You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

কারাগারের রোজনামচা
শেখ মুজিবুর রহমান

জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই – তারা জানে না জেল কি জিনিস। বাইরে থেকে মানুষের যে ধারণা জেল সম্বন্ধে ভিতরে তার একদম উল্টো। জনসাধারণ মনে করে চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে সমস্ত কয়েদি এক সাথে থাকে, তাহা নয়। জেলের ভিতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে।

কারাগার যার একটা আলাদা দুনিয়া। এখানে আইনের ব্যয়িতে যত রকম শাস্তি আছে সকল রকম শাস্তিপ্রাপ্ত লোকই পাওয়া যায়। খুনি, ডাকাত, চোর, বদমায়েশ, পাগল – নানা রকম লোক এক যায়গায় থাকে। রাজবন্দীও আছে। আর আছে হাজতি – যাদের বিচার হয় নাই বা হতেছে, এখনো জামিন পায় নাই। এই বিচিত্র দুনিয়ায় গেলে মানুষ বুঝতে পারে কত রকম লোক দুনিয়ায় আছে। বেশিদিন না থাকলে বোঝা যায়না। তিন রকম জেল আছে। কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলা জেল, আর সাবজেল – যেগুলি মহকুমায় আছে। জেলখানায় মানুষ, মানুষ থাকেনা – মেশিন হয়ে যায়। অনেক দোষী লোক আছে; আর অনেক নির্দোষ লোকও সাঁজা পেয়ে আজীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে। সাবজেল দুই তিন মাসের সাজাপ্রাপ্ত লোক ছাড়া রাখেনা। ডিসট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়। প্রায় তিন বছরের উপর জেল হলে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাইয়া দেয়।
আমি পাঁচবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি। আমার জীবনে কী ঘটেছে তা লিখতে চাইনা, তবে জেলে কয়েদিরা কিভাবে তাদের দিন কাটায়, সেইটাই আলোচনা করব। পূর্বেই বলেছি, ‘জেলের ভেতর অনেক ছোট ছোট জেল আছে’। জেলের কাজ কয়েদিরাই বেশি করে, আলাদা আলাদা এরিয়া আছে। হাজতিরা এক যায়গায় থাকে। সেখান থেকে তারা বের হতে পারেনা। রাজবন্দীরা আলাদা আলাদা যায়গায় থাকে। সেখান থেকে তারা বের হতে পারেনা। কয়েদিদের জন্য আলাদা যায়গা আছে। ছোট ছোট দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যেই থাকতে হয়। আর একটা এড়িয়ে আছে যাকে বলা হয় সেল এরিয়া। যেখানে জেলের মধ্যে অন্যায় করলে সাজা দিয়ে সেলে বন্ধ করে রাখা হয়। আবার অনেক সেলে একরারিদের রাখা হয়। সেল অনেক রকমের আছে – পরে আলোচনা করব।

কয়েদিদের গুণতি দিতে দিতে অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। সকালে একবার গণনা করা হয়, লাইন বেঁধে বসিয়ে গণনা করে। জমাদাররা যখন সকালে দরজা খোলে তখন একবার, আবার দরজা খোলার পরে একবার, ১১ টার সময় একবার, সাড়ে ১২ টায় একবার, বিকালে একবার, আবার সন্ধ্যায় তালাবন্ধ করার সময় একবার। প্রত্যেকবারই কয়েদিদের জোড়া জোড়া করে বসতে হয়। কয়েদিদের জন্য আলাদা আলাদা ওয়ার্ড আছে। কোন ওয়ার্ডে একশত, কোনটায় পঞ্চাশ, কোনটায় পঁচিশ, আবার এক এক সেলে এক একজন, কোন সেলে তিনজন, চারজন, পাঁচজনকেও বন্ধ করা হয়। তবে এক সেলে কোনোদিন দুইজনকে রাখা হয়না। কারণ, দুইজন থাকলে ব্যাভিচার করতে পারে, আর করেও থাকে।
জেলের ভিতর হাসপাতাল আছে, ডাক্তারও আছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসাও পায়। কাজ করতে হয়। যার যা কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। যারা লেখাপড়া জানে, তারা অফিসে রাইটারের কাজ করে। কেহ বাগানে, কেহ গুদামে, কেহ ফ্যাক্টরিতে, কেহ সুতা কাটে, কেহ পাক করে, কেহ ঝাড়ু দেয়, আর কেহ মেথরের কাজও করে। যত রকম কাজ সবই কয়েদিদের করতে হয়। সন্ধ্যার পরে কেউ বাইরে থাকতে পারেনা। সন্ধ্যায় সকলকেই তালা বন্ধ করে দেওয়া হয় বাইরে থেকে। ভিতরে থাকে কয়েদিরা। কয়েদিরা যতদিন জেলে থাকে – সন্ধ্যার পরে অন্ধকার হল, কি চাঁদের আলো, এ খবর খুব কম রাখে।

কয়েকদিনের ভিতর আবার প্রোমোশনও হয়। কালো পাগড়ি নাইটগার্ড, গেট পাহাড় দেয় ইত্যাদি। যে সাজা তাদের দেয়া হয় তার অর্ধেক জেলখাটা হয়ে গেলে তাদের পাহারার কাজ দেয়া হয়। পাহারাদের কালো ব্যাচ পড়তে হয়। এরা দরজায় দরজায়, দেয়ালে দেয়ালে, পাহারা দেয়। আবার কেউ কয়েকজন কয়েদির মালিক হয়, এই কয়েদিদের কাজ করায়। সেলে ব্যাজের ‘পাহারা’ জেলের সকল যায়গায় যেতে পারে। কাউকে ডাকতে হলে, কোন কয়েদিকে আনার দরকার হলে জমাদার সিপাহিরা এদের পাঠায়। এদের উপর থাকে, ‘কনভিক্ট ওভারসিয়ার’ – যাদের ‘মেট’ বলা হয়, এদের কোমরে চামড়ার বেল্ট থাকে। এরাও পাহারাদের মত কাজ করায়। কয়েকজন কয়েদি – তাদের উপর যে যার মেট থাকে – এদের দেখাশোনা করে। তিনভাগের দুইভাগ সাজা খাটা হলে ‘মেট’ হতে পারে। এর উপর নাইটগার্ড করা হয়। এরা কোমরে বেল্ট ও সিপাহিদের মত বাঁশি পায়। দরকার হলে এরা বাঁশি বাজাতে পারে এবং পাগলা ঘণ্টা দেওয়াতে পারে। যারা রাতে সিপাহীদের সাথে ডিউটি দেয় তাদের খাট-মশারি-বালিশ দেয়া হয়। তারা জেলের ভেতরে সকল যায়গায় ঘুরতে পারে। এর উপরে থাকে কালা পাগড়ি, তাদের কালা পাগড়ি পড়তে হয় এরা কোমরে বেল্ট ও বাঁশি পায়। এদের ক্ষমতা প্রায় সিপাহিদের সমান। এরা এক একটা এরিয়ার চার্জে থাকে এবং সেপাই জমাদারদের সাহায্য করে।
যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড খাটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তাদেরই এই ‘পাওয়ার’ দেয়া হয়। সকলকেই নাইটগার্ড বা কালা পাগড়ি দেয়া হয় না। যারা জেলের মধ্যে ভালভাবে থেকেছে, স্বভাব চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় তাদেরকেই নাইটগার্ড করা হয়। কালা পাগড়ি ওঁ নাইটগার্ডদের বাইরে ডিউটি দেয়া হয়। ‘মেট’ পাহারা ভেতরে পাহারা দেয়। যেখানে কয়েদিদের বন্ধ করে রাখা হয় সেখানে পাঁচজন করে মেট পাহারা থাকে। তারা দুই ঘণ্টা করে পাহারা দেয়। বাইরের থেকে সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করে ভেতর থেকে উত্তর দেয়। প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে নাম্বার আছে। সিপাহিরা জিজ্ঞাসা করে আর নম্বর বলে ভেতর থেকে উত্তর দিতে হয়।

যেমন একজন সিপাহি বলল, ‘পাঁচ নাম্বার’ সাথে সাথে ভেতর থেকে বলতে হবে, ঠিক আছে, পঞ্চাশ জানালা বাড়ি ঠিক। মানে হল কয়েদি ৫০ জন, আর বাড়ি ঠিক আছে। আবার জানালাও ঠিক আছে। এমনি এক নম্বর, দুই নম্বর, তিন নম্বর – এমনি করে রাতভর সিপাহিরা ডাকতে থাকে, যার উত্তর কয়েদি পাহারা ওঁ মেটেরা ভিতর থেকে দিতে থাকে। রাতে দুই ঘণ্টা পরপর সিপাহি বদলি হয়ে যখন নতুন সিপাহি আসে, তারা এসে তালা ভালভাবে চারিদিক পরীক্ষা করে দেখে, পূর্বের সিপাহির কাছ থেকে কাজ বুঝে নিতে হয়। সিপাহি বদলির সাথে সাথে আবার ভিতরে পাহারাও বদলি হয়ে পূর্বের পাহারার থেকে কাজ বুঝে নেয়।

কয়েদিরাই কয়েদিদের চালনা করে ও কাজ করায়। কাজ বুঝিয়ে দিতে হয় আবার কাজ বুঝে নিতে হয়। কয়েদিদের ওপর যে অত্যাচার হয় বা মারপিট হয়, তাও কয়েদিরাই করে। ইংরেজের কায়দা, ‘কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলা হয়’। একটা সত্য ঘটনা না লিখে পারছিনা। ঘটনাটা ঢাকা জেলে ঘটেছিল।
একজন কয়েদির কয়েকটা চুরি মামলায় কয়েক বছর জেল হয়। চোর বলে গ্রামের লোক ওর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় এবং জেল দেওয়াইয়া দেয়। গ্রামের লোক কেউই ওকে দেখতে পারত না। যারা জেল খাটার পরে ‘পাহারা’ হয় এবং পরে কনভিন্ট ওভারসিয়ার হয় – যাকে মেট বলা হয়, তারা বেল্ট পরতে পারে। মেট হয়ে যখন কয়েকজন কয়েদির ভার পরল ওর ওপরে কাজ করাবার জন্য তখন ওর কথামত তাদের চলতে হতো। তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে তার স্ত্রীর কাছে চিঠি লিখল। তাতে লিখেছে, ‘গ্রামে আমার কথা কেহই শুনত না, আমাকে সকলে আমাকে ঘৃণা করত, কিন্তু খোদার মেহেরবানিতে জেলখানায় আমার এত প্রতিপত্তি হয়েছে যে, আমার কথামত কতগুলি লোককে কাজ করতে হয়। বসতে বললে বসতে হয়, দাঁড়াতে বললে দাঁড়াতে হয়, কথা না শুনলে কোমরের বেল্ট খুলে খুব মার দেই। কারো প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নাই। আল্লাহ আমাকে খুব সন্মান দিয়েছে। এত বড় সন্মান সকলের কিসমতে হয় না। গ্রামের লোক আমাকে চোর বললে কি হবে, জেলে আমি একটা মাতুব্বর শ্রেণির লোক। চুরি না করলে আর জেলে না আসলে এ সন্মান আমাকে কেউই দিত না। তুমি ভেবো না। এখানে খুব সন্মানের সাথেই আছি।’ সত্যিই এত বড় সন্মান ও কোনোদিন আশা করতে পারেনাই।

কয়েদিরা চিঠি যখন পাঠায় তখন পরীক্ষা করে দেখা হয় জেল অফিসে। যখন এই চিঠি পরীক্ষা করার জন্য খোলা হল তখন তো সকলে পড়ে হাসতে হাসতে সারা। চিঠি জেলার সাহেব, সুপার সাহেব সকলেই পড়লেন। পরের দিন তাকে হাজির করে বেল্টটা খুলে নেয়া হল। তার মতব্বরি শেষ। এই গল্পটা কোন এক জেলার সাহেব আমাকে বলেছিলেন।
জেলে কতগুলি কথা ব্যবহৃত হয় যা বাইরের লোক সহজে বুঝতে পারবে না। আমি যখন প্রথম জেলে আসি তার পরদিন সকালে একজন কয়েদি ‘পাহারা’ এসে আমার ও আমার সাথী কয়েকজনকে বলল আপনাদের ‘কেসটাকোলে’ যেতে হবে। আমরা তো ভেবেই অস্থির। বাবা ‘কেসটাকোল’ কী জিনিস? কোথায় যেতে হবে? বলল ওখানে ‘কেসটাকোল’ হয়। আমরা একে অন্যের মুখের দিকে চাই। বললাম চলো, আমাদের নিয়ে যাওয়া হল এক যায়গায়। সেখানে জেল সুপার সাহেব এসে কয়েদিদের সকল কিছু জেনে টিকেটে লিখে নেয়। কয়েদিরা অন্যায় করলে বিচার হয়। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখন সুপার সাহেব বললেন, ‘আপনারা চলে যান আপনাদের রুমে। আপনাদের ওজন, নামধাম আপনাদের ওখানে যেয়ে লিখে আনবে।’ সিপাহি একজন আমাদের পৌঁছাইয়া দিল।

আমাদের সাথে কয়েকজন ডিভিশন কয়েদি ছিল তার মধ্যে শাহাবুদ্দিনকে আমি জানতাম। বাড়ি সিলেট। সিলেট গণভোটে কাজ করত, মুসলিম লীগের একজন নামকরা কর্মি ছিল। বিখ্যাত কালাবাড়ি খুন মামলায় ২০ বছরের সাজা হয়েছে। শাহাবুদ্দিনের নাম ছিল পি এম শাহাবুদ্দিন। সকলে ঠাট্টা করে বলত, ‘পলিটিকাল মারদাঙ্গার শাহাবুদ্দিন’। জেলখানায় অনেকের পেছনে সে লাগত, কারো ভালো দেখতে পারত না। তবে লেখাপড়া জানত। কয়েদিদের কাজ করে দিত বলে কেহ কিছু বলত না।

শাহাবুদ্দিনকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম। ‘কেসটাকল’ কীরে ভাই?’ ওতো হেসেই অস্থির। আমাকে বলল দেখেনতো, ইংরেজি ডিকশনারিতে আছে নাকি? আমি বললাম জীবনে তো শুনি নাই। থাকতেও পারে। ইংরেজি তো খুব ভালো জানিনা। পুরনো ডিভিশন কয়েদিরা সকলেই হাসে। আমি তো আহাম্মক বনে গেলাম, ব্যাপার কী? পরে হাসতে হাসতে বলল, কেস ফাইল, কেস টেবিল, ‘কেসটাকোল’ না। কয়েদিরা একে এই নামে ডাকে। কেস টেবিলে বিচার হয়। কয়েদিরা অন্যায় করলে শাস্তি পায়। কয়েদিদের অনুরোধ, দাবীর কথা শোনে। চিঠিপত্র লেখে। নিজেকে আমি আহাম্মক মনে করেছিলাম। কেস টেবিল থেকে ‘কেসটাকোল’ নতুন একটা ইংরেজি শব্দ কয়েদিরা জন্ম দিয়েছে। এরকম অনেক শব্দ ও নাম জেলখানায় আছে। পরে লিখব। সেন্ট্রাল জেলে অনেক রকম ডিপার্ট্মেন্ট আছে। কয়েদিদের ভাগ করে দেয়া হয়। এই ডিপার্টমেন্ট কে ‘দফা’ বলা হয়।

জেলে শব্দকোষের কয়েকটি এরকমঃ

রাইটার দফা – যারা পড়ালেখা জানে, অফিসের কাজ করে, চিঠিপত্র লিখে দেয়, হিসাব রাখে, আপিল লিখে দেয়, দরখাস্ত লিখে দেয়, চিঠিপত্র বিলি করে। কয়েদিদের খালাসের সময় হিসেব করে। কতদিন জেল খাটা হল। হাসপাতালে কাজ করে, ঔষধপত্র হিসেব রাখে। একজন কর্মচারিকে কাজে সাহায্য করার জন্য একজন দুইজন অথবা বেশি রাইটার থাকে। এরা কর্মচারিদের সাহায্য করে। মাল গুদামের হিসাব রাখে, কয়েদিদের বেতন ভাগ করে দেয়, বাজার থেকে কি কি কিনতে হবে – তাহাও লিখে কর্মচারিদের দস্তখত নিয়ে কনট্রাক্টরদের কাছে পাঠায়।যত গোলমাল এই রাইটাররাই বেশি করে।
চৌকি দফা – যেখানে কয়েদিদের পাক (রান্না) হয়। হিন্দু এবং মুসলমানদের আলাদাভাবে পাক হয়ে থাকে। এখানে বহু কয়েদি কাজ করে। পানি আনে, মাছ ও তরকারি কোটে, মরিচ বাটে, খাওয়া বিলি করে, যাবতীয় খাওয়ার ব্যাপার এই চৌকি থেকে হয়। বহু লোকের পাক হয়। ডিভিশন চৌকি আলাদা হয়ে থাকে। ডিভিশন অর্থ হল যে সমস্ত কয়েদিদের বাইরে অবস্থা ভাল, শিক্ষিত, সন্মানিত জেলে এসে পড়েছে তাঁদের ডিভিশন দেওয়া হয়। এক কথায় বলতে গেলে এদের উচ্চ শ্রেণি বলা চলে।

এদের কনভিক্ট ডিভিশন – ২ বলা হয়; ডিভিশন – ১ ও আছে। যারা হাজতি তারা ডিভিশন -১ পায়। যারা কনভিক্ট তাঁদের ডিভিশন- ২ বলা হয়। আর আছে সাধারণ কয়েদি যাদের তৃতীয় শ্রেণির কয়েদি বলা হয়। ডিভিশন কয়েদিরা জুতা, জামা, খাট, মশারি পায়। আর জেলখানায় একটু মাতব্বরিরও বেশি করতে চেষ্টা করে। আর করেও। কারণ প্রায়ই লেখাপড়া জানা ও অবস্থাসম্পন্ন লোক অথবা সরকারী কর্মচারি ঘুষ খেয়ে সাজা পেয়ে জেলে এসেছে। এদের পাকও আলাদা হয়। কারণ এরা রোজই মাছ, তরকারি, অন্যান্য জিনিস সাধারণ কয়েদিদের থেকে বেশি পায়। এদেরই এক কথায় সুখী কয়েদি বলা চলে।
চৌকি দফায় যারা কাজ করে ও মেট পাহারা যারা থাকে, পরিশ্রম করতে হয় তাঁদের বেশি। খাওয়া দাওয়ার কষ্ট হয় না। অনেক কিছু তৈয়ার করে পালাইয়া পালাইয়া খেয়ে থাকে, আর বিক্রিও করে। আশ্চর্য হবেন, বিক্রির ইতিহাস পরে আলোচনা করা যাবে। জেলখানায় পাওয়া যায়না এমন জিনিস খুব অল্পই আছে। তবে মেয়েলোক শুধু পাওয়া যায়না।

জলভরি দফা – বুঝতে বোধহয় কষ্ট হবেনা, জলভরি কাকে বলে। কয়েদিদের মধ্যে একটা দফা আছে যারা পানি টানে ও ওয়ার্ডে পানি দেয়। বেশ শক্তিশালী লোক দেখে এই দফা পূরণ করা হয়। সকালে বাঁশের ভেতর দুইটা করে বড় বালতিতে পানি ভরে প্রত্যেক ওয়ার্ডে হাউজ আছে তাতে ভর্তি রাখতে হয়। এদের কষ্ট একটু বেশি, কারণ তিন তোলা পর্যন্ত হাউজে পানি তুলতে হয়, সকালে ও বিকালে। যদি কোন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, দারোগা, পুলিশ, দফাদার কয়েদি হিসেবে জেলে আসে তখন কয়েদিরা এক হয়ে তাদের দিয়ে পানি টানায় এবং নীচের থেকে তিন তলায় পানি টানায়।

ঝাড়ু দফা – এদের কাজ ঝাড়ু দেওয়া, ময়লা পরিষ্কার করা। বুড়া বুড়া, অসুস্থ লোক দেখে এখানে দেওয়া হয়। দিনভর গাছের পাতা, সামান্য ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে হয়। এরাই সুখী বেশি কারণ কাজ নাই তবে ইদানীং নতুন সুপাতেন্টেন্ডেন্ট ঢাকা জেলে আসাতে এদের উপর কাজের চাপ একটু বেশি পড়েছে। কারণ তিনি গাছের পাতা দেখলে কয়েদিদের মেট পাহারাদের দিয়ে সেল বন্ধ করে শাস্তি দেন। তবে কয়েদিরাও চালাক কম না। একদিন বসে আছি হঠাত শুনতে পেলাম একজন কয়েদি আর একজন কয়েদিকে বলছে আরে ভাই ‘ঝাড়ু মার ঝাড়ু মার বড় সাহেব আসছে।’ আমি সহজে বুঝতে পারলাম না কেন বড় সাহেবকে ঝাড়ু মারতে চায়। পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে, ইনি খুব কড়া লোক। তাই কয়েদিরা ঝাড়ু মারে মাটিতে, বলে সুপার সাহেবের নাম। পরে বিস্তারিত আলোচনা কড়া যাবে।

বন্দুক দফা – একটা বিখ্যাত দফা আছে যার নাম কেহই বুঝবেন না, একে বন্দুক দফা বলা হয়। একদল কয়েদি আছে যারা মেথরের কাজ করে। মেথর হলে রোজ মাছ পাওয়া যায়। তেল পাওয়া যায়। আঁটি করে বিড়ি পাওয়া যায়, সাবানও পাওয়া যায়। লোভে পড়ে অনেকে মেথর দফায় কাজ করে, পায়খানা পরিষ্কার করে। আগে জুলুম করে, মারপিট করে মেথর করতে হত। সহজে কেহ মেথর হতে চায়না। তাই অত্যাচার করার জন্য কয়েদিদের মধ্যে থেকে দালাল ঠিক করে দেয়া হত।

আপনারা জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বন্দুক দফা কেন বলা হয়? একটা গল্প আছে এর পেছনে। বাঁশ দিয়ে কাঁধে নিয়ে টিনে করে পায়খানার ময়লা দূরে নিয়ে লাল গাড়িতে ফেলতে হয়। তাই টিন ঘাড়ে করে টানতে টানতে দাগ হয়ে যায়। একজন কয়েদি মেথর দফায় কাজ করতে করতে তার কাঁধে দাগ হয়ে যায়। একবার তার ভাইরা তাকে দেখতে এসে কাঁধের দাগ দেখে জিজ্ঞাসা করে দাগ কিসের, তার উত্তরে মেথর কয়েদিটা বলে ‘আমি বন্দুক দফায় জেলখানায় কাজ করি, সিপাহি সাহেবদের বন্ধুক আমাকে বহন করে বেড়াতে হয়। তাই দাগ পড়ে গেছে।’ সেই হতে এই দফার নাম বন্দুক দফা।

পাগল দফা – জেলখানায় আরেকটা দফার নাম পাগল দফা। জেলখানায় বহু পাগল আছে। এদের আলাদা রাখার ব্যবস্থা আছে। এদের জন্য সকালে একজন সিপাহি, বিকেলে একজন। কয়দিদের মধ্যে থেকে মেট পাহারা কয়েকজন রাখা হয় এদের দেখাশোনা করার জন্য। অনেক কয়েদি পাগল হয়ে যায়, বেশি দিন জেল জীবন সহ্য করতে পারেনা বলে। অনেক কয়েদি আপনজনকে হত্যা করে পাগল হয়ে যায়। এরা ভালো না হওয়া পর্যন্ত বিচার বন্ধ থাকে।
ফরিদপুরের এক পুলিশের হাওলাদার তার স্ত্রীর চরিত্রের উপর সন্দেহ করে স্ত্রী ও কন্যাকে হত্যা করে। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। তারপর সে পাগল হয়ে যায়। আবার অনেকে বাইরে পাগল হয়, আত্মীয় স্বজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুমতি নিয়ে জেলে পাঠাইয়া দেয়। অনেকে ভালো হয়, আবার অনেকে বেশি পাগল হয়ে যায়। দুনিয়ায় কত রকমের পাগল আছে জেলে আসলে বোঝা যায়। আমার কপাল ভালো কি মন্দ বলতে পারিনা। তবে যেখানে পাগলদের রাখা হয় তার কাছেই আমাকে রাখা হয়েছিল। রাত হলে পাগলের পাগলামি বাড়ে। ৪০ সেলে পাগল রাখা হয়। এক এক সেলে এক এক জনকে বন্ধ কড়া হয়। অনেকে চুপচাপ থাকে, আবার অনেকে সারারাত গান জ্ঞায় – কত রকমের গান ঠিক নাই। যাকে এক কথায় পাগলের গান বলা যায়। মাঝে মাঝে থালা পিটায়, মাঝে মাঝে দরজা ধাক্কা শুরু করে। আর মাঝে মাঝে দুএকজন রাতভরে গালাগালি করে। কাকে করে বুঝতে পারিনা – তবে গালাগালি চালিয়ে যায়।

বহু রাত্রে ঘুমাতে না পেরে ওদের চিৎকারে বিছানায় শুয়ে রাত কাটাতে হয়েছে আমার। পাগলের উৎকট চিৎকারে কে ঘুমাতে পারে। এক পাগল ছিল, মাঝে মাঝে ক্ষেপে যেত। যখন ক্ষেপত রাতভর, ‘আল্লাহু আকবর’ ‘জিন্দাবাদ’ এই দুই কথাই বলে রাত কাটিয়ে দিত। কেউ কেউ সিপাহিদের ডাকত বিড়ি খেতে, বলত ‘বাবু ও বাবু এদিকে আসেন’ – ড্যাকতেই থাকত, কিছুক্ষণ ডাকার পরে যদি না আসে তাহলে বাবুর পরিবর্তে মা বোন তুলে গালি দিত।

চল্লিশ সেলের দুই ধারে ছোট ছোট কামরা, সিপাহিদের বলে কয়ে ক্ষেপা পাগলদের অন্য পাশে বন্ধ করতে অনুরোধ করতাম। কিন্তু কখন যে কোনদিকের কে ক্ষেপে উঠে কি করে বসবে তার ঠিক নেই। আজ একজন ঘুমাইয়া ছিল, রাতে আরেকজন শুরু করল। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে সবগুলিকে এক এক করে নিয়ে যায়, পানির হাউজে গোসল করায়। পাগল সহজে গোসল করতে চায়না, তাই জোর করে পানির ভিতর ফেলে দেয় আর চেপে ধরে। অনেক পাগল আবার চালাক, চুবানোর ভয়ে তাড়াতাড়ি কলের নিচে বসে নিজেই গোসল করে নেয়।

একদিন দাঁড়াইয়া পাগলের গোসল দেখছি। এক পাগলের গোসল হয়ে গেছে। সে কাঁপতে কাঁপতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে। আর একজন পাগলকে কয়েকজন কয়েদি ধরে এনে গোসল করাচ্ছে। যে পাগলটা আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া রোদ পোহাচ্ছে সে আমাকে বলে, ‘কি দেখেন, এগুলি সব পাগল, খুব পাগলামি করে।’ আমি তো হেসেই অস্থির। নিজে যে পাগল তা ভুলে গেছে।

১৯৫৪ সালে জেলে গিয়ে এক পুরানা পাগলের সাথে দেখা হল। ওকে আমি চিনতাম, কারণ বছরের মধ্যে প্রায় ১১ মাস ভালো থাকে, মাঝে মাঝে ক্ষেপে যায়। যখন ভালো থাকে তখন খুব ভালো ভালো কথা বলে। ওদের যখন নিয়ে যাচ্ছে আমি দাঁড়াইয়া দেখছি, দেখি সেই পুরাণ পাগল। নাম তার কফিলউদ্দিন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি কফিলউদ্দিন কেমন আছো?’ বলল, ‘ভালো তো আছি, ছাড়ে তো না। আপনারা তো ছাড়লেন না। আবার বুঝি আসছেন।’ আমি কিছু বললাম না। সে চলে গেল। রোজ যখন আমার সামনে দিয়ে নিয়ে যেত তখন আমাকে দূর থেকে একটা আদাব করত। কফিলউদ্দিন আজও জেলে আছে – কতকাল থাকতে হয় জানিনা। আর একজন ছিল আমাকে দেখলেই ইংরেজি বলত। পরে খবর নিয়ে জানলাম স্কুলের মাস্টার ছিল। পাগল হয়ে গেছে।

একদিন জেল গেটে যাচ্ছি আমার স্ত্রীর সাথে স্বাক্ষাত করতে। যাবার পথেই ওদের দরজা। এক পাগল দাঁড়াইয়া আছে ওদের দরজায়। আমাকে দেখে বলে, ‘কি খবর! সিগারেটগুলি একলাই খান আমাদের দিতে হয়না।’ বললাম সিগারেট খাবা, এসে দিব। ফিরে এসে দেখলাম ওদের তালাবন্ধ করে দিয়েছে। ওকে সহজে সেলের বাইরে করেনা কারণ খুব শক্তিশালী। ক্ষেপে গেলে মেরে ধরে অস্থির করে দেয়। এক সিপাহি বসে বসে ডিউটি দিতেছিল। ও আস্তে আস্তে এসে কাছে বসেছে, হঠাৎ সিপাহির হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে সিপাহিকে মারতে শুরু করল। সিপাহির মাথা ফেটে গেল। সিপাহি দৌড় দিয়ে কোন মতে নিজেকে রক্ষা করল। পরে অনেক সিপাহি ও কয়েদি এসে ওর কাছ থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। এক ঘণ্টা পর্যন্ত ওর কাছে কেউ যেতে পারেনাই।

দুই একজন সিপাহি আছে যাদের দেখলে পাগলরা ক্ষেপে যায়। তাই তাদের ডিউটি পাগল খাতায় দেয়া হয়না। পাগলের সঙ্গে রাগ করলে, গালাগালি করলে তারা আরও ক্ষেপে যায়। একমাত্র ঔষধ পানি। যদি বলা যায়, কাল সকালে তোকে পানির ভিতর ফেলে দেব তখনই ভয় পায়। আমি মাঝে মাঝে বিড়ি কিনে পাগলদের দিতাম, বড় খুশী হত বিড়ি পেলে। এবার দিতে পারি নাই, কারণ আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে বের হওয়া বা কারো সাথে কথা বলা নিষেধ।

শয়তানের কল –
আরেকটা দফার নাম শয়তানের কল। জিজ্ঞাসা করলাম শয়তানের কল কি? কম্বল ফ্যাক্টরি। ঢাকা জেলে একটা কম্বল ফ্যাক্টরি আছে, ভাল ভাল কম্বল তৈরি হয়। বিশেষ করে জেলখানার কয়েদিদের তিনটা করে কম্বল শীতের দিনে দেওয়া হয়, আর গরমের দিন দুইটা। ঢাকা জেলের কম্বল ফ্যাক্টরি সমস্ত জেলের কয়েদিদের কম্বল সাপ্লাই করে। এখানে কয়েদিদের কাজ করতে হয়। উল, তুলা বাইরে থেকে কিনে আনা হয়। যারা বেশিদিন জেলে আছে তাদেরই এখানে কাজ শেখানো হয়। এরা কম্বল তৈয়ার করে বাইরেও বিক্রি করে। আমি এক কয়েদিকে জিজ্ঞেস করলাম, শয়তানের কল বলো কেন? বলে, হুজুর তুলা যখন ওড়ে তখন আমাদের দিকে চাইলে চিনতে পারবেন না; সমস্ত চুল, মুখ, কাপড় তুলার কণায় ও ধুলায় ভরে যায়। সন্ধ্যায় গোসল করে তবে আমরা খেতে পারি। সাফ সুতরা হয়ে গোসল না করলে আমাদের চিনতে পারবেন না, মুখ, সারা শরীরে তুলা লেগে আমাদের চেহারা শয়তানের মতও হয়ে যায় বলে, শয়তানের কল নাম দেয়া হয়েছে।

দরজি খাতা –
ঢাকা জেলে চাদর, কয়েদিদের কাপড়, মোড়া, টেবিল, চেয়ার, খাট, গদি অনেক কিছুই এখানে তৈয়ার হয়। একজন ডেপুটি সুপারেন্টেনডেন্ট এর চার্জে থাকে। একে কয়েদিরা ডিপটি বলে। দরজি খাতা খুব বড়ো এখান থেকে পুলিশ লাইনেরও পোশাক বানাইয়া দেওয়া হয়।

মুচি খাতা –
মুচি খাতা আছে যেখানে জুতা তৈয়ার হয়। তবে একে আরও উন্নত ধরণের করা যায় যদি ভালো মেশিন সাপ্লাই করা হয়। এবং কয়েদিদের কিছু বেতন দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। কয়েদিরা কাজ করতে চায়না, ফাঁকি দেয় – শুধু দিন গোনে। আজ একদিন গেল – কাল দুইদিন – এমনি। যদি এরা বুঝতে পারে বেশী কাজ করলে টাকা পাওয়া যাবে তাহলে বেশী কাজ করত।

অনেক সত্য ঘটনা আমি দিবার চেষ্টা করব – যাতে বুঝতে পারা যাবে, কেমন করে জেলে আশার পরে খাবারের অভাবে স্ত্রী তালাক দেয়া হয়। একটা না , বহু ঘটনা আছে। প্রথম প্রথম জেলে এসে অনেক কথা বুঝতেই আমার কষ্ট হত, যেমন একদিন এক, ‘পাহারা’ এসে বলল তার ‘সিকম্যান’ যেতে হবে। আমি তার মুখের দিকে চেয়ে আছি, কিছুই বুঝতে পারিনা। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সিকম্যান কিরে?’ বলে হুজুর ‘সিকম্যান’ জানেন না, যেখানে ওষুধ পাওয়া যায়, আমার যেতে হবে ওষুধ আনতে। আর কোন কথা না বলে চুপ করে রইলাম। বুঝলাম, এসব জেলের নিজস্ব ভাষা, আমি বুঝতে পারবো না।

ডিভিশন কয়েদি ছিল বরিশালের বারী সাহেব ও ওহাব সাহেব। আমরা একসাথেই থাকতাম। বারী সাহেব হাসপাতালে রাইটারের কাজ করতেন আর ওহাব সাহেব ফ্যাক্টরিতে রাইটারের কাজ করতেন। দুইজন খালাতো ভাই। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। প্রায় আট বছর জেলে আছে। জমিজমার ব্যাপারে একটা খুন হয়ে যায়। তার দণ্ড এই জেল।ওহাব সাহেব একটা ছেলে রেখে এসেছে। জোয়ান সুপুরুষ। বিধবা মা ছিলেন, মারা গেছেন জেলে আশার পর। মাত্র স্ত্রী আর ছেলেটা, এক বছরের রেখে আসছে আর দেখা হয় নাই। বারী সাহেবের ছেলেমেয়ে আছে, মেয়েটার বিবাহ হয়েছে জেলে আসার পরে। খুব চিন্তিত থাকেন সকল সময়। কোন রকমের কথাবার্তায় উত্তর নাই, গোলমালের ভিতর নাই। চুপচাপ থাকেন। ওহাব সাহেব ভীষণ গোঁয়ার লোক, রাগ হয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। এরা যখন কাজ করে ফিরে এলেন তখন, ‘সিকম্যানের’ কথা জিজ্ঞেস করলাম। বারী সাহেব বললেন, ‘সিকম্যান’ মানে হাসপাতাল, কয়েদিরা সিকম্যান বলে। বুঝলাম ব্যাপারটা।

জেলখানায় হাসপাতাল আছে, পূর্বেই বলেছি। সেন্ট্রাল জেলে, বিশেষ করে ঢাকা জেলে ভালো হাসপাতাল। দোতলা দালান, প্রায় একশ’ রোগীর স্থান হতে পারে, তিনজন ডাক্তার আছে, একজন কম্পাউন্ডার, সপ্তাহে দুইবার সিভিল সার্জন আসেন। তারই চার্জে জেল হাসপাতাল। ঔষধ যথেষ্ট থাকে, ডাক্তারের হুকুম মত যে কোন খাদ্য কয়েদিদের দিতে বাধ্য। একে ‘মেডিকেল ডাইট’ বলা হয়। কয়েদিদের ওজন কম হয়ে গেলে ডাক্তাররা ডাইট দিয়ে থাকেন, তবে সকল ডাক্তার এক না। হাসপাতালে চিকিৎসাপ্রাপ্ত হয়ে যদি রোগ ভালো না হয়, তবে জেলের মেডিকেল অফিসার ইচ্ছা করলে মেডিকেল কলেজে পাঠাতে পারে। দুঃখের বিষয় কয়েদিদের কপালে ভালো ঔষধ কম জোটে। কারণ ভালো ব্যাবহারের ডাক্তার যারা – যারা কয়েদিদেরও মানুষ ভাবে, আর রোগী ভেবে চিকিৎসা করে, তারা বেশিদিন জেলখানায় থাকতে পারেনা।

অনেক ডাক্তার দেখেছি এই জেলখানায় যারা কয়েদিদের ‘ডাইট’ দিতে কৃপণতা করেনা, অসুস্থ হলে ভালো ঔষধ দেয়। আবার অনেক ডাক্তার দেখেছি যারা কয়েদিদের কয়েদিই ভাবে, মানুষ ভাবেনা, রোগ হলে ঔষধ দিতে চায়না। পকেটে করে ঔষধ বাইরে নিয়ে বিক্রি করে। ঘুষ খায়, চিকিৎসা করার নামে। আবার টাকা পেলে হাজতিদের মাসের পর মাস হাসপাতালে ভর্তি করে রাখে, ব্যারাম নাই যদিও। এভাবে বাইরের থেকে জামিনের চেষ্টা করা যায়। ম্যাজিস্ট্রেট যখন জেলখানায় দেখতে যায় কয়েদিদের অবস্থা, তখন হাসপাতালে ভর্তি দেখায়ে দেয়। এতে জামিন পেয়ে যায়। বাইরে থেকে বিচারাধীন আসামীর কেউ হয়ত কোন ডাক্তারের সাথে দেখা করে টাকা পয়সা দিয়ে গেছে, বলে গেছে জামিন হলে আরও দেব। যার অসুখ নাই তাকে মাসের পর মাস হাসপাতালে সিট দিয়ে রেখেছে, আর যে সত্যিই রোগী তার স্থান নাই। এটা বাইরেও হয়ে থাকে, শুধু জেলে না, তবে এখানে একটু বেশী হয়।

আবার এমন ডাক্তার দেখেছি যারা জেলখানায় পানিও মুখে দেয়না, ঘুষ তো দূরের কথা। রোগীদের ভালভাবে চিকিৎসা করে, রাতদিন পরিশ্রম করে। আবার এমন ডাক্তার জেলে দেখেছি, সুন্দর চেহারা, মুখে দাঁড়ি, নামাজ পড়তে পড়তে কপালে দাগ পড়ে গেছে – দেখলে মনে হয় একজন ফেরেস্তা। হাসপাতালের দরজা বন্ধ করে কয়েদিদের ডাইট থেকে ডিম, গোস্ত, রুটি খুব পেট ভরে খান, আর ঔষধও মাঝে মাঝে বাইরে নিয়ে বিক্রি করেন।

হাসপাতালের রোগীদের জন্য আলাদা পাক হয়। এখানটায় হল খাওয়ার আড্ডা। কয়েদিরা কথা বলতে সাহস পায়না, তাই তাদের মুখের গ্রাস অনেকেই খেয়ে থাকেন। একজন ডাক্তারকে আমি জানতাম, মুখে খুব ভদ্রলোক। আসতে সালাম, যাইতে সালাম, খবর নিয়ে জানলাম তিনি এক প্যাকেট সিগারেটও ঘুষ খান।

জেলে কোন ঘটনা চাপা থাকেনা। যে কোন ঘটনা জেলখানায় আধা ঘণ্টার ভিতর আড়াইহাজার কয়েদির কানে চলে যাবে।

আমাকে ও মওলানা সাহেবকে মেডিকেল ‘ডাইট’ বাঁচাইয়া রেখেছিল দ্বিতীয়বার। পরে খবর নিয়ে শুনলান, নুরুল আমিন সাহেব নাকি জেল সুপারিন্টেনডেন্ট সাহেবকে বলে রেখেছিলেন যে আমাদের যেন কোন খাওয়ার, থাকার কষ্ট না হয়। সেজন্য বোধহয় একটু যত্ন পেয়েছিলাম।

পাকিস্তান হওয়ার পরে রাজবন্দীদের যেসমস্ত সুযোগ সুবিধা ইংরেজ আমলে ছিল তাহা উঠাইয়া দেওয়া হয়। রাজবন্দীদের কোন বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতনা। তাদের ব্যবহার করা হত সাধারণ কয়েদিদের মত। কাহাকেও তৃতীয় শ্রেণীর মত ব্যবহার করত। আইবিদের ইচ্ছা। আমার মনে আছে, এক এম বি বি এস ভদ্রলোক ডাক্তারকে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি করে দুই বৎসর রাখা হয়েছিল। আমার এক ভাগ্নে মেডিকেল কলেজে পড়ত যাকে গ্রেপ্তার করে তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদি করে জেলে রাখা হয়েছিল আমার চোখের সামনে। ওর দিকে আমি চাইতে পারতাম না। দু’একবার জেল পালানো বা জেলের আইন মানে না, মারপিট করে – ডেঞ্জারাস কয়েদিদের রাখা হত যেখানে সেই জেলে তাকেও রাখা হয়েছিল। আমাকেও দুই চারবার এই সমস্ত জেলে থাকতে হয়েছে। তাই রাজবন্দীরা মেডিকাল ডায়েট না পেলে স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু সকল সময় তাদের কপালে তা জুটত না।

হাসপাতালে রাজবন্দীদের ভর্তি করলে তাড়াতাড়ি রোগ ভালো হোক আর খারাপ হোক, সেদিকে খেয়াল না করে তাড়াইয়া দেওয়া হত। ডাক্তাররা ইচ্ছা করলে কয়েদিদের যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। যত রকম রোগ আমরা সাধারণ মানুষ জানি তা জেলখানায় আছে। টিবি রোগীকেও রাখার ও চিকিৎসা করার বন্দোবস্ত জেলের ভেতর করা আছে। ডাক্তারদের থেকেও বেশী চুরি করে একশ্রেণীর কয়েদি – যারা ডাক্তারদের রাইটার। এরা কম্পাউন্ডারের কাজও করে। জেলখানায় ডাক্তাররা ইনজেকশন দেওয়া ভুলে যায়। কারণ কয়েদিদের দিয়েই অধিকাংশ কাজ করাইয়া থাকে। তবে সকল ডাক্তার না। অনেকে আবার খুব পরিশ্রমও করে রোগীদের ভালো চিকিৎসার জন্য।

রাজবন্দীদের সাধারণ কয়েদিদের সাথে রাখা হতনা। এদের জন্য ছোট ছোট জেল আছে ঢাকা ও অন্যান্য জেলে। আবার সকল রাজবন্দীকে এক জায়গায় রাখা হতো না, কোথাও দুইজন, কোথাও পঞ্চাশ জন, কোথাও একশ’ জন এইভাবে রাখা হত। এক স্থানের রাজনৈতিক বন্দীদের সাথে অন্য স্থানের রাজনৈতিক বন্দীদের এক জেলে থেকেও পাঁচ বছরে একবারও দেখা হয়নাই এমন ঘটনাও আছে। পূর্বেই বলেছি, অধিকাংশ রাজনৈতিক বন্দীদের ডিভিশন না দেয়ায় সাধারণ কয়েদিদের যা দেয়া হতো, এদেরও তাই দেয়া হতো।

১৯৫০ সালে সমস্ত রাজবন্দী প্রায় ৬০ দিন অনশন ধর্মঘট করে সরকারের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে। ১৯৫১ কি ৫২ সালেও হতে পারে ঠিক বলতে পারিনা। জেল কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক বন্দীদের উপর বিশেষ করে ক্ষমতা দেখাতে পারেনা। কারণ আইবি – এর হুকুম নিয়ে চলতে হয়। কোথায় কাকে কিভাবে রাখতে হবে তাহাও আইবি বলে দেয়। সেই মত কাজ করতে হবে জেল কর্তৃপক্ষের। যদি কেউ কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে হঠাত দেখবেন তাকে অন্য জেলে পাঠাইয়া দেয়া হইয়াছে।

রাজনৈতিক বন্দীদের সচরাচর এক জেল থেকে অন্য জেলে চালান দেওয়া হয়। ইংরেজ আমলে খাবার ও থাকার বন্দোবস্ত অনেক ভালো ছিল। এমনকি এলাউন্সও দেওয়া হত। মাসে টাকা বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতো সরকার। জেলবন্দীর স্ত্রী বা ছেলেমেয়েদের অথবা তাদের বৃদ্ধ পিতা মাতাদের এখন তো জান বাঁচানোই কষ্টকর। এ নিয়ে জেলখানায় অনেক গোলমাল করার পরে সরকার এদের দুইটা করে গ্রেড দেন। প্রথম দেওয়া হয় গ্রেড ওয়ান, গ্রেড টু। গ্রেড ওয়ান যারা তাদের রোজ দুই ছটাক মাছ, সকালে দুই টুকরা রুটি আর চা। মাখন, ডিম কিছুই দেওয়া হত না।

এখানে আমি বলছি ১৯৫২ সালের কথা। ভাল তরকারিও কিছু দেওয়া হত না।

যারা ডিভিশন কয়েদি তারাও সকালে রুটির সাথে মাখন পেত, কিন্তু আমাদের দেওয়া হত না। ১৫ দিনে একদিন সাক্ষাৎ পাওয়া যেত। সপ্তাহে একটা চিঠি লিখতে দিত। তা আবার আইবি অফিস হয়ে যেত। স্ত্রীর কাছে চিঠি লিখলে আইবি কর্মকর্তারা পড়তেন। প্রেমের চিঠিও তারা পড়ে আনন্দ পেতেন। জেলে থেকে যদি কাউকে কিছু আনন্দ দেওয়া যায় ক্ষতি কি! জেলবন্দীর কাছে লেখা চিঠিতে যদি কিছু রাজনীতি বা ঐ ধরনের কথা থাকত তবে সে চিঠি রাজবন্দীদের দেওয়া হত না; যদি দেওয়া হতো মাঝে মাঝে কালো কালই দিয়ে এমনভাবে মাখাইয়া দেওয়া হত, তা আর পড়ার উপায় থাকত না। এমনকি আমার স্ত্রীর ও বাবার চিঠি অনেকগুলি আছে যার অর্থেক কালো কালি দিয়ে মুছে দেওয়া, বোধ হয় বাবা স্বান্তনা দিয়েছেন অথবা বলেছেন, ‘চিন্তা করিও না।’

আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে স্বাক্ষাতের সময় একজন আইবি কর্মচারি বসে থাকত, আর জেলের পক্ষ থেকেও একজন ডেপুটি জেলার উপস্থিত থাকতেন। মাত্র ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়। এর মধ্যে যাবতীয় আলাপ করতে হবে। কথা আরম্ভ করতেই ২০ মিনিট কেটে যায়। নিষ্ঠুর কর্মচারিরা বোঝে না যে স্ত্রীর সাথে দেখা হলে আর কিছু না হউক একটা চুমু দিতে অনেকেরই ইচ্ছা হয়, কিন্তু উপায় কি? আমরা তো পশ্চিমা সভ্যতায় মানুষ হই নাই। তারা তো চুমুটাকে দোষোনীয় মনে করে না। স্ত্রীর সাথে স্বামীর অনেক কথা থাকে কিন্তু বলার উপায় নাই। আমার মাঝে মাঝে মনে হত স্ত্রীকে নিষেধ করে দেই যাতে না আসে। ১৯৪৯ সাল থেকে ৫২ সাল পর্যন্ত আমার স্ত্রীকে নিষেধ করে দিয়েছিলাম ঢাকায় আসতে, কারণ ও তখন তার দুইটা ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশের বাড়িতে থাকত।

১৯৪৯ সাল থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য একটা মামলা চলে। আমার, শামসুল হক সাহেব, মওলানা সাহেব, ফজলুল হক ও আব্দুর রউফের বিরুদ্ধে। মামলাটা হয় লিয়াকত আলী খান ঢাকা আসলে আমরা একটা শোভাযাত্রা বের করি। শোভাযাত্রা লাঠি চার্জ করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়, আর শামসুল হক সাহেব ও আরও একজনকে গ্রেপ্তার করে। কয়েকদিন পর মওলানা সাহেবকে আর দেড় মাস পরে আমাকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদের জামিন দেওয়া হয়, কিন্তু আমাদের তিনজনকে রাজনৈতিক বন্দী করা হয়। তাই আমাদের জামিন হয় না। আমরা নিরাপত্তা বন্দী হয়ে যাই। যখন সরকারের ইচ্ছা ছাড়বে। বিনা বিচারে বন্দী। মুক্তি পাওয়াটা সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। এক বৎসর মামলা চলল। মাওলানা সাহেব ও হক সাহেবকে মুক্তি দেওয়া হল। আর আমাদের বাকি তিনজনকে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল তিন মাস করে। নিরাপত্তা বন্দিও রইলাম, সাথে সাথে সশ্রম কারাদণ্ডও ভোগ করতে লাগলাম। আপীল করা হল। আমাকে ফরিদপুর পাঠাইয়া দেওয়া হল। হক সাহেব ৭/৮ মাস পরে মুক্তি পান। মওলানা সাহেব ও আমি ছিলাম এক জেলে। আমাদের অন্য রাজবন্দীদের সাথে রাখা হত না। আমরা যদি ওদের সাথে থাকি তবে কম্যুনিস্ট হয়ে যাব – এই হল ভয়। কম্যুনিস্ট রাজবন্দী ছিল বেশি। মওলানা সাহেব একলা রইলেন। যখন বিদায়ের সময় হল মওলানা সাহেব কেঁদে দিলেন। বুঝলাম, বুড়ার মনে ব্যথা।
আমাকে গোপালগঞ্জ চালান দেওয়া হল। কারণ সেখানে একটা মামলার আসামি – সেটা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের। গোপালগঞ্জে পৌঁছে খবর পেলাম, আমার মা-বাবা ও স্ত্রী ঢাকায় আমাকে দেখতে গেছেন। সাবজেলে আমাকে রাখা হল না, কারণ যায়গা নাই, পাঠাইয়া দেওয়া হল ফরিদপুর জেলে। মামলার তারিখ পড়ে গেছে। ফরিদপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হল। আমাকে ভাড়া দেওয়া হত ইন্টার ক্লাসের, নিজের টাকা দিয়ে সেকেন্ড ক্লাস করে নিলাম। সিপাহি বেচারারা কোনোদিন আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে নাই, খুবই আদর করেছে ও ভদ্র ব্যবহার করেছে। যে টাকা পথ খরচ সরকার দিতেন তাতে একবেলা খাওয়া হয়, স্টিমারে আর এক বেলা খাওয়া হত না। তাই নিজের টাকা দিয়ে খেয়ে নিতে হত।

ফরিদপুর জেলে একলা এসে পড়লাম। রাজবন্দীরা আছে। তাদের আলাদা যায়গায় রাখা হয়েছে। আর আমাকে রাখা হয়েছে একলা এক যায়গায়। হাসপাতালের একটা রুম ছেড়ে দিল। সেখানেই থকলাম। প্রথমে হাসপাতাল থেকে খাবার দিত, পরে অন্য নিরাপত্তা বন্দীরা চার পাঁচজন এক যায়গায় থাকত, তারা নিজেদের পাক দেখাশোনা করত। আমাকে পরে সেখান থেকে খাবার আনাইয়া দেওয়া হত। আমাকে ফরিদপুর জেলায় আনার পরে কাজ দেওয়া হল, সুতা কাটা, কারণ এখন আর আমি রাজবন্দী নই, কয়েদি। সুতা কাটতে হত। আর কয়েদিদের কাপড় পড়তে হত। তিন মাস খেটে ফেললাম, আমারও সাজা খাটা হয়ে গেল। আবার রাজনৈতিক বন্দী হয়ে গেলাম।

কিছুদিন পরে খবর পেলাম আমি আপিলে খালাস হয়ে গেছি। সাজাও খাটা হয়ে গেছে, আবার আপিলেও খালাস হলাম। এত কথা লেখার দরকার হত না। একই জেলে আরও রাজবন্দী আছে, তারা এক ঘরে থাকে, তাদের সামনেই পাক হয়। আর আমাকে একই জেলে একাকী থাকতে হচ্ছে। দোষ কি জানি না। জেলের আইন ভঙ্গ করি নাই, তবুও একাকী থাকতে হচ্ছে।

তবে মাসে শুধু একবার গোপালগঞ্জ যেতে হয় ফরিদপুর থেকে। স্টিমার, নৌকা, গাড়িতে বেশ একটু খোলামেলা বাতাস খাইতাম। যদিও কথা বলা নিষেধ, তবু আসসালামুআলাইকুম তো নিষেধ না। আমাকে কিছু কিছু মানুষ চিনত। তাই সকল যায়গায়ই কিছু চেনাশোনা মানুষ পাওয়া যেত, আসসালামু আলাইকুম করেই শেষ করতাম। তা না হলে সিপাহিদের চাকরী যাবে।
কারণ আইবিও কর্মচারি আছে।

একবার আমাকে কে যেন মিষ্টি দিয়েছিল মাদারীপুর স্টেশনে। সেই মিষ্টি কেন আমি খেলাম তাতে সিপাহিদের কৈফিয়ত দিতে জান সারা হয়ে গেছে। একজন নাকি সাসপেন্ড হতে যাচ্ছিল, হাত পাও ধরে বেঁচে গেছে তাই ওদের জন্য কারো সাথে আলাপ করতাম না। যদি কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করত বলতাম, ‘আমি কয়েদি, কথা বলা নিষেধ।’ আমার জন্য ওদের ক্ষতি হবে কেন!

আইন দফা – জেলে একটা আইন দফা ছিল। এইটাই হল সকলের চেয়ে কষ্টকর দফা। একটু মেজাজ দেখানো কয়েদি হলেই, সাজা দেওয়ার জন্য আইন দফা পাশ করা হত। এদের গরুর মত ঘানিতে ঘুরতে হত। আর একটা পরিমাণ ঠিক ছিল, সেই পরিমাণ তেল ভেঙ্গে বের করতে হত। পিছনে আবার পাহারা থাকত, যদি আস্তে হাঁটত অমনি পিটান।

এটা ইংরেজ আমলেই বেশি ছিল, তবে পাকিস্তান হওয়ার পরে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে। সেন্ট্রাল জেলে এটা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে; তবে জেল ও সাবেজেলে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত চলে। শক্তিশালী লোকগুলি ঘানি টেনে এক বছরের ভিতর এত দুর্বল হয়ে পরত যে সে কথা কী বলব!

আমি যখন ফরিদপুর জেলে যাই তখন দেখতে পেলাম মানুষ দিয়ে ঘানি ঘুরাইয়া তেল বাহির করা হয়। একদিন জেলার সাহেবকে আমি বললাম, ‘সরকার হুকুম দিয়েছে কয়েদি দিয়ে ঘানি ঘুরানো চলবে না, আপনার জেলে এখনো চলছে কেন?’ তিনি বললেন, ‘২/১ দিনের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে, গরু কিনতে হুকুম দেওয়া হয়েছে। উপরে লিখেছি, অনুমতি এলেই কয়েদিদের পরিবর্তে গরু দিয়ে করা হবে।’ সত্যই জেলার সাহেব আমি থাকতেই বন্ধ করে দিলেন। না দিলে হয়ত আমার প্রতিবাদ করতে হত অথবা সরকারের কাছে দরখাস্ত করতে হত।

একটা লোক ঘানি ঘুরাতে ঘুরাতে অসুস্থ হয়ে একবার হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে কষ্টের কথা আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। সে বলেছিল, ‘হুজুর দিনভর গরুর মত ঘুরে রাতে যখন শুতে যাইতাম তখনো মনে হয় ঘুরছি, ঘুমাতে পারতাম না, দেখেন সেই যে শরীর নষ্ট হয়ে গেছে আর ভালো হয় নাই। খোদা আপনাকে বাঁচাইয়া রাখুক, আপনি জেলে না আসলে আর কতদিন যে গরুর মত ঘুরতে হত বলতে পারিনা।’

জেলখানায় কথা এক মিনিটে প্রচার হয়ে যেত।

ডালচাকি দফা – ডালচাকি দফা নামে একটা দফা আছে। এদের ডাল ও গম ভাঙতে হয়। আজও আছে একটা। ডাক্তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে দেয়। যাদের ‘good’মার্কা স্বাস্থ্য তাদের রোজ এক মণ করে ডাল ভাঙতে হয়, আর যাদের স্বাস্থ্য ‘মিডিয়াম’ তাদের আধামন ডাল রোজ ভাঙতে হয়। গমও ভাঙতে হয়। প্রত্যেকের রোজ দশ সের করে গম ভাঙতে হয়।

হাজতি দফা- এখানে হাজতিদের রাখা হয় – যাদের জামিন হয় নাই, মামলা চলছে। ঢাকা জেলে তিন তলা একটা দালানে এদের রাখা হয়। ছয়টা রুম আছে। কোণ লোক যখন হাজতে থাকে – যার মামলা চলতে থাকে, তখন সমস্ত রাত কারো ঘুমাবার উপায় থাকেনা। রাত ভরে নামাজ, জেকের, মিলাদ। তজবি জপে ‘আল্লাহু, আল্লাহু’ করতে থাকে।

১৯৪৯ সালে আমাকে গ্রেপ্তার করে সকালে জেলে এনে হাজতে রাখল, কারণ আমাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। আরও কয়েকজন রাজবন্দী ছিল নীচের একটা রুমে। তাদের কাছে আমাকে রাখা হল। আরও হাজতি ছিল সেই রুমে। খাবার দিল ডাল, একটা তরকারি, আর ভাত – কি আর করা যাবে, খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম – খেয়ে নিলাম। যা পাক করেছে, তেলের গন্ধ, ময়লা – বিশেষ করে চাউলের ভিতর কাঁকর, ডাল দিয়ে চারটা মুখে দিলাম। জান তো বাঁচাতে হবে।

দুপুর বেলা দেখা এক মওলানা সাহেবের সঙ্গে, কোরানে হাফেজ, তাঁর বাবাও খুব বড় পীর ছিলেন, কুমিল্লায় বাড়ি। হাজতিদের মধ্যে নামাজ পড়বার আগে বক্তৃতা করছেন, ওয়াজ করছেন, হাজতিরা বসে শুনছে। আমি দূরে দাঁড়াইয়া তাঁর বক্তৃতা শুনছি। তিনি বলছেন খুব জোরে, ‘দুরুদ শরিফ’ পড়। শয়তান দূর হয়ে যাবে। জোরে পড়। অনেকক্ষণ বক্তৃতা করলেন; সুন্দর চেহারা, অল্প বয়স, চমৎকার বলার কায়দা। তবে জামাটা খুব বড়। ঐটা দেখেই মনে সন্দেহ হল। একদম পা পর্যন্ত জামা। বোধ হয় ছয় সাত গজ হবে কমপক্ষে। তজবি হাতেই আছে। মাঝে মাঝে চক্ষু বুজে কথা বলেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই মওলানা সাহেব কি মামলায় এসেছেন।’ আমাকে এক ‘পাহারা’ বলল, ‘জানেন না, ‘রেপ কেস’; একটা ছাত্রীকে পড়াতো তার উপর পাশবিক নির্যাতন করেছে, মসজিদের ভিতর। মেয়েটার ১২/১৩ বৎসর বয়স, চিৎকার করে উঠলে লোক এসে দেখে ফেলে। তারপর ধরে আচ্ছামত মারধর করে। জেলে এসে কয়দিন তো হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে। আমি বললাম, ‘হাজতে এসে ধর্ম প্রচার শুরু করেছে।’ বেটা তো খুব ভণ্ড। জমাইছে তো বেশ।

সন্ধ্যার পরে আমাদের তালাবদ্ধ করে দিয়েছে। আমাদের উপরের কোঠায় সেই হাফেজ সাহেব থাকতেন। মগরেবের নামাজের পর চলল তার ‘মিলাদ’। অনেকক্ষণ, তারপর দুরুদ, তারপর চলল কোরআন তেলাওয়াত। তিনি যে কোরআনে হাফেজ সেটাই দেখাতে ব্যাস্ত আছেন বলে আমার মনে হল। মামলায় তার চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। তিনি দরখাস্ত করেছিলেন ডিভিশন পাওয়ার জন্য। যদিও তার গ্রামের রিপোর্টে জানা গিয়েছিল তিনি সন্মানি ঘরের থেকে এসেছেন। তবে তাকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই – কারণ তিনি পাশবিক অত্যাচারের অপরাধে অপরাধী।

ফরিদপুর থেকে ফিরে এসে দেখলাম হাফেজ সাহেবকে ডিভিশনের কয়েদিরা এনেছেন তার কাছে কোরআন পড়তে। আমার সাথে আলাপ হল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এমন একটা কাজ করলেন ছাত্রীর সাথে, তাও আল্লাহর ঘর মসজিদের ভিতর।’ তিনি বললেন, ‘মিথ্যা মামলা। একাজ আমি কোনোদিন করতে পারি!’ তবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বেশি কথা বলে ধরা পড়ে গিয়েছিলেন আমাদের কাছে। অনেক মওলানা সাহেব মুরিদানের বাড়িতে বেশি মুরগির গোসত খান। তাই শক্তিও বেশি, এজন্য এক বিবাহতে হয়না, তিনটা চারটা বিবাহ করেন। এটা এদের অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক। কারণ কাজ কর্ম করতে হয়না, ভিক্ষার টাকাতেই সংসার করেন, তাই তাকত বেশি। আবার অনেক মওলানা মৌলবী সাহেবরা আছেন যারা কাজ করেন, পরের জন্য দেওয়া অর্থ কড়ি নেন না, আর বিবাহও একটা করেন। কারণ তাদের মন পবিত্র।

ছোকরা দফাঃ জেলখানায় আরেকটা দফা বড় ভয়ানক ব্যাপার। সেটা হল ছোকরা দফা। অল্প বয়সের কয়েদি ও হাজতিদের এক যায়গায় রাখা হয়, আলাদা করে। সাধারণ কয়েদিদের কাছে রাখতে দেওয়া হয়না। খুব কড়াকড়ি করা হয়। ছোকরাবাজি জেলে বেশি হয়। অনেকে ২০, ১০, ১২, ৫, ৭, ৪, ৩ বৎসর জেল নিয়ে আসে। নওজোয়ান অনেক থাকে, নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে এই সমস্ত কুকর্ম করে বেড়ায়। রীতিমত টাকাপয়সা খরচও করে এবং ছোকরা রাখে।

জোগাড় করে ছোকরাদের ভালো ভালো জিনিস খাওয়ায়। ছোকরাবাজিতে ধরা পড়লে খুব অপমানও করা হয়। একবার একটা ঘটনা আমার মনে পড়ে। একটা লোক ছোকরাবাজিতে ধরা পড়ে। তাকে কয়েদিরা মুখে কালি, গলায় জুতার মালা আর একজন লাঠি নিয়ে মারতে মারতে সারা জেল ঘুরিয়ে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে নিয়ে আসে।

লোকটা উপরের দিকে চাইছেনা, আমি তো প্রথমে বুঝতে পারিনাই – পরে জিজ্ঞাসা করলে একজনে বলল সমস্ত ঘটনা। বলল এতো কিছুই না, আরও অনেক মার ওর কপালে আছে। এবিষয়ে কড়াকড়িও খুব বেশি, একাজ তা সত্ত্বেও চলে বেশি। তাই ছোকরা চাইলে সহজে কাউকে দেওয়া হয়না। মেট পাহারা সিপাহিরা কড়া নজরে রাখে।
আমরা যেখানে থাকতাম কিছুদিন আমাদের ঘরের পাশের ঘরে ছোকরাদের রাখা হত। দিনে আমরা যেখানে বেড়াতাম সেখানেই ওরা বেড়াতো। ৬ বৎসর থেকে ১৫ বৎসর বয়স পর্যন্ত অন্ততপক্ষে তখন প্রায় ৫০ জন হাজতি কয়েদি ছিল। ছোট ছোট ছেলে ডাকাত বা চোরের দলে ‘খোঁজারু’ ছিল। এরা কারো বাড়িতে যেয়ে খোঁজ নিয়ে আসত। এদের ট্রেনিং দেওয়া হত। কারো বাড়িতে চাকর থাকত, কয়েকদিন পরে পালাইয়া যেয়ে সমস্ত খোঁজ খবর দিত চোরের দলকে। আবার অনেকগুলি আছে পকেটমার। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। একটা ৮ বছরের ছেলে পকেট মারার জন্য তিনবার জেলে এসেছে। কিছুদিন জেল দেয়, ছোট ছেলে বলে ছাড়া পায়, তারপর আবার বাইরে যেয়ে পকেট মারে। পকেট মাড়ের বড় দল আছে। ভাল ভাল শিক্ষিত অর্থশালি সর্দারও আছে। পকেট মেরে নিয়ে এক যায়গায় ভাগ হয়। আবার কেহ কেহ একলাই করে।

একটা ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, ‘হুজুর কি যে বলেন, একদিনে আমার ব্যয় হয় ১০/১৫ টাকা, আমি কেন আরেকজনের বাড়িতে কাজ করব। তার চাইতে ভাল একটা দান মারব, থানায় কিছু দেব, চুপ হয়ে যাবে। যদি হাতেনাতে ধরা পড়ি তবেই তো বিপদ। পকেটমারের আর কয়দিন জেল হয়?’ এই সমস্ত ছেলেরা একবার জেলে আসলে এদের জেলের ভয় ভেঙ্গে যায়। অনেক বুড়োলোক বহুদিন জেলে আছে, ছোট ছোট ছেলেদের দেখলে বোধ হয় তাদের নিজের ছেলেদের কথা মনে পড়ে, তাই এদের অনেককে খুব আদর করে, না খাইয়ে খাওয়া। এদের স্নেহ পিতৃস্নেহ। জেলে আসলে অন্য পকেটমারদের বা ডাকাতদের কাছে থেকে বেশ ট্রেনিং পায়, বাইরে যেয়ে আরও বড় ডাকাত হয়। জেল দিয়ে লোকের চরিত্র ভাল হয়েছে বলে আমি জানিনা।

একবার জেলে আমি শুয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছি। আমি একলা থাকতাম, অন্য রাজবন্দীদের আমার সাথে রাখা হত না। একটা ঘরে যাকে দেওয়ানি বলা হয় – সেখানে আমি থাকতাম। আমার দেখাশোনা ও পাক করার জন্য দুইজন কয়েদি ছিল। একজনের নাম নবাব আলী, গ্রাম- সংকর, পোঃ- বোয়াইল, থানা- ধামরাই, জিলা- ঢাকা। আর একজনের নাম হোসেন খা, গ্রাম – সরাকাঠি, পোঃ-শ্যামপুর, জিলা- বরিশাল। প্রথমজনের ১০ বৎসরের আর দ্বিতীয়বার ৭ বৎসরের জেল হয়েছে খুনের মামলায়। বাইরে কাজ করছে। সিপাহি বলে পাহারা দিচ্ছে বাইরে।

এটা ১৯৪৮ সালের ঘটনা, বোধ হয় ডিসেম্বর মাস। হঠাত একজন ‘কয়েদি পাহারা’ আমার পা জড়াইয়া ধরে শুধু বলছে ‘আমাকে বাঁচান। আমাকে মেরে ফেলল।’ আমার কাছে কোণ কয়েদির রাখার বা কথা বলার হুকুম নাই। আমি হঠাত চমকাইয়া উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ব্যপার! তুমি এখানে কি করে এলে? কি হয়েছে বলো।’ সে কাঁপছে আর বলছে, ‘একজনকে মেরেছি, এখন আমাকে ধরে নিয়ে মারবে।বিচারে যে শাস্তি হয় তাতে আমার আপত্তি নাই, তবে আমাকে না মারে।’ এর মধ্যে সিপাহি ছুটে এসে একে ধরে ফেলেছে। মেট, পাহারা, জমাদার সকলে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথায় পালালো। পরে ওকে ধরে নিয়ে গেল কেস টেবিলে। সেখানে সুবেদার আছে, আমি বলে দিলাম জমাদারকে ওকে যেন না মারা হয়। কারণ ও যখন চলে এসেছে আমার কাছে আশ্রয় নিতে, ওকে মারবেন না। জমাদার, সিপাহি, মেট ‘পাহারা’ আমার কথা শুনল।
এর মধ্যে দেখি একজন কয়েদিকে ৫/৬ জন কয়েদি ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। ভীষণভাবে জখম হয়েছে। কয়েদিটা ঘুমাইয়া ছিল। সে অন্য যায়গায় কাজ করত তাকে লোহার একটা লাঠি দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায়ই মুখে আঘাত করে, একটা দাঁত পড়ে যায়, আর কতগুলি নড়ে যায়। আর যে এসে আমার পাধরেছে, যে মরলো তার নাম হল আলী হোসেন। বিশ বৎসর সাজা, যাকে বলা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায় আর যাকে মেরেছে তার নাম হল মাহাতাব, বাড়ি ঢাকা।

এদের মধ্যে গোলমাল চলছে বহুদিন থেকে, কারণ দুইজনই একজন ছোকরা কয়েদিকে পছন্দ করত। আলী হোসেন ছোকরাটাকে সকল সময় যত্ন করত, খাওয়াতো। বিড়ি দিত। কিন্তু ছোকরাটা মাহতাবাবের কাছেই থাকত। ওর কাছে বেশি যেতো, খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলেই চলে যেত মাহাতাবের কাছে। রাতেও মাহাতাব যেখানে পাহারা দিত সেখানেই ও থাকত। তাই রাগ হয়ে মাহাতাব যখন ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছিল ওর নিজের যায়গায় তখন অন্য যায়গা থেকে আলী হোসেন সিপাহি জমাদারদের ফাঁকি দিয়ে সেখানে যেয়ে মেরে এক দৌড়ে পালাইয়া আমার কাছে চলে আসে। ধরা পড়লে বেশ ‘ধোলাই’ করা হতো। ধোলাই কথা ব্যবহার হয় জেলখানায়; বেশ মতো যাকে মারা হয় তাকে এক কথায় ‘ধোলাই’ করা বলে। এই রকম অনেক ঘটনাই জেলে ঘটে থাকে।
ঢাকা জেলে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার কয়েদি আছে।
১৯৫০ সালে যখন জেলে ছিলাম তখন একজন কয়েদির সাথে আলাপ হয়। নাম তার লুদু ওরফে লুতফর রহমান। ঢাকা শহরের লুতফর রহমান লেনে তার বাড়ি। আমি তাকে ১৯৫৪ সালে দেখে যাই, আবার যখন ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারি হয় এবং আমাকে গ্রেপ্তার করে – জেলে এসে দেখি লুদু আছে। সে নিজেকে সকলের চেয়ে সিনিয়র কয়েদি হিসেবে জাহির করত এবং দাবীও করত। জেলের সাধারণ আইন কানুন তার কণ্ঠস্থ ছিল। কথায় কথায় আইন ঝাড়তো। তার মতের বিরুদ্ধে কিছু হলেই সে সুপার ও জেলার সাহেবের কাছে নালিশ করত। সে ‘বি-ক্লাশ’ কয়েদি ছিল। সাধারণ কয়েদিরা তাকে ভয় করে চলত। কারণ সে খুব সাহসী, সহজে কাউকে মানত না। আমি যেখানে থাকতাম সেখানে সে পানি দিত ও ঝাড়ু খাতায় কাজ করত। একজন জেল ওয়ার্ডার আমার ওখানে ডিউটি দিত। লোকটা অমায়িক ও ভদ্র, নাম তার কদের মিয়া। সে লুডুকে বলত, ‘লুদু ভালো হও, আর চুরি করো না।’ আমি ঘরে বসে বই পড়তাম, তাদের কথা ভেসে ভেসে আমার কানে আসতো। আমি তাদের আলাপ চুপচাপ করে শুনতাম।

লুদুকে আমি ডেকে বললাম, ‘লুদু, তোমার জীবনের ঘটনাগুলি আমাকে বলবা।’ লুদু বলল, ‘হুজুর আমার জীবনের কথা নাই বা শুনলেন, বড় দুঃখের জীবন। প্রায় ২০ বৎসর আমার জেলখানাতে হয়েছে। ১৩ বৎসর বয়স থেকে চুরি ও পকেট মারতে শুরু করেছি। কেন যে করেছিলাম আজও জানিনা। তবে মাঝে মাঝে ভাবি, কেন এই পথ বেছে নিয়েছিলাম। জীবনটা দুঃখেই গেল। বোধ হয় জীবনে আর শান্তি হবেনা। চোর ও পকেটমারের জীবনে শান্তি হয়না।’ লুদু বলতে বলতে চোখের পানি ফেলেছিল, বোধ হয় অনেক দুঃখের কথা তার মনে ভেসে এসেছিল।

লুদু বলতে লাগল, আর আমি ঘটনাগুলি লিখতে শুরু করলাম। একটা সামান্য চোরের জীবন আমি কেন লিখছি – এ প্রশ্ন অনেকেই আমাকে করতে পারেন। আমি লিখছি এর জীবনের ঘটনা থেকে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন, তারা বুঝতে পারবেন আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর, ডাকাত, পকেটমার হয়। আল্লাহ কোন মানুষকে চোর, ডাকাত করে সৃষ্টি করেনা। জন্মগ্রহণের সময় সকল মানুষের দেল একইভাবে গড়া থাকে। বড়লোকের ছেলে ও গরিবের ছেলের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকেনা, যেদিন জন্মগ্রহণ করে। আস্তে আস্তে এক একটা ব্যবস্থায় এক একজনের জীবন গড়ে ওঠে। বড়লোক বা অর্থশালীর ছেলেরা ভালো খায়, ভালো পরে, ভালো শিক্ষা পায়। আর গরিবের ছেলেরা জন্মের পরে যে অবস্থা বা পরিবেশে বেড়ে ওঠে এবং যাদের সাথে মেলামেশা করে তাদের স্বভাব চরিত্রই তারা পায়।

লুদুর বাবার অবস্থা নেহাত খারাপ ছিলোনা। খেয়ে পরে সুখেই ছিল। কিন্তু সাতটা বিবাহ করে এবং বহু ছেলেমেয়ে জন্ম দেয়। সাথে কিছু বদ অভ্যাসও ছিল – মদ, তাড়ি খেয়ে টাকা উড়াইতো। তারপরে যাহা বাঁচতো রবিবার পকেটে করে ঘোড় দৌড় খেলায় তাহাও শেষ করে ফতুর হয়ে আসত। এইভাবে আস্তে আস্তে সংসার ভেঙ্গে পড়তে লাগল। অভাব অভিযোগ দেখা দিল। লুদুর মা ছিল তার বাবার প্রথম স্ত্রী। এরা চার ভাইবোন ছিল। অন্য পক্ষেরও আরও নয়জন ছেলেমেয়ে ছিল। ফলে সংসারে ভীষণভাবে অভাব দেখা দিল।

লুদুর বড় ছিল এক ভাই, সে রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়েছিল। যা কিছু উপার্জন করত নিজেই ব্যয় করত, আর বাবার কিছু গুণও পেয়েছিল। ঘোড় দৌড়, জুয়াও শুরু করল।

লুদুর বাবা অন্য বিবাহ করার জন্য তার মাকে দেখতে পারত না। তাই বাধ্য হয়ে লুডু মাকে নিয়ে আলাদাভাবে বাস করতে লাগল। সেই সময়ে লুদুকে দর্জির কাজ শিক্ষা করার জন্য ওর বড় ভাই এক দর্জির দোকানে দিল। প্রায় এক বছর থাকার পর ওর বাবা তাকে ফিরাইয়া আবার রাজমিস্ত্রির সাথে জোগালির কাজ করতে দিল। একাজে যা কিছু পেত তাতে সংসার চলত না।

ঐ সময় ওর বাবার মৃত্যু হল, বড়ভাই সংসারের মালিক হল। লুদু লেখাপড়া শিখতে চায়। তাই বড় ভাইকে বলল তাকে স্কুলে দিতে। কিন্তু বড় ভাইয়ের সংসারে টানাটানি। তার টাকার প্রয়োজন। ওদের ওপর অত্যাচার করতে লাগল। বাধ্য হয়ে একদিন লুদু ও তার ছোট ভাই বাড়ি ত্যাগ করে নানার বাড়ি চলে গেল। নানাবাড়িও ঢাকা শহরে। নানার বাড়িতে খাঁয় আর ঘুরে বেড়ায়। এই সময় সে দেখত একদল যুবক চাখানায় চা খাঁয়, আড্ডা মারে, জুয়া খেলে, দুই হাতে টাকা উড়ায়।

ওর নানার বাড়ীর পাশেই একটা যুবক চুরি করত। তার নাম গোপাল। গোপালের সাথে লুদুর পরিচয় হয়। তার সাথে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেত। সে লুদুকে বলল, ‘কি করিস, তুই আমার সাথে কাজ করলে তোর বেশ কিছু টাকা পয়সা হবে।’ লুদুকে সকল কথা গোপাল খুলে বলল। একদিন ঠিক হল গোপাল ওকে নিয়ে রাতে চুরি করতে যাবে। ভয় পেলে চলবে না। যা বলবে তাই করতে হবে। এইভাবে মাঝে মাঝে গোপালের সাথে চুরি করত। গোপাল ওকে কিছু কিছু টাকা দিত। বেশ ব্যয় ট্যায় করত চা সিগারেট খাইতে, দু একখান ভালো কাপড়ও পরতো। কিছুদিন গোপালের সঙ্গে চুরি করার পর বোধ হয় ১৩/১৪ বৎসর বয়সে নিজেই একদিন চুরি করতে লোভ হল। একলাই চুরি করব, তবে সকল টাকা একারই হবে। প্রথমে চুরি বেশ সুন্দরভাবে করে আসতে লাগল। সাহস বেড়ে গেল। এইভাবে তিনমাস পর্যন্ত মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে একলাই চুরি করত। কিছু টাকা যখন লুদুর হাতে এল তখন সে তার ছোট ভাইকে স্কুলে দিল।

এইসময় একবার চুরি করতে যেয়ে ধরা পরে গেল। বেশ কিছু উত্তম মধ্যম দিয়ে থানায় দেওয়া হল। দারোগা সাহেব হাজতে পাঠাইয়া দিয়া একটা মামলা দায়ের করলেন। প্রায় তিন মাস হাজত খাটতে হল। এই সময় লুদুর সাথে অনেক পুরনো চোরের পরিচয় হয় এবং তাদের কাছ থেকে চুরির নতুন নতুন ফন্দিও কিছু শেখে। ম্যাজিস্ট্রেট লুদুর বয়স বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দিতে রাজি হলেন। শর্ত হল, যদি লুদুর বড় ভাই একশ টাকার জামিন হয়, এক বছরের মধ্যে যদি আর কোন চুরি বা খারাপ কাজ না করে তবে তাকে ক্ষমা করা হবে। লুদুর বড় ভাই তার মায়ের কান্নাকাটিতে রাজি হয়ে একটা বণ্ড লিখে দিয়ে ওকে খালাস করে নিয়ে যায়।

কয়েক মাস ভালো থাকার পর, আবার চুরি করতে আরম্ভ করে। কারণ, টাকার তার প্রয়োজন। দুই তিন মাস পর আবার চুরি করতে যায়। জেলের এক চোরের সাথে তার আলাপ হয়েছিল, সে খালাস পেয়ে লুদুকে নিয়ে চুরি করতে যেয়ে হাতে নাতে ধরা পরে যায়। এইবার লুদুর নয় মাস কারাদণ্ড হয়।

জেলখানায় ছোট ছোট ছেলেদের কয়েদিরা খুব ভালোবাসে। অনেকে নিজের ছেলে মেয়েকে ফেলে আসে তাই পিতৃবাৎসল্য জেগে ওঠে। ছোট ছোট ছেলেদের দেখলে এরা না খাইয়ে সেই বাচ্চাদের খাওয়ায়।

আর একদল – যারা ছোকরাবাজ তারাও এদের পেছনে লাগে। ভালো ভালো জিনিস জোগাড় করে খাওয়ায়। বিড়ি তামাকের অভাব হয়না। জঘন্য লোকগুলো এই ছেলেগুলিকে খারাপ করে ফেলে।

জেলে নয়মাস লুদুর কোনো কষ্ট না হওয়াতে তার মনে ধারনা হলো যে, জেল তো কিছুই না। এখানে আসলে আরামই পাওয়া যায়। সাথে সাথে পেশাদার চোরদের কাছ থেকে অনেক রকমের চুরির ফন্দি সে শিখে নেয় এবং দল সৃষ্টি করে। বাইরে এসে সকলে এক হয়ে চুরি করে। যখন নয় মাস পরে খালাস হলো, তাকে পুলিশের নজরে রাখার জন্য এক বৎসরের হুকুম হলো। প্রতি রাতে ১২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত পুলিশ তাকে ডেকে দেখতো সে ঘরে আছে কিনা।

জেলখানায় আসার আগে কি করে পকেট মারতে হয় তা সে শিখে এসেছিল। রাতে যখন পুলিশ তার ঘরে পাহারা দেয়, তখন দিনেই পকেট মারা ভালো মনে করলো সে। লুদু পকেট কাটতে শুরু করলো। প্রায় পাঁচ মাস এইভাবে চলল। এই সময় একদিন পুলিশ এসে তাকে থানায় ডেকে নিয়ে বলল, ‘তুই কি করিস সে খবর রাখি; তোকে এবার ধরতে পারলে জেল দেওয়াব তিন বছরের জন্য আর বেতের বাড়ি তোর খেতে হবে। তুই কেন আমার সাথে দ্যাখা সাক্ষাত করিস না’, তখন বুঝতে পারলো সে কিছু দিতে হবে।
একদিন পকেট মেরে বেশ কিছু টাকা পেয়ে লুদু ভাবল দেখা যাক দারোগা সাহেব কি করেন। বাজার থেকে বড় একটা মাছ, কিছু পটল, কিছু আলু, আর দশটা টাকা নিয়ে দারোগা সাহেবের বাসায় চাকরকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘সাহেব বাড়ি আছে কি না?’ সে উত্তর দিল ঘরে আছে। ‘তাকে বল যে লুদু আসছে দেখা করতে। লুদু – সেই লুৎফর রহমান লেনের পকেটমার।’ দারোগা সাহেব বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কি জন্য আসছিস, এইগুলা আবার কি?’ লুদু দেখলো, দারোগা সাহেব খুশি হয়েছেন। লুদু বলল, হুজুর সামান্য জিনিশ এনেছি, গরিব মানুষ কোথায় পাবো! দারোগা তার চাকরকে বলল, এগুলো ভেতরে নিয়ে যাও। দশটা টকাও লুদু দিল। টাকা পকেটে রেখে দারোগা বললেন, ‘বোধহয় ভালো দান মেরেছ, তা মাত্র দশ টাকা কেন? বেশী কিছু দেও।’ লুদু বলল, ‘সামান্যই পেয়েছিলাম, আমার দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। মাঝে মাঝে কিছু দেবার চেষ্টা করব।’ দারোগা সাহেব বললেন, ‘সপ্তাহে কত দিবি বল?’ লুদু বলল, ‘তা কেমন করে বলব, কিছু মারতে পারলেই আপনার জন্য নিয়ে আসব।’ দারোগা সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে, তবে হাওালাদার, সিপাহিদের দেওয়ার জন্য সপ্তাহে ১০ টাকা দিবি। আর চুরি করলে, তার কিছু ভাগ আমাকে দিয়ে যাবি। কারণ খবর আমার কাছে আসবে। তোকে আর রাতে ডাকা হবে না, কাজ চালাইয়া যা।’ দারোগা হাওালাদারকে বলে দিল আমাকে আর রাতে ডাকাডাকি না করতে। আমি রাতে চুরি করতাম, আর দিনে পকেত মারতাম। বেশ টাকা পয়সা আমার হাতে আসতে লাগল। জুয়া খেলা, তাড়ি খাওয়াও শুরু করলাম।

এইভাবে মাত্র পাঁচ মাস কাটালাম। হঠাৎ একদিন পকেট মারতে যাই রেলওয়ে স্টেশনে। রেলওয়ে যে জি আর পি পুলিশের আন্ডারে একথা আমি তখন জানতাম না। এদেরও যে হাত করতে হয় এ ধারনা আমার ছিল না। আমি পকেট মারতে যেয়ে ধরা পড়ে গেলাম টাকা সমেত। আমাকে জিআরপি অফিসে নিয়ে খুব বানানো হলো। তারপরে বলল, ‘নতুন বুঝি পকেট মারিস, কোনো খবর টবর রাখিস না।’ একজন পুলিশ এসে আমাকে বলল, ‘তোর বাড়ি কোথায়? টাকা খরচ করতে পারবি?’ লুদু বলল, কিছু তো পারি, যদি বলে।’ পুলিশটা ১০০ টাকা চাইলো দারোগা সাহেবের জন্য, আর নিজের জন্য পচিশ টাকা। লুদু তাকে বললো, অত টাকা তো ঘরে নাই, তবে ৭০ টাকা দারোগা সাহেবকে দেন, আর আপনি ২০ টাকা নেন। রাজি হলো, আমি আমার ছোট ভাইয়ের ঠিকানা দিয়ে থানার ঐ সিপাহিকে পাঠালাম। সিপাহি আমার ভাইকে নিয়ে হাজির হলো। দারোগা সাহেবকে টাকা দিলে তিনি সিপাহিকে কি যেন বলে বিদায় দিলেন। একটু পরে আমাকে ছেড়ে দিলেন।
এইভাবে জিআরপি পুলিশকে হাত করলাম। রোজ পকেট মারতাম। সকালে স্টেশনে, জিআরপিকে ভাগ দিতাম। আর বিকালে পকেত মারতাম সদরঘাট, তার ভাগ দিতাম কোতওয়ালী থানায়। এইভাবে দুই বৎসর চলল।
এর মধ্যে একটা বাসে পকেত মারতে চেষ্টা করেছি, দেখি এক ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে আছে; আমি হাত টান দিয়ে নিয়ে এলাম। ভদ্রলোক আমাকে চোখ ইশারা দিল পকেট মারতে। প্রথম ধকল যখন কেটে গেল তখন আবার পকেট মারলাম। আমি যখন নামলাম ঐ ভদ্রলোকও দুইজন লোক নিয়ে নামল। আমি তাদের নিয়ে এক রেস্টুরেন্টে গেলাম। পকেট মেরে খামের মধ্যে ৭০০ টাকা রেখেছিলাম, আমি হাত সাফাই করে সরাইয়াছিলাম ৪০০ টাকা, খামের মধ্যে থাকল ৩০০ টাকা। লুদু বলল, এই দুই ভদ্রলোক তাকে বলেছিল, এরা সিআইডি। টাকা ভাগ হলো, লুদুর ১০০, আর ওদের ২০০। কথা ঠিক হলো এইভাবে বাসে গাড়ীতে পকেট মারবে, আর এরা লুদুকে বাঁচাইয়া দিবে। লুদু যখন পকেট মারত এরা প্রায়ই তার সাথে থাকত। কয়েকবার ধরা পড়েছে, এরা বলে কয়ে ছাড়াইয়া দিয়াছে। ‘মাইরের হাত থেকেও আমাকে অনেকবার রক্ষা করেছে। এভাবে সিআইডি অফিসেও আমার হাত হয়ে গেল। আমি বেপরোয়াভাবে পকেট মারা ও চুরি করা শুরু করলাম। লুদু বলল, এই সময় আমি লোহারপুলের কাছে সূত্রাপুর বাজারে পকেট মারতে চেষ্টা করায় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হই। সূত্রাপুর থানায় আমি কিছু দেই নাই, দিলেও বোধহয় কোন উপায় ছিল না। কারণ যাদের হাতে ধরা পড়েছি তারা বাইরের লোক। এই কেসে তিনমাস হাজতখানায় খাটার পর আমার দেড় বছরের জেল হয়।

আমি জেলে এসে এবার ভালইপাকা হলাম। গলার ভিতর ‘খোকড়’ বা ভান্ডার করা শিখলাম। পেশাদার ডাকাত, চোরদের গলায় একপ্রকার গর্ত করা থাকে; এরা গলার ভিতর ডাক্তার দিয়ে অপারেশন করে খোকড় করে। এই খোকড়ে ৫/৭ টা মোহর অথবা ৮ থেকে ১০ টা গিনি একসাথে রাখা যায়। কাঁচা টাকা প্রায় ৭-৮ টা এক সাথে রাখা যায়। এমনকি ১০০ টাকার নোট সিগারেটের কাগজ দিয়ে মুড়ে দুই তিনখানা একসাথে রাখা যায়। না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না। এরা টাকা রাখে কারণ, জেলে এসে সিপাহি জমাদারদের টাকা দিয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। এরা গাঁজা, আফিম, চরস সরাব সবকিছু কিনে এনে খায়। এই টাকা খরচ করে জেল কর্তৃপক্ষের কর্মচারীদেরও মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়।
চোর-ডাকাতকে যেখন থানায় থানায় মারপিট করে তখন একখানা গিনি বের করে দিলে আর মার খেতে হয় না। জামিনও পাওয়া যায়। লুদু এই সময় ‘খোকড়’ তৈয়ার করা চেষ্টা করতে লাগলো। ‘খোকড়’ দুই রকমের; কাঁচা ও পাকা। কাঁচা খোকড় বন্ধ হয়, বেশী কিছু রাখা যায় না। গলা টিপলে, মাথায় মারলে হঠাৎ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পাকা খোকড় থেকে চেষ্টা করলেও টাকা বা গিনি বের করা যায় না – যে পর্যন্ত নিজ নিজ থেকে বের করে দেয়। লুদু কাঁচা খোকড় করার জন্য গলার ভিতর সীসা গোল করে সুতা বেঁধে গলার মধ্যে রেখে দিত। সুতা দাঁতের সাথে বাঁধা থাকে, যাতে ভেতরে না চলে যায়। এইভাবে অনেকদিন রাখলে একটা গর্ত হয়। এই গর্তের উপর সোনা রাখতে পারলে আস্তে আস্তে পাকা হয়ে যায়। তা না হলে বাইরে যেয়ে ডাক্তার দ্বারা অপারেশন করে পাকা করা হয়। লুদু কাঁচা খোকড় তৈয়ার করল। এই সময় জেলে ছোকরা নিয়ে ছোরা-মারামারি করায় দশজনকে বদলি করল। এই জেলেই লুদুকে বাকি দিনিগুলো খাটতে হলো।
লুদু বলে, এইবার জেল থেকে একবারে পাকা চোর হয়ে ফিরে এলাম। পাকা ‘খোকড়’ করলাম, দলবল খোঁজ করে তিনজন একসাথে হলাম। ঠিক করলাম, ঢাকা শহরে পকেট কেটে বেশিদিন বাইরে থাকা যাবেনা। বিদেশেই যেতে হবে। তিনজন এক সাথে হয়ে সিলেট জেলায় গেলাম। সিলেট তখন আসামের ভিতর। লুদু বলল, তারা চামড়ার ব্যাপারী সেজে শ্রীমঙ্গলে এক বাড়িতে আশ্রয় নিল। দুই একটা চামড়া কিনত, লবণ লাগাত আর পকেট মারত। এখানে সে বাড়িওয়ালার এক মেয়েকে সে বিবাহ করে। কয়েকদিন পর আবার ধরা পরে মৌলভীবাজার জেলে যেতে হল। মেয়েপক্ষ যখন খবর পেল লুদু একটা দাগি চোর, তখন জেলে গিয়ে তার কাছ থেকে মেয়েটার তালাক নেওয়াইল। এখানে লুদুর ৯ মাস জেল হল। এরপর আরও কয়েকবার জেল হয়।
১৯৪৯ সালে যখন আমি জেলে তখন লুদুর সাথে আমার পরিচয় হয়। ১৯৫২ সালে লুদু মুক্তি পায়, আবার ১৯৫৩ সালে আবার গ্রেপ্তার হয়। এইবার ওর বৎসর জেল হয়, তিনটা মামলা মিলে। ভালোভাবে জেলে থাকলে ৬ বৎসর খেটে বের হতে পারতো।
কিন্তু তার স্বভাব মোটেও পরিবর্তন হয় নাই। খোকড় তার করতেই হবে। বি ক্লাস কয়েদি সকলেও তাকে সমীহ করে চলে। মার যে সে কত খেয়েছে তার সীমা নাই। একদিন বলল, ‘কানে একটু কম শুনি, কারণ অনেক চড় কানে পড়েছে। শরীরের কোনো জায়গাই বাদ নাই মার খেতে।’
আমার মনে হত মার না খেলে লুদুর ভালো লাগে না। কাউকেও সে ভয় করে না, জেলে তাকে সকলেই সমীহ করে চলে। সুপারেনটেনডেন্ট যখন সাত দিনে একদিন ফাইল দেখতে আসে, লুদু সালাম করে দাঁড়াইয়া বলে, ‘আমার নালিশ আছে হুজুর।’ পূর্বের সুপারেরা নাকি বি ক্লাস কয়েদির কথা বেশী শুনত না। নিয়ামতুল্লা সাহেব সকলের কথা মনযোগ দিয়ে শোনেন। আমি যখন জেলে, একদিন সুপার সাহেবকে আধঘণ্টা দাঁড়া করে লুদু নালিশ করল। জেলার থেকে শুরু করে সুবেদার, ডাক্তার সকলের বিরুদ্ধেই সে বলল। কিছু কিছু সত্য কথাও বলেছিল। সে জানতো এই নালিশ করার পর তার বিপদ হবে। কিন্তু পরোয়া নাই। কারণ, তাকে রাতে সেলে থাকবার হুকুক দিয়েছে। দিনে সেল এরিয়ার বাইরে যাওয়ার হুকুম নাই। পানি টানে, ঝাড়ু দেয়, কাজ সে বেশী করে না। তার ইচ্ছা মত চলে।
আমার বাগানে সে ঝাড়ু দিত মাঝে মাঝে, গাছেও মাঝে মাঝে পানি দিত। আমি বললে আপত্তি করত না।
এবার লুদুর কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। সে বলে, ‘আর পকেট মারবো না, ভালোভাবে থাকবো।’ জেল হলে এখন তার আর ভালো লাগে না। তার স্ত্রীর কথা বলে মাঝে মাঝে দুঃখ করত। কারণ, শাশুড়ি নাকি তার স্ত্রীকে নিয়ে দুইবার তালাকের জন্য এসেছে। লুদু রাজি ছিল, তার স্ত্রী শোনে না, সে তার মাকে বলে ‘দেখেই তো বিয়ে দিয়েছিলে যে ও চোর। তবে এখন কেন তালাক নিতে বল। আমার কপালে যা আছে তাই হবে। ও কতদূর যায় শেষ না দেখে ওকে ছাড়ব না।’ এই কথা লুদু বলে দুঃখ করে, আর বলে নিজের জন্য দুঃখ নাই, দুঃখ হলো ওর জীবনটা শেষ করে দিলাম। একট ছেলে ছিল তাও মরে গেছে, ও কি করে থাকবে জানি না।

লুদু জেলের বাহির হয়ে কি করবে জানি না, তবে কথায় বার্তায় মনে হয়, ওর জীবনের উপর একটা ধিক্কার এসেছে।

২রা জুন ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনলাম রাত্রে কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়ে এসেছে। কয়েদিরা, সিপাহীরা আলোচনা করছে। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বুঝতে বাকি রইল না আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীদের নিয়ে এসেছে, ৭ই জুনের হরতালকে বানচাল করার জন্য। অসীম ক্ষমতার মালিক সরকার সবই পারেন। এত জনপ্রিয় সরকার তাহলে গ্রেপ্তার শুরু করেছে কেন! পোস্টার লাগালে পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, মাইক্রোফোনের অনুমতি না দেওয়া, অনেক অত্যাচারই শুরু করেছে। জেলের এক কোণে একাকী থাকি, কিভাবে খবর জানব?
এদিকে কয়েদি ডিআইজি যথা জেল সুপারেনটেনডেন্ট সাহেব আজ সেল এরিয়ায় আসবে। সিপাই জমাদার সকলেই ব্যস্ত। আমাকে সেল এরিয়ায়ই রাখা হয়েছে। এখানে আমার ঘরটা ছাড়া সবই সেল। এখানে অনেক একরারী এবং সাংঘাতিক প্রকৃতির কয়েদি আছে। যারা একবার জেল থেকে পালিয়েছিল অথবা পালাবার চেষ্টা করেছিল, তাদের এই এরিয়ায় রাখা হয়। ডিয়াইজি সাহেব এক এক সপ্তাহে এক এক দিন পরিদর্শন করেন। কারও কোন অসুবিধা হলে, কাকেও অন্যায়ভাবে অত্যাচার করলে, তাঁর কাছে অভিযোগ করা যেতে পারে। কারও কোন দুঃখ থাকলে তাও বলা যায়। যদি কোন জেল কর্মচারী কোন কয়েদীর উপর অত্যাচার করে তাহলে তারাও নালিশ করতে পারে। তাছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে কিনা তাও দেখেন তিনি।

সেল এরিয়ায় তিনি আসবেন। আমি জেলে আসার পর জেল আইজি সাহেব যখন এসেছিলেন তাঁর সাথে এসেছিলেন। আর একদিন রাত্রে যেদিন আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম, তিনি নিজেই সিভিল সার্জন সাহেবের সাথে দেখতে এসেছিলেন আমাকে, তখন রাত্র ১০টা।

আজ জেল সুপার পরিদর্শন করতে আসবেন, তাই হৈ চৈ পড়ে গেছে। চুনা লাগাতে লাগলো। পায়খানা পরিষ্কার করতে শুরু করল কয়েদিরা। সাজ সাজ রব। আমার মেট আর কয়েদিরা ঘরটাকে পরিষ্কার করল। রোজই কিছু কিছু করে। তবে আজ আলাদাভাবে। যদি কোন আবর্জনা থাকে তবে মেট আর কয়েদিদের দণ্ড দেওয়া হয়। জেলের মধ্যে কয়েদিদের দণ্ড সবচেয়ে দুঃখের। এতে যে দিনগুলিতে কাজ করে মার্কা পায় সেগুলি কেটে দেওয়ার ক্ষমতা জেল কর্তৃপক্ষের আছে।

শুননাম ১২/১৩ জন রাতে এসেছে। নাম কেউ বলতে পারে না বা বলতে পারলেও বলবে না। খবরের কাগজে কারো নাম উঠবে। একই জেলে থেকেও কারও সাথে কারও দ্যাখা হওয়া তো দূরের কথা, খবরও পাওয়ার সাধ্য নাই নতুন লোকের পক্ষে। তবে আমি পুরানো লোক – বহুবার এই জেলে অতিথি হয়েছি। এই জেলের সকলেই আমাকে জানে। নিশ্চই বের করে নেব।

ডিয়াইজি সাহেব জেলের ডেপুটি জেলারসহ সকলকে নিয়ে আসলেন। আমার ঘরেও এলেন, একটু বসলেনও। জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কেমন আছেন?’ বললাম, শরীর অনেকটা ভাল, কোন অসুবিধা নাই। কারণ বলে কোন লাভ নাই যে আমাকে কেন আলাদা করে একাকী রেখেছেন? গোয়েন্দা বিভাগ নাকি আদেশ করেছে। ভবিষ্যতে দরকার হলে কেউই স্বীকার করবে না, সে আমি জানি। যাহোক, এরপর তিনি উঠে গেলেন।

আমি আমার জায়গায় বসে রইলাম। চিন্তা একই, কে কে এল!
আবদুল মোমিন এডভোকেট, প্রচার সম্পাদক আওয়ামী লীগ, ওবায়দুর এওহমান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক, হাফেজ মুছা, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, মোস্তফা সরোয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি, শাহাবুদ্দীন চৌধুরী, সহ-সভাপতি ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, রাশেদ মোশাররফ, সহ সম্পাদক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী হারুনুর রশিদ ও জাকির হোসেন। দশ সেলে এদের রাখা হয়েছে। এত খারাপ সেল জেলে আর নাই। এখানে আমাদের প্রথমে রাখা হয়েছিল। আমরা প্রতিবাদ করে ওখান থেকে চলে আসি। বাতাস ঐ সেলে ভুল করেও ঢোকে না। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ডেপুটি জেলার সাহেবকে বললাম। শুনলাম মোমিন সাহেব ডিয়াইজি সাহেবকে বলেছেন।
মোস্তফা সরোয়ারের ব্যবসার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। পাটের ব্যবসা, একদিন না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। খুব আঘাত পেলাম। এই নেতৃবৃন্দ গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য আন্দোলন যে পিছাইয়া যাবে না, সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নাই। বুঝলাম সকলকেই আনবে জেলে। ধিরতে পারলে কাউকেই ছাড়বে না। মীজান ফিরে এসেছীই একটা ভরসা। অনেকে আবার ভয়েতেঘরে বসে যাবে, সে আমার জানা আছে। হাফেজ মুসা সাহেব, বুড়া মানুষ, কষ্ট পাবেন হয়ত, পূর্বে কোনদিন জেলে আসেন নাই। তবে শক্ত মানুষ। চৌধুরী সাহেব বেচারা খুবই নরম। আর সকলেই শক্ত আছে। আন্দোলনের ক্ষতি হবে এই ভাবনা আমার মনটাকে একটু চঞ্চল করেছে।

কোনমতে খেয়ে বসে রইলাম, খবরের কাগজ কখন আসবে! কাগজ এলো! বহুদিনের গোলমালের পরে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে আপোষ হয়ে গেছে। বন্ধুভাবে বসবাস করার কথা যুক্তভাবে ঘোষণাও করেছে। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে খবর এসেছে পুলিশ বাহিনী নিজেরাই দিনের বেলা ৭ ই জুনের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছে। ঢাকা ও অন্যান্য যায়গায় তো করছেই। এই তো স্বাধীনতা আমরা ভোগ করছি।
এক অভিনব খবর কাগজে দেখলাম, মর্নিং নিউজ কাগজে ন্যাপ নেতা মিস্টার মশিউর রহমানের ফটো দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করেছে। ইত্তেফাক ও অন্যান্য কাগজেও খবরটি উঠেছে। তিনি ৬ দফার দাবী সম্বন্ধে তার মতামত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ৬ দফা কর্মসূচি কার্যকর হইলে, পরিশেষে উহা সমস্ত দেশে এক বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব জাগাইয়া তুলিবে। এমনকি তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হতেন তাহা হলে ‘৬ দফা বাস্তবায়িত হতে দিতেন না।’ এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পরে গেছে জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদেরকে বিরোধী দল হিসেবে দাবী করে এড়া জনগণকে ধোকা দিতে চেষ্টা করছে। এড়া নিজেদেরকে চীন পন্থী বলেও থাকেন। এক জন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাইনা, তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এড়া পিণ্ডি করাচী যাওয়া আসা করে আর পারমিটের ব্যবসা বেনামিভাবে করে থাকে। এদের জাতই হল সুবিধাবাদী। এর পুর্বে মওলানা ভাসানী সাহেবও ৬ দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।

মওলানা সাহেবকে আমি জানি, কারণ তিনিই আমার কাছে অনেকবার অনেক প্রস্তাব করেছেন। এমন কি ন্যাপ দলে যোগদান করেও। সেসব আমি বলতে চাইনা। তবে ‘সংবাদে’র সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী সাহেব জানেন। এসব কথা বলতে জহুর ভাই তাকে নিষেধও করেছিলেন। মওলানা সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে এক কথা বলেন, আর পূর্ব বাংলায় এসে অন্য কথা বলেন। যে লোকের যে মতলব সেই লোকের কাছে সেই ভাবেই কথা বলেন। আমার চেয়ে কেউ তাকে বেশি জানেনা। তবে রাজনীতি করতে হলে নীতি থাকতে হয়। সত্য কথা বলার সাহস থাকতে হয়। বুকে আর মুখে আলাদা না হওয়াই উচিৎ।

বিকাল হয়ে গেল। কাগজ রেখে উঠে পড়লাম। একটু পরে দরজা বন্ধ করতে এল। ঘরে ঢুকে বই পড়া শুরু করলাম। কাজ তো একটাই। খাওয়া শেষ করে এসে শুয়ে পড়া।

ভোর ২ টায় হঠাত ঘুম ভেঙ্গে গেল। এক পাগল ক্ষেপে গিয়েছে। খুব জোরে চিৎকার করছে আর গালাগালি করছে। সন্ধ্যার সময় এক পাগল চিৎকার করছিল, তাকে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে অণুরোধ করায় তাকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। জেল কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ কি? কখন কোন পাগল ক্ষেপে ওঠে বুঝবে কেমন করে? আর কি ঘুম হয়! বৃষ্টি হয়েছে, বেশ ঠাণ্ডাও পড়েছে।

৩রা জুন ১৯৬৬। শুক্রবার।
ঘুমে যখন আর পড়তে পারি নাই তখন তালা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়লাম। দেখি জমাদার সাহেব লুঙ্গি পড়া দুইজন লোক নিয়ে পুরানো বিশ সেলের দিকে যাচ্ছেন। বৃষ্টি হচ্ছে, ছাতা মাথায়, বুঝলাম আরও কিছু ‘আমদানি’ হয়েছে। জেলে নতুন কয়েদি এলে ‘আমদানি’ বলে আর চলে গেলে ‘খরচ’ বলে। আমার বারান্দা থেকে দেখা যায় পুরানা বিশ সেলে দুইজন কে রেখে জমাদার সাহেব ফিরে চলেছেন। বললাম, ‘বোধহয় রাতে ঘুমাতে পারেন নাই?’ সোজা ভাবে জিজ্ঞেস করলে বলবে না। বলল, আপনার জন্য কি আর শান্তিতে জেলের চাকরী করতে পারব! রাত দুইটা থেকে এই একই অবস্থা। একে আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। জেলের কয়েদিরা দুনিয়ার খবর রাখে। বৃষ্টি থেমে গেলে খবর পেলাম দুইজন এসেছে দশ সেলে। ‘এই দুইজনও শেখ সাহেবের দলের’ – কয়েদিরা বলাবলি করতে থাকে। নাম কী করে জানব? পরে খবর পাওয়া গেল ঢাকা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শামসুল হক সাহেব, আরেকজন আওয়ামীলীগের সদস্য নন, আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন জীবন ভরে, নাম আব্দুল মাজেদ সরদার। পুরানা ঢাকার নাম করা সরদার। বেলা ১২ টার সময় তাকে আবার মুক্তি দেওয়া হল। কারণ বুঝে কারো বাকি থাকেনা!

আজ আর লেখাপড়ায় মন দিতে পারছিনা। কি হবে বাইরে, কর্মিদের কী অবস্থা, অত্যাচার ও গ্রেপ্তার সমানে চলছে, আওয়ামীলীগ কর্মিদের উপর।

দিনভরই ছটফট করতে লাগলাম, কাগজ পাবো কখন? একটা বেজে গেল, দুইটাও বেজে গেল, মনে মনে ভীষণ রাগ হলাম। জমাদার সাহেবকে খবর দিলাম। বললাম, ‘কাগজ এখনো আসেনাই কেন? ভীষণ অন্যায় কথা। সকালে কাগজ আসে, আর এখন আড়াইটা বাজে। তিনি জেল অফিসে চলে গেলেন। খবর নিয়ে এসে বললেন, ডেপুটি সাহেবের সই হয় নাই। দস্তখত না হওয়া পর্যন্ত কাগজ জেলের ভিতর আসেনা। এখানেও সেন্সর হয়। তিনটার সময় কাগজ এলো। অর্ধেক কাগজ কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। পড়ার উপায় নাই। যারা যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের নামও ঢেকে দিয়েছে। শুধু ইত্তেফাক নয়, আজাদ ও পাকিস্তান অব্জার্ভার কাগজেও কালি দিয়ে দিয়েছে, অথচ জেল কর্তৃপক্ষের সেন্সর করার কোন অধিকার নাই। জেলের মধ্যে কোন ঘটনা বা কোন আসামি পালাইয়া গেলে, কেউ অনশন করলে কালি দিয়ে বন্ধ করে থাকেন। কিন্তু অন্য কিছু করা তাদের উচিৎ না। আমি জেলার সাহেব ও ডেপুটি সাহেব কে খবর দিলাম এর প্রতিবাদ করার জন্য। কাগজ দিতে যদি না চান, মানা করে দেন, কিন্তু কাগজ নষ্ট করবেন কেন!

শুনলাম জেলার সাহেব অসুস্থ, অফিসে আসেন নাই। ডেপুটি সাহেব পরে আসবেন। বিকেল বেলা যে একটু হাঁটাহাঁটি করতাম তাও আজ করতে পারলাম না। কারণ আমার সহকর্মিদের যে অবস্থায় রেখেছে – তাদের ডিভিশনও দেওয়া হয় নাই। আমার বুঝতে বাকি রইল না আমার যখন তিন দিন পরে ডিভিশন আসে, তখন এদের কথা তো ঢাকার নতুন ডিসি সাহেবের মনেই না থাকবার কথা। কারণ তাকে মোনায়েম খাঁ সাহেব ময়মনসিংহ থেকে বদলি করে এনেছেন। তার ‘কীর্তি’ অনেকেরই জানা আছে। আর আশা করি মনেও থাকবে। পাপ কোনোদিন চাপা থাকেনা।

হায়রে দেশ! হায়রে রাজনীতি! লুমুম্বার হত্যার পেছনে যারা ছিল তারাই আজ ফাঁসির কাষ্ঠে জীবন দিল। কঙ্গোর একজন প্রধানমন্ত্রী সহ চারজন সাবেক মন্ত্রীর প্রকাশ্য যায়গায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। যেখানে বিশ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন। কঙ্গোতে সাম্রাজ্যবাদের দাবা খেলা এখনো চলছে। জেনারেল মোবুতু যে পথ বেছে নিয়েছেন সে পথ বড় কন্টকাকীর্ণ। রক্তের পরিবর্তে রক্তই দিতে হয় একথা ভুললে ভুল হবে। মতের বা পথের মিল না হতে পারে, তার জন্য ষড়যন্ত্র করে বিরুদ্ধ দলের বা মতের লোককে হত্যা করতে হবে এ বড় ভয়াবহ রাস্তা। এ পাপের ফল অনেককেই ভোগ করতে হয়েছে।

শরীরটা ভালো লাগছে না। সেল এরিয়ার সবই বন্ধ হয়ে গেছে, এখন আমাকে বন্ধ করা হবে। দরজা বন্ধ হল, কিছু সময় বসে রইলাম চুপ করে। মেটের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যাই খেতে গেলে, ‘স্যার, আরেক্টু নেন, একটু মাছ, একটু তরকারি।’ বেচারা আমাকে খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘এত বড় শরীর, আধা পোয়া চালের ভাত খাবেন না, তাহলে বাঁচবেন কেমন করে?’ শুধু ভাবি, তোমাদের এই স্নেহের প্রতিদান কী করে দিতে পারব।

আমার বাবুর্চি একটু চালাক চতুর ছেলে, কেরামত নাম। বলে, ‘স্যার, আপনি ৎ জানেন না – যেখানে দুইশত তিনশত কয়েদি থাকে তারা নামাজ পড়ে আপনাকে দোয়া করে। তারা বলে, আপনি ক্ষমতায় থাকলে তাদের আর চিন্তা থাকত না।’ দুঃখ হয়, এদের কোন কাজেই বোধ হয় আমি লাগব না। অনেক গল্প শুনলাম – কয়েদিরা কী বলে সে সম্পর্কে। তবে একথা সত্য, যখন আমি জেল অফিসে যাই তখন কয়েদিদের সাথে দেখা হলে, জেল অফিসারদের সামনেই আমাকে সালাম দিতে থাকে। যারা দূরে থাকে তারাও এগিয়ে আসে। বুড়া বুড়া দ’একজন বলেই ফেলে, ‘বাবা, আপনাকে আমরা দোয়া করি।’

খেতে যে পারিনা, তার বিশেষ কারণ জেলের পাক। কয়েদিরা পাকায়, ভালোই লাগেনা। তবুও খেতে হবে। তবুও বাঁচতে হবে। যারা এই দুই দিনে জেলে এসেছে তাদের ডিভিশন দেয় নাই, কিভাবে কোথায় রেখেছে জানার উপায় নাই।

ঠাণ্ডা ছিল, বৃষ্টি হয়েছে। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। যদি জেলের মধ্যে ঘুমিয়ে কাটাতে পারতাম তাহলে কত ভালই না হতো!

সকালে বাইরে বসে আছি। একজন লোক, ঝারুদফায় কাজ করত, অসুস্থ হয়ে জেল হাসপাতালে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে এসেই আমার কাছে এল। এসে বলল, ‘আমাকে আপনি ছেড়ে দেন, আপনি বললেই জেল থেকে বের করে দেবে।’ আমি বললাম, ‘আমি তো তোমার মত একজন কয়েদি, আমার ক্ষমতা থাকলে আমিই বা জেলে আসব কেন?’ সে বলে, ‘আপনি কলম মাইরা দিলেই কাজ হয়ে যায়।’ আমি বললাম, ‘কলম আছে, কিন্তু মাইরা দিবার ক্ষমতা নাই।’ সে কি শোনে, তাকে ছাড়াতেই হবে? সে আমাকে বলে, ‘আমি ১৪/১৫ বছর জেল খাটলাম, আমাকে ছাড়ছে না।’

জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ৫/৬ বৎসর খেটেছে। মাথা একটু খারাপ আছে। প্রথমে ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, পরে ২০ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। বাবা ছোটকালে মারা গেছে। মা জেলে আসবার পরে মারা গেছে। সকলেই ওকে ক্ষেপায়, কিন্তু ও ক্ষেপে না – আস্তে আস্তে কথাগুলি বলে। সাজা কত খেটেছে সেটা ঠিক মত উঠায় নাই। সময় পেলেই আমার কাছে আসে, আর ঐ এক কথা। পরে বুঝলাম অন্যান্য কয়েদিরা ওকে ফুসলায়, ‘সাহেবকে ধর, ভালো করে ধর, খালাস হয়ে যাবি।’ শুধু কি কয়েদিরা, সিপাই, জমাদারও ওকে বলে, যাও শীঘ্র ঐ সাহেবের (আমার) কাছে, কাজ হয়ে যাবে। আর যায় কোথায়! এসে হাজির! ওকে আর বুঝাইয়া লাভ নাই, কারণ ও বুঝবে না।

আজ বাবুর্চিকে বললাম, ‘আমিই পাকাব, তুমি সব ব্যবস্থা করে আমাকে ডাক দিয়ো।’ পড়তে বসলাম। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হতেছে। ঘরেই থাকতে হবে। বাইরে যাওয়ার উপায় নাই। রোজই কিছু কিছু লোক ধরে আনছে। ঢাকা শহরের বাসিন্দাই বেশি – হরতাল বানচাল করার জন্য।

৯টার সময় বাবুর্চি এল আমাকে ডাকতে, গেলাম পাকের ঘরে, বসলাম চেয়ার নিয়ে। যদিও বাইরে কোনোদিন পাক করার সময় আমি পাইনাই। আর প্রয়োজনও কোনোদিন হয় নাই। তবু জেলে এসে যখন একা থাকতাম তখন পাক করতাম। সময় তো কাটানো যায়। ডাল আগেই পাকাইছে। পটল ভাজি করলাম। ইলিশ মাছ পাক করলাম। নিজেই পাক করেছি। সেজন্য মন্দ লাগলো না।

খবরের কাগজ এসে গেল – দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম, এদেশ থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ চিরদিনের জন্য এরা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছে! জাতীয় পরিষদে, ‘সরকারী গোপন তথ্য আইন সংশোধনী বিল’ আনা হয়েছে। কেউ সমালোচনামূলক যে কোন কথা বলুক না কেন মামলা দায়ের হবে। ডিপিআর তো আছেই, সিকিউরিটি অব পাকিস্তান আইন তো আছেই। এছাড়া ১২৪ ধারাও আছে।

বক্তৃতা করার জন্য, ১২৪ ধারা ৭(৩) (ইস্ট পাকিস্তান স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিন্যান্স) এবং ডি পি আর রুল দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মোটমাট পাঁচটি মামলা আর অন্যান্য আরও তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রফেসর ইউসুফ আলী ভালো বক্তৃতাই করেছেন। বক্তৃতা করলে কী হবে, কে কার কথা শোনে! সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাকিস্তান- ভারত যুদ্ধের সময় ডিপিআর দিয়ে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মিদের গ্রেপ্তার করেছে। তাসখন্দে শান্তিচুক্তি করে এসে আরও অনেক রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মিদের গ্রেপ্তার শুরু করেছে। নিশ্চই এই আইনও তারা ব্যবহার করবে বিরুদ্ধ দলের কর্মিদের বিরুদ্ধে। এদেশকে তারা কোথায় নিতে চায় বুঝতে আর বাকি নাই। যে কোন বক্তৃতা বা বিবৃতিকে সরকার অপব্যাখ্যা করে মামলা দায়ের করতে পারে।

ইত্তেফাক দেখে মনে হল ৭ই জুনের হরতাল সম্বন্ধে কোন সংবাদ ছাপতে পারবে না বলে সরকার হুকুম দিয়েছে। কিছুদিন পুর্বে আরও হুকুম দিয়েছিল, ‘এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করেছে এটা লিখতে পারবা না। ছাত্রদের কোন নিউজ ছাপাতে পারবা না। আবার এই যে হুকুম দিলাম সে খবরও ছাপাতে পারবা না।’ ইত্তেফাকের উপর এই হুকুম দিয়েছিল। এটাই হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা! আমরা তো লজ্জায় মরে যাই। দুনিয়া বোধ হয় হাসে আমাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দেখে! যে দেশে মানুষের মতামত বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সে দেশে সংবাদপতরের স্বাধীনতা থাকবে কেমন করে? যারা আজও বুজছে না, জীবনেও বুঝবে না।

আমার ভয় হচ্ছে এরা পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির দিক নিয়ে যেতেছে। আমরা এরা এপথে বিশ্বাস করিনা। আর এপথে দেশে মুক্তিও আস্তে পারে না। কিন্তু সরকারের এই নির্যাতনমূলক পন্থার জন্য এদেশের রাজনীতি ‘মাটির তলে’ চলে যাবে। আমরা যারা গণতন্ত্রের পথে দেশের মঙ্গল করতে চাই, আমাদের পথ বন্ধ হতে চলেছে। এর ফলে যে দেশের পক্ষে কি অশুভ হবে তা ভাবলেও শিহরিয়া উঠতে হয়! কথায় আছে, ‘অন্যের জন্য গর্ত করলে, নিজেই সে গর্তে পড়ে মরতে হয়।’

বড় সুখের খবর, সোভিয়েত ইউনিয়ন আর পূর্ব পাকিস্তান সরকার ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য এক যুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রুশরা এটাই আজ সাধারণ মানুষের কামনা।

ইন্দোনেশিয়া দুনিয়াকে বেশ খেলা দেখাল। সে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দলকে রেজিস্ট্রি করার হুকুম দেওয়া হয়েছে। প্রায়ই পাকিস্তানের আপন মা’র পেটের ভাই।

বন্ধু শহিদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’ বইটি পড়তে শুরু করেছি। লাগছে ভালোই, বাইরে পড়তে সময় পাই নাই। যা হোক আওয়ামীলীগ কর্মিরা আর ছাত্র তরুণ কর্মিরা কাজ করে যেতেছে। বেপরোয়া গ্রেপ্তারের পরেও ভেঙ্গে পরে নাই দেখে ভালোই লাগছে। রাজনৈতিক কর্মিদের জেল খাটতে কষ্ট হয়না যদি বাইরে আন্দোলন থাকে।

আজাদ কাগজ দেখে একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম। প্রথম লিখেছে, ‘উজিরসভা হইতে জনাব ভুট্টোর পদত্যাগ আসন্ন।’ মোটেই আশ্চর্য হলাম না – যখন চিন্তা করলাম। এটাই তো স্বাভাবিক। ডিক্টেটররা যখন দরকার হয় খুব ব্যবহার করে, আর যখন দরকার ফুরিয়ে যায়, ছেড়া কাপড়ের মত ফেলে দেয়। ছেঁড়া কাপড় তো অনেক সময় দরকারে লাগে। স্বৈরশাসকদের সে দরকারও হয়না। একদম বিদায়। টু শব্দ করার ক্ষমতা নাই।

প্রায় তিনটার সময় বিজলি পাখা খারাপ হয়ে গেছে। মাঝে বৃষ্টি হয়েছে কিন্তু গরম যায়না। অনেক খবর দিলাম, জেল অফিসে। সন্ধ্যার সময় এসে ঠিক করে দিয়ে গেল। বিকাল বেলা পাকের ঘরে যেয়ে মুরগি পাক করে নিয়ে এলাম। বেশি ভালো হয় নাই। কারণ মসলা ঠিক করে দিতে পারি নাই।

সন্ধ্যা হয়ে এল। একটু পরেই ভিতরে যেতে হবে। তাই একটু হাঁটাহাঁটি করলাম। রুমে বসে লেখাপড়া করা ছাড়া উপায় কি! তাই পড়লাম বইটা নিয়ে। পরে আপন মনে কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলাম। মনে পড়ল আমার বৃদ্ধ বাবা-মার কথা। বেরিয়ে কি তাদের দেখতে পাবো? তাদের শরীরও ভাল না। বাবা বুড়া হয়ে গেছেন। তাঁদের পক্ষে আমাকে দেখতে আসা খুব কষ্টকর। খোদার কাছে শুধু বললাম, ‘খোদা তুমি তাঁদের বাঁচিয়ে রেখ, সুস্থ রেখ।’

৫ জুন ১৯৬৬ রবিবার
ঘুম থেকে উঠে বাইরে গেলাম। জমাদার এসেছেন। শুনলাম পাগলদের গোসল করানো হচ্ছে, একটু এগিয়ে যেয়ে দেখি সব উলঙ্গ। এক একজনকে ধরে এনে এনে চৌবাচ্চার ভিতর ঠেসে ধরছে। ভালো করে গোসল করায় ওদের। কতকাল যে ওরা এভাবে পড়ে আছে আর কতকাল থাকবে কে জানে। মাঝে মাঝে ভাল হয়, আবার মাঝে মাঝে খারাপ হয় এবং পাগলামি করে। এদের কেহ আপনজনকে খুন করে এসেছে, কেহ বা পাগল হয়ে খুন করেছে। কেহ বা বাইরে পাগল হয়ে গেছে, পরিবারের লোকেরা সামলাতে না পেরে জেলখানায় দিয়ে গেছে। একবার জেলে এলে খুব কম লোকই ভালো হয়েছে। দুই একজন ভালো হলেও তাদের ছাড়তে এত দেরী করে ফেলে যে আবারো পাগল হয়ে যায়। এখবরও আমি পেয়েছি। দুই একজন ভালো হয়ে বাইরেও চলে গেছে, তবে বেশির ভাগ আজিমপুর কবরস্থানেই যেয়ে থাকে। একবার জেলের গল্প করতে আমার একমাত্র সহধর্মিণীকে বলেছিলাম, ‘যদি কোনোদিন পাগল হয়ে যাই তবে পাগলা গারদে বা জেলের পাগলখানায় আমাকে দিওনা।

ফণীকে ডেকে আনলাম। ফণীও কিছুদিন পাগল ছিল এখন ভাল হয়েছে। গান মন্দ গাইতে পারেনা। বললাম, ফণী বাবু গান গাও। সে দেহতত্ত্ব, মারফতি, কীর্তন মন্দ গায় না। দেশে দেশে গান গেয়ে বেড়াত। যখন সে গান গায় মনে হয় কোথায় যেন চলে গিয়াছে আর এ দুনিয়ায় নাই। একটার পর একটা গান গেয়ে চলে। কত গান যে সে জানে তার কোন ঠিক নাই। অফুরন্ত ভাণ্ডার। আজকাল রোজই তার গান শুনি। কারণ আমি যেখানে থাকি সেখানে সে ঝাড়ু দফায় কাজ করে।

জমাদার ও সিপাহি সাহেবরাও তার গান শোনে। সকলেই ওকে স্নেহ করে, কারণ সরল লোক। মনে আর মুখে একই কথা। এসমস্ত গান আমি যখন ছোট ছিলাম অনেক শুনেছি। জেলের মধ্যে এমন গান খুব ভালোই লাগে। ঘরে এসে আবার সংশপ্তক বইয়ের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চেষ্টা করলাম।
আজ খুব বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি থেমে গেলে গরমও পড়ে। পাখা খারাপ হয়ে গেছে খবর দিয়েছি মিস্ত্রি পাঠাতে। দিনভর বৃষ্টি। আজ আবার ন্যাপের জনসভা। সভাটি হওয়া প্রয়োজন। মওলানা ভাষানী সাহেবের ভুল নীতির জন্য এই দলটি জনসমর্থন যা কিছু ছিল তাও হারাইয়া ফেলেছে দিন দিন।

আওয়ামীলীগ কর্মিদের গ্রেফতার করে চলছে। আরও আটজন কর্মিকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন যায়গায়। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবী দাবাইয়া দেওয়া যায়না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে, গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিৎ। যে পথ অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব ভালো হবে বলে মনে হয়না। আওয়ামীলীগ কর্মিরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবী যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচানোর সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামীলীগ কর্মিরা দেশের আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলানো হতেছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারী কর্মচারিদের দিয়ে।
আজ খুব বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি থেমে গেলে গরমও পড়ে। পাখা খারাপ হয়ে গেছে খবর দিয়েছি মিস্ত্রি পাঠাতে। দিনভর বৃষ্টি। আজ আবার ন্যাপের জনসভা। সভাটি হওয়া প্রয়োজন। মওলানা ভাষানী সাহেবের ভুল নীতির জন্য এই দলটি জনসমর্থন যা কিছু ছিল তাও হারাইয়া ফেলেছে দিন দিন।

আওয়ামীলীগ কর্মিদের গ্রেফতার করে চলছে। আরও আটজন কর্মিকে গ্রেপ্তার করেছে বিভিন্ন যায়গায়। দমননীতি সমানে চালাইয়া যেতেছে সরকার। নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গণদাবী দাবাইয়া দেওয়া যায়না। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে, গণতান্ত্রিক পথেই মোকাবিলা করা উচিৎ। যে পথ অবলম্বন করেছে তাতে ফলাফল খুব ভালো হবে বলে মনে হয়না। আওয়ামীলীগ কর্মিরা যথেষ্ট নির্যাতন ভোগ করেছে। ছয় দফা দাবী যখন তারা দেশের কাছে পেশ করেছে তখনই প্রস্তুত হয়ে গিয়াছে যে তাদের দুঃখ কষ্ট ভোগ করতে হবে। এটা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচানোর সংগ্রাম। যথেষ্ট নির্যাতনের পরেও আওয়ামীলীগ কর্মিরা দেশের আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে নাই। তবুও পোস্টারগুলি পুলিশ দিয়ে তুলে ফেলানো হতেছে। ছাপানো পোস্টার জোর করে নিয়ে যেতেছে সরকারী কর্মচারিদের দিয়ে।

আমার মনে হয় মোনায়েম খান সাহেব পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে কোন কোন বন্ধুর কাছ থেকে বুদ্ধি নিয়েছেন। তিনি ভুলে গেছেন এটা পূর্ব বাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান নহে! আন্দোলন করা এবং নির্যাতন সহ্য করার ক্ষমতা এরা রাখে। তিনি অনেক বড় বড় কথা বলেন। রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে বকেই চলেছেন। মানুষের স্মৃতিশক্তি কিছুটা আছে, এত তাড়াতাড়ি তারা ভুলে যায় না। তিনি যখন খাজা নাজিমুদ্দিন সাহেব ও নুরুল আমিন সাহেবের সমর্থক ছিলেন তখন ময়মনসিংহ জেলা মুসলিম লীগের কর্মকর্তাও ছিলেন। মুসলিম লীগের নমিনি হিসেবে গণপরিষদের সদস্য হয়ে করাচীতে গিয়ে প্রত্যেক কাজে মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে দমাইবার জন্য। ময়মনসিংহে গুণ্ডা ভাড়া করে আমাদের কর্মিদের উপর অত্যাচার করেছেন। পূর্ব বাংলার যে কোন আন্দোলনের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়াতেন, সেকথা ভোলেন কি করে? ময়মনসিংহের আওয়ামীলীগ সেক্রেটারি রফিকউদ্দিন ভুঁইয়াকে আড়াই বছর পর্যন্ত জেলে রাখার জন্য একমাত্র তিনিই দায়ী ছিলেন। নুরুল আমিন সাহেব তার কথা মতোই ময়মনসিংহে কাজ করতেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।

১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরেও ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগে ছিলেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এই দির্ঘ ১১ বৎসরের মধ্যে ৯ বৎসর মুসলিম লীগ কেন্ত্রিয় সরকারের ক্ষমতায় ছিল। তখন তিনি মুসলিম লীগের সভ্য হয়েও একদিনও পূর্ব বাংলার শোষণের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেন নাই। শুধু সমর্থন করেন নাই, ভাতা নিয়ে সমর্থন করেছেন। তিনি যখন ইসলামের নাম করে সত্য কথা না বলে, এমন কি মাথায় কিস্তি টুপি দিয়ে রাজনীতিবিদের গালাগালি করেন তখন হাসি পায়। বাইরে থাকতেও কোনোদিন এদের কথার উত্তর দিবার প্রবৃত্তি আমার হয় নাই। কারণ আমি জানি এদের চাকরী আইয়ুব খান সাহেবের দয়ার উপর নির্ভর করে। তাঁকে খুশী রাখলে সব ঠিক, জনমতের এরা কি ধার ধারে?
খবরের কাগজ এলো। পাকিস্তান অবজার্ভার দেখে ভাবলাম বোধহয় একটু এরা ছাপে আজকাল। আমি নিজে অবজার্ভার সকল সময়েই পড়ি। একবার কয়েকদিনের জন্য রাগ হয়ে বন্ধ করেছিলাম বাইরে থাকতে। আবার নিলাম, কারণ যাহাই হউক না কেন পূর্ব বাংলার কাগজ। মর্নিং নিউজের মত পশ্চিমা শিল্পপতিদের মুখপাত্র নয়। এবং সরকারের অন্ধ সমর্থকও নয়। আজাদ কাগজ সব সময়ই কিছু কিছু সংবাদ বহন করে। মতের মিল না থাকতে পারে, সংবাদপত্র কেন সংবাদ দিবে না। বিকাল পর্যন্ত কাগজই পড়লাম।
এখন একমাত্র চিন্তা নেতাকর্মিরা আন্দোলন চালাইয়া যেতে সক্ষম হবে কিনা! আমার বিশ্বাস আছে আওয়ামীলীগের ও ছাত্রলীগের নিস্বার্থ কর্মিরা, তাদের সাথে আছে। কিছু সংখ্যক শ্রমিক নেতা – যারা সত্যই শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করে – তারাও নিশ্চই সক্রিয় সমর্থন দেবে। এত গ্রেপ্তার করেও এদের দমাইতে পারে নাই। ৭ জুন হরতালের জন্য এরা পথসভা ও মিছিল বের করেই চলেছে। পোস্টার ছিঁড়ে দিলেও নতুন পোস্টার লাগাইতেছে, প্যামফ্লেট বাহির করছে। সত্যই এতোটা আশা আমি করতে পারি নাই।

বিকাল বেলা বাইরে বসেই চা খেয়ে নিলাম। তারপর স্বাস্থ্যকর কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। একটু পরেই আবার বৃষ্টি এলো।
সন্ধ্যার পূর্বে বৃষ্টি বন্ধ হল। একটু বাইরে যেয়ে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় দেখলাম, হাসপাতাল থেকে কে যেন আমাকে সালাম দিতেছে। অনেক দুরে চেনা যায়না। চোখে চশমা ছিলোনা। তবে ভাবলাম নিশ্চই আওয়ামীলীগের কেহ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এসেছে। চশমা আনতে বললাম। চশমা পড়ে দেখলাম, আরে এত আমাদের শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা শহর আওয়ামীলীগের সহসভাপতি। আমাকে ইশারা দিয়ে দেখাল, পেটে হাত দিল। বুঝলাম পেটের কোন যন্ত্রণা এবং জ্বর হয়েছে। বেচারা আর কোনোদিন জেলে আসে নাই। এই প্রথম জেল তার মধ্যে আবার অসুখ হে ভেঙ্গে পড়বে। পরের দিন খবর নিলাম অনেকটা ভাল আছে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নিলাম। ঘরে এলাম, তালা বন্ধ হল। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঘরেই থাকতে হবে। মাথার ভিতর শুধু ৭ই জুনের চিন্তা। কি হবে! তবে জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। জনমত আমার জানা আছে।

৬ জুন ১৯৬৬, সোমবার
আগামীকাল ধর্মঘট। পূর্ব বাংলার জনগণকে আমি জানি, হরতাল তার করবে। রাজবন্দীদের মুক্তি তারা চাইবে। ছয়দফা সমর্থন করবে। তবে মোনায়েম খান সাহেব সেভাবে উস্কানি দিতেছেন তাতে গোলমাল বাধাবার চেষ্টা যে তিনি করছেন এটা বুঝতে পারছি। জনসমর্থন যে তার সরকারের নাই তা তিনি বুঝেও বোঝেন না।

ঘরে এসে বই পড়তে শুরু করে আবার মনটা চঞ্চল হয়ে যায়, আবার বাইরে যাই – কেবল একই চিন্তা! এইভাবে সারা সকাল কেটে গেল। খাওয়াদাওয়া কোনোদিকেই আমার নজর নাই। ভালোও লাগছে না কিছুই। যা হোক দুপুর বেলা খাওয়ার পূর্বেই কাগজ এল।

ধরপাকড় চলছে সমানে। কর্মিদের গ্রেপ্তার করছে। যশোর আওয়ামীলীগ অফিস তল্লাশি করেছে। ভুতপূর্ব মন্ত্রী আওয়ামীলীগ নেতা জনাব মশিউর রহমান প্রতিবাদ করেছেন। জনাব নুরুল আমিন সাহেব আওয়ামীলীগ কর্মি ও নেতাদের গ্রেপ্তারের তীব্র সমালোচনা করেছেন এবং মুক্তির দাবী করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শত্রুবিনাশের জন্য রচিত আইনে দেশবরেণ্য নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার দেশবাসীকে স্তম্ভিত করিয়াছে।’ ঢাকার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যরা এক যুক্ত বিবৃতিতে আমাকে সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী করিয়াছে, আর ৬ দফার দাবীকে সমর্থন করিয়াছে এবং জনগণকে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সরি হওয়ার আহবান জানাইয়াছে।

৯ জন আইয়ামিলিগ দলীয় এমপি ধরপাকড়ের তীব্র প্রতিবাদ করিয়াছে এবং তাদের মুক্তি দাবী করেছেন। আওয়ামীলীগ, শ্রমিক, ছাত্র ও যুব কর্মিরা হরতালকে সমর্থন করে সভা করে চলেছে। মশাল শোভাযাত্রাও একটি বের হয়েছে। শত অত্যাচার ও নির্যাতনে কর্মিরা ভেঙ্গে পড়ে নাই। আন্দোলন চালাইয়া চলেছে। নিশ্চয় আদায় হবে জনগণের দাবী।
গভর্নর নারায়ণগঞ্জ জনসভায় আবার হুমকি ছেড়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গের চেষ্টা করলে কঠোর হস্তে দমন করবেন।’ আইন শৃঙ্খলা আওয়ামীলীগ কোনোদিন ভাঙতে চায় নাই। তারা বিশ্বাসও করেনা ঐ রাজনীতিতে। কিন্তু যিনি আইন শৃঙ্খলার মালিক হয়ে আইন শৃঙ্খলা ভাঙতে উস্কানি দিতেছেন তার বিচার কে করবে? যার সরকার বেআইনি এবং অন্যায়ভাবে কর্মিদের হয়রানি করছেন, গ্রেপ্তার করছেন তার বিচার কবে হবে? মোনায়েম খান সাহেবের জানা উচিৎ ১৯৪৯ সাল থেকে আওয়ামীলীগ কর্মিরা অনেকবার জেলে গেছেন, মিথ্যা মামলার আসামিও হয়েছেন। পূর্বের সরকার এবং মুখপাত্ররা এরকম হুমকি অনেকবার দিয়েছেন।

সরকার কর্মিদের বন্দী করেও অত্যাচার করেছে, ২৪ ঘণ্টা তালা বন্ধ করে রেখেছে জেলের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জে মোস্তফা সারওয়ার, শামসুল হক ভূতপূর্ব এম পি এ, হাফেজ মুছা সাহেব, আব্দুল মোমিন এডভোকেট, ওবায়দুর রহমান, শাহাবুদ্দিন চৌধুরীর মতো নেতৃবৃন্দকে ‘সি’ ক্লাস করে রাখা হয়েছে। কি করে এই সরকার সভ্য সরকার বলে দাবী করতে পারে আমি ভেবেও পাই না।

আজাদ যেটুকু সংবাদ পরিবেশন করিতেছে তাহাতে ধন্যবাদ না দিয়ে পারা যায় না। আমি একা থাকি, আমার সাথে কাহাকেও মিশতে দেওয়া হয় না। একাকী সময় কাটানো যে কত কষ্ট তাহা যাহারা ভুক্তভোগী নন বুঝতে পারবেন না। আমার নিজের উপর বিশ্বাস আছে, সহ্য করার শক্তি খোদা আমাকে দিয়েছেন। ভাবি শুধু আমার সহকর্মিদের কথা। এক এক জনকে আলাদা আলাদা জেলে নিয়ে কিভাবে রেখেছে? ত্যাগ বৃথা যাবে না, যায় নাই কোনোদিন। নিজে ভোগ নাও করতে পারি, দেখে যেতে নাও পারি, তবে ভবিষ্যৎ বংশধররা আজাদি ভোগ করতে পারবে। কারাগারের পাষাণ প্রাচীর আমাকেও পাষাণ করে তুলেছে। এ দেশের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মা-বোনের দোয়া আছে আমাদের উপর। জয়ী আমরা হবই। ত্যাগের মাধ্যমেই আদর্শের জয় হয়।

বিকালে বাগানে কাজ করতে শুরু করলাম। সময় তো আমার কাটে না। আলাপ করার লোক তো নাই। লাউয়ের দানা লাগাইছিলাম, গাছ হয়েছে।

ঝিংগার গাছও বেড়ে উঠেছি। ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া গোছাইয়া করতে শুরু করেছি। বেশ সুন্দর দেখতে হয়েছে। আজকাল সকলেই প্রশংসা করে। নতুন জীবন পেয়েছে ফুলের গাছগুলি।

৭ই জুন ১৯৬৬ || মঙ্গলবার
সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। কি হয় আজ? আব্দুল মোনায়েম খান যেভাবে কথা বলছেন তাতে মনে হয় কিছু একটা ঘটবে আজ। কারাগারের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে খবর আসলো দোকান-পাট, গাড়ী, বাস রিকশা সব বন্ধ। শান্তিপূর্নভাবে হরতাল চলছে। এই সংগ্রাম একলা আওয়ামী লীগই চালাইতেছে। আবার সংবাদ পাইলাম পুলিশ আনসার দিয়ে ঢাকা শহর ভরে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই জনগণ বে-আইনী কিছু করবে না। শান্তিপূর্নভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার প্রত্যেক্টি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু এরা শান্তিপূর্নভাবে প্রতিবাদ করতে দিবে না।

আবার খবর এলো টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে। লাঠি চার্জ হতেছে সমস্ত ঢাকায়। আমি তো কিছুই বুঝতে পারি না। কয়েদিরা কয়েদিদের বলে। সিপাইরা সিপাইদের বলে। এই বলাবলির ভিতর থেকে কিছু খবর বের করে নিতে কষ্ট হয় না। তবে জেলের মধ্যে মাঝে মাঝে প্রবল গুজবও রটে।

অনেক সময় এসব গুজব সত্যই হয়, আবার অনেকসময় দেখা যায় একদম মিথ্যা গুজব। কিছু লোক গ্রেপ্তার হয়ে জেল অফিসে এসেছে। তারমধ্যে ছোট ছোট বাচ্চাই বেশী। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে।

১২ টার পরে খবর পাকাপাকি পাওয়া গেলো যে হরতাল হয়েছে, জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে হরতাল পালন করেছে। তারা ছয়দফা সমর্থন করে আর মুক্তি চায়, বাঁচতে চায়, খেতে চায়, ব্যাক্তি স্বাধীনতা চায়। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি, কৃষকের বাঁচবার দাবি তারা চায় – এর প্রমাণ এই হরতামের মধ্যে হয়েই গেল।

এ খবর শুনলেও আমার মনকে বুঝাতে পারছি না। একবার বাইরে একবার ভিতরে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। বন্দি আমি জনগণের মঙ্গল কামনা করা ছাড়া আর কি করতে পারি! বিকেলে আবার গুজব শুনলাম গুল হয়েছে, কিছু লোক মারা গেছে। অনেক লোক জখম হয়েছে। মেডিকেল হাসপাতালেও একজন মারা গেছে। একবার আমার মন বলে, হতেও পারে, আবার ভাবি সরকার কি এত বোকামি করবে? ১৪৪ দেওয়া হয় নাই। গুলি চলবে কেন? একটু পরেই খবর এল ঢাকায় ১৪৪ জারি করা হয়েছে। মিটিং হতে পারবে না। কিছু জায়গায় টিয়ার গ্যাস মারছে সে খবর পাওয়া গেল।

বিকালে আরো বহুলোক গ্রেপ্তার হয়ে এল। প্রত্যেককে সামারী কোর্ট করে সাজা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাহাকেও এক মাস, কাহাকেও দুই মাস। বেশীরভাগ লোকই রাস্তা থেকে ধরে এনেছে শুনলাম। অনেকে নাকি বলে রাস্তা দিয়া যাইতেছিলাম ধরে নিয়ে এল। আবার জেলও দিয়ে দিল। সমস্ত দিনটা পাগলের মতোই কাটলো আমার। তালাবদ্ধ হবার পূর্বে খবর পেলাম, নারায়ণগঞ্জ, তেজগাঁ, কার্জন হল, পুরানা ঢাকার কোথাও কোথাও গুল হয়েছে, তাতে অনেক লোক মারা গেছে। বুঝতে পারি না সত্য কি মিথ্যা! কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারি না। সেপাইরা আলোচনা করে, তার থেকে কয়েদিরা শুনে আমাকে কিছু কিছু বলে।

তবে হরতাল যে সাফল্যজনকভাবে পালন করা হয়েছে সে কথা সকলেই বলছে। এমন হরতাল নাকি কোনদিন হয় নাই। এমনকি ২৯শে সেপ্টেম্বরও না। তবে আমার মনে হয় ২৯শে সেপ্টেম্বরের মতই হরতাল হয়েছে।

গুলি ও মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু পাইপই টানছি – যে এক টিন তামাক বাইরে আমি ছয়দিন খাইতাম, সেইটিন এখন চারদিনে খেয়ে ফেলি। কি হবে? কি হতেছে? দেশকে এরা কোথায় নিয়ে যাবে, নানা ভাবনায় মনটা আমার অস্থির হয়ে রয়েছে। এমনিভাবে দিন শেষ হয়ে এল। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা জেলে আছি। তবুও কর্মীরা, ছাত্ররা ও শ্রমিকরা যে আন্দোলন চালাইয়া যাইতেছে, তাদের জন্য ভালোবাসা দেওয়া ছাড়া আমার দেবার কিছুই নাই।

মনে শক্তি ফিরে এল এবং আমি দিব্যচোখে দেখতে পেলাম ‘জয় আমাদের অবধারিত’। কোন শক্তি আর দমাতে পারবে না।

অনেক রাত হয়ে গেল, ঘুম তো আস না। নানা চিন্তা এসে পড়ে। এ এক মহাবিপদ। বই পরী, কাগজ উলটাই-কিন্তু তাতে মন বসে না।

ভুলে গেছি, বিকালে কয়েক মিনিটের জন্য জেলার সাহেব আমাকে দেখতে এসেছিলেন। তাঁর শরীরও ভাল না দেখলাম। আজ অসুখ থেকে উঠে এসেছেন। আমার মন ভাল নাতাই বললাম, কিছু কথা আছে, দুই একদিন পরে আসবেন। তিনি বললেন, ‘আসবো’। বিদায় নিলেন।

৮ই জুন ১৯৬৬ || বুধবার
ভোরে উঠে শুনলাম সমস্ত রাত ভর গ্রেপ্তার করে জেল ভরে দিয়েছে পুলিশ বাহিনী। সকালেও জেল অফিসে বহু লোক পড়ে রয়েছে। প্রায় তিনশত লোককে সকাল ৮ টা পর্যন্ত জেলে আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৬ বৎসর বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সের লোকও আছে। কিছু কিছু ছেলে মা মা করে কাঁদছে। এরা দুধের বাচ্চা, খেতেও পারেনা নিজে। কেস টেবিলের সামনে এনে রাখা হয়েছে। সমস্ত দিন এদের কিছুই খাবার দেয় নাই। অনেকগুলি যুবক আহত অবস্থায় এসেছে। কারো পায়ে জখম, কারো কপাল কেটে গিয়াছে, কারো হাত ভাঙ্গা এদের চিকিৎসা করা বা ঔষধ দেওয়ার কোন দরকার মনে করে নাই কর্তৃপক্ষ। গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছিল অন্য যায়গায়, সেখান থেকে সন্ধ্যার পর জেলে এনে জমা দেওয়া শুরু করে। দিনভরই লোক আনছিল, অনেক। কিছু সংখ্যক স্কুলের ছাত্রও আছে। জেল কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেহ কেহ খুবই ভালো ব্যবহার করেছে। আবার কেহ কেহ খুবই খারাপ ব্যবহারও করেছে। বাধ্য হয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে জানালাম। অত্যাচার বন্ধ করুন। তা না হলে ভীষণ গোলমাল হতে পারে। মোবাইল কোর্ট করে সরকার গ্রেপ্তারের পরে এদের সাজা দিয়েছে। কাহাকেও তিন মাস, কাহাকেও দুই মাস, এক মাসও কিছু সংখ্যক ছেলেদের দিয়াছে। সাধারণ কয়েদি, যাদের মধ্যে অনেকেই মানুষ খুন করে অথবা ডাকাতি করে জেলে এসেছে তারাও দুঃখ করে বলে, এই দুধের বাচ্চাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে! এরা রাতভর কেঁদেছে। ভালো করে খেতেও পারে নাই। এই সরকারের কাছ থেকে মানুষ কেমন করে বিচার আশা করে?

জেল কর্তৃপক্ষ কোথায় এত লোকের জায়গা দিবে বুঝে পাই না! ছোট ছোট ছেলেদের আলাদা করে রাখতে হয়। এরা জেলে আসার পর খবর এল ভীষণ গুলিগোলা হয়েছে, অনেক লোক মারা গেছে তেজগাঁ ও নারায়ণগঞ্জে। সমস্ত ঢাকা টিয়াস গ্যাস ছেড়েছে, লাঠিচার্জও করেছে। চুপ করে বসেনীরবে সমবেদনা জানানো ছাড়া আমার কি করার আছে! আমার চরিত্রের মধ্যে ভাবাবেগ একটু বেশি। যদিও নিজেকে সামলানোর মত ক্ষমতাও আমার আছে। বন্দি অবস্থায় এই সমস্ত খবর পাওয়ার পরে মনের অবস্থা কি হয় ভুক্তভোগী ছাড়া বুঝতে পারবে না।

মেটের পীড়াপীড়িতে নাস্তা খেতে বসেছিলাম। খেতে পারি নাই। দুপুরে ভাত খেতে বসেছি একই অবস্থা। সঠিক খাবার না পাওয়ার জন্যই মন আরও খারাপ। খবরের কাগজের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কাগজ আসতে খুব দেরি হতেছে, ২ টার সময় কাগজ এল। আমি পূর্বে যা অনুমান করেছি তাই হলো। কোনো খবরই সরকার সংবাদপত্রে ছাপতে দেয় নাই।

ধর্মঘটের কোন সংবাদ নেই। শুধু সরকারি প্রেস নোট। ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার সকলের একই অবস্থা। একেই বলে ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’! ইত্তেফাক মাত্র চার পৃষ্ঠা। কোনো জেলার কোনো সংবাদ নাই। প্রতিবাদ দিবস ও হরতাল যে পুরাপুরি পালিত হয়েছে বিভিন্ন জেলায় সে সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ রইল না।

খবেরের কাগজগুলি দেখে আমি শিহরিয়া উঠলাম। পত্রিকার নিজস্ব খবর ছাপতে দেয় নাই। তবে সরকারি প্রেসনোতেই স্বীকার করেছে দশজন মারা গেছে, তখন কতগুন বেশী হতে পারে ভাবতেই আমার ভয় হলো! কত জন জখম হয়েছে সরকারি প্রেসনোটে তাহা নাই। সমস্ত দোষই জেন জনগণের। সেখানে উসকানি দিতেছে সরকারের প্রতিনিধিরা, আওয়ামী লীগ সেখানে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, ‘শান্তিপূর্নভাবে প্রতিবাদ দিবস পালন করতে চাই’। এবং সে অনুযায়ী তারা কর্মীদের নির্দেশও দিয়েছে। এখন জনগণকে দোষ দিয়ে লাভ নাই। যেখানে পুলিশ ছিল না সেখানে কোন গোণ্ডগোল হয় নাই। চকবাজার ও অন্যান্য জায়গায় শান্তিপূর্নভাবে ধর্মঘট হয়েছে। সে খবর পেয়েছি।

বেলা ১১টার সময় ১৪৪ ধারা জারি করে আর সাথে সাথে গুলি শুরু হয়। পূর্বে জারি করলেই তো কর্মীরা আর জনসাধারণ জানতে পারতো। যখন আওয়ামী লীগ তার প্রোগ্রাম খবরের কাগজে বের করে দিল তাতে পরিষ্কার লেখা ছিল, ১০টায় শোভাযাত্রা, বিকেলে সভা শেষে আবার শোভাযাত্রা। তখন তো ১৪৪ ধারা জারি করে নাই। পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় সরকারের দালালেরা ও কিছুসংখ্যক অতি উৎসাহী কর্মচারী কোনো এক উপর তলার নেতার কাছ থেকে পরামর্শ করে সর্বনাশ করেছে।

সরকার যদি মিথ্যা কথা বলে প্রেসণোট দেয়, তবে সে সরকারের উপর মানুষের বিশ্বাস থাকতে পারেনা। জীবন ভরে একই কথা শুনিয়াছি ‘আত্মরক্ষার জন্যই পুলিশ গুলিবর্ষন করতে বাধ্য হয়।’ একথা কেউ বিশ্বাস করবে? যারা মারা গেল তাদের ছেলেমেয়ে, মাবাবা তাদের কী হবে? কত আশা করে তারা বসে আছে, কবে বাড়ি আসবে তাদের বাবা। কবে আসছে তাদের ছেলে। রোজগারের টাকা আসবে মাসের প্রথম দিকে। এরা জেলে বন্দী, সহসা আর ফিরে যাবেনা, টাকাও আর পৌঁছাবে না সংসারে। একথা ভেবে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছি আমি। কিছুতেই মনকে স্বান্তনা দিতে পারছিনা। কেন মানুষ নিজের স্বার্থের জন্য পরের জীবন নিয়ে থাকে?

তবে এদের ত্যাগ বৃথা যাবেনা। এই দেশের মানুষ তার ন্যায্য অধিকার আদায় করার জন্য যখন জীবন দিতে শিখেছে তখন জয় হবেই, কেবলমাত্র সময় সাপেক্ষ। শ্রমিকরা কারখানা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কৃষকরা কাজ বন্ধ করেছে। ব্যবসায়ীরা দোকান-পাঁট বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্ররা স্কুল কলেজ ছেড়েছে। এতবড় প্রতিবাদ আর কোনোদিন কি হয়েছে?

৯ই জুন ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
ভোর বেলা বাহির হয়েই চোখে পড়লো পুরানা বিশে যাদের রাখা হয়েছে তারা দরজার ফাঁক দিয়ে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি আসতে আসতে ওদের দিকে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম ওদের অবস্থা। বলল, করুণ কাহিনী। রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। সারা দিন রাত থানায় একটা ঘরে বন্ধ করে রেখছে। এত লোক থানা হাজতে রেখেছে যে বসতে পর্যন্ত পারে নাই, সেখানেই পায়খানা, প্রসাব করেছে। যখন এঁদের ধরে আনে তখন খুব মারপিট করছে। কয়েকজনের কপালে মারার দাগ আমি দেখলাম। ছোট ছোট জখম। কয়েকজন কলেজের ছেলেও আছে। এখানে ১২টা সেল ৭২ জন লোককে রেখেছে। এক এক সেলে ৬ জন করে রেখেছে। পরনের কাপড় আর কয়েকজনের গায়ে জামা ছাড়া কিছুই নাই। এই দুই দিন দুই রাত্রে তাদের যা অবস্থা হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমি পানি দফার লোকদের বললাম ওদের পানি দিতে, গামছা এনে দিতে বললাম। জমাদার সাহেব, মেট, পাহারা, সকলকেই গামছা জোগাড় করে আনতে বললেন। দুই চারজন গোসল করেছে। খবর এল, কেস টেবিলে নিয়ে যেতে। আবার সকলকে বের করে লাইন ধরে ফাইল করে গুনে নিয়ে চললো কেস টেবিলে। স্বাস্থ্য পাশ হবে। নাম ঠিকানা ঠিক করে লিখবে। নাস্তা সেখানেই খাওয়াবে। আমি কেস টেবিলের ডিউটি জমাদারকে খবর দিলাম ওদের খাবার দিতে। কেস টেবিলের সামনে সকলকে ফাইল করে বসান হয়েছে। কাহাকেও উঠতে দেয় না। ওখানেই বসে ওদের খেতে হয়। গোসল-টোসল তো হলোই না। যাদের শাস্তি দিয়েছে তাঁদের কয়েদি কাপড় পরায়ে দিয়েছে। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে দরজা খুললে ওদের অনেককে দেখা যায়। আমি খোঁজখবর নিতে ছিলাম। এমন সময় ডাক্তার সাহেব সেই পথে আসছিলেন। দরজা খুলে গেছে, আমাকে ওরা দেখতে পেয়েছে, প্রায় দুই তিন শত হবে। আর হাত তুলে চিৎকার করে উঠেছে। আমিও ওদের হাত তুলে অভিনন্দন জানালাম। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আমি সরে আসলাম; কারণ যদি হৈ চৈ বেশি করে তবে ওদের উপর অত্যাচার হতে পারে। এক জমাদার নাকি ওদের গালাগালি করেছে আর মারধর করেছে। তাকে আমি খবর দিয়ে বললাম, এ কাজ আর করবেন না। সে আমার কাছে কসম করল, আর বললো, আমাদেরও ছেলে মেয়ে আছে স্যার, আমারও মানুষ। আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। যাদের ধরে নিয়ে এসেছে এঁরা গরিব, দিন মজুরি না করলে বাঁচতে পারবে না।

অনেক রিকশাওয়ালাকে এনেছে, বোধ হয় বাড়িতে তাঁদের ছেলেমেয়ে না খেয়েই আছে। দুই মাসের সাজা দিয়েছে অনেককে। দুপুর হয়ে গেল এই ভাবেই। কাগজ এল, দেখলাম তথাকথিত জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ থেকে বিরোধী দল ওয়াক আউট করেছে প্রতিবাদে। কারণ মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার সাহেব উঠাতে দেন নাই। একেই বলে আইন সভা! আর একেই বলে আইন সভার ক্ষমতা! চমৎকার ফার্স। ডিবেটিং ক্লাব বললেও চলে। তাহাও সব ক্ষেত্রে বলা চলে না। আমাদের দেশে একটা কথা আছে, ‘যেই না মাথার চুল তার আবার লাল ফিতা’।
সরকার স্বীকার করেছে আরও একজন হাসপাতালে মারা গিয়াছে। এই নিয়ে ১১ জনের মৃত্যু হলো। যারা আহত হয়েছে তাঁদের কোনো সংবাদ নাই আজ পর্যন্ত। প্রশ্ন জাগে, ’১১ জন মারা গেছে না অনেক বেশি মারা গেছে?’
সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন একটি চমৎকার কথা বলেছেন। কথাটি একেবারে সত্য। ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জয়ের সাধ্য নাই, ফেরারও পথ পাইতেছে না’।
পাঁচটার সময় বাইরে যেয়ে একাকী বসে চিন্তা করছি এমন স্মউ জমাদার সাহেব এসে বললেন, চলুন আপনার ইন্তারভিউ আছে, বেগম সাহেবা ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন। হঠাত এল, ব্যাপার কি! আজকাল তো ১৫ দিনের কমে দেখা করতে দেয় না। আগে যখন জেলে এসেছি তখন দেখা করতে অনুমতি দিত। কোনো খারাপ খবর কিনা! তাড়াতাড়ি রওয়ানা হলাম জেল গেটের দিকে। প্রায় দুই তিন শত ছেলে-কয়েদির কাপড় পরে, ফাইল করে বসে আছে। আমাকে দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেল। আমাকে হাত তুলে এক সাথে অভিবাদন জানাল, আমিও তাঁদের অভিনন্দন দিলাম। দাঁড়াবার হুকুম নাই, জেলের আইনে। তাই গেটের দিকে চললাম। শুভেচ্ছা জানিয়ে চললাম ছোট্ট ছেলেটা পূর্বের মতোই ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে উঠলো। আমি তাকে কোলে নিলাম। আদর করলাম। বাচ্চা মেয়েটি দরজার কাছে দাঁড়াইয়া ছিল। তাকেও আদর করলাম। জামালের জ্বর, দুরেই বসেছিল, কাছে ডেকে আনলাম। বড়মেয়ে, বড় ছেলে, খোকা, আমার স্ত্রী একে অন্যের দিকে চাইছে, কি যেন বলতে চায় বলতে পারছিনা। আমি বললাম এত তাড়াতাড়ি দেখা করার অনুমতি দিল – ব্যাপার কি? আমার স্ত্রী আস্তে আস্তে বলল যে, “টেলিগ্রাম এসেছে মার শরীর খুব খারাপ। বুঝতে আর বাকি রইলো না, মার শরীর বেশি খারাপ না হলে আমার আব্বা কোনোদিন টেলিগ্রাম করতেন না”। তিনি খুব বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোক। মনটা আমার খুবই খারাপ হয়ে পড়ল। ছেলে-মেয়েদের বুঝতে দিলাম না যে আমি খুব মুষড়ে পড়েছি। কিছু সময় বসলাম, কোনো কথাই আমার আর ভালো লাগল না। বেগম সাহেবার কাছ থেকে একটা পান খেলাম। ঢাকার ও অন্যান্য স্থানের অবস্থা যে খুব খারাপ বুঝতে বাকি রইলো না। আমার স্ত্রী বললো প্যারোলের জন্য দরখাস্ত করতে। আমি বললাম “কয়েকদিনের জন্য যেয়ে মার শরীর যদি ভালো নাহয় তাকে ফেলে আবার জেলে ফিরে আসলে তার হার্টফেল করে যেতে পারে। মুক্তি দেয় যাব, নতুবা নয়। কাউকে সত্বর পাঠাইয়া দেও, নাসেরকে খবর দেও বাড়ি যেতে”।
ফিরে এলাম আবার সেই নির্জন কারাগারে। আসার পথে কয়েদিরা আমাকে আদাব করল। কিন্তু ওদের দিকে চাইতে পারলাম না। শুধু হাত তুলে সালাম দিলাম ও লইলাম। আমার মনের অবস্থা দেখে মেট আলিমুদ্দি, বাবুর্চি, ফালতু ছুটে এল।
বললাম, “আমার মায়ের অসুখ”।
মনে পড়লো মা’র কথা। কিছুদিন আগে আমার মা খুলনা থেকে আমাকে ফোন করে বলেছিল, “তুই আমাকে দেখতে আয়, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। আমি বাড়ি যাইতেছি”। বললাম, “মা, আমি শীঘ্রই বাড়ি যাব তোমাকে দেখতে”। এরপর শুরু হল আমার উপর জুলুম, যশোরে গ্রেপ্তার। আমি যখন খুলনা গেলাম মা তখন বাড়ি চলে গিয়েছেন। যশোর থেকে ঢাকা এলাম। ঢাকায় গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলল শ্রীহট্ট। সেখানে জামিন হলো। আবার জেলগেটে গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলল ময়মন্সিংহ।
জামিন পেয়ে ঢাকায় এলাম। সিলেটে তারিখের দিন হাজির হতে হবে। আটটা মামলা আমার বিরুদ্ধে। মাসের অর্ধেক দিন চলে যায়। বরিশালে প্রোগ্রাম দিলাম। ১২ই মে সভা করব। সেখান থেকে আমার বাড়ি কাছে। আব্বাকে খবর দিলাম ১৩ তারিখে বাড়িতে পৌছাবো। আব্বা মা নিশ্চয়ই খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার উপর আমার মা বাবার টান যে কত বেশি সে কথা কাহাকেও বোঝাতে পারব না। তারা আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকেন। মনে হয় আজও আমি তাঁদের ছোট্ট খোকাটি। পারলে আমাকে কোলে করেই শুয়ে থাকে। এই বয়সেও আমি আমার মা-বাবার গলা ধরে আদর করি। কিন্তু হঠাত ৮ই মে দিন গত রাতে ঢাকায় আমাকে বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা জেলে আটক করল। আমার সেই কথাই বার বার মনে পড়তে লাগলো। “আমি বাঁচব না। আমাকে দেখতে আয়”- মা বলেছিলেন। কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে রইলাম। লেখাপড়া করতে পারলাম না। মেট আর বাবুর্চি জোর করেই আমাকে খাওয়াতে চেষ্টা করলো। গতকাল খবর এল কত লোক মারা গেছে তেজগাঁও এবং নারায়ণগঞ্জে। অনেক চেষ্টা করলাম ঘুমাতে, পারলাম না।

১০ই জুন ১৯৯৬ ।। শুক্রুবার
আগেই লিখেছি আমাকে একা রাখা হয়েছে। কারও সাথে আলাপ করার উপায় নাই। কারও সাথে পরামর্শ করারও উপায় নাই। সান্ত্বনা দেবারও কেহ নাই। কারাগারের ভিতর একাকী রাখার মতো নিষ্ঠুরতা আর কি হতে পারে? অন্যান্য রাজবন্দিরা বিভিন্ন জায়গায় এক সাথে যাবে, কিন্তু আমাকে কারও কাছে দেওয়া চলবে না। সরকারের হুকুম। জেল কর্তৃপক্ষের কিছুই করার নাই। নূরুল ইসলাম চৌধুরী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মুজিবুর রহমান (রাজশাহী) এবং তাজউদ্দীনকে পূর্বেই ঢাকা জেল থেকে বিভিন্ন জেলে আলাদা আলাদা করে রেখেছে। আমাদের দলের আর যাদের গ্রেপ্তার করে এনেছে তাঁদের সবচেয়ে খারাপ সেলে রাখা হয়েছে। এঁদের খাবার কষ্টও দিচ্ছে। মাত্র দেড় টাকার মধ্যে খেতে হবে।
বাইরে যে ছোট বসার জায়গাটি আছে তার উপর বসেই চুপ করে আছি। জমাদার সাহেব এসে বললেন, চিন্তা করে শরীর নষ্ট করবেন না। দুই একজন কয়েদিও পাশ দিয়ে ঘুরে গেল, সাহস করে কিছুই বলল না। এইভাবে অনেক সময় কেটে গেল। ৯টার সময় ডিপুটি জেলার সাহেবকে খবর দিলাম আমার সাথে দেখা করার জন্য। তিনি খবর পেয়েই চলে এলেন। তাকে বললাম একটা টেলিগ্রাম করতে চাই চীফ সেক্রেটারির কাছে, এই কথা বলে, ‘মায়ের শরীর খুবই খারাপ আমার গ্রামের বাড়িতে। যদি সম্ভবপর হয় আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন’। তিনি বললেন, দিয়ে দেন, আমরা তো পাঠাবার মালিক।
টেলিগ্রাম লিখে পাঠাইয়া দিলাম। জানি কি হবে! এঁরা আমাকে ছাড়বে না। পরে বলবে, সরকারকে তো জানানো হয় নাই। তাই জানাইয়া রাখলাম।
ইত্তেফাক কাগজেও মায়ের অসুখের কথা উঠেছে। অনেক চেষ্টা করি, চিন্তা করব না। তবুও বার বার একই কথা মনে পড়ে। আমার মার প্রত্যেকটি কথাই আমার মনে পড়তে থাকে।
পাকিস্তানি কায়েম হওয়ার পরেই ১৯৪৮ –এ যখন আমাকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেপ্তার করল, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে ১৯৫২ সালে ছাড়ল, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস – এদেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?’

বলতে পারেন, আমার এই গ্রাম্য মা’র কথার কি জবাব দিব? বললাম ‘মা তোমাকে পরে বলবো’। কোনো কিছু বলার আমার ছিল কি? একদিন সুযোগ বুঝে মার কাছে অনেক কথা বললাম, মা কি বুঝতে চায়! আমার মাকে কোনদিন বোঝাতে পারি নাই। মাঝে মাঝে আমাকে বলত, ‘যে তোকে জেলে নেয় আমাকে একবার নিয়ে চল, বলে আসব তাকে মুখের উপর’। আমার ভাইবোনেরা সকলেই হাসতো মা’র কথা শুনে। আজ মার অনেক কথাই আমার মনে জাগছে।
দৈনিক খবরের কাগজগুলি এল, দেখলাম কাগজগুলিকে সরকার সংবাদ সরবরাহ করা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায়ই প্যামফ্লেট করে রেখেছে। কোনো সংবাদই নাই এই আন্দোলনের।
জেলের কয়েদিদের খবর হলো, হাজার লোকের উপর মারা গেছে পুলিশের গুলিতে’ –এমন অনেক খবর রটছে। সত্য খবর বন্ধ হলে অনেক আজগুবি খবর গ্রামে গ্রামে ছড়াইয়া পড়ে, এতে সরকারের অপকার ছাড়া উপকার হয়না।
আজ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা, যারা বাইরে আছেন যদি সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেন তবে দাবি আদায় করতে বেশি সময় লাগবে না।
লেখাপড়ায় আজ আর মন দিতে পারলাম না। কখন যে তালাবদ্ধ করে চলে গিয়াছে সে খবরও আমার জানা নাই, কারণ সন্ধ্যার একটু পূর্বেই ঘরে চলে এসেছিলাম। মেট, বাবুর্চি, ফালতু, সিপাহিরা-যারা আমার ঘরে থাকে তারা আমার কাছে এসে বলতে লাগল, ‘ভাববেন না স্যার। আল্লা করলে আপনার মা ভাল হয়ে যাবেন’।
তাই ভাবি রাজনীতি মানুষকে কত নিষ্ঠুর করে! কয়েদিদেরও মায়া আছে, প্রান আছে, কিন্তু স্বার্থান্বেষীদের নাই। ভাবলাম রাতটা কাটাতেই কষ্ট হবে। কিন্তু কেটে গেল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ বাইরে তাকাইয়া ছিলাম। দেখতে চেষ্টা করলাম ‘অন্ধকারের রূপ’, দেখতে পারলাম না। কারণ আমি শরৎচন্দ্র নই। আর তার মতো দেখবার ক্ষমতা এবং চিন্তাশক্তিও আমার নাই।

১১ই জুন ১৯৬৬ ।। শনিবার
জেলার সাহেবকে খবর দিলাম, আমি দেখা করতে চাই। তিনি খবর পাঠালেন নিজেই আসবেন দেখা করতে। তিনিও শুনছেন মায়ের অবস্থা ভাল না। বাইরে বসে দেখতে লাগলাম, একটা মোরগ একটা মুরগি আর একটা বাচ্চা মুরগি আপন মনে ঘুরে ঘুরে পোকা খেতেছে। আমার বাবুর্চি খাবার থেকে কোনোমতে কিছু কিছু বাঁচাইয়া এই কয়টা মুরগি জোগাড় করেছে। ছোট ছোট যে মাঠগুলি পড়েছিল আমার ওয়ার্ডে সেগুলিতে দূর্বা ঘাস লাগাইয়া দিয়াছিলাম। এখন সমস্ত মাঠতি সবুজ হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি পেয়ে তাড়াতাড়ি বেড়ে চলেছে। দেখতে বড় সুন্দর হয়েছে জায়গাটি। এরই মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় মুরগিগুলি। অনেকক্ষণ বসে রইলাম। ফুলের গাছ চারদিকে লাগাইয়াছিলাম, নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করেছে। বড় চমৎকার লাগছে। আজকে সূর্যের জোর নাই, বেশ মেঘলা দিন। খুবই বাতাস বইছে। ঘরে ফিরে বসলাম। দেখি কম্পাউন্ডার সাহেব আসছেন। বহুদিন দেখা হয় নাই। সিভিল সার্জন সাহেব জেল ভিজিট করেন সপ্তাহে দুইবার। কিন্তু দুই সপ্তাহ আমাকে দেখতে আসেন নাই। বোধ হয় আজ আসবেন। আধা ঘন্টা পরে জেলের ডাক্তার সাহেবদের সাথে নিয়ে আমাকে দেখতে আসলেন। চিন্তা করে শরীর খারাপ করতে নিষেধ করলেন। খোদার রহমতে মা ভাল হয়ে যাবেন তাহাও বললেন। খুব খোদাভক্ত লোক। এই বয়সে হজ্ব করেও এসেছেন। দেরি করতে পারেন না, অনেক কাজ। কাজ নাই আমাদের মতো বিনা বিচারে বন্দি হতভাগাদের!
আমি আবার বই নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাজও একটাই। আমি তো একা থাকি। আমাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। একাই থাকতে হবে। জেলার সাহেব সিকিউরিটি ব্রাঞ্চের ডিপুটি জেলার সাহেবকে নিয়ে আসলেন। বসতে দিয়ে বললাম, ‘আপনার অনেক কাজ, বহু লোককে রাস্তা থেকে ধরে এনে জেল দিয়েছে – তাঁদের বন্দোবস্ত করা, তবু কস্ট দিতে বাধ্য হলাম’। বললাম, ‘আমাকে কেন একলা রাখা হয়েছে? আমার সহকর্মীদের কেন কনডেম সেলের মধ্যে রেখেছেন? তাঁদের মাত্র দেড় টাকা দেওয়া হয়েছে খাবার জন্য। অন্যান্য ডিপিআর ও রাজবন্দিদের এক জায়গায় রাখতে পারেন। তারা দেখাশোনা করে নিজের পাকের বন্দোবস্ত করতে পারে। ২৬ সেলে পুরানা সিকিউরিটি আছে। তারা এক জায়গায় আছে, তাঁদের পাকের বন্দোবস্ত তারাই করে। তাঁদের সামনেই পাক হয়। ডিপিআরদের এক এবং দুই নং ওয়ার্ডে রেখেছেন। ডিভিশন পাওয়া কয়েদিরা এক জায়গায় থাকে, তাদেরও আলাদা পাক হয়। আমি একলা থাকি, আমার সামনেই পাক হয়। আমার সহকর্মীরা কি অন্যায় করেছে, কেউ কি জেলের আইন ভেঙেছে যে এক জায়গায় থাকতে পারেন না, আর একসাথে পাক হতে পারে না? এঁদের কাউকে ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। এক সাথে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত করলে আপনাদের কি ক্ষতি হয়? আমার মনের অবস্থাও খারাপ, মা অসুস্থ। অনেক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। বহুলোককে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। আমি এই অবস্থায় একলা থাকলে শরীর ভেঙ্গে পরবে’। তার একই উত্তর, তাঁদের হাতে কিছুই নাই। উপর থেকে যা হুকুম আসে তাঁদের তাই করতে হয়। অন্য কোন রাজবন্দীদের বা ডিপিআরদের বেলায় বোধ হয় উপরের হুকুম আসে না – কোথায় কাকে রাখতে হবে! শুধু কি আওয়ামী লীগারদের বেলায় এই অন্যায় ব্যবস্থা। তিনি বললেন জেলের ডিআইজি সাহেবকে তিনি বলবেন তিনি কিছু করতে পারেন না, তার হাতে কিছুই নাই।
তাঁদের মুখের ভাব দেখে বুঝলাম সত্যই তাঁদের হাতে কিছুই নাই। কয়েদিদের কোথায় রাখা হবে জেল কর্তৃপক্ষ জানেন না। তবে দায়িত্ব তাঁদের। কোনো কিছু গোলমাল হলে এরাই আবার দায়ী হবে।
জেলার সাহেব ও ডিপুটি জেলার সাহেব চলে গেলেন। আমি গোসল করে খেতে বসেছি, দেখি ইলিশ মাছ, নারিকেল দিয়ে পাক করেছে। জিজ্ঞাসা করলাম এটা আবার কি? এতো কোনোদিন খাই নাই, এ আবার কেমন? বাবুর্চি বললো, একজন বলেছিল তাই পাকালাম। বললাম আমিতো এখানেই ছিলাম। জিজ্ঞাসা করলেই ভাল হতো। যাহা হউক, কিছু খেয়ে কাগজ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কাগজ পড়তে পড়তে ঘুম আসে, কিন্তু ঘুমাতে চাই না। দিতে ঘুমালে রাতে তা হলে আর ঘুমাতে পারব না।
সর্বনাশ! ট্রেন দুর্ঘটনায় বহুলোক মারা গেছে। অনেক জখম হয়েছে। এখনও পুরা খবর পাওয়া যায় নাই। দুর্ঘটনা কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছে হয়েছে। ব্রিটিশ আমলের লাইন। সেখানে একটু খারাপ হলে মেরামত করা হয়। পুরাপুরি এর একটা মেরামত হওয়া প্রয়োজন। কে খেয়াল করে! পূর্ব বাংলার রেলওয়ের দুরাবস্থা আমার খুব জানা আছে। ট্রেনে চড়ে বহু ভ্রমণ আমি করেছি। দুই চারটি নতুন ট্রেন ছাড়া আর সকলগুলিই ব্রিটিশ আমলের। এমন কোনো ট্রেন যাতে বৃষ্টি নামলে পানি পড়েনা। তবে পানি যখন ট্রেনে পাওয়া যায় না, তখন খোদার পানি পড়তেই বা আপত্তি কি! কিছুদিন পূর্বে যখন আমাকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ নেওয়া হয় তখন এক ফার্স্ট ক্লাসে আমি ছিলাম, দুই পুলিশ ইন্সপেক্টারও ছিলেন। হঠাত বৃষ্টি হলো, আমরা অনেক কষ্টে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সমস্ত কামরাটি ভিজে গেল। বললাম চলুন অন্যঘরে যাওয়া যাক। তারাও আমার সাথে পাশের ঘরে এসে আশ্রয় নিল। সেখানেও পানি পড়ে, তবে একটু অল্প পরিমানে। খাবার পানিও অনেক সময় থাকে না। কোন মন্ত্রী যেন বলেছেন ‘সাবোটাস’! ঠিকই বলেছেন, সাবোটাস তো নিশ্চয়ই, কারণ কেন্দ্রীয় সকারই ‘সাবোটাস’ করেছে দীর্ঘ ১৭ বৎসর!
ভারতবর্ষ যখন ভাগ হয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন কায়েম হয় তখন রেলওয়ের ক্ষতিপূরণ পাওয়া গিয়েছিল সংখ্যানুপাতে। পূর্ব বাংলা টাকা বেশি পেয়েছিল ভাগে। দুঃখের বিষয়, যতদূর পশ্চিম পাকিস্তান রেলওয়ের উন্নতি হওয়া প্রয়োজন ছিল তাহা করে নিয়ে পূর্ব বাংলার রেলওয়ে আলাদা করে প্রদেশের হাতে দেওয়া হলো। সেই পরিমাণ ক্ষতিপূরন কি দেওয়া হয়েছে? ভাল ভাল ইঞ্জিন ও বগিগুলি পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে নেওয়া হয়। কতগুলি নিয়েছে তার হিসাব কি তারা দিয়েছে? আজ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটি ডাবল লাইন করা হয় নাই।
পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে দেখুন কত বাহার। বিরোধী দল ও স্বতন্ত্রদল পূর্ব বাংলার আইন পরিষদের কক্ষ ত্যাগ করেছেন রেল দুর্ঘটনার মুলতবি প্রস্তাব অবৈধ ঘোষণার প্রতিবাদে। মাহিনা ও পাসগুলি থাকলেই ত চলে! চমৎকার আইন সভা! দুনিয়ায় এর নজির নাই।
এতো ‘মৌলিক গণতন্ত্র’, এর সৃষ্টিকর্তা জনাব আইয়ুব খান। নিজকে পাকাপাকিভাবে ক্ষমতায় রাখার ব্যবস্থা। জনগনের কি প্রয়োজন এতে? মৌলিক গণতন্ত্রী আছে, টাকা আছে, সরকারী কর্মচারী আছে। আইয়ুব সাহেব আছেন ক্ষমতার শীর্ষে আর তার দুই ছোট লাট মোনায়েম খান সাহেব আর পশ্চিম পাকিস্তানে কালাবাগের খান সাহেব তো আছেন। চিন্তা কি?
সিলেটে ভয়াবহ বন্যায় বহু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আবার অনেক জায়গায় ঝড়েও যথেষ্ট মানুষ মারা গেছে ও ঘড়বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। জানি না সরকারি সাহায্য কত পরিমাণ পৌঁছাবে। সরকারি সাহায্যের নমুনা আমার জানা আছে, কারণ কক্সবাজারে ধ্বংসলীলা আমি দেখে এসেছি।
বিকালে হাসপাতালের দিকে চেয়ে দেখতে পাই শাহাবুদ্দিন চৌধুরী আমার দিকে চেয়ে আছেন। তাকে সালাম দিলাম এবং তাড়াতাড়ি সুস্থ হউন এই কামনা করলাম। বহুদূর, কথা বললে শুনবে না, আর বলাও উচিৎ নয়, আইনে বাধা আছে। দেখি বাদশা মিয়া (বাবু বাজারের) আমাকে সালাম দিচ্ছে। বেচারা জেল খাটতে খাটতে শেষ হয়ে গেল। তার শক্তি ও টাকাই তার কাল। বাদশা মিয়ার পিছনে দাঁড়াইয়া অনেকে আমাকে পিঠ দেখাল কেমন করে পুলিশ অত্যাচার করেছে। অনেকের মাথায় ব্যান্ডেজ, আহত হয়ে হাসপাতালে আছে। শুনলাম প্রায় ৪০/৫০ জন হাসপাতালে আছে। ক্ষোভে দুঃখে মনে মনে বললাম, ‘মার খাও। তোমাদের জাত ভাইয়ের লাঠির বাড়ি ও বন্দুকের গুলি খাও। জেল জুলুম তোমাদের কপালে আছে। কারণ তোমরা তো পরাধীন জাতি’। পরাধীন জাতের কপালে এমন লাঞ্ছনা অ বঞ্চনা হয়েই থাকে। এতে আর নতুনত্ব কি?
লেখাপড়া করতে ইচ্ছে হয় না। সময়ও কাটে না, জেলে রাতটাই বেশি কষ্টের। আবার যারা আমার মত একাকী নির্জন স্থানে থাকতে বাধ্য হয়-যাকে ইংরেজিতে বলে ‘Solitary Confinement’-তাঁদের অবস্থা কল্পনা করা যায় না।

১২ই জুন ১৯৬৬ ।। রবিবার
সকালে যখন হাঁটাহাঁটি করতেছিলাম তখন শুনলাম ৮২ জন ছেলে, যাদের ৭ই জুন গ্রেপ্তার করেছে তাঁদের দুইটি ব্লকে রাখা হয়েছে। সর্বমোট ৮টা ছোট ছোট সেল, চার হাত চওড়া আট হাত লম্বা। দুই নম্বর ব্লক খালি করে খুব ভোরে একজনকে এনে রাখা হয়েছে। নাম আবদুল মান্নান। ভাবতে লাগলাম কোন মান্নান? জিজ্ঞাসা করলাম, চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কি না, কেউ বলতে পারলো না। কোন ধারায় গ্রেপ্তার করেছে, বলল ডিপিআর না। খোঁজ নিয়ে জানলাম মামলা দিয়েছে নারায়ণগঞ্জ, তাতেই তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ডিভিশন দেয় নাই। এক কাপড়ে এসেছে। জুতা খুলে রেখেছে গেটে। গামছা নাই, কাপড় নাই, কোন জামা নাই, যে জামাটি গায়ে দিয়ে এসেছে তা ছাড়া। আমি তাড়াতাড়ি কিছু কাপড়চোপড় পাঠাইয়া দিলাম যাতে আপাতত চলতে পারে। ভাত নিতে যখন সেল থেকে বের হলো আমি দাড়িয়েছিলাম ওকে দেখতে। দেখলাম সত্যিই শ্রমিক নেতা মান্নান। তাকে বললাম, ‘চিন্তা করিও না, জামিনের চেষ্টা করতে হবে’।
কিছুই তো আমার ভাল লাগছে না। মায়ের খবর না পাওয়া পর্যন্ত মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছি না। বাগানের কাজে হাত দিলাম। আবার ঘরে ফিরে এলাম। গতকালের কাগজগুলি আবার ভাল করে দেখতে লাগলাম। অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব ১৯৬৬-৬৭ সালের বাজেট পেশ করেছেন। রাজস্ব খাতে আয় ধরা হইয়াছে ৫৬৩ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা। ব্যয় হইবে ৩৭২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা। ১২৭ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা প্রদেশের ভাগে যাবে। রাজস্ব খাতে ৬৩ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। উন্নয়ন খাতে আর্থিক বৎসরে ৪৪২ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা আয় হইয়াছে, ব্যয় বরাদ্দ হইয়াছে ৪৭৯ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা। উন্নয়ন খাতে ৩৬ কোটি ৫৬ লক্ষ টাকা ঘাটতি পড়িবে। নুতন কর বসাইয়াছে তাহাতে ৩৭ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা আদায় হইবে। কেরোসিন, লবণ, সাবান অন্যান্য জিনিসের উপর কর ধার্য হয়েছে। ডাক মাশুলও বাড়াইয়াছে। দেশরক্ষা খাতে ২২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ ধরা হইয়াছে। ১৯৬৫-৬৬ সালে ১৩৬ কোটি টাকা ছিল। যে কর ধার্য করা হইয়াছে তাহার সবটাই গরিবকে দিতে হইবে। শোয়েব সাহেব যে অর্থনীতি চালু করিয়াছেন তাহাতে গরিবকে আরও গরিব করিয়া কয়েকজন বড় লোক ও শিল্পপতিকে সুযোগ-সুবিধা করিয়া দিবার ষড়যন্ত্রই কায়েম হইবে।
সরকার ক্রমাগত কর ধার্য করিয়া জনসাধারনের দুঃখ দুর্দশা বাড়াইয়া চলিয়াছেন। শোয়েব সাহেব অর্থনীতিতে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করিয়া চলিয়াছেন। তার বাজেটে এই শিল্পপতিদের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘ট্যাক্স হলিডে’ ভোগের ব্যবস্থা রাখিয়াছেন। কিন্তু গরিব জনসাধারণ বোধহয় আর আলো জ্বালাইয়া রাতের খাবার খেতে পারবে না। খাবার জন্য কিছুই থাকবেও না। দেশ রক্ষা খাতে যে শতকরা ৬৫ ভাগ ব্যয় করা হবে এর মধ্যে পূর্ব বাংলা কতটুকু পাবে? ৫/১০ ভাগ এর বেশি নিশ্চয়ই না।
দেখেই খুশি হলাম যে আমি ও আমার সহকর্মীরা অনেকেই জেলে আটক থাকা অবস্থায়ও আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীরা শান্তিপূর্ব গণ আন্দোলন চালাইয়া যাওয়ার সংকল্প করিয়াছে। রক্ত এঁরা বৃথা যেতে দিবে না। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক্টিং সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের। তার সভাপতিত্বে ১১ ঘন্টা ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়েছে। মিজানুর রহমান চৌধুরী জাতীয় পরিষদে যোগদান করতে পিন্ডি চলে গেছে। ১৭ই, ১৮ই, ১৯শে জুন ‘জুলুম প্রতিরোধ’ দিবস উদযাপন করার আহবান জানাইয়াছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ১৬ই অগাস্টের পূর্বে সমস্ত গণবিরোধী ব্যবস্থার অবসান দাবী করিয়াছে। তা না করিলে ১৬ই অগাস্ট থেকে জাতীয় পর্যায়ে গণআন্দোলন শুরু করা হবে। মনে মনে ভাবলাম আর কেউ আন্দোলন নষ্ট করতে পারবে না। দাবি আদায় হবেই।
৬দফার বাস্তবায়নের সংগ্রাম আওয়ামী লীগ অব্যাহত রাখবে তাও ঘোষণা করেছে। এখন আর আমার জেল খাটতে আপত্তি নাই, কারণ আন্দোলন চলবে।
ভাবতে লাগলাম কর্মীদের টাকার অভাব হবে। পার্টি ফান্ডে টাকা নাই। আমিও বন্দোবস্ত করে দিয়ে আসতে পারি নাই। মাসে যে টাকা আদায় হয় তাতে অফিসের খরচটি চলে যেতে পারে। তবে আমার বিশ্বাস আছে, অর্থের জন্য কাজ বন্ধ হয়ে থাকেনা। জনসমর্থন যখন আওয়ামী লীগের আছে, জনগনের প্রাণও আছে। আমি দেখেছি এক টাকা হাজার টাকা অফিসে এসে দিয়ে গিয়াছে, যাদের কোনো দিন আমি দেখি নাই। বোধহয় অনেককে দেখবোও না। ভরসা আমার আছে, জনগণের সমর্থন এবং ভালবাসা দুইই আছে আমাদের জন্য। তাই আন্দোলন ও পার্টির কাজ চলবে।
সন্ধ্যার একটু পূর্বে বরিশাল থেকে বাবু চিত্ত সুতারকে নিয়ে এসেছে। আমার সামনেই বিশ সেলের ৫নং ব্লকে রেখেছে। এখানে পাবনার রণেশ মৈত্রও থাকেন। পরীক্ষা দিতে এসেছেন। দুইজন এক সাথেই থাকবে। ইনি এমপি ছিলেন, খুব নিঃস্বার্থ কর্মী। তাকেও ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। তার কাছ থেকে খবর পেলাম আমার ভগ্নিপতির সাথে জাহাজে দেখা হয়েছে, আমার মা অনেকটা ভাল। মনে একটু শান্তি পেলাম।
চিত্তবাবু বললেন, অন্যান্য দল ভুল করেছে আওয়ামী লীগের ডাকে সাড়া না দিয়ে। আর আলাপ হতে পারলো না। কারণ আমি রাস্তায় ছিলাম তাই একটু কথা হলো। তারপর তারা যার যার ব্লকে চলে গেল। আমি আমার ব্লকে একা, একেবারে একা। কথা বলারও লোক নাই, কয়েকজন সাধারণ কয়েদি ছাড়া। ডাক পড়েছে, বুড়া জমাদার সাহেব বন্ধ করতে এসেছেন। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে কাগজ কলম নিয়ে আমার লেখার কাজে বসে পড়লাম।

১৩ই জুন ১৯৬৬ ।। সোমবার
আজকাল খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠি। স্বাস্থ্য রক্ষা করারও চেষ্টা করি। বাইরে বসার জায়গায় যখনই বসেছি দেখি ইউনুস এসে হাজির। ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করে। ইউনুসের বিশ বছরের সাজা হয়েছে। খুনের মামলা। সে বলে কিছুই জানিনা। এর বেশি কিছু গোছাইয়া বলতে পারে না। আমাকে এসে ধরেছে, ‘একটা কলম মাইরা দেন না, আমি খালাস হয়ে যাই। আপনি সইটা দিলেই হয়’। রোজই দুই একবার একই কথা বলতে থাকে। আজ আর ছাড়ছেইনা। জমাদার, সিপাহি যেই আসে তারা ওকে বলে, ‘সাহেবকে ভালো করে ধর, তা হলেই খালাস’। জমাদার সিপাহীদের সে অনুরোধ করে গেটটা খুলে দিতে। তাহারা এখন মজা করে আমাকে দেখাইয়া দেয়। এক জমাদার সাহেব খুব রসিক মানুষ। বলে, ‘খালিখালি কি কাজ হয় পাকিস্তানে? কিছু খরচ টরচ করো’। ইউনুসের কয়েক টাকা জমা আছে। মেট, পাহারা সকলকে বলে কিছু বাজার আনাইয়া দিতে। দুই টাকার বাজার সিগারেট যে এনে দিবে তাকে আধা দিবে। বাকিটা আমাকে ও জমাদার সাহেবকে খাওয়াবে। সকলেই ওকে নিয়ে খেলা করে। আজ সত্য সত্যই সে বাজার আনতে গেটে রওয়ানা হয়েছে। অফিসে জমা টাকা থেকে সিগারেট, বিড়ি কিনে দেয়। এখন আর বিড়ি না, সকলে সিগারেট বা তামাক খায়।
আমি বললাম, ‘ইউনুস কোথায় যাও?’ বলে ‘বাজার আনতে যাই, স্যার। আমি রাগ করে বললাম, যদি বাজার আনো তবে আর আমি কলম মারবো না। সে চুপ করে দাঁড়াইয়া রইল। না বাজার সে আনবে না, যদিও সিপাহি ও কয়েদিরা বলেছে। কি করে ওকে বোঝাই আমার কলম যে ভোতা হয়ে গেছে। এ কলমে যে আজ আর কাজ হয় না। আমিও যে একজন ওরই মত বন্দি সেটা আমি শত চেষ্টা করেও বোঝাতে পারিনা। সকলেই ওকে নিয়ে তামাশা করে। ও যে একেবারে পাগল হয়ে যেতে পারে তাহা আমি সকলকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। এখন এমন অবস্থা হয়েছে, কেউ কিছু না বললেও, সে আমার কাছে চলে আসে, আর ঐ একই কথা।
খবরের কাগজ এসেছে, আমিও এরমধ্যে খেয়ে নিয়েছি। সিলেটের বন্যায় দেড়লক্ষ লোক গৃহহীন। ১০ জন মারা গেছে। কত যে গবাদি পশু ভাসাইয়া নিয়া গেছে তার কি কোনো সীমা আছে! কি করে এদেশের লোক বাচবে তা ভাবতেও পারিনা। তার উপর আবার করের বোঝা।
ডক্টর নূরুল হুদা সাহেব পূর্ব পাকিস্তানের বাজেট পেশ করেছেন। এক কোটি ১৬ লক্ষ টাকা নূতন কর ধার্য করেছেন। রাজস্ব খাতে আয় দেখাইয়াছেন ১১৮ কোটি ২৭ লক্ষ আর ব্যয় দেখাইয়াছেন ৯৮ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা। উদ্বৃত্ত ১৯ কোটি ৯৯ লক্ষ টাকা। উন্নয়ন খাতে ব্যয় বরাদ্দ ২৩০ কোটি, প্রাপ্ত সম্পদ ২০৪ কোটি ৬৯ লক্ষ টাকা। মোট ঘাটতি ২৫ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা।
কত কত মানুষ দিবে! কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব বলেছেন, জনসাধারণ অধিকতর স্বচ্ছল হইয়াছে তাই কর ধার্য করেছেন। তিনি যাদের মুখপাত্র এবং যাদের স্বার্থে কাজ করেছেন তারা সচ্ছল হয়েছেন। তাঁদের করের বোঝা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীরা আনন্দিতই শুধু হন নাই, প্রকাশ্যে মন্ত্রীকে মোবারকবাদ দিয়ে চলেছেন। আর জনসাধারণ এই গণবিরোধী বাজেট যে গরিব মারার বাজেট বলে চিৎকার করতে শুরু করেছে।
পাকিস্তান নাকি ইন্দোনেশিয়াকে চৌদ্দ কোটি টাকা ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। যে সরকার ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুনিয়া ভর ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমেরিকা সাহায্য না দিলে যারা বাজেট পেশ করতে পারে না, দিন দিন জনগনের উপর করের বোঝা চাপাইয়া অতিষ্ঠ করে তুলেছে, তারা আবার ঋণ দিতে রাজি! এভাবেই আমরা ইসলামের খদ্মত করছি! কারণ না খেয়ে অন্যকে খাওয়ানো তো ইসলামের হুকুম। দয়ার মন আমাদের! এমন প্রেম ভালবাসা-ই তো আমাদের নীতি হওয়া উচিৎ! কাপড় যদি কারও না থাকে তাকে কাপড়খানা খুলে দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসবা। আমাদের সরকারের অবস্থাও তাই।
মা আরোগ্যের দিকে যেতেছে। ছোট ভাই নাসের তাকে খুলনায় নিয়ে এসেছে চিকিৎসার জন্য। মনটা আমার একটু ভাল। বিকালে আবার পূর্বের মতো প্রায় এক ঘন্টা জোরে জোরে হাঁটাহাঁটি করি। ‘আমার বাঁচতে হবে, অনেক কাজ বাকি রয়েছে’।
একটু গরম কম পড়েছে, রাতে ঘুম হয় আজকাল বেশ।

১৪ই জুন ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
ভোরের দিকে বৃষ্টি হতেছিল। তাড়াতাড়ি উঠেছি জানলা বন্ধ করতে। বিছানা ভিজে যাবে। উঠে দেখি মেট উঠে জানালা বন্ধ করেছি। আমি আবার শুয়ে পড়লাম, বিজলি পাখা বন্ধ করতে বললাম, কারণ বেশ একটু ঠান্ডা পড়েছে। আবার ঘুমাইয়া পড়লাম, উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল। উঠেই দেখি চা প্রস্তুত। খেয়ে বাইরে হাটতে বেরুলাম। মুরগিটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাকে যেন কি কি ওষুধ খাইয়েছে বাবুর্চি। বলল, একটু ভাল। আমাকে বলল, মোরগটা জবাই দিয়ে ফেলি। বললাম, না, দরকার নাই। ও বেশ বাগান দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওর চলাফেরার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভাল লাগে।
আজ থেকে হাইকোর্টে আমার হেবিয়াস কর্পাস মামলার শুনানি হবে। কি হবে জানি না। অন্যায়ভাবে আমাকে গ্রেপ্তার করেছে, ডিপিআরএ গ্রেপ্তার চলেছে। ঘাটাইল আওয়ামী লীগ অর্গানাইজিং সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলি মোক্তারকে গ্রেপ্তার করে ময়মনসিংহ জেলে পাঠাইয়াছে।
Rawle Knox (Daily Telegraph, June 7, 1966) ‘East Pakistan’s Case’ এই নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তার ব্যক্তিগত মতামত। কাগজ যে কোনো মতামত দিতে পারে তাতে আমার কিছুই বলা উচিৎ না। তবে পূর্ব পাকিস্তানের উপর জুলুমের খবর আজ আর ছাপে নাই। ৬ দফা দাবি পেশ করার সাথে সাথে দুনিয়া জানতে পেরেছে বাঙালিদের আঘাত কোথায়? বাঙালিদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা এমনকি ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কিছুই নাই। ১৯ বৎসর পর্যন্ত চলেছে শোষণ আর লুণ্ঠন। এখন এঁরা বুঝে ফেলেছে এঁদের জুলুম করার কায়দা কৌশল। তবে আর বেশি দিন নাই। যদিও জাতি হিসাবে বাঙালি পরশ্রীকাতর জাতি। ‘পরশ্রীকাতরতা’ দুনিয়ার কোন ভাষায় খুঁজিয়া পাওয়া যাবে না, একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। এটি আমাদের চরিত্রের সাথে ওতোপ্রোতভাবে মিশে আছে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকার যেভাবে বাংলাকে শোষন করেছিল তার চেয়েও উলঙ্গভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি কলোনিয়াল শোষকরা পূর্ব বাংলাকে শোষণ করছে। ইংরেজদের শাসনের সময়ও ইংরেজদের সাহায্য করবার জন্য বাঙালির অভাব হয় না। আজও হবে না। তবে যারা ত্যাগ করতে পেরেছে – ত্যাগ করে যাক, দুঃখ ও আফসোস করার কোনো দরকার নাই। সাংবাদিক Rawle Knox একটি সত্য কথা লিখেছেন, ‘If Rawalpindi continues to believe that the revolutionary spirit of Bengal is something of a joke, the Pakistani capital could be making quite a mistake.’
পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য আমারও মনে হয় ৬ দফা দাবি মেনে নেওয়া উচিৎ – শাসকগোষ্টীর বিশেষ করে আইয়ুব খান ও তার অনুসারীদের। তা না হলে পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভবনা আছে। বাঙালির একটি গোঁ আছে, যে জিনিস একবার বুঝতে পারে তার জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরনও করতে পারে। পূর্ব বাংলার বাঙালি এটা বুঝতে পেরেছে যে এঁদের শোষণ করা হইতেছে চারদিক দিয়ে। শুধু রাজনৈতিক দিক দিয়েই নয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়াও। আমি বিকালে সেলের বাইরে বসে আছি। কয়েকজন ছোট ছোট বালক জামিন পেয়ে বাইরে যেতেছে। খুব তাড়াতাড়ি হাটছে, মনে হয় যেতে পারলেই বাঁচে; থাকতে চায়না, এই পাষাণ কারার ভিতরে। আমার কাছে এসে থেমে গেল। বলল, ‘আমরা চললাম স্যার, আপনাকে বাইরে নেওয়ার জন্য আবার আন্দোলন করব’।
আমি বললাম, ‘যাও, সকলকে আমার সালাম দিও। আমার জন্য চিন্তা করিও না’। ওদের দিকে আই চেয়ে রইলাম। ওদের কথা শুনে আনন্দে আমার বুকটি ভরে গেল। মনে হলো এটা তো আমার কারাগার নয়, শান্তির নীড়। এই দুধের বাচ্চাদের কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য আমার দুঃখ ভুলে গেলাম। শান্তি পেলাম মনে। মনে হলো পারবো! বহুদিন জেল খাটতে পারব। এরাও যখন এগিয়ে এসেছে দেশের মুক্তির আন্দোলন তখন কে আর রুখতে পারে?
আমি যে একলা থাকি এ কথা কখনও আমার মন থেকে যায় না। এতে আমার শরির নষ্ট হবার সম্ভবনা আছে। আমাকেও আওয়ামী লীগ কর্মীদেরই সরকার বেশি কষ্ট দিতে চায় কারাগারে বন্দি করে।
রাতে আমাকে গল্প শোনাল এক কয়েদি-কি করে ডাকাতি করেছে তাঁদের দল। ডাকাই পূর্বে করে নাই। তবে আসামি হওয়ার পরে ধরা না দিয়ে মামলার খরচ যোগাড় করার জন্য তিনটা ডাকাতি করেছে। তবে যে ডাকাতি মামলায় তার জেল হয়েছে তাতে তার কোন দোষ নাই, কারণ সে ঐ ডাকাতির দলে ছিল না। আরও বলল, ‘আর ডাকাতি করব না। কোনোমতে যে কয়দিন বেঁচে আছি, ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতে পারলেই হলো। তবে ভয় হয় টাকা দিতে না পারলে অন্য কোনো মামলায় আসামি না হয়ে পড়ি। যাই হোক না কেন, আর ডাকাতি করব না।। ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে বাস করতে চাই’।

১৫ই জুন ১৯৬৬ ।। বুধবার
আজ আমার ছেলেমেয়েরা আসতেও পারে, কারণ ১৫ দিন হয়ে যায়। আমিও একটা দরখাস্ত করেছি, মায়ের অবস্থা জানবার জন্য তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই। অনুমতি না আসা পর্যন্ত তো সঠিক খবর পাব না। চিন্তা না করতে চাইলেও চিন্তা আসে।
আমার বাবুর্চি একটা কবুতরের বাচ্চা পালে। তাকে আদর করে কোলে নিয়ে বেড়াই। এখনও কাপড়ের ছোট্ট থলিয়া বানাইয়া তার ভিতর ভিজা চাউল দিয়ে তারপর একটা ফুটো করে খাবার খাওয়াতে হয়। এখন একটু একটু উড়তে শিখছে। চুপচাপ কিছু সময় তারপর দেয় ছুট। একেবারে পাকের ঘরের দিকে ছুটলো। মানে আমাকে আর ধরতে হলো না। বাচ্চাটা বাবুর্চিকে দেখলে মনে করে সেই বোধ হয় তার সবকিছু।
আজ বাইরে তনেক সময় বসে রইলাম। অনেক কথা মনে আসে! নানা বিষয়ের অনেক কথা। বরিশালের মি. চিত্তসূতার ও পাবনার রণেশ মৈত্র আমার সামনেই বিশ সেলে আছেন। আগে মাঝে মাঝে দরজা খুলতো, আজ থেকে কড়া হুকুম, দরজা খোলাই হবে না।
কি ভীষণ দুরবস্থা! যদিও ভিতরে সামান্য জায়গা আছে তবুও মন দেখতে চায় বাহিরটাকে। তাই মনের উপর এই ভীষণ অত্যাচার। বন্দি লোকগুলি অন্ধ হয়ে যাবে, নাহ্য স্বাস্থ্য একবারে ভেঙ্গে যাবে-বাইরে যেয়ে যেন আর কোনো কাজ করতে না পারে-এটাই স্বৈরাচারী সরকারের উদ্দেশ্য। আমি দূর থেকে অনেকক্ষণ দেখলাম, দরজা খোলা হলো না। পরে খবর নিয়ে জানলাম কড়া হুকুম, জমাদার সিপাহির চাকরি থাকবে না। আমার সাথে যেন কোনোমতে কথা না বলতে পারে। কথা তো আমরা বলতেও পারিনা। দরজা খুললে দরজার কাছে দাড়ালে দূর থেকে একে অন্যের শুভেচ্ছা জানাতে পারি। এর বেশি তো আর না। আমার অবস্থা হয়েছে, ‘পর্দানশীন জানানা’র মতো, কেউ আমাকে দেখতেও পারবেনা, আমিও কাউকে দেখতে পারব না। কেউ কথা বলতে পারবেনা, আমিও পারব না’।
আমার উপর সরকারের কড়া নজর। জেলের ডি.আই.জি. সাহেবকে বলেছি, জেলের আইন ভঙ্গ করে আমাকে একাকী রেখেছেন। জেল আইনে কাহাকেও বিনা অপরাধে, ‘Solitary Confinement’ – রাখার নিয়ম নাই। এটা আইন বিরুদ্ধ, তবুও আপনারা আইন ভঙ্গ করে চলেছেন। ‘উপরের হুকুম’ বলে আপনারা চুপ করে থাকেন। আমাকে ‘হুকুম’ দেখান, আমি আপত্তি করব না। একাকী থাকবো যত কষ্টই হয়। ডিআইজি সাহেব বললেন, ‘আমি উপরের সাথে আলাপ করে জানাবো’। কি হবে সে আমি জানি, তবে পরে আমাকে দোষ দিতে পারবেন না। আমি বিনা প্রতিবাদের অত্যাচার সহ্য করার মত লোক নই।
সময় কাটছে না, খবরের কাগজ পাঠাতে দেরি করছে। বসে আছি গেটের দিকে চেয়ে,কখন আসে, ১২টা, ১টা, ২টা বেজে গেল-কাগজ এল না। তখন ব্ধ্য হয়ে ডিউটি জমাদার সাহেবকে বললাম, কি অন্যায়, ২টা বেজে গেল, আর এখনও খবরের কাগজ জেল অফিস থেকে আসছে না। মেহেরবানী করে খবর নেন কাগজ দিবে কি দিবে না? যদি একবারেই না দেয় সে অন্য কথা। আমরা বুঝতে পারি রাজা বাদশার আমলের বন্দিখানায় আছি। সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে হকাররা কাগজ দিয়ে যায়, আর একটা দস্তখত করে ভিতরে পাঠাতে সময় লাগে পাঁচ ঘন্টা, ছয় ঘন্টা। এর কোনো অর্থ বুঝতে আমার সত্যই কষ্ট হয়। ইচ্ছা করলেই ১০টার মধ্যে কাগজ আমাদের দিতে পারে। বন্দির ত কোন মতামত নাই। আর এঁদের ইচ্ছা বলেও কোনো পদার্থ নাই। কাগজ দেখে মনে হলো, ১৪ তারিখে আমাদের মামলা শুরু হয় নাই হাইকোর্টে।
ইংল্যান্ড থেকে আমাকে এক তারবার্তা পাঠাইয়াছে ‘প্রবাসী বাঙালীরা সমগ্র বৃটেনে শহীদ দিবস পালন করবে ১৭ ও ১৮ জুন’। ব্রিটেনস্থ পাকিস্তানিদের প্রতিষ্ঠান প্রগতি ফ্রন্টের জেনারেল সেক্রেটারি এস এম হোসেন বৃটেনের সকল পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানি সংস্থাসমূহের প্রতি সাফল্যজনকভাবে শহিদ দিবস উদযাপনের দ্বারা অত্যাচারী জালেমশাহীর পাশবিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের আহবান জানান।
তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, দূর্নীতি, অবিচার ও অগণতান্ত্রিক কার্যকপালের অবসানের জন্য আমাদের সংঘবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলিতে হইবে।
এই সংবাদ দৈনিক আজাদ কাগজে ৭ই জুন ৩১ জ্যৈষ্ঠ তারিখে বাহির হয়েছে।

‘বৃটেনস্থ পাকিস্তানিদের পক্ষ হইতে জনাব হোসেন ও ‘পাকিস্তান সমিতি’র প্রেসিডেন্ট জনাব আফরোজ বখত দেশ ও জনগণের জন্য সাহসিকতাপূর্ব সংগ্রাম পরিচালনা ও দুঃখ ভোগের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অভিনন্দন জানাইয়া এক তারবার্তা প্রেরণ করিয়াছেন।
তারবার্তায় তাহারা বলেন, “প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আপনি যে সংগ্রাম চালাইয়া যাইতেছেন তাহাতে আমাদের সমর্থন রহিয়াছে। এই আন্দোলনকে নৈতিক, আর্থিক ও সামাজিক প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাহায্য দানের জন্য আমরা প্রস্তুত রহিয়াছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে আম্মাদের প্রানদানকারী ভ্রাতাদের রক্তপাত ব্যর্থ যাইবে না। আমরা তাহাদের জন্যও একই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কাজ করিয়া যাইতেছি – জনসাধারনের প্রতি ইহাই আমাদের বানী।
‘জাতীয় পরিষদের ভিতর ও বাহিরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম পরিচালনার উদ্দেশ্যে তারবার্তায় জনাব নূরুল আমীনের প্রতিও অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়।
তারবার্তায় পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক রক্তপাতের তীব্র নিন্দা করা হয় এবং বলা হয় যে ইহার ফলে পাকিস্তানের সর্বাধিক কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হইল।
তারবার্তায় জাতীয় সংহতির স্বার্থে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তিদান ও দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহবান জানানো হয়’।
এই তারবার্তা আমার কাছে পৌছায় নাই। কারণ আমাকে আইবি ডিপার্টমেন্ট দিবে না। কোনো কাগজপত্র চিঠি বই খাতা যদি আনতে হয় তবে এঁদের মাধ্যমে আসবে। ইচ্ছা করলে না দিয়াও পারে। বলবার কিছুই নাই। এমনকি স্ত্রীর সাথে বা ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে হলে গোয়েন্দা বিভাগের কর্মচারী সামনে বসে থাকবে, কোন রাজনৈতিক কথা বলি কিনা শুনবে।
যখন প্রবাসী পাকিস্তানিরাও অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছে এবং নায্য দাবি সমর্থন করিতে শুরু করিয়াছে তখন সাফল্যের আর বেশি দিন নাই। বন্ধুদের তারবার্তার উত্তর যখন দিতে পারলাম না, তখন নীরবে তাঁদের মঙ্গল কামনা করি। আর প্রতিজ্ঞা করি হতভাগা ভাইদের রক্তকে বৃথা যেতে দিব না।
সাড়ে চারটায় জেলের লোক এসে বলল-চলুন আপনার দেখা আসিয়াছে, আপনার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে বসে আছে জেল অফিসে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা করলাম। দূর থেকে দেখি রাসেল, রেহানা ও হাচিনা চেয়ে আছে আমার রাস্তার দিকে। ১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না-যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া অকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ওর ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে অকে ফাঁকি দিতে হয়। ছোট মেয়েটার শুধু একটা আবদার। সে আমার কাছে থাকবে। আর কেমন করে কোথায় থাকি তা দেখবে। সে বলে, থেকে যেতে রাজি আছি। রেনু বলল, মাকে আমার ছোটভাই খুলানায় নিয়ে গেছে। একটু ভালর দিকে। ঢাকা আনা সম্ভব হবেনা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। হাচিনার কলেজ বন্ধ, তাই খুলনা যেতে চায়। বললাম, যেতে দাও মা’র একটু খেদমত হবে। জামালের শরীর খারাপ, গলা ফুলে রয়েছে। এ বড় খারাপ ব্যারাম। রেণুকে তাই বললাম, ডাক্তার দেখাইও। স্কুলে যেতে পারবে না। এছাড়াও আরো অনেক কথা হলো।
রাশেদ মোশাররফ ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক। আমার বাড়ির কাছে থাকে। তাহার বিবাহের তারিখ ১২ই জুন ঠিক ছিল, বিবাহের কার্ডও ছাপান হয়েছিল। তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে আনা হয়েছে। রেণু দুঃখ করে বলল, সে তো বিবাহ নিয়াই ব্যস্ত ছিল, তাকে যে কেন ধরে এনেছে! এঁদের গ্রেপ্তারের কোন তাল নাই। ছোট ছোট দুধের বাচ্চাদের ধরে নিয়ে এসেছে রাস্তা থেকে, রাতভর মা মা করে কাঁদে। একজন মহিলা, এক ভদ্রলোকের বাড়িতে কাজ করে। এরই মাধ্যমে সংসার চালায়, বড় গরীব। তার ছয় বৎসরের ছেলেকে নিয়ে চলেছে সেই বাড়িতে কাজ করতে। গাড়ি থামাইয়া পুলিশ ডাক দেয়, এই ছেলে শোন। ছেলেটি এগিয়ে গেছে, তাকেও গাড়িতে উঠাইয়া নিয়েছে। মহিলাটি চিৎকার করে কাদতে শুরু করেছে। কে কার কথা শোনে! একেবারে জেলে নিয়ে এসেছে। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে মোনায়েম খান সাহেবের দৌলতে।
প্রায় এক ঘন্টা রেণু এবং আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিলাম। সংসারের ছোটখাট আলাপ। ওদের বলেছি আর কোন কষ্ট নাই; একাকী সঙ্গীবিহীন আছি। মানিক ভাইকে বলতে বললাম, তিনি যেন চীফ সেক্রেটারিকে বলেন কেন এই অত্যাচার? আমার স্ত্রী বলল, মানিক ভাইর সাথে দেখা করবো। সাক্ষাতের সময় শেষ হয়ে গেছে আর দেরি করা চলে না। তাই বিদায় দিলাম ওদের। রাসেলকে গাড়ির কথা বলে কামালের কাছে দিয়ে সরে এলাম।
কে বুঝবে আমাদের মতো রাজনৈতিক বন্দিদের বুকের ব্যথা। আমার ছেলেমেয়েদের তো থাকা খাওয়ার চিন্তা করতে হবে না। এমন অনেক লোক আছে যাদের স্ত্রীদের ভিক্ষা করে, পরের বাড়ি খেটে, এমনকি ইজ্জত দিয়েও সংসার চালাতে হয়েছে। জীবনে অনেক রাজবন্দির স্ত্রী বা ছেলেমেয়ের চিঠি পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। সে করুণ কাহিনী কল্পনা করতেও ভয় হয়।
যারা স্বার্থের জন্য আমাদের বৎসরের পর বৎসর কারাগারে বন্দি করে রেখেছ-কিছুদিন যে ক্ষমতায় ছিলাম তখন তাঁদের কাহাকেও গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি করে রাখি নাই। এমনকি জেলগেটে এসে রাজবন্দিদের মুক্তি দিয়েছিলাম।
এখানকার স্বৈরশাসকদের বি.টীম অ সি.টীম এখন অন্য ভোল ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তারাই আজ জুলুম করেছে আমাদের উপর। যদি কিছুদিনের জন্য জেল দিয়ে সেলের মধ্যে ২৪ ঘন্টা দরজা বন্ধ করে রেখে একবার লুছমি খাবার দিতাম, তবে জীবনের আর রাজনীতির নাম নিত না। জেল বন্দি করার সাথে বন্ড দিয়া বাহির হয়ে যেত। অথচ এমন অনেক রাজবন্দি এখনও জেলে আছে, যারা প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে; হাটতে চলতেও পারেনা, খেয়ে হজম করতেও পারেনা। প্রায় ১৩/১৪ বৎসর – পাকিস্তান হওয়ার পরেই জেলে আছে। তারা জানে জেলেই তাঁদের মরতে হবে বোধহয়, তবুও বন্ড দেয় নাই। এই সমস্ত ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাদেরও আমরা শ্রদ্ধা করি। এঁদের উপর যারা জুলুম করে, তারা কত বড় নিষ্ঠুর হতে পারে তা ভাষায় প্রকাশ করা কষ্টকর। আমার ভাষা নাই তাই লিখতে পারলাম না।
আবার কারাগারের ক্ষুদ্র কুঠুরিতে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে থাকি জমাদার সাহেবের আগমনের জন্য। তালাবন্ধ হতে হবে। যথারীতি আমার গুহার মধ্যে রাতের জন্য শুভাগমন করিয়া ‘তৃপ্তির’ নিশ্বাস ফেললাম। যেদিন বাচ্চাদের সাথে সাক্ষাৎ হয়, ওরা চলে যাবার পর মন খারাপ লাগে। আমাদের মতো ‘দাগী’দেরও মন খারাপ হয়। পরে আবার ঠিক হয়ে যায়।

১৬ই জুন ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
ঘুম থেকে উঠেই খবর পেলাম ইত্তেফাক কাগজের কোনো এক বড় অফিসারকে গ্রেপাতার করে এনেছে। ভাবলাম কে হবে, মানিক ভাই ছাড়া! খবর কেহই সঠিক বলতে পারছে না। পাগলের মতো সকলকেই জিজ্ঞাসা করলাম। কেহই ঠিক মতো বলতে পারে না। এমনভাবে প্রায় এক ঘন্টা কেটে গেল। আমি চুপ করে বসে আছি, খবর আমাকে জানতেই হবে। বুঝতে পেরেছি মানিক ভাই, কিন্তু পাকাপাকি খবর পাচ্ছিনা। একটু পরেই একজন বলল, ‘তফাজ্জল হোসেন সাহেবকে ভোরবেলা নিয়ে এসেছে। ১০ নম্বর সেলে রেখেছে’। আমার মনে ভীষণ আঘাত লাগল খবরটায়। এঁরা মানিক ভাইকেও ছাড়লো না? এঁরা কতদুর নেমে গেছে। পাকিস্তানের সাংবাদিকদের মধ্যে তার স্থান খুবই উচ্চে। তার কলমের কাছে বাংলার খুব কম লেখকই দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে তার রাজনৈতিক সমালোচনার তুলনায়ই হয় না। তার নিজের লেখা ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’, পড়লে দুনিয়ায় অনেক দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বুঝতে সহজ হয়। সাধারণ লোকেরও তার লেখা বুঝতে কষ্ট হয়না। তাকে এক অর্থে শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী বলা যেতে পারে।
তিনি কোনোদিন সক্রিয় রাজনীতি করেন নাই। তার একটি নিজস্ব মতবাদ আছে। সত্য কথা বলতে কাহাকেও তিনি ছাড়েন না। আইয়ুব খান সাহেবও তাকে সমীহ করে চলেন। তিনি মনের মধ্যে এক কথা আর মুখে এক কথা বলেন না। তিনি হঠাত রেগে যান, আবার পাঁচ মিনিট পরে শান্ত হয়ে পড়েন। কেহ ভাবতেই পারবেন না তাহার মুখ খুবই খারাপ, মুখে যাহা আসে তাহাই বলতে পারে। অনেক সময় আমার তার সাথে মতের অমিল হয়েছে। গালাগালি ও রাগারাগি করেছেন, কিন্তু অন্য কেহ আমাকে কিছু বললে, আর তার রক্ষা নাই, ঝাঁপাইয়া পড়েন। আমাকে তিনি অত্যধিক স্নেহ করেন। আমিও তাকে বড় ভাইয়ের মত শ্রদ্ধা করি। কোনো কিছুতে আমি সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে তার কাছে ছুটে যাই। তিনিই আমাকে সঠিক পথ দেখাইয়া দেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের মৃত্যুর পর তার কাছ থেকেই বুদ্ধি পরামর্শ নিয়ে থাকি। কোনো লোভ বা ভ্রুকুটি তাকে তার মতের থেকে সরাতে পারে নাই। মার্শাল ল’র সময়ও তাকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে গ্রেপ্তার করার পরেও তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আবার আজও তাকে গ্রেপ্তার করে এনেছে। তার উপর অনেকেরই ঈর্ষা এবং আক্রোশ রয়েছে।
এঁরা অনেকেই মনে করে আমি যাহা করি সকল কিছুই তার মত নিয়ে করে থাকি। আমার দরকার হলে আমিই তার কাছে যাই পরামর্শের জন্য। তিনি কখনও গায়ে পড়ে কোনোদিন পরামর্শ দেবার চেষ্টা করেন নাই। তবে তার সাথে আমার মনের মিল আছে, কারণ ২৫ বৎসর এক নেতার নেতৃত্ব মেনে এসেছি দুইজন। অনেকেই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে বেইমানী করেছেন। আমরা দুইজন একদিনের জন্যও তার কাছ থেকে দূরে সরে যাই নাই। পাকিস্তানের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার জনসাধারণের জন্য ইত্তেফাক যা করেছে তা কোনো খবরের কাগজই দাবি করতে পারে না। এদেশ থেকে বিরুদ্ধ রাজনীতি মুছে যেত যদি মানিক মিয়া এবং ইত্তেফাক না থাকতো। একথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ করা হবে। ১৯৫৮ সালের মার্শাল ল’ জারি হওয়ার পর থেকে হাজার রকমের ঝুঁকি লইয়াও তিনি এদেশের মানুষের মনের কথা তুলে ধরেছেন।
ছয় দফার আন্দোলন এ আজ এত তাড়াতাড়ি গণ আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এখানেও মানিক ভাইয়ের লেখনী না হলে তা সম্ভব হতো কিনা তাহা সন্দেহ! আমি যাহা কিছু করি না কেন, তাহা মানিক ভাইয়ের দোষ, সরকারের এটাই ভাবনা। ভারতবর্ষ যখন পাকিস্তান আক্রমণ করল তখন যেভাবে ইত্তেফাক কাগজ সরকারকে সমর্থন দিয়েছে এবং জনগনকে উদ্বুদ্ধ করেছে – ত্যাগের জন্য ও মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য, ইত্তেফাকের পাতা খুললেই তাহা দেখা যাবে। তবুও আজ তাকে ডিপিআরএ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন বুঝতে কারও বাকি নাই যে কেন জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করছেন না সরকার। দেশরক্ষা করার জন্য যে আইন করা হয়েছিল সে আইন আজ রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। খবরের কাগজের স্বাধীনতার উপর পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করিতেছে। এমনকি মানিক মিয়ার মতো সম্পাদককেও দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করতে একটু লজ্জা করলো না। তফাজ্জল হোসেন সাহেব, যাকে আমরা সকলে মানিক ভাই বলে ডাকি তিনি শুধু ইত্তেফাকের মালিক ও সম্পাদক নন, তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সটিটিউটের পাকিস্তান শাখার সভাপতি এবং প্রেস কোর্ট অব অনারের সেক্রেটারি।
১৯৫৯ সালে আমি যখন জেলে ছিলাম আমাকে তখনও একাকী রাখা হয়েছিল। মানিক ভাইকে গ্রেপ্তার করে পুরানো ২০ সেলে রাখা হয়েছিল। সকালে ও বিকালে কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার সাথে তার দেখা হতো। তখন তিনি বোধ হয় একমাস কি দেড়মাস ছিলেন। মানিক ভাইকে খুবই কষ্টে রাখা হয়েছিল। ১৯৬২ সালে গ্রেপ্তার হয়ে তাকে আমি জেল গেটে এসে পাই। যতদিন জেলে ছিলাম একসাথেই ছিলাম। সকলে খালাস হয়ে গেলেও আমি আর মানিক ভাই ছিলাম। মানিক ভাই অসুস্থ হয়ে বাইরের হাসপাতালে গেলে আমি একলাই ছিলাম। কয়েকদিন পরেই আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
আজ আমাকে রাখা হয়েছে সেল এলাকায়। এখানে ভয়ানক প্রকৃতির লোক, একরারী আসামি, জেল আইন ভঙ্গ করার জন্য সাজাপ্রাপ্ত আসামি, আর পাগলা গারদ। এই এরিয়ার সবগুলোই সেল। মোট ৯৩টা সেল আছে। আমার ঘরটা বাদে। এটা সেল না, সেলের থেকে একটু বড়। তবে দক্ষিন-পূর্ব দিকে উঁচু দেয়াল। শুধু সুবিধা হলো ঘরটার সামনে কিছু জায়গা আছে। কিছু গাছ-গাছালি আছে বলে ফুলের ও ফলের বাগান করতে পারি। এঁদের কাছে থাকতে আমার আপত্তি নাই, কারণ বোধ হয় নিজেও আমি ‘ভয়ানক প্রকৃতির লোক। মানে ভয়ডোর একটু কম।
মানিক ভাই ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের রাখা হয়েছে আমার থেকে অনেক দূরে। দেখা হওয়ার উপায় নেই। ১০ সেলে মানিক ভাই ও সহকর্মীরা কি করে আছে ভাবতে আমার কষ্টই হয়। নিচু সেল, জানলা নাই, একটা দরজা তাও আবার সামনে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। উপরের থেকে নাকি হুকুম আসে কাকে কোথায় রাখতে হবে। জেল কতৃপক্ষের হাতে কিছুই নাই। আমি প্রতিবাদ করলাম। আমার কাছে না দেয় তাতে আপত্তি নাই, কিন্তু এমন জায়গা দেওয়া হউক যেখানে তাহারা মানুষের মতো বাস করতে পারেন। জেল কতৃপক্ষকে বলে হয়রান হয়ে গেছি। তবে আমার কাছে খবর আছে, এক ভদ্রলোক বলে দেন কোথায় কাকে রাখতে হবে।
মানিক ভাইয়ের লেখা পড়ব না এটা আমার একটা দুঃখ। দিন যে কিভাবে কেটে গেল বলতেও পারিনা। খবরের কাগজে মানিক ভাইয়ের গ্রেপ্তারের কোনো খবর নাই। বোধহয় খুব ভোরে গ্রেপ্তার করেছে।
সমস্ত পূর্ব বাংলায় এবারও বন্যা হবে। সিলেট তো শেষই হয়ে গিয়াছে বলে মনে হয়। ময়মনসিংহ, ফরিদপুর্‌ বগুড়া, রংপুর, পাবনায়ও বন্যা হবে। ঢাকাও বাদ যেতে পারে না। পূর্ব বাংলার লোকের দশা কি হবে তাই ভাবছি। এর উপর আবার করের বোঝা সরকার চাপাইয়া চলছে।

১৭ই জুন ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
ভীষণ বৃষ্টি। বাইরে যাওয়ার উপায় নাই। বারান্দায় ঘুরলাম, বারান্দায় কয়েকজন কয়েদি আশ্রয় নিয়েছে। একজন খবর দিল রফিক সাহেব নামে আমাদের দলের একজন নেতা এসেছেন। তাকেও দশ সেলে রাখা হয়েছে। চলেছে গ্রেপ্তার সমানে। মনে হয় মোনায়েম খান সাহেব ৭ তারিখের পরে আরও ক্ষেপে গেছেন। বোধ হয় ভুলে গেছেন, যে লোক বেশি রাগান্বিত ও অধৈর্য্য হয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত তাঁকেই হারতে হয়। মাথা ঠান্ডা রেখে যে সংগ্রাম চালাইয়া যায় শেষ পর্যন্ত তারই জয় হয়। রফিক আমার বহুদিনের সহকর্মী। কলিক্কাতা থেকেই একসাথে রাজনীতি করেছি। তবে মাঝে অনেকবার এদিক ওদিক করেছে। সেই জন্য সহকর্মীদের মধ্যে অনেকে ওকে বিশ্বাস করতে চায় না। এবার যখন আবার আওয়ামী লীগে ফিরে এল তখন সত্যই ওকে আমি বিশ্বাস করেছি, কারণ এখন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাবার কোনো সম্ভবনা নাই। কোনোদিন ওকে কেহ গ্রেপ্তার করতে পারে নাই। ১৯৪৯, ১৯৫২, ১৯৫৪ প্রত্যেক বারেই রফিক কেটে পড়েছে। তাই মনে মনে বললাম, ‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান?’ এবার যে সে ভাগতে চেষ্টা করে নাই, তার প্রমাণও পেয়েছি। সভা সমিতিতে যেয়ে জোর বক্তৃতা করেছে আমাদের গ্রেপ্তারের পরেও। মনে হয় আওয়ামী লীগের কাকেও আর বাইরে রাখবেনা। বোধ হয় এখনও অনেককে ধরতে চেষতা করছে। কেউ কেউ বোধ হয় আত্মগোপন করে কাজ চালাইয়া যেতেছে।
মানিক ভাইয়ের কাছেই রেখেছে রফিককে। ভালই হয়েছে কজন সাথী পেয়েছেন। যারা ১০ সেলে আছে তারা মানিক ভাইকে সমীহ করে চলে। নিশ্চয়ই দূরে দূরে থাকতে চেষ্টা করবে।
ন্যাপ দলীয় মশিউর রহমান আইন পরিষদে যাহা বলিয়াছেন তাহাতে কোনো লোক আশ্চর্য না হয়ে পারবে না। সরকারি দলের সমর্থকরা যাহা বলিয়াছেন তিনি সেই কথাগুলি আরও জোরে জোরে বলিয়াছেন। তিনি তাঁদের সুরে সুরে মিলাইয়া বলিয়াছেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানে গোলমাল সৃষ্টি করার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইএ) অর্থ প্রদান করিয়াছে’। ‘গত সপ্তাহে প্রদেশে যে ধর্মঘট হইয়াছে বলিয়া তিনি জানান’। এঁরা আবার প্রগতির কথা বলে! পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসনের দাবি, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি, শ্রমিক ও কৃষকদের দাবি আজ নূতন নয়। তিনি যখন ১৯৪৭-৫৭ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন, প্রত্যেকটা গণআন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য রংপুরে গুন্ডা লেলাইয়া দিতেন। বাংলা ভাষার আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য নিজে কর্মী ও ছাত্রদের উপর গুন্ডামি করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৫৪ সালের মুসলিম লীগের টিকিট নিয়ে যখন জমানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তখন ১৯৫৬ সালে পৃথক নির্বাচন সমর্থন করে মুসলিম লীগের ঝান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সারাজীবন দালালির রাজনীতি করে বেড়াইয়াছেন, আবার রাতারাতি ১৯৫৭ সালে ‘প্রগতিবাদী’ হয়ে ন্যাপে যোগ দিয়াছেন। আর যারা এই স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের আন্দোলনের জন্য সারাজীবন অত্যাচার সহ্য করেছে এবং মামলার আসামি বা রাজবন্দি হিসেবে বৎসরের পর বৎসর কারাগারে কাটাইয়াছে, তাঁদের সম্বন্ধে এই সমস্ত নীচ কথা উচ্চারন করা তার পক্ষেই সম্ভবপর। সরকারের সাথে গোপনে পরামর্শ করে যে লোক জাতীয় পরিষদের সদস্য হয়, রাওয়ালপিন্ডি আর করাচী ঘুরে পারমিটের ব্যবসা করে বেড়ায়, তাহার কাছে একটা সংগ্রামী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে এবং জনগণের গণআন্দোলন সম্বন্ধে এইসব কথা শোভা পায় কিনা জনগণ বিচার করবে।
আজ এতগুলি লোক গুলি খেয়ে জীবন দিল। শত শত লোক কারাগারে বন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। শত শত লোকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে। শত শত মামলা ছাত্র রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সে সম্বন্ধে কোনো সহানুভূতি যে পার্টির নেতারা দেখান না, তাঁদের পক্ষে সবই সম্ভবপর। আমি জানি এই সকল কথা বললে এঁরা পিন্ডি বসে পারমিটের ব্যবসা করার আরও সুযোগ পাবে। কত হাজার টন সিমেন্টের পারমিট করাচী থেকে এনে কার কাছে বিক্রি করেছেন – একথাও আমার জানা আছে। আমি বন্দি, আমার সহকর্মীরা বন্দি, তা না হলে তাকে ও তাঁদের নেতাদের কি উত্তর দিতে হয় তা আমি জানি। জনগন তাঁদের পিছনে নাই, এখন উপরতলার রাজনীতি করেন। শুধু ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে চিৎকার করে আর সাম্রাজ্যবাদের দালালদের তলে তলে সমর্থন করে সাম্রাজ্যবাদকে ধবংস করা যাবে না। গণআন্দোলনে বিশ্বাস করেন, জনগনের উপর নির্ভর করেন। ৬ দফা শুনে ঘাবড়াবেন না, এ দাবি জণগনের দাবি। আপনার ‘নেতা’ মাওলানা ভাসানী সাহেবকে ময়দানে নামান। আইয়ুব সাহেবের দলে তো আপনারা আছেনই এবং সাহায্য নিয়ে থাকেন। অবস্থা কি আপনাদের? এ নেতার সম্বন্ধে আমার এতখানি না লেখলেও চলত, কারণ এঁদের কথার দাম বাঙালি দেয় না। আন্দোলন কখনও বাইরে থেকে আমদানি হয় না। বাংলাদেশের লোকের প্রাণ আছে। পারমিটের টাকা দিয়া গণআন্দোলন হয় না। আপনার জানা উচিৎ সিআইএ’র এজেন্টরাই পাকিস্তান শাসন করছে। নূতন এজেন্টের দরকার হয় নাই, আর হবেও না। আর দরকার হলেও আপনাদের মতো এজেন্ট অনেক পাবে তারা। কারণ তারা বোধহয় জানে আপনাদের চরিত্র। এজেন্সির রাজনীতি আপনাদের নেতারাই করে থাকেন।
ইত্তেফাক কাগজ আসে নাই। এর পরিবর্তে আমাকে ‘দৈনিক পাকিস্তান’ দিয়েছে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলল, কাগজ বন্ধ, সরকার নাকি বন্ধ করে দিয়েছে। আর খবর পেলাম রাতে মানিক ভাইয়ের কাছে একটা নোটিশ দিয়ে গিয়াছে। আমার মনে হলো সরকার নিশ্চয়ই কাগজ বন্ধ করে দিয়াছে। মোনায়েম খান সব পারে, ‘বানরের হাতে শাবল’! যে যতটুকু ক্ষমতা হজম করতে পারে তার ততটুকু দেওয়া উচিৎ। দুঃখের বিষয় ক্ষমতার অপব্যবহার যে সে করবে সে সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। আইয়ুব সাহেব নাকি তাকে পূর্ব বাংলাকে ঠিক রাখার জন্য সব ক্ষমতা দিয়েছেন!
আজ আজ সঠিক খবর পেলাম না। মানিক ভাইকে যেখানে রেখেছে, সেখান থেকে খবর আনা খুবই কষ্টকর। এতবড় আঘাত পেলাম তা কল্পনা করতে বোধ হয় অনেকেই পারবে না। প্রথম থেকেই এই কাগজের সাথে আমি জড়িত ছিলাম।
সারাদিন একই চিন্তা এবার জেলে এসে একদিনও শান্তিতে থাকতে পারলাম না। ঘরে বাইরে করতে করতে দিন চলে গেল। রাতটাও কেটে গেল একই চিন্তায়। আগামীকাল খবরের কাগজ এলে সঠিক খবর পাওয়া যাবে এই আশায় রইলাম। আমি বলে দিয়েছি দৈনিক পাকিস্তান রাখবো না, ‘সংবাদ’ কাগজ যেন দেওয়া হয়। পূর্বে ছিল ইত্তেফাক, আজাদ, অবজারভার, মর্নিং নিউজ আর ডন। এখন সংবাদও আসবে। ইত্তেফাকের কিমহবে এখন ঠিক বলতে পারি না।

১৮ই জুন ১৯৬৬ ।। শনিবার
সূর্য উঠেছে। রৌদ্রের ভিতর হাঁটাচলা করলাম। আবহাওয়া ভালই। তবুও একই আতঙ্ক-ইত্তেফাকের কি হবে! সময় আর কি সহজে যেতে চায়। সিপাহি, জমাদার, কয়েদি সকলের মুখে একই কথা, ‘ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে দিয়েছে’।
ঘরে এসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলা-র লেখা ‘তেরেসা রেকুইন’ (Therese Raquin) পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্র-জোলা তার লিখার ভিতর দিয়া। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘন্টা সময়।
আজ সিভিল সার্জন আসলেন আমাকে দেখতে। শরীরের অবস্থা জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম ভালই আছি, ভালই থাকতে হবে। তিনি কাজের লোক, দেরি না করে চলে গেলেন। আমিও বাইরে বারান্দায় এসে দাড়ালাম। বহুদিন পর্যন্ত দু’টি হলদে পাখিকে আমি খোঁজ করছি। ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন ছিলাম এই জায়গাটিতে তখন প্রায়ই ১০টা/১১টার সময় আসত, আর আমগাছের এক শাখা হতে অন্য শাখায় ঘুরে বেরাত। মাঝে মাঝে পোকা ধরে খেত। আজ ৪০ দিন এই জায়গায় আমি আছি, কিন্তু হলদে পাখি দু’টি আসল না। ভাবলাম ওরা বোধহয় বেঁচে নাই অথবা অন্য কোথাও দূরে চলে গিয়াছে। আর আসবে না। ওদের জন্য আমার খুব দুঃখই হলো যখন ১৬ মাস এই ঘরটিতে থাকতাম তখন রোজই সকাল বেলা লেখাপড়া বন্ধ করে বাইরে যেয়ে বস্তাম ওদের দেখার জন্য। মনে হলো ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে।
খাবার কাজটি কোনোমতে শেষ করে খবরের কাগজের অপেক্ষায় রইলাম। আজও অনেক দেরি হলো কাগজ আসতে। ডিউটি জমাদার সাহেবকে বললাম, আপনি ডিউটিতে আসার পর থেকে কাগজ দেরি করে আসতে শুরু করেছে। কাগজ আসতে দেরি হলে আমার ভীষণ রাগ হয়। দুই এক সময় কড়া কথাও বলে ফেলি।
প্রায় তিনটার সময় কাগজগুলি কয়েদি পাহারা নিয়ে এল। পাকিস্তান দেশরক্ষা আইন বলে ‘নিউনেশন প্রেস’ বাজেয়াপ্ত করিয়াছে সরকার। এই প্রেস হইতে ‘ইত্তেফাক’, ইংরেজি ‘সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস’ ও বাংলা চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক ‘পূর্বাণী’ প্রকাশিত হইত। পুলিশ প্রেসে তালা লাগাইয়া দিয়াছে। ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। পূর্বের দিন ইত্তেফাক ও নিউনেশন প্রেসের মালিককে দেশ্রক্ষ আইনে গ্রেপ্তার করিয়া ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ১০ সেলে বন্দি করিয়া রাখা হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে ইত্তেফাক সকল কাগজের থেকে বেশি ছাপা হয়। এর পাঠকের সংখ্যা অসংখ্য। বাংলার গ্রামে গ্রামে ইত্তেফাক পরিচিত। দেশরক্ষা আইনের বলে অন্য কোনো কাগজকে এত বড় আঘাত করা হয় নাই। ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে এবং তাহার মালিকো সম্পাদককে গ্রেপ্তার করে ৬ দফার দাবিকে বানচাল করতে চায়। কিন্তু আর সম্ভব হবেনা। এতে আন্দোলন আরও দানা বেঁধে উঠবে। যার পরিণতি একদিন ভয়াবহ হবে বলে আমার বিশ্বাস। কি করে আইয়ুব খান সাহেব মোনায়েম খান সাহেবকে এ কাজ করতে অনুমতি বা নির্দেশ দিলেন আমার বুঝতে কষ্ট হয়।
খবর নিয়ে জানলাম মানিক ভাই প্রস্তুত হয়েই ছিলেন, সে জন্য একটুও মুষড়ে পড়েন নাই। আমি কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কারণ কোনো প্রেসেই আওয়ামী লীগের কোনো প্যামফলেট ও পোস্টার ছাপাইয়ে দেওয়া হইতেছে না। যে প্রেসই ছাপায় তার মালিককে দেশরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে। প্যামফলেট ছপানো বেআইনি নয়। এমনকি কালো ব্যাজ ছাপার জন্যে ‘দি বেঙ্গল প্রিন্টিং প্রেসের’ মালিককে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে। বোঝা গেল গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে তারা দিবে না। একদলীয় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায়। পূর্ব বাংলায় এটা বেশি দিন চলতে পারে না। আন্দোলনকে ভিন্ন গতি নিতে এঁরা বাধ্য করেছে-যা আমরা চাই নাই। ইত্তেফাক বন্ধ হতে পারে কিন্তু ইত্তেফাক যা চায় তা জনগণেরই দাবি এবং মনের কথা।
এখন আর কাগজ পড়তে বেশি সময় আমার দরকার হয় না। ‘মর্নিং নিউজে’র হেড লাইনগুলি দেখলেই বুঝতে পারি কি লিখতে চায়। ‘আজাদ’ আওয়ামী লীগের কিছু কিছু সংবাদ দেয়। ‘সংবাদ’ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে যেগুলি দরকার তাই ছাপায়। ‘অবজারভার’ বোধ হয় একটু ভয় পেয়েছে। আশ্চর্য হয়ে চিন্তা করলাম, খবরের কাগজের সম্পাদকরা আজ পর্যন্ত প্রতিবাদ করে একটি বিবৃতিও দিল না-এমনকি সহকর্মী ইত্তেফাকের সম্পাদকের মুক্তি চেয়েও না। ইত্তেফাককে যদি অত্যাচার করে ধ্বংস করতে পারে তবে কেউই রেহাই পাবে না। একটু সবুর করলেই দেখতে পাবেন। আমার মনে হয়, আমার সহকর্মীরা-যারা বাইরে আছেন তারা এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করে যদি দরকার হয়, গ্রেপ্তার হয়ে তাঁদের জেলে আসা উচিৎ।
মার্কিন সরকার পাকিস্তান ও ভারতকে পূর্ণ অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান পুনরায় শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশকে সাহায্য প্রদান বন্ধ করে দিয়েছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর হতে বলা হইয়াছে বর্তমানে পাক-ভারতের মধ্যে শান্তি ফিরিয়া আসিয়াছে। তবে আপাতত কাহাকেও সামরিক সাহায্য দিবে না। প্রেসিডেন্ট মি. লিন্ডন বি জনসন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ওয়াশিংটনে বসিয়া আলাপ করিয়া খুশি হইয়াছেন। নিজের দেশকে এত হেয় করে কোনো স্বাধীন দেশের সরকার এরূপভাবে সাহায্য গ্রহণ করতে পারেন না। শুধু সরকারকেই অপমান করে নাই, দেশের জনগণ ও দেশকেও অপমান করেছে। ভিক্ষুকের কোনো সম্মান নাই। তবে শোয়েব সাহেব যে অর্থনীতি এখানে চালাইছেন তাতে ইহা ছাড়া আইয়ুব সাহেবের উপায় বা কি ছিল? একমাত্র সমাজতন্ত্র কায়েম করলে কারও কাছে এর হেয় হয়ে সাহায্য নিতে হতো না। দেশের জনগণেরও উপকার হতো। এখন তো কিছু কিছু লোককে আরও বড় লোক, আর সমস্ত জাতিকে ভিখারী করা ছাড়া উপায় নাই। পুঁজিপতিদের কাছে পাকিস্তানকে কি বন্ধক দেওয়া হলো জীবনের তরে? মাওলানা ভাসানী সাহেব কোথায়? কি বলেন? আইয়ুব সাহেবের হাতকে শক্তিশালী করে পুজিপতি ও সম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে বের করে এনে সোসালিস্ট ব্লকে যোগ দিতে তিনি নাকি সক্ষম হবেন! তাই তিনি আইয়ুব সাহেবের সমস্ত অগণতান্ত্রিক পন্থাকে সমর্থন করেছেন। আর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলকে সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল বলে গালি দিয়েছেন। এখন তো প্রমাণ হয়ে গেছে মাওলানা সাহেব ও তাহার দলের কিছু সংখ্যক লোক সাম্রাজ্যবাদীদের দালালের দালালি করেছেন।
আমার এক বন্ধু এমপিএ ছিলেন ১৯৫৭ সালে। মাওলানা সাহেব যখন ন্যাপ করলেন ইস্কান্দার মির্জার সাহায্যে প্রগতিশীল বৈদেশিক নীতির ধুয়া তুলে, তখন ন্যাপ পার্লামেন্টারি পার্টি গঠন করে আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন উঠাইয়া নিলেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলো। তখন তিনি ন্যাপের এক পার্টি মিটিংয়ে বলছিলেন, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা চলবে না। কে এস পি, নিজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ কোয়ালিশনকে সমর্থন করা উচিৎ। তখন কিছু কিছু সদস্য তার প্রতিবাদ করে বলছিলেন, এই সমস্ত দল কি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন করতে পারে? এঁরা ইস্কান্দার মির্জার দালালি করছে। ইস্কান্দার মির্জা আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারকে ধ্বংস করতে চায়। আওয়ামী লীগ তো বন্দিদের মুক্তি দিয়েছে, ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। যুক্ত নির্বাচনের জন্য যুদ্ধ করছে। কেমন করে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে এই সমস্ত নীতি বিবর্জিত দলদের সমর্থন করতে পারা যায়! মওলানা ভাসানী সাহেব তার উত্তর দিয়েছেন এইকথা বলে, মিশরের নাসের যদি সমাজতন্ত্র করতে পারে, তবে ইস্কান্দার মির্জাকেও একবার পরীক্ষা করে দেখলে অন্যায় কি? এরপরেই জানা গেলো মওলানা সাহেব ইস্কান্দার মির্জার সাথে গোপন সন্ধিতে যোগ দিয়েছেন, ‘সোহরাওয়ার্দী নিধন’ যজ্ঞে। তার নীতি আমার জানা আছে। জেলে বসে আইয়ুব সাহেবের কাছে কি কি চিঠি দিয়েছেন তাও আমার জানা আছে।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর দিন ফুরাইয়া এসেছে। একটু দেরি করুণ দেখতে পাবেন, আপনার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা, আইয়ুব খান সাহেবের রূপ।
বৃদ্ধকালে সরকারি ব্যয়ে একটু বিদেশে ঘুরবার সুযোগ পেয়েছেন। দুনিয়া দেখতে কেহ আপত্তি করে না। জনগণের সাথে আর ছল চাতুরি না করাই শ্রেয়। আওয়ামী লীগ কর্মীরা ও জনগণ যখন জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও গণতন্ত্রের দাবির জন্য গুলি বুক পেতে নিতেছে, যখন কারাগার ভরে গিয়াছে তখন তাহার দলেরই দুই একজন নেতা এর মধ্যে সাম্রাজ্যবাদীর হাত দেখতে পেয়েছেন। এই অত্যাচারের প্রতিবাদও করেন নাই। জনগণ এঁদের চিনে ফেলেছে, সে সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ নাই।
আওয়ামী লীগের ডাকে জনগণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করছে খবর পেলাম, আর সরকারও অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাইয়া যেতেছে। দেখা যাক কি হয়।
বিকালটা ভালই ছিল। বৃষ্টি হয় নাই। হাসপাতালে আহত কর্মীরা দরজার কাছে দাঁড়াইয়া আছে। নারায়ণগঞ্জের খাজা মহিউদ্দিন ও অন্যান্য কর্মীরা এবং সাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেবও হাসপাতালে আছেন। তিনিও নেমে এসেছেন দরজার কাছে। আমি একটু এগিয়ে যেয়ে ওদের বললাম, ‘চিন্তা করিও না। কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না। দেখ না আমাকে একলা রেখেছে। সিপাই সাহেবের মুখ শুকাইয়া গেছে, কারণ কথা বলা নিষেধ, চাকরি যাবে। আমি এঁদের ক্ষতি করতে চাইনা, তাই চলে এলাম আমার জায়গায়। শুধু ওদের দূর থেকে আমার অন্তরের স্নেহ ও ভালবাসা জানালাম। জানি না আমার কথা ওরা শুনেছিল কিনা, কারণ দূর তো আর কম না!
সূর্য বিদায় নিয়েছে, জেলখানায় একটু পূর্বেই বিদায় নেয়। কারণ ১৪ ফিট দেয়াল দাঁড়াইয়া আছে আমাদের চোখের সম্মুখে।
২৬ সেলের সিকিউরিটি বন্ধুরা আমাকে একটা রজনীগন্ধার তোড়া উপহার পাঠাইয়াছে। আমার পড়ার টেবিলের উপর গ্লাসে পানি দিয়ে রাখলাম। সমস্ত ঘরটি রজনীগন্ধার সুমধুর গন্ধে ভরে গিয়েছে। বড় মধুর লাগলো। বিশেষ করে ঐ ত্যাগী বন্ধুদের-যারা জীবনের ২৫ থেকে ৩০ বৎসর নীতি ও দেশের জন্য জেল খেটেছেন, আজও খাটছেন। তাঁদের এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান। শুধু মনে মনে বললাম, ‘তোমাদের মতো ত্যাগ যেন আমি করতে পারি। তোমরা যে নীতিই মান না কেন, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। তোমরা দেশের মঙ্গল চাও, তাতে আমার সন্দেহ নাই। তোমরা জনগণের মুক্তি চাও এ কথাও সত্য। তোমাদের আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাদের এই উপহার আমার কাছে অনেক মূল্যবান।
রাত কেটে গেল। এমনি অনেক রাত কেটে গেছে আমার। প্রায় ছয় বৎসর জেলে কাটিয়েছি। বোধহয় দুই হাজার রাতের কম হবেনা, বেশি হতে পারে। আরও কত রাত কাটবে কে জানে? বোধহয় আমাদের জীবনের সামনের রাতগুলি সরকার ও আইবি ডিপার্টমেন্টের হাতে।

১৯শে জুন ১৯৬৬ ।। রবিবার
ঘরটা তো আমাদের এক মাত্র জায়গা-যা একটু বাহিরে হাঁটাহাঁটি করতাম তাও বন্ধ। বৃষ্টি চলছে সমানে। বারান্দা দিয়ে হাটতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু বারান্দাটা ভিজে যাবে। পায়খানায় যাওয়ার উপায় নাই। পানি পড়ে সমস্ত শরীরটা ভিজে যাবে। ছাতাও নাই। চা প্রস্তুত হয়ে গেছে, খেয়ে নিয়ে ঘরের ভিতরই ঘুরতে আরম্ভ করলাম। প্রায় ৯টায় বৃষ্টি থামলে আমি বের হয়ে পড়লাম। দেখলাম বরিশালের বাবু চিত্তরঞ্জন সুতারও দাঁড়াইয়া আছেন তার সেলের দরজার কাছে। বুঝলাম তার অবস্থাও আমার মতো। আমার ঘরের একটা সামান্য বারান্দা আছে। কিন্তু তার সেলে তাও নাই। বৃষ্টি থেমেছে, তাই বের হয়ে পড়েছে একটু হাফ ছেড়ে বাঁচতে। তাহাকেও আলাদা করে রাখার হুকুম দিয়েছে। বরিশাল জেলে ছিলেন। মাসে অন্ততপক্ষে স্ত্রী ও ছেলের সাথে দেখা হতো। তা আর হবে না। কষ্ট দেও, যত পার। আমাদের আপত্তি নাই। আমরা নীরবে সবই সহ্য করব ভবিষ্যৎ বংশধরদের আজাদীর জন্য। আমাদের যোইবনের উন্মাদনার দিনগুলি তো কারাগারেই কাটিয়ে দিলাম। আধা বয়স পার হয়ে গেছে।
আর চিন্তা কি? এই নিষ্ঠুর ব্যবহারের বিচার একদিন হবেই। দেখেও যেতে পারি, আর না দেখেও যেতে পারি। তবে বিশ্বাস আছে, হবেই।
আবার বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি পাকের ঘরে উপস্থিত হলাম। ‘দেখি কি পাক করছে’? বাবুর্চি বলল, ‘পটল ভাজি করছি, পেঁপেও পাক করব। মাছ এখনও আসে নাই’। কিছু সময় দাঁড়াতে হলো। দেখলাম কিভাবে পাক করবে। পানি পড়ে ঘর দিয়ে। আধা ঘর ভিজে গিয়াছে। একটু পরে আমি জমাদার সাহেবকে বললাম খবর দিতে। এভাবে চলতে পারে না।
কম্পাউন্ডার সাহেব এলেন আমার এখানে ইনজেকশন দিতে। বললাম ‘বসেন, কেমন আছেন’? বলল, ‘কেমন থাকব। স্বল্প বেতনের কর্মচারী, জীবনটা কোনোমতে কাটাইয়া নিয়ে যাচ্ছি’। তার কাজ শেষ করে তিনি চলে গেলেন।
আমি বই নিয়ে বসে পড়লাম। মনে করবেন না বই নিয়ে বসলেই লেখাপড়া করি। মাঝে মাঝে বইয়ের দিকে চেয়ে থাকি সত্য, মনে হবে কত মনোযোগ সহকারে পড়ছি। বোধহয় সেই মুহূর্তে আমার মন কোথাও কোনো অজানা অচেনা দেশে চলে গিয়েছে। নতুবা কোনো আপনজনের কথা মনে পড়ছে। নতুবা যার সাথে মনের মিল আছে। তার কথাও চিন্তা করে চলেছি। হয়ত বা দেশের অবস্থা, সহকর্মীদের উপর নির্যাতনের কাহিনী নিয়ে ভাবতে ভাবতে চক্ষু দু’টি আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসছে। বই রেখে আবার পাইপ ধরালাম।
সাড়ে এগারটায় জেলের কয়েদিদের খাবার সময় হয়ে যায়। এঁরা গোসল করে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। বালতিতে ডাল, টিনের বড় এক পাত্রে ভাত আর একটি বালতিতে তরকারি। কয়েদিরা দফায় দফায় এসে বিলাইয়া যায়। ভাত নিয়ে যে যেখানে পারে বসে খেয়ে নেয়। মেশিনের মতো চলে। আমার কিন্তু একটার পূর্বে খাওয়া অসম্ভব। আজ বহুক্ষণ ভাবলাম গোসল করব কিনা। মেট বলল, না করলে শরীর খারাপ হবে। বসে পড়তে পড়তে পিঠে একটা ব্যথা হয়েছে। খুব তেল মালিশ করে গোসল করে এলাম। খাবার পরেই কাগজ এসে হাজির।
ব্যাপার কি! ভুট্টো সাহেব নাই! বিতাড়িত। ছুটি চেয়েছেন, পেয়েছেনও। সসম্মানে তাড়াইয়া দেওয়ার একটা ফন্দি। আমেরিকার ধাক্কা আইয়ুব সাহেব সামলাইবেন কেমন করে! শোয়েব সাহেবের দৌলতে তিনি যে অর্থনীতি কায়েম করতে চলেছেন তাহাতে আমেরিকা ছাড়া আর কে সাহায্য করতে পারে! আমেরিকা সেখানে সাহায্য দিতে চায় সেখানে অধীনস্ত না করে অর্থ সাহায্য দেয় না। পণ্ডিত জওহরলালের মতো ত্যাগী, কর্মঠ, শিক্ষিত প্রধানমন্ত্রীও কৃষ্ণ মেননের মতো বৈদেশিক মন্ত্রীকে আমেরিকার চাপে সরায়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর আমাদের আইয়ুব সাহেব যাদের বদৌলতে ক্ষমতায় বসেছেন, যাদের দৌলতে ক্ষমতায় টিকে আছেন, কেমন করে সেই মুরুব্বীদের বেজার করবেন? ভাই ভুট্টো আমার কথাগুলি মনে করে দেখবেন নিশ্চয়ই। যখন হঠাত আমার সাথে মোলাকাত হয়ে গিয়াছিল তখন তাকে বলেছিলাম, বেশি দিন আর বাকি নাই, আপনারও দিন ফুরাইয়া এসেছে। ডিকটেটরের ধর্ম নাই। সে শুধু নিজেকে চেনে এবং নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে কাহাকেও ছাড়ে না। অ্যামেরিকানরা যে আইয়ুব সাহেবকে ছাড়তে পারে না তাহাও আমার বুঝতে বাকি নাই। এমন নেতা আমেরিকা চায় যারা জনগণের সাথে সম্বন্ধ রাখে না। আইয়ুব সাহেব বিবৃতি দিয়েছেন, ‘বৈদেশিক নীতি পূর্বের মতো চলবে। এঁর কোনো পরিবর্তন হবে না’। আমরা জানি যে, কোনোদিন পরিবর্তন করতে পারবেন না।
শনিবার রাতে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকারী পরিষদের সভায় দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক ঢাকা টাইমস ও সাপ্তাহিক পূর্বাণীর মুদ্রণালয়, নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণ, সংবাদপত্রের উপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা, দেশরক্ষা আইনে জনাব তফাজ্জল হোসেন, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন সহ অন্যান্য সাংবাদিক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আগামী সোমবার একদিন প্রতীক ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
দি নিউ নেহনে প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্তকরণের উপর স্বতন্ত্র দলের নেতা জনাব আসাদুজ্জামানের ও গণপরিষদের সদস্যের অধিকার সংক্রান্ত মুলতবি প্রস্তাব এবং বিরোধীদলের নেতা আবদুল মালেক উকিলের আনীত মুলতবি প্রস্তাব স্পিকার সাহেব কতৃক অগ্রাহ্য করার প্রতিবাদে বিরোধী ও স্বতন্ত্র দলীয় সদস্যরা পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন।
বিরোধী দলের ও স্বতন্ত্র দলের সদস্যরা কালো ব্যাজ পরিধান করেন। কারণ জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করা হইতেছে ১৭, ১৮, ১৯ তারিখে। পূর্ব বাংলার প্রায় সমস্ত জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে। জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করতে দেওয়া হবে না। নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার করে, শান্তিপূর্ণ শোভাযাত্রায় উপর গুলি করে, প্রেস বন্ধ করে দিয়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা দিয়ে কিছু দিনের জন্য আন্দোলন বন্ধ রাখা যায়, বেশি দিন না।
বিকাল বেলা বৃষ্টি একটু কম হলেও মাঝে মাঝে চলছে। মাজায় ব্যথা বেশি হাটতেও পারলাম না। রাত কেটে গেল। রাতে ভীষণভাবে বৃষ্টি হলো। ঘুম ঠিকই হয়েছে, তবে মাঝে দু’বার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।

২০শে জুন ১৯৬৬ ।। সোমবার
হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার! কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার ফুলের বাগানের এক অংশের কিছু মাটি ধ্বসে পড়েছে। ভিতরে অনেকদুর দেখা যায়। কি ব্যাপার এখানে কি আছে? কেউ বলে ভিতরে কিছু নিশ্চয়ই হবে। কোনোদিন এই ঘটনা ঘটে নাই। মাটি ধ্বসে নিচের দিকে গিয়াছে। আমি দেখলাম জমাদার ছুটে এসেছে। চীফ হেডওয়ার্ডারকে খবর দেওয়া হয়েছে। কি করা যায়? আমি আমার মেট, পাহারা মেম্বরকে বললাম, পুরনো আমলের একটি পানির কুয়া ছিল বলে মনে হয়। জায়গাটি গোলাকার, চারদিকে ইট দিয়ে বাধা। অনেকেই বলল, ‘তাই হবে’/ এরপর শুনলাম জেলার সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে। জেলার সাহেব দেখতে আসবেন। তখন আমি হাসতে হাসতে বললাম, মনে হয় ভিতরে কিছু আছে। জেলখানার এই জায়গাটি শায়েস্তা খানের আমলে লালবাগ ফোর্টের অংশ ছিল। এখানে নবাবদের ঘোড়াশালা, হাতিশালাও ছিল। আমি যে ঘরটিতে থাকি সেটা ঘোড়া থাকার মতোই ঘর। দেখলে বোঝা যাবে এখানে ঘোড়াই রাখা হতো।
ইংরেজরা এই অংশটাকে কয়েদখানায় পরিণত করেছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, এই গর্তের মধ্যে টাকা পয়সা সোনা রূপা পাওয়া যেতে পারে। অনেকেই গম্ভীর হয়ে শুনল। অনেকে বিশ্বাস করতেও আরম্ভ করল। জেলার সাহেব জেলের ডিআইজি সাহেবকেও খবর দিলেন। এটা বন্ধ করা চলবে না, যে পর্যন্ত এটিকে ভাল করে না দেখা হবে।
চিত্ত বাবুর সাথে সামান্য আলাপ করলাম দূর থেকে। যদিও খুব কাছে থাকেন, তবে তার সেল ছেড়ে বাইরে আসার হুকুম নাই। তাকে বরিশাল থেকে নিয়ে এসেছে। কি জন্য এসেছে তিনি বলতে পারেন না। তাকেও আলাদা করে রাখার হুকুম। তবে তার সাথে একজনকে রাখা হয়েছে।
আজও খুব বৃষ্টি হলো। বৃষ্টি হলেই কেমন যেন হয়ে যায় মনটা। লাইব্রেরিতে বই আনতে পাঠালাম। আজ আর বই পাওয়া যাবে না। আমার নিজের কিছু বই আছে, কয়েকদিন চালাতে পারব
ভয়াবহ বন্যায় পূর্ব বাংলার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেল। প্রত্যেক বৎসর এ রকম হলে মানুষ বাচবে কেমন করে? এখনই দেশের অবস্থা খারাপ/ তারপর আছে ট্যাক্স বা কর। আবার বন্যায় ফসল নষ্ট। এই দেশের হতভাগা লোকগুলি খোদাকে দোষ দিয়ে চুপ করে থাকে। ফসল নষ্ট হয়েছে, বলে আল্লা দেয় নাই, না খেয়ে আছে, বলে কিসমতে নাই। ছেলেমেয়ে বিনা –চিকিৎসায় মারা যায়, বলে সময় হয়ে গেছে বাচবে কেমন করে! আল্লা মানুষকে এতো দিয়েও বদনাম নিয়ে চলেছে। বন্যা ত বন্ধ করা যায়, দুনিয়ায় বহু দেশে করেছে। চীন দেশে বৎসরে বৎসরে বন্যায় লক্ষ লক্ষ একর জমি নষ্ট হতো। সে বন্যা তারা বন্ধ করে দিয়েছে। হাজার কোটি টাকা খরচ করে ক্রুগ মিশনের মহা পরিকল্পনা কার্যকর করলে, বন্যা হবার সম্ভবনা থাকে না। এমনকি বন্যা হলেও, ফসল নষ্ট করতে পারবে না। এ কথা কি করে এঁদের বোঝাব! ডাক্তারের অভাবে, ওষুধের অভাবে, মানুষ অকালে মরে যায়-তবুও বলবে সময় হয়ে গেছে। আল্লা তো স্বল্প বয়সে মরবার জন্য জন্ম দেয় নাই। শোষক শ্রেণী এঁদের সমস্ত অম্পদ শোষণ করে নিয়ে এঁদের পথের বিখারি করে, না খাওয়াইয়া মারিতেছে। না খেতে খেতে শুকায়ে মরছে, শেষ পর্যন্ত না খাওয়ার ফলে বা অখাদ্য খাওয়ার ফলে কোনো একটি ব্যারাম হয়ে মরছে, বলে কিনা আল্লা ডাক দিয়েছে আর রাখবে কে?
কই গ্রেট বৃটেনে তো কেউ না খেয়ে মরতে পারে না। রাশিয়ায় তো বেকার নাই, সেখানে তো কেহ না খেয়ে থাকে না, বা জার্মানি, আমেরিকা, জাপান এই সকল দীশে তো কেহ শোনে নাই-কলেরা হয়ে কেহ মারা গেছে? কলেরা তো এসব দেশে হয় না। আমার দেশে কলেরায় এত লোক মারা যায় কেন? ওসব দেশে তো মুসলমান নাই বললেই চলে। সেখানে আল্লার নাম লইবার লোক নাই একজনও; সেখানে আল্লার গজব পড়ে না। কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বরও হয় না। আর আমরা রোজ আল্লার পথে আজান দিই, নামাজ পড়ি, আমাদের ওপর গজব আসে কেন? একটা লোক না খেয়ে থাকলে ঐ সকল দেশের সরকারকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। আর আমার দেশের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক দিনের পর দিন না খেয়ে পড়ে আছে, সরকারের কোনো কর্তব্য আছে বলে মনেই করে না।
তাই আমাদের দেশের সরকার বন্যা এলেই বলে ‘আল্লার গজব’। কিছু টাকা দান করে। কিছু খয়রাতি সাহায্য ও ঋন দিয়ে খবরের কাগজে ছেপে ধন্য হয়ে যায়। মানুষ এভাবে কতকাল চলতে পারবে সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নাই। বড় লোকদের রক্ষা করার জন্যই যেন আইন, বড়লোকদের আরও বড় করার জন্যই মনে হয় সিপাহি বাহিনী। এই দেশের গরিবের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই আজ বড় বড় প্রাসাদ হচ্ছে, আর তারা দু’বেলা ভাত পায় না। লেখাপড়া, চিকিৎসা ও থাকার ব্যবস্থা ছেড়েই দিলাম। বন্যায় শত শত কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট হয়ে যাইতেছে প্রত্যেক বৎসর। সেদিকে কারও কোনো কর্তব্য আছে বলে মনে হয় না।
পাকিস্তানে রাজধানী একটা আছে করাচিতে, আরও দুইটা রাজধানী তৈয়ার করিতেছে। একটা রাওয়ালপিন্ডি, আধা রাজধানী, আর একটা রাওয়ালপিন্ডি থেকে ১২ মাইল দূরে ইসলামাবাদে। খরচ হবে ৫০০ কোটি টাকা। পূর্ব বাংলায় একটা তথাকথিত উপ রাজধানী শহরের সেরা জায়গা নিয়ে করছে।
একে রাজধানী না, পূর্ব বাংলাকে ধোকা দেওয়ার জন্য ‘প্রোপাগান্ডা রাজধানী’ করা হতেছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের করাচী পূর্বেই রাজধানী ছিল, তারপর মধ্যবর্তী রাজধানী রাওয়ালপিন্ডি। তারপর ইসলামাবাদ। আর পূর্ব বাংলার বন্যা বন্ধ করার জন্য টাকার অভাব! এ দুঃখের কথা কাকে জানাব!
বাংলাদেশ শুধু কিছু বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকদের জন্যই সারাজীবন দুঃখ ভোগ করল। আমরা সাধারণত মীর জাফর আলি খাঁর কথাই বলে থাকি। কিন্তু এর পূর্বেও ১৫৭৬ সালে বাংলার স্বাধীন রাজা ছিল দাউদ কারানী। দাউদ কারানীর উজির শ্রীহরি বিক্রম-আদিত্য এবং সেনাপতি কাদলু লোহানী বেঈমানি করে মোগলদের দলে যোগদান করে। রজমাবাদের যুদ্ধে দাউদ কারানীকে পরাজিত, বন্দি ও হত্যা করে বাংলাদেশ মোগলদের হাতে তুলে দেয়। এরপরও বহু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই বাঙালি জাত। একে অন্যের সাথে গোলমাল করে বিদেশি প্রভুকে ডেকে এনেছে লোভের বশবর্তী হয়ে। মীরজাফর আনলো ইংরেজকে, সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করল বিশ্বাসঘাতকতা করে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে এই বাঙালিরাই প্রথম জীবন দিয়ে সংগ্রাম শুরু করে; সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয় ব্যারাকপুর থেকে। আবার বাংলাদেশে লোকের অভাব হয়না ইংরেজকে সাহায্য করবার। ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত এই মাটির ছেলেদের ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসি দিয়েছে এদেশের লোকেরাই-সামান্য টাকা বা প্রমোশনের জন্য।
পাকিস্তান হওয়ার পরেও দালালি করার লোকের অভাব হলো না-যারা সব কিছুই পশ্চিম পাকিস্তানে দিয়ে দিচ্ছে সামান্য লোভে। বাংলার স্বার্থ রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করছে তাঁদের বুকে গুলি করতে বা কারাগারে বন্দি করতে এই দেশে সেই বিশ্বাসঘাতকদের অভাব হয় নাই। এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ এত উর্বর; এখানে যেমন সোনার ফসল হয়, আবার পরগাছা ার আগাছাও বেশি জন্মে। জানি না বিশ্বাসঘাতকদের হাত থেকে এই সোনার দেশকে বাচানো যাবে কিনা!
ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ, মনের খোরাক তো পাওয়া যাবে না। তবুও কাগজগুলি বসে বসে দেখি। ইত্তেফাক বন্ধ করল কে?
বিকালে সিনিয়র ডিপুটি জেলার সাহেব আসলেন সেই গর্ত দেখতে। বললাম, দেখুন তো কিছু পাওয়া যায় কিনা এর ভিতরে। ভদ্রলোক হিন্দু। ভয়েতে আমার সাথে বেশি কথা বলেন না। হ্যা-না, বলেই কেটে পরতে পারলে বাচেন। চলে গেলে শুনলাম এটা এভাবেই থাকবে, আগামীকাল ডিআইজি সাহেব দেখে যাহা বলবেন তাহাই করা হবে।
খেতেই আমার ইচ্ছা হয় না যেন কেন। অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকে এই অবস্থা হয়েছে, খেতে ইচ্ছাও বেশি হয় না। মেট ও বাবুর্চি বলে, তবে পাকাই কেন, যদি কিছু না-ই খাবেন? বললাম, তোমরা খাও। যা খাই তাতেই আমার চলবে। রাত্র শুরু হয় আমাদের সন্ধ্যা থেকে, কারণ সন্ধ্যার পরেই জেলখানার সব দরজা বন্ধ। সমস্ত কয়েদিদের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয় সূর্যাস্ত হওয়ার সাথে সাথেই। এত বড় রাত কাটানো খুব কষ্টকর। আজ আর ঘুমাতে পারলাম না। মেহেরবানি করে একটা পাগল ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার শুরু করেছে। দিনের বেলা হলে একটা বন্দোবস্ত হতো, পাগলা সেলের অন্যপাশেও সেল আছে। কিন্তু রাতে কোনো উপায় নাই। তাই আল্লা আল্লা করে রাতটা কাটাতে হলো।

২১শে জুন ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
আকাশটা আজ মেঘে ভরে রয়েছে। বৃষ্টি নাই। শুনলাম জেলের ডিআইজি সাহেব এদিকে আসবেন, যদিও আজ এখানে আসার কোন কথা নাই। তিনি আসবেন ওই গর্তটা দেখতে। বৃষ্টি পেয়ে দূর্বা ঘাসগুলি বেড়ে উঠেছে লিকলিক করে, সমস্ত মাঠটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে। বাজে গাছ আমি তুলে ফেলে দিই। একটু ভাল লাগলেই অর ভিতর দিয়ে হেঁটে বেড়াই আর যে পরগাছা চোখে পড়ে তাঁকেই ধ্বংস করি।
শুনলাম মানিক ভাইকেও আলাদা রাখবার হুকুম হয়েছে। কিন্তু রাখবে কোথায়? সেল এরিয়ায় আমাকে একলা রাখা হয়েছে। ২৬ সেলে সিকিউরিটি, পুরানা হাজত এবং ১/২ খাতায় ডিপিআর বন্দিরা। আইবি তো হুকুম দিয়েই চলেছে সকল আওয়ামী লীগারদের আলাদা আলাদা রাখতে হবে। তাঁদের কষ্ট দিতে হবে। তাঁদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে হবে।
মানিক ভাই ও মোস্তফা সরওয়ারকে ‘এ’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। মোমিন সাহেব, হাফেজ মুছা ও শাহাবুদ্দিন চৌধুরীকে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়েছে। শামসুল হক সাহেব, রাশেদ মোশাররফ ও ওবায়দুর রহমানকে এখনও সি ডিভিশনে রাখা হয়েছে, কারণ এঁরা নাকি ইনকাম ট্যাক্স দেয় না। ১৫০০ শত টাকার উপরে আয় হলে ‘বি’ ক্লাস দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি এমএ পাশ করলেও ‘সি’ ক্লাস হতে হবে। টাকা থাকলেই বড় ক্লাস, শিক্ষার কোন দাম নাই। পদের দাম নাই, সম্মানের দাম নাই। এমনকি পদমর্যাদারও দাম নাই।
আমি জেল কতৃপক্ষকে বললাম, যদি কোন প্রফেসার, ডিসি, এসপি কোনোমতে ডিপিআর-এ গ্রেপ্তার হতে বাধ্য হয় তারও সি ক্লাস হবে এবং রোজ দেড় টাকায় খাওয়া ও নাস্তার সকল কিছু বন্দোবস্ত করতে হবে। রাস্তার কত পাগলকে ডিপিআর করেছে। শামসুল হক সাহেবের বাবার সম্পত্তি আছে, নিজে কাজকর্ম করেন না। জেলা, আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পলিটিক্যাল সেক্রেটারি ও এমপিএ ছিলেন, তাকেও যদি ক্লাস না দেওয়া হয় আর দেড় টাকার খাওয়াই যদি খেতে হয় তার বিচার তো এখন হতে পারে না, পরে দেখা যাবে। ওবায়দুর রহমান এমএ পাশ। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন, এখন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক। তাকেও সি ক্লাস। রাশেদ মোশাররফের বাবা বড়লোক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক, বিরাট বাড়ি ঢাকা শহরে, নিজেও ছোটখাট ব্যবসা করে, তাকেও সি ক্লাস। কাকে দুঃখের কথা বলব? যে কোনো রাস্তার লোক টাকা উপার্জন করেছে দুর্নীতি করে, ইনকাম ট্যাক্স দেয় তাকে দিতে হবে ক্লাস ‘এ’। আমি তো ওদের সাথে দেখা করতে পারব না আর সান্ত্বনাও দিতে পারব না। এইবার সরকার আমাদের হবর খেলা দেখাচ্ছে। ইতরামির চরমে পৌছেছে।
এভাবে অত্যাচার চলতে থাকলে বাধ্য হবো বোধ হয় এর প্রতিবাদ করতে। আমি বার বার জেল কতৃপক্ষের কাছে প্রতিবাদ করেছি। বার বার বলতে আমার লজ্জাও করে। জেল কতৃপক্ষ এক কথাই বলেন, ‘আমাদের কোনো হাত নাই। আমরা হুকুম তামিল করি’। আমার মনে হয় আমাদের যে কষ্ট হতেছে তাতে তারা লজ্জিত হয় কিন্তু কি করবে? ছোটলোক যেখানে শাসন চালায় তখন আর ভদ্রতা আশা করা কষ্টকর! আমি জানি উপরের কড়া হুকুম, আমার কাছে কেউই থাকতে পারবে না। কারও সাথে আলাপ করতে পারব না। একাকী রাখতে হবে। মনে মনে ভাবি আমি কষ্ট না পেলে আমাকে কষ্ট দেয় কে? যতই কষ্টের ভিতর আমাকে রাখুক না কেন, দুঃখ আমি পাব না। কারণ, ‘কোনো ব্যাথাই আমাকে দুঃখ দিতে পারে না এবং কোনো আঘাতই আমাকে ব্যথা দিতে পারে না’। এঁরা মনে করেছে বন্ধু শামসুল হককে জেলে দিয়ে যেমন পাগল করে ফেলেছিল, আজ আর তার কোনো খোঁজ নাই, কোথায় না খেয়ে বোধ হয় মরে গিয়েছে। আমাকেও একলা একলা জেলে রেখে পাগল করে দিতে পারবে। আমাকে যারা পাগল করতে চায় তাঁদের নিজেদেরই পাগল হয়ে যাবার সম্ভবনা আছে।
কিছু কিছু সরকারি কর্মচারী যারা ইংরেজদের কাছ থেকে শিখেছে তারা এর পিছনে আছে। আমি তাঁদের জানি, যদি বেঁচে থাকি তবে এর বিচার একদিন হবে, আর যদি মরে যাই তবে সহকার্মীদের বলে যাবো তাঁদের নাম। কঠোর সাজা যেন দেওয়া হয়। জীবনে যেন না ভোলে। সাবধান করে দিয়ে যাবো-ক্ষমতায় গেলে এরাই সবার পূর্বে এসে আনুগত্য জানাবে এবং প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাবে।
খবরের কাগজ আজ আর এলো না। সাংবাদিকরা প্রতিবাদ দিবস পালন করছে নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে এবং মানিক ভাই ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে। কোনো কাগজেই আসে নাই।
দিনটা মেঘলা, সূর্যের মুখ দেখলাম না। তবে বৃষ্টি হয় নাই। সন্ধ্যার পরে ভীষণ বৃষ্টি শুরু হয়। আরামে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত দু’টায় এক পাগল আজও ক্ষেপে গিয়েছিল। তবে ঘুম বেশি নষ্ট করতে পারে নাই।

২২শে জুন ১৯৬৬ ।। বুধবার
ভোর থেকে ভীষণভাবে বৃষ্টি নেমেছে। থামবার নামও নিতেছে না। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে যেতে দেখি ডিম দিয়েছে একটা। যতগুলি ডিম আমাকে এ পর্যন্ত দিয়েছে সবই নষ্ট। যাদের ডিমের কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয় তারা বাজার থেকে পচা ডিম কিনে আনে। বাধা দিবে কে? মুখতো বন্ধ। কন্ট্রাক্টর সাহেব নিশ্চয়ই জানে কেমন করে মুখ বন্ধ করতে হয়! দোষ কাকে দিব? সমস্ত দেশটায় যাহা চলছে এখানেও সেই একই অবস্থা। দেখার লোকের অভাব। কেহ ভাল হতে চেষ্টা করলে তার সমূহ বিপদ।
একটা ঘটানা আমার জানা আছে। এক থানায় একজন কর্মচারী খুব সৎ ছিলেন। ঘুষ খেতেন না। কেহ ঘুষ নিক তিনি তাহাও চাইতেন না, সকলে তাকে বোকা বলতে শুরু করে-ছোট থেকে বড় পর্যন্ত। একদিন তার এক সহকর্মী তাকে বলেছিল, সাধু হলে চাকরি থাকবে না। বড় সাহেবের কোটা তাকে না দিলে খতম করে দিবে। তিনি তাহা শুনলেন না। বললেন, ঘুষ আমি খাবো না, আর ঘুষ দিবও না। সত্যই ভদ্রলোক ঘুষ খেতেন না। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল ঘুষ খাওয়ার অপরাধে তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। এই মিথ্যা মামলায় তাকে চাকরি হারিয়ে কোর্টে আসামি হতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকে তিনি মুক্তি পান, চাকরি আর করেন নাই। সকল জায়গায়ই একই অবস্থা আজকাল, এখন অনেক বেশি। কাহাকেও ভয় করে না। সোজাসুজিই এসব চলছে।
কারাগারের অবস্থা বাইরে যারা আছেন বুঝবেন না। অনেক কর্মচারী আছে যারা এক পয়সাও ঘুষ খায় না। এমনকি জেলের কোনো জিনিসও গ্রহণ করেন না। আমি অনেককে জানি। তাঁদের চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় নাই। যাক, আমার জিনিসপত্র মন্দ নাই, আমার ব্যাপারে সকলেরই সহানুভূতি আছে। আমাকে ভাল জিনিস দিতে পারলে এঁরা খুশিই হয়। ডিম এই সময় একটু বেশিই নষ্ট হয়। চেষ্টা নিশ্চয়ই তারা করেন, ভাল ডিম পায় না কি করবে? আমি যাহা চাই তাহাই তারা দিতে চেষ্টা করে। যদিও আমি খাওয়ার দিকে বেশি খেয়াল দিই না। কোনোদিন নিজ হাতে লিখেও দেই না। যাহা দরকার ৫ টাকার মধ্যে দিয়ে দেবেন, যদি না হয় খবর দেবেন-বাজার থেকে নিজেই টাকা দিয়ে কিনে আনবো, না হয় বেগম সাহেবা দেখা করতে এলে বলে দিব। কয়েদি থেকে কর্মচারী পর্যন্ত সকলেই আমার দিকে খেয়াল রাখ, যাতে কোনো কষ্ট না হয়। ডাক্তার সাহেবরাও নিজের ইচ্ছায় কিছু কিছু জিনিস আমাকে দিয়ে থাকে, বলার প্রয়োজন হয়না। আমি যাহা পাই নিজে খেয়েও আমার চারজন মেট, বাবুর্চি, ছাফাইয়া, ফালতুরা খেয়েও কিছু কিছু অন্য কয়েদিদের দেওয়া হয়-যারা আমার সেলের সামনে কাজকর্ম করে, পানি দেয়, বাগান পরিষ্কার করে। সকলকে একদিনে দেওয়া যায়না। তাই এক এক দিন এক এক জনকে দেওয়া হয়। বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি কিছু কিছু বাঁচাইয়া একদিন একটু বেশি পাক করে কয়েকজনকে দিও। যাহা হউক যারাই আমার আশে পাশে আছে সকলকেই একদিন না একদিন কিছু দিতে পেরেছি এবং দিতেও থাকব। তবে মেট, ফালতু, বাবুর্চি আর ছাফাইয়া প্রত্যেক বেলায় ভাগ পায়। এঁদের রেখে আমি খাই কি করে! আমার পক্ষে সম্ভব নহে। চা একটু বেশি খরচ হয়। আমি আমার নিজের টাকা দিয়ে কিনে আনি। জেলের নিয়ম, আমার কাছে থাকবে, আমার জন্য পাক করবে, আমার ঘর পরিষ্কার করবে, কাপড় ধুইয়ে দিবে কিন্তু আমার সাথে খাইতে পারবে না। তাঁদের খাওয়া বাইরের থেকে আসবে। মানে সরকারি চৌকি থেকে। যাহা পায় তাহা তো পাবেই। আমি ওদের না দিয়ে খাই কেমন করে? আমি না খেয়ে থাকতে রাজি, কিন্তু ওদের না দিয়ে খেতে পারব না।
আজ নাস্তা খেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কারণ বৃষ্টি হতেছে ভীষণভাবে। মনে হয় আকাশ ফেটে গিয়েছে। ঘুমাতে পারলাম না। পুরানা কাগজগুলি পড়তে লাগলাম-যা সামান্য বাকি ছিল। তারপর আবার চা। আবার বই নিয়ে বসা। বৃষ্টি হলে একাকী খুবই খারাপ লাগে। সময় যেতেই চায় না। ১২টায় সিকিউরিটি জমাদার সাহেব এলেন, কিছু বাজার করতে হবে, বিস্কুট চাই, আমার বাড়িতে মুড়ি খাবার অভ্যাস। বাড়িতে খবর দিলে পাঠাইয়া দিতো। কষ্ট দিতে ইচ্ছে হয়না বেচারীকে। সকল কিছুই তো তার করতে হয়, আমি তো মুসাফির। বাড়িতে আমি বেগম সাহেবার মুসাফির। এখানে সরকারের মুসাফির।
আমি বাইরে যেয়ে হাটতে লাগলাম, কারণ বৃষ্টি থেমে গেছে। এই সুযোগ ভাল করে ব্যবহার করলাম। একমাত্র পরিশ্রম।
গোসল করে এসে ভাত খেয়ে আবার বই নিয়ে বসলাম। জেল লাইব্রেরী থেকে কয়েকখানা বই দিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে কাগজ এল। দেখলাম হাইকোর্টে মামলা করেছে নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে ও মানিক ভাইকে বন্দি করার বিরুদ্ধে।

২৩শে জুন ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
মিজানুর রহমান চৌধুরী এম.এন. এ.-কে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক ছিল। মনে হতেছে কাহাকেও বাইরে রাখবে না। এখন সমস্ত পাকিস্তান, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান তো একটা বড় ‘কারাগার’। কথা বলা শক্তি নাই। জেলায় জেলায় ১৪৪ ধারা। ইত্তেফাক প্রেস বাজেয়াপ্ত। তফাজ্জল হোসেন (মানিক ভাই) কে গ্রেপ্তার করে আলাদা রাখার ব্যবস্থা। গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে কর্মীদের বিরুদ্ধে। মিজানকে এনেও দশ সেলে রাখা হয়েছে। ডিভিশন আসতে কমপক্ষে ১৫ দিন সময় লাগে, এই কয়দিনে যে খাওয়া দেয় তা নাই বললাম। অপেক্ষা করে আছি কতজনকে আনবে জেলে। তবু দাবি আদায় হবে, রক্ত যখন বাঙালি দিতে শিখেছে।
বন্যা ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করেছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলেছে। চাউলের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা মন হয়ে গেছে। জনগণের আর শান্তি নাই। শান্তি চেয়ে আনা যায় না, আদায় করে নিতে হয়। অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াও। অত্যাচারী ভয় পেয়ে যাবে। যে অত্যাচার করে টিকে থাকতে চায় তার মেরুদণ্ড খুব দুর্বল। আঘাত করলেই ভেঙ্গে যাবে।
আজকাল কাগজে আর রাজনৈতিক খবর পাওয়া যায় না-বোধহয় তা বন্ধই করে দিয়েছে। জুলুম প্রতিরোধ দিবসের সংবাদ ছাপাইতে পারবে না। দাও না বন্ধ করে আওয়ামী লীগের অফিসের দরজা। কাহাকেও যখন বাইরে রাখবা না, তখন আর অফিসের দরকার কি?
দুপুরের দিকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উকি মারতে শুরু করছে। রৌদ্র একটু উঠবে বলে মনে হয়। বৃষ্টি আর ভাল লাগছে না। একটা উপকার হয়েছে আমার দূর্বার বাগানটার। ছোট মাঠটা সবুজ হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসগুলি বাতাসের তালে তালে নাচতে থাকে। চমৎকার লাগে, যেই আসে আমার বাগানের দিকে একবার না তাকিয়ে যেতে পারে না। বাজে গাছগুলো আমি নিজেই তুলে ফেলি। আগাছাগুলিকে আমার বড় ভয়, এগুলি না তুললে আসল গাছগুলি ধ্বংস হয়ে যাবে। যেমন আমাদের দেশের পরগাছা রাজনীতিবিদ যারা সত্যিকারের দেশপ্রেমিক তাঁদের ধ্বংস করে, এবং করতে চেষ্টা করে। তাই পরগাছাকে আমার বড় ভয়। আমি লেগেই থাকি। কুলাতে না পারলে আরও কয়েকজনকে ডেকে আনি। আজ বিকালে অনেকগুলি তুললাম।
আমার মোরগটা আর দুইটা বাচ্চা আনন্দে বাগানে ঘুরে বেড়ায় আর ঘাস থেকে পোকা খায়। ছোট কবুতরের বাচ্চাটা দিনভর মোরগটার কাছে কাছে থাকে। ছোট মুরগির বাচ্চারা অকে মারে, কিন্তু মোরগটা কিছুই বলে না। কাক যদি অকে আক্রমণ করতে চায় তবে মোরগ কাকদের ধাওয়া করে। রাতে ওরা একসাথেই পাকের ঘরে থাকে। এই গভীর বন্ধুত্ব ওদের সাথে। এক সাথে থাকতে থাকতে একটা মহব্বত হয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ অনেক সময় বন্ধুদের সাথে বেঈমানী করে। পশু কখনও বেইমানী করে না। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পশুরাও বোধহয় মানুষের চেয়ে একদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ।
চা বানাতে বললাম। আজ যাকে পাওয়া যায় তাঁকেই চা খাওয়াতে বললাম। সাধারণ কয়েদিরা একটু চায়ের জন্য কত ব্যস্ত। তাই আমি বলে দিয়েছি যে-ই চা খেতে চাইবে তাঁকেই দিবা। আমার মেটা একটু কৃপণ, সহজে কিছু দিতে চায় না। যদি আমার কম পড়ে যায়, বাইরের থেকে আসতে দেরি হলে অসুবিধা হবে। তাকে বলে দিয়েছি, কম পড়ে পড়ুক, আনতে দেরি হয় হউক, চাইলে দিতে হবে। কিইবা আমি দিতে পারি, এই নিষ্ঠুর কারাগারে!
বিকালে আজ আবার নতুন করে কেডস সু পরে হাটতে শুরু করলাম। না হাটলে তো খাওয়াই হজম হবে না। ব্যায়াম আমার প্রয়োজন। তাই সময় পেলেই একটু ঘোরাঘুরি করি। পাশের ২০ সেলে পাবনার সাংবাদিক রণেশ মৈত্র থাকেন। ল’ পরীক্ষা দিতে এসেছেন পাবনা থেকে এখানে, আজ শেষ পরীক্ষা হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন পরীক্ষা দিলেন’? বললেন, ‘মন্দ হয় নাই’। আমার সামনে দিয়েই তার যেতে হয়, যেখানে থাকেন সেইখানে। রণেশ বাবু যে কোনোদিন পাবনা চলে যাবেন। তবুও মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখা হতো ভদ্রলোকের সাথে। বাবু চিত্ত সুতার খবর দিলেন, রণেশ বাবু গেলেও তার একলা থাকতে আপত্তি নাই। কারণ দূর থেকে হলেও আমার সাথে দেখা হয়। জেল কতৃপক্ষকে বলতে বললেন। আমার কথা তারা শুনবে কেন? সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
জমাদার সাহেব এসে হাজির হয়েছেন। বন্ধ করতে শুরু করেছেন, এমন সময় ডিপুটি জেলার সাহেব এলেন আমাকে দেখতে। তাকে নিয়ে দুইখানা চেয়ার নিয়ে ঘাসের উপর বসলাম। বোধহয় আজই ঘাসের উপর চেয়ার নিয়ে দুইজন বসলাম। একা আমি প্রায়ই বসে থাকি, একাই তো থাকি। তাকে বললাম, আমার অন্যান্য সহকর্মীদের খাওয়ার খুব কষ্ট হতেছে একটা কিছু করেন। চোর ডাকাতের থেকেও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা খারাপ হয়ে গেছে? তাঁদের কষ্ট দিতেই হবে?
তিনি বললেন, আমাদের বলে আর লাভ কি! আমরা তো হুকুমের চাকর।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে ঘরে ঢুকলাম। খট করে তালাবদ্ধ। আমিও বই আর খাতা নিয়ে বসলাম।

২৪শে জুন ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
ভোরে ঘুম থেকে উঠতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। উঠতে ইচ্ছাই হয় না। মেট চা নিয়ে এসে হাজির। বিছানায় বসেই চা খেলাম। দেখলাম আকাশের অবস্থা ভাল। আমার ঘরের দরজার কাছে একটা কামিনী ও একটা শেফালী গাছ। কামিনী যখন ফুল দেয় আমার ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে থাকে। একটু দূরেই দুইটা আম আর একটা লেবু গাছ। বৃষ্টি পেয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলি যেন আরও সবুজ আরও সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ভাল লাগল দেখতে। মাঠটা সবুজ দূর্বায় ভরে উঠেছে। তারপর গাছগুলি, বড় ভাল লাগলো। বাইরেই যেয়ে বসলাম। দেখলাম এঁদের প্রাণ ভরে। মনে হলো যেন নতুন রূপ নিয়েছে। মোরগ মুরগির বাচ্চা ও কবুতরটা মাঠটা ভরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
একজন এসে বলল, আপনার দলের সুলতান কে? তাকে আজ ভোরে নিয়ে এসেছে গ্রেপ্তার করে। ঢাকায় বাড়ি। বললাম, বুঝেছি। সুলতান আওয়ামী লীগ অফিসের ‘Whole time worker’, সকল সময়ের কর্মী। বড় নিঃস্বার্থ কর্মী। সমস্ত ঢাকা শহর তার নখদর্পণে। প্রত্যেকটা কর্মী ও তাঁদের বাড়ি ও চিনে। কাজ করতে কখনও আপত্তি করে না, দিন রাত সমানে কাজ করে যায়। হুকুম দিলেই তামিল করে। নিজস্ব একটা মতবাদও আছে।
সুলতানের ফুফুই সুলতানদের তিন ভাইকে মানুষ করেছে। এঁদের সাথে আমার বড় মধুর সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৫৪ সালে যখন আমি মন্ত্রী হলাম-শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক সাহেবের মন্ত্রীসভায়; কয়েকদিন পরেই মন্ত্রিত্ব ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার ১৯২-ক ধারা জারি করল। হক সাহেবকে বাড়িতে বন্দি করল, আমাকে মিন্টু রোডের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে আনল। আমার স্ত্রীও তখন নতুন ঢাকায় এসেছে। বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার পূর্বে যদিও কলিকাতা গিয়াছে কয়েকবার আমাকে দেখতে, কিন্তু ঢাকায় সে একেবারে নতুন; সকলকে ভাল করে জানেও না। মহাবিপদে পড়লো। সরকার হুকুম দিয়েছে ১৪ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে। টাকা পয়সাও হাতে নাই বেশি। বাড়ি ভাড়া কোথায় পাওয়া যায়। তখন বন্ধু ইয়ার মহম্মদ খান, হাজী হেলালউদ্দিন সাহেবের মারফতে এই সুলতানের নাজিরা বাজারের বাড়ি ভাড়া করে দেয়। পাশের বাড়িতে সুলতানরা তিন ভাই আর ফুফু থাকতো। বৃদ্ধা ভদ্র মহিলা আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের এত আদর করতেন-যে না দেখেছে সে কল্পনাও করতে পারবে না। পুলিশ তো প্রায়ই আমার বাড়িতে আসতো, কোনো আত্মগোপনকারী কর্মী আশ্রয় নিয়েছে কিনা জানতে। এক জাত কর্মচারী আছে সুযোগ সন্ধানী, ‘যখন যেমন তখন তেমন’। এঁরা তেমনি।

ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মহা বিপদেই পড়ে গেল আমার স্ত্রী। সেই হতে এই সুলতানদের সাথে আমার ফ্যামিলির ঘনিষ্ঠতা হয়ে রয়েছে। আমরা ও আমার ছেলেমেয়েরা এঁদের কোনো দিন ভুলি নাই। আর আমরা বুড়িকে নানী বলি। কোনো কিছু ভাল পাক হলে আমাদের না দিয়ে খায় না। সুলতানও আমার কাছে থাকে। পার্টির কাজ করে। আমার মনে হয় সুলতান গ্রেপ্তার হওয়াতে পার্টির খুবই ক্ষতি হয়েছে। সকল কর্মকর্তা, কর্মীদেরও গ্রেপ্তার করছে দেখে মনে হয় অফিসের পিয়নটাকেও গ্রেপ্তার করতে পারে! মোনায়েম খান সব পারেন। তিনি পারেন না এমন কোনো কাজ নাই দুনিয়াতে। আইয়ুব খান সাহেব ভাল লোকই পেয়েছেন, ‘রতনে রতন চেনে’! তবে উপকার থেকে ক্ষতিই বেশি হবে। শ্রীঘ্রই প্রমাণ পাবেন, কিছুটা পেয়েছেনও বটে!
সুলতানকে আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের কাছে রাখে নাই। রেখেছে অন্যান্য ডিপিআরদের সাথে। দুপুরে কাগজ এলে মর্নিং নিউজে দেখলাম করাচী আওয়ামী করাচী আওয়ামী লীগ সভাপতি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে লিখেছেন, জেল থেকে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, মালিক গোলাম জিলানী, খাজা মহম্মদ রফিক, জনাব সিদ্দিকুল হাসান তাকে জানাইয়াছে যে, ‘তারা শেখ মুজিবুরের ৬ দফা প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো মতানৈক্য নাই’। আমি জানি সত্যের জয় একদিন হবেই। পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইরাও একদিন এই ৬ দফা সমর্থন করে পাকিস্তানকে মজবুত করবেন। সারা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপর জুলুম চলেছে। সেখানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নাই। আজ পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতারা কারাগারে বনি। আওয়ামী লীগ আজ জেলখানায়। ‘মানুষকে জেলে নিতে পারে কিন্তু নীতিকে জেলে নিতে পারে না’।
কনভেনশন মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি জনাব আসলাম খান। বোধ হয় পূর্বে কেহ এই ভদ্রলোকের নাম শোনেন নাই, নতুন আমদানি। জনাব বলেছেন, সারা বাংলায় ঘুরে ৬ দফার সমর্থক পেলেন না। বন্ধু একটু ধীরে চলুন, বাংলাদেশকে চিনতে এখনও আপনার বহুদিন লাগবে! বেশি দালালি করে লাভ নাই। ভুট্টো সাহেবের অবস্থা দেখেও শিখলেন না! আপনার পূর্বে আরও কয়েকজন সেক্রেটারি বড় বড় বক্তৃতা করেছেন, তারা কোথায়? বোধ হয় এখন আর খোঁজ খবর নাই।
ড. মির্জা নূরুল হুদা সাহেব ৬ দফার উপর কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘পাকিস্তান দুর্বল হয়ে যাবে’। যাহা হউক, পাকিস্তান দুই টুকরা হয়ে যাবে এ কথাতো তারা বলেন নাই। ড. হুদা সাহেবকে আমার জানা আছে। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পূর্বে কি বলেছেন, আর মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পরে কি বলছেন! ‘হায়রে মন্ত্রিত্ব, তোমার কি জাদু! যাকেই হার দিয়েছ তাঁকেই বশ করে ফেলেছ’।
সন্ধ্যার দিকে জেলার সাহেব এলেন। কয়েকদিন ছুটিতে ছিলেন। তার শ্বশুর মারা গিয়াছেন। জেলার সাহেব খুব হাসিখুশি লোক। অমায়িক ব্যবহার। শুধু বললাম, ‘আমার দলের লোকগুলিকে অত কষ্টে না রাখলেই পারতেন। এরাই বোধহয় সকলের থেকেই খারাপ লোক? বুঝি, আপনাদের অসুবিধা! একজন ভদ্রলোক আওয়ামী লীগের কাকে কোথায় রাখা হবে ফোন করে বলে দেন। তাহার হুকুম আপনাদের তামিল করতেই হবে, কি বলেন? যাহা হউক, আমাদেরও সহ্যের সীমা আছে! আমাকে একলা রেখেছেন ঠিক আছে, একলাই থাকব। এমন অনেক আমি রয়েছি। কিন্তু এঁদের নিজেদের পাকের ব্যবস্থা নিজেদের সামনেই করতে দিন। দেখাশোনা করে খাবে। তাহাও যদি সরকার বাধা দেয় তবে জানাবেন, আমাদের পথ আমরাই বেছে নিব। তবে আপনাআরা এতো ভদ্র ব্যবহার করে যে কিছুই আমরা করতে পারিনা। আমার সহকর্মীদের পূর্বেই বিভিন্ন জেলে বদলি করে দিয়েছেন। দেখেন চিন্তা করে’। বেচারার মনটাও খারাপ। তালাবন্ধের সময় হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি কথা বন্ধ করলাম। ঘরে ঢুকতেই বাতি নিভে গেল। বিজলি পাখাও বন্ধ হয়ে গেল। হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে বই নিয়ে বসলাম। অনেক রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করলাম। মাঝে মাঝে বাইরের দিকে চেয়ে অন্ধকারটা একটু দেখে নিই। যাকে বলে চক্ষু জুড়াই।
আবার ড. এম. নূরুল হুদা সাহেবের বক্তৃতা ভাল করে পড়লাম। একজন শিক্ষিত ভদ্রলোক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন, হঠাত একজনের দয়ায় মন্ত্রী হয়ে রাজনীতিবিদ হওয়ার চেষ্টা করছেন। তাই রাজনীতি সম্বন্ধে কি বলতে কি বলে ফেলেছেন, বোধহয় নিজেই বুঝতে পারেন নাই। তাই কথা গুলি লিখে রাখলাম ভবিষ্যতে প্রয়োজন হতে পারে।
“The Finance Minister also brought serious allegations against the advocates of Six-Point Programme of Awami League. He said that certain forces continued to have the Consortium Aid postponed. These forces also thrust a war on Pakistan. But their two actions failed to break Pakistan as the People stood united like a rock. Then came the Six-Pooint Programme of Awami League.
This programmer really aims at setting up a weak national government, which means a weak Pakistan, the Finance Minister commented. The most important thing is however, the timing of the Programme, he added.
Pakistan Observer 24.6.1966
মন্ত্রিত্বের লোভে ভদ্রলোক এত নিচে নেমে গিয়েছেন যে একটা দলের বা লোকের দেশপ্রেমের উপর কটাক্ষ করতেও দ্বিধাবোধ করলেন না। যদি বলতে হয় পরিষ্কার করে বলাই উচিৎ।
রাত অনেক হয়েছে, শুয়ে পড়া ছাড়া আর উপায় কি?

২৫শে জুন ১৯৬৬ ।। শনিবার
আজ অনেকক্ষণ বেড়ালাম। পড়তেও ইচ্ছা হয় না। চুপ করে একাকী বসে থাকার চেয়ে হাটতে ভাল লাগে। তাই হাটতে লাগলাম আপন মনে। বেগম সাহেবা বাড়ির আম ও বিস্কুট পাঠাইয়াছেন। এতগুলি কি করে একলা মানুষ খাব? ভালই হয়েছে কয়েদিগুলিকে খাওয়াতে পারব, ওদের কিস্মত তো ফাঁকা। বৎসরে দয়া করে যদি একদিন আম দেওয়াও হয় সেগুলি বাজারের সকলের নিকৃষ্ট। কন্ট্রাকটার সরবরাহ করে থাকেন কিনা। কাজেই বুঝতেই পারেন কি আম দেওয়া হয়। আম কেটে যারা সামনে বসে কাজ করে তাঁদের সকলকে কিছু কিছু দিতে বললাম। আর আমায় যারা দেখাশোনা করে তাঁদের জন্য তো আছেই।
বই নিয়ে বসেছি। জমাদার সাহেব ও কম্পাউন্ডার সাহেব এলেন। বসলেন আমার ঘরে। বললাম, খবর কি? দেশে খুব পানি হয়েছে, ফসলের কি হবে বলা যায় না। কম্পাউন্ডার সাহেব বললেন, একটা মেয়ে ও একটা ছেলেকে গ্রেপ্তার করে আনা হয়েছিল। দ’জনে প্রেম করে বিবাহ করেছিল। মেয়ের বাবা মামলা করে দুজনকে গ্রেপ্তার করে আনিয়েছে। আজ ছেলেটা মামলায় জিতেছে। মেয়েটাকে নিয়ে চলে গিয়েছে, গাড়ি নিয়ে এসেছিল। মেয়েটার খুব ফূর্তি। কম্পাউন্ডার সাহেবও খুব খুশি হয়েছেন বলে মনে হলো। বললাম, আপনিও খুব শুখি হয়েছেন দেখছি! বললেন, ওদের দু’জনের আনন্দ দেখে আমার খুব ভাল লেগেছে। বললাম, ‘প্রথম জীবনের উন্মাদনায় এই রকমের হয়ে থাকে, কিন্তু ফলাফল শেষ পর্যন্ত ভাল হয় না। এমন অনেক প্রমাণ আছে। ছেলে ও মেয়ে একে অন্যকে পছন্দ করে বিবাহ করুক তাতে আপত্তি নাই, তবে উচ্ছৃঙ্খলতা এসে গেলে সমাজ ধ্বংস হতে বাধ্য। দেখা গেছে এমন অনেক হয়েছে শেষ পর্যন্ত সুখী হতে না পেরে অনেক অঘটন ঘটেছে। তাই আজকাল দেখবেন আমাদের সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। যার পরিণাম ভাল না। শুরুও হয়ে গেছে এ দেশে এর ফলাফল। নারী শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে, নারী শিক্ষা না হলে দেশের মুক্তি আসতে পারে না। কিন্তু শিক্ষার নামে যে নির্লজ্জতা বেড়ে যেতেছে এদিককেও সমাজের নজর দেওয়া উচিৎ’। ওর কাজ আছে, আমার মতো সরকারের অতিথি উনি নন, তাই চলে গেলেন। বহু ইনজেকশন দিতে হবে।
আমি বইয়ের মধ্যে মন দিলাম। মেট এসে হাজির, স্যার ডাব খাবেন না? বললাম আনো। পেটে ব্যথা, পেট খারাপ হয়েই থাকে। তাই ডাব মাঝে মাঝে খাই। ডাব খেয়ে পাইপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আবার ফুলের বাগানে। একটা মাত্র বন্ধু ফুলের বাগান। ওকে আমি ভালবাসাতে আরম্ভ করেছি। যাদের ভালবাসি ও স্নেহ করি, তারা তো কাছে থেকেও অনেক দূরে। ইচ্ছা করলে তো দেখাও পাওয়া যায় না। তাই তাঁদের কথা বার বার মনে পড়লেও মনেই রাখতে হয়। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের সাথে তো মাসে দু’বার দেখা হয় আর কারও সাথে তো দেখা করারও উপায় নাই। শুধু মনে মনে তাঁদের মঙ্গল কামনা করা ছাড়া উপায় কি!
গোসল করে খেয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম। মতিয়ার নামে একটা ছেলে আমাদের সেল এরিয়ায় পানি দেয়। বাড়ি টঙ্গাইল, স্কুলে পড়তো। দুই পক্ষে ফুটবল খেলা নিয়ে গোলমাল হয় এবং একটা খুন হয়। সেই মামলায় ছয় বৎসর জেল হয়েছে। আমার কাছে এসে বলল, জেলার সাহেবকে একটু বলে দিতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা জেল থেকে দিতে চায়, তার অনুমতির বন্দোবস্ত করতে। বললাম, জেলার সাহেব আসলে অনুরোধ করব-যদি শোনেন। ছেলেটা এখানে এসে কাগজ পড়ে। শুনলাম ওকে জেলের আইন ভঙ্গ করার জন্য জেলার সাহেব একবার শাস্তি দিয়েছেন, তাই অনুমতি দিতে চান না। রাগ করে আছেন। জেলার সাহেব ওকে নিজের অফিসে প্রথমে নিয়েছিলেন, সেখানে গোলমাল করার জন্য তাড়াইয়া দিয়েছেন। তবুও ওকে বললাম, জেলার সাহেব আসলে অনুরোধ করব।
কাগজ এল। মর্নিং নিউজে দেখলাম জনাব খান আব্দুস সবুর খান বলেছেন ‘বাংলাদেশের লোক আওয়ামী লীগের ধাপ্পা ধরে ফেলেছে, জুলুম প্রতিরোধ দিবসই কেহই পালন করে নাই’। পিন্ডি চলেছেন, তার নেতাকে খুশি করতে পারবেন একথা বলে। তাই হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় সাংবাদিক সাক্ষাতকারে বলেছেন ঐ কথা। এসব কথা বলে বাঙালির দাবি আর দমাতে পারবেন না, এ কথা ভাল করে জেনে রাখুন সবুর সাহেব। জেল, জুলুম, মামলা সমানে চালাইয়াছেন। কাগজ বন্ধ করেছেন, এতেই গণআন্দোলন বন্ধ হয় না, সেরকম ভেবে থাকলে ভুল করেছেন।
মর্নিং নিউজ সবুর সাহেবের নামের দুই পাশেই ‘খান’ লাগাইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানি কায়দা। আগে ছিল আব্দুস সবুর খান, এখন হয়েছেন খান আব্দুস সবুর খান। চমৎকার, এই তো চাই! পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিত লোকেরা যে গোপনে গোপনে হাসেন একথা বুঝেও বোঝেন না এই ভদ্রলোকেরা। এই মুসলিম লীগের এক নেতা সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে তার পূর্ব-পুরুষের গোরস্থান খুজেছিলেন। আজ সবুর সাহেব বোধ হয় ওদিকে অন্য কিছু খোঁজ করেছেন?
ন্যাপের অন্যতম এমপিএ আহমেদুল কবির সাহেব ৫ একর জমির খাজনা মওকুফ করতে দাবি করেছেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমি চার বৎসর পূর্বে ২৫ বিঘা জমির উপর থেকে খাজনা মওকুফ করার দাবি করে অনেক জনসভা ও আন্দোলন করেছি। এমনকি সর্বদলীয় বিরোধীদলের ১২ দফা দাবির মধ্যেও আওয়ামী লীগের এই দাবি গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিলাম। যদিও মরহুম খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব প্রথমে আপত্তি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। ন্যাপের কোনো কোনো নেতা ৬ দফা গোপনে গোপনে সমর্থন করলেও লজ্জায় বলেন না, আর কেউ কেউ এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। দিন আসছে ৬ দফা ও স্বায়ত্তশাসনের দাবি না মেনে এদেশে রাজনীতি করতে হবে না। তবে রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন অনেকেই।
বিকালে খবর পেলাম মিজান খুব ঘুমাচ্ছে। বোধহয় ওকে রাতে ঘুমাতে দেয় নাই।
সন্ধ্যায় দেখলাম পুরানা বিশ সেলে নারায়ণগঞ্জের খাজা মহীউদ্দিনকে নিয়ে এসেছে। ওর বিরুদ্ধে অনেকগুলি মামলা দিয়েছে। ডিভিশন দেয় নাই। ভীষণ মশা, পরশু পরীক্ষা, মশারিও নাই। তাড়াতাড়ি একটা মশারির বন্দোবস্ত করে ওকে পাঠিয়ে দিলাম। আমার কাছাকাছি যখন এসে গেছে একটা কিছু বন্দোবস্ত করা যাবে। বেশি কষ্ট হবে না। খাজা মহীউদ্দিন খুব শক্তিশালী ও সাহসী কর্মী দেখলাম। একটুও ভয় পায় নাই। বুকে বল আছে। যদি দেশের কাজ করে যায় তবে এ ছেলে একদিন নামকরা নেতা হবে, এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। ত্যাগ করার যখন প্রাণ আছে, আদর্শ যখন ঠিক আছে, বুকে যখন সাহস আছে একদিন তার প্রাপ্য দেশবাসী দেবেই।

২৬শে জুন ১৯৬৬ ।। রবিবার
ভোর রাত্র থেকেই মাথা ভার ভার লাগছিল। বিছানা ছাড়তেই মাথার ব্যথা বেড়ে গেল। আমার মাথায় যন্ত্রনা হলে অসহ্য হয়ে উঠে। অনেকক্ষণ বাইরে বসে রইলাম, চা খেলাম, কিছুতেই কমছিল না। ওষুধ আমার কাছে আছে, ‘স্যারিডন’, কিন্তু সহজে খেতে চাই না। আবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শুলে………
বেশি লাগে তাই অনেকক্ষণ বাইরে যেয়ে হাটতে লাগলাম। বাতাসে ভালই লাগছিল। ব্যাথা একটু কম লাগছিল। ব্যথা একটু কম কম লাগছিল।
আজ তো রবিবার। কয়েদিরা কাপড় পরিষ্কার করবে। ঠিক করেছি, স্যারিডন সহজে খাব না। মেট ও পাহারা কাহাকেও কিছু বললাম না। প্রায় দশটার দিকে আরাম লাগছিল। বাইরে থাকতে মাথা ব্যাথায় অনেক সময় কষ্ট পেতাম। স্যারিডন দুই তিনটা খেয়ে চুপ করে থাকতাম। আধা ঘন্টা পরেই ভাল হয়ে যেতাম। আবার কাজে নেমে পড়তাম। রেণু, স্যারিডন খেতে দিতে চাইত না। ভীষণ আপত্তি করত। বলত, হার্ট দুর্বল হয়ে যাবে। আমি বলতাম, আমার হার্ট নাই, অনেক পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে। বাইরে তার কথা শুনি নাই। কিন্তু জেলের ভিতর তার নিষেধ না শুনে পারলাম না।
ডিপুটি জেলার সাহেব এলেন। কিছু সময় পরে জমাদার সাহেব তার ফৌজ নিয়ে হাজির। আমার ঘর তালাশ করবে। কোনো কিছু বেআইনি লুকাইয়া রাখি কিনা? এটা জেলের নিয়ম। রাজবন্দিদের ঘরগুলি সপ্তাহে একবার করে তালাশি দেওয়া হয়ে থাকে। তবে আমার ঘর তালাশি বেশি করে না। এসে দেখে যায়। কারণ জানে বেআইনি কাজ আমি করি না। আর বেআইনি জিনিস আমার কাছে থাকে না। তবে আসলেই আমি নিজেই বলি যের হয়ে যেতেছি, আপনারা তালাশ করে দেখে নিন। ইচ্ছা করলে এঁরা শরীর তল্লাশী করতে পারে, তবে জেলার ও ডিপুটি জেলার ছাড়া অন্য কেহ পারে না। সিপাহিরা ঘরের ভিতর আসল না, শুধু জমাদার সাহেব ভিতরে এসে ঘুরে গেলেন।
আমি বললাম, ‘প্রত্যেক সপ্তাহে আসেন কিছুই পান না। একবার বলবেন, আমি কিছু বেআইনি মাল রেখে দিব’। এঁরা খোঁজ করে কোনো চিঠিপত্র বাইরে পাঠাই কিনা? কোনো অস্ত্রপাতি আনি কিনা বাইরে থেকে, যা দিয়ে পালাতে পারি। রাজবন্দি অস্ত্রপাতি আনে এ খবর আমার জানা নাই। তবে অনেক সময় চিঠি পত্র পাওয়া গেছে রাজবন্দিদের কাছ থেকে। এঁরা এক সেল থেকে অন্য সেলে যোগাযোগ রাখে। যখন জেল কতৃপক্ষ অথবা সরকারের সাথে বোঝাপড়া করতে চায় তখন যাতে একসাথে করতে পারে। সেজন্যই যোগাযোগটা করে। আজকাল তাহাও করে না। কারণ বিচার কোথায়?

জমাদার চলে গেলেন। ডিপুটি জেলার সাহেব বসলেন কিছু সময়। আমার সহকর্মীদের উপর সরকারের এই ব্যবহারের কথা বললাম। আওয়ামী লীগ কর্মীদের ও মানিক ভাইকে যে অবস্থায় রেখেছে দুষ্ট প্রকৃতির কয়েদিদেরও সেভাবে রাখা হয়না। এঁদের বলে লাভ নাই জানি, কারণ, গ্রেপ্তার করে জেলগেটে পৌঁছাইয়া হুকুম দিয়ে যায়-কোথায় কাদের রাখা হবে।
যদি জেল কতৃপক্ষ ইচ্ছা করে তবে পাকের বন্দোবস্ত বন্দিদের হাতেই দিতে পারে। বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও তা করছে না। আমার সাথে আমার দলের কাহারও এক জেলে থেকেও দেখা হয় না। আমি একদিকে আর অন্যরা অন্যদিকে। বোধহয় জেলের মধ্যে দেখা হওয়ার সম্ভবনাও নাই। সরকারের হুকুম আমার কাছে কাহাকেও দেওয়া হইবে না, কাহারও সাথে যোগাযোগ রাখতে পারব না। আমার খবর বন্দি নেতা কর্মীরা পায় কিনা জানিনা, তবে ওদের খবর আমি রাখি, কি অবস্থায় – তাঁদের রাখা হয়েছে।
ডিপুটি জেলার সাহেব চলে গেলেন। রবিবার ছুটির দিন। তবুও এঁদের ছুটি নাই, অনেক কাজ। নারায়ণগঞ্জ থেকে চটকল ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুল মান্নানকে নিয়ে এসেছে। জামিন দেয় নাই, নারায়ণগঞ্জে মামলায় তাকে আসামি করেছে। ভদ্রলোক কাছেও ছিল না। শুনলাম নারায়নগঞ্জে মশা কামড়াইয়া তার হাত মুখ ফুলাইছে দিয়াছে। আরও বহু লোককে গ্রেপ্তার করে নারায়ণগঞ্জ জেলে রেখেছে। অনেক ছাত্রও আছে। জামিন পায় নাই। কাপড় দেয় নাই, ডিভিশন দেয় নাই। প্রত্যেকটা লোক অর্ধেক হয়ে গেছে। তিন শতের উপর লোককে আসামি করেছে। যাকেই পেয়েছে গ্রেপ্তার করে জেলে দিতেছে।
‘জাতীয় সরকার’ অত্যাচার করো, ফলাফল একদিন পেতে হবে, বেশি দেরি নাই। তখন আবার ‘নিষ্ঠুর’ বলিও না। কাহারা এই অত্যাচার করছে – বাঙালিরা, চাকরির জন্য। এঁরা বোঝে না কাদের জন্য এই লোকগুলি জীবন দিল? কার জন্য এঁরা কষ্ট ভোগ করছে? এঁদের অনেকেরই ছেলেমেয়ে না খেয়ে কষ্ট পেতেছে। কিছুদিন পর বের হয়ে দেখবে কেউ নাই, সব শেষ। যে লোকটা উপার্জন করে, দিন মজুরি করে সংসার চালাতো তাকে আটকিয়ে রাখলে তারা ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা মা না খেয়ে থাকবে। আস্তে আস্তে মরে শেষ হয়ে যাবে। এই খবর কি সরকার জানে না? আমাদের দেশের এই শিক্ষিত চাকরিজীবীদের মধ্যে কিছুসংখ্যক লোক আছে পদোন্নতির জন্য তারা কত যে সংসার ধ্বংস করেছে তার কি কোনো সীমা আছে?
খাজা মহীউদ্দিন পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছে। আর একটা ছেলে-মিলকী তাকাএ অনুমতি দেওয়া হয় নাই। জেল কতৃপক্ষ ঢাকার এসডিওকে জানাইয়াছিল। তিনি বলেছিলেন, ডিসি সাহেবের সাথে পরামর্শ করে জানাবেন। আগামীকাল সকালে পরীক্ষা শুরু হবে। কোনো খবর এসিডও সাহেব দেন নাই। বোধহয় ঢাকার ডিসি সাহেব গভর্নর সাহেবের অতি প্রিয় লোক। অনুমতি দেন নাই। খুব মুখ কালো করে দাড়িয়েছিল ছেলেটা। একটা বৎসর নষ্ট হয়ে গেল। ফিস দিয়েছে, সকাল কিছু প্রস্তুত, কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেয় নাই।
পুরানা ২০ সেলে তাকে বললাম দূর থেকে, ‘ভেব না ভাই। আমাকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাহির করে দিয়েছিল। যারা বাহির করে দিয়েছেন তাঁদের অনেকেই আমার কাছে এসেছিলেন। ক্ষমা করে দিয়েছিলাম-পরে শোধ নিতে পারতাম, নেই নাই। খোদার উপর নির্ভর করো’। খাজা মহীউদ্দিন যে কি খেয়ে পরীক্ষা দিবে তাই ভাবলাম। ডিপুটি জেলার সাহেবকে বললাম, একটু খেয়াল রাখবেন ছেলেটার দিকে। আমার কাছে তো কিছু কিছু জিনিস আছে কিন্তু দেবার তো হুকুম নাই। তবুও ভাবলাম, বেআইনি হলেও আমাকে কিছু দিতে হবে। দেখা হয়েছিল। আমার সেলের কাছ দিয়ে যেতে হয়। আমি এগিয়ে যেয়ে ওকে আদর করে বললাম, ‘ভেব না, তুমি পাশ করবা। মাথা ঠান্ডা করে লেখবা’।
আক বাজার থেকে আমার খাবার টাকা বাচিয়ে দু’টা মুরগি এনেছি। বাগান দিয়ে এঁরা ঘুরে বেড়ায়। সূর্য অস্ত গেল, আমরাও খাচায় ঢুকলাম। ‘বাড়িওয়ালা’ বাইরে থেকে খাঁচার মুখটা বন্ধ করে দিল। বোধহয় মনে মনে বলল, আরামে থাক, চোর ডাকারের ভয় নাই, পাহারা রাখলাম।

২৭শে জুন ১৯৬৬ ।। সোমবার
নিজের শরীরও ভাল না; বাবুর্চি কেরামত আলীরও রাত্রে খুব জ্বর হয়েছে। বললাম হাসপাতালে যেতে, রাজি হলো না। দেখলাম জ্বর এখনও আছে। নতুন লোক এনে পাকাইতে দিলে মুখ দেওয়া যাবে না। কোনোমতে একে শিখাইয়া নিয়াছি।
ডাক্তার এলে ওষুধ দিলাম। শুয়েই রইল, শুয়ে শুয়ে দেখাইয়া দিল, একজন ফালতু কোনোমতে পাক করে আনল।
আজ আমার পড়তে ভাল লাগছে না, মাথা ঘুরছে। পাশেই নতুন বিশ-এর ২নং ব্লক, পাচটা সেল। কয়েকজন ‘নামকরা’ কয়েদি, একজন মোক্তার বাবু, পটুয়াখালী বাড়ী-আর নুরুদ্দিন নামে ডাকাতি মামলার আসামি একজন নতুন কয়েদিকে এখানে আনা হয়েছে। তার বাড়ি গোয়ালন্দ মহকুমায়। ভদ্রলোকের ছেলে, বাড়ির অবস্থা ভাল, লেখাপড়াও জানে। রাত্রে শুয়ে শুয়ে তার গান শুনছিলাম। চমৎকার গান গায়। ভারী সুন্দর গলা। যদি সত্যিই সাধনা করত তাহলে বাংলাদেশের বিখ্যাত গায়কদের অন্যতম গায়ক হতো। আইন মানে না। কথা শোনে না। যথেষ্ট মার খেয়েছে এই কারাগারে এসে। কাউকেই মানে না, যা মুখে আসে তাই বলে। সমস্ত মার্ক কেটে দিয়েছে জেল কতৃপক্ষ। কোনো মার্ক পাবে না। তিনমাসে কয়েদিরা ১৮ দিন থেকে ২৩ দিন পর্যন্ত মার্ক পেয়ে থাকে। মানে ভালোভাবে জেল খাটাকে আইন ভঙ্গ না করলে কয়েদিদের নয় মাস সাড়ে নয় মাসে বৎসর। যত মার্ক শুরুতে তা আবার কেড়ে নিয়েছে জেল কতৃপক্ষ। পুরা দশ বৎসর খাটতে হবে। ভালোভাবে থাকলে সাত বৎসর বা কাছাকাছি জেল খাটলেই খালাস পেত। এখন ওকে পুরা জেল খাটতে হবে। আমাকে বলে, ‘পুরাই খেটে যাব। আর যাবারও ইচ্ছা নাই। মরলেও ভাল হতো। বাবা ভাইরা কোনো খবর নেয় না। ডাকাতি ও খুনের মামলায় জেল হয়ে তাঁদের ইজ্জত মেরেছি’। একবার ওর মা ফরিদপুর জেলে এসেছিল। তাকেও নিষেধ করে দিয়েছে। ২২ বৎসর বয়সে জেলে এসেছে। স্বাস্থ্য নষ্ট করে ফেলেছে। সকলেই বলে, ‘লোক সাংঘাতিক’!
আমি বললাম, ‘নুরু কেন জীবন নষ্ট করলে বলতে পার? বাবা-মার মুখে চুনকালি দিলে, বংশের ইজ্জত নষ্ট করলে, কারাগারে কষ্ট করলে, কি লাভ হলো? তোমাকে জেলেও সকলেই খারাপ বলে। যে কয়দিন থাক, ভালোভাবে থাক, তাড়াতাড়ি জেল খেটে বাড়ি যাও। বাবা মার কাছে ফিরে যাও, আর এক পথে পা বাড়িও না’। বলল, ‘স্যার আমার দুঃখের কথা নাই শুনলেন। চেষ্টা করব আপনার কথা রাখতে, তবে কি মুখে আর বাবা মার কাছে যাবো? তাই গোলমাল করে পুরা জেল খাটতে চাই। বাইরে যেয়ে আর হবে কি? মরতে পারলে ভাল হয়’। আমি বললাম, ‘তোমার জেল থেকে বের হবার পূর্বে (সম্ভবনা কম) যদি আমি বের হই, তবে দেখা করো। তোমার বাবা ও ভাইকে আমি চিঠি দিব। কিন্তু বের হলে কিছুদিন বাড়ির বাইরে যেতে পারবা না এবং ঐ কুপথে আর পা বাড়িও না’। সে বলল, ‘আপনার কাছে আমাকে নিয়ে নেন’। আমি বললাম, আমার আপত্তি নাই’। ‘তোমাকে আমার কাছে দিবে না। গান গাঁও নুরু, তোমার গান শুনি, ভাল লাগছে তো আমারও’। অনেক গান গাইল, বললাম, ‘বাংলার মাটির সাথে যার সম্বন্ধ আছে সেই গান গাঁও’। আমি বারান্দায় মাটিতে বসে পড়লাম। নুরু ওর সেলের বারান্দার কাছে বসে গান করতে শুরু করল। অনেকক্ষণ গান শুনলাম। পরে আবার হাটতে লাগলাম।
ভাত খেয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিলাম। কাগজ এল, কাগজ পেয়ে বইটা রেখে দিলাম। কাগজ এলেই-হাসেম মিয়া জেলের মেম্বর, পাহারাও-বরিশাল বাড়ি, একবার প্রেসিডেন্ট ছিল ইউনিয়ন বোর্ডের; আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালিয়ে ৬ বৎসর জেল খেটে এসেছে সে, মতিয়ার রহমান টাঙ্গাইল বাড়ি ও রফিক আমার এখানকার ছাপাইয়া-এরা ছুটে আসে কাগজ পড়তে। বোঝার মত লেখাপড়া এঁরা সকলেই জানে। তাই বাংলা কাগজগুলি ওদের দিয়ে দিই পড়তে। খবর কিছুই থাকে না আজকাল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এত বেশি যে কেহই কিছু লেখতে সাহস পায় না।
বিকালে সিভিল সার্জন সাহেব আমাকে দেখতে এলেন। বললাম, ভালই আছি। তবে জেল কোড অনুযায়ী কোনো লোককে দুই মাসের বেশি একলা থাকতে দেওয়া নিষেধ, অথচ আমাকে একলা রাখা হয়েছে। এর বেশি বললাম না কারণ ডাক্তার হিসাবে চমৎকার লোক। রোগীকে রোগী হিসেবেই দেখেন। কাহাকেও কয়েদি হিসেবে দেখেন না। কয়েদিরা যাতে ভালভাবে ঔষধ পায়, খাওয়া পায় তার দিকে যথেষ্ট নজর আছে।
কিছু সময় পরে বের হয়ে পড়লাম ঘর থেকে স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য। দেখলাম জেলার সাহেব আসছেন। কয়েক মিনিট বসে তিনি চলে গেলেন। আমার বাগানের প্রশংসাও করলেন।
আবার একাকী ঘুরতে ঘুরতে সময় হয়ে এল। আজকে দশ মিনিট দেরি হলো দরজা বন্ধ করতে। রাজবন্দিদের দরজা বন্ধ হওয়া উচিৎ না। ইংরেজের সময়ও অনেক কাল পর্যন্ত রাজবন্দিদের দরজা বন্ধ করার হুকুম ছিলনা।
দরজা বন্ধ কেন? গলা টিপে মারো, তাতেও আমাদের কোনো আপত্তি নাই। শুধু শোষণ বন্ধ কর। জনগণের অধিকার ফেরত দাও।

২৮শে জুন ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
কি বিপদেই না পড়েছি! বাবুর্চি বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, পাক করবে কে? নতুন একজন আনলে আবারও আমার কয়েকদিন না খেয়ে থাকতে হবে। আমার তো তেমন কোনো ধারণাও নাই, তবুও বাবুর্চিকে নিয়ে একটা পাক প্রনালী আবিষ্কার করেছি। মেট বলল, একটা মুরগি এনেছিলাম, ডিম দিয়েছে। খুব খুশি জেলখানায় আবার মুরগিতে ডিম দেয়? বললাম, খুব ভাল, রেখে দেও, মুরগিকে বাচ্চা দেওয়াব। ডিম কিন্তু খাওয়া চলবে না।
২৬ সেলে সিকিউরিটি বন্দিরা থাকেন। ১৯৫৮ সালে গ্রেপ্তার হয়ে এখনও আছেন। সরকার ছাড়বার নাম নিচ্ছেন না। তারাও জানেন না কি করে মাথা নত করতে হয়। অনেকেই আছেন যারা ইংরেজ আমলেও দুই চারবার জেল খেটেছেন।
সেই ২৬ সেল থেকে আমার জন্য কুমড়ার ডগা, ঝিংগা, কাকরোল পাঠিয়েছেন। তাঁদের বাগানে হয়েছে, আমাকে রেখে খায় কেমন করে! আমার কাছে পাঠাতে হলে পাঁচটি সেল অতিক্রম করে আসতে হয়, দূরও কম না। বোধহয় বলে কয়ে পাঠিয়েছেন। তারা যে আমার কথা মনে করেন আর আমার কথা চিন্তা করেন, এতেই মনটা আনন্দে চরে গেল। এঁরা ত্যাগী রাজবন্দি দেশের জন্য বহু কিছু ত্যাগ করেছেন। জীবনের সবকিছু দিয়ে গেলেন এই নিষ্ঠুর কারাগারে। আমি তাঁদের সালাম পাঠালাম। তারা জানেন, আমাকে একলা রেখেছে, খুবই কষ্ট হয়, তাই বোধহয় তাঁদের এই সহানুভূতি।
আজ ফলি মাছ দিয়েছে। বাবুর্চি বলল, কোপ্তা করতে হবে। বাবুর্চি জানে না, কেমন করে করতে হয়, আমিও জানি না। তবু করতে হবে। বললাম বোধহয় এইভাবে করতে হয়। বাবুর্চি ও আমি পরামর্শ করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করলাম। সেইভাবেই করা হলো। যখন খেতে শুরু করলাম মনে হলো কোপতা তো হয় নাই, তবে একটা নতুন পদ হয়েছে। কি আর করা যায়, চুপ করে খেয়ে নিলাম। বললাম, ‘বাবারা, বাড়িতে যে রকম খাই তার ধারে কাছ দিয়েও যায় নাই। যাহা হউক খেয়ে ফেল, ফলি মাছ তো’! মনে মনে হাসলাম, পাস করা বাবুর্চি আমি! ভাগ্য ভাল, বাইরের লোক ছিল না, থাকলে কোপতা আমার মাথায় ঢালতো। এই সময়ই মনে হলো একলা হয়ে সুবিধাই হয়েছে।
খবরের কাগজে এসেছে। ভাসানী সাহেবের রাজনৈতিক অসুখ ভাল হয়ে গেছে। যখন গুলি চলছিল, আন্দোলন চলছিল, গ্রেপ্তার সমানে সমানে চলেছে তখন দেখলাম গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আবার দেখলাম দুই তিন দিন পরে কোথায় যেতে ছিলেন পড়ে যেয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছেন। হঠাত অসুস্থ মানুষ আবার বাড়ির বাহির হলেন কি করে? যখন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য কর্মীরা কারাগারে-এক নারায়নগঞ্জে সাড়ে তিনশত লোকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা ঝুলছে, তখনও কথা বলেন না। আওয়ামী লীগ যখন জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালন করল তখন একদল ভাসানীপন্থী প্রগতিবাদী (!) এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন বলে সরকারের সাথে হাত ও গলা মিলিয়েছে। এখন তিনি হঠাৎ আবার সর্বদলীয় যুক্তফ্রন্ট করবার জন্য আহ্বান জানিয়েছে এবং নিজে ময়দানে নামবেন।
মওলানা সাহেব পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে আইয়ুব খানকে সমর্থন করে চলেছেন। মওলানা সাহেব তো দেশের সমস্যার চিন্তা করেন না। বৈদেশিক নীতি নিয়ে ব্যস্ত। দেশে গণ আন্দোলন বা দেশের জনগণের দাবি পূরন ছাড়া বোইদেশিক নীতিরও কোনো পরিবর্তন হতে পারে না। জনগণের সরকার কায়েম হলেই, জনগন যে বৈদেশিক নীতি অবলম্বন করতে বলবে, নির্বাচিত নেতারা তাহাই করতে বাধ্য। ডিক্টেটর যখন দেশের শাসন ক্ষমতা অধিকার করেছে এবং একটা গোষ্টীর স্বার্থেই বৈদেশিক নীতি ও দেশের নীতি পরিচালনা করছে তার কাছ থেকে কি করে এই দাবি আদায় করবেন আমি বুঝতে পারছিনা। পূর্ব পাকিস্তানের জনগন যখন তাঁদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, খাদ্য, রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে তখন পিছন থেকে ছুরিকাঘাত করে এখন এসেছেন যুক্তফ্রন্ট করতে! আওয়ামী লীগের প্রায় সকল নেতা ও কর্মীই কারাগারে বন্দি। কেহ কেহ আত্মগোপন করে কাজ করছে, এখন যে কয়েকজন বাইরে আছে তারা কিছুতেই এঁদের সাথে যোগদান করতে পারে না। আর ছয় দফা দাবি ছেড়ে দিয়ে কোনো নিম্নতম কর্মসূচি মেনে নিতে পারে না। ছয় দফাই হলো নিম্নতম কর্মসূচি। কোনো আপোষ নাই। জনগন যখন এগিয়ে এসেছে তখন দাবী আদায় হবেই। আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে যাবে। জনগনকে আর ধোকা দেওয়া চলবে না। অনেক জগাখিচুড়ি পাকানো হয়ে গেছে। আর না। ভাসানী সাহেব এগিয়ে যান আইয়ুব সাহেবের দল নিয়ে। এখন তো তিনি সুখেই আছেন, আর কেন মানুষকে ধোঁকা দেওয়া? আওয়ামী লীগ বা তার নেতারা যদি ছয় দফা দাবি ত্যাগ করে আপোষ করতে চান তারা ভুল করবেন। কারণ তাহলে জনগণ তাদেরও ত্যাগ করবে।
চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, মানিক বাবু ও আব্দুল মান্নানের জন্য হাইকোর্টে রীট পিটিশন করা হইয়াছে। বিচারে কি হয় দেখা যাক।

২৯শে জুন ।। বুধবার
ঘুম ভাঙালো বৃষ্টির পানি গায়ে লেগে, মশারির একটা অংশ ভিজে গিয়াছে। খুব ঘুমিয়েছিলাম, টের পাই নাই। ব্রিষ্টি হতেছে, মুষল ধারে। যখন বৃষ্টির খুব প্রয়োজন ছিল তখন হয় নাই, এখন যখন বৃষ্টির প্রয়োজন না তখন খুব হতেছে। বন্যায় দেশের খুবই ক্ষতি হয়েছে। চাউল তেল ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে। মোনায়েম খান সাহেবের বক্তৃতায় পেট ভরে যাবে সকলের। তিনি বলেন, আল্লাহর তরফ থেকে বন্যা হয়েছে। কষ্টের ভিতর দিয়ে খোদা লোককে পরীক্ষা করে থাকেন। কি আর বলা যায়! বন্যা কন্ট্রোল করতে পারে আজকাল দুনিয়াতে। অনেক দেশে করেছেও। একটু চক্ষু খুলে দেখলে ভাল হয়। ভদ্রলোকের দোষ কি? কিই-বা জানেন আর কিই-বা বলবেন। খান সাহেব এদিক দিয়ে ভাল লোক, স্বীকার করেন যে তিনি নূরুল আমীন সাহেবের হুকুমে গুণ্ডামি করে বেড়াতেন। এখন তিনি লাট হয়েছেন। ভাল কথা। ‘গুণ্ডার পরে পান্ডা। পান্ডার পরে নেতা, এইতো হলো নেতার ডেফিনেশন’।
হঠাৎ পেট দিয়ে রক্ত পড়লো অনেক ফিনকি দিয়ে, চেয়ে দেখলাম, সবই লাল। ব্যাপার কি? পাইলস তো সেরে গিয়াছে, অনেক আগেই, প্রায় তিন বৎসর হলো। পেটে কোনো অসুখ নাই। তাই মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
আবার সকাল দশটায় একবার পায়খানায় যাই। দেখি আবার রক্ত, বুঝলাম আবার পাইলস হয়েছে। কিন্তু চিন্তা করে লাভ কি? ভুগতে তো হবেই। ডাক্তার সাহেব এলেন। বললেন, ঔষধ দিতেছি। ঔষধ পাঠাইয়া দিলেন। খুব সাবধানে থাকি আমিজেলে। শরীর রক্ষা করতে চাই, বাঁচতে চাই, কাজ আছে অনেক আমার। তবে একটা ছেড়ে আর একটা ব্যারাম এসে দেখা দেয়।
কাল জাতীয় পরিষদ থেকে বিরোধী দল একই দিনে দুইবার পরিষদ কক্ষ বর্জন করে-স্পিকারের রুলিংয়ের প্রতিবাদে। আমার মনে হয় বিরোধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যদের এই পরিষদ থেকে পদত্যাগ করাই উচিৎ। এই পরিষদের যা ক্ষমতা তাতে এর সদস্য হওয়ার অর্থ কি? দুনিয়াতে পার্লামেন্টের যে কনভেশন আছে তার ধারে কাছ দিয়েও এঁরা যায় না।
প্রেসিডেন্ট, সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে একটা পরিষদ করেছে দুনিয়াকে দেখানোর জন্য। বিরোধী দলের নেতাকে বলতে দেয় না স্পিকার, এই প্রথম শুনলাম।
চীনের প্রধানমন্ত্রী চৈ এন লাই রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছেন আইয়ুব সাহেবের সাথে নতুন পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য। আপনাকে আমরাও স্বাগতম জানাই। চীনের সাথে বন্ধুত্ব আমরাও কামনা করি। তবে দয়া করে সার্টিফিকেট দিবেন না। আগে আপনি ও আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বড় বড় সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়াছেন। লাভ হবে না। আপনারা জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন তাঁদের সার্টিফিকেট দেওয়া আপনাদের উচিৎ না। এতে অন্য দেশের ভিতরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হয়। এই ব্যাপারে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও আপনাদের পথ এক না হওাই উচিৎ।
১৯৫৭ সালে আমি পাকিস্তানি পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে চীন দেশে যাই। আপনি, আপনার সরকার ও জনগন আমাকে ও আমার দলের সদস্যদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং আমাকে আপনাদের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে দিয়ে যে সম্মান দিয়েছিলেন তা আজও আমি ভুলি নাই। আমি আপনাদের উন্নতি কামনা করি। নিজের দেশে যে নীতি আপনারা গ্রহণ করেছেন আশা করি অন্য দেশে অন্য নীতি গ্রহণ করবেন না। আপনারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আর আমার দেশে চলেছে ধনতন্ত্রবাদ, আর ধনতন্ত্রবাদের মুখপাত্রকে আপনারা দিতেছেন সার্টিফিকেট। আপনারা আমেরিকান সরকারের মতো নীতি বহির্ভূত কাজকে প্রশ্রয় দিতেছেন। দুনিয়ার শোষিত জনসাধারণ আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন। যেমন আমেরিকানরা নিজের দেশে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আর অন্যের দেশে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গনতন্ত্রকে হত্যা করে ডিটেক্টর বসাইয়া দেয়।
আজ তো আমার দেখা হওয়ার কথা নাই, এর মধ্যে জমাদার সাহেব এসে বললেন, চলেন আপনার, ‘সাক্ষাৎ’। তাড়াতাড়ি যেয়ে দেখি আমার স্ত্রী আসে নাই। তার শরীর অসুস্থ কয়েকদিন ধরে। ছেলেমেয়েরা এসেছে। ছোট ছেলেটা আমাকে পেয়ে কিছু সময় ওর মায়ের কথা ভুলে গেল। ছেলেমেয়েরা ওদের লেখাপড়ার কথা বলল। আমার মা খুলনায় আছে, অনেকটা ভাল। ছোটখাট অনেক বিষয় বলল। অনেক আবদার। আমার কষ্ট হয় কিনা! ছোট মেয়েটা আমার কাছে কাছে থাকে, যাতে ওকে আমি আদর করি। বড় মেয়েটা বলছে, আব্বার চুলগুলি একেবারে পেকে গেল। বড় ছেলে কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। লজ্জা পায়। আমার কোম্পানির ম্যানেজার এসেছিল, ব্যবসা সম্বন্ধে আলোচনা করতে। বললাম যে, যারা আমাদের ব্যবসা দেয় তাঁদের আমার কথা বলতে, নিশ্চয়ই ব্যবসা দিবে। ছোট ছেলেটার, তার মার কথা মনে পড়েছে। তাড়াতাড়ি বললাম, তোমরা যাও নাহলে ও কাঁদবে।
ছেলেমেয়েরা চলে গেল। দেখলাম ওরা যেতেছে। মনে পড়ল নিশ্চয়ই রেণুর শরীর বেশি খারাপ নতুবা আসতো। সামান্য অসুস্থতায় তাকে ঘরে রাখতে পারত না। জেলের ভিতর চলে এলাম আমার জায়গায়। আমিতো একা আছি, এই নির্জন ইটের ঘরে। আমাকে একলাই থাকতে হবে। চিন্তা তো মনে আসেই।

৩০শে জুন ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
সকালে উঠে হাটছিলাম। ৭ তারিখের হরতালের দিনে যে ছেলেগুলিকে ধরেছিল তার মধ্যে কয়েকটা ছেলেকে আমার কাছেই পুরানা ২০ সেলে রেখেছিল।নাস্তা নিতে বের হয়েছে। দুটা ছেলে আমাকে দেখে বলছে, “স্যার আমাদের সাজাও দেয় নাই যে খেটে খাবো, আবার জামিন নেওয়ারও কেহ নাই। আমরা গ্রাম থেকে চাকরির জন্য এসেছিলাম’। বলুন তো এঁদের কি উত্তর দেব? ওরা কি বোঝে আমিও কয়েদি? শুধু কয়েদি নয় আলাদা করে রেখেছে, একাকী। কিছুই না বলে চুপ করে রইলাম। মনে মনে বললাম এ অত্যাচার আর কতদিন চলবে! দয়া মায়া কি এঁদের নাই! শাসকগোষ্টী বা সরকারী কর্মচারীদের কি ছেলেমেয়েও নাই যে এঁরা বোঝে না! যদি কেহ অন্যায় করে থাকে, বিচার করো তাড়াতাড়ি। এই জেলে অনেক লোক আছে যারা দুই তিন বৎসর হাজতে পড়ে আছে সামান্য কোনো অপরাধের জন্য। যদি বিচার হয় তবে ৬ মাসের বেশি সেই ধারায় জেল হতে পারেনা। বিচারের নামে একি অবিচার! আমার মনের অবস্থা আপনারা যারা বাইরে আছেন বুঝতে পারবেন না। কারাগারের এই ইটের ঘরে গেলে বুঝতে পারতেন।
শরীরটা ভাল যেতেছে না। ভাল বইপত্র দিবে না, Reader’s Digest পর্যন্ত দেয় না। মনমতো কোনো বই পড়তেও দিবে না। এইভাবে শাসন চলতে পারে না। এর ফলাফল ভয়াবহ হবে দেখেও এঁরা বোঝে না। ইংরেজ যাবার সময় যেমন তাদেরই তাবেদারদের হাতে ক্ষমতা দিয়েছিল আর তা হবে না। একথা বুঝেও বোঝে না।
ঘরে চলে এলাম, জমাদার সিপাহি মেট পাহারা হৈ চৈ লাগাইয়া দিয়েছে। বড় সাহেব আসবে ডিগ্রি এলাকায়। আমাদের দেখতে আসেন, কিছু বলার থাকলে তিনি শোনেন। প্রায় দশটার সময় সদলবলে আসলেন আমার ঘরে, বসলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,কেমন আছি? খুব ভাল আছি। আমার কিছু বলার নাই । ঠিক করেছি কোনো কিছুই বলব না। একলাই জেল খেটে যাবো। যতদিন রাখতে হয় রাখুক, কিছুই আসে যায় না। জীবনে একলাই জেল খেটেছি অনেক দিন।
তিনি চলে গেলেন। আবার বই নিয়ে বসলাম।
দুপুরে কাগজ এলে দেখলাম সংবাদপত্র সম্পাদক পরিষদ, নিখিল পাক সংবাদপত্র সমিতি ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি সমবায়ে গঠিত যুক্ত কমিটি অদ্য দৈনিক ইত্তেফাকের বিরুদ্ধে গৃহীত সরকারি ব্যবস্থার প্রতিবাদে আগামী ৫ই জুলাই একদিন প্রতীকী ধর্মঘট পালনের জন্য সংবাদপত্র শিল্প ও সংসদ সরবরাহ সংস্থাসমূহের প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। ৫ই জুলাই সান্ধ্য পত্রিকা ও ৬ই জুলাই কোনো প্রভাতি পত্রিকা যাহাতে প্রকাশিত হতে না পারে সেই জন্য অনুরোধ জানাইয়াছেন। সমন্বয় কমিটির সদস্যবৃন্দ ইত্তেফাক সপাদক জনাব তফাজ্জল হোসেনের গ্রেপ্তার ও তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন করেন।
নিশ্চয় এটা একটা শুভ সূচনা। কারণ আজ ইত্তেফাক ও ইত্তেফাক সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলা, কাল আবার অন্য কাগজ ও তার মালিকের উপর সরকার হামলা করবেনা কে বলতে পারে! সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নাই, এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছে। পাকিস্তানকে শাসকগোষ্টী কোণ পথে নিয়ে চলেছে ভাবতেও ভয় হয়। আজ দলমত নির্বিশেষে সকলের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান উচিৎ।
আজ জুন মাস শেষ হয়ে গেল।

১লা জুলাই ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
ভোরবেলায় খবর পেলাম গত সন্ধ্যায় ১০সেলে যেখানে মানিক ভাই,শামসুল হক, মিজান, মোমিন, ওবায়েদ, হাফেজ মুছা সাহেব, সুলতান, হারুন রশিদ এবং বোধহয় রাশেদ মোশাররফ ও অনেককে রাখা হয়েছে-সেখানে গোলমাল হয়েছে তালাবন্ধ করার সময়। মানিক ভাই যেখানে আছেন কোনো গোলমাল সেখানে হতে পারে না, কারণ আমাদের কেহই তার সামনে কোনো অন্যায় করতে যাবে না। সঠিক খবর কিছুই পাই নাই। সিপাহিদের মধ্যে আলোচনা হতেছে। কেহ কেহ বলে ১০ সেলের সাহেবদের কোনো দোষ নাই। আর কেউ বলে, সিপাহিদের সাথে গোলমাল শোভা পায় না নেতাদের। তারা হলো দেশের নেতা, দেশের জন্য জেল খাটছে। সিপাহি যদি বেশি কথা বলেও, তবুও চুপ করে থাকা উচিৎ।
প্রায় ১০ ঘটিকার সময় খবর পেলাম মিজানুর রহমানের ঘর যখন বন্ধ করতে গিয়াছে তখন মতিউল্লা নামে এক পুরানা সিপাহি তালাবন্ধ করে খটখট শব্দ করতে শুরু করে। টেনে দেখে, তালা ঠিক মতো বন্ধ হয়েছে কিনা। তাতে মিজান নাকি বলেছে, ডিউটি সিপাহিকে বলে দিবেন রাতে যেন আস্তে আস্তে তালা টেনে দেখে, কারণ আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত হয়। সিপাহি বলেছে জোরে জোরেই নাকি টানতে হয়। মিজানের তালাবন্ধ হয়ে গিয়াছে। বাইরে মোমিন সাহেব জিজ্ঞাসা করেছেন ‘বাড়ি কোথায় আপনার’? মোমিন সাহেবের রুম তখনও বন্ধ হয় নাই। এক দুই কথায় খুব ঝগড়া হয়েছে। আমাদের এঁরা নাকি সিপাহিদের মারতে যায়। মতিউল্লা এসে জেল কতৃপক্ষকে কিছু কিছু বাড়াইয়া বলে। আমাদের এরাও ডিআইজির কাছে দরখাস্ত করার জন্য কাগজ চেয়ে পাঠাইয়াছে। মহা গোলমাল! আমি সিকিউরিটি জমাদারকে ডেকে মানিক ভাইয়ের কাছে খবর পাঠাইয়া দিলাম এ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি না করাই উচিৎ। ‘ভদ্রলোকের কিল খেয়ে হজম করতে হয়’। সিপাহিদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন লোকই আমাদের ভক্তি করে, আমাদের প্রতি সহানুভূতি আছে। আমার বিশ্বাস ছিল, মানিক ভাই যখন আছেন এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি হবে না। বিকালে খবর পেলাম চুপচাপই আছে আমাদের এঁরা। সিপাহিদের সাথে কোনো কথা নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ না। ওরা হুকুম পায়, তামিল করে। আমাদের কিছু বলতে হলে, জেলার সাহেব, ডিপুটি জেলার বা ডিআইজি সাহেবকে বলাই উচিৎ। এঁদের সাথে কথা কাটাকাটি করা মোটেই উচিৎ হয় নাই।
আমাদের মধ্যে এঁরা অনেকেই নতুন জেলে এসেছে। আমার কাছে রাখলে কোনো কথাই হতো না, কিন্তু সরকার রাখবে না আমার কাছে কাহাকেও। যদি জেলের ভিতর কোনো ‘বিপ্লব করে বসি’!
বিকালে মতিউল্লাকে ডেকে আমি বলে দিলাম, মনে কিছু না করতে। কারণ একে আমি জানি বহুদিন থেকে। একটু কথা বেশি বলে, মনটা খারাপ না।
আজ বৃষ্টি না হওয়াতে একটু ভালই লেগেছে। হাঁটাহাঁটি করে শরীরটাকে হাল্কা করতে চেষ্টা করেছি। রেণুর শরীর খারাপ। আমায় দেখতে আসতে পারে নাই। মনটা খারাপ লাগছিল।
পুরানা ২০ সেলের পাঁচ নম্বর ব্লকে চিত্ত সুতার ও রণেশ মৈত্র থাকেন। তাঁদের বাইরের দরজা বন্ধ করে রাখা হয়-যদি আমার সাথে দেখা হয়ে যায়! সর্বনাশ, দেখা হলে দেশটা ধ্বংস হয়ে যাবে যে! দরজাটা খুলেছে খাবার দিতে, তারাও দরজার কাছে এসে দাড়াল। দেখা হলো, দুই একটা কথাও হলো দূর থেকে কেমন আছেন? ভাল আছি। দরজা বন্ধ করতে হবে কারণ সিপাহির চাকরি থাকবে না, যদি বড় সাহেবরা আমাদের কথা বলতে দেখে।
মোস্তফা সরোয়ারের ভাই গ্রেপ্তার হয়ে এসেছিল নারায়ণগঞ্জ মামলায়। সে পরীক্ষার্থী, বিএ পরীক্ষা দু’টা দিয়েছিল। আবার চার তারিখে পরীক্ষা। ওর নাম হাসু। আমি হাসু বলেই ডাকি। হঠাত খবর এল জামিন হয়ে গেছে, এখনি যাবে। আমার সামনে দিয়েই যেতে হবে। দাঁড়িয়ে রইলাম। সে এসে গেল। বললাম, ‘মন দিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিয়ো। তোমার ভাবীকে খবর দিও ইনকাম ট্যাক্স নোটিশের উত্তর আমার সাথে দেখা না করে যেন না দেয়। টেলিফোন করে দিও’।
আরও দুইটা ছেলে পরিক্ষার্থী পড়ে রইল। একজন পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছে-নাম খাজা মহীউদ্দিন। আর একজন অনুমতি না পেয়ে খুবই মুষড়ে পড়েছে। কি করব? মনুষ্যত্ব যাদের মধ্যে নাই তাঁদের সম্বন্ধে কি লিখব?

২রা জুলাই ১৯৬৬।।শনিবার
আজ মিলাদুন্নবী। জেলখানায় কয়েদিদের ছুটি। বড় বড় কর্মচারীদেরও ছুটি। বড় সাহেবদের আগমন বার্তা নিয়ে কয়েদিরা আজ আর হৈ চৈ করছে না। কয়েকজন লোক নিয়ে আমার ফুলের বাগানের আগাছাগুলি তুলে ফেলতে শুরু করলাম। দেখলাম মিজানকে নিয়ে হাসপাতালে যেতেছে জমাদার সাহেব-মিজানের দাতের ব্যথা দেখাবার জন্য। আজ আমাদের দলের একজনকে দেখলাম বহুদিন পরে। এক জেলে থাকি। বেশি হলে ২০০ হাত দূরে হবে। ওদের দশ সেল, আমার দেওয়ালের মাঝে ২৪ ফিট দেওয়াল। আমার ঘরটা দেওয়াল ঘেঁষে, ওদেরটা একটু দূরে। মধ্যে গরুর ঘর আছে। তবুও দেখা হওয়ার উপায় নাই। একজন আর একজনকে দূর থেকে শুভেচ্ছা জানান ছাড়া আর কিইবা করতে পারি!
আর আইয়ুব সাহেবের মাস পহেলা বক্তৃতা পড়লাম। পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক গোলযোগ সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট বেতার ভাষণে বলেন যে, ‘মানুষের আবেগ প্রবনতা নিয়া খেলা করতে অভ্যস্ত এইরূপ একটি গোষ্টী পূর্ব পাকিস্তানে গোলযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা করিয়াছিল। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়া তাহারা এমন একটি কর্মসুচি চালু করতে প্রসার ঘটাইত। সরকার ধৈর্য সহকারেই এই সব লক্ষ্য করিতেছিলেন। কিন্তু তাহাদের কার্যকলাপ সীমা ছাড়াইয়া যাওয়ায় সরকার বাধ্য হইয়া কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন’।
তিনি বলেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত এবং জনগন ভুল পথে পরিচালিত হওয়া হইতে রক্ষা পাইয়াছে’। তিনি এইজন্য আল্লাহ তায়ালাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।
প্রেসিডেন্ট বলেন যে, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগন চিরদিনই যে অবিচ্ছেদ্য থাকবে, তা আমার পক্ষে উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন নাই। উভয় অংশের জনগণের সম্মুখে একই বিশ্বাস, প্রতিজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ রহিয়াছে। এমতাবস্তায় তাহাদের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদের প্রশ্নই উঠিতে পারে না’। তিনি আরও অনেক কিছু বলিয়াছেন, দেশের অন্যান্য পরিস্থিতি সম্বন্ধে।

প্রেসিডেন্ট সাহেব গোড়ায়ই গলদ করেছেন। যে কর্মসূচির কথা উনি আলোচনা করেছেন তার মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার কোনো কর্মসূচি নাই। স্বায়ত্তশাসনের দাবি নতুন নয় এবং যে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান কায়েক করা হয়েছিল তার মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের কথা পরিষ্কার ভাষায় লেখা ছিল। তিনি যে সম্বন্ধে ভাবলেন না। আর যে গোষ্টীর কথা বলছেন, তারা পাকিস্তান কায়েক করার জন্য সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি যাদের নিয়ে শাসন করেছেন তারা অনেকেই পাকিস্তানের আন্দোলনকে শরীক তো হনই নাই, বৃটিশকে খুশি করার জন্য বিরোধীতা করেছিলেন। তিনি যদি সময় না পেয়ে থাকেন পড়তে, তাকে আমি ভারতবর্ষ ও পাকিস্তান –দুইটা রাষ্ট্র গঠন হওয়া সম্বন্ধে কিছু ইতিহাস দিতে চাই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগন যে অবিচ্ছেদ্য সে সম্বন্ধে কাহারও মনে এতটুকু সন্দেহ নাই। তবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক ও শাসকগোষ্টীর হাত থেকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন চায়, কারণ ১৯ বৎসর পর্যন্ত ছলে বলে কৌশলে এবং মীরজাফরদের সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে এমন এক জায়গায় আনা হয়েছে তার থেকে মুক্তি পেতে হলে, শান্তিপূর্ন সংগ্রাম করা ছাড়া তাঁদের উপায় নাই। যখন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়ার কথা হয়েছে, তখনই এই একই কথা একইভাবে সকলের মুখ দিয়েই শুনেছি। তবে শান্তিপূর্ন আন্দোলন সাময়িকভাবে অত্যাচার করে বন্ধ করলেও অদূর ভবিষ্যতে এমনভাবে শুরু হতে বাধ্য, যারা ইতিহাস পড়েন তারা তা জানেন। এইভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি শাসকগোষ্ঠী যদি অত্যাচার করে দাবাইয়া দিতে চান তার পরিণতি দেশের জন্য ভয়াবহ হবে।
ভারতের মুসলমানরা যখনই তাঁদের অধিকারের জন্য দাবি করেছে তখন বর্ণ হিন্দু পরিচালিত কংগ্রেস তার বিরুদ্ধাচারণ করে বলেছে, ‘মুসলমানরা স্বাধীনতা চায় না’। মুসলমানরা ফেডারেল ফর্মের সরকার দাবি করেছিল, কিন্তু কংগ্রেস এককেন্দ্রিক সরকার গঠন করার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকল। মুসলমানরা বাংলাদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হলে ই কয়েকটি প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শাসন চালাতে পারে, এ জন্য ফেডারেল ধরণের শাসনতন্ত্র দাবি করলো।
১৯২১ সালে মওলানা হজরত সোহানী যখন মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন, তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘The fear of Hindu majority can be removed, if an Indian Republic was established on federal basis, similar to that of United States of America’.
ইউনাইটেড স্টেটস অব ইন্ডিয়া হলে সব প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে সেখানে মুসলমানরা শাসন করতে পারবে। কিন্তু কংগ্রেস এতে রাজি হলো না, যদিও এই বৎসর হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটা স্থায়ী শান্তি প্রচেষ্টা খুব ভালভাবে চলছিল।
১৯২৪ সালে মিঃ জিন্নার সভাপতিত্বে লাহোরে মুসলিম লীগের যে সভা হয় সেখানে মুসলমানদের পক্ষ থেকে এক প্রস্তাব করা হয়েছিল। তা এই, ‘It envisaged that the existing provinces shall be united under a common government on federal basis, so that each province shall have full and complete provincial autonomy, the functions of the central government being confined to such matters only as are of general and common concerns’.

এই প্রস্তাবেও কংগ্রেস রাজি হতে পারলো না। ১৯২৮ সালে সর্বদলীয় কনফারেন্সে মতিলাল নেহেরুকে ভার দেওয়া হলো একটা রিপোর্ট দাখিল করতে, যাতে হিন্দু মুসলমান সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এ রিপোর্ট আরও বিভেদ সৃষ্টি করল।
এর পরেই কলিকাতার সর্বদলীয় সম্মেলন ডাকা হলো নেহেরু রিপোর্ট সম্বন্ধে আলোচনা ও তা গ্রহণ করার জন্য। মি. জিন্না তখন কতকগুলি সংশোধনী প্রস্তাব দিলেন এবং দুনিয়ার বহুদেশের শাসনতন্ত্রও সেখানে উল্লেখ করলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার একটি সংশোধনী প্রস্তাবও গ্রহণ করা হলোনা। তিনি চোখের পানি ফেলে বের হয়ে এসেছিলেন। মি. জিন্নাকে’হিন্দু মুসলমানের মিলনের দূত’ বলা হতো। এরপরেই ছোট ছোট যে দলাদলি মুসলমানদের মধ্যে তা শেষ হয়ে গেল। স্যার মহম্মদ সফি ও মি. জিন্নার দল একতাবদ্ধ হয়ে ১৯২৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফারেন্স ডাকলেন দিল্লীতে। সেখানে তাঁদের পুরানা দাবি ফেডারেল সরকারের প্রস্তাব দিলেন এবং ভবিষ্যতে মুসলমানদের দাবি কি হবে সেগুলিও গ্রহণ করলেন। সেখানে তারা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। এরপরেই জিন্না সাহেবের ১৪ দফা বের হলো। এতে ছিল, ‘It pointed out that no constitution would be acceptable to muslims unless and until it is based on federal principles with residuary powers vested in the province’.
১৯৩০-৩১ সালে যে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স বিলাতে হয় তাতে ভারতের মুসলমানদের পক্ষ থেকে এই একই দাবি স্যার সফি করেছিলেন। এমনকি মওলানা মহম্মদ আলি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী র‍্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের কাছে ১৯৩১ সালে এক চিঠিতে লিখেছিলেন যে, ‘মুসলমানদের একমাত্র গ্রহনযোগ্য ফেডারেল শাসনতন্ত্র-যেখানে প্রদেশগুলি পাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’।
১৯৩৭ সালে কয়েকটা প্রদেশে কংগ্রেস শাসিত মুসলমানদের উপর ভাল ব্যবহার করা হলো না। আলোচনা হয়েছিল প্রদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হউক।কংগ্রেস রাজি হয় নাই। তার পরেই ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগ গ্রহণ করে। যার ফলে আজ ভারতবর্ষ দুই দেশে ভাগ হয়েছে।
আজ যারা ৬ দফার দাবি যথা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে আলাদা করার দাবি বলে উড়াইয়া দিতে চায় বা অত্যাচার করে বন্ধ করতে চায় এই আন্দোলনকে, তারা খুবই ভুল পথে চলেছে। ছয় দফা জনগণের দাবি। পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচা মরার দাবি। এটাকে জোর করে দাবান যাবে না। দেশের অমঙ্গল করা হবে একে চাপা দেবার চেষ্টা করলে। কংগ্রেস যে ভুল করেছিল প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ফেডারেল শাসনতন্ত্র না মেনে আমাদের শাসকগোষ্ঠীও সেই ভুল করতে চলেছেন। যখন ভুল বুঝবে তখন আর সময় থাকবে না। আমরা পাকিস্তানের অখন্ডতায় বিশ্বাস করি, তবে আমাদের ন্যায্য দাবিও চাই, অন্যকে দিতেও চাই। কলোনি বা বাজার হিসেবে বাস করতে চাই না। নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার চাই।

৩রা জুলাই ১৯৬৬।। রবিবার
সকালে বৃষ্টি হওয়ার পরে দিনটা একটু ভালই হয়েছে। রৌদ্র উঠেছে। বিছানাগুলি রৌদ্রে দেওয়া দরকার, তাই বের করে রৌদ্রে দিলাম।
মানিক ভাইকে বিজলি পাখা দেওয়ার হুকুম দিয়েছে। বেচারা একটু আরামে ঘুমাতে পারবেন। মানিক ভাই কষ্ট সহ্য করতে পারেন। যে কোনো কষ্টের জন্য যে তিনি প্রস্তুত আছেন, আমি জানি। তবু তার স্বাস্থ্য ভাল না। জীবনে বহু কষ্ট স্বীকার করেছেন। স্বাস্থ্য একবার নষ্ট হলে আর এ বয়সে ভাল হবে না। এই ভাবনাই আমার ছিল। ১০ সেল সম্বন্ধে আলোচনা পূর্বে করেছি, সেখানেই আমার সহকর্মীদের রাখা হয়েছে শুধু কষ্ট দিবার জন্য।
আর আর খবরের কাগজ আসবে না। মিলাদুন্নবীর জন্য বন্ধ। দিন কাটানো খুবই কষ্টকর হবে। আমি তো একাকী আছি, বই আর কাগজই আমার বন্ধু। এর মধ্যেই আমি নিজেকে ডুবাইয়া রাখি। পুরানা কয়েকটা ইত্তেফাক কাগজ বের করে পড়তে শুরু করলাম।
জেল কতৃপক্ষ যে মাছ আমাকে দিয়েছিল তা খাওয়ার অযোগ্য। ফেরত দিয়ে দিলাম। আমার কাছে সামান্য যা ছিল তাই পাক করতে বললাম। কোনোমতে খাওয়া দাওয়া সেরে বই নিয়ে বসলাম। দুপুর বেলা ঘুমের সাথে আমি রীতিমত যুদ্ধ করি। পড়তে পড়তে ঘুম এলে বাইরে যেয়ে একটু ঘোরাঘুরি করতেছিলাম দেখি যে চটকল ফেডারেশনের সেক্রেটারি আব্দুল মান্নানকে নিয়ে যায়। শুনলাম বাজার আনতে গেটে নিয়ে যেতেছে। বাইরে গাছের নিচে বসলেই কাক মহারাজরা বদ কর্ম করে মাথা থেকে সমস্ত শরীর নষ্ট করে দেয়। জেলে কাকের উতপাত একটু বেশি। কয়েকদিন পূর্বে একটা ধনুক বানাইয়াছি। ধনুকটাকে আমি ‘বন্দুক’ বলে থাকি। ইটের গুড়া দিয়ে কাক বাহিনীদের আমি আক্রমণ করলেই ওরা পালাতে থাকে। আবার ফিরে আসে। কিছু সময় কাক মেরেও কাটাইয়া থাকি।
বিকেলে যখন বেড়াচ্ছিলাম দেখি ঢাকার ন্যাপ কর্মী আব্দুল হালিমকে হাসপাতালে নিয়ে চলেছে। দুই দিন থেকে ওর জ্বর। নূতন ২০সেলের ১ নম্বর ব্লকে হালিম ও আর চারজন থাকেন। খুন নিকটে হলেও দেখা বা কথা বলার উপায় নাই। দরজা অন্য দিক থেকে। আমি এগিয়ে যেয়ে ওর মাথায় হাত দিলাম, খুবই জ্বর। বললাম, ‘হালিম তুমি যে দলই কর পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তোমার দান আছে। ১৯৪৯ সালে তুমি আমার সাথে আওয়ামী লীগ করেছ, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছ। তোমার যদি কোনো জিনিসের প্রয়োজন হয় খবর দিও, লজ্জা করো না। তোমার ত্যাগকে আমি শ্রদ্ধা করি’।
সে হাসপাতালে চলে গেল। আমি মনে মনে ওর আরোগ্য কামনা করে বিদায় নিলাম। একজন জমাদার সাহেব আমার এখানে ডিউটি দেয়। সিপাহির কাছ থেকে শুনলাম জমাদার সাহেব তার এক ছেলেকে এমএসসি পড়াইতেছে। এবার পরীক্ষা দিবে। আমি তাকে ডেকে বললাম, ‘ভাই খুব ভাল কাজ করেছেন’। এত অল্প বেতন পেয়েও ছেলেকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন, আপনাকে ধন্যবাদ দিতে হয়’। বলল, ‘স্যার, আমার ছেলেটাও ভাল। প্রাইভেট টিউশনি করে কিছু টাকা উপার্জন করে নিজের পড়ার খরচ চালাইয়া আমাকেও সাহায্য করে’। তার কথা শুনে আমার খুব আনন্দ হলো।
সূর্য অস্ত গেল। আমিও আমার নীড়ে ফিরে এলাম। দুই তিন দিন হলো রাতে তিন চার বার ঘুম ভেঙে যায়। আর বাজে বাজে স্বপ্ন দেখি। শরীরটা ভাল না, পাইলস ও গ্যাস্ট্রিক কষ্ট দেয়।

৪ঠা জুলাই ১৯৬৬ ।। সোমবার
রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল, দেখলাম আড়াইটা বাজে। আমি উঠে বসে পাইপ ধরালাম। আপন মনে পাইপ টানতে আরম্ভ করলাম। মশারির বাইরে বসার কি উপায় আছে! মশক শ্রেণী সাঁড়াশির মতো আক্রমণ করে। তবে একটা গুন আছে এই জেলখানায় মশক শ্রেণীর, শূল বসিয়ে রক্ত খেতে থাকে চুপচাপ। একদিনের জন্যেও ‘বুন বুন’ শব্দ শুনি নাই। তারা ডাকাডাকিতে নাই, নীরবে কাজ সারতেই পছন্দ করে। কয়েদিরা যেমন অত্যাচার সহ্য করে, মার খায়, সেল বন্ধ হয়, ডাণ্ডাবেড়ি পরে, হাতকড়ি লাগায় – প্রতিবাদ করার উপায় নাই, কথা বলার উপায় নাই। নীরবে সহ্য করে যায়। তাই বুঝি মশক বাহিনী বড় সাহেবদের খুশি করার জন্য শব্দ না করেই শূল বসাইয়া দেয়। জেলখানায় কত রক্ত খাবে? যত মশাই হউক, মশারিতো কয়েদিরা পাবে না। বোধহয় তিন হাজার কয়েদির মধ্যে সুই শত কয়েদি মশারি পায়। রাজবন্দি আর যারা ডিভিশন পায় তারাই মশারি পায়। প্রথম যখন এসেছিলাম মশার আমদানি এত ছিল না।
খবর পেলাম গত রাতে ৬১ জন বিড়ী শ্রমিককে বন্দি করে আনা হয়েছে। তারা কি অন্যায় করেছে জানি না। তাদেরও বাচ্চার অধিকার আছে। বিড়ির পাতা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে প্রায় তিন চার লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। তারা ও তাঁদের সংসারের সকলেই না খেয়ে দিন কাটাতেছে। সরকার পাতা বন্ধ করে দিলেন কিন্তু তাঁদের কাজের বন্দোবস্ত করার কথা চিন্তা করলেন না। সরকারের কোনো দায়িত্বও নাই বলে মনে হয়। আবার তাঁদের গ্রেপ্তার করাও শুরু হয়েছে। যারা জনগণের কাজের দায়িত্ব নিতে পারে না বেকার করার দায়িত্ব নিশ্চয়ই তাঁদের নাই। জুলুম করেই চলেছে। সিরাজগঞ্জের এই সকল শ্রমিক লাট বাহাদুরের কাছে দাবি করে ভাতের পরিবর্তে লাঠির আঘাত ও টিয়াস গ্যাস খেয়েছে। গ্রেপ্তার চলেছে সমানে। বাড়িতে যেয়ে যেয়ে কর্মীদের গ্রেপ্তার করে জেলে দিতে শুরু করেছে। আমার মনে হয় পাকিস্তানকে একটা কারাগার ঘোষণা করলেই ভাল হয়, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানকে। জেলের মধ্যে সকলকে ভাত ও কাপড় দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। দেশটাকে জেলখানা ঘোষণা করে সকলের খাওয়ার ও থাকার বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব নিলেই তো সব গোলমাল থেমে যায়। আর মায়ের সামনে কচি শিশুও না খেয়ে ধুকে ধুকে মরবে না। তোমাদের জুলুম যতই জোরে চলবে, গন আন্দোলনও ততই জোরে শুরু হবে। অত্যাচার চরমে পৌছালে গণআন্দোলনও চরমে পৌছাবে। দেখে খুশি হয়েছি। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নবাব কালাবাগ সাহেবের আমন্ত্রণক্রমে কয়েকজন সম্পাদক, মালিক এবং পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা তার সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি বলেছেন, যদি ৫ই জুলাই ধর্মঘট বন্ধ রাখা হয় তাহলে জনাব তফাজ্জল হোসেনের গ্রেপ্তার ও নিউনেশন প্রেসের বাজেয়াপ্তের ব্যাপারে একটা সন্তোষজনক মীমাংসার জন্য তিনি চেষ্টা করতে রাজি আছেন, এবং উর্ধবতন কতৃপক্ষের সাথেও আলোচনা করবেন। তাই সাংবাদিকরা ধর্মঘট স্থগিত রেখেছেন আগামী ২০শে জুলাই পর্যন্ত।
আমার মনে হয় একটা কিছু হবে, কারন নবাব কালাবাগকে আমি জানি, তার সাথে মতের মিল আমার না থাকলেও তিনি যা বলেন, করতে চেষ্টা করেন। নবাব সাহেব ও আমি একসাথে প্রায় সাড়ে তিন বৎসর পার্লামেন্টের সদস্য ছিলাম। তিনি পূর্ব বাংলার গভর্নর সাহেবের মতো ফালতু কথা বেশি বলেন না।
আজ থেকে ডন কাগজ আমাকে দেওয়া শুরু করেছে। তবে একদিন দেরিতে পাই। এতে আমার দুঃখ নাই, কাগজ যে দেয় এটাইতো ভাগ্যের কথা! যে লোকের পাল্লায় পূর্ব বাংলার লোক পড়েছে, সে কতদুর নিয়ে যায় বলা কষ্টকর।
বিকাল সাড়ে চারটার সময় ডেপুটি জেলার সাহেব এলেন। বললেন, কেমন আছেন? জমাদার সাহেবকে ডেকে যেন কি বললেন, তারপরই বাঁশি বেজে উঠল। পাগলা ঘন্টা, আর যায় কোথা! দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল। কয়েদিরা যার যার ঘরে চলে গেল। তালাবদ্ধ হয়ে গেল। ফৌজ নিয়ে বন্দুক নিয়ে সার্জেন্ট সাহেব ঢুকলেন সেল এরিয়ায়, যেখানে আমি থাকি। বন্দুকের গুলি হতে লাগল, ফাঁকা গুলি। আধ ঘন্টা পরে আবার ঘন্টা পড়ল, সব ঠিক আছে। একে জেলে ‘মাস কাবারী’ বলে। মাসে একবার করে কয়েদিদের ভয় দেখাবার জন্য এরকম করা হয়। আমরা তো ভয় পেয়ে বসেই আছি। আবার কেন বাবা!
জেলার সাহেব এলেন। তাকে বললাম, আপনার জেলে সাধারণ কয়েদিদের উপর জুলুম চলেছে, খাওয়া দাওয়াও ভাল হতেছে না। আশা করি আপনি খেয়াল রাখবেন। বদনাম আপনাকেই মানুষ করবে। আর বদ দোয়াও করবে আপনাকে। জেলার সাহেব কয়েদিদের উপর নিজে কোনো অত্যাচার করেন না, সে আমি জানি।

৫ই জুলাই ১৯৬৬ ।। মঙ্গলবার
জমাদার ও সিপাহি সাহেবরা মুড়ি খেতে চায়। মুড়ি জেলখানায় কয়েদিরা চোখেও দেখে না। মেটকে বললাম, মুড়ি-কাচা মরিচ ও পিঁয়াজ দিয়ে তৈয়ার কর। পূর্বেই আমি দেখাইয়া দিয়েছি কী করে তৈয়ার করতে হয়। নিজেও জানি কিছুটা। সাধারণ কয়েদিরা যারা আমার এখানে কাজ করে তাঁদের জন্যও বানাও। পাশের সেলে যে কয়জন জেল হতে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি আছে তাদেরও দিতে হবে। খেয়েদেয়ে ‘ডন’ কাগজ পড়তে লাগলাম। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক খবরই পাওয়া যায়।
বৃষ্টি নেমেছে ভীষণভাবে, আর থামতেই চায় না। মশারিটা সকালে ধোপা দফায় পাঠিয়ে দিয়েছি, রৌদ্র দেখে। এখন কি উপায় করি? আজ বোধহয় মশক বাহিনীর আক্রমণ আমাকে নীরবে সহ্য করতে হবে।
মোনায়েম খান সাহেব আবার হুমকি দিয়েছেন। সাবধান! সত্য কথা কেহ লিখতে ও বলতে পারবা না। চাউলের দাম বেশি বাড়ে নাই-বেড়েছে কিছুটা, তবে ভয়ের কোনো কারণ নাই। অনেক সিপাহি ছুটি ভোগ করে বাড়ি থেকে এসেছে। তাঁদের কাছেও শুনলাম ৫০ থেকে ৬০ টাকাও দাম উঠেছে চাউলের মন। সত্য কথা চাপা দেওয়ার এই চেষ্টা কেন? আপনার সরকারের কী ক্ষতি হতেছে! চাউল তো আপনার গুদামে যথেষ্ট আছে, আর ভয় কি? ছেড়ে দেন বাজারে, অথবা রেশনিং প্রথা গ্রামে গ্রামে প্রচলন করুণ। খাজনা আদায় বন্ধ করুণ। বিনা পয়সায় কিছু চাউল গরিবদের মধ্যে বিলি করুণ, কোনো গোলমাল থাকবে না।
কাগজগুলিকেও তিনি হুমকি দিয়াছেন। জনগন বোধহয় বেশি ভয় আর করবে না। বেশি বাড়লে ঝড়ে ভেঙে পড়ে। আপনার দিনও ফুরাইয়া এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে একটি বাড়ি এই সুযোগে করে রাখুন। সুবিধা হবে, না হলে অনেক বিপদে বোধহয় পড়তে হবে ভবিষ্যতে।
আজ একজন জেল কর্মচারী আমাকে জেলের দুর্নীতির কথা বলেছিল। কিছুদিন পূর্বে একজন অর্থশালী লোককে এনেছিল জেল দিয়ে। তাঁদের ডিভিশন দেওয়া হয় নাই। একজনের বেশি বয়স। আর যায় কোথায়? পানি আনতে হুকুম হলো, বেচারারা পারে না, কাদতে থাকে। তখন কয়েদির মধ্য থেকে কিছু দালাল এসে বলে, যদি কিছু টাকা দিতে পারেন, তবে ভাল কাজের বন্দোবস্ত করে দিতে পারি। কোনো কষ্ট হবে না, বসে বসে লেখাপড়া করতে পারবেন বা হাসপাতালে রাখার বন্দোবস্ত করে দেওয়া যাবে। বেচারা বোকার মতো বলে, জেলখানায় টাকা পাব কোথায়? তখন ঐ দালালই বুঝাইয়া দেয়: একখানা কাগজ এনে দিবে, বাইরে তার লোকের কাছে লিখে দিতে হবে অমুকের সাথে দেখা করে টাকা দিয়ে যেতে; নতুবা বাঁচবো না। যাদের টাকা আছে তারা তো কোনোমতে জোগাড় করে এনে দেয়, আর যাদের নাই তাঁদের কোনো কিছু বিক্রি করে অথবা যেভাবে পারে জোগাড় করে দিতে হবে।
একবার টাকা দিলে আর উপায় নাই। টাকা পেয়ে কয়েকদিন ভালই থাকার বন্দোবস্ত করল। আবার জুলুম। জেল কর্মচারী বেচারা ভাল মানুষ। এসব পথে হাটে না। অনেক গল্প আমার সঙ্গে করল। আমি তো এসব ঘটনা বহু জানি। কারণ কারাগার তো আমার পুরানা সাথী। এমন কি গরিব কয়েদিদেরও টাকা এনে দিতে হয় মহকুমা জেলগুলিতে। সে অনেক ইতিহাস, লেখা কষ্টকর। আবার অনেক ভদ্রলোক আছে সিপাহি জমাদারদের ভিতর, যারা না থাকলে কয়েদিরা জেল খাটতে পারত না। নিজেদের সামান্য বেতন থেকেও কয়েদিদের কিছুকিছু জিনিস এনে দেয়। আবার সাহায্যও করে আদরও করে।
বিকালে বৃষ্টি থামলে বের হলাম ঘর থেকে। ধনুক আছে কাকের উৎপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। ওদের কিছু তাড়া করে বসে কাগজ পড়তে পড়তে দিন কাটাইয়া দিলাম।

৬ই জুলাই ১৯৬৬ ।। বুধবার
নাস্তা খেতে বসে দেখলাম, রুটি দুই টুকরা ছাড়া আর কিছুই নাই। বললাম, খেতে আমার ইচ্ছা নাই। কারণ সকালে চা খেয়েছি। কিন্তু মেট কি শোনে? খেতেই হবে কিছু। এক টুকরা রুটি আর জেলখানার একটা কলা খেয়ে নিলাম। জেলখানার কলা কেন বললাম প্রশ্ন আসতে পারে। কন্ট্রাক্টর কয়েদিদের জন্য আনে বাজারের সবচেয়ে ছোট কলা। কারণ যারা আপত্তি করবে, তাড়া আপত্তি করা দরকার মনে করে না।
৬ই জুলাই ১৯৬৬ ।। বুধবার
নাস্তা খেতে বসে দেখলাম, রুটি দুই টুকরা ছাড়া আর কিছুই নাই। বললাম, খেতে আমার ইচ্ছা নাই। কারণ সকালে চা খেয়েছি। কিন্তু মেট কি শোনে? খেতেই হবে কিছু। এক টুকরা রুটি আর জেলখানার একটা কলা খেয়ে নিলাম। জেলখানার কলা কেন বললাম প্রশ্ন আসতে পারে। কনট্রাকটর কয়েদিদের জন্য আনে বাজারের সবচেয়ে ছোট কলা। কারণ যারা আপত্তি করবে, তাড়া আপত্তি করা দরকার মনে করে না।
গতকালের কগজ নিয়ে বসলাম। আমার মেট এসে হাজির, ‘আর কিছু খাবেন না? এতে চলবে কি করে?’ বললাম, ‘বাবা মাফ করো। তোমার জন্য অস্থির হয়ে পড়লাম। শুধু খাই খাই’। কিছু সময় পরে মুড়ি নিয়ে এল। যে দুইটা ছেলে পরীক্ষা দিতেছে তাঁদের মধ্যে একজনের ভোর রাত থেকে বমি ও সকালে পাতলা পায়খানা হয়েছে। আমাকে খবর দিয়েছে একটা ডাবের দরকার। আমার কাছে ডাব ছিল পাঠাইয়া দিলাম। আর ডাক্তারকে খবর দিতে বললাম। ডাক্তার সাহেব এলেন, ওষুধ দিলেন, বেচারা একটু সুস্থ বোধ করল এবং পরীক্ষা দিতে গেল। ভালভাবে পরীক্ষা দিক এটাই কামনা করলাম।
কাগজ এল। দেখি ইন্দোনেশিয়ার পিপলস কংগ্রেস আজ সুকর্ণকে আজীবন প্রেসিডেন্ট পদ হইতে অপসারিত করিয়াছে, তবে তিনি আগামী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই অন্যতম বিশাল রাষ্ট্রে আজ কমিউনিজম, লেনিনবাদ ও মার্ক্সবাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছে। পিপলস কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তে – প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ সম্মতি দান করিয়াছেন। কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের বাড়াবাড়ির জন্যই আজ ইন্দোনেশিয়া এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হইয়াছে। তাড়াতাড়ি করে ক্ষমতা দখল করতে যেয়েই এই অঘটন ঘটাল, লক্ষ লক্ষ কম্যুনিস্ট কর্মীদের জীবন দিতে হলো। এখন গ্রেপ্তার ও অত্যাচার সহ্য করতে হতেছে। দুনিয়ার ডিক্টেটরদের চোখ খুলে যাওয়া উচিৎ। মনে হয় সুকর্ণকে আজ দয়া করে প্রেসিডেন্ট রাখা হয়েছে। কোনো ক্ষমতাই তার নাই। তাঁর নিজের কথাগুলিকে নিজেরই হজম করতে হতেছে। আজ জাতিসংঘ, অর্থনৈতিক ব্যাংক ও অন্যান্য সঙ্ঘগুলির সদস্য হবার জন্যও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় অর্থনীতি আজ ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আজ আবার সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরে তাকে পড়তে হবে বলে মনে হয়।
বিকালে চা খাবার সময় সিকিউরিটি জমাদার সাহেবকে আসতে দেখে ভাবলাম বোধহয় বেগম সাহেবা এসেছেন। গত তারিখে আসতে পারেন নাই অসুস্থতার জন্য। ‘চালিয়ে, বেগম সাহেবা আয়া’। আমি কি আর দেরি করি? তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি পরেই হাটা দিলাম গেটের দিকে। সেই পুরান দৃশ্য। রাসেল হাচিনার কোলে। আমাকে দেখে বলছে, ‘আব্বা!’ আমি যেতেই কোলে এল। কে কে মেরেছে নালিশ হলো। খরগোস কিভাবে মারা গেছে, কিভাবে দাঁড়াইয়া থাকে দেখালো। রেণুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘খুব জ্বরে ভুগেছ। এখন কেমন আছ’?
‘পায়ে এখনও ব্যথা। তবে জ্বর এখন ভালই’।
বললাম, ‘ঠান্ডা লাগাইও না’।
আমার চারটা ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে এসেছে। ছেলে দুইটাই বাসায় ফিরেছে। মেয়ে দুইটার একজন কলেজ থেকে, আর একজন স্কুল থেকে সোজা এসেছে। ছোট ছেলেটা রাস্তার দাঁড়াইয়া থাকে কখন আমি গেটে আসবো।
ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, মা, আব্বা, ভাইবোনদের খোজ-খবর নিলাম। মা ঢাকা আসতে চান না। এতদূর আসতে তাঁর কষ্ট হবে –কারণ অসুস্থ। আবার বয়সও হয়েছে। আব্বার বাড়িতে। তারও কষ্ট হয় সকলের চেয়ে বেশি। একলা আছেন। আজ অনেক সময় কথা বললাম। সবই আমাদের সাংসারিক খবর এবং আমি কিভাবে জেলে থাকি তাঁর বিষয়। বাচ্চারা দেখতে চায় কোথায় থাকি আমি। বললাম, ‘বড় হও, মানুষ হও দেখতে পারবা’।
সময় হয়ে গেছে, ‘যেতে দিতে হবে’। ফিরে এলাম আমার জায়গায়। হরলিক্স ও আম নিয়ে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমার জন্য না এনে বাচ্চাদের কিনে দেও ত’।
সন্ধ্যা হয়ে এল। ওদের বিদায় দিয়ে আমার স্থানে আমি ফিরে এলাম। মনে মনে বললাম, আমার জন্য চিন্তা করে লাভ কি? তোমরা সুখে থাক। আমি যে পথ বেছে নিয়েছি সেটা কষ্টের পথ।

৭ই জুলাই ১৯৬৬ ।। বৃহস্পতিবার
নতুন বিশ সেলের দোতালায় একটা ব্লকে একজন কয়েদিকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। একে ‘জাল সেল’ বলা হয়। একে তো সেল, তাঁর উপর আবার জান দিয়ে সামনেটা ঘেরা। ওকে একদিন আমি দেখেছি। আমার জায়গার কাছ দিয়েই দোতালার সিঁড়ি। চেহারাটা যে একদিন খুব ভাল ছিল সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। লোকটার না নেছার খাঁ। আজ ১৭ বৎসর জেলে আছে। যাদের যাবজ্জীবন জেল হয় তাদেরও ১২/১৩ বৎসরের বেশি খাটতে হয় না। একে ১৭ বৎসর রাখা হয়েছে কেন? খবর নিয়ে জানতে পারলাম, আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় ছিল তখন জেল-মন্ত্রী এসেছিলেন জেল তদারক করতে। আট সেলে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল তাকে যাতে সে মন্ত্রী বাহাদুরের কাছে নালিশ করতে না পেরে জেলের দুর্নীতি সম্বন্ধে। কারণ লোকটা বড় সাহসী, মুখের উপর সত্য কথা বলে দেয়। যখন মন্ত্রী সাহেব সেই সেলের পাশ দিয়ে যেতেছিলেন সে দেয়ালে উঠে চিৎকার করে বলেছিল, ‘স্যার আমার নালিশ আছে’। মন্ত্রী সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে এই লোকটা’? তাকে বলা হয়েছিল লোকটা পাগল। তারপর মন্ত্রী সাহেব চলে যাওয়ার পরে যা ঘটাবার তাই ঘটল। তখনকার দিনের বড় সাহেবের হুকুম জেলখানায় পাগলাগারদ ৪০ সেলে এনে বন্দি করা হলো। এবং ঘোষণা করা হলো সে পাগল হয়ে গেছে। পাগলের তো কোনো নির্দিষ্ট সময় নাই। যতদিন ভাল না হবে এবং সিভিল সার্জন সাহেব সার্টিফিকেট দিয়ে সরকারের কাছে না লিখবেন ততদিন ছাড়া পেতে পারে না। এতদিন তাকে পাগল করেই রাখা হয়েছে, যদিও সে পাগল না। এভাবে রাখলে ভাল মানুষও পাগল হয়ে যায়। নতুন সিভিল সার্জন সাহেব এসে ঘোষণা করেছেন, সে পাগল না। তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে লিখেছেন। বোধহয় শীঘ্রই মুক্তির হুকুম আসবে।
আমার কাছে খুবই খারাপ লাগল। আমাদের সরকারের সময়ই এই অত্যাচার হয়েছিল এজন্য লোকটা এখনও ভুগছে। এর পরেও আমি তিনবার জেলে এসেছি। কেহই এ ঘটনা আমাকে বলে নাই। আর বললেও কি করতে পারতাম? এখন যারা জেল কতৃপক্ষ আছেন তারা এঁদের ছাড়তে দেরি করেছেন। পাগল বলে মুক্তি দেবার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের হাতে নাই। মানুষ এমন নিষ্ঠুর হতে পারে! যে ভদ্রলোক আমাদের সময় প্রমোশন পেয়েছিলেন, তিনি এই নীচু কাজটা করেছিলেন।
১১টার সময় ডিআইজি জনাব ওবায়দুল্লা দেখতে এসেছেন সেল এরিয়ায় আমার কাছে আসলে তিনি দুইচার মিনিট বসেন। আজ অনেকক্ষণ বসলেন। হাদিস শরীফ নিয়ে আলোচনা করলেন। খানে দজ্জাল ইমাম মেহেদী আসবেন। ঈসা নবীও আর একবার আসবেন। এজ্জাজ, মাজুজও হাজির হবে। দুনিয়া প্রায়ই ধ্বংস হয়ে যাবে-আরও অনেক কিছু বলেন। আমিও দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বললেন, রসুলআল্লার জন্মের ১৪শত বছর পর দুনিয়ায় এসেছে, ইমাম মেহেদীর খবর কি? তিনি বুঝলেন আমি কাকে ইঙ্গিত করলাম। হেসে দিয়ে বিদায় নিলেন, কোনো কথা আর বলবেন না।
আমি আমার কাজে আত্মনিয়োগ করলাম এবং আর একবার চায়ের প্রয়োজন জানালাম। মুড়ি ও চা এসে হাজির হলো। যথারীতি মুড়ি নিধন করিয়া বই নিয়া বসলাম।
মনে মনে ভাবলাম, আজও দুনিয়ায় মানুষ অনেক আজগুবি কথা বিশ্বাস করে? বিশ্বাস না করে উপায় কি? কিল খাওয়ার ভয় আছে। যাক, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’।

৮ই জুলাই ১৯৬৬ ।। শুক্রুবার
প্রাতঃভ্রমণ করছি এমন সময় হাসপাতালের দিকে চেয়ে দেখি শাহাবুদ্দিন চৌধুরী সাহেব তাকাইয়া আছেন। আমাকে হাত ইশারা দিয়ে দেরি করতে বলে হঠাত চলে গেলেন ভিতরে। তিনটা ছেলেকে কোলে করে কয়েকজন কয়েদি নিয়ে এল বাইরে দেখলাম একজনের হাত কেটে ফেলেছে, একজনের বুকের কাছে গুলি লেগেছিল, আর একজন হাঁটতেই পারে না কোলে করেই রেখেছে। বাইরের হাসপাতাল থেকে এঁদের এনেছে। অত্যাচার করে, মারপিট করে, গুলি করে জখম করেছে। এঁদের জীবন শেষ করে দিয়েছে, তারপর আবার আসামি করে গ্রেপ্তার করে জেলে নিয়ে এসেছে। কি নিষ্ঠুর এই দুনিয়া! এরাই তো আমাদের ভাই, চাচা, প্রতিবেশী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায় হলে এঁদের বংশধররা সুযোগ সুবিধা পাবে। এঁদেরকে বাদ দিয়ে তো কেউ অধিকার ভোগ করবে না। যারা মৃত্যুবরণ করলে আর যারা পঙ্গু হয়ে কারাগারে এসেছে, জীবনভর কষ্ট করবে আমাদের সকলের জন্যই। কেন এই অত্যাচার? কেনই বা এই জুলুম! অত্যাচার কতকাল চলবে!
মনকে শক্ত করতে আমার কিছু সময় লাগল। ভাবলাম সকল সময় ক্ষমা করা উচিৎ না। ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ, কিন্তু জালেমকে ক্ষমা করা দুর্বলতারই লক্ষণ। ইসলামে ঠিক কথাই বলেছে, ‘ক্ষমা করতে পার ভাল না করতে পারলে, হাতের পরিবর্তে হাত, চক্ষুর পরিবর্তে চক্ষু নিতে আপত্তি নাই’।
আজ আরও একটা ছেলেকে সাতাশ সেল থেকে নিয়ে এসেছে পুরানা বিশ সেলে। ম্যাট্রিক দেবে। নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় বাড়ি। মাথায় আঘাত পেয়েছিল। ধরে নিয়ে ভীষণভাবে মারপিট করেছে। অনেকে জখম নিয়েই কারাগারে এসেছে। খাজা মহীউদ্দিন আমাকে তাঁর পিঠটা দেখালো, এখনও দাগ রয়ে গেছে। তাকে ধরে এনে মেরেছে। শুনলাম ইপিআর-এর লোকগুলি এঁদের মারধর করে নাই। তাড়া বেঙ্গল পুলিশকে মিছামিছি গুলি করার জন্য জনসাধারণের সামনেই গালাগালি করেছে। এখনও বহুলোক জেলে আছে। নারায়ণগঞ্জে মামলায় এখনও গ্রেপ্তার চলছে। এঁদের মধ্যে বেশির ভাগই বাচ্চা ছেলের দল। কি কষ্টেই যে এঁরা আছে, বলব কি? বলবার ভাষা নাই। একই কাপড় পরে জেলে এসেছে। দিনের পর দিন কাপড় পরেই রয়েছে। সন্ধ্যার সময় এক সিপাহি আমাকে বলল, ‘দেশের কথা কি বলব স্যার’! কয়েকদিন পূর্বে ফরিদপুরের একটা মেয়েলোক আমার এক বন্ধুর কাছে ১৩ দিনের একটা ছেলেকে ১০ টাকায় বিক্রি করে দিয়ে গিয়াছে। এমনিই দিয়ে যেতে চেয়েছিল, বন্ধু ১০ টাকা দিয়ে দিল। কোনো কথা না বলে ছোট্ট মেয়ের হাত ধরে সে চলে গেল। একটা কথাও বলল না। শুধু বলল, আমি মাঝে মাঝে দেখতে চাই ছেলেটা ভাল আছে’। আরও বলল, অনেক গ্রামের কচু গাছ ও গাছের পাতাও বোধ হয় নাই। বললাম, এইতো আইয়ুব খান সাহেবের উন্নয়ন কাজের নমুনা। মোনায়েম খাঁ সাহেবের ভাষায় চাউলের অভাব হবে না, গুদামে যথেষ্ট আছে। যে দেশের মা ছেলে বিক্রি করে পেটের দায়ে, যে দেশের মেয়েরা ইজ্জত দিয়ে পেট বাঁচায়, সে দেশও স্বাধীন এবং সভ্য দেশ! গুটিকয়েক লোকের সম্পদ বাড়লেই জাতীয় সম্পদ বাড়া হয় বলে যারা গর্ব করে তাঁদের সম্বন্ধে কি-ইবা বল্ব!
বাঙালি জাতটা এত নিরীহ, না খেয়ে মরে যায় কিন্তু কেড়ে খেতে আজও শিখে নাই। আর ভবিষ্যতেও খাবে সে আশা করাও ভুল। চুপ করে শুয়ে চিন্তা করতে লাগলাম গ্রামের কথা, বস্তির কথা। গ্রামে গ্রামে আনন্দ ছিল, গান বাজনা ছিল, জেয়াফত হতো, লাঠি খেলা হতো, মিলাদ মাহফিল হতো। আজ আর গ্রামের কিছুই নাই। মনে হয় যেন মৃত্যুর করাল ছায়া আস্তে আস্তে গ্রামগুলিকে প্রায় গ্রাস করে নিয়ে চলেছে। অভাবের তাড়নায়, দুঃখের জ্বালায় আদম সন্তান গ্রাম ছেড়ে চলেছে শহরের দিকে। অনেকক্ষণ শুয়ে শুয়ে ছোটবেলার কত কাহিনীই না মনে পড়ল। কারণ আমি তো গ্রামেরই ছেলে। গ্রামকে আমি ভালবাসি।

৯ই জুলাই ১৯৬৬ ।। শনিবার
ভিয়েতনামের হ্যানয় ও হাইফং-এ আবারও বোমাবর্ষণ করেছে আমেরিকা। জাতীয় পরিষদে একটা মুলতবি প্রস্তাব হ্যানয় ও হাইয়াং বোমাবর্ষণের ব্যাপার নিয়ে এনেছিল বিরোধী দল। স্পিকার নাকচ করেছেন, অন্য দেশের ঘরোয়া ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ না বলে। কিন্তু বিশ্বশান্তি নিয়ে তো আলোচনা করা যায়। পাকিস্তানি সরকারের নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির নমুনা।
আইন মন্ত্রী জাফর সাহেব বলেছেন, সরকার উদ্বিগ্ন। চমৎকার কথা। আমি খুশি হয়েছিলাম এই মুলতবি প্রস্তাব এনেছিল বলে। দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখনই অত্যাচার করে, আওয়ামী লীগ তাঁর প্রতিবাদ করে এবং নিজের দেশের সাম্রাজ্যবাদের দালালদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালাইয়া যায়। চীন আজ বহুদিন পর্যন্ত শুধু হুমকিই মেরে চলেছে। কখন সাহায্য করবে? যখন ভিয়েতনামের জনগন অত্যাচারে, নির্বিচারে গুলির আঘাতে মৃত্যুবরণ করবে তখন বোধ হয় একবার যেতে পারে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে তাড়াতে না পারলে জনগন শান্তির সাথে বাস করতে পারে না। এই সব হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধেও আজ আমেরিকার অনেক প্রগতিশীল মানুষ তীব্র প্রতিবাদ করিতেছে। সুদূর মার্কিন দেশেও প্রতিবাদের ঝর উঠেছে। তবুও চক্ষু খুলছে না জনসন সরকারের।
আমাদের পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার তিনটা কাগজের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছে। একটা সংবাদ, পূর্ব পাকিস্তানের কাগজ, আর দুইটা ‘নওয়াই ওয়াক্ত’ ও ‘কোহিস্তান’- পশ্চিম পাকিস্তানের। প্রায় সকল কাগজকেই সরকার ছলে বলে কৌশলে নিজের সমর্থক করে নিয়েছে। যে দু’চারটা কাগজ এখনও নিরপেক্ষতা বজায় রেকেহ জনগণের দাবি দাওয়া তুলে ধরছে তাঁদের শেষ করার পন্থা অবলম্বন করেছে সরকার। ইত্তেফাক প্রেসতো বাজেয়াপ্ত। ঢাকার কাগজের মধ্যে মর্নিং নিউজ, দৈনিক পাকিস্তান, পয়গাম, পাসবান সরকারের সমর্থক কাগজ। প্রথমোক্ত দু’টাই প্রেস ট্রাস্টের। ইত্তেফাক তালাবন্ধ। সংবাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে শেষ করার অবস্থা। পাকিস্তান অবজারভার তো ‘যখন যেমন, তখন তেমন, হায় হোসেন, হায় হোসেনের দলে’। কখন যে আঘাত আসে বলা যায় না।
এক কথায় বাংলাদেশ বিরোধী দলের কোনো কাগজ থাকতে পারবে না। এই সমস্ত থেকে বুঝতে পারা যায় সরকার কোনদিকে চলেছে। এক দলীয় সরকার গঠন করার চেষ্টা করলেই তো ভাল হয়। এই সমস্ত অত্যাচার জুলুম করে লাভ কি? যারা পারবে গোপনে রাজনীতি করবে। যারা পারবে না চুপ করে সংসার করবে। দেশকে ধ্বংসের দিকে এঁরা নিয়ে চলেছে। ফলাফল ভয়াবহ হবে।
আজ সকাল থেকে আমি দূর্বাঘাস কাটায় নেমে যাই। ঘাস কাটা মেশিন আনা হয়েছে। নতুন ঘাস কাটতে অসুবিধা হয়। আমি তদারক করতে থাকি আর কয়েদিরা কেটে চলেছে। ঝাড়ুদারদের দিয়ে পরিষ্কার করাই। আজ দিনটা কাজের মধ্যে থেকে ভালই লাগছিল। দুপুরে কাগজ পড়ে, আবার বিকালেও এই একই কাজ করে, একটা বাগান সুন্দর করে কেটে তৈরি করেছি। এর পরে যখন ঘাসটা আবার উঠবে তখন আরো সুন্দর হবে।

১০ই জুলাই ১৯৬৬ ।। রবিবার
আমি যেখানে থাকি তাঁর সাথেই নূতন বিশ সেলের ২ নম্বর ব্লক। রবিবার ছুটির দিন গানের জলসা বসেছে। নূরু ভালই গান গায়।
আমি আরাম কেদারায় বারান্দার পাশে আরামে বসলাম, গান শুনব বলে। জেলের ভিতর আর একজন কয়েদি আছে, নাম বেলাল। ঢাকা শহরেই বাড়ি, ভাল গজল ও কাওয়ালি গান গায়। সে ফুলের বাগানের পাহারা, আমার বাগানে আজ কাজ করতে আসবে। ৯টায় এসে সেও হাজির হয়। তাঁর কাছ থেকেও কাওয়ালি শুনলাম কয়েকটা। এঁদের তবলা হলো এলমুনিয়ামের থানা। থালা বাজাইয়া গান করে। বেলালের গলাটা একটু খারাপ হয়েছে কাওয়ালি গাইতে গাইতে। তাঁর সুযোগ আছে, সব জায়গায় যাইতে পারে। তাই যেখানে যায় সিপাহি জমাদাররা ওকে ধরে কাওয়ালি শোনে। নূরুর বাংলা গান শুনলাম। খুবই সুন্দর গলা। তালও ঠিক আছে। ভাবলাম ‘হতভাগা’টা জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে। জেলে পড়ে নানারকম অত্যাচার সহ্য করে আর জেলের খাওয়া খেয়েও গলাটাকে এখনও কিছুটা ঠিক রেখেছে। ধন্যবাদ দিতে হয়। গাইতে কষ্ট হয় বুঝতে পারি। শক্তি না থাকলে গান আসবে কোথা থেকে? তবুও বড় ভাল লাগল ওর গান শুনে। বিশেষ করে পল্লীগীতি ও চমৎকার গায়।
বেলাল বলে গেল, “স্যার কেবল ‘পাহারা’ হয়েছি। আপনার কাছে এসে কাওয়ালি গেয়েছি শুনলে কি আর রক্ষা আছে?” আমি ওকে রক্ষা করতে পারি? আমি তো ওর চেয়েও ‘সাংঘাতিক’ কয়েদি! কেউ আমার সাথে কথা বলতে বা মিশতে পারবে না। একদম সরকারের হুকুম। বাগানে কাজ করতে এসেছিল তাই বোধহয় একটু সুযোগ পেলাম ওর কাওয়ালি শুনতে।
আইয়ুব সাহেবের সরকারের শুভ সংবাদ, দেশের জন্য শুভ কিনা, বলা কষ্টকর। কর্নসর্টিয়াম ১৯৬৬-৬৭ সালে পাকিস্তানকে ৫৫০ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মনে রাখা দরকার, এই ডলার সবই ঋণ নেওয়া হলো। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের কপালে কি আছে আমরা জানি না, তবে সুদসহ টাকা পূর্ব পাকিস্তানকেই বেহসি ফেরত দিতে হবে।
ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গুলির স্বায়ত্তশাসন শেষ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডান্ডা চালাইয়তে সক্ষম হইবেন। অবস্থা যে কি হবে! বোধহয় শিক্ষিত সমাজ একটু ঘাবড়াইয়া গিয়াছেন, ভয় নাই, কলম ফেলে দিন। লাঠি, ছোরা চালান শিখুন। আর কিছু তেল কিনুন রাতে ও দিনে যখনই দরকার হবে নিয়ে হাজির হবেন। লেখাপড়ার দরকার নাই। প্রমোশন পাবেন, তারপরে মন্ত্রী হতেও পারবেন।
শুধু ভাবি, ‘ব্যাপারটা কি হলো’! কোথায় যাইতেছি!

১১ই জুলাই ১৯৬৬ ।। সোমবার
সকাল থেকে মাথা ভার হয়ে আছে, ঠিক হয়ে বসতেই পারছি না। এই অবস্থায় অনেক সময় কাটাইয়া দিলাম বারান্দায়। ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। কিছু খেতেও ইচ্ছে করেছে না। প্রায় ১১টার সময় ডাক্তার সাহেব এলেন, বললাম আমার অবস্থা। তিনি বললেন রক্তচাপটা দেখতে হবে। রক্তচাপ আমার নাই (ব্লাড প্রেসার যাকে বলা হয়)। কোনোদিন তো ছিল না। দেখাযাক কি হয়! এই খুঁতখুঁতে ব্যারাম বেশি কষ্ট দেয়। যদি কিছু একটা হয় ভালভাবে হয়েই শেষ হয়ে যাওয়াই উচিৎ। চোখ বুজে থাকলে ভাল লাগে। মেট বার বার তাগিদ দিতেছে কিছু খাবার জন্য। সকালে তো কিছু খেয়েছি, আবার কি? হঠাত মেজাজটা খারাপ করে ফেললাম। পরে দুঃখিত হলাম। বললাম ভাল লাগে না কিছুই খেতে। আমার বেগমের দৌলতে কোনো জিনিসের তো আর অভাব নাই। বিস্কুট, হরলিক্স, আম, এমনকি মোরব্বা পর্যন্ত তিনি পাঠান। নিজে আমি বেশি কিছু খাইনা, কারণ ইচ্ছা হয় না। আবার ভয়ও হয় যদি পেট খারাপ হয়ে পড়ে! আবারও একদিন রক্ত পড়েছে। পাইলস ভাল হয়ে গিয়াছিল, আবার হলো। উপায় তো নাই। আমি একলাই শুধু ভুগি না কয়েদিরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ব্যারামে ভোগে। বিশেষ করে রাজবন্দিরা, কারণ এঁদের তো কোনো কাজ নাই। খাও শুয়ে থাক আর বদহজমে ভোগ, তারপর একটা একটা করে রোগে তোমাকে আক্রমণ করুক এইতো সরকার চায়। স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাক। আরামপ্রিয় হয়ে উঠুক। বাইরে গেলে আর কাজ করতে পারবেনা।
আজ পাবনার রণেশ মৈত্রের সাথে আমার হঠাত দেখা হলো। ল’ পরীক্ষা দিতে পাবনা থেকে আনা হয়েছিল। দুই একদিনের মধ্যে চলে যাবেন এখান থেকে। বললাম, ‘আপনার ছেলেমেয়ের কি খবর?’ বললেন, ‘কি আর খবর, না খেয়েই বোধ হয় মারা যাবে। স্ত্রী ম্যাট্রিক পাশ। কাজ কর্ম কিছু একটা পেলে বাঁচতে পারতো; কিন্তু উপায় কি! একে তো হিন্দু হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি, তারপর রাজবন্দি, কাজ কেউই দিবে না। একটা বাচ্চা আছে। বন্ধু-বান্ধব সাহায্য করে কিছু কিছু, তাতেই চালাইয়া নিতে হয়। গ্রামের বাড়িতে থাকার উপায় নাই’। মৈত্র কথাগুলি হাসতে হাসতে বললেন। মনে হলো তাঁর মুখ দেখে এ হাসি বড় দুঃখের হাসি।
সন্ধ্যায় তালা বন্ধ করার সময় বাইরের দরজাটা একটু খুলেছিল, তাই দেখা হয়ে গেল হঠাত। আবার বললাম, ‘পাবনা যাবেন বোধহয়। বন্ধু মোশতাককে পাবনায় জেনে নেওয়া হয়েছিল। বোধহয় সেখানেই আছে, কেমন আছে জানি না। তাকে খবর দিতে বলবেন’।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বোধহয় দুই তিন মিনিট হবে। এক জেলে থেকেও আমরা রাজনৈতিক বন্দি বলে একে অন্যের সাথে দেখা বা কথা বলতে পারি না। আমার সাথে তো কাহাকেও কথা বলতে দেয় না।
খবরের কাগজ এসেছে অনেক বেলায়। কোনো সংবাদই নাই। তবে আতাউর রহমান সাহেবের একটি বিবৃতি আছে খাদ্য সমস্যার উপর মোনায়েম খাঁ সাহেব সরকারি প্রেস নোটের প্রতিবাদ করে। ঘরে ঘরে বিবৃতি দিয়ে চাউলের দাম কমানো যায় না। সক্রিয় কর্মপন্থা দরকার। সে সাহস জনাবদের নাই। বিবৃতি ও বক্তৃতা দিয়েই নেতা হয়ে থাকতে চান আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক রাজনীতিবিদ।

Next