১২ই জুলাই ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
ভালই লাগে না, কি যে করব বুঝে উঠতে পারি না। মাথা ব্যথাটা এখন অনেক কমেছে। খবরের কাগজে পড়বার মতো কিছু থাকে না। একঘেয়ে সংবাদ। প্রেসিডেন্টে আইয়ুব কি বললেন, কি করবেন, কোথায় গেলেন, কার সাথে দেখা করলেন, দেশের উন্নতি, অগ্রগতি, গুদাম ভরা খাদ্য, অভাব নাই, বিরাট বিরাট প্রজেক্ট গ্রহণ করা হয়েছে, কাজ শুরু হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছু তথাকথিত মুসলিম লীগের নেতারা এক ঈমান, এক রাষ্ট্র, এক মুসলমান, এক দেশ,এক নেতা বলে সর্বক্ষন গলা ফাটাচ্ছে, আবার কেহ কেহ বাঙালি মুসলমানদের পাকিস্তানের উপর আনুগত্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেহ কেহ মুরব্বিয়ানাচালে দেশপ্রেমিকের সার্টিফিকেটও দিয়ে থাকেন। দুনিয়ায় নাকি পাকিস্তানের সম্মান এতো বেড়ে গেছে যে আসমান প্রায় ধরে ফেলেছে। নানা বেহুদা প্রশংসা, তবুও তাই পড়তে হবে। সময় যে কাটে না। ডন কাগজও দেখলাম, যদি পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো ভাল খবর পাওয়া যায় নাই! ঐ একই প্যামফ্লেট। আমার তো মনে হয় সরকার বিরাট প্ল্যান নিয়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত দেশে একদলীয় সরকার করতে চেষ্টা করবে। ভুল হবে এ চেষ্টা করলে। ভীষণ আত্মকলহ ও বিশৃঙ্খলা শুরু হবে কেহ তা দমাতে পারবে না। আমাদের রাজনীতিবিদরা অনেকে পিছনে পড়ে থাকবে। কারণ তালে তাল মিলায়ে চলতে পারবে না।
দুপুরে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম। কারণ মাথার ব্যথা যেন আর না হয়। একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, আধা ঘন্টার উপর হবে। উঠে আবার কাগজ নিয়ে পড়তে পড়তে সিকিউরিটি সিপাই এসে বলল, আপনার সাক্ষাৎ আছে, চলুন। বললাম, কে এসেছে। বলতে পারে না। ভাবলাম উকিল সাহেবরা এসেছেন। এডভোকেট রব সাহেব ও আবুল হোসেন সাহেব এসেছেন। তাঁদের সাথে আলাপ করতে করতে দেখি আরেকটা সাক্ষাৎ দিয়েছে আমার বেগমের সাথে। রব সাহেবকে বললাম, হাইকোর্টে রীট পিটিশন করতে – কেন মোশতাক, তাজউদ্দীন, নূরুল ইসলাম ও অন্যান্য নেতাদের মফস্বল জেলে আলাদা আলাদা করে রেখেছে? আর আমাকে কোন আইনের বলে Solitary confinement-এ রাখা হয়েছে! জেল আইনে দু’মাসের বেশি কাউকেও রাখতে পারে না। একাকী এক জায়গায় রাখা উচিৎ না। রব সাহেব আইন দেখে রীট পিটিশন করবেন বললেন। তারপরই আমার বেগম ও বাচ্চারা এল। হঠাত দেখা পাওয়ার অনুমতি পেল কি করে! রব সাহেব চলে গেলেন।
আমি কিছু সময় বাচ্চাদের সাথে আলাপ করলাম। মা’কে আব্বা খুলনা থেকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছেন। অনেকটা ভাল এখন, তবে আপাততঃ ঢাকা আসবে না। রেণু বলল, কামাল খুব লেখাপড়া আরম্ভ করেছে। আগামীবারে ম্যাট্রিক দিবে সকলকে মন দিয়ে পড়তে বলে বিদায় নিলাম। বেশি সময় কথা বলার উপায় নাই – ছোট্ট কামরা জেল অফিসের, বিজলি পাখা বন্ধ। ছোট্ট বাচ্চাটা গরমে কষ্ট পাচ্ছে। ছোট মেয়েটা স্কুল থেকে এসেছে। বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলে গেটে দাঁড়াইয়া ওদের বিদায় দিলাম। গেট পার হয়েও রাসেল হাত তুলে আমার কাছ থেকে বিদায় নিল। বোধহয় বুঝে গিয়েছে এটা ওর বাবার বাড়ি, জীবনভর এখানেই থাকবে!
অনেক খাবার নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যায় কিছু কিছু বন্ধুবান্ধবদের দিলাম। আবার রাতেও খাবার সময় আশে পাশে কিছু দিলাম, কারন নষ্ট হয়ে যাবে।
রাতে আমার আব্বাকে স্বপ্নে দেখে জেগে উঠলাম। আব্বার চেহারা মলিন হয়ে গেছে বলে মনে হলো। ভোর রাতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আবারও স্বপ্নে দেখি নবাবজাদা নছরুল্লাহ খানকে। অনেক বুড়ে হয়ে গেছেন, দাঁড়ি পেকে গেছে। আর কিছুই আমার মনে নাই। উঠতে অনেক দেরি হলো ঘুম থেকে।
১৩ই জুলাই ১৯৬৬ ।। বুধবার
একই সমস্যা একই সমাধান, গুলি করা। ভারতবর্ষে বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালাইয়া আটজনকে হত্যা করেছে। কয়েকশত লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। জনসাধারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে বামপন্থী দলগুলির ডাকে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে যেয়ে গুলি খেয়ে জীবন দিল। শত শত কর্মী গ্রেপ্তার হলো। কংগ্রেস নেতারা সারাজীবন জেল খেটেছিলেন। গুলির আঘাত নিজেরাও সহ্য করেছেন। আজ স্বাধীনতা পাওয়ার পরে তারাই আবার জনগণের উপর গুলি করতে একটুও কার্পণ্য করেন না। আমরা দুইটা রাষ্ট্র পাশাপাশি। অত্যাচার আর গুলি করতে কেহ কাহারও চেয়ে কম নয়। গুলি করে গ্রেপ্তার করে সমস্যার সমাধান হবে না। ভারতের উচিৎ ছিল গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা স্থায়ী শান্তি চুক্তি করে নেওয়া। তখন পাকিস্তান ও ভারত সামরিক খাতে অর্থ ব্যয় না করে দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারত। দুই দেশের জনগণও উপকৃত হত। ভারত যখন গণতন্ত্রের পূজারি বলে নিজেকে মনে করে তখন কাশ্মীরের জনগণের মতামত নিতে কেন আপত্তি করছে? এতে একদিন দুইটি দেশই এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হতে বাধ্য হবে।
রাশিয়া উত্তর ভিয়েতনাম সরকারকে সামরিক সাহায্য প্রেরণের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাশিয়া পূর্ব থেকেই অনেক সাহায্য দিয়াছে। আমেরিকানরা যতই নিজকে শক্তিশালী মনে করুণ, রাশিয়া যখন হ্যানয় সরকারকে সাহায্য করতে আরম্ভ করেছে তখন যুদ্ধে জয়লাভ কখনই করতে পারবে না। এর পরিণতিও ভয়াবহ হবে। একমাত্র সমাধান হলো তাঁদের ভিয়েতনাম থেকে চলে আসা। ভিয়েতনামে জনসাধারণ নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নিবে।
২৫শে আগস্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা হতে জনাব শোয়েব বিদায় গ্রহণ করে বিশ্বব্যাংকের চাকরি গ্রহণ করবেন। শেষ পর্যন্ত শোয়েব সাহেবকেও যেতে হলো। ভুট্টো সাহেবকে তাড়ানোয় চীনা লবীর লোকেরা খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। নিশ্চয়ই আমেরিকানদের চাপে তাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। শোয়েব সাহেবকে তাড়াইয়া দেখালেন যে আমেরিকানদেরও প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ধার ধারেন না। তাই আমেরিকা লবীর নেতা শোয়েবকেও তাড়াইলেন। এটা শোয়েবের সাথে পরামর্শ করেই করা হয়েছে বলে মনে হয় – জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। তাকে জায়গা মতোই পাঠান হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা। মনে হয় চাকরী পাকাপাকিই ছিল। আমেরিকানদের দালালি করেছেন মন প্রাণ দিয়ে। পাকিস্তানকে বন্ধক দিয়েছেন তাঁর একটু প্রতিদান তো জনাব শোয়েব পাবেনই!
সকালেই খবর পেলাম চটকল শ্রমিক ফেডারেশন সেক্রেটারি জনাব মান্নান জামিন পেয়েছে। আজই চলে যাবে, আমার সামনেই বিশ সেলে ছিল, সাধারণ কয়েদি করে রাখা হয়েছিল। রাতে ও মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতো। শুনতাম রাতভর জেগে বসে থাকত। ডিপিআর অস্ত্র নিক্ষেপ করে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখতেও পারতো। যাহা হউক, শেষ পর্যন্ত যেতে দিয়েছে। এত কষ্ট করার পরও মান্নানের মুখে হাসি দেখেছি। মোটেই ভয় পায় নাই। তাঁর উপর আমার বিশ্বাস আছে – শ্রমিকদের স্বার্থ বিসর্জন সে দিবে না, তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের মতো।
আজ বিকালে পাবনার রামললিতকে ঢাকা জেল থেকে অন্যত্র পাঠাইয়া দিয়েছে। বিকালে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। আমি বারান্দায়ই পায়চারী করতেছিলাম। বৃষ্টি কিছু কম হয়েছে, দেখা গেল রণেশ বাবু যেতেছেন। তাকে আদাব করে বিদায় দিলাম, আর বললাম, ‘যদি পাবনা জেলে যান তবে বন্ধু মোশতাককে বলবেন, চিন্তা না করতে। আমাদের ত্যাগ বৃথা যাবে না’।
জমাদার সাহেব তালাবদ্ধ করতে এলেন। বৃষ্টির দিন তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দিয়ে বিদায় হলেন।
১৪ই জুলাই ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
১৭৮৯ সালের ১২ই জুলাই ফরাসি দেশে শুরু হয় বিপ্লব। প্যারি নগরীর জনসাধারণ সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার পতাকা হাতে সামনে এগিয়ে যায় এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা করে। ১৪ই জুলাই বাস্তিল কারাগার ভেঙে রাজবন্দিদের মুক্ত করে এবং রাজতন্ত্র ধ্বংস করে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। ১৭৭ বৎসর পরেও এই দিনটি শুধু ফ্রান্সের জনসাধারণই শ্রদ্ধার সাথে উদযাপন করে না, দুনিয়ার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী জনসাধারণও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে।
তাই কারাগারের এই নির্জন কুঠিতে বসে আমি সালামজানাই সেই আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের, যারা প্যারি শহরে গণতন্ত্রের পতাকা উড়িয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ দুনিয়ার মুক্তিকামী জনসাধারণ এই দিনটার কথা কোনোদিনই ভুলতে পারে না।
গতকাল পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের পূর্ণ বেঞ্চ পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধি বলে অনেক ব্যাক্তির ২২টা রীট আবেদন বাতিল করে দেন। দেশরক্ষা বিধি বলে নিম্নলিখিত নেতৃবৃন্দকে আটক রাখা হয়েছে। কতকাল এঁদের রাখবে কে জানে?
১। মিয়া মানজার বশীর, ২। খাজা সিদ্দিকুল হাসান, ৩। চৌধুরী কলিমুদ্দিন, ৪। মহম্মদ ইসমাইল, ৫। সিকান্দার হায়াত, ৬। সরদার মহম্মদ জাফরুল্লা, ৭। নাওয়াবজাদা নসরুল্লাহ, ৮। মালিক গোলাম জিলানী, ৯। খাজা মহম্মদ রফিক, ১০। সরদার শওকত হায়াত, ১১। খাজা আহম্মদ সাফদার, ১২। চৌধুরী মহম্মদ হোসেন, ১৩। আবু সাঈদ এনতার, ১৪। সৈয়দ মকসুদ, ১৫। জনাব আবদুল আজিজ, ১৬। খলিফা শাহনেওয়াজ, ১৭। মাহবুব মোস্তফা, ১৮। কমর ইদরিস, ১৯। সালাউদ্দিন শেখ, ২০। হেলাল আহম্মদ শেখ এবং ২১। মাহমুদ আহমেদ সিন্ধী।
আজ ঢাকা জেলের ডিআইজি সাহেব কয়েদিদের দেখতে ভিতরে এসেছিলেন। আমাকেও দেখতে এসেছিলেন, কিছু সময় বসেছিলেনও। ধর্মকথা আলোচনা করলেন। বললাম, ইসলামের কথা আলোচনা করে কি লাভ? পাকিস্তানের নামতো ইসলামিক রিপাবলিক রাখা হয়েছে। দেখুন না ‘ইসলামের’ আদর্শ চারিদিকে কায়েমের ধাক্কায় ঘুষ, অত্যাচার, জুলুম, বেঈনসাফি, মিথ্যাচার, শোষণ এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে যারা আল্লায় বিশ্বাস করে না, তারাও নিশ্চয়ই হাসবে আমাদের অবস্থা দেখে।। দেখুন না রাশিয়ায় যেখানে ধর্ম বিশ্বাস করে না সেখানে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেষ্টা করছে, ঘুষ, শোষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষের বাঁচবার অধিকার স্বীকার করেছে।
গ্রেট বৃটেনে দেখুন, ন্যায়ের রাজ্য কায়েম করেছে। বেকার থাকলে সরকার থেকে ভাতা দেওয়া হয় – যে পর্যন্ত কাজের বন্দোবস্ত না করতে পারে। বৃদ্ধ অথবা অচল হয়ে পড়লেও পেনশন দেওয়া হয়। চিকিৎসার এবং ঔষধের জন্য এক পয়সাও খরচ করতে হয় না। বাচ্চা হলে দুধ খাওয়ার জন্য সরকার অর্থ দিয়ে সাহায্য করে, যাতে শিশু দুর্বল হয়ে না পড়ে। অন্যায়ভাবে কাহাকেও কারাগারে বন্দি করতে পারে না।
ডিআইজি সাহেব খুব ধর্মভীরু, বেশি সময় তিনিই বলেন, আমি শুনি। মাঝে মাঝে দুই এক কথা আমি বলি।
১৫ই জুলাই ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
কি ব্যাপার, আমি যে ঘরে থাকি তা মাপামাপি করছে কেন? চল্লিশ ফুট লম্বা, চারফুট চওড়া, কয়টা জানালা, কয়টা দরজা সব কিছু লিখে নিতেছে জমাদার সাহেব। বললাম, ব্যাপার কি? সরকার জানতে চেয়েছে? আরও একটু লিখে নেন না কেন, দক্ষিণ দিকে ছয়টা জানলা, কিন্তু তাঁর এক হাত দূরে চৌদ্দ ফুট উঁচু দেওয়াল, বাতাস শত চেষ্টা করেও ঢুকতে পারে না আমার ঘরে। জানলা নিচে, দেওয়াল খুব উঁচু। উত্তর হলো, ও সব লেখা চলবে না। লেখুন না আর একটু – দেওয়ালের অন্য দিকে গরুর ঘর, পূর্বদিকে পনের ফিট দেওয়াল ও নূতন বিশ। ভয়ানক প্রকৃতির লোক-যারা জেল ভেঙে দুই একবার পালাইয়াছে তাঁদের রেখেছিল এখানে। আর উত্তর দিকে ৪০ সেল, সেখানে ৪০ পাগলকে রেখেছে। আর পশ্চিম দিকে একটু দূরেই ৬ সেল ও ৭ সেল, যেখানে সরকার একরারী আসামি রেখেছেন। আর এরই মধ্যে ‘শেখ সাহেব’। তিনি বললেন ‘ও বাত হামলোক নেহী লেখতে ছাকতা হায়, নকরি নেহি রহে গাঁ’।
আধাঘন্টা পর দেখি সিভিল সার্জন সাহেব জেল ডাক্তার নিয়ে এসেছেন। আমার কি কি রোগ হয়েছে দেখার জন্য। বললাম, ভালই আছি। পাইলস হয়েছে, কিছু কষ্ট দেয়। পেটটা মাঝে মাঝে খারাপ হয়। আমাশা আছে। ঘুম একটু কম হয়। বসে থেকে মোটা হয়ে নিষ্কর্মা হয়ে যাবো আর কি! ওজন দেখলেন। ভাঙা একটা মেশিনে, সাত পাউন্ড নাকি বেড়েছে। ভালই, ভুড়ি হতে আর বেশি দেরি হবে না। যাহোক ভদ্রলোক চলে গেলেন।
ভাবলাম ‘সরকারও বোধহয় আমার স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল’। অথবা হাইকোর্ট বলতে হবে যে, দেখ কি ভালভাবে ‘শেখ সাহেব’কে রেখেছি আমরা। কোনো কষ্ট দিচ্ছি না। আমাকে যে একলা এক জায়গায় কারও সাথে কথা বলতে বা দেখা করতে দেওয়া হয় না, সে কথা বোধ হয় চাপা দিবারই চেষ্টা করবেন। আজকালকার দিনে সত্য কথা একটু কমই বলা হয়। ওটা নাকি, ‘নয়া ডিকটেটোরিয়াল রাষ্ট্রবিজ্ঞান’।
আজ সকালে আওয়ামী লীগের অফিস সেক্রেটারি মোহাম্মদউল্লাহ এডভোকেট সাহেবকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। ১০ সেলেই রেখেছে। ভদ্রলোক শুধু অফিসের কাজকর্ম দেখেন। কোনোদিন জীবনে একটা বক্তৃতাও করেন নাই, কোনো সভা সমিতিতে বেশি যেতেন না, কোনোদিন মফস্বলে যান নাই, সভা করতে। আজ ১৫ বৎসর নীরবে অফিসের কাজকর্ম করে থাকেন। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবকে যখন গ্রেপ্তার করেচে তখন আওয়ামী লীগের কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। মোহাম্মদ উল্লাহ সাহেবের ছেলেমেয়েদের খুব কষ্ট হবে, কারণ অর্থাভাব কিছুটা আছে, উপার্জন না করলে চলে না। বড় নিরীহ ভদ্রলোক, কোনোদিন কিছু দাবি করে নাই, একবার জাতীয় পরিষদের সদস্য পদের জন্য নমিনেশন দেওয়া হয়েছিল মাত্র ১২ ভোটে পরাজিত হয়। কয়েক বৎসর পূর্বে যক্ষা রোগে ভুগে, ভাল হয়ে গিয়েছিলেন। জেনে এসে আবার আক্রান্ত না হয়! একই কারাগারে থেকেও আমার সাথে দেখা হওয়ায় উপায় নাই।
আজ দূর থেকে তিনজনের মুখ দেখলাম হাসপাতালে। হাফেজ মুছা, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী ও রাশেদ মোশাররফ হাসপাতালে এসেছে অসুস্থ হয়ে। আমার এখান থেকে হাসপাতালের দোতলায় দাড়ালে চেহারাটা দেখা যায়। তবে অনেক দূর, চিৎকার করে বললেও কথা শুনবে না।
১৬ই জুলাই ১৯৬৬ ।। শনিবার
১৯৬৬-৬৭ সালের নয়া আমদানী নীতি পড়লাম, বোঝা গেল প্রতিযোগিতায় ক্ষুদ্র আমদানিকারকগন টিকে থাকতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানিরা যাও দুই একজন কিছু কিছু আমদানি করত, তারাও শেষ হয়ে যেতে বাধ্য হবে।
বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ অবাধ আমদানি নীতির এই সুযোগে তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকসমূহের সহায়তা যথেষ্ট পরিমাণ আমদানী করে বাজার থেকে ক্ষুদ্র আমদানিকারকগনকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হবে। একচেটিয়া পুঁজিবাদী সৃষ্টি করার আর একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার ক্ষুদ্র শিল্পপতিরাও এবার চরম আঘাত খেতে বাধ্য হবে। কারণ বোনাস ভাউচার দিয়ে আমদানি করে পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্পপতিদের সাথে প্রতিযোগিতায় না পেরে তাঁদের কাছেই বিক্রি করতে বাধ্য হবে তাঁদের শিল্পগুলি। জেলের মধ্যে বসে একথা চিন্তা করে লাভ কি? যার সারাটা শরীরে ঘা, তাঁর আবার ব্যথা কিসের! গোলামের জাত গোলামি কর। আমি কারাগারে আমার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ‘আরামেই’ আছি! ভয় নাই, মাহমুদ আলি, জাকির হোসেন, মোনায়েম খান, আব্দুস সবুর খান, মহম্মদ আলী এরকম অনেকেই বাংলার মাটিতে পূর্বেও জন্মেছে, ভবিষ্যতে জন্মাবে।
দুপুর বেলা কাগজ পড়ছি। হঠাত হৈ চৈ করছে কয়েদিরা। কান খাড়া করে শুনলাম। কোর্টের ভিতর ঢাকা গ্যাং ডাকাতি মামলার ১০০ জনের মতো আসামির উপর ঘর বন্ধ করে টিয়ার গ্যাস মেরেছে। কয়েকজনের অবস্থা ভাল না। জেলগেট থেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়াছে। আমার কাছেই আসামী একজন থাকে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছিল? সে কোর্ট থেকে এসেছে। বলল, ‘সাত-আট বৎসর আমরা হাজতে। বিচার হয় না। মাঝে মাঝে কোর্টে নিয়ে যায়, আর ফিরিয়ে আনে। সিআইডিরা ইচ্ছা করেই দেরি করায়। একরারীদের উপর নির্ভর করে এই মামলা। তাড়া ইচ্ছেমত কোর্টে যায়। আবার ইচ্ছে হলো না, সিআইডির পরামর্শে অসুস্থ হয়ে পরে। সাত-আট বৎসর হাজতে। আমাদের কি আর আছে! বাড়ি ঘর আত্মীয় পরিজন কিছুই তো নাই। যারা ছিল, না খেয়ে মরে গেছে বা কোথাও ভিক্ষা করে খেতেছে। আসামীদের পক্ষ থেকে হাকিমকে জানালো, ‘স্যার আমাদের বিচার করুণ। এখনও নিম্ন কোর্টে, এরপর হবে জজকোর্টে। কারণ ডাকাতি ও খুনী মামলার আসামিই বেশি। গ্যাং কেস আন্তঃজেলা মামলা।
হাকিম সাহেবও নাকি সিআইডির উপর রাহ করেছে কয়েকবার। আজ যখন কোর্টে নিয়ে বলেছে, আজ মামলা হবে না, একরারী কোর্টে আসে নাই – তখনই এঁরা প্রতিবাদ করে বলেছে, ‘আমাদের এখানেই রেখে দিন আমরা আর জেলে যাবো না। আর যায় কোথা! গ্যাস পার্টি এনে এঁরা কোর্টে যেখানে জালের বেড়ার মধ্যে ছিল সেখানে টিয়ার গ্যাস ছেড়ে দিল। কোনো দয়া মায়া নাই। বাকি মানুষ পালাবার পথ পায় নাই। অনেকে চক্ষু মেলতেই পারে না। অনেকে বমি করতে করতে বেহুঁশ হয়ে গেছে। ছয় জনের অবস্থা নাকি খারাপ। জেল হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ইনসাফ কি এদেশ থেকে একেবারেই উঠে গেল? যাহার যাহা ইচ্ছা তাহাই করে। কিছু কিছু কর্মচারী এতো বেড়ে গেছে, মনে করে, যা ইচ্ছা করতে পারে। শুধু লাট সাহেবকে খুশি রাখতে হবে। ফলাফল যে শুভ হবে না সে বুঝি! তবে পাকিস্তানকে এঁরা কোথায় নিয়ে চলেছে! ভাবলাম সাত-আট বৎসর যদি একটা মামলা চলে তারপরে যদি শাস্তি হয় তবে অবস্থা কি হয়! ভুগতেই হবে তোমাদের। তোমরা যে ‘স্বাধীন দেশের নাগরিক’! ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ তোমাদের রাষ্ট্র! ভুগতেই হবে তোমাদের ‘দেশের খাতিরে’। ইহকালে কষ্ট করলে কি হবে, পরকালে অনেক কিছু পাবা। হুরপরি, চিন্তা নাই।
মুড়ি খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে কারাগারে। কাঁচা মরিচ, পিঁয়াজ, আদা, আর সরিষার তৈল দিয়ে একবার মাখালে যে কি মজা তাহা আমি তো প্রকাশ করতে পারিনা। আমার না খেলে চলে না। সিপাহি জমাদার সাহেবরা যাদের ডিউটি পড়ে তারা মেটকে বলে চুপি চুপি মুড়ি খেয়ে নেয়। যদি বড় সাহেবরা দেখে! আমি দেখেও দেখি না, কারণ মেটকে বলে দিয়েছি মুড়ি চাইলে ‘না’ বলবা না।
আমি মুড়ি খেতে বসলেই আমার নেতা শহীদ সাহেবের কথা মনে পড়ে। আর তুমি কোথায়? তোমার মানিক মিয়া, মুজিব ও কর্মীরা কারাগারে বন্দি, অন্যায়ভাবে জুলুম চলছে চারিদিকে, হাহাকার করছে দেশের লোকেরা। তোমার হাতে গড়া ইত্তেফাক আজ বন্ধ। পাকিস্তান আজ এতিম। জানি তোমার দোয়া আছে আমাদের উপরে। জয় জনগণের হবে, কিন্তু জনগন তোমার সেবা পাবে না।
১৭ই জুলাই ১৯৬৬ ।। রবিবার
বাদলা ঘাসগুলি আমার দুর্বার বাগানটা নষ্ট করে দিতেছে। কত যে তুলে ফেললাম। তুলেও শেষ করতে পারছিনা। আমিও নাছোড়বান্দা। আজ আবার কয়েকজন কয়েদি নিয়ে বাদলা ঘাস ধ্বংসের অভিযান শুরু করলাম। অনেক তুললাম আজ। কয়েদিরা আজ তাঁদের কাপড় পরিষ্কার করবে। বেশি সময় রাখা যায় না, তাই তাড়া চলে গেল। আমি কিছু সময় আরও কাজ করলাম ফুলের বাগানে। তারপর পাইপ নিয়ে বই নিয়ে বসে পড়লাম। ভুঁড়ি হতে চলেছে আমার বসে থাকতে থাকতে। ভীষণ খারাপ লাগে ভুঁড়ি হলে। ব্যায়াম করবার উপায় নাই, হাটুতে বেদনা। বিকালে হাঁটাচলা করি, একলা কত সময় হাঁটা যায়! ভাল লাগে না, তাই আবার চুপ করে বসে থাকি।
খবর এল আওয়ামী লীগের আর এক নেতাকে নিয়ে এসেছে ধরে। বলল, জালাল সাহেব। বুঝতে বাকি রইল না মোল্লা জালালউদ্দিন, এডভোকেট। ঢাকার প্রায় সকলকেই আনা হয়েছে, জালালই প্রতিষ্ঠানের একটিং সেক্রেটারীর ভার নিবে। ওকেই সেক্রেটারী করার কথা আমি বলেছিলাম। অফিসটা বোধহয় বন্ধ করতেই চায়। কেই বা চালাবে, সকলকেই তো গ্রেপ্তার করেছে। কয়েকজন তো এবডো হয়ে রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হতে পারবেন না। কর্মীদের অবস্থা কি হবে, কে চালাবে! টাকা কোথায় পাবে?
সরকার পিছন দরজা দিয়ে বন্ধ করতে চায়। লাভ হবে না। সকলকে এক সাথে আনছে না, এক একজন করে নিয়ে আসছে। সব কয়জন সেক্রেটারীকে নিয়ে এসেছে, এখন একমাত্র মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগম আছে। জেলখাটা ও কষ্টকরা শিখতে দেও, এতে কর্মীদের মধ্যে ত্যাগের প্রেরণা জাগবে। ত্যাগই তো দরকার। ত্যাগের ভিতর দিয়েই জনগণের মুক্তি আসবে। জালালকে ১০ সেলে রাখা হয়েছে। দেখা হবার উপায় নাই আমার সাথে। এখন আর আমাকে আঘাত করতে পারে না। চঞ্চলও আমি হই না। আমার কতগুলি বইপত্র আইবি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s Digest, টাইমস, নিউজউইক এবং ‘রাশিয়ার চিঠি’, কোনো বইই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই। নভেল পড়তে দেয়। প্রেমের গল্প যত পারো পড়ো। একজন রাজনীতিক এগুলি পড়ে সময় নষ্ট করে কি করে! কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তাঁর কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারবা না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে তাড়া সকলেই মহাজ্ঞানী ও গুনী!
আজ আমি বাবুর্চিগিরি করেছি। কলিজা দিয়েছিল, পাকাতে হবে। আমি ও বাবুর্চি দুইজনই প্রায় সমান। ‘কেহ কারে নাহি পারে সমানে সমানে’। তবু ধারণা করে নিয়ে পাকালাম, মনে হলো মন্দ হয় নাই। খাইলাম কিছুটা। এক একটা মূল্যবান দিন চলে যেতেছে জীবনের। কোনো কাজেই লাগছে না। কারাগারে বসে দিনগুলি কাটাইয়া দিতেছি।
১৮ই জুলাই ১৯৬৬ ।। সোমবার
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রায় সকলেই কারাগারে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হতেছে। নরসিংদী আওয়ামী লীগের দুইজন কর্মীকেও গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। কাহাকেও আর বাইরে রাখবে না। তবুও দেখে আনন্দই হলো যে, ২৩ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করেছে। কাজ করে যেতে হবে। ৬ দফা দাবির সাথে কোনো আপোষ হবে না। আমাদেরও রাজনীতির এই শেষ। কোনো কিছুই আওয়ামী লীগ কর্মীরা চায় না। তাড়া শুধু চায় জনগন তাঁদের অধিকার আদায় করুক।
ন্যাপের সভাপতি নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সব দলকে এক করতে চান, আজ তাঁদের সভায় বলেছেন। নিম্নতম কর্মসূচি দিয়ে চুপচাপ তাহার নতুন বাড়ি বিন্নাচর গ্রামে যেয়ে বসে থাকলেই দেশ উদ্ধার হয়ে যাবে! সোহরাওয়ার্দী সাহেব যখন আওয়ামী লীগ শুরু করেন সেই সময় হতে এই ভদ্রলোক বহু খেলা দেখাইছেন। মিস জিন্নাহর ইলেকশন ও অন্যান্য আন্দোলনকে তিনি আইয়ুব সরকারকে সমর্থন করার জন্য বানচাল করতে চেষ্টা করেছেন পিছন থেকে। তাকে বিশ্বাস করা পূর্ব বাংলার জনগণের আর উচিৎ হবে না। এখন আর তিনি দেশের কথা ভাবেন না। ‘আন্তর্জাতিক’ হয়ে গেছেন। মাঝে মাঝে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার কাছে টেলিগ্রাম পাঠান আর কাগজে বিবৃতি দেন। বিরাট নেতা কিনা? ‘আফ্রো-এশীয় ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের মজলুম জননেতা’। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাঁচুক আর মরুক তাতে তাঁর কি আসে যায়! আইয়ুব সাহেব আর একটা ডেলিগেশনের নেতা করে পাঠালে খুশি হবেন। বোধহয় সেই চেষ্টায় আছেন।
নূরুল আমীন সাহেব সকল দলকে ডাকবেন একটা যুক্তফ্রন্ট করার জন্য। ৬ দফা মেনে নিলে কারও সাথে মিলতে আওয়ামী লীগের আপত্তি নাই। মানুষকে আমি ধোঁকা দিতে চাই না। আদর্শে মিল না থাকলে ভবিষ্যতে আবার নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ দেখা দিতে বাধ্য। সেদিকটা গভীরভাবে ভাবতে হবে। আইয়ুব সরকারের হাত থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা আনতে হলে আদর্শের সাথে যেদের মিল নাই তাঁদের সাথে এক হয়ে গোঁজামিল দিয়ে থাকা সম্ভবপর হতে পারে না। এতে আইয়ুব সাহেবের ক্ষতি কিছু করা গেলেও জনগণের দাবি আদায় হবে না। এত অত্যাচার করেও আন্দোলন দমাতে পারে নাই এবং পারবেও না। এখন যারা আবারও যুক্তফ্রন্ট করতে এগিয়ে আসছেন তাড়া জনগণকে ভাওতা দিতে চান। যারা আন্দোলনের সময় এগিয়ে আসে নাই তাঁদের সাথে আওয়ামী লীগ এক হয়ে কাজ করতে পারে না। কারণ এতে উপকার থেকে অপকার হবে বেশি। কোনো নিম্নতম কর্মসূচির কথা উঠতেই পারে না। নিম্নতম কর্মসূচি হলো ছয় দফা। শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ঠিক না হলে কোনো দাবিই আদায় হতে পারে না। পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো পূর্বে ঠিক হওয়া দরকার। লোহার শিকগুলি ও দেওয়ালগুলি বাঁধা দেয় সন্ধ্যায় পূর্বে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ দেখতে। বাইরে যখন ছিলাম খোলা আকাশ দেখার সময় আমার ছিলনা। ইচ্ছাও বেশি হয় নাই। কারণ কাজের ভিতর নিজকে ডুবাইয়া রাখতাম।
১৯ই জুলাই ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
আমীর মোহাম্মদ খান, পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর – ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত ও মানিক মিয়া সাহেবের গ্রেপ্তারের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে একটা সন্তোষজনক মীমাংসা করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। গতকালই আলাপ হওয়ার কথা ছিল। কি যে হয়েছে জানি না। সমস্ত সময়ই একই চিন্তা আমাকে পীড়া দিতেছিল। এই জংলী আইন দিয়ে যদি এঁরা দেশ শাসন করতে থাকে, তবে ফলাফল কি হবে তা বলা কষ্টকর। একজনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কোনো কারণ না দর্শাইয়া বাজেয়াপ্ত করা, একজন শ্রেষ্ট সম্পাদক ও কাগজের মালিককে বিনা অপরাধে, বিনা বিচারে কারা প্রাচীরের অন্তরালে নিক্ষেপ করা, কি জঘন্য প্রকৃতির কাজ হতে পারে তাহা চিন্তা করতেও ভয় পায় বলে মনে হয় না। কোনো খবরই আমরা পাইতেছি না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান করাচি থেকে রাওয়ালপিন্ডি গিয়াছেন। নবাব আমীর মোহাম্মদ খানও ওখানেই আছেন। কিছু একটা হবে বলে সকলেই আশা করছেন। নিশ্চয়ই মোনায়েম খান সাহেব বাঁধা দিবেন। হাইকোর্টেও মানিক ভাইয়ের রীট আবেদন চলছে। রায় স্থগিত রাখা হয়েছে। আমাদের জেলখানায় কিভাবে কাটছে ভুক্তভোগীই বুঝতে পারবেন। যাহা কিছু একটা ফয়সালা হয়ে গেলে আমরাও নিশ্চিন্ত হই।
মওলানা ভাসানী সাহেব হঠাত সুস্থ হয়ে ঢাকায় এসেছেন এবং সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘৬ দফা সমর্থন করে না। তবে স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করেন’। কারণ, তাঁর পার্টির জন্ম হয় স্বায়ত্তশাসনের দাবির মাধ্যমে। কাগমারি সম্মেলনের কথাও তিনি তুলেছেন। তিনি নাকি দেখে সুখী হয়েছেন যে, ‘একসময়ে যারা স্বায়ত্তশাসনের দাবি করবার জন্য তাঁর বিরোধিতা করেছেন তারাই আজকাল স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলেছে’। মওলানা সাহেব বোধহয় ভুলে গিয়াছেন, ভুলবার যদিও কোনো কারণ নাই, সামান্য কিছুদিন হলো ঘটনাটা ঘটেছে। খবরের কাগজগুলি আজও আছে। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কর্মীরা আজও বেঁচে আছে। তাড়া জানে, বিরোধ ও গোলমাল হয় বৈদেশিক নীতি নিয়ে। সে গোলমালও মিটমাট হয়ে গিয়েছিল সম্মেলনের পূর্বের রাতে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ। মওলানা সাহেবই সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সমর্থন করে ওয়ার্কিং কমিটিতে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগের ১২ জন সদস্য কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে আছে, শহীদ সাহেবকে নিয়ে ৮০ জন সদস্যের মধ্যে। ১২ জনের নেতা প্রধানমন্ত্রী, কেমন করে বৈদেশিক নীতি পরিবর্তন করা সম্ভবপর হবে। শহীদ সাহেব যখন যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন করে দিয়েছেন, ব্যক্তি স্বাধীনতা জনগণকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এবং চেষ্টা করেছেন তাড়াতাড়ি সাধারণ নির্বাচন দিতে তখন আমরা বৈদেশিক নীতি নিয়ে আর হৈচৈ করবো না-যে পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচন না হয়’। ওয়ার্কিং কমিটিকে তিনি বলেছিলেন, ‘পার্লামেন্টারী পার্টির হাতে ক্ষমতা দিতে। বৈদেশিক নীতি বিষয়ে পার্লামেন্টারী পার্টি যাহা ভাল মনে করে, করবেন’। সম্মেলন শান্তিপূর্ণভাবে হয়ে যাওয়ার পরে মওলানা সাহেব খবরের কাগজে অসত্য বিবৃতি দিয়েছিলেন যে, ‘বৈদেশিক নীতির প্রস্তাব পাশ হয়েছে এবং ভাসানীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে’। বৈদেশিক নীতির উপরে কোনো প্রস্তাবই নেওয়া হয় নাই, আর হবে না বলেও ঠিক করা হয়েছিল। মওলানা সাহেব জানতেন, কাউন্সিল সভায় তাঁর কোনো প্রস্তাবই পাশ হবে না। কারণ, সদস্যগণ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে শ্রদ্ধা করতেন এবং সমর্থন করতেন। কয়েক মাস পরে ঢাকার নিউ পিকচার্স হাউস ও গুলিস্তান সিনেমা হলের সম্মেলনে ভাসানী সাহেব মাত্র ৪৩ ভোট পেয়েছিলেন ৮৩৪ ভোটের মধ্যে। সেখানে স্বায়ত্তশাসনের কোনো কথাই ওঠে নাই। কারণ, আওয়ামী লীগের যেদিন জন্ম হয় সেইদিন থেকেই স্বায়ত্তশাসনের বিষয় নিয়ে সংগ্রাম করছে। মওলানা সাহেব বোধহয় ভুলে গেছেন যে, ১৯৫৫-৫৬ সালে পার্লামেন্টে যখন শাসনতন্ত্র তৈয়ার হয়, তখন স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব করে আওয়ামী লীগ প্রত্যেক দফায় সংগ্রাম করেছিল। এখনও কেন্দ্রীয় আইন সভার রেকর্ড থেকে তা পাওয়া যাবে। আর আমার কাছেও সেগুলি আছে। এমনকি জনাব আবুল মনসুর আহমদ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমরা দুইটা দেশ; কিন্তু একটা জাতি তৈয়ার করতে হবে’ (বাকি কথাগুলি আমার ঠিক মনে নাই)। সেইজন্যই পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। এইরকম শত শত এমেন্ডমেন্ট আবুল মনসুর আহমদ সাহেব, জহিরুদ্দিন, দেলদার সাহেব, খালেক সাহেব, আমি ও আরও অনেকে দিয়েছিলাম। স্বায়ত্তশাসন না দেওয়ায় সোহরাওয়ার্দী সাহেবসহ আমরা সকলে ওয়াক আউট করেছিলাম।
আওয়ামী লীগ ভেঙে যখন ন্যাপ করা হলো, তখন বোইদেশিক নীতির উপরই হয়েছিল বলে এতদিন মওলানা সাহেব বলতেন, এবার নতুন কথা শুনলাম। কিছুদিন বেঁচে থাকলে অনেক নতুন কথাই তিনি শোনাবেন। যেমন, তিনি কোনোদিনই মওলানা পাশ করেন নাই তবুও মওলানা সাহেব না বললে বেজার হন।
ন্যাপ কেন হয়েছিল? আদর্শের জন্য নয়। মওলানা সাহেবের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা খুব বেশি। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারেন নাই এবং তাঁর মধ্যে এতো ঈর্ষা দেখা দেয় যে, গোপনে ইস্কান্দার মির্জার সাথে হাত মিলাতেও তাঁর বিবেকে বাধে নাই। তিনি মির্জা সাহেবকে মিশরের নাসের করতে চেয়েছিলেন।
তাকে লোকে চিনতে পেরেছে, তাঁর অনশন আমার জানা আছে। নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে তিনি আইয়ুব সাহেবকে সমর্থন করবেন, না আন্দোলন করবেন তাঁর কথায় বোঝা কষ্টকর। মওলানা সাহেব ৬ দফা সমর্থন না করলেও আন্দোলন চলছে, চলবে এবং আদায়ও হবে। জনগন ৬দফাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে।
২০শে জুলাই ১৯৬৬ ।। বুধবার
ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত ও মানিক ভাইয়ের গ্রেপ্তার সম্বন্ধে কোনো ফয়সালা বোধহয় হবে না। মোনায়েম খান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও নবাব কালাবাগ সাহেবকে বলেছেন পূর্ব বাংলার ৬ দফার আন্দোলন শেষ করে দিয়েছেন। আর কিছুদিন থাকলে একদম নস্যাৎ করে দিতে পারবেন। তাই হয়তো কোনো সমঝোতায় আসলেন না সরকার। খুব ভাল কাজ বোধহয় করলেন না। পরিণতি বেশি ভাল হবে বলে মনে হয় না। মানিক মিয়া রাজনীতি করেন না, তবে তাঁর নিজস্ব মতবাদ আছে। তাকে দেশরক্ষা আইনে বন্দি করা যে কত বড় অন্যায় ও নীতিবিরুদ্ধ তা কেমন করে ভাষায় প্রকাশ করব। সাংবাদিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো একটা ভরসা বোধহয় পেয়ে থাকবেন। গতকাল থেকে আমার, তাজউদ্দীনের, খন্দকার মোশতাকের ও নূরুল ইসলাম চৌধুরীর রীট আবেদনের শুনানি শুরু হয়েছে। জানি না কি হবে। তবে আমাদের ছাড়বে না সরকার, তা বুঝতে পারি। জানি না কি হবে। তবে আমাদের ছাড়বে না সরকার, তা বুঝতে পারি। দেশরক্ষা আইন থেকে মুক্তি পেলে, অন্য কোনো আইনে জেলে বন্দি করতে পারে। আর আমার কথা আলাদা। আটটা মামলা চলছে, আরও কয়েকটা বন্দোবস্ত করে রেখে দিয়েছে। দরকার হলে চালু করে দিব। ধন্য তোমায় মোনায়েম খান সাহেব, ধন্য তোমার রাজনীতি!
নূরুল আমীন সাহেব ঐক্যবদ্ধ হতে অনুরোধ করেছেন। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকলেই দাবি আদায় হয় না। নূরুল আমিন সাহেব যাদের নিয়ে দল করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই আন্দোলনের ও জেলে যাবার কথা শুনলে প্রথমে ঘরের কোণেই আশ্রয় নিয়ে থাকেন, আর পিছন থেকে আন্দোলনকে আঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। বেশি গোলমাল দেখলে পাসপোর্ট নিয়ে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিদেশে রওয়ানা হয়ে যান ৬ দফার দাবিতে যে গণঐক্য দেশে গড়ে উঠেছিল, যার জন্য হাসিমুখে কত লোক জীবন দিল, কত লোক কারাবরণ করছে, তখন এই ‘ঐক্যবদ্ধ’ করার আগ্রহশীল নেতারা কেহ ঘর থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা প্রতিবাদ পর্যন্ত করেন নাই। আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এঁরা ‘সংগ্রাম করবে’! অন্য কেহ বিশ্বাস করলে করতে পারে, কিন্তু আমি করি না। কারণ এঁদের আমি জানি ও চিনি।
জনসাধারনের আর ‘নেতাদের ঐক্যের’ ওপর বিশ্বাস নাই। জনগণের ঐক্যই প্রয়োজন। তাহা পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠেছে। শুধু সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলেই দাবি আদায় হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ সংগ্রামী দল, সংগ্রাম করে যাবে। আদর্শের মিল নাই, সামান্য সুবিধার জন্য আর জনগণকে ধোঁকা দেওয়া উচিৎ হবে না। নিম্নতম কর্মসূচিই ছয় দফা। সেই সঙ্গে রাজবন্দিদের মুক্তি, কৃষকদের পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, গরিব কর্মচারীদের সুবিধা ও খাদ্য সমস্যা সম্বন্ধে কর্মসূচি নেওয়া চলে। তবে ৬দফা বাদ দিয়া কোনো দলের সাথে আওয়ামী লীগ হাত মেলাতে পারে না। আর করবেও না।
দিনভরই আমি বই নিয়ে আজকাল পড়ে থাকি। কারণ সময় কাটাবার আমার আর তো কোনো উপায় নাই! কারও সাথে দু’এক মিনিট কথা বল্ব তাও সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। বিকালের দিকে একা একা হাটাচলা করি, আর দুনিয়ার অনেক কথাই ভাবি। অনেক পুরানা স্মৃতি আমার মনে পড়ে। বন্ধু-বান্ধবরা আমার সাথে কখন কিভাবে, কি ব্যবহার করেছেন তাও মনে পড়ে। কত মানুষ আমাকে ভালবেসেছে, কতজন আবার ঘৃণাও করেছে। একাকী বসে সে কথাও ভাবি। আমার যেমন নিঃ স্বার্থ বন্ধু আছে, আমার জন্য হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে, তেমনই আমার শত্রু আছে, যারা হাসতে হাসতে জীবনটা নিয়ে নিতে পারে। আমাকে যারা দেখতে পারেন না, তারা ঈর্ষার জন্যই দেখতে পারে না। জীবনে আমার অনেক দুঃখ আছে সে আমি জানি, সেই জন্য নিজেকে আমি প্রস্তুত করে নিয়েছি। আমার মনে সবসময়েই বেশি পীড়া দেয় যখন আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চেহারা ফুতে উঠে আমার চোখের সামনে।
২১শে জুলাই ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
জেল-হাসপাতাল থেকে আজ রাশেদ মোশাররফ ও শাহাবুদ্দিন চৌধুরীকে বিদায় দেওয়া হয়েছে। তাঁদের শরীর একটু ভাল। তাঁদের দশ নং সেলে পাঠান হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা আছে। দোতলা থেকে আমাকে ইশারা করে জানাল তাড়া আজ চলে যাবে হাসপাতাল থেকে। আমি ওদের দিকে একটু এগিয়ে যেয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম। যখন রওয়ানা হলো আমি একটু এগিয়ে গিয়ে ওদের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটু চিৎকার করে বললাম, ‘চিন্তা করিও না, ত্যাগ বৃথা যাবে না। জনগণের দাবি জনগণই আদায় করবে’।
তাড়া আমার কাছে থাকার জন্য কত ব্যস্ত। অন্তত দূর থেকে হলেও আমাকে দেখতে পেত, এখন আর তাও হবে না। তাঁদের চোখে মুখে বেদনার ছাপ আমি দেখতে পেলাম। হাফেজ মুছা এখনও হাসপাতালে আছে। তাঁর শরীরও ভাল না।
ভেবেছিলাম আজ রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখতে আসবে আমাকে। হিসাবে পাওয়া যায় আর রেণুও গত তারিখে দেখা করার সময় বলেছিল, ’২০ বা ২১ তারিখে আবার আসব’। চারটা থেকে চেয়েছিলাম রাস্তার দিকে। মনে হতেছিল এই বোধহয় আসে খবর। যখন ৫টা বেজে গেল তখন ভাবলাম, না অনুমতি পায় নাই। আমিও ঘর থেকে বের হয়ে স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য হাঁটতে শুরু করলাম। ভীষণ গরমও পড়েছে। কিছু কিছু ব্যায়ামও করা শুরু করেছি। কারণ, রাতে ঘুম হয় না ভালভাবে। সন্ধ্যার পূর্বে কিছু বেগুন গাছ লাগালাম নিজের হাতে।
সৈয়দ শরীফুদ্দিন পীরজাদা নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। ইনি পাকিস্তানের এটর্নি জেনারেল ছিলেন। এডভোকেট হিসেবে যথেষ্ট নাম করেছেন। এই তো শাসনতন্ত্র! যখন ইচ্ছা মন্ত্রী, যখন ইচ্ছা বিদায়-প্রায় বাদশাহি কায়দায়। অনেক খেলা দেখলাম, আরও কত দেখতে হবে খোদাই জানে!
উত্তর ভিয়েতনামে ঘোষণা করেছে মার্কিন পাইলটদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিচার করা হবে না, বিচার করা হবে যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে। অন্যায়ভাবে অন্যের দেশে বোমাবর্ষণ করা যুদ্ধ ঘোষণা না করে, এর চেয়ে ভাল ব্যবহার আশা করতে পারে কি করে?
বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত ঢাকা হাইকোর্টের এক বিশেষ বেঞ্চ সমীপে বিচারাধীন জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও আমার হেবিয়াস করপাস মামলার শুনানি গতকাল শেষ হয়ে গেছে। বিচারপতি উপরোক্ত মামলাগুলির রায় দান স্থগিত রেখেছেন। আব্দুস সালাম খান সাহেব ও অন্যান্য এডভোকেটগণ মামলা পরিচালনা করেন।
২২শে জুলাই ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
রাত্রে এমনিই একটু ঘুম কম হয়। তারপর আজ আবার দুইটা পাগল একসাথে চিৎকার করতে শুরু করে। একজন পাগল ৪০ সেল থেকে চিৎকার করতে থাকে। সে একটু চুপ করলে আর একজন ঠিক কুকুর, বিড়ালের মতো ডাকতে থাকে। এইভাবে চলতে থাকে। প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল। পরে মশারির ভিতর থেকে হেসে উঠি। কারণ, একজন পাগল সত্য সত্যই একদম কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে পারে। ভোররাতে একটু ঘুম লাগলে আবার শুরু হয় গণনা। জমাদার সাহেবরা গণনা করে দেখে রাত্রে কয়েদিরা ঠিক আছে কিনা। উঠেই পড়লাম বিছানা থেকে। উঠেই দেখি, আমার তিনটা মুরগির মধ্যে একটা মুরগির ব্যারাম হয়েছে। দুইটা ডিম দেয়। যে মুরগিটার ব্যারাম হয়েছে, সেটা দুই-চারদিনের মধ্যেই ডিম দিবে। মুরগিটা দেখতে খুব সুন্দর। ওকে ডকে আমি নিজেই খাবার দিতাম। ওষুধ দেওয়া দরকার। প্রথমে পিঁয়াজের রস, তারপর রসুনের, যে যাহা বলে তাহাই খাওয়াইতে থাকি। দেখলাম, এত অত্যাচার করলে ও শেষ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে পানি, কিছু খাবার খেতে দেই ও মাথা ধোয়াইয়া দেই। বিকালের দিকে অবস্থা বেশি ভাল লাগে নাই। কি হয়, বলা যায় না।
মনটা খারাপ করে ছয় সেলের কাছে যেয়ে দাঁড়াই। হঠাত দেখি পায়ে ডান্ডাবেড়ি দিয়ে একজন হাঁটাচলা করছে। বললাম, ‘ব্যাপার কি?’ জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনাকে ডান্ডাবেড়ি দিয়েছে কেন?’ বলল, ‘স্যার কোর্টে যেতে হবে, ৫৩ বৎসর জেল দিয়ে দিয়েছে, খাটতে হবে ২৫ বৎসর। আরও ১৯৩টা কেস চলছে। যাকে বলা হয় মুন্সীগঞ্জ ‘গ্যাং কেস’। কতদিন জেল হয় খোদায় জানে! জেল থেকে একবার পালাইয়া ছিলাম। তারপর আবার এত বছর জেল, তাই ডান্ডাবেড়ি লাগাইয়া কোর্টে যেতে হয়’। বললাম, ‘কেন ডাকাতি করে জীবনটা নষ্ট করলেন? আপনার কে আছে?’ তখন তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘মা-বাবা ছোট বয়সে মারা যায়। এক ফুফাতো ভাই ডাকাত ছিলেন। বোধহয় নাম শুনেছেন, মুন্সীগঞ্জের ফেলু ময়াল। আমাকে ফুসলাইয়া ডাকাতি করতে নিয়ে যায়। তখন আমার বয়স অল্প, কিছু টাকাও আমাকে দেয় ডাকাতি করে এনে। তারপর লোভ হয়, তাঁর সাথেই ডাকাতি করা শুরু করি। তাকে ছাড়াও দু’একবার করেছি। মোট ১০-১২টা ডাকাতি করেছি সত্য, আজ বুঝতে পেরেছি কি ভুলই না জীবনে করেছি! আজ সেই ফেলু ময়াল, আমার ফুফাতো ভাই সরকারি সাক্ষী (একরারী) হয়েছে। সাত বৎসর মামলা চলেছে আরও কতকাল চলবে খোদাই জানে। তবে আমার জীবনের আর কি আছে? ৫৩ বৎসর জেল! কনফার্ম করে ২৫ বৎসর খাটতে হবে। এ মামলায়ও কয়েক বৎসর জেল হবে। মানে, জীবন এই জেলের সেলের মধ্যেই কাটাতে হবে। আমার একটা মেয়ে আছে ও স্ত্রী আছে। আর কি কোনোদিন ওদের কাছে থাকতে পারব। মা-বাবা না মরে গেলে বোধহয় এ পথে আসতে হতো না। জীবনে বহু অন্যায় ও পাপ করেছি। খোদা কি মাফ করবে?’ চুপ করে আবার বলল, ‘মেয়েটা ও স্ত্রীর কি হবে? কিছু তো আর রেখে আসতে পারি নাই। বাহিরে গেলেও আর উপায় নাই। ডাকাতি না করলেও জেলে আসতে হবে। কারণ, দাগী খাতায় নাম উঠেছে। ডাকাতি হলেই পুলিশ আমাদেরই ধরে আনবে’। লোকটির নাম ছোটন। সুগঠিত শরীর, ছোটখাটো লোকটা। অটুট স্বাস্থ্য। মনে হয়, বুলেটও ঢুকবে না ওর শরীরে। কারাগারের এই নিষ্ঠুর ইটের ঘরেই জীবনটা দিতে হবে। তবুও আশা করে পঁচিশ বৎসর খেটে বের হতে পারবে। আবার মুক্ত বাতাস, মুক্ত হাওয়ায় বেড়াতে পারবে। ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার করবে। মানুষের আশার শেষ নাই। অনেকে বিশ বৎসর জেল খেটে বের হয়ে যায়। কিন্তু বাইরে যেয়ে বেশিদিন বাঁচে না। এখানে বেশিদিন থাকলে ভিতরে কিছুই থাকে না, শুধু থাকে মানুষের রূপটা।
আজকাল রীতিমত বিকালে বেড়াই। হিসাব করে এক মাইল থেকে দুই মাইল হাটি। অল্প জায়গা কত বার হাঁটলে এক মাইল হয় হিসাব করে নিয়েছি, তাই ঘুরে ঘুরে হাঁটি।
২৩শে জুলাই ১৯৬৬ ।। শনিবার
সকালে বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছিলাম। একজন কয়েদি সেলের দরজায় দাড়ায়ে আছে। কি যেন বলতে চায়। সাধারণ কয়েদিদের মধ্যে অনেক বিচক্ষণ লোকও আছে। রাজনীতি সম্বন্ধে সাধারণ জ্ঞানও আছে। এই কয়েদিটি সাংঘাতিক প্রকৃতির। জেলের আইন-টাইন বেশি মানে না। অনেক মারধোর খেয়েছে জীবনে। লেখাপড়া কিছুটা জানে। দু’একটা ইংরেজিও মাঝে মাঝে বলে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিছু বলতে চাও?’ বয়স বেশি না, ২৫-২৬ হবে, তাই ‘তুমি’ বললাম। বলল, ‘আপনি পূর্ব বাংলার কথা বলেন, আর আমাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও বলে থাকেন কিন্তু শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারাই দায়ী না, পূর্ব পাকিস্তানিরাও দায়ী আছে’। আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বললাম, ‘আরও কিছু বলবে?’ উত্তর দিল, ‘না’। বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হলো, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমাদের এই সংগ্রাম নয়; পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ সুখে থাকুক, আমরাও সেটা চাই। তবে, পশ্চিম পাকিস্তানে একদিকে শক্তিশালী শোষক শ্রেণী আছে, তাঁদের সাথে আছে এক শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী তাহারাই দায়ী। তারাই প্রথম থেকে ষড়যন্ত্র করেছে, ছলে বলে কৌশলে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করতে হবে। তাঁদের সূক্ষ্ম বুদ্ধিও আছে। পূর্ব বাংলার নেতারাও দায়ী অনেকখানি। আমাদের নেতারা ১৯৪৭ সাল থেকে বুঝেও স্বার্থের লোভে সুযোগ দিয়েছে শোষণ করতে। বাঁধা দেয় নাই, প্রতিবাদ করে নাই, যদি বড়কর্তারা বেজার হন! মন্ত্রীত্ব ও চাকরি যদি না থাকে! ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত যারাই এই শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের খুশি করার জন্য, তাহাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। এঁদের দিয়েই স্বায়ত্তশাসনের দাবি, রাষ্ট্রভাষা বাঙালিদের নিয়োগে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। এঁরা বুঝেও বুঝতে চাইতো না। এমনকি দু’একজন উর্দু হরফে বাংলা লেখার জন্য প্রচার করে বেড়াতো। যখন নৌ-ঘাটি চট্টগ্রামে চেয়েছি তখন কেবলমাত্র মন্ত্রীত্ব রক্ষা করার জন্যই এরাই বাঁধা দিয়েছে বেশি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর যখন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণী বুঝলো এবার বোধহয় আর শোষণ করা চলবে না, তখন আবার ষড়যন্ত্র করল সেই লোকগুলিকে দিয়ে যারা ইলেকশনের পূর্বে হক সাহেবের মাথায় চেপে, আওয়ামী লীগের কাঁধে পা রেখে ইলেকশনে পার হয়ে এসেছে। বৃদ্ধ হক সাহেবকে ব্যবহার করল এঁরা। যখন দ্বিতীয় কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলী শাসনতন্ত্র তৈয়ার করতে শুরু করল, আওয়ামী লীগের সদস্যরা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে ভিতর ও বাহিরে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে সংগ্রাম শুরু করল, তখন এই বাঙালিদের ভোট দিয়ে আমাদের দাবিকে ভোটে পরাজিত করে নতুন শাসনতন্ত্র গঠন করল। তখনও যদি বাঙালিরা এক হতে পারতাম তাহলে নিশ্চয়ই স্বায়ত্তশাসন দাবি আদায় করতে পারতাম। আজও যে আমাদের ওপর জুলুম হচ্ছে-মোহম্মদ আলী (বগুড়া) সাহেব যদি আইয়ুব সাহেবের হাতে মন্ত্রীত্বের লোভে ধরা না দিতেন, তবে অনেকগুলি দাবি আদায় হতো। আজও দেখুন, আওয়ামী লীগ যখন ৬ দফার দাবি তুলল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক স্বায়ত্বশাসনের জন্য তখন এই বাঙালিরাই বেশি বাঁধা দিতেছে। মোনায়েম খাঁ সাহেব গভর্নর আছেন, কে তাকে তাড়াচ্ছে? তিনি চরম অত্যাচার করে চলেছেন।। আমাদের গ্রেপ্তার, ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ, নিউনেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত, তাঁর মালিককে গ্রেপ্তার, নারায়ণগঞ্জ ও তেজগাঁয় গুলি করতে একটুও মনে বাধলো না তাঁর। কাদের গ্রেপ্তার করছে? কাদের গুলি করে হত্যা করা হলো? কে বা কারা শতশত ছাত্রের জীবন নষ্ট করল? তাড়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিশ্চয়ই আসে নাই। যদি এই স্বায়ত্তশাসনের দাবি কৃতকার্যতা লাভ করে, তবে যারা অত্যাচার করল, তাঁদের ছেলেমেয়ে বংশধররা তাঁর সুবিধা ভোগ করবে কিনা? যারা জীবন দিল তাঁদের বংশধররাই কি শুধু ভোগ করবে? আমাদের দুঃখের জন্য আমরাই দায়ী বেশি। আমার ঘর থেকে যদি চুরি করতে আমিই সাহায্য করি সামান্য ভাগ পাওয়ার লোভে তবে চোরকে দায়ী করে লাভ কি?
এই সব কথা বলতে বলতে জমাদার চলে এল আর সিপাহিও এগিয়ে এল। কয়েদিটা তাড়াতাড়ি সেলে চলে গেল। আমি চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থেকে আবার খবরের কাগজ নিয়ে পড়তে লাগলাম।
বিকালে জেলার সাহেব এলে তাকে বললাম, ‘তিনি যেন ১০ সেলের আওয়ামী লীগের লোকদের জন্য এক জায়গায় পাক করার ব্যবস্থা করেন। ১/২ ওয়ার্ডে, সেখানে আরও ডিপিআর আসামি আছে তাঁদের পাকের বন্দোবস্ত আলাদা করেছে। তাড়া ডিপিআর-এর বন্দি। ১/২ ওয়ার্ডের রাজবন্দিরা মনে করবে কি? পূর্বে এক জায়গায় পাক হতো। যদি আলাদা পাকের বন্দোবস্ত করতে হয়, তবে যেখানে তাঁদের রাখা হয়েছে সেখানেই করুণ, সেটাই তো আওয়ামী লীগের রাজবন্দিদের দাবি ছিল। তাড়া তো এক জায়গায় দুই পাক করতে বলে নাই। ১/২ খাতার রাজবন্দিরা নিশ্চয়ই দুঃখ পেয়েছে। মনে করবে, সহকর্মীদের কি করে আলাদা পাক করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে?
জেলার সাহেব বললেন, ‘এটা তো আমি চিন্তা করি নাই। নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। কিন্তু করব কি? জায়গা তো নাই। আপনাদের তো জেল কতৃপক্ষের ইচ্ছায় রাখা হয় না। ১০ সেলের কাছেও কোনো পাকের বন্দোবস্ত নাই’। বললাম, ‘আমাদের কপাল! সকলের চেয়ে খারাপ জায়গায় আওয়ামী লীগারদের রাখা হবে, যেমন আমাকে একলাই থাকতে হবে। কাহাকেও দিবেন না আমার কাছে’। জেলার সাহেব চুপ করে থাকলেন। আমি জানি, এঁদের বলে কোনো লাভ নাই। নীচতার সাথে যুদ্ধ করতে হলে নীচতা দিয়েই করতে হয়, তাহা যখন পারব না তখন নীরবে খোদার ওপর নির্ভর করেই জেলখাটতে হবে। বিদায় নিয়ে জেলার সাহেব চলে গেলেন।
আমার মুরগিটা মারা গেছে। অনেক ওষুধ খাইয়েছি। বেচারার খুব কষ্ট হতেছিল, ভালই হলো। আমার একটু কষ্ট হলো। মুরগিটাকে আমার খুব ভাল লাগত। ওর হাঁটাচলার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য ছিল।
২৪শে জুলাই ১৯৬৬ ।। রবিবার
আব্বার চিঠি পেলাম আজ সকালে। আমি যখন চিঠি পড়ি একজন কয়েদি পাহারার, লেখাপড়া জানে, জিজ্ঞাসা করল, ‘চিঠি কি আপনার আব্বা লিখেছেন, ‘বাবা খোকা’। বাবা ছাড়া একথা আর কে আপনাকে লেখতে পারে!’ আমি হেসে উঠলাম এবং বললাম, ‘বাবা-মায়ের কাছে আজও আমি ‘খোকা’ই আছি। যতদিন তাড়া বেঁচে থাকবেন ততদিনই আমাকে এই বলেই ডাকবেন। যেদিন এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন আর কেহই এ স্নেহের ডাকে আমাকে ডাকবে না। কারণ এ অধিকারই বা কয়েকজনের আছে! আমার ৪৫ বৎসর বয়স, চুলেও পাক ধরেছে। পাচটি ছেলেমেয়ের বাবা আমি, তথাপি আজও আমি আমার বাবা আমি, তথাপি আজও আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে বোধহয় ‘সেই ছোট্ট খোকাটি’-এখনও মায়ের ও আব্বার গলা ধরে আদর করি, আমার সাথে যখন দেখা হয়।
আমার বাবা খুব শান্ত প্রকৃতির লোক। সকল সময়ই গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন। তাকে আমরা ভাইবোনেরা ছোট্ট কালে ভালবাসতাম এবং ভয়ও পেতাম। আমার মা আমাদের না দেখলেই কাঁদতেন। তাঁর মধ্যে আবেগ খুব বেশি। কিন্তু আমার বাবার সহ্যশক্তি অসম্ভব। জীবনে মুখ কালো করতে আমি দেখি নাই। বোধহয় একটু প্রকৃতির ছিলাম বলে বাবা আমাকেউই খুব বেশি স্নেহ করতেন। আব্বা এক জায়গায় লিখেছেন, ‘তোমরা গত ১৯/৬/৬৬ এবং ১/৭/৬৬ তারিখের চিঠি দুইখানা গতকাল পাইয়া তোমার কুশল জানিতে পারিলাম। তবে আমাদের জন্য চিন্তা করিবা না, খোদার মর্জিতে আমাদের মতন সুখী লোক বোধহয় নাই; থাকিলেও খুব কম। আমার সহ্যশক্তিও আছে।, বিপদে আপদে কখনও বিচলিত হই না, তাহা তোমার ভালভাবে জানা আছে’।
বারবার আমার আব্বা ও মা’র কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সাথে কি আবার দেখা হবে? অনেকক্ষণ খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারি না, ভালও লাগছে না। অনেকক্ষণ ফুলের বাগানেও কাজ করেছি আজ। মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম।
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়’।
দিনের আলো নিভে গেল, আমিও আমার সেই অতি পরিচিত আস্তানায় চলে গেলাম।
২৫শে জুলাই ১৯৬৬ ।। সোমবার
শরীরটা খারাপই হয়ে চলেছে। বসে থাকার জন্যই বোধহয় খুবই দুর্বল লাগে। আওয়ামী লীগ শান্তিপুর্ণ আন্দোলন চালাতে জনগণকে অনুরোধ করেছে-যে পর্যন্ত ৬ দফার দাবি আদায় না হয়। যদিও শান্তিপূর্ণ ও নিয়ন্তান্ত্রিক আন্দোলন করে চলেছে আওয়ামী লীগ, তথাপি সরকার অত্যাচার করে চলেছে। গুলি হলো, গ্যাস মারল, শতশত কর্মীকে জেলে দিল, বিচারের নামে প্রহসন করল, কত লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে কে তা বলতে পারে? সরকার নিজেই স্বীকার করেছে ১১ জন মারা গেছে ৭ই জুনের গুলিতে। আমরা পাকিস্তানকে দুইভাগ করতে চাই বলে যারা চিৎকার করছে তারাই পাকিস্তানের ক্ষতি করছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া উচিৎ। তাড়া আলাদা হতে চায় না। পাকিস্তান একই থাকবে, যদি স্বায়ত্তশাসনের দাবি মেনে নেওয়া হয়। ইংরেজ কত লোককে হত্যা করেছিল কিন্তু দাবাইয়া রাখতে পারে নাই। এই দেশে কত ছেলেকে ফাঁসি দিয়েছিল। অনেকেরই সে কথা মনে আছে – গোপীনাথ সাহা, নির্মল, জীবন ঘোষ, রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, তারকেশ্বর আরও কত লোককে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেছিল। তবু আন্দোলন দাবাতে পারে নাই। আন্দোলন আরও জোরে চলেছিল। আমরা যদিও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, তথাপি ইংরেজের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই শুরু হয়েছিল ঐ পথ। এমন দিন এসেছিল ইংরেজ সাহেবরা ঘর থেকে বের হতেও ভয় পেত।
আমি জানি আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করে, তাঁদের উপর অত্যাচার কথা কোনো মতেই উচিৎ হতেছে না। ‘সরকার বলে দিলেই তো পারে, তোমরা রাজনীতি করতে পারবা না’। আমরা চিন্তা করে দেখতাম রাজনীতি করব, কি করব না? মার্শাল ল’-এর সময় তো আমরা রাজনীতি করি নাই। চুপচাপ ছিলাম কারণ রাজনীতি তখন বেআইনি ছিল। আজ দিন যে কিভাবে কেটে গেল আমি জানি না।
২৬শে জুলাই ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
আজ নিশ্চয়ই ‘দেখা’। ছেলেমেয়ে নিয়ে রেণু আসবে যদি দয়া করে অনুমতি দেয়। পনের দিনতো হতে চলল, দিন কি কাটতে চায়, বার বার ঘড়ি দেখি কখন চারটা বাজবে। দুপুরটা তো কোনোমতে কাগজ নিয়ে চলে যায়। এত দুর্বল হয়ে পড়েছি যে, হাঁটতে ইচ্ছা আজ আর হয় না। সাড়ে চারটায় আমাকে নিতে আসল সিপাহি সাহেব। একসাথে দুইটা দেখার অনুমতি, আমার কোম্পানির ম্যানেজার ও একাউন্টেন্টও এসেছে ব্যবসা-বানিজ্য নিয়ে কিছু আলোচনার জন্য। দূর থেকেই ছোট্ট বাচ্চাটা ‘আব্বা, আব্বা’ করে ডাকতে ধুরু করে। এইটাই আমাকে বেশি আঘাত দেয়। দুইজন করে অফিসার পাঠায়। এঁরা জানে আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা রাজনীতির ধার ধারে না। এঁদের সাথে আলোচনা ঘর-সংসারের। মা কিছুটা ভাল আছেন, আব্বা খুলনায় গেছেন, আমার ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা কেমন, সংসার কেমন চলছে-অর্থাভাব হবে কি না? উপার্জন কম করি নাই, তবে খরচ করে ফেলেছি। এই সমস্ত ঘরোয়া কথাবার্তা। বেচারা কর্মচারীরা বোধহয় লজ্জাও পায়। কি শুনবে বসে বসে। রেণুকে বললাম, মোটা হয়ে চলেছি, কি যে করি! অনেক খাবার নিয়ে আসে। কি যে করব বুঝি না। রেণু আমার বড় মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব এনেছে, তাই বলতে শুরু করল। আমার মতামত চায়। বললাম, ‘জেল থেকে কি মতামত দেব; আর ও পড়তেছে পড়ুক, আইএ, বিএ পাশ করুক। তারপরে দেখা যাবে’। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কতদিন যে আমাকে রাখবে কি করে বল্ব! মনে হয় অনেকদিন এঁরা আমায় রাখবে। আর আমিও প্রস্তুত হয়ে আছি। বড় কারাগার থেকে ছোট কারাগার, এই তো পার্থক্য।
২৭শে জুলাই ১৯৬৬ ।। বুধবার
ছেলেমেয়েরা চলে যাবার পরই আমাকে একটা নোটিশ দেয়া হলো। নোটিশ পাঠাইয়াছেন, এ আহমদ প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট-আমার বিচার হবে জেলগেটে। কোর্টে নেওয়া হবে না। এই মামলাটা রমনা থানার ৮০(৪)/৬৬ নম্বরের মামলা। জি.আর. নম্বর ১৮৯৩/৬৬ ইউ.আর. ৪৭ ডিপিআর ১৯৬৫। এই মামলাটা ঢাকায় আমার গ্রেপ্তারের কিছুদিন পূর্বে দায়ের করা হয়েছিল।। এই মামলায় আমাকে জেলা জজ বাহাদুর জামিন দিলে আবার রাতে আমার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে সিলেট পাঠাইয়া দেয়। ডিপিআর-এ গ্রেপ্তার করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিনাবিচারে বন্দি করে রেখেও এঁদের শান্তি নাই। অত্যাচারেরও একটা সীমা থাকে! আটটা মামলা সমানে আমার বিরুদ্ধে দায়ের করেছে। একজন লোকেরই এই বুদ্ধি। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পিছন দরজার রাজনীতিতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। এই সকল নীচতা দেখে মনটা আমার বিষিয়ে ওঠে। যে জাতের ভিতর এইরকম নীচ প্রকৃতির লোক জন্ম নিতে পারে, তাঁদের মুক্তি কি কোনোদিন আশা করা যায়!
নোটিশটা আর ২০/২৫ মিনিট পূর্বে পেলে সুবিধা হতো। আমার স্ত্রীর কাছে বলে দিতে পারতাম জহিরুদ্দিন ও অন্যান্য উকিল সাহেবদের আসতে। কাগজপত্র, নকল কত কি প্রয়োজন। এমনি আইবি আজকাল খুবই কৃপনতা করে, দেখা করতে অনুমতি দিতে। মনে করে, জেলে বসে রাজনীতি করি। তাঁদের বোঝা উচিৎ আমরা ও ধরণের রাজনীতি করিনা। তাহলে তো প্রকাশ্যে ৬ দফার কথা না বলে গোপনে গোপনে কাজ করে যেতাম। আমি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। যদি ঐ পথে কাজ করতে না পারি ছেড়ে দিব রাজনীতি। প্রয়োজন কি! আমরা একলা দেশসেবার মনোপলি নেই নাই। যারা সন্ত্রাসবাদীতে বিশ্বাস করে তারাই একমাত্র রাজনীতি করবে, মাটির তলা থেকে ধাক্কা দেবে সুযোগ পেলেই। আমার কি আসে যায়? বহুদিন রাজনীতি করলাম। এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে আরাম করব। তবে সরকার যেভাবে জুলুম চালাচ্ছে তাতে রাজনীতি কোনদিকে মোড় নেয় বোঝা কষ্টকর।
আজ দিনভরে শুয়েই কাটালাম বেশি। নিজের জন্য আমার বেশি ভাবনা নেই। শুধু দুঃখ হয় এঁদের অত্যাচারের ধরনটা দেখে। আমার উপর এতো অত্যাচার না করে ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেললে সব ল্যাঠা মিটে যেত। শুনলাম, আমার বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, ঢাকা সব জায়গাতেই মামলা দায়ের করেছে। আমি একা এত মামলা সামলাব কেমন করে? আমি ভাসাইয়া দিয়াছি নিজেকে যাহা হবার হবে। খোদাই আমাকে রক্ষা করেছে জালেমদের হাত থেকে, আর ভবিষ্যতেও করবে।
২৮শে জুলাই ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
ভীষণভাবে ব্যথা শুরু হয়েছে, পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত। বুঝতে পারলাম না, কেন এই ব্যথা। বসতেই পারি না। শুয়ে থাকলে একটু আরাম লাগে। হাটতে পারি। হাঁটলে বেশি ব্যথা লাগে না, তবে সোজাভাবে হাঁটতে হয়। দিনভরই শুয়ে থাকতে হয়। সরিষার তেল গরম করে মালিশ করালাম দুইবার। রফিক ছাফাইয়াটা মালিশ ভাল করে। রাতে ঘুমাতে পারিনাই।
২৯শে জুলাই ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
সারাদিন ব্যথায় কাতর। ডাক্তার ক্যাপ্টেন সামাদ সাহেব এলেন আমাকে দেখতে। খাবার ঔষধ দিলেন, আরও দিলেন মালিশ। বিছানায় পড়ে রইলাম। সন্ধ্যার দিকে কষ্ট করে বের হয়ে বাগানের ভেতর আরাম কেদারায় কিছু সময় বসে আবার শুয়ে পড়লাম। খুবই কষ্ট পেতেছি।
৩০শে জুলাই ১৯৬৬ ।। শনিবার
আজ সিভিল সার্জন সাহেব এলেন, ঔষধও দিলেন। ব্যথা একটু কমেছে তবে উঠতে বসতে কষ্ট হয়। সারাদিন তো একলাই আমাকে থাকতে হয়। তারপর আবার শরীর খারাপ। বিকালে বাইরে বসে আছি, দেখি আমাদের অফিস সেক্রেটারি এডভোকেট মোহাম্মদউল্লাহকে নিয়ে চলেছে পুরানা ২০ সেলের এক নম্বর ব্লকে। আমি যেখানে থাকি তাঁর সামনে দিয়েই রাস্তা। জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে? বুঝতে আমার বাকি রইল না। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের ১৯৫৫ সালে একবার যক্ষ্মা হয়ে মহাখালী টিবি হাসপাতালে ছিলেন প্রায় ৭/৮ মাস। চিকিৎসা করে ভাল হয়েছিলেন। বোধহয় আবার আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। এক্স-রে করতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে নেওয়া হয়েছিল। রিপোর্ট বোধহয় খারাপ। তাই তাকে ১০ সেল থেকে টিবি ওয়ার্ডে নিয়ে এসেছে। জেলখানার টিবি ওয়ার্ড মানে সেল। ভাল লোকের মাথা খারাপ হয়ে যায় সেলে থাকলে। আর অসুস্থ মানুষের কি হবে সহজেই বুঝতে পারা যায়। কথা বলতে না পারলেও দেখতে পারব, খোজখবর নিতে পারব। মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের আর্থিক অবস্থা আমার জানা আছে। মহাখালী হাসপাতালে কেবিন নিয়ে থাকতে বহু খরচ। তারপর আবার বাড়ির খরচ। জানি না সরকার মুক্তি দিবে কিনা তাকে! দিন কেটে যায়, আর যাবেও। কোনো কাজেই লাগছি না।
৩১শে জুলাই ১৯৬৬ ।। রবিবার
সোনার খাঁচায়ও পাখি থাকতে চায় না। বন্দি জীবন পশুপাখিও মানতে চায় না। আমরা মানুষ, আমাদের মানতে কি ইচ্ছা হয়! মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের কথা ভাবতে ভাবতে অনেক কথা আজ মনে পড়ল। যুগে যুগে যারা আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছে তাড়া নিশ্চয়ই ক্ষমতা দখলের জন্য করে নাই। একটা নীতি ও আদর্শের জন্যই ত্যাদ স্বীকার করে গেছে। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, কত বোনকে বিধবা করেছে, কত লোককে হত্যা করা হয়েছে, কত সংসার ধ্বংস হয়েছে। কারণ তো নিশ্চয়ই আছে, যারা এই অত্যাচার করে তাড়া কিন্তু নিজ স্বার্থের বা গোষ্টী স্বার্থের জন্যই করে থাকে। সকলেই তো জানে একদিন মরতে হবে। তবুও মানুষ অন্ধ হয়ে যায় স্বার্থের জন্য। হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। পরের ছেলেকে যখন হত্যা করে, নিজের ছেলের কথাটি মনে পড়ে না। মানুষ জাতি স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়।
পাকিস্তানের ১৯ বৎসরে যা দেখলাম তা ভাবতেও শিহরিয়া উঠতে হয়। যেই ক্ষমতায় আসে সেই মনে করে সে একলাই দেশের কথা চিন্তা করে, আর সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী আরও কত কি! মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রেখে অনেক দেশনেতাকে শেষ করে দিয়েছে। তাঁদের স্বাস্থ্য নষ্ট করে দিয়েছে, সংসার ধ্বংস হয়ে গেছে। আর কতকাল এই অত্যাচার চলবে কেই বা জানে! এইতো স্বাধীনতা, এই তো মানবাধিকার!
অনেকক্ষণ চিন্তা করলাম বসে বসে। মনে হয়, এ পথ ছেড়ে দেই, এত অত্যাচার নীরবে সহ্য করব কি করে? বিবেক যে দংশন করে। বয়স হয়েছে, শরীর তো খারাপই হতে থাকবে। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পারব কি না? মনকে সান্ত্বনা দেই এই কথা ভেবে, আর কতদিনই বা বাঁচব? চলুক না। এই দেশের মানুষের জন্য কিছু যদি নাও করতে পারি, ত্যাগ যে করতে পারলাম এটাই তো শান্তি। ব্যথাটা অনেক সেরে গেছে। আস্তে আস্তে হাঁটাচলা করতেও আরম্ভ করেছি।
১লা আগস্ট ১৯৬৬ ।। সোমবার
বড় আশ্চর্য লাগছে। মোনায়েম খান সাহেব কিছুদিন একেবারেই চুপচাপ। একটাও হুমকি ছাড়েন নাই, পিন্ডি থেকে এসে। সর্বদলীয় সভা জনাব নূরুল আমীন সাহেবের বাড়িতে হয়েছে। নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলনে আমার আপত্তি থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আন্দোলন করার নেতা কেউই নন। ছয়দফা দাবির ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং রাজবন্দিদের মুক্তি, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত করার আদেশ প্রত্যাহার, কৃষক শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হতে পারে। আমার মনে হয়, এনডিএফ নেতারা তাঁদের সেই গৎবাঁধা নীতি ধরে বসে আছেন: ‘গণতন্ত্রের দাবি’। আর কোনো দাবির প্রয়োজন নাই, দলও থাকবে না, ‘এক কমান্ড’ বলে বেড়ান। এতে আন্দোলন হয় না, আর দাবি আদায়ও হয় না। ঘরে বসে গুজগুজ রাজনীতি চলে, আর কোনো মতে একটা আপোস করা যায় কিনা সেই ফন্দি। ন্যাপ আলাদের অন্য পথ, সকলের সাথে মিশে কাজ করতে রাজি, তবে তাঁদের দাবিগুলি নিম্নতম কর্মসুচির মধ্যে গ্রহণ করতে হবে। এদেশে এসব হবে না। আন্দোলন যে দল করবে, ত্যাগ যে দল করবে তারাই কাজ করে চলুক। দেখা যাক কি হয়। জনসমর্থন ছয় দফার আছে, শুধু নেতৃত্ব দিতে পারলেই হয়। ৭ তারিখে নেতৃত্ব যে ভুল করেছে তা এখানে লেখলাম না।
ভেবেছিলাম এডভোকেট ও আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ মিলবে, কারণ মামলা আরম্ভ হবে জেলগেটে, ৮ই আগস্ট থেকে। কোর্ট তো জেলগেটেই বসবে। মাত্র ছয়দিন আছে, কখন কাগজপত্র নিবে, নকল নিতে সময় লাগবে কোর্ট থেকে। কোন কোন এডভোকেট থাকবে? এঁরা বিচারের নামে প্রহসন করতে চায়। মার্শাল ল’ যখন চলছিল তখনও বিচার পেয়েছিলাম, আজকাল জামিনের কথা উঠলেই টেলিফোন বেজে উঠে।
২রা আগস্ট ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
মোহাম্মদউল্লাহ সাহেবের সঠিক খবর জানার জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছিলাম। এক্স-রে কি পাওয়া গেছে? ডাক্তার সাহেবের কি অবস্থা? তিনি বললেন, এক্স-রেতে ধরা পড়েছে এখনও তিনি ভুগছেন যক্ষ্মা রোগে। একে জেলে ধরে আনার যে কি অর্থ হতে পারে বুঝি না। এ রকম নিরীহ লোক আমার জীবনে দেখিনি। তিনি অফিসের কাজ করেন। কোনোদিন সভায় বক্তৃতা করেন নাই। কোথাও পার্টি গঠন করতে যান নাই। অফিসের কাজগুলি দেখতেন এইমাত্র। বোধহয় সরকারের কাছে দরখাস্ত করেছেন তাঁর ভাল চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার জন্য, নতুবা মুক্তি দিতে। জানি না কি হবে, তবে তাঁর শরীর যদি আরও খারাপ হয় আর কোনো অঘটন ঘটে তবে সরকারই দায়ী হবে।
আমার কাছেই একজন কয়েদি পাহারা থাকে, নাম ফয়েজ, বাড়ি মানিকগঞ্জ। বাড়ি থেকে তাঁর লোকেরা দেখা করতে এসে কিছু লেবু দিয়ে গিয়েছিল। সেই লেবুর থেকে চারটা লেবু এনে আমার সেলের কাছে দিয়ে গিয়াছে, বলেছে আমাকে খেতে। আমি ডেকে বললাম, ‘ফয়েজ আমার তো রোজই লেবু আসে। তোমরা খাও’। বলে কিনা, ‘স্যার, খুব দুঃখ পাব যদি আপনি না খান’। আমার সঙ্গে আর কোনো কথা হলো না। শুধু ভাবলাম, এঁদের কত বড় মন, থাকলে সবই দিয়ে দিতে পারত। তাঁর বাড়ির থেকে লেবু এসেছে, আমাকেও খেতেই হবে।
পাচটা কাগজ রাখি, কোনো সংবাদই নাই। কাগজগুলিকে প্যামফ্লেট করে ফেলেছে। আইয়ুব সাহেবের মাস পহেলা বক্তৃতা ভালভাবে পড়লাম, তবে ভারতের সাথে আলোচনা ও ফয়সালা হতে হলে কাশ্মিরের একটা সন্তোষজনক মীমাংসা হওয়া উচিৎ। ভালই বলেছেন তিনি। পত্রিকায় লিখেছে: ‘President Ayub Khan said today, without meaningful talks on the problem of Jammu and Kashmir, any treaty between India and Pakistan to resolve basic disputes would be futile’. আমি ‘meaningful’ অর্থটা বুঝলাম না। পূর্বেও প্রেসিডেন্ট সাহেবের মুখ থেকে একথা শুনেছি। এর অর্থ কি এই হয় না যে আমাদের আর গণভোটের দাবি নাই। যদি না থাকে, তাহাও পরিষ্কার করে বলা উচিৎ। ভারতও তাঁর মতের কোনো পরিবর্তন করতে রাজি নয়। ‘গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ভারত, গণতন্ত্রের পথে যেতে রাজি হয় না কেন?’ কারণ, তাড়া জানে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের মতামত নিলে ভারতের পক্ষে কাশ্মীরের লোক ভোট দিবে না। তাই জুলুম করেই দখল রাখতে হবে।
দুই দেশের সরকার কাশ্মীরের একটা শান্তিপূর্ণ ফয়সালা না করে দুই দেশের জোঙ্গণের ক্ষতিই করছেন। দুই দেশের মধ্যে শান্তি কায়েম হলে, সামরিক বিভাগে বেশি টাকা খরচ না করে দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা যেত। তাতে দুই দেশের জনগণই উপকৃত হতো। আমার মনে হয়, ভারতের একগুঁয়েমিই দায়ী শান্তি না হওয়ার জন্য।
নাইজেরিয়ার খবর দেখলাম, আবার হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। নাইজেরিয়ার লৌহমানব সামরিক রাষ্ট্রপ্রধান জনসন সান্ডন সারনমি নিহত হয়েছেন। একজন কর্নেল ইয়াকুবু নাইজেরিয়ার সর্বময় ক্ষমতা দখল করেছেন।
জনাব আইয়ুব খান সাহেব আজকাল আল্লা ও রসুলের নাম দিতে শুরু করেছেন। খুব ভাল কথা। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব বলেন, ‘দেশের দুই অংশকে যুক্ত করার সূত্র আমাদের পয়গম্বর হজরত মহম্মদ (দ.)- এর মহান ব্যক্তিত্বেই পরিলক্ষিত হইয়াছে। যতদিন এই যোগসূত্রের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন জাতীয় একতা অক্ষুন্ন থাকিবে’। মহান আদর্শের নামে নিশ্চয়ই হজরত মহম্মদ (দ.) দেশের একটা অংশ অন্য অংশকে শোষণ করবে এ কথা বলে যান নাই। তিনি তো ইনসাফ করতে বলেছিলেন। শোষক ও শোষিতের মধ্যে সংগ্রাম হয়েই থাকে এবং হবেও। শোষকদের কোনো জাত নাই, ধর্ম নাই। একই ধর্মের বিশ্বাসী লোকদেরও শোষণ করে চলেছে ছলে বলে কৌশলে। প্রেসিডেন্ট আজও ছয় দফা দাবির উপর ইঙ্গিত দিয়েছেন। জনাব সবুরতো প্রকাশ্যভাবেই বলে চলেছেন, পাকিস্তানকে দুই ভাগ করার অভিসন্ধি নাকি ৬ দফার মধ্যে আছে? কোথায় পেলেন? কিভাবে পেলেন? পাকিস্তান এক না থাকলে এই দাবিগুলি আদায় হয় কি করে? এই সমস্ত কথা বলে আর মানুষকে ধোঁকা দেওয়া চলবে না। জণগন বুঝতে শিখেছে।
৩রা আগস্ট ১৯৬৬ ।। বুধবার
সকালে দেখতে আসলেন সিভিল সার্জন সাহেব। আমার শরীর ভাল না তাই। শরীর কি ভাল থাকে, একলা থাকলে জেলখানায়? প্রায়ই শরীর খারাপ হয়। আমার স্ত্রীকে কিছুই বলি নাই। কারণ, চিন্তা করে শরীর নষ্ট করবে।
আজ অনেকক্ষণ হাঁটাচলা করলাম। বিকালে চা খেতে বসেছি, দেখি সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের সিপাহি সাহেব এসেছে আমাকে জেলগেটে নিতে। ‘দেখা’ এসেছে-জহিরুদ্দিন সাহেব, আবুল সাহেব ও আমার স্ত্রী। ছোট তিনটা বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। মামলা সম্বন্ধে আলোচনা হলো কিছুটা। আইবি অফিসারদের সামনেই আলোচনা করতে হবে। দুইজন ইন্সপেক্টর দিয়েছে। সামনেই বসে থাকে কোনো কিছু আলাপ করার উপায় নাই। কিভাবে মামলা চালাব তাহাই আইবি জানতে চায়। আর আমরা তা বলব কেন? বললাম, নকল (certified copy) নিতে। নকল না দিলে মামলা করব না। বলে দিব, যাহা ইচ্ছা করুক। কাগজপত্র না পেলে মামলা চালাইব কি করে? সালাম সাহেবও আসবেন। শুনলাম অনেক উকিল আসবেন ৮ তারিখে জেল গেটে মামলা করার জন্য। রেণুকে বললাম, কিছু টাকা দিতে নকল নেওয়ার জন্য। ছোট্ট ছেলেটা আমার কানে কানে কথা বলে। একুশ মাস বয়স। বললাম, আমার কানে কানে কথা বললে আইবি নারাজ হবে, ভাববে একুশ মাসের ছেলের সাথে রাজনীতি নিয়ে কানে কানে কথা বলছি। সকলেই হেসে উঠল। এটা রাসেলের একটা খেলা, কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপ করে থাকে আর হাসে। আজ আমার কাছ থেকে ফিরে যাবার চায় না। ওর মায়ের কাছে দিয়ে ভিতরে চলে আসলাম। ছোট্ট মেয়েটা-রেহানা আমার কাছ সরতে চায় না, তাই তাকে একটু আদর করলাম। মামলায় যে কি হবে জানি না। তবে সরকারের উৎসাহ একটু বেশি মনে হয়। অনেকগুলি মামলাই তো আছে। জেল থেকে কবে যে বের হতে পারব জানি না। সন্ধ্যার একটু পূর্বে আসলাম, ‘আমার সেই পুরানা বাড়িতে’।
বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিল। একজন সিপাহি আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার আপনাকে নাকি আপনার বাবা ত্যাজ্য পুত্র করে দিয়েছে, রাজনীতি করার জন্য আর বারবার জেলখাটার জন্য?’ বললাম, এরকম কথা জিবনে আমি অনেক শুনেছি। আমার বাবা আজও আমাকে যে স্নেহ করেন বোধহয় অনেক পুত্রের কপালেই তা জোটে না জীবনে। আমার আব্বা কখনও আমার সাথে মুখ কালো করে কথা বলেন নাই। এখনও কাছে গেলে ছোট ছেলের মতো আদর করেন। আর কোনো দিন আমাকে কোনো কিছুর জন্য নিরাশ করেন নাই। আমার বাবা কখনও বড়লোক ছিলেন না। অনেক কষ্ট করেছেন, কিন্তু আমার প্রয়োজন তিনি মিটাইয়াছেন। এমনকি আমি জেলে থাকলেও আমার ছেলেমেয়ের দরকার হলে ধান, পাট বিক্রি করে টাকা পাঠাতে কৃপণতা করেন নাই। আমার বাবা কখনও বড়লোক ছিলেন না। অনেক কষ্ট করেছেন, কিন্তু আমার প্রয়োজন তিনি মিটাইয়াছেন। এমনকি আমি জেলে থাকলেও আমার ছেলেমেয়ের দরকার হলেধান, পাট বিক্রি করে টাকা পাঠাতে কৃপণতা করেন নাই। সিপাহিকে দেখালাম কয়েকদিন পূর্বের চিঠি। তাতে লিখেছেন ‘তাঁর (আমার বাবা) মতো সুখী এ জগতে কয়জন আছে’।
যাবে। কারণ বেচারা বহু টাকা খরচ করে ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্সুরেন্স কোম্পানীর কাছ থেকে হলটা কিনেছে। আমার এক আনা শেয়ারও যদি থাকত তবে আর কষ্ট করতে হতো না’।বেচারা অবাক হয়ে চেয়ে রইল আমার দিকে। ‘বলেন কি স্যার, আজও তো অনেকে বলে’। বললাম, ‘বলতে দিন, ওটা তো আমাদের কিসমত – যাদের জন্য আমি রাজনীতি করি তাঁদের কেউ কেউ আমাদের বিশ্বাস করে না’। অনেকক্ষণ ভাবলাম, এই তো দুনিয়া! জনাব সোহরাওয়ার্দীকে ‘চোর’ বলেছে, হক সাহেবকে ‘চোর’ বলেছে, নেতাজি সুভাষ বসুকে, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে এই বাঙালিরা ‘চোর’ বলেছে দুঃখ করার কি আছে!
৪ঠা আগস্ট ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
রেণু কিছু খাবার দিয়ে গেছে-কি করে একলা খেতে পারি? কই মাছ খেতে আমি ভালবাসতাম, তাই ভেহে দিয়েছে। কয়েকটা মাছ পাকিয়ে দিয়েছে, মুরগির রোস্ট, এগুলি খাবে কে? কিছু কিছু খেয়ে বিলিয়ে দিলাম কয়েদিদের মধ্যে। তাড়া কত খুশি এই জিনিস খেয়ে! কেহ বলে, সাত বৎসর কেহ বা পাঁচ বৎসর, কেহ বা তিন বৎসর এই জেলে এক ঘেয়ে খাওয়া খেয়ে বেঁচে আছে। যখন মিঠা কুমড়া শুরু হয় কয়েক মাস মিঠা কুমড়াই চলে, আবার যখন ক্ষেতে ডাঁটা জন্মায় আবার শুরু হয়ে কিছুদিন চলে, আবার কিছুদিন পুঁইশাক। ডালতো আছেই। আমার এক ছাফাইয়া ছিল একটু রসিক, সাত বৎসর জেল হয়েছে, প্রায় পাঁচ বৎসর খেটেছে বলে খালাসের সময় হয়ে এসেছে। বলে, এই রকম মজার খাবার পেলে আর কিছুদিন জেলে থাকতে রাজি আছি? মেট বলে, ‘পেটে ডালের চর পড়ে গিয়াছিল। বিশ বৎসর সাজা, সাত বৎসর খেটেছি এখন আর ডালখেতে হয় না’।
আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম। জেলখানায় আমার জন্য কাজ করবে, আমার জন্য পাক করবে, আমার সাথে এক পাক হবে না! আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, চাকরদের জন্য আলাদা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সামন্তবাদ ছিল, তখনও জমিদার তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ যখন সামন্ততন্ত্রের কবরের উপর শিল্প ও বানিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে, সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।
আমিতো অনেক আরামেই থাকি; কিন্তু সাধারণ কয়েদিদের জীবন তো দূর্বিষহ। কয়েদিরা যেন মেশিন হয়ে গেছে। আমার জন্য যারা কাজ করে তাড়া ছাড়াও আমার এরিয়ায় যারা কাজ করে তাঁদের প্রত্যেককেই আমি মাঝে মাঝে কিছু কিছু খেতে দিতে চেষ্টা করি। কিছু কিছু করে জমাই আমার খাবার থেকে, তারপর ডাকাইয়া ওদের মধ্যে বিলি করি। কত আনন্দ দেখি ওদের মুখে। ২৬ সেলে যারা সিকিউরিটি আইনে বন্দি আছেন, বহুদিন ধরেই আছেন। ধীরেন বাবু ওখানে ফুলের বাগান করেন। আমি শুনেছি এত সুন্দর বাগান নাকি ঢাকা শহরেও নাই। ঐ বাগানটা আমি ১৯৬২ সালে শুরু করি, তখন ওখানে টমেটোর বাগান ছিল। কিছুদিন পরে আমি খালাস হয়ে যাই তখন থেকে তাহারা ওখানেই আছেন। আমি খবর দিয়েছিলাম কয়েকটা গোপাল ফুলের চারা দিতে। আজ বিকালে তিনটা লাল গোলাপের চারা পাঠাইয়া দিয়াছেন। আমি লেগে পড়লাম বাগানে, তাড়াতাড়ি গর্ত করে, সার দিয়ে লাগাইয়া দিলাম। এত ইটের টুকরা পরিষ্কার করতে জান শেষ হয়ে যায়। আমার বাগানটাও এখন সুন্দর হয়ে উঠেছে। দেখতে বেশ লাগে। এইত আমার কাজ। বই পড়া ও বাগান করা।
ওকালতনামা আইবির কাছ থেকে সেন্সার হয়ে এসেছে আমার সই নেবার জন্য। দেখলাম, দুইটা ওকালতনামায় না হলেও প্রায় ৪০জন এডভোকেট দস্তখত করেছেন। জেলগেটে কোর্ট করে বিচার হবে, কি চমৎকার ব্যবস্থা! আমাকে নাকি বাইরের কোর্টে নিলে, ভয়ানক গোলমাল হবে। এতই যদি ভয় হয়, তবে ছেড়ে দেও এবং ৬ দফার দাবি মেনে নেও।
আমি নাকি ভ্যানক প্রকৃতির লোক? আমাকে নাকি জেলগেট থেকে কেড়ে নিবে? তাই চারজন করে বন্দুকধারী সিপাহি রাখা হয়েছে-জেল দরজার কাছে। ইংরেজ আমল থেকে আমার এবার জেলে আসা পর্যন্ত একজন বন্দুকধারী পাহারা থাকত। ইংরেজ আমলে যখন বিপ্লবীরা গুলি চালায়ে সাদা চামড়াদের হত্যা করত তখনও একজন সিপাহি বন্দুক নিয়ে থাকত, এখন জেল সিপাহি একজন, আর্ম পুলিশ থেকে দুইজন, আর আনছার দুইজন। বন্দুক নিয়ে চব্বিশ ঘন্টা গেটের কাছে দাড়াইয়া পাহারা দেয়। ভয় নাই, ভয় নাই এ রাজনীতি এখনও আমরা করছি না। পালাব না, আর জেলগেট ভাঙতেও কেহ আসবে না।
আজ ডিপুটি জেলার সাহেব একবার এসেছিলেন।
আমার মুড়ি ফুরাইয়া গিয়াছিল, জমাদার সাহেব আজ মুড়ি কিনে দিয়েছেন।
আমার মুড়ি জেলখানায় খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সিপাহি, জমাদার ও কয়েদিদের মধ্যে থেকে অনেকে পালিয়ে মুড়ি খেতে আসে।
সুপ্রিম সোভিয়েত আলেক্সী কোসিগিনকে দ্বিতীয়বারের জন্য সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেছে। মি. কোসিগিন অভিযোগ করেছেন, ‘চীন সরকার সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাইয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ব্যাপক সাহায্য করিতেছে’। আমার মনে হয় কথাটার মধ্যে কিছুটা সত্য নিহিত আছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির বিভেদকে আমেরিকা পুরাপুরি ব্যবহার করতে ছাড়বে না।
৫ই আগস্ট ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
কয়েদিদের ধারণা, আমি ছাড়া পেলে ওদের মুক্তিরও একটা সম্ভাবনা আছে। একজন কয়েদি কিছুদিন পূর্বে ২০ বৎসর সাজা খেটে মুক্তি পেয়েছিল, তিন বৎসরের মধ্যেই আবার ২৫ বছর জেল নিয়ে ফিরে এসেছে। খবর নিয়ে জানলাম, যারা তাকে খুনের মামলায় সাক্ষী দিয়ে জেল দিয়েছিল তাড়া খুব প্রভাবশালী লোক। কোথায় একটা ডাকাতি ও খুন হলো আর তাকে আসামি করে সাক্ষী দিয়ে আবার সাজা দিয়ে দিয়েছে। শপথ করে বলল, এ ঘটনা সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না। বাড়ি যেয়ে বিবাহ করেছিল। ঠিক করেছিল যে কয়দিন বেঁচে আছে, সংসার করবে আর কোনো গোলমালের মধ্যে যাবে না। প্রথম যখন জেলে এসেছিল তখন যে স্ত্রীকে রেখে এসেছিল সে তারই এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে পরে বিবাহ বসে। চাচাতো ভাইয়ের ভয় হয়েছে, যদি প্রতিশোধ নেয়। তাই সেও তাঁর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আর একজন বরিশাল থেকে এসেছে। পূর্বে ২০ বৎসর জেল খেটে গেছে। এবার ২৫ বছর জেল নিয়ে এসেছে। ৪০-৫০ বভহর এমনকি ৭০ বৎসর জেল হয়েছে বিভিন্ন ডাকাতি ও খুন মামলায় এরকম কয়েদিও ঢাকা জেলে আছে। জেল খাটছে, হাসছে, খেলছে। ‘অল্প দুঃখে কাতর, অতি দুঃখে পাথর’, অনেকেই পাথর হয়ে গেছে। মনে করে এই জেলেই তাঁদের বাড়ি। জীবনে আর যাওয়া হবে না বাইরে। এতদিন জেল খাটলে কি আর বাচবে। তবুও আশা করে আর সুযোগ পাইলেই বলে, ‘স্যার, আপনি নিশ্চয়ই আমাদের ছাড়বেন, আপনি যদি ক্ষমতায় যান-জেল কি জিনিস আপনিই বোঝেন, তাই আমাদের ছেড়ে দিবেন’। মনে মনে বললাম, আমাকে এঁরা ছাড়বে না আর…
তোমাদের আশা এ জীবনে আর পূরন হবে না।
৬ই আগস্ট ১৯৬৬ ।। শনিবার
আজ জনাব আইয়ুব সাহেব তাঁর ‘কলোনি’ পূর্ব পাকিস্তান দেখতে আসবেন। মাঝে মাঝে মাইকের শব্দ আসে, হাওয়াই আড্ডায় যেয়ে পাকিস্তানের ‘লৌহ মানবকে’ সাদর অভ্যার্থনা জানাবার অনুরোধ। জনসাধারণ স্বইচ্ছায় যাবে কিনা এ সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে! তবে ছোট খাঁ সাহেব টাকায় ভাড়া করে কিছু লোক নেবার চেষ্টা করবেন। যদি এই দেশই হবে তবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসলেই তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এই অভ্যার্থনার প্রহসন কেন? আইয়ুব সাহেব সবই বোঝেন। মোনায়েম খান সাহেব তাঁর চাকরি রক্ষা করার জন্য এসমস্ত করে থাকেন, আর দুনিয়াকে দেখাতে চান, দেখ কত জনপ্রিয়তা! একবার যদি গণভোটের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা যাচাই করতেন তাহলে বুঝতে পারতেন তাঁর শোচনীয় অবস্থা। আশা করি তিনি নিজে ভাল করে বুঝে নিবেন অবস্থাটা। কারণ, এরপরও যদি এই জুলুম, অত্যাচার ও ধরপাকড় চলতে থাকে পরিণতি বোধহয় ভাল হবে না। ইত্তেফাক কাগজ সম্বন্ধে তিনি কিছু একটা করবেন অনেকেই আশা করেন। তবে আমার নিজের মতে, মোনেম খান তাঁর অনুমতি না নিয়ে এতবড় কাজ করতে সাহস পান নাই।
আজই দুইজন ছাত্রলীগের নেতাকে ডিপিআরএ গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছে। একজনের নাম নূরে আলম সিদ্দিকী, আর একজন খুলনার কামরুজ্জামান। এঁদের পুরানা ২০ সেলে রাখা হয়েছে, ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। নূরে আলম এম এ পরীক্ষার্থী, আগামী সেপ্টেম্বর মাসে পরীক্ষা।
সন্ধ্যায় আরও দুই ভদ্রলোককে জেলে আনল, একজন সন্ধ্যার পূর্বে, আর একজন তালাবন্ধ করার পরে। তাদেরও পুরানা ২০ সেলের ৪ নম্বর ব্লকে রাখা হয়েছে। খবর নিয়ে জানলাম একজনের নাম ফজলে আলী, তিন মাস পূর্বে চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হয়ে বিলাত থেকে এসেছেন। আর-একজন আলমগীর কবির, ন’মাস পূর্বে বিলাত থেকে এসেছেন-সাংবাদিক। কি করেছে জানি না, পূর্ব বাংলায় রাজনীতি করে নাই। কোনোদিন করলে নিশ্চয়ই আমি জানতাম। বিলাতে বসে কোনো কিছু করেছেন কি না জানি না। বিলাতি কায়দায় কাপড়-চোপড় পরে এসেছে। ভাবলাম, বেচারা কোথায় এসেছে একটু পরেই বুঝতে পারবে। দুনিয়ায় দোজখ, পাকিস্তানি জেল। দেড় টাকা খোরাক বাবদ সারাদিন ভরে। এঁদের ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে ওদের জায়গাটা দেখা যায়। ঐ ঘরে আমিও একদিন ছিলাম জাকির হোসেন সাহেবের বদৌলতে। কাপড়, জামা, বিছানা কিছুই আনে নাই। একেবারে নতুন লোক। বেশ কষ্ট হবে। বোধহয় বিলাত থাকতে পূর্ব বাংলার দাবি-দাওয়ার কথা একটু একটু বলে থাকবে। ইংরেজের গণতন্ত্র দেখে এসেছে। এইবার পাকিস্তানি গণতন্ত্র দেখবে।
এঁদের জন্য দুঃখ হলো কিছুটা। আইয়ুব সাহেব পৌছে গেছেন।আজ একজন সিপাহির কাছ থেকে শুনলাম। নিশ্চয়ই হুঙ্কার ছেড়েছেন।
৭ই আগস্ট ১৯৬৬ ।। রবিবার
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান ছয় দিন ব্যাপী সফরের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেছেন। আমি আশ্চর্য হলাম, প্রেসিডেন্ট কিভাবে এসব কথা বলতে পারেন। নিশ্চয়ই তিনি সরকার সমর্থকদের সম্বন্ধে বলেছে। তিনি বলেছেন, ‘বিভেদ সৃষ্টিকারীদের কার্যকলাপ যদি সকল সীমা অতিক্রম করে তাহা হইলে তাহাদের রোধ করিবার জন্য অন্য পন্থা অবশ্যই গ্রহণ করিতে হইবে’। তিনি আরও বলেন, ‘যে সকল বিভেদ সৃষ্টিকারী জাতীয় ঐক্য ও সঙ্ঘতির বিরুদ্ধাচারন করিতেছে তাহাদের বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইবার জন্য জনগণের কাছে আবেদন করেন।
সরকার পক্ষে মি. আফসার উদ্দিন, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, বিচার করেছেন। ২টা পর্যন্ত মামলা চলল। ৫জন সরকার পক্ষের সাক্ষী হাজির হয়েছিল। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের ১০ মাসের ১০ তারিখে মামলার তারিখ ঠিক হলো। বাকি সাক্ষ্য সেই দিন হবে। গতকার তেজগাঁ থেকে আরও কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। ফজলে আলী ও আলমগীর কবিরকে ডিপিআর-এ ধরে এনেছিল। ২০ সেলের সামনে রেখেছিল, আজ তাঁদের অন্য কোনো জায়গায় নিয়ে গেল। যারা তাঁদের দিতে গিয়েছিল তাঁদের কাছ থেকে খবর পেলাম পুরানা হাজতে নিয়ে গেছে। ভালই হয়েছে, নুতন লোক সেলে কষ্ট হতেছিল।
আজ আমার তিন মাস পূরন হলো। ডাইরি লেখাও শেষ করলাম। আগামীকাল থেকে ছোটখাট ঘটনাগুলো লিখবো। নোটিশ পেয়েছি আর একটা মামলা জেল গেটে হবে সে মামলাটাও বক্তৃতা করার জন্য। আব্দুল মালেক, ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণী, নোটিশ দিয়েছে। আগামী ১৭ই সেপ্টেম্বর জেলগেটে মামলা আরম্ভ হবে।
সিলেট আওয়ামী লীগ সপাদক আবদুর রহীম ও সহ-সভাপতি জালাল উদ্দিন আহম্মদ এডভোকেটকে পূর্ব পাকিস্তান ডিপিআর-এ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আওয়ুব খান সাহেবের সফর উপলক্ষ্যে গোলমাল নাকি হয়েছিল তাঁর সভায়। ছাত্র ও ন্যাপ কর্মীদের কয়েকজনকেও গ্রেপ্তার করেছে।
৩রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ ।। শনিবার
নূরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। একজন ভাল কর্মী, বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে। ১/২ খাতায় রেখেছে। ডেপুটি জেলার সাহেবকে বলেছি একটু ভাল জায়গায় রাখতে। কিছুদিন পূর্বে মাহমুদুউল্লাহ সাহেব, মোস্তফা সরোয়ার, হাফেজ মুছা, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী এবং রাশেদ মোশাররফকে সরকার মুক্তি দিয়েছে।
৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৬ ।। বুধবার
রেণু দেখা করতে এসেছিল। রেহানার জ্বর, সে আসে নাই। রাসেল জ্বর নিয়ে এসেছিল। হাচিনার বিবাহের প্রস্তাব এসেছে। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেটাকে পছন্দও করেছে। ছেলেটা সিএসপি। আমি রাজবন্দি হিসেবে বন্দি আছি জেনেও সরকারি কর্মচারী হয়েও আমার মেয়েকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দিয়াছে। নিশ্চয়ই তাহার চরিত্রবল আছে। মেয়েটা এখন বিবাহ করতে রাজি নয়। কারণ আমি জেলে, আর বিএ পাশ করতে চায়।
আমি হাচিনাকে বললাম, ‘মা আমি জেলে আছি, কতদিন থাকতে হবে, কিছুই ঠিক নাই। তবে মনে হয় সহজে আমাকে ছাড়বে না, কতগুলি মামলাও দিয়েছে। ব্যবসা-বানিজ্য ধ্বংস হয়ে চলেছে। তোমাদের আবারও কষ্ট হবে। তোমার মা যাহা বলে শুনিও’। রেণুকে বললাম, ‘আর কি বলতে পারি?’ আবার বললাম, ’১০ তারিখে মামলা আছে। আকরাম ও নাছেরকে পাঠাইয়া দিও। বাচ্চারা কেমন আছে জানাইও’।
৮ই সেপ্টেম্বর
আজ চার মাস পূর্ব হলো আমি জেলে এসেছি। ডিপিআর-এর বন্দি আমি। এ দুঃখ রাখার জায়গা নাই।
১৬ই সেপ্টেম্বর
বৃষ্টি বৃষ্টি আর বৃষ্টি। গতকাল সারাদিন ও সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। দেশের অবস্থাও খুবই ভয়াবহ। বৎসরে দুবার বন্যা, তারপর আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শুনলাম, ঢাকা শহরের অধিকাংশ জায়গা বন্যার পানিতে ডুবে গিয়াছে। আমি যে ঘরটাতে থাকি এটা বোধহয় দুইশত বৎসরের পুরানা। সমস্ত জায়গা দিয়েই বোধহয় পানি পড়ে। গত রাতটা কোনোমতে কাটাইয়াছি। সামান্য একটু জায়গা প্রায়ই ফাঁক আছে, যেখান দিয়ে পানি পড়ে না। ঘরটার ভিতরে পানির ঢেউ খেলেছে সারাদিন। তিনজন লোক সারাদিন আমার জিনিসপত্র রক্ষা করতে ব্যস্ত রয়েছে। বিছানা থেকে নামার উপায় নাই। খবর পেয়ে জেলার সাহেব, ডেপুটি জেলার সাহেব ও জমাদার সাহেবরা এসেছিলেন। বললেন, ‘কি করে এখানে থাকবেন? পাশেই নতুন ২০ সেলের একটা চার সেলের ব্লক আছে, সেখানে থাকুন। বললাম, ‘সেলের ভিতর, তাঁর উপর পায়খানা প্রসাবখানা নাই, কেমন করে থাকব? একটা টিন দিয়ে দিবেন ওতে আমার চলবে না। আমাকে ভাল জায়গা দিতে হলে সরকারের অনুমতি লাগবে, কি বলেন? রাতে ঘুমাব না, তাতে কি হবে? জীবনে অনেক দিন না ঘুমাইয়া কাটাইয়াছি। যদি স্বায়ত্তশাসন ও ৬ দফা আদায় করে নিতে পারি নিব। তবে আমরা রাজবন্দিরা তো খুনি, ডাকাত, একরারীর থেকেও আজকাল খারাপ! দেখুন পুরাআ ২০ সেলে রণদা সাহেব বার-এট-ল’, বাবু চিত্ত সুতার ভূতপূর্ব এমপিএ, আব্দুল জলিল এডভোকেট, দুইজন ছাত্র-একজন এমএ পরীক্ষা দিবে নূরে আলম সিদ্দিকী, আর একজন বিএ পরীক্ষা দিয়েছে কামরুজ্জামান। আরও আছে শংকর বাবু, পুরানা রাজনৈতিক কর্মী বাড়ি রংপুর, আরও কয়েকজনকে রেখেছেন। তাঁদের অবস্থা কি? উপর দিয়ে পানি পড়ে। দরজা দিয়ে পানি ঢোকে, একটা করে টিনের পায়খানা। ৭ সেল অনেক ভাল। সেখানে রেখেছেন একরারীদের, আরও অনেক জায়গা ভাল আছে সেখানেও রাখতে পারেন, কিন্তু রাখবেন না। কষ্ট দিতে হবে। আপনারা আমাদের বাধ্য করেছেন মোকাবেলা করে দাবি আদায় করতে’।
বিশাবস বোধহয় অনেকেই করবেন না, কিন্তু সত্য কথা রতন নামের আট বৎসরের ছেলে ডিপিআর আইনে জেলে বন্দি আছে, আজও ছাড়া হয় নাই। কুমিল্লা জেলায় বাড়ি। রতনের বাবা চলে গেছেন ত্রিপুরা রাজ্যে। দুই কাকা পাকিস্তানে আছে, বর্ডারে বাড়ি। ভারতে আবার কষ্ট হলে ওর বাব মা কাকাদের কাছে পাঠাইয়া দেয়। যুদ্ধ বেধে গেলে ওর কাকাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। ওরা খবর নিয়ে জানল ওর বাবা ভারতে থাকে, তাই ওকেও গ্রেপ্তার করে নিয়ে এল কাকার সাথে। কাকা ‘পাকিস্তানি’ বলে মুক্তি পেয়েছে। রতন ‘ভারতীয়’ তাই মুক্তি পায় নাই, জেলেই আছে। ওকে আমাকে একজন কয়েদি দেখাল। কোলে করে বলল, সার ডিপিআরএ বন্দি আজ দশ মাস হলো, আর কতকাল থাকতে হয়! এই দুধের বাচ্চার কে আছে? এমন আশ্চর্য ঘটনা অনেক ঘটেছে এই দেশে।
কারাগারে সাক্ষাৎ
জেল কারাগারে সাক্ষাৎ করতে যারা যায় নাই তাহারা বুঝতে পারে না সেটা বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। ভুক্তভোগীরা কিছু বুঝতে পারে। কয়েদিরা সপ্তাহে একদিন দেখা করতে পারে আত্মীয় স্বজনের সাথে। সকাল বেলা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দরখাস্ত করতে হয়। তারপর জেল কর্তৃপক্ষ দরখাস্তগুলি দেখে নেয় এবং সাক্ষাতের অনুমতি দেয়। গেট থেকে বিকালে যে যে দেখা পাবে তাঁদের নাম ধরে জেলের ভিতর যেয়ে চিৎকার করে কয়েদি পাহারারা ডাকতে থাকে এবং অনুমতিপত্র দিয়ে যায়। দূর দূর থেকে আত্মীয়স্বজন ভোর বেলা থেকে জেল গেটের বাইরে বসে থাকে-ছেলেমেয়ে, বুড়া-বুড়ি, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে। তারপর বেলা ৩টা থেকে নামডাকা শুরু হয়। এক সাথে ১০-১২ জন। একই জানলা দিয়ে কথা বলতে শুরু করে। ভিতরের দিকে কয়েদিরা বাইরের দিকে তাঁদের আত্মীয়স্বজন মধ্যখানে লোহার জালের বেড়া ভাল করে চেহারাও দেখা যায় না। দুই চার মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করতে হয়। দেখাও শেষ করতে হয়। ছেলেকে দেখতে আসে বৃদ্ধা বাবা-মা, বাবাকে দেখতে আসে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে, স্ত্রীকে দেখতে আসে স্বামী, স্বামীকে দেখতে আসে স্ত্রী। শুধু চিৎকার ও কান্না। দূরে সরে আসে কারাপ্রাচীরের অন্তরালে কয়েদি। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে চলে যায়। হতভাগাদের আত্মীয় স্বজন বহু দূর থেকে আসে, কেহ বা বরিশালের পটুয়াখালী বা ভোলা থেকে, কেহ বা ময়মনসিংহ বা ফরিদপুর থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। তবুও আসে দেখতে কেমন আছে তাঁদের আপনজন। এই সাক্ষাৎকে প্রহসনও বলা চলে। অনেক সময়ে কিছু টাকা খরচ করে ভিতরে গেটে এসেও কয়েক মিনিট দেখা করে থাকে কিছু কিছু লোক। না দেখলে বা না ভুগলে কেউই বুঝবে না যখন সাক্ষাৎ হওয়ার পরে ছাড়াছাড়ি করতে হয় তখনকার অবস্থা। সিপাহি ও কর্মচারীদের মধ্যে অনেকে আছে যারা এঁদের দুঃখ দেখে দুঃখিত হয়। তারপর আস্তে আস্তে তারাও মেশিনের মতো শক্ত হয়ে যায়।
আমরা যারা রাজবন্দি তাড়া আধ ঘন্টা থেকে একঘন্টা সময় পাই। পাশাপাশি বসে আইবি অফিসারদের শুনিয়ে কথা বলে থাকি। দুঃখ হয় যখন বৃদ্ধা মা-বাব, স্ত্রী এবং ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা বিদায় নেয়, কেহ বা কাদতে কাঁদতে, কেহ বা মুখ কালো করে।
“চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি? তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে”।
এ খাতাটি ১৯৬৭ সালে লেখা। ১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দি। তাঁর বিরুদ্ধে ১১ টি মামলা দায়ের করেছে আইয়ুব-মোনায়েম সরকার। একটি ছোট্ট বাঁধানো খাতা। ২৪০ পৃষ্ঠার। তাঁর কারাগারের জীবনযাপন, ব্যক্তিগত ভাবনা, পারিবারিক কথা ছাড়াও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে অনেক কথাই এ খাতায় লিখেছেন।
কারাগারের রোজনামচা (২০১-২৫০)
ইউনিকোড রূপান্তরঃ জুলকার নাইন
১ল জানুয়ারি-২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭
শরীরটা খারাপ নিয়ে নতুন বৎসর শুরু। চোখের অসুখে ভুগছিলাম, এখন একটু আরামের দিকে। পায়ে একটা ফোড়া হয়েছিল। এখন এটা কারবানক্যল হয়ে গেছে। ৬/৭ তারিখে জেলগেটে মামলা হবে। হাঁটতে পারি না, তবুও যেতে হবে। কারণ ডাক্তার সাহেব ও সিভিল সার্জন সাহস পাআয় না আমাকে অসুস্থ ঘোষণা করতে। যদি সরকার রাগ হয়, বদলি করে দেয়। বললাম, স্ট্রেচার নিয়ে আসুন, যাবো। স্ট্রেচার প্রস্তুত, হাকিম শুনে তো অস্থির। স্ট্রেচারে এনে মামলা করলে হৈচৈ হয়ে যাবে। তাই হাকিম সাহেব আমার এডভোকেট সালাম সাহেবের সাথে পরামর্শ করে মামলার শুনানি বন্ধ করে দিলেন। আমাকে আর গেটে নেওয়া হলো না। কারবানক্যল সারতে বেশ কয়েকদিন লাগল। ৭/৮দিন প্রায় শুয়েই কাটালাম।
১১ তারিখে রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখাঁ করতে। আগামী ১৩ই ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নিবে না। ঈদ করবে না। কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন কর।
এই ঈদটা আমি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার আব্বা ও মায়ের কাছে বাড়িতেই করে থাকি। ছোট ভাই খুলনা থেকে এসেছিল আমাকে নিয়ে বাড়ি যাবে। কারণ কারও কাছে শুনেছিল ঈদের পূর্বেই আমাকে ছেড়ে দিবে। ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি নাই। ওরা বুঝতে শিখেছে। রাসেল ছোট্ট তাই এখনও বুঝতে শিখে নাই। শরীর ভাল না, কিছুদিন ভুগেছে। দেখা করতে এলে রাসেল আমাকে মাঝে মাঝে ছাড়তে চায় না। ওর কাছ থেকে বিদায় নিতে কষ্ট হয়। আমিও বেশি আলাপ করতে পারলাম না শুধু বললাম, “চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোনো আঘাতেই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে”। ওদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় রেণুকে বললাম, বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, নাহলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে।
রাত্র ১০টায় হৈ চৈ, আগামীকাল ঈদ হবে।
১২ই সকালবেলা জেলের মধ্যে ঈদ হবে, কারণ সরকারের হুকুম। অনেক সিপাহি ও জেল কর্মচারী রোজা ভাঙতে রাজি হয় নাই। তবে কয়েদিদের নামাজ পড়তেই হবে, ঈদ করতেই হবে। শুনলাম পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি লোক চাঁদ দেখেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে উন্নতি হলে পূর্ব বাংলার উন্নতি হয়! হাজার মাইল দূরে পশ্চিম পাকিস্তানে চাঁদ দেখেছে, এখানে নামাজ পড়তেই হবে। আমাদের আবার নামাজ কি! তবুও নামাজে গেলাম, কারণ সহকর্মীদের সাথে দেখা হবে। এক জেলে থেকেও আমার নিজের দলের নেতা ও কর্মীদের সাথে দেখা করার উপায় নাই। আমি এক পার্শ্বে আর অন্যান্যরা অন্য পার্শ্বে।
রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় আলাদা আলাদা করে রাখা হয়। ২ নম্বর ব্লকে শ্রমিক কর্মীদেরই বেশি রাখা হয়েছে। নামাজের আগে রুহুল আমিন, সহিদ (তেজগাঁও), আদমজীর সফি আরও অনেকে ছুটে এল আমার কাছে। শাহজাহানপুরে আমার সহকর্মী আব্দুল কাদের ব্যাপারীর ছেলেকেও ধরে এনেছে। তাঁর নাম সিদ্দিক। প্রেসে নাকি কি কাগজ ছাপাইয়াছে। ন্যাপের হালিম, ভাগ্নে মণি পুরানা হাজত থেকে তারা এসেছে। এক জেলে থাকি আমার ভাগ্নে আমার সাথে দেখা করতে পারে না। কি বিচার!
১০ সেল থেকে শামসুল হক, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মোল্লা জালাল, মহীউদ্দিন (খোকা), সিরাজ, হারুন, সুলতান এসেছে। দেখা হয়ে গেল, কিছু সময় আলাপও হলো। এঁরা সকলেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী। রহিকুল ইসলাম, বজলুর রহমান ও শাহ মোয়াজ্জেম নামাজে আসে নাই।
আমার কাছাকাছিই থাকে ছাত্রলীগ কর্মী নূরে আলম সিদ্দিকী ও খুলনার কামরুজ্জামান, ছাত্র ইউনিয়নের রাশেদ খান মেনন এবং আওয়ামী লীগের নূরুল ইসলাম। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতারও আছেন। আমার পায়ে ব্যথা, তাই বসে বসেই মিললাম সকলের সাথে। কারাগার থেকেই দেশবাসী ও সহকর্মীদের জানাই ঈদ মোবারক। পূর্ব বাংলার লোক সেইদিনই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে পারবে, যেদিন তারা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে, এবং দেশের সত্যিকারের নাগরিক হতে পারবে।
নামাজ আমাদের আজই পড়তে হয়েছে। বাড়ির থেকে খাওয়া দাওয়া কিছুই আসে নাই। কারণ বাইরের লোক তো আমাদের মত বন্দি না, তারা ১৩ তারিখেই ঈদ করবে। ১৩ তারিখেই শতকরা ৯০ জন লোক ঈদ করেছে। কিন্তু কারাগারে খাওয়ার বন্দোবস্তও ১২ তারিখেই হয়েছে।
আজ ১৩ তারিখ খবর পেলাম ঢাকায়ও আজ নামাজ হয়েছে। অনেকেই নামাজ পড়েছে। জেল কর্মচারীরা আজই দেখা করতে এসেছে। তাঁদের কথা হলো চাকরি করে বলে নামাজও সরকারের ইচ্ছায় পড়বে নাকি?
আজ ১০ সেল থেকে খাবার এসেছে আমাদের জন্য, ২৬ সেলের নিরাপত্তা বন্দীরাও পাঠাইয়াছেন। আমার তো কিছু করার উপায় নাই, একলা মানুষ, এক জায়গায় থাকি। রোজ পাঁচ টাকা দেয়, ৪/৫জন লোক নিয়ে খেতে হয়, টাকা বাঁচাব কি করে? তাই কিছুই করি নাই। দেখি ১১টার সময় বেগম সাহেবা খাবার পাঠাইয়াছে। কিছু কিছু অন্যান্য জায়গায় পাঠাইলাম। যার যা ছিল পুরানা ২০ সেলের রাজবন্দিদের নিয়ে আজ এক জায়গায় বসে খাব, বলে দিলাম। আইন আজ আর মানি না। তাই সকলকে নিয়ে আমার জেলখানার ঘরে বিছানা পেতে এক সাথে খেলাম। যে ৬০/৭০ জন কয়েদি সেল এলাকায় ছিল তাদেরও কিছু কিছু দিলাম। পান সিগারেট আনাইয়া রেখেছিলাম। কয়েদিরা আমার সাথে যারা দেখা করতে এসেছিল তাদেরও দিলাম। ৪০ সেলের পাগল ভাইদের কিছুই দিতে পারলাম না, সংখ্যায় তারা প্রায় ৭০ জন। সরকার টাকা আনতে দেয়না রাজবন্দিদের। ফল ফলাদিও বন্ধ। তবুও ঠিক করেছি ওদের কিছু আনাইয়া খাওয়াতে হবে। কয়েদিদের ‘পোলাও’ দিয়েছিল। মুখে দিয়ে দেখলাম পোলাও না, একটু ভালো করে রান্না ভাত। অনেক দিন ধরে কয়েদির খাবার খরচের থেকে টাকা বাঁচাইয়া একদিন ভাল খাওয়াবে। কি আর বল্ব, চোরের টাকা চুরি করে খায় আজকাল আমাদের মেসের কিছু কিছু কর্মচারী। পূর্বেও জেলে ছিলাম একটা চক্ষুলজ্জা ছিল, এখন তাঁর বালাই নাই। লুট চলছে, কেউই দেখার নাই। এক কয়েদি আমাকে বলল, “দেখুন স্যার আমরা চোর, পেটের দায়ে চুরি করে জেলে এসেছি, আর আমাদের খাবার থেকে চুরি করে খেয়ে কেমন মোটা হয়েছে জেলের কিছু কর্মচারী”। আমি বললাম, “সকলে তো চুরি করে না”। সে বলল, “যার হাত আছে সেই চুরি করে খায়”। আমার বুঝতে বাকি রইল না কাকে বলছে।
১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে। বাইরে সকলেই ১৩ তারিখে ঈদ করেছে। ঈদের আনন্দ তো বন্দিদের থাকতে পারে না! তারপর আবার রেণু এক দুঃখের সংবাদ আমাকে জানাল। আমার ফুফাতো ভাই, ক্যান্সার হয়েছিল, মারা গিয়াছে। মাদারীপুরে বাড়ি-ছোট বেলায় আমার ফুফা ও ফুফু মারা যান, আমার আব্বাই ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন, ম্যাট্রিক পর্যন্ত আমরা এক সাথেই ছিলাম। সিভিল সাপ্লাই অফিসে সামান্য চাকরি করত। কয়েকটা ছেলেমেয়ে রেখে গিয়াছে, জমিজমা যা ছিল প্রায়ই আড়িয়াল খাঁ নদী গ্রাস করে নিয়েছে। কি করে এঁদের চলবে? ছেলেমেয়েগুলি ছোট ছোট।
সময় কেটে গেল, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি এসে শুয়ে পড়লাম, আর ভাবলাম এই তো দুনিয়া! রাত কেটে গেল, খাওয়া দাওয়া ভাল লাগল না। ছোট বেলায় আমি আর আমার ফুফাতো ভাই ৭/৮ বৎসর এক ঘরেই থেকেছি। ওর ডাকনাম ছিল তারা মিয়া।
১৫ তারিখে ৪০ সেলের পাগলা গারদের পাগল ভাইদের জন্য নিজেই মুরগি পাক করে পাঠাইয়া দিলাম। আমি না খেয়ে জমাইয়া ছিলাম। আমার যাওয়ার হুকুম নাই ওদের কাছে – যদিও খুবই কাছে আমি থাকি। জমাদার সাহেবকে ডেকে বললাম, আপনি দাঁড়াইয়া থেকে ওদের মধ্যে ভাগ করে দিবেন। তিনি তাই করলেন। ওরা যে আমার বহুদিনের সাথী, ওদের কি আমি ভুলতে পারি? ভুলতে চেষ্টা করলেও সন্ধ্যার পরে ওরা আমাকে মনে করাইয়া দেয় – যখন ওরা আপন মনে চিৎকার করে আবার কেউ অদ্ভুত স্বরে গানও গায়।
মহা হৈ চৈ জেলের ভিতর। কারণ জেলের আইজি সাহেব ঢাকা জেল দেখতে আসবেন আগামীকাল। রাস্তাঘাট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হবে কয়েদিদের। চুনা লাগানো হবে। জনাব নিয়ামতুল্লা আইজি হবার পূর্বে এই জেলেই সুপারিনটেনডেন্ট এবং ডিআইজি হিলেন। তিনি ময়লা আবর্জনা দেখলে ক্ষেপে যান-সকলেই জানে। চমৎকার ব্যবহার, অমায়িক, ভদ্র, কোনো কয়েদি কষ্ট পাক এ তিনি চান না। আমি নিজেই দু’বার তাঁর সময়ে এই জেলে এসেছি। আমার সাথে তাঁর পরিচয় ছিল। এবারও যখন জেলে এসেছি তিনি খবর পেয়েই আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তিনি স্কল কয়েদিদেরই সুবিধা অসুবিধা দেখতেন। আমার দিকে তিনি ব্যক্তিগত নজর দিতেন। সাধারণ কয়েদিরা তাকে ভয়ও করে এবং ভক্তিও করে। কাহাকেও তিনি অন্যায়ভাবে কষ্ট দিতেন না। কয়েদিদের খাওয়া ও কাপড়ের দিকে নজর দিতেন। তিনি জেল দেখতে এসে আমার কাছে এলেন, বসলেন। আমার কিছু বলার আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। আমি সাধারণত কিছু বলি না, কারণ নিজের ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারলেই বেঁচে যাই। আমি বললাম, ভালই আছি। ডিপিআরের রাজনৈতিক বন্দিদের অসুবিধার কথা বললাম। ‘এ’ ‘বি’ ‘সি’ ভাগ না করে এক ক্লাশই করলে ভাল হয়। প্রায় সকলকেই ‘সি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। দেড় টাকায় কি করে চলতে পারে খাবার, নাস্তা, চা ইত্যাদি। আবার কিছুই বাড়ি থেকে আনতে দিবে না। মাসে পাঁচ টাকা দেয় কাগজ, দাতন, সাবান, তোয়ালে ইত্যাদি কিনতে। একটা খবরের কাগজ কিনতে তো ছয় টাকা লাগে মাসে। তাঁর সহানুভূতি থাকা স্বত্বেও কিছু করার নাই, কারণ সরকারের হুকুম।
পাগলদের ৪০ সেলে দেখাইয়া বললাম, দেখেন জেলের মধ্যে কি অবস্থা, আমাদের মত হতভাগাদের কি অসুবিধা হয়। হঠাত গম্ভীর হয়ে বললেন, কি করা যাবে, এতগুলি পাগল কোথায় রাখব? ব্যবস্থা তো নাই। আমি বললাম, চিন্তা করবেন না, প্রথম বেশ কষ্ট হয়েছিল। এখন সয়ে গেছে। সেলগুলির কথা বললাম। দশ সেল, পুরানা বিশ সেল, নূতন বিশ সেলে রাজনৈতিক বন্দিদের অসুবিধার কথাও বললাম। সাধারণ কয়েদিদের বিষয় আলোচনা হলো। তিনি বললেন, আপনাকে তো একলাই রাখা হয়েছে। বললাম, ‘আপনারা কি করবেন, উপায় নাই যে। ‘বড়কর্তারা’ হুকুম দিয়েছে একাই থাকতে হবে’। তিনি বললেন, ‘দেখি চেষ্টা করে কিছু করা যায় কিনা’। তাঁর সহানুভূতি থাকলেই বা কি হবে! পূর্ব বাংলার মোতয়াল্লি সাহেবের নজর বোড় খারাপ আমার ও আমার পার্টির কর্মীদের উপর। জেলের ভিতরও যাতে কষ্ট পাই তাঁর চেষ্টা তিনি করেন। আইজি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি আমার বই পড়ার কাজে মন দিলাম।
২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৭ ।। ৮ই ফাল্গুন
আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। ঠিক পনের বছর আগে সেদিন ছিল বাংলা ১৩৫৮ সালের ৮ই ফাল্গুন, বৃহষ্পতিবার, ইংরেজি ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য শহীদ হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের কয়েকজন বীর সন্তান: ১। আব্দুস সালাম, ২। আবদুল জব্বার, ৩। আবুল বরকত, ৪। রফিকউদ্দিন। আহত হয়েছিলেন অনেকেই। ঠিক পনের বৎসর পূর্বে এইদিনে আমিও জেলে রাজবন্দি ছিলাম ফরিদপুর জেলে। ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করি। জানুয়ারি মাসে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনশন করব আর ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দিবস পালন করা হবে বলে স্থির হয়। আমাকে আবার জেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো চিকিৎসা না করে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি আমাকে ও মহিউদ্দিনকে ফরিদপুর জেলে চালান দেওয়া হলো। মহিউদ্দিনও আমার সাথে অনশন করবে স্থির করে দরখাস্ত দিয়েছিল।
আজ ঠিক পনের বৎসর পরেও এই দিনটিতে আমি কারাগারে বন্দি।
প্রথম ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১১ই মার্চ ১৯৪৮ সালে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ (এখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ) ও তমদ্দুন মজলিসের নেতৃত্বে। ঐদিন ১০টায় আমি, জনাব শামসুল হক সাহেব সহ প্রায় ৭৫ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হই এবং আব্দুল ওয়াদুদ-সহ অনেকেই ভীষণভাবে আহত হয়ে গ্রেপ্তার হয়।
১৫ই মার্চ জনাব নাজিমুদ্দীন (তখন পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিস্টার ছিলেন) সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলাপ করে ঘোষণা করলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান আইন সভা হতে প্রস্তাব পাশ করাইবেন বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে’। সকল বন্দিকে মুক্তি দিবেন এবং নিজেই পুলিশের অত্যাচারের তদন্ত করবেন। ঐদিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তি পাই। ১৬ই মার্চ আবার বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সভা হয়, আমি সেই সভায় সভাপতিত্ব করি। আবার বিকেলে আইন সভার সামনে লাঠি চার্জ হয় ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। প্রতিবাদের বিষয় ছিল, ‘নাজিমুদ্দীন সাহেবের তদন্ত চাই না, জুডিশিয়াল তদন্ত করতে হবে’। ২১ শে মার্চ বা দুই একদিন পরে কায়েদে আজম প্রথম ঢাকায় আসবেন। সেই জন্য আন্দোলন বন্ধ করা হলো। আমরা অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। তিনি এসে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’। ছাত্ররা তাঁর সামনেই কনভোকেশনে প্রতিবাদ করল। রেসকোর্স ময়দানেও প্রতিবাদ উঠল। তিনি হঠাত চুপ করে গেলেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন এরপরে কোনোদিন ভাষার ব্যাপারে কোনো কথা বলেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রত্যেক বৎসর ১১ই মার্চকে ‘ভাষা দিবস’পালন করেছে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগ (এখন আওয়ামী লীগ) এই একই দিনে ‘ভাষা দিবস’ পালন করেছে। ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দান সবচেয়ে বেশি। পরে ইয়ুথ লীগও আন্দোলনে শরীক হয়েছে।
১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যে ওয়াদা আইনসভায় করেছিলেন, ১৯৫২ সালে ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তা ভেঙ্গে পল্টনের জনসভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই রাষ্ট্রভাষা হবে’। তখন প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। আমি তখন বন্দি অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত্রের অন্ধকারে মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের সহায়তায় নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শ করে ২১ শে ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদের দিন স্থির করা হয়। কারণ ২১ শে থেকে বাজেট সেশন শুরু হবে। আমি ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করব মুক্তির জন্য। কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, মোল্লা জালালউদ্দিন, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দীন, খালেক নেওয়াজ, আজিজ আহম্মদ, আবদুল ওয়াদুদ ও আরো অনীক গোপনে গভীর রাতে আমার সঙ্গে দেখা করত।
তখন জনাব নূরুল আমীন মুখ্যমন্ত্রী। ২১ শে ফেব্রুয়ারি গুলি হলো। আমার ভাইরা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত করল।
এইদিন আমাদের কাছে পবিত্র দিন। ১৯৫৫ সালে নূতন কেন্দ্রীয় আইন সভায় আওয়ামী লীগ ১২ জন সদস্য নিয়ে ঢুকল এবং তাঁদের সংগ্রামের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা বাধ্য হলো ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে বাংলা ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে। আওয়ামী লীগ যখন ১৯৫৬ সালে ক্ষমতায় বসল তখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করল। ১৯৫৭-৫৮ সালে এই দিবসটা সরকারিভাবেও পালন করা হয়েছে। শহীদ মিনার করার জন্য পরিকল্পনা করে বাজেটে টাকা ধরে কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হওয়ার পরে এই দিনটি সরকারি ছুটির তালিকা থেকে বাদ পড়ল, আর মিনারটা চুনকাম করেই শেষ করে দেওয়া হলো।
আমি কারাগারের এই ছোট্ট ঘরটি থেকে আমার আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই বাংলার যুব সমাজ ও জনসাধারনকে আর শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামন করি।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মজহারুল হক (বাকী) জামিন পেয়ে এতদিন জেলের বাহিরে যেতে পারে নাই। আজ সকালে তাকে কোর্টে পাঠাইয়া দিয়েছে। জেল হাজত থেকে মুক্তিপেয়ে শহীদ দিবস পালন করছে।
২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ ।। শনিবার
আজ আমার ১১টি মামলার একটা মামলা জেলেগেট, যার বিচার চলছে জনাব আফসারউদ্দিন সাহেবের কোর্টে; তাঁর আর্গুমেন্ট হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হতে পারে নাই। কারণ আমার এডভোকেট জনাব সালাম খান সাহেব এবং জহিরুদ্দিন সাহেব উপস্থিত হতে পারেন নাই। জনাব মাহমুদুল্লা সাহেব হাজির হয়ে দরখাস্ত করেছিলেন, আমি উপস্থিত ছিলাম। স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হবার কথা, কখন শুরু হবে? তিনি বলেছেন, আসামি কারাগারে সরকারের তত্ত্বাবধানে আছেন। সরকার ইচ্ছা করলেই হাজির করতে পারেন।
আফসারউদ্দিন সাহেবের কোর্টে মামলার দিন ঠিক হয়েছে মার্চ মাসের ১৮ তারিখে। যাহা হউক, এই মামলা দুই মাসের মধ্যেই যা হয় একটা হয়ে যাবে। আবার নতুন মামলা শুরু হবে। আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে বললাম, চিন্তা করি না; ১১টা মামলা, চিন্তা করে কি হবে! গাঁ ভাসাইয়া দিয়াছি। ‘সাগরে শয়ন যার শিশিরে কি ভয় তাঁর’।
ভেবেছিলাম বড় ছেলেটি আসবে, বাসার খবর পাব। বোধ হয় আসতে পারে নাই। এ সপ্তাহে বাড়ির থেকে ‘দেখাও’ আসে নাই। বোধহয় অনুমতি পায় না।
১লা মার্চ ১৯৬৭ ।। বুধবার
গতকল্য মোলাকাত হয়েছে ছেলেমেয়েদের সাথে। শরীরটা যে ভাল যেতেছে না একথা বললাম না-গোপন করলাম যাতে চিন্তা না করে। কারাগারে দিনগুলি কেটে যেতেছে। বই পড়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় নাই। খবরের কাগজ আর বই। খবরের কাগজগুলি খুললে শুধু আইয়ুব খান সাহেব ও মোনায়েম খান সাহেবের বক্তৃতা। মোনায়েম সাহেব তো রোজই একটা করে বিবৃতি অথবা বক্তৃতা দেন। শেষ পর্যন্ত মাওলানা ভাসানী সাহেবকে পরাজিত হতে হয়েছে মোনায়েম সাহেবের কাছে। এককালে খবরের কাগজে ভাসানী সাহেবকে পাওয়া যেত এখন খান সাহেবকে পাওয়া যায়। পূর্ব বাংলার একমাত্র প্রতিনিধি যিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেবের কাছ থেকে নিয়োগ পত্র পেয়েছেন।
১৬ই মার্চ ১৯৬৭ ।। বৃহস্পতিবার
পাবনায় ভুট্টা খাওয়া নিয়ে ভীষণ গোলমাল চলেছে। প্রায় তিনশত লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। একজন লোক মারা গিয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা ভুতপূর্ব মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ভূতপূর্ব এমএএন জনাব আমজাদ হোসেন, জনাব আমিনউদ্দিন, আওয়ামী লীগ শ্রমিক নেতা আমজাদ হোসেন উকিল আরও বহুনেতা ও ছাত্র কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ত্রাসের রাজত্ব চলেছে সেখানে। অত্যাচার চরমে উঠেছে। ঘরে ঘরে যেয়ে অত্যাচার করছে। পূর্ণ সঠিক খবর এখনও পাই নাই।
১৭ই মার্চ ১৯৬৭ ।। শুক্রুবার
আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই-বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধহয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই। ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস;! দেখে হাসলাম। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করতে অনুমতি কি দিবে? মন বলছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালই হত। ১৫ তারিখেও রেণু এসেছিল জেলগেটে মণির সাথে দেখা করতে।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে নূরে আলম-আমার কাছে ২০ সেলে থাকে, কয়েকটা ফুল নিয়ে আমার ঘরে এসে উপস্থিত। আমাকে বলল, এই আমার উপহার, আপনার জন্মদিনে। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। তারপর বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার একটা রক্তগোলাপ এবং বাবু সুধাংশু বিমল দত্তও একটি সাদা গোলাপ এবং ডিপিআর বন্দি এমদাদুল্লা সাহেব একটা লাল ডালিয়া আমাকে উপহার দিলেন।
আমি থাকি দেওয়ানী ওয়ার্ডে আর এঁরা থাকেন পুরানা বিশ সেলে। মাঝে মাঝে দেখা হয় আমি যখন বেড়াই আর তারা যখন হাঁটাচলা করেন স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য।
খবরের কাগজ পড়া শেষ করতে চারটা বেজে গেল। ভাবলাম ‘দেখা আসতেও পারে। ২৬ সেলে থাকেন সন্তোষ বাবু, ফরিদপুরে বাড়ি। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী দলে ছিলেন, বহুদিন জেলে ছিলেন। এবারে মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পরে জেলে এসেছেন, ৮ বৎসর হয়ে গেছে। স্বাধীনতা পাওয়ার পরে প্রায় ১৭ বৎসর জেল খেটেছেন। শুধু আওয়ামী লীগের ক্ষমতার সময় মুক্তি পেয়েছিলেন। জেল হাসপাতালে প্রায়ই আসেন, আমার সাথে পরিচয় পূর্বে ছিল না। তবে একই জেলে বহুদিন রয়েছি। আমাকে তো জেলে একলাই অনেকদিন থাকতে হয়েছে। আমার কাছে রাজবন্দিকে দেওয়া হয় না। কারণ ভয় তাঁদের আমি ‘খারাপ’ করে ফেল্ব, নতুবা আমাকে ‘খারাপ’ করে ফেলবে। আজ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ২৬ সেলে যাবেন। দরজা থেকে আমার কাছে বিদায় নিতে চান। আমি একটু এগিয়ে আদাব করলাম। তখন সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধহয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা নিয়ে রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিয়ে দিল। ওকে নিয়ে আমি ঢুকলাম রুমে। ছেলেমেয়েদের চুমা দিলাম। দেখি সিটি আওয়ামী লীগ একটা বিরাট কেক পাঠাইয়া দিয়াছে। রাসেলকে দিয়েই কাটালাম, আমিও হাত দিলাম। জেল গেটের সকলকে কিছু কিছু দেওয়া হলো। কিছুটা আমার ভাগ্নে মণিকে পাঠাতে বলে দিলাম জেলগেটে থেকে। ওর সাথে তো আমার দেখা হবে না, এক জেলে থেকেও।
আর একটা কেক পাঠাইয়াছে বদরুন, কেকটার উপর লিখেছে ‘মুজিব ভাইয়ের জন্মদিনে’। বদরুন আমার স্ত্রীর মারফতে পাঠাইয়াছে এই কেকটা। নিজে তো দেখা করতে পারল না, আর অনুমতিও পাবে না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমার স্নেহের দান আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম। জীবনে তোমাকে ভুলতে পারব না’। আমার ছেলেমেয়েরা বদরুনকে ফুফু বলে ডাকে। তাই বাচ্চাদের বললাম, ‘তোমাদের ফুফুকে আমার আদর ও ধন্যবাদ জানাইও’।
ছয়টা বেজে গিয়াছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যাথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না।
ফিরে এলাম আমার আস্তানায়। ঘরে ঢুকলাম, তালা বন্ধ হয়ে গেল বাইরে থেকে। ভোর বেলা খুলবে।
১৮ই মার্চ, ১৯৬৭ ।। শনিবার
জেলগেটে আমার দ্বিতীয় মামলার সওয়াল জবাব হবে। ১০ ঘটিকা হতে বসে আছি প্রস্তুত হয়ে। ১২টার সময় আমাকে জেলগেটের কোর্টে নিতে এসেছে। যেয়ে দেখি জহির সাহেব, রব সাহেব, মাহমুদুল্লা সাহেব, আবুল হোসেন, জোহা চৌধুরী প্রমুখ এডভোকেট সাহেবরা এসে বসে আছেন হাকিমের সামনে।
আমার আত্মীয়স্বজন ছাড়াও মোস্তফা আনোয়ার, চৌধুরী নিজাম, আলি হোসেন ও কর্মীরাও এসেছে। ছাত্রলীগের নির্বাচন নিয়ে খুবই গোলমাল।
শুধু অনুরোধ করলাম, ‘তোমরা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করিও। ছাত্রলীগকে ভেঙে ফেলে দিও না। সকলকে আমার সালাম দিও’। ঐতিহ্যবাহী এই ছাত্র প্রতিষ্ঠান আমি গড়েছিলাম কয়েকজন নিঃস্বার্থ ছাত্রকর্মী নিয়ে। প্রত্যেকটি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন, রাজবন্দিদের মুক্তি আন্দোলন, ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ও ছাত্রদের দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করে বহু জেল-জুলুম সহ্য করছে এই কর্মীরা। পূর্ব বাংলার ছয় দফার আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের পুরাভাগে থেকে আন্দোলন চালিয়েছে ছাত্রলীগ। এই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গোলমাল হলে আমার বুকে খুব আঘাত লাগে। তাই রেজাকে বললাম ‘প্রতিষ্ঠান রক্ষা করিও’।
মামলা আজ আর চলবে না। কারণ সরকার পক্ষের উকিল সাহেব অসুস্থ-উপস্থিত হতে পারেন নাই। কোর্টে শুনলাম আমার বিরুদ্ধে ঢাকার পাঁচটি মামলা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় ছয়টি মামলা দায়ের করেছে সরকার-চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা ও যশোরে। চার্জ শীটও নাকি দিয়েছে। যাহা হউক, প্রস্তুত আছি। হাইকোর্ট থেকে শাহ মোয়াজ্জেমকে ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়েছে। নূরে আলম সিদ্দিকী ছাত্রকর্মী, কোর্টের থেকে খবর নিয়ে এসেছে হাইকোর্টে তাকেও ছেড়ে দিতে হুকুম দিয়েছে। এডভোকেট রব সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি বললেন, হাইকোর্টে এখনও ওর মামলার রায় দেয় নাই। ছেলেটা বাইরে যাবে বলে কত খুশি হয়েছে। আট মাস মিছামিছি ওকে ডিপিআর আইনে বন্দি করে রেখেছে। ওর ধারণা একটা মামলা ঢাকা কোর্টে আছে, জামিন পেলেই বাইরে যেতে পারবে। আমাকে বলেছিল, ওর বাবা বসে আছেন ঢাকায়, মুক্তির পরে ওকে নিয়ে বাড়ি যাবেন ঈদ করতে। আগামী ২২ তারিখে ঈদ। কি বলব ওকে ভিতরে যেয়ে। ভাব্লাম, ধোঁকা দেওয়া ভাল হবে না। বলেই দেই সত্য কথা। জেলের ভিতরে যেয়ে ওকে খবর দিলাম, তুমি ভুল শুনেছ, তোমার মামলার রায় হয় নাই, ঈদের পরে হবে। মুখটা ওর কালো হয়ে গেল। মনে হলো খুবই আঘাত পেয়েছে। দিন কেটে গেল। রাত্র আটটায় হঠাত শুনতে পেলাম কে যেন আমাকে ডাকছে, ‘মুজিব ভাই’, ‘মুজিব ভাই’ বলে। জানলা দিয়ে চেয়ে দেখি শাহ মোয়াজ্জেম। বললাম, ‘কি ব্যাপার তুমি এখানে?’ ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়েছি এখন-বিচারাধীন আসামি তাই ১০ সেল থেকে আমাকে নিয়ে এসেছে। ডিপিআরদের কাছে আমাকে রাখবে না। জমাদার সাহেবকে বললাম, কোথায় রাখবেন? বলল, রাতে আর কোথায় রাখব ২০ সেলে আমার কাছাকাছি। বললাম, ‘কাপড় চোপড় বিছানা আছে?’ বলল, যা আছে চলে যাবে, খাবারও ১০ সেল থেকে রাতের জন্য আসবে। আমার সাথে কথা বলা নিষেধ, তবু রাস্তা যখন পড়েছে আমার ঘরের কাছ দিয়ে তখন মুখে হাত দিয়ে তো বন্ধ করতে পারে না। বললাম, আর চিন্তা কি! মামলা দুইটি আছে, জামিন পেয়েছ, আর দুই একদিন দেরি হতে পারে।
২২শে মার্চ ১৯৬৭ ।। বুধবার
আজ কোরবানির ঈদ। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দি জীবনে ঈদ উদযাপন করা একটি মার্মান্তিক ঘটনা বলা চলে। বার বার আপনজন বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে, পিতামাতার কথা মনে পড়ে।
ইচ্ছা ছিল না নামাজে যাই। কিইবা হবে যেয়ে, কয়েদিদের কি নামাজ হয়! আমি তো একলা থাকি। আমার সাথে কোনো রাজনৈতিক বন্দিকে থাকতে দেয় না। একাকী কি ঈদ উদযাপন করা যায়? জেলার সাহেব নামাজ বন্ধ করে রেখে আমাকে নিতে আসেন। তাই যেতে বাধ্য হলাম।
মোশতাককে আনা হয়েছে রাজশাহী জেল হতে গত মে মাসে। ঢাকা থেক পাবনা জেলে বদলি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাজউদ্দীন এখনও ময়মনসিংহ জেলে আটকে আছে। মোশতাক, জালাল, মোমিন সাহেব, ওবায়দুর রহমান ও নারায়নগঞ্জের মহিউদ্দিন নামাজে আসে নাই। পুরানা হাজত থেকে মনি, হালিম আরও অনেকে এসেছে।
১/২ ওয়ার্ড থেকে রুহুল আমিন, প্রতাপউদ্দিন সাহেব, আবদুস সালাম খান ও অনেকে এসেছে। সকলের সাথেই দেখা হয়ে গেল। মোশতাকের শরীর খারাপ হয়ে গেছে। ১০ সেল থেকে নূরুল ইসলাম আমার সাথেই নামাজে যায়। তাকে সিলেট জেল থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁর টিবি ভাল হয়ে গিয়েছে।
শাহ মোয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে হেবিয়াস কার্পাস করে মুক্তি পেয়ে হাজতে আছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুইটা মামলা আছে। একটি জামিন পেয়েছে আর একটি জজকোর্ট থেকে জামিন পায় নাই। এখন হাইকোর্টে যেতে হবে। শাহ মোয়াজ্জেম একজন এডভোকেট, তাঁর জামিন না দেওয়ার কি কারণ বুঝতে পারলাম না। বাড়ি থেকে খাবার পাঠাইয়াছিল। আমি শাহ মোয়াজ্জেম, নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীকে নিয়ে খেলাম। হ্যা খেতে হবে। রেণু বোধ হয় ভোর রাত থেকেই পাক করেছে, না হলে কি করে ১২টার মধ্যে পাঠাল!
নামাজ পড়ার পরে শত শত কয়েদি আমাকে ঘিরে ফেলল। সকলের সাথে হাত মিলাতে আমার প্রায় আধাঘন্টা সময় লেগেছিল।
২৩শে মার্চ ১৯৬৭ – ৭ই এপ্রিল ১৯৬৭
আজও কারাগারের কয়েদিদের ছুটি। পাকিস্তান দিবস আজ। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলীম লীগ লাহোরে পাকিস্তান প্রস্তাব পাস করে। মরহুম শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী এইদিনে পাকিস্তানকে রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়। এই দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী শাসনতন্ত্র তৈয়ার না করার জন্য উই পাকিস্তানে আজও ভুল বুঝাবুঝি চলছে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি কলোনিতে পরিণত করা হয়েছে। আমি যে ৬ দফা প্রস্তাব করেছি, ১৩ই জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে-লাহর প্রস্তাব ভিত্তি করে, সে প্রস্তাব করার জন্য আমি ও আমার সহকর্মীরা কারাগারে বন্দি। ইত্তেফাক কাগজ ও প্রেস বাজেয়াপ্ত এবং মালিক ও সম্পাদক মানিক ভাই কারাগারে বন্দি। এই দাবির জন্যই ৭ই জুন ৭ শত লোক গ্রেপ্তার হয় এবং ১১ জন জীবন দেয় পুলিশের গুলিতে। আমি দিব্যচোখে দেখতে পারছি দাবি আদায় হবে, তবে কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হবে। আজকাল আবার রাজনীতিবিদরা বলে থাকেন লাহোর প্রস্তাবের দাম নাই। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দিলে পাকিস্তান দুর্বল হবে। এর অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কোটি লোককে বাজার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, যতই দিন যাবে তিক্ততা আরও বাড়বে এবং তিক্ততার ভিতর দিয়ে দাবি আদায় হলে পরিণত ভয়াবহ হবার সম্ভবনা আছে। লাহোর প্রস্তাব আমি তুলে দিলাম: ‘Resolved that it is the considered view of this session of the All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to Muslims unless it is designed on the following basic principle, namely, that geographically contiguous units are demarcated into regions which should be so constituted, with such territorial readjustments as may be necessary, that the areas in which the Muslims are numerically in a majority, as in the North-Western and Eastern Zones of India, should be grouped to constitute Independent States in which constituent units shall be autonomous and sovereign.’
March 23, 1940
Moved by Late A. K. Fazlul Haque
আজ ২৫ দিন চটকল শ্রমিকরা ধর্মঘট শুরু করেছে। শান্তিপূর্নভাবে এদের ধর্মঘট চলেছে। টঙ্গিতে গোলমাল সৃষ্টি করে আজ শত শত শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে জেলে আনা হয়েছে। চারজনকে জেল হাসপাতালে রাখা হয়েছে।
২৫/৩০ জনকে ডিপিআর আইনে বন্দি করেছে আর সবাইকে মামলা দিয়ে হাজতে রেখেছে। চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সম্পাদক আব্দুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। কিছুদিন পূর্বেও খাদ্য আন্দোলন করার অপরাধে ন্যাপ সহ-সভাপতি হাজী মোহাম্মদ দানেশ, সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন, সিরাজুল হোসেন খান ও কৃষক নেতা হাতেম আলি খানকে ধরে এনেছে। নতুন বিশ সেলে রাখা হয়েছে। ডিপিআর করে দিয়েছে, বিনা বিচারে বন্দি। জেল-জুলুম, অত্যাচার, গুলি সমানে পূর্ব বাংলায় চলেছে।
আইয়ুব খান সাহেব পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন ২৭শে মার্চ। এপ্রিল মাসের তিন তারিখে ঢাকা থেকে রাজধানীতে ফিরে গিয়াছেন। স্বায়ত্তশাসনের অর্থ তিনি করেছেন পূর্ব বাংলাকে নাকি আলাদা করার ষড়যন্ত্র। তিনি যাহাই বলুন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতেই হবে একদিন। না দিলে ফলাফল খুবই খারাপ হবে। ইতিহাস এই শিক্ষাই দিয়েছে। যখনই জনাব পূর্ব বাংলায় আসেন তখনই তাকে বিরাট অভ্যর্থনা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয় লাখ লাখ টাকা খরচ করে। দেখে মনে হয় তিনি বাদশা হয়ে প্রজাদের দেখতে আসেন। পশ্চিম পাকিস্তান তাঁর দেশ আর পূর্ব বাংলা তাঁর কলোনী। কারণ লাহোর করাচী গেলে তো গেট করা হয় না, মালা কিনে বিলি করা হয় না। ট্রাক, বাস ভরে ভাড়াটিয়া লোক নেওয়া হয়না। তিনি দুনিয়াকে দেখাতে চান তাঁর জনপ্রিয়তা। কিন্তু জনগণের ভোটে ইলেকশন হলে পূর্ব বাংলায় তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হত একথা তিনি বুঝেও বুঝতে চান না।
পূর্ব বাংলার মাটিতে বিশ্বাসঘাতক অনেক পয়দা হয়েছে, আরও হবে, এঁদের সংখ্যাও কম না। কিন্তু বিশ্বাসঘতকদের স্থান কোথায় এঁরা দেখেও দেখে না! বিশেষ করে একদল বুদ্ধিজীবী যেভাবে পূর্ব বাংলার সাথে বেঈমানী করছে তা দেখে আশ্চর্য হতে হয়।
সামান্য পদের বা অর্থের লোকে পূর্ব বাংলাকে যেভাবে শোষণ করার সুযোগ দিতেছে দুনিয়ার অন্য কোথাও এটা দেখা যায় না। ছয় কোটি লোকাজ আস্তে আস্তে ভিখারি হতে চলেছে।এরা এঁদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথাও চিন্তা করে না।
কয়েকদিন পূর্বে খবর পেয়েছিলাম আব্বা খুবই অসুস্থ। আমার ভাই তাকে খুলনায় নিয়ে এসেছে চিকিৎসা করাতে। একটু আরোগ্যের দিকে চলেছে। আমার ভাই সরকারকে টেলিগ্রাম করেছে আমাকে কয়েকঘন্টার জন্য প্যারোলে ছেড়ে দিতে, কারণ আব্বা আমাকে দেখতে চান। ৮০ বৎসরের উপরে বয়স। আমাকে অত্যন্ত ভালবাসেন। আমি জানি না আমার মত এত স্নেহ অন্য কোনো ছেলে প্যেছে কিনা। আমার কথা বলতে আমার আব্বা অন্ধ। আমরা ছয় ভাই বোন। সকলে একদিকে, আমি একদিকে। খোদা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছে, কিন্তু আমার আব্বা মার অসুস্থতার কথা শুনলে আমি পাগল হয়ে যাই, কিছুই ভাল লাগে না। খেতেও পারি না, ঘুমাতেও পারি না। তারপর আবার কারাগারে বন্দি। আমি কারাগারে বন্দি অবস্থায় যদি আমার বাবা বা মায়ের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তবে সহ্য করতে পারব কিনা জানিনা। এখন আমার ৪৭ বৎসর বয়স, আজও আব্বা ও মায়ের গলা ধরে আমি আদর করি, আর আমাকেও তারা আদর করেন। খোদাকে ডাকা ছাড়া কি উপায় আছে।
৬ই এপ্রিল থেকে আমার বড় ছেলে কামাল ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবে। কোনো খবর পাই নাই কেমন পরীক্ষা দিল।
আমি সরকার বা আইজির কাছে কোনো দরখাস্ত সচারাচর করি না। আব্বার খবর জানবার জন্য একটা বিশেষ দেখার অনুমতি চেয়েছিলাম আমার স্ত্রীর সাথে। আজ সাত তারিখ, কোনো খবর নাই।
১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনেকবার এবং অনেকদিন জেল খেটেছি। এবার জনাব মোনায়েম খান যে ব্যবহার করেছেন এরূপ ব্যবহার আগে কেহই করেন নাই। রীতিমত অপমান করেছেন আমাদের। মার্শাল ল’ এর সময়ও এ ব্যবহার পাই নাই। খোদা করলে বেঁচে আমি থাকব এবং মোনায়েম খান সাহেবের সাথে নিশ্চয়ই ‘দেখা’ হবে।
আজ কয়েকদিন পর্যন্ত পাগলের উৎপাতে ঘুমাতে পারি না। যেখানে থাকি তাঁর থেকে মাত্র ৪০ হাত দূরে ৪০ জন পাগল রাখা হয়েছে। আর আমার খাঁটের থেকে মাত্র ৪০ হাত দূরে ৪০ জন পাগল রাখা হয়েছে। আর আমার খাটের থেকে তিন হাত ও ছয় হাত দূরে নিউ বিশ সেলে দুইটা লোহার টিন দিয়ে ঘেরা বড় কপাট। রাতে দুই ঘন্টা পর পর সিপাহি বদলি হয় আর বিকট শব্দ করে আমার ঘুম ভেঙে দেয়। অনেকদিন সারারাত ঘুমাতে পারি না। আবার কোনো কোনো দিন ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। এ জন্য প্রায়ই আমার মাথার যন্ত্রনা হয়। জেল কতৃপক্ষকে বলেছি সিপাহিরা যাতে শব্দ না করে তাঁর চেষ্টা করেন। কিন্তু পাগল নিয়ে কি করবেন? তারা তো ভয় পায় না।
৮ই এপ্রিল – ১০ই এপ্রিল ১৯৬৭
আজ জেল গেটে ১৯৬৫ সালের ২০শে মার্চ তারিখে পল্টন ময়দানের সভায় যে বক্তৃতা করেছিলাম সেই বক্তৃতার মামলার সওয়াল জবাব শেষ হয়। জনাব আবদুস সালাম খান সাহেব ও জহিরউদ্দিন সাহেব আমার পক্ষে সওয়াল জবাব করেন। প্রায় চার ঘন্টা চলে। ৬ দফা দাবি কেন সরকারের মেনে নেওয়া উচিৎ তাঁর উপরই বক্তৃতা করেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া দরকার। দেশরক্ষা শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গত পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো যোগাযোগ ছিল না। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হবে। আরও অনেক কিছু।
আমি নাকি হিংসা, দ্বেষ ও ঘৃণা পয়দা করতে চেয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমার বুকে ব্যাথা, কিন্তু তা বলতে পারব না। আমার পকেট মেরে আর একজন টাকা নিয়ে যাবে, তা বলা যাবেনা! আমার সম্পদ ছলে বলে কৌশলে নিয়ে যাবে বাঁধা দেওয়া তো দূরের কথা-বলা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানে তিনটা রাজধানী করা হয়েছে যেমন করাচী, পিন্ডি এখন ইসলামাবাদ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা বন্ধ করার টাকা চাওয়া যাবে না।
দেশরক্ষা আইনে বিচার হয়েছে। এই একই ধরণের বক্তৃতার জন্য ডজন খানেক মামলা দায়ের করা হতেছে। মামলার কিছুই নাই, আমাকে জেল দিতে পারে না। যদি নিচের দিকে জেল দিতে বাধ্য হয় তবে জজকোর্ট ও হাইকোর্ট টিকবে না। সহকর্মী অনেকে এসেছিল, দেখা হলো। কামাল এসেছিল। বলল, পরীক্ষা ভাল দিয়েছে। আব্বা খুলনায় আমার ভাইয়ের বাসায় চিকিৎসাধীনে আছেন। একটু ভালর দিকে। এখনও আরোগ্য লাভ করেন নাই। মাও সাথে আছেন।
সালাম সাহেবের সাথে আরো দুইটা মামলা ও দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলো। পাবনায় জনসাধারণ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর চরম অত্যাচার চলছে। আওয়ামী লীগের সকল নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করে ফেলেছে। জামিন দেওয়া হয় নাই। সালাম সাহেব নিজে গিয়েছিলেন জামিন নিতে। তাকে দেখা করতে দেয় নাই বন্দিদের সাথে।
১১ই এপ্রিল – ১৩ই এপ্রিল ১৯৬৭
শাহ মোয়াজ্জেম হাইকোর্ট থেকে ডিপিআর আইনে মুক্তি পেলেও একটা মামলায় জামিন না পাওয়ার জন্য জেলে সাধারণ কয়েদি হয়ে কষ্ট পেতেছে। বক্তৃতার মামলায় সেশন জজ সাহেবও জামিন দেন নাই। হাইকোর্টে জামিনের জন্য আর্জি পেশ করা হয়েছে, আজ পর্যন্ত শুনানি হয় নাই। বড় দুঃখ করছিল, বলছিল সহকর্মীরা একটু চেষ্টা করলেই জামিন হয়ে যেত। পুরানা বিশ সেলে আছে। আমার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করি। সে নিজেও একজন এডভোকেট। তাঁর অন্যান্য এডভোকেটদের উপর দাবি বেশি।
আমার ওয়ার্ডটার নাম সিভিল ওয়ার্ড। ৪০ হাত দূরের পুরানা ৪০ সেলকে পাগলা গারদ বলা হয়। দিনে প্রায় ৭০ জন আর রাত্রে ৩৭ জন পাগল থাকে। ৩৭টা সেলের তিনটা সেল নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েকদিন ধরে পাগলরা রাতে খুব চিৎকার করতে শুরু করেছে। দিনের বেলায় আমি ঘুমাই না, রাতে যাতে ঘুম হয়। কিন্তু পাগলদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যাই। রাতে মাঝে মাঝে বসেও থাকতে হয়। জেল কতৃপক্ষকে কি বলব? পাগল রাখবার জায়গা আর নাই।
সিভিল ওয়ার্ডের সামনে ছোট একটা মাঠ আছে। সেখানে কয়েকটা আম গাছ আছে। ফুলের বাগান করেছি। জায়গাটা ছাড়তে ইচ্ছে হয় না। আবার কোথায় দিবে ঠিক কি? রাতে যখন ঘুমাতে পারি না তখন মনে হয় আর এখানে থাকবো না। সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়।আমার ঘরটার কাছের আম গাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাঁদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়।
১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাখি দুইটা আসত। এবার এসে তাঁদের কথা আমার মনে আসে, আমি খুজতে শুরু করি। এবারও ঠিক একই সময় দুটা হলদে পাখি এখানে আসত। মনে হয় ওদেরই বংশধর ওরা।
তারা বোধহয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও চলে গিয়াছে। ১০টা-১১টার মধ্যে ওদের কথা এমনি ভাবেই আমার মনে এসে যায়। চক্ষু দুইটা অমনি গাছের ভিতর নিয়া ওদের খুজতে থাকি। কয়েকদিন ওদের দেখতে পাই না। রোজই আমি ওদের খুঁজি। তারা কি আমার উপর রাগ করে চলে গেল? আর কি ওদের আমি দেখতে পাব না? বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে। যে কয়েকটা কবুতর আমার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে তারা এখানে বাচ্চা দেয়। কাউকেই আমি ওদের ধরতে দেই না। সিপাহি জমাদার সাহেবরাও ওদের কিছু বলে না। আর বাচ্চাদেরও ধরে নিয়ে খায় না। বড় হয়ে উড়ে যায়। কিছুদিন ওদের মা-বাবা মুখ দিয়ে খাওয়ায়। তারপর যখন আপন পায়ের উপর দাড়াতে শিখে এবং মা-পায়রার নতুন ডিম দেওয়ার সময় হয় তখন ওই বাচ্চাদের মেরে তাড়াইয়া দেয়। আমি অবাক হয়ে ওদের কীর্তিকলাপ দেখি।
কাকের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। আমার সামনের আম গাছ কয়টাতে কাক বাসা করতে আরম্ভ করে। আমি বাসা করতে দেব না ওদের। কারণ ওরা পায়খানা করে আমার বাগান নষ্ট করে, আর ভীষণভাবে চিৎকার করে। আমার শান্তি ভঙ্গ হয়। আমি একটা বাঁশের ধনুক তৈয়ার করে মাটি দিয়ে গুলি তৈয়ার করে নিয়েছি। ধনুক মেরেও যখন কুলাতে পারলাম না তখন আমার বাগানী কাদের মিয়াকে দিয়ে বার বার ভেঙ্গে ফেলি। বারবারই ওরা বাসা করে। লোহার তাঁর কি সুন্দরভাবে গাছের সাথে পেঁচাইয়া ওরা বাসা করে। মনে হয় ওরা এক এক জন দক্ষ কারিগর, কোথা থেকে সব উপকরণ যোগাড় করে আনে আল্লাহ জানে! পাঁচটা আম গাছ থেকে ৫/৭ বার করে বাসা ভেঙ্গে ফেলি আর ওরা আবার তৈরি করে। ওদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখে মনে মনে ওদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হই। তিনটা গাছ ওদের ছেড়ে দিলাম – ওরা বাসা করল। আর একটা গাছ ওরা জবর দখল করে নিল। আমি কাদেরকে বললাম, “ছেড়ে দেও। করুক ওরা বাসা। দিক ওরা ডিম। এখন ওদের ডিম দেওয়ার সময়-যাবে কোথায়?”
এই সমস্ত বাসা ভাঙবার সময় আমি নিজে ধনুক নিয়ে দাঁড়াতাম আর গুলি ছুঁড়তাম। ভয় পেয়ে একটু দূরে যেয়ে চিৎকার করে আরো কিছু সঙ্গী সাথী যোগাড় করে কাদেরকে গাছেই আক্রমণ করত। দুই একদিন শত শত কাক যোগাড় করে প্রতিবাদ করত। ওদের ওই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়েও ওদের একতা বেশি।
এখন চারটা বাসায় ডিম দিয়েছে। একটা বাসায় বসে থাকে আর একটা পাহারা দেয়। দাঁড়কাক ওদের শত্রু। দুই পক্ষের যুদ্ধও দেখেছি। তুমুল কান্ড! ছোট কাকদের সাথে শেষ পর্যন্ত পারে না। দাঁড়কাক যুদ্ধ ভঙ্গ করে পালাইয়া যায়। বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে যদি দাঁড়কাকদের মত শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত তবে নিশ্চয়ই তারাও জয়লাভ করত। তাই কাকের অধ্যবসায়ের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখে আমার মনে দুঃখও হয়েছে, কারণ আমার ঘর ভেঙেই তো আমাকে কারাগারে বন্দি করে রেখে দিয়েছে।
কিছুদিন পর্যন্ত কাকরা আমাকে দেখলেই চিৎকার করে প্রতিবাদ করত, ভাবত আমি বুঝি ওদের ঘর ভাঙবো। এখন আর আমাকে দেখলে ওরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে না, আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না।
১৩ তারিখে আমার ১৯৬৪ সালের আর একটা মামলা শুরু হয়েছে জেলগেটে। এটাও পল্টনের বক্তৃতার মামলা। ঢাকার এডিসি মিঃ খানকে সরকার স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। এটা ১২৪-এ ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা। জেলগেটে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব এসেছিলেন। আমিও হাজির হয়েছিলাম। শুধু এডভোকেট মাহমুদুল্লা সাহেব এসেছিলেন। জহির, আবুল কেহই প্রথমে আসতে পারবে না কারণ আমার এডভোকেট সাহেবরা আজ আসতে পারবেন না।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আগামী ২২/৪/৬৭ তারিখে দিন ঠিক করে চলে গেলেন, ঠিক তাঁর দুই মিনিট পরে জহির সাহেব এলেন।
নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মোস্তফা, কামাল এসেছিল। কামাল পরীক্ষা ভালই দিয়েছে। এই খবরটার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। আব্বা একটু ভালর দিকে চলেছেন। কিছু সময় কথাবার্তা বলে আমার পুরানা জায়গায় ফিরে এলাম। খোন্দকার মোশতাক জেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাঁর শরীর খুবই খারাপ। আমার জায়গা থেকে আমি দেখলাম মোশতাক হাসপাতালের বারান্দায় চেয়ারে বসে রয়েছে। চেনাই কষ্টকর। বেচারাকে কি কষ্টই না দিয়েছে! একবার পাবনা, একবার রাজশাহী একবার ঢাকা জেল।
১৪ই এপ্রিল – ১৫ই এপ্রিল ১৯৬৭
১৪ তারিখে ১৫ দিন পরে ছেলেমেয়েদের সাক্ষাৎ পেলাম। একটা দরখাস্ত করেছিলাম বিশেষ দেখার অনুমতি চেয়ে, ডিআইজি সাহেব অনুমতি তো দেনই নাই, জবাব দেওয়াও দরকার মনে করেন নাই। কারও কাছে দরখাস্ত আমি খুব একটা করি না, কারণ উত্তর না দিলে আত্মসম্মানে বাঁধে। আব্বা অসুস্থ তাঁর সংবাদ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। সেকথাও লিখেছিলাম। বহু জেল খেটেছি এ অবস্থা কোনোদিন দেখি নাই। সকলেই বলে কি করব? উপরের চাপ। অর্থাৎ লাট সাহেবেরা নিষেধ করে দিয়েছেন। লাট সাহেব দেখার অনুমতি দিতে নিষেধ করেছেন এ কথা কে বিশ্বাস করবে?
আজকাল শাসন ব্যবস্থা যা হয়েছে, হলে হতেও পারে। জানি না সত্য কি মিথ্যা তবে কানে এসেছে জনাব মোনেম খান সাহেব নাকি হুকুম দিয়েছেন আওয়ামী লীগ বিশেষ করে আমার কোনো ব্যাপার হলে তাকে খবর দিতে হবে এবং অনুমতি নিতে হবে। চীফ সেক্রেটারি বা সেক্রেটারি সাহেবও কোনো কিছুর অনুমতি দিতে পারেন না। ১৪ দিন পরে একদিন ‘দেখা’ আইনে আছে, তাই বোধহয় তিনি বন্ধ করেন নাই মেহেরবানি করে। হুকুম দিলেই বন্ধ হয়ে যেত, বড়ই দয়া করেছেন! টাকা আনা, খাবার আনা, সকল কিছুই তো বন্ধ করে দিয়েছেন যাতে কারাগারের রাজনৈতিক বন্দিরা কষ্ট পায় এবং আদর্শচ্যুত হয়ে যায়, বন্ড দিয়ে বের হয়ে যায়। ভুল করেছেন তিনি-এরা ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু বাকা হবে না। নীতির জন্য, আদর্শের জন্য এবং দেশের জন্য যারা ছেলেমেয়ে সংসার ত্যাগ করে কারাগারে থাকতে পারে, যেকোনো কষ্ট স্বীকার করবার জন্য তারা প্রস্তুত হয়েই এসেছে।
জেলগেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভিতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, “বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাসে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে”। রাসেল ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা’। আমার উপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।
এক ঘন্টা সময়। সংসারের কথা, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, আব্বা মা’র শরীরের অবস্থা আলোচনা করতে করতে চলে যায়। কোম্পানী আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরী ছেড়ে দিয়েছি-চারমাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, ‘জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাঁদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাঙ্কেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপনতা করবে না’। ‘যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নিব’, রেণু বলল। সরকার যদি ব্যবসা করতে না দেয় তবে বাড়িতে যে সম্পত্তি আমি পেয়েছি আব্বার, মায়ের ও রেণুর তাতে আমার সংসার ভালভাবে চলে যাবে। রেণু বলল, ‘চিন্তা তোমার করতে হবে না’। সত্যই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি’।
সরকারের এক বিশেষ দফতরের একজন কর্মচারী যার সাথে পাকিস্তান আন্দোলনের সময় কলকাতায় পরিচয় ছিল-তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবেরও ভক্ত ছিলেন এবং চাকরি করতেন। কলকাতায় বাড়ি। আমাকে কিছু মিষ্টি পাঠাইয়াছেন এই কথা বলে ‘আমি যেন তাঁর এই সামান্য উপহারটুকু গ্রহণ করি’। এর সাথে বহুদিন আমার দেখা হয় নাই। তিনি আরো বলেছেন, ছয় দফা দাবি সমর্থন প্রায়ই সকলে করে তবে বলতে পারে না। এর পরিচয় আজ দেওয়া উচিৎ হবে না কারণ সে এক বিশেষ দফতরে আছে। সরকার খবর পেলে শুধু চাকরিই নিবে না, জেলেও দিতে পারে।
আজ বাংলা নববর্ষ, ১৫ই এপ্রিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম আরও কয়েকজন রাজবন্দি কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ সেল ছেড়ে আমার দেওয়ানীতে এসে হাজির। আমাকে কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাল। ২৬ সেল হাসপাতাল থেকে বন্ধু খোন্দকার মোশতাক আহমদও আমাকে ফুল পাঠাইয়াছিল। আমি ২৬ সেল থেকে নতুন বিশ সেলে হাজী দানেশ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, হাতেম আলি খান, সিরাজুল হোসেন খান ও মৌলানা সৈয়েদুর রহমান সাহেব, ১০ সেলে রফিক সাহেব, মিজানুর রহমান, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, মহিউদ্দিন, সুলতান, সিরাজ এবং হাসপাতালে খোন্দকার মোশতাক সাহেবকে ফুল পাঠাইলাম নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে। শুধু পাঠাতে পারলাম না পুরানা হাজতে, যেখানে রণেশ দাশগুপ্ত, শেখ ফজলুল হক (মণি)-আমার ভাগনে, হালিম, আব্দুল মান্নান ও অন্যরা থাকে-এবং ১/২ খাতায় যেখানে শ্রমিক নেতারা, ওয়াপদার কর্মচারী ও কয়েকজন ছাত্র থাকে। তাঁদের মুখে খবর পাঠাইলাম আমার শুভেচ্ছা দিয়ে। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল; কারও সাথে কারও দেখা হয়না-বিশেষ করে রাজনৈতিক বন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছে। এরা তো ‘রাষ্ট্রের শত্রু’! বিকালে পুরানা বিশ সেলের সামনে নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলাম ও হানিফ খান কম্বল বিছাইয়া এক জলসার বন্দোবস্ত করেছে। বাবু চিত্তরঞ্জন সুতার, শুধাংশু বিমল দত্ত, শাহ মোয়াজ্জেম আরও কয়েকজন ডিপিআর ও কয়েদি, বন্দি জমা হয়ে বসেছে। আমাকে যেতেই হবে সেখানে, আমার যাবার হুকুম নাই তবু আইন ভঙ্গ করে কিছু সময়ের জন্য বসলাম। কয়েকটা গান হলো, একজন সাধারণ কয়েদিও কয়েকটা গান করলো। চমৎকার গাইল। শিক্ষিত ভদ্রলোকের ছেলে, প্রেম করে একজনকে বিবাহ করেছিল। পরে মামলা হয়। মেয়েটা বাবা মায়ের উলটা সাক্ষী দেয় এবং নারীহরণ মামলায় ৭ বৎসরের জেল নিয়ে এসেছে। ছোট হলেও জলসাটা সুন্দর করেছিল ছেলেরা।
আমি কারাগার থেকে আমার দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
১০ সেল থেকে মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাইয়া একটা টুকরা কাগজে নিম্নলিখিত কবিতাটা লিখে পাঠায়,
‘আজিকের নূতন প্রভাতে নূতন বরষের আগমনে
-মুজিব ভাইকে’
‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেউ রও,
ক্ষমা কর আজিকার মত,
পুরাতন বরষের সাথে,
পুরাতন অপরাধ হতে’।
নববর্ষের শ্রদ্ধাসহ মিজান
১লা বৈশাখ ১৩৭৪ সাল।
১৩৭৩ সালের বৈশাখ হতেই আমার উপর সরকারের জুলুম পুরাদমে শুরু হয়। এর পূর্বেও পাঁচটা মামলা ঢাকা কোর্টে দায়ের করা হয়। একটি মামলায় আমাকে ঢাকার এডিসি জনাব বদিউল আলম এক বৎসরের জেল দেয়, হাইকোর্ট আমাকে জামিনে মুক্তি দেয়। অন্য মামলা গুলি চলছিল। ৩রা বৈশাখ খুলনায় মিটিং করে ঢাকায় মোটরে ফেরার পথে ৪ঠা বৈশাখ আমাকে যশোরে গ্রেপ্তার করে এবং জামিনে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় ফিরে আসি।
৭ই বৈশাখ আবার আমাকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে সিলেটে পাঠায়।
৮ই বৈশাখ আমার জামিনের আবেদন মহকুমা অগ্রাহ্য করে জেল হাজতে প্রেরন করে।
৯ই বৈশাখ জজ বাহাদুর আমাকে জামিনে মুক্তি দেন। পুনরায় জেল গেটে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ জেলে প্রেরন করে।
১০ই বৈশাখ আমার জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে আমাকে জেলে পাঠাইয়া দেয়।
১১ই বৈশাখ জেলা জজ আমাকে জামিনে মুক্তি দেন আমি মোটরে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি।
২৪শে বৈশাখ তাজউদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমের চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) ও আমাকে ডিপিআর হিসাবে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলে বন্দি করে এবং চট্টগ্রামে জনাব এম. এ. আজিজ কে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম জেলে বন্দি করে। ২৪শে বৈশাখ থেকে আজ পর্যন্ত কারাগারেই বন্দি আছি।
১৬ই এপ্রিল-২২শে এপ্রিল ১৯৬৭
শরীর কেন যেন আবার কিছুটা খারাপ হয়েছে। কয়েকদিন পর্যন্ত মাথার যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে স্যারিডন খাই। খাওয়ার পরে কিছু সময় ভাল থাকি, আবার মাথার যন্ত্রনা শুরু হয়, আবার খাই। এইভাবে তিন দিন চলে। মাথার যন্ত্রনা হলে লেখাপড়া করতে পারি না, লেখাপড়া না করলে সময় কাটাই কি করে?
কিছু সময় আজকাল শাহ মোয়াজ্জেমের সাথে আলাপ করতে সুযোগ পাই। ডিপিআর থেকে মুক্তি পেয়ে ও বন্দি আছে কয়েদি হয়ে, এখনও জামিন পায় নাই, কয়েকদিনের মধ্যে জামিন হয়ে যাবে। পুরানা ২০ সেলে রেখেছে। প্রায় একমাস সাধারণ কয়েদি থেকে দুই তিন দিন হলো ডিভিশন পেয়েছে। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও আবদুল মোমিন সাহেব হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোশতাক সাহেবের শরীর খুবই খারাপ, অনেক ওজন কম হয়ে গেছে। মোমিন সাহেব এখন ভাল। তাঁদের সাথে দেখা হয়েছিল হাসপাতালের দরজায়। তারা সব দলের ঐক্য চায়, তবে পূর্ব বাংলার দাবি ছেড়ে নয়, ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে। মোমিন সাহেব নতুন জেলে এসেছেন কিন্তু একটুও ঘাবড়ান নাই। খুবই শক্ত। আদর্শনিষ্ঠা আছে, পূর্ব বাংলাকে ভালবাসে, সংগ্রাম চালাইয়া যেতে পারবে। মোশতাক সাহেব তো পুরানা পাপী। অত্যন্ত সহ্য শক্তি, আদর্শে অটল। এবার জেলে তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছে। একবার পাবনা জেলে, একবার রাজশাহী জেলে আবার ঢাকা জেলে নিয়ে। কিন্তু সেই অতি পরিচিত হাসি খুশি মুখ।
নূরুল ইসলাম ও নূরে আলম সিদ্দিকী পুরানা ২০ সেলে থাকে। একটু সুযোগ পেলেই ছুটে আমার কাছে চলে আসে, সিপাহিদের মুখ শুকাইয়া যায়। জমাদার সাহেবরা কি বলবে? ছেলে মানুষ এঁরা, জেলের আইন টাইন বেশি মানতে চায় না। আমি বুঝাইয়া রাখি। নূরুল ইসলাম পুরানা কর্মী। যথেষ্ট বুদ্ধি রাখে। মাঝে মাঝে ওর সাথে আমি পরামর্শ করি।। বড় শান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়লেও, জানার ও পড়ার আগ্রহ আছে। আমি ওকে খুবই স্নেহ করি। আজ প্রায় ১০ বৎসর আমার সাথেই আছে। যাহা হুকুম করি হাসিমুখে পালন করে। আর্থিক অবস্থা সচ্ছল না।
নূরে আলম সিদ্দিকী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভাল লেখাপড়া জানে, এমএ প্রথম ভাগ জেলে থেকেই দিয়েছে, দ্বিতীয় শ্রেনীতে পাশ করেছে। বয়স খুবই অল্প। বাংলা ভাষার উপর অধিকার আছে। চমৎকার বক্তৃতাও করে। দেশের প্রতি ভালবাসা আছে। বাংলার মানুষকে ভালবাসে। কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির। তাই একটু বেশি কথা বলে, বয়সের সাথে ঠিক হয়ে যাবে। ‘রক্ত কপোত’ নামে একটা বই লেখার জন্য একটা মামলার আসামি আছে, মাঝে মাঝে কোর্টে যায়। ছাত্রদের সাথে কোর্টে গেলে দেখা হয় তাতে খুব আনন্দ পায়। তাঁর মা মারা গেছেন। বাবার একমাত্র ছেলে। খুবই আদরের। মাঝে মাঝে বাবা মা’র কথা বলে। তাকে আমি খুবই স্নেহ করি। প্রথম প্রথম ভেবেছিল ছেড়ে দিব এখন সহজে ছাড়া পাবে না বুঝতে পেরেছে। কতদিন থাকতে হয় তাই মাঝে মাঝে ভাবে। একদিন আমাকে বলে, “বস, আপনাকে যদি ছেড়ে দেয় আর আমাকে রেখে দেয় তবে আমার দশাটা কি হবে?” ওকে অন্য জায়গায় নিতে চেয়েছিল, আমার কাছ থেকে যেতে চায় না। আমি বললাম, “তুমি পাগল, আমার মুক্তির অনেক দেরি কত বৎসর থাকতে হয় ঠিক নাই। আর আমি যখন মুক্তি পাব তাঁর অনেক পূর্বেই তোমরা ছাড়া পাবা। মনে রেখ থরোর কথা-
‘Under a government which imprinsons any unjustify, the place for a just man is also a Prison’.
আমি ভালই আছি। যেখানে বিচার নাই, ইনসাফ নাই, সেখানে কারাগারে বাস করাই শ্রেয়।
আবার সর্বদলীয় ঐক্য নিয়ে তাড়াহুড়া শুরু হয়েছে। বিরোধী দলগুলি এক হয়ে আইয়ুব সাহেবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে গণতন্ত্র কায়েম করার জন্য। সংগ্রাম কে করবে জানি না, তবে পূর্ব বাংলার আত্ম নিয়ন্ত্রণের বা স্বায়ত্তশাসনের দাবি যখন চারিদিক থেকে উঠতে শুরু করেছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, সরকার সমর্থক বা বিরুদ্ধদল চঞ্চল হয়ে উঠেছে। পূর্ব বাংলার লোকদের ধোঁকা দেওয়ার আর একটা ষড়যন্ত্র কিনা কে জানে?
আজ ২২ তারিখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁ, মালিক গোলাম জিলানী, গোলাম মহম্মদ খান লুন্দখোর, মালিক সরফরাজ ও জনাব আকতার আহম্মদ খান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এবং আব্দুস সালাম খান, জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, নজরুল ইসলাম, এমএ আজিজ, আবুল হোসেন এবং আরো অনেকে জেল গেটে কোর্টে আমার সাথে দেখা করতে আসে। যশোর থেকে আব্দুর রশিদ, খুলনা থেকে আব্দুল মোমেন এসেছিল। অনেক আলাপ হলো। যুক্তফ্রন্ট করা যায় কিনা? নিম্নতম কর্মসূচির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট করার আপত্তি অনেকেরই নাই তবে ৬ দফা দাবি ছাড়তে কেহই রাজি নয়। এটা আওয়ামী লীগের কর্মসূচী হলেও জনগণ সমর্থন দিয়েছে, প্রান দিয়েছে, জেল খেটেছে। এই দাবি পূরন না হলে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচবার কোনো পথ নাই। আমি আমার মতামত দেই নাই কারণ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা নিজেরাই আলোচনা করে তাঁদের পথ ঠিক করুক। আমি আমার মত চাপাইয়া দিতে যাবো কেন? আমি বন্দি। বাইরের অবস্থা তারাই ভাল জানে। তবে ৬ দফা দাবি দরকার হলে একলাই করে যাবো।
২৩শে এপ্রিল-২৭শে এপ্রিল ১৯৬৭
বিরোধীদল্গুলি নিম্নতম কর্মসূচির মাধ্যমে ঐক্যজোট করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় সকল দলের নেতৃবৃন্দই এসেছেন। শুধু ন্যাপ নেতারা আসেন নাই। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকারী কমিটি ও পূর্ব বাংলার ওয়ার্কিং কুমিটির সভা একসাথে ডাকা হয়েছে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ঐক্যজোটের পক্ষে মত দিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভিতরে তীব্র মতভেদ হয়েছে শুনলাম। যতবারই আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্যজোট করতে চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙ্গন ধরেছে। আমি, সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন, বিশিষ্ট নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদ জেলে আছি। আমরা ৬ দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। আজও প্রচার সম্পাদক আব্দুল মোমিন, কালচারাল সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রভাবশালী নেতা শাহ মোয়াজ্জেম, ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মোল্লা জালাল উদ্দিন, মহীউদ্দিন আহম্মদ সিটি আওয়ামী লীগ সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা সিটির অফিস সেক্রেটারি মোহাম্মদ সুলতান এবং ঢাকা জেলা অফিস সেক্রেটারি সিরাজউদ্দিন জেলে।
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ একটা প্রস্তাবও পাশ করে নাই আমাদের মুক্তির জন্য।
মোল্লা জালাল ও সিরাজউদ্দিনকে কুমিল্লা জেলে হঠাত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাপার বুঝলাম না। এই সময় এঁদের বদলি করার অর্থ কি? এতদিন জেলে রাখার পরেও সরকারের রাগ মেটে নাই। জালালের ফ্যামিলি ঢাকায়। সিরাজের বাবা মা কেহই নাই। ঢাকায় দুউই একজন বন্ধু বান্ধব আছে। জেলের ভিতর আমার কাছে একটা প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আমি পড়ে দেখলাম একটা ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ ছাড়া আর কিছুই না। ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন না মানলে ঐক্য হয় কি করে?
নিম্নে প্রস্তাবটা উঠাইয়া রাখলাম ভবিষ্যতের জন্য।
Nawabjada Nasrulla’s Draft-
1. The constitution shall provide for a federation of Pakistan with Parliamentary form of government, supremacy of legislature, directly elected on the basis of universal adult franchise, complete and full fundamental rights, unfettered freedom of the press and independence of the judiciary.
2. The federal government shall deal with the following subject- (I) defence (II) foreign affairs (III) currency and federal finance (IV) inter wing communication and trade and such other subject as may be agreed upon.
3. Ther shall be full regional Autonomy and residuary powers in regard to all other subjects shall vest in the govt. as enmisiged by the constitution in the two wings.
4. It shall be the constitutional responsibility of the government of Pakistan to remove the economic disparity between to wings of the country in the course of ten years ans within this period to spend all the foreign exchange earned by East Pakistan exclusively in that wing. The foreign exchange acquired by the provinces shall be at the absolute disposal of the provincial governments, after allowing for East Pakistan’s proportionate share of the defence, foreign expenditure and the central liabilities. The government of Pakistan shall also give priority in foreign aid and loan to East Pakistan till economic disparity in removed and shall adopt such fiscal and monetary policies as would stop the flight of capital from the Eastern wing. For this purpose appropriate legislation shall be enacted from time to time with regard to bank deposit and profits insurance premium and industrial profits in particular.
5. Currency, Foreign Exchange and Central Banking. (I) Inter Wing Trade, (II) Inter Wing Communication, (III) Foreign Trade
Should each be managed by a board consisting of an equal number of members from East and West Pakistan.
6. The Supreme Court and all departments of central services including diplomatic services and autonomous bodies shall consist of an equal number of persons from East and West Pakistan. To achieve this parity future appointments should be made in a manner so that the total strength of such officers be brought at par within a period of ten years.
7. It shall be the constitutional responsibility of the Government of Pakistan to bring at par the effecting fighting and fire power in the armed services in the two wings of the country and to that end to establish a Military academy, Ordinance Factories, Cadet colleges and School, raise recruits for the three services from East Pakistan to ensure implementation of the above, a Defence Council consisting of equal number of members from East and West Pakistan shall be established.
8. The Constitution in this declaration means the constitution of 1956 which shall be promulgated immediately. Within six months of the promulgation of the constitution, General Election shall be held to the Central and Provincial Assemblies. The foremost business transacts by the National Parliament shall be The Incorporation of the changes as spelt out in the Proceding clauses into the constitution.
আমাদের দলের অনেক নেতা এটা গ্রহণ করেছেন; এর মধ্যে যে কত ফাঁক রেখেছেন যারা একটু চিন্তা করে দেখবে তারা সহজেই বুঝতে পারবে। আমার মত জানবার চেষ্টা করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিরোধী দলের ঐক্য চাই, কিন্তু জনগণের দাবি জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রস্তাব দিয়েছে আমার মত নিয়ে কাজে অগ্রসর হতে। কোর্টে জহির সাহেব আমার কাছে মত জিজ্ঞাসা করেছেন আর বলেছেন অনেকদুর অগ্রসর হয়ে গেছে-পিছান কষ্টকর। আমি আমেনা, আজিজ, মোস্তফা ও জহির সাহেবকে বলে দিয়েছি ঐক্যে আমার আপত্তি নাই তবে সকল বিরোধী দলকে নিতে হবে, ন্যাপকে বাদ দেওয়া চলবে না; দ্বিতীয়ত পার্টির কাজ বন্ধ হবেনা -৬ দফা আন্দোলন চালাইয়া যাবে পার্টি। আমি ও আমার সহকর্মী যারা জেলে আছি বিশেষ করে খোন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন ও আমাকে কোনো সর্বদলীয় কমিটিতে রাখবা না। আমরা ৬ দফা দাবির জন্য জেলে এসেছি। অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে, অনেক কর্মী জেল খাটছে তাঁদের ত্যাগের দাম আমাকে দিতেই হবে। তাঁদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমি করতে পারব না। তবে ঐক্য হউক, এই সমস্ত নেতারা কি করে দেখি? এঁরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে কিনা আমি জানি না। তবে আমার সন্দেহ আছে! আমি তোমাদের বাঁধা দিতে চাই না, তবে উপরে উল্লেখিত দাবি না মানলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ যোগদান করবে না। যদি করে তাতে আমি আর কি করতে পারি! আমিতো জেলেই আছি।
২৭ তারিখে আমার একটা মামলার রায়, ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগ কতৃক আয়োজিত সভায় বক্তৃতা দানের অভিযোগে। জনাব আফসার উদ্দিন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট জেলগেটের অভ্যন্তরে কোর্ট করে আমার বিচার করেন এবং পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ ধারা বলে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড দেন।
এই দণ্ড দেওয়ার পরেই জহিরের সাথে আমার আলাপ হয়। আমি তাকে বললাম আমাকে জেলে দিয়েছে আমি বিনা বিচারে বন্দি আছি। কতকাল থাকতে হয় জানিনা, আমার পক্ষে পূর্ব বাংলার মানুষের সাথে বেঈমানী করা সম্ভব নয়। যাহা ভাল বোঝ কর। আমি জানি ৬ দফা দাবি পূরন না হওয়া ছাড়া এঁদের বাঁচবার উপায় নাই। আজ আমি এক বৎসর দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারে জেলে আছি। আমার সহকর্মীরাও আছে। আমি দেখলাম আমার অবর্তমানে দুই গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। একদল ৬ দফা ছাড়া আপোষ করবে না আর একদল নিম্নতম কর্মসুচিতেই রাজি।
আমাকে প্রথম শ্রেণীর কয়েদি করা হয়েছে। রোজ খাবার আড়াই টাকার মত এখন পাব। একলা থাকি একলাই পাক করাইয়া খাই। কি করে চলবে! যারা আমার খানা পাক করে আর যারা আমার দেখাশোনা করে তাঁদের রেখে তো কোনোদিন কিছু খাই নাই।
জামিন দিল না। আজ থেকে আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। তবে দেশরক্ষা আইনে বিনা বিচারের আদেশও থাকবে যদি জামিন পাই। জজকোর্টে আপীল করার পরে আবার দেশরক্ষা আইনে বিনাবিচারে জেলে থাকতে হবে। আমার পক্ষে সবই সমান। আর একটা মামলায়ও আমার জেল আড়াই বৎসর। সেটাও বক্তৃতা মামলা, হাইকোর্টে পড়ে আছে। কনফার্ম করেছে এক বৎসর খাটতে হবে যদি হাইকোর্ট থেকে মুক্তি না পাই। বুঝতে পারলাম আরও যে ছয় সাতটা বক্তৃতা মামলা আছে সব মামলাই নিচের কোর্টে আমাকে সাজা দিবে। শুধু মনে মনে বললাম:
‘বিপদে মোরে রক্ষা কর
এ নহে মোর প্রার্থনা।
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
কবিগুরুর এই কথাটা আমার মনে পড়ল।
আজ ২৭শে এপ্রিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুর হক সাহেবের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। পাঁচ বৎসর (১৯৬২) যখন তিনি ঢাকায় মারা যান সেদিনও আমি জেলে ছিলাম। হক সাহেব ছিলেন পূর্ব বাংলার মাটির মানুষ এবং পূর্ব বাংলার মনের মানুষ। মানুষ তাঁহাকে ভালোবাসতো এবং ভালোবাসে। যতদিন বাংলার মাটি থাকবে বাঙালি তাঁকে ভালোবাসবে। শেরে বাংলার মতো নেতা যুগ যুগ পরে দুই একজন জন্মগ্রহণ করে।
শেরে বাংলা হক সাহেব ১৯৪০ সালে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন এবং সেই প্রস্তাবের জন্যই আমরা পাকিস্তান পেয়েছি। লাহোর প্রস্তাবে যে কথাগুলি ছিল আমি তুলে দিলাম-‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা এ দেশের কয়েক কোটি মুসলমান দাবি করিতেছে যে সব এলাকা একান্তভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চল, প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানার বদল করিয়া ঐ সকল এলাকাতে ভৌগোলিক দিক দিয়া এরূপভাবে পূনর্গঠিত করা হউক যাহাতে উহারা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র স্টেটস-এর রূপ পরিগ্রহণ করিয়া সংশ্লিষ্ট ইউনিটদ্বয় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা লাভ করিতে পারে।
এই লাহোর প্রস্তাবের কথা বললে আজ অনেক তথাকথিত নেতারা ক্ষেপে যান এবং আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে শুধু গালি দেন বা কারাগারেও বৎসরের পর বৎসর বন্দি করে রাখেন। যে দিন লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গঠন করা যাব সেইদিনই শেরে বাংলার প্রতি শ্রদ্ধা দেখান হবে এবং তার আত্মা শান্তি পাবে।
শেরে বাংলা তাঁর নিজের সম্বন্ধে যা নিজেই লেখে রেখে গেছেন তা হলো:
Self Analysis
‘In my stormy and chequered life chance has played more than her fair part. The fault has been my own. Never at any time have I tried to be the complete masster of own fate. The strongest impulse of the moment has governed all my action. When change has raised me to dazzling heights, I have received her gifts without-streched hands. When she has cast me down from my hight pinnacle, I have accepted her bufferts without complaint. I have my hours of my own pinnacle and regret. I am introsprective enought to take an interest in the examination of my own conscience. But this self-analysis has always been ditched. It has never been morbit. It has neither aided nor impeded the fluctuations struggle which man wages on behalf of himself against himself. Disappointments have not cured me of ineradicable romanticism. If at times I am sorry for something I have done, remores assails me only for the things I have left undone.’
Fajlul Haq
শেরে বাংলার এই সামান্য কথা থেকে আমরা তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারি।
আজ লাহোর প্রস্তাবের মালিকের মৃত্যুবার্ষিকী । আর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তি করে আমি যে ৬ দফা পেশ করেছি তার উপর বক্তৃতা করার জন্য এ দিনটিতে আমাকে ১৫ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। আল্লার মহিমা বোঝা কষ্টকর!
২৮শে এপ্রিল-৩০শে এপ্রিল ১৯৬৭
কারাদণ্ড হওয়ার পরে জেলের ভিতরে যখন আমি ফিরে এলাম। এসেই শুনলাম আমার ভিতরে আসার পূর্বেই সাধারণ কয়েদিরা খবর পেয়েছে যে, আমাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করল এই জুলুমের কি কোনো প্রতিকার নেই? এদের চোখে মুখে বেদনা ভরা। দুই একজন তো কেদেই দিল। আমি ওদের হাসতে হাসতে বললাম, ‘দুঃখ করবেন না। আমি তো এই পথে জেনে শুনেই নেমেছি। দুঃখ তো আমার কপালে আছেই। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে, কষ্ট ও জুলুম স্বীকার করতে হয়।‘ আমার কাছে কোনো কয়েদির দেখা করা বা কথা বলা নিষেধ। তবুও সিপাহি জমাদারদের বলে ফাকে ফাকে পালাইয়া আসে। কত দরদ ভরা এদের মন। ক্যান যে এরা আমাকে ভালোবাসে আজও বুঝতে পারলাম না। পাষাণ প্রাচীর ঘেরা এই কারাগারের বন্দি কয়েদিরাও আজ চায় নিজের অধিকার নিয়ে বাঁচতে। তারাও বুঝতে শুরু করেছে তাদের শোষণ করছে এক শাষকগোষ্ঠী। দিন ভরেই কয়েদিরা আসছে আর আফসোস করছে। হায়রে বাঙালী শুধু কাঁদতেই শিখেছে আর কিছুই করার ক্ষমতা তোমাদের নেই!
আজ ১৪ দিন হয়ে গেছে, রেণু তার ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে আসবে বিকাল সাড়ে চারটার। চারটার সময় আমি প্রস্তত হয়ে রইলাম। পৌনে পাঁচটায় সিপাহি আসলো আমাকে নিতে। আজ তো আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, আইবি অফিসার আইনতভাবে আমার যখন আলাপ করবো তখন থাকতে পারবে না। যেয়ে দেখলাম আইবি অফিসার ঠিকই এসেছে তবে কিছু দূরে বসে আছে। আমরা যে রুমে বসে আলাপ করবো সে রুমে বসে নাই। রুমে এলে আমি বাধ্য হতাম তাকে বের করে দিতে। আর দিতামও। বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সাথে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা। ঘর সংসার, বাড়ির কথা আরও অনেক কিছু। আমার শাস্তি হয়েছে বলে একটুও ভীত হয় নাই, মনে হলো পূর্বেই এরা বুঝতে পেরেছিল। রেণু বলল, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দিবে। দেখেই খুশিই হলাম। ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাব ভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, ‘তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কত দিন থাকতে হয় জানি না। তবে অনেকদিন আরও থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ি সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটাইয়াছি তোমার মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।’ ছোট মেয়েটা বলল, আব্বা এক বৎসর হয়ে গেল।’ আমি ওকে আদর করলাম, চুমা দিলাম। আর বললাম ‘আরও কত বৎসর যায় ঠিক কি? ’ আপীল করার কথা বললাম। আর নোয়াখালী, সিলেট, চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহ ও পাবনার মামলাগুলির কাগজপত্র আনাতে এবং হাইকোর্টে মামলা করতে বললাম যাতে সকল মামলা ঢাকায় আনা হয়। জেলে বসেই নিম্ন আদালতের বিচারগুলি হয়ে যায়। সবই বক্তৃতার মামলা।
রেণু শুনল। এখন যাহা পাই একলার পাক করে খাওয়া কষ্টকর । আমাকে বলল, কিছু প্রয়োজন আছে কিনা? বললাম, দেখা যাক কি হয় তারপর দরকার হলে জানাব। রাসেল একবার আমার কোলে, একবার টেবিলের উপরে উঠে বসে। আবার মাঝে মাঝে আপন মনেই এদিকে ওদিকে হাঁটাচলা করে। বড় দুষ্ট হয়েছে, রেহানাকে খুব মারে। রেহানা বলল, আব্বা দেখেন আমার মুখখানা কি করেছে রাসেল মেরে।’ আমি ওকে বললাম, ‘তুমি রেহানাকে মার? রাসেল বলল, ‘হ্যাঁ মারি।’ বললাম, ‘না আব্বা আর মেরো না।’ উত্তর দিল, ‘মারবো।’ কথা একটাও মুখে রাখে না। জামাল বলল, ‘আব্বা আমি এখন লেখাপড়া করি।’ বললাম, ‘তুমি আমার ভালো ছেলে মন দিয়ে পড়িও।’ সন্ধা হয়ে এলে ছেলেমেয়েদের চুমা দিয়ে ও রেণুকে বিদায় দিলাম। বললাম, ‘ভাবিও না অনেক কষ্ট আছে। প্রস্তুত হয়ে থাকিও।’
ফিরে এলাম। একটু পরেই তালাবন্ধ হয়ে গেল। আমিও বই নিয়ে বসলাম। রাত্র দশটা পর্যন্ত লেখাপড়া করি আজকাল। তারপর খেয়ে শুয়ে পড়ি। কোনো দিন শুয়েই ঘুম এসে যায় আবার কোনোদিন পাগল ভাইদের চিৎকার শুনি মশারির ভিতরে শুয়ে।
২৯ তারিখ সকালে বসে কাগজ পড়ছি, ডাক্তার সাহেব আমাকে দেখতে আসলেন। বললাম, রোগ ও শোক এই দুইটাতো কারাগারের সাথী-কি আর দেখবেন? সকালে ১০টা-১১টা পর্যন্ত কাগজ অথবা বই পড়ি। ১২টার সময় দেখি রেণু কয়েক সের চাউল, কিছু ডাউল, তেল, ঘি, তরকারি, চা, চিনি, লবন, পিঁয়াজ ও মরিচ ইত্যাদি পাঠাইয়াছে। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ডিভিশন ‘ক’ কয়েদিরা বাড়ির থেকে এসব আনতে পারে ডিআইজি প্রিজনের অনুমতি নিয়ে। অনুমতি নিয়েই পাঠাইয়াছে দেখলাম। ভালোই হয়েছে। কিছুদিন ধরে পুরানা বিশ সেলে যে কয়েকজন ছাত্র বন্দি আছে আরা খিচুড়ি খেতে চায়। বহুদিন আমাকে বলেছে কিন্তু কুলাতে পারব না বলে নড়াচড়া করি না। কিছু কিছু বাঁচাইয়াছি কয়েকটা মুরগি, কিছু ডিমও জোগাড় করেছি। নূরুল ইসলাম, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আরও কয়েকজন মিলে ‘খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করেছে। খিচুড়ি আদায় করতেই হবে। একদিন হঠাত আমার পাকের ঘরের কাছে একটা কাঁঠাল গাছ আছে, সেখানে খবরের কাগজে কালি দিয়ে লিখে কাঁঠাল গাছে টানাইয়া রেখেছে কোনো কয়েদিকে দিয়ে। তাতে লেখা আছে ‘ আমাদের দাবি মানতে হবে, খিচুড়ি দিতে হবে।’ নীচে লেখা ‘খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ।’ আমি তো নূরুল ইসলামের হাতের লেখা চিনি। বাইরে ও পোস্টার লেখতো। তারই হাতে লেখা। আমি তাদের ডেকে বললাম, এসব দাবি টাবি চলবে না। দরকার হলে জনাব মোমেন খানের পন্থা অবলম্বন করব। খুব হাসাহাসি চললো। মাঝে দুই একজনে দুই একবার শ্লোগানও দিয়েছে-‘খিচুড়ি দিতে হবে।’
আজ সুযোগ হয়ে গেল। মালপত্র পাওয়া গেল। বিকালে তাদের বললাম ‘যাহা হউক তমাদের ভাবির দৌলতে তোমাদের খিচুডি মঞ্জুর করা গেল। আগামীকাল খিচুড়ি হবে।’
যথারীতি রবিবার সকাল থেকে খিচুড়ি পাকের জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা হলো। রেণু কিছু ডিম পাঠাইয়াছে। কয়েকদিন না খেয়ে কয়েকটা ছোট ছোট মুরগির বাচ্চাও জোগাড় হয়েছে। আমি তো জেলখানার বাবুর্চিকে দেখাইয়া দিলাম। পানি একটু বেশি হওয়ার কারনে দলা দলা হয়ে গেছে। কিছু ঘি দিয়ে খাওয়ার মত কোনমতে করা গেল। পুরানা বিশ সেলে আট জন ডিপিআর, তাদের ফালতু, পাহারা, মেট চারজন করে দেওয়া হলো। আমার আশে পাশেও ৮/১০ জন আছে সকলকেই কিছু কিছু দেওয়া হলো। ডিম ভাজা, ঘি ও অল্প অল্প মুরগির গোস্তও দেওয়া হলো। গোসল করে যখন খেতে বসলাম তখন মনে হলো খিচুড়ি তো হয় নাই তবে একে ডাউল চাউলের ঘাণ্টা বলা যেতে পারে। উপাই নাই খেতেই হবে কারণ আমিই তো এর বাবুর্চি। শাহ মোয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম বলল, ‘মন্দ হয় নাই।’ একটু হেসে বললাম, ‘যাক আর আমার মন রাখতে হবে না। আমিই ত খেয়েছি।’ যাহা হউক খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদের দাবি আদায় হলো, আমিও বাঁচলাম।
বিকালে শুনলাম মণিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, শরীর খারাপ করেছে। দুইদিন পরে আইন পরীক্ষা দিবে। একটু চিন্তাযুক্ত হলাম। খবর নিয়ে জানলাম, চিন্তার কোনো কারণ নাই।
১লা মে-২রা মে ১৯৬৭
খবরের কাগজের মারফতের দেখতে পেলাম কয়েকটি বিরোধী দল ৮ দফা কর্মসূচির উপর ভিত্তিতে একতা ঐক্য জোট গঠন করেছে। ঐক্য জোটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন’। কর্মসূচি পূর্বেই আমি পেয়েছি। ঐক্যজোটের চুক্তিতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান, আবদুর সালাম খান এবং গলাম মোহাম্মদ খান লুন্দখোর, কাউন্সিল মোছলেম লীগের মিয়া মমতাজ দৌলতানা, খাজা খয়ের উদ্দিন এবং তোফাজ্জল আলি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের জনাভ নূরুল আমীন, জনাব আতাউর রহমান খান এবং হামিদুল হক চৌধুরী, জামাতে ইসলামী পার্টির জনাব তোফায়েল মোহাম্মদ , জনাব আবদুর রহিম এবং জনাব গোলাম আজম, নেজামে ইসলাম পার্টির চৌধুরী মহম্মদ আলি, জনাব ফরিদ আহম্মদ এবং এম আর খান স্বাক্ষর করেন।
৮ দফা কর্মসূচী
(১) পার্লামেন্টারী পদ্ধতির ফেডারেল সরকার।
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত আইন পরিষদের প্রাধান্য। পূর্ণাঙ্গ মোউলিক অধিকার, সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা।
(২) কেন্দ্রীয় সরকার নিম্নলিখিত বিষয়গুলির দায়িত্ব গ্রহণ করিবেঃ
(ক) দেশরক্ষা, (খ) বৈদেশিক বিষয়, (গ) মুদ্রা ও কেন্দীয় অর্থনীতি, (ঘ) আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য এবং অন্যান্য যে বিষয়গুলি স্বীকৃত হইবে।
(৩) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হইবে, এবং অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত রেসিডিঊয়ারী ক্ষমতা শাসনতন্ত্রের মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত সরকারের নিকট অর্পিত হইবে।
(৪) দশ বৎসরের মধ্যে উভয় প্রদেশের মধ্যকার বৈষম্য দূরীকরণ করা সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকিবে। দেশরক্ষা, বৈদেশিক ব্যয়, বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতি পূর্ব পাকিস্তানের আনুপাতিক ভাগ বাদ দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানেই ব্যয় হইবে। এবং অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্বাধীন থাকিবে । অর্থনৈতিক বৈশম্য বলবৎ থাকা পর্যন্ত পকিস্তান সরকার বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অগ্রাধিকার প্রাদান করিবে। এবং এমন অর্থনীতি গ্রহণ করিবে যাহাতে পূর্বাঞ্চল হইতে মূলধন পাচার বন্ধ হইয়া যায়। এই উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গকের মওজুদ ও মুনাফা বীমা প্রিমিয়াম ও শিল্প ক্ষেত্রে মুনাফা সম্পর্কে উপযুক্ত আইন প্রণয়ন করা হইবে।
(৫) (ক) মুদ্রা, বৈদেশিক ও কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্গকিং, (খ) আন্তঃপ্রাদেশিক বাণিজ্য, (গ) আন্তঃপ্রাদেশিক যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয়গুলির ভার জাতীয় পরিষদের সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমসংখ্যক সদস্য সম্বলিত বোর্ডের উপর অর্পণ করা হইবে।
(৬) সুপ্রিম কোর্ট এবং কূটনীতিক সার্ভিস সহ কেন্দীয় সরকারের সকল বিভাগের ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সম-সংখ্যক ব্যক্তি গ্রহণ করা হইবে। এই সংখ্যক সাম্য লাভের জন্য ভবিষ্যতের নিয়োগ এমনভাবে করা হইবে যাহাতে দশ বৎসরের মধ্যে বৈষম্য দূর হয়।
(৭) দেশরক্ষা বাহিনীর শক্তিতে উভয় প্রদেশের মধ্যে সমতাবিধান করা পাকিস্তান সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকিবে। এই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে মিলিটারী একাডেমী, অস্ত্র নির্মাণ কারখানা, ক্যাডেট কলেজ ও স্কুল নির্মাণ করা হইবে। দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি শাখায় লোক নিয়োগ করা হইবে এবং নৌ-বাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করা হইবে। ইহা বাস্তবায়িত করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান হইতে সমসংখ্যক সদস্য লইয়া একটা প্রতিরক্ষা কাউন্সিল গঠিত হইবে।
(৮) এই শাসনতন্ত্রের অর্থ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র। এই শাসনতন্ত্র অবিলম্বে ক্ষমতায় অসীন হইবার পর জারি করা হইবে এবং জারি করার ৬ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিদেশনে কর্মসূচীর দুই ও সাত নম্বর ধারা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হইবে। সকল অঙ্গ দল ও সংস্থা এই উদ্দেশ্য সাধনে অঙ্গীকারবদ্ধ।
২রা মে-৩রা মে ১৯৬৭
হটাৎ খবরের কাগজে দেখলাম সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং মিসেস আমেনা বেগম, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতি দেন ঐক্যফ্রন্টের চুক্তিতে স্বাক্ষর সম্বন্ধে। তারা বিবৃতে বলেন, ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিত গঠিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের স্বাক্ষর দানের বৈধতা সম্পর্কে।
আবার জহির সাহেবেও একটি বিবৃতি দেখলাম। মহা চিন্তায় পড়লাম। অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলাম। তারপর কলম ধরলাম। আমার মতামত দেয়া প্রয়োজন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা যারা চেয়েছিল তাহাই হলো। আওয়ামী লীগ ভাঙতে। এখন দুই দলের ইজ্জতের প্রশ্ন হয়েছে। আমি আশ্চর্য হলাম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রস্তাব দেখে। পাকিস্তান অবজারভারের ২রা মে-র কাগজে এই প্রস্তাবটি উঠেছে তাতে লেখা আছে:
‘The All Pakistan Awani League Working Committee at its meeting in Decca on April 23 discussed Six-Point Programme of East Pakistan Awami League. On the basis of this programme it evoled a formula in which besides the restoration of complete democracy in the country the genuine demands of East Pakistan People were incorporated. This formula was unanimously adopted by the East Pakistan Awami League also as the basis for negotiations with others political parties. Says press release’.
আমি বুঝতে পারলাম না কেমন করে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে এই আট দফা দাবির মধ্যে।
৩রা মে-২৩মে ১৯৬৭
কিছুদিন থেকে শরীরের অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। প্রায় ৭ সের অজন কমে গেছে। অর্শ রোগ হওয়ার জনয় মাঝে মাঝে রক্ত পড়ে পায়খানার দ্বার দিয়ে। শরীরের প্রতি যত্ন নিয়েও কিছু হচ্ছে না। দুর্বল হয়ে পড়েছি। ৩রা মে দেশরক্ষা আইনে (বিনা বিচারে) শেষ তিন মাসের সরকারি হুকুমনামা আমাকে হয় নাই । এক বৎসর শেষ হয়ে গেছে ৩রা মে তারিখে । ৪ তারিখে হুকুম পাব আশা করেছিলাম। বুঝতে পারলাম আমার ১৫ মাস জেল হয়েছে। আমি দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদি তাই হুকুম নামা দেওয়া হয় নাই। এখন আমি শুধু দণ্ডভোগ করছি। আপীল দায়ের করা হয়েছে সাজার বিরুদ্ধে। আপীল মঞ্জুরও হয়েছে। আগামী ২৯ তারিখ জামিন সম্বন্ধে শুনানি হবে ঢাকা জেলা জজের কাছে। যদি জামিন পেয়ে যাই তবে সরকার আবারও আমাকে ডিপিআর-এ বিনা বিচার আইনে বন্দি করে রাখবেন। ২৯শে জুন তারিখে মামলার শুনানি হবে জজ সাহেব বলে দিয়েছেন।
হাইকোর্ট থেকে একটা হুকুম পেয়েছি যে বক্তৃতার মামলায় জনাব মালেক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট, আমাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে সরকার হাইকোর্টে আপীল করেছেন। আহামী ২৯ তারিখে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি হবে বলে নোটিশ পেয়েছি। কাগজটা পাঠাইয়া দিয়েছি রেণু’র কাছে এডভোকেটদের সাথে পরামর্শ করে যে কোনো একজন ভালো এডভোকেট দিয়ে, মামলা পরিচালনা করতে। এতগুলি বক্তৃতার মামলা দিয়েছে। দুইটায় সাজা হয়েছে। একটায় খালাস পেয়েছি, তার বিরুদ্ধে সরকার আপীল করতে কত উৎসাহ। যদিও এডভোকেট সাহেবরা টাকা নেয় না, তথাপি নকল ও অন্যান্য খরচ বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হয়। জেলে আছি উপার্জন নাই। ছেলেমেদের খুবই অসুবিধা হবে। লড়তে হবে উপায় কি? রাজনৈতিক কারণে মানুষ মানুষকে অত্যাচার করে তবে তার একটা সীমা আছে ও লজ্জা আছে। নিশ্চয়ই জনগণ বুঝতে পারে যে একটা লোককে ধ্বংস করার জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সরকার নিশ্চয়ই জানে ‘যার কিছুই নাই তার আবার নষ্ট হবার ভয় কি?’ একটা ‘দোষ’ বোধ হয় আমার কাছে মনে সেটা হলো জনগণ আমাকে ভালোভাবাসে এবং যে ৬ দফা দাবি করেছি তাহা সমর্থন করে, তাই বোধ হয় এই অত্যাচার। দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা গেছে যে কোন ব্যক্তি জনগণের জন্য এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য কোনো প্রোগ্রাম দিয়েছে, যাহা ন্যায্য দাবি বলে মেনে নিয়েছে। অত্যাচার করে তাহা দমানো যায় না। যদি সেই ব্যক্তিকে হত্যাও করা যায় কিন্তু দাবি মরে না এবং সে দাবি আদায় হয়। যারা ইতিহাসের ছাত্র বা রাজনীতিবিদ, তারা ভাল করে জানেন। জেলের ভিতরে আমি মরে যেতে পারি তবে এ বিশ্বাস নিয়ে মরব। জনগণ তাদের ন্যায্য আধিকার একদিন আদায় করবে।
মণি জেল হাসপাতাল থেকেই ল’ পরীক্ষা দিতেছে, ভালই দিয়েছে খবর পেলাম। শাহ মোয়াজ্জেম আমার পাশেই বিশ সেলে আছে। হাইকোর্ট ডিপিআর থেকে খালাস দিয়েছে কিন্তু একটা মামলার জামিন না হওয়ার জন্য জেলে পড়ে আছে। নুরুল ইসলাম, নুরে আলম সিদ্দিকীও পুরানা বিশে থাকার জন্য একটু আরামেই আছি। কারণ ওদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে পারি মাঝে মাঝে, ফাঁকে ফাঁকে তাসও খেকে থাকি। যদিও তাস খেলা ভাল জানি না। ব্রীজ খেলতে গেলে উল্টা-পাল্টা খেলে বসি। মোয়াজ্জেম আমার সাথী, মুখ কালা করে ফেলে, কিছু বলতেও পারে না আর সইতেও পারে না ।
দুপুর বেলা বিছানায় শুয়ে থাকলে রাতে আর ঘুম হতে চায় না। তাই দুপুর বেলা খাওয়ার পর কিছু সময় নষ্ট করি। আমি তো একাকীই থাকি, কোনো দেওয়াল ভিতরে না থাকায় ওরা চলে আসে। আর আমি তো কয়েদি হয়েছি, রাজনৈতিক বন্দি তো নই। আর মোয়াজ্জেমও বিচারাধীন আসামি। আর মোয়াজ্জেম কাছে থাকায় অনেক সময় গল্প করে কাটাতে পারি। মোয়াজ্জেম বলে, ‘মুজিব ভাই কিছু লেখেন’। আমি বলি, ‘কি লিখব, বল, লেখার অভ্যাস তো কোনোদিন করি নাই’।
নূরুল ইসলাম ওনূরে আলম সিদ্দিকীর দুষ্টামী খুব ভাল লাগে। ব্রীজ খেলতে যখন পারি না তখন ব্রে খেলা শুরু করলাম। পরপর কয়েকদিন কয়েকদিন আমাকেই ব্রে হতে হলো কারণ ও খেলাটাও আমি ভালো জানি না। আমাকে নিয়ে ওরা ‘মহা বিপদে’ পড়েছে। আস্তে আস্তে শিখে নিয়ে ওদেরও ব্রে করতে শুরু করলাম’ পূর্বের মত আর একচেটিয়া অবস্থা নাই। তবে শাহ মোয়াজ্জেমকে ব্রে করা খুব কঠিন, দুই একবার ছাড়া করা যায় নাই। এখন ব্রে খেলা চলছে। সকালে লেখাপড়া, দুপুরে খাওয়ার পরে কাগজপড়া ও ব্রে খেলা। সন্ধ্যার পরে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয় যার যার সেলে। আর আমাকে দেওয়ানী অয়ার্ডে। সন্ধ্যা হলেই বই নিয়ে বসে পড়ি। দশটায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি, ঘুম হলেও শুয়ে থাকতে হবে আর না হলেও শুয়ে থাকতে হবে। বাইরে যেয়ে একটুও হাওয়া খাওয়ার উপায় নাই।
১৭ তারিখে রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। হাচিনা আইএ পরীক্ষা দিতেছে। হাচিনা বলল, “আব্বা প্রথম বিভাগে মনে হয় পাশ করতে পারব না তবে দ্বিতীয় বিভাগে যাবো”। বললাম, “দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে মন দিয়ে পড়। দ্বিতীয় বিভাগে গেলে আমি দুঃখিত হব না, কারণ লেখাপড়া তো ঠিকমত করতে পার নাই”।
রাসেল আমাকে নিয়ে জেতে চায় বাড়িতে। এক বৎসর হয়ে গেছে জেলে এসেছি। রাসেল একটু বড় হয়ে গেছে। জামাল আসে নাই, খুলনায় গিয়াছে। শুনলাম বাইরে খিব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। জেলা ও মহকুমার প্রেসিডেন্ট ও সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে। সভা আমার বাড়িতে করতা হবে বলে একটিং সভাপতি ও একটিং সম্পাদক রেণুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকালে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও। আমার আপত্তি নাই।
আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের মধ্যে জার আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। তাজউদ্দিন, মোমিন সাহেব, অবায়দুর, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে রাজি নয়। খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সেও পিডিএমএর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এ কথা বলে আর বাইরে অন্য কথা পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে। তাজুদ্দিন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নূরে আলম, নূরুল ইসলাম-আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমীক নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএমএ এর পক্ষে, কর্মীরা কেউই রাজি না। মানিক ভাইও পিডিএমএ এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএমএ দিয়েছে। আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নূরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের ‘মানস পুত্র’ বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভালো। আমি এটা স্বীকার কররে পারি নাই-তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে। পূর্ব বাংলার লোকদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মাওলানা মওদুদী চৌধুরী মহম্মদ আলী । ৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না। ঐক্যবদ্ধ অন্দোলন আমিও চাই, তবে এই সকল বড় বড় নেতারা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না তা আমার জানা আছে।
মাওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছন্নতাবাদী বলে আক্রণও করেছে। ১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি পিডিএম এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দরখস্ত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাঊন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হবে না। অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন। আমার ব্যক্তিগত মত ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাইছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না। প্রে জানাইয়া দেই। এও বলেছি এমনভাবে প্রস্তাব করবেন যাতে যারা দরখস্ত করেছে তারা যেন সসম্মানে ফিরে আসতে পারে। তবে যদি পিডিএম কোনো আন্দোলন করে তাদের সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছি-সহযোগিতা চাইলে, এইভাবে প্রস্তাব করবেন। প্রস্তাব সেইভাবে করা হয়েছে। দেখলাম কাগজে আমার কথা মতই প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে:
‘The meeting of the E.P.A, League Working commettee discussed the 8-point programme of the PDM and resolved that the matter be referred to East Pakistan Awami League Council for final decision.
It is further resolved that pending decisions by the council the East Pakistan Awami League will extend it responsive cooperation to any movement of the PDM for the restoration of democratic rights of the peoples of Pakistan.
The meeting of the East Pakistan Awami League working committee reiterates its faith in the six-points programme and will continue the movement for its realization’।
ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আবদুল রশিদ ও নূরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম এ যোগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এরা পিডিএম করতেই চায়। ৬ দফার আর প্রয়োজন নাই তাদের কাছে।
ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ করেই জনাব জহিরুদ্দিন, মশিয়ুর রহমান, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), আবদুর রশিদ ও নূরুল ইসলাম চৌধুরী পিডিএম এ যোগদান করার জন্য লাহোর রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। তারাও সভায় যোগদান করেছে। বুঝতে আর বাকি রইল না এঁরা পিডিএম করতেই চায়। ৬ দফার আর প্রয়োজন নাই তাঁদের কাছে।
পিন্ডি থেকে জনাব কামরুজ্জামান এমএনএ, জনাব ইউসুফ আলী এমএনএ, জনাব নূরুল ইসলাম এমএনএ আওয়ামী লীগের এই তিন সদস্য পিডিএম সম্মেলনে যোগদান করেছেন। ৬ দফা পিডিএমএ যোগদান করতে এঁদের নিষেধ করা হয়েছে।
ন্যাপও পিডিএমএ যোগদান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিলে আন্দোলন কে করবে? সারা পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ কর্মী ছাড়া অন্য দলের একটি কর্মীও জেলে নাই। ত্যাগ করলে এই দুই দলের নেতা ও কর্মীরা করেছে। ঘরে বসে বিবৃতি দিয়ে এই দলের কর্মীরা রাজনীতি করে না। কিছুদিন মধ্যেই প্রমাণ হয়ে যাবে যে এই পিডিএম করার পিছনে বিরাট ষড়যন্ত্র আছে।
লাহোরের সভায় পিডিএম কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাতে নবাবজাদা নসরুল্লাহকে সভাপতি আর মাহমুদ আলীকে সম্পাদক করা হয়েছে। আওয়াই লীগের সভাপতি আর প্রেসিডেন্ট করার পিছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এটা পূর্ব পাক আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধোঁকা দেওয়ার ষড়যন্ত্র। কিছুতেই পারবে না – এ বিশ্বাস আমার আছে।
২৪শে মে ১৯৬৭ ।। বুধবার
আজ ২৪শে মে সকালে সিভিল সার্জন সাহেব আমাকে দেখতে এসেছেন। কারণ আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। খবরের কাগজে ছাপা হওয়ার জন্য সরকার বোধহয় জানতে চেয়েছেন আমার শরীরের অবস্থা। ওজন নিলেন, পাইলসের অবস্থা শুনলেন, মাথার যন্ত্রণা, পিঠে বেদনা ও গ্যাস্ট্রিক নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছি আমি। কয়েকদিন পূর্বে, বোধহয় ১০/১২ দিন হয়ে গেছে মেডিকেল কলেজ থেকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এনে দেখার জন্য নোট দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ পর্যন্ত কেহই আসেন নাই বা আনা হয় নাই। মুক্তি তো আমাকে দেবে না। চিকিৎসাও ভালভাবে করবে না। আমার স্বাস্থ্য ভালই ছিল। খুবই পরিশ্রম করতে পারতাম, আজ আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। হাটতেও ইচ্ছা হয় না। বসে বসে কাটাই অথবা শুয়ে থাকি। একদিন সকালে হঠাত মাথা ঘুরে পড়ে গিয়াছিলাম, পাশেই একটা বসার জায়গা থাকায় ধরে নিজেকে সামলাইয়া নিয়াছিলাম। এত দূর্বল কেন যে হয়ে পড়লাম বুঝতে পারি নাই। রেণুকে ও ছেলেমেয়েদের বেশি কিছু বলি না কারণ ওরা চিন্তা করবে। স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে পড়লে জেল খাটব কেমন করে? জেলের ভিতর সামান্য অসুখ হলেই মন খারাপ হয়, মনে হয় কত বড় ব্যারামই না হয়েছে! বিশেষ করে আপনজনের কথা মনে পড়ে। আপনজনের সেবা চায় মন বার বার, বোধহয় এটাই নিয়ম, যা পাওয়া যায়না বা পাওয়া যাবেনা তারই উপর আগ্রহ হয় বেশি। তাই ভাবি, জীবনের কত হাজার হাজার দিন এই কারাগারে একাকী কাটাইয়া দিলাম আর কতকাল কাটাতে হয় কেইবা জানে! তবুও দুঃখ আমার নাই, নীতি ও আদর্শের জন্য অত্যাচার সহ্য করেছি। যুগে যুগে অনেক নেতা ও মনীষী নিজের আদর্শ এবং সত্যের জন্য জীবন দিয়েছে। কারাগারে বসে ধুকে ধুঁকে মারা গিয়াছে। তাঁদের কথা কেউই তো আজ মনে করে না। এই বাংলাদেশের কত ছেলে ইংরেজের ফাসিকাষ্টে ঝুলে জীবন দিয়েছে-তাদের নাম কেউ মনেও করে না। কেহ যদিও মনে করে তাঁদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলা হয়। এই বাংলাদেশের যুবকদের গলায় বাঙালিরাই তো ইংরেজের হুকুমে ফাঁসির দড়ি পরাইয়া দিয়েছে। একটু দুঃখ তো করে নাই, অনুতাপ তো দূরের কথা। বাংলার মাটির দোষই বোধহয়! যে বাঙালিরা আমাকে আসামি করেছে, আটকাইয়া রাখছে, জেল দিতেছে-তারাও তো এই মাটিরই মানুষ এবং উচ্চ শিক্ষিত। এঁদের ছেলেমেয়ে ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যই তো আমি ও আমার মত শত শত কর্মীরা কারাবরণ করেছি। আরও কত লোকই না জীবন দিল তারই ভাইয়ের গুলিতে। এরাও একদিন বুঝবে, তবে সময় থাকতে না।
সিভিল সার্জন ও জেলের ডাক্তার সাহেবকে বললাম, ‘যদি পারেন ভাল চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত করুণ’। এই অত্যাচারীদের কাছে মাথা নত করব না, মরতে হয় কারাগারেই মরব। পাপ আর পূণ্য পাশাপাশি চলতে পারে না। মৃত্যু যদি জেলেই থাকে, হবে। একদিন তো মরতেই হবে! সন্ধ্যায় ঘরের ভিতর বন্ধ করে দেয়, আর ভোরবেলা তালা খুলে দেয়। কি করে স্বাস্থ্য ঠিক থাকতে পারে!
২৫শে মে ১৯৬৭ ।। বৃহস্পতিবার
আজ জেলের ডিআইজি মওলানা ওবায়দুল্লা সাহেব এলাকায় এসেছেন কয়েদিদের নালিশ শুনতে। প্রায় আধাঘন্টা আমার কাছে ছিলেন, অনেক বিষয় আলাপ আলোচনা হলো। বললাম, আমি তো এখন রাজনৈতিক বন্দি নই, এখন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি। পুরাপুরি জেল কর্মচারীদের অধীনে। আইবির হুকুম বোধহয় এখন নিতে হয় না। মওলানা সাহেব বললেন, “চিঠিপত্র আইবির মাধ্যমে যাওয়া আসা করবে এটা আইনে আছে। আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করার সময় সাদা পোশাকে পুলিশ কর্মচারী থাকতে পারে না”।
“আমাদের সুর্য অস্তের সময় যে তালাবন্ধের নিয়ম আছে সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের জন্য তা একঘন্টা বাড়িয়ে দিবার নিয়ম করেছিলেন সেটা আপনারা অনুসরণ করুণ, কারণ এই গরমে সূর্যাস্তের সময় তালাবন্ধ হয়ে ঘরের মধ্যে থাকা সম্ভবপর নয়”। অনেক আইন নিয়ে আলোচনা হলো। তারপর বললেন, আমি সরকারকে লেখব অনুমতির জন্য। এই সরকার রাজনৈতিক কর্মীদের বন্দি করে কষ্ট দেবার সকল পন্থাই অবলম্বন করেছে। এখানেও যাহা হবে বুঝতেই পারি।
দৈনিক সংবাদ কাগজটাও বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। শুধু প্রকাশকের নাম বদলাবার অনুমতি না দিয়ে ১৬ বৎসরের কাগজটা বন্ধ করে দিতে পারে কোনো সভ্য সরকার? আবার বলে বেড়ায় গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এদেশে নাকি খুবই আছে। যে ভাবে ও যে পথে সরকার চলছে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে তাহা আমি দিব্য চোখে দেখতে পারি।
আজ পিডিএম এর সভা শেষ হয়েছে, কয়েকটা প্রস্তাবও নিয়েছে।
২৭শে মে – ২৮শে মে ১৯৬৭
ডিপুটি জেলার সাহেব খবর দিলেন ২৭ তারিখে জেলগেট কোর্টে আমার ১২৪ক ধারার মামলা শুরু হবে। আরও বললেন, আপনার ছেলেমেয়েদের সাথেও কাল দেখা করার অনুমতি পেয়েছেন।শরীর ও মন দুটোই খারাপ। অসহ্য গরম পড়েছে-যাকে বলা হয় ভ্যাপসা গরম। জেলের ভিতর এমনিই গরম থাকে। ১৪ ফিট দেওয়াল ঘেরা, বাতাস চেষ্টা করলেও আসতে কষ্ট হয়।
ভোর থেকে প্রস্তুত হয়ে আছি, কখন ডাক পড়বে ঠিক নাই। প্রথম খবর পেলাম হাকিম ১০টায় আসবেন। আবার খবর পেলাম ১১টায় আসবেন। আসতে আসতে প্রায় ১২টা বেজে গেছে। সিপাহি এসে বলল, “চলুন স্যার হাকিম এসেছেন সকলে বসে আছে”। তাড়াতাড়ি রওয়ানা হয়ে গেলাম। জেলগেট নাজিমুদ্দীন রোডে, আর আমিথাকি ডিক্রি এলাকায় উর্দু রোডের পাশে। জেলটা ছোটনা। যেয়ে দেখি জনাব সালাম সাহেব, জহিরুদ্দিন সাহেব, মশিয়ুর রহমান সাহেব,মাহমুদুল্লা সাহেব, আবুল হোসেন এডভোকেট এসেছেন। এদিকে একটু পরেই আমেনা, মোস্তফাও এসেছে। খুলনা থেকে আলী ও অন্যান্য কর্মীরা এসেছে। মামলা শুরু হলো। সরকারি উকিল জনাব আলীম সাহেব এসেছেন সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে। ভদ্রলোক এতবড় বেহায়া যাহা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। না জানে ইংরেজি, না জানে বাংলা, না জানে ভদ্রলোকদের সাথে আলাপ করতে। সরকারের নেমক খেয়েছে তাঁর কর্তব্য পালনে একটু ত্রুটি নাই। তাঁর নাকি একমাত্র গুন হও সাক্ষীদের ভাল করে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াতে পারে। তিনটা সাক্ষী হলো। জেরা পরে হবে। এটাও আমার পল্টন ময়দানের ১৯৬৪ সালের বক্তৃতার মামলা। দেড় ঘন্টা সাক্ষী হলো, তারপর হাকিম চলে গেল। এডভোকেট সাহেবরা বসলেন আমাকে নিয়ে আলাপ করতে।
জহিরুউদ্দিনের ইচ্ছা আর সালাম সাহেব চান পূর্ব-পাক আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করুক। যেভাবে পিডিএম প্রস্তাব গ্রহণ করেছে তাতে আছে ৮ দফার বিপরীত কোনো দাবি করা যাবে না। অর্থ হলো, ৬ দফা দাবি ছেড়ে দিতে হবে। আমি পরিষ্কার আমার ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। ৬ দফা ছাড়তে পারব না। যেদিন বের হব ৬ দফারই আন্দোলন করব। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম কমিটিতে যোগদান করতে পারবে না। কাউন্সিল সভা হউক দেখা যাবে।। যদি পার্টি যেতে চায় আমার আপত্তি কি? কতদিন থাকব ঠিক তো নাই। এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে ৬ দফা আন্দোলনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই না। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ, শোষক ও শাসকগোষ্টী এই ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের নেতারা বুঝেও বুঝতে চায় না। নবাবজাদা নসরুল্লাহ সাহেব বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান না করলে তাঁর সভাপতিত্ব পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যখন তিনি সভাপতি হয়েছে পিডিএম-এর তখন তো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পিডিএম-এ যোগদান করে নাই। দেখলাম, জহির সাহেব ও সালাম সাহেব অসন্তুষ্ট হয়েছে। মশিয়ুর ভাই আমাকে গোপনে বললেন, “লাহোর যেয়ে আমার কিছুটা ধারণা হয়েছে এর কিছু ষড়যন্ত্র আছে”। আমাকে আরও বললেন, আমি যদি যোগদান না করি তবে তিনিও পিডিএম থেকে পদত্যাগ করবেন।
আমেনাকে বললাম, “৭ই জুন শান্তিপূর্নভাবে পালন করিও। হরতাল করার দরকার নাই। সভা শোভাযাত্রা পথসভা করবা”। সকলেই তাঁদের ব্যক্তিগত সুবিধা ও অসুবিধার কথা বলল।
আড়াইটার সময় ফিরে এলাম। গোসল করে খাবার খেয়ে কাগজ নিয়ে বসলাম। পাচটায় আবার গেটে যেতে হলো। রেণু এসেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। হাচিনা পরীক্ষা ভালই দিতেছে। রেণুর শরীর ভাল না। পায়ে বেদনা, হাঁটতে কষ্ট হয়। ডাক্তার দেখাতে বললাম। রাসেল আমাকে পড়ে শোনাল, আড়াই বৎসরের ছেলে আমাকে বলছে, ‘৬ দফা মানতে হবে, সংগ্রাম, সংগ্রাম –চলবে চল্বে-পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, ভাঙা ভাঙা করে বলে, কি মিষ্টি শোনায়! জিজ্ঞাসা করলাম, “ও শিখলো কোথা থেকে?” রেণু বলল, “বাসায় সভা হয়েছে, তখন তোমার কর্মীরা বলেছিল তাই শিখেছে”। বললাম, “আব্বা, আর তোমাদের দরকার নাই এ পথের। তোমার আব্বাই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত করুক”। জামাল খুলনা থেকে ফিরে এসেছে। রেহানা খুলনায় যাবার জন্য অনুমতি চায়। বললাম, ‘স্কুল বন্ধ হলে যাইও’। কামালও বাড়ি যেতে চায় আব্বাকে দেখতে। বললাম, ‘যেও’। কোথা থেকে যে সময় কেটে যায় কি বলব? জেলে সময় কাটতে চায়না, কেবল দেখা করার সময় এক ঘন্টা দেখতে দেখতে কেটে যায়। ছেলেমেয়েরা বিদায় নিয়ে চলে গেল, আমিও আমার চির পরিচিত দেওয়ানি ওয়ার্ডের দিকে চললাম। ওবায়েদ কোর্টে গিয়াছল দেখা হয়ে গেল পথে। বললাম, ‘খবর কি?’ ওবায়েদ বলল, ‘আপনার যাহা মত আমাদেরও সেই মত’।
শাহ মোয়াজ্জেম ও নূরে আলম মাঠের মধ্যে বেড়াইতেছিল। আমাকে দেখে এগিয়ে এল। জিজ্ঞাসা করল, ভাবি কেমন আছে। বললাম, আমার শরীর খারাপ হওয়াতে বোধহয় তারও শরীর খারাপ হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুতে হলো। দরজা বন্ধ করতে আসবে। জমাদার চাবি নিয়ে হাজির। সব বন্ধ হয়ে গেছে। আমিও ভিতরে চলে গেলাম। খট করে বন্ধ হয়ে গেল বাইরের তালা। আমিও চা খেয়ে বই নিয়ে বসলাম।
২৮ তারিখের কাগজে দেখালাম ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, জয়দেবপুর ও ফতুল্লা থানা এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে-যাতে ৭ইই জুন ‘৬দফা দাবি দিবস’ পালন না করতে পারে। বুঝতে আর কষ্ট হলো না।
সংবাদ ও ইত্তেফাক বন্ধ করার ব্যাপার নিয়েও আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটাকে দমাতে হবে। এটাই হলো সরকারের উদ্দেশ্য।
আর একটা আশ্চর্য জিনিস আজ কাগজে দেখলাম, কলেজগুলির অনুমোদন নিতে হবে সরকারের থেকে। ইংরেজকেও হার মানাইয়া দিয়েছে এই সরকার। কলেজের অনুমোদন দিত বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজ আমল থেকে এ পর্যন্ত চলছিল এই নীতি। হঠাত সরকারের হাতে এই ক্ষমতা নেয়ার অর্থ বুঝতে কারই বা কষ্ট হয়! ভুল করছেন, বুঝতে পারছেন না! বাঁধন শক্ত হলে ছিড়েও তারাতাড়ি।
শাহ মোয়াজ্জেম একটা বই লিখেছে, আমায় পড়ে শোনালো। ভালই লিখেছে, অনেকক্ষণ ওর সাথে আলাপ হলো আজ। বোধহয় ৫.৭ দিনের মধ্যে জামিন পেয়ে জেল থেকে চলে যাবে। আবার একলা পড়ে যাবো। মাঝে মাঝে ২০ সেল ছেড়ে আমার কাছে চলে আসে। আমি চাই ওর মুক্তি হউক। আমার জীবনটাই একাকী কাটাতে হবে এই নিষ্ঠুর ইটের ঘরে।
২৯শে মে – ৩১ শে মে ১৯৬৭
যে মামলায় আমাকে ১৫ মাস জেল দিয়েছে জনাব আফসার উদ্দিন আহম্মেদ জেল গেটে কোর্ট করে, সেই মামলায় আমাকে জেলা জজ বাহাদুর জামিন দিয়েছে খবরের কাগজে দেখলাম। জমানতের কাগজ আজও জেল গেটে আসে নাই। দুই একদিনের মধ্যেই আসবে বলে মনে হয়। আবার রাজনৈতিক বন্দি হয়ে যাবো। এক মাসের বেশি বিনাশ্রম কারাদন্ড ভোগ করলাম। রেণু এসেছিল জেল গেটে মণিকে দেখতে। ছেলেমেয়েরা ভালই আছে। মাংশ মাছ পাকাইয়া নিয়ে এসেছিল, গেট থেকে পাঠাইয়া দিয়েছে। গরম করে করে দুইদিজ এগুলিই খেলাম। শাহ মোয়াজ্জেম, নূরে আলম, নূরুল ইসলাম ও চিত্ত বাবুকে রেখে তো খেতে পারি না, তাদেরও ভাগ দিলাম। আজ দিলাম অন্যান্য সকলকে। বড় ভাল লাগে সকলকে দিয়ে খেতে। কয়েদিদের একঘেয়ে পাক খেতে খেতে জীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে একটু পরিবর্তন হলে ভালই হয়। রাজনৈতিক বন্দি হিসাবে ঘরের জিনিস আনার হুকুম নাই। তবে কয়েদি হলে আনতে পারে। বিচিত্র দেশ, বিচিত্র আইন! রাজনৈতিক বন্দিদের ফলফালদি আনারও হুকুম নাই।
আজ কাগজ দেখে ভীষণ আঘাত পেলাম। খবরটা পেয়ে আমার কথা বলাও বন্ধ হয়ে গিয়াছিল। ভাবতেও কষ্ট হয় বন্ধু সহকর্মী ডা. গোলাম মওলা ইহজগৎ ছেড়ে চলে গিয়াছেন। ডা. গোলাম মওলা এমএসসি এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার ছিল। আমার সাথে পরামর্শ করে মাদারীপুরে প্রাকটিস করত। যেমন চেহারা তেমনি স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ছিল। মাত্র ৪৩ বৎসর বয়স হয়েছিল। এত ভাল স্বভাব ও মধুর ব্যবহার খুব অল্প লোকেরই আমি দেখেছি। মাদারীপুরের নড়িয়া থেকে ১৯৫৬ সালে এমএএন হয়। ১৯৬২ সালে আবার আইয়ুব সাহেবদের পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়। একদিনের জন্যও দলত্যাগ করে নাই। দেশের লোক তাকে ভালোবাসতো। দলমত নির্বিশেষে সকলেই তাকে তাঁর ব্যবহারের জন্য সম্মান করত ও ভালোবাসতো। ডাক্তার হিসেবে তাঁর যথেষ্ট নাম ছিল। দেশ একজন নিঃস্বার্থ নেতাকে হারাল। আর আমি হারালাম আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহকর্মীকে। কিছুই করতে পারব না শুধু খোদাকে ডাকা ছাড়া। বন্দি জীবনে এই সমস্ত খবর খুব কষ্ট দেয়। ডা. মওলার চেহারা বার বার ভেসে উঠছিল আমার চোখের সামনে। আমাদের সকলকেই তোমার পথের সাথী একদিন হতে হবে মওলা। দুই দিন আগে আর পরে। তোমার আত্মা শান্তি পাক এই দোয়াই খোদার দরবারে করি।
২২শে জুন ১৯৬৭ ।। বৃহস্পতিবার
২২শে জুন খবরের কাগজে দেখলাম। নারায়ণগঞ্জের বজলুর রহমান, ঢাকার হারুনুর রশিদ, তেজগাঁর মাজেদুল হক, রাজশাহী থেকে মুজিবুর রহমান, সিলেট থেকে জালালউদ্দিন সাহেব, দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সিরাজ উদ্দিন টাঙ্গাইলের মোহাম্মদ আলি, খুলনার শেখ মোহাম্মদ আলি, চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরীকে মুক্তির দেওয়ার হুকুম দিয়েছে। এঁরা সকলেই আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতা। যাহা হউক সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে, ছাড়তে যখন শুরু করেছে কিছু কিছু লোক ছাড়বে।
২৫ তারিখে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল হকও মুক্তি পেয়েছে। বেগম সাহেবা এসেছিলেন আমার বড় বোনকে সাথে নিয়ে। আমাকে দেখেতো কেঁদেই অস্থির। বললাম, “বুজি, তুমি কাদ কেন? আমার সত্যই কোনো কষ্ট হয় না। আর ভিতর বাইরে সবই সমান। যারা দেশ চালায় তাঁদের অনেকের মধ্যে দয়া মায়া তো দূরের কথা মনুষ্যত্বই নাই। চিন্তা করিও না।
আমার বড় বোন ১৯ বৎসর বয়সে বিধবা হয়েছে। একটা মেয়ে কোলে আর একটা ছেলে পেটে ছিল যখন ভগ্নিপতি মারা যান। আমার ভাগনে আজ বড় হয়ে অর্থশালী হয়েছে, তিনটা ছেলে মেয়ে হয়েছে। আজও আমার চোখের দিকে চেয়ে কথা বলে না। দেখা করতে এসে একদিন ছোট বাচ্চার মত কেঁদেছিল আর বলেছিল, “মামা ভাববেন না। মামি ও বাচ্চাদের যত টাকা লাগে আমি দিব”। ওর টাকাও আছে, প্রাণও আছে।
৮ই ফেব্রুয়ারি ২ বৎসরের ছেলেটা এসে বলে, “আব্বা বালি চলো”। কি উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে আন আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, “তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো”। ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে!
দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। ওন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।
কারাগারের রোজনামচা (২৫০-২৯৬)
ইউনিকোড রূপান্তরঃ জুলকার নাইন
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি রাত ১২ টার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়।কারাগারের গেইট থেকে বাইরে এলে সেনাবাহিনীর লোকজন তাঁকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে বন্দি করে রাখে। এসময় বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের কোনো সংবাদ বাইরে প্রকাশ না হওয়ায় তিনি বেঁচে আছেন কিনা জনগণের মনে সে বিষয়ে সন্দেহ, সংশয় ও উদ্বেগ দেখা দেয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টার কুর্মিটোলা অফিসার মেসের ১০ নং কক্ষে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি অবস্থায় এই স্মৃতিকথা লেখা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবাঙালি সদস্যরা তাঁকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ও সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রেখেছিল।
পাঁচ মাস পর দুঃসহ বন্দি জীবনযাপনের সময় এই খাতাটি বেগম মুজিব তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। রয়েল স্টেশনারি সাপ্লাই হাউজের ৩২০ পৃষ্ঠার রুল টানা খাতাটির মাত্র ৫২ পৃষ্ঠা লেখার তিনি সুযোগ পান। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হবার পরই প্রথম পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ হয়। আর তখনই এই খাতাখানা দেয়া হয়। তবে মামলা চলার কারনে তিনি খুব বেশি লিখতে পারেন নাই। এটা তাঁর লেখা শেষ পাতা।
১৯৬৬ সালের ৮ই মে দেশ্রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে দিন যাপন করতেছিলাম।
১৯৬৮ সালের ১৭ই জানুয়ারি রাত্রে যথারীতি খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি। দেওয়ানি ওয়ার্ডে আমি থাকতাম। দেশরক্ষা আইনে বন্দি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল মোমিন এডভোকেট আমার কামরায় থাকতেন। ১৭ মাস একাকী থাকার পরে তাকে আমার কাছে দেয়া হয়। একজন সাথী পেয়ে কিছুটা আনন্দও হয়েছিল। হঠাৎ ১৭ই জানুয়ারি রাত্র ১২ টার সময় আমার মাথার কাছে জানালা দিয়ে কে বা কারা আমাকে ডাকছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখি নিরাপত্তা বিভাগের ডেপুটি জেলার তোজাম্মেল সাহেব দাঁড়াইয়া আছেন।
জিঞ্জাসা করলাম, এত রাত্রে কি জন্য এসেছেন ? তিনি বললেন, দরজা খুলে ভেতরে এসে বলব। ডিউটি জমাদার দরজা খুলে দিলে তিনি ভিতরে এসে বললেন, আপনার মুক্তির আদেশ দিয়েছে সরকার। এখনই আপনাকে মুক্ত করে দিতে হবে। মোমিন সাহেবও উঠে পড়েছেন। আমি বললাম, হতেই পারে না। ব্যাপার কি বলুন। তিনি বললেন, স্তুই বলছি আপনাকে ছেড়ে দিতে হবে – এখনই, কাপড় চোপড় নিয়ে চলুন। আমি আবার তাকে প্রশ্ন করলাম, আমার যে অনেকগুলি মামলা রয়েছে যার জামানত নেওয়া হয় নাই। চট্টগ্রাম থেকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট রয়েছে, আর যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী, পাবনা থেকে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট রয়েছে। ছাড়বেন কি করে ? এটাতো বেআইনি হবে। তিনি বললেন, সরকারের হুকুমে এগুলি থাকলেও ছাড়তে পারি। আমি তাকে হুকুমনামা দেখাতে বললাম। তিনি জেল গেটে ফিরে গেলেন হুকুমনামা আনতে।
আমি মোমিন সাহেবকে বললাম, মনে হয় কিছু একটা ষড়যন্ত্র আছে এর মধ্যে। হতে পারে এরা আমাকে এ জেল থেকে অন্য জেলে পাঠাবে। অন্য কিছু একটাও হতে পারে, কিছুদিন থেকে আমার কানে আসছিলো আমাকে ‘ষড়যন্ত্র’ মামলায় জড়াইবার জন্য কোনো কোনো মহল থেকে চেষ্টা করা হতেছিল। ডিসেম্বর মাস থেকে অনেক সামরিক, সিএসপি ও সাধারন নাগরিক গ্রেপ্তার হয়েছে দেশরক্ষা আইনে –রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা উপলক্ষ্যে, সত্য মিথ্যা খোদাই জানে!
প্রথম খবর পাই জেলের মধ্যে ঈদের নামাজে। এই দিন বিভিন্ন ওয়ার্ডের বন্দিরা কিছু সময়ের জন্য এক জায়গায় নামাজ পড়তে জমা হয়। আমাকে দেখে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ কর্মী কেঁদে ফেলে এবং বলে তাকে ২১ দিন পুলিশ কাস্টডিতে রেখেছিল। মেরে পা ভেঙে দিয়েছে। তারপর রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসা করে একটু আরোগ্য লাভ করলে জেলে পাঠাইয়া দিয়েছে। আমাকে জড়াইয়া ধরে কেঁদে দিয়ে বলল, শুধু আপনার নাম বলাবার জন্য আমাকে এতো মেরেছে, সহ্য করতে পারি নাই বলে যাহা বলেছে তাহাই লিখে দিয়ে এসেছি। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম আর বললাম, আল্লার উপর নির্ভর কর। যাহা হবার হবেই। আমাকে বলল, সরকারের কাছে দরখাস্ত করব।
ফজলুর রহমান সিএসপিও বলল, আপনাকে জড়াবার খুব চেষ্টা চলছে। আরও দুই একজন ভীতপূর্ব সামরিক বাহিনীর কর্মচারীরও আমাকে বলল। এর মধ্যে মি. কামালউদ্দিন নামে একজন ভূতপূর্ব নৌ-বাহিনীর কর্মচারীর পুরানা ২০ সেল থেকে জেল গেটে যাবার সময় আমার সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে আদাব করলেন। আমি বললাম, আপনাকে তো কোনোদিন দেখি নাই, আপনি কে? বলল, আমার নাম কামালউদ্দিন। পুলিশ হাজতে নিয়ে অসম্ভব মেরেছে। সমস্ত শরীর পচাইয়া দিয়েছে। সোজাভাবে শুয়ে থাকতে পারি না। পায়খানার দ্বারের ভেতর কি ঢুকিয়ে দিয়েছিল যন্ত্রণায় অস্থির। এই দেখুন জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে জায়গায় জায়গায় পোড়াইয়া দিয়েছে। আপনার নাম লেখাইয়া নিয়েছে আমার কাছ থেকে যদিও অনেক বলেছি যে ‘শেখ মুজিবের সাথে আমার পরিচয় নাই’। একজন প্রথম শ্রেনীর ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ লাইনেই উপস্থিত আছেন, টাইপ করে কাগজ দেয়, তাই পড়ে দিয়ে আসতে হয়। না পড়লে আবার মারতে শুরু করে। কি করব স্যার, লিখে দিয়ে এসেছি, তবে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস করব। সেখানে সব বলব। মামলা সে করেছিল, খবরের কাগজে অত্যাচারের করুণ কাহিনী প্রকাশ হয়ে পড়েছিল কামাল উদ্দিনের মামলায়। এরপরে জেলে বসে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেসনোট পড়লাম, তাতে ২৮ জনের নাম দিয়েছে। জনাব রুহুল কুদ্দুস সিএসপি ও ফজলুর রহমান সিএসপি সহ সামরিক বেসামরিক লোকের নাম রয়েছে। তিনজন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মীর নামও দেখলাম। প্রেসনোটে লেখা ছিলো এই ২৮ জন লোকই ষড়যন্ত্র করেছে। মোমিন সাহেবকে বললাম, বোধ হয় চিন্তা ভাবনা করে আমাকে বাদ দিয়েছে, কারন আজ ১৭ মাস ধরে আমি কারাগারে বন্দি। এতবড় মিথ্যা কথা সরকার বলবে কেমন করে! তিনি ও অন্যান্য রাজবন্দিরা জানতে পেরেছিলেন বিভিন্ন ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের থেকে –যে আমাকে জড়াবার চেষ্টা চলেছে। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে আমাকে খবরও পাঠাইয়াছিল। আমার সাথে দেখা করতে এসে রেণু (আমার স্ত্রী) আমাকে বলেছিল, তোমাকে জড়াবার চেষ্টা হতেছে। জানি না খোদা কি করে। আল্লার উপর নির্ভর কর।
আমি বললাম, দেশরক্ষা আইনে জেলে রেখেছে, ১১ টা মামলা দায়ের করেছে আমার বিরুদ্ধে। কয়েকটাতে জেলও হয়েছে, এরপরও এদের ঝাল পড়ল না। ৬ দফার ঝাল এতো বেশি জানতাম না। আইবি ও জেল অফিসার সামনে বসে থাকে, কথা বলা যায় না। আমার শরীরও খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল, কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম,হাসপাতালে যেতে হয় নাই, তবে ভর্তি করে খাওয়া দাওয়া কন্ট্রোল করেছিল। অনেক ওজন কম হয়ে গিয়েছিল। একটু আরোগ্য লাভ করেছিলাম। তখনও ভর্তি ছিলাম যেদিন আমার ‘মুক্তির’ আদেশ নিয়ে ডিপুটি জেলার রাত ১২ টায় হাজির হয়েছিলেন।
ডিপুটি জেলার হুকুমনামা নিয়ে এলেন, আমাকে দেখালেন। আমি পড়ে দেখলাম, দেশরক্ষা আইন থেকে আমাকে ‘মুক্তি’ দেওয়া হয়েছে। মোমিন সাহেব প্রথমে খুশি হয়েছিলেন পরে তিনি বুঝতে পারলেন ভিতরে কিছু ‘কিন্তু’ আছে। বিছানা কাপড়গুলি বেঁধে দিল কয়েদিরা। মোমিন সাহেব কে বললাম, বাড়িতে রেনুকে খবর দিতে,আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়াছে। আমি দেখলাম, ডেপুটি জেলার ও সিপাহি জমাদার, যারা আমাকে ও মালপত্র নিতে এসেছে তাদের মুখ খুব ভার। কারো মুখে হাসি নাই। আমার বুঝতে আর বাকি রইল না যে, অন্য কোনো বিপদে আমাকে ফেলেছে সেটা আর কিছু না, ‘ষড়যন্ত্র মামলা’। বিদায় নিবার সময় মোমিন সাহেব কে বললাম, বোধহয় আর আপনাদের সাথে দেখা হবে না। আপনারা রইলেন এদেশের জন্য, আমি চললাম। খোদা আপনাদের সহায় আছেন। আমাকে যারা খানা পাকাইয়া খাওয়াতো, কাজ করে দিত, তাদের কাছ থেকেও ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিয়ে প্রায় ১টার সময় জেলগেটে হাজির হলাম।
বইখাতা ও খাবার জিনিসপত্র রেখে এলাম। বলেছিলাম, আপনাদের জিনিসগুলি রেখে আমার জিনিসপত্র কামালকে (আমার বড় ছেলে) খবর দিলে নিয়ে যাবে এসে। আমাকে কোথায় নিয়ে যায় ঠিক নাই।
জেলগেটে এসেই দেখি এলাহি কান্ড! সামরিক বাহিনীর লোকজন যথারীতি সামরিক পোষাকে দাঁড়াইয়া আছেন আমাকে ‘অভ্যর্থনা’ করার জন্য।আমি ডেপুটি জেলার সাহেবের রুমে এসে বসতেই একজন সামরিক বাহিনীর বড় কর্মকর্তা আমার কাছে এসে বললেন, “শেখ সাহেব আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো”। আমি তাকে বললাম, নিশ্চয়ই আপনার কাছে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে। আমাকে দেখালে বাধিত হব। তিনি একজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারীকে বললেন, পড়ে শোনাতে। তিনি পড়লেন, “আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হলো।“ আমি বললাম, ঠিক আছে চলুন, কোথায় যেতে হবে। সামরিক বাহীনির কর্মচারী বললেন, “কোনো চিন্তা করবেন না, আপনার মালপত্র যেখানে থাকবেন সেখানে পৌঁছে যাবে”।
আমাকে কোনো লিখিত আদেশ দিল না। আমি ডিপুটি জেলার সাহেবের কাছ থেকে টাকাগুলি বুঝে নিয়ে রওয়ানা করছি, এমন সময় ঢাকা জেলের জেলার ফরিদ আহম্মদ হাসতে হাসতে আমার কাছে এসে বললেন, “আপনাকে তো আমরা ছাইড়া দিলাম”। এই ভদ্রলোকের কথায় আমার প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল এবং কড়া উত্তর দিবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। শুধু বললাম, বাজে কথার দরকার নাই। এই ভদ্রলোকের উপর রাগ করে লাভ নেই, কারন একে আমি পূর্বের থেকেই জানতাম। এই জেলেই কয়েক বৎসর পূর্বে ডিপুটি জেলার ছিল। তখনও আমি রাজবন্দি ছিলাম। এখন জেলার হিসেবে কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। তাহার ব্যবহার সম্বন্ধে সকলেরই ধারনা আছে। নানা কারনে অন্যান্য কর্মচারী ও কয়েদিরা একে মোটেই দেখতে পারে না। আর সত্যই ভদ্রলোক কথা বলতেও জানে না।
আমি জেলগেটে দেখলাম ঢাকা জেলের সুপারটেনডেন্ট বা ডিআইজি সাহেবের রুমে আলো জ্বলছে। তিনিও এই সময়ে উপস্থিত হয়েছেন –বোধ হয় আমাকে ‘মুক্তি দিবার জন্য’।
জেলের লোহার দরজা খুলে দেয়া হলো। সামনেই একটা গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। চারদিকে সামরিক বাহিনীর জোয়ানরা পাহারায় রত আছেন। একজন মেজর সাহেব আমাকে গাড়িতে উঠতে বললেন। আমি গাড়ির ভেতরে বসলাম। দুই পার্শ্বে দু’জন সশস্ত্র পাহারাদার, সামনের সিটে ড্রাইভার ও মেজর সাহেব। গাড়ি নাজিমুদ্দীন রোড হয়ে রমনার দিকে চললো। আমি পাইপ ধরাইয়া রাত্রের স্নিগ্ধ হাওয়া উপভোগ করতে লাগলাম, যদিও শীতের রাত। ভাবলাম কোথায় আমার নূতন আস্তানা হবে! কোথায় নিয়ে যাওয়া হতেছে! কিছুই তো জানি না। গাড়ি চললো কুর্মিটোলার দিকে।
বহুকাল পর ঢাকা শহর দেখছি, ভালোই লাগছে। মনে মনে শেরে বাংলা ফজলুল হক, জননেতা সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দীনের কবরকে সালাম করলাম। চিরনিদ্রায় শুইয়ে আছ, একবারও কি মনে পড়ে না এই হতভাগা দেশবাসীদের কথা! শাহবাগ হোটেল পার হয়ে, এয়ারপোর্টের দিকে চলেছে।
এয়ারপোর্ট ত্যাগ করে যখন ক্যান্টনমেন্ট ঢুকলাম তখন আর বুঝতে বাকি রইল না। মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, “তোমাকে আমি ভালবাসি। মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা।“
অনেক কথা মনে পড়তে লাগলো। বিশেষ করে আমার আব্বা ও মায়ের কথা। খবর পেলে এই দুইজনের বৃদ্ধ বয়সে কি অবস্থা হবে ? আব্বার বয়স ৮৪ বৎসর আর মায়ের বয়স ৭৫ বৎসর। আর কতদিনই বা বাঁচবেন! দুঃখ পেয়ে আঘাত সহ্য করতে না পারলে যে কোনো অঘটন হয়ে যেতে পারে। বধ হয় আমি আর দেখতে পাব না। এর মধ্যেই এসে পৌঁছলাম একটা ঘরের সামনে। এখানেও সামরিক বাহিনী পাহারা দিতেছে। দরজা খুলে দিল। আমি নেমে পড়লে মাকে সাথে নিয়ে একটা কামড়ায় নিয়ে গেল। সেখানে তিনজন সাদা পোশাক পরিহিত কর্মচারী দাঁড়াইয়া আছেন। আমার সাথে কেহ কোনো আলাপ করলেন না, আমিও চুপ করে দাঁড়াইয়া রইলাম। কয়েক মিনিট পরে বললাম, শরীর ভালো না, কোথাও বসতে অনুমতি দিন। আমাকে পাশের আরেকটা কামরায় নিয়ে বসতে দেওয়া হলো। কয়েক মিনিট পরে এক ভদ্রলোক এলেন এবং আমাজে জিঞ্জাসা করলেন, ‘ষড়যন্ত্র ব্যাপার সম্বন্ধে’। বললাম, কিছুই জানি না।
এর মধ্যে এক ভদ্রলোক বলিষ্ঠ গঠন, সুন্দর চেহারা, আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তিনি একজন ডাক্তার। আমার হার্ট পেট রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন। কিছুই না বলে চলে গেলেন পাশের কামরায়। কয়েক মিনিট পর আর একজন কর্মচারী এসে বললেন, চলুন। একটা জীপ গাড়িতে করে আমাকে অন্য এক জায়গায় নেয়া যাওয়া হলো। এক কামরাবিশিষ্ট এক দালান। সাথে গোসলখানা, ড্রেসিং রুম, স্টোর রুম আছে। দুখানা খাট পাশাপাশি। একটা খাটে একটা বিছানা আছে। আর একটা খাট খালি পড়ে আছে। আমাকে বলা হলো আপনার মালপত্র এসে গেছে দেখে নেন। বিছানা খুলে বিছানা করে নিলাম। একজন কর্মচারী –যার নাম জাফর ইকবাল সাহেব, তিনি আমার পাশের খাটেই ঘুমাবেন সামরিক পোশাক পরে-সাথে রিভলবার আছে। লেফটেন্যান্ট সাহেব একাকী প্যাসেন্স খেলতে লাগলেন।আমি বিছানায় বসে পাইপ টানতে লাগলাম, কোনো কথা নাই। কুর্মিটোলার কোন জায়গায় আমি আছি নিজেই জানি না।
আধা ঘন্টার মধ্যে সেই দুজন সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক কর্মচারী এলেন –যাদের সাথে পূর্বেই দেখা হয়েছিল। আ,আকে জিঞ্জাসা করলেন, কোনো অসুবিধা আছি কিনা? এখানেই আপাতত আমাকে থাকতে হবে।
আমাকে চা খেতে অনুরোধ করলেন। আমি আগ্রহের সাথে রাজি হলাম। কারন ঘুম ভাঙাইয়া আমাকে নিয়ে এসেছে, জড়তা এখনও যায় নাই। তিনজন এক সাথে চা খেলাম। আমি বললাম, “আমাকে কেন আপনারা এনেছেন জানি না, তবে সত্য চাপা থাকবে না। অন্যায় ভাবে আমার উপর অত্যাচার করে কি লাভ হবে বুঝতে পারছি না।“ একজন মনে হলো –মেজর হবে, একটু টিটকারী দিয়ে কথা বলছিলেন, এমনকি আমার স্ত্রীও জড়িত আছেন এমন ইঙ্গিতও দিতে ভুল করলেন না। আমি তাহাকে লক্ষ্য করে বললাম, “দেখুন, আমার স্ত্রী রাজনীতির ধার ধারে না। আমার সাথে পার্টিতে কোনোদিন যায় নাই। সে তার সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাইরের লোকের সাথে মেলামেশাও করে না। আমার রাজনীতির সাথে তার সম্বন্ধ নাই। “ এই সময় আমি দেখলাম আর একজন ভদ্রলোক যিনি কর্নেল হবেন বলে মনে হলো, অন্য আর একজনের দিকে চেয়ে ইশারা দিয়ে নিষেধ করল। কর্নেল ভদ্রলোকের নাম পরে জানতে পারলাম শের আলি বাজ। খুবই ভদ্র, অমায়িকভাবে আলোচনা করছিলেন। কর্নেল শের আলি বাজ যাবার সময় বলে গেলেন, থাকবার খাবার কোনো অসুবিধা হবে না। ভদ্রলোকের ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনো আক্রোশ খুজে পেলাম না। পরে জানতে পারি এর বাড়ি পেশওয়ার জেলায়।
আমি শুয়ে পড়লাম। আলো জ্বালান থাকলো। ঘুমের ব্যঘাত তো নিশ্চয়ই হবে। তারপর মনের অবস্থা খারাপ। যাহা হউক ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, উঠতে দেরি হলো। রাত্রে যে ভদ্রলোক আমার কামরায় পাহারায় ছিলেন তিনি সকালবেলা চলে গেলে আর একজন ভদ্রলোক নাম লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদ জাফর ডিউটিতে এলেন।
দরজা জানালা বন্ধ। জানালা ও দরজার কাচগুলিকে লাল রঙ করে দেওয়া হয়েছে। ঘরগুলি অন্ধকার তাই আলো জ্বালাইয়া রাখতে হলো।দরজা বন্ধ থাকবে। এই কামরায়ই থাকতে হবে। কিছুই জানি না, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। সময় কাটবে কি করে? বই পত্র নাই, খবরের কাগজ দেওয়া হবে না। যে অফিসার পাহারায় রত থাকবেন তার উপর হুকুম আছে –পারিবারিক, রাজনৈতিক, সামরিক কোনো বিষয়েই আলাপ করতে পারবে না। তবে আভাওয়ার কথা জিঞ্জাসা করলে হাঁ বা না সূচক ভাষায় উত্তর দিতে বোধহয় আপত্তি নাই। কথাবার্তা না বলে দুজন লোক একই কামরায় নীরবে বসে থাকতে হবে। আর অফিসার ভদ্রলোকের কাজ হলো আমাকে চোখে চোখে রাখা যাতে আমি ভাগতে চেষ্টা না করি বা আত্মহত্যা করতে না পারি। ভাবতে লাগলাম এই অবস্থায় দিন কাটবে কি করে ! আর কতকাল থাকতে হয় ঠিক কি? এইভাবে থাকলে যে কোনো লোক পাগল হতে বাধ্য। তবুও তো থাকতে হবে। কারন ‘পড়েছি পাঠানের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। ‘
নাস্তা, দুপুর ও রাত্রের খাবার ঠিক সময় মতো এসে হাজির হয়। অবে দু’বেলাই রুটি। আমি আমাশয়ের রুগি। পেটের ব্যথাও শুরু হয়ে পড়ল। জানতে পারলাম আমি যেখানে আছি এটা অফিসার মেস। আমার ঘরটা হলো গেস্ট হাউস। অফিসাররা যা খেয়ে থাকেন আমাকেও তাই খেতে দেয়া হয়। সমস্ত কর্মচারীই হলো পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী, তারা রুটিই খেয়ে থাকে। সাথে থাকে মাংস। রুটি,মাংস ও ডাল খেয়ে আমার পক্ষে বাঁচা কষ্টকর। উপায় নেই। যতদিন চলে চালাতে হবে। আমার কাছে দুইখানা মাত্র বই ছিল। অন্য বইগুলি জেলখানায় রেখে এসেছি। ভুল করেছি বই না এনে। অফিসার ভদ্রলোক কে জিঞ্জাসা করলাম, বই পড়তে আপত্তি আছে কিনা। তিনি বললেন, বই দেওয়ার হুকুম আপাতত পাই নাই। তবে আপনার কাছে থাকলে পড়তে পারেন। তিনি মাঝে মাঝে বাইরে যান। আমি যে কড়িকাঠ গুনবো সেই ব্যবস্থাও নাই। কারন কড়িকাঠও দালানে নাই। আলো জ্বালানই ছিল। সুকর্ণর পতন সম্বন্ধে বই দু’টি পড়তে লাগলাম। কিন্তু মন বসছে না, নানা চিন্তা ঘিরে ধরছে। কি করব বসে বসে শুধু পাইপ খেতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম রাজনীতি এত জঘন্য হতে পারে! ক্ষমতার জন্য মানুষ যে কোনো কাজ করতে পারে। আমাকে ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে কারো বিবেকে দংশন করলো না। আমি তো ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তে বিশ্বাস করি নাই। জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি। যাহা ভাল বুঝছি তাই বলেছি। বক্তৃতা করে বেড়াইছি, গোপন কিছুই করি না বা জানি না। সত্য কথা সোজাভাবে বলেছি তাই সোজাসুজি জেলে চলে গিয়াছি। কাহাকে ভয় করে মনের কথা চাপা রাখি নাই। যে পথের দেশের মঙ্গল হবে, যে পথা মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তাহাই করেছি ও বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানের জঙ্গন যাতে তার ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারে তার জন্য আন্দোলন করেছি। বার বার জেলে যেতে হয়েছে আর মামলার আসামী হতে হয়েছে। কিন্তু মনের কথা চাপা রাখি নাই। জেলে যেতে হবে জেনেও ছয় দফা জনগনের কাছে পেশ করেছিলাম। যদিও জানা ছিলো শাসক ও শাসকগোষ্ঠীর আতেঁ ঘা লাগবে। ঝাপাঁইয়া পড়বে আমার ও আমার সহকর্মীদের উপর। অত্যাচার চরম হবে তবুও গোপন করি নাই। আজ দুঃখের সাথে ভাবছি আমাকে গোপন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে শাসকদের একটুও বাধলো না ! এরা তো আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ভাল করে জানে। ভাবা ও চিন্তা করা ছড়া কোনো কাজই যখন নাই যখন মনকে বললাম,’ভাবো যত পারো, কিন্তু পাগল করো না।‘ জীবনের বহু কথা মনে পড়তে লাগলো। খাতা কাগজ নাই যে কিছু লেখব। কলম আছে। কাগজ ও খাতা পাওয়ার কোনো উপায়ও নাই, আর কলম ও নাই।
আমাকে ছাড়াও অন্য কাহাকেও গ্রেপ্তার করেছে কিনা? পূর্বে ২৮ জন গ্রেপ্তার হয়ে বিভিন্ন জেলে ছিল। ঢাকা জেলে প্রায় ২০/২২ জন ছিল। তাদেরও এখানে এনেছে কিনা? জানার উপায় নাই। কে কোথায় আছে কিছুই বলতে পারি না। পূর্বের ২৮ জন, আমি ছাড়াও নূতন গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা ?
কামরার সামনে একজন রাইফেল্ধারী সিপাহি ও পিছনে একজন দাঁড়াইয়া আছে সর্বক্ষণের জন্য। মিলিটারি কাস্টডি কাকে বলে ধারনা ছিল না। প্রথম দিন এইভাবে কেটে গেল। পরেরদিন একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী এলেন আমার কামরায়। তাকে আমি জানি না। তিনি আমাকে বললেন, কোনো অসুবিধা আছে কিনা? বললাম, জানালাটা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন, না হলে স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে কি করে? তিনি জানালা খুলে দিতে হুকুম দিয়ে চলী গেলেন। আমি সেই অন্ধকার কামরায় বসে বসে খোদা কে ডাকা ছাড়া কি করতে পারি! রাত্রে আর একজন কর্মচারী এলেন তার নাম মেজর নাইম। এরা সকলেই প্রায় থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কর্মচারী। আমি এদেরই মেসে আছি। ইনি কুমিল্লা থেকে এসেছেন, সাখানেই তার পোস্টিং, যথারীতি পরিচয় হওয়ার পরে কোনো কথাবার্তা না বলে চুপ করে বসে থাকতে হয়। পাইপ খাওয়া বেড়ে গেছে অস্বাভাবিক। কয়েক টিন তামাক আমার কাছে আছে। মাস দেড়েক চলতে পারে। ভাবলাম রেণু ও ছেলেমেয়েদের দেখা করতে দিবে না তামাক আসবে কি করে! তাহারা নাও জানতে পারে আমি কোথায় আছি। আর জানলেও পাঠাবে কি করে? স্থির করলাম যে কয়দিন তামাক আছে খেতে থাকি, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিব। বাব-মা, ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বাড়ির সবজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সকলকে ছেড়ে থাকতে পারি আর তামাক ছাড়া থাকতে পারব না ! দুই দিন পরে সকালে আর একজন ভদ্রলোক এলেন সাদা পোশাক পরিহিত। বললেন দু’ একদিনের মধ্যে অফিসাররা আসবে আমাকে জিঞ্জাসাবাদ করতে। তারপর জনাব রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন। আমি তাকে যথারীতি ধন্যবাদ দিলাম। তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
(পাঁচ মাস পরে খাতা পেয়েছি। তাই দিন তারিখগুলি আমার মনে নাই, ঘটনাগুলি যতদূর মনে পড়ে তাই লিখে রাখছি।)
পরের দিন সকাল ১১ টার দিকে দু’ জন ভদ্রলোক এলেন। তাদের জানি না, শুধু বুঝলাম সামরিক কর্মচারী হবেন। আমাকে জিঞ্জাসা করলেন, আমি কিছু জানি কিনা এই ষড়যন্ত্রে সম্বন্ধে। করাচিতে জনাব ফজলুর রহমান সিএসপি সহ নৌ-বাহিনীর কর্মচারীদের সাথে সাক্ষাৎ করেছি কিনা? ঢাকায় জনাব রুহুল কুদ্দুস সিএসপিএর সাথে একসাথে গোপন সভা করেছি কিনা? চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ কর্মী মানিক চৌধুরী কে অর্থ সাহায্য করতে বলেছি কিনা? আমি বললাম, আজ ২১ মাস আমি দেশরক্ষা আইনে বন্দি। আপনারা বিশ্বাস করেন কেমন করে যে আমি ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করতে পারি? আমি কিছুই জানি না, কাহাকেও টাকা পয়সা দেই নাই। তাহারা চলে গেলেন, আমিও খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় পড়ে রইলাম। রাত্রে খবর দেয়া হলো মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আগামীকাল সকাল বেলা আসবেন আমার সাথে দেখা করতে।
দু’টা বই ছিলো পড়ে ফেলেছি। এখন উপায় কি? সময় কাটবে কি করে? এতদিন শরীর কিছু ঠিক রেখেছিলাম এবার বোধ হয় আর পারলাম না।
পরের দিন সকাল ১০ টায় মি. রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর মেসে বসে ডিউটি অফিসার লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদ জাফরকে খবর দিলেন আমাকে মেসে নিয়ে যেতে। আমি প্রস্তুত হয়ে ছিলাম। সূর্যের আলো তো গায়ে লাগে নাই এই কয়দিন, তাই বের হয়ে গেলাম। এক মিনিটের বেশি সময় লাগলো না পৌঁছতে। রিজভী সাহেবের নাম আমি শুনেছি, কিন্তু আলাপ ছিলো না। যথারীতি আলাপ পরিচয় হওয়ার পরে আমাকে নিয়ে রৌদ্রে বসলেন। আমি জিঞ্জাসা করলাম, কেন আমাকে ষড়যন্ত্র জড়িত করা হয়েছে? আপনারা তো আমার সম্বন্ধে জানেন। আমি তো গোপন ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। যাহা ভাল বুঝেছি তাহাই করেছি। স্বায়ত্তশাসনের দাবী তো ১৯৪৯ সাল থেকে আমি করতে শুরু করেছি। পার্লামেন্টে প্রাদেশিক আইন সভার বাইরে ও ভিতরে আমি প্রচার করেছি। তারপর ছয় দফা প্রোগ্রাম দিয়েছি ১৯৬৬ সালে। বই ছাপাইয়াছি, বক্তৃতা করেছি। আপনারা আমাকে ও আমার সহকর্মীদের দেশ রক্ষা আইওনে গ্রেপ্তার করে জেলে রেখে কতকগুলি মামলাও দায়ের করেছেন। আমি পাকিস্তানের অমঙ্গল কামনা করি নাই। দুই অঞ্চলকে আলাদা করতেও চাই নাই। কারন সংখ্যাগুরু অঞ্চল সংখ্যালঘুদের ভয়ে আলাদা হতে পারে না। আর এমন কোনো নজির ইতিহাসে নাই। আমি বুঝতে পেরেছি আমাকে আপনারা রাজনীতি করতে দিবেন না। ঠিক আছে আপনারা আমার একটা চিঠি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সাহেবের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে রাজি আছেন কিনা? কারন যতদূর আমার জানা আছে তিনি অন্যায়ভাবে কাউকে কষ্ট দেওয়ার পক্ষপাতী নন।
তাহারা বললেন, আমরা কি করব যদি অন্যান্য আসামিরা আপনার নাম বলে। আপনাকে এই মামলায় জড়িত আমরা করি নাই। অনেকেই আপনার নাম বলেছে। আপনি তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছেন এবং অন্যকে দিতে বলেছেন।
আমি বললাম, যাহা হবার হবে তবে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে আমার পত্রটা পৌঁছাইয়া দেন। কারন পাকিস্তান দুইভাগ হয়ে যাক আমি চাই নাই। যদি চাইতাম তবে প্রকাশ্যে বলতাম। তিনি ইচ্ছা করলে হস্তক্ষেপ করতে পারেন, কারন আজ ২১ মাস আমি জেলে বন্দি। আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে ছাড়া কারও সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না।
তাহারা বললেন, চিঠি আমরা নিতে পারব না। তবে টেপরেকর্ডে আপনি যদি কিছু বলতে চান বলে দিবেন –আমরা তাঁকে শুনাবো। রিজভী সাহেবকে আমার বাড়িতে খবর দিতেঅনুরোধ করলাম যে আমি ভাল আছি এবং এখনও বেচে আছি। ব্রিগেডিয়ার আকবরকে বই দিতে অনুরোধ করলে তিনি ডিউটি অফিসারকে আমাকে বই পরতে দিতে অনুমতি দিলেন, আর সন্ধ্যার পরে এক ঘন্টা বাইরে বেড়াবার হুকুম দিলেন।
রিজভী সাহেব বললেন, “ আপনার বাড়িতে আমি নিজেই যাবো এবং আপনার স্ত্রীকে বলে আসবো যে,আপনি ভালো আছেন। অসুবিধা নাই।“ বললাম, “ মেহেরবানি করে এই কাজটা করলে বাধিত হব।“ খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হবে না, কারন আইনে নাই।
তাহারা চলে গেলেন, আমিও কামরায় এসে ভাবতে বসলাম মানুষ স্বার্থের জন্য কিই না করতে পারে! শুনেছিলাম ভালোবাসা ও রাজনীতিতে ভাল মন্দ বলে কোনো জিনিস নাই। আমি ব্রিগেডিয়ার আকবরকে বলেছিলাম, মনে রাখবেন এদেশের লোক বিশ্বাস করবে না আর করতে পারে না যে আমি ষড়যন্ত্র করতে পারি। আমার চরিত্র সম্বন্ধে তাদের ধারনা আছে। আমাকে জড়িত করে দেশের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই করলেন। দরজা বন্ধ। ঘরের মধ্যে বসে মনে মনে ভাবলাম, রাজনীতি জঘন্য রুপ ধরেছে। এর আর শেষ নাই। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্ধীকে যে কোনো পন্থায় শেষ করার পথ অবলম্বন করেছে। লেফটেন্যান্ট ওয়াহিদকে হুকুম দিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার আকবর আমাকে বই দিতে। তিনি আমাকে একটা বই এনে দিলেন। রাত্রের ডিউটি অফিসার মেজর নাইমও আমাকে একটা বই দিলেন। বইটা তার নিজের। মেজর নাইম কুমিল্লায় থাকতেন। ঢাকায় এসেছেন কিছুদিনের জন্য আমাদের দেখাশোনা বা পাহারা দিতে। আমি বইয়ের মধ্যে ডুবে যেতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারতাম না। অনেকগুলি পাতা পড়ে ফেলেছি, কিন্তু কি যে পড়েছি মনে নাই। আবার নতুন করে পড়তে হয়েছে।
সন্ধ্যার পরে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। সমস্ত লাইট নিবাইয়া দেয়া হতো। যেখানে আমি হাঁটতাম তার দুই পাশে দুই সশস্ত্র সিপাহি পাহারায় রত থাকতেন। আর একজন অফিসার আমার সাথে হাঁটতেন। বড় দুঃখ হতো এই অফিসারটার জন্য, কারন কথা বার্তা নাই, চুপচাপ আমার সাথে সাথে হাঁটতে হবে। সমস্ত দিন রাত্র দরজা বন্ধ। এই অবস্থায় কামরায় থাকার পরে যখন বাইরের হাওয়া গায়ে এসে লাগত তখন যে মনের অবস্থা কি হতো, কিভাবে প্রকাশ করব! বাইরের এই শীতল বাতাস আমার মনে যে কি আনন্দই না বয়ে দিত। তবুও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারলাম না। আবার চিন্তা এসে ঘিরে ধরতো। কর্মচারীদের আলোচনায় বুঝতে পারতাম কোর্ট মার্শালে বিচার করে সকলকে ফাঁসি বা গুলি করে মেরে ফেলবে। সকল কিছুই সম্ভব। মনে মনে প্রস্তুত হতে চেষ্টা করছিলাম। একজন কর্মচারীকে জিঞ্জাসা করলাম, “ভাই বলতে পারেন, ‘পাকিস্তান আর্মি, এয়ারফোর্স ও নেভী আইনটা কি?’ আমার তো কোনো ধারনা নাই। আমি সাধারন নাগরিক। সামরিক বাহিনীর কর্মচারীও না। আমাকে কি করে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হলো।“
তিনি বললেন, আইনে আছে যদি কোনো নাগরিক সামরিক বাহিনীর কর্মচারীদের সাথে কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তবে এই আইনে তাকেও গ্রেপ্তার করা যেতে পারে।
বুঝলাম, ব্যাপারটা কি। তিনি অন্য কিছু বলতে চাইলেন না। কারন তাদের আলাপ করা নিষেধ।
দিন কি কাটতে চায়?আমি ছাড়াও আর কোনো আওয়ামী লীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে এনেছে কিনা- কোনো খবর নাই।
জনাব রিজভী ও ব্রিগেডিয়ার আকবর আমার সাথে আবার দেখা করতে এলেন। বললেন, চিঠি আপনি দিতে পারেন, আমরা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছে পৌঁছাইয়া দিব।
আমি একটা খসড়া চিঠি লিখে রেখেছিলাম। তা পড়ে শোনালাম। তাহারা এই চিঠি নিতে রাজি হলেন না। বললেন, শেষের দিকে পরিবর্তন করলে নিতে পারি। বললাম, ঠিক আছে বলুন কি লিখতে হবে। ব্রিগেডিয়ার আকবর বললেন, আমি লিখে নিলাম। তারপর আর একটা কাগজে নূতন করে লিখে তার হাতে দিলাম। তারা বললেন, পিন্ডি যেয়ে চিঠি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছাইয়া দিব। তিনি কি বলেন তা আপনাকে জানাবো।
চিঠির শেষ প্যারাটা আমাকে বাধ্য করল লিখতে। না লিখে আমার উপায় ছিল না। ইজ্জতের ভয়তেই লিখতে হলো। আমাকে মিথ্যা মামলায় আসামী করে দেশের মঙ্গল হবে না। পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের কেহ বিশ্বাস করবে না। জনগন বলবে, আমাকে অত্যাচার করার জন্যইএই ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করা হয়েছে। ৬দফা প্রস্তাব জনগনের সামনে পেশ করার পর থেকে সরকার আমার ওপর অত্যাচার চালাইয়া যাচ্ছে। ১২ টা মামলাও দায়ের করেছে। আমার সহকর্মী খোন্দকার মোশতাক, তাজউদ্দীন, আব্দুল মোমিন, ওবায়দুর রহমান, নূরুল ইসলাম, আমার ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও আরও অনেকে ১৯৬৬ সাল থেকে জেলে আছে এবং সকলের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
রিজভী সাহেব আমার বাড়িতে যেয়ে রেণুকে খবর দিয়ে এসেছেন, আর আমার বাড়িতে যে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ স্বরূপ কিছু তামাকও নিয়ে এসেছেন। বললেন, আপনার বাড়ির সকলে ভাল আছে। আপনিও ভাল আছেন বলে এসেছি।
একটু নিশ্চিন্ত হলাম এই জন্য যে আমি যে কোথায় কি অবস্থায় আছি কেউই জানে না। একাকী কামরায় রাত্রদিন থাকা যে কি ভয়াবহ অবস্থা তাহা ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না। দিন কাটতে চায় না। বাইরে যেয়ে একটু হাঁটাচলা করবো তারও উপায় নাই। সূর্যের আলোও গায়ে স্পর্শ করার উপায় নাই। লুঙ্গি, জামা, গেঞ্জি নিজেরই ধুতে হয়। বিছানা নিজেরই করতে হয়। ধোপা কাপড় নিয়ে যায়, তবে ইচ্ছা মাফিক সময় লাগায়। আর আমি তো লুঙ্গিই পরি। নিজেই ধুয়ে নেই। কাপড় ধুবার সাবান যাহা ছিল প্রায় শেষ এসেছে। এখন কি করি। গেঞ্জি তো রোজই ধুতে হয়। সাবান কোথায় পাওয়া যাবে? সাবান যখন ফুরিয়ে গেল তখন গায়ে দেওয়া সাবান দিয়েই গেঞ্জি ধুতে আরম্ভ করলাম। একদিন মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমার উপর পাহারারত ছিলেন। বললাম, সাবান পেতে পারি কেমন করে। টাকা আমার আছে, কিনবার অনুমতি থাকলে কিনে দিবার বন্দোবস্ত করলে বাধিত হব। তিনি একটি সাবান আমাকে আনাইয়া দিলেন। আমি ধন্যবাদের সাথে গ্রহণ করলাম।
যেখানে থাকি সেখানকার আবহাওয়াও খুব ভয়াবহ বলে মনে হয়। মিলিটারি কাস্টডি কাকে বলা হয় তা তো পূর্বে জানতাম না। আমার থাকবার বন্দোবস্ত ভালই করা হয়েছে, কিন্তু যে খাবার দেয় তা খেতে আমার কষ্ট হয়। আমাশা রোগে অনেকদিন থেকে ভুগছি। রোজ রোজ গোস্ত ও রুটি খাই কেমন করে? পেটের ব্যথা শুরু হলো। ডাক্তার সাহেবরা আসেন ঔষধ দেন, কিছু দিন ভাল থাকি আবার অসুস্থ হয়ে পড়ি। একদিন বললাম, রুটি আমি খেতে পারব না। আমাকে ভাত দেওয়ার বন্দোবস্ত করুন। দু’ একদিন পরেই ভাতের বন্দোবস্ত হলো। তবে গোস্ত চলল। অফিসার মেসে আমার খাবার বন্দোবস্ত, সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী –মাছ খেতে পারে না। এইভাবেই দিন চললো। তবে দিনে তিন চারবার চা খাবার বন্দোবস্ত হয়েছিল। চা না হলে আমার অসুবিধা হয়। এরপর লেফটেন্যান্ট রাজা নসরুল্লা আজাদ কাশ্মীরের লোক, আমার কাছে ডিউটিতে আসতো। ভদ্রলোকের মনে খুবই দয়া। আমাকে খুব শ্রদ্ধা করতো। কারো কাছ থেকে কোনো দিন খারাপ ব্যবহার পাই নাই। খাবার কথা উঠলে তারা বলতো, কি করব আমরা যা খাই তাই আপনাকে দেই। আমার শরীর যে ভাল না, তা তারা বুঝতে পারতো। কোনো বদনা বা লোটা না থাকায় খুবই অসুবিধা হতো। একদিন ক্যাপ্টেন ওয়াহিদকে বললে তিনি নিজে টাকা দিয়ে একটা বদনা কিনে দিলেন।
আমিও কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি না। এই মেসে আর কোনো বন্দি আছে কিনা বুঝতে পারছি না। দরজাটা সকলেরই বন্ধ। এই কামরাটার খবর ছাড়া কিছুই জানি না। কারো কোনো চিঠি পাই না। রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে কি অবস্থায় আছে? আব্বা মা ভাই বোন কোথায় কি করছে, কেমন আছে? এমনিভাবে একাকী দিন কাটছে। কোনো খবর নাই। শরীরও দিন দিন খারাপ হতেছে। একদিন একজন কর্মচারী বলল, দিনভর বসে আর শুয়ে থাকবেন না, ঘরের ভিতর যে জায়গাটুকু আছে সেখানে হাঁটাচলা করুন। কথাটা আমার মনে ধরল। যদিও ছোট্ট কামরা, ৩ ঘন্টা সকালে দুপুরে বিকালে আপন মনে হাঁটতাম। খোদা ছাড়া কেইবা সাহায্য করতে পারে! দেশের কোথায় কি হতেছে? দুনিয়ায় কি ঘটছে? কোনো কিছুর খবর নাই। কাগজ পড়া নিষেধ। রেডিও শুনতে পারব না। কারো সাথে কথা নাই। দিন কাটাও। মনে মনে ভাবতাম, আমি তো ৭/৮ বৎসর জেল খেটেছি, আমার অবস্থায়ই এই। আর অন্য কাহাকে এনে থাকলে তাদের অবস্থা কি হয়েছে? এনেছে অনেককে গ্রেপ্তার করে। তবে কতজন এবং তারা কারা? ২৮ জনের নাম দেখেছিলাম কাগজে। নতুন কাকেও এনেছে কিনা! দিনগুলি কি কাটতে চায়! তবুও কাটাতে হবে। বই পেয়ে একটু রক্ষা পেয়েছিলাম।
অতিথিশালায় আমি থাকি, আর মেসে অন্য কোনো হতভাগা আমার মতো আছে কিনা, খবর নেওয়ার উপায় নাই। কেহ কিছু বলে না। সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে আমাকে নিয়ে বাইরে কিছু সময় বেড়াবার হুকুম ছিল। আমি এই সময়টুকুর জন্য দিনভর অপেক্ষা করতাম। বাইরে যখন হাঁটতাম তখন দেখতে চেষ্টা করতাম কেহ আছে কিনা। একদিন দেখলাম তিনটা দরজা বন্ধ, অন্য দরজাগুলি খোলা। বুঝতে পারলাম বোধহয় আরও তিন হতভাগা এখানে আছে।
আমাকে সন্ধ্যার পরে আলো বন্ধ করে মেস এরিয়ার বাইরে একটা রাস্তায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো। একজন অফিসার আমার সাথে সাথে হাঁটতো আর দু’ জন মিলিটারী রাস্তার দুইদিকে পাহারা দিত। কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারত না। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হতো। কয়েকদিন বেড়াবার পরে আমার একটু সন্দেহ হলো। মেস এরিয়ার মধ্যে এত জায়গা থাকতে আমাকে বাইরে বেড়াতে নেওয়া হচ্ছে কেন? দু’ একজনের ভাবসাবও ভাল মনে হচ্ছিল না। একটা খবরও আমি পেলাম। কেহ কেহ ষড়যন্ত্র করছে আমাকে হত্যা করতে। আমাকে পিছন থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। তারপর বলা হবে পালাতে চেষ্টা করেছিলাম, তাই পাহারাদার গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হতো জায়গাটা মেসের বাইরে। জনসাধারণ বা অন্য কাউকে দেখাতে পারবে যে আমি ভেগে বাইরে চলে গিয়াছিলাম তাই গুলি করা হয়েছে। আমি যে ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পেরেছি এটা কাহাকেও বুঝতে না দিয়ে বললাম, এরিয়ার বাইরে বেড়াতে যাবো না। ভিতরেই বেড়াব। ষড়যন্ত্রকারীরাও বুঝতে পারল যে আমিও বুঝতে পেরেছি। আমি অফিসারদের সামনেই বেড়াতাম। আর একটা খবরও পেয়েছিলাম পরে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নাকি বলে দিয়েছেন, আমার উপর যেন শারীরিক কোনো অত্যাচার না হয়। আমিও কথায় কথায় কর্মচারীদের জানাইয়া দিয়েছিলাম, আমার গায়ে যদি হাত দেওয়া হয় তবে আমি আত্মহত্যা করব। জানি ইহা একটি মহাপাপ। কিন্তু উপায় কি? মানসিক অত্যাচার যাহা করেছে তাহার চেয়ে গুলি করে মেরে ফেলা অনেক ভাল। দুই একজন ছাড়া থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সকলেই ভাল ব্যবহার করেছিল।
আমার সাথে আবহাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিষয় কেহই আলোচনা করত না। একজন অফিসার সর্বক্ষণ আমাকে চোখে চোখে রাখতেন। আমি কি করি, কি অবস্থায় থাকি। মাঝে মাঝে দুই একজন সাদা পোশাক পরিহিত সামরিক কর্মচারী আমার সাথে আলাপ করতে আসতেন জানবার জন্য। যাকে ইন্টারগেশন বলা হয়। আমার কোনো ধারণা নাই –কিছুই জানি না এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা সম্বন্ধে। তবে কথাত ভিতর থেকে বুঝতে পারতাম আমার স্ত্রী সহ অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কিছুসংখ্যক সিএসপি অফিসার, দুই একজন পুলিশ অফিসার, একজন বিখ্যাত সাংবাদিককেও জড়িত করবার চেষ্টা চলছে।
আমার স্ত্রী সহ অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, কিছুসংখ্যক সিএসপি অফিসার, দুই একজন পুলিশ অফিসার, একজন বিখ্যাত সাংবাদিককেও জড়িত করাবার চেষ্টা চলছে। কিছু সংখ্যক অতি উৎসাহী সামরিক কর্মচারী একদম পাগল হয়ে গেছে বলে মনে হয়। বিরাট কিছু একটা হয়ে গেছে। দেশকে রক্ষা করবার সমস্ত দায়িক্ত্বই যেন তাদের উপরই পড়েছে। একটু গন্ধ পেলেই হলো, আর যায় কোথায়-একদম লাফাইয়া পড়ে অত্যাচার করার জন্য। তাদের ধারনা পূর্ব বাংলার জনসাধারণ সকলেই রাষ্ট্রদ্রোহী। বুদ্ধি আক্কেল সকল কিছু পশ্চিম বাংলা থেকে চালান হয়ে ঢাকা আসে। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় পূর্ব বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য টাকা পয়সা জমিজমা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত। দুই একজন আমাকে কথায় কথায় বলেছে এখনও বাঙ্গালিরা হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত এবং তাদের উপরই নির্ভরশীল। কিন্তু
কোথায় যে হিন্দুদের কর্তৃত্ব আমার জনা নাই। বর্ণ হিন্দুরা প্রায় সকলেই পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে গেছে, কিছুসংখ্যক নিম্ন বর্ণের হিন্দু আছে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেকটা কর্মচারীর ধারনা পূর্ব বাংলার লোক হিন্দুদের দ্বারা পরিচালিত।
কুর্মিটোলার সামরিক বাহিনীর ১৪ ডিভিশন হেডকোয়ার্টারই পূর্ব পাকিস্তানের হেডকোয়ার্টার। থাকলে বোঝা যায় যে কুর্মিটোলা একটা পাঞ্জাবি কলোনী। এখানে বাঙালি চোখে খুবই কম পড়ে। থার্ড পাঞ্জাব মেসে থাকতাম। সেখানে একজন মালি আর একজন বেয়ারা ছাড়া বাঙালি ওষুধ করতেও পাওয়া যায় না। বাঙালি খানা এখানে পাওয়ার উপাই নাই। পাঞ্জাবি খানাই খেতে হতো আমাদের। বাবুর্চিও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি। কিভাবে যে এই খাওয়া খেয়ে বেঁচে আছি জানি না। জান বাঁচানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন তাই খেতে বাধ্য হতাম। অনেক বলেও একজন বাঙালি বাবুর্চি রাখতে পারলাম না।
তাদের কথা, সিকিউরিটির জন্য বাঙালি বাবুর্চি রাখা জায় না। একটা আশ্চর্য ব্যাপার আমার চোখে পড়ল। এমনভাবে মাসের পর মাস এদের সাথে থাকার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। এখানে থাকবার সুযোগ পেয়ে দেখলাম বাঙ্গালিদের তারা ব্যবহার করতে প্রস্তুত, কিন্তু বিশ্বাস করতে রাজী নয়। আর বিশ্বাস করেও না। সকলকেই সন্দেহ করে। তাদের ধারণা প্রায় সকলেই নাকি আমার ভক্ত। মনে মনে সকলেই নাকি আলাদা হতে চায়। পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালির মুখ দেখতে পারি নাই কয়েকমাস এ কথা কি কেহ বিশ্বাস করবে ?
পাঁচ মাসের মধ্যে বাংলায় কথা বলতে পারি নাই। কারণ কেউই বাংলা জানে না। ঢাকা রেডিও এরা শোনে না। হয় কলম্বো, না হয় দিল্লি-হিন্দি উর্দু গান শোনবার জন্য। বাংলা গান এরা বোঝে না বলেই শুনতে চায় না। বাংলা গান হলেই রেডিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। একজন বাঙালি ডাক্তার দেখতে আসতেন। তাঁর বাড়ি কুমিল্লা। নাম মেজর সফিক (ডা.)। তিনি কখনও একাকী আমাদের কামরায় আসতেন না। সাথে ডিউটি অফিসারকে নিয়ে আসতেন। কখনও বাংলায় কথা বলতেন না। ইংরেজি বা উর্দু। আমি তার চেহারা দেখে বুঝতে পেরেছিলাম তিনি পূর্ব বাংলার লোক। বাংলায় আমি কথা বললে ইংরেজি বা উর্দুতে জবাব দিতেন। একদিন আর সহ্য করতে না
পেরে বললাম, বোধ হয় বাংলা ভুলে গেছেন তাই উর্দু বলেন। তিনি বেহায়ার মত হাসতে লাগলেন। মনে হতো ভীষণ ভয় পেয়ে গেছেন। পরে তার সম্বন্ধে জানলাম তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বিবাহ করেছেন। বাড়ির সাথে কোনো সম্বন্ধ নাই। নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে ভয় পান। যদি কেহ মনে প্রাণে বাঙালি হয় তবে তার ভবিষ্যতের দরজা বন্ধ। এই ষড়যন্ত্র মামলা ইনকোয়ারী শুরু হওয়ার পরে যে কয়েকজন সামান্য বাঙালি কর্মচারী সামরিক বাহিনীতে আছেন তাদের অবস্থা বড় করুণ। কখন যে গ্রেফতার হবে কে বলতে পারে !
তাই তারা ভয়ে ভয়ে দিন কাটায়।
থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কোনো বাঙালি কর্মচারী বা সিপাহি নাই। যে অফিসার মেসে আমাকে রাখা হয়েছে, সেখানে একজন বয় আছে যার উপর হুকুম আছে আমাদের কাছে আস্তে পারবে না। আর একজন লোককে জানালার ফাক দিয়ে দেখি, মালি। তাই বাংলা কথা বলার উপাই নাই- পূর্ব বাংলার মাতিতে থেকেও-একেই বলে অদৃষ্ট। প্রাণটা আমার হাপাইয়া উঠছিল,সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। বাংলা বই পাওয়ার উপাই নাই। অফিসার মেসের যে ছোট লাইব্রেরী আছে তাতে কোনো বাংলা বই নাই, সমস্তই প্রায় ইংরেজি ও উর্দুতে। হেডকোয়ার্টার লাইব্রেরী থেকে মেজর গোলাম হোসেন চৌধুরী আমাকে দু’ একখানা এনে দিতেন। ভদ্রলোকও খুব লেখাপড়া করতেন। কোনো বাংলা বই বোধ হয় সেখানে নাই। খবরের কাগজ পড়া নিষেধ, তাই বাংলা কাগজ পড়ার প্রশ্ন আসে না। যে কয়েকজন অফিসার
আছেন তারা সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, তারাই আমার ডিউটি করতেন। বাঙ্গালিদের বোধ হয় ডিউটি দেওয়া নিষেধ ছিল। অন্য কোনো রেজিমেন্টে বাঙালী দুই একজন থাকলেও আমার কাছে আসার হুকুম নাই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের পরিচয় ( ১৯৫৫-১৯৭৫ )
১৯৫৫
৫ জুন বঙ্গবন্ধু গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ২১ দফা ঘোষণা করা হয়। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের কার্যকারী পরিষদে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা না হলে দলীয় সদস্যরা আইনসভা থেকে পদত্যাগ করবেন। ২৫ আগস্ট করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধু বলেন ;
Sir, you will see that they want to place the word ‘East Pakistan’ instead of ‘East Bengal’. We have demanded so many times that you should use Bengal instead of Pakistan. The word ‘Bengal’ has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we have to go back to Bengal and ask them whether they accept it. So far as the question of One-Unit is concerned it can come in the constitution. Why do you want it to be taken up just now? What about the state language, Bengali? What about joint electorate? What about autonomy? The people of East Bengal will be prepared to consider One-Unit with all these things. So, I appeal to my friends on that side to allow the people to given their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebiscite.
[অনুবাদঃ স্যার আপনি দেখবেন ওরা ‘পূর্ব বাংলা’ নামের পরিবর্তে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে, আপনারা এটাকে বাংলা নামে ডাকেন। ‘বাংলা’ শব্দটার একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য। আপনারা এই নাম আমাদের জনগনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞাসা করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কি না। এক ইউনিটের প্রশ্নটা শাসনতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আপনারা এই প্রশ্নটাকে এখনই কেন তুলতে চান? বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহন করার ব্যাপারে কি হবে? যুক্ত নির্বাচনী এলাকা গঠনের প্রশ্নটারই কি সমাধান? আমাদের স্বায়ত্তশাসন সম্বন্ধেই বা কি ভাবছেন? পূর্ব বাংলার জনগণ অন্যান্য প্রশ্নগুলোর সমাধানের সাথে এক ইউনিটের প্রশ্নটাকে বিবেচনা করতে প্রস্তুত। তাই আমি আমার ঐ অংশের বন্ধুদের কাছে আবেদন জানাব তারা যেন আমাদের জনগণের ‘রেফারেন্ডাম’ আথবা গণভোটের মাধ্যমে দেয়া রায়কে মেনে নেন। ]
২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল আধিবেশন দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৫৬
৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ মুখ্যমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে খসড়া শাসনতন্ত্রে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান। ১৪ জুলাই আওয়ামী লীগের সভায় প্রশাসনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্বের বিরোধিতা করে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আনেন বঙ্গবন্ধু। ৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিল বের করা হয়। চকবাজার এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে ৩ জন নিহত হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু কোয়ালিশন সরকারে শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন।
১৯৫৭
সংগঠনকে সুসংগঠিত করার উদ্দেশ্যে ৩০ মে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেখ মুজিব মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ২৪ জুন থেকে ১৩ জুলাই তিনি চীনে সরকারি সফর করেন।
১৯৫৮
৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা ও সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করে। রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১১ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয় এবং একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। প্রায় ১৪ মাস জেলখানায় থাকার পর তাঁকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জলগেইটেই গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬০
৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করে তিনি মুক্তি লাভ করেন। সামরিক শাসন ও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষে বঙ্গবন্ধু গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ সময়ই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট ছাত্র নেতৃবৃন্দ দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি মহকুমায় এবং থানায় নিউক্লিয়াস গঠন করেন।
১৯৬২
৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ২ জুন চার বছরের সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৮ জুন বঙ্গবন্ধু মুক্তি লাভ করেন। ২৫ জুন বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যৌথ বিবৃতি দেন। ৫ জুলাই পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু আইয়ুব সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু লাহোর যান, সেখানে শহীদ সোহরাওয়ারদীর নেতৃত্বে বিরোধীদলীয় মোর্চা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠিত হয়। অক্টোবর মাসে গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য তিনি শহীদ সোহরাওয়ারদির সাথে সারা বাংলা সফর করেন।
১৯৬৩
সোহরাওয়ারদী অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে পরামর্শের জন্য লন্ডন যান। ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ারদী বৈরুতে ইন্তেকাল করেন।
১৯৬৪
২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এই সভায় দেশের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি সাধারন মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায় সম্বলিত প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন। সাম্প্রদিয়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। দাঙ্গার পর আইয়ুববিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহনের জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ গ্রহন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ১৪ দিন পূর্বে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৬৫
শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও আপত্তিকর বক্তব্য প্রদানের অভিযোগ মামলা দায়ের। এক বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টের নির্দেশে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
১৯৬৬
৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু ৫ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেতার করা হয়। বঙ্গবন্ধু এ বছরের প্রথন তিন মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ৮ মে নারায়ণগঞ্জ পাটকল শ্রমিকদের জনসভায় বক্তৃতা শেষে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ৭ জুন বঙ্গবন্ধু ও আটক নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘটের সময় ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে পুলিশের গুলিতে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় মনু মিয়াসহ ১১ জন শ্রমিক নিহত হয়।
১৯৬৮
৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে এক নাম্বার আসামি করে মোট ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে পুনরায় জেলগেইট থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযুক্ত আসামিদের মুক্তির দাবিতে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯ জুন ঢাকা সেনানিবাসে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আগারতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের বিচারকার্য শুরু হয়।
১৯৬৯
৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত। কেন্দ্রিয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়। পরে ১৪৪ ধারা ও কারফিউ ভঙ্গ, পুলিশ-ইপিআর-এর গুলিবর্ষণ, বহু হতাহতের মধ্যে দিয়ে গণঅভ্যুত্থানে রুপ নিলে আইয়ুব সরকার ১ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকের আহবান জানায় এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারালে মুক্তি দান করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু প্যারালে মুক্তিদান প্রত্যাখ্যান করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি জনগনের অব্যাহত চাপের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য আসামিকে মুক্তিদানে বাধ্য হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ( সোহরাওয়ারদি উদ্যান ) ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। প্রায় ১০ লাখ ছাত্র জনতার এই সংবর্ধনা সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের ভাষণে ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খানের গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে বলেন, ‘গণঅসন্তোষ নিরসনে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন প্রদান ছাড়া কোন বিকল্প নেই’। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদরা বঙ্গবন্ধুর দাবি অগ্রাহ্য করলে ১৩ মার্চ তিনি গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করেন এবং ১৪ মার্চ ঢাকায় ফিরে আসেন। ২৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হন। ১৫ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তিন সপ্তাহের সাংগঠনিক সফরে লন্ডনে গমন করেন। ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহরাওয়ারদীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরন করেন ‘বাংলাদেশ’। তিনি বলেন, “একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্টা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকু চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।
…একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। …জনগনের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’-এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।
১৯৭০
৬ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১ এপ্রিল আওয়ামী লীগ কার্যকারী পরিষদের সভায় নির্বাচনে আংশগ্রহনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রশ্নে আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। ১৭ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ‘নৌকা’ প্রতীক পছন্দ করেন এবং ঢাকার ধোলাইখালে প্রথম নির্বাচনী জনসভার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারনা শুরু করেন। ২৮ অক্টোবর তিনি জাতির উদ্দেশ্যে বেতার-টিভি ভাষণে ৬ দফা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জয়যুক্ত করারা জন্য দেশবাসির প্রতি আহ্বান জানান। ১২ নভেম্বরের গোর্কিতে উপকূলীয় এলাকায় ১০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটলে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারণা বাতিল করে দুর্গত এলাকায় চলে যান এবং আর্তমানবতার প্রতি পাকিস্তানী শাসকদের ঔদাসিন্যের তব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। ৭ ডিসেম্বর সাধারন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯ টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসন লাভ করে।
১৯৭১
৩ জানুয়ারি রেসকোর্স জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহন পরিচালনা করেন। আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যরা ৫ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগনের প্রতি আনুগত্যের সপথ গ্রহন করেন। ৫ জানুয়ারি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বাধিক আসন লাভকারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তাঁর সম্মতির কথা ঘোষণা করেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮ জানুয়ারি জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধু সাথে আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। তিন দিন বৈঠকের পর আলচনায় ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠক বয়কটের ঘোষণা দিয়ে দুই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দুই দলের প্রতি ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবি জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে জনাব ভুট্টোর দাবির তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “ভুট্টো সাহেবের দাবি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। ক্ষমতা একমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। ক্ষমতার মালিক এখন পূর্ব বাংলার জনগণ।” ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদ বৈঠক স্থগিতের ঘোষণা দিলে সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের জরুরি বৈঠকে ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালিত হবার পর বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য প্রেসিডেন্টের প্রতি দাবি জানান। ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’। ঐতিহাসিক ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খল মুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। …রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।” তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান এবং ইয়াহিয়া খানের সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এদিকে রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়ার নির্দেশ যেত, আপরদিকে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ যেত, বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলতেন। অফিস, আদালত, ব্যাংক, বীমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলন বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মুলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। ১৬ মার্চ ঢাকায় ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয়। আলোচনার জন্য জনাব ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। ২৫ মার্চ আলোচনা ব্যর্থ হবার পর সন্ধ্যায় ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা রাইফেল সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
বঙ্গবন্ধু ২৫শে মার্চ রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন:
This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with wherever you have, to resist the army of occupation to the last. You fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.
[অনুবাদঃ এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনিকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।]
এই ঘোষণা বাংলাদেশের সর্বত্র ওয়ারলেস, টেলিফোন ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে প্রেরিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বাংলার নিম্নলিখিত একটি বার্তা পাঠান; পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা ইপিআর ঘাটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমন করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, আমি বিশ্বের জাতিসমুহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আমাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।
বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা দেশে পাঠানো হয়। সর্বস্তরের জনগনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাসে বাঙালি জওয়ান ও অফিসাররা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং এর তিন দিন পর তাঁকে বন্দি অবস্থায় পাকিস্তান নিয়ে যাওয়া হয়। ২৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া এক ভাষণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করে।
২৬ মার্চ চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম. এ. হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রতি পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্বসমর্পণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। বাংলাদেশ লাভ করে স্বাধীনতা। তার আগে ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে (লায়ালপুর) জেলে বঙ্গবন্ধুর গোপন বিচার করে তাঁকে দেশদ্রোহি ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। বিভিন্ন দেশ ও বিশ্বের মুক্তিগামী জনগণ বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার দাবি জানায়। ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জনক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের দাবি জানান হয়। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি বাংলাদেশের স্থপতি, কাজেই পাকিস্তানের কোন অধিকার নেই তাঁকে বন্দি করে রাখার। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বহু রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে।
১৯৭২
৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ হয়। লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেন। বিমানবন্দরে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি ও প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছালে তাঁকে অবিস্মরণীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে লক্ষ জনতার সমাবেশ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকারের আমন্ত্রনে তিনি ভারত যান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে দেয়া বহিষ্কারদেশ প্রত্যাহার করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যান। ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ১ মে তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি ঘোষণা দেন। ৩০ জুলাই লন্ডন থেকে তিনি জেনেভা যান। ১০ অক্টোবর বিশ্বশান্তি পরিষদে বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরী’ পুরস্কারে ভূষিত করে। ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের তারিখ (৭ মার্চ ১৯৭৩) ঘোষণা করেন। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয়। প্রশাসনিকব্যবস্থার পুনর্গঠন, সংবিধান প্রণয়ন, এক কোটি মানুষের পুনর্বাসন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত বিনামূল্যে এবং মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত নামমাত্র মুল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ, মদ, জুয়া, ঘোড়দৌড়সহ সমস্ত ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে নিষিদ্ধকরন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন, ১১,০০০ প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাসহ ৪০,০০০ প্রাথমিক স্কুল সরকারিকরন, মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর হাতে ধর্ষিতা মেয়েদের পুনর্বাসনের জন্য নারি পুনর্বাসন সংস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ, বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি উপকরন বিতরণ, পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত ব্যাংক, বীমা ও ৫৮০ টি শিল্প ইউনিটের জাতীয়করণ ও চালু করার মাধ্যমে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান, ঘোড়াশাল সার কারখানা, আশুগঞ্জ কমপ্লেক্সের প্রাথমিক কাজ ওঅন্যান্য নতুন শিল্প স্থাপনা, বন্ধ শিল্প কারখানা চালুকরনসহ অন্যান্য সমস্যার মোকাবেলা করে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবকাঠামো তৈরি করে দেশকে ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চালানো হয়। অতি স্বল্প সময়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের উল্ল্যেখযোগ্য সাফল্য।
১৯৭৩
জাতীয় সংসদে প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ। ৩ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপের সমন্বয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়। ৬ সেপ্টেম্বর জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়া যান। ১৭ অক্টোবর তিনি জাপান সফর করেন।
১৯৭৪
২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে পাকিস্তান স্বীকৃতি দেয়। ২৩ ফেব্রিয়ারি ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান গমন করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে এবং বঙ্গবন্ধু ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলায় ভাষণ দেন।
১৯৭৫
২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন এবং বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রপতির দায়িত্বভার গ্রহন। ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমস্বয়ে জাতীয় দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় দলে যোগদানের জন্য দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তাই স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন যার লক্ষ্য ছিল – দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে খামারে ও কলকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করার মানসে ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার আওতায় চলে আসে।
নতুন আশার উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের সে সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
১৫ আগস্টের ভোরে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ বাসভবনে সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্চভিলাষী বিশ্বাসঘাতক অফিসারদের হাতে নিহত হন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা লে. শেখ কামাল, পুত্র লে. শেখ জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী কামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভিগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর কন্যা বেবী সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আবদুল নাঈম খান রিন্টুসহ ১৬ জনকে ঘাতকরা হত্যা করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহিদ হওয়ার পর দেশে সামরিক শাসন জারি হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। শুরু হয় হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। কেড়ে নেয় জনগনের ভাত ও ভোটের অধিকার।
বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষার জন্য হত্যাকারীর বিচারের বিধান রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য ২৬শে সেপ্টেম্বর এক সামরিক অধ্যাদেশ (ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স) জারি করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে এক কুখ্যাত কালো আইন সংবিধানে সংযুক্ত করে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করে। খুনিদের বিদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যগণকে হত্যার বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করা হয়। ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়। ১ মার্চ’৯৭ ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়। ৮ নভেম্বের’৯৮ জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ৭৬ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণায় ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১৪ নভেম্বর’২০০০ সালের হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলে দুই বিচারক বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন এবং বিচারপতি আ.বি.এম খায়রুল হক দ্বিমতে বিভক্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর তৃতীয় বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। এরপর পাঁচজন আসামি আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। ২০০২-২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। ২০০৭ সালে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠিত হয়। ২০০৯ সালে ২৯ দিন শুনানির পর ১৯ নভেম্বর প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচজন বিচারপতি রায় ঘোষণায় আপিল খারিজ করে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি আপিল বিভাগে আসামিদের রিভিউ পিটিশন দাখিল এবং তিন দিন শুনানি শেষে ২৭ জানুয়ারি চার বিচারপতি রিভিউ পিটিশনও খারিজ করেন। এদিনই মধ্যরাতের পর ২৮ জানুয়ারি পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঘাতকদের একজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা গেছে এবং ছয় জন বিদেশে পলাতক রয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি ৩৪ বছর পর বাস্তবায়িত হল।
১৫ আগস্ট জাতির জীবনে এক কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শোক দিবস হিসাবে বাঙালি জাতি পালন করে।*
• জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত এলবাম জাতির জনক, ৩য় প্রকাশ, ১৭ মার্চ ২০১০ থেকে উদ্ধৃত।
বঙ্গবন্ধু
১৯৬৯ সালে এদেশের জনগন গভীর ভালোবাসায় শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গনন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করে। এর অর্থ, “বাংলার বন্ধু”। জনগন কর্তৃক এ ধরণের উপাধি প্রদান এ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যগত রীতি। যেমন, দেশবন্ধু, শেরে বাংলা অথবা নেতাজী। তবে বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে নামটি আলংকারিক নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে জনগনের অবিসংবাদিত নেতৃত্বের ভূমিকায় স্থিত করার লক্ষ্যেই এই অভিধা।
১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ তদানীন্তন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার একটি শান্ত, নিভৃত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে গোপালগঞ্জ মহকুমাকে জেলা শহরে উন্নীত করা হয়। তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান স্থানীয় মুন্সেফ আদালতে সেরেস্তাদার হিসাবে কাজ করতেন। শেখ মুজিবুর রহমান স্থানীয় জমিদার এবং নীলকরদের সঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষের প্রতিরোধের সংগ্রামের গল্প শুনে বড়ো হন। এই জমিদার এবং নীলকরদের কারণে তাঁর পূর্বপুরুষের অনেকেই আর্থিক সমস্যা এবং হয়রানির শিকার হয়েছিলেন। পরিবারের এসব নিগৃহীত হবার কাহিনি, ঔপনিবেশিক সামন্তবাদ এবং ভূস্বামী গোষ্ঠী কর্তৃক যাবতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁকে আন্দোলন-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ ভুমিকা রাখে।
শেখ মুজিবুর রহমান পরিবারের সদস্য কর্তৃক তাঁদের গ্রামেই প্রতিষ্ঠিত মাইনর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব সমাপ্ত করেন। অতঃপর তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৪ সালে ৭ম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর হৃদপিণ্ড এবং চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গ্লুকোমা রোগের জন্য তাঁর চিকিৎসা করা হয়। ডাক্তারের পরামর্শ মতো চার বছর তাঁর পড়াশুনা বন্ধ থাকে। ১৯৩৭ সালে নব উদ্দীপনায় তিনি স্কুলে ফিরে যান।
যৌবনের বছরগুলোয় শেখ মুজিবর রহমান ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সব ধরণের আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করা শুরু করেন যে, ব্রিটিশ শাসক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রত্যেকেরই উচিত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা। যৌবনের প্রারম্ভিক বছরগুলোয় শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সচিব হিসেবে সমাজ সেবায় অংশ নেয়। এই সংগঠনটি দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে সাহায্য করত।
১৯৩৮ সালে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক এবং তাঁর মন্ত্রীপরিষদের বাণিজ্য এবং শ্রমবিষয়ক মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শন করেন। তরুন শেখ মুজিবুর রহমানের দায়িত্ব ছিল তাঁদের সংবর্ধনার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা। এই উপলক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভবিষ্যতের রাজনৈতিক দীক্ষাদাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে প্রথম পরিচিত হন।
শেখ মুজিবুর রহমানের সাংগঠনিক ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তাঁকে গোপালগঞ্জে মুসলিম লীগের শাখা এবং মুসলিম ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে বলেন। মন্ত্রীদের সফর উপলক্ষ্যে গঠিত মুসলিম লীগ সংবর্ধনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সংবর্ধনা – বিরোধী কংগ্রেস সদস্যদের যে সংঘর্ষ হয় তার জের ধরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগে মিশন স্কুলের ছাত্র শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। যেহেতু তখন কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য ছিল হিন্দু, সেহেতু একটি ভুল ধারনা জনমনে সৃষ্টি হয় যে হিন্দুরা মুসলিম স্বার্থের পরিপন্থি।
১৯৪২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে বেকার হোস্টেলে আবাসিক ছাত্র হিসেবে থাকা শুরু করেন। তিনি ১৯৪৫ এবং ১৯৪৬ সাল নাগাদ ইসলামিয়া কলেজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পরপর দু’বার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ইসলামিয়া কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। দেশভাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানভুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের উন্নততর চাকরি বিধিমালা প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করে। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনবিষয়ক ডিগ্রি কোর্সের পড়া তিনি শেষ করতে পারেননি।
ছাত্র হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মধ্যম মানের। কারণ বিদ্যায়তনিক উৎকর্ষ অর্জনের বদলে রাজনীতিতেই তিনি বেশি সময় ব্যয়ে নিষ্ঠাবান ছিলেন। একটি বুদ্ধিমান, ধারালো এবং অনুসন্ধিৎসু মনের সুবাদে অবসর সময়ে তিনি শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস এবং দর্শন জ্ঞান অর্জনে সচেষ্ট থাকতেন। তিনি অবিভক্ত বাংলার শেষ দশক এবং পূর্ব পাকিস্তানের শুরুর দুই দশকের নানা ঐতিহাসিক ঘটনার গভীর পর্যবেক্ষণ এবং ব্যাখ্যা দান করেছেন অসমাপ্ত আত্মজীবনী শীর্ষক লেখায়। সেই পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়নে একজন চাক্ষুষ প্রত্যক্ষদর্শী এবং সক্রিয় সমর্থক হিসেবে তাঁর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় মেলে।
রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘ সময় কারান্তরিন থাকায় বিশেষত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আগ্রহের বিষয়সমূহের বই পড়ে এবং স্মৃতিকথা লিখে সময় অতিবাহিত করেছেন। একবার তিনি জেল থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে লেখা একটি চিঠিতে ইংল্যান্ডে যাবার এবং সেখানে ব্যারিস্টার-অ্যাট- ল পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অথবা এ. কে . ফজলুল হকের তুলনায়, যাঁদের প্রতি তাঁর ছিল গভীরতম শ্রদ্ধা, শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন কলেজ গ্র্যাজুয়েট।
দুই অগ্রজ নেতার তুলনায় শেখ মুজিবের ভেতর যে বিরল গুণসমূহের সমাবেশ ঘটেছিল তা হলো প্রত্যুৎপন্নমতিতা, চিন্তার স্বচ্ছতা এবং দর্শক–শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো বাচন ক্ষমতা। সত্যি বলতে রাজনৈতিক জীবনের গোড়াতেই তিনি জনসমাবেশে বক্তৃতা করার শিল্প এবং জনগণকে সংগঠিত করার কৌশল আয়ত্ত করেন। নিজের বেড়ে উঠার গ্রামীণ প্রেক্ষাপট থেকে তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে আপনজনের মতো মিশতে পারতেন। একাধারে জনপ্রিয়, আকর্ষণীয় এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক রাজনীতিকের ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন যা একইসাথে গ্রামীণ এবং নাগরিক উভয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে।
উদ্দীপ্ত যৌবনে দীর্ঘকাল বাংলার রাজনীতি ও সংস্কৃতির মূলকেন্দ্র কলকাতায় অবস্থান নানাভাবে শেখ মুজিবের জীবনে গঠন ও পরিণত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলায় সহায়ক হয়। তিনিই পূর্ব বাংলার সর্বশেষ রাজনীতিক যার সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতা এবং গ্রামীণ পূর্ব-পাকিস্তানের সংযোগ-সুত্র ছিল। কলকাতার তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সঙ্গে যেমন তাঁর পরিচয় ছিল তেমনি দু’পক্ষের কিছু সংখ্যক নেতৃত্বের মধ্যে উদারতাও তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। তবু তিনি দ্রুতই নেতাজীর ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক প্রত্যয়, হিন্দু-মুসলিম বোঝাপড়া তৈরির প্রচেষ্টা এবং তীব্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থানের জন্য তাঁর গভীর অনুরাগী হয়ে পড়েন। হিন্দু-মুসলিম সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রতিও তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল।
কলকাতায় অবস্থানকালীন শেখ মুজিবুর রহমান হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসেন। এছাড়া তিনি এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল হাশিম এবং প্রগতিশীল মুসলিম নেতাদের অনেকের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন। সেই সঙ্গে নবাব এবং খান বাহাদুররা তো ছিলেনই। এঁদের মতো কলকাতায় বেশিরভাগ সময় কাটানোর চেয়ে মাওলানা ভাসানীর ন্যায় নিজের গ্রামীণ পরিমণ্ডলের সাথে আচ্ছেদ্য সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ রাখেন তিনি।
যৌবনেই শেখ মুজিবুর রহমান সক্রিয় রাজনীতির ভুবনে পা রাখেন। ১৯৪০ সালে তিনি “ অল ইন্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশন” এবং “অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্টস লীগে”র কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। একই সময়ে তিনি গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগের মহকুমা শাখার সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৪১ সালে শেখ মুজিবর রহমান কলকাতায় ছাত্রনেতা আবদুল ওয়াসেক প্রমুখের নেতৃত্বে হলওয়েল সৌধ অপসরণের দাবিতে গড়ে তোলা আন্দোলনে অংশ নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (আই.এন.এ.)-র সমর্থনকারী আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি একাত্মতা বোধ করেন। ১৯৪২-৪৩-এর দুর্ভিক্ষের সময় গোপালগঞ্জে দুর্গত মানুষের সেবায় ফেরার সিদ্ধান্তের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষাজীবন পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীকালে বিহার ও কলকাতার দাঙ্গায় মানুষকে বাঁচানো ও দুর্গত মানুষের সেবায় রাতদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকার দাঙ্গায় তাঁর ভুমিকা ছিল একই রকম।
১৯৪৭-এর শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ তাগ করেন। দেশভাগের পরপরই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক আধিপত্য তাঁর মহমুক্তি ঘটায়। এছাড়া হিন্দুদের প্রান্তিকীকরনের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীতিমালা এবং তাদের জন্য পৃথক নির্বাচকম-লী নির্ধারণ তাঁর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া করাচি থেকে প্রেরিত আদেশের ভিত্তিতে খাজা নাজিমুদ্দীনের সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ব বাংলা থেকে বহিষ্কার করায় তিনি বিচলিত হয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি পাকিস্তান অর্জনে বড়ো ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মুসলিম লীগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান নতুন সংগঠনের মাধ্যমে নিজের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা প্রকাশে উদ্যোগী হন। তিনি ‘গণতান্ত্রিক যুব লীগে”র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। একই সময় তিনি “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ” গঠন করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি নবগঠিত “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ”-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫২সালে তিনি এই দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে, দলকে সুসংগঠিত করেন। ১৯৫৩ সালে সম্মেলনের মাধ্যমে তিনি এই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। নবগঠিত “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” যা আজকের আওয়ামী লীগের পূর্বসূরি।
শেখ মুজিবর রহমান ভাষা আন্দোলনে প্রবল আগ্রহে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের গভর্নর জেনেরাল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” উক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন গড়ে তোলেন। সে সময় তিনি বাংলা ভাষার পক্ষে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিদানকারী মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দীনের সঙ্গে এ বিষয়ে তীব্র বাদানুবাদ চালান।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন এক ঐতিহাসিক মোড় পরিবর্তনের মুখোমুখি দাঁড়ায়। কারণ ২৭শে জানুয়ারি ঢাকার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঘোষণা যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এবং বাংলা লিখতে আরবি লিপি ব্যাবহার করতে হবে এর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্রবিক্ষোভ দমন করতে পুলিশ গুলি চালায় যার ফলে চার জন শহীদ এবং অনেকেই আহত হন। এই ঘটনার ফলে যে শক্তিশালী ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তা বাংলাদেশে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উপাদানটিকে সংহত করে। এই আন্দোলনের ফলে শেখ মুজিবুর রহমান যখন কারারুদ্ধ তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রক্ত ছিটকে পড়ছে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি জেলে থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে সব ধরণের নিপীড়ন অবসানের দাবিতে অনশন শুরু করেন। ঢাকা কারাগারে তাঁর সঙ্গে ঢাকার ছাত্রদের যেন কোনো যোগাযোগ না হয় সেজন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। জনগনের প্রবল চাপ অগ্রাহ্য করতে না পেরে তাঁকে ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৫ই মে ১৯৫৪ থেকে ৬ই জুন ১৯৫৫ পর্যন্ত তিনি এ. কে. ফজলুল হকের মন্ত্রীসভায় সমবায়, ঋণ এবং গ্রামীণ পুনর্গঠন বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৫ সালের জুনে তিনি পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুখমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পরিচালিত আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভায় বাণিজ্য, শ্রম এবং শিল্প মন্ত্রির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালের ৮ই আগস্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান সেই দায়িত্ব পালন করেন। ৮ই আগস্ট তিনি মন্ত্রী হিসাবে তাঁর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন, পূর্ণ সময় আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পালন করবেন বলে।
শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তাঁর দলের স্বার্থ মন্ত্রিত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি বোধ করেছিলেন যে মন্ত্রী হওয়ার স্বার্থ দলের স্বার্থের কাছে বিসর্জন দেওয়া উচিত। এসব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রায়ই বাদানুবাদ হতো যা শেষবধি দুই নেতার ভেতরে অমোচনীয় বিভেদ তৈরি করে। যাহোক, মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করার পর শেখ মুজিবুর রহমান দলের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সামগ্রিক দায়িত্ব নির্বাহ করা শুরু করেন। যারা ভেতরে ছিল আইন পরিষদ বা সংসদে সংগঠন গড়ে তোলা এবং রাজনৈতিক সমাবেশের দায়িত্ব। কাজের সূত্রে দেশের ভেতরে নানা জায়গায় তাঁর প্রচুর ভ্রমন করতে হয়। আর এই সুবাদে অসংখ্য মানুষকে তিনি দলে নিয়ে আসেন এবং দেশজুড়ে দলের অসংখ্য শাখা স্থাপন করেন। স্বভাবজাত বাগ্মিতা, প্রতুৎপন্নমতিতা এবং সুস্পষ্টভাবে ভাবনা-চিন্তা ব্যক্ত করার কারণে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নানা সভা এবং সম্মেলনে বিপুল জনসমাবেশ তৈরিতে সক্ষম হতেন।
তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে প্রায়ই গ্রেফতার হয়েছেন। ১৯৪৮-এর সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৫৪-এর ১৪ই মার্চ নাগাদ তিনি চারবার গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক এ.কে. ফজলুল হকের মন্ত্রীসভা ভেঙে দেবার অব্যবহিত পরপরই তিনি পঞ্চম বারের মতো গ্রেফতার হন। ১৯৫৭ সালের ১২ই অক্টোবর পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা শেখ মুজিবকে “পূর্ব পাকিস্তান দুর্নীতি বিরোধী আইন ১৯৫৭” এবং ১৯৫৮ সালের অধ্যাদেশ-এর অধিনে গ্রেফতার করে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা ভিত্তিহীন অভিযোগটি ছিল তাঁর আয়ের উৎসের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এবং বিসদৃশ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন। এর পরপরই কঠোরতর “জন নিরাপত্তা আধ্যাদেশ”-এর অধীনে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং দুর্নীতি দমন ব্যুরো তাঁর বিরুদ্ধে একটি অতিরিক্ত অভিযোগ দায়ের করে। এই যাবতীয় মিথ্যা অভিযোগের উদ্দেশ্যে ছিল নানা ভয়-ভীতি দেখিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির ন্যায্য অধিকারের জন্য দৃঢ় সংকল্প আন্দোলন পরিত্যাগে বাধ্য করা।
এরপর এলো শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন যা-সম্পদ বিতরণে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সমতা; শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি এবং মুদ্রা ব্যতীত রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। এই বৈধ দাবি যার প্রতি বাঙালিদের পূর্ণ সমর্থন ছিল তা’ পাকিস্তানি নেতৃত্ব এবং সামরিক বাহিনীর সাথে বাঙালিদের সংঘাত ও সংঘর্ষের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় ইচ্ছা ও সংকল্প তাঁকে গনমানুষের ভালোবাসা, প্রশংসা এবং অপ্রতিহত সমর্থন লাভে সাহায্য করে। আর এভাবেই এদেশের মানুষ গভীর ভালোবাসা এবং ঐকমত্যের সঙ্গে “বঙ্গবন্ধু” আভিধায় তাঁকে ভূষিত করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি করা এই যাবতীয় অন্যায় এবং অন্যায্য ব্যবহার চূড়ান্ত মাত্রা পেল যখন ১৯৬৬ সালের ৮ই মে তাঁকে গ্রেফতার এবং কারারুদ্ধ করা হয়। কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভক্তির ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করার দায়ে পুনরায় গ্রেফতার এবং ঢাকা সেনাছাউনিতে কারারুদ্ধ করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা গেল না বটে তবে তাঁকে কারান্তরিন থাকতে হলো। অবশেষে ছাত্র-জনতার প্রবল বিক্ষোভের মুখে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তাঁকে জেল থেকে মুক্ত করা হয়। হাজার হাজার হর্ষোৎফুল্ল সমর্থকদের এক সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। ইতঃপূর্বে পাকিস্তানের কোনো জন সমাবেশে এত মানুষ সমাবেত হয়নি। শেখ মুজিবুর রহমান রাতারাতি হয়ে উঠলেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা।
বস্তুত স্বভূমির জনগনের দুর্দশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর এবং নিখাদ উদ্বেগ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে অকুতোভয় সাহস তাঁকে আন্দোলন গড়ে তুলতে শক্তি জুগিয়েছে। তাঁর প্রেরনাদায়ী নেতৃত্ব, কঠোর সংকল্প, গতিশীলতা এবং অভাবনীয় স্বতঃপ্রবৃত্ত শক্তি কোটি কোটি নর-নারী এমনকি শিশু অনুসারী সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। যাঁরা স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশায় তাঁকে অন্ধের মতো অনুসরণ করেছে। আর এইসব শেখ মুজিবুর রহমানকে গত শতাব্দীর সবচেয়ে সফল এবং বাঙালির স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র গঠনের মহান নেতার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে।
ড. এনায়েতুর রহিম
ড. জয়েস রহিম