিলেন, দেখলেন দিনে প্রথম বার উনি কোনও খাবার (খাদ্য বা পানীয়) গ্রহণ করলেন, কয়েক ফোঁটা ফলের রস ছাড়া সবই এর আগে প্রত্যাখ্যান করেছেন। একটু সাহস পেলাম। অ্যাম্বুল্যান্সের ব্রেকডাউন ছাড়া আর সব কিছুই কিন্তু মােটের উপর ঠিকঠাক যাচ্ছে। যদি বিমানযাত্রা ঠিকমতাে উতরে যাওয়ার পর রাস্তায় তাঁর মৃত্যু ঘটে যেত, কী কাণ্ডই না হতাে। উদ্বেগের চোটে আবার
৪১৬
ওঁর নাড়ি পরীক্ষা করলাম; চায়ে কাজ দিয়েছে, নাড়ি আর একটু নিয়মিত হয়েছে। পাশ দিয়ে ট্রাক, বাস সব চলে যাচ্ছে, কিন্তু কোনওটাই আমাদের জন্য সুবিধেজনক নয়। অসম্ভব অসহায় লাগছিল। অত্যন্ত যন্ত্রণাময় অপেক্ষার পর অ্যাম্বুল্যান্স এসে পৌঁছল। তাড়াতাড়ি কায়েদ-এ-আজমকে নতুন অ্যাম্বুল্যান্স-এ তােলা হল, আবার যাত্রা শুরু হল। অ্যাম্বুল্যান্স-এ গভর্নর জেনারেল-এর পতাকা লাগানাে ছিল না, কেউ বুঝতেই পারল না যে করাচির রাস্তা দিয়ে ঘােরতর অসুস্থ অবস্থায় কায়েদ-এআজমকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
গভর্নর জেনারেল-এর ব্যক্তিগত চিকিৎসকের এই বর্ণনা পড়ে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় কী। নতুন স্বাধীন দেশ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল জিন্না অসম্ভব দুর্বল, মৃত্যুশয্যায়। তিনি চলছেন পাকিস্তানের প্রথম রাজধানীতে। বিমানবন্দরে তাঁর অতিসাধারণ অভ্যর্থনা, সকলেরই নিরুদ্বিগ্ন ভাব, শেষে অ্যাম্বুল্যান্স খারাপ হয়ে যাওয়া, পাশ দিয়ে একের পর এক ট্রাক ও বাস নির্বিকার ভাবে চলে যাওয়া, এর মধ্যে কী যেন একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার, দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি রয়েছে। “ছ’টা বেজে দশে আমরা গন্তব্যে পৌঁছলাম, মৌরিপুর বিমানবন্দরে পৌঁছনাের দুই ঘণ্টা পরে। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে কী স্বস্তি যে হল, বলার নয়।”
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, সেই রাত্রেই, করাচিতে, পাকিস্তানের কায়েদ-এআজম, মহম্মদ আলি জিন্না মারা গেলেন। সময় তখন রাত দশটা।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব, কাথিয়াড়ের দুই বরেণ্য সন্তান, ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা ও আইন-ব্যবসায়শিক্ষার দুই উল্লেখযােগ্য ফসল, হিন্দু ও মুসলিম দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের দুই অবিসংবাদী নেতা, দু’জনেই ১৯৪৮ সালে কয়েক মাসের ব্যবধানে দেহরক্ষা করলেন। গাঁধী: ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারি। জিন্না: ১৯৪৮-এর ১১ সেপ্টেম্বর।
তাঁদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে এক বিশিষ্ট ধারার রাজনীতিও শেষ হয়ে গেল। জিন্নার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হল পাকিস্তানের যা-কিছু অর্থ, আদর্শ। সে শূন্যতা আর কোনও দিন পূর্ণ হয়নি।
বিশেষ গেজেট প্রকাশিত হল: “পাকিস্তানের সরকার শােকের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, ১১ সেপ্টেম্বর, শনিবার, রাত ১০ টা বেজে পঁচিশ মিনিটে কায়েদ-এ আজম মহম্মদ আলি জিন্নার মৃত্যু হয়েছে।
রবিবার ৩টের সময় তাঁর শেষ যাত্রা, গভর্নর জেনারেল-এর বাড়ির সামনে থেকে। করাচির এগজিবিশন গ্রাউন্ডে নমাজ-ই-জানাজা হবে। নমাজ পড়বেন মৌলানা সাবির আহমদ ওসমানি। ওই এগজিবিশন গ্রাউন্ডের কাছে প্রস্তাবিত জামা মসজিদের মধ্যে তাঁকে কবর দেওয়া হবে।”
উত্তরাধিকার নিয়ে কোনও সমস্যা হল না। খাজা নাজিমুদ্দিন পরের গভর্নর জেনারেল। হলেন। দিল্লিতেও রাষ্ট্রীয় শােক পালিত হল, পতাকা অর্ধনমিত রইল। ভারতের গভর্নর
৪১৭
জেনারেল সি. রাজাগােপালাচারি জিন্নার প্রতি শ্রদ্ধাবশত একটি সরকারি সভা বাতিল করে দিলেন।
১৯৪৮-এর ১৩ জানুয়ারি প্রতিটি কাগজে সম্পাদকীয় পাতায় জিন্নার মরণােত্তর শ্রদ্ধালিখন প্রকাশিত হল। তখনকার প্রধান দুটি ইংরেজি কাগজ ‘হিন্দুস্তান টাইমস। ও ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’-য় জিন্নার ভূমিকার বিস্তারিত বিশ্লেষণও বার হল। লন্ডন টাইমস’-এ প্রশংসার স্রোত বয়ে গেল: “তাঁর নিজের সমাজের কাছে মিস্টার জিন্না ছিলেন কায়েদ-এ আজম বা রাষ্ট্রপ্রধানের থেকেও অনেক বেশি কিছু। যে মুসলিম রাষ্ট্র তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন তার স্থপতির থেকেও আসলে তিনি অনেক বড় ছিলেন। গােটা সমাজের কল্পনা এবং প্রত্যয় তৈরি করেছিলেন তিনি একাই। ইকবাল ভারতের মুসলিমদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণের যে কল্পনা করেছিলেন, সেই কল্পনার বাস্তবায়ন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার ভার গিয়ে পড়িছেল একা জিন্নার কাঁধেই, অথচ সামনে ছিল একের পর এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান যে বিশ্ব-দরবারে স্থান করে নিতে পারল, তা একা তাঁরই জন্য। খুব কম রাষ্ট্রনায়ক তাঁদের জীবৎকালে এমন নিশ্চিত ভাবে রাজনীতির নতুন খাত তৈরি করে ঘটনাপ্রবাহের স্রোত সে দিকে বইয়ে দিতে পারেন, জিন্না তা পেরেছিলেন। জীবদ্দশাতেই তিনি ছিলেন কিংবদন্তি।”
‘হিন্দুস্তান টাইমস’ ছিল তখনকার (এখনও?) কংগ্রেস পার্টির মুখপত্র। সেখানে বলা হল: “গাঁধী যে অর্থে স্বাধীন ভারতের প্রতিষ্ঠাতা, জিন্না কিন্তু পাকিস্তানের তেমন প্রতিষ্ঠাপুরুষ নন। দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানাে, বার বার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া, তাদের সামনে কঠিন লক্ষ্য তৈরি করে দেওয়া, এবং তাদের জন্য এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা যা নানা ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে মানুষকে টেনে। নিয়ে যাবে- এমন ক্ষমতা বা ইচ্ছা মিস্টার জিন্নার কোনও কালেই ছিল না। জিন্না বরং। ছিলেন রাজনীতির ‘মাস্টার ট্যাকটিশিয়ান’, ঠিক সময়ে ঠিক সুযােগ আঁকড়ে ধরতে হয়। কী ভাবে, তার আশ্চর্য দৃষ্টান্ত… ভারত তখনও ভুলবে না যে তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন এক জন জাতীয়তাবাদী হিসেবে, … শেষের কয়েক বছরের। জিন্না আসলে পরিস্থিতির এক অমােঘ শিকার, ইতিহাসের সেই পরিস্থিতির মধ্যে যে বিপুল প্রলােভন ছিল, তাকে অগ্রাহ্য করে চলার ক্ষমতা তাঁর মধ্যে ছিল না… তাঁর মৃত্যুর ফলে যে ভারত পাকিস্তান আবার এক হয়ে যাবে, ভারতীয়রা যদি এমন ভেবে থাকে, সেটা হবে সম্পূর্ণ মূর্খামি।”
‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ জিন্না আর গাঁধীর মধ্যে তুলনা আরও খানিক দূর টেনে নিয়ে গেল: “কায়েদ আর মহাত্মা গাঁধীর মধ্যে কোনও আদর্শগত তুলনা চলে না। ইতিহাসের দীর্ঘ ধারার মধ্যে তাঁরা দুই জন দুই সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর নেতা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ইংল্যান্ডে আইনি প্রশিক্ষণের পর থেকে কিছু কাল তাঁদের রাজনৈতিক জীবন একই খাতে প্রবাহিত হয়েছিল…. কিন্তু তার পর এক জনের ভাবনারাজ্য দখল করে নিল আত্মিক মূল্যবােধ, অন্য জন তাঁর অনমনীয় দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নিয়ে কেবল আইনি
৪১৮
ঘােরপ্যাঁচের মধ্যেই থেকে গেলেন, সাংগঠনিক খুঁটিনাটি থেকে শুরু করে শীতল দরকষাকষির খেলায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করে দিলেন, ফল কী হবে না ভেবে দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই-এ মেতে উঠলেন। জিন্নার মধ্যে কি এক ধরনের নেপােলিয়ন-সুলভ বিভ্রম কাজ করত? সে যা-ই হােক, তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি পাকিস্তানের উপর তাঁর মৃত্যুর প্রভাব অনস্বীকার্য: দেশটার ভরকেন্দ্রই নড়ে গেল।”
জিন্নার মৃত্যুর সংবাদ শুনে নেহরু দুঃখ পেলেও স্বভাবগত অহঙ্কারােদ্দীপ্ত ভাবে বললেন: “ভারতের ইতিহাস জিন্না পাল্টে দিয়েছেন, এ কথা ঠিকই, কিন্তু সে পরিবর্তনের অভিমুখ মন্দের দিকে, অশুভের দিকে… কী ভাবে তাঁর ভূমিকা বিচার করব আমরা? গত কয়েক বছরে একাধিক বার আমি তাঁর উপর প্রবল ক্রুদ্ধ হয়েছি। কিন্তু এখন আমার মধ্যে তাঁর বিষয়ে আর কোনও তিক্ততা অবশিষ্ট নেই, কেবল যে বিশাল ঘটনা এর মধ্যে ঘটে গেছে, তার জন্য রয়েছে একটা গভীর দুঃখবােধ। … বাইরের দিক দিয়ে বিচার করলে, তিনি যা চেয়েছিলেন, তা পেয়েছেন, কিন্তু কী অসম্ভব বেশি মূল্য দিতে হল তার জন্য! এবং এও ঠিক, তিনি যা চেয়েছিলেন আর যা তিনি শেষ অবধি লাভ করেছেন, সে দু-এর মধ্যে কত যােজন দূরত্ব! বেঁচে থাকলে তিনি কী ভাবতেন আজ? দুঃখবােধ করতেন না? অনুতাপ হত না? হয়তাে হত না, কেননা তিনি এক তীব্র ঘৃণাবােধের আবরণে নিজেকে ঢেকে ফেলেছিলেন, তার থেকেই নিঃসৃত হত। তাঁর অপছন্দের মানুষদের প্রতি তাঁর সমস্ত অনুভূতি। কী অসম্ভব ভয়ানক এই ঘৃণার সযত্নলালন!”
এই সম্পাদকীয় ও ‘অবিচুয়ারি’গুলি আমাদের কাছে উত্তরাধিকার হিসেবে রয়ে গেল। রয়ে গেল জিন্নার চিন্তা, ভাবনা, এবং পাকিস্তানের জন্য তাঁর যা কিছু প্রয়াস, সব কিছুর উত্তরাধিকার।
তথ্যসূত্র
১. ডিজাস্ট্রাস টোয়াইলাইটস; আ পার্সোনাল রেকর্ড অব দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, মেজর জেনারেল শহিদ হামিদ, পৃ. ২২৮-২২৯, বামলে: লিও কপার, ১৯৮৬।
২. ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮
৪১৯
একাদশ অধ্যায়
অতীতের দিকে ফিরে
ওদের দাম দিতে হয়েছিল….
বিশ্ব জুড়ে তখন আগুন জ্বলছে
কিন্তু ওদের নিজেদের ঘৃণাই
ওদের আত্মাকে হনন করল,।
কোনও জয় হাসিল হবার আগেই
(কিপলিং, দি আউটল’জ, ১৯১৪) ।
আমাদের ‘উপলব্ধির যাত্রা’– ১৯৪৭-এ আমাদের মর্মান্তিক দেশভাগের অন্তর্নিহিত কারণগুলি বুঝবার চেষ্টার এখানেই সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। আমরা শুরু করেছিলাম হিন্দুস্থানে সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের আগমন দিয়ে। তারপর বেশ কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে আমরা চলে আসি ১৮৫৭ সালে। এ সময়েই, উনিশ শতকের মাঝামাঝি আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতীক দখল করে নিয়ে ব্রিটিশ বুটের তলায় তাকে পিষে ফেলা হয়। ওই সুদূরবর্তী ভূখণ্ডের বাণিজ্যিক স্বার্থ একটি সম্পূর্ণ অচেনা সভ্যতার ধ্যানধারণা, আচরণ ও মূল্যবােধকেই এ দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়তির নিয়ন্তা করে তােলে। তাদের অভিপ্রায়, তাদের বিবেচনা, এমনকী তাদের মূঢ়তাই ভারতের ভৌগােলিক আকার, ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং সামাজিক আচরণের নিয়ামক হয়ে ওঠে।
সে সময় যে ব্রিটিশরা ভারতে আসত, তাদের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে আসা অধিকাংশ মানুষই এই দেশ, তার মানুষ, তাদের নানা ভাষা, প্রথা, আচরণবিধি, ধর্মবিশ্বাস কিংবা তাদের আবেগ, প্রবৃত্তি বা দায়বদ্ধতা সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানত না। এই বিশাল সভ্যতার খুব সামান্য তাৎপর্যই তারা ধরতে পারত। তারা বহু দূর থেকে কলকাতা, দিল্লি, সিমলা মারফত শাসন করত এমন এক বিরাট ভূভাগ, যা আয়তনে ও জনসংখ্যায় আজকের ইউরােপীয় ইউনিয়নের সংযুক্ত ভূখণ্ডের চেয়েও বড়। যত দিন ভারতীয়রা নিজেরাই এই ভূভাগ শাসন করেছে, তত দিন নিজস্ব সৌভাগ্য বা
৪২০
দুর্ভাগ্য, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, এমনকী খুনােখুনিও ছিল তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু ভারত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে তারা প্রজা’ হয়ে গেল, ভারত হয়ে গেল প্রজা-রাষ্ট্র। এই অসম্মান প্রায় একশাে বছর স্থায়ী হয়- ১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭। দুর্ভাগ্যবশত, ‘৪৭-এর পরেও আমাদের ভাগ্য আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। নানা কারণে ইউরােপীয় চিন্তা, ভাষা, ক্ষমতা ও ঐতিহ্যের বশ্যতা আমরা এখনও শিরােধার্য করে চলেছি। হ্যাঁ, ব্রিটিশরা চলে গেলেও রেখে গেছে অনেক উত্তরাধিকার যা দেশের উপকারে লেগেছে, আবার কিছু বিভেদপন্থা, যা আমাদের চূড়ান্ত ক্ষতি করেছে। দেশের ইংরেজি-শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই বিভেদকে আরও উশকানি দিয়েছে। যাওয়ার সময় ব্রিটিশরা আমাদের স্বাধীনতাকে খণ্ডিত করে যায়। আমরা উপরন্তু সেই স্বাধীনতার মর্ম থেকেও নাগরিকদের বঞ্চিত করি।
গাঁধী এ সব ভালই বুঝতেন। বুঝতেন ‘৪৭-এর বিভাজন, দ্বন্দ্ব, স্ববিরােধ। কারণ তিনি দেসের আত্মাকে জানতেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলাে পেলেও তার শিকড় ছিল ভারতের মাটির গভীরে প্রােথিত। জিন্না বা নেহরু সম্পর্কে তা বলা যায় না। তারা দুজনই ব্রিটিশ শিক্ষা-সংস্কৃতির দ্বারা এতই আচ্ছন্ন ছিলেন যে, তাদের গােটা রাজনৈতিক জীবনব্যাপী তারা সাহেবই থেকে যান। উভয়েই ঔপনিবেশিকদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার স্বরূপ এক-একটি রাষ্ট্র চেয়েছিলেন: কেউ ভারত, কেউ পাকিস্তান, যা ইউরােপীয় জাতিরাষ্ট্রের অনুরূপ কেন্দ্রীভূত, নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমায় বাঁধা, যা পাশ্চাত্য আধুনিকতার যাবতীয় উপাদানকে আত্মস্থ করবে। এই বীক্ষা থেকেই জিন্না ভারতীয় মুসলিমদের ‘স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে শনাক্ত করলেন। আর তার এই সূত্র ধরেই সাম্রাজ্যবাদীরা উশকে দিল ‘পােকায়-কাটা’ পাকিস্তান। আর সে জন্যই স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ধারণাটি অসম্পূর্ণ ও সংশয়-কণ্টকিত হয়ে রইল।
ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে দেশভাগ এবং মুসলিমদের ‘স্বতন্ত্র জাতি’ রূপে শনাক্ত হওয়াকে মেনে নেওয়ার ফলে সমাজ ও রাজনীতিতে এমন এক সঙ্কট সৃষ্টি হল, ভারতীয় উপমহাদেশে যার জের এর পর বহু কাল ধরে চলতে থাকবে। কেননা এর মূলে রয়েছে যে সংখ্যালঘু-তােষণ, তা নিত্যনতুন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পৃথক-পৃথক জাতি রূপে গণ্য করার দাবি তুলতে থাকবে। পাকিস্তান ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি হলেও এখনও ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। বস্তুত, ভ্যাটিকান ছাড়া সেই অর্থে কোনও ধর্মীয় রাষ্ট্র নেই এই বিশ্বে। কিন্তু যে তাড়াহুড়ােয় মুসলিমদের পৃথক জাতি বলে মেনে নেওয়া হল, গাঁধী ও গুটিকয়েক নেতা ছাড়া কেউ সেই দ্রুততার বিরােধিতা করেননি।
অথচ পাকিস্তানের জন্মও স্বতন্ত্র জাতীয়তা সংক্রান্ত এই বিতর্কটির নিষ্পত্তি করতে পারল না। ভারতের সংখ্যালঘুদের, বিশেষত মুসলিমদের অবস্থান কী হবে, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ কী হবে, তারও মীমাংসা হল না। পাকিস্তানেও হয়নি। ভারতীয় রাজনীতিকরা ১৯০৯ সালে সংরক্ষণের যে নীতি মেনে নিয়েছিলেন, তার পর ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগও মেনে নিয়েছিলেন, তার পর ভারতে থেকে-যাওয়া মুসলিমদের দাবি আজ তারা উড়িয়ে দেবেন কী করে? তেমন মুসলিমদের কেউ-কেউ এখন তৃতীয়
৪২১
একটি দেশভাগের কথাও (পাকিস্তান ও বাংলাদেশের পর) বলতে শুরু করেছেন।
আমাদের খণ্ডিত, পােকায়-খাওয়া স্বাধীনতার এও এক জের। ওই স্বাধীনতায় আমাদের ভেঙে-যাওয়া দেশের কোনও অংশই শান্তি পায়নি। কারণ, যার ভিত্তিতে এই বিভাজন, সেই হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটির এই দেশভাগের মাধ্যমে কোনওই সমাধান হয়নি। আমরা শুধু ভূখণ্ডকেই ভাগ করতে সায় দিইনি, মানবিক সমাজকেও ভেঙে দুটুকরাে করতে সায় দিয়েছিলাম। সেই সম্মতির উত্তরাধিকার এখন ওরা আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চায়। যে মুসলিমরা পড়ে রইল, পরিত্যক্ত হল, সীমান্তপারের স্বজাতি-বর্গের সঙ্গে কোনও আত্মীয়তাই তারা বােধ করল না। সামাজিক নিরাপত্তা ও মনস্তাত্ত্বিক একাত্মতাবােধের এই অভাব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের হিন্দুরাও বােধ করছেন, যদিও তার মধ্যেই তাদের ধীরে-ধীরে সে সব দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছেও বটে।
স্বাধীনতা-উত্তর অন্য চ্যালেঞ্জটি ছিল আমাদের নিজেদের একটি গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক কাঠামােয় সংগঠিত করা। কিন্তু আমাদের জটিল সমাজে এই কাজটা এখনও সন্তোষজনক ভাবে করা যায়নি। তার একটা কারণ নিশ্চিত ভাবেই নতুন কিছু শ্রেণি বা বর্গের উৎপত্তি, যার এক দিকে রয়েছে সাধারণ মানুষ। তারা কেবল সাধারণ মানুষই, তার বেশি কিছু নয়। অন্য দিকে রয়েছেন তাঁরা, যাঁরা সঙ্কট মােচনে তাৎক্ষণিক কিছু দাওয়াই বাতলান, কিন্তু সে-সবই টোটকা দাওয়াই, দীর্ঘস্থায়ী সুচিন্তিত কোনও আরােগ্যবিধি নয়। কিছু সময়ের জন্য সেই ফাপা ব্যবস্থাপত্রগুলি কিছু কাজ করে, এই যা। নিদান দেওয়ার ভার যাঁদের, তাঁদের সততা ও নিষ্ঠাও প্রশ্নাতীত নয়। ফলে সমস্যাগুলির বেশির ভাগ অমীমাংসিতই থেকে যায়। বিভাজন বাড়তে থাকে, শ্রেণিগুলির মধ্যে বিভেদও বাড়ে। ভােট কুড়নাের রাজনীতি সব কিছুকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
প্রায় হাজার বছর ধরে মুসলিমরা উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে শাসক হিসাবে থাকতে অভ্যস্ত ছিল। তার পর ক্রমে তারা ব্রিটিশের প্রজা হওয়ার অভ্যাস রপ্ত করে। ‘৪৭ সালের পর থেকে ভারতে অন্তত তত্ত্বগত ভাবে তারা বড় জোর ‘সমান নাগরিক। কারণ ভারতীয় সংবিধানের মূলে রয়েছে ব্যক্তি-নাগরিক, যা এই প্রজাতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত্তিপ্রস্তর। এ দিকে সেই সংবিধানটি গ্রহণ করেই আমরা বিশেষ অধিকার’ উপহার দিতে শুরু করলাম। সেটাও আবার বেছে-বেছে দিতে থাকলাম। স্বভাবতই মুসলিম নাগরিকরাও এখন তেমন বিশেষাধিকার চাইছেন। কেউ-কেউ বিদ্রুপ করে বলে উঠছেন— ‘বিশেষ অধিকার’? পাকিস্তানের পরেও? কেন? আর সে জন্যই দেশভাগের অসমাপ্ত অ্যাজেন্ডার জের নিয়ে কথা হচ্ছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এবং পরেও এই ধরনের যে যে প্রশ্ন উঠেছিল, সে সবের নিষ্পত্তি কি আমরা করতে পেরেছি? না পেরে থাকলে, আজ হঠাৎ কী করে নিষ্পত্তি করব? দেশভাগের পর এই প্রশ্নগুলির মীমাংসা করা যে আরও জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রশ্নগুলিও আরও অনেক ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে।
ধর্মতত্ত্ব, বিশেষত ইসলাম-তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের বিখ্যাত সূত্র ছিল, ইসলামে যদি কোনও মতাদর্শগত বিপ্লবের সম্ভাবনা থাকে, তবে ভারতেই
৪২২
তা ঘটবে। (১৯৯৩-এর ৬ মার্চ ‘আওয়ার রিপাবলিক, পােস্ট ডিসেম্বর ৬ ১৯৯২: আ ডায়ালগ’ শীর্ষক সেমিনারে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া-র উপাচার্য বশিরুদ্দিন আহমেদ এই সূত্রটি উল্লেখ করেন।) দেশভাগ সেই সূত্রটিকেও নাকচ করেছে। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে এবং জিন্না কেবল নিজেকেই অবিভক্ত ভারতের সব মুসলিমের একমাত্র প্রতিনিধি বলে দাবি করে গেছেন। এখন জিন্নার অবর্তমানে কে পাকিস্তানে সেই প্রতিনিধিত্বের দাবিদার? বাংলাদেশের মুসলিমদের কী হবে? ভারতীয় মুসলমানরাই বা কী করবেন? নির্বাচনী পাটীগণিত তাঁদের বিপক্ষে। তেমন কোনও নেতাও নেই যিনি তাঁদের চোরাবালি থেকে টেনে তুলে পথ দেখাবেন। তাই তারা ভােট নামক নিলামের সময় বিভিন্ন দলের সঙ্গে অবমাননাকর দর-কষাকষি করে যেখানে যতটুকু সুযােগসুবিধা, এঁটোকাটা পাওয়া যায়, তার চেষ্টায় থাকেন। এতে বিভাজন আরও বাড়ে বই কমে না। দেশভাগের অসমাপ্ত অ্যাজেন্ডার কথাও ফিরে আসে। রােমান ‘স্টোয়িক’ দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক এবং নাট্যতত্ত্ববিদ, সম্রাট নিরাে-র শিক্ষক ও উপদেষ্টা সেনেকা বলেছিলেন: যা ভেঙে যায়, তা দ্রুত বিভ্রান্তও হয়ে পড়ে। আমাদের নিজেদের কথাই ধরুন, আমরা অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ। কেন আমরা ইতিহাসকে খণ্ডন করতে গেলাম? ইতিহাস তাে আমাদের কাছে কেবল কিছু তথ্যের সংগ্রহ নয়, তা যে আমাদের সম্মিলিত, যৌথ অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সংশ্লেষ, আমাদের জনসাধারণের সঞ্চিত অনুভব ও জ্ঞানের খনি, যা থেকে ধৈর্য ও যত্নসহকারে সম্পদ আহরণ করতে হয়।
আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় খাকসার, আহরার, খুদাই খিদমদগার, মােমিন প্রভৃতি মুসলিম সংগঠনকে নিয়ে বিশেষ আলােচনা বা অনুসন্ধান হয়নি, যারা দেশভাগের তীব্র বিরােধিতা করেছিল। ফলে দেশভাগ পর্যন্ত মুসলিম লিগের ভূমিকাই কেবল আলােচিত হয়ে এসেছে। কিছু প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, যার উত্তর খোঁজা দরকার। যেমন জিন্না ও তার মুসলিম লিগ যখন ১৯৩৭ সাল থেকে কেবল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানিয়েছেন, কংগ্রেসকে সেখানে এক সঙ্গে দুটি ফ্রন্টে লড়তে হয়েছে ব্রিটিশ ও মুসলিম লিগ। যদি খাকসার বা আহরারদের মতাে সংগঠনকে (যারা দেশভাগ ও ব্রিটিশ উভয়েরই বিরােধিতা করে) কংগ্রেস নেতৃত্ব একটি বৃহত্তর মাের্চায় টেনে আনতে পারত, তবে কী হত? অবশ্য সে সময় অত্যন্ত দ্রুত গতিতে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল এবং হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ মাের্চা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে।
এই সব প্রশ্নই আমায় ভাবায়— কেন ১৯৪৭-এ দেশভাগ এড়ানাে গেল না? কিংবা যে ভাবে ভাগ হল, তা কি অনিবার্য ছিল? আমার অবশ্য সে সময়কার পরিস্থিতিগত বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে কোনও গভীর জ্ঞান বা অনুসন্ধান নেই, নিতান্তই ভাসা-ভাসা কিছু ধারণা আছে। ষাট বছর হয়ে গেল, তবু এখনও বিংশ শতাব্দীর উপমহাদেশের ইতিহাসে ওই ঘটনাটিই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এখন স্বাধীন রাষ্ট্র, নিজের-নিজের অর্থনীতি ও সমাজের নির্মাণে নিয়ােজিত। তবু আমরা সকলেই দেশভাগের সন্তান, ১৯৪৭-সালের তৃতীয় ত্রৈমাসিক অবধি যারা এক সঙ্গেই ছিলাম।
৪২৩
প্রশ্ন জাগে আজ তিনটি পৃথক সত্তায় বিভক্ত হয়ে থাকলেও সত্যিই কি আমরা পরস্পর থেকে ততখানিই ভিন্ন?
দার্শনিক মর্তে তঁার ‘এসেজ’-এর ‘অব এক্সপিরিয়েন্স’ প্রবন্ধে যেমন বলেছেন, প্রশ্ন বুনতে থাকলে এই বিশ্ব অনিশ্চয়তায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তার এই প্রজ্ঞার সঙ্গে ভিন্নমত পােষণ করা কঠিন, কেননা অনেক রকম ব্যাখ্যা সত্যকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আমাদের সত্যটি ঠিক কোথায় লুকিয়ে রয়েছে ?
সতত সত্যের অন্বেষণে নিরত গাঁধীও দেশভাগের মধ্যে এক হৃদয়বিদারক কাণ্ড খুঁজে পান। ১৯৪৬-এর সেই দুর্ভাগ্যজনক বছরে নােয়াখালিতে একটি চিরকুটে তিনি পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলেন: “আমি একজন ব্যর্থ মানুষ হয়ে মরতে চাই না, কিন্তু, কে জানে, আমি হয়তাে ব্যর্থই।” (গােপালকৃষ্ণ গাঁধী সম্পাদিত ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত (২০০৮) দি অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া গাঁধী, পৃ ৬১৫) জিন্নাও শােচনীয় ভাবেই ব্যর্থ হন, দেশভাগের এক বছরের কিছু পরেই তার জীবনও নিঃশেষিত হয় (১৪ অগস্ট ‘৪৭ থেকে ১১ সেপ্টেম্বর ‘৪৮)। তাঁকেও একটি পােকায়-কাটা পাকিস্তান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় এবং সেটাকেও তিনি কোনও কার্যকর রাষ্ট্রের চেহারা দিতে পারেন না, মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার অসম্ভব তত্ত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ রূপে প্রতিষ্ঠা করা তাে দূরস্থান। পরিণতিতে ভারত, পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের খণ্ডিত ভূখণ্ডগুলি এমন একটা উপমহাদেশ তৈরি করে, যা আমাদের সকলের শান্তি হরণ করে নেয়। এই অবস্থাই কি বরাবর চলবে? যদি চলে, তবে তার চেয়ে বিপর্যয়কর আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আমরা কি সে বিপর্যয় ঠেকানাের মতাে উপাদান সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি? আমার মনে হয়, ক্রমাগত নিজেদের প্রশ্ন করে এবং আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আত্মানুসন্ধান করেই একমাত্র আমরা অতীত বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারি।
মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতি?
এ জন্যই প্রশ্নগুলাে উঠছে— কেন দেশ ভাগ? এবং মুসলিমরা কি একটি স্বতন্ত্র জাতি? প্রশ্নগুলাে মাত্রই একশাে বছরের পুরনাে (সিমলা ডেলিগেশন, ১৯০৬)। সেই বৈঠকেই পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি তােলা হয় এবং সেটাই পরবর্তী কালে হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র জাতীয়তার দাবি, যার ভিত্তিতে মহম্মদ আলি জিন্না সেই আপাত-অসম্ভব ধারণাটিকে জনপ্রিয়তা দেন— মুসলিমরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। ১৯৪৭-এর ১৪ অগস্ট সেই জাতির জন্ম হয়। ক্রমাগত বিষয়টির উপর জোর দিতে দিতে জিন্না দাবিটিকে প্রায় তত্ত্বের বৈধতা দেন। কিন্তু পাকিস্তানের জন্ম কি তার সেই তত্ত্বকে প্রমাণ করেছে? না কি বাংলাদেশের জন্ম জিন্নার সেই তত্ত্বকেই নাকচ করেছে? এ ধরনের প্রশ্ন বা সংশয়গুলি সহসা চলে যাওয়ার নয়। আরও একটু গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করা যায়, জিন্নার মৃত্যু কি তার স্বতন্ত্র
৪২৪
মুসলিম জাতীয়তার ধারণাটিকেও ফাপা করে দেয়? ওই তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান কি ধারণাটির আদি সারমর্মের অনুরূপ হয়েছিল? জিন্নার যাত্রা কি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে-সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়? না কি এই ধারণাটির অতীত আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়তিরও নির্দেশক? | তার জীবনের শেষ দিকে (১৯৪০-৪৭) জিন্না অবিভক্ত ভারতের সমগ্র মুসলিম সমাজের কেবল স্বঘােষিত নেতা নন, প্রকৃত নেতাই হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু হিন্দু মুসলিম ঐক্য এবং ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তির সংগ্রামের প্রতি সার্বিক দায়বদ্ধতা দিয়ে। সে সময় তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ ভারতের প্রবক্তা ছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি যখন মুসলিম জাতীয়তার প্রবক্তা হলেন, তখন ভারতকে ভিতরে-বাইরে বিভক্ত করার মধ্য দিয়েই সেই জাতীয়তা হাসিল করতে চাইলেন। কিছু দিন জিন্নার সচিব ছিলেন যে এম আর এ বেগ, তিনি লিখেছেন, “ইসলাম সে ভাবে তার চিন্তার মধ্যে স্থান পায়নি। একই জাতিসত্তার কিছু মানুষ কেবল ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে কী ভাবে স্বতন্ত্র জাতীয়তা হয়ে উঠতে পারে, সেই প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দিতেন মার্কিনদের উদাহরণ দিয়ে, যা প্রমাণ করে, জাতীয়তাবাদ সর্বদাই একটি বিষয়ীগত ধারণা। মুসলিমরা যদি নিজেদের একটি জাতি মনে করে, তবে সেই মনে হওয়াটাই তাদের জাতীয় স্বাতন্ত্রের পক্ষে যথেষ্ট।” এটা কেবল এক জন আইনজীবীর যুক্তি নয়, জিন্না তার এই বিশ্বাসের ওপর জোর দিতেন যে ধর্মীয় ঐক্যবােধ জাতীয়তার সংজ্ঞা হতে পারে। এই যুক্তির অনেক ফঁক-ফোকর আছে, কিন্তু জিন্নার কাছে এটাই ছিল একমাত্র মতাদর্শ, যা তিনি বর্মের মতাে পরিধান করেছিলেন। হিন্দু ধর্ম বা হিন্দু জনসাধারণ নয়, জিন্নার বিরােধিতা ছিল কংগ্রেসের প্রতি, যাকে তিনি মুসলিম লিগের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন এবং নিজেকেই মনে করতেন লিগ। ১৯৪৬-এ বাংলা ও বিহারে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন এবং এটাকে মুসলিমদের রক্ষায় কংগ্রেস সরকারের ব্যর্থতা বলে প্রচার করেছিলেন। মুসলিমদের লিগে যােগ দিতে প্ররােচিত করতে তিনি হিন্দু রাজ’-এর ভয় দেখাতেও পিছপা হননি। কিন্তু তার সঙ্গে আমার অসংখ্য কথােপকথনের স্মৃতি হাতড়ে হিন্দুদের বা হিন্দু ধর্মের প্রতি তার কোনও আক্রমণের কথা স্মরণ করতে পারছি না। পরবর্তী কালে প্রায় ঘৃণায় পরিণত হওয়া তার যাবতীয় বিরূপতা কেন্দ্রীভূত ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি।”[১]
মুসলিম সম্প্রদায় জিন্নার কাছে একটা নির্বাচকমণ্ডলী হয়ে ওঠে এবং মুসলিম জাতীয়তা তার রাজনৈতিক মঞ্চ। তিনি যে সব লড়াই লড়েন, সেগুলি ছিল কংগ্রেস বনাম লিগের আদ্যন্ত রাজনৈতিক লড়াই। “পাকিস্তানের রাজনৈতিক দাবি নিয়েই তিনি ও তার মুসলিম লিগ শাসন করতে পারতেন। ধর্ম এর মধ্যে নেহাতই ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়ে। তার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের সব উপাদানকেই পুষ্ট করে পাকিস্তান। পাকিস্তান হাসিল করার জন্য জিন্নার যেমন প্রয়ােজন ছিল, তেমনই জিন্নার সম্পূর্ণতার জন্যও পাকিস্তানের প্রয়ােজন ছিল।” জিন্নার সম্ভবত একমাত্র জীবিত প্রত্যক্ষদর্শীর এই মূল্যায়ন: “তুখােড় রণকৌশলে জিন্না মুসলিম সংহতির বিকাশ সংগঠিত ও ত্বরান্বিত
৪২৫
করেন। চতুর দরকষাকষি, ঠাণ্ডা মাথার যুক্তি, প্রবলতর প্রতিপক্ষের সামনেও নিঃশঙ্ক ও অকুতােভয়, নিজের ও প্রতিপক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকায় প্রতিটি সামান্য সুযােগকেও তিনি লিগের অনুকূলে সদ্ব্যবহার করেছেন। কংগ্রেস হাইকমান্ড তার সমূহ দক্ষতা নিয়েও জিন্নার একক চাতুর্যের সমকক্ষ হতে পারেনি। নিজের অনুরাগী-ভক্তদের এক সমাবেশে নিজের সম্পর্কে এক বার তিনি বলেন, আমি চরিত্রগত ভাবে এবং দীর্ঘ অভ্যাসে ঠাণ্ডা মাথার যুক্তিবাদী। এর চেয়ে ভালভাবে কেউ তাকে বর্ণনা করতে পারবে না।
“লিগে জিন্নাই সর্বেসর্বা। আগামী বছর ভারত স্বাধীনতা পাবে, ব্রিটিশের এই ঘােষণার মাসখানেক পরে আমি এটা লিখছি। এই কয়েক সপ্তাহে কোনও মুসলিম নেতা এই ব্রিটিশ ঘােষণার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। কেন? কারণ জিন্না মুখে কুলুপ এঁটেছেন, সম্ভবত কৌশলগত কারণেই এই মৌন। সংযুক্ত প্রদেশে লিগের বিধায়ক দলের উপ-নেতা আমাদের জানুয়ারিতে বলেন, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে কোয়ালিশন গড়ার পক্ষপাতী এবং তাকে দায়িত্ব দিলে তিনি রাজ্য দলকেও সেই সম্ভাবনার দিকে ঘুরিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু জিন্না যদি তার এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেন, তা হলে তার সঙ্গে একটা ভােটও থাকবে না।”[২]
পাকিস্তানে যে মুসলিমরা গেল না কিংবা যেতে পারল না, সেই দুর্ভাগাদের সমস্যাটাও স্বতন্ত্র জাতীয়তার তত্ত্বের ত্রুটি ধরিয়ে দেয়। তাদের কী হবে? তাদের জন্যও কি আবার একটা পৃথক জাতি’র তকমা দরকার হবে? সেই সময়ের ঘটনাবলির সংবেদনশীল পর্যবেক্ষক ও কথাকার এ জি নুরানি’র বই ‘দ্য মুসলিম অব ইন্ডিয়া লিখছে: “পরিস্থিতির মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যাবার পরেও অবিশ্বাস্য ভাবে মুসলিম লিগের কিছু ওজনদার নেতা ভারতীয় গণ-পরিষদে স্বতন্ত্র মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি তুলে বসেন। আর তাতেই অ্যাসেম্বলিতে মুসলিমদের প্রতি অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। এ থেকেই বােঝা যায় তখনকার ভারতীয় মুসলিমদের বিবেচনাবােধের অভাব এবং যােগ্যতাহীন নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা।”
নুরানির মতে, দোষটা জিন্নারই। পাকিস্তান নিয়ে আচ্ছন্ন জিন্না ভারতের সমগ্র মুসলিম সমাজকে বিকাশমান নতুন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করেননি। তখনকার এক বরিষ্ঠ মুসলিম নেতা মহম্মদ রাজা খান সখেদে লিখেছেন: ‘৪৭-এর জুলাইয়ের শেষাশেষি। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মুসলিম সদস্যরা জিন্নার সঙ্গে শেষ বারের জন্য সাক্ষাৎ করেন। এটা জিন্নার বিদায়-সম্বর্ধনাও বটে। করাচি চলে যাওয়ার জন্য তিনি তৈরি। অনেকেই ভারতে থেকে যাওয়া মুসলিমদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিলেন। এখানে তাদের ও মুসলিম লিগের ভবিষ্যৎ বিষয়ে পরামর্শ চাইলে জিন্না নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলতে চান না। শেষমেষ বলেন যে তারা তাে এত কাল তার নেতৃত্বে অনেক অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছেন, তার ভিত্তিতেই নিজেদের নীতি ও কর্মসূচি স্থির করে নিন। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন কাঠামে। তাদের নিজেদেরই সে সব স্থির করতে হবে। তবে জিন্না তাদের নিশ্চিত ভাবেই ভারতের প্রতি অনুগত থাকার উপদেশ দেন এবং
৪২৬
দু’নৌকায় পা দিয়ে চলার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে বলেন।[৪]
১৯৪৭-এর ১৫ ডিসেম্বর ভারতে থেকে যাওয়া মুসলিম লিগ নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করার একটা প্রস্তাব নেয়। গাঁধী তাদের নিরস্ত হতে এবং কংগ্রেস দলকে সমর্থন করতে পরামর্শ দেন। বিচক্ষণ পরামর্শ, এমনকী সােহরাওয়ার্দিও এতে সমর্থন জানান। দুর্ভাগ্যবশত মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সেই উচ্চতায় উঠতে ব্যর্থ হন, যা হতাশাগ্রস্ত, বিভ্রান্ত মুসলিম সমাজকে নেতৃত্ব দিতে পারে। ২৩ অক্টোবর জামা মসজিদে সেই বিখ্যাত ভাষণে তিনি তার পরামর্শ উপেক্ষা করে জিন্নার পিছনে ছােটার জন্য মুসলিমদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তিরস্কার করতে থাকেন: “আমি তােমাদের আহ্বান জানিয়েছিলাম, তােমরা সে দিন আমার জিভ কেটে নিয়েছিলে।”
গণ-পরিষদে মুসলিম লিগের সে সময়কার নেতারা উন্মাদের মতাে মুসলিমদের জন্য কেবল সংরক্ষিত আসনেরই আব্দার তােলেননি, পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবিও জানিয়েছিলেন। এতে ক্ষেপে গিয়ে সর্দার বল্লভভাই পটেল এমন কিছু মন্তব্য করেন, যা হয়তাে না করলেই ভাল হত। কিন্তু সদ্য-সদ্য হওয়া দেশ ভাগের ক্ষত তখনও শুকোয়নি, এই দাবি নতুন করে সেই ক্ষতে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে দিল। ক্ষোভে ও বেদনায় সর্দার বলে ওঠেন “এ দেশে যা ঘটেছে, তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও অনুভবের পরও ওদের (মুসলিমদের) মনােভাবে কোনও পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না, অন্তত ওদের। আনা এই সংশােধনী থেকে সেটাই মনে হচ্ছে। তবে ওরা যে মুসলিম লিগের নির্দেশেই এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। ওদের জন্য আমার দুঃখ হয়। আজ বাইরের কারও হুকুমে চলার সময় নয়, নিজেদের বিবেক অনুযায়ী চলার এবং দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করার সময়। কোনও জনগােষ্ঠী বা সম্প্রদায় যদি মনে করে যে তার স্বার্থ তার দেশের স্বার্থের চেয়ে আলাদা, তবে তারা বিরাট ভুল করবে। ধরে নেওয়া যাক, আজ আমরা আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব মেনে নিলাম, সে ক্ষেত্রে আমিই হয়ে উঠব একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এ কাজের পরিণামের জন্য দায়ী মুসলিমদের বৃহত্তম শত্রু।….. যারা সংখ্যাগুরুদের ওপর আস্থা রাখে না, তারা স্বভাবতই সরকারে আসতে পারবে না।…সেই অনুযায়ীই সরকারে তােমাদের কোনও অংশীদারিই ধার্য হবে না। তােমরা নিজেরাই নিজেদের বাইরে রেখে দেবে এবং চির কালের জন্য সংখ্যালঘুই থেকে যাবে। এতে তােমাদের কী লাভ হবে?”
এ জন্যই কি এই ইতিবৃত্তের মধ্যে নিহিত এত বিরাট হতাশা আর বেদনা? সম্ভবত। সম্ভবত আজও আমরা সেই যুগান্তকারী সময়ের ভ্রান্তিগুলাের পুনরাবৃত্তি করে চলেছি। সংখ্যালঘুত্বের কথাই যদি ধরা যায়, এমজে আকবর তার বই ‘দ্য মেজর মাইনরিটি’-তে চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন:
“গত হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলিমরা ঠিক কোন সময় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছিল? প্রশ্নটি নিতান্তই আলঙ্কারিক। কারণ মুসলিমরা এই উপমহাদেশে কখনওই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু ভারতীয় মুসলিমরা কি মুঘল শাসনের সময় নিজেদের সংখ্যালঘু মনে করতাে? ….ব্রিটিশ আমলেও তার সবচেয়ে শক্তিশালী
৪২৭
মুসলিম রাজ্য হায়দরাবাদে মুসলিমরা ছিল জনসংখ্যার মাত্র ১১ শতাংশ। ৮৪ শতাংশ ছিল হিন্দু। কিন্তু মুঘল প্রশাসক নিজাম-উল-মুলকের বংশধররা যখন ১৭২৩ সালে স্বাধীন হায়দরাবাদ রাজ্য গড়ে শাসন কায়েম করল, তখন মুসলিমরা কি নিজেদের সংখ্যালঘু মনে করত? না, করত না। আসলে সংখ্যালঘুত্বটা শেষ বিচারে সংখ্যার ব্যাপার নয়, এটা ক্ষমতায়নের সংজ্ঞা মাত্র। যত দিন মুসলিমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে একাত্ম বােধ করেছেন, অর্থনৈতিক সুযােগসুবিধা এবং আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত থেকেছেন এবং তাদের ধর্মাচরণের স্বাধীনতা (আমন-ই-আওয়াল) অক্ষুন্ন থেকেছে, তত দিন জনসংখ্যার লঘু-গুরুত্ব তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক ছিল।” সে জন্যই সে সময় তারা সংখ্যালঘুর মনস্তত্ত্বে আক্রান্ত হননি। অথচ, আকবর লিখছেন, “সেই মুসলিমরাই ১৯৪৮ সালে নিজাম গদিচ্যুত হয়ে হায়দরাবাদ ভারতীয় ইউনিয়নে সংযুক্ত হওয়ায় নিজেদের সংখ্যালঘু ভাবতে শুরু করে দিলেন।” কেন?
এই সংখ্যালঘু-মনস্তত্ত্বের মধ্যেই নিহিত ছিল দেশভাগের বীজ, যার আগাছা ক্রমে অপ্রতিরােধ্য গতিতে ছড়িয়ে পড়ে ঐক্যবদ্ধ ভারতের গােটা ইমারতটিতেই ফাটল ধরিয়ে দেয়। জিন্নার দাওয়াই ছিল বিভাজন, যা পরে নেহরু, পটেল এবং কংগ্রেসের অন্যরাও নিরুপায় হয়ে মেনে নেতে বাধ্য হন। কিন্তু সংখ্যালঘুর মনস্তত্ত্ব ভারতে থেকেই যায় এবং আজ এটা আরও জোরালাে, আরও তীব্র। কারণ আজ এই মনস্তত্ত্বকে শিরােধার্য করার ঐতিহাসিক নজির সামনে রয়ে গেছে, যা অনুসরণ করা সাংবিধানিক বিধান রূপায়ণের চেয়েও অগ্রাধিকার পায়। এই মনস্তত্ত্ব আত্মঘাতী। তবু আমরা এই মর্ষকামে পীড়িত হতে দ্বিধান্বিত নই। পাকিস্তানে সংখ্যালঘুত্বের সংকীর্ণ ছক নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে, বাংলাদেশেও তা-ই, যদিও অবিভক্ত বাংলার হিন্দুরা রাজ্যকে ভাগ করতে সম্মতি দিয়েছিলেন। এই সব কিছুর মধ্যে কি কোনও মীমাংসাসূত্র পাওয়া গেল? আমি অন্তত কোনও সূত্র পাই না। ১৯৪৭-এর দেশভাগের গােটা পর্বটাই স্ববিরােধিতায় ভরা, যা উত্তরের চেয়ে বেশি প্রশ্নের জন্ম দেয়।
ইসলাম ও জাতীয়তার ধারণা
প্রয়াত গিরিলাল জৈন তার গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘দ্য হিন্দু ফেনােমেনন’-এ লিখেছেন: “কিছু মুসলিম পণ্ডিত মুসলিম রাষ্ট্র থেকে ইসলামি রাষ্ট্রের ধারণাটির বৈধতাকে প্রশ্ন করেছেন। প্রথমটি একটি আদর্শগত প্রস্তাব, যেহেতু ইসলামের ইতিহাসে কখনও কোনও মুসলিম রাষ্ট্র ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে ওঠেনি, কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্র তার বিগত চৌদ্দশাে বছরের ইতিহাসে অনেক গড়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭৯ সালে ইরানে খােমেইনির নেতৃত্বে বিপ্লবের পর কোরান ও হাদিশের ভিত্তিতে একটি ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার বিষয়টি নিয়ে
৪২৮
বিশ্বময় বিতর্ক হয়েছে।[৮]
তথ্য হিসাবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মুসলিম দুনিয়ায় ক্ষমতা দখলের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইতিহাস দেখেছে, তা কোনও অংশে অন্যান্য ভুবনের দ্বন্দ্বের চেয়ে কম হিংস্র ও অনৈতিক নয়। মুসলিম শাসকরা প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে অন্য রাজাদের। মতােই স্বার্থপর ও সম্ভোগপরায়ণ থেকেছেন। “কিন্তু এই সব তথ্যকে তাদের যথাযথ প্রেক্ষিতে স্থাপন করতে হবে। বুঝতে হবে, ইসলামি সমাজের ভিত্তি যে মােল্লাতন্ত্র থেকেই এসেছে, এ কথা তত সত্য নয়, বরং এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আল্লাহর অনিবার্য উপস্থিতি। গাই ইটন তার ইসলাম অ্যান্ড দ্য ডেস্টিনি অব ম্যান’ বইয়ে এটাই বলতে চেয়েছেন।”[৯] এই গুরুত্বপূর্ণ ও সূক্ষ্ম পার্থক্যটি ইসলাম বিষয়ক অধিকাংশ রচনায় উপলব্ধ নয়।
সামাজিক ক্রিয়াকলাপে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা তুলনামূলক ভাবে আধুনিক ঘটনা। প্রাচীন সমাজ রাষ্ট্রকে এক অশুভ কিন্তু প্রয়ােজনীয় শক্তি বলেই গণ্য করেছে, কেননা উপজাতীয় সংগঠন দিয়ে আর এত বিপুলায়তন, ক্রমবর্ধমান জনগােষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। “হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি অধিকাংশই স্বীকার করেন। স্বনিয়ন্ত্রিত জনগােষ্ঠী হিসাবে হিন্দুরা কখনওই রাষ্ট্রের উপর খুব একটা নির্ভর করেনি। আর সে জন্যই তারা বিদেশি শাসনের দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বহুলাংশে বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছে।”
মুসলিমদের ক্ষেত্রে সব রকম কর্তৃত্বই আল্লাহতে নিবদ্ধ, তার বাইরে কোনও কিছুরই অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারে না। তাই মানবসমাজের একমাত্র আইনপ্রণেতাও তিনিই। গাই ইটনকে উদ্ধৃত করে বলা যায়- কোরানে বলা হয়েছে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনও দেবতা নেই। তার অনুসরণে বলা যায় ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনও আইনপ্রণেতাও নেই। এ জন্যই মুসলিমদের সব আইন-কানুনই কোরান ও পয়গম্বরের সুন্না থেকে উঠে আসতে হবে। গত চোদ্দোশাে বছর ধরে সেটাই হয়ে এসেছে। নানা রাজনৈতিক উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে গেলেও এটাই মুসলিম উম্মাকে ঐক্যবদ্ধ করে রেখেছে। ওই একই কারণে ধর্মতত্ত্ব নয়, আইনবিজ্ঞান তথা ব্যবহারশাস্ত্রই থেকেছে ইসলামি বিদ্বজ্জনের জ্ঞানচর্চার প্রধান বিষয়।
ইসলামে বিতর্কের প্রধান বিষয় তাই রাষ্ট্রকে কী ভাবে ধর্ম থেকে আলাদা করা যায়, তা নয়, বরং সমাজকে আদৌ ধর্ম থেকে আলাদা করা যায় কিনা, তাই নিয়ে। দ্বিতীয় তর্কটির উত্তর যেহেতু জোরালাে ভাবে নেতিবাচক, তাই প্রথমটির উত্তরও নেতিবাচক। যে সব পণ্ডিত দ্বিতীয় প্রশ্নটি না করে কেবল প্রথম প্রশ্নটি তােলেন, তারা ঘােড়ার আগে গাড়িকে জুতে দেওয়ার প্রমাদের শিকার। ইসলামের এই সামগ্রিকতার জন্যই আধুনিক মন তাকে অবধান করতে পারে না। ইসলামি সমাজ ইসলাম ধর্মের গভীরে প্রােথিত, এবং এর বিপরীতটা সত্য নয়। এটা খুব ভাল ভাবে বুঝে নেওয়া দরকার যে ইসলামি সমাজকে যার নিরিখে সচরাচর বিচার করা হয়, সেই খ্রিস্টীয় সমাজের সঙ্গে কিন্তু এর তুলনা চলে না। মহম্মদের মতাে যিশু তার অনুগামীদের কোনও আইন-বিধি
৪২৯
দিয়ে যাননি, খ্রিস্টানরা সে সময় প্রচলিত রােমান আইনই অনুসরণ করেছেন। সংকীর্ণ অর্থে ধর্মীয় কিছু ধারণা ছাড়া খ্রিস্টানরা তাদের গ্রিক-রােমান ঐতিহ্য থেকে খুব একটা সরেননি, তার অনুগমনই করেছেন। কিন্তু ইসলামি আইন-বিধি আবার প্রাক-ইসলামি আরব ঐতিহ্যে প্রােথিত নয়, তার উৎস একান্ত ভাবেই কোরান এবং পয়গম্বরের সুন্না। প্রাক-ইসলামি কিছু উপাদান আহরণ করলেও ইসলামি সমাজ কিন্তু একটা সম্পূর্ণ নতুন ‘সৃষ্টি, খ্রিস্টান সমাজ যা নয়। (সনাতন ধর্ম, যাকে ঢিলেঢালা ভাবে হিন্দু ধর্ম বলা হয়, সেটাও ইসলামের মতােই এক সামগ্রিকতা, তবে এখানে তা নিয়ে আলােচনার অবকাশ নেই)।
ইসলাম যখন আরবের রুক্ষ ভূমি পেরিয়ে সম্প্রসারিত হতে শুরু করল, তার শাসকরা বাইজান্টিনীয় ও সাসানি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার আত্মস্থ করতে বাধ্য ছিল। এবং তারা সহজেই ওই দুই সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করল। আজ আমরা যে গৌরবময় মুসলিম সভ্যতার প্রশংসা করি এবং মুসলমানরা যাতে গর্ব বােধ করেন, তা কিন্তু ওই অ-ইসলামি প্রভাবেরই পরিণাম।
এই সভ্যতার একটা দিক খুব বেশি লােকের মনােযােগ আকর্ষণ করেনি। সেটা হল, এই সভ্যতা কিন্তু এক দিকে এক পার্সি-প্রভাবিত, উচ্চ মার্গের ভােগবাদী, অভিজাত সমাজ ও অন্য দিকে, তার বিপরীতে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলমানের দুটি পৃথক শ্রেণি সৃষ্টি করে। সংহতির উপর ইসলামের জোর সত্ত্বেও সেই দুই সমাজের ব্যবধান এখনও ঘােচেনি। ইসলামের পক্ষে এই দ্বন্দ্ব মারাত্মক হতে পারত, যদি অ্যারিস্টটলীয় যুক্তিবাদ অনুসরণ করে ইসলামি দর্শন রাষ্ট্রকে সমাজ নিয়ন্ত্রণের সেই ক্ষমতা দিত, যে ক্ষমতা আজ তার করায়ত্ত হয়েছে। ইসলামি সভ্যতা টিকে যাওয়ার কারণ হল, তার ইতিহাসের এক সুদীর্ঘ কাল ধরে রাষ্ট্র কেবলই একটি প্রান্তিক শক্তি থেকেছে।
ইসলামে উলেমাদের সর্বজনবােধ্য লৌকিক বিধান এবং সুফিদের মতাে দীক্ষিতদের গুহ্যবিদ্যার বিরােধ উপেক্ষার বিষয় নয়। একাদশ শতাব্দীর ইরানের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত আল গাজ্জালি সুফি দর্শনের সঙ্গে শরিয়তকে একাত্ম করতে বহু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার পক্ষেও কাজটা দুরূহ ছিল। যা হােক, এই চমৎকার বিষয়টির বিশ্লেষণ ছেড়ে এ বার আবার আমাদের জিন্নার প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হবে।
দেশ-ভাগ ও ভারতে তার জের
প্রথমে দুটি ভাগ, এবং পরে পাকিস্তান বাংলাদেশে ভেঙে যাওয়ায় তিনটি ভাগে উপমহাদেশের বিভাজনের জের চলতে থাকে। অচিরেই বিভাজিত দেশগুলি বিভাজনের আবশ্যকতা নিয়ে পুনর্বিবেচনা শুরু করে। দেশভাগের অন্যতম প্রধান কারিগর, বস্তুত ওই বিভাজনের খসড়া-রচনাকারী নেহরু অচিরেই নিজের ভাবনা ও কাজ নিয়ে প্রশ্ন
৪৩০
তুলতে শুরু করেন। জিন্না তার পাকিস্তান সৃষ্টির এত অল্প দিনের মধ্যে মারা যান যে, আত্মসমীক্ষা বা কৃতকর্মের বিশ্লেষণের কোনও অবকাশই তার ছিল না। তবে কী করেছেন, তার যথার্থ হদিশ তিনিও ওটুকু সময়ের মধ্যেই পেতে শুরু করেছিলেন।
একের পর এক বিভাজন ভারতের মানসিকতায় এক অনপনেয় ছাপ ফেলে যায়। ‘৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের বাবরি মসজিদ-কাণ্ড উপলক্ষে একটি আলােচনাচক্রে বশিরুদ্দিন আহমদ বলেন: “আমি আরও একবার শুরুর দিনগুলােয় ফিরে যেতে চাই। সব সময় অতীতের জের টানা খুব সহায়ক নাও হতে পারে, তবে আজ সেই অতীতের কথা তুলেই প্রশ্ন করতে হয়, কেন ৬ ডিসেম্বর আদৌ ঘটল? উত্তরটা আগেও দিয়েছি, আবারও বলছি, ৬ ডিসেম্বর ঘটল, কারণ জাতীয় আন্দোলনের একটা কৃত্য অসমাপ্ত ছিল। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ বলতে কী বােঝায়, আমার ধারণা, সেই প্রশ্নটিরও এখনও ঠিক উত্তর মেলেনি।
..আমার এই মন্তব্যের জন্য কেউ আমার সমালােচনা করতে পারেন। তবে আমার ধারণা, এই জাতীয়তাবাদ যে ভাবে বিবর্তিত হচ্ছিল, তা সাংস্কৃতিক ভাবেই হিন্দু। মাঝপথে সেই অগ্রগতির স্বাভাবিক যাত্রাপথ রুদ্ধ হয়। অ্যাডহক ভিত্তিতে সমস্যা সমাধান করার একটা দুশ্চেষ্টা এ সময় প্রবল হয়ে ওঠে। এক বার দেশ-ভাগ হয়ে গেলে পরিস্থিতি এতটাই পাল্টে যায় যে, কোনও সুস্থ রাজনৈতিক বিতর্ক চালানােই কার্যত অসম্ভব হয়ে ওঠে। সেটা ছিল আগুন নেভানাের সময় এবং দেশের কর্ণধার তখন ছিলেন আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণার প্রতি দায়বদ্ধ পণ্ডিত নেহরু। তাতে কোনও দোষ নেই, আমি নিজেও একই মতাদর্শে বিশ্বাসী। আমিও ভারতকে একটি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দেখতে চাই। কিন্তু নেহরুর ওই প্রবল উপস্থিতি, তার অপরিসীম। প্রভাবও সমস্যা সমাধানে সফল হয়নি। সমস্যাটাকে জিইয়ে রাখা হয়। কিন্তু অনন্ত কাল তা সম্ভব নয়। এক বার দেশের সামাজিক রূপান্তর ঘটতে শুরু করায়, শহরেগ্রামে বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত জনসাধারণ শিক্ষিত হতে থাকায় জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে অসমাপ্ত বিতর্কটি সামনে নিয়ে আসা যেত। দেশ-ভাগ তাে সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী মঞ্জুর করারই পরিণাম। তাই আজ ‘মুসলিম আত্মপরিচয়’, ‘মুসলিম ক্ষোভ’ বাড়ার কথা অতীতের সেই বিভেদপন্থী রাজনীতির প্রক্রিয়াকেই মনে পড়িয়ে দেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলিম বিক্ষোভ’-এর কোলাহলে চাপা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি জরুরি প্রশ্ন যে ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শে তাদের আস্থা ও অবদান কতটা। কারণ সবাই এখন ভােট সংগ্রহে ব্যস্ত।”
নেহরু তঁার ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’য় ‘৪৭-এর আগের পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে। ১৯৪৪ সালে লিখছেন— জিন্নার চিন্তাভাবনা ধর্মের সঙ্গে জাতিকে এক করে ফেলে। আজকাল কিন্তু ও ভাবে কেউ ভাবে না। তবে ভারতকে একটি জাতি বা দুটি জাতি বা অনেক জাতি বলে বর্ণনা করা হবে কি হবে না, তাতেও কিছু যায়-আসে না, কেননা জাতীয়তার আধুনিক ধারণার সঙ্গে রাষ্ট্রীয়তার কোনও সম্পর্ক নেই। ভারতে আমরা অতীতের ঘটনা ও মতাদর্শ থেকে ধার করা অপ্রাসঙ্গিক স্লোগান
৪৩১
ও ছকে-বাঁধা প্রবচন দিয়ে বর্তমানের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা ও নিরাসক্ত বিচারের প্রাসঙ্গিকতা নষ্ট করতে পারদর্শী। ভাসা-ভাসা অগভীর ধারণা ও অনির্দিষ্ট অবাস্তব ভাবনার মায়াজাল অলস আবেগ উশকে তােলার পক্ষে সহায়ক হলেও তা স্বচ্ছ চিন্তা ও বিশ্লেষণের পরিপন্থী। সম্প্রতি ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তার ঐক্য ও বিভাজন নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। কিন্তু যারাই দেশ-ভাগ ও পাকিস্তানের প্রস্তাবক, তারা কিংবা তাদের বিরুদ্ধবাদীরা সকলেই বিষয়টি নিয়ে অসম্ভব আবেগতাড়িত। এ যদি পাকিস্তানের অবিভাজ্যতার কথা বলে, ও তবে অখণ্ড হিন্দস্তানের কথা। গােষ্ঠীর আবেগ কিংবা যুথবদ্ধ অবচেতনই এখানে নির্ণায়ক। অথচ তথ্য এবং বাস্তব কেবল আবেগ ও অবচেতনের প্রতি সংবেদনশীল থাকতে বলে না।
নেহরু মনে করতেন, দেশ-ভাগ যদি অনিবার্যও হয়, তবু সেই বিভক্ত ভারতের বিভিন্ন অংশকে নানা ভাবে পরস্পরকে সাহায্য করতে হবে। পরে তিনি এর সঙ্গে যােগ করেন, বর্তমান সময় দেশের সামনে দুটি বিপরীত বিকল্প হাজির করেছে: অবিভক্ত ও স্বাধীন ভারত কিংবা বিভক্ত ও পরনির্ভরশীল ভারত। দুর্ভাগ্যবশত, নেহরু শেষ পর্যন্ত বিভাজন তথা দেশভাগেরই প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। ‘৪৭-এর ১৫ আগস্টের পর যে এ নিয়ে তার যাবতীয় দ্বিধা ও আক্ষেপ দূর হয়ে যায়, এমন নয়। এর পর পরই গাঁধী নিহত হন। দেশভাগের আগে-পরে ঘটে যায় অসংখ্য নিরীহ মানুষের দেশত্যাগ, খুন, লুঠতরাজ, মানবসম্পদের অভূতপূর্ব অপচয়। স্ট্যানলি ওলপার্ট তঁার ‘শেমফুল ফ্লাইট গ্রন্থে এই মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি সম্পর্কে মাউন্টব্যাটেনকে বলা নেহরুর কথা উদ্ধৃত করে লিখেছেন “আমার বা আর কারও পক্ষে গত এক বছরে আমরা কী করেছি, তার বিচার করা সম্ভব নয়। ঘটনাগুলাে এত টাটকা এবং আমরা তার সঙ্গে এত ওতপ্রােত ভাবে যুক্ত। হয়তাে আমরা অনেক গুরুতর ভুলভ্রান্তি করেছি আমরা এবং আপনারাও। দু’এক প্রজন্ম পরের ঐতিহাসিকরা হয়তাে বিচার করতে পারবেন, আমরা কতটা কী ঠিক করেছি, আর কতটা ভুল।… আমার বিশ্বাস, আমরা ঠিক কাজ করার চেষ্টা করেছি, তাই আমাদের অনেক অপরাধই ক্ষমার চোখে দেখা হবে।”[১২]
নেহরু কি ঠিক কাজ করেছিলেন? কিংবা মাউন্টব্যাটেন ? আমাদের মনে এ নিয়ে গভীর সংশয় রয়েছে। এবং আমাদের মূল্যায়ন তাদের প্রতি তত ক্ষমাসুন্দর নয়। গভীর দুঃখের সঙ্গে আমাদের বলতেই হবে যে, ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা থেকে ১৯৪৭-এর দেশভাগ পর্যন্ত সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা বাস্তববােধ, দূরদৃষ্টি, উদ্দেশ্যমুখিতা ও দৃঢ়চিত্ততার পরিচয় দিতে পারেননি। ১৯৪৮ সালের ৯ জুলাই ভােপালের নবাব সাহেব দেশভাগের সিদ্ধান্তে নেহরুর সম্মতি বিষয়ে প্রশ্ন করলে নেহরু তাকে চিঠিতে লেখেন: “এটা আমাদের ও পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য যে অশুভ প্রবৃত্তিগুলােই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। আমি আমার প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের অধিকাংশ সময়ই কিছু আদর্শের অনুসরণ করে কাটিয়েছি।… দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে তা করার পর সেই আদর্শগুলােই ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখে আমার যে মনােবেদনা হচ্ছে, আপনি কি তা অনুমান করতে পারেন?… আমি জানি যে এর অনেক কিছুর জন্য আমরা নিজেরাই
৪৩২
দায়ী।… দেশ-ভাগ অনিবার্য হলে আমরা এই আশায় তা সমর্থন করি যে হয়তাে সেই যন্ত্রণাদায়ক বিভাজনই শান্তি নিয়ে আসবে।… হয়তাে সেই ভাবনা ভুল ছিল। এখনই অৱশ্য এর বিচার করা যাবে না।… আবার সেই বিভাজনের পরিণাম এত মর্মান্তিক হয়েছে যে কেউ-কেউ ভাবতে পারেন, এর চেয়ে অন্য যে-কোনও পন্থাই শ্রেয় ছিল।… আমার সমগ্র ইতিহাসবােধ ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে বিদ্রোহ করে ওঠে।… এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি কোনও মতেই মেনে নেওয়া যায় না, সংঘাতও তাই তৈরি হচ্ছে। হয়তাে ভারত ও পাকিস্তানে যারা ক্ষমতাসীন, তাদের মূঢ়তাই এই সব সংঘাতের কারণ।… শেষ পর্যন্ত আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ যে ভারত ও পাকিস্তান এক দিন পরস্পরের কাছাকাছি আসবে… হয়তাে কোনও ধরনের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে… এ ছাড়া শান্তির কোনও রাস্তা নেই। এর একমাত্র বিকল্প হল যুদ্ধ।”[১৩]
অত্যন্ত খােলামেলা এবং আবেগার্ত একটি চিঠি, প্রায় স্বীকারােক্তির পর্যায়ে। এ ধরনের উত্তরচিন্তা, নিজের ক্রিয়াকলাপের কঠোর ও সৎ মূল্যায়ন এবং আত্মসমীক্ষা ছিল মানুষ হিসাবে নেহরুর বিরাট শক্তি এবং সদ্যস্বাধীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার বিরাট দুর্বলতা
যে দেশ-ভাগ আমাদের সকলের শান্তি হরণ করল।
ভােপালের নবাব সাহেবের কাছে নেহরু আশা প্রকাশ করেছিলেন, “দেশ-ভাগ হয়তাে আমাদের শান্তি দেবে।” তার আশা দুরাশাই প্রতিপন্ন হয়। ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলিমদের জন্য পৃথক বাসভূমির বন্দোবস্ত আমাদের সাম্প্রদায়িক বিরােধ মিটিয়ে স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা দেবে, এই চিন্তা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। শান্তি আমাদের বরাবরের জন্য ছেড়ে যায়। কী ভাবে? কেন ?
এ প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে জিন্নার অভিযান। কারণ মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার ভুয়াে তত্ত্বের বেসাতিই এই অশান্তি আবাহন করে আনে। এই তত্ত্ব প্রথমত জিন্নার নিজের অতীতকেই নাকচ করে। তিনি নিজে তাে ভারতীয় হয়েই জন্মেছিলেন। ভারতের মাটি, তার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিই তাকে গঠিত, বিকশিত করেছিল। ভারতীয় মুসলিমরা একটি পৃথক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওইটুকুই যা পার্থক্য। তারা কোনও স্বতন্ত্র জনগােষ্ঠী ছিলেন না, বিদেশাগত বা নৃতাত্ত্বিকভাবে পৃথক কোনও জাতিসত্তা ছিলেন না। যত দিন তারা ভারতের বিভিন্ন অংশ শাসন করেছেন, তত দিন তঁারা স্বেচ্ছায় ভারতীয় ছিলেন। তারপর ক্রমে, ধীর গতিতে তাদের শাসনক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে এবং এক দিন শেষ মুঘল সম্রাটের হাত থেকে সিংহাসন কেড়ে নেওয়া হয়। তাদের নিরাপত্তাহীনতা ও অনিশ্চয়তার বােধের সেই শুরু। তার পরে অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে, অবশেষে জিন্না এসে স্বাতন্ত্রের ভেরি বাজিয়ে দেন।
৪৩৩
মন্টফোর্ড সংস্কার সম্পত্তির মালিকদের পুরসভায় ভােট দানের অধিকার মঞ্জুর করলে মুসলিমদের সামনে একটা সুযােগ আসে। তারা সঙ্গে-সঙ্গে সেটা আঁকড়ে ধরেন। সংরক্ষণের দাবি দিয়ে শুরু হয় এবং তা মঞ্জুর হতেই মুসলিমরা একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বর্গ হিসাবে স্বীকৃতি পান। অতঃপর সংরক্ষণ থেকে বিশেষ শতাংশের হার, এক-চতুর্থাংশ থেকে এক-তৃতীয়াংশ কোটা ও অবশেষে সংখ্যালঘু অধিকার এবং যেখানে তারা সংখ্যাগুরু, সেখানে তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, তা থেকে পৃথক পার্টি এবং সেই পার্টির মঞ্চ থেকে পৃথক ভূখণ্ডের আন্দোলন। এমন নিরবচ্ছিন্ন ভাবেই মুসলিমদের দাবি-সনদ বিবর্তিত হতে থাকে। দেশ-ভাগ চাইতেই হত, কিন্তু কোন যুক্তিতে? নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক শৃঙ্খলা, শান্তির যুক্তিতে? এর মধ্যে কোন যুক্তিতে বিভাজনের তাগিদ দাঁড় করানাে যায় ? কোনওটাই নয়। তাই পৃথক জাতীয়তার তত্ত্ব হাজির করা হল। শােনামাত্র এই তত্ত্বকে অযৌক্তিক, ভ্রান্ত, অগ্রহণযােগ্য মনে হয়। তবু এই তত্ত্বটাই জনপ্রিয় হতে থাকল, পৌনঃপুনিক প্রচার মারফত মুসলিম সমাজমানসে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। যেন তত্ত্বটি এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে এর বিরােধিতা করা ঘাের অন্যায়। শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এবং ব্রিটিশ শাসকরা এত নিষ্ঠা ও ধারাবাহিকতার সঙ্গে ভারতকে বিভক্ত করার চেষ্টা করল যে, দেশটা ভাগই হয়ে গেল। বিভাজনের অন্তিম লগ্নটা এক নিষ্ঠুর, সৌজন্যবর্জিত সংখ্যা-বিনিময় হয়ে উঠল— তুমি এইটুকু নাও, তার বদলে আমাকে ওইটুকু দাও। এ ভাবেই এই মহান ও প্রাচীন ভূখণ্ডটির সংহতি টুকরাে হয়ে গেল। প্রথমে হিন্দু ও মুসলিমদের পৃথক কামরায় ভাগ করে তার পর তাদের কামরার দরজায় শক্ত করে খিল তুলে দেওয়া হল। পাকাপাকি করে দেওয়া হল দুই সম্প্রদায়ের পারস্পরিক বিদ্বেষ, ঘৃণা আর অবিশ্বাস। ঘরের ভিতরকার হিন্দুমুসলিম ঝগড়া আন্তর্জাতিক মঞ্চের ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হল। পাকিস্তানের কাছে ভারতের প্রতি স্থায়ী বিদ্বেষ ও আক্রোশই হয়ে উঠল তার রাষ্ট্রনীতির মূল মঞ্চ। এর অন্যথা হওয়ার জো ছিল না। ভারত-বিরােধিতা ছাড়া যে পাকিস্তানের অস্তিত্বই যুক্তিসঙ্গত, বৈধ হয় না।
মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে দাবি করা মহম্মদ আলি জিন্নার মৌলিক ভুল বলে আমি মনে করি। এ জন্যই পাকিস্তান সৃষ্টির পর দুই দেশ শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দে মিলেমিশে থাকবে, জিন্নার এই আশাও অন্তঃসারশূন্য এবং প্রতারণামূলক। তুলনায় জেনারেল জিয়া-উল-হক সত্যের অনেক কাছাকাছি। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। পাকিস্তানের নিরবচ্ছিন্ন ভারত-বিদ্বেষ নিয়ে। উত্তরে তিনি বলেন- ‘তুরস্ক বা মিশর যদি উগ্র ইসলামি ভঙ্গি গ্রহণ নাও করে, তবু তারা তুরস্ক ও মিশরই থাকবে। কিন্তু পাকিস্তান যদি আগ্রাসী ইসলাম অনুশীলন না করে, তা হলে তা আবার ভারতই হয়ে যাবে। ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্য চালানাের অর্থ ওই বিরাট দেশের আলিঙ্গনে পাকিস্তানের আবৃত ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়া। ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের সব নেতার মনেই এই আশঙ্কা সর্বদা মূর্ত থেকেছে। ‘৪৭-এর পর থেকে পাকিস্তানে কী কী ঘটেছে? জন্ম থেকেই সে দেশ চড়া তারে-বাঁধা
৪৩৪
নাটকীয় উত্থান-পতনে উতরােল। ইতিহাস, অতিকথা, মহৎ স্বপ্ন ও তা ঘিরে দেশবাসীর সেখানে তুঙ্গ আবেগ এবং বাস্তবসম্মত যুক্তিবাদের অনুপস্থিতি। পাকিস্তান-এর ধারণাটি প্রায়শই ছিনতাই হয়ে গিয়েছে, তার মিত্র’রা হয়ে উঠেছে তার প্রভু, আর দেশটি হয়ে পড়েছে নড়বড়ে, ভঙ্গুর, অনিশ্চিত, উত্তেজনাপ্রবণ। ভারত থেকে স্বতন্ত্র একটি জাতি হয়ে উঠতে গিয়ে সর্ব ক্ষণ সে নিজের ‘ইসলামি আত্মপরিচয় খুঁজে বেড়িয়েছে। স্বতন্ত্র মুসলিম জাতীয়তা থেকে ইসলামি রাষ্ট্র হয়ে ওঠার এই প্রক্রিয়ায় কোনও স্বাভাবিক বিবর্তন থাকেনি। ফলে পাকিস্তান একটি আধুনিক সফল রাষ্ট্র রূপেও বিবর্তিত হতে পারেনি, কোনও যুক্তিপূর্ণ জাতীয়তাবাদও তার ভিত্তি হয়ে ওঠেনি। ইসলামি রাষ্ট্র থেকে অনিবার্য ভাবেই পাকিস্তান একটি জেহাদি রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে, যা তাকে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের উর্বর সূতিকাগারে পরিণত করেছে। আল কায়দা, ওসামা বিন লাদেন, তালিবান ও অন্যান্য জেহাদি জঙ্গিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এখন পাকিস্তান।
পাকিস্তানকে তার জীবন শুরুই করতে হয় প্রশাসনিক নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হলেও ভারতের ধারাবাহিক আত্মপরিচয়ের সুবিধা ছিল, ছিল কার্যকর একটি প্রশাসনিক কাঠামাে এবং এই বিশাল ভূখণ্ডে ছড়িয়ে থাকা বিপুল জনসমষ্টি, যার বারংবার নানা অভিঘাত সহ্য করার ও আত্মস্থ করার ইতিহাস রয়েছে। পাকিস্তানের কিন্তু অনুরূপ কোনও সুবিধাই ছিল না। জন্মক্ষণ থেকেই তার সামনের চ্যালেঞ্জগুলাে তাই ছিল প্রবল দুর্লঙ্ঘ্য। হাজার হােক, ‘পাকিস্তান’ আদতে ছিল মুসলিম লিগের তরফে ব্রিটিশদের সঙ্গে দরকষাকষির একটি ধারণা মাত্র, একটি রণকৌশল। বিশেষ, যার প্রয়ােগ করা হয় ‘হিন্দু কংগ্রেস’-এর হাতে ছেড়ে না রেখে মুসলিমদের রাজনৈতিক-সামাজিক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায় করার লক্ষ্যে। তা ছাড়া, কেউই, এমনকী জিন্নাও পাকিস্তানকে কখনও সংজ্ঞায়িত করেননি, ইসলামের নামেই তার রব তােলা হয়েছে। তাই পাকিস্তানের স্বপ্ন যখন বাস্তব হয়ে গেল, কেউই তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে, কোন কোন বিষয়ই বা অগ্রাধিকার পাবে, তার কোনও আগাম মূল্যায়ন ছিল না। কারণ পাকিস্তানের চূড়ান্ত চেহারা কী হবে, সে সম্পর্কেও কারও ধারণা ছিল না। তবু ১৪ অগস্ট আর অপেক্ষা করতে পারেনি, জিন্নাও সময় চাননি।
দু’মাসেরও কম সময়ের মধ্যেই প্রদেশগুলিকে ভাগ করা হল, অসামরিক ও সামরিক বিভাগকে দ্বিধাবিভক্ত করার ছিল, সম্পদ বখরা করার ছিল। এই সময়সীমা পাকিস্তানের পক্ষে নিদারুণ সমস্যা সৃষ্টি করে, ভারতের মতাে উত্তরাধিকার সূত্রে যে কোনও রাজধানী বা সরকার পায়নি, পায়নি এমন আর্থিক সম্পদ যা দিয়ে দ্রুত প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে ফেলা যায়। উপরন্তু কোটিকোটি উচ্ছিন্ন শরণার্থীর সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তান-প্রবেশ এই শিশু রাষ্ট্রের ওপর ত্রাণ ও পুনর্বাসনের সমূহ বােঝা চাপিয়ে দেয়। এই সব কঠিন সঙ্কট থেকে শিশুরাষ্ট্রটির পরিত্রাণের একমাত্র রাস্তা ছিল দেশবাসীর নজর অন্য দিকে, ভারত-বিরােধিতার দিকে
৪৩৫
ঘুরিয়ে দেওয়া। দুর্ভাগ্যবশত, দেশীয় সমস্যা থেকে নজর ঘােরাবার এই মরিয়া প্রয়াস সে দিন বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি, এত কাল পরে আজও যেমন হয় না।
এখন, পিছনে তাকিয়ে মনে হয়, সে সময়েই ভারত কিছু ছাড়তে পারত, নিজের শরীরেরই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া টুকরােটার প্রতি আরও উদার হতে পারত। জানি, খুবই কঠিন কাজ ছিল সেটা। গােটা উপমহাদেশের ওই রক্তস্নান ও নৃশংসতা মানবিক সংবেদনশীলতাকে এমন অসাড় করে দিয়েছিল যে, উদারতা দেখানাে সহজ ছিল না। যে ভাবে ভূখণ্ডটিকে কেটে টুকরাে করা হয়, একটা গােটা প্রজন্মের মনকে যে ভাবে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া হয়, বহু কোটি মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেওয়া হয়, তাতে অন্যের প্রয়ােজনে নিজের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার উদারতা একটা অতিমানবিক মনুষ্যত্ব দাবি করে। অন্তত পাকিস্তানের জন্মলগ্নে পরিস্থিতি তেমনটাই ছিল। পাকিস্তান তার রাষ্ট্রীয়তার পথে যাত্রা শুরু করার সময় আগের একান্নবর্তী পরিবারের শরিকদের কোনও শুভেচ্ছা বা সম্পত্তি বণ্টনজনিত সাহায্যও পায়নি। বরং পারস্পরিক তিক্ততা ও শত্রুতা সম্বল করেই তাকে এগােতে হয়। এ অবস্থায় ভারত কি আর একটু সমব্যথী, সহমর্মী হতে পারত? এখন অবশ্য এটা নিছকই অ্যাকাডেমিক বিতর্কের বিষয়। পাকিস্তানের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানাে। তখন তার কোনও শিল্প নেই, কলকারখানা নেই। সে দেশে উৎপন্ন পাটকে বাজারজাত করার সব কারখানাই ভারতে। বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ পাটের উৎপাদক হলেও তা চটে পরিণত করে বিক্রি করার কলগুলি সব ভারতে। অমুসলিম উদ্যোগপতিরা সকলেই তাঁদের যাবতীয় সম্পদ নিয়ে পাকিস্তান ছেড়ে ভারতমুখী। পাকিস্তানকে মঞ্জুর করা আর্থিক সম্পত্তি ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে এবং তখনকার পরিস্থিতিতে সেই সম্পত্তির মসৃণ হস্তান্তরের সম্ভাবনাও দূরপরাহত।[১৪]
তা ছাড়া, একটি অখণ্ড পাকিস্তানের ধারণার ছায়ায় লড়লেও পাকিস্তান শুরু থেকেই একাধিক আত্মপরিচয়ে বিড়ম্বিত হতে শুরু করে। তার মধ্যে ভারতীয়তাও তাে একটি পরিচিতি। কেননা পাকিস্তানের প্রবক্তারা, তা আদায়ের জন্য আন্দোলনের নায়ক ও কুশীলবরা সকলেই তাে প্রথমে ভারতীয়, ভারতীয় হিসাবেই তাে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের কাছে তাঁদের ওই দাবির প্রতিষ্ঠা। সে ভারতীয় হিন্দু-নিয়ন্ত্রিত না হতে পারে, কিন্তু ভারতীয়তা তাে বটে। বস্তুত, ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এই জাতীয়তার সমস্যাটা একটা চমকপ্রদ সমস্যা। ভারতও এই পরিচয়ের সমস্যা থেকে মুক্ত নয়, পাকিস্তানি আত্মপরিচয়ের নানা দিক ভারতীয়দের মধ্যেও প্রকট হয়ে থাকে। বিশেষত যারা এক দিন, পাকিস্তানের জন্মের আগে আজকের পাকিস্তানেরই বাসিন্দা ছিল এবং সেখান থেকেই বয়ে এনেছে তাদের ভারতীয়তা। ভূগােলকে কে অস্বীকার করতে পারে?
পাকিস্তান-এর অন্য কয়েকটি আত্মপরিচয়ও আছে। এক সময় পাকিস্তান মুঘল রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের আধুনিক সম্প্রসারণ হিসাবে পরিচিত হতে চেয়েছে। কিন্তু এই চাওয়া তাদের বর্তমান ও ঐতিহ্যগত বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। মুঘলরা যে উত্তর
৪৩৬
ভারতের একটা অংশ সাড়ে তিনশাে বছর ধরে শাসন করতে পেরেছিল, তার কারণ তারা সে সময়ের অন্য প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি রাজপুতদের সঙ্গে শুরুতেই আঁতাত গড়ে নিয়েছিল। পাকিস্তান ব্রিটিশ রাজ-এর ঘরানায় ব্রিটিশ ভারতের উত্তরসুরি হতে গিয়ে উল্টো পথে চলে যায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবস্থায় যতটা ছিল, তার চেয়েও এখন পাকিস্তান আরও বেশি করে একটা ভাড়া দেওয়া রাষ্ট্র। মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক যােগসূত্র হওয়ার স্বপ্ন তার পূরণ হয়নি। আবার মধ্য এশিয়ার সীমান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তার নেই। সে বরং সেখানকার সন্ত্রাসবাদী গােষ্ঠীগুলির ‘আউটপােস্ট’ হয়ে উঠেছে।
একটি খণ্ডিত স্বাধীনতা
যে ভাবেই দেখা হােক না কেন, ব্রিটিশ রাজ-এর হাত থেকে পাওয়া ভারতের স্বাধীনতা একটি খণ্ডিত স্বাধীনতা। ‘৪৭-এ যে স্বাধীনতা আসে, তা জমি ও মানুষকে ভাঙা ও ছেড়ার যন্ত্রণায় অতিক্লিষ্ট। হিংসা, রক্ত ও আগুনে জর্জরিত সেই আখ্যান আমাদের এই সুপ্রাচীন দেশেও এক বিরল অভিজ্ঞতা। শত-শত বছর ধরে বাস করার পর নিজের দেশেই প্রবাসী হয়ে পড়ার, ভিটে ছেড়ে প্রকৃত প্রবাসকে স্বদেশ বানাবার যাত্রাপথে আবার সর্বস্ব খােয়ানাের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা কেবল তিক্ততা আর হতাশাই অবশিষ্ট রেখে দেয়।
যাঁরা এ ঘটনায় আন্তরিক ভাবেই অস্থির হয়েছিলেন, গাঁধী তাদের এক জন। নিজের জীবনসায়াহ্নে তার গলায় বাজল হতাশার সুর। “আমি এক জন ব্যর্থ মানুষ হিসাবে মরতে চাই না। কিন্তু হয়তাে আমি ব্যর্থই গণ্য হব।”১৫ গাঁধীর কাছে ব্রিটিশের কাছ থেকে পাওয়া এই ভাঙা-ছেড়া স্বাধীনতা তাে তাঁর ব্যর্থতাই বটে, কারণ এই স্বাধীনতা লাভ করার পথেই তিনি সারা জীবন ধরে প্রচার করা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে হারিয়েছেন। মাঝেমধ্যেই তার হতাশা ব্যক্ত হতে থাকে। “আমি দেশ-ভাগ না চাইলেও তা ঘটল। এটা আমাকে ব্যথিত করেছে। যে ভাবে এই দেশ-ভাগ করা হয়েছে, তা আমাকে আরও ব্যথিত করেছে।”[১৬]
কিন্তু এত জন মিলে সে সময় জাতীয় ঐক্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছিলেন যে, দেশভাগ এক রকম অনিবার্যই হয়ে ওঠে। সকলকেই সে সময় গ্রাস করে ক্লান্তি আর অবসাদ: ব্রিটিশ শাসককুল, নেহরু, জিন্না, এমনকী পটেলকেও। গাঁধী একা যদিও প্রথম থেকে এই বিভাজনের বিরােধিতা করে আসছিলেন, তত দিনে তিনি প্রায় এক নিঃসঙ্গ ধর্মযােদ্ধা, নিজেরই তৈরি করা কংগ্রেস পার্টি থেকে নিজেকে অনেকটা গুটিয়ে, দূরে সরিয়ে নেওয়া মানুষ। ভারতের স্বাধীনতা আদায়ের জন্য তার নিজেরই তৈরি সেই হাতিয়ার কংগ্রেসকে তিনি যেন আজ আর চিনতেই পারছেন না। তারই কংগ্রেস দেশ
৪৩৭
ভাগ শিরােধার্য করে নিচ্ছে এবং তার তৈরি সেনাপতিরাই তার সঙ্গে পরামর্শ না করেই তা করে ফেলছে, এ তার কল্পনাতীত।
এ বিষয়টি আমরা ইতিপূর্বেও একাধিক বার আলােচনা করেছি। তবু আরও এক বার জিন্নার সঙ্গে গাঁধীর সম্পর্কের স্পর্শকাতরতা ও উত্তেজনাময়তার উল্লেখ করতে হল। গাঁধী-জিন্নার সম্পর্কে যে কৌণিক মাত্রা ও তির্যকতা ছিল, জিন্না-নেহরুর সম্পর্কে তা তীব্র ও অসহিষ্ণু বিদ্বেষের চেহারা নেয়। এই বিদ্বেষ দেশ-ভাগেও প্রতিফলিত হয়, যেমন প্রতিফলিত হয় আমাদের প্রাপ্ত স্বাধীনতার খণ্ডতায়। নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস দেশভাগের প্রস্তাবে সম্মত হয়। অতএব সেই বাঁটোয়ারার আনুষঙ্গিক রক্তস্নানের দায়ও তাকেই নিতে হবে, যেহেতু তিনিই তখন সরকারের প্রধান হিসাবে শাসনক্ষমতায় আসীন এবং আইনশৃঙ্খলা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক স্থিরতা রক্ষার দায়িত্ব তখন তারই। সে দিন বয়ে যাওয়া রক্ত আজও হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষকে জমাট করে বেঁধে রেখেছে। এ জন্যই গাঁধী শেষ পর্যন্ত তাঁর বক্তব্যে ‘আগে স্বাধীনতা, পরে পাকিস্তান’ এই সূত্রে অবিচল থেকেছিলেন। জিন্না এতে সম্মত হননি। দুর্ভাগ্যবশত, নেহরুও একমত হননি। পটেলও মহাত্মাকে সমর্থন করেননি।
১৯৩৭ সাল থেকে ভারতীয় মুসলিমদের মুখ্য প্রবক্তা হয়ে ওঠা জিন্না স্বভাবতই ভারতীয় সার্বভৌমত্বের অংশীদারি চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের নীতি-নির্ধারক সংস্থায় দৃশ্যত মর্যাদার আসন। সেই আসন পেলে ভারতীয় মুসলিমরা পৃথক জাতীয়তার দাবি ছেড়ে দেবে, এ কথা তিনি বার বার বলেছেন। কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিমদের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্ব অর্জনই তার কাছে মুখ্য বিষয় ছিল। সেই সঙ্গে মুসলিম গরিষ্ঠতা সম্পন্ন পঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বাংলা এবং জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যগুলিতে লিগের প্রাধান্যও তাঁর কাম্য ছিল, যাতে হিন্দু-প্রধান রাজ্যগুলি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। নেহরু তা চাননি। তিনি অন্তত সে সময় তত কিছু সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদী ছিলেন না, যেমনটা নাকি তার সম্পর্কে প্রচারিত। তিনি সমানাধিকারের পাশাপাশি সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনেরই দাবি জানান, যার মূলে থাকবে অভিন্ন ও সমান নাগরিকত্ব। দেশভাগের পর অবশ্য এই অভিন্ন ও সমান নাগরিকত্ব কার্যকর করা কঠিন হয়ে উঠবে। কেননা তখন মুসলিম পাকিস্তানের উত্থান হয়ে গেছে। নেহরু এটা জানতেনও। সে জন্যই আবারও প্রশ্নটি উঠবে: এই দেশ-ভাগ কি এড়ানাে যেত না? এমন কোনও কারণ কি ছিল, যা দেশ-ভাগকে অনিবার্য করে তােলে ? থাকলে সেটা কী? না কি স্বাধীনতা-সংগ্রামে নিরত দেশনেতাদের সকলের সম্মিলিত ক্লান্তি ও অবসাদই সেই কারণ, যা তাদের খণ্ডিত স্বাধীনতার উপহার মাথা পেতে নিতে প্ররােচিত করে? দেশভাগের মূলে কি তবে প্রধান কারণ আমাদের আন্দোলনকারী দেশনেতাদের ক্লান্তি ? নিষ্ঠর এবং বেদনাদায়ক প্রশ্ন এ সব। কিন্তু প্রশ্নগুলাে তােলাও দরকার।
উত্তর নিয়ে মতভেদ স্বাভাবিক। পুরােপুরি বস্তুনিষ্ঠ, তথ্যনির্ভর উত্তর পাওয়াও কঠিন। মনে রাখতে হবে, আমরা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে তার বিশ্লেষণ করছি। তাই হয়তাে
৪৩৮
হাতছাড়া হওয়া সুযােগ নিয়ে এত সহজে বলতে পারছি। কিন্তু, যথাসম্ভব নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিচার করলেও মনে হয়, দেশ-ভাগ অনিবার্য ছিল না। সেটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে জিন্নার অনমনীয় জদের জন্য, মুসলিমদের জন্য তার একের পর এক নতুন-নতুন দাবি-সনদ তুলে ধরায়, স্বাধীন ভারতে তাদের জন্য ক্ষমতার আরও অংশীদারি নিশ্চিত করার অবিশ্রাম দরাকষিতে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পারস্পরিক মেজাজ-মর্জিও একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল। দেশ-ভাগকে নেতাদের রাজনৈতিক হিসেবনিকেশের পরিণাম হিসাবে দেখলে জিন্না ও নেহরুর পারস্পরিক অবিশ্বাসকেও এই প্রক্রিয়াকে পরিণামের দিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী করতে হবে।
বিরুদ্ধ মতটি হল, দেশ-ভাগকে কোনও একটি নির্দিষ্ট সম্পর্ক বা ঘটনাক্রমের পরিণাম হিসাবে দেখা উচিত নয়, কারণ সেটা হয়ে যাবে অতি-সরলীকরণ। মেজাজ, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র নিশ্চয় ভূমিকা নিয়েছে, বিশেষত নেহরু ও জিন্নার সম্পর্কের ক্ষেত্রে। কিন্তু এগুলিই একমাত্র কারণ হতে পারে না। দেশভাগের জন্য নেহরুকে দায়ী করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে তার স্কুল, অসংবেদী আচরণ, শিশুসুলভ ঔদ্ধত্য, কৌশলহীনতা। যে জিন্নাকে বিরূপ করেছে, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু শুধু এ জন্যই কি এত কাণ্ড ?১৭ যেটা নিশ্চিত করে বলা যায়, তা হল নেহরু নিজেকে সংযত করতে পারতেন না, সব সময় সংবাদপত্রকে এমন ভাবে তার বক্তব্য জানিয়ে দিতেন যাতে তা নতুন বিতর্ক ও বিরােধ জাগিয়ে তুলত, এবং ইতিপূর্বে বহু কষ্টে অর্জিত ঐকমত্য ধূলিসাৎ করে দিত। স্বাধীনতার আগে একাধিক বার এমন হয়েছে। দেশভাগের পরেও কয়েকটি গুরুতর মুহুর্তে এমন ঘটেছে, তবে সে সব অন্য প্রসঙ্গ। ১৯৪৩-এর শেষাশেষি আহমদনগর জেলে বসে লেখা তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে জিন্না সম্পর্কে নেহরু মতামত লেখেন: “জিন্না কোনও সুসভ্য মনের অধিকারী নন। তার যাবতীয় চাতুরি ও দক্ষতা সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছে, বর্তমান দুনিয়া ও তার সমস্যাবলি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং উপলব্ধিহীন। আমার কেমন যেন মনে হয়, এই লােকটাকে শতহস্ত দূরে রাখা দরকার, সে জন্য পাকিস্তান বা অন্য যা কিছু সে চায়, তা-ই তাকে দিয়ে বিদায় করা উচিত। তা না হলে চির কাল ভারতের প্রগতির পথে সে তার বিভ্রান্তি ও ঔদ্ধত্য নিয়ে নাক গলাবে।”[১৮] এত তীব্র বিরূপতা থেকে চরম ও বেদনাদায়ক বিচ্ছেদই ঘটা সম্ভব।
দেশ-ভাগে নিশ্চয় এই বিরূপতার একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু আর কী এ জন্য দায়ী ছিল ? সেটা কি ১৯৪২ থেকে ৪৫ অবধি চলা ‘ভারত-ছাড়াে আন্দোলন, যার ব্যর্থতা কংগ্রেসকে এতটাই হতাশাগ্রস্ত করে যে, জাতীয় ঐক্যের জন্য সংগ্রাম করার ইচ্ছা বা শক্তি কোনওটাই আর অবশিষ্ট থাকে না? কয়েক দশক আগে, বিশের দশকের হােম রুল লিগের দিনগুলিতে ড, অ্যানি বেসান্ত গাঁধীর সঙ্গে রাজনৈতিক মতভেদ জানাতে গিয়ে বলেছিলেন: “অসহযােগ আন্দোলনের সাফল্য কংগ্রেসকে এমন এক কানাগলিতে নিয়ে ফেলবে, যা থেকে বার হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।”[১৯] তার এই ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক প্রমাণিত হয়। যখনই গাঁধী তার অসহযােগ সমাপ্ত করেছেন, তখনই
৪৩৯
কংগ্রেস হাইকমান্ড পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে, তা নিয়ে আতান্তরে পড়েছে। গাঁধী তার আইন-অমান্য আন্দোলনের বাইরেও নানা কর্মসূচি নিয়েছেন, এবং সেগুলি আজ যত উদ্ভটই মনে হােক, সেগুলির মধ্যে একটি উদ্দেশ্যমুখিতা, একটি নির্দিষ্ট দিশা এবং নৈতিক সংহতি থেকেছে। কিন্তু অন্যরা সে সময় কী করেছে? তারা কেবল অনুসরণ করেছে। এবং যখনই তারা কোনও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তা হয় খুব সংক্ষিপ্ত ও ক্ষণস্থায়ী হয়েছে, নয়তাে খুব সংকীর্ণ। বার বার জেলে যেতে-যেতে কংগ্রেসের নেতাকর্মীদের (যাদের অধিকাংশই হিন্দু) মনে হয়েছে, তারা স্থায়ী শহিদত্বের মর্যাদা পেয়ে গেছেন। ভাবছিলেন, এই পৌনঃপুনিক জেলযাত্রা ও তার আনুষঙ্গিক ‘আত্মত্যাগ নিশ্চয় এক মহৎ বলিদান রূপে গণ্য হবে এবং ব্রিটিশ রাজের চেয়েও শক্তিশালী ও উচ্চতর এক কর্তৃত্বের দ্বারা যথাসময়ে পুরস্কৃত হবে। কিন্তু এ ভাবে দু দিন পর পর জেলে পাড়ি দিয়ে কংগ্রেস নেতারা কার্যত তাদের দায়িত্বই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৪২ থেকে ৪৫ পর্যন্ত তাদের জেল-জীবনের নিষ্ক্রিয়তা ও বিচ্ছিন্নতার কালেই কিন্তু জিন্না নিজের নেতৃত্বকে তুঙ্গ তৎপরতায় সংহত করে ফেলেন। এ সময় জিন্না কাজ করছিলেন কংগ্রেসের তুলনায় অনেক ছােট জনগােষ্ঠী নিয়ে, কেবল মুসলিমদের নিয়ে। মুসলিম লিগকে তিনি মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি করে তােলেন, এবং নিজেকে তার একমাত্র মুখপাত্র ও কর্তৃত্ব করে তােলেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মতাে সাবেক কংগ্রেস দুর্গে তিনি ফাটল ধরান। কিন্তু এর উল্টোটা কখনও ঘটেনি। কেন? কেন কংগ্রেস মুসলিম-গরিষ্ঠ একটি প্রদেশকেও নিজের পক্ষে টেনে আনতে পারেনি? উল্টে এই প্রদেশগুলি ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিকল্পই আঁকড়ে ধরে। সেটা কি এ জন্য যে কংগ্রেস আদ্যন্ত একটি হিন্দু সংগঠন রূপেই তত দিনে পরিচিত হয়েছিল? তা হলে কীসের ভিত্তিতে বরাবর সে মুসলিমদেরও প্রতিনিধিত্বের দাবি জানিয়ে এসেছে?
১৯৩৫-এর ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া আইন একটি ব্রিটিশ আইন ছিল, আমরা তার গভীর তাৎপর্য না বুঝেই সম্ভবত সেই আইনকে সমর্থন করি। ব্যাপারটা বিস্ময়কর, কেননা স্বাধীনতা-সংগ্রামে সে সময় তুখােড় সব আইনজ্ঞ শামিল ছিলেন। অথচ ব্রিটিশ আইন বলেই ভারতে ব্রিটিশ স্বার্থ তা খুব ভাল ভাবে রক্ষা করেছিল। এবং ভারতীয়। দেশপ্রেমিকরা যে সব বিষয়কে একান্ত ভাবেই ভারতীয়দের স্বার্থসংক্রান্ত ব্যাপার বলে মনে করতেন, সেই যুদ্ধ বা শান্তির প্রক্রিয়ায় যােগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও ব্রিটিশের নাক গলানাের অধিকার আইনে স্বীকৃত করেছিল। কোনও আইন দিয়েই অবশ্য হিন্দু ও মুসলিমদের ব্যবধান দূর করা সম্ভব ছিল না। তত দিনে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ভারতের ঐক্য বজায় রেখেই পাশাপাশি ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা কার্যত অসম্ভব, যদি না খুব উদার কোনও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে হিন্দু-মুসলিমদের বাঁধা যায়। আর এখানেই নেহরুর কেন্দ্রীকরণের প্রবণতার সঙ্গে বিরােধ সৃষ্টি হয়। ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’র রচয়িতা নেহরু কিন্তু ঘােষণা করেছিলেন: হয় জাতীয় ঐক্য এবং স্বাধীনতা, নতুবা জাতীয় বিভেদ এবং অধীনতা। সেই নেহরুর সঙ্গে এই নেহরুর কত তফাত !
৪৪০
এটাই অতএব সেই মহৎ ভুল, দেশকে বিভক্ত করে ফেলার সেই নিহিত অলক্ষ্য কারণ: ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর মতাে একটি বিকেন্দ্রীভূত, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে স্বাধীন ভারতের প্রস্তাবে স্বীকৃতি না জানানাে, অথচ যা আমরা সে দিন ইচ্ছা করলেই পেতে পারতাম। এই ভুলের পটভূমি বিংশ শতাব্দীর শুরুর দশকগুলিতে, এ প্রশ্নে গাঁধীর সঙ্গে নেহরুর মতভেদের মধ্যে, এমনকী ১৯২৬-এর বালফুর প্রস্তাবের মধ্যে। প্রশ্ন হল, তা হলে এখন আর কান্নাকাটি করে কী হবে? যদি অতীতের সেই মারাত্মক ভুলগুলিকে আজও আমরা স্বীকার না করি, যা আমাদের এই বর্তমান অবস্থায় এনে ফেলেছে, তা হলে ওই ভুলগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটার বিপদটাও থেকে যায়। | ১৯৪৬ সালের ক্যাবিনেট মিশনের সময় আরও একটা সুযােগ আসে। মিশন একটি সংবিধানের প্রস্তাব দেয় যা ভারতের ঐক্য রক্ষা করবে, তবে তিনটি স্বতন্ত্র রাজ্যগােষ্ঠী সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের অধীনে থাকবে। ১৯৩৪-এ জমা দেওয়া যৌথ স্মারকলিপির মধ্যে এই প্রস্তাবের বীজ নিহিত ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের মনােভাব ছিল এই প্রস্তাব এড়িয়ে যাওয়ার, অর্থাৎ কার্যত তা প্রত্যাখ্যান করার। ফলে দেশভাগ ছাড়া আর কোনও রাস্তা খােলা রইল না। অখণ্ড ভারত থেকে একটি মুসলিম অংশ কেটে নেওয়া হল, কিন্তু অবশিষ্ট ভারত হিন্দু ভারত বলে পরিচিত হল না। এক দ্রুত, অসংবেদী ও বিরাট অস্ত্রোপচার মারফত ভারতকে কেটে ফেলা হল। জিন্না সেটাই চেয়েছিলেন, মাউন্টব্যাটেনও। এবং তাদের অনুসরণ করে নেহরু এবং পটেলও। তারা না চাইলেও এই বিভাজনে সম্মতি দেন। অনেক বছর পরে লেনার্ড মােসলে নেহরুকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কেন?” নেহরু সৎ অনুতাপের সঙ্গে জবাব দিয়েছিলেন, “আমরা সে সময় দীর্ঘ কারাবাসে ক্লান্ত, অবসন্ন। তাই…” (লেনার্ড মােসলে, লাস্ট ডেজ অব ব্রিটিশ রাজ, পৃ ২৮৫)।
জিন্না কিন্তু তার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন, লক্ষ্য অর্জনের উপায় উদ্ভাবনেও। তিনিও ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির জন্য লড়েছিলেন, কিন্তু একই সঙ্গে মুসলিমদের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও অধিকারও তার চাহিদা ছিল। অক্লান্ত ভাবে এই দুই অভীষ্ট সাধনে তিনি কাজ করে যান। তিনি স্বীকার করতেন যে হিন্দু ও মুসলিমরা একজোট না হলে ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া কঠিন। তবে সে জন্য সংখ্যাগুরু হিন্দুদের বেশি ত্যাগ স্বীকার করার দাবিই তুলেছিলেন তিনি। তিনি মনে করতেন, হিন্দুদেরই সংখ্যালঘু মুসলমানকে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে স্বাধীন ঐক্যবদ্ধ ভারতে তারা নিরাপদ থাকবে। দুর্বলতার অবস্থান থেকেও কী করে তুমুল দরকষাকষি করা যায়, সেই কৌশলকে তিনি শিল্পের। স্তরে উন্নীত করেন। ক্রমাগত ‘না’ বলে-বলে এবং দাবি-সনদ পেশ করে-করে, সেই সনদে উত্তরােত্তর দাবির সংখ্যা বাড়িয়ে-বাড়িয়ে এক সময় তিনি সেই জায়গায় পৌঁছে। যান, যেখান থেকে সামনে এগােনাের ‘সব রাস্তাই বন্ধ। আর তার পরই পাকিস্তানের দাওয়াই প্রস্তাব করা হয়, তখনও পর্যন্ত যার কোনও ভৌগােলিক সীমা নির্ণীত নয়। তত দিনে তিনি জেনে গেছেন যে তিনি মৃত্যুপথযাত্রী, তার হাতে আর সময় নেই, তাই তাড়াতাড়ি যা করার করতে হবে।
৪৪১
তাড়া ছিল ব্রিটিশদেরও। ওঁরা চলে যেতে চাইছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ওঁদেরও ক্লান্ত, অবসন্ন করেছিল। উপরন্তু ভারতীয় নেতাদের অবিরাম ঝগড়ায় মধ্যস্থতা করতেকরতেও তারা তখন ক্লান্ত। ভারত থেকে তখন তারা পালাতে পারলে বাঁচেন। অন্য কিছু ব্যাপারও ছিল। তত দিনে প্যালেস্টাইন ম্যান্ডেট-এর অবসান হয়েছে। মূল ইউরােপীয় ভূখণ্ডে লড়াই থেমে যাওয়ায় সেখানে আটক ইহুদিদের প্যালেস্টাইনের জমিতে সরিয়ে এনে বসত করানাের চাপ উত্তরােত্তর বাড়ছে। প্যালেস্টাইনে আত্মগােপনকারী জঙ্গি ইহুদি গােষ্ঠীগুলিও ব্রিটিশ বাহিনীর উপর চোরাগােপ্তা হামলা চালাচ্ছে। ‘৪৬-এর ২২ জুলাই ইরগুন গেরিলারা কিং ডেভিড হােটেলে ব্রিটিশ বাহিনীর তদানীন্তন সদর দফতর বােমায় উড়িয়ে দেয়, যাতে ৯২ জন নিহত হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জও ‘৪৭-এর ১৫ মে প্যালেস্টাইনের উপর একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে এবং তা যে প্যালেস্টাইনকে বিভক্ত করার জন্যই, সেটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ যে পশ্চিম এশিয়ায় একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রমরমা ছিল, সেখান থেকেও তাদের উৎখাত হতে হচ্ছে।
কিন্তু কংগ্রেসের পার্টির এত তাড়া কীসের ছিল? দলের গােটা নেতৃত্ব তত দিনে হতক্লান্ত হয়ে পড়েছে বলেই কি? অন্তর্বর্তী সরকারে কংগ্রেস ইতিমধ্যেই শাসনক্ষমতার স্বাদ পেতে শুরু করেছে, এবং সেই ক্ষমতা সে স্বেচ্ছায় ভাগ করতে চাইবে, এমনটাও মনে হচ্ছিল না। তার পরিণামে যদি দেশ ভাগ হয়ে যায়, তা-ই যাক। নেহরু মােসলের কাছে প্রকারান্তরে সে কথাই স্বীকার করেন, কিন্তু সে তাে অনেক পরের ঘটনা। কংগ্রেস প্রায় সর্বদাই নিজের ক্ষমতা ও প্রভাবকে বড় করে দেখেছে এবং কংগ্রেসি নেতারা কিছুতেই জিন্নাকে কেবল মুসলিম লিগই নয়, অধিকাংশ মুসলমানের নেতা বলেও মানতে চাননি। তাদের বাস্তববােধও খুব প্রখর ছিল বলে মনে হয় না। ১৫ অগস্টের পক্ষকাল আগে মাউন্টব্যাটেন নেহরু ও পটেলকে ডেকে বলেন যে, আর কয়েক দিনের মধ্যেই তারা পূর্ণ ক্ষমতা ও দায়িত্ব পেতে চলেছেন, তারা কি এর মর্ম বুঝতে পারছেন?[২২] জবাবে উভয়েই জানান যে তারা ভাল মতােই জানেন তাদের ঠিক কী করতে হবে। বাস্তবে কি তা-ই দেখা গেল ? না কি তারা সে সময় অজ্ঞতাপ্রসূত আত্মবিশ্বাসে ভুগছিলেন?
জিন্নার দরকষাকষির অন্যতম কৌশল ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বকে এই বলে অভিযুক্ত করা যে তারা তার অর্থাৎ মুসলিম লিগের সঙ্গে কোনও মিটমাট চান না। যদিও আসলে ঠিক এর উল্টোটাই ছিল সত্যি। কিন্তু কংগ্রেস নেতাদের দোষ ছিল, যখনই তারা টের পেতেন যে ব্রিটিশরা তাদের সঙ্গে একটা কোনও রফা করতে উদ্যত, তখনই তারা জিন্নাকে উপেক্ষা করতেন। তাই ব্রিটিশরা যখন জিন্নার সঙ্গে কথা বলতেন, তখন জিন্নাও কংগ্রেসকে বিশেষ পাত্তা দেওয়া দরকার মনে করতেন না। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের সম্পর্কে এই বিরূপতা জিইয়ে রাখা ছিল ব্রিটিশদেরই একটা কৌশল। কেননা এই কৌশল ব্রিটিশ স্বার্থই সিদ্ধ করত, যেমন করত জিন্নার স্বার্থও, তাই জিন্নাও কখনও এতে বাধা দেননি। আশ্চর্যজনক ভাবে কংগ্রেস নেতারাও এই খেলায় স্বেচ্ছায় মেতেছেন, যদিও তাদেরই হারাবার বস্তু ছিল বেশি।
৪৪২
দীর্ঘ কাল ধরে কংগ্রেস এই ভ্রান্তি আঁকড়ে থেকেছে যে ব্রিটিশের মধ্যস্থতা ছাড়া উপমহাদেশের হিন্দু ও মুসলিমদের সমস্যা মেটার নয়। গাঁধীর মত এমন ছিল না। কিন্তু তত দিনে তার মতামত দলে গুরুত্ব হারিয়েছে। মধ্যস্থ বা রেফারির ভূমিকা পেয়ে যাওয়ায় ব্রিটিশের পক্ষে ভারতকে ইচ্ছা মতাে অস্ত্রোপচার করা সহজ হয়ে যায়। সেই অর্থে জিন্না যতটা না পাকিস্তান অর্জন করেছেন, তার চেয়ে বেশি নেহরু-পটেল জিন্নাকে পাকিস্তান দেশটি উপহার দিয়েছেন। ব্রিটিশরা এ ক্ষেত্রে নবজাতক রাষ্ট্রটির ধাত্রী হিসাবে কাজ করে। কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক চলবেই। তবে এখন আমরা আরও নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক ভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে অতীতের ঘটনার উপর আতস কাচ ফেলে বিশ্লেষণ করতে পারছি। ১৪ অগস্ট ও ১৫ অগস্ট দিন-দুটি একদা-বিশাল ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ঐক্যবদ্ধ ভারতের অবসানও সূচিত করে ওই দুটি তারিখই। মনে পড়িয়ে দেয়, হাজার বছর ধরে অনেক ঘাতপ্রতিঘাত, উত্থান-পতন সহ্য করে যাওয়া আমাদের এই বিশাল ভারতবর্ষকে ওই দুটি দিনে আমরা নিজেরাই বিদেশি শাসকদের শানানাে ছুরি দিয়ে কেটে টুকরাে ও রক্তাক্ত করে ফেলেছি।
আর এই চিন্তাটাই আমাকে আহত করে। আমি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সে সময়কার নেতাদের সংকীর্ণতা দেখে শিহরিত হই। একটি দাড়ি-কমা-সেমিকোলন নিয়ে তাদের কাজিয়া, ছােটখাটো কানুনি খুঁটিনাটি নিয়ে মতান্তর, খসড়ার শব্দার্থ বা বাক্যাংশ বা শব্দবন্ধ নিয়ে চুলােচুলির আড়ালে যেন এই অন্ধরা দেখতেই পাচ্ছিলেন না, আত্মরতিতে মগ্ন এই রাজনীতিকরা বুঝতেই পারছিলেন না, তাঁদের রচিত বা মঞ্জুরীকৃত খসড়াটি কী বিপুল সুদূরপ্রসারী বিপর্যয় ঘনিয়ে আনছে। ইংরেজ কবি ব্রাউনিংকে উদ্ধৃত করে লর্ড ওয়াভেল যেমন বলেছিলেন, “নাও, যথেষ্ট হয়েছে তােমাদের বাক্যাংশের বিন্যাস, তােমাদের সারগর্ভ যতিচিহ্ন, তােমাদের সদিচ্ছাপ্রণােদিত পরামর্শ,..
নিজের মতামত সম্পর্কে স্থির প্রত্যয়ে পৌঁছনাে ওই রাজনীতিকদের ঔদ্ধত্য ও আত্মপ্রত্যয় আমাকে বিমূঢ় করে। অবাক করে, ধর্ম, বিশ্বাস, শাসনপ্রণালী থেকে শুরু করে যে-কোনও বিষয়ে তাদের মতামতের অভ্রান্ত বিষয়ে তাঁদের নিজেদের ওপর এই বিশাল পরিমাণ বিশ্বাস। নেহরু যেমন ঘােষণা করেছিলেন, “ডােমিনিয়ন স্টেটাসের ভাবনাটাই যেন আমার দম বন্ধ করে দেয়,”[২৩] অথচ ‘৪৭-এর অগস্টে তিনি তাে সেটাই চাইলেন বা মেনে নিলেন। উপরন্তু সেই ডােমিনিয়ন আর অখণ্ডও রইল না। তা হলে মাঝের ওই বছরগুলির এত যন্ত্রণা, এত মৃত্যু, রক্তপাত কেন? দেশভাগের বিরাট ট্র্যাজেডির তুলনায় কী অকিঞ্চিৎকর ও হাস্যকর ঠেকে সে সময় পরস্পরকে বিতর্কে কোণঠাসা করার সেই আনন্দ! কয়েক শতাব্দী ধরে তিল-তিল করে গড়ে ওঠা সম্প্রীতি ও সৌহার্দের, সহযােগিতার, প্রতিযােগিতার, (হয়তাে দ্বন্দ্বেরও) একান্নবর্তিতা কেবল কয়েকটি বিদেশি ধ্যান-ধারণার আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। আমরা বহু বিষয়কে, ধারণাকে উল্টো করে দাড় করালাম। এমনকী ভারত ও স্বাধীনতার ধারণাটিকেও। ‘আমার মতটাই সবার ওপরে থাকবে। মুসলিমরা স্বতন্ত্র জাতি, কায়েদ-এ আজমের
৪৪৩
এই রণহুঙ্কার শেষ পর্যন্ত তাকে একটি পােকায়-কাটা পাকিস্তানই উপহার দিল। অথচ যা এক ছিল, তাকে দুটো টুকরােয় ভাঙতে গিয়েও আমরা পারলাম কই? ভারত ভেঙে পাকিস্তান হল ঠিকই। কিন্তু পঞ্জাব তাে সীমান্তের এ-পার, ও-পার, দু দিকেই রয়ে গেল! বাংলাও তাে তা-ই! এখন এই প্রাচীন প্রদেশ ভেঙে দুই দিকের বাংলাকে দুই নামে অভিহিত করতে ব্যস্ত আমরা।
আর একটি প্রশ্নও মনে জাগে। জিন্না তার পাকিস্তানের জন্য যে ভৌগােলিক সীমান্ত দাবি করেছিলেন, তাকে কি ধর্মীয় বিশ্বাসের সীমান্তে পরিণত করাও তার অভিপ্রায় ছিল? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? ধর্মের ভিত্তিতে মানুষ যদি এই উপমহাদেশে তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, তা হলেও ধর্মীয় স্বাতন্ত্র পেরিয়ে সহযােগিতা, সাযুজ্য, সাদৃশ্য ও পারস্পরিকতার যে অন্তঃসলিলা ঐতিহ্য সময় ও বিপর্যয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, তা জিন্না বা অন্য কেউ কেমন করে শুধু ধর্মের ধ্বজা দিয়ে তাতে অন্তর্ঘাত ঘটাবেন? তা ছাড়া, এতটা অশুভ ও নেতিবাচক কোনও অভিযাত্রা হতে পারে না। এত কোটি মানুষ এত তীব্র ঘৃণায় পুড়ল কেন, যে-ঘৃণার তীব্রতা আজ এত বছর পরেও মলিন হয়নি? এত হিন্দু, মুসলমান, শিখ তবে উদ্বাস্তু হল কেন? এত দিনে কি কায়েদ-এ আজমের যাত্রা তার গন্তব্যে পৌঁছেছে? না কি সবে তার প্রথম মাইলফলকটি পেরােনাে গেছে? বিভেদের কি অবসান হয়েছে, না কি সে বিভেদ এখনও আসছে, এখনও বিবর্তনশীল? দুটি স্বতন্ত্র, সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কি দুই সম্প্রদায়ের অসাম্যের অবসান ঘটিয়েছে, না কি সেই অসাম্য ও বঞ্চনার ধারণাগুলিকে ঘুরপথে, নতুন করে, নতুন পরিভাষায় পল্লবিত করেছে?
আজও আমাদের উদ্বেগ-আশঙ্কায় ভরে দেয় মহম্মদ আলি জিন্নার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, তার নানা সময়ের জবাব ও প্রতিক্রিয়া, তার খণ্ডিত চিন্তাভাবনা, যার মধ্যে প্রায়ই কোনও সামঞ্জস্য, শৃঙ্খলা বা যুক্তির বুনােট থাকত না, যদিও তিনি নিজেকে সর্বদাই যুক্তিনিষ্ঠ বলে বিজ্ঞাপিত করতেন। ১৯৪৬-এর ১৪ নভেম্বর এক সাংবাদিক বৈঠকে তাকে ভবিষ্যতের পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন: “এখন যে উত্তেজনা রয়েছে একটি জাতি অন্য জাতির উপর আধিপত্য করার ফলেই সেই উত্তেজনা— তার অবসান হবে। সংখ্যালঘুরা তখন নিজেদের সংখ্যালঘুত্ব মেনে নেবে, তারা স্বীকার করবে সংখ্যালঘুরা সংখ্যালঘু, কেবল সংখ্যালঘু হিসাবেই থাকতে পারে, আধিপত্যকারী হিসাবে নয়।” (কী বিচিত্র পরিহাস! তা হলে আর এতদিনকার এত দাবি-দাওয়া, বিশেষ মর্যাদা, সমতা ইত্যাদি অর্জনের জন্য এত আন্দোলন করে কী হল?)
“এক বার যখন সংখ্যালঘুরা বুঝে যাবে, তাদের সংখ্যালঘু হয়েই থাকতে হবে, তখন পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান, উভয় দেশেই স্থিতিশীল ও নিরাপদ সরকার কায়েম হবে। এর পর আর ঝগড়ার কী রইল? উপমহাদেশের স্তর থেকে অনেক সংকীর্ণ পরিসরে সমস্যাটা নেমে এল। এ ভাবেই দুই ভূখণ্ডে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষিত রাখা যাবে।… যদি না এটা ধরে নেওয়া হয় যে আমরা মুসলিমরা পশুর স্তরে নেমে এসেছি। না হলে
৪৪৪
পাকিস্তানের মুসলমানরা কেন সেখানকার সংখ্যালঘুদের সঙ্গে উদার আচরণ করবে না, তা আমার মাথায় ঢুকছে না।”
ইসলামের আগ্রাসী বিস্তারের তত্ত্বকে একটা ফাপানাে জুজু বলে খারিজ করে দিয়ে জিন্না বলেন, “অন্যরা যাই বলুক, ভৌগােলিক ভাবে পরস্পর সংলগ্ন থাকায় এবং পারস্পরিক স্বার্থেই পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান এই উপমহাদেশে বন্ধু হিসাবেই থাকবে। .এক জনের বিপদে অন্য জন তার পাশে দাঁড়াবে এবং বাইরের কেউ নাক গলাতে এলে বলবে, খবরদার! তখন আমরা আমেরিকার থেকেও সারগর্ভ একটা ‘মনরাে ডকট্রিন’ পাব।..বিশ্বাস করুন, আমি যখন পাকিস্তান দাবি করছি, তখন আমি কেবল মুসলমানদের জন্য লড়াই করছি না, পাকিস্তান এবং হিন্দুস্থান পেলে তবেই হিন্দু ও মুসলিমরা উভয়েই স্বাধীনতা পাবে।”[২৪]
কী হল এই সব মহৎ ধারণার পরিণাম? কী হল এত প্রত্যাশার ? গাঁধী কি আগাম সর্বনাশের ইঙ্গিত পেয়েছিলেন? না হলে কেন লিখবেন, “জিন্না ঘােষণা করেছেন, পাকিস্তানে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরু মুসলিমদের চেয়েও ভাল আচরণ পাবেন, কেউ কাউকে দাবিয়ে রাখবে না। যদি সত্যিই মুসলিম গরিষ্ঠতা-সম্বলিত প্রদেশগুলি ব্রিটিশ অধীনতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে জিন্না-প্রতিশ্রুত এই উচ্চ আদর্শ অনুসরণ করতে পারে, গােটা ভারত সে দিন সেই শুভ বন্দোবস্তকে স্বাগত জানাবে, তার নাম যা-ই হােক না কেন। গােটা ভারতই তখন পাকিস্তান হয়ে যাবে।”[২৫]
সে দিনের মতাে আজও প্রয়ােজন পরিস্থিতির গভীরতর অনুধাবন, অপরের দৃষ্টিভঙ্গিকে ধৈর্যসহকারে শােনার ইচ্ছা, বিদেশ থেকে আমদানি করা ধারণা ও মতবাদের সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়া। সে সব ধারণা ও মতবাদই তাে কালের গতিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, হেরে গেছে ভারতের ‘ভারতীয়তা’র কাছে। ভারত যে তবু সে দিন পরাভব মেনেছিল, তার কারণ, সময়, কাল তাকে হারিয়ে দিয়েছিল।
সাম্য প্রতিষ্ঠার কার্যকর হাতিয়ার ‘গণতন্ত্র’কে এই দেশ সফল ভাবে বিভাজনের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করে। সংরক্ষণ’-এর ধারণাটিও বড় চমকপ্রদ। যারা অনুন্নত, বঞ্চিত, মুসলিম হােক বা অন্য কেউ, তাদের তুলে আনার সদর্থক তৎপরতা হিসাবে প্রস্তাবিত এই বন্দোবস্তটিও ব্যবহৃত হয়েছে নতুন এক শ্রেণির সুবিধাভােগী বর্গের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠায়, যারা কিছুতেই অন্যের সঙ্গে নিজের সুবিধা ভাগ করে নেবে না। এও কি আমাদের, কায়েদ-এ আজম, গাঁধী, নেহরু বা কংগ্রেসের অভীষ্ট ছিল ? এ ভাবে বিভেদ ও শত্রুতার পৃথক কামরায় বসে যাত্রা করার? ‘৪৬-এর নভেম্বরে জিন্না ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে আমেরিকার চেয়েও মজবুত এক ‘মনরাে ডকট্রিন’-এর কথা বলেছিলেন না? এক দিকে ‘আমেরিকার চেয়েও মজবুত মনরাে ডকট্রিন’-এর কথা বলা, অন্য দিকে জনসংখ্যার স্থানান্তরের প্রস্তাব দেওয়া! পরের দিনের ‘ডন’ সংবাদপত্রে এটা একটা এক-লাইনের খবর ছিল। জিন্নাকে উদ্ধৃত করে তাতে লেখা হয়, ‘বিহারের মর্মান্তিক দাঙ্গার পর জনসংখ্যা স্থানান্তরের বিষয়টি যথাসম্ভব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।” দক্ষিণ এশিয়ার ওই যন্ত্রণাদায়ক ইতিহাস আজ আর বদলানাে
৪৪৫
যাবে না। কিন্তু বিপুল জনসংখ্যার সেই স্থানান্তর যাত্রার দায় তাে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও এড়াতে পারবে না। স্বাধীনতা-সংগ্রামের সে দিনের কাণ্ডারীরা ভবিষ্যতের প্রতি তাদের দায় পালন করেননি।
জিন্নাও কি তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছিলেন? কিংবা আদৌ কি সেটাই তার সংগ্রামের লক্ষ্য ছিল? আমার পক্ষে এই ভয়ানক স্পর্শকাতর আর বিপজ্জনক প্রশ্ন নিয়ে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত হবে না। বরং পাকিস্তান এবং ভারতীয় মুসলিমদেরই। এর উত্তর খুঁজতে হবে। জিন্নার ‘মুসলিম জাতীয়তা’র কোনও ভৌগােলিক গন্তব্য ছিল না , থাকতে পারে না। তিনি কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য একটা জুতসই সংজ্ঞা খুঁজছিলেন। সেই সংজ্ঞার মধ্যেও গুরুতর গােলমাল ছিল। তাই জিন্না তার পােকায়কাটা ভূখণ্ড পেলেও তা থেকে কোনও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়তে সমর্থ ছিলেন না। আর স্বতন্ত্র জাতি গড়তে তাে তিনি শােচনীয় ভাবেই ব্যর্থ হলেন। তিনি এবং মাউন্টব্যাটেন, নেহরু প্রমুখ ভারতের বুকে অস্ত্রোপচার করে তাকে শারীরিক ভাবে টুকরাে করলেন বটে, কিন্তু ওই অস্ত্রোপচার কোনও নতুন জাতি বানাতে পারল না।
জিন্নার কাছে যদি দেশ-ভাগ একটা সহজ, বাস্তবসম্মত সমাধান হয়ে থাকে এবং দ্বিজাতিতত্ত্ব হয়ে থাকে তার মতাদর্শগত বৈধতা, দেশভাগের পরেও ভারতের সঙ্গে এক যােগে কাজ করার ধারাবাহিকতা যদি তার অভীষ্ট হয়, তবে কংগ্রেস কিন্তু জাতীয় ঐক্যের প্রবক্তা হয়েও ভারতের বিভিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে তার মধ্যে ঐক্যসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেনি। ভারতীয় যুক্তরাজ্যে স্বায়ত্তশাসন কী ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে কোনও ভাবনা তার ছিল না। বরং ১৯৪২ সালে পাশ হওয়া বিখ্যাত জগৎনারায়ণ রাই প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের কোনও সদস্যের জন্যই বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার খােলা রাখা হল না। অথচ ৪৫-এর ডিসেম্বরে এই প্রস্তাবটির প্রসঙ্গ টেনেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একই নিঃশ্বাসে জানিয়েছিল, কোনও জনগােষ্ঠীকেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতীয় যুক্তরাজ্যের অধীনে থাকতে বাধ্য করা যাবে না। কংগ্রেসের মধ্যে কেবল মৌলানা আজাদ বিষয়টি নিয়ে ভেবেছিলেন। আত্মজীবনীতে তিনি পরে লেখেন, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেবল তিনটি বিষয় হাতে রাখা উচিত, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা যাতে প্রদেশগুলি সর্বোচ্চ পরিমাণে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে পারে। আজাদ বলেন, গাঁধী তার প্রস্তাব মেনে নেন, কিন্তু পটেল মানেননি। ‘৪৬-এর ১৫ এপ্রিল পাকিস্তানপ্রস্তাবের সমালােচনা করে তিনি অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতার যুক্তরাষ্ট্রীয় কেন্দ্রের পক্ষে সওয়াল করেন। কিন্তু এটা যে আজাদের ব্যক্তিগত মতামত ছিল, কংগ্রেস দলের নয়, পরবর্তী ঘটনাক্রম তা স্পষ্ট করেছে।[২৬]
আমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলােচনা করতে গিয়ে লয়েড রুডলফ এবং সুসান রুডলফ প্রশ্ন তুলেছিলেন: “জিন্না কি একটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যই দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করেন, না কি তার উদ্দেশ্য ছিল একটি বহুজাতিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা কংগ্রেসের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া?” আমার মনে হয়, রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসেবে জিন্নার কার্যক্রমকে দেখাই সঙ্গত। কেন, সেটা বলছি।
৪৪৬
জিন্নার রাজনৈতিক কেরিয়ারের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্ত ছিল ১৯১৬ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের সঙ্গে লখনউ চুক্তির দরকষাকষি। সে সময় তিনি এক জন জাতীয়তাবাদী নেতা এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের রূপকার হিসাবে অভিবাদন পাচ্ছেন। এবং এমন ভাবে তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে দরাদরি করছেন, যেন কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ একই সারিতে রয়েছে। কংগ্রেস যে তখন লিগকে বিরাট ছাড় দিচ্ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। কংগ্রেসের দিক থেকে লিগকে এই ছাড় সত্যিই একটা বিরাট ঘটনা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, এর থেকে একটা অত্যন্ত অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিও তৈরি হয়। বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাসনির্ভর ‘এথনিক’ বা জনগােষ্ঠীভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয়, যা জাতীয়তাবাদী সত্তাপরিচয়কে এই ধরনের বিশ্বাসের সঙ্গে একাত্ম করে দেখতে শুরু করায়। এর ফল হয় মারাত্মক। ভারতের মতাে দেশে মুসলিমদের কল্পনারাজ্যকে এই ভাবনা যে-ই অধিকার করে ফেলে, তার পর থেকেই শুরু হয় এর অবধারিত ফল: জন্ম হয় পলিটিকস অব আইডেন্টিটি কিংবা সত্তাপরিচয়ের ক্ষুদ্র রাজনীতির।
এমন কি হতে পারে যে জিন্না ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করলেও সেই স্বাধীনতাকে একটি বহুজাতিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় দেশের কাঠামাের মধ্যেই ন্যস্ত রাখতে চেয়েছিলেন? ১৯১৬ থেকে ১৯৪৭ ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতৃত্বের মধ্যে যে ত্রিপাক্ষিক দরকষাকষি চলে, তা কিন্তু শাসনক্ষমতায় অংশীদারিত্বের এই দিকগুলি নিয়েই। ১৯২৮ সালের নেহরু রিপাের্টের সময় জিন্না কেন্দ্রীয় আইনসভার এক-তৃতীয়াংশ আসন মুসলিমদের জন্য দাবি করেন। মুসলিম-গরিষ্ঠ সিন্ধু ও বালুচিস্তান পেলে ওই কোটা এক-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনতেও তিনি রাজি ছিলেন। ১৯৪৬-এর দরাদরি এবং ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনায় জিন্না একটি বহু-স্তর যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রকল্প মেনে নেন, যাতে পার্ট-এ-তে পঞ্জাবের সঙ্গে একই দলে থাকা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পার্ট-বি-তে বাংলার সঙ্গে একই দলে থাকা অসমের উপর কংগ্রেসের শাসনও মেনে নেওয়া হয়। নেহরু কিন্তু সে প্রস্তাব হজম করতে পারেননি।
১৯৪০-এর শেষের দিকে জিন্নার অবস্থান স্পষ্ট হতে থাকে। দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করলেও তিনি মুসলিমদের একটি স্বতন্ত্র জাতি-রাষ্ট্র গণ্য করছেন না। লয়েড রুডলএর ভাষায়, “তখনও তিনি একটি বহুজাতিক বা বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের কথা ভাবছেন, যা জাতি-রাষ্ট্রের পশ্চিম ইউরােপীয় ধারণা থেকে স্বতন্ত্র, যার সার্বভৌমত্ব কোনও একটি জাতি বা জনগােষ্ঠীর হাতে থাকবে না, বণ্টিত হয়ে থাকে একাধিক জাতীয়তার হাতে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রদেশগুলি, বিশেষত তার ভাষাভিত্তিক রাজ্যবিন্যাস কতকটা এ ভাবেই সার্বভৌমত্বে অংশও নেয়, আবার অংশীদারি বাড়াতে দরাদরিও করে। একই ভাবে তফশিলি জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ এবং সংবিধানের ৭৩তম সংশােধনী মারফত সৃষ্ট পঞ্চায়েতি রাজের স্থানীয় স্বশাসনও সার্বভৌমত্বের অংশীদারি নিয়ে দরাদরিরই প্রতিফলন। লখনউ চুক্তির সময় এবং তার পরবর্তী কালে জিন্না দরকষাকষির যে পন্থা-প্রকরণ অনুসরণ করেন, তার মূলেও কিন্তু সার্বভৌমত্ব ভাগ করে নেওয়ার একই তাগিদ সক্রিয় ছিল।
৪৪৭
সে যাই হােক, ভারত থেকে স্বতন্ত্র একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান বিগত ষাট বছরে অনেকটাই বিবর্তিত হয়েছে। তার পাকিস্তানি আত্মপরিচয়, ভারত থেকে আলাদা একটি দেশ হওয়ার চেতনা আগের চেয়ে অনেক তীক্ষ্ণতর হয়েছে। ভারতের। প্রতি স্থায়ী শত্রুতার মনােভাবও আর তত তীব্র নেই, কারণ দেশটির আত্মবিশ্বাস আগের চেয়ে বেড়েছে। তাই ভারতের সঙ্গে তার ঐক্য ও অভিন্নতার উপাদানগুলি অনুধাবন করার আগ্রহও বেড়েছে। এই অভিন্নতা যে সহযাত্রার তাগিদ রচনা করে, পাকিস্তান হয়তাে তার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হচ্ছে। কিংবা, হচ্ছে কি?
ইসলামের দিক দিয়েও স্বতন্ত্র দেশ পেয়েই কিন্তু পাকিস্তান থেমে থাকেনি। পাকিস্তান ইসলামিকরণের দিকে এগিয়েছে, দেশকে ইসলামি রাষ্ট্র বানিয়েছে এবং শরিয়তকেই তার আইনবিজ্ঞানের দার্শনিক ভিত্তি বানিয়েছে। ধর্মদ্রোহকে শাস্তিযােগ্য অপরাধ হিসাবে আইনি সম্মতি দেওয়াও দেশের দস্তুর হয়ে উঠেছে। আইনের ব্যাখ্যার দায়িত্ব আদালত। থেকে মৌলবিদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। দুঃখের কথা, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদকে রাষ্ট্রনীতি হিসাবে গ্রহণ করেছে, যা বহির্দেশে আগ্রাসনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীত পরিণতি প্রায় অনিবার্যই ছিল। সন্ত্রাসবাদের দানবকে যে রাষ্ট্র মুক্ত করে কাজে লাগিয়েছিল, তাকেই এখন সন্ত্রাসবাদ গিলে খেতে চাইছে। পাকিস্তান এখন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের কেন্দ্র হয়ে দাড়িয়েছে এবং তালিবানি জেহাদ তার অন্তঃকরণকে কুরে-কুরে খাচ্ছে। জিন্নার স্বতন্ত্র মুসলিম জাতীয়তার স্বপ্নে এমন কোনও দুঃস্বপ্ন ছিল না।
রােজালিন্ড ও’হ্যানলন লিখেছেন, ‘জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অসম্পূর্ণতায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। ১৮৬০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত পঞ্জাব উপনিবেশের যােদ্ধা-সরবরাহকারী প্রদেশ ছিল। তার কৃষক ও জমিদাররা উদার কৃষিনীতির দ্বারা লালিত, পুষ্ট হয়েছে। ভারতের অন্যত্র কংগ্রেস ও সমাজতন্ত্রীদের। সংগঠিত যে কৃষি-সংস্কার কর্মসূচি ও আন্দোলন জমিদারদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, পঞ্জাবে তা অনুপস্থিত। স্বাধীনতার পর তাই পাকিস্তানের সবথেকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে তার সেনাবাহিনী এবং ভূস্বামী শ্রেণি।” এ যুক্তি কেবল পাক পঞ্জাবের ক্ষেত্রে নয়, গােটা পাকিস্তানের বেলাতেই প্রযােজ্য।
নিয়তির এক বিচিত্র পরিহাস যে, পশ্চিমি শক্তিগুলির দ্বারা তাদের রণনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র আজ ষাট বছর পরে, সেই পাশ্চাত্যের পক্ষেই একটি অতীব বিপজ্জনক ও বিশৃঙ্খল ভূখণ্ড হয়ে উঠেছে। এবং সেটা শুধু তথাকথিত ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদ’-এর জন্যই হয়েছে, এমনও নয়। এর পিছনে অনেক কারণ। পিছনে আছে পাকিস্তানি জনসমাজের ক্ষোভ যে, তারা সেই ‘৪৭ সাল থেকেই বার বার প্রতারিত হয়েছে পশ্চিমি দেশগুলির দ্বারা, এমনকী ভারতের দ্বারাও। পাকিস্তান আজ আর পশ্চিমি রণনৈতিক স্বার্থের ঘাঁটি নয়, পশ্চিমের কাছে এক মূর্ত বিপদ।
মায়ানমার থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতীয় উপমহাদেশ বরাবরই জনসাধারণ ও পণ্যের চলাচলের এক স্বাভাবিক অভিন্ন বাজার। দেশ-ভাগ এই উপমহাদেশের ভূগােল ও আবেগের উপরই কেবল অস্ত্রোপচার করেনি, এই অভিন্ন
৪৪৮
বাজার, বাণিজ্যপথ এবং জনসমাজের স্বাভাবিক চলাচলের ক্ষেত্রকেও সঙ্কুচিত, খণ্ডিত করেছে। ভারতীয়রা তাদের নিজেদের দেশেই এর ফলে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয় এবং অতীতে যা স্বাভাবিক পণ্য-চলাচল ছিল, তা-ই এখন চোরাচালান নামে অভিহিত হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতই। তার ভূখণ্ড, জনসমাজ এবং তার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংহতি ভেঙে টুকরাে হয়ে যায়। কিন্তু কায়েদ-এ আজমের তাতে কী-ই বা এসে গিয়েছে!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যবাদী মুকুটের সবচেয়ে উজ্জ্বল হিরেটিকে এ ভাবেই জলাঞ্জলি দেয়। ঠিক সময়েই দেয়, না হলে তার নিজের দেশ ও জনসাধারণকে বিপুল দুর্দশায় পড়তে হত। তাদের সামনে বেছে নেওয়ার পথ ছিল দুটি: সাম্রাজ্য কিংবা স্বদেশ। কিংবা সত্যিই কি বেছে নেওয়ার কিছু ছিল? তাই দুটোর মধ্যে যেটা তারা বেছে নিল এবং যে পদ্ধতিতে তা কার্যকর করল, তার মধ্যে বীরােচিত কিছু গুণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বরং সেটাকে বলতে হয় অন্তর্ঘাত, যা বিপর্যয়ের খুব কাছাকাছি। তা করতে গিয়ে ভারতের নিজস্ব স্বার্থ তারা বিক্রি করে দেয়, উপমহাদেশ থেকে বরাবরের জন্য শান্তিকে নির্বাসিত করে। সে শান্তি আজও ফেরেনি, যেমন ফেরেনি শৃঙ্খলাও। দু’দেশের কোনওটিতেই শান্তি ও আইনের শাসনের মতাে সু-রাজ-এর দুটি অপরিহার্য উপাদান এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ব্রিটেনের সঙ্গে স্বার্থ-বিনিময়ের এটাই কি চূড়ান্ত মূল্য? সপ্তদশ শতাব্দীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক স্বার্থই এ শতাব্দীতেও বরাবরের মতাে অগ্রাধিকার পেল। আর ব্রিটেনের বড় বড় ভুলের মাসুল গুনতে হল ভারতকে।
ভাবতে খুব কষ্ট হয় যে আমরা এই বিনিময়কে মেনে নিলাম এবং তাকে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা-হস্তান্তর’ আখ্যা দিলাম। এই হস্তান্তরের জন্য আজও ভারতকে দাম দিয়ে যেতে হচ্ছে, যা নিশ্চয় কায়েদ-এ আজমের যাত্রাশেষের লক্ষ্য ছিল না। এ ছিল আমাদের নিজেদেরই কৃতকর্ম। আর ব্রিটিশদের মনের অবস্থা কেমন ছিল, বিদ্রুপ করে এ এ গিল সে সম্পর্কে বলেছেন, “সাম্রাজ্যের অবসান নিশ্চয় ব্রিটিশদের হৃদয় বিদীর্ণ করে। দিয়েছিল, কিন্তু তারা সে কথা কাউকে জানাতে পারেনি। ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে যাদের নিক্ষেপ করা হয়, তাদের সকলেরই যেমন অভিজ্ঞতা হয়, ইংরেজদেরও তা-ই হল, মধ্য বয়সের এক বিপর্যয়কর আত্মবিশ্বাসহীনতায় তারা আক্রান্ত হয়ে পড়ে, অতীত গৌরবের স্মৃতির জাবর কেটেই শােকে সান্ত্বনা পেতে শুরু করে।”
পাকিস্তান ও তার নাগরিকরাও গত ছয় দশকে অনেক যন্ত্রণা ভােগ করেছেন। বাংলাদেশ তাকে দু’টুকরাে করেছে, চার-চারটি সামরিক একনায়কতন্ত্র তারা শিরােধার্য করেছেন, অন্তর্বর্তী সময়ে যে সব অসামরিক সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে, তারাও ঠিক জনকল্যাণে নিয়ােজিত থাকেনি। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধও তার সম্পদের ভাণ্ডারকে নিঃস্ব করেছে। তার পর এসেছে সন্ত্রাসবাদ। পাকিস্তান এখন রকমারি সংকীর্ণ প্রাদেশিক বিভাজন ও সন্ত্রাসে জর্জরিত। তা সত্ত্বেও দেশটির বিপুল প্রাণশক্তি, মহৎ সৃজনশীলতা এবং উষ্ণ আতিথেয়তায় কোনও ঘাটতি নেই। এর সামনে অতীতের অনেক কিছুই আজ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। পাকিস্তান অনেক
৪৪৯
আপাত-অনতিক্রম্য বাধা অতিক্রম করেছে, কিন্তু কায়েদ-এ আজমের অভীষ্টের সঙ্গে তার বর্তমান বাস্তবতার বিরাট অসাদৃশ্য থেকেই গেছে। অথচ পাক জনসাধারণের এর চেয়ে হয়তাে আরও অনেক বেশি কিছুই প্রাপ্য ছিল।
যবনিকা?
নতুন করে আর বিশেষ কিছু বলার নেই। কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে আসবে: দেশ-ভাগ আমাদের কী দিল? কোটি-কোটি মানুষের নিরবচ্ছিন্ন কষ্ট আর যন্ত্রণা, একটা স্থায়ী অভিশাপ। এই যন্ত্রণা একান্ত ভাবেই আমাদের নিজস্ব, আমাদেরই কঁাধে বহন করার ক্রুশ। এখন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা পাকিস্তানের কায়েদ-এ আজম-এ পরিণত হওয়ার মহাকাব্যিক যাত্রার বিবরণের শেষ প্রান্তে এসে আমরা এটুকু বলতেই পারি যে, সব ইতিহাসই ইতিহাসকারের সমসময়ের নিরিখেই রচিত হয়। সেই হিসাবে মহম্মদ আলি জিন্নার এই রাজনৈতিক জীবনকথাও প্রেক্ষিত-নিরপেক্ষ নয়। শেষ বিচারে দেশভাগের ওই মর্মান্তিক নাটকে কার কতটুকু লাভ হয়েছিল, তার খোঁজ হয়তাে অবান্তর। জিন্না যদিও পাকিস্তান-জন্মের মহিমার মধ্যেই মারা যান, তঁার জাতক দেশটি অভিভাবকহীন, অনাথই থেকে যায়। তার অর্জনটিও রয়ে যায় এক রকম বন্ধ্যা। পাকিস্তান প্রমাণ করেছে মুসলিমদের স্বতন্ত্র জাতীয়তার তত্ত্বটির দেউলিয়াপনা। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা সেখানে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। তার পর প্রাদেশিক নানা বিভেদ এবং জল, জমি ও সীমানা নিয়ে কাজিয়াও এই ইসলামি সংহতির অভ্যন্তরীণ অস্তিত্বকে ছত্রভঙ্গ করেছে।
সাম্প্রতিক অতীতের মলিন অবশেষ, দেশভাগের রক্তাক্ত বেদনার স্মৃতি ভারতপাক সম্পর্ককেও আজ তিক্ত করে রেখেছে। অবিশ্বাস এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়গুলিকেও প্রত্যহ চরম সন্দেহের চোখে দেখা হয়। জিন্না যে ‘দক্ষিণ এশীয় মনরাে ডকট্রিন’-এর কথা বলেছিলেন, তেমন কিছুর অস্তিত্ব তাে। তৈরি হয়ই নি, তার জায়গার লতায়-পাতায় বেড়ে উঠেছে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষ। তাই, মনে প্রশ্ন জাগে, ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর আমরা যদি বিরােধে লিপ্ত না হয়ে পরস্পরের সহযােগিতা করতাম এবং পাকিস্তানের জন্মের পর অতীতের অবিশ্বাস ও বিরূপতা সরিয়ে রেখে ভ্রাতৃপ্রতিম মনােভাব নিয়ে এগােতাম, তা হলে কী হত? তা হলে কি আমাদের উপমহাদেশের হারানাে শান্তি ফিরে আসত? জোর দিয়ে বলতে পারি না। কেউই কি পারে? কারণ, একটা বড় সমস্যা, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অতীত আজও বার বার নিজেকে পুনরাবিষ্কার করে বর্তমানে রূপান্তরিত হয়, এবং আমাদের অতীত স্মৃতির কারাগার থেকে মুক্তির পথ রােধ করে দাঁড়ায়। এই সমস্যার মীমাংসার ভারও আমাদেরই। অন্য কারই বা তা হওয়া সম্ভব?
৪৫০
সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের পক্ষেই ভারত-ভাগ বিংশ শতাব্দীর একটি নির্ণায়ক মুহূর্ত। তার যন্ত্রণা এখনও বড় তীব্র। আমরা সেই বিভাজনকে আজও নতুন করে বিশ্লেষণ করে চলি, কারণ আমরা সে সময়কার মারাত্মক ভুলগুলাে আর কখনও না । করার তাড়নায় আজও তাড়িত। হয়তাে স্মৃতিচারণই আমাদের বেদনার উপশম।
এই বিবরণ জিন্না মানুষটির এবং তার বীরােচিত ক্রিয়াকলাপের ইতিবৃত্ত। সঙ্গে অন্যদের ইতিবৃত্তও বটে।
এবং এ থেকেই তৈরি হয়ে ওঠে একটা গল্প: তবে আল্লাহ তাে নিজেই সব জানেন?
তথ্যসূত্র
১. এম আর এ বেগ, জিন্না, খুদাবক্স ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি, পটনা, পৃ ১৯।
২. ফিলিপস ট্যালবট, অ্যান আমেরিকান উইটনেস টু ইন্ডিয়া’জ পার্টিশন, সেজ পাবলিকেশনস, ২০০৭, পৃ ২৪০-২৪১
৩. এ জি নুরানি, দ্য মুসলিমস অব ইন্ডিয়া, পৃ ৩
৪. মহম্মদ রেজা খান, হােয়াট প্রাইস ফ্রিডম, চেন্নাই, ১৯৬৯, পৃ ৩২১-৩২২, নুরানি, মুসলিমস অব ইন্ডিয়া-তে উল্লিখিত।
৫. মুসলিমস অব ইন্ডিয়া, ভূমিকা, পৃ ৭, একই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের, ৭ নম্বর নথি
৬, তদেব, ৮ নম্বর নথি।
৭. কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অব ইন্ডিয়া বিতর্ক, ২৬ মে ১৯৪৯, রিপাের্ট অন মাইনরিটিজ, পৃ ৩৫০, খণ্ড ৩
৮.১৯৭৮-৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব, যাতে মহম্মদ রেজা খান পহ্লাবিকে আসনচ্যুত করা হয়। বিদ্রোহীরা আয়াতােল্লা রুহােল্লা খােমেইনি নামে এক নির্বাসিত ধর্মগুরুর নেতৃত্বে শাহ-এর ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান প্রতিষ্ঠা করে। সব রকম পাশ্চাত্য প্রভাব বর্জন করার চেষ্টা করে এই নতুন রাষ্ট্র, শিয়া ইসলামি মতবাদ দ্বারা চালিত হতে থাকে।
৯. থিয়ােসেন্ট্রিক: আল্লাহ বা ঈশ্বরকেই সব কিছুর কেন্দ্রে স্থাপন করা। থিয়ােক্র্যাসি: এমন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেখানে আল্লাহ বা ঈশ্বরের নামে তাঁর পুরােহিত বা প্রতিনিধিরা শাসন করেন।
১০. বশিরউদ্দিন আহমদ ১৯৯২-৯৬ সালে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন, কনসর্টিয়াম অব এডুকেশনাল কমিউনিকেশন-এর অন্যতম মনােনীত সদস্য।
১১. ভারতের প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর ষােড়শ শতকে অযােধ্যায় বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪০-এর আগে, তার নাম ছিল মসজিদ-ই-জন্মস্থান। মসজিদটি রামকোট পাহাড়ে অবস্থিত ছিল। মনে করা হয় যে বাবরের সেনাপতি মির বাকি ওই একই জায়গায় একটি মন্দির বিনষ্ট করে মসজিদটি তৈরি করেন। হিন্দুরা এও মনে করেন যে ওই মন্দির ছিল বিষ্ণুর অবতার
৪৫১
অযােধ্যারাজ রামচন্দ্রের জন্মস্থানকে স্মরণ করে নির্মিত। ১৯৯২ সালের ৬ দিসেম্বর এক দাঙ্গায় মসজিদটি ভেঙে ফেলা হয়।
১২. পার্টিশন অব ইন্ডিয়া: লেজেন্ড অ্যান্ড রিয়ালিটি, পৃ ১৫৯।
১৩. ভােপালের নবাবকে লেখা নেহরুর চিঠি, ৯ জুলাই ১৯৪৮, SWJN VII (১৯৯৮), পৃ ৫-৬
১৪. হােসেন হাকানি, পাকিস্তান: বিটউইন মস্ক অ্যান্ড মিলিটারি, কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস, ২০০৫, পৃ১১।
১৫. গােপালকৃষ্ণ গাঁধী সম্পাদিত, গাঁধী: দি এসেনশিয়াল রাইটিংস, অক্সফোর্ড, পৃ ৬১৫
১৬. তদেব, পৃ ৬৪৪।
১৭. সুনীল খিলনানি, “নেহরু’জ জাজমেন্ট”, রিচার্ড বুর্ক ও রেমন্ড গস সম্পাদিত পলিটিকাল জাজমেন্ট: এসেজ অন অনর অব জন ডান, কেমব্রিজ, ২০০৮।
১৮. তদেব
১৯. কাঞ্জি দ্বারকাদাস, টেন ইয়ার্স অব ফ্রিডম, পপুলার প্রকাশন, বম্বে, ১৯৬৮, পৃ ২১৯
২০. ব্রিটিশ লর্ড আর্থার বালফুরের নামাঙ্কিত রিপাের্ট, ১৯২৬ সালের বালফুর ডিক্লারেশনে গ্রেট ব্রিটেন এবং তার ডােমিনিয়নগুলির সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়। বলা হয়, সেগুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বশাসিত ও সমান মর্যাদার অধিকারী হবে, পরস্পরের সঙ্গে কোনও অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সংযুক্ত হবে না, ব্রিটিশ রাজা বা রানির প্রতি অধীনভাবান্বিত, ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এর সদস্য রাষ্ট্র হবে।
২১. ইরগুন দোয়াই লেওমি (ন্যাশনাল মিলিটারি অর্গানাইজেশন), কিংবা ইতজেল গ্রুপ, জেরুজালেম-এ অব্রাহাম তেহমির নেতৃত্বে চালিত। এরা মনে করে প্যালেস্তাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই তাদের প্রথম কাজ।
২২. টেন ইয়ার্স অব ফ্রিডম, পৃ ২২০
২৩. লয়েড রুডলফ অ্যান্ড সুজান রুডলফ, পােস্টমডার্ন গাঁধী অ্যান্ড আদার এসেজ: গাঁধী ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড অ্যাট হােম, দিল্লি, অক্সফোর্ড, ২০০৬, দ্বিতীয় অধ্যায়
২৪. ডন, ১৫ নভেম্বর, ১৯৪৬। ট্রান্সফার অব পাওয়ার, খণ্ড ৯, পৃ ৭৪-৭৫
২৫. গাঁধী: এসেনশিয়াল রাইটিংস, অক্সফোর্ড, পৃ ৬২১
২৬. নুরানি, “দ্য ক্যাবিনেট মিশন অ্যান্ড ইটস আফটারমাথ”, সি এইচ ফিলিপস ও মেরি ডরিন ওয়েনরাইট সম্পাদিত দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া: পলিসিজ অ্যান্ড পার্সপেকটিভস, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন লিমিটেড, লন্ডন, ১৯৭০, পৃ ১০৫
৪৫২