This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
মুক্তির সংগ্রামে বাংলা
আসাদুজ্জামান আসাদ
প্রথম অধ্যায় সংগ্রামের পটভূমি
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে ১৮৫৪ সালে গঠিত হয় বাংলা প্রেসিডেন্সি। পরবর্তীকালে ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি এই মর্মে রিপাের্ট প্রদান করে যে বাংলার বিশাল সীমানা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে দুর্ভিক্ষ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। দুর্ভিক্ষ অনুসন্ধান কমিটি বাংলার বিদ্রোহ সম্পর্কেও কতকগুলাে সুপারিশ করে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী বাংলা প্রেসিডেন্সির আয়তন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে। ১৮৭৪ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে আসাম প্রদেশকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল সিলেট, গােয়ালপাড়া, কাছাড় প্রভৃতি অঞ্চলকে কেটে আসামের অঙ্গীভূত করে তা একজন কমিশনারের ওপর ন্যস্ত করা হয়। সেই হিল বঙ্গভঙ্গের প্রথম সূত্রপাত। | বাংলা থেকে আসামকে বিচ্ছিন্ন করা সত্ত্বেও তার প্রশাসনিক সমস্যার সমাধান হলাে । উনিশ শতকের শেষের দিকে চট্টগ্রাম বিভাগকে বাংলা প্রেসিডেন্সির সঙ্গে রাখা হবে,
আসামের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হবে তা নিয়ে মতবিরােধ শুরু হয়। এই সময়ে (১৮৯৮) লর্ড কার্জন ভারতে বড়লাট নিযুক্ত হয়ে আসেন। এদেশে আসার পূর্বে তিনি ভারত উপমহাদেশ সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নিয়ে আসেন। কার্জনের শাসনামলের সর্বাপেক্ষা বিতর্কিত বিষয় ছিল বঙ্গভঙ্গ বা বাংলা বিভাগ যার মাধ্যমে বাঙ্গালীদের বিভক্ত করার অপচেষ্টা ছিল।
ভারতে যে সকল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তার অগ্রভাগে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাঙ্গালী জাতি। বাঙ্গালীরা যখন জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হয়ে অগ্রসর হচ্ছিল তখনই
________________________________________
(১৯০৪) রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপান রাশিয়াকে পরাজিত করে। একটি ক্ষুদ্র দেশ কর্তৃক একটি বিশাল দেশের সেই পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবােধ এবং বিদেশী প্রভাব থেকে মুক্ত হবার একটা তীব্র আকাশ জেগে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই তা ভারতে জাতীয় আন্দোলনের ওপর একটা গভীর প্রভাব ফেলে। ঐসময় দক্ষিণ ।
আফ্রিকার কৃষ্ণকায়দের ওপর ইংরেজদের বৈষম্যবাদী নীতি ও চরম অত্যাচারের ঘটনা এই অঞ্চলের মানুষের মনে বৃটিশ বিদ্বেষকে আরাে বাড়িয়ে দিয়েছিল।
বঙ্গভঙ্গ প্রশ্নে লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা ছিল চরম প্রতিক্রিয়াশীল। কংগ্রেসের ভেতরে তখন উগ্র জাতীয়তাবাদী গােষ্ঠী এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তখন তিনি মনে করেন এই উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা ভারতে বৃটিশ শাসনের ক্ষেত্রে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অতএব এই আন্দোলনের প্রধান ঘাটি বাংলা অঞ্চলকে দুর্বল করতে হলে বিভক্তি নীতি প্রণয়ন করতে হবে।’এনড্রো জোর নামক একজন ইংরেজ বাংলা বিভাগের সুপারিশ পেশ করেন।
১৯০৩ সালে, এনড্রো ফ্লেজারের পরামর্শ অনুযায়ী লর্ড কার্জন চট্টগ্রাম বিভাগ এবং ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে একত্রিত করার প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আলােড়ন সৃষ্টি হয়। ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন দুই বাংলা পরিদর্শনে আসেন। এই সময় নবাব সলিমুল্লাহ এই অঞ্চলের মুসলমানদের জন্য একটা স্বতন্ত্র প্রদেশ দাবি করেন।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলার পূর্বাঞ্চল ও আসাম নিয়ে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ভারত সচিবের নিকট প্রেরণ করেন। ভারত সচিব ব্রডারিক তা অনুমােদন করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী আসাম, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিভাগ নিয়ে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠিত হয়। দার্জিলিংকে পূর্ব প্রদেশ থেকে বাদ রাখা হয় । কিন্তু জলপাইগুড়ি, ত্রিপুরা ও মালদহ সংযুক্ত করা হয়। নবগঠিত প্রদেশের জন্য ছােট লাট, ব্যবস্থাপক পরিষদ ও রাজৰ বাের্ডের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু বিচার বিভাগকে রাখা হয় কলিকাতা হাইকোর্টের অধীনে। পশ্চিম বাংলাকে পুরাতন বঙ্গদেশের অধীনে রাখা
| বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব প্রথম থেকেই মানুষের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিলাে। বিভিন্ন যুক্তি, প্রতিরােধ, প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। ‘বেঙ্গলী’ পত্রিকা বঙ্গভঙ্গকে মারাত্মক জাতীয় বিপর্যয়’ বলে আখ্যায়িত করে। এবং সরকারকে ভারতব্যাপী জাতীয় সংগ্রামের জন্য সতর্ক করে দেয়। নিখিল ভারত কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের বিরােধিতা করে সক্রিয় আন্দোলনে নামে। এই সংগঠন কোন সাম্প্রদায়িক সংগঠন ছিল না। বহু প্রতিবাদ-প্রতিরােধের মধ্য দিয়ে অবশেষে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনা কার্যকরী হয় এবং স্যার জেমস ফিন্ড পূর্ব বাংলার প্রথম ছােটলাট নিযুক্ত হয়ে আসেন।
________________________________________
স্বদেশী আন্দোলন ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের প্রতিবাদ প্রতিরােধ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায়নি। সেই আন্দোলন বৃটিশের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনকারীরা এ সময় ইংরেজদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বর্জনের আহবান জানায়। মতিলাল ঘােষ, কালীপ্রসন্ন কাব্য বিশারদ, সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ উক্ত ‘বর্জন’ আন্দোলনের পুরাভাগে ছিলেন। ১৯০৫ সালে খুলনার বাগেরহাটে এক জনসভায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে বয়কট প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয় যতদিন বঙ্গভঙ্গ রদ না হচ্ছে, ততদিন বাংলার মানুষ সকল বৃটিশ পণ্য বর্জন করবে। দিনাজপুরের এক জনসভায় “স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ঐ সিদ্ধান্তের মধ্যে ছিল বাংলার বিভিন্ন স্থানে জনসভা করে মানুষকে সচেতন করা ও এক বছর সময় ধরে জাতীয় শােক পালন করা।
১৯০৫ সালের জুলাই মাসে রিপন কলেজের এক অনুষ্ঠানে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রথম কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ছাত্ররা এই সমাবেশে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। যেসব ছাত্র ইতিপূর্বে বয়কট বা স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিল তারা এই সভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হাজার হাজার ছাত্র সংযুক্ত বাংলার দাবিতে শ্লোগান দেয়। পরবর্তীকালে এই স্বদেশী আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকা পালন করে ছাত্ররা। ছাত্রদের নেতৃত্বে সারা বাংলায় গড়ে ওঠে স্বদেশী আন্দোলনের সংগঠন। মূলত এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় তারাই। বাংলার সাধারণ মানুষ এই স্বদেশী আন্দোলনকারীদের শ্রদ্ধার চোখে দেখতে জ করে। | বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাঙালী জাতিকে এক গভীর জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সহ প্রখ্যাত লেখকবৃন্দ সেই সময় বহু স্বদেশী সাহিত্য রচনা করেন। স্বদেশী আন্দোলনের প্রেরণায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি”। স্বদেশীদের ডাকে সবাই ইংরেজ সাহেবী পােশাক পরিত্যাগ করে দেশী কাপড় পরতে রু করেন। এই আন্দোলনে কোন বিভেদ ছিল না। মুসলমান নেতাদের মধ্যে ব্যারিষ্টার আঃ রসুল, খান বাহাদুর মােঃ ইউসুফ, আব্দুল হালিম গজনবী, লিয়াকত হােসেন, মােহাঃ ইসমাইল প্রমুখ নেতা স্বদেশী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
স্বদেশী আন্দোলনের ফলে ভারতে দ্রুত শিল্পায়ন শুরু হয়। গড়ে ওঠে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই আন্দোলন কেবল বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পাঞ্জাব, বােম্বে, মাদ্রাজ প্রভৃতি অঞ্চলেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং ঐ অঞ্চলেও প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলন ক্রমেই সর্বভারতীয় আন্দোলনে রূপ নেয় এবং এক পর্যায়ে স্বরাজ আন্দোলনে পরিচিত হয়। এই আন্দোলনে ছাত্রদের ব্যাপক অংশগ্রহণ বৃটিশ শাসনকে
________________________________________
এক অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পৌছে দেয় এবং সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। এই স্বদেশী আন্দোলনই পরবর্তীকালে মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠে।
স্বদেশী আন্দোলন এক পর্যায়ে এসে সশস্ত্র সংগঠনে পরিণত হয় এবং এই সংগঠনের সক্রিয় কর্মীরা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুরু করে। সমগ্র দেশে শত শত শাখা গড়ে তােলা হয়। সংগঠনের কর্মীদের এসময় থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হয়। পাশাপাশি শুরু হয় সরকারী দমন নীতি । স্বদেশী আন্দোলনের অজুহাতে চরম শাস্তি দেয়া হতাে। স্বীকারােক্তি আদায়ের নামে করা হতাে অমানবিক নির্যাতন। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, অরবিন্দ ঘােষ, প্রীতিলতা প্রমুখ দেশপ্রেমিক স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
বঙ্গভঙ্গ রদের ঘােষণা ১৯১০ সালে লর্ড মিন্টোর কার্যকাল শেষ হলে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতের বড়লাট নিযুক্ত হয়ে আসেন এবং ঘােষণা করেন যে ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে বৃটিশ সম্রাট ভারত সফরে আসবেন এবং নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনায় বসবেন। এই আগমনের পূর্বে ভারত সচিব বঙ্গদেশ পুনর্গঠনের নতুন পরিকল্পনা করেন। ১২ ডিসেম্বর সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লিতে বঙ্গভঙ্গ রদের কথা ঘােষণা করেন। এর ফলে বাংলা ভাষাভাষী পাঁচটি বিভাগ নিয়ে বাংলাদেশ পুনর্গঠিত হলাে । বিহার ও উড়িষ্যাকে বঙ্গদেশ থেকে পৃথক করা হলাে। ১৯১২ সালের জানুয়ারী থেকে শুরু হােল নতুন ব্যবস্থা। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্যেবর্তী সময়ে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বীজ বপন হয় এবং শুরু হয় মুসলিম লীগের পেশাভিত্তিক রাজনীতি। লক্ষৌ প্যায়ে সংশ্লিষ্ট সব মহল এর স্বীকৃতি দান করে। এবং বিভিন্ন স্তরে ধর্মীয় সাম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নির্বাচনের আসন নির্দিষ্ট হয়।
লাহাের প্রস্তাব ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহােরে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ. কে. ফজলুল হক লাহাের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সভায় ঐ প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি জানানাে হয় । লাহাের প্রস্তাবে ভারতের পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলাে নিয়ে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি করা হয়।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর বড়লাট লিন লিথগাে বৃটেনের পক্ষে ভারতের যুদ্ধে যােগদানের কথা ঘােষণা করেন। কিন্তু কংগ্রেস ঐ ঘােষণার বিরােধিতা করে বলে তারা প্রদেশ থেকে তাদের মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করাতে রাজি নয়। পক্ষান্তরে জিন্নাহ যুদ্ধে বৃটেনকে সহযােগিতা করার ঘােষণা দেন এবং ২৭ মে পত্রিকায় তাঁর ঐ
________________________________________
ঘােষণার কথা প্রকাশিত হয়। কংগ্রেসের সঙ্গে এ ধরনের বিভিন্ন মতবিরােধের কারণে ১৯৩৯ সালে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্ব” ঘােষণা করেন। ১৯৪১ সালের আগষ্টে জিন্নাহ ও ফজলুল হকের মধ্যে চরম মতবিরােধ ঘটে, ফলে ফজলুল হক মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করেন। | ১৯৪২ সালে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল তার মন্ত্রিসভার সদস্য ক্রিপসকে দিল্লি পাঠান। তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে আলােচনা করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে কারাে কাছেই তার প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য হয়নি। কংগ্রেস অখন্ড ভারত নীতিতে অটল থাকে। অন্যদিকে মুসলিম লীগ লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়নের দাবি জানায়। ১৯৪২ সালের ৮ আগষ্ট থেকে শুরু হয় ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। ১৯৪০ সালের সেন্টম্বরে শুরু হয় গান্ধী-জিন্নাহ আলােচনা কিন্তু তারাও কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হন। লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তান হতাে একটি স্বাধীন সার্বভেীর রাষ্ট্র । কিন্তু পরবর্তীকালে বাস্তবে তা হয়নি।
রেনেসা সংক্রান্ত দলিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমেদ, মুজিবুর রহমান খা, হাবিবুল্লাহ বাহার, তালেবুর রহমান, আব্দুল হক, ফররুখ আহমেদ প্রমুখ ব্যক্তি তাদের রচনায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে আলােচনা করেন। আবুল মনসুর আহমেদ এ প্রসঙ্গে একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ লেখেন।
১৯৪৩ সালে লিখিত ও মাসিক মােহাম্মদী তে প্রকাশিত “পূর্ব পাকিস্তানের জবান” শীর্ষক এই প্রবন্ধে তিনি উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও জাতীয় ভাষারূপে চাপিয়ে দেবার বিপদ ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বলেন, “চার কোটি বাংলাভাষী জনগণ হাজার বছরেও উর্দুভাষী হবে না। এর ফলে কেবল একটি অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হবে যাদের সংগে সাধারণ মানুষের কোন সংযােগ থাকবে না। এই সম্প্রদায় পশ্চিমাদের সুরে কেবল উর্দুর মহত্ত্ব গেয়ে যাবেন। এরা হবেন পশ্চিমাদের আত্মীয় এবং এদেশের এ্যাংলাে ইন্ডিয়ান শাসক শ্রেণী। শাসক শ্রেণীর ভাষা থেকে সাধারণের ভাষা পৃথক থাকার এক সুবিধে আছে। তা হলাে তাতে কখনাে প্রকৃত গণতন্ত্রের পথ সুগম হয় না। সুতরাং পূর্ব পকিস্তানে রাজনৈতিক মতলবে এ অভিজাত শ্রেণীকে বাংলার ঘাড়ে চাপিয়ে রাখা যাবে কিন্তু বাংলাকে যদি পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যায় তবে শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজেরাই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্পায়নে হাত দিতে পারবে। আমাদের নিজস্ব বুদ্ধি ও প্রতিভা দিয়ে আমাদের জনসাধারণকে উন্নত জাতিতে পরিণত করব।”
“পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা কি হবে তা নিয়ে আজো এরা সােজাসুজি আলােচনা করেনি। মাতৃভাষা উর্দু হবে না বাংলা হবে তা নিয়ে খুব জোরেসােরেই একবার তর্ক উঠেছিল।
মুক্তি সংগ্রামে বাংলা ২
________________________________________
বাংলার শক্তিশালী নেতৃবৃন্দের মধ্যে সােহরাওয়ার্দী সহ অনেকেই উর্দুকে বাঙালীর মাতৃভাষা করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। পক্ষান্তরে বাংলার আলেম সমাজ সেই অপচেষ্টায় বাধা দিয়েছিলেন। মওলানা আকরাম খাঁর নেতৃত্বে অনেকেই উর্দুর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। বাংলার উপর উর্দুকে চাপাবার চেষ্টা তখনকার মত ব্যর্থ হয়।” আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, * আবার উর্দুওয়ালারা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। মনিং নিউজ ও চার অব ইন্ডিয়া এ বিষয়ে কলম ধরেছে এবং কয়েকজন লেখকও সেখানে জুটেছেন। তারা বলছেন পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা স্বাভাবিকভাবেই উদ্হবে।”
ভারতের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে বিজনদের আলােচনা সভায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা যায় কিনা এ নিয়ে আলােচনা করা হয়। ঐ আলােচনা সভার বিবরণ বাংলা ১৩৪৫ সনের ফান সংখ্যায় প্রবাসী’তে প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ভবনে এক আলােচনা সভায় পন্ডিত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, অৰ্ধিন্দু কুমার, উপেন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্রোপাধ্যায় প্রমুখ আলােচনায় যােদান করেন। সেই সভায় কতিপয় প্রস্তাব। গৃহীত হয় এবং বাংলা ভাষার প্রচারের জন্য নিম্নলিখিত উপায় অবলম্বন করার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়।
(১) বিশেষ প্রয়ােজন ভিন্ন বাঙালী মাত্রই বাংলা ভাষার ব্যবহার করবে, (২) বাংলাদেশে বিদেশী বা অন্যান্য ভাষাভাষী ব্যক্তিদের সঙ্গে যতদূর সম্ভব বাংলা ভাষায় কথা বলতে হবে, (৩) অবাঙালী ও বাংলার বাইরে বাংলা সাহিত্যের প্রচার বৃদ্ধি করতে হবে, (৪) বাংলা সাহিত্যের সম্পদ ও সমৃদ্ধির কথা মনে রেখে বঙ্গ ভাষাকেই রাষ্ট্রীয় ভাষারূপে নির্ধারণ করতে হবে, (৫) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদসহ সকল সাহিত্য পরিষদকে এ বিষয়ে একযােগে কার্য পরিচালনা করতে হবে।
ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যয় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, সাহিত্যের গৌরব থাকলেই ভাষার প্রসার হয় না। ইংরেজ জাতির আত্মপ্রসারের শক্তির ফলে ইংরেজির প্রসার ঘটেছে।
বাংলার স্বতন্ত্র ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ, “জাতির চিন্তারাজ্যে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন সাধনের নাম রেনেসা। অতীতের যা ভাল ও স্থায়ী তাই রেনেসাঁর ভিত্তিভূমি। অতীতের ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে বর্তমানের রেনেসা আগামীকে বরণ করে। তাই রেনেসাঁ চিন্তারাজ্যের বিপ্লব। আমরা চাই পূর্ব পাকিস্তান অধিবাসীর চিন্তারাজ্যের পরিবর্তন। তাই আমাদের সংগঠনের নাম পুর্ব পকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটি। পলাশীর বিপর্যয়ের পর ভারতের এই অঞ্চলের অধিবাসীদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এযাবৎ ভুল পথেই চালিত হয়েছে। পরের দেখানাে পথে আজাদী মেলে না। আমরা ভুল পথে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিলাম। অতীতের ভুল ও ব্যর্থতা জাতিকে দিয়েছে নতুন করে সত্যিকার পথের সন্ধান। নিজস্ব সাহিত্যের ধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে আমরা কিছুদিন বিজাতীয় উর্দুর মােহে কাটিয়েছি। পূর্ব পকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটি আমাদের সাহিত্যের স্বকীয়তা ফিরিয়ে
________________________________________
আনতে চায়। তমুন, শিক্ষা, ইতিহাস, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা তাদের বৈশিষ্ট্য খুঁজে বের করতে চায়। আমরা আর আত্মবিস্মৃত জাতি হয়ে থাকতে চাই না। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা। রেনেসাঁ সােনার কাঠির স্পর্শে জাতির সকল বন্ধ্যাত্বকে ঘুচাবে।”
স্বাধীন বাংলার প্রশ্নে লেখা সম্পাদকীয় ভারতবর্ষকে পরাধীনতার শৃখলে আবদ্ধ রাখতে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ সরকার কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্ট সৃষ্টি করে। বৃটিশের এদেশে আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষ যখনই কোন সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অধীনে এসেছে তখনই কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের লৌহনিগড় ভারতবর্ষের সকল দেশকে শূলে আবদ্ধ করেছে। কিন্তু ভারতের অন্যান্য সকল দেশকে শুখলাবদ্ধ করলেও অতীতে একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শত চেষ্টা করেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে পারেনি। আর্যসাম্রাজ্য মিথিলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করলেও বাংলাদেশকে তাদের অঙ্গীভূত করতে পারেনি। এমন কি মহাপরাক্রমশালী সম্রাট অশােক, কনিক, সমুদ্রগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য তারাও বাংলাদেশকে তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেনি। গুও আমল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা কোন বিদেশীর স্পর্শে কলুষিত হয়নি।
পাল ও সেন বংশের স্বাধীন রাজাদের শাসনকালেও বাংলা সমগ্র ভারত হতে আলাদা থেকে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রেখেছিল। মােহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বাংলা বিজয়ের আগ পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস বলতে স্বাধীন বাংলার ইতিহাসই বােঝায়। পরবর্তীকালে বিদেশী মুসলমান নৃপতিগণ বাংলাদেশ দখল করে কালক্রমে তাকে যখন নিজের দেশ বলে মেনে নিল তখন শুরু হলাে দিল্লির কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের বন্ধন থেকে মুক্তির সংগ্রাম। দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দীনের মৃত্যুর পরই গৌড়ের শাসকরা দিল্লির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করতে থাকেন। সুলতান আলতামাস দিল্লির সিংহাসনে আরােহন করার পর বিদ্রোহী বাংলাকে পুনরায় শৃঙ্খলিত করলেন ঠিকই কিন্তু গিয়াসউদ্দিন বলবনের আমলে কেন্দ্রীয় গভর্নমেন্টের নিগড় ভেঙ্গে তুঘরিল খা আবার বাংলার স্বাধীন পতাকা উড়ালেন।
সেই থেকে শুরু হলাে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সংগ্রাম। পরবর্তীকালে পাঠানও মােঘল আমলের শেষ পর্যন্ত তা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রইল । ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানী বলেছেন, বাংলার অধিবাসীদের বিদ্রোহী হবার একটা মজ্জাগত স্পৃহা আছে”। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়া সত্যিই বাঙালী চরিত্রের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। বাংলার স্বাধীনতা অব্যাহত রাখতে বারবার যে লড়াই হয়েছে সেই ইতিহাসই বাংলার প্রকৃত ইতিহাস। দিল্লির সাম্রাজ্যকে কোনদিনই বাংলা বরদাস্ত করতে পারেনি। পাশাপাশি বাংলার স্বাধীনতাকেও দিল্লির কোন সম্রাট সহজে
মানতে পারেনি। সে কারণে চিরদিন দিল্লি ও বাংলার মধ্যে একটা আপােসহীন লড়াই চলেছে। সেই লড়াইয়ে কখনাে কখনাে বাংলা দিল্লির শাসনে বাধা পড়েছে, আবার কখনাে কখনাে দিল্লিকে পরাজিত করে তার স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে স্বীয় পতাকা উড়িয়েছে। দিল্লি ও বাংলার মধ্যে বারবার পদানত করা আর স্বাধীন সত্তা সমুন্নত রাখার সংগ্রাম অব্যাহত থেকেছে।
সমগ্র ভারত থেকে নিজের স্বাতন্যকে অক্ষুন্ন রাখার একটা ঐতিহ্য বাংলার রয়েছে। সেই অহংকার বা অনুভূতিই সমগ্র বিশ্বে একটা গৌরবময় আসন প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাঙালীরা সেই ট্রাডিশনের প্রেরণাতেই স্বাধীন সার্বােেম রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাধারা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। ভারত থেকে বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সকল বন্ধন ছিন্ন করে বাংলাদেশ তার সত্তাকে বিশ্বের নিকট উচু করে তুলে ধরতে উন্মুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু একশ্রেণীর দেশদ্রোহী ব্যক্তির স্বার্থবাদী ভূমিকা বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করার চক্রান্তকে অব্যাহত রাখে।
বাঙালীদের প্রতি বৈষম্য ও বিদ্বেষের কথা, আসাম ও বিহারের বাঙালীদের প্রতি অত্যাচার ও অবিচারের কথা, অবাঙালী কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে বাংলার সম্পদ শােষণের কথা, নিখিল ভারত কংগ্রেসের রাজনীতিতে তাদের অবহেলার কথা-সবই এইসব ষড়যন্ত্রকারীদের জানা আছে। তা সত্ত্বেও এরা ব্যক্তিস্বার্থে বিদেশেীদের প্রেরণায় বাংলার একটি অংশকে পুনরায় বিদেশী উপনিবেশে রূপান্তরের জন্য পাগল হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে সপ্তাহিক মিল্লাত’ পত্রিকা এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ৯ মে ‘৪৭-এ প্রকাশিত ঐ সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বাঙালী হয়েও আজ যারা দেশকে বিভক্ত করার পক্ষে বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বিদেশীদের হয়ে মাঠে নেমেছে তাদের প্রতি প্রশ্ন, বাঙালীর রক্ত শােষণ করে যারা বিত্ত গড়েছে তারা হঠাৎ করে এমন পরােপকারী হয়ে ওঠার কারণ কি? এই কেন’র মধ্যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সকল রহস্য। সব কিছু জেনেনে বাংলার ঐতিহ্যকে পদদলিত করে ভারতের তাবেদাররূপে বাংলার একটি অংশকে বেঁধে রাখার জন্য যে স্বার্থবাদী বাঙালীরা আজ ক্ষেপে উঠেছে তাদের ক্ষ্যাপামির ফলে বাঙালীর জীবনে যে ভয়াবহ অভিশাপ দেখা দেবে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষেরা রক্ত দিয়ে অনুভব করবে।
পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই মুসলিম লীগের দুটি অংশ কাজ করতে থাকে। একটি অংশের নেতৃত্ব দেন খাজা শাহাবুদ্দিন ও খাজা নাজিমুদ্দিন এবং অন্য অংশের নেতৃত্ব দেন আবুল হাশিম ও শহীদ সােহরাওয়ার্দী। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল। আবুল হাশিম ও সােহরাওয়ার্দী সমর্থক। পরবর্তীকালে এই সংগঠন থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগের বহু কর্মী ও নেতৃত্ব জন্ম নেয়।
________________________________________
১৯৪৭ সালে পূর্ব পকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তাদের কর্মসূচী ঘােষণা করে। কর্মসূচীর মধ্যে উল্লেখযোেগ্য বিষয় ছিল-(১) পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্নমুখী প্রতিভা সৃষ্টির উপযােগী পরিবেশ তৈরি করা, (২) কারিগরি তথা ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি শিক্ষার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহিত করা, (৩) পাকিস্তানকে বহিঃশক্তিকবলমুক্ত রাখা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, (৪) স্বার্থবাদী মহলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তােলা, (৫) নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করা, (৬) সাম্প্রদায়িক সপ্রীতি রক্ষা করা, (৭) জনসংখ্যার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের দাবিদাওয়া নিশ্চিত করা, (৮) দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও মুনাফাখােরদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তােলা। এই ছাত্রলীগ তাদের কর্মসূচীর সঙ্গে কতিপয় দাবি পেশ করে
(১) শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্য পুস্তকের পরিবর্তন, (২) অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন, (৩) বিনা ব্যয়ে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা, (৪) নৌ সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তর, (৫) বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষার জন্য ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলােতে অধিক সরকারি সাহায্য, (৬) গরীব ও মেধাবী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদান করা, (৭) নারী শিক্ষা প্রসারে উপযুক্ত ব্যবস্থা, (পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান ও পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা।
পাকিস্তান মদুন মজলিস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি অংশের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর তমুদুন মজলিস” প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার মাধ্যমে সংস্কৃতির চর্চা করা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষার পক্ষে এই সংগঠনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে এই সংগঠনের একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। পুস্তিকায় বলা হয়, বাংলা ভাষাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম। অফিস-আদালতের ভাষা ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দুটি-যথাক্রমে ইংরেজি ও বাংলা। বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা-বিজ্ঞানের ভাষা। এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শিক্ষালাভ করবে। উর্দু হবে দ্বিতীয় ভাষা। যারা পশ্চিম পাকিস্তানে চাকরি করবে কেবল তারাই এ ভাষা শিক্ষা লাভ করবে। কেবল উচ্চতর শ্রেণীতে এই ভাষা শিক্ষা দেয়া হবে। ইংরেজি হবে দেশের তৃতীয় ভাষা। পাকিস্তানের কর্মচারী হিসাবে যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কিংবা উচ্চতর বিজ্ঞান শিক্ষায় নিয়ােজিত হবে কেবল তারাই এ ভাষা শিক্ষা নেবে। ঠিক এইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু, দ্বিতীয় বাংলা ও তৃতীয় ইংরেজি।
মুসলিম ছাত্রলীগের আহবান আজিজ আহমেদ, আব্দুল ওয়াদুদ, নুরুল কবীর ও কাজী গােলাম মাহবুব স্বাক্ষরিত ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত অপর এক প্রচারপত্রে সকল ছাত্র-ছাত্রীকে পূর্ব
________________________________________
পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগে যােগদানের জন্যে আহবান জানানাে হয়। এতে বলা হয় যে প্রত্যেক পরাধীন জাতির মুক্তির সগ্রামে ছাত্ররা এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ঠিক তেমনি পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও ছাত্র সমাজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ন। স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে একটি জাতির নতুন ইতিহাস গড়ে ওঠে যার অংশীদার হয় প্রতিটি নাগরিক। কিন্তু আজ আমরা দেখছি সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা। একটি রাষ্ট্র গঠন করা যত না কঠিন তার চেয়েও কঠিন ঐ রাষ্ট্রকে দৃঢ় ভিত্তিতে গড়ে তােলা। তাই সব সমস্যা সমাধানের পথ হচ্ছে শক্তিশালী সংগঠন।
পূর্ব পাকিস্তানের গােটা শিক্ষা ব্যবস্থা আজ ধ্বংসের মুখে। সকল ক্ষেত্রে সমস্যা বিরাজ করছে কিন্তু তা সমাধানের কোন পদক্ষেপ নেই। বরং শিক্ষা সংকোচনের তােড়জোড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছাত্রসমাজের দাবিদাওয়া আদায়ের ভার গ্রহণ করেছে। কাজেই সকলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পতাকাতলে সমবেত হয়ে দাবি আদায়ে একযােগে সােচ্চার হয়ে উঠুন। প্রচারপত্রে ১০ ডিসেম্বর বেলা দু’টায় ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে ছাত্রলীগের নিজস্ব অফিসে ঢাকা সিটি কমিটি নির্বাচনে সবাইকে হাজির হবার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়।
নওবেলাল পত্রিকার ভূমিকা ১৯৪৮ সালে ঢাকা থেকে কোন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতাে না। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কয়েকটি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতাে। সিলেট থেকে প্রকাশিত নওবেলাল” এ সময় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি ও বাংলা ভাষার পক্ষে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেছিল।
৪ মার্চ ‘৪৮ সালে প্রকাশিত সংখ্যায় নওবেলাল এক বলিষ্ঠ সম্পাদকীয় লিখে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, পাকিস্তান লাভের আগে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধারণা ছিল যে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, তমুদুন সবকিছুই অক্ষুন্ন থাকবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশের বাসিন্দাদের অধিকাংশ মুসলমান হওয়া ছাড়া তাদের ভাষাগত দিক সহ বিভিন্ন বিষয়ে যে পার্থক্য রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এক্ষেত্রে যদি এক অঞ্চলের ভাষা ও কৃষ্টি অন্য অঞ্চলের ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয় তাহলে ঐ অঞ্চলের ভাষাগত মর্যাদার ওপর অবিচার করা হবে। | বৃটিশ সরকারের সঙ্গে নব পাকিস্তান সরকারের তুলনা করে বলা হয়, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের আমলেও কারেন্সি নােটে বাংলা ভাষার স্থান ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার এক নিমিষেই তা তুলে ফেললাে। এই সরকার মনি অর্ডার ফরম, ডাকটিকেট, পােস্টকার্ড প্রভৃতি থেকেও বাংলার অস্তিত্ব মুছে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের উক্তি প্রসঙ্গে পত্রিকাটি বলে,জনাব লিয়াকত আলী খান যে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন তাতে
________________________________________
মর্মাহত হওয়ার কারণ ঘটেছে। তিনি বলেছেন পাকিস্তান যেহেতু একটি মুসলিম রাষ্ট্র তাই এদেশের ভাষা হবে উর্দু। তার এই অপরিণামদর্শী আচরণ অত্যন্ত দুঃখজনক। এইসব ঘােষণার প্রতিক্রিয়া ও পরিণাম যে কি ভয়াবহ হতে পারে সে বিষয়ে জনাব লিয়াকত আলী খানকে ভেবে দেখার অনুরােধ করি।”
খাজা নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের সমালােচনা করে পত্রিকাটি লেখে-পূর্ব পাকিস্তানের জনমতের উল্লেখ করতে গিয়ে জনাব নাজিমুদ্দিন ও তমিজউদ্দিন খান যেসব অসমীচীন উক্তি করে যাচ্ছেন তাতে নিশ্চয় একদিন তাদের পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের নিকট জবাবদিহির জন্য দাড়াতে হবে। খাজা সাহেবরা তাদের পারিবারিক ভাষা যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্ট করছেন তাতে কেবল এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছে।
পত্রিকাটি গণপরিষদে মুসলিম লীগ সদস্যদের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করে, “আপনারা মাতৃভাষার মূলে যেভাবে কুঠারাঘাত করছেন তাতে কি একবারও ভেবে দেখেছেন যে এর মাধ্যমে একটি জাতির আশা-আকাশ সুখ-দুঃখ ধুলায় মিলিয়ে দেয়া হয়েছে? প্রলােভনে পড়ে আজ আপনারা আপনাদেরই অস্তিত্ব বিলােপে শরীক হয়েছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি মানুষ কিছুতেই আপনাদের ক্ষমা করবে না। মাতৃভাষার অপমান কোনমতেই তারা সহ্য করে নেবে না একথা জেনে রাখুন । ইতিমধ্যেই এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করছে। বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে। এই গণবিক্ষোভ যখন বিস্ফোরণে পরিণত হবে তখন আপনাদের আসনও ভেঙ্গে যাবে।”
পত্রিকাটি সবশেষে মন্তব্য করে যে, পকিস্তানের সংহতি, ঐক্য ও শান্তির স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করা হােক। তা না হলে ঐ অঞ্চলের মানুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হবে যে বাঙালীদের উপর পাকিস্তানীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য একে একে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
৪৮ সালের হরতাল প্রসঙ্গে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে ছাত্রদের আহূত হরতাল সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান সরকার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বলে, বাংলাকে কেন্দ্রের সরকারি ভাষা না করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আহুত ধর্মঘট কার্যকর করার জন্য ঢাকাতে কিছু সংখ্যক * ছাত্র নামক আন্তর্ঘাতক” বিশৃখলার সৃষ্টি করে। শহরের মুসলিম এলাকা ও মুসলিম ব্যবসায়ীরা তাতে যােগ দিতে অস্বীকার করে। শুধুমাত্র হিন্দু এলাকা ও হিন্দু ব্যবসায়ীরা কিছু কিছু দোকনপাট বন্ধ রাখে। অফিস-আদালতে কাজকর্ম স্বাভাবিক ছিল। পিকেটাররা রমনা, সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট সহ কয়েকটি স্থানে সমবেত হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ
________________________________________
আক্রমণাত্মক হয়ে পুলিশ ও অফিসে বােগদানকরীদের ওপর হিংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু করে। ফলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ ৬৫ জনকে গ্রেফতার করে। ১৪ জন আহত হয় পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে দেখা যাচ্ছে যে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষ্যে পাকিস্তানকে খর্ব করার জন্য এক গজর ষড়যন্ত্র চলছে।
s
প্রাদেশিক সভায় মওলানা ভাসানী ১৭ মার্চ ‘৪৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে মওলানা ভাসানী স্পীকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখানে যারা সদস্য তারা সবাই স্বীকার করেন যে এটা বাংলা ভাষাভাষীর দেশ, এখানে যারা সদস্য তারাও বাঙালী, কাজেই এ এ্যাসেম্বলীর যিনি শীকার তিনিও বাংলাতে বলবেন এটাই আমার আশা করি। আপনি কি বলেন তা আমরা কিছুই বুঝতে পারি না। আপনাদের বক্তব্যের সঙ্গে সদস্যদের কোন সংস্রব থাকে না। আপনি যদি বাংলায় রুলিং না দেন তাহলে আমরা কিভাবে আলােচনায় শরিক হব। আমি আশা করি আপনি বাংলায় কুলিং দেবেন ও অন্যান্য সকলেও বাংলায় বলবেন। | ১৯ মার্চবাজেট বিতর্কে অংশ নিয়ে ভাসানী বলেন, বৃটিশের শশাষণ ও শাসন থেকে মুক্তিলাভ করে পূর্ববঙ্গের মানুষ আশা করেছিল স্বাধীন রাষ্ট্রে মুক্তভাবে তারা জীবিকা নির্বাহ ও মতামত ব্যক্ত করবে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক উন্নতি লাতে সক্ষম হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অর্থসচিব যে বাজেট পেশ করেছেন তা জনসাধারণের প্রতিনিধি: হিসেবে করেননি। গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে তা করেছেন। এই বাজেটে জনসাধারণের দুঃখ-বেদনার কথা মােটেও প্রতিফলিত হয়নি। পেশকৃত বাজেটে ধনী ও আমলাদের ভােগবিলাসের সকল ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের মেরুদন্ড কৃষক-মজুর যারা দিনরাত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে রাজৰ যােগায় তাদের কথা বাজেটের কোথাও নেই। শতকরা ৪ জন যারা শহরে বাস করে তাদের স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে। শতকা ১৬ ভাগ যারা গ্রামে বাস করে এই বাজেটে তাদের জন্য কোন ব্যবস্থাই রাখা হয়নি যুগে পুলিশ খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি দুই লাখ টাকা আর বর্তমান বাজেটে এই খাতে কেবল পূর্ব বঙ্গের জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। পুলিশের ব্যয় বৃদ্ধি করে স্বাধীন পাকিস্তানকে রক্ষা করার চেষ্টা অত্যন্ত লজ্জাকর। যারা পূর্ব পাকিস্তান অর্জন করেছে কেবল তারাই দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
ভাসানী বলেন, দেশের সব উন্নতি নির্ভর করে শিক্ষার উপর। অথচ সেই শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে মাত্র দুই কোটি টাকা। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করলে দেশের এক কোটি লােক বেকার হয়ে যাবে বলে অর্থ-সচিব যে মন্তব্য করেছেন তা অস্পষ্ট। কেননা পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি মানুষের মধ্যে শতকরা ৯৫ জন কৃষক। জমিদারী উচ্ছেদ করলে এক কোটি লােক কিভাবে মারা যায়? কৃষকের ওপর লাখ টাকা জুট লাইসেন্স ফি ধার্য করা হয়েছে অথচ জমিদারদের কাছে ২ কোটি টাকা বাকি রয়েছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট
________________________________________
সারাদিন ঘুমিয়ে কাটান আর সন্ধ্যায় জেগে কেবল দস্তখত করেন। সামান্য ঋণের দায়ে গরীব কৃষকের ঘরবাড়ি নিলামে তােলার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় কিন্তু জমিদার-জোতদারদের কাছে পাওনা কোটি কোটি টাকা আদায়ের জন্য কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই হাউজেই অনেক মন্ত্রী ও সচিবের নিকট লাখ লাখ টাকা বাকি আছে। স্বয়ং অর্থ সচিব হামিদুল হকের নিকট “সেস” বাকি আছে। মন্ত্রীবৃন্দ যদি কৃষকদের মেরে মন্ত্রিত্ব করতে চান তাহলে তারা আর পদে থাকতে পারবেন না। | দেশে আজ বৃটিশের শাসন নেই। স্বাধীন পাকিস্তানের সকলের সমান অধিকার এই দাবির ভিত্তিতেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। প্রত্যেক মানুষেরই অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ঔষধ দান, শিক্ষার ব্যবস্থা করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। দেশের প্রধানমন্ত্রী আলহাজ্ব তিনি নিশ্চয়ই মদের ডিপাে, গাঁজার দোকান, বেশ্যাবৃত্তি সহ সকল দুর্নীতিমূলক ব্যবস্থা তুলে দেবেন এবং জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করবেন। এদেশের মানুষ বৃটিশের গােলামী করেনি, বর্তমান সরকারের কোন গণবিরােধী নীতিও মেনে নেবে না।
| একটি রাজনৈতিক মুক্তি “রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও খাজা নাজিমুদ্দিনের মধ্যে ভাষা ও রাজনৈতিক সুযােগদান সংক্রান্ত এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৫ মার্চ ‘৪৮-এ স্বাক্ষরিত চুক্তি বিবরণ নিম্নরূপ-(১) বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাদেরকে আটক করা হয়েছে তাদের মুক্তি দেয়া হবে, (২) পুলিশের অত্যাচার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী নিজে তদন্ত করে একে মাসের মধ্যে বিবৃতি দেবেন, (৩) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করে গণপরিষদ কেন্দ্রীয় সরকারে ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে উর্দর সমমর্যাদা দানের জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে, (৪) প্রদেশের সরকারি ভাষা ইংরেজি স্কুলে বাংলাকে সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতি দেয়া হবে ও শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা, (৫) ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকরীদের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, (৬) সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে, (৭) ভাষা আন্দোলনের জন্য জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে, (৮) সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আলােচনা করে একথা নিঃসন্দেহে পাওয়া গিয়েছে যে এই আন্দোলন কোন দুশমনি দ্বারা পরিচালিত হয়নি। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক কামরুদ্দীন আহমেদ-এর খসড়াকৃত একটি স্মারকলিপি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর নিকট প্রদান করা হয়। ‘৪৮-এর ২৪ মার্চ প্রদত্ত ঐ স্মারকপত্রে বলা হয়, সংগ্রাম পরিষদ মনে করে যে ‘বাংলা’ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। কারণ বাংলা পাকিস্তানের দুই-তৃতীয়াংশের ভাষা এবং পকিস্তান জনগণের রাষ্ট্র হওয়ায় এই দাবি মেনে নেয়া উচিত।
আধুনিক যুগে বিভিন্ন দেশে একাধিক ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গৃহীত হয়েছে। দৃষ্টম্বরূপ কয়েকটি দেশের নাম করা যায়-যেমন ।। (১) বেলজিয়াম (ফ্লেমিং ও ফরাসী), (২) কানাডা (ইংরেজী ও ফরাসী), (৩) সুইজারল্যান্ড (ফরাসী জার্মানী ও ইটালী), (৪) দক্ষিণ আফ্রিকা (ইংরেজি ও আফ্রিকান), (৫) মিসর (ফরাসী ও আরবী)।
________________________________________
এই ডােমিনিয়নের মধ্যে বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবার জন্য উপযুক্ত। কেননা এই ভাষা পৃথিবীর মধ্যে সপ্তম স্থান দখল করেছে। আলাওল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, কায়কোবাদ, এমদাদ আলী, ওয়াজেদ আলী, জসীম উদ্দীন সহ অনেকেই তাদের সৃষ্টি দিয়ে এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাংলার সুলতান হুসেন শাহ এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। কাজেই মৌলিক অধিকারের এই দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যহত থাকবে।
পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৫দিন পর ‘৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে যারা স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় অগ্রভাগে ছিলেন সেইসব যুবকদের সমন্বয়ে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ গঠিত হয়। পাকিস্তানকে সুখী সমৃদ্ধিশালী আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার সংকয়ে সভায় উপস্থিত সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করে। এই সংগঠনের কর্মীরা পাকিস্তানকে বৃটিশ কমনওয়েলথ-এর বাইরে এসে জনগণের সহযােগিতায় দেশ গড়ার দাবি জানায়। অল্পদিনের মধ্যেই সারা দেশে এই সংগঠনের শাখা গড়ে ওঠে এবং গণমানুষের স্বার্থ ও তাদের দাবিদাওয়া আদায়ে সােঞ্চার হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের তীব্র পুলিশী নির্যাতন ও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের অত্যাচারের ফলে প্রতিষ্ঠার মাত্র এক বছরের মধ্যেই ১৯৪৮ সালের শেষদিকে এসে এই সংগঠনের বিলুপ্তি ঘটে।
১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে মােহাম্মদ একরামুল হক স্বাক্ষরিত একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় । ঐ পুস্তিকায় যুব সমাজ দাবি করে যে ইতিপুর্বে তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ও খাদ্য সংকট সমাধানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেও তারা পুরােভাগে রয়েছে। ইতিমধ্যে পকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর গত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে দেশের সাত কোটি জনগণের জন্য যুব সমাজ যে অঙ্গীকার করেছিল তা কতটুকু পালিত হয়েছে সে বিষয় আজ খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। | পাকিস্তান বৃটিশ কমনওয়েলথ-এর বাইরে এসে আজও পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণা করেনি। গত এক বছরে পাকিস্তানে ব্যক্তি-স্বাধীনতার কবর হয়েছে। সভা-সমিতির অধিকার হরণ করা হয়েছে। বিনা বিচারে অনেককে গ্রেফতার করে আটক রাখা হয়েছে। সংবাদপত্রের কণ্ঠ রােধ করা হয়েছে। ‘অর্ডিন্যান্স’ নামক বিভীষিকা দেশের সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। ফলে কারখানায় লাখ লাখ লােক ছাটাই হচ্ছে। দেশব্যাপী খাদ্য সংকট তীব্র। মধ্যবিত্তর সংকট মারাত্মক আকার ধাশ করেছে। যে আশা-আকাবা নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল তা ধূলিসাৎ হয়েছে। সুখ-শান্তি ও গণতন্ত্রের পরিবর্তে নতুন দাসত্বের শৃখলে মানুষ বন্দী হয়েছে।
সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করে কতিপয় ব্যক্তি নিজেদের ভােগবিলাসে পাকিস্তানকে ব্যবহার করছে। সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থকে ইসলামের দোহাই দিয়ে রক্ষা করে
________________________________________
যাচ্ছে। সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রণীত হচ্ছে। যুব সমাজের সেই প্রতিভা মেশিনগানের সামনে রুদ্ধ হয়ে আছে। তাদের সব কার্যক্রমকে আজ দেশেদ্রোহিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। তবুও যুব সমাজ তাদের প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জনগণের সংগ্রামে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই জনতার পথ রােধ করার সাধ্য কারাে নেই। যুব সমাজ তাদের শক্তি ও জনগণের বিশ্বাস সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হবে। ১৯৪৭ সালে ঢাকায় গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠার এক বছর পরে রাজশাহীতে বিভাগীয় যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে যুব কর্মীরা নতুন করে শপথ গ্রহণ করে। কয়েকটি প্রস্তাবও সভায় গৃহীত হয়-(১) কৃষক-শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা, (২) জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করা, (৩) কলে-কারখানায় ছাঁটাই প্রতিহত করা, (৪) শিক্ষা ও চিকিৎসা সংকট থেকে দেশেকে রক্ষা করা, (৫) পূর্ণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা প্রভৃতি।
যুবলীগের এক ইশতেহারে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের ৭০০ যুবকর্মীর সহযােগিতায় যুবলীগ জন্মলাভ করে। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানকে একটি সুখী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই গড়ে তােলা। এ লক্ষ্যে একটি গণদাবির সনদ রচিত ও গৃহীত হয় এবং আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে সরকারকে সহযােগিতা করার সকল প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার এক বছর পরে আজ প্রশ্ন জেগেছে যে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা কতটুকু সফল হয়েছে। দেশ কি গণতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছে নাকি সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের জালে দেশবাসী জড়িয়ে পড়েছে। মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কমেছে না বেড়েছে।
স্বাধীনতার পরেও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরন ও বৃটিশ আধিপত্যের জন্য দায়ী কে এবং কোন পথে এই অবস্থার অবসান হতে পারে তা আজ সকল চেতনাসম্পন্ন যুবকের মনে বড় প্রশ্ন।
গণদাবির যে সনদ গৃহীত হয়েছিল, কোন্ ভিত্তিতে তা বাস্তবায়ন সম্ভব বা বর্তমান সরকার দ্বারা ঐ দাবি আদৌ বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা এবং সম্ভব না হলে যুবলীগ কোন্ কর্মপন্থার ভিত্তিতে অগ্রসর হবে তা মূল প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। গত এক বছরে যুবলীগের সনদ কেবল গণদাবি হিসেবেই রয়ে গেছে। কার্যকরী গণসংগ্রাম আজো গড়ে ওঠেনি। এক্ষেত্রে সংগঠনের কিছুটা শৈথিল্য লক্ষ্যণীয়। যুবসমাজ একথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে একটা আদর্শ বা প্রােগ্রাম হাজির করলেই চলে না। তাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে প্রয়ােজন সক্রিয় গণসংগ্রামের নেতৃত্বদান করা। কিন্তু গত এক বছরে এরূপ কোন নির্দেশনা সংগঠনের পক্ষ থেকে গৃহীত হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের যুব কর্মীরা বিপুল শক্তি নিয়ে কেবল সঠিক নির্দেশনার অভাবে দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অথচ ইতিপূর্বে এই যুবকেরাই সঠিক নেতৃত্বের অধীনে বৃটিশ বিরােধী ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
ইতিমধ্যে সংগঠিত বাংলা ভাষা আন্দোলন একথা প্রমাণ করেছে যে গণদাবির অংশ হিসেবে বাংলা ভাষার অধিকার অর্জন করতে গিয়ে যুব সমাজ শাসক শ্রেণীর জেল-জুলুম
________________________________________
পর্যালােচনা করে নতুন কাপবে। ঢাকা সম্মেলনে
পুনর্গঠন, শিল্প বি
সহ্য করেছে। কাজেই সংগঠনের সকল দাবি আদায় করতে গেলেই বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু ভাষা আন্দোলন একথা প্রমাণ করে যে, শাসক শ্রেণীর সকল আঘাত উপেক্ষা করেও যুব সমাজ আন্দোলনে প্রস্তুত। এই মুহুর্তের বড় প্রয়ােজন সময়মত সঠিক নেতৃত্ব।
বর্তমান আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়ােজন অবিলম্বে বিগত দিনের সকল কার্যক্রম পর্যালােচনা করে নতুন কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করা। কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য প্রয়ােজনে কর্মসূচীর পরিবর্তনেও করা যেতে পারে। ঢাকা সম্মেলনে যে সনদ গৃহীত হয় তাতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, আর্থিক গণতন্ত্র, কৃষি পুনর্গঠন, শিল্প বিপ্লব, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি দাবির কথা বলা হয়েছে। সনদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পরাধীন দেশের সকল নিয়ম-কানুন বাতিল করে নতুন আঙ্গিকে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেই পুরানাে নিয়মের সব রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।
যুব সমাজের দাবি ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করার। অথচ বর্তমান সরকার বিশ্বয়করভাবে স্বাধীনতার মাত্র এক বছর পরে ইংরেজ রাজার জন্ম দিবস পালন করলেন। ইতিমধ্যে জিন্নাহ ঘােষণা করেছেন যে তিনি বৃটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে থেকে কাজ করে যাবেন। এখনাে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বড় বড় পদে ইংরেজগণ নিযুক্ত রয়েছেন। লুট করা হচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকা। এসব ঘটনা থেকে ধরে নেয়া যায় যে এটি মেকি স্বাধীনতার একটি আস্তরণ মাত্র।
গণতান্ত্রিক যুবলীগ দাবি করেছিল যে পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রদেশকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দেয়া হােক। এতে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা জনগণের উপর ন্যস্ত থাকবে। অথচ শাসকশ্রেণী অধিকারের বদলে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করলেন। তারা জনমতের বিরুদ্ধে সিন্ধু প্রদেশ থেকে করাচিকে আলাদা করলেন। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইন সভার হাত থেকে সকল ক্ষমতা বড়লাটের উপর ন্যস্ত করা হলাে। কী অত স্বাধীনতা আর আশ্চর্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা!
সনদে সকল প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি ইংরেজ প্রবর্তিত নির্বাচন পদ্ধতিই চালু রয়েছে। অর্ডিন্যান্স জারি করে জনগণের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। কিন্তু জনগণকে দেয়া ওয়াদা পূরণ করা হচ্ছে না। সংগঠনের দাবির মধ্যে সভা-সমিতিশােভাযাত্রা, পত্রিকা প্রকাশ, বিক্ষোভ, ধর্মঘট, বিনাবিচারে আটককৃতদের মুক্তি প্রভৃতি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত এক বছরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে, সব কিছুই টুটি টিপে বন্ধ করা হয়েছে। পুলিশ-গােয়েন্দা দ্বারা সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলন ও কর্মীদের ধ্বংস করা হচ্ছে। ইচ্ছেমত যখন তখন ১৪৪ ধারা জারি করে সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। যাকে তাকে ইন্দেমত গ্রেফতার করে কঠোর নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারােক্তি আদায়ের চেষ্টা চলছে। পুলিশী নির্যাতন প্রতিদিনের ঘটনা
________________________________________
হয়ে দাঁড়িয়েছে। পঞ্চম বাহিনী, রাষ্ট্রের শত্র, কমিউনিষ্ট প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে চরম দমননীতি প্রয়ােগের মাধ্যমে মানুষের জীবন বিপন্ন করে তােলা হয়েছে। জমিদার, জোতদার, মালিক, আমলা প্রভৃতি গােষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত লাগে এমন যেকোন আন্দোলনকে সরকার নির্মম আঘাতের মাধ্যমে প্রতিহত করছে।
কোন দেশের রাজনৈতিক কাঠামাে কেমন তা বুঝতে হলে প্রথমেই সেদেশের অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ্য করতে হয়। যেদেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শােষণ ও জুলুমের ভিত্তিতে গঠিত এবং যেদেশের ৯৫ শতাংশ জনগণের বিরুদ্ধে মাত্র পাঁচজনের স্বার্থকে রক্ষা করা হয়, যেদেশে মােটা অংকের টাকা দিয়ে আমলা পুষে গরীব কেরানী ও শ্রমিক ছাঁটাই করা হয় এবং যেদেশে সাম্য বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না-সেদেশে গণতন্ত্রের কথা কেবল প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। ইংরেজ সরকার এদেশে তাদের শাসন ও শােষণ বজায় রাখতে জমিদারী প্রথা সৃষ্টি করেছিল। শিছে অনগ্রসর করে রাখতে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। গুটিকয়েক জমিদারের হাতে দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন ও ভাগ্যকে জিম্মি করা হয়েছিল। আর সেকারণে আমাদের স্বাধীনতার মূল কথাই হলাে-ইংরেজ কর্তৃক তৈরীকৃত সকল অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙ্গে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামাে তৈরি করা। এ লক্ষ্যে মূল কথাই হিল তাৎক্ষণিকভাবে জমিদারী প্রথা ধ্বংস করে কৃষকদের জমির প্রকৃত মালিক বলে ঘােষণা করা এবং একজনের হাতে অধিক পরিমাণে আবাদী জমি একত্রিত হতে না দেয়া। এক্ষেত্রে গরীব, গৃহহীন, ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে হালের বলদ ও গৃহনির্মাণ ঋণ দিয়ে সাহায্য করা। অথচ এই সরকার বিস্ময়করভাবে জমিদারী উদেচ্ছদের যে বিল এনেছে, তাতে এই শিশুরাষ্ট্রের পকেট থেকে চল্লিশ কোটি টাকা খেসারত প্রদানের কথা বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে জোতদার-মহাজনদের দুইশত বিঘা পর্যন্ত জমি রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে এবং জমিদারদের ঋণ লাডের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ দিনমজুর, কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাকুরে তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে সে বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। যুবলীগ আরাে বলে যে, “শিক্ষক কর্মচারী কেরানী কৃষক শ্রমিক সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার নামে আমলা ও মন্ত্রীদের বিলাসে লাখ লাখ টাকা ব্যয় হতে দেয়া আর বরদাস্ত করা যায় না। একজন শিক্ষককে পনের টাকা বেতন দিতে যে সরকার। লজ্জাবােধ করে না তারা কিভাবে ৫০০০ টাকা বেতন দিয়ে দুর্নীতি পরায়ণ আমলা ও ইংরেজ আমলের অত্যাচারী কর্মচারী পুষছে তা বােধগম্য নয়। বর্তমান অবস্থায় কোন কর্মচারীর বেতন ১০০ টাকার নিচে হতে পারে না এবং কোন আমলার মাসিক ভাতাও ৫০০ টাকার উর্ধে হতে পারে না। এই সরকার ইসলামী সমাজতর কথা বলে ইংরেজ আমলের শােষণ ও অসাম্যকে কায়েম রেখেছে। বর্তমান সময়ের ঘুষ, দুনীতি, স্বজনপ্রীতি, স্বেচ্ছাচারিতা বৃটিশের আমলকেও হার মানিয়েছে, | শিল্প বিস্তারের ক্ষেত্রে সরকার শ্রমিক ও জনসাধারণের সহযােগিতা লাভ করলে তাতে কোটি কোটি টাকা পুঁজিপতির হাতে জমা না হয়ে সরকারের হাতে জমা হয়। এতে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা সব। তাতে জনগণের আয় বেড়ে, ব্যয় কমে এবং
________________________________________
বেকার সমস্যার সমাধান হয়। এই ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে গুটিকয়েক স্বার্থলােতী শ্রেণী ও সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠীর শক্র হওয়া যায় ঠিকই কিন্তু দেশের কোটি কোটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। এক্ষেত্রে দেখা যায় যুদ্ধের প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও সােভিয়েত রাশিয়া সহ নতুন গণতান্ত্রিক দেশস কেবল তার শক্তির উপর নির্ভর করে দ্রুত অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। অন্যদিকে মার্কিন সাহায্য লাভ করে বিভিন্ন দেশ কেবল সম্মেলন করছে। যে জাতি নিজ দেশে ধনিক শ্রেণী ও আমলাদের লালন-পালনে ব্যস্ত থাকে তাদেরই কেবল বিদেশীদের কাছে হাত পাততে হয়। এরা নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও বিদেশী সাহায্য কামনা করে এবং অর্থনৈতিক গােলামী থেকে রাজনৈতিক গােলামে পরিণত হয়।
পাকিস্তান সরকার আজ ধনিক শ্রেণী ও আমলা-জমিদারের স্বার্থকে রক্ষাকল্পে জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে ধ্বংস করতে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও বৃটিশ -আমেরিকার লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। সে কারণেই বৃটিশের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদের বদলে তাদের সঙ্গে অঙ্গীভূত থাকার কথা বলছে। এদেশে বৃটিশরাজের জন্মদিবস পালিত হচ্ছে। এভাবেই আজ একটি স্বাধীন দেশ দাসত্বের দিকে এগিয়ে চলছে। এই সরকার দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার নীতি অনুসরণ করছে। | সােভিয়েত রাশিয়া সহ নয়া গণতান্ত্রিক দেশসমূহে কৃষক শ্রমিক গরীব মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ক্ষমতা দখল করছে। সেখানকার জনগণ প্রকৃত স্বাধীনতার ও গণতন্ত্রের সুখ ভােগ করার পাশাপাশি শিল্প বিস্তারের চরম শিখরে আরােহণ করছে। অথচ স্বাধীনতার একবছর পরেও আজ মানুষের পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, রােগে চিকিৎসা নেই। পক্ষান্তরে আলবেনিয়া, হাঙ্গেরী, পােল্যান্ড প্রভৃতি দেশ স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পেরেছে। যে সরকার ধনিকের স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাকে সুযােগ দেয়া যায় না। কেননা তাতে পুঁজিপতিদের ক্ষমতাই কেবল বৃদ্ধি পায়।
গ্রামে গ্রামে শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রতি ইউনিয়নে চিকিৎসা দাবি করা হয়েছিল, যার কোনটি জনগণ পায়নি। বেকার সমস্যা আজ সমাজের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সকল উদ্দেশ্য-আদর্শ সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। নতুন সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হলেও দেখা যাচ্ছে যে পুরাতন ব্যবস্থাই ভেঙ্গে পড়া অবস্থায় বহাল রয়েছে। খাদ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। উৎপাদন বৃদ্ধির কোন পদক্ষেপ নেই। ধার করে আনা অর্থ নিয়ে লুটপাটের প্রতিযােগিতা চলছে। ইতিমধ্যে দেশের কুটির শিল্প ধ্বংসের মুখােমুখি দাঁড়িয়েছে। সরকারি কোন পদক্ষেপ নেই। শিল্প প্রতিষ্ঠানে পুঁজিপতির স্বার্থরক্ষায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সরকারের পুলিশ বাহিনী দমনমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে। এদেশে চাকরি করে গিয়েছে যেসকল ইংরেজ আজো তাদের পেনশনে নামে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা ইংল্যান্ডে পাঠানাে হচ্ছে। দেশের অর্ধেক মানুষ প্রতিদিন না খেয়ে থাকছে।
________________________________________
অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ও শােষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার বদলে অন্ন-বস্ত্রহীন কংকালসার মানুষের সারি ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। এই কি ইসলামী সমাজতন্ত্র, নাকি ইসলামের নামে প্রতারণা
এদেশে শিল্প বিস্তারের প্রচুর সম্ভবনা থাকলেও সেক্ষেত্রে কোন বাস্তব অগ্রগতি হয়নি। যেখানে জনগণ দাবি জানালে যে বৃটিশের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ না করা হলে এখানে কোন উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না, সেখানে সরকার মােটা অংকের টাকা দিয়ে বৃটিশ বিশেষজ্ঞদের জড়ো করছে। এই সরকার বুঝতে পারছে না যে, কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি স্বীয় স্বার্থে অন্যকে স্বনির্ভর হতে দেয় না। বৃটিশ ও আমেরিকা এই দেশকে পশ্চাৎপদ রাখতে তাদের করণীয় সবকিছুই করবে। আমেরিকান পুঁজিপতিদের শিল্প বিস্তারের জন্য এদেশে ডেকে আনার অর্থ হচ্ছে খাল কেটে নিজের ঘরে কুমিরের ছানা প্রবেশ করানাে, অথচ চোখের সামনে ইউরােপের নয়া দেশসমূহ পুঁজিপতিদের দেয়া ঋণ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে স্বীয় শক্তিতে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়েছে। তারা যদি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরােধিতা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে পারে, তাহলে পাকিস্তান কেন পারবে না? স্বাধীনতা লাভের পর একমাত্র জাতীয় পতাকা ছাড়া আর কোন কিছুতেই পরিবর্তন আসেনি। জনসাধারণকে ভােলানাের জন্য নামমাত্র একটা গণপরিষদ খাড়া রাখা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্বাধীন দেশের দিকে তাকালে আমাদের ঐ গণপরিষদকে একটা অগণতান্ত্রিক স্থবির বন্ধুর মত মনে হয়, অথচ দেশের মানুষ এর মাধ্যমে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আশা করেছিল। এই পরিষদ কিভাবে বৃটিশের প্রণীত পদ্ধতি টিকিয়ে রেখেছে তা ভাবতে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। আজ একথা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে এই গণপরিষদ মানুষের সকল আশাকেই নিরাশায় পরিণত করেছে।
জাতির ভবিষ্যৎ মানুষকে মােটেও আশান্বিত করছে না। বরং এই আশংকা আরাে তীব্রতর হচ্ছে যে বর্তমান অবস্থার গতিরােধ করতে না পারলে আগামীতে এক ঘােরতর বিপর্যয় অনিবার্য। ক্রমেই দেশের ঘাড়ে একনায়কের ভূত জেঁকে বসছে। পাকিস্তানের যুব সমাজ এই এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার খেয়ালখুশীকে বরদাস্ত করবে না। সরকার যদি মনে করে থাকে যে দমননীতি চালিয়ে সবকিছু শান্ত করা যাবে তাহলে সে ভুল পথে চালিত হচ্ছে। বিগত দিনের ইতিহাস থেকে এই সরকার কিছুই শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বন্দুক ও জেলখানার ভয় দেখিয়ে গণআন্দোলনকে কখনাে রােধ করা যায় না। হিটলার-মুসােলিনী পর্যন্ত যে কাজে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বর্তমানের পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকার বৃথাই সেই পথ অনুসরণ করছে। যে প্রেরণা একদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যুব সমাজকে উৎসাহিত করেছিল, প্রয়ােজনে তার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বর্তমান শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে উৎসাহিত করেছিল, প্রয়ােজনে তার দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বর্তমান শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। যেকোন হুমকিকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করে।
এই সরকারের সাম্রাজ্যবাদী নীতি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে আর তাদের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। যুব সমাজ জাতির মূল চাবিকাঠি। এদের সঙ্গে দেশের
________________________________________
খেটেখাওয়া মানুষের কোন বিরােধ নেই। এই দুয়ের সহযােগিতার মাধ্যমেই কেবল একটি প্রকৃত সুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে। যুব সমাজ মনে করে কোন্ দেশ কতটা গণতান্ত্রিক তার প্রমাণ মেলে সেদেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি ঐ দেশের সরকারের মনােভাবের মধ্য দিয়ে। গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট আন্দোলন সার্থক করার জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচী পেশ করেঃ
(১) বৃটিশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে ও বৃটিশ উপনিবেশ সম্মেলনে যােগদান করা চলবে না। কোন ইংরেজ কর্মকর্তা বা কর্মচরীর পেনশন-ভাতা প্রদান করা চলবে না। বৃটিশের কাছে সকল পাওনা ১৯৪৮ সালের মধ্যেই আদায় করতে হবে। (২) প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নতুন গণপরিষদ কর্তৃক শাসন পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে। (৩) ভাষার ভিত্তিতে স্বয়ংশাসন অধিকারসম্পন্ন প্রদেশ গড়ার এবং নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকতে হবে। (৪) সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার মানতে হবে। (৬) বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করে কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা প্রদান করতে হবে। (৭) শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা প্রভৃতি রাষ্ট্রায়াত করতে হবে। (৮) বিদেশী পুঁজি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিদেশী ঋণ জাতীয় স্বার্থবিরােধী কাজে গ্রহণ করা চলবে না। (৯) বিনা ব্যয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।(১০) রাষ্ট্রীয় কারণে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। (১১) জনগণকে সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। (১২) নারী জাতির সমান অধিকার প্রদান করতে হবে।
রাজশাহী সম্মেলনের প্রস্তাব রাজশাহী সম্মেলনে বক্তারা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে চাউলের দাম প্রকট হয়ে উঠেছে। যশাের জেলায় চাউলের মন ৪০ টাকা, খুলনায় ৩০ টাকা, পাবনায় ৩৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এক কথায় বলতে গেলে পূর্ব পাকিস্তানে চাউলের দাম ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এটি দ্বিতীয় খাদ্য সংকট। সরকার এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেবল বিবৃতি দিয়ে দায় সারছে। খাদ্য সংগ্রহের কোন সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। সারা পূর্ব পাকিস্তান আজ ভয়াবহ এক দুর্ভিক্ষের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
রাজশাহীর যুব সম্মেলন উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতি লক্ষ্য করছে এবং খাদ্যশস্য সরবরাহের কর্মপদ্ধতি গ্রহণের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানাচ্ছে-(১) কৃষকদের নিকট থেকে জবরদস্তিমূলক ধান কেড়ে নেয়া চলবে না। মজুতদারদের মজুত ধান বাজেয়াপ্ত করতে হবে। (২) ভারত ও পাকিস্তানের বাইরে অন্যান্য দেশ থেকে সমঝােতামূলক ভাবে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। (৪) সকল শহরে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (৫) নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের মূল্য কমাতে হবে। (৬) খাদ্য ক্রয়ে অক্ষম ব্যক্তিদের বিনামূলে খাদ্য প্রদান করতে হবে। (৭) কৃষকদের কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। (৮) মজুর ও মধ্যবিত্তের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। (১) “জিন্নাহ তহবিল থেকে দুই-তৃতীয়ংশ অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে হবে।
________________________________________
গণতান্ত্রিক যুবলীগ উপরােক্ত দাবিসমূহ কার্যকরী করা ও আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য জনসাধারণের নিকট আবেদন জানায়।
বৃটিশ সরকারে এদেশে স্বীয় সম্মান ও শােষণ অব্যাহত রাখার স্বার্থে জমিদারী প্রথার সৃষ্টি করে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা পঙ্গু করে দেয়, যে কারণে দেশে ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দেয়। স্বাধীনতা লাভের পর জমিদারী উচ্ছেদ করে কৃষকদের হাতে জমি বন্টন করা হবে বলে যে ওয়াদা নেতারা করেছিলেন তাও নেতারা ভুলে যান। পক্ষান্তরে সরকার যে বিল এনেছে তাতে বলা হয়েছে-(১) জমিদারদের ৪০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে । (২) জোতদারদের জমি দেয়া হবে । (৩) জমিদারদের সকল ঋণ মওকুফ করা হবে। (৪) ওয়াকফ ও দেবােত্তর সম্পত্তির সুবিধা প্রদান প্রভৃতি। উপরােক্ত সকল শর্ত দেশের স্বার্থবিরােধী। এই বিল পাস হলে জমিদারী উচ্ছেদের পরিবর্তে কৃষকরাই উচ্ছেদ হয়ে যাবে। এই বিলের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন গড়ে তােলা দরকার।
বর্তমান সরকারের শ্রমনীতি রেলশ্রমিকদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রেলওয়ের প্রায় ১৬ হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মুখে। পে কমিশন অনুযায়ী, শ্রমিকদের কোন দাবির প্রতিই সরকার কর্ণপাত করেনি। রেশ্রমিকদের নিম্নলিখিত ৫টি দাবির প্রতি যুবসমাজ সর্বতােভাবে সমর্থন দান করে-(১) পুরাতন পে কমিশনের রায় চালু করতে হবে, (২) ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে, (৩) গ্রেনশপের তালিকাভুক্ত সকল দ্রব্য সরবরাহ করতে হবে, (৪) বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, (৫) ট্রেড ইউনিয়নের পূর্ণ অধিকার প্রদান করতে হবে। গণতান্ত্রিক যুব সমাজ রেল শ্রমিকদের এই দাবিসমূহ ন্যায্য বলে মনে করে এবং তাদের সকল আন্দোলনকে সাফল্যের সাথে চালিয়ে যাবার জন্য সমর্থন দিচ্ছে।
পাকিস্তান সরকার যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তাদের ওপর কঠোর দমননীতি অনুসরণ করে। ঢাকার কেন্দ্রীয় অফিস তছনছ করা হয়। বহু নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা জারী করে। সম্মেলনে সকল গ্রেফতারী পরােয়ানা ও হুলিয়া প্রত্যাহারের দাবি জানানাে হয়। স্বাধীনতা লাক্সে পূর্বে রাজশাহী জেলায় প্রাথমিক স্কুল ছিল ১২০০ কিন্তু পকিস্তান সরকার ঐ সংখ্যা ৮০০-তে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করে। এই ব্যবস্থাকে কার্যকরী না করার জন্য যুবসমাজ সরকারকে হুশিয়ার করে দেয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে আজ যে সংকট দেখা দিয়েছে তা রােধকল্পে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানাে হচ্ছে এবং তা কার্যকরী করার জন্য ছাত্রদের আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য আহবান জানাচ্ছে-(১) কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তুলে দেয়া যাবে না। (২) শিক্ষকদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়ােজনীয় বেতন দিতে হবে। (৩) বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যমরূপে চালু করতে হবে। (৪) বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (৫) শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র নিয়মিত সরবরাহ করতে হবে। (৬) শিক্ষকদের শূন্য পদসমূহ পূরণ করতে হবে। (৭) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে গণতান্ত্রিকভাবে ইউনিয়ন চালু করতে হবে।
________________________________________
সম্মেলনে বলা হয়, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ বিপন্ন। জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা নগণ্য। ওষুধপত্রের কোন ব্যবস্থা হাসপাতালে নেই। সরকারি ব্যবস্থা যেটুকু আছে তা দুর্নীতিতে পূর্ণ। সম্মেলনে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য সরকারকে পূর্ণভাবে দায়ী করে এবং অনতিবিলছে বিজ্ঞি অব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহবান জানায়-(১) হাসপাতালগুলােকে দুর্নীতিমুক্ত ও প্রয়ােজনীয় ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। (২) প্রতি ইউনিয়নে বিনামূল্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (৩) মেডিকেল স্কুল ও কলেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। (৪) জনস্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের চাকুরী স্থায়ী করতে হবে।
সাহিত্য সম্মেলনে ডঃ শহীদ ১২ মার্চ ‘৪৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সভাপতির বক্তব্য রাখেন। ভাষা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা আজ এক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রাদেশিক রাজধানীর বুকে মুক্ত মানুষরূপে সমবেত হতে সক্ষম হয়েছি। জাহাঙ্গীর, শায়েস্তা খান, ইসলাম খান, আধীমূসসান স্মৃতিবিজড়িত (জাহাঙ্গীরনগর) ঢাকা আজ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী। পূর্ববঙ্গের এককালীন রাজধানী সােনারগাঁও ন্যায়বান বাদশাহ গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের পুণ্য স্মৃতি বুকে ধরে আছে। বিক্রমপুর সেন রাজাদের রাজধানী। সেখানে একদিন লক্ষণ সেন, কেশব সেন, মধু সেন রাজত্ব করতেন। দূর স্মৃতি আমাদের টেনে নিয়ে যায় বিক্রমপুরের সন্নিকটে। রাজা রামপালের স্মৃতিচিহ্ন বিজড়িত রামপালে এবং বৌদ্ধ মহাপন্ডিত শীলভদ্র কমল শীল ও দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশের অধুনা বিস্তৃত জন্মভূমিতে। এই অঞ্চল যেমন বৌদ্ধ, হিন্দু ও মুসলমানের স্মারকলিপি হয়ে আছে, প্রার্থনা করি তেমনি যেন নতুন রাষ্ট্র জাতি, বর্ণ, ধর্ম, নির্বিশেষে সকল নাগরিকের মিলনভূমি হয়।
তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার বিশেষ গৌরব এই যে প্রদেশের প্রাচীন নাম “বাঙ্গাল” থেকে সমস্ত দেশের নাম হয়েছে বাঙ্গালা বা বাংলা। এই বাংলা নাম আমরা পাই রাজেন্দ্র চোড়ের ১০২৩ সালের তিরুমলে” লিপিতে। বৌদ্ধ যুগের কবি “ভুসুক” একটি চর্যাগীতিতে লিখেছেন-“বমানরূপী নৌকায় পাড়ি দিয়ে পদ্মার খালে বাইলাম । অজয় রূপ বঙ্গাল দেশ লুট করলাম। এতে বােঝা যায় পদ্মানদীর পাড়েই বঙ্গাল দেশ। বাঙ্গাল আমাদের নিন্দার কথা নয় বরং তা দেশবাসীর প্রাচীন নাম । সিরাজের অমর কবি হাফিজ সােনারগাঁয়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহকে গজল লিখে পাঠিয়েছিলেন। কেবল হাফিজ নয়, মিথিলার বিদ্যাপতিও বাংলার এই সুলতানকে প্রশংসা করেছেন। মালব, কর্ণাট প্রভৃতি দেশের নামের ন্যায় এই বাঙ্গাল দেশও সঙ্গীতশারে এক বিশেষ রাগের নামকরণ করেছে। বৌদ্ধ কবি সুক একটি চর্যাগীতি বাঙ্গালা রাগে রচনা করেছেন।
ডঃ শহীদুল্লাহ বলেন, এই দেশ থেকেই বাংলা সাহিত্য এবং নাথ ছন্দের উৎপত্তি হয়েছে। সংসােস্ত্র নাথ যেমন বাংলার আদি লেখক তেমনি তিনি নাথ ছন্দের প্রবর্তক।
________________________________________
নিবাস ছিল ক্ষীরােদ’ সাগরের তীরে চন্দ্রদ্বীপে। বর্তমান যাকে সন্দীপ বলা হয় । ৭ খৃষ্টাব্দে তিনি রাজা নরেন্দ্র দেবের রাজত্বকালে নেপালে উপস্থিত হন। মৎসােস্ত্র এর অনুসরণ কালুপ, কসকুরীপ, জেসবী, সরহ কবরী সহ বহু সিদ্ধাচার্য চর্যাগীতি রচনা ছেন, যা পারমার্থিক গান বলেও পরিচিত। তাদের লিখিত গানগুলাের একটি বিশেষ তা ছিল। যে ভণিতার রীতি প্রাচীন বাংলা থেকে সংস্কৃতিতে যায়। যেমনি কবি দেবের গীত গােবিন্দ’। নাথ পন্থের বিস্তার ঘটে ভারতের পাঞ্জাব পর্যন্ত। পরে সেখান ক তা পারস্য পর্যন্ত যায়। পারস্য গজল আরবীর অনুকরণে নয়, তা চর্যাগীতিরই সরণ। আরবীতে কাসিদা আছে, গজল নেই। ডঃ শহীদুল্লাহ বলেন, ত্রিপুরার গােপীচন্দ্র জলন্ধবীর নিকট নাথ পন্থে দীক্ষিত হয়ে গী হয়ে যায়। নাথ পাহু ভারতের বিভিন্ন ভাষার কবিতার উপজীব্য হয়ে ওঠে। সুদূর লয়ের ঝংড়া উপত্যাকয় গােপীদের গানেও তা প্রচলিত আছে। পূর্বাঞ্চলের ভীম, বক, ঈশাখা, চাদ রায়, কেদার রায় প্রমুখ নিজেরা সাম্রাজ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই ছিল। পূর্ববঙ্গের সাহসী সন্তানেরা শুধু আজ নয় প্রাচীন কাল থেকেই নির্ভীক। এরাই দিন সুমাত্রা, জাভা দ্বীপ, বালি দ্বীপ, কম্বােডিয়া এবং বার্নিও পর্যন্ত পৌছেছিল। মহাকবি লদাস দক্ষ বঙ্গবাসীর উল্লেখ করেছেন। কবি কংকন প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসরণ করেই পতি সওদাগরের জাহাজের মাঝিমাল্লাদের পূর্ববঙ্গবাসী বলে বর্ণনা করেছেন। ণ-পূর্ব এশিয়ায় ও পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ধর্মে, সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে বাংলার ছাপ ছে। বাংলার উপকথা সেখানেও প্রচলিত। বাংলার রক্ত যে তাদের রক্তের সঙ্গে শনি তা কে বলতে পারে? প্রাচীন রাঢ় বরেন্দ্র এবং বঙ্গ নিয়েই বাংলাদেশ। রাঢ় ব্রাহ্ম ধর্মকে আঁকড়ে ছিল। এনে শর বংশীয় রাজার রাজত্ব করতেন | এই বংশের আদি শূর বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ দানী করে হিন্দুত্বকে বাঁচিয়ে রাখতেন। শূর বংশের পর সেন বংশ রাঢ় বাংলা থেকেই ত্ব বিস্তার করেন। তারাও গোঁড়া হিন্দু ছিলেন। বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথা চালিয়ে আদি র ধারাকেই স্থায়ী করেন। তুর্কীদের বাংলা বিয়ের সূত্রপাত রাঢ় থেকে হলেও নে ইসলাম ধর্ম তেমন বিজয়ী হতে পারেনি। বরেন্দ্র ও বঙ্গ মুসলিম আক্রমণের য়ে নাথপন্থী ছিল। তারা সনাতনপন্থীদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছিল। ঠিক এ সময়ে আসে দের হামলা। তারা বিদেশীদের রক্ষাকর্তা মনে করে সাহায্য করেছিল এবং পরে লাম ধর্মে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সময়ের নাথপন্থীদের হড়ায় অহিন্দুদের মনের ছাপ রয়েছে। পরবর্তীকালে কিছু { হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মুসলমান যে বৌদ্ধ গজাত তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রাচীন মুসলমান লেখকেরা কেউই ঈশ্বর বা ভগবান প্লাহর প্রতিশব্দরূপে ব্যবহার করেনি। কিন্তু তারা নিরঞ্জন শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই টি বৌদ্ধ উৎপত্তির একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।
________________________________________
ইসলাম জাত-পাত মানে না। মানুষ মাত্রেই আদমের সন্তান এবং সমান। কাজেই আমরা বংশ দেখি না, দেখি গুণ। বাংলার মুসলমান যদি গুণে শ্ৰেষ্ঠ হতে পারে তবে আরব, পারস্য, তুর্কী, হিন্দুস্তান প্রভৃতি যে কোন দেশের চেয়ে সে কেন উন্নত হবে না?
ডঃ শহীদুল্লাহ বলেন, স্বাধীন পূর্ববাংলায় আজ আমাদের প্রয়ােজন হয়েছে সমৃদ্ধ এক সাহিত্যের। যে সাহিত্য হবে আমাদের মাতৃভাষা বাংলায়। পৃথিবীর কোন জাতি নিজ ভাষা ছেড়ে, অন্য ভাষায় সাহিত্য রচনা করে খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গােড়ার দিকে পারস্য আরব কর্তৃক বিজিত হয়েছিল। পারস্য তখন আরবের ধর্ম নিয়েছিল। আরবী সাহিত্যের চর্চাও করেছিল। কিন্তু তারা নিজের সাহিত্য ছাড়েনি। তাই রুদাসী, ফেরদৌসী, নিযামী, সাদী, হাফিজ, উর্মি, থানাৰী, বু আলী সীনা, গাজ্জালী, থৈয়াম প্রমুখ কবি, ভাবুক ও দার্শনিকগণের রচনায় পারস্য সাহিত্য উজ্জ্বল হয়ে আছে । বাংলা সাহিত্যের চর্চা আজ নতুন নয়। বাংলা দিল্লীর অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এক স্বাধীন সু ৩ানী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকেই বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির দিকে রাজার মনােযােগ পড়ে। ইউসুফ শাহ, হােসেন শাহ, নুসরত শাহ, ফিরােজ শাহ, নিয়াম শাহ, ছুটি খা, পরপল থা প্রমুখ রাজা ও রাজপুরুষগণ বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। কৃত্তিবাসের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন এক গৌড়েশ্বর। সম্ভবত তিনি ছিলেন জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ। কৃত্তিবাস স্বধর্ম ত্যাগী ছিলেন।
বৃটিশ যুগের ও বর্তমান মুসলমানের সাহিত্য সাধনার কথা সকলের জানা। এখন আমাদের প্রয়ােজন আদিকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত সাহিত্য সাধনার ইতিহাস লেখা। ও প্রাচীন লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশ করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের কর্তব্য পূর্ব বাংলার সকল স্থান থেকে পুথি, পল্লীগীতি, উপকথা সংগ্রহ করা ও তা প্রকাশ করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা পূর্ববঙ্গের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়রূপে দেখতে চাই। সরকারি নওকরখানা রূপে নয়।
বাংলার হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান এক মিশ্রিত জাতি। তেমনি তাদের ভাষাও এক মিশ্রিত ভাষা। বাংলার উৎপত্তি গৌড় অপভ্রংশ থেকে। সংস্কৃতের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক দূরের। বাংলার কোন শব্দই সংস্কৃত থেকে আসেনি। তবে বাংলার গােড়ায় যে আর্যভাষা তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না আর্যভাষার সঙ্গে মিশে আছে আদি যুগের কোল, মধ্যযুগর পার্সি ও পার্সির ভিতর দিয়ে কিছু আরবী ও সামান্য তুর্কী এবং পরবর্তী যুগে পর্তুগীজ ও ইংরেজি। দু-চারটা দ্রাবিড়, মঙ্গলীয়, ফরাসী, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার শব্দ বাংলায় আছে। মিশ্র ভাষা বলে বাংলার কোন লজ্জা নেই। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা চলতি ভাষা ইংরেজির অনেক শব্দ বিদেশী । মনে রাখতে হবে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা খুঁৎমার্গের কোন স্থান নেই। নদীর গতিপথ যেমন নির্দেশ করে দেয়া যায় না, তেমনি ভাষারও। একমাত্র সময় বা কালই ডাষার গতি নির্দিষ্ট করে। ভাষার গতি ও রীতি কোন নির্দিষ্ট ধরাবাধা নিয়মের অধীন হতে পারে না।
________________________________________
ভঃ শহীদুল্লাহ বলেন, কিছুদিন থেকে বানান ও গ্রামারের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সংস্কারমুক্তভাবে এগুলাে আলােচনা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করা দরকার। যারা পালি, প্রাকৃত ও ধ্বনিতত্ত্বের সংবাদ রাখেন তারা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাংলা বানান অনেকটা অবৈজ্ঞানিক; সুতরাং তার সংস্কার দরকার। স্বাধীন পূর্ব বাংলায় কেউ আরবী হরফে, কেউ রােমান অক্ষরে বাংল লিখতে উপদেশ দিচ্ছেন। কিন্তু বাংলার শতকরা ৮৫ জন যে নিরক্ষর সেক্ষেত্রে অক্ষরজ্ঞান বিস্তারের কি চেষ্টা হচ্ছে আরবী হরফে বাংলা লিখলে বাংলার বিরাট সাহিত্য ভাণ্ডার হতে আমাদের বঞ্চিত হতে হবে।
সােনার বাংলাকে কেবল জনে নয়, ধনে-মানে জ্ঞানে-গুণে শিল্প-বিজ্ঞানে পৃথিবীর যে কোন দেশের সমকক্ষ হতে হবে। তাই কেবল কাব্য ও উপন্যাসের মধ্যেই বাংলাকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। দর্শন, ইতিহাস, ভূগােল, গণিত, রসায়ন, পদার্থ, ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনােবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাকে উচ্চ আসন নিতে হবে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়ােজন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। দেশে স্ত্রী শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষার প্রচলন করতে হবে।
তিনি আরাে বলেন, আমাদের একটি একাডেমি করতে হবে যার কাজ হবে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য বিষয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থগুলাের অনুবাদ বাংলায় প্রকাশ করা। আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালী। এটি কোন আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য।
আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম মেনিফেষ্টো ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি হন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। সম্পাদক শামসুল হক ও যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মােশতাক আহমেদ। এই মােশতাকই পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে এবং বাংলার দ্বিতীয় মীরজাফর হিসেবে পরিচিত লাভ করে।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলনে বিবেচনার জন্য শামসুল হক ‘মূল দাবী নামে একটি মুদ্রিত পুস্তিকায় লিপিবদ্ধ তাঁর বক্তব্য পাঠ করেন। পুস্তিকার প্রারম্ভে তিনি বলেন, ১৯৪৯ সালের ২৩, ২৪ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন মনে করে যে লাহাের প্রস্তাব একটি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কোন বিরুদ্ধ পরিবেশে মানুষের উন্নতি ও বিকাশ সম্ভব নয়। মানুষ পরিবেশের দাস-একথা আধুনিক বিজ্ঞানও স্বীকার করে। তাই ভারতের মুসলমানগণ বহু শতাব্দীর অভিজ্ঞতা থেকে এই সত্য উপলব্ধি করে মৃত ইসলামী পরিবেশ কায়েমের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র হলেও শুধু মুসলমানদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠ, করার এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা
________________________________________
ও শিক্ষা প্রভাবিত ইসলামবিরােধী সাম্রাজ্যবিরােধী ধনতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তােলার ইচ্ছা তার ছিল না।
মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। স্রষ্টা ও পালনকর্তা হিসেবে তিনি পরিবর্তন ধাপে ধাপে সুখ, শান্তি ও পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেবেন। ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহ শুধু মুসলমানের নয়, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষের।
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনাে দল বিশেষের ছিল না। এটা ছিল উপমহাদেশের মুসলমানদের প্লাটফরম। এই সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের মূলনীতিগুলােকে কার্যকরী করে গড়ে তুলতে নতুন চিন্তাধারা, নতুন নেতৃত্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচী এবং মুসলিম লীগকে জনগণের সত্যিকার জাতীয় প্লাটফরম হিসেবে গড়ে তােলা। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমান পকেট লীগ নেতৃবৃন্দ উপরােক্ত কর্মপন্থা অনুসরণ না করে নিজেদের স্বার্থে প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য লীগের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন। মুসলিম লীগকে তারা ব্যক্তিবিশেষের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। শুধু তাই নয় পবিত্র ইসলামকেও তারা অসাধুভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। কোন দেশপ্রেমিক এই ধরনের কাজ করতে পারে না। যারা এ ধরনের কাজে অংশ নিয়ে তারা মূলত পাকিস্তানের শক্র। মুসলিম লীগকে এইসব স্বার্থান্বেষী মহলের হাত থেকে রক্ষা করে জনগণের প্রতিষ্ঠানরূপে গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় মুসলিম লীগকে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সাংগঠনিক নীতি প্রভাবিত দল বলে ঘােষণা করে অন্যান্য সবাইকে দল গঠনের অধিকার দিতে হবে। মুসলিম লীগের ভেতর সকল ব্যক্তি-দল-উপদলের স্বাধীন মতামত, আদর্শ, নীতি, কর্মসূচী ব্যক্ত করার অধিকার দিতে হবে। ছাত্র, যুবক, কৃষক, নারী, মজুর প্রভৃতি শ্রেণীর সংঘ গড়ার স্বাধীনতা থাকবে। ইসলামী রাষ্ট্র রূপরেখা সম্পর্কে বলা হয়(১) পাকিস্তান বৃটিশ কমনওয়েলথের বাইরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ইসলামী রাষ্ট্র হবে। (২) পাকিস্তানের ইউনিটগুলােকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে; (৩) রাষ্ট্রের সর্বাভৌমত্ব জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে; (৪) গঠনতন্ত্র হবে নীতিতে ইসলামী গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।
কৃষি পূর্ণগঠন সম্পর্কে বলা হয়-(১) জমিদারী প্রথা ও অন্যান্য কয়েকটি স্বার্থ বিনা খেসারতে উচ্ছেদ করতে হবে; (২) কর্ষিত ও অকর্ষিত কৃষিজমি কৃষকদের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করতে হবে; (৩) অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে কৃষকদের তেভাগা দাবি মানতে হবে; (৪) রাষ্ট্র তত্ত্ববধানে সমবায়ে ও যৌথ কৃষিখামার গড়ে তুলতে হবে; (৫) সেচ, সার, বীজ, ঋণ, সঠিক মূল্য, সমবায় প্রভৃতি ক্ষেত্রে কৃষকদের সাহায্য করতে হবে; (৬) ভবিষ্যতে সব জমি রাষ্ট্র সম্পত্তিতে পরিণত করে সরকারের তত্ত্বাবধানে যৌথ সমবায় কৃষি প্রথা চালু করতে হবে।
দেশীয় শিল্পকে রক্ষার ক্ষেত্রে কতিপয় কর্মসূচীর উল্লেখ করা হয়-(১) প্রাথমিক শিগুলােকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করতে হবে, যেমন যুদ্ধশির, ব্যাংক, বীমা, যানবাহন, বিদ্যুৎ খনি ইত্যাদি এবং ছােট শিয়গুলােকে পরিকল্পনার ভেতর দিয়ে সরাসরি
________________________________________
রাক্টর তত্ত্বাবধানে নিতে হবে; (২) পাট ও চা শিল্পকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করে তাকে সরকারি ব্যবসায় পরিণত করতে হবে; (৩) কুটির শিল্পকে বিশেষভাবে সাহায্য ও উৎসাহিত করতে হবে; (৪) বিল, হাওর ও নদীর উপর কায়েমী স্বার্থ তুলে দিয়ে সেক্ষেত্রে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৎস্য ব্যবস্থার পক্তন করতে হবে; (৫) শিল্প ও ব্যবসায় একচেটিয়া ব্যক্তিগত অধিকার থাকবে না; (৬) বৃটিশের নিকট পাওনা টার্লিং অবিলম্বে আদায় করে তা দিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে; (৭) সকল অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করতে হবে; (৮) সকল বৃটিশ ও বৈদেশিক ব্যবসাকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করতে হবে; (১) শি বিদেশী মূলধন খাটানাে বন্ধ করতে হবে; (১০) শিয়ে মুনাফার হার আইন করে বেঁধে দিতে হবে। | মানবতার চুড়ান্ত মুক্তি সংগ্রাম যাতে বিলম্ব না হয় সেজন্য জাতিকে ব্যক্তিগত ও দলগত বিভেদ বিসর্জন দিয়ে এক কাতারে শামিল হতে মুসলিম লীগ কর্মী সম্মেলন আহবান জানায়। সাম্রাজ্যবাদী সরীসৃপের শব্দ সমাজের সর্বত্র শােনা যাচ্ছে। এইসব সরীসৃপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে তাদের বিষর্দাত ভেঙ্গে দিতে হবে। হযরত আবু বকর বলেছেন, যদি আমি ঠিক থাকি তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, আর যদি আমি ভুলপথে চালিত হই তাহলে আমাকে অনুসরণ করাে না। সেই অমর আদর্শকে সামনে রেখে আসুন আমরা সমবেত চেষ্টায় পূর্ব পাকিস্তানকে সুখী, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তুলি।
হাজং বিদ্রাহ জমিদারী অত্যাচারের বিরুদ্ধে সিলেট-ময়মনসিংহ এলাকায় হাজংদের মধ্যে আন্দোলন গড়ে ওঠে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হাজংদের আন্দোলন আবার নতুন করে জেগে ওঠে। কৃষকদের উৎপাদিত ধানের ওপর সরকারি লেভী ও টংক প্রথার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন এক পর্যায়ে সশস্ত্র রূপ নেয়। পরবর্তীকালে কঠোর সরকারি অত্যাচার ও পুলিশী নির্যাতনের ফলে হাজং আমােণনের সমাপ্তি ঘটে। হাজং আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল কমিউনিষ্ট পার্টির অংগ সংগঠন কৃষক সমিতি।
১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহ জেলার আসাম ও পূর্ববঙ্গ সীমান্তবর্তী হাজং অধিবাসীরা তীর, ধনুক, বর্শা, বল্লম, রামদা প্রভৃতি নিয়ে লেদুবাস্তিত পুলিশ ক্যাম্প আক্রমণ করে। আক্রমণকারীরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে হামলা চালায়। পুলিশের পাল্টা আক্রমণ চালানাের ফলে ১০ জন হাজং নিহত হয় এবং বহু আহত হয়। পরে পুলিশ হাজংদের গ্রামে অভিযান চালিয়ে বহু হাজংকে গ্রেফতার করে। সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধানে জানা যায় হাজংরা সরকারি কর ও টংক সংগ্রহ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছিল। টংক প্রথা হলাে টাকার পরিবর্তে উৎপাদিত শস্যের অংশ ভাগ করে দেয়া। ৪ ফেব্রুয়ারি সংগঠিত ঘটনার কয়েকদিন পর ময়মনসিংহ ও আসাম সীমান্তবর্তী এলাকার গারাে ও
হাজং অধিবাসীরা পুনরায় সংগঠিত ও অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দূর্গাপুর ও হালুয়াঘাট থানা আক্রমণ করে। পুলিশ পাল্টা আক্রমণ চালালে ঘটনাস্থলে বহু হতাহত হয়। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুভব করে হালুয়াঘাট, নলিতাবাড়ী ও শ্রীবর্দী থানায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার উক্ত এলাকায় রাইফেল বাহিনী প্রেরণ করে।
ময়মনসিংহের হাজং অঞ্চলে সরকারের চরম অত্যাচার সম্পর্কে আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান টান্ডার্ড পত্রিকা সংবাদ প্রকাশ করলে পূর্ব বাংলা সরকার প্রেসনােটের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানায়। প্রেসনােটে বলা হয়, উক্ত পত্রিকা ঘটনা প্রসঙ্গে কিছু না জেনেই কল্পিত সংবাদ পরিবেশন করেছে। ১০০ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করার যে খবর পরিবেশিত হয়েছে, তা সত্যি নয়। মূলত কমিউনিষ্টদের প্ররােচনায় হাজংরা বিদ্রোহের আওয়াজ তােলে। মারাত্মক অরে সজ্জিত হয়ে তারাই প্রথম পুলিশদের আক্রমণ করে এবং একজন পুলিশ নিহত হয়। পুলিশের বারবার সাবধান করে দেয়া সত্ত্বেও তারা মারমুখী হয়ে আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। বাধ্য হয়ে তখনই পুলিশ গুলি চালায়। মোেট নিহতের সংখ্যা ১৩ জন। | ১৪ জানুয়ারি কমিউনিষ্ট সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশন হাজংদের ওপর পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভা আহবান করে। সভা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নিখিল পূর্ব পকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্যরা হামলা চালায়। সভাস্থল তছনছ করে দেয় এবং চেয়ার-টেবিল পুকুরে নিক্ষেপ করে। এরা আয়ােজক ছাত্রদের মারাত্মকভাবে আহত করে। সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় নিখিল পকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ গঠিত হয়েছিল। এদের প্রধান ও একমাত্র কাজ ছিল মুসলিম লীগ সরকারের নির্দেশে বিরােধীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা। এদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেই শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরউদ্দিন, নঈমউদ্দিন আহমেদ, আজিজ আহমেদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মতিন প্রমুখ নেতৃবর্গ “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ” গঠন করেন ।
একটি লিফলেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ দেশব্যাপী এক ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করে। কর্তৃপক্ষ আন্দোলন স্তিমিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দমনমূলক নীতি অবলম্বন করে। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্র সমাজ কোন জুলুমের ভয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। তারা আরাে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে আন্দোলনমুখী হয়েছে এবং প্রতিকুলতা কাটিয়ে মাথা উঁচু করে রেখেছে। সংগ্রাম পরিষদের লক্ষ্য অনুযায়ী সকল ছাত্র সমাজকে একত্র করে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দালালরা ছাত্র সংহতির মধ্যে ভাঙ্গন ধরানাের জন্য নানা প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি করেও ব্যর্থ হয়। জনগণের সামনে তাদের মুখােশ উন্মােচিত হয়েছে।
________________________________________
১৯৪৯ সালের জুনে প্রচারিত ঐ লিফলেটে আরাে বলা হয় যে ছাত্র ফেডারেশন নামক একদল অতিবিপ্লবী পরিস্থিতি বুঝে সুযােগ গ্রহণ করে। আন্দোলনের চেয়ে বিশৃংখলা সৃষ্টি করাই তাদের মুখ্য কাজ। বিগত ভাষা আন্দোলনে তারা উড়ে এসে আন্দোলনটিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। এবারের ছাত্র আন্দোলনেও তারা সুযােগ গ্রহণ করতে যেয়ে ব্যর্থ হয়েছে। ছাত্ররা তাদের অনুপ্রবেশ ব্যর্থ করে দিয়েছে। এবার তারা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে।
অন্যদিকে ছাত্র ফেডারেশন এক ইশতেহারে বলে, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ বারবার ছাত্র সমাজের সংগ্রামী জোয়ারে লাগাম টেনেছে। এরা নিখিল পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি ঐ দুই ছাত্র সংগঠনের পরস্পর বিরােধী বক্তব্যও চলতে থাকে।
পূর্ব পকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ তাদের লিফলেট ছাত্র সমাজকে কতিপয় বিষয়ে সতর্ক করে দেয়-(১) বিভেদ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ার; (২) বাম পন্থীদের চেহারা উদঘাটন করে আন্দোলন চালু রাখুন; (৩) সকল বন্দীর মুক্তির দাবি তুলুন; (৪) সরকারের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করুন; (৫) শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করুন; (৬) সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে গড়ে তুলুন।
উর্দুপক্ষীয় বাঙ্গালীদের বক্তব্য। উর্দুকে বাঙালীদের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বহু বাঙালী জোট বেঁধেছিল। তাদের বক্তব্য ও দাবিদাওয়া কেবল আলাপ-আলােচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। নিয়মিত সভা-সমাবেশ ও বিবৃতি প্রদান ছাড়াও তাদের সমর্থনে পত্রিকায় সম্পাদকীয় পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এমনি একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয় “মাহেনও পত্রিকায় ১৯৪৯ সালের ১৪ আগষ্ট সংখ্যায় । | ঐ সম্পাদকীয়তে বলা হয় “দুনিয়ার সকল স্বাধীন রাষ্ট্রের নিজস্ব ভাষা আছে। এ বিষয়ে তর্কের কোন জায়গা নেই। কায়দে আযম নির্দেশ দিয়ে গেছেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। কায়দে আযমের নির্দেশ যুক্তিসংগত। রাষ্ট্রভাষা হবার কাবেলিয়াত উর্দুই আছে। আনজাম এন্তেজাম শুধু বাকী। আর আলােচনার দরকার নেই। তবে যেহেতু তাবৎ সমালােচনা এ নিয়ে, তাই উর্দুকে উর্দু না বলে পাকিস্তানী ভাষা বলা যেতে পারে। ইসলামী কল্যাণে ও নিজস্ব শক্তি ও সৌন্দর্যের দৌলতে উর্দু মুসলমানদের নিকট খুবই আদরুণীয়। উর্দুর সব বুনিয়াত বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। উর্দু বলতে গেলে বাংলাভাষীদের খালাত ভাই । তথাকথিত সাহিত্যিক মাশরেকী ভাষা নয়। ভৌগােলিক ব্যবধানের কারণে মুসলিম মিল্লাতের তাবধারা ছিন্ন হতে পারে না।
বাংলা ভাষারও নাম পরিবর্তনের কথা উঠেছে। বাংলার মুসলমানী নাম পরিবর্তন করে পকিস্তানী করা যেতে পারে। পাকিস্তানের কল্যাণে এটা শুধু সংগত নয়, জরুরী। নাম পরিবর্তনে উর্দুর আসন বজায় থাকবে। পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের কাছে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। বাংলা আমাদের ভাষা হলেও আমরা বরাবর উর্দু।
________________________________________
চর্চার পক্ষপাতি। ইনশাআল্লাহ পাকিস্তান চিরস্থায়ী হবার জন্যেই এসেছে। পাকিস্তানী নামের বদলে উর্দু ভাষা পাবে তার পাকাপােক্ত আস্তানা পাকিস্তানের মাটিতে।”
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী মহল | হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল এক বিবৃতি প্রদান করেন। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত ঐ বিবৃতিতে তারা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের নিকট আবেদনে বলেন, দুই শত বছরের গােলামির পর আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। কিন্তু গভীর দুঃখের বিষয় যে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার কারণে আমাদের অশান্তি দেখা দিয়েছে। তাই দুই বাংলারই সংখ্যালঘুদের প্রতি উৎপীড়নকে আমরা মৃণা করি। এই ঘটনায় ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে ভেঙে পড়ার কারণ দুই দেশের প্রতিই অনাকাশিত চাপ বাড়ছে। এতে আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন হতে বাধ্য।
বিবৃতিতে আরাে বলা হয়, মহান স্রষ্টা বলেছেন, যে ব্যক্তি হত্যাকারী ও উ পীড়নকারী সে মনুষ্য জাতির শত্রু। হযরত মুহম্মদ (সঃ) সলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন জিমি বা দুর্বলকে কষ্ট দেয় সে আমাকেই কষ্ট দেয়। কাজেই মনে রাখা উচিত পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের দ্বারা অনুষ্ঠিত অন্যায়ের জন্য এদেশের হিন্দুরা কিছুতেই দায়ী হতে পারে
। মুসলমানদের মত তারাও এদেশের নাগরিক। কাজেই তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করাও আমাদের কর্তব্য। তাছাড়া হিন্দুরা এদেশে একজন মুসলমান নাগরিকের মত সকল রাষ্ট্রীয় অধিকার নিয়েই বসবাস করছে। অর্থাৎ সেও একজন পাকিস্তানী নাগরিক। কলকাতার সংগঠিত ঘটনার প্রতিবাদে এখানের নিরপরাধ হিন্দুদের ওপর কোন প্রতিশােধ নিলে তাতে হিন্দুস্তানের মুসলমানদের কোনই উপকারে আসবে না। বরং এতে তারা আরাে বিপন্ন হয়ে পড়বে। দেশে শান্তি বজায় থাকার দ্বারাই কেবল উভয় বাংলার সত্যিকার উপকার করা যেতে পারে।
আমরা হিন্দুভাইদের বােঝাব আপনারা সংগঠিত হয়ে জন্মভূমি ত্যাগ করবেন না। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ অনুসরণ করে হিন্দু-মুসলমান মিলন মন্ত্রকে গ্রহণ করুন। ক্রোধকে জয় করুন। রাষ্ট্রের সকল হিতাকামী মানুষ আপনাদের সাথে আছেন।
আবেদনকারী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ছিলেন| (১) ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, (২) ডঃ এম এন রায়, (৩) আর পি সাহা, (৪) আলী আহমেদ খান, (৫) বসন্ত কুমার দাস, (৬) আনােয়ারা খাতুন, (৭) আঃ খালেক, (৮) খায়রাত হােসেন, (৯) আব্দুল হাকিম, (১০) তফাজ্জল হােসেন, (১১) রাধাবল্লভ সাহা, (১২) আতাউর রহমান , (২৩) মােঃ নূরুল হুদা, (১৪) কফিল উদ্দিন চৌধুরী, (১৫) আলী আমজাদ, (১৬) শামসুল হক প্রমুখ।
________________________________________
পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ঘােষণা পত্র পাকিস্তানের যুব শক্তি যাতে দলমত নির্বিশেষে একটি সংগঠনে সমবেত হয়ে প্রগতিশীল আন্দোলন সৃষ্টির মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে সেই লক্ষ্যে তাদের কর্মসূচী ঘােষণা করে। সংগঠনের প্রচার দপ্তরের পক্ষে ৪৩/২ যােগীনগর, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ঐ প্রচারপত্রে বলা হয়
আজ পাকিস্তানের যুব সমাজ চরম সংকটের সম্মুখীন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে আমরা ভেবেছিলাম যে দুই শত বছরের বৃটিশ শােষণ ও অত্যাচারে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ শিক্ষা-শি, সম্পদে ভরে উঠবে। বৃটিশ পুঁজির দাসত্ব থেকে দেশ মুক্ত হবে। জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ ঘটবে। সেইসংগে মানুষ ফিরে পাবে তার নতুন জীবন। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাঁচ বছর। অথচ এখনাে দেশ বৃটিশ কমনওয়েলথের শিকলে বাঁধা। পাট-চা সহ বিঘ্নি ব্যবসার ওপর বৃটিশ পুঁজির কর্তৃত্ব অব্যাহত। সেই লক্ষ্যে জোট বেঁধে কতিপয় দেশীয় পুঁজিপতি তাদের সঙ্গে ভােগবিলাসে মত্ত হয়েছেন।
আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে এতদিনে শিল্পের কোন বিকাশ ঘটেনি। বিদেশী পণ্যেও পুঁজিপতিরা বাজারের একত্র দখল গ্রহণ করেছে। অর্থনীতি গত পাঁচ বহরেও ঔপনিবেশিক। দেশের ৮০ ভাগ মানুষ এখনও সামন্তবাদী জমিদারী প্রথার জাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। নামেমাত্র জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে। দেশের মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। এক মুঠো ভাতের জন্য সকাল-সন্ধ্যা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয়। সুন্দর জীবনের কোন প্রত্যাশা আজ তাদের সামনে নেই। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কোন চেষ্টা বা ইচ্ছেও সরকারের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মুসলিম লীগ সরকারের কর্মকান্ডে সবাই হতাশ হয়ে পড়েছে। যে আশায় সবাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিল সেই আশা সবার মন থেকে তিরােহিত।
যুব সমাজের যে অংশ রেলে কাজ করে, ডকে গতর খাটে, সূতাকলে পরিশ্রম করে, রিকশা চালায় এবং যারা দিনরাত্রি পশ্রিম করে জীবিকা নির্বাহ করে-তারা আশা করেছিল যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকার হয়ত জীবন ধারণের সর্বনিম্ন ব্যবস্থাটুকু তাদের জন্য করবে। শিক্ষালাভের সুযােগ ঘটবে এবং কর্মের স্থায়ী নিশ্চয়তা থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কল-কারখানায় ছাঁটাই চলছে। শিক্ষার আলাে নির্বাপিত । হু হু করে বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলছে। পাশাপাশি গড়ে উঠছে একশ্রেণীর ধনিক গােষ্ঠী, যাদের চলা-বলা সবকিছু জমিদারী আদলে।
মধ্যবিত্ত যুব সমাজের সেই স্বপ্ন যা তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে দেখেছিল -শিক্ষা, চাকুরী, ব্যবসা, সংস্কৃতি সব মিলিয়ে একটা ন্যূনতম জীবনের নিশ্চয়তা-তা আৰু বাস্তবের কঠিন আঘাতে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে। অভাবের তাড়নায় তারা আজ জর্জরিত। লাখ লাখ বেকার এক মুঠো ভাতের জন্য যেখানে সেখানে ধর্না দিচ্ছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করছে।
________________________________________
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যারা সবকিছু হারিয়ে মােহাজের হয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সরকারের কোন মাথাব্যথা নেই। সব দেখেশুনে চোখ বুজে কানে তুলা দিয়ে আছে। মাঝে-মধ্যে খবরের কাগজের মাধ্যমে সাহায্য করছে। কোন বাস্তব পদক্ষেপ নেই। নারী সমাজ ভেবেছিল যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সামাজিক অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে। তাদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা হবে। জীবনের সকল ক্ষেত্রে মর্যাদা পাবে। তাদের সেই আশা কল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও তাদের সামান্যতম উন্নতি ঘটেনি। পক্ষান্তরে সরকার সিলেটে মেয়েদের স্কুল, ঢাকার কামরুন্নেসা কলেজ, ইডেন স্কুল, বরিশাল ছাত্রীনিবাস ও জগন্নাথ কলেজে মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা তুলে দিয়ে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ অভিযান শুরু করেছে। অথচ আলজেরিয়ার মত মুসলিম রাষ্ট্র নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করে নিরক্ষতা দূর করা সম্ভব হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান অর্থনীতির মেরুদন্ড কৃষি। অথচ কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের মূল্য পানির মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। ৩০ টাকা মূল্যের পাট ১২ টাকায় নেমে এসেছে। ৭৫ টাকা মূল্যের সুপারি ১০ টাকা মনে বিক্রি হচ্ছে। শুল্ক ধার্যের কারণে এই অবস্থা, পক্ষান্তরে কৃষকের নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
যুব সমাজ মনে করেছিল পাকিস্তান লাভের পর বৃটিশের শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তনের ফলে দেশের মানুষ অশিক্ষার অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু তার পরিবর্তে সরকার ৫০ ভাগ স্কুলে তুলে দিয়ে শিক্ষা সংকোচনের নীতি বাস্তবায়ন করছে। চট্টগ্রাম জেলায় ৮৪৪ টি, নাটোর ৪০০টি স্কুল তুলে দেবার নির্দেম দেয়া হয়েছে। শিক্ষা খাতকে সংকুচিত করে যুদ্ধ খাতকে ৭২ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে শুধু নিরুৎসাহিত নয়, এক্ষেত্রে সরকার মাতৃভাষার দাবিকেও উপেক্ষা করে সকল অগ্রগতিকে রুদ্ধ করতে চায়। পাকিস্তানের মােট শতাংশের ৬২ জনের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষার দাবিকে উপেক্ষা করে উর্দুকে চাপানাে এক হীন ষড়যন্ত্র ও আরবী হরফে বাংলা লেখা ও শেখানাের গভীর চক্রান্ত করে আমাদের সকল উন্নতির পথ রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্র চলছে।
যুব সমাজ সরকারের প্রতি যে ঘােষণা ও দাবি জানায় তার মধ্যে ছিল -(১) যুদ্ধ নয় শাস্তি চাই; (২) প্রত্যেক ভাষাভাষী প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন; (৩) বৃটিশের সাথে সকল প্রকার সম্পর্কচ্ছেদ; (৪) পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা; (৫) যুব সমাজের জীবিকা অর্জনের জন্য নিশ্চয়তা: (৬) শিক্ষা ও সার্বজনীন ভােটাধিকার; (৭) সংস্কৃতি ও বিনােদনের জন্য পাঠাগার, খেলাধুলার জন্য ক্লাব প্রভৃতি; (৮) জনগণের চিকিৎসা জন্য যথেষ্ট হাসপাতাল; (৯) জমিদারী উচ্ছেদ করে কৃষকের হাতে জমি বন্টন (১০) বিদেশী শিল্পের জাতীয়করণ ও পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা; (১১) যুব সমাজের জন্য সামরিক শিক্ষা; (১২) সকল মামলা বাতিল ও গ্রেফতারকৃত ও সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তিদান; (১৩) সভা-সমাবেশ করার অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা: (১৪) সকল ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার (১৫) সাম্প্রদায়িকতার উচ্ছেদ
________________________________________
বাংলাভাষা সরলীকরণের চর্চা পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাংলা ভাষা নিয়ে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র চলে। বাংলা ভাষার অস্তিত্বের উপর সরাসরি আঘাত হানে পাকিস্তান সরকার। ভাষার বিলােপ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে প্রথমেই বাংলা ভাষাকে সরলীকরণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আরবী হরফে লেখার একটি অপচেষ্টা এক পর্যায়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ঐ প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাতে বলা হয়, ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান সরকার একটি ভাষা কমিটি গঠন করে ঐ কমিটিতে আবুল হাসনাত নামক একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে অন্যতম প্রধান সদস্যরূপে নিয়ােগ করা হয়। কিন্তু দেশের কবি-সাহিত্যিকসহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীবৃন্দ কমিটির সুপারিশের সঙ্গে একমত হননি। এদিকে সরকারি সিদ্ধান্তের আগেই জনাব হাসনাত আরবী হরফে বাংলা ও পত্রিকা ছাপানোের নির্দেশ প্রদান করেন। হাসনাত সাহেবের এই নির্দেশের পিছনে সরকারের কোন হাত আছে কিনা তা জনগণ জানতে চায়। একটা সরকারি অব্যবস্থাপনা দেশের সর্বত্র বিদ্যমান। জনাব হাসনাত বাংলা ব্যাকরণ স্বীকার করেন না। পত্রিকাটি আরাে বলে, এই পরিস্থিতিতে সকারের উচিত জনাব হাসনাতকে পুলিশের পদ থেকে দেশের ভাষা সংস্কার ও শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান করলেই ভাল হয়। এই প্রতিভাকে লিশের পদে আটকে রাখা কেন? এসব দেখেশুনে মনে হয় দেশের শিক্ষা বিভাগে কাজ করছেন প্রকৌশল বিভাগ আর স্বাস্থ্য বিভাগের কাজ করছেন গণপূর্ত বিভাগ এবং আয়কর বিভাগের লােকেরা পত্রিকা প্রকাশের কাজে নিয়ােজিত। এই যদি দেশের অবস্থা হয় তাহলে আমরা জানতে চাই হসানাতের এই কর্মকান্ডের পিছনে সরকার জড়িত কিনা যদি জড়িত হয় তাহরে নগণ ঐ প্রচেষ্টা প্রতিহত করবে।
উর্দুকে শ্রেষ্ঠ বানানাের পক্ষে বক্তব্য উর্দুকে শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে প্রমাণ করার পক্ষে ১৯৫১ সালের ১৫ এপ্রিল করাচিতে নিখিল পাকিস্তান উর্দু কনফারেন্সে’ তৎকালীন বাঙালী শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বলেন, পাক-ভারত উপমহাদেশের সকল মানুষকে উর্দুভাষা এক গ্রন্থিতে সংযুক্ত করেছে। উর্দুকে যার মাতৃভাষারূপে দাবি করে না তাল’ ও উর্দু উন্নয়নে সহযােগিতা করেছেন। একমাত্র উর্দুর রয়েছে সর্বজনীন গ্রহণক্ষমতা। উর্দু সাহিত্যে আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। জনগণের সঙ্গে রয়েছে তার নিকট সম্পর্ক। উর্দু হিন্দু শাসকদের আক্রমণ মােকাবেলা করে বৃটিশের এবং এদেশের জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
মুসলমানদের একটা জাতি হিসেবে টিকে থাকার সংগ্রাম আর উর্দুকে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম একই কথা। উদুই উপমহাদেশের মুসলিম তমুন ও তাহজীবের ভান্ডার। উর্দুই তাদের জাতিত্ববােধের প্রধান সহায়ক শক্তি। উর্দুর মাধ্যমে আলাপ-আলােচনা, সংবাদ আদান-প্রদান চলবে। উর্দু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মৌলিক ভাবধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত। উর্দু এবং বাংলা মিলিত হয়ে উভয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করবে।
________________________________________
তিনি আরাে বলেন, পকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ‘৪৭ সালের নভেম্বর মাসে করাচিতে এক কনফারেলে উর্দুকে জাতীয় ভাষারূপে গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিদ্ধান্ত কায়েদে আযম “বাব্য-এ-মিল্লাত” অনুমােদন করেন। এবং এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, যে সকল স্কুলে শিক্ষার বাহন উর্দু নয় সেখানে উর্দুকে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া সরকার ইংরেজির স্কুলে উর্দুকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষার মাধ্যম করার বিষয় সুপারিশ করেছেন।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পর উর্দুর ওপর নতুন দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। সর্বকালের গ্রহণীয় ভাষা উর্দুকে রক্ষার্থে আমাদের অচিরেই আরাে যত্নবান হতে হবে। তিনি সকল লেখক-সাহিত্যিককে উর্দু ভাষায় সাহিত্য রচনার জন্য আহবান জানিয়ে বলেন, উর্দু কনফারেল ভাষা ও সাহিত্যের তরীর জন্য নতুন পথের সন্ধান দেবে।
ভাষা অন্নে নাজিমুদ্দিন ১৯৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ২৬ জানুয়ারী পল্টন ময়দানে এক জনসভায় “রাষ্ট্র খেদমতে আত্মনিয়ােগ করার অনুরােধ জানান। প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত জনসভায় তিনি বলেন, কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর আমার ঘাড়ে’ গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, ইতিপূর্বে যারা সকল ক্ষেত্রে আমাকে সহযােগিতা করেছেন আজও আমি তাদের সহযােগিতা চাই। ইতিমধ্যে সরকার জমিদারী উচ্ছেদের বিল পাস করেছেন। যারা কোন উন্নতি হয় না বলে চিৎকার করেন তারা নিরপেক্ষ কথা বলেন না।
প্রাদেশিকতার বিরুদ্ধে তিনি বলেন, পাকিস্তানকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করতে চাই। এক্ষেত্রে কোন প্রাদেশিকতার বীজ বপন করা চলবে না। প্রাদেশিকতাকে যারা প্রশ্রয় দেয় তারা পাকিস্তানের দুশমন।
ভাষা প্রশ্নে নাজিমুদ্দিন মরহুম কায়দে আযমের বক্তৃতা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। একধিক রাষ্ট্রভাষা থাকলে সেই দেশ কোন শক্তিশালী দেশ হতে পারে না।
একুশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনাপঞ্জী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাপঞ্জী ও একুশের ইতিহাস সম্পর্কে ‘৫২ সালে প্রকাশিত “একুশে ফেব্রুয়ারী” নামক সংকলনের কবিরউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৮ সালে ছাত্রসমাজ, সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীবৃন্দ প্রথমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। তখন থেকেই সরকারের চূড়ান্ত দমননীতি নেমে এসেছিল তাদের ওপর। ছাত্র-জনতার দূর্বার আন্দালনের মুখে বিশ্বাসঘাতক নাজিমুদ্দিন আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। তিনি পূর্ববঙ্গ আইন সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে স্বীকার করে প্রস্তাব পাস করেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ থেকে ৫২ এই চার বছরে
________________________________________
সেই আইন কার্যকর হয়নি। নাজিমুদ্দিন তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। মুসলিম লীগ সরকারর সেই বিশ্বাসঘাতকতাই জনসাধারণের মনে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল।
ঘটনাচক্রে খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলেন। ‘৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি পূর্ববঙ্গ সফরে এস পল্টন ময়দানে এক জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের ইতাষা করার ঘােষণা দেন। সেই ঘােষণা বাংলা কোটি কোটি মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তােলে। প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তােলার শপথ গ্রহণ করে ৩০ জানুয়ারী ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেয়। ১৯৪৮ সালে আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠিত হয়। ৫২’র ভাষা আন্দোলনকে তারাই সংগঠিত রূপ দেয়। পরবর্তীকালে কাজী গােলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ”।
সর্বদলীয় কর্মপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ৫২’র ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমবেত হয়ে এক সভা করে। সভাশেষে প্রায় ৫০০০ ছাত্র-ছাত্রীর এক বিশাল মিছিল সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। বিকালে কর্মপরিষদের সভায় বক্তব্য রাখেন মওলানা ভাসানী, আবুল হাসেম ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হবে। সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ঘর্মঘটের ডাক দেয়া হয় এবং ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রস্তুতি চালানাের কথা বলা হয়।
অন্যদিকে কর্মপরিষদের ধর্মঘটের ডাকে ভীত হয়ে অসহায় সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্রমাগত ১ মাসের জন্য ঢাকা জেলার সর্বত্র সভা-সামবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। সর্বত্র মানুষের প্রতিক্রিয়া বিক্ষোভে রূপ নেয়। একদিকে সরকারের চূড়ান্ত দমননীতি, অন্যদিকে জনসাধারণের তীব্র অসন্তোষ- এ অবস্থায় কর্মপরিষদ এক সভা ডাকে। ছাত্ররা পরিস্থিতি আলােচনা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পরে ঐ সিদ্ধান্ত অভ্যন্তরীণ মতবিরােধের কারণে প্রত্যাহার করা হয়। অলি আহাদ আন্দোলনের পক্ষে জোর মত ব্যক্ত করেন।
| একুশের সকাল থেকেই মানুষের মধ্যে শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে ক্রোধের ছাপ লক্ষ্য করা যায় । কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আগে থেকেই ধর্মঘটের প্রতি একটা অনুকুল মনােভাব তৈরি হয়েছিল। ১২টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের ভিড় বাড়তে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহবায়ক আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছেড়ে দেন। এই পর্যায়ে শামসুল হক ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ব্যাপারে যে বক্তব্য রাখেন তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে তিনি ও কর্মপরিষদের নেতৃবৃন্দ সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান।
অতঃপর পরিস্থিতি আলােচনা করে ছাত্ররা মিছিল করে অগ্রসর হতে থাকে। পুর্ব থেকেই গেটের বাইরে ছিল পুলিশ বাহিনী। তারা মিছিলকারী ছাত্রদের গ্রেফতার করতে
শুরু করে। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের ট্রাকে ভরে লালবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকায় পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এই পর্যায়ে ছাত্ররা অধিক মাত্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা মেডিকেল কলেজ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ বিভিন্ন স্থানে সমবেত হতে থাকে এবং সেইসঙ্গে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হলে পুলিশ গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে রফিক ও জব্বার নিহত হয়। হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে বরকত । অনেককে মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই ঘটনার পর পরিস্থিতি পুলিশ ও জনতা উভয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শহরের সমস্ত মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৪৪ ধারার নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে যায়। অফিস-আদালত কোর্ট-কাছারী সকল স্থান থেকে মানুষ স্রোতের মত রাস্তায় নেমে আসে। মেডিকেল হােষ্টেলের ব্যারাকে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তােলা হয়। মানুষ তখন কেবল প্রতিশােধের স্পৃহায় জুলতে থাকে । তীব্র ক্রোধে সবাই শেষ মুহুর্তের অপেক্ষায় উদ্বিগ্ন। এসময় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন চলছিল। বিরােধী সদস্যরা ছাত্রদের বিরুদ্ধে গুলি চালানাের কৈফিয়ৎ চান এবং পরিষদ মুলতবী ঘােষণার দাবি করেন। এই পর্যায়ে নূরুল আমিন বলেন “কয়েকজন ছাত্রের জখমের বিষয় নিয়ে ভাবাবেগচালিত হলে চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদ ওঠ। আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ তীব্রভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন এবং পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে আন্দোলনরত ছাত্রদের সংগে যােগ দেন।
২২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাগুলো এই মর্মে খবর দেয় যে, পুলিশের গুলিতে ৩জন নিহত, কয়েক শত আহত এবং অসংখ্য আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছাত্রদের ওপর গুলি চালানাের খবর দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র মানুষ দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত বন্ধ করে রাস্তায় নামে। এইদিন মেডিকেল কলেজের ভেতর গায়েবানা জানাযা পড়া হয় । ইমাম সাহেব তার মােনাজাত বলেন, “হে আল্লাহ, যারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে তারা যেন দুনিয়ার বুক থেকে ধ্বংস হয়ে যায়।” জানাযা শেষে প্রায় লাখ লােকের মিছিল বের হয়। মিছিল যখন জগীরূপ ধারণ করে তখন কোন প্রকার পূর্বঘােষণা ছাড়াই পুলিশ গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে নিহত হয় শফিউর রহমান। এই অবস্থায় মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে কয়েকদিকে এগুতে থাকে। | এইদিন সকালে বিপ্লবী জনতা “দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকা পুড়িয়ে দেয় । এখানে সেনাবাহিনী জনতার উপর গুলি চালায়। হতাহত হয় অনেক। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানাের প্রতিবাদে সন্ধ্যায় শহরের মহল্লায় মিছিল বের হতে থাকে। ঢাকা ছাড়াও এদিন দেশের বিভিন্ন শহরে জনতা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট করে । “আজাদ” সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রতিবাদ জানিয়ে পার্লামেন্ট বর্জন করেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি মিল্লাত তার সম্পাদকীয়তে লেখে যে গত দুদিনে পুলিশের গুলি চালনায় যেসব লােক নিহত হয়েছেন, পুলিশ তাদের ফেরত দেয়নি। ইসলামী নীতি ও
________________________________________
বিধান অনুসারে তাদের দাফন হওয়া দরকার। অথচ সরকার লাশগুলাে অভিভাবকদের ফেরত না দিয়ে ইসলামবিরােধী কাজ করছে। এই সরকার ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষক হিসেবে আর নিজেদের দাবি করতে পারে না। এদিনের পত্রিকায় ৫জন নিহত হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়। সারাদেশ বারুদের মত জ্বলে ওঠে। অন্যদিকে সরকারের ব্যাপক ধরপাকড় ও পুলিশী নির্যাতন ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। | ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একটানা আন্দোলন চলতে থাকে। সরকারের সমস্ত কাজে শ্রমিক-কর্মচারীবৃন্দ অসহযােগিতা করে। সরকার তার পতনের আশঙ্কায় ভীত হয়ে ওঠে, রাস্তায় রাস্তায় মিলিটারী টহল জোরদার হয়। আইন পরিষদের সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৫ তারিখ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। মিলিটারী সমস্ত হল, স্কুল-কলেজ থেকে মাইক ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং ১০০ জনকে গ্রেফতার করে। মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্রদের তৈরি স্মৃতিস্তম্ভটি আর্মিরা উড়িয়ে দেয়। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মেয়েরা পৃথকভাবে মিছিল করে সমবেত হয় এবং মিছিল করে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানায়। এদিন আবার কর্মপরিষদের সভা আহবান করা হয় এবং শহীদ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় ৩৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানানাে হয় এবং নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন নিয়ােগের দাবি। জানানাে হয়। | ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় । ছাত্র-ছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। সমস্ত শহরে সরকারের নিপীড়ন – উ পীড়ন চরমভাবে বৃদ্ধি পায়। ব্যাপকহারে ধরপাকড় শুরু হয়। এই সময় সংবাদপত্রগুলাের চরিত্র আশ্চর্যজনকভাবে বদলে যায়। তারা আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রের শত্রু বলে খবর প্রকাশ করে। | ২৭ ফেব্রুয়ারি পুলিশ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নয়জন নেতাকে গ্রেফতার করে। ইতিপূর্বে ৫ মার্চ ঢাকা শহরে দিবস আহবান জানান হয়েছিল, সেনাবাহিনী তা প্রতিরােধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেয়। সরকার জনগণের প্রচন্ড দাবির মুখে নামমাত্র তদন্ত কমিশন নিয়ােগ করেন। মােজাফফর আহমেদ, অজিত গুহ, অলি আহাদ, মােঃ তােয়াহা, মুনীর চৌধুরী দীর্ঘদিন জেল খাটেন। পরবর্তীকালে ৫২ একুশ তার নিজস্ব ইতিহাস নির্মাণ করে।
মন্ত্রীসভার পদত্যাগ দাবী ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবি করার প্রেক্ষিতে ছাত্রদের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন চালায় তার প্রক্ষিতে দৈনিক আজাদ এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে ২৩ ফেব্রুয়ারী। আবুল কালাম শামসুদ্দিন লিখিত ঐ সম্পাদকীয়তে বলা হয়
________________________________________
ঢাকা শহরে যে বর্বরােচিত হত্যাকান্ড ঘটেছে তা শুধু মানুষকে শােকাহত করেনি, বরং তাদের আরাে বিদ্রোহী করেছে। নূরুল আমিন ও তার সরকার তদন্তের কথা বলেছিলেন কিন্তু তার কোন ব্যবস্থা হয়নি। এখনাে ১৪৪ ধারা জারি রয়েছে। ফলে প্রতিদিন মানুষের রক্তে রাজপথ রক্ষিত হচ্ছে। সরকারের চরম ব্যর্থতা ফুটে উঠেছে। আমরা এই মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করছি। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবি জানিয়েছে তা ন্যায়সঙ্গত । এক্ষেত্রে পাকিস্তান আইনসভার সদস্যদের বাংলার দাবিদাওয়া প্রতিষ্ঠার ভার গ্রহণ করতে হবে। | গভর্নরের কাছে লিখিত পদত্যাগপত্রে তিনি বলেন, “বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবি করার অপরাধে পুলিশ যে বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে তার প্রতিবাদে আমি পরিষদ সভার সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি। নূরুল আমিন সরকারের একজন সমর্থক হয়ে আমি এই পরিষদে থাকতে চরম লজ্জা ও ঘৃণা রােধ করছি। একই ধরনের প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করেন জাতীয় পরিষদের অপর সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।
ভাষা প্রসঙ্গে লেখা সম্পাদকীয় ১৯৫২ সালে ভাষা প্রসঙ্গে একটি মূল্যবান প্রসঙ্গে ছাপা হয় নওবেলাল পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় । বিশিষ্ট কমিউনিষ্ট নেতা খােকা রায় আলী আশরাফ ছদ্মনামে “সকল ভাষার সমান মর্যাদা” নামক প্রবন্ধটি লেখেন। প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি বলেনঃ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু এ মতই বর্তমানে প্রচলিত। এ থেকেই আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি জানাচ্ছেন যে পূর্ব বঙ্গের স্কুলগুলােতে যেভাবে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতেও বাংলাকে বাধ্যতামূলক করা হােক। প্রগতিশীল মহল মনে করছেন রাষ্ট্রভাষার যে দাবি উঠেছে তাতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের এবং উর্দুকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হলে সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু তাতে গণতান্ত্রিক সমাধান হবে না। | কেননা যে নীতি অনুসারে আমরা মাতৃভাষার সমাধান চাচ্ছি সেই নীতি অনুসারে অন্যদের ও তাদের ভাষার অধিকার দিতে হবে। পাকিস্তানের জনগণ শুধু বাংলা ও উর্দু এই দুই ভাষাতেই কথা বলে না। রাষ্ট্রের অধীনে আরাে ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে, যেমন- পশতু, সিন্ধী, পাঞ্জাবী, বেলুচি, গুজরাটি প্রভৃতি এবং এসব ভাষাভাষী গােষ্ঠীর নির্দিষ্ট ও স্থায়ী। আবাসভূমি রয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক জীবন আছে রয়েছে নিজস্ব কৃষ্টি ও ইতিহাস।
মুসলিম লীগ এইসব বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করে কেবল উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করতে চাইছে, যা প্রতিক্রিয়াশীলতার পর্যায়ে পড়ে। এই ব্যবস্থা যদি কার্যকরী হয় তাহলে অন্যান্য ভাষাভাষী ও সম্প্রদায়ের ওপর এই ভাষা চাপিয়ে দেয়া হবে, যা স্বৈরাচারী ও গণতন্ত্রবিরােধী। তাছাড়া আরাে যে সমস্যা রয়েছে তা হল ঐ সম্প্রদায়গুলাে এতে ক্ষেপে উঠবে এবং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। জাতিগত বিরােধ আরাে চরমে উঠবে। কাজেই এ আওয়াজ পরিত্যাজ্য।
________________________________________
বহু ভাষাভাষী জাতির মিলন কেন্দ্র পাকিস্তানের ভাষা-সমস্যার গণতান্ত্রিক সমাধানের মুলনীতি হবে সকল ভাষাভাষীকে সমান অধিকার দেয়া। সে ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য নিন্মলিখিত দাবিগুলি সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ করা যেতে পারে(১) কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সমস্ত আইন, ঘােষণা, দলিল প্রভৃতি বাংলা, উর্দু, সিন্ধী, পাঞ্জাবী, গুজরাটি, পশতু ও বেলুচ ভাষায় প্রকাশ করতে হবে; (২) কেন্দ্রীয় আইন সভার সকল সদস্য নিজ নিজ ভাষায় বক্তব্য রাখতে পারবেন; (৩) প্রত্যেক ভাষাভাষী জনগণ প্রদেশের রাষ্ট্রকর্ম ও আইন-আদালত চালাবেন নিজ নিজ ভাষায়; (৪) উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে উপজাতীয় ভাষায় নিজ নিজ কর্ম চলবে; (৫) সকল জনসমষ্টি তার নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ করবে।
| মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বক্তব্য পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে ১৯৫২ সালের ৩ মার্চ এক বেতার ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, “কমিউনিষ্ট ও বিদেশী চরেরা ধ্বংসাত্মক চক্রান্তের মাধ্যমে দেশকে নষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত। তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আপনাদের অবহিত করানাে আমার কর্তব্য। ২১ ফেব্রুয়ারি যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করা হয়েছে তা পাকিস্তানের বিরােধীদের কাজ। তারা কখনাে পাকিস্তানকে মানতে পারেনি। পাকিস্তানের ধ্বংসে আজ তারা লিপ্ত হয়েছে। এদের চর বিশ্ববিদ্যালয়েও রয়েছে। তারা শাসন ব্যবস্থাকে বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এরা এতদিন সুযােগের অপেক্ষায় ছিল। আজ বাংলা ভাষায় আড়ালে এরা জনগণের আবেগকে পুঁজি করে তাদের হীন চেষ্টা চালাচ্ছে।
এ কথা স্পষ্ট যে প্রাদেশিক আইন সভার অধিবেশনের প্রথম থেকেই এরা গােলমাল করার পরিকল্পনা করে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে: ভাষার প্রশ্নে করা হয়নি। ঢাকায় যা ঘটেছে তা চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্রের এবং জনসমর্থন লাভের একটা চেষ্টা মাত্র। এতে ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুরা সামান্য হলেও কিছুটা ফললাভ করেছে। আমাদের কোমলমতি যুবক ও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ঢাকায় সংগঠিত ঘটনা তারা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়। এইসব রাষ্ট্রীয় দুশমনদের সাধারণ মানুষ চিনতে পারেনি।
উর্দুভাষী ও বাংলাভাষী মানুষের মিলনের ফলে উভয় ভাষার মানুষের উন্নতি ঘটেছে এবং তাদের মধ্যেকার ব্যবধান দূর হচ্ছে। আসলে ভাষার প্রশ্নটা মােটেই আসল প্রশ্ন নয়। এটা ভাষার প্রশ্নের আড়ালে একটা গভীর দুরভিসন্ধি ! পাকিস্তান ও তার সরকারকে ধ্বংস করার চক্রান্ত মাত্র। আজ যুক্ত বাংলার প্রশ্ন উঠেছে। এ থেকেই ষড়যন্ত্রের জাল কতদূর বিস্তার করেছে তা বােঝা যায়। এই ষড়যন্ত্রকারীরা মুসলিম লীগ থেকেও কিছু সদস্যকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। সংবাদপত্রগুলােকে ভয় দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে সংবাদ প্রচার করাচ্ছে। কর্মচারী ও কর্মকর্তাদেরও তারা কাজে যােগ দিতে দিচ্ছে না।
________________________________________
রেডিও, টেলিফোন, ট্রেন সব স্থানে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রশ্নে সরকার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এখন বাধ্য।
এদেশের বিত্তশালী লােকেরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে নয়। আমরা পাকিস্তানের ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নে করতে চাই। ভাষাভাষী প্রশ্নে এখানে কোন বিরােধ নেই।
যুবলীগের রাজনৈতিক ঘােষণা | পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ২৭ মার্চ ৫২ তে দাবি দিবস উপলক্ষে তাদের রাজনৈতিক ঘােষণা প্রকাশ করে। ঐ ঘােষণায় তারা বলে-পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাঁচ বছরেও তাদের কোন প্রত্যাশা পূরন হয়নি, এবং যে আশংকা নিয়ে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অংশ নিয়েছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। তাই আজ তারা তাদের সংকটময় জীবনের অবসানকল্পে ১৪ দফা দাবির ভিত্তিতে নতুন করে সংঘবদ্ধ হতে চায়। প্রধান প্রধান দফগুলাের মধ্যে ছিল(১) মানবতা-বিরােধী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধ চাই না; (২) বৃটিশ কমনওয়েলথ থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তান একটি সুখী রাষ্ট্রে পরিণত হােক, সকল ভাষাভাষী জনগণ নিজ নিজ প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হােক; (৩) বেকারত্বের অবসান ও জীবিকার নিশ্চয়তা; (৪) সর্বজনীন ভােটাধিকার ও যুক্ত নির্বাচন (৫) যুদ্ধ খাতে ব্যয় কমানাে ও শিক্ষা খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ; (৬) কৃষকের হাতে জমি প্রদান; (৭) শ্রমিকের স্বার্থে আট ঘন্টা শ্রম ও তাদের উপযুক্ত মজুরি; (৮) সকল দাসত্বমূলক আইন প্রত্যাহার; (৯) নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার; (১০) সকল সাম্প্রদায়িতার অবসান।
বাংলাভাষার পক্ষে একটি নিবন্ধ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার একমাস পূর্বে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব” শিরােনামে মাহবুব জামান লিখিত একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ইত্তেফাক পত্রিকার ২০ জুলাই ১৯৪৭ সালের সংখ্যায় । ঐ নিবন্ধে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা নিয়ে ব্যাপক আলােচনা হচ্ছে। বাংলা ও উর্দুকে নিয়ে এই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। এটি কোন উচ্ছাস-আবেগের ব্যাপার নয়। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে প্রত্যেকটি ভাষার দাবি বিচার করতে হবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ভাষার গুণাবলী বিচার করা প্রয়ােজন। রাষ্ট্রীয় ভাষা হতে গেলে তার কতিপয় বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, যেমন-ভাষাভাষীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় হলে চলবে না। ভাষাভাষীর প্রতিপত্তি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে ইত্যাদি।
পাকিস্তানের জনসংখ্যায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ বাংলার কথা বলে থাকে; সুতরাং উপযুক্ততার ক্ষেত্রে বাংলার দাবি অগ্রগণ্য। যদি গণভােটে ডাষা সমস্যার সমাধান হতাে তাহলে বাংলা ভাষাই হত সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু তাতে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর অবিচার করা হয়। প্রাদেশিক রাষ্ট্রে প্রাদেশিক ভাষাকেই কর্তৃত্বে রাখা উচিত। পূর্ব
________________________________________
ইংরেজরা পাক-ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতিকে পশ্চাৎপদ রেখে সাম্রাজ্যবাদী শশাষণ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখার জন্য ইংরেজি ভাষাকে চালু করেছিল। মুসলিম লীগ সরকার সেই একই উদ্দেশ্যে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে। বাংলাকে পশ্চাৎপদ রাখতে পারলে বাঙালীকে পেছনে রাখা সম্ভব হবে। ফলে পশ্চিম পকিস্তান তার কাশিত লক্ষ্যে পেীছাতে পারবে। তাই তাদের সকল ষড়যন্ত্রকে প্রতিরােধ করতে হলে আজ সকল ভাষাভাষীকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
কমিউনিষ্ট পার্টি তাদের অপর প্রচারপত্রে বলে, নূরুল আমীন সরকার ভাষা আন্দোলন প্রতিহত করতে যেয়ে অসংখ্য দেশপ্রেমিক কর্মীকে হত্যা করেছে। কিন্তু যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে জীবন উৎসর্গ করেছে তারা জীবনে চিরশ্বরণীয় হয়ে থাকবে। বিক্ষুব্ধ মানুষ অবশ্যই নুরুল আমীন সরকারের বর্বর হত্যাকান্ডের জবাব দেবে। মুসলিম লীগ সরকার সংকট সমাধানের পরিবর্তে তাকে বাড়িয়ে তুলেছে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনকে তারা রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চায়। কাজেই সকল ভাষাভাষী মানুষের প্রথম কাজ হবে এই সরকারের উচ্ছেদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। সবাইকে এক সঙ্গে আওয়াজ তুলতে হবে-(১) নূরুল আমিন গদি ছাড়, (২) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি চাই, (৩) হত্যাকারীর শাস্তি চাই, (৪) সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাও, (৫) নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার কর এবং শহীদদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন শপথ গ্রহণ করুন।
গণতন্ত্রী দলের আত্ম প্রকাশ | কনফেডারেশন গঠনের দাবি নিয়ে ১৯৫৩ সালের ১৭, ১৮, ১৯ জানুয়ারী ঢাকার আরমানীটোলায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে আগত প্রতিনিধিবৃন্দ “পূর্ব পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল” গঠন করেন। অভ্যর্থনা কমিটির প্রধান দেওয়ান মাহবুব আলী সম্মেলনে অংশগ্রহণ কারীদের প্রতি তার ভাষণে বলেন, দেশের বর্তমান সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য একটি যুক্তরাষ্ট্র’ গঠনের প্রয়ােজন দেখা দিয়েছে। ইংরেজ প্রবর্তিত বর্তমান শাসনতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের নামান্তর। মুসলিম লীগ সরকার ধনীদের প্রতিনিধিত্ব করছে। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কোন চেষ্টা নেই । দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ উৎখাত করে সকল নাগরিককে সমান অধিকার প্রদানের জন্য গণতন্ত্রী দল গঠিত হয়েছে। দলের আহবায়ক মাহমুদ আলী তার বক্তৃতায় বলেন, দেশ শাসনে মুসলিম লীগ সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের মানুষ চরম অবস্থার মধ্যে পৌঁছেছে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে তারা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বৃটিশের নির্দেশে এখনাে দেশ পরিচালিত হচ্ছে। নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি এখন অপরিহার্য।
সভায় পাঞ্জাব প্রদেশের শওকত হায়াত খান, আব্দুস সালাম, মাহমুদ আলী বক্তৃতা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানী বক্তারা সরকারের কঠোর সমালােচনা ও কনফেডারেশন গঠনের দাবি করে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের গদিতে বসে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাগ্য
________________________________________
উন্নয়ন এবং তাদের দুঃখ-দুর্দশা বােঝা সম্ভব নয়। বক্তারা জনগণকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
সভায় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মােতাবেক হাজি দানেশ সভাপতি মুজিবুর রহমান খান, আব্দুল জব্বার (খুলনা), দবির উদ্দিন চৌধুরী (সিলেট), মহিউদ্দিন আহমেদ (সাংবাদিক), রফিকুল ইসলাম (চাঁদপুর) সহ-সভাপতি মাহমুদ আলী সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মাহবুব আলী ও দেওয়ান আতাউর রহমান (রাজশাহী)-কে যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত করে ২১ সদস্যের নির্বাহী কমিটি গঠিত হয়।
যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে শেখ মুজিব | যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক সভায় ১২ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে তার বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান হবার পূর্বে যারা একজাতিতে বিশ্বাস করতেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তারা দুই জাতিত্বে বিশ্বাস করছে। ইসলাম বিশ্বাস করে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব। আজ একদল লােক খােদাকে ছােট করতে চায়। তারা বলছে, আল্লাহ কেবল মুসলমানদের, দুনিয়ার অন্য কোন মানুষের জন্য আল্লাহ নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ দুনিয়ার সব মানুষের। তিনি পৃথিবীর সব মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখেন।
“দুই জাতি থিওরি” প্রসংগে কেউ কেউ বলছেন, পাকিস্তানের দুটি জাতি আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান প্রভৃতি মিলিয়ে ৬-৭টি জাতি আছে। জাতীয় পরিষদে যখন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন হয় তখন সভাপতিত্ব করেছেন মিঃ গিবন যিনি ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বিশ্বাস করেন না। অথচ তিনি আমাদের শাসনতন্ত্র পাশ করেছেন। জাতীয় পরিষদের ৮৩ জন সদস্যের মধ্যে ১২ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ইসলামী শাসতন্ত্রে ভােট দিয়েছেন। কোন জাতিভেদ সেখানে কাজ করেনি। এভাবে ধর্মের নামে যুগে যুগে মানুষকে প্রভাবিত করা হয়েছে।
পৃথিবীতে ৫০ কোটি মুসলমানের মধ্যে মাত্র সাড়ে চার কোটি পূর্ববঙ্গের বাস করে। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ায় ৭ কোটি মুসলমান রয়েছে। সেখানে হিন্দু, খৃষ্টান ও বৌদ্ধ রয়েছে। সেখানেও যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু আছে। টার্কিতে প্রেসিডেন্ট মুসলমান, সেখানেও যুক্ত নির্বাচন। ভারতের চার কোটি মুসলমান হিন্দুদের সঙ্গে ভােট দেয়। রাশিয়াতে যুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অথচ আমাদের দেশে ফতােয়া দেয়া হয়েছে যে যুক্ত নির্বাচনে ভােট দিলে সবাই কাফের হয়ে যাবে। আজ বলা হচ্ছে দুই জাতির ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছে কিন্তু যখন দেশ ভাগ হলাে তখন তিন কোটি মুসলমানকে ভারতে ফেলে আসা হলাে কেন? এক জাতিতে বিশ্বাসীরা কেন সেদিন তাদের ফেলে এলাে। আজ যারা একথা বলছে তারা নিজেদের সাথে বেঈমানী করছেন।
________________________________________
শেখ মুজিব আরাে বলেন, ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আসেনি। এর পেছনে অন্য যে কারণ ছিল তা হলাে মুসলমানদের দুরাবস্থা। এই আর্থিক দুরাবস্থা থেকে মুক্তিলাতের সংগ্রামের সংগে সংগে ধর্মীয় আন্দোলন যুক্ত হয়ে পড়ে। চার কোটি মুসলমান ভারতের যুক্ত নির্বাচনে ভােট দেয়। তখনই কেবল এক জাতির ভিত্তিতে নির্বাচন হতে পারে যদি ভারতের চার কোটি মুসলমানকে এখনাে আনা সম্ভব হয়। যুক্ত নির্বাচনে ভােট দিলে মানুষ অমুসলিম হয়ে যায় না। ইসলামের নামে মুসলমানকে কেবল ধোকা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু তাতে শুধু মুসলমানেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অগ্রগতির পাল্লায় তারা পিছিয়ে পড়েছে। কেবল ইসলামী দোহাই দেওয়ার ভিত্তিতে মুসলমান রাষ্ট্রগুলাে তৃতীয়-চতুর্থ গ্রেডের রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে। বিশ্বের অসংখ্য দেশে যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু রয়েছে। পাকিস্তানে শুধু কথায় কথায় ইসলামের দোহাই দেয়া হয়। অথচ মানুষের দুঃখের সীমা নেই। কিন্তু প্রকৃত ইসলাম তা নয়। প্রকৃত ইসলামের অর্থ হলাে সেখানে জুলুম থাকবে।
, ঘুষ থাকবে না, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। সবাই খেতে পারবে, পরতে পারবে। মাথা গোঁজার স্থায়ী নিশ্চয়তা থাকবে। শিক্ষা পাবে, চিকিৎসা পাবে। শুধু মুখের কথার সঙ্গে কাজের সম্পর্ক থাকতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান স্পীকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই হাউজে ৭২ জন মাইনরিটি সদস্য রয়েছেন। সেক্ষেত্রে যদি যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু না হয় তাহলে কি একটি এসেম্বলিতে চলবে, না তাদের জন্য আলাদা এসেম্বলি করতে হবে? হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে ভােট দিলে যদি ইসলাম নাজায়েজ হয় যায় তাহলে এসেম্বলিতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান একসঙ্গে ভােট দেয় কেমন করে? হিন্দু-মুসলমান সবাই একসঙ্গে ভােট দিয়ে এই হাউজে স্পীকার নির্বাচন করেছে। পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র। করেছে। এ পর্যন্ত যত আইন পাস হয়েছে তাও যৌথ মতের ভিত্তিতে।
আমরা দেশের মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত নই ঠিকই কিন্তু তারা মৃর্থ নয়। তারা জেনেশুনেই যুক্ত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। আমরা পরিষদে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান একসঙ্গে বসে আইন করছি, তবে জনগণ কেন একসঙ্গে ভােট দিতে পারবে না? মুসলিম শীগ বলহে যুক্ত নির্বাচন নাজায়েজ, তাহলে আমরা পূর্ব বাংলার যে ৪৫ জন সদস্য রয়েছি যারা একসঙ্গে কাজ করছি সেটাও তাহলে নাজায়েজ। আজ একথা স্পষ্ট হয়েছে যে, যারা জনগণের মঙ্গল চায় না, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সর্বদা তৎপর থাকে সেইসব সুযােগ সন্ধানী লােকেরাই আজ যুক্ত নির্বাচনের বিরুদ্ধে।
একজন সদস্য বলেছেন তারা মাইনরিটিদের খাটো করে দেখেন না। যদি না দেখেন তাহলে ইসলামিক রিপাবলিক না করে পাকিস্তান রিপাবলিক করা হােক। ইতিপূর্বে আমরা এ বিষয়ে আন্দোলন করেছি। আমরা রাজনীতিতে কোন ভেদাভেদ চাইনি। সাম্যের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার কথা বলেছিলাম। অন্যায়-অনাচার থেকে সব মানুষ একইভাবে মুক্তি পাবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা ছিল। দেশ অন্যায়-অনাচারে ঘুষ-দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। অশিক্ষায় বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যায়, সেক্ষেত্রে কেবল ইসলামিক রিপাবলিক
________________________________________
টিকিয়ে রাখলে লাভ নেই। আমরা পৃথিবীকে দেখাতে চাই যে এখানে সব মানুষ সমান। সেখানে কোন জাতিগত ভেদাভেদ থাকবে না, মােহাজের আনছার বলে কিছু থাকবে না। আমাদের উচিত অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। আজ আমাদের ভাবতে হবে ভারতে যে কয়েক কোটি মুসলমান রয়েছে তাদের কথাও। কেননা আমরা যদি শুধু মুসলমানদের স্বার্থ দেখি আর ভারতে হিন্দুরা যদি কেবল তাদের স্বার্থই দেখে তাহলে উভয় দেশের সংখ্যালঘুরা এক মর্মান্তিক পরিস্থিতির শিকার হবে।
শেখ মুজিব আরাে বলেন, মুসলমানরা যেমন বলছে তারাও স্বতন্ত্রভাবে সবকিছু করবে, সেক্ষেত্রে হিন্দুরাও যদি বলে তারাও স্বতন্ত্রভাবে হিন্দু টে চায় তাহলে অবস্থা কি হবে? অতএব আমি সকল সদস্যের প্রতি অনুরােধ জানাই অন্তত ইনসাফের খাতিরে তারা যেন স্বতন্ত্র নির্বাচনের দাবি প্রত্যাহার করেন। তাছাড়া এদেশে শতকরা ৯০ জন মুসলমান। হওয়া সত্ত্বেও যদি আলাদা নির্বাচন চাওয়া হয় তাহলে পৃথিবীর সভ্যদেশের মানুষের কাছে লজ্জায় আমাদের মুখ দেখানাে যাবে না। হিন্দুরা যেখানে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও আলাদা নির্বাচন দাবি করছে না সেখানে মুসলমানদের ঐ দাবি লজ্জাকর। পবিত্র কোরআন শরীফও উল্লেখ রয়েছে যে, মানুষের মঙ্গলকর এবং মানুষের কল্যাণের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকতে পারে না। আর সে কারণে দেশে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষে সবার একমত হওয়া প্রয়ােজন।
গণতান্ত্রিক কর্মি সভায় ভাসানী নিখিল পকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী ২৬ জুলাই ১৯৫৬ সালে বক্তৃতা করেন। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, নিপীড়িত মানুষের ইজ্জত ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জনা হযরত মােহাম্মদ (সঃ) মরুভূমির বুকে সারা জীবন সশ্রাম করেছেন। তার সংগ্রাম ছিল জালেমদের বিরুদ্ধে। আরবদের ক্রীতদাসে পরিণত করার বিরুদ্ধে। রাসুলের আবির্ভাব যদি সেখানে না ঘটত তাহলে হয়ত সেখানকার মানুষের ইতিহাস এক কলঙ্কময় অধ্যায় হয়েই থাকত।
পাক-ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসও অন্য কোন দেশের সংগ্রামের ইতিহাস থেকে ভিন্ন নয়। যেদিন থেকে বিদেশী ইংরেজ এদেশে তাদের রাজত্ব কায়েম করে সেদিন থেকে স্বাধীনতার জন্য এদেশের মানুষ জীবন শুরু করে। সিপাহী বিপ্লব তারই এক গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস। দিল্লীর শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহকে বার্মায় নির্বাসিত করা হলাে। প্রাণ দিলেন ঝাসির রানী, অযােধ্যায় বেগম, তাতিয়া তােপী, নানা সাহেব, মওলানা আব্দুল্লাহ সহ আরাে অনেক হিন্দু-মুসলমান। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজের সঙ্গে জীবন দিল মীর মদন, মােহনলাল। সে হিল স্বাধীনতাকামীদের এক মহান পরীক্ষা। বিশ্বাসঘাতকদের কোন দেশ নেই, ধর্মীয় পরিচয় নেই। সিরাজের বিরুদ্ধে সেদিন যােগ দিয়েছিল বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর, রাজভ, উমিচাদ, ঘসেটি বেগম। বিশ্বাস ঘাতকরাই সেদিন জয়লাভ করে। আমাদের দেশে কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আবার ঘটতে যাচ্ছে।
________________________________________
পলাশী যুদ্ধের পর বৃটিশ এদেশে একটি নতুন শােষক শ্রেণী তৈরী করে। যা ইংরেজ চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। পাশাপাশি বিরােধী ঐক্যও গড়ে উঠে। ওহাবী আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ, প্রভূতিদের ঐক্যের পতাকা তুলে ধরে খেলাফত আন্দোলন’। বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনের মূলকথা ছিল সর্বপ্রকার শশাষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব মুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা । সেই আদর্শের ভিত্তিতেই সেদিন কোটি কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি কিন্তু দেশবাসীর জীবনে সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি। গত ১০ বছরেও কৃষিক্ষেত্রে সামান্য উন্নতি হয়নি। বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে মানুষ মারা যাচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে চরম অধঃগতি হয়েছে। শিল্পের ক্ষেত্রে কোন উন্নয়ন ঘটেনি। হাজার হাজার বেকার। মুসলিম লীগ এই দুরবস্থায় কোন প্রতিকার করছে না। কেবল ভিক্ষার ঝুলি হাতে তারা দেশে দেশে ফিরছে।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তানের শাসকগণ বৃটিশেরই নিকট থেকে দুর্নীতি পদ্ধতি আয়ত্ব করেছে। লীগ যুফ্রন্ট কারাে আমলেই তার পরিবর্তন ঘৃটেনি। সমাজের সর্বত্র আজ অন্যায়, অনাচারে ভরে গেছে। ২১ দফার ভিত্তিতে আমরা স্বায়ত্বশাসন দাবি করেছিলাম। সেই দাবি পূরণ হয়নি। এক্ষেত্রে সােহরাওয়ার্দী তারুপ্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না।
ইতিপূর্বে মুসলীম লীগ সরকার যেসব বৈদেশিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে তা দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বৃটিশ সব সময় বিশ্বাসঘাতক। তাদের সঙ্গে কোন চুক্তি চলে না। আরবের বুকে ছুরিকাঘাত করে বৃটিশ ও আমেরিকা ইসরাইলের পত্তন করেছে। আমেরিকার ডলার সাহায্য নিয়ে দেশের উন্নতি করা যাবে না। সােহরাওয়ার্দী যুক্ত ঘােষণার মাধ্যমে আমেরিকার বৈদেশিক নীতির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে পূর্ব স্বাক্ষরিত চুক্তি বহাল রেখেছেন। তার কর্মকান্ড দেখে মনে হচ্ছে আমরা আমেরিকার কাছে আমাদের স্বাধীনতা বন্ধক দিয়েছি।
দুশ বছর বিদেশী শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার পর আজ পাকিস্তানের কর্ণধারগণ যেভাবে পুনরায় বিদেশী শশাষকদের নিকট সার্বভৌমত্ব বিক্রি করার চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছেন তাতে শংকিত না হয়ে পারা যায় না। এতে কেবল দেশবাসী পুনরায় বিদেশীদের শৃংখলে বাঁধা পড়বে। এতে মনে হয় শাসকেরা জনগণ নয়, নিজের স্বার্থই বড় করে দেখছেন।
ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের ঘােষণা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। এই দাবিতে “ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ” ৬নং নয়া পল্টন ঢাকা থেকে ১৯৫২ সালের মে মাসে এক প্রচারপত্র প্রকাশ করে। ১০ আজিমপুর থেকে আমাদের প্রেস” মক ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত ঐ প্রচারপত্রে বলা হয়, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ বিশ্বাস করে যে, বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার যে দাবি
________________________________________
জনসাধারণের পক্ষ থেকে উঠেছে তা ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সম্ভব নয়। পৃথিবীর সকল দেশের উন্নয়নের প্রথম শর্ত হচ্ছে মাতৃভাষার প্রসার। হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর সময়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা ছিল ‘হি’, কিন্তু জনগণের স্বার্থেই কোরআন নাজেল হয়েছিল অপেক্ষাকৃত সহজ ভাষা “আরবীতে”। আরবী ছাড়া সেদিন অন্য কোন ভাষায় কোরআন নাজেল হলে আরববাসীদের পক্ষে দ্রুত কোরআন অবগত হওয়া সম্ভব হতাে না।
পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষার মাধ্যমে ইসলামের বাণী ঘরে ঘরে পৌছে দিতে হবে। এছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথে অগ্রগতি সম্ভব নয়। ইংরেজ আমলে বাঙালী মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার প্রধান কারণ ইংরেজদের সৃষ্টি করা ভাষা সংকট। ইংরেজরা ফার্সীকে উচ্ছেদ করে সেখানে নিয়ে এল ইংরেজী ভাষা। এতে শিক্ষাদীক্ষায় বাঙালীরা পিছিয়ে পড়ে। মুসলমানরা বাংলার চর্চাও করলাে না, ইংরেজিও শিখলাে না। তাদের অবস্থা হল মৎস্যজীবী পর্যায়ের। একদিকে ইংরেজি বর্জন, অন্যদিকে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এই দুয়ের মাঝে পড়ে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় বাঙালী জাতির উন্নতি ও বিকাশ। ধীরে ধীরে মুসলমান সমাজ মাতৃভাষার কদর বুঝতে পেরে বাংলা সাহিত্য ও সাধানায় অগ্রসর হতে থাকে। এতে করে একটি মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে ওঠে। তারপর এল দেশ বিভাগ। স্বাভাবিকভাবেই এদেশের সাড়ে চার কোটি মানুষ আশা করেছিল মাতৃভাষা বাংলার মাধ্যমে তাদের সর্বাত্মক উন্নয়ন সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ইংরেজ সরকারের মত পাকিস্তান সরকারও ভাষা সংকট সৃষ্টি করে উন্নতির পথে বাধার সৃষ্টি করছে। বৃটিশ ফার্সীকে তাড়িয়ে এনেছিল ইংরেজি আর এবার বাংলাকে উচ্ছেদ করে আমদানি করা হচ্ছে উর্দু।
পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাস বহিরাগত রাষ্ট্রভাষার নজির নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে একশ্রেণীর ভাড়াটে লােক সস্তা যুক্তি দেখাল। তা হলাে বাংলা সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন এবং হিন্দু সাহিত্যিক দ্বারা পুষ্ট। অতএব এই ভাষা ইসলাম বিরােধী। কিন্তু তাদের নিশ্চয় জানা নেই যে, উর্দু কম-বেশি সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন । আমাদের প্রশ্ন যখন কোরআন নাজেল হয় তখন আরবী কাদের ভাষা ছিল? পুতুল পুজারী পৌত্তলিক নাছাড়দের নয় কি? যদি তাই হয় তাহলে আরবীকে পবিত্র ভাষার মর্যাদা দেয়া হলাে কেন? আসলে ভাষা কেবল ভাব প্রকাশের বাহন মাত্র।
বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম ভাষা। এই ভাষায় যদি ইসলাম প্রচার ও প্রসার অসম্ভব হয় তাহলে বুঝতে হবে ইসলামী ভাবধারাতেই দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু এটি স্বীকার করার সাহস কারাে আছে কি? উর্দুকে ইসলামী ভাবধারার বাহন বলা হয়ে থাকে, কিন্তু এই উর্দুতেই “নিরীশ্বরবাদী কমিউনিষ্ট সাহিত্যের প্রচার সম্ভব হচ্ছে। উর্দু যদি এতই পাক-পবিত্র হয় তবে সে ভাষায় এগুলাে হচ্ছে কিভাবে?
এ থেকে বােঝা যায় বাংলা ভাষা সম্পর্কে যারা ইসলামী ফতােয়া জাহির করেন তারা একপেশে কথা বলেন। ইসলামী ভাবধারার প্রকাশ যে কোন ভাষায় যে কোন যুগে চলতে
________________________________________
পারে। কেননা সে তার নিজস্ব দীপ্তিতে উজ্জ্বল, ভাষার মাধ্যমে নয় । বাংলা ভাষার ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যাবে এর বিস্তার ছিল মুসলমানরা। প্রাচীন বাংলা শব্দে প্রচুর আরবী এবং ফার্সী ভাষার ব্যবহার থেকে তা স্পষ্ট। নবাব হােসেন শাহের আমলে বাংলা সাহিত্যের ব্যাপক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বাংলা উর্দু অপেক্ষা আহরণী প্রতিভায় উজ্জ্বল।
একটির বেশি রাষ্ট্রভাষা থাকলে ইসলামী ঐক্যে ফাটল ধরবে বলে যারা বলে থাকে তাদের কথায় আমরা বিশ্বাসী নই। কেননা ঐক্য বজায় রাখতে গেলে সবাইকে এক খাদ্য খেতে হবে, এক বস্ত্র পরতে হবে একথা সত্যি নয়। ইসলামের যুক্তিতেই একথা অচল। কেবলমাত্র একটি আদর্শ বা নীতির মাধ্যমেই একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানীরা যদি বাংলা শেখেন এবং বাঙালীরা যদি উদু শেখেন তাহলে উভয়াংশের জনগণের মধ্যে একটা সহমর্মিতা গড়ে উঠতে পারে। পরিশেষে ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ তাদের বক্তব্যে বলে যে, বাংলা ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের ঐকে। ফাটল ধরায়নি বরং শক্তিশালী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে।
যুক্তফ্রন্ট গঠন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে এবং জনগণের ও প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয়। যুন্ট।
আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ, কে, ফজলুল হক আওয়ামী লীগ অফিসে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে এবং আসন্ন নির্বাচন বিষয়ে আলােচনা করেন। আলােচনা শেষে এক বিবৃতিতে বলা হয়, আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করা এবং জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠনের জন্য পাকিস্তানের দুটি প্রধান বিরােধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এখন মুসলিম লীগের বিরােধী সকল রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি ফ্রন্ট গঠনের কাজ করা হবে।
আমরা বিশ্বাস করি পাকিস্তানের বৃহত্তর স্বার্থে ভােটারগণ যুফ্রন্ট কর্তৃক মনােনীত প্রার্থীদেরকে সমর্থন করবেন। সেইসঙ্গে দুর্দশা সৃষ্টিকারী পাকিস্তান মুসলিম লীগকে পরাজিত করবেন।
১৯৫৪ সালের জানুয়ারীতে যুক্তফ্রন্ট তাদের একুশ দফা ঘােষণা করে-(১) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে; (২) বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী ও খাজনা আদায়কারী শর্ত উচ্ছেদ ও ভূমিহীনদের মাঝে খাস জমি বিতরণ করা হবে ও খাজনা হ্রাস করা হবে; (৩) পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণের স্বার্থে তাকে রাষ্ট্রীয় অধীনে আনা ও পাটের প্রকৃত মূল্য প্রদান এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় পাট কেলেংকারি তদন্ত ও তাদের অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হবে; (৪) সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে, কুটির শিল্পের উন্নয়ন সাধন করা হবে; (৫) লবণ শিল্পকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে সমুদ্র
________________________________________
উপকূলে কুটির শিল্প ও বৃহৎ শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হবে; (৬) শিল্প ও কারিগরি শ্রেণীর কাজের ব্যবস্থা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে; (৭) সেচের ব্যবস্থা সহ বন্যা ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে: (৮) পূর্ব বাংলাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করে কৃষিকে আধুনিকীকরণ করা হবে এবং শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হবে; (৯) দেশে অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন সহ শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন দেয়া হবে; (১০) শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ ও মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদান ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে; (১১) বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা সহ সকল কালাকানুন বাতিল করা হবে: (১২) উচ্চ বেতনভােগীদের বেতন কমিয়ে নিম্ন বেতনভােগীদের বেতন বাড়ানাে হবে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমানাে হবে; (১৩) দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি,ঘুষ বন্ধ করা হবে, সেই সঙ্গে ১৯৪০ সাল থেকে সকল উচ্চ পদাধিকারীদের আয়-ব্যয়ের হিসাব করা হবে; (১৪) জননিরাপত্তা আইন সহ প্রতিক্রিয়াশীলদের কালাকানুনসমূহ বাতিল করা হবে, বন্দীদের মুক্তি প্রদান, সভা-সামিতি ও নাগরিক অধিকার নিরঙ্কুশ করা হবে; (১৫) বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে; (১৬) যুঞ্জন্টের প্রধানমন্ত্রী কম বিলাসী বাড়িতে থাকবেন, বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা গবেষণাগারে পরিণত করা হবে; (১৭) বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হবে এবং শহীদ পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে; (১৮) ২১ ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ঘােষণা করে ঐদিন সরকারী ছুটির দিন ধার্য করা এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত অন্য সমস্ত বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনা হবে, স্কুল বাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পকিস্তানে ও নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে রাখা হবে, পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষা স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হবে, আনসার বাহিনীকে সশন্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হবে, (২০) যুফ্রন্ট সরকার কোন অবস্থাতেই আইন পরিষদের মেয়াদ বাড়াবে না; (২১) যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার আমলে আসন শুন্য হলে তিনমাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়া হবে। তিনটি উপনির্বাচনে যদি ফ্রন্ট পরাজয় বরণ করে তবে ফ্রন্ট স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
যুটের প্রচার পুস্তিকা যুন্ট ৪ মার্চ ১৯৫৪ সালে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। যুক্তফ্রন্টের কেন্দ্রীয় প্রচার দপ্তর থেকে প্রকাশিত ঐ পুস্তিকায় বলা হয়, কায়েদ আযম মুসলিম লীগকে আজ্ঞাবহ করে গিয়েছিলেন। সেই মুসলিম লীগ মরে গিয়ে গেলাম লীগে পরিণত হয়েছে। সেই গােলাম এখন জালেমের ভূমিকায় অবতীর্ণ। মুসলিম লীগের শাসন ও শােষণের ছয় বছর সংক্ষেপে তুলে ধরা হলাে।
ঐতিহ্যসম্পন্ন একটি জাতির জন্যে একটি আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়ােজন ছিল। কাজেই স্বাভাবিকভাবেই নতুন রাষ্ট্রর মাধ্যমে জাতি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে বলে আশা করেছিল। কিন্তু দেশের নেতৃত্ব এমন ব্যক্তিদের হাতে চলে যায় যারা দেশ শাসনে সম্পূর্ণ
অযােগ্য। বর্তমান শাসকদের কোন রাজনৈতিক ইতিহাস নেই। ধর্ম ও ঈমানের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। এদের কুকীর্তি আলােচনা করলে রাষ্ট্রদ্রোহীর কমিউনিষ্ট, শৃংখলা ভঙ্গকারী প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে কষ্ঠ রােধ করা হচ্ছে। ঈমানের নামে তারা চরম বেঈমানীর পরাকাষ্ঠা ব্যবহার করছে। এরা চরম ভােগবিলাসে গা ভাসিয়ে দরিদ্র জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করতে লিপ্ত রয়েছে। | পাকিস্তান অর্জন করেছিল নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। পাকিস্তান অর্জনের পর সেই লীগের অৰ্তিত্ব ছিল না। বর্তমানে যারা দেশ শাসন করছে তারা সেই লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। বর্তমান মুসলিম লীগ ক্ষমতালি দুর্নীতিবাজ স্বার্থপর লােকদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কায়দে আযম এদেরই হাতে লীগকে রেখে গেছেন। জনগণ এদের ধাপ্পাবাজিতে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হয়ে অন্ধকারের দিকে এগুচ্ছে।
মুসলীম লীগের বর্তমান শাসকরা বিভ্রান্তিকর কৌশল অবলম্বন করতে থাকলে তাতে ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপন্ন হতে বাধ্য। বর্তমান শাসকদের অপরাধ ফাঁসির তুল্য। এরা ধর্মবিরােধী কর্মকান্ড চালাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধেই মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বে পূর্ব পকিস্তান ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নেমেছে।
বৃটিশের আশীর্বাদপুষ্ট খাজা নজিমুদ্দিন রাষ্ট্রের প্রধান হয়েই আঘাত হানা শুরু করেন। তিনি স্বাধীনতার জন্য কোন ত্যাগ স্বীকার করেননি। পাকিস্তানের এই নয়া খলিফারা বেতন নেন ১২,৫০০ টাকা। বার্ষিক ভাতা নেন ৫০,০০০টাকা। বিনা ভাড়ার বাড়িতে থাকেন এবং অন্যান্য সকল রাষ্ট্রীয় সুযােগ-সুবিধা ভােগ করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীবৃন্দ বেতন পান চার হাজার টাকা এবং ভাতা সহ অন্যান্য সকল রাষ্ট্রীয় সুযােগ-সুবিধা গ্রহণ করেন।
বিদেশে যেসব রাষ্ট্রদূতকে পাঠানাে হচ্ছে তারা পাকিস্তানের সুনামে কলংঙ্ক লেপন করছেন। তাদের পেছনে লাখ লাখ টাকা ব্যয় করা হচ্ছে। খেলাফত যুগের রাষ্ট্রনেতাদের বেতন এবং অন্যান্য সুযােগ-সুবিধার সঙ্গে নয়া ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়কদের ব্যয় এবং বেতন তুলনা করলে দেখা যায় যে ইসলামকে উচ্ছেদ করার জন্যই এরা নাজেল হয়েছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী মাও সেতুং বেতন পান ৫০০ টাকা। তার অন্য মন্ত্রীরা বেতন নেন ২০০টাকা। গাড়ি, বাড়ির খরচ নিজেদের বহন করতে হয়। বৃটিশের শাসনকালে বড়লাট বেতন নিতেন ২৫,০০০টাকা।
বৃটিশ আমলের চেয়েও বর্তমানের ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে মদ বিক্রি বেড়ে গেছে ব্যাপক হারে। ইংরেজ আমলে ঢাকা ক্লাবে মদ বিক্রি হতো মাসে ৮০ গ্যালন। বর্তমানে ইসলামী পাকিস্তানে তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ গ্যালনে। এছাড়া জনাব নূরুল আমিনের মেহেরবাণীতে ছয়টি মদের দোকান অনুমােদন লাভ করেছে। ইসলামী আইন অনুসারে লাট সাহেবরা খলিফাদের সমান । এই খলিফাদের বাসভবনে মদ মজুদ রাখা জরুরী। ককটেল পার্টিতে মেয়েদের কোমর ধরে নাচানাচি করা হয়। ইসলামী বিধানে এরূপ ককটেল পার্টি বা বল নাচের অনুমােদন নেই।
________________________________________
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা শােচনীয় আকার ধারণ করেছে। এক হিসেবে দেখা যায় ১৯৪৮-৪৯ সালে মজুদ তহবিল ছিল ১০৮ কোটি টাকা। অথচ সরকার ঠোটের রং, নখের পালিশ কেনার জন্য দেদার খরচ করছে। এই সরকার উচ্চবিত্তদের প্রতিনিধিত্বকারী । গত সাত বছরেও দেশের শাসনতন্ত্র রচিত হয়নি। আজও ইংরেজদের শাসনতন্ত্র এদেশ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু ভারত স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যেই নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করছে। আমেরিকা তার শাসনতন্ত্র রচনা করতে সময় নিয়েছিল মাত্র সাত মাস। ভারতের শাসনতন্ত্র রচনায় ব্যয় হয়েছিল নয় লাখ টাকা। আমেরিকা ব্যয় করেছিল ১৯ লাখ টাকা। পক্ষান্তরে পকিস্তানে এ বাবদ ৯৬ কোটি টাকা ব্যয় হলেও শাসনতন্ত্র রচিত হয়নি।
একটি স্বাধীন দেশের শাসনতন্ত্র না থাকায় মানুষের অধিকার বিপন্ন হচ্ছে। কয়েক হাজার দেশপ্রেমিক বিনা বিচারে জেলে আটক রয়েছে। কিন্তু বিধান অনুসারে কাউকে বিনা বিচারে আটক রাখা যায় না। হিটলার সামান্য কারণে যেভাবে বন্দীদের হত্যা করত মুসলিম লীগ শাসিত পাকিস্তানে সেই একই অবস্থা বিদ্যমান। রাজশাহী জেলে গুলি করে বন্দীদের হত্যা করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের দাফন ইসলামী বিধান অনুসারে হয়নি। এজন্য সরাসরি নূরুল আমিন ও তার মুসলিম লীগ সরকার দায়ী। লালবাগে পুলিশের উপর গুলি চালিয়ে যে কয়েকশ’ পুলিশ হত্যা করা হলাে তার কারণ আজও অজ্ঞাত । ছাত্ররা বেতন বৃদ্ধির বিরুদ্ধে যে মিছিল করেছিল সরকার তাদের প্রতিও গুলি চালায়। সেখানে ১২ জন ছাত্র নিহত হয়।
নির্মম আর পাশবিক না হলে কোন সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের প্রতি এই কাজ করতে পারে না । চট্টগ্রামের নবীনগরের মসজিদে এই সরকারের পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে এক অনন্য কীর্তি স্থাপন করেছে। বহু আলেমকে উলঙ্গ করে নৃশংসভাবে প্রহার করা হয়েছে। সেই বর্বরতার কাহিনী আজও মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত ।
১৯৪৭ সালে দেশে অপরাধের সংখ্যা ছিল ৫৪,৫৬৬। বর্তমানে ১৯৫৬ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.০৮.৬৭০। পুলিশ বিভাগের সংখ্যা ও ব্যয় বিপুল পরিমাণে বাড়ানাে সত্ত্বেও অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। পূর্ব পাকিস্তান আজ একটি ভিখারীর দেশে পরিণত হয়েছে। দুর্ভিক্ষে কেবল খুলনাতে ২০,০০০ লােক মৃত্যুবরণ করে। মুসলিম লীগের অন্যতম দালাল খুলনার খান এ সবুর ঐ মৃত্যু সম্পর্কে বিবৃতি দিয়ে মুসলিম লীগের মন্ত্রী। ১৯৫১ সালের লবণ সংকট মুসলিম লীগের অন্যতম অপকীর্তি। মন্ত্রীরা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের স্বার্থে ঐ লবণ সংকট সৃষ্টি করে। এদের কারণে দুই আনার লৰণ মােল টাকা সের দরে বিক্রি হয়। এ সময় সরকার প্রতিবাদী আন্দোলনকারীদের কঠোরভাবে নির্যাতন করে।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যখন খাদ্যাভাবে মারা যাচ্ছে মন্ত্রীরা তখন নিজেরাই চাউলের ব্যবসা খুলে বসে। বস্ত্রহীন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আজ উলঙ্গ প্রায়। সরকার গত
________________________________________
ক’বছরে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে ৭/৮টি বকল স্থাপন করে। অথচ পূর্ববঙ্গে একটি বকলও স্থাপন করা হয়নি। এই সুযােগে মুসলিম লীগের ওহিদুজ্জামান দুই কোটি টাকার কাপড় আমদানি করে বিরাট মুনাফা করে। ঔষধের ক্ষেত্রেও চরম সংকট বিরাজ করছে। দু’জন মন্ত্রী ঔষধ আমদানির লাইসেন্স নিয়েছেন। মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। অথচ দেশে একজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন।
শিক্ষার বিরুদ্ধে মুসলিম লীগ সরকার ‘জেহাদ’ ঘােষণা করেছেন। ক্ষমতা দখলের পর থেকে লীগ সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে অশিক্ষিত রাখার এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ক্ষমতালাভের পরপরই তারা কয়েক হাজার স্কুল বন্ধ করে দেয়। যেগুলাে চালু রয়েছে সেগুলাের শিক্ষকবৃন্দ নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না। যা পাচ্ছেন তাও অতি সামান্য। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থাকে পঙ্গু করা সরকারের এক ইচ্ছাকৃত পরিকল্পনা। নাজিমুদ্দিন ও নুরুল আমিন যৌথভাবে এই চক্রান্তে লিপ্ত। শিক্ষাক্ষেত্রে একজন অথর্ব শিক্ষামন্ত্রী কাজ করছেন। ছয় বছরে পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৫টি মেডিকেল কলেজ, ৩টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ৮টি বত্র কলেজ, ২টি ফরেষ্ট কলেজ, ৯টি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ২টি বিশ্ববিদ্যালয়, ১টি মেডিকেল কলেজ, ১টি কারিগরি কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। অথচ লােকসংখ্যা পশ্চিমের থেকে পূর্ব পকিস্তানে অনেক বেশি। ১৯৮৭ সালে গঠিত একটি কমিটি রিপাের্ট পেশ করেছিল যে মাতৃভাষার মাধ্যমে যেন অন্তত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাদান করা হয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে।
মুসলিম লীগের প্রতিশ্রুতি ছিল জমিদারী উচ্ছেদ করে কৃষকদের মধ্যে খাস জমি বন্টন করবে। কিন্তু পর্দার আড়ালে আলােচনা করে ৬০ কোটি টাকা দিয়ে জমিদারী খরিদ করা হােল। এই টাকা যতদিন পরিশােধ না হবে ততদিন জমিদারকে সুদ প্রদান করতে হবে। এবাবদ মােট ১৩৫ কোটি টাকা প্রদান করতে হবে। অথচ এসব জমিদার দেশদ্রোহিতার এনাম স্বরূপ বৃটিশের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে জমিদারী লাভ করেছিল। হেষ্টিংসের আমল হতে আজকের নাজিমুদ্দিন পর্যন্ত তারা জনতাকে শােষণ করে চরম ভােগবিলাসী জীবনে মত্ত থাকে। তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রশ্নই ওঠে না; বরংট্রাইব্যুনাল গঠন করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিত।
পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ পাট জন্মে পূর্ব বাংলায়। কিন্তু উৎপাদনকারী চাষীরা ক্ষুধায় ভাত পায় না। পাট ব্যবসায়ী আজ পাটমন্ত্রী। যড়যন্ত্রমূলকভাবে যে ১৪টি প্রতিষ্ঠান পাট ব্যবসায় নিয়ােজিত তার সঙ্গে মন্ত্রী ফজলুর রহমান জড়িত । ১৪টি প্রতিষ্ঠানের মাত্র একজন পূর্ব পাকিস্তানী । এরা পাট মওসুমে পাট ক্রয় বন্ধ রাকে, ফলে ১৯ টাকার পাট মাত্র ৩ টাকা দরে বিক্রি হয়। ইস্পাহানী, আদমজী, র্যালি ব্রাদার্স প্রমুখ ব্যবসায়ী কৌশলে এই পাট বিক্রি করে ৪৫ টাকা দরে। এই নীতির সঙ্গে ইংরেজ আমলের নীল ব্যবসায়ীদের নীতির প্রচুর মিল রয়েছে। পাটচাষীদের ওপর, সুপারির ওপর ও তামাক ব্যবসায় লাইসেন্স ফি চালু করা হয়েছে। চাষীদের কাছ থেকে দশ টাকা মন দরে তামাক কিনে চল্লিশ টাকায় বিক্রি করা হয়। সরকারি সহযােগিতায় পুঁজিপতিরা দেশব্যাপী চক্রান্তের ফাঁদ পেতে
________________________________________
রেখেছে। পাকিস্তানের মােট লােকসংখ্যার ৫ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা; জালিম মুসলিম লীগ সরকার বাঙালীদের ভাষাও কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়েছে। গােপনে তারা আরবী ও উর্দু চাপানাের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। পূর্ব পাকিস্তানী মুসলিম লীগ নেতারা এই চক্রান্তের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। পুলিশের গুলিতে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে রাস্তায় নেমে ছাত্র-জনতা কমিউনি, ইসলামবিরােধী ও দেশের দুশমন প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত হচ্ছে। মুসলিম লীগ জনগণকে বিভ্রান্ত করছে নিজেদের কলংক ঢাকার জন্য। কিন্তু তাদের চরিত্র সূর্যালােকের মত স্পষ্ট।
যুক্রন্টের নির্বাচনে বিজয় ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। মুসলিম লীগ সরকার ঐ বিজয়কে বানচাল করার জন্য নানা প্রকার অজুহাত আনতে থাকে। প্রবল জনরােষের ভয়ে ২ এপ্রিল সরকার নির্বাচনের ফল ঘােষণা করতে বাধ্য হয়। যুট পায় মােট ২১৫টি আসন। ফজলুল হক দুটি আসনে জয়লাভ করেন। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্য থেকে ৭ জন যুফ্রন্টে যােগ দেন, ফলে যুক্তফ্রন্টের মােট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২২১
নির্বাচনে দলভিত্তিক ফলাফল হলােঃ যুফ্রন্ট-২২১, মুসলিম লীগ-৯, স্বতন্ত্র-৫, খেলাফত রাব্বানী-১, সংখ্যালঘু আসনে কংগ্রেস পায় ২৪, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট-৯. গণতন্ত্রী দল-২, কমিউনিষ্ট-৫, তফসীল ফেডারেশন ও স্বতন্ত্র-২৮, বৌদ্ধ-২, খৃষ্টান-১ জন। | দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামী মুসলিগ লীগ ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে এক লিফলেট প্রচার করে । ঐ লিফলেটে নেতা ও কর্মীদের প্রতি জরুরী আহবান জানিয়ে বলা হয় তারা যেন নিম্নে বর্ণিত ১৫টি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে দলের অফিস ৫৬ সিম্পসন রােড, সদরঘাট, ঢাকা-এই ঠিকানায় প্রেরণ করেনঃ
(১) নিজ নিজ এলাকার সব অফিস-আদালতে দুর্নীতির বিস্তারিত রিপাের্ট: (২) যেসব জমিদারী সরকার গ্রহণ করেছেন সেসব স্থানে কৃষকদের উপর সার্টিফিকেট জারি হয়েছে কিনা এবং সেসব স্থানের কৃষকদের ওপর কোন প্রকার অত্যাচার হচ্ছে কিনা; (৩) সাধারণ মানুষের মধ্যে সুতা বিতরণে কালােবাজারি চলছে কিনা; (৪) অর্থাভাবে কোন অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ালেখা ছাড়তে বাধ্য হয়ে থাকলে তাদের বিষয়ে বিস্তারিত রিপাের্ট; (৫) দুর্নীতিপরায়ণ; কালােবাজারী ও সরকারি কর্মচারীরা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত কিনা তার বিস্তারিত তথ্য; (৬) যুফ্রন্টের নবনির্বাচিত সদস্যরা স্ব-স্ব এলাকায় গিয়ে সাধারণের অভাব-অভিযােগ সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে কিনা; (৭) সরকারি মূল্যে বহু বিতরণ হচ্ছে কিনা অথবা কালােবাজারে তা বিক্রি চলছে কিনা; (৮) নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ও কৃষিপণ্যের মূল্য কেমন; (৯) সরকারি ও বেসরকারি অফিসসমূহে ছাঁটাই
________________________________________
নীতি কার্যকরী হয়েছে কিনা, হলে কোন্ অফিসে কতজন ছাঁটাই হয়েছে এবং তারা কি অবস্থায় জীবন যাপন করছে; (১০) সরকার কিরূপ জমি অগ্রিহণ করেছে এবং তার মূল্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পেয়েছে কিনা; (১১) স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মন্দির প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য; (১২) যুন্ট ট্যাক্স পরিমাণ; (১৩) আগত মােহাজের সংখ্যা এবং তাদের বর্তমান অবস্থা কেমন (১৪) শিক্ষকগণ নিয়মিত বেতন পান কিনা এবং কারাে বেতন বাকী আছে কিনা; (১৫) কোন এলাকায় কতজন রাজনৈতিক কর্মী আটক রয়েছেন তাদের তালিকা সহ মামলার বিবরণ।
পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২৩ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে। কার্জন হলে অনুষ্ঠিত ঐ সম্মেলন উদ্বোধন করেন ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তার উদ্বােধনী ভাষণে বলেন-১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট স্বাধীনতা লাভের পর মানুষ আশা করেছিল যে বাংলা সাহিত্য একটি উন্নত সমৃদ্ধির পথ খুঁজে পাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে বােঝা যাচ্ছে স্বাধীনতা একটি মতিভ্রম ছাড়া কিছু নয়। আরবী হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় আরবী ও ফার্সীর ব্যবহার প্রভৃতিতে একশ্রেণীর লেখককে পেয়ে বসেছে। এসব মাতলামিতে তারা এমনভাবে মেতে উঠলাে যে তারা প্রকৃত সাহিত্যসেবীদের নানা প্রকার বিড়ম্বনা ও বিপদগ্রস্ত করতে আদা-জল খেয়ে লেগে গেলেন। এদের সঙ্গে যােগ দিল কতিপয় আমলা। ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকদের গ্রন্থ সম্পর্কে আলােচনা এমনকি বাঙালী নামটি পর্যন্ত যেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন। কেউ কেউ আবার মিলিত বঙ্গের ভূতের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। মুসলিম লীগ সরকার বাংলার উন্নতির বিপরীতে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে আরবী হরফে বাংলা লেখা এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালানাের অপচেষ্টা চালালেন।
পূর্ববঙ্গবাসীদের উদারতা যে, তারা সাড়ে চার কোটি মানুষের ভাষা বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি না করে বরং উর্দুকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে মত দিয়েছে। এই উদারতাকে কেউ কেউ দুর্বলতা মনে করে বলেছেন যারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে তারা পাকিস্তানের দুশমন। এ প্রসঙ্গে পূর্ববঙ্গবাসীর বক্তব্য হলাে, উর্দু-পূজারীরাই পাকিস্তানের দুশমন এবং এরাই পাকিস্তানের ধ্বংস করবে। এই সম্মেলনের প্রথম কর্তব্য হচ্ছে পূর্ব বঙ্গের সব সাহিত্যিককে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমরা। চাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের মত একটি কেন্দ্রীয় সাহিত্য সমিতি। যে সমিত্রি কাজ হবে ঘরে ঘরে মানুষের মধ্যে সাহিত্যের আলাে ছাড়িয়ে দেয়া। | তমান অবস্থায় আমরা পূর্ববঙ্গ সরকারের সহযােগিতা আশা করছি। সহযোগিতা ছাড়া সমৃদ্ধি সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমী’ বা বাংলা সাহিত্য নিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে তা অত্যন্ত আনন্দের বিষয়। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম
________________________________________
কর্তব্য হবে বাংলা সাহিত্যের উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলাের সংগ্রহ, মুদ্রণ ও প্রকাশ। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা ।ফ্রাল একটি অভিধান রচনা করেছে, তাতে যেসব শব্দ আছে তার বাইরে ফরাসী সাহিত্যিকদের শব্দ ব্যবহার করার অধিকার নেই। এদেশে যখন বাংলা রাষ্ট্রভাষা হচ্ছে তখন আমাদেরও কাজ হবে অনুরূপ একটি অভিধান সংকলন করা। আশা করি এই বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করবেন। | অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে লীগ সরকারের আমলে বাংলা ভাষা ও অক্ষর সম্পর্কে যে কৃত্রিম সমস্যার সৃষ্টি করা হয়েছিল এখন পর্যন্ত কেউ কেউ সে বিষয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। তাদেরকে আমি কবি আব্দুল হাকিমের একটি কবিতা শােনাতে চাই
“ যে সব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সেসব কাহার জন্য নির্ণয় ন জানি”।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে নজুয়ায় নিজ দেশ ত্যাগি কেন বিদেশ ন যায়।”
সাহিত্য সংসদের কার্যনির্বাহকদের মধ্যে ছিলেন কাজী মােতাহার হােসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, সরােয়ার মুর্শেদ, আব্দুল গনি হাজারী, মােস্তফা নূরুল ইসলাম, ফয়েজ আহমেদ, হাসান হাফিজুর রহমান, বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আলাউদ্দিন আল আজাদ, ফজলে লােহানী, আবদুল্লাহ আল মুতী, আমিনুল ইসলাম, এম, আর, আখতার মুকুল, শামসুর রাহমান, সরদার জয়েনউদ্দিন, আতাউর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আনিসুজ্জামান ও শেখ লুৎফর রহমান।
এ, কে ফজলুল হকের ভাষণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে যুন্ট আয়ােজিত ১০ এপ্রিল ‘৫৫তে অনুষ্ঠিত পল্টনের জনসভায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তাষণ দেন। তিনি বলেন, ১৮২০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সৈনিকেরা পাকিস্তান অর্জন করেছে। কিন্তু যে ত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা এসেছে তার সুফল কি মানুষ পেয়েছে মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত। ইংরেজ প্রবর্তিত আইনে আজও দেশ শাসিত হচ্ছে। এখনাে কোন শাসনতন্ত্র রচিত হয়নি। ৭ বছরের মুসলিম লীগ শাসনে দেশ দেউলিয়া। | ১৯৫৪ সালের এপ্রিলে যুক্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের ৫৭ দিন পরই বাতিল করে আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সাসপেন্ড করে রাখা হয়। যুঞ্জন্টের এম, এল, এ, ও নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে জেলে রাখা হয়েছে। অথচ আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। পক্ষান্তরে পাঞ্জাবে প্রবল আন্দোলন সত্ত্বেও আইন পরিষদকে বাতিল করা
________________________________________
হয়নি। কিন্তু পূর্ব বাংলার বেলায় অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ১২ (ক) ধারা বজায় রয়েছে। মূলত এটা হচ্ছে যুক্তফ্রন্টকে চেপে রাখার চেষ্টা। পৃথিবীর কোথাও কোন মতবিরােধের কারণে পার্লামেন্টারি শাসন বন্ধ রাখার রীতি নেই। ইউরােপে সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মস্তিসভা রদবদল হয়, কিন্তু পার্লমেন্টারি শাসন হতে জনগণকে বঞ্চিত করা হয় না। কারণ ব্যক্তির চেয়ে দেশ ও জাতি অনেক বড়।
২৪ অক্টোবর গভর্নর মন্ত্রিসভা বাতিল করে বলেছিলেন-জনগণ সকল ক্ষমতার অধিকারী। কাজেই তাদের ইচ্ছানুযায়ী সবকিছু করা হবে। আদালতে তমিজুদ্দিন খাঁর মামলা পরিচালনার সময়ও কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী মিঃ ডিপলক বলেছিলেন একই কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন ও শংকিত। কেননা সরকার সভ্য মনােনয়ন করে শাসনতন্ত্র রচনা করতে চান বলে সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। যদি তাই হয় তাহলে তা হবে জনগণের সাথে সরাসরি বিশ্বাসঘাতকতা। এটা জনগণ কখনাে গ্রহণ করবে না ।
ভাসানীর বিরুদ্ধে সরকার মওলানা ভাসানী কিহােমে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনের জন্য ‘৫৪ সালের মে মাসে পাকিস্তান ত্যাগ করেন। কিন্তু দেশত্যাগের পর ৯২(ক) ধারা প্রবর্তনের মাধ্যমে তার দেশে ফেরার পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। ইস্কান্দার মির্জা সরাসরি এই বলে হুমকি দেন যে “ভাসানী দেশে ফিরলে তাকে হত্যা করা হবে। এর প্রতিবাদে দেশের রাজনৈতিক কর্মীবৃন্দ সরকারের নিকট দাবি পেশ করে বলেন-কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার পর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী অপর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ইস্কান্দার মির্জাসহ ঢাকায় আসছেন প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। যে কনফেডারেশনের সদস্য মনােনয়নের জন্য তারা আসছেন তার ইতিমধ্যেই বেআইনী ও গণতন্ত্র-বিরােধী বলে ঘােষিত হয়েছে। এই কনফেডারেশনে গণতন্ত্র-বিরােধী সংখ্যাসাম্যের ব্যবস্থা করে পূর্ববঙ্গের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে পদদলিত করা হয়েছে।
১৯৪৭ সালের গণপরিষদে আসন বন্টনের যে নীতি ঘােষিত হয়েছিল তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। একটি স্বাধীন দেশের শাসনতন্ত্র রচনার মত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ছাড়া সম্পন্ন হতে পারে না।
ইতিপূর্বে সােহরাওয়ার্দী ঘােষণা করেছিলেন যে, তিনি মওলানা ভাসানীকে সঙ্গে করে তবেই পূর্ববঙ্গে আসবেন। কিন্তু পক্ষান্তরে দেখা গেল, যে ব্যক্তি তাকে দেশদ্রোহী, কমিউনিষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছে, বাংলার মানুষকে নির্বোধ অশিক্ষিত বলে গালি দিয়েছে, তিনি তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন। আমরা তার এই আগমনের তীব্র প্রতিবাদ করি।
________________________________________
সােহরাওয়ার্দী ৫ মাস হলাে কেন্দ্রে যােগ দিয়েছেন, এর মধ্যে তিনি ভাসানীকে দেশে ফেরানাের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তাছাড়া এদেশের জনগণ সােহরাওয়ার্দীর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যােগদানকে দুঃখজনক বলে মনে করে। এ অবস্থায় আমরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে মওলানা ভাসানীকে জাতীয় সংকট থেকে দূরে সরিয়ে রেখে যদি অবৈধ কার্যকলাপ দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা চালানাে হয়, তাহলে জনগণ ডিটেরি ও জবরদস্তির কাছে মাথা নত করবে না।
আওয়ামী লীগের প্রচার পত্র টাঙ্গাইলের কাগমারীতে ২৬ নভেম্বর ১৯৫৫ সালে পূর্ববঙ্গ আওয়ামী লীগের কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । ঐ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি প্রচারপত্র বিলি করে তাতে বলা হয়- এক মাসের মধ্যে পাকিস্তান আইন পরিষদের সভা আহবান করতে হবে। বর্তমান সরকার ২১-দফা পালন করতে ধৰ্মত ও আইনত বাধ্য । যদি এর বিপরীতে ঘটনা ঘটে তাহলে দেশব্যাপী আন্দোলনের ঝড় বয়ে যাবে।
(১) কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সামরিক বিভাগ, মুদ্রা তৈরি, বৈদেশিক নীতি এই তিনটি ছাড়া অন্য সব বিষয় প্রাদেশিক সরকারের পক্ষ থেকে আইন পরিষদের কাছ থেকে পাস করতে হবে; (২) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে; (৩) জমিদারী উচ্ছেদের ব্যাপারে নুরুল আমিন সরকার যে ৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেছে তা বাতিল করে ২১ দফার ওয়াদা অনুযায়ী আইন পাস করতে হবে, সাটিফিকেট প্রথা বাতিল ও বকেয়া খাজনা মওকুফ সহ নদী সিকস্তি বাতিল করতে হবে; (৪) পাক-মার্কিন চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি, পাক-বাগদাদ চুক্তি সহ বিভিন্ন জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী চুক্তি বাতিল করতে। হবে; (৫) স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার ছাত্রদের বেতন ও হােটেল খরচ কমাতে হবে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােকে সরকারি করতে হবে; (৬) কিস্তিবন্দী মােতাবেক কিস্তির টাকা আদায় করতে হবে, ঋণ সালিশী বাের্ড কর্তৃক মাফকৃত সুদ আদায় বন্ধ করতে হবে; (৭) পাটের মূল্য কমপক্ষে ৩০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে, পাট ব্যবসার প্রসার, পাটের ট্যা ও লাইসেন্স ফি রহিত করতে হবে, সর্বত্র পাকা ৮০ তােলা ওজন প্রবর্তন করতে হবে; (৮) ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করতে হবে, ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘােষণা করতে হবে, বর্ধমান হাউসকে বাংলা গবেষণাগারে পরিণত করতে হবে; (৯) ভিসা প্রথা বাতিল ও সর্বহারা মােহাজেরদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে; (১০) ৯২ (ক) ধারার আবরণে ৯৩ ধারা কার্যকরী করা চলবে না, যে সকল পরিষদ সদস্য ৯৩ ধারা বেঙ্গল এ্যাক্ট, ফ্রন্টিয়ার ক্রাইমস এ্যাক্ট ও পাস। করানাের পক্ষে ভােট দিয়েছেন তাদের সমাজের শত্রু হিসেবে ঘােষণা করতে হবে; (১১) রাস্তাঘাটের সংস্কার ও নদী-খাল-বিল সংস্কার করে বন্যা প্রতিরােধ ও সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। মুসলমানদের ‘ওয়াফ’, হিন্দুদের দেবােত্তর’ প্রভৃতি সম্পত্তি জনহিতকর কাজে ব্যয় করতে হবে; (১২) মাথাভারী গভর্নর জেনারেল, গভর্নর, মন্ত্রী, রাষ্ট্রদূত, কমিশনার
________________________________________
সহ অন্যান্য পদস্থ আমলাদের বেতন কমিয়ে ও পদ লােপ করে নিম্ন বেতনভােগীদের বেতন বাড়াতে হবে; (১৩) বেকার ভূমিহীনদের জন্য কাজের সংস্থান ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ‘টাই বন্ধ করতে হবে; (১৪) বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস করে শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন প্রদান ও স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ করতে হবে; (১৫) নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম কমাতে হবে; (১৬) আখচাষীকে উপযুক্ত মূল্য প্রদান সহ তাঁতীদের জন্য সুতা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে; (১৭) মদ, গাজা, ভাং, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি বন্ধ করতে হবে; (১৮) মানুষ যাতে শরীয়ত মােতাবেক চলাফেরা ও চরিত্র গঠন করতে পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ও অন্য ধর্মের লােকদের জন্য একই ব্যবস্থা করতে হবে; (১৯) ঘুষ, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির প্রতিকার করতে হবে; (২০) রেলের ভাড়া কমাতে হবে, পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে: (২১) সামরিক বিভাগের বিভিন্ন পদে বাঙালীদের উপযুক্ত পরিমাণে ভর্তি করতে হবে; (২২) গরীব কৃষকদের জন্য গৃহনির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে; (২৩) প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রিসভা ৯ সদস্যের বেশি হবে না।
| গণপরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ইস্কান্দার মির্জা ও বগুড়ার মহম্মদ আলী যুক্তফ্রন্ট পার্টির মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে ভাঙ্গন ধরানাের চেষ্টা চালাতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা এ কাজে সফল হন। ফলে কে, এস, পি, এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরােধ দেখা দেয়। পরে আওয়ামী লীগ ছাড়াই আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বে যুক্রন্ট সরকার গঠিত হয়। এই মন্ত্রিসভায় ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই রাজবন্দীদের মুক্তি দেন। মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন হাজী দানেশ, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, ফণি মজুমদার, দেওয়ান মাহবুব আলী ও মাহমুদ আলী প্রমুখ ব্যক্তি। ৯২ (ক) ধারাও প্রত্যাহার করা হয়।
১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান গণপরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ-(১) যু ন্ট-১৬; (২) আওয়ামী লীগ -২২; (৩) ন্যাশনাল কংগ্রেস-৪; (৪) ইউপিপিপি-২; (৫) সিডিউল কাট-৩; (৬) মুসলিম লীগ-১; (৭) কমিউনিষ্ট পার্টি-১; (৮) স্বতন্ত্র-১।
পাকিস্তান অবজারভার’ পত্রিকা ১৯৫৫ সালের জুনে আওয়ামী লীগের বরাত দিয়ে এক চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ করে। ঐ সংবাদে মুসলিম লীগের ৭ বছর কালীন দুঃসময়ের বিভিন্ন চিত্র প্রকাশিত হয়। -(১) ভাসানী সহ অসংখ্য দেশপ্রেমিককে বিনা বিচারে কারাগারে আটক রাখা; (২) স্বীয় স্বার্থে কৃত্রিম উপায়ে লবণ সংকট সৃষ্টি করে ১৬ টাকা হারে লবণ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন; (৩) কেন্দ্রীয় শাসকদের নিকট আত্মসমর্পণ করে জনগণের ন্যায্য দাবি বিকিয়ে দেয়া; (৪) আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের চেষ্ট করা; (৫) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা; (৬) কৃত্রিম উপায়ে মুনাফা লােভীদের স্বার্থে খাদ্য সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে লাখ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটানাে; (৭) পাট ব্যবসায়ীদের সংগে ষড়যন্ত্র করে পাটকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা; (৮) দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি; (৯) দলীয় কর্মীদের মাঝে লাইসেন্স বিতরণ; (১০) ৭
________________________________________
বছর পর্যন্ত নির্বাচন বন্ধ রাখা; (১১) পুলিশী নির্যাতন ও দেশপ্রেমিকদের গ্রেফতার করা; (১২) পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদে গড়ে ওঠা কলকাতাকে বিনা আলােচনায় ছেড়ে দেয়া; (১৩) চাকুরী ও ব্যবসা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের কাছে আত্মসমর্পণ।
আওয়ামী লীগ নবগঠিত যুক্রন্টের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন অভিযােগ পেশ করে। তার মধ্যে ছিল-(১) ‘৫৪ সালের নির্বাচনে পরাজিত ৯২ (ক) ধারার প্রবর্তক কুখ্যাত মুসলিম লীগের কাছে আত্মসর্শণ করে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ; (২) পূর্ব বাংলার মানুষের ২১ দফা দাবিকে অগ্রাহ্য করা; (৩) বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কোন প্রতিকার না করা; (৪) আওয়ামী লীগের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়া; (৫) পরাজিত হবার ভয়ে ১৪ মাস নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখা; (৬) দেড় বছর কাল পরিষদের সভা আহবান না করা; (৭) দলীয় লােকদের মধ্যে ৩৩ লাখ মন চাল বিতরণের মধ্য দিয়ে স্বজনপ্রীতি প্রদর্শন করা; (৮) শাসনতন্ত্র রচনায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ বিসর্জন দেয়া; (৯) ২১ দফার খেলাপ করে অতিরিক্ত বেতন গ্রহণ; (১০) পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১২০০ কোটি টাকা ও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মাত্র ২০০ কোটি টাকার ব্যবস্থা মেনে নেয়া; (১১) শত শত কর্মীকে বিনা বিচারে জেলে আটক রাখা; (১২) দলীয় লােকদের লাইসেন্স-পারমিট প্রদান করা।
আওয়ামী লীগ কোয়ালিশনের আড়াই মাস শাসনের খতিয়ান-(১) ক্ষমতা গ্রহণের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সকল বন্দীর মুক্তিদান; (২) ১১ দিনের মধ্যে পরিষদের অধিবেশন আহবান ও নিরাপত্তা আইন বাতিল ও বাজেট পাস; (৩) বকেয়া খাজনা-সুদ মওকুফ; (৪) সার্টিফিকেট প্রথা উচ্ছেদ; (৫) কৃষিঋণ সুদসহ মওকুফ; (৬) প্রতি ইউনিয়নে লঙ্গরখানা খােলার আদেশ; (৭) লাখ লাখ মন চাল গরীবের মধ্যে বিতরণ; (৮) প্রচুর পরিমাণে কৃষিঋণ প্রদান; (৯) রাস্তাঘাট-খাল-বিল প্রভৃতি উন্নয়নের জন্যে প্রয়ােজনীয় অর্থ বরাদ্দ: (১০) নির্বাচনে মন্ত্রীদের সরাসরি খরচ না করার নির্দেশ; (১১) শিক্ষক ও কম বেতনভােগীদের বকেয়া পরিশােধের নির্দেশ; (১২) মেডিকেল স্কুলগুলােকে উন্নীত করে ৫টি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত; (১৩) কোর্ট ফি ও কাগজের মূল্য কমানাে; (১৪) দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘােষণা: (১৫) দেশের সর্বত্র দ্রুত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা।
| বাংলা একাডেমীর উদ্বােধন ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমীর উদ্বােধন হয়। উদ্বোধন করেন আবু হােসেন সরকার। তিনি বলেন, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে দাবি তার থেকেই মূলত বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। এটি ভাষা আন্দোলনের প্রথম স্বীকৃতি। আমরা ভাষা আন্দোলনে শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করছি। বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ প্রথম যুন্ট সরকারই নিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্ব তাদের জীবনের বিনিময়ে এই একাডেমী প্রতিষ্ঠা পেল।
________________________________________
কেউ কেউ বলে থাকেন বাংলা পৌত্তলিকদের ভাষা। কিন্তু একথা মিথ্যা ও অজ্ঞতাসুলভ। বাংলা কোন বিশেষ ভাষা থেকে উদ্ভূত নয়। এ ভাষা এদেশের প্রকৃত জনগণ তথা সাধারণ মানুষের ভাষা। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সবার সমবেত চেষ্টা এর পেছনে কাজ করেছে। মধ্যযুগের বাংলার নৃপতি হােসেন শাহ বাংলার বিকাশে কাজ করেছেন। পরে এসে বাংলা পদ্য ও পুঁথি সাহিত্যের যে বিকাশ ঘটে তা মানুষের হৃদয়ের বন্ত হয়ে ওঠে। এই ভাষার সঙ্গে আমাদের নাড়ী ও রক্তের সম্পর্ক। শংকরাচার্যের আন্দোলনের পর সব বৌদ্ধ এই অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন; তাদের চেষ্টায়ও বাংলা ভাষা সমৃদ্ধি লাভ করে। শ্রী চৈতন্যের বৈষ্ণববাদের বাহনও ছিল বাংলা। প্রথম বাংলা গদ্যের রচয়িতা উইলিয়াম কেরীর নাম সবার জানা।
আমরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ফজলুল হক সাহেবের বক্তব্যের সাথে একমত পােষণ করে বলতে চাই, যে শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হবে না সেই শাসনতন্ত্র আমরা গ্রহণ করব না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ব্যাকরণ, পরিভাষা, বর্ণমালা ও মুদ্রণের উন্নতি, অভিধান প্রণয়ন প্রভৃতি সমস্যা বাংলা একাডেমী দূর করবে।
এছাড়া পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষার একটি স্বাতন্ত্র্য আছে; যেমনঃ-যশাের, রংপুর, নােয়াখালী সহ বিভিন্ন স্থানে নানা কথ্য ভাষা চালু আছে। কিন্তু সারা বাংলায় কোন ষ্ট্যান্ডার্ড ভাষা চালু নেই। বাংলা একাডেমী এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বার্থে আমরা সবকিছু করব। আমাদের জাতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাহন হিসেবে বাংলা নিঃসন্দেহে বিশ্বের দরবারে আসন লাভ করবে। বাংলা ভাষায় রচিত উন্নত সাহিত্যকর্মগুলাে অনুবাদ করে দুনিয়ার সর্বত্র পৌছে দিতে হবে এবং আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের এ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটে। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে এ সময় আওয়ামী মুসলিম লীগ ভেঙে গঠিত হয় আওয়ামী লীগ। এর তিনমাস পর ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল পেশ করা হয়। উথাপিত শাসনতন্ত্র বিল প্রসঙ্গে গণপরিষদে তুমুল বিতর্ক হয়। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিতর্কের পর মার্চের প্রথম দিকে গণপরিষদ “পাকিস্তান শাসনতন্ত্র অনুমােদন করে।১৫ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় বিল সংক্রান্ত বক্তব্যে বলেন-এই শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে সাত কোটি জনগণকে শংখলিত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমরা এই গণবিরােধী শাসনতজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলবে। ভাসানী ১৬ জানুয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ খৃষ্টান সবার প্রতি এক সপ্তাহ কালাে ব্যাজ ধারণ এবং ২ জানুয়ারি
________________________________________
প্রচারপত্রে আরাে বলা হয়-মিশর, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশে যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু আছে। মানুষ এখনাে ইউনিয়ন বাের্ড ও জেলা বাের্ডে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতিতে ভােট দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে আইন পরিষদে যুক্ত নির্বাচনে বাধা কোথায়? পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবিচার চালিয়ে আসছে। আসল কথা হলাে পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করে শােষণ করার স্বার্থেই পশ্চিমা শাসকচক্র যুক্ত নির্বাচন প্রথার বিরুদ্ধে। কিন্তু ওদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ করার লক্ষ্যেই আজ যুক্ত নির্বাচন প্রয়ােজন।
গত ৯ বছর যাবৎ মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম এদেশে সাম্প্রদায়িকতার ওপর নির্ভর করে বেঁচে ছিল। এবং এখনাে তারা একই স্বার্থে যুক্ত নির্বাচনের বিপক্ষে। এই সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে তারা ইতিমধ্যে দেশের বহু ক্ষতি করেছে। তাদের সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ দূর করা প্রয়ােজন এবং সেজন্যই দরকার যুক্ত নির্বাচন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সর্বস্তরের মানুষের স্বার্থে হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে দেশে আজ যুক্ত নির্বাচন একান্তভাবে অপরিহার্য।
আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভা গঠন করে। মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান আতাউর রহমান খান। দায়িত্ব গ্রহণের পর ৭ সেপ্টেম্বর নীতি নির্ধারণী বক্তৃতায় তিনি বলেন, আমাদের অনেকগুলাে ভয়াবহ সমস্যার সমাধান করতে হবে। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র একদিন আগেও গুলি চালিয়ে বহু লােক হত্যা করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিশন হচ্ছে।
দেশের খাদ্য ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থার চরম অবনতির ফলে গ্রামের মানুষের দুঃখ-কষ্ট অবর্ণনীয়। সরকার প্রথমেই খাদ্য সমস্যার সমাধান করবে। ইতিমধ্যে ব্যবস্থাও গহীত হয়েছে। যেমন-(১) পূর্বে প্রদত্ত এক কোটি দশ লাখ মন খাদ্যশস্য আমদানির আদেশের পর আরাে ২৭ লাখ মন চাউল আমদানির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। (২) অতি দ্রুত খাদ্যশস্য আমদানির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। আক্টোবরের মধ্যেই এক কোটি সাঁইত্রিশ লাখ মন খাদ্য আমদানি করতেই হবে। (৩) খাদ্যশস্যের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের নির্দেশ দেয় হবে। কালােবাজারী ও সুদখােরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও তাদের নির্দেশ প্রদান করা হবে । (৫) ফুড কমিটি গঠনের মাধ্যমে সেগুলােকে অধিকতর শক্তিশালী করা হবে। (৬) লঙ্গরখানা খােলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আমরা প্রশাসনকে পুনর্গঠন করব । অসৎ, অকর্মণ্য কর্মচারীকে সরিয়ে দেয়া হবে। সৎ, কর্মক্ষম ও গতিশীল লােককে নিয়ােগ করা হবে। জনসাধারণের ন্যস্ত বিশ্বাসের ভিত্তিতে ও ২১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা ইতিমধ্যেই রাজবন্দীদের মুক্তির নির্দেশ দিয়েছি। রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
________________________________________
নিরাপত্তা আইনের প্রত্যাহারক আইন প্রণয়ন করা হবে। অনাচার ও দুর্নীতি দূর করার লক্ষ্যে পন্থা অবলম্বন করা হবে। অতিরিক্ত ধনসম্পদ অর্জনকারীদের বিরুদ্ধে কমিটি গঠিত হচ্ছে। অনুসন্ধানে দোষী প্রমাণিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন করা হবে। কম ব্যয়ে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থাই হবে আমাদের প্রধান ব্রত। যারা এদেশে সংখ্যালঘু তাদের আমরা অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করি। এখন থেকে তারা সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার পাবেন এবং পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে ধর্ম পালন করতে পারবেন।
স্বাধীনতার ১০ বছর পরেও যারা মােহাজের নামে পরিচিত তাদের সুষ্ঠুভাবে পুনর্বাসন করা হবে। যাতে তারা এদেশের জনগণের অংশ হিসেবে সম্মানজনভাবে জীবন যাপন করতে পারেন সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।
যুক্ত নির্বাচন আইন পাকিস্তান গণপরিষদে বহুল আলােচিত যুক্ত নির্বাচন বিল উত্থাপন করা হয় ১০-১১ অক্টোবর, ১৯৫৬ সালে। বিলটি উত্থাপিত করেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। ব্যাপক বিতর্কের পর বিলটি ভােটে দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একটানা ১৪ ঘন্টা বিতর্কের পর বিলটি ভােটে দেয়া হলে পক্ষে ৪৮ ভােট এবং বিপক্ষে ১৯ ভােট পড়ে। ১২ অক্টোবর পাকিস্তান গণপরিষদে যুক্ত নির্বাচন বিল পাস হবার পর তা আইনে পরিণত হয়।
কাগমারী সম্মেলন ১৩ জানুয়ারি, ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী বাংলার গরীব কৃষক মজুর ছাত্র যুবক ও সাধারণ মানুষের প্রতি এক আবেদনে বলেন, এদেশ শুধু মন্ত্রী, আমলা, সরকারি কর্মচারীদের নয়। এদেশের ৯৫ ভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের স্বার্থ রক্ষায় দুনীতি-স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন সমাজবিরােধী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য রুখে দাঁড়ান। তিনি ১৪ দফা দাবি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগরে মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার আহবান জানিয়ে ৭-৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সম্মেলনে যােগদানের জন্য সবাইকে অনুৱেধ করেন।
৩ ফেব্রুয়ারি সম্মেলন সংক্রান্ত অপর এক প্রচারপত্রে তিনি বলেন। বাঙালীদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও ঐতিহাসিক ২১ দফ বাস্তবায়ন করা হােক। দেশের সর্বস্তরের মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগের সংগঠন গড়ে
কাগমারী সম্মেলনে ভাসানী বলেন, আমি কোন যুদ্ধজোটে বিশ্বাস করি না। যেকোন একার যুজজোট মানব সভ্যতা ও মুক্তির পথে বাধাস্বরূপ। জনগণের ভবিষ্যৎ কল্যাণে
________________________________________
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির জন্য সংগ্রাম করে যাব। উল্লেখ্য যে ১৯৫৬ সালের ২০ মে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বপ্রকার যুদ্ধ জোটের বিরােধিতা করে বাগদাদ, সিয়াটো প্রভৃতি যুদ্ধ চুক্তি বাতিলের দাবি জানানাে হয়েছিল। | ৭ ফেব্রুয়ারি কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী বলেন, আপনারা মুসলিম লীগের ইতিহাস বিস্মৃত হবেন না। গত সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের যে শশাচনীয় পরাজয় হয়েছে তা পৃথিবীর কোন দেশের ক্ষমতাসীন দলের হয়নি। মুসলিম লীগের এই শশাচনীয় মৃত্যুর কারণ কি? আওয়ামী লীগকে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। বিরােধী দলের ভুল জনগণ ক্ষমা করে কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের ভুলের কোন ক্ষমা নেই। মুসলিম লীগ কি কি ভুল করেছিল তার কিছু উল্লেখ করলেই আমাদের পক্ষে সতর্ক হওয়া সম্ভব হবে।
(১) ক্ষমতা লাভের পরই মুসলীম লীগ করাচীতে রাজধানী স্থাপন, উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে ঘােষণা এবং চাকরির ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করল । (২) ব্যক্তিস্বার্থে তারা রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার শুরু করে ও মুসলিম লীগের সমালােচনাকে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে আখ্যা দিল। (৩) মুসলিম লীগ নেতাদের ব্যক্তি জীবনে ইসলামের লেশমাত্র চিহ্ন না থাকলেও রাজনৈতিক সভা-সমিতিকে ওয়াজ নসিহতের জলসায় পরিণত করে। (৪) তারা এক আল্লাহ, এক দল এক নীতির প্রচারে লিপ্ত হল; একথাও বললাে যে, মুসলিম লীগের বিরোধিতা মানে আল্লাহ ও কোরআনের বিরােধিতা। (৫) লীগের কর্মকর্তারা পাকিস্তানকে নিজৰ জমিদারী মনে করে ধন-সম্পদ লুণ্ঠনে ব্যস্ত এবং ভােগবিলাসী জীবনে মেতে ওঠে। লুটপাটের রাজত্বে পরিণত হলাে সারা দেশ। (৬) উপমহাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হবার পর মুসলমানদের সমাজজীবন গােমরাহী ও মৃর্থতায় নিমজ্জিত হয়। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে চেষ্টা করতে থাকে। ফলে গড়ে উঠতে থাকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ! এই সত্যকে লীগ নেতারা ভুলে গেলেন এবং নিজেদের চরম বিজ্ঞতার অধিকারী ও নির্ভুল মনে করতে থাকলেন। ফলে মূৰ্থতার সঙ্গে যােগ হলাে অহমিকার, এতে যা ঘটার তাই ঘটল এবং তাদের সেই ভুলের খেসারত দিল সমগ্র জাতি। (৭) লীগ সরকার রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতিকে গুলিয়ে ফেললেন। ভাবতাড়িত অর্থনীতি যে একেবারে অচল, নেতারা তা ভুলে গিয়ে ভারতের সঙ্গে সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিলেন। ফলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলাে এবং খেসারত দিল সাধারণ মানুষ। তারা পাকিস্তানের দুই অংশে স্বর্ণের মূল্য দুরকম নির্ধারণ করে। ফলে অর্থনীতি আরাে পঙ্গু হয়ে পড়ে। (৮) ইংরেজ আমলের মাথাভারী আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনকে আরাে জটিল করে তােলা হলাে। যে কারণে মাথাপিছু বার্ষিক আয় ১০০ টাকারও কম। ধর্মের জিগির তুলে দেশকে নিমজ্জিত একটা ভিক্ষুক রাষ্ট্রে পরিণত করলেন।
জনসাধারণ কখনাে ভুল করে না। ভুল করলে তারা কখনাে একটি স্বাধীন দেশ আনতে পারে না। আওয়ামী লীগের মেনিফেষ্টোর মূলকথা হলাে পররাষ্ট্র, মুদ্রা এবং দেশরক্ষা ছাড়া বাকী সকল বিভাগের আর প্রদেশের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। বিনা
________________________________________
খেসারতে জমিদারী উচ্ছেদ করতে হবে; কেননা ৬০ কোটি টাকা দেবার ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নেই। যে টাকা জমিদার-তালুকদারদের দেবার ব্যবস্থা পূর্বতন সরকার করেছিলেন তা দিয়ে এদেশে নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে তােলা হবে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা হবে।
সামরিক বিভাগে মাত্র পাঁচ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানী যুবক ভর্তি হতে পারে, এক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে। বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানীরা খর্বকায়; তারা দেশরক্ষার উপযুক্ত নয়। তাহলে চীনা ও জাপানীরা কি করে একটি আধুনিক সেনা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। সকল উন্নয়ন বাজেটের ৭৫ ভাগ ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এই বৈষম্য আর চলতে দেয়া হবে
। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচুর আবাদী জমি রয়েছে; সেখানে আধুনিক উপায়ে কৃষির উ ৎপাদন বাড়ানাে সম্ভব । পূর্ববঙ্গে যেহেতু জনবসতি অত্যন্ত বেশি সেহেতু এদেশকে ব্যাপক হারে শিল্পায়িত করতে হবে। এযাবৎ শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বাংলাকে চরমভাবে অবহেলিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য প্রাদেশিক সরকারের উচিত হবে একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যার দায়িত্ব হবে কেবল পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করা । পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে বিভেদ সৃষ্টি এবং শাসন করাে” শত শত বছরের এই সাম্রাজ্যবাদী নীতি ব্যর্থ করে জনগণের স্বার্থে নতুন নীতি গড়ে তুলতে হবে।
কাগমারী সম্মেলনে সােহরাওয়ার্দী ১৯৫৭ সালের ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে শহীদ সােহরাওয়ার্দী আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর ৭ ফেব্রুয়ারী বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক শিক্ষার প্রয়ােজন রয়েছে।
তিনি ভাসানীর স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কিত দাবির প্রেক্ষিতে বলেন, ইতিমধ্যে আমরা ৯৮ ভাগ স্বায়ত্তশাসন পেয়েছি। আমাদের উপর জনগণের আস্থা অর্জিত হয়েছে।
তিনি দেশের সংহতির উপর গুরুত্বারােপ করেন। পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই দাবির কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। কেবল জাতীয় পরিষদে আইন পাস করলেই অবস্থার কোন উন্নতি হবে না। পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রের যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য পাচ্ছে। তিনি স্বতন্ত্র প্রবণতার তীব্র প্রতিবাদ করেন।
তিনি বলেন, ভাসানী সামরিক জোটের বিরােধী হলেও দেশের উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য গ্রহণের বিরােধী নন। পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমার সঙ্গে তাদের পার্থক্য আমার প্রতি চ্যালেঞ্জম্বরূপ।
সম্মেলন প্রসঙ্গে দৈনিক আজাদ কাগমারী সম্মেলন প্রসঙ্গে মুসলিম লীগের মুখপাত্র দৈনিক আজাদ’ এক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ১২ ফেব্রুয়ারি ‘৫৭ তে প্রকাশিত ঐ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, সম্প্রতি
________________________________________
কাগমারীতে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়ে গেল-সেই সঙ্গে একটা তথাকথিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। পাক-বাংলার সাহিত্য তমুন——নিয়ে যারা চর্চা করেন তারা ঐ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেনি। কাজেই এ সম্মেলনকে কিছুতেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিমূলক বলা চলে না।।
“ভারতীয় বাংলায় সাহিত্যসেবীদের ভক্তি-শ্রদ্ধা দেখে পুলকিত হতে হয়, সম্ভব হলে ভারতীয় বাংলা উজাড় করে সাহিত্যিকদিগের কাগমারী আনতে দ্বিধা ছিল না। কিন্তু তা সম্ভব না থাকায় কয়েকজনকে এনে দুধের সাধ ঘােলে মিটিয়েছে। সম্মেলনের ভেতর দিয়ে যে সুর ফুটে উঠেছে তা বড় মারাত্মক ও ভয়ানক। এর মাধ্যমে একটি অশুভ ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে। | সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের যে মারাত্মক চেষ্টা হয়েছিল তা প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর হস্তক্ষেপে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে যা অত্যন্ত সুখের বিষয়। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে অপচেষ্টাকারীরা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এতে আওয়ামী লীগের অঙ্গন রােধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। ভাসানীর নেতৃত্বে তারা পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে যেতে চান? পররাষ্ট্রনীতিতে নিরপেক্ষতা মানে বন্ধুত্বহীনতা এবং ব্লাকমেইলিং। এই রাজনীতি ভারতকে বন্ধুত্বহীন করেছে। ভারতের অনুসরণ কোন্ উদ্দেশ্যে? পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে এইসব ষড়যন্ত্রকারীরা পাকিস্তানের শত্রু। ভাসানীর বক্তব্যে পাকিস্তানী মাত্রই আজ শংকিত। ভাসানী বলেছেন, প্রাক-স্বাধীনতা যুগে মুসলিম লীগের কোন অস্তিবাচক জীবন দর্শন ছিল না, যে কারণে পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত কোন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলাে না। এই কথার অর্থ হলাে কায়দে আযমের নেতৃত্বে যে পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছিল তা ছিল নিতান্তই একটা হট্টগােল মাত্র এবং এই মারকাট হট্টগােলের মধ্য দিয়ে যেহেতু পাকিস্তান সৃষ্টি সেহেতু এখন পর্যন্ত কোন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
কায়দে আযম সম্পর্কে কোন ভারতীয় নেতাও অদ্যাবধি এমন কথা বলতে সাহস করেননি। পাকিস্তান সম্পর্কে এমন ঘৃণ্য ন্যক্কারজনক উক্তি শােনার দুর্ভাগ্য হবে তা আমরা কল্পনাও করিনি।
ভাসানী পাকিস্তানকে রসাতলে নিয়ে যাবার মতলব এটেছে। তার সেই মতলব জনগণের কাছে ধরা পড়ে গেছে। তিনি বলেছেন, পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পকিস্তানের শশাষণ যদি বন্ধ না হয় তাহলে অদুর ভবিষ্যতে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানকে “আসসালামু আলাইকুম জানাবে”। ভাসানীর এই বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।
এর জবাবে দেশবাসী ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি মওলানা ভাসানী ২৬ মার্চ ৫৭ সালে এক আবেদনে বলেন, মিথ্যা প্রচারে কর্ণপাত না করে ২১ দফা আদায়ের জন্য সবাই দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলুন। সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন যে শতকরা ৫৭ জন অধিবাসীর দাবি অনুযায়ী পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত করতে হবে।
________________________________________
পাকিস্তানের সংহতি ও মিলন নির্ভর করছে একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের ওপর ” মুসলিম লীগের সঙ্গে যারা হাত মিলিয়ে সাড়ে চার কোটি মানুষের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেক্ষা করেছিল তারা বর্তমানে আওয়ামী লীগের বিরুতে লিপ্ত হয়েছে। এরা দেশকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
| বায়ত্ব শাসন প্রস্তাব | ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ। প্রস্তাবটি উত্থাপন করতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে একটি প্রতিক্রিয়াশীল যুগের অবসান হয়েছিল। তখন যুঞ্জন্টের যে ২১ দফা ছিল তার মধ্যে প্রধান দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন । এটি জনগণের গণতান্ত্রিক দাবি। এই দাবিকে বানচালের জন্য সড়যন্ত্র হচ্ছে। তারা বলছে স্বায়ত্তশাসনের অর্থ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা । এরা একথাও বলে যে যুক্তফ্রন্ট মানে যুক্ত বাংলা। মুসলিম লীগের একথা নতুন নয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি অতি যুক্তিসংগত। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের উভয় অংশই শক্তিশালী হবে। স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন কেবল পূর্ব পাকিস্তানের নয়, বরং এটি উভয় পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন। | আসাবউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে। এর বিরােধিতা মানে লাহাের প্রস্তাব ও পাকিস্তানের বিরােধিতা করা। মুসলিম লীগের পতন হয়েছে কেবল স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সচেষ্ট না হওয়ার কারণে এবং তারা উল্টো সবটুকু ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে তুলে দিল। ভাসানী, ফজলুল হক ও সােহরাওয়ার্দী ২১ দফার যে সনদে স্বাক্ষর করেছিলেন তাতেও স্বায়ত্তশানের কথা ছিল। | শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, স্বায়ত্তশাসনের দাবি পূর্ব পকিস্তানের জনগণের দাবি। এই দাবির ভিত্তিতে গত নির্বাচনে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলাম। শাসনতন্ত্র রচনার সময় আওয়ামী লীগের ১২ জন সদস্য স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করেছিল। গত ৯ বছরের ইতিহাস আলােচনা করলে বােঝা যাবে আমরা কেন স্বায়ত্তশাসন চাই। এই দাবি কেবল রাজনৈতিক নয়, এ আমাদের বাঁচা-মরার দাবি।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৫ জুলাই ১৯৫৭ সাল ঢাকায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি জন্মলাভ করে। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সম্মেলনে উভয় পাকিস্তানের প্রায় ১২ শ’ নেতা ও কর্মী যােগদান করে। অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করবে বলে ঘােষণা করে।
________________________________________
পশ্চিম পকিস্তানের আব্দুল গাফফার খান, জি, এ, সৈয়দ, মিয়া ইফতেখার, মাহমুদুল হক ওসমানী, আব্দুল মজিদ সিন্ধি, মাহমুদ আলী কাসুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। ভাসানী বিভাগপূর্ব কাল থেকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভ পর্যন্ত রাজনৈতিক অবস্থার পর্যালােচনা করে সুদীর্ঘ বক্তৃতা দেন । ভাসানীর বক্তব্য শেষে ইয়ার মােহাম্মদ খান নয়া প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব উত্থাপন করলে মােহাম্মদ তােয়াহা তা সমর্থন করেন। | প্রস্তাবে বলা হয়, সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও শশাষণমুক্ত জাতি প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন, নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। নতুন জাতীয় দল গঠন এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য। এই নতুন রাজনৈতিক দলটির নাম হবে “ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। পার্টির মেনিফেস্টোতে বলা হয়ঃ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন, দেশ ও জাতির অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নের স্বার্থে একটি নয়া রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। এই দল স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করবে।
নির্বাচন বানচালের আভাষ সাধারণ নির্বাচন বানচাল প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা ২৮ নভেম্বর ১৯৫৭ সালে এক পূর্বাভাসে জানায়, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের শর্তে কেন্দ্রে মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত বিল জাতীয় পরিষদে উথাপনের কথা। কিন্তু কোয়ালিশনের অঙ্গদল “রিপাবলিকান পার্টি” এই বিল উত্থাপন না করার জন্য প্রধানমন্ত্রী চুন্দ্রিগড়কে অনুরােধ করেছেন। পার্টি-সদস্যবৃন্দকেও এ বিষয়ে রিপাবলিকান পার্টির দলীয় নির্দেশ মেনে চলার জন্য বলেছে।
পত্রিকাটি আরাে বলে, পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য এই যে, রাজনৈতিক দলগুলাে আজ যা বলে কাল তার উল্টো করে বসে। এই রিপাবলিকান দল সােহরাওয়ার্দীর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করলে তিনি পদত্যাগ করেন। সেই রিপাবলিকানদের সমর্থনেই আবার মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আবার মন্ত্রিসভা ভাঙবে । রিপাবলিকান দলের এই সুবিধাবাদী নীতি পাকিস্তানকে একটা অনিশ্চিত আগামীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সবাই আশা করেছিল পৃথক নির্বাচনের যে শর্তে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল রিপাবলিকান পার্টি সেই শর্ত পূরণ করবে। কিন্তু তারা তাদের মত পাল্টেছে। আবার দেখা যাবে সুবিধাবাদী দর্শন অনুযায়ী তারা পুনরায় এই বিলে সমর্থন দেবে। রিপাবলিকান দলের এই দোটানা মতের পেছনে হয়ত কোন গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। যাই হােক জনগণ আশা করছে পূর্বপ্রতিশ্রুত ওয়াদা অনুযায়ী ৫৮সালের নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তা না হলে তারা সকল প্রকার চক্রান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।
________________________________________
আতাউর রহমান খানের ভাষণ পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থা ব্যাখ্যা করে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ৪ জুন ১৯৫৮ সালে বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান মারাত্মক আর্থিক সংকটে ভুগছে। ১৯৪৭ সালে ১৪ কোটি ১৬ লাখ টাকার দেনা ঘাড়ে নিয়ে পাকিস্তানের জন্ম হয়। ফলে প্রাদেশিক সরকারকে বছরের পর বছর ধরে সেই দেনা পরিশােধ করতে হয়।
১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গের রাজস্ব আয় ছিল ১৭ কোটি টাকা। কেন্দ্রের কাছ থেকে পশ্চিমের তুলনায় পূর্ববঙ্গের অনেক বেশি সাহায্য প্রয়ােজন ছিল কিন্তু তা কোনদিন পাওয়া যায়নি। ১৯৫৮-৫৯ সালে কেন্দ্র পশ্চিম পাকিস্তানকে দিয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানকে দিয়েছে মাত্র ২৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। লােকসংখ্যা তাদের ৩ কোটি ৩৭ লাখ এবং আমাদের ৪ কোটি ১৯ লাখ; এ হিসেবে আমাদের প্রাপ্য অনেক বেশি।
দেশ বিভাগের আগ থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে কিছু উন্নয়ন কাজ চলছিল এবং সে বাবদ তদানীন ভারত সরকার সেই অর্থ সাহায্য বন্ধ করে দেয়। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও পূর্ববঙ্গের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। ১৯৫৭-৫৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ঋণ পেয়েছে ৯৫ কোটি টাকা, পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তান ঋণ পেয়েছে ৪৫ কোটি টাকা। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থও সমুদয় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শূন্যের কোঠা থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে এগুতে হচ্ছে।
১৯৫৬-৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দেশরক্ষা বাবদ ব্যয় করা হয় ১৮ কোটি টাকা অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৪৮০ কোটি টাকা। পূর্ব পাকিস্তানকে তার অস্তিত্ব রক্ষার্থে কঠোর সংগ্রামের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। স্বাধীনতার পর এযাবৎ এখানে কোন বড় রকম উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়নি। অথচ জনগণের উপর অধিক হারে করের বােঝা চাপানাে হয়েছে। সিএসপি আমলা ও গভর্নরকে আরাে বেশি আর্থিক সুবিধাদানের জন্য কেন্দ্র প্রাদেশিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। পাট রপ্তানির ক্ষেত্রেও সরকার উপকারের পরিবর্তে অপকারই বেশি করছে। পাট থেকে ১৯৫০-৫১ সালে যেখানে আয় ছিল প্রায় ৭ কোটি টাকা সেখানে বিভিন্ন প্রকার শুল্ক ধার্যের কারণে ১৯৫৩-৫৪ সালে আয় দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ কোটি টাকা। প্রদেশের আর্থিক অবস্থার এই করুণ পরিস্থিতির প্রধান কারণ হচ্ছে প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের দায়িত্বহীনতা ইপিআর ও সীমান্ত পুলিশের খরচ কেন্দ্রের বহন করার কথা ছিল; সে বাবদ বর্তমান পাওনা ৮ কোটি টাকা, কিন্তু কেন্দ্র সে অর্থ প্রদান করেনি। বেসামরিক দেশরক্ষা বাবদ পাওনা ৫৩ লাখ টাকা সেই অর্থ পরিশােধ করা হয়নি।
১৯৫৪-৫৫-৫৬ সালে সর্বগ্রাসী বন্যা ও ১৯৫৭ সালের অনাবৃষ্টি দেশকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। কৃষি উৎপাদন সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়েছে। গবাদি পশু উজাড় হয়েছে। কলেরা মহামারীতে দেশ ছেয়ে গেছে। ফলে দেখা দিয়েছে মারাত্মক খাদ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্যের
________________________________________
উর্ধগতি। জনগণের এই সংকটকালে কেন্দ্র তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকে। প্রাদেশিক সরকার যথাসম্ভব তাদের দায়িত্ব পালন করছে।
কেন্দ্রীয় সরকার ঘােষণা করেছে যে, পূর্ববঙ্গের খাদ্য আমদানির জন্য তারা আর কোন অর্থ বরাদ্দ করবে না। কেন্দ্র আরেকটি নির্দেশ দিয়েছে তা হলাে পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চাল কিনতে হবে, তাতে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। তাছাড়া এই নীতি অমানবিক ও পূর্ববঙ্গকে শশাষণ করার শামিল।
কলেরা, বসন্ত, বন্যা, খরা, ঝড় প্রভৃতি দুর্যোগ পূর্ব পাকিস্তানের নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। কলেরা ও বসন্তে ১৯৫৩ সালে মারা গেছে ২৭, ২৯০ জন, ‘৫৪ সালে ১০,৯১২ জন, ‘৫৫ সালে ১৫,০৭৫জন, ‘৫৬ সালে ২০, ৭৯৯জন, ‘৫৭ সালে ১৬,২৫০ জন, ‘৫৮ সালে ১৯,০০৬ জন । এটি সরকারি হিসাব।
আইয়ুব খানের সামরিক আইন ঘােষণা ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনা প্রধান জেনারেল আইয়ুব খান দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করেন। সারা দেশে সামরিক আইন জারি করে সকল বিরােধী রাজনৈতিক নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানকেও বন্দী করা হয়। | এক ঘােষণার মাধ্যমে জনগণকে জানানাে হয় যে, জাতীয় প্রয়ােজনে পাকিস্তানের সীমানার মধ্যে এখতিয়ার প্রয়ােগ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। সুবিধাজনক পন্থায় সামরিক আইনের হুকুমনাম প্রকাশ করা হবে। প্রচারিত হুকুম লংঘিত হলে যে কোন ব্যক্তিকে সামরিক আইনের আওতায় বিচার করা হবে। রেগুলেশন্সমূহে বিশেষ দভের বিধান সহ বিচার ও শাস্তি প্রদানের জন্য বিশেষ আদালত নিয়ােগ করা যেতে পারে। আইয়ুব খানের এই অবৈধ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলকে স্বাগত জানায় জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম সহ আরে কয়েকটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। | ১৯৫৮ সালের আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পর সমগ্র দেশ নিশ্ৰুপ হয়ে যায় । কারাে টুশ করার উপায় থাকে না। এই সময় জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা আলী। আসাদ বিপ্লবী তরুণদের সমন্বয়ে গড়ে তােলেন “পূর্ব বাংলা লিবারেশন ফ্রন্ট । জামালপুরে স্থাপিত হয় সংগঠনের গােপন সেল । ক্রমান্বয়ে দলের সদস্যসংখ্যা বাড়তে থাকে ।এই দলের সদস্যরাে ভারত সরকারের সঙ্গে আলােচনা সাপেক্ষে সেখানে ট্রেনিং নিতে যায় কিন্তু ট্রেনিংয়ের এক পর্যায়ে ভারত সরকার তাদের গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করে। পরে আইয়ুব সরকারের গ্রেফতারী পরােয়ানা ও জারিকৃত হুলিয়ার কাগজপত্র পাঠানাে হলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। পরে তারা গারাে পাহাড় দিয়ে দেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে পকিস্তান সরকারের গুণ্ড বাহিনী তাদের। গ্রেফতারে চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। বিপ্লবী আলী আসাদ ক্ষেতমজুরের বেশে সমগ্র পূর্ব
________________________________________
বাংলায় সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তােলেন। এক পর্যায়ে স্বাধীনতার পূর্বেই তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরবর্তীকালে তার আর কোন সংবাদ পাওয়া যায় না।
শহীদ দিবস পালনের আহবান ১৯৬৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সমাজের একটি প্রচারপত্র প্রকাশিত হয়। প্রচারপত্রের মাধ্যমে তারা দেশবাসীকে ‘৫২র ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের আহবান জানান।
প্রচারপত্রে বলা হয়, এগার বছর পূর্বে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন তাদের আদর্শ আমাদের উত্তরাধিকার। ২১ এদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতীক দিবস। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বাংলা ভাষাভাষী গণতান্ত্রিক স্বাধিকারের আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এই দিবস আমাদের জাতীয় দিবসে পরিণত হয়েছে। | গণবিরােধী শাসকচক্রের কার্যকলাপে দেশের মানুষ আজ দিশেহারা। গ্রেফতার, জেল, গুলি, বহিস্কার প্রভৃতি আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে। নজীরবিহীন অত্যাচারে জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। দেশের এই সংকট মুহূর্তে ২১-এর আগমন বিরাট তাৎপর্যময়। কাজেই আজকের এই মহান দিবসে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অটল থেকে আমাদের পরবর্তী সিদ্ধান্ত বাস্তাবায়নে শপথ নিয়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
ভোের ৫-১৫ মিনিটে কালাে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শহীদ দিবসের কর্মসূচী শুরুর নির্দেশ দেয়া হয়। কবর জিয়ারত, প্রভাত ফেরী, শশাভাযাত্রা সহকারে শহর প্রদক্ষিণ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সভা, মসজিদ-মন্দিরে মােনাজাত-প্রার্থনা ও সন্ধ্যায় মিলাদ মাহফিলের মাধ্যমে দিনের কর্মসূচী শেষ করার কথা বলা হয়। সামরিক শাসনােত্তর প্রথম এই শহীদ দিবসের প্রচারপত্রে ২৯ জন ছাত্রনেতা স্বাক্ষর করেন।
শিক্ষা দিবস পালনের আহবান স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের কঠোর নির্যাতনের মুখে প্রথমেই দেশের শিক্ষা জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আন্দোলন করার জন্য অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ, প্রতিদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র সমাজ ১৯৬৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালনের আহবান জানিয়ে এক প্রচারপত্র বিলি করে। এই প্রচারপত্রে বলা হয় যে, চরম নির্যাতনের মুখেও ছাত্র সমাজকে তাদের। দাবি আদায়ের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। প্রতিহত করতে হবে সরকারের অবৈধ নির্যাতন। এছাড়া ছাত্র সমাজের ২২ দফা আদায়ের লক্ষ্যে দেশব্যাপী কালােব্যাজ ধারণ; কালাে পতাকা উত্তোলন, ধর্মঘট, শশাভাযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শন সহ বিভিন্ন কর্মসূচী ঘােষণা
সাপ্রদায়িক দাঙ্গা ১৯৬৪ সালে ‘৪৭-এর পরে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সাম্প্রদায়িক দুর্বত্তদের হাতে নিহত হয় অসংখ্য মানুষ। লুটপাট, অগ্নিসংযােগ ও নারী ধর্ষণের মত নিকৃষ্ট কাজে লিপ্ত হয় এক শ্রেণীর সুযােগ সন্ধানী নরপশু যারা হিন্দুও.নয়, মুসলমানও নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এ সময় এক নরককুন্ডে পারিণত হয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে দেশের সকল জনগণকে রুখে দাঁড়াবার আহবান জানান। ১৭ জানুয়ারি দেশের প্রগতিশীল সংবাদপত্রে এই আহবান প্রকাশিত হয়। এতে পাড়ায় পাড়ায় দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠনের মাধ্যমে যেকোন উপায়ে শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করার কথা বলা হয়।
নেতৃবৃন্দের আবেদন জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রধান প্রধান নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সর্বদলীয় সার্বজনীন ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন কর্মপরিষদ” নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। আট সদস্যের এই কর্ম পরিষদ কমিটিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, মহিউদ্দীন আহমেদ প্রমুখ।
১৯৬৪ সালের মার্চে এই কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত এক প্রচারপত্রে কতিপয় কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়। এই কর্মসূচীর মধ্যে ছিল ১৮ মার্চ রাস্তার মােড়ে মােড়ে পথসভা ও খন্ড মিছিল। ১৯ মার্চ হরতাল এবং পল্টন ময়দানে জনসভা, সভাশেষে শােভাযাত্রা।
কর্মপরিষদের বিশাল প্রচারপত্রে আরাে বলা হয় যে, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা যে স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম মাত্র ছয় বছরের মধ্যে সেই অধিকার থেকে আমরা বঞ্চিত। দেশের জনগণ এক চরম হতাশাজনক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্যে বসবাস করছে। গণতন্ত্রের নামে যে একনায়কতন্ত্র চলছে তাতে এদেশের মানুষের মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। উন্নয়নের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। জনগণ ও সংবাদপত্রের বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়েছে।
আইয়ুব সরকার সকল গণদাবি উপেক্ষা করে জাতীয় পরিষদে নতুন নতুন আইন পাসের চক্রান্ত করছে। দেশের কৃষক ও সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের খাজনা, ট্যাক্স, তথা দেশ পরিচালনার সকল রসদ যােগাচ্ছে অথচ তারা মতামত প্রকাশের অধিকার পাচ্ছে না। নাগরিক সুযােগ-সুবিধার সামান্যতম অংশীদারও তারা নন, অথচ বর্তমান সরকার প্রচারযন্ত্রে জনগণের জন্য কুঞ্জরা বর্ষণ করছে। পাশাপাশি এই সরকার জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদকে এক তামাসায় পরিণত করেছে। এই অবস্থায় স্বৈরাচারী শাসন থেকে
________________________________________
মুক্তি পেতে হলে দেশের জনগণকে কঠোর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সুদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টি করে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছাত্র কৃষক মুটে মজুর ব্যবসায়ী চাকুরীজীবী সবাইকে দুর্বার আন্দোলনে শরীক হতে হবে। সেইসঙ্গে হরতাল, পথসভা, জনসভা, শশাভাযাত্রা প্রভৃতি কর্মকান্ডে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে হবে।
আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফতেমা জিন্নাহ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ করচির লাখাম হাউসে সম্মিলিত বিরােধী দলের এক বৈঠকে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনােনীত করা হয়। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান সহ আরাে কয়েকজন মিস জিন্নাহকে সম্মিলিত বিরােধী দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জানান।
অপেক্ষমান সাংবাদিক ও জনতার উদ্দেশে মিস জিন্নাহ বলেন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে বিরােধী দলসমূহের এই সিদ্ধান্তে তিনি সম্মত। এই ঘােষণায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বিরােধী দলের ঐক্যকে স্বাগত জানায়। | সরকারি মহল ও এক শ্রেণীর সংবাদপত্র মিস জিন্নাহকে প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের জন্য চাপ প্রয়ােগ ও অপপ্রচার চালাতে থাকে। কিন্তু মিস জিন্নাহর মনােভাবের ফলে তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
| হাজী দানেশের জবাব। কনভেনশন মুসলিম মনােনীত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আইয়ুব খাঁ তার নির্বাচনী প্রচারকালে জনমনে নানা বিভ্রান্তির চেষ্টা করেন। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম সহ বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে তিনি যে মিথ্যাচার চালাতে থাকেন তাতে অতিষ্ঠ হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক হাজী মােহম্মদ দানেশ অক্টোবর ৬৪তে পার্টির প্রকাশিত এক পুস্তিকার মাধ্যমে তার উত্তর প্রদান করেন। রাজনীতি ও বয়সের শেষ প্রান্তে এসে নীতিভ্রষ্ট হাজী দানেশের রাজনৈতিক চরিত্র আলােড়ন তুলেছিল।
তিনি বলেন, আইয়ুব খান বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যােগদানের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এই উপমহাদেশের মানুষ যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত তখন তিনি বিদেশী শাসকদের নির্দেশে গুলির আঘাতে নিজ দেশের জনগণের বুকের রক্ত ঝরাচ্ছিলেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের একজন অনুগত সেবক হিসেবে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার কোন অবদান নেই। স্বাধীনতা অর্জনের পর বিদেশী প্রভুদের পদলেহনকারী কর্মকর্তাদের অপসারণ করে সে ক্ষেত্রে নতুন দেশপ্রেমিক যােদ্ধাদের নিয়ােগ করা হয়, কেননা তারা জানে স্বাধীনতা অর্জনের কষ্ট ও তা রক্ষার দায়িত্ব কতটুকু। কিন্তু আশ্চর্যভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পরেও পুরােনাে আমলাতন্ত্র ও সামরিক স্বৈরাচারকে অটুট রাখা হলাে।
________________________________________
আইয়ুব খাঁ স্বাধীনতার আগেও যেমন পরেও তেমনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত রইলেন। পরে তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান পদে অধিষ্ঠিত হলেন। চাকরিতে থাকাকালেই মােট তিনবার তার মেয়াদ বৃদ্ধি হয়। আইয়ুব খাঁ তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে ধরনা দিলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। এরপর তিনি গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদের শরণাপন্ন হন। কিছুদিন পর গােলাম মােহাম্মদ প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে খাজা নাজিমুদ্দিনকে অপসারণ করেন। অন্যদিকে আইয়ুবের চাকুরির মেয়াদও বৃদ্ধি করা
শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বিচারের সময় যখন তার বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপিত হয় তখন তিনি বলেছিলেন যে তার সম্পর্কে যে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযােগ করা হয়েছে তার মধ্যে কেবল একটি অভিযােগই উঠতে পারে আর তা হলাে সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুবের চাকুরির মেয়াদ বৃদ্ধির হুকুম। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইস্কান্দার মির্জা। গােলাম মােহাম্মদ ও ইস্কান্দার মির্জা উভয়ের শাসনকালে অন্যায়ভাবে আইয়ুব খাঁর চাকুরির মেয়াদ দুইদফা বৃদ্ধি করা হয়েছে কেবল শাসকগােষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলের জন্যে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই দুই অশুভ গ্রহের সাথে আইয়ুবের যে ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকে যে তারা কখনােই জনগণের স্বার্থে দেশ পরিচালনা করেনি, কিংবা একটি স্বাধীন দেশের জনগণের প্রতিনিধিও তারা হতে পারেনি। এতে আরাে প্রমাণ মেলে তখন অগণতান্ত্রিকভাবে গায়ের জোরে গােলাম মােহাম্মদ ১৯৫৫ সালে গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে ট্যালেন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এই কথিত মন্ত্রিসভায় তিনি আইয়ুব খানকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পদে বসান। পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে শনির হায়া হয়ে সেই প্রথম একজন সেনাপতি আবির্ভূত হন।
উল্লেখ্য যে গােলাম মােহাম্মদের অসুস্থতা ও দায়িত্ব পালনে তিনি অক্ষম এই অজুহাত দেখিয়ে ট্যালেন্ট মন্ত্রিসভার এক বৈঠক আইয়ুব খাঁ নিজেই গভর্নর জেনারেল পদে ইস্কান্দার মির্জার নাম ঘােষণা করেন। এই সভায় তিনি আরাে বলেন, সেনাবাহিনীর ইচ্ছা যে ইস্কান্দার মির্জা রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হােক। ঐ সভায় সেদিন আইয়ুবের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কেউ টুশব্দ করেনি।
| ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুবের পরামর্শে পাকিস্তানে সামরিক শাসন কায়েম করেন এবং সেইসঙ্গে ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। এই ঘটনার মাত্র কুড়িদিনের মধ্যেই আইয়ুব ইস্কান্দার মির্জাকে লাথি মেরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আবির্ভূত হন। | সেই আইয়ুব খা আজ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে গণতন্ত্রের জন্য আহাজারি করছে। অথচ ‘৫৮-র অক্টোবরে তিনি নিজহাতে যে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছেন তা ভুলে গিয়েছেন। সামরিক আইন জারির মাধ্যমে শাসনকে গলা টিপে হত্যা করেছেন। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছেন। সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ করেছেন। শত শত দেশপ্রেমিক নেতৃবৃন্দকে কারাগারে বিনাবিচারে আটক রেখেছেন।
________________________________________
বেলুচিস্তানের শত শত লােককে স্বায়ত্তশাসন দাবি করার কারণে বন্দী শিবিরে আটক করে মর্মান্তিকভাবে অত্যাচার করে হত্যা করেছেন। বােমা নিক্ষেপ করে হাজার হাজার বাড়িঘর ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়েছে। আইয়ুব খাঁ গণতন্ত্রের জন্য যত কথাই বলুক তাতে সন্তানহারা মায়েদের দুঃখ মুছে যাবে না। মানুষ কখনােই এই একনায়ক স্বৈরাচারের অত্যাচারের কথা ভুলবে না। ভুলবে না তার গণবিরােধী হিংস্র দমননীতি আর বর্বরতার ইতিহাস। হাজী দানেশ বলেন, আইয়ুব খাঁ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের ও পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বলেছেন যে, পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার নেতারা ক্ষমতার কাড়াকাড়ি করে দেশকে অনিশ্চিত এক জাহান্নামে পরিণত করেছিলেন, বরং তিনি তার থেকে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির মাধ্যমে দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু আইয়ুব খান জানেন না যে, প্রকৃতপক্ষে কখনােই এদেশে সঠিক পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়নি। ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে ঐ শাসন ব্যবস্থার সূচনা ঘটেছিল মাত্র, যা বাস্তবায়নের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লগ্নেই ইস্কান্দার মির্জার নেতৃত্বে আইয়ুব খারা সামরিক শাসন কায়েম করে সেই পথ রুদ্ধ করেছেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পৃষ্ঠপােষকতায় ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুবের মত সামরিক নেতারাই পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থাকে গলা টিপে হত্যা করেছেন।
তিনি আরাে বলেন, ১৯৫৩ সালে ওয়াশিংটনের পরামর্শে গােলাম চক্র খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ করে বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে বসান। এই মােহাম্মদ-মির্জা চক্রই ১৯৫৪ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিল ড্রোথের পরামর্শে যুফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ঐ চক্রই আবার মােহম্মদ আলীকে সরিয়ে তার স্থলে চৌধুরী মােহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী করে। এই গণবিরােধী শক্তি আবারাে ষড়যন্ত্র করে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করে চুশ্রীগড় মন্ত্রিসভা গঠন করে। এই চক্র আবারাে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভার পতন ঘটায়। এই দুঃশাসকরা পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় সংগঠিত হানাহানিতে এবং শাহেদ আলী হত্যায় উকানি যােগায় এবং সুযােগের ব্যবহার করে সামরিক শাসন জারি করে। এই ভাঙ্গাগড়ার প্রধান হােত ছিল কায়েমী স্বার্থবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের দোসর গােলাম মােহাম্মদ-ইস্কান্দর মির্জা-আইয়ুব খাঁ।
১৯৫৩ সাল থেকে বারবার পাকিস্তান মন্ত্রিসভার যেসব পরিবর্তন ঘটেছে তার সবগুলােই হয়েছে পর্দার আড়ালে চক্রান্তের ফলে। আইয়ুব খাঁ সামরিক শাসনের থাব মেরে দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে দেন নাই।
গত ছয় বছরে তার শাসনে দেশের কোন পরিবর্তন হয়নি-এই না হওয়াই যদি স্থিতিশীলতা হয় তাহলে বলতে হয় স্পেনের ফ্রাংকো’ এবং পর্তুগালের ‘সালাজার সরকার পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি স্থিতিশীল সরকার। কেননা তারা উভয়ে প্রায় ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছেন। কিন্তু দুনিয়ার সকল মানুষ জানে যে, তাদের মত মানবতা-বিরােধী স্বৈরাচারী একনায়ক পৃথিবীতে আর একটি নেই। আইয়ুব খানের ৬
________________________________________
বছরের স্থিতিশীলতা স্বৈরাচারী একনায়কের শাসন ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ জনগণের ওপর তিনি যে হিস্র দমননীতি চালিয়েছেন, জনগণের অধিকার হরণ করেছেন, শৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছেন তাতে কেবল কবরে বসবাসের মতই স্থিতিশীলতা বজায় ছিল।
পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থায় প্রকৃত গণতন্ত্র চালু হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে জনগণের দুয়ারে ভােটের জন্য যেতে হবে। তাতে করে জনগণ বিচার করতে পারবেন কোন্ দল তাদের কাছে গ্রহণীয় এবং দেশের স্বার্থে নিবেদিত । এই পন্থাই হলাে প্রকৃত গণতান্ত্রিক পন্থা। এতে দেশের অনিষ্ট হবার সুযােগ থাকে না। এই পদ্ধতিতে দেশের সকল স্তরের জনগণের রাজনৈতিক শিক্ষালাভের সুযােগ থাকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও একটা সুস্থ রাজনৈতিক ধারা গড়ে ওঠে। এই পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির মত এক ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটার কোন সুযােগ নেই। পার্লামেন্টারি পদ্ধতিতে জনগণের সমর্থন ছাড়া সরকার গঠনের কোন ব্যবস্থা নেই। আর তাই জনগণই কেবল পারে স্থিতিশীল সরকার গঠন করতে।
আইয়ুবি উন্নয়নের চেহারা আইয়ুব খাঁ তার শাসনামলে দেশের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে বলে দাবি করেন। দেশে যেটুকু অগ্রগতি বা শিল্প বিকাশ সাধিত হয়েছে তা আইয়ুবের কোন কৃতিত্ব নয়। বরং একথা বলা যায় যে সামরিক শাসনামলে সেই অগ্রগতির ধারা ব্যাহত হয়েছে। মানুষ কোন বিনিয়ােগে উৎসাহ হারিয়েছে। ইস্পাত শিল্প কিংবা নির্মাণ শিল্প কোনটিই গড়ে ওঠেনি। উন্নয়নের মধ্যে আইয়ুবের শাসনকালে পূর্ব ও পশ্চিমের পার্থক্যই কেবল বৃদ্ধি পেয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সত্ত্বেও তার সিকি ভাগও এই অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে ব্যয় হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নতিকল্পেই শুধু বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ ব্যয় করা হয় ।
ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও চরম বৈষম্য বিদ্যমান। এক্ষেত্রেও আদমজী, ইস্পাহানী, দাউদ, সায়গল, গান্ধার প্রমুখ শিল্পপতিদের স্বার্থ রক্ষা করাই রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাংক, বীমা ব্যবসা, শিল্প সবকিছুতেই পশ্চিমাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নীতি ও পরিচালনার সকল পরিকল্পনা পরিচালিত হয় রাওয়ালপিন্ডিতে বসে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের ধারা যেমন অবহেলিত হয়েছে তেমনি জনমনে নৈরাশ্য ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।
পশ্চিমা শিল্পপতিদের দ্বারা এদেশে সমুদয় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হওয়ায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, তারা শতকরা প্রায় ৩০০ ভাগ পর্যন্ত মুনাফা অর্জন
________________________________________
করছে কিন্তু যে শ্ৰমিক-শ্রেণী তাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে তারা থাকছে উপবাসে। ক্রয়ক্ষমতা সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় মানুষের অবস্থা চরম পর্যায়ে পৌছেছে।
ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও আইয়ুব খাঁ চরম গণবিরােধী ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা চালু করেছে। এক্ষেত্রে উভয় দেশের বড় বড় জােতদার ও ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে। জমির সিলিং ৩৭৫ থেকে ১৫০০ বিঘায় স্থির করা হয়েছে। অথচ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লােক ভূমিহীন দরিদ্র। জমির খাজনা ও ট্যাক্স বহুগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে যা স্বল্পআয়ের লােকদের জীবন ধারণের জন্য মারাত্মক হুমকি। এসব বিভিন্ন গণবিরােধী সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষ রােগ, শােক, অভাব, উপবাস, অশিক্ষা ও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে।
অন্যদিকে আমেরিকা থেকে পিএল-৪৮০ এর অধীনে আসা গম টাউট বাটপাড়দের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে যার ফলে সমগ্র দেশ বাটপাড়দের আড্ডায় পরিণত হয়েছে। এইসব দুনীতিপরায়ণ লােকেরাই হচ্ছে আইয়ুব খার সমর্থক। সেইসঙ্গে যোগ হয় ছাত্র নামধারী ও ত্রাস সৃষ্টিকারী এন, এস, এফ নামক সন্ত্রাসী বাহিনী।
সারা দুনিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা যেভাবে মার খাচ্ছিল ও তাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠেছিল ঠিক সেই সময়ে আইয়ুব খাঁ তাদের একজন তাঁবেদারে পরিণত হন। নির্লজ্জভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমেরিকানদের সহযােগিতা করেন। তিনি সিয়াটো ও সেন্টোর মত গণবিরােধী চুক্তি ও অন্যান্য অসম চুক্তি বাতিল না করে ধামাচাপা দিয়ে রাখলেন। মার্কিনীদের সঙ্গে যাবতীয় চুক্তি সম্পাদনের প্রকৃত হােত গােলাম মােহাম্মদ, ইস্কান্দার মির্জা ও আইয়ুব খাঁ। পাকিস্তানের পক্ষে যে কজন ১৯৫১থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যে বারবার আমেরিকা গিয়ে চুক্তি সম্পাদনের জন্য দেন-দরবার করেছেন, তাদের মধ্যে এই তিনজন অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেন। কাজেই সেইসব চুক্তি আইয়ুবের পক্ষে বাতিল করার প্রশ্নই আসে না। বরং তার হাতে ক্রমাগতভাবে মার্কিন স্বার্থ সুরক্ষিত হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘদিন থেকে এদেশে যে বৃটিশ পুঁজি ছিল তারও কোন সুরাহা হয়নি। পক্ষান্তরে আরাে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অবাধ প্রবেশ ঘটেছে।
বিরােধী দলকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে আইয়ুব খাঁ এক বিবৃতিতে বলেন, ‘৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট যেমন অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ভেঙ্গে পড়েছিল তেমনি বর্তমান বিরােধী দলের অবস্থাও তাই হবে। এ প্রসঙ্গে হাজী দানেশ বলেন, আইয়ুব খাঁ সত্যের বিকৃত রূপ জনসমক্ষে উপস্থাপন করছেন। প্রকৃত সত্য এই যে, এক পর্যায়ে যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদলগুলাের নেতৃত্বের কোন্দলে কিছুটা বিরােধ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ফ্রন্টের বিজয়ের পর থেকে অর্জিত সাফল্যের কাছে অতি নগন্য একটি বিষয় মাত্র।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পকিস্তান মুসলিম লীগ শােচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। প্রদেশের সাড়ে ৫ কোটি জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট ও তার ২১ দফা কর্মসূচীকে
________________________________________
সমর্থন করেন। মূলত এই ঘটনাই কেন্দ্রীয় শাসকবর্গের রাতের ঘুম হারাম করে দেয়। বিশ্ববাসীর কাছে তখন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে মুসলিম লীগের প্রয়ােজন শেষ হয়ে গেছে।
পূর্ব পাকিস্তানে পরাজয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা হয়েছিল যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে পদত্যাগ করবেন এবং এটাই গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। জনগণের কাছ থেকেও এই দাবি উঠেছিল কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কেউই বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা আঁকড়ে রইল। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারা সুরে সুর মিলিয়ে বলে যে তাদের সেই নির্লজ্জ অভিলাষ যুক্তিসঙ্গত । মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সমর্থনে এগিয়ে এলো । সকল কুটনৈতিক নীতি ও শালীনতা বিসর্জন দিয়ে খােদ রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে ঘােষণা দিলেন যে “পকিস্তানের নির্বাচনের ফলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের কোন প্রয়ােজন নেই।
এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট বােঝা যায় যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের সহযােগী এদেশের ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে গণরায়কে উপেক্ষা করে মুসলিম লীগ সরকার ক্ষমতায় রয়ে গেল । তথাপি পূর্ব পাকিস্তানে যুক্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হলাে। এই মন্ত্রিসভা তাদের ২১ দফা পূরণে ওয়াদাবদ্ধ ছিল। তারা পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধেও প্রকাশ্যে ঘােষণা দিল। কাজেই যুক্রন্ট মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করা কায়েমী স্বার্থবাদীদের জন্য জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। | শুরু হয় ষড়যন্ত্র। মার্কিনীদের প্রধান মুখপত্র “নিউয়র্ক টাইমস’-এর করাচি সংবাদদাতা কালাহান এক আজগুবি সংবাদ পরিবেশন করে তাতে লেখেন যে, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক বলেছেন যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বঙ্গের একত্রীকরণ কামনা করেন। পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাম্রাজ্যবাদের ভাড়াটিয়া-কালাহান পরিবেশিত ঐ মিথ্যা সংবাদকে পুঁজি করে কেন্দ্রীয় সরকার যুক্রন্ট মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে নামে। আদমজীতে শুরু হয় বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী দাঙ্গা। পরে আদালতে প্রমাণ হয় যে রক্তক্ষয়ী ঐ দাঙ্গা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ।
ঐ দাঙ্গায় আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে এই অজুহাতে নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করা হয়। ৯২(ক) ধারা জারির মাধ্যমে পূর্ব পকিস্তানের সকল শাসনক্ষমতা তুলে দেয়া হয় কুখ্যাত ইস্কান্দার মির্জার হাতে। বগুড়ার মােহাম্মদ আলী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আর গোলাম মােহাম্মদ গভর্নর জেনারেল। আইয়ুব খাঁ। সেনাবাহিনীর প্রধান ও ঘটনার নেপথ্যের খল নায়ক। যুজফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করার কয়েকদিনের মধ্যেই প্রথম পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, হাজী দানেশ পরবর্তীতে দেশের ক্ষমতা দখলকারী একজন সেনাশাসকের সৃষ্ট দলের সদস্য হিসেবে নির্বাচন করে মানুষের ধিক্কার কুড়িয়েছিলেন।
________________________________________
বিভেদ ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার অপসারণ সত্ত্বেও শাসকবর্গের সমস্যার কোন সমাধান হলাে না। কেননা যুফ্রন্ট ক্ষমতা থেকে পদচ্যুত হওয়া সত্ত্বেও জনতার সমর্থন তাদের পেছনেই রইলাে। এই সমস্যা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাকে চরম বিপাকে ফেললাে। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শুরু করলাে ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাতে। এই ভাঙ্গন প্রক্রিয়া সফল করতে কেন্দ্রীয় শাসকেরা পূর্ব থেকেই দেশব্যাপী সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এক অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করে। এই অজুহাতে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। দেশে বিরাজমান শ্বাসরুদ্ধকর সেই পরিস্থিতিতে গােলাম মােহাম্মদ ও ইস্কান্দার মির্জার প্রতিনিধিরা গােপনে ফ্রন্ট নেতাদের দুয়ারে ধর্না দিয়ে বিভিন্ন প্রলােভনের মাধ্যমে মন্ত্রিত্ব গ্রহণের জন্য প্রলুব্ধ করে। এক পর্যায়ে কেউ কেউ চক্রান্তের ফঁদে পা দিয়েছিল। এই আপােস এদেশের মানুষকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত দিক দেয়ে হাজার বছর পিছিয়ে দিয়েছিল। আইয়ুব খাঁ এই চক্রান্তের মধ্যমণি। হিসেবে কাজ করেছিলেন। যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গনের ক্ষেত্রে তিনি বিদেশী প্রভুদের পরামর্শে পাকিস্তানের রাজনীতিকে কলংকিত করেছিলেন। আইয়ুব খাঁ বিরােধী নেতাদের বামনের সাথে তুলনা করেন। এ প্রসঙ্গে হাজী দানেশ বলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই আজ সম্মিলিত বিরােধী নেতৃত্ব একযােগে একনায়কত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। এখানে প্রশ্ন ব্যক্তির নয়, প্রশ্ন আদর্শের। এদেশের জনগণ ফজলুল হক ও সােহরাওয়ার্দীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, আজও তেমনি সম্মিলিত বিরােধী দলের পক্ষে সাড়া দিয়েছে। কাজেই জনতার কঠোর ত্যাগ ও সংগ্রামের জয় নিশ্চিত। সেদিন সম্মিলিত বিরােধী দলের মূল কথাই ছিল প্রগতির স্বার্থে একনায়কত্বের অবসান ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এজন্য তারা একটি দাবিনামাও পেশ করেন-(১) জনগণের ভােটধিকারের ভিত্তিতে পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা প্রচলন; (২) জনগণের ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি; (৩) সকল রাজবন্দীর মুক্তি; (৪) সকল দমনমূলক আইন বাতিল;-৫) খাজনা, ট্যাক্স কমান; (৬) দুর্নীতি উচ্ছেদ প্রভৃতি।
অপপ্রচারের বিরুদ্ধে শেখ মুজিব দেশব্যাপী সরকারের অপপ্রচারের জবাবে শেখ মুজিবুর রহমান নভেম্বর ১৯৬৪-তে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে বলেন, সরকার ও তার সহযােগীরা নির্বাচকমন্ডলীর সদস্যদের বিভ্রান্ত করার জন্য বিরােঞ্চ দলের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। জাতীয় পরিষদে মনােনয়ন প্রথা বিলােপ হওয়া সত্ত্বেও খান এ সবুররা ইউনিয়ন কাউন্সিলে মনােনয়নের লােভ দেখাচ্ছেন। নির্বাচকমন্ডলীর সদস্যদের নিরুৎসাহিত করার জন্য আইয়ুব খাঁ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা অপপ্রচারের সাহায্যে বলছেন যে বিরােধীদল জয়লাভ করলে মৌলিক গণতন্ত্র প্ৰথ্য ও ওয়ার্কস্ কর্মসূচী বাতিল করবে। নবনির্বাচিত সদস্যদের সদস্যপদ বাতিল করে তিনমাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেবে। সরকার পক্ষের এ জাতীয় গােয়েবলসীয় মিথ্যা
________________________________________
প্রচারণা অব্যাহত থাকায় বিরােধী দল বলতে চায় যে, (১) বর্তমান আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন কাউন্সিল বা কমিটিতে কোন প্রকার মনােনয়ন চলতে পারে না; (২) বিরােধী দল গণতন্ত্র প্রথা বাতিল করবে না; (৩) নবনির্বাচিত সদস্যরা পূর্ণ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকবে; (৪) নির্বাচকমন্ডলীর সদস্যদেরই মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্য করা হবে; (৫) ওয়ার্কস কর্মসূচী বহাল রেখে ইউনিয়ন কাউন্সিলের ওপর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেবে। এছাড়া সদস্যদের ওপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করে তা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে।
ভাসানীর আবেদন কৃষক সমিতির প্রচার দপ্তর থেকে নভেম্বর ১৯৬৪ তে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে কৃষক-জনতার প্রতি মওলানা ভাসানী এক আবেদনে বলেন, ২ জানুয়াররি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তারিখ ধার্য হয়েছে।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। এই প্রেসিডেন্ট হবেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। জনগণের ভাগ্য নির্ধারিত হবে তার হাতে। এই পদে প্রার্থী মিস ফাতেমা জিন্নাহ ও আইয়ুব খাঁ । মিস জিন্নাহ গণতন্ত্র ও পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী আর আইয়ুব খাঁ একনায়কত্ব, উৎপীড়ন ও অগণতান্ত্রিক সরকারে বিশ্বাসী। কুমিল্লার বাতাকান্দিতে পুলিশের গুলিবর্ষণে অসংখ্য নিরীহ মানুষের মৃত্যু তার বড় প্রমাণ। আপনারা ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলুন
(১) পূর্ণ গণতন্ত্র ও প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভােট ও মৌলিক অধিকার কায়েম কর। (২) সকল নির্যাতনমূলক আইন বাতিল, রাজবন্দীদের মুক্তি, গ্রেফতারী পরােয়ানা বাতিল ও বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি প্রত্যার্পণ কর। (৩) সার্টিফিকেট প্রথা ও নতুন রাজস্ব আদায় বিল বাতিল কর। (৪) ৯৩ কোটি টাকার ঋণ থেকে কৃষকদের রেহাই দিতে হবে। (৫) ভুল রেন্টরুল সংশােধন ও এজমালী খতিয়ান বাটা খতিয়ানে পরিণত করতে হবে। (৬) খাজনা-ট্যাক্স কমাতে হবে; নগর শুল্ক বাতিল করতে হবে; খাজনার সুদ নেয়া চলবে না। (৭) উৎপাদিত ফসলের ওপর হারাহারি বা কর প্রথা চালু করতে হবে। ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা নেয়া চলবে না। ১০০ বিঘার ওপর কাউকে জমি রাখতে দেয়া চলবে না। (৮) ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে সরকারি খাস জমি বিতরণ করতে হবে । (৯) মােহাজেরদের নামে আদায়কৃত ট্যাক্সে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। (১০) হাট-বাজার ও জলার ইজারা প্রথা বাতিল করে সরাসরি খাজনা আদায় প্রথা চালু করতে হবে । (১১) পাট ৪০ টাকা ওআখ ৪ টাকা প্রতিমন নির্ধরণ করতে হবে। (১২) শিক্ষার ব্যয়ভার কমাতে হবে ও শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন প্রদান করতে হবে। (১৩) জুগ মিশন সুপারিশ মােতাবেক বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। (১৪) বেকার সমস্যার সমাধানকয়ে শিক্ষা বিস্তার সহ পল্লী উন্নয়নে মনােনিবেশ করতে হবে। দিনমজুরদের প্রতিদিনের শ্রমমূল্য ৩
________________________________________
টাকায় বেঁয়ে দিতে হবে। (১৫) নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য কমাতে হবে। (১৬) সংখ্যালঘুদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের অধিকার দিতে হবে। (১৭) পুলিশী জুলুম বন্ধ করতে হবে। (১৮) পল্লী উন্নয়নের নামে জমিকাটা বন্ধ করতে হবে; বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্মানজনক শর্তে ব্যবসা করতে হবে। (১১) কুটির শিল্পকে রক্ষার স্বার্থে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। (২০) সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন করতে হবে।
| ফাতেমা জিন্নাহকে নির্বাচনের আহবান আইয়ুব খাকে পরাজিত করে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে জয়যুক্ত করার আহবান জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তান সগ্রামী ছাত্র সমাজের এক প্রচারচত্র প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ‘৬৪ সালে। প্রচারপত্রে বলা হয়, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতার রক্তে আইয়ুবশাহীর হাত রঞ্জিত, কাজেই সুযােগ এসেছে তার বিগত ছয় বছরের নির্যাতন আর অত্যাচারের প্রতিশােধ নেবার । গােলামির শৃংখল থেকে, একনায়ক ডিক্টেটরের জুলুম থেকে মুক্তির এখন সময়। শােষিত নির্যাতিত মানুষ আজ জেগে উঠেছে। স্বৈরতন্ত্রের পরাজয় আর গণতন্ত্রের বিজয়ের দিন এসেছে।
আগামী ২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রের। এই নির্বাচন মুক্তিকামী মানুষ আর জুলুমশাহীর মধ্যে । কাজেই সতর্কতার সাথে এই বিজয়কে অর্জন করতে হবে।
ফাতেমা জিন্নাহকে জয়যুক্ত করাই হবে আজ আপনাদের প্রধান কর্তব্য। জাতীয় এই চরম মুহুর্তে ক্ষমতাসীন চক্রের মিথ্যা প্রচারে কান দেবেন না। কোন প্রকার প্রলােভনে ভুলবেন না। ক্ষমতাসীন চক্র আজ নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা পবিত্র ধর্মের নামে মিথ্যাচার চালাচ্ছে। কেউ জনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। আপনাদের কাছে আবেদন এই মহান দায়িত্ব পালনে আপনারা এগিয়ে আসুন।
কৃষক সমাজের প্রতি ছাত্র সমাজ বলে, আজ শােষকের উচ্ছেদ হবার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে আপনাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করুন। গত ছয় বছরে আইয়ুব সরকার কৃষকদের চরম সর্বনাশ করেছে। কৃষিপণ্যের মূল্য কমেছে, অন্যদিকে খাজনা-ট্যাক্স বেড়েছে বহুগুণ। কৃষক নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়েছে। তাই আজ একতাবদ্ধ হয়ে আপনাদের নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইয়ুবের সকল ষড়যন্ত্রে মিথ্যা প্রমাণিত করে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করুন।
প্রচারপত্রে ছাত্র সমাজ কতিপয় কর্মসূচী ঘােষণা করে(১) সকল ইউনিয়নে ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচনী কমিটি গঠন । (২) সকল ইউনিটে জনসভা করে ফাতেমা জিন্নাহকে ভােট প্রদানের জন্য শপথ গ্রহণ । (৩) গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র
পথসভা ও মিছিল কর। (৪) ভােটের দিন ক্ষমতাসীনদের কব্জা থেকে ভােটারদের রক্ষা করা। (৫) মিস জিন্নাহর নির্বাচনী তহবিলে অর্থ সগ্রহ প্রভৃতি।
রাষ্ট্র প্রধান পদে মহিলা জায়েজ রাষ্ট্রপ্রধানের পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ কিনা এ প্রসঙ্গে দেশের দশজন আলেম এক বিবৃতি দেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ঐ বিবৃতিতে তারা বলেন, রাষ্ট্রপ্রধানের পদে মহিলা নির্বাচনে কোন ধর্মীয় বাধা নেই। অর্থাৎ, প্রেসিডেন্ট পদে মহিলা নির্বাচন জায়েজ। বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতারা হলেন, (১) মওলানা আশরাফ থানভী, (২) মওলানা সৈয়দ সােলেমান নদভী, (৩) মওলানা মুহম্মদ শফী, (৪) মওলানা আবুল আলা মওদুদী, (৫) মওলানা আতাহার আলী, (৬) মওলানা শামসুল হক, (৭) মওলানা মুহম্মদ আযমী (৮) মওলানা তাজুল ইসলাম, (৯) মওলানা আব্দুর রহিম, (১০) মওলানা মােহাম্মদ সিদ্দিক। বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্র ব্যবস্থা তিন প্রকার-গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রকৃত শাসক। রাষ্ট্রপ্রধান একজন পরামর্শক মাত্র। পরিষদের ইচ্ছার বাইরে তার কোন কৃতিত্ব নেই। পবিত্র কোরআনে পবিত্র হযরত বিলকিসের রাজত্ব কাহিনীর বর্ণনা করে বলা হয়, মুসলমান হওয়া তার রাষ্ট্রাধিকার কেড়ে নেয়ার বা বিরুদ্ধাচরণের কোন প্রমাণ ইতিহাসে নেই। বিলকিসের রাজত্ব পদ্ধতির প্রতি কোরানে কোনরূপ অবজ্ঞা বা অসমর্থন প্রকাশ না করে বর্ণনা করা হয় তাহলে তা শরীয়তে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হতে পারে। সুতরাং কোরানের বর্ণনা হতে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হচ্ছে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মহিলার নেত্রীত্ব চলতে পারে এবং ধর্মীয় বিধি মােতাবেক তা জায়েজ। | ঐ বিবৃতিতে আরাে বলা হয়, যখন কোন জাতি ফেনা-ফ্যাসাদের সম্মুখীন হয় এবং তা থেকে রক্ষার জন্য যদি এমন কোন ব্যক্তি জনগণের দৃষ্টিতে মহিলাও হয়, তবে সে জাতির নেতৃত্বে প্রদান করতে পারবে। তাছাড়া ধর্মমতে একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানােতে যদি এক আনা দোষের কাজ হয় তাহলে একজন জালেমের শাসনকে টিকিয়ে রাখলে তা দশগুণ বেশি গুনাহের কাজ। এ প্রসঙ্গে তারা বলেন, ফাতিমা জিন্নার পরিবর্তে আইয়ুব খাকে নির্বাচিত করা মুসলমানের পক্ষে সম্পূর্ণ হারাম। আইযুব খা মুসলিম পারিবারিক আইন জারি করে শরীয়তকে বিকৃত করেছেন। ইদ্দত, তালাক ইত্যাদি ব্যাপারে কোরানের নির্দেশিত আইন লংঘন করেছেন, সুতরাং প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাকে সমর্থনকারীও সমান গুনাহের ভাগীদের হবেন। অর্থাৎ, কোরআন-হাদিস ও ইসলামী বিধান অনুযায়ী শরীয়ত মােতাবেক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নারীকে নির্বাচন করা সম্পূর্ণ জায়েজ বা ধর্মসম্মত।
________________________________________
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সেনাশাসক জেনারেল আইয়ুব খাঁ সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন তার সরকারি ফলাফল প্রকাশিত হয় ৮ জানুয়ারি রাওয়ালপিন্ডি থেকে এবং তাতে আইয়ুব খাকে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করা হয়। নির্বাচনে মােট চারজন প্রার্থীর মধ্যে মিস ফাতেমা জিন্নাহ ও আইয়ুব খাঁ ছাড়া অন্য দুজন প্রার্থী ছিলেন কে এম কামাল ও মিয়া রশীদ আহমেদ।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ১৪ দফা ১৯৬৫ সালের ৪-৭ জুন ঢাকায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দলের ১৪ দফা কর্মসূচী গৃহীত হয়, যাকে ন্যাপের পক্ষ থেকে জাতীয় মুক্তির সনদ” হিসেবে বলা হয়। সভায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলােচনা করে বলা হয়, বর্তমান পদ্ধতির সরকার পাকিস্তানের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযােগী এবং মারাত্মক ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। যে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু রয়েছে তা এদেশের জন্য অনুপযুক্ত। হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত দুটি অংশের একটি রাষ্ট্রে কখনাে এই পদ্ধতি চলতে পারে না।
পাক-ভারত যুদ্ধের পর দেশে মারাত্মক খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ৪০ টাকা চালের মন, যা ৯৫ ভাগ মানুষের ক্ষয়ক্ষমতার বাইরে। তার মধ্যে লেডি ব্যবস্থা একটা জুলুমে পরিণত হয়েছে। এছাড়া সার্টিফিকেট প্রথা সেই দুর্দশাকে আরাে অসহনীয় করে তুলেছে। ১৩ টাকা মন পাট বিক্রি হচ্ছে যা উৎপাদন অপেক্ষা অনেক কম। মানুষের প্রতি সেই পূর্বের শােষণ অব্যাহত আছে। তারপর রয়েছে আমলাদের অদৃশ্য নির্যাতন, যার ফলে এদেশের মানুষ ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নেই।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও তার দলের কোন রাজনৈতিক চরিত্র নেই । ৮ বছর যাবৎ মানুষ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে নিস্পেষিত হচ্ছে। দেশের সর্বত্র যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে ছাড়া সমাধান সম্ভব নয় । মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে আজ সবকিছু বন্দী। এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গড়ে তােলা উচিত, যা নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে গঠিত হবে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করতে হবে এবং মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। পুঁজিপতিদের শােষণ খর্ব করতে হবে। | চাকরি ক্ষেত্রে উভয় প্রদেশের সমান সুযোেগ থাকবে এবং সেনাবাহিনী জনসংখ্যার ভিত্তিতে গঠিত হবে। পুঁজিপতিদের শােষণ খর্ব করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলাের সহযােগিতায় একটি নতুন অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে, যা মানুষের ওপর বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যুদ্ধ সম্প্রসারণ করে চীনের বিরুদ্ধে নয় মােকাবেলা, ভারতকে অস্ত্র প্রদান, সেন্টো-সিয়াটো চুক্তি তারই
________________________________________
প্রমাণ। এক্ষেত্রে আমাদের আগামী নীতি ও কর্মপন্থা হলাে, অবশ্যই শক্রদের অবস্থান, রাজনীতি ও কৌশল সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। স্বাধীনতার পর সােভিয়েত ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন দেশ নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। অথচ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আজও আমাদের সগ্রাম করতে হচ্ছে। শক্রর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য এখন আমাদের শক্তি সঞ্চয় করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে ন্যাপ তাদের ১৪ দফা দাবি ঘােষণা করে
(১) আইন পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে সার্বজনীন ভােটের মাধ্যমে নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা শাসনতন্ত্র সংশােধন।
(২) ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রদান; জরুরী অবস্থা ও দমনমূলক আইন প্রত্যাহার ।
(৩) সাজাপ্রাপ্ত ও বিনা বিচারে আটক ব্যক্তিদের মুক্তিদান, গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে।
(৪) সিয়াটো, সেন্টো থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার ও মার্কিন ঘাটির বিলােপ করতে হবে, নতুন কোন সাম্রাজ্যবাদী চুক্তি করা চলবে না ।
(৫) প্রতিরক্ষা কাঠামাে পুনর্গঠন করতে হবে এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর ঢাকায় স্থাপন করতে হবে।
(৬) দেশের মূল অর্থনৈতিক নীতি হবে জনগণের কল্যাণ করা; সরকারি খাতে শিল্প স্থাপন করতে হবে।
(৭) দেশরক্ষা শিল্প সরকারি খাতে রেখে তা দুই প্রদেশে স্থাপন করতে হবে। (৮) ব্যাংক, বীমা, পাট ব্যবসা ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি জাতীয়করণ করতে হবে। (৯) ব্যক্তিগত জমির মালিকানা ৩০-১০০ একরে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে এবং ৫-১২ একর জমির খাজনা মওকুফ করতে হবে।
(১০) শ্রমিক সংগঠন থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে ন্যনতম মজুরির ব্যবস্থা করতে হবে।
(১১) মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ও হামুদুর রহমান শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে।
(১২) বেলুচিস্তানে নির্যাতন ও সরদারি প্রথা বাতিল করতে হবে। (১৩) পূর্ব পাকিস্তানের বন্য প্রতিরােধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (১৪) খাজনা-ট্যাক্স কমাতে হবে।
ঐতিহাসিক ৬ দফা। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালী জাতির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ৬-দফা সম্পর্কিত এক প্রচারপত্রে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের বাঁচার
________________________________________
পাবি ৬-দফা। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, জনগণের মুক্তিসনদ ২১ দফা দাবি, যুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবি, স্বল্পব্যয়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভের সুযােগ সহ সকল প্রকার দাবির মধ্যেই শাসক শ্রেণী এবং তার দালালেরা ইসলাম ও দেশকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করছেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা দাবির মধ্যেও তারা বিভিন্ন প্রকার দুরভিসন্ধি আবিষ্কার করবেন। কিন্তু ৬-দফায় পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শােষিত বঞ্চিত মানুষের অন্তরের কথাই প্রতিফলিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদের অনুমােদনের মাধ্যমে তা জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে কায়েমী স্বার্থবাদীদের অপপ্রচার জনগণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে কায়েমী স্বার্থবাদীদের অপপ্রচারে জনগণ আর বিভ্রান্ত হবে না।
কিন্তু জনগণের দুশমনরা ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে সরকারি দলে একত্র হয়েছে। ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তারা জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বার্থে একজোট। নানা ছলাকলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে তারা লিও। শেখ মুজিবুর রহমান ৬-দফার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে।
(১) এক নম্বর দফায় বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেশনরূপে গড়ে তুলতে হবে। পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং সকল নির্বাচন প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটে অনুষ্ঠিত হবে। আইন সভার সার্বভৌমত্ব থাকবে।
লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন পাকিস্তানের জনগণের নিকট সকল রাজনৈতিক নেতার নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচন সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। জনগণ ভােটও দিয়েছিল ঐ প্রস্তাবের দরুন । ‘৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসনের শতকরা সাড়ে ৯৭টি একুশ দফার পক্ষে এসেছিল। কারণ লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল নির্বাচনের প্রধান দাবি। মুসলিম লীগ তখন প্রদেশ ও কেন্দ্র দু জায়গাতেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তারা তখন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছিল। এই প্রস্তাবের পক্ষে ভােট দিলে ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হবে এসব যুক্তিও তারা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলার মানুষ একুশ দফার পক্ষে ভােট দিয়েছিল। তখনই এই প্রস্তাব জনগণের পক্ষ থেকে চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়েছে। কাজেই লাহাের প্রস্তাবভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ন্যায়সঙ্গত। এই প্রস্তাবের বিরােধিতাকারীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেননি, এরা সবসময় কায়েমী স্বার্থবাদীদের পক্ষে কাজ করেন কেবল নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এবং মূলত এরাই দেশের শক্র। শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাবের বিরােধিতাকারীদের পুনরায় গণভােটে অংশ নেবার আহবান জানান।
(২) দুই নম্বর দফায় বলা হয়েছে যে ফেডারেল সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যাপার দুটি থাকবে। অবশিষ্ট ক্ষমতা প্রদেশসমূহের হাতে থাকবে।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এই প্রস্তাবের বিরােধিরা সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষেপেছে।
________________________________________
এতে নাকি ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংস হবে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে যে বৃটিশ সরকারের কেবিনেট মিশন ১৯৬৬ সালে যে প্লান দিয়েছিলেন এবং যা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ে গ্রহণ করেছিল তাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল, বাকী বিষয়গুলাে প্রদেশের হাতে দেয়া হয়েছিল। এতে প্রমাণ হয়েছে বৃটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মতে এই তিনটি বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকলে দেশ চলতে পারে। তবে এক্ষেত্রে যােগাযােগ ব্যবস্থা পৃথক করার কারণ এই যে অখন্ড ভারতের বেলায় যা প্রযােজ্য তা দীর্ঘ ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের বেলায় প্রযােজ্য নয়।’
(৩) তিন নম্বর দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রথম প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজ বিনিময়-যােগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। এই ব্যবস্থায় কারেন্সি আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। দুই প্রদেশে দুটি স্বতন্ত্র ষ্টেট ব্যাংক থাকবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়, দুই প্রদেশের জন্য একই কারেন্সি থাকবে, কিন্তু সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্র সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হতে পারে। এই ব্যবস্থায় একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুই অঞ্চলে দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। | তিনি বলেন, এই দুই ব্যবস্থার যেকোন একটিকে গ্রহণ করা ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। দুই পাকিস্তানে একই মুদ্রা হওয়ায় আঞ্চলিক কারেন্সি সাকুলেশনে কোন নির্ভুল হিসেব নেই। মুদ্রা ও অর্থনীতি কেন্দ্রের হাতে থাকায় অতি সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায় । সকল সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক-বীমা বাণিজ্যের ও বৈদেশিক অফিসসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় এই পাচারের কাজ অবিরাম গতিতে চলছে। এই ফ্লাইট অব ক্যাপিটাল’ বন্ধ করতে না পারলে পূর্ব পাকিস্তানীরা শিল্প-বাণিজ্য কোন ক্ষেত্রেই অগ্রসর হতে পারবে না। কেননা এই অবস্থায় কোন মূলধন গড়ে উঠতে পারে না।
(৪) চার নম্বর দফায় বলা হয়েছে যে, সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোন কর্তৃত্ব। সেখানে থাকবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত অর্থের নির্ধারিত অংশ সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল সরকারের খাতে জমা হয়ে যাবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের ওপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকবে। এইভাবে জমাকৃত অর্থ ফেডারেল সরকারের তহবিল হবে।
| এই দফা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্লান বৃটিশ, সরকার রচনা করেছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ে গ্রহণ করেছিল তাতে ট্যাজ ধার্যের সব ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রের কোন ক্ষমতা সেক্ষেত্রে ছিল না। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ফেডারেশন সােভিয়েট ইউনিয়নের কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী বা অর্থ দফতর বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই।
________________________________________
(৫) পাঁচ দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের বিষয়ে শাসনতান্ত্রিক সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন,
প্রথমত, দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসেব রাখতে হবে।
দ্বিতীয়ত, পর্ব পাকিস্তানের অর্জিত আয় পূর্ব পাকিস্তানের অধীনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে থাকবে।
তৃতীয়ত, ফেডারেশনের প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা দু অঞ্চল থেকে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্র নির্ধারিত হারে আদায় হবে। চতুর্থত, দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুতে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি চলবে।
পঞ্চমত, ব্যবসা-বানিজ্য বিষয়ে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং বিদেশে আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত রেখে শাসনতান্ত্রিক বিধান করতে হবে।
এই দফার সমর্থনে তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ৩ নং দফার মতই আবশ্যক। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত অর্থ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের নেই। এদেশের অর্জিত সমুদয়, আয় পশ্চিম পাকিস্তানে জমা হচ্ছে। যে কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন সহজতর হচ্ছে, অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে। | পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত আয়ই যে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানে জমা হচ্ছে এবং তা ব্যয় হচ্ছে শুধু তাই নয়, যে সকল বিদেশী ঋণ ও এইড আসছে তাও পশ্চিম পাকিস্তান সম্পূর্ণভাবে ব্যয় করছে। কাজেই স্ব-উপার্জিত অর্থে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বনির্ভর করতে হলে প্রস্তাবিত ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ খােলা নেই।
(৬) ছয় নম্বর দফায় পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিটারি বা রক্ষী বাহিনী গঠনের সুপারিশ করা হয়। এই দফা প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন, ২১-দফার দাবি অনুসারে দেশের আনসার বাহিনীকে নিয়মিত সশন্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরের দাবি করা হয়েছিল কিন্তু তা না করে বরং পূর্ব পকিস্তান সরকারের অধীনস্থ ইপিআর বাহিনীকে কেন্দ্রের হাতে নেয়া হয়েছে। নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপনের যে দাবি ২১ দফায় করা হয়েছিল তাও কেন্দ্র বাস্তবায়ন করেনি। এ ধরনের দাবির উত্তরে কেন্দ্র বারবার বলে যে, পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষার ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানে রয়েছে। একথা শাসনকর্তাদের মুখে শােভা পায় না। বিপদের সময় আমরা কতবড় অসহায় থাকি পাক-ভারত যুকে সময় তাকে প্রমাণিত হয়নি। নিজেদের দুঃসময়ে পূর্ব পাকিস্তান আর অন্যের দয়ার ওপর নির্ভর করতে পারে না। যেমন করেই হােক তারা আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করবে।
এ প্রসঙ্গে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানী জনগণের উদ্দেশে বলেন, ৬-দফা কর্মসূচীতে পশ্চিম পাকিস্তানের দাবিও সমান ভাবে রয়েছে। এই দাবি স্বীকৃত হলে তা উভয় প্রদেশের জন্য সমানভাবে কার্যকরী হবে। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না হবে
________________________________________
ততদিন অসাম্য দূর হবে না। আমাদের আঞ্চলিক শােষণের জন্য দায়ী ভৌগলিক অবস্থান এবং তাকে অগ্রাহ্য করে চালিত শাসন ব্যবস্থা। পাকিস্তানের মােট রাজস্বের ৬২ ভাগ খরচ হয় দেশরক্ষা খাতে।
শেখ মুজিব পশ্চিম পকিস্তানীদের উদ্দেশ্য করে বলেন, এইসব দাবি আপনারা করলে আমরা তা মেনে নিতাম । আপনাদের প্রাদেশিকতাবাদী বলে গালি দিতাম না, কারণ নিজের পাওনা দাবি করা অন্যায় নয় বরং কর্তব্য। তিনি আরাে বলেন, প্রথম গণপরিষদে আমাদের সদস্যসংখ্যা ছিল ৪৪ জন, আপনাদের ২৮ জন। তখন আমরা রাজধানী ও দেশরক্ষার সদর দফতর ঢাকায় স্থানান্তরিত এবং বাংলাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে পারতাম । আপনাদের মন থেকে মেজরিটি স্ব দূর করার জন্য আমরা সংখ্যাসাম্য গ্রহণ করেছিলাম। যারা জেনেশুনে পাকিস্তানের এক অংশকে দুর্বল করতে চায় তারা পাকিস্তানের শত্রু রাষ্ট্রনায়ক হতে গেলে নায়কের অন্তর হতে হয় বিশাল ও অসাধারণ। এই ৬ দফা কেবল পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি নয়, বরং তা উভয় অংশের অস্তিত্বের দাবি। এই দাবির মধ্যে অন্যায়, অসঙ্গত, পশ্চিম পাকিস্তান বিরােধী কোন প্রস্তাব নেই। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর ভালবাসাকে সম্বল করে ৬-দফা আদায়ে যেকোন ত্যাগে আমি প্রস্তুত। একজন প্রকৃত নেতার কাছে দেশবাসীর জন্য সংগ্রাম করার মত মহৎ কাজ আর কিছুই নেই।
পুলিশ কর্তৃক গণহত্যা ও আওয়ামী লীগের হরতাল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৭ জুন পুলিশের গুলিতে যে ১০ জন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হয়, এর পক্ষ সমর্থন করে মুসলিম লীগ সরকার বলে যে, আওয়ামী লীগ কর্তৃক আহুত হরতাল পথচারী ও যানবাহনে বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়। সরকারি বাসগুলির ক্ষতিসাধন করা হয়। পুলিশ এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে বাহাদুর শাহ পার্ক কাওরান বাজার সহ বিভিন্ন স্থানে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এক পর্যায়ে বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী গুডারা তেজগায় চট্টগ্রাম মেলকে লাইনচ্যুত করে। বাধাদানের জন্য একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালালে ঘটনাস্থলে ৪ জনের মৃত্যু হয়। নারায়ণগঞ্জে একদল বিশৃখলা সৃষ্টিকারী মানুষ ঢাকাগামী ট্রেন আটক এবং ৩৬ ডাউন ট্রেনের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। যাত্রীদের উদ্ধারের জন্য পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালালে ঘটনাস্থলে ৬ ব্যাক্তি মারা যায় । আদমজী, ডেমরা, সিদ্ধিরগঞ্জ প্রভৃতি শিল্প এলাকা থেকে শ্রমিকরা ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে বেরিয়ে আসে এবং ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। নগরীর দুই মাইল দূরে ইপিআর বাহিনী তাদের গতিরােধ করে। সন্ধ্যায় গেন্ডারিয়া, তেজগা প্রভৃতি স্থানে জনগণ ট্রেন আটকে দেয় এবং কালেক্টরেট ভবনে হামলা চালালে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
পুলিশের গুলিতে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৭ জুন যে হত্যাকান্ড সংগঠিত হয় তার
________________________________________
প্রতিবাদ এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরিত একটি প্রচারপত্র ৮ জুন ১৯৬৬ সালে প্রদেশব্যাপী বিলি করা হয়। প্রচারপত্রে নেতৃবৃন্দ বলেন, জালিমশাহী আবারাে গুলি করে ১১ জনকে হত্যা করেছে। দেড় হাজার নিরপরাধ লােককে গ্রেফতার করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করে সামরিক ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে। | রাজবন্দীদের মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের আহবানে সারাদেশে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালিত হয়। হরতালের এই সাফল্য শাসকগােষ্ঠীকে হতচকিত করে তােলে এবং তাকে বানচাল করার জন্য সরকার নির জনতার ওপর গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে। রুটি-রুজির দাবিতে ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ এটাই প্রথম নয়। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে কৃষকদের ওপর ‘৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ও ‘৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্রদের ওপর; টঙ্গী, খুলনা, কালুরঘাটে শ্রমিকদের ওপর; সুসং, মানেশ্বর, নাচোল, মাগুড়া ও বালিকারায় কৃষকদের ওপর এবং ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলে দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। বেলুচিস্তানে ন্যাপনেতাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ৭ জুনের হত্যাকান্ড তারই ধারাবাহিকতার বীভৎস নজীর।
শাসক গােষ্ঠীর নৃশংস বর্বরতা সকল পূর্বসূরীকে হার মানিয়েছে। গত ঈদের জামাতেও এই সরকার কেবল তার গদি রক্ষার স্বার্থে পাশবিক হত্যালীলা চালাতে দ্বিধা করেনি। পুঁজিবাদ ও সামন্ত স্বার্থের রক্ষক এবং সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী আমলাতান্ত্রিক স্বৈরশাসনে দেশ আজ এ অবস্থায় পৌঁছেছে। জনতার মনে পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ শান্তিপূর্ণ। হরতালের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। | সাম্রাজ্যবাদী শাসকগােষ্ঠী ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন কায়েমের মধ্য দিয়ে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কজা করেছে। মানুষের সকল মৌলিক অধিকার তারা ছিনিয়ে নিয়েছে। শাসকগােষ্ঠী একচেটিয়া মুনাফা লাভের স্বার্থে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। দেশী-বিদেশী। স্বার্থবাদীরা দেশকে ধ্বংস করতে চায়। তাদের বাধার কারণে স্বাধীনতার এতদিন পরে এদেশে কোন ইস্পাত বা ভারী শিল্প গড়ে ওঠেনি। সােভিয়েত ইউনিয়নের একটি সহযােগিতাকেও ক্ষমতাসীন মহল বাস্তবায়ন করেনি। কেননা পূর্ব পাকিস্তানে ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠলে পাকিস্তানী স্বার্থবাদী শ্রেণী ও তাদের দোসর আমেরিকার বাণিজ্য-বাজার নষ্ট হবে। আর এইভাবে দেশকে একটি গরীব কৃষিপ্রধান ও সাহায্যনির্ভর দেশে পরিণত করা হচ্ছে। টেন্ডুপাতা ব্যবহার নিষিদ্ধ করে শত শত বিড়ি শ্রমিককে মারার যােগাড় করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার ট্যাক্স আরােপের ফলে মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
পাক-ভারত যুদ্ধ মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে। বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে পূর্ব পাকিস্তান কোন দিক দিয়েই তার ন্যায্য হিস্যা পায়নি। পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়ােজনে পশ্চিম পাকিস্তান সর্বদা প্রস্তুত বলে যে কথা একদিন বলা হয়েছে তা অন্তঃসারশূন্য কথায় পরিণত হয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা সরেজমিনে
তদারকি দূরের কথা স্বয়ং প্রেসিডেন্টও একবার খোঁজখবর নেবার প্রয়ােজন বােধ করেননি। সেদিনের আক্রমণের মুখে এদেশবাসী নিজেদের সম্পূর্ণ অসহায়ত্ব মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে। এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অপরিহার্য। | এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আজ সারা দেশ বিক্ষুব্ধ। জালিমশাহীর হাত থেকে মুক্তির জন্য দুর্বার গণআন্দোলনই একমাত্র পথ। নিহত ১১ জনের আত্মদান এদেশের মানুষকে মুক্তির দিক-নির্দেশনা দেবে। দেশমাতৃকার ডাকে যারা প্রাণ বিসর্জন দেয় তাদের আত্মত্যাগ কখনাে বিফলে যায় না। ৭ জুনের হত্যাকান্ড জালিমশাহীকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রয়ােজন সকল অনৈক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ।
নেতৃবৃন্দ কতিপয় দাবি পেশ করেন; দাবিসমূহের মধ্যে ছিল(১) বিচার বিভাগের মাধ্যমে ৭ জুনের হত্যাকান্ডের তদন্ত করা ও ক্ষতিপূরণ দান;
সকল রাজবন্দীর মুক্তিদান, হুলিয়া ও জরুরী অবস্থা সহ সকল বিধিনিষেধ প্রত্যাহার: (৩) পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন; (৪) পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষা, কৃষ্টি ও ভৌগলিক ঐক্যের ভিত্তিতে বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব সরহদ এই চারটি পৃথক প্রদেশ গঠন করা; (৫) ফেডারেল ও পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা; (৬) সকল নাগরিকের ভােটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন; (৭) রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সমভাবে ভারী শিল্প-কারখানা স্থাপন: (৮) বিদেশী ঋণ বর্জন করে জাতীয় সম্পদের ওপর স্বাধীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি ব্যাংক। বীম’ পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করা; (৯) বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসেচের ব্যবস্থা: (১০) খাজনা-ট্যাক্স কমানাে, বকেয়া ঋণ মওকুফ, তামাক-পাট-আখের ন্যায্যমূল্য প্রদান করা এবং প্রকৃত কৃষকের হাতে জমি বন্টন কর; (১১) ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার ও বরখাস্তকৃত শ্রমিকদের পুনর্বহাল; (১২) যুদ্ধজোট বর্জন করে স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি।
প্রচারপত্রে স্বাক্ষর করেন-হাজী মােহাম্মদ দানেশ, মহিউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, দেওয়ান মাহবুব আলী, পীর হাবিবুর রহমান, মােজাফফর আহমেদ, হাতেম আলী খান, ওসমান গনি, গােলাম মাের্তজু, নুরুল ইসলাম, এম এ ওয়াদুদ।
গুলিবর্ষনের প্রতিবাদে বিরােধী দল ৭ জুন সংঘটিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ৮ জুন ১৯৬৬ সালে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বিরােধী দল কর্তৃক উত্থাপিত গুলিবর্ষণ সংক্রান্ত তিনটি প্রস্তাব স্পীকার আব্দুল জব্বার খান কর্তৃক বাতিল হবার প্রতিবাদে বিরােধী দল পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করেন। স্পীকার জব্বার সর্বদাই পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা করতেন।
স্পীকারের বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে পরিষদ কক্ষে তুমুল হৈ চৈ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিরােধী দলের ওয়াক আউটের সঙ্গে স্বতন্ত্র সদস্যরাও যােগ দেন। এদিকে প্রাদেশিক
________________________________________
পরিষদেও বিরােধী দল ও স্বতন্ত্র সদস্যরা ঘটনার প্রতিবাদে পরিষদ কক্ষ বর্জন করেন।
১৯৬৭ সালের ২৭ মার্চ আইয়ুব খাঁ বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে পূর্ব পাকিস্তান পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভােগ করছে শীকার আব্দুল জব্বার খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মােনায়েম খানও বক্তব্য রাখেন। আইয়ুব খাঁ তার বক্তব্যে আরাে বলেন, নিজস্ব বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যারা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য চেঁচামেচি করছে তারা দেশের দুই অংশের বিতাি কামনা করছে। এরা জনগনের শত্রু।
তিনি বলেন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য যদি শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করা হয় তাহলে বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। উন্নয়নমূলক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান অগ্রাধিকার লাভ করছে। এই প্রদেশকে উন্নয়নের জন্য ২০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। কাজেই সকল পূর্ব পাকিস্তানীকে খাটি পাকিস্তানী হওয়া উচিত। সামরিক শাসনের পূর্বে দেশ চরম অবনতির গহুরে পতিত ছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সমালােচনা করে তিনি বলেন, তারা দেশে বিবাদ, সংঘাত, বিভ্রান্তি ও অনৈক্যের সৃষ্টি করেছিল। তিনি বিরােধী দলের প্রদত্ত পার্লামেন্ট পদ্ধতির দাবি প্রসঙ্গে বলেন, এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে দেশের কল্যাণ সাধন করা সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রসঙ্গীত বর্জন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ সরকারি প্রচার মাধ্যম থেকে রবীন্দ্র সংগীতের প্রচার কমিয়ে ফেলার একটি আদেশ প্রদান করে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গর্ভনমেন্ট ১৯৬৭ সালের জুনে। ২৩ জুন পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে এদেশের প্রগতিশীল বাঙালী শিক্ষিত সমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ১৮ জন বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতিতে বলেন, এই সিদ্ধান্ত আমরা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি। তাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে ঐশ্বর্য দান করেছে। তার সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গর্ভরতা দান করেছে তা বাংলাভাষীদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। আমরা আশা করি সরকারি নীতি নির্ধারকরা বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তাকে যংর্থ মর্যাদা দেবেন।
| বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন ডঃ কুদরত-ই-খুদা, কাজী মােহতাহার হােসেন, সুফিয়া কামাল, জয়নুল আবেদীন, এস এ বারী, মােহাম্মদ আব্দুল হাই, মুনীর চৌধুরী, খান সারােয়ার মুর্শেদ, সিকান্দার আবু জাফর, মােফাল হায়দার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহীম, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, হাসান ২ ফজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দিন, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, মােহা. মনিরুজ্জামান, শহীদুল্লাহ কায়সার।
শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচারে সরকারি ঘােষণার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলার মানুৰেকবি, বাংলা ভাষার কবি। তার সাহিত্য এদেশের
________________________________________
মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। তাকে বাদ দিয়ে বাঙালীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়
। তিনি সরকারের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিরুদ্ধে যে কোন ষড়যন্ত্র জনগণ প্রতিহত করবে। তিনি আরাে বলেন, রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা মানে বাঙালীকে অস্বীকার কর। কাজেই শাসক গােষ্ঠীর এই হীন চেষ্টার মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির দাবিকে দমিয়ে রাখা যাবে না।
মওলানা ভাসানী রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশন সম্পর্কে ২৭ জুন ১৯৬৭ সালে তাঁর বিবৃতিতে বলেন, তথ্যমন্ত্রী সাহাবুদ্দিন ঘােষণা করেছেন যে রবীন্দ্র সঙ্গীত ইসলাম ও পাকিস্তানের ঐতিহ্য বিরােধী বিধায় তা আর রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করা হবে না। কিছুদিন পূর্বে আরেক মন্ত্রী সবুর খানও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একই বিবৃতি প্রদান করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ উপন্যাস ও সংগীতের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে নতুন গৌরবে অভিষিক্ত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের আবেদন সার্বজনীন । ইসলাম সত্য ও সুন্দরের জন্য ঘােষণা করেছে এবং সেই সত্য ও সুন্দরের পতাকাকে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। যারা ইসলামের নামে রবীন্দ্রনাথের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছেন তারা আসলে ইসলামে বিশ্বাসী নন। দেশের মানুষের প্রতি সরকারের ঐ অশুভ প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার আহবান জানান।
আরবী হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হামুদুর রহমান আরবী হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ করেন। ১৪আগষ্ট, ১৯৬৭ সালের দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় বলা হয় যে, হামুদুর রহমান বলেছেন, আরবী হরফ চালু করা হলে তা জাতীয় সংহতি জোরদার করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। লাহােরে অনুষ্ঠিত বাংলা সাহিত্যের ২০ বছর শীর্ষক আলােচনা সভায় তিনি ঐবক্তব্য রাখেন।
তিনি আরাে বলেন, বাংলাকে সহজেই আরবী হরফে লেখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কয়েক বছর আগে থেকে হফেউল’ কোরান নামক একটি বাংলা সাময়িকী আরবী হরফে প্রকাশিত হচ্ছে। তিনি পাকিস্তানের লেখকদের প্রতি সুস্থ মস্তিকে ব্যাপারটি চিন্তা করে আরবী হরফে বাংলা লেখা শুরু করতে বলেন।
পিডিএম গঠন ১৯৬৭ সালের মে মাসে পিডিএম বা সংক্ষেপে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট গঠিত হয়। জামাতে ইসলামী, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সমন্বয়ে গঠিত এই ফ্রন্টে আওয়ামী লীগের কতিপয় দলছুট লােক যােগ দেন। ‘৬৭ সালের সেপ্টেম্বরে ফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক পুস্তিকায় পাকিস্তানের
________________________________________
ঐক্য ও অখন্ডতা অক্ষুন্ন রাখা সহ বিভিন্ন প্রকার দাবিদাওয়া ছিল। ফ্রন্টের ৮ দফা দাবি সম্বলিত পুস্তিকায় সকল মানুষকে পিডিএম-এ সামিল হবার আহবান জানানাে হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই পিডিএমের ভূমিকা মানুষের নিকট অস্পষ্ট ও ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়ে ওঠে। জামাত, মুসলীম লীগ ও নেজামে ইসলাম একাত্তরে সরাসরি স্বাধীনতার বিপক্ষে ভূমিকা পালন করে এবং পকিস্তানী দালালে পরিণত হয়।
ন্যাপের সম্মেলন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ৩০ শে নভেম্বর, ১৯৬৭ সালে অনুষ্ঠিত সভায় মওলানা ভাসানী দলের আন্দোলনের কর্মসূচী পেশ করে বলেন, আইয়ুব সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট বুর্জোয়া সামন্তবাদীয় শ্রেণীর একনায়ক সরকার। দেশী বুর্জোয়া ও সামন্তবাদ এই ত্রিশক্তি এক এবং অবিভাজ্য। এই শক্তির পতনের মাধ্যমেই দেশের জনগণ প্রকৃত সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। নিজেদের স্বার্থে এখনাে অনেকেই মার্কিনের বিরাগভাজন হতে চান না। এরা বলেন, আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হােক তারপর মার্কিন বিরােধিতার বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে। কিন্তু গণতন্ত্রের সংগ্রাম ও মার্কিন বিরােধী সংগ্রাম এক এবং অভিন্ন। এদের একটির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গেলে অন্যটি সহজেই এসে পড়ে।
ভাসানী বলেন, আমরা নাকি ৬ দফা আন্দোলনের বিরােধিতা করে প্রকারান্তরে স্বায়ত্তশাসনের বিরােধিতা করছি। তবে একথা সত্য যে ৬ দফাকে আমরা জাতীয় মুক্তির সনদ হিসেবে মেনে নিতে পারি না। জনগণকে আমরা ঐ ৬ দফার ভিত্তিতে বিভ্রান্ত করতে চাই না। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ন্যাপ ইতিপূর্বে তাদের ১৪ দফা দাবি পেশ করেছে। ঐ ১৪ দফার মধ্যেই ৯৮ ভাগ মানুষের কথা প্রতিফলিত হয়েছে।
বিরােধীরা বলছেন, ৬ দফা দাবি লাহাের প্রস্তাব ও ২১ দফার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বাংলার মানুষ কখনাে ৬ দফার জন্য বুকের রক্ত ঢালতে যাবে না।
৬-দফা কর্মসূচীতে বাংলার মেহনতি মানুষের কোন কথা নেই। স্বায়ত্তশাসনের নামে ৬-দফা ভিত্তিক তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন মেহনতি মানুষের উপর শশাষণ-পীড়নে পরিণত হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান কাজ দেশে একটি সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করা এবং গণতান্ত্রিক পথ উন্মুক্ত করা। ন্যাপ ব্যতীত অন্য সকল দলই এ ধরনের নেতৃত্ব দানে ব্যর্থ। ন্যাপই একমাত্র দল যারা সাধারণ মানুষের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। কাজেই তারা কখনাে অন্য কোন দলের দেয়া কর্মসূচীর লেজুড়বৃত্তি করবে না। ন্যাপ অখন্ড পাকিস্তানে বিশ্বাসী। পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে ভাসানী তার বক্তৃতা শেষ করেন।
________________________________________
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা জানুযারি ‘৬৮ সালে সিভিল সার্ভিস, সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনী এবং রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মােট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ৭ জানুয়ারি সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে দৈনিক পাকিস্তান সবাইকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ভারতীয় কূটনীতিক মিঃ ওঝার সঙ্গে তারা যােগাযােগ রক্ষা করতেন এবং আগরতলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেঃ কর্ণেল মিশ্র এবং মেজর মেননের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। ভারতের অস্ত্র ও অর্থ সহযােগিতা নেয়াই ছিল সেই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য। কাশ্মীর ও অন্যান্য বিরােধের কারণে ভারত ঐ সব দেশদ্রোহীদের প্রতি সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ।
সরকারি প্রেসনােটে বলা হয় যে, ষড়যন্ত্র সফল করার লক্ষ্যে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গােলা-বারুদ ও অর্থ সংগ্রহ করাই ছিল গ্রেফতারকৃতদের উদ্দেশ্য। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার দলিল পত্রও হস্তগত করেছেন। বিশৃংখলা সৃষ্টির সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছে। সরকার গ্রেফতারকৃতদের তদন্ত অগ্রগতি ও বিচার সম্পর্কে সময়মত সবকিছু জানাবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় খবরে বলা হয়, আগরতলা ষড়যন্ত্রের অভিযােগে ঢাকাস্থ ভারতীয় কূটনৈতিক মিঃ ওঝাকে বহিস্কার করা হয়েছে। প্রতিবাদে ভারতও নয়াদিল্লীতে পাকিস্তানী কূটনীতিক মিঃ আহমেদকে ভারত ত্যাগের নির্দেশ দেয়।
গ্রেফতারকৃতদের তালিকা-(১) লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জম হােসেন, (২) চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের ভূপতি ভূষণ চৌধুরী, (৩) মিঃ বিধান কৃষ্ণ সেন, (৪) চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাইদুর রহমান, (৫) সিভিল সার্ভিস ইন্টারন্যাশনালের এম আলী রাজা, (৬) আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, (৭) রুহুল কুদুস সিএসপি, (৮) নেভির মহিবুর রহমান, (৯) নেডির কামাল উদ্দিন আহমেদ, (১০) পিআইএ’র মির্জা এম রমিজ, (১১) নেভির সুলতান উদ্দিন আহমেদ, (১২) বিমান বাহিনীর আমির হােসেন, (১৩) বিমান বাহিনীর এ বি এম সামাদ, (১৪) নেভির খুরশীদ আলম, (১৫) মােঃ মাহমুদ আলী, (১৬) এ বি এম ইউসুফ, (১৭) তাজুল ইসলাম, (১৮) খুরশীদ মিয়া, (১৯) দলিলুদ্দিন, (২০) মাহমুদ আলী চৌধুরী, (২১) আনােয়ার হােসেন, (২২) নৌবাহিনীর লেঃ মতিউর রহমান, (২৩) ক্যাপ্টেন খুরশীদ উদ্দিন, (২৪) সুবেদার আব্দুর রাজ্জাক, (২৫) সার্জেন্ট এ এম ফজলুল হক, (২৬) সার্জেন্ট শামসুদ্দিন, (২৭) হাবিলদার ইনসাফ আলী, (২৮) খান শামসুর রহমান। এই মামলাই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে।
শেখ মুজিবের প্রতি অভিযােগ ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের এক প্রেসনােটে বলা হয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দায়ে যাদের নাম ইতিপূর্বে ঘােষণা করা হয়েছে, তাদের
________________________________________
পাকিস্তান আইনে আটক করা হয়েছিল। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর আইনবলে তাদের পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা এসব আইনের আওতায় অপরাধ করেছেন। এ ব্যাপারে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
প্রেসনােটে বলা হয়, ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা ও পরিচালনার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাজেই অন্যান্যের সাথে তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তিনি পূর্ব থেকেই জেলে ছিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানকে জড়িত করার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাকে হেয় প্রতিপন্ন করে প্রবল গণআন্দোলন স্তিমিত করা। কিন্তু পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর সেই প্রচেষ্টা জনগণের ব্যাপক আন্দোলনের মুখে খড়কুটোর মত ভেসে যায়। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী শেখ মুজিব কোন গােপন আঁতাতের মাধ্যমে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা লাভ করতে চাননি। কাজেই সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় তার ক্ষমতা দখলের বিষয়টি ছিল অবান্তর।
শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের পর পরই আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক জরুরী বৈঠক বসে। বৈঠকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত থাকার অভিযােগে অভিযুক্ত শেখ মুজিবকে আত্মসমর্থনের সুবিধা এবং প্রকাশ্য বিচার অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানাে হয় এবং আরাে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী এবং ৬ দফার ভিত্তিতে জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত থাকবেই।
| শেখ মুজিবের জবানবন্দী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে পদদলিত করার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সৃষ্টি করে এদেশের ২৮ জন দেশপ্রেমী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতীয়তাবাদী ও সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত মহান মানবতাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে অন্যতম। | ১৯৬৮ সালের জুনে মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে শেখ মুজিব বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি দাবিয়ে রাখার জন্যই এই ষড়যন্ত্র মামলা। স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ জনগণের আশা-আকাঙ্গার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। ফলে ১৯৪৯ সালে গঠিত হয় । শুরু থেকেই এই দল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব প্রাদেশিক পরিষদে এবং পরে জাতীয় বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন। দুইবার পাকিস্তানের মন্ত্রী হন । চীনে প্রেরিত পরিষদ প্রতিনিধিদের প্রতিনিধিত্ব করেন। জনগণের কল্যাণে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরােধী দল গঠন করায় তাকে বহু বছর কারা নির্যাতন ভােগ করতে হয়েছে ।
সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর থেকে সরকার তার ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে
১৯৫৮ সালে সরকার জননিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেফতার করে দেড় বছর বিনা বিচারে আটক রাখে। সরকার এ সময় তার বিরুদ্ধে ৬টি ফৌজদারী মামলাও দায়ের করে। যার প্রত্যেকটিতেই তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। মুক্তিলাভের পর সরকার তার ওপর নানা রকম বিধিনিষেধ আরােপ করে। যার মধ্যে ঢাকা ত্যাগের আগে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানানাের নির্দেশ ছিল গােয়েন্দা বিভাগের লােকেরা তার ওপর সর্বদা ছায়ার মত লেগে থাকে। ১৯৬২ সালে যখন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয় তখনাে নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স নামে হয় মাস বিনা বিচারে জেলে আটক রাখা হয়। তিনি সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুর্নজীবিত ও সম্মিলিত বিরােধী দলের অঙ্গদল হিসেবে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নির্বাচনী অভিযানের পর থেকে সরকারি কর্তৃপক্ষ কয়েকটি মামলার মাধ্যমে তাকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করতে থাকে।
১৯৬৫ সালে শেখ মুজিব পাক-ভারত যুদ্ধের বিরােধিতা করে ভারতের আক্রমণের বিরুদ্ধে নিন্দা জানান। সে সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ও প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে গড়ে তােলার জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের নিকট দাবি জানান। কারণ যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ বিল্লি হয়ে এক অসহায় অবস্থার মধ্যে পতিত হয়। তিনি তাসখন্দ ঘােষণাকে সমর্থন করে বলেন, আমরা শান্তিতে, সহ-অবস্থানে বিশ্বাস করে। কাজেই আন্তর্জাতিক বিরােধ শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা হওয়া উচিত।
১৯৬৪ সালের গােড়ার দিকে লাহােরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনী বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সামাধান ৬-দফা কর্মসূচী উপস্থাপন করেন। ৬-দফা কর্মসূচীতে পাকিস্তানের উভয় অংশের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হয়। আওয়ামী লীগ ৬-দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ৬-দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়। এতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারি নেতৃবৃন্দ তাকে অস্ত্রের ভাষায় হুমকি প্রদান করে এবং একসাথে এক ডজন মামলা করে তাকে হয়রানি করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে তিনি যখন খুলনায় জনসভা করে ফিরছিলেন তখন যশােরে গ্রেফতার করা হয়।
যশােরের মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেট ঐ মামলায় তাকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। পরে ঢাকার দক্ষিণ মহকুমা শাসক জামিন বাতিল করলে জেলা দায়রা জজ পুনরায় জামিন দেন। ঐদিন সন্ধ্যায় আবার সিলেট থেকে প্রদত্ত এক পরােয়ানা বলে তাকে গ্রেফতার করে সিলেটে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সিলেটের মহকুমা শাসক জামিন বাতিল করেন। পরের দিন সিলেটের জেলা জজ আবার জামিন প্রদান করেন। কিন্তু মুক্তি পাবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আবার তাঁকে গ্রেফতার করে। এবারের গ্রেফতারী পরােয়ানা পাঠানাে হয় ময়মনসিংহ থেকে। একইভাবে ময়মনসিংহ মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট জামিন বাতিল করলে
________________________________________
জেলা জজ তা পুনরায় অনুমােদন করেন। উপরােক্ত সব মামলাই প্রহসন ও হয়রানিমূলক ছিল। এসব ঘটনা ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হয়।
| ১৯৬৬ সালের মে মাসে পুনরায় তাকে ডিফেন্স অব পাকিস্তান রুল-এর ৩২ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। ঐ সময় আরাে বহু নেতাকেও গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন আহমেদ, আব্দুল আজিজ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমেদ চৌধুরী সহ আরাে অনেকে। এই ঘটনার কিছুদিন পূর্বে আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরী, আব্দুল মােমন, ওবায়দুর রহমান, শামসুল হক, হাফিজ মােঃ মুসা, মােল্লা জালালুদিন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আমজাদ হােসেন, মুস্তফা সারােয়ার, মহীউদ্দিন আহমেদ, মােহাম্মদ উল্লাহ, মােয়াজ্জেম হােসেন, সিরাজউদ্দিন হােসেন, হারুনুর রশিদ, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, আব্দুল হাকিম, রাশেদ মােশাররফ, মােঃ ইদ্রীস, সুলতান আহমদ, নুরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান, হাসনাইন আব্দুর রহমান সিদ্দিকী সহ বহু নেতা ও কর্মীকে ৩২ ধারা বলে গ্রেফতার করা হয়। ইত্তেফাকের তােফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকেও গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে।
এসব ঘটনার প্রতিবাদে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন আওয়ামী লীগ দেশব্যাপী হরতাল আহবান করে। হরতাল চলাকালীন সময়ে পুলিশ ১১ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। আহত হয় অসংখ্য এবং গ্রেফতার করা হয় ৮০০ জনকে। এসময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মােনায়েম খান প্রায়ই বলতেন যে, তিনি যতদিন ক্ষমতায় থাকবেন ততদিন শেখ মুজিবকে কারাগারে শৃংখলিত থাকতে হবে। একটানা একুশ মাস কারাবাসের পর ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়। রাত একটায় মুক্তিলাভের সাথে সাথেই গেট থেকে কতিপয় সামরিক অফিসার তাকে পুনরায় গ্রেফতার করে সেনানিবাসে নিয়ে যায় এবং তার সঙ্গে সকল প্রকার যােগাযােগ বন্ধ রাখা হয়। যােগাযােগ বিত্রি অবস্থায় তিনি একটানা ৫ মাস সেখানে থাকেন। সামরিক বাহিনী তার উপর অকথ্য শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালায়। আগরতলা মামলা শুরুর মাত্র ১ দিন আগে তিনি আব্দুস সালাম খানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পান এবং তাকে কৌসুলি নিয়ােগ করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তাঁকে এবং তার দল আওয়ামী লীগকে লাতি, অপমান ও ধ্বংস করার লক্ষ্যে জঘন্য মনােবৃত্তি নিয়ে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজানাে হয়েছে। ৬-দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও সকল ক্ষেত্রে সমতার দাবি আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করার লক্ষ্যই এর মূল উদ্দেশ্য। তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং এই দলের কর্মসূচী নিয়মতান্ত্রিক ও সুসংগঠিত। দেশের উভয় অংশের প্রতি ন্যায় বিচার ও ৬-দফা দাবি দলের প্রধান লক্ষ্য। এই দল সর্বদা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনসমক্ষে প্রবেশ করেছে। কিন্তু প্রতিবারই তারা শাসক গােষ্ঠী কর্তৃক নিগৃহীত হয়েছে। কেননা শাসক গােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শােষণ ও শাসন অব্যাহত রাখতে চায়। সেহেতু মিথ্যা ও প্রতিহিংসা বসেই কেবল তাকে ঐ মামলায় জড়ানাে হয়েছে। প্রথমদিকে সরকার কর্তৃক ঘােষিত লিষ্টে তার নাম ছিল না।
________________________________________
লেখক সংঘের সােৎসব পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংঘের উদ্যোগে ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসে পাঁচদিন ব্যাপী “মহাকবি স্মরণােৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ৫জুলাই রবীন্দ্রনাথ দিবস, ৬ জুলাই ইকবাল দিবস, ৭ জুলাই গালিব দিবস, ৮ জুলাই মাইকেল মধুসূধন দিবস, ৯ জুলাই নজরুল দিবস পালিত হয়। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে আয়ােজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইসলামী একাডেমির পরিচালক আবুল হাসিম এবং প্রবন্ধ পাঠ করেন আনিসুজ্জামান। আবুল হাসিম বলেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এক বস্তু নয়। সাহিত্য একটি শিল্প। যেকোন শিল্পকেই যে কোন আদর্শের বাহন হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। একথা আমরা মনে না রেখে একের সঙ্গে অপরকে গুলিয়ে ফেলি। তিনি বলেন, বাংলা ভাষাকে একটা শিল্প হিসেবে আয়ত্ত করার চেষ্টা করতে হবে। একশ বছরের বাংলা সাহিত্যকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। রবীন্দ্রনাথ সকল মত ও পথের উর্ধ্বে ছিলেন।
ডঃ আনিসুজ্জামান তাঁর প্রবন্ধে বলেন, চলতে চলতে রবীন্দ্রনাথ মত বদলেছেন, পথ বদলেছেন। ক্রমেই সকল সংকীর্ণতার গন্ডি ভেদ করে মানুষের পৃথিবীর নাগরিক হতে চেয়েছেন। ৮০ বছর ধরে তার মধ্যে একই ব্যক্তি বাস করেনি। এই নানা রবীন্দ্রনাথের যােগ ঘটেছিল বলেই তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বাংলা ভাষার শক্তিকে শতগুণে বৃদ্ধি করা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নির্মাতা।
৬ জুলাই অনুষ্ঠিত সভায় বাংলা উন্নয়ন বাের্ডের ডঃ এনামুল হক বলেন, আনন্দ সৌন্দর্য কবিই সৃষ্টি করতে পারেন কিন্তু জাতিকে ভবিষ্যতের পথনির্দেশ ও চলার পথ দেয়ার কবি খুব বিরল; যারা মানুষের সত্তাকে জাগ্রত করে। আলােচনা সভায় প্রবন্ধ পাঠ করেন মােঃ মাহফুজউল্লা ও মনিরুদ্দিন ইউসুফ।
৯ জুলাই নজরুল দিবসের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। এদিনের সভায় সভাপতিত্ব করেন আব্দুল কাদির এবং প্রবন্ধ পাঠ করেন বােরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও রফিকুল ইসলাম। সভাপতি তার ভাষণে বলেন, নজরুল ছিলেন নিপীড়িত মানুষের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের কবি। বাংলা সাহিত্যে তিনি গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের প্রথম প্রবক্তা। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে সঙ্গীতের নজরুল অনেক বড়।
বর্ণমালা সংস্কার প্রসঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক বাংলা বানান ও সংস্কার অনুমােদন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১২ আগষ্ট ১৯৬৮ সালে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বাংলা বানানের ক্ষেত্রে যে ক্রমবর্ধমান বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে তার অবসানকল্পে উচ্চশিক্ষা ও বাংলার উন্নয়নকে সুগম করার জন্য এই সংস্কার অনুমােদন করা হয়েছে। বাংলা ভাষার উন্নয়নকে ব্যাহত করা এই সংস্কারের উদ্দেশ্য বলে ইঙ্গিত করা হলে তা একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে ভুল বােঝা হবে। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নিজে এই কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
________________________________________
কিন্তু অসুস্থ থাকার কারণে তিনি এই রিপাের্টে স্বাক্ষর করতে পারেননি। অনুমােদিত সংস্কারির বিস্তারিত বিষয়টি ঠিক করার জন্য ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠনের ব্যাপারে কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সদস্যদের দু’জন এই অনুমােদনের বিরােধিতা করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে আরাে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের বিগত বৈঠকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির রিপাের্ট রদবদলের রায় গ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের ২৮ মার্চ এই কমিটি গঠিত হয়। কমিটির উদ্দেশ্য ছিল বাংলার সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সাধন করা । একাডেমিক কাউন্সিল কমিটির চেয়ারম্যান ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়া বাকী ১০ জনকে নিয়ে এই কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন (১) কাজী দীন মােহাম্মদ, (২) ফেরদৌস খান, (৩) অধ্যক্ষ আব্দুল হাই, (৪) সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন, (৫) মােহাম্মদ ওসমান গনি, (৬) আবুল কাসেম, (৭) অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, (৮) ডঃ এনামুল হক, (৯) মুনীর চৌধুরী, (১০) টি হােসেন।
১৯৬৮ সালের ২২ মার্চ রেজিষ্টার কমিটির তিনজন সদস্যের বিরােধী মন্তব্যসহ কমিটির রিপাের্ট পান। বিরােধী সদস্যরা হলেন (১) আব্দুল হাই, (২) মুনীর চৌধুরী, (৩) ডঃ এনামুল হক। ৪ মে একাডেমিক কাউন্সিলের কাছে রিপাের্টটি বিরােধীদের মন্তব্য সহ পেশ করা হয় । ৩ আগস্ট কাউন্সিল রিপাের্টটি বিবেচনায় বসেন । বিস্তারিত আলােচনা শেষে সামান্য রদবদল বরে রিপাের্ট বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর বিস্তারিত প্রয়ােগের জন্য যে উপকমিটি গঠিত হয় তার সদস্যরা হলেন (১) ওসমান গনি, (২) আব্দুল হাই, (৩) ইব্রাহিম খাঁ, (৪) নূরুল মােমেন, (৫) কাজী দীন মােহাম্মদ। আরো জানানাে হয় যে কাউন্সিল যেভাবে রিপাের্ট গ্রহণ করবে তাতে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণের কোন প্রশ্নই ওঠে না। বানানের প্রয়ােগের ক্ষেত্রে কেবল কয়েকটি অক্ষর বাদ দেয়া হয়েছে। অক্ষরগুলাে হলাে ঙ, ণ, ২, ষ, স, ঐ ৪। কমিটি মনে করে ঐসব বাড়তি অক্ষর শিক্ষার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরাে বলা হয়, দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের একটি সৎ ও মহৎ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত সহজ সরল উদ্যমের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। অসুস্থতার জন্য ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এতে স্বাক্ষর দিতে পারেননি। তা নিয়েও ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বিরুদ্ধবাদীরা বলছেন, তিনি নাকি এই সংস্কারের বিরােধী। প্রথম ৫০ জন সদস্যের বৈঠকে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। তাতে অধ্যক্ষ আব্দুল হাই ও এ কে এম কবীর প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন এই বলে যে, এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। একাডেমিক কাউন্সিল বাংলা ভাষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এ অভিযােগ দ্বারা দায়িত্বশীল ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণের দেশপ্রেম ও সততাকে কটাক্ষ করা হচ্ছে। অথচ একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার অভাবে বাংলা বানান ক্রমশ জটিল হয়ে পড়েছিল। ১৯৩০ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কতিপয় সংস্কার সাধন করে যা সবাই গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই সংকার ছিল অসম্পূর্ণ এবং আংশিক। প্রস্তাবিত সংস্কারের পেছনে বাংলা ভাষার বিকাশ ব্যাহত করার মতলব আছে এমন কোন ইংগিত করা হলে তা হবে মারাত্মক।
________________________________________
সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক বাংলা বানান ও সংস্কারের যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এর প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের ৪২জন বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী এক বিবৃতি দেন।১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ সালে তাদের দেয়া বিবৃতি দেশের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত হয় । ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, প্রস্তাবিত পরিবর্তন গ্রহণ করা হরে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সাথে আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক বিপর্যস্ত হবে এবং সৃজনশীল রচনার ক্ষেত্রে এক বিরাট বন্ধ্যাত্ব দেখা দেবে। পাশাপাশি ভাষা ও সাহিত্য পঙ্গু হয়ে পড়বে। ধ্বনি বিজ্ঞানের বিচারে বাংলা বর্ণমালা অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে বিন্যস্ত বলে স্বীকৃত। এই সংস্কার সেই বিজ্ঞান ভিত্তিকে বিনষ্ট করবে। এটি জনগণকে বিভ্রান্ত করার কৌশল এবং তাদের এক চোখ অন্ধ করে দেবার শামিল। ভাষা ও বর্ণমালার প্রকৃত মালিক দেশের জনসাধারণ। তাদের অগােচরে এর মৌলিক পরিবর্তন করার অধিকার কতিপয় ব্যক্তির নেই। এই সংস্কার প্রতিহত করার জন্য তারা দেশবাসীকে আহবান জানান।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যথাক্রমে কাজী মােতাহার হােসেন, আব্দুল হাকিম, মােঃ মুনসুর উদ্দিন, সৈয়দ মুরতজা আলী, মােহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল, কাজী মােঃ ইদ্রিস, সিকান্দার আবু জাফর, হােসেন চৌধুরী, আব্দুল গনি হাজারী, শহীদুল্লাহ কায়সার, হাসান হাফিজুর রহমান, ফজল শাহাবুদ্দীন, শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, আফলাতুন, লায়লা সামাদ, শহীদ কাদরী, কালাম মাহমুদ, কে জি মুস্তফা, আতাউস সামাদ, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, জাহির রায়হান, রােকনুজ্জামান খান, নুরজাহান। বেগম, এহতেশাম হায়দার চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, আলী আকসাদ, খালেদ চৌধুরী, ওয়াহিদুল হক, কাজী মাসুম, ইসাহাক চাখারী, শওকত আলী, মােঃ সালেউদ্দিন, আব্দুল আউয়াল, জামালউদ্দিন মােল্লা, গােলাম রওশান, আবু কায়সার, আহমেদ নূরে আলম, শহিদুর রহমান ও কবি জসীমউদ্দীন।
সাধারণ ছাত্রদের প্রতিবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক বাংলা ভাষার বর্ণ বর্জন ও সংস্কারের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ সালে মধুর রেস্তোরায় এক প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করে। প্রতিবাদ সভা উপলক্ষে প্রচারিত এক প্রচারাপত্রে বলা হয় যে, বর্ণমালা বর্জনের দ্বারা ডাষা সহজ হবে এবং তা শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক হবে বলে কর্তৃপক্ষ যে প্রচার চালাচ্ছে তা একটি স্বার্থবাদী মহলের চক্রান্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ কর্তৃক ২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ঐ প্রচারপত্রে আরাে বলা হয়, বানান পরিবর্তনের ফলে শব্দ তার মূল অর্থ ও ব্যবহারগত অনুষঙ্গ থেকে বিচ্যুত হবে। ভাষা তার সচল প্রবাহ হাৱাৰে। এই ব্যবস্থা বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলা ভাষায় শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করবে। এই ব্যবস্থাকে শিক্ষা সংকোচন নীতি বলা যেতে পারে।
________________________________________
গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বাঙালী বাতবােধ তথা বাঙালী সংস্কৃতির যে জাগরুণ দেখা দিয়েছে তাকে স্তিমিত করার জন্যই সরকারি পৃষ্ঠপােষকতায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানী তমুদুন-এর দোহাই দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। এই ঘটনা কোন বিন্নি ঘটনা নয়। পরােক্ষভাবে বাংলা বর্ণমালা বর্জনের মাধ্যমে বাণীদের শিক্ষার পথকেই রুদ্ধ করা হচ্ছে। এই ঘটনার পেছনে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। বাংলা ভাষার ওপর এই আঘাতকে অবশ্যই ছাত্র সমাজ প্রতিহত করবে।
আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের বৈঠক আইয়ুব খার স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের লক্ষ্যে বিরােধী দলগুলাের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের বিষয়ে মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরীর মধ্যে ১৯৬৮ সালের ২৬ নভেম্বর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দেশব্যাপী ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ ও ধরপাকড়ের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার প্রেক্ষিতে আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য বিরােধী দলগুলাের মধ্যে ঐক্য সাধনের জন্য কয়েকটি বিরােধীদল প্রস্তাব দেয়।
এয়ার মার্শাল আসগর খান ও বিচারপতি এস এম মুর্শেদের রাজনীতিতে যােগদান প্রশ্নে ভাসানী বলেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের আবির্ভাবে রাজনীতিতে কোন পরিবর্তন সূচিত হয় না। মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, ৬-দফার প্রশ্নে গণআন্দোলন গড়ে তােলার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সম্মতি আছে। এ বিষয়ে ফ্রন্ট গঠন করতে তারা রাজী।
শ্রমিক আন্দোলনের বিসিসি মুক্তিযুদ্ধের বিতর্কিত ভূমিকা পালন ও “শ্রেণীচক্র খতমের নীতিতে বিশ্বাসী পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি গৃহীত দলিলটি সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির তাত্ত্বিক ভিত্তিপ্রস্তর। এটি ১৯৬৮ সালের ১ ডিসেম্বর “শ্রমিক আন্দোলনের পুস্তিকা” নামে প্রকাশিত হয়। দলিলটি সংক্ষিপ্তকারে তুলে ধরা হলােঃ
এদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কস, লেনিন, মাও সেতুং চিন্তাধারা আমরা কিভাবে প্রয়োেগ করব? তাদের চিন্তাধারা হবে “তীর” যা নিক্ষেপ করতে হবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবকে লক্ষ্য করে। লক্ষ্যহীনরা অবশ্যই বিপ্লবের ক্ষতি করতে পারেন। বহু বিপ্লবী সুবিধাবাদী প্রতিবিপ্লবী ভূমিকা পালন করছেন। মাও সেতুং বলেছেন, অতীতের ভুলগুলাে অবশ্যই প্রকাশ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতের কাজ আরাে সতর্কভাবে সম্পন্ন করা যেতে পারে। এটাই হচ্ছে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও তা ভবিষ্যতে এড়ানাের অর্থ।
________________________________________
প্রাক-স্বাধীনতাকালে ভারতে কমিউনিষ্ট পার্টি কেন ব্যর্থ হলাে উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী সংগ্রামে নেতৃত্ব গ্রহণ করতে এবং ঔপনিবেশিক ও শাসনতান্ত্রিক শশাষণের অবসান ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে? স্বাধীনতা-উত্তরকালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিষ্ট পার্টি কেন ব্যর্থ হলাে উপনিবেশবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী সংগ্রাম পরিচালনা করে সমাজতন্ত্রের পথ তৈরি করতে? এ ব্যর্থতার কারণগুলাে ক্ষমাহীনভাবে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে উদঘাটন করতে হবে। যাতে একই ভুল ভবিষ্যতে না হয় এবং মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুংবাদীরা সক্ষম হন তাদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে।
বৃটিশের শাসনামলে ভারতের সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী ছিল-(১) ভারতীয় জনগণের সাথে বৃটিশ উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ; (২) ভারতের বিশাল কৃষক জনগণের সাথে সামন্তবাদের বন্দু; (৩) ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব; (৪) ভারতের হিন্দু-মুসলিম বুর্জোয়া সামন্ত গােষ্ঠী ও শ্রমিক-কৃষকদের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ। ভারতের সকল বুর্জোয়া শ্রেণী নিজ স্বার্থে স্বাধীনতা দাবি করে। প্রথম অবস্থা থেকেই তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল। তারা নিজেদের স্বার্থে কিছু সুযােগ-সুবিধা দাবি করে এবং এভাবেই শ্ৰেণীস্বার্থ তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দুকে তীব্র করে তােলে। এক পর্যায়ে সেই দ্বন্দ্ব বৈরী রূপ ধারণ করে, যা থেকে মুসলিম বুর্জোয়া গােষ্ঠী স্বার্থরক্ষার জন্য মুসলিম লীগ গঠন করে এবং মুসলমানদের জন্য নিজস্ব ভূখণ্ড পাকিস্তান দাবি করে। এই মুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণী। মুসলমান কৃষকদের সংঘবদ্ধ করার জন্য সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের সুযােগ গ্রহণ করে এবং তাদের মাঝে জঘন্য সাম্প্রদায়িক প্ররােচনা ছড়ায়। অন্যদিকে অমুসলিম বুর্জোয়া শ্রেণী অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার মানসে পাকিস্তান আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য অমুসলিম শ্রমিক-কৃষকদের জঘন্য সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে খেপিয়ে তােলে, যাতে তারা অমুসলিম সামন্তবাদীদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়। অপরদিকে বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত করে নিজেদের শাসন ও শােষণ অব্যাহত রাখার জন্য উভয় শ্রেণীর মধ্যে তীব্র সাম্প্রদায়িক প্ররােচনা চালায়। এসব কারণেই বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয় যা বৈরী সাম্প্রদায়িক দ্বন্দের রূপলাভ করে। শ্রমিক ও কৃষক শ্ৰেণী ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দ্বিধাবিভক্তিতে বৃটিশের শাসন ও শােষণের সুবিধা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষ, স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অংশ গ্রহণ, কৃষক-শ্রমিকদের চেতনার বিকাশ এ পর্যায়ে উপনিবেশবাদীদের বাধ্য করে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে। এভাবেই উপমহাদেশ একটি আধা-উপনিবেশে পরিণত হয় এবং সেইসঙ্গে সৃষ্টি হয় ভারত ও পকিস্তান নামক রাষ্ট্রের। | প্রাক-স্বাধীনতা কালে ভারতের সামাজিক অবস্থা ছিল ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী। ঔপনিবেশিক শক্তি সামন্তবাদকে জীবিত রেখে তাদের মাধ্যমে বিশাল কৃষক শ্ৰেণীকে শােষণ ও নিপীড়ন করত। কাজেই উপনিবেশবাদ-বিরােধী জাতীয় বিপ্লব এবং সামন্তবাদ-বিরােধী গণতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়া উচিত ছিল। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বুর্জোয়া
________________________________________
শ্রেণী সম্পন্ন করতে অক্ষম। কাজেই ঐতিহাসিকভাবে সর্বহারা শ্রেণী ও তার পার্টির দায়িত্ব এই বিপ্লব সম্পন্ন করা। এ বিপ্লব হওয়া উচিত ছিল জাতীয় গণতান্ত্রিক অথবা নয়া গণতান্ত্রিক বিপুব-যার লক্ষ্য সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম।
নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার জন্য দরকার ছিল- (১) মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের তত্ত্বে সুসজ্জিত আত্মসমালােচনার পদ্ধতি প্রয়ােগকারী ও জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত একটি পার্টি; (২) এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে একটি সেনাবাহিনী; (৩) এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে সমস্ত বিপ্লবী শ্রেণী ও বিপ্লবী দলের যুক্তফ্রন্ট। ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি উপরােক্ত শর্ত পালনে ব্যর্থ হয়। ফলে বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। নিজেদের স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার সুযােগ নিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে কৃষক-শ্রমিকদের নিজেদের পেছনে ঐক্যবদ্ধ করে এবং ভারতকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত দ্বন্দুগুলাে বিদ্যমান-(১) পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব; (২) পূর্ব বাংলার বিশাল কৃষক-জনতার সাথে সামন্তবাদের ল; (৩) পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সংশােধনবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ; (৪) পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর ।।
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া সামন্তবাদীরা নিজেদের বিকাশের জন্য পাকিস্তানে যােগ দেয় । সামন্তবাদের অবসান সম্ভব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এবং ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান সম্ভব জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে। বুর্জোয়ারা এই বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারে না। এ বিপ্লব সম্পন্ন করতে পারে কেবল সর্বহারা শ্রেণী ও তার পার্টি। এ বিপ্লবের একটি অংশ সশস্ত্র বিপ্লব। এই বিপ্লব করতে গেলে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ও দেশপ্রেমিক শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করতে হবে। এই বিপ্লবের আরেকটি পথ হলাে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম । কিন্তু এ বিপ্লবে বিজয়ের সম্ভাবনা খুবই কম; কারণ পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক-জনতার মধ্যে ঐক্যের অভাব ও সংশােদবাদী কর্তৃক জনগণকে বিপথে চালিত করা ।
পক্ষান্তরে ঔপনিবেশিক শক্তি একত্রিত । গ্রাম পর্যন্ত তাদের শাসন ব্যবস্থা বিস্তৃত। সে ক্ষেত্রে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ তাদের সাহায্য করবে। এই অবস্থা পরিবর্তন করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়ােজন। কাজেই পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এ বিপ্লবের অন্য চরিত্রটি হলাে গ্রাম এলাকা দ্বারা শহর ঘেরাও দখল করা। কাজেই গ্রাম এলাকায় গিয়ে কষকদের গেরিলা যুদ্ধের জন্য জাগিয়ে তুলে গ্রামে ঘাটি স্থাপন করতে হবে। এ বিপ্লবের অন্য চরিত্রটি হলাে ঐকফ্রন্ট গঠন করা। যে ঐকফ্রন্টে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ও উদ্যোগ গ্রহণ থাকতে হবে এবং থাকার প্রথম শর্ত হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে একটি গণফৌজ। গণফেীজ না থাকলে জনগণের কিছুই থাকবে না।
________________________________________
সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার প্রতিবাদে ঢাকার সাংবাদিক ও সংবাদপত্রসেবীরা ১ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে প্রেসক্লাবে একটি সমাবেশ করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, দেশরক্ষা বিধি, প্রেস অর্ডিন্যান্সসহ সকল কালাকানুন বাতিল, ইত্তেফাকের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি জানায়। বিক্ষোভকারীরা গভর্নর হাউজের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
সমাবেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহবান জানিয়ে বক্তৃতা করেন তফাজ্জল হােসেন, আলী আশরাফ, এ বি এম মুসা, শহীদুল্লাহ কায়সার ও আতাউস সামাদ।
আন্দোলন প্রশ্নে আইয়ুব খান আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে সরকারকে বিরােধী দল টলাতে পারবে না । ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের সমাবেশে আইয়ুব খাঁ একথা ঘােষণা করেন। বিরােধী দলকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি আরাে বলেন, বিরােধীরা জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে ধ্বংস করছে। তাদের গণতন্ত্রের দাবি হচ্ছে প্রদেশকে বিল্লি করে ফেলা। তাদের হাতে ক্ষমতা প্রদানের অর্থ হচ্ছে অতীতের দূর্যোগময় দিনে ফিরে যাওয়া এবং নিজের পিঠে ছুরি মারা। বিরােধী নেতাদের কোন গঠনমূলক কর্মসূচী নেই।
আইয়ুব খান মুসলিম লীগ কর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন সকল পরিস্থিতি মােকাবেলা করে বিরােধীদের প্রতিহত করতে হবে। জাতীয় সব উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড নির্ভর করছে মুসলিম লীগের ওপর। কাজেই মুসলিম লীগকে যেকোন উপায়ে রক্ষা করতে হবে। তিনি ১৯৫৮ সালে তার ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশের উন্নয়নের একটি বিবরণ জনতার উদ্দেশ্যে পেশ করেন। প্রমাণ হিসেবে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কথা বলেন।
| বিরােধী দলের ধর্মঘট বিরােধী দল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতন ও অব্যাহত গণবিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে। জনগণ স্বতঃফুর্তভাবে হরতালে অংশ গ্রহণ করে। দোকানপাট, হাট-বাজার, কলকারখানা, যানবাহন বন্ধ থাকে। আগের দিন থেকেই শহরে পুলিশ ও ইপিআর যৌথভাবে টহল দিতে থাকে। পিকেটিং ও মিছিল চলাকালে পুলিশ বহু কর্মীকে গ্রেফতার করে। পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা আসগর খান এই হরতালকে সমর্থন করেন। ধর্মঘট কেবল ঢাকা শহরে আহবান করা হলেও নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকরা তাতে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। ডকইয়ার্ডের কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ে। পুলিশ সূত্র জানায় ৬৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
________________________________________
১৯ ডিসেম্বর ৭ জন ছাত্রনেতা পরবর্তী আন্দোলনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহবান জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ছাত্র সমাজ সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য সকল গণতান্ত্রিক বিরােধী দলগুলাের প্রতি আহবান জানাচ্ছে। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি তােফায়েল আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরি, ছাত্র ইউনিয়নের সাইফুদ্দিন মানিক, শামসুদ্দোহা, মােস্তফা জামাল হায়দার, ছাত্রলীগের আব্দুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী। ছাত্র নেতৃবৃন্দ আরাে বলেন, সরকার নির্যাতন, গুন্ডামী, পুলিশী অভিযান চালিয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ধ্বংস ও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন ধ্বংস করতে চাচ্ছে। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্র সমাজ গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর কারাে হস্তক্ষেপ সহ্য করবে না।
নির্বাচন বয়কটের আহবান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের আহবানে সাড়া দিয়ে দেশের কয়েকটি বিরােধী দল নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকায় শেখ মুজিবের বাসভবনে মিলিত হয়ে তারা তাদের সমর্থনের কথা জানিয়ে জনগণকে নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানায়। সভায় একটি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধার করা। ঘােষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ন্যাপের আমির হােসেন শাহ, জামায়াত ইসলামের মুফতি মাহমুদ প্রমুখ।
ঘােষণাপত্রে আরাে বলা হয়, স্বৈরাচারী সরকার নির্যাতনমূলক শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। জরুরী অবস্থা অব্যাহত রেখে রাজনৈতিক নেতাদের আটক ও নাগরিক অধিকার লংঘন করে তারা ক্ষমতায় টিকে আছে। এই সরকার পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির জন্য দায়ী। সকল ক্ষেত্রে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, ফলে দেশের মানুষের মনে একটা বিরাট হতাশা বাসা বেঁধেছে। এই চরম বিপর্যয়ের পটভূমিতে দেশের আটটি রাজনৈতিক দল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
ঘােষণাপত্রে প্রদত্ত দাবির মধ্যে ছিল-(১) শেখ মুজিব ও ওয়ালী খান সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তিদান; (২) ফেডারেল প্রকৃতির পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা; (৩) জরুরী আইন প্রত্যাহার; (৪) শ্রমিকদের অধিকার প্রদান; (৫) সংবাদপত্র সংক্রান্ত বিধিনিষেধ প্রত্যাহার প্রভৃতি। সবশেষে বলা হয়, সারা দেশে ব্যাপক গণআন্দোলন প্রমাণ করেছে যে জনগণ ডিয়েটরশীপের শাসন চায় না। অধিকার প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।
________________________________________
লেখক কমিটির প্রচার পত্র দেশের ক্রমবর্ধমান সার্বিক অবনতি, সাধারণ মানুষের চিন্তা ও মত প্রকাশের ওপর বিধিনিষেধ আরােপের প্রতিবাদে রাজনৈতিক দলসমূহের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে “লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটি” ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে একটি প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রে বলা হয়, মানুষের চিন্তা ও মত প্রকাশ করা মৌলিক অধিকার। এই অধিকারের ভিত্তিতেই সকল উন্নত জাতির বিকাশ ঘটেছে। উন্নয়ন প্রয়াসী সকল জাতি চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে অধিক মূল্যবান বলে মনে করে এবং তা সংরক্ষণে যেকোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকে। পাশাপাশি একথাও সহ যে কোন জাতিকে দাবিয়ে রাখতে চাইলে সে দেশের শাসকবর্গ প্রথমেই তাদের চিন্তাশক্তিকে রুদ্ধ করে দেয় । এ লক্ষ্য অর্জনে ঐ শাসকবর্গ যেকোন ষড়যন্ত্র করতে দ্বিধা করে না।
পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও বিগত ২২ বছরের ইতিহাসে দেখা গেছে সরকার স্বাধীনতার পর থেকে এ প্রদেশের কণ্ঠরােধ করার জন্য এমন নীতি নেই যা অবলম্বন করেননি। কুখ্যাত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধের স্বেচ্ছাচারী নজীর স্থাপন করেছে। যা কেবল বৃটিশের শাসন নীতির সাথে তুলনা হতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকেই সংবাদপত্রের ওপর সরকারি বিধিনিষেধের খড়গ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে তথ্য দপ্তরের অলিখিত প্রেস উপদেশ রেডিও-টেলিভিশনকে সরকার সম্পূর্ণ নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজস্ব প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সংবাদপত্রসমূহকে সংগ্রাম করে, কখনাে বা আপােসের মাধ্যমে টিকে থাকতে হচ্ছে। যেক্ষেত্রে আপােসে সম্ভব নয় সেক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে সংবাদিক-কর্মচারীদের উপর আঘাত হানা হচ্ছে।
পাশাপাশি রয়েছে গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকারি দমন নীতি। স্বাধীনতার পর এদেশে বহু বই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। গ্রন্থ বিশেষের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করে কারণ দর্শানাে নােটিশের মাধ্যমে লেখকদের কণ্ঠরােধের নতুন ষড়যন্ত্রে তৎপর হয়ে। উঠেছে, যা স্বৈরাচারকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে সাংস্কৃতিক মহলে নেমে এসেছে এক চরম বন্ধ্যাত্ব। দেশের এই পরিস্থিতিতে লেখক স্বাধিকার কমিটি চিন্তা ও মত প্রকাশের ওপর যে কোন প্রকার হামলা প্রতিরােধের জন্য সকল জনগণতে ঐক্যবদ্ধ হতে আহবান জানায়। প্রচারপত্রে ১৫ জানুয়ারি বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়ােজিত সভায় সবাইকে উপস্থিত হয়ে মিছিলে অংশ গ্রহণের অনুরােধ জানানাে হয়। ডঃ এনামুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেদিনের সভায় বক্তা ছিলেন জয়নুল আবেদীন, আহমেদ শরীফ, সুফিয়া কামাল, সিকান্দার আবু জাফর, কে জি মুস্তফা, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনসুরউদ্দিন প্রমুখ।
________________________________________
ত্রদের ১১ দফা ১১দফার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার আহবান জানিয়ে সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সারা দেশব্যাপী প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রে বলা হয়, স্বৈরাচারী সরকারের ক্রমবর্ধমান একটানা গণবিরােধী নীতির ফলে ছাত্র সমাজ ও দেশবাসী ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। শাসন ও শােষণে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্র-জনতা গণআন্দোলনের পথে যেতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্র সমাজ দেশবাসীর স্বার্থে এগারাে দফার দাবিতে দেশব্যাপী গণআন্দোণের আহবান জানায়।
১. (ক) সল কলেজসমূহকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি ত্যাগ করে জগন্নাথ কলেজ সহ প্রাদেশিকীকরণ কলেজসমূহকে পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে।
(খ) শিক্ষা প্রসারের জন্য দেশের সর্বত্র স্কুল-কলেজ স্থাপন করে বেসরকারি স্কুল-কলেজসমূহকে অনুমােদন করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা প্রসারের জন্য প্রয়ােজনীয় শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। (গ) প্রদেশের কলেজসমূহে নৈশ শিফটে আই এ, আই কম, আই এসসি, বি এ, বি কম, বি এসসি, এবং প্রতিষ্ঠিত কলেজসমূহে এম এ, এম কম চালু করতে হবে। (ঘ) ছাত্রদের বেতন ৫০ টাকা হ্রাস করে স্কলারশিপ ও বৃত্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে। (ঙ) ছাত্রদের হল ডাইনিং খরচা ৫০ ভাগ সরকারকে বহন করতে হবে। (চ) হল হােটেল সমস্যার সমাধান করতে হবে। (হ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু ও অফিস-আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার চালু করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি ও স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার দিতে হবে। (জ) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও কৃষি কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি মেনে নিয়ে কনডেন্স কোর্স চালু করতে হবে। (ঝ) বাস ট্রেন স্টিমারসহ সকল যানবাহনে ছাত্রদের ৫০ ভাগ কনসেশন দিতে হবে। যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও ছাত্রদের ৫০ ভাগ কনসেশন দিতে হবে। (ঞ) অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক নারী শিক্ষার প্রচলন করতে হবে। (ট) মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে অটোমেশন প্রথা বিলােপ, নমিনেশনে ভর্তি বন্ধ, মেডিকেল অর্ডিন্যান্স বাতিল, ডেন্টাল কলেজকে পূর্ণাঙ্গ কলেজে পরিণত করে ছাত্রনার্সদের দাবি মেনে নিতে হবে। (ঠ) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা বিলােপ, শতকরা ১০ ভাগ ও ৫০ ভাগ রুল বাতিল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর ব্যবস্থা ও প্রকৌশল ছাত্রদের শেষ বর্ষের ক্লাস দেবার ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। (ড) পলিটেকনিক ছাত্রদের কনডেন্স কোর্সের সুযােগ দিতে হবে এবং ফাইনাল পরীক্ষা বাতিল করে সেমিষ্টার পদ্ধতিতে ডিপ্লোমা দিতে হবে। (ট) টেক্সটাইল, সিরামিক, লেদার টেকনােলজি ও আর্ট কলেজ ছাত্রদের সকল দাবি মেনে নিতে হবে । আই ই আর ছাত্রদের দশ দফা, সমাজকল্যাণ কলেজ ছাত্রদের এবং এমবিত্র ছাত্রদের ও আইনের ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগকে আলাদা ফ্যাকাল্টি দিতে হবে। (ণ) চাকুরীর নিশ্চয়তা দিতে হবে। (ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ
________________________________________
স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। (খ) হামুদুর রহমান কমিশন রিপাের্ট বাতিল করে ছাত্র সমাজ ও দেশবাসীর স্বার্থে বহুমুখী বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
২. প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হবে।
৩. পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে নিম্নলিখিত দাবিসমূহ মেনে নিতে হবে – (ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে হবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্র সংঘ ও আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। (খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এই কয়টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য বিষয়গুলােতে প্রদেশের ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ। (গ) দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে এবং কেন্দ্র তা নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু শাসনতন্ত্র এ বিষয়ে নির্দিষ্ট বিধান থাকবে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হতে পারে। একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুই অঞ্চলে দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তন করতে হবে। (ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা-কর ধার্য ও আদায়ের সকল ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকার কর্তৃক আদায়কৃত রেভিনিউর নির্ধারিত অংশ সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে জমা হবে। শাসনতন্ত্রও এই মর্মে বিধান থাকবে। (ঙ) আঞ্চলিক সরকারসমূহ বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসেব রক্ষা করবে এবং বহিঃবাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলাের অধীনে থাকবে। ফেডারেল সরকারকে শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারে সেই অর্থ প্রদান করা হবে। দেশে উৎপাদিত পণ্য বিনা শুৰুে উভয় অঞ্চলে আমদানি-রপ্তানি করা যাবে। বৈদেশিক ব্যবসা-বাণিজ্য অঙ্গ রাষ্ট্রগুলাের হাতে থাকবে এবং সে বিষয়ে শাসনতন্ত্রে বিধান থাকবে। (চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর এবং অস্ত্র কারখানা নির্মাণ করতে হবে।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু সহ সকল প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে সাব-ফেডারেশন গঠন করতে হবে।
৫. ব্যাংক, বীমা, পাট, বৃহৎ শিল্প জাতীয়করুণ করতে হবে।
৬. কৃষকের ঋণ মওকুফ করে খাজনা-ট্যাক্স কমাতে হবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করে তহশিলদারদের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে। পাটের বিক্রয়মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে আখের ন্যায্য মূল্য প্রদান করতে হবে।
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও বােনাস দিতে হবে এবং তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকের স্বার্থ বিরােধী কার্যকলাপ বাতিল করে তাদের ধর্মঘটের ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিতে হবে।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলসম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। ৯, জরুরী আইন, নিরাপত্তামূলক আইন সহ সকল নিবর্তনমূলক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
________________________________________
১০, সিয়াটো, সেন্টো, মার্কিন সহ সকল সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট-বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করতে হবে।
১১. দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে সকল গ্রেফতারী পরােয়ানা, হুলিয়া এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। প্রচারপত্রে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের পক্ষে স্বাক্ষর করেন তােফায়েল আহমেদ, আব্দুর রউফ, নাজিম কামরান চৌধুরী, খালেদ মােঃ আলী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, শামসুদ্দোহা, মােস্তফা জামাল হায়দার ও দীপা দত্ত।
হাত্র মিছিলে হামলা | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বদলীয় ছাত্ররা ১৭ জানুয়ারী ১৯৬৯ সালে কলাভবনের বটতলা থেকে সমাবেশ শেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করলে পুলিশ ছাত্রদের উপর ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গরম পানি নিক্ষেপ করে। ছাত্রদের ১১ দফা দাবির ভিত্তিতে ডাকসু ভিপি তােফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্ররা সভাশেষে পূর্বঘােষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে মিছিল বের করে। মিছিল কলাভবন হয়ে প্রক্টর অফিসের গেট দিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে লাইব্রেরির দিকে এগুতে থাকলে রােকেয়া হলের সামনে মােতায়েন পুলিশ বাহিনী রায়ট কারের সাহায্যে অতর্কিতে গরম পানি নিক্ষেপ শুরু হয়। সেই সঙ্গে কাঁদুনে গ্যাস ও বেপরােয়া লাঠিচার্জ শুরু করে। ফলে অসংখ্য ছাত্র আহত ও বহু ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। কোমরে দড়ি বেঁধে এসব ছাত্রকে গাড়িতে তােলা হয়। সংজ্ঞাহীন অনেককে বস্তা তােলার মত ট্রাকে ফেলা হয় ।
ডাকসু নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি ঢাকা ও ১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালনের আহবান জানায়। ছাত্ররা সরকারকে তাদের ১১ দফা মেনে নেবার আহবান জানিয়ে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে বলে। ঘটনার প্রতিবাদে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররাও কালাে পতাকা উত্তােলন ও কালাে ব্যাজ ধারণ করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় এসে আন্দোলনের সাথে সংহতি ঘােষণা করে। অপরদিকে চিকিৎসকরাও স্বায়ত্তশাসিত স্বাস্থ্য সার্ভিসের দাবি জানায়।
ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি পুলিশ কর্তৃক ছাত্র মিছিলে হামলার প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি ছাত্র সমাবেশে পুলিশ পুনায় হামলা চালায়। ফলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ বেধে যায়। পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, গরম পানি প্রভৃতি ব্যবহার করে। মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের সঙ্গে
________________________________________
যােগ দেয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে ইকবাল হল জিন্নাহ হলে ইপিআর বাহিনী শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ছাত্র-জনতা ব্যারিকেড তৈরি করে।
রােকেয়া হলের ভেতরেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং কয়েকজন ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করে। দুপুর ২ টার দিকে একটি জঙ্গী ছাত্র মিছিল জিন্নাহ এভিনিউতে চলে যায়। সেখানে তারা গুলিস্তান কামানের পাশে সমবেত হয়ে জনসভা করে। এখানেও পুলিশ বেধড়ক মারপিট করে অসংখ্য ছাত্রকে গ্রেফতার কলে। অনেককে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানাে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকও পুলিশের হাতে নিগৃহীত হন। ডঃ মফিজউদ্দিন ও ডঃ ইন্নাস আলী সহ অনেক শিক্ষক ছাত্রদের সঙ্গে যােগ
আওয়ামী লীগের বিবৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত ছাত্রসমাবেশে ইপিআর ও পুলিশী হামলার প্রতিবাদে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী প্রবেশ করে যেভাবে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও একজন মওলানাকে মারপিট করেছে তা অত্যন্ত জঘন্য ও বর্বরােচিত।
বিবৃতিতে পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়, মারপিট ও গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে গ্রেফতারকৃতদের ছেড়ে দেবার দাবি জানানাে হয় এবং ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার ও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির ওপর কঠোর হুশিয়ারী জানানাে হয়। | অন্যদিকে ১৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির জরুরী সভায় পুলিশী হামলার বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানানাে হয়। ডঃ মফিজউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদনে গ্যাস নিক্ষেপ ও ছাত্র-ছাত্রীদের নির্বিচারে মারধর ও ইপিআর বর্তৃক বহু ছাত্র গ্রেফতারের নিন্দা জানানাে হয়। ছাত্ররাও পৃথক এক সমাবেশে তাদের ১১ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য নতুন করে শপথ গ্রহণ করে।
আসাদের মৃত্যু উনসত্তরের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতৃস্থানীয় ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি। পুরানাে কলাভবনে ও পােষ্ট গ্রাজুয়েট সম্মুখবর্তী রাস্তায় একটি মিছিলে নেতৃত্ব দেবার সময় পুলিশের একটি চলন্ত জিপ থেকে একজন ইন্সপেক্টর সরাসরি তাকে রিভলভার থেকে গুলি করে হাসপাতালে নেবার পথেই সে মারা যায়।
________________________________________
আসাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্ত্র দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পােষ্ট মর্টেম শেষে হাজার হাজার ছাত্র সন্ধ্যায় লাশ নিয়ে মিছিল বেরুবার চেষ্টা করলে পুলিশের আইজি বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলে ছাত্ররা শহীদ আসাদের লাশ সরিয়ে ফেলে। পুলিশ গভীর রাত পর্যন্ত সমগ্র মেডিকেল এলাকা ঘিরে রাখে।
আসাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শত শত ছাত্র-ছাত্রী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যায়। বিকেল ৩ টায় শােক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন প্রখ্যাত ছাত্রনেতা ও ডাকসু ভিপি তােফায়েল আহমেদ ও ছাত্রনেতা শামসুদ্দোহা। | অপরদিকে আসাদের মর্মান্তিক হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ শােকসভা ও মিছিল বের করেন। শিক্ষকমন্ডলীর সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ডঃ ইন্নাস আলী, ডঃ আবু লতিফ, কামরুদ্দিন হােসেন, এটিএম জহুরুল হক, আব্দুল মান্নান, এ এস এম আব্দুল্লাহ ডঃ আবুল খায়ের। সভাশেষে তারা কালাে ব্যাজ ধারণ করে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করেন। ঐ মিছিলে শত শত ছাত্র ও সাধারণ মানুষও যােগ দেন। তারা ইপিআর বাহিনীর তীব্র নিন্দা জানান। অন্যদিকে এক শােক সমাবেশের মাধ্যমে সরকারকে ১১ দফা মেনে নেবার আহবান জানিয়ে তীব্র আন্দোলনের শপথ গ্রহণ করেন।
২১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ছাত্ররাও ধর্মঘট পালন করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের বিশাল মিছিলে পুলিশ বাহিনী হামলা চালিয়ে অনেককে আহত ও গ্রেফতার করে। পুলিশের হামলা সত্ত্বেও ছাত্ররা জঙ্গী আকার ধারণ করে এগুতে থাকে। পুলিশের বেপরােয়া লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ সভা করে। এছাড়া রাজশাহী, খুলনা সহ দেশের সমস্ত শহরে ছাত্ররা প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল করে।
ছাত্রদের শপথ গ্রহণ এগার দফার ভিত্তিতে সংগ্রামী ছাত্র সমাজ দাবি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার শপথ গ্রহণ করে। ছাত্ররা সংগ্রামী ছাত্র সমাজের রক্তশপথ নামে একটি প্রচারপত্র সারা দেশে বিলি করে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রচারিত ঐ প্রচারপত্রে ছাত্ররা বলে পূর্ব বাংলার জনগণ গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান শুরু করেছে। এতে শাসক গােষ্ঠী ভীত হয়ে ব্যাপক দমননীতি ও হত্যাকান্ড শুরু করেছে। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসক গােষ্ঠী কোনভাবেই জনগণের ন্যায়সঙ্গত অ্যুথানকে ধ্বংস করতে পারবে না। জালেমশাহীকে উচ্ছেদ, গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, সম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদকে ধ্বংস তথা ছাত্র সমাজের ১১ দফা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-জনতার সম্মিলিত এই গণঅত্যুত্থান চলবে। ছাত্ররা নিম্নলিখিত শর্ত মােতাবেক জনগণকে প্রস্তুত থাকার আহবান জানায়।
(১) সকল জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম ও প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের উদ্যোগে সংগ্রাম কমিটি গঠন; (২) আন্দোলনের কর্মপন্থা ঘােষণা,
________________________________________
প্রচারপত্র, পথসভা ও মাইকিং-এর জন্যে এই কমিটি কর্তৃক দায়িত্ব পালন; (৩) জনগণকে সংগঠিত করা; (৪) গ্রামে গ্রামে গণভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত হওয়া; (৫) স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন; (৬) সংগ্রামকে সফল করার জন্য সবাই এগিয়ে আসুন: (৭) শৃংখলা বজায় রাখা ও সরকারি উস্কানির মুখে সতর্ক থাকা; (৮) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকা; (৯) কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নির্দেশ মেনে চলা।
সংগ্রামী ছাত্রসমাজ দেশবসীর নিকট তাৎক্ষণিকভাবে কতিপয় আহবান জানায়-(১) পুলিশ, ইপিআর সহ বিভিন্ন সরকারি বাহিনী কর্তৃক গুলিবর্ষণ, বেয়নেট চার্জ ও লাঠির আঘাতে আহতদের জন্য রক্তদান করা; নিহত ও আহতদের সাহায্যার্থে তােফায়েল আহমেদ, রুম নং ৩১৩, ইকবাল হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’-এই ঠিকানায় যােগাযােগ করা; (২) রিকশা চালক, ক্ষুদে শ্রমিক, দরিদ্র জনগণকে সাহায্য করা। রিকশা মালিকরা যেন চালকদের নিকট থেকে সারা দিনের ভাড়া গ্রহণ না করেন; (৩) দোকানদার ও ব্যবসায়ী ডায়েরা যেন দ্রব্যের অতিরিক্ত মূল্য গ্রহণ না করেন; (৪) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়া এবং সকল প্রকার উস্কানির মুখে সতর্ক থেকে শৃংখলা বজায় রাখা। | দেশব্যাপী আগুনের লেলিহান শিখার মত ছড়িয়ে পড়া ছাত্রসমাজের ঐ প্রচারপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন তােফায়েল আহমেদ, নাজিম কামরান চৌধুরী, আব্দুর রউফ, সাইফউদ্দিন আহমেদ মানিক, মােস্তফা জামাল হায়দার, খালেদ মােহাম্মদ আলী, শামসুদ্দোহা, মাহবুবউল্লাহ প্রমুখ।
ছাত্রদের কৃষ্ণ দিবস পালন সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের ডাকে ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কৃষ্ণ দিবস পালন করা হয়। এদিন ঢাকার সকল দোকানপাট, যানবাহন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালাে পতাকা উত্তোলন করা হয়। যানবাহনে ও দেয়ালে দেয়ালে আইয়ুব বিরােধী পােষ্টার দেখা যায় । ছাত্রলীগ আহুত ধর্মঘটে ছাত্র-ছাত্রীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন থেকে একটি বিশাল মিছিল এদিন শহরের বিভিন্ন পথ প্রদক্ষিণ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে সমবেত হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীর সমাবেশে ছাত্রনেতা ও ডাকসু ভিপি তােফায়েল আহমেদ বলেন, পাকিস্তান সরকারের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকের রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত হয়েছে। ১১ দফা দাবি শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকের শপথে পরিণত হয়েছে। ১১ দফা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। গােলটেবিল বৈঠক প্রত্যাখ্যান করে
________________________________________
তােফায়েল আহমেদ বলেন, কয়েকজন নেতাকে ডেকে বৈঠক করলে চলবে না। তার পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান, মােজাফফর আহমেদ সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দিতে হবে। ইত্তেফাক পুনঃপ্রকাশের অনুমতি, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল হক ও মােহাম্মদ ফরহাদ সহ সকল দেশপ্রেমিক কর্মীদের বিরুদ্ধে জারিকৃত হলিয়া তুলে নিতে হবে। তিনি সমবেত ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে বলেন, পল্টনের সমাবেশ থেকে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ঘােষণা করা হবে। | সমাবেশ শেষে ছাত্রদের বিশাল মিছিল কলাভবন থেকে বের হয়ে নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, আজিমপুর, লালবাগ, উদ্রােড, চকবাজার, ইসলামপুর, সদরঘাট, নবাবপুর, তােপখানা প্রদক্ষিণ করে বিকেলে শহীদ মিনারে সমবেত হয়। এখানে সমবেত ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে নেতারা বলেন, ১১ দফা দাবি না মানা পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কোন বৈঠক জনগণ ও ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সহ সকল রাজনৈতিক মামলা, হুলিয়া ও গ্রেফতারি পরােয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সহ সকল বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করতে হবে। সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে হবে। গুলিতে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এছাড়া সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয় যার মধ্যে গর্ভনর মােননম খানের অপসারণ ও নির্যাতনের নেতৃত্বদানকারী সরকারি কর্মচারীদের শাস্তির বিধান ছিল।
উত্তাল উনসত্তরের কয়েকদিন ২৫ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের আহবানে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র হরতাল পালন, সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র-জনতার সাথে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর সংঘর্ষ বাধে। সরকারি হিসেবে ঢাকায় তিনজন, ময়মনসিংহে দুইজন ও চট্টগ্রামে একজনের প্রাণহানি ঘটে এবং আহত হয় ১৫০ জন। এদিন প্রায় বিশ হাজার লােকের এক মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সমস্ত শহরে শুরু হয় পুলিশ-ইপিআর ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ।
২৬ জানুয়ারি কার্ফ থাকাকালে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত হয়। ঘটনার অবনতি হলে কার মেয়াদ আরাে ২৪ ঘন্টা বাড়ানাে হয়। নারায়ণগঞ্জ সহ ঢাকার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও কার্য জারি করা হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ অসংখ্য বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করে। খুলনায় পুলিশের সঙ্গে জনতার খন্ডযুদ্ধ হয়। সিলেট, বরিশাল, নােয়খালী, রংপুর, বড়া, যশাের সহ বিভিন্ন জেলাতে হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত
২৭ জানুয়ারি ঢাকাসহ তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পুলিশ তিনজনকে গুলি করে হত্যা করে। কার্টু চলে সারাদিন। ময়মনসিংহে জনতা-পুলিশ ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। গ্রেফতার
________________________________________
বরণ করে প্রায় ১০০ জন। এদিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ফিদা হাসান করাচী থেকে ঢাকা আসেন। পুলিশী টহল বৃদ্ধি পায়।
| ২৯ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের ন্যাপ সভাপতি মােজাফফর আহমেদকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা হাইকোর্ট বার সমিতি গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানায় এবং দেশব্যাপী মিছিল-মিটিংয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
৩০ জানুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলী এক সভায় মিলিত হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লংঘনের জন্য সরকারকে অভিযুক্ত করে। সারাদেশে মিছিল মিটিং বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন শহরে কার্টু জারি করা হয়।
৩১ জানুয়ারি কার্য সম্পর্কে ফরিদ আহমেদের রীট নাকচ হয়ে যায়। মাদারীপুরে পুলিশের গুলিতে একজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। ১ ফেব্রুয়ারি দেশরক্ষা আইনে অলী আহাদকে গ্রেফতার করা হয়।
ফরিদপুরের ভেদরগঞ্জে জনতার মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। বগুড়ায় হরতাল পালিত হয়। সরকারের পক্ষে মুসলিম লীগ বিবৃতি প্রদান করে। গােপালগঞ্জের জলির পাড়ে পুলিশের গুলিতে ১ জন ও বাগেরহাটে পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত হয়। | ২ ফেব্রুয়ারি রংপুরে মহিলাদের মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ থেকে সরকারের প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। বিরােধী দলের ব্যাপক প্রতিবাদ সত্ত্বেও পৌর বিল পাস করা হয়।
৪ জানুয়ারি সরকার গর্ভনর পদ পরিবর্তনের কথা স্বীকার করে। দেশব্যাপী সাংবাদিকদের ২৪ ঘন্টা ধর্মঘট পালিত হয়। সরকারের নির্যাতনমূলক কর্মকান্ডকে সমর্থন করে জামাতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ বিবৃতি দান করে।
না
।
গােল টেবিল বৈঠক প্রবল গণআন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খা বাধ্য হয়ে ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বিরােধী নেতাদের গােলটেবিল বৈঠকের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মওলানা ভাসানী বৈঠকের বিরােধিতা করে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য সবার প্রতি আহবান জানান। তিনি ছাত্রদের ১৪ ফেব্রুয়ারি আহূত হরতালের প্রতি সমর্থনের কথা ঘােষণা করেন।
১৯৬৯ সালের ঐ দলীয় সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গণসংগ্রামকে অব্যাহত রাখার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারােপ করে বলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ তাদের স্বার্থরক্ষাকারী আইয়ুবশাহীর ত্ৰিশংকু অবস্থায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই মুহুর্তে যেকোন আপােস হবে জনগণের জন্য আত্মহত্যার শামিল। গণঅভ্যুত্থানকে আরাে তীব্রতর করে গড়ে তুলে পৈশাচিক শক্তিকে খতম করতে হবে। সংগ্রামের পথই একমাত্র মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথ। যে ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত ঢেলে গণসংগ্রামকে তুলে ধরেছে তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
________________________________________
পল্টন ছাত্র সমাবেশ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে এক ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে উপস্থিত লাখ লাখ ছাত্র-জনতা আইয়ুবশাহীর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নতুন শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে নির্যাতনের মাধ্যমে ধ্বংস করা যাবে না।”
সমাবেশে আন্দোলনে শহীদ আসাদ, মতিউর, মিলন সহ সকল বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শােক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১১ দফার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে বলা হয়-শাসক গােষ্ঠীর তীব্র ও নিষ্ঠুর আক্রমণেও দেশবাসী যেকোন মূল্যে গণঅভ্যুত্থানের পতাকা উড্ডীন রেখে আন্দোলনকে এগিয়ে নেবে। যেভাবে স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে এদেশের মানুষ নিষ্পেষিত হচ্ছে তার শেষ না হওয়া, পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। একনায়ক আইয়ুবের অবসান ঘটিয়ে বাংলার মানুষ তাদের প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি শাসন প্রতিষ্ঠা করবেই।
সমাবেশ থেকে সকল রাজবন্দীর মুক্তিদান, জরুরী আইন প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, সকল প্রকার দমন নীতি প্রত্যাহারের দাবি জানানাে হয়। ১৯ দফা পূরণ হওয়া পর্যন্ত ছাত্ররা তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখার দৃঢ়সংকল্প ঘােষণা করে। গােলটেবিল বৈঠক প্রসঙ্গে নেতৃবৃন্দ বলেন, সকল দাবি পূরণ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বিরােধী নেতাদের গােলটেবিল বৈঠকে বসতে দেয়া হবে না। আর সেজনন্য পূর্বশর্ত হচ্ছে-(১) জরুরী আইনে গ্রেফতারকৃত সকল রাজবন্দীর মুক্তি দিতে হবে। (২) শেখ মুজিব, ওয়ালী খান, মনিসিং, তাজউদ্দিন আহমেদ, আবদুল জব্বার সহ সকল নেতাকে মুক্তি দিতে হবে। (৩) নিরাপত্তা আইনে আটক কর্মী নেতৃবৃন্দকেও মুক্তি দিতে হবে। এই আইনে মন্মথ দে ও সন্তোষ ব্যানার্জী দশ বছর আটক রয়েছেন। (৪) দেশরক্ষা আইনে সাজাপ্রাপ্ত মতিয়া চৌধুরী, আব্দুর রাজ্জাক, রাশেদ খান মেনন সহ সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। (৫) আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। (৬) খােকা রায়, সুখেন্দু দস্তিদার, অনিল মুখার্জী, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল হক, জ্ঞান চক্রবর্তী, চৌধুরী হারুনর রশীদ, মােহাম্মদ ফরহাদ, কাজী জাফর, নাসিম আলী, ফয়েজউদ্দিন, আবদুস সাত্তার, সুখেন্দু কানুনগাে সহ নেতৃবৃন্দের ওপর থেকে হুলিয়া ও গ্রেফতারী পরােয়ানা প্রত্যাহার করতে হবে। (৭) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতা, দমনমূলক আইন, সংখ্যালঘু অর্ডিন্যান্স সহ সকল কালাকানুন বাতিল করতে হবে। (৮) সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। (৯) ছাত্র সমাজের ১১ দফা মেনে নিতে হবে এবং শ্রমিক-কৃষকের মজুরি বৃদ্ধিসহ স্বল্পবেতনের চাকুরেদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে।
১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঐ সমাবেশ থেকে বাংলার জনগণের মহান শহীদ দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য আহবান জানানাে হয়। এদিন সরকারি ছুটি ঘােষণার দাবি জানিয়ে
________________________________________
বলা হয়-অন্যথায় জনগণই ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘােষণা করবে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঐদিন অফিস-আদালত, দোকান-পাট, যানবাহন বন্ধ রেখে সকল স্থানে কালাে পতাকা উত্তোলনের কথা বলা হয়।
সমাবেশ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মােননম খানের পদত্যাগ দাবি করে সহিংস ঘটনার জন্য দায়ী সরকারি কর্মকর্তাদের শাস্তির দাবি জানানাে হয়। আইয়ুবনগরের নাম পরিবর্তন করে শেরে বাংলা নগর’ আইয়ুব গেটের নাম ‘আসাদ গেট’, আইয়ুব পার্কের নাম মতিউর পার্ক’ রাখার প্রস্তাব এবং প্রতিবছর ২৪ জানুয়ারি ১১ দফা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বক্তারা বিরােধী দলের এম এন এ, এম পি’দের পদত্যাগ করার জন্য আহবান জানান।
সার্জেন্ট জহুরের মৃত্যু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী গুলিবিদ্ধ সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে ঢাকাস্থ সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। অন্য এক ঘােষণার বলা হয় যে মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট ফজলুল হকের প্রাণরক্ষার জন্য চেষ্টা চালানাে
| অন্যদিকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানী শাসক গােষ্ঠীকে উদ্দেশ করে বলেন যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের দিন শেষ হয়েছে। আগামী ২ মাসের মধ্যে ছাত্রদের ১১ দফা না মানলে জনগণ খাজনা ট্যার বন্ধ করে দেবে এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে সহিংস ও অসহযােগ আন্দোলন শুরু করবে। প্রস্তাবিত গােলটেবিল বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বৈঠক বৃটিশ আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন গােলটেবিল বৈঠকের চেয়েও খারাপ হবে বৃটিশের গােলটেবিলে যেমন উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি ঠিক তেমনি বর্তমানের বৈঠকেও জনতার দাবি আদায় সম্ভব হবে না।
২১ ফেব্রুয়ারি বন্ধ ঘােষণা দেশব্যাপী ব্যাপক গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তান সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘােষণা কর। ১৭ ফেব্রুয়ারি দেশের দৈনিক পত্রিকাসমূহে এই ঘােষণার কথা প্রকাশিত হয়।
‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্বরণে সর্বদলীয় ছাত্র সমাজ ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটি ঘোষণার এই দাবি জানিয়েছিল। ‘৫৪ সালের যুট সরকার ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকারি ছুটি ঘােষণা করেছিল কিন্তু সামরিক শাসন জারির পরের দিন সেই নির্দেশ বাতিল হয়ে যায়।
২১ ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য সম্পর্কে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ মন্তব্য রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ আব্দুল হাই বলেন, মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া জাতীয়
________________________________________
চেতনার বিকাশ সম্ভব নয়। জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার মর্যাদা সম্পর্কে যে চেতনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা ভাষা আন্দোলনের অবদান। বাংলা বিভাগের অন্যতম শিক্ষক যিনি ৫২’র ভাষা আন্দোলনে কারাভােগ করেছেন, তিনি মুনীর চৌধুরী। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক মুনীর চৌধুরী একুশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, সরকারি ছুটি ঘােষণার মধ্য দিয়ে একুশের গুরুত্ব প্রমাণিত হলাে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম শিক্ষক ও চিন্তাবিদ ডঃ আহমদ শরীফ বলেন, একুশের চেতনা আমাদের চেতনা ও প্রেরণার উৎস।
| ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধালা লংঘন করে মিছিল বের করা হয়। ছাত্র-জনতা সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি ঘিরে ফেলে। এই অবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডঃ শামসুজ্জোহা ছাত্রদের ফিরিয়ে নেবার চেষ্টাকালে সেনাবাহিনী গুলি বর্ষণ করে তাকে হত্য; করে। অসংখ্য ছাত্র আহত হয়। গুরুতর আহতদের মধ্যে ছিল প্রফেসর খালেক, ডঃ কসিমুদ্দিন মােল্লা, ডঃ কাজী আব্দুল মান্নান। পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠলে দুপুর ২.৩০ মিনিট থেকে শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। এ অবস্থায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে আতাউর রহমান খান, আসাদুজ্জামান খান প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের নিকট জরুরী তারবার্তা প্রেক্ষণ করেন।
ছাত্র জনতার প্রবল বিস্ফোরণ রাজশাহীতে সংঘটিত ঘটনার জের হিসেবে ঢাকার ছাত্র-জনতা প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমে আসে। সেনাবাহিনীর টহল ও আইন-শৃখলা রক্ষাকারী সংস্থার সকল প্রতিরােধ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় । জলােচ্ছ্বাসের মত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের জন্য প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মিছিলে মিছিলে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটলে কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারি করে। জনমনে এ বিষয়েও সন্দেহ জাগে যে সরকার শেখ মুজিবের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে আন্তরিক নয়। এ ধারণা জনতাকে আরাে ক্ষুব্ধ করে তােলে। তারা সকল বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ মিছিল অব্যাহত রাখে। সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে প্রায় সারারাত্রি মিছিল চলতে থাকে। এক পর্যায়ে সামরিক বাহিনীর আগমন ও গােলাগুলির আওয়াজে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ সূত্র অভিযােগ করে যে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের লাশ ও আহতদের স্থানান্তরিত করতে সেনাবাহিনী এ্যাম্বুলেন্সকে বাধা প্রদান করে। হাসপাতাল সূত্র আরাে জানায় যে হাসপাতালে বহু বুলেটবিদ্ধ লােককে ভর্তি করা হয়েছে এবং আহতদের জন্য এ্যাম্বুলেন্স পাঠানাের জন্য অসংখ্য টেলিফোন আসতে থাকে।
________________________________________
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার “প্রসিডেন্ট আইয়ুব খাঁ দেশব্যাপী গণরােষের ফলে আগরতলা মামলাসহ সকল অর্ডিন্যান্স বাতিল কর দেন। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিলাভ করেছেন তিনি এখন ধানমন্ডির বাসভবনে অবস্থান করছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ প্রকাশিত দৈনিক পাকিস্তানের খবরে আরাে বলা হয় যে ৬৮ সালের ফৌজদারী আইন সংশােধনী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল অর্ডিন্যান্স ৪ ধারা অনুযায়ী ৬৮ সালের ২১ এপ্রিলের বিজ্ঞপ্তি নং এস আর ও ৫৯ (আর) ৬৮ সালে বিশেষ ট্রাইব্যুনলে “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্যের মামলা শুরু হয় এবং ১৯৬১ সালের ২৭ জানুয়ারি শেষ হয়।
বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রদান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ লােকের সমাবেশে ললেন, ছাত্রদের ১১ দফা দাবি সমর্থন করে আমি পুনরায় কারাবরণ করতে রাজি। তিনি আরাে বলেন, তার দল সংখ্যাসাম্য মেনে নেবে না। এই সংখ্যাসাম্যের অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানকে ঠকানো হয়েছে। তিনি জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি লাভের পর ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি তার সম্মানে আয়ােজিত সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ৬৯ সালের ঐ জনসভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক তােফায়েল আহমদ। সভায় আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত অন্যান্য ব্যক্তিগণ উপস্থিত ছিলেন।
শেখ মুজিব বলেন, আমরা কারাে কাছে দেশ বিক্রি করে দেইনি। ৬-দফার সঙ্গে এদেশের জনগণ রয়েছে। ছাত্রদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন । এদেশের মুক্তি ও জনতার দাবি যদি আদায় করতে না পারি তবে পুনরায় কারাগারে যাব কিন্তু আপােস করব না। শেখ মুজিব শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি অবহেলার অভিযােগ করে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের কথা বলেন। তিনি বলেন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পার্লামেন্ট ঠিক করবে বর্তমান শাসনতন্ত্র বাতিল করা হবে না সংশােধন করা হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলােতেও স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কিছু না চাপিয়ে দেবার কথা বলেন।
দেশের অর্থনীতি ও শিল্পনীতির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ সবরকম সুযােগ-সুবিধা ভােগ করছে। চাকুরী, শিক্ষা সকল ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য বিরাজ করছে। সকল কেন্দ্রীয় অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে। সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য সেখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে এ দেশে মূলধন গড়ে উঠছে না। দেশরক্ষা খাতের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, এই খাতের ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের দুই অংশের মানুষের মাধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। আমরা কেবল বৈষম্য দূর করতে চাই।
________________________________________
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে অসহায় মানুষের কথা বিবেচনা করেই ৬-দফা দাবি পেশ করেছিলাম। অথচ আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়া হলাে। আমরা দেশের জনসংখ্যার ৬৫ ভাগ, আমরা কেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। তিনি বলেন, আমরা গুটিকয়েক রাজনীতিক, শিল্পপতি, আমলা ও ব্যবসায়ীর জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করিনি।
তিনি জনগণকে শান্তি-শৃংখলা বজায় রেখে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। পাশাপাশি সরকারকে কোন প্রকার উস্কানিমূলক প্রচারণা থেকে বিরত থাকতে বলেন। তিনি প্রতি মহল্লায় গ্রামে মহকুমায় সংগ্রাম গঠনের জন্য আহবান জানান।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আয়ােজিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক তােফায়েল আহমেদ পরিষদের পক্ষ থেকে এই ঘােষণা দিলে লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশাল জনসমুদ্র বিপুল করতালিতে তা সমর্থন করেন ।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই সভায় শেখ মুজিবকে তাদের ঐতিহাসিক ১১-দফা বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানায়। সংগ্রাম পরিষদ এই সভায় আইয়ুব খানের পদত্যাগ দাবি করে জনগণের হাতে ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে ১১-দফার ভিত্তিতে নতুন শাসনতন্ত্র বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রাম গড়ে তােলার আহবান জানায়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে শেখ মুজিবের প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধা জানানাে হয় ।
নিরাপত্তা আইন, প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, হুলিয়া ও মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে ৪ মার্চ ‘৬৯ সালে প্রদেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের পদত্যাগের জন্যে আহবান জানানাে হয় ।
গােলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিব ১৯৬৯ সনের ১০ মার্চ রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত গােলটেবিল বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, জনগণের দাবীসমূহ আলােচনা করলে তিনটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, রাজনৈতিক অধিকার ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হওয়া। দ্বিতীয়ত, জনগণ অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকার যাদের বেশিরভাগই শ্রমিক, কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী। তারা অব্যাহতভাবে বনিক শ্রেণী দ্বারা শােষিত। তৃতীয়ত, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি চরম বৈষম্য। রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি ছাত্রদের এগার দফার মাধ্যমে বুঝা যায় এবং যা আওয়ামী লীগের ছয় দফার মাধ্যেও প্রস্ফুটিত। এগার দফায় অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এবং দেশের অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের দাবী জানানাে হয়েছে। হয় দফায় দেশের অর্থনৈতিক আমূল পুনর্গঠন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ছয় দফায় ও ১১ দফায় বিভিন্ন আঞ্চলিক দাবীর ভিত্তিতে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথাই বলা হয়েছে।
________________________________________
গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি এই বিষয়গুলাে নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করে কিছু পরিবর্তন ও সংশােধনের কথা বলেছে-(১) যুক্তরাষ্ট্রীয় সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে; (২) সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক তােটাধিকার চালু করতে হবে; (৩) পশ্চিম পাকিস্তানে একটির স্থলে কয়েকটি উপ-ফেডারেশন থাকবে; (৪) বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন থাকবে।
বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ্য করে আরও বলন, আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি প্রধানত বর্তমান সংকট থেকে মুক্তি অর্জনের জন্য এবং একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে যা আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচীতে প্রতিফলিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে একটি মুক্তিযােদ্ধার দল। সেই যােদ্ধাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে চায়। এজন্য তারা যেকোন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। এক ব্যক্তি এক ডােট” এই নীতির উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রীয় আইনসভা গঠনের দাবী উঠেছে যা হয় দফায় প্রতিফলিত । ভােটাধিকার কেবল আঞ্চলিক ভিত্তিতেই হবে না। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলােই যুক্তরাষ্ট্রীয় আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব করবে। বিগত ২১ বছরে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দলগতভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলােকে বলা যায় পূর্ব পাকিস্তান তার আঞ্চলিক দাবীদাওয়ার ব্যাপারে সর্বদা বঞ্চিত হয়েছে। যদিও জনসংখ্যার দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। প্রথম জাতীয় পরিষদে পশ্চিম পাকিস্তানের ২৮ জনের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ৪৪ জন সদস্য থাকা সত্ত্বেও পূর্ব বাকিস্তানের আঞ্চলিক দার্থকে কখনােই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তারা কেবল আইন সভাতেই নয়, সকল ক্ষেত্রেই সাম্যের নীতি গ্রহণ করেছিলাে। কিন্তু জাতীয় পরিষদের বাইরে কোথাও, যেমন-সাধারণ, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সাম্যের প্রতিফলন ঘটেনি। পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রাদেশিক রাজধানী থাকা সত্ত্বেও সকল সদর দফতরই পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। এর ফলে প্রশাসনিক খাতে রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে ২৭০ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধু বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইদের প্রতি জনসংখ্যা ও আইনসভার প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অংশীদারিত্ব মেনে নেয়ার আহবান জানাচ্ছি। সেই সংগে তাদের একথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, তারা যেন পূর্ব পাকিস্তানীদের কেবল দাবীদাওয়া আদায়কারী না ভাবে। আমরা চাই পারস্পরিক বৈরিতা অবসান করে সুসম্পর্ক ও সহাবস্থানে ক্ষেত্রে তৈরি করতে। দেশের বিরাজমান সমস্যাসমূহের নিস্পত্তিকল্পেই হয় দফার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ছয় দফা পাকিস্তানের কোটি কোটি জনগণের অধিকার সমুন্নত করে যে যুক্তরীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করবে তাতে ফেডারেল সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র ও স্বায়ত্তশাসনের কথা স্বীকার করে এগুলে দেশকে অধিকতর শক্তিশালী রায় পরিণত এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করবে। ছাত্রদের এগার। দফাতেও জনগণের অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত বৈষম্য দূরীকরণের কথা বলা হয়েছে।
________________________________________
আমি সংবিধানের সেই ধরনের সংশােধনের পক্ষে যা মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করবে।
| তিনি আরও বলেন, দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য ও অব্যবস্থার জন্য দায়ী অর্থনীতির কেন্দ্রীয়করণ । আমি এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ জানাই এবং সেই ২২ পরিবারের তীব্র বিরােধী যারা কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় অবৈধ পন্থায় দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দেশকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পৌছে দিচ্ছে। পাকিস্তানের দুই অংশের জন্যই এই অবস্থার প্রভাব হুমকিমূলক। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা সবার জানা। প্রানিং কমিশনের এক তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৫১ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বৈষম্যের হার ছিল ৬০ ভাগ। কর্মসংস্থান, শিল্প স্থাপনার সুযােগ, চিকিৎসা সুবিধা ও কল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রেও ব্যাপক বৈষম্য বিদ্যমান। ১৯৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে হাসপাতালের বেড সংখ্যা ছিল ২৬,২০০ পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৬,৯০০। কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা পশ্চিমে ছিলাে ৪৮এবং পূর্বে মাত্র ১৮টি। পশ্চিম পাকিস্তানে বৈদেশিক সাহায্যের ৮০ ভাগ ব্যবহৃত হয়, পূর্ব পাকিস্তানে সেই ক্ষেত্রে মাত্র ২০ ভাগ। পাকিস্তানের সংবিধান এই বৈষম্য নিরসন করতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থনীতি কেন্দ্রীয়করণের মতাে ঝুকিপূর্ণ সমস্যাগুলােকে আমাদের মােকাবেলা করতে হবে। ছয় দফায় ফেডারেল প্রথা এই সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়। তাই আমরা কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মতাে বিষয়গুলাে সমাধানের প্রস্তাব দিচ্ছি।
৬ দফায় বৈদেশিক লেনদেন, বাণিজ্য ও প্রাদেশিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। এগুলাে প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে। আঞ্চলিক সরকারের তুলে ধরা হয়েছে। এগুলাে প্রাদেশিক সরকারের হাতে থাকবে আঞ্চলিক সরকারের অর্থনৈতিক নীতির আওতায় কর আদায় হবে। মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কেও সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এই প্রস্তাবগুলাের প্রধান দিকগুলাে হচ্ছে-(১) এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মুদ্রার স্থানান্তর আঞ্চলিক সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুটি বা সহজে বিনিময়যােগ্য একটি মুদ্রা থাকবে। (২) বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। (৩) দুই প্রদেশে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। ঐ ব্যাংক প্রদেশসমূহের বৈদেশিক মুদ্রার আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখবে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ মুদ্রা কেন্দ্রকে প্রদান করবে। (৪) প্রাদেশিক সরকারের হাতে করারােপ ও কর আদায়ের ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রকে সেখান থেকে রাজস্ব প্রদান করা
পরিশেষে তিনি বলেন, বর্তমান সংকট সমাধানে নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হলে তা গভীর সংকটে নিপতিত হবে। পূর্ণ অর্থনৈতিক সাম্যের মাধ্যমেই কেবল তা থেকে উত্তরণ সম্ভe
________________________________________
আইয়ুবের সার্বভৌমত্ত স্বীকার ও পদত্যাগ দেশব্যাপী প্রবল গণআন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কঠোর হুশিয়ারীর প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলকারী প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খাঁ বিরােধীদলের সাথে রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত গােলটেবিল বৈঠকে প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকার ও পার্লামেন্টারী সাম্য ব্যবস্থা মেনে নেন। কিন্তু প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও এক ইউনিট বিলােপের মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে ১৯৬৯ সালের ১৩ মার্চের ঐ বৈঠক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। | এদিকে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন যে, জনগণের অবশিষ্ট দাবীসমূহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
অন্যদিকে আইয়ুব খাঁ বলেন, তিনি পার্লামেন্টারী সরকার ও শাসনতন্ত্র সংযােজনের উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করবেন। তবে বয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভােটে প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টি বিলের আকারে পেশের পূর্বে বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়ােজন রয়েছে। আইয়ুবের বক্তব্যের মধ্যেই তার স্ববিরােধিতার বিষয়টি স্পষ্ট।
১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী প্রবল গণআন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আইয়ুব খাঁ সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের সংগে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকশেষে ২৪ মার্চ আইয়ুব খা ইয়াহিয়া খানকে লেখা চিঠিতে তার পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে তাকে ক্ষমতা গ্রহণের অনুরােধ জানান। ঐ পত্রে তিনি বলেন, ‘দেশের সকল প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কৰ্তত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমান উদ্বেগজনক মাত্রায় অবস্থার যদি অবনতি ঘটতে। থাকে তাহলে দেশের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেহেতু আমি ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া কোন গত্যন্তর দেখছি না।
অতএব আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে দেশের পূর্ণ ক্ষমতা প্রদানের ইচ্ছা প্রকাশ করছি। কেবল সামরিক বাহিনীই দেশের একমাত্র কর্মক্ষম ও আইনানুগ যন্ত্র।”
এই চিঠি পাওয়ার পর পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইয়াহিয়া খান নরঘাতক প্রেসিন্টে’ হিসেবে ক্ষমতা দখল করেন।
কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের কর্মসূচী কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি জনগণের নিকট তাদের স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচী পেশ করেন। ১৯৬৯ সনের এপ্রিলে প্রকাশিত কমিটির প্রচারপত্রে বলা হয় পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনতা সর্বগ্রাসী সংকটের আগুনে জ্বলছে। তাদের উপর চলছে কঠিন জাতিগত নিপীড়ন। এই অত্যাচার মানুষের ধমনীতে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। পূর্ব বাংলার মানুষ অনাদর, অত্যাচার, দুঃখ ও দারিদ্র থেকে মুক্তি চায়। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ পুঁজির প্রতিভূ স্বৈরাচারী সমরবাদী সরকারের উচ্ছেদের মাধ্যমে “স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। এর জন্য
________________________________________
প্রয়ােজন জোতদার মহাজন শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে সামন্ত শ্রেনীকে উৎখাত করা। মুক্ত এলাকা গঠন করে সেখানে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। তারপর গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে পূর্ববাংলা জনগণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র” গঠন করতে হবে। | রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনাে ও কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে আরাে বলা হয় যে, আসুন চীন ও পশ্চিম বাংলার নকশালবাড়ী আন্দোলন থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে আদর্শের কর্মসূচী বাস্তাবায়ন করি। যে আদর্শের মূল কথাই হলাে “বন্দুকের নলই সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।
কমিউনিষ্ট বিপ্লবীরা তাদের মহান নেতা মাও সেতুঙ-এর আদর্শকে ব্রত হিসেবে গ্রহণের কথা বলেছিলো, কিন্তু সেই মহান মাও” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে লক্ষ লক্ষ বাঙালী হত্যায় পাকিস্তানীদের সহযােগিতার মাধ্যম সারা বিশ্বে স্ববিরােধিতার রাজনীতির নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। পাশাপাশি, বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস তাদের এই নীতি ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয় ।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আহবান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান মােজাফফর আহমদ ১৯৬৯ সালের এপ্রিলে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সার্বজনীন প্রত্যক্ষ ভােটে সার্বভৌম পার্লামেন্ট গঠনের আহবান জানান। তিনি বলেন, এ কারণে অবিলম্বে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়ােজন। কেননা দেশে বর্তমানে কোন গণতান্ত্রিক সরকার ও শাসনতন্ত্র নাই। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র দেশবাসীর নিকট গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। কারণ ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা নাই। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের সমুদয় স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে এবং অগণতান্ত্রিকভাবে সংখ্যাসাম্য নীতি কায়েম করা হয়েছে। ঐ শাসনতন্ত্রকে নির্বাচনের ভিত্তি হিসাবে ধরা যায় না। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে নমনীয় নীতি গ্রহণ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানবাসীকে ধোকা দেওয়া হবে।
মােজাফফর আহমেদ বলেন, জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্রের মূলনীতি স্থির করে গণভােটের মাধ্যমে তা গ্রহণের যে প্রস্তাব করা হয়েছে সে বিষয়েও আমরা একমত নই। কারণ তার ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠান সুদূরপ্রসারী হবে। বরং এই মুহূর্তে বিভিন্ন প্রস্তাব বিবেচনা করে প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে একটি পরিষদ নির্বাচন করা দরকার যা একই সংগে গণপরিষদ ও পার্লামেন্টের দায়িত্ব পালন করবে। অর্থাৎ, দেশশাসন ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শাসনতন্ত্র রচনা উভয় দায়িত্ব পালন করতে পারে।
________________________________________
তিনি আরাে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের দাবী অস্বীকার করে দেশের শাসনতন্ত্র সমস্যার সমাধান কোনভাবেই সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক ১১ দফায় ঐ সকল দাবী জোরালােভাবে উত্থাপিত হয়েছে। জনগণ ১১ দফাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছে-যার প্রমাণ দেশের বর্তমান গণঅভুথান।
ছাত্র সমাজের আবেদন দেশের ক্ষমতা দখলকারী কুখ্যাত সেনাশাসক প্রতিক্রিয়াশীল ইয়াহিয়া চক্রের শিক্ষানীতির নামে অপপ্রচার সম্পর্কে আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী বৃহৎ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তােফায়ের আহমেদ, আব্দুর রব, শামসুদ্দোহা, নুরুল ইসলাম, মােস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুবউল্লা ১৯৬৯ সালের আগষ্টে বলেন, সামরিক সরকার কর্তৃক প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি ছাত্রসমাজ সমর্থন করবে না। সামরিক সরকারের সমর্থক সাম্প্রদায়িক ‘জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘ’ ইয়াহিয়ার শিক্ষানীতি সমর্থন করে দেশের বৃহৎ ছাত্রসমাজের প্রতি লক্ষ্যহীন অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা দেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলােকে ইসলামের স্বৈর শাসনকে একই কায়দায় সমর্থন করেছে। এরা ধর্মের অজুহাত তুলে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা দেশবাসী ও গণতান্ত্রিক মহলের দাবীসমূহ ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র ও নির্বাচন বানচালের চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, ছাত্র সংঘ। প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলগুলাে সামরিক সরকারের সংগে আঁতাত করে পূর্ব পাকিস্তানের দাবী-দাওয়া ও স্বায়ত্তশাসনের বিরােধিতা করছে। পবিত্র মসজিদসমূহকে এরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের আখড়ায় পরিণত করেছে এবং ধর্মপ্রাণ মানুষদের বিপথে চালিত করছে। এরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করারও বিরােধী। ১২ আগষ্ট বাংলা ভাষা বিষয়ে “ডাকসু আয়ােজিত অনুষ্ঠানের এর বিরােধিতা ও গােলযােগ সৃষ্টি করে।
ইসলামী ছাত্রসংঘ শুরু থেকে দেশের স্বার্থবিরােধী সকল ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে এবং সকল সামৰূিক সরকারের লেজুড়ে পরিণত হয়েছে। এযাবৎ প্রগতিশীল ছাত্রসমাজের প্রায় সকল কর্মকান্ডের প্রতি এরা বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং কোন না কোনভাবে গােলমাল বাধানাের চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক ছাত্র-সমাজ বার বারই তাদের সেই অপচেষ্টাকে প্রতিহত করেছে। গণতান্ত্রিক ছাত্র-সমাজ মনে করে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনের প্রতিফলন ঘটেনি, কাজেই এই শিক্ষানীতি ছাত্র-সমাজ গ্রহণ করতে পারে না। এই শিক্ষানীতি বাস্তাবায়িত হলে দেশের শিক্ষাসংকট বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে। গণতান্ত্রিক ছাত্র সমাজ ইসলাম ও সংহতির বিরােধী নয়। তারা কেবল জাতিগত শােষণ ও পীড়ন বন্ধ করতে চায়। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির অর্থ ইসলাম বিরােধিতা নয়। বরং তারা সকল ধর্মের সমান অধিকারভিত্তিক শিক্ষানীতি চায় ।
________________________________________
আওয়ামী লীগের নীতি ও কর্মসূচী আওয়ামী লীগ ১৯৬৯ সালের মার্চে, ৬৬ সালের মার্চে ও ৬৭ সালের আগষ্টে অনুষ্ঠিত তার কাউন্সিল অধিবেশনসমূহে গৃহীত সংশােধনী অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৬৯ সালের নীতি ও কর্মসূচী ঘােষণা করে। ঐ নীতি ও কর্মসূচীর সংক্ষিপ্তসার ছিল নিম্নরূপঃ
স্বাধীন সার্বভৌম পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল সুবিচার ও ন্যায়নীতিভিত্তিক এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা হড়ে তােলা যেখানে জনগণের জীবন হবে সর্বাঙ্গীণ সুন্দর, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল সমাজ গড়ে তােলা যেখানে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় ধনিক শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়ে সমগ্র দেশের জনগণর মধ্যে সমানভাবে বন্টন হবে। আশা করা হয়েছিল প্রতিটি নাগরিক অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও চিকিৎসা পাবে। কর্মের নিশ্চয়তার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছন্দ জীবন গড় তুলবে। তারা চিন্তা ও কথা বলার পূর্ণ স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা, অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতর এবং অন্যান্য সকল মৌলিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা পাবে। পাশাপাশি থাকবে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ন্যায়বিচারের রাষ্ট্রীয় নিশ্চয়তা।
কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশবাসীর সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তারা সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা এ দেশে কার্যকরী করার সুযােগ হয়নি। একদল ক্ষমতালােভী, চক্রান্তকারী ও সংকীর্ণ আমলাগােষ্ঠী ও পুঁজিবাদী শ্রেণী মিলিতভাবে দেশ গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রচলনের প্রচেষ্টা বানচাল করেছে। এই স্বার্থবাদী কুচক্রী মহলের নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত অসংখ্য । তারা সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়ােজন নস্যাৎ করেছে। ক্ষমতালােভীদের চক্রান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে পাহাড়প্রমাণ বৈষম্য গড়ে উঠেছে। দেশের রাজনৈতিক কাঠামাে ধ্বংস প্রায়।
দেশকে এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে রক্ষার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের । প্রকৃত গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই আওয়ামী লীগের জন্ম। কাজেই তার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। ভৌগােলিক ও অন্যান্য কারণে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন একান্তভাবে অপরিহার্য। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে যে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল তাতে প্রমাণ হয়েছে যে, স্বায়ত্তশাসন ছাড়া পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় কোন পথ খােলা নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলােকে সেই অপরিহার্য সত্য অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ মনে করে জনগণের নির্দেশেই সকল ব্যবস্থার উৎস।”
আওয়ামী লীগ জাতীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। তারা মনে করে জনগণই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধিকারী এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা ও কর্তত্ব পরিচালিত হবে। তারা সকল কার্যকলাপের জন্য জনগণের নিকট দায়ী থাকবে। মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রে আইন প্রণয়ন, শাসনকার্য, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও দেশরক্ষার ব্যাপারে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা” ভিত্তিক পূর্ণ
________________________________________
স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ বর্তমান সর্বাধিক প্রয়ােজন। এই বাস্তব ব্যবস্থার মাধ্যমেই কেবল পাকিস্তানের সংহতি, স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি সম্ভব বলে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। রাষ্ট্রের সকল প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের সার্বজনীন ও প্রত্যক্ষ ভােটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী ও মত নির্বিশেষে নারী-পুরুণ সকল নাগরিক ১৮ বছর বয়সে ভােটধিকার লাভ করবে এবং ২১ বছর পূর্ণ হলে যে কোন ভােটার নির্বাচন প্রার্থী হওয়ার অধিকারী হবে। নির্বাচন স্বাধীন ও গােপন ব্যালটের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে। | ধর্ম, বর্ণ, মত, শ্রেণী নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে স্বীকৃত প্রতিটি অধিকার ভােগের অধিকারী হবে। নাগরিকগণ ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু জীবন যাপনের অধিকার ও সুযােগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সকলের মৌলিক প্রয়ােজনীয় খাদ্য, বস্তু বাসস্থান, চিকিৎসা ও ন্যায়সঙ্গত ও সহ উপায়ে জীবিকা অর্জনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আইনের চোখে সকল নাগরিক সমান বলে বিবেচিত হবে। দেশের সকল নাগরিক ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও মর্যাদার অধিকারী। হবে। দ্রুত ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা লাভ করবে।
প্রতিটি নাগরিককে জীবনের সকল ক্ষেত্রে পূর্ণস্বাধীনতা দিতে হবে যাতে সে নিজ প্রতিষ্ঠা বিকাশের পূর্ণ সুযােগ লাভ করে এবং জাতীয় জীবনের সকল পর্যায়ে যােগ্যতা অনুযায়ী অংশ গ্রহণ করতে পারে ও সমাজের বৃহত্তম কল্যাণ সাধন করতে পারে। মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, বই-পুস্তক সংবাদ ও প্রচারপত্র মুদ্রণ ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা, সমবেত হওয়ার ও সংগঠন করার পূর্ণ অধিকার এবং দেশের সর্বত্র অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা থাকতে হবে। উপযুক্ত ও আইনসঙ্গত কারণ ব্যতীত কাউকে গ্রেফতার কিংবা বিনা বিচারে কাউকে আটক রাখা চলবে না। কেবলমাত্র যুদ্ধকালীন সময় ছাড়া কখনও এই সকল অধিকার খর্ব করা যাবে না। জরুরী অবস্থার অজুহাতে কোন নাগরিককে হয়রানি করা যাবে না। আওয়ামী লীগ হিন্দু-মুসলিম বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বৌদ্ধ-খৃষ্টান সমস্ত প্রকার সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিক বিভেদ ও বৈষম্যের সম্পূর্ণ বিরােধী। আওয়ামী লীগ ধর্মবর্ণ, শ্রেণী, মত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাসী যা গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রথম শর্ত।
রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে। শাসনতন্ত্রে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার বিধান থাকবে। বিচার বিভাগের যােগ্যতা, নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার উপযুক্ত ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
আওয়ামী লীগ নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিধি ব্যবস্থায় বিশ্বাসী এবং এই শর্তাবলী প্রতিষ্ঠার জন্য এই সংগঠন সকল প্রকার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে পাকিস্তান হবে একটা ফেডারেশন বা যুক্তরাষ্ট্র। এই ব্যবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। সরকার হবে পার্লামেন্টারী, যাতে পূর্ণ বয়স্ক নাগরিকগণ প্রত্যক্ষ
________________________________________
ভােটের মাধ্যমে আইনসভার প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। আইনসভার আসন সংখ্যা জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে। ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দুইটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। যথা, ফেডারেল ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট বিষয়ে অংগরাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ। সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক অথবা সহজে বিনিময়যােগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা বিশেষ শর্তাধীনে মুদ্রাও অর্থনীতির যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়রূপে গৃহীত হতে পারে। এ ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অধীনে ষ্টেট ব্যাংকের পরিচালনার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। এই আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংকগুলি আঞ্চলিক সরকারের অর্থনৈতিক ব্যাপারে পরামর্শ দান করবে এবং যাতে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অর্থ পাচার না হতে পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। | শাসনকার্য নির্বাহের সুবিধার জন্য এবং নানা প্রকার জটিলতা এড়ানাের জন্য কর ও ও ধার্যের দায়িত্ব অঙ্গরাষ্ট্রগুলির উপর ন্যস্ত থাকা বাঞ্ছনীয় এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারকে ক্ষমতা প্রদানের প্রয়ােজন নাই তবে প্রয়ােজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাষ্ট্রগুলির রাজস্বের একটি অংশ শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়মানুসারে যুক্তরাষ্ট্রীয় তহবিলে জমা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অংগরাষ্ট্রের বহিঃবাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে এবং বহিঃর্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক অর্ধের মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রয়ােজনীয় বৈদেশিক অর্থের চাহিদা সমান হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলি প্রদান করবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈদেশিক নীতির সংগে সঙ্গতি রেখে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্য প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্বীয় স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
| আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। শাসনতন্ত্র কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সামরিক ও বেসামরিক চাকরিতে উভয় অংশের লােকসংখ্যনুপাতে নিযুক্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের কর্তৃত্বাধীন সরকারী, আধাসরকারী, বেসরকারী সংস্থা ও বিভাগসমূহকে এমনভাবে স্থাপন করতে হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের ব্যয়, বিনিয়ােগ নিমিত্ত কার্য এমনভাবে পরিচালিত হবে যাতে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের লােকসংখ্যার অনুপাতে সমান সুযােগ ও সুবিধা লাভ করতে পারে।
আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শােষণহীন, শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মাধ্যমে শােষণ, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্দশার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলে আওয়ামী লীগ মনে করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চুড়ান্ত লক্ষ্য।
যুগ যুগ ধরে শশাষণের ফলে দেশ সামগ্রিকভাবে অনুন্নত রয়েছে। দেশের মান উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক ও কৃষি সম্পদের ব্যবহার দ্বারা সুষমভাবে দেশকে শিল্পায়িত করা
________________________________________
আওয়ামী লীগের লক্ষ্য। শিল্প ও ব্যবসা ক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার স্বীকার করা হবে না। ক্ষুদ্র ও মনােহারি শিল্প প্রতিষ্ঠানমূহের মূলধন সরবরাহ ও অন্য সকল বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করা হবে। ভৌগলিক অবস্থা, ভূমির পরিমাণ ও জনসংখ্যা এবং প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার | প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর শিল্পায়িত করার ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ভারী ও বৃহৎ শিল্প, যেমন-খনিজ, ইস্পাত, সমর, বিদ্যুৎ ও রাসায়নিক শিল্পসমূহ জাতীয়করণ করতে হবে। এবং তা পরিচালনার ভার রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে গঠিত ও পরিচালিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত হবে। | ব্যাংক, বীমা, গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন ও যােগাযোগ প্রভৃতি জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণ করা হবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য প্রভৃতি জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয়করণ করা হবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রের অধীনে পরিচালিত হবে। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মত জনবহুল দেশে কুটির শিল্প প্রসারের প্রয়ােজনীয়তা, উপযােগিতা ও সাফল্য অনস্বীকার্য সহজ অর্থনীতির খাতিরে কুটির শিল্পকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও উ ৎসাহ প্রদান করতে হবে।
কৃষির স্বভাবজাত উপাদান থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক সমাক্ত কঠোর দারিদ্র্যের পেষণে জর্জরিত । এই বেদনাদায়ক অবস্থার জন্য কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত পর্যায়ে আনার জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী করতে হবে । | পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি প্রাকৃতিক সম্পদে পুষ্ট । এই ভূমি বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও ব্যবহার করতে হবে। সমবায় পদ্ধতিতে যৌথ চাষাবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকের জমির পরিমাণ এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যে, সমবায় পদ্ধতিতে চাষাবাদ ছাড়া কৃষির ব্যাপক ও দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের সর্বত্র যৌথ কৃষি খামার গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন ব্যাংকের কৃষিঋণের টাকা কৃষকদের মূলধন সমস্যা সমাধানকড়ে ব্যয় করতে হবে।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি পূর্ব পাকিস্তানে প্রস্তুতের জন্য কারখানা স্থাপন করতে হবে। কৃষকের বীজ, সার, সেচ ও গবাদী পশু সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি উন্নয়নের সর্বাধুনিক পন্থা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি পূর্ব পাকিস্তানে প্রস্তুতের জন্য কারখানা স্থাপন করতে হবে। কৃষকের বীজ, সার, সেচ ও গবাদী পশু সমস্যা সমাধানে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি উন্নয়নের সর্বাধুনিক পন্থা প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করতে হবে। সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীনে পাট ক্রয়-বিক্রয় পরিকল্পনা করতে হবে। এতে সরকারের মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য থাকবে না। পাট ব্যবসার জন্য একটি সুই ও সামগ্রিক পরিকল্পনা থাকবে।
পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা একটি জাতীয় সমস্যা। এই বন্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য ‘গ মিশনের | রিপাের্ট ও উপদেষ্টাদের মতামতের আলােকে একটা সুইও কার্যকরী পরিকল্পনা রচনা
________________________________________
করতে হবে এবং বন্যা সমস্যাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, যাতে সমাধানের ক্ষেত্রে বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় ।
কৃষি কৃষকের মান উন্নয়নের জন্য ভূমি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ও সংস্কার করে কৃষককুলকে মুক্ত করার স্বার্থে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হবে। পরবর্তী পর্যায়ে সকল কৃষকের খাজনা মওকুফ করা হবে। আমলাদের জুলুমবাজি, বিভিন্ন কর, সামন্তবাদী অবস্থা ও ক্লেশপূর্ণ জীবন থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার সুপারিশের ভিত্তিতে শ্রমিকদের সকল প্রকার। সুযােগ-সুবিধা ও অধিকার আইন প্রণয়ন করে সকল শ্রমিকের উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। জীবনযাত্রার সংগে সঙ্গতি রেখে শ্রমিকদের বেতন আশু প্রদান করতে হবে এবং চাকুরীর নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। বিনা ভাড়ায় তাদের বাসস্থানের, চিকিৎসার, তাদের সন্তানদের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযােগ প্রদান করতে হবে। সেই সংগে থাকবে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ ও পূর্ণ বেতনসহ ছুটির ব্যবস্থা ।
শিল্পের মুনাফার একটি অংশ শ্রমিক উপহার হিসেবে সংরক্ষিত রেখে শ্রমিকদের শিল্পের অংশীদার হওয়ার সুযােগ প্রদান করতে হবে। শ্রমিক সংঘ গঠন ও ধর্মঘটের অধিকার স্বীকৃত হবে। কলকারখানা পরিচালনার ব্যাপারে শ্রমিকদের মতামত গ্রহণ করা হবে। বেকার ও বার্ধক্যের জন্য শ্রমিকদের ভাতা প্রদান করতে হবে। বেসরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানেও একইভাবে সুযােগ সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে।
বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য সুষ্ঠু ও ব্যাপক পরিকল্পনা করা হবে। জনশক্তিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের সার্বিক উন্নয়নে নিয়ােগ ও জনশক্তির অপচয় রােধ করা হবে ও জাতীয় অর্থনীতির উপর বেকারত্বের অপসারণ লক্ষ্যে তা গতিশীল রাখার ব্যবস্থা করা
দেশের সকল নাগরিকের শিক্ষার অধিকারকে বাস্তবে রূপদানের জন্য শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক করতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষাকে সহজ করার লক্ষ্যে তাকে প্রসারিত করা হবে যাতে দরিদ্র নাগরিকগণও শিক্ষার সুযােগ পেতে পারে উচ্চশিক্ষা লাভের দিকেও লক্ষ্য রাখা হবে। সময়ের চাহিদা অনুসারে কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানরূপে স্বীকৃতি দিতে হবে। একজন সুপ্রতিষ্ঠিত সর্বজন গ্রাহ্য শিক্ষাবিন চ্যান্সেলার হবেন। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ হস্তক্ষেপে বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে দমনমূলক আইন প্রবর্তিত হয়েছে। তা বাতিল করা হবে। বিভিন্ন স্থানে শিক্ষাদানরত ব্যক্তিদের জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে উচ্চ মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিগণ শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হন।
পাকিস্তানের সব অঞ্চলে মাতৃভাষাকে শিক্ষার সর্বোচ্চ মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলাভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রচলন করতে হবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য সহ জীবন যাপনের সর্বক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে
________________________________________
হবে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার উন্নতি ও বিকাশের জন্য কার্যকরী উ ৎসাহ ও ব্যবস্থা করতে হবে।
বাস্তুহারা ও মােহাজেরদের স্থায়ী পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মােহাজের ও স্থানীয়দের মধ্যে প্রভেদ দূর করে সবাইকে দেশ গঠনে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সকল রাষ্ট্রের জন্য বন্ধুত্ব আওয়ামী লীগ এই আন্তর্জাতিক নীতিতে বিশ্বাস করে। বিশ্বে শান্তি স্থাপনে আওয়ামী লীগ একান্তভাবে কাজ করার জন্য জাতিসংঘ সনদের সমর্থক। আওয়ামী লীগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও একনায়কত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে সকল মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামকে আওয়ামী লীগ সমর্থন করবে।
একটি বৈষম্য রিপাের্ট পাকিস্তানের বৈষম্য সম্পর্কে তদন্তের জন্য ১৯৬৭ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জর্জ উডস নিরপেক্ষ ও মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেন। ১৯৬৮ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী এল, বি, পিয়ারসনকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিটি গঠিত হয় । বিশ্বের অন্যান্য ৭টি দেশ থেকে সাতজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কমিটির সদস্য নিয়ােগ করা হয়। তারা হলেন, যুক্তরাজ্যের এডােয়ার্ড ব্রয়েল, ব্রাজিলের রবার্টো অলিভিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ডগলাস ডিলন, জার্মানির উলফ্রেড গুন, জ্যামাইকার ডর আর্থার, ফ্রান্সের রবার্ট সারজোলিন, জাপানের সবুরাে ওকিতে।
তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান মিঃ পিয়ারসন ৭ জন সদস্য ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৪ জন বিশেষজ্ঞের মতামত গ্রহণ করেন। কমিটির বৈঠক রােম, কোপেনহেগেন, জেনেভা, রাওয়ালপিন্ডি, দিল্লি, সিংগাপুর প্রভৃতি শহরে অনুষ্ঠিত হয় । মাত্র দুই মাসের মধ্যে কমিটির চেয়ারম্যান মিঃ পিয়ারসন আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত রিপাের্ট বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট মিঃ ম্যাকনামারার কাছে পেশ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় তা ঐ রিপাের্টে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় এবং তুমুল আলােড়নের সৃষ্টি হয়। ঐ রিপাের্টই পিয়ারসন কমিটির রিপাের্ট’ নামে সারা বিশ্বে পরিচিত লাভ করে। প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার ও রিপোর্টের অতি সংক্ষিপ্ত অংশ তুলে ধরা হলাে।
পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় এবং উনের হার হ্রাস করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি ই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা কার্যকরীকরণের জন্য বিশেষজ্ঞ নিয়ােগের প্রয়ােজন, অন্যথায় ভবিষ্যৎ পরিণতি হবে অত্যন্ত মারাত্মক।
রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের অংশীদার হওয়া অনেকট’ সান্ত্বনা চের মত । অর্থনীতির সঙ্গে এই বিষয়টি ও পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্যকে আরাে তীব্র করে তুলেছে। কৃষি, শিল্প, অর্থনীতির ক্ষেত্রে এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্যলাভের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে।
________________________________________
দেশটির দুই অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান এই অর্থনৈতিক বৈষম্যই রাজনৈতিক বিরােধ ও অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চেষ্টা সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক কাঠামাের অভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটিতে আধুনিক কারিগরি বিদ্যা প্রয়ােগের যথেষ্ট প্রয়ােজন রয়েছে। সবচেয়ে জরুরী প্রয়ােজন হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক সুসামঞ্জস্যপূর্ণ একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং অর্থ ও বিশেষজ দিয়ে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা। পশ্চিম পাকিস্তানের পরিকল্পনা কার্যকর করার ব্যয় হ্রাস করতে হবে এবং উন্নয়ন হার কমাতে হবে। অন্যথায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি উপেক্ষার ফল বিপজ্জনক হবে। | কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানকে আদো গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি, ফলে পূর্ব পাকিস্তান ঘাটতি এলাকায় পরিণত হয়। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর অধিক গুরুত্ব আরােপের কারণে খাদ্য উদ্ভও এলাকায় পরিণত হয়। ফলে আঞ্চলিক বৈষম্য দিন দিন তীব্র আকার ধারণ করে। দেশের দু অঞ্চলের জন্য এই বিপরীতমুখী নীতির কারণে পূর্বাঞ্চলের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। কাঁচামালের অভাব সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করা হচ্ছে। অন্যদিকে যথেষ্ট কাঁচামাল ও জনশক্তি থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে কোন শিল্পায়নের চেষ্টা করা হয়নি। যে কারণে দুই অংশের বৈষম্য আরাে বৃদ্ধি পেয়েছে। | পিয়ারসন কমিশন তার রিপাের্টে আরাে বলছেঃ ‘৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের ২১ বছর পরেও পূর্ব পাকিস্তানে কোন সবুজ বিপ্লব সংঘটিত হয়নি। কমিশন কৃষি উন্নয়নকেই সবুজ বিপ্লব বলে অভিহিত করেছে। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে সকল প্রকার আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় যার ফলে মাত্র ২০ বছরে ৫০ ভাগ গম উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বৈষম্যমূলক এই কৃষিনীতি দু অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ভেতরকার দূরত্ব আরাে বৃদ্ধি করেছে। | আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কমিশন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে। ১৯৬৭ সালেই কেবল পাকিস্তান ৩০ ভাগ বৈদেশিক সাহায্য লাভ করে। এই আমদানি বাণিজ্যে পূর্ব পাকিস্তান কিভাবে বঞ্চিত হয়েছে, তার হিসাব খোদ সরকারি কাগজপত্রেই রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাপ্য অংশ দিয়ে পশ্চিম পকিস্তানে নতুন যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ কাঁচামাল, ওষুধপত্র প্রভৃতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তােলা হয়েছে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানও গড়ে তােলা হয়।
কমিশন আরাে বলেছে, পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য কাঁচামাল থেকে পাকিস্তান তার ৯০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। অথচ অর্জিত অর্থের ও অন্যান্য ঋণের ২০ ভাগও পূর্ব পাকিস্তান লাভ করেনি। যার হিসাব খােদ সরকারি কাগজপত্রেও গােপন করা সম্ভব হয়নি। কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি এই ক্রমাগত বৈষম্য তার মূলধন গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, অন্যদিকে ক্রমাগত পুঁজি ও সম্পদের এই পাচার ঘটিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাব স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তােলা হয়।
________________________________________
| পিয়ারসন রিপাের্টে আরাে বলা হয় যে সংস্কারের ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে চরমভাবে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারি উচ্চ পর্যায়ের প্রায় ৯৮ ভাগ দখল করে আছে পশ্চিম পাকিস্তান। এমনিভাবে সেনাবাহিনী ও সাধারণ চাকুরীর ক্ষেত্রেও এই অবস্থা বিদ্যমান। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রায় একচেটিয়া বাজার দখল করে আছে পশ্চিমারা। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে কোন পুঁজি গড়ে উঠেনি, যার ফলে অন্তত বেসরকারিভাবে ও কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। | কৃষিক্ষেত্রে বৈষম্য সম্পর্কে কমিশন বলেছে, পূর্ব পাকিস্তানের ভূমি অত্যন্ত উর্বর, যার ফলে সামান্য সরকারি উদ্যোগ লাভ করলেই দেশটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভে সক্ষম হবে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানির জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধিকল্পে সরকার কোটি কোটি টাকা বিনিয়ােগ করছে; উন্নত প্রযুক্তির যাবতীয় ব্যবহার সেখানে ঘটানাে হচ্ছে। যার ফলে উৎপাদনে নাটকীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ১৯৫০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে পানি নিস্কাশ’ ও লবণাক্ততার জন্য সামান্য পরিমাণ ফসল উৎপাদন সম্ভব ছিল না, সেখানে ক্রমাগত সরকারি প্রচেষ্টার ফলে অভাবনীয় পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা দূরে থাকুক, তারা বন্যার কবল থেকে নিজেদের বাঁচাতে সরকারের সামান্য সহযােগিতা থেকেও বঞ্চিত। ২১ বছরের ক্রমাগত বৈষম্য ও অসন্তুষ্টি দেশটিকে এক অনিশ্চিত আগামীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইয়াহিয়া খানের প্রতি ছাত্রসমাজ গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, এক ব্যক্তি এক ভােটের ভিত্তিতে নির্বাচন ও অধিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ইয়াহিয়া ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর বেতার ভাষ দেন। ইয়াহিয়া খানের ঐ ভাষণ সম্পর্কে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের তােফায়েল আহমেদ, শামসুদ্দোহা ও অন্যরা এক বিবৃতিতে বলেন,
গণঅভ্যুত্থান ও ১ দফার আন্দোলন বৃথা যায়নি। গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে সামরিক শাসন গণদাবির নিকট পরাভূত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সুনির্দিষ্ট দাবির প্রেক্ষিতে জনগণের নিকট মাথানত করে নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। এর ফলে সংখ্যাসাম্যের অবসান ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবার পথ সুগম হলো। | ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান শাসনতন্ত্র চালু করার যে চেষ্টা রক্ষণশীল গােষ্ঠী চালিয়ে যাচ্ছিল, এই ঘােষণার মাধ্যমে তা নস্যাৎ হয়েছে। এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বায়ত্তশাসনের পথ মুক্ত হলেও যে স্বায়ত্তশাসনের জন ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের রক্তক্ষয়ী সগ্রাম, ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী করা হয়েছিল এবং ১৯৬৯ সালের ১১ দফা দাবিতে পৃথিবী বিখ্যাত যে গণঅভূত্থান হলাে সেই স্বায়ত্তশাসন জনগণ এখনাে পায়নি। কেবলমাত্র স্বায়ত্তশাসনের ন্যায্যতর ভিত্তি স্বীকৃত হয়েছে।
কিন্তু জনগণের প্রধান দাবি সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হােক এবং মানুষের
________________________________________
মৌলিক দাবি ফিরিয়ে দেয়া হােক। জননেতা মনি সিং সহ সকল দেশপ্রেমিক রাজবন্দী ও বিনাবিচারে আটককৃতদের মুক্তি দেয়া হােক। ছাত্র সমাজ আশা করে নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। জনগণের প্রতিনিধিগণ নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন এবং স্বায়ত্তশাসনসহ শাসনতান্ত্রিক যাবতীয় সমস্যার সমাধান করবেন। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে ছাত্র সমাজের বক্তব্য ঐতিহাসিক ১১ দফাতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে যে বক্তব্য রেখেছেন তা ছাত্রসমাজের নিকট গ্রহণযােগ্য হবে না। এ সম্পর্কে দেশবাসী মনে করে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে শাসনতন্ত্র গ্রহণের গণতান্ত্রিক ভিত্তি পূর্বেই ঘােষণা করতে হবে। তা না হলে ১২০ দিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র রচনা সম্ভব হবে না। শাসনতন্ত্র রচনার পর প্রেসিডেন্টের অনুমােদনের বিষয়টি একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাপার মাত্র বলে পূর্বে ঘােষণা করতে হবে। সকল বিষয়ে শাসনতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ‘কেবল জাতীয় পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। এক ব্যক্তি এক ভােট ও এক ইউনিট বাতিল শাসনতন্ত্রে থাকতে হবে। এছাড়া এক ইউনিট ভেঙ্গে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক চারিটি প্রদেশকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে পূর্ব পাকিস্তানের নাম স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব বাংলা’ হবে। কিন্তু প্রদেশের নামকরণ পূর্ব বাংলা না রেখে বাংলাদেশ” রাখতে হবে, সেই সঙ্গে সিন্ধু, বেলুচিস্তান সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব তাদের স্ব স্ব নামে পরিচিত হবে।
ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের প্রচার পত্র। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাদের পল্টন ময়দানের জনসভায় এক প্রচারপত্রে কতিপয় কর্মসূচী ঘােষণা করে। ঐ কর্মসূচী ঘােষণার অপরাধে রাশেদ খান মেনন ও কাজী জাফর আহমেদকে ৭ বছর ও মােস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুবউল্লাকে ১ বছর কারাদন্ড প্রদান করা হয় । প্রচারপত্রে ঘােষিত কর্মসূচীর মধ্যে ছিল
(১) প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর ভােটে গণপরিষদ প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। প্রয়ােজনে জনগণ তাদের প্রতিনিধি প্রত্যাহার করবে। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজির দালাল ও সমর্থক শ্রেণী ভােটাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। সকল সম্প্রদায়ের মানুষ সমান রাজনৈতিক অধিকার পাবে। জনগণের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সকল মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ধর্মের নামে রাজনৈতিক শােষণ চলবে না।
(২) পূর্ব বাংলার সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী একটি গণবাহিনী থাকবে এবং সমাজের নিম্নস্তরের জনগণকে নিয়ে গণমিলিশিয়া গঠন করা হবে। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করতে হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়ােগ করতে হবে। বিচার বিভাগের মূল ভিত্তি হবে “গণআদালত।
(৩) পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তান আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত সরকারের বিরােধিতা করবে। যেকোন বন্ধুদেশের বশ্যতা স্বীকার করা হবে না। সমাজতান্ত্রিক প্রগতিশীল
________________________________________
দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য স্থাপিত হবে মুনাফার ভিত্তিতে । পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করা হবে।
(৪) ইজারাদারী, মহাজনী সহ সকল প্রকার শােষণ ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটানাে হবে। “কৃষকের হাতে জমি” এই নীতি বাস্তাবায়ন করা হবে। মহাজনদের জমি বাজেয়াপ্ত করে বন্টন করা হবে। টাকা ও পণ্যে আদায়কৃত খাজনা প্রথা বন্ধ করতে হবে। ধান, পাট, চা। প্রভৃতির উপযুক্ত মূল্য প্রদান করতে হবে। কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ দিতে হবে এবং উন্নত চাষাবাদের জন্য প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা। করতে হবে।
(৫) বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং তা জনগণের সম্পত্তি হবে। জনগণের স্বার্থে ২২ পরিবারের পুঁজি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। ব্যাংক, বীমা প্রভৃতি ব্যবসা জাতীয়করণ করতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রায়ত্ত করতে হবে। সকল পরােক্ষ কর বাতিল করা হবে। অসৎ ব্যক্তি ও আমলাদের অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের ব্যবসায় অর্থ প্রদান করতে হবে।
(৬) শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থান করতে হবে। সাম্প্রদায়িক, প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা হবে দশম শ্রৈণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গণসংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে । কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে হবে ।
লেখক কমিটির বক্তব্য ডঃ আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে ১৯৭০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে প্রেস অর্ডিন্যান্স বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সাহিত্যিকদের আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
চলমান রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ছাড়াও কমিটি তার সাংগঠনিক বিষয়ে আলােচনা, করে। কমিটি দেশের সকল কবি-সাহিত্যিকদের সরকারি নির্যাতন বন্ধ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য অনুরােধ করে।
অপরদিকে সরকার মার্চের প্রথম সপ্তাহে ছাত্রনেতা ও শ্রমিক নেতাদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশী ও ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার করে। সিরাজুল হােসেন খান সহ বহু শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৭০ সালের মার্চে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দশজন অভিযুক্ত ব্যক্তি লাহোের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করেন। লেঃ কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন সভাপতি ও আব্দুস সামাদ কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। কমিটি এক ঘােষণায় বলে, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চের লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী একটি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে এই
১৩
________________________________________
কমিটি গঠন করা হয়েছে। সমাজের সর্বন্তরের মানুষের প্রতি তারা তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণার আবেদন জানান। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন-টুয়ার্ড মুজিব, সুলতান উদ্দিন আহমেদ, শামসুল হক, নুর মােহাম্মদ, আব্দুর রাজ্জাক, মােহাম্মদ খুরশীদ।
এদিকে ৩০ মার্চ ইয়াহিয়া খান আইনগত কাঠামাে আদেশ ঘােষণা করেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে সারাদেশে তুমুল ঝড় বয়ে যায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নেতৃবৃন্দের বক্তব্য-বিবৃতি প্রকাশিত হতে থাকে। জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামের মত কয়েকটি দল ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল আইনগত কাঠামাে আদেশ সংশােধনের আহ্বান জানান। তারা বলেন, ইয়াহিয়ার ঘােষিত কাঠামাে গণতান্ত্রিক মূলনীতির পরিপন্থী।
বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভায় ঘােষিত কাঠামাে আদেশ যথাযথভাবে সংশােধনের আহবান জানানাে হয় । লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি বলে, এই বিধান গণতন্ত্রের পরিপন্থী। অধ্যাপক মােজাফফর আহমেদ বলেন, তারা কাঠামাের ২৫ ও ২৭ ধারার তীব্র বিরােধী।
ছাত্রলীগের দাবী দিবস। আইনগত কাঠামাে ঘােষণার প্রতিবাদে এবং ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ছাত্রলীগ ১৯৭০ সালের ৭ এপ্রিল দাবি দিবস পালনের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানায়। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে প্রচারিত বক্তব্যে বলা হয়ঃ ৬ দফা ও ১১ দফার দাবিতে গড়ে ওঠা গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে দেশব্যাপী সামরিক শাসন জারি করা হয়। সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান শুরু থেকে তার কথা ও কর্মে ব্যাপক অসঙ্গতি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ২৮ মার্চের ভাষণ ও ৩০ মার্চ ঘােষিত শাসনতান্ত্রিক আইনগত কাঠামাে ঘােষণায় একথা প্রমাণিত হয়েছে যে বাংলা ও বাঙ্গালীর ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অন্ধকার। ঐ ঘােষণার সবকিছুই বাঙালীদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। ঐ ঘােষণা একনায়ক সুলভ ও বাঙালীর স্বার্থবিরােধী। অতএব ছাত্রলীগ একথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চায় যে, বাংলার সংগ্রামী মানুষ ইয়াহিয়ার ঘােষিত নীতিমালা গ্রহণ করবে না। বাংলার কোটি মানুষের মনে ৬ দফা ও ১১ দফার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে বাঙলার মানুষ ৬ দফা ও ১১ দফা থেকে সামান্য বিচ্যুতিও স্বীকার করবে না। বরং মানুষ আরাে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলে বাংলার স্বার্থের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবে। সার্বভৌম পার্লামেন্ট ও ইয়াহিয়া খানের আইনগত কাঠামাে ঘােষণা প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়নের মূল অংশ অর্থাৎ মতিয়া গ্রুপ ১৯৭০ সালের ১৩ এপ্রিল দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালনের আহবান জানায়। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি শামসুদ্দোহা ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ঐ প্রচারপত্রে বলা হয়ঃ বিগত গণঅভ্যুত্থানের ফলে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের পতন ঘটেছে। তারপর মানুষ আশা
________________________________________
করেছিল যে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত জাতীয় পরিষদ স্বাধীনভাবে একটি শাসনতন্ত্র রচনা করবে। কিন্তু নতুন ক্ষমতা দখলকারী ইয়াহিয়া খান আইনগত কাঠামাে ঘােষণার মাধ্যমে দেশবাসীর আশা-আকাবার বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছে। ঐকাঠামাে আদেশ দ্বারা জাতীয় পরিষদকে একটি তথাকথিত পরিষদে পরিণত ও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে আরাে পাকাপােক্ত করা হয়েছে। ১১ দফা ও ৬ দফার দাবিকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। ঘােষণায় কেবল স্বায়ত্তশাসনকেই প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে তাই নয়, ধর্মের ভিত্তিতে জনগণকে বিভক্ত করার ব্যবস্থা বলবৎ করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে জনগণ কর্তৃক বাতিলকৃত ১৯৬৫ সালের প্রতিক্রিয়াশীল শাসনতন্ত্রের মনীতিগুলােই চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে স্বৈরতান্ত্রিক আইয়ুবী ব্যবস্থাই চালু থাকছে। অন্যদিকে সরকার ছাত্র সমাজের সব দাবি অগ্রাহ্য করে কেবল তার ঝুঁকিই বাড়িয়ে তুলছে। জননেতা মনি সিং, অজয় রায়, হাবিবুর রহমান, দেবেন সিকদার, শহিদুল্লাহ চৌধুরী সহ অসংখ্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার, কারারুদ্ধ ও গ্রেফতারী পরােয়ানার মাধ্যমে নির্যাতন করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্র ইউনিয়ন দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১১ দফার দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাবার আবেদন জানাচ্ছে।
ছাত্র ইউনিয়নের দাবী দিবস। ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলন সফল করার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাব পেশ করে-(১) সার্বভৌম পার্লামেন্টের দাবি, (২) নির্বাচনী কাঠামাে সংশােধন, (৩) শাসনতন্ত্রের মূলনীতি বাতিল, (৪) সামরিক আইন বাতিল, (৫) সামরিক সরকারের শিক্ষানীতি বাতিল, (৬) সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি অন্যতম।
স্বায়ত্ব শাসন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের ৭ জুন বলেন, আসন্ন নির্বাচন হবে স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে গণভােট । ইসলাম হুমকির সম্মুখীন বলে যারা প্রচার করছে তারা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও স্বার্থ হাসিলের জন্যই একথা প্রচার করছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময়ও তারা একথা বলেছে।
১৯৬৬ সালের ৭ জুন নিহতদের স্মরণে আওয়ামী লীগ আয়ােজিত রেস কোর্সের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু আরাে বলেন, আসন্ন নির্বাচন হবে ৬ দফার ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে গণভােট। তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে মীরজাফরদের চিরতরে বিনাশের আহবান জানান।
________________________________________
বঙ্গবন্ধু বলেন, কোন বার্ষিক পরিকল্পনাই কার্যকরী হবে না যদি না তাতে জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের চেষ্টা না থাকে। আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে একটি শােষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নিবেদিত। ৬ দফার কোন বিকল্প আর জনগণের সামনে নেই। এর বাস্তবায়নই কেবল মুক্তির একমাত্র পথ। তিনি ১৯৫৪ সালের আদমজী জুট মিলে দাঙ্গার কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই ধরনের গােলযােগ এখন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। | আওয়ামী লীগ দেশের কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর। সে কারণে ঘােষণাপত্রে কলকারখানার শ্রমিকের অংশীদারিত্ব স্বীকৃত হয়েছে। কৃষকের ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফের কথা বলা হয়েছে। তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত করার জন্য জামাতে ইসলামীকে দায়ী করে ঐ দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি করে বলেন, মওলানা মওদুদীর লােকেরা এদেশে অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
তিনি কাইয়ুম খান, নসরুল্লা খান, মােহাম্মদ আলী, আতাউর রহমান খান এবং ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে নুরুল আমীনের কঠোর সমালােচনা করেন। নূরুল আমীন কর্তৃক ৬ দফার সমালােচনার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ভারতে যখন মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ভারত বিভক্তির বিরােধিতা করে মুসলমানরা তখন গণভােটের মাধ্যমে পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দেয়। তিনি ইয়াহিয়া ঘােষিত আইনগত কাঠামাে আদেশের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে জনগণকে আসন্ন আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
ছাত্রলীগের প্রস্তাব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা ইন্দোনেশিয়ার জনক ডঃ সুকনোর মৃত্যুতে গভীর শােক প্রকাশ করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের ১৯৭০ সালের ২২ ও ২৩ জুলাই আহুত জরুরী সভা শুরু করে। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে দেশ যখন একটা পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে ঠিক তখনই সরকার ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনজোয়ার স্তিমিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাপকহায়ে সামরিক আইনের প্রয়ােগ ঘটিয়ে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে কারাদন্ড দিয়েছে। ছাত্রলীগ মনে করে, দেশের এই মুহুর্তে তারা আর নিরব দর্শক হতে পারে না। তারা যেকোন চক্রান্ত নস্যাৎ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে।
শাহজাহান সিরাজ স্বাক্ষরিত ঐপ্রস্তাবনায় আরাে বলা হয়, ছাত্রলীগ আশা করে সরকার অনতিবিলম্বে সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে ছেড়ে দেবে। হাঁটাইকৃত কর্মচারীদের পুনর্বহাল করবে। সকল নির্যাতনমূলক হয়রানী বন্ধ করবে। ছাত্রদের দাবিসমূহ মেনে নেবে। সভার সাংগঠনিক প্রস্তাবে সকল জেলা, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন শাখাসমূহকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু বলেন, কোন বার্ষিক পরিকল্পনাই কার্যকরী হবে না যদি না তাতে জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের চেষ্টা না থাকে। আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে একটি শােষণমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নিবেদিত। ৬ দফার কোন বিকল্প আর জনগণের সামনে নেই। এর বাস্তবায়নই কেবল মুক্তির একমাত্র পথ। তিনি ১৯৫৪ সালের আদমজী জুট মিলে দাঙ্গার কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই ধরনের গােলযােগ এখন জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার ষড়যন্ত্র চলছে। | আওয়ামী লীগ দেশের কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর। সে কারণে ঘােষণাপত্রে কলকারখানার শ্রমিকের অংশীদারিত্ব স্বীকৃত হয়েছে। কৃষকের ২৫ বিঘা জমির খাজনা মওকুফের কথা বলা হয়েছে। তিনি জনগণকে সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত করার জন্য জামাতে ইসলামীকে দায়ী করে ঐ দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি করে বলেন, মওলানা মওদুদীর লােকেরা এদেশে অপতৎপরতা চালাচ্ছে।
তিনি কাইয়ুম খান, নসরুল্লা খান, মােহাম্মদ আলী, আতাউর রহমান খান এবং ভাষা আন্দোলন প্রশ্নে নুরুল আমীনের কঠোর সমালােচনা করেন। নূরুল আমীন কর্তৃক ৬ দফার সমালােচনার জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ভারতে যখন মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ভারত বিভক্তির বিরােধিতা করে মুসলমানরা তখন গণভােটের মাধ্যমে পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দেয়। তিনি ইয়াহিয়া ঘােষিত আইনগত কাঠামাে আদেশের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে জনগণকে আসন্ন আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
ছাত্রলীগের প্রস্তাব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রবক্তা ইন্দোনেশিয়ার জনক ডঃ সুকনোর মৃত্যুতে গভীর শােক প্রকাশ করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি তাদের ১৯৭০ সালের ২২ ও ২৩ জুলাই আহুত জরুরী সভা শুরু করে। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আসন্ন নির্বাচন উপলক্ষে দেশ যখন একটা পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে ঠিক তখনই সরকার ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতনের মাধ্যমে জনজোয়ার স্তিমিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাপকহায়ে সামরিক আইনের প্রয়ােগ ঘটিয়ে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে কারাদন্ড দিয়েছে। ছাত্রলীগ মনে করে, দেশের এই মুহুর্তে তারা আর নিরব দর্শক হতে পারে না। তারা যেকোন চক্রান্ত নস্যাৎ করে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করবে।
শাহজাহান সিরাজ স্বাক্ষরিত ঐপ্রস্তাবনায় আরাে বলা হয়, ছাত্রলীগ আশা করে সরকার অনতিবিলম্বে সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে ছেড়ে দেবে। হাঁটাইকৃত কর্মচারীদের পুনর্বহাল করবে। সকল নির্যাতনমূলক হয়রানী বন্ধ করবে। ছাত্রদের দাবিসমূহ মেনে নেবে। সভার সাংগঠনিক প্রস্তাবে সকল জেলা, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন শাখাসমূহকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়।
________________________________________
দেশ ও জাতির কল্যাণ, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ একটি শিক্ষানীতি ভবিষ্যৎবংশধরদের জন্য প্রণয়নের স্বার্থেই তা করেছে। তাদের আত্মদান মনে রেখে ছাত্রলীগ সংগ্রাম করে যাবে। | চরম প্রতিক্রিয়াশীল জনগােষ্ঠী, অতিবিপ্লবী, হটকারী বামপন্থী গােষ্ঠী, একশ্রেণীর আমলা এবং গণবিরােধী পশ্চিমা পুঁজিপতি, সামন্ত প্রভু, জোতদার, মহাজন শ্রেণী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। এবারের নির্বাচন ৬ দফা ও ১১ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের গণভােট। ছাত্রলীগ আগামী নির্বাচন ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে ভােট প্রদানের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানাচ্ছে।
ছাত্রলীগ সরকারের প্রতি সকল প্রকার নির্যাতন বন্ধ, গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, নির্বাচনে সরকারি ভূমিকা নিরপেক্ষ রাখা ও সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়।
শিক্ষা সমস্যা সম্পর্কে ছাত্রলীগ আরাে বলে যে, একটি গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতি প্রণয়ন, পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি নামক গ্রন্থ বাতিল, জগন্নাথ কলেজ সহ সকল কলেজকে প্রাদেশিকীকরণ বাতিল করে আরাে সরকারি কলেজ সৃষ্টি করা হােক। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করা হােক। সেই সঙ্গে নৈশ বিভাগ সহ কারিগরি বিভাগ চাল ও ছাত্রদের আবাসিক সমস্যার সমাধান করা হােক, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পথ সুগম করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ণাঙ্গ করা হােক।
অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে ছাত্রলীগ বলে যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, বিরূপ প্রকৃতি প্রভৃতি কারণে দেশের মানুষ তথা কৃষককুল মুত্যুর মুখোমুখি। এই অবস্থা থেকে তাদের রক্ষাকয়ে দ্রুত সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়ােজন। ছাত্রলীগ মন করে এসব সমস্যার সমাধানকড়ে দেশীয় ও বৈদেশিক সাহায্যের সমবন্টন ও কমিটি গঠন করে ক্রুগ মিশন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা দরকার। উপদ্রুত এলাকায় মেডিকেল স্কোয়াড ও পর্যাপ্ত রিলিফ প্রেরণ, মুনাফাখাের ও কালােবাজারীদের প্রতিহত করা প্রয়ােজন। দুর্ভিক্ষাবস্থা ঘােষণা করে রেশনিং, লঙ্গরখানা, বিনামূল্যে বত্র, খাদ্য ও খাজনা-ট্যাক্স মওকুফ করা অপরিহার্য। সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রােধে কঠোর ব্যবস্থা ও কৃষকদের ৫ দফা দাবি মেনে নেয়া দরকার।
অন্যদিকে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন’ ২ অক্টোবর ১৯৭০ সালে এক সমাবেশে মেহনতী জনতার স্বার্থ একাত্ব হবার জন্য সবার প্রতি আহবান জানিয়ে বলে, শ্রেণীসংঘর্ষের সগ্রাম বিপ্লবী প্রক্রিয়া জনযুদ্ধের মহান পথে শশাষক শ্রেণীর বলপূর্বক উচ্ছেদই মুক্তির একমাত্র পথ।
বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী ভাষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের ১৭ অক্টোবর ঢাকার এক সমাবেশে বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে যদি বাঙালীদের দাবি আদায় না হয় তাহলে জনগণ আবার আন্দোলনে যাবে।
________________________________________
প্রােগ্রাম নেয়া হবে। মেডিকেল, প্রকৌশল ও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানাে হবে। আঞ্চলিক ভাষাগুলাের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। শহরে মানবেতরভাবে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের লােকদের জন্য গ্রাধিকারভিত্তিক গৃহসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জরুরীভিত্তিতে প্রতি ইউনিয়নে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং প্রতি থানায় একটি করে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে।
শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার ও তাদের জীবন ধারণের জন্য উপযুক্ত বেতন দেয়া হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু সবার সমান অধিকার থাকবে। তিনি ৬ দফার বিরােধিতাকারীদের উদ্দেশে বলেন, মানুষে মানুষে সমান অধিকার ইসলামের মহান আদর্শ। আওয়ামী লীগের কোন নীতিই ইসলাম বিরােধী নয়। তারা স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতিতে বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ সিয়াটো-সেন্টোর মত সামরিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চায় এবং পৃথিবীর সকল অংশে উপনিবেশবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত জনতাকে সমর্থন করে। | “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, শত্রুতা নয়” এই নীতির আলােকে প্রতিবেশীসহ সকল দেশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে; এজন্য সীমান্তবর্তী সমস্যাগুলােকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। জাতিসংঘ প্রস্তাবের আলােকে কাশ্মীর ও ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করা হবে। তিনি সকল রাজনৈতিক নেতার মুক্তি দাবি করে সমস্ত নিবর্তনমূলক অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানান।
ভাসানীর নির্বাচনী ভাষণ ১৯৭০ সালের ৫ নভেম্বর এক নির্বাচনী ভাষণে মওলানা ভাসানী বলেন, আসন্ন নির্বাচন একটি সংবিধান রচনার সুযােগ তৈরি করেছে। ইয়াহিয়া খানের প্রতি তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যদি ঐক্য তৈরি করতে হয় তাহলে রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন, ছাত্র নেতাদের নিয়ে অচিরেই একটি কনভেনশন আহবান করা দরকার, যাতে সবার মতামতের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরি হতে পারে। সংবিধানের শূন্যতা পাকিস্তানকে একটি অপরাধের রাজ্যে পরিণত করেছে।
ভাসানী বলেন, পাকিস্তানের সূচনাই সততার সঙ্গে হয়নি। এদেশের জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযােগ কমই পেয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার সর্বদা বিঘ্ন সৃষ্টি করে চলছে। এদেশে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের আসন বরাদ্দ রাখা দরকার। তিনি সাংবিধানিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার প্রস্তাব করে বলেন, নিম্নবিত্তদের স্বার্থে শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। জায়গিরদারী প্রথা বিলােপের পক্ষে মত পােষণ করে ভাসানী বলেন, দেশে যদি কোন সংবিধান না থাকে তাহলে কোন সরকারই স্থায়ী হবে না । যে কারণে বারুবার সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ২৩ বছরেও পাকিস্তানের ৯৫ ভাগ মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। নেতৃবৃন্দ কেবল ভােটের সময়ই তাদের পক্ষে যায়। সরকার
________________________________________
যতদিন পুঁজিপতিদের দ্বারা চালিত হবে ততদিন দেশের ও জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না। বহিঃশক্তি সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, যেকোন উপায়ে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে আমরা কাজ করে যাৰ এবং পাকিস্তানের বিভ্রিতা সর্বশক্তি দিয়ে মােকাবেলা করা হবে।
রেহমান সােবহানের বক্তব্যে আন্তঃপ্রাদেশিক বৈষম্যের উপর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ডঃ রেহমান সােবহান ১৯৭০ সালে একটি রিপাের্ট প্রদান করেন। ঐ রিপাের্টে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজস্ব আয় কম একথা অযৌক্তিক। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ১৯৬৫-৬৬ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত রাজস্ব ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়-পূর্ব পাকিস্তানের ৪৮৪,৯ কোটি রূপী, সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ১৬৫৯.৫ কোটি রূপী। উন্নয়ন খাতে পূর্ব পাকিস্তানে ১১০৭.৬ কোটি রূপী। রাজধ ও উন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ পূর্ব পাকিস্তানে যেখানে ১৩৬৬ কোটি রূপী সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ২৭৬৮ কোটি রূপী। ১৯৬৪-৬৫ থেকে ১৯৬৮-৬৯ পর্যন্ত সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানে মূল্য বেড়েছে ১৬ ভাগ, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানে তা বেড়েছে ৩০ ভাগ। | পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পণ্য ক্রয় করতে গেলে পূর্ব পাকিস্তানকে অতিরিক্ত আবগারি কর দিতে হয় যা পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৬৮-৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের আবগারী করের ২০ ভাগ অর্জিত হয় বখাত থেকে যার সম্পূর্ণটাই আমদানি হয় পূর্ব পাকিস্তানে। অফিস-আদালত শিল্প-কারখানা সেখানেই গড়ে উঠছে, ফলে রাষ্ট্রের একটি অংশ ক্রমেই সমৃদ্ধিশালী হচ্ছে এবং অপরটি ক্রমেই নিমজ্জমান। ঐ রিপাের্টে আশা করা হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষিত সম্প্রদায় এই বৈষম্য বুঝতে পারবে এবং রাষ্ট্রের দুই অংশের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে।
ডঃ মােজাফফর চৌধুরী বক্তব্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী ১৯৭০ সালের নভেম্বরে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, দেশের সব রাজনৈতিক দলই প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চায় যদিও তাদের দাবি বাস্তবায়নের ধরনও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। প্রাদেশিক স্বায়ত্ত শাসন হলাে একটি সাধারণ পরিভাষা যার দ্বারা একটি নিজের ব্যাপারে কর্তৃত্ব প্রয়ােগের অধিকারী। এর গুরুত্ব হলাে ক্ষমতা প্রাদেশিক ও ফেডারেল সরকারের মধ্যে বিভক্ত হবে। উভয় সরকারই স্বীয় বিষয়ে ক্ষমতাধর। এই ক্ষমতা সংবিধানে স্বীকৃত থাকতে হবে। কেউ কারাে বিষয়ে নাক গলাতে পারবে না। ডঃ চৌধুরী ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আলােকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে
________________________________________
আলােচনা করার দাবি করেন। ১৯৪৭ সালের ভারতীয় সংবিধান আইনে এর স্বীকৃতি রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনাসমূহের জন্য বাের্ড ছিল কিন্তু ১৯৬২ সালে তা পরিবর্তন করে কেন্দ্রের হাতে সমর্পণ করা হয়। এই সংবিধান কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগের হাতে যে সমস্ত ক্ষমতা প্রদান করে তা হলাে-(১) অর্থনীতি, (২) পরিকল্পনা, (৩) নিরাপত্তা, ৪) ব্যাপক ক্ষমতা। এর ফলে সমস্ত জরুরী। বিষয়, যেমন-প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, বৈদেশিক বাণিজ্য, প্রাদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশিক লেনদেন, ঋণ, সাহায্য, মুদ্রা, রাজস্বের বড় বড় উৎস, পাকিস্তান সার্ভিস উৎস প্রভৃতি। এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে সকল ক্ষমতা ন্যস্ত হয় ।
যে কারণে ক্রমবর্ধমান হারে অর্থনৈতিক বিনিয়ােগ, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার, রাজত্ব, উন্নয়ন, বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়ােগ, পরিবহন, যােগাযােগ, সামাজিক মান, সঞ্চয়, প্রতিরক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দুই পাকিস্তানে বৈষম্য অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকে। কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির কারণে এমন ঘটেছে। যার ছোঁয়া লেগেছে অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থায়। সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক ভারসাম্যহীনতার। পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদের পাহাড় জমে উঠেছে আর পূর্ব পাকিস্তান ক্রমেই নিমজ্জিত হয়েছে। | ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রপ্তানি হয় ২২৩৯.৫ কোটি রূপী এবং একই সময়ে আমদানি হয় ১৬৩০.৮৯ কোটি রূপী। উতৃত্ত ছিল ৬০৮,৭ কোটি রূপী। একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে রপ্তানি হয় ১৭৫৯.৭ কোটি রূপী এবং আমদানি হয় ৩১১০.৫ কোটি রূপী। অর্থাৎ, ঘাটতির পরিমাণ হলাে ২০৩৯.৮ কোটি রূপী। এতে দেখা যায় বৈদেশিক লেনদেন পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূলে ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান তার অনুকূল বাণিজ্যকে উন্নয়ন কাজে লাগাতে পারেনি। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পণ্য বিনিময় বাণিজ্য থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান তা পারত না। ফলে সেই শূন্যতা পূরণ করতে হত নগদ মুদ্রায়। যে কারণে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ত। পূর্ব পাকিস্তানে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প বিকাশে ব্যয় হতাে। এছাড়াও পূর্ব পাকিস্তান তার অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিরাট অংশ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি করেছে। পূর্ব পাকিস্তান যদি তার বৈদেশিক মুদ্রা কাজে লাগাতে পারত তাহলে তার অবস্থার পরিবর্তন হতাে, কিন্তু তার কোন ব্যবস্থা না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে সমর্পিত হতে হয়।
সত্তরের মহাপ্লাবন ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রলয়ংকরী প্রাকৃতিক বিপর্যয় সংগঠিত হয়। সেদিনের ঝড়-জলােচ্ছ্বাসে প্রায় ৫ লাখ মানুষ
________________________________________
মৃত্যুবরণ করে। সমুদ্রের তােড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় হাতিয়া, সন্দীপ, রামগতিসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, জাতীয় জীবনের সেই মহাদুর্দিনে তৎকালীন ক্ষমতা দখলকারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কিংবা তার কোন মন্ত্রী উপকূল অঞ্চল পরিদর্শনে যাননি এবং কোন প্রকার সাহায্য প্রদান করেননি। সেদিনের সেই দুঃসময়ে মানবিক সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে ভারত, রাশিয়া, বৃটেন সহ বহু দেশ। ভারত ও বৃটেনের পার্লামেন্ট জরুরী অধিবেশন বসে বাংলাদেশের মানবিক সাহায্যকয়ে।
আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিষ্ট পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ত্রাণকার্য পরিচালনা করে উপদ্রুত এলাকায়। ২৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু এক সাংবাদিক সম্মেলনে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সরকারের ভূমিকার কঠোর সমালােচনা করেন। এ সময়ে তিনি কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যে কোন ষড়যন্ত্র হলে জনগণ আন্দোলনে যাবে ।
বঙ্গবন্ধুর সাংবাদিক সম্মেলনের পর ইয়াহিয়া খান এক ঘােষণায় নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং বলেন, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। কিন্তু পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠভাবে জনগণের ৯৮ ভাগ ভােট পেয়ে জয়লাভ করলেও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি। যার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে শুরু হয় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ।
আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত হলাে আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের আদর্শের প্রতীক হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবুর রহমান। পাশাপাশি বাংলাদেশের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান এদেশের মানুষের মনে।
বঙ্গবন্ধুর আবেদন আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের ১ ডিসেম্বর দেশব্যাপী এক প্রচারপত্র বিলি করে। ঐ প্রচারপত্রে বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও মানবতার প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন হচ্ছে দেশ ও মানুষের তীব্র সংকট ও দুর্নীতি থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তির সুযােগ । ২৩ বছরের দীর্ঘ সংগ্রাম, শত শত মানুষের আত্মদানের পর বাংলাদেশের জনগণের সামনে এই সুযােগ এসেছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিরা একটি প্রকৃত শাসনতন্ত্র প্রণয়নের মূল দায়িত্ব লাভ করবে।
বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি এবারের সুযােগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা চিরতরে দাসত্ব শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে। সম্পদ লুণ্ঠনকারী এবং একনায়কত্ববাদের প্রতিনিধিরা জেঁকে বসবে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কাজেই বাংলার মুক্তিসনদ ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতে কৃষক শ্রমিক সর্বহারা শ্রেণীর স্বার্থে এবার সকলে বুয়ে ভােট দেবেন।
________________________________________
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক ব্যক্তি এক ভােট’ আদায় করেছে। এর মাধ্যমে যদি তারা ক্ষমতায় যেতে পারে তাহলে ২৩ বছরের জেঁকে বসার অবসান ঘটবে। অবসান হবে বাংলাদেশের নির্যাতিত নিপীড়িত ভাগ্যাহত দুঃখী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। এদেশের একশ্রেণীর রাজনীতিবিদ বাঙালী বিদ্বেষীদের তল্পীবাহকের ভূমিকা পালন করছে। এই মূহুর্তে ভাগ্য বিপর্যস্ত মানুষের জন্য একমাত্র আওয়ামী লীগকেই কথা বলতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ক্ষমতা লাভের চেয়ে জনতার দাবি আদায়ের সংগ্রাম অনেক বড়। কাজেই “আমি ক্ষমতা চাই না, জনগণের অধিকার চাই”। সেই অধিকার পেতে গেলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মাধ্যমে জনগণকে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৭ দিনের যুদ্ধে বাঙালীদের পাশে কেউ ছিল না। এদেশের কোটি কোটি মানুষ এক অসহায় অবস্থার মধ্যে কাটিয়েছে। সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের যােগাযােগ বিজ্ঞি হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিমা শাসকরা সেদিন এদেশের মানুষকে কীটপতঙ্গের মতই মনে করেছিল। তারপর ১৯৬৬ সালে এদেশের গণমানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনের দাবি হিসেবে ৬ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। যার মূল দাবি ছিল বৈষম্যের অবসানকয়ে বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসন।
বঙ্গবন্ধু বলেন, তারপর আমাকে বহু অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। বাংলার কোটি কোটি মানুষ আমার সঙ্গে ছিল। মনু মিয়া, আসাদ, মতিয়ুর, জহুর, জোহা, আনােয়ার সহ বহু জীবন সংগ্রাম করতে গিয়ে অকালে ঝরে গেছে। সে কথা আমি ভুলে যাইনি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যদি আমার মৃত্যুদণ্ডও হয় তাহলেও আমি বাংলার মানুষ আর শহীদদের সাথে বেঈমানী করব না। জীবনে যদি কখনাে প্রয়ােজন হয় তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের ভালােবাসার ঋণ আমি শােধ করে যাব । “জয় বাংলা” ধ্বনি দিয়ে বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্য শেষ করেন।
নির্বাচনী ফলাফল ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল ছিল নিম্নরূপ। নির্বাচনে স্বতন্ত্রসহ মােট ১৭টি রাজনৈতিক দল অংশ গ্রহণ করে। প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের তিনটি গ্রুপ ও পিপলস পার্টি সহ মােট ১২টি দল কোন আসন লাভে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে পাঁচটি মুসলিম মৌলবাদী দলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। অন্য দুটি মুসলিম মৌলবাদী দল জামাতে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম ১টি করে এবং ওয়ালী খানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি আসন পায় । এছাড়া স্বতন্ত্র সদস্যরা ৭টি ও ডেমােক্রেটিক পার্টি ২টি আসনে জয়ী হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসন লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের মােট আসন ছিল ৩০০টি। ৩০০টি আসনের বাইরে ১০টি নির্ধারিত মহিলা আসন ছিল যা আওয়ামী লীগ লাভ করে। ফলে আওয়ামী লীগের মােট আসন সংখ্যা পাড়ায় ২৯৮টিতে।
________________________________________
জাতীয় পরিষদের আসন সংখ্যা ছিল ৩০০টি। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬০টি আসন। এছাড়া আওয়ামী লীগ নির্ধারিত মহিলা আসনের ৭টি লাভ করে। পিপলস পার্টি ৮৩টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করে। ২০০ আসনে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জামাতে ইসলামী পায় মাত্র ৪টি আসন। এছাড়া স্বতন্ত্র সদস্যরা ১৪টি আসন নিয়ে তৃতীয় স্থানে থাকে। নির্বাচনে মুসলিম লীগ সহ অন্যান্য মৌলবাদী দলগুলাের মারাত্বক ভরাডুবি ঘটে।
দেশব্যাপী নির্বাচনের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বদলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ক্রমেই ঘনীভূত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরে পশ্চিমা শাসকচক্র নানারকম ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে। নির্বাচনে মারাত্মক ভরাডুবি ইয়াহিয়া খানকে দিশেহারা করে তােলে। এসময় হাতিয়ার’ পত্রিকা তার ১৯৭০ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যায় লেখে যে, জনগণের সুস্পষ্ট রায় সত্ত্বেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট প্রকত শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবার সম্ভাবনা নেই। রাষ্ট্রযন্ত্রটি মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি, আমলা, সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরাই তাদের মুঠোয় রাখতে চায়। নিপীড়ন ও শশাষণের মাধ্যমেই তারা দেশটিকে ব্যবহার করতে চায়। পুঁজিবাদের কেনা গােলাম সেনাশাসক ইয়াহিয়া চায় ঘুণে ধরা রাষ্ট্রযন্ত্রটি অক্ষুন্ন থাকুক। বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রটি বহাল রাখার স্বার্থে তারা ১৯৫২ সালে এবং ১৯৬২ সালে দুটি অবৈধ শাসনযন্ত্র চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু জনগণ তাদের সেই অপচেষ্টা গণঅত্যুত্থানের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিয়েছে। জনগণের এবারের চেতনা গণঅভূত্থানের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। কাজেই তারা শাসক শ্রেণীর যে কোন ষড়যন্ত্র মােকাবেলায় প্রস্তুত। ৬ দফা ও ১১ দফা ভিত্তিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কাঠামাে তারা প্রতিষ্ঠা করবেই।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান ভুটো যিনি আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধক, বাঙালী হত্যাযজ্ঞের অন্যতম প্রধান ভূমিকা পারনকারী এবং নষ্ট ও নিকৃষ্টতম রাজনীতিকদের একজন যিনি ২০ ডিসেম্বর ঘােষণা করেন যে পিপলস পার্টি জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলের আসনে বসবে না। তার সেই ছেলেমানুষী ও বালসুলভ আবদার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়।
রাজনৈতিক সুযােগসন্ধানী ও ক্ষমতালােভী ভুট্টোর মন্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, জনগণ ভােট দিয়েছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংবিধান ও সরকার গঠনের জন্য; আর আওয়ামী লীগ জনগণেরই সেই ম্যান্ডেট লাভ করেছে । ভুঠোর উক্তি শাসক গােষ্ঠীর উক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আওয়ামী লীগ জনগণের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে যে কোন হুমকি মােকাবেলায় প্রস্তুত এবং জনগণের ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটাতে দায়িত্বশীল ও সতর্ক।
একটি পুস্তিকার বর্ণনা ১৯৭০ সালের প্রবল আন্দোলনের সময় বিভিন্ন দল ও গােষ্ঠী স্বনামে ও বেনামে নানা প্রকার প্রচারপত্র ও পুস্তিকা প্রকাশ করে। এমনি একটি পুস্তিকর বর্ণনা থেকে জানা যায় ।
________________________________________
১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব-পশ্চিম দুটি পৃথক রাষ্ট্র না হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের ওপর খড়গ নেমে আসে। পশ্চিমা শাসক শ্রেণী পূর্ব পাকিস্তানীদের ওপর একচেটিয়া শাসন-শােষণ ও নিপীড়ন চালাতে থাকে। পাশাপাশি ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদী মুসলমান শাসকরা এখানকার মানুষের প্রতি উৎপীড়ন শুরু করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার জেরার সময়ে প্রকাশ পায় যে পাকিস্তানী সামরিক, বাহিনীতে বাঙালী সৈন্যের অনুপাত শতকরা মাত্র ৪ ভাগ। সামরিক অফিসার হলেন মাত্র শতকরা দেড়জন। ১৯৬৮ পর্যন্ত সময়ে ২০ জন সচিবের মধ্যে একজনও বাঙালী ছিলেন না। পরিকল্পনা কমিশনে কোন বাঙালী নিয়ােগ পায়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের বেসামরিক চাকরিতে গড় বাঙালীর পরিমাণ হলাে শতকরা ৯ জন। | ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে বাঙালীরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যােদ্ধা। কিন্তু তার পরেও সেনাবাহিনীতে যে লােক নিয়োেগ শুরু হয়েছে সেক্ষেত্রে বাঙালীরা শতকরা মাত্র ২ জন ভর্তির সুযােগ পেয়েছে। সরকার চাকরি খাতে প্রতিবছর যেমন বেতন প্রদান করে তার ৯০ শতাংশ যায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের পকেটে। এই বৈষম্যের প্রশ্ন তুললেই শাসক শ্রেণী সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার, দেশরক্ষা আইন ও নিরাপত্তা আইনের খড়গ ঝুলিয়ে দেয়। আগরতলা ষড়যন্ত্রের মত মিথ্যা মামলা সাজাতেও দ্বিধা করে না।
পশ্চিম শাসক শ্রেণী ২৩ বছরে পূর্ব পাকিস্তানকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিকে সুজলা-সুফলা করে তুলেছে। পক্ষান্তরে শ্যামসুন্দর পূর্ব বাংলা হয়েছে শশানে পরিণত । বিলাসবহুলভাবে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তােলা হচ্ছে পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানকে দাবার গুটিতে পরিণত করা হয়েছে। এদেশে পশ্চিমা শাসকদের একশ্রেণীর তল্পীবাহক মনে করেন ইসলামাবাদ ও মক্কায়ই কেবল ইসলাম সীমাবদ্ধ। মুর্থরা ইসলামের দোহাই দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে আটকে রাখতে চায়। পূর্ব পাকিস্তানের একশ্রেণীর কথিত নেতা পশ্চিমাদের প্রভু বলে মেনে নিয়েছে। ইয়াহিয়া খানের পদলেহন ও পশ্চিমাদের তল্পীবাহনই তাদের কর্ম।
তথাকথিত সেইসব রাজনীতিকের ওপর নির্ভর করলে হাজার বছরেও বাংলাদেশের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে না । শত শত শাসনতন্ত্র পাস করলেও বৈষম্যের সমাধান হবে না। ঐসব নেতারা পশ্চিমাদের কেনা গােলাম। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার একমাত্র পথ হলাে, ৬ দফায় বর্ণিত লাহাের প্রস্তাব মতে পূর্ব পাকিস্তানকে আরাদা করে একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র গঠন করা । | ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথ বাক্য পাঠ করান। জাতীয় পরিষদের ১৫১ জন ও ২৬৮ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধ পরিচালিত ঐ শপথ অনুষ্ঠানটি ছিল পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ইতিহাসে প্রথম গণশপথ। অনুষ্ঠানের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেন, গণপ্রতিনিধিরা এখানে উপস্থিত হাজার হাজার জনগণকে
________________________________________
সাক্ষ্য রেখে শপথবাক্য পাঠ করবেন। এই ঘােষণার পর হাজার হাজার জনগণ উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং তাদের সর্বাত্মক সহযােগিতার কথা ব্যক্ত করে।
গণপ্রতিনিধিরা বলেন, আমরা শপথ গ্রহণ করছি মহান আল্লাহর নামে সেইসব বীর শহীদদের নামে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এবং এদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের নামে। তারা আরাে বলেন, এদেশের জনগণ আওয়ামী লীগের কর্মসূচী বাস্তবায়নের যে দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত করেছেন তা সম্পাদনে তারা সর্বশক্তি নিয়ােগ করবেন। ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি সুস্পষ্ট গণরায় মােতাবেক শাসনতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়ােগ করবেন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু আরাে বলেন, আমরা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি এবং জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনা করব। কেননা শাসনতন্ত্র প্রশ্নে জনগণের রায়ই চূড়ান্ত । তিনি চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাক্সবন্দী করে রাখার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। এছাড়া সর্বস্তরে জনগণকে প্রতি পাড়া, মহল্লা, গ্রাম, ইউনিয়ন, মহকুমা, জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম গড়ে তুলতে এবং সবাইকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে বলেন।
আপােস না করার সিদ্ধান্ত ৬ দফা ও ১১ দফার প্রশ্নে কোন আপােস হবে না। প্রয়ােজনে এ বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সহযােগিতা চাওয়া হবে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘােষণা দেন। তিনি আরাে বলেন, ভবিষ্যৎ সংবিধান ৬ ও ১১ দফার ভিত্তিতেই রচিত হবে। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনা করা হবে। তবে মৌলিক প্রশ্নে কোন আপােস হবে না। সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও করাচিতে রাজধানী মেনে নেয়া হয়েছে। এদেশের সংবিধানের কাঠামাে জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে অনুমােদন করেছে।
তিনি আরাে বলেন, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। ইতােমধ্যে পাবনার নির্বাচিত সদস্য রফিককে হত্যা করা হয়েছে। তিনি জনগণকে বলেন, তার মৃত্যু হলেও যেন অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নির্বাচন নিয়ে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে তা যেন অচিরেই বন্ধ করা হয়। না হলে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে। তিনি আরাে বলেন, আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তানের দরিদ্র জনগােষ্ঠীর ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নেবে। তবে ২৩ বছরের শােষণকারীদের সঙ্গে কোন প্রকার আপােস হবে না।
সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতি তিনি বলেন, অচিরেই আইয়ুবী আমলের মনােভাব পরিবর্তন করতে হবে অন্যথায় জনগণকে তাদের বাসাবাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দিয়ে বলা হবে তারা ভাল লােক নন। বঙ্গবন্ধু বলেন, যারা ইসলামের দোহাই দিয়ে রাজনীতি করছে
________________________________________
জনতার সামনে তাদের প্রকৃত চেহারা উন্মুক্ত করা হবে। ইসলামী ফ্রন্ট গঠনকারীদের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি জনগণকে সর্বাত্মক প্রকৃতি নিয়ে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, তাঁর নির্দেশে যেন সবাই ঝাপিয়ে পড়েন।
মহিলাদের প্রতি তিনি বলেন, নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, তাদের আত্মত্যাগের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিক্ষাদান করা হবে। তিনি বলেন, ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ভুঠো আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলােচনা করেন। আলােচনায় ভুঠোর অগণতান্ত্রিক দাবি এবং ৬ দফার প্রশ্নে আপােসহীন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোন সমঝোতায় পৌছুতে ব্যর্থ হয়। | এ সময়ে দুইজন কাশীরী কর্তৃক একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই হয়। অপহরণকারীরা বিমানটিকে পাকিস্তানের লাহােরে অবতরণ করায় ।৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ সম্পর্কে বলেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াকে নস্যাতের ষড়যন্ত্র চলছে। এ ধরনের তৎপরতার ফল মারাত্মক হবে বলে তিনি উল্লেখ করে বিমান ছিনতাই ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের দাবি জানান।
১৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের সমালােচনা করে বলেন, এটি জনগণের বিরুদ্ধে আরেকটি ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস। তিনি বলেন, যেকোন অপচেষ্টা প্রতিহত করে জনগণের প্রতিনিধিরা ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করবে। আওয়ামী লীগ জনগণকে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি থেকে একবিন্দুও সরে আসবে না। জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ক্রমেই একটি অশুভ চক্রান্তের জাল চারদিকে বিস্তার লাভ করছে। সবাইকে সামনে বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শত অপ্রতুলতা সত্ত্বেও আমরা জয়ী হব। কেননা ন্যায়ের পক্ষে চিরকাল মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর হুশিয়ারী উচ্চারণের পর ১৩ ফেব্রুয়ারি এক ঘােষণায় ক্ষমতাদখলকারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ, ১৯৭১ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। ঘােষণায় বলা হয়, প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে সকাল ৯ টায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে দুটো এই ঘােষণার বিরােধিতা করে ১৫ ফেব্রুয়ারি বলেন, তার দল অর্থাৎ পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান করবে না। এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আগুন লইয়া খেলিবেন না”। ফ্যাসিষ্ট পন্থা পরিহার করে গণতন্ত্র সম্মতভাবে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিরােধিতাকারীদের প্রতি তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, সাত কোটি বাঙালী আজ ঐক্যবদ্ধ। মেশিনগানের সামনে বুক পেতে দেব তবু অধিকার ছাড়ব
না।
________________________________________
বঙ্গবন্ধুর আহবানের জবাবে জুয়া ও অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ বলেন, ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র যেকোনভাবে প্রতিহত করা হবে।
১৭ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এমন কোন ব্যক্তি নেই যে ঠেকাতে পারে। কেননা বাংলার মানুষ রক্ত দিতে জানে। বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সে কথা প্রমাণিত হয়েছে। শহীদদের রক্ত বাঙালীদের দিয়েছে ঐক্যবদ্ধ হবার প্রেরণা। তিনি বলেন, একুশের আন্দোলন কেবল ভাষার আন্দোলন ছিল না, তা ছিল বাঙালীর সংস্কৃতির মুক্তির আন্দোলন। কাজেই অস্ত্র দেখিয়ে তাদের থামানাে যাবে
। এই সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কাজেই সেই অধিকার থেকে তাদের আর বঞ্চিত করার শক্তি ও সাহস কারাে নেই।
অন্যদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এক প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রে বলা হয়, মানুষ প্রতি মুহুর্তে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ হুমকির সম্মুখীন। ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে ১৫ লাখ মানুষ নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করেছে। সবাই আজ সােচ্চার, মানুষ আর একজাতি-তত্ত্বের লােক ভােলানাে কাগুজে বুলির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকবে না। গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তারা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করবে।
একই দিনে বাংলা ছাত্রলীগ আল মুজাহিদী ও মােশাররফ হােসেন স্বাক্ষরিত অপর এক প্রচারপত্রে বলে, “স্বাধীন সার্বভৌম গণবাংলা” কায়েমের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ হােন। ভাষা সৈনিক রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সালাউদ্দীনের আত্মাকে সাক্ষ্য রেখে ঐ প্রচারপত্রে আরাে বলা হয় যে ৬৯ সালের গণঅভূত্থান ও ৭০ সালের নির্বাচনের আলােকে বিশ্বের কাছে বাঙালী জাতির স্বাতন্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এই পটভূমিতে “জাতীয়তাবাদী স্বাধীন সার্বভৌম গণবাংলা গঠনে সবাই এগিয়ে আসুন।
ফেব্রুয়ারি শেষদিকে এসে শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল সর্বহারা মেহনতী মানুষের নেতৃত্বে বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার আহবান জানায়। দলের পক্ষে হারুনর রশীদ কর্তৃক প্রচার প্রচারপত্রে আরাে বলা হয় যে, একমাত্র সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে মেহনতী জনতার ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়েই কেবল পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা খতম হওয়া সম্ভব, অন্যথায় নয়। যার মূল লক্ষ্য সমাজবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।
২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তাদের ১৪ দফা সম্বলিত এক প্রচারপত্র বিলি করে। এ, কে, এম, জাহাঙ্গীর স্বাক্ষরিত প্রচারপত্রে বলা হয় যে একটি পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কায়েমের জন্য সংগ্রাম করা বর্তমান মুহূর্তে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বলে ছাত্র ইউনিয়ন মনে করে। কেননা পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সমস্যার স্থায়ী এবং গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞানসম্মত সমাধান হওয়া একান্ত প্রয়ােজন ছাত্র ইউনিয়ন আরাে
________________________________________
মনে করে যে পার্লামেন্ট হবে সম্পূর্ণ সার্বভৌম দেশের প্রেসিডেন্ট ও গভর্নরগণ হবেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান মাত্র।
২৩ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান রাওয়ালপিণ্ডিতে প্রাদেশিক গভর্নর ও সেনাপ্রধানদের সঙ্গে এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে জেনারেল হামিদ খান, জেনারেল পীরজাদা সহ আরাে অনেকে উপস্থিত ছিলেন। দেশের সংকটময় অবস্থা নিয়ে তারা রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন। এর একদিন আগে ২২ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া খান মন্ত্রিপরিষদ বাতিল ঘােষণা করেন। ভুঠোর পিপলস পার্টির পক্ষ থেকে এ সময় ইয়াহিয়া খানের সমস্ত কার্যক্রমকে স্বাগত জানানাে হয়। মন্ত্রিপরিষদ বাতিলের সিদ্ধান্তকে তারা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে অভিনন্দিত করেন। দেশপ্রেমী বিরােধীদল ঐ গােপন বৈঠক এবং মন্ত্রিপরিষদ বাতিলের সিদ্ধান্তকে আসন্ন বিপদের পূর্বাভাস বলে মন্তব্য করে। | উপমহাদেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরােধা বিশিষ্ট জননেতা কমরেড মনি সিং-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিষ্ট পার্টি বিরাজমান অবস্থার নিরসনকল্পে কতিপয় প্রস্তাব পেশ করেন প্রস্তাব বলা হয়, নির্বাচিত পারিষদবৃন্দ ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করুন’ এটা গরিষ্ঠ জনগণের দাবি। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল চক্র, যারা গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের বিরােধিতা করে আসছে, তারা এর বিরােধিতা করছে। এই চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে পিপলস পার্টি প্রধান ভুট্টো এবং ক্ষমতাসীন চক্রের মদদেই তিনি তা করেছেন। এই পরিস্থিতিতে সংসদ বসবে কিনা এবং বসলে শাসনতন্ত্র রচিত হবে কিনা বা হলেও তা প্রেসিডেন্ট কর্তৃক অনুমােদিত হবে কিনা সেক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। | এই পরিস্থিতিতে জনগণের মর্যাদা রক্ষার জন্য অবশ্যই ৩ মার্চ পরিষদ অধিবেশন বসতে হবে এবং একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে। যাতে প্রেসিডেন্ট অবশ্যই অনুমােদন দেবেন এবং জনপ্রতিনিধিদেরই হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু যদি অধিবেশন স্থগিত হয়ে যায় ও শাসনতন্ত্র রচিত না হয় এবং হলেও যদি প্রেসিডেন্ট তাতে সম্মতি না দেন তাহলে সারাদেশে সগ্রামের আহবান জানাতে হবে। সে আন্দোলন একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দিকে যেতে পারে, যে সংগ্রামে কমিউনিষ্ট পার্টি সর্বাত্মক অংশ নেবে।
সম্বর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১ মার্চ নির্বাচিত সদস্যদের আহবান জানিয়ে বলেন, তারা যেন আসন্ন পরিষদ অধিবেশনে যােগ দিয়ে সংবিধান রচনায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করেন। ৬ দফা প্রশ্নে তিনি বলেন, এ শুধু বাংলার দাবি, নয় এর মাধ্যমে পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান, সিন্ধু উপকৃত হবে। ৬ দফা সংশােধনের কোন ক্ষমতা নেই। তিনি ভুট্রার প্রসঙ্গে বলেন, তার মন্তব্য আপত্তিকর এবং
________________________________________
তাকে দিয়ে ভবিষ্যতে বহু সমস্যার সৃষ্টি হবে। তিনি তার ৮৩ জন সদস্যকে যােগ দিতে
করেছেন, তেমনি যদি আওয়ামী লীগের ১৬২ জন যােগ না দেয় তাহলে তার ভয়াবহতা সম্পর্কে কি তিনি অবগত? ভুঠো আত্মবিধ্বংসী কাজে মেতে উঠেছেন। | বঙ্গবন্ধু আরাে বলেন, দেশকে এবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে গড়ে তােলা হবে। শ্রমিক-মজুর এই ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার পাবে। এদেশে আর ২২ পরিবার থাকবে না। ক্ষমতাসীনদের সম্পর্কে তিনি বলেন, মৃত্যুবরণ পর্যন্ত কোন আপােস নেই। বৈষম্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শতকরা ১০ ভাগ এদেশের লােক সরকারি চাকরিতে সুযােগ পায় না। এখন থেকে কেন্দ্রীয় নিয়ােগ হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে। উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ ভাগ বিনিয়ােগ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এখন থেকে তা প্রতিহত করা হবে। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান সম্পর্কে তিনি বলেন, এ শ্লোগান কেবল রাজনৈতিক শ্লোগান নয়। জয় বাংলা’ বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি ওবাঁচার শ্লোগান। | ১ মার্চ অপর এক ঘােষণায় ইয়াহিয়া খান জাতীয় পষিদের ৩ মার্চ আহুত অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। কারণ হিসেবে তিনি দেশের মারাত্মক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন, বর্তমান অবস্থায় দেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে না। তিনি আরাে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ভারত দায়ী। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় নেতা অধিবেশনে অংশ নেবেন না। যে কারণে অধিবেশন স্থগিত করতে হলাে।
১ মার্চের ঘােষণার পরপর আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এক সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করে বলেন, ২৩ বছরের অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য বাঙালীরা এখন যেকোন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রতিনিধিরা বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেবে না। সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচী ঘােষণার প্রথম দুইদিন অর্থাৎ ২ ও ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহবান করা হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচী ঘােষণা করা হবে। অগ্নিদীপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু আরাে ঘােষণা করেন, শাসক গােষ্ঠীর যেকোন ষড়যন্ত্রের মােকাবেলা করা হবে। ভূটো সম্পর্কে তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে। ভুঠো বলেছে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কোন প্রতিনিধি ঢাকায় এলে তিনি দেখে নেবেন। তার এই বক্তব্য আইনকে নিজ হাতে তুলে নেয়া। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি স্বাধীনতার ডাক দেবেন কিনা, এর জবাবে বন্ধু সবাইকে অপেক্ষা করতে বলেন। জনমতের ভিত্তিতে ৬ ও ১১ দফার আলােকে সংবিধান রচনার কথাও তিনি পুনরুল্লেখ করেন। বিহারীদের প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, যেহেতু তারা বর্তমানে এদেশে বসবাস করছে সেহেতু তারা অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে যােগ দেবেন। তিনি ভূয়ো প্রসঙ্গে বলেন যে, সে সবসময়ই দায়িত্বহীন, আলােচনায় অনাগ্রহী ও সবক্ষেত্রে প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায়।
________________________________________
পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন ২ মার্চ ১৯৭১ সালে সারাদেশে প্রচারিত এক খােলা চিঠির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহবান জানায়। শ্রমিক আন্দোনের বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক প্রচারিত ঐ চিঠিতে বলা হয় আওয়ামী লীগের ৬ দফায় রক্তাক্ত ইতিহাস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব কেবলমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন করে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি পরিষদ আরাে বলে যে এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাকে ভােট দিয়েছে অবাঙালী ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা কায়েমের জন্য। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন জনগণের আশা-প্রত্যাশা পূরণের জন্য আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি কতিপয় প্রস্তাব পেশ করে
(১) বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন প্রগতিশীল পূর্ববাংলা ঘােষণা করুন; (২) দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল নিয়ে পূর্ববাংলা প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করুন; (৩) পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহবান জানান এবং মুক্তিবাহিনী গঠন করুন”; (৪) প্রকাশ্যে ও গােপন কর্মরত সকল দেশপ্রেমিক দল ও ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ” বা “জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করুন; (৫) পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি প্রকাশ্যে ও গােপনে বিপ্লবী পদ্ধতিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করার আহবান জানান; (৬) পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীকে উৎখাত ও সকল জাতীয় বিশ্বাসঘাতকদের নাগরিকত্ব বাতিল ও চরম শাস্তির ব্যবস্থা করুন।
পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন পুর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ২ মার্চ ১৯৭১ সালে সারাদেশে প্রচারিত এক খােলা চিঠির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহবান জানায়। শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক প্রচারিত ঐ চিঠিতে বলা হয় আওয়ামী লীগের ৬ দফার রক্তাক্ত ইতিহস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে যে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব কেবলমাত্র সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিক্তি ও স্বাধীন করে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি পরিষদ আরাে বলে যে এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাকে ভােট দিয়েছে অবাঙালী ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা কায়েমের জন্য। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন জনগণের আশা-প্রত্যাশা পূরণের জন্য আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি কতিপয় প্রস্তাব পেশ করে
(১) বাংলার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয় পরিষদের নেতা হিসেবে স্বাধীন প্রগতিশীল পূর্ববাংলা ঘােষণা করুন; (২) দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল নিয়ে পূর্ববাংলা প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করুন; (৩) পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর
________________________________________
বিরুদ্ধে সশর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আহবান জানান এবং মুক্তিবাহিনী গঠন করুন”; (৪) প্রকাশ্যে ও গােপনে কর্মরত সকল দেশপ্রেমিক দল ও ব্যক্তিদের নিয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ” বা “জাতীয় মুন্টি ” গঠন করুন; (৫) পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি প্রকাশ্যে ও গােপনে বিপ্লবী পদ্ধতিতে সশস্ত্র সংগ্রাম করার আহবান জানান; (৬) পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীকে উৎখাত ও সকল জাতীয় বিশ্বাসঘাতকদের নাগরিকত্ব বাতিল ও চরম শাস্তির ব্যবস্থা করুন।
জয়বাংলাকে জাতীর শ্লোগানের স্বীকৃতি ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার আহবান জানিয়ে কতিপয় প্রস্তাব পেশ করেন। সভার প্রস্তাবে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক নিহত বাঙালী ভাইদের বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধের আহবান জানায়। ঐ সভায় পাকিস্তানীদের কবল থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, শশাষণহীন সমাজ ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করা হয়। সভায় স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা রেখে দলমত নির্বিশেষে বাংলার প্রতিটি মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যাবার আহবান জানানাে হয়।
ঐ সভায় “জয় বাংলা”কে মুক্তির প্রতীক জাতীয় শ্লোগানের স্বীকৃতি দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করে বলে যে, ২৩ বছরের পাকিস্তানী শাসন ও শােষণ থেকে বাঙালীরা স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচতে চায়। এখন থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম এই রাষ্ট্রের নাম হবে “বাংলাদেশ। এই ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনের কথা বলা হয়-(১) স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালী জাতি ও বাঙালীর ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করা; (২) স্বাধীন বাংলাদেশে বৈষম্য নিরসনকল্পে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু ও কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করা; (৩) নির্ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।
বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত কর্মপন্থা অবলম্বনের কথা বলা হয়
(ক) বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, থানা, মহকুমা ও জেলার স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি” গঠন করা; (খ) সর্বস্তরের মানুষের সহযােগিতা ও তাদের ঐক্যবদ্ধ; (গ) দেশের প্রতিটি এলাকায় কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা; (ঘ) সকল সাম্প্রদায়িক মনােভাব পরিহার করে সম্প্রীতি স্থাপন করা; (ঙ) স্বাধীনতা সংগ্রামকে অব্যাহত ও সুশৃংখলভাবে এগিয়ে নেয়া এবং সকল প্রকার সমাজবিরােধী কার্যক্রম বন্ধ
স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারা বর্ণনায় বলা হয় যে পাকিস্তান সরকারকে বিদেশী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করে তার সকল আইন বেআইনী বিবেচনা করা বা অমান্য করা।
________________________________________
পাকিস্তানী অবাঙালী মিলিটারীদের হামলাকারী বিদেশী সৈন্য হিসেবে গণ্য করে তাদের খতম করা।
সকল প্রকার খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া এবং প্রতিহত ও প্রতিরােধকল্পে সবাইকে সম্পন্ন শিক্ষা দানের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ও গণমুখী করে গড়ে তােলা। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসাবে বিশ্বখ্যাত বাঙালী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি” সংগীত ব্যবহার করা। পশ্চিম পাকিস্তানের সবকিছু বর্জন এবং তাদের সকল ক্ষেত্রে অসহযােগিতা করা। পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের গাঢ় সবুজের মাঝে লাল বৃত্ত” খচিত পতাকা ব্যবহার করা।
সভাশেষে লাখ লাখ জনতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে মেনে নেয়ার শপথ গ্রহণ এবং বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত শ্লোগানসমূহকে জয়ধ্বনি হিসেবে গ্রহণ করে
(ক) স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, দীর্ঘজীবী হােক। (খ) স্বাধীন বাংলার মহান নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। (গ) স্বাধীন কর স্বাধীন কর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। (ঘ) গ্রামে গ্রামে দুর্গ গড়, মুক্তিবাহিনী গঠন কর। (ঙ) বীর বাঙালী অ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। (চ) মুক্তি যদি পেতে চাও, বাঙালীরা এক হও। (ছ) তােমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা । (জ) তােমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। (ঝ) তােমার নেতা আমার নেতা, শেখ শেখ মুজিব। (ঞ) জয় বাংলা।
নিউক্লিয়াস সেল ছাত্রলীগেরই নেতৃস্থানীয় একটি অংশের সমন্বয়ে ১৯৬২ সালে গঠন করা হয় “উিক্লিয়াস সেল”। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে গােপনে গড়ে ওঠা এই সংগঠনের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রখ্যাত ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান। এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে আরাে ছিলেন সে সময়ের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা ও নীতিনির্ধারক আব্দুর রাজ্জাক, ছাত্রনেতা কাজী আরেফ আহমেদ, মার্শাল মনি সহ আরাে অনেকে। জেলা পর্যায় পর্যন্তও এই কমিটি গড়ে তােলা হয়।
বঙ্গবাহিনী নামক সংগীত ১৯৬২ সালে আরাে একটি স্বাধীনতাকামী ছাত্র সংগঠনর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় । “বঙ্গবাহিনী” নামে এই সংগঠনটিও গােপনভাবে ঢাকা কেন্দ্রিক গড়ে ওঠে। অনুর্ধ-১৬
________________________________________
বছরের উৎসাহী তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন হারুনউর রশীদ, শেখ আলী আক্কাছ, সৈয়দ কুতুবুর রহমান, মােফাজ্জল হােসেন সহ অনেকে। এই উভয় সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বিশ্বাস করতেন যে, শেখ মুজিবের নেতৃত্বেই স্বাধীনতা আনতে হবে। কেননা বাংলার মানুষ একমাত্র শেখ মুজিবের কথাই শােনে এবং তাকে বিশ্বাস
বঙ্গবন্ধুর হুশিয়ারী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ১৯৭১ সালে প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন, মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক কায়দায় তারা আর নির্যাতন সহ্য করবে না। যেভাবে বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করা হচ্ছে তার পরিণতি ভাল হবে না। তিনি আরাে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আওয়ামী লীগ অধিবেশনে যােগ দিতে প্রস্তুত ছিল কিন্তু অধিবেশন স্থগিত করে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এর পরিণাম ষড়যন্ত্রকারীদের অবশ্যই বহন করতে হবে। এদেশের মানুষ বহু নির্যাতন, ষড়যন্ত্র সহ্য করেছে। এবার তারা স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বাঁচবে। তিনি সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বলেন যে জনবিরােধী শক্তির সঙ্গে তাদের সহযােগিতা করা ঠিক হবে না। তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, অন্যথায় পরিস্থিতির মারাত্মক বিপর্যয় তাদের সহ্য করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচী ঘােষণা করেন। এতে ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয়া হয়। এছাড়া ৩ মার্চ পল্টনে ছাত্রলীগের জনসভায়, রেডিও, টিভি, সংবাদপত্রে আন্দোলনের খবর প্রকাশ করা না হলে তা বর্জনের কথা বলা হয়। জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে জনসভায় আন্দোলনের চূড়ান্ত কর্মসূচী ঘােষণা করা হবে। সম্পর্কে তিনি জনগণকে দীর্ঘ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন।
৩ মার্চ আওয়মী লীগ প্রধান পুনরায় ক্ষমতা দখলকারী সেনা শাসকদের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত নেবার আহ্বান জানান। পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ঐজনসভায় তিনি আরো বলেন, বাঙলার মানুষ যে কোন পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে জানে, কাজেই দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে তারা পিছনে হটবে না। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর না হলে বাংলার মানুষ তাদের অধিকার ছিনিয়ে নেবে।
ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় আরাে বক্তব্য রাখেন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল মান্নান, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ডাকসুর জিএস আব্দুল কুদুস মাখন। বঙ্গবন্ধু সরকারি দালাল সম্পর্কে জনগণকে হুশিয়ার থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, তিনি মৃত্যুকে বরণ করবেন তবু
________________________________________
তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। তিনি জনগণকে লুটপাট ও ভিতরের শত্রু সম্পর্কে সতর্ক থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার কথা বলেন। জুমা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সে আগুন নিয়ে খেলছে। পশ্চিম পাকিস্তানী অন্যান্য নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তারা যদি সংবিধান রচনার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ না হয় তা হলে বাঙালীরা তাদের সংবিধান রচনা করবে।
সাংবাদিকদের প্রতি বঙ্গবন্ধু বলেন, তারা যেন কোন প্রকার বাধানিষেধ না মানেন এবং সঠিক খবর প্রকাশ করেন। এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানী নেতা গােলাম জিলানীসহ আরাে কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর দাবিকে ন্যায়সঙ্গত এবং তার কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে পিপিপির প্রধান ভুয়োর কঠোর সমালােচনা করেন এবং বলেন, ভুলো পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশের মাত্র ১টিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। কাজেই এককভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব প্রদানের অধিকার তার নেই। নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি দাবি জানান। | পাকিস্তানের দ্রুত অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এয়ার মার্শাল আসগর থান ৪ মার্চ এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরই বর্তমান মুহূর্তে সংকট অবসানের একমাত্র পথ । এছাড়া বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন পথ নেই। তিনি আরাে বলেন, এই মুহূর্তে প্রেসিডেন্টের উচিত শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানানাে এবং যেকোনভাবে আপােস রফায় পৌছানাে : ভুট্টো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনগণ শেখ মুজিবকে ভােট দিয়েছে তা তাকে বুঝতে হবে। তিনি স্বীকার করেন যে ২৩ বছরের শাসনে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। | ৪ মার্চ অপর এক বক্তব্যে পাকিস্তান উলামায়ে ইসলামী পার্টির প্রধান মওলানা হজরতী শেখ মুজিবের প্রতি তার পূর্ণ সমর্থনের কথা ঘােষণা করে বলেন, এক্ষেত্রে ভূট্রোর ভূমিকা পাকিস্তানকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মওলানা আরাে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে এককভাবে কথা বলার কোন অধিকার ভুট্রোর নেই।
পশ্চিম পকিস্তানের অপর নেতা ওয়ালী খান ইয়াহিয়া কর্তৃক অধিবেশন স্থগিত করাকে অগণতান্ত্রিক এবং ধ্বংসাত্মক বলে অভিহিত করেন। নেতৃবৃন্দ দেশের দ্রুত অবনতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য জামাত ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পিপিপি ও মুসলিম লীগকে দায়ী করে বলেন যে, ঐ দলসমূহ প্রেসিডেন্টকে উস্কানি দিচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলী। • বঙ্গ ৪ মার্চ সরকারি-বেসরকারি যে সকল অফিসে কর্মচারীদের বেতন প্রদান করা হয়নি তাদের বেতন দেবার জন্য নির্দেশ দেন এবং ব্যাংক কর্মচারীদের প্রতি ২-৩০ থেকে
________________________________________
৪-৩০টা পর্যন্ত ২ দিন ব্যাংক লেনদেনের অনুমতি দেন। এছাড়া তিনি হাসপাতাল, ফার্মেসি, এ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্র, ওয়াসা, বিদ্যুৎ, টেলিফোন, ফায়ার সার্ভিস, খাবার হােটেল খােলা রাখার নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর এই নির্দেশ সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করেন এবং দেশব্যাপী স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অগ্নিস্ফুলিঙ্গের আকার ধারণ করে।
৫ মার্চ দেশব্যাপী বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযােগ আন্দোলনের তীব্রতায় পাকিস্তানী শাসকরা মরিয়া হয়ে ওঠে এবং দেশের প্রধান প্রধান শহরে কার্ফ জারি করে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেয়। এতে পরিস্থিতির আরাে মারাত্মক অবনতি ঘটে। সারা দেশ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সর্বাত্মকভাবে শহর নগর গ্রাম মাঠ-ঘাটের মানুষ কেবলই মিছিলমুখী হয়ে এগুতে থাকে। অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য এক পর্যায়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে শ্লোগানমুখর জনতার প্রতি ইয়াহিয়ার দখলদার সরকার গুলি চালাতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, ময়মনসিংহ প্রভৃতি স্থানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা (বাঙালী) বিপ্লবী জনতার প্রতি গুলি চালাতে অস্বীকার করে।
৬ মার্চ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাপ্তাহিক ‘স্বরাজ’ সারাদেশে সংগঠিত আন্দোলনের উপর খবর ছাপে। তাতে বলা হয়, যশাের, খুলনা, রংপুর, টঙ্গী, ঢাকা, বরিশাল, ফরিদপুর, সর্বত্র এক বিভীষিকাময় অবস্থা বিরাজ করছে। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ প্রবল আক্রোশে ফেটে পড়েছে। শহর, বন্দর, নগর, গ্রাম, সর্বত্র কেবলই বিক্ষোভ, কেবলই মিছিল আর জনসভা। কৃষক লাঙ্গল রেখে ছুটে এসেছে মিছিলে, জেলে জাল ফেলে চলে এসেছে মিছিলে । গ্রামবাংলার দূরন্ত কিশোেরর মুখে তুলে নিয়েছে মিছিলের গান, শ্লোগানের ভাষায় প্রতিবাদী রাখাল শূন্যে লঠি ঘুরিয়ে বিদ্রোহের গান উচ্চারণ করে। মায়েদের ক্রোধ অভিশাপ হয়ে বর্ষিত হচ্ছে পাক সামরিক জান্তাদের প্রতি। সমস্ত বাংলায় পুঞ্জীভূত আক্রোশের এক প্রচন্ড বহিঃপ্রকাশ। পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন”বন্ধ ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা সহ সারাদেশ ডয়াল রূপ ধারণ করে। লাখ লাখ মানুষ রাজপথে বেরিয়ে আসে। সারাদেশ হয়ে উঠে মিছিলের দেশ, অফিস আদালত স্কুল কলেজ হাটবাজার সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলােতে কার্য জারি করা হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে অব্যাহতভাবে আন্দোলন চালিয়ে যায় । জনতার গগনবিদারী শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে চতুর্দিক। এক পর্যায়ে সামরিক জান্তার বুলেটের আঘাতে ঢাকাতে ২৬ জন আর চট্টগ্রামে ১২ জন নিহত হলাে। খুলনায় মিছিলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হলাে ২১ জনকে। এমনিভাবে যশাের, পাবনা, ফরিদপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলাতে নিহত হলে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু বিপ্লবী জনতা সকল মৃত্যুকে তুচ্ছ করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে যায়।
________________________________________
৬ মার্চ লেখক-শিল্পীবৃন্দ জনতার প্রতি সকল আপােসের বাণী জ্বালিয়ে দেবার আহবান জানিয়ে বলে, বাংলার মাটি কুচক্রী মহলের নগ্ন থাবায় লাল হয়ে উঠেছে। মা তার সন্তান হারিয়েছে, স্ত্রী তার স্বামী হারিয়েছে, বােন ভাই হারিয়েছে। আইয়ুবের পা-চাটা দালাল, কুচক্রী ভুট্টোর পরামর্শে ইয়াহিয়া বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলেছে।
কিন্তু বাংলার মানুষ ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছে যে স্বাধীনতাই মুক্তির একমাত্র পথ। সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। গােলটেবিলের ভেলকিবাজিতে তারা আর ভুলবে না। বাংলার শিল্পী-সাহিত্যিকদের জাগ্রত বিবেক আর মােহাচ্ছন্ন থাকবে না। তারা তাদের স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেই ।
একই দিন ইয়াহিয়া খান তার এক বেতার ভাষণে জনতার আন্দোলনকে দস্যুবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করে বক্তব্য দেন। আন্দোলনকে থামানাের জন্য তিনি বিভিন্ন প্রকার ভয়-ভীতি প্রদর্শন করেন। ৬ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান সেনাবাহিনীর জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়ােগ করে তাকে কঠোর হাতে আন্দোলন প্রতিহত করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বি, এ, সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাতে অস্বীকৃতি জানান।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ মানুষের বিশাল জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। যা বিশ্বের রাজনীতিতে শ্রেষ্ঠ ভাষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ঘোষণা হিসেবে পরিগণিত হয়। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পরই বালার সাড়ে সাত কোটি মানুষ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে এবং তার নির্দেশিত অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যায় । ৭ মার্চের ভাষণ সকল স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষের মনে মুক্তির সংগীত বা যুদ্ধজয়ের গান হিসেবে স্থান লাভ করে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, করুণ আর্তনাদের ইতিহাস। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগকে ভােট দেয় যাতে শাসনতন্ত্র তৈরির মাধ্যমে তারা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পায়। ১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও বাঙালীরা ক্ষমতায় বসতে পারেনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খা মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর আমাদের গােলাম করে রাখে। ১৯৬৪ সালে ৬ দফা আন্দোলনের সময় আমাদের ছেলেদের গুলি করে হত্যা করে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খার
________________________________________
পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন । তিনি বললেন দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর নির্বাচন হলাে। আমি শুধু বাংলার নয় পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরােধ করলাম জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দিতে । তিনি কথা রাখলেন
। কথা রাখলেন ভুট্টো সাহেবের। তিনি বললেন মার্ড সভা বসবে। আমি বললাম আমরা এসেম্বলিতে বসবাে, আলােচনা করে ন্যায্য কথা হলে আমরা মেনে নেব। অন্যান্য নেতাদের সাথে আলােচনা করে ন্যায্য কথা হলে আমরা মেনে নেব। অন্যান্য নেতাদের সাথে আলােচনা করে শাসনতন্ত্র তৈরি করব। কিন্তু ভুঠো সাহেব বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের কোন মেম্বর যদি অধিবেশনে যােগ দেন তাহলে সেখানে কসাইখানা হবে। যারা যাবে তাদের হত্যা করা হবে। আমি বললাম এসেমরি বসবে। কিন্তু হঠাৎ করে মার্চের ১ তারিখে এসেমরি বন্ধ করে দেয়া হলাে । দোষ দেয়া হলাে বাংলার মানুষের, দোষ দেয়া হলাে আমাকে।
দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন। কলকারখানা বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাে। সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাে। আমরা জামা কেনার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী মানুষের বিরুদ্ধে। বাঙালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছে তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
আমি বলেছিলাম জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে বাংলার মানুষদের উপর গুলি করা হয়েছে। কিভাবে আমার মায়ের বুক খালি করা হয়েছে। তিনি বললেন রাউন্ড টেবিল বসবে। আমি বললাম, কিসের এসেম্বলি আপনারা মানুষের রক্ত নিয়েছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলবাে? গােপন বৈঠকে তারা সমস্ত দোষ বাংলার মানুষের ওপর দিয়েছেন। | ২৫ তারিখ এসেমব্লি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। শহীদদের রক্তে পাড়া দিয়ে এসেমরি খােলা চলবে না। সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। সমস্ত সেনাবাহিনীর লােককে ব্যারাকে ঢুকতে হবে। হত্যার তদন্ত করতে হবে। জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব আমরা এসেমব্লিতে বসতে পারব কি পারব না।
আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই। আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয় সেজন্য রিক্সা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে। সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনকিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। যদি বেতন না
________________________________________
দেয়া হয় এরপর যদি একটা গুলি চলে, এরপর যদি আমার লোেকদের হত্যা করা হয়, তােমাদের কাছে অনুরােধ রইলে, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট যা কিছু আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবাে, পানিতে মারবাে। সৈন্যরা, তােমরা আমার ভাই তােমরা ব্যারাকে থাকো। আর গুলি চালাবার চেষ্টা করবা না। সাত কোটি বাঙালীকে দাবিয়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।
যে পর্যন্ত এদেশের মুক্তি না হচ্ছে, ততদিন খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়া হলাে। কেউ দেবেন না। মনে রাখবেন শক্র পেছনে ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহের সৃষ্টি করবে । লুটতরাজ করবে। এই বাংলার হিন্দু-মুসলমান যারা আছে বাঙালী-অবাঙালী তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের, যেন বদনাম না হয়। রেডিও যদি আমাদের কথা না শশানে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও ষ্টেশনে যাবেন না। টেলিভিশন যদি আমাদের নিউজ
দেয়, টেলিভিনে যাবেন না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম চলবে, বাংলাদশের নিউজ বাইরে পাঠানাে চলবে।
বাঙালীরা বুঝে-শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর সমগ্র বাংলার চলমান আন্দোলন আরাে তীব্রমুখী হয়ে ওঠে এবং সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। গ্রামবাংলার নিভৃত পল্লীর প্রতিটি স্তরের মানুষ পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তে সর্বশেষ নির্দেশ পালনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
গেরিলা যুদ্ধের ডাক ৮ মার্চ সারাদেশে গেরিলা যুদ্ধের আহবান সম্বলিত একটি লিফলেট প্রচারিত হয়। তাতে জনগণকে গেরিলা যুদ্ধের নিয়মকানুন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়। বলা হয় প্রত্যেক গেরিলা যােদ্ধার স্বাধীনতার চেতনা ও প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে উপলব্ধি থাকতে হবে। যেকোন জিনিস দ্বারা শত্রুকে আঘাত করতে হবে। অত্র ছাড়াও গেরিলা যুদ্ধ চলতে পারে। শত্রু গেরিলা সম্পর্কে জানতে পারে না। সকল গেরিলাকে বুদ্ধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। একজন গেরিলাই কেবল পারে শত্রুর ওপর আঘাত হানতে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনকে
________________________________________
সমর্থন করে গড়ে তােলা হয় সংগ্রাম কমিটি। ভারত, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, জাপান প্রভৃতি দেশে বসবাসরত বাঙালীরা এর নেতৃত্ব দেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে বিশ্বের সকল দেশের জনমত গঠনে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের লন্ডন হয়ে ওঠে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্র। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বহিঃর্বিশ্বে এই সংগঠনসমূহের মূল নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে রাশিয়া ও ভারত সহ বিভিন্ন দেশের সর্বাত্মক সহযােগিতার পাশাপাশি আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব সহ আরাে কয়েকটি দেশ এদেশের মুক্তি সংগ্রামের তীব্র বিরােধিতা করে পাকিস্তানকে যুদ্ধাস্ত্রসহ সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদান করে।
৮ মার্চ ছাত্রলীগ স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহবান জানায় ৪২ বলাকা ভবন ঢাকাতে অনুষ্ঠিত এক জরুরী বৈঠকে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নাম পরিবর্তন করে ছাত্রলীগ’ ব্যবহার করার প্রস্তাব পাস হয়। সকল জেলা ও কলেজসমূহে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেয়া হয় এবং আন্দোলন তীব্রতর করার জন্য নির্দেশ দেয়। হয়। এছাড়া সভায় আরাে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে দেশের সকল স্থানে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন, পাকিস্তানী সংগীত বাজানাে, উর্দু ছবি প্রদর্শন বন্ধ থাকবেধ্বং বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত সকল কর্মসূচী মেনে চলতে হবে। | ৯ মার্চ কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয় যে, পূর্ব বাংলায় একটি স্বাধীন ও পৃথক রাষ্ট্র গঠনের যে দাবি উত্থাপন করেছেন তা ন্যায়সঙ্গত বলে পার্টি মনে করে। কমিউনিষ্ট পার্টি এই সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানায়। ইতিমধ্যে অসহযােগ ও সর্বাত্মক আন্দোলনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে তা নজিরবিহীন। এছাড়া কমিউনিষ্ট পাটি আওয়ামী লীগ উপিত দাবি ও কর্মসূচীর প্রতি একাত্মতা ঘােষণা করে কমিউনিষ্ট পার্টি সকল এলাকায় গণবাহিনী গঠনের আহবান জানায়।
৯ মার্চ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের জয় বাংলা’ শ্লোগান এবং তাদের নির্দেশিত কর্মসূচীর বিরােধিতা করে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে এসময় ডাসানীর ভুমিকা চরম বিতর্কিত ছিল। একইদিন অপর এক প্রচারপত্রে চীনচন্থী মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিষ্ট পার্টি জনগণের প্রতি হরতাল, ধর্মঘট ও অসহযােগ আন্দোলন ত্যাগের আহবান জানায়। দৈনিক পাকিস্তান’ এদিন তার সম্পাদকীয় মন্তব্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানায় এবং বঙ্গবন্ধু শর্তসমূহরেক অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত বলে মন্তব্য করে। পত্রিকায় আরাে বলা হয় যে শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ শাসন করার আইনগত অধিকার রয়েছে এবং সেক্ষেত্রে সকল বাধা দূর হওয়া
১০ মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ভাসানী পুনরায় বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার সংগ্রামী বীর। তাকে আপনারা অবিশ্বাস করবেন না। তিনি আরাে বলেন,
________________________________________
দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে কেবল তার উপরই আস্থা রাখা যায়। তিনি ইয়াহিয়ার ভূমিকার কঠোর সমালােচনা করে বলেন, আমি অহিংসায় বিশ্বাস করি না। অহিংসা অবাস্তব, হযরত মােহাম্মদ (সঃ) অহিংসার বিরােধিতা করে বলেছেন, জুলুমের প্রতিশোেধ নাও। তিনি ভুঠো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালােচনা করেন। সবশেষে ভাসানী জনতার উদ্দেশে ঘােষণা করেন যে তিনি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আস্থা রেখে স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম করবেন। তিনি জনগণকে শেখ মুজিবের নির্দেশ মেনে চলার অনুরােধ জানান।
একই দিন জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি সরকার গঠনের আহবান জানান। তিনি আরাে বলেন, আজ আমাদের মধ্যে কোন কোন্দল নেই। এই মুহূর্তে কেবল শেখ মুজিবের নির্দেশই বাংলার মানুষ মেনে নেবে। সকল ষড়যন্ত্রের জাল কেবল তিনিই ভেদ করতে পারেন। প্রস্তাব পাঠকালে দলের সম্পাদক মশিউর রহমান ঘােষণা করেন, আজ আমরা আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যবদ্ধ।
তাজউদ্দিনের নির্দেশাবলী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রখ্যাত জননেতা তাজউদ্দিন আহমেদ ৭১-এর ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে দেশের জনগণ ও সরকারি আধা-সরকারি সংস্থাসমূহের প্রতি দলের নির্দেশাবলী প্রদান করেন। ঐ নির্দেশে বলা হয় ব্যাংকসমূহ ১২টা পর্যন্ত খােলা থাকবে। তবে তা কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকান্ড পরিচালনা করবে। কেউ ১০০ টাকার উর্ধ্বে তুলতে পারবে না। কেউই বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠাতে পারবে না স্টেট ব্যাংক শুধু ব্যাংকিং তৎপরতা চালাতে পারবে। বিদ্যুৎ বিভাগ চালু থাকবে। কৃষি কর্পোরেশন কেবলমাত্র সার ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহ করবে। দেশের ভেতরে খাদ্য সরবরাহ চলবে। ট্রেজারি ও এজি চালু থাকবে। পােঠ ও টেলিগ্রাম অফিস শুধুমাত্র বাংলাদেশের মধ্যে চিটিপত্র আদান-প্রদান করবে। দেশের বাইরে কেবল সংবাদ টেলিগ্রাম করা যাবে। পানি, গ্যাস, স্বাস্থ্য কার্যক্রম চলবে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা আইন-শৃংখলা রক্ষা করবে। আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে হরতাল চলবে । জনগণ ও সরকারি অফিসসমূহ এই ঘােষণার প্রতি সর্বাত্মক সাড়া দেন।
১০ মার্চ দৈনিক পাকিস্তান অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ঐ সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরাে বলা হয় যে, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে যে চেতনা এসেছে তা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। জনতার দাবি পূরণের মাধ্যমেই কেবল ভেদাভেদ দূর করা সম্বব। বল প্রয়ােগ করে অধিকার আন্দোলন
________________________________________
স্তিমিত করা যাবে না। গণপ্রতিনিধিদের হাতে অবশ্যই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। ৬ দফা ও ১১ ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে হবে।
এছাড়া ঐ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয় যে ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু যে শর্ত ও দাবিসমূহ উল্লেখ করেছেন তা বর্তমান সংকট দূর করার লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পাশাপাশি একই দিন দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভূয়োর তীব্র সমালােচনা করে বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতিকে তিনি ক্রমেই উস্কে দিচ্ছেন এবং দেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছেন।
১১ মার্চ দেশের অর্থনৈতিক কর্মসূচীকে সচল রাখার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ কতিপয় নির্দেশ প্রদান করেন। তাজউদ্দিন আহমেদ স্বাক্ষরিত ঐ ঘােষণায় বলা হয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দুর্বার গণআন্দোলন শুরু হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত । এজন্য উৎপাদন ব্যবস্থা পূর্ণোদ্যমে চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থবিরােধী শক্তির মােকাবেলায় বদ্ধপরিকর হতে হবে। জুট মিল, চিনিকল ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য টেলিপ্রিন্টার ব্যবহার করা যাবে। বিদেশী কূটনীতিকবৃন্দ বৈধ কাগজপত্রের মাধ্যমে লেনদেন করতে পারবেন। লকার সিষ্টেম চলবে না। দেশের বাইরে কোন অর্থ প্রদান করা যাবে না। কৃষিক্ষেত্রে ঋণ, বীজ, সার, গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলাে চলবে। এছাড়া কৃষির উৎপাদনমূলক সকল কার্যক্রম চালু থাকবে। বন্দরসমূহে অন্ধ অথবা বিস্ফোরক কাজে ব্যবহার করা যায় এমন দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে কোন জাহাজ এলে তাকে প্রতিহত করতে হবে । ত্রাণ-পুনর্বাসন চলবে। সরকারকে অবশ্যই সকল কর্মচারীর বেতন পরিশােধ করতে হবে।
১৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের সংখ্যালঘিষ্ঠ দল, জাতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহ আওয়ামী লীগের দাবি ও কর্মসূচীর প্রতি সমর্থন জানান। জমিয়তে ওলামা পার্টির সভাপতি মুফতি মাহমুদের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় নেতৃবৃন্দ তাদের সমর্থনের কথা বলেন। তারা ইয়াহিয়া খানের প্রতি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আবেদন জানান এবং সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও গুলিবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্তের যে দাবি করা হয় নেতৃবৃন্দ তার প্রতিও সমর্থন জানান। | ১৪ মার্চ পিপিপি প্রধান ভুট্রো করাচির জনসভায় ক্ষমতা দখলকারী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও পিপিপির হাতে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে হস্তান্তরের আবেদন জানান। ১৬ মার্চ পুনরায় এক বিবৃতিতে ভুঠো বলেন যে সংখ্যাগরিষ্ঠতাভিত্তিক সরকার পাকিস্তানের জন্য প্রযােজ্য নয়। ভুট্টোর এই ঘােষণার প্রতিবাদে বিভিন্ন দেশপ্রেমী রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ তার কঠোর সমালােচনা করে বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তিনি আরাে সংকটের মুখে ঠেলে
________________________________________
দিচ্ছেন। সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে তিনি কোন ভুমিকা না রেখে পরিস্থিতি জিইয়ে রেখে ফায়দা লােটার চেষ্টা করছেন।
তবে এক্ষেত্রে ১৭ মার্চ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সভাপতি মওলানা ভাসানী ভুট্টো প্রদত্ত বক্তব্যকে সমর্থন করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উচিত হবে অনতিবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা জুয়ার হাতে অর্পণ করা। ভাসানীর এই স্ব-বিরােধী বক্তব্যে জনগণ বিভ্রান্ত হয় এবং তিনি জনতার আস্থা হারান।
বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নতুন কর্মসূচী ঘােষণা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ মার্চ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচী ঘােষণা করে বলেন, বর্তমানে সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রাম এবং আমাদের সংগ্রাম একই সূত্রে গাঁথা। আজ সমগ্র বাংলার মানুষ দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করছে যে তারা আপােস কিংবা আত্মসমর্পণের চেয়ে মৃত্যুকেই শ্রেয় বলে মনে করে। এই মুহূর্তে সামরিক সরকার যেসব সার্কুলার জারি করে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছেন তা অত্যন্ত হাস্যকর। বাংলার মানুষ আর কোন ভীতির কাছে মাথা নত করবে না। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এখন কোন রক্তচক্ষুকে ভয় করে না। এখন তাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠা করা।
বঙ্গবন্ধু আরাে বলেন, যে কোন শক্তির মােকাবেলায় আপনারা প্রস্তুত থাকুন। চলমান আন্দোলনের তৃতীয় সপ্তাহ দৃঢ়তার সাথে পালনের জন্যও তিনি আহবান জানান । ৭ মার্চের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি পুনরায় বলেন, সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, কোর্ট-কাচারী, স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকবে। ১৫ মার্চ থেকে নিম্নলিখিত নতুন কর্মসূচী ঘােষণা করা হয়ঃ
(১) কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সচিবালয়, সরকারি-বেসরকারি অফিসসমূহ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং শাখা আপাতত হরতাল পালন করবে।
(২) বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
(৩) জেলা প্রশাসক ও মহকুমা প্রশাসকগণ তাদের অফিস বন্ধ না রেখে কেবল এলাকার আইন-শৃংখলা রক্ষা, উন্নয়ন কর্মকান্ড তদারক এবং এই সকল নির্দেশ কার্যকরী ও প্রয়ােগের দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া তারা সর্বক্ষণ আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করবেন। পুলিশ ও আনসার বাহিনী আইন-শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করবেন।
(৪) বন্দর কর্তৃপক্ষ সকল কাজ করে যাবেন। তবে কেবল সেইসব অফিস খােলা
________________________________________
থাকবে যেগুলাে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়ােজনীয়। কিন্তু সৈন্য চলাচল ও অন্ত্রপাতি আনা-নেয়ার কাজে কোনভাবেই সহযােগিতা করা যাবে না। তবে খাদ্যবাহী জাহাজসমূহের তদারকী দ্রুততার সাথে করতে হবে। | (৫) আমদানিকৃত মালামাল দ্রুত খালাস করতে হবে। ডাক বিভাগ তাদের কাজ করে যাবে। এ ব্যাপারে কেবল ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং লিঃ ও ইষ্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড হিসাব খােলা যাবে। কাষ্টমস কালেক্টরগণ এই দায়িত্ব পালন করবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। আদায়কৃত শুক কোনভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেয়া যাবে না।
. (৬) রেল চালু থাকবে। তবে এক্ষেত্রে রেলের বিশেষ কর্ম বিভাগ কেবল চালু থাকবে। কিন্তু পরিবহণের ক্ষেত্রে সৈন্য কিংবা সমরাস্ত্র আনা-নেয়ায় সহযােগিতা করা যাবে না।
(৭) সড়ক পরিবহনের ক্ষেত্রে ই, পি, আর, টি. সি, চালু থাকবে।
(৮) অভ্যন্তরীণ বন্দরগুলাের কাজ চালিয়ে যাবার জন্য প্রয়ােজনীয় কিছু সংখ্যক কর্মচারী কাজ চালাবেন। কিন্তু গণনির্যাতনের জন্য রণসভার সংক্রান্ত কোন কিছু পরিবহনের ক্ষেত্রে সহযােগিতা করা যাবে না।
(৯) বাংলাদেশের ভেতরে চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম, মনিঅর্ডার, পৌছানাের ক্ষেত্রে ডাক ও তার বিভাগ কাজ করবে। আন্তর্জাতিক প্রেস টেলিগ্রাম চালু থাকবে ।
(১০) দেশের মধ্যে কেবল আন্তঃজেলা ট্রাংক, টেলিফোন চালু থাকবে।
(১১) বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র তাদের কাজ চালিয়ে যাবে। যদি তা না করা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে কেউ দায়িত্ব পালন করবে না।
(১২) হাসপাতাল, ক্লিনিক, ও স্বাস্থ্য সার্ভিস যথারীতি তাদের কাজ করে যাবে। (১৩) বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে ওয়াপদা তাদের দায়িত্ব পালন করবেন। (১৪) গ্যাস ও পানি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
(১৫) আমদানি রপ্তানি জরুরী ভিত্তিতে চালু থাকবে। এক্ষেত্রে পরিবহন ব্যবস্থা চালু থাকবে।
(১৬) কৃষিবিজ্ঞান, গবেষণা, ধান, পাট, বীজ, কীটনাশক ওষুধ ক্রয় চালু থাকবে।
(১৭) পাওয়ার পাম্প, জ্বালানি তেল, সেচ যন্ত্রপাতির সকল বিভাগ খােলা থাকবে। সমবায় ব্যাংকসমূহ তাদের কৃষিঋণ প্রদান অব্যাহত রাখবে।
(১৮) বন্যা নিয়ন্ত্রণ, শহর রক্ষণ, বৈদেশিক সাহায্যের প্রকল্পসমূহের কাজকর্ম চলবে।
________________________________________
| দুর্গত এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড চলবে। সকল ক্ষেত্রে ঠিকাদারদের পাওনা মিটিয়ে দিতে
(১৯) কলকারখানায় উৎপাদন বাড়ানাের চেষ্টা করতে হবে। ইষ্টার্ন রিফাইনারীর কাজ চলবে। সকল ক্ষেত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন সময়মত প্রদান করতে হবে। সামরিক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনশন পরিশােধ করতে হবে। এজির সামান্য সংখ্যক কর্মচারী জরুরী ভিত্তিতে কাজ চালাবে।
(২০) ব্যাংকসমূহ ৯টা থেকে ১২ টা পর্যন্ত খােলা থাকবে। ব্যাংকগুলাে দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক লেনদেন করবে। বিদেশে টাকা পাঠানাে চলবে না। বাণিজ্যিক খাতে সপ্তাহে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রদান করা যাবে। ব্যক্তিগতভাবে ১ হাজার টাকার বেশি তােলা যাবে না। উন্নয়ন কাজে নিয়ােজিত ঠিকাদারদের অর্থ দেয়া যাবে। তবে সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কাজের বৈধ কাগজপত্র থাকবে। যেসব ব্যাংকের সদূর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে সেগুলাে ন্যাশনাল ব্যাংক ও ষ্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে পাওনা গ্রহণ করতে পারবে। ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত টেলিপ্রিন্টার চালু থাকবে। অনুমােদিত ডিলারের সাহায্যে ফরেন ট্রাভেলার্স চেক ভাঙানাে যাবে। কূটনীতিকবৃন্দ তাদের হিসাব পরিচালনা করতে পারবে। লকার বন্ধ থাকবে। কোনভাবেই দেশের বাইরে টাকা পাঠানাে যাবে না। পণ্য বিনিয়ােগের চুক্তি মােতাবেক প্রেরিত দ্রব্য ছাড় করানাে যাবে।
(২১) আমদানি-রপ্তানি কন্ট্রোলারদের অফিস চলবে, ট্রাভেল এজেন্ট ও বিমান চালু থাকবে। তাবে তাদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ বাংলাদেশে থাকবে। কোন খাজনা বা কর আদায় করা যাবে না। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পরােক্ষ কর আদায় করা যাবে, তবে কেন্দ্রীয় খাতে জমা করা যাবে না। ঐ অর্থ স্থানীয় ব্যাংকের হিসাবে জমা রাখতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রত্যক্ষ কর আদায় বন্ধ থাকবে। সকল বীমা ও ইস্যুরেন্স চালু থাকবে। সকল ব্যবসা ও দোকান-পাট চলবে। সমস্ত বাড়িতে কালাে পতাকা উত্তোলিত হবে। সংগ্রাম পরিষদ সকল নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাবে।
আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আহুত আন্দোলনের ১৬ দিন অতিবাহিত হয় ১৭ মার্চ। সারা বাংলা মিছিল-মিটিংয়ে মুখরিত হয় আন্দোলনের প্লাবনে। শহর নগর বন্দর গ্রাম সবখানেই কেবল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত আইন মেনে চলে সর্বস্তরের মানুষ।
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সার্ভিসেস ফেডারেশন, উদীচী শিল্পী গােষ্ঠী, ব্রতচারী আন্দোলন, ব্যাংক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ, দেশরক্ষা খাতে বেসাসরিক কর্মচারীবৃন্দ, সমবায় ইউনিয়ন, ব্যবসায়ী সমিতি, শিল্পোন্নয়ন সমিতি, সংগ্রাম পরিষদ সহ শত শত সংস্থা ও সংগঠন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আস্থা জ্ঞাপন করে পূর্ণ অসহযােগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ এবং
________________________________________
শপথ গ্রহণ করে যে, বঙ্গবন্ধুর যে কোন নির্দেশে তারা তাৎক্ষণিকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু মহান নেতায় পরিণত হন। বাংলার মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত তার নির্দেশ পালন করে যায়।
নিজের জন্মদিন প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইয়াহিয়া খানের অনুরােধে তার সাথে ঢাকায় এক আলােচনা সভায় মিলিত হন। আলােচনা শেষে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে কোন প্রকার মন্তব্য করা হয়নি। তবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে বলা হয় যে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে । এরপর বঙ্গবন্ধু দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন।
একজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে তার ৫২ তম জন্মদিবসে শুভেচ্ছা জানান। উত্তরে তিনি বলেন, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ আমার জন্মদিন। জীবনে কখনাে আমি জন্মদিন পালন করিনি। কেননা আমার দেশের জনগণের অবস্থা আপনারা জানেন। যাদের খাবারের নিরাপত্তা নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই, অন্যের ইচ্ছার ওপর তাদের মৃত্যু নির্ভর করে-সেক্ষেত্রে জন্মদিন পালনের প্রশ্ন আসে না। তবে সাত কোটি মানুষ আমার পেছনে ঐক্যবদ্ধ । এর চেয়ে বড় সুখের আর কিছু নেই। বিদেশী সাহায্যের প্রয়ােজন আছে কিনা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেন, লক্ষ্য অর্জনে বাংলার মানুষ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের কোন বিদেশী সাহায্যের দরকার নেই। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের কি নেই? একজন বিদেশী সাংবাদিকের এরূপ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, এই মুহূর্তে স্বাধীন দেশের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার বাংলার মানুষের নেই।
১৮ মার্চ সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে ঘােষণা করা হয় যে সারাদেশে সেনাবাহিনী যে হত্যাকান্ড ও নির্যাতন চালিয়েছে তার তদন্ত করা হবে। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার এ প্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে বলেন সানামূলক ছেলে ভােলানাে গল্প দিয়ে আর বাঙালীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে না, তদন্তের ভার এবার নিজেরাই নেবে।
ইয়াহিয়ার অনুরােধে পুনরায় বঙ্গবন্ধু দেশের চলন রাজনৈতিক ও শাসনতন্ত্র সংক্রান্ত অচলাবস্থা নিরসনকল্পে ২০ মার্চ চতুর্থ দফা আলােচনায় মিলিত হন। এদিনের আলােচনায় বঙ্গবন্ধুর সাথে অংশ নেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ, তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, মনসুর আলী, ডঃ কামাল হােসেন প্রমুখ। ইয়াহিয়া খানের সহযােগী ছিলেন মিঃ কর্নেলিয়াস, এ কে ব্রোহী, শরিফুদ্দীন পীরজাদা। আলােচনাশেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা সবসময় খারাপ অবস্থার জন্য তৈরী । আলােচনায় অগ্রগতি কতদূর? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ভূমিকা পরিষ্কার, বাংলার মানুষের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোন প্রকার আপােস
________________________________________
মীমাংসায় উপস্থিত হওয়া সম্ভব নয়। এদিনের আলােচনার সময় প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে। ও সারা শহরে লাখ লাখ মানুষ জয়বাংলা’ শ্লোগানে সমস্ত শহর প্রকম্পিত করে তােলে।
১৯ মার্চ ইয়াহিয়া খান যখন বঙ্গবন্ধু সঙ্গে প্রহসনমূলক আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছে ঠিক। তখনই ঢাকার অদূরে জয়বেদপুরে “ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর “খান সেনারা হঠাৎ করে হামলা চালায় এবং তাদের হতাহত করে অস্ত্র কেড়ে নেবার চেষ্টা চালায় । মুহূর্তের মধ্যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সিপাহীরা সক্রিয় প্রতিরােধ গড়ে তােলে। এইখবর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার মানুষ প্রবল স্রোতের মত দূরদূরান্ত থেকে এসে বাঙালী সৈনিকদের সমর্থনে ঢাকা-জয়দেবপুর সড়কে সমবেত হয়ে ব্যারিকেড গড়ে তােলে। এসময় কয়েক লাখ বিদ্রোহী মানুষকে নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শামসুল হক। এই পর্যায়ে পাক সেনাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায় ।
২১ মার্চ পিপিপি প্রধান ভুট্টো হঠাৎ করে ঢাকায় আসেন এবং ইয়াহিয়ার সঙ্গে গােপন বৈঠকে মিলিত হন। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে তিনি হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান নেন এবং সাংবাদিকদের সাথে কোন প্রকার আলােচনা থেকে বিরত থাকেন। এ সময় হােটেলের বাইরে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে পাকিস্তান ও ভূয়া বিরােধী শ্লোগান দেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে দুই ঘন্টা বৈঠকের পর ভুয়ো পিটিআই-এর একজন সাংবাদিকের কাছে মন্তব্য করেন, সব কিছু ঠিক করে দেয়া হবে, অপেক্ষা করুন। এসময় ডুঠোকে বিমর্ষ ও বিচলিত দেখাচ্ছিল। হােটেল কর্মচারীরা এদিন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও কালাে ব্যাজ ধারণ করে।
২৩ মার্চ ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন। এই ঘােষণায় অগ্রগতি, আলােচনা ও মীমাংসার সর্বশেষ সম্ভবনাও শেষ হয়ে যায়।
২৪ মার্চ সমস্ত বাংলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানাে হয়। শহর নগর বন্দর হাট বাজার গ্রাম স্কুল কলেজ সবখানেই এই পতাকা আসন্ন স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে ওঠ। সারা বাংলা থেকে পাকিস্তানী পতাকার নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে যায়। বৃটেন, ভারত, রাশিয়াসহ বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। চীনা ও আমেরিকা দূতাবাস সহ অন্য দু-একটি দূতাবাস কোন পতাকা না উড়িয়ে বিতর্কিত ভূমিকা পালন করে। এদিন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী শাসকদের প্রতি কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, বাংলার নির্য জনগণকে হত্যার চেষ্টা করা হলে তা বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হবে না। বাংলার বীর সন্তানেরা এই মুহুর্তে তাদের মুক্তির জন্য কাশিত লক্ষ্য অর্জনে যেকোন পরিস্থিতির মােকাবেলায় প্রবত। এই ঘােষণার পরদিন ইয়াহিয়া ও ভুয়া ঢাকা ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যায়।
________________________________________
স্বাধীনতার ঘােষণা বঙ্গবন্ধুর সাথে পকিস্তানী শাসকেরা মূলত আলােচনার নামে প্রহসন চালিয়ে যায় এবং ভেতরে ভেতরে বাঙালীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী নরপশুরা ঢাকাসহ সারাদেশে নির জনতার ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় শত শত সাঁজোয়া যানের বহর নিয়ে ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর তারা আঘাত হানে। আবাসিক এলাকা, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানায় ইপিআর বাহিনীর ওপর পাকিস্তানী পদাতিক ও গােলন্দাজ বাহিনী একযােগে আক্রমণ করে। নিহত হয় অগণিত মানুষ।
ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু বাংলার অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন এবং সেইসঙ্গে দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিংবদন্তি তুল্য নেতার নির্দেশ এসময় মানুষ মন্ত্রমুখের মত বেদবাক্য হিসেবে পালন করতে থাকে। জনগণের প্রতি তার অসীম ত্যাগ ও ভালবাসার কারণে তিনি মানুষের মনে ঐ প্রতিষ্ঠা পান। পাক বাহিনীর এই আক্রমণের মুহুর্তে তিনি তাঁর শেষ নির্দেশ দানের জন্য প্রস্তুতি নেন। | ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। ঐ ঘােষণায় তিনি বলেন-“পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লােকদের হত্যা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। বিশ্বের জাতিসমূহেy কাছে আমি সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোেদ্ধারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমাদের আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোেস নেই। জয় আমাদের হবেই । আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন । সকল আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লােকদের এ সংবাদ পৌছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।”
২৬ মার্চ অপরাহ্ন ২-৩০ মিনিটে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্য আব্দুল হান্নান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয়বার বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। ইতিমধ্যে সমগ্র বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ২৭ মার্চ পুনরায় মেজর জিয়া চট্টগ্রামের কালুরঘাট ভ্রাম্যমাণ বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তৃতীয়বার স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণাই ছিল স্বাধীনতার মূল ঘােষণা। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি সেই ঘােষণা বাস্তবায়নের জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করেন।
________________________________________
দ্বিতীয় অধ্যায় যুদ্ধের প্রস্তুতি ১৭৫ ০ ২৫৬
যে ভাবে শুরু উনিশ’শ একাত্তর সালে বাঙ্গালী জাতি এক আশ্চর্য সময় অতিক্রম করেছিলাে। এমন দুঃসময় কখনাে আসেনি তাদের জীবনে। কিন্তু এই সময়ের জন্যই তারা দু’শ বছর ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলাে। এই সময়ের জন্যই তারা ২৩ বছরের পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলাে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতাকে বাঙ্গালীরা মনে করে যে, তা ছিলাে বৃটিশ রাজত্ব থেকে তাদেরকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের নতুন বন্দিশালায় প্রবেশ করানাে এবং একই ঐতিহ্যের অধিকারী বাঙ্গালী জাতিকে হিন্দু-মুসলিম বৈষম্যের সৃষ্টি করে বিভক্ত করা । যা ছিলাে ইংরেজ, পাকিস্তান ও ভারতের স্বার্থবাদী মহলের একটি সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত।
১৯৪৮ সাল থেকেই উগ্র সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিকতাবাদী পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী বাঙ্গালী জাতির ভাষা প্রশ্নে মত বিরােধ ঘটে। ১৯৫২ সালে এই মত বিরােধ তীব্র আকার ধারণ করে যা বাঙ্গালী জাতিকে তার নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বেঁচে থাকার প্রশ্নে প্রেরণা যােগায়। ১৯৭১ সালে এসে সেই দীর্ঘ সংগ্রামী ঐতিহ্যের সফল সমাপ্তি ঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ‘৭১ সালে বাঙ্গালী জাতি তার নিজস্ব আত্ম-পরিচয় আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।
ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙ্গালীদের মনে যে প্রবল জাতীয়তাবােধের জন্ম নেয় তার প্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকের মাধ্যমে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরাজিত হয় পাকিস্তানী সেনা শাসক ক্ষমতা দখলকারী। জেনারেল ইয়াহিয়া খান, যিনি মুসলিম লীগ নামক রাজনৈতিক দলের ত্রছায়ায় নিজেকে উপস্থিত করেন। পরাজিত হবার পর তিনি নানা অজুহাতে বাঙ্গালীদের হাতে ক্ষমতা
________________________________________
হস্তান্তরে ষড়যন্ত্র শুরু করেন। ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠা স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালীরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে ১৯৭১ সালে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
‘৭১ সালের সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক কাল কেমন ছিলাে, কিভাবে অতিক্রান্ত হয়েছিলাে সেই সময়, ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক, ছাত্র-যুবক, শ্রমিক-কৃষক কিভাবে সংগঠিত হয়েছিল-এই গ্রন্থে তারই জেলা ভিত্তিক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে।
| খুলনা ১৯৪৭ সালে বাঙ্গালীদের দাবী উপেক্ষা করে ব্যাপক গােজামিলের মাধ্যমে যে পাকিস্তান নামক দেশটি জন্মেছিল তাতে মাত্র এক বৎসরের মধ্যেই ফাটল ধরে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা বাংলাদেশকে তাদের একটি ঔপনিবেশিক বাজারে পরিণত করার স্বার্থে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে মেনে নিতে পারেনি। বাঙ্গালীদের মাতৃভাষা বাংলার স্থলে তারা উর্দুকে বাঙ্গালীর ভাষা রূপে চাপানাের অপচেষ্টা চালায়। এ কারণে বাঙ্গালীদের সঙ্গে উর্দুভাষী পশ্চিমাদের বিরােধ ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যায়। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পরেও পশ্চিমা শাসকেরা বাঙ্গালীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে দশ লাখ মানুষের এক বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সগ্রাম।’ ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব রাজনীতিতে শ্রেষ্ঠ ভাষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল ঘােষণা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ভাষণের পর বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ একটি স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। | খুলনা জেলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর ডাক সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। ৮ মার্চ থেকে এ জেলার সর্বস্তরের মানুষ এবং জেলা প্রশাসন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে চলতে থাকে। গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই পরিষদ সমগ্র খুলনা জেলাকে মােট ১২ টি ভাগে বিভক্ত করে এবং ১২ টি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করে। আঞ্চলিক কমিটি গুলি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য সর্বস্তরের জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কাজ শুরু করে। খুলনা জেলার জনগণ সংগ্রাম কমিটির ডাকে তাদের সকল প্রকার সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে। সমুদ্রের তরঙ্গের মত আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। খুলনা হাদিস পার্কে প্রতিদিন জমায়েত হতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। এই
________________________________________
জমায়েতে জনতাকে প্রতিদিন পরবর্তী পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য বিস্তারিত কর্মসূচী জানানাে হতে থাকে। সংগ্রাম কমিটির ব্যয় নির্বাহের জন্য ইষ্টার্ণ ব্যাংকে একটি হিসাবের মাধ্যমে জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অর্থ প্রদান করে। পাশাপাশি জনতাকে উদ্দীপ্ত করার জন্য বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ নাটক, গণসংগীত প্রভৃতির মাধ্যমে তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে। দেশের ডাক’ নামক একটি পত্রিকা স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্পাদক ছিলেন লুৎফর রহমান জাহাঙ্গীর। ২ মার্চ থেকে পত্রিকাটি আন্দোলন পরিস্থিতি ও কর্মসূচী প্রচারের কাজ অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যায়। যুদ্ধকালীন সময়ে পাক দস্যুরা পত্রিকাটির অফিস পুড়িয়ে দেয়। | খুলনা জেলায় গঠিত স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের যারা নেতৃত্বেছিলন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আঃ আজাদ, সালাউদ্দীন ইউসুফ, এ্যাডঃ মােমিন উদ্দিন, এম এ গফুর, ডাঃ মনসুর আলী, এনায়েত আলীসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখযােগ্য। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলাে তাদের মধ্যে স ম বার আলী, নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবীর, বুলু, রাশেদ আহমেদ, এ টি এম খালিদ, জাহিদ, নুরুজ্জামান বাচ্চু, কাজী জাহাঙ্গীর, শাহনেয়াজ জামান চৌধুরী, হেকমত আলী, আঃ কাইয়ুম, মােতাহার উদ্দিন, শ্যামল সিং, লিয়াকত হােসেন, আঃ ছালাম প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য।
এ জেলার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা হলেন যথাক্রমে কামরুজ্জামান টুকু, মির্জা খয়বার হােসেন প্রমুখ। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন কানাই বিশ্বাস ও খালেদ রশীদ সহ অন্যান্যরা। এ জেলায় মহিলাদের সংগঠিত করার কাজে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে হাসিনা বানু শিরীন, অলােক দাস, তহমিনা বেগম, ফেরদৌসী আলী ও কৃষ্ণা বসুর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। ১৪ মার্চ খুলনাতে অনুষ্ঠিত বিশাল মহিলা সমাবেশের এরা প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ছাড়াও স্বাধীনতা সংগামে খুলনা জেলায় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাপক ভূমিকা ছিলাে। ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপ খুলনা পিটিআই স্কুলের মাঠে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কর্মসূচী হাতে নেয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনের প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন এবং তারা সবাই তার নির্দেশেই সর্বাত্মক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে।
২৩ মার্চ খুলনা শহীদ হাদিস পার্কে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনের নেতৃত্ব দেন স ম বারী আলী, আব্দুল কাইয়ুম, হুমায়ুন কবীর বুলুসহ প্রমুখ ছাত্রনেতা। ৭ মার্চের পর থেকেই খুলনা সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছাত্র-যুবক-জনতাকে সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়। ২৭ মার্চ পাক সৈন্যরা খুলনায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ যুদ্ধ। একটানা নয় মাস যুদ্ধের পর সফল সমাপ্তি ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ৭১ সালে।
________________________________________
যশাের ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। সমগ্র বাংলায় বিক্ষুব্ধ মানুষের উত্তাল জোয়ার। আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীতে দেশের মানুষ যখন সােচ্চার তখন যশােরের সর্বদলীয় পরিষদ ৩ মার্চ শহরের ঈদগা ময়দানে এক সমাবেশ আহবান করে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ এদিনের সমাবেশে অংশ নেয়। সভা শেষে বিশাল জনতার একটি মিছিল যখন রেলরােড ধরে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন অতর্কিতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঐ মিছিলে গুলি ছােড়ে। এতে কয়েকজন মারাত্মকভাবে আহত হল জনতা তীব্র রােষে ফেটে পড়ে এবং মারমুখী হয়ে এগুতে থাকে। এক পর্যায়ে বিশাল জনতার মিছিলটি যখন শহরের কেন্দ্রস্থল টেলিফোন ভবনের সামনে আসে তখন পাক সৈন্যরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং পুনরায় মিছিলে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন মিছিলে অংশ নেয়া গৃহবধু চারুবালা ধর। আহত হন আরাে অনেকে। এই ঘটনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে মানুষ অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত রুদ্ররােষে জ্বলে ওঠে। এবং তারা বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাস্তায় নেমে আসে। জনতা নেতৃবৃন্দকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য চাপ দিতে থাকে।
২ মার্চ যশাের ঈদগা ময়দানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উত্তোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছাত্র লীগের খান টিপু সুলতান, আঃ হাই, আলী হােসেন মনি, রবিউল আলম, ইকরামুল, শেখ হাসান ইমাম, নজরুল ইসলাম ঝরনা, রাজেক আহমেদ, অশােক রায়, রতন, ঝিন্না, মঈন, মােসাদ্দেক, মাহফুজ, ওমর ফারুক, হায়দার গনি খান পলাশ, মশিয়ার রহমান, সেখ আঃ ছালাম, ছালেহা বেগম, রওশন জাহান সাথী, সাহিদা, ফিরােজা, মতিয়ার, বাবুল, আশরাফ চৌধুরী সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। | ১ মার্চ সৈয়দ মহব্বত আলী, অমল সােম, মাহমুদুল হক সহ অন্যান্যের নেতৃত্বে সবুজের উপর লাল সূর্য ও তিন তারকা খচিত পতাকার ডিজাইন তৈরি হয়। পতাকা সেলাই করেন অমল সােমের স্ত্রী, ছালেহা বেগম ও তার সহকর্মীরা।
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের খবর ঐদিন রাতেই টেলিফোনে যশাের পৌছে যায়। আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমানের বাড়ীতে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিবরণ শােনেন। তবে ভাষণের পূর্ণ বিবরণ ও ঘােষণা জনতা শুনতে পারে পরদিন ৮ মার্চ সকালে রেডিওর মাধ্যমে। এই বেতার ভাষণের পর সর্বস্তরের মানুষ সংগ্রাম মুখর হয়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়াদিয়ে সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলনর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে। মুক্তি যুদ্ধের প্রস্তুতিকালীন সময়ে গণদাবী, মাতৃভূমি ও নতুন দেশ নামক ৩ টি পত্রিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা আন্দোলনকে আরাে বেগবান করে তােলে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পরই যশােরে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান, রওশন আলী, মােশারফ হােসেন, নুরুল ইসলাম, তবিবর রহমান সরদার, হাদিউজ্জামান, পীযুষ
n
________________________________________
কান্তিসহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন টিপু সুলতান, রবিউল আলম, আব্দুল হাই, রওশন জাহান সাথী, ছালেহা বেগম, ফিরােজা বেগম, খয়রাত হােসেন, অলােক রায়, রাজেক আহমেদ, হায়দার গনি খান পলাশ, শেখ আঃ ছালাম, মাইনুদ্দিন, জালাল উদ্দিন রতন, আবদুল মান্নান, হাসান শিবলী,ঝরনা, আলী হােসেন মনি প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এস এম জামাল উদ্দিনসহ অন্যান্য নেতৃব। আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মুল নেতৃত্ব থাকলেও এ সময় কমিউনিষ্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিলাে। এদের মধ্যে আঃ শহীদ লালের নাম উল্লেখযােগ্য।
জেলা সংগ্রাম কমিটি মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য গ্রাম পর্যায় থকে কমিটি গঠন শুরু করেন। থানা ও মহকুমা কমিটিগুলােকে তৃণমূল পর্যায়ের কমিটিগুলাের তদারকির দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সকল স্তরের প্রতিটি কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিলো ১১ জন’ করে। কমিটি সমূহের প্রথম কাজ ছিলাে ব্যাপক সভা সমাবেশের মাধ্যমে জনতাকে সংগঠিত করা। বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যশাের এম, এম কলেজ ও শংকরপুরে স্থাপিত হয় মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের প্রধান দুটি ক্যাম্প। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন নান্ন ও ই পি আর এর নায়েক সেকেন্দোর আলী দু’টি ক্যাম্পের প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন। | ৮ মার্চ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এ জেলার বিক্ষুব্ধ মানুষ পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে ওঠে এবং তারা প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যশাের সেনানিবাসের সকল যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেয়। একই সঙ্গে জনতা সেনা নিবাসের বিদ্যুৎ, খাবার পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এসব ক্ষেত্রে স্ব স্ব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ সাধারণ মানুষের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে রাস্তায় বেরিয়ে
২৩ মার্চ যশাের নিয়াজ পার্কে (ষ্টেডিয়াম সংলগ্ন) প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছাত্র-জনতার প্রথম কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ মার্চ আন্দোলনরত জনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। ২৫ মার্চ স্যা থেকে আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান, রওশন আলী ও মােশাররফ হােসেনের বাড়ীতে হাজার হাজার ছাত্র-যুবক-জনতা সমবেত হয়। পরবর্তী পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য তারা নেতৃবৃন্দের নির্দেশ শুনতে চায়। রাতে ঢাকা থেকে নেতৃবৃন্দের প্রতি টেলিফোনে খবর পৌছে যে, তারা যেন অত্যন্ত সতর্ক থেকে পরিস্থিতি মােকাবেলা করেন। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হাজার হাজার মানুষ এদিন সন্ধ্যা থেকেই সশস্ত্র অবস্থায় সেনা নিবাসের প্রধান গেটে অবস্থান নেয়।
২৫ মার্চ রাত ১ টার দিকে যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক ব্যহিনীর প্রায় ৫০ টি সৈন্যবাহী গাড়ি শহর অভিমুখে যাত্রা করে। সমবেত জনতা সামান্য অৱ নিয়ে তাদের প্রতিরােধে ব্যর্থ হয়। শহরে প্রবেশ করেই পাক বাহিনী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে ব্যাপক জ্বালাও পােড়াও অভিযান শুরু করে। পাক বাহিনীর প্রধান টার্গেট ছিলাে
________________________________________
আওয়ামী লীগ অফিস, নেতা কর্মীদের বাসভবন, ছাত্রাবাস ও সন্দেহজনক এলাকা সমূহ । সারারাত পাক দস্যরা ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়ে ভােরবেলা সমবেত হয়ে শুরু করে যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি। | ২৯ মার্চ যশাের সেনানিবাসের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসে। ক্যাপঃ হাফিজ উদ্দিন, লেঃ আনােয়ার ছিলেন তাদের অন্যতম । এই বিদ্রোহে প্রায় ৩০০ বাঙ্গালী সৈন্য নিহত হয়। এদিন শহরে অবস্থানরত পাক সৈন্যরাও সাধারণ মানুষের উপর হামলা চালায়। এ সময় ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসে এবং জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তাদের সর্বাত্মক সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে।
কুমিল্লা। ৭ মার্চ ১৯৭১। কুমিল্লা জেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ রেডিও সেট সামনে নিয়ে অপেক্ষা করছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শােনার জন্য। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচার
হওয়ায় হাজার হাজার জনতা আওয়ামী লীগ অফিস ও নেতৃবৃন্দের বাসভবনে ভিড় জমায়। জনতা নেতাদের কাছ থেকে পরবর্তী নির্দেশও সেই মুহূর্তে করণীয় কি তা জানতে চায়। পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং সর্বস্তরের মানুষ একটি আশংকাজনক অবস্থার জন্য তৈরি হতে থাকে।
৭ মার্চ রাতে এ জলার নেতৃবৃন্দ ঢাকা থেকে টেলিফোনে খবর পায় যে, রেসকোর্সের জনসভায় প্রায় দশ লক্ষ মানুষের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। এই খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে শহরের প্রতিটি পাড়া মহল্লা থেকে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং মিছিল করতে থাকে। মিছিলের গগন বিদারী শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে।
কুমিল্লা জেলার সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছিল ৭ মার্চের আগে। ৩১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির আহবায়ক ছিলেন অধ্যাপক খােরশেদ আলম। ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি ওমর ফারুকের নেতৃত্বে গঠিত হয় ৩১ সদস্য বিশিষ্ট আরেকটি কমিটি। এরা অস্ত্র সংগ্রহের জন্য সরাসরি ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে। এক্ষেত্রে শিব নারায়ন দাস অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
৮ মার্চ থেকে জেলার প্রতিটি গ্রাম, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা এবং মহকুমা পর্যায়ে প্রতিরােধ কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি তাদের নিজ নিজ এলাকায় কাঠের ডামি রাইফেল’ দিয়ে স্থানীয় ছাত্র যুবক সহ উৎসাহী জনতাকে সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ শুরু করে। এসব প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন সেনা ও পুলিশ বাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকেরা। এ ছাড়াও ছুটিতে থাকা সামরিক সদস্যরাও কর্মস্থলে যােগ না দিয়ে সর্বাত্মকভাবে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে এগিয়ে আসে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ মাঠ ও
________________________________________
| জাঙ্গালিয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে স্থাপিত হয় প্রধান দুটি প্রশিক্ষণ শিবির। এছাড়া জেলার সকল স্কুল
ও কলেজ মাঠসমূহে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে ওঠে। | জনতা পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের সহযােগী দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ কর্মসূচীর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে কুমিল্লা সেনানিবাসে খাদ্য ও জ্বালানি সহ সকল প্রকার অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি জনতাকে সংগঠিত করার জন্য মিছিল, মিটিং এবং সশস্ত যুদ্ধ সংক্রান্ত বিস্তারিত ব্যাখ্যা সংবলিত লিফলেট বিলি করা হয়। ২৪ মার্চ জেলার বুড়িচংয়ে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয়। সভায় উপস্থিত জনতা বাঁশের লাঠি, হাতে তৈরি অস্ত্র দিয়ে পাক বাহিনীকে মােকাবেলা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে।
প্রস্তুতির প্রথম দিকে কুমিল্লায় একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটেছিলাে। এবং ঐ ঘটনাটি জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিশষ ভূমিকা রেখেছিল। মেজর খালেদ মােশাররফ জেলার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে এই মর্মে খবর পাঠান যে, তার উপর সিলেট অভিযানের নির্দেশ এসেছে কাজেই তাকে সিলেট অভিমুখে যাত্রার সময়ে জনতা যেন পথিমধ্যে তাদের গতিরােধ করে। নেতল খালেদ মােশারফের প্রস্তাবিত অনুরােধ অনুযায়ি প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং ছাত্রনেতা আকবর ও সাইফুলকে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নেতৃবৃন্দও জনতাকে সংগঠিত করার জন্য সেখানে পাঠান। নেতৃবৃন্দ হাজার হাজার জনগণকে সংগে নিয়ে নির্ধারিত সময়ে খলেদ মােশাররফের বাহিনীকে প্রতিরােধ করে। আগে থেকেই একথা বলা ছিলাে যে, সেনা বাহিনী জনতার অবরােধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোন প্রচার পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। ফলে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ব্রাহ্মনবাড়িয়া সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ছিলাে বিদ্রোহী জনতার দখলে।
কুমিল্লা জেলার সশন্ত্র প্রতিরােধ কমিটিতে যারা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রেখেছিলাে তাদের মধ্যে প্রফেসর আবদুল মান্নান চৌধুরী, মােঃ আব্দুর রউফ, আফজল খান, মইনুল হুদা, ইকবাল আহমেদ, আঃ রশীদ ইঞ্জিনিয়ার, আঃ মান্নান, জসিম উদ্দিন, কামাল মজুমদার, নাজমুল হাসান, রুস্তম আলী, সৈয়দ আহমেদ, শাহ আবদুল ওয়াদুদ, খলিলুর রহমান, হেদায়েত উল্লা, মােঃ ফয়জুল্লা, এহসানুর রহমান, আলী আশ্রাফ, আবুল হাসেম সহ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে গন্য। | কুমিল্লা জেলার মুক্তিযােদ্ধারা পাক বাহিনীর আক্রমন (২৪ মার্চ) ঠেকাতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা চট্টগ্রাম সড়কের কয়কটি ব্রীজ ধ্বংস করে দেয় । শ্যাম বক্সী ও ময়নামতিতেও দুটি পুল ভেঙ্গে দেয় সংগ্রামী জনতা। জনতার প্রবল প্রতিরােধ সত্বেও ২৫ মার্চ পাক সৈন্যরা কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাবে ধড় পাকড় ও ধ্বংসাত্মক কাজে মেতে ওঠে। প্রথমেই পাকদস্যরা বাঙ্গালী পুলিশ সিপাহীরা তাৎক্ষনিক প্রস্তুতি নিয়ে পাক সৈন্যদের প্রতিরােধ করতে ব্যর্থ হয়। ঘটনাস্থলেই সম্মুখ যুদ্ধে জীবন বিসর্জন দেয় কয়েকশ বাঙ্গালী পুলিশ সিপাহী। বেশ কিছু সিপাহী অন্ত্র সহ ব্যারাক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়। এসব সিপাহীরা মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ শুরু করে।
________________________________________
২৬ মার্চ ভােরে পাক বাহিনী শহরে কা জারি করে। একই সাথে তারা শহরময় ব্যাপক ধংসাত্মক কর্মকান্ডে মেতে ওঠে। পাক দস্যুদের গণহত্যার শিকার হয় আবুল হােসেন, ডি কে রায়, এম সি রায়, আকবর আলী সহ অসংখ্য জানা অজানা নাম। এদেরকে তারা অত্যন্ত নৃশংস ভাবে পৈচাশিক কায়দায় হত্যা করে। ২৬ মার্চ থেকে জনতা সর্বাত্মক সম্মুখ যুদ্ধের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। অনেকে অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যায়।
টাঙ্গাইল। মার্চ মাসের শুরু থেকেই টাঙ্গাইল জেলার স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। ১ মার্চ টাঙ্গাইলের ছাত্র নেতা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আহুত একটি বিশাল গণমিছিল সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। মিছিল শেষে শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের আঃ লতিফ সিদ্দিকী, খন্দকার আনােয়ার হােসেন, সােহরাব আলী, সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর পরই এ জেলার জনগণ এক চূড়ান্ত জনযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষ বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। সমবেত জনতা পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নেতৃবৃন্দের কাছে জানতে চায় ।
৯ মার্চ টাঙ্গাইলে গঠিত হয় ‘জয়বাংলা বাহিনী। এই বাহিনীর নেতা নির্বাচিত হন ছাত্রলীগ সভাপতি আবু মােঃ এনায়েত করিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুল কাদের সিদ্দিকী। জয়বাংলা বাহিনীর নেতৃবৃন্দ প্রথমেই জনগনক ঐক্যবদ্ধ করার পাশাপাশি জেলার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ও সেনা সদস্যদের একত্রিত করে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। প্রথম দিকে কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিংয়ের কাজ শুরু হয়। জেলার মােহাম্মদ আলী কলেজের ছাত্ররা প্রথম গ্রুপে অন্ত ট্রেনিং গ্রহন করে। মােঃ আলী। কলেজ, বিন্দুবাসিনী কলেজ, শিবনাথ স্কুল ও আনসার ক্যাম্প সহ বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপিত হয়। নেতৃবৃন্দ জেলার সকল ইউনিয়ন, থানা, মহকুমা, গুলােতেও স্থানীয় নেতৃবৃন্দকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি ও সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য জরুরী ভিত্তিতে কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশ দেন। জয়বাংলা বাহিনীর নেতৃত্বে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের চুড়ান্ত ও সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হােত বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘােষণা দেন সেটি প্রথম কাগমারী ওয়ারলেস কেন্দ্রে ধরা পড়ে। বার্তাটি তাৎক্ষণিক ভাবে ওয়ারলেস কেন্দ্র থেকে টাঙ্গাইল থানায় পাঠানাে হয়। থানা থেকে বার্তাটি আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গ্রহণ করেন। একই সময়ে বার্তাটি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ ওয়ারলেসেও ধরা পড়ে। মির্জাপুর থেকে বার্তাটি নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগ নেতা ফজলুর রহমান। ২৬ মার্চ সারাদিন টাঙ্গাইল শহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা মাইক যােগে প্রচার করেন ছাত্র নেতা আনােয়ার উল আযম ও ফারুক আহমেদ। এদিন
________________________________________
আওয়ামী লীগ নেতারা শহরের আদালত পাড়ায় এক জরুরী সভায় মিলিত হন। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন মির্জা তফাজ্জল হােসেন মুকুল, এডঃ নুরুল ইসলাম, বদিউজ্জামান খান সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এই সভায় সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার জন্য টাঙ্গাইল জেলা হাইকমান্ড” গঠিত হয় এবং হাইকমান্ডের অধীনে সকল সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগ নেতা আঃ লতিফ সিদ্দিকী জেলা সশষ বাহিনীর প্রধান নির্বাচিত হন। এনায়েত করিমকে সশন্ত্র বাহিনীর উপ প্রধান নিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া জেলা হাই কমান্ডের যারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন বদিউজ্জামান খান, শামসুর রহমান খান, সৈয়দ আবদুল মতিন, হাবিবুর রহমান খান, ফজলুর রহমান ফারুক, নুরুল ইসলাম, নঈম উদ্দিন আহমেদ, আল মুজাহিদী সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। জেলা হাই কমান্ডের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন খন্দকার আসাদুজ্জামান এবং চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন বদিউজ্জামান খান।
হাই কমান্ড নেতৃবৃন্দ প্রথমেই জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে বেশকিছু বন্দুক ও পিস্তল সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া সেনা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা সদস্যদের কাছ থেকেও অনেকগুলাে অস্ত্র সংগৃহীত হয় ২৭ মার্চ রাত টাঙ্গাইলের মুক্তিযােদ্ধারা জেলা সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাক সৈন্যদের উপর প্রথম সশস্ত্র আঘাত হানে। এই অভিযানের নেতৃত্ব দেন কাদের সিদ্দিকী। টাঙ্গাইল অবস্থানরত মার্চ দ্বিতীয় দফায় টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজ আক্রমনের জন্য মেজর শফিউল্লা জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল আসেন এবং এদিনই পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনা করেন। মুক্তিযােদ্ধারা সার্কিট হাউজ দখল করে নেয়। এই যুদ্ধে বহু পাক সেনা নিহত হয়। এই ঘটনার পর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার সহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পন করে।
ঢাকা থেকে যাতে পাক বাহিনী টাঙ্গাইলে না প্রবেশ করতে পারে সেজন্য কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা নাটিয়া পাড়া, মির্জাপুর ও গোড়ান নামক স্থানে ডিফেন্স গড়ে তােলে। ৩ এপ্রিল পাক দস্যুরা টাঙ্গাইলে আসার পথে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। বহু পাকিস্তানী দস্যু এই যুদ্ধে হতাহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে সুবেদার আঃ আজীজ অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন। হাবিলদার খালেক বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধকরে শহীদ হন। পাক বাহিনীর মারাত্মক অস্ত্রের মুখে এক পর্যায় এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের ডিফেন্স ভেঙ্গে যায় এবং ৩০ জন মুক্তিযোেদ্ধা শহীদ হয়। এরপর পাক বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় এবং যেখানে যাকে যে অবস্থায় পায় তাকে সেখানে হত্যা করে।
অন্যদিকে মুক্তি যােদ্ধারা পুনরায় সংগঠিত হতে শুরু করে। তারা জেলা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে বিপুল পরিমান অস্ত্র শস্ত্র নিজেদের দখলে নেয়। এরপর জনতার সর্বাত্মক সহযােগিতার মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে চুড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
________________________________________
দিনাজপুর মার্চের শুরু থেকেই দিনাজপুর জেলার সর্বত্র আন্দোলন অগ্নিমুখী হয়ে ওঠে। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালীরা একটি আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। ৩ মার্চ দিনাজপুর ইনষ্টিটিউট মাঠে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে জনতার বিশাল জঙ্গী মিছিল জনসমুদ্রে পরিনত হয়। হাজার হাজার মানুষ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানায় এবং যে কোন ষড়যন্ত্রের জন্য সেনাশাসক ইয়াহিয়া খানকে হুশিয়ার করে দেয়। ৭ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক স্থানীয় নেতৃবৃন্দের কাছে পৌছলেও জনগন প্রবলভাবে উদ্দীপ্ত হয় ৮ মার্চ সকালে রেডিওতে বঙ্গবন্ধু ভাষণ শােনার পর। এদিন দিনাজপুর শহরে জনতার ঢল নামে। গ্রাম গঞ্জের রাস্তা ঘাট মানুষের মিছিলে সয়লাব হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ অফিস ও নেতৃবৃন্দের বাড়ীতে জনতার ঢেউ আছড়ে পড়ে দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে শহরে মিছিল আসতে থাকে। শুরু হয় সর্বাত্মক প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রস্তুতি ।
৭ মার্চের ভাষণের পরপরই এ জেলার নেতৃবৃন্দের মধ্যে যােগাযােগ শুরু হয় এবং ৮ মার্চ গঠিত হয় দিনাজপুর জেলা সংগ্রাম কমিটি”। সংগ্রাম কমিটির মধ্যে উল্লেখযােগ্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রহিম, ইউসুফ আলী, মােকাসেদ আলী, গােলাম রহমান, শাহ মাহতাব, শাহ মােঃ ইউসুফ, ওয়াকিল উদ্দিন মন্ডল, খতিবুর রহমান, মজিদ চৌধুরী, গুরুদাস তালুকদার, এস এ বারী, আবুল কালাম আজাদ, মির্জা আনােয়ারুল হক, এটি এম মকবুল হােসেন, তেজেন নাগ, রফিক চৌধুরী, আজিজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ রিয়াজুল ইসলাম, মােশারফ হােসেন, ‘স্রাদুল লতিফ, আবদুস সাত্তার সহ প্রমুখ
ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী ছাত্র নেতৃবৃন্দের সময় গঠিত হয়। “ছাত্র ব্রিগেড”। ছাত্র ব্রিগেডের পাশাপাশি গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ”। এই দুটি কমিটিই পরস্পর একে অন্যের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করে যায়। এ সব কমিটির যারা নেতৃত্ব দিয়ে আন্দোলন বেগবান করেছেন তাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুর রহিম, সাধারণ সম্পাদক মােকসেদুর রহমান, ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি মতলেবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক মােঃ সাইফুল ইসলাম। এ ছাড়া এ দুটি কমিটিতে আরাে যারা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে ছিলেন জাফর আলী, শরিফুল ইসলাম, মুহমুদুল হাসান মানিক, মখান, মকসুদ নুর, তহিদুল ইসলাম, মােহাঃ যাকারিয়া, আহমেদ আসাদুল্লা সহ আরাে অনেকে।
দিনাজপুর অঞ্চলে নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে ছাত্র নেতারা এ জেলার গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কমিটি গঠন করে স্থানীয় যুবক-ছাত্র ও আগ্রহী ব্যক্তিদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। প্রাথমিক ভাবে জেলার লাইসেন্সকৃত বন্দুক যা গ্রাহকরা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে নেতাদের দিয়েছিলেন তা দিয়ে প্রাথমিক প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে তােলা হয়। জেলার অবসর প্রাপ্ত আনসার, পুলিশ, ইপি আর ও সেনা সদস্যবৃন্দ
________________________________________
| মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে আসে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে | মমভার হােসেনের নেতৃত্বে একটি অৱ মিছিল শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করলে তা আন্দোলনরত মুক্তিপাগল মানুষের মনে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে।
এ ছাড়া দিনাজপুরের বন্দর, বিরল, সৈয়দপুর সহ প্রতিটি থানায় ব্যাপক ভিত্তিতে গনপ্রতিরােধ বাহিনী গড়ে ওঠে। এসব প্রতিরােধ বাহিনীর নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে ছিলেন বিরল থানার কাশেম উদ্দিন, আনােয়ার খলিফা, ইদরিস আলী, মােহাম্মদ শফিক। চিরির বন্দরের মাহতাব বেগ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ২৩ মার্চ মাহতাব বেগের নেতৃত্বে প্রায় ৩০ হাজার মুক্তি পাগল বাঙ্গালী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমন করে। পাকিস্তানী সৈন্যদের ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সামনে এসব মুক্তিপাগল জনতা অতি সামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে কেবল মনােবলের জোরে দীর্ঘ সময় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে যায়। এক পর্যায়ে প্রতিরােধ বাহিনীর নেতা মাহতাব বেগ একটি বন্দুক নিয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ক্ষীপ্র গতিতে পাক সেনাদের মােকাবেলা করতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে শক্রর একটি গােলা মাহতাব বেগের বক্ষ ভেদ করে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ ঘটনায় জনতার মনােবল ভেঙ্গে যায় এবং তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । এই যুদ্ধে পাক দস্যুদের হাতে বহু মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। পাক বাহিনীর এই হত্যাজঙ্কের প্রতিশােধ | নিতে ২৪ মার্চ ভূসির বন্দরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পুনরায় সমবেত হয়। নেতৃবৃন্দ “কেল মনােবল সম্বল করে যুদ্ধ জয় করা যায় না”-একথা বুঝিয়ে সমবেত জনতাকে তাদের তাৎক্ষণিক অগ্রযাত্রা থামাতে সমর্থ হন এবং প্রস্তুত হয়ে পরবর্তী আক্রমণের জন্য সবাইকে তৈরি হতে বলেন। | ২৫ মার্চ ঢাকার পাক বাহিনীর নৃসংশ গণহত্যার খবর ভারতীয় বেতারে ২৬ মার্চ প্রচারিত হলে সমগ্ৰ দিনাজপুরের মুক্তিপাগল মানুষ জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সমবেত হয়ে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আলােচনা করেন। এদিন পাক সৈন্যদের একটি বিশাল কনভয় দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করে আস্তানা গড়ে এবং ব্যাপক ধ্বংসলীলা আরম্ভ করে। শত্রুর পাশাপাশি মুক্তি প্রত্যাশী জনতা চারদিক থেকে “জয়বাংলা” শ্লোগানে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত করে তােলে। সেই সঙ্গে শুরু হয় চূড়ান্ত জনযুদ্ধের প্রস্তুতি। কেবিএম কলেজ কেন্দ্রে স্থাপিত হয় প্রধান প্রশিক্ষণ শিবির। এখানে প্রধান দায়িত্ব পালন কারীদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, বশীর উদ্দিন মাষ্টার, মহসীন আকতার, নাদের চৌধুরী, হাবিবুর রহমান। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযােদ্ধারা মােহনপুর, ভূসির বন্দর,কাঞ্চন, দশ মাইল মােড় সহ জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাদের অবস্থান গড়ে তােলে। ২৮ মার্চ জেলার পুলিশ, ইপি আর, আনসার সদস্যরা বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেন। এ সকল সদস্যরা পুলিশ ব্যারাক, ইপি আর ব্যারাক আক্রমণ চালিয়ে বিপুল পরিমান অৱশৰ গােলাবারুদ দখল করে। মুক্তিযােদ্ধারা একপর্যায়ে সার্কিট হাউজে আক্রমন করে পাক সৈন্যদের হঠিয়ে দিয়ে সেখানে তাদের ঘাটি গড়ে তােলে এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখে।
________________________________________
নােমাখালী “এবারের সংগ্রামী স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”-১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্দ্যান) বঙ্গবন্ধু শখ মুজিবুর রহমানের এই স্বাধীনতার ডাক নােয়াখালীতে পৌছানাে মাত্র সর্বস্তরের মানুষ অগ্নিলিঙ্গের মত জ্বলে ওঠে। ৭ মার্চ সারাদিন এ জেলার মানুষ অপেক্ষা করছিলাে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ নির্দেশ শােনার জন্য। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার পর জনতা আওয়মী লীগ নেতাদের কাছে এ ধরনের একটি ঘােষণাই আশা করছিলাে। রাতে টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা নােয়াখালীতে পৌছামাত্রই শহরে সর্বত্র প্রতিটি মহল্লায় শুরুহয় মিছিল মিটিংসেই সঙ্গে ব্যাপক প্রস্তুতি। ৮ মার্চ সকালে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষন প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে সংগ্রামী জনতা উত্তাল সমুদ্রের মত গর্জে ওঠে।
নােয়াখালী জেলায় স্বাধীনতার স্বপক্ষে মুক্তি প্রত্যাশী মানুষের জন্য যারা সর্বাত্মক, আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের মধ্যে কামাল উদ্দিন আহমেদ, হাজী আঃ রশীদ, শামসুজ্জামান বাবুল, আবদুল মালেক উকিল, শহীদ এস্কান্দার, নুরুল হুদা, খাজা আহমেদ, আবদুল মালেক, নাসের চৌধুরী, নুরুল হক, আবদুল হাই, মােহাম্মদ হানিফ, কাজী ইদ্রিস, দেলােয়ার হােসেন, শফিকুর রহমান, আজিজুল হক ছিলেন অন্যতম। এ সকল নেতৃবৃন্দ ছাগল নাইয়া, পরশুরাম, হাতিয়া, রায়পুর সহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত প্রতিরােধ আন্দোলনের কেন্দ্র প্রস্তুত করেন।
ছাত্র নেতাদের মধ্যে এ জেলার যারা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মমিন উল্লা, আবুতাহের মাহমুদুর রহমান বেলায়েত, মােস্তাফিজুর রহমান, লুৎফর রহমান, এনামুল হক, মােশাররফ হােসেন, ফজলে এলাহী, গােলাম হরােয়ার, ফখরুল ইসলাম, জয়নাল আবেদিন, মিজানুর রহমান, নেফায়েত উল্লা, মােস্তফা ভূইয়া, সাইফুল জাহাঙ্গীর, আজিজুর রহমান ইকবাল, সরােয়ার দীন, আসম আঃ রব, মােস্তফা কামাল, নবী নেওয়াজ, আবদুর রাজ্জাক, হিমাংশু বনিক, কাজী হারুন, ফজলুল হক ওয়াদুদ সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এ সকল ছাত্র নেতারা মূলতঃ যুবক ও ছাত্রদের সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এ জেলার বেশীর ভাগ সামরিক প্রশিক্ষণ বা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয় চর এলাকায়। মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে তাদের মধ্যে কর্মসূচী ভাগ করে দেয়া হয়। এসব কর্মসূচীর মধ্যে ছিলাে গােয়েন্দা সূত্রে খবর সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহ ও সরবরাহ প্রভৃতি। এসব কমিটিকে সহায়তা করার জন্য বিভিন্ন পেশার মানুষ সকল প্রকার সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেন। নােয়াখালী জেলার শহীদ মিনার মাঠ, কচিকাচার মাঠ, ফুল ও কলেজ সমূহের মাঠ, জর্জকোর্ট প্রাঙ্গন, পিটি আই স্কুল প্রাঙ্গনে প্রথম দিকে ট্রেনিং সেন্টার খােলা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য এ সকল প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পাক বাহিনীর নাগালের বাইরে বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে স্থাপন করা হয়। ছুটিতে থাকা এবং অবসর প্রাপ্ত সেনা ও পুলিশ সদস্যরাই ছিলেন ট্রেনিং ক্যাম্পগুলাের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে। ১৮৬
________________________________________
| ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পাক বাহিনীর পৈচাশিক আক্রমনের খবর নােয়াখালীর নেতৃবৃন্দ এদিন গভীর রাতেই জেলা প্রশাসক মনযুর-উল-করিম ও পুলিশের কর্মকর্তা এস এ খানের মাধ্যমে পেয়ে যান। ২৬ মার্চ সার্কিট হাউজ প্রাঙ্গনে হাজার হাজার মানুষের এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে। বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগ নেতা আঃ হাকিস সহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। জেলা প্রশাসক মনযূর উল করিম এই জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত প্রাপ্ত স্বাধীনতার ঘােষনা পড়ে শশানান। সভাশেষে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হয়। জেলা ছাত্রলীগের মমিন উল্লা ও আবদুল হাই ঢাকা থেকে পাঠানাে স্বাধীন বাংলার একটি পতাকা নিয়ে সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করেন। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়ে যায়। একই সঙ্গে জনতা তাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় এগিয়ে আসে। | নােয়াখালী জেলার প্রধান পরিচালনা কক্ষ খােলা হয়েছিল পাবলিক লাইব্রেরীতে । মােহাম্মদ হানিফ, শহীদ এস্কেন্দার আবদুর রশীদ, খালেদ সাইফুল্লা, আজিজুল ইসলাম, কামালউদ্দিন আহমেদ সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এই পরিচালনাঁ কাজের দায়িত্বে ছিলেন। নেতৃবৃন্দের প্রধান কাজ ছিল জেলা ও কেন্দ্রের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় বজায় রাখা এবং বিভিন্ন স্থানের অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের খোঁজ খবর রাখা, তাদের রসদ সংগ্রহ ও তা যথাস্থানে পৌছে দেয়া ইত্যাদি। পুলিশ বিভাগের লুৎফর রহমানের নেতৃত্বেও একটি গ্রুপ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খবর সরবরাহের কাজ করতেন।
২৩ এপ্রিল পর্যন্ত নােয়খালীতে মুক্তিযােদ্ধারা নির্বিঘ্নে তাদের কর্মতৎপরতা চালিয়ে যায়। ২৪ এপ্রিল পাক সেনারা শহরে প্রবেশ করে ঘাটি স্থাপন এবং তাদের অপারেশন শুরু করে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায় এবং অনেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে গমন করে।
সিলেট ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানী শাসকেরা বাঙ্গালীদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রদানে নানা প্রকার তাল বাহানা শুরু করে। সেই সঙ্গে স্বৈরাচারী সেনা শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে নানা রকম ষড়যন্ত্র আটতে থাকে। বিন্নি অপকৌশলের এক পর্যায়ে ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করে। সিলেট জেলার সর্বস্তরের জনগণ তার এই ঘােষনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং মিছিল মিটিং এর মাধ্যমে সমস্ত শহর প্রকম্পিত করে তােলে। জনতা এক পর্যায়ে একটি অনিশ্চিত অবস্থার মুখােমুখি হয় এবং অনিবার্য সংঘাতের আশংকা করতে থাকে।
________________________________________
নেতৃবৃন্দ এসময় যে কোন পরিস্থিতি মােকাবেলা করার জন্য সর্বস্তরের মনুষকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আত্মনিয়ােগ করে।
সিলেটের সমস্ত স্কুল কলেজ ১ মার্চ থেকে বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য তাদের কার্যক্রম শুরু করে।৩ মার্চ বিক্ষুব্ধ জনতার একটি মিছিলে পাক সৈন্যরা গুলি চালালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়। মানুষ মারমুখী হয়ে ওঠে। এদিন সিলেট রেজিষ্ট্রী মাঠে জনতার বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তৃতা করেন সদর উদ্দিন, চৌধুরী, আবদুল মােমিন, সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, ইবনে আজীজ, এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। পাক বাহিনীর কার্য উপেক্ষা করে রাস্তায় রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। আওয়ামী লীগে নেতা দেওয়ান ফরিদ গাজির নেতৃত্বে দেশ প্রেমিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সামরিক শাসকদের এক আপােষ বৈঠক ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ইতিপূর্বে পাক বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবীতে জনতা একপর্যায়ে মারমুখী হয় উঠলে প্রশাসন তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। জেলা প্রশাসক আঃ ছামাদ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করলেও জেলা পুলিশ সুপার আঃ কুদ্স বিরােধী ভূমিকা পালন করে।
৭ মার্চ রাতে সিলেট বেতার কেন্দ্র এদিন ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সংক্ষিপ্তসার বিশেষ সংবাদ শিরােনামে প্রচার করে। সিলেট বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক মন মুস্তফার নেতৃত্বে কর্মীরা স্বাধীনতার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । এদের মধ্যে মনােয়ার আহমেদ, জমির সিদ্দিকী, মহিউদ্দীন বদরুল হােসেন, সায়ফুল জায়গীরদার, আনােয়ার মাহমুদের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য।
এ জেলার নারী সমাজ ১০ মার্চ একটি বিশাল মিছিল বের করে। ব্যাপকভাবে সংগঠিত মিছিল মিটিংয়ের পাশাপাশি নেতৃবৃন্দ স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নেতৃবৃন্দ স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বাের্ডের মাঠে প্রথম প্রশিক্ষণ শিবিরটি স্থাপিত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন আঃ মান্নান। এ জেলার লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী সমাজও বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনতাকে উদ্দীপ্ত করে তােলে।
২৩ মার্চ সিলেটের জেলা রেজিঃ মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় । আওয়ামী লীগ নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জেলা সংগ্রাম কমিটিতে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন সাদাত খান, ডাঃ এম এ মালিক, আঃ সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজী, হাবিবুর রহমান, সিরাজ উদ্দিন, মােদাব্বের আলী, মুজিবুর রহমান সহ আরাে অনেকে। নেতৃবৃন্দ জনতাকে সংগঠিত করে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বাইরে সিলেট জেলায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে পীর হাবিবুর রহমান, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, আবদুল হামিদ, আ, ফ, ম, কামাল, ইকবাল আহমেদ চৌধুরী, আতিক চৌধুরী, মনির উদ্দিন আহমেদ, আসাদ্দর আলী সহ প্রমুখ। এ ছাড়া ছাত্রলীগ নেতা সদর
________________________________________
উদ্দিন চৌধুরী, বাবরুল হােসেন, মকসুদ আজীজ লামা, সফিকুর রহমান, রফিকুল হক, মােমন চৌধুরী, মােহাম্মদ হােসেন, আবদুল মােজদির, তারিক উল্লার নাম বিশেষ ভাবে অগ্রগন্য । অত্র ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে ছিলেন রেজোয়ান আহমেদ, তবারক হােসেন, সুকুমার দেবনাথ, বরুন রায়, প্রদীপ রায়, দিলদার হােসেন, সাইদুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম, আরজান আলী, নরেন্দ্র ঘােষ, সামসুল হক, খায়রূন নাহার। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের গােলাম মোের্তজা, আবদুল গনী, আবদুল নুর, আবুল ফজল প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে এ জেলার আরাে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে কবি দিলওয়ার, মেজর মােত্তালিব, হেমেন ভট্টচার্য, উষা দাস, নীনা চৌধুরী, আমিনুর রশীদ সহ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
২৫ মার্চ সিলেটে প্রায় এ লক্ষ লােকের এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। নেতৃবৃন্দ | এই জনসভা থেকে জনতাকে অদের কর্মসূচী জানিয়ে পরবর্তী যে কোন অবস্থা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। ২৫ মার্চের রাতেই পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর সরাসরি কনভয় শহরে প্রবেশ করে। সেই সঙ্গে শুরু হয় জনতার সর্বাত্মক প্রতিরােধ । পাকিস্তানী দখলদার শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের মুক্তিযুদ্ধ।
डिग्री ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগের পর অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চল (আজকের বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তানের দখলে চলে যায় । ৪৭ থেকে ‘৭১ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী অবাঙ্গালী উর্দুভাষী স্বৈরাচারী শাসকেরা বাংলার ঘাড়ে জেঁকে বসে এবং বাঙ্গালীদের উপর নানা প্রকার নীরিফামূলক অপশাসন চালিয়ে যায়। শুরু থেকে তাদের বিমাতাসুলভ আচরণে বাঙ্গালীরা ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ‘৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এসবই বাঙ্গালী জাতির জীবনে তাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন ‘৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে একেকটিকে মাইলফলক।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয় লাভের পরেও পশ্চিমা শাসকেরা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ষড়যন্ত্র আটতে থাকে যা দেশকে ক্রমশঃ একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যায়। যে অনিবার্য পরিস্থিতির জন্য বাঙ্গালী জাতি অপেক্ষা করছিলাে। এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তারা একটি মুক্তির সূর্যালােক স্পর্শ করার জন্যই অপেক্ষা করছিলাে। | কুষ্টিয়া জেলার মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণাকে স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্বাগত জানায়। এবং সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি”। কুষ্টিয়া জেলার গড়াই নদীর চরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ২৫ মার্চ গঠিত ‘জয় বাংলা সংগ্রাম কমিটি”। ২৬
________________________________________
মার্চ ছাত্র নেতা আখতারুজ্জামানের বাড়ীতে জেলার সর্বদলীয় ছাত্র নেতাদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। মারফত আলী, আবদুল মােমেন, সামসুল হাদী সহ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ সরাসরি পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার পক্ষে মত ব্যক্ত করে।
২৫ মার্চ গঠিত জয় বাংলা সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্ব প্রদানের জন্য যারা নিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন মির্জা জিয়াউল বারী, আনােয়ার আলী, আবদুল বারী, শহিদুল ইসলাম, আবদুল মােমেন, শেখ দলিল উদ্দিন, আবদুল জলিল, আখতারুজ্জামান, জুলফিকার আলী, জাফর উল্লা খান, শমসের বারী, শামসুল হাদী, আলম বিশ্বাস, শেখ সুলতান, জালাল উদ্দিন, ফিরােজ আলম, কমর উদ্দিন, নজর আলী, কাইজার হােসেন, হাবিব উদ্দিন, সুহাত আলী, মতিয়ার রহমান, আমির ছালাম, আতিয়ার রহমান, মখলেসুর রহমান, আনিস হােসেন বাদশা, সালাউদ্দিন পিন্টু, সফিউল ইসলাম, আঃ হামিদ রায়হান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
কুষ্টিয়া জেলায় ৩ মার্চ স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করা হয়। শহরের ইসলামিয়া কলেজ প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্র লীগের জালাল উদ্দিন। এ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত ও সর্বাত্মক প্রতিরােধ যুদ্ধের যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অহিউদ্দিন আহমেদ, কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী, বাদল রশীদ, সৈয়দ আলতাফ হােসেন, বাহাউদ্দিন আহমেদ, শেখ রওশন আলী, আমির উল ইসলাম, নুরে আলম জিকু, আঃ রউফ চৌধুরী, আনিসুর রহমান আক্কাস, শামসুল আলম দুদু, হাদি আহমেদ, আহসান উল্লা, গােলাম কিবরিয়া, আশাবুল হক, আবু ওসমান চৌধুরী, আযম চৌধুরী, তৌফিক এলাহি চৌধুরী, কে এম নুরুন্নবী, কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী, শামসুল হুদা, আবদুল জলিল, মিজানুর রহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, মুরশেদ আলম, নিজামুল হক, রেজাউল করিম, রশিদুজ্জামান দুদু, আবদুল হান্নান, আঃ আজিজ খান, শহিদুল ইসলাম, নুরুল হুদা, আইনুল হক, সৈয়দ নিযাম উদ্দিন, গােলাম মােস্তফা ফটিক, জয় গােপাল বাগচী, নাজমুল আলম সাদী, মুজিবুল হক মঈন, রাজা মিয়া, এহসানুল হক, যুগল কিশাের, আবুল হােসেন তরুন, নাসিমউদ্দিন আহমেদ, সিদ্দিক জামাল প্রমুখ। এদের মধ্যে আবু ওসমান চৌধুরী সেক্টর কমান্ডার এবং তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী সাব সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন।
কুষ্টিয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা, খােকসা, কুমারখালী, মিরপুর, ভেড়ামারা, দামুরহুদা, জীবননগর, মেহেরপুর সহ বিভিন্ন স্থানে গঠিত হয় জয় বাংলা বাহিনী। প্রতিটি এলাকায় নেতৃবৃন্দ তাদের নিজ নিজ উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যান। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী কুষ্টিয়া শহরে আক্রমন চালায়। শহরে প্রবেশের পর তারা ব্যাপক ধরপাকড় এবং বাড়ীঘরে অগ্নিসংযােগ করে। ২৫ মার্চের রাতেই তারা প্রায় দু’শােলােককে হত্যা করে। পুলিশ ব্যারাকের একশ বাঙ্গালী সিপাহীকে ব্রাশ করে হত্যা করে। ৮ মার্চ থেকেই কুষ্টিয়াতে অবসর প্রাপ্ত সৈনিকদের সহযােগিতায়
________________________________________
নেতৃবৃন্দ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধের যাবতীয় কার্যক্রম শুরু করেন। জেলার হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করে।
ফরিদপুর সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী পরাধীন মানুষের নেতা বাঙ্গালী জাতির জনক ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহান মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যার নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিলাে মুক্তিযুদ্ধে সেই মহান জনকের জন্মস্থান ফরিদপুরের গােপালগঞ্জে। স্বাভাবিকভাবেই সেকারণে এ জেলার স্বতন্ত্র ঐতিহ্য রয়েছে।
ফরিদপুর জেলার মানুষ মার্চের শুরু থেকেই ঐক্যবদ্ধভাবে যেকোন পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য তৈরি ছিলাে। এ জেলার প্রতিটি পাড়া মহল্লা পর্যন্ত স্বাধীনতার দীপ্ত চেতনায় উজ্জীবিত মানুষ আসন্ন এক যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছিলাে আগে থেকে। কাজেই ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতি এ জেলার সংগ্রামী মানুষের আগ্রহ ছিলাে বেশী। এ দিন সন্ধ্যার আগেই * এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের এই মূল ঘােষণা ফরিদপুরে পৌছে যায়। মুহূর্তের মধ্যে তা দাবানলের মত ছড়িয়ে যায় চতুর্দিকে। গ্রাম গ্রামান্তর থেকে হাজার হাজার মানুষ অগ্নিস্রোতের মত ঢাল, সড়কি, বল্লম, তীর ধনুক প্রভৃতি নিয়ে শহরের দিকে আসতে থাকে।
৭ মার্চ জেলার নেতৃবৃন্দ সন্ধ্যায় এক জরুরী বৈঠকে বসে। পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য সভায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রথমে ছাত্র-যুবক-জনতাকে সংগঠিত করে তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ প্রদান এবং মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অত্র সংগ্রহের মত প্রধান বিষয়গুলি আলােচনায় প্রধান্য পায়। তবে চূড়ান্ত সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় ১১ মার্চ। এই কমিটির সদস্য ছিলেন শামসুদ্দিন মােল্লা, কে, এম, ওবায়দুর রহমান, সৈয়দ হায়দার হােসেন মােঃ আমিন উদ্দিন, ডাঃ আবতাব উদ্দিন, ব্যারিষ্টার সালাউদ্দিন, এ্যাডঃ মােশাররফ হােসেন, ইমাম উদ্দিন আহমেদ, এস এম নুরুন্নবী, মনােরঞ্জন সাহা, বিভূতি ঘােষ, রবীন্দ্র ত্রিবেদী, আমিনুর রহমান, আবদুর রহমান, পীযুষ বন্দোপধ্যায়, নুর মােহাম্মদ, মােঃ আবু জাফর, শাহরিয়ার কুমী, কবিরুল আযম, কাজী সালাউদ্দিন, সহ প্রমুখ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ নেতৃবৃন্দ।
এই সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে গঠিত সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলাে একটি নির্দিষ্ট কমান্ডের মধ্যে চলে আসে এবং চূড়ান্ত যুদ্ধ ট্রেনিং এর কাজ শুরু হয়ে যায়। এক একটি মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপকে সর্বোচ্চ ২১ দিনের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এ সকল মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষন ও পাক বাহিনীর প্রতিরােধ করে জেলার পুলিশ সুপার নুরুল মমিন খান তার নিয়ন্ত্রন অগ্রগার খুলে দেন। এ ছাড়াও জেলায় যে সকল লাইসেন্সপ্রাপ্ত বন্দুক বা অন্ত্রপাতি ছিলাে জনগণ দেশের স্বার্থে
________________________________________
সেগুলাে সংগ্রাম কমিটির হাতে তুলে দেন। পাশাপাশি হাতে অ তৈরির একটি উদ্যোগ গৃহীত হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন হরেন্দ্র কর্মকার খায়রুজ্জামান বতু, কার্জী সালাউদ্দিন, আমিনুর রহমান ও কাজী তসলিম। এই গ্রুপ মূলতঃ বােমা তৈরির কাজ চালিয়ে যায় । | ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক আলম ইউসূফ ও পুলিশ সুপার নুরুল আমিন খান সংগ্রাম কমিটিকে সর্বতােভাবে সহযােগিতা করে মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহিত করেন। পাক বাহিনী শহরে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত তারা সগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমেই প্রশাসন পরিচালনা করেন। ২২ এপ্রিল পাক বাহিনী ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে। শহরে প্রবেশের পর থেকেই পাক দস্যুরা বাঙ্গালীদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন, গ্রেফতার, হত্যা ও জ্বালাও পােড়াও অভিযান রু করে। অন্যদিকে প্রতিশােধের আগুনে উজ্জ্বল মুক্তিপ্রত্যাশী। সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার নিয়ে মাঠে নামে। জেলার বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যে এগিয়ে আসে আপামর জনতা।
বগুড়া দু’শ বছরের ইংরেজ রাজত্বের অবসানের পর বাঙ্গালীরা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলাে মূলতঃ তা ছিলাে বৃটিশের কাছ থেকে পাঞ্জাবীদের (পাকিস্তানী) কয়েদ খানায় প্রবেশমাত্র। এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলতঃ বাঙ্গালীদের বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রর সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছিলাে। পশ্চিমারা যে বাঙ্গালীদের শাসন করতে চেয়েছিলাে তা মাত্র এক বৎসরের মাথায় স্পষ্ট হয়ে যায়। ফলে ১৯৪৮ সাল থেকেই বাঙ্গালীরা স্বীয় আত্ম-পরিচয়ে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। বাঙ্গালীদের সেই প্রত্যাশার সফল বাস্তবায়ন ঘটে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কঠে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের তার ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্যে দিয়ে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে। বাঙ্গালী জাতি দু’শ বছরেরও অধিক কাল ধরে এমন একটি ঘােষণার জন্যই অপেক্ষা করেছিলাে। এমন একজন দেশপ্রেমিক নেতার জন্যই তারা অপেক্ষা করেছিলাে। ৭ মার্চের সেই ঘােষণার পরপরই সমগ্র দেশের মতই বগুড়া জেলার সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ একটি চুড়ান্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। পাকিস্তানী অপশাসক আর তাদের দস্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিশােধের আগুনে উজ্জ্বল এ জেলার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল সমূহের নেতৃবৃন্দ গঠন করেন সংগ্রাম পরিষদ।
বড়া জেলার সংগ্রাম পরিষদের যারা নেতৃত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য যারা তারা হলেন গাজিউল হক, রফিকুল ইসলাম, আকরাম খান, মকবুল, আমান, রেজাউল বাকী, হায়দার আলী, মাহফুজার, আবদুর রাজ্জাক, ফেরদৌস জামান, মাসুদার রহমান হেলাল, মমতাজ উদ্দিন মানিক, রফিকুল ইসলাম লাব, মােরর মন্ডল, মমতাজ
________________________________________
মন্ডল, মাহমুদুল হাসান খান, মখলেসুর রহমান, ডাঃ জাহেদুর রহমান, এম আই চৌধুরী সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। মার্চের মাঝামাৰি সময়ে গাজিউল হক সহ কয়েকজনকে নিয়ে গঠিত হয় “হাইকমান্ড” এই হাই কমান্ডের প্রধান কার্যালয় শহরে পাক বাহিনী প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত ছিলাে সার্কিট হাউজে। শহরের মাসুদ মিলনায়তনে প্রথম কয়েকদিন এই কমিটি কাজ চালায়। নেতৃবৃন্দ ব্যাপক গণসংযােগের মধ্যে দিয়ে জনমত গঠন ও ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও অস্ত্রের যােগাড়ে ব্যাপকভাবে আত্ম নিয়ােগ করেন। এছাড়া সংগ্রাম কমিটি বিভিন্ন উপকমিটি গঠনের মাধ্যমে তাদের হাতে কাজ কর্ম ভাগ করে দেন। | বগুড়া জেলার প্রধান প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি স্থাপিত হয় সেন্ট্রাল স্কুল, মতিননগর, জেলা স্কুল, করনেশন ফুল সহ অন্যান্য স্থানে। প্রথমদিকে কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল ও বাঁশের লাঠি দিয়ে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ। পরে বিভিন্ন ভাবে সংগৃহীত অন্ত মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং এর জন্য ব্যবহার করা হয়। ২৫ মার্চের আগে জেলা পুলিশের ও শেরপুর থানা থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গােলা বারুদ যােগাড় করা হয়। জেলার বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযােদ্ধারা রাত্রিকালীন পাহারার ব্যবস্থা করে। একাজে প্রধানত ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এসব কাজে কেউ কারাে প্রতি কোন প্রকার বিদ্বেষ পােষণ করেনি। অবশ্য এ বিষয়টি কেবল বগুড়াতেই নয় বরং তা সমগ্র দেশের মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। এসব কাজে সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করে থাকতাে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা প্রদানের জন্য। কাউকে কোন দায়িত্ব প্রদান করা হলে তা অত্যন্ত মর্যাদাকর বলে মনে করা হােত । এবং এই বােধই বাঙ্গালী জাতিকে তার কাংখিত লক্ষ্যে পৌছুতে সাহায্য করে।
২৫ মার্চ পাক বাহিনী বগুড়া শহরে প্রবেশ করে। তবে প্রবেশের শুরুতেই তারা প্রতিরােধ বাহিনীর সম্মুখীন হয়। এই যুদ্ধে শহীদ হয় ছনু, হিটলু, আসাদ সহ আরাে অনেকে। মুক্তিযােদ্ধারা প্রথম প্রতিরােধ যুদ্ধে অত্যন্ত দৃঢ় মনােবল ও বীরত্বের পরিচয় দেয়। পাক বাহিনীও এই যুদ্ধে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। এর আগে ২৩ মার্চ শহরের আলতাফুন্নেহা মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই মাঠে মুক্তিযােদ্ধারা ব্যাপকভিত্তিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতাে এবং প্রশিক্ষিতদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হােত। দিনরাত্রি ২৪ ঘন্টা জেলার প্রশিক্ষণ শিবিরগুলাের কর্মকান্ড অব্যাহত থাকতাে। ২৫ মার্চ রাতে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দকে এই মর্মে খবর পাঠানাে হয় যে, পাক বাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে-এই সংবাদের ভিত্তিতে সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় গাছ, ইট, ট্রেনের ভাঙ্গা বগি প্রভৃতি দিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। জেলা পুলিশ বাহিনীর বেশীর ভাগ সদস্য পরে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এস মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।