You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

জিন্না ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা
যশোবন্ত সিংহ

প্রস্তাবনা: একটি জটিল সূচনা
ভারতের সঙ্গে ইসলামের প্রথম পরিচয় কিন্তু দ্বন্দ্বের রূপ নেয়নি। তেমন কোনও দ্বন্দ্বের বােধই তখন ছিল না। ইসলাম ধর্মের সূচনার বহু আগে থেকে পারস্য, মেসােপটেমিয়া, আরবের নানা দেশের সঙ্গে যে নৌবাণিজ্য চলছিল, বণিকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরেও সে সম্পর্কের কোনও পরিবর্তন হয়নি। সপ্তম শতাব্দীর পর থেকে কিন্তু দেখা। গেল, এই যােগাযােগের চরিত্র বদলে গিয়েছে। এর পর থেকেই পশ্চিম থেকে স্থলপথে হামলা, লুটপাট শুরু হয় ভারতে। কয়েক শতক ধরে বারবার আক্রমণ চলতে থাকে, প্রধানত ভারতের অতুলনীয় সম্পদ লুট করার জন্য। অনেক আক্রমণকারী সেই সময়ে ইসলাম ধর্মের ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সব রকম অ-ইসলামীয় স্থাপত্য বা মূর্তি বা প্রতীক ধ্বংস করতে শুরু করে। এরাই ইসলামের কালাপাহাড়, যারা সব রকম ‘শয়তানের প্রতীক’ নষ্ট করতে উদ্যত হয়। আক্রমণ, বংশানুক্রমে এ দেশে রাজত্বচালনা এবং আক্রমণকারীদের এ দেশের সঙ্গে মিশে যাওয়া, এ সব আরও পরের ঘটনা। এ তিন ঘটনাকে কখনওই জ্যামিতিক সুক্ষ্মতায় আলাদা করা যায় না, একটা কখনওই অন্যটাকে অনুসরণ করেনি, বরং একটার গতি অন্যটায় মিলিয়ে গিয়েছে। আক্রমণগুলির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে— অবিশ্বাসীদের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। তার পর এমন একটা সময় এসেছে যখন ইসলাম ভারতের দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে মিশে গিয়েছে, একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে ভারতের মধ্যে মিলিয়ে গিয়েছে। এই সামান্য কয়েকটি বাক্যে যে কথাগুলাে আমরা বললাম, বাস্তবে তা ঘটতে লেগেছিল প্রায় দেড় হাজার বছর!
ইসলামের সঙ্গে ভারতের এই বিভিন্ন ধরনের মানব-অভিজ্ঞতার গােটা পরিধিটা স্থান পেয়েছিল এই উপমহাদেশের ভৌগােলিক সীমার মধ্যে। বিজেতার ধর্মবিশ্বাস হিসেবে যা শুরু হয়, এই দেশকে ক্রমশ তা স্বভূমি বলে গ্রহণ করে। এবং শেষ অবধি । সেই দেশকেই টুকরাে করে তারা সে দেশ ছেড়ে চলে যায়। ইসলাম ভারতে এসেছিল প্রধানত মুসলিম আক্রমণকারীদের সঙ্গে, সিংহাসন জেতার লােভে, এই সম্পদশালী, উর্বর, সমৃদ্ধ দেশকে শাসন করবার আশায়। ফলে ইসলাম প্রধানত বিদেশি বিজেতার ধর্ম বলেই পরিচিত হয়েছিল।
এখানে আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় হল ‘জিন্নার গমনপথ’– অর্থাৎ কী ভাবে ইসলাম এই বিদেশি পরিচয় হারাল, প্রথমে ভারতীয় হল, তারপর এই ভৌগােলিক

ভূখণ্ডে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করল। বহু দিন ধরে যা ছিল রাজা, সম্রাট এবং ভারতের শাসকদের ধর্ম, পরে সেটাই পরিণত হল বিচ্ছিন্নতাবাদীর ধর্মে, যে ধর্ম দেশকে বিভক্ত করে, ভারত থেকে নিজেদের (ধারণায়) সরিয়ে তার পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে সরে যায়, এবং যারা ভারতে থেকে গেল তাদের চিরকালের জন্য আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে সংশয় এবং দ্বিধায় পর্যবসিত করে। যারা থেকে গেল তাদের অসম্মান করে প্রশ্ন করা হল, “তােমরা আসলে কোথাকার?’ এই বিভ্রান্ত, স্বজনবিচ্যুত মানুষেরা এখন দুঃখ করে বলেন, “আমরাও কি উন্মা-র নই? তা হলে মুসলিম লিগ যে গর্ব করে বলত, সে হল ‘ধর্মবিশ্বাসীদের এক এবং একমাত্র প্রতিনিধি ? লিগ দাবি করেছিল, সে ইসলামের আদর্শগত বিশ্বাসের ধারক, মুসলিম জনমতের একটা বড় অংশের প্রতিনিধি। তাই লিগ চেয়েছিল, কিংবা বলা ভাল, ধরেই নিয়েছিল, তারা হয়ে উঠবে একটিমাত্র মুসলিম মাধ্যম। একটি বিশিষ্ট জাতির ধারণা তৈরি করে তা থেকে নিজের জন্য একটি আলাদা ভূখণ্ড দাবি করেছিল। সেই জন্যই এই প্রশ্ন আমাদের বারবার পীড়া দেয়: কীসের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল তারা? যারা ভৌগােলিক ভাবে আলাদা হতে পারেনি, তাদের জন্য কী রইল ? ভৌগােলিক, কিংবা ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিতে অভিন্ন যে দেশ, তাকে কী করে ভাগাভাগি করা যায় ? কেবল মানচিত্রে লাইন এঁকে? মাউন্টব্যাটেন-এর ভাষায়, ‘অস্ত্রোপচার করে’? দুঃখের বিষয়, নেহরু, পটেল আর কংগ্রেস দল কিন্তু এই ভাগাভাগি শেষ পর্যন্ত মেনেই নিয়েছিল। জিন্না তাে তারও আগে থেকে এটাই দাবি করে আসছিলেন।
এই অর্থে মুসলিম লিগ জিন্নার নেতৃত্বে সাফল্য পেয়েছিল, কারণ তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, ঠিক তাই করতে পেরেছিলেন। লিগ ছিল তাঁর রাজনৈতিক অস্ত্র, আর তাঁর সূক্ষ্মদৃষ্টি তাঁকে কংগ্রেসের দুর্বলতা-গ্রহণের সুযােগ করে দিয়েছিল, বিশেষত ১৯৩০ সালের পর। তার সঙ্গে তিনি যােগ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দুর্বলতা। এই সবের সাহায্যে তিনি কেটে বার করে নিয়েছিলেন পাকিস্তানকে, যদিও জন্ম থেকেই তার চেহারা ছিল ‘পােকায়-খাওয়া।
ইতিহাসের টীকাকাররা অনেকেই এ বিষয়ে চিন্তা করেছেন, যেমন ‘দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া: পলিসিজ অ্যান্ড পার্সপেক্টিভ ১৯৩৫-১৯৪৭’ বইয়ের লেখক সি এইচ ফিলিপস এবং মেরি ডরিন ওয়েনরাইট। লিগের জয়ের এই রাস্তাটি যথেষ্ট আলােচিত, যদিও তা এখন কিছু আবছা হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। আমরা এই রাস্তাতেই আরও একবার হাঁটব। আলােচনা করব মহম্মদ আলি জিন্নার রাজনৈতিক যাত্রাপথ। প্রশ্ন করব, কী করে? কেন? বিংশ শতকের প্রথম ৪৭ বছর যিনি ছিলেন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রথম সারির একজন নেতা–কেন তিনি নিজেকে ভারতের এক প্রান্তদেশে সরিয়ে নিলেন? সুতরাং এই যাত্রা ভারতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যেরও যাত্রা। গােখলে, এবং পরে সরােজিনী নাইডু যাঁকে ভারতের হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক বা দূত বলেছিলেন, তিনি কী করে পাকিস্তানের প্রথম এবং, আয়েশা জালালের কথায়, ‘একমাত্র মুখপাত্র হয়ে উঠলেন? তিনি কি সত্যিই তাই ছিলেন ? না কি এক সামগ্রিক ভুলের ফলেই

তৈরি হয়েছিল তাঁর পাকিস্তান? লয়েড এবং সুসান রুডলফ একটি বক্তৃতায় এই প্রশ্নটি সােজাসুজি তুলে ধরেছেন, “জিন্নাকে উদার, বহুসংস্কৃতিমান এবং ধর্মনিরপেক্ষ বলেই দেখা হত, যিনি ভারতের ঐক্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগাে যাঁকে বলেছিলেন, কংগ্রেসের চেয়েও বেশি কংগ্রেস।” তা হলে ঠিক কী ঘটেছিল? কী করে দেশভাগের মতাে বিধ্বংসী একটা ঘটনা ঘটতে পারল, যা চল্লিশের দশকের গােড়াতেও কল্পনা করা যেত না, ১৯৪৬ সালের আগে যে বিষয়ে কোনও বুদ্ধিগ্রাহ্য ধারণাও জন্মায়নি? কেন এবং কখন ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত, উদারপন্থী সংবিধানবাদী, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী মহম্মদ আলি জিন্না শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন, ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের ভাষায়, এক ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্ট দানব’, যে সেই জগৎকেই টুকরাে-টুকরাে করে, যার মহানুভবতা তাকে নির্মাণ করেছে?
আমার মনে হয়, দেশভাগের আরও কিছু ট্র্যাজেডি আমাদের মনােযােগ দাবি করে। এই যে জীবন্ত একটি ভূখণ্ডকে দু-ভাগ করা, তা কি ভারতের স্বরূপকেই প্রশ্ন করে না? জিন্নার দাবি অনুসারে মুসলিমরা যদি একটি পৃথক জাতি হয়, তা হলে ভারত | আসলে কী? দেশভাগের পর যা রইল, তা কি একটি জাতি নয়? আমরা কি অনেকগুলি গােষ্ঠীর একটি সমষ্টি? নাকি জিন্নার কথামতাে, অনেকগুলি জাতির সহাবস্থান মাত্র ? নিশ্চয়ই ভারত এ সব কিছু নয়, ভারত একটি জাতি। আমরা বলছি বলে নয়, ইতিহাসও তাই বলে। জাতি হিসেবে আমরা সমান অধিকার দিতে চাই সব নাগরিককে, এবং সকলকে এক নাগরিকত্ব দিতে চাই। তা হলে কী করে এবং কেন আমরা ধর্ম, জাত, গােষ্ঠী প্রভৃতি বিভিন্ন পরিচয় তৈরি করি, ভারতের সেই ঐক্য যা নিয়ে আমরা এত গর্ব করি, তাকেই আবার খণ্ডিত করার চেষ্টা করি? যারা দুর্গত, তাদের সাহায্যের জন্য আর ঐতিহাসিক, সামাজিক অসাম্য দূর করার জন্য আমরা সংরক্ষণ নীতি গ্রহণ করি, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ভ্রান্তদৃষ্টি থেকে সমাজগঠন। শেষ বিচারে এটাই তাে ছিল ‘মুসলিমদের একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে জিন্নার কেন্দ্রীয় এবং ক্রমাগত দাবি, কারণ তিনিও চেয়েছিলেন মুসলিমদের একটি বিশেষ অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে, সরকারি চাকরিতে। গাঁধীজি আপত্তি করেছিলেন। অন্যরা প্রথমটা গােড়ায় অরাজি হলেও, পরে আশ্চর্য ভাবে সংরক্ষণের পিছল সিঁড়ি বেয়ে ওঠার জন্য তাড়াহুড়াে শুরু করলেন। কিন্তু এই চিন্তা জিন্নার যাত্রাপথে আমাদের যাত্রাকে ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে।
আবার ফিরে তাকানাে যাক। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে, সেই সময়ের বড় বড় সংবিধানবাদীদের মধ্যে জিন্না আর নেহরুই মুসলিমদের ‘বিশেষ অবস্থান’-এর সমর্থক হয়ে উঠলেন। জিন্না প্রত্যক্ষ ভাবে, নেহরু পরােক্ষে। সব ভারতীয়রাই সংবিধানের চোখে সমান, জিন্না তাই মুসলিমদের জন্য বিশেষ অবস্থান দাবি করলেন, এবং জিন্না যে মুসলিমদের একমাত্র মুখপাত্র, নেহরু সেই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করলেন, এ ভাবে দু’জনেই ভারতীয়দের মধ্যে মুসলিমদের বিশেষ অবস্থানের সমর্থক হয়ে উঠলেন। দুঃখের কথা, এই দুই নেতাই মুসলিমদের মুখপাত্র হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। এটা ঘটল

এই কারণেই যে, এঁরা দু’জনেই ইউরােপীয় চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং সামাজিক বিন্যাসে এমন গভীর ভাবে প্রভাবিত ছিলেন যে তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতিচেতনা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন। তা হলে কে ভারতীয় ঐক্য নিয়ে কথা বলার জন্য থেকে গেলেন? দুঃখের কথা, কেবল গাঁধী।
নিষ্ঠুর সত্য এই যে, দেশভাগে যা হওয়ার কথা ছিল, হল ঠিক তার উলটো। দুই জাতির মধ্যে বিদ্বেষ দূর করার চাইতে বরং হিন্দু, মুসলিম, শিখ প্রভৃতি পরিচয় আরও উসকে দিল। দুর্ভাগ্যের কথা, মুসলিম, তফসিলি জাতি বা জনজাতির জন্য সংরক্ষণ এই সব পরিচয়ের দূরত্ব কমিয়ে দেয় না, বরং তার উপর দাগ বােলায়, তার শিকড়ে জল সেচন করে। স্বার্থসিদ্ধির সার দিয়ে পরস্পর-বিচ্ছিন্নতাকে জাগিয়ে রাখা হয়। সংরক্ষণ সমাজের মধ্যে দেওয়াল তােলে, ফলে শেষ অবধি জাতির একাত্মতাবােধ টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। ভারতে মুসলিমদের জন্য বিশেষ অবস্থান’-এর দাবি শেষ পর্যন্ত সেই কাজটাই করল।
কিন্তু এ তাে হল যা ঘটে গিয়েছে, তার একটা কাজ-চালানাের মতাে স্কেচ। যে ঐতিহাসিক সময়ের কথা আমরা বলছি, তার কী হবে? কোন সময় সেটা? সহজ উত্তর, সময়টা হল ১৮৫৭ এবং ১৯৪৭ সালের মধ্যে। ১৮৫৭ চিহ্নিত হয়ে রয়েছে যে ঘটনায়, তা হল ভিন দেশের বণিকদের দ্বারা ভারতের সার্বভৌমত্বের চিহ্নগুলি ছিনিয়ে নেওয়া। যদিও অষ্টাদশ শতকের গােড়া থেকেই ভারতে মুঘল সম্রাটদের কর্তৃত্ব কমতে শুরু করেছিল, তবু তার তুলনাতেও, ১৮৫৭ ছিল এক হিংস্র দখলদারি। এরই পশ্চাৎপটে আমাদের বিংশ শতকের প্রথম চার দশক পাড়ি দিতে হবে, ১৯০৬ সালের সিমলা চুক্তি থেকে ১৯৪৬ সালের ভারতের স্বাধীনতা আইন পর্যন্ত সময়কালটাকে বুঝতে হবে। এই চার দশকে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসীদের জীবন উল্লেখযােগ্য ভাবে বদলে যায়, এবং তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের ঘটনা এবং সমস্যার উপরও প্রভাব ফেলে। ‘বিশেষ সংরক্ষণ’-এর দাবি তুলে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের গণনার মধ্যে যে একটা পক্ষপাতিত্বের কথা থেকে সেই যাত্রার শুরু, শেষ অবধি দেশের ব্যবচ্ছেদে তার শেষ। এই দুঃখজনক যাত্রার এটাই হল বৌদ্ধিক, ভৌগােলিক এবং ঐতিহাসিক সীমা। কিছুটা শঙ্কিত ভাবে এই সংকটময় পথে আমি পা বাড়াচ্ছি, বুঝতে চাইছি কী হয়েছিল। কী করে ১৯৪৭ সালের মহাসংকট উপস্থিত হল? এমন বৃহৎ পরিবর্তন আনল যে ঘটনা, তার সম্পর্কে নিশ্চয়ই সকলে একমত হতে পারেন না, অনেকেই বিরুদ্ধ মত পােষণ করবেন, তবুও..।
“ভারতে যে মতটা খুব প্রচলিত, তা হল— দেশভাগ এক শােচনীয় ব্যাপার, এক জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ’, তাই ভারতে এ বিষয়ে আলােচনার ঝোঁকটা পড়ে “উপমহাদেশের ঐক্য বজায় রাখতে ব্যর্থতার জন্য দোষারােপের উপর”, এবং দেশভাগের ভয়ানক ফল নিয়ে আক্ষেপ। এক প্রশংসনীয় নিরপেক্ষতার সঙ্গে সাধারণত কংগ্রেস নেতাদেরই এ বিষয়ে প্রধানত দায়ী করা হয়, তাকে তারিফ করা হয়: তাঁরা যদি এই করতেন, বা ওটা করা থেকে বিরত থাকতেন, তা হলে দেশভাগ হত না। অন্য দিকে, পাকিস্তানে কিন্তু,

স্বাভাবিক ভাবেই, দেশভাগ যে না-ও হতে পারত, সে কথাটা গ্রহণযােগ্য বলে মনে করা হয় না, এবং ইতিহাসের গভীরে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদের উৎসের সন্ধান করে চলা হয়, তার সঙ্গে একটি মুসলিম দেশ বা জাতির প্রতিষ্ঠার যােগসূত্র স্থাপন করে পৃথক রাষ্ট্রের জন্মকে অবশ্যম্ভাবী বলে দেখানাে হয়।
এই অনুসন্ধান, এবং এই বইয়ের এটাই হল উৎস এবং সারাংশ। বইটির নির্মাণ অবশ্য আরও সরল। কেননা আমাদের সেই যুগান্তকারী দশকগুলির ওঠা-পড়ার নানা চ্যালেঞ্জের মােকাবিলা করেই যাত্রা করতে হবে।
এখানে একটি অসুবিধার কথা জানিয়ে রাখা ভাল। এই রচনা কি কেবল দেশভাগের একটি পুনর্বিবরণ? যা যা ঘটেছিল, তার সময়ানুক্রমিক কাহিনি? আমার এক বন্ধু স্কটল্যান্ড থেকে সম্প্রতি আমায় লিখেছেন যে ইতিহাসের জনক হেরােডােটাস গ্রহণ। করেছিলেন এই দৃষ্টিভঙ্গি যে, ইতিহাস হল নিয়মানুসারে পরীক্ষিত নানা তথ্যের সমাহার। আবার, বিখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবন খালদুন দ্য মুকাদ্দিমা’-তে ইতিহাস কী, বা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে যা বলেছেন
(ইতিহাস রচনা) বহু উৎস এবং অনেক বিষয়ে জ্ঞান দাবি করে। তার জন্য কল্পনাপ্রবণ মন এবং সর্বাত্মক চিন্তা চাই, যাতে ঐতিহাসিক সত্যের কাছে পৌঁছতে পারে, এবং তার ভুলচুক না হয়। যদি যে ভাবে ইতিহাস বাহিত হয়ে এসেছে তাকেই সে বিশ্বাস করে, পরম্পরা থেকে যে সব নীতি তৈরি হয়েছে তার পরিষ্কার ধারণা যদি তার না থাকে, রাজনীতির মৌলিক তথ্য, সভ্যতার প্রকৃতি, মানবসমাজ গঠনের শর্ত যদি সে
জানে, অধিকন্তু, প্রাচীন বিষয়বস্তুর সঙ্গে সমকালীন বিষয়ের তুলনামূলক মূল্যায়ন যদি সে না করে, তবে সে হোঁচট খাবে, পিছলে যাবে, সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হবে। ঐতিহাসিকরা, কোরানের টীকাকাররা, জ্ঞানী মানুষেরা প্রায়ই তাঁদের কাহিনি এবং ঘটনার বিবরণে ভুল করেছেন। তাঁরা যা শুনেছেন তাকেই গ্রহণ করেছেন, তার মূল্যায়ন করেননি। তাঁরা ঐতিহাসিক ঘটনার অন্তর্নিহিত নীতিগুলাের সঙ্গে ঘটনাগুলি মিলিয়ে নেননি, একই ধরনের বিষয়ের সঙ্গে তাঁরা তুলনা করেননি। তাঁরা দর্শনের নিরিখেও অনুসন্ধান করেননি, বস্তুর প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের সাহায্য নিয়ে, কিংবা ইতিহাসের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চাননি। সেই জন্য তাঁরা সত্যের পথ থেকে সরে গিয়ে ভিত্তিহীন এবং ভ্রান্ত ধারণার মরুভূমিতে পথ হারিয়েছেন।
অর্থাৎ আমাকে থাকতে হবে এই সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্পষ্ট নির্দেশাবলির সীমার মধ্যে। জিন্নার ‘কায়েদ-এ-আজম’ রূপে বিবর্তনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই শর্তগুলিই আমি পূরণ করার চেষ্টা করব।
স্বীকার করে নিচ্ছি, কোনও বিবরণই নৈর্ব্যক্তিক নয়, তা হওয়া সম্ভবও নয়। যাই হােক না কেন, আমার বিবরণ বা ব্যাখ্যা তাে সেই দহনকালের ব্যাখ্যা, যখন ভারত নামের এই প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐক্যভূমিকে জোর করে ব্যবচ্ছেদ করা হয়েছিল। ঘটনার

বিবরণ যে কোনও বৌদ্ধিক সিদ্ধান্ত, তত্ত্বের অনুসারী, কিংবা ব্যক্তিনিরপেক্ষ, সে দাবি আমি করতে পারি না। বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাে নয়ই। কেন এত প্রাচীন দেশটিকে ভাঙা হল? এই প্রশ্ন আজও আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায়, এবং প্রতিটি ব্যক্তি তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেই বিচিত্র ঘটনাপ্রণালীর অর্থ করে।
পাশ্চাত্যের কোনও দার্শনিক সিদ্ধান্ত থেকে কি এই বৃহৎ, পীড়াদায়ক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে? আমার তা বিশ্বাস হয় না। তা হলে কি কেবল ঘটনার পুনর্বিবরণে তা পাওয়া যাবে? আবারও, স্পষ্টতই এর উত্তর, না। আমরা যতদিন না নিজেরা প্রায় সেই যুগে ফিরে যেতে পারি, সেই সব কলহে শ্বাস নিতে পারি, সেই সব বিতর্কে যােগ দিতে পারি, যতটা নিকটে যাওয়া সম্ভব যেতে পারি, তা হলে কেবল ঘটে-যাওয়া ঘটনাক্রম, বা তার উপরে যা কিছু মন্তব্য করা হয়েছে সে সব বলে কোনও লাভ নেই। সে সময়ের প্রবল আবেগ বুঝতে গেলে অন্তত এটুকু আমাদের করতেই হবে। আর সেই আবেগে স্পন্দিত না হলে ইতিহাসের সেই প্রকম্পনের বিষয়ে কোনও কথা বলা চলে না। আমাদের নিজেদের স্বার্থরঞ্জিত কাচের মধ্যে দিয়ে দেখলে সেই বিশাল ট্র্যাজেডির কেবল একটি বিষন্ন কৌতুকনাট্যই আমরা রচনা করতে পারব।
তথ্যসূত্র
১. লয়েড রুডলফ অ্যান্ড সুজান হেবার রুডলফ, পােস্টমডার্ন গাঁধী অ্যান্ড আদার এসেজ: গাঁধী ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড অ্যাট হােম, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগাে প্রেস, সহ-প্রকাশক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ইন্ডিয়া, ২০০৬, পৃ-২৭২।
২. মুশিরুল হাসান (সম্পাদিত), ইন্ডিয়া’জ পার্টিশন: প্রােসেস, স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড মােবিলাইজেশন, ও ইউ পি, দিল্লি ১৯৯৩, ভূমিকা (পৃ ১০ ও ৩৬)
৩. রুডলফ অ্যান্ড রুডলফ, পােস্টমর্ডান গাঁধী, পৃ-৬৪
৪. আরবি শব্দ, যার অর্থ মুখবন্ধ (প্রিফেস) বা ভূমিকা (ইন্ট্রোডাকশন), ইবন খালদুন-কৃত বিশ্ব ইতিহাস কিতাব আল-ইবর (বুক অফ অ্যাডভাইস), ১৩৭৭, যে গ্রন্থে ‘ইউনিভার্সাল হিষ্ট্রি বিষয়ে মুসলিমদের প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গি পাওয়া যায়।
৫. ইবন খালদুন-এর লেখা দি মুকাদ্দিমহ, অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু হিষ্ট্রি গ্রন্থের ভূমিকা থেকে সংগৃহীত। মূল আরবি ভাষা থেকে বইটি অনুবাদ করেন ফ্রানজ রােজেনথাল এবং সংক্ষিপ্তকরণ ও সম্পাদনা করেন এন জে দায়ুদ, বলিনজেন সিরিজ, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস।

প্রথম অধ্যায়
ভারত ও ইসলাম
ভারত-ইসলাম– জাতীয়তা
হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত থেকে কী ভাবে মহম্মদ আলি জিন্না পাকিস্তানের কায়েদ-এআজম’ হয়ে উঠলেন, সেই অনুসন্ধানের যাত্রাপথ শুরু হল এখান থেকে। মুসলিমরা একটি পৃথক জাতি, এই অতি-বিতর্কিত তত্ত্বই যদি ‘পাকিস্তান’কে সৃষ্টি করে থাকে, তা হলে কী করে সেই ‘মুসলিম জাতি’-র একটি অংশ আবার সেই জাতিকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে, ভয়ঙ্কর হিংসাত্মক অভিজ্ঞতা আর অগণিত মানুষের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আলাদা হয়ে গেল? বাংলাদেশ কেন আলাদা হল? এ বিষয়ে আমাদের বিশদে চিন্তা করতে হবে। কিন্তু তারও আগে দেখতে হবে ভারতে ইসলামের যাত্রার শুরু এবং শেষ। এও ভাবতে হবে, যা ভারতের মাটিতেই বৃদ্ধি পেল, তা কেন শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষুদ্রতা বেছে নিল?
ভারতে ইসলামের অভিজ্ঞতা আসলে এক বিস্ময়কর নকশা, যা আক্রমণ থেকে সহাবস্থান, এবং তার থেকে এক রকমের আত্তীকরণ বা মিশে যাওয়ায় গিয়ে শেষ হয়। ভারতের ঐক্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তা শেষে ভারতকেই বাতিল করে এক পৃথক ইসলাম জাতিকে খোঁজে, এবং শেষ অবধি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পােকায়-খাওয়া পাকিস্তানে এসে পৌঁছায়। এটা কী করে সম্ভব হল যে, যে ভারত মধ্যপ্রাচ্যের চেয়ে বেশি মুসলিমকে আশ্রয় দিয়েছে, সেই দেশ এই মহান ধর্মের ধ্বজাধারী না হয়ে বিভক্ত দেশভূমিতে পরিণত হল? তা হলে কি ইসলাম বরাবরই এ দেশে আক্রমণকারীর ধর্ম বলে বিবেচিত হয়ে এসেছে, যাকে এক দিন বেরিয়ে যেতেই হবে? নাকি দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসলাম, ইসলামীয় সংস্কৃতি এবং মুসলিম জনসাধারণ ভারতেরই বাসিন্দা হয়ে উঠেছিল, এই মাটিরই সন্তান, এই ভারতীয় উপমহাদেশের বহুস্তরীয় সংস্কৃতির অঙ্গ? তা যদি হয়, তা হলে কেন এবং কী করে মহম্মদ আলি জিন্না বলতে পারলেন, ‘মুসলিমরা একটি পৃথক জাতি’? আরও গুরুতর প্রশ্ন, নেহরু, পটেল থেকে শুরু করে কংগ্রেসি নেতাদের একটি গােটা প্রজন্ম কেন গ্রহণ করে নিল

এই ভ্রান্ত ধারণা? আমাদের দেশকে কেন ব্যবচ্ছিন্ন হতে দিল? সেটাও কিন্তু আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়।[১]
স্পষ্টতই, খ্রিস্টধর্ম এবং জরথুষ্ট্রের ধর্মের মতােই, ইসলামও এ দেশের নিজস্ব ধর্ম নয়। তার উৎপত্তি অন্যত্র, ভারতে তার আগমন আক্রমণকারীর তরােয়ালের সঙ্গে। ফলে তা অন্যের ধর্ম হয়েই এসেছে, এবং গােড়ায় ভিনদেশের ধর্ম হয়েই থেকেছে। কিন্তু ভারত হল সংস্কৃতির একটা সাগর, যেখানে পলির একটি স্তরের উপর আর একটি স্তর এসে পড়ে, দুটি স্তর মিশে এক হয়ে যায়, তৈরি হয় সেই ভারতের অভিন্ন অঙ্গ। এর একটা স্তর থেকে অন্য স্তরকে আলাদা করে, কোনটি মৌলিক ভিত্তির স্তর, সেটা নির্ণয় করা এক দুরূহ কাজ। ভিত্তিটা হল বৈদিক, যদিও অনেক ঐতিহাসিক সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন, তার পর আসে ‘ইন্ডিক’ (ভারতীয়) এবং তারপর লৌকিক (ইন্ডিজেনাস)। গিরিলাল জৈন বলেছেন, “ইসলাম হল এক সামগ্রিক জীবনদর্শন।” তিনি লিখেছেন, “আধুনিক মন ইসলামকে কিছুতেই অনুধাবন করতে পারে না, কারণ ইসলাম হল একটি সামগ্রিক তত্ত্ব। ইসলামীয় সমাজ ইসলাম ধর্মে প্রােথিত, উলটোটা নয়। এই কথাটার উপর খুব জোর দিতে হবে যে ইসলামীয় সমাজ আসলে ঈশ্বরকেন্দ্রিক, ধর্মশাসিত নয়।”[২]
ভারতে মুসলিমদের আগমন হয় তিনটি আলাদা পর্যায়ে, যা প্রায় আট শতাব্দী ধরে। চলে। প্রথম পর্যায়ে আরবরা আসে, সপ্তম এবং অষ্টম শতাব্দীতে। সিন্ধুতে এসে তারা কয়েকটি যুদ্ধ করে ফিরে যায়। করাচির ৪০ কিলােমিটার দক্ষিণে রয়েছে বানভাের নামে একটি পরিত্যক্ত নগর। অনেকে বলেন, ওখানেই প্রথম হানা দিয়েছিলেন মহম্মদ বিন-কাসিম। মনে করা হয়, ভারতের প্রথম মসজিদ এখানেই গড়ে উঠেছিল। এখন তার ভগ্নদশা। অন্য দিকে মালাবার উপকূলও ভারতের প্রথম মসজিদের দাবি করে। তবে ভারতে মসজিদের জন্মের ইতিহাস আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় নয়। দশম এবং একাদশ শতাব্দীতে আফগান এবং ফার্সিরা আসে, তার পরবর্তী পর্যায়ে আসে তুর্কি এবং মােগলরা, দ্বাদশ থেকে ষােড়শ শতাব্দীতে। প্রথম পর্যায়ের আক্রমণ থেকে খুব কমই আরব এ দেশে থেকে গেল, যেমন দ্বিতীয় পর্যায়ে নাদির শাহ প্রভৃতি ফার্সিদের আক্রমণের সূত্রে থেকে গিয়েছিল খুব কম ফার্সি। কিন্তু তুর্কি বা আফগানদের সম্পর্কে সে কথা চলে না। বেশ কিছু আফগান এখানে রয়ে গেল, একেই তাদের বাসভূমি করে তুলল। মােগলরাও ক্রমশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে মিশে গেল, এবং সব অর্থেই ‘হিন্দুস্তানি হয়ে উঠল। আবারও বলতে হয়, এই ইসলাম আক্রমণের পর্যায়গুলির বিবরণ দেওয়া আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়, আমাদের উদ্দেশ্য সেগুলির কিছু বিশেষ ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যের বিশ্লেষণ করা।
পারস্য-প্রভাবিত তুর্কিদের ভারতে আসাকে ইতিহাসবিদরা প্রায়ই ‘মুসলিম বিজয়’ বলে থাকেন। আমার মনে হয় এটা অদ্ভুত, কারণ ত্রয়ােদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী অবধি পুরাে সময়টাকে ‘মুসলিম যুগ’ বলাটা ভুল, অতিসরলীকরণ। এর ফলে বেশ কিছু ধারণাগত এবং শব্দগত ভুলের সৃষ্টি হয়। প্রশ্ন হল, আমরা কি কোনও

আক্রমণকে আক্রমণকারীর ধর্মবিশ্বাস (ইসলাম, পূর্বপুরুষ-পূজারী, শমন প্রভৃতি) দিয়ে চিহ্নিত করি, না কি সে যেখান থেকে এসেছে, সেই দেশ দিয়ে চিহ্নিত করি? অন্য দেশের ক্ষেত্রে কী হয়েছে, তা দিয়ে তুলনা করলেই এটা স্পষ্ট হয়। আমরা কি আমেরিকায় খ্রিস্টান-বিজয়ের কথা বলি? কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার অর্থাৎ ১৪৯২-এর পরবর্তী সময়টাকে কি আমেরিকার ‘খ্রিস্টযুগ’ বলে অভিহিত করা হয় ? স্পেন যদিও মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকার বিজয়কে দ্বিধাহীন ভাবে খ্রিস্ট ধর্ম দিয়েই বর্ণনা করেছিল, তবু সে সব দেশের সভ্যতাকে ধ্বংস করাটাকে কিন্তু ‘স্প্যানিশ বিজয়’ বলেই বিবৃত করা হয়, ধর্ম দিয়ে নয়। কেন সেখানে খ্রিস্ট ধর্মের কথা টানা হয় না? আর, সবচেয়ে বড় কথাটা এখানে না বলে পারছি না, ব্রিটেনের ভারত জয়কে কেন ‘ব্রিটিশ’ যুগ বলা হয়, খ্রিস্টান’ যুগ বলা হয় না? এই রকম ভুল ধারণার জন্যই আমাদের ভাষায় ভুল এসে যায়, আর এই বিরক্তিকর প্রশ্নটা চাড়া দিতে থাকে যে, ইসলামের ক্ষেত্রেই এই ব্যতিক্রম হল কেন? কোথা থেকে ইসলামীয় বিজয়ের ধারণা ঐতিহাসিকদের মধ্যে গেঁথে বসল? এই একবিংশ শতাব্দীতেও কিন্তু সেই ধারণা দিব্যি টিকে রয়েছে। এর ফলে বহু ক্ষতি হয়েছে, যার মধ্যে একটা হল জিন্নার ভারতের মধ্যে একটি পৃথক মুসলিম জাতির দাবি তােলা, ফলে একটি পৃথক ভৌগােলিক দেশ দাবি করা। সেই অংশ তখনকার ভারতের থেকেই বার করতে হয়েছিল, ফলে ব্রিটিশরা তাই করেছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু না, আবারও আমরা বডড বেশি তাড়াতাড়ি এগােচ্ছি।
মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাস লিখেছিলেন যে ফার্সি লেখকরা, তাঁরা যেহেতু ইসলামকে তাঁদের পৃষ্ঠপােষক নবাবদের সঙ্গে এক করে দেখতেন, তাই স্তাবকতা করে সেই সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে তাঁরা এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ কথা বলেছিলেন, “ভারতের। ইতিহাস শুরু হল ঠিক সেই সময়, যখন মুসলিমরা দিল্লি (কিংবা আগরা, মালওয়া) শহরের আশেপাশে রাজত্ব শুরু করে। এই মনােভাব শুরু হয় তুর্কি শাসনের সময় থেকেই, যদিও আশ্চর্য ভাবে, যে সময়ে এখানে দিল্লির সুলতানরা তাদের রাজত্বের গােড়াপত্তন করে, সেই সময়েই ইসলামের জন্মভূমি মােঙ্গলদের আক্রমণে ছারখার হয়ে যায়। মােঙ্গলদের বিপুল শক্তি, তাদের হিংস্রতা বহু ফার্সি-সংস্কারে দীক্ষিত তুর্কিকে নিজের জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য করে। ইরান এবং মধ্য এশিয়া থেকে তাদের অনেকে হিন্দুস্তানে আসে শরণার্থী হয়ে। এখানে তারা আশ্রয় পায়, নতুন সুলতানদের দরবারে চাকরিও পায়। ১২৫৮ সালের মধ্যে আব্বাসিদ বংশের রাজধানী বাগদাদ ধুলােয় মিশে যায়, তুর্কিরা ইসলামের খলিফা পদটি দখল করে। সুতরাং প্রশ্ন কেবল ভারতে ইসলামের আধিপত্যের ধারণা নিয়েই ওঠে না, তার জাগতিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতীকী মূল্য নিয়েও ওঠে। এর ফলে দিল্লিতে যে সম্প্রদায় আশ্রয় নিল, তাদের মধ্যে একটা সংরক্ষণশীল মানসিকতা গড়ে ওঠে। তাদের অনেকেরই মনে তুর্কি এবং মােঙ্গলদের অমানবিক হিংস্রতা এবং বিধ্বংসী আচরণের স্পষ্ট স্মৃতি ছাপ ফেলে। তাই তাদের আশ্রয়দাতা ভারতবর্ষ, এই নিরাপদ দেশটিই তাদের ‘অবশিষ্ট ইসলামি সভ্যতার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। এর পর থেকেই এই খানদানি প্রশাসক, যােদ্ধা

এবং বিদ্বানরা ভারতে মুসলিমদের উপস্থিতিকে ইসলামের আধিপত্য, এবং ইসলামের সঙ্গেই এক করে দেখে।[৫] অথচ বরাবরের মতােই, ‘হিন্দ[৬] তাদের আশ্রয় দিয়েছে, কিন্তু নিজেকে সম্পূর্ণ দেয়নি। কারণ তখন যে জাতীয়তাবাদ সুপ্ত ছিল, তা সে ভারতীয়ত্বই হােক আর হিন্দুত্বই হােক, ক্রমশ তা নিজের উপস্থিতি স্পষ্ট করতে লাগল। মােটামুটি এই সময়েই আল বিরুনি ভারতে আসেন, খানিকটা ছাত্র হিসেবে, খানিকটা শরণার্থী হিসেবে, এবং খেদ প্রকাশ করেন, ‘হিন্দুরা মনে করে তাদের দেশ ছাড়া আর কোনও দেশ নেই, তাদের মতাে কোনও রাষ্ট্র নেই, তাদের রাজার মতাে রাজা নেই, তাদের মতাে ধর্ম নেই, তাদের মতাে বিজ্ঞান নেই। তারা উদ্ধত, অসার আত্মশ্লাঘাপূর্ণ, আত্মগর্বী এবং অবিচলিত। যা তারা জানে, তা জানানাের বিষয়ে তারা কৃপণস্বভাব, নিজেদের দেশেরও অন্য জাতের কাছ থেকে সে জ্ঞান আড়াল করতে তারা অত্যন্ত যত্নশীল, বিদেশিদের থেকে তাে আরওই বেশি। আশ্চর্য নয় যে, আক্রমণকারী এবং আক্রান্ত, মুসলিম এবং হিন্দুর ব্যবধান এই ভাবে আমাদের সামাজিক চেতনা, সমাজব্যবস্থার মধ্যে ছড়িয়ে যেতে লাগল।
লক্ষ করতে হবে, বহিরাগত, আক্রমণকারী বা শরণার্থীদের প্রতি হিন্দুস্তানের মনােভাব কী ছিল, কী ভাবে তাদের সম্পর্কে কথা বলা হত। সেই সব শব্দব্যবহার বুঝিয়ে দেবে, সে যুগে সমাজ এই শরণার্থীদের গ্রহণ করেছিল, বর্জন করেছিল, না কি উদাসীন ভাবে সহ্য করেছিল। ধরা যাক, পাকি, নিগার, হুন, চিঙ্ক-এর মতাে শব্দ। অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী অবধি এই বিদেশিদের পরিচয় দেওয়া হত ভাষা কিংবা জাতি দিয়ে, ধর্ম দিয়ে নয়। যেমন, তুর্কি (তুরস্ক), খােরাসানি, কিংবা ইরানি বা আরব। কিংবা তারপর, ‘ম্লেচ্ছ’, অর্থাৎ বহিরাগত, অপরিচিত। (এই শব্দটির মধ্যে বর্জনের যে অর্থ রয়েছে, তা অনেক পরে সংযােজিত)। কিন্তু মুসলিমদের কাছে তারা আক্রমণকারীই হােক, কিংবা শরণার্থী, কিংবা ভারতের বাসিন্দাই হােক—হিন্দুমাত্রই হল ‘কাফির’, অর্থাৎ তাদের ধর্মে যারা বিশ্বাসী নয়। এর পাশাপাশি, তৎকালীন ফার্সি রচনায় যা-ই লেখা থাকুক না কেন সে সময়ের হিন্দুরা কিন্তু তাদের ধর্মবিশ্বাস বা ঐতিহ্যকে কখনওই এত বিশেষ বলে মনে করেনি যে তাদের কেবল ধর্মের তকমা দিয়ে চিহ্নিত করা সঙ্গত বলে ভাববে। যে সব গােষ্ঠী ভারতকে কখনও আক্রমণ করত, কখনও ভারতে আশ্রয় খুঁজত, মুসলিমদেরও তেমনই এক বহিরাগতদের দল বলেই গ্রহণ করেছিল। আত্মজীবনীর একটু ছোঁওয়া দিয়ে বলতে পারি, আমার ছেলেবেলায় দূর দেশ থেকে কোনও মুসলিম অভ্যাগত এলে বলা হত, ‘এক জন তুর্কি অতিথি এসেছেন। হিন্দুরা সব সময়ে সেই সব আক্রমণকে ‘ইসলামি আক্রমণ’ বলে মনে করত না, কেবল ‘মুসলিম আক্রমণ’ বলেও না। তা হলে কী করে এই শব্দগুলি ঔপনিবেশিক এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে ঐতিহাসিকদের কাছে সংজ্ঞাবাচক শব্দ হয়ে উঠল? আমার কাছে এর উত্তর নেই, উত্তর নেই এই প্রশ্নটিরও যা এর পর অভ্রান্ত ভাবে উঠে আসে: তা হলে কি ভারতীয় ইতিহাসচর্চাও পার্থক্যমূলক মনােভাবের জন্য অন্তত অংশত দায়ী, এবং তা-ও, কেবল ইসলামের সঙ্গে, কিংবা হিন্দু-মুসলিম পার্থক্য হিসেবে? না হলে
১০
কেন তারা কখনও ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের (ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগিজ) খ্রিস্টান আক্রমণকারী বলে অভিহিত করেনি? ব্রিটিশ ভারত ব্রিটিশই রইল, ‘মুসলিম ভারতএর পাশাপাশি খ্রিস্টান ভারত’ হল না?
আমি দেখেছি যে প্রাচ্য পণ্ডিত, ঔপনিবেশিক প্রশাসক, ধর্মীয় সংস্কারক, এমনকী জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরাও যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন এই দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে, এবং তা দীর্ঘায়িত করতে। এই দ্বন্দ্ব বিদেশি এবং স্বদেশির পার্থক্য করে এসেছে কেবল ধর্ম দিয়ে, এবং তাও আবার কেবল হিন্দু আর মুসলিমদের ক্ষেত্রে, খ্রিস্টানদের মতাে অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। সব সময়েই বর্তমান পরিচিতিকে অতীতে প্রসারিত করে তবেই বােঝার চেষ্টা করা হয়েছে।।
শিকাগাে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লয়েড রুডলফ বলেছেন যে আজকের ‘জাতি’-র মতাে প্রতিষ্ঠান বা ধারণাকে ধরে নিয়ে ইতিহাসে তাকে প্রতিষ্ঠা করা ঠিক হবে না। অর্থাৎ উনিশ শতকের শেষে বা বিশ শতকে ভারতীয়, হিন্দু বা মুসলিম জাতি বলে কিছু ছিল, তা ধরে নেওয়া যাবে না। তিনি বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের শব্দবন্ধ ‘কল্পিত জনগােষ্ঠী’৭ (ইমাজিনড কমিউনিটি) ব্যবহার করে বলেছেন, স্যর সৈয়দ আহমেদ খান বা জিন্নার মতাে মানুষেরাও প্রথমে একটা মুসলিম সম্প্রদায় ‘কল্পনা করে, তার পর ভারতে মুসলিম এবং জাতির কল্পনা করেছেন। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন বলেন যে জাতীয়তা একটি নির্মাণ করার বিষয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়, পরিবর্তনশীল বিষয়। কোনও প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক জনগােষ্ঠী, জাতিসত্তা যে থাতে পারে, সে ধারণাকে কবর দেওয়ার কৃতিত্ব তাঁরই। সঙ্গীত থেকে খাবার থেকে পােশাক, যা কিছু জাতীয় বা ঐতিহ্যবাহী বা মুসলিম, তার সব কিছুই আসলে নির্মাণ করা হয়েছে।[৮]’
যেমন, ইসলামের ক্ষেত্রে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা ইসলামের নিজস্ব গুণাগুণ, মূল্যবােধ এবং প্রকৃতি বােঝার জন্য সপ্তম শতাব্দীর আরবের দিকে তাকান। কিন্তু ম্যাক্স ওয়েবার[৯] যখন ইসলামকে চিহ্নিত করেন জাতীয় আরবি যােদ্ধাদের ধর্ম”[১০] বলে, তা ইসলামের চরিত্রের সাধারণীকরণ করার একটা অদ্ভুত পদ্ধতি বলে মনে হয়, যা খুবই বিভ্রান্তিজনক। মুসলিমদের সম্পর্কে এমন বর্ণনা মুসলিমদের যেন একটি নির্দিষ্ট ধাঁচার মধ্যে ফেলে দেয়— আগে তাদের ধর্মবিশ্বাস, ইসলাম, আরব দুনিয়ার সঙ্গে তাদের ভৌগােলিক যােগ, এবং তার পর এই ধারণা যে সব আরবের মধ্যেই যােদ্ধাদের চরিত্রের সমস্ত গুণাবলি বিদ্যমান। এতই সাফল্যের সঙ্গে এই চিহ্নিতকরণ করা হয়েছে যে এ সব ধারণা আজও রয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, হিন্দুস্তান এবং হিন্দুদের মুসলিমদের প্রতি একটা উদাসীনতা রয়ে গিয়েছে, যতদিন না মুসলিমরাই প্রশ্ন তুলেছে, তারা একটি পৃথক জাতি কি না। এই দাবি মূলত ভ্রান্ত, তাই তা নিয়ে এত বিভাজনের সৃষ্টি। জিন্না কেন এই কথাটার উপর জোর দিয়েছেন তা আমি খানিকটা বুঝতে পারি, কিন্তু কংগ্রেস কেন তা গ্রহণ করল তা বুঝি না। যদিও স্বীকার করতেই হয় যে বিচ্ছিন্নতাবােধের আরও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ছিল ভিন্ন ধর্মবিশ্বাস এবং উপাসনার রীতি, সামাজিক রীতিনীতিতে প্রচুর পার্থক্য, কয়েকটি বিশেষ রীতি এবং খাদ্যাভ্যাস যা একে অপরের
১১
কাছে গ্রহণযােগ্য নয়, সেই সঙ্গে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংসের স্মৃতি, আক্রমণ, খুনজখম, লুটপাট, এ সব কিছুর স্মৃতিই বড় পীড়াদায়ক, সে যুগের আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্য যা-ই হয়ে থাক না কেন।।
ভারতে ইসলামের ঐতিহ্য[১১]
এই পরিমাণ ধ্বংসলীলা সত্ত্বেও ইসলাম কী করে ভারতের সংস্কৃতির চালচিত্রের অংশ হয়ে উঠল, তা বুঝতে হলে এই দেশ এবং তার মানুষ সম্পর্কে গভীর ধারণা থাকা দরকার, ভারতের বিপুল ইসলামি ঐতিহ্যের ধারণা থাকা দরকার। এই বইয়ে বিশদে এ সব প্রশ্ন আলােচনার অবকাশ নেই। কিন্তু আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ভারতে ইসলামের ঐতিহ্যের মধ্যে নানা সম্প্রদায়, ভাষাগত গােষ্ঠী এবং সামাজিক শ্রেণির উপস্থিতি রয়েছে, যাদের সবাইকে ‘মুসলিম’ বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু ভারতে কখনওই মুসলিমরা একটিমাত্র গােষ্ঠী ছিল না, যেমন তারা পাকিস্তানেও নয়। কিন্তু দু’দেশেরই রাজনৈতিক মানুষজন তাদের তেমন ভাবে দেখতে চাইতে পারেন, বিশেষত ভােটে জেতার ‘নিঃস্বার্থ’ উদ্দেশ্যে। এটা খুবই দুঃখজনক, কারণ এই ধরনের মনােভাব থেকেই বিভাজন তৈরি হয়, একটা বাদানুবাদ তৈরি হয় যা দু’পক্ষকে আরও দূরে ঠেলতে থাকে, সামাজিক আদানপ্রদান কমতে থাকে, পারস্পরিক বিদ্বেষ আরও ইন্ধন পায়, যা আবার রাজনৈতিক সুবিধাবাদের সুযােগ তৈরি করে।
আরও একটা বিষয়ের উপর জোর দেওয়া দরকার। কোরান শরিফ, যা পয়গম্বরের কাছে আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয়, কোন মাধ্যমে তা ভারতের ভিন্নভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছতে পারল? কী করে ভারত বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুসলিমের বাসভূমি হয়ে উঠল ? নিশ্চয়ই কোরান অনূদিত হয়েছিল এখানে ‘অনুবাদ’ বলতে কেবল ভাষান্তরই নয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অঙ্গীভূত হওয়াই বােঝানাে হয়। ভাষা এবং সামাজিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে কোরানই ভারতীয় সাহিত্যের ধারা এবং সংযােগের নানা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে উপযােগী হয়ে ওঠে। ফার্সি এবং আরবি লিপির ব্যবহার ক্রমশ ইসলামি শব্দাবলি ব্যবহারের সুযােগ করে দেয়, ফলে সেই সব ধারণা বােঝানােও সহজ হয়। ক্রমশ এগুলিই ভারতে দেশীয় ভাষায় ইসলামীয় ঐতিহ্যের বাহক হয়ে ওঠে। এর পর থেকে, যে সব ধারণা আদতে আরবি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি ভারতীয় মুসলিম চিন্তাধারায় প্রবেশ করে, প্রধানত তাদের বাবৈশিষ্ট্য, লিপি এবং পরস্পর সংযােগের ভাষার মধ্যে দিয়ে।
সুতরাং ভারতের ইসলামীয় ঐতিহ্য একই সঙ্গে ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলামকে মানিয়ে নিয়ে, এবং ভারতীয় মুসলিমদের বিশ্বের ব্যাপকতর মুসলিম সমাজের সঙ্গে সংযােগ সাধন করতে সাহায্য করে। এই ইসলামি ঐতিহ্যগুলির দুটি ধারা লক্ষ করা
১২
যায়, একটি লাহৌর থেকে দিল্লি এবং তারপর দক্ষিণে হায়দরাবাদ পর্যন্ত, দিল্লির পূর্বে পটনা এবং পশ্চিমে আমদাবাদ পর্যন্ত। এখানে মূল সাংস্কৃতিক ধারাটি হল ফার্সি। তার বাইরে, সিন্ধুর কিছু অঞ্চলে, থর পারকর কিংবা নগরপারকর, রাজপুতানা, তামিলনাড়, মালাবার, কাশ্মীর এবং বাংলায়, ইসলাম স্থানীয় রীতিনীতি এবং বাগবৈশিষ্ট্যের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে পড়েছিল ইসলাম।[১২]
যে সব এলাকায় ফার্সি ইসলামীয় ঐতিহ্যই প্রধান ছিল, সেখানে একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতি শাসকদের সংস্কৃতি বলে পরিচিত হল, এঁরাই এখনও ‘আশরফ’[১৩] পরিচয়ে পরিচিত— অর্থাৎ ‘বিশ্ব-অধিবাসী’, যাঁদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন অন্য সংস্কৃতি থেকে। এই পরিচয় হয়তাে কিছু অংশের ক্ষেত্রে সত্য, কিন্তু আবার এও ঠিক, অধিকাংশ মুসলিমই এই সাংস্কৃতিক পরিচয় দাবি করে থাকেন। তাঁরা মনে করেন, অন্য দেশ থেকে তাঁরা এসেছেন শাসন করতে, ক্ষমতা অধিকার ও প্রয়ােগ তাঁদের স্বাভাবিক অধিকার। ফার্সি-ইসলামীয় আচার-আচরণ তাঁরা পালন করতেন, এবং তাঁদের জগতে তাঁরা সেই হিন্দুদেরই প্রবেশাধিকার দিতে রাজি, যাঁরা তাঁদের কাজে সহায়তা করতেন, যাঁরা মুসলিম সংস্কৃতির আচার আচরণ খানিক রপ্ত করে নিতে তৈরি ছিলেন— যেমন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ কিংবা কায়স্থ গােষ্ঠী। ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের গ্রহণ করতে কিন্তু তাঁরা দ্বিধা করতেন, কারণ এঁরা আসলে গরিব শ্রেণি থেকেই আসতেন বেশি। আশরফরা মনে করতেন, এই ধর্মান্তরিত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁদের জগতের কোনও যােগাযােগ নেই, ওরা ‘মাসাল্লাহ’, যারা কাঠ কাটে, জল বয়ে আনে, ওরা হল ‘আতরফ।[১৪] কিন্তু অষ্টাদশ শতকের মধ্যে দেখা গেল, যে ভিত্তির উপর ভারতে ফার্সি-ইসলামীয় সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা অতি দ্রুত দুর্বল হতে শুরু করেছে। উনবিংশ শতকের গােড়ায় মুসলিম ‘ক্ষমতা সংকীর্ণ হয়ে অযােধ্যা, হায়দরাবাদ এবং উত্তর-পশ্চিমের প্রান্তিক অঞ্চলে। সীমায়িত হয়ে যায়। হয়তাে এই সময়ে ইসলামের বিকাশ ঘটে বলেই, অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকের সময়টা ভারতে ফার্সি সংস্কৃতি তার উচ্চতম পর্যায়ে পৌঁছয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আসে তার সমাপ্তি, একটি আরবি প্রবচন যেমন বলে, ‘বাড়ি এক বার তৈরি হয়ে গেলেই তার ক্ষয় শুরু হয়।
একদা-বিখ্যাত তৈমুর বংশের পতন এবং তার ফলস্বরূপ যে বিশৃঙ্খলা, সে সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল বিবরণ পাওয়া যায় সি পি সন্ডার্সের লেখায়, যিনি ছিলেন অফিশিয়েটিং কমিশনার এবং লেফটন্যান্ট গভর্নরের এজেন্ট। ১৮৫৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার, যখন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিচারের অভিনয় চলছিল, সে সময় তাঁকে জেরা করেন জাজ অ্যাডভােকেট।
প্রশ্ন: কেন দিল্লির শাসকরা ব্রিটিশ সরকারের প্রজা এবং পেনশনপ্রাপক হয়ে উঠলেন, আপনি কি আদালতকে সে কথা বলতে পারেন?
উত্তর: দিল্লির সম্রাট শাহ আলম বন্দি হলেন গুলাম কাদিরের হাতে, তাঁর চোখ অন্ধ করে দেওয়া হল, নানা ভাবে তাঁর অমর্যাদা করা হল, তার
১৩
পর ১৭৮৮ সালে তিনি মরাঠাদের হাতে পড়লেন। যদিও দিল্লির উপর তখনও সম্রাটের নামকাওয়াস্তে শাসন, তাঁকে বন্দি করা হল। সশ্রম কারাদণ্ড, ১৮০৩ সাল অবধি। সেই বছরই জেনারেল লেক আলিগড় জয় করার পর ব্রিটিশ সৈন্য নিয়ে দিল্লিতে এলেন। দিল্লি থেকে ছয় মাইল দূরে পটপরগঞ্জে মরাঠা সেনাদের আক্রমণ করলেন জেনারেল লেক, তাদের সম্পূর্ণ পরাভূত করলেন। মরাঠারা শহর এবং কেল্লা ছেড়ে পালিয়ে গেলে সম্রাট শাহ আলম জেনারেল লেককে একটি বার্তা পাঠান, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করে। ১৮০৩ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর, যে দিনটি ১৮৫৭ সালের যুদ্ধের সাফল্যের জন্য আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে, সে দিনটিতে ব্রিটিশ সেনা ঢুকল দিল্লিতে। সেই সময় থেকে দিল্লির সম্রাটরা ব্রিটিশের পেনশনার হয়ে গেলেন, এবং মরাঠাদের অধীনে যে কষ্টকর বন্দিদশা ছিল, তার চেয়ে তুলনায় সহনশীল অবস্থায় প্রহরার মধ্যে রইলেন। বন্দি উত্তরাধিকার সূত্রে সম্রাটের খেতাব পায় ১৮৩৭ সালে। নিজের প্রাসাদের বাইরে তাঁর আর কোনও ক্ষমতাই রইল না, যারা তাঁর নিজস্ব কর্মচারী তাদের খেতাব দেওয়ার অধিকার তাঁর ছিল কিন্তু তার বাইরে আর কারও প্রতি সেই ক্ষমতা প্রয়ােগের অধিকার রইল না। তিনি এবং তাঁর উত্তরাধিকারীই কেবল কোম্পানির আদালতের আইনের বাইরে থাকলেন। তবে তাঁরা সুপ্রিম সরকারের অধীন ছিলেন।
প্রশ্ন: বন্দির সশস্ত্র রক্ষীর সংখ্যা কি বেঁধে দেওয়া হয়েছিল?
উত্তর: বন্দি লর্ড অকল্যান্ডকে বলেছিলেন, তাঁর দেখাশােনার জন্য যত জন লােক প্রয়ােজন বলে তিনি মনে করেন, তাই যেন রাখা হয়। গভর্নর জেনারেল উত্তরে বলেন, বন্দি তাঁর বরাদ্দ টাকা থেকে যত জনকে রাখতে পারেন, তাই যেন তিনি রাখেন।
প্রশ্ন: বিদ্রোহ শুরুর সময়ে সরকার বন্দিকে কত টাকা পেনশন দিত, তা কি বলতে পারেন?
উত্তর: তিনি প্রতি মাসে এক লক্ষ টাকা পেতেন, তার মধ্যে ৯৯ হাজার টাকা দিল্লিতে দেওয়া হত, এবং হাজার টাকা দেওয়া হত লখনউতে তাঁর পরিবারকে। এ ছাড়াও দিল্লির আশেপাশে সম্রাটের নিজস্ব জমির রাজস্ব বাবদ মাসে আরও দেড় লক্ষ টাকা পেতেন। এ ছাড়া দিল্লির জমি ও বাড়ি থেকে ভাড়া বাবদ বেশ কিছু টাকা পেতেন।
এই ভাবে শেষ হয় মহান ‘মুঘল সুলতান’ বংশ। ১৮৫৭ তাে ছিল তার এপিটাফ মাত্র, আসলে জেনারেল লেক-এর দিল্লি বিজয়ের পর আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
১৪
১৮৩০ সালের পর থেকেই ফার্সি-ইসলামি সংস্কৃতি ক্রমশ ক্ষয় হতে লাগল, কিংবা বলা যায়, দ্রুত ভেঙে পড়ল। প্রধান কারণ অবশ্যই উদীয়মান ব্রিটিশ ক্ষমতা, যে ক্ষমতা উত্তরােত্তর আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছিল। ব্রিটেনের সংস্কৃতিই দেশজয়ের সংস্কৃতি, তারা আসামাত্রই ভারতের বড় বড় অঞ্চল শাসন করতে শুরু করল। বাণিজ্যের নিরাপত্তার লক্ষ্যে তারা জমির মালিকানা এবং রাজ্য জয়ের ছাড়পত্র লাভ করতে উদ্যত হল। তবে ব্রিটিশদের ঔদ্ধত্যই কিন্তু মুঘল পতনের একমাত্র কারণ নয়। ব্রিটিশরা বাইরে থেকে সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে, কিন্তু তৎকালীন হিন্দু এবং মুসলিমরা তাকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেয়। মুঘল ক্ষমতার যেটুকু দেখনদারি ছিল, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের পর তাও শেষ হল। ফার্সি নান্দনিকতার আধিপত্যও শেষ হয়ে এল।[১৫]
এই পতনের আরও একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ফল দেখা গেল। ১৮৫৭ সাল থেকেই ব্রিটিশদের কাছে মুসলিমরা মুসলিম’ বলে প্রতিভাত হতে শুরু করে, এর পরই তারা মুসলিমদের হিন্দুদের থেকে আলাদা সম্প্রদায়, অন্য রাজনৈতিক চরিত্রের সম্প্রদায় বলে দেখতে শুরু করে। ১৮৫৭ সালের পর বছর দশেকের মধ্যেই ব্রিটিশরা মুসলিমদের একটি আলাদা রাজনৈতিক গােষ্ঠী বলে পৃথক করে ফেলে, ভারতে রাজনৈতিক ভারসাম্যের দুই দিকের একটি দিক বলে চিহ্নিত করে | টমাস মেটকাফ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ বিষয়ে ব্রিটিশদের মনােভাব সংক্ষেপে বলেছেন এই ভাবে, “ক্ষোভের প্রথম স্ফুলিঙ্গটা হিন্দ সিপাহিরাই জালিয়েছিল, কিন্তু তার পর মুসলিমরা সেই অসন্তোষের আগুনে হাওয়া দেয় এবং নিজেদের এই আন্দোলনের নেতৃত্বে বসায়, কারণ তারা ধর্মীয় অসন্তোষকেই রাজনৈতিক ক্ষমতার সিড়ি হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করে। সুতরাং ব্রিটিশদের দৃষ্টিতে, “মুসলিম ষড়যন্ত্র এবং মুসলিম নেতৃত্ব সিপাহিদের বিদ্রোহকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে পরিণত করে, ব্রিটিশ রাজের অবলুপ্তি চায়।”[১৬] স্যর জর্জ ক্যাম্পবেলও মুসলিমদের প্রতি ব্রিটিশদের তিক্ততা দেখেছিলেন উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে, “মুসলিমদের কড়া মনােভাব আমি প্রথম বুঝি মেরঠে, কারণ জাতপাত নিয়ে অভিযােগ, বিদ্রোহের পিছনে যা ছিল প্রধান কারণ, তার সঙ্গে ওদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। নিয়মিত বাহিনীর মুসলিম সিপাহিরা যখন অন্যদের সঙ্গে যােগ দিল, তখন আমরা আশাহত হলাম। ভেবেছিলাম অনিয়মিত বাহিনীর সিপাহিরা, যারা বেশির ভাগই মুসলিম, তারা অন্তত আমাদের পাশে থাকবে। তারাও ওদিকে গেল যখন, আমরা মর্মাহত হলাম।”
আপাতদৃষ্টি অনেক সময়ই বিভ্রান্ত করতে পারে, স্বীকার করেন তখনকার গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং, এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থরা। ক্যানিং বলছেন, গােড়ার দিকের সেনা বিদ্রোহ শুরু করেছিল হিন্দু সিপাহিরা, যারা তাদের জাত, মর্যাদা এবং আত্মসম্মান খােয়ানাের ভয়ে ছিল। অযােধ্যা, বিহার এবং মধ্য ভারতে নাগরিকদের বিদ্রোহ প্রধানত ঘটেছিল হিন্দুদের নেতৃত্বে।” অযােধ্যার বিদ্রোহী তালুকদাররা
১৫
অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু— ঝাঁসির রানি, তাঁতিয়া টোপি এবং নানা সাহেব, সবাই হিন্দু। কমিশনার আরও লক্ষ করেছিলেন যে গােরখপুর অঞ্চলে “রাজপুতদের মধ্যে উচ্চবর্ণের কিছু জনগােষ্ঠী তীব্র বিরুদ্ধতা করেছিল।[১৮] পাশাপাশি, মুসলিমরাও কিন্তু। ব্যক্তিগত, শ্রেণিভিত্তিক এবং আঞ্চলিক বিভাজনে হিন্দুদের মতােই বিভক্ত ছিল। তারাও একই রকম চাপ অনুভব করছিল। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের প্রতি অনুগত মুসলিম শাসকদের মধ্যে ছিলেন হায়দরাবাদের নিজাম, রামপুর, কার্নাল, মােরাদাবাদ ও ঢাকার নবাব। বিপরীতে, বিরুদ্ধতা করছিলেন ফারুকাবাদ এবং দান্দার নবাবরা। “কিছু মুসলিম কর্মী এক দিকে গেলেন, কিছু অন্য দিকে।” আলিগড় এবং রােহিলখন্ডে যাঁরা বিদ্রোহে যােগ দিয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগ মুসলিম। কিন্তু বাংলার মুসলিম, যারা সম্ভবত ব্রিটিশদের অধীনে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারা কিছুমাত্র আলােড়িত হয়নি, এমনকী ব্রিটিশ-বিরােধিতায় কোনও কথাও বলেনি। এই জন্যই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আসন অটুট রইল ভারতে। পঞ্জাবে মুসলিমরা শিখদের সঙ্গে যােগ দিয়েছিল এবং দিল্লির সীমার বাইরে ব্রিটিশ সেনার সংখ্যা বাড়িয়েছিল। তবে পাঠান, রাজপুত এবং বুন্দেলা, তার আগে ৫০ বছর ধরে যারা জমি-সম্পত্তি হারিয়েছে, তারা এই বিদ্রোহে পুরােদমে যােগ দিয়েছিল। আবার, “বিহারের মুসলিম এবং জমিদার, এবং বেনারসের কিছু অংশ, যারা ব্রিটিশদের কাছে অল্প সময় আগে নতিস্বীকার করেছে, তারা তেমন ভাবে বিদ্রোহে যােগ দেয়নি।” আশ্চর্য, যে মুসলিম গােষ্ঠীগুলি “সবচেয়ে বেশি ধর্মবিশ্বাসী, যেমন দক্ষিণ ভারতের ফরাইজি বা মােপিল্লা, তারা একেবারেই জড়িত হয়নি।”[১৯]
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের কারণ, এবং তাতে মুসলিমদের অংশগ্রহণ বিষয়ে ক্যানিং তাঁর সিদ্ধান্ত করেন, “এটা ঠিকই যে ভারতের নানা জায়গায় মুসলিমরা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি প্রতিকূল। নানা সময়ে তাঁরা বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছেন … এও ঠিক যে মুসলিমরা যে দিন দেখবে তাদের ধর্ম জয়ী হয়েছে, সে দিন তারা অত্যন্ত খুশি হবে। মুসলিম শাসনকে ব্রিটিশ শাসনের চেয়ে অনেক বেশি পছন্দ করবে। কিন্তু এগুলি তাদের গােপন ইচ্ছে বলে ধরে নিলেও, কঠোর বাস্তব হল, মুসলিমরা বিদ্রোহে কিন্তু কেবলমাত্র আংশিক ভাবেই যােগ দিয়েছেন, তা-ও আবার বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর।”[২০]
১৮৫৭ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লি পুনর্দখলের পর অসহায় মুসলিমদের উপর সাংঘাতিক প্রতিশােধ নেমে এল। বাহাদুর শাহ জাফরকে লােকদেখানাে বিচারের পর নির্বাসিত করা হল রেঙ্গুনে। মুঘল রাজপুত্রদের মাথা কাটা হল, সুরাপাত্র হাতে হডসন[২১] তা নিয়ে গর্ব করলেন। দিল্লির মুসলিম বিদ্বজ্জন, যাঁরা বাড়িতে পরিবারের কাছে ফিরতে চাইলেন, তাঁদের জরিমানা দিতে হল। প্রধানমন্ত্রী পামারস্টোন ক্যানিংকে লিখলেন, “মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি নাগরিক সৌধকে (জামা মসজিদের প্রতি বক্র ইঙ্গিত) মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া উচিত, প্রাচীনত্বের জন্য তার মর্যাদা কিংবা শৈল্পিক উৎকর্ষের কথা চিন্তা না করে।”[২২] প্রতিশােধমূলক শাস্তি দেওয়ার তাগিদে বিচারের একটা ভান হল মাত্র, উত্তর ভারতে গ্রামাঞ্চলে এত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা
১৬
হল যে গ্রামীণ সমাজের অর্থনৈতিক শিরদাঁড়াটাই ভেঙে গেল। ব্রিটিশরা প্রধানত তাদের প্রতিশােধস্পৃহার দ্বারা চালিত হয়েছিল, কোন গােষ্ঠীকে যে মারা হচ্ছে, সে সব বিচারের মধ্যেই গেল না।
১৮৫৭ সালের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শেষ করে দিল ভারতে মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রাধান্যের দীর্ঘ যুগ। যদিও একটা বড় রাজনৈতিক গােষ্ঠী হিসেবে তাদের অস্তিত্ব থেকে গেল, কিন্তু নিজেদের ‘শাসক বলে দেখার সুযােগ আর রইল না। মুসলিমরা সমাজে একটি স্বার্থ-গােষ্ঠী হিসেবে নিজেদের দেখতে শুরু করল, যাদের বাসনা দাঁড়াল, ভারতের দুই প্রধান রাজনৈতিক জনগােষ্ঠীর অন্যতম হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা। ১৮৫৭ সালের ঘটনা ব্রিটিশ ভারতে ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভারসাম্যে মুসলিমদের গুরুত্ব কমাতে পারল না ঠিকই[২৩], কিন্তু ব্রিটিশরা যা চায়, সে ভাবে নিজেদের গড়েপিটে নিতে তাদের বাধ্য করল। “পুরনাে অস্ত্রচালনা বা রাষ্ট্র পরিচালনার পুরনাে পদ্ধতি আর নয়। এখন থেকে মুসলিমদের আদর্শ আর আকবর বা আওরঙ্গজেব নয়, এ বার থেকে ব্রিটিশরাই তাদের হুকুমদারের আসনে।”[২৪] যে বিপুল পরিমাণ মুসলিম এই পরিবর্তন গ্রহণ করতে রাজি হয়ে গেল, সেটা বিস্ময়কর। সাধারণত ইতিহাসে ধরে নেওয়া হয়, মুসলিমরা ১৮৫৭ সালে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কথাটা সত্য নয়। বরং অনেকেই এর থেকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হয়েছিল।
তবে ১৮৫৭ মুসলিম সমাজে ভূমি বণ্টনের নকশা বদলে দিল, “মুঘল অতীত জায়গা করে দিল ব্রিটিশ ভবিষ্যৎকে।”[২৫] ১৮৫৭ সালের আগেই মুসলিম জমিদারদের একটি শ্রেণি ব্রিটিশদের অধীনে কাজ করতে রাজি ছিল ডেপুটি কালেক্টর, সদর আমিন[২৬] বা এই ধরনের অন্যান্য পদে। যারা জমির নিলামের ফলে লাভবান হয়েছিল, তারাও সামাজিক সিঁড়িতে উঠে আসছিল। ১৮৫৭ সালের পরবর্তী সময়ে এই অনুগত সমাজ, যারা ব্রিটিশ শাসনকে নিজেদের কাজে লাগিয়েছিল, তারা স্যর সৈয়দ আহমেদ খানের অনুবর্তী হয়ে পড়ে, নিজেদের সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষাকে উৎসাহ দিতে শুরু করে, এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সহযােগিতায় হাত মেলায়।[২৭]
সন্দেহ নেই যে পুরনাে মুসলিম পরিবারগুলি অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হল। ১৮৫৭ সালের মূল্য চোকাতে গিয়ে তাঁদের মর্যাদাহানি হল, আর্থিক অনটনের ফলে তাঁদের আত্মমর্যাদাও অটুট রইল না, জীবনধারা চিরকালের মতাে বদলে গেল। ১৮৫৭ সালের পর মুঘল রাজকুমারীদের এক বিপর্যস্ত, অপমানিত জীবন কাটাতে হয়। ব্রিটিশরা তাঁদের আরও অপমানিত করার জন্য কিছু অনুদান দিতে থাকে, তার সামান্য অর্থমূল্য এবং অনুগ্রহ দানের ভঙ্গি, দুই দিক থেকেই আরও বেশি অমর্যাদা বহন করে আনল।[২৮]
১৮৫৭ সালের পর মুসলিমদের প্রতি ব্রিটিশ মনােভাবে একটি দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেতে শুরু করে, এক দিকে মুসলিমদের একটি বিশিষ্ট স্বার্থ-গােষ্ঠী হিসেবে গ্রহণ করা, অন্য দিকে তাদের মধ্যে যে কোনও রাজনৈতিক বিদ্বেষকে কঠোর ভাবে দমন করা। ১৮৫৭ সালের পর থেকেই ব্রিটিশরা ভাবতে শুরু করে, তাদের ভারত থেকে তাড়িয়ে দেওয়া তা হলে খুব অসম্ভব নয়। সেই আশঙ্কা আর কোনও দিনই তাদের পিছু ছাড়েনি।
১৭
এও তাদের মনে হল যে, এই অঘটন তখনই ঘটতে পারে, যদি ভারতের দুই প্রধান গােষ্ঠী, জাতপাত এবং ধর্মের বিভাজন ভুলে বা সরিয়ে রেখে একত্রিত হয়। কিন্তু এখানেই তাদের নিরাপত্তার বীজও লুকিয়ে, কারণ ভারতের সমাজের বিভাজনকে তারা কাজে লাগানাের সুযােগ করে নিতেই পারে। ব্রিটিশের দৃষ্টিতে ভারতীয় সমাজে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব নিহিত (যদিও তারা কোনও দিনই এই দুই ধর্মবিশ্বাসকে বােঝেনি, কেবল তার বৈশিষ্ট্যগুলিকে কাজে লাগিয়েছে), সেই দ্বন্দ্বের জন্য চির কালই তাদের এক জন নিরপেক্ষ ‘আম্পায়ার’-এর প্রয়ােজন হবে, আর সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে ব্রিটিশরা।
এত সত্ত্বেও অবশ্য ব্রিটিশদের উপর সব দোষ চাপানাে মুশকিল। তারা যে নিজেদের শাসন কায়েম করতে দুটি ওতপ্রােত সম্প্রদায়কে আলাদা করে ফেলেছিল, তা তাে নয়। বরং যেখানে ইতিমধ্যে বিভাজন হয়েই ছিল, সেখানে তারা বিভাজনের সুযােগ ও সুবিধেগুলাে কাজে লাগাতে শুরু করল, বিভেদরেখাকে ক্রমে গভীর ক্ষতে পরিণত করল।
ভারতে ব্রিটিশ রাজের ইসলামি প্রতিক্রিয়া
১৮৫৭ সালের বহুমাত্রিক ভয়ংকর ঘটনার একটি অনিবার্য ও দুঃখজনক ফল— ভারতে ফার্সিদের অবস্থার অবনতি। এর ফলে ‘আশরফ’ সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতীয় ইসলামে ইরান এবং মধ্য এশিয়ার অবদান যে বৌদ্ধিক বিজ্ঞান, তার অবনতি শুরু হয়। পরিবর্তে, যে সব ঐতিহ্য কোরান এবং হাদিছের[২৯] পাঠের উপর জোর দেয়, এবং নকশাবন্দি[৩০] ধারায় সংস্কারের কথা বলে, তা ইসলামি চিন্তায় ক্রমশ প্রাধান্য পেতে শুরু করে। শেখ আহম সরহিন্দির[৩১] সময়ে অন্তর্মুখী সুফি মতবাদের যে বীজ বপন করা হয়েছিল, এখন তা প্রস্ফুটিত হল। ভারতীয় ইসলাম ক্রমশ সংরক্ষণশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ল, তার মধ্যে মৌলবাদের রং আরও গাঢ়, আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। আশরফ সমাজ এই পরিবর্তনকে রুখতে পারল না কারণ (আরও নানা কারণের মধ্যে) তারা এত বেশি আরামপ্রিয় ছিল যে যারা ইসলামের তরবারি আন্দোলিত করছিল তাদের প্রথম সারিতে থাকার মতাে উদ্যোগ এদের ছিল না।
উনিশ শতকের সংস্কার আন্দোলনে মুসলিমরা অবশ্যই যােগ দিয়েছিলেন, কিন্তু তা প্রধানত প্রাক্তন শাসনগােষ্ঠীর বাইরের মানুষদের থেকে, এবং বরেলির সৈয়দ আহমেদ খােলাখুলি তাদের সমালােচনা করেছিলেন। তারা যে মুঘল বংশকে আবার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, কিংবা মুঘল জমানার খানদানি বংশগুলিকে পুনরায় গুরুত্ব দিতে চেয়েছিল তা নয়, তাদের বরং ঝোঁক ছিল গােড়ার দিকের মুসলিম সমাজের একটি অনুলিপি প্রস্তুত করার, সেই সময়ের উদ্দীপনা ফিরিয়ে নিয়ে আসার। এমনকী
১৮
সৈয়দ আহমেদও বিশ্বাস করতেন যে এক দিন মুসলিমরা “আবার ভারত জয় করার প্রেরণা পাবে, তবে এবার ঈশ্বরের নামে। আজকের মতাে সে দিনও এই ধরনের বার্তা স্পষ্টতই গােটা মুসলিম সমাজের সব স্তরের কাছে এক ধরনের আবেদন নিয়ে আসে।
এখানে আমাদের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামি চরিত্রের উপর নজর দিতে হবে, যাঁদের জীবনের শুরু আলাদা, রাজনৈতিক দর্শনও বিপরীত। ভারতে মুসলিমদের উপর তাঁদের প্রভাব আলােচনা করতে হবে। এদের মধ্যে প্রথম হলেন স্যর সৈয়দ আহমদ খান।
সৈয়দ আহমদ খান
যে বছর তাঁর পিতার মৃত্যু হয়, সেই ১৮৩৮ সালে সৈয়দ আহমদ খানের বয়স ছিল প্রায় ২২। যদিও তাঁর বাবা দিল্লির লাল কেল্লায় অবশিষ্ট মুঘল সাম্রাজ্যের এক জন কর্মী ছিলেন, সৈয়দ আহমদ খান কেল্লা ছেড়ে কোম্পানি বাহাদুর’-এর অধীনে কাজ নিয়েছিলেন। তাঁর সময়কে তিনি খুব ভালই বুঝেছিলেন, নিজের কাজে লাগিয়েছিলেন। সে সময় আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণাই ছিল না, ব্রিটিশ-প্রতিষ্ঠিত আদালত সম্পর্কেও না। তাঁর কাকা, দিল্লির সদর আমিন[৩৩] মৌলবি খালিলুল্লা খান, তাঁর অভিভাবক হিসেবে ব্রিটিশ রাজের চাকরিতে তাঁকে ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁর জীবনব্যাপী ইংরেজপ্রীতির সেই শুরু।
১৮৫৭ সালের উত্তাল দিনগুলােতে সৈয়দ আহমদের কাজ তাঁকে নিয়ে এল। দিল্লিতে, তার পর আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি হয়ে শেষ অবধি গেলেন বিজনৌরে। সেখানে তিনি কী ভাবে ইউরােপীয়দের বাঁচানাের এবং বিজনৌরের প্রশাসন হাতে পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তা আলতাফ হুসেন হালির লেখা তাঁর জীবনী ‘হায়াত-ই-জাভিদ’-এ বিস্তারিত রয়েছে। ১৮৫৯ সালে যখন ১৮৫৭ সালের পর ভারতীয়দের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য একটি কমিটি তৈরি হয়, তখন রােহিলখণ্ডের কমিশনার এবং মুরাদাবাদের জজ: এই দুই ইউরােপীয় ছাড়া এক জনই ভারতীয় তাতে জায়গা পেয়েছিলেন, তিনি সৈয়দ আহমদ খান। | আলিগড় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে উজ্জ্বল নামগুলির মধ্যে একটা সৈয়দ আহমদ খান। গােড়ার দিকে আরও যে নামী মানুষরা এর সঙ্গে ছিলেন, তাঁরা হলেন সৈয়দ মেহদি আলি খান (১৮৩৭-১৯০৭), মৌলভি নাজির আহমদ (১৮৩০-১৯১২), এবং মৌলভি সমিউল্লা খান (১৮৩৪-১৯০৮)। সৈয়দ আহমদ বহু দিন দিল্লিতে ছিলেন, কেল্লার সঙ্গে তাঁর পরিবারিক, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাই সে শহরের কী সাংঘাতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল তা না জেনে তাঁর উপায় ছিল না। কিন্তু তিনি ছিলেন সেই ‘শরিফ (আশরফ) শ্রেণির মানুষ যারা ক্ষমতা এবং উঁচু পদের বসার বিশেষ সুবিধের সুযােগ
১৯
নেওয়ার জন্য বিখ্যাত, যাঁদের ক্ষমতাসীনের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক রাখার অদ্ভুত দক্ষতা। তাঁদের নিজেদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ধরে রাখার একমাত্র উপায় ছিল ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য দেখানাে, ব্রিটিশ ক্ষমতার অংশ হওয়া। আলিগড় আন্দোলনের শরিকদের তা করার একমাত্র উপায় ছিল সমস্ত ইউরােপীয় বস্তু গ্রহণ করা। তার জন্য তাঁদের সংস্কৃতিতে থেকে অনেকটা সরে আসা প্রয়ােজন ছিল, তা সত্ত্বেও খুব দ্রুত তাঁরা এই কাজ করেছিলেন। তাঁদের কাছে ব্রিটিশদের সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার সঙ্গে নিজেদের সেতুবন্ধনের এটাই ছিল সহজ উপায়।
সৈয়দ আহমদ খানের মতাে অন্যান্য মুসলিমরাও, যেমন সৈয়দ আমির আলি এবং নবাব আবদুল লতিফ, যাঁরা সে সময়ের ‘আধুনিকমনস্ক মানুষ ছিলেন, চাইতেন যে মুসলিমরা কংগ্রেসের থেকে দূরে থাকুক। কংগ্রেস কিন্তু তার তথাকথিত ‘জাতীয়’ চরিত্র ধরে রাখার জন্য মুসলিম সমর্থনের প্রয়ােজন বুঝতে পারছিল। যেহেতু কংগ্রেসের মােট ৭২ জন প্রতিনিধির মধ্যে মাত্র দু’জন ছিলেন মুসলিম, এবং সেই দু’জনও তাঁদের নিজেদের সমাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন না, দ্বিতীয় কংগ্রেসের রিসেপশন কমিটি আরও ভাল মুসলিম প্রতিনিধিত্বের জন্য যত্নবান হল। তার প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দ আহমদ খান আলিগড় মুসলিম গেজেট-এর ২৩ নভেম্বর, ১৮৬৬ সংখ্যায় কংগ্রেস আন্দোলনকে ‘রাজদ্রোহমূলক’ অ্যাখ্যা দিলেন। ১৮৮৬ সালে কলকাতায় যে দ্বিতীয় কংগ্রেস হয়েছিল, তাতে মােট ৪৩১ প্রতিনধির মধ্যে মাত্র ৩৩ জন মুসলিম ছিলেন, এবং আবারও, তাঁরা কেউই মুসলিমদের মধ্যে খুব ওজনদার ব্যক্তি ছিলেন না।
১৮৮৭ সাল থেকে সৈয়দ আহমদের সঙ্গে কংগ্রেসের কলহ প্রকাশ্যে চলে এল। তৃতীয় কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করার জন্য আহ্বান জানানাে হল বদরুদ্দিন তায়েবজিকে। আলিগড়ের মহমেডান অ্যাংলাে-ওরিয়েন্টাল কলেজের বেশ কিছু ছাত্র সেই অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। ফলে মুসলিম অংশগ্রহণ অনেকটাই বেড়ে গেল। এতে ভয় পেয়ে সৈয়দ আহমদ খান ১৮৮৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর একটি বক্তৃতায় বিকল্প ভাবনার প্রথম রূপরেখা পেশ করেন। সেখানে তিনি স্পষ্টই সতর্ক করেন যে, কংগ্রেসকে সমর্থন করলে মুসলিমরা বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ইতিমধ্যে কংগ্রেস দাবি তুলতে শুরু করেছে যে, কেন্দ্রীয় (ইম্পিরিয়াল) এবং প্রাদেশিক (প্রভিনশিয়াল) মন্ত্রিসভাগুলিতে ভারতীয় সদস্যদের জায়গা দিতে হবে, নির্বাচনের মাধ্যমে। সৈয়দ আহমদের কাছে তার অর্থ দাঁড়াল, কাউন্সিলগুলিতে কেবল। সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং সেই প্রতিনিধিত্ব হবে চিরকালীন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি প্রথম দাবি করলেন যে মুসলিমরা একটি পৃথক জনগােষ্ঠী, একটি পৃথক জাতি। এই দৃষ্টিভঙ্গি, বক্তব্য এবং কাজের জন্য সৈয়দ আহমদকে কঠোর সমালােচনা করেছিলেন লালা লাজপত রায়। ১৮৮৮ সালের শেষে লালাজি অভিযােগ করলেন যে সৈয়দ আহমদ নিজের আগের বক্তব্যের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বলছেন, এবং তিনি নিজেই তাঁর ‘ভারতীয় বিদ্রোহের কারণ’ বইতে যা চেয়েছেন, কংগ্রেস তার চেয়ে বেশি কিছু দাবি করছে না। তিনি অভিযােগ করেন, স্যর সৈয়দ কেবল ব্রিটিশকে খুশি
২০
করতে কংগ্রেসের বিরােধিতা করছেন।
১৮৯৩ সালে সৈয়দ আহমদ মহামেডান অ্যাংলাে-ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স অ্যাসােসিয়েশন-এর প্রতিষ্ঠা করেন, যার উদ্দেশ্য, মুসলিমদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা। ১৮৯৬ সালে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় মুসলিম প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন সৈয়দ আহমদের পুত্র সৈয়দ মামুদ ও আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিওডাের বেক। তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, যেখানেই মুসলিমরা জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ বা তার বেশি, সেখানে প্রতিনিধিত্বে সমতা থাকতে হবে, এবং তা কেবল উঁচুতলার কাউন্সিলগুলিতে নয়, মিউনিসিপ্যালিটি এবং জেলাগুলিতেও। এই পরিকল্পনার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব ছিল, কাউন্সিল এবং স্থানীয় সংগঠনগুলির মুসলিম সদস্যদের কেবল মুসলিমরাই ভােট দেবে। মুসলিম সংবাদমাধ্যম স্বাভাবিক ভাবেই একে স্বাগত জানাল। সৈয়দ মামুদ-বেক’ পরিকল্পনাই হল সেই বীজ, যা ক্রমে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হল, – ভারতের ভিতরেই হােক আর বাইরে।
সৈয়দ জামাল আদ-দিন ‘আল-আফগানি’
সৈয়দ জামাল আদ-দিন ‘আল আফগানি’ (১৮৩৯-১৮৯৭) এই সময়ের আর এক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, যিনি সৈয়দ আহমদের প্রায় সমসাময়িক। তিনি ভারতে এসেছিলেন ১৮৫৫-৫৬ সালে, এবং এখানে যা দেখেছিলেন, যে অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল, তার দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। হয়তাে এই ভারত ভ্রমণের ফলেই তিনি ব্রিটিশ শাসনের সমালােচক হয়ে উঠলেন। নিঃসন্দেহে ১৮৫৭ সালের বিষয়ে তিনি পরে যা শুনেছিলেন, তার ফলেই তাঁর মধ্যে এই পরিবর্তন আসে। সেই কারণেই আফগানির কাছে সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন এক পরম শত্রুর অনুগামী। সৈয়দ আহমদ খানের মতবাদ তিনি কখনওই গ্রহণ করতে পারেননি।
সেই সময়ের পক্ষে আফগানির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিস্ময়কর রকমের যথাযথ। তিনি চেয়েছিলেন ‘ভাষা এবং ভূগােলের ভিত্তিতে জাতীয়তা’, যার অর্থ, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। ভারতীয় মুসলিমদের সঙ্গে অন্য দেশের মুসলিমদের ঐক্যের বিষয়ে তিনি প্রায় কিছুই বলেননি।[৩৪] তিনি বিশ্বায়িত ইসলামে বিশ্বাসী ছিলেন না, সে ধারণাকে নিজের লেখায় নস্যাৎ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, “জাতীয়তা ছাড়া আনন্দ নেই, এবং ভাষা ছাড়া জাতীয়তা নেই, আর ভাষাকে কখনওই ভাষা বলা যায় না, যতক্ষণ না উৎপাদন এবং বাণিজ্যের সমস্ত ব্যাপারকে সে তার পরিধিতে আনতে পারে।”[৩৫] হয়তাে এই কারণেই আফগানি একটি সর্বজনীন ভাষার উপর জোর দিয়েছিলেন, যা ব্যক্তি, জনজাতি এবং জনগােষ্ঠীকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি’ করে তুলবে। এই ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তা ধর্ম
২১
ভিত্তির জাতীয়তার চেয়ে ভাল, কারণ তা আরও মানুষকে এক করার আরও কার্যকর এবং দীর্ঘমেয়াদি উপায়: “মানবজগতে যে বন্ধনগুলি বিস্তৃত হয়েছে তার মধ্যে দুটিই প্রধান। এক, ভাষার ঐক্য, যা দিয়ে জাতীয়তা এবং জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়। অন্যটি হল ধর্ম। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ভাষার ঐক্য এই জগতে ধর্মের চেয়ে বেশি দীর্ঘস্থায়ী, কারণ তা অন্যটির মতাে অল্প সময়ে বদলায় না।”[৩৬]
তিনি জাতীয় ভাষা পড়ানাে এবং শেখার উপর জোর দিয়েছিলেন, যা জাতির অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করবে এবং বিদেশি ভাষায় শিক্ষার চেয়ে আরও অনেক মানুষের কাছে শিক্ষাকে পৌঁছে দেবে। “জাতীয় ভাষাকে উৎসাহ দেওয়া জাতীয় ঐক্য এবং দেশপ্রেমের একটি শর্ত, তাই ভারতীয়দের আধুনিক জ্ঞান তাদের নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করতে হবে, বিশেষত উর্দুতে।”[৩৭] তাঁর চিন্তাভাবনা বিস্ময় জাগায়, বিশেষত যদি মনে রাখা যায় যে এগুলি উনিশ শতকের মাঝামাঝি বলা হয়েছিল।
যে ধরনের সংরক্ষণশীলতা পশ্চিমি জ্ঞানের বিরােধিতা করে, আফগানি তারও বিরুদ্ধে ছিলেন। তিনি মনে করতেন, শরিয়া (ইসলামীয় আইন) কখনওই বিজ্ঞানের বিরােধিতা করে না, বরং উলটোটাই, কারণ যে জ্ঞান কার্যকর তা ধর্মানুরাগীদের সম্পদ, উচ্চপদ এবং খ্যাতি এনে দেওয়ার ফলে তাদের ধর্মানুরাগ আরও শক্ত করে। “ইংরেজদের কলা এবং শিল্পবাণিজ্য অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু তাকে দেশীয় ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে ছড়াতে হবে।”[৩৮] আফগানি তাঁর সময়ের তাৎপর্য বুঝেছিলেন বলেই ধর্মীয় ঐক্যের কথা না বলে ভাষাগত ঐক্যের কথা বলেছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী এবং ব্রিটিশবিরােধী মনােভাবের সঙ্গে এই মতবাদ সবচেয়ে বেশি মিলে যায়। আর এই মনােভাব ছিল স্যর সৈয়দ আহমদ খানের ঠিক বিপরীত।।
মুসলিম সংস্কার আন্দোলন
যে কোনও ধর্মের মতােই, মুসলিম ধর্মও তার প্রভাব কমে আসতে দেখে আত্মানুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়, নতুন রাস্তার সন্ধান করে। ১৮৫৭ সালের পর ভারতীয় ইসলাম সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়। বরিলির সৈয়দ আহমদের সময়েই একটি আন্দোলনের সূচনা হল বাংলায়। এই আন্দোলন ছিল মাটির কাছাকাছি, মুসলিম কৃষকদের দৈনন্দিন জীবনের লড়াইয়ের আন্দোলন। নাম, ফরাইজি আন্দোলন।” দাদু মিঞা এবং তিতুমিরের কৃষক আন্দোলনের মূল কথাগুলাে কিন্তু সৈয়দ আহমদের কথাবার্তার মতােই, কারণ এই সংস্কারকদের প্রায় সবাই ইসলামের পবিত্রকরণ’-এর উপর জোর দেন। এই ধরনের সংস্কার আন্দোলনের ফলে ভারতের মুসলিমরা ক্রমশ ‘ধর্মবিশ্বাসীদের জনগােষ্ঠী থেকে রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হয়, যৌথ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়। এই আন্দোলনগুলি মধ্যযুগীয়, ফার্সি সংস্কৃতির বিনম্রতা থেকে ইসলামকে তার পূর্বতন
২২
কঠোরতর, পবিত্রতর রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। শহুরে মহফিল বা আশরফরা এই আন্দোলন ঘটায়নি। আন্দোলকারীরা হিন্দুদের থেকে গ্রহণ করা রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রচার করতে শুরু করে। সংস্কারকরা জোর দিয়ে বলতে থাকে, “হিন্দুদের রীতিনীতি গ্রহণ করা ঠিক নয়, কারণ ভারত তাদের দেশ নয়, তাদের থাকার জায়গা মাত্র।”[৪২] দাদু মিঞা, তিতুমির বা সৈয়দ আহমেদের এই ধর্মীয় এবং সামাজিক সংস্কারের ফলে ক্রমশ একটা শাণিত, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, সাম্প্রদায়িক বাপ্রীতি তৈরি হল। সেই সঙ্গে এই আন্দোলনগুলি পতনােন্মুখ উচ্চশ্রেণির মুসলিম সংস্কৃতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলল। কবিতা, চিত্রাঙ্কন, সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির চর্চা, উচ্চবিত্ত নাগরিক ভদ্রলােকের ‘সােনালি দিনগুলি’, যত কিছু সুখস্মৃতি, সবই ধর্মীয় সংস্কারের কঠোরতার আঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে গেল, ঠিক যে ভাবে ১৮৫৭ সালের পর আর্থিক কাঠিন্যের অমর্যাদার সামনে পড়তে হয়েছিল তাদের। সময়ের নিষ্ঠুর কশাঘাতে নতুন এক ধর্মীয় উন্মাদনার জন্ম হল, যার মধ্যে ছিল একটা প্রায়শ্চিত্তের মনােভাব, এবং একই সঙ্গে ধর্মবিশ্বাস প্রকাশের আকুতি। কেবল ইসলামে নয়, প্রতিকুলতার অভিজ্ঞতা সব ধর্মেই এই ভাবেই প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
ইসলামের এই সংস্কার আন্দোলনের পুরােভাগে ছিল দেওবন্দ। শাহ ওয়ালিউল্লার[৪৩] ঐতিহ্যে ১৮৬৭ সালে উলেমা এর প্রবর্তন করেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার উদ্দেশ্য মুসলিমদের ব্রিটিশদের সেবক হওয়া নয়, শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য মুসলিমদের এমন এক দুনিয়ায় টিকে থাকতে’ শেখানাে যেখানে তাদের হাতে কোনও ক্ষমতা নেই। তা সত্ত্বেও, বিংশ শতাব্দীর গােড়া পর্যন্ত বহু আশরফ তাঁদের ফার্সি-ইসলামি অতীত থেকে সাংস্কৃতিক রসদ আহরণ করেছিলেন, এই যুক্তিতে যে তাঁদের পূর্বপুরুষরা ভারতে ‘রাজত্ব করতে এসেছিলেন, ক্ষমতা ও তার প্রয়ােগ রয়েছে তাঁদের রক্তে, সেটা তাঁদের জন্মগত অধিকার, সেই অধিকার তাঁদের ন্যায্য এবং অবধারিত প্রাপ্য হিসেবে রয়েই গিয়েছে। সেই ক্ষমতা তাঁদের হাতে ফিরে আসাটা সময়ের প্রশ্ন, অন্তত সেই রকমই তাঁরা নিজেদের বুঝিয়েছিলেন।
এই মনােভাবটা বেশির ভাগ মুসলিম রাজনীতির হৃদ্‌কেন্দ্রেই ছিল, হয়তাে এখনও রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর গােড়ায় তাে বটেই, পাকিস্তানে আজও এই মনােভাব আছে, ভারতেও অনেক দুর্বলতর আকারে রয়ে গিয়েছে। এই ধারণাই আলিগড় আন্দোলনকে প্রেরণা দিয়েছিল, যার প্রমাণ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের নিজেদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বােঝানাের কাজে নাছােড়বান্দা মনােভাব। ইকবালের কবিতায় যে ক্ষমতার উপাসনা রয়েছে, তারও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এখানে, সেই মনােভাব কেবল পাকিস্তানের দাবিতেই শেষ হয়নি, এখনও ভারতের রাজনৈতিক চিন্তায় অনেকটা ধোঁয়াশা তৈরি। করে রেখেছে। পাকিস্তানের সৃষ্টিতে অন্য যে সব কারণ কাজ করেছে, সেগুলির অবমূল্যায়ন না করেই বলা যায়, এটা বােধহয় ভারতের ফার্সি-ইসলামি মূল্যবােধের নিদর্শন, বিংশ শতাব্দীর গােড়ার অন্যান্য মূল্যবােধগুলির মতােই, যার জটিল স্ববিরােধ এবং আত্মঘাতী অন্তর্মুখিতা ক্রমশ প্রকাশ পেয়েছে।
২৩
দিল্লি থেকে কিছু দূরে দেওবন্দ, আজ যা ইসলামীয় পঠনপাঠনের কেন্দ্র হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, সেই দেওবন্দ কিন্তু গােড়ার দিকে কেবলমাত্র দানের উপর নির্ভরশীল ছিল। ছাত্ররা সবাই ছিল মুসলিম, কেবল উত্তর ভারত বা উত্তরপ্রদেশ নয়, পঞ্জাব, বাংলা, এমনকী আফগানিস্তান থেকেও আসত, কেউ কেউ আসত ইরান। থেকেও। পাঠক্রম ছিল একান্ত সনাতন ধারার। ইংরেজি পড়ানাে হত না, বিজ্ঞানও নয়। সরকারি চাকরি থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং ঐতিহ্যের দ্বারা ক্ষুদ্র শিল্প থেকেও বিচ্ছিন্ন (মুদ্রণ এবং বই বাঁধানাে ছাড়া) দেওবন্দের ছাত্ররা পাশ করার পর মুসলিম ভারতের মাদ্রাসাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে প্রথমে এদের ‘শিক্ষিত করা এবং পরে ‘শিক্ষিত’দের অন্যদের থেকে পৃথক করার ধারাটি বজায় রইল। দেওবন্দের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা বেশির ভাগই ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লার প্রতিষ্ঠিত দিল্লি মাদ্রাসার ছাত্র, যেটি ব্রিটিশরা ১৮৫৭ সালে ধ্বংস করে দেয়। তাঁদের অন্তত কয়েক জন সেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন।
দেওবন্দের বিরােধী একটি দল হল ‘বারেলভি’– ১৮৮০-র দশকে তার উত্থান। এদের পরিচালিত করে আহমদ রিজা খানের চিন্তা,[৪৪] যাঁর মতে হিন্দু এবং মুসলিম আবশ্যিক ভাবেই পরস্পরবিরােধী। খ্রিস্টানরা অন্তত ধর্মগ্রন্থ অনুসারী মানুষ, কিন্তু হিন্দুদের উত্তরণের পথ নেই, তারা কাফির।’ এমন কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও বারেলভিদের সঙ্গে দেওবন্দিদের মতের পার্থক্য ছিল— সেই ধর্মীয় বিচারের বিপজ্জনক ক্ষেত্রে আমি প্রবেশ করব না, যার ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীর গােড়ায় তাদের মধ্যে ফতােয়া যুদ্ধ শুরু হয়। ব্রিটিশরা পরে এই বিভাজনও কাজে লাগিয়েছিল, দেওবন্দিদের প্রভাব হ্রাস করে বারেলভির অনুগতদের দলে ঢােকাতে।
ইসলাম– ধারণা ও সত্য
লর্ড ডাফরিন, ভারতের তৎকালীন ভাইসরয়, ১৮৮৮ সালের নভেম্বরে ভারতীয় মুসলিমদের সম্পর্কে লিখছেন[৪৫], “প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ নিয়ে একটি জাতি, যারা একেশ্বরবাদ, মূর্তিবিরােধী উন্মত্ততা, পশুবলি, সামাজিক সাম্য এবং দিল্লিতে শাসন করার প্রাচীন স্মৃতি নিয়ে দিনযাপনে অভ্যস্ত।” এই শাসকের কথাটি উনিশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের গােড়ার ভারতের শিক্ষিত, আধুনিক মুসলিমদের খুব নিখুঁত ছবি তুলে ধরে। নিজেদের সম্পর্কে এই ধারণা তাঁদের মধ্যে তৈরি হয় এক সুদুর অতীতের স্মৃতি, সেই অবস্থায় ফিরে যাওয়ার অদম্য আকাঙক্ষা, এবং সেই সময়ের গৌরবের অন্তত কিছুটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা থেকে। এমন অযৌক্তিক স্মৃতিকাতরতার যথেষ্ট কুফল ফলেছিল, যা আমরা পরে দেখব। এর তাগিদেই মুসলিমরা প্রথমে ব্রিটিশ ভারতে একটি বিশিষ্ট জায়গা, এবং পরে চল্লিশের দশকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে
২৪
সমান হওয়ার দাবি থেকে একটি পৃথক, স্বশাসিত রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে আসেন, তৈরি করেন নিজের দেশ’, পাকিস্তান-এর দাবি। তাঁরা মনে করতেন মুসলিমরা একটি পৃথক জাতি, মনে করতেন তাদের এ দাবি সঙ্গত। লর্ড ডাফরিন তাঁদের সে ভাবে দেখেছিলেন বলেই যে তাঁরা এমনটা মনে করতেন, তা তাে নয়।।
অদ্ভুত ব্যাপার, তাঁদের নিজেদের দেশের দাবির খোঁজে বেরিয়ে তাঁদের নিজেদের সম্পর্কেই ধারণাটা কেন নষ্ট হয়ে গেল, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই তা কেন অদৃশ্য হয়ে গেল, তার কিন্তু ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আলাদা দেশ যখন এল, স্বাভাবিক ভাবেই অতীত গৌরবের মহিমার আর সন্ধান মিলল না। যে মুসলিমরা ভারতে রয়ে গেল, তাদের জন্য তাে সেই গৌরবের স্বপ্নও মুছে গেল। গােটা পশ্চিম ইউরােপ মহাদেশের আকারের এই উপমহাদেশে, অসমান ভাবে ছড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যে, এই মুসলিমদের ধর্মসম্প্রদায়গত বিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতিনীতি, পােশাক, পেশা এবং প্রায়শ ভাষাও ছিল আলাদা। প্রায় কখনওই তাঁরা নিজেদের ‘এক’ বলে চিন্তা করতেন না, একসঙ্গে কাজ করার তাে প্রশ্নই ওঠে না। তাঁরা নিজেরা এক হতে পারেননি, কারণ ভারতে থাকার সঙ্গেই এমন ধরনের একতার বােধের একটা ঘাের বিরােধ রয়েছে, ভারতীয় হওয়া এবং ভারতীয় মুসলিম হওয়ার জন্যেই তাঁরা ‘এক হতে পারেননি।
ভারতে সবে মুসলিম পদার্পণের সেই সময়টায় যদি ফিরে যাই, আমরা দেখব প্রাক-মুসলিম ভারতের পশ্চিম উপকূলে ফার্সি এবং আরব বণিকরা বাণিজ্যে ব্যস্ত। ইসলামের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সেই বণিকরাই আবার ধর্মান্তর করে মুসলিম বণিক’ হয়ে উঠল, ব্যবসা ছিল তাদের উত্তরাধিকার, ইসলাম তাদের দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। পয়গম্বরের মৃত্যুর মাত্র চার বছর পরে, উমর খলিফার রাজত্বকালে, মুম্বইয়ের কাছে ‘থানে’-তে প্রথম মুসলিম নৌবহর’ দেখা যায়। ভারতে আসার জন্য স্থলপথই ছিল পছন্দের, সেই পথেই সপ্তম এবং অষ্টম শতাব্দীতে আক্রমণ ঘটে সিন্ধুদেশে। একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে মুসলিমরা ভারতে আসার স্থলপথ এবং সমুদ্রপথের উপর সম্পূর্ণ দখল তৈরি করে। বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে যে সব জায়গায় মুসলিমরা থাকতে শুরু করে, সেগুলাে হচ্ছে মালাবার, কোঙ্কন, এবং ভারতের পশ্চিম উপকুল।
উত্তর ভারতে যারা প্রথম যুগে বসবাস শুরু করে, সেই মুসলিমরা ছিল আক্রমণকারী, অথবা আক্রমণকারীদের সঙ্গী, যারা ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে দেশান্তরী হয়েছিল। সিন্ধু প্রদেশে আরবরা সপ্তম, অষ্টম শতাব্দীতে হামলা চালায়, তার ফলে গজনির মাহমুদের আক্রমণের পর একাদশ শতাব্দীতে সেখানে মুসলিমদের একটি ছােট বসতি গড়ে ওঠে। এই আক্রমণের সঙ্গে মহম্মদ ঘােরির আক্রমণের মধ্যে, অর্থাৎ একাদশ এবং দ্বাদশ শতকের মধ্যে, উত্তর ভারতে বেশ কিছু ছােট ছােট মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে। পঞ্জাবে গজনাবিদ-দের এই বসতি উত্তর ভারতে তাদের ভিত্তিপত্তন, যার থেকে তারা পূর্বের দিকে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। ঘােরির আক্রমণের প্রায় ৫০ বছর পরে ছােট ছােট বিচ্ছিন্ন
২৫
অঞ্চলে মুসলিম দেশান্তরীরা থাকতে শুরু করেন উত্তর ভারতে। কনৌজের রাঠোর বংশের সময়েও বারাণসীতে মুসলিম শাসক ছিলেন।
কিন্তু যত দিন মুসলিমদের বাণিজ্য হিন্দু শাসকদের জন্য রাজস্ব নিয়ে আসছিল, তাদের স্বাগত জানানাে হয়। হিন্দু রাজাদের বাহিনীতে বেতনভুক সৈন্য হিসেবে নাম লেখানােতেও তাদের স্বাগত জানানাে হত। কিন্তু অভ্যর্থনা করা হােক আর না হােক, তারা যুদ্ধ করে ভারতের কেন্দ্রস্থলে এগিয়ে যেতে লাগল, স্থলপথে এবং জলপথে, তাদের নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করার জন্য। থানের প্রথম নৌবহর (৬৩৬ সাল) থেকে কাসিম এবং গজনির আক্রমণের মধ্যে বহু বার আক্রমণ ঘটেছে, বিশেষ করে ১০৮০ এবং ১১১৪ সালের মধ্যে, এবং তার পর ১১৩৩ সাল থেকে ১১৬৯ সালের মধ্যে। সে সব আক্রমণের কয়েকটি হয়তাে ব্যর্থও হল, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, তাদের সংখ্যা এবং প্রভাব বেড়ে উঠছিল। অবশ্যই হিন্দুদের ধর্মীয় সহনশীলতা, অন্যের ধর্মাচরণের বিষয়ে নিস্পৃহতা তাদের সাহায্য করেছিল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে হিন্দুরা কখনওই মুসলিমদের ধর্মান্তরকরণের চেষ্টাকে স্বাগত জানায়নি। ধর্মান্তরকরণ তারা থামাতে পারেনি, তাই এ ব্যাপারে তারা অনেকটাই ছিল উদাসীন।
গজনীর শাসন কায়েম হওয়া আর তরাইনের যুদ্ধের মধ্যে প্রায় ১৫০ বছরের ফারাক। কিন্তু এই দুই স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে যথেষ্ট যােগ, ব্যবধান কেবল সময়ের। কারণ পঞ্জাবে মুসলিম শাসন কোনও না কোনও ভাবে কায়েম ছিলই, যদিও তার বিস্তার, গভীরতা এবং কার্যকারিতায় ছিল বিস্তর হেরফের। সেই জন্য ঘােরির শেষ সাফল্য ছিল দিল্লি এবং পঞ্জাবে একটা গ্রহণযােগ্য শাসনব্যবস্থা তৈরি, যা ভারতে শাসন বিস্তারের জন্য আবশ্যিক, প্রয়ােজনীয়। এর আরও একটা ফল এই যে, ভারতে মুসলিম শাসন কোনও না কোনও রূপে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়িয়েই যায়। মুসলিম শাসকরা ধর্মান্তরকরণকে সমর্থন করতেন, উৎসাহ দিতেন, মুসলিম পণ্ডিত এবং পাঠদান কেন্দ্রগুলিকে নানা অনুদান দিতেন, জমিজমা, পেনশনও দিতেন মুসলিম জ্ঞানী ব্যক্তিদের। মাঝেসাঝে, আক্রমণের উত্তেজনায়, আক্রমণকারীরা যুদ্ধবন্দিদের মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করত। কখনও সখনও কোনও মুসলিম শাসক কাউকে জমিদারি, কিংবা উচ্চপদ দেওয়ার শর্তই করত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ। বেশির ভাগ সময়েই তারা এমন পরিস্থিতি তৈরি করে তুলত যাতে ধর্মান্তরকরণে মানুষ বাধ্য হত। নিজের ধর্মে অবিচল থাকা, অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম পালন করার অর্থ ছিল শাস্তিভােগ, যার মধ্যে কুখ্যাততম ছিল জাজিয়া বা জিজিয়া কর। [৪৮]
মুসলিমদের শাসনের এলাকা যত বেড়ে গেল, তার অধীন মুসলিমদের সংখ্যাও ততই বেড়ে উঠল। ভারতীয় জীবনে তখন ধর্মান্তরকরণ মানে সমাজ পরিবর্তন ছাড়া খুব বেশি কিছু নয়। নিজের মানসজগতের খুব বেশি পরিবর্তনের প্রয়ােজন হত না, যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটাও ঘটত। ইসলামে ধর্মান্তরিত মানুষটি একটি নতুন সমাজে প্রবেশ করত, যদিও সামাজিক সম্পর্কের নিরিখে ভারতের অন্যান্য মুসলিমদের খুব ঘনিষ্ঠ হতে পারত না: বিয়ে, খাওয়া-দাওয়া, ধর্মীয় রীতি রক্ষার বিষয়ে দূরত্ব থেকে
২৬
যেত। তা ছাড়া পুরনাে সঙ্গীদের ছাড়া মানেই পুরনাে জীবনযাত্রা ত্যাগ করা নয়, কারণ নতুন ধর্মগ্রহণকারীকে মুসলিমরাও নিজের সমান বলে গ্রহণ করত না, অন্তত দুই-এক প্রজন্মের আগে নয়। তত দিন পর্যন্ত তারা হত ‘মুসাল্লাহ’, যা মুসলিম হয়েই জন্মানাের চেয়ে এক ধাপ নীচে।
মুসলিম মৌলভি, কাজি, পীর, ফকিররাও এমন দাবি করতেন না যে, যারা সদ্য ধর্মান্তরিত হয়েছেন, তাঁরা পুরনাে ধর্মের সব রীতিনীতি, অভ্যাস, সামাজিকতা ত্যাগ করবেন। তাঁরা মুসলিম আইন থেকে নতুন মুসলিমদের কিছু ভিন্নতা মেনে নিতেন, যেমন উত্তরাধিকারের বিষয়ে। কোনও সম্পন্ন পরিবার, যার যথেষ্ট জমিজমা আছে, তার সদস্যরা যখন ইসলাম গ্রহণ করতেন, তখন তাঁদের সঙ্গে যাদের ‘যজমানি’[৪৯] সম্পর্ক তাঁরাও অনুসরণ করতেন। এটা সুবিধের জন্য, নতুন ধর্মের প্রতি আগ্রহের জন্য নয়। ভারতে মুসলিম শাসকদের সাফল্যের নানা হেরফের ছিল, কিন্তু ভারতে ব্রিটিশদের মতােই, প্রথম দিকের সামরিক সাফল্যের পর তাঁরা ক্রমশ যুদ্ধের থেকে কূটনীতির দিকেই বেশি ঝুঁকতেন, রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে নিজেদের শাসন কায়েম রাখতেন এবং সামরিক শক্তি প্রয়ােগের থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে বেশি কাজে লাগিয়ে শাসন চালাতেন। ব্রিটিশ রাজের মতাে, ভারতে মুসলিম শাসনও নির্ভর করত শাসিতের সহনশীলতার উপর, শক্তির কাছে পরাভূত হবার উপর নয়। তা ছাড়া, ভারতে কোনও একটি কেন্দ্র থেকে গােটা দেশ শাসিত হওয়ার ব্যাপারটা অনেকটাই ছিল ধারণার ব্যাপার। এই বিশাল, বৈচিত্রপূর্ণ দেশে তা বাস্তবায়িত হওয়ার উপায় ছিল না।
রাজ-এর কাছে নতিস্বীকার
১৮৭১ সালে বাংলার সিভিল সার্ভেন্ট স্যর উইলিয়াম হান্টার[৫০] লিখছেন, “মুসলমানরা সমস্ত দিক থেকেই… ব্রিটিশ শাসনের দ্বারা পরাভূত এক জাতি। বেশির ভাগ ঐতিহাসিকরা ভুলে যান যে এই কথাটা দক্ষিণবঙ্গের প্রসঙ্গেই বলা হয়েছিল, এবং এই কথাটা শেষ কথা বলে ধরে নেন, সেটাকে গােটা ব্রিটিশ ভারতের জন্য সত্য বলে ধরে নেন। কিন্তু অন্যান্য মুসলিম, যেমন পঞ্জাবের মুসলিমরা, ব্রিটিশ শাসনের কারণে যথেষ্ট নিরাপত্তা পেয়েছিল। মুম্বইতে যে মুসলিমরা ব্যবসা-বাণিজ্যে নিযুক্ত ছিল, ব্রিটিশ রাজ তাদের আরও ধনী করেছিল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে যারা ব্রিটিশদের অধীনে কাজ করত, তারা জমিজমা পেয়েছিল। সাধারণ ভাবে কেবল এটাই বলা চলে। যে ভারতের সমাজে সাফল্যের ধারণাটা সামরিক থেকে আর্থিক সাফল্যে বদলে দিল ব্রিটিশ শাসন। তাদের প্রলােভন হয়ে দাঁড়াল– ব্রিটিশদের মেনে নাও এবং বৈষয়িক সম্পদ পাও— যে টোপটা গিলে ফেলতে প্রস্তুত ছিল বহু সংখ্যক মানুষ।
উনিশ শতকের গােড়ায় এসে ব্রিটিশরা নিঃসন্দেহে নিজেরাই বিস্মিত হয়ে যায় এই
২৭
দেখে যে, আর্থিক শােষণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে তারা আরও কত কিছু লাভ করতে পেরেছে। তাই তারা উত্তর ভারতের মুঘল সংস্কৃতিকে সতর্ক সম্মান দিয়ে চলত। দিল্লি জয় করে ফেলার পরেও তারা প্রথম দিকে শাহ আলমের উচ্চতম পদকে রক্ষা করেই নিজেদের কাজ করত। অবশ্য সেটা এক দিন না এক দিন শেষ হতই। মুঘল সম্রাটের অধিকার মানতে রাজি না হওয়ার জেদে ব্রিটিশরা ক্রমশ সে দিকে এগােতে শুরু করল। ১৮৫৭ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, দিল্লিতে মুঘলদের শাসন একটা নিতান্ত বেখাপ্পা ব্যাপার, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীন ভূখণ্ডের মুসলিমরাও আসলে সম্রাটের প্রতি উদাসীন। এটা ঠিক শােক করার মতাে ব্যাপার নয়, যে কোনও দুর্বল শাসকের এমনই হাল হয়, সব জায়গাতেই, সে দিনের মতাে এই একবিংশ শতাব্দীতেও একই ব্যাপার ঘটে।
নতুন ভূমিকা, নতুন দায়িত্ব, জীবনে কোনও এমন পদ যাতে তারা অভ্যস্ত তার খোঁজে মুসলিম সমাজ বাইরে অনুসন্ধান শুরু করল। এই আগ্রহ থেকে ভারতের মুসলিমরা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কার্যক্রমে যােগ দিল। মনে করল, নইলে তারা আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে। হিন্দুরা আরও বেশি শিক্ষিত, বেশি সহনশীল, ইতিমধ্যেই তারা আন্দোলন শুরু করেছিল। ১৮৮৫ সালেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়, লর্ড ডাফরিনের শাসনকালে, যিনি তাঁর রাজত্বকালে নিজের বাগিচা-পার্টিতে নিয়মিত কংগ্রেসকে নিমন্ত্রণ করতেন।
এই অনুসন্ধানের ফলে শেষ অবধি একটা উদ্যোগের জন্ম হল: ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের জন্য আবেদনের উদ্যোগ। এর ফলেই শেষ অবধি ১৯০৬ সালে সিমলা ডেলিগেশন। এই আবেদনের রাজনীতি থেকেই ১৯০৯ সালের ইন্ডিয়া কাউন্সিলস অ্যাক্ট-এ দুটো আলাদা নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি হল, যা মুসলিমদের একটি পৃথক সাংবিধানিক অস্তিত্ব দিল। এই সাংবিধানিক অস্তিত্ব অবশ্য সাম্রাজ্যের অধীনে সীমিত গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেই প্রযােজ্য। ভাইসরয় কার্জন (১৮৯৮-১৯০৫) বঙ্গভঙ্গ নামক যে প্রশাসনিক সংস্কার করার চেষ্টা করেছিলেন, এটা তারও ফল। কিন্তু আমরা বড় তাড়াতাড়ি এগােচ্ছি। এ সব কিছুর সঙ্গে কার্জনের বাংলা বিভাগ, যা প্রশাসনিক দৃষ্টিতে যথাযথ হলেও রাজনৈতিক দৃষ্টিতে অত্যন্ত ভয়ানক ফলদায়ক, সেই গােটা ইতিহাসটাকে আমরা কেবল ওপর থেকে ছুঁয়ে যাচ্ছি।
২৮
ভাষার বিভেদ
দুটি ধর্মবিশ্বাসের বিশেষত্ব এবং পৃথক রীতিনীতির বাইরে হিন্দু এবং মুসলিমদের যা আলাদা করে রেখেছিল, তা হল শিক্ষা। যে ভাষার মাধ্যমে পড়াশােনা হত, এবং যে পাঠক্রম পড়ানাে হত, তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বেশির ভাগই ছিল মন্দির, মসজিদ বা অন্য কোনও মিলনক্ষেত্রে। পড়ানাের মাধ্যম হিন্দু স্কুলে ছিল সংস্কৃত, হিন্দি কিংবা আঞ্চলিক ভাষা, ঠিক যেমন মুসলিম স্কুলে ছিল ফার্সি, আরবি কিংবা উর্দু। হিন্দু ছাত্ররা যদিও মুসলিম স্কুলে ভর্তি হতে পারত, হিন্দু প্রতিষ্ঠানে মুসলিমদের দেখা পাওয়া মুশকিল ছিল। হিন্দুরা প্রায়ই ফার্সি বা উর্দু শিখত, কিন্তু সংস্কৃত বলায় সড়গড় মুসলিম পাওয়া যেত খুব কম। যদিও এখনকার মতাে তখনও হিন্দি ছিল প্রচলিত মাধ্যম।
ভারতের সনাতন শিক্ষার প্রথাই উনিশ শতকের প্রথমার্ধে প্রচলিত ছিল, যদিও পাঠক্রমের দিক থেকে আধুনিক স্কুলও ক্রমশ আরও বেশি করে দেখা দিতে লাগল। যদিও তখনও মুসলিমরা জনসংখ্যায় তাদের অনুপাত অনুসারে সরকারি চাকরিতে কাজ পেতে পারত, কিন্তু উত্তর ভারতের মুসলিমদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত হয়ে গেল যে তাঁরা ইংরেজি শিক্ষার সুযােগ পাননি।
বাংলায় পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, দক্ষিণ ভারতের মতােই। কিন্তু আমরা এখানে বাংলার দিকেই তাকাব, যেখানে মুসলিমরা শিক্ষায় বিশেষ ভাবে পিছিয়ে ছিল। এর অনেকগুলি কারণ, যার মধ্যে প্রধান ছিল ‘ওয়াহাবি প্রভাব। উত্তর ভারতে স্যর সৈয়দ যেখানে ছিলেন সংস্কারে নিবিষ্ট, সেখানে বাংলায় কিন্তু তেমন কেউ ছিলেন না। সৈয়দ আমির আলি, নবাব আবদুল লতিফ, বাংলার এমন সব মুসলিম নেতারা যদিও বলেছিলেন যে হিন্দুরা যেমন বাংলায় পড়ে, তেমনই মুসলিমদের জন্য উর্দু চালু হােক। কিন্তু তা সত্ত্বেও উর্দু কখনওই সেই মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। এ কথার উপর বার বার জোর দেওয়া হত যে গড়পড়তা বাংলা স্কুলে হিন্দু প্রভাব খুব বেশি।
১৮৭০-এর দশকে হিন্দি এবং উর্দু মাধ্যমের প্রবক্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিল। যদিও হিন্দুরা কখনও উর্দুকে অগ্রাহ্য করেননি, এই ক্যাম্প ভাষার চেয়ে হিন্দির ব্যবহারের সুবিধা এবং অন্যান্য আকর্ষণের কারণে বিহারের হিন্দির প্রবক্তারা প্রতিবাদ করলেন। তার ফলে বাংলার সরকার আদেশ দিল, বিহারের আদালতে হিন্দি ব্যবহার হবে, যার পর থেকে বিহারের সরকারি নথিপত্র কেবলমাত্র দেবনাগরিতে লেখা হতে লাগল। যে একাগ্রতার সঙ্গে এই আদেশ পালিত হতে লাগল, তাতে মুসলিমরা ক্ষুব্ধ হলেন। এই বিতর্ক উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও পৌঁছে গেল। এখানে উলটো ফল দেখা দিল দেবনাগরির ব্যবহার প্রবর্তনে ব্যর্থতা হিন্দুদের মধ্যে ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠল।
এই দুই সম্প্রদায়ের কাছেই ভাষা এবং লিপি কেবল তাদের ব্যবহারিক তাৎপর্য ছাড়িয়ে গেল। হিন্দুদের মনে হল, হিন্দি হল আরবি-ফার্সির প্রভাবমুক্ত এক ভাষা, মুসলিমদের মনে হল উর্দু ভাষা ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রতীক, যার ফলে আরবি লিপি
২৯
একটি সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত তাৎপর্য পেয়ে গেল। এ সব ঘটল উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, তত দিনে সরকারি ভাষা হিসেবে ফার্সির স্থান নিয়েছে উর্দু। উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের সাহিত্যিক মণ্ডলে ফার্সি এবং উর্দুর বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন পণ্ডিত প্রতাপ নারায়ণ মিশ্র এবং ভারতেন্দু হরিশচন্দ্রের মতাে বিখ্যাত মানুষেরা, যাঁরা তাঁদের প্রকাশমাধ্যম, এবং তাঁদের আনুগত্য, উর্দু থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন হিন্দিতে। সরকারি চাকরিতে উর্দুভাষী রইস মানুষদের প্রতি পক্ষপাতিত্বে আঘাত দিতে ভারতে হরিশ্চন্দ্রের পত্রিকা কবি বাচন সুধা’[৫১] প্রায়ই সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের মনােগত ইচ্ছার প্রকাশ করত: “এ কথা সত্যি যে মুসলিমরা ফার্সি থেকে নাগরি লিপিতে পরিবর্তন হলে সমস্যায় পড়বেন, কিন্তু তাঁরা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। অল্পের স্বার্থ সব সময়েই বৃহত্তর স্বার্থকে জায়গা করে দেয়। বারাণসী হয়ে উঠল হিন্দির সপক্ষে আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস। এখানে ১৮৭০ সাল থেকে রাজা শিবপ্রসাদ, প্রধানত ভারতেন্দু হরিশ্চন্দ্রের সাহায্যে, হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের রচনার একটি বৃহৎ সংগ্রহ প্রস্তুত করেন। এই কাজের অনেকটাই ছিল বাংলা লেখার হিন্দি অনুবাদ। আর্য সমাজের মানুষরাও দেখল, তারা হিন্দি এবং দেবনাগরিকে জনসংযােগের কাজে লাগাতে পারে।
হিন্দু স্বার্থের প্রতি সচেতনতা তৈরির একটা মাত্র দিক হল হিন্দি ভাষা এবং দেবনাগরি লিপির জন্য প্রচার। এ ছাড়া গাে-রক্ষা আন্দোলন এবং নানা ধর্মীয় উৎসবে মিছিলের আয়ােজনও বিশেষ ভাবে হিন্দুদের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে করা হত। দুর্ভাগ্যবশত, পুরসভার স্তরে এই ধরনের ধর্মীয় স্বার্থের প্রকাশের জন্য রাজনৈতিক দলগুলাে ক্রমশ নিজেদের ধর্মীয় দল হিসেবে ধরে কাজ করতে লাগল। এর ফলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্বল সামাজিক বন্ধন আরও আহত হল, যার জন্য বহু জায়গায় উর্দুভাষী ভদ্র ব্যক্তিরা বহু স্থানে হিন্দুদের পাশ থেকে সরে গেলেন, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, কারণ এত দিন কিন্তু উর্দু ভাষা হিন্দু এবং মুসলিম, দুই দিককেই ধরে রাখতে পেরেছিল।
ব্রিটিশ শাসনের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ হিন্দু সমাজের মধ্যে তখন বেশ কিছু সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠল, যেমন কলকাতার ব্রাহ্ম সমাজ (১৮২৮), মুম্বইয়ের প্রার্থনা সমাজ এবং আর্য সমাজ (১৮৭৫)। এই সব সংস্কার আন্দোলন যখন রক্ষণশীল হিন্দু ধর্মকে আঘাত করল, তখন এল পালটা প্রতিক্রিয়া। ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা হতেই তৈরি হল ধর্ম সভা। আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠার ফলে রক্ষণশীলদের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে উঠল ভারত ধর্ম মহামণ্ডল। এই সনাতনপন্থীরাই যুক্তরাজ্যে ১৯১০-এর মাঝামাঝি তৈরি করল হিন্দু সভা, যা ছিল পুরসভার স্তরে মুসলিমদের স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর দাবির প্রতিক্রিয়া। হিন্দু সভা পঞ্জাব, যুক্তরাজ্য পেরিয়ে বিহার, বাংলা এবং কেন্দ্রীয় রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে। পড়ল, তার প্রভাবের মধ্যে এসে গেল বম্বে প্রেসিডেন্সিও।
৩০
কার্জনের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৫
শেষ বিশ্লেষণে বলতে হয়, বঙ্গভঙ্গের বিরােধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে যে মুসলিম জনমত তৈরি হয়েছিল, তার কারণ বঙ্গভঙ্গের সম্ভাবনা নয়, ওই আন্দোলনই তার কারণ। বিভাগের আগে এবং পরে গ্রামের হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছিল, আর সেই বিরােধিতার ভিত্তি প্রধানত ছিল হিন্দু ধর্মীয় আবেগ। ইতিহাসের দৃষ্টিতে বাংলার এই বিভাগ, এবং তারপর পূর্ব বঙ্গকে অসমের সঙ্গে যুক্ত করা, এমন এক বিষ-বীজ বপন করে যা আজও পুরাে অঞ্চলকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে, অসমে অবাধে বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘটছে, এবং এই এলাকায় একটি বিধ্বংসী মুসলিম নির্বাচনী শিবির তৈরি হয়েছে। বাংলার মুসলিমদের কাছে অসমের উর্বর জমি এক বিরাট প্রলােভন (এখনও তাই রয়েছে, তাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার স্থান খুঁজে নেওয়ার। পক্ষে উপযুক্ত, প্রথমে বেআইনি ভাবে ঢুকে তারপর অধিকার প্রয়ােগ করে জুড়ে বসার সুযােগ। তত দিনে রাজনৈতিক আন্দোলন, পৃথক পরিচয়, হিন্দুদের সঙ্গে সমান অধিকারের দাবি, মুসলিমদের মধ্যে এ সব কিছুই এসে গিয়েছে। আর এ সব কিছুই ঘটে দিয়েছে ১৮৫৭ সালের অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই। আবার, হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক চেতনার জাগরণের ৫০ বছরের মধ্যে, অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর গােড়া থেকে তার মাঝামাঝির মধ্যে, হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক সমতার অবাস্তব যুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে অবধারিত ভাবেই বিভেদ ঘটাল। বলা হয়, যেমন বীজ পুঁতেছ তেমনই ফল পাবে। এমন বহুশ্রুত কথাটি আবার বলার কোনও অর্থ হয় না, তবে এ ক্ষেত্রে তা কিন্তু বাস্তবিকই প্রাসঙ্গিক, কারণ বিভেদের বীজ পোঁতার পর, যা সীমিত ভাবে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে শুরু হয়েছিল, সেই মনােভাব বাড়তে থাকল এবং ছড়াতে থাকল, যতক্ষণ না শেষ অবধি পৃথক রাষ্ট্রের দাবিতে গিয়ে পৌঁছনাে গেল।
সেই দুর্ভাগ্যতাড়িত ১৯০৫ সালে এসে আমাদের একটু থামা দরকার। এক বার যেই মুসলিম-প্রধান পূর্ব বঙ্গ তৈরি হল, মুসলিমরা স্পষ্ট দেখতে পেলেন তার সুবিধেগুলাে, আর সেই দৃষ্টি থেকে জন্ম নিল স্বার্থচিন্তা। সেই জন্যই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে নেতৃত্বকারী হিন্দুদের দেখে মুসলিমদের মনে হতে লাগল, তারা মুসলিমদের অধিকারে বাধা দিচ্ছে, তাদের মুসলিম প্রদেশে হস্তক্ষেপ করছে। ১৯০৬ সালে লর্ড মিন্টো ফুলারের পদত্যাগ গ্রহণ করলেন,[৫২] যেহেতু সিরাজগঞ্জে[৫৩] স্কুল আন্দোলনকে দমন করতে ভারত সরকার রাজি ছিল না। যে সময়ে মুসলিমরা এই মুসলিম-প্রধান রাজ্যে সরকারি আনুকূল্যের অনভ্যস্ত উষ্ণতা উপভােগ করছিল, সেই সময়ে এমন ছােটখাটো ঘটনাও হিন্দু আন্দোলনকারীদের জয় বলে মনে হল। এর ফলে ক্রমে, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে, পূর্ব বঙ্গের মুসলিমরা রাজনৈতিক ভাবে উত্তর ভারতে তাদের ধর্মের মানুষদের কাছে চলে এলেন।
কিন্তু এ সব কিছুরই কোনও ফল হল না, কারণ নতুন পূর্ব বঙ্গের অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে লাগল। ভারতের জাতীয়তা আন্দোলনের ইতিহাসে লভেট লিখছেন, [৫৪]
৩১
“কেবল আবেগসর্বস্ব আবেদনে জন-মর্থন আদায়ের কাজ হল না, তাই বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী (হিন্দু) নেতারা এক জন জাতীয় নেতা খুঁজতে লাগলেন এবং বম্বে থেকে শিবাজিকে আমদানি করার চেষ্টা চালালেন, জনসাধারণের কাছে ধর্মের নামে আবেদন করলেন, শক্তি এবং ধ্বংসের দেবতা কালীকে তাদের আন্দোলনের দেবী করে তুললেন।”[৫৫] ভাগ্যের পাশা খেলা তখন শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা এখন স্পষ্ট ভাবে সেই পাশার ছক দেখতে পাচ্ছি ঠিকই, তবে সেই স্বচ্ছতায় মিশে রয়েছে আমাদের পশ্চাদৃষ্টির অসহায়তা।
কংগ্রেস সেই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে না জড়িয়ে পারেনি। মুসলিমরাও এই সব ঘটনার টানাপােড়েনে সক্রিয় হয়ে তাঁদের নেতাদের বােঝালেন, আত্মরক্ষার জন্য উদ্যোগী হওয়ার সময় এসে গিয়েছে। এই সব আন্দোলনের ফলেই লর্ড মিন্টোর কাছে সিমলায় প্রতিনিধিরা গেলেন ১৯০৬ সালে। সে বিষয়ে বিশদে পরে বলা হবে।
পরিচিতির রাজনীতি
এই পরিবর্তনের সময়ে মুসলিম রাজনৈতিক সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, মুসলিম যুব সম্প্রদায়ের উত্থান। সেটা ছিল বিংশ শতকের গােড়ার দিক। এই ‘যুব সম্প্রদায়’ প্রধানত ছিলেন আইনজীবী এবং অন্যান্য পেশার মানুষরা, যাঁদের পরিবারের জমিজমা থাকলেও শিক্ষা এবং সচেতনতার উপর ভর করে তারা রাজনৈতিক ভাবে বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন। রক্ষণশীলদের তাঁরা চ্যালেঞ্জ জানালেন। এঁরা প্রধানত যুক্তপ্রদেশ থেকে উঠে এলেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন মহম্মদ আলি, তাঁর ভাই শওকত আলি, এবং হাকিম আজমল খানের মতাে মানুষেরা। ঢাকার নবাবের মতাে রক্ষণশীল ব্যক্তিত্বেরা এই তরুণদের প্রতিবাদের প্রাবল্যে শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। মহসিনআল-মু উর্দুর প্রশ্নে সরকারের কাছে নতিস্বীকার করলেন। এই আশঙ্কা থেকেই সম্ভবত ভিকর-উল-মুক৯ ১৯০১ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে রক্ষণশীল নেতৃত্বের অধীনে যুক্তপ্রদেশে মুসলিমদের একটি নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিমদের বিষয়ে এই সব টুকরাে টুকরাে তথ্যকে একসঙ্গে গাঁথার দরকার ছিল, সেগুলির কোনও একটি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করার প্রয়ােজনে।
ব্রিটিশরা ঠিক সেটাই করল, মর্লে এবং মিন্টোর মাধ্যমে। এঁরা ভারতের জনমতকে প্রভাবিত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, যাতে ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসন সহজ হয়। তাছাড়া, ১৮৫৭ সালের প্রতিধ্বনি তখনও শােনা যেত ব্রিটিশ রাজের অলিন্দে, যখন হিন্দু এবং মুসলিমদের একত্রিত হওয়ার সম্ভাবনাই ব্রিটিশদের বিরাট সমস্যার কারণ তৈরি করেছিল বলে মনে করতেন ব্রিটিশ পরামর্শদাতারা। এই আশঙ্কা আরও ঘন হয়ে এল। ১৮৮০-র দশকের মাঝামাঝি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হওয়ায়, যেখানে হিন্দু
৩২
বুদ্ধিজীবীরা শিক্ষাদীক্ষায় বেশি এগিয়ে থাকার জন্য স্বভাবতই বেশি প্রাধান্য পেতে শুরু করেন। বম্বেতে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়। সেখানে ছিলেন মাত্র দু’জন মুসলিম। দ্বিতীয় বছর কলকাতার অধিবেশনে ছিলেন ৩৩ জন মুসলিম, ১৮৯০ সালে ষষ্ঠ অধিবেশনে ৭০২ জন প্রতিনিধির মধ্যে ১৫৬, অর্থাৎ ২২ শতাংশ ছিলেন মুসলিম। যত বেশি মুসলিম এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়তে লাগলেন, সরকার ততই বিচলিত হয়ে উঠল। ব্রিটিশদের তখন স্বীকৃত সরকারি নীতি হয়ে উঠল, মুসলিমদের আনুগত্য আদায় করা।
১৯০৬ সালের ১১ মে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড মর্লে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড মিন্টোকে চিঠি লিখেছেন, প্রিন্স অব ওয়েলস-এর ভারত সফরের সময়ে তাঁর সঙ্গে কথােপকথনের বিষয়ে, “তিনি (প্রিন্স) জাতীয় কংগ্রেসের দ্রুত শক্তিশালী হয়ে ওঠার বিষয়ে কথা বললেন … কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, আমরা পছন্দ করি আর না-ই করি।” কিন্তু এই রাজকীয় চিন্তার একটি আশ্চর্য দৃষ্টিকোণও ছিল। অনুগত’ সংবাদপত্র আল-হক-এর সম্পাদক সৈয়দ মহম্মদ জাকি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবে প্রিন্সের ভারত সফরের সঙ্গী ছিলেন। জাকি ভারতের মুসলিম নেতাদের সঙ্গে, বিশেষত সৈয়দ হুসেন বিলগ্রামির (ইমাদ-উল-মুলক) সঙ্গে প্রিন্সের সাক্ষাতের বর্ণনা করেছেন। বহু দিন পরে, ১৯৪৩ সালে জিন্নাকে লেখা একটি চিঠিতে জাকি সেই সাক্ষাৎগুলির বিষয়ে স্মৃতিচারণা করেছেন, যেগুলি মুসলিম দল প্রতিষ্ঠায়, এবং সিমলা ডেপুটেশনের দিকে তাঁদের এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এই বিশদ বিবরণটিতে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠা এবং সিমলা ডেলিগেশনের স্মৃতিনির্ভর বিবরণ রয়েছে।
জাকির বিবরণ ছাড়াও, ১৯০৬ সালের ৪ অগস্ট মহসিন আল-মুল্ক, আলিগড় কলেজের তৎকালীন সচিব, তাঁর সিমলায় অবসরযাপনকারী অধ্যক্ষ আর্চিবল্ডকে লিখেছিলেন, “আপনি নিশ্চয়ই ভারতের বাজেটের উপর জন মর্লের বক্তৃতাটি পড়েছেন এবং তা নিয়ে চিন্তা করেছেন। ভারতের মুসলিমদের মধ্যে তা নিয়ে খুবই কথা হচ্ছে, এবং তা জাতীয় কংগ্রেসের একটি বড় সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে। আপনি জানেন যে মুসলিমরা ইতিমধ্যেই একটু হতাশ হয়েছে, এবং শিক্ষিত, যুবক মুসলিমরা কংগ্রেসের প্রতি সহানুভূতিশীল, আর এই বক্তৃতাটি তাদের মধ্যে কংগ্রেসে যােগ দেবার প্রবণতা বাড়িয়ে তুলবে। আমি অনেকগুলি চিঠি পেয়েছি যা বিশেষ করে আইনসভায় প্রতিনিধি নির্বাচনের নতুন প্রস্তাবটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেগুলি বলছে যে বর্তমান নিয়মবিধি মুসলিমদের কোনও অধিকার দেয় না, এবং কোনও মুসলিম নির্বাচিত হয়ে কাউন্সিলে যােগ দেয় না। নতুন বিধিগুলি যদি নির্বাচনকে আরও বিস্তৃত আকারে দেখতে চায়, তাহলে মুসলিমরা কোনও আসনই পাবে না, এবং কোনও মুসলিম কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।”[৬২] | মিন্টো ১৯০৬ সালের ৮ আগস্ট মহসিন আল-মূলকের চিঠিটি দেখেন, এবং তা মর্লেকে পাঠিয়ে দেন। ১০ অগস্ট ভাইসরয়ের সচিব আর্চিবল্ড মহসিন আল-মুলক কে জানান যে মিন্টো মুসলিমদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে তাদের অভিযােগ শুনবেন।
৩৩
শেষ অবধি ১ অক্টোবর ১৯০৬, মিন্টো ৩৫ জন মুসলিম প্রতিনিধিদের আহ্বান করেন, যারা উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছাড়া ভারতের সব প্রদেশ থেকে এসেছিলেন। ভাইসরয়ের কাছে তখন একটি আবেদন পেশ করা হল, এই দাবি করে যে, “ভারতে মুসলিমদের জন্য বিস্তৃত প্রতিনিধিত্বের একটি ন্যায্য অংশের চিন্তা করা হচ্ছে,”[৬৩] কিন্তু সেই ন্যায্য অংশের হিসেব কেবল ভারতে মুসলিমদের সংখ্যার নিরিখে স্থির করলে হবে না, সেই সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষায় তাদের অবদানের নিরিখেও করতে হবে।”[৬৪] ইউরােপীয় ধাঁচের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান ভারতে নতুন, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে এই আবেদন আরও বলে যে, “আইনসভায় মুসলিমদের এখনও অবধি যা প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়েছে তা যথেষ্ট নয় এবং যাদের প্রতিনিধিত্ব তাঁরা করছেন তাঁদের অনুমতি ছাড়াই তা স্থির করা হয়েছে।” আরও বলা হল, মুসলিমদের নির্বাচনের সম্ভাবনা কম, যদি না তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি সহানুভূতিশীল হন, যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অবশ্যই হিন্দু। সে ক্ষেত্রে তারা আর মুসলিমদের প্রতিনিধি হতে পারবে না”, যে হেতু মুসলিমরা “একটি বিশিষ্ট জনগােষ্ঠী, যাদের কিছু অতিরিক্ত স্বার্থ রয়েছে, যে স্বার্থ অন্যান্য জনগােষ্ঠীর স্বার্থের থেকে আলাদা। এত দিন ঠিক মতাে সেই স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব না হওয়ায় তারা বহু কষ্ট সহ্য করেছে। এই আবেদনে প্রস্তাব দেওয়া হল, ‘মিউনিসিপ্যাল এবং ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক মুসলিম প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করুন, এবং প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় মুসলিম প্রতিনিধিদের সংখ্যা মুসলিমদের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুসারে স্থির হােক, যাদের কেবল মুসলিম নির্বাচকরা ভােট দেবেন, এবং এই একই ব্যবস্থা হােক ভাইসরয়ের আইনসভার জন্য, মনােনীত প্রতিনিধিদের চেয়ে যে হেতু নির্বাচিত প্রতিনিধিই শ্রেয়।”[৬৫]
মিন্টোর প্রতিক্রিয়া ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। তিনি ভারতের আলােকপ্রাপ্ত মুসলিম জনগােষ্ঠীর মতামত এবং উচ্চাশার অভিব্যক্তির জন্য প্রতিনিধিদের স্বাগত জানালেন, [৬৬] ঘােষণা করলেন যে “প্রতিনিধিত্বের যে কোনও ব্যবস্থার শুরু বা বিস্তারের প্রস্তাব, তা সে মিউনিসিপ্যালিটি, ডিস্ট্রিক্ট বাের্ড, লেজিসলেটিভ কাউন্সিল, যে স্তরেই হােক, সেখানে মুসলিমরা একটি পৃথক জনগােষ্ঠী বলে বিবেচিত হবে … আমি আপনাদের সঙ্গে একান্ত একমত, অনুগ্রহ করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। কী ভাবে বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কিছু বলার আমি কোনও চেষ্টাই করব না, কিন্তু আমি আপনাদের মতােই নিশ্চিত যে, জনগােষ্ঠীর বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যকে গুরুত্ব না । দিয়ে ব্যক্তিগত ভােটাধিকার দিলে যে নির্বাচনমূলক প্রতিনিধিত্ব ভারতে তৈরি হবে, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।”[৬৭]
মিন্টোর উৎসাহ এবং স্বীকৃতির জোরে এই পদক্ষেপ ‘পৃথক’ হওয়ার মানসিকতা তৈরি করায় বিশেষ সহায়তা করল। অবশ্য সেই সঙ্গে আরও নানা বিষয় ছিল, যেগুলাে আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করে দেখব। কিন্তু তর্কাতীত ভাবে এই ব্যক্তিগত ভােটাধিকার বর্জন এবং ধর্ম-ভিত্তিক সংরক্ষণের পদ্ধতি গ্রহণ শেষ অবধি ভারতের মুসলিম মানসিকতাকে বিভাজনের পথে নিয়ে গেল। সেই যখন স্যর সৈয়দ আহমদ
৩৪
খান জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও সম্বন্ধ তৈরি করতে রাজি হচ্ছিলেন না, তখন থেকেই এই মনােভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, যে মনােভাব ছিলই, ব্রিটিশরা কি কেবল তার স্বীকৃতিটুকুই দিল? না কি তারা ভারতে বিভাজনের মনােভাবটি তৈরি করতেও সাহায্য করল, যেমন বেশ কিছু ঐতিহাসিক বলে থাকেন? আরও একটি প্রশ্ন: সিমলায় এই ডেপুটেশন কি ছিল ‘সরকার-নির্দেশিত অনুষ্ঠান’– যেমন বলেছিলেন মৌলানা মহম্মদ আলি?[৬৯] না কি তা বাস্তবিক বিভেদের একটি প্রকাশ? এ বিষয়ে সব সময়েই দুটি আলাদা মতবাদ থাকবে। কিন্তু এখানে আরও উদ্বেগজনক একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে। তা হল, গণতন্ত্রে প্রতিনিধি নির্বাচনের অর্থই তাে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে একটি মঞ্চ দেওয়া, কণ্ঠ দেওয়ার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করা। যদি সেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পদ্ধতিই বিভেদ সৃষ্টি করে, যা এ ক্ষেত্রে স্পষ্ট হচ্ছিল, তা হলে। কী কর্তব্য?
এই সময়ে ফিরােজশাহ মেটা গােষ্ঠীর এক জন কংগ্রেস সদস্য, দাদাভাই নওরােজির নিজস্ব সচিব ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না, যিনি কলকাতা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। জিন্নার একেবারেই পছন্দ হয়নি সিমলা ডেপুটেশন। মুম্বই থেকে প্রকাশিত ‘গুজরাতি’ কাগজে তিনি এই ডেপুটেশন এবং ভাইসরয়ের কাছে পেশ করা তাদের আবেদন বিষয়ে একটি চিঠি লেখেন। তাঁর চিঠি প্রথমে ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ কাগজের জন্য লেখা হয়েছিল, কিন্তু কোনও কারণবশত তা সেই কাগজে স্থান পায়নি। তাঁর চিঠিতে তিনি ডেপুটেশনের সদস্যদের অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি লিখছেন,
প্রিয় মহাশয়, আপনাদের কাগজ-সহ নানা কাগজে প্রকাশিত হয়েছে যে মুসলিমদের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক ডেপুটেশন ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে ১ অক্টোবর। আমি কি জানতে পারি, মুম্বইয়ের এই তথাকথিত প্রতিনিধিত্ব যাঁরা করতে চলেছেন, সেই ভদ্রলােকদের কারা নির্বাচন করেছেন? অত্যন্ত দুঃখের কথা যে কিছু মানুষ সব সময়েই প্রতিনিধির ভূমিকা নিতে তৎপর, যদিও সেই প্রতিনিধিত্বের কিছুমাত্র ভিত্তি নেই। আমি মুসলিমদের এমন কোনও মিটিং-এর কথা জানি না, যেখানে এই সুযােগ্য মানুষগুলিকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। আর, এই ডেপুটেশনের উদ্দেশ্যটি জানতে পারি কি? এখনও অবধি কেউ জানে না, এই ডেপুটেশন কী করতে চায়। এই ভাবে কি লক্ষ লক্ষ মানুষের হয়ে । কথা বলা যায়, তাঁদের হয়ে কী করা হচ্ছে সে বিষয়ে তাঁদের আগে থেকে । কিছুই না জানিয়ে? এই শহরের মুসলিমদের মতামত কী, সেটা জানার জন্য কিন্তু কিছুই করা হয়নি।
৩ অক্টোবর ১৯০৬, লর্ড মিন্টোর ডায়রিতে যা লেখা হয়েছে তা থেকে আগা খাঁ-র ভূমিকার উৎস এবং প্রকৃতি নিয়ে বেশ কিছু কৌতূহলােদ্দীপক তথ্য পাওয়া যায়। মহান
৩৫
মুসলিম নেতা’ নবাব মহসিন-উল-মুলকের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে, তাঁর গুণাবলির মধ্যে এই কথাগুলি উল্লেখ করা হয়েছে: “তিনিই সাম্প্রতিক মুসলিম ডেপুটেশন সংগঠন করেছিলেন। ওই ডায়রিতেই ১ অক্টোবরকে একটি ঘটনাবহুল দিন, ভারতের ইতিহাসে যুগান্তকারী’ দিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, এবং আর একটি মন্তব্য করা হয়েছে। সেই সন্ধ্যায় লেডি মিন্টো এক কর্মকর্তার থেকে (নাম উল্লেখ করা হয়নি) একটি চিঠি পান, যাতে লেখা ছিল, “আমি আপনাকে এক লাইন লিখে পাঠাচ্ছি এই কথা বলতে যে আজ একটা মস্ত ঘটনা ঘটে গেছে, এমন একটি কূটনৈতিক ঘটনা যা বহু বছর ধরে ভারত এবং ভারতীয় ইতিহাসকে প্রভাবিত করবে। ৬ কোটি ২০ লক্ষ। মানুষকে বিদ্রোহ আন্দোলন থেকে কোনও মতে টেনে সরিয়ে রাখার থেকে এই ঘটনা কোনও অংশে কম নয়।”
ধর্মভিত্তিক নির্বাচকমণ্ডলী যে উদ্দেশ্যে তৈরি করেছিল, সেই উদ্দেশ্য এত ভাল ভাবে পূর্ণ হয় যে এক দশক পরে ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট মন্টেগু এবং ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড লেখেন, “ধর্ম এবং শ্রেণি অনুসারে বিভেদের অর্থ একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিরােধিতা তৈরি করা, যা মানুষকে গােষ্ঠীগত ভাবে চিন্তা করতে শেখায়, নাগরিক হিসেবে নয় … তাই আমরা ধর্মভিত্তিক নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি করা স্বশাসনের নীতি তৈরির পক্ষে বাধা বলে মনে করি।” ‘মন্টফোর্ড সংস্কারের’ রচয়িতারা তারপর এও যােগ করছেন, “এই নীতি এত ভাল কাজ করে যে এক বার তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তা ধর্মবিদ্বেষকে এমন গভীরে প্রােথিত করে যে চাইলেও তার থেকে আর বেরিয়ে আসা যায় না।”[৭০] এই ভাবে মন্টফোর্ড সংস্কারের মাধ্যমে ধর্ম-ভিত্তিক নির্বাচকমণ্ডলী সমাজে গভীর ভাবে প্রােথিত হল। র্যামজে ম্যাকডােনাল্ডের লেবার সরকারের সময়ে সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড অলিভিয়ের তা স্বীকার করেন: “ভারতের সঙ্গে যাদের কিছুমাত্র পরিচয় রয়েছে তারা কখনওই অস্বীকার করবে না যে ভারতে ব্রিটিশ প্রশাসনিক কর্তাদের মুসলিমদের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে। এই পক্ষপাত খানিকটা তাদের প্রতি সহানুভূতি-বশত, কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণ, হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিপরীতে তাদের ব্যবহার করা।”[৭১]
এক শতাব্দী পরে এই বিষয়ে কী মন্তব্য-ই বা করা যায়? কিছু বিষয় অবশ্য পরিষ্কার। সব ব্রিটিশ অফিসারদের মধ্যে একমাত্র লউ-এর তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার হারকোর্ট বাটলার মুসলিমদের লখনউতে সমাবেশে মিলিত হওয়া এবং ভাইসরয়ের কাছে আবেদনের খসড়া তৈরি করার বিরােধিতা করেছিলেন, এবং তাঁর উপদেশ না মানায় মুসলিমদের সমালােচনা করেছিলেন। বাটলার পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবির বিরােধিতা করেন। এ বিষয়ে নিজের দ্ব্যর্থহীন মতামত লেখেন, “ফুলারের অবসরের পর পুরাে ব্যাপারটি নিয়ে মহসিন আল মুল্ক এবং বিলগ্রামের ইমাদ আল-মুল্ক বড় তাড়াহুড়াে করে ফেলেছেন।” মহসিন আল-মুলককে লেখা ভাইসরয়ের নিজস্ব সচিব ডানলপ স্মিথের চিঠিতে প্রস্তাব ছিল যে মুসলিমরা মনােনয়নের ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের আবেদন করুন, নির্বাচনের ভিত্তিতে নয়। সিমলা ডেপুটেশনের সদস্যরা
৩৬
আশ্বাস পেয়েছিলেন যে তাঁদের কথা ব্রিটিশরা সহানুভূতির সঙ্গে শুনবে, সুতরাং তাঁদের সাফল্যের’ যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। ৮ অগস্ট ১৯০৬, মিন্টো মর্লেকে লেখেন, “কংগ্রেস যে সব গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে, তারা ছাড়া অন্যান্য গােষ্ঠীর প্রতিনিধিদেরও সম্পূর্ণ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়ােজন।”[৭৩] পঞ্জাবের লেফটেনান্ট-গভর্নর ১০ অগস্ট, ১৯০৬ সালে ডানলপ স্মিথকে লেখেন, “আমি অন্যান্য জায়গা থেকেও শুনেছি, মুসলিম যুব সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা বিষয়ে মহসিন আল-মুল্ক কী বলছেন। তাঁদের প্রত্যাশা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু সেই প্রত্যাশা যদি তাঁদের কংগ্রেস দলের কাছে টেনে নিয়ে যায়, সেটা হবে একটা দারুণ দুর্ঘটনা, কারণ বর্তমানে শিক্ষিত মুসলিমরাই ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে রক্ষণশীল অংশ।”[৭৪] ঠিকই তাই, কারণ সিমলা ডেপুটেশনে যে মুসলিমরা ছিলেন তাঁরাও প্রধানত রক্ষণশীল অংশই ছিলেন, তবে তাঁরা ছিলেন স্ব-নিযুক্ত প্রতিনিধি। মুসলিম যুব সম্প্রদায়ের কোনও প্রতিনিধিত্ব কার্যত সেই দলে ছিল না।
ব্রিটিশ অফিসাররা মিন্টোকে ক্রমাগত বুঝিয়েছিলেন যে সিমলা ডেপুটেশন-এ মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ছিল অত্যন্ত বাস্তবানুগ। তাঁরা এও বুঝিয়েছিলেন যে, মুসলিমদের অসন্তোষ বেড়ে উঠলে তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতার প্রতি এক মস্ত বিপদের কারণ হয়ে উঠবে (আবারও সেই ১৮৫৭ সালের ছায়া)। হারকোর্ট বাটলারই কেবল সতর্কবার্তা জানাতে থাকেন, কারণ তিনি জানতেন, “মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠনের বীজ ব্রিটিশ আনুকূল্যের সূর্যালােক পেলে গােটা ভারতে দ্রুতগতিতে বেড়ে উঠবে।”[৭৫] ভাইসরয়ের পৃষ্ঠপােষকতা ঠিক সে কাজটাই করল। ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯০৬-এ ভারত সরকারের ‘ল মেম্বারকে একটি চিঠিতে বাটলার লিখছেন, ‘হিন্দু-বিরােধিতাই ছিল “বস্তুত একমাত্র মঞ্চ’[৭৬] যার উপরে মুসলিমরা জড়াে হয়েছিলেন লউতে, সিমলার আবেদনের খসড়া তৈরি করেছিলেন। তা হলে কি সিমলা ডেপুটেশন ব্রিটিশদের রাজনৈতিক প্রয়ােজন (মুসলিমদের কংগ্রেসের থেকে দূরে রাখা) এবং মুসলিম স্বার্থের (প্রধানত উত্তর প্রদেশের) এক সুযােগসন্ধানী বিবাহ বলেই ধরতে হবে? এই সব কিছুর মধ্যে নিহিত ছিল একটি মৌলিক ধারণা যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম থাকবে, সুতরাং ব্রিটিশরা যা বলবে তা-ই হবে। শেষ অবধি ১৯০৯ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিলস অ্যাক্ট পাশ হয়। এর মধ্য দিয়ে ভারত সরকার রক্ষণশীল মুসলিমদের কাছে তাদের সাহায্যের আবেদনকে সতর্কতার সাইরেনে পরিণত করে।
পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বিষয়ে কাউন্টেস অব মিন্টো, মেরি-র দিনলিপি থেকে একটি কৌতূহলােদ্দীপক অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি:
মিঃ গাঁধী যখন লন্ডনে গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দিতে গিয়েছিলেন, বিকানিরের মহারাজা (স্বৰ্গত স্যর গঙ্গা সিংহজি) একটি পার্টিতে তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসেন।
আমি (মেরি) প্রশ্ন করলাম, আমার নাম কি আপনার মনে রয়েছে?
৩৭
‘আপনার নাম মনে নেই!’ গাঁধী বললেন, ‘মিন্টো-মর্লে সংস্কার। আমাদের শেষ করে দিয়েছে। পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী না হয়ে থাকলে এত দিনে আমাদের মতপার্থক্য মিটিয়ে নেওয়া যেত।
আমি বললাম, “মিঃ গাঁধী, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর প্রস্তাব করেছিলেন আপনারই পূর্বসূরি নেতা মিস্টার গােখলে।
‘আহ!’ মিঃ গাঁধী হেসে বললেন, ‘গােখলে ভাল লােক ছিলেন, কিন্তু ভাল লােকও ভুল করতে পারেন।
কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন ইন্ডিয়ান অফিসের কাউন্সিলের সদস্য এক পঞ্জাবি ভূস্বামী। তিনি বললেন, হ্যাঁ, আর লর্ড মিন্টো যদি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী তৈরির উপর জোর না দিতেন, তা হলে আমাদের মুসলিমদের আর অস্তিত্ব থাকত না।
মুসলিমদের পৃথক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হলে তা যে হিন্দু-মুসলিম ব্যবধান কমাবে না, বরং বিদ্বেষ আরও বাড়াবে, এই অভিযােগের উত্তরে বরাবরই ব্রিটিশ রাজ বলে এসেছে, “ওই পার্থক্য বরাবরই ছিল। লাহােরে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে হিন্দু সভার বক্তব্যের উত্তরে ডানলপ স্মিথ বলেন যে হিন্দু সভাকে ভাইসরয়ের জানানাে উচিত, “যে সরকার এক দিনের জন্যও ভারত শাসন করতে আসবে, তাকেই ধর্মীয় পার্থক্যের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।”[৭৮] সেই সঙ্গে, “হিন্দু, মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এক,” এই দাবি যখনই করা হয়েছে, তার উত্তর এসেছে, “মুসলিম এবং অন্যরা তা মনে করে না।’[৭৯]মিন্টো (এবং তাঁর অফিসারদের) পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর পক্ষে অবস্থানের অনেকটা উৎসই ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে মুসলিমদের চাহিদা। তা ছাড়া মুসলিমদের অসন্তোষকে মিন্টো ভয়ও করতেন বেশ (আবার ১৮৫৭!)। তিনি হারকোর্ট বাটলারের মতটি মর্লের কাছে জানালেন। জানালেন যে, “অনেক মুসলিম তাদের হৃদয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিপক্ষে। মুসলিম ভূস্বামী, মুসলিম আইনজীবী এবং পেশাদার শ্রেণিরা ক্রমে ব্রিটিশের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। এবং, “যুযুধান নানা ধারণার দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকে বার বার দুটি দল উঠে আসছে, যারা ব্রিটিশ শাসনের পক্ষে এবং যারা বিপক্ষে। আগে মিন্টো মর্লেকে বলেছিলেন, “যদিও মুসলিমরা মােটের উপর চুপচাপ থাকে, তারা কিন্তু অত্যন্ত শক্তিশালী।” কিন্তু পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ধারণা যেই এক বার মর্লের অনুমােদন পেয়ে গেল, তার পরই মুসলিমরা কাউন্সিলগুলিতে অনুপাতের চেয়ে বেশি আসনসংখ্যা দাবি করতে শুরু করল, মিন্টো যে অনুপাত যথাযথ মনে করেছিলেন তার চেয়েও বেশি অনুপাতে। সাধারণ নির্বাচকদের মধ্যেও মুসলিমরা থাকবে, সেই ধারণায় তারা তীব্র আপত্তি জানাতে লাগল। মিন্টো তখন মর্লের সঙ্গে যােগ দিয়ে মুসলিমদের মনে করিয়ে দিলেন, তাঁরা কিন্তু আবেদনকারী ছাড়া আর কিছুই নন, এবং তাঁরাই ব্রিটিশ
৩৮
শাসকদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়, রক্ষণশীল মুসলিমরা যা-ই মনে করুন না কেন, আর হিন্দুরা শেষ বিচারে ভারতের সবচেয়ে সংগঠিত দল, স্যর লান্সলট হেয়ার যাই বলুন না কেন। মর্লে-র সংক্ষিপ্ত সাবধানবাণী, ব্রিটিশদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে তারা মুসলিমদের হাত করতে গিয়ে হিন্দুদের হাতছাড়া না করে।”[৮৩]
পশ্চাদৃষ্টি দিয়ে আমরা এখন বুঝতে পারি, রাজনৈতিক সংগঠনগুলিতে যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অংশ নিশ্চিত করতে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি করলে দাবি কেবল বাড়তেই থাকে, এবং শেষ অবধি কোনও সমতা যেহেতু আনা সম্ভব হয় না, তাই অসাম্য বাড়তেই থাকে। এ বিষয়ে শেষ মতামত দিলেন লর্ড মর্লে। হাউস অব লর্ডস-এ ১৭ ডিসেম্বর, ১৯০৮ সালে তিনি ঘােষণা করলেন, “আমাকে যদি ভারতে সাংসদীয় গণতন্ত্র তৈরি করতে হয়, কিংবা যদি বলা হয় যে সংস্কারের এই অধ্যায় সরাসরি ভারতে সাংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে, তা হলে আমি এর সঙ্গে কোনও সম্পর্কই রাখতে চাই না। সুতরাং শাসকদের অভিপ্রায় কী ছিল, তা যথেষ্ট পরিষ্কার। তা সত্ত্বেও সেই সময়ের স্মৃতিতে মুদ্রিত হয়ে রইল এ কথাও যে, ভাগ্যই রাজনৈতিক পার্থক্যের দিকে মানুষকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সব সতর্কতার সিগন্যাল একে একে জ্বলতে শুরু করেছিল। তার কোনওটাই আমরা পড়তে পারিনি।
এই পরিস্থিতির মধ্যে পৃথক একটি রাজনৈতিক গােষ্ঠীর পরিচিতি লাভ করে মুসলিমরা রাজনৈতিক সংগঠনের আয়ােজন করতে লাগলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন। গােটা ভারতের সব স্বনিযুক্ত প্রতিনিধিরা, যাঁরা সিমলা ডেপুটেশনে অংশ নিয়েছিলেন। সিমলার সেই ঘটনার খােলস থেকে ক্রমে যে নতুন রাজনৈতিক সংগঠন বেরিয়ে আসার চেষ্টা করবে, তা ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ‘মহমেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স’ ঢাকার বৈঠকে পরিণত হল ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ’এ। যদিও ঢাকাতে সিমলা ডেপুটেশনের বেশির ভাগ প্রতিনিধিই লিগের প্রভিশনাল কমিটি’তে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে স্থান পেলেন, লিগের ভিত কিন্তু তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, যিনি সিমলা ডেপুটেশনে উপস্থিত ছিলেন না, ‘সর্বভারতীয় মুসলিম কনফেডারেসি’র পরিকল্পনা তিনিই সকলের মধ্যে বিতরণ করে লিগের মূল উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন। যুক্ত প্রদেশের মুসলিমরা বাংলার মুসলিমদের কাছে হার মানতে রাজি ছিলেন না ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। যুক্তপ্রদেশের এই অস্থির, অধৈর্য যুবআইনজীবী সম্প্রদায়— ঢাকাতেও তত দিনে যাঁদের প্রচুর সংখ্যক সমর্থক নিজেদের মত প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। প্রভিশনাল কমিটির ৫৫ জনের মধ্যে ২৫ জনই জমিদার। তাঁরা সরকারি পেনশনভােগীদের আনুগত্যের পথ অনুগমন করতে রাজি হলেন না। এই সব মতদ্বন্দ্বকে চাপা দিতে শেষে একটি পক্ষপাতহীন প্রস্তাব গ্রহণ করা হল। মুসলিমদের রাজনৈতিক স্বার্থ কী, কোন স্বার্থ রক্ষা করতে হবে বা প্রচার করতে হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনার চেষ্টাই হল না। হয়তাে সে ধরনের উদ্যোগের সময় সেটা ছিল না। এই সময়ে লিগ ছিল কেবল আনুগত্য প্রকাশের একটি সংগঠনমাত্র।
৩৯
এ সব ক্ষেত্রে যেমন হয়, জন্মের পর বেশ কয়েক দশক পরেও কিন্তু মুসলিম লিগ দুর্বল শিশু হয়েই রইল। আর্থিক ভাবে এই সংগঠন মুসলিম নবাব এবং রাজাদের মুখাপেক্ষী। ১৯০৯ সালে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ শুরু হল, তখন মুসলিম লিগের তুলনায় স্থানীয় অঞ্জুমানদের থেকেই বরং অনেক বেশি আবেদন জমা পড়ল, যাতে সরকার তার অবস্থানে অনড় থাকে। ১৯১০ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কারের পর প্রথম যে নির্বাচন, সেখানে মুসলিম লিগ একটি সংগঠন হিসেবে কাজ করতে ব্যর্থ হল। মুসলিম নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে লিগ নিজেকে একটি রাজনৈতিক দল বলে তুলে। ধরতে পারল না, প্রধান রাজনৈতিক মঞ্চও হয়ে উঠল না। তার যে সদস্যরা বর্ধিত আইনসভার সদস্য হতে পারল, তারা স্থানীয় মানুষের কাছে নিজেদের সম্মানের জন্যই পেরেছিল, লিগের সদস্যপদের জন্য নয়। লিগের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া গেল ১৯১১ সালে, যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হল। যদিও তা মুসলিম স্বার্থের বিরােধী বলেই মনে করা হয়েছিল, কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে লিগকে আলােচনায় ডাকাও হল না। যুক্তপ্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্নরকে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেখা একটি চিঠিতে মিন্টো, লিগকে মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন বলে স্বীকার করতে কিংবা কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে প্রথমেই তার মতামত নিতে স্পষ্টতই অস্বীকার করলেন। এই অবস্থা থেকে ক্রমে এক অনেক লম্বা পথ পেরিয়ে লিগ হয়ে উঠল মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠন, এবং মহম্মদ আলি জিন্না হয়ে উঠলেন মুসলিমদের একমাত্র মুখপাত্র। কিন্তু না, আমরা আবার ফিরে যাই।
লিগের সদস্যসংখ্যা ছিল অতি অল্প। সংগঠনের বার্ষিক রিপাের্ট অনুসারে, বিশের দশকের গােড়ায় তা ১২০০-ও ছাড়ায়নি। চৌধুরি খালেকুজ্জামানের স্মৃতিচারণ অনুযায়ী খিলাফত আন্দোলনের দিনগুলিতে লিগ বেঁচেছিল কেবল খাতায়-কলমেই। তার পর এক দল নতুন ‘নবাব’ এসে লিগের নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নিল। তাঁরা কেবলমাত্র বার্ষিক সভাগুলিতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতেন, এবং তাঁদের মতােই সম্মাননীয় অন্যান্য আতিথ্যপ্রদানকারীর প্রশংসা অর্জন করতেন। কত কষ্ট করে তাঁরা আসতেন, “এত কষ্ট সহ্য করে অতিথি হিসেবে এসে অপরিচিত বাসভবনে তাঁরা থাকতেন, তার পর এই সব অনভ্যস্ত (কিন্তু খুবই সুস্বাদু) খাবার খেতেন, যদিও যথেষ্ট পান এবং সিগারেট তাঁদের কষ্ট কিছুটা লাঘব করত।” কী অসাধারণই না ছিল সেই আশরফ। জগৎ, কী আত্মম্ভরিতার সঙ্গেই না চলত জাতীয় রাজনীতির সেই খেলা। লিগে যে সব কর্মসূচি নেওয়া হত, তার সবই পাঠানাে হত সংবাদপত্রে, যদিও তার অনেক আগেই যা যা কথা হয়েছে, অনুগত সেবকদের থেকে তার প্রতিটির অনুপুঙ্খ বিবরণ পৌঁছে। যেত ব্রিটিশদের কাছে। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার মানে ছিল সে বছরের মতাে সংগঠনের কাজকর্মেরও শেষ। কেউই নজরও দিত না কী বলা হয়েছে তা নিয়ে, কেবল অল্প কয়েক জনেরই মাসখানেক পরও মনে থাকত কী সব কথাবার্তা হয়েছিল। কেবল এই কথাবার্তার বিস্তারিত বিবরণ থাকত ভারত সরকারের নথিপত্রে।”[৮৪]
সেই প্রথম বছরগুলােতে লিগ যেন ছিল এক ‘অপেশাদার খেলােয়াড়, যারা
৪০
সমানেই আমন্ত্রিত দর্শকদের জন্য প্রদর্শনী করে যাচ্ছে।[৮৫] খুব সীমিত, সম্পত্তিভিত্তিক ভােটাধিকার দিয়ে নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে মুসলিম যুব সম্প্রদায়কে কংগ্রেসের প্রগতিপন্থীদের থেকে, এবং দরবারে-আমন্ত্রিত’ মুসলিমদের থেকে আলাদা করে রাখতে ব্রিটিশ এবং রক্ষণশীল মুসলিম, দু’পক্ষই বেশ সফল হয়েছিল। এই যুব সম্প্রদায় গ্র্যাজুয়েট হিসেবে ভােট দিত, সেই সঙ্গে তারা বাইরের বৃহত্তর মুসলিম মানুষজন যারা ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে রয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টাও করত, উলেমা, মুসলিম ধর্মীয় বিদ্বজ্জন, প্রভৃতির মাধ্যমে। এই ভাবে তারা মুসলিম লিগের নেতৃত্ব দখলের চেষ্টা চালাতে লাগল। বস্তুত পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী দিয়ে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে মুসলিম রাজনীতিকে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা দিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা অবশ্য এও টের পেল যে তাদের হাতে আর সেই ভূমিকার নিয়ন্ত্রণ নেই, মুসলিমরা আর তাদের নির্দেশ পালন করবে না। সেটা অন্য কথা। অনভিপ্রেত কার্যফল’-এর তত্ত্ব আর এক বার হাতে নাতে সত্য প্রমাণিত হল, এই আর কী।
যে মুসলিমরা সিমলা ডেপুটেশনের ব্যবস্থা করেছিলেন, এবং ব্রিটিশদের উৎসাহী সহায়তায় যাঁরা নির্বাচকমণ্ডলীকে পৃথক করেছিলেন, তাঁরা এখন বস্তুত অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন নিজেদের জীবনযাত্রার মান রক্ষা করতে। নিজেদের সমাজের ‘নিম্নশ্রেণির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখার কাজটা এখন যেন হিন্দুদের। উপর রাজনৈতিক আধিপত্য তৈরি করার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সিমলা ডেপুটেশনের মুসলিমরা বাস্তবিক যা চেয়েছিলেন, তা হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তাঁদের নিজেদের সামাজিক আধিপত্য বজায় রাখতে। তাঁদের ‘মুসলিম পরিচিতির উপর জোর দেওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশদের থেকে কোনও রাজনৈতিক বা আদর্শগত স্বতন্ত্রতার কথা তাঁরা তখন ভাবতে পারেননি। | এই সময়ে, সে যুগের এই তাম্রপটে মুসলিমদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খােদাই করার কাজটা করতেই যেন আবির্ভূত হলেন মহম্মদ আলি জিন্না। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা দেখব পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে জিন্নার বিবর্তন, যে বিবর্তনের জমি নানা জটিল ঘটনার মধ্যে দিয়ে এক রকম তৈরি হয়েই ছিল। এই ঘটনাগুলিই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ১৯৪৭ সালের ভয়ানক ঘটনার রূপ পরিগ্রহ করল। কত সহস্র মানুষের মূল উৎপাটিত হল। ভারতের প্রাচীন ভূমিতে কত মৃত্যু, কত প্রতিশােধস্পৃহা ঘুরে বেড়াতে লাগল। এই জীবন্ত ব্যবচ্ছেদ সম্পর্কে ভাবতে গেলে একটি তিক্ত চিন্তা আমাদের প্রবল আঘাত করে। জিন্না কি এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে হারিয়ে-ফেলা অতীতের সেই বিগত চাকচিক্যের সন্ধানই করছিলেন? নাকি ভারতে যে নতুন গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছিল সেখানে যথেষ্ট পরিসর খোঁজার চেষ্টা করছিলেন? অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠদের স্রোতে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচতে চাইছিলেন? সেই সন্ধানের অর্থ বুঝতে না পারাই কি ১৯৪৭ সালের দিকে আমাদের নিয়ে গেল? পরের অধ্যায়গুলিতে আমরা তার উত্তরও খুঁজব।
৪১
তথ্যসূত্র
১. প্রথম দিকে ইকবাল এবং জিন্না, দুজনেই একই ভারতীয় জাতিসত্তার পক্ষে সওয়াল করেন। কিন্তু, পরে তাদের ‘আমরা’র পক্ষে অবস্থানটি ‘তারা’য় পরিবর্তিত হয়। এবং জিন্নার তুলনায় ইকবালের ক্ষেত্রেই এটি আগে ঘটে। আর, ক্রমশই ভারতীয় মুসলিমদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্রের প্রয়ােজন প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
জাতীয়তা (মুসলিম জাতীয়তাবােধ) বিষয়ে ইকবালের ধারণা তার প্রকৃত মুসলিম বিষয়ক ধারণা থেকেই উঠে এসেছিল। মুসলিম মূল্যবােধের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি জাতি-ঐক্যই ছিল তাঁর কাছে আদর্শস্বরূপ। সুতরাং এ রকম একটি ধারণা সর্বজনীন ও দেশাতীত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। অন্য দিকে, এ বিষয়ে পশ্চিমি বিশ্বাস ছিল দেশ বা ভূখণ্ড কেন্দ্রিক (এবং অবশ্যই যে কোনও রকম ধর্মীয় অনুশাসন ব্যতিরেকেই)। ইকবাল এই রকম বিশ্বাস গ্রহণ করেননি, যেমন তিনি মেনে নিতে পারেননি বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের মিশেলে তৈরি ভারতীয় জাতীয়তাবােধকেও। কিন্তু, ব্রিটিশ ভারতবর্ষে বসবাসকারী মুসলমানরা যেখানে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই সেই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে থাকবে— জীবনের প্রান্তবেলায় ইকবালের এ রকম দাবিই পৃথক এক মুসলিম রাষ্ট্রের সম্ভাবনাকে দৃঢ় ও অবশ্যম্ভাবী করে দিয়েছিল।
২. গিরিলাল জৈন, দ্য হিন্দু ফেনােমেনন, ইউ বি এস পাবলিশার্স, ১৯৯৪, পৃ-১৩২, পরিশিষ্ট-২।
৩. রিচার্ড এম ইটন, ইন্দো-মুসলিম ট্রাডিশনস, ১২০০-১৭৫০: টুওয়ার্ডস দ্য ফ্রেমওয়ার্ক অব স্টাডি’, ২০০১-এর ২২ নভেম্বর লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ-এ প্রদত্ত ‘দি অ্যানুয়াল সাউথ এশিয়া লেকচার’ শীর্ষক বক্তৃতা, সাউথ এশিয়া রিসার্চ, সেজ পাবলিকেশনস, ২০০২, পৃ-২।
৪. ভারতে মুসলিম শাসন মধ্য এশিয়া থেকে ঔপনিবেশিক শাসন নয়, ভারতে কোনও একটি জাতির শাসনও নয়। পূর্ব ইরানের হিরাটের পূর্ব দিকের ঘুর-এর দলপতিদের নেতৃত্বে তুর্কি দাস এবং আফগানরা ১১৯২ থেকে ১২০৬ সালের মধ্যে ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকার কিছু অংশের উপর আধিপত্য করেছিল। ১২২১ সালের মধ্যে ঘুরদের ক্ষমতা আফগানিস্তান থেকে অন্তর্হিত হয়, এবং ভারতে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মােঙ্গলরা তাদের সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
তুর্কি দাস ইলতুতমিস ১২১১-১২৩৬ সালের মধ্যে দিল্লিতে সুলতান শাসনের পত্তন করেন, যদিও ত্রয়ােদশ শতকের শেষে তা বার বার মােঙ্গল আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়। চতুর্দশ শতকের শেষে তুর্কি আমির তিমুর (১৩৭০-১৪০৫) দিল্লি আক্রমণ করেন এবং দিল্লির সুলতানি শাসন ভেঙে গুজরাত, মালওয়া, জৌনপুরে আঞ্চলিক সুলতানি শাসন গড়ে ওঠাকে ত্বরান্বিত করেন।
৫. ১২৬০ সালে তৎকালীন ভারতের সর্বাধিক খ্যাতিমান ঐতিহাসিক মিনহাজ সিরাজ জুজানি মুঘল শাসনের আওতার ঠিক বাইরে, দিল্লি থেকে তিক্ত ভাবে লিখছেন, “অভিশপ্ত চেঙ্গিস খান মধ্য এশিয়া, ইরান ও ইরাকের ইসলামিক দেশগুলিকে জয় করেছে, যা আবার বিধর্মীদের ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। কিন্তু তিনি যােগ করছেন, ‘সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কৃপায় এবং ইলতুতমিস বংশের প্রহরার জন্য হিন্দুস্তানের রাজত্ব ইসলামি মানুষদের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে।
৪২
রিচার্ড এম ইটন, ‘ইন্দো-মুসলিম ট্র্যাডিশনস’, পৃ ৩
৬. ইউরােপীয়রা আসার আগে অবধি যেহেতু ইন্ডিয়া’ শব্দটির অস্তিত্ব ছিল না, তাই আমি হিন্দ এবং হিন্দুস্তান শব্দগুলি ব্যবহার করেছি, ব্রিটিশ আসার পর ইন্ডিয়া শব্দটি ব্যবহার করেছি।
৭. বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন, ইম্যাজিৰ্ড কমিউনিটিজ: রিফ্লেকশনস অন দি অরিজিন অ্যান্ড স্পেড অব ন্যাশনালিজম জাতি ও জাতীয়তাবাদের উপর একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ, সেখানে কল্পিত জাতীয়তার ধারণা নিয়ে আলােচনা রয়েছে। অ্যান্ডারসনের মতে জাতীয়তা হল কল্পিত, কারণ ‘ক্ষুদ্রতম দেশের মানুষরাও তাদের সহ-নাগরিকদের বেশির ভাগকেই জানবে না, বা তাদের কথা শুনবেও না, কিন্তু প্রত্যেকের মনেই সমগ্রের একটা ছবি রয়েছে। গেলনার প্রায় একই কথা বলছেন যখন তিনি লিখেছেন, জাতীয়তা কোনও জাতির সচেতনতায় উত্তরণ নয়; তা হল জাতি কল্পনা করা, যখন জাতি বলে কিছুই নেই। গেলনার প্রমাণ করতে উদগ্রীব যে ‘জাতীয়তা তঞ্চকতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়, তা ভ্রান্ত এবং বানানাে, ‘কল্পনা’ বা ‘নির্মাণ নয়। জাতিকে একটি সীমা-বিশিষ্ট সত্তা বলে চিন্তা করা হয়, কারণ ১০০ কোটি মানুষের দেশেরও সীমা রয়েছে, যার পরে রয়েছে অন্য দেশ। কোনও জাতি নিজেকে সমগ্র মানবজাতির সঙ্গে এক করে দেখে না। যারা জাতীয়তাবাদী, তারাও কখনও এমন চিন্তা করে না যে বিশ্বের। সমস্ত মানুষ একদিন তাদের জাতিতে যােগ দেবে, যে ভাবে কোনও কোনও সময়কালে, ধরা যাক, খ্রিস্টানরা চিন্তা করেছিল যে গােটা গ্রহটাই খ্রিস্টান হবে।
‘জাতিকে সর্বভৌম বলে চিন্তা করা হয়েছে, যে হেতু সে ধারণা এমন এক সময়ে জন্ম নিয়েছিল যখন বিপ্লব এবং যুক্তিবাদ বংশগত, ঐশ্বরিক রাজত্বের ধারণাকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল। মানবতার ইতিহাসের এই সময়ে, যখন গোঁড়া ধর্মাবলম্বীরাও ধর্মের বহুত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছিলেন, এবং প্রতিটি ধর্মের সত্যতার দাবি এবং ভৌগােলিক বিস্তার দেখতে পাচ্ছিলেন, সেই সময়ে জাতিগুলি স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যদি ঈশ্বরের অধীনে হয় তবে তা সরাসরি তাঁরই অধীনে। এই স্বাধীনতার প্রতীকই ছিল সার্বভৌম রাষ্ট্র।
‘শেষত, একে জাতি বলে কল্পনা করা হয়েছিল, কারণ প্রতিটি দেশে অসাম্য এবং শােষণ থাকা সত্ত্বেও, জাতি সব সময়েই এক গভীর সহমর্মিতার ধারণা তৈরি করে। এই ভ্রাতৃত্ববােধই শেষ অবধি গত দুশাে বছর ধরে এত কোটি মানুষের পক্ষে জাতির সীমাবদ্ধ ধারণার জন্য কেবল অপরকে মারতে নয়, নিজেকেও মরতে প্রণােদিত করেছে।
‘এই সব মৃত্যু আমাদের এই মূল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় যে, গত দুই শতকের এই দুর্বল কল্পনা কী করে এত বৃহৎ আত্মদান সম্ভব করল? আমি মনে করি, জাতীয়তার সাংস্কৃতিক ধারণার মধ্যে তার উত্তর লুকিয়ে রয়েছে।
৮. তদেব
৯. ম্যাক্স ওয়েবার (এপ্রিল ২১, ১৮৬৪-জুন ১৪, ১৯২০) জার্মান রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানী। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান এবং শাসনতন্ত্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয় তাঁকে। ভার্সাইয়ের সন্ধির অন্যতম সদস্য হিসেবে, এবং ওয়াইমার সংবিধানের অন্যতম লেখক হিসেবে, তাঁকে তৎকালীন জার্মান রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী মনে করা হত। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা, ‘দ্য প্রটেস্টান্ট এথিক অ্যান্ড দ্য স্পিরিট অব ক্যাপিটালিজম।
১০. ম্যাক্স ওয়েবার ইসলাম নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেননি। তাঁর ‘প্রােটেস্টান্ট এথিক’
৪৩
এর সঙ্গে ইসলাম-বিষয়ক নােট লিখেছিলেন তিনি। ওয়েবারের মতে, ইসলামে যুক্তিগ্রাহ্য কোনও নিয়ম নেই। তাঁর মতে, ইসলামের স্বাভাবিক বিবর্তন সম্ভব না হওয়ার অন্যতম কারণ এই যে তার মূল ধারকরা একটি ‘যােদ্ধা গােষ্ঠী। ফলে ইসলামের ধর্মীয় বার্তা যােদ্ধাদের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ মূল্যবােধই হতে বাধ্য।
১১. এর পর থেকে হিন্দু বা হিন্দুস্তানের জায়গায় আমরা ইন্ডিয়া ব্যবহার করব, যাতে বুঝতে সুবিধে হয়।
১২. ইটন, ‘ইন্দো-মুসলিম ট্র্যাডিশনস’, পৃ ১০
১৩. ভারতে মুসলিম পারসি-আরব-তুর্কি অভ্যাগতদের আশরফ বলা হত। আশরফদের মধ্যে বিভাগ ছিল, যেমন সৈয়দ, শেখ ইত্যাদি। যাঁরা আশরফ ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে তিনটি শ্রেণি ছিল, উচ্চবর্ণ থেকে যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, প্রধানত রাজপুত— যদি না তারা শেখ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন তার পর জুলাহাদের মতাে হস্তশিল্পীরা, এবং শেষে অচ্ছুৎ, নিম্নবর্গীয়রা।
১৪. মুসলিম কৃষক এবং গ্রামের হস্তশিল্পী।
১৫, ফ্রান্সিস রবিনসন, দি উলামা অব ফারাঙ্গি মহল অ্যান্ড ইসলামিক কালচার ইন সাউথ এশিয়া, পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, দিল্লি, ২০০১, পৃ ৩৫
১৬. টমাস মেটকাফ, দি আফটারমাথ অব রিভােল্ট: ইন্ডিয়া ১৮৫৭-১৮৭০, প্রিন্সটন ১৯৬৫, পৃ ২৯৮
১৭. স্যার জর্জ ক্যাম্পবেল, মেমােয়ার্স অব মাই ইন্ডিয়ান কেরিয়ার, খণ্ড ১, লন্ডন, ১৮৯৩, পৃ ২৪৩-২৪৪
১৮. সদর বাের্ড অব রেভিনিউকে লেখা ২০ ডিসেম্বর ১৮৫৮ তারিখের রিপাের্ট, প্রােক্ল্যামেশন নং ৩১, এন-ডব্লিউ পি, ১৪-৩০ এপ্রিল ১৮৫৯, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, রেঞ্জ ২২১, খণ্ড ২৪
১৯. পঞ্চদশ শতকে ইউরােপীয়রা আসার পর মালাবারের মােপিলা গােষ্ঠী এবং উচ্চবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে সামাজিক প্রভাবের জন্য প্রতিযােগিতা শুরু হয়। ব্রিটিশ জয়ের ফলে কৃষি সম্পর্কে যে পরিবর্তন, তার জন্য মােপিলারা বহু দিন ধরে হিন্দু উচ্চবর্ণদের আক্রমণ করে। তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছয় ১৯২১-২২ সালে, যখন মােপিলারা ইসলামি আদর্শকে সামনে রেখে ইসলামি রাজ্য গড়ার চেষ্টা করে।
২০. উদ্ধৃতি নং ৩৬২, পেপারস অন মিসেলেনিয়স সাবজেক্টস, ক্যানিং পেপারস।
২১. মেজর উইলিয়াম হডসন, এক ব্রিটিশ সেনা, ভারতীয় বাহিনীতে যােগ দেন ১৮৪৫ সালে, এবং পরে পঞ্জাবের একটি প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৮৫৭’র বিদ্রোহের সময়ে তিনি গােয়েন্দা বিভাগের প্রধান হয়ে ওঠেন এবং একটি ঘােড়সওয়ার বাহিনীর প্রধান হন, যা পরে ‘হডসনস হর্স’ নামে পরিচিত হয়। দিল্লি এবং লখনউ পুনরুদ্ধারে তিনি অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুঘল সম্রাটকে গ্রেফতার করেন, নিজের হাতে তরুণ মুঘলবংশীয়দের হত্যা করেন। কয়েক মাস পরে দিল্লির একটি প্রাসাদ অধিকার করতে গিয়ে নিজে মারা যান (১৮২১১৮৫৮)।
২২. এস এন সেন, এইটিন ফিফটি সেভেন, দিল্লি, ১৯৫৭, পৃ ১১৬
২৩. পিটার হার্ডি, দ্য মুসলিমস ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭২, পৃ ৭১-৭২
৪৪
২৪. তদেব, পৃ ৭৩
২৫. তদেব, পৃ ৭৮
২৬. সদর আমিন: সেই সময়ে ব্রিটিশ প্রশাসনে যে উচ্চতম পদগুলি ভারতীয়রা পেতে পারত, তা হল প্রশাসকদের মধ্যে ডেপুটি কালেক্টর এবং আইনি ব্যবস্থায় সদর আমিন।
২৭. স্যর সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সালের অক্টোবরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশ ছিল দিল্লির মুঘল সভার সঙ্গে যুক্ত সম্মানিত, তবে খুব প্রভাবশালী নয়। তাঁর মাতামহ লর্ড ওয়েলেসলির সময়ে ইরানের দূতাবাসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে কাজ করেন। স্যর সৈয়দ ১৮৩৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জুডিশিয়াল সার্ভিসে যােগ দেন, ১৮৫৭ সালের মধ্যে তিনি সদর আমিন, বা ‘সাব জজ’-এর পদে উন্নীত হন।
১৮৫৭ সাল তাঁর জীবন ও চিন্তার মােড় ফিরিয়ে দেয়। তিনি নিজে ব্রিটিশদের অধীনতায় বিজনৌর জেলাকে সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করেন। তখন তাঁর সব কাজের লক্ষ্য ছিল মানুষকে বােঝানাে যে পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ইসলাম-বিরােধী নয়।
২৮. পিটার হার্ডি, দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ৭৯
২৯. হাদিথ হল নবী মহম্মদের বাণী ও কাজ সম্পর্কিত ঐতিহ্য। ইসলামি বিচারব্যবস্থায় হাদিথ সমগ্রকে সুন্না, বা ইসলামি জীবনধারা নির্ধারণ করার উপায় বলে গণ্য করে।
৩০. নকশবন্দি (নকশবন্দিয়া) হল ইসলামের প্রধান চারটি সুফি ধারার (তারিকা) একটি। ১৩৮০ সালে এই ‘সংযত’ ধারা তৈরি হয়, যা নীরব ঈশ্বরচিন্তায় (‘ধিকর’) এবং গুরু-শিষ্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে (‘সুহবাত’) বিশ্বাস করে। নকশবন্দি শব্দটি ফার্সি, যা এসেছে এই ধারার প্রতিষ্ঠাতা বাহা-উদ-দিন নকশাবন্দ বুখারি-র নাম থেকে।
৩১. শেখ আহমেদ সরহিন্দি: বিদ্বজ্জন, ফারুকি চিস্তিয়া ধারার অনুগামী, হিজরি ৯৭১ সালে পঞ্জাবের সরহিন্দ-এ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ আহমেদ সরহিন্দি (১৫৬৪-১৬২৪) ইসলামের প্রথম যুগের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব খলিফা উমরের বংশধর বলে নিজেকে দাবি করেন। শেখ আহমদ সরহিন্দি ছিলেন হাফিজ, বড় মাপের পণ্ডিত, যিনি শিয়ালকোটের মৌলা কামাল কাশ্মীরির কাছে তর্কশাস্ত্র, দর্শন এবং ধর্মশাস্ত্র পড়েন, এবং শেখ ইয়াকুব সমিফির কাছ থেকে হাদিথের পাঠ নেন। আকবরের সুল-ই-কুলের প্রতিবাদ করার পর শেখ আহমদ সরহিন্দিকে বলা হত মুজাদ্দিদ আলফ-ই-থানি, অর্থাৎ (ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) দ্বিতীয় সহস্রাব্দের পুনরাবিষ্কর্তা।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-১৭৬৩) এক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি নজিব-উদ-দৌল্লা এবং আহমেদ শাহকে এক হয়ে মারাঠাদের পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে পরাস্ত করতে আহ্বান। জানিয়ে চিঠি লেখেন। মুসলিমদের ভাগ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁর কৌশল ছিল ইবন খালদুনএর অনুগামী: ‘ইসলামের সূত্রপাতের সময়কার পবিত্রতায় ফিরে না গেলে পুনর্জাগরণ সম্ভব নয়। তাঁর ক্ষেত্রে তিনি শরিয়া’র আইনে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তবে তিনি ‘ইজতিহাদ’এর ধারণায় জোর দিয়ে বলেন, উদ্দীপনা বজায় রাখতে ব্যক্তির যুক্তিবাদিতার প্রয়ােজন রয়েছে। তিনি প্রায়ই গোঁড়া বিচারকদের সমালােচনা করেছেন। তিনি কোরানকে ফার্সিতে অনুবাদ করেন তাকে আরও জনপ্রিয় করে তােলার জন্য, দিল্লিতে তাঁর মাদ্রাসা হাদিথের পঠন-পাঠনের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাঁর উত্তরসূরিরা হলেন শাহ আব্দুল আজিজ (১৮০৩ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফতােয়ার রচয়িতা) শাহ আব্দুল কাদির, শাহ রফিউদ্দিন এবং তার পর
৪৫
সৈয়দ আহমদ বরেলভি, যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘােষণা করেছিলেন। দুদু মিয়া এবং তিতুমির এদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
সৈয়দ আহমেদ বরেলভি ভারতীয় ইসলামের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ-র পুত্র আব্দুল আজিজের শিষ্য, এবং অষ্টাদশ শতকের গােড়ার দিকের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের জনক। তিনি ভারতীয় ইসলামি ধারা থেকেই উদ্ভূত, কিন্তু আব্দুল আজিজ যেখানে ভারতকে ‘রণভূমি’ (দার-উল-হারব) ঘােষণা করেছিলেন, এবং ইসলামকে হিন্দু-রীতিশূন্য করে পবিত্র করতে চেয়েছিলেন, তিনি ধর্মযুদ্ধ (জিহাদ) ঘােষণা করেননি। জিহাদ ছিল বরেলভির অবদান। এই কারণে তাঁর অনুগামীদের ওয়াহাবি বলা হয়। কিছু লেখক লিখেছেন, গােড়ার দিকে জিহাদ কেবল শিখদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল, কারণ ব্রিটিশরা মুসলিমদের অবাধে ধর্মাচরণ করতে দিলেও শিখরা দিত না। অন্যরা মনে করেন, বরেলভি গােড়ায় জিহাদের আহ্বান শিখদের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন— যেহেতু ইংরেজ ও শিখদের মধ্যে শিখরা তুলনায় দুর্বল ছিল, তাই তাদের হারানাে সহজ ছিল। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিই ঠিক, কারণ সৈয়দ আহমেদ দরবারকে পরাজিত করতে পারেননি, যে হেতু তাঁর বহু সময় এবং সম্পদ ব্যয়িত হয়েছে পাঠানদের আনুগত্য ধরে রাখতে। ব্রিটিশরা তাদের অধীন রাজ্যে টাকা এবং মানুষ যাতায়াতে সাহায্য করেছে, এবং পটনায় ওয়াহাবি কর্মকেন্দ্র খুলতে দিয়েছে।
তবে ১৮৪৯ সালে জিহাদিরা পঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিমের রাজ্যগুলি দখল করার পরেও জিহাদ চলতে থাকে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে ওয়াহাবিদের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল। দেওবন্দে তারা দার-উল-উলুম তৈরি করে, যা এই উপমহাদেশে উলেমা প্রশিক্ষণের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে।
৩২. বরেলির সৈয়দ আহমেদ (মৃত্যু ১৮৩১) পুনর্জাগরণ এবং সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলামকে ছড়িয়ে দিতে চান। তিনি ইসলাম থেকে হিন্দু রীতি বাদ দিতে চান, সন্তদের ক্ষমতার ধারণা বাতিল করতে চান এবং এক আদর্শ মুসলিম সমাজ গড়তে চান যেখানে মুসলিমরা পবিত্র আইন অনুসারে জীবনযাপন করবে। তাঁর আন্দোলন জিহাদে পরিণত হয় এবং তিনি নিজে ১৮৩১ সালে নিহত হন। তাঁর অনুগামীরা উনিশ শতকের শেষ অবধি ভারতের নানা অংশে আন্দোলন করেন।
৩৩. দ্র সূত্র ২৯
৩৪. নিকি আর কেডি, অ্যান ইসলামিক রেসপন্স টু ইমপিরিয়ালিজম: পলিটিক্যাল অ্যান্ড রিলিজিয়স রাইটিংস অব সৈয়দ জামাল আদ-দিন ‘আল আফগানি’, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৬৮, পৃ ৫৫-৫৬
৩৫. তদেব, পৃ ৫৬।
৩৬. মাকালাত-ই-জামালিয়ে, পৃ ৭৫-৭৬, তদেব, পৃ ৫৬
৩৭. তদেব, পৃ ৫৭
৩৮. তদেব, পৃ ৫৭
৩৯. ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে পূর্ব বাংলায় ফরাইজি আন্দোলন (১৮৩০-৫৭) হয়। এর সূত্রপাত করেছিলেন হাজি শরিয়াতুল্লাহ। এই আন্দোলন ছিল ব্রিটিশদের কৃষি নীতি, এবং তার জন্য জমিদারদের ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। শােষিত মুসলিমদের মধ্যেই এর প্রাধান্য
৪৬
ছিল। তাদের বলা হয়েছিল অ-ইসলামি রীতিনীতি ত্যাগ করতে এবং ধর্মীয় ‘ফরাইজ’ বা কর্তব্য অনুসারে কাজ করতে।
৪০, দাদু মিয়া ছিলেন ফরাইজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজি শরিয়াতুল্লাহ-র পুত্র। দাদু মিয়া এই আন্দোলনকে জনপ্রিয় করেন এবং শক্তিশালী করেন। তাঁর প্রভাব বাখরগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর এবং পাবনার মুসলিম কৃষক ও হস্তশিল্পীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি খলিফাদের নিযুক্ত করেন, যাঁরা তাঁকে নিজেদের এলাকার সব বিষয়ে অবহিত করতেন। দাদু মিয়া বিশেষ করে দুর্গাপুজোর জন্য গরিব মুসলিমদের উপর জমিদারদের আরােপিত করের তীব্র বিরােধিতা করেন। তিনি সরকারি জমিতে মুসলিম কৃষকদের বাস করতে বলেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়ে ফরিদপুরের কৃষকদের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগঠিত করার জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ১৮৬০ সালে মারা যান।
মির নাসির আলি, যিনি তিতু মির বলে পরিচিত, ছিলেন আর এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব যিনি বঙ্গদেশের কৃষকদের দুরবস্থায় বিচলিত হয়েছিলেন। হজ থেকে ফিরে এসে তিতুমির নিজেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেন। কলকাতার কাছে নারকেলবেড়িয়া গ্রামকে তাঁর কাজের কেন্দ্র করেন। হিন্দু জমিদার কৃষ্ণ দেব রাজের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহু মুসলিম কৃষক তিতু মিরের অধীনে সংগঠিত হন। তিতু মির কৃষ্ণ দেবকে হারিয়ে অস্থায়ী সরকারও স্থাপন করেন। ব্রিটিশরা ১০০ ইংরেজ সৈন্য এবং ৩০০ দিশি সিপাহিদের একটি ছােট সেনাদল পাঠায়। ১৮৩১ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে তিতুমির মারা যান।
তিতু মিরের মৃত্যু তাঁর অনুগামীদের হতাশ করেনি, বরং তাঁর উদাহরণ বহু বছর তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
৪১. পিটার হার্ডি, দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, লন্ডন, ১৯৭২, পৃ ৫৮।
৪২. দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ৫৯।
৪৩. শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (১৭০৩-১৭৬২) ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারক, যিনি দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম শাসন এবং বৌদ্ধিক পঠনপাঠনের পুনরুদ্ধার করতে কাজ করেছিলেন। তিনি উলেমাদের ক্ষমতা ও প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ইসলামের ভিতরের বিভাজন তিনি অপছন্দ করতেন এবং ধর্মকে পবিত্র করে সব ভারতীয় মুসলিমকে সত্য বা। ‘হক’-এর অধীনে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন।
৪৪. উনবিংশ শতকে তিনি বারেলভি ধারা স্থাপন করেন। এই সংস্কারক দলটি বহু পুরনাে রীতিনীতি পুনরায় চালু করে এবং দেওবন্দ ধারা ও তার দর্শনের বিরােধিতা করে।
৪৫. দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ১।
৪৬. স্ট্রাগল ফর এম্পায়ার, ভারতীয় বিদ্যা ভবন, পৃ ৫৪, ৮২, ইন্ডিয়া অ্যান্টিকোয়ারি, ২২, পৃ ২১৯ এপিগ্রাফিকা ইন্ডিকা ৪, ১১৯
৪৭. প্রথম তরাইনের যুদ্ধ, যা হয়েছিল মহম্মদ ঘােরি এবং আজমেঢ় ও দিল্লির শাসক পৃথ্বীরাজ চৌহানের মধ্যে, ১১৯০-৯১ সালে। মহম্মদ ঘােরি পরাজিত এবং আহত হয়ে ঘজনিতে ফিরে যান।
দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধ: মহম্মদ ঘােরি হতাশ হননি। পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে আর একটি শক্তিশালী সৈন্যদল গঠন করে, যথাযথ প্রস্তুতি নিয়ে ১১৯২ সালে ভারত আক্রমণ করেন।
৪৭
থানেশ্বরের কাছে তরাইনেই আবার যুদ্ধ হয়। এ বার মহম্মদ ঘােরি রাজপুতদের সম্পূর্ণ পরাজিত করেন। পৃথ্বীরাজ চৌহানকে বন্দি করে হত্যা করা হয়।
৪৮. জাজিয়া বা জিজিয়া ছিল মুসলিম রাষ্ট্রের একটি কর, যা অ-মুসলিমরা দিত নিজেদের সুরক্ষার জন্য। তাদের মুসলিমদের মতাে জাকত বা অন্য কর দিতে হত না। এটা শেষ বার মুঘল বাদশা ঔরঙ্গজেবের সময়ে জারি হয়, যিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে মুসলিমরা সংখ্যায় কম হলেও মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।
৪৯. যজমানি হল ভারতের গ্রামসমাজে বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে প্রচলিত একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার ফলে একটি পরিবার অপর একটি পরিবারের জন্য সব ধরনের পরিষেবা দেবে, যেমন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজ, ক্ষৌরকর্ম, কৃষিশ্রম দেওয়া, ইত্যাদি। এই সম্পর্কগুলি বহু প্রজন্ম ধরে চলত।
৫০. হান্টার, স্যর উইলিয়াম উইলসন (১৮৪০-১৯০০) ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসএর সদস্য, সংখ্যাতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিক। তিনি ১৮৬২ সালে সিভিল সার্ভিসে যােগ দেন এবং বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বেছে নেন। ১৮৬২ সালের নভেম্বরে তিনি বাংলায় আসেন এবং বীরভূমের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর নিযুক্ত হন। জুলাই ১৮৬৯ সালে ভারত সরকারের অধীনে তিনি বেঙ্গল গেজেটিয়ার-এর সংকলক (কমপাইলার’) নিযুক্ত হন। ফেব্রুয়ারি ১৮৭১ থেকে তিনি ভারত সরকারের ‘হােম ডিপার্টমেন্ট’-এ আন্ডারসেক্রেটারি হিসেবে কাজ করেন। ইতিমধ্যে তাঁর জন্য ভারত সরকার ‘ডিরেক্টর জেনারেল অব স্ট্যাটিসটিক্স’ পদটি তৈরি করে, এবং সেপ্টেম্বর ১৮৭১ থেকে তিনি সেই পদে যােগ দেন। ১৮৭৫ থেকে ১৮৮১- তিনি বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় ইংল্যান্ডে কাটান ‘স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল’ এবং ‘ইমপিরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ সংকলনের জন্য।
৫১. কবি বচন সুধা, বেনারস, ৮ অগস্ট ১৮৭৩, ইউ পি এন এন আর, ১৮৭৩
৫২. স্যর ব্যামফিল্ড ফুলার পূর্ব বাংলা এবং আসামের প্রথম লেফটন্যান্ট জেনারেল, ১৯ অক্টোবর ১৯০৫ থেকে এই পদে ছিলেন, ২০ অগস্ট ১৯০৬ পদত্যাগ করেন।
৫৩. সিরাজগঞ্জের আন্দোলন: লেফটন্যান্ট-গভর্নর এবং সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের মতবিরােধ হওয়ায় স্যর ফুলার পদত্যাগ করেন (অগস্ট ১৯০৬)। সংক্ষেপে ঘটনা ছিল, ‘স্কুল ইনস্পেক্টরদের ২ জানুয়ারি, ১৯০৬ রিপাের্টের ভিত্তিতে লেফটন্যান্ট গভর্নর ১০ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে চিঠি লেখেন, যাতে ছাত্র এবং শিক্ষকদের রাজদ্রোহমূলক কাজের শাস্তিস্বরূপ পাবনার সিরাজগঞ্জের বনােয়ারি লাল এবং ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলের নথিভুক্তি বাতিল করতে বলা হয়। কে দোষী, তা সাব্যস্ত করার সব চেষ্টা স্কুল কর্তৃপক্ষের অসহযােগিতায় ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে গভর্নর জেনারেলের প্রস্তাব ছিল, একমাত্র রাস্তা হল গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গলের চিফ সেক্রেটারি আর ডব্লিউ কার্লাইলের সমস্ত ম্যাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টরদের কাছে প্রেরিত নির্দেশ (অক্টোবর ১০, ১৯০৫) অনুসারে, যে সব স্কুল বা কলেজ তাদের ছাত্রদের রাজনৈতিক আন্দোলনে যােগদান এবং বয়কট প্রভৃতি থেকে বিরত করতে পারবে না, তাদের সরকারি অনুদান বাতিল হবে, স্কলারশিপের জন্য প্রতিযােগিতার সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা হবে এবং স্কলারশিপ-প্রাপ্ত ছাত্রদের ভর্তির সুযােগও বাতিল হবে, এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে সেই সব প্রতিষ্ঠানের অনুমােদন বাতিল করতে বলা হবে। ৫৪. হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল মুভমেন্ট, স্যর ভার্নি লভেট, এক নৌ অফিসার।
৪৮
৫৫. তদেব।
৫৬. মৌলানা মহম্মদ আলি (১৮৭৮-১৯৩১)— ‘জওহর’ ছদ্মনামে বেশি পরিচিত ছিলেন খিলাফত আন্দোলনের নেতা। প্রতিভাবান লেখক ও অভিনেতা এই ব্যক্তি ছিলেন মৌলানা শওকত আলির ভাই, এবং প্রধান ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষার সংবাদপত্রে লিখতেন ইংরেজি ও উর্দু ভাষায়। তিনি উর্দুতে ‘হামদর্দ’ সাপ্তাহিক এবং ইংরেজিতে ‘কমরেড’ বার করেন ১৯১১ সালে।
মহম্মদ আলি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসারের জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। তখন তার নাম ছিল মহামেডান অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান কলেজ। তিনি ছিলেন ১৯২০ সালে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার সহ-প্রতিষ্ঠাতা, যা পরে দিল্লিতে সরে যায়।
মহম্মদ আলি ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠার সভায় যােগ দেন, এবং ১৯১৮ সালে তার প্রেসিডেন্ট হন। ১৯২৮ সাল অবধি তিনি মুসলিম লিগে সক্রিয় ছিলেন।
৫৭. ডা. হাকিম ‘আজমল খান (১৮৬৩-১৯২৭) ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিখ্যাত চিকিৎসক এবং শিক্ষাবিদ। তিনি দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এবং অল ইন্ডিয়া খিলাফত কমিটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
৫৮. হিন্দি বা হিন্দুস্তানির ফার্সি সংস্করণ: নামটি দিল্লি প্যালেসের বাইরে ‘উর্দু-ই-মুয়াল্লা’ নামক একটি জায়গার নাম থেকে এসেছে, যেখানে খিলজি শাসনকালে এর বিবর্তন হয়েছে। বিদেশি মুসলিম সেনা, যারা দিল্লিতে থাকত, তাদের কাছে স্থানীয় ভাষা বলা জরুরি ছিল। আলাউদ্দিন খিলজি তাই একটি বই প্রস্তুত করান, যেখানে সাধারণ হিন্দি শব্দগুলির ফার্সি এবং আরবি প্রতিশব্দ লেখা থাকত। বইটির নাম ছিল খালিকবারি। এর অগণিত কপি বিদেশি মুসলিম সেনাদের মধ্যে বিতরণ করা হত। কিন্তু এই বিদেশিদের পক্ষে স্থানীয় ভাষা বলা প্রত্যাশিত ছিল না, তারা যা বলত তা উর্দু বলে পরিচিত ছিল, যা ফার্সি, আরবি এবং হিন্দির একটি সংমিশ্রণ। প্রায় ৫০০ বছর উর্দ কেবল কথিত ভাষা ছিল, তার পর তা লিখিত ভাষায় পরিণত হয়। আরবি অক্ষরে লেখার ফলে উর্দু হিন্দির থেকে আলাদা হয়ে গেল। হিন্দি দেবনাগরী অক্ষরে লেখা হত।
মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের সময়েও সরকারি দফতরে বা আদালতে উর্দুর প্রবেশ ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে উর্দ ফার্সির জায়গা নিতে শুরু করে, এবং শেষ অবধি বাহাদুর শাহ। জাফরের সময়ে প্রাধান্য পায়, বিশেষত তিনি নিজে তাঁর উর্দু কবিতা সভার কবিদের কাছে পড়ে শােনাতেন বলে। ব্রিটিশরা যখন ক্ষমতা দখল করে তখন গােটা উত্তর ভারতে উর্দুই ছিল রাজসভার ভাষা।
৫৯, নবাব ভিকর-উল-মুলক উত্তরপ্রদেশের মােরাদাবাদে ১৮৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্যর সৈয়দ এবং মােহসিন-উল-মুলক মুসলিমদের শিক্ষার আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এবং ভিকর-উল-মুলক তাতে একটি রাজনৈতিক মাত্রা যােগ করেন। তিনি স্যর সৈয়দ এবং মােহসিন-উল-মুলক-এর রাজনৈতিক ধারণার সঙ্গে একমত ছিলেন। তিনি একটি পৃথক রাজনৈতিক মঞ্চ এবং একটি পৃথক রাজনৈতিক দলের প্রয়ােজন অনুভব করেন এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে যান।
৪৯
১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার যুগ্ম সম্পাদক হন। বঙ্গভঙ্গ রদ হলে ব্রিটিশদের সম্পর্কে মােহভঙ্গ হয় তাঁর, এবং তাঁর বিখ্যাত রচনা লেখেন, ‘মুসলমানোঁকা আয়েন্দা লৈহা-এ-আমাল’ (মুসলিমদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি) এবং আলিগড় ইনস্টিটিউটের জার্নালে প্রকাশ করেন তাঁর ব্রিটিশ-বিরােধিতার প্রমাণ হিসেবে। তিনি জানুয়ারি ২৭, ১৯১৭ মারা যান।
৬০. স্যার গিলবার্ট জন মারে কিনিনমন্ড ইলিয়ট, চতুর্থ আর্ল অব মিন্টো: কানাডার গভর্নর জেনারেল হিসেবে কাজ করার পর তিনি ভারতের ভাইসরয় হন ১৯০৫ সালে। তিনি কানাডায় তাঁর কাজের ধারা অনুসারে ভারতেও অনেক সংস্কার করেন। তিনি অবসর নিয়ে ১৯১০ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে যান।
৬১. গভর্নরের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একটি পদবি।
৬২. মর্লেকে মিন্টোর ৮ অগস্ট ১৯০৬ সালে লেখা চিঠিপত্রের মধ্যে যুক্ত, মর্লে পেপারস, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, ই ইউ আর ডি ৫৭৩, নং ৯।
৬৩, পৃ ১৫৪, দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পিটার হার্ডি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, লন্ডন, ১৯৭২
৬৪. পৃ ১৫৫, দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পিটার হার্ডি, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, লন্ডন, ১৯৭২।
৬৫. সিমলা ডেপুটেশনের সম্পূর্ণ বয়ান এবং মিন্টোর উত্তর পাওয়া যাবে: রাম গােপাল, ইন্ডিয়ান মুসলিমস, আ পলিটিকাল হিস্ট্রি, লন্ডন ১৯৫৯, পৃ ৩২৯-৩৩৮।
৬৬. দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ১৫৫
৬৭. তদেব ।
৬৮. ‘মুসলিমস অন দ্য হােল এগেন্সট দ্য কংগ্রেস’, এ ও হিউমকে বদরুদ্দিন তায়েবজি।
বদরুদ্দিন তায়েবজি ডিসেম্বর ১৮৮৭ সালে ভারতীয়, জাতীয় কংগ্রেসের মাদ্রাজ . অভিবেশনের সভাপতিত্ব করেন। সৈয়দ আহমেদ খানের নেতৃত্বে বেশ কিছু প্রভাবশালী মুসলিমদের এটা ভাল লাগেনি। একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়— জৈয়াজি এবং সৈয়দ আহমেদের মধ্যে, এবং অন্যদের সঙ্গেও, বেশ কিছু চিঠি চালাচালি হয়। তায়েবজি গােড়ায় নিজের সমর্থনে বলেন, তিনি সভাপতির ভাষণে ভারতকে একটি রাষ্ট্র বলে মেনে নেননি। তিনি চিঠিতে সৈয়দ আহমেদকে এও লেখেন যে মুসলিমরা না চাইলে কংগ্রেস কোনও একটি বিষয় আলােচনা করবে না। কিন্তু তাতেও সৈয়দ আহমেদ এবং অন্যরা সন্তুষ্ট হননি। তাঁরা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছিলেন, তাই তায়েবজি পিছু হঠলেন। কংগ্রেসের সচিব এ ও হিউমকে লেখা এই চিঠিতে তায়েবজি বলেন যে কংগ্রেসের ইলাহাবাদ অধিবেশনের পর পাঁচ বছর কংগ্রেস মুলতুবি রাখা উচিত, কারণ তা হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে অত্যন্ত শত্রুতা তৈরি করেছে। যদি পাঁচ বছর পরেও রেষারেষি থাকে, তা হলে কংগ্রেস বন্ধ করে দেওয়া উচিত। হিউম অবশ্যই এই প্রস্তাব মানেননি, তবে তায়েবজি এর পর আর কোনও অধিবেশনে যােগ দেননি।
প্রিয় হিউম,
আমি ২০ তারিখে লেখা আপনার চিঠি, জব্বলপুরের পত্রের সঙ্গে, পেয়েছি। আমি কিছু বিলম্বে উত্তর লিখছি, কারণ আমি মনে করি আমি আপনাকে যা বলতে চাই তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই তা নিয়ে চিন্তা করতে কিছু সময় নেওয়াই ঠিক বলে মনে করেছি। অবশ্যই
৫০
আমি কংগ্রেসের বন্ধু হিসেবে লিখছি, যে বন্ধু কংগ্রেসের সাফল্যের বেশি কিছুই চায় না। আপনি নিশ্চয়ই মুসলমানদের গতিপ্রকৃতি লক্ষ করছেন, কিন্তু তাদের মনােভাব বিষয়ে আমি যত ভাল জানি আপনি তা জানেন না। আমি বিষয়টি নিয়ে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে আলােচনা করেছি, যাঁরা সকলেই কংগ্রেসের পক্ষে। আমি যা লিখছি তা কেবল আমার মত বা বােম্বাইয়ের প্রধান মুসলিমদের মত নয়, মেটা, তেলাঙ্গদের মতাে ব্যক্তিদেরও মত। আমরা সবাই মনে করি, মুসলিমদের প্রতি ক্রমবর্ধমান বিদ্বেষের মনােভাব, যা প্রতিদিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে, তার কথা মাথায় রেখে প্রতি বছর কংগ্রেসের অধিবেশন করা ঠিক কি না ভেবে দেখা দরকার। আমার নিজের মত হল, প্রতি বছর যে সংঘর্ষ এবং তিক্ততা সৃষ্টি হচ্ছে তা অধিবেশনের সুফলকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। যদি ভারতের সব সম্প্রদায়ের মানুষ একমত হত, তা হলে কংগ্রেস নিঃসন্দেহে একটা দারুণ ব্যাপার হত এবং ভারতের মানুষের জন্য অনেক ভাল কাজ করতে পারত। যা আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য, কংগ্রেস বিভিন্ন সম্প্রদায়ের এবং রাজ্যের মানুষকে এক করে সেই একতা বাড়াতে পারত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মুসলিমরা যে কেবল হিন্দুদের থেকে অভূতপূর্ব ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে তাই নয়, মুসলিমরা নিজেরাও দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে, এবং সেই ব্যবধান বেড়েই চলেছে। নিজাম এবং রাজ্যের প্রধান ব্যক্তি যেমন সালার জঙ্গ, মুনির-উল-মুক, ফতে নওয়াজ জঙ্গ এবং সর্বোপরি সৈয়দ হুসেন বিলগ্রামি বিরােধীদের পক্ষে যােগ দিয়েছেন, যার নেতৃত্বে রয়েছেন সৈয়দ আহমেদ, আমির আলি, এবং আব্দুল লতিফের মতাে সুপরিচিত ব্যক্তিরা। আমি তর্কের খাতিরে ধরে নিচ্ছি এরা সবাই ভ্রান্ত, এবং আমরা ঠিক। তা সত্ত্বেও আমাদের বুঝতে হবে যে আমরা চাই আর না চাই, অধিকাংশ মুসলিম যে আন্দোলনের বিরুদ্ধে, সেই সত্যের উপর দাঁড়িয়ে আমাদের এগােতে হবে। এই প্রতিরােধের সামনে দাঁড়িয়ে এটা বলা বৃথা যে, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মুসলিমরা কংগ্রেসের সঙ্গে রয়েছে। যদি সমগ্র মুসলিম সমাজ কংগ্রেসের বিরােধী হয় তারা ঠিক কি ভুল তাতে কিছু যায় আসে না— তা হলে বুঝতে হবে যে এই আন্দোলন সাধারণের, বা জাতীয় কংগ্রেসের নয়। তা যদি হয়, তা হলে আন্দোলনের ভাল কিছু করার ক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে যাবে। কিছু মানুষের ক্ষমতা এবং মনের জোরে তা নিশ্চয়ই চলতে পারে, কিন্তু মুসলিমরা সামগ্রিক ভাবে তাতে যােগ দিলে যা হত, তা হবে না। আমি হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান তিক্ততা লক্ষ করছি, এবং মুসলিমদের মধ্যে ভিন্নমতপ্রসূত সংঘর্ষ এবং তিক্ততার অত্যন্ত খারাপ ফল হতে দেখছি। মুসলিম সমাজের বিচিত্র অবস্থানের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি যে আমরা সব রাজনৈতিক বিষয়ে এক সঙ্গে কাজ করি, কিন্তু এই সংঘর্ষ তার পথে বাধা হচ্ছে, এবং আমি দেখছি যে বােম্বাইতেও আরও আগের মতাে কাজ করতে পারছি না। এই পরিস্থিতিতে খুব ভাল করে চিন্তা করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে প্রতি বছর কংগ্রেস অধিবেশন বন্ধ করার সময় এসেছে। আমি ইলাহাবাদ কংগ্রেসকে যতখানি সফল করা যায় তার চেষ্টা করব, কিন্তু তার পর কংগ্রেসকে মুলতুবি রাখতে চাই, অন্তত পাঁচ বছরের জন্য। এটা আমাদের গােটা অবস্থানটা ভাল করে ভেবে দেখার এবং প্রয়ােজন হলে সম্মানের সঙ্গে সরে যাওয়ার সুযােগ দেবে, একই সঙ্গে যথেষ্ট সময় দেবে আমাদের পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়িত করার, যা ইতিমধ্যেই খুব বৃহদাকার হয়ে পড়েছে। যদি পাঁচ বছর পরে আমাদের সম্ভাবনার উন্নতি হয়, আমরা কংগ্রেসকে নতুন করে গড়তে পারি। যদি তা না হয়, তা হলে আমরা তাকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে পারি, এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যে আমরা ভারতের প্রগতির জন্য
৫১
এবং দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়কে এক করার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি।
(সূত্র: নুরানি, এ জি বদরুদ্দিন তায়েবজি, নিউ দিল্লি, পাবলিকেশনস ডিভিশন, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, ১৯৬৯, পৃ ১৮৬-১৮৮)
৬৯. দ্র মহম্মদ আলি জোহরের উপর ৫৯ নং নােট।
৭০. ভি ভি নাগরকর, জেনেসিস অব পাকিস্তান, অ্যালায়েড পাবলিশার্স, ১৯৭৫, পৃ
৭১. সাভেল জিমা, লিভিং ইন্ডিয়া, বুকস ফর লাইব্রেরিজ প্রেস, ফ্রিপাের্ট, নিউ ইয়র্ক, পৃ ১৪২-১৪৩
৭২. দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ১৫৬
৭৩. তদেব, পৃ ১৫৬-১৫৭
৭৪. মার্টিন গিলবার্ট, সার্ভেন্ট অব ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯৬৬, পৃ ৫১
৭৫. হারকোর্ট বাটলার পেপার্স, ই ইউ আর এফ ১১৬-৬৫
৭৬. তদেব ।
৭৭. দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ১৫৯
৭৮. মার্টিন গিলবার্ট, সার্ভেন্ট অব ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯৬৬, পৃ ১৮৯
৭৯. তদেব ।
৮০. মিন্টোকে হারকোর্ট বাটলার, ২২ জুলাই, ১৯০৯, ২৫ জুলাই ১৯০৯ সালে লেখার সঙ্গে সংযুক্ত মর্লেকে মিন্টো, মর্লে পেপার্স, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, ই ইউ আর ডি ৫৭৩-২১
৮১. তদেব।
৮২. দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ১৬৩
৮৩. তদেব।
৮৪. পাথওয়ে টু পাকিস্তান, লাহাের, ১৯৬১, পৃ ১৩৭-৮ ৮৫. দ্য মুসলিমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ১৬৬।
৫২
দ্বিতীয় অধ্যায় –
জেনাভাই থেকে জিন্না: একটি সফর
কাথিয়াবাড়,সিন্ধ
আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি ভারতে ইসলাম কী ভাবে বেড়ে উঠেছিল, যদিও মাত্র একটি অধ্যায়ের মধ্যে সেই বিশাল কাহিনিকে সংক্ষিপ্ত প্রায় অসম্ভব। বহু শতাব্দী জুড়ে এই সফর, মানব অভিজ্ঞতার সমস্ত পরিধি জুড়ে তার ব্যাপ্তি। সময়ের নিরন্তর ঘর্ষণে, ক্রমাগত পরিবর্তিত পরিস্থিতির মােকাবিলায় এবং বহু দূরের দ্বীপ ব্রিটেন থেকে আগত বণিকদের ঔদ্ধত্যে, ভারতের বড় বড় অংশের শাসকবর্গ আস্তে আস্তে ক্ষমতাধিপতি বা উপহারদাতা থেকে ক্রমশ ফিরিঙ্গিদের দরবারে আবেদন-নিবেদনের পদে চলে এল। প্রথম যুগের মুসলিম আক্রমণকারীরা যেমন সাহসী, প্রত্যয়ী মনােভাব নিয়ে এসেছিল, তেমন মনােভাব নিয়েই এসেছিল ব্রিটিশরা। মুসলিমদের প্রথম যুগের মনােভাব ছিল, হয় বিজয়ী হও না হলে মৃত্যুবরণ করাে, প্রায় সেই মনােভাব নিয়েই এল ব্রিটিশরাও। ব্রিটেন ছিল বহু দূরের এক দেশ, ভারতে থেকে যাওয়ার চাইতে তাদের ফিরে যাওয়ার পথ কিছু কম বিপজ্জনক ছিল না, তাই থেকে গিয়ে জিতে যাওয়াই তারা ভাল মনে করছিল।
মহম্মদ আলি জিন্না যখন ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এলেন, মুসলিম লিগ বলে কিছু সে সময় না থাকলেও, ছিল এক নবজাগ্রত মুসলিম চেতনা, সেই সঙ্গে শােনা যাচ্ছিল ভারতীয়দের হাতে আরও ক্ষমতা দেওয়ার দাবি। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের বলা হল ‘নেটিভ’দের হাতে আরও রাজনৈতিক ক্ষমতা ছেড়ে দিতে, যাতে তারা নিজেদের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু এই সব দাবিই করা হচ্ছিল অত্যন্ত কঠোর নিয়ন্ত্রিত সীমার মধ্যে, সাম্রাজ্যবাদীর অধিকার কিছুমাত্র লাঘব না করে। বস্তুত চেষ্টা হচ্ছিল ক্ষমতা বণ্টনের একটা ধারণা তৈরি করে সেই আধিপত্যের অধিকার আরও বাড়াতে, যদিও বস্তুত কোনও বণ্টন হচ্ছিল না।
সেটা ছিল বিশ শতকের শুরু। গ্রেট ব্রিটেন নিজের সাম্রাজ্যবাদী গরিমার শীর্ষে, রানি ভিক্টোরিয়া প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছেন, যে লেডি এবং সাহেবরা তাঁর হয়ে ভারত
৫৩
শাসন করছেন তাঁরা সাম্রাজ্যবাদের আকাশে মেঘের টুকরােও দেখতে পাচ্ছেন না, তাঁদের ভবিষ্যৎ-দৃষ্টির সামনে একটিও সমস্যার বিন্দু দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কী করে এক দরিদ্র খােজা, ভারতের ‘আশরফ’ শ্রেণি থেকে বহু দূরে, পারিবারিক সম্পদ, অবস্থান বা নাম কিছুই যাঁর নেই, কী করে তিনি বম্বের শহুরে জীবনে প্রবেশের ছাড়পত্র পেলেন, সেখানকার সামাজিক ও রাজনৈতিক আকাশে নিজের নাম এত গভীর ভাবে খােদাই করতে পারলেন? ইনিই মহম্মদ আলি জিন্না। যাওয়া যাক কাথিয়াবাড়। তাঁর জন্মের স্থান।
ভারতের গুজরাত প্রদেশে কাথিয়াবাড়ের অবস্থান, কচ্ছের বৃহৎ রান-এর তলায়। পশ্চিমে আরব সাগর তাকে ঘিরে রয়েছে, প্রসারিত হয়েছে স্থলের দিকে, উর্বর এবং সুজলা ‘একশাে রাজত্বের ভূমি, ভাল নাম সৌরাষ্ট্র। কাথিয়াবাড় অর্থাৎ কাথি’দের ভূমি, যেখানে পাওয়া যায় উত্তম কাথিয়াবাড়ি ঘােড়া, সুন্দরী কাথি নারী, বিচক্ষণ বণিক এবং বহু ধনী বণিক পরিবার, হিন্দু এবং মুসলিম।
এই অঞ্চলের মানচিত্রের উপর আরও যে নানা স্থানের নাম, পােরবন্দর, জামনগর, গােন্দাল, গনােদ, পানেলি, তার কোনওটাই দেখার মতাে সময় এখন নেই। এগুলাে সবই ২০০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে অবস্থিত, আর আমরা রয়েছি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। অযােধ্যা বা গাঙ্গেয় উপত্যকার মারাত্মক বিপর্যয় ভারতের এই অঞ্চলকে বিশেষ সংকটাপন্ন করতে পারেনি। ইসলাম অবশ্য এখানে এসেছে অনেক আগে, ১০২৪ সালে সােমনাথ মন্দির ধ্বংসের আগে থেকেই। তত দিনে গুজরাতে বেশ কিছু মুসলিম শাসকও এসে গিয়েছেন। মহম্মদ শাহ বেগরার নিপীড়নের কথা এই দেশ আর তার মানুষের মনে রয়ে গিয়েছে, যেমন রয়েছে বেগরার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে পার্শ্ববর্তী রাজস্থানের মেলানি থেকে (আজকের বাঢ়মের জেলা) আসা রাঠোর গােষ্ঠীর নেতাদের কথা। কাথিয়াবাড়ে কৃষ্ণ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন, হিন্দুদের চারটি বড় তীর্থের একটি হল এই দেশ। হজ করতে যাওয়ার জন্য পাটন বন্দর দিয়ে যেতে হত মুসলিমদের, সাগরপাড়ি দেওয়ার জন্য। এই অঞ্চলেই রয়েছে পােরবন্দর, যেখান থেকে মােহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর পরিবার এসেছিল। মােহনদাস ছিলেন কর্মচন্দের চতুর্থ সন্তান, ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর তাঁর জন্ম হয় রাজকোটে, যেখানে তাঁর পিতা তখন দেওয়ানের পদ অধিকার করে ছিলেন। রাজকোটের ৫০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে পানেলি গ্রাম, যা তখন একটি ছােট কাথিয়াবাড়ি জনপদ, গােন্ডালের অন্তর্গত। পানেলিতে খােজা মুসলিমদের একটি পরিবার থাকত, যারা বােহরাদের মতােই ছিল, এবং এখনও রয়েছে, শান্তিপ্রিয় বণিক। আগ্রাসনে, যুদ্ধবিগ্রহে তাদের কোনও উৎসাহ ছিল না। পুঞ্জাভাই, তাঁর তিন পুত্র বলজিভাই, নাথুভাই, জেনাভাই, এবং এক কন্যা মানবাই, বরাবরই ছিলেন পানেলির বাসিন্দা। অন্যান্যদের মতােই, তিনিও তাঁতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান জেনাভাই পানেলি ছাড়ার ঝুঁকি নিয়ে গােন্ডালে এলেন। এই তাঁর প্রথম স্বাধীন পদক্ষেপ। দ্বিতীয় পদক্ষেপটি অবশ্য স্থান-কাল-পরিস্থিতির নিরিখে, এবং শেষ অবধি পরিণামেও অনেক বড়। ১৮৭৫ সাল
৫৪
নাগাদ তিনি করাচির উদ্দেশ্যে সাগরপাড়ি দিলেন। করাচিতে ব্যবসা শুরু করলেন, তাতে সমৃদ্ধিও পেলেন। বম্বে এবং ভারতের অন্যান্য বন্দরের মতাে, করাচিতেও ব্রিটিশ সংস্থাগুলি বাণিজ্যিক দফতর তৈরি করেছিল। এখানে সৌভাগ্যক্রমে জেনাভাইয়ের সঙ্গে যােগাযােগ হল ফ্রেডরিক লে-ক্রটের। এর ফলেই ভাগ্য ঘুরে গেল জেনাভাইয়ের, তাঁর ও তাঁর পরিবারের সামনে নানা ভাবে বিপুল সুযােগের দরজা খুলে গেল।
করাচিতে ২৫ ডিসেম্বর, ১৮৭৬ (যদিও ঠিক তারিখটি নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে) জেনাভাই এবং মিঠিবাইয়ের একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করে। প্রথা অনুসারে জেনাভাই নাম স্থির করেন, মিঠিবাই সম্মতি জানান এবং এক কাজি সমস্ত রীতিনীতি সমাধা করেন। কাথিয়াবাড়ে পুঞ্জাভাইয়ের পরিবারের সকলেরই নামের হিন্দুদের নামের সঙ্গে অত্যন্ত সাদৃশ্য, কিন্তু করাচির পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। সেখানে মুসলিমদের উপস্থিতি ছিল বেশি, পাড়ার অন্যান্য ছেলেদের নাম ছিল একেবারেই ইসলামি রীতির। অন্য ধরনের নাম রাখলে নবজাতক সমস্যায় পড়ত। তাই ‘মহম্মদ আলি জেনাভাই’ নামটিই যথাযথ বলে মনে করা হল, পিতার নাম শেষে রাখার নিয়ম মেনে।
‘আকিকা[৪] অনুষ্ঠানের জন্য মহম্মদ আলির বাবা-মা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাসান পিরের দরগায়, সেই গানােদে, পানেলির চেয়ে যা কয়েক মাইল দূরে। মহম্মদ আলির মাথা কামিয়ে ফেলা হল, কারণ তখন বিশ্বাস করা হত (এখনও হয়) যে হাসান। পিরের অসাধারণ ক্ষমতা তা হলে মহম্মদ আলি, এবং অন্য সব বিশ্বাসীর জন্যে এক। দারুণ ভবিষ্যৎ নিয়ে আসবে। ভক্তিমতী মা মিঠিবাই তাই সেখানেই প্রার্থনা করলেন, আশীর্বাদ চাইলেন।
মহম্মদ আলির প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা ছিল না। তখনকার রীতি অনুসারে, এক জন শিক্ষক করাচির বাড়িতে এসে মাতৃভাষা গুজরাতি ভাষা শিখিয়ে যেতেন। নয় বছর বয়সে মহম্মদ আলিকে একটি প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করা হল, যেখান থেকে এক বছর পরে তাঁকে ‘সিন্দ-মাদ্রাসা-তুল-ইসলাম’-এ[৫] ভর্তি করা হল। সেখানে তিনি সাড়ে তিন বছর সময় কাটান। তারপর করাচির চার্চ মিশন স্কুলে যান। তার কিছু পরে, ফ্রেডরিক লে-ক্রফটের পরামর্শ অনুসারে, মহম্মদ আলিকে পাঠানাে হয় লন্ডনে, প্রধানত জাহাজের ব্যবসার খুঁটিনাটি শিখতে, যে ব্যবসায় তাঁর বাবা তখন নিযুক্ত ছিলেন। ক্রফট মহম্মদের জন্য একটি অ্যাপ্রেনটিসশিপ জোগাড় করার আশ্বাস দেন। এত বড় সুযােগ ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। লন্ডন যাওয়ার আগে সে যুগের নিয়ম অনুসারে ১৬ বছরের মহম্মদ আলির বিয়ে হয় ১১ বছরের এমা বাইয়ের সঙ্গে। সেটা ১৮৯২ সালের কথা।
সে বছরের নভেম্বরের গােড়ায় মহম্মদ আলি লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, কিন্তু তার আগে হঠাৎই তাঁর বাবার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। একটি মামলায় জেনাভাইয়ের বিরুদ্ধে রায় দেয় আদালত। যে টাকা দিতে আদালত নির্দেশ দেয়, তা মজুত না থাকায় পরিবারের সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যায়। ছেলেকে দূরে পাঠিয়ে দেওয়াই জেনাভাই ঠিক মনে করেন। ছেলের বিদায়ের পর তিনি নিজেকে ‘দেউলিয়া ঘােষণা করেন। ১৮৯৩ সালের জানুয়ারিতে তাঁর সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায় করার প্রক্রিয়া শুরু
৫৬
হয়। জেনাভাই আবার স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। এ বার তিনি আসেন বম্বে, যেখানে ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে দুর্গা মহল্লাতে[৬] থাকতে শুরু করেন। জায়গাটা বম্বের কেল্লার ঠিক বাইরে।
ইংল্যান্ডে তরুণ মহম্মদ আলির অভিজ্ঞতার সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা যায়। কেবল জানা যায় যে কাথিয়াবাড়ে জন্মে, করাচিতে বড় হয়ে এই বিদেশে এসে তিনি খুবই একা হয়ে পড়েছিলেন, ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছিলেন, বিদেশিদের মধ্যে অস্বস্তি বােধ করতেন এবং তখনও অবধি ইংরেজিতে খুব সড়গড় ছিলেন না। লে-ক্রফটের বদান্যতায় তিনি লন্ডনে গ্রাহামসের হেড অফিসে ‘বিজনেস অ্যাপ্রেনটিস’ হিসেবে কাজ করছিলেন। যে হেতু আইনের জ্ঞান থাকলে এই ব্যবসায় সুবিধে, তাই মহম্মদ আলি জেনাভাই ক্রমশ আইনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ভর্তি হওয়ার নিয়ম ছিল নমনীয়। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসেন এবং ১৮৯৩-এর জুনে লিঙ্কনস ইন-এ ভর্তি হন। একটি মত অনুযায়ী, তাঁর এই কলেজ বেছে নেওয়ার কারণ, নিউ হলে প্রধান প্রবেশপথের একটির উপরে তিনি একটি ফ্রেস্কো দেখেন, যাতে পয়গম্বর মহম্মদকে জগতের অন্যান্য আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে দেখানাে হয়েছিল।
জেনাভাই—ইংল্যান্ডে জিন্না
লন্ডনে জিন্নার জীবনে দেখা দিলেন দাদাভাই নওরােজি, তাঁর অন্যতম অনুপ্রেরণাদাতা এবং উপকারক হিসেবে। গাঁধী লন্ডনে পৌঁছনাের বিষয়ে স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, “আমি দেখলাম যে ভারতীয় ছাত্ররা নওরােজির কাছে দিনের যে কোনও সময়ে যেতে পারত। তিনি তাদের সকলের পিতার স্থান নিয়েছিলেন, যে প্রদেশের বা ধর্মেরই তাঁরা হােন না কেন। তিনি তাদের পরামর্শ দিতেন, বিপদে সাহায্য করতেন। আমি বরাবরই হিরােদের পুজো করি, তাই দাদাভাই আমার সত্যিকারের ‘দাদা’ হয়ে উঠলেন।”[৭]জুলাই ১৮৯২-তে দাদাভাই নওরােজি হাউস অব কমনসে নির্বাচিত হন। ভারতীয় ছাত্ররা তখন দারুণ উদ্যমে তার হয়ে নির্বাচনী প্রচার করেছিল, যদিও জিন্না তখনও করাচিতে, তাই। সে সুযােগ পাননি। কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই সাফল্যের উদ্যাপনের মিলনসভায় ছিলেন, যা হয়েছিল জানুয়ারি ২৩, ১৮৯৩।
এর পর থেকে জিন্না নিয়মিত অতিথি হিসেবে হাউস অব কমনসের কথাবার্তা শুনতে যেতেন। এক বার খুব উৎসাহের সঙ্গে বলেছিলেন, “আমি লন্ডনেই থাকতে চাই, পার্লামেন্টে প্রবেশ করতে চাই, যেখানে আমি আমার প্রভাব ফেলতে পারব। ব্রিটিশ রাজনৈতিকদের সঙ্গে সমান মর্যাদায় মিশতে পারব।” এই তারুণ্যের উৎসাহ হয়তাে ভারতের জন্য পার্লামেন্টে দাদাভাইয়ের নানা কাজ দেখে জন্ম নিয়েছিল। তাঁর বােন ফতিমা জিন্না সেই সব দিনের স্মৃতি চারণ করে বলেছেন, “আমার ভাই আমাকে
৫৭
বলেছিল, যখন শুনলাম যে লর্ড স্যালিসবেরি তাঁর বক্তৃতায় দাদাভাইকে ‘কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ’ বলে উপহাস করেছেন, এবং ফিনসবেরির নির্বাচকদের বলেছেন তাঁকে নির্বাচিত না করতে, আমি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। যদি দাদাভাই কালাে হন, আমি আরও কালাে, আর এই যদি আমাদের রাজনৈতিক প্রভুদের মানসিকতা হয়, তা হলে আমরা কখনওই তাঁদের কাছ থেকে ন্যায় পাব না। সেই দিন থেকে আমি সব ধরনের বর্ণবিভেদের ঘাের বিরােধী। প্রতিশােধস্পৃহা থেকে আমি ওই বুড়াে মানুষটির (দাদাভাইয়ের জন্য প্রাণপণ কাজ করতে লাগলাম। সৌভাগ্যক্রমে, তিনটি ভােটে তিনি জিতে গেলেন। তফাত যত কমই হােক, ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে আনন্দের উচ্ছ্বাস ছিল অসাধারণ। গ্যালারিতে বসে ওঁর প্রথম বক্তৃতা শুনতে শুনতে নিজের মধ্যে এক নতুন উত্তেজনা টের পেলাম!” দাদাভাইয়ের জন্য জিন্না অত্যন্ত শ্রদ্ধা আর মুগ্ধতা অনুভব করে এসেছেন বরাবর।
৫৮
পরেও দাদাভাই জিন্নার রাজনৈতিক পরিচয়ের উপর অনেকটাই প্রভাব ফেলেছেন। জিন্না বরাবরই ‘বুড়াে মানুষটির একান্ত বন্ধু ছিলেন, যদিও দু’জনের মধ্যে বয়সের তফাত অনেকটাই। কংগ্রেসের প্রথম দিকের বছরগুলিতে দু’জনেই স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন অনেক।[৮]
জিন্নার সৌভাগ্যক্রমে, সে বছরই ছিল ‘লিটল গাে’-র মাধ্যমে আইন পড়ার সুযােগ। পাওয়ার শেষ বছর। পরের বছর থেকে পরিবর্তিত আইন অনুযায়ী জিন্নাকে আরও
৫৯
দু’বছর অপেক্ষা করে আইনের পরীক্ষা দিতে হত। তাই জিন্না সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়ে গ্রাহামসের শিক্ষানবিশি ছেড়ে দিয়ে লিটল গাে’তে উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন। এর জন্য তাঁকে বসতে হল তিনটি পরীক্ষায়, ব্রিটিশ ইতিহাস, ইংরেজি ভাষা এবং লাতিন। বেশির ভাগ ভারতীয়দের কাছেই তৃতীয় বিষয়টি ছিল অত্যন্ত কঠিন। লাতিনের সঙ্গে কেবল প্রাথমিক স্তরের পরিচিতির জন্যই দু’বছর লাগত, যার মধ্যে এই পরীক্ষার সুযােগ চলে যেত। কিন্তু লাতিন পরীক্ষা থেকে রেহাই পাওয়ার সুযােগ ছিল যদি সেই ই-এর ‘মাস্টার্স অব দ্য বেঞ্চ’ ছাত্রের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতায় সন্তুষ্ট থাকতেন। জিন্না এই ছাড়ের সুবিধার জন্য আবেদন করলেন।
লিঙ্কনস ই-এর স্পেশাল কাউন্সিল এই আবেদন গ্রহণ করে তাঁকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় লাতিন পেপার থেকে মুক্তি দিলেন। ১৮৯৩ সালের ২৫ মে পরীক্ষা হল, জিন্না পাশ করে গেলেন। আইনের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটির প্রথম পদক্ষেপ এ ভাবেই শুরু হল। এই সময়েই তিনি তাঁর নাম থেকে ‘ভাই’ কথাটি ছেটে বাদ দিলেন, এবং নামের বানানও বদলে ফেললেন। তিনি সেই নাম নিলেন যে নামে তিনি পরিচিত হবেন বাকি জীবন ধরে: মহম্মদ আলি জিন্না।
জিন্না যে কেবল নাম বদলালেন তাই নয়, বারবার নিজের নামের বানান বদল করেছেন। মহমদালি জিন্নাভাই’ থেকে ‘জেনাভাই’ বাদ দিয়ে ‘জিন্না’ গ্রহণ, আবার ‘মহমদ আলি জিন্না, তারপর ‘আল্লি থেকে একটি এল’ বাদ দিয়ে এবং মহমদ-এ একটি ‘এম’ যােগ করে, শেষ অবধি মহম্মদ আলি জিন্না।
এটা খুব তুচ্ছ কথা নয়। যে কোনও সমাজ মনােবিজ্ঞানী নিঃসন্দেহে এই পরিবর্তনগুলির মধ্যে অনেক কিছু খুঁজে পাবেন। স্পষ্টতই এটা আমাদের ভবিষ্যতের কায়েদ-এ-আজমের ব্যক্তিত্বের বিবর্তনের দিকে নির্দেশ দেয়। বােঝা যায়, একই সঙ্গে জিন্নার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটছিল, এবং তরুণ জিন্না ঠিক সেই নামটিকে খুঁজছিলেন যা তাঁর ভবিষ্যতের ব্যক্তিত্বের জন্য যথাযথ হবে।
বম্বেতে জিন্না
ইংল্যান্ডে পড়াশােনা শেষ করে জিন্না ১৮৯৬ সালে ভারতে ফিরে এলেন। করাচিতে যাওয়ার কোনও কারণ ছিল না, তাই তিনি এলেন বম্বেতে। তিনি বাইরে থাকাকালীন তাঁর বালিকা স্ত্রী এমি বাই মারা গিয়েছেন, তাঁর মায়েরও মৃত্যু ঘটেছে। পরবর্তী ৫১ বছর বম্বেই তাঁর বাসস্থান হয়ে রইল। প্রথমে হাই কোর্টের কাছে, রেলওয়ে হােটেলে থেকে মক্কেলের অপেক্ষা করতেন। সে সময়ে তাঁর জীবন সহজ ছিল না। সৈয়দ পিরজাদা একটি ছবিতে বলেছেন জিন্নার জীবনের সেই সব দিনের কথা, যে “জিন্না বলত, আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন আমার কাছে ট্রাম বাসে চড়ার মতাে পয়সাও ছিল না।
৬০
বেশির ভাগ সময়েই হেঁটে যাওয়া-আসা করতাম।” “সর্বোচ্চ স্তরে সব সময়েই জায়গা আছে, কিন্তু সেখানে যাওয়ার কোনও লিফট নেই, তােমাকেই লড়াই করতে হবে।” তিনি সত্যিই লড়াই করেছিলেন, খুব কঠিন লড়াই। বলেন, “আপনারা হয়তাে জানেন, ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার আগে দু-তিন বছর আমার সময় খুব খারাপ যাচ্ছিল, এবং প্রায় দিনই আমি রাস্তার নীচে ওয়াটসন হােটেলে যেতাম। বাজি রেখে বিলিয়ার্ড খেলতাম, এবং সেই ভাবে আমার সামান্য রােজগারে কিছু যােগ করতাম।” ওয়াটসন হােটেলের এখন খুবই খারাপ দশা। তার রেলিং-এ ‘ডব্লিউ’ অক্ষরটি কেবল স্মৃতিচিহ্ন হয়ে রয়েছে।
বম্বের হাই কোর্ট অব জুডিকেচার-এ তিনি নাম লেখালেন ২৪ অগস্ট ১৮৯৬,”[৯] আর তার পরেই অ্যাডভােকেট হিসেবে শপথ নিলেন। গাঁধী ফিরে এসে নাম লিখিয়েছেন ১৮৯১ সালে। মহম্মদ আলি জিন্না তখন মাত্র কুড়ি বছরের তরুণ, আইন ও রাজনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তাঁর সামনে প্রসারিত।
প্রথম দিনগুলির কঠোরতা সত্ত্বেও, তাঁর ফিরে আসার সময়টা ছিল খুবই ভাল, কারণ সেই সময়ে তাঁর বাবা করাচির আদালতে বেশ কিছু কঠিন মামলায় জড়িয়ে রয়েছেন। জিন্না নিজে সাক্ষীদের প্রশ্ন করা এবং অভিযুক্তের হয়ে মামলা প্রস্তুত করার দায়িত্ব। নিলেন। বাবার হয়ে লড়াই করে মামলা জিতলেন।[১০] জিন্নার পেশাদারি জীবন শুরু হয়ে গেল, এবং খুব শীঘ্রই তিনি বম্বে বার-এ সেরাদের একজন হয়ে উঠলেন।[১১] তৎকালীন অ্যাডভােকেট জেনারেল, জন মােলসওয়ার্থ ম্যাকফার্সনের চেম্বারে জায়গা পেলেন। সরােজিনী নাইডুর ভাষায়, এটা একটি সৌজন্যমূলক স্বীকৃতি, এই প্রথম যা দেওয়া হল কোনও ভারতীয়কে, এর গ্রহীতা বরাবরই নিজের জীবনযুদ্ধের প্রথম অন্ধকারময় দিনগুলির পর এক আশার আলাে বলে ঘটনাটিকে মনে রেখেছেন।[১২] স্যর চিমনলাল সেতলবাদ বলেছেন, “ম্যাকফার্সনের প্র্যাকটিস ছিল খুব বড়। তাঁর ভাষা, উচ্চারণ ছিল নিখুঁত। শিক্ষানবিশির সময়ে জিন্না তাঁর দক্ষতার গােড়াপত্তন করেন, কিন্তু মাঝেসাঝে কিছু ব্রিফ পাওয়া ছাড়া তাঁর পেশায় উপরে ওঠার তেমন কিছু সুযােগ পাননি।”[১৩] জিন্নার প্রথম সুযােগ এল ১৯০০ সালে, যখন তিনি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ শুরু করলেন, যে নিয়ােগ এক তরুণ আইনজীবীর জন্য খুবই সম্মানজনক।
প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জিন্নার নিয়ােগের পর প্রাদেশিক গর্বে পূর্ণ একটি খবর বেরােল করাচির দৈনিক ‘সিনধ গেজেটে’, ১০ মে ১৯০০ সালে। করাচির খােজা সম্প্রদায়কে অভিনন্দন জানাতে হয় মি, মহম্মদ আলি জিন্না বম্বের তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার জন্য। তিনি করাচির প্রবীণ এবং শ্রদ্ধেয় ব্যবসায়ী মি. জেনাভাইয়ের পুত্র। মি. মহম্মদ আলি জিন্না তরুণ বয়সে বার পরীক্ষায় পাশ করে ফিরে এসে বম্বে হাই কোর্টের অ্যাডভােকেট হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছেন।” তখন জিন্নার বয়স মাত্র ২৪।
আইনের প্রতি জিন্নার আগ্রহ এবং অনুরাগের আর একটি দিক ছিল তাঁর অসাধারণ সততা। তিনি কিছু দিন স্যার জর্জ লাউন্ডেস-এর চেম্বার্স-এ ছিলেন, যিনি পরে ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের আইন সদস্য হন, এবং তারও পরে প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য হন। “লাউন্ডেস-এর মাথা ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার, খুব জোরালাে
৬১
ভাবে তিনি সওয়াল করতেন। জিন্না এক দিন নিজের চেম্বারে বসে পড়ছিলেন, তখন তিলকের একটি বক্তৃতার বিষয়ে লাউন্ডস-এর মতামত চাওয়া হল। আলােচনার আগে লাউন্ডেস জিন্নাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি ব্রিফটি পড়েছেন কি না, এবং সে বিষয়ে কী মনে করেন। জিন্না উত্তর দিলেন, তিনি ব্রিফটি স্পর্শ করেননি, এবং পড়েও দেখবেন না, কারণ তিনি তিলকের মতাে একজন মহৎ দেশপ্রেমীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানাের জন্য সরকারের সমালােচনা করতে চলেছেন, এবং তার জন্য নিজেকে এ বিষয়ে জড়াতে চান না।”[১৪]
তত দিনে বম্বেতে উকিল হিসেবে মহম্মদ আলি জিন্নার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। এক বার একটি শুনানির সময়ে এক বিচারপতি তিন বার জিন্নার কথার মধ্যে ‘রাবিশ’ কথাটি বলেন। জিন্না বলেন, “আজ সারা দিনে মহামান্য বিচারপতির মুখ দিয়ে রাবিশ ছাড়া আর কিছুই বেরােয়নি।”[১৫] জিন্না যখন ওকালতি শুরু করেছিলেন, তখন আইনজীবী মহলে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষ যথেষ্ট ছিল। কিন্তু খুব দ্রুত, নিজের দক্ষতার জোরে জিন্না বেশ ভাল প্র্যাকটিস গড়ে তােলেন। সে যুগের বড় বড় আইনজীবীদের। পাশে দাঁড়িয়ে এই সাফল্য উকিল হিসেবে তাঁর ক্ষমতা, তাঁর মানসিক দৃঢ়তা এবং চরিত্রের পরিচয়।।
জিন্না ও তাঁর ধর্মবিশ্বাস
হিন্দু লােহানা[১৬] জাতি থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন খােজা সম্প্রদায়। জিন্না খােজা। মুসলিম ছিলেন, তিনি শিয়া গােষ্ঠীর ইথনা আশারি[১৭] সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। খােজাদের বিশ্বাস এবং ধর্মীয় আচার-আচরণ সহজে কোনও পরিচিত ছাঁচের মধ্যে ফেলা চলে না। বার্নার্ড লিউইস খােজাদের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এরা “এক পাতলা মুসলিম আচ্ছাদনের তলায় হিন্দু মনােভাবাপন্ন।”[১৮] ইসলামি ধর্মবিশ্বাসের অধীনে এ এক বিশিষ্ট সম্প্রদায়, যার মধ্যে হিন্দু-মুসলিম দুয়েরই মিশ্রণ। ১৯১৭ সালে সরােজিনী নাইডু যখন লেখেন, “জিন্না জনসম্প্রদায়গত ভাবে হিন্দু এবং ধর্মে মুসলিম: এ হয়তাে কেবল প্রতীকী নয় যে খােজা পিতা-মাতার এই সন্তান ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত’ হয়ে উঠবেন,[১৯] তখন জিন্নার উদার ব্যক্তিত্বকে তাঁর খােজা উত্তরাধিকারের সঙ্গেই যােগ করেছিলেন।
বােহরা এবং মেমনদের মতাে, খােজারাও তাঁদের সম্পদ, তাঁদের বাণিজ্য এবং ব্যবসায়ে দক্ষতার জন্য পরিচিত। তাঁরা চারিত্রিক ভাবে একান্ত শান্তিপ্রিয়। তাঁদের অবস্থান মূলত সুরাট, ভারুচ, আহমেদাবাদ, করাচি এবং বম্বে, ভারতের পশ্চিম উপকূল ঘিরে। এই সব কেন্দ্র থেকে তাঁরা বম্বে প্রেসিডেন্সির ভিতরের ব্যবসার একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেই সঙ্গে পূর্ব আফ্রিকা এবং মরিশাসের সঙ্গে বাণিজ্য করতেন,
৬২
আর বম্বে শহরের মধ্যেও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। ইংরিজি ভাষায় শিক্ষার নিরিখে অবশ্য তাঁরা কখনওই খুব অগ্রসর ছিলেন না। কিন্তু সেটা তাঁদের খুব বড় দুর্বলতা হয়ে দেখা দেয়নি, কারণ তারা নিজেদের মাতৃভাষা গুজরাতিতে অগ্রসর হিন্দুদের মতােই সড়গড় ছিলেন। সম্প্রদায় হিসেবে তাঁদের ইংরেজি জানার খুব বেশি প্রয়ােজনও ছিল , কারণ তাঁদের ব্যবসায়ের কাজ তাঁরা গুজরাতিতে ভালই চালিয়ে নিতেন। তাঁদের কাছে সরকারি চাকরি বা পদ সাফল্যের কোনও প্রমাণ ছিল না। তাঁদের ধর্মীয় নেতা ছিলেন আগা খান, যদিও জিন্না তাঁকে কখনও সেই স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিলেন না।
ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকায় স্বাভাবিক ভাবে তাঁদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও সে ভাবেই নির্ধারিত হয়। সে সময়ে সরকারি চাকরির জন্য প্রতিযােগিতাই সাম্প্রদায়িক পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। খােজারা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সমৃদ্ধ গােষ্ঠী হিসেবে এই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হননি। খােজারা যে কখনওই নিজেদের মুসলিম পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করতে সম্প্রদায় হিসেবে উদ্যোগী হননি, অধিকাংশ মুসলিম গােষ্ঠীর সঙ্গে এই ছিল তাঁদের প্রধান তফাত। তা ছাড়া, বম্বের বাণিজ্যিক জগতের সদস্য হওয়ায় ব্যবসাগত কারণেই সব সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে সদ্ভাব রাখাটা তাঁদের কাছে ছিল একান্ত জরুরি। নইলে কী করেই বা তাঁরা ব্যবসায়িক এবং আর্থিক সুযােগ সুবিধে পেতেন?
জিন্না: প্রথম যুগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
জিন্না অবশ্য এই সব সাধারণ নিয়মের বাইরে ছিলেন। ব্যবসায়ীরা যে ভাবে মানিয়ে চলে, অন্যকে স্থান দেয় কিংবা আর্থিক লাভের জন্য কাজ করে, তিনি আদৌ তা করতেন না। তাঁর প্রকৃতি ছিল আত্মপ্রত্যয়ী এবং লড়াকু। জাতীয়তাবাদে তাঁর উৎসাহ স্বার্থসিদ্ধির ইচ্ছা থেকে জন্মায়নি, তার উৎস ছিল জিন্নার মুক্ত, উদার প্রকৃতি, ইংল্যান্ডে তাঁর অভিজ্ঞতা, তাঁর রমরমা আইনি প্র্যাকটিস, যা তিনি তৈরি করে তুলেছিলেন। নিজের আপ্রাণ চেষ্টায়। নিজের চেষ্টায় পড়াশােনা করেছিলেন, জীবনে দাঁড়িয়েছিলেন, এবং যৌবনকালে তাঁর প্রধান উদ্বেগ ছিল যাতে তাঁর প্রতিভা স্বীকৃতি পায়, পুরস্কৃত হয়। তাঁর সময়ে অন্যান্য ব্যারিস্টারদের মতাে তাঁর জন্ম, বংশ বা সামাজিক অবস্থানের তত সুবিধে ছিল না। ইংল্যান্ডে ঘুরে এসেছিলেন বলেই ইংরেজদের দ্বিচারিতা তাঁকে আঘাত করত— নিজেদের দেশে ইংরেজরা এক রকম নিয়ম মানতেন, আর ভারতে, ভারতীয়দের জন্য মানা হত আর এক নিয়ম। যাঁরা বিলেতে আইন পড়েছেন, তাঁদের অনেকের মতােই জিন্না ফিরে এসে ‘এক দিকে ব্রিটিশদের ঔদ্ধত্য, অন্য দিকে ভারতীয়দের হীনম্মন্যতা,[২০] এই দুটিকেই নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারের জন্য তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে সাংবিধানিক নিয়মকানুনের প্রতিও তাঁর
৬৩
আগ্রহ ছিল পুরােমাত্রায়, যে বিৈশষ্ট্য এসেছিল তাঁর আইনি পেশার থেকেই। তিনি ছিলেন সেই মানুষদের মতােই, যাঁরা নিজের চেষ্টায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন, নিজের ক্ষমতার দ্বারা, এবং নিজের নীতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকে। আর কোনও অস্ত্র না থাকায়, তিনি এইগুলােই ব্যবহার করেন ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের মােকাবিলায়।
আইনজীবী হিসেবে তাঁর জীবনের গােড়াতেই তাঁর প্রশিক্ষণ মুসলিম সমাজের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়। ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক অসুবিধা সত্ত্বেও তিনি নিজে উচ্চ স্থানে পৌঁছেছিলেন বলে তিনি আশা করতেন, অন্যরাও বিশেষ সাহায্য ছাড়াই শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সফল হতে পারবে। যখন মার্চ ১১, ১৯১৩ সালে পাবলিক সার্ভিসেস কমিশনের কাছে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, লর্ড ইসলিংটন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, এক সঙ্গে পরীক্ষা হলে পশ্চাৎপদ জনগােষ্ঠীগুলির অসুবিধে হবে না? জিন্না অবিচল ভাবে বলেন, “আমি যদি দক্ষ লােক পাই, তা হলে যদি কোনও বিশেষ গােষ্ঠীর আধিপত্যও থাকে, (যদিও এই মুহূর্তে সেই সম্ভাবনায় আমার ঘাের সন্দেহ), তা হলে আমি আপত্তি করব না।” ইসলিংটন আরও বলেন, “আমার কাছে বলা হয়েছে যে, কোনও হিন্দুকে যদি মুসলিমদের বিচারের দায়িত্বে বসিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে সমস্যা হবে। আপনি কি মনে করেন যে এক জন শিক্ষিত, প্রভাবশালী মুসলিমের থেকে কয়েক নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য কোনও হিন্দু একটা মুসলিম প্রধান জেলায় এক জন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে বেশি ভাল কাজ করতে পারবেন?” উত্তরে জিন্না বলেন, “সে ক্ষেত্রে আপনি হিন্দুদের প্রতি অত্যন্ত অন্যায় করবেন। কেন এক জন হিন্দু একটি মুসলিম-প্রধান জেলার দায়িত্বে থাকবেন না, আমি তার কোনও কারণ দেখি না।” এই ধরনের মতবাদ জিন্নার জীবনের প্রথম দিকে তাঁকে কংগ্রেসের সদস্য করে তােলে, মুসলিম লিগের নয়।
পাকিস্তান সরকার জিন্নার সরকারি জীবনীকার হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন হেক্টর বােলিথােকে। পার্সিভাল স্পিয়ারের ‘জিন্না, দ্য ক্রিয়েটর অব পাকিস্তান’ বইটি থেকে উদ্ধৃত করে লেখেন, “ব্যক্তিগত সততা, নীতির প্রতি দায়বদ্ধতার সঙ্গে যােগ করতে হয়। তাঁর সাহস, তাঁর মনে কোনও ক্ষুদ্র চিন্তা বা ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যের অনুপস্থিতি। বিশের দশকের মাঝামাঝি স্বরাজ এবং সরকারি শক্তির মধ্যস্থতা, কিংবা সর্বদলীয় বৈঠকের আলােচনায় প্রতিরােধ, কিংবা গাঁধীর সম্মান এবং কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একক লড়াই, বিশ্বযুদ্ধে নিরত সাম্রাজ্যবাদী সরকারের সিদ্ধান্তের বিরােধিতা, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের দরদস্তুরে চাপের মুখে নতিস্বীকার না করা, এর কোনও বিষয়েই জিন্নার মধ্যে কখনও সাহসের অভাব দেখা যায়নি।”
অনেক বছর আগে, তাঁর বিবাহের সময়ে, জিন্না মাউন্ট প্লেজেন্ট রােডে একটি পুরনাে গােয়ান বাংলােয় থাকতেন। ১৯২৯ সালে রাতির মৃত্যুর পরেও তিনি সেখানেই থাকতেন, ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে অবধি। ১৯৩৪ সালে ফিরে এসে তিনি গােয়ান বাংলােটিকে ভেঙে এখনকার জিন্না হাউস তৈরি করান। যে দু’বছর ধরে বাড়িটি তৈরি হয়, সে সময়ে তিনি মালাবার হিলের লিটল গিবস রােডে একটি
৬৪
ভাড়া বাড়িতে ছিলেন। এই বছরগুলি ছিল ‘একাকিত্ব, মানসিক এবং নৈতিক সংযমের সংমিশ্রণ এবং ‘সততা, যা এতই তীব্র যে প্রায় আত্মনির্যাতনের পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তাঁর গুণগুলি ছিল তীব্র, তুলনায় দোষগুলি খুবই নগণ্য।
জিন্না: রাজনৈতিক শুরু
জিন্নার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তাঁর আইনের প্র্যাকটিস শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, ব্রিটেন থেকে ফেরার পর। তিনি আঞ্জুমান-ই-ইসলাম[২৩] নামে মুসলিমদের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠনে যােগ দেন ১৮৯৭ সালে।[২৪] বম্বে হাই কোর্টের বিচারক বদরুদ্দিন তায়েবজি ছিলেন ওই সংগঠনের নেতৃত্বে, তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি হয়ে উঠলেন জিন্নার মুসলিম পরামর্শদাতা। এটা বড় সৌভাগ্য বলে ধরতে হবে, কেননা এর ফলে জিন্নার আইনি এবং রাজনৈতিক, দুই জীবনেই যথেষ্ট সাহায্য হয়েছিল। বিশেষত কংগ্রেসে মুসলিমদের ভূমিকা কী, সে বিষয়ে তিনি পথনির্দেশ পেয়েছিলেন। ১৮৮৭ সালে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেই তায়েবজির উপর চাপ সৃষ্টি করেন সৈয়দ আহমদ খান, যিনি মনে করতেন যে কংগ্রেস মুসলিমদের সাহায্য করতে পারবে না, তাই তার থেকে দূরে থাকা দরকার। তায়েবজি তার পর মুসলিমদের অনুভূতির মর্যাদা দিতে কংগ্রেস থেকে পাঁচ বছর দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আর কোনও কংগ্রেস বৈঠকে উপস্থিত থাকেননি। জিন্না আঞ্জুমান-ই-ইসলাম-এ তাঁর প্রথম দিকের দিনগুলিতে তায়েবজির কাছাকাছি এসেছিলেন, তার আগেই তিনি পার্সি কংগ্রেস সদস্য দাদাভাই নওরােজির সংস্পর্শ পেয়েছিলেন। সে সব দিনে কংগ্রেস রাজনীতিতে পার্সিদের প্রাধান্য ছিল। বম্বের লােকে ফিরােজশাহ মেটা, দিনশ ওয়াচার মতাে মানুষদের দিয়েই কংগ্রেসকে চিনত। জিন্নার সৌভাগ্য, আঞ্জুমানের বম্বের প্রতিনিধিরা কংগ্রেসের জন্য সন্ত্রস্ত বােধ করেননি। তাঁরা ছিলেন মুক্তচিন্তার মানুষ। তা ছাড়া, বম্বে কংগ্রেসের পার্সি সদস্যরা গােখেল এবং জিন্নার উপর নির্ভর করতেন, যাতে তিলকের মতাে নেতারা প্রাধান্য না পান, যেহেতু তিলকের জাতীয়তাবাদকে তাঁরা ‘হিন্দু মনে করতেন। পার্সিরা তখন বম্বের আইনজগতে আধিপত্য করছেন, কারণ তাঁদের গােষ্ঠী অন্যদের আগেই ইংরেজি শিক্ষার সুযােগ পেয়েছে। পার্সিদের মানসিকতাও ব্রিটিশ শাসন এবং তার আমলাতন্ত্রের সঙ্গে অন্যদের চেয়ে ভাল ভাবে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
এই সময় রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেকের উৎসবের জন্য যে কমিটি তৈরি হল, তায়েবজির সঙ্গে জিন্নাও তার সদস্য হলেন। ১৯০৪ সালের ২৮ জুলাই কংগ্রেসের রিসেপশন কমিটির বৈঠকেও তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন, যার সভাপতিত্ব করেছিলেন ফিরােজশাহ মেহতা, কিন্তু মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বিষয়ে বিতর্কে যােগ দিতে রাজি হননি।[২৫] ওই বছরেই বম্বে কংগ্রেস ইংল্যান্ডে একটি প্রতিনিধি দল
৬৫
পাঠানাের সিদ্ধান্ত নেয়, যারা ব্রিটিশ জনগণের মতকে প্রভাবিত করে স্বরাজের পক্ষে সমর্থন আদায় করবে। কংগ্রেসের রাজ্য কমিটি জিন্নার নাম প্রস্তাব করে, কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিলক আপত্তি তােলেন। কারণটা ছিল রাজনৈতিক— জিন্নাকে ফিরােজ শাহ মেটার গােষ্ঠীর সদস্য বলে দেখা হত, তাই।[২৬] সময়ের স্রোতে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আমাদের এ বার যােগ দিতে হবে সুরাতের কংগ্রেসে—নাগপুরে নয়, যেখানে প্রথমে ওই কংগ্রেসের পরিকল্পনা হয়েছিল। এখানে। দলের মধ্যে একটা বিভাজন হয়ে যায়। যদিও তিলকের শক্তির জায়গা নয়, তবু সুরাত অধিবেশন শেষ হয় বিশৃঙ্খলায়, যেখানে পরিবর্তনকামীরা সত্যাগ করেন। দশ বছর পরে, ১৯১৬ সালে, তাঁরা আবার কংগ্রেসে ফেরেন। তত দিনে গােখেল এবং মেটা, দুই বিশাল মাপের নেতার কেউই আর জীবিত নেই। জিন্না তাই আবার তিলকের সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করেন। কংগ্রেসের এই ভাঙনে খুশি হয় ব্রিটিশরা। রাজদ্রোহিতার অভিযােগে তারা তিলককে গ্রেফতার করে ১৯০৮ সালে। এই সময়ে জিন্না এক সাহসী পদক্ষেপ নেন। তিনি বম্বে হাইকোর্টের ভারতীয় বিচারপতি ডি ডি দাবরের সামনে। তিলকের জন্য জামিনে মুক্তির আবেদন করেন। বিচারপতি নানা অজুহাতে দেরি করতে থাকেন, শেষ অবধি কোনও কারণ না দেখিয়েই আবেদন খারিজ করে দেন। তিনি আরও বলেন যে মামলা আদালতে বিচারের জন্য না এলে কোনও কারণ দর্শানাের প্রয়ােজন নেই। দুর্ভাগ্যবশত, জিন্নার এত চেষ্টা সত্ত্বেও তিলক তাঁকে তার কৌঁসুলি করতে রাজি হলেন না। তিলক নিজে আইন গ্র্যাজুয়েট ছিলেন, তাই নিজের কেস নিজেই হাই কোর্টে লড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
১৯২০ সালে তিলককে সম্মান জানাতে গিয়ে জিন্না বলেছিলেন, “তিলক ছিলেন এক জন বিচক্ষণ, বাস্তববাদী রাজনীতিক। সুরাতে বিভাজনের পর আমি যখন তাঁকে প্রথম চিনলাম ১৯০৭ সালে, কংগ্রেসে তিলকের গােষ্ঠীর কণ্ঠ ছিল সামান্যই, সংখ্যায়ও তারা কম ছিল। রাজদ্রোহের অভিযােগে তিলকের শাস্তি তাঁকে প্রায় ছয় বছর রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। এ এক অমানবিক বিচার। আমাকে তাঁর পক্ষ সমর্থনের ভার দেওয়া হয়, আমি জামিনের জন্য আবেদন করি, যা জাস্টিস দাবর খারিজ করেন … তাঁর সঙ্গে কৌঁসুলি হিসেবে আমার গুরুত্বপূর্ণ মতদ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় কারণ আমি কৌঁসুলি হিসেবে আমার যা শ্রেষ্ঠ মনে হয়েছিল, সেটা ছাড়া অন্য কোনও পথ অবলম্বন করতে অস্বীকার করি।”[২৭] এই বিচার চলে আট দিন, যার পরে তিলককে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ন্যায়বিচারের জন্য বিচারপতি দাবর ‘নাইট’ উপাধি পান। জিন্না তাঁর সম্মানে আয়ােজিত নৈশভােজের তিক্ত সমালােচনা করেন, তাতে যােগ দেন না।
সে সময়ে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, অভিজ্ঞতায়, নাগরিক জীবনে, স্বতন্ত্র ভাবধারার। চিন্তাশীল ভারতীয় হিসেবে তাঁর যে বিবর্তন, প্রথম জীবনে লড়াইয়ের পর তাঁর সাফল্য, সংস্কারক হিসেবে ইসলামের প্রতি দৃষ্টি, এ সব কিছুই জিন্নার প্রথম জীবনের রাজনীতিকে অন্য কোনও পথে যেতে দেয়নি। তাঁর একমাত্র চিন্তা ছিল ব্রিটিশ ঔদ্ধত্য
৬৬
থেকে ভারতের মুক্তি, তাই তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্র জাতীয় না হয়ে উপায় ছিল না। তাঁর চিন্তা খুব কমই রাজ্য রাজনীতিতে খাপ খাওয়াতে পেরেছে। কিন্তু এখানেই তিনি সবচেয়ে বড় সমস্যার সম্মুখীন হন: একটি রাজ্যের পূর্ণ সমর্থন না পেয়ে কী করে জাতীয় রাজনীতিতে কাজ করা যায়? সেই সঙ্গে তাঁর আরও এক দ্বন্দ্ব ছিল, কী করে । কংগ্রেসের সদস্য পদ থেকে সদ্য-প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লিগের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। যায়? লিগকে উপেক্ষা করার উপায় ছিল না, অথচ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এই সময়ে (তখন তাঁর বয়স তিরিশের কোঠায়) লিগকে তাঁর রাজনৈতিক দল নির্বাচন করলে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেকে বেঁধে ফেলা হত। একমাত্র উপায় ছিল কংগ্রেস সদস্য হিসেবে মুসলিম লিগের বৈঠকে যােগ দেওয়া।[২৯] এই সিদ্ধান্তে জিন্না একটি শর্ত যােগ করলেন ১৯১৩ সালের শরৎকালে, “মুসলিম লিগের প্রতি এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি আনুগত্য কখনওই জাতীয় স্বার্থের প্রতি আনুগত্যহীনতার ছায়ামাত্রও বােঝাবে না, যার প্রতি তাঁর (জিন্নার) জীবন নিবেদিত।” এটা কি নীতির মধ্যে বিভাজনে সেতু বাঁধার জন্যই? কিন্তু সেটাও কি নীতির প্রশ্ন ছিল ? না কি দই নৌকোয় পা রাখার হিসেব-কষা উপায় ? দুই ব্যাখ্যারই সমর্থক রয়েছে।
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রাজনৈতিক নির্বাচন। এখানেও জিন্নার সামনে এক জটিল দ্বন্দ্ব উপস্থিত হল। তিনি উত্তেজক, জ্বালাময়ী বক্তৃতার মানুষ ছিলেন না। তাঁর ব্যক্তিত্বই ছিল আত্মস্থ, সংযত এক মানুষের, যিনি যুক্তি, চিন্তার স্বচ্ছতা এবং তীক্ষ প্রকাশক্ষমতা দিয়ে কাজ করেন। “যতক্ষণ রাজনীতি হল আলােচনার ব্যাপার, তাঁর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু সমাজে রাজনীতি, গণতন্ত্রের প্রসার । এবং মানুষের অংশগ্রহণের হার বাড়তে থাকায় জাতীয় নেতাদের রাজ্য এবং স্থানীয় রাজনৈতিক ধারার সঙ্গেও যােগ রাখা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল”[৩০], এবং এইখানে জিন্না তাঁর সর্বভারতীয় মঞ্চ হারিয়ে ফেললেন। তাঁকে অগণিত সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছিল, যার মধ্যে প্রধান ছিল ভারতীয় জনতার উপর গাঁধীর প্রভাব। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এই দুই বিশাল ব্যক্তিত্বের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আমাদের কিছু সময় কাটানাে দরকার। এ কাজ সহজ নয়, কিন্তু একান্ত জরুরি।
গাঁধী ও জিন্না
জিন্নার সঙ্গে গাঁধীর তুলনা করা খুব জটিল কাজ। কিন্তু খুব জরুরি কাজও বটে, কারণ তাঁরা দুজনে স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন। গাঁধী ছিলেন ভিন্ন ছাঁচের মানুষ, কিন্তু তিনিও কাথিয়াবাড়ে তাঁর জন্মের দিনগুলাে থেকে লন্ডনের ব্যারিস্টার হয়ে তারপর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তফাতও ছিল। গাঁধীর পরিবার ছিল বিশিষ্ট, তাঁর পিতা ছিলেন একটি ভারতীয় রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী, যা তাঁকে বহু
৬৭
সাহায্য করে। জিন্নার পরিবার কিন্তু তাঁর জীবনের গােড়ায় তাঁকে তেমন কোনও সুযােগ এনে দেয়নি। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। গাঁধী প্রতিবাদের রাজনীতির এক অসাধারণ দক্ষ নেতা হয়ে ওঠেন। সেটা করার জন্য তাঁর নিজের প্রকৃতিকে বদলে ফেলতে হয়নি, তাঁর ভাষাকেও বদলাতে হয়নি। তিনি ভারতে রাজনীতির প্রকৃতিকেই বদলে দিয়েছিলেন। তিনি বদলে দিয়েছিলেন মানুষকে, যারা দীর্ঘ দিন বিদেশি শাসনের অধীনে থেকে অধীনতার একটা শৈলী রপ্ত করে নিয়েছিল। গাঁধী তাঁদের এই দীর্ঘ নৈতিক অধীনতা থেকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতিকে উচ্চবিত্তদের বসার ঘর, বিতর্ক সভা এবং নানা সংগঠন থেকে বার করে গ্রামের সমাজে, মাটির কাছে নিয়ে এলেন, তাঁর শিকড় ছিল সেই মাটিতে। গ্রামের মানুষের ভাষা, প্রাত্যহিক বাদানুবাদ এবং তত্ত্বের মধ্যেই তাঁর জীবন ছিল। সেই জীবনের ঘাম, গন্ধ, আর তার অসাধারণ সৌন্দর্য ও সুগন্ধ, সবই তিনি জানতেন।
হেক্টর বােলিথাে তাঁর ‘ইন কোয়েস্ট অব জিন্না’ বইয়ে এই দুই মহান ভারতীয়ের কিছু চমকপ্রদ পার্থক্য দেখিয়েছেন। লিখেছেন, জিন্না ছিলেন ক্ষমতার উৎস, গাঁধী ছিলেন ক্ষমতার অস্ত্র। জিন্না ছিলেন রাজনীতিতে শীতল যুক্তিবাদী, তাঁর মন ছিল একমুখী, যার পিছনে ছিল প্রচণ্ড শক্তি। জিন্নার মধ্যে সহানুভূতির শক্তি নিহিত ছিল, কিন্তু তাঁর ব্যবহার ছিল খুবই শীতল, আন্তরিকতাহীন। গাঁধী ছিলেন করুণার প্রতিমূর্তি। জিন্না দরিদ্রদের স্পর্শ করতে চাইতেন না, গাঁধী সারা জীবনই দরিদ্রকে সাহায্য করতে গিয়ে নিজের হাত কলুষিত করেছেন।
জিন্না শৈশবে বার বার স্থান পরিবর্তনের পর, তিনি কোথাও সহজে শিকড় গাড়তে পারতেন না, অন্যের সঙ্গে সহজে সম্পর্কও তৈরি করতে পারতেন না। তাঁর নির্যাস ছিল সংবিধানবাদীর, তাই তাঁকে একটা ভিন্ন পথ নিতে হয়েছিল। তাঁর পক্ষে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া, গ্রাম-ভারতের ধুলাে-ভরা রাস্তাকে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না। সেই জন্য ১৯২০ সাল নাগাদ গাঁধীর আবির্ভাব এবং দ্রুত উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় স্তরে নিজের অবস্থান বজায় রাখা তাঁর কাছে কঠিন হয়ে ওঠে। এমন কোনও রাজ্য ছিল না, তখন বা তার পরেও, যাকে জিন্না একেবারে নিজের এলাকা বলে দাবি করতে পারতেন। গণ-রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তাঁর অক্ষমতা বরাবরই ছিল এক বড় সমস্যা। তার পর, জাতীয় স্তরে তাঁর অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দিয়েছিল তাঁর ‘মুসলিম’ পরিচিতি, কারণ জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তখন অনেক নেতা। মুসলিম নেতা হিসেবে দ্বিতীয় সারির নেতা ছাড়া তাঁর আর কোনও ভূমিকা ছিল না। জিন্নার জন্য দ্বিতীয় সারির ভূমিকা মানেই তিক্ততার ব্যাপার, তিনি সব সময়েই মঞ্চের কেন্দ্রে জায়গা করে নিতে চেয়েছেন, এবং পেরেছেন। কিন্তু যখন এতগুলাে শক্তি যখন তাঁকে কেবলই প্রান্তের দিকে ঠেলছে, তখন কেন্দ্রে থাকার উপায় কী?
শিকাগাে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, স্বামী-স্ত্রী লয়েড রুডলফ এবং সুসান রুডলফ, আমার সঙ্গে চিঠিতে তাঁদের চিন্তার বিনিময় করেছেন এ বিষয়ে। তাঁরা মনে করেন, “জিন্না গাঁধীকে সহ্য করতে পারতেন না, কিন্তু নেহরুর প্রতি তাঁর
৬৮
বিদ্বেষের থেকে এই বিদ্বেষ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। জাতীয় রাজনীতিতে গাঁধীর প্রবেশের গােড়া থেকেই, ১৯১৫-১৯২০-র মধ্যে জিন্না কেবল গাঁধীকে প্রতিদ্বন্দ্বীই ভাবেননি, তাঁকে ‘ভণ্ড, ধাপ্পাবাজ, হুজুগে’ বলে মনে করেছেন। ইংল্যান্ডে তাঁদের অভিজ্ঞতা ছিল এক ধরনের, একই মানুষের সাহচর্য পেয়েছেন, সমর্থন ও সমাদর পেয়েছেন, আইনজীবী হওয়ার জন্য পড়াশােনা করেছেন। ভারতে উদারনীতির মধ্যপন্থী নেতা গােখলেরও সাহায্য পেয়েছেন দু’জনেই।” জিন্না ইংরেজ ‘জেন্টলম্যানের’ রীতিনীতি অভ্যস্ত করে ফেলেছিলেন এবং উদারপন্থার সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন। গাঁধীর দক্ষিণ আফ্রিকার দিনগুলাের ছবি থেকে বােঝা যায়, তিনিও কিছু দিন ইংলিশম্যানের পােশাক ও রীতিনীতি মেনেছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় ২১ বছর থেকে গাঁধী যখন ফিরে এলেন তত দিনে তিনি ইংলিশ জেন্টলম্যানের পরিচিতি ত্যাগ করেছেন, এবং তাঁর উদার চিন্তার সঙ্গে যােগ হয়েছে সাধারণ মানুষের নেতা হওয়ার দায়বদ্ধতা। ভারতের নগর ও গ্রামের সাধারণ মানুষদের এক জন হয়ে ওঠা।
জিন্না তাঁর থ্রি-পিস সুট, তাঁর সিগারেট হােল্ডার এবং সাহেবি ইংরিজির প্রতি অনুরক্ত থাকলেন বরাবর। গুজরাতি তাে নয়ই, কোনও ভাষাতেই ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে কথা বলা তাঁর ধরন ছিল না। জিন্না সংসদীয় রাজনীতিতে অত্যন্ত সফল ছিলেন, যে ধরনের রাজনীতি মধ্যপন্থী গােখলে ভাল পারতেন, চরমপন্থী তিলক যাকে ব্যঙ্গ করতেন। গাঁধী আলােচনামূলক, অহিংস রাজনীতির সঙ্গে মানুষের সাক্ষাৎ, সক্রিয় রাজনীতিকে মিলিয়েছিলেন সত্যাগ্রহে, এই ভাবে তিনি উদারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে চরমপন্থী রাজনীতির যােগ ঘটিয়েছিলেন। তাঁর রাজনীতি ছিল খােলা রাজপথের রাজনীতি এবং জনমতের রাজনীতি, সংসদের কক্ষ এবং ক্ষমতার অলিন্দের রাজনীতি নয়। গাঁধীজি প্রথমে সাধারণ মানুষের জামাকাপড় পরলেন, পরে তাও ত্যাগ করে। একেবারে দরিদ্রতম মানুষের ন্যূনতম কাপড় পরলেন, জিন্না ক্রমশ তাঁর প্রতি আরও বিরক্ত হলেন, তাঁকে ভণ্ড, হুজুগে নেতা বলে মনে করতে লাগলেন। জিন্না বহু দশক ধরে গাঁধীর সাধারণ মানুষের রাজনীতির প্রতিরােধ করে এসেছেন। তবে এও ঠিক, শেষ অবধি, ১৯৪৬-এর ১৬ অগস্টে, ডিরেক্ট অ্যাকশন’-এর ডাক দিয়ে নিজেই সেই হুজুগে, লােক-খ্যাপানাে নেতাই হয়ে উঠলেন, ঠিক যা তিনি গাঁধীর মধ্যে বিশেষ অপছন্দ করতেন। আগুন দিয়ে আগুনের সঙ্গে লড়াই করতে নামলেন, কিন্তু তা তাঁকে গাঁধীর কাছাকাছি নিয়ে এল না। একই সঙ্গে, বহু বছর ধরে জিন্না এক ধরনের সতর্ক শ্রদ্ধা অনুভব করতে শুরু করেন সেই মানুষটির জন্য, যিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময় ধরে তাঁকে কেবল ছাড়িয়ে গিয়েছেন, হারিয়ে দিয়েছেন। শেষের দিকে তিনি গাঁধীকেই অনুকরণ করতে শুরু করেন, যা কিনা প্রশংসারই আর এক মাত্রা বলে দেখা সম্ভব। কংগ্রেসে গাঁধীর মতােই, জিন্নাও লিগের একমাত্র মুখপাত্র হয়ে উঠতে চান।
কংগ্রেসকে জিন্না নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে দেখতে থাকেন। স্বাধীন ভারতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের ক্ষমতার লড়াইয়ের জন্যই দেশ ভাগ হয়েছিল। গাঁধী কিন্তু নেহরুর
৬৯
মতাে মনে করেননি যে স্বাধীন ভারতে কংগ্রেসেরই ক্ষমতা দখল করা দরকার। তিনি মনে করতেন, কংগ্রেস স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারক, গঠনমূলক কাজের বাহক। কংগ্রেস পার্টির কার্যকলাপে তিনি মােটেই আগ্রহী ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, তাঁর মৃত্যুর আগের দিন নিজের শেষ উইলে তিনি কংগ্রেস দল ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশে ক্ষমতার জন্য লড়াই করার চিন্তা, সেই ক্ষমতা প্রয়ােগের চিন্তা তাঁকে বিরূপ করে তুলেছিল। তিনি তাঁর শেষ উইলে কংগ্রেস সব নারী-পুরুষ সদস্যকে আহ্বান করেছিলেন লােক-সেবক সঙ্ঘ তৈরি করতে, যাতে তাঁরা নগর ও গ্রামে গঠনমূলক কাজ করতে পারেন। গাঁধী নাগরিক সমাজের মানুষ ছিলেন, যিনি ব্যক্তি ও জাতির স্বরাজের জন্য কাজ করেছিলেন, রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল ও প্রয়ােগ করার। জন্য নয়। সেটা চেয়েছিলেন নেহরু। এই পরিপ্রেক্ষিতেই গাঁধী মাউন্টব্যাটেনের কাছে বলেছিলেন, জিন্নাকে কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য আহ্বান করতে, এবং মুসলিম লিগকে সরকার তৈরি করার সুযােগ দিতে। গাঁধী চেয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা। কংগ্রেস শাসন তিনি চাননি। আর সেই কারণেই, তিনি জিন্নার কাছ থেকে সেই অবিশ্বাস এবং শত্রুতা পাননি, যে অবিশ্বাস ও শত্রুতার লক্ষ্য হয়েছিলেন নেহরু।
সরােজিনী নাইডু জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা স্মরণ করেছেন। এটা সেই সময়, যখন জিন্না সবে রাজনীতি বুঝতে শুরু করেছেন। ১৯০৬ সালে কলকাতা কংগ্রেসে (যে বছর ঢাকায় মুসলিম লিগের পত্তন হয়) জিন্না ছিলেন দাদাভাই নওরােজির ব্যক্তিগত সচিব, সেখানেই দাদাভাই প্রথম স্বরাজের ধারণার কথা বলেন। সে সময়ে জিন্নাকে উজ্জ্বল, তরুণ আইনজীবী এবং উদীয়মান রাজনীতিক হিসেবে ভাবা হচ্ছিল। দ্রুত তিনি নিজের জায়গা করে নিচ্ছিলেন। এর পর বেশ কয়েক বছর জিন্না নিয়মিত কংগ্রেসের বাৎসরিক বৈঠকে যােগ দিয়েছেন। যত দূর মনে পড়ে, মার্টিন গ্রিনের ‘গাঁধী: নিউ এজ রেভােলিউশনারি’ বইটিতে বলা হয়েছে, জিন্না এবং গাঁধী দু’জনেই সরােজিনী নাইড়র সুনজর লাভ করতে চেয়েছিলেন। আমার মনে হয় জিন্না এবং সরােজিনী নাইড় ইংল্যান্ডে একই সময়ে ছিলেন। জিন্না মঞ্চাভিনয় করার চেষ্টা করেছিলেন, হয়তাে তা পেশা হিসেবে নেওয়ার কথাও ভেবেছিলেন। সরােজিনী নাইডু এবং জিন্না দুজনেই শিল্পে আগ্রহী ছিলেন, সরােজিনী কবি ও লেখক হিসেবে, জিন্না নাটকে। গ্রিন এই প্রতিভাময়ী মেয়েটির পক্ষপাতের জন্য গাঁধী ও জিন্নার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা লিখেছেন। ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, সরােজিনী কিন্তু গাঁধীর দিকেই ঝুঁকেছিলেন।
কলকাতা কংগ্রেসে জিন্না দুটি বিষয়ে কথা বলেন, দুটিই মুসলিম-সম্পর্কিত বিষয়। তিনি তাে মুসলিম প্রতিনিধিই ছিলেন, তাই কী করে আর মুসলিমদের উপেক্ষা করতে পারতেন? প্রথম বক্তব্য ছিল ‘ওয়াকফ-ই-ঔলাদ’৩২-এর মান্যতা বিষয়ে, এবং দ্বিতীয়টি ছিল সংরক্ষণের বিষয়ে। তিনি মুসলিমদের স্বার্থে যুক্তি দেন, কিন্তু সেই সঙ্গে কংগ্রেসের মঞ্চকে মুসলিম স্বার্থে ব্যবহার করার সম্ভাবনার উপর জোর দেন, এবং তা-ও হিন্দুদের সঙ্গে মিলিত ভাবে। তাঁর প্রস্তাবিত সংশােধন কংগ্রেসের বৈঠকে গৃহীত হয়। | সে বছর অক্টোবরে তিনি আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ নেন। আগা খাঁ যে
৭০
ডেলিগেশন নিয়ে ভাইসরয়ের কাছে গিয়েছিলেন, তার প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা নিয়েই তিনি প্রশ্ন তুললেন। মনে করতেন, কংগ্রেস মুসলিমদের কিছু কম প্রতিনিধিত্ব করে না, বস্তুত কংগ্রেসই দেশের একমাত্র রাজনৈতিক কণ্ঠ।[৩৫] তিনি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীরও বিরােধিতা করেন একটি মেমােরেন্ডামের মাধ্যমে, যা তিনি বম্বে প্রেসিডেন্সি অ্যাসােসিয়েশনের মাধ্যমে লর্ড মিন্টোর কাছে পাঠিয়ে দেন। (গুজরাতি’ পত্রিকায় জিন্নার চিঠি, ৭ অক্টোবর ১৯০৬)৩৬
জিন্না সারা জীবন যাঁর বিরােধিতা করেছেন, সেই আগা খাঁ নিজের স্মৃতিকথায় পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বিষয়ে লিখতে গিয়ে বলছেন, “১৯০৬ সালে কে আমাদের সবচেয়ে সাহসী প্রতিপক্ষ ছিল ? বম্বের এক বিশিষ্ট আইনজীবী জিন্না। বরাবরই তিনি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতেন, কিন্তু এই সময়ে আমাদের সব কাজকর্মের তিক্ত বিরােধিতা শুরু করলেন তিনি। তিনিই ছিলেন একমাত্র সুপরিচিত মুসলিম যিনি এই অবস্থান নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর বিরােধিতার মধ্যে কোনও মিনমিনে ভাব ছিল না। তিনি বলেন যে আমাদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর নীতি দেশকে নিজের বিরুদ্ধে ভাগ করে দিচ্ছে। প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনিই আমাদের সবচেয়ে অনমনীয় সমালােচক ও বিরােধী রয়ে গেলেন।” [৩৭] ।
তার পর এল পরিবর্তন। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া কাগজে ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৯ একটি চিঠিতে জিন্না স্পষ্টই ভিন্ন অবস্থান নিলেন, এবং (প্রথম বার ?) স্বীকার করলেন যে মুসলিমরা “নতুন সংস্কারে বাস্তবিক এবং যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার অধিকারী।”[৩৮] কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, সেটা কী করে সম্ভব— “গ্রামীণ বাের্ড থেকে ভাইসরয়ের কাউন্সিল, সব স্তরেই কি পৃথক প্রতিনিধিত্ব থাকবে? যদি তার চেয়ে কম কিছু হয়, তবে কোন স্তর পর্যন্ত ?” জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলিমদের ২৫ শতাংশ অবধি সংরক্ষণ পাওয়ার কথা। কিন্তু এই ভাগ যদি এক-তৃতীয়াংশ অবধি করা যেত। তা হলে ধর্মভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের পুরাে সমস্যাটাই এড়ানাে যেত।”[৩৯] তা না হলে, “সংরক্ষণ ব্যবস্থা রেখে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।” বম্বেতে মুসলিমদের একটি বৈঠকে, ১৩ অগস্ট, ১৯০৯ সালে জিন্না বলেন যে, বম্বে আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধি পাঠানাের পথ যদি দুটিই হয়, এক, পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচন, দুই,। মনােনয়নের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্ণয়, সে ক্ষেত্রে প্রথম পথটিই গ্রহণ করা উচিত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংবেদনশীল বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি আরও বদলে গেল, যদিও খুব ধীরে। ১৯১০ সালে ২৬-২৯ ডিসেম্বর, কংগ্রেসের ২৫তম অধিবেশনে জিন্নার এই পরিবর্তন এবং তজ্জনিত তাঁর অস্বস্তি তাঁর আচরণে স্পষ্টই ধরা পড়ল। তত দিনে দেখা গেল, পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বিষয়ে তাঁর মত তাঁর ধর্মের অধিকাংশ মানুষের থেকে আর খুব আলাদা নয়। বেশ কিছু কংগ্রেস নেতার চাপে তিনি একটি প্রস্তাব আনলেন, যা সর্বসম্মতি অনুসারে গহীত হল, “কংগ্রেস মিউনিসিপ্যালিটি, ডিস্ট্রিক্ট বাের্ড এবং অন্যান্য স্থানীয় সংগঠনে পৃথক ধর্মীয় নির্বাচকমণ্ডলীর একান্ত বিরােধিতা করছে।”৪০ কিন্তু এই কাজ করার সময়ে তিনি স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে দ্বিধা করেন, এবং সংক্ষেপে কথা
৭১
বলেছিলেন: “আমি কোনও কথাই বলতে চাইনি, কিন্তু কংগ্রেসের বহু নেতার অনুরােধে আমি আপনাদের সামনে এই প্রস্তাব রাখছি।” কিন্তু তিনি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিরােধী ছিলেনও বটে। ১৯১৩ সালে মুসলিম লিগের আগ্রা অধিবেশনে জোর দিয়ে বলেন, ‘বিশেষ প্রতিনিধিত্ব’ বা ‘পৃথক প্রতিনিধিত্ব’ ভারতে কেবল দুটি ‘জল-অচল কক্ষ তৈরি করবে।[৪১] এখানেই তিনি দ্বন্দ্ব দেখেছিলেন, এমন দ্বন্দ্ব যার নিরসন অত্যন্ত কঠিন। কারণ, এক দিকে তিনি সংখ্যালঘু মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষা ব্যবস্থার বিরােধী ছিলেন না। তা না হলে তিনি কখনওই ‘ভারতের বাস্তব পরিস্থিতির পক্ষে উপযুক্ত স্বশাসন পাওয়াকে মুসলিম লিগের উদ্দেশ্য বলে সমর্থন করতেন না। অন্য দিকে, কী করে তিনি তাঁর নিজের বিশ্বাস, চরিত্র, এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি, আর তাঁর সমর্থকদের প্রতি (যারা বেশির ভাগই মুসলিম) একই সঙ্গে অনুগত থাকতে পারেন, সে প্রশ্নের বৃত্তে তিনি অনবরত ঘুরছিলেন।
১৯১০ সালের শরৎকালে জিন্না ভাইসরয়ের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে মুসলিম প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হলেন। হারালেন মৌলবি রফিউদ্দিনকে, যিনি বম্বে মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এই কাউন্সিলে যােগ দেওয়ার মাত্র এক মাস পরে জিন্না স্বয়ং ভাইসরয়, লর্ড মিন্টোর সঙ্গে উত্তপ্ত বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। নাতালে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক খাটানাের বিষয়ে এই বিতর্ক হয়। জিন্না বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি যে কঠোর ও নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হচ্ছে তা সব শ্রেণির ভারতীয়দের অনুভূতিকে ক্ষোভের চরমে পৌঁছে দিয়েছে।”[৪২] লর্ড মিন্টো প্রতিবাদ করে বলেন, “নিষ্ঠুর শব্দটা একটু বেশি কড়া হয়ে যাচ্ছে।” জিন্না নিজের অবস্থানে অবিচল থেকে উত্তর দেন, “মাই লর্ড, আমি আরও কঠিন শব্দ ব্যবহার করতে চাই, কিন্তু আমি এই কাউন্সিলের সংবিধানকে এক মুহুর্তের জন্যও অতিক্রম করতে চাই না, কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে ভারতীয়দের প্রতি যে ব্যবহার করা হচ্ছে তা যতটা কল্পনা করা যায় ততটাই কঠোর, এবং আগের মতােই আমি বলব, এ বিষয়ে দেশের মানুষ সম্পূর্ণ একমত।”[৪৩] সম্ভবত এই প্রথম ভাইসরয়ের মুখের উপর সরকারকে এত স্পষ্ট ভাবে সমালােচনা করা হল।
উত্তর ভারত থেকে যাঁরা ধর্মীয় নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের উপরে যে ধরনের চাপ থাকত, তা জিন্নার উপরে ছিল না। বম্বেতে যে, মুসলিমরা ভােটাধিকার পাওয়ার মতাে ধনী ছিলেন, তাঁরা ইসলামকে প্রধান বিবেচ্য বিষয় করে তুলতেন না। দেশভাগ অবধি বরাবর জিন্না বম্বে কনস্টিটিউয়েন্সি থেকে যে ভাবে বার বার নির্বাচিত হয়েছেন, তা কেবল মুসলিম ভােটের জোরে নয়, পার্সি এবং হিন্দুরাও তাঁকে ভােট দিত। ভাইসরয়ের কাউন্সিলে জিন্না সে যুগের বিখ্যাত মানুষদের পাশে জায়গা পেয়েছিলেন—কংগ্রেসের ভূপেন্দ্রনাথ বসু, দিনশ ওয়াচা, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী, মাজহার উল হক, তেজ বাহাদুর সপু এবং মদন মােহন মালব্য। এ ছাড়া মাহমুদাবাদের রাজা, স্যর আলি ইমাম, এদের সঙ্গেও জিন্নার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, যদিও তাঁদের রাজনৈতিক মতবাদ ছিল আলাদা।
কাউন্সিলে উদারনৈতিক সংস্কারের সমস্ত উদ্যোগ সব সময়েই জিন্নার সমর্থন
৭২
পেত, আর সেই সঙ্গে জাতির কাছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও তিনি তাঁর সমর্থন এগিয়ে দিতেন, যেমন গােখলের বুনিয়াদি শিক্ষা আইন (১৯১২), পরবর্তী কালে প্রাথমিক শিক্ষা আইন (১৯১৭), এবং অবশ্যই স্পেশ্যাল ম্যারেজ বিল[৪৪] যার প্রতি সংরক্ষণশীল ভারতীয়রা অত্যন্ত বিরূপ ছিলেন। তাঁর উৎসাহ সব সময়েই ছিল নব্য শিক্ষিত ভারতীয়দের কাছে নতুন সুযােগ নিয়ে আসার দিকে, যেমন, ভারত এবং ইংল্যান্ডে একই সঙ্গে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা নেওয়া হােক (১৯১৭)। এটা একটা দৃষ্টান্ত। এমন আরও ছিল।
১৯১১ এবং ১৯১২ সালে জিন্না কংগ্রেসের অধিবেশনে অংশ নেননি। যদিও তিনি তখনও খাতায়-কলমে সদস্য নন, তিনি মুসলিম লিগের ১৯১০ এবং ১৯১২ সালের অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলেন। এই সময়ে তাঁর দৃষ্টি পড়ে মুসলিম ওয়াকফের দিকে, এবং তিনি লিগের উপর এতটাই প্রভাব বিস্তার করেন যে তার সদস্য না হয়েও তিনি সংবিধান বদলাতে সফল হন। এর ফলে ১৯১৩ সালে তাঁর লিগে যােগ দেওয়ার পথটা সহজ হয়ে যায়।[৪৫]
১৯১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাঁকিপুরে মুসলিম লিগ কাউন্সিলের বৈঠকে যােগ দেওয়ার জন্য তাঁকে প্রথাগত ভাবে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তখনও তিনি কংগ্রেসের সদস্য। এই মিটিং-এ সভাপতিত্ব করেন আগা খান। এখানে মুসলিম লিগের উদ্দেশ্য। বিষয়ক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, যার চার নম্বর অধ্যায় ছিল, লিগের অন্যতম উদ্দেশ্য “ভারতের উপযােগী স্বশাসন ব্যবস্থা পাওয়া।” এর সপক্ষে কথা বলেন জিন্না, এবং ঠিক আদর্শকে সমাজের সামনে রাখার জন্য লিগের প্রশংসা করেন। যদিও তিনি কংগ্রেসের সদস্য, তবু তিনি বলেন যে এ ব্যাপারে কংগ্রেস ভুল পথে চলছে, তার থেকে লিগ বরং এগিয়ে আছে, লিগ তাই অভিনন্দনের যােগ্য। লিগের সরকারের প্রতি আনুগত্যের অবস্থান বদলে স্বশাসনের দাবি আনা খুব সামান্য সাফল্য নয়। নবাব ভিকর-উল-মুলক, মৌলভি মুশতাক হুসেন এবং নবাব আবদুল্লা খাঁর মতাে পুরনাে দিনের নেতাদের বিরুদ্ধে তাঁকে অনেক লড়াই করতে হয়েছিল। তবে তাঁর সমর্থকও ছিল, যেমন মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব এবং সৈয়দ ওয়াজির হাসান। আগা খাঁ-র নিরপেক্ষ অবস্থানও তাঁকে সাহায্য করেছিল। সরকার অবশ্যই এই অবস্থানে অত্যন্ত অখুশি হন এবং যুক্তপ্রদেশের তৎকালীন লেফটেনান্ট গভর্নর স্যর জেমস মেসটন ও ভাইসরয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য স্যর হারকোর্ট বাটলার চেষ্টা করেন যাতে জিন্না ও তাঁর সমর্থকরা যা করেছেন, সে সব বানচাল করতে। কিন্তু এত দিনে জিন্না সর্বভারতীয় স্তরে তাঁর প্রভাব বিস্তার করার মতাে অবস্থায় চলে এসেছেন।[৪৭]
১৯১৩ সালের এপ্রিলে গােখেলের সঙ্গে জিন্না পাড়ি দেন ব্রিটেনে, ছমাস থাকেন ভারতের বাইরে। সেই সময়েই ঘটে যায় কানপুর মসজিদের দুর্ঘটনা। শহরে দাঙ্গা শুরু হয়, প্রতিবাদ ছড়িয়ে যায় কানপুরের বাইরে। ইংল্যান্ডে সেক্রেটারি অব স্টেট এবং হােম গভর্নমেন্টের কাছে মুসলিমদের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য মুসলিম নেতারা মহম্মদ আলি জোহর এবং ওয়াজির হাসানকে প্রতিনিধি করেন। ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে
৭৩
মহম্মদ আলি জোহর জিন্নার সাহায্য পাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।[৪৯] জিন্না রাজি হন, কিন্তু বলেন যে ‘ভারতীয় ঐক্য’ নামক আরও বড় একটি ধারণার সমর্থন তিনি করবেন ভারতীয় প্রতিনিধিদের সময় না দেওয়ার জন্য সেক্রেটারি অব স্টেটের নিন্দাও করেন। জিন্না। আঞ্জুমান-ই-ইসলাম যখন প্রতিনিধিদের প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে স্বাগত অনুষ্ঠান করে, জিন্না তাতে অংশগ্রহণ করেন[৫০]। জিন্না এত দিনে বাস্তবিকই নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছেন। এক স্বাধীন চিন্তাধারার অনুসরণ করছেন, এবং কংগ্রেস নেতা ও লিগ নেতা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা স্বীকৃতি পেয়েছে। এই সময় তিনি যে কেবল কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে ঐক্য আনার চেষ্টা করছিলেন তাই নয়, তিনি মধ্যপন্থী ও চরমপন্থীদের মধ্যে সমঝােতারও চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। রাজনীতিতে এই সময়ে সব দলই তাঁকে মান্যতা দিয়েছে: চরমপন্থী, মধ্যপন্থী, মুসলিম, হিন্দু, পার্সি এবং অন্যান্যরা।
কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ, দুই নৌকোয়
১৯১৪ সালের শেষে, লন্ডন থেকে ফিরে আসার আগে জিন্না খাতায়-কলমে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগে যােগ দিলেন। ওই সংগঠনে তাঁর বন্ধুদের অনুরােধে তিনি যােগ দিতে রাজি হলেন। এই বিরল যৌথ-প্রতিনিধিত্বের জন্য প্রশ্ন উঠল সরােজিনী নাইডুর কাছ থেকে, যার ফলে জিন্নার পৃষ্ঠপােষকরা বিবৃতি দিলেন, “মুসলিম লিগ এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি আনুগত্য কোনও ভাবে, কোনও সময়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রতি আনুগত্যে ছায়াও ফেলবে না, যার জন্য তাঁর (জিন্নার) জীবন নিবেদিত।[৫১]
ভারতে ফিরে এসে জিন্না প্রথমে করাচিতে কংগ্রেসের আঠাশতম অধিবেশনে (১৩ ডিসেম্বর, ১৯১৩) যােগ দিলেন, তারপর তাড়াতাড়ি করে আগ্রা গেলেন মুসলিম লিগের সপ্তম অধিবেশনে যােগ দিতে (২৬-২৮ ডিসেম্বর)। তিনিই হয়তাে প্রথম ব্যক্তি যিনি কাউন্সিলে সংস্কারের জন্য একই প্রস্তাব কংগ্রেসের করাচি অধিবেশন এবং লিগের আগ্রা অধিবেশনে পেশ করেন। তাঁরই প্রণােদনায় কংগ্রেস লন্ডনে কাউন্সিল অব দ্য সেক্রেটারি অব স্টেট-এর গঠন এবং কর্তব্যে পরিবর্তনের জন্য বেশ উচ্চাশা-সম্পন্ন একটি প্রস্তাব নেয়। লিগের অধিবেশনে ধর্মানুসারে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর প্রস্তাবে উষ্ণ বিতর্ক তৈরি হয়। মৌলবী রফি-উদ্দিন এই প্রস্তাবনা করে বলেন, বেশি বিতর্ক ছাড়াই এই প্রস্তাব পাশ হওয়া উচিত, কারণ গত ছয় বছর ধরেই লিগের প্রতিটি অধিবেশনে এটা সর্বসম্মত ভাবে পাশ হয়ে আসছে। এই প্রস্তাব বলে: “মুসলমান জনগণের স্বার্থে সব ক’টি স্বশাসিত সরকারি সংস্থায় ধর্মানুসারী প্রতিনিধিত্বের প্রয়ােগ হওয়া দরকার, এবং মিউনিসিপ্যাল ও ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডে মুসলমানদের যথেষ্ট এবং কার্যকর প্রতিনিধিত্ব হল ইম্পিরিয়াল এবং প্রভিনশিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে এই নীতির প্রয়ােগেরই অপর দিক, এবং একই সঙ্গে এই সরকারি সংস্থাগুলির সফল ভাবে কাজ করার জন্য
৭৪
তা প্রয়ােজন।” পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর প্রস্তাব ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলিমদের ঐক্যে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে মহম্মদ আলি প্রস্তাব করলেন যে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা এক বছর মুলতুবি করা হােক, যেহেতু “হিন্দু ও মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াই শেষ বিচারে ভারতের স্বার্থ।” তিনি জোর দিয়ে বললেন যে হিন্দুরা যদিও এর আগে বরাবরই পৃথক প্রতিনিধিত্বের বিরােধিতা করে এসেছে ….. “কিন্তু এ বছর মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধাবশত কংগ্রেস এর বিরােধিতা করেনি। সুতরাং মুসলিমদেরও এটা দেখাতে হবে যে তারা হিন্দুদের দিকে অগ্রসর হতে রাজি আছে।”[৫৩] প্রস্তাবক মহম্মদ আলিকে জিন্না খুব জোরালাে ভাবে সমর্থন করলেন। তিনি মুসলিমদের বললেন “প্রশ্নটি আবেগহীন ভাবে চিন্তা করুন, কেবল বর্তমান লাভের কথা মাথায় রেখে নয়, ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদি সুবিধের কথা ভেবে।” তিনি তাঁর সহধর্মের মানুষদের সতর্ক করেছিলেন, “বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দাবি করার ফলে তারা কেবল দুটি জল-অচল কক্ষ পাবে।” আগা খাঁও মহম্মদ আলি এবং জিন্নার এই অবস্থানকে সমর্থন করেন, কিন্তু তা বিফল হয়, কারণ এই প্রস্তাব পরাজিত হয়, প্রস্তাবের পূর্বের সংস্করণটিই গৃহীত হয়।
ভাইসরয়ের কাউন্সিলে তিন বছর কাটানাের পরে জিন্না একটু অসন্তুষ্ট হতে শুরু করলেন। সরকারি সদস্যরা সৌজন্য দেখিয়ে প্রচুর বক্তৃতা শুনতেন, কিন্তু কিছুই করতেন না, করার প্রয়ােজনই অনুভব করতেন না। তা ছাড়া ওই কাউন্সিলের বাস্তবিক কোনও ক্ষমতা ছিল না। অসরকারি সদস্যরা বরাবরই ছিলেন সংখ্যায় কম, তাঁদের অধিকার ছিল কেবল বাজেট বিতর্কের সময় কথা বলা, প্রশ্ন করা, প্রাইভেট মেম্বারের বিল আনা, অবশ্যই সরকারি অনুমতিসাপেক্ষে। জিন্না তাই বিরক্ত হয়ে স্থির করলেন, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। যদিও ভাইসরয় তাঁকে ১৯১৩ সালের যে অধিবেশনে মুসলিম ওয়াকফ বোের্ড আইন পাশ হয়, সেটি পরিচালনা করার জন্য মনােনয়ন দিয়েছিলেন, তবু ১৯১৫ সালের আগে তিনি আর নির্বাচিত সদস্য হিসেবে কাউন্সিলে বসেননি। তাঁর মােহভঙ্গ আরও গভীর হল, এবং তিনি সংস্কারের জন্য কাউন্সিলের বাইরে কাজ করতে শুরু করলেনও কেবল কংগ্রেসের সঙ্গে নয়, মুসলিম লিগের সঙ্গেও। যদিও গােড়ার দিকে জিন্না মুসলিম লিগকে সংকীর্ণ বলে মনে করছিলেন, তাঁর কাজে খুব সুবিধে হল যখন লখনৌতে মাহমুদাবাদের রাজা সাহেবের মতাে নেতারা উঠে আসার জন্য, যাঁদের সঙ্গে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে কাজ করার সময় থেকেই জিন্নার পরিচয় ছিল। এই দলের মধ্যে ছিলেন লিগের সেক্রেটারি ওয়াজির হাসান, লখনউ মিউনিসিপ্যাল বাের্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ নবিউল্লাহ, লখনউ আদালতের আইনজীবী সমিউল্লাহ বেগ। রাজা সাহেব ছাড়া সকলেই আইনজীবী, এবং তাঁদের পেশায় সফল। ফলে তাঁরা জিন্নার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থক ছিলেন, কিন্তু প্রধানত রাজ্য স্তরে সংস্কারে আগ্রহী ছিলেন, তাঁর মতাে জাতীয় স্তর নিয়ে নয়। বাস্তববুদ্ধি দিয়ে তাঁরা বুঝেছিলেন যে রাজ্যস্তরের দাবিগুলিই সফল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, আর তা-ও যদি সেগুলিকে ‘জাতীয় স্বার্থের’ ছাতার তলায় দেখানাে যায়। লিগের সেক্রেটারি ওয়াজির
৭৫
হুসেন লিগের অবস্থান বদল করেন ১৯১২ সালে, এবং রাজা সাহেব মাহমুদাবাদের সঙ্গে তিনিই পরবর্তী বছরগুলিতে সংকটপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে লিগকে দক্ষতার সঙ্গে চালিত করেন, লিগকে জাতীয় রাজনীতির মধ্যস্থলে রাখতে সক্ষম হন। যুক্ত প্রদেশে লিগের লখনউয়ের নেতারা বিশেষ সম্মান পেতেন না, কারণ তাঁদের ‘কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতা’ নীতিকে অনেকে দুর্বল মনে করতেন, কংগ্রেসের কাছে নতিস্বীকার মনে। করতেন, এমনকী লিগের পক্ষে আত্মহননের সমান বলেও মনে করতেন।
১৯০৯ সালে কাউন্সিলের সংস্কার নির্বাচকমণ্ডলীর প্রসার ঘটাল, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাও বাড়াল। ফলস্বরূপ স্থানীয় সমস্যার অভিযােগ বৃদ্ধি পেল বহুগুণ, যা আগে চিন্তাও করা যায়নি। যারা শিক্ষিত, পেশাদার, কথা বলায় চৌকশ, তাঁরা নিজেদের অবস্থানের উন্নতি করতে রাজনীতি শুরু করলেন। দ্বিতীয়ত, প্রভিনশিয়াল কাউন্সিলে নির্বাচনকে মিউনিসিপ্যাল এবং ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের সদস্যদের ভােটের উপর নির্ভরশীল করে তােলার জন্য, এই স্থানীয় প্রশাসনিক সংগঠনগুলির সদস্যপদের জন্য প্রতিযােগিতা বেড়ে গেল। এর ফলে শুরু হল দলবাজি, ধর্মবিদ্বেষ, হিন্দু-মুসলিম বিভেদ। এই সব কিছুই শুরু হল সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলীর অস্তিত্ব সত্ত্বেও।
নিজের ধর্মসম্প্রদায়ে সংস্কার আনার চেষ্টা করতে গিয়ে জিন্না ক্রমশ স্থানীয় স্বার্থ বনাম জাতীয় স্বার্থের জটিল জালে জড়িয়ে পড়লেন, সেই সঙ্গে রাজনীতিতেও। এই জটিলতা দেশভাগ হওয়া অবধি চলল, বস্তুত তার পরেও চলেছে। দ্বন্দ্ব ছিল এই যে, জিন্নার ক্ষেত্র ছিল জাতীয়, তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় নেতা, তিনি সেখানে নিজের কণ্ঠ এবং ক্ষমতা দাবি করছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে ভাইসরয়ের অনমনীয়তা, রাজ্যগুলিতে সঙ্গীদের সহানুভূতিহীনতার সঙ্গে যুঝে, রাজ্যগুলির স্বার্থদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতে পারছিলেন না। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম থেকেই এই সমস্যার শুরু, আর তাঁর জীবনের শেষ দিন অবধি এর সমাধান হয়নি।
১৯১৪ সালের মধ্যে জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে জিন্নার সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। তিলক মান্দালয়ে তাঁর কারাবাসের মেয়াদ পূর্ণ করে ভারতে ফিরে এসেছেন, গাঁধীও ভারতের পথে। এই সময়ে জিন্নার সামনে এল সেই বিশাল চ্যালেঞ্জ, এ বার আর শুধু মধ্যপন্থী আর চরমপন্থীদের মেলানাের কাজ নয় নয়, হিন্দু আর মুসলিমদের ঐক্য তৈরি করা। এই জন্য গােখলে আর তিলকের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি করার চেষ্টা শুরু হল। জিন্না গােখেলের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি সাংবিধানিক সূত্র বার করার চেষ্টা করলেন, যা ভারতের নানা রাজনৈতিক স্বার্থকে যুক্ত করবে। গােখলে তেমন একটি সূত্র বার করেছিলেন, কিন্তু ১৯১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। তাঁর মৃত্যুর সময়ে সেটি ছিল কেবল খসড়ার পর্যায়ে। এই দরখাস্ত সূত্রটি ১৯১৭ সালে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসেন আগা খাঁ, লন্ডনে। এই ‘গােখলে স্কিম প্রতিটি রাজ্যের জন্য একজন গভর্নর এবং তাঁর ক্যাবিনেটে ছয় জন সদস্যের প্রস্তাব নিয়ে এল, যার তিন জন হবেন ভারতীয়, তিন জন ইউরােপীয়। প্রশাসন আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। পরিষেবাগুলিকে রাজ্যস্তরে নিয়ে আসা হবে। ভাইসরয় এবং তাঁর কাউন্সিলের কেবল
৭৬
নাম-কা-ওয়াস্তে ক্ষমতা থাকবে। জিন্না এই ফর্মুলায় সব রাজনৈতিক দলকে সম্মত করার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সেই সময়ে গােখলের মৃত্যুতে তাঁর খুব বড় ক্ষতি হয়ে গেল।[৫৪] সেই সময়ে খলিফার পদ বাতিল করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটিও বড় হয়ে উঠল। এর ফল কী হবে, সে বিষয়ে সম্ভবত জিন্নাই প্রথম ভারতীয় নেতা যিনি ব্রিটিশ সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। ১৯১৬ সালে, তিনি ছিলেন মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট। ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি আবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েডকে বলেছিলেন, এর কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে। ১৯২০ সালের জানুয়ারিতে তিনি ভাইসরয়, লর্ড চেমসফোর্ডের কাছে প্রেরিত প্রতিনিধি দলের এক জন সদস্য ছিলেন। খিলাফত সভা থেকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরিত হল, কিন্তু তাদের তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯২০ সালের ১৫ মে সেভ-এর সন্ধি স্বাক্ষরের ফলে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে গেল। আর ঘটনাচক্রে এর ঠিক বারাে দিন পরে হান্টার কমিটির রিপাের্ট বার হল ১৯১৯ সালের এপ্রিলে পঞ্জাবের ঘটনার বিষয়ে, যাতে কর্নেল ডায়ারকে অতিসামান্য সাজা-সহকারে মুক্তি দেওয়া হয়। এই দু-মুখাে চাপে ভারতের জনমত উত্তপ্ত হয়ে উঠল। এই উত্তাপেরই প্রকাশ, মুসলিম লিগ এবং কংগ্রেসের যৌথ আহ্বানে কলকাতায় বিশেষ অধিবেশন, ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।[৫৫]
এই বিশেষ অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২০ সালে জিন্না ডায়ারের সমর্থনে হাউস অব লর্ডস-এ পাশ করা সিদ্ধান্তটির নিন্দা করেন। চেম্বারের সদস্যদের তিনি বলেন, “ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজ আসলে বুদ্ধিহীন রক্ত দিয়ে তৈরি।” ভারতীয়রা অসহযােগিতা করলে তার ফল কী হবে, সে সতর্কবাণীও তিনি ছুঁড়ে দেন, যদিও গাঁধীজি যে অর্থে সতর্ক করছিলেন, সে অর্থে নয়।
কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে একমাত্র মােতিলাল নেহরুই গাঁধীজির অসহযােগিতার আন্দোলনকে সমর্থন করেন। লালা লাজপত রায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপিনচন্দ্র পাল, অ্যানি বেসান্ত, মালব্য এবং জিন্না, সকলেই গাঁধীর বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তবু গাঁধীজির প্রস্তাবই গৃহীত হয়। কলকাতায় কংগ্রেসের এই বিশেষ অধিবেশনই কংগ্রেসে গাঁধীযুগের সূচনা করে।[৫৬] গাঁধীজির অসহযােগিতার প্রস্তাব গৃহীত হয় ১৮৮৬ ভােটে, বিপক্ষের ভােট ছিল ৮৮৪। স্পষ্টতই এখন গাঁধী আর জিন্নার মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল কেবল সময়ের প্রশ্ন, যা ঘটল ১৯২০ সালের ৩ অক্টোবর। হােম রুল লিগের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অ্যানি বেসান্ত পদত্যাগ করেন, গাঁধীজি নতুন প্রেসিডেন্ট হন। কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবের সঙ্গে হােম রুল লিগের উদ্দেশ্যের সমন্বয় সাধনের জন্য গাঁধী তার প্রকৃতি, এবং নামও পালটাতে চান। জিন্না তাঁকে বাধা দিয়েও ব্যর্থ হন, এবং প্রতিবাদ করার জন্য তিনিও হােম রুল লিগ থেকে পদত্যাগ করেন।[৫৭]।
নাগপুরে কংগ্রেসের ৩৫তম অধিবেশন (২৬-৩১ ডিসেম্বর, ১৯২০) তার প্রকৃতির পরিবর্তনের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিল, এক বছরের মধ্যে স্বরাজ লাভের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করা হল। জিন্নাই ছিলেন একমাত্র প্রতিবাদী কণ্ঠ। তিনি সাহসের পরিচয় দিয়ে মঞ্চে উঠে প্রশ্ন তুললেন, স্বরাজ বলতে কী বােঝা হচ্ছে। আর অসহযােগিতার পন্থাকে তিনি
৭৭
অরাজনৈতিক এবং যুক্তিবিরুদ্ধ বলে আখ্যা দিলেন। মুসলিম লিগের একটি অধিবেশন, যা একই সময়ে এম এ আনসারির সভাপতিত্বে নাগপুরে ডাকা হয়েছিল, অসহযােগিতার প্রতি মুসলিম লিগের সমর্থন জানাল, এবং কংগ্রেসের অবস্থানের পরিবর্তনকে সমর্থন জানিয়েও আর একটি প্রস্তাব গৃহীত হল। মনে হল যেন সকলেই গাঁধীকেই অনুসরণ করছে। জিন্না বুঝলেন, সে দিনটি ‘তাঁর’ দিন নয়, তাই পত্রপাঠ নাগপুর ছেড়ে চলে গেলেন।[৫৯]
কার্যত গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের আমদাবাদ অধিবেশন (১৯২১) পৌছল তার শেষ পরিণামে। এই অধিবেশনে অভ্যাগতদের জন্য কোনও টেবিল-চেয়ার ছিল না। সকলকে মাটিতে বসতে হল। সকলে খাদি পরিধান করেছিলেন, খাদির তৈরি তাঁবুতে ছিলেন, সকলকে খাদি সুতাে কাটতে হচ্ছিল। জিন্নাও আমদাবাদে উপস্থিত ছিলেন, এবং শেষ বারের জন্য কংগ্রেসের অধিবেশনে যােগ দিচ্ছিলেন। তিনিই সম্ভবত ছিলেন একমাত্র প্রতিনিধি যিনি কলার-টাই-সহ বিদেশি পােশাক পরেছিলেন, এবং যাঁকে চরকা কাটতে দেখা যায়নি।
১৯১২-১৯১৮, এই ছয় বছর জিন্না এবং লখনউয়ের রাজনৈতিক নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতার নীতি অনুসরণ করছিলেন, কিন্তু আঞ্চলিক স্তরে সংঘাত তাদের চেষ্টায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল। ১৯১৩ সালে আগ্রা অধিবেশনে জিন্না এবং মজহর উল হক লিগকে বােঝানাের চেষ্টা করেছিলেন, যাতে চিরাচরিত রীতিতে স্থানীয় প্রশাসনে পৃথক সাম্প্রদায়িক নির্বাচক মণ্ডলীর প্রস্তাব না নেওয়া হয়। আগের মতাে সে বারেও ‘মিউনিসিপ্যালিটি পলিটিশিয়ানরা সে প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। দু’বছর পরে বােম্বেতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের বৈঠক হল, এই প্রথম দুটি সংগঠনের বৈঠক এক শহরে হল। সে বারও স্থানীয় রেষারেষিতে সংস্কারের প্রশ্নে দুই শিবিরের এক অবস্থানের সম্ভাবনা খারিজ হতে বসেছিল। জিন্না ও তাঁর সহযােগীরা কাসিম মিঠা[৬০] তাঁর সহকারীদের পিছনে ফেলতে তাজমহল হােটেলে দরজা বন্ধ করে প্রাইভেট অধিবেশন করেছিলেন। ১৯১৫ এবং ১৯১৬ সালে যখন ইউনাইটেড প্রভিন্স মিউনিসিপ্যাল বিল প্রস্তাবিত হল, তখন স্থানীয় স্বার্থ পুরাে মাত্রায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। যেহেতু এই প্রস্তাবিত আইনটি স্থানীয় স্তরে ক্ষমতার হস্তান্তরের কথা বলেছিল, তাই যারা ক্ষমতার অভিলাষী, তাদের মনে হতে লাগল যে মিউনিসিপ্যালিটির ক্ষমতা এ বার হাতের মুঠোয় এসে গিয়েছে। ফলে ‘পৃথক বনাম অভিন্ন নির্বাচকমণ্ডলী’ বিতর্কটি যেন আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। স্থানীয় ক্ষমতাবান মানুষরা রাজ্যস্তরে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন চাইল, তাতে স্থানীয় স্তরে আঞ্চলিক ক্ষমতা পেতে সুবিধে হবে বলে। জিন্না অবশ্য যুক্ত প্রদেশে ক্ষমতা নিয়ে এই রেষারেষির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যদিও তিনি ১৯১৬ সালে লখনউতে জাতীয় স্তরের সমঝােতার অংশ ছিলেন।[৬১] কিন্তু এই সব স্থানীয় রেষারেষির ফলে তিনি দরদস্তুর করার ক্ষমতা অনেকটাই হারালেন। এবং তা এতটাই যে শেষ অবধি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ উলটে গেল। ১৯১৩ সালে যিনি আবেগের সঙ্গে অভিন্ন নির্বাচকমণ্ডলীর সমর্থন করতেন, ১৯১৬ সালে তিনিই
৭৮
কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে প্রবল তর্ক করতে লাগলেন এই বলে যে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বিষয়ে মুসলিমদের দাবি না মেনে নিলে কোনও ঐকমত্যে আসা যাবে না। এই সময় থেকেই ‘মুসলিম নেতা’ জিন্নার আবির্ভাব শুরু হল, যার কারণ ছিল দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, তাঁর নিজের জাতীয় রাজনীতি, এবং জনমানসে তাঁর অবস্থিতি।
জিন্নার কাছে এর অর্থ কী দাঁড়াল? প্রথমত, হিন্দু-মুসলিম সহযােগিতার যে নীতি তিনি ১৯১৬ সালের লখনউ সন্ধিতে স্থাপন করলেন, তা তাঁর কাছে ব্যক্তিগত ভাবে। হতাশাজনক হয়েছিল। যদিও সর্বভারতীয় স্তরে তাতে জিন্নার অবস্থান আরও দৃঢ় হয়েছিল, কিন্তু তা ছিল ‘মুসলিম হিসেবে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত হিসেবে নয়। তা। সত্ত্বেও, তাঁর এই অবস্থান বজায় রাখতে এবং সর্বভারতীয় স্তরে সংস্কারের সম্ভাবনা বজায় রাখতে তাঁকে আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে। কেবল সেই ভাবেই তিনি জাতীয় এবং আঞ্চলিক স্তরে সংস্কারের নীতি চালিয়ে যেতে পেরেছেন।
সরকারের প্রতিক্রিয়া? সরকার ঠিক করল, জাতীয় স্তরে অটল থাকা, এবং আঞ্চলিক স্তরে সামান্য বদান্যতা দেখানাে, এই হল পথ। মন্টেগু-র ভারতে আসা অবধি কংগ্রেস এবং লিগকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার কোনও রাজনৈতিক সুফল পাননি জিন্না।[৬২] এ বিষয়ে তাঁর নিজের ক্ষোভ স্পষ্ট। ১৯১৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে তাঁর বক্তৃতা থেকে তা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে: “মাই লর্ড, আমি কি জানতে পারি কেন ভারত সরকার এত পবিত্র হয়ে থাকবে যে তাকে স্পর্শ করা চলবে না? সরকারের কোনও এমন বিভাগ কি নেই যা আইনসভার অধীনে আনা যায়? আমি জিজ্ঞাসা করছি, কেন একই সঙ্গে অগ্রগতি হবে না?”[৬৩]
এই সংস্কারের পরে ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটে, যদিও তার প্রায় সবটাই কেবল আঞ্চলিক স্তরে। সংস্কারের জন্য জিন্না এবং অন্যান্য অধ্যাপক, আইনজীবী, ডাক্তারদের কঠিন পরিশ্রম সত্ত্বেও স্পষ্টতই কোনও লাভ হয়নি। সাম্রাজ্যবাদের যুক্তিতেই তা সম্ভব ছিল না, কারণ তাঁদের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর হলে কেন্দ্রীয় সাম্রাজ্যবাদী কর্তৃত্ব এবং প্রশাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ত। বাস্তবে, এই ক্ষমতার হস্তান্তর এমন ভাবে পরিকল্পিত হল যে তা ব্রিটিশদের সনাতন সমর্থক অর্থাৎ গ্রামের জমিদার শ্রেণির ক্ষমতাই বৃদ্ধি। করল। এর ফলে মুসলিম লিগের শহরবাসী, পেশাজীবী নেতারা অনেকে আশাহত হয়ে রাজনীতি থেকে সরে এলেন। যেমন ওয়াজির হুসেন, যিনি ১৯২০ সালের পর থেকে ক্রমশ নিজের আইনজীবী পেশার প্রতি বেশি মনােযােগ দিলেন এবং বিক্ষোভের পথ নিলেন। কিন্তু তত দিনে বিক্ষোভের মঞ্চও চলে গিয়েছে তাঁদের হাতের বাইরে। এর পর থেকে বিক্ষোভের এবং প্রতিবাদের রীতি কংগ্রেসের কুক্ষিগত হয়ে পড়ল, ১৯৪০এর দশকের মাঝামাঝি অবধি।
৭৯
জিন্না: সাংবিধানিক সংস্কারক
স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চোখ বােলালেই বােঝা যায়, হিন্দু এবং মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক ঐক্য সব সময়েই সাংবিধানিক সংস্কারের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছ। যখনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্ভব হয়েছে, তখনই ব্রিটিশ রাজ সংস্কার করেছে, কারণ হিন্দুমুসলিম ঐক্য ব্রিটিশদের অত্যন্ত ভীত করে তুলত।
১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার যখন শেষ অবধি কার্যকর হল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তখন সামান্য হলেও তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ছাড়ল। এই ঘটনার জন্য নানা কারণের মধ্যে কংগ্রেস ও লিগের যৌথ অবস্থানের চাপও ছিল অন্যতম। সেই চাপ না থাকলে ব্রিটিশদের এমন উদ্যোগের তেমন সম্ভাবনা ছিল না।
এই যৌথ অবস্থানের জন্য জিন্নার অবদান ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। লিগ এবং কংগ্রেসের আদর্শগত ঐক্য তৈরি জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন, সফলও হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনিই এই দুই সংগঠনকে ইন্ডিয়ান কাউন্সিলের সংস্কারের প্রতি দায়বদ্ধ করেন, কারণ তিনিই কংগ্রেসে ও লিগে কাউন্সিল সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। এর উদ্দেশ্য ছিল কাউন্সিলে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ ভারতীয় সদস্য, যাদের নির্বাচন করবেন ভারতের কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক আইনসভার সদস্যরা। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই প্রস্তাব রেখেছিলেন। ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট। এর সপক্ষে সওয়ালের জন্য জিন্নার নেতৃত্বে এবং তাঁরই উদ্যোগে ভারত থেকে প্রতিনিধিদের একটি দল ব্রিটেনে যায়। তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড ক্রিউয়ের আনা প্রস্তাব হাউস অব কমনস পাশ করে, কিন্তু হাউস অব লর্ডস বাতিল করে দেয়। এর আরও নানা অপ্রিয় ফল হয়। জিন্নার হতাশা আরও বাড়ে, কারণ ব্রিটিশ রাজ প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশন নির্ধারিত দিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার যুক্তি দেখিয়ে ডিসেম্বর ১৪, ১৯১৪ থেকে পিছিয়ে দেন। কেবল জিন্না নন, অন্যদের কাছেও এই অসঙ্গত যুক্তি এবং আদেশ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
জিন্না এখন মুসলিম লিগের কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে আরও প্রবল চেষ্টা শুরু করলেন, যাতে বম্বেতে মুসলিম লিগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর প্রচেষ্টার বিরােধিতা করেন ব্রিটিশ সমর্থকরা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন হাজি কাসিম মিঠা এবং মৌলানা রফিউদ্দিন। তাঁরা প্রধানত বম্বের গভর্নর লর্ড ওয়েলিংডনের কথা অনুসারে কাজ করছিলেন। জিন্নার চেষ্টায় শেষ অবধি ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে লিগ এবং কংগ্রেসের অধিবেশন একই শহরে অনুষ্ঠিত হয়, সেই প্রথম বার।।
এই অধিবেশনগুলিতে দুটি প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে সহযােগিতার মনােভাব বিরাজ করত। এই সব অধিবেশনে পৃথক কমিটির আহ্বান করতেন, যেগুলি আলােচনা করে একটি সাংবিধানিক ফর্মুলা তৈরি করত, সংস্কারের পরবর্তী ধাপের জন্য। এই সব বৈঠকগুলির জন্যও জিন্না একনিষ্ঠ ভাবে পরিশ্রম করে যেতেন। এই সব উদ্যোগ থেকে গােখলের সেই বিখ্যাত উক্তি উঠে এসেছিল— ‘জিন্না হলেন হিন্দু
৮০
মুসলিম ঐক্যের দূত। পরে, লখনউ সন্ধির সময়ে জিন্না এই উপাধির যথেষ্ট ফায়দা তুলেছিলেন। তিলকের মতাে নেতাকে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিষয়ে রাজি করানােও ছিল জিন্নার কৃতিত্ব, যার জন্য পরে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতাে নেতাদের রাজি করানাে গিয়েছিল, যাঁরা এর ঘােরতর বিরােধী ছিলেন।
জিন্না অক্টোবর ১৯১৬ সালে ষােড়শ বম্বে প্রভিনশিয়াল কনফারেন্সের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। এম আর সায়ানির পরে তিনিই ছিলেন দ্বিতীয় মুসলিম যিনি এই পদটি পেলেন। সভাপতির ভাষণে জিন্না সংবিধানের কেন্দ্রীয় এবং আঞ্চলিক দিকগুলির বিষয়ে কথা বললেন, যা পরে ডিসেম্বরে লখনউতে গৃহীত হয় এবং লখনউ সন্ধি বলে পরিচিত হয়। কংগ্রেস এবং লিগের সংস্কারের যৌথ প্রস্তাবগুলির এটাই ছিল প্রথম, যার মূল ধারণা ছিল যে দুটি দলই একসঙ্গে যথাসম্ভব শীঘ্র স্বরাজ পাওয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করে যাবে। জিন্নার উদ্যোগেই লখনউতে একটি যৌথ কমিটি তৈরি হয়, যা ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করার জন্য একটি বিল তৈরি করে। সে উদ্দেশ্যে একটি যৌথ ডেপুটেশনেরও পরিকল্পনা করা হয়।
এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হয়নি, যেহেতু ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ চলাকালীন কোনও ভারতীয় রাজনীতিককে সুযােগ দেওয়ার অবস্থায় ছিল না। তার বদলে সিদ্ধান্ত হয়, ভারতের সেক্রেটারি অব স্টেট এডউইন এস মন্টেগু ভারতে আসবেন এবং নানা মতামত খতিয়ে দেখবেন। তিনি ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ভারতে আসেন, প্রায় ছয় মাস থেকে ১৯১৮ সালে ফিরে যান। তার মধ্যেই তাঁর সাংবিধানিক রিপাের্ট লেখা হয়ে গিয়েছিল, যা ১৯১৮ সালে জুলাইয়ের গােড়ায় প্রকাশিত হয়।
এই সময়ে জিন্না দুটি হােম রুল লিগের নেতা হিসেবে কাজ করছিলেন। দু’দলেরই আস্থা ছিল তাঁর উপর, যার ফলে তিনি মন্টেগুর কাছে তিনটি যৌথ ডেপুটেশন নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। প্রথমটির নেতা ছিলেন তিলক, কংগ্রেস এবং লিগ দুয়েরই তরফে। পরেরটির নেতা ছিলেন মিসেস বেসান্ত, দুটি হােম রুল লিগের তরফে। তৃতীয়টির নেতৃত্ব দেন জিন্না নিজে, বম্বে প্রভিনশিয়াল হােম রুল লিগের তরফে। জিন্না অবশ্যই প্রথম দুটো ডেপুটেশনেরও সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও জিন্না বেশ কিছু উপলক্ষে মন্টেগুর সঙ্গে দেখা করেন সংবিধান সংশােধনের জন্য। তাঁর অবদান, দক্ষতা এবং অন্যান্য গুণের কথা মন্টেগুর ‘অ্যান ইন্ডিয়ান ডায়েরি’ বইয়ে যথেষ্ট স্বীকৃতি পেয়েছে।
মন্টেগু রিপাের্ট প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে ভারতীয় নেতাদের মধ্যে গুরুতর মতপার্থক্য দেখা দিল। জিন্না বেশ কিছু আলােচনার মাধ্যমে সেগুলির সমাধান করে ঐকমত্যে পৌছন, যার ফলে পার্লামেন্টে পেশ হওয়ার আগে ওই রিপাের্টে নানা সংশােধন দাবি করতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের যৌথ প্রতিনিধিদল লন্ডনে পৌঁছয়। দুর্ভাগ্যবশত, যুদ্ধ চলার কারণে ব্রিটিশরা তখন এই ধরনের কোনও প্রতিনিধি দলকেই সুযােগ দিতে রাজি ছিল না। তারা ভারতের লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে এ নিয়ে সীমিত আলােচনা চাইল, কিন্তু জিন্না তাতে রাজি ছিলেন না। তাদের শান্ত করতে এবং একটা সমঝােতার উপায়স্বরূপ সরকার আবার একটা কমিটি গঠন করল।
৮১
জিন্না কখনওই মন্টফোর্ড রিপাের্টকে স্বরাজের দিকে তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ বলে। মনে করেননি। তাঁর কাছে আঞ্চলিক স্বক্ষমতা অনেকটাই নির্ভর করছিল কতটা ক্ষমতা কেন্দ্রে এবং কতটা রাজ্যের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে, সেই দ্বৈত প্রশাসন ব্যবস্থার গঠনের উপর। তিনি ঠিকই আশঙ্কা করেছিলেন যে একটি অপরিণত দ্বৈত ব্যবস্থার ফলে ভারতীয় মন্ত্রীরা, কেবল দর্শক হয়েই থেকে যাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে দেশের কিছু কিছু অঞ্চল নিজেদের কাজ নিজেরা সামলানাের দক্ষতা রাখে, সুতরাং সেখানে সব ক্ষমতাই ভারতীয়দের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। যে প্রস্তাব কখনওই গ্রহণযােগ্য ছিল না, তা হল আইনসভায় কোনও আইন বা আইনের প্রস্তাবকে খারিজ করে দেওয়ার ক্ষমতা আঞ্চলিক গভর্নরদের হাতে তুলে দেওয়া। ১৯২০ সালের অগস্ট মাসের ঘােষণায় বলা হয়েছিল ‘দায়িত্বশীল প্রশাসনের কথা, যার অর্থ জিন্নার কাছে। সম্পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর, কারণ তাঁর কাছে দেশের স্বাধীনতা এবং দায়িত্বশীল প্রশাসন ছিল অভিন্ন দুটি শব্দ।
আইনসভায় সরকারের প্রতিনিধিরা এই ধরনের কথায় স্বভাবতই বিচলিত হয়েছিলেন। কিন্তু জিন্নার মতাে মানুষদের অবশ্য এটা কোনও বাধা বলে মনে হয়নি। ১৯১৯ সালের জানুয়ারিতে বম্বেতে সাউথ বারাে কমিটির কাছে মন্টেগু-চেমসফোর্ড রিপাের্টকে সংশােধন করার এই প্রস্তাবগুলি আনা হয়েছিল। কিন্তু সে বছর অগস্টে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে জিন্নার বক্তব্য ছিল অনেক বিশদ ও সােজাসাপটা। পার্লামেন্ট এই কমিটি তৈরি করেছিল গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া বিল (১৯১৯) সংশােধন করার জন্য, যে উদ্দেশ্যে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলােচনা করছিলেন তাঁরা, যাঁদের পরে লন্ডনে ডেকে সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
আশ্চর্য ব্যাপার, যখন তাঁর সহকর্মীরা ভারতের স্বাধীনতার কথা ভাবতে রাজি ছিলেন না, জিন্না কিন্তু স্বাধীন ভারতের দিকে যাওয়ার জন্য তাঁর সংবিধান-আশ্রিত ধারণাগুলিকে জোরালাে ভাবে এগিয়ে দিতে শুরু করেন। প্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সিভিল সার্ভিস, সব বিভাগের ভূমিকাই তিনি বিশদ ভাবে বুঝিয়ে দেন। কমিটির কাছে তাঁর যুক্তি ছিল—
তবে কি আজ আমরা দায়িত্বশীল সরকার চাইছি, যদিও আমাদের জনগণের মাত্র ১০ শতাংশ নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হতে পারে? না, আমরা তা চাইছি না। কানাডায় আপনারা কী দেখছেন? সেখানে যখন সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানকার মানুষের পুরসভাতেও ভােট দেবার অধিকার ছিল না। … সুতরাং আমি বলছি যে, আমাদের নির্বাচকমণ্ডলী নেই এটা কোনও যুক্তি নয়। এমন যুক্তির কোনও প্রয়ােজন নেই।
জিন্না চেয়েছিলেন একটি ফেডারেল ব্যবস্থা, যেখানে অবশিষ্ট ক্ষমতাগুলি থাকবে
৮২
রাজ্যের হাতে। সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়ার দফতরটির তখন যে আকার ছিল, তিনি তার পক্ষে ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, ভাইসরয় এবং গভর্নরদের হাতে একতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকা উচিত নয়। কেবলমাত্র জননিরাপত্তা এবং পুলিশি প্রশাসনের বিষয়ে তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে, কিন্তু তাঁদের আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ করতে হবে। আইনসভাই আর্থিক ক্ষমতা-সহ সব ক্ষমতার অধিকারী হবে। আঞ্চলিক এবং কেন্দ্রের আইনসভায় সদস্য মনােনয়ন প্রথা বন্ধ করতে হবে, সব আসনই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণ করা হবে, যে নির্বাচনে অংশ নেবেন জনসংখ্যার ১০-১২ শতাংশ মানুষ। নানা প্রস্তাবের মধ্যে এও বলা হয়েছিল যে ইংল্যান্ডের জনজীবনে যাঁরা উজ্জ্বল, তেমন মানুষদের মধ্য থেকে গভর্নর বাছা হােক, যাতে তাঁরা ভারতের সমাজে নতুন চিন্তা আনতে পারেন। আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে দেওয়া হােক, যারা আঞ্চলিক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে পারেন, গভর্নরের কাছে নয়। পরে ১৯৩৫ সালে গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া বিলের যে সংশােধন তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, সেগুলাে ছিল প্রায় এই একই।
এর পর অবশ্যই গাঁধীর সংস্কারের ব্যাপারে জিন্নার সঙ্গে একমত হননি, নিজের রাস্তা খুঁজে বার করছিলেন এবং আইন অমান্য ও সত্যাগ্রহের পদ্ধতি নিয়েছিলেন। কিন্তু এটা ঠিকই যে, ১৯২০ সাল অবধি জিন্না ভারতীয় রাজনীতির মধ্যে নানা শক্তিকে ধরে রেখেছিলেন, এবং একই সঙ্গে সরকারের উপরও চাপ বজায় রেখেছিলেন। গাঁধীর পদ্ধতির জন্য এই চাপ কমে গেল, এবং ব্রিটিশ রাজ আরও তিন বছরের জন্য ভারতে কায়েম রইল।
গাঁধী এবং জিন্না: দুই পরস্পরবিরােধী কাথিয়াবাড়ি
এর আগে আমরা খুব সংক্ষেপে এই দুই মহৎ কিন্তু পরস্পরবিরােধী ভারতীয়ের কথা বলেছি, দুজনেই কাথিয়াবাড়ি বণিক সম্প্রদায়ভুক্ত, কিন্তু এ ছাড়া আর তেমন কিছু সাদৃশ্য তাঁদের মধ্যে নেই। এক জন একান্ত ভক্তিমান হিন্দু, অন্য জন ইসলামের সমর্থক, তবে তীব্র নয়। এক জন ধর্মকে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছিলেন, অন্য জন নৈতিক কারণে সেই ব্যবহার থেকে দূরে থাকতেন। গাঁধী বাস্তবিকই টলস্টয় দ্বারা প্রভাবান্বিত মানুষ (দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর বসতির নামও তিনি দিয়েছিলেন টলস্টয়ের নামে), এবং জিন্না কেবলমাত্র নিজের ওপর দাদাভাই এবং গােখলের প্রভাব স্বীকার করতেন। গাঁধী তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও জনসমক্ষে নিয়ে এসেছিলেন, জিন্না তাঁর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কেও গােপনীয়তা বজায় রাখতেন। এঁরা দু’জন নানা ভাবে কেবল যে স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিলেন, তা-ই নয়, তাকে নিজের নিজের মতাে করে আকারও দিয়েছিলেন। গাঁধী সর্বদা নিজের ব্যর্থতার কথা বলতেন,
৮৩
জিন্না সম্পর্কে বলা হয় তিনি নাকি বলতেন “কেবল একটা টাইপরাইটার আর এক জন কেরানির সাহায্যেই তিনি পাকিস্তান জিতে নিয়েছিলেন। এই দুই মহান ভারতীয়কে বােঝা এক অসাধারণ মনােগ্রাহী প্রয়াস। অধ্যায়ের এই অংশটি তার একটি রূপরেখা মাত্র।
যদিও কাথিয়াবাড়ে গাঁধী ও জিন্নার পরিবার মাত্র ৪০ কিলােমিটার দূরত্বে বাস করত, এই নিকটত্ব রাজনীতিতে তাঁদের কাছে আনেনি। ১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে গুর্জর সভায় তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়, গাঁধীকে অভিনন্দন জানানাের জন্য সেই সভার আহ্বান করা হয়েছিল। স্বাগত ভাষণের উত্তরে গাঁধী বলেছিলেন, তিনি “এক জন মুসলিমকে তাঁর নিজের অঞ্চলের সভায় অংশগ্রহণ করতে শুধু নয়, সভাপতিত্ব করতে দেখে খুশি হয়েছেন। জিন্না চেহারা, পােশাক, কিছুতেই বাঁধা গতের মুসলিম ছিলেন না, তবু গাঁধী তাঁকে মুসলিম বলে আলাদা করে নির্দিষ্ট করলেন। জিন্না অবশ্য গাঁধীর প্রতি অনেক বেশি সপ্রশংস ছিলেন।
গাঁধী জাহাজে করে জানুয়ারি, ১৯১৫ সালে ভারতে পৌছলে জিন্না এবং গােখলে সহ ভারতের বহু নেতা বম্বে যান তাঁকে স্বাগত জানাতে। এই সময়ে জিন্না সর্বভারতীয় নেতা বলে পরিচিত, তিনি যে শুধু হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উদ্দেশ্যে কাজ করছেন তা নয়, শুধু নরমপন্থী ও চরমপন্থী ঐক্যের উদ্দেশ্যেও নয়, ভারতের নানা শ্রেণির মধ্যে ঐক্যসাধনের কাজ করতেন তিনি। গাঁধীকে স্বাগত জানাতে জিন্না ১৯১৪ সালের মাদ্রাজ কংগ্রেসের বৈঠকও ছেড়ে দিয়েছিলেন। গাঁধীকে তিনি উষ্ণ সম্বর্ধনা জানিয়েছিলেন, এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য তাঁকে পাশে চেয়েছিলেন। জিন্নার জনপ্রিয়তা এবং মর্যাদার জন্যই ‘শ্রী ও শ্রীমতী গাঁধী’কে স্বাগত জানাতে গুর্জর সভা আয়ােজিত গার্ডেন পার্টিতে তাঁকে সভাপতিত্ব করতে বলা হয়েছিল, ১৯১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি, গাঁধী বম্বে পৌঁছনাের পর।
সভাপতির ভাষণে জিন্না ‘শ্রী ও শ্রীমতী গাঁধীকে স্বাগত জানান কেবল বম্বের পক্ষ থেকে নয়, গােটা ভারতবর্ষের পক্ষ থেকে। তিনি গাঁধীকে বােঝাতে চান যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল “দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐকমত্য ও সহযােগিতা তৈরি করা যাতে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের কাছ থেকে ভারতের দাবি একযােগে আদায় করা যায়। সেই জন্য তিনি চাইছিলেন, “সেই মানসিকতা, সেই অবস্থা, সেই পরিস্থিতি যা তাঁদের আনতে হবে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে, যাতে তার বেশির ভাগ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।” জিন্না এও বলেন, “নিশ্চয়ই গাঁধী কেবল রত্ন হয়ে থাকবেন না, তিনি এমন এক জন প্রকৃত কর্মী হবেন যাঁর জুড়ি মেলা কঠিন।” এই মন্তব্যে প্রধানত হিন্দু শ্রোতারা করতালি দিয়েছিল, সভার বিবরণ বলছে। গাঁধী অবশ্য তাঁর প্রতিক্রিয়ায় অনেক সতর্ক ছিলেন। তিনি এই যুক্তি দিলেন যে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি সব ভারতীয় সমস্যাগুলি খতিয়ে দেখবেন। গােখেল তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, রাজনীতিতে প্রবেশ করার আগে অন্তত এক বছর পরিস্থিতিটা ভাল করে দেখতে। এই অবধি ঠিকই ছিল, কিন্তু তারপর নেহাত অপ্রয়ােজনীয় ভাবে তিনি জিন্নাকে ধন্যবাদ দেন ‘একটি হিন্দু বৈঠকে’
৮৪
সভাপতিত্ব করার জন্য। জিন্নার উষ্ণ স্বাগতের পর এই মন্তব্য ছিল এক নিরাশাজনক প্রতিক্রিয়া। সভাকে তা কিছুটা দমিয়ে দেয়।
গাঁধী গােড়ার দিকে ছিলেন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, এবং গােখলে, জিন্না ও অন্যান্য নরমপন্থী নেতাদের অনুগমন করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা দেখতে পাননি। তার কারণ। তত দিনে তিলকও নরমপন্থার রাস্তায় চলে এসেছেন। গাঁধী তাঁদের সকলের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিলেন, তবে তা ১৯২০ সাল পর্যন্ত, যার পর গাঁধীর মতবাদটিই প্রাধান্য পেল। তত দিনে গাঁধী ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকেও স্বীকৃতি পেয়ে গিয়েছেন, যদিও তার কারণ স্বয়ং গােখলে, যিনি ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের উপর তাঁর মর্যাদা এবং প্রভাবের সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন ভারত সরকারকে গাঁধীর পাশে এসে দাঁড়াতে। ১৫ এই সময়ে ভারত সরকার জিন্নার হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ধারণায় বিচলিত হয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছিল কংগ্রেসকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ থেকে দূরে রাখতে।
এক অর্থে জিন্নার অবস্থান ফিরে যাচ্ছে সেই এক বছর আগের সময়ে, ১৯১৪। সালের মে মাসে যখন তিনি ইংল্যান্ডে কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধি দলকে তাঁর নেতৃত্বে নিয়ে গিয়েছিলেন সেক্রেটারি অব স্টেট এবং পার্লামেন্টের অন্যান্য সদস্যদের উপর চাপ দেওয়ার জন্য, যাতে অন্তত তিন জন ভারতীয়কে কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াতে নির্বাচিত করা যায়। বিশ শতকের গােড়ার তিন প্রধান নেতা, নওরােজি-মেটা-গােখলের ৭ উত্তরসূরি হিসেবেই যেন তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি অবশ্যই ছিলেন কংগ্রেসের পশ্চিমাঞ্চলের নেতা। ইন্ডিয়া অফিস কিন্তু এই দাবিগুলি সরাসরি খারিজ করে দিল। সময়টা তেমন ঠিক ছিল না, কারণ সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। জিন্না যখন এই বিষয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন গাঁধী যুদ্ধের গােড়ায় তাঁর দেশবাসীকে বলেন ‘সাম্রাজ্যবাদীর মতাে করে চিন্তা করতে।[৬৮] তিনি ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স ট্রেনিং কোর সংগঠন করতে সাহায্য করেন, মিত্রশক্তির জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকায়, বুয়র যুদ্ধের সময়ে এই। ধরনের কাজ তিনি করেছিলেন বলে শােনা যায়, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তাঁর অবস্থান ছিল আলাদা। সে যাই হােক, সেই সময়ে গাঁধীর নেতৃত্ব ছিল প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক চরিত্রের, যেখানে জিন্না ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, জাতীয়তাবােধে উদ্দীপ্ত এক নেতা।
১৯১৬ সালের লখনউ সন্ধি
যে ঘটনাবলির ক্রম অনুসরণ করে এই অসামান্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেগুলি একটু অনুসরণ করা দরকার। পণ্ডিত মদনমােহন মালব্যের সভাপতিত্বে সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটি ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসে আঞ্চলিক কমিটিগুলিতে আলােচনার জন্য প্রস্তাবগুলির একটি রূপরেখা তৈরি করে। অগস্টে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ একই
৮৫
কাজ করে, যেখানে আলােচনার পরিচালনা করেন জিন্না। লিগ তার প্রস্তাব ১৯১৬ সালের নভেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করে ফেলে। তারপর কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের একটি যৌথ অধিবেশন হয় কলকাতায়, ১৯১৬ সালের ১৭ নভেম্বর। স্বনামধন্য বাঙালি নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তার সভাপতি। প্রধানত জিন্নার বিরামহীন, ক্লান্তিহীন চেষ্টায় একটা ঐকমত্যে পৌঁছনাে যায়। জিন্নার এই অবদান স্বীকৃতি পায়, যখন ডিসেম্বরে লখনউয়ে অনুষ্ঠিতব্য মুসলিম লিগ অধিবেশনের সভাপতি করা হয় তাঁকে। কংগ্রেস মহলেও এই নির্বাচন সাধুবাদ পায়। এর পর জটিল আলােচনাকে দক্ষতার সঙ্গে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে, এবং কংগ্রেসে তিলকের অমূল্য সমর্থনের জন্য, দুই পক্ষ একটি সমঝােতায় পৌঁছয়। এরই সম্পূর্ণ নাম হয় ‘সংস্কারের জন্য কংগ্রেসলিগ যৌথ পরিকল্পনা’, সংক্ষেপে যাকে বলা হয় ‘লখনউ চুক্তি। এটা সম্ভব হয় জিন্নার ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতি অবদানের জন্য’[৬৯]: ১ জানুয়ারি, ১৯১৬ বম্বে ক্রনিকল-এর মন্তব্য।
লখনউ চুক্তি জাতীয় স্তরে এমন কিছু নীতির বিষয়ে সহমত তৈরি করে, যা কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ প্রশাসন ও আইনসভায় ক্ষমতার বিভাজন করতে পারে। গােখলে স্কিম’[৭০] আগে যা ভেবেছিল, এই চুক্তি তারই আরও বিশদ বর্ণনা করল। চুক্তি অনুসারে কংগ্রেস কেন্দ্রীয় প্রশাসনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পাবে, লিগ পাবে এক-তৃতীয়াংশ। কিছু বিশেষ ধর্মীয় বিষয় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, যেগুলি ওই সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থন ছাড়া পাশ করানাে যাবে না। মুসলিমদের পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীকে নৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া হল, যা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিলকের সমর্থনে জিন্নার সব রকম আশ্বাসের ভিত্তিতে চুক্তি সই করা হয়। জিন্না পরবর্তী কালে নিজেকে এই চুক্তির প্রধান দুষ্কৃতী’ বলে আখ্যা দেন।
গাঁধীর প্রত্যাবর্তনের ছয় বছরের মধ্যে নেতৃত্বের ছক পালটে গেল। ১৯২০ সালের মধ্যে, অর্থাৎ নাগপুর কংগ্রেসের মধ্যে, গাঁধী নিজের জায়গা তৈরি করে নিলেন, যার পর জিন্না কংগ্রেস দলের মধ্যে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। এমন নয় যে এই দু’জন নেতা নিজেদের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বদলালেন, আসলে এই কয়েক বছরে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনেকটাই পালটে যায়, এবং এই দুই নেতা সেই পরিবর্তনের প্রতি আলাদা ধরনে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তা ছাড়া, ১৯২০ সালের মধ্যে গাঁধীও নিজের চারপাশে যথেষ্ট মুসলিম সমর্থক পেয়েছিলেন, সেই সঙ্গে পেয়েছিলেন আর্থিক সহায়তাও। গাঁধীই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠলেন, যে স্থানে জিন্না কখনও পৌঁছতে পারেননি। অমৃতসর থেকে কলকাতা থেকে নাগপুর, প্রতিটি কংগ্রেসে গাঁধীর ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। নাগপুর কংগ্রেসে দেখা গেল, প্রশ্নাতীত ভাবে গাঁধীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছে কংগ্রেস।
জিন্না, যাঁকে এক সময়ে বলা হল ‘মুসলিম গােখলে’, হয়তাে যুদ্ধ না হলে কংগ্রেসের এক কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হয়েই থাকতেন, এবং সেই সঙ্গে মুসলিম লিগেরও। সাংবিধানিক প্রক্রিয়াতে দুই দলের, এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য আনার চেষ্টা করতেন।
৮৬
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সব পালটে দিল। ভাগ্যের ইচ্ছা কি অন্য রকম ছিল? নাকি, জিন্নাকে বুদ্ধি ও কৌশলে পরাস্ত করেছিলেন গাঁধী? না কি, আরও দুঃখের কথা, মুসলিম হওয়াতে তিনি প্রথম থেকেই অসুবিধার অবস্থায় ছিলেন ? রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হৃদয়হীন খেলায় জিন্না বরাবরই প্রতিবন্ধকতার বােঝা বয়েছিলেন, তখনও, তার পরও।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে জিন্নার রাজনৈতিক দাবিগুলি ইংল্যান্ড বাতিল করে। কিন্তু এই দাবিগুলিই মন্টেগু পরে ভারতের জন্য দায়িত্বশীল প্রশাসন’ বলে ঘােষণা করে, এবং মাত্র তিন বছরের মধ্যে তা আইনে পরিণত হয়। তার ফলে জিন্নার পায়ের তলা থেকে রাজনীতির একটি প্রধান মঞ্চ সরে যায়। কংগ্রেসে জিন্নার কোণঠাসা হওয়ার আর একটা কারণ, অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়া, যার ফলে খলিফার আসন বিলুপ্ত হয়। ভারতের রাজনৈতিক আকাশে আবির্ভাব ঘটে আলি ভাইদের, মহম্মদ আলি জহর এবং শওকত আলি জহর। কিছু দিনের জন্য তাঁরা সকলকে মুগ্ধ করে রাখেন। ফলে মুসলিম লিগের জমিও জিন্নার পায়ের তলা থেকে সরে যায়। কিছুটা বিষন্ন ভাবেই তিনি বম্বের তৎকালীন গভর্নর স্যর জর্জ লয়েডকে বলেন যে “আপনার সংস্কার থেকে যা কিছু লাভ এবং জনসমর্থন আশা করা গিয়েছিল সে সবই দ্রুত ডুবে যাচ্ছে কেবল দুএক জন লােকের কাজের জন্য (আলি ভাইরা ও গাঁধী?)। তা ছাড়া সিপাহি বিদ্রোহের পর আর কখনও জনমত এত খারাপও ছিল না।”[৭২]
কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যান্য ফলও ক্রমশ বােঝা গেল। প্রথমত ভারতীয়দের বুঝতে শেখাল যে এশীয়রাও শ্বেতাঙ্গদের হারাতে পারে। ১৯০৫ সালে জাপানের হাতে রুশদের পরাজয় থেকে তাঁরা কিছুটা প্রেরণা পেলেন। যুদ্ধ ছাড়াও, ইউরােপ এবং আরব দেশে রাজনৈতিক প্রত্যাশার নকশাটা ভারতীয়দের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। ভারতীয় সেনারা ইউরােপ দেখল, “বিলায়েত’[৭৩] দেখল, সাদা সৈন্যদের পৃথক একটি ভূমিকায় দেখল। ফলে তাদের প্রতি সহিষ্ণুতা কমে এল। গণসমর্থন আদায়ের এটাই ছিল আদর্শ সুযােগ, এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে তাঁর যথেষ্ট অভিজ্ঞতার কারণে গাঁধী তৎক্ষণাৎ সেই সুযােগ নিলেন। যুদ্ধের জন্য ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ এবং দোলাচল তৈরি হয়েছিল। জিন্না যেখানে মুসলিম ধর্ম-ভিত্তিক আন্দোলন থেকে দূরে থাকতেন, সেখানে। গাঁধী, একজন ছাঁচে-ঢালা হিন্দু, খিলাফত আন্দোলনের বাঘের সওয়ারি হতে এগিয়ে এলেন। ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠার আগে অবধি গাঁধী কোনও জনসংগঠনের নেতৃত্বের জন্য প্রতিযােগিতা থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি আর্য সমাজ (স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ), কংগ্রেস এবং হােম রুল লিগের নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। জিন্না গাঁধীর জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতায় উত্তরণের ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন, কিন্তু তাঁর করার কিছু ছিল না। ১৯১৭ সালে তিনি মেস্টনকে[৭৪] বলেছিলেন, “চরমপন্থীদের একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি রয়েছে, যা হয়তাে অবাস্তব, কিন্তু তা মানুষের মর্যাদাবােধের কাছে আবেদন রাখে। নরমপন্থীদের তেমন কোনও মতবাদ নেই, সরকারকে বিশ্বাস করা ছাড়া। তারা যদি মঞ্চে উঠে মানুষকে বলে সরকারের উপর আস্থা রাখতে, মানুষ তৎক্ষণাৎ তাদের প্রশ্ন করে, সরকার তাদের জন্য কী করছে। নরমপন্থীরা উত্তর দিতে পারে না। সরকার
৮৭
তার উদ্দেশ্য তাঁদের কাছে বলেনি, তাই তাঁদের কথা চাপা পড়ে যায়। অন্য দিকে চরমপন্থীদের অবস্থান স্পষ্ট, সম্ভব, এবং তারা আইন না ভাঙলে এমন কিছু নেই যা বােঝায় যে সরকার তাদের প্রচার বিশ্বাস করছে না।”[৭৫] বার বার দেখা গিয়েছে, এ প্রসঙ্গে এবং অন্য প্রসঙ্গেও, যে প্রায় সব সময়েই চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মধ্যে প্রতিযােগিতায় অল্প সময়ের জন্য হলেও চরমপন্থীরাই জিতে যায়।
জিন্না সাংবিধানিক সংশােধন, আইন সংশােধন এবং সম্প্রদায়ের ঐক্য নিয়ে লড়ে যেতে লাগলেন, আর গাঁধী চলে গেলেন চম্পারন, আমদাবাদ এবং খেদা’— সাফল্য থেকে সাফল্যে। তত দিনে স্পষ্ট হয়ে গেল যে তিনি এক ঐতিহাসিক জনসমর্থন পেয়েছেন, তাঁর অবস্থান নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ রইল না। জিন্নার তেমন কোনও জনসমর্থন ছিল না, মুসলিম-প্রধান প্রদেশগুলিও তাঁর সঙ্গে ছিল না। আশ্চর্য ভাবে, এই সময়েই জিন্নার জাতীয়তাবাদ ব্রিটিশদের সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করছিল। ১৯১৮ সালের গােড়ায় বম্বের গভর্নর উইলিংডন জিন্নাকে মদনমােহন মালব্য, বালগঙ্গাধর তিলক এবং অ্যানি বেসান্তের সঙ্গে তাঁর তুলনা করে বললেন, “যারা চরমপন্থী এবং সাম্রাজ্যের সংকটের প্রতি যাদের কোনও সহানুভূতি নেই।”[৭৭] চেমসফোর্ডও কাউন্সিলের প্রতি জিন্নার সমালােচনার জন্য বিক্ষুব্ধ ছিলেন। উইলিংডনের উত্তরসূরি স্যর জর্জ লর্ড পরে মন্টেগুকে সাবধান করেছিলেন “জিন্না এবং শ্রীমতী নাইডু … দু’জনেই সুবক্তা কিন্তু হৃদয়হীন। সমঝােতা অসম্ভব।”[৭৮]
১৯১৯ সালের এপ্রিলে রাওলাট আইন পাশ করার প্রতিবাদে জিন্না ভাইসরয়ের কাউন্সিল থেকে ইস্তফা দেন। তত দিনে তিনি বম্বের হােম রুল লিগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, ১৯১৭ সালে অ্যানি বেসান্তের পর। জিন্নার ইস্তফাপত্রটি স্পষ্ট:
…এই বিলটি পাশ করে মাননীয় সরকার সেই সব নীতিকে পদদলিত করেছে, যার জন্য ব্রিটেন এক দিন যুদ্ধ করেছিল। অস্থির এবং অকর্মণ্য আমলাতন্ত্র, যারা মানুষের প্রতি দায়বদ্ধও নয়, জনমতের সঙ্গে সংস্পর্শও রাখে না, তাদের দিয়ে ন্যায়ের মৌলিক ভিত্তিকে উপড়ে ফেলা হয়েছে, মানুষের সাংবিধানিক অধিকারকে আক্রমণ করা হয়েছে। … অথচ রাষ্ট্রের সামনে কোনও বড় বিপদ ছিল না।”[৭৯]।
জিন্না সিমলাতে তাঁর কাউন্সিল আসন ত্যাগ করলেন জনসমর্থন পাওয়ার আশায় নয়, বরং রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান ভাইসরয়ের কাউন্সিল থেকে এমন একটি স্থানে সরিয়ে আনায়, যা বেশি কাজে দেবে বলে মনে করেছিলেন হােয়াইট হল। তিনি ইস্তফা দেন এই বলে, “এই পরিস্থিতিতে আমি মনে করি না যে আমি কাউন্সিলে মানুষের কোনও কাজে আসতে পারব, আমার মতে যে সরকার শান্তির সময়ে এমন আইন পাশ করতে পারে তা সভ্য সরকার হিসেবে গণ্য হওয়ার অধিকার হারিয়েছে … আমি এখনও আশা করি সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া মহামান্য সম্রাটকে পরামর্শ দেবেন এই কালা আইন যাতে পাশ না হয়।[৮০]
জিন্না ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে মুসলিম লিগের একটি প্রতিনিধি দলকে নিয়ে লন্ডন গেলেন মন্টেগুর কাছে আবেদন করতে এবং লর্ড সেলবাের্নের সিলেক্ট কমিটি অন
৮৮
রিফর্মস-এর কাছে সাক্ষ্য দিতে। তাঁর সাফল্য ছিল সীমিত। তিনি বম্বেতে ফিরে এলেন এই বিশ্বাস নিয়ে যে “ভারত যদি লন্ডনে বাস্তবিক প্রতিনিধি পাঠায় তা হলে অনেক কাজ হতে পারে, এবং তিনি নিজে সেই স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে প্রস্তুত ছিলেন। গত কয়েক দশক ধরে গােখলে এবং উইলিয়াম ওয়েদারবার্ন যে কথা বলে আসছেন, তাঁর এই সমাধান ছিল তারই অনুরূপ। যদিও তাঁর চিন্তার যে ‘ডমিনিয়ন স্টেটাস’ তা অবিভক্ত ভারতের জন্য সবচেয়ে দ্রুত, যুক্তিযুক্ত এবং কম কষ্টজনক হত, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর দিল্লির রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে তা কোনও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেল না।
গাঁধী-জিন্না এবং খিলাফত আন্দোলন
পঞ্জাবের গণহত্যার তদন্তের বিষয়ে অবদান, খিলাফত আন্দোলনের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা এবং শওকত ও মহম্মদ আলি ভাইদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গাঁধীকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দিল। গাঁধী বলতেন, হিন্দু এবং মুসলমান একই মায়ের সন্তান, একই মাটির মানুষ, তাই পরস্পরকে ভালবাসতে হবে। খিলাফতের প্রশ্নে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, হিন্দু ও মুসলিম যদি ভাই হয়, তা হলে একে অপরের দুঃখ ভাগ করে নেওয়াই কর্তব্য। এর আগে হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে এতটা সহযােগিতার কথা কমই শােনা গিয়েছে।
সে সময়ে আটলান্টিক মান্থলিতে এডমান্ড শ্যান্ডলার বিবরণ দিয়েছেন, “যে নেতা। এই দুই বিপরীতমুখী স্রোতকে একটি ধারায় মেশাতে পারবেন তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধ অর্ধেক জিতেই গিয়েছেন। তাই ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হিন্দু-মুসলিম আঁতাত ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক আন্দোলন। যখন ১৯১৯ সালের এপ্রিলে স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ জামা মসজিদের মঞ্চে উঠে সমবেত জনতাকে উদ্দেশ্য করে ভাষণ দিলেন, সেই ঘটনাকে ভারতের মুসলিম সংবাদমাধ্যমে সাম্প্রতিক ইসলামি ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে বর্ণিত হয়। সেই ডিসেম্বরেই গাঁধীকে খিলাফত কনফারেন্সের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এই সময়কার রাজনৈতিক বুলি, ‘আল্লাহু আকবর এবং ওম একই নাম’ চার দিকে প্রতিধ্বনিত হয়, এবং হিন্দুদের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মুসলিমরা গােহত্যা বন্ধ করে। মুসলিম চরমপন্থীদের সঙ্গে গাঁধীর যােগাযােগের এই শুরু। পরের ধাপে তিনি ইসলামের এতটাই সমর্থক হয়ে ওঠেন যে সরকারের প্রতি আনুগত্যের শর্ত করেন সেভরের চুক্তি সই করাকে।
যদি তুর্কিদের উপর তাঁর বিশ্বাস থাকত, তা হলে ইসলামি আন্দোলনে গাঁধীর এই সমর্থন মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু তাঁর সমালােচকরা মনে করেন, কেবল রাজনৈতিক সুবিধার জন্য তিনি এমন এক বিষয়কে সমর্থন করছেন, এবং ভুল করছেন। যিনি নিজে নম্রতার প্রতিমূর্তি, নিজের দেশের মানুষদের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত, তাঁর
৮৯
সঙ্গে বিদ্বেষবাদী তুর্কিদের কী মিল-ই বা থাকতে পারে, যাতে তিনি ওসমান আলিদের নির্যাতনের শাসন সমর্থন করতে পারেন? গাঁধী কিন্তু তাঁর নিজের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ছিলেন। তুর্কির প্রতি তাঁর আগ্রহ কোনও ভান ছিল না। প্রশাসনের প্রশ্নে তিনি তুর্কিদের গণহত্যার ইতিহাস সত্ত্বেও মনে করতেন, খ্রিস্টান, আরব, ইহুদিদের অধিকার অটোমান সাম্রাজ্যে সুরক্ষিত। গাঁধী বলেন, ভারতের মুসলিমদের ইতিহাসে একটি সংকটময় মুহূর্তে তাঁদের সাহায্য করে আমি তাঁদের বন্ধুত্ব কিনতে চাই।” এবং যত দিন তিনি তাঁদের প্রতি অবিচারের বিষয়টিকে বিশ্বাস করেছেন, তত দিন তা ছিল সম্পূর্ণ ন্যায্য এক চুক্তি। “হিন্দু-মুসলিম আঁতাত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রথম শর্ত।”
সেই সময়ের ঘটনাবলির একটি বিশদ বিবরণের জন্য আমি স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের নিজের বক্তব্যের উপর নির্ভর করছি:
১৯১৯ সালের ৪ এপ্রিল দিল্লির জন্য ছিল একটি রক্তাক্ষরের দিন।। যথেচ্ছ গুলিচালনার পর সেটাই প্রথম শুক্রবার। জামা মসজিদে সমবেত প্রার্থনা হওয়ার কথা ছিল। দায়িত্বশীল মুসলমানরা একটি বিজ্ঞপ্তি বিলি । করছিলেন, যাতে এলাকার সব মানুষকে স্মরণসভায় যােগ দিতে আহ্বান । করা হয়, হিন্দু ও মুসলিম শহিদদের জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার জন্য।
আমি প্রতি দিনের মতাে শহর পরিক্রমা করছিলাম, যখন বেশ কিছু হিন্দু ভদ্রলােক এসে আমাকে বললেন যে মুসলিম ভাইরা হিন্দুদের বলছেন মসজিদে গিয়ে স্মরণসভায় যােগ দিতে। এ বিষয়ে তাঁরা আমার পরামর্শ চাইলেন। তাঁদের প্রশ্নের কারণ— মসজিদের ম্যানেজিং কমিটির অনুমতি ছাড়া অ-মুসলিমদের মসজিদে ঢােকার অধিকার ছিল না, বিশেষত নমাজ পড়ার সময়ে। আমি তাঁদের অপেক্ষা করতে বলে আব্দুল রহমান ভকিলের সঙ্গে পরামর্শ করতে গেলাম, যাঁর অফিস কাছেই। তিনি আমায় বললেন, হাকিম সাহেবের সঙ্গে পরামর্শ না করে মসজিদে না যেতে। হাকিম সাহেব বাড়িতে ছিলেন না, তাই আমি আমার আশ্রমে ফিরে এলাম, এই মনস্থ করে যে নমাজ এবং স্মরণসভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি থেকে বেরােব না। …
বেলা একটা নাগাদ আমি যখন লেখায় ব্যস্ত, প্রায় ৫০ জন মুসলমান। ভদ্রলােক আমার বাড়িতে এসে আমাকে আপ্যায়ন করে নিয়ে গিয়ে তুললেন এক টাঙ্গাতে। রাস্তায় তাঁরা বারকয়েক যান বদল করলেন, যতক্ষণ না একটা ফাঁকা মােটরগাড়ি পাওয়া গেল। তারপর আমাকে তাড়াতাড়ি করে জামা মসজিদের দক্ষিণের সিঁড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া হল। কিছু লােক নেমে আসছিলেন, কিন্তু আমাকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে দেখেই তাঁরা ধ্বনি দিলেন ‘মহাত্মা গাঁধীর জয়, “হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের
৯০
জয়’ এবং সবাই আবার ফিরে চললেন। ভিতরে অন্তত ৩০ হাজার। মানুষ ছিলেন। আমি শেষ জনের পিছনে বসে পড়বার চেষ্টা করতে অন্য মুসলমান ভাইরা ছুটে এসে আমাদের বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন এবং তারপর বাইরে, যেখানে একটি স্থায়ী কাঠের মঞ্চ তৈরি করা রয়েছে মৌলবির ব্যবহারের জন্য। মৌলবি আবদুল মজিদ তখন ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি আমাকে উঠতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি ইতস্তত করলাম।
ণ্ঠ আমাকে উঠতে অনুরােধ করল। দু’ধাপ ওঠার পর আমি আবার ইতস্তত করলাম। সেই বিশাল জনসমাবেশের সবাই দাঁড়িয়ে উঠে। আবার একযােগে আমাকে মঞ্চে উঠতে অনুরােধ করল। আমি মঞ্চে উঠলে তাঁরা সকলে বসে পড়ল। | আমি ভেবেছিলাম, মৌলবি আবদুল মজিদ তাঁর ভাষণ চালিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি এই মন্তব্য করে থেমে গেলেন, আপনারা জানেন, শহিদদের রক্ত সম্পর্কে কোরান মজিদ কী বলেছে। স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ এ বার বলবেন পবিত্র বেদ, যা আমাদের হিন্দু ভাইয়েরা প্রকাশিত সত্য বলে। মনে করে, সেই বেদও কী ভাবে এই একই বার্তা নিয়ে আসে। আমাকে। দাঁড়াতে হল। আমি সেই বৈদিক মন্ত্রটি পড়লাম যা ঈশ্বরের পিতৃত্ব এবং মাতৃত্বের কথা বলে।
আমি সেই বিপুল জনসমাবেশকে বললাম শহিদদের কলুষহীনতার সাক্ষী থাকতে, এবং যে ঈশ্বর সকলের পিতা এবং মাতা, তাঁর চরণে। অবনত হতে। এটুকু বলেই কথা শেষ করলাম।
যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা সেই দৃশ্যের ভাল বিবরণ দিতে পারবেন। যখন আমি তিন বার বললাম, “ওম শান্তি, আমিন, তখন সমস্ত মানুষ আমার সঙ্গে সে কথা মন্দ্রস্বরে উচ্চারণ করল। সে ছিল এক আশ্চর্য প্রেরণাদায়ক দৃশ্য। নেমে এলাম। দর্শকদের সঙ্গে বেরিয়ে এলাম, যাঁদের মুখ দেখে বােঝা যাচ্ছিল, কতটা অভিভূত তাঁরা।
এর পর হিন্দু সাধুরা মসজিদের মঞ্চ থেকে বললেন, এবং মুসলিম সন্তরা হিন্দু মন্দির থেকে দু-সম্প্রদায়ের মিশ্র শ্রোতাদের সামনে প্রচার করতে লাগলেন গােটা দেশের নানা জায়গায়। সেই মহান দৃশ্যের পর বহু কিছু ঘটে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমি আজও তার স্মৃতিতে অভিভূত, এই আশা নিয়ে বেঁচে রয়েছি যে সকল সংশয়ের মেঘ দূর হবে, বিশ্বাস ও সত্যের আলাে তার সব ঐশ্বর্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
ভিতরে যখন এই অপরূপ দৃশ্য চলছিল, সেই বিশাল মসজিদের বাইরে মজুত ছিল সাঁজোয়া গাড়ি, সেনা ও পুলিশ, উস্কে দেওয়ার মতাে সংখ্যায়। কিন্তু তাঁদের নেতাদের অনুরােধ মেনে মানুষ প্রশংসনীয় ভাবে শান্তি বজায় রেখেছিল।
৯১
অশান্ত বিশের দশক আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই সম্প্রীতির জোয়ার শেষ হয়ে গেল, আবার পুরনাে পরিস্থিতি ফিরে এল, সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের আরও অবনতি হল। গাঁধীর। সমকালীন নেতা বি আর আম্বেদকর তঁার বই ‘পাকিস্তান অথবা দেশভাগ’ বইটিতে লিখছেন, “কলঙ্কজনক সত্য এই যে বেশ কিছু উজ্জ্বল হিন্দু যাঁরা মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত দিয়েছিলেন, উন্মত্ত মুসলিমের হাতে তাঁদের লেখার জন্য কিংবা শুদ্ধি আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য জীবন দিতে হয়েছিল কিন্তু প্রথম প্রাণটি দিয়েছিলেন স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ, যাঁকে ২৩ ডিসেম্বর ১৯২৬ গুলি করে হত্যা করে আব্দুল রশিদ। এর পর নিহত হলেন নানা নানকচাঁদ, দিল্লির এক বিশিষ্ট আর্য সমাজি। রাজপাল, রঙ্গিলা রসুলের রচয়িতা, ছুরিকাহত হলেন ইলামদিনের দ্বারা, ৬ এপ্রিল ১৯২৯, যখন তিনি তাঁর দোকানে বসে ছিলেন। আব্দুল কয়িক হত্যা করেন নাথুরামল শর্মাকে, সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে। সেটা ছিল দুঃসাহসী হত্যা, কারণ শর্মাকে ছুরি মারা হয় সিন্ধুপ্রদেশের জুডিশিয়াল কমিশনারের আদালতে, যেখানে তিনি আদালতের রায় শােনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন … ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে একটি প্রচারপত্র রচনার জন্য। হিন্দু সভার সচিব খান্না ১৯৩৮ সালে গুরুতর আক্রান্ত হন আমদাবাদে হিন্দু মহাসভার অধিবেশনের পর। অল্পের জন্য তাঁর প্রাণ রক্ষা পায়।” ..
৩০ নভেম্বর, ১৯২৭ সালে দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া তার কলাম ‘থ্র ইন্ডিয়ান আইজ’-এ লেখে: “বলা হচ্ছে স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের হত্যাকারী আবদুল রসুলের আত্মার পরকালে গতির জন্য দেওবন্দের ধর্মীয় কলেজে ছাত্র এবং অধ্যাপকরা পাঁচ বার সম্পূর্ণ কোরান পাঠ করেছেন এবং প্রতি দিন সওয়া একলাখ কোরানের মন্ত্রের আবৃত্তি করার পরিকল্পনা নিয়েছেন। তাঁদের প্রার্থনা, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মাহরুমকে (রশিদকে) সপ্তম স্বর্গের চূড়ায় স্থান দিন।”
তথ্যসূত্র
১. দেওয়ান: সরকারি উচ্চপদ, বিশেষত ক্যাবিনেট সদস্য বা সম্রান্ত স্তরের।
২ খােজা; মূল অর্থে একটি ভারতীয় জাত— মুখ্যত নিজারি ইসমাইলি এবং কিছু সুন্নি ও ইসমাইলি সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন বারােটি শিয়া গােষ্ঠী এর অন্তর্ভুক্ত। বৃহত্তর অর্থে খােজা বলতে বােঝায় সমস্ত ভারতীয় নিজারি এবং মূলতানের শামসি ও উত্তর গুজরাতের মােমনার মতাে কিছু গােষ্ঠীকে। নিজারিদের বেশির ভাগ কাজকর্মই সিন্ধুপ্রদেশে কেন্দ্রীভূত।
সপ্তদশ শতাব্দী থেকে খােজারা ভারত ও পূর্ব আফ্রিকার মধ্যে বাণিজ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর পরে তারা পূর্ব আফ্রিকায় বসতি করেন। ১৮৪০ সালে আগা খান হাসান আলি শাহ ভারতে আসার পরে ইমামের ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব নিয়ে খােজা সম্প্রদায়ের অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে উঠল। ১৮৬৬ সালে একটি মামলায় রায় দেওয়া হল যে, ইমামের ক্ষমতা চূড়ান্ত, নিরঙ্কুশ। এর ফলে ভিন্নমতাবলম্বী সুন্নি খােজারা গােষ্ঠী থেকে বেরিয়ে গেল৷৷ পরবর্তী কালে ১৮৭৭ এবং ১৯০১ সালে আরও যাঁরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন তারা বম্বে
৯২
এবং পূর্ব আফ্রিকায় ইথনা আশারি খােজা গােষ্ঠী তৈরি করলেন।
৩. বােহরা: ভারতে ইসমাইলি শাহ ইসলাম-এর একটি মুসতালি উপগােষ্ঠী। সৈয়দনা মুহম্মদ বুরহানউদ্দিন তাদের ধর্মীয় নেতা। বােহরাদের বিশ্বাস, একুশতম ইমাম, মহম্মদের কন্যা ফতেমার প্রত্যক্ষ বংশধর তায়েব আবি ই-কাসিম বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে নিজস্ব মত তৈরি করেছিলেন। দাউদি বােহরারা সেই মতাদর্শের দ্বারাই চালিত।
৪. আকিকা: নবী-র সমকালীন আরব দুনিয়ায় প্রচলিত একটি রীতি। এই রীতি অনুসারে, একটি পশুকে জবাই করে তার রক্ত শিশুর মাথায় ঢেলে দেওয়া হয়, তার পরে শিশুর মাথা নেড়া করে দেওয়া হয়। বিশ্বাস ছিল এই যে, এটা না করলে ওই শিশুর জীবনে বিপদ বা দুঃখ আসার সম্ভাবনা বাড়ে।
৫. সিন্ধু প্রদেশের অগ্রণী শিক্ষাব্রতী খান বাহাদুর হাসান আলি এফেন্দি প্রতিষ্ঠিত একটি উচ্চ বিদ্যালয়।
৬. আক্ষরিক অর্থ ‘লােকালিটি।
৭. আর পি মাসানি, দাদাভাই নওরােজি।
৮. শরিফ আল মুজাহিদ সম্পাদিত, ফতিমা জিন্নার লেখা ‘মাই ব্রাদার’ থেকে উদ্ধৃতি।
৯. ইসলিংটন কমিশনের সামনে জিন্নার বক্তব্য; মিনিটস অব এভিডেন্স, আই ও আর, খণ্ড ২২, কলাম ৭২৯৪
১০. দেওয়ানি মামলা নং ১১, ১৮৯৬ সাল, জেলা আদালত, করাচি
১১. পৃ ৪, মহম্মদ আলি জিন্না: অ্যান অ্যামবাসাডর অব ইউনিটি, হিজ স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস, ১৯১২-১৯১৭, গণেশ অ্যান্ড কম্পানি, মাদ্রাজ, ১৯১৮
১৩. চিমনলাল সেতলবাদ, রিকালেকশনস অ্যান্ড রিফ্লেকশনস, পৃ ৬১, পদ্মা পাবলিকেশনস, বম্বে, ১৯৪৬
১৪. এম সি চাগলা, রােজেস ইন ডিসেম্বর, পৃ ১৪, ভারতীয় বিদ্যা ভবন, মুম্বই ।
১৫. দি অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া গাঁধী, এসেনসিয়াল রাইটিংস, গােপালকৃষ্ণ গাঁধী সংকলিত ও সম্পাদিত, পৃ ৬৯০, অক্সফোর্ড
১৬. লােহানা: শহরভিত্তিক হিন্দু বণিকগােষ্ঠী, স্বতন্ত্র নৃগােষ্ঠীও বটে। বসতি প্রধানত গুজরাতে ও মুম্বইয়ের সন্নিহিত অঞ্চলে। আদিতে পঞ্জাবের ক্ষত্রিয়, প্রায় আটশাে বছর আগে সিন্ধু ও গুজরাতে অভিবাসী হন। আগে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে থাকলেও পরে অর্থনৈতিক কারণে বাণিজ্যে মন দেন। কিছু লােহানা মুসলমান হন, তারা পরিচিত হন মেমন নামে। লােহানাদের আফগানিস্তানে ও পাকিস্তানে এখনও পাওয়া যায়। আফগানিস্তানে তারা নিজেদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন, সেখানে তারা লােখাতরা নামে পরিচিত। সিন্ধুতে যে লােহানারা হিন্দু পরিচয় বজায় রেখেছেন তাদের ‘সিন্ধি লােহানা’ বলা হয়। যাঁরা শিয়া ইসলাম গ্রহণ করেছেন তঁারা খােজা নামে পরিচিত। তাদের মধ্যে সবচেয়ে নামডাক যাঁর তিনি মহম্মদ আলি জিন্না। জিন্নার বাবার নাম ছিল জেনাভাই ঠক্কর।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গুজরাত থেকে বহু হিন্দু লােহানা পূর্ব আফ্রিকার ব্রিটিশ উপনিবেশগুলিতে অভিবাসী হয়েছিলেন। তাঁদের বংশধররা অনেকেই সাম্প্রতিক কালে ব্রিটেনে চলে গেছেন। পূর্ব আফ্রিকার লােহানারা ছিলেন সফল উদ্যোগী, মাধওয়ানি ও মেটা’রা শিল্পে সফল।
৯৩
১৭. খােয়াজা (সরকারি ভাবে খােজা): অধিকাংশই মুসলমান। প্রধানত দক্ষিণ এশিয়া নিবাসী। তবে অভিবাসনের ফলে দুনিয়ার নানা দিকে ছড়িয়ে পড়েছেন অনেকেই। পাকিস্তানে এঁরা থাকেন প্রধানত সিন্ধুপ্রদেশে, সবচেয়ে বেশি করাচি শহরে। ভারতে বেশির ভাগের বাস গুজরাত, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে এবং হায়দরাবাদ শহরে।
১৮, জি ই ভন গ্রুনেবম সম্পাদিত ‘ইউনিটি অ্যান্ড ভ্যারাইটি ইন মুসলিম সিভিলাইজেশন’, পৃ ৮, শিকাগাে, ১৯৫৫
১৯, পৃ ৩, মহম্মদ আলি জিন্না: অ্যান অ্যামবাসাডর অব ইউনিটি, হিজ স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস, ১৯১২-১৯১৭, গণেশ অ্যান্ড কম্পানি, মাদ্রাজ, ১৯১৮
২০. ইসলিংটন, স্যর জন পয়ন্ডার ডিকসন-পয়ন্ডার (১৮৬৬-১৯৩৬), নিউজিল্যান্ডের সপ্তদশ গভর্নর। ভারতে পাবলিক সার্ভিস সংক্রান্ত রয়াল কমিশনের চেয়ারম্যান (১৯১২১৪)। হাউস অব লর্ডস-এ আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেটস ফর কলােনিজ (১৯১৪-১৫), আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেটস ফর ইন্ডিয়া (১৯১৬-১৮) এবং ১৯১৭-১৮’য় অল্পকালের জন্য ইন্ডিয়া অফিসের সর্বেসর্বা।
২২. ইসলিংটন কমিশনের সামনে বক্তব্য; মিনিটস অব এভিডেন্স, আই ও আর, খণ্ড ২২
২৩. অঞ্জুমান-ই-ইসলাম: ভারতের একটি প্রথম সারির শিক্ষা তথা সমাজ সংগঠন। ১৮৭৪ সালে স্যর বদরুদ্দিন তায়েবজির নেতৃত্বে মুসলিম সমাজের কিছু দূরদর্শী মানুষ এই প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। কয়েকটি তথ্য: শিক্ষা ট্রাস্ট-এর প্রধান লক্ষ্য ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয় সংহতি।
ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল, পলিটেকনিক, হােম সায়েন্স, হােটেল ও কেটারিং ম্যানেজমেন্ট, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বি এড কলেজ ইত্যাদি নানা ধরনের ক্ষেত্রে ও মানবসেবায় নিয়ােজিত শতাধিক প্রতিষ্ঠান।। ছাত্রসংখ্যা লক্ষাধিক। তিনটি অনাথ সদন, বিপন্ন পরিবারের জন্য একটি কেন্দ্র এবং অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা। শিক্ষা এবং সমাজ সংক্রান্ত কাজের জন্য মহারাষ্ট্র সরকার প্রদত্ত ‘স্টেট অ্যাওয়ার্ড ফর ২০০০’-এ সম্মানিত।
২৪. বম্বে গেজেট, ৩০ জুন, ১৯০৩
২৫. বম্বে গেজেট, ৩০ জুলাই, ১৯০৪
২৬, এইচ পি মােদী, স্যর ফিরােজশাহ মেটা: আ পলিটিকাল বায়ােগ্রাফি, খণ্ড ১, পৃ ২৫২২৫৩, মুম্বই ১৯২১
২৭. রেমিনিসেন্সেস অব লােক টিলক, পৃ ৩৩-৩৫, জিন্নার রচনাবলিতে উদ্ধৃত।
২৮. দি ইংলিশম্যান, ৩ জুলাই, ১৯০৮
২৯; ১৯১৬-র কাছাকাছি সময়ে সচরাচর কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের অধিবেশন ডাকা হত একই শহরে এবং মােটামুটি একই সময়ে, যাতে ইচ্ছুক প্রতিনিধিরা দুটিতেই যােগ দিতে পারেন।
৩০. মহম্মদ আলি জিন্না অ্যান্ড দ্য সিস্টেম অব ইম্পিরিয়াল কন্ট্রোল ইন ইন্ডিয়া ১৯০৯৩০, ডেভিড পেজ। প্রবন্ধটি আছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (করাচি ২০০৫) প্রকাশিত, এম আর কাজিমি সম্পাদিত ‘এম এ জিন্না, ভিউজ অ্যান্ড রিভিউজ’ সংকলনে।
৯৪
৩১, তদেব।
৩২. ওয়ালউ-আলাল-আউলাদ: মুসলিম ধর্মে পবিত্র, ধর্মীয় বা দাতব্য হিসাবে স্বীকৃত উদ্দেশ্যে সম্পত্তির ব্যবহার।
৩৩. ২২তম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রিপাের্ট।
৩৪. ভাইসরয়: বড়লাট। ব্রিটিশ রাজা বা রানির প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের শাসক। কথাটির মূলে আছে লাতিন উপসর্গ ‘ভাইস’, যার অর্থ ‘পরিবর্তে’ এবং ফরাসি শব্দ ‘রয়’, অর্থাৎ রাজা। বড়লাটের নিয়ন্ত্রণাধীন রাজত্বকে বলা হত ‘ভাইসরয়ালটি। ভাইসরয় থেকে বিশেষণ— ভাইসরিগাল। ভাইসরয়ের আসনে কোনও নারী থাকলে (নিতান্ত বিরল, কারণ ভাইসরয় একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর মাথায় থাকতেন) তাকে অথবা ভাইসরয়ের স্ত্রীকে বলা হত ‘ভাইসরেইন।
৩৫. দ্য কালেক্টেড ওয়ার্কস অব কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিন্না, খণ্ড ১, সৈয়দ শরিফুদ্দিন পিরজাদা সম্পাদিত, পৃ ১, ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট পাবলিশিং কম্পানি, করাচি, ১৯৮৪
৩৬. তদেব
৩৭. দ্য মেমােয়ার্স অব আগা খান, পৃ ১২৪-১২৫, সাইমন অ্যান্ড শুস্টার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৪।
৩৮. কায়েদ-এ-আজম জিন্না: হিজ পার্সোনালিটি অ্যান্ড পলিটিক্স, এস এম বার্ক ও সেলিমআল-দুই-কুরেশি, পৃ ৯৬ ও ইউ পি, করাচি, ১৯৯৭
৩৯. তদেব।
৪০. তদেব।
৪১. তদেব।
৪২. তদেব
৪৩. তদেব
৪৪. গােখলে-র এলিমেন্টারি এডুকেশন বিল, ১৯১২: ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল-এ বম্বে প্রেসিডেন্সির বেসরকারি প্রতিনিধি গােখেল ভারতে অবৈতনিক এবং আবশ্যিক ভিত্তিতে বুনিয়াদি শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য একটি বিল পেশ করেন। এতে বলা হয়েছিল, যে সব এলাকায় স্কুলে যাওয়ার বয়সী ছেলেদের অন্তত ৩৩ শতাংশ ইতিমধ্যেই স্কুলে পড়ছে, কেবল সেখানেই বুনিয়াদি শিক্ষাকে আবশ্যিক করতে হবে। এই রক্ষাকবচ সত্ত্বেও বিলটি পাশ করা যায়নি, এর বিরুদ্ধে প্রধান যুক্তি দেওয়া হয়েছিল: বুনিয়াদি শিক্ষাকে আবশ্যিক করার জন্য জনসাধারণের কোনও চাহিদা নেই এবং বাড়তি কর চাপানাে চলবে না।
প্রাইমারি এডুকেশন বিল, ১৯১৭: ভাইসরয়ের সুপ্রিম লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে গােখলে প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি তুললেন। তিনি এই মর্মে একটি প্রস্তাব পেশ করলেন যে, “আজ গােটা দুনিয়ায় এ কথা মান্য করা হয় যে দেশের সমস্ত ভাবী নাগরিককে একটা ন্যূনতম শিক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য, প্রায় সমস্ত সভ্য দুনিয়ায় রাষ্ট্র সেই কর্তব্য পালনের চেষ্টা করছে। তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, ভারতের লক্ষ লক্ষ শিশুর মঙ্গল ‘শিক্ষার মানবিক প্রভাব’-এর উপর ভিত্তি করে দাড়িয়ে আছে। এই বিলটিও পাশ করা গেল না। স্বাধীন ভারতে এই বিলের প্রধান প্রতিপাদ্যগুলি সাংবিধানিক আইন হিসেবে সর্বোচ্চ স্তরের মর্যাদা লাভ করেছে।
৯৫
স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট: ১৮৭২ সালে আইনটি প্রণীত হয়।
৪৫. ২৬তম ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর রিপাের্ট, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট কালচারাল অ্যান্ড হিস্টরিকাল রিসার্চ, ইসলামাবাদ, (১৯৮৮) প্রকাশিত রিয়াজ আহমেদ-এর ‘জিন্না: ফর্মেটিভ ইয়ার্স, ১৮৯২-১৯২০’ গ্রন্থে (পৃ ৯২-৯৩) উদ্ধৃত।।
৪৬, স্ট্যানলি রিড সম্পাদিত ‘দি ইন্ডিয়ান ইয়ার বুক, ১৯১৪’, পৃ ৪৭৬, বম্বে, ১৯১৫
৪৭. মেস্টন পেপার্স, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি, এম এস এস, ই ইউ আর. এফ. ১৩৬/৬
৪৮. দ্য কমরেড, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩
৪৯, বম্বে ক্রনিকল, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯১৩
৫০. তদেব, ২২ ডিসেম্বর, ১৯১৩
৫১. পৃ ১১, মহম্মদ আলি জিন্না: অ্যান অ্যামবাসাডর অব ইউনিটি, হিজ স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস, ১৯১২-১৯১৭, গণেশ অ্যান্ড কম্পানি, মাদ্রাজ, ১৯১৮
৫২. আলি ভ্রাতৃদ্বয়, অর্থাৎ মহম্মদ আলি এবং শওকত আলি ছিলেন ভারতের দুই প্রমুখ প্যান-ইসলামিস্ট। মহম্মদ আলি ছিলেন আলিগড় মহমেডান অ্যাংলাে-ইন্ডিয়ান কলেজের ছাত্র। ১৯০৭ সালে তিনি কলেজের ট্রাস্টিদের কাজে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি আনার জন্য একটি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেন, ১৯১০-এ এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার দাবিতে প্রচারে যােগ দেন। বলকান অঞ্চলে ইউরােপীয় রাষ্ট্রশক্তির আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়াটিকে তিনি প্রভুত্বের এক চরম রূপ হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর মতে ভারতীয়রা নিজ দেশেই প্রভুত্বের শিকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যাওয়ার পরেই মহম্মদ আলি তুরস্ক নিয়ে রাজনৈতিক প্রচারে নামলেন, উলেমাদের সঙ্গে তার যােগাযােগও হল এই সময়েই। এবং এই পর্বেই তিনি ব্রিটিশ রাজ-এর বিরােধিতা ও কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতার কথা বলতে শুরু করলেন।
মহম্মদ আলি যে রাজনৈতিক সমন্বয় গড়ে তুলতে চাইলেন, তার ছিল দুটি মেরু: দিল্লি এবং আলিগড়। দিল্লি তিনি ‘কমরেড’ সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেন।
৫৩, কায়েদ-এ-আজম জিন্না: হিজ পার্সোনালিটি অ্যান্ড পলিটিক্স, এস এম বার্ক ও সেলিমআল-দুই-কুরেশি, পৃ ৯৫, ও ইউ পি, করাচি, ১৯৯৭
৫৪. জিন্না: দ্য ফর্মেটিভ ইয়ার্স, ১৮৯২-১৯২০’, রিয়াজ আহমেদ, পৃ ১২০-১২১ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট কালচারাল অ্যান্ড হিস্টরিকাল রিসার্চ, ইসলামাবাদ, ১৯৮৮
৫৫. কায়েদ-এ-আজম জিন্না: হিজ পার্সোনালিটি অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ ১২৩-১২৬, ও ইউ পি, করাচি, ১৯৯৭।
৫৬. ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে লিগ এবং কংগ্রেস দুই দলই কলকাতায় বিশেষ অধিবেশন ডেকেছিল।
৫৭, তদেব, পৃ ১২৭-১৩০
৫৮. তদেব ।
৫৯. অল গ্রু দ্য গাঁধিয়ান এরা, এ এস আয়েঙ্গার, হিন্দ কিতাব, ১৯৫০
৬০. কাসিম মিঠা ছিলেন বম্বের এক মুসলিম নেতা এবং বম্বের রাজনীতিতে জিন্নার প্রতিদ্বন্দ্বী।
৯৬
৬১. লখনউ চুক্তি, ১৯১৬: শুরুতে মুসলিম লিগ ছিল একটি নরমপন্থী সংগঠন, ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করাই ছিল তার লক্ষ্য। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করার পরে মুসলিম লিগ তাদের অবস্থান পালটায়। ১৯১৩ সালে মুসলিম সমাজ থেকে একগুচ্ছ নতুন নেতা উঠে এলেন, যাঁরা হিন্দুদের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে আগ্রহী ছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না, তিনি তখনই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য। মুসলিম লিগ নিজের নীতি বদলে কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ ভাবে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির নীতি নিল। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে কী ধরনের সংস্কার আনা উচিত, সে বিষয়ে চেমসফোর্ড ভারতের রাজনীতিকদের পরামর্শ চাওয়ার ফলে লিগের এই উদ্যোগের আরও সুবিধা হল।
জিন্নার প্রবল চেষ্টায় ১৯১৫-র ডিসেম্বরে বম্বেতে লিগ এবং কংগ্রেস, উভয়েরই অধিবেশন ডাকা হল। এই দুই সংগঠনের ইতিহাসে সেই প্রথম দু’পক্ষের প্রধান নেতারা একই সময়ে একই জায়গায় সমবেত হলেন। দুই অধিবেশনেই বক্তৃতার মেজাজ এবং মূল বক্তব্য ছিল একই ধরনের। এর কয়েক মাস পরে, ১৯১৬-র অক্টোবরে ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের হিন্দু ও মুসলমান মিলিয়ে উনিশ জন সদস্য বড়লাটকে সংস্কার বিষয়ক একটি স্মারকপত্র দিলেন। ব্রিটিশরা এই স্মারকপত্রটিকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না, কিন্তু নভেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের নেতারা একটি বৈঠকে এই স্মারকপত্রটি নিয়ে আলাপ আলােচনা করে ও কিছু সংশােধন এনে সেটি অনুমােদন করলেন। আইনসভার গঠন কী হবে, সেখানে দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের অনুপাত কী হবে, এই সব বিষয়ে দু’পক্ষের নেতারা একটা বােঝাপড়ায় পৌঁছলেন। কংগ্রেস এবং লিগ লখনউতে তাদের বার্ষিক অধিবেশনে, যথাক্রমে ২৯ ও ৩১ ডিসেম্বর, এই বােঝাপড়ায় চূড়ান্ত সম্মতি দিল। লখনউ চুক্তির প্রধান রূপকার জিন্নাকে সরােজিনী নাইডু ‘অ্যামবাসাডর অব হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি’ অর্থাৎ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত হিসেবে অভিনন্দন জানালেন। লখনউ চুক্তির প্রধান বিষয়গুলি ছিল এই রকম—
১) ভারতে স্বশাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
২) কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলমানদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ থাকবে।
৩) প্রতিটি সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী থাকবে, যদি না কোনও সম্প্রদায় সম্মিলিত নির্বাচকমণ্ডলীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার দাবি জানায়।
৪) বিভিন্ন সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্ব দেওয়া হবে।
৫) কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্যসংখ্যা বাড়িয়ে ১৫০ করা হবে।
৬) প্রাদেশিক স্তরে আইনসভার পাঁচ ভাগের চার ভাগ সদস্য নির্বাচিত হবেন, একপঞ্চমাংশ হবেন মনােনীত সদস্য।
৭) বড় আয়তনের প্রদেশগুলিতে আইনসভার সদস্যসংখ্যা হবে অন্তত ১২৫, ছােট প্রদেশে ৫০ থেকে ৭৫।
৮) মনােনীত সদস্য ছাড়া অন্য সব সদস্য প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হবেন।
৯) কোনও সম্প্রদায়ের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত কোনও বিল সম্পর্কে আইনসভায় সেই সম্প্রদায়ের সদস্যদের তিন-চতুর্থাংশের আপত্তি থাকলে বিলটি পাশ হবে না।।
১০) লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর।
৯৭
১১) লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্যরাই তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন।
১২) ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের অর্ধেক সদস্য হবেন ভারতীয়।
১৩) ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ভেঙে দিতে হবে।
১৪) সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্স-এর বেতন মেটাতে হবে ব্রিটিশ সরকারকে, ভারতীয় রাজস্ব থেকে নয়।
১৫) দু’জন আন্ডারসেক্রেটারির এক জন হবেন ভারতীয়।
১৬) শাসনবিভাগকে বিচারবিভাগ থেকে স্বতন্ত্র করতে হবে।
যদিও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আয়ু আট বছরের বেশি হয়নি, খিলাফত-উত্তর কালে সেই ঐক্য বিনষ্ট হয়, তবু দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের ইতিহাসে লখনউ চুক্তি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই প্রথম কংগ্রেস মুসলিম লিগকে এই অঞ্চলের মুসলমানদের প্রতিনিধি রাজনৈতিক দল হিসাবে স্বীকার করল। স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি মেনে নিয়ে কংগ্রেস কার্যত মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবেও বিবেচনা করতে রাজি হল। সুতরাং তারা। প্রকারান্তরে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণাটি গ্রহণ করল।
৬২. ই এস মন্টেগু ছিলেন সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়া (১৯১৭-২৩), লর্ড চেমসফোর্ড ছিলেন বড়লাট (১৯১৬-২১)। তাদের সময়েই ‘মন্টেগু চেমসফোর্ড রিফর্মস’ (১৯১৯) নামক সংস্কার নীতি বলবৎ হয়। ভারতসচিব হিসাবে মন্টেগু ভারত সফর করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করেন। জিন্নার সঙ্গেও তার কথা হয়, সে বিষয়ে নিজের দিনলিপিতে তিনি লিখেছেন। জিন্না লন্ডনে থাকার সময়েও ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে মন্টেগুর সঙ্গে কথা বলেছিলেন।
৬৩. ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিল বিতর্ক, ১৯১৮, ১৯১৯, ৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৮, পৃ ১৩৩।
৬৪. গুর্জর সভার অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে এম কে গাঁধী, বম্বে, ১৪ জানুয়ারি ১৯১৫, কালেক্টেড ওয়ার্কস অব মহাত্মা গাঁধী, ত্রয়ােদশ খণ্ড, প্রকাশনা বিভাগ, তথ্য মন্ত্রক, দিল্লি, ১৯৬৪, নং ৮, পৃ ৯
৬৫. জিন্না: দ্য ফর্মেটিভ ইয়ার্স, ১৮৯২-১৯২০’, রিয়াজ আহমেদ, পৃ ১২২ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট কালচারাল অ্যান্ড হিস্টরিকাল রিসার্চ, ইসলামাবাদ, ১৯৮৮
৬৬. তদেব।
৬৭. তিন জনের মধ্যে গােখলের বয়স ছিল সবচেয়ে কম। ভারতের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান’ দাদাভাই নওরােজি জীবনের বেশির ভাগটাই ইংল্যান্ডে ভারতীয় স্বশাসনের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে কাটিয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী ফিরােজশাহ মেটা ১৮৯০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন। গােখলের চোখে নওরােজি এবং মেটা ছিলেন গুরুর মতাে, অনুকরণীয়। তিন জনের সঙ্গেই কোনও না কোনও সময়ে জিন্নার যােগাযােগ হয়েছিল। নওরােজির প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসাবে জিন্না তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন; তঁার আইনি এবং রাজনৈতিক জীবন তৈরি করতে মেটা কে অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন; নিজের রাজনৈতিক জীবনের প্রথম দিকে জিন্না ‘মুসলিম গােখলে’ বলে পরিচিত ছিলেন।
৬৮, ১৯১৭-র অগস্টে গাঁধী লন্ডনে গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের বিদেশ নীতির প্রশংসা
৯৮
করেন, ভারতীয়দের ‘সাম্রাজ্যের অঙ্গ হিসাবে চিন্তাভাবনা করতে বলেন এবং একটি ভারতীয় রেজিমেন্টের জন্য সেনা নিয়ােগ-এর ভারপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রূপে কাজ করেন।
৬৯, বম্বে ক্রনিকল, ১ জানুয়ারি ১৯১৬; জিন্না: দ্য ফর্মেটিভ ইয়ার্স, ১৮৯২-১৯২০’, রিয়াজ আহমেদ, পৃ ১৪৭-১৪৮ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট কালচারাল অ্যান্ড হিস্টরিকাল রিসার্চ, ইসলামাবাদ, ১৯৮৮
৭০. গােখলের পরিকল্পনা
প্রবীণ কংগ্রেস নেতা গােপালকৃষ্ণ গােখলে (১৮৬৬-১৯১৫) নাকি মৃত্যুর দু’দিন আগে একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেন। তার তিনটি প্রতিলিপি পাঠানাে হয়েছিল লর্ড উইলিংডন, ফিরােজশাহ মেটা এবং আগা খাঁকে। ১৯১৭ সালে, মন্টেগু বিবৃতির সমকালে এটি লন্ডনে প্রকাশ করেন আগা খাঁ, ভারতে শ্রীনিবাস শাস্ত্রী। গােখলের উইল এবং টেস্টামেন্ট’ নামেও পরিচিত এই নথিটিতে ব্রিটিশ সরকারকে অবিলম্বে এবং স্বতঃপ্রণােদিত ভাবে প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ঘােষণা করার আবেদন জানানাে হয়েছিল। যদি ব্রিটিশ সরকার ভারতকে প্রাদেশিক স্বশাসন মঞ্জুর করে, তা হলে গভর্নরের একজিকিউটিভ কাউন্সিলে ভারতীয় সদস্যদের স্থান দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে কয়েকটি সুপারিশ ছিল এই রকম:
লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা হবে ৭৫ থেকে ১০০-র মধ্যে, তাদের পাঁচ ভাগের চার ভাগ হবেন নির্বাচিত সদস্য।
সদস্যরা বিভিন্ন স্বার্থগােষ্ঠীর দ্বারা নির্বাচিত হবেন, কয়েকটি সম্প্রদায়ের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে। মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী থাকবে। প্রশাসন সম্পর্কে সদস্যদের মতামত প্রকাশের অধিকার থাকবে।
লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির অনুমােদন ছাড়া বাজেট পাশ করা যাবে না, তবে গভর্নরের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে।
গােখলের টেস্টামেন্ট-এর গুরুত্ব ছিল এইখানে যে, তিনি সাম্প্রদায়িক সংকট নিরসনের একটা পথ দেখিয়েছিলেন। মর্লি-মিন্টো রিফর্মস-এর মতােই তিনি হিন্দু এবং মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন।
৭১. জিন্না: দ্য ফর্মেটিভ ইয়ার্স, ১৮৯২-১৯২০’, রিয়াজ আহমেদ, পৃ ১৪৮ ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট কালচারাল অ্যান্ড হিস্টরিকাল রিসার্চ, ইসলামাবাদ, ১৯৮৮
৭২. মন্টেগুকে স্যর জর্জ লয়েড, ১৩ অগস্ট ১৯২০, মন্টেগু পেপার্স
৭৩, অর্থ বােঝার জন্য সপ্তম অধ্যায়ের শেষটীকা দ্রষ্টব্য
৭৪. এই সময়ের এক সিনিয়র আই সি এস অফিসার, স্যর জেমস মেস্টন।
৭৫. চেমসফোর্ডকে মন্টেগু, ১১ জানুয়ারি ১৯১৭, খণ্ড ১৮, নং ১৪, পৃ ১৬-১৯, চেমসফোর্ড পেপার্স
৭৬. আমদাবাদ মিল ধর্মঘট শেষ হতে না হতেই গাঁধী খেদা সত্যাগ্রহ শুরু করলেন। খেদা জেলায় দুর্ভিক্ষের মতাে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতেই এই সত্যাগ্রহ। খেদার পটিদাররা চেয়েছিলেন, অজন্মার বছরটিতে তাদের খাজনা মকুব করা হােক। মােহনলাল পাণ্ড্য এবং শংকরলাল পারেখের মতাে স্থানীয় সহযােগীদের নিয়ে গাঁধী এই দাবিতে সত্যাগ্রহ
৯৯
শুরু করলেন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই গুজরাতে সত্যাগ্রহের ধারণা কার্যকর হল, এই আন্দোলনের সূত্রেই গাঁধী খুঁজে পেলেন বল্লভভাই পটেলকে।
৭৭. এডউইন মন্টেগুকে লর্ড উইলিংডন, বম্বে, ৩০ এপ্রিল ১৯১৮, পৃ ৫০-৫১, মন্টেগু পেপার্স, এম এস এস ই ইউ আর ডি ৫২৩/১৮
৭৮. মন্টেগুকে লয়েড, ১২ জুন ১৯১৯, মন্টেগু পেপার্স, এম এস এস ই ইউ আর ডি ৫২৩/২৫
৭৯. চেমসফোর্ডকে জিন্না, ২৮ মার্চ ১৯১৯
৮০. তদেব।
৮১. জিন্না কি, হয়তাে অবচেতনে, কংগ্রেসের ছায়া থেকে মুক্ত একটি মঞ্চ এবং ভূমিকা খুঁজছিলেন? তিনি কি বুঝতে পারছিলেন যে ব্রিটেনে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বের জন্য যতটা কদর পাবেন, নিছক এক জন মুসলমান হিসেবে ততটা পাবেন না? এটাই কি ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মঞ্চটি ধরে রাখতে তার আর এক প্রয়াস? শেষ কথা কে বলবে?
৮২. আই সি এস অফিসার স্যর উইলিয়ম ওয়েডারবার্ন বম্বে প্রদেশের চিফ সেক্রেটারি হিসেবে অবসর নিয়েছিলেন। ১৮৮৯ সালে তিনি বম্বেতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ কংগ্রেসের সভাপতি হন। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লিবারাল সদস্য হন। উদারপন্থী হিসেবে তিনি স্বশাসনের আদর্শে বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এ ভারতের শরিক হওয়ার পক্ষে ছিলেন তিনি। তার একটি বড় অবদান ছিল ইন্ডিয়ান রিফর্ম আন্দোলনের পক্ষে তার আজীবন প্রয়াস। মন্টফোর্ড রিফর্মকে তাই তার জীবনের একটি মাইলফলক বলা চলে।
গােখলে ১৮৮৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য হন, ১৮৯৫ সালে টিলকের সঙ্গে কংগ্রেসের জয়েন্ট সেক্রেটারি হন। নাগরিকদের ভারতের সেবায় আত্মনিবেদনের জন্য প্রশিক্ষিত করতে এবং সাংবিধানিক পদ্ধতিতে ভারতের জাতীয় স্বার্থের প্রসার ঘটাতে ১৯০৫ সালে তিনি সারভ্যান্টস অব ইন্ডিয়া সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। গােখলে ছিলেন এক জন অগ্রণী সমাজ সংস্কারকও জাতপাত এবং অস্পৃশ্যতার কঠোর সমালােচক, নারীমুক্তি এবং স্ত্রীশিক্ষার প্রবল প্রবক্তা। রাজনৈতিক সংস্কার সাধনের জন্য যে ভারতীয়রা সরকারের সঙ্গে সহযােগিতায় ইচ্ছুক ছিলেন, গােখলে তাদের জন্য আরও বেশি স্বশাসনের অধিকার চেয়েছিলেন।
১০০
তৃতীয় অধ্যায়
উত্তাল কুড়ির দশক
১৯২০’র দশকে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব
এই সমস্যাসঙ্কুল পর্বে স্থায়ী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং যৌথ হিন্দু-মুসলিম মঞ্চের জন্য যত চেষ্টা হচ্ছিল, যেন সেই অনুপাতেই দুই সম্প্রদায়ের বিরােধ ও সংঘাত বেড়ে চলছিল। আগেও মাঝে মাঝেই এমন সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। যেমন, ১৯০৪১৪ বা ১৯১৭-১৮ সময়পর্বে। এই আগের ঘটনাগুলির মধ্যে একটা যােগসূত্র ছিল—
যখনই রাজনৈতিক ক্ষমতার আংশিক হস্তান্তরের কোনও উদ্যোগ হয়েছে, তখনই দ্বন্দ্ব বেড়েছে। তার কারণ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুসলিম আধিপত্য কমার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুরা সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছে, তার ফলে প্রতিবাদ হয়েছে, সেই প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, সংঘাত বেড়েছে। ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে একটু একটু করে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা দিয়েছে, সেই ক্ষমতার ভাগ নিয়ে হিন্দু-মুসলমান রেষারেষি বেড়েছে, সংরক্ষণের মতাে প্রশ্নগুলি মাথা চাড়া দিয়েছে। প্রতিবাদের জন্য যে সব আন্দোলন গড়ে উঠেছে, সেগুলিও নতুন নতুন বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এই সব কিছুর মধ্যে দিয়েই হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অন্ধকার দিকটা ক্রমশ প্রকট হয়েছে। ১৯১৯ সালের কাউন্সিল সংস্কারের পদক্ষেপও এই বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। অসহযােগ আন্দোলন বিভাজনগুলিকে কিছুটা ঢেকে দিতে পেরেছিল, ওই আন্দোলন প্রত্যাহৃত হওয়ায় সমস্যা আরও বেড়ে গেল। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য’র স্লোগানটি এই পরিস্থিতির বলি হল, এখন হয় এটিকে ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার করা হতে লাগল, অথবা হিন্দু ও মুসলমান। দু’পক্ষই এই ঐক্যের স্লোগানটিকে সরাসরি আক্রমণ করতে লাগলেন। প্রেস অ্যাক্ট রদ হওয়ায় এবং কংগ্রেস ও মুসলমান খিলাফতিদের মধ্যে বােঝাপড়া ভেঙে যাওয়ায় সংবাদপত্রেও আবার সেই আগের মতাে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব নিয়ে উত্তেজক খবর ও মতামত ছাপানাে শুরু হল।
এই সময় মালাবারে একটা বড় সংকট দেখা দিল। ১৯২১ সালের অগস্ট থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে মােপলা বিদ্রোহ শুরু হল। এ ধরনের অস্থিরতা নতুন নয়, এর একটা ইতিহাস ছিল। কিন্তু এ বার একটা বড় বিদ্রোহ হল। পঞ্চাশ হাজার মানুষ এই
১০১
বিদ্রোহের শরিক হল, ব্রিটিশরা বিদ্রোহ দমনে এতটা শক্তি প্রয়ােগ করল, “১৮৫৭-র পরে অভ্যন্তরীণ কোনও আন্দোলন দমনে যেমন যুদ্ধপ্রচেষ্টা আর দেখা যায়নি।”[৩] সরকার বলল, এটা কংগ্রেস-খিলাফত আন্দোলনের সরকারবিরােধী প্রচারেরই পরিণাম, খিলাফতের আদর্শ এই বিদ্রোহের একটা ধর্মীয় চেহারা দিয়েছে।
পঞ্জাবে রাওলাট অ্যাক্ট-এর পরবর্তী সামরিক শাসনের স্মৃতি তখনও তাজা। সেখানে ভয় ছিল, ১৯১৯-এ পঞ্জাবে যে চণ্ডনীতি প্রয়ােগ করা হয়েছিল, মালাবারেও তার পুনরাবৃত্তি হবে। বিশিষ্ট জননায়ক লালা লাজপত রায় সম্পাদিত লাহােরের ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকা এই বিদ্রোহের কঠোর সমালােচনা করল। ব্রিটিশ সরকার ‘খিলাফত আন্দোলনই এ জন্য দায়ী বলে যে প্রচার করছিল, লালাজি তার নিন্দা করে লিখলেন, ‘এটা একটা কল্পিত কারণ, তার যুক্তিসঙ্গত অভিমত ছিল, “এই বিদ্রোহ যদি খিলাফত আন্দোলনের পরিণামই হবে, তা হলে এটা করাচিতে তথা সিন্ধুপ্রদেশে ঘটবার কথা ছিল।”[৫] এই ধরনের সংবাদপত্রে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা চলতে লাগল, কিন্তু প্রতি দিন দক্ষিণ থেকে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের নানা খবর আসছিল, ফলে সংবাদপত্রগুলির পক্ষে এই অবস্থান বজায় রাখা কঠিন হয়ে উঠছিল। মালাবার বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়া উত্তর ভারতেও পৌছল এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষতি করল।
এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস পড়ল বিভিন্ন পরস্পরবিরােধী স্বার্থের সংঘাতে। তখন কংগ্রেসের সমস্ত বড় নেতাই কারাবন্দি, দল অর্থাভাবে ভুগছে, ভবিষ্যতে কোন দিকে যেতে হবে সে বিষয়েও নীতি পরিষ্কার নয়। এই সব দ্বন্দ্ব ও বিরােধ কংগ্রেসের মৌলিক হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আদর্শেই আঘাত করল। কংগ্রেস কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করল ঠিকই, কিন্তু তাতে ফল বিশেষ হল না।
হিন্দুদের স্বার্থের উপর জোর দেওয়ার ব্যাপারে পঞ্জাব ইতিমধ্যে যুক্তপ্রদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। যুক্তপ্রদেশে হিন্দু মহাসভা তৈরিই হয় ১৯১১ সালে, তার ঠিক ভাবে কাজ শুরু করতে করতে ১৯১৫ হয়ে যায়। হিন্দু মহাসভার ইতিহাসে ১৯২২ খুব। গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর এবং তার পিছনে ছিল হিন্দু সমাজে মুসলিম আতঙ্ক’র নাটকীয় প্রচার। মালাবারে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের খবর তাে কাগজপত্রে ছাপা হচ্ছিলই, এ বার তার সঙ্গে যােগ হল পঞ্জাবের খবর। ১৯২২-এর সেপ্টেম্বরে মহরমের সময় মূলতানে একটা বড় দাঙ্গা হল, তাতে হিন্দুদেরই বেশির ভাগ ক্ষয়ক্ষতি হল। তখন গুরুকা-বাগ-এর অকালি শিখ সমস্যা নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য পণ্ডিত মদনমােহন মালব্য পঞ্জাবে ছিলেন। তিনি অমৃতসরে এবং লাহৌরে বড় বড় জনসভায় বক্তৃতা দিলেন এবং সেখানে মূলতানের এই ঘটনা সম্পর্কে বিশদ ভাবে প্রচার করলেন। লাহৌরে তিনি দাঙ্গার মর্মান্তিক সব বর্ণনা দিলেন এবং হিন্দুরা আত্মরক্ষার যথেষ্ট ব্যবস্থা করতে পারেনি বলে আক্ষেপ করলেন, হিন্দুদের সমালােচনাও করলেন।
‘মােপলা বিদ্রোহ’ এবং মূলতানের দাঙ্গার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়া হল সুদূরপ্রসারী। পরবর্তী ছ’বছরে ‘মালাবার এবং মূলতান’-এর নামে জিগির তুলে হিন্দু সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তােলার প্রবল চেষ্টা চলল। ১৯২২-এর ডিসেম্বরে গয়ায় হিন্দু মহাসভার
১০২
বার্ষিক অধিবেশনে পণ্ডিত মদনমােহন মালব্য প্রচারের সুরটি বেঁধে দিলেন। তিনি প্রস্তাব করলেন, প্রত্যেকটি গ্রামে হিন্দু সভা গড়ে তােলা হােক। এই অধিবেশনে পণ্ডিত মালব্যের প্রস্তাব কেবল সমর্থনই পেল না, অধিবেশন শেষ হল আরও অনেক বেশি। জঙ্গি মানসিকতায়।
ইতিমধ্যে, কুড়ির দশকের মাঝামাঝি, হিন্দুদের প্রচারের মােকাবিলায় মুসলমানরা তেমন সংগঠিত হতে পারেনি। হিন্দু মহাসভার ‘মহাবীর দল’-এর জবাব হিসেবে ‘আলি গােল” নামে একটি শরীরচর্চা-ভিত্তিক সাংস্কৃতিক দল তৈরির চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু বিশেষ কাজ হয়নি। সত্যিকারের ‘সংগঠন’[৯] গড়ার একটাই উদ্যোগ হয়েছিল। সেটাও প্রায় সম্পূর্ণতই এক জন মানুষের উদ্যোগে। ১৯২৪ সালে শওকত আলির। অন্যতম সহযােগী সইফুদ্দিন কিচলু ‘তাঞ্জিম’ আন্দোলন শুরু করলেন। তিনি কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির কাছে কিছুটা সাহায্য পেলেন, অমৃতসরে ‘তাঞ্জিম’ নামে একটি উর্দু দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করলেন এবং অর্থ সংগ্রহ ও মত প্রচারের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা সফরে ঘুরলেন। সংগঠন নিয়ে মুসলিম সমাজের প্রতিক্রিয়া ছিল বিক্ষিপ্ত, এর ফলে নতুন কোনও প্রতিষ্ঠানও তৈরি হল না। কিন্তু এই উদ্যোগ হিন্দুদের পক্ষে স্বস্তিদায়ক হয়নি, তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মুসলমানরা প্রবল, তাদের রুখতে সক্রিয় হওয়া দরকার।’
আরও একটা ব্যাপার হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বে ইন্ধন জোগাত (এখনও জোগায়)। দুই সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসবগুলি বছরের একই সময়ে পড়ে। এই নিয়েই সমস্যা। বিশেষ সমস্যা হত (এবং হয়) রামলীলা বা দসেরা আর মহরম ও বর-ইদ-এর সমাপতন নিয়ে। এক দিকে গােহত্যা, অন্য দিকে মসজিদের সামনে মাইক বাজানাে, এই নিয়ে অশান্তি হত, আজও হয়। কুড়ির দশকে এই উৎসবের মরসুমেই দাঙ্গা বেশি হত। এমন অবস্থা দাড়িয়েছিল যে ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকরা হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের ঘটনাগুলিকে বিদ্রুপ করে ‘গরু আর গানবাজনা’র প্রশ্ন বলতেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ-এ ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক রােজালিন্ড ও’হ্যানলন যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, “ব্রিটিশদের আইনসর্বস্ব মনােভঙ্গি সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে তুলেছিল। ব্রিটিশরা চাইত, যে কোনও বিবাদ আদালতে নিয়ে যেতে। তাদের মত ছিল এক বার একটা মামলায় আদালত যে রায় দেবে, সেটাই পরে অনুরূপ বিবাদ নিরসনের ক্ষেত্রে ‘নজির হিসেবে কাজে লাগবে। স্বভাবতই দুই সম্প্রদায়ের নেতারা বিবাদে নিজের নিজের পক্ষের হয়ে লড়াই করতে বাধ্য হতেন, তার ফলে বিবাদ আরও গড়াত এবং তিক্ততা বেড়েই চলত।”
‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রশ্নের মূল ছিল অন্যত্র, কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক কারণগুলি কী ভাবে সেই প্রশ্নটিকে আরও জটিল করে তুলেছিল, তার একটা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হল। এর থেকেই পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতটি বুঝতে সুবিধা হবে। মনে রাখতে হবে, যখন দুই তরফের মধ্যে বােঝাপড়ার উদ্যোগ চলেছে, তখনও এই
১০৩
মূলগত সামাজিক বিভেদ দ্বন্দ্ব, বিচ্ছিন্নতা এবং আধিপত্য নিয়ে রেষারেষির আগুনে ইন্ধন জুগিয়ে গিয়েছে। রাজনীতির মঞ্চে স্বশাসন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং অনুরূপ সব বিষয় নিয়ে আলাপ আলােচনা চলেছে, কিন্তু সামাজিক স্তরে আচার, বিশ্বাস এবং অনুশীলনের ক্ষেত্রে দুই সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতা সামাজিক কাঠামােয় ক্রমাগত ধাক্কা দিয়েছে, অনেক সময়েই তাকে ভেঙে দিয়েছে।
উনিশশাে কুড়ির দশকের ঐতিহাসিক ঘটনাপরম্পরাকে বুঝতে হলে এই পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রাখতে হবে।
ব্যবধান আরও প্রসারিত হল
প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হল। পট দ্রুত বদলে গেল। ব্রিটিশদের শাসন-যােগ্যতা নিয়ে অনেক বেশি প্রশ্ন উঠতে লাগল। প্রথম মহাযুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে ইউরােপের মাটিতে ইউরােপীয় সৈন্যদের সঙ্গে ভারতীয় সৈন্যদের লড়াই অনেক বার্তা পৌঁছে দিল। সেভরের চুক্তির১২ পরে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ও খলিফা পদটির বর্জন১৩ হিন্দু ও মুসলমানদের সাময়িক ভাবে এক মঞ্চে দাড় করিয়ে দিল। খলিফা বর্জনের এই প্রতিক্রিয়া থেকেই খিলাফত আন্দোলনের উৎপত্তি। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল, একটা ঘটনার পরিণাম অনেক সময়েই আগে থেকে কিছুই বােঝা যায় না।
এই সব কারণে একটা ব্যাপার ঘটে। দু’বছর আগেও ব্রিটিশদের যে সব উদ্যোগে ভারতীয়রা সদর্থক সাড়া দিত, এখন সেগুলিই তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। ১৯১৯-এর কাউন্সিল সংস্কার যখন শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়, তখন এটাই বাস্তব।
তত দিনে অবশ্য আরও এক বিরাট বাধার সৃষ্টি হয়েছে: বিয়ােগান্ত, মর্মান্তিক এবং শেষ পর্যন্ত ঐক্যবিনাশী এক ঘটনা, যার ফলে চর্তুদিকে সব আশা হারিয়ে যেতে বসার উপক্রম। সেটা হল ১৩ এপ্রিল ১৯১৯, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। দেশ জুড়ে এই ঘটনার এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া হল যে ব্রিটিশ সরকারের সব উদ্যোগ তখনকার মতাে অবান্তর হয়ে গেল। এর আগে অবধি গাঁধী মিত্রশক্তির সঙ্গে সহযােগিতার কথা বলছিলেন, এই ঘটনার পরে তিনি গণপ্রতিবাদ ও অসহযােগ আন্দোলনের নতুন জমি পেলেন। এর পর কংগ্রেস দ্রুত নরমপন্থা থেকে আইন অমান্য আন্দোলনের পথে চলে গেল। এই পরিবর্তনের সবচেয়ে প্রকট নজির দেখা গেল হােম রুল লিগ-এর ক্ষেত্রে এত দিন এটি ছিল একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, এ বার সেটি পরিণত হল একটি রাজনৈতিক সংগঠনে। এই বিষয়ে আমরা পরের অধ্যায়গুলিতে আলােচনা করব।
কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ উভয়েই ১৯১৬ সালে লখনউতে নিজের নিজের অধিবেশনে সমস্ত প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর প্রশ্নে সম্মত হয়েছিল, এমনকী হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলিতেও তাদের একটি বিশেষ গুরুত্ব দিতে
১০৪
রাজি হয়েছিল। এটাকেই দুই সম্প্রদায়ের, এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে একটা কাজ চালানাের মতাে সহযােগিতার ভিত্তি হিসেবে দেখা হয়েছিল। তার ‘পিলগ্রিমেজ টু ফ্রিডম’-এ কে এম মুনশি চমকপ্রদ গদ্যে ঘটনাবলির বিবরণ দিয়েছেন: “এক অর্থে জিন্না তখন (একই সঙ্গে) কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছেন। তিনি ভারতের একটি খসড়া সংবিধান প্রণয়নে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন এবং সেই প্রস্তাবটি কংগ্রেস ও লিগ, দুই সংগঠনের অধিবেশনেই। অনুমােদন করিয়ে নিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক লখনউ চুক্তি এই সংবিধানেরই অঙ্গ। এই চুক্তিতে মুসলমানরা স্বাধীনতার জন্য হিন্দুদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়তে রাজি হল, বিনিময়ে কংগ্রেসকে তাদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী মেনে নিতে হবে, যে নির্বাচকমণ্ডলীতে তাদের জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।”[১৫]
এই জিন্নাই পরে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের বিনাশকারী হিসেবে নিন্দিত হবেন এবং একই সঙ্গে বন্দিত হবেন পাকিস্তানের স্রষ্টা হিসেবে। তাকে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর প্ররােচনা দেওয়ার জন্য এবং ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্য নষ্ট করার জন্যও ধিক্কার কুড়ােতে হবে। কিন্তু সে সব পরের কথা। এখানে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, ১৯০৬ সালে এক জন জাতীয়তাবাদী মুসলমান হিসেবেই তিনি কংগ্রেসে প্রবেশ করেছিলেন এবং ১৯১৬ পর্যন্ত তার প্রধান অবদান লখনউ চুক্তি, যা ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক প্রতীক।
কিন্তু বাতাসে তখনই পরিবর্তনের হাওয়া। পথগুলাে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সেটা কেবল খিলাফতের ব্যাপারে গাঁধীজির সমর্থন আর জিন্নার বিরােধিতার জন্যই নয়, গােটা হােম রুল লিগের প্রশ্নেও। কে এম মুনশি লিখছেন, “গাঁধী হােম রুল লিগের উদ্দেশ্যটাকেই পালটে দিলেন- আগে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বশাসনের দাবি, এখন বলা হল পূর্ণ স্বরাজ চাই এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি চাই। তা ছাড়া, লিগের উদ্দেশ্য-তালিকায় ‘সাংবিধানিক উপায়ে কথাগুলির বদলে লেখা হল ‘শান্তিপূর্ণ এবং বৈধ উপায়ে। জিন্না প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন যে, হােম রুল লিগের নিয়মে যথাযথ নােটিস না দিলে এবং তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের অনুমােদন না পেলে তার সংবিধান সংশােধন করা যায় না… অথচ এই সংশােধনটি সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই পাশ করিয়ে নেওয়া হল, সমস্ত আপত্তি গাঁধী উড়িয়ে দিলেন। এর পর জিন্না আরও উনিশ জন সদস্যকে (কে এম মুনশি সহ) নিয়ে হােম রুল লিগ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মুনশি এই ঘটনার পরিণাম সম্পর্কেও লিখেছেন। তাঁর বক্তব্য, “গাঁধীজি যখন জিন্না ও তার অনুগামীদের হােম রুল লিগ থেকে এবং পরে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করলেন, তখন জিন্নার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও মনে হয়েছিল যে, জনসাধারণের ওপর তার বিরাট প্রভাব কাজে লাগিয়ে গাঁধী যদি একটি অসাংবিধানিক আন্দোলন (আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে তােলেন, তার পরিণতি হিংসাত্মক হতে বাধ্য, আর সেটা শিক্ষিত হিন্দু ও মুসলমানের সহযােগিতার ভিত্তিতে স্বশাসনের প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজে ব্যাঘাত ঘটাবেই। জনসাধারণের মধ্যে বলপ্রয়ােগের শক্তি জাগিয়ে তুললে দুই
১০৫
সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় আকারের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে, এবং ঠিক সেটাই হয়েছিল। জিন্নার বাস্তববােধ প্রখর ছিল বলেই তিনি এই প্রশ্নে গাঁধীর সঙ্গে কোনও আলােচনায়। রাজি হননি।” মুনশি আরও লিখেছেন, “আর একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল— প্রথম মহাযুদ্ধের পরে তুরস্কে খলিফার পদ বর্জনের বিরুদ্ধে মহম্মদ আলি ও শওকত আলির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা খিলাফত আন্দোলনকে গাঁধী সমর্থন করলেন।”[১৭] খিলাফত যে মূলত ধর্মীয় আন্দোলন ছিল, সেটা ২০ অক্টোবর ১৯২১-এর ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’য় গাঁধীর নিজের লেখাতেই পরিষ্কার, তিনি লিখেছিলেন, “আমার দাবি, আমাদের উভয়ের পক্ষেই খিলাফত খুব গুরুত্বপূর্ণ, মৌলানা মহম্মদ আলির কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি তার ধর্মের ব্যাপার, আর আমার কাছে এর গুরুত্ব এইখানে যে, খিলাফতের জন্য জীবন বাজি রেখে আমি মুসলমানের ছুরি থেকে গাে-প্রজাতিকে বাঁচাতে পারি, সেটা আমার ধর্ম।”
গাঁধী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আনার উদ্দেশ্যে খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করেছিলেন, কারণ তিনি সত্যই বিশ্বাস করতেন যে, এই আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালে সম্প্রীতি আনা যাবে। মুনশি বলেছেন, জিন্না কিন্তু “গাঁধীজিকে মুসলিম ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুগামীদের ধর্মান্ধতায় উৎসাহ না দিতে বলেছিলেন। খিলাফত আন্দোলনের বিপদের কথা তিনি যে একাই লক্ষ করেছিলেন তা-ও নয়। শ্রীনিবাস শাস্ত্রীও পি এস শিবস্বামী আইয়ারকে লিখেছিলেন, “…আমার আশঙ্কা, খিলাফত আন্দোলন আমাদের সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।” অন্য অনেকেই লিখেছেন যে, খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করে গাঁধীজি ভুল করেছিলেন। অনেক বছর পরে, বাংলার তৎকালীন গভর্নর রিচার্ড কেসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে গাঁধী জানান যে, “জিন্না তাকে বলেছিলেন, তিনি (গাঁধী) ভারতীয় জীবনের অনেক অসুস্থ জিনিসকে তুলে এনে এবং সেগুলিকে রাজনৈতিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের রাজনীতিকে নষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি যে ভাবে রাজনীতি আর ধর্মকে মিশিয়েছেন, সেটা একটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।” (নজরটান যােগ করা হয়েছে।)[২০]
প্রতিজ্ঞা এবং শুভ ইচ্ছা থাকলে মানুষ কী করতে পারে, ১৯১৬-র লখনউ চুক্তি তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আবার এই দৃষ্টান্তই দেখিয়ে দেয়, এমন উদ্যোগও শেষ পর্যন্ত নিষ্ফল হয়ে যেতে পারে। এই চুক্তি সম্পাদনে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন জিন্না ও তিলক। জিন্না নিজে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছিলেন; এক সময় তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর কঠোর সমালােচক, ক্রমশ তিনি এ বিষয়ে অনেকটা নরম হলেন, তবে সবটাই হিন্দুমুসলিম ঐক্যের স্বার্থে। স্পষ্টতই, জিন্না অনেক সময় তার অবস্থান পালটেছেন, কিন্তু রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি পালটেছেন খুব কম ক্ষেত্রে। গাঁধী যে গণ-আন্দোলনের পথ নিয়েছিলেন, সেটা তার ধাতে ছিল না। জিন্না নিজেকে সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে সীমিত রেখেছিলেন, জনসাধারণের কাছে গাঁধীর আকর্ষণ ছিল অনেক বেশি, ফলে তার দ্রুত রাজনৈতিক উত্থান ঘটল। এ ছাড়া ১৯১৯-এর কাউন্সিল সংস্কারের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রবণতাগুলি জিন্নার সামনে রাজনীতির অনেক দরজা বন্ধ করে দিল। এই প্রক্রিয়ায় দুই
১০৬
নেতার দুটো আলাদা পথে যাওয়াটা ক্রমশ অনিবার্য হয়ে উঠল। দু’জনের ব্যক্তিত্বও ছিল মূলত আলাদা। এই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, ঘটনাপরম্পরার গতিপ্রকৃতি এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্রুত পালাবদল— সব মিলিয়েই এই পরিণতি ছিল স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে, নেপথ্যে, এত দিনে, নেমে আসছিল সাম্রাজ্যের গােধুলি।
এই সময়ের প্রধান ঘটনাগুলি এক বার সংক্ষেপে পর্যালােচনা করে নেওয়া যাক। প্রথমত, কাউন্সিল সংস্কার। ১৯০৯-এর ব্যবস্থায় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের কাছে। সরকারের কোনও জবাবদিহির দায় ছিল না, কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মেনে চলার কোনও দায়ও সরকারের ছিল না। ১৯১৯-এর সংস্কারের নিয়ম বদলাল, সরকারের একচ্ছত্র ক্ষমতা খর্ব করা হল। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা, কারণ ব্রিটিশ রাজ এর মাধ্যমে নিজেদের সাম্ৰাদ্যবাদী আধিপত্য কিছুটা হলেও ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিল এবং স্বেচ্ছায়। ফলে ভারত শাসনের জন্য এখন থেকে দেশের মানুষের সহযােগিতা পাওয়া সরকারের পক্ষে আবশ্যক হয়ে উঠল।
মন্টেগু-চেমসফোর্ড (সংক্ষেপে মন্টফোর্ড) সংস্কার কার্যকর করা হল ১৯১৯ সালের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট বা ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে। এই আইন প্রাদেশিক স্তরে ‘ডায়ার্কি’ বা দ্বৈতশাসন চালু করল। প্রশাসনের কাজকর্ম দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। কিছু দফতরের দায়িত্ব পেল নির্বাচিত মন্ত্রিসভা, তারা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের কাছে দায়বদ্ধ থাকল। অন্য দফতরগুলি থাকল সরকারি অফিসারদের, প্রধানত গভর্নরের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের হাতে। অনেকেই এই সংস্কার নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। দুটো বড় ভুল হয়েছিল, যার ফলে এই সংস্কারের রূপায়ণে সমস্যা বাড়িয়ে তুলল। এক, রাওলাট আইন, যে আইনে নিবারণমূলক গ্রেফতারের অনুমােদন দেওয়া হল। দুই, জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ার-এর অকল্পনীয় নিষ্ঠুর এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন হত্যাকাণ্ড। এই দুই কারণে ১৯১৯-এর আইন ঠিক ভাবে রূপায়ণ করা অসম্ভব হয়ে দাড়াল। তা ছাড়া, গাঁধীও এই সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর অহিংস অসহযােগ আন্দোলন শুরু করলেন।
তবুও এটা সত্য যে এই সংস্কারের প্রতিক্রিয়া নানা দিক দিয়ে সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, ত্রিশের দশক অবধি তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছিল। যেমন, ১৯২৩ সালে কাউন্সিলের দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের সময় বােঝা গেল, কেন্দ্রীয় রাজনীতিকে এখন থেকে প্রদেশের চাহিদার দিকে নজর দিতে হবে, এবং যাকে আমরা ‘সর্বভারতীয়’ মঞ্চ বলি, তার ওপরেও এই প্রবণতার প্রভাব পড়ল। এত দিন যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সে ভাবে ওঠেনি, এই বার সেটি সামনে চলে এল: ভারতে শাসনতন্ত্র কেমন হবে— বিকেন্দ্রীকত যুক্তরাষ্ট্রীয়, না কেন্দ্রীভূত এককেন্দ্রিক?
স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী সংক্রান্ত পুরনাে বিতর্কের সঙ্গে এ বার যােগ হল দ্বৈতশাসন সংক্রান্ত নতুন প্রশ্ন। নবনির্বাচিত প্রতিনিধিদের সামনে এখন সরকারি ক্ষমতার আকর্ষণ, কারণ তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কর্তৃত্ব এবং প্রসাদ বিতরণের অধিকার। স্বভাবতই পদের জন্য রেষারেষি বাড়ল, হিন্দু-মুসলমান-এর বিচ্ছেদে সেটা নতুন ইন্ধন জোগাল।
১০৭
জাতপাত, সম্প্রদায় ইত্যাদি নানা ধরনের গােষ্ঠীস্বার্থ এই রেষারেষিতে একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাড়াল। তার অবশ্যম্ভাবী ফল হল এই যে, একটি সম্প্রদায় হস্তান্তরিত ক্ষমতা কুক্ষিগত করল (যেমন পঞ্জাবে), আবার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত ভাবে সাম্প্রদায়িক ক্ষোভ জাগিয়ে তােলা হতে লাগল (যেমন যুক্তপ্রদেশে), যেমন আজও হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। উদ্বুদ্ধ হল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রয়াস। মন্টফোর্ড সংস্কারে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলা হল, কিন্তু ব্রিটিশ আধিপত্যে সত্যিকারের কোনও ফাটল ধরল না, ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল একটুও শিথিল হল না। কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের মতােই এ ক্ষেত্রেও সর্বভারতীয় স্বার্থের সঙ্গে প্রাদেশিক স্বার্থের বিরােধ দেখা দিল। ব্রিটিশরা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য প্রায় সর্বদাই প্রাদেশিক স্বার্থের দিকে ঝুঁকল। তার কারণ, কেন্দ্রের শাসনক্ষমতা তাদের কুক্ষিগত ছিলই, কিন্তু প্রদেশের স্বার্থগুলি বিভিন্ন ধরনের, একে অন্যের থেকে দূরবর্তী, তাই তাদের তাবে রাখা ছিল শাসনকর্তাদের পক্ষে জরুরি।
এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্রিটিশরা ভূস্বামী ছাড়াও মুসলমানদের উপর নির্ভর করল। পক্ষান্তরে মুসলমানদের পক্ষে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী’র দাবি খুব বড় হয়ে উঠেছিল, আর সে দাবি পূরণ করতে পারত একমাত্র দিল্লির সরকার। এ ক্ষেত্রে মুসলিম নেতাদের একটা বিরাট আশঙ্কা ছিল এই যে, কোনও এক দিন ‘হিন্দুরা’ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ হাতে পাবে। স্বার্থের তাড়নাতেই বিভিন্ন প্রদেশের মুসলিম গােষ্ঠীগুলি প্রায় সর্বদাই রাজধানীর ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে থাকল, কারণ তারাই তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারে। এই কারণেই ১৯১৯-এর কাউন্সিল সংস্কারের ঘটনাটি হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এই সংস্কারের ফলে দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্ক উন্নত হল না, বরং বিচ্ছেদ বাড়ল।
কাউন্সিল সংস্কারের ফলে জিন্না এবং তার জাতীয় রাজনীতির বিশেষ কোনও সুবিধা হল না, কিন্তু দ্বৈতশাসনের ফলে তাদের সমস্যা বাড়ল। কংগ্রেসের অসহযােগ আন্দোলনের ফলে ১৯২০-তে তার জাতীয় আইনসভায় প্রবেশের পথও বন্ধ হয়ে গেল। তিনি নানা দিক থেকে সংকটে পড়লেন— তিনি গাঁধীর আন্দোলনে পুরােপুরি সায় দিতেও পারলেন না, আবার কংগ্রেস থেকে নিজেকে পুরােপুরি দূরে সরিয়ে নেওয়াও তখন তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
১৯২১-এর গ্রীষ্মে জিন্না ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। গাঁধীর অসহযােগের জবাব হিসেবে সাংবিধানিক পদক্ষেপ করার জন্য তিনি সেখানে দরবার করলেন। তিনি বললেন, পঞ্জাবে যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিকার করা হােক এবং প্রাদেশিক স্বশাসন মঞ্জুর করার জন্য সংবিধান সংশােধন করা হােক। তার আরও বক্তব্য ছিল, কেন্দ্রীয় স্তরে যদি কিছুটা দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করা হয়, তা হলে অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু তার চেষ্টা আবারও নিস্ফল হল। ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের সাংবিধানিক পরিবর্তনের কোনও অধিকার ভারতসচিব মন্টেগুর ছিল না। মুসলিমপ্রধান পঞ্জাব ও বাংলা এবং মুসলমানদের পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত
১০৮
গুরুত্বপূর্ণ যুক্তপ্রদেশের পরিস্থিতি সংক্ষেপে পর্যালােচনা করে নিলে কুড়ির দশকের ঘটনাপরম্পরার অর্থ বুঝতে সুবিধে হবে।
হিন্দুদের মতােই, বাংলার মুসলিমরাও একটি একমাত্রিক, ঐক্যবদ্ধ গােষ্ঠী ছিল না। সি আর দাশের নেতৃত্বে কংগ্রেস স্বরাজিরা৩ ১৯২৩-এর প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম সমাজের কয়েকটি অংশকে নিজেদের দিকে রাখতে পেরেছিলেন। এটা ছিল প্রধানত বেঙ্গল প্যাক্ট-এর সুফল। আইনসভায় হিন্দু-মুসলমান সংহতির ফলে বাংলায় দ্বৈতশাসন কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব ছিল, কিন্তু এই ‘সংহতি’ই হিন্দুদের একটি অংশকে অস্বস্তিতে ফেলল।
কলকাতায় ১৯২৬ এপ্রিলের দাঙ্গা নিঃসন্দেহে দুই সম্প্রদায়ের ভঙ্গুর ঐক্য নষ্ট করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল। যখন ১৯২৬-এর নির্বাচন এল, তত দিনে দুই সম্প্রদায়ের ঐক্য ভেঙে গেছে, কংগ্রেসের মুসলিম সমর্থন বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই। বেঙ্গল প্যাক্ট সত্ত্বেও স্বরাজিরাও মুসলিম সমাজের সমর্থন ধরে রাখতে পারেননি।
ভারতের পশ্চিমে, পঞ্জাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কুড়ির দশকের পরে শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে মুসলিম রাজনীতির কেন্দ্রও মালওয়া থেকে মাঝায় সরে গেল। এখানে বাংলার সঙ্গে একটা তফাত ছিল গ্রামীণ মুসলিম নেতৃত্ব এখানে বিশেষ সুবিধা ভােগ করত। ১৯১৯-এর আইনেও তাদের সুবিধা হয়েছিল।
কিন্তু পঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির ইতিহাস বােধহয় গােটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল। ১৯২৩-এর মার্চ মাসে, নির্বাচনে আগে সি আর দাশ, নেহরু, আজাদ, সরােজিনী নাইড়র মতাে নেতারা সেই প্রদেশে সফর করে দেখলেন পরিস্থিতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মনে রাখতে হবে, ১৯১৯-এর সংস্কারের ফলে পঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজের সুবিধা হয়েছিল, অন্য দিকে উচ্চশিক্ষিত, পেশাজীবী এবং রাজনীতিসচেতন হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর এই সংস্কারের নানা অপরিকল্পিত কুফল এসে পড়েছিল, ফলে দুইয়ের স্বার্থের মধ্যে সংঘাত ছিল অনিবার্য। মিউনিসিপ্যাল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী পুর কমিটিগুলি পুনর্গঠিত হল, তার সুবিধাও পেলেন মুসলমানরা কোনও হিন্দু আসন বাদ দেওয়া হল না বটে, কিন্তু মুসলিম আসনের সংখ্যা বাড়ানাে হল, ফলে অনেকগুলি পুরসভায় মুসলমানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হল, হিন্দুদের ক্ষোভ বাড়ল।
এর সঙ্গে যুক্ত হল আর্যসমাজের ওপর গাঁধীর আক্রমণ। এতে সমস্যা আরও বাড়ল, কারণ পঞ্জাবে আর্যসমাজ তখন গাঁধী বা তার কংগ্রেসের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিপত্তিশালী। ১৯২৪-এর সেপ্টেম্বরে কোহট দাঙ্গার পরে অনেক হিন্দু সরকারি সাহায্য নিয়ে সীমান্ত এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন, অনেকে এমনকী সুদূর রাওয়ালপিণ্ডিতে আশ্রয় নিলেন। কেউ সে দিন সরকারকে জিজ্ঞাসা করেনি, “শৃঙ্খলা রক্ষা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়াই প্রশাসনের দায়িত্ব, তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা নয়, তা হলে তারা এমনটা করল কেন?” এই ছিন্নমূল, ক্ষুব্ধ এবং আশাহত নাগরিক হিন্দুরা ক্রমশ নিজেদের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের
১০৯
ধারণাগুলিকে পালটে ফেলতে লাগলেন। সেটা প্রথম প্রকাশ পেল ১৯২৪ সালের ডিসেম্বরে, যখন সাম্প্রদায়িক সম্পর্কে উন্নতিসাধনের উদ্দেশ্যে গাঁধী লাহৌরে গেলেন। এই সময় পঞ্জাবের নাগরিক হিন্দুরা এমনকী মহাত্মার আবেদনেও সাড়া দিলেন না। ভারতের রাজনৈতিক আকাশে গাঁধী কিন্তু তখন মহানক্ষত্র।
১৯২৫ সালের মধ্যেই পঞ্জাবের নাগরিক হিন্দুরা কেবল নিজেদের সমস্যার জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই দোষী সাব্যস্ত করেননি, তারা পণ করেছেন যে রাজনৈতিক কারণে নিজেদের স্বার্থ আর এক বিন্দুও ছেড়ে দেবেন না, অন্তত যত দিন না তাদের সমস্যাগুলির প্রতিকার হয়। সম্ভবত এই কারণেই ১৯২৬-এর নির্বাচনের ফলাফল কংগ্রেসের পক্ষে শােচনীয় হল। মুসলিম সমাজে স্বরাজিদের তুলনায় কংগ্রেসের ব্যর্থতা ছিল অনেক বেশি প্রকট। তবু তাে তখনও কংগ্রেস স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর প্রস্তাবটিকে সম্পূর্ণ নাকচ করেনি। ১৯২৬-এ গৌহাটি কংগ্রেসে সেই উদ্যোগও হল, স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী বাতিল করার দাবিতে একটি প্রস্তাব আনা হল। মােতিলাল নেহরু এবং গাঁধীজির তৎপরতায় সেই প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল বটে, কিন্তু এর অল্পকাল পরেই নিজের ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের সঙ্গে রাখার তাগিদে মােতিলাল নেহরুকে নিজের মত বদলাতে হবে। কুড়ির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এটাই ছিল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ অবস্থা। জিন্নার অবস্থান বিশ্লেষণের জন্য এই পরিপ্রেক্ষিতটি বােঝা দরকার। • কেন্দ্রীয় আইনসভায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি এবং স্বরাজিদের নেতা হিসেবে জিন্নার ভূমিকাশুরু থেকেই আলাদা হয়ে গেল। দুই দলের রাজনৈতিক আদর্শ আলাদা, তাই পথও আলাদা হয়ে গেল। প্রথম দিকে অবশ্য দুইয়ের মধ্যে একটা আপস হয়েছিল, তারা যৌথ ভাবে প্রাদেশিক স্বশাসন এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনে কিছুটা দায়িত্বের জন্য ‘জাতীয় দাবি তুলতে সম্মত হয়েছিল। ১৯২৫-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি মােতিলাল নেহরু এই দাবি-প্রস্তাব পেশ করলেন। কিন্তু তার আগেই সরকার জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা এমন কোনও ছাড় দেবে না, বড়জোর বিভিন্ন অভিযােগ সম্পর্কে বিভাগীয় তদন্ত করা যেতে পারে। কিন্তু সরকারের এই আপত্তির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্থির করার প্রশ্নে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি এবং স্বরাজিরা একমত হতে পারল না।
লর্ড রিডিংয়ের মতে, জিন্না তখন জাতীয় স্তরে নেতৃত্ব অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছিলেন। তার পরের তিন মাসের কার্যকলাপ এই ধারণাকে সমর্থন করে। প্রথমে তিনি সরাসরি এ জন্য তৎপর হলেন। আইনসভা নির্বাচনের পরে তিনি বম্বেতে ফিরলেন এবং প্রায় প্রতি দিন মােতিলাল নেহরু, এম আর জয়াকর, পুরুষােত্তমদাস ঠাকুরদাস এবং বিঠলভাই পটেলের সঙ্গে আলােচনা চালাতে লাগলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সব পক্ষকে নিয়ে একটা নতুন দল গঠন করা। গাঁধী এবং সি আর দাশও একাধিক বৈঠকে যােগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্যের কারণে জিন্নার উদ্যোগ ব্যর্থ হল। নেহরু ও দাশের ওপর গাঁধীর চাপ ছিল। তারা সব সময় সেই চাপের কাছে মাথা নােয়াননি বটে, কিন্তু গাঁধীর আদর্শের প্রতিকূল অভিমতকে প্রকাশ্যে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে তাদের ভরসা হয়নি। ১৯২৪ অক্টোবরে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারি হওয়ার
১১০
পর গাঁধী যখন অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে স্বরাজিদের কংগ্রেসের সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিতে চাইলেন, তখন হয়তাে জিন্নার লক্ষ্য পূরণের একটা চেষ্টা করা যেত, কিন্তু তত দিনে যথারীতি আরও নানা নতুন বাধার সৃষ্টি হয়েছে।
জিন্না একই সঙ্গে মুসলিম লিগকে নতুন করে বাঁচিয়ে তুলতে চেষ্টা করছিলেন। ১৯২৪ মার্চে দিল্লিতে লিগ কাউন্সিলের অধিবেশনে তিনি সহকর্মীদের লাহৌরে একটি অধিবেশন আয়ােজনের ব্যাপারে রাজি করালেন, যাতে ‘জাতীয় দাবি’তে ভাইসরয়ের সাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। দুর্ভাগ্যবশত, লাহৌরকে অধিবেশনের জন্য বেছে নেওয়াটা তার ভুল হল, কারণ একমাত্র পঞ্জাবেই মুসলমানরা স্বেচ্ছায় এবং সাফল্যের সঙ্গে দ্বৈতশাসন চালাচ্ছিলেন, ফলে তারা সাংবিধানিক সংস্কারের পক্ষে ছিলেন, সংস্কার আটকে দেওয়ার দাবি তাদের ছিল না। কিন্তু মুসলিম লিগ যদি তেমন দাবি তােলে, তা হলে যাঁরা এত দিন বলছিলেন যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনই সাংবিধানিক সংস্কারের পথে বাধা, তাদের মুখের মতাে জবাব দেওয়া যাবে। এবং জিন্না যেহেতু এই বিষয়ে মুসলিম জনমত গড়েছেন, সুতরাং এতে তাঁর নেতৃত্বের মর্যাদা বাড়বে। তখন অন্তত তেমনটাই মনে হয়েছিল। এ এক জটিল দ্বন্দ্ব: দ্বৈতশাসন বনাম প্রাদেশিক স্বশাসন। দীর্ঘজীবী হতে চলেছে এই দ্বন্দ্ব, এমনকী স্বাধীনতার পরেও, ভারত এবং পাকিস্তান, দুই দেশেই।
ফজলি হােসেন ভীষণ ভাবে প্রাদেশিক শাসনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তিনি জিন্নাকে খুব সহজে সমর্থন করতে চাননি। তাই নিজের সমর্থকদের তিনি বিরাট সংখ্যায় লিগের লাহৌর অধিবেশনে হাজির করিয়েছিলেন। এতে কাজ হল। সাবজেক্টস কমিটি
ন বিষয়ক মূল প্রস্তাবটি যখন উঠে এল, তখন দেখা গেল সেটি প্রায় ষােলাে আনা একটি পঞ্জাবি সিদ্ধান্ত। যে সব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু, সেখানকার প্রতিনিধিরা স্বভাবতই এর বিরােধিতা করলেন, কিন্তু সেই আপত্তি লিগের সিদ্ধান্তে প্রতিফলিত হল না, তখনও না, পরেও নয়।
লাহৌর অধিবেশনের এক সপ্তাহের মধ্যে মােতিলাল নেহরু এবং জিন্না রিফর্মস এনকোয়ারি কমিটিতে (মুডিম্যান কমিটি)[৩৩] বেসরকারি সদস্য হিসাবে যােগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। ফেব্রুয়ারিতে হেলিও বিভাগীয় তদন্তের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই কমিটি তারই পরিণাম। মােতিলাল নেহরু এই আমন্ত্রণ গ্রহণে রাজি ছিলেন, কিন্তু স্বরাজি নেতৃত্বের আপত্তিতে তাকে ‘না’ বলতে হল। জিন্নার ওপর বাইরের চাপ এতটা ছিল না, তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। এর ফলে তার সংস্কার বিষয়ক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের চেষ্টা করার দারুণ সুযােগ এল, তিনি অন্যদের মতামত জানার এবং প্রয়ােজনে তাদের স্বমতে আনতে উদ্যোগী হওয়ার সুযােগ পেলেন। কমিটির কাছে যাঁরা সাক্ষ্য দিতে এলেন, জিন্না তাদের যে সব প্রশ্ন করেছিলেন, তা থেকে মনে হয় তার প্রধান লক্ষ্য ছিল তিনটি। এক, তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে দ্বৈতশাসন ব্যর্থ হয়েছে। এবং সংবিধানের আমূল পরিবতর্ন দরকার। দুই, সাম্প্রদায়িক বিভেদ উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করছে এই অভিযােগ তিনি ভুল প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। তিন, একটা নতুন ‘লখনউ প্যাক্ট’ কী ভাবে প্রণয়ন করা যায়, সেটা বুঝতে চেয়েছিলেন।
১১১
কমিটির চেয়ারম্যান, এবং হােম মেম্বার, স্যর আলেকজান্ডার মুডিম্যান তাকে বিস্তর বাধা দিলেন, বাধা পেলেন ল’ মেম্বার স্যর মহম্মদ শফি’র কাছেও, যে শফিকে কেবলমাত্র ‘সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধি হিসেবেই কমিটিতে রাখা হয়েছিল। পঞ্জাবি মুসলমানরা অবশ্য সংস্কার চাইছিলেন এবং নিজেদের লক্ষ্য পূরণের জন্যই তারা সাম্প্রদায়িক বিভেদের ব্যাপারটাকে আড়ালে রাখতে চাইছিলেন, তারা জিন্নাকে সমর্থন করলেন। জিন্না যুক্তপ্রদেশের মুসলমানদেরও সমর্থন পেলেন।
রিফর্মস এনকোয়ারি কমিটির কাজ শেষ হওয়ার পরে নতুন বাধা এল। স্যর তেজবাহাদুর সপ্রু এবং শিবস্বামী আইয়ার-এর সঙ্গে সঙ্গে জিন্না কমিটির রিপাের্টে স্বাক্ষর করতে নারাজ হলেন, তারা একটি মাইনরিটি রিপাের্ট দিতে চাইলেন। তাতে তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দ্বৈতশাসনের বিরােধিতা করলেন এবং প্রাদেশিক শাসনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় স্তরেও দায়িত্বের জন্য দাবি জানালেন। ১৯২৪-এর ৩ ফেব্রুয়ারি কমিটির চূড়ান্ত রিপাের্টে স্বাক্ষরপর্ব যখন সম্পন্ন হল, তখন মনে হল জিন্নার উচ্চাশা পূর্ণ হয়েছে। বেঙ্গল অর্ডিনান্স জারি করে সরকার ঐক্য প্রতিষ্ঠায় নতুন উৎসাহ জোগাল। অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে গাঁধীও কংগ্রেসের সামনে নতুন সম্ভাবনা খুলে দিলেন। অতঃপর ২১ নভেম্বর বম্বেতে একটি সর্বদল সম্মেলন ডাকা হল এবং সেই সম্মেলনে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক কমিটি গঠন করা হল, যে কমিটি সরকারের বিরুদ্ধে। একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট তৈরি করবে।
কিন্তু জিন্না তখনও নিশ্চিন্ত নন। অন্যদের বেঁধে দেওয়া শর্ত মেনে ঐক্যের আলােচনায় যােগ দেওয়া তঁার মনঃপূত ছিল না। অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহৃত হওয়ার ফলে তঁার কংগ্রেসে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল বটে, কিন্তু ১৯২৪-এ বেলগাঁও অধিবেশনে যােগ দেওয়ার প্রশ্নে তিনি দোটানায় পড়লেন। জিন্না বরাবরই চেয়েছিলেন। যে স্বরাজিরা পুরােপুরি সাংবিধানিক পদ্ধতি অনুসরণ করুক, কিন্তু তাদের লড়াইটা লড়ে দেওয়ার কোনও বাসনাই তার ছিল না। ইন্ডিপেন্ডেন্টদের নেতা এবং মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট তার দুটি আসনই ছিল পাকাপােক্ত, তাই তিনি আগে থেকেই কংগ্রেসের। সিদ্ধান্তের শরিক হয়ে তার সঙ্গে সমানে সমানে দরকষাকষির ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাননি। সর্বদল সম্মেলনে যােগ দেওয়ার ব্যাপারেও তার মাথায় একই হিসেব কাজ করেছিল। এই কারণেই তিনি গাঁধীর ‘ইউনিটি কমিটি’তে যােগ দিতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু শর্ত দিয়েছিলেন যে, ভােটের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া চলবে না, কারণ মতানৈক্য থাকলেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােটে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়ােজন হয়, তিনি চান সবাই স্বেচ্ছায় এবং সর্বসম্মত ভাবে সব সিদ্ধান্ত নিক। সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রধান রাজনৈতিক নায়ক হিসাবে জিন্না এই ভাবে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, ভােটভিত্তিক সিদ্ধান্তের ফঁদ থেকে এবং সংখ্যাগুরুবাদের বিপদ থেকে বাঁচতে চেয়েছিলেন।
১৯২৪-এর মে মাসে লাহৌর অধিবেশনে মুসলিম লিগ অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে পরামর্শ করে তার সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছিল। এটা ছিল জিন্নার উদ্যোগ। এই নিয়ে তার অনেক আশা ছিল। এ বিষয়ে লিগ কংগ্রেসেরও
১১২
পরামর্শ চেয়েছিল, কিন্তু তারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়নি। বেলগাঁওয়ে কংগ্রেস এবং লিগের যৌথ অধিবেশনের যে প্রস্তাব জিন্না দিয়েছিলেন, সেটিও নাকচ হয়ে যায়। কংগ্রেসের অন্তর্নিহিত ধারণা পালটাতে জিন্না আবারও ব্যর্থ হলেন। লিগের কাউন্সিলের কয়েক জন সদস্য বংগ্রেসের এই উদ্ধত আচরণে এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে কংগ্রেসের সঙ্গে একই জায়গায় লিগের অধিবেশন করতেও তাদের আপত্তি ছিল।
গাঁধী ও আলি ভ্রাতৃদ্বয় রাজনৈতিক উপায়ে পঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক সমস্যার জট ছাড়ানাের যে চেষ্টা করলেন, সেটি ছিল আরও তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯২৪ ডিসেম্বরের গােড়ায় তারা লাহৌরে গিয়ে প্রস্তাব দিলেন, স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী রদ করা হলে বিনিময়ে আইনসভায় ও বিভিন্ন সরকারি কাজে মুসলমানদের সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দেওয়া যেতে পারে। লিগ নিজেকে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি বলে যে দাবি জানাচ্ছিল, এই প্রস্তাব তাকে নস্যাৎ করতে চেয়েছিল এবং একই সঙ্গে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছিল যে লাহৌরে যে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে তা মেনে নিতে কংগ্রেস রাজি নয়। এই প্রস্তাব শেষ অবধি গৃহীত হয়নি, কিন্তু জিন্না আবারও বুঝতে পারলেন, রাজনৈতিক শক্তির বিন্যাস কী ভাবে বদলে যাচ্ছে।
কংগ্রেস ও লিগের সম্পর্ক ইতিমধ্যেই বেশ খারাপ, তবু জিন্না এবং স্বরাজিরা একটা বােঝাপড়া চাইছিলেন। মােতিলাল নেহরু যখন জানতে পারলেন যে মুসলিম লিগ বম্বেতে তাদের অধিবেশন ডাকতে চায়, তখন তিনি জিন্নাকে অনুরােধ জানালেন, অধিবেশন বেলগাঁওয়ে স্থানান্তরিত করা হােক। জিন্না বললেন সেটা আর সম্ভব নয়, সময় নেই, কিন্তু তার পর তিনি লিগের অধিবেশন কয়েক দিন পিছিয়ে দিলেন, যাতে কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রতিনিধিরা যেতে পারেন। লিগের অধিবেশনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সৈয়দ রাজা আলি কংগ্রেসের মধ্যে লিগের অন্তর্ভুক্তির আশঙ্কা সম্বন্ধে সতর্ক করে দিলেন। জিন্না কিন্তু স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর প্রশ্নে কংগ্রেস ও লিগের মতানৈক্যের কথা মেনে নিলেও একটা মিটমাটের চেষ্টা করতে আবেদন জানালেন। সেই আবেদন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। লাহৌরে গঠিত লিগের সংবিধান কমিটিকে নতুন করে গঠন করা হল, সেখানে কংগ্রেসি মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব অনেক বাড়ানাে হল এবং পরে, সম্ভবত গাঁধীর উদ্যোগে, সর্বদল সম্মেলনের ঐক্য কমিটিতে এই কমিটিকে পুরােপুরি ঢুকিয়ে নেওয়া হল।
এই সময় বােঝাপড়ার পথে প্রধান বাধা এল পঞ্জাব এবং যুক্তপ্রদেশের হিন্দুদের কাছ থেকে। পঞ্জাবের স্বরাজি নেতা লালা লাজপত রায় ক্রমশ জাতীয় নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলেন। মালব্য এবং চিন্তামণির মতােই ‘হিন্দুদের বিপদ’ স্লোগানটি তার বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। লালাজি নিজেও এ ভাবেই ভাবতেন। ১৯২৪-এর ২৬ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে তিনি মুসলমানদের নিরঙ্কুশ অধিকারের দাবির সমালােচনা করে ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকায় তেরােটি প্রবন্ধ লিখলেন। সাম্প্রদায়িকতাবাদী মুসলিম লিগের জন্য লােক জোগাড় করছেন বলে জিন্নার নিন্দা করলেন, নিন্দা। করলেন সম্প্রদায়ভিত্তিক নির্বাচকমণ্ডলীরও। তিনি দূরদৃষ্টির সঙ্গে লিখলেন, সাম্প্রদায়িক
১১৩
নির্বাচকমণ্ডলী এক বার তৈরি হলে আর কখনও তাকে বিদায় দেওয়া যাবে না, বিদায় দিতে গেলে গৃহযুদ্ধ বাধবে, এ জিনিস মেনে নিলে ভারতবর্ষ দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যাবে: হিন্দু ভারত এবং মুসলিম ভারত। তার আরও বক্তব্য ছিল, পঞ্জাবি মুসলমানরা যেহেতু সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিতে রাজি নয়, সুতরাং পঞ্জাবকে ভাগ করাই শ্রেয়, দরকার হলে বাংলাকেও ভাগ করতে হবে এবং স্বশাসিত, হিন্দু ও মুসলিম প্রদেশ নিয়ে একটি ফেডারেশন গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে, সমস্ত প্রদেশের বিশিষ্ট হিন্দুদের কাছে প্রেরিত এক প্রতিবেদনে তিনি লখনউ চুক্তিতে সম্মতি দেওয়ার জন্য কংগ্রেসের নিন্দা করলেন এবং হিন্দু মহাসভাকে নিজেদের রাজনৈতিক মুখপাত্র করার জন্য আবেদন জানালেন। বেলগাঁওয়ে এই আবেদনে রীতিমত সাড়া মিলল, সেখানেই প্রথম হিন্দু মহাসভার কর্মকাণ্ডের একটা রাজনৈতিক চরিত্র প্রকট হল। অতঃপর সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে হিন্দু অভিমত তৈরির জন্য একটি কমিটি তৈরি হল। এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন লালা লাজপত রায়, রাজা নরেন্দ্র নাথ, চিন্তামণি, রাজা স্যর রামপাল সিংহ, সিন্ধুর জয়রামদাস দৌলতরাম এবং সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস থেকে মােতিলাল নেহরুর স্বরাজি সহযােগী বি এস মুঞ্জে ও এন সি কেলকর।
১৯২৫-এর ২৩ জানুয়ারি দিল্লিতে সর্বদল সম্মেলন আবার বসল, তত দিনে লখনউ চুক্তির ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হয়ে গেছে। বিস্তর ভুল বােঝাবুঝি জমে উঠেছে, সেগুলি দূর না করে এক পা-ও এগােনাে যাবে না। ২৮ জানুয়ারি সম্মেলন এক মাসের জন্য মুলতুবি রাখা হল। কার্যত ওখানেই এই উদ্যোগের অবসান হল, কারণ এই অধিবেশনের পরে জিন্না এ বিষয়ে সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা সংকেত দিল, হিন্দু মহাসভা ভবিষ্যতে কংগ্রেসকে তটস্থ রাখবে। এমনকী নেহরু এবং গাঁধী বােঝাপড়ায় আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু মহাসভার আপত্তি অগ্রাহ্য করে কিছু করতে পারলেন না। ১৯২৫-এর ২ মার্চ দিল্লিতে একটি ঘােষণায় মােতিলাল নেহরু এবং গাঁধী জানিয়ে দিলেন, মীমাংসার কোনও সম্ভাবনা নেই। তিন দিন পরে গাঁধী বম্বেতে সাংবাদিকদের বললেন, তিনি হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটিকে ‘এক পাশে সরিয়ে রাখতে চান।[৩৭]
এই সম্মেলন ব্যর্থ হওয়ার পরে মােতিলাল নেহরু ও জিন্নার রাজনৈতিক দূরত্ব আরও বাড়ল। হিন্দু মহাসভার প্রবল তােপের মুখে পড়ে মােতিলাল নেহরু নিজের অবস্থান পালটাতে বাধ্য হলেন, আইনসভায় তিনি অনেক বেশি নেতিবাচক হয়ে উঠলেন। জিন্না হতাশ হলেও সব ব্যাপারে বাধা দেওয়ার নীতি মানতে পারলেন না। ১৯২৫-এর বসন্তকালে দুই নেতা প্রথম প্রকাশ্যে নিজেদের ভিন্নমতের কথা বলতে শুরু করলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তৈরি ‘সম্মিলিত ফ্রন্ট’ ভেঙে পড়ল। এখানে বলে নেওয়া দরকার, মােতিলাল নেহরু এবং মহম্মদ আলি জিন্নার সামাজিক তথা ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিন্তু শেষ অবধি ভাল ছিল।
জিন্না চেয়েছিলেন, মুডিম্যান রিপাের্ট নিয়ে আলােচনা হােক, কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত মুলতুবি রাখল। ইতিমধ্যে ভাইসরয় লর্ড রিডিং ইংল্যান্ডে গেলেন—
১১৪
রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে আলােচনা করতে নয়, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আগুন নেভানাের উপায় খুঁজতে। তার কাছে মুডিম্যান কমিটি ছিল সময় নেওয়ার একটা কৌশলমাত্র, জিন্নার ‘যুক্তিসম্মত প্রতিবাদ’-এর কোনও গুরুত্বই তার কাছে ছিল না, জিন্না যদিও সেটা ধরতে পারেননি। ১৯২৪-এ ব্রিটেনে লেবার পার্টির সরকার আর ভারতে আইনসভায় জাতীয়তাবাদীদের আধিপত্য— এই টানাপােড়েনে রিডিং কিছুটা বিপাকে ছিলেন। ১৯২৫-এ কনজারভেটিভরা ব্রিটেনে ক্ষমতায় ফিরে এল, ভারতে নেহরু আর জিন্নার রাজনৈতিক সংঘাত দেখা দিল, সুতরাং রিডিং এখন অনেক জোরদার অবস্থায়, তিনি স্বমতে অটল থাকলেন।
১৯২৫-এর ৭ জুলাই হাউস অব লর্ডস-এ লর্ড বার্কেহেড আশু সংস্কারের সব আশায় জল ঢেলে দিলেন। অচিরে একটি কমিশন বসানাের সম্ভাবনা তিনি একেবারে উড়িয়ে দিলেন না, কিন্তু বুঝিয়ে দিলেন যে, ভারতীয় নেতারা সংস্কারের প্রক্রিয়ায় সহযােগিতা না করলে কোনও ছাড়ই দেওয়া হবে না। ভারতে সংঘাতের রাজনীতিতে এটাই একটা সন্ধিক্ষণ হয়ে দাড়াল। তার আগে পর্যন্ত মােতিলাল নেহরুর নেতৃত্ব এবং স্বরাজিদের কৌশলের কোনও বিকল্প ছিল না, সর্বভারতীয় স্তরে সাফল্য সম্ভব বলে মনে হয়েছিল। লর্ড বার্কেহেড-এর এই ‘চরমপত্র’ দুটি সম্ভাবনাকেই নাকচ করে দিল। অনেক “প্রাদেশিক বাহিনীই (তখন) রণক্ষেত্র থেকে সরে গেল এবং শত্রুদের সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করল।”[৩৮] ফলে মােতিলাল নেহরু সম্মুখসমর থেকে সরে গিয়ে নিজের দলের অন্তর্বিরােধ প্রশমনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সে জন্য তাকে শেষ পর্যন্ত আইনসভা ছেড়ে দিয়ে গাঁধীর অসহযােগে যােগ দিতে হল।
জিন্না আরও হতাশ হলেন, কারণ তার আরও বেশি ক্ষতি হয়েছিল। তার নীতিই সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেল। মুডিম্যান রিপাের্ট নিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত বিতর্ক হল, তখন তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল এবং তিনি অদম্য ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “আমি আবার সরকারকে জিজ্ঞাসা করছি, লর্ড বার্কেহেডকে জিজ্ঞাসা করছি, লর্ড রিডিংকে জিজ্ঞাসা করছি, যারা আপনাদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন, তাদের দেওয়ার মতাে কোনও উত্তর আপনাদের কাছে আছে কি? নেই। আমাকে আপনারা বলছেন, রাজনৈতিক মনােভাবাপন্ন লােকদের, যাঁরা বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের সদস্য, তাদের কি আপনি। নতজানু করতে পারবেন? আপনি কি পণ্ডিত মােতিলাল নেহরুকে ভাইসরয়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে বলাতে পারবেন—স্যর, আমি আপনার অনুগত, আমি আপনার সামনে হাঁটু মুড়ে বসছি, আপনি কি আমাকে দয়া করে একটি রয়্যাল কমিশন দেবেন? এটাই কি আপনারা চান? পণ্ডিত মােতিলাল নেহরু এই আইনসভায় কী করছেন? তিনি কি আপনাদের সঙ্গে সহযােগিতাই করছেন না? আমি জানতে চাই, আপনারা আর কী চান? আমি কি জানতে পারি, দায়িত্বশীল নেতারা আপনাদের সঙ্গে সহযােগিতা করতে চাইছেন, এর আর কী লিখিত বা মৌখিক প্রমাণ আমরা দিতে পারি? আপনাদের কি চোখ নেই? কান নেই? মস্তিষ্ক নেই?”[৩৯]
এটা এমন এক জন মানুষের বক্তব্য, যিনি একটা বড় লড়াইয়ে হেরেছেন। নেহরুর
১১৫
সঙ্গে জিন্নার তফাত ছিল এই যে তার হাতে আর কোনও দল ছিল না, অসহযােগ আন্দোলনের সান্ত্বনা ছিল না। তিনি বড়জোর বার্কেনহেড-এর চ্যালেঞ্জটা নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগে যােগ দিতে পারতেন, তাতে কাজের কাজ যেটুকুই হােক। ১৯২৫-এর জুলাইয়ে। তিনি আবার বম্বে’র স্বরাজি জয়াকরের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন, এবং নভেম্বরে সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস-এর বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসিদের নিয়ে একটা দল গঠন করারও চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি যতই বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসিদের দিকে এগিয়ে গেলেন, ততই মুসলিম লিগের ক্ষমতাশালীদের থেকে তার দূরত্ব বাড়ল। এই সমস্যার কোনও সহজ সমাধান তার কাছে। ছিল না। মােতিলাল নেহরুকে সমর্থন করলে অসহযােগ আন্দোলনে সমর্থন জানাতে হয়, কিন্তু তাতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রসার ঘটবে। অন্য দিকে, লিগের মধ্যে তার বিরােধী। যাঁরা, তাদের সমর্থন করলে ব্রিটিশদের পক্ষে দাঁড়াতে হয়, সেটা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পরিপন্থী। জিন্না দু’দিক বজায় রাখতে চাইলেন, কিন্তু সেটা খুব কঠিন ছিল। হতাশার প্রায় চরমে পৌঁছে তিনি ১৯২৬-এ স্কিন কমিটির সদস্য হয়ে ইউরােপে পালিয়ে গেলেন, সে বছরের ভােট শেষ হওয়ার আগে আর সক্রিয় রাজনীতিতে যােগ দিলেন না।
২০ মার্চ, ১৯২৭, দিল্লিতে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর বিষয়ে মুসলমানদের একটি সম্মেলন হল। এ বার দাবিপত্রে আরও অনেক বিষয় যােগ করা হল: বম্বে থেকে সিন্ধুকে আলাদা করতে হবে; সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানে সংস্কার আনতে হবে; পঞ্জাব ও বাংলায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করতে হবে; কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমানদের জন্য তেত্রিশ শতাংশ সংরক্ষণ আনতে হবে। এই সম্মেলন প্রধানত জিন্নার উৎসাহেই ডাকা হয়েছিল, এবং এই প্রশ্নে, বিশেষত স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যাপারে জিন্না তার আগের অবস্থান থেকে, যেমন ১৯১৬’র লখনউ চুক্তির সময়কার অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ সরে এসেছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই হিসেব করে দেখেছিলেন যে, তার এখনকার অবস্থান তাকে প্রদেশের মুসলিমদের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এই অবস্থান নিলেন। আসলে তিনি জাতীয় সমস্যা নিরসনে তার দীর্ঘ প্রয়াসটাই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তা ছাড়া, কংগ্রেসের ক্রমর্ধমান গণসমর্থনের জবাবও দিতে চাইছিলেন তিনি।
ভাইসরয় আরউইন ঘটনার গতিপ্রকৃতি অনুমান করে এই সমস্যাটার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, “জিন্নার আদি ইচ্ছা যা-ই থেকে থাকুক, (এবং সেটা তখন মােটেই পরিষ্কার বােঝা যায়নি), তার চেষ্টার পরিণামে দুই সম্প্রদায়ের দূরত্ব কমবার বদলে আরও বেড়ে গেল।”[৪০] এই পরিণাম তখনকার ভারতীয় রাজনীতি সম্পর্কে দুটো জিনিস বুঝিয়ে দেয়: এক, প্রাদেশিক মুসলিম সমাজের মত কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল; দুই, হিন্দুদের সমস্যাকে এতটুকু তুচ্ছ করা হলে হিন্দু মহাসভা কোনও বােঝাপড়ায় রাজি ছিল না। কিন্তু প্রদেশের মুসলিম জনমতও সমস্যা নিরসনে সহায়ক হল না। হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লিগ, কাউকেই শেষ বিচারে দোষী সাব্যস্ত করা চলে না, উভয়েই ‘নিজের নিজের সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছিল। সেটাই তাে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের ভিত্তি।
১১৬
সব দেখেশুনে ১৯২৭-এর ২৯ মার্চ জিন্না সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য একটি বিবৃতি দিলেন। তাতে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তার চারটি প্রস্তাব হয় পুরােপুরি মানতে হবে, নয়তাে পুরােপুরি নাকচ করতে হবে। কিন্তু এতেও সমস্যার সুরাহা হল না। বস্তুত, সে বছর (১৯২৭) পটনায় যখন হিন্দু মহাসভার বৈঠক হল, সেখানে জিন্নার বিবৃতিটিকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিরা তার প্রস্তাব নিয়ে কোনও আলােচনাই করলেন না। প্রাদেশিক মুসলিম সমাজের প্রতিক্রিয়াও খুব ভাল কিছু ছিল না। তারা জিন্নার সর্বভারতীয় উদ্যোগের বিরােধিতা শুরু করেছিল, কারণ তাদের ভয়। ছিল যে, এই উদ্যোগের ফলে প্রদেশের গুরুত্ব খর্ব হতে পারে। প্রাথমিক ভাবে যাঁরা জিন্নার প্রস্তাবগুলি সমর্থন করেছিলেন, তাদের একাংশ এখন পিছু হটতে লাগলেন। এই সব ঘটনা সম্পর্কে তৈরি করা একটি খসড়া নথি সম্পর্কে মুডিম্যান মন্তব্য করেছিলেন, “এ হল একটা রাজনৈতিক অবস্থান দখল করার কৌশল, এবং মুসলমানরা যথারীতি সেই কৌশলের লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারবেন না, কিন্তু কোনও পক্ষই চাইলেও সমাধান এনে দিতে পারবে না…।”[৪২]
খণ্ডিত হল মুসলিম লিগ
ফিরে যাওয়া যাক পঞ্জাবে। মার্চ ১৯২৭ সালে জিন্নার উদ্যোগের পর থেকে পঞ্জাবের মুসলিম লিগ তাঁর প্রতি সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁদের ভয় হয়, সর্বভারতীয় দাবির কাছে তাঁদের রাজ্যের প্রাধান্য খর্ব হয়ে যাবে। ১৯২৭ সালের অক্টোবর মাসে যখন সিমলাতে মুসলিম লিগের অধিবেশন হয়, তাঁরা জিন্নাকে মাদ্রাজে বার্ষিক অধিবেশন করার থেকে প্রতিহত করেন, এই ভয়ে যে তিনি তা হলে সর্বভারতীয় কার্যসূচির সপক্ষে মত তৈরি করবেন। উত্তর প্রদেশের দলের মতােই, তাঁরাও দাবি করলেন যে উত্তর ভারতেই অধিবেশন হতে হবে। এর ফলে জিন্না কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ অধিবেশন এবং লাহােরে লিগের বৈঠক, এই দুটো দাবিই ছেড়ে দিলেন। তিনি বরং কলকাতায় অধিবেশনের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। কিন্তু পঞ্জাবের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে কলকাতা আরও কম গ্রহণযােগ্য মনে হল। তাঁরা যেহেতু সহযােগিতার পক্ষে ভােট দিয়েছিলেন, তাঁদের কাছে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের বৈঠক এমন কোথাও হবে যেখানে আঞ্চলিক সমর্থন তাঁরা পাবেন। ফিরােজ খান নুন-এর উদ্যোগে প্রস্তুতির জন্য ২০ নভেম্বর, ১৯২৭ দিল্লিতে মুসলিম লিগের কাউন্সিলের বৈঠক পঞ্জাবিদের কাছে একটি জয় বলে প্রতিপন্ন হল। জিন্না এবং আলি ভাইদের বিরােধিতা সত্ত্বেও লাহােরে বৈঠকের পক্ষে ভােট দেওয়া হল, এবং স্যর মহম্মদ শফি আগামী প্রেসিডেন্ট বলে নির্ধারিত হলেন। জিন্নার কাছে এটা অসন্তোষজনক ছিল, ঠিক যেমন কলকাতায় বৈঠক পঞ্জাবিদের কাছে অসন্তোষজনক
১১৭
ছিল। তাঁর মর্যাদা রক্ষা করার জন্য জিন্নার জন্য এই সিদ্ধান্তকে বদলানাে একান্ত প্রয়ােজন ছিল। আইনসভায় তাঁর সহকর্মী মহম্মদ ইয়াকুব এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হন, এবং লিগের তৎকালীন সচিব ড. কিচলুকে কাউন্সিলের আর একটি অধিবেশন ডাকতে উৎসাহ দেন। সেই সঙ্গে ডাঃ আনসারিকে[৪৩] উৎসাহ দেন তাঁর প্রভাব খাটিয়ে কলকাতায় অধিবেশন ডাকতে, যেখানে আগা খান সভাপতিত্ব করবেন।
এর ফলে ১১ ডিসেম্বর, ১৯২৭ আবার কাউন্সিলের বৈঠক হল। কেবল ২৩ জন উপস্থিত ছিলেন, এবং যদিও ফিরােজ খান নুন এবং তাঁর সহযােগীরা শারীরিক উপস্থিতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন, অনুপস্থিতদের ভােটের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা গেল জিন্নার দিকে। চুরাশিটি (৭৪ জন অনুপস্থিত) পেলেন জিন্না, বিপক্ষ পেল ৫৪ (৪১ জন অনুপস্থিত), ফলে লাহৌরে বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে গেল, এবং কলকাতাতে বৈঠকই স্থির হল। জিন্না জিতলেন, কিন্তু তার মূল্য চোকাতে হল, কারণ ফিরােজ খান নুন, স্যর মহম্মদ ইকবাল, হজরত মােহানি এবং নুনের বেশ কিছু পঞ্জাবি সহযােগী সেই বৈঠক ত্যাগ করলেন, নিজেরা সংগঠন শুরু করলেন, লিগ খণ্ডিত হয়ে গেল। দিল্লিতে ১৯২৭ সালে এই সংঘাতের ফলে দুটি মুসলিম লিগ তৈরি হল, একটির বৈঠক হল লাহৌরে, একটির কলকাতায়। লাহােরে সভাপতিত্ব করলেন স্যর মহম্মদ শফি, এবং কলকাতায় মহম্মদ ইয়াকুব। লাহৌরে গৃহীত প্রস্তাব স্বাভাবিক ভাবেই পাঞ্জাব মুসলিম লিগে গৃহীত হল (১৩ নভেম্বর, ১৯২৭)। এই বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল এই যে, যুক্তপ্রদেশ এবং পঞ্জাব শাখা ঐক্যবদ্ধ হল। মার্চে যারা দিল্লিতে জিন্নার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরাই কলকাতায় জিন্নার লিগের বৈঠকে ছিলেন, কিন্তু উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মানুষেরা এবং মুসলিম-প্রধান রাজ্যগুলির এবং শহরবাসী সংবিধানপন্থীরা তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিলেন।
কলকাতায় মুসলিম লিগের বৈঠকে স্বাধীনতার দাবি তােলা হবে কি না[৪৪] সে বিষয়ে কোনও প্রশ্ন তােলা হল না, যা গোঁড়া খিলাফতি-দের দ্বিধাবিভক্ত চিন্তা এবং স্বাধীনতার সমর্থক গােষ্ঠীর উত্থানের দ্যোতক, যার প্রতিনিধি ছিলেন জিন্না, আলি ইমাম এবং মহম্মদ ইয়াকুব। তাঁরা স্পষ্টতই এই বৈঠকের উপর প্রভাব বিস্তার করেন, জিন্না স্থায়ী সভাপতি হিসেবে, ইয়াকুব বৈঠকের সভাপতি হিসেবে এবং আলি ইমাম প্রস্তাবের প্রস্তাবক হিসেবে। তাঁদের অবস্থান ছিল সাংবিধানিক রাজনীতির মূল ধারার ভিতরেই, বাস্তবসম্মত, ফলে তাঁরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা কিংবা শর্তহীন বয়কট, কোনওটাই ঘােষণা করতে আগ্রহী ছিলেন না।
কলকাতা লিগের উদ্যোক্তারা সাম্প্রদায়িক ঐক্যের উপর বিশেষ ভাবে জোর দেন। কিন্তু বৈঠকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যায় যে জিন্নার চারটি প্রস্তাব বাংলার এই বৈঠকেও গৃহীত হবে না। ফলে লিগ যদিও কংগ্রেসের সঙ্গে চুক্তিতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু নিজেদের দরদস্তুর করার ক্ষমতাকে বাড়ানাের প্রয়ােজন অনুভব করল। লিগের প্রভাব থেকে স্পষ্ট হল যে যখন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এই সংস্কারগুলি গ্রহণ করবে, এবং সিন্ধুপ্রদেশ
১১৮
একটি পৃথক রাজ্য হবে, তখনই পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি ত্যাগ করা হবে।
কংগ্রেসের আহ্বানে লিগের নেতারা সতর্ক ভাবে রাজি হলেন দিল্লির সর্বদলীয় বৈঠকে যােগ দিতে। ১৯২৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এই বৈঠক যখন শেষ অবধি ডাকা হল, তখন দেখা গেল যে ঐকমত্যে পৌঁছনাে সহজ হবে না। পণ্ডিত মদন মােহন মালব্য, কংগ্রেসের দিকে ঝুঁকে থাকার জন্য যাঁর উপর সবাই সন্দেহ করছিল, তাঁকে আরও কোণঠাসা করলেন মুঞ্জে, যিনি সিন্ধকে আলাদা করা কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠদের জন্য আসন সংরক্ষণকে (যেমন, পঞ্জাবে মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণকে) মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। জিন্না এই অবাধ্যতার উত্তরে কলকাতা অধিবেশনে লিগের শর্তগুলি আর এক বার পেশ করলেন, ফলে অবধারিত ভাবে এক অচলাবস্থা তৈরি হল। জিন্নার দৃষ্টিকোণ থেকে এটা একেবারেই অসন্তোষজনক ছিল। লিগের মধ্যে তাঁর সমর্থকরা আগেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল, এ বার মনে হতে লাগল তিনি সমস্ত সমর্থনই খােয়াবেন। ফলে তিনি আবার ভাইসরয়ের কাছে ফিরে গেলেন এবং আরউইনকে চাপ দিতে লাগলেন যাতে স্ট্যাটিউটরি কমিশনের বিধিতে পরিবর্তন আসে। হয় একটা মিশ্র কমিশন হােক, না হলে ভারতীয় কমিশনারদের দিয়ে গঠিত কমিশন হােক যাদেরও সমাজ ক্ষমতা এবং দায়িত্ব থাকবে। আশ্চর্য নয় যে, তাঁর আবেদন অগ্রাহ্য হল। আরউইন বুঝতে পারছিলেন, জিন্নার প্রভাব কমে আসছে, তাই তাঁকে খুশি করার জন্য কোনও পরিবর্তন করার যুক্তি খুঁজে পাননি। এখানেই জিন্নার সমস্যা শুরু হল। তিনি । কমিশনে কোনও আসনও পেলেন না, আবার বয়কটের এমন কোনও মঞ্চ পেলেন
যা মুসলিমদের থেকে ন্যূনতম কিছু সমর্থন পেতে পারে। ঐক্যবদ্ধ দল, গ্রহণযােগ্য কোনও অবস্থান ছাড়া কী করে তিনি সর্বদলীয় বৈঠকে যােগ দেবেন? সরে দাঁড়ানাে ছাড়া তাঁর সামনে কোনও রাস্তা ছিল না। ১৯২৮ সালের ১৭ মার্চ তিনি মুসলিম লিগ। ডেলিগেশনকে বৈঠক থেকে সরিয়ে নিলেন, এবং মে মাসে চলে গেলেন ইংল্যান্ডে।
লিগের এই সরে যাওয়া, এবং জিন্নার ইউরােপযাত্রা সর্বদলীয় বৈঠককেও অনেকটা দুর্বল করে দিল। বেশির ভাগ কংগ্রেস সদস্যর কাছে, জিন্নাই ছিলেন একমাত্র মানুষ যিনি মুসলিমদের তরফে কিছু করে দেখাতে পারতেন।[৪৫] বৈঠকে তাই সিদ্ধান্ত হল। যে “সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে সামগ্রিক ভাবে খতিয়ে দেখার জন্য একটি ছােট কমিটি কোনও একটা পথ বার করতে পারে।”[৪৬] মােতিলাল নেহরু আবার সভাপতি নিযুক্ত হলেন, সঙ্গে নয়জন সদস্য।[ ৪৭] তবে কাজের প্রধান ভার ন্যস্ত হল পাঁচজনের উপর মােতিলাল নেহরু, শােয়েব কুরেশি, মঙ্গল সিংহ, আনে এবং সঞ, যদিও জওহরলাল নেহরুও শেষের দিকের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
১৯২৮ সালের ৫-২২ জুনের মধ্যে এই কমিটি প্রতি দিন বেশ কয়েক ঘন্টার জন্য। বৈঠক করত ইলাহাবাদে, মােতিলাল নেহরুর বাড়িতে। সংবিধানের রূপরেখার বিষয়ে তাঁদের কাজ অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের কোনও সূত্র বেরােল না। শেষে ৭ জুলাই, ১৯২৮ সালে একটা সমঝােতা সূত্রে পৌঁছানাে গেল, যাতে বলা হল, সব। সদস্যরাই আসন সংরক্ষণের বিরােধী, তা সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু, যার জন্যই হােক।
১১৯
কমিটির কার্যকলাপের একটি বিশেষ দিক হল, সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনগুলিতে জওহরলাল নেহরুর একটি ভূমিকা ছিল। জুলাইয়ের ৬ এবং ৭ তারিখে অধিবেশনের পর জওহরলাল যে রিপাের্টের খসড়ার অন্যতম লেখক হয়ে উঠেছিলেন এবং রিপাের্টের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ তিনিই লিখেছেন, সে কথা। মােতিলাল নিজেই স্বীকার করেছেন। সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলি নিয়ে লিখেছিলেন। মােতিলাল, কিন্তু বাস্তবে জওহরলাল লেখার বিষয়ের অনেকটাই প্রস্তুত করেছিলেন। সাম্প্রদায়িক সমস্যার মােকাবিলা করার প্রত্যয়, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলির সমাজকে পরিবর্তন করার বিষয়ে অনিচ্ছা, এগুলি স্পষ্টতই মােতিলালের রচনা। কিন্তু স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক দলগুলি ‘অর্থনীতির ভিত্তিতে তৈরি হবে, এই প্রত্যাশার স্বর, এই দর্শন তাঁর পুত্র জওহরলালের বৈশিষ্ট্য, পিতার নয়।
২১ অগস্ট, ১৯২৮, নেহরু রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। যে সংবিধানের প্রস্তাব দিল এই রিপাের্ট, তা তখনও অবধি সবচেয়ে বেশি প্রগতিশীল। যদিও তার সাম্প্রদায়িক বিষয়ের বক্তব্যগুলিই পরবর্তী কালে বেশি আলােচিত হয়েছে, রাজনৈতিক প্রস্তাবগুলিও কম বিতর্কিত ছিল না, যার ফলে সাম্প্রদায়িক মতবিরােধ নতুন করে শুরু হয়েছিল। যে জাতীয় সরকারের কথা চিন্তা করা হয়েছিল, তা ছিল ‘ইউনিটারি’, ‘ফেডারাল’ নয়, এবং অবশিষ্ট ক্ষমতাও কেন্দ্রীয় সরকারের উপরেই ন্যস্ত হয়েছিল। এই প্রস্তাবই সবচেয়ে বেশি আপত্তিকর হয়ে উঠল, নানা বিরােধী আপত্তি জানাতে লাগলেন। সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে রিপাের্ট প্রস্তাব দিল পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী বাতিল করতে এবং সংখ্যালঘুদের উপর বিশেষ জোর দিতে। সংখ্যাগুরুদের জন্য সংরক্ষণের মুসলিম দাবি এবং কেন্দ্রে ৩৩ শতাংশ আসনের দাবিও বাতিল করা হল। কেবল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিমদের খুশি হওয়ার কারণ ছিল, যেহেতু সিন্ধুপ্রদেশকে বম্বে থেকে আলাদা করা, এবং ওই অঞ্চলকে সমান মর্যাদা দেওয়া, এই দুটিই কমিটির অনুমােদন পেয়ে যায়।
সর্বদলীয় বৈঠক, যা কমিটিকে তৈরি করেছিল, তা ২৮ অগস্ট লখনউতে আবার সমবেত হল রিপাের্টটি নিয়ে আলােচনার জন্য। জিন্নার অনুপস্থিতির জন্য দুই নেহরু বৈঠক পিছিয়ে দিতে অনুরােধ করা হল। তাঁরা মেনে নেওয়ার ভান করলেন, আসলে অনুরােধ রাখলেন না, অসৌজন্যের পরিচয় দিয়ে বৈঠক মাত্র এক দিন পিছােল। জিন্নার সঙ্গে আপােস করতে নেহরুরা খুব আগ্রহী ছিলেন না, দুটি শিখ সংগঠন-সহ সমস্ত ধর্মীয় সংগঠনকেও বাদ রাখা হল, কেবল একশাে জনে উপস্থিতি সীমাবদ্ধ রাখা হল। তাই আশ্চর্য নয় যে বৈঠক এই রকম ফল দিল।
সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণ বাতিল করার জন্য কেবল শওকত আলির কাছ থেকে মৃদু আপত্তি শােনা গেল। তিনি হিন্দু মহাসভাকে বিশেষ সুযােগ দেওয়ার জন্য মােতিলাল নেহরুর থেকে ভিন্ন হলেন, এবং যে মুসলিমরা মােতিলালকে সমর্থন করছিলেন তাঁদের থেকেও ভিন্ন হলেন। এই আপত্তি কংগ্রেসকে খুবই বিব্রত করেছিল। কিন্তু আরও বড় চ্যালেঞ্জ এল সেই রাজ্য শক্তিগুলির কাছ থেকে, যাদের উপর সরকার ভরসা করেছিল।
১২০
যদিও মােতিলাল নেহরু সর্বদলীয় কমিটির বৈঠকে জিন্নার প্রতি তেমন সৌজন্য দেখাননি, তবু তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে জিন্নাই সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, এবং তিনি রাজি হলে নেহরু রিপাের্ট প্রয়ােজনীয় মর্যাদা পাবে। তাই শওকত আলি আর কোনও ক্ষতি করার আগেই জিন্নাকে রাজি করানাের জন্য নেহরু পুরুষােত্তম ঠাকুরদাসকে। নিয়ােগ করেন। জিন্না কিন্তু দেশে ফিরে সরাসরি রিপাের্টের প্রতি তাঁর সমর্থন ঘােষণা করলেন না। বরং স্বভাববিরােধী সতর্কতার সঙ্গে তিনি মুসলিমদের মতামত জানতে চাইলেন। লখনউতে মুসলিম লিগ কাউন্সিলের যে বৈঠক তিনি ডাকলেন, তা থেকে কোনও সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল না। এর ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করা তাঁর পক্ষে কঠিন, এমনকী রাজনীতিবিরােধী হয়ে দাঁড়াল।
এই অচলাবস্থার জন্য মােতিলাল নেহরু ডিসেম্বর ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে আক্ষেপ করেছিলেন, “ঐক্যবদ্ধ না হলে বিদেশির সামনে দাঁড়ানাে মুশকিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে বিদেশি আধিপত্য থাকলে ঐক্যবদ্ধ হওয়াও মুশকিল।” জওহরলালও গভীর ভাবে চিন্তা করেছিলেন, কী কারণে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে অনড় অবস্থান নেহরু রিপাের্টকে ব্যর্থ করে দিল এবং গােল টেবিল বৈঠকের পথ রােধ করে দাঁড়াল। তিনি একই সিদ্ধান্তে পৌছলেন যে এমন রাজনৈতিক দরদস্তুর করলে দেশ বেশি দূর এগােবে না, কারণ, “আমরা যা-ই দিতে চাই না কেন, তা যত বেশিই হােক, সব সময়েই একটা তৃতীয় পক্ষ থাকবে যা আরও বেশি দিতে পারবে, উপরন্তু, তার কথা রাখতেও পারবে। এই তৃতীয়, নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষ সব সময়েই আধিপত্য করে এবং তার পছন্দ মতাে উপহার বণ্টন করে।”
কিন্তু ঘটনাক্রম এগিয়ে গেল। কলকাতায় ডিসেম্বর ১৯২৮ সালে বৈঠক হওয়ার আগে আর একটি শক্তিশালী গােষ্ঠীর সমর্থন চলে গেল। এটি হল খিলাফত গােষ্ঠী, যারা আগেই নেহরু রিপাের্টকে বাতিল করেছিল। স্পষ্টতই, ক্লান্তিহীন আলিভাইরা ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছিলেন। শেষ অবধি লিগ যখন কলকাতায় বৈঠক করল, তখন স্থির হল একটি প্রতিনিধিদল তৈরি হবে যা সর্বদলীয় বৈঠকে সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলির ফয়সালা করবে। এর পর, মুসলিম লিগ এবং খিলাফত গােষ্ঠীর সঙ্গে সর্বদলীয় কনভেনশনের সাব-কমিটির যৌথ বৈঠকের পর জিন্না এবং টি কে শেরওয়ানি এই দাবিগুলি তুলে ধরলেন, যা আগের চার থেকে এখন সাতে এসে ঠেকল (কোনও কোনও ঐতিহাসিক অবশ্য বলেছেন, ছয়টি)।
খুব সম্ভব কেন্দ্রে ৩৩ শতাংশ প্রতিনিধিত্বের দাবির জন্য জিন্নাই দায়ী ছিলেন। ১৯২৭ সালের মার্চ মাসে এটি ছিল চারটি দাবির একটি। এবং তাঁর যথেষ্ট কারণ ছিল এই দাবিতে লেগে থাকার, কারণ তাঁর মুসলিম অনুগামীরা, বিশেষত সংখ্যালঘু রাজ্যগুলির ব্যক্তিরা, এই কারণেই নেহরু রিপাের্টের বিরােধিতা করেছিল। তাঁর দাবিতে লেগে থাকার সপক্ষে জিন্নার যুক্তি ছিল, বাড়তি আসনগুলােকে সংখ্যালঘু রাজ্যগুলিতে বণ্টন করে দিতে হবে, যা অনুগামীদের ইচ্ছেই প্রতিফলিত করে।
সর্বদলীয় বৈঠকের সাব-কমিটি কী ভাবে এই দাবিগুলি গ্রহণ করেছিল, তা বােঝাই
১২১যায়। ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে ১১ জন হিন্দু, শিখ এবং খ্রিস্টান ছিলেন, এক জন ছিলেন সিন্ধপ্রদেশ পৃথক হওয়ার ঘাের বিরােধী, এবং ছয় জন হিন্দু মহাসভার প্রধান নেতা। তেত্রিশ শতাংশ প্রতিনিধিত্বের দাবি গাঁধী এবং তেজ বাহাদুর সপ্রু সমর্থন করেন কিন্তু হিন্দু মহাসভা এবং শিখরা বিরােধিতা করে। অবশিষ্ট ক্ষমতা রাজ্যগুলির কাছে থাকার প্রস্তাবে মহাসভা এবং লিবারেল ফেডারেশন, দু’পক্ষই আপত্তি করে, যদিও সপ্রু এবং চিন্তামণি কী কী বিষয় থাকবে তা বিচার করতে রাজি ছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলােচনার সময়ে গাঁধী বা মােতিলাল নেহরু কেউ-ই কোনও কথা বলেননি। সব প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার পাওয়া না গেলে বাংলা এবং পঞ্জাবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সংরক্ষণের দাবি এড়িয়ে যাওয়া হল এই বলে যে, “তেমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।”[৫২] সিন্ধুপ্রদেশের বিষয়ে দাবি এই বলে বাতিল হল যে লখনউতে যে সিদ্ধান্তে পৌছনাে গিয়েছে তা বাতিল করতে হবে। খােলা অধিবেশনে জিন্না আবার কমিটির মত পরিবর্তনের চেষ্টা করলেন। তিনি দর্শকদের বললেন, যে পরিবর্তনগুলির প্রস্তাব করা হয়েছে, তা ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত। কোনও দেশ সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা না করে স্বাধীনতা পায়নি, এবং দেশের রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়ােজন। যদিও ডা. স… জিন্নাকে সমর্থন করলেন, তীব্র যুক্তিপূর্ণ বিরােধিতা এল এম আর জয়াকরের কাছ থেকে, যিনি বৈঠকে বললেন, “জিন্না মুসলিমদের মধ্যে একটি সামান্য অংশের প্রতিনিধি, এবং তাঁর দাবি মেনে নেওয়ার কোনও অর্থ হবে না কারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশির ভাগের কাছে তাতে কিছু পরিবর্তিত হবে না।”[৫৪] “তা ছাড়া,” তিনি বললেন, “জিন্না তাে তাঁদের দিকেই আছেন, এবং মুসলিম লিগকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য সব রকম চেষ্টা করবেন।”[৫৫] জিন্নার উত্তরে বােঝা যায়, তিনি নিজের কোণঠাসা অবস্থা কতখানি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন: “কেবল মুসলিম লিগ নয়, ভারতের মুসলমানদের আপনাদের সঙ্গে পেতে হবে, এবং এখানে আমি কথা বলছি কেবল এক জন মুসলমান হিসেবে নয়, এক জন ভারতীয় হিসেবে। আমার ইচ্ছে, ভারতের সাত কোটি মুসলমান স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমাদের সঙ্গী হােক। আমি যদি বলি আমি আপনাদের সঙ্গে রয়েছি, আপনারা কি সন্তুষ্ট হবেন? কিন্তু আপনারা কি চান, নাকি চান না, যে ভারতের মুসলমানও আপনাদের সঙ্গী হােক?”[৫৬] খুবই জোরালাে যুক্তি, ভাল প্রশ্ন, কিন্তু জয়ার আগেই তার উত্তর দিয়ে দিয়েছেন। বৈঠকে জিন্নার প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেল, এবং এর ফলে জিন্নার পথ আলাদা হয়ে গেল, যা হেক্টর বােলেথাে উদ্ধৃত করছেন,
১০ মার্চ, ১৯৫২: জামশেদ নাসেরওয়ানজির সঙ্গে কথার প্রতিলিপি
বেশ লােক এই বৃদ্ধ পার্সি মানুষটি। মেট্রোপােল হােটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। একটা লম্বা সাদা কোট আর চেক-কাটা ছাইরঙা। টুপি পরেছিলেন। বললেন তিনি জিন্নার পুরনাে বন্ধু এবং তারপর ভারী
১২২
সুন্দর একটা কথা বললেন, উনি বললেন, ‘ওঁর স্মৃতি বড় সুন্দর।
জিন্নার সম্পর্কে তিনি বললেন ‘উনি আবেগপ্রবণ এবং স্নেহশীল। ছিলেন, কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারতেন না। সব কিছুই ছিল নিয়ন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রণ।
তার পর, এক বার আমি ওঁকে কাঁদতে দেখেছিলাম। সে একটা দারুণ জিনিস ছিল। সেটা ছিল ১৯২৭ (১৯২৮), কংগ্রেসের কলকাতা। অধিবেশনের সময়ে। তিনি একটু থেকে বললেন, ‘আমি তােমার জন্য ওটা লিখে আনব।’
আবার, জিন্নার সম্পর্কে, ‘জিন্নার মধ্যে একটা একাকিত্ব ছিল। একটি একা মানুষ। পরদিন জামশেদ নাসেরওয়ানজি আমার জন্য এই নােটটি নিয়ে এলেন।
পথ পৃথক হয়ে গেল
১৯২৭ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে (সর্বদলীয় জাতীয় কনভেনশন, ডিসেম্বর ১৯২৮) দিল্লি থেকে জিন্নার একটি টেলিগ্রাম এল, এই বলে যে তিনি এবং তাঁর ছয় সহকর্মী কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে দেখা করে কিছু বিষয় আলােচনা করতে চান – এগুলি ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁদের সমঝােতার শর্ত। জওহরলাল নেহরু ছিলেন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। বেশির ভাগ নেতাই এর বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু মহাত্মা গাঁধী তাঁদের রাজি করালেন জিন্না ও তাঁর দলকে কলকাতায় আহ্বান করতে। তাঁরা এলেন, এবং জিন্না তাঁর দাবিগুলি একটি বিশেষ কমিটির কাছে রাখলেন, কিন্তু কমিটি সেগুলি খারিজ করল। বিপক্ষে ছিলেন ১৮ জন, পক্ষে দু’জন। সেই দু’জন গাঁধীজি এবং আমি। জিন্না চোখে জল নিয়ে হােটেলে ফিরে গেলেন। মহাত্মা গাঁধী দুঃখিত ভাবে রাত তিনটের সময়ে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন, এবং ভাের ছ’টা অবধি চরকা কাটলেন। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ জিন্না এবং তাঁর সঙ্গীরা দিল্লির জন্য রওনা দিলেন। আমি স্টেশনে তাঁদের বিদায় জানাতে গেলাম। তিনি আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন, এবং এই কথাগুলি বললেন, ‘জামশেদ, আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল।
এর পর থেকে জিন্না সমস্ত প্রস্তাব, এমনকী সর্বদলীয় সিদ্ধান্তগুলি পর্যন্ত ক্রমাগত খারিজ করেছেন। কংগ্রেসের নেতাদের উপর তাঁর আর আস্থা ছিল না। তিনি লন্ডনের গােল টেবিল বৈঠকে ঐকমত্যে পৌঁছনাের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আবার হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলাে ইতিহাসের বিষয়। কিন্তু তা হওয়ার ছিল না, অন্তত তখনও নয়। জিন্নাকে কেন বার বার বাদ পড়তে হয়েছিল, সে সব কারণ খুবই জটিল। কেবল
১২৩
সে সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের মনােভাব নয়, সে সময়ের রাজনীতি যে ভাবে কাজ করত, তার প্রক্রিয়া অনেক বেশি কাজ করেছিল। ১৯২০-র দশকের গােড়ার দিকে যদিও আঞ্চলিক রাজনীতি কখনও কখনও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত, আসল সংঘাতটা ছিল ‘জাতীয় নেতা’ এবং আঞ্চলিক নেতার মধ্যে। মন্টেগুচেমসফোর্ড সংস্কার আইনে পরিণত হওয়ার পর স্বার্থে এই সংঘাত প্রকাশ্য এবং তীব্র হয়ে উঠল। এই সময়ের রাজনীতি নিয়ে পড়ার আনন্দটাই হল, কী ভাবে প্রধান ভূমিকার মানুষরা রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিকাঠামাের সংকীর্ণতার সঙ্গে লড়াই করেছেন, তা লক্ষ করা। জিন্নার প্রধান সমস্যা ছিল একটা মজবুত রাজনৈতিক ভিত্তি না থাকা, তা ছাড়া রাজনৈতিক আন্দোলনের যুগে তিনি ছিলেন ‘আলােচক’ রাজনৈতিক নেতা। ফলে তাঁর জাতীয়তার বােধ যতই সাচ্চা হােক, আঞ্চলিক মুসলিম নেতা এবং কেন্দ্রে কংগ্রেসের সহকর্মীদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে তাঁকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল। তিনি নিজে কোনও আঞ্চলিক রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না, তাঁর পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। তাঁর কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই ভাস্করের মতাে, যাকে কাজ করতে হয় এমন বস্তু দিয়ে যার আকার কেবল বদলে যাচ্ছে। আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে যত নতুন নতুন দাবি উঠে আসতে লাগল, জিন্নাকেও তত নিজের রাজনৈতিক লক্ষ্য বদলাতে হল। ১৯২৭ সালে তিনি চারটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ১৯২৮ সালে তা দাঁড়ালে ছয়ে, আর ১৯২৯ সালে চোদ্দোয়।[৫৭]
শেষ অবধি কংগ্রেস এবং জিন্নার মধ্যে আলােচনা আর ফলপ্রসূ রইল না। জিন্না কেবলই আঞ্চলিক রাজনীতির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখছিলেন, এতটাই যে তিনি আর কংগ্রেসের সঙ্গে লড়াইয়ে নিজেকে সক্রিয় রাখতে পারছিলেন না। ব্যক্তি হিসেবে কংগ্রেসের পরিকল্পনায় যােগ দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, নিজের সঙ্গে মুসলিমদের একটি বড় অংশকে রাখা তাঁর রাজনৈতিক প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু যে মুসলিমদের কাজ জিন্নাকে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তাঁর দরদস্তুরের শর্ত পালটাতে বাধ্য করেছিল, তারাই আঞ্চলিক স্তরে কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। এখানেই ছিল জিন্নার দ্বিধা, হয় তাঁকে কংগ্রেসের শিবিরে থাকতে হবে, নইলে মুসলিমদের শিবিরে, কিন্তু দুটোতেই থাকা অসম্ভব। এই নিষ্ঠুর যুক্তি, এবং তার নিরন্তর দাবির চাবুক শেষ অবধি জিন্নাকে পাকিস্তানের ‘কায়েদ-ই আজম’ করে তুলল। ঠিক যেমন সেই সব কংগ্রেসি, যাঁরা ‘স্বাধীনতা এবং অসহযােগিতা সমর্থন করতেন, তাঁরা নেহরু এবং সঞদের চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেছিলেন, তেমনই বিভিন্ন আইনসভার যে মুসলিমরা এখন ব্রিটিশ সম্রাটের প্রতি আনুগত্য জানাতে শুরু করলেন, এবং সাংবিধানিক রীতিনীতির উপর শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠলেন, তাঁরা জিন্নাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন, “তুমি কি আমাদের সঙ্গে আছ, না কি নেই? ভারতের রাজনৈতিক সত্তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছিল, সরকার এবং মুসলিমরা এক দিকে, অন্য দিকে হিন্দুরা। কংগ্রেস যখন আইন অমান্য আন্দোলনের ধুলাে-মাখা পথে ডান্ডির রাস্তায় নামল মহাত্মার অনুগামী হয়ে, তখন মুসলিমরা, যারা এই ব্যবস্থার সুবিধা পাচ্ছিল, তারা ব্রিটিশ রাজের প্রতিরক্ষায় শামিল হয়ে পড়ল।
১২৪
তথ্যসূত্র
১. ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পর থেকেই একটা মনােভাব তৈরি হয় যে মুসলিমদের তাতে যােগ দেওয়া উচিত নয়। ব্রিটিশ নীতির পরিণামস্বরূপ যে সব সামাজিক পরিবর্তন ঘটে, সেগুলি মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক চেতনা আরও সংহত করে। ১৮৮০-র শেষ এবং ১৮৯০-এর শুরুর দিকে বদরুদ্দিন তায়েবজির মতাে স্বনামধন্য এক জন কংগ্রেস সভাপতিও পরামর্শ দিয়েছিলেন কংগ্রেস সাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দিচ্ছে, অতএব তাকে গুটিয়ে নেওয়া হােক। তার পর বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলন এবং সেই আন্দোলনে ব্যবহৃত হিন্দু প্রতীকগুলি মুসলিম মানসে সম্প্রদায়গত সংহতিচিন্তা আরও সংগঠিত করে। লখনউ চুক্তির পরবর্তী সময়ে নিখিল ইসলামি সংহতির একটা অবয়ব পরিস্ফুট হতে থাকে, যা আবার মুসলিমদের সম্প্রদায়-চেতনা আরও সংহত করে।
২. দীর্ঘ কাল ধরে মুসলিমদের নিয়ন্ত্রিত মশলা-বাণিজ্য বার-বারই পর্তুগিজরা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কেরলের মােপলা বিদ্রোহের মূলে থেকেছে এই হস্তক্ষেপ, যা কালক্রমে বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে মােপলা মুসলিমদের সম্পর্ককে তিক্ত করেছে। ইউরােপীয় হস্তক্ষেপ মােপলা চাষি, মালয়ের রাজা এবং অভিজাত নায়ার সম্প্রদায়ের মধ্যে এলাকা দখলের এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে, যা প্রায়শ রক্তাক্ত হয়ে ওঠে।
ব্রিটিশ বিজয় বর্ণহিন্দু ভূস্বামীদের দিকে পাল্লা ভারী করে এবং মােপলা রায়তরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক শােষণের জাঁতাকল থেকে বের হতেই মােপলা ভাগচাষিরা নিয়মিত বিদ্রোহ করতে থাকে। শহিদ হওয়ার প্রথা অনুসরণ করেই মােপলারা লড়াই করতে থাকে। ১৯২১-২২-এর বিদ্রোহে লড়াই চূড়ান্ত আকার নেয়।
৩. এডওয়ার্ড টমসন, দ্য রিকন্সট্রাকশন অফ ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯৩০, পৃষ্ঠা ১৪১
৪. খিলাফত কোনও ভারতীয় ঘটনা ছিল না এবং মুসলিমরা অন্য যাবতীয় ভারত-বিষয়ক প্রশ্নের থেকেও খিলাফতের সমর্থনে অধিকতর উৎসাহে সমবেশিত হন। গাঁধী এটাকে খুব স্বাভাবিক মনে করেছিলেন। ১৯২১ সালের ২ অক্টোবর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘সাহসী আলি ভ্রাতৃদ্বয় তাদের স্বদেশকে যথেষ্টই ভালবাসেন। কিন্তু তারা আগে মুসলমান, তার পর অন্য কিছু, এবং সব ধার্মিক লােকেদেরই তেমনটাই হওয়া উচিত। খিলাফত আন্দোলন তাই ভারতীয় মুসলমানদের মনে কোনও জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তােলেনি। পরিবর্তে এক ধরনের মুসলিম সম্প্রদায়গত চেতনা উস্কে তােলে, যা পরবর্তী কালে পাকিস্তানের দাবিতে রূপান্তরিত হয়।
৫. বন্দে মাতরম, ৯ সেপ্টেম্বর, ১৩ অক্টোবর ১৯২১, জি আর থার্সবি, হিন্দু-মুসলিম রিলেশন্স ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া, পৃ ১৩৩
৬. গুরু কা বাগ অমৃতসর থেকে কুড়ি কিলােমিটার দূরে। অনেক গুরুদ্বারকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে মুক্ত করার পর এখানেই শিখদের কষ্ট সহ্য করার ও প্রতিরােধ গড়ে তােলার ক্ষমতা চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। পারস্পরিক আলােচনার মাধ্যমে মােহন্ত সুন্দর দাস গুরুদ্বারের পরিচালনভার শিরােমণি কমিটির হাতে তুলে দেন, নিজে শিখ ধর্মও গ্রহণ করেন। কিন্তু পরে তিনি দাবি করেন, গুরুদ্বারটি শিরােমণি কমিটির হাতে তুলে দিলেও তার লাগােয়া গুরু-কাবাগ-এর জমির মালিক তিনিই। তাই শিখরা লঙ্গর বানানাের জন্য সেই বাগের গাছ কাটতে
১২৫
গেলে তিনি আপত্তি জানান। তাকে তুষ্ট করতে ব্যর্থ পুলিশ ১৯২২ সালের ৯ অগস্ট ৫ জন। শিখকে অনধিকার প্রবেশের দায়ে গ্রেফতার করে। সুন্দর দাসের অভিযােগ নয়, পুলিশের কাছে আসা একটি গােপন রিপাের্টের ভিত্তিতেই এই গ্রেফতারি। পর দিনই তড়িঘড়ি ওই শিখদের বিচার হয় এবং পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের রায় হয়। সরকারের এই পদক্ষেপ অগ্রাহ্য করে শিখরা তবু লঙ্গরখানার রােজকার জ্বালানির প্রয়ােজনে কাঠ কাটতে থাকেন। গ্রেফতারি ও কারাদণ্ডে কাজ হচ্ছে না দেখে পুলিশ তাদের সন্ত্রস্ত করার নতুন উপায় উদ্ভাবন করে-কাঠ কাটতে আসা শিখদের প্রবল মারধর করে সংজ্ঞাহীন করে দেওয়া, তার পর তাদের চুলের মুঠি ধরে মাটির ওপর দিয়ে টেনে-হিচড়ে নিয়ে যাওয়া এবং যথেষ্ট শিক্ষা দেওয়া গেছে মনে করে ঘৃণাভরে রাস্তার ধারে ফেলে যাওয়া। শিখরা এ সবই নীরবে সহ্য করেন এবং শারীরিক নিগ্রহ উপেক্ষা করে প্রতি দিনই আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় কাঠ কাটতে জমায়েত হয়ে পুলিশের উদ্যত যষ্টির সামনে নিজেদের পিঠ পেতে দেন। ৩১ অগস্ট থেকে নিগৃহীত হতে আসা শিখদের সংখ্যা দৈনিক ১০০’তে তুলে দেওয়া হয় এবং প্রত্যহ একশাে শিখ মার খেতে হাজির হন। আত্মনিয়ন্ত্রণ ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে থাকেন শিখরা।
৭, এইচ এন মিত্র সম্পাদিত, ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্ট্রার, ১৯২৩, পৃ ৯৪৩-৯৪৪
৮. এগুলি ছিল, শারীর-শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের হিন্দু সংগঠন হনুমান আখড়ারই মুসলিম সংস্করণ, যা মুসলিম যুবকদের পেশি-বৃদ্ধির কাজ করবে। সাংগঠনিক একক হিসাবেও এগুলি সাম্প্রদায়িক সংহতির উপর জোর দিতে পারবে।
৯, বিরােধী ধর্মীয় সম্প্রদায়কে প্রতিরােধ করার শক্তি। সংগঠন’ শব্দটির মানেই হয়ে দাড়ায় সম্প্রদায়ের সম্পদ একত্র করে শক্তি সংগ্রহ করা। যে-সব হিন্দু মনে করত, জঙ্গিপনা ও সমাবেশপ্রবণতায় তারা মুসলিমদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে, তাদের কাছে শব্দটি হয়ে ওঠে উত্তেজনাময় ও উৎসাহব্যঞ্জক।
১০. সাধারণে যা-ই মনে করুক, মহরম কিন্তু কোনও বিশেষ একটি দিন নয়, এটা ইসলামি পঞ্জিকার প্রথম মাসের নাম। যে চারটি মাসকে ইসলামে পবিত্র মনে করা হয়, মহরম তার একটি। বাধ্যতামূলক না হলেও এই মাসটিতে উপবাস পালনের রীতি আছে, বিশেষত মাসের দশম দিনটিতে, যাকে ‘আসুরা’ও বলে।
এই মহরমের মাসেই (আনুমানিক দিনটি ২০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) ইরাকের ইউফ্রেটিস নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে পয়গম্বরের নাতি ইমাম হােসেন নিহত হয়েছিলেন। মহরমের মাসে আসুরার দিনটিতে তার মৃত্যুর শােক প্রতি বছর আনুষ্ঠানিক ভাবে পালিত হয়। শহিদের শবাধার বা সমাধির অনুকরণে নির্মিত ‘তাজিয়া নিয়ে শােকার্তরা খালি পায়ে রাস্তা দিয়ে ড্রাম বাজাতে-বাজাতে যায়। শােকে-দুঃখে বিহুল এই জনতা প্রায়শ নিজেদের বুক চাপড়ায়, এমনকী নিজেদের চাবুকের আঘাতে ক্ষতবিক্ষতও করে।
১১. বলিদানের উৎসব ইদ-উল-আধা ভারতে ইদ-উল-আঝা নামে উচ্চারিত হয় এবং সাধারণ্যে ইদুজ্জোহা নামেই বেশি পরিচিত। একে বকরি-ইদও বলা হয়। ধুল হিজ্জা মাসের দশম দিনে এই উৎসব পালিত হয়। পুণ্যার্থীরা এই বলি দেয়। পবিত্র হজযাত্রার অঙ্গ হিসাবেও এই বলিদান। যাত্রীরা যখন মিনায় এই বলির আয়ােজন করেন, তখনই অবশিষ্ট মুসলিম বিশ্বেও বলির অনুষ্ঠান চলে।
১২. প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২০ সালের ১০ অগস্ট প্যারিসের কাছে জোটশক্তির সঙ্গে
১২৬
অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রাম জোটশক্তির সদস্যদের আবার আলােচনার টেবিলে ফিরতে বাধ্য করে এবং নূতন করে আবার চুক্তি বানাতে হয়। ১৯২৩ সালের এই চুক্তির নাম লুসান চুক্তি।
১৩. খলিফ (আরবিতে খলিফা শব্দের অর্থ ঈশ্বরের ডেপুটি কিংবা পয়গম্বরের উত্তরসূরি) এক জন এমন শাসক, যাঁকে মহম্মদের মৃত্যুর পর (৬৩২ খ্রিস্টাব্দ) মুসলিম সম্প্রদায়ের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রেরই কর্তৃত্ব অর্পণ করা হয়। প্রথম খলিফা হন মহম্মদের বন্ধু ও শিষ্য আবু বকর। এই আবু বকর, ওমর, উথমান এবং আলি, অর্থাৎ প্রথম চার খলিফাকেই সুন্নিরা ঠিক দিশায় চালিত খলিফা গণ্য করেন। এর পর খলিফা উপাধিটি বংশানুক্রমিক হয়ে যায়। দামাস্কাসে ও পরে কর্ডোবায় উম্মায়েদ রাজবংশ, বাগদাদে আব্বাসিদ শাসকরা, মিশরে ফতিমিদ ও মামলুক শাসকরা এবং আরও বহু মুসলিম যুদ্ধসর্দার কালক্রমে খলিফা উপাধি ধারণ করেন। ষােড়শ শতাব্দীতে অটোমান সুলতানরা এই উপাধিটি হস্তগত করেন, ১৫১৭ সালে মিশরের রাজধানী কায়রাের শেষ খলিফাকে পরাস্ত করার পর। ১৯২৪ সালে তুরস্কে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা খলিফা উপাধিটিই বরবাদ করে দেয়। খলিফাদের কোন ধারাটি বৈধ, তা নিয়ে বিরােধই শিয়া বনাম সুন্নি দ্বন্দ্বের মূলে। গােটা ইসলামের ইতিহাস জুড়েই খলিফা থেকেছেন মুসলিমদের সংহতির প্রতীকী কেন্দ্র এবং খলিফা উপাধি বা পদের অবসান হলেও একাধিকবার নিখিল ইসলামি সম্মেলনের মঞ্চ থেকে এক জন বৈধ খলিফা পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টাও হয়েছে।
১৪. দ্রষ্টব্য দ্বিতীয় অধ্যায়, ২৩৯ পৃষ্ঠা, ৬০ নম্বর পাদটীকা।
১৫. কে এম মুন্সি, পিলগ্রিমেজ টু ফ্রিডম, ভারতীয় বিদ্যাভবন, প্রথম খণ্ড, পৃ ৭।
১৬. হােমরুল আন্দোলন এবং লিগ: হােমরুল আন্দোলন এবং লিগের উৎসে ছিল পরুস্পরের প্রতি এক সতর্ক প্রতিক্রিয়া, যা স্বশাসন অর্থে ‘স্বরাজ’ শব্দটির দ্যোতনাকে ঘিরে আবর্তিত, যার মধ্যে ব্রিটিশ রাজের চোখে দ্রোহ ও বিপদের ব্যঞ্জনা নিহিত। স্বরাজ আনতে চাওয়া যাবতীয় কার্যকলাপকে তাই কঠোর ভাবে দমন করা হত। এ ভাবে নিরুৎসাহিত হয়েই বালগঙ্গাধর তিলক ও অ্যানি বেসান্তের মতাে নেতারা স্বরাজ-এর স্লোগানকে হােম-রুল-এর স্লোগানে পরিণত করেন। ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে তিলক সহকর্মীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করেন এবং ১৯১৬-র এপ্রিলে হােমরুল লিগের প্রতিষ্ঠা হয়, বর্তমান পুণে’তে তার সদর-দফতর বসে। মূল লক্ষ্য অপরিবর্তিতই থাকে— ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই যাবতীয় সাংবিধানিক উপায় অবলম্বন করে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা এবং দেশকে সেই পথে নিয়ে যেতে জনমতকে সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত করা। একই ভাবে অ্যানি বেসান্তও চেন্নাইয়ের কাছে। আডিয়ারে একটি হােম-রুল লিগ স্থাপন করেন সে বছর সেপ্টেম্বরে।
১৯১৬ সালে তিলক সারা দেশ চষে বেড়ান হােম-রুলের দাবিতে জনসাধারণকে সচেতন। করতে। ব্রিটিশ রাজের শ্বাসরােধকর আমলাতন্ত্রকে উৎখাত করাই লিগের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। তার প্রতিটি বক্তৃতায় তিলক জোরের সঙ্গে বলতে থাকেন যে, হােম-রুল না-থাকাই ভারতের রাজনৈতিক দুর্গতির একমাত্র কারণ এবং স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। আর সে কারণেই ভারতের বাইরের একটি ছােট্ট দেশের স্বল্পসংখ্যক লােককে কোনও মতেই একতরফা ভাবে অনন্ত কাল এ দেশকে শাসন করতে দেওয়া যায় না।
অ্যানি বেসান্তও একই ভাবে গােটা দেশে ঘুরে-ঘুরে প্রচার করতে থাকেন, যা দেশময় প্রবল
১২৭
উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। তার লেখালেখিও রীতিমত সাড়া ফেলে দেয়। সি ওয়াই চিন্তামণি তার এই মৌখিক ও লিখিত শব্দের যুগপৎ প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আলাে ফেলেছিলেন ভারতীয় নারীদের উপর, যাদের বীরত্ব, সহনশীলতা এবং আত্মত্যাগ নারীপ্রকৃতির মহিমাকেই দেখিয়ে দেয়।
হােম-রুলের প্রবক্তারা নিয়মতান্ত্রিক পথের পথিক ছিলেন, এবং সব রকম হিংসা বা বৈপ্লবিক সংগ্রামের বিরােধী। সে সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সঙ্কট মােকাবিলায় ব্যতিব্যস্ত ব্রিটিশ সরকারকে কোনও ভাবেই বিব্রত করার অভিপ্রায় তাদের ছিল না। ওই যুদ্ধে ব্রিটিশরা যাতে সাফল্য পায়, সে জন্য সব রকম সাহায্যের হাত বাড়াতেও প্রস্তুত ছিলেন তারা।
১৯১৭-র জুনে অ্যানি বেসান্তকে তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্য কারান্তরিন করা হয়। বিষয়টা জিন্নাকে এতই বিচলিত করে যে তিনি মুম্বই হােম-রুল লিগে যােগ দেন, কেবল এক সাধারণ সদস্য হিসাবে নয়, বরং তার সভাপতি রূপে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেই যুগেও (সেটা লখনউ চুক্তির কাল) অধিকাংশ নেতা এমন সব প্রতীক ও প্রবচন ব্যবহার করতেন, যা মুসলিমদের মনে সন্দেহ ও প্রশ্ন জাগিয়ে তুলত হিন্দু নেতাদের প্রকৃত অভিপ্রায় কী? তিলক এবং গাঁধীর মতাে নেতাও এই সন্দেহের বাইরে ছিলেন না। তারা মানুষকে অনুপ্রাণিত করার জন্য ধর্মীয় আবেদন ছাড়া আর কিছু ভাবতেও পারতেন না। দ্য স্টেটম্যান সংবাদপত্রে গােহত্যা নিয়ে হিন্দু-মুসলিমের দীর্ঘমেয়াদি বিরােধ সম্পর্কে গাঁধীর এক মন্তব্যকেই ধরা যাক: ‘ঠিক হােক বা ভ্রান্ত, হিন্দুর স্বভাবই হলাে গরুকে পুজো করা… অতএব সত্যের মুখােমুখি দাড়ানােই শ্রেয়। এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে ইউরােপীয়দের জন্য যে গাে-হত্যা হয়ে চলেছে, হিন্দুদের মনে তার কোনও প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে না। আমি জানি যে তাদের সেই ক্ষোভ ব্রিটিশ শাসনক্ষমতার চাপে ঢাকা পড়ে আছে। কিন্তু ভারতে এমন এক জন হিন্দুও নেই যে ভবিষ্যতে এক দিন তার দেশকে গাে-হত্যা থেকে মুক্ত করার আশা করে না। কিন্তু হিন্দু ধর্মের দ্বার। বিষয়ে আমার নিজের অনুভব যাই হােক, এক দিন হিন্দু তার তরবারির জোরেও খ্রিস্টান বা মুসলমানদের এ দেশে গাে-হত্যা থেকে নিরস্ত হতে বাধ্য করতে পারে। এ ধরনের বক্তব্য সে সময় জিন্নার রাজনীতির ভাষার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। জিন্না রাজনীতিতে ধর্মকে বর্জন করার পক্ষপাতী ছিলেন, গাঁধী আবার তার রাজনৈতিক বিশ্বাস, পরিভাষা, উচ্চারণ ও দায়বদ্ধতায় দ্বিধামুক্ত ভাবে হিন্দু ছিলেন।
জিন্না তিলকের রাজনীতির প্রকরণ সমর্থন করতেন না। তবু তিনি অবিচলিত ভাবে তিলকের সপক্ষে দাড়িয়েছেন, প্রথম বার ১৯০৮ সালে আদালতে, দ্বিতীয় বার ১৯১৬ সালে মান্দালয়ে ছয় বছরের কারাবাস থেকে মুক্ত হয়ে আসার পর কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে। গােখেল এবং তিলকের মধ্যে মতান্তর দূর করতেও জিন্না প্রভূত চেষ্টা করেছেন। তিলকের সঙ্গে জিন্নার বর্ধমান ঘনিষ্ঠতা গাঁধীর সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলি এই তিন মহান ভারতীয়ের জীবনেরই ঘটনা।
আগেই বলেছি, ১৯১৭ সাল ছিল হােম-রুল লিগের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ বছর, যখন তার দুই প্রবক্তা তিলক ও অ্যানি বেসান্ত একসঙ্গে কাজ করছেন। কে কোন অঞ্চলে কাজ করবেন, সে বিষয়েও একটা নিজস্ব বােঝাপড়া তাদের মধ্যে ছিল। তিলক সাধারণ ভাবে মুম্বই প্রেসিডেন্সি এবং কেন্দ্রীয় প্রদেশেই তার প্রচার সীমাবদ্ধ রাখেন, অবশিষ্ট ভারত অ্যানি বেসান্তের জন্য ছাড়া থাকে। স্বভাবতই গােটা দেশ জুড়েই হােম-রুল আন্দোলনের শাখা গড়ে
১২৮
ওঠে এবং এই মর্মে গণদাবিও জোরদার হয়।
১৯১৮-র মার্চে হােম-রুল লিগ সিদ্ধান্ত নেয়, ব্রিটিশ জনসাধারণকে ভারতের প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করতে তিলকের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাে হবে। কিন্তু দলটি ইংল্যান্ডে পৌছবার অনেক আগেই তাদের পাসপাের্ট বাতিল করা হয় এবং জোর করে তাদের দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে নামিয়ে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে ৮ এপ্রিল জিন্নার সভাপতিত্বে মুম্বইয়ে লিগের একটি সভা হয়।
২৪ এপ্রিল যুদ্ধের বর্ধমান বিপদ সম্পর্কে একটি যৌথ ইশতাহারে স্বাক্ষর করেন জিন্না, তিলক এবং অ্যানি বেসান্ত। এর পরই দিল্লিতে আয়ােজিত হয় যুদ্ধ-পরিষদের সম্মেলন, যেখানে প্রতিষ্ঠিত সব নেতৃস্থানীয় রাজনীতিককে উপেক্ষা করে লর্ড চেমসফোর্ড গাঁধী সহ কিছু দেশীয় রাজা, ভূস্বামী ও বণিককে আমন্ত্রণ করেন। গাঁধী সে সময় গুজরাতের খেড়া-য় কর নাদেওয়ার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তবু তিনি চেমসফোর্ডের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সম্মেলনে যােগ দেন। অথচ তিলক, অ্যানি বেসান্ত ও আলি ভ্রাতৃদ্বয়কে আমন্ত্রণই করা হল না। ৩০ এপ্রিল সম্মেলনে ভাষণপ্রসঙ্গে গাঁধী ব্রিটিশ যুদ্ধপ্রয়াসে ভারতের তরফে যাবতীয় সহযােগিতার আশ্বাস দেন। এই সম্মেলনে জিন্নাও যােগ দিয়েছিলেন। কিন্তু যখন তিনি বৈঠকে সাংবিধানিক সংস্কার বিষয়ে একটি প্রস্তাব তুলতে যান, সভাপতি একতরফা ভাবে আঁকে থামিয়ে দেন এবং গাঁধীও তার সাহায্যে দাড়াননি।
লন্ডনের যুদ্ধ-সম্মেলনের পর মুম্বইতে ১৯১৮-র ১০ জুন একটি প্রাদেশিক সম্মেলনও, আয়ােজিত হয়, যাতে লর্ড ওয়েলিংডনের সভাপতিত্বে তিলক এবং গাঁধী যােগ দেন। ব্রিটিশ যুদ্ধ-প্রয়াস নিয়ে তিলকের সঙ্গে গাঁধীর মতভেদ এই সম্মেলনে আরও প্রকট হয়ে ওঠে। তিলক জানিয়ে দেন, তিনি এই সম্মেলনে যােগই দেবেন না যদি ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাজনৈতিক মুক্তি বিষয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি না দেয়। তিনি যখনই কথা বলতে ওঠেন, তখনই ওয়েলিংডন তাকে বাধা দিতে থাকেন, যার ফলে ক্ষুব্ধ তিলক ওয়াক-আউট করে সভা থেকে বেরিয়ে যান। গাঁধী কিন্তু চুপচাপ বসে রইলেন। জিন্নাও ব্রিটিশ প্রস্তাবে সংশােধনী আনতে উঠে দাঁড়ান, কিন্তু তাকেও যথারীতি থামিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ জিন্না বলে ওঠেন— এই প্রস্তাবের পুরােটা আমি সমর্থন করতে পারি না, … তাই সংশােধনী আনতে চাই। অথচ কোনও সংশােধনীর অনুমতিই দেওয়া হচ্ছে না। এ রকম পদ্ধতির কথা কেউ কখনও শােনেনি এবং আমিও এর সঙ্গে যুক্ত হতে চাই না। ইন্দুলাল যাজ্ঞিক তার ‘গাঁধীকে আমি যে ভাবে চিনতাম’ বইয়ে তিলকের সঙ্গে গাঁধীর বিরােধ বিষয়ে লিখেছেন- ‘তিলকের পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকার থেকে জনসাধারণে রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তান্তরের মৌলিক দাবিতে তিনি এত অবিচল ছিলেন যে, এ জন্য ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত বা কূটনৈতিক স্তরে দরকষাকষি করার কোনও প্রয়ােজনই তিনি অনুভব করেননি, সুযােগও খোঁজেননি। এই কর্তৃপক্ষস্থানীয়রা গাঁধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য সদাই উদগ্রীব থাকতেন এবং যে কোনও দাবিদাওয়া (তা যত সংকীর্ণই হােক) মেটাতে তৎপর থাকতেন। তিলককে ব্রিটিশরা এত ঘৃণা করত যে তার সঙ্গে মােলাকাতই করতে চাইত না, কারণ তিনিই যে ছিলেন বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জাতির প্রতিবাদের মূল প্রবক্তা’।
নিজ-নিজ হােম-রুল লিগে তিলক ও অ্যানি বেসান্তের নিয়ন্ত্রণ থাকলেও গাঁধীর প্রভাব একটু-একটু করে বাড়ছিল। লিগ কর্মীরা এ বার দিশার খোঁজে গাঁধীর দিকে তাকাচ্ছিলেন। অবশেষে বেসান্তের লিগ গাঁধীর প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে ‘স্বরাজ লিগ’ নাম ধারণ
১২৯
করে এবং অসহযােগ আন্দোলনে মিশে যায়। ১৯২০-র অক্টোবরে জিন্না হাম-রুল লিগ থেকে পদত্যাগ করেন (পূর্ববর্তী অধ্যায় দেখুন)। অ্যানি বেসান্ত আগেই ছেড়েছিলেন, কেননা তার মতে, গাঁধী লিগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর লিগ বড় বেশি ধর্মের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। ডঃ বেসান্তের নেতৃত্বে জিন্নার সদস্য থাকা কালে লিগের স্লোগান ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে স্বায়ত্তশাসন’। গাঁধী আবেদন করলেন ‘পূর্ণ স্বরাজ’-এর, ব্রিটেনের সঙ্গে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করার। এই পরিবর্তনের প্রতি জিন্নার প্রতিক্রিয়া ছিল আইনজীবীসুলভ। তিনি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বনের দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করছিলেন। যখন তিনি প্রতিবাদ করেন যে লিগের সভা তার সংবিধান পাল্টানাের অধিকারী নয়, তখন সভাপতির তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়… যে কোনও সদস্য পরিবর্তিত সংবিধান না মানলে লিগ থেকে ইস্তফা দিতে পারেন। জিন্না আরও ১৯ জন সদস্যকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ লিগ ছাড়েন।
গাঁধী এ বার অন্য কয়েকটি বিষয়ে মনােনিবেশ করলেন। তিলকের কার্যকলাপ ভারতীয় মুসলিমদের খুব প্রসন্ন করেনি। গাঁধী তার সংস্কার-করা হিন্দুত্ব নিয়ে মুসলিমদের সহযােগিতা পেতে উদ্যোগী হলেন। ১৯১৮-র শুরু থেকে তিনি মুসলিম সমাজের সঙ্গে সংযােগ বৃদ্ধিতে জোর দিলেন। সরকারের সঙ্গেও এ বিষয় নিয়ে পত্রালাপ শুরু করলেন। এই ঝোঁকটাই তাকে খিলাফত আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট করে, যদিও তাঁর মতে এই আন্দোলন আদতে তত ব্রিটিশ-বিরােধী ছিল না। তত দিনে জিন্নার সঙ্গে তার মতপার্থক্যও এতটাই বেড়ে গেছে যে তা আর ঘুচবার নয়। গাঁধী আন্দোলনের পথে পা বাড়াচ্ছিলেন, যা জিন্নার কাছে অভাবনীয় ছিল। গাঁধীর মতাে ধর্মপ্রাণ হিন্দুর কাছে খিলাফতের ধর্মীয় উপাদানগুলি গ্রহণযােগ্য হলেও জিন্নার কাছে একেবারেই গ্রাহ্য ছিল না, কারণ তখনও পর্যন্ত তিনি ইসলামের তাত্ত্বিক গোঁড়ামি দিয়ে নিজের রাজনীতিকে প্রভাবিত করার ঘাের বিরােধী ছিলেন।
১৭. ভারতীয় সংবিধানের নথিপত্র, প্রথম খণ্ড, পিলগ্রিমেজ টু ফ্রিডম।
১৮. তদেব, ৪ নম্বর টীকা।
১৯. তদেব, ভারতীয় সংবিধানের নথিপত্র, প্রথম খণ্ড, পৃ ২২।
২০. ট্রান্সফার অফ পাওয়ার, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ ৬১৭
২১. জিন্না বিরােধিতা করছিলেন, কারণ অসহযােগ আন্দোলনের নামে কংগ্রেস আইনসভার প্রশ্নেও সরকারের বিরােধিতা করছিল। ১৯২০ সালের কাউন্সিল নির্বাচন কংগ্রেস বয়কট করে। অসহযােগ আন্দোলনের সমর্থক না হলেও জিন্না প্রকাশ্যে কংগ্রেসের নীতি বা খিলাফতপন্থীদের বিরুদ্ধাচরণ করতে পারছিলেন না। তাই তিনিও ১৯২০-র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলেন না।
২২. জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও তার পর পঞ্জাব সরকারের তীব্র দমননীতি।
২৩, স্বরাজি: স্বাধীনতা আন্দোলনে এঁরা ছিলেন চরমপন্থী, যাঁরা হােম-রুল লিগের নরমপন্থীদের বিরােধী ছিলেন। এই জঙ্গি আন্দোলন যত দানা বাঁধতে থাকল, ততই ইংল্যান্ড ও ইংরাজি শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠানগুলির মহিমা ও জৌলুস ম্রিয়মাণ হতে লাগল। দেশজ ইতিহাসের উপাদান ও ইউরােপের বিদ্রোহের সাহিত্য থেকে প্রেরণা সংগ্রহ হতে থাকল। ব্রিটিশ সাংবিধানিক ইতিহাসের অধ্যয়ন নরমপন্থীদের মনে স্বায়ত্তশাসনের প্রকরণ সম্পর্কে মােহ তৈরি করেছিল। কিন্তু একই সঙ্গে ইতালীয়রা কী ভাবে অস্ত্রীয়দের দেশছাড়া করে জঙ্গি জাতীয়তাবাদীদের
১৩০
প্রাসঙ্গিক করে তুলেছিল, সেই কাহিনিও মুখে-মুখে ফিরছিল। তাই নরমপন্থীরা যখন ব্রিটিশের অধীনেই স্বশাসনের ছক বানাচ্ছিলেন, চরমপন্থীরা তখন বিদেশি প্রভুত্ব ঘুচিয়ে পূর্ণ স্বরাজ চাইছিলেন।
বালগঙ্গাধর তিলক (১৮৫৬-১৯২০) ও অন্য চরমপন্থীরা সরাসরি আঘাত হানা ও প্রতিরােধ করার পক্ষপাতী ছিলেন, তারা নরমপন্থীদের আবেদন-নিবেদনের নিন্দা করতেন। বঙ্গভঙ্গ-বিরােধী আন্দোলনের সময় তিলক লিখেছিলেন—‘স্বরাজ বা স্বায়ত্তশাসন চাওয়ার সময় এসে গেছে। কোনও প্রসাধনী সংস্কার দিয়ে কাজ চলবে না। দেশের বর্তমান প্রশাসন। দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হয় তা নিজেকে সংশােধন করুক, নয়তাে জাহান্নামে যাক। তার মতে, স্বরাজ প্রত্যেক ভারতীয়ের জন্মগত অধিকার।
আর এক চরমপন্থী নেতা বিপিন পালের (১৮৫৮-১৯৩২) কাছে স্বরাজ কেবল কোনও রাজনৈতিক ধারণা নয়, এটি একটি নৈতিক ধারণা। “আমাদের দেশীয় ভাষায় স্বরাজ শব্দের অনুবাদ ইংরাজির অধীনতা-হীনতা নয়, বরং নিজের ইচ্ছাধীন থাকার স্ব-অধীনতা। এই স্ব-অধীনতার অর্থ হলাে, সর্বজনীনের সঙ্গে ব্যক্তির পূর্ণ অভেদ।
তিলকের মতােই আর এক স্বরাজি অরবিন্দ ঘােষ (১৮৭২-১৯৫০) বলেছিলেন, “আমরা যারা নব্যপন্থী, তারা পূর্ণ স্বরাজ তথা স্বায়ত্তশাসনের ব্রিটিশ প্রকরণ থেকে এক ইঞ্চিও নামতে রাজি নই। আমরা আমাদের থেকে নিকৃষ্ট একটি পরদেশি সভ্যতার দ্বারা দমিত হতে কিংবা অধিকতর যােগ্যতার ভুয়া অজুহাতে নিজেদের উত্তরাধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে সাজানাে অপযুক্তি খারিজ করি।।
লাজপত রায় (১৮৬৫-১৯২৮), বালগঙ্গাধর তিলক এবং বিপিন পালের সঙ্গে মিলেই জনমনে পরিচিত হন ‘লাল-বাল-পাল’ ত্রয়ী রূপে। লাজপত রায়ও বিশ্বাস করতেন, ভারতকে তার নিজের জোরেই নির্ভর করতে হবে, ব্রিটেনের দিকে সাহায্যের আশায় তাকিয়ে থাকলে হবে না।
স্বরাজিরা মনে করতেন, ব্রিটিশ শাসনকে যতই উন্নত, উদারনৈতিক বা সংস্কার করা হােক না কেন, তা কখনওই ভারতীয়দের স্বশাসনের মতাে উপকারী হবে না। আয়ারল্যান্ডের সিন ফেন নেতা আর্থার গ্রিফিথের মতােই ছিল তাদের মনােভাব, যিনি বলেছেন, যারা ব্রিটিশ অপশাসনের অবসানের কথা বলে, আমি তাদের বলি…প্রশ্নটা সুশাসন বা অপশাসনের নয়, প্রশ্নটা আয়ার্ল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের। স্বরাজিরাও এ জন্যই স্ব-অধীনতাকে নিজেদের জন্মগত অধিকার গণ্য করতেন।
২৪. বেঙ্গল প্যাক্ট: ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টের মাধ্যমে সরকারি এবং স্থানীয় প্রশাসনের চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষণ স্বীকৃত হয়। প্যাক্টটি মুসলমানদের প্রতি ছিল যথেষ্ট উদার। কারণ, ক্ষোভের মাটিতেই সাম্প্রদায়িকতার জন্ম এবং যত ক্ষণ না ভারতীয়রা এই ক্ষোভ প্রশমনের জন্য দৃঢ় ভাবে ব্যবস্থা করবে, তত ক্ষণ কোনও মতেই ক্ষোভ কমবে না। বেঙ্গল প্যাক্টের মাধ্যমে চিত্তরঞ্জন দাশ মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই প্যাক্টের শর্তাবলি সম্বন্ধে যে যা-ই মত পােষণ করুন না কেন, নিঃসন্দেহে এই বেঙ্গল প্যাক্ট একটি গঠনমূলক প্রস্তাব ছিল।।
২৫. ১৯২৬ সালের ঘটনাবলির মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার ছিল, সে বছরে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। প্রথম বার মে মাসে দাঙ্গা হয়, তার পর ফের জুলাইয়ে। আর্য সমাজের
১৩১
একটি শােভাযাত্রা একটি মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গানবাজনা করে— অশান্তির সূত্রপাত হয় এই ঘটনা থেকেই। এর থেকে আরম্ভ হয় হিংসা। দু’পক্ষেরই অনেক লােক মারা যান। শেষ পর্যন্ত যখন দু’দলই হাঁফিয়ে ওঠে, তখন সমঝােতা হয়। যদিও এই দাঙ্গার আগুন কলকাতার বাইরে বেরােতে পারেনি, তবু এই ঘটনার ফলে গােটা দেশেই যথেষ্ট উত্তেজনা ছড়ায়। ১৯২৬ সালের নভেম্বরে আইনসভার নির্বাচন আয়ােজিত হওয়ার কথা। বােঝা যায়, নির্বাচন হবে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটেই।
২৬. শতদ্রু এবং যমুনা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় মালওয়া অঞ্চল। পঞ্জাব এবং হরিয়ানার কিছু অংশ এই অঞ্চলে পড়ে। এই অঞ্চলের লােকেরা মালওয়াই নামে পরিচিত, এবং তারা পঞ্জাবি ভাষার যে কথ্য রূপে কথা বলেন, তাকে বলে মালয়ি।
বিপাশা নদীর ডান তীর থেকে উত্তর দিকের অঞ্চলের নাম মাঝা। এই অঞ্চল ভারত এবং পাকিস্তানের সীমান্তের গ্রাম ওয়াগা পর্যন্ত বিস্তৃত। পঞ্জাবি ভাষায় মাঝা শব্দটির অর্থ মূল অঞ্চল। এই অঞ্চল দুটি জেলায় বিভক্ত— অমৃতসর ও গুরদাসপুর।
২৭. পঞ্জাবের প্রাদেশিক সরকার ছিল মুসলমান-নিয়ন্ত্রিত। এই রাজ্যে যে আইন পাশ করা হয়, তাতে সুবিধা হয় মুসলমান কৃষিজীবী শ্রেণির। তারা সংখ্যায় ছিলেন হিন্দুদের তুলনায় অনেক বেশি। এই মুসলমান কৃষিনির্ভর শ্রেণি মুখ্যত শহরাঞ্চলের বাসিন্দা। আইনটি ক্ষুদ্র চাষি এবং কৃষি-শ্রমিকদের তুলনায় পশ্চিম পঞ্জাবের জমিদারদেরও অনেক বেশি সুবিধা দেয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিভাজনের সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক অসন্তোষের ওপর পড়ে। তারা এই আইনকে তাদের প্রতি বৈষম্যমূলক হিসেবেই দেখেন।
২৮. আর্যসমাজ একটি ধর্মীয়। সামাজিক সংস্কারমূলক প্রতিষ্ঠান। ১৮৭৫ সালে বম্বেতে এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। আর্য শব্দটির অর্থ এক জন মহৎ মানুষ, যিনি চিন্তাশীল, অন্যের উপকারসাধনে উৎসাহী এবং যিনি ভাল কথা ভাবেন ও ভাল কাজ করেন।
২৯. কোহট দাঙ্গা: ১৯২৪ সালে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কোহটে একটি বড় হিন্দুবিরােধী দাঙ্গা আরম্ভ হয়। সেপ্টেম্বরের ৯ থেকে ১১ তারিখের মধ্যে দাঙ্গায় ১৫৫ জনের বেশি হিন্দু ও শিখ প্রাণ হারান। স্থানীয় হিন্দু এবং শিখ বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে পালাতে বাধ্য হন। ১৯২৪ সালের অক্টোবরে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে গাঁধী ২১ দিনের অনশন আরম্ভ করেন। কোহটের জীবন নামে জনৈক ব্যক্তি ‘রঙ্গলীলা রসুল’ নামক এক পুস্তিকায় নবী হজরত মহম্মদের সম্বন্ধে খারাপ ছবি আঁকেন, এমন একটি অভিযােগ থেকেই এই দাঙ্গার সূচনা হয়।
৩০. ১৯২৬ সালের নির্বাচন সাম্প্রদায়িক অশান্তির প্রেক্ষাপটেই অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় জিন্নার ইনডিপেনডেন্ট পার্টি। পূর্ববর্তী কেন্দ্রীয় আইনসভায় জিন্না কংগ্রেস এবং সরকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি করেছিলেন। এই নতুন আইনসভায় (১৯২৬) তিনি এক জন অনুগামী-হীন নেতায় পরিণত হন। এই নতুন আইনসভায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য তার কিছু অনুগামী জোগাড় করা জরুরি হয়ে পড়ে। তিনি মুসলমান গােষ্ঠীর নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
৩১. ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনের পর বাংলার সরকার বার বার দাবি করতে আরম্ভ করল যে বিপ্লবীদের সঙ্গে স্বরাজ পার্টির সম্পূর্ণ যােগাযােগ আছে। লর্ড লিটন লর্ড রিডিংকে বার বার বাংলার বিপ্লবী হিংসা সম্বন্ধে সাবধান করে দিলেন। ১৯২৩ সালে বাংলার
১৩২
সরকার বিপ্লবীদের কঠোর হাতে দমন করার জন্য বিশেষ ক্ষমতা দাবি করে, কিন্তু ভারত সরকার সেই দাবি নাকচ করে দেয়। কিন্তু তার পর ভাইসরয়’স কাউন্সিল মেনে নেয় যে পরিস্থিতি বদলেছে এবং ১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে অর্ডিন্যান্সটি পাশ করতে সম্মত হয়।
৩২. ফজলি হুসেন, পঞ্জাব ইউনিয়নিস্ট পার্টির নেতা। মিয়া স্যর ফজলি হুসেন, পঞ্জাবের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। পঞ্জাবের প্রধান শাসক দল ছিল ইউনিয়নিস্ট পার্টি— প্রচুর জমির মালিক হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের ধর্মনিরপেক্ষ জোট। এই দলটি হিন্দু, মুসলমান ও শিখ জমির মালিকদের সংগঠন ছিল। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রসিদ্ধ নেতা ছিলেন স্যর ফজলি হুসেন, এক মুসলমান। কিন্তু তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন স্যর ছােটু রাম, এক প্রসিদ্ধ হিন্দু (জাঠ) জমিদার। দলে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা তৃতীয় নেতা ছিলেন স্যর সুন্দর সিং মাজিথিয়া, সম্পন্ন শিখ কৃষকদের প্রতিনিধি।
৩৩. মুডিম্যান কমিটি রিপাের্ট সরকারি ভাবে ‘দ্য রিপাের্ট অব দ্য রিফর্মস এনকোয়ারি কমিটি, ১৯২৪’ হিসেবে পরিচিত। এই রিপাের্টটির জন্ম গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯১৯এর কারণে। কমিটি কাজ আরম্ভ করার পরে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিভিন্ন রেজোলিউশন আনা হয়। মূল উদ্যোক্তা ছিলেন স্বরাজপন্থীরা। তাদের দাবি ছিল, সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে। ভারতকে পূর্ণ, স্বশাসিত ডমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়া হােক। এই দাবি খতিয়ে দেখার জন্য ব্রিটিশ সরকার স্যর আলেকজান্ডার মুডিম্যানের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। নয় সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির বিচার্য ছিল: গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের অন্তর্নিহিত সমস্যা এবং এই অ্যাক্ট প্রয়ােগে যে অসুবিধা, তা খতিয়ে দেখা, এবং এই অ্যাক্টের পরিধিতে ভারত সরকার এবং প্রাদেশিক সরকারের যে আইন আছে, তা বিচার করে দেখা; এই সমস্যা এবং অসুবিধাগুলি দূর করার জন্য যে ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন, অ্যাক্টের কাঠামাে, নীতি এবং লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তা কত দূর করা যায় এবং তা করা আদৌ উচিত কি না, বিচার করে দেখা, অথবা এই প্রশাসনিক অসঙ্গতিগুলি দূর করার জন্য অ্যাক্টটিকে সংশােধন করা যায় কি না, তা বিচার করা। কমিটি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ১৯২৪ সালের অগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কাজটি শেষ করে ফেলে। ১৯২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমিটি রিপাের্ট জমা দেয়। এই রিপাের্টের সংযােজিত অংশে যে নেতারা এবং সাধারণ মানুষ কমিটির কাছে প্রমাণপত্র জমা দিয়েছেন, তাদের নামের তালিকা ছিল; গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের আইনগত এবং সাংবিধানিক কাঠামাের মধ্যে থেকেই কী ভাবে অগ্রসর হওয়া যায়, তার স্মারকলিপি ছিল; এবং ছিল এক সদস্য বিজয় চাদ মহতাবের একটি দীর্ঘ নােট।
৩৪. হেলি ছিলেন এক জন ব্রিটিশ সিভিল সারভেন্ট। তিনি তার জীবনের অধিকাংশ সময় ভারতেই কাটান। তিনি দিল্লির কমিশনার ছিলেন, পঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশের গভর্নর ছিলেন এবং ভাইসরয়’স এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে হােম মেম্বারও ছিলেন। তিনি লর্ড আরউইনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন বলে জানা যায়।
৩৫, ২৯ নং টীকা দ্রষ্টব্য।
৩৬. ভি সি জোশী (সম্পাদিত), লালা রাজপুত রাই, হিজ রাইটিং অ্যান্ড স্পিচেস, খণ্ড ২, দিল্লি ১৯৬৬, পৃঃ ১৭৫-১৭৮ এবং ২১০-২১৪
৩৭. সি ডব্লিউ সি, খণ্ড ২৬, পৃঃ ২৩২-২৩৪
৩৮. ইন্ডিয়া কোয়ার্টারলি রেজিস্টার, ১৯২৫, খণ্ড ১, পৃঃ ৭৩
১৩৩
৩৯. ইন্ডিয়ান লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ডিবেটস, খণ্ড ৬, অংশ ২, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৫, পৃঃ ৯৪০-৯৪১
৪০. হ্যালিফ্যাক্স পেপারস, ৩, আরউইন টু বারকেনহেড, ২৪ মার্চ, ১৯২৭
৪১. ইন্ডিয়ান কোয়ার্টারলি রেজিস্টার, ১৯২৭, খণ্ড ১, পৃঃ ৩৬-৭
৪২. গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হােম পলিটিক্যাল, ৬/১৯২৭: নােট বাই মুডিম্যান, ২৪ মে ১৯২৭
৪৩. কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ, উভয় পক্ষের মুসলমান নেতাদের কাছেই ডক্টর আনসারি । সমান ভাবে সম্মাননীয় ছিলেন। তিনি ন্যাশনালিস্ট মুসলিমস’ দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ছিলেন। এই দলটি তৎকালীন জাতীয় রাজনীতিতে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। ১৯৩৪ সাল নাগাদ এই দলটির গুরুত্ব কমতে আরম্ভ করে, কারণ তখন থেকে রাজনীতিতে আরও বেশি মেরুকরণ আরম্ভ হয়। জিন্না দিল্লির সব উদার মুসলমান নেতাদের তার সমর্থনে দাড়াতে বলেন।
৪৪. মাদ্রাজে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে (১৯২৭) স্বাধীনতার দাবিতে একটি ঘােষণাপত্র গৃহীত হয়।।
৪৫. জওহরলাল নেহরুর প্রতি আনসারি, ২৯ মার্চ, ১৯২৮, এ আই সি সি পেপারস, জি ৬০
৪৬. অল পার্টিজ কনফারেন্স ১৯২৮, রিপাের্ট, পৃ: ২৩।
৪৭. শােয়েব কুরেশি এবং স্যর আলি ইমান মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করবেন; এম আর জয়াকর এবং এম এস অ্যানি হিন্দু মহাসভার; শিখদের প্রতিনিধিত্ব করবেন সর্দার মঙ্গল সিংহ; অব্রাহ্মণদের প্রতিনিধি জি আর প্রধান; উদারপন্থী নেতাদের প্রতিনিধি স্যর তেজ বাহাদুর সঞ; শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতিনিধি এন এম জোশী; এবং বাংলা থেকে সুভাষচন্দ্র বসু। এঁদের মধ্যে জয়ার কোনও অংশগ্রহণই করেননি, এবং স্যর আলি ইমান, এন এম জোশী, জি আর প্রধান ও সুভাষচন্দ্র বসুর যােগদান অত্যন্ত সীমিত ছিল।
৪৮. আ বাঞ্চ অব ওল্ড লেটার্স, পৃঃ ৬০-৬১। গাঁধীর প্রতি মােতিলাল নেহরু, ১১ জুলাই ১৯২৮; ‘আমাকে এবং জওহরকে রিপাের্ট তৈরির দায়িত্ব দিয়ে বাকি সদস্যরা নিজেদের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন। আমরা রিপাের্টটি নিয়ে জোর পরিশ্রম করছি।’
৪৯. মৌলানা শওকত আলি ইসলামে গভীর ভাবে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত ছিলেন। তার জন্ম রামপুরে, শিক্ষা আলিগড়ে। ‘হামদর্দ’ এবং ‘কমরেড’ প্রকাশে তিনি মৌলানা মহম্মদ আলিকে সহায়তা করেন। এই দুটি প্রকাশনা মুসলমান-ভারতের রাজনীতি স্থির করার বিষয়ে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
৫০. সংযুক্ত প্রদেশের এক মুসলমান জমিদার রাজনীতিক। পরবর্তী কালে, ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তার পরিবার কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলায়।
৫১. ১) কেন্দ্রীয় আইনসভার উভয় কক্ষেই নির্বাচিত সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান হতে হবে।
২) যদি পঞ্জাব এবং বাংলায় সর্বজনীন ভােটাধিকার চালু করা সম্ভব না হয়, তা হলে জনসংখ্যার অনুপাতের ওপর ভিত্তি করে মুসলমানদের জন্য দশ বছরের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে। এই সময়কালের পরে তা পুনর্বিবেচনা করা হবে। কিন্তু তাদের (মুসলমানদের)
১৩৪
অতিরিক্ত কোনও আসনে লড়ার অধিকার থাকবে না।
. ৩) ক) প্রদেশগুলির হাতেই অবশিষ্ট ক্ষমতা থাকবে, কেন্দ্রীয় আইনসভার হাতে নয়। এর সঙ্গে প্রস্তাবিত সংবিধানের ধারা এবং তফসিল সম্পর্কে আরও কিছু বিস্তারিত পরামর্শ ছিল।
খ) সাপ্লিমেন্টারি রিপাের্টের অন্তর্ভুক্ত ১৩এ ধারা বর্জন করতে হবে;
গ) তফসিল এক এবং দুইয়ের বিষয়গুলির বিভাজন পুনর্বিবেচনা করতে হবে;
৪) সংবিধান সংশােধনের বা পরিবর্তনের যে কোনও প্রস্তাব যত ক্ষণ না প্রথমে আইনসভার উভয়কক্ষে পৃথক ভাবে উপস্থিত সদস্যদের চার-পঞ্চমাংশের সমর্থন পাচ্ছে, এবং তার পর যৌথ অধিবেশনে উপস্থিত সদস্যদের চার-পঞ্চমাংরশের সমর্থন পাচ্ছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত সংবিধান সংশােধিত অথবা পরিবর্তিত হবে না;
৫) অবিলম্বে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব চালু করতে হবে;
৬) নেহরু রিপাের্টে পঞ্জাবের সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিকে বিস্তারিত ভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে;
৫২. প্রসিডিংস অব দি অল পার্টিজ ন্যাশনাল কনভেনশন, পৃ ৭৬-৭৭; আনসারি পেপারস, পেনসিলে লেখা নােট মডিফিকেশনস ইন দ্য নেহরু রিপাের্ট।
৫৩. প্রসিডিংস অব দি অল পার্টিজ ন্যাশনাল কনভেনশন, পৃ ৭৮-৮২
৫৪. তদেব, পৃ ৮৬-৯২
৫৫. তদেব, পৃ ৮৬-৯২
৫৬. তদেব, পৃ ৯৩
৫৭. ১৯২৯ সালের মার্চ মাসে জিন্না তার ফর্মুলা পেশ করলেন। তার ১৪টি বক্তব্য ছিল:
১. ভবিষ্যৎ সংবিধানের চরিত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় হবে, অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশগুলির হাতে থাকবে।
২, প্রতিটি প্রদেশকে সমান স্বশাসনের অধিকার দেওয়া হবে।
৩. দেশের প্রতিটি প্রদেশের আইনসভা এবং অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের যথেষ্ট এবং কার্যকর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা হবে, তবে কোনও প্রদেশেই সংখ্যাগুরুদের সংখ্যালঘুর সমান বা কম প্রতিনিধিত্ব দেওয়া চলবে ।
৪. কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমান প্রতিনিধিদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের কম হওয়া চলবে না।
৫. সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব আপাতত পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে স্থির করা হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে কোনও সম্প্রদায় যদি চায়, তা হলে তাকে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর পরিবর্তে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর নির্বাচনে আসতে দেওয়া হবে।
৬. কোনও কারণে অঞ্চল বণ্টনের প্রয়ােজন হলে তা কোনও ভাবে পঞ্জাব, বাংলা এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমান সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না।
৭. প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষকে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা, অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাস, উপাসনা, প্রচার, মেলামেশা এবং শিক্ষার স্বাধীনতা দেওয়া হবে। ৮, যদি কোনও আইনসভায় বা অন্য কোনও নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে কোনও একটি বিশেষ
১৩৫
সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ অথবা তার বেশি প্রতিনিধি কোনও একটি বিল বা কোনও রেজলিউশন অথবা কোনও বিল বা রেজলিউশনের কোনও অংশ সম্বন্ধে এই মর্মে আপত্তি জানান যে বিষয়টি তাদের সম্প্রদায়ের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে, তা হলে হয় সেই বিল বা রেজলিউশন বা তার আপত্তিজনক অংশটিকে পাশ করা যাবে না, অথবা এই সমস্যাটি তৈরি না করে কাজ করা সম্ভব, এমন কোনও বিকল্প খুঁজে বার করতে হবে।
৯. বম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে সিন্ধুপ্রদেশকে বাদ দিতে হবে।
১০. অন্যান্য প্রদেশে যে গতিতে সংস্কার হবে, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানেও সেই গতিতেই সংস্কার করতে হবে।
১১. সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে প্রাদেশিক এবং স্থানীয় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির চাকরিতে মুসলমানরা যথেষ্ট সুযােগ পান। তবে, তাদের চাকরির জন্য আবশ্যিক যােগ্যতার শর্তটি পূরণ করতে হবে।
১২. সংবিধানে যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে মুসলমান সংস্কৃতিকে রক্ষা করা যায়, এবং মুসলমানদের শিক্ষা, ভাষা, ধর্ম, পার্সোনাল ল’ এবং মুসলমান দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করা যায় এবং তার উন্নতিসাধন সম্ভব হয় এবং প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক সাহায্যে মুসলমানরা তাদের যথার্থ ভাগ পান।
১৩. অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান সদস্য না রেখে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক স্তরে কোনও মন্ত্রিসভা গঠন করা যাবে না।।
১৪. কেন্দ্রীয় আইনসভা সংবিধানে এমন কোনও পরিবর্তন করতে পারবে না যেখানে প্রদেশের অভিমত গ্রাহ্য করা হয়নি।
‘কাউন্সিল অব দি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ’ কায়েদের এই ১৪টি বক্তব্য গ্রহণ করে। ভারতের সংবিধান সংক্রান্ত যে কোনও পরিকল্পনা যত ক্ষণ না এই ১৪টি বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে চলেছে, তত ক্ষণ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনাকে গ্রহণ করা হবে না, এই মর্মে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয়। [সূত্র: ২৯] ডেভিড পেজ, প্রিলিউড টু পার্টিশন: দি ইন্ডিয়ান মুসলিমস অ্যান্ড দি ইম্পিরিয়াল সিস্টেম অব কন্ট্রোল, ১৯২০-৩২, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ১৯৮২
১৩৬
চতুর্থ অধ্যায়
লক্ষ্য নির্দিষ্ট হচ্ছে, পথও সীমিত হয়ে আসছে
গত শতকের বিশের দশক। মােহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ভারতে ফিরেছেন মাত্রই বছর পাঁচেক। জিন্না এ দিকে সক্রিয় রাজনীতিতে তত দিনে পনেরাে বছরের পুরনাে হয়ে গেছেন। গাঁধী ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় একুশ বছর কাজ করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা। নিয়ে তিনি রাজনীতির গােটা প্রক্রিয়াটাকে শহরের আরামদায়ক বিতর্কসভার বাইরে টেনে আনলেন, রাজনীতিকে নিয়ে এলেন দেশের হৃৎপিণ্ডে— ধুলােমাখা, অবহেলিত, সর্বদা-নিন্দিত সেই গ্রামভারতে।
কয়েকটি বিষয় ঘিরে রাজনীতি তখন উত্তাল: স্বরাজ, স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু, সেগুলি পাওয়া যাবে কী ভাবে?
রাতারাতি? নাকি, ধীরে, ক্ষমতার ক্রমিক হস্তান্তরের মধ্যে দিয়ে? আরও একটি বিষয় আলােচনার কেন্দ্রে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। স্বাধীন এবং অখণ্ড ভারতই যদি বাঞ্ছিত হয়, তা হলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেই হবে। এই লক্ষ্যে পৌঁছনাে সহজ ছিল না। যত দিন না জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত ভারতবাসীর হাতে স্বাধীন, স্বশাসিত একটি ভারত তুলে দেওয়া যাচ্ছে, এবং দেশটা যে শুধু ব্রিটিশ জমানা থেকেই মুক্তি পাচ্ছে, তা নয়, বরং সংখ্যাগুরুর পীড়ন-সংক্রান্ত যাবতীয় প্রকৃত এবং কাল্পনিক ভয় দূর হচ্ছে, তত দিন যে সেই সত্যকার স্বাধীনতা আসবে না, তা বােঝাই গিয়েছিল। হিন্দুমুসলিম মৈত্রীর পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল বহু শতাব্দীর জমে ওঠা তিক্ত সব স্মৃতি। বলতে গেলে, ইতিহাসের বিষগ্ন অধঃক্ষেপ। দৃশ্যতই ব্রিটিশ সাম্রাজ্য তখন ভেঙে পড়ার মুখে, এবং সেটা খেয়াল করেই মুসলিমরা তাঁদের হারানাে গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন, তারা ব্রিটিশ রাজ থেকে মুক্তি চাইলেন ঠিকই, কিন্তু সেই জায়গায় হিন্দুপ্রধান ভারতের উত্থানের সম্ভাবনা দেখে আদৌ উৎফুল্ল হলেন না। অন্য দিকে, হিন্দুরা দেখলেন, বহু কালের দাসত্বের পরে স্বাধীনতা যেন দিগন্তে উঁকি দিচ্ছে। তারা বুঝতে পারলেন, এ বার সেই লগ্ন উপস্থিত, যখন তারা নিজেরাই নিজস্ব নিয়তির নির্ধারণ করতে পারবেন। ‘দূর হটো, দূর হটো, এ দুনিয়াওয়ালাে, হিন্দুস্তান হামারা হ্যায়’- এই বলে সেই সময়কার আবেগের একেবারে নির্যাসটুকু ঘােষণা করেছিল প্রদীপ, কিন্তু,
১৩৭
এখন ফিরে ভাবলে মনে হয়, সেটা কার হিন্দুস্থান হওয়ার কথা ছিল? তখনকার প্রায় সমস্ত কথা চালাচালির উদ্দেশ্য; কী করে পরম্পর-বিরােধী স্বার্থের সংঘাতকে সামাল দেওয়া যায়। পারস্পরিক ভয়কে, সেটা যুক্তিসঙ্গতই হােক বা কাল্পনিক, কী ভাবে সেই আতঙ্ককে রােখা যায়। অন্য ভাবে বললে, কী ভাবে প্রধানত হিন্দু এবং মুসলিমের মধ্যে এবং পাশাপাশি শিখ এবং আরও অন্যদের মধ্যে সার্বভৌমত্বটাকে যথাসম্ভব যুক্তিযুক্ত এবং সম হারে ভাগ করে দেওয়া যায়। একই সঙ্গে আরও একটা উত্তরের খোঁজ চলছিল। তদানীন্তন ভারতে প্রায় শ’ছয়েক ‘প্রিন্সলি স্টেট’ ছিল। তাদের কী হবে, সেই প্রশ্নটাও গুরুত্বপূর্ণ। উনিশশাে সাতচল্লিশের আগে ভারতের একটা বিপুল অংশ জুড়ে ওই সব করদ রাজ্য। আয়তনে তখনকার ভারতের পাঁচ ভাগের দু’ভাগ, আর জনসংখ্যায় গােটা দেশের এক-তৃতীয়াংশ। প্রশ্ন আরও। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ চলে গেলে সেই শ্রেষ্ঠত্ব, পরিভাষায় সেই ‘প্যারামাউন্টসি’ কোথায় মিলবে? আমরা এই সব প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজব, তবে আলােচনার কেন্দ্রে থাকবে সে দিনকার টালমাটাল ভারতে মহম্মদ আলি জিন্নার ভূমিকা।
এই উত্তর সন্ধানের আগে অন্য একটা দিকে দৃষ্টি ফেরানাে প্রয়ােজন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ব্রিটেনে তখন ঠিক কী ঘটেছিল? সন্দেহ নেই, সব যুদ্ধ শেষ করে দেওয়ার সেই মহাযুদ্ধ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য শক্তির ঊর্ধ্বমুখী গতিটি থামিয়ে দিয়েছিল। মার্কিন আধিপত্যের জমানা তখন সবে শুরু হয়েছে। তা ছাড়া, ১৯২২-এ ট্রিটি অব সেভর শুধু যে আরব দুনিয়ার রাজনৈতিক ভূগােলটাকেই পালটে দিল তা নয়, গােটা দুনিয়ার রাজনীতিতেও তার প্রভাব পড়ল। প্যারাডক্স-এর মতােই, এর ফলে এমন একটা শান্তিও এল, যাতে কিনা সমস্ত শান্তির সম্ভাবনাই এলােমেলাে হয়ে গেল। কারণ, শান্তির আর থাকলটাই বা কী? ওই পরিস্থিতিতে কী ধরনের শান্তিই বা স্থাপিত হতে পারে? একতরফা ভাবে, কখনও স্রেফ খেয়ালের বশেই যেন তখনকার মানচিত্র ভেঙে, কাগজে আর বালিতে আঁচড় কেটে নতুন নতুন দেশ তৈরি করা হল। ঘটনার সেই সব গতিপ্রকৃতি তদানীন্তন ভারতে আরও ভাল ভাবে খেয়াল করা উচিত ছিল। দুঃখের বিষয়, তা হয়নি। বিশ্ব রাজনীতির এই সব ওঠাপড়া তখনও এ দেশের চেতনায় ততটা ঘা দেয়নি। স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং অক্টোবর বিপ্লবের ঝাপট কী ভাবে শুধু রাশিয়াকেই নয়, গােটা ইউরােপকে টলিয়ে দিচ্ছে, খসে পড়ছে একের পর এক রাজমুকুট, সেই বৃত্তান্ত জওহরলাল নেহরুর নজর কাড়ল বটে, কিন্তু ঘরের কাছেই আরব দুনিয়া এবং মেসােপটেমিয়াতে ইচ্ছাকৃত ভাবে যে সব ফাটল ধরানাে হচ্ছে, সে দিকে তিনি ততটা। দৃষ্টি দিলেন না। অথচ, নজরটা প্রতিবেশীর দিকেই আরও বেশি করে দেওয়া উচিত ছিল। তার বদলে ইউরােপীয় সংগ্রামই তঁার নজর কাড়ল। হাজার হােক, আমরাই ছিলাম তখনকার দিনে সেরা ‘অ্যাংলােফিল’, সমস্ত শাসিত জাতির মধ্যে আমরাই সব থেকে নিখুঁত ভাবে ব্রিটিশদের নকল করতাম, যদিও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইটাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। আমরা সব সময় ইউরোপ গিয়েছি, কিন্তু সেই সব আশ্চর্য শহরে যাইনি, যারা আমাদের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক আত্মীয়, এক সময় যারা ছিল
১৩৮
সভ্যতার এক একটি উজ্জ্বল কেন্দ্র: বাগদাদ, ইস্তানবুল, আঙ্কারা, কায়রাে, তেহরান। সুতরাং, চলুন ইউরােপে গিয়ে দেখা যাক, ঠিক কী চলছিল সেখানে।
গ্রেট ব্রিটেনে তখন কী ঘটছে, তার বর্ণনা দিয়েছেন ইয়ান ব্রায়ান্ট ওয়েলস:
বিশের দশকের শেষের দিকে স্ট্যানলি বল্ডউইন-এর টোরি সরকার স্পষ্ট বুঝতে পারল, লেবার পার্টির ক্ষমতা ক্রমশ বাড়ছে এবং আর কিছু দিনের মধ্যে তারাই ক্ষমতায় আসবে। (ফলে) টোরিরা ভারতে রাজনৈতিক সংস্কারের বন্দোবস্ত খতিয়ে দেখার জন্য একটি স্ট্যাটিউটরি কমিশন গঠন। করল। উদ্দেশ্য ছিল, ভারতে তাদের নীতিটাই যাতে বজায় থাকে, তা সুনিশ্চিত করা। সেই কমিশন থেকে ভারতীয়দের বাদ দেওয়ার কাজটা তদানীন্তন ভারত সরকারের ভিতর থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯২৬-এ ভাইসরয় লর্ড আরউইন ভারতে এসে দেখলেন, তার চতুর্দিকে প্রশাসনের পঞ্জাব শাখার বিভিন্ন উপদেষ্টা। এই সব উপদেষ্টা, বিশেষ করে স্যর ম্যালকম হেলি এবং জেফ্রি ডি মন্টমােরান্সি-র চাপেই শুধুমাত্র। শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে এই কমিশন গঠিত হয়।[২]
লর্ড আরউইন ভারতকে ডােমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তাতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ড এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কনজারভেটিভ পার্টির নেতা স্ট্যানলি বল্ডউইন-এরও সায় ছিল। মনে রাখা ভাল, কনজারভেটিভ পার্টি তখন ম্যাকডােনাল্ড-এর ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট-এর সর্ববৃহৎ অংশীদার। আরউইন-এর ঘােষণা নিয়ে হাউস অব কমনস-এ বিতর্ক শুরু হল শুক্রবার, ৮ নভেম্বর, ১৯২৯। প্রধানমন্ত্রী ডােমিনিয়ন স্টেটাস দানের কথা বললেন, বল্ডউইন তাতে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থনের কথা ঘােষণা করলেন, কিন্তু কনজারভেটিভ পার্টিরই এক-তৃতীয়াংশ বেঁকে বসল। তারা গােমড়া মুখে দলনেতার বক্তব্য শুনছিলেন, বক্তব্য চলাকালীন তাদের প্রশংসাবাক্যগুলাে যেন নেহাত বলতে হয় তা-ই বলা, কট্টরপন্থীরা। ভীষণ ভাবে এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করলেন… উইনস্টন চার্চিল তাে ফুসছিলেন…।” চার্চিল-এর ক্ষোভ প্রকাশ পেল ডেলি মেল-এর পাতায়, তিনি লিখলেন, “ব্রিটেন ছিল বলেই ভারত একেবারে বর্বর যুগে ফিরে যায়নি… স্বায়ত্তশাসনের কথা তাে কল্পনাই করা যায় না।… ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর চিন্তাও আজগুবি… যদি ভাইসরয়ের এই প্রস্তাব গৃহীত হয়, তা হলে ব্রিটিশ রাজ চলে গিয়ে সেই জায়গায় গাঁধী রাজ শুরু হবে।”
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে সাত সদস্যের স্ট্যাটিউটরি কমিশন নিযুক্ত হল, নেতৃত্বে আইনজীবী এবং লিবারাল পার্টির এমপি স্যর জন সাইমন। এ ছাড়াও, কনজারভেটিভ পার্টির চার জন এবং লেবার পার্টির দু’জন এম-পি-কে নিয়ে গড়া কমিশন মুম্বইতে (তদানীন্তন বন্বে) পা রাখল ১৯২৮-এর ৩ ফেব্রুয়ারি। কমিশনের দায়িত্ব ছিল, ১৯১৯-এ মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের কাজকর্ম খতিয়ে দেখতে হবে। যখন দরকার,
১৩৯
তার আগেই কেন এই কমিশন গঠিত হল, তার উত্তর অনেক। ভারতে স্বায়ত্তশাসনের জন্য ক্রমশ বাড়তে থাকা দাবি তাে ছিলই, পাশাপাশি ছিল স্ট্যানলি বল্ডউইন-এর সেই অনুমান, টোরিদের দিন ফুরিয়ে এসেছে, লেবার পার্টির জয় আসন্ন। এই পুরাে প্রেক্ষাপটের মধ্যেই সাইমন কমিশনের ইতিহাসটা নিহিত। এ দিকে, ভারত তখন কী নিয়ে উত্তাল ? হিন্দু-মুসলিম ঐক্য? মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব? নাকি, স্বাধীনতা? সেই দিকেই এ বার দৃষ্টি ফেরাতে হবে। দুঃখিত, স্যর জন সাইমনকে আরও একটু অপেক্ষা করতে হবে।
গাঁধীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক চিন্তার একটা কেন্দ্রীয় অংশ জুড়ে ছিল হিন্দুমুসলিম ঐক্য। সম্ভবত, একমাত্র স্বরাজ্যপন্থীদের বাদ দিলে কংগ্রেসিদের মধ্যে তিনিই সব থেকে ভাল ভাবে এই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। ফলে, তিনি খিলাফত আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ান। যদিও, এতে বিতর্ক বেধেছিল বিস্তর, এবং ফিরে দেখলে মনে হতেই পারে, গাঁধীর পথটি যথাযথ ছিল না। তাতে লাভ হয়নি, উল্টে ক্ষতি হয়েছে। গাঁধী খলিফা-বিতর্কটিকে দেখেছিলেন শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, তিনি নির্দ্বিধায় সে কথা জানিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন, খিলাফত আন্দোলন সমর্থন করলে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ প্রশস্ত হবে। তিনি এও ভেবেছিলেন যে, খলিফার অপসারণে মুসলিম মানসে আঘাত লেগেছে। এই সব ভাবনায় যে ভুল ছিল তা নয়, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনি খেয়াল করেননি। তা এই যে, খলিফার অপসারণের সিদ্ধান্ত মুখ্যত তুর্কিরা নিজেরাই নিয়েছে এবং সেই ব্যাপারটাও এসেছে মুস্তাফা কামাল পাশার নেতৃত্বে ঘটে যাওয়া একটি বিপ্লবের হাত ধরে। নিশ্চিত, গাঁধী এই সব কথাই জানতেন, কিন্তু সেটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি এই আশায় যে, হিন্দুদের সমর্থন যদি মুসলিমদের আবেগের ক্ষতে প্রলেপ দেয়, তা হলে ব্রিটিশের বিরােধিতায় হিন্দুমুসলিম মিলিত সংগ্রাম আরও জোরদার হবে। সেটা অবশ্য হয়েছিল। যদিও, খুবই স্বল্প একটা সময়কালের জন্য, এবং কালক্রমে দেখা গেল, গাঁধী যা চেয়েছিলেন, তার ঠিক উল্টোটা ঘটেছে।
হিন্দু-মুসলিম ঐক্য থেকে ডােমিনিয়ন মর্যাদার দিকে এগােনােটাই ছিল অনিবার্য এবং যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ। সর্বোপরি, তাতে দেশভাগ ঠেকানাে যেত এবং ১৯১৬-র লখনউ চুক্তি (জিন্না নিজেই যে-চুক্তির মুখ্য প্রবক্তা) যা আঁচ করেছিল, সেই সংখ্যাগুরুর আধিপত্যের শঙ্কাও যথেষ্ট কমে যেত। ডােমিনিয়ন মর্যাদার বিশ্লেষণে আশ্চর্য অন্তদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন লয়েড রুডলফ এবং সুসান হারবার রুডলফ, তাঁদের রচনাটির নাম ‘দ্য রােড নট টেকন’।[৬]
গাঁধী এবং তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী জওহরলাল নেহরুর মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য সংঘাত বাধল ১৯২৭-এর ডিসেম্বর মাসে, মাদ্রাজে, কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে। কংগ্রেস কি ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর লক্ষ্যেই অনড় থাকবে, না ‘পূর্ণ স্বরাজ’-কেই নতুন লক্ষ্য হিসাবে বেছে নেবে- এই প্রশ্নের সামনে দাড়িয়ে তারা দ্বিমত হলেন। গাঁধী ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর পক্ষে, নেহরু চান পূর্ণ স্বরাজ। দু’বছর চলল এই টানাপােড়েন।
১৪০
মিটল ১৯২৯-এ, সে বছর লাহৌরে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে নেহরু জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হলেন। কংগ্রেসও তার জাতীয় আন্দোলনের রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসাবে পূর্ণ স্বরাজকেই বেছে নিল।
ঠিকই, দুটি লক্ষ্যের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল সার্বভৌম স্বায়ত্তশাসন, কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ছিল আলাদা, দায়িত্বও ভিন্ন ধাঁচের। ডােমিনিয়ন স্টেটাস মানেই ব্রিটিশ রাজমুকুটের প্রতি আনুগত্য, সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রথা-প্রতিষ্ঠানে যােগদান এবং অন্তত আংশিক ভাবে হলেও ব্রিটেনের রাজনীতি এবং ব্রিটিশ জনমতের সঙ্গে এক ধরনের বােঝাপড়া। ডােমিনিয়ন স্টেটাস এটাও দাবি করত যে, ক্ষমতা হস্তান্তর কী পরিস্থিতিতে ঘটতে পারে, তা নিয়ে আলােচনা হবে। যেমন, ব্রিটিশরা স্বাভাবিক ভাবেই সংখ্যালঘুর অধিকার এবং তাদের প্রতিনিধিত্বের কথা তুলে চাপ সৃষ্টি করতে পারত। অন্য দিকে, পূর্ণ স্বরাজের দাবির মধ্যে ছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী সংগ্রাম, একপাক্ষিক জাতীয়তাবাদ এবং সংখ্যাগুরুশাসিত গণতন্ত্রের ছায়া। পূর্ণ স্বরাজ মানে একটা সম্পর্ক ছিন্ন হবে, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় একটা ছেদ পড়বে… পরিণামে নতুন রাষ্ট্রের নিয়ন্তা হবে জাতীয়তাবাদী শক্তি।” ‘পূর্ণ স্বরাজ-এর আরও একটা তাৎপর্য ছিল। নতুন রাষ্ট্র সংখ্যালঘুর সঙ্গে সার্বভৌমত্ব ভাগ করে নেবে, সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
“ইতিহাসের দু’রকম পাঠ থেকে ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর বিষয়টিকে দেখেছিলেন গাঁধী এবং নেহরু।” গাঁধীর রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ একুশ বছর কেটেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়, সেখানে তিনি ভারতীয় সংখ্যালঘুদের হয়ে অধিকার আদায়ের জন্য বর্ণবৈষম্যবাদী জমানার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। দেখেছেন, কী ভাবে কাজ করে এই গােটা ‘সিস্টেম। দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ রাজমুকুট এবং নাগরিকত্ব’ ছিল সেই অধিকারের লক্ষ্যে সংগ্রামের একটা বড় উৎস, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানাের হাতিয়ারও বটে। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন গাঁধী “লন্ডনে গিয়ে আইনি সাহায্য চেয়েছেন। জুলু এবং বুয়র যুদ্ধের সময় মেডিক্যাল কর্পস গড়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য লােকজনও জোগাড় করেছেন।” কিন্তু, নেহরু “বয়সে গাঁধীর চেয়ে ছােট… (তিনি) সাম্রাজ্যবাদ এবং ধনতন্ত্রকে বিশ্বরাজনীতিতে অশুভ শক্তি হিসাবেই দেখলেন।” বিলিতি আদবকায়দা তার পছন্দ ছিল, ইংরেজ বন্ধুবান্ধবও ছিল প্রচুর কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল শত্রু।”
১৯২৭-এ ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। সে বছর ডিসেম্বরে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নিল, সাইমন কমিশনকে সম্পূর্ণ বয়কট করা হবে। মুসলিম লিগ এবং স্বরাজ্য দল-এর সিদ্ধান্তও তাই। ইয়ান ওয়েলস লিখছেন, “সাইমন কমিশন জাতীয়তাবাদীদের স্মরণ করিয়ে দিল, তাদের সবার সাধারণ শত্ৰুটি কে এবং জিন্না সহ আরাে নানা রাজনীতিবিদ, যাঁরা কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তারা ফিরে এলেন।… জিন্না ছিলেন এই বিরােধিতার কেন্দ্রে, কমিশন বয়কটের লক্ষ্যে একটি সংযুক্ত ফ্রন্ট গড়ার জন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। কারণ, গাঁধী, মােতিলাল নেহরু এবং সঞর মতাে জিন্নাও তত দিনে নিশ্চিত, ভারতকে ডােমিনিয়ন স্টেটাস
১৪১
দেওয়ার সময় এসে গিয়েছে। বাস্তবে, ১৯৩০-এর মে মাসে সাইমন কমিশন-এর । রিপাের্ট “ক্ষমতা হস্তান্তরের যাবতীয় সম্ভাবনা উড়িয়ে দিল এবং সুপারিশে ডমিনিয়ন স্টেটাস প্রদানের নামগন্ধও থাকল না।”
এই রকম একটা অচলাবস্থা থেকেই গােল টেবিল বৈঠকের উদ্ভব। ১৯২৯-এর ৩১ অক্টোবর ভাইসরয় আরউইন ঘােষণা করলেন, লন্ডনে বৈঠক হবে, আলােচ্য বিষয় ভারতীয় সাংবিধানিক সংস্কার, এও জানালেন যে, এই বৈঠকের সম্ভাব্য নানা ফলাফলের মধ্যে ভারতকে ডােমিনিয়ন স্টেটাস প্রদানের বিষয়টিও থাকছে। ভারতের জাতীয়তাবাদীদের কাছে অবশ্য সাংবিধানিক সংস্কারের একটা চেহারা আগে থেকেই মজুত ছিল, বর্তমান গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ‘১৯২৮ নেহরু রিপাের্ট নিয়ে সবিস্তারে আলােচনাও করা হয়েছে। সেই রিপাের্ট-এর কয়েকটি মুখ্য সুপারিশের অন্যতম ছিল ভারতকে ডােমিনিয়ন মর্যাদা প্রদান। ঘটনাচক্রে এই রকম একটা পরিস্থিতিকে হাতিয়ার করেই নেহরু সেই ‘রিপাের্ট এবং ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর দাবিকে কার্যত উড়িয়ে দিলেন এবং খুব সফল ভাবে সেই জায়গায় তুলে আনলেন পূর্ণ স্বরাজ-এর দাবি। ঘটনার গতি দ্রুত, কিন্তু আমাদের আলােচনা বােধহয় তার থেকেও জোরে এগােচ্ছে !
১৯২৭-এ গাঁধীর কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিন্দু-মুসলমান ঐক্য, ফলে তিনি ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর লক্ষ্যে অবিচল। তার মতে, এর ফলে দুই সম্প্রদায়ের ঐক্য আরও জোরালাে হবে, কিন্তু, এই সবের পাশাপাশি তিনি জানাচ্ছেন, এই ঐক্যের বিষয়টিকে তিনি কোনও রকম ‘বিমা’ করে সুরক্ষিত রাখতে নারাজ। নিঃসন্দেহে, এই ঐক্য রক্ষার জন্য তিনি আরও নানা চেষ্টা করেছিলেন। যেমন, ডা. এ এম আনসারি যাতে কংগ্রেসের মাদ্রাজ বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হতে পারেন, গাঁধীই তা নিশ্চিত করেছিলেন। ভাবা হয়েছিল, এতে মুসলিম সম্প্রদায় আশ্বস্ত হবে। এবং ১৯১৬-র লখনউ চুক্তির রেশ ধরেই যেন গাঁধী আশা করেছিলেন, আনসারিও দেখবেন যাতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা চুক্তি রূপায়িত হয়, অনেকটা যেমন জিন্না প্রায় করেই ফেলেছিলেন ১৯২৭-এর গােড়ায়, ‘দিল্লি প্রােপােজাল’-এর মাধ্যমে।[৭]
লয়েড এবং সুসান লিখছেন, “গাঁধী যখন এই পরিকল্পনায় ব্যস্ত, ঠিক তখনই তার অতি বিশ্বস্ত এবং কংগ্রেসের অন্যতম পুরােধা মােতিলাল নেহরু অনুরােধ করলেন, তার ছেলে জওহরলালকে মাদ্রাজ অধিবেশনে কংগ্রেস সভাপতি করা হােক। গাঁধী। তখন নিশ্চিত যে, কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রজন্মগত পরিবর্তন আনার থেকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য বজায় রাখাটা অনেক বেশি জরুরি। তিনি মােতিলালকে জানিয়ে দিলেন, এখনই জওহরলালকে কংগ্রেস সভাপতি করার সময় আসেনি। আনসারিই সভাপতি নির্বাচিত হলেন”, জওহরলালকে তুলনায় অনেকটা উঁচু ধাপে নিয়ে আসা হল। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একাধিক সাধারণ সচিবের অন্যতম, হলেন কংগ্রেসের কার্যকরী সচিব।
কিন্তু, জওহরলালের ‘অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলি ছিল আলাদা। তখন সবে তিনি প্রলম্বিত ইউরােপ ভ্রমণ সেরে ফিরেছেন, ১৯২৭-এর ডিসেম্বর নাগাদ একেবারে
১৪২
কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনের সময়েই তার প্রত্যাবর্তন। মনে হচ্ছিল, ব্রাসেলসে ঔপনিবেশিক আগ্রাসন এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিনিধি হিসাবে থেকে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে তিনি পাল্টে গিয়েছেন। এক দিকে সাম্রাজ্যবাদ, অন্য দিকে বৈপ্লবিক পন্থা বিষয়ে “নবলব্ধ এই চেতনার বশে নেহরুর মনে হল, বিশের দশকে গাঁধী ভারতের গ্রামে গিয়ে যে গঠনমূলক কাজকর্ম করার কথা বলেছিলেন, চরকায় খদ্দর বােনার কথা বলেছিলেন, সে সব নিছকই দুর্বল এবং হেঁদো।” স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে গাঁধীর নেতৃত্বে যে তুমুল অসহযােগ আন্দোলন হয়েছিল, তার পর ছ’টি বছর কেটে গিয়েছে। নেহরু এবং অন্য আরও অনেকে যখন ভেবেছিলেন, সাফল্য এল বলে, ঠিক তখনই চৌরিচৌরার ঘটনার পরে আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় গাঁধী অসহযােগ প্রত্যাহার করে নেন। মধু লিমায়ে লিখছেন, “১৯২৭-এ যে জওহরলাল দেশে ফিরে এলেন, তিনি একেবারে অন্য মানুষ। তিনি গভীর ভাবে মার্ক্সবাদ অধ্যয়ন করেছেন, তাঁর ভাবনা জুড়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরােধিতা, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি এবং সমাজতন্ত্র।” সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নয়, শ্রেণি রাজনীতিই এই জওহরলালের চিন্তাভাবনার কেন্দ্র। ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে কংগ্রেসের উদারপন্থী মনােভাব বজায় রাখাই ছিল গাঁধীর নীতি। তার বিরােধিতা করে নেহরুই উদ্যোগ নিলেন কী করে আরও বৈপ্লবিক কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়। ১৯২৭-এর সেই অধিবেশনেই একটি প্রস্তাবে।
ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর পরিবর্তে পুর্ণ স্বরাজকে কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসাবে বর্ণনা করা হল, আর একটি প্রস্তাবে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের নিন্দা করা হল।
“গাঁধী খুব কড়া ভাবেই তার প্রতিক্রিয়া জানালেন। তার খুব ভেবেচিন্তে বানানাে রণনীতির বিরুদ্ধে নেহরুর এই আক্রমণ প্রসঙ্গে তিনি জওহরলালকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির তারিখ ৪ জানুয়ারি, ১৯২৮। গাঁধী লিখছেন, “তুমি একটু বেশি তাড়াতাড়ি এগােচ্ছ। তােমার উচিত ছিল গােটা বিষয়টা নিয়ে আরও একটু ভাবনাচিন্তা করা, এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। তুমি যে সব প্রস্তাবের রূপরেখা ঠিক করেছ, এবং পাশ করিয়েছ, তাদের বেশির ভাগই আরও এক বছর পরে গ্রহণ করা যেতে পারত। এই যে রিপাবলিকান আর্মি’-র লক্ষ্যে তুমি ঝাপ দিলে (ব্রিটিশ রাজমকটের প্রতি আনগত্য-নির্ভর ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর পরিবর্তে পুর্ণ স্বরাজ-এর দাবি তুললে, যাতে কিনা এই জাতীয় আনুগত্যের প্রশ্নই ওঠে না), আমার মতে তা একটু তাড়াহুড়াে করে নেওয়া সিদ্ধান্ত।”
ঠিক এর পরেই আছে নেহরুর নবলব্ধ বিপ্লবী উৎসাহের আরও খাপখােলা সমালােচনা:
“তােমার এই সব ভুল সময়ে, ভুল ভাবে নেওয়া প্রস্তাব-এ আমি ততটা দুঃখ পাইনি, কিন্তু তুমি কিছু দুবৃত্ত এবং সমাজবিরােধীদের উৎসাহ দিচ্ছ, এ দৃশ্য আমার কাছে খুবই পীড়াদায়ক। জানি না, তুমি এখনও নিখাদ অহিংসার নীতিতে বিশ্বাস করাে কি না, কিন্তু তুমি যদি ইতিমধ্যে মতটা পাল্টেও ফেলে থাকো, সে ক্ষেত্রেও এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, লাগামছাড়া, নিয়ন্ত্রণহীন হিংসার মাধ্যমেই সুফল মিলবে। যদি তােমার
১৪৩
ইউরােপীয় অভিজ্ঞতার আলােয় দেশটাকে দেখে মনে হয় যে, এখন যে সব নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, সে সব ভ্রান্ত, তা হলে সর্বাত্মক ভাবে তােমার মতটাকে কার্যকর করার চেষ্টা কোরাে, কিন্তু দয়া করে একটা শৃঙ্খলাবদ্ধ দল গড়ে তুলাে… তত দিন পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকরী সচিব হিসাবে তােমার দায়িত্ব দলের মুখ্য নীতিটির রূপায়ণ যাতে ঠিকমতাে হয়, তা সুনিশ্চিত করা, অর্থাৎ ঐক্য… ( ক্রুদ্ধ নেহরুর উত্তর এল ঠিক সাত দিনের মাথায়। তারিখ ১১ জানুয়ারি, ১৯২৮ “আপনি শব্দ এবং ভাষা ব্যবহার নিয়ে এত সচেতন, অথচ দেখে অবাক লাগছে যে, আপনি এমন সব কথা লিখেছেন, যা আমার মতে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক… আপনি বিশেষ ভাবে কিছু প্রস্তাবকে বেছে নিয়ে সমালােচনা করেছেন, নিন্দা করেছেন… আপনি শৃঙ্খলার কথা লিখেছেন… আমি কি খুব সবিনয়ে আপনাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারি যে, আপনি নিজেও কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির সদস্য। কংগ্রেসের এক জন শীর্ষ নেতার পক্ষে সেই দলেরই মুখ্য কিছু প্রস্তাবের সমালােচনা করাটা কি খুব আশ্চর্যের নয় ?…” এর পরেই নেহরু সরাসরি আসল প্রসঙ্গে চলে আসছেন, “আপনি লিখেছেন, স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রস্তাবটি তাড়াহুড়াে করে গৃহীত এবং বিশেষ ভাবনাচিন্তা না করেই প্রস্তাবটি পাশ করানাে হয়েছে (হেস্টিলি কনসিভড অ্যান্ড থটলেসলি পাসড়’)। (এখানে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, গত পাঁচ বছর ধরেই নেহরু এবং অন্যরা এই বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, বার্ষিক অধিবেশনেও এ বিষয়ে আলােচনা হয়েছে)… যে ভাবেই বলা হােক না কেন, কোনও ভাবেই এই ‘হেস্টিলি কনসিভড়’ কিংবা ‘থটলেসলি পাসড়’ কথাদুটিকে মেনে নেওয়া যায় না… স্বাধীনতার দাবি এবং তার সঙ্গে আরও যা যা জড়িয়ে আছে, সে সব আমার কাছে খুব বড় একটা মূল্য নিয়ে দেখা দিয়েছে এবং অন্য প্রায় সব কিছুর তুলনায় সেটাই আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ… আমার সন্দেহ হয়, খুব ছােট্ট একটা বৃত্তের বাইরে আর কেউ কি বুঝতে পারে, আপনার মতটা ঠিক কী… উদারপন্থীরা (যেমন, স্যর তেজবাহাদুর সপ্রু বা মােতিলাল নেহরু) এবং মুসলিমরা (যেমন, জিন্না) স্বাধীনতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেই পারেন, নেহরু মেনে নিচ্ছেন, “এবং তারা ডােমিনিয়ন স্টেটাস চাইতেই পারেন, কিন্তু তারা চান বা না-ই চান, এটা আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না যে কী ভাবে ডােমিনিয়ন স্টেটাস একটা জাতীয় সংগঠনের আদর্শ এবং লক্ষ্য হতে পারে। কথাটা ভাবলেই তাে আমার কেমন দমবন্ধ লাগে, মনে হয় কেউ যেন গলাটা টিপে ধরেছে।” (নজরটান সংযােজিত)
নেহরু এর পর সাধারণ ভাবে গাঁধীর নীতি এবং নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন। সেই সব প্রশ্নের মধ্যে বেরিয়ে আসছে আধুনিকতা আর উত্তর-আধুনিকতার দ্বন্দ্ব: “আপনি জানেন, আমি কতটা গভীর ভাবে আপনাকে শ্রদ্ধা করি এবং বিশ্বাস করি যে আপনিই যথার্থ নেতা…আপনার আগের কিছু বইতে, যেমন ‘হিন্দ স্বরাজ’ ইত্যাদি আপনি যা লিখেছেন, তার সঙ্গে আমি বিন্দুমাত্র একমত নই, কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসে ঘাটতি পড়েনি। আমার আগেও মনে হয়েছে, এবং এখনও
১৪৪
মনে হয় যে ওই সব চটি বইয়ের তুলনায় আপনি অনেক বড়, অনেক মহান। সমস্যা এই যে আপনি যখন জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে এলেন (ফেব্রুয়ারি ১৯২৪), তখন থেকেই কোথাও একটা কিছু সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয়…আপনি বার বার আপনার মত পাল্টেছেন…আমরা অনেকেই সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত, বুঝতে পারছি না যে ঠিক কী হয়েছে…আমি অনেক বার আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি যে ভবিষ্যতে কী করা উচিত, আপনি কী করতে চাইছেন, আপনি যে সব উত্তর দিয়েছেন, সেগুলি আদপেই সন্তোষজনক মনে হয়নি…আপনি বলেছিলেন, খাদি আন্দোলন দ্রুত ছড়াবে সেই অলৌকিক কাণ্ডটি ঘটেনি…আমি তাে এখন সত্যিই ভাবতে শুরু করেছি যে খাদি কবে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে, তার জন্য স্বাধীনতাকে যদি বসে থাকতে হয়, তা হলে হয়তাে গ্রিক কালেন্ড পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে…আমাদের এই খাদির কাজকর্মের সঙ্গে রাজনীতির বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই… সে ক্ষেত্রে কী করণীয়? আপনি কিছুই বলেন না…শুধু সমালােচনা করেন, সত্যিই কোনও সাহায্য হতে পারে, এমন কোনও নেতৃত্ব আপনার কাছ থেকে মেলে না…।”
এর পর নেহরু সরাসরি গাঁধীর বিশ্বদৃষ্টির কথা তুলছেন। “ইয়ং ইন্ডিয়া-য় আপনার বেশ কিছু লেখা, আপনার আত্মজীবনী ইত্যাদি পড়ে আমার বার বারই মনে হয় যে আমার আদর্শের সঙ্গে আপনার নীতির কী বিপুল ফারাক…আমার মনে হয়, আপনার পশ্চিমি সভ্যতার মূল্যায়নে বড়সড় গলদ আছে, পশ্চিমের বেশ কিছু ব্যর্থতাকে আপনি ফুলিয়ে ফঁপিয়ে দেখেছেন…অতীতের তথাকথিত রামরাজ্য যে বিরাট ভাল কিছু ছিল, আমার তা মনে হয় না, আমি চাইও না যে সেই রাজ্য ফিরে আসুক। আমার মনে হয়, পশ্চিমি, কিংবা শিল্পসমৃদ্ধ সভ্যতাই ভারতের ভবিষ্যৎ…শিল্পায়নের বিপদগুলি সকলেই জানে, তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যই বিভিন্ন ইউটোপিয়া এবং সামাজিক তত্ত্ব প্রণীত হয়েছে।”
নেহরু এখানেই থামছেন না, ভারতের দারিদ্রের কারণ কী, এবং সেখান থেকে মুক্তির উপায় কী, সে বিষয়ে তার আধুনিক বােধ-ব্যাখ্যার পাশাপাশি টেনে আনছেন গাঁধীর ‘পােস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গির কথা: “আপনি ভারতের দরিদ্র শ্রেণির দাবিদাওয়ার কথা বলেছেন…আমার সন্দেহ হয়, এই দারিদ্রের শিকড়টা ঠিক কোথায়, আপনার বাতলে দেওয়া দেওয়া সমাধানের মধ্যে (গ্রামীণ কর্মসংস্থান এবং গঠনমূলক কাজকর্ম) তা ধরাই পড়েনি… আপনি আধা-সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেন না… ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা কী ভাবে শ্রমিক এবং উপভােক্তাদের শােষণা করে চলেছে, সে বিষয়েও আপনি নীরব।”
এ বার একটু থেমে খেয়াল করে নেওয়া যাক, এই চিঠিতে নেহরু কী কী বলছেন। শিল্পায়িত, বা আধুনিক সভ্যতাই ভারতের ভবিষ্যৎ; সভ্যতার এই ধাঁচে যে সংকট আছে, তা পশ্চিমি (পড়ুন ফেবিয়ান এবং/অথবা মার্ক্সীয়) কল্পস্বর্গ এবং সামাজিক তত্ত্বের মাধ্যমে দূর হবে; চরকা কাটা, খদ্দর বােনা এবং খদ্দর পরিধানে স্বরাজ-এর অনুশীলন উদ্দীপিত তাে হয়ই না, বরং মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে; সামন্ততন্ত্র এবং ধনতন্ত্রকে আক্রমণ
১৪৫
করতে হবে এবং এদের হাত থেকে মুক্তি না-পাওয়া পর্যন্ত ভারতের দারিদ্র ঘুচবে না; এবং গাঁধী তার লেখা চটি বইগুলির তুলনায় (যেমন ‘হিন্দ স্বরাজ’) অনেক মহান, ওই সব বই পড়ে নেহরু উপলব্ধি করেছেন গাঁধী এবং তার আদর্শে কী বিপুল ফারাক।
খেয়াল রাখা ভাল, ছবিটা কিন্তু সব সময়েই এ রকম ছিল না। গত শতকের বিশের দশকের গােড়ায়, এবং মধ্যপর্বেও, ইউরােপ ভ্রমণে যাওয়ার আগে পর্যন্ত, নেহরুর বক্তব্যে স্পষ্ট গাঁধীবাদের ছায়া। তিনি হিংসার নিন্দা করছেন এবং অহিংসার গুণগুলি দেখিয়ে দিচ্ছেন। ১৯২৩-এ তিনি বলছেন, “আমাদের সামনে এখন দুটো পথ, হয় লেনিন এবং মুসােলিনি, নয়তাে গাঁধী।” তিনি আরও বলছেন, স্বাধীন ভারত কখনওই পশ্চিমি দেশের একটা শস্তা নকল’ হতে পারে না। জনতার কাছে খাদির বার্তা নিয়ে যাওয়া সেই নকলনবিশি আটকানাের একটা পথ বলেই তিনি মনে করেন।
১৭ জানুয়ারি, ১৯২৮। গাঁধী নেহরুর এই চিঠির জবাব দিলেন। জওহরলাল তার গাঁধীবাদী সত্তাটিকে যে ভাবে অস্বীকার করেছেন, সে বিষয়ে তিনি লিখলেন, নেহরু নিশ্চয়ই এত বছর তার প্রকৃত সত্তাটিকে “নায়কের মতাে অবদমিত করে রেখেছিলেন এবং তিনি স্বচ্ছন্দে গাঁধীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন। তিনি আরও বলছেন, গাঁধী এবং কংগ্রেসের মাদ্রাজ অধিবেশনের সমালােচনা করে লেখা জওহরলালের প্রবন্ধগুলি নিছকই শূন্যে চার দিকে গুলি ছােড়া ছাড়া কিছু নয়, লিখছেন, “আমার কোনও ধারণাই ছিল না যে আমাদের মধ্যে পার্থক্যের মাত্রাটা এমন সাংঘাতিক”, লিখছেন, “তুমি যখন নিজের সব কথা মনের মধ্যে চেপে রেখেছিলে, তখন তুমি নিশ্চয়ই সেই জিনিসগুলাে এড়িয়ে গিয়েছিলে, যেগুলাে এখন তােমার কাছে আমার গুরুতর ভ্রান্তি বলে মনে হচ্ছে। আগে এই ধরনের সমালােচনা চোখে পড়েনি, কারণ “তুমি যখন নিজেই কী করবে ঠিক করে উঠতে পারােনি, তখন ওই কাজকর্মগুলাে তােমার কাছে এতটা বিরক্তিকর বলে মনে হয়নি।”
কী করতে হবে, তা নিয়ে অবশ্য গাঁধীর মােটেই সংশয় নেই, “যদি (তুমি যেমন বলেছ) আমি ভুল করে থাকি, তা হলে নিশ্চিত ভাবেই আমি দেশের একটা অপূরণীয় ক্ষতি করেছি, করে চলেছি… এই অবস্থায় আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাটাই তােমার দায়িত্ব…।” তিনি লিখছেন “তােমার এবং আমার মতের মধ্যে ফারাক এতটাই বেশি যে কোথাও দু’জনের কোনও মিল হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। তােমার কাছে লুকোব না, সে ক্ষেত্রে তােমার মতাে একজন সাহসী, বিশ্বস্ত, যােগ্য এবং সৎ সহকর্মীকে হারানাের যন্ত্রণা আমাকে মেনে নিতে হবে…কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব যদি সত্যিই সেটা আসে— আমাদের ব্যক্তিগত নৈকট্যে কোনও ছাপ ফেলবে না। এরপর গাঁধী বলছেন, কী ভাবে তাদের মধ্যে এই বিচ্ছেদ এবং কার্যত শত্রুতার সূচনা করতে হবে, “তােমার নিজস্ব মতামত জানানাের একটা শালীন পন্থা তােমাকে জানাই। তােমার মতভেদের কথা জানিয়ে আমাকে একটা চিঠি দাও, আমি ইয়ং ইন্ডিয়ায় চিঠিটা’ ছাপিয়ে দেব, সঙ্গে একটা ছােট্ট উত্তরও দেব… তুমি যদি আরও একটা চিঠি লেখার কষ্ট করতে না চাও, তা হলে আমার সামনে যে চিঠিটা আছে (১১ জানুয়ারি,
১৪৬
১৯২৮), সেটাও আমি ছাপিয়ে দিতে পারি…আমার মতে এই চিঠিটা খুব খােলামেলা এবং সৎ নথির দৃষ্টান্ত।”
লয়েড এবং সুসান ব্যাখ্যা করে লিখছেন: “নেহরু গাঁধীর ১৭ জানুয়ারির চিঠি পেয়ে মর্মাহত (শকড অ্যান্ড পেনড) হলেন। কিন্তু, দ্রুত ঠিক করলেন যে বিরােধী পক্ষে দাড়ানাের জন্য গাঁধী যে আবেদন করেছেন, সেই পথে এগােবেন না, কারণ সেই রকম একটা অবস্থান নিলে সেটা সরাসরি তার শিক্ষক এবং পৃষ্ঠপােষকের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার শামিল হয়ে দাড়ায়। পরিবর্তে, নেহরু পিছিয়ে এলেন। তঁার ১১ জানুয়ারির চিঠিটি মূলত ছিল আবেগপ্রবণ, ভাবনাচিন্তার ছাপও ততটা ছিল না। গাঁধী কোনও দিনই ওই চিঠি ছাপতেন না। নেহরু কবুল করলেন, কখনও সরাসরি গাঁধীর মত এবং পথ নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না। নেহরু লিখলেন, আপনার মতাে কেউ আমাকে এতটা উদ্বেল করেনি, অনুপ্রাণিতও করেনি… ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার তাে কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু, আরও প্রসারিত অর্থে, রাজনীতিতে আমি কি আপনারই সন্তান নই, যদিও সম্ভবত একটি বিপথগামী সন্তান?’ নেহরু লিখছেন, সম্ভবত এই ‘উল্লেখযােগ্য মতবিনিময়’-ই আমাদের বুঝিয়ে দেবে কী করে ডােমিনিয়ন স্টেটাস এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে এই বিরােধের সমাধান ক্রমে দেশভাগের মতাে ঘটনার জন্ম দিল।…”
১৯২৮-এর জানুয়ারিতে এই গাঁধী-নেহরু দ্বন্দ্ব আসলে কংগ্রেসের বৃহত্তর পরিকল্পনা বিষয়ে একটি বিতর্ক। দেশের লক্ষ্য কী হওয়া উচিত, ডােমিনিয়ন স্টেটাস না কি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা? তত দিনে সাংবিধানিক দিকগুলি খতিয়ে দেখার জন্য সাইমন কমিশন নিয়ােগ করা হয়ে গিয়েছে, ২২ ফেব্রুয়ারি তাদের ভারতে আসার কথা। আমরা আগেই খেয়াল করেছি, এই কমিশনের সাত সদস্যের মধ্যে একজনও ভারতীয় ছিলেন না, এবং কমিশনের রাশ ছিল রক্ষণশীল টোরিদের হাতে। এই গােটা ব্যাপারটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে খুব অপমানজনক ঠেকেছিল, এবং নেহরুর মতাে তরুণ প্রজন্মের নেতারা বিষম ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
গাঁধী চেয়েছিলেন, যে ধরনের ডােমিনিয়ন স্টেটাস দেওয়ার কথা উঠেছে, সেটা গ্রহণ করাই উচিত। এতে সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে মুসলিমদের, আশ্বস্ত করা যাবে, সেই স্বশাসনের মধ্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের প্রতিনিধিত্বের বন্দোবস্ত থাকবে। নেহরুর মতাে ‘পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তুললে এ সব কিছুই হবে না। তা ছাড়া, এই ডােমিনিয়ন বন্দোবস্তে পঞ্জাব এবং বাংলার মতাে মুসলিম-প্রধান প্রদেশ, এবং বিভিন্ন রাজন্য প্রদেশকেও চিন্তায় পড়তে হবে না। স্বাধীনতার ভাগাভাগিতে এই প্রদেশগুলির গুরুত্ব বিপুল। তারাও আশ্বস্ত হবে এই দেখে যে নতুন রাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােয় এই প্রদেশগুলির স্বশাসনের বন্দোবস্ত থাকবে, সার্বভৌমত্বের ভাগাভাগির মধ্যে তাদের কোনও সমস্যা হবে না।
সন্দেহ নেই, ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর পক্ষে গাঁধীর এই বক্তব্যের পিছনে আছে তঁার দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘ কাল কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা। ফলে, পূর্ণ
১৪৭
স্বাধীনতার তুলনায় ডােমিনিয়ন স্টেটাসকেই তাঁর কাছে বেশি গ্রহণযােগ্য বলে মনে হয়েছে। এখানেই শেষ নয়। গাঁধী জানতেন, ভারতের হয়ে যাঁরা দর-কষাকষি করবেন, কথাবার্তা চালাবেন, তাদের ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থা এবং ব্রিটিশ জনমতের কাছাকাছি থাকাই বাঞ্ছনীয়। এই ব্যাপারটাও ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর পক্ষেই গিয়েছিল। গাঁধী এও জানতেন যে, ভারতে সাংবিধানিক সংস্কার এবং স্বশাসনের বিষয়টা ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেই পাশ করাতে হবে, এবং গােড়ার দিকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এবং ব্রিটিশ বিচারব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকলে কার্যক্ষেত্রে প্রভূত সুবিধা হবে।
আলাপ-আলােচনার এই যে ধাঁচ, অর্থাৎ এমন কিছু প্রস্তাব পেশ করা, যেগুলাের (ব্রিটিশ) পার্লামেন্ট-এ গৃহীত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা, সেই ধাঁচটা অবশ্য এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তৈরি হয়েছিল। নেহরু এই ধাঁচটাই ভাঙতে চেয়েছিলেন, এবং তাকে গাঁধীর তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছিল। ১৯১৬-য় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে যে লখনউ চুক্তি হয়, তাতে দু’পক্ষই এক হয়ে ভারতের জন্য স্বশাসন এবং একটি সংসদীয় ব্যবস্থা দাবি করেছিল। সেই চুক্তিতে আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর কথা বলা হয়েছিল, মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশেষ ‘ওয়েটেজ’-এর বন্দোবস্তও ছিল। অর্থাৎ, গােটা জনসমষ্টির তুলনায় সংখ্যালঘুদের যে অনুপাত, তাদের জন্য আসনও সেই অনুপাতে বরাদ্দ হবে না, আসনসংখ্যা তার তুলনায় বেশি হবে। ১৯১৮-র সংস্কারের ক্ষেত্রে এটাই ছিল দর-কষাকষির অবস্থান।
১৯২৮-এর নেহরু রিপাের্ট এক ধাপ এগিয়ে স্বশাসন পাওয়ার পরে কী করণীয়, সেই অনুমানের ভিত্তিতে তৈরি হল। তাতে ডােমিনিয়ন স্টেটাস-ই চাওয়া হল বটে, কিন্তু লখনউ চুক্তির ওই পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী এবং ‘ওয়েটেজ’-এর বিষয়টা বাদ। পড়ল। মুসলিম লিগের তরফে জিন্না মুসলিমদের জন্য কেন্দ্রীয় আইনসভায় একতৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ চেয়েছিলেন, পরিবর্তে নেহরু রিপাের্ট সেই অঙ্কটা পঁচিশ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা বলল, অর্থাৎ মােটামুটি দেশের জনসংখ্যার তুলনায়। মুসলিমদের যা অনুপাত, সেটুকুই। ওয়েলস লিখছেন, “সর্বদলীয় কনফারেন্স-এর আবহাওয়া ছিল সম্পূর্ণ জিন্নার বিরুদ্ধে… নেহরু এবং তার থেকেও কনিষ্ঠ কংগ্রেসিদের মনােভাব, কনফারেন্স-এ (হিন্দু) মহাসভা সদস্যদের বিপুল সংখ্যায় যােগদান, তা ছাড়া কনফারেন্স-এ পঞ্জাব থেকে আসা হিন্দুদের ঢল- এই সব দেখে বােঝাই গিয়েছিল যে জিন্নার ছয় দফা দাবি বাতিল করা হবে। এই ছয় দফার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযােগ্য দাবিটি ছিল কেন্দ্রীয় আইনসভার উভয় কক্ষেই মুসলিমদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন থাকবে। সপুর মতাে উদারপন্থীরা মুসলিমদের অনেক দাবিই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস মানতে চায়নি।”
সর্বদলীয় কনফারেন্স-এ নেহরু রিপাের্ট গৃহীত হওয়া এবং নিজে প্রবল বিরােধিতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, ওয়েলস লিখছেন, “জিন্না তার জাতীয়তাবাদী অবস্থান থেকে সরলেন না, এবং কী করে হিন্দু এবং মুসলিম দুই সম্প্রদায়কে একটি সাধারণ রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, সেই স্বপ্নেই মগ্ন থাকলেন। গােটা ১৯২৮ জুড়েই তার
১৪৮
এই দুই সম্প্রদায়কে কাছাকাছি নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চলল। গাঁধীর মতাে, এবং নেহরুর উল্টো পথে, জিন্নাও মনে করতেন যে, হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নটি একটি জাতীয় সমস্যা, নিছকই সাম্প্রদায়িক কাজিয়া নয়।” ১৯২৮-এর শেষেও দেখা যাচ্ছে, জিন্না ভাবছেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্বরাজ-এরই নামান্তর এবং তখনও তার বিশ্বাস অটুট যে, একমাত্র সাংবিধানিক পথেই স্বরাজ আসা সম্ভব।
জওহরলাল প্রথমে (মােতিলাল) নেহরু রিপাের্ট-এ সায় দিয়েছিলেন, কিন্তু দ্রুতই তিনি দেখলেন যে, এই রিপাের্ট-এর সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব এবং ডােমিনিয়ন স্টেটাস মেনে নেওয়ার প্রশ্নে একমত হওয়া সম্ভব নয়। হাজার হােক, ইউরােপ থেকে ফেরার পরে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা একটি ব্যক্তিত্ব। গাঁধীর আদর্শের প্রতি তার যে আনুগত্য, তার উপরে এসে পড়ল তাঁর নতুন সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ, সম্ভবত তাঁর আগের আনুগত্যটিকে কিছুটা সরিয়ে দিয়েই। তার জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটিও পাল্টাল; এ বার তিনি এমন একটি সমন্বিত জাতীয়তাবাদ চাইলেন, যার সঙ্গে সাধারণ নাগরিকত্ব এবং সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে গড়া গণতন্ত্রের ধারণা খাপ খায়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কী ভাবে বুঝতে হবে, সেই বােধের মধ্যে অন্য নানা সামাজিক বর্গভাগ, বিশেষ করে ধর্মকে সরিয়ে সামনে উঠে এল শ্রেণিচেতনা। তিনি যখন সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্ব এবং ডােমিনিয়ন মর্যাদার দাবি খারিজ করলেন, তখন তার মধ্যে দিয়ে ভারতে একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্র এবং বহু-সাংস্কৃতিক সমাজের কিছু মূল বৈশিষ্ট্যকেই আসলে উড়িয়ে দিলেন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব, তাদের রক্ষাকবচ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাের দাবি নেহরু মানতে চাইলেন না। মনে রাখা ভাল, গাঁধীকে লেখা তার চিঠিতে নেহরু বলেছিলেন, ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর কথা ভাবলেই তার “দম বন্ধ হয়ে আসে, কেউ যেন তার গলা টিপে ধরে”।[৫১০]
এই পরিপ্রেক্ষিতে, এ জি নুরানি লিখছেন, “সংখ্যালঘুদের জন্য, বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য রক্ষাকবচের দাবি খারিজ করে নেহরু ভারতের বহুত্ববাদী সমাজে ‘অন্ধ ভাবে’ ‘ব্রিটিশ প্রথা এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করার উপরেই জোর দিলেন।” বলা। হল, রক্ষাকবচ (যেমন, মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণ) এবং ‘ওয়েটেজ’ (মােট জনসংখ্যায় সংখ্যালঘুদের অনুপাতের তুলনায় তাদের জন্য বেশি মাত্রায় আসন বরাদ্দ) প্রয়ােজন নেই; সংবিধান ধর্ম এবং জাতি নির্বিশেষে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য সাধারণ অধিকারের বন্দোবস্ত করবে এবং সেটাই যথেষ্ট। যাই হােক, এই রক্ষাকবচের বিষয়টা ব্রিটিশ ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতির একটা বড় অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ভারতে সামাজিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রশ্নটা মাথায় রাখলে এই বিষয়টিকে কখনওই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। “কংগ্রেস যখন একমাত্রিক ভাবে সংখ্যাধিক্যের আধিপত্য চাইল, তখন যে সংখ্যালঘুরা শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল, তাদের পরিস্থিতি ভাবলে রক্ষাকবচের প্রশ্নটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।”
উনিশশাে কুড়ির দশকে, প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় স্তরে সংখ্যালঘুরা ক্রমেই রাজনৈতিক চেতনা অর্জন করছে, তাদের নিজস্ব একটা কণ্ঠস্বর তৈরি হচ্ছে, একটা
১৪৯
অস্তিত্ব গড়ে উঠছে, তারা যথাযথ মাত্রায় প্রতিনিধিত্বের দাবিতে সরব হয়ে উঠছে, এবং সেই অধিকার প্রয়ােগ করতেও পিছপা হচ্ছে না। পরিস্থিতিটা বিচিত্র এক প্যারাডক্সের মতাে। মুসলিমরা যদি স্বেচ্ছায় একটা স্বাধীন ভারতীয় নেশনকে মেনে নেয়, শুধুমাত্র তা হলেই ভারত একটি দেশ হিসাবে থাকতে পারে, কিন্তু মুশকিল এই যে, মুসলিমরা ঠিক সেখানেই ভয় পেয়ে গেল, স্বাধীন ভারতে তাদের অবস্থা কী হবে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। তা হলে কি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দুদের অত্যাচার তাদের মেনে নিতে হবে? এ রকম একটা সম্ভাবনা যে নেই, সে কথা বললেও তা বিশ্বাস করা কঠিন। অতীতের বহু শতাব্দীর স্মৃতি, ইতিহাসের ছায়া এসে দৃষ্টি এবং চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে।
“কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, গাঁধী বা নেহরু কারও অভিলাষই পূর্ণ হল না, ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্রোত তাদের যাবতীয় হিসাব এলােমেলাে করে দিল, সেই ঘটনাচক্র নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা গাঁধী বা নেহরু কারও হাতেই ছিল না।” লর্ড আরউইন ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর পক্ষেই ছিলেন, ১৯২৮-এ মােতিলাল নেহরু রিপাের্টও ডােমিনিয়ন স্টেটাস চেয়েছিল, কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ড-এর সরকার এক দিকে নানা মতে বিভক্ত, তারা যে ভারতের প্রতি বিশেষ বন্ধুভাবাপন্ন ছিল তা-ও নয়, ফলে ডােমিনিয়ন স্টেটাস এল না। তা ছাড়া, ১৯২৯-এ কংগ্রেস যখন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাল, তখন ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর বিষয়টাও গুরুত্ব হারাল।
মােতিলাল নেহরুর ১৯২৮-এর রিপাের্ট-এর পরিণাম যা হল, তা ওই রিপাের্ট যারা প্রস্তুত করেছিলেন, তাদের সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ছিল, সন্দেহ নেই। এর ফলে মুসলিমদের বিভিন্ন সংগঠন নিশ্চিত হল যে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষার খাতিরেই এ বার তাদের মুসলিম লিগের থেকে আলাদা, বৃহত্তর একটি সংগঠনের আওতায় জড়াে হতে হবে। সেই সংগঠনই হল অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স। তারা আরও স্থির করলেন যে, একটা কোনও সাধারণ লক্ষ্য থাকবে, যে বক্তব্যটিকে সেই সংগঠনের তরফে পেশ করা হবে। আমরা আগেই দেখেছি, ১৯২৮-এর নেহরু রিপাের্ট ১৯১৬-র লখনউ চুক্তির সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর ভিত্তিতে নির্বাচনের দাবি খারিজ করে দিল, সংখ্যালঘু-ভিত্তিক প্রদেশগুলির জন্য ‘ওয়েটেজ’-এর দাবিও বাতিল হল। যুক্তপ্রদেশ, বিহার বা ওই জাতীয় আরও নানা সংখ্যালঘু-ভিত্তিক প্রদেশে সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্বে সরাসরি তার ছাপ এসে পড়ল। কেন্দ্রীয় আইনসভায় সংখ্যালঘুর প্রতিনিধির সংখ্যাও কমে গেল। ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রীয় আইনসভায় জিন্না এবং তাঁর সহকর্মীরা বিষম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন, বিভিন্ন প্রদেশের মুসলিম নেতাদের সঙ্গে আলােচনা শুরু করলেন। দিল্লিতে, ১৯২৮-এর ৩১ ডিসেম্বর, আগা খাঁ-র নেতা ফজলি হুসেন। যাঁরা সেই কনফারেন্স-এ যােগ দিলেন, তাদের মােটামুটি দু’টি ভাগে ভাগ করা যায়। এক দিকে পঞ্জাব ইউনিয়নিস্ট-এর মত কিছু সংগঠন, সঙ্গে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন উত্তরপ্রদেশের মুসলিম। অন্য দিকে ছিলেন তারা যারা ব্রিটিশের সঙ্গে প্রায় অন্তহীন। লড়াই করতে করতে ক্লান্ত, এও বুঝে গিয়েছেন যে, জিন্নার নেতৃত্বে কংগ্রেসের সঙ্গে যে কথাবার্তা চলছে, তাতেও বিশেষ সুফল মেলার আশা ক্ষীণ। এঁদের মধ্যে ছিলেন
১৫০
বিভিন্ন মুসলিম-প্রধান প্রদেশের নেতা, ‘ফ্রন্টিয়ার্সম্যান’, ছিলেন পঞ্জাবি এবং বাঙালি নাগরিক সংবিধানপন্থী নেতা (আর্বান কনস্টিটিউশনালিস্ট), ছিলেন সংখ্যালঘু প্রদেশের খিলাফতি নেতারা, সঙ্গে সিন্ধু প্রদেশের বিভিন্ন নেতা। এই মুসলিম কনফারেন্স থেকে ওঠা দাবির মধ্যে থাকল: পূর্ণ প্রাদেশিক স্বশাসন, যথাযথ একটি ফেডারেশন, পঞ্জাব এবং বাংলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্য, আলাদা নির্বাচকমণ্ডলী, মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশে ‘ওয়েটেজ’-এর বন্দোবস্ত এবং কেন্দ্রীয় আইনসভায় তখন যে রীতি চালু ছিল, সেই এক-তৃতীয়াংশ মুসলিম প্রতিনিধিত্ব পুনর্বহাল।
জিন্না ১৯২৮-এর ডিসেম্বরে দিল্লির এই কনফারেন্স-এ যােগ দেননি, কিন্তু ১৯২৯-এ কনফারেন্স-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর বরফ গলল, কনফারেন্স জিন্নাকেই তাদের মুখপাত্র হওয়ার অনুরােধ জানাল, তারপরই জিন্না তার বিখ্যাত চোদ্দো দফা দাবি তৈরি করলেন।[১২] মুসলিম কনফারেন্স এই দাবিগুলিকেই তাদের বক্তব্য হিসাবে মেনে নিল, এবং নেহরু কমিটির কাছে চোদ্দো দফা দাবি পেশ করা হল। মােতিলাল নেহরু সেই সব দাবি উড়িয়ে দিলেন, সাফ জানালেন যে, “এই দাবিগুলি মােটেই বাস্তব রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে খাপ খায় না।” ১৯২৯-এর অগস্টে তিনি গাঁধীকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন, “এই সব উদ্ভট দাবিদাওয়া তুলে উনি স্রেফ নিজের দলবল নিয়ে নিজেকে নেতৃপদে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন…আমি নিঃসন্দেহ, যদি সত্যিকার জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের সঙ্গে কোনও সমঝােতা করতে হয়, তা হলে মিস্টার জিন্না এবং আলি ভাইদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাই ঠিক হবে।”[১৩] সুতরাং, এই মুসলিম কনফারেন্স-এর প্রতিনিধিত্ব বিশেষ কিছু আদায় করতে পারল না।
১৯৩০-এর মে মাসে সাইমন কমিশন-এর রিপাের্ট বেরনাের পরে মুসলিম কনফারেন্স ফের বড় মাপের একটি চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি হল। তার আগেই অবশ্য সাইমন-এর প্রস্তুতিপর্বেও সমস্যা দেখা দিয়েছে বিস্তর। জিন্না সে ব্যাপারে সচেতন ছিলেন, তা ছাড়া মুডিম্যান কমিটির অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নিয়েছিলেন (দ্রষ্টব্য তৃতীয় পরিচ্ছেদ), ফলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, কোনও ভারতীয় সাংবিধানিক তদন্ত কমিটি কাদের নিয়ে গড়া হবে, সেই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২৬-এর মার্চেই আইনসভায় একটি বক্তৃতায় জিন্না সরকারের কাছে একটি স্ট্যাটিউটরি কমিশন গড়ার আর্জি জানিয়েছিলেন। ১৯১৯-এর আইনে তার বন্দোবস্তও ছিল। তিনি স্পষ্ট ভাবে আরও জানিয়েছিলেন যে, “কমিশনের সদস্যদের এমন ভাবেই বেছে নিতে হবে জনগণ যাতে সন্তুষ্ট হয়..যদি কোনও রয়্যাল কমিশন গঠন করতেই হয়, তা হলে এমন কোনও কমিশন গড়ে লাভ নেই যা জনসাধারণের আস্থা এবং বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে না।” সাইমন কমিশন গঠনের কথা ঘােষণা করার ঠিক এক সপ্তাহ আগে লর্ড আরউইন জিন্নাকে ডাকলেন। এবং খুব গােপনে তাকে জানালেন, প্রস্তাবিত কমিশনে কারা থাকছেন। জিন্নার সঙ্গে সেই সাক্ষাতের স্মৃতি ধরা আছে আরউইন-এর লেখায়: “জিন্নার সঙ্গে আজ অনেকক্ষণ। কথা হল। খুব মনােযােগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন, তারপর বললেন, যদি সব ঠিকই হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে আর কথা বলে কী লাভ, তিনি বুঝতে পারছেন না। অবশ্য
১৫১
এর পরে তিনি বেশ খানিকক্ষণ ধরেই কমিশন নিয়ে চেনা সব আপত্তির কথা তুললেন, বললেন, নিছকই একটি সংসদীয় কমিশন গড়ে কী লাভ। বললেন, এ তাে একটা বিচারবিভাগীয় তদন্তের মতাে হয়ে যাচ্ছে, যেখানে ভারতীয়রা এমনিতেই বেকায়দায়। বললেন, এর ফলে জাতীয় মর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে, জাতীয় আবেগেও আঘাত লাগছে। তার আশঙ্কা, এই সংসদীয় কমিশনের ফলে এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে যাতে আইনসভায় সিলেক্ট কমিটির প্রস্তাবটাই বানচাল হয়ে যেতে পারে। জিন্নার মতে, সিলেক্ট কমিটির এই প্রস্তাবের যথেষ্ট সাংবিধানিক তাৎপর্য আছে। সাধারণ ভাবে এই সব বিষয়েই আমরা কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললাম, কিন্তু এই কমিশনের পরিণাম কী হতে পারে, সে ব্যাপারে তিনি যে মতটাই বদলে ফেলেছেন, আমি তার বিন্দুমাত্রও ইঙ্গিত পাইনি। উনি কোনও আভাসই দেননি। শুধু বললেন যে, কমিশনের কথা ঘােষণা করা হলে প্রতিক্রিয়া কী রকম হবে, সে ব্যাপারে তিনি মােটেই আশাবাদী নন।”[১৬]।
আরউইন অবশ্য ভারতে যা যা করা সম্ভব সাধ্যমতাে সবই করেছিলেন, বিশেষ ভাবে ভারতীয় নেতাদের কাছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার আবেদন জানানাে থেকে শুরু করে জিন্নার ‘যথার্থ শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা’[১৭] অর্জন পর্যন্ত সবই করেছিলেন। ফলে, আরউইন যদিও জিন্নাকে খুবই বিষগ্ন দেখেছিলেন, তৎসত্ত্বেও জিন্না কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সংযমের পরিচয় দিলেন। আরউইনের সঙ্গে সাক্ষাতের পরের সপ্তাহে জিন্না আরউইনের কাছে আবেদন রাখলেন, কোনও গােপনীয়তা ভঙ্গ হবে না, তা নিশ্চিত করে অন্তত দু’জন ভারতীয় যাতে কমিশনে থাকেন, তার জন্য সাধ্যমতাে চেষ্টা করুন। ভারতীয় নেতাদের কাছেও তিনি আবেদন জানালেন, ছাপা হওয়ার পরে প্রস্তাবগুলি নিয়ে আলােচনায় বসুন, এবং একটা সাধারণ কার্যনীতি স্থির করুন। তখন এরকম একটা অনুমান খুব জোরালাে ছিল যে, ব্রিটিশ লেবার পার্টি ভারতীয়দের পক্ষে সক্রিয় হবে, পরে যদিও এই অনুমান ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছিল। কমিশন নিয়ােগের কথা ঘােষণার দু’দিন পরে সংসদীয় লেবার পার্টি সরকারি ভাবে বিবৃতি দিল, তাতে ভারতীয় নেতাদের প্রতি উপদেশ, “কমিশনের প্রতি কী মনােভাব নেবেন, তা স্থির করার আগে পার্লামেন্ট-এ বিতর্কের ফল কী হয়, তার জন্য অপেক্ষা করুন।”[১৮] একটি প্রথম সারির। ব্রিটিশ সংবাদপত্র এও জানাল যে, ভারতীয় কমিশনে কিছু অদলবদল হতে পারে। ১৪ নভেম্বর, ১৯২৭, অর্থাৎ কমিশন ঘােষণার এক সপ্তাহ পরে জিন্না ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টির ফেনার-ব্রকওয়েকে এই টেলিগ্রামটি পাঠালেন:
কমিশনে একজনও ভারতীয়কে না নেওয়াটা একটি মৌলিক ভ্রান্তি। এখনও পর্যন্ত যে সব সংশােধনীর কথা প্রস্তাব করা হয়েছে, খবরেও জানা গিয়েছে, সেগুলিও একই রকম অসম্ভব। কোনও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং অনুমােদিত (অ্যাক্রেডিটেড) ভারতীয়ই এই কমিশনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন না, যদি না তাকে কমিশনের বাকি সদস্যদের সঙ্গে একই শর্তে এবং একই অধিকার দিয়ে গ্রহণ করা হয়। লেবার পার্টির
১৫২
কাছে আবেদন রাখছি, তারা সক্রিয় ভাবে এই ভারতীয় আবেগের প্রতি সহানুভূতি ব্যক্ত করুন এবং ভারতীয় আত্মমর্যাদায় আঘাত করার জন্য ছক কষে যে কমিশন থেকে ভারতীয়দের সরিয়ে রাখা হয়েছে এবং যাতে সত্যিই ভারতের সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছে, লেবার পার্টির প্রতি আবেদন, ভারতীয় জনমতের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাদের কোনও সদস্য যেন সেই কমিশনের কাজে যুক্ত না হয়।[২০]
টোরি সরকার অবশ্য শেষ পর্যন্ত লেবার পার্টির প্রয়ােজনীয় সমর্থন জোগাড় করে ফেলল এবং কমিশন নিয়ােগের রয়াল ওয়ার্যান্ট স্বাক্ষরিত হল ২৬ নভেম্বর, ১৯২৭। পর দিন জিন্না সংবাদমাধ্যমের কাছে বললেন, তিনি নিশ্চিত যে, ‘ভারত কোনও সময়েই এবং কোনও ভাবেই এই নীতিতে সায় দিতে পারে না, কমিশনের সঙ্গে কোনও সহযােগিতাও করতে পারে না, কারণ এই কমিশন ভারতীয়দের আদৌ সহযােগী (পার্টনার) হিসাবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ডিসেম্বর মাস জুড়ে সমস্ত সংবাদপত্রে খবর, জিন্না প্রস্তাবিত কমিশনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে তৎপর এবং পঞ্জাবের নিজের ধর্মেরই কিছু বড় মাপের নেতার সঙ্গে তার বিরােধ বেধেছে। কলকাতায়,
পয়লা জানুয়ারি ১৯২৮-এ মুসলিম লিগের অধিবেশনে জিন্না যে সভাপতির ভাষণ দিলেন, সেখানেই তার মনােভাবের চূড়ান্ত প্রকাশ দেখা গেল: “গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক যুদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছে। আমাদের তরফ থেকে আর সমঝােতার জন্য কোনও প্রস্তাব যাবে না। কী ভাবে এই সংকটের ইতি হতে পারে, তা সরকারই খুঁজে নিক। আমাদের সমমর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে এবং আমরা সাধ্যমতাে এই নীতির বিরােধিতা করে যাব। জালিয়ানওয়ালাবাগ-এর কাণ্ডে সরাসরি নিধন করা হয়েছিল। এ বার, সাইমন কমিশন মানসিক ভাবে আমাদের আত্মায় আঘাত হেনেছে। শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করে লর্ড বার্কেহেড এটাই বােঝাতে চেয়েছেন। যে আমরা স্বশাসনের পক্ষে উপযুক্ত নই। পণ্ডিত মালব্যকে স্বাগত, পাশাপাশি কংগ্রেস আর হিন্দু মহাসভার তরফে আমাদের দিকে যে সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাকেও স্বাগত জানাই। ব্রিটিশ আমাদের যতটাই ছাড় দিক না কেন, তার চেয়ে আমার কাছে এই সহযােগিতার তাৎপর্য অনেক বেশি। আসুন, আমরা এই সহযােগিতার মর্মার্থ অনুধাবন করি। এই দিনটি নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল, এবং এই দায়িত্বটুকু যে আমরা পালন করতে পারলাম, তার জন্য লর্ড বার্কেনহেড-এরও ধন্যবাদ প্রাপ্য।”[২২] খুবই কঠোর ভাষণ। সাইমন কমিশনের ফলে ভারতের সমস্ত দল শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যে পৌছতে না পারলেও অন্তত ঐক্য গড়ার কথা বলল।
১৯২৮-এর মে মাস, জিন্না জাহাজে বিলেত পাড়ি দিলেন। সঙ্গে তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার, এবং দেওয়ান চমনলাল। থাকলেন ছ’মাস, এবং এই গােটা সময়টা জুড়ে আরউইন খবর পেলেন যে, কমিশনে যাতে ভারতীয় সদস্য নিয়ােগ করা হয়, তার জন্য জিন্না লেবার পার্টি এবং ইন্ডিয়া অফিস-এ নিরন্তর তদ্বির করে
১৫৩
চলেছেন। বিশেষ ফল হল না, অক্টোবরে ফিরে এলেন ব্যর্থ, হতাশ জিন্না। বম্বে ফিরেই টাইমস অব ইন্ডিয়াকে ২৬ অক্টোবর একটি সাক্ষাৎকারে জিন্না দেশবাসীকে হুঁশিয়ারি দিলেন, ইংল্যান্ডের কোনও দল কোনও সাহায্য করবে, এই প্রত্যাশা করাটাই সবচেয়ে বড় ভুল হবে। আরও জানালেন, আশার আলাে একটাই, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য। তত দিনে নেহরু রিপাের্ট পেশ করা হয়ে গিয়েছে, তা সত্ত্বেও জিন্না আশাবাদী, এই সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের কোনও না কোনও একটা উত্তর পাওয়া যাবে, ফলে নতুন করে তিনি এ বিষয়ে উদ্যোগী হলেন।
মার্চ ১৯২৮। জিন্না তত দিনে লর্ড আরউইনের কাছে সংকট নিরসনের ‘দু’টি উপায় জানিয়ে দিয়েছেন- “এক, সাইমন কমিশনে শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ সদস্য রাখা চলবে , কমিশনের গঠন মিশ্র করতে হবে। দুই, না হলে একই রকম ক্ষমতা দিয়ে এরই যমজ আর একটি ভারতীয় কমিশন নিয়ােগ করতে হবে।”[২৩] সেই বছরেই জুন মাসে আরউইন স্যর চিমনলাল সেতলবাদ-এর তরফেও একই সুপারিশ পেলেন এবং যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে এই বক্তব্যটি বিবেচনা করলেন। সত্যি বলতে এতটাই গুরুত্বের সঙ্গে যে, তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড বার্কেহেড-এর সঙ্গে তার প্রায় কূটনৈতিক সংঘাত বাধার উপক্রম হয়েছিল। বার্কেনহেড এই প্রস্তাবের মধ্যে নিছকই আরও কিছুটা জমি দখলের লক্ষ্যে ভারতীয়দের চাপ সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাননি। তার এও মনে হয়েছিল যে এক বার জমি ছাড়লে ক্রমশ এই চাপ বাড়তেই থাকবে। আরউইনের চাপে অবশ্য প্রস্তাবগুলি ব্রিটিশ ক্যাবিনেট-এর কাছে পেশ করা হল, যদিও সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড বার্কেহেড তার সহকর্মীদের উপর বুঝিয়ে এবং প্রভাব খাটিয়ে আরউইনের উল্টো একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেললেন।
এর পর থেকে আরউইনের রাজনৈতিক তৎপরতার স্থান পরিবর্তন হল, ভারত থেকে সরে গেল ব্রিটেনে। ১৯২৯-এর মাঝামাঝি থেকেই অবশ্য তিনি ব্রিটেনে গিয়ে সেখানকার নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে চাইছিলেন, তাদের বােঝাতে চাইছিলেন যে ভারতীয় পরিস্থিতি ঠিক কতটা জটিল। এরপর হঠাৎই মেঘ কেটে আলাের রেখা দেখা দিল, ১৯২৮-এর অক্টোবরে ইন্ডিয়া অফিস থেকে লর্ড বার্কেহেড পদত্যাগ করলেন। ১৯২৯-এর জুন মাসে, অর্থাৎ চার মাসের ছুটিতে আরউইন যখন দেশে ফিরবেন, ঠিক তার আগেই ব্রিটেনে লেবার পার্টি ক্ষমতায় এল, ভারতের নতুন সেক্রেটারি অব স্টেট হলেন অ্যান্টনি ওয়েজউড বেন। তাতে আরউইনের আরও সুবিধা হল, কারণ তত দিনে আরউইনের ভাবনাচিন্তা আর নিছকই কমিশনের সদস্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আরউইনের মনে হল, এই কমিশনের বা তার সুপারিশের আর কোনও প্রয়ােজনীয়তা নেই। সাইমন কমিশনের অন্যতম সদস্য এবং ব্যক্তিগত জীবনে তার আত্মীয় জর্জ লেন ফক্স-কে আরউইন জানালেন: “আপনারা যখন কাজটা শেষ করবেন, যখন সুপারিশগুলি কার্যকর করা হবে, তখন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী রকম থাকবে, সেটাই কিন্তু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্বেষের একটা আবহাওয়ার মধ্যে কোনও পরিকল্পনা কার্যকর করার চেষ্টা না-করাই ভাল।” মাস পাঁচেক পরে, ১৯২৯-এর নভেম্বর মাসে আরউইন।
১৫৪
আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবেরিকে লিখলেন, “এক দিকে কিছুই না করা, অন্য দিকে এমন কিছু করা যায় কি না যা সত্যিই অর্থবহ, এই দুয়ের মধ্যে থেকেই আমরা কী করব, সেটা আমাদেরই বেছে নিতে হবে। ক্রমশ আরও বেশি করে আমি এই কথাটা বুঝতে পারছি। প্রথমটার পক্ষে ঢের যুক্তি দেওয়া যায়, কিন্তু আমি এটা না বলেও পারছি না যে, বছরের পর বছর ধরে এই জিনিসটা করলে তার পরিণাম হবে এই যে ভারতীয় রাজনীতি আরও বাম-ঘেঁষা হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, দ্বিতীয় পথটা নিলে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ সহযােগিতা আদায় করতে পারব।”[২৪]
এই অবস্থায় আরউইনের সামনে দুটো উদ্দেশ্য ছিল: প্রথমত, ভারতের ভবিষ্যৎ বিষয়ে ব্রিটেন কী ভাবছে, সে ব্যাপারে ভারতীয়দের আস্থা অর্জন করা— ১৯২৪এর ফেব্রুয়ারিতে আইনসভায় স্যর ম্যালকম হেলির বক্তব্যের কারণে এই আস্থা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।[২৫] দ্বিতীয়ত, আরউইন ভারতীয় এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের একটি গােল টেবিল বৈঠক চেয়েছিলেন, যাতে একটা ঐক্যের আবহাওয়ায় ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধানের রূপরেখা নির্ণয় করা যায়। ১৯২২-এই অবশ্য এ রকম একটা সম্মেলনের কথা উঠেছিল, বম্বেতে সে বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি সেই ‘কনফারেন্স অব লিডারস’-এ জালিয়ানওয়ালাবাগ এবং খিলাফতের কথা উঠেছিল, স্বরাজ-এর দাবি নিয়েও আলােচনা হয়েছিল। ১৯২৪-এর ফেব্রুয়ারিতেও আইনসভায় গৃহীত একটি প্রস্তাবে এ রকম একটি সম্মেলনের কথা বলা হয়েছিল। ফলে, ১৯২৯-এর গােড়ায় আইনসভার বক্তৃতায় আরউইন সেই প্রস্তাবটিই আর এক বার পড়লেন, যদিও কথাটা বলার আগে দেখে নিলেন, এ ব্যাপারে সাইমন কমিশন কী ভাবছে। আরউইন তার বক্তৃতায় বললেন, “আমি এই আইনসভাকে আবার বলছি, এবং সেই সূত্রে ভারতকেও ফের জানাচ্ছি যে, ১৯১৭ সালে যে ঘােষণায় বলা হয়েছিল, সম্পূর্ণ জাতীয় একটি রাজনৈতিক সত্তা অর্জনের লক্ষ্যে কোনও ব্যক্তি অন্য এক জনকে যত দূর সাহায্য করতে পারে, ব্রিটিশ জনতা ভারতীয়দের ততখানিই সাহায্য করবে। সেই ঘােষণা এখনও বহাল আছে, ভবিষ্যতেও বহাল থাকবে এবং এই মর্মে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কোনও ভাবেই তার অমর্যাদা করা হবে না। যে হেতু মনে করা হয় যে কথার চেয়ে কাজের দাম অনেক বেশি, তাই আমি আরও বলতে চাই যে, যদি দেখতাম যে ব্রিটিশ তার সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে, তা হলে আজ আমি এখানে এসে দাঁড়াতাম না।”[২৬]
১৯৩০-এর মাঝামাঝি সাইমন কমিশনের অধিকার যদিও অনেকটাই খর্ব হয়েছে, প্রথমে কমিশন বয়কটের সিদ্ধান্ত, তারপর ভাইসরয়ের গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব কমিশনের ক্ষমতাকে লঘু করে দিয়েছে, তবুও আনুষ্ঠানিক ভাবে রিপাের্ট পেশ করে কাজটা শেষ করতেই হত। পঞ্জাবের ফজলি হুসেন শঙ্কিত হলেন, কমিশনকে যে হেতু লন্ডন থেকে নিয়ােগ করা হয়েছে, তাই বিশেষ ভাবে মুসলিম সংখ্যাধিক্য’-এর প্রশ্নটি উল্লেখ করা না হলে কমিশনের রিপাের্ট মুসলিম কনফারেন্স-এর স্বার্থবিরােধী হতে পারে।
১৫৫
দেখা গেল, রিপাের্ট-এ সে সব কিছুই নেই, আবার যা চাওয়া হয়েছিল, সেই সিন্ধু। প্রদেশ ভাগ করা নিয়েও কোনও উচ্চবাচ্য নেই। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সমান মর্যাদা দাবি করেছিল, সে দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে। বালুচিস্তান নিয়েও কোনও পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি। সর্বোপরি, পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর প্রশ্নে কমিশন আদৌ কোনও সায় দেয়নি। এমনকী, কেন্দ্রীয় আইনসভায় পৃথক প্রতিনিধিত্ব তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। পঞ্জাব এবং বাংলায় আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের দাবিকেও আদৌ কোনও পাত্তা দেওয়া হয়নি। মুসলিম কনফারেন্স ভাবল, এই রিপাের্ট সরাসরি একটা চ্যালেঞ্জ ছাড়া কিছু নয়। উদারপন্থীরা ভাবলেন, এই রিপাের্ট জেনেশুনেই প্ররােচনা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকার এবং মুসলিমদের মধ্যে সেতুর মতাে দাড়িয়ে ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’-এর কাজটা করলেন মূলত ফজলি হুসেন। গােড়ায় তিনি সরকারি কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সীমান্ত প্রদেশের মুসলিমদের শান্ত করলেন, তার পর তাদের বােঝালেন, সীমান্ত প্রদেশে সংস্কারের সুফল কী কী হতে পারে। ক্রমে তাঁরা ফজলির কথা মেনে নিলেন। তার পর, তিনি যথাসাধ্য প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে মুসলিম-প্রধান রাজ্যগুলিকে শান্ত করলেন। সংখ্যালঘুর প্রসঙ্গে বললেন, ধর্ম বা সংস্কৃতি নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত নন, বিভিন্ন স্থানীয় প্রশাসন এবং পরিষেবায় প্রতিনিধিত্বের হারটা কী। হবে, সেটাই আসল প্রশ্ন। সব মিলিয়ে, ফজলি হুসেন এটাই বললেন যে, ১৯১৬-র লখনউ চুক্তি মেনে সুপারিশ করে সাইমন কমিশন খুবই অন্যায় করেছে। তিনি জোর দিয়ে আরও জানালেন যে, পঞ্জাব এবং বাংলার মতাে প্রদেশে মুসলিম সংখ্যাধিক্যের জন্য কখনওই মুসলিম-সংখ্যালঘু প্রদেশে ‘ওয়েটেজ’-এর দাবি ছেড়ে দেওয়া যায় না। ফজলি হুসেন-এর বক্তব্য আসলে বিভিন্ন প্রদেশেরই বক্তব্য, তার কাছে পঞ্জাব এবং বাংলায় মুসলিম প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটির আলাদা, নিজস্ব গুরুত্ব ছিল। তার মত ছিল এই যে, যতদিন না প্রদেশগুলি নিজেদের যথাযথ ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে, তত দিন কেন্দ্রে কোনও পরিবর্তন করা উচিত হবে না। তবে, একটা সিদ্ধান্ত যখন হয়েই গেল যে, কিছু জিনিস সত্যিই হস্তান্তরিত হবে, তখন সেগুলি যাতে ন্যূনতম মাত্রার মধ্যেই থাকে, সে জন্য তিনি তৎপর হয়ে উঠলেন। সাইমন কমিশন অ্যাসেম্বলিতে পরােক্ষ নির্বাচনের যে সুপারিশ করেছিল, ফজলি হুসেন তার সমালােচনা করেছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল এই যে, এর ফলে প্রাদেশিক চক্রের (ককাস) হাতে ক্ষমতা চলে যাবে, নয়তাে লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে কংগ্রেস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। যতদিন
প্রথম গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব কার্যকর হচ্ছে, তত দিন ফজলি হুসেনের মনে সংশয় ছিল— যে ক্ষমতা একসময় হস্তান্তরিত হবে, তার গতিপ্রকৃতি নিয়েই সংশয় ছিল। সেই প্রস্তাব তখনও বাতাসে ভাসমান, যত দিন না সেগুলি একটা নির্দিষ্ট রূপ পাচ্ছে, তত দিন ফজলি হুসেন স্বস্তি পাননি। এ রকমই একটা জটিল পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যেই জানা গেল, প্রথম গােল টেবিল বৈঠক হবে, লন্ডনে, ১৯৩০-এর নভেম্বর মাসে।
১৫৬
প্রথম গােল টেবিল বৈঠক – ১২ নভেম্বর, ১৯৩০
১৯২৯-এর মে মাসে আরউইন ব্রিটেনে গেলেন, তার আগে জিন্নার সঙ্গে তার একটি দীর্ঘ, ব্যক্তিগত কথােপকথন হল। সেই কথােপকথনের মধ্যে জিন্না তাকে প্রস্তাবিত বৈঠকের ব্যাপারে নিজের মতটি সবিস্তার জানালেন। ঠিক তার পরেই জিন্নার চিঠি গেল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ড-এর কাছে, তাতেও ডােমিনিয়ন মর্যাদা কেন দরকার, এবং একটি গােল টেবিল বৈঠক কতটা প্রয়ােজনীয়, সে কথাই ফের লিখলেন জিন্না। ১৯২৯-এর অক্টোবরে কেন্দ্রীয় আইনসভার বক্তৃতায় আরউইন এই দুটি বিষয়েই । কথা বললেন, জিন্না এবং তার অনুগামীরা যা চাইছিলেন, তা পূর্ণ হল। তখনও পর্যন্ত কোনও ভাইসরয় ভারতের জন্য এতটা করেননি, লর্ড আরউইন যা করে দেখালেন।
আরউইনের ঘােষণার উত্তরে জিন্না এ বার গােটা বিষয়টাকে একটা চ্যালেঞ্জ-এর মতােই নিলেন, কী করে বৈঠককে সফল করে তােলা যায়, সেটা যেন তার ব্যক্তিগত দায়িত্বের মতাে হয়ে দাড়াল; তিনি এই কাজটাকে নিজের একটা নৈতিক দায়িত্বের মতােই গ্রহণ করলেন। ইতিমধ্যে কংগ্রেস তাদের লিডারস ম্যানিফেস্টো’ প্রকাশ করেছে, যাতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ডােমিনিয়ন স্টেটাস কবে দেওয়া হবে, সেই দিনক্ষণ স্থির করার আশায় বৈঠকে বসে কোনও লাভ নেই, বরং ভারতের জন্য ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর একটা সাংবিধানিক রূপরেখা তৈরি করলেই কাজের কাজ হবে। স্পষ্টই বােঝা যাচ্ছে, অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রটাই আলাদা। প্রথম মতটি যেন ধরেই নিচ্ছে যে ডােমিনিয়ন স্টেটাস এসে গিয়েছে, ফলে ডােমিনিয়ন স্টেটাসকে একটা বাস্তবসম্মত রাস্তা ধরে নিয়ে সেখান থেকেই শুরু করার কথা বলা হচ্ছে। দ্বিতীয় মতটি আগেই একটি শর্ত রাখছে, ডােমিনিয়ন সংবিধান তৈরি করতে হবে। অর্থাৎ, এই দ্বিতীয় শিবির অনেক সাবধানে, আইনসিদ্ধ পথে মেপে এগােতে চাইছে, আগেই একটা ঢালাও সম্মতি দিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে খুঁটিনাটি বিষয়গুলি জেনে নেওয়ার চেষ্টা এখানে স্পষ্ট। কোন রাস্তাটি ভাল, সেই প্রশ্ন এখানে ততটা জরুরি নয়। বরং কোন পথে এগােলে ‘ঐক্য এবং স্বাধীনতা’র দ্বৈত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে, সেটাই ভেবে দেখা দরকার।
এ বার জিন্নার প্রথম কাজটি হল, গাঁধী এবং কংগ্রেসের সঙ্গে বিরােধ মিটিয়ে নেওয়া। ফলে, আরউইন ভারতে ফেরার ঠিক পরেই বম্বেতে জিন্না যখন তার সঙ্গে দেখা করলেন, বৈঠকের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা হল: কারা থাকবেন বৈঠকে, কবে হবে বৈঠক, এবং রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমাপ্রদর্শনের কী হবে তত দিনে কিন্তু জিন্নার সঙ্গে গাঁধীর প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষ যােগাযােগ তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই সময় থেকে শুরু করে ১৯২৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত জিন্না স্যর তেজবাহাদুর সঞ’র সঙ্গে অক্লান্ত ভাবে কাজ করলেন, যাতে ভাইসরয়ের সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের একটা বৈঠকে বসানাে যায়। শেষ পর্যন্ত ২৩ ডিসেম্বর বৈঠকটি হল। ভাইসরয় ছাড়াও সেখানে থাকলেন গাঁধী, মােতিলাল নেহরু, স্যর তেজবাহাদুর সঞ, বিঠলভাই পটেল এবং জিন্না। ভাইসরয়ের মনে হল, গাঁধী এবং মােতিলাল নেহরু নিছকই (তরুণ কংগ্রেসি নেতাদের!)
১৫৭
চাপে পড়ে বৈঠকে এসেছেন এবং আগে থেকেই কিছু আশ্বাস আদায় করবেন বলে ঠিক করে এসেছেন। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য, এই প্রতিশ্রুতিটুকু আদায় করা যে, ডােমিনিয়ন সংবিধানের রূপরেখা স্থির করাটাই এই বৈঠকের একমাত্র উদ্দেশ্য। আগেই খেয়াল করা হয়েছে যে, এটা একেবারে স্বভাবসিদ্ধ চাতুরি৷ বৈঠক যদি গােড়া থেকেই প্রস্তাবের খুঁটিনাটিতে চলে যায়, এমনকী প্রস্তাবের নীতিটুকু অনুমােদিত হওয়ার আগেই চলে যায়, তা হলে অনেক কূট বিষয়, যেমন যুক্তরাষ্ট্র বনাম কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা, সংরক্ষণ, কেন্দ্রীয় আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি উঠে এসে সমূহ প্রচেষ্টাটিই ভেস্তে দিতে পারে। এবং সে জন্য দায়িত্বভারও কংগ্রেসের থেকে অন্য দিকে সরে যাবে। কিন্তু এটা অনুমােদন করা ভাইসরয়ের ক্ষমতার মধ্যে ছিল না, তিনি কাজটা করতে চাইলেও ছিল না। ফলে, আলােচনা ব্যর্থ হল। সেই বৈঠকের স্মৃতিচারণ করে আরউইন লিখছেন: “গাঁধী এবং মােতিলাল’ যে মনােভাব নিয়েছিলেন, তাতে ‘স, জিন্না ও পটেল খােলাখুলিই বিরক্ত হয়েছিলেন।” বেছে নেওয়ার মতাে রাস্তাও আর বেশি রইল না।
খেয়াল করা দরকার, এ সবের মধ্যেই বেছে নেওয়ার রাস্তাগুলিও কিন্তু আগে থেকেই কিছুটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। কারণ, লাহৌরে ১৯২৯-এর শেষের দিকে কংগ্রেস ইতিমধ্যেই স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে, এবং মার্চে তারা ফের দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে। জিন্না ভয় পেলেন, এবং সঙ্গত কারণেই ভয় পেলেন যে, আন্দোলন/সত্যাগ্রহের এই রাস্তা এবং জবাবে ব্রিটিশদের দমনপীড়নের মধ্যে প্রার্থিত পথটিই বানচাল হয়ে যাবে। ফলে, তিনি ভাইসরয়ের কাছে আর্জি জানালেন, গােল টেবিল বৈঠকের দিন স্থির করা হােক, এবং তাতে আমন্ত্রিতদের তালিকাটি ‘তাকে দেখানাে হােক, সে ক্ষেত্রে যদি তার কিছু বলার থাকে, তিনি তা জানাতে পারবেন।[২৭]
এই পরিস্থিতিতে স্যর তেজবাহাদুর সঞ, এম আর জয়াকরের সঙ্গে যৌথ ভাবে কংগ্রেস এবং সরকারের মধ্যে শান্তি স্থাপনের আরও একটি চেষ্টা করলেন। তাঁরা পিতাপুত্র দুই নেহরুকেই গাঁধীর কাছে নিয়ে গেলেন, কারণ উভয়েই তখন আইন অমান্য আন্দোলনের কারণে আলাদা আলাদা কারাগারে বন্দি। সেই বৈঠকও নিস্ফলা হল, কারণ গাঁধীর মনে হল সময়টা তখন কোনও সম্মানজনক সমাধান আদায় করার পক্ষে অনুকূল নয়। ফলত, জিন্না ১৯ অগস্ট ১৯৩০ ভাইসরয়কে পরামর্শ দিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুন। এই মুহূর্তে জিন্না লন্ডনের দিকেই তাকিয়ে, এবং ১৯৩০-এর অগস্টের মাঝামাঝি তিনি ডক্টর মুহম্মদ ইকবালকে মুসলিম লিগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণও জানিয়ে ফেলেছেন, কারণ সেই অধিবেশন চলাকালীন তিনি লন্ডনে থাকবেন।
১৯৩০-এর শরতে লন্ডনে সেই বহু প্রতীক্ষিত গােল টেবিল বৈঠক ডাকা হল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বৈঠক সংবিধান প্রণয়ন করে একটা নয়া পর্ব শুরু করবে বলে ভাবা হল।। কৌতূহল (এবং গুরুত্ব) কেন্দ্রীভূত হল অন্য একটি প্রশ্নে: বৈঠকে ভারতের প্রতিনিধি
১৫৮
কারা হবেন, কে কী বলবেন, এবং কার পক্ষে বলবেন? মুসলিম কনফারেন্স-এর পক্ষে যােগ্য প্রতিনিধি কারা, তা বেছে নেওয়াটাই ফজলি হুসেনের নতুন কর্তব্য। বলতে গেলে নতুন চ্যালেঞ্জও হয়ে দাড়াল। যুক্তিযুক্ত ভাবেই ফজলি হুসেনের মনে হল, জিন্নার মতাে নেতারা, যাঁরা কেন্দ্রীয় স্তরে রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী, প্রাদেশিক মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ও অনিবার্য ভাবেই তাঁদের হাতে চলে যেতে পারে। ফজলি হুসেন প্রমাদ গুনলেন। স্যর ম্যালকম হেলিকে লিখলেন, “সত্যি বলছি, জিন্নাই একা সব কথা বলে। যাচ্ছেন, এবং এমন কিছু বলছেন, যা ভারতীয় মুসলিমদের অনুমােদিত বক্তব্য নয়, অথচ কারও ক্ষমতাও হচ্ছে না যে বাধা দেয়… এ রকম একটা দৃশ্য আমার মােটেও পছন্দ নয়। তখন জিন্না এবং মহম্মদ সফি ভারতের সুখ্যাত আইনজীবীদের অন্যতম। তারা উচ্চতম স্তরে রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক সম্বন্ধে যথেষ্ট পরিচিত, এবং নিঃসন্দেহে ভারতীয় মুসলিমদের উজ্জ্বল প্রতিনিধিও বটে— তা সত্ত্বেও কিন্তু এক জন ‘প্রাদেশিক’ ব্যক্তির প্রয়ােজন হল। পাল্টা ভারসাম্য রক্ষার জন্য ফজলি হুসেনের পছন্দের ব্যক্তিটি হলেন। যুক্ত প্রদেশের জাফরুল্লা খান এবং সাফাত আহমদ, এবং ছত্রী-র নবাব সাহেব।[২৮]
এত সবের পরেও ফজলি হুসেনের অস্বস্তি থেকেই গেল, কারণ সর্বভারতীয় স্তরে ছাড় এবং প্রাদেশিক ফায়দার মধ্যে একটি নিহিত বৈষম্য থেকে গিয়েছিল। এই দুই শিবিরের লােকেরাই আলাদা আলাদা ভাবে, এবং স্বাধীন ভাবে ভারত সরকারের কাছে নিজেদের বক্তব্য পেশ করেছেন, কিন্তু তাদের কখনও সম্মুখসংঘাত বাধেনি। কিন্তু লন্ডনে তাঁরা একই টেবিলে থাকবেন এবং নতুন একটি পক্ষ সালিশি করবেন, ব্রিটেনে লেবার পার্টির সরকার। তা ছাড়া সমঝােতার লক্ষ্যে সর্বভারতীয় স্তরের রাজনীতিবিদদের উপর চাপও ক্রমাগতই বাড়ছিল। তেজবাহাদুর সপ্রু এবং শ্রীনিবাস শাস্ত্রীর মতাে উদারপন্থী নেতারা দেখলেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বে অসহযােগ আন্দোলন যদি দীর্ঘকাল চলে, তা হলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ফলে, তারা কিছু একটা ইতিবাচক বন্দোবস্ত করে ভারতে ফেরার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, যা দেখিয়ে কংগ্রেসকে সাংবিধানিক আলােচনার রাস্তায় ফের টেনে আনা যায়। কেন্দ্রেও কিছুটা দায়িত্বভার অধিকার করাটাও ভারতীয় উদারপন্থীদের আর একটি লক্ষ্য ছিল, যার জন্য তারা ব্রিটিশ-ভারত এবং রাজন্যশাসিত রাজ্য নিয়ে একটা ফেডারেশন-এর কথা প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু, আবারও সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান ছাড়া এই লক্ষ্যে এগােনাে অসম্ভব ছিল, ফলে মুসলিমদের প্রতি তারা যথেষ্টই উদার ছিলেন। অন্য দিকে, জিন্না এবং মহম্মদ সফিও তখন জাতীয় স্তরের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে উন্মুখ। মােটামুটি ভাবে এই হল বৈঠকের গড়ন, যদিও এটাকে এখনও সম্পূর্ণ বলা যাচ্ছে না, কারণ আমরা এখনও রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির কথা আলােচনা করিনি। তবে, এই মুহূর্তে আমরা রাজন্যশাসিত ভারতের জটিলতার দিকে এগােব না।
জিন্না জাহাজে করে লন্ডন পাড়ি দিলেন ৪ অক্টোবর, ১৯৩০। গােল টেবিল বৈঠকের দিন ছিল ১২ নভেম্বর, ১৯৩০; মুসলিম প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচিত হলেন এইচ এইচ আগা খাঁ, তাদের কার্যকলাপের কেন্দ্র হল লন্ডনের রিৎজ হােটেল। বৈঠকের প্রথম
১৫৯
প্লেনারি অধিবেশন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন দিয়ে শুরু হল, সভাপতিত্ব করলেন মহামান্য রাজা পঞ্চম জর্জ। এইচ এইচ আগা খাঁ বৈঠকে উপস্থিত সমস্ত ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রতিনিধি, অর্থাৎ রাজন্যবর্গ বাদে সমস্ত ভারতীয় প্রতিনিধিদের সভাপতিও নিযুক্ত হলেন। সেন্ট জেমস প্রাসাদে বৈঠকের কাজ শুরু হল। প্রতিটি বড় দলই তাদের সুচিন্তিত, স্পষ্ট মতামত নিয়ে বৈঠকে এসেছে, যে যার নিজস্ব প্রতিনিধিত্বমূলক দাবিদাওয়াও এনেছে, যেগুলি পেশ করার পরে তাদের মধ্যে কী ভাবে সমন্বয় আনা যায়, সে ব্যাপারে চেষ্টাচরিত্র শুরু হবে। এই ভাবে, ব্রিটিশের কাছে একগুচ্ছ দাবি এবং পাল্টা দাবি এসে পৌঁছবে।
সুতরাং, একটা সম্মিলিত ফ্রন্ট গড়ে তােলাটা অনিবার্য ভাবেই প্রধান কর্তব্য ছিল। আর ব্রিটিশ-ভারতীয় প্রতিনিধি দলে মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে একটি সেতু গড়ে তােলাটাই ছিল সেই পথে এগনাের প্রথম ধাপ। যুক্তি ছিল, একমাত্র সেটা করা গেলে তখনই “ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের কাছে সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে একটি যৌথ প্রস্তাব পেশ করা সম্ভব।”[২৯] এই লক্ষ্যে যাঁরা উদ্যোগী হলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ভােপাল-এর নবাব সাহেব।” তিনি এবং আগা খাঁ ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করলেন, যেখানে কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতেই ন্যস্ত, রাজ্যগুলিও স্বশাসিত অধিকার এবং কার্যকলাপের স্বাধীনতা ভােগ করছে।
সেই বৈঠকে ছিলেন স্যর চিমনলাল সেতলবাদ, ‘রিকালেকশন অ্যান্ড রিফ্লেকশনস বইতে তিনি লিখেছেন, “গােল টেবিল বৈঠকের বেশ খানিকটা আগেই আমরা লন্ডন পৌঁছলাম। ঠিক হল, হিন্দু এবং মুসলিমদের তরফে কিছু প্রতিনিধি বৈঠকে বসে স্থির করবেন সাম্প্রদায়িক চুক্তির ব্যাপারে কি সিন্ধান্ত নেয়া যায়। হিন্দুদের পক্ষে সপ্রু,শাস্ত্রী, আমি, জয়াকর, মুঞ্জে এবং অম্বেডকর। মুসলিমদের তরফে ছিলেন আগা খাঁ, জিন্না এবং আরও কয়েকজন। প্রথম বৈঠকেই আমি আগা খাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, যদি অন্য সব বিষয়ে মােটামুটি একটা সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছনাে যায়, তা হলে কি তিনি যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি মেনে নেবেন? তিনি বললেন, যদি আপনারা আমাদের অন্য দাবিদাওয়াগুলাে মেনে নেন, তা হলে আমাদেরও যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীতে আপত্তি নেই, তবে মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করতে হবে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, যদি যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী-সমেত অন্য নানা বিষয়েই একটা সমঝােতায় আসা যায়, তা হলে কি মুসলিমরা বৈঠকে জাতীয়তাবাদের দাবি সমর্থন করবে? ওঁর জবাবটি ছিল স্বভাবসিদ্ধ, এবং সংক্ষিপ্ত: “সে ক্ষেত্রে আপনারা সামনে। থাকবেন, আমরা আপনাদের অনুসরণ করব।”
সপ্রু, শাস্ত্রী আপত্তি করেননি, বাদ সাধলেন জয়াকর এবং মুঞ্জে। স্যর চিমনলাল লিখছেন, এই ভাবে একটা সােনার সুযােগ হাতছাড়া হয়ে গেল। আগা খাঁ-র স্মৃতিতেও একই বক্তব্যের ছায়া। চিমনভাইয়ের স্মৃতিকথার উল্লেখ করে তিনি লিখছেন, “এই যে প্রথম গােল টেবিল বৈঠক প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হল, শেষ পর্যন্ত ডােমিনিয়ন স্টেটাসও এল না, ভারত ভাগের পথেই হাঁটতে হল, এই সব ঘটনার একটা বড় কারণ ছিল এই
১৬০
যে, হিন্দু প্রতিনিধিরা সে দিন আমার প্রস্তাব মানতে চাননি।” চিমনলাল সেতলবাদও তার স্মৃতিকথায় আগা খাঁর এই বক্তব্যকেই সমর্থন করেছেন। তার কিছু সহকর্মী বেঁকে বসলেন, হিন্দু মহাসভাও আপত্তি করল।
বৈঠকের আগে থেকেই ফেডারেশন নিয়ে জিন্না-সহ মুসলিম প্রতিনিধিরা অনেকেই সংশয়ে ছিলেন, বৈঠকের প্রথমেও তাদের সংশয় কাটেনি। এক দিকে নবীন গণতন্ত্র, অন্য দিকে কিছু দেশীয় রাজ্য, যেখানে রাজার নিজস্ব নীতিই শেষ কথা। এদের এক সঙ্গে জুড়ে দিলে কী হবে, তার ফল আদৌ ভাল হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় ছিলই। সঙ্গে অন্য একটি ভয়। দেশীয় রাজ্যের রাজারা অধিকাংশই হিন্দু। ফলে, ফেডারেশন-এ মুসলিমদের গুরুত্ব কমে যেতে পারে, সেই চিন্তাও তাদের মাথায় ছিল। আগা খাঁ অবশ্য নিঃসংশয় ছিলেন, সমস্যা যা-ই থাক, ভারতের সমস্যা মেটাতে হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির কোনও বিকল্প হতে পারে না। তার মত ছিল, এমন একটি সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে হলে প্রয়ােজনে কিছু আপসও করতে হবে, সেই সামান্য মূল্যটুকু দিতে তার আপত্তি ছিল না।
দেশীয় রাজারাও যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের সরকারের ক্ষেত্রে এক ধরনের আংশিক সম্মতি দিয়েছিলেন। এ বার যে-সব গ্যারান্টি চাওয়া হল, সেগুলি মােটামুটি এই রকম: এক, পঞ্জাব এবং বাংলায় কোনও আইনি পন্থা প্রয়ােগ করে মুসলিমদের সংখ্যালঘু করে দেওয়া হবে না। দুই, সিন্ধু প্রদেশকে বম্বের থেকে পৃথক করা হবে। তিন, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ-এর সংস্কারমূলক কাজকর্ম করা হবে। চার, সেনা এবং আমলার চাকরিতে মুসলিমদের জন্য কিছুটা বাধ্যতামূলক সংরক্ষণের বন্দোবস্ত থাকবে। এই সব ভাবনার পিছনে যুক্তি ছিল এই যে, এই ভাবে সব দিক থেকে আটঘাট বেঁধে এগােলে মুসলিম প্রতিনিধিরা ব্রিটিশের সামনে একটা ঐক্যের ছবি তুলে ধরতে পারবেন। আগা খাঁ প্রস্তাব করলেন, কোনও ভারতীয় নেতার নেতৃত্বে একটি ইউনাইটেড কম্যান্ড গঠন করা হােক, মুসলিমরা যাতে সেই কম্যান্ড’কে মেনে নেয়, তিনি তা দেখবেন।[৩১]
আগা খাঁ পরে লিখেছিলেন, “সে দিন যদি আমার প্রস্তাব মেনে নেওয়া হত… তা হলে পুরাে ইতিহাসটাই অন্য খাতে বইত, আর সে ক্ষেত্রে বহু দিন আগেই ভারতে একটা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার তৈরি হয়ে যেত, যাতে দেশের প্রাত্যহিক প্রশাসনে হিন্দু এবং মুসলিমরা পাশাপাশিই থাকতেন… আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল, আমরা যে ভাবে এগােচ্ছি, তাতে বড় মাপের কোনও সুফল মিলবে তাে? কারণ ১৯৩০ সালে ভারতের বাস্তব পরিস্থিতিটা হয়তাে সে ভাবে মাথায় রাখা হচ্ছিল না…সবার আগে এবং সর্বোপরি হিন্দু এবং মুসলিমদের মধ্যে যে মৌলিক কিছু ফারাক আছে, সেই কথাটাই ভুলে যাওয়া হয়েছিল। আরও একটা কথার দিকে কারও খেয়াল ছিল না। তা এই যে, এক দিকে ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব দিকের মুসলিম, অন্য দিকে বাকি অংশে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মধ্যে এই ফারাক সব থেকে বেশি… এ কথাও কারও মনে ছিল না যে, বুদ্ধিজীবীরা হিন্দু জনসংখ্যার মাত্র দশ শতাংশ হলেও সংখ্যায় কিন্তু তাঁরা চার থেকে পাঁচ কোটি, ফলে নিছকই ‘আণুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু’ বলে এদের উড়িয়ে
১৬১
দেওয়া যায় না; তখন এ কথাও ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে, এঁরা চান ব্রিটিশ তল্পিতল্পা গুটিয়ে চিরদিনের মতাে ভারত ছেড়ে চলে যাক; তারা এই লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করছিলেন এবং ১৯৪৭-এ সেই জিনিসটাই বাস্তবায়িত হয়েছিল… তা ছাড়া, যাবতীয় ধনসম্পদ, যােগ্যতা, সম্মান, অন্যকে মুগ্ধ করার মতাে ব্যক্তিত্ব এবং ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য সত্ত্বেও রাজন্যবর্গের ক্ষমতা এবং প্রভাব যে খুবই সীমিত, তা-ও অনেকেরই তখন মনে ছিল না।”[৩২]
এক দিকে নির্বাচকমণ্ডলীর গঠন, অন্য দিকে অবশিষ্ট বা রেসিডুয়ারি ক্ষমতা কী দাড়াবে তার হিসাব– সেই সব বিষয়ে যখন আলােচনা থমকে গেল, ১৯৩০-এর নভেম্বরে, তখন ভারতীয় উদারপন্থীরাও খুব কিছু একটা অগ্রগতি করে দেখাতে পারলেন না। যখন আলােচনা ফের শুরু হল, চুক্তির পথে প্রধান কাটা হয়ে দাড়াল পঞ্জাব। শিখ এবং হিন্দুরা কিছুতেই ‘পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মানতে প্রস্তুত নন, ফজলি হুসেনের মতে আবার ব্রিটিশদের পক্ষে সমস্যা তৈরি করছে। লেবার পার্টি, ভারতীয়দের শিবিরে গােল বাধাচ্ছেন জিন্না, ভােপালের নবাব, মহম্মদ সফি এবং ফজলুল হক। ফজলি হুসেনের সব থেকে বড় ভয়টা ছিল, যে, কেন্দ্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বার্থে মুসলিমরা পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি ছেড়ে দেবে। ভাইসরয়কে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, যদি যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর ভিত্তিতে কোনও আলােচনা হয়, তাতে ভারতীয় তাতে ভারতীয় মুসলিমদের আদৌ কোনও সায় নেই। তার আরও আক্ষেপ, লেবার পার্টির সরকার চায় না মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হােক। এই সময় আরও দুটো কথা ক্রমে সুকৌশলে চাউর হল। এক, গােল টেবিল বৈঠকে পঞ্জাবি মুসলিমদের প্রতিনিধি মহম্মদ সফি এবং জাফরুল্লা খাঁ শিখ-প্রধান অঞ্চল থেকে এসেছেন; ফলে হিন্দু এবং শিখদের সমর্থন না-পেলে সফির বক্তব্য বিপুল ভাবেই খণ্ডিত হবে। আর, শিয়ালকোটের আইনজীবী জাফরুল্লা তাে ‘আহমদিয়া’, ফলে যথার্থ মুসলিমই নন। শেষ ইঙ্গিতটি ছিল খুবই বিষাক্ত। এই ধরনের ভাবনাচিন্তা উত্তর ভারতীয় মুসলিমদের উপরে যথেষ্ট ছায়া ফেলেছিল এবং পরে এর নানাবিধ বিরূপ প্রতিক্রিয়াও দেখা দিয়েছিল।
ফজলি হুসেনের প্রয়াস সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতির মেরুকরণের জন্যই বৈঠক থেকে ইতিবাচক কোনও ফল পাওয়া গেল না। আরও বােঝা গেল যে, রাজন্যবর্গ এবং রাজনীতিবিদের লক্ষ্যও আলাদা।।
বৈঠকের উন্মুক্ত অধিবেশনে জিন্না আরও সক্রিয় হওয়ার ডাক দিয়ে বললেন, “ডােমিনিয়নের প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিনিধিদের সামনে এসে ভাল লাগছে। ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস-এর মধ্যে যে নতুন ভারতীয় ডােমিনিয়নটি এ বার পায়ে পা মিলিয়ে চলবে, তারই জন্মলগ্নের সাক্ষী হওয়ার জন্য এঁরা সবাই যে এখানে এসেছেন, তা দেখে ভাল লাগছে।”[৩৩] পঞ্জাব এবং যুক্ত প্রদেশের প্রাক্তন গভর্নর ম্যালকম হেলি সম্মেলনে আগত মুসলিম প্রতিনিধিদের বিষয়ে লর্ড আরউইনকে লিখলেন, “আগা খাঁ ওদের তেমন কোনও নেতৃত্ব দিতে পারেননি, কিন্তু নিজেই কবুল করেছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মত যে দিকে যাবে, উনি সে দিকেই থাকবেন। লােকজন জিন্নাকে বিশেষ
১৬২
একটা বিশ্বাস করছে না; বৈঠকের সূচনায় তিনি যা বললেন, তাতে দলের অনুমােদন ছিল না, ফলে পরিণামটাও একটু তিক্ত হল। বৈঠকের সচিবালয়ের কাছে অন্য সবাই যেমন বক্তৃতার কপি আগে জমা দিচ্ছিলেন, তিনি সেটা করতে রাজি হলেন না। তবে জিন্না তাে বরাবরই ওস্তাদ খেলােয়াড়, আর ওঁরই পূর্বপুরুষেরা বম্বেতে যে বাণ মাছের ব্যবসা করতেন, জিন্না সেই বাণ মাছের মতােই পিচ্ছিল।”[৩৪]
বল্ডউইনের টোরি সরকারে, ১৯২২ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত, ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিদেশসচিব ছিলেন লর্ড পিল। বৈঠকে তিনিই ছিলেন রক্ষণশীল দলের নেতা। তাকেই জিন্না খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, সাইমন কমিশন-এর রিপাের্ট ‘মৃত’।[৩৫] এমনকী, জিন্না যে ফেডারেল স্ট্রাকচার কমিটিতে ছিলেন, সেখানেও তিনি সাফ জানিয়েছিলেন যে, মুসলিম এবং অন্য সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তার বােধ তৈরি হবে, এমন কোনও বন্দোবস্ত যদি করা না-হয়, তা হলে কোনও সংবিধানই কার্যকর করা যাবে না।
প্রথম গােল টেবিল বৈঠক থেকে জিন্নার ভিতরের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব বেরিয়ে এসেছিল, এবং ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান-এর পর্যবেক্ষণে তা ধরাও পড়েছিল স্পষ্ট: “গােল টেবিল বৈঠকে মিস্টার জিন্নার অবস্থানটি ছিল বিচিত্র। হিন্দুরা ভাবতেন যে তিনি সাম্প্রদায়িক মুসলিম, মুসলিমরা তাকে হিন্দু-পন্থী ভাবতেন, দেশীয় রাজারা ভাবতেন তিনি বড় বেশি গণতান্ত্রিক। ব্রিটিশদের মতে তিনি আবার ঘাের চরমপন্থী, ফলে তিনি সর্বত্রই আছেন, আবার কোথাওই নেই। কেউই তঁাকে চায় না।”[৩৬]
বহুকাল পরে, লাহােরে, ১৯৩৬-এর ২ মার্চ একটি জনসভায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন জিন্না, তাতে এই বৈঠকের কথা ফিরে দেখেছেন তিনি: “আমি মুসলিমদের চটিয়েছিলাম। হিন্দু বন্ধুরাও ‘বিখ্যাত’ চোদ্দো দফার ফলে খুশি হয়নি। রাজন্যবর্গের লুকোনাে, অসৎ ক্রিয়াকলাপের প্রবল বিরােধিতা করেছিলাম, ফলে তারাও খেপে গিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টও আমার উপর খুশি হয়নি, কারণ আমি গােড়া থেকেই জানতাম, বলেওছিলাম যে ওরা আদ্যন্ত ধাপ্পাবাজ, ফলে এদের বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিলাম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখলাম যে, আমার চারপাশে কোনও বন্ধু নেই।”[৩৭]
গাঁধী-আরউইন চুক্তি
ঠিক কী ভাবে বৈঠক শেষ হল, সে প্রশ্ন আলাদা, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্তে তাে পৌছতে হবে, কিছু ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ইঙ্গিত তাে দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ড ঘােষণা করলেন, কেন্দ্রীয় স্তরে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচে আইনসভা গঠিত হলে সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে প্রস্তুত। ভারতের উদারপন্থী নেতারা তৎক্ষণাৎ এই ঘােষণাটিকে নিজেদের দরকষাকষির হাতিয়ার করে ফেললেন। এতে সাম্প্রদায়িক
১৬৩
সমস্যা মেটার কোনও আশা ছিল না, কারণ সংবিধান রচনার কাজে কংগ্রেস যদি মুসলিম লিগের সঙ্গে একজোট হয়ে উদ্যোগী না হয়, তা হলে সেই সংকটের সমাধান বেরােবে কী করে? যা-ই হােক, পরিস্থিতির সাপেক্ষে কংগ্রেসকে একটু উৎসাহ দেওয়ার জন্য ভারত সরকার কংগ্রেসের কিছু শীর্ষ নেতাকে মুক্তি দিলেন। পরিণামে, গাঁধী এবং লর্ড আরউইন-এর মধ্যে প্রথমে আলােচনা, পরে ৫ মার্চ ১৯৩১ তারিখে দিল্লি চুক্তি সম্পাদিত হল। এই চুক্তি অনুযায়ী সরকার অর্ডিন্যান্স-এর মাধ্যমে আইন জারি স্থগিত রাখল, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতেও রাজি হল। বিনিময়ে তিনটি জিনিস মেনে নিল। এক, সমস্ত রকম অসহযােগ আন্দোলন তুলে নেওয়া হবে। দুই, ডােমিনিয়ন স্টেটাসকেই লক্ষ্য হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে। তিন, কংগ্রেস দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দেবে।
এই চুক্তি সম্পাদনের সময় মনে হয়েছিল, সরকার যতটা দিতে চেয়েছিল, কংগ্রেস তার চেয়ে অনেকটা বেশিই পেয়ে গেল। এ ছাড়া, গ্রামভারতে আর একটা বার্তা, বলা যায় অনভিপ্রেত বার্তাই, পৌছে গেল যে, কংগ্রেসের বিরাট জয় হয়েছে, রাম রাজ্য আর বেশি দূরে নয়। অসহযােগ আন্দোলন প্রত্যাহার করায় পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সরকার দমনমূলক নীতি স্থগিত রাখায় কংগ্রেসও প্রভাব বিস্তার করার একটা সুযােগ পেল। ১০ মার্চ জওহরলাল নেহরু ঘােষণা করলেন, “এটা সাময়িক যুদ্ধবিরতি মাত্র, চূড়ান্ত শান্তি নয়।”[৪০] এলাহাবাদের কালেক্টর আক্ষেপ করেছেন, চুক্তি সম্পাদনের আগে পর্যন্ত ক্রমে অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল, কর দেওয়াও শুরু হয়েছিল, তার পরেই চুক্তির প্রভাবে সব কিছু ফের গােলমাল হয়ে গেল।
অন্য দিকে, বিশেষ করে মুসলিম কনফারেন্স, এবং সামগ্রিক ভাবেই মুসলিমদের একটা অস্পষ্ট ধারণা হল যে, তারা ‘বঞ্চিত হয়েছে। এই সময়েই ইউনাইটেড প্রভিন্স-এ রক্তক্ষয়ী কিছু দাঙ্গা সেই ক্ষোভে আরও ইন্ধন জোগাল। পরিণামে, এই প্রথম মুসলিমরা দাবি তুলল যে, ধর্মীয় ব্যাপারে তাদের নিজস্ব শরিয়তি বিধি ছাড়া অন্য কোনও আইন তারা মানতে বাধ্য থাকবে না, এবং কোনও সরকারই কোনও রকম আইন করে এই বন্দোবস্তের কোনও ব্যত্যয় ঘটাতে পারবে না। এই দাবি থেকে দুটো জিনিস বেরিয়ে আসে। প্রথমত, সংখ্যালঘু মুসলিমদের মনে কতটা উদ্বেগ জমা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ধর্ম কী ভাবে আরও বেশি করে রাজনীতির বৃত্তে ঢুকে পড়ছে। এ সবের পাশাপাশি ছিল, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি। এর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন ফিরােজ খান নুন-এর তরফে উত্থাপিত— যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে নয়— একটি উদ্ভট দাবি, ব্রিটিশরা ক্ষমতা
চন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাদের বরং প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণেই রাখা হােক। তঁার আশঙ্কা ছিল, কেন্দ্রে হয়তাে সংখ্যাগুরু হিন্দুরাই ক্ষমতায় থাকবে, সে ক্ষেত্রে দাঙ্গা বাধলে কেন্দ্রের অধীন সেনা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে। পঞ্জাবের মুসলিমরা এবং ইউনিয়নিস্ট পার্টিও ভয় পেল এই ভেবে যে, তাদের প্রাদেশিক রাজনৈতিক স্বার্থে ঘা লাগবে, পাশাপাশি সেনাবাহিনীতে তাদের যে আধিপত্য ছিল, নয়া বন্দোবস্তে তাও ক্ষুন্ন হতে পারে।
১৬৪
এ দিকে, সরকার যেমন কংগ্রেসের দিকে সমঝােতার হাত বাড়ানাে শুরু করেছিল, একই ভাবে কংগ্রেসও মুসলিমদের সঙ্গে সমঝােতার রাস্তা খুঁজতে চাইল। দিল্লি চুক্তিতেই স্থির হয়েছিল, কংগ্রেস দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকে যােগ দেবে। গাঁধী দেখলেন, সেই বৈঠকে তিনি যদি ঐক্যবদ্ধ ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে যেতে না পারেন, তা হলে কোনও লাভ নেই, ফলে তিনি বলতে শুরু করলেন, লন্ডন যাওয়ার আগে সাম্প্রদায়িক সমস্যা বিষয়ে একটা সমাধানে আসাই শ্রেয়। অবশ্য কংগ্রেস এই বক্তব্য কত দূর অনুমােদন করবে, সে ব্যাপারে গাঁধী নিজেই সংশয়ে ছিলেন কি না, তেমন একটা সন্দেহ উঠতেই পারে, কারণ গােটা অসহযােগ আন্দোলনটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, দুই সম্প্রদায়ের তরফে একজোট হয়ে দাবি পেশ করা কার্যত অসম্ভব। যা-ই হােক, গাঁধী ১৯৩১-এর এপ্রিল মাসে মুসলিম নেতাদের সঙ্গে কথা শুরু করলেন, দ্রুত সেই আলােচনা, লন্ডনেরই মতাে, আলাদা নির্বাচকমণ্ডলীর প্রশ্নে ফের নিষ্ফলা জায়গায় এসে দাড়াল। কংগ্রেসের ভিতরে মতপার্থক্য, তার সঙ্গে কংগ্রেস জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ দুয়ে মিলে গাঁধীর প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিল।
১৯৩১-এর মে মাস নাগাদ গাঁধী প্রস্তাব করলেন, লর্ড আরউইন-ই বরং দুই সম্প্রদায়ের ভিতরে সালিশির কাজ করুন। গাঁধী অবশ্য সারাক্ষণই কংগ্রেসের দাবিকেই সারা ভারতের বক্তব্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন, যদিও তিনি কখনওই চাননি, কংগ্রেস সমঝােতার জন্য কোনও আলােচনায় জড়িয়ে পড়ুক। সেটাই ছিল আসল। সমস্যা। কারণ, কংগ্রেস যদি আলােচনার দরজা বন্ধ করে দেয়, তা হলে লন্ডনে তাদের অবস্থান ক্ষুন্ন হবে। আর, যদি আলােচনায় বসে, তা হলে দেশের জনসমর্থনে ফাটল ধরবে।
সন্দেহ নেই, মুসলিম কনফারেন্স-এ যেমন, তেমনই কংগ্রেসের ভিতরে মুসলিম নেতারাও সমঝােতা চাইছিলেন। কনফারেন্স-এর খিলাফতপন্থী মুসলিম, বা পঞ্জাবের নাগরিক সংবিধানপন্থীরাও কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝােতায় নারাজ ছিলেন না। মহম্মদ সফির ওকালতিতে ইউনিয়নিস্ট পার্টি ক্ষুব্ধ হয়েছিল। বিশের দশকে পঞ্জাবে ইউনিয়নিস্টদের উত্থানে সমঝােতাকামীদের কোনও সুবিধাই হয়নি। এমনকী, কাশ্মীরি বংশােদ্ভূত নাগরিক মুসলিম জনপ্রিয় কবি ইকবালও সমঝােতার খুব একটা বিপক্ষে ছিলেন না, যদিও মহম্মদ সফির উপরে না থাকলেও তার উপরে ফজলি হুসেনের প্রভাব ছিল যথেষ্ট, ফলে পরবর্তী আলাপ-আলােচনায় ইকবাল-এর একটা বড় ভূমিকা ছিল।
কংগ্রেসের ভিতরে মুসলিমরাও ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বার্থে মনেপ্রাণে সমঝােতা চাইছিলেন। আনসারি, খালেকুজ্জামান বা শেরওয়ানির মতাে নেতার পক্ষে আলি ভাইদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করে চলা যথেষ্টই কঠিন ছিল। তারাও কিন্তু কংগ্রেসের লাহৌর অধিবেশন-এর পরে হতাশ হয়ে দেখলেন যে, ১৯২৮এর নেহরু রিপাের্ট-এর মেয়াদ ফুরিয়ে গেল, কাজের কাজ কিছুই হল না, বরং স্থির হল। যে পূর্ণ স্বরাজ’-এর লক্ষ্যে অসহযােগ আন্দোলন চলবে, সেই আন্দোলনে মুসলিমদের ভুমিকা ক্ষীণ এবং আন্দোলন চলাকালীন সাম্প্রদায়িক সমঝােতার কথাবার্তা চলার
১৬৫
সম্ভাবনাও নেই বললেই চলে। ফলে, ১৯৩০-এর গােড়াতেই আনসারি, খালেকুজ্জামান এবং শেরওয়ানি কংগ্রেসের সমস্ত পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে চার আনা’র নামমাত্র সদস্য থাকলেন। শেরওয়ানি, এমনকী মুসলিম লিগের সঙ্গেও কথাবার্তা শুরু করলেন, যদিও ভিতরে ভিতরে কংগ্রেসকে সমঝােতার রাস্তায় আনার চেষ্টাও জারি ছিল। কংগ্রেসের এই সব মুসলিম নেতা গাঁধী-আরউইন চুক্তির পরে নতুন করে আশার আলাে দেখলেন।
কংগ্রেসের মুসলিম নেতারা সমঝােতা চাইলেও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী এবং প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠা উচিত, সেই দাবি থেকে সরেননি। সেই মতাে সমস্ত মুসলিম সংগঠনের একটি গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব উঠল। মুসলিম কনফারেন্স এই বৈঠক চায়নি, ফজলি হুসেন এমন কোনও উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে জড়াতেই চাননি, যা থেকে মনে হতে পারে, কনফারেন্স যে। সব দাবি তুলেছে, সে বিষয়ে আদৌ কোনও আলােচনা চলতে পারে। তার বারণ সত্ত্বেও ইকবাল, সফি, শওকত আলি এবং আরও কিছু নেতা জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের সঙ্গে বৈঠক করলেন, কিন্তু তাতে বিশেষ ফল হল না। এ রকমই একটা বৈঠক থেকে, ১৯ জুন ১৯৩১ ফজলি হুসেনের পছন্দসই একটি সমাধানসূত্র হিসাবে বলা হল, মুসলিম সংখ্যালঘু প্রদেশে ‘ওয়েটেজ’-এর দাবি, এবং পঞ্জাব আর বাংলায় মুসলিমরাই যে সংখ্যাগুরু, সেই স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি বহাল থাকছে, কিন্তু যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী এবং প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকার মানা হবে না। স্বাভাবিক, এর পরে জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের সঙ্গে আলােচনার আর কোনও অর্থ থাকল না।
এই গােটা পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই গাঁধী-আরউইন চুক্তির গুরুত্ব বিচার করতে হবে। অসহযােগ আন্দোলনের তুমুল উত্তেজনার ঠিক পরেই এই চুক্তি বিশেষ সাড়া জাগায়নি বটে, কিন্তু স্বয়ং ভাইসরয় কংগ্রেসের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, এই ঘটনাটি কংগ্রেসের নিচুতলায় একটা ভ্রান্তিবিলাস জাগিয়ে তুলেছিল যে, যেন বিরাট একটা জয় করায়ত্ত হয়েছে। ব্রিটিশ রাজ-এর সঙ্গে সহযােগিতার কোনও মনােভাব কিন্তু এই চুক্তি থেকে গড়ে ওঠেনি।
গাঁধী ফের গােল টেবিল বৈঠকে বসবেন কি না, সেই বিষয়টি একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনিশ্চিত থাকায় এক দিকে উদ্বেগ, আর এক দিকে বিপুল জল্পনা তৈরি হল। তালিকাটি মােটামুটি এই রকম: নিশ্চয়ই কোনও সমস্যা হয়েছে; গাঁধী নিজেই ‘নৈতিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলেন; সরকারি কর্তারা চুক্তিভঙ্গ করেছেন; সর্বাগ্রে হিন্দুমুসলিম সমস্যার সমাধান করতে হবে, তার পর কথা; গাঁধীর ‘হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে (যা কিনা প্রায়শই হত), এবং সব থেকে মারাত্মক শঙ্কাটি ছিল, ব্রিটিশরা মত পাল্টে ফেলেছে। গাঁধী তাে নিজেই এক বার ঘােষণা করেছিলেন, “বিবেক’-এর তাড়নায় তিনি এই সংগ্রামে এই সাময়িক বিরতি রদ করবেন। পাশাপাশি আর একটি ঘটনা ঘটল। বিপুল এবং অবাস্তব প্রত্যাশা বাস্তবের জমিতে আছড়ে পড়লে যা হয় তা-ই হল, ক্রমে গাঁধী-আরউইন চুক্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস কমে এল, কংগ্রেসের নীতি নিয়েও জনগণ প্রশ্ন
১৬৬
তােলা শুরু করল। গাঁধী স্থানীয় আধিকারিকদের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের অভিযােগ তুলে একটি ‘চার্জ শিট পাঠিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তত দিনে ভাইসরয় পদে আরউইনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন উইলিংডন, জবাবে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, সরকারি কাজকর্মে কারও হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল, গাঁধী এবং উইলিংডন-এর মধ্যে উদ্বিগ্ন কথাবার্তা শুরু হল। এ দিকে, লন্ডনে গােল টেবিল বৈঠকের জন্য ভারতীয় প্রতিনিধি দলের রওনা হওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। ইংল্যান্ডের জাহাজ ধরার জন্য বম্বে যেতে হবে, কিন্তু বম্বে যাওয়ার শেষ ট্রেনও ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। সময় প্রায় পেরিয়ে যায় যায়, এ রকম একটা অবস্থায় স্নায়ু যখন টানটান, গাঁধী আচমকা ঘােষণা করলেন, তিনি উইলিংডন-এর প্রস্তাবে রাজি। একটি বিশেষ ট্রেন অপেক্ষায় ছিল, তাতে চড়েই তড়িঘড়ি বম্বের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন তিনি। লর্ড উইলিংডন কিন্তু তার মূল বক্তব্য থেকে এক চুলও সরেননি, সরকারের স্বার্থও বিন্দুমাত্র বিসর্জন দেননি। তা হলে, গাঁধীর লাভটা কী হল ?
দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠক: পরিপ্রেক্ষিত
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি হঠাৎই টালমাটাল হয়ে পড়ল। বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার প্রভাবে বিশ্বের বৃহত্তম দু’টি অর্থনীতি মার্কিন এবং ব্রিটিশ অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়ল। গােল্ড স্ট্যান্ডার্ড-এ ধস নামল প্রথমে ব্রিটেনে, পরে আমেরিকায়। বেকারিত্ব ভয়াবহ আকার নিল। ১৯৩১-এর ২৪ অগস্ট ব্রিটেনে ম্যাকডােনাল্ড-এর সরকার ইস্তফা দিল। তখন তিনি রক্ষণশীল, উদারপন্থী এবং শ্রমিক দলকে নিয়ে একটি জাতীয় জোট সরকার গড়লেন, দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকের মাঝ পথে, মােটামুটি তিন ভাগের। দু’ভাগ তখন সারা, ২৭ অক্টোবর সেই সরকারও পদত্যাগ করল, ফলে নতুন করে। নির্বাচন ছাড়া আর কোনও পথ থাকল না। ভােটে ম্যাকডােনাল্ড-এর জোটই ক্ষমতায় এল, নতুন সরকারে মুখ্য ভূমিকায় থাকল রক্ষণশীল গােষ্ঠী, এবং সেই সরকারের ভারতীয় দাবিদাওয়ার প্রতি কোনও সহানুভূতি নেই, বরং এক অর্থে তারা ভারতীয়দের স্বশাসনের দাবির প্রতি বিরূপ মনােভাবাপন্নই বলা চলে। ১৯৩৫-এর জুন মাসে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সেই সরকারই বহাল থাকল।
আর্থিক মন্দার গ্রাস থেকে বেরােতে না বেরােতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। ১৯৩৯-এর সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ থেকেই ‘এন্ডগেম’ শুরু হল বলা চলে, যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭-এ দেশভাগ এবং স্বাধীনতা। সব মিলিয়ে, দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকের সময়টা ছিল খুবই খারাপ। এই পরিস্থিতিতে, স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের সংবিধান নিয়ে কথাবার্তা খুব একটা গুরুত্ব পেল না, ফলে গােটা বৈঠকটাই খুব উদ্দেশ্যহীন ভাবে এলােমেলাে হয়ে পড়ল, মুসলিম প্রতিনিধিরা তাে
১৬৭
একটা সময় ‘ওয়াক আউট’-এর হুমকিও দিলেন। শেষটায় তাদের বুঝিয়েসুজিয়ে রাখা গেল বটে, কিন্তু তারা স্রেফ দর্শকের ভূমিকায় থাকলেন। এই রকম একটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে বৈঠক অবশ্য চলল, অনিয়মিত ভাবে, প্রক্রিয়াগত কিছু খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখাটাই বিভিন্ন কমিটির কাজ হয়ে দাড়াল। এ ভাবে আর যা-ই হােক, ভারতের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। টানা বেশ কয়েক দিন ধরে বৈঠকের ‘ওপন সেশন’ ডাকাই যাচ্ছিল না, শেষে যখন ডাকা হল, ঘটনাচক্রে সে দিন আবার গাঁধীর মৌনাবলম্বনের দিন। তারিখ ৩০ নভেম্বর, ১৯৩১। সারা দিন ধরে যাঁরা কথা বললেন, তারা কেউই সাংবিধানিক জট কী ভাবে খুলবে, সে ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু বলতে পারলেন না। মধ্যরাত পেরিয়ে গাঁধী যখন মুখ খুললেন, তার কাছ থেকেও, এক ভাষ্যকারের কথা অনুযায়ী, রাইটিয়াস বিটারনেস’ ছাড়া আর তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। স্পষ্ট বােঝা গেল, কংগ্রেস শীঘ্রই ফের অসহযােগ আন্দোলনের রাস্তায় ফিরে যাবে।
যা-ই হােক, গােড়াতেই গাঁধী যখন আলি ইমান এবং এম এ আনসারিকে কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, তখন থেকেই মুসলিম কনফারেন্স-এর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক, মুসলিম কনফারেন্স এতে প্রমাদ গুনল। তাদের মনে হয়েছিল, কনফারেন্সই যে মুসলমানদের সার্বিক প্রতিনিধি, সেই মৌলিক প্রস্তাবনাটিতেই গাঁধী আঘাত করতে চাইছেন। এই সব অর্থহীন মতবিরােধের ফল হল এই যে, ফজলি হুসেন আনসারিকে কংগ্রেস থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রয়ােজনীয় মওকাটি পেয়ে গেলেন। এই গােলটেবিল বৈঠক থেকেও বিস্ময়কর কিছু বেরােল না। সাম্প্রদায়িক বিষয়ে গাঁধী কোনও আলােচনাই করবেন না, স্রেফ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকতে পারেন, তার বেশি কিছু নয়— এ রকম একটা অবস্থান তৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি ১৯৩০ সালে যা ছিল, কার্যত তা-ই থাকল, বিশেষ কিছু উন্নতি হল না। আগের মতােই, ভারতের উদারপন্থীরা দেখলেন যে, মুসলিম প্রতিনিধিরা আলােচনায় প্রস্তুত, কিন্তু আবারও সার্বিক মতৈক্যের পথে কাটা হয়ে দাড়াল পঞ্জাব। কোনও ভাবেই তাদের কিছু বােঝানাে গেল না।
১৯৩১-এর নভেম্বরে কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে লন্ডনে পৌছলেন গাঁধী, সঙ্গে সরােজিনী নাইডু। সেই সফরে গাঁধীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের বিবরণ দিয়ে আগা খাঁ লিখছেন: “আমরাও দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকে যােগদানকারী প্রতিনিধি, সেই হিসাবেই কথা হল, মধ্যরাতে, আমারই ঘরে, রিৎজ হােটেলে। প্রেসের আলােকচিত্রীদের জন্য একসঙ্গে ছবি তুললাম আমরা, তার পরে কথা শুরু হল। প্রথমেই আমি বললাম, মহাত্মাজি, আপনি যদি এই মুহূর্তে ভারতের মুসলিমদের প্রকৃত পিতার ভূমিকায় দেখা দেন, তা হলে মুসলিমরাও ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে আপনার আন্দোলনে যথাসাধ্য সহযােগিতা করবে। শুনে মহাত্মাজি আমার দিকে ফিরলেন, বললেন, সত্যি বলতে কী, মুসলিমদের প্রতি আমার যে কোনও পিতৃত্বের অনুভূতি আছে, তা কিন্তু নয়। তবে, আপনি যদি গােটা বিষয়টাকে রাজনৈতিক প্রয়ােজনীয়তার দিক থেকে দেখতে চান, তা হলে আমি আলােচনায় তৈরি। আমি এ বিষয়ে কোনও রকম সেন্টিমেন্ট-এ জড়াতে চাই না।”
১৬৮
এই মন্তব্যকে গাঁধীর স্বভাবসিদ্ধ দুষ্টুমি, বা হয়তাে পরিহাস বলেও ধরে নেওয়া যেত, কিন্তু আলােচনার গােড়াতেই ওই মন্তব্য গােটা বিষয়টার মধ্যেই ঠান্ডা জল ঢেলে দিল। এমন একটা শীতল আবহাওয়া তৈরি হল, আগা খাঁ লিখছেন, “যা আমাদের বাকি কথাবার্তার মধ্যেও ছায়া ফেলল। আমার মনে হল, আমি যখন সত্যিকার একটি মানসিক নৈকট্য, এবং আত্মীয়তার স্পষ্ট প্রমাণ দিলাম, মহাত্মাজির তরফে তেমন কোনও সাড়াই এল না।” আগা খাঁ লিখছেন, “বেশ কয়েক বছর পরে, ১৯৪০-এ আমি যখন তাকে ওই ঘটনাটির কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম, তিনি বললেন, সবটাই তার স্পষ্ট মনে আছে। আরও বললেন, আমি খুবই দুঃখিত যে সে দিন আপনারা আমার কথাটি ভুল ভাবে নিয়েছিলেন। মুসলিমদের সঙ্গে আমার কোনও মানসিক যােগ নেই, তঁাদের কল্যাণের জন্য কোনও ভাবনাচিন্তা নেই, আমি মােটেই তা বলতে চাইনি। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম যে, মুসলিমদের সঙ্গে সম্পূর্ণ ভ্রাতৃবােধে আমার আস্থা আছে, তবে পিতৃত্বের প্রসঙ্গটা এলেই যে একটা সুপিরিয়রিটি, একটা উচ্চতর অবস্থানের কথা চলে আসে, তাতে আমি বিশ্বাস করি না।”
আগা খাঁ লিখছেন, “আর, আমি শুধুমাত্র তাঁর বয়সােচিত অশক্ত অবস্থার প্রতি সম্মান জানিয়ে ‘পিতা’ শব্দটি বলেছিলাম। অবশ্যই তার শারীরিক বা মানসিক দুর্বলতার কথা বলতে চাইনি, শুধু তার বৃদ্ধ বয়সের প্রতি সম্মানবশতই কথাটি বলা, সেই সূত্রে কোনও রকম উচ্চতর অবস্থানের কথা মাথাতেই আসেনি।”
শব্দের ব্যবহার নিয়ে গােড়াতেই যে এই দুর্ভাগ্যজনক ভুল বােঝাবুঝি, তার রেশ শুধু সেই রাতেই নয়, গােটা গােল টেবিল বৈঠকেই থেকে গেল। এ রকম একটা ধারণা তৈরি হল যে, আগা খাঁ লিখছেন, “মুসলিম-হিন্দু বােঝাপড়ায় পৌঁছনাের জন্য আমাদের যত চেষ্টা, সবই যেন নিছক রাজনৈতিক কৌশল, তার গভীরে পারস্পরিক সভ্যতা এবং সংস্কৃতির প্রতি কোনও শ্রদ্ধা নেই, দীর্ঘকাল সহ-নাগরিক থাকার কোনও মানসিক বন্ধন নেই। এর ফলে, আমাদের পক্ষে যেটুকু বােঝাপড়া হয়তাে অর্জন করা সম্ভব ছিল, সেটুকুও আর আন্তরিক থাকল না; আমরা সেই শীতল রাজনৈতিক বুলি কপচানিতে ফিরে গেলাম, আলােচনাটাকে প্রাণ দিতে পারে, এমন কোনও মানসিক বােঝাপড়া আর থামল না।” তার এই বক্তব্য যথাযথ। দুঃখজনক, কিন্তু যথাযথ।
দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকের মূল পর্ব প্রসঙ্গে আগা খাঁ লিখছেন: (এগুলি তার স্মৃতিকথার অংশ, ফলে একান্তই তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ। আমি এগুলি উদ্ধৃতি করছি, কারণ এখান থেকে বৈঠক সম্পর্কে এবং বৈঠকের সময় কী ঘটেছিল সে বিষয়ে একটা অনুপুঙ্খ ধারণা পাওয়া যাবে)
প্রাথমিক কথাবার্তা থেকে খুব কিছু একটা লাভ হল না। তার পরে, প্রত্যহ মাঝরাতের দিকে, আমারই ঘরে বেশ কয়েক দফা আলােচনা। চলল। সাধারণত আমিই আয়ােজক হিসাবে সভাপতিত্ব করতাম, কথা
১৬৯
বলতেন এক দিকে মিস্টার জিন্না এবং স্যর মহম্মদ সফি, অন্য দিকে মহাত্মা গাঁধী। আনুষ্ঠানিক আলােচনা নয়, কোনও রেকর্ডও রাখা হত না । আমি নিজে বলতাম খুবই কম, আমাদের তরফে আলােচনাটা মূলত মিস্টার জিন্না এবং স্যর মহম্মদ সফি-ই চালাতেন, মাঝে মাঝে আরও কয়েক জন প্রতিনিধি যােগ দিতেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য স্যর জাফরুল্লা খান, মিস্টার শওকত আলি এবং সাফাত আলি খান… আলােচনাটা সব সময়েই কয়েকটি মৌলিক পার্থক্যের জায়গায় চলে যেত: ভারত কি একটা নেশন, না দু’টি নেশন? ইসলাম কি নিছকই একটা ধর্মীয় সংখ্যালঘু জাতি, নাকি মুসলিমরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে তাদের বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্ব এবং দায়িত্ব পাওয়া উচিত? এ সব বিষয়ে কংগ্রেসের মতটি আমাদের গোঁড়া এবং অবাস্তব বলে মনে হয়েছিল। তারা একজাতি’-তত্ত্বে অনড়। যদিও আমরা জানতাম যে, ঐতিহাসিক দিক থেকেই এই মতকে সমর্থন করা যায় না। আমাদের বক্তব্য ছিল একটাই, ব্রিটিশ রাজ আসার আগে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যা অবস্থা ছিল, তাকে কোনও মতেই একটি মাত্র দেশ বলা চলে না। ব্রিটিশ রাজ এসে এক ধরনের কৃত্রিম এবং সাময়িক ঐক্য তৈরি করেছিল, কিন্তু তারা যখন চলে যাবে, তখন সেই ঐক্য আর ধরে রাখা যাবে না, এবং ধর্ম এবং জাতির দিক থেকে আলাদা সব মানুষ মােটেই আর নিশ্চিন্তে পাশাপাশি শুয়ে থাকবে না, তারা তখন যে যার নিজের পথে চলে যাবে। …এই ভাবে আলােচনার খুঁটিনাটি নিয়ে আমরা মতৈক্যের যত কাছাকাছিই আসতে পারি না কেন, নীতিগত দিক থেকে এই মৌলিক মতভেদটুকু কখনওই দূর করা যায়নি।
তিনি আরও লিখছেন: “মহাত্মা প্রথমেই একটি মৌলিক শর্ত রাখতে চাইছিলেন; তা এই যে, মুসলিমরা নিজেদের জন্য যে কোনও রকম নিশ্চিতির প্রতিশ্রুতি দাবি করার আগে মেনে নিক যে, স্বরাজ নিয়ে যে কংগ্রেসের যে ব্যাখ্যা— স্বায়ত্ত শাসন— সেটা তাদেরও লক্ষ্য। উত্তরে মিস্টার জিন্না সঙ্গত ভাবেই বললেন যে, গােল টেবিল-এ আরও যে সব হিন্দু প্রতিনিধি আছেন, তাদের জন্য তাে মহাত্মা এই ধরনের কোনও। শর্ত আরােপ করছেন না, তা হলে শুধু মুসলিমদের উপর এই শর্ত চাপাচ্ছেন কেন? এই ভাবে আলােচনার মধ্যে আরও একটা বড় বাধা তৈরি হল।” অতঃপর জিন্নার যুক্তি দাড়াল এই রকম: “আমাদের শর্ত বরাবর একই ছিল: কেন্দ্রে একমাত্র প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ দফতর বাদে বিশেষ ক্ষমতা দরকার নেই; বাকি সব ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, বিশেষত মুসলিমরা যেখানে সংখ্যাগুরু সেই সব রাজ্যে হস্তান্তর করতে হবেপঞ্জাবে, বাংলায়, সিন্ধুপ্রদেশে, বালুচিস্তানে এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। আমরা এই দাবিতে অনড় ছিলাম, কারণ আমরা জানতাম যে, বাংলা এবং পঞ্জাবে
১৭০
যে মুসলিমরা আছেন, তারাও একই রকম অনড়।” এর সঙ্গে আগা খা যােগ করছেন: মহাত্মা গাঁধী স্পষ্টই বুঝতে পারছিলেন, তার শিবিরে আমাদের নিয়ে যেতে পারলে কতখানি লাভ হবে। কে জানে, তিনি হয়তাে তার মতাে করে আমাদের বক্তব্যটা মেনে নেওয়ার কোনও রাস্তাও দেখেছিলেন, কিন্তু পণ্ডিত মালব্য এবং হিন্দু মহাসভা প্রবল ভাবে আমাদের বিরুদ্ধে গেল, এমন সব বিমূর্ত রাজনৈতিক তত্ত্ব আর নীতি আউড়ে চাপ তৈরি করল—১৯৪৭-এর দেশভাগ দেখিয়ে দিয়েছে যার সঙ্গে ভারতের বাস্তবতার কোনও যােগ নেই।
এই সব চুলচেরা বিশ্লেষণ ক্রমে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে থাকল, সময়ও বয়ে চলল, যুক্তিপরম্পরা ক্রমশই আরও বেশি করে বিমূর্ত আকার ধারণ করল: একটি জাতি তার প্রদেশের হাতে অনির্দিষ্ট ক্ষমতা দিতে পারে না; সংখ্যাগুরুকে যার মাধ্যমে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা যায়, সেই প্রক্রিয়ার উপরে সীমারেখা আরােপ করার কোনও সাংবিধানিক পন্থা নেই— সন্দেহ নেই, এ সবই অ্যাকাডেমিক বিষয় হিসাবে দারুণ, কিন্তু ভারতীয় জীবনধারার সঙ্গে, বাস্তবতার সঙ্গে এদের কোনও যােগ নেই।
মহম্মদ সফির কন্যা এবং দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকে অন্যতম প্রতিনিধি বেগম শাহ নওয়াজকে যদি বিশ্বাস করা যায়, তা হলে সত্যিই মতৈক্যের একটা জায়গা তৈরি হয়েছিল, নিজস্ব বিবরণীতে তিনি লিখছেন: “একটা সময় মুসলিম এবং উদারপন্থীরা তাদের নিজেদের মধ্যে একটা ঐকমত্যে পৌঁছলেন, মনে হল যে একটা বােঝাপড়া হয়তাে সম্ভব। সফি মিষ্টি এবং পানীয়ের অর্ডার দিলেন, মুসলিম প্রতিনিধিরা সবাই এই ঘটনাটিকে সেলিব্রেট করার জন্য রিৎজ-এ আগা খাঁর ঘরে জড়াে হলেন। কিন্তু, উৎসবটা শুরুই হল না। গাঁধী শিখ এবং হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধিদের চুক্তিটি সবিস্তারে বােঝাতে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। বললেন, ভদ্রমহােদয়গণ, খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আমি ওঁদের বােঝাতে পারিনি। আমরা যে নীতির কথা প্রস্তাব করেছি, শিখ এবং মহাসভার প্রতিনিধিরা তা মানতে নারাজ। সমস্ত ঘর একটা বিচিত্র নৈঃশব্দ্যে ছেয়ে গেল। আমরা যারা ঘরে ছিলাম, তাদের অধিকাংশেরই মনে হল, দু’চোখ থেকে তিক্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। সফি একটি বিকল্প প্রস্তাব দিলেন, বললেন, ‘আসুন, মুসলিমরা এবং কংগ্রেস এই নীতির উপরে ভিত্তি করেই একটা চুক্তিবদ্ধ হােক। গাঁধী জবাব দিলেন, সফি, আমি আমার সীমাবদ্ধতাটুকু বিলক্ষণ জানি, আমি এই কাজ করতে পারি না। উৎসব মাটি হয়ে গেল। সফি এবং তাঁর কন্যা বাড়ি ফিরে এলেন, ‘এবং আমরা যখন ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম, বাবা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়লেন, এক সময় সংজ্ঞাও হারিয়ে ফেললেন।[৪৩]
হিন্দু মহাসভা এবং শিখ প্রতিনিধিরা যাতে সায় দেবেন না, গাঁধীও যে শেষ পর্যন্ত সেই নীতিতেই অটল থাকতে চাইলেন না, সেটা আসলে নতুন কিছু নয়। ১৯৩১-এর গ্রীষ্মে ভারতেও তিনি এই একই রাস্তা নিয়েছিলেন। জানিয়েছিলেন, তিনি মধ্যস্থতাকারী হতে প্রস্তুত, কিন্তু কোনও পক্ষ নেবেন না (নাকি, পক্ষ নিতে পারবেন না!)। গাঁধী জানতেন ‘সাম্প্রদায়িক’ আবেদনের প্রভাব ঠিক কী রকম। তিনি এও জানতেন যে,
১৭১
খােলাখুলি ভাবে হিন্দু দাবির বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি যদি কোনও অবস্থান গ্রহণ করেন, তা হলে কংগ্রেসের ক্ষেত্রে তার পরিণাম কী হতে পারে। কতটা কী ছাড় পাওয়া যাবে, তখনও পর্যন্ত তা স্পষ্ট নয়, এবং তখন যে নির্বাচনী ব্যবস্থা বহাল ছিল, তাতে গাঁধী এই জাতীয় কোনও অবস্থান নিলে তার পরিণাম হত একটাই: কংগ্রেসের সমর্থনে তুমুল । ভাটা পড়ত। গাঁধী নিশ্চয়ই হিসাবটা কষে ফেলেছিলেন, এ ব্যাপারে বরং সরকারই সিদ্ধান্ত নিক, এবং এর ফলে যদি কোনও অপ্রিয়তা সৃষ্টি হয়, তার দায়ভারটা সরকারের কঁাধেই যাক, খামােখা কংগ্রেসকে এর মধ্যে টেনে আনার কোনও অর্থ হয় না। ফলে, গােটা আলােচনাটার মধ্যে থেকে শেষ পর্যন্ত গাঁধী বলটা সরকারের কোর্টেই ঠেলে দিলেন। সংখ্যালঘু সাব-কমিটির কাছে তিনি কবুল করেছিলেন যে, একটা চুক্তিতে পৌছতে পারেননি বলে তিনি ব্যথিত, অপমানিতও বটে, কিন্তু এই ব্যর্থতার দায় তার নয়, কারণ প্রতিনিধিদের তাে সরকারই বেছে নিয়েছিল। অর্থাৎ, প্রকৃতপক্ষে তিনি আসলে যা বলতে চাইলেন তা এই যে, সরকার রাজনৈতিক ছাড় নিয়ে আলােচনা করবে, কিন্তু বিনিময়ে তারাই সাম্প্রদায়িক বােঝাপড়া চাইছে। তিনি এও বােঝাতে চাইলেন যে, সরকার আগে ছাড়ের কথা ঘােষণা করুক, তার পরেই এই জাতীয় চুক্তি করা সম্ভব। কী বিচিত্র, এবং কী ট্র্যাজিক এই যুক্তির বৃত্তাকার চলন সরকার বলছে, ‘আগে সাম্প্রদায়িক চুক্তি করাে, তার পরে ছাড় পাবে’; জবাব আসছে, না, আগে ছাড়ের কথা ঘােষণা করাে, তার পরে আমরা, বিভিন্ন সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে চুক্তি করে নেব।’
দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠক শেষ হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই কংগ্রেস ফের আইন অমান্য শুরু করে দিল। গােটা পরিস্থিতির যুক্তিক্রম সে দিকেই ইঙ্গিত করছিল। বাইরে সম্প্রীতির একটা লােকদেখানাে আবরণ থাকলেও ১৯২৮ নাগাদ, প্রাদেশিক স্তরে রাজনৈতিক মেরুকরণ এমনই ছিল যে, গােটা ভারতীয় রাজনীতিটাই পরস্পর-বিরােধী কিছু শিবির ভাগ হয়ে গিয়েছিল। খুব সামান্য একটা সময়ের জন্য, গাঁধী-আরউইন চুক্তির ঠিক পরেই, কংগ্রেস এবং সরকার দু’পক্ষই নমনীয় একটা অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেই পর্বটি ছিল খুবই স্বল্পস্থায়ী।
দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকের আগে, সন্দেহ নেই, লাভের পাল্লা কংগ্রেসের দিকেই ভারী ছিল। লন্ডনে গিয়ে অবশ্য হিসাবটা উল্টে গেল, সরকার খুব সফল ভাবেই দেখিয়ে দিল যে, তখন যে সব দল গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কংগ্রেস আসলে তাদেরই অন্যতম, তার বেশি কিছু নয়। এর ফলে, ব্রিটিশ রাজের হাত শক্ত হল, পরের দফায় যখন ভারতে দমনপীড়ন শুরু হল, তখন এই নবলব্ধ শক্তি কাজে এসেছিল। গােল টেবিল বৈঠক থেকে মুসলিমরা অবশ্য বিশেষ কোনও রক্ষাকবচ পায়নি। যদি কোনও সিদ্ধান্ত হয়, এবং যখন হবে, তখন সেটা তাদের পক্ষে যাবে কি না, সে বিষয়ে তারা মােটেই নিশ্চিত ছিল না। ফলে, ‘কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড’-এর[৪৪] লগ্ন ঘনিয়ে এল, তারা ততই বেপরােয়া হয়ে উঠতে থাকল।
গাঁধী যখন ভারতে ফিরলেন, তখন সরকারের সামনে একটাই প্রশ্ন ছিল, পরবর্তী
১৭২
সাংবিধানিক আলােচনায় কংগ্রেস সহযােগিতা করবে তাে? তবে, যুক্তপ্রদেশে যত দিন ভাড়া-বন্ধ কর্মসূচি চালু থাকবে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সংঘাতের প্রস্তুতি চলবে, তত দিন যে সহযােগিতা অসম্ভব, তা বােঝাই যাচ্ছিল। ফলে, পরের ছ’মাসের মধ্যেই সরকারের কর্তৃত্ব ফের পূর্ণমাত্রায় দেখা দিল; যুক্তপ্রদেশে ভাড়া-বন্ধ কর্মসূচি থেমে গেল, সীমান্ত প্রদেশেও আন্দোলনকে কড়া হাতে দমন করা হল। বােঝা গেল, সরকারের পক্ষে এটাই তৎপর হওয়ার সময়।[৪৫] জানুয়ারি, ১৯৩২। গাঁধীকে গ্রেফতার করা হল, রাখা হল যারবেদা কারাগারে। মাত্র। কয়েক দিনের মধ্যেই ভারতীয় উদারপন্থীরা তার মুক্তির দাবিতে একটি ইস্তাহার প্রকাশ করলেন। অন্য নানা দলও সেই পথেই হাঁটল। গণমাধ্যমও গাঁধীর মুক্তির দাবিতে সরব হল। কিন্তু উইলিংডন অনড়, অন্তত প্রথমে আইন অমান্য আন্দোলন তুলে না নেওয়া পর্যন্ত মুক্তি অসম্ভব। তবে গণমাধ্যমে হইচই চলতে থাকল, আইনসভাতেও তার ছায়া পড়ল, এমনকী হাউস অব কমনস-ও বাদ গেল না। শেষ পর্যন্ত স্যর স্যামুয়েল হাের হাউস অব কমনস-এ বিবৃতি দিয়ে জানাতে বাধ্য হলেন, কংগ্রেস সহযােগিতা করবে কি না, তার জন্য শর্ত রেখে দরকষাকষির কোনও প্রশ্নই ওঠে না।[৪৬] এই বিবৃতির পরে অসন্তোষ কমল।
১৯৩১-এর শেষ দিকে দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠক শেষ হল, কিন্তু বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল, অবিলম্বে যেগুলির উত্তর সন্ধান জরুরি। ফলত, তিনটি কমিটি গঠিত হল। একটি ভােটদানের অধিকার বিষয়ে ভারতীয়দের মতামত সমীক্ষা করবে। একটি অর্থনৈতিক বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। তৃতীয়টি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে রাজন্য প্রদেশগুলি কী ভাবে থাকতে পারে, তা বিবেচনা করবে।
ভােটদানের অধিকার-সংক্রান্ত কমিটি লর্ড লােথিয়ান-এর নেতৃত্বে গােটা দেশ সফর করল, এবং তার পরে প্রতিবেদন মারফত জানাল যে, ভােটদাতার সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে, ৭০ লক্ষ থেকে বেড়ে তিন কোটি ষাট লক্ষ হয়েছে। শিক্ষার পাশাপাশি ভােটদানের অধিকার লাভের মুখ্য যােগ্যতা থাকল বিষয়সম্পত্তি। মহিলাদের জন্য আলাদা নির্বাচকমণ্ডলী তৈরি হল।
স্যর ইউস্টাস পেসি-র সভাপতিত্বে অর্থসংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রীয় কমিটি ১৯৩২-এর মে মাসে রিপাের্ট পেশ করল, তাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারের অর্থসংক্রান্ত ক্ষমতাবিন্যাসের সবিস্তার বর্ণনা, আশা করা হল যে, এর ফলে নতুন সংবিধানের কার্যকর হওয়ার পথ সুগম হবে।
রাজ্যসংক্রান্ত কমিটি বিভিন্ন রাজ্য এবং ব্রিটিশ ভারতের সরকারের রাজনৈতিক। সম্পর্কের বিষয়টি একেবারে উৎস থেকে খতিয়ে দেখল, এবং বৃহত্তর ভাবে কিছু নীতি প্রণয়নের কথা বলল, ভবিষ্যতে কোনও চুক্তি সম্পাদিত যেগুলি কাজে লাগতে পারে।
অতঃপর, ১৯৩২-এর গােড়ার দিকে গােল টেবিল বৈঠকের উনিশ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে ভাইসরয়ের সভাপতিত্বে একটি পরামর্শদাতা (কনসাল্টেটিভ) কমিটি তৈরি হল,
১৭৩
উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রের খুঁটিনাটি নানা বিষয়ে নীতি প্রণয়ন। কমিটির কাজে অবশ্য বারবারই ব্যাঘাত ঘটতে থাকল, কারণ কিছু মুসলিম প্রতিনিধি বেঁকে বসলেন, সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ ঘােষিত না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনও প্রস্তাব আলােচনা করতেই নারাজ। তঁাদের ভয় ছিল, কেন্দ্রীয় স্তরে দায়িত্ব বণ্টনের সময় কংগ্রেস সুবিধা পেয়ে যাবে, এবং মুসলিমদের স্বার্থ হয় ক্ষুন্ন করা হবে, নয়তাে নিশ্চিত ভাবেই অবহেলা করা হবে। ১৯৩৩-এর জানুয়ারি নাগাদ উইলিংডন পরামর্শদাতা কমিটিতে যােগদানের বিষয়ে মুসলিমদের সংশয় অনেকটাই দূর করলেন বটে, কিন্তু কাজ করতে রাজি হলেও মুসলিম তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় স্তরে ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়ে কোনও কথাই শুনতে রাজি হলেন না। ১৯৩২-এর ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ তারা কমিটির কাজকর্ম প্রায় অচল করে দিলেন, ফলে যাবতীয় তৎপরতা স্থগিত করে দেওয়া ছাড়া উইলিংডনের সামনে আর কোনও পথও থাকল না। একই ভাবে, অন্য কমিটিগুলির কাজেও বাধা পড়তে থাকল, যদিও এ কথাও ঠিক যে তাদের কাজকর্মের জন্যই, খানিকটা হলেও, তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠকের রাস্তা সুগম হয়েছিল।
সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা
দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠকের দ্বিতীয় অধিবেশনে গাঁধী একমাত্র মুসলিম ছাড়া অন্য কারও জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বিরােধিতা করেছিলেন, এবং হরিজনদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিষয়েও যথেষ্ট কড়া মনােভাব নিয়েছিলেন। দেশে ফেরার পরে ‘সাম্প্রদায়িক আসন সংরক্ষণ’-এর তিক্ত প্রশ্নটির একটি সর্বজনগ্রাহ্য উত্তর খোঁজা জরুরি হয়ে পড়ল। এই পরিস্থিতিতে, ১৯৩২-এর অগস্টে প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডােনাল্ড একটি সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ ঘােষণা করলেন। এতে, অন্য আরও নানা জিনিসের সঙ্গে, পশ্চাৎপদ শ্রেণি’-র (হরিজন/দলিতদের এই নামেই ডাকা হত) জন্য একটি বিশেষ নির্বাচনী কেন্দ্রে কিছু আসন সংরক্ষণের কথা ঘােষণা করলেন, এবং নির্দিষ্ট কিছু সংরক্ষিত আসনের কথাও জানালেন। এই ঘােষণার পাঁচ মাস আগে বিদেশসচিবকে লেখা একটি চিঠিতে গাঁধী জানিয়েছিলেন, পশ্চাৎপদ শ্রেণির জন্য যে কোনও রকম আলাদা আসন সংরক্ষণের প্রস্তাব এলে তিনি প্রয়ােজনে প্রাণ দিয়েও তার বিরােধিতা করবেন। তার মত ছিল, এর ফলে হিন্দু সমাজের মধ্যে বিভেদ আরও বেড়ে যাবে, এবং যাঁরা সেই পশ্চাৎপদ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, তাদের অবস্থার আরও অবনতি হবে। ১৮ অগস্ট, ১৯৩২ তারিখে গাঁধী প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন, তিনি আগের সিদ্ধান্তে অটল এবং ‘হরিজন’দের৭৭ পক্ষে ক্ষতিকারক এই সিদ্ধান্ত যদি ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বদলানাে না-হয়, তিনি প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ’[৪৮] আমরণ অনশনে বসবেন। নির্দিষ্ট দিনে গাঁধী অনশনে বসলেন। গােটা দেশ এই ঘটনায় যেন জেগে উঠল,
১৭৪
জাতীয় অনশন দিবসের কথা ঘােষণা করা হল, জাতীয় প্রার্থনা দিবসের কথাও ঘােষিত হল, এবং আট মাসের একটি ব্যবধানের পরেই দেখা গেল, দেশজুড়ে বিভিন্ন সভায় ভিড় উপচে পড়ছে। পরিণামে, প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাডােনাল্ড-এর পূর্বপ্রস্তাবিত হরিজনদের জন্য আলাদা নির্বাচনী ক্ষেত্র’-এর পরিবর্তে ১৪৮টি আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করা হল।
তত দিনে উইলিংডন স্পষ্টতই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন, তিনি স্থির করলেন যে, এই পরিস্থিতিতে একমাত্র বাস্তবসম্মত সমাধান হল আরও কিছু দায়িত্ব বাড়িয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। ১৯৩১-এর মার্চ থেকে ১৯৩২-এর মার্চ পর্যন্ত তার সঙ্গে তদানীন্তন ভারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিদেশসচিব স্যর স্যামুয়েল হােরএর যে পত্রালাপ হল, তাতে তার এই নীতির কথাই ঘুরেফিরে এসেছে।
ব্রিটিশদের তদানীন্তন কাজকর্ম থেকে তাদের দু’ধরনের দ্বিধার ছবি বেরিয়ে আসে। একটা ছবি উইলিংডনের এই কেন্দ্রকে আরও শক্তিশালী করে তােলার প্রয়াস থেকে স্পষ্ট। দ্বিতীয়ত, তিনি যে মুসলিমদের সমর্থন ফিরে পেতে চাইলেন, সেখান থেকেও আর এক ধরনের দ্বিধার পরিচয় ফুটে ওঠে। মুসলিম কনফারেন্সও এক ধরনের চরমপত্র দিয়েছিল, ১৯৩২-এর জুন মাসের মধ্যে সংস্কার নিয়ে কোনও স্পষ্ট সিদ্ধান্তের কথা না জানানাে হলে তারাও প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এ নামবে। তত দিনে এটাই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, চুক্তিতে না পৌঁছনাে পর্যন্ত সাংবিধানিক পথে আর কোনও ভাবেই এগােনাে সম্ভব নয়। সুতরাং, ব্রিটিশের ভয় ছিল যে, শেষ পর্যন্ত যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হােক না কেন, তাতে বিশেষ ফল হবে না, ব্রিটিশ রাজ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে, ভাইসরয়ের সামনে প্রশ্নগুলি ছিল স্পষ্ট, এবং কঠিন: মুসলিম প্রাদেশিকতাকে কি উশকানি দেওয়া হবে? যদি হয়, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রের কী হবে? কেন্দ্রকে যদি আরও শক্তিশালী করে তােলা না হয়, তা হলে অন্য একটাই রাস্তা খােলা থাকে। প্রদেশগুলির হাতে আরও ক্ষমতাপ্রদান। তাতে পঞ্জাবেরই সুবিধা হবে, মুসলিম প্রাদেশিকতাও ইন্ধন পাবে, আবার জিন্না এবং তার যে রাজনীতি, তার কোনও লাভ হবে না, কংগ্রেসেরও কোনও ফয়দা হবে না। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠকের কথা ঘােষণা করা হল। | বিদেশ সচিব ২৭ জুন ১৯৩২ তারিখে হাউস অব কমনস-এ ঘােষণা করলেন, যেহেতু প্রস্তাবিত ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের সময় লাগবে, তাই প্রয়ােজনীয় সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করে কবে যথাযথ ভাবে যুক্তরাষ্ট্র শুরু করা যাবে, তার জন্য অপেক্ষা না করে প্রদেশগুলির হাতে এ বার দায়িত্বভার তুলে দেওয়া হবে। বিদেশ সচিব একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি গড়ার কথাও প্রস্তাব করলেন, যার কাজই হবে সংস্কারমূলক বিভিন্ন প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে পার্লামেন্টে পেশ করার আগে সেগুলি সম্পর্কে ভারতীয় প্রতিনিধিদের মতামত আহ্বান করে পুরাে বিষয়টা খতিয়ে দেখা।
এতেই ব্রিটেনের উদারপন্থীরা বিষম ক্রুদ্ধ হলেন। তাঁদের মনে হল এই বন্দোবস্ত সরাসরি অপমানের তুল্য। কারণ, এতে বৈঠকের তাে বটেই, যৌথ আলাপ-আলােচনার
১৭৫
গােটা প্রক্রিয়াটাকেও বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। বিরােধী লেবার পার্টিরও তখন একই মনােভাব। ভারতীয় প্রেস, বিশেষ করে সেই অংশটি যারা বৈঠক বয়কটের দাবিতে মুখর ছিল, এবং যারা নীতিগত ভাবে, এমনকী আত্মিক ভাবেও আইন অমান্য আন্দোলনের পক্ষে, তারাও এই ঘােষণাকে ধিক্কার জানাল। পরামর্শদাতা কমিটি এবং অন্য নানা কমিটি থেকেও উদারপন্থী সদস্যরা দ্রুত পদত্যাগ করলেন। ভারতীয় জনমতের যে অংশটি তাদের সমর্থন করে এসেছে, সরকার তাদের দূরে সরিয়ে রাখতে পারল না। ফলে, ৫ সেপ্টেম্বর সরকারের তরফে ঘােষণা করা হল, ব্রিটিশ ভারত এবং রাজ্যগুলির কিছু নির্বাচিত প্রতিনিধি আবার লন্ডনে একটি বৈঠকে আমন্ত্রিত হবেন। ১৯৩২-এর নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ সেই বৈঠক হবে। ভারতের আকাশে আচমকা যে কালাে মেঘের ঘনঘটা দেখা দিয়েছিল, এর পর তাড়াতাড়িই তা সরে গেল।
তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠক: প্রেক্ষিত
তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠকের গড়নটি ছিল তুলনায় ছােট, অনেক বেশি কার্যকর, যাকে বলে ‘বিজনেস-লাইক’, আগের বিভিন্ন বৈঠকের কথাবার্তাকে যা বারবার ব্যাহত করেছে, সেই বাগাড়ম্বর নেই, রাজনৈতিক নীতি নিয়ে যুক্তিজাল বিস্তার নেই তা সত্ত্বেও, ছবিটা যে খুব একটা পাল্টাল, তা-ও কিন্তু নয়। আসলে এর সঙ্গে এত রকম স্বার্থ জড়িত ছিল, তাদের মধ্যে ফারাকগুলিও খুব স্পষ্ট, আবার সময়ের ব্যবধানও এমন কিছু বেশি নয় যে তাতে সেই পারস্পরিক পার্থক্যের ধারটা ক্ষয়ে আসবে— ফলে, দেখা গেল যে মূল কিছু প্রশ্নের উত্তর আর পাওয়াই গেল না। তবে, ব্রিটেন বা ভারত, কারও পক্ষেই আর সময়ের অপচয় করা সম্ভব ছিল না, প্রত্যেকেই সহমত হবেন, এমন কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি পক্ষকেই যথেষ্ট সময় দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতে সুফল মেলেনি। বৈঠক শেষ হল, প্রতিনিধিরাও চলে গেলেন, চুড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনাে গেল না। ভারতীয় প্রতিনিধিরা অসন্তুষ্টচিত্তে ফিরে এলেন; রাজন্যবর্গও সন্দিগ্ধ মনে ফিরলেন, ভাইসরয় সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটি উপলব্ধি করলেন, কিন্তু তিনি হাত গুটিয়ে বসে থেকে গােটা অবস্থাটিকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে, প্রথমেই তিনি সমস্ত প্রতিনিধিদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বললেন, দেখতে চাইলেন ভারতীয় উদারপন্থীদের এবং অন্যদের মতামতকে কী ভাবে প্রস্তাবিত সংবিধানের মধ্যে আনা যায়।
এই বৈঠকের দু’টি অধিবেশনের মধ্যে জিন্না শুধুমাত্র প্রথমটিতেই ছিলেন। হিন্দু উদারপন্থী নেতারা, বিশেষত সঞ এবং জয়াকর কড়া মনােভাব না নিলে তৃতীয় অধিবেশনটি হতই না। ভারতের তদানীন্তন বিদেশ সচিব স্যামুয়েল হাের এই উদারপন্থীদের চাপের সামনে নত হলেন ঠিকই, কিন্তু এই অধিবেশনে প্রতিনিধি বাছাই
১৭৬
এমন ভাবেই করা হত যাতে.শুধুমাত্র রক্ষণশীল’ এবং প্রাদেশিক’ নেতারাই উপস্থিত থাকেন। এই অধিবেশন বা যৌথ সংসদীয় কমিটি, কোথাওই জিন্নার নির্বাচিত হওয়ার কোনও সুযােগ ছিল না। তাকে এমনকী যৌথ সংসদীয় কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়নি, যদিও প্রচুর ভারতীয় এবং ব্রিটিশ সেই ডাক পেয়েছিলেন। তবে সরকারের তরফে আমন্ত্রণ পেলে যে জিন্না এই অধিবেশনে আসতেন বা যৌথ সংসদীয় কমিটিতে কাজ করতেন, কিংবা সাক্ষ্য দিতেন, তা নিয়ে বিশেষ সংশয়ের অবকাশ নেই। হাজার হােক, বৈঠকের গতি আশাজনক না ঠেকলেও তিনি বৈঠকের দু’টি অধিবেশনেরই একেবারে শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গিয়েছেন।
গাঁধী যদিও এই তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠকে ছিলেন না, তবে কংগ্রেসের বাইরে থাকা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের একটি বড় অংশ বৈঠকে ছিলেন। বৈঠকে কী হয়েছিল, তা ফিরে দেখতে গিয়ে আগা খাঁ আক্ষেপ করেছেন এই ভেবে যে, জিন্না বা গাঁধী দু’জনের কেউই এই বৈঠকে আসেননি। তিনি লিখছেন, এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা, মুসলিমরা মিস্টার জিন্নাকে আমাদের সঙ্গে নেওয়ার জন্য কোনও চাপ। সৃষ্টি করিনি; যদি তিনি প্রতিনিধি দলে থাকতেন, তা হলে আমি যে জিনিসটাকে এই বৈঠকের সব থেকে মূল্যবান ফসল বলে মনে করি, তিনিও হয়তাে সেটা সমর্থন করতেন।” সেই মূল্যবান বস্তুটি, আগা খাঁর মতে, “একটি যৌথ মেমােরান্ডাম, যাতে কিনা ভারত-ব্রিটিশ পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিহাসে সেই প্রথম, সমস্ত জনগােষ্ঠীর পক্ষ থেকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে একটি দাবি পেশ করা হল। লক্ষণীয়, তার মধ্যে কিন্তু সেই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিটি বিষয়ই ছিল। অর্থাৎ, এই ভাবে এমন একটি জিনিস প্রস্তাবিত হল, যা কিনা বিরাট একটি অগ্রগতির তুল্য হয়ে উঠতে পারত— বলতে গেলে, একে ডােমিনিয়ন স্টেটাস-এর ঠিক আগের ধাপ বললেও অন্যায় হবে না। পরবর্তী কালে দায়িত্ব হস্তান্তর কী ভাবে হবে, আমরা সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে যাতে একটা ধারাবাহিকতা থাকে, আমরা সেই জিনিসটাকেই এই প্রয়াসের মধ্যে দিয়ে নিশ্চিত করতে চাইলাম। সমস্ত অ-সরকারি ভারতীয় প্রতিনিধিরা এতে স্বাক্ষর করলেন। বস্তুত, চূড়ান্ত কিছু সিদ্ধান্ত, যা কিনা ব্রিটিশ সরকারই গ্রহণ করবেন, সেগুলি ছাড়া বাকি প্রায় সমস্ত ক্ষমতাই ভারতীয়দের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি তােলা হল। এই মর্মে তৈরি সংবিধান যদি অনুমােদন পেত, তা হলে পরবর্তী কালে বিভিন্ন কুট সিদ্ধান্ত, যেমন ১৯৩৯-এ যুদ্ধ ঘােষণা, ১৯৪২-এ ক্রিপস মিশনের সময়কালীন বিবিধ সমস্যা বা শেষে চুড়ান্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের মতাে প্রক্রিয়া অনেক সহজ হত। আর এই সংবিধান সম্পূর্ণ কার্যকর হলে যেটুকু ক্ষমতা তখনও ব্রিটিশ সরকারের হাতে ছিল, সেটুকু হস্তগত করাও কঠিন হত না। খসড়ায় এই ক্ষমতাগুলিকে সাংবিধানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের চুড়ান্ত পর্যায়ের জন্য চিহ্নিত করে রাখা হয়েছিল।”
স্মৃতিকথায় আগা খাঁ কি ঈষৎ বেশি মাত্রায় আশাবাদী হয়ে পড়েছিলেন? তার কথাগুলি কি অবান্তর ঠেকছে? এই ধরনের অনুমানের কোনও অর্থ নেই, কারণ বােঝাপড়া হােক বা না-ই হােক, ঘটনাপরম্পরা প্রায় নিজের ইচ্ছামাফিক এগােচ্ছিল।
১৭৭
গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া বিল নিয়ে গঠিত যৌথ কমিটির সামনে আগা খাঁ সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন: “আমি ‘দায়িত্বশীল সরকার’ কথাটা মেনে নিতে প্রস্তুত, যদিও আদর্শ হিসাবে আমি ‘স্বশাসিত সরকারকেই অগ্রাধিকার দেব… তবে, বাস্তব পরিস্থিতিটা স্বীকার করতে হবে… নিশ্চিত ভাবেই ‘দায়িত্বশীল সরকার’-এর পথ ধরেই আমরা ভবিষ্যতের দিকে এগােব, তা থেকেই এমন কিছু পরিকল্পনা বেরিয়ে আসবে যার মধ্যে দিয়ে ভারত মহান কিছু রাজ্যের সমষ্টি হয়ে উঠবে, এবং আমার বিশ্বাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে থেকে একটা পথের হদিস মিলতে পারে। এর সঙ্গে তিনি আরও জানান, “যাবতীয় গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও (অন্তত আমরা যা ভেবেছিলাম) কংগ্রেস ওই যৌথ মেমােরান্ডাম অস্বীকার করল, ফলে ব্রিটিশ সরকারও একে নাকচ করতে বাধ্য হল।” কিন্তু, এ সবই আগা খাঁর নিজস্ব মতামত। ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক সরণিতে তখন যে তুমুল দড়ি-টানাটানির পালা চলছিল, সেখানে, কিংবা রাজন্যশাসিত প্রদেশের দরবারে এই সব বক্তব্য বিশেষ পাত্তা পেয়েছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
এ দিকে জিন্নাকে সাংবিধানিক আলােচনার বাইরেই রেখে দেওয়া হল, এবং তিনি ১৯৩২ থেকে ১৯৩৪- এই সময়কালের বেশির ভাগটাই লন্ডনে কাটালেন। স্বেচ্ছানির্বাসন? না, ভারতের রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসরগ্রহণ? কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন একে? তিনি বিলাসবহুল হ্যামস্টেড এলাকায় একটি সুবৃহৎ বাড়ি কিনলেন, এবং একমাত্র সন্তান, দিনা-কে কাছেই একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি করালেন। এ সবই তঁার স্বেচ্ছা-সন্ন্যাস কি না, তা নিয়ে নানা রকম অনুমান আছে, যদিও এই জাতীয় ব্যাখ্যা দিলে জিন্নার সংকল্প এবং তার দায়বদ্ধ জাতীয়তাবাদ-এর প্রতি অবিচার করা হয়। জনজীবনে, এবং তার ব্যক্তিগত জীবনেও এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল, যার জন্য তিনি লন্ডনে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, তবে সেটাকে খানিকটা বিরতি হিসাবে, যাকে ‘স্যাবাটিক্যাল’ বলে, সে ভাবেই দেখা ভাল। তত দিনে তিনি রাজনৈতিক ভাবে যেন একটি ‘নাে ম্যানস ল্যান্ড’-এ চলে গিয়েছেন। তবে উইলিংডনের সঙ্গে তার গুরুতর বিরােধ থেকেই গিয়েছিল। দুর্গা দাসকে তিনি বলেছিলেন, “আমি লন্ডন চলে এসেছি। কারণ ওই অসহ্য ভাইসরয়টির সঙ্গে আর দেখা করতে চাইনি।”[৪৯]
এই চিন্তা নিশ্চিত ভাবেই পরে এসেছিল, কারণ শত্রুতার ইতিহাসটি দীর্ঘ। জওহরলাল নেহরু জিন্নাকে সহ্যই করতে পারতেন না, এবং গাঁধীর সঙ্গে তার যে দীর্ঘ, নিরবচ্ছিন্ন পত্রালাপ, সেটাই প্রমাণ যে মুসলিম স্বার্থের প্রতি তিনি বিশেষ সহানুভূতিশীল ছিলেন। না। ফলে, জিন্নার প্রতি জওহরলালের মনােভাব ছিল নির্মম। একটি দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ তারিখে জিন্না জওহরলালকে জানালেন যে, “নয়া সংবিধানে মুসলিমদের জন্য এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে তারা আশ্বস্ত বােধ করেন, এবং তা যথেষ্ট মাত্রায় রাখা উচিত, না হলে এই সংবিধান টিকবে না, ভেঙে পড়বে।”[৫০]— উত্তরে জওহরলাল তীক্ষ ভাবে বললেন, এই বক্তব্য জিন্নার ‘উদ্ভট খেয়াল এবং সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক মনােভাবের একটি আশ্চর্য মিশেল ছাড়া আর কিছুই নয়।”[৫১] জিন্নার ‘হাস্যকর চোদ্দো দফা সূত্র’৫২ নিয়ে তার সমালােচনা আরও নির্মম। সেপ্টেম্বরের শেষে
১৭৮
যখন জিন্না গোঁ ধরে আছেন যে তার চোদ্দো দফা সুত্র পুরােটাই মেনে নিতে হবে, তখন জওহরলালের মন্তব্য: “জানি না, এই পথে এগােনাে নরকে যাওয়ার থেকে আরও বেশি মারাত্মক হত কি না। আমাকে যদি প্রিয় বন্ধু মহম্মদ আলি জিন্নার চূড়ান্ত আবােলতাবােল সব বক্তব্য খানিক্ষণ ধরে শুনতে হয়, তা সে যতটুকু সময়ই হােক না কেন, আমি বরং ভাবব, এর থেকে দক্ষিণ সমুদ্রের কোনও দ্বীপে চলে যাওয়া বরং ভাল, যেখানে, আমি আশা করতেই পারি, লােকেরা এতটাই বুদ্ধিমান, বা এমনই মুখ । যে, চোদ্দো দফা নিয়ে বকবক করবে না।”[৫৩],
সুতরাং বাস্তবে এটা কী ভাবে সম্ভব যে জিন্না-চালিত মুসলিম লিগ এবং নেহরুচালিত কংগ্রেস সক্রিয় ভাবে কোনও যৌথ কর্মসূচি নিয়ে এগােবে? একটা বিচ্ছেদ, বলতে গেলে একটা দেশভাগ, অনিবার্যই ছিল বলা যায়।
পাশাপাশি, জিন্নার লন্ডনবাসের পিছনে তার ব্যক্তিগত জীবনেরও একটা ছায়া ছিল। ভারতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামে জিন্না যত আরও বেশি করে জড়িয়ে পড়লেন, তরুণী রাটি (রতনবাই পেটি)-র সঙ্গে তাঁর রােমান্টিক বিবাহবন্ধন ততই আলগা হতে থাকল। তার ব্যক্তিগত জীবন, এবং ভারতের স্বাধীনতার লড়াই দুটোই কিছুটা সময় এবং দায়বদ্ধতা দাবি করত। শেষ পর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিগত জীবনই অবহেলিত হল। চুড়ান্ত মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতে যেতে এক সময় তাদের বিবাহবন্ধন ছিন্ন হল, যদিও তিনি এবং রাটি তার পরেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। দীর্ঘ অসুস্থতার ফলে, ১৯২৯-এ রাটি প্রয়াত হলেন, জিন্নার নিজের স্বাস্থ্যও ভেঙে গেল, তত দিনে তার বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি, ধূমপান চলেছে প্রবল, এবং রাজনৈতিক স্ট্রেস’ও চূড়ান্ত। তা ছাড়া, একটি শিশুর দায়িত্বও তখন তার কাধে। ফলে, সব মিলিয়েই, তিনি একটা পরিবর্তন চাইছিলেন, অন্তত কিছু সময়ের জন্য, একটা ভিন্ন পরিবেশ। নিস্ফল গােল টেবিল বৈঠকের হতাশা, হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্কের অচলাবস্থা এবং ব্রিটিশরাজের শীতল, অনড় মনােভাব জিন্নাকে নতুন একটা প্রশ্নের সামনে দাড় করিয়ে দিল। তার জীবন এ বার কোন দিকে বইবে? ‘হাউসের একটা সদস্যপদ নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে ঢুকে পড়ার একটা চেষ্টা করব নাকি? ভাবলেন তিনি, এবং যদিও সাময়িক ভাবে চিন্তাটা লােভনীয়ই ঠেকেছিল, কিন্তু দ্রুতই তিনি উপলব্ধি করলেন, কোনও ব্রিটিশ দলই তাকে গ্রহণ করবে না। তত দিনে তার মর্যাদা সেই ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপের অনেকটাই ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে। তা ছাড়া, ভারত তাকে হাতছানিও দিচ্ছিল, অবিরাম।
১৯৩৩-এর মার্চে ভারতের সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের ঠিক পরেই তিনি লন্ডনে বসেই এ ব্যাপারে মত ব্যক্ত করলেন। ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি প্রসঙ্গে শ্বেতপত্রের বিভিন্ন প্রস্তাব তিনি খতিয়ে দেখলেন, গভর্নর জেনারেল এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নরের ক্ষমতা ও ক্রিয়াকলাপের সমালােচনা করলেন, শ্বেতপত্রের অন্তর্গত বিভিন্ন রক্ষাকবচের বন্দোবস্তও তার সমালােচনা থেকে বাদ গেল না, এবং তিনি এও দেখিয়ে দিলেন যে, এই ব্যবস্থা অনুযায়ী এগােলে একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাজ্য গঠনে সমস্যা হবে। তার প্রতিক্রিয়ার একটি অংশ সুবিদিত: “এ
১৭৯
বিষয়ে আমার মনে কোনও সংশয় নেই যে, যথার্থ হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছাড়া ভারতের উন্নতির কোনও আশা নেই, এবং সংখ্যাগুরু যারা, সেই হিন্দুরাই কেবলমাত্র এই ঐক্য গড়ে তুলতে পারে। একটা সত্যকার হৃদয় পরিবর্তন হওয়া জরুরি। শুধুমাত্র তখনই গােটা দুনিয়া ভারতের দিকে সসম্ভ্রমে তাকাবে, এবং ভারতের বক্তব্য বিশ্বের দরবারে সত্যিই একটা কার্যকর ভূমিকায় আসবে। ভারত যতক্ষণ বিভক্ত হয়ে আছে, তত দিন এটা আশা করাই অর্থহীন যে, সিলেক্ট কমিটি এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসবে, যাতে ভারতের সুবিধা হতে পারে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়ে তােলার কাজে ক্রমান্বয়ে একের। পর এক ব্যর্থতাই তাকে গভীরতম হতাশায় ঠেলে দিয়েছিল। পরে, ১৯৩৮-এ আলিগড় অ্যাংলাে-মুসলিম কলেজে একটি বক্তৃতায় তিনি নিজের সেই ক্রোধ এবং বেদনা উপুড় করে দিয়েছিলেন:

গােলটেবিল বৈঠকে বিভিন্ন আলােচনার সময়েই জীবনের সব থেকে বড় আঘাতটা পেয়েছিলাম। আমি সরাসরি দেখতে পেলাম বিপদটা। কোথায়। হিন্দু আবেগ, হিন্দু মন, হিন্দুদের মনােভাব থেকেই আমি সিদ্ধান্তে এলাম, ঐক্যের কোনও আশাই নেই। আমার দেশের কথা ভেবে। আমার মনটা হতাশায় ভরে গেল। পরিস্থিতিটা এতটাই দুর্ভাগ্যজনক! মুসলমানরা যেন ‘নাে-ম্যানস ল্যান্ড’-এ বাস করছে: তাদের চালাচ্ছে। হয় ব্রিটিশ সরকারের কিছু বেতনভুক ভৃত্য, কিংবা কংগ্রেসের ধামাধরা কিছু লােক। যখনই মুসলিমদের সংগঠিত করার কোনও চেষ্টা হয়েছে, তৎক্ষণাৎ এক দিকে সেই সব চাকরবাকরের দল, অন্য দিকে কংগ্রেস শিবিরের বিশ্বাসঘাতকরা সেই চেষ্টা বানচাল করে দিয়েছে। একটা সময় আমি ভাবতেও শুরু করে দিয়েছিলাম যে, আমার দ্বারা ভারতের কোনও উপকার হল না, আবার আমি হিন্দুদের মনােভাবও পাল্টাতে পারলাম না, বার মুসলমানরা যে একটা বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে আছে, সেটাও আমি তাদের বুঝিয়ে বলতে পারিনি। আমি এত হতাশ, এবং অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লাম যে ঠিক করেই ফেললাম, ঢের হয়েছে, এ বার থেকে লন্ডনেই থাকব। তার কারণ এই নয় যে আমি ভারতকে ভালবাসি না, বরং নিজেকে আমার প্রচণ্ড অসহায় বলে মনে হচ্ছিল।[৫৪]
এই স্বীকারােক্তির বক্তব্য যা-ই হােক, তার যে গুণ বা দোষই থাক, আবেগটুকু অনস্বীকার্য। মাঝে ১৯৩৩-এর অগস্ট এবং সেপ্টেম্বর, দু’মাসের একটি বিরতির পরে যৌথ সংশােধিত কমিটি ভারতীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনায় বসল, এবং ১২০ জন সাক্ষীর বক্তব্য শুনল। ভারত এবং ব্রিটেন থেকে যাঁরা সাক্ষ্য দিলেন, এবং চরমপন্থী মত ব্যক্ত করলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন স্যর মাইকেল ও-ডায়ার, উইনস্টন চার্চিল
১৮০
এবং ড. বি এস মুঞ্জে। এই সব সাক্ষী যা বলেছিলেন, তার বিবরণ জিন্নার হতাশা নিশ্চয়ই আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৩৪-এর জানুয়ারিতে তিনি বিষগ্নচিত্তে দেশে ফিরলেন। বম্বে (বর্তমান মুম্বই)-তে মুসলিম স্টুডেন্ডস ইউনিয়ন ২০ জানুয়ারি, ১৯৩৪ তার সম্মানে একটি সভার আয়ােজন করেছিল, সভাপতি এম সি চাগলা। জিন্না সেই সভায় সাফ জানালেন, তিনি কোনও আলাে দেখতে পাচ্ছেন না, অনুরােধ রাখলেন, শ্রোতারাই বরং বলুক, তিনি কী করতে পারেন! ভারতে যে কোনও রাজনৈতিক ঐক্য নেই, ফের সেই আক্ষেপ ব্যক্ত করে তিনি ঐক্য গড়ে তােলার আবেদন রাখলেন: ‘ব্রিটিশ সরকারের সামনে পেশ করা যায়, গােটা দেশে এমন কোনও একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি নেই। এমন একটি সংগঠনও নেই যারা ঐক্যবদ্ধ ভারতের তরফে কথা বলতে পারে, এবং এমন একজন নেতাও নেই, গােটা দেশ যার পিছনে গিয়ে দাড়াতে পারে। নেতারা যদি নিজেদের বিভেদ ভুলে সম্পূর্ণ পরিস্থিতি ফের নতুন করে খতিয়ে দেখতে না পারেন, তা হলে এই শ্বেতপত্র ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার একটা আশঙ্কা থেকেই যাবে… সুদূর ভবিষ্যতে কী হতে পারে, সেই চিন্তা বাদ দিয়ে আপনারা যদি একেবারে এই মুহূর্তে উদ্যত এই বিপদকে চিনতে না পারেন, যদি ঐক্যবদ্ধ হতে না পারেন, তা হলে উন্নতির কোনও আশা নেই, ব্রিটিশ সরকারই সে ক্ষেত্রে দেশের চাবিকাঠি নিজেদের হাতে রেখে দেবে।”
ইংল্যান্ডে ফেরার আগে জিন্না চার মাস ভারতে ছিলেন, ১৯৩৪-এর জানুয়ারি থেকে এপ্রিল, এবং এই সময়কালের মধ্যে তিনি সেই ঐক্যের লক্ষ্যেই কাজ করেছেন, যার কথা তিনি বম্বেতে মুসলিম ছাত্রদের সামনে বলেছিলেন। আগা খাও তখন ভারতে, এবং মুসলিম লিগে ১৯২৭ নাগাদ যে ভাঙন ধরেছিল, এ বার তারই উদ্যোগে সেই ফাটল জোড়া লাগল। ফলে, ১৯৩৪-এর ফেব্রুয়ারিতে জিন্না জানালেন যে, তিনি মুসলিম লিগ-এর সভাপতি হতে ইচ্ছুক। তার পর লিগ-এর পুনর্গঠন সংক্রান্ত প্রাথমিক ক্রিয়াকর্মগুলি সেরে তিনি ফের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান খোজার কাজে মন দিলেন। এ বার তিনি একটি নয়া সাম্প্রদায়িক সূত্র বের করলেন, যাতে হিন্দুদের জন্য সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার অন্তর্ভূক্ত আলাদা নির্বাচকমণ্ডলী গড়ার কথা বলা হল, আরও বলা হল যে, “বর্তমানে এই বন্দোবস্ত বহাল থাকবে এই বােঝাপড়ার ভিত্তিতে যে, দু’তরফেরই সম্মতিক্রমে বেচে নেওয়ার একটি সময়কালের পরে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী ওই পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর জায়গা নেবে।” এর পরই জিন্নার সঙ্গে পণ্ডিত মদনমােহন মালব্যর আলােচনা শুরু হল। অবশ্য, দ্রুত ভেস্তে গেল সেই কথা। বিভিন্ন প্রাদেশিক স্বার্থের কথা ফের উঠে এল, বিশেষত পঞ্জাব এবং বাংলায় মুসলিম প্রতিনিধিত্বের ধাঁচ কী হবে, সেই প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিল। জিন্না ১৯৩৪-এর এপ্রিলে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেওয়ার আগে একটি দীর্ঘ বিবৃতি দিয়ে তাঁর সঙ্গে পণ্ডিত মালব্যর কী আলােচনা হয়েছে, তা সবিস্তার জানিয়ে দিলেন। সেই বছরে নভেম্বরে সংসদীয় কমিটির রিপাের্ট প্রকাশিত হল। এই সময়েই আইনসভার নির্বাচনও হল এবং জিন্না মহমেডান আর্বান-বম্বে সিটি আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন। ফলে, ডিসেম্বরে ভারতে ফিরেও
১৮১
এলেন তিনি, এবং এমন একটা সময় যখন লন্ডনে সংবিধান-সংক্রান্ত আলােচনা পালা ফুরিয়েছে, এবং রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ভরকেন্দ্র ফের ভারতেই ফিরে এসেছে; ঠিক তখনই তার রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ফের নতুন করে শুরু হল। সব দিক থেকেই নতুন একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল, ইউরােপেও নয়া একটা শক্তি ধীরে মাথাচাড়া দিচ্ছিল; নাৎসি জার্মানি। এ ছাড়া, মুসলিম লিগ-এর বিভিন্ন শিবিরও তাকে একটি ঐক্যবদ্ধ মুসলিম লিগ-এর সভাপতি হওয়ার আমন্ত্রণ জানাল। এস এস পিরজাদার সম্পাদিত বই ‘ফাউন্ডেশনস’-এ (দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৪-২২৮) এই বিবরণী পাওয়া যায়। “সেই ফজলি হুসেন, যিনি ১৯৩০-এ লিখেছিলেন, আর টি সি-তে জিন্না অপকর্ম করছেন (২২ ডিসেম্বর ১৯৩০, ফজলি হুসেনের ডায়েরি, পেপার্স, ষষ্ঠ খণ্ড), সেই ব্যক্তিকেই জিন্না আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখলেন, ভারতের মুসলিমরা আপনাকে হারানাের কথা ভাবতেই পারে না। স্বচ্ছ দৃষ্টি, স্বাধীন বিচারবােধ এবং চারিত্রিক দৃঢ়তাসম্পন্ন মানুষরা সংখ্যায় এত অল্প !”[৫৫]
পার্সিভ্যাল স্পিয়ার তাঁর নিবন্ধ ‘জিন্না, দ্য ক্রিয়েটর অব পাকিস্তান’-এ বলছেন যে, “বােলিথাে তার লেখা পত্রে জানিয়েছেন যে, বিশের দশকে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পক্ষে দাড়িয়ে জিন্না আপাতভাবে তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারের বিপুল ক্ষতি করেছিলেন। ১৯৩৪-এ তার দেশে ফেরার সঙ্গেও এই ঐক্যভাবনার একটা যােগসূত্র ছিল, সঙ্গে একটি ক্ষীণ আশাও থেকে গিয়েছিল। এই কারণেই তিনি ইকবাল-কথিত বিচ্ছিন্নতার যুক্তিকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। শেষে কংগ্রেস যখন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে লিগ-এর সঙ্গে কোনও সহযােগিতা চলতে পারে না, স্রেফ একটা অধীনতার সম্পর্ক বা এক ধরনের অধিগ্রহণের সম্পর্কই চলতে পারে, তখন জিন্না হাল ছেড়ে দিলেন।” শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস-এর স্বৈরতান্ত্রিক মনােভাবই কিন্তু জিন্নাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ করে তুলল, ‘‘জিন্নার আহত আত্মাভিমান নয়, বরং কংগ্রেসের অতি দর্পের জন্যই তার মনােভাবে এমন বিপুল পরিবর্তন এল।”
তথ্যসূত্র
১. ডেভিড ফ্রমকিন, দ্য ফল অব দি অটোমান এম্পায়ার অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অব দ্য মডার্ন মিডল ইস্ট, আউল বুকস, হেনরি হােল্ট অ্যান্ড কোম্পানি, এল এল সি, নিউ ইয়র্ক (এখানেই ‘আ পিস টু এন্ড অল পিস’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করা হয়েছে)
২. ওয়েলস, অ্যাম্বাসাডর অব হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি, পৃষ্ঠা ১৬৫-৬
৩. উইলিয়ম ম্যাঞ্চেস্টার, উইনস্টন স্পেন্সার চার্চিল: দ্য লাস্ট লায়ন, প্রথম খণ্ড: ভিশনস অব গ্লোরি, ১৮৭৪-১৯৩২, আ ডেল্টা বুক।ডেল পাবলিশিং, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা ৮৪৫-৬
৪. দ্রষ্টব্য তৃতীয় অধ্যায়, ফুটনােট ২৩।
১৮২
৫. যাঁরা বলেন রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই, তারা জানেনই না, ধর্ম জিনিসটা কী।’— গাঁধী।
৬. লয়েড এবং সুসান হেবার রুডলফ, পােস্টমডার্ন গাঁধী অ্যান্ড আদার এসেজ, গাঁধী ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড অ্যাট হােম, ইউনিভার্সিটি অব শিকাগাে প্রেস, ২০০৬, তারই একটি অধ্যায়।
৭. দিল্লি প্রস্তাব: পৃথক নির্বাচনমণ্ডলীই যে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের উন্নতির পথে প্রধান অন্তরায় তা বুঝতে পেরে জিন্না প্রস্তাব করলেন, হিন্দুরা যদি কিছু রক্ষাকবচ দিতে রাজি হয়, তা হলে মুসলিমরা তাদের দাবি ছেড়ে দেবে। এরই পরিণতিতে ১৯২৭-এ দিল্লিতে মুসলিমদের একটি সম্মেলনে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হয়, এটিই ‘দ্য দিল্লি-মুসলিম প্রােপােজাল’ নামে খ্যাত। এতে যে সব রক্ষাকবচের কথা বলা হয়েছিল, সেগুলি নীচে উল্লেখ করা হল:
ক. পৃথক সিন্ধু প্রদেশ গঠন করতে হবে।
খ. অন্যান্য প্রদেশের মতােই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানেও সংস্কার চালু করতে হবে।
গ. যদি না এবং যতক্ষণ না এই প্রস্তাবগুলি কার্যকর হচ্ছে, ততক্ষণ মুসলিমরাও পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বের দাবি ছাড়বে না। যদি এই দুটি প্রস্তাব মুসলিমদের মনােমত ভাবে কার্যকর হয়, সে ক্ষেত্রে মুসলিমরা পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর পরিবর্তে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলী মেনে নেবে। তবে তখন জনসংখ্যায় বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর আনুপাতিক হারে আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করতে হবে। তা ছাড়া, নিম্নলিখিত শর্তগুলিও মেনে চলতে হবে।। ঘ. হিন্দু-সংখ্যাগুরু এলাকায় মুসলিমদের জন্য যে আনুপাতিক হারে আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত হচ্ছে, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য জনসংখ্যার অনুপাতে যথাযথ হারে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঙ. কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব এক-তৃতীয়াংশের কম করা যাবে না।
চ. ধর্মীয় স্বাধীনতার বাইরেও সংবিধানে এমন বন্দোবস্ত রাখতে হবে, যাতে কোনও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে কোনও রকম বিল নিয়ে আসা বা কোনও প্রস্তাব পাশ করা না যায়, যদি সেই সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ সেই বিল বা প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন।
এই সব প্রস্তাব মানতে বা নাকচ করতে গেলে, প্রস্তাবটি হুবহু যা আছে, সেই অবস্থায় করতে হত। সুতরাং, মুসলিমরা আসন সংরক্ষণ পেলে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি ছেড়ে দিতে তৈরি ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, কংগ্রেস প্রথমে এই প্রস্তাব মেনে নিয়েও পরে খারিজ করে।
৮. পােস্টমডার্ন গাঁধী অ্যান্ড আদার এসেজ, গাঁধী ইন দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যান্ড অ্যাট হােম, পৃষ্ঠা ৬৭
৯. কালেন্ড (Kalend) ছিল গ্রিক নয়, রােমান ক্যালেন্ডারের অংশ, তাই ‘গ্রিক কালেন্ড’।
১০, জওহরলাল নেহরু, গাঁধীকে লেখা চিঠি, ১১ জানুয়ারি, ১৯২৮
১১, আগা খাই ১৯২৭-এর ডিসেম্বরে আইনসভায় মুসলিম প্রতিনিধিদের বৈঠকের কথাটি প্রথম তােলেন। তবে নেহরু রিপাের্ট প্রকাশ পাওয়ার পরেই এ বিষয়ে যাবতীয় তৎপরতা শুরু হয়, এবং তখন সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে জিন্নার কিছু সহকর্মী, যেমন স্যর মহম্মদ ইয়াকুব এবং ফজল রহিমতুল্লা গােটা ব্যাপারটাকে বাস্তবে রূপ দেন।
১২. জিন্নার চোদ্দো দফা এ রকম:
১৮৩
১. ভবিষ্যৎ সংবিধানের চরিত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় হবে, অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশগুলির হাতে থাকবে। ২. প্রতিটি প্রদেশকে সমান স্বশাসনের অধিকার দেওয়া হবে।
৩. দেশের প্রতিটি প্রদেশের আইনসভা এবং অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে সংখ্যালঘুদের যথেষ্ট এবং কার্যকর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা হবে, তবে কোনও প্রদেশেই সংখ্যাগুরুদের সংখ্যালঘুর সমান বা কম প্রতিনিধিত্ব দেওয়া চলবে না।।
৪. কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলমান প্রতিনিধিদের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশের কম হওয়া চলবে না।
৫. সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব আপাতত পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে স্থির করা হবে। কিন্তু ভবিষ্যতে কোনও সম্প্রদায় যদি চায়, তা হলে তাকে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর পরিবর্তে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর নির্বাচনে আসতে দেওয়া হবে।
৬. কোনও কারণে অঞ্চল বণ্টনের প্রয়ােজন হলে তা কোনও ভাবে পঞ্জাব, বাংলা এবং উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুসলমান সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার ওপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না।
৭. প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষকে পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা, অর্থাৎ ধর্মীয় বিশ্বাস, উপাসনা, প্রচার, মেলামেশা এবং শিক্ষার স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
৮. যদি কোনও আইনসভায় বা অন্য কোনও নির্বাচিত প্রতিষ্ঠানে কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের তিন-চতুর্থাংশ অথবা তার বেশি প্রতিনিধি কোনও একটি বিল বা কোনও রেজলিউশন অথবা কোনও বিল বা রেজলিউশনের কোনও অংশ সম্বন্ধে এই মর্মে আপত্তি জানান যে বিষয়টি তাদের সম্প্রদায়ের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকারক হবে, তা হলে হয় সেই বিল বা রেজলিউশন বা তার আপত্তিজনক অংশটিকে পাশ করা যাবে না, অথবা এই সমস্যাটি তৈরি করে কাজ করা সম্ভব, এমন কোনও বিকল্প খুঁজে বার করতে হবে।
৯, বম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে সিন্ধুপ্রদেশকে বাদ দিতে হবে।।
১০. অন্যান্য প্রদেশে যে গতিতে সংস্কার হবে, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানেও সেই গতিতেই সংস্কার করতে হবে।
১১. সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে প্রাদেশিক এবং স্থানীয় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির চাকরিতে মুসলমানরা যথেষ্ট সুযােগ পান। তবে, তাদের চাকরির জন্য আবশ্যিক যােগ্যতার শর্তটি পূরণ করতে হবে।
১২. সংবিধানে যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে যাতে মুসলমান সংস্কৃতিকে রক্ষা করা যায়, এবং মুসলমানদের শিক্ষা, ভাষা, ধর্ম, পার্সোনাল ল’ এবং মুসলমান দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করা যায় এবং তার উন্নতিসাধন সম্ভব হয় এবং প্রাদেশিক ও স্থানীয় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলির আর্থিক সাহায্যে মুসলমানরা তাদের যথার্থ ভাগ পান।
১৩. অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান সদস্য না রেখে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক স্তরে কোনও মন্ত্রিসভা গঠন করা যাবে না।
১৪. কেন্দ্রীয় আইনসভা সংবিধানে এমন কোনও পরিবর্তন করতে পারবে না যেখানে প্রদেশের অভিমত গ্রাহ্য করা হয়নি।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ-এর কাউন্সিল কায়েদ-এর এই চোদ্দো দফা সূত্র মেনে নিয়েছিল। তারা একটি প্রস্তাবও পেশ করে যাতে বলা হয়, ভারত সরকারের সংবিধান যদি কায়েদ-এর
১৮৪
এই চোদ্দো দফা সূত্র মেনে না নেয়, তা হলে কোনও ভাবেই তা মুসলিমদের কাছে গ্রাহ্য হবে ।
১৩, মােতিলাল নেহরু পেপার্স: নেহরু টু গাঁধী, ১৪ অগস্ট, ১৯২৯
১৪. মুভিমান কমিটি রিপাের্ট-এর সরকারি নাম রিপাের্ট অব দ্য এনকোয়ারি রিফর্মস কমিটি, ১৯২৪। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, ১৯১৯ থেকেই এর উৎপত্তি। কমিটি কাজ শুরু করার পরেই মূলত স্বরাজ্য দলের নেতৃত্বে সংবিধান পুনর্বিবেচনা করে ভারতকে স্বশাসিত ডােমিনিয়ন-এর মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে আইনসভায় প্রস্তাব পাশ করার তােড়জোড় শুরু হয়। এই দাবিদাওয়ার ফলে তৎকালীন ভারত সরকার স্যর আলেকজান্ডার মুডিমান-এর নেতৃত্বে ন’সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে, তাদের কাজ ছিল এই রকম: কেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্য প্রদেশে গভর্নর-শ্বাসিত সরকারের পরিচালনার ক্ষেত্রে গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন থেকে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, বা ওই অ্যাক্টের মধ্যেই কোনও সমস্যা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা, উল্লিখিত অ্যাক্ট-এর কাঠামাে, নীতি এবং উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কোনও সংশােধনী আনা উচিত কি না, সে সব অনুপুঙ্খ বিচার করা, ১৯২৪-এর অগস্ট থেকে ডিসেম্বর-এর মধ্যেই কমিটি কাজ শেষ করে ফেলেছিল, রিপাের্ট পেশ করে ১৯২৫-এর সেপ্টেম্বরে। সেই রিপাের্ট-এর সংযােজনের মধ্যে ছিল যারা কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, সেই সব জননেতা বা ব্যক্তির তালিকা। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-এর মধ্যে আইনগত এবং সাংবিধানিক পথে কী কী করা যেতে পারে, সে বিষয়ে মেমােরান্ডাম, এবং কমিটির অন্যতম সদস্য বিজয়াদ মহতাব-এর লেখা একটি দীর্ঘ নােট।
১৫. পার্লামেন্টের কিছু সদস্য নিয়ে গড়া যে ছোেট কমিটি কোনও একটি বিশেষ বিষয়কে খতিয়ে দেখার জন্য তৈরি হয়, তাকেই সিলেক্ট কমিটি বলে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচেই এর উৎপত্তি।
১৬. জিন্নার সঙ্গে আরউইন-এর সাক্ষাৎকারের নােট, ৩১ অক্টোবর, ১৯২৭। হ্যালিফ্যাক্স সংগ্রহ, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি (এইচ সি, আই ও এল), এম এস এস.ই ইউ আর.সি ১৫২/২১
১৭. জিন্নার চিঠি, তদেব
১৮. দ্য টাইমস, লন্ডন, ১০ নভেম্বর ১৯২৭
১৯. দ্য ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, ১৫ নভেম্বর, ১৯২৭
২০. টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১৫ নভম্বর, ১৯২৭ (এ ছাড়াও দেখুন জিন্না-আরউইন করেসপন্ডেস, ওয়াহিদ আহমেদ সম্পাদিত, রিসার্চ সােসাইটি অব পাকিস্তান, ইউনিভার্সিটি অব পঞ্জাব, লাহৌর, ১৯৬৯, পৃষ্ঠা ৬)।
২১. টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২৮ নভেম্বর, ১৯২৭ (এ ছাড়াও জিন্না-আরউইন করেসপন্ডেস, রিসার্চ সােসাইটি অব পাকিস্তান।
২২. দ্য সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট, লাহৌর, ৪ জানুয়ারি ১৯২৮
২৩. বার্কেহেডকে আরউইনের চিঠি, ১৫ মার্চ, ১৯২৮ (এইচ সি, আই ও এল), এম এস এস, ই ইউ আর. সি ১৫২/২৯
২৪. ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপকে আরউইনের চিঠি, ২৯ নভেম্বর, ১৯২৮
২৫. ১৯১৭-র ঘােষণায় ভারতে ‘দায়িত্বশীল সরকারের সদর্থক বাস্তবায়নের দিকে নজর
১৮৫
রেখে স্বশাসিত সংস্থার ক্রমিক বিকাশের কথা বলা হয়েছিল। এই একই শব্দবন্ধ আইনটির প্রস্তাবনার মধ্যেও উপস্থিত, রয়্যাল ওয়ারান্ট অব ইনস্ট্রাকশনস-এর মধ্যেও এই পরিভাষাটি হাজির, সেখানে আরও বলা হয়েছে যে, ভারত এই ভাবে বিশ্বের অন্য আরও নানা ডােমিনিয়নের মধ্যে জায়গা করে নেওয়ার যােগ্য হয়ে উঠবে। এই পরিভাষাটির নিজস্ব তাৎপর্য আছে। আমরা জানি, সচেতন ভাবেই এটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেস এবং লিগ ব্রিটিশ সরকারকে অনুরােধ করেছিল, সরকার যে অবিলম্বে ভারতকে স্বশাসন দিতে ইচ্ছুক, সে কথা ঘােষণা করা হােক, তখনই মন্ত্রিসভা ওই পরিভাষাটি বেছে নেয়। আইনে যে ভাবে শব্দবন্ধটি আছে, তার প্রয়ােগ খুবই সূক্ষ্ম, এর মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে ভারতকে যাঁরা চালনা করবেন, তঁারা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের পরিবর্তে ভারতীয় আইনসভার কাছেই দায়বদ্ধ থাকবেন। যদি ‘ফুল ডমিনিয়ন সেলফ গভর্নমেন্ট’ কথাটি খুঁটিয়ে দেখা যায়, তখন বােঝা যাবে যে, এর মাত্রা অনেক ব্যাপক, যাতে শুধুমাত্র এ কথাই বােঝাচ্ছে না যে, ভারতে কার্যনির্বাহীরা আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন, বরং এ কথাও সেখান থেকে বেরিয়ে আসছে যে, আইনসভারও সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে যা কি না আধুনিক ডমিনয়নের একটি বৈশিষ্ট্য। আমার মতে, ভিতরে কিছু পার্থক্য আছে, কারণ দায়িত্বশীল সরকার বস্তুটি মােটেই সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন আইনসভার সঙ্গে সঙ্গতিশীল নয় ভাবলে ভুল হবে। হতেই পারে যে দায়িত্বশীল সরকার থেকেই যুক্তিসঙ্গত ধাঁচে এক সময় ফুল ডমিনিয়ন সেলফ গভর্নমেন্ট উঠে আসবে, অথবা আরও একটু তলিয়ে ভাবলে এটাই হয়তাে দায়িত্বশীল সরকারের একটা অনিবার্য এবং ইতিহাসানুগ বিবর্তন। কিন্তু, এটা আরও প্রসারিত এবং চূড়ান্ত একটি ধাপ। (ভারতকে সম্পূর্ণ স্বশাসিত ডমিনিয়ন মর্যাদা দান প্রসঙ্গে স্যর ম্যালকম হেলি, ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সদস্য, গােয়ের এবং আপ্পাদুরাই, পৃষ্ঠা ২২০)।
২৬. লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি ডিবেট, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৪, পৃষ্ঠা ৭৬৮
২৭. জিন্নার চিঠি আরউইনকে, জিন্না-আরউইন করেসপন্ডেস, পৃষ্ঠা ৪১
২৮, ছত্রির নবাব: আহমেদ সয়ীদ খান (জন্ম ১৮৮৮): যুক্তপ্রদেশের শিল্পমন্ত্রী ১৯২৩-২৫, হােম মেম্বার, যুক্তপ্রদেশ, ১৯২৬-৩৩, কার্যনির্বাহী গভর্নর, যুক্তপ্রদেশ, ১৯২৮ এবং ১৯৩৩, হায়দরাবাদ-এর প্রধানমন্ত্রী, ১৯৪৭, জমিদার পার্টি এবং মুসলিম লিগ-এর নেতা।
২৯. আগা খাঁ, দ্য মেময়ার্স অব আগা খান, সাইমন অ্যান্ড শুস্টার, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৪
৩০. ভােপাল-এর নবাব, স্যর হামিদুল্লা খাঁ (১৮৯৪-১৯৬০), চেম্বার অব প্রিন্সেস-এর চ্যান্সেলর, ১৯৩১-২ এবং ১৯৪৪-৭
৩১. দ্য মেময়ার্স, অব আগা খাঁ, পৃষ্ঠা ২৩১
৩২. তদেব, পৃষ্ঠা ২৩৩-৩৪
৩৩, স্ট্যানলি ওলপার্ট, জিন্না অব পাকিস্তান, পৃষ্ঠা ১২০
৩৪. তদেব, তবে মূল উদ্ধৃতিটি স্যর ম্যালকম হেলি-র একটি জীবনী থেকে গৃহীত।
৩৫. তদেব, পৃষ্ঠা ১২১
৩৬. জোয়াকিম আদা, মেন অ্যান্ড সুপারমেন অব হিন্দুস্থান, বম্বে, ১৯৪৩-এ উদ্ধৃত, পৃষ্ঠা ২২৬
৩৭. দ্য সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেট, ৩ মার্চ, ১৯৩৬। ৩৮. ডেভিড পেজ, প্রিলুড টু পাকিস্তান— দি ইন্ডিয়ান মুসলিমস অ্যান্ড দি ইম্পিরিয়াল
১৮৬
সিস্টেম অব কন্ট্রোল, ১৯২০-১৯৩২, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লি, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ২২৯
৩৯. ‘রাম রাজ’ বা ‘রাম রাজ্য’: গাঁধী বলেছিলেন, “রাম রাজ মানে আমার কাছে মােটেই হিন্দু রাজ নয়। রাম রাজ বলতে আমি বুঝি একটা স্বর্গরাজ্য, ঈশ্বরের সাম্রাজ্য। রাম রাজ্য সেটাই যেখানে স্থানীয় প্রশাসন স্থানীয় সম্পদগুলি নিয়ন্ত্রণ করে, স্থানীয় স্তরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যেখানে রাষ্ট্র জনতার মতামতকে সম্মান করে, স্বচ্ছতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করে, পরিকাঠামাে এবং নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়ে যুক্তিসঙ্গত হারে কর আরােপ করে, এবং যথার্থ সমন্বয়সাধনের বন্দোবস্ত করে, হস্তক্ষেপ করে না বা অবস্থার সুযােগ নিয়ে ক্ষমতা ফলায় না।
৪০. জি আই হােম পলিটিক্যাল, 33/x/1931:AICC Circular No. 12.১০ মার্চ, ১৯৩১
৪১. আনা হল টাকা (Rupee)-র এক চতুর্থাংশ, যেখানে টাকা হচ্ছে ষােলাে আনার সমতুল্য। এই পরিভাষাটি বহু দিনই পরিত্যক্ত। চার আনার সদস্য’ মানে নিছকই ‘প্রাথমিক সদস্য।
৪২. ফজলি হুসেন পেপার্স: মহম্মদ ইকবালকে লেখা হুসেনের চিঠি, ১ মে, ১৯৩১
৪৩. দ্য মেময়ার্স অব আগা খাঁ, পৃষ্ঠা ২৩৫
৪৪. ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্যর র্যামসে ম্যাকডােনাল্ড-এর (১৮৮৬-১৯২৭) ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন এখনও হয়নি। তিনি ১৯২৪-এ গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পরে ফের ১৯২৯-৩৫ সময়কালে প্রধানমন্ত্রী হন এবং ১৯১১ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত ছিলেন লেবার পার্টির নেতা। প্রথম দিকে ভারতে তিনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে ১৯১১-য় ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁকে সভাপতিত্ব করার আহ্বান জানানাে হয়েছিল, যদিও স্ত্রী প্রয়াত হওয়ায় সেই অনুরােধ তিনি রাখতে পারেননি। যাঁরা বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করেছিলেন, তাদের তালিকায় তার নাম প্রথম সারিতে। পরে তিনি আরও ঘােষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার প্রতিরক্ষা, বিদেশ মন্ত্রক, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার মতাে কিছু রক্ষাকবচ বাদ দিলে আইনসভার হাতে অন্য কার্যনির্বাহী ক্ষমতা তুলে দেওয়ার নীতি বিবেচনা করতে প্রস্তুত। অবশ্য, তিনি ছিলেন পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী প্রবর্তন করার মূল কারিগর। ডিপ্রেসড ক্লাস’-এর জন্য ম্যাকডােনাল্ড যে কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড ঘােষণা করেন, তারই মধ্যে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর বন্দোবস্ত ছিল, প্রতিবাদে গাঁধীজি আমরণ অনশন শুরু করেন। ম্যাকডােনাল্ড সখেদে বলেছিলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ একটি ভারতের আশা, নিজস্ব উদ্দেশ্য এবং নিয়তি সম্পর্কে সচেতন একটি ভারতের আশা ক্রমেই মনে হচ্ছে চূড়ান্ত অলীক স্বপ্নের বেশি কিছু নয়। সাইমন কমিশন নিয়ােগের পিছনে তার একটি বড় ভূমিকা ছিল। এই ধরনের বন্দোবস্তের জন্যই স্ট্যানলি বল্ডউইন তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। রক্ষণশীল ধাঁচ গ্রহণ করার জন্যই এই অভিনন্দন। উইনস্টন চার্চিল বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, সরকার যে গােটা দুনিয়াকে ধনতন্ত্র বিষয়ে আরও সচেতন করে তােলার, বলতে গেলে দুনিয়াটাকে ধনতন্ত্রের জন্য আরও নিরাপদ করে তােলার রক্ষণশীল কর্মসূচি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছে, তাতে তিনি পূর্ণ সহযােগিতা করতে প্রস্তুত। লয়েড জর্জ বলেছিলেন, ম্যাকডােনাল্ডই হচ্ছেন ‘শেষ রক্ষণশীল। এমনকী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুও নিশ্চিত ছিলেন, ম্যাকডােনাল্ডের নেতৃত্বে লেবার পার্টির সরকার ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনও উপকারেই আসবে না।
১৮৭
৪৫. বক্সি, মহাত্মা গাঁধী: কংগ্রেস অ্যান্ড ইটস লিডারশিপ, আনমােল পাবলিশার্স, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ১৪৩
৪৬. ভিক্টর ট্রেঞ্চ, লর্ড উইলিংডন ইন ইন্ডিয়া, ১৯৩৪, পৃষ্ঠা ২১২
৪৭. গাঁধী নিয়মই করে দিয়েছিলেন যে তাঁর আশ্রমে (আশ্রম অর্থে গাঁধীর ভাবনাপ্রসূত এক ধরনের সমবায় খামার, যেখানে গাঁধীর নির্দেশিত পথে যাঁরা চলেন, তারা থাকতে পারতেন, সেই সংস্কৃতির প্রচারও করতে পারতেন) প্রতিটি আশ্রমবাসীকেই গৃহস্থালির প্রতিটি কাজকর্ম নিজেকেই করতে হবে, এমনকী হিন্দু জাতপাতের ধারায় নিম্নতম বর্গ ‘ভাঙ্গি’র যে কাজ, সেই মলমূত্র পরিষ্কারও নিজেদেরই করতে হবে। এই ভাঙ্গিদেরই তিনি পরে নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’।.
৪৮. দ্য কালেক্টেড ওয়ার্কস অব মহাত্মা গাঁধী, পাবলিকেশনস ডিভিশন, শিক্ষা এবং সম্প্রচার মন্ত্রক, ভারত সরকার, দিল্লি
৪৯. দুর্গা দাস, ফ্রম কার্জন টু নেহরু, ১৯৭০, পৃষ্ঠা ১৫৯।
৫০. জওহরলাল নেহরু, গাঁধীকে লেখা চিঠি, ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩১, সিলেক্টেড ওয়াকর্স, পঞ্চম খণ্ড, ১৯৭২-৪, পৃষ্ঠা ৩১-২
৫১. তদেব।
৫২. তদেব, ৪ অক্টোবর, ১৯৩১, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, পঞ্চম খণ্ড, ১৯৭২-৪, পৃষ্ঠা ১৩৭
৫৩. তদেব, ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩১, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, পঞ্চম খণ্ড, ১৯৭২-৪, পৃষ্ঠা ৪৬
৫৪. ইয়ান ওয়েলস, পৃষ্ঠা ২২৯
৫৫, ফজলি হুসেন টু জিন্না, পেপার্স, খণ্ড ১৬-১৭
১৮৮
পঞ্চম অধ্যায়
ছােট দশক, লম্বা দৌড়
১৯৩৫: মুসলিম লিগ
মহম্মদ আলি জিন্না যে মুসলিম লিগের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, সেটি কোনও সচল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৩৫-৩৬ সালের এই মুসলিম লিগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা প্রায় সবাই উচ্চ বর্গের খেতাবধারী মানুষ, নবাব, জমিদার। আর একটা অংশ ছিল সুযােগসন্ধানীর দল, যারা চিরকালই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে ঘােরাফেরা করে, এ কালে তাদের রকমটা পালটেছে, এই যা। এই নেতৃত্ব ‘মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিলেন বটে, কিন্তু সবার আগে ছিল নিজেদের স্বার্থচিন্তা। সমাজে বা ব্রিটিশদের কাছে তাদের স্বার্থহানি হয়, এমন কিছু তারা কোনও অবস্থায় মেনে নিতে রাজি ছিলেন না।
১৯০৬ সালে জন্মের সময় থেকেই মুসলিম লিগের কার্যকলাপ ছিল চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ‘আশরফ’দের পরিশীলিত, ভদ্র আলােচনা ও তর্ক ছাড়া আর কিছুই হত না। এতে তাদের নিজেদের ছাড়া আর কারও কোনও মাথাব্যথা ছিল না। এমনকী, লিগের বার্ষিক অধিবেশনও হত শামিয়ানা খাটিয়ে অথবা কোনও বড় হল ভাড়া করে। সেখানে বাইরের লােক বলতে থাকতেন বড়জোর কয়েক জন আমন্ত্রিত অতিথি। গণ আন্দোলনের কথা লিগের নেতারা ভাবতেনও না। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে লিগের সদর দফতর ছিল আলিগড়ে, এই প্রতিষ্ঠান কার্যত মহামেডান অ্যাংলাে-ওরিয়েন্টাল কলেজ-এর সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করত, স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার কোনও ভূমিকাই ছিল না। স্যর সৈয়দ আহমদ খান-এর সময় থেকেই আলিগড় ছিল মুসলিমদের অধিকাংশ কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। শেষ পর্যন্ত ১৯১০ সালে মুসলিম লিগের দফতর স্থানান্তরিত হল লখনউয়ে। সদস্যদের টাকা এবং বার্ষিক চাদা থেকে লিগের যা আয় হত, তাতে দফতরের খরচ চালানােই কঠিন ছিল, অন্য কার্যকলাপ তাে দূরের কথা। লখনউয়ে রাজাসাহেব মাহমুদাবাদ-এর বার্ষিক তিন হাজার টাকা অনুদানে লিগের কাজ চলত। কংগ্রেসের মতাে সম্পন্ন পৃষ্ঠপােষক মুসলিম লিগ গােড়ার দিকে পায়নি।
১৮৯
‘খিলাফত আন্দোলনের যুগে মুসলিম লিগের এই সীমিত সম্পদও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় লিগের প্রায় কোনও অস্তিত্বই ছিল না। যখন খিলাফত সম্মেলন বা কংগ্রেসের অধিবেশন বসত, তখন তার পাশাপাশি লিগের সভাও সেরে নেওয়া হত। বাকি সময়টা তার প্রায় কোনও কাজকর্মই থাকত না। মুসলিম লিগ কী বলেছে। বা করেছে, সরকারি নথিপত্র ছাড়া আর কোথাও কেউ তার কোনও খোঁজই রাখত না। খিলাফত আন্দোলনে যে ধরনের মানুষ শামিল ছিলেন, মুসলিম লিগেও যুক্ত ছিলেন। তারাই। কিন্তু, খিলাফতের মতাে মুসলিম সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার কোনও লক্ষ্য লিগের ছিল না। ১৯৩৫ সালে মুসলিম লিগের কোনও অধিবেশন হয়নি, খিলাফত কমিটি তার আগেই অধিবেশন ডাকা বন্ধ করে দিয়েছিল। লিগের এই মৃতপ্রায় অবস্থার পিছনে। ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য: মুসলিম রাজনীতির আসল ভরকেন্দ্র ছিল প্রদেশগুলিতে, সর্বভারতীয় আন্দোলন গড়ে তােলার মতাে কোনও আদর্শ তার তহবিলে ছিল না।
প্রাদেশিক নির্বাচনের কাল সমাগত হল। সেই কথা মাথায় রেখে ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে খালেকুজ্জামান দিল্লিতে মুসলিম লিগের একটি অধিবেশনের নােটিস পাঠালেন। জিন্নাকে সেই অধিবেশনে সভাপতি হওয়ার জন্য অনুরােধ করা হল। এই সভাতেই মুসলিম লিগ এবং মুসলিম ইউনিটি বাের্ডের মিলন ঘটানাের ব্যাপারে জিন্নার সঙ্গে কথা হল। খালেকুজ্জামান তঁার ‘পাথওয়ে টু পাকিস্তান’ গ্রন্থে জিন্নার একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। জিন্না ওই অধিবেশনে বলেছিলেন, “আমি দেখতে চাই, মুসলিম লিগের সংগঠন পরিশুদ্ধ এবং নতুন জীবন পেয়েছে, এই উদ্দেশ্যেই ১৯৩৬-এর ১০ মে মুম্বইয়ে আমি মুসলিম লিগের একটি অধিবেশন ডাকতে চলেছি। সেখানে আমি লিগকে আবেদন করব, যেন আমাকে আসন্ন নির্বাচনের জন্য একটি পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।… আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, ওই বাের্ডে আপনাদের দলের মানুষকে আমি সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দেব। আমাদের যদি মুসলিম টিকিটে নির্বাচনে লড়তে হয়, তা হলে আমাদের দু’পক্ষকেই দেখতে হবে, যাতে আমাদের ভােট ভাগ হয়ে না যায়। সুতরাং, আসুন, আমরা মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ডের ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামি।”[২]
১৯৩৬-এ মুসলমানদের রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। একটি সুসংবদ্ধ দলের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে একটা ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে দাঁড়িয়ে লড়াই করার। কোনও সম্ভাবনাই তাদের সামনে ছিল না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে একটা অভিন্ন মুসলিম মঞ্চ থেকে লড়াইয়ের জন্য জিন্না জামিয়াত-উল-উলেমা-ই-হিন্দএর সেক্রেটারি মৌলানা আহমেদ সয়ীদ-এর সঙ্গে আলােচনা শুরু করলেন। কিন্তু, সেই ন্যূনতম ঐক্যের জন্যও মুসলিম লিগের সঙ্গে মুসলিম ইউনিটি বাের্ডের বােঝাপড়া জরুরি ছিল, কারণ ১৯৩৪ সালের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় এক-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হওয়ার সুবাদে মুসলিম ইউনিটি বোের্ড নিজেকে প্রকৃত মুসলিম মঞ্চ হিসেবে গণ্য করত। একটা রাজনৈতিক দল নির্বাচনে সফল হলে তার পক্ষে নিজের মর্যাদা বিসর্জন দেওয়া প্রায় অসম্ভব, এমনকী যদি সেই দল কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে
১৯০
পড়ে, তা হলেও। অথচ, ১৯৩৭ সালের নির্বাচন শিয়রে এসে পড়েছে, তার জন্য একটা সন্তোষজনক পরিকল্পনা চাই। এই ব্যাপারটা ভাল করে বােঝা দরকার, কারণ ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭, এই সময়পর্বে মুসলিম লিগ-ই ছিল ভারতীয় মুসলমানদের প্রথম যথার্থ রাজনৈতিক আন্দোলন। তার আগে স্যর সৈয়দ আহমদ খানের কর্মকাণ্ড ছিল মুসলমানদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে পরিচালিত। এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে মুসলিম সমাজের যােগদানে তার স্পষ্ট আপত্তি ছিল।
জিন্না ছিলেন ষােলাে আনা রাজনীতিক। স্পষ্টতই তিনি তখন একটি মুসলিম ভূখণ্ড চেয়েছিলেন, ইসলামি রাষ্ট্র চাননি। এই প্রশ্নে লিগের ওয়ার্কিং কমিটির কনিষ্ঠ সদস্য রাজাসাহেব মাহমুদাবাদের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে তার চাপা মতবিরােধ চলছিল।
তবু, ত্রিশের দশকের গােড়ার দিকে মুসলমানদের মধ্যে কোনও ঐক্য ছিল না এবং মুসলিম লিগ তখনও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে একেবারেই নগণ্য। তাই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে লিগ মুসলিম ভােটের মাত্র ৪.৮ শতাংশ পেল। হেক্টর বলিথাে-র ‘ইন কোয়েস্ট অব জিন্না বইতে লেখকের সঙ্গে এ বি (সনি) হাবিবুল্লার একটি কথােপকথনের বর্ণনা আছে। কথােপকথনটি ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ২ এপ্রিল। সনি হাবিবুল্লা বলেছিলেন,
“পুনরুজ্জীবিত মুসলিম লিগে আমি ছিলাম জিন্নার প্রথম পর্বের শিষ্যদের এক জন। তার সঙ্গে আমি চার বছর ছিলাম: ১৯৩৬ থেকে ১৯৪০। ১৯৩৮ কিংবা ‘৩৯-এ এক ব্যক্তি জিন্নাকে ‘আমার দেশের (নেশন) নায়ক’ বলে সম্বােধন করেছিলেন। জিন্না তাকে বলেন, আমি আপনার নেতা হতে পারি, কিন্তু আলাদা কোনও দেশের নেতা নই।
“জিন্নার অহংবােধ ছিল অতি প্রবল এবং তিনি ছিলেন অত্যন্ত তােষামােদপ্রিয়।… ১৯৪৩ পর্যন্ত তিনি বেশ পরমতসহিষ্ণু ছিলেন, এমনকী তর্ক তুললে খুশি হতেন। কিন্তু তার পর তার শরীর ভাঙতে শুরু করল, তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন, কোনও বিষয়ে। তর্ক শুনতে চাইতেন না, যারা সব কথায় ‘হ্যা হ্যা বলে তাদের পছন্দ করতেন। কিন্তু তার হাসিটি ছিল সংক্রামক, এবং মাথাটা একটু পিছন দিকে হেলিয়ে যখন হাে হাে করে হাসতেন, ভঙ্গিটি বড় মনােহর ছিল।
“তার অসহিষ্ণুতা ছিল প্রকাণ্ড। মাহমুদাবাদ বলেছিলেন, ‘আমার নেতার দক্ষতম রাজনীতিক হওয়ার কোনও প্রয়ােজন নেই, তাকে ঈশ্বরের সবচেয়ে নিকটবর্তী হতে হবে। এই কথা বলার জন্যে জিন্না মাহমুদাবাদকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি যুক্তপ্রদেশের (ইউনাইটেড প্রভিন্স) মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট ইসমাইল খানকে অপসারণ করেছিলেন, কারণ জিন্নার কোনও কথা বা কাজ ভুল মনে হলে খান সে কথা তাকে বলে দিতেন।”
১৯১
১৯৩৭ নির্বাচন: প্রথম পদক্ষেপ
ব্রিটিশদের ধারণা ছিল, কংগ্রেসের নেতারা অনেক দিন কারাবন্দি থাকার ফলে দলের মনােবল ভেঙে গেছে, তাই ১৯৩৭-এর নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না। কংগ্রেসের নেতৃত্ব তখন আর ঐক্যবদ্ধ এবং দৃঢ়মনস্ক নয়। কংগ্রেসের অনেক নেতা, বিশেষত যাঁরা বামপন্থী মনােভাবাপন্ন, সংবিধানকে ভিতর থেকে ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিলেন বটে, কিন্তু দলের নেতাদের মধ্যে প্রবল মতানৈক্য ছিল। এমনকী মহাত্মা গাঁধীর প্রধান সহযােগীরা বলেছিলেন, নেহরু কংগ্রেসের লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রের প্রচার থেকে বিরত না হলে তারা কংগ্রেসের সেন্ট্রাল একজিকিউটিভ (যাকে ওয়ার্কিং কমিটি বলা হত) থেকে পদত্যাগ করবেন। দলের প্রধান নেতারাও তখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। ১৯৩৬-এর জুনের শেষে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার পটেল, চক্রবর্তী রাজাগােপালাচারি, আচার্য কৃপালনী এবং ওয়ার্কিং কমিটির অন্য সদস্যরা কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি নেহরুকে একটা কড়া চিঠি দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন:
“আমরা মনে করি, আপনি এবং আপনার সমাজতন্ত্রী সহকর্মীরা যে সব বক্তৃতা দিচ্ছেন এবং যা করছেন, তার ফলে দেশের সর্বত্র কংগ্রেসের কোনও লাভ না হয়ে ক্ষতিই হচ্ছে। দেশের সামনে এখন যে রাজনৈতিক কর্মসূচি রয়েছে, বিশেষত যে নির্বাচন এসে পড়েছে, তার ওপর আপনাদের প্রচারের ফল ক্ষতিকর হবে। এই অবস্থায় আমরা দলীয় সংগঠন জোরদার করে ভােটে লড়তে পারব না। এই পরিপ্রেক্ষিতেই অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমরা ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
এই সংকট কেটে গিয়েছিল বটে, কিন্তু বিলক্ষণ বােঝা গিয়েছিল যে, নেহরুর ‘সাহেবি’ চিন্তাধারায় তার দলের লােক কতটা বিরক্ত ছিলেন।
তাই নির্বাচনী প্রক্রিয়া যখন শুরু হল, সে সময় জিন্নার আশা ছিল, সকলের প্রতি সমদৃষ্টি নিয়ে চললে ন্যাশনাল এগ্রিকালচারালিস্ট পার্টি (এন এ পি) এবং মুসলিম ইউনিটি বাের্ড-এর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মেটানাে সম্ভবপর হবে। তিনি চাতারি-র নবাব সাহেব এবং চৌধুরী খালেকুজ্জামান, দুজনকেই অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ড-এর (এ আই এম এল পি বি) সদস্য মনােনীত করলেন। কিন্তু মনােনীত হওয়ার অল্পকাল পরেই নবাব চাতারি এবং এন এ পি’র স্যর মুহম্মদ ইউসুফ প্রকাশ্যে মুসলিম লিগের সঙ্গে তাদের মতানৈক্যের কারণগুলি জানিয়ে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলেন।
স্যর মুহম্মদ ইউসুফ বললেন সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার আতঙ্কের কথা, এবং নবাব চাতারির মতােই তিনিও বললেন যে একমাত্র হিন্দু-মুসলমানের যৌথ প্রচেষ্টার সাহায্যেই এই বিপদের মােকাবিলা করা সম্ভব। তারা আরও বললেন যে, ইউ পি’র পরিস্থিতি অবশিষ্ট ভারতের থেকে আলাদা। খালেকুজ্জামানের গােষ্ঠীর সঙ্গে নিজেদের মতের সাযুজ্য নিয়ে তিনি যা বললেন, সেটা চাতারির কথায় আরও স্পষ্ট বেরিয়ে এসেছিল: “নবাবজাদা লিয়াকত আলি খানের মাধ্যমে আমরা এ কথা পরিষ্কার জানিয়েছিলাম
১৯২
যে, এখনও আমরা পার্লামেন্টারি বাের্ডে কাজ করতে পারি, কিন্তু আমাদের মুসলিম লিগ এবং এন এ পি, দুটিরই টিকিটে দাঁড়াতে দিতে হবে এবং লিগ কাউন্সিলে এই প্রদেশগুলির যে পঞ্চাশ জন সদস্য আছেন তাদের নিয়ে একটি প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠনের অনুমতি দিতে হবে। কিন্তু পার্লামেন্টারি বাের্ডের যে সব নিয়ম সম্প্রতি প্রণীত হয়েছে, তাতে আমাদের মধ্যে এমন সহযােগিতা ও সমন্বয়ের কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।”[৩]
জিন্না একটি সর্বভারতীয় মুসলিম প্রতিষ্ঠান এবং মঞ্চ খুঁজছিলেন। ১৯৩৬-এর ২৭ ও ২৮ এপ্রিল তিনি দিল্লিতে অনেকের সঙ্গে কথা বললেন, তার পর পার্লামেন্টারি বাের্ড সদস্যদের একটি তালিকা প্রকাশ করলেন। এই সব আলােচনার সময় লিয়াকত আলি সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, কোনও একটি গােষ্ঠীকে যেন বেশি গুরুত্ব না দেওয়া হয়। এর পর খুব জটিল, কিন্তু খুব পরিচিত একটা বােঝাপড়ার প্রক্রিয়া চলল এবং তার থেকে বেরিয়ে এল একটি জটিল বন্দোবস্ত। তার বিশদ বিবরণের কোনও প্রয়ােজন নেই। এইটুকু বললেই হবে যে, বােঝাপড়ার পরে ১৯৩৬ সালের মে মাসে জিন্না চুড়ান্ত নাম-তালিকা প্রকাশ করলেন। এর অল্প দিনের মধ্যেই, ৮ ও ৯ জুন রাজাসাহেব সালেমপুর এবং চৌধুরী খালেকুজ্জামান প্রত্যাশিত ভাবেই নতুন আপত্তি তুললেন— লাহােরে যে সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আপত্তি সেই বিষয়েই।
এই মতানৈক্যের মীমাংসার উদ্দেশ্যে মাহমুদাবাদের রাজা, সালেমপুরের রাজা এবং চৌধুরী খালেকুজ্জামান আবার লাহৌরে জিন্না ও লিয়াকত আলির সঙ্গে দেখা করলেন, সেখানে আর একটি সূত্র স্থির করা হল। সূত্রটি এই রকম:
“স্থির হয়েছে, ইউ পি’র প্রাদেশিক বাের্ড গঠনের জন্য প্রস্তাবিত সম্মেলনে অল। ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ-এর কাউন্সিলে ইউ পি’র সমস্ত সদস্যকে (দিল্লির চার জন। সদস্যকে বাদ দিয়ে) আমন্ত্রণ জানানাে হবে। যেহেতু প্রাদেশিক বাের্ডের মােট সদস্য সংখ্যা (সম্ভব হলে) হবে ১০০, সুতরাং বাকি ৪৪ জন হবেন মনােনীত সদস্য। তাদের মনােনয়নের পদ্ধতিটি হবে এই রকম:
‘নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান মনােনীত করবেন ১৮ জনকে, নবাব ইসমাইল খান ২৬ জনকে। খালেকুজ্জামান ছাড়া উপস্থিত সমস্ত সদস্য এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছেন, তবে খালেকুজ্জামান বলেছেন তিনি এই সিদ্ধান্ত মেনে চলবেন।”[৪]
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে এই ‘সূত্র দিয়ে সব বিবাদের মীমাংসা হল না। এই সূত্রটির মর্মার্থ বােঝাই ছিল দুষ্কর। অতঃপর নবাব চাতারি এবং স্যর মুহম্মদ ইউসুফ (তাদের কেউই লাহােরের দ্বিতীয় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না) তাদের পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলেন। লিয়াকত আলি গােটা ব্যাপারটাতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন, তার সন্দেহ হল, খালেকুজ্জামান গােষ্ঠী কংগ্রেসের সঙ্গে তলায় তলায় বােঝাপড়া করছে। এটা তাে ঘটনা যে, অতীতে তাদের কারও কারও সঙ্গে কংগ্রেসের যােগাযােগ ছিল, কারও কারও সঙ্গে এখনও আছে।
এই জটিল এবং কিছুটা দুর্বোধ্য লাহৌর সূত্রটির কার্যকারিতা পরবর্তী ঘটনাবলিতে
১৯৩
আরও কমে গেল। রাজা মাহমুদাবাদ লিয়াকত আলিকে সঙ্গোপনে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, নবাব ইসমাইলের কোটা-র ২৬ জনের নাম স্থির করার জন্য ১৯৩৬-এর ৯ জুলাই একটি বৈঠকের আয়ােজন করা হয়েছে। কিন্তু লাহাের সূত্র অনুযায়ী ২৬ জনকে মনােনীত করার বদলে এই বৈঠকে স্থির হল যে, ‘তিনশাে’ জনের একটি সম্মেলন ডাকা হবে। লিয়াকত আলি প্রতিবাদ জানালেন। বল ফেরত গেল জিন্নার কোর্টে। কিন্তু ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে ওঠার আগে লিয়াকত আলি প্রস্তাব দিলেন, লাহােরে যা ঠিক হয়েছিল তার চেয়ে বেশি মুসলমান মানুষকে যদি ডাকা হয়, তবে আমন্ত্রিতদের “প্রতিনিধিত্ব’র যােগ্য হতে হবে। এই প্রস্তাব গ্রাহ্য হল না। এ বার বাধ্য লিয়াকত আলি বিদ্রোহী হলেন। তিনি জিন্নাকে তারযােগে জানালেন, তিনি বাের্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করতে অপারগ। তিনি একটি প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে ইউ পি পার্লামেন্টারি বাের্ডকে ‘প্রতিনিধিত্বমূলক নয়’ বলেও অভিহিত করলেন।
লিয়াকত আলির ভয় পাওয়ার কিছু কারণ ছিল। সত্যই ভয় ছিল যে, খালেকুজ্জামানের সঙ্গে লিগে এক দল লােক ঢুকে যাবেন, যাঁরা কংগ্রেসের স্বার্থে কাজ করবেন। সম্ভাবনা ছিল যে, নির্বাচনী রাজনীতির পরিচিত কৌশলে রফি আহমেদ কিদোয়াই কলকাঠি নেড়ে চৌধুরী খালেকুজ্জামান, নবাব মুহম্মদ, ইসমাইল খান এবং অন্যান্য মুসলিম কংগ্রেস সদস্যদের মুসলিম লিগের টিকিটে ভােটে দাঁড়াতে রাজি করাবেন। এই কৌশলের ফলে শেষ পর্যন্ত সুবিধা হবে কংগ্রেসের। এ কথা কারও অজানা ছিল না যে, নির্বাচন। ঘােষণার সময় পর্যন্ত খালেকুজ্জামান ছিলেন কংগ্রেসের সদস্য।
এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী গােষ্ঠীর কার কী রাজনৈতিক মতাদর্শ, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছিল না। মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চলার কথা বলেছিল বটে, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় নিজেকে মুছে দেওয়ার জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। অথচ, জওহরলাল নেহরু ঠিক সেটাই চেয়েছিলেন এবং জিন্না এতেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। এখন খালেকুজ্জামানের জন্য মুসলিম লিগের স্বতন্ত্র অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ল। খালেকুজ্জামানের ব্যাপারে লিয়াকত আলি যে আপত্তি জানালেন, সেটা আসলে লিগকে ধরে রাখার লক্ষ্যেই।
জিন্না এই সব জটিল তর্কের মধ্যে ঢুকলেন না। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ-এর কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বাের্ড গঠিত হওয়ার পর তাঁর প্রথম বিবৃতিতে তিনি বললেন, তিনি এই ‘বাের্ডকে যথাসম্ভব প্রতিনিধিত্বমূলক করতে চান। মুসলিম লিগের সমস্ত গােষ্ঠীকে স্থান দেওয়া এবং ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যেই তিনি কাজ করছিলেন। নবাব চাতারি এবং মুহম্মদ ইউসুফ-এর বেরিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি কোনও অনমনীয় অবস্থান নিলেন না। বিভিন্ন গােষ্ঠীর মধ্যে তীব্র বিবাদ চললেও জিন্না তাদের থেকে নিজেকে দূরে রাখলেন, কোনও গোঁড়ামি দেখালেন না। খালেকুজ্জামানের মতাে সহযােগীদের তুলনায় তিনি অনেক বেশি মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা করলেন। কলকাতায় তার একটি বক্তৃতা সম্পর্কে যে রিপাের্ট প্রকাশিত হয়েছিল সেটি এই রকম: “তার কিছু সমালােচকের কথা বলতে গিয়ে জিন্না মন্তব্য করেন, একটা গােষ্ঠীর ধারণা হল,
১৯৪
মুসলিমদের প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে; আবার রক্ষণশীল গােষ্ঠীর আশঙ্কা, জিন্না মুসলিমদের কংগ্রেসের বা উগ্র বামপন্থীদের শিবিরে নিয়ে যাবেন। জিন্না জবাব দিলেন, ‘মুসলিমদেরই ঠিক করতে হবে তারা কোন দিকে যাবেন। সমালােচকরা ক্রমাগত ভবিষ্যদ্বাণী করে চলেছেন কেন? যতক্ষণ স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী থাকবে, ততক্ষণ মুসলমানরা স্বতন্ত্র ভাবে সংগঠিত হবেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেটাই আদর্শ ব্যবস্থা, বা তিনি এই ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট। কিন্তু তাকে বাস্তব অবস্থা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে, তারই মধ্যে তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন।”[৫]
মুসলিম লিগের বম্বে অধিবেশন হল ১৯৩৬-এর ১০ মে, স্যর ওয়াজির হাসান-এর সভাপতিত্বে। ইউ পি’র সম্পন্ন ভূস্বামীদের অধিকাংশই ওই গরমে ভারতের মধ্যভাগের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড পেরিয়ে বম্বে যেতে রাজি ছিলেন না। তা ছাড়া, অনেকে ইতিমধ্যেই ইউ পি’র এগ্রিকালচারিস্ট পার্টিতে যােগ দিয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন, জিন্নার সঙ্গে ইউনিটি বাের্ডের কী বােঝাপড়া হয়েছে। বম্বে সম্মেলনে লিগ জিন্নাকে পার্লামেন্টারি বাের্ড মনােনয়নের অধিকার দিল, সেই বাের্ডে সারা ভারতের অন্তত পঁয়ত্রিশ জন সদস্য থাকতে হবে। বাের্ড তার নিজের নির্বাচনী ইস্তাহার তৈরি করবে এবং আসন্ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রয়ােজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা করবে।
বাংলায় মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ডের হাল বােঝার জন্য জিন্না সেই প্রদেশেও সফর করেছিলেন। বাংলার দুই সুপরিচিত নেতা ফজলুল হক এবং খােয়াজা নাজিমুদ্দিন তখন যথারীতি দুদিকে যাচ্ছেন। ফজলুল হক কৃষক প্রজা পার্টির টিকিটে ভােটে লড়তে চান, নাজিমুদ্দিন ও তার সহযােগীরা মুসলিম লিগের মঞ্চ থেকে লড়তে রাজি।
১৯৩৭-এর নির্বাচনে ইউ পি’র ভাগচাষিরা প্রথম প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। এর আগে পর্যন্ত সমস্ত নির্বাচনে তারা ভূস্বামীদের ভােট দিয়ে এসেছেন, কিন্তু এ বার আর সেই আনুগত্য দেখালেন না তারা। ভূস্বামীরা শেষ মুহুর্ত অবধি সেটা টের পাননি। এমনকী ইউ পি’র গভর্নর স্যর হ্যারি হেগ-ও নিশ্চিত ছিলেন যে, ১৪৪টি হিন্দু আসনের মধ্যে কংগ্রেস ষাটটির বেশি পাবে না। যখন ফলাফল বের হল তখন। দেখা গেল, কংগ্রেস পেয়েছে ১৩৪টি আসন। অন্য দিকে মুসলিম টিকিটে লড়েছিলেন ৩৬ জন প্রার্থী, জয়ী হলেন ২৯ জন। দারুণ সাফল্য। কিন্তু কংগ্রেস টিকিটে এক জন মুসলমানও জয়ী হলেন না। ভবিষ্যতের পক্ষে ভয়ঙ্কর সংকেত, তবে সেই সংকেত ঠিক ঠিক পড়ার ক্ষমতা থাকা দরকার।
ভােটের ফল ঘােষণা চলছে, তারই মধ্যে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ একটি প্রেস বিবৃতিতে বললেন, “আইনসভায় কংগ্রেস অন্য কোনও গােষ্ঠী বা দলের সঙ্গে হাত মেলাবে না।” রাজেন্দ্র প্রসাদ সাত তাড়াতাড়ি এই মন্তব্য করে শুরুতেই খেলাটাকে ঘেঁটে দিলেন।।
যুক্তপ্রদেশের মন্ত্রিসভায় মুসলিম লিগের প্রতিনিধিত্ব কেমন হবে, সেই বিষয়ে কংগ্রেস এবং লিগের যে বােঝাপড়া চলেছিল, তার বিশ্লেষণ করার সময় এই পটভূমিটা মনে রাখা জরুরি। মন্ত্রিসভায় মুসলিম লিগের কত জন প্রতিনিধি থাকবেন, নেহরুর কাছে সেটা বড় প্রশ্ন ছিল না। লিগের প্রতিনিধিদের নেওয়ার পরে মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরীণ
১৯৫
সংহতি বজায় থাকবে কি না, সেটাই ছিল তার চিন্তার কারণ। এই বােঝাপড়ার প্রক্রিয়ায় নেহরু নিজে বড় ভূমিকা নেননি। নির্বাচনের পরেই তিনি কিছু দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন, ফলে আনন্দ ভবন-এর বাইরে বেরােননি। তার প্রতিনিধি হিসেবে বােঝাপড়ার প্রক্রিয়াটি চালাচ্ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। তিনি অবশ্য নিয়মিত নেহরুর সঙ্গে যােগাযােগ রেখে চলছিলেন। কিন্তু কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটা সাধারণত নেহরুর হাতে ছিল না। এই বিষয়ে সমান ভূমিকা নিয়েছিলেন গােবিন্দবল্লভ পন্থ, রফি আহমেদ কিদোয়াই, কে এম আশরফ, পুরুষােত্তম দাস টন্ডন এবং ইউ পি আইনসভার অন্য সদস্যরা। নেহরু এবং কংগ্রেসের প্রাদেশিক নেতাদের সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় ছিল এই যে, ভূস্বামীদের সমর্থনে পুষ্ট মুসলিম লিগ যদি মন্ত্রিসভায় যােগ দেয়, তা হলে কংগ্রেসের ভূমি সংস্কার, বিশেষত জমিদারি প্রথা বিলােপের কর্মসূচি বিপন্ন হতে পারে। এই ভয়টা অমূলক ছিল না। নির্বাচনের আগের বছরগুলিতে মুসলিম লিগ যে ভাবে ইউ পি’তে ভূমি সংস্কারে বাধা দিয়েছিল, তাতে এমন ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল।
মে মাসের মধ্যে প্রাদেশিক নির্বাচনের সমস্ত ফলাফল প্রকাশিত হল। জোট গড়ার চেষ্টা হল। সেই বােঝাপড়ার বেশ বিশদ বিবরণ আছে খালেকুজ্জামানের পাথওয়ে টু পাকিস্তান’ গ্রন্থে। তিনিই মুসলিম লিগের তরফে আলােচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি লিখছেন,১৭ “নেহরুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ১৯৩৭-এর ১২ মে, আনন্দ ভবনে। আমি তাকে বােঝানাের চেষ্টা করলাম, আইনসভায় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের পারস্পরিক সহযােগিতা কেন জরুরি, আমার মতে এই সহযােগিতা থাকলে ভারতের ব্যাপারে ব্রিটিশদের নাক গলানাের সম্ভাবনা কমে যাবে এবং দেশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রসারিত হবে। কিন্তু নেহরুর মত ছিল আমার মতের সম্পূর্ণ বিরােধী। তিনি মনে করতেন, ভারতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যাটা মুষ্টিমেয় কিছু মুসলমান বিদ্যাজীবী ভূস্বামী এবং পুঁজিপতির তৈরি করা, সাধারণ মানুষের মনে এর কোনও জায়গাই নেই। আইনসভায় মুসলিমদের স্বতন্ত্র সংগঠনের ধারণাটিই তার কাছে হাস্যকর। দলের বিভিন্ন গােষ্ঠীর স্বাতন্ত্র বজায় রাখা তার মতে বিপজ্জনকও বটে, এই যুক্তির সপক্ষে তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং ইউরােপের আরও নানা দেশের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আমি তাকে বললাম, ভারতের মুসলমানদের সমস্যাটা একেবারেই তার নিজস্ব, দুনিয়ার কোথাও এর কোনও তুলনা পাওয়া যাবে না।… (সুতরাং) কানাডা বা অন্য পশ্চিমি দেশের সঙ্গে তুলনা করতে গেলে ভারতের ইতিহাস এবং এ দেশের মুসলিমদের অবস্থা, দুটোকেই সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হবে। আমি আরও বললাম, গণতন্ত্র দেশের পক্ষে ভাল, কিন্তু পশ্চিম থেকে ধার করা একটা শাসনতন্ত্রের পায়ে দেশকে সমর্পণ করা উচিত নয়; ভারতে যে ধরনের সমস্যা রয়েছে, পশ্চিমি গণতন্ত্রকে কখনও সে ধরনের সমস্যার মুখােমুখি পড়তে হয়নি। আমাদের মতে মিলল না এবং আমাকে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হল।”
এই সময় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা ঘটনা ঘটল। ১৯৩৭-এর ১৭ মে ইলাহাবাদে ইউ পি’র উলেমাদের একটি সম্মেলন হল। উলেমারা মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ড ছেড়ে
১৯৬
নিঃশর্ত ভাবে কংগ্রেসে যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটা ঘটল খালেকুজ্জামানের সঙ্গে নেহরুর আলােচনার মাত্র পাঁচ দিন পরে। এর পিছনে ছিলেন মৌলানা আজাদ, কিন্তু এর ফলে নেহরু যে ভাবে ভাবছিলেন, সেটাই আরও জোরদার হল। ইতিমধ্যে পণ্ডিত পন্থ খালেকুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে, যদি জোট হয় তবে কী ভাবে মন্ত্রিসভায় আসন বণ্টন হবে সে বিষয়ে আলােচনা করলেন। খালেকুজ্জামান বললেন, মন্ত্রিসভার মােট আসনের তেত্রিশ শতাংশ তাঁদের চাই। পন্থ তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, মুসলিম লিগের মন্ত্রী কারা হবেন, সে বিষয়ে তার মতের কোনও দাম থাকবে কি না। খালেকুজ্জামান বললেন, আপনাদের (কংগ্রেসের) মন্ত্রী নির্বাচনে আমার মতের যতটা দাম থাকবে, ঠিক ততটাই।
১৯৩৭-এর ৫ জুলাই কংগ্রেস জানাল যে তারা মন্ত্রিসভা গড়বে। এক সপ্তাহ পরে, ১২ জুলাই মৌলানা আজাদ খালেকুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করতে লখনউয়ে এলেন। আবার খালেকুজ্জামানকে উদ্ধৃত করা যাক, “সরকারের সঙ্গে কোনও মতপার্থক্যের কারণে কংগ্রেস যদি আইনসভা থেকে পদত্যাগ করে,তা হলে লিগের কর্তব্য কী হবে— এটাই ছিল মৌলানা আজাদের প্রশ্ন। আমি জবাব দিয়েছিলাম, আমরা যদি জোট সরকারে থাকি, তা হলে আমাদের নৈতিক কর্তব্য হবে কংগ্রেসের সঙ্গে সঙ্গে আইনসভা থেকে বেরিয়ে যাওয়া। জোট গড়লে বৃহত্তর সমন্বয় থাকা দরকার। এর পর তিনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ‘হাফিজ ইব্রাহিমকে কি আপনারা মন্ত্রিসভায় রাখবেন? আমি বললাম, না, মন্ত্রিসভায় আমার সহকর্মী হবেন নবাব ইসমাইল খান, কারণ তিনি কেবল আমার দলের আস্থাভাজন নন, প্রদেশের মুসলমানদের তার উপর আস্থা আছে। তখন তিনি বললেন, ‘আপনারা কি আমাকে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি আছেন যে কংগ্রেস আইনসভা থেকে পদত্যাগ করলে মুসলিম লিগও সরে যাবে? আমি বললাম, আমার কথাই যথেষ্ট। তবে কংগ্রেস চাইলে আমি লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতেই পারি।”
১৫ জুলাই মৌলানা আজাদ আবার লখনউয়ে ফিরে এলেন, এ বার তার সঙ্গে ছিলেন গােবিন্দবল্লভ পন্থ। খালেকুজ্জামানের বিবরণ:
“প্রাথমিক কিছু কথাবার্তার পরে মৌলানা আমার হাতে দু’পাতার একটি টাইপ করা নােট ধরিয়ে দিলেন। বুঝতে পারলাম, কংগ্রেস-লিগ জোটের দাম চুকিয়ে দেওয়ার। জন্য আমাকে সেটিতে সই করে দিতে হবে। এই সেই নােট:[১১]
‘যুক্তপ্রদেশের আইনসভায় মুসলিম লিগ আর একটি স্বতন্ত্র গােষ্ঠী হিসেবে কাজ করবে না। ইউ পি অ্যাসেম্বলিতে মুসলিম লিগের বর্তমান সদস্যরা কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত হবেন, তাঁদের মর্যাদা ও কর্তব্য হবে কংগ্রেসের অন্য সদস্যদের সমান। দলের আলাপ আলােচনায় যােগদানেরও সমান অধিকার থাকবে তাদের। আবার তাদের কংগ্রেসের দলীয় নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলাও মেনে নিতে হবে, আইসভায় এবং সাধারণ ভাবে সদস্যদের আচরণ সম্পর্কে দলীয় বিধি ও অনুশাসন মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন তারা। প্রত্যেক সদস্যের একটি ভােট— এই নিয়মে দলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভােটে সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা হবে।
১৯৭
‘আইনসভায় সমস্ত সদস্যের জন্য কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে নীতি সাব্যস্ত করেছে।
এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনসভায় তাদের আচরণ সম্পর্কে যে সব নির্দেশ দিয়েছে, এই সমস্ত (মুসলিম লিগ থেকে যাওয়া) সদস্য সহ দলের সমস্ত সদস্য সেই নীতি এবং নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য থাকবেন।
‘যুক্তপ্রদেশে মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ড ভেঙে দেওয়া হবে, এই বাের্ড অতঃপর কোনও উপনির্বাচনে প্রার্থী দেবে না। এর পর কোনও আসন শূন্য হলে কংগ্রেস যে প্রার্থী দেবে, তাকেই (মুসলিম লিগ) সমর্থন জানাবে।
‘কংগ্রেসের সমস্ত সদস্য কংগ্রেসের নিয়মাবলি মেনে চলবেন এবং কংগ্রেসের স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষার জন্য সম্পূর্ণ ও আন্তরিক সহযােগিতা করবেন।
‘কংগ্রেস যদি মন্ত্রিসভা বা আইনসভা থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে উপরােক্ত গােষ্ঠীর সদস্যরাও সেই সিদ্ধান্ত অনুসরণে বাধ্য থাকবেন।
“এই টাইপ করা শর্তাবলির সঙ্গে মৌলানা আজাদ একটি নােটও দিলেন, তাতে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া ছিল। তাতে লেখা ছিল: ‘আশা করা যায়, এই শর্তগুলি মেনে নিলে এবং মুসলিম লিগ গােষ্ঠীর সদস্যরা কংগ্রেস দলের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে যােগ দিলে তারা আর একটি স্বতন্ত্র গােষ্ঠী বলে গণ্য হবেন না। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠনের সময় স্বভাবতই তাদের প্রতিনিধি থাকা যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচিত হবে।”
“নােটটি পড়ে আমি পড়লাম: ‘মৌলানা, এটি এক আশ্চর্য নােট। আমি আপনার সঙ্গে মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ডের এক জন প্রতিনিধি হিসেবেই কথা বলতে পারি, আর কোনও পরিচয়ে নয়, অথচ আপনি আমাকে মুসলিম লিগের মৃত্যুদণ্ডাদেশে সই করতে বলছেন। তা ছাড়া, এই নােটে আরও অনেক কথা আছে যা অত্যন্ত আপত্তিকর। আমি এতে সই করতে পারি না। তার পর প্রায় আটটা পর্যন্ত প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য ধরে ধরে একটা দীর্ঘ আলােচনা হল। আমি যখন বিদায় নিচ্ছি, সেই সময় পন্থজি বললেন, ‘বেশ, আমি দু’এক দিনের মধ্যেই আপনাকে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেব।’
কয়েক দিন পরে আমি মৌলানাকে ফোন করে জানতে চাইলাম, তিনি চুক্তিপত্রে একটি শর্ত যােগ করতে রাজি আছেন কি না। শর্তটি এই যে, ‘যুক্তপ্রদেশের আইনসভায় সাম্প্রদায়িক কোনও প্রশ্নে ভােটাভুটি হলে মুসলিম লিগের প্রতিনিধিরা নিজেদের বিবেকের নির্দেশ অনুসারে ভােট দিতে পারবেন। মনে হল, ফোনে এই প্রস্তাবটি শুনে মৌলানা খুব বিচলিত হয়েছেন। তিনি বললেন, এই প্রস্তাব নিয়ে বিবেচনা করে এর উত্তর জানিয়ে দেবেন। সন্ধ্যাবেলায় পন্থজি আমাকে ফোন করে বললেন, ‘সাম্প্রদায়িক বিষয় বলতে আপনি কী বােঝাতে চেয়েছেন? আমি বললাম, ‘পন্থজি, সাম্প্রদায়িক বিষয় নিয়ে এর মধ্যে আমাদের বিস্তর মাথা ঘামাতে হয়েছে, আপনি জানেন সাম্প্রদায়িক বিষয় বলতে কী কী বােঝায়। তবু আপনার অবগতির জন্য জানাই, তার মধ্যে পড়ে ধর্ম, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ভাষা, সংস্কৃতি, ইত্যাদি। তিনি জানতে চাইলেন, আমি কবে ফিরব। আমি বললাম, “কাল সকালে নবাব ইসমাইল খান এবং আমি দুজনেই লখনউ পৌঁছব।
১৯৮
লখনউ স্টেশন থেকে আমরা সােজা পন্থজির বাড়িতে পৌছলাম, দেখলাম সেখানে মৌলানা আজাদও আছেন, চা পান করছেন। আমরা নােটটা মৌলানাকে ফেরত দিলাম এবং জানালাম, ২৭ জুলাই ১৯৩৭ যখন আইনসভার অধিবেশন শুরু হবে, তখন আমরা বিরােধী আসনে বসব, তার পর যা হওয়ার হবে।”-
যুক্তপ্রদেশের এই ‘জোট বিতর্ক’-র ভাল-মন্দ নিয়ে আর যা-ই বলার থাকুক, একটা বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ১৯৩৭-এর ঘটনাবলি ‘জিন্নার ওপর একটা তীব্র, প্রায় মর্মান্তিক প্রভাব ফেলেছিল। “প্রাদেশিক স্বশাসনের জোয়ার এল এবং চলে গেল, তিনি কিছুই পেলেন না।” ইউ পি মন্ত্রিসভায় তাঁর দল নিজের শর্তে দুটি আসন পেল না , সেটা বড় কথা নয়। “কুড়ি বছর ধরে যে অনুমানগুলির ভিত্তিতে তিনি তার নীতি নির্ধারণ করেছিলেন, সেগুলি তাসের ঘরের মতাে ভেঙে পড়ল। তার আশা ছিল, স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর ভিত্তিতে তৈরি একটি স্বতন্ত্র মঞ্চে মুসলিমদের সমবেত করে তিনি এমন ভাবে প্রদেশের সীমানাগুলি নতুন করে টানবেন যাতে যথাসম্ভব বেশি সংখ্যক প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেন এবং অন্যত্রও তাদের সংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধিত্ব পান। নতুন সংবিধানে তার চোদ্দো দফা প্রস্তাব কার্যত মেনেই নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই সব রক্ষাকবচ থেকে তিনি যে সুবিধা পাবেন বলে আশা করেছিলেন, তা তিনি পেলেন না। মুসলিমরা যে সব প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেখানে মুসলিম লিগ সঙ্গত ভাবেই জয়ী হওয়ার আশা করেছিল, সেখানেও তাদের নির্বাচনী বিপর্যয় ঘটল।”[১২] সিন্ধু প্রদেশের আইনসভায় লিগ পেল তিনটি আসন, পঞ্জাবে মাত্র একটি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে একটিও না। বাংলার আইনসভায় লিগ পেল মুসলিম আসনের এক-তৃতীয়াংশ (এবং মােট আসনের ছ’ভাগের এক ভাগ), কিন্তু সেখানেও এই দল চালকের আসনে বসতে পারল না।“মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পন্ন প্রদেশগুলিতে দলীয় আনুগত্য ধর্মীয় বিভাজনকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। পঞ্জাবে স্যর সিকন্দর হায়াত খান, বাংলায় ফজলুল হক এবং সিন্ধু প্রদেশে স্যর গুলাম হুসেন হিদায়তুল্লা জিন্নার ‘মুসলিম ঐক্য’র আহ্বানে সাড়া দেননি, ধর্মীয় আনুগত্যের বদলে তারা দৃশ্যত ব্যক্তিগত বা শ্রেণিগত স্বার্থেই চালিত হয়েছিলেন।” . ড. জাইদি তীক্ষ দৃষ্টিতে লক্ষ করেছেন যে, “১৯৩৬-৩৭-এর নির্বাচনী ফলাফল এবং সরকার গঠনের অভিজ্ঞতা ভারতের রাজনীতির অন্তর্নিহিত ক্রিয়াপ্রক্রিয়াগুলির স্বরূপ উন্মােচন করল। সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘু, দুই বর্গের মনােভাবই স্পষ্ট ধরা পড়ল। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কংগ্রেসের চিন্তাধারা। এই দল দেশে একটি একদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অভিমুখে যেতে চাইছিল, তার আশা ছিল অন্য দলগুলি তার মধ্যে নিজেদের মিশিয়ে দেবে। অন্য দিকে ছিল মুসলিম ভারতের উদীয়মান ঐক্যের ধারণা।” এই কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জিন্না বাস্তব রাজনীতির কিছু মূল্যবান শিক্ষা পেলেন, যে শিক্ষা তিনি রাজনীতির তত্ত্ব চর্চা করে কোনও দিন পেতেন না। তিনি এবং মুসলিম লিগ “আদর্শবাদী হিসেবে নির্বাচনে গিয়েছিলেন, নির্বাচন তাদের
১৯৯
রাজনৈতিক বাস্তববাদী করে তুলল। ভারতের পক্ষে, তার ভাবী স্বাধীনতার পক্ষে এর তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।”[১৩]
তিনি আরও লিখেছেন, “১৯২১ ডিসেম্বরের শেষের দিকে আমদাবাদে মুসলিম লিগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে মৌলানা হসরত মােহানি প্রথম ভারতের রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যার এই মুসলিম সমাধানের প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। কুড়ি এবং ত্রিশের দশকে প্রধান মুসলিম সংগঠন এবং তাদের নেতারা নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্য যে সব দাবিদাওয়া পেশ করেছিলেন, মৌলানা মােহানির এই প্রস্তাব ছিল, কিছু সংশােধন সাপেক্ষে, তার ভিত্তি। যে সব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে কেন মুসলমানদের আধিপত্য চাই, তার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তির সন্ধান চলছিল। বলা হচ্ছিল, ভারতীয় মুসলমানরা নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র ‘জাতি’ (নেশন), দেশের অন্যান্য ‘জাতি’ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই তাদের স্বশাসনের অধিকার থাকা উচিত, তারা যাতে নিজস্ব দেশভূমি তৈরি করে সেখানে ইসলামি সংস্কৃতি এবং শাসনব্যবস্থার আদর্শ অনুসরণ করতে পারেন। কেউ কেউ (যেমন ১৯৩০-এ মহম্মদ ইকবাল) ‘ভারতের মধ্যে একটি মুসলিম ভারত’ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ (যেমন ১৯৩৩-এ রহমত আলি) মুসলিম ভারত’কে অবশিষ্ট ভারত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে একটি নতুন মুসলিম রাষ্ট্র (পাকিস্তান) তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ১৯৩৭ নির্বাচনের ফলাফল সম্প্রদায়-মনস্ক মুসলমানদের বিস্মিত এবং স্তম্ভিত করে দিল। তার বুঝতে পারলেন, মুসলমানরা দুর্বল, বিভক্ত এবং বিচ্ছিন্ন।”
এই একটি নির্বাচনকে বহু বিশেষজ্ঞ বহু ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু তাঁদের সকলের বক্তব্যের মধ্যেই একটি মূল সুর শােনা যায়। নেহরুর অবস্থানের সপক্ষে যে তাত্ত্বিক বা নীতিগত যুক্তিই খাড়া করা হােক না কেন, লিগের সঙ্গে জোটে না যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের পক্ষে তার পরিণাম হল ভয়াবহ। কংগ্রেস চাইলেও ইউ পি’তে বা অন্যত্র মুসলমানদের অস্তিত্ব অস্বীকার করার কোনও উপায় ছিল না। তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই তাদের গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের অধিকারকেও এক ভাবে মেনে নেওয়া হয়। বস্তুত, ১৯০৯ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত, এবং সব ক’টি রাউন্ড টেবল কনফারেন্স-এ, এই বিষয়েই তুমুল বিতর্ক চলেছিল। নেহরুর তাত্ত্বিক অবস্থানটি নিয়ে নানা প্রশ্ন ছিল। একটি নির্বাচনী গণতন্ত্রে সংখ্যাই কি সব? ভারত একটি অনন্য দেশ, তাই স্পেন, ইতালি বা ইউরােপের অন্য কোনও দেশের দৃষ্টান্ত এ দেশের পক্ষে প্রাসঙ্গিক হবে কেন?
তঁার ‘পিলগ্রিমেজ টু ফ্রিডম’ গ্রন্থে কে এম মুনশি লিখেছিলেন, “তখন ব্যাপারটাকে খুব বড় কিছু বলে মনে হয়নি, কিন্তু ঘটনাবলি যে দিকে চলল তাতে বছর দশেকের মধ্যে বােঝা গেল যে, ভারত ভাগের প্রহর গােনা শুরু হয়ে গিয়েছে।”[১৪] অতঃপর ১৯৩৭ একটা সন্ধিক্ষণ হয়ে দাড়াল। এই বইয়ের শুরুতে যে প্রশ্নটি করেছিলাম, সেটিই আবার লিখতে হয়: “গণতন্ত্রের মানে যদি হয় প্রতিনিধিত্ব, তা হলে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে তা কেন এবং কী ভাবে তাকে বিভক্ত করল? এবং খুব যন্ত্রণার সঙ্গে ও খুব
২০০
সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন তুলতে হয়, আজও কেন, কী ভাবে সেই প্রক্রিয়াই চলছে ?” ১৯৩৭এর কথা আর একটু বলা দরকার।
১৯৩৭: গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি সন্ধিক্ষণ? যুক্তপ্রদেশে নির্বাচন (পূর্বানুবৃত্তি)
কেন্দ্রে সর্বভারতীয় নেতার আসন গ্রহণে অভিলাষী জিন্না প্রদেশগুলিতে নির্বাচনী সাফল্যের ওপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। সেই কারণেই তিনি ইউ পি’তে এই রাজনৈতিক জোট তৈরিতে উৎসাহী হয়েছিলেন। গণ-আন্দোলনের রাজনীতিতে তার কোনও ভক্তি ছিল না বটে, কিন্তু সমকালের অধিকাংশ কংগ্রেসির সঙ্গে জিন্নার কার্যত কোনও তফাতই ছিল না। নেহরুর জীবনীকার এস গােপাল জিন্না এবং তার রাজনীতি সম্বন্ধে লিখেছেন: “১৯৩৬ সালে জিন্না যখন আবার মুসলিম লিগের হাল। ধরলেন, তখনও তিনি এক জাতীয়তাবাদী, বিদেশি শাসনকে সমর্থন করা বা তার ওপর নির্ভর করা যাঁর ধাতে নেই। বস্তুত, তার চারিত্রিক নিঃসঙ্গতা, সামর্থ্যের অভাব এবং সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী মনােভাবের জন্য ব্রিটিশরা তাকে যে কোনও কংগ্রেসির মতােই অপছন্দ করতেন। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস এবং লিগের মধ্যে যে লখনউ চুক্তি হয়, জিন্নাই ছিলেন তার প্রধান রূপকার। এ বারেও তিনি ওই রকম একটি বােঝাপড়া হবে বলে আশা করেছিলেন। তাই লিগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ব্রিটিশ-অনুগত কোনও নেতাকে জিতিয়ে আনলেন না, তার উদ্যোগে ওই পদে এলেন স্যর ওয়াজির হাসান। স্যর ওয়াজির ছিলেন লখনউয়ের এক জন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, ইউ পি’তে কংগ্রেসের নেতাদের সঙ্গে যাঁর পরিবারের দীর্ঘ যােগাযােগ ছিল। জিন্নার তৈরি করা। লিগের ইস্তাহার ছিল অনেকাংশে কংগ্রেস ইস্তাহারের অনুরূপ। লিগের পার্লামেন্টারি বাের্ডে কংগ্রেসের সমর্থক জামিয়াত-ই-উলেমা’র মতাে সংগঠনের প্রতিনিধিদের স্থান দেওয়া হয়েছিল।”[১৫]
কিন্তু কংগ্রেস যে যুক্তপ্রদেশের মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ডের মাধ্যমে মুসলিম আসনগুলি কৰ্জা কতে চেয়েছিল, তার একটা অন্তর্নিহিত অর্থ ছিল এই যে, কংগ্রেস যদি নির্বাচনের পরে প্রাদেশিক সরকার গড়ে, তা হলে যুক্তপ্রদেশ মুসলিম লিগ পার্লামেন্টারি বাের্ড মন্ত্রিসভার ‘মুসলিম অংশ’টি সরবরাহ করবে। কংগ্রেসের অনুমােদিত ইতিহাসের রচয়িতা সীতারামাইয়া বলেছিলেন, “কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ যৌথ ভাবেই নির্বাচনের মুসলিম প্রার্থীদের পছন্দ করেছিল। কংগ্রেস মাত্র ন’টি আসনে প্রার্থী দেয়, বাকি সব ছেড়ে দেয় লিগকে। পারস্পরিক আলােচনা এতটাই ‘ঘনিষ্ঠ হয়েছিল যে রফি আহমেদ কিদোয়াই নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরে তাকে উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার সুযােগ করে দেওয়া হয়। এর ফলে মানুষের মনে স্বাভাবিক ভাবেই এই ধারণা জন্মায় যে নির্বাচনের পরে জোট মন্ত্রিসভা তৈরি হবে। কার্যক্ষেত্রে কংগ্রেস
২০১
পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল ২২৮ জনের আইনসভায় ১৩৪টি আসন। কিন্তু অন্য দিকে, কংগ্রেস একটি মুসলিম আসনেও জিততে পারেনি, আর মুসলিম লিগ ৬৬ টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২৯টিতে জয়লাভ করেছিল।
কংগ্রেস ও লিগের জোট সংক্রান্ত আলােচনা ভেস্তে গেল প্রধানত এই কারণে যে, নির্বাচনী:সাফল্যের অহঙ্কারে কংগ্রেস জোট গঠনের এমন সব শর্ত আরােপ করতে লাগল যে মুসলিম লিগ নেতা খালেকুজ্জামানের পক্ষে তা মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। সংশয় হয়, যুক্তপ্রদেশের মুসলিম লিগকে গ্রাস করে নেওয়াই কংগ্রেসের আসল উদ্দেশ্য ছিল কি না। অথচ এমন লক্ষ্য কেবল অনুচিত নয়, অসম্ভবও ছিল। মুসলিম লিগ কী করে নিজেকে কংগ্রেসের মধ্যে মিশে যেতে দিতে পারে ? ফল হল। উল্টো, মুসলিম লিগের প্রতিপত্তি উত্তরােত্তর বাড়তে লাগল, যার চুড়ান্ত পরিণাম হল দেশভাগ।
এস গােপাল নেহরুর সপক্ষে লিখেছেন, “যে কোনও বােঝাপড়া হলেই প্রমাণিত হত যে, রাজনীতি হল উচ্চবর্গের নিজেদের বােঝাপড়ার ব্যাপার এবং তাতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ মনােভাবাপন্ন মুসলমানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হত, বিসর্জন দিতে হত নেহরুর অতি প্রিয় অর্থনৈতিক কর্মসূচিও। এমন কোনও বােঝাপড়া টিকত না, কারণ লিগের কোনও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্য ছিল না। লিগ নেতাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার গদি, এক বার সেই লক্ষ্য পূর্ণ হলেই ঐক্যে ফাটল বাড়ত।… এই পরিপ্রেক্ষিতে খালেকুজ্জামানের সঙ্গে আলােচনাকে বাড়তি কোনও গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না, ওই আলােচনা ব্যর্থ হওয়ার ফলে বিশেষ কিছুই বদলায়নি।”[১৬] এই বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত, কোনওটাই পরবর্তী ঘটনাবলির ধােপে টেকেনি।
নেহরু যুক্তি দিয়েছিলেন, জোট সরকার গঠনের ব্যাপারে কোনও চুক্তি নির্বাচনের আগে হয়নি, তাই জোট সরকার না-হওয়াটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। এটা আইনের ভাষা মাত্র। লিগের সঙ্গে কংগ্রেসের যে একটা নির্বাচনী বােঝাপড়া হয়েছিল, তার অন্তর্নিহিত অর্থই ছিল এই যে, কংগ্রেস সরকার গড়ার সুযােগ পেলে জোট সরকার হবে। আর একটা যুক্তি হিসেবে বলা হত, কংগ্রেসের সঙ্গে লিগের আদর্শগত ব্যবধান বিরাট। কিন্তু সাম্প্রদায়িকভিত্তিক’ লিগের সঙ্গেই তাে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কংগ্রেস নির্বাচনের আগে বােঝাপড়া করেছিল। আর পার্থক্যটা যদি নেহরুর প্রগতিশীল রাজনীতি বনাম ইউ পি এম এল পি বি’র রক্ষণশীল ধ্যানধারণার হয়, তা হলেও এই যুক্তির পাল্টা কয়েকটা কথা বলা যায়। খালেকুজ্জামান এবং ইসমাইল খান’কে সচরাচর কংগ্রেসমনস্ক রাজনীতিক বলা হত, আর ইউ পি এম এল পি বি’র কিছু সদস্যের মতামত তাে যে কোনও কংগ্রেসির চেয়ে কোনও অংশে কম বৈপ্লবিক ছিল না। মনে রাখতে হবে, বাংলার কংগ্রেস সদস্যরা তখন প্রজাস্বত্ব এবং কৃষিঋণ ব্যবস্থার সংস্কারের প্রবল বিরােধী। এমনকী ইউ পি’র মুসলিম লিগের গঠনও তখন অনেক কম প্রগতিশীল ছিল— পরে অবস্থাটা পাল্টায়। এই সময় বেশির ভাগ মুসলমান জমিদার নামে মুসলিম লিগের সদস্য হলেও নির্বাচনে লড়েছিলেন নির্দল অথবা ন্যাশনাল এগ্রিকালচারালিস্ট
২০২
পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল ২২৮ জনের আইনসভায় ১৩৪টি আসন। কিন্তু অন্য দিকে, কংগ্রেস একটি মুসলিম আসনেও জিততে পারেনি, আর মুসলিম লিগ ৬৬ টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২৯টিতে জয়লাভ করেছিল।
কংগ্রেস ও লিগের জোট সংক্রান্ত আলােচনা ভেস্তে গেল প্রধানত এই কারণে যে, নির্বাচনী:সাফল্যের অহঙ্কারে কংগ্রেস জোট গঠনের এমন সব শর্ত আরােপ করতে লাগল যে মুসলিম লিগ নেতা খালেকুজ্জামানের পক্ষে তা মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। সংশয় হয়, যুক্তপ্রদেশের মুসলিম লিগকে গ্রাস করে নেওয়াই কংগ্রেসের আসল উদ্দেশ্য ছিল কি না। অথচ এমন লক্ষ্য কেবল অনুচিত নয়, অসম্ভবও ছিল। মুসলিম লিগ কী করে নিজেকে কংগ্রেসের মধ্যে মিশে যেতে দিতে পারে ? ফল হল। উল্টো, মুসলিম লিগের প্রতিপত্তি উত্তরােত্তর বাড়তে লাগল, যার চুড়ান্ত পরিণাম হল দেশভাগ।
এস গােপাল নেহরুর সপক্ষে লিখেছেন, “যে কোনও বােঝাপড়া হলেই প্রমাণিত হত যে, রাজনীতি হল উচ্চবর্গের নিজেদের বােঝাপড়ার ব্যাপার এবং তাতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ মনােভাবাপন্ন মুসলমানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হত, বিসর্জন দিতে হত নেহরুর অতি প্রিয় অর্থনৈতিক কর্মসূচিও। এমন কোনও বােঝাপড়া টিকত না, কারণ লিগের কোনও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বা সামাজিক লক্ষ্য ছিল না। লিগ নেতাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতার গদি, এক বার সেই লক্ষ্য পূর্ণ হলেই ঐক্যে ফাটল বাড়ত।… এই পরিপ্রেক্ষিতে খালেকুজ্জামানের সঙ্গে আলােচনাকে বাড়তি কোনও গুরুত্ব দেওয়ার মানে হয় না, ওই আলােচনা ব্যর্থ হওয়ার ফলে বিশেষ কিছুই বদলায়নি।”[১৬] এই বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত, কোনওটাই পরবর্তী ঘটনাবলির ধােপে টেকেনি।
নেহরু যুক্তি দিয়েছিলেন, জোট সরকার গঠনের ব্যাপারে কোনও চুক্তি নির্বাচনের আগে হয়নি, তাই জোট সরকার না-হওয়াটা কোনও বড় ব্যাপার নয়। এটা আইনের ভাষা মাত্র। লিগের সঙ্গে কংগ্রেসের যে একটা নির্বাচনী বােঝাপড়া হয়েছিল, তার অন্তর্নিহিত অর্থই ছিল এই যে, কংগ্রেস সরকার গড়ার সুযােগ পেলে জোট সরকার হবে। আর একটা যুক্তি হিসেবে বলা হত, কংগ্রেসের সঙ্গে লিগের আদর্শগত ব্যবধান বিরাট। কিন্তু সাম্প্রদায়িকভিত্তিক’ লিগের সঙ্গেই তাে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কংগ্রেস নির্বাচনের আগে বােঝাপড়া করেছিল। আর পার্থক্যটা যদি নেহরুর প্রগতিশীল রাজনীতি বনাম ইউ পি এম এল পি বি’র রক্ষণশীল ধ্যানধারণার হয়, তা হলেও এই যুক্তির পাল্টা কয়েকটা কথা বলা যায়। খালেকুজ্জামান এবং ইসমাইল খান’কে সচরাচর কংগ্রেসমনস্ক রাজনীতিক বলা হত, আর ইউ পি এম এল পি বি’র কিছু সদস্যের মতামত তাে যে কোনও কংগ্রেসির চেয়ে কোনও অংশে কম বৈপ্লবিক ছিল না। মনে রাখতে হবে, বাংলার কংগ্রেস সদস্যরা তখন প্রজাস্বত্ব এবং কৃষিঋণ ব্যবস্থার সংস্কারের প্রবল বিরােধী। এমনকী ইউ পি’র মুসলিম লিগের গঠনও তখন অনেক কম প্রগতিশীল ছিল— পরে অবস্থাটা পাল্টায়। এই সময় বেশির ভাগ মুসলমান জমিদার নামে মুসলিম লিগের সদস্য হলেও নির্বাচনে লড়েছিলেন নির্দল অথবা ন্যাশনাল এগ্রিকালচারালিস্ট
২০৩
ভুল বােঝা হয়েছিল) এবং সঙ্গতিহীন (কংগ্রেস প্রায়শই এর উল্টো অবস্থান নিয়েছিল), তা ছাড়া এর ফল হয়েছিল উল্টো, কারণ এর ফলে মুসলিম লিগ আরও বেশি কট্টর অবস্থান নিল। এটাই যদি কংগ্রেসের নীতি, তা হলে দশকের শুরু থেকে এবং নির্বাচনের সময়েও তারা লিগের সঙ্গে সহযােগিতা করে চলল কেন, আর তার পরেও বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনে ‘মােল্লা এবং সবুজ পতাকার সঙ্গে একজোট হয়ে লড়ল কেন? এন এ শেরওয়ানি নির্বাচনী প্রচারে মৌলবিদের চেয়েছিলেন বলে নেহরু তাকে ভৎর্সনা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু উলেমাদের কাছে সব রকম সাহায্য নেওয়া বন্ধ করে দিতে তাকে বাধ্য করা হয়নি। জামিয়াত-উল-উলেমা-ই-হিন্দকে পাশে পাওয়ার জন্য মৌলানা আজাদকে কাজে লাগানােও তা হলে কংগ্রেসের উচিত হয়নি। নেহরুর কথায় স্পেন বা ইউরােপের অন্যান্য দেশের মতাে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংহতি, বিশুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক চরিত্র এবং র্যাডিকাল কর্মসূচি’ই যদি কংগ্রেসের কার্যক্রমের আদর্শ ছিল, তা হলে মৌলবিদের প্রয়ােজন হল কেন?
জোট সরকার গড়ার বিরুদ্ধে আর একটা যুক্তি ছিল মুসলিম লিগকে জোটে নিলে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেওয়া হবে যে, কংগ্রেস ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু, সে কথা তাে কংগ্রেস আগেই কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিল। তা না হলে, ইউ পি-তে মাত্র ৯টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার এবং বাংলায় একটিতেও প্রার্থী না দেওয়ার মানে কী? কংগ্রেসে মুসলমান সদস্যরা ছিলেন বটে, কিন্তু সেই গণআন্দোলনের যুগেও মুসলমান সদস্য নেওয়ার জন্য কংগ্রেস মুসলিম সংগঠনগুলির সাহায্য নিয়েছিল। অসহযােগ আন্দোলনের সময় সেই ‘সহযােগী’-র ভূমিকায় ছিলেন খিলাফতিরা, গাঁধী তাদের মাধ্যমে সহজে মুসলমানদের কাছে পৌঁছতে চেয়েছিলেন— সেই কৌশল সফল হয়নি, সেটা অন্য কথা। আইন অমান্য আন্দোলনের সময় কোনও শক্তপােক্ত মুসলিম সহযােগী মেলেনি, ফলে ওই পর্বে মুসলমানদের ভূমিকা সীমিত ছিল। ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকে মুসলিম কংগ্রেস-সদস্যদের তুলনায় কংগ্রেস অনেক বেশি নির্ভর করেছে বিভিন্ন মুসলিম সংগঠনের ওপর, যেমন জামিয়াত-উল-উলেমাই-হিন্দ, অহরর[১৭], মুসলিম ইউনিটি বাের্ড১৮, মােমিন কনফারেন্স৯, ইত্যাদি। তেমনই, ১৯৩৭-এ মুসলিম লিগ কংগ্রেসের সহযােগী হিসেবেই ইউ পি-তে ২৯টি আসনে জয়ী হল। এই সহযােগিতার স্বাভাবিক পরিণতিতেই জোট সরকার গঠনের কথা ছিল। এ বার কেবল আন্দোলনের সহযােগীকে আইনসভায় ও প্রশাসনে সহযােগীর আসন দিতে হত, এই যা!
তা হলে কংগ্রেস লিগের সঙ্গে জোট গড়ল না কেন? একটা প্রাথমিক কারণ নিশ্চয়ই ছিল পাটীগণিত— কংগ্রেস নিজেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গিয়েছিল। এতটা সাফল্য পাবে, সেই নিশ্চয়তা ছিল না বলেই কংগ্রেস নির্বাচনী আঁতাতে গিয়েছিল, এখন আর সেই আঁতাতকে মর্যাদা দিয়ে সংখ্যায় ছােট, সুতরাং অপ্রাসঙ্গিক সহযােগীকে ক্ষমতার ভাগ দেওয়ার দরকার থাকল না। এটা একেবারে বিশুদ্ধ সংখ্যাগুরুবাদ। এর তাত্ত্বিক যুক্তি খাড়া করা যায়, কিন্তু বাস্তব পরিণাম ভয়ঙ্কর।
২০৪
কংগ্রেসের অবস্থানের একটা বুদ্ধিগ্রাহ্য এবং যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা তবে কী? এর কিছুটা উত্তর পাওয়া যাবে কংগ্রেসের রাজনৈতিক মতাদর্শে– ‘ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ‘সংখ্যাগুরুচালিত গণতন্ত্র’-র যে মতাদর্শ তারা গ্রহণ করেছিল। ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে নিজেকে জাহির করেই কংগ্রেস ‘জাতীয় দলের মর্যাদা দাবি করতে চেয়েছিল।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিতর্ক
ঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের সূত্রে ইউরােপের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের তত্ত্ব ভারতে প্রয়ােগ করা হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত বিতর্ক তারই একটি পরিণাম। ভারতে এই ধারণাটি প্রথম থেকেই একটা সংঘাতের তত্ত্ব সৃষ্টি করে। হিন্দু শব্দটা হয়ে দাঁড়ায় ‘সাম্প্রদায়িক চরিত্রের অভিজ্ঞান। সুতরাং, ধর্মনিরপেক্ষতা’-র প্রতিকূল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজতাত্ত্বিক বা সমাজকর্মীরা পশ্চিমি ধারণাটিকে ভারতের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে মেলাতে পারেননি। যেমন, টি এল মদন মনে করেছেন, এই ধারণা ভারতের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতা’-র সঙ্গে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-কে মেলানাে যায় না। ধারণাটি বিচিত্র, কিন্তু বামপন্থী মনােভাবাপন্নরা এই ধারণার খুব ভক্ত। এর থেকে যেন মনে হয় যে, ‘সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা’ অনেক বেশি গ্রহণীয়, প্রায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র শামিল।
কারও কারও মতে, ভারত যেহেতু চরিত্রে ‘হিন্দু’, তাই সে কখনওই যথার্থ ‘নিরপেক্ষ হতে পারবে না। এই অভিমতের পিছনে আছে হিন্দু, ‘সনাতন’ চিন্তাধারা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।
দেশভাগের পরে রাজনৈতিক চিন্তা, মত বা আদর্শ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা’-র নানা ধরনের অর্থ করা হয়েছে। কারও কাছে এর মানে হল একটা অনির্দিষ্ট ‘সহনশীলতা, ‘রাজনৈতিক জীবনে ধর্ম’-কে স্থান দিতেও তার আপত্তি নেই। গাঁধী ধর্মীয় ভাষাকে, এমনকী ধর্মকেও সমতার যুক্তি হিসেবে নিঃসংশয়ে ব্যবহার করেছেন। অন্য দিকে, নেহরুর মতাে নেতারা ধর্মনিরপেক্ষতার মানে খুঁজেছেন ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখার নীতিতে। অবশ্য, কার্যক্ষেত্রে ভারতের হিন্দু সংস্কৃতির একটা চাপা উদযাপনে নেহরুর আপত্তি ছিল না। এই ব্যাখ্যাকে ভুল ভাবে এবং সংকীর্ণ ভাবে প্রয়ােগ করে দাবি করা হয়েছে যে, কংগ্রেসই বরাবর একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ’ দল, তার আচরণ যেমনই হােক না কেন।
অন্যরা ধর্মনিরপেক্ষতা’-কে ভারতের সর্বধর্ম-সমভাব’ ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন। এ ক্ষেত্রে ‘ধর্ম’ বলতে বােঝানাে হয়েছে জীবনধারণের ‘পন্থা। কারও কারও বক্তব্য, পশ্চিম দুনিয়া সাম্প্রতিক কালে যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ খুঁজে পেয়েছে, ভারতে সেটা হাজার হাজার বছর ধরে জানা ছিল। এই অভিমতের একটা অর্থ এই যে, এ দেশে
২০৫
সাম্প্রদায়িক বিভেদের জন্য মুসলমানরা দায়ী ছিল বা এখনও দায়ী।[২০]
১৯৩৭ সালে খুব অল্পসংখ্যক মুসলিম আসনে প্রার্থী দিয়ে এবং সেগুলিতেও হেরে গিয়েও কংগ্রেস নিজেকে একটি জাতীয় দল হিসেবে গণ্য করেছিল, কারণ এখন সে নিজের ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচয়ের ওপর জোর দিচ্ছিল, সুতরাং মুসলিম সমর্থনের যেন তার আর কোনও দরকার ছিল না। এ এক বিচিত্র যুক্তি। দল যেহেতু নিজেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ, সুতরাং ‘জাতীয়’ আখ্যা দিয়েছে, সুতরাং নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হােক না কেন, তাকে জাতীয় দল বলে মেনে নিতে হবে! ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’-র ধারণাটিকে বাস্তববর্জিত। ভাবে ব্যবহার করার এই কৌশল ফৈজপুর কংগ্রেসে নেহরুর ভাষণেই স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল। সেখানেই তিনি তার সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন যে, ভারতবর্ষে দুটি শক্তি আছে— ‘জাতীয়তাবাদের প্রতিভূ কংগ্রেস এবং সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ ব্রিটিশ। জিন্না বলেছিলেন, মুসলিমরা হল তৃতীয় শক্তি। স্পষ্টতই এই অভিমতের সমালােচনা করে নেহরু কয়েক মাস পরে মন্তব্য করেন, তৃতীয় শক্তির কোনও গুরুত্ব নেই, কারণ কংগ্রেস একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণের দায়িত্ব পেয়েছে। কিন্তু সেই স্বঘােষিত ‘দায়িত্ব নিশ্চয়ই দেশটাকে ভাগ করে ফেলার জন্য দেওয়া হয়নি।
কংগ্রেসকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ধরে নিয়েছিলেন বলেই নেহরু মনে করতে পেরেছিলেন যে, যুক্তপ্রদেশের মুসলিম নির্বাচনী কেন্দ্রগুলিতে দলের বিপর্যয় ছিল একটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা। “যুক্তপ্রদেশে কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন বটে, কিন্তু তাই বলে আমি এ কথা মানতে রাজি নই যে, মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে কংগ্রেসের কোনও প্রভাব নেই। তিনি এই কথারই সূত্র ধরে আরও বলেছিলেন, “এ বারের নির্বাচনে আমাদের ব্যর্থতাই বরং বুঝিয়ে দেয় যে, সাফল্য আমাদের হাতের মুঠোয় এবং মুসলিম জনসাধারণ উত্তরােত্তর কংগ্রেসের দিকে চলে আসছেন।”[২৩] নেহরুর মত ছিল এই যে, কংগ্রেস মুসলিমদের মধ্যে কাজ করতে পারেনি বসেই তাদের ভােট পায়নি। এটা হয়তাে সত্যি কথাই। তা ছাড়া, মুসলিম লিগের যে প্রায় কোনও সাংগঠনিক কাঠামাে ছিল না সেটাও ভুল নয়। তাদের একটা ভিত অবশ্য ছিল, যদিও সেই ভিতটা সম্পূর্ণ গােষ্ঠীভিত্তিক এবং আঞ্চলিক স্বার্থের ছকে বাঁধা। _ নেহরু বিশ্বাস করতেন, যুক্তপ্রদেশের মুসলিম সমাজে একটা আলােড়ন চলছিল, তারা অপদার্থ সাম্প্রদায়িক নেতাদের সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তারা সাম্প্রদায়িক কানাগলি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা এবং প্রগতির পথে হাঁটতে চাইছিলেন। নির্বাচনে “… সাম্প্রদায়িকতার ভূত কিছুটা তাড়ানাে গিয়েছে।”[২৪] মুসলিমদের একটি অংশ যদি কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন, তবে সেটা শহরে, গ্রামে নয়। “আমি নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে যখন সুযােগ আসবে, আমরা গ্রামে একটি মুসলিম আসনেও হারব না, শহরের কথা অবশ্য বলতে পারি না।”[২৫] ১৯৩৭-এর নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে নেহরুর এই ‘আশাবাদী অবাস্তব ধারণা ছিল বলেই যুক্তপ্রদেশে মুসলিম লিগের সাহায্য ছাড়াই কংগ্রেস সরকার গড়তে পারবে বলে তিনি এত নিশ্চিত ছিলেন।
আরও একটা কারণে কংগ্রেস মুসলিম সমর্থনের অভাবকে তুচ্ছ করতে পেরেছিল।
২০৬
কংগ্রেসের নেতারা সাধারণ ভাবে ওয়েস্টমিনস্টার মডেল’-এর সংখ্যাগরিষ্ঠতাসর্বস্ব গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন, সেখানে আসনসংখ্যার পাটীগণিতটাই শেষ কথা। তার বাইরেও একটা সামাজিক পাটীগণিত থাকে, সেটা ছাড়া নৈতিক বৈধতা পাওয়া যায় না । এই কারণেই নেহরু এবং আরও অনেক কংগ্রেস নেতাই ভুলে গিয়েছিলেন যে, (১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে) স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলীর ভিত্তিতে তৈরি সরকার যদি কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে দাঁড়িয়ে থাকে, যদি সেখানে সংখ্যালঘুর স্থান
থাকে, তা হলে তার প্রতিনিধিত্বের নৈতিক অধিকার থাকে না। অবশ্য কংগ্রেসের মধ্যে আরও অনেকে ছিলেন (এবং এখনও আছেন) যাঁরা মনে করতেন, এ ভাবে যুক্তপ্রদেশের সংখ্যালঘু মুসলিমদের ‘সমঝে’ দেওয়া গেল।
প্রায় সমস্ত মুসলিম এম এল এ’কে বিরােধী আসনে বসিয়ে কংগ্রেস যখন সরকার তৈরি করল, তখন অ-কংগ্রেসি মুসলমানরা হঠাৎ উপলব্ধি করলেন যে তারা প্রায় সম্পূর্ণ শক্তিহীন হয়ে পড়েছেন। তারা বিদ্যুৎচমকের মতাে দেখতে পেলেন যে, কংগ্রেস যদি একটাও মুসলিম আসন না পেয়ে নিছক সংখ্যাগুরু হিন্দু ভােটের জোরে আইনসভায়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তা হলেই তারা সরকার গড়তে পারে; মুসলিম রাজনীতিকরা নিজেদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা বিসর্জন না দিলে সরকারের বাইরেই থেকে যাবেন, আবার নিজেদের স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিলে তারা নির্বাচিত হবেন না। ভবিষ্যতে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার পক্ষে এটা খুব বিপজ্জনক একটা ব্যাপার, কারণ এর মানে দাড়ায় এই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী কংগ্রেস শাসিত ভারতে মুসলমানদের, বস্তুত কোনও সংখ্যালঘু গােষ্ঠীরই, কোনও জায়গা থাকবে না, এক যদি না কংগ্রেস কোণঠাসা হয়ে পড়ে— সে ক্ষেত্রে অবশ্য তারা যে কোনও গােষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলাবে।
জোট সরকার গঠন না করার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস-এ লেখা হয়েছে, “কংগ্রেস নেতাদের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ভুল ছিল, এর পরিণাম খারাপ হতে বাধ্য। মুসলমানরা বুঝতে পারলেন, একটি স্বতন্ত্র গােষ্ঠী হিসেবে তাদের কোনও রাজনৈতিক সম্ভাবনাই নেই।… কংগ্রেসের চরমপত্রের একটাই মানে ছিল— দুই শিবিরের পথ দু’দিকে চলে যাবে, যার পরিণতিতে জন্ম নেবে পাকিস্তান।”
ভি পি মেনন তার ট্রান্সফার অব পাওয়ার’ গ্রন্থে লেখেন, “কংগ্রেস নিজের জোরে সুসংহত মন্ত্রিসভা তৈরি করবে বলে স্থির করেছিল, দলের সদস্যদের মধ্যে থেকেই মুসলিম মন্ত্রীদের বেছে নিয়েছিল। এই থেকেই কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে বড় রকমের বিচ্ছেদ শুরু হল, মুসলিম সমাজের নিরপেক্ষ মানুষের সমর্থন জিন্নার দিকে চলে যাওয়ার পিছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল।”[২৬]
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ। তার আত্মজীবনী ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’-এ আজাদ ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পরবর্তী অধ্যায় সম্পর্কে লিখেছেন, “যুক্তপ্রদেশ মুসলিম লিগের সহযােগিতার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে লিগ কার্যত কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে যেত। জওহরলাল যুক্তপ্রদেশে
২০৭
লিগকে এক নতুন জীবন দিলেন।… যুক্তপ্রদেশ থেকেই লিগ নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে শুরু করল। জিন্না অবস্থার পূর্ণ সুযােগ নিয়ে যে অভিযান শুরু করলেন, তার পরিণামে দেশ ভাগ হয়ে গেল।”[২৭] ব্ৰেশার তার নেহরু-জীবনীতে মন্তব্য করেন, “নির্বাচনে কংগ্রেসের জয়ের যুগপৎ তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদি ফল হল এই যে, মুসলিম লিগের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়ে গেল। সাফল্যের মৌতাতে কুঁদ হয়ে কংগ্রেস অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দলকে তার আজ্ঞাবহ বলে ভাবতে লাগল। এই পর্বতপ্রমাণ ভুল’-এর চড়া মাসুল তাকে পরবর্তী বছরগুলিতে দিতে হয়েছে। ১৯৩৭-এর মার্চ মাসে নেহরুর উগ্র মন্তব্য এই পরবর্তী ইতিহাসের সুর বেঁধে দিয়েছিল। নেহরু বলেছিলেন, ‘ভারতে এখন কেবল দুটি শক্তি আছে: ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, কংগ্রেস যার প্রতিনিধি। জিন্না অবিলম্বে এর জবাব দেন: ‘না, একটি তৃতীয় পক্ষ আছে— মুসলমানরা। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তিনি ঠিক বলেছিলেন।”[২৮]
১৯৬৯ সালে লিখতে গিয়ে শিব রাও ১৯৩৭-এর নির্বাচনের সম্পর্কে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, এটা তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার যে ওই নির্বাচনের পরেও জিন্না স্বতন্ত্র পাকিস্তান রাষ্ট্রের কথা বলেননি। শিব রাও লিখেছেন, “১৯৩৭-এর নির্বাচনের অল্পকাল পরেই জিন্না একটি প্রকাশ্য ঘােষণায় বলেন, “হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে একটা সম্মানজনক বােঝাপড়া হােক, এটা আমার চেয়ে বেশি কেউ চায় না, এবং এ জন্য আমার চেয়ে বেশি চেষ্টা করতেও কেউ তৈরি নয়। এর পর তিনি এই বিষয়ে সাহায্য চেয়ে গাঁধীকে প্রকাশ্য আবেদন জানান। গাঁধীর উত্তর ছিল কিছুটা হতাশাব্যঞ্জক। তিনি বলেছিলেন, “আমি কিছু করতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ অসহায়। ঐক্যের প্রতি আমার বিশ্বাস আজও সমান উজ্জ্বল, কিন্তু আমি কোনও দিবালােক দেখতে পাচ্ছি না, আমার সামনে নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, এবং এই বিপন্ন সময়ে আমি কেবল ঈশ্বরের কাছে আলােকভিক্ষা চাইছি।”[২৯] ইতিহাস সাক্ষী, ঈশ্বর কংগ্রেসকে প্রজ্ঞা বা আলাে দিয়ে পথ দেখাতে আগ্রহী ছিলেন না। গাঁধীর কথাই যদি তিনি না শােনেন, কংগ্রেসের ভিতরে আর কার কথা শুনবেন? গাঁধী ছিলেন নিঃসন্দেহে এক জন ধর্মপ্রাণ হিন্দু, অন্তত নেহরুর চেয়ে অনেক বেশি— নেহরুর চিন্তা এবং পথ (দুর্ভাগ্যবশত, তাঁর। ভাষা এবং বাচনভঙ্গিও) ভারতের বিশ্বাস, চিন্তাভাবনা এবং প্রজ্ঞার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের তুলনায় অনেক বেশি আলােকিত হত আমদানি করা পশ্চিমি ধারণায়।
অত্যন্ত কঠিন শর্ত মেনে না নিলে মুসলিম লিগকে মন্ত্রিসভায় নেওয়া হবে নাকংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ ফল হল। প্রথমত, যুক্তপ্রদেশের মুসলিম। রাজনীতিকরা তাদের রাজনৈতিক রণকৌশল এবং উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য। হলেন। তারা বুঝতে পারলেন, কংগ্রেস তাদের সঙ্গে প্রদেশ-স্তরে কোনও বােঝাপড়া করবে না, ফলে তারা জিন্না এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লিগের শরণাপন্ন হলেন। তারা বুঝতে পারলেন, সর্বভারতীয় মুসলিম ঐক্য আনতে পারলেই কংগ্রেসের সঙ্গে দর কষাকষিতে একটা জোর পাওয়া যাবে, তখন কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক, উভয় স্তরেই কংগ্রেসের কাছ থেকে তারা নানা দাবি আদায় করতে পারবেন। কংগ্রেসের অনমনীয়
২০৮
অবস্থানের ফলে জোট তৈরির জন্য খালেকুজ্জামান এবং নবাব ইসমাইল খানের সমস্ত চেষ্টা ১৯৩৭ শেষ হওয়ার আগেই ব্যর্থ হয়ে যায়, তার পরে প্রাদেশিক স্তরে কোনও বােঝাপড়ার আর কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। এর পর থেকে জিন্না সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের সর্বভারতীয় মীমাংসার জন্য ক্রমশ অনড় হয়ে উঠলেন, দাবি জানালেন যে, কংগ্রেস মুসলিম লিগকে সর্বভারতীয় স্তরে মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিক। তার যুক্তি ছিল, লিগকে এই স্বীকৃতি না দিলে এবং তাকে ভারতীয় মুসলমানের ‘অদ্বিতীয় মুখপাত্র বলে মেনে না নিলে কংগ্রেস লিগের ন্যায্য প্রাপ্যটুকুও তাকে দেবে না। এবং কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতা করে চলার সময় যে জিন্না ও খালেকুজ্জামান জমিদার-বিরােধী অবস্থান নিয়েছিলেন, এ বার তারাই ভােল পালটে যুক্তপ্রদেশের সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের অধিকাংশকেই দলে টানলেন; সেটা কেবল টাকার জন্য নয়, মুসলিম সংহতির তাগিদেও।
কংগ্রেস দু’বছরের ওপর ক্ষমতায় থাকল। এই দু’বছরের অভিজ্ঞতা মুসলমানদের মনে সাধারণ ভাবে কংগ্রেসের প্রতি অনুকূল মনােভাব জাগায়নি। লিগ যত উদাহরণ দিয়েছিল, সেগুলির কোনটা কতখানি সত্য, সেই তর্কে না গিয়েও বলা যায়, সাধারণ ভাবে সমস্ত শ্রেণির মুসলমানদের ধারণা হয়েছিল: ‘হিন্দু রাজ’ এসে গেছে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তপ্রদেশের মুসলমানরা বুঝলেন যে স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী দিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সাধিত হবে না, ক্ষমতার ভাগ পেতে চাইলে অন্য উপায় খুঁজতে হবে। সংখ্যালঘুর অন্তর্নিহিত দুর্বলতা অতিক্রম করে নিজেদের মত প্রতিষ্ঠার সামর্থ্য অর্জন কী ভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই ‘প্যারিটি’ বা সমতার ধারণাটি উঠে এসেছিল। যুক্তি ছিল, গণতন্ত্রে নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠতার যত গুরুত্বই থাক, সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে কার্যকর একটা সমতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যে সমতা সংখ্যার ওপর নির্ভর করবে না। তার কারণ, একমাত্র সমতা থাকলেই সংখ্যালঘুদের কথা শােনা হবে। সুতরাং একটা ‘জাতি’র (নেশন) প্রতিনিধিদের জন্য সমতার দাবিই ন্যায্য এবং সঙ্গত দাবি— জিন্না তত দিনে ভারতের মুসলমানদের একটি জাতি বলেই দাবি করছিলেন।
কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের আরও একটি দীর্ঘমেয়াদি ফল হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে কংগ্রেসের যে দাবি ছিল, তাতে এ বার চোট পড়ল। শাসনক্ষমতার অংশীদার হল এই দল, ফলে যুক্তপ্রদেশে সরকারি নীতি, প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়ভাগ বর্তাল তাদের ওপর। কোনও গােলমাল হলে— যুক্তপ্রদেশের মতাে। একটি বিরাট প্রদেশে গােলমাল হওয়া অনিবার্য ছিল— কংগ্রেস তােপের মুখে পড়বে, এটা অনিবার্য ছিল। মুসলিম প্রতিনিধিরা প্রায় সবাই বিরােধী আসনে, সুতরাং যে কোনও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে সরকারি নীতি নিয়ে গােলযােগ দেখা দিলে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আরও বেশি সংশয় দেখা দেবেই। যেহেতু যুক্তপ্রদেশে মুসলমান ভােটদাতারা কংগ্রেস প্রার্থীদের প্রবল ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাই ‘জাতীয় দল হিসেবে নিজেকে বিশ্বাসযােগ্য করে তুলতে হলে কংগ্রেস সরকারের পক্ষে সাম্প্রদায়িক
২০৯
ঐক্য ও সংহতি রক্ষায় বিশেষ ভাবে তৎপর হওয়া আবশ্যক ছিল। এত দিন কংগ্রেস ‘ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে যত প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে, এ বার সরকারের তরফে তার প্রমাণ দেওয়ার পালা। তা ছাড়া, বিরােধী পক্ষের মসলিম রাজনীতিকদের অনিবার্য প্রতিবাদের মােকাবিলা করতে চাইলে নিজেদের নিঃসংশয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ বলে প্রমাণ করা ছিল কংগ্রেস দল এবং সরকারের আবশ্যিক দায়িত্ব। যুক্তপ্রদেশে তখন যা পরিস্থিতি, তাতে এটা প্রায় অসম্ভব ছিল।
এই কারণেই যুক্তপ্রদেশের দেশভাগ-পূর্ববর্তী প্রাদেশিক রাজনীতিতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের জোট সংক্রান্ত আলােচনা ভেস্তে যাওয়াটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে দাড়ায়। এর ফলে মুসলিম লিগের সংগঠন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি রূপান্তরিত হল, কংগ্রেসের ভাবমূর্তির অবক্ষয় ঘটল এবং যুক্তপ্রদেশের অধিকাংশ মুসলমান কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, পরবর্তী এক দশকের রাজনৈতিক বিতর্ক ও প্রচারের ওপর এই বিচ্ছেদের একটা বিরাট প্রভাব পড়ল। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পিছনে এর বিরাট অবদান ছিল।
১৯৩৭-এর নির্বাচনের পরে জিন্নার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, তার কী করণীয়। মুসলিম লিগকে মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র করে তােলাটাই হবে এখন থেকে। তার সবচেয়ে বড় কাজ। এই কাজে অনেক কিছুই তাকে সাহায্য করেছিল, কিন্তু কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকারের নীতি যে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তিনি এক বার বলেছিলেন, “রাজনীতিতে দাবা খেলার মতােই ভেবে চাল দিতে হয়। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর প্রথম চাল হবে মুসলিম লিগের পুনরুজ্জীবন ঘটানাে। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তত দিন লিগের কোনও বােঝাপড়ায় আসা উচিত হবে না, বিশেষ করে কংগ্রেসের সঙ্গে বােঝাপড়ার চেষ্টার ফল যখন ভাল হয়নি। জিন্না স্থির করলেন, ক্ষমতার ভাগ দিতে পারে একমাত্র ব্রিটিশরাই, কংগ্রেসের কাছে কিছু প্রত্যাশা করে কোনও লাভ নেই। কংগ্রেসের সঙ্গে বােঝাপড়া করতে চাইলে আগে নিজের শক্তি বাড়িয়ে নেওয়া দরকার। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে যেতে হবে, সেটা তিনি যথেষ্ট পরিমাণে করে চললেন।
অন্য প্রশ্নটা ছিল, কংগ্রেসের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় যােগ দেওয়া উচিত কি না। এই প্রশ্নের দ্রুত উত্তর পাওয়া দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রে মূল প্রশ্ন ছিল গভর্নরদের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে। কংগ্রেস নেতারা দলের সর্বভারতীয় কমিটির নির্দেশ অনুসারে দাবি জানালেন, গভর্নররা ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের ৯৩ ধারায় প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করবেন না, এই মর্মে তাদের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।” তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেল না, তাই কংগ্রেসও মন্ত্রিসভায় গেল না। ভাইসরয় লিনলিথগাে’র পক্ষে এটা ছিল একটা প্রাথমিক ধাক্কা। ” অন্য দিকে যে সব প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না, সেখানে মন্ত্রিসভা গঠনের কাজ ঠিক ঠিক এগিয়ে গেল। ১৯৩৭-এর মার্চ নাগাদ গাঁধী অস্বস্তি বােধ করতে শুরু করলেন— কংগ্রেস কি নিজেকে একটা কানাগলির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে? তিনি
২১০
কংগ্রেসকে পরামর্শ দিলেন, গভর্নরদের সঙ্গে কথা বলে একটা মীমাংসার পথ সন্ধান করা হােক। কংগ্রেসের এই সংকট বুঝতে পেরে মুসলিম লিগের পূর্ববর্তী অধিবেশনের সভাপতি সৈয়দ নাজির হাসান একটি বিবৃতি দিয়ে দাবি জানালেন, সংখ্যালঘু মন্ত্রিসভা গঠন করা আইনসম্মত হবে না, সুতরাং সরকারের উচিত ভারত শাসন আইনের ৯৩, ধারা প্রয়ােগ করে গভর্নরের শাসন জারি করা। লিনলিথগাে সেটা মােটেও করতে চাইলেন না, কংগ্রেসকে তার নিজের তৈরি করা সংকট থেকে পরিত্রাণের পথ করে দেওয়া তার একেবারেই অভিপ্রেত ছিল না।
১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন অনুসারে প্রাদেশিক নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পরে সংস্কারের তালিকায় এ বার উঠল ফেডারেশন-এর প্রশ্ন। রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলি নিয়ে যে সব প্রস্তাব এল, সেগুলি ওই সব প্রদেশে আশঙ্কা সৃষ্টি করল। কিন্তু ১৯৩০-এ প্রথম গােল টেবিল বৈঠক এবং ১৯৩৫-এ ভারত শাসন আইন প্রণয়নের মধ্যবত। পর্বে রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির মনােভাব অনেক পালটে গিয়েছিল, তারা গােড়ার দিকে ফেডারেশনের পক্ষে কথা বললেও ক্রমশ স্বশাসনের ওপর জোর দিচ্ছিল। ভারত শাসন আইনে তাদের স্বাধিকার খর্ব করার যে স্পষ্ট সম্ভাবনাগুলি ছিল, তারা সেগুলিতে আপত্তি জানাল, এমনকী প্রস্তাবিত ফেডারাল কর্তৃপক্ষ ভারতীয় প্রদেশগুলিতে যে ন্যূনতম ক্ষমতা হাতে রাখতে চায়, তা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলল। তাদের দাবি ছিল, ব্রিটিশ সরকারকে তাদের সঙ্গে সঙ্গে সমানে সমানে বােঝাপড়ায় আসতে হবে। ব্রিটিশ সেক্রেটারি অব স্টেট এই দাবি সরাসরি নাকচ করে দিলেন। নিজেদের সার্বভৌম অধিকার নিয়ে এবং ব্রিটিশ সরকারের কর্তৃত্ব নিয়ে রাজন্যবর্গের সংশয় থেকেই গেল।
এই সমস্যার জট ছাড়াতে বিস্তর সময় লাগল। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৯-এর গােড়ায় লিনলিথগাে ভারত শাসন আইনে রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির যােগ দেওয়ার একটা গ্রহণীয় ব্যবস্থা খুঁজে পেলেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রদেশে কংগ্রেস সমর্থিত প্রজা পরিষদ আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া কয়েকটি বড় প্রদেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যে, ফেডারেশনের অঙ্গ হলে তাদের রাজস্বের কী পরিণতি হবে। ১৯৩৭-এর নভেম্বরে ভারতে এসে লর্ড লাথিয়ান দেখেছিলেন যে, নেহরুর এ বিষয়ে ঘােরতর আপত্তি ছিল, তিনি এটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি যে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের অধিকাংশই প্রতিরক্ষার জন্য বরাদ্দ করতে হবে, ফলে যে ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নেহরু কংগ্রেসকে দায়বদ্ধ করেছিলেন সেগুলির জন্য যথেষ্ট অর্থের সংস্থান করা যাবে না। তা ছাড়া, রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলিতে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠলে সরকারে তাদের অংশগ্রহণের প্রস্তাব মেনে নিতেও তার আপত্তি ছিল। লােথিয়ান-এর মনে হয়েছিল, ফেডারেশনের প্রস্তাব নিয়ে চাপাচাপি করলে কংগ্রেস একটা সংকট সৃষ্টি করে দিতে পারে।
লিনলিথগাে অবশ্য আশা ছাড়লেন না। তাঁর মনে হয়েছিল, কংগ্রেসকে যদি তিনি আর একটা বছর ক্ষমতায় রাখতে পারেন, তা হলে তারা ফেডারেশনে যােগ দিতে বাধ্য হবে। কীসের ভিত্তিতে তিনি এই ধারণায় পৌঁছেছিলেন সেটা অবশ্য স্পষ্ট ছিল না। তবে
২১১
মুসলিমরা তত দিনে বুঝে গিয়েছিল যে, একটি সংগঠন হিসেবে পায়ের নীচে শক্ত মাটি ধরে রাখতে গেলে তাদের ‘হিন্দু কংগ্রেস’-এর বিরােধী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ফলে একটি অখণ্ড স্বাধীন ভারতের সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছিল এবং তার জন্য দায়ী ছিল কংগ্রেসের নীতি ও ভ্রান্তি। নেহরু ফেডারেশনের বিষয়ে নিজের আপত্তি জানানাের পরে ১৯৩৭-এর অক্টোবরে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে সফর করলেন এবং জোর দিয়ে বললেন যে, “বর্তমান সংবিধানটি বিসর্জন দিয়ে ব্রিটিশ সংসর্গ বর্জন করা-ই কংগ্রেসের চড়ান্ত লক্ষ্য।”[৩১] লক্ষ করার বিষয়, তিনি এটাও বললেন যে ইউরােপে যুদ্ধ অনিবার্য এবং সেটা কংগ্রেসের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে একটা বড় সুযােগ। তিনি ঘােষণা করলেন, “ক্ষমতার ভাগ পাওয়া নয়, আমাদের সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল গণসংগঠন গড়ে তােলা এবং জনসাধারণের মধ্যে ‘গণ-বৈপ্লবিক মানসিকতা সৃষ্টি করা।”[৩২] তিনি বললেন, মুসলিম সমাজকে কংগ্রেসের শরিক করে তােলাও একটা বড় কাজ।[৩৩]
গাঁধী একেবারেই কোনও চরমপন্থী অবস্থান নেননি। প্রস্তাবিত ফেডারেশন কার্যকর হলে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলিকে পদত্যাগ করতে হবে, এই প্রস্তাব তিনি ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, যদিও লর্ড লােথিয়ান-এর কাছে নেহরু যে সব আপত্তি জানিয়েছিলেন সেই বিষয়ে গাঁধীও একমত ছিলেন। রাজন্যশাসিত রাজ্যের প্রশ্নে ফেডারেশনের প্রস্তাবে আপত্তি জানাতেও গাঁধী রাজি ছিলেন না। তার অনেক বেশি চিন্তা ছিল প্রতিরক্ষা এবং বিদেশনীতি নিয়ে, তিনি চেয়েছিলেন, এই দুটি বিষয় যেন। আর কেন্দ্রের নিরঙ্কুশ এক্তিয়ারে না রাখা হয়।
অন্য দিকে, মুসলমানরা এই কঠিন সময়ে এক জন সর্বভারতীয় নেতা খুঁজছিলেন। তারা মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে খুঁজে পেলেন মহম্মদ আলি জিন্নাকে— কেবল একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে নয়, বাস্তবে ‘একমাত্র পরিত্রাতা হিসেবে। জিন্নার সঙ্গে যখন লিনলিথগাের প্রথম দেখা হয় তখন তিনি অনুমান করতে পারেননি, জিন্না মুসলমানদের ওপর ভবিষ্যতে কতটা প্রভাব বিস্তার করবেন। তখন ভাইসরয় লিখেছিলেন, “সত্যি কথা বলতে কী, আমি ওঁকে দেখে বিশেষ ভরসা পাইনি, আমার মনে হয় উনি সেই জাতের রাজনৈতিক নেতাদের এক জন, যাঁদের পুরাে রাজনীতিটাই ব্যক্তিগত; অনুগামীদের ওপর নিজের প্রভাব তঁারা ধরে রাখতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে প্রায়শই প্রশ্ন ওঠে।”[৩৪] এটা ১৯৩৭-এর কথা। বড়লাট খুব হুড়ােহুড়ি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন, তিনি জানতেনও না, বাস্তব পরিস্থিতি কত দ্রুত পালটে যাচ্ছে। জিন্না তত দিনে জাতীয় স্তরে মুসলিম রাজনীতির একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন।
গাঁধীর মতােই জিন্নাও ফেডারেশন প্রস্তাবের সরাসরি বিরােধিতা করেননি। আইনসভায় তিনি ১৯৩৫-এর আইনের যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কিত অংশটির প্রবল বিরােধিতা করেছিলেন, বলেছিলেন ওই অংশটি ‘বস্তাপচা, মূলত খারাপ এবং একেবারেই গ্রহণীয় নয়’, তা ছাড়া এটি কার্যকরও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আবার বলেছিলেন যে সর্বভারতীয় ফেডারেশন সম্পর্কে তার নীতিগত কোনও আপত্তি নেই, তার আপত্তি
২১২
ব্রিটিশ সরকারের প্রস্তাবিত ফেডারেশন সম্পর্কে। (ভারতের সাংবিধানিক সংস্কার বিষয়ে যৌথ সংসদীয় কমিটির রিপাের্ট-এর ওপর ১৯৩৫-এর ৭ ফেব্রুয়ারিতে আইনসভায় জিন্নার বক্তৃতা) ভাইসরয় বা বড়লাট লর্ড লিনলিথগাে যে হিন্দু নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তাঁদের মতােই জিন্নাও বলেছিলেন, তারা ফেডারেশন-এর কাঠামােয় বিন্যস্ত ব্রিটিশ ভারত চান। রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলি যদি জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবং বহু মানুষের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রতিনিধি পাঠায়, তা হলে ফেডারেশনে তাদেরও স্থান দেওয়া যাবে। তিনি কিছুটা তিক্ত ভাবেই অভিযােগ করেছিলেন যে লিনলিথগাে গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে বুদ্ধিমানের কাজ করেননি, কারণ এর ফলে ‘কংগ্রেসের খুব দর বেড়ে গিয়েছিল এবং মুসলমানদের সম্ভাবনা ব্যাহত হয়েছিল। এই বৈঠকে লিনলিথগাে জিন্নাকেই বেশির ভাগ সময় কথা বলতে দিয়েছিলেন, তার কাছে। এই বৈঠক ছিল জল মেপে নেওয়ার একটি সুযােগ।[৩৫]
মাত্র কিছু দিন আগেই নির্বাচনে তার দল বেশ ধাক্কা খেয়েছিল বটে, কিন্তু জিন্না ভারতের বহু কোটি মুসলমানের প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলার অধিকার দখল করে নিচ্ছিলেন: “আমি যখন দশ কোটি বলছি, আমি বলতে চাইছি তাদের শতকরা ৯৯ জন আমাদের সঙ্গে আছেন, কিছু বিশ্বাসঘাতক, ছিটগ্রস্ত, অতিমানব এবং উন্মাদকে বাদ দিলে।
কয়েক সপ্তাহ পরে, ১৯৩৭-এর অক্টোবরে মুসলিম লিগের লখনউ অধিবেশনে। জিন্না সম্পূর্ণ ‘হিন্দু নীতি অনুসরণের জন্য কংগ্রেসের কঠোর সমালােচনা করলেন, বললেন, কংগ্রেসের এই নীতির ফলে “বিশৃঙ্খলা, তিক্ততা এবং সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি হবে, ভারতের ওপর সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্ব আরও প্রবল হবে।”[৩৬] জিন্না বললেন, “কংগ্রেসের শাসনে মুসলমানের ন্যায়বিচার বা সমদৃষ্টি পাওয়ার কোনও আশাই নেই এবং তাদের (কংগ্রেস এবং লিগ) মধ্যে কোনও বােঝাপড়াই সম্ভব নয়।”[৩৭] এই সভাতেই সিকন্দর হায়াত খান একটি ঘােষণা করলেন, লিনলিথগাের মতে যেটি ছিল এক ‘বিস্ময়কর ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তিনি জানালেন, পঞ্জাবে তার ইউনিয়নিস্ট পার্টির সমস্ত মুসলিম সদস্যকে তিনি মুসলিম লিগে যােগদানের পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হকও বাংলার মুসলমানদের একই আবেদন জানালেন। লখনউ অধিবেশনে ফেডারেশন গঠনের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব অনুমােদিত হল, ঘােষণা করা হল যে, ‘স্বাধীনতা’ই লিগের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সব মিলিয়ে লিগের লখনউ অধিবেশন জিন্নাকে খুব বড় সাফল্য এনে দিল। লিগের শক্তি অনেক বেড়ে গেল, এর পর তার সংগঠন দ্রুত জোরদার হয়ে উঠবে। বাংলা এবং পঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রীরা নিজেদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে জিন্নার হাত শক্ত করতে বাধ্য হলেন।
১৯৩৮-এর ফেব্রুয়ারির গােড়ায় ব্রিটিশ সম্রাটকে লিনলিথগাে জানালেন, হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের বিস্তর অবনতি হয়েছে। তিনি আরও লিখলেন, বহু মুসলমান মন্ত্রীদের কাছে। সাহায্য পাওয়ার আশায় লিগ ছেড়ে কংগ্রেসে যােগ দেওয়ায় জিন্না গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। জিন্না এই সমস্যার মােকাবিলা করার জন্য মুসলমানদের এই বলে তাতিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
২১৩
করলেন যে, কংগ্রেসের ‘শক্তিবৃদ্ধি মুসলিম সংস্কৃতির পক্ষে বিপজ্জনক।[৩৯]
১৯৩৮-এর ৬ এপ্রিল ভাইসরয় আবার জিন্নার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বুঝতে পারলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেবে, এমন কোনও শাসনকাঠামাে এই ‘মুসলিম নেতা’ (ইতিমধ্যে জিন্না তার চোখে সেই গুরুত্ব অর্জন করেছেন) মেনে নেবেন না। জিন্নার প্রতিপত্তি তখন বেড়ে চলেছে, বড়লাটের সঙ্গে তার প্রথম বৈঠকের পর থেকে তিনি আরও কঠোর অবস্থানে সরে গিয়েছেন। তিনি মুসলিম লিগকে নতুন করে সংগঠিত করার ফলে সাম্প্রদায়িক উদ্বেগ আরও বেড়ে গিয়েছিল, এমনকী মাদ্রাজের মতাে প্রদেশেও, যেখানে এত দিন কোনও সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছিল না।
ইতিমধ্যে দু’পক্ষই নিজেদের অবস্থান দৃঢ়তর করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, ফলে সাম্প্রদায়িক উদ্বেগ বাড়ছিল। মুসলিম লিগ কলকাতায় একের পর এক সভা করল, সেখানে জিন্না এবং ফজলুল হক কড়া বক্তৃতা দিলেন। ফজলুল হক ভাইসরয়ের সমালােচনা করলেন, কারণ তিনি কেবল গাঁধীর সঙ্গে কথা-ই বলেননি, সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস শাসিত সরকার ভাল কাজ করছে বলে তাকে জানিয়েছেন। ১৯৩৮-এর জুলাইয়ে লিনলিথগাে সিকন্দর হায়াত খানের সঙ্গে কথা বললেন। তিনি ফেডারেশন গঠন মুলতুবি রাখার অনুরােধ জানালেন, কারণ এখনই ফেডারেশন হলে কেন্দ্রে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বলবৎ হবে, তারা অবিলম্বে প্রতিরক্ষা এবং বিদেশ নীতিকে কেন্দ্রের একচ্ছত্র এক্তিয়ার থেকে বার করে আনার চেষ্টা করবে। যদি তা হয়, তবে সেনাবাহিনীতে পঞ্জাবের মানুষকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটা আর থাকবে না। সিকন্দর হায়াত খান একটি বিকল্প প্রস্তাব দিলেন যে, ভারতকে ছ’টি আঞ্চলিক গােষ্ঠীতে ভাগ করা হােক, যাদের একটি হতে পারে পাকিস্তান। তার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারে প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে তিনি একটি জটিল বিধিব্যবস্থার সুপারিশ করলেন, যাতে ভবিষ্যতে সর্বভারতীয় আইনসভায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়। এমন কাচা অযৌক্তিক প্রস্তাবও বড়লাট ধৈর্য ধরে শুনলেন, কারণ ব্রিটিশরা মুসলিমদের সহযােগী হিসেবে চাইছিল, তারা জানত যে হিন্দু এবং মুসলমান দুটি সম্প্রদায়ই বিরুদ্ধে চলে গেলে তাদের সমস্যা বাড়বে। ব্রিটিশরা যত দিন ভারতে ছিল, ১৮৫৭-র অভিজ্ঞতা তারা কখনও ভােলেনি।
লিনলিথগাের সামনে এখন দুটি পথ: ১৯৩৫-এর আইন সংশােধনের জন্য চাপ দেওয়া অথবা অপেক্ষা করা। তিনি সমস্ত প্রদেশের গভর্নরদের সঙ্গে কথা বললেন। তঁাদের সকলের মত এক নয়, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে তাদের পরামর্শ ছিল স্থিতাবস্থার পক্ষে, কারণ পরিস্থিতি এমনিতেই উদ্বেগজনক, পরিবর্তন ঘটাতে গেলে সংকট আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। সেক্রেটারি অব স্টেট-এর প্রয়ােজন মাফিক কিছু অদলবদল। নিশ্চয়ই করা যাবে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। ভাইসরয়ও ক্রমশ স্থিতাবস্থার পক্ষেই চলে এলেন, ঠিক করলেন যে ১৯৩৫-এর আইন সংশােধনের জন্য বিভিন্ন দিক থেকে চাপ এলেও তা প্রতিহত করতে হবে।
১৯৩৮-এর দ্বিতীয়ার্ধের গােড়ার দিকে দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েক
২১৪
দফা আলােচনা হল। তত দিনে জিন্না প্রকাশ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছেন এবং “লিগ যা চায়, সেই প্রশ্নে কোনও আপস চলবে না বলে দাবি জানাচ্ছেন। কার্যনির্বাহী ভাইসরয় লর্ড ব্রাবোের্নকে তিনি বললেন, কেন্দ্রীয় সরকার যেমন আছে তেমনই বহাল রাখা হােক, কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের রক্ষা করার দায়িত্ব নিক, বিনিময়ে মুসলমানরা দিল্লির দরবারে ব্রিটিশ রাজ কায়েম রাখতে সাহায্য করবে। জিন্না অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন, তিনি বিলক্ষণ জানতেন যে এটা কোনও সমাধান হতে পারে না, কিন্তু এই প্রস্তাবটা দেওয়া তার পক্ষে সেই মুহূর্তে খুব সুবিধাজনক ছিল, তাই তিনি এই প্রস্তাব দিলেন।
এই সময়েই লিনলিথগাে মূলত ফেডারেশনের প্রস্তাব নিয়ে জিন্নার সঙ্গে এক দীর্ঘ বৈঠক করলেন। জিন্না বললেন, তিনি ফেডারেশনের প্রস্তাব পুরােপুরি নাকচ করছেন।
, কিন্তু ফেডারেশন এমন হতে হবে যেখানে হিন্দু-মুসলমান ভারসাম্য যথেষ্ট বজায় থাকে। ভাইসরয় জানতে চাইলেন, এটা কী ভাবে সম্ভব? জিন্না মনে মনে চাইছিলেন, আঞ্চলিক বিভাজন এবং ভােট ভাগ করেই হিন্দু-মুসলমান ভারসাম্য রাখা হােক, কিন্তু এই প্রশ্নে তঁাকে চেপে ধরা হলে তিনি “বিব্রত হয়ে পড়লেন, এবং খুব জোর দিয়ে। বলতে লাগলেন যে দেশকে কোনও ভাগ করা হােক তা তিনি চান না।” ভাইসরয় তখন জিন্নাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে গেলে কি হিন্দু-মুসলমান ভারসাম্য বজায় থাকবে বলে তিনি মনে করেন? জিন্না জানান, সে বিষয়ে গভীর সন্দেহ আছে। তবে কি তিনি চাইছিলেন যে ব্রিটিশরা থাকুক?
পরে ভাইসরয় সেক্রেটারি অব স্টেট লর্ড জেটল্যান্ডকে জিন্নার সঙ্গে এই কথােপকথনের খবর জানাতে গিয়ে লিখেছিলেন, “তিনি (জিন্না) অগত্যা স্বীকার করলেন, ব্যাপারটা এ-রকমই দাড়াতে পারে বলে মনে হচ্ছে বটে, কিন্তু তিনি এটাও যােগ করলেন যে অনেকেই আমাদের (ব্রিটিশদের) ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এটা খুব স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আমরা ভারত ছেড়ে যাব কি না সে বিষয়ে মন স্থির করিনি। এই অবস্থায় মুসলিমদের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক ছিল জনসমক্ষে যথাসম্ভব জোরগলায় আমাদের মুণ্ডপাত করা। সেটা কিছুটা এই কারণে যে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলাম। কিন্তু একই সঙ্গে, মুসলমানদের এটা জনসমক্ষে প্রতিপন্ন করা জরুরি ছিল যে তারা অন্য সম্প্রদায়ের চেয়ে কোনও অংশে কম ভারতীয় তথা জাতীয়তাবাদী নন। যত দিন আমরা থাকি, তত দিন তারা তলায় তলায় অনেক বেশি সহযােগী মনােভাব নিয়ে চলতে প্রস্তুত ছিলেন।”[৪০]
“অন্য দিকে, আমরা সত্যি সত্যিই এ দেশে ছেড়ে যেতে চাইলে মুসলিমদের পক্ষে সংগঠিত সংগ্রাম করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না, এবং তিনি (জিন্না) সে ক্ষেত্রে প্রয়ােজনে কংগ্রেসের সাহায্য নিতেও পিছপা হবেন না।[৪১]
‘ব্রিটিশ ভারসাম্য’ মানে দাঁড়াল এই। ১৯৩৮-এর মার্চে এক দিকে চৌধুরী খালেকুজ্জামান এবং অন্য দিকে নেহরু, গাঁধী ও আজাদের দীর্ঘ মতবিনিময় হল। এর ফলে খালেকুজ্জামান মন্তব্য করলেন, “এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি। যখন আমি সংকট
২১৫
এড়ানাের জন্য ওঁদের পিছু পিছু সাহায্য চেয়ে ঘুরেছিলাম, তখন ওঁরা আমাদের কথায় কান দেননি, অথচ এখন আবার সেই পুরনাে কাসুন্দি ঘাঁটার চেষ্টা শুরু করলেন; যদিও ইতিমধ্যে সমস্য আরও জট পাকিয়ে গিয়েছে।”[৪২]
মৌলানা আবুল কালাম আজাদও প্রধানত কংগ্রেসের স্বার্থে কংগ্রেস এবং লিগের একটা বােঝাপড়া চাইছিলেন, যদিও তার নিজের স্বার্থও জড়িত ছিল— লিগের সঙ্গে এই ‘ঝগড়া’ চলতে থাকলে ‘‘সম্প্রদায়ের মধ্যে তার নিজের অবস্থান নিয়েও সংশয় দেখা দেবে।”[৪৩]
এই সময়, ১৯৩৮ সালে, তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সুভাষচন্দ্র বসু সাম্প্রদায়িক সমস্যার মীমাংসা খুঁজতে তৎপর হলেন। ফেব্রুয়ারিতে কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনের পরে তিনি জিন্নার সঙ্গে কিছু পত্রবিনিময় করলেন। তার পর মে মাসে বম্বেতে দুজনের মুখােমুখি কথা হল। এই আলাপের পরে জিন্নাকে ১৫ মে একটি চিঠি লিখলেন সুভাষচন্দ্র। সেই চিঠিতে তিনি একটি প্রতিনিধিস্থানীয় কমিটি তৈরি করার আবেদন জানালেন, যে কমিটি একটা বােঝাপড়ায় আসবে। জিন্না এর উত্তরে লিখলেন, জুনের প্রথম সপ্তাহে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এই বিষয়ে আলােচনা করা হবে।[৪৪] কংগ্রেসের নতুন সভাপতির সঙ্গে মতবিনিময়ের সূত্রে জিন্না বলেছিলেন, কংগ্রেস এবং লিগ, উভয়েই কী চায় সেটা আগে পরিষ্কার করা দরকার, তবেই বােঝাপড়া হতে পারে। তিনি আলােচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি প্রাথমিক সূত্র দিলেন, বললেন এই ভাবে শুরু করা যায় যে, “ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ এবং হিন্দু জনমতের প্রতিভূ হিসাবে কংগ্রেস দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে এবং হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নের মীমাংসার জন্য এই অবস্থানে পৌঁছেছে।”[৪৫] আরও বিবেচনার পরে প্রস্তাবিত সূত্রটি সংশােধন করা হয়, কেবল হিন্দুদের প্রতিনিধি হিসাবে কংগ্রেসের যে পরিচিতি দেওয়া হয়েছিল, সেটি বাদ দেওয়া হয়। অতঃপর প্রস্তাবটির মুখবন্ধ দাঁড়ায় এই রকম: “কংগ্রেস এবং ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসাবে মুসলিম লিগ একটি চুক্তির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমান বােঝাপড়ার জন্য নিম্নলিখিত সত্রাবলিতে পৌঁছেছে।”[৪৬]
সুভাষচন্দ্রের মত ছিল, মুসলিম লিগ ভারতীয় মুসলমানদের একটি বিরাট অংশের মতের প্রতিনিধিত্ব করে ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেসকে মুসলিমদের অন্য কিছু কিছু সংগঠনের সঙ্গেও কথা বলতে হবে, যে সংগঠনগুলি অতীতে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিল। তিনি আরও বললেন, “অন্যান্য সংখ্যালঘু গােষ্ঠীর স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে তাদের সংগঠনের সঙ্গেও কথা বলতে হবে।”[৪৭] তখনকার মতাে আলােচনা এই মর্মেই শেষ হল। এর পর ৪ জুন বম্বেতে লিগের ওয়ার্কিং কমিটির একটি বৈঠক হল। সুভাষচন্দ্রের প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে একটি প্রস্তাব সেখানে তৈরি করা হল। সেই প্রস্তাবে বলা হল, মুসলিম লিগকে বাদ দিয়ে কংগ্রেস ‘অন্য সংখ্যালঘুদের দলে টানার চেষ্টা করে ‘খুব অন্যায় করেছে। পরের দিনই জিন্না সুভাষচন্দ্রকে লিখলেন, “১৫ মে ১৯৩৮ আপনি আমাকে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তার উত্তরে আমি ১৬ মে লিখিত
২১৬
চিঠিতে আপনাকে যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সেই অনুসারে আমি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের এগজিকিউটিভ কাউন্সিল-এর সর্বজনসম্মত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে এতদ্বারা আপনাকে অবহিত করছি।
সিদ্ধান্ত ১
কংগ্রেসের তরফে সুভাষচন্দ্র বসু ১৪ মে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট জিন্নাকে যে নােটটি দিয়েছিলেন এবং ১৫ মে যে চিঠি দিয়েছিলেন, লিগের এগজিকিউটিভ কাউন্সিল সেটি বিবেচনা করে জানাচ্ছে যে, ভারতের মুসলমানদের যথাযােগ্য প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম লিগকে মেনে না নিলে হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নের মীমাংসার জন্য কংগ্রেসের সঙ্গে বােঝাপড়া করা মুসলিম লিগের পক্ষে সম্ভব নয়।
সিদ্ধান্ত ২
কাউন্সিল গাঁধীর ২২ মে তারিখের চিঠিটিও বিবেচনা করেছে এবং তার মতে, কংগ্রেস যে প্রস্তাবিত কমিটি তৈরি করতে চায়, সেখানে কোনও মুসলমান প্রতিনিধি থাকা ঠিক হবে না।
সিদ্ধান্ত ৩
এগজিকিউটিভ কাউন্সিল পরিষ্কার জানাতে চায় যে, মুসলিম লিগের ঘােষিত নীতি হল, অন্য সমস্ত সংখ্যালঘু গােষ্ঠীর অধিকার এবং স্বার্থ সুরক্ষিত করা দরকার, যাতে তারা নিরাপত্তা বােধ করে এবং তাদের আস্থা অর্জন করা যায়, এ জন্য যখন যেমন প্রয়ােজন হবে, মুসলিম লিগ এই সব গােষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনা করবে।”
সুভাষচন্দ্র তখন ওয়ার্ধায়। তিনি কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সহকর্মীদের সঙ্গে এই সিদ্ধান্তগুলি নিয়ে আলােচনা করে যে উত্তর দিলেন তাতে লিগের প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নিয়েই মন্তব্য ছিল। তিনি লিখলেন, “প্রথম সিদ্ধান্তটিতে ‘কেবলমাত্র বিশেষণটি ব্যবহার করা হয়নি, কিন্তু সেটি অবশ্যই বােঝাতে চাওয়া হয়েছে। মুসলমানদের বিভিন্ন সংগঠন আছে, যারা মুসলিম লিগের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাদের কিছু কিছু সংগঠন কংগ্রেসের প্রবল সমর্থক। লিগ কাউন্সিলের প্রথম সিদ্ধান্তে যে শর্তটি দৃশ্যত মানতে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের পক্ষে সেটি স্বীকার করে নেওয়া সম্ভব নয়। ওয়ার্কিং কমিটি আশা করে, লিগ কংগ্রেসকে অসম্ভব দাবি মেনে নিতে বলবে না।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটিতে যে দাবি নিহিত, কংগ্রেস তা মানতে পারে না।
ওয়ার্কিং কমিটি তৃতীয় সিদ্ধান্তটির অর্থ বুঝতে অপারগ।
২১৭
জিন্না সুভাষচন্দ্রকে পত্রপাঠ যে উত্তর দিলেন, তার বিষয়বস্তু এবং বাচনভঙ্গি, দুটিই ছিল তীব্র এবং দ্ব্যর্থহীন। এই জবাব কার্যত কংগ্রেস সভাপতির সমস্ত উদ্যোগে জল ঢেলে দিল। অন্য নানা বিষয়ের পাশাপাশি জিন্না লিখলেন, “অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ বা বম্বেতে তার এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির কংগ্রেসের কাছ থেকে কোনও স্বীকৃতি বা অনুমােদনের প্রয়ােজন নেই। কিন্তু কংগ্রেসের ভূতপূর্ব সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু যখন একটি বিবৃতিতে লিগের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন যে ভারতে ‘দুটি মাত্র পক্ষ’ আছে— ‘ব্রিটিশ সরকার এবং কংগ্রেস কাউন্সিল মনে করেছিল, কীসের ভিত্তিতে দুই তরফের আলােচনা এগােতে পারে সেটা কংগ্রেসকে জানিয়ে দেওয়া দরকার।”
সুভাষচন্দ্র কঠিন কাজে হাত দিয়েছিলেন, তার সেই চেষ্টার এখানেই সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু, এই সময়েই জিন্না গাঁধী ও নেহরুর সঙ্গে পত্রালাপ করে মতানৈক্য নিরসনের চেষ্টা করলেন। প্রথমে জিন্না-নেহরু পত্রালাপ। তবে, তার আগে একটু ভূমিকা করে নেওয়া দরকার।
“জিন্না সম্পর্কে নেহরুর ব্যক্তিগত ধারণা জিন্নার সঙ্গে তার সমস্ত আলােচনাকে প্রভাবিত করেছিল। দু’জনের মধ্যে নানা বিষয়ে মিল ছিল। দুজনেই প্রান্তিক সামাজিক গােষ্ঠীর মানুষ— জিন্না খােজা মুসলিম, নেহরু কাশ্মীরি পণ্ডিত। দুজনেই প্রশিক্ষিত আইনজ্ঞ, বিলিতি কেতায় দুরস্ত, অহঙ্কারী। ১৯২০ সালে জিন্নার কংগ্রেস ছেড়ে দেওয়ার আগে অবধি দুজনেই কংগ্রেস সদস্য। কিন্তু, পরস্পরের প্রতি তাদের দুজনেরই ব্যক্তিগত বিরাগ ছিল তীব্র এবং সুস্পষ্ট। সেই ১৯২৯-এই নেহরু লিখেছিলেন, ‘জিন্নাকে কী ভাবে স্থান দেওয়া যাবে, আমি ঠিক জানি না। দৃষ্টিভঙ্গিতে তার সঙ্গে আমার বিশেষ কোনও মিল নেই। পরবর্তী কালে এই মতানৈক্যই প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৩৮-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি বম্বে থেকে লেখা চিঠিতে নেহরু মুসলিম লিগের ভিত নিয়েই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমায় কবুল করতেই হবে যে, বিবাদের মূল কারণগুলি আমি এখনও জানি না। এই কারণেই আপনাকে সেগুলি স্পষ্ট করে জানাতে অনুরােধ করে চলেছিলাম। এখনও পর্যন্ত সে ব্যাপারে কোনও সাহায্য আপনার কাছে পাইনি। এবং তার পর খুব ওপর থেকে কথা বলার ভঙ্গিতে তিনি লিখেছিলেন, যখন আমাদের দেখা হবে (যদি হয়), আমরা কী নিয়ে কথা বলব? সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতারা তাে হাওয়ায় কথা বলতে পারেন না। জবাবে জিন্না লিখলেন, আপনি যখন বলেন, বিতর্কের মূল কারণগুলাে আপনার জানা নেই, তখন আমি আপনার অজ্ঞতায় চমৎকৃত হই। কিন্তু, নেহরু এতে দমে যাওয়ার পাত্র নন। ৮ মার্চ তিনি ইলাহাবাদ থেকে ঠাট্টার সুরে লিখলেন, “আমি আপনাকে বার বার বলে চলেছি বিতর্কের মূল কারণগুলি কী, সেটা জানাতে, আর আপনি বলছেন, সেটা চিঠিতে জানানাে যায় না।” এ বার জিন্না বিরক্ত হয়ে ব্যঙ্গের সুরে লিখলেন, “আপনি যখন জানতে চান, কী নিয়ে তর্ক, তখন আমি সত্যিই বিস্মিত হই। আপনি হয়তাে চোদ্দো দফার কথা শুনেছেন।” পুরাে পত্রালাপটা পড়লে অবশ্য মনে হয়, নেহরুর কথায় একটা সঙ্গতি ছিল।
২১৮
তিনি একটানা বলে এসেছেন, সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন’ বলে কিছু নেই। ১৯৩৮-এর ১ মার্চ লাহৌরের ‘নিউ টাইমস’ লিখেছিল: “হরিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেস সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অধিকারের সমর্থনে একটি প্রস্তাব পাস করেছে। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন নেহরু। কিন্তু, তিনি এই প্রস্তাব সম্পর্কে কথা বলার সময় মন্তব্য করেছিলেন, “আমি তথাকথিত সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটিকে দুরবিন দিয়ে দেখেছি। তাতেও যদি কিছুই দেখা না যায়, তা হলে এই ধরনের একটা প্রস্তাব পেশ করা মানে খুব বড় রকমের অসততা। যদি কোনও সংখ্যালঘু সমস্যা না-ই থাকে, তবে, তা নিয়ে একটা প্রস্তাব পেশ করা কেন? কেন আমরা জানিয়ে দেব না যে, কোনও সংখ্যালঘু প্রশ্নই নেই?”
সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন ব্যাপারটা বুঝতেই যে তিনি অপারগ, সে কথা নেহরু এর আগেও বলেছিলেন। তাঁর মত ছিল এই যে, মধ্য বা উচ্চ বর্গের মুসলমানরা আইনসভা, মন্ত্রিসভা এবং সরকারি চাকরিতে কিছু আসন পাওয়ার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নটা তৈরি করেছেন।
নেহরু জানিয়ে দিলেন, লিগের দাবি মানতে গেলে সংবিধানে এমন অনেক পরিবর্তন ঘটাতে হবে, যা আমরা মেনে নেওয়ার অবস্থায় নেই। তার মতে ‘চোদ্দো দফা দাবি কিছুটা পুরনাে ও অবান্তর হয়ে গিয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক মীমাংসাকে জাতীয়তা-বিরােধী না বলাটা নিতান্তই ভুল’ হবে। তিনি আরও বললেন, “মুসলিম লিগকে ভারতীয় মুসলমানদের এক এবং অদ্বিতীয় সংগঠন বলতে কী বােঝায়, সেটা আমার বােধগম্য নয়। মুসলিম লিগ নিশ্চয়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন এবং আমরা তাকে সে ভাবেই দেখি। কিন্তু, আমাদের সমস্ত সংগঠন এবং ব্যক্তির সঙ্গেই কাজ করতে হয়। তাদের মধ্যে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিচার আমরা করি না।”
এই বক্তব্যে একটা উড়িয়ে দেওয়ার সুর ছিল সুস্পষ্ট। জিন্না একই রকম ক্রুদ্ধ এবং তীক্ষ ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন।
৬ এপ্রিল কলকাতা থেকে পাঠানাে নেহরুর চিঠির জবাবে তিনি ১২ এপ্রিল বম্বে থেকে লিখলেন,
“আপনার চিঠি আমাকে খুব বেদনা দিয়েছে। আমার মনে হয়েছে, আপনি আমার চিঠির বক্তব্য ঠিক ভাবে বুঝতেই পারেননি। আপনি নিজেই স্বীকার করেছেন, আপনার মন এখন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে ভারাক্রান্ত, ভারতে আমাদের সামনে কোন পরিস্থিতি রয়েছে, তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথা নেই। আপনি বিশ্বের আসন্ন বিপর্যয় নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমি যা লিখেছিলাম, আপনি তাকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে আমার বক্তব্যের সম্পূর্ণ ভুল অর্থ করেছেন, এটা আমার পক্ষে গভীর পরিতাপের বিষয়।
‘আমার মনে হয়েছিল, কোনও সাংবিধানিক পরিবর্তন জরুরি কি না, সেই পরিবর্তন। কী ভাবে সাধন করা উচিত— এই সব প্রশ্ন আমরা পারস্পরিক আলােচনার মাধ্যমে বিচার করব। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে, আপনি আপনার চিঠিতে (ইতিমধ্যেই) এ বিষয়ে।
২১৯
(আপনার) রায় দিয়ে দিয়েছেন।… আপনার ভাষা এবং ভঙ্গিতে আবার সেই উদ্ধত এবং যুদ্ধং দেহি মনােভাব ফুটে উঠেছে, যেন কংগ্রেস একটি সার্বভৌম শক্তি।… এখানে বলা দরকার, কংগ্রেস মুসলিম লিগকে নিজের সম্পূর্ণ সমকক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে এবং সেই ভিত্তিতে লিগের সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রশ্নে বােঝাপড়ায় রাজি না থাকলে আমাদের নিজেদের ক্ষমতার ওপরেই নির্ভর করতে হবে, সেই অনুসারেই নির্ধারণ করতে হবে, তার (লিগের) গুরুত্ব কতটা, স্বাতন্ত্রই বা কতখানি। আপনার যা মানসিকতা, তাতে আমাদের বক্তব্য আপনাকে আর বােঝানাের চেষ্টা করা আমার পক্ষে সত্যিই দুষ্কর।”
এই চিঠিতেই জিন্না এ কথাও জানিয়ে দিলেন যে “এই বিষয়ে তিনি আর পত্রালাপ চালিয়ে যেতে চান না। আর একটা ব্যাপার চমকপ্রদ। তখন পট দ্রুত বদলে চলেছে। সেই সময় মঞ্চে যাঁরা উপস্থিত বড়লাট, সমগ্র কংগ্রেস নেতৃত্ব, গাঁধী, সুভাষচন্দ্র, অন্য সমস্ত রাজনৈতিক সংগঠন— সবাই বুঝতে পারছিলেন যে মুসলিম লিগ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে, কেবল নেহরু প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে কথা বুঝতে নারাজ ছিলেন। সুভাষচন্দ্র এবং পণ্ডিত নেহরুর সঙ্গে জিন্নার পত্রালাপে কোনও ফল হল না, এবং সেই আলাপ কিছুটা আচমকা শেষ হয়ে গেল। তবে এর পরেও এক জন বাকি ছিলেন– গাঁধী।
প্রিয় জিন্না
খের আমাকে আপনার বার্তাটি দিয়েছেন। কিছু করতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ নিরুপায়। ঐক্যের উপর আমার নিজের বিশ্বাস আজও সমান প্রবল, কিন্তু এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে আমি কোনও আলাে দেখছি না। এই সংকটে আমি ঈশ্বরের কাছে আলােকভিক্ষা করছি।
একান্ত আপনার
এম কে গাঁধী
জিন্না বি জি খের (জনৈক বম্বেবাসী)[৪৮] মারফত হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রার্থনা করে এবং যৌথ ভাবে ভারতের স্বাধীনতার জন্য চেষ্টা করতে চেয়ে একটি বিশেষ বার্তা গাঁধীর কাছে পাঠিয়েছিলেন। খের দক্ষিণ গুজরাতের তিথল-এ গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে সেই বার্তাটি দেন। গাঁধী জিন্নাকে যে উত্তর দিলেন, সেটি একেবারে তার স্বভাববাচিত। তিনি লিখেছিলেন, “আপনি অভিযােগ করেছেন যে আমি নীরব হয়ে আছি। আমার নীরবতার যে কারণ আমার চিঠিতে লিখেছি, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। বিশ্বাস করুন যে মুহুর্তে দুই সম্প্রদায়কে এক সঙ্গে আনার জন্য আমি কিছু করতে পারব, তৎক্ষণাৎ তা করব, পৃথিবীতে কোনও শক্তি আমাকে সেই চেষ্টা থেকে বিরত করতে পারবে না।”
২২০
এই পত্রালাপের সূত্রে ক্রমশ জিন্না আর একটু মন খুলে কথা বললেন। ১৯৩৮-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি লিখলেন, “আপনি লিখেছেন, ১৯১৫ সালে যখন আপনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এলেন, তখন সবাই আমাকে এক জন কট্টর জাতীয়তাবাদী হিসেবে চিনত, আমাকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বড় ভরসা হিসেবে দেখত আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, আপনি কি সেই জিন্না-ই আছেন? আপনি আরও লিখেছেন, “যদি আপনি বলেন, আপনার বক্তৃতায় আপনি যা-ই বলুন না কেন, আসলে আপনি বদলাননি, তবে আপনার কথা আমি অবিশ্বাস করব না। এবং আপনার অভিযােগ, আমার বক্তৃতায় আপনি সেই পুরনাে জাতীয়তাবাদীকে খুঁজে পান না। আপনি কি মনে করেন, কথাটা আপনি ঠিক বলছেন? ১৯১৫ সালে আপনার সম্পর্কে লােকে কী বলত, আর এখনই বা কী বলে, আমি কিন্তু সে সব কথা তুলছি না।জাতীয়তাবাদ কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, আর আজকের দিনে জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দেওয়াও খুব কঠিন। কিন্তু আমি এই নিয়ে তর্ক করতে চাই না।
ঐক্যের ভিত্তি হিসেবে প্রস্তাব রচনার কথা বলেছেন আপনি। আপনি কি মনে করেন, সেটা চিঠিতে করা সম্ভব?”
গাঁধী লিখলেন, “আমার কথা যদি বলেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রশ্নে আগে আমি ড. আনসারির পরামর্শ নিয়ে চলতাম। তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। এখন আমি মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে আমার পরামর্শদাতা হিসেবে বরণ করেছি। তাই আমার মনে হয়, আপনি প্রথমে মৌলানা আজাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা শুরু করলে ভাল হবে। কিন্তু জানবেন, আমি সব সময় আপনার অনুগত আছি এবং থাকব।”
এটা অবশ্যই একটা ভুল ছিল। আলাপ আলােচনার ক্ষেত্রে মৌলানা আজাদ কখনওই গাঁধীর কার্যকর বিকল্প হতে পারতেন না, তার সঙ্গে আলােচনা চালিয়ে মীমাংসার পথে এগােনাে জিন্নার পক্ষে সম্ভব ছিল না। জিন্না কয়েক দিনের মধ্যেই সেটা জানিয়ে দিলেন। ৩ মার্চ লেখা চিঠিতে তিনি বললেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি আপনার মানসিকতায় কোনও পরিবর্তন ঘটেনি, তাই আপনি বলতে পেরেছেন, আনসারি নেই বলে আপনি মৌলানা আজাদের পরামর্শে চলছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চললে আপনি আবারও সেই আগের ভুল করবেন। আগেও আপনি বলেছেন, আনসারির কট্টর সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে আপনার কিছু করার নেই, আপনি নিরুপায়। আপনি রাউন্ড টেবল কনফারেন্স-এ যােগ দেওয়ার আগে ঠিক এটাই হয়েছিল। আবার সেই ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে। সেখানেও আপনি নিজে সাময়িক ভাবে কিছু শর্ত মানতে প্রস্তুত ছিলেন, হিন্দু ও মুসলমানরা একটা বােঝাপড়ায় এলে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে আপনার। তা মেনে নিতে কোনও আপত্তি ছিল না, কিন্তু হিন্দুদের আপত্তি অতিক্রম করার সাধ্য আপনার হয়নি।
আমরা এমন একটা অবস্থায় পৌঁছেছি, যখন ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি এবং যােগ্য সংগঠন হিসেবে মুসলিম লিগকে স্বীকৃতি দিতেই হবে, এ বিষয়ে
২২১
কোনও সংশয়ই থাকতে পারে না। অন্য দিকে, আপনি কংগ্রেস এবং দেশের সমস্ত হিন্দুর প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃত। একমাত্র এই ভিত্তিতে দাড়িয়েই আমরা অগ্রসর হতে পারি, মীমাংসার উপায় খুঁজতে পারি।
আপনার সঙ্গে দেখা করতে আমার অবশ্যই ভাল লাগবে। আবার আপনি যদি চান, তা হলে পণ্ডিত জওহরলাল বা শ্ৰীযুক্ত বসুর সঙ্গে মুখােমুখি কথা বলতেও আমার কিছুমাত্র আপত্তি নেই। তবে, আপনি জানেন, আপনার অভিমত ও নির্দেশ ছাড়া ওঁরাও এগােতে পারবেন না। তাই প্রথমে আমি আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাইব।”
পত্রালাপ চলতে থাকল। ৮ মার্চ সেগাঁও থেকে গাঁধী একটি নােট পাঠালেন, তাতে তিনি নিজের দায়িত্বের প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। তিনি জিন্নাকে লিখলেন, “আপনি চিঠিতে দুটি প্রশ্ন তুলেছেন, যার জবাব দেওয়া দরকার। আপনি প্রশ্ন করেছেন, আমি আলাে দেখতে পেয়েছি কি না। গভীর পরিতাপের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পাইনি। আর, আপনার প্রত্যাশা, আমি কংগ্রেস এবং ভারতের সমস্ত হিন্দুর প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলব; এই প্রত্যাশা পূরণের সাধ্য আমার নেই।”
প্রাথমিক পর্বে মৌলানা আজাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, গাঁধীর এই দাবি, এবং সে দাবি মানতে জিন্নার আপত্তি— এই নিয়ে টানাপড়েন চলল কিছু দিন। সেটা দুর্ভাগ্যজনক, কারণ ‘সময়’ বস্তুটিই তখন অত্যন্ত মূল্যবান। গাঁধী বলে চললেন, কংগ্রেস একটি হিন্দু পার্টি নয়, তাই কংগ্রেসের তরফে এক জন মুসলিম প্রতিনিধি ঐক্যের আলােচনায় থাকা জরুরি, আর জিন্নার দাবি: তিনিই ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র মুখপাত্র। অচলাবস্থা। চলতে থাকল। ১৫ এপ্রিল গাঁধী দিল্লি থেকে জিন্নাকে লিখলেন, ।
“মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কি সাক্ষাৎকারের সময় আমার সঙ্গে থাকতে পারেন? আমাকে ওয়ার্ধায় চিঠি লিখে এর উত্তর জানান, আমি কাল সেখানে পৌঁছব।”
জিন্না এর সংক্ষিপ্ত কিন্তু ভদ্র (তখনও) উত্তর দিলেন, “আমি আপনার সঙ্গে একা দেখা করতে চাই।”
সে আমলের রাজনৈতিক নেতারা চিঠি লেখার ব্যাপারে কতটা অক্লান্ত ছিলেন, সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। টেলিফোন ছিল, টেলিগ্রাফও, কিন্তু সকলেই চিঠি লিখতেন, অথচ এটা তাদের বিলক্ষণ জানা ছিল যে ব্রিটিশ রাজশক্তি সে সব চিঠি খুলে দেখে, কপি করে রাখে, পড়ে, তাদের বক্তব্য লিখে রাখে, তবে সেগুলি গন্তব্য ঠিকানায় যেতে দেয়। তা সত্ত্বেও পারস্পরিক আলােচনার সবচেয়ে সভ্য উপায় হিসেবে চিঠির তুল্য কিছু আছে বলে কেউ মনে করতেন না।
এ বার আমাদের মূল কাহিনিতে ফিরতে হবে। প্রধান নায়কদের মধ্যে এই পত্রালাপ চলছিল বটে, কিন্তু তার পাশাপাশি আরও কিছু ঘটনাও ঘটছিল। যেমন ১৯৩৮-এর জুন মাসে কলকাতায় খালেকুজ্জামানের সঙ্গে মৌলানা আজাদের কথা হল। রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে মৌলানা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, কংগ্রেস এবং
২২২
লিগের বােঝাপড়া না হলে মুসলিম সমাজে তাঁর নিজের অবস্থান বিপন্ন হবে। তিনি খালেকুজ্জামানকে বললেন, এমন কোনও সূত্র দিতে পারেন কি না যা কংগ্রেস এবং লিগ উভয়ের কাছেই গ্রহণীয় হয়। খালেকুজ্জামান বললেন, সুভাষচন্দ্র বসুর দেওয়া। সূত্রটি মুসলিম লিগের কাছে গ্রহণযােগ্য হতে পারত, কিন্তু তিনি (মৌলানা) পরে অন্য মুসলিম সংগঠন এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গােষ্ঠী’র কথা এনে ফেলায় সেই সুযােগ বানচাল হয়ে যায়। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ এবং সরকারের মধ্যে কয়েক দফা আলােচনা ব্যর্থ হওয়ায় এবং কংগ্রেস ও লিগের মধ্যে অচলাবস্থা চলতে থাকায় মুসলমান সমাজের মনেও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে, বিশেষ করে এই কারণে যে এমন কোনও বড় আদর্শ তাদের সামনে ছিল না যাকে আঁকড়ে ধরে তারা একটা স্থায়ী এবং সংগঠিত আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারেন। তাদের মনে চিন্তা দেখা দিল, তবে কি খিলাফত আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পরে খিলাফত কমিটি যে ভাবে ভেঙে পড়েছিল, কিংবা ১৯৩২-এর আইন অমান্য আন্দোলনের পরে কংগ্রেস যে ভাবে কমজোর হয়ে পড়েছিল, মুসলিম লিগেরও সেই পরিণতি হবে?
এই জটিল পরিস্থিতিতে খালেকুজ্জামান প্যালেস্তাইন প্রশ্নে আলােচনায় যােগ দিতে কায়রাে ও লন্ডন সফরে গেলেন। তিনি ১৯৩৮-এর ১ নভেম্বর লন্ডন পৌঁছলেন। তার পর আরব প্রতিনিধিদলের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা। এর মধ্যে এক দিন সন্ধ্যায় তার সঙ্গে ‘পাকিস্তান’ শব্দটির স্রষ্টা চৌধুরী রহমত আলির দেখা হল। ১৯৪০-এর পাকিস্তান প্রস্তাবের পিছনে সেই ঘটনা এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলির বড় অবদান ছিল। সেই ঘটনাপরম্পরার কথা খালেকুজ্জামান এই ভাবে লিখেছেন,
“আমরা পাকিস্তানের প্রকল্প নিয়ে কথা শুরু করলাম। দেখলাম, তিনি কেবল এ বিষয়ে গভীর ভাবে ভাবেনইনি, এই ভাবনাকে রূপায়িত করার ব্যাপারেও তার প্রবল আগ্রহ। ভারতে আমরা বিলক্ষণ জানতাম যে প্রথম রাউন্ড টেবল কনফারেন্স-এর সময় তিনি মুসলিম প্রতিনিধিদের কাছে এই প্রস্তাব পেশ করেছিলেন, কিন্তু কেউ তখন পাত্তা দেয়নি।… কিছুক্ষণ কথা বলার পরে আমি তাকে জানালাম, আমার এই বিষয়ে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু পাকিস্তান’ শব্দটিকে দেশভাগের জন্য ব্যবহার করা ঠিক হবে না, কারণ তাতে এক দিকে ব্রিটিশরা সন্দিহান হয়ে পড়বে, অন্য দিকে হিন্দুরা চটে যাবে। পাকিস্তান’-এর উল্লেখ না করে আমরা নিজেদের এলাকাগুলির জন্য স্বশাসনের অধিকার চাইব না কেন? কিন্তু এই প্রস্তাব তার পছন্দ হল না। এ নিয়ে আমাদের অনেক আলােচনা হল। আমি তাকে বললাম, তার প্রকল্পটি বিশদ ভাবে আমাকে পাঠাতে। ১৯৩৮-এর ১২ ডিসেম্বর তিনি আমাকে একটি চিঠি লিখে সেটা জানালেন।… দুটি মুসলিম ফেডারেশনের ধারণাটা আমার পছন্দ হল, একটা বাংলা ও অসম নিয়ে পূর্বাঞ্চলে, অন্যটা সিন্ধু, পঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে পশ্চিমে…”[৪৯]
খালেকুজ্জামান আরও লিখছেন, “প্যালেস্তাইন বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পরে আমাদের লন্ডনে বসে থাকার আর কোনও যুক্তি ছিল না। ১৯৩৯-এর ১০ মার্চ আমরা স্থির। করলাম, ভারতে ফিরে যাব। কয়েক দিন পর আমি কাগজে একটি খবর পড়লাম যে
২২৩
আন্ডারসেক্রেটারি অব স্টেট ভারত সফর করে ফিরেছেন। আমার মনে হল, তার সঙ্গে কথা বলে মুসলিম লিগের শক্তি এবং নীতি সম্পর্কে তিনি কী বুঝেছেন সেটা জেনে নিলে। লাভ হতে পারে। রহমানের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললাম। তার পর আন্ডারসেক্রেটারি কর্নেল মুরহেড-এর সঙ্গে দেখা করার আবেদন জানালাম। সাক্ষাৎকারের দিন স্থির হল ১০ মার্চ। আমি শুরুতেই জানতে চাইলাম, ভারতে আমাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আমাদের সামর্থ্য এবং নীতি সম্পর্কে তার কী মনে হয়েছে। আমাদের কথােপকথন যথাসম্ভব বিশদ ভাবে তুলে ধরছি। (যত দূর মনে আছে, আন্ডারসেক্রেটারির নাম ছিল কর্নেল মুরহেড।)
কর্নেল মুরহেড: “হঁ্যা, আমি আপনাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের সওয়াল শুনেছি। আপনাদের প্রতি আমাদের গভীর সহানুভূতি আছে, কিন্তু কী ভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি, জানি না। আপনারা বলছেন, ব্রিটিশ ধাঁচের গণতন্ত্র। আপনাদের উপযুক্ত নয়। আমরাও সেটা বুঝি। কিন্তু আমরা অন্য কোনও ধরনের গণতন্ত্রের কথা জানি না। আমরা নিজেদের দেশে যে নীতি অনুসরণ করি, ভারতেও সেটাই প্রয়ােগ করতে চাই। আপনারা কিন্তু কোনও বিকল্পের সন্ধান দেননি।”
তার কথা শেষ হতেই আমি তার ঘরে ভারতের যে মানচিত্রটি ঝুলছিল সে দিকে এগিয়ে গেলাম। দুটি অঞ্চল নির্দেশ করলাম: উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব। এই দুটি মুসলিমপ্রধান এলাকা, এই দুটিকে অবশিষ্ট ভারত থেকে আলাদা করে নেওয়া যায়। আমি যখন ফিরে এসে চেয়ারে বসলাম, তিনি একটু হেসে বললেন, ‘হ্যা, সেটা একটা বিকল্প বটে। আপনারা কি এই বিষয়ে লর্ড জেটল্যান্ড-এর সঙ্গে কথা বলেছেন?
আমি: না, আমরা কলােনিয়াল সেক্রেটারি মি. ম্যাকডােনাল্ড-এর সঙ্গে কথা বলেছি, লর্ড জেটল্যান্ড-এর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি।’ কর্নেল মুরহেড: ‘তঁার সঙ্গে দেখা করছেন না কেন? আমি: ‘আমি ২১ মার্চ ভারতের পথে রওনা হচ্ছি, তিনি কি সময় দিতে পারবেন? কর্নেল মুরহেড: না না, আমি ব্যবস্থা করব, যাতে তিনি আপনাদের সঙ্গে কথা বলেন। শুধু ওঁকে একটা চিঠি লিখুন, তা হলেই হবে।
এর পর আমরা উঠে পড়লাম। বিদায় নেওয়ার সময় আমি কর্নেল মুরহেডকে বললাম, “তিনি (লর্ড জেটল্যান্ড) আমাদের সম্পর্কে অবহিত আছেন কি না, জানি না।
তিনি বললেন, ‘ও নিয়ে ভাববেন না, তিনি যা জানার, সবই জানবেন। দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশদের মনােভঙ্গি সম্পর্কে আমার অনুমান সত্য হয়ে উঠছিল।
সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করে লেখা আমাদের চিঠির উত্তরে জানানাে হল, ২০ মার্চ অপরাহে সেক্রেটারি অব স্টেট আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন, অর্থাৎ আমাদের ইংল্যান্ড ছেড়ে। ভারতের পথে রওনা হওয়ার ঠিক আগের দিন।
লর্ড জেটল্যান্ড আমাদের সঙ্গে খুব সহৃদয় ব্যবহার করলেন। প্রথমে আবহাওয়া
২২৪
নিয়ে কিছু কথাবার্তার পরে আমি তাকে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্কের দেড়শাে বছরের ইতিহাস খুব সংক্ষেপে জানিয়ে ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-এর প্রসঙ্গ অবধি চলে এলাম। তার পর বললাম, এখন আপনারা ভারতের হাতে আরও ক্ষমতা দিচ্ছেন, কিন্তু এমন ভাবে দিচ্ছেন যে আপনাদের কাজ শেষ হলে পনেরাে কোটি ভারতীয় মুসলমান দেখবেন যে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের দাসানুদাসে পরিণত হয়েছেন। এই সময় তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে সেই কথাই বললেন, আন্ডারসেক্রেটারি যা বলেছিলেন। তিনি বললেন, কিন্তু আপনারা তাে কোনও বিকল্প প্রস্তাব দেননি। আমি কর্নেল মুরহেডকে যা বলেছিলাম, সেটাই আবার বললাম, আপনারা মুসলিম অঞ্চলগুলিকে অবশিষ্ট ভারত থেকে আলাদা করে দিয়ে ফেডারেশনের প্রকল্প নিয়ে এগােতে পারেন, মুসলিম এলাকাগুলি তার মধ্যে পড়বে না, সেগুলি স্বতন্ত্র থাকবে।’
লর্ড জেটল্যান্ড: রাজ্যগুলির কী হবে?
আমি: তারা ভৌগােলিক পরিস্থিতি অনুযায়ী চলবে। যে রাজ্যগুলি হিন্দু অঞ্চলে পড়বে তারা হিন্দুদের সঙ্গে যাবে, যেগুলি মুসলিম অঞ্চলে পড়বে তারা মুসলমানদের সঙ্গে যাবে।
লর্ড জেটল্যান্ড: প্রতিরক্ষার বিষয়ে কী হবে?
আমি: কত দিনের জন্য? আপনারা যত দিন ভারতের প্রশাসনে কোনও না কোনও ভাবে জড়িত থাকবেন, তত দিন তাে কোনও সমস্যা নেই, আপনারা আপনাদের বিচারবুদ্ধি মাফিক দুই অঞ্চলেরই সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করতে পারবেন। যদি তার পরের কথা বলেন, তবে দয়া করে আমাকে এই প্রশ্ন করবেন না, কারণ তার পর আমাদের কী হবে সেটা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। লর্ড জেটল্যান্ড: আপনি কি আমার উত্তর জানতে চান ? আমি: আপনাকে এই প্রস্তাব জানানাের সঙ্গে সঙ্গে আপনার মত জানতে চাওয়ার স্পর্ধা আমার নেই। আমি আপনাকে অবহিত করতে চেয়েছি যে মুসলিম লিগের পরবর্তী অধিবেশনে এটাই হবে আমাদের অবস্থান। এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার জন্য আপনার হাতে যথেষ্ট সময় থাকবে
আমরা লর্ড জেটল্যান্ডের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা কথা বলার পরে তিনি আমাদের বিদায় দেওয়ার সময় জানালেন, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবিনেট বৈঠক আছে। তিনি জানালেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক, কেউ জানে না কী হতে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধও হতে পারে।”
১৯৩৯-এর ১২ মে খালেকুজ্জামান বম্বে পৌঁছলেন। সে দিনই সন্ধ্যায় তিনি জিন্নার সঙ্গে দেখা করে আন্ডারসেক্রেটারি ও সেক্রেটারি অব স্টেট-এর সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে, সে বিষয়ে সবিস্তার জানালেন।
২২৫
কংগ্রেস মন্ত্রিসভা (১৯৩৭-১৯৩৯): পরিণাম
যে দু’বছর বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা, ক্ষমতা প্রয়ােগ ততটা নয়, প্রসাদ বিতরণে ব্যস্ত থাকল, সেই সময়ে মুসলিম লিগ উত্তর ভারতে মুসলিম জনমত সংগঠিত করতে তৎপর ছিল। এর পিছনে একটা বড় ভূমিকা নিল বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যেগুলি সবই ঘটল কংগ্রেস জমানায়। সমস্ত দাঙ্গার দায়িত্ব নিশ্চয়ই আসলে কংগ্রেসের ছিল না, কিন্তু যেহেতু প্রদেশের শাসন তাদের হাতে, সুতরাং বিশেষত যুক্তপ্রদেশে কোনও গােলমাল হলে জবাবদিহির দায় তার ওপর এসে পড়বেই।
যত দিনে বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করল, তত দিনে তাদের রেকর্ড কলঙ্কিত সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং দ্বন্দ্ব বেড়ে চলার কলঙ্ক। এই পরিস্থিতির ফলে যুক্তপ্রদেশে মুসলমানদের মধ্যে ক্রোধ অনেক বেড়ে গেল, তারা এখন মুসলিম লিগের মতাে সাম্প্রদায়িক আদর্শের অনুসারী দলের ওপর অনেক বেশি ভরসা করতে লাগলেন। অন্য দিকে, দাঙ্গার ফলে হিন্দুদের মধ্যেও যুদ্ধং দেহি ভাব অনেক বেড়ে গেল, ফলে কংগ্রেসের কাছে কোনও পরিত্রাণ বা সাহায্য পাওয়া যাবে, এমন আশা মুসলমানরা পরিত্যাগ করলেন। মুসলিম লিগ ক্রমাগত মুসলমান সমাজের স্বার্থের কথা জোর গলায় বলে এবং সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির মােকাবিলায় কংগ্রেসের ব্যর্থতার কঠোর সমালােচনা করে মুসলমানদের কংগ্রেসের প্রতি আরও বিরূপ করে তুলল এবং নিজের দিকে নিয়ে এল।
মন্ত্রিসভায় যােগ দেওয়ার ফলেই কংগ্রেস আরও মুশকিলে পড়ল, কারণ তারাই এখন ‘সরকার’৫০, ফলে যুক্তপ্রদেশের মতাে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাপ্রবণ একটি প্রদেশে দাঙ্গার দায় তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ হল। তাই কংগ্রেসের সরকার চালনার ব্যাপারটাই মুসলিম লিগের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হয়ে দাড়াল। ১৯৩৭-এর নির্বাচনের পরে যুক্তপ্রদেশের রাজনীতি দুটি শিবিরে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছিল, সরকারের আসনে হিন্দুপ্রধান কংগ্রেস এবং বিরােধী আসনে মুসলিম লিগ। এর পরিণাম শুভ হওয়ার কারণ ছিল না। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন এমনিতেই গভীর ছিল, ব্রিটিশরা সেই বিভাজন বাড়িয়ে চলেছিল, তার ওপর এই রাজনীতি— ফল হল বিধ্বংসী।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে যুক্তপ্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে কংগ্রেসের যেটুকু সমর্থন ছিল তা আরও কমে গেল, মুসলিম লিগের প্রতিপত্তি বাড়ল। এক দিকে মুসলিম সমাজে কংগ্রেসের জনসংযােগের প্রচেষ্টা দাঙ্গা এবং মুসলিম লিগের প্রচারের ফলে। বড় ধাক্কা খেল, অন্য দিকে দাঙ্গার ফলে মুসলিম লিগ মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে আত্মপ্রচার করতে লাগল প্রবল ভাবে। বেশির ভাগ দাঙ্গাই হয়েছিল গ্রামে ও ছােট শহরে, আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্তদের বেশির ভাগই ছিলেন কৃষিজীবী ও কারুজীবী, এবং প্রধানত মুসলিম। মুসলিম লিগ এত দিন মুসলিম সমাজের উচ্চকোটিতেই অনেকাংশে সীমিত ছিল। দাঙ্গার সুযােগে এই দল সাধারণ মুসলমানের হয়ে কথা বলতে পারল, ফলে তাদের বিরাট রাজনৈতিক সুবিধা হল।
২২৬
এটা ঘটনা যে বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের দুরাচার, দাঙ্গা নিয়ে কংগ্রেসের প্রচার, প্রশাসনিক ভ্রান্তি, হয়তাে বা পক্ষপাতিত্ব, এই সবের ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম সমাজের সম্পর্ক খারাপ হয়েছিল। কিন্তু মুসলিম লিগ ক্রমাগত ইন্ধন না জোগালে হয়তাে পরিণতি এতটা খারাপ হত না। লিগ এমন ভাবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রচার করত যাতে মুসলিম সমাজে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ক্রোধ তীব্রতর হয়, মুসলমানদের মনে আরও জ্বালা ধরে। কংগ্রেস পরিচালিত প্রাদেশিক সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হওয়াটা প্রধান বিরােধী দল হিসেবে লিগের দায়িত্ব ছিল, কিন্তু সেই সমালােচনা তারা বিধানসভায় ততটা করেনি, যতটা করেছে যুক্তপ্রদেশের ‘কসবা’য় এবং গ্রামে, তাতে মুসলমানরা কংগ্রেসের প্রতি আরও বিরূপ হয়েছেন।
কংগ্রেস যে ভাবে সাম্প্রদায়িক বিবাদের মােকাবিলা করল, মুসলিম লিগ তার নানা ধরনের সমালােচনা করেছিল জনসভায় দাড়িয়ে সরাসরি কংগ্রেসের মুণ্ডপাত করা থেকে শুরু করে তুলনায় সংযত, কিছুটা তথ্যভিত্তিক প্রতিবাদ, যেমন পিরপুর রিপাের্ট। যুক্তপ্রদেশের সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ইতিহাসে এই রিপাের্টটির গুরুত্ব কম নয়। বস্তুত, ১৯৩৯-এর গােড়ায় যখন এই রিপাের্ট নিয়ে আলােচনা শুরু হয়, তখন যুক্তপ্রদেশের তদানীন্তন মুখ্য সচিব মনে করেছিলেন, এর ফলে ওই প্রদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে যেতে পারে। নিজেদের সমালােচনাকে একটি রিপাের্টের মধ্যে দিয়ে গ্রন্থাকারে। প্রকাশ করে লিগ কংগ্রেস-বিরােধী প্রচারে একটা বড় সাফল্য পেল।
শুধু যুক্তপ্রদেশে নয়, অন্যত্রও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে মুসলমান সমাজে লিগের প্রতিপত্তি বাড়ল। কেবল দাঙ্গার তীব্রতা এবং বিস্তারের জন্যই নয়, তখনকার রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতটিও এ ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। শাসকের আসনে কংগ্রেস এবং বিরােধী আসনে মুসলিম লিগ— ফলে যে কোনও সাম্প্রদায়িক সমস্যা কংগ্রেসের ব্যর্থতা এবং পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ হিসেবে দেখানাে হতে থাকল। জোট সরকার থাকলে মুসলিম লিগকেও সাম্প্রদায়িক সংকটের দায়ভাগ নিতে হত, তা ছাড়া মন্ত্রিসভায় মুসলিম প্রতিনিধিরা ভাল সংখ্যায় থাকলে পক্ষপাতিত্বের অভিযােগটা এত বড় করে উঠত না। বাস্তব পরিস্থিতি যা ছিল, তাতে গােষ্ঠী-বিভাজন পেরিয়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। | কিছুটা এই পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় এবং কিছুটা তাকে সামাল দেওয়ার জন্য কংগ্রেস মুসলিম সমাজের সঙ্গে জনসংযােগের একটা কর্মসূচি নিল। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সম্মিলিত সংগ্রামে ভারতীয় মুসলমানদের সংগঠিত করার জন্য এটাই ছিল কংগ্রেসের শেষ চেষ্টা। এর পুরােটাই নেহরুর ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়েছিল, মুসলিম লিগের গুরুত্ব স্বীকার করা হয়নি, সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি কতটা জটিল হয়ে পড়েছিল সেটাও বহুলাংশে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। কংগ্রেসের দুর্ভাগ্য, এই ‘গণসংযােগ কর্মকুঁচির ফলে কার্যক্ষেত্রে লাভ হল জিন্নার, তার মুসলিম সমর্থন আরও জোরদার হল। সন্দেহ নেই, জওহরলাল নেহরু এবং এই কর্মসূচির অন্য উদ্যোক্তাদের নানা রকমের সমস্যা ছিল— জিন্নার প্রল বাধা, নিজের দলের (কংগ্রেসের) সহকর্মীদের
২২৭
উৎসাহের অভাব এবং সাম্প্রদায়িক তিক্ততা, দাঙ্গায় যার প্রতিফলন ঘটছিল। কিন্তু এই সমস্যাগুলি নতুন ছিল না, দুর্লঙ্ঘ্যও ছিল না, নেহরু নিজেও নির্বাচনের পরে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সেটা বলেছিলেন।
এই সব পড়ে-পাওয়া সুবিধা সত্ত্বেও মুসলিম লিগের কিছু দুর্বলতা ছিল। লিগের ভিতর অনৈক্য ছিল, সংগঠনও ছিল তুলনায় দুর্বল। পঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশ ও বাংলায় মুসলিম সমাজের একটা শক্তিশালী অংশের সমর্থন জিন্নার দখলে ছিল না। গণসংযােগ কর্মসূচির প্রতি জিন্নার বিরাগ এবং এই কর্মসূচির অগ্রগতিতে বাধা দিতে লিগের নানান তদবিরের ব্যাপারটাকে এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখা দরকার। কংগ্রেস অচিরেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলল এবং গণসংযােগ কর্মসূচি থেমে গেল। এর ফলে জিন্নার পক্ষে ক্রমশ খারাপ হতে থাকা সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির সুযােগ নেওয়া এবং মুসলিম সমাজের ‘একমাত্র পরিত্রাতা হয়ে উঠে একটা স্বতন্ত্র মুসলিম স্বভূমি’র আশা জাগিয়ে তােলা আরও সহজ হল।
গােটা ইতিহাসটা পর্যালােচনা করলে মনে হয়, জিন্না আসলে আলােচনার টেবিলে আসতে চাননি বলেই মুসলিম লিগকে মুসলমানদের একমাত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে এত ব্যস্ত ছিলেন। ১৯৩৮ মার্চে নেহরু যখন লিগকে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে জানাতে বললেন, তখন জিন্না স্রেফ তঁাদের ‘চোদ্দো দফা প্রস্তাব দেখিয়ে দিলেন, আর তার সঙ্গে দেখালেন কয়েকটি লেখা: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮-এ দ্য স্টেটসম্যান-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ, যাতে লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়নি; ১ মার্চ ১৯৩৮-এ দ্য নিউ টাইমস-এ প্রকাশিত একটি লেখা এবং ন্যাশনালিস্ট পার্টির নেতা এম এস অ্যানে’র একটি বিবৃতি। এর বেশি আর কিছুই লিগ জানাল না।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ: কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ
এই সন্ধিক্ষণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ভারতে পৌছল। এত দিন পর্যন্ত এই সংঘর্ষ ছিল প্রধানত ইউরােপীয় যুদ্ধ। ১৯৩৯-এর ৪ সেপ্টেম্বর লর্ড লিনলিথগাে ভারতকে যুদ্ধের শরিক এবং সহযােগী দেশ হিসেবে ঘােষণা করলেন। ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রবল প্রতিবাদ শােনা গেল। বড়লাটের যুক্তি ছিল, ভারত ব্রিটেনের ‘অধীন দেশ’, সুতরাং ব্রিটেন যদি যুদ্ধরত হয়, ভারতও হবেই। ভারতের যুদ্ধে যােগ দেওয়া নিয়ে আইনসভার সম্মতি চাওয়া হয়নি বলে লিনলিথগাে শুধু ভারতেই সমালােচিত হলেন না, ব্রিটেনেও অনেকে তার সমালােচনা করলেন। কিন্তু লিনলিথগাে যখন ‘যুদ্ধে ভারত’ সংক্রান্ত ঘােষণা করেন, সেই সময় গাঁধী বা অন্য কোনও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নেতা প্রতিবাদ করেননি, তাদের প্রতিবাদ শােনা গেছে পরে। আর আইনসভার অনুমােদন নেওয়ার প্রশ্নে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বাদ দিলেও লিনলিথগাে পরে খুব সঙ্গত ভাবেই ব্রিটিশ রাজের
২২৮
প্রতিনিধিদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কংগ্রেস অনুরােধ না রাখলে (সম্ভবত তারা অনুরােধ রাখত না। তিনি কোথায় যেতেন?
১৯৩৯-এর ৪ সেপ্টেম্বর বড়লাট জিন্নার সঙ্গে দেখা করলেন। এই সাক্ষাতের আগে তিনি সিকন্দর হায়াত খানের কাছ থেকে একটি বার্তা পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, জিন্নার সঙ্গে এমন কোনও আচরণ না করাই ভাল যাতে তার রাগ আরও বেড়ে যায় বা তাকে বাগে আনা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। সিকন্দর হায়াত খান আগেই প্রকাশ্যে বলেছিলেন, আবারও জানালেন, ‘জিন্না আর তার বন্ধুরা যা-ই বলুন না কেন, পঞ্জাব এবং বাংলার মানুষ এই যুদ্ধে পুরােপুরি সরকারের পাশে আছে।[৫৫]
বড়লাট গাঁধীকে যা বলেছিলেন, এ বার সেটাই জিন্নাকেও বললেন, যে, ফেডারেশন নিয়ে কথাবার্তা এ বার বন্ধ করা দরকার। জিন্না জানালেন, সিকন্দর হায়াত খান মুসলিম লিগের সহকর্মীদের মতামতের অপেক্ষা না করে আগ বাড়িয়ে যুদ্ধে সমর্থন জানিয়ে দিয়ে ঠিক করেননি। সিকন্দরের বিরুদ্ধে তার কিছু বলার নেই, কিন্তু তিনিই তাে আর সব নন, তাই জিন্না বড়লাটকে তঁার হাত শক্ত করার অনুরােধ জানালেন। তিনি এমন একটা ইতিবাচক কিছু চাইলেন যা নিয়ে তিনি নিজের সমর্থকদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন— ভাল হয় যদি সংবিধানের একটা নতুন চেহারা দেওয়া যায়। লিনলিথগাে জিজ্ঞাসা করলেন, জিন্না কি চান যে, কংগ্রেসের মন্ত্রীদের বের করে দেওয়া হােক? জিন্না বললেন, “হঁ্যা, অবিলম্বে ওঁদের বহিষ্কার করুন। আর কোনও ভাবে ওঁদের বােধােদয় হবে না। আপনি হয়তাে বিশ্বাস করবেন না, আমিও দু’বছর আগে বিশ্বাস করতাম না, ওঁদের উদ্দেশ্য হল আপনাদের এবং আমাদের ব্রিটিশ এবং মুসলিম, দু’পক্ষকেই ধ্বংস করা। ওঁরা কখনও আপনাদের পাশে দাড়াবেন না।”[৫৬]
বড়লাট অতঃপর জিন্নাকে বললেন, তিনি সম্প্রতি একটি প্রকাশ্য বিবৃতিতে বলেছেন যে, তিনি আর ভারতে গণতান্ত্রিক সরকার হবে বলে বিশ্বাস করেন না— কথাটার মানে কী? গণতন্ত্র ছাড়া আর কী ভাবে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে? জিন্না জবাব দিলেন— দেশভাগই এই অচলাবস্থা থেকে মুক্তির উপায়।
সম্ভবত এই প্রথম জিন্না আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারত বিভাজন’-এর কথা বললেন। বড় লাট পরের দিনই, ৫ অক্টোবর আবার জিন্নার সঙ্গে দেখা করলেন। এই দিন তার মনে হল, জিন্নার আচরণ অনেক বেশি বন্ধুত্ব এবং সহযােগিতার পরিচায়ক। জিন্না বড় লাটকে ধন্যবাদ জানালেন, কারণ বড় লাট তাকে মুসলমানদের সংহতি ধরে রাখতে সাহায্য করেছেন। বড় লাট খুব জাঁক করে বললেন, “জনস্বার্থেই মুসলিমদের অভিমত সম্পূর্ণ এবং যথাযথ ভাবে প্রকাশিত হওয়া দরকার। এর পর বড় লাট বললেন, কংগ্রেসের সঙ্গে আলােচনায় বিশেষ অগ্রগতি হচ্ছে না, এবং সংবিধানে কিছু সংশােধনের বেশি কোনও পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিও তঁারা দিতে পারবেন না, আর সেটাও যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে। দুটি প্রধান সম্প্রদায় যদি ফেডারেশনের মতাে একটা প্রাথমিক ব্যবস্থাই অন্তত আনুষ্ঠানিক ভাবে মেনে নিতে রাজি না থাকে, তা হলে ডােমিনিয়ন স্টেটাস মঞ্জুর করা বা শান্তি ঘােষণা করার কোনও মানেই হয় না। জিন্না এমন কোনও ঘােষণার
২২৯
পক্ষপাতী ছিলেন না। তার মতে এর ফলে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তিনি মনে করতেন, কংগ্রেস যদি সমস্ত গােষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবি না ছাড়ে এবং মুসলিম লিগকে মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকার না করে, তা হলে ঐক্যের কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি অবশ্য স্বীকার করলেন যে, নেহরুকে এ কথা তিনি বােঝাতে পারেননি। অতঃপর জিন্না মুসলিমদের স্বার্থরক্ষার জন্য আরও ব্যবস্থা নিতে বললেন। বড় লাট জানালেন, তিনি গােটা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন, কিন্তু মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ পাননি। জিন্না বললেন, হিন্দুরা মুসলমানদের বিপাকে ফেলার জন্য নানা রকম ‘অভিসন্ধি’[৫৮] করছে, যেমন উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হিন্দি শিখতেই হবে বলে নির্দেশ দিয়েছে।
১৯৩৯ সালের নভেম্বরের মধ্যে সমস্ত প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করল, তাদের কয়েকটির বিদায় নেওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না, তারা গভীর মনস্তাপের সঙ্গে পদত্যাগ করল।
মহাযুদ্ধ এবং কংগ্রেস মন্ত্রিসভার পদত্যাগের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন পরিস্থিতি তৈরি হল। কংগ্রেস তার দর কষাকষির একটা বড় ক্ষমতা হারাল। বস্তুত, কংগ্রেসের অনেক ভুলের তালিকায় এই পদত্যাগও একটি বড় ভ্রান্তি। যত দিন তারা মন্ত্রিসভায় ছিল, তত দিন লিনলিথগাে তাদের অগ্রাহ্য করতে পারতেন না— আর যা-ই হােক, তারা এগারােটি প্রদেশের মধ্যে আটটিতে প্রশাসন চালাচ্ছিল, সুতরাং সরকারের যুদ্ধপ্রয়াস আটকাতে না পারুক, তাতে বাধা দিতে সমর্থ ছিল। কিন্তু পদত্যাগের পরে তাদের খুশি রাখার কোনও দায় আর বড়লাটের থাকল না, ফলে তার আচরণও পালটে গেল। সংসদীয় ব্যবস্থা শিকেয় তুলে প্রদেশগুলিতে গভর্নরের শাসন চালু হওয়ার ফলে যুদ্ধের কাজও অনেক সহজ হয়ে গেল। ব্রিটিশদের বিশ্বাস ছিল যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালীন কংগ্রেস আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করবে না, সেটা তাদের আদর্শগত অবস্থানের প্রতিকুল হবে, তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দিতও হবে। আর, বড়লাট নিশ্চিত ছিলেন, কংগ্রেস যদি আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করে, তা হলে সেই আন্দোলনের মােকাবিলা করার ক্ষমতা সরকারের আছে।
১৯৩৯-এর শেষেও মুসলিম লিগ প্রকাশ্যে সরকারের যুদ্ধপ্রয়াসের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি, কিন্তু তার বিরােধিতাও করেনি। বস্তুত, বাংলায় এবং পঞ্জাবে মুসলিম মন্ত্রিসভা যুদ্ধের প্রয়াসে নিঃশর্ত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী কাজও করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস দাবি জানাল, আগে ব্রিটিশরা যুদ্ধের উদ্দেশ্য কী সেটা পরিষ্কার করে জানাক, তার পর তারা সমর্থন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই অবস্থান দেখে লিনলিথগাের সংশয় ছিল যে, কংগ্রেস ব্রিটেনের সমস্যার সুযােগ নিতে চাইছে। কংগ্রেসের সম্ভাব্য বিরােধিতার মােকাবিলার তাগিদে এবং প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে খিলাফত আন্দোলনের মতাে (এবং ১৮৫৭?) আবার যাতে কংগ্রেস ও মুসলিমদের যৌথ প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে না হয়, সেই উদ্দেশ্যে বড়লাট অন্যত্র সমর্থন খুঁজতে চাইলেন। সেই খোঁজে স্বভাবতই তিনি জিন্না এবং তার মুসলিম লিগের দিকে নজর
২৩০
দিলেন। লিনলিথগাে মুসলিম লিগকে কাছে টানতে এবং ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হয়ে দাড়াতে উৎসাহ দিলেন। এই প্রক্রিয়ায় ব্রিটিশরা হিন্দু এবং মুসলমানদের ‘অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব’কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের অবস্থান দৃঢ়তর করতে তৎপর হল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে নিতে জিন্নার দেরি হল না। তিনি বলেছিলেন, “যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে… আমি গাঁধীর সমান গুরুত্ব পেলাম। আমাকে হঠাৎ যে ভাবে গাঁধীর পাশে বসানাে হল, সেটা দেখে আমি চমৎকৃত হয়ে। গিয়েছিলাম।”[৫৯]
লিনলিথগাে জানতেন, জিন্নার সাহায্যের ওপর তারা ভরসা করতে পারেন। সেই ১৯৩৮ সালেই তৎকালীন কার্যনির্বাহী বড়লাট লর্ড ব্রাবাের্নকে জিন্না আশ্বাস দিয়েছিলেন, তারা ব্রিটিশদের যুদ্ধপ্রচেষ্টায় সাহায্য করবেন। লর্ড ব্রাবাের্ন এই আশ্বাসের ভিত্তিতেই বলেছিলেন যে ব্রিটিশদের উচিত এখনকার মতাে কেন্দ্রীয় প্রশাসন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলিতে মুসলিমদের সাহায্য করা, তা হলে। মুসলমানরা কেন্দ্রে আমাদের সাহায্য করবে।”[৬০] জিন্নার কথা শুনে লর্ড জেটল্যান্ড অবাক হননি, তিনি বিশ্বাস করতেন, “ভারতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ প্রধান ভূমিকা নেবে”,[৬১] জিন্নার কথায় তার সেই বিশ্বাসই জোরদার হল। তিনি অনেক দিন যাবৎ মনে করতেন যে, “ইসলামের সংহতি একটা কঠোর বাস্তব, ওই দেওয়ালে মাথা ঠুকে লাভ নেই, ওটি ভাঙা যাবে না।”[৬২]
পরে, ১৯৪৫ সালে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে জিন্না বলেছিলেন, “গাঁধী এবং লর্ড লিনলিথগাের মধ্যে একটা বােঝাপড়া হতে চলেছিল। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় হল। যুদ্ধ কেউ চায় না, কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের। পক্ষে শাপে বর হল।”৬৩ জিন্না বুঝে নিলেন, ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযােগিতা করলে লাভ হবে, তিনি অবস্থার পূর্ণ সুযােগ নিলেন এবং নিজেদের অবস্থান বদলে ফেললেন। কিন্তু বিনিময়ে অত্যধিক দাবি জানিয়ে তিনি ব্রিটিশদের বিরক্তি উৎপাদন করলেন না, আবার যুদ্ধের ব্যাপারে তাদের নিঃশর্ত সমর্থনও জানালেন না। তিনি ব্রিটিশ প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন না, কিন্তু ব্রিটিশরা তার একটা দাবি মেনে নিলেই আর একটা দাবি তুলতে লাগলেন। হাতের তাস নিপুণ ভাবে খেলে তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষেত্রে লিগকে কংগ্রেসের সমকক্ষ করে তুললেন। অন্য দিকে, কংগ্রেসের আচরণে দেখা গেল দুরদৃষ্টি, রাষ্ট্রনীতিজ্ঞান এবং নমনীয়তার অভাব, ফলে তারা নিজেদের পুরনাে প্রাধান্য ফিরে পেল না। ভি পি মেনন লিখেছেন, “(সাম্রাজ্যবাদী) আনুকূল্যের (এই) সূর্যালােকে লিগ তরতর করে বেড়ে উঠল।”[৬৪]
লিগ তথা জিন্না ব্রিটিশদের যা বলেছিলেন এবং যে ভাবে যুদ্ধে সহযােগিতা। করেছিলেন, তার সঙ্গে গাঁধীর প্রস্তাবের পার্থক্য ছিল বিস্তর। বড়লাট লিনলিথগাের মাধ্যমে গাঁধী ব্রিটিশ সরকার এবং ব্রিটেনের ‘যানুষকে অহিংসার মাধ্যমে তার সহযােগিতা দেবেন। গাঁধীর পরামর্শ ছিল, ব্রিটিশরা অস্ত্র নামিয়ে রেখে অহিংসা অভ্যাস করুক। গাঁধী এই প্রস্তাবটি খুব গুরুত্ব সহকারেই দিয়েছিলেন। ১৯৪০-এর জুলাইয়ের গােড়ার
২৩১
দিকে গাঁধী ব্রিটিশ সরকারকে একটি খােলা চিঠি লিখলেন। ৪ জুলাই অমৃতবাজার পত্রিকায় ‘মেথড অব নন-ভায়ােলেন্স: মহাত্মা গাঁধী’স অ্যাপিল টু এভরি ব্রিটন’ শিরােনামে সেটি প্রকাশিত হল। তার কিছু অংশ ছিল এ রকম: “আমি সংঘর্ষ বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি… কারণ যুদ্ধ মূলত খারাপ। আপনারা নাতসিবাদকে ধ্বংস করতে চান। আপনাদের সৈন্যরাও (কিন্তু) জার্মানদের মতােই ধ্বংসকাণ্ড চালাচ্ছে। তফাত একটাই, আপনাদের ধ্বংসলীলার মাত্রা হয়তাে জার্মানদের চেয়ে কম।… আমি আপনাদের সামনে আরও সাহসী এবং মহৎ একটি উপায়ের প্রস্তাব পেশ করছি, যে সৈনিকরা সবচেয়ে বেশি সাহসী, এই উপায়টি তাদের উপযােগী। আমি চাই, আপনারা বিনা অস্ত্রে… অথবা অহিংসার অস্ত্রে নাতসিদের মােকাবিলা করুন। যে অস্ত্র আপনারা ব্যবহার করছেন, সেগুলি আপনাদেরও রক্ষা করবে না, মানবজাতিকেও রক্ষা করবে , সেগুলি ফেলে দিন।… হের হিটলার এবং সেনিয়র মুসােলিনিকে আমন্ত্রণ জানান, যে দেশগুলিকে আপনারা আপনাদের সম্পত্তি মনে করেন, সেগুলির যতটা অংশ ওঁরা দখল করতে চান দখল করতে দিন। আপনাদের সুন্দর দ্বীপ, তার সুন্দর ইমারতগুলি, সব ওঁদের হাতে তুলে দিন। এ সবই আপনারা দেবেন, কিন্তু আপনাদের আত্মা কিংবা হৃদয় দেবেন না…”[৬৫]
এই খােলা চিঠিটি সম্পর্কে ঠিক কী বলা উচিত, সেটা ভেবে ওঠাই কঠিন। কিন্তু এই চিঠি একটি প্রশ্ন তােলে বড় লাট চিঠিটি পেয়ে কী ভেবেছিলেন ? তিনি কি এই পরামর্শ লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন? ব্রিটেন, ভারত বা ডােমিনিয়ন-এর সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর সেনানীরা, যাঁরা লড়াই করছিলেন, রণক্ষেত্রে মৃত্যু বরণ করছিলেন, তারা এবং তারা প্রিয়জনেরাই বা সংবাদপত্রে এই চিঠি পড়ে কী ভেবেছিলেন?
লিগকে সংহত করে তুলতে লিনলিথগাে যে সহযােগিতা করেছিলেন, সে জন্য জিন্না তার প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারে জিন্না ‘লিনলিথগােকে দলকে ধরে রাখার কাজে তিনি যে সহযােগিতা করেছেন সে জন্য বিশেষ ধন্যবাদ জানালেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।[৬৬] কংগ্রেস ‘অসহযােগী’ আচরণ করছিল এবং তার চাহিদাগুলির মােকাবিলার জন্য বড়লাট উল্টো দিকে একটি শক্তিশালী মুসলিম লিগকে রাখতে চাইলেন। ভারত সরকারের পরিচালকরা সাধারণ ভাবে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও বােঝাপড়ার বিপক্ষে ছিলেন, তারা বরং মুসলিম লিগের চাহিদাগুলি সহৃদয় ভাবে বিবেচনা করার পক্ষে ছিলেন। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধের সময় ভারতীয় সাম্রাজ্য অক্ষত রাখা এবং ভারতকে যুদ্ধের কাজে যথাসম্ভব ব্যবহার করাই ছিল লিনলিথগাের কাছে। প্রথম এবং প্রধান কাজ। এই কারণেই তিনি যুদ্ধের জন্য প্রচার করলেন, সংখ্যালঘুদের অসম্ভব দাবিগুলিকে গুরুত্ব দিলেন এবং জানালেন যে কোনও ধরনের সাংবিধানিক অগ্রগতির পূর্বশর্ত হবে প্রধান দলগুলির (কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ) বােঝাপড়া। লিনলিথগাের পরামর্শ অনুসারে লর্ড জেটল্যান্ড হাউস অব লর্ডস-এ জানালেন, ব্রিটিশ সরকার মনে করে যে, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বােঝাপড়া না হলে কোনও সাংবিধানিক পরিবর্তন ঘটানাে যাবে না।
২৩২
১৯৩৯-এর নভেম্বরের গােড়ায় লিনলিথগাে গাঁধী, রাজেন্দ্রপ্রসাদ এবং জিন্নাকে একসঙ্গে একটি বৈঠকে ডাকলেন। তার বক্তব্য ছিল, “প্রধান সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আগে থেকে বােঝাপড়া থাকলে কেন্দ্রে একটা সুষ্ঠু ঐক্যবদ্ধ প্রশাসন চালানাে সহজ হয়, সেই বােঝাপড়া নেই বলেই সাংবিধানিক অগ্রগতি বিলম্বিত হচ্ছে। তিনি তাই প্রধান সম্প্রদায়গুলিকে নিজেদের মধ্যে কথা বলে সর্বজনগ্রাহ্য প্রস্তাব পেশ করতে পরামর্শ দিলেন, যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে ‘কেন্দ্রে গভর্নর জেনারেল’স কাউন্সিলের কিছুটা সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে, লিনলিথগাে তাঁর নিজের শর্ত ছাড়া কংগ্রেসকে প্রশাসনে ফিরে আসতে দিতে রাজি ছিলেন না। কংগ্রেস তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলল, তিনি ভারতীয় জনসাধারণের অনুমতি না নিয়ে ভারতকে যুদ্ধের শরিক বলে ঘােষণা করেছেন বলেই ভারতে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আর মুসলিম লিগের সঙ্গে কোনও সংঘাতের কারণে তাে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা। থেকে পদত্যাগ করেনি, সুতরাং তাদের সঙ্গে বােঝাপড়ার শর্তের কথা উঠছে কেন? কংগ্রেসের বক্তব্য ছিল, তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের মৌলিক মতবিরােধের ফলেই আলাপ-আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে।
লিনলিথগাে তার আলােচনা কেন ব্যর্থ হল সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কখনও তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের মতপার্থক্যের কথা বলেননি, শুধু কংগ্রেস আর লিগের মতানৈক্যের কথা বলেছেন। এতে মনে হয়, তিনি দুই পক্ষের মতানৈক্যের দোহাই দিয়ে নিজেদের দায় অস্বীকার করতেই চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের কথা, ব্রিটিশ-বিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলন এখন হিন্দু-মুসলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পর্যবসিত হল। সাম্রাজ্য এখন আর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য থাকল না।
কংগ্রেস নেতারা জিন্নার সঙ্গে দেখা করলেন, কিন্তু কোনও বােঝাপড়া হল না। কংগ্রেস যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সমর্থন জানানাের যে সব শর্ত আরােপ করেছিল, তিনি প্রকাশ্যে সেগুলির বিরােধিতা করতে পারলেন না, কারণ তা হলেই তার তথা লিগের গায়ে দেশপ্রেমিক নয়, ব্রিটিশদের সমর্থক বলেই ছাপ পড়েই যেত। আবার লিগের জন্যে কিছু সুবিধে আদায় না করেই কংগ্রেসকে সমর্থন করলে কেবল ব্রিটিশ সরকারই ক্ষুন্ন হত না, কংগ্রেসের শক্তি বাড়ত, লিগ দুর্বল হত। জিন্না তাই মূল প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতার পাঁচটি শর্ত দিলেন: প্রদেশগুলিতে জোট মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে, প্রাদেশিক আইনসভায় মুসলিম সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশের আপত্তি থাকলে কোনও প্রস্তাব অনুমােদন করা চলবে না, জনসমাগম হয় এমন প্রতিষ্ঠানে কংগ্রেসের পতাকা ওড়ানাে যাবে না, বন্দে মাতরম’ গাওয়া বন্ধ করতে হবে, কংগ্রেসকে মুসলিমদের মধ্যে গণসংযােগের কর্মসূচি পরিহার করতে হবে। এই শর্তগুলির কোনওটিই কংগ্রেসের পক্ষে মেনে নেওয়া সহজ ছিল না, কিন্তু জিন্না পুরাে দায়টা কংগ্রেসের কাঁধে চাপিয়ে দিলেন।
আগের অনুচ্ছেদগুলিতে এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে এই সময়ে জিন্না বড়লাটের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছিলেন। এক বার লিনলিথগাের সঙ্গে কথা
২৩৩
বলতে গিয়ে জিন্না স্বীকার করেছিলেন যে, গাঁধী তার কাছে জানতে চেয়েছেন, কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারকে যে ঘােষণার জন্য চাপ দিচ্ছিল, মুসলিম লিগও কংগ্রেসের সঙ্গে যৌথ ভাবে সেটার জন্য দাবি জানাতে পারে কি না। জিন্নার পক্ষে অবস্থাটা কিছুটা অস্বস্তিকর ছিল, কংগ্রেসের দাবি সরাসরি অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে কঠিন ছিল। কংগ্রেস নেতারা সতর্ক করে দিলেন যে, তাদের দাবিতে সুর না মেলালে জিন্না জনসমক্ষে ভারতের স্বাধীনতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধক বলে প্রতিপন্ন হবেন। এই পরিস্থিতিতে লিনলিথগাে সর্বদলীয় সম্মেলন ডাকার পরিকল্পনা বর্জন করলেন। কংগ্রেস নিজেকে সমগ্র ভারতের প্রতিনিধি বলে যে দাবি জানিয়ে আসছিল, সেটি যে ‘অন্তঃসারশূন্য’, সে কথা প্রতিপন্ন করতেই লিনলিথগাে এই সম্মেলন ডাকতে চেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এই সম্মেলনে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় প্রতিনিধিত্বের দাবি অসার প্রতিপন্ন হতে পারে ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে কংগ্রেসের এই দাবিও সত্য বলে প্রমাণিত হবে যে, মুসলিম লিগ ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে। জিন্নার সঙ্গে তার আলাপের সম্বন্ধে জেটল্যান্ডকে অবহিত করতে গিয়ে তিনি পরিষ্কার বললেন, “কংগ্রেসের দাবির বিপরীত অবস্থান নিয়ে তিনি (জিন্না) আমাকে খুব সাহায্য করেছেন এবং আমি সে জন্য কৃতজ্ঞ। এটা পরিষ্কার যে, জিন্না যদি কংগ্রেসের দাবি সমর্থন করতেন এবং আমাকে যৌথ দাবিদাওয়ার মােকাবিলা করতে হত, তা হলে আমার এবং ব্রিটিশ সরকারের সমস্যা অনেক বেড়ে যেত। তাই আমার মনে হয়েছিল, তার অবস্থানে আমার একটা গভীর স্বার্থ ছিল।” [৬৭]
কেন ব্রিটিশরা লিগকে উৎসাহ দিতে চেয়েছিল, আগের উদ্ধৃতি থেকেই সেটা বােঝা যায়। আর যা-ই হােক, তখন ব্রিটিশরা যুদ্ধে লিপ্ত, যে যুদ্ধ তাদের কাছে আক্ষরিক অর্থেই একটা জীবনমরণ লড়াই। এই অবস্থায় কংগ্রেসের পাশে যদি লিগের সমর্থন থাকত, তা হলে ব্রিটিশদের পক্ষে তাদের দাবি ফেরানাে অসম্ভব হত। তাই অন্তর্বর্তী যুদ্ধ চলাকালীন যাতে কংগ্রেসের সঙ্গে লিগের মিল না হয়, সেটা ব্রিটিশরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। আর একই কারণে ব্রিটিশদের এই ফাদে পা না দেওয়াটা কংগ্রেসের পক্ষেও জরুরি ছিল। এ সবই অবশ্য পরের ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভেবে দেখা।
বড়লাট অবশ্য সর্বসাধারণের জন্য একটা অন্য ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন, তিনি ‘বােঝাপড়ার জন্য সর্ব প্রকার চেষ্টা করতে’ দু’পক্ষের নেতাদের সহযােগিতা ‘ভিক্ষা করেছিলেন। তিনি জোর দিয়ে বললেন, সমস্যাটা ভারতীয়দের, তাই তাদের নিজেদের বােঝাপড়াটা একান্ত জরুরি। তবে, কৃষ্ণ মেননের নেতৃত্বে লন্ডনে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে সক্রিয় ইন্ডিয়া লিগ লিনলিথগাের চালটা ধরতে পেরেছিল। ইন্ডিয়া লিগ একটি বিবৃতি দিয়ে জানাল, ‘সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে’ কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের আলােচনা ভেঙে গেছে, এটা ঠিক নয়, আর জিন্না ও রকম কোনও আপত্তিও তােলেননি। তারা আরও বলল যে, আলােচনা ব্যর্থ হওয়ার মানে এই নয় যে, কোনও সাম্প্রদায়িক অনৈক্য দেখা দিয়েছে, আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে, কারণ “ব্রিটিশ নীতির সঙ্গে (ভারতীয়দের) মতপার্থক্য তীব্রতর হয়েছে এবং ব্রিটিশ সরকার একটা সন্তোষজনক ঘােষণা করতে চাইছে না বলেই তাদের সঙ্গে কোনও বােঝাপড়া সম্ভব হয়নি।”[৬৯]
২৩৪
ইন্ডিয়া লিগের এই বিবৃতিতে ইন্ডিয়া অফিস খুবই অসন্তুষ্ট হল। এই বিবৃতিকে ভুল প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে লর্ড জেটল্যান্ড লিনলিথগােকে দেখতে বললেন, জিন্নাকে এর প্রতিবাদ করে রয়টার্স-এর কাছে একটি বিবৃতি দিতে রাজি করানাে যায় কি না। তিনি জানালেন, জিন্না এমন কোনও বিবৃতি দিলে ব্রিটেনে এবং ভারতে তা ব্যাপক ভাবে প্রচার করা হবে। জিন্না এই প্রস্তাবে উৎসাহ দেখালেন এবং প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, ‘উপযুক্ত সময়ে তিনি সমুচিত জবাব দেবেন।[৭০]
এ জিন্না যে কখনও ‘সমুচিত জবাব দিয়েছিলেন, তার কোনও স্পষ্ট প্রমাণ নেই। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে কংগ্রেস-লিগ বােঝাপড়ার পথ খুঁজতে নেহরুর সঙ্গে কথাবার্তা চালানাের সময়েই জিন্না আচমকা তার অবস্থান পালটে ফেলে মুসলমানদের মুক্তি দিবস পালনের জন্য আহ্বান জানালেন। দৃশ্যত, এটা ছিল কংগ্রেস শাসনের “গত আড়াই বছরে অত্যাচার, নিপীড়ন এবং অন্যায় থেকে মুক্তির উৎসব।[৭১] জিন্না এর সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ সরকারকে কংগ্রেস মন্ত্রিসভাগুলির ‘মুসলিম-বিরােধী নীতি বিষয়ে অনুসন্ধানের আবেদন জানালেন। মুক্তি দিবস’-এর আয়ােজন থেকে তাকে বিরত করার চেষ্টা সফল হল না। ধরে নেওয়া হল, তার এই বিবৃতি আসলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে খােলাখুলি আক্রমণ।
এর ফলে নেহরু আর জিন্নার আলােচনা অবিলম্বে বন্ধ হয়ে গেল। জিন্না সরকারের প্ররােচনাতেই ‘মুক্তি দিবস’-এর ডাক দিয়েছিলেন, এমন সিদ্ধান্ত হঠকারিতার শামিল হবে। কিন্তু লিনলিথগাে জিন্নার এই ঘােষণাকে ইন্ডিয়া লিগের বিবৃতির একটা ‘উচিত জবাব’ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।[৭২] তিনি সেক্রেটারি অব স্টেটকে তার চিঠিতে জানালেন, জিন্নার ‘মুক্তি দিবস’ পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে, সাম্প্রদায়িক বিভেদ কতটা প্রবল। একই সঙ্গে ব্রিটিশ ক্যাবিনেট এবং পার্লামেন্টের কাছে মুসলিমদের বক্তব্য পরিষ্কার করে জানানাের জন্য লিনলিথগাে একটি ব্রিটেনে মুসলিম প্রতিনিধি দল পাঠানাের প্রস্তাব দিলেন। জেটল্যান্ড এতে আপত্তি করলেন। নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানরা স্বশাসিত ভারতের অংশীদার হতে পারবে না— এমন একটা সম্পূর্ণ নেতিবাচক প্রচারে তার সম্মতি ছিল না। তার বক্তব্য ছিল, লিগ সাফ সাফ জানাক, কোন শর্তে তারা স্বশাসন মেনে নিতে রাজি।
লিনলিথগাে অতঃপর মুসলিম লিগকে বললেন, তারা যেন কংগ্রেসের স্বাধীনতার দাবি এবং স্বাধীন ভারতের সংবিধান রচনার জন্য একটি গণ পরিষদ তৈরির দাবির মােকাবিলা করার জন্য নির্দিষ্ট প্রস্তাব দেয়। লিনলিথগাে কয়েক বার জিন্নার সঙ্গে কথা বলে তাকে বােঝালেন যে, ব্রিটিশ সরকারকে একটা পােশাকি স্মারকপত্র। দিয়ে ব্রিটেনের জনমত এবং আরও নির্দিষ্ট করে’ হাউস অব কমনস-এর শ’ছয়েক প্রতিনিধির মতামতকে প্রভাবিত করা অসম্ভব। জেটল্যান্ডকে এই বিষয়ে জানাতে গিয়ে লিনলিথগাে লিখলেন, “আমি আবার একটা গঠনমূলক নীতি রূপায়ণের যুক্তিগুলি তাকে বললাম, তিনি বললেন, তার এবং তার বন্ধুদের পক্ষে তাদের অবস্থান যথাসময়ে জনসমক্ষে প্রকাশ করাটাই ঠিক হবে।”[৭৩]
২৩৫
লিগের পায়ের নীচের জমি তখনও যথেষ্ট শক্ত ছিল না, তাই সাংবিধানিক প্রশ্নে নিজের অবস্থান পুরােপুরি জানিয়ে দেওয়া তাদের পক্ষে কঠিন ছিল। কিন্তু আবার সেই জানিয়ে দেওয়ার কাজটা অনির্দিষ্টকাল ঠেকিয়ে রাখাও লিগের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৫-এর আইনে যে সর্বভারতীয় ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা করেছিল, কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ, উভয়েই তা প্রত্যাখ্যান করে। কংগ্রেস একটা বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল যে, গণ পরিষদ গঠন করে সংবিধান রচনা করতে হবে। লিগ ব্রিটিশ প্রস্তাবের বিরােধিতা করে, কংগ্রেসের প্রস্তাবও তারা মানেনি, কিন্তু তারা নিজেরা কোনও বিকল্প প্রস্তাব দেয়নি। এর আগে তারা ভারতে একটা ঢিলেঢালা ফেডারেশন তৈরির কথা বলেছিল। ১৯৩৭-এর নির্বাচনের ফলাফল পরিষ্কার দেখিয়ে দিল, স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী এবং আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা সত্ত্বেও প্রস্তাবিত ফেডারেশনে লিগ নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারবে না, সর্বভারতীয় ফেডারেশনে তারা খুবই দুর্বল অবস্থায় থাকবে। লিগ বলল, ব্রিটিশ সরকার বরং ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান একেবারে নতুন করে পর্যালােচনা করুক।
‘পাকিস্তান প্রস্তাব: লাহৌর ১৯৪০
এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিংশ শতাব্দীর সেই দুর্ভাগ্যতাড়িত চল্লিশের দশকে এসে পৌঁছল ভারত। ১৯৪০ সাল শুরু হল দেশের সামনে দুটি মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে: বড়লাট তার কাউন্সিল সম্প্রসারণের যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির কাছে গ্রহণীয় কি না এবং যুদ্ধ পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়ার জন্য ভারতীয় নেতাদের নিয়ে একটি উপদেষ্টামণ্ডলী গঠনের প্রস্তাবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলির সায় আছে কি না।
দিল্লিতে ১৯৪০-এর ফেব্রুয়ারি মাসে লিগের ওয়ার্কিং কমিটির একটি বৈঠক হল। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং সেক্রেটারি অব স্টেট-এর কাছে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যার জন্য লন্ডনে মুসলিম লিগের একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাের যে প্রস্তাব বড়লাট দিয়েছিলেন, সেটাই ছিল এই বৈঠকের আলােচ্য। জিন্না প্রস্তাব দিলেন, খালেকুজ্জামানকে প্রতিনিধিদলে রাখা হােক। অতঃপর এই বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হল। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ছিলেন ফজলুল হক, স্যর সিকন্দর হায়াত খান, খােয়াজা নাজিমুদ্দিন এবং খালেকুজ্জামান স্বয়ং।
ব্রিটিশ সরকারের কাছে কী কী প্রস্তাব পেশ করা হবে, সে বিষয়ে ফেব্রুয়ারির বৈঠকে জিন্নার পরামর্শ চাওয়া হল। খালেকুজ্জামান জেটল্যান্ড এবং কর্নেল মুরহেডের সঙ্গে তার যে আলােচনা হয়েছিল, সে বিষয়ে কমিটির সদস্যদের অবহিত করলেন। এর পর ওয়ার্কিং কমিটি ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য’র একটি বিকল্প নিয়ে আলােচনা করল।
২৩৬
স্যর সিকন্দর ভারতকে সাতটি অঞ্চলে ভাগ করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সেটিও আলােচিত হল। জিন্না তার প্রস্তাবের বিরােধিতা করলেন। মুসলিম অঞ্চলগুলিকে অবশিষ্ট ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার যে প্রস্তাব নিয়ে আগে জেটল্যান্ড এবং মুরহেডের সঙ্গে আলােচনা করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেটিই গৃহীত হল। এই প্রথম মুসলিম লিগ ওয়ার্কিং কমিটি ভারত ভাগের দাবি তুলবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। কী ভাবে, ‘কোথায় এবং কোন প্রদেশগুলিতে ভারতকে ভাগ করা হবে, সেটা কেউ জানত না, কিন্তু নিয়তির পদধ্বনি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।।
অবশেষে ১৯৪০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জিন্না বড়লাটকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দিলেন যে, মুসলিম লিগ ২৩ মার্চ মুক্ত অধিবেশনে দেশভাগের দাবি জানাতে চলেছে। তত দিনে লর্ড জেটল্যান্ডও এ বিষয়ে জেনে গিয়েছেন।
১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনে প্রস্তাবিত ফেডারেশনের পরিকল্পনাটিকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ তার এই অধিবেশনে প্রবল ভাবে প্রত্যাখ্যান করল। লিগ যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করল, তাতে দাবি জানানাে হল, পঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানকে সম্পূর্ণ স্বশাসন এবং সার্বভৌম ক্ষমতা দিতে হবে, একই ধরনের ক্ষমতা দিতে হবে পূর্বের সংশ্লিষ্ট প্রদেশগুলিকেও,[৭৪] এবং এই প্রদেশগুলিকে নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করতে হবে। ফজলুল হক প্রস্তাবটি উত্থাপন করলেন, জিন্না খালেকুজ্জামানকে এই প্রস্তাব সমর্থন করতে বললেন।
১৯৪০-এর ২৩ মার্চ মধ্যরাত্রে প্রস্তাব গৃহীত হল। পরের দিন সকালে সমস্ত সংবাদপত্রের শিরােনামে বলা হল, ‘পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে। কেউ বক্তৃতায় এই কথাটি ব্যবহার। করেননি, প্রস্তাবের মূল বয়ানেও এটি ছিল না। সংবাদপত্রগুলি মুসলিম জনসাধারণকে একটি স্লোগান সরবরাহ করল, যেটির মধ্যে হাতে-গরম একটি রাষ্ট্রের ধারণা ছিল। লাহৌর প্রস্তাবটির যথার্থ ব্যাখ্যা জনসাধারণকে বুঝিয়ে বলতে হলে মুসলিম লিগের নেতাদের বিস্তর পরিশ্রম করতে হত। পাকিস্তান প্রস্তাব’-এর ধারণাটি সেই পরিশ্রম বহুলাংশে বাঁচিয়ে দিল। নিয়তি আরও একটি লাইন টেনে দিল, যে লাইন মােছা যাবে না।
এত দিন পর্যন্ত যা ছিল সাম্প্রদায়িক সমস্যা, লাহৌর প্রস্তাব সেটি সম্পূর্ণ বদলে দিল। এ পর্যন্ত যতগুলি প্রস্তাব বিবেচিত হয়েছিল— স্বতন্ত্র নির্বাচকমণ্ডলী, মিশ্র মন্ত্রিসভা, আসন সংরক্ষণ, সমতা—সবই হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল। একটি ব্রিটিশ সংবাদপত্রে লেখা হল, “আপাতত জিন্না ভারতে বিশৃঙ্খলার রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।”[৭৫] কংগ্রেস নেতারা এর আগে পর্যন্ত সাংবিধানিক সংকটকে তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের দ্বন্দ্ব হিসেবেই দেখেছিলেন, পাকিস্তান প্রস্তাব’ তার জটিলতা বাড়িয়ে তুলল।।
ড. লতিফ বললেন, “মুসলমানরা যেখানে সংখ্যাগুরু, যেখানে তারা নিজেদের দেখভাল করতে পারেন, সেখানে তাদের নিয়ে সত্যিকারের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু দিল্লি, লখনউ, পটনা থেকে শুরু করে কেপ কমােরিন-এর মতাে যে সব জায়গায় মুসলমানরা সংখ্যালঘু, জিন্নার পরিকল্পনা কার্যকর হলে সে সব জায়গায় মুসলমানরা চিরকালের মতাে অনাথ হয়ে পড়বেন।… আমি লক্ষ করেছি, জিন্না ভারতের দশ কোটি
২৩৭
মুসলমানকে একটি অবিভাজ্য গােষ্ঠী হিসেবে ভাবতেই পারেন না, তিনি বুঝতেই পারছেন না যে, তার পাকিস্তান প্রস্তাব থেকে তিনি যে সুবিধে আদায় করতে চাইছেন, সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যাটাকে দেখতে পারলে তার সবটাই পাওয়া সম্ভব, একই সঙ্গে পাকিস্তান প্রস্তাবের সমস্যাগুলিকে এড়ানাে সম্ভব।”
জিন্নার কাছে পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল একটি সুচিন্তিত রণকৌশলের অংশ। তিনি জানতেন, ভারতে এবং ভারতের বাইরে মুসলিম রাষ্ট্রের মােড়কে সব রকম সম্ভাবনাকে পুরে দেওয়া যাবে। পাকিস্তান’ বলতে ঠিক কী বােঝানাে হচ্ছে, সেটা তিনি খােলসা করে বলেননি, তার প্রধান কারণ এই যে, সেটা তিনি নিজেও জানতেন না এবং তার অনুগামীদের নিজেদের পছন্দ মাফিক এই প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করার স্বাধীনতা দিলেন তিনি। কট্টরপন্থীরা স্বপ্ন দেখলেন এমন এক রাষ্ট্রের, বিশুদ্ধ ইসলাম হবে যার প্রাণ। তুলনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি’(!) যাঁদের, তাঁরা নিজেদের রাষ্ট্র’ তৈরি হলে যে সব আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাবে তার আকর্ষণে ভুললেন। তা ছাড়া, একটি সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রের সম্ভাবনা অনেকের মনে অতীত মুসলিম শাসনের মহিমময় স্মৃতি জাগিয়ে তুলল। অধিকাংশ মুসলিম মানুষই তাই পাকিস্তানের ধারণাটিকে সাগ্রহে বরণ করে নিলেন। বড়লাট একটি গঠনমূলক প্রস্তাব’-এর জন্য লিগকে যে অনুরােধ জানিয়ে আসছিলেন, পাকিস্তান প্রস্তাব কি তারই একটি উত্তর ছিল?
তা ছাড়া, ১৯৪০-এর এই ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ এক বার গৃহীত হওয়ার পর পঞ্জাবে মুসলিম রাজনীতির রাশ হাতে নেওয়াটা লিগের পক্ষে জরুরি হয়ে উঠল— জিন্না। বললেন, ওই প্রদেশটি হল ‘পাকিস্তানের ভরকেন্দ্র। (১৯৪৩-এর ২৪ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের দিল্লি অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ) জিন্না পরে বললেন যে, তিনি প্রাদেশিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবেন না বলে আদৌ কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি। তাঁর বক্তব্য ছিল, এক জন নেতার (তিনি নিজে) সঙ্গে এক জন অনুগামীর (সিকন্দর হায়াত খান) ‘চুক্তি’ কী করে হতে পারে? (১৯৪৪-এর ৩০ এপ্রিল শিয়ালকোটে পঞ্জাব মুসলিম লিগ সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ।) তিনি মুসলিম নেতাদের আহ্বান জানালেন, “গােষ্ঠীস্বার্থ, ঈর্ষা, খণ্ডজাতীয়তার মােহ এবং স্বার্থপরায়ণতা বর্জন করে ইসলাম এবং আপনাদের জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠুন” (১৯৪৩-এর ২৪ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের দিল্লি অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ) কিন্তু ১৯৪৪-এও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খিজির হায়াত খানের সঙ্গে জিন্নার আলােচনা ব্যর্থ হল, ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশে তার এবং লিগের মর্যাদা ক্ষুন্ন হল। (হুমায়ুন কবীর, মুসলিম পলিটিক্স, ১৯৪২৪৭, পৃ ৩৯৩-৪ দ্রষ্টব্য; তবে আলােচনায় এই মতটির যাথার্থ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।)
বাংলাতেও মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের সঙ্গে ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৩-এ তার পরাজয় পর্যন্ত জিন্নার ক্রমাগত বিরােধ চলেছে। লিগ এবং সেই সূত্রে ভারতীয় মুসলমানরা পাকিস্তানের লক্ষ্য আনুষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করার অনেক পরে, ১৯৪১-এর সেপ্টেম্বর মাসে ফজলুল হক লিগের ওয়ার্কিং কমিটি এবং কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করলেন। মুসলমানরা যেখানে সংখ্যালঘু, সেই সব অঞ্চলের নেতারা যে ভাবে পঞ্জাব ও বাংলার
২৩৮
মতাে প্রদেশের মুসলমানদের স্বার্থ বিপন্ন করছেন, হক তার পদত্যাগপত্রে তার কঠোর সমালােচনা করলেন। এক জন ব্যক্তির অভিরুচির যুপকাষ্ঠে যে ভাবে গণতন্ত্র এবং স্বাধিকারের আদর্শগুলিকে বলি দেওয়া হচ্ছে, তিনি তারও কঠোর নিন্দা করলেন। [৭৬] ১৯৪৩-এ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতন হল, ‘বাংলার রাজনীতি শাপমুক্ত হওয়ায় জিন্না উল্লাস জানালেন।[৭৭]
তথ্যসূত্র
১. চৌধুরী খালেকুজ্জামান, পাথওয়ে টু পাকিস্তান, পৃ. ১৪
২. তদেব।
৩. স্যর মহম্মদ ইউসুফ, স্টার অব ইন্ডিয়া, ২০ জুন, ১৯৩৬। এ ছাড়াও, মহম্মদ রেজা কাজমি, লিয়াকত আলি খান অ্যান্ড দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট, পাকিস্তান স্টাডি সেন্টার, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৭, পৃ. ১১১
৪. কায়েদ-এ-আজম পেপার্স, ১১২২ খণ্ড, পৃ. ১৬৭-৮, স্টার অব ইন্ডিয়া, কলকাতা, ১১ অগস্ট, ১৯৩৬ ৫. স্টার অব ইন্ডিয়া, কলকাতা, ২৯ মে, ১৯৩৬, পৃ. ৩
৬. এ কে ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৭২)। শের-ই-বেঙ্গল নামে সুপরিচিত। অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে পাকিস্তান আন্দোলন সংক্রান্ত সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুরােভাগে ছিলেন। উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের সামগ্রিক উন্নতিতে তার বিপুল অবদান ছিল।
ফজলুল হকের জন্ম ২৬ অক্টোবর, ১৮৭৩। বাড়িতেই প্রাথমিক ও ধর্মীয় শিক্ষা। পবিত্র কোরান, আরবি ও ফারসি শিখেছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিতদের কাছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও গণিত নিয়ে স্নাতক এবং পরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। দুটিতেই ভাল ফল করেছিলেন।
১৯০০ সালে ফজলুল হক কলকাতা হাইকোর্টে অ্যাডভােকেট হিসেবে নথিভুক্ত হলেন। নিজের শহর বরিশালে ওকালতি করতে করতে তিনি উপলব্ধি করলেন, শিক্ষার অভাবই মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ। মুসমানদের শিক্ষার প্রসার এবং রাজনৈতিক অগ্রগতি হয়ে দাড়াল তার ধ্যানজ্ঞান। তিনি ক্রমে ক্রমে তরুণ রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠলেন। ১৯০৬ সালে যে চার সদস্যের কমিটি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের সংবিধানের খসড়া রচনা করেছিলেন, তিনি ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। দরিদ্র এবং যােগ্য মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য ১৯১২ সালে তিনি সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহমেডান এডুকেশনাল অ্যাসােসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করলেন। ১৯১৪ সালে তিনি বাংলার মুসলমানদের নেতার ভূমিকা গ্রহণ করলেন। প্রদেশের প্রতিনিধি হিসেবে লখনউ চুক্তিতে শরিক হলেন তিনি। ১৯২০ সালে হলেন বাংলার শিক্ষামন্ত্রী। ১৯১৯ থেকে ১৯২১, অসহযােগ আন্দোলনের সময়ে তিনি মুসলমান ছাত্রদের মন দিয়ে পড়াশােনা চালিয়ে যেতে বললেন, তাঁর মত ছিল— ছাত্রজীবন রাজনীতি করার সময় নয়। ফজলুল হক ছিলেন মুখ্যত জননেতা। দেশভাগের আগে দাঙ্গায় অভিযুক্ত হাজার হাজার
২৩৯
মুসলমানের হয়ে তিনি মামলা লড়েছিলেন। তিনি বাংলার কৃষকের স্বার্থরক্ষাতেও মনােযােগী ছিলেন। তিনি রাউন্ড টেবল কনফারেন্সে যােগ দেন এবং প্রশাসনিক কাজে মুসলিমদের প্রাপ্য দায়িত্ব অর্জনের জন্য জোর সওয়াল করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ কায়েদ-এ-আজম-এর সভাপতিত্বে আয়ােজিত মুসলিম লিগের অধিবেশনে ঐতিহাসিক পাকিস্তান প্রস্তাব পেশ করেন ফজলুল হক।
দেশভাগের পর ফজলুল হক পাকিস্তানে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভােকেট জেনারেলএর পদ গ্রহণ করেন। আশি বছর বয়সে তিনি পাকিস্তানের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত সফর করেন। ২৭ এপ্রিল, ১৯৬২ তঁার মৃত্যু হয়। অবসান হয় ভারতীয় উপমহাদেশের অর্ধশতাব্দীব্যাপী এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক জীবনের।
৭. খােয়াজা নাজিমুদ্দিন (১৮৯৪-১৯৬৪)-এর জন্ম ১৯ জুলাই। আলিগড়ের এম এ ও কলেজ এবং কেমব্রিজের ট্রিনিটি হল-এ শিক্ষালাভ করেন তিনি। ১৯২২ থেকে ১৯২৯ ঢাকা পুরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯২৯ সালে প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী রূপে ১৯৩০-এর বেঙ্গল রুরাল প্রাইমারি এডুকেশন বিল প্রণয়নে উদ্যোগী হন। হিন্দু সদস্যদের এই বিল-এ তীব্র আপত্তি ছিল। ১৯৩৪ সালে এগজিকিউটিভ কাউন্সিলর হন। এই পদে থাকার সময় বাংলার কৃষকদের অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য তিনি দু’টি বিল পাশ করান। ১৯৩৭ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ১৯৪১ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হকের জোট মন্ত্রিসভায় সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ফজলুল হক পদত্যাগ করার পরে ২৪ এপ্রিল ১৯৪৩ মুখ্যমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। তার আগের দু’বছর তিনি ছিলেন আইনসভায় বিরােধী নেতা। ১৯৪৭ সালের অগস্ট মাসে তিনি পূর্ববঙ্গে মুসলিম লিগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মহম্মদ আলি জিন্নার মৃত্যু হলে খােয়াজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন। লিয়াকত আলি নিহত হওয়ার পরে তাকে প্রধানমন্ত্রীর আসন গ্রহণের অনুরােধ জানানাে হয়, মালিক গােলাম মহম্মদ হন গভর্নর জেনারেল।
৮, ১৯৩০-এর দশকে বাংলার রাজনীতিতে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক প্রজা পার্টির আধিপত্য ছিল।
৯. পাথওয়ে টু পাকিস্তান, পৃ. ১৫৩
১০. তদেব, পৃ. ১৫৭
১১. তদেব, পৃ. ১৬১
১২. বি আর নন্দ, নেহরু, দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস অ্যান্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, ১৯৩৫-৪৭, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, পৃ. ১৫৭
১৩, জেড এইচ জাইদি, আসপেক্টস অব ডেভেলপমেন্ট অব মুসলিম লিগ পলিসি, ১৯৩৭৪৭, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, পৃ. ২৪৫
১৪. মুনশি, ভারতীয় বিদ্যাভবন, পৃ. ৪৬।
১৫, এস গােপাল, জওহরলাল নেহরু: আ বায়ােগ্রাফি, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৩
১৬. তদেব, পৃ. ২২৮-২২৯
১৭. মুসলিম ধর্মীয় নেতৃত্ব
১৮, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বাের্ড তৈরি হয় ১৯৩৭ সালে।
১৯. বাংলায় ১৯৩৭ সালে শুরু হয় মােমিন কনফারেন্স, তঁাতিদের উন্নতি ও প্রশিক্ষণ ছিল
২৪০
এর লক্ষ্য।
২০. উইলিয়ম গুল্ড, হিন্দু ন্যাশনালিজম অ্যান্ড দ্য ল্যাংগােয়েজ অব পলিটিক্স ইন লেট কলােনিয়াল ইন্ডিয়া, কেমব্রিজ
২১. সভাপতির ভাষণ, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৬
২২. জওহরলাল নেহরু, এইটিন মানথস ইন ইন্ডিয়া, পৃ. ১৫৩
২৩. সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব জওহরলাল নেহরু, অষ্টম খণ্ড, পৃ. ৫৪-৫৫
২৪. তদেব, পৃ. ৬৩
২৫. তদেব, পৃ. ৫৫
২৬. ভি পি মেনন, ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া, ওরিয়েন্ট লংম্যান, পৃ. ৫৬
২৭. মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, ওরিয়েন্ট লংখ্যান, পৃ. ১৭১
২৮. এম জে আকবর, দ্য শেড অব সাের্ডস, রাউটলেজ, ২০০৩, পৃ. ১৮৩
২৯. ও পি রথন, এনসাইক্লোপিডিয়া অব পলিটিকাল পার্টিস, আনমােল, প. ৬৭৪
৩০. প্রদেশে সংসদীয় ঘরানায় নির্বাচিত সরকার থাকবে, কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নরদের হাতে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য বিশেষ ক্ষমতা থাকবে, সরকার ভেঙে পড়লে প্রশাসন হাতে নেওয়ার ক্ষমতাও থাকবে। ১৯৩৫-এর আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার সূত্রে একে ‘সেকশন ৯৩’ ক্ষমতাও বলা হত।
৩১. জন গ্লেনডােভেন, দ্য ভাইসরয় অ্যাট বে, কলিনস, ১৯৭৭, পৃ. ৭৫
৩২. তদেব।
৩৩. তদেব, পৃ. ৭৭।
৩৪. তদেব, পৃ ৭৭
৩৫. তদেব ।
৩৬, তদেব, পৃ ৭৮
৩৭. তদেব, পৃ ৭৮
৩৮. তদেব, পৃ ৭৮
৩৯. তদেব, পৃ ৮৭
৪০. তদেব, পৃ ১১৯
৪১. তদেব
৪২. পাথওয়ে টু পাকিস্তান, পৃ ১৮২
৪৩, তদেব
৪৪. তদেব, পৃ ১৯১। (তবে জিন্না এবং বসুর ১৯৩৮-এর চিঠিপত্র থেকে মূল সূত্রটি উদ্ধার করা যায়।)।
৪৫. সুভাষচন্দ্র বসুর চিঠিপত্র, ১৪ মে, ১৯৩৮, পৃ ৫। কায়েদ-এ-আজম-এর সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের চিঠিপত্র, এস কায়েম হুসেন জাফরি সম্পাদিত। আজিজ পাবলিশার্স, লাহৌর, পাকিস্তান।
৪৬. তদেব।
৪৭. তদেব, পৃ ৬
৪৮. বালগঙ্গাধর খেরকে ইতিহাসের দেবী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছিলেন। তিনি বম্বে প্রদেশের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হলেন। অমায়িক, সুরসিক মানুষটি গাঁধীজি থেকে শুরু করে
২৪১
কংগ্রেসের সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯২২ সালে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়, তিনি স্বরাজ্য পার্টির বম্বে শাখার সচিব হন। আইন অমান্য আন্দোলন এবং ভারত ছাড়াে আন্দোলনের সময় তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য বরাদ্দ কারাবাস ভােগ করেন। ১৯৫৭ সালের ৮ মার্চ তার মৃত্যু হয়।
৪৯. পাথওয়ে টু পাকিস্তান, পৃ ২০১
৫০. রুলার্স’, ‘স্টেট অথরিটি’ বা ‘গভর্নমেন্ট বােঝাতে শব্দটি হিন্দিতে ব্যবহার করা হত।
৫১. আক্ষরিক অর্থে, হিন্দিতে ছােট এলাকা
৫২. মুসলমানদের ক্ষোভ খতিয়ে দেখার জন্য মুসলিম লিগ পিরপুর-এর রাজা সৈয়দ মুহম্মদ মেহদি-র নেতৃত্বে একটি কমিটিকে দিয়ে পিরপুর রিপাের্ট তৈরি করিয়েছিল। কংগ্রেসশাসিত প্রদেশগুলিতে মুসলমানদের দুরবস্থা নিয়ে অন্য রিপাের্টগুলির মধ্যে ছিল এ কে ফজলুল হকএর ‘মুসলিম সাফারিংস আন্ডার কংগ্রেস রুল’ এবং ‘শরিফ রিপাের্ট।
৫৩. প্রেস বিবৃতি, স্টার অব ইন্ডিয়া, ৭ জুলাই, ১৯৩৭: কংগ্রেসের গণসংযােগের নিন্দায় জিন্না— মুসলমানরা চাটুকার নয়’: “কংগ্রেসের একটা বড় অংশ নিজেদের কর্মসূচি জনসমক্ষে প্রকাশ না করে মুসলিম লিগের নীতি এবং কর্মসূচির বিরােধিতা করছে এবং… প্রচার করছে। যে, মুসলিম লিগের সঙ্গে যারা আছে তারা সবাই রাজনৈতিক ক্রীতদাস এবং কংগ্রেসের সহযােগী… তাদের ধামাধরা এবং ভৃত্য। এই ভাবেই কি কংগ্রেস মুসলমানদের মধ্যে জনসংযােগ করতে চায়? আমার মতে, মুসলমানদের মধ্যে কংগ্রেসের জনসংযােগ কর্মসূচির পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে।”
৫৪. নেহরু অ্যান্ড দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া, ১৯৩৫-৪৭, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, লন্ডন, ১৯৭০, পৃ (১৬৩)
৫৫. দ্য ভাইসরয় অ্যাট বে, পৃ ১৩৭ ‘
৫৬, তদেব, পৃ ১৩৮
৫৭. ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-এ একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছিল, যাতে ব্রিটিশ ভারতের পাশাপাশি রাজন্যশাসিত প্রদেশগুলির প্রতিনিধিরাও থাকবেন, সেই প্রদেশের শাসকরা তাদের পরে মনােনীত করবেন। কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুটি কক্ষ থাকবে: একটি লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি বা বিধানসভা এবং একটি কাউন্সিল অব স্টেটস বা রাজ্যসভা। প্রাদেশিক স্তরে দ্বৈতশাসনের (ডায়ার্কি) অবসান ঘটবে, কেন্দ্রীয় স্তরে দ্বৈতশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে।
স্থির হয়েছিল, রাজন্যশাসিত রাজ্যগুলির অন্তত অর্ধেক প্রস্তাবিত রাজ্যসভায় বসতে রাজি
হলে ফেডারেশনের প্রস্তাব কার্যকর করা যাবে না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কনজার্ভেটিভরা বিলটির যুক্তরাষ্ট্রীয় অংশটিতে প্রবল জানিয়েছিলেন। ভারতে বিলটির প্রাদেশিক অংশ মােটামুটি অনুমােদিত এবং কার্যকর হল। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় স্তরে ফেডারেশন প্রস্তাব কার্যকর করা গেল না।
৫৮. দ্য ভাইসরয় অ্যাট বে, পৃ ১৫১
৫৯. ভি পি মেনন, ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পৃ ৫৯-৬০. মেনন এই বিবৃতির দিন উল্লেখ করেননি, কিন্তু মনে হয়, ১৯৩৯-এর ৫ অক্টোবর জিন্নার সঙ্গে লিনলিথগাে’র কথা হওয়ার পরেই এই বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল।
২৪২
৬০. লিনলিথগাে পেপার্স: ই ইউ আর. এফ. ১২৫/৬/১৫, জেটল্যান্ডকে ব্রাবাের্ন, ১৯ অগস্ট, ১৯৩৮; ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি। স্যর সিকন্দর হায়াত ব্রাবাের্নকে এই আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশরা একটা ন্যায্য সুযােগ দিলে মুসলমানরা ‘সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ব্রিটিশদের পাশে দাড়াবে।
৬১. জন এল ডান্ডাস, এসেজ দ্য মেমােয়ার্স অব লরেন্স, সেকন্ড মার্কেস অব জেটল্যান্ড।
৬২. তদেব।
৬৩, আহমদ, স্পিচেস অ্যান্ড রাইটিংস অব মি. জিন্না, লাহাের ১৯৪৭, দ্বিতীয় সংস্করণ ১৯৬৪, পৃ ২৪৫
৬৪. ট্রান্সফার অব পাওয়ার, পৃ ৪৩৭
৬৫. মেথড অব নন-ভায়ােলেন্স, মহাত্মা গাঁধী’স মেসেজ টু এভরি ব্রিটন, অমৃতবাজার পত্রিকা, ৪ জুলাই, ১৯৪০
৬৬. ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস, পলিটিকাল ডিপার্টমেন্ট কালেকশনস— এল/পি অ্যান্ড জে/৮/৫০৫। ৫ অক্টোবর ১৯৩৯-এ লিনলিথগাে ও জিন্নার একটি কথােপকথনের প্রতিলিপি।
৬৭. গওহর রিজভি, লিনলিথগাে অ্যান্ড ইন্ডিয়া, রয়াল হিস্টরিকাল সােসাইটি, লন্ডন ১৯৭৮, পৃ ১১৩-১১৪ ; ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডস, পলিটিকাল ডিপার্টমেন্ট কালেকশনস এল/পি অ্যান্ড জে/৮/৫০৬। ৪ নভেম্বর ১৯৩৯
৬৮. আই ও আর, ১৯৩৯, দুই, ৪১১
৬৯. লিনলিথগাে পেপার্স, ই ইউ আর.এফ. ১২৫/১৮/৩০৩, লিনলিথগােকে জেটল্যান্ড প্রেরিত তারবার্তা, ১৮ নভেম্বর, ১৯৩৯, আই ও এল; এ ছাড়াও গওহর রিজভি।
৭০. লিনলিথগাে পেপার্স, ই ইউ আর.এফ. ১২৫/১৮/৫১১, লিনলিথগােকে জেটল্যান্ড প্রেরিত তারবার্তা, ২৮ নভেম্বর, ১৯৩৯, আই ও এল।
৭১. হিন্দুস্তান টাইমস, দিল্লি, ৩ ডিসেম্বর ১৯৩৯।
৭২. লিনলিথগাে অ্যান্ড ইন্ডিয়া, পৃ ১১৫
৭৩. লিনলিথগাে পেপার্স, ই ইউ আর.এফ. ১২৫/১৯/৬, লিনলিথগােকে জেটল্যান্ড প্রেরিত তারবার্তা, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৪০, আই ও এল।
৭৪. লাহোর প্রস্তাব (১৯৪০): ২২ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ, ১৯৪০। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ লাহৌরের মিন্টো পার্ক-এ তাদের বার্ষিক অধিবেশন করল। এটি হয়ে দাড়াল এক ঐতিহাসিক অধিবেশন। প্রথম দিনে কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিন্না আগের কয়েক মাসের ঘটনাবলির বিবরণ দিলেন। মুসলিম সমস্যার সমাধানে তার নিজের বক্তব্য ছিল, ভারতের সমস্যাটা দুই। সম্প্রদায়ের মধ্যে নয়, দুই জাতির মধ্যে। তার মতে হিন্দু আর মুসলমানের দূরত্ব এতটাই বেশি যে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় দু’পক্ষকে একসঙ্গে আনতে গেলে খুব বড় ঝুঁকি নিতে হবে। তারা দুটি স্বতন্ত্র এবং পৃথক জাতি, তাই তাদের জন্য আলাদা আলাদা রাষ্ট্র তৈরি করে দেওয়াই সমাধানের একমাত্র পথ।।
কায়েদ-এ-আজম বলেছিলেন, “হিন্দু আর মুসলমানদের ধর্ম আলাদা, দর্শন আলাদা, সামাজিক রীতিনীতি আলাদা, সাহিত্য আলাদা। তাদের পরস্পর বিবাহের রীতি নেই, একসঙ্গে বসে খাওয়ার রীতি নেই। বস্তুত, এদের আছে দুটি আলাদা সভ্যতা, যা দাড়িয়ে আছে
২৪৩
পরস্পরবিরােধী ধ্যানধারণার ওপর। তাদের জীবনদর্শন এবং জীবনবােধ আলাদা। হিন্দু এবং মুসলমানরা ইতিহাসের বিভিন্ন অংশ থেকে নিজেদের প্রেরণা সংগ্রহ করে। তাদের মহাকাব্য আলাদা, ইতিহাসকাহিনি আলাদা, তারা আলাদা আলাদা নায়কের গুণমুগ্ধ। অনেক সময়েই এক পক্ষের কাছে যিনি নায়ক, অন্য পক্ষের কাছে তিনি শত্রু। স্বভাবতই, এক দলের কাছে যে ঘটনা জয়সূচক, অন্য দল তাকে পরাজয় মনে করে। এমন দুটি গােষ্ঠী নিয়ে যদি একটি রাষ্ট্র তৈরি হয়, যাদের একটি সংখ্যাগুরু, অন্যটি সংখ্যালঘু, তা হলে অসন্তোষ বাড়বেই এবং তার ফলে শেষ পর্যন্ত সেই রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র ভেঙে পড়বেই।”
তিনি আরও বললেন, “জাতি কথাটার যে কোনও সংজ্ঞা অনুসারে মুসলমানরা একটি জাতি। আমরা চাই, মুসলমান জাতি নিজস্ব আদর্শ, বিচারবুদ্ধি ও সামর্থ্য অনুসারে নিজেদের আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, এবং রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণতম বিকাশ সাধন করুক।”
এই ধারণাগুলির ভিত্তিতে বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ঐতিহাসিক প্রস্তাবটি পেশ করলেন। সেটিই লাহৌর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাব নামে পরিচিত হল।
এই প্রস্তাবে ঘােষণা করা হল, “ভৌগােলিক ভাবে পরস্পর সন্নিহিত এলাকাগুলিকে প্রয়ােজনীয় পরিমার্জন সাপেক্ষে নির্দিষ্ট করে না দিলে কোনও পরিকল্পনাই মুসলমানদের কাছে গ্রাহ্য হবে না। ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্ব অঞ্চলে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই এলাকাগুলি নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে, সেই রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলি হবে স্বশাসিত এবং সার্বভৌম।”
প্রস্তাবে আরও বলা হল, “সংখ্যালঘুদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অন্যান্য অধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে এবং অঙ্গরাজ্যে যথেষ্ট, তা কার্যকর এবং অবশ্যপালনীয় রক্ষাকবচ সংবিধানে রাখা হবে। সুতরাং মুসলমানরা যেখানে সংখ্যালঘু, সেখানে তাদের নিরাপত্তার বন্দোবস্ত করতে হবে।”
এই প্রস্তাবে অবিভক্ত ভারতের ধারণা নাকচ করা হল, এতে সুপারিশ করা হল যে উত্তরপশ্চিমে পঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (এন ডব্লিউ এফ পি), সিন্ধু ও বালুচিস্তান এবং উত্তর-পূর্বে বাংলা ও অসম নিয়ে একটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করা হােক। পঞ্জাবের মৌলানা জাফর আলি খান, এন ডব্লিউ এফ পি’র সর্দার আওরঙজেব, সিন্ধুর স্যর আবদুল্লা। হারুন এবং বালুচিস্তানের কাজী এমা সহ অনেকেই এই প্রস্তাব সমর্থন করলেন।
২৪ মার্চ প্রস্তাবটি অনুমােদিত হল। এতে কেবল নীতিগুলি নির্ধারিত হল, বলা হল যে খুঁটিনাটি ঠিক করা হবে পরে কোনও এক সময়ে। এই প্রস্তাবটি ১৯৪১-এ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ সংবিধানের একটি অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হল। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ১৯৪৬ সালে মুসলিম লিগ মুসলমানদের জন্য দুটির বদলে একটি রাষ্ট্রের দাবি জানানাের সিদ্ধান্ত নেয়।
পাকিস্তান প্রস্তাব পাশ করার মধ্য দিয়ে ভারতের মুসলমানরা তাদের লক্ষ্য পাল্টালেনহিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযােগিতার বদলে তারা যে পথে পাড়ি দিলেন তার শেষ ছিল ভারতের মুসলমানদের জন্য এক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র।
৭৫, ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান, ২ এপ্রিল, ১৯৪০
৭৬. চৌধুরী খালেকুজ্জামান, পাথওয়ে টু পাকিস্তান, পৃ. ২৫৫-২৫৬ ৭৭.সভাপতির ভাষণ, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ, দিল্লি অধিবেশন, ২৪ এপ্রিল, ১৯৪৩
২৪৪

Next