You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

এপ্রিলের প্রথম দিকে বগুড়া শহর পুরােপুরি পাক বাহিনীর দখলে চলে যায়। এই পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ গ্রামাঞ্চলে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করে। অনেকে অন্ত্রের যােগাড় এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে চলে যায়।
জামালপুর। লাহাের প্রস্তাবে বাঙ্গালীদের জন্য একটি স্বাধীন আবাস ভূমির কথা স্বীকৃত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী কালে অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার নামে মূলতঃ বাঙ্গালীদের বিভক্ত করে তাদের আরাে দুর্বল করে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হােল। ধর্মের ভিত্তিতে জোড়াতালি দিয়ে ৪৭ সালে কতিপয় রাজনৈতিক দস্যুর চক্রান্তে যে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিলাে তা কেবল অজ্ঞতা প্রসূত রাজনৈতিক অদুরদর্শিতাই নয়-ত্য কোন রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না সে কথা একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রমাণ হয়েছে। | পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সেনা শাসক কুখ্যাত জেনারেল ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালীদের প্রবল প্রতিবাদ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবীর প্রতি কোন প্রকার তােয়াক্কা না করে ১মার্চ (১৯৭০) জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থাগিত ঘােষণা করে। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মত সেদিন জামালপুর জেলার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর” এই শ্লোগান মুখরিত জনতা এদিন বিকেলে রেলষ্টেশন মাঠে এক বিশাল সমাবেশে সমবেত হয়।১ মার্চের সেই সমাবেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন প্রধানত ছাত্র লীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা। ২ মার্চ জামালপুর শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় জনসভা। এ সময় ক্রমেই মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। এর পাশাপাশি জেলার সংগ্রামী জনতা পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের জন্য তৈরী হতে থাকে। | ৪ মার্চ জেলার গৌরীপুর মাঠে ছাত্রলীগের উদ্দ্যোগে আয়ােজিত জনসমাবেশ এক বিশাল জনসমুদ্রের আকার ধারণ করে। এই জনসভাতেই এ জেলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি আবদুল হাকিমের নেতৃত্বে একটি দল আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে আলােচনার জন্য ঢাকায় যান। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা নির্বাচিত হন আবদুল হাকিম এবং আহবায়ক নিযুক্ত হন মতিয়ার রহমান তালুকদার। সগ্রাম পরিষদের নির্দেশে আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল করিমের নেতৃত্বে একদল প্রচার কর্মী শহরের বিভিন্ন স্থানে মাইক যােগে জনগণকে আন্দোলনের কর্মসূচী জানিয়ে দেয় । ৫ মার্চ ছাত্র নেতারা জনতাকে সঙ্গে নিয়ে জামালপুরে পাক বাহিনীর অত্র ভর্তি একটি ট্রেন আটক করে। ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে সেদিন যারা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন সােলায়মান হক, ফজলুল বারী তারা, আঃ মতিন হিরু, আবদুল মান্নান, সাইফুর রহমান, খায়রুল ইসলাম, উৎপল কান্তি ধর, মােঃ শাহনেওয়াজ, মাহবুবুর রহমান আনসারী সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
________________________________________
৭ মার্চ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না হওয়ায় জামালপুর জেলার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এবং জেলার বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন ও মহকুমাগুলােতে প্রচন্ড বিক্ষোতে প্রদর্শিত হয়। এদিন রাতেই বিভিন্ন মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল ঘােষণা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে পৌছে যায়। ৮ মার্চ সকালে ঢাকার রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণ রেডিওতে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোেগ হয়। অসহযােগ আন্দোলকে আরাে তীব্রমুখী করার লক্ষ্যে সরিষাবাড়ি, দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ, মেলান্দহ সহ বিভিন্ন স্থানে গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি। এসকল সংগ্রাম কমিটির যারা নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে রাশেদ মােশাররফ, হাজী আঃ ছামাদ, আবদুল মালেক, আবদুল হাই বাচ্চু, করিমুজ্জামান তালুকদার, নুরুল ইসলাম, রাশিদুল হক, কামাল চৌধুরী, ইনসান মাষ্টার, ওয়াসিম উদ্দিন, আবদুল মজিদ, হারুনুর রশীদ, বাদশা আনসারী, শচীন বাবু, গােবিন্দ পােদ্দার, মনজু, প্রদীপ পাল, মামুনুর রশীদ, আব্দুস সবুর, হামিদ, মােক্তার, আবদুল জলিল, আনসার আলী, মােক্তার হােসেন, দীপেন বসাক, অধীর মােহান্ত, আবদুর রাজ্জাক, আনােয়ার হােসেন, মিনহাজ উদ্দিন, ডাঃ সাইদুজ্জামান, রফিউদ্দিন তালুকদার, দুদু মিয়া, দুলাল চক্রবর্তী, আহমেদ সাদী, নজরুল তালুকদার, আশরাফ হােসেন, আবদুল হামিদ, বদরুল ইসলাম, ফিরােজ মাষ্টার নুরুল মিয়া, মাকসুদ আলী খান, আঃ মজিদ আকন্দ, মােকাদ্দেস আলী, আনােয়ার হােসেন চান, ময়েন আহমেদ, সৈয়দ আলী মন্ডল, দিদারুল আলম, ডিএমওয়াহেদ, ডাঃ আনিসুজ্জামান, ফখরুদ্দিন খােকা, রনবীর সিং, শামসুল হক, আবদুল জলিল, ডাক্তার বেলাল, গিয়াস উদ্দিন, আবদুর রশীদ, আবদুল ওয়াহেদ, আকু মন্ডল, সাহাবুদ্দিন কালু, হাসান ফকির, হামিদ মিয়া, খালেক তালুকদার, সামূদ্দিন তালুকদার, মন্মথ দে ছিলেন অন্যতম প্রধান সংগঠকদের সারিতে। | জামালপুর জেলা সদর সহ সকল থানাতেই মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির ও ক্যাম্প স্থাপিত হয়। প্রথম দিকে রামদা, সড়কি, বল্লম, তীর-ধনুক, লাঠি এবং সামান্য কয়েকটি রাইফেল ও বন্দুক দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়। জেলার প্রধান দুটি প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপিত হয় ষ্টেডিয়াম ও শহীদ মিনার মাঠ। ষ্টেডিয়াম কেন্দ্রের মূল দায়িত্ব ছিল ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের হাতে এবং শহীদ মিনার কেন্দ্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ। এ ছাড়া সার্বিক কর্মকান্ড পরিচালনায় ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ।
১৯৪৭ সালে বিতাড়িত ইংরেজ শাসকদের চক্রান্তের সঙ্গে হাত মেলায় এই উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাজনীতিকেরা। ফলে বাঙ্গালীদের স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চক্রান্তকারীদের ফাঁদে সাময়িক ভাবে আটকে যায়। খন্ডিত বাংলার পূর্বাঞ্চলকে পরাধীনতার নতুন বেড়ি পরিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীনে ন্যান্ত করা হয়। পাকিস্তানী শাসকেরা বাঙ্গালীদের উপর শুরু থেকেই আধিপত্যবাদের
________________________________________
ভঙ্গিতে স্বৈরাচারী কায়দায় দুঃশাসন শুরু করে। ফলে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে উগ্র আঞ্চলিকতাবাদী, হিংস্র মনােভাবাপন্ন, কঠোর সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানীদের সঙ্গে বাঙ্গালীদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সাল বাঙ্গালী জাতিকে দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে তার কাংখিত সীমানায় পৌছে দেয়। | ১ মার্চ থেকে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের মত অগ্নিযুগের বিদ্রোহের সূতিকাগার চট্টগ্রামেও আন্দোলনের ঢেউ জেগে ওঠে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের ১ মার্চের অধিবেশন স্থগিতের ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম জেলার আন্দোলন নতুন গতি লাভ করে। ৭ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা হাতে লিখে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেন। ৮ মার্চ সকালে সকাল রেসকোর্সের ভাষণ রেডিওতে প্রচারিত হয়। এদিন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকী ঢাকা থেকে ভাষণের মূল কপি নিয়ে চট্টগ্রামে পৌছান। ৯ মার্চ জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসভবনে নেতৃবৃন্দ জরুরী বৈঠকে মিলিত হন।
১০ মার্চ চট্টগ্রামে “সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। পাঁচ সদস্যের সেই নির্বাহী কমিটিতে ছিলেন জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম, আর সিদ্দিকী, এম, এ, হান্নান, আবদুল খালেদ ও এম, এ, মান্নান। যদিও এর আগে থেকেই চট্টগ্রামে সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। প্রথম দফায় আওয়ামী লীগ অফিসে কমিটি গঠন হলেও পরে এম আর সিদ্দিকীর বাসভবনে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ দ্বিতীয় দফায় মিলিত হন। এখানে নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী ও রূপরেখা নিয়ে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চুড়ান্ত আলােচনা করেন। এই বৈঠকে চূড়ান্ত সশস্ত্র যুদ্ধের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কর্মসূচীর মধ্যে প্রতিদিন মিছিল, মিটিং ও জনসংযােগের মধ্যে দিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজ আরম্ভ হয়ে যায়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিছনের খােলা চত্বরে শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ। জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে সংগৃহিত অন্ত এখানে জমা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক কর্মকান্ডে এগিয়ে এলেন এ জেলার মহিলারা। জাহানারা আঙ্গুর ও নুরুন্নাহার জহরের নেতৃত্বে কয়েকশ মহিলা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। এ জেলার বেশীর ভাগ ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয় কুমিল্লার অরণ্য অঞ্চলে, বােয়াল খালীর, গােমদন্ডী, জালালাবাদ পাহাড়, ষােল শহর বন গবেষণা কেন্দ্র, লাল খান বাজার, পুলিশ লাইন সহ বিভিন্ন স্থানে। এসকল কেন্দ্রে সামরিক প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন যারা তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন আতিয়ারা মওলা, এনায়েত মওলা, দেলােয়ার হােসেন, সুবেদার মেজর জামসেদ।
২৫ মার্চ কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের একটি যৌথ গ্রুপ আদালত ভবনের অস্ত্রাগার আক্রমণ করে সেখান থেকে প্রচুর গােলা বারুদ ও অন্ত্ৰশ উদ্ধার করে। এ জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে ১৫ মার্চ থেকে সাংস্কৃতিক কর্মীরা পুরােদমে জনগণকে উদ্ধ।
________________________________________
করতে ব্যাপকভাবে আত্মনিয়ােগ করেন। শহরের লালদিঘী ময়দানে সাংস্কৃতিক দলের নিয়মিত অনুষ্ঠানগুলােতে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হতে থাকে। ২০ মার্চ শহরের ঝাউতলা, শেরশাহ কলােনী, হালিশহর, পাঞ্জাবী লেন, ফিরােজ শাহ কলােনী সহ প্রভৃতি স্থানে শুরু হয় বাঙ্গালী-বিহারী দাঙ্গা। বিহারী অধ্যুষিত অঞ্চলে বসবাসরত বাঙ্গালীদের অবাঙ্গালী বিহারীরা জবাই করে হত্যা করে। একমাত্র ২০ তারিখের রাতেই চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানী সৈন্যদের মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধের সৃষ্টি করে। এই প্রতিরােধের নেতৃত্বে দেন আওয়ামী লীগ নেতা এম, এ, হান্নান। এই অস্ত্র খালাসের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য পাকিস্তানীরা বাঙ্গালী মেজর জিয়াকে নিয়ােগ করেন। মেজর জিয়া অৱ খালাসের জন্য সৈন্যসহ দক্ষিণ হালি শহরে পৌছুলে সেখানে হাজার হাজার বাঙ্গালীর প্রতিরােধের সম্মুখীন হন এবং তিনি অবস্থা বেগতিক দেখে ফিরে আসতে বাধ্য হন।
২৫ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা সংগ্রাম কমিটি এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। সেদিন নেতৃবৃন্দ বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন যে দেশ এক সংকট জনক অবস্থার মুখােমুখি। কাজেই অত্যন্ত সুচিন্তিত ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সামনে এগুতে হবে। যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতির সময়ে সেদিন যারা এ জেলা থেকে স্বাধীনতার স্বপক্ষে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে বেলাল মােহাম্মদ, আবুল কাসেম সন্দীপ, সামসুল হুদা চৌধুরী, আতাউর রহমান কায়সার, এ,কে,খান, মেজর ভূইয়া, মােশারফ হােসেন পুলিন দে, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, জানে আলম, ইদ্রিস আলম, এম, এ, ওয়াহাব, আবু ছালে, মােখতার। আহমেদ, জাহান চৌধুরী, সৈয়দ ফজলুল হক, বি এম ফয়জুর রহমান, এস, এম, ইউসুফ, এ, বি, এম, মহিউদ্দিন, ইসামুল ইসলাম, নাজিম উদ্দিন, মােখলেস উদ্দিন আহমেদ, গােলাম রব্বানী, আবুল কালাম আযাদ, ডাঃ মাহফুজুর রহমান, কাজী ইনামুল হক, ফরিদুল আলম, মৌলবী সৈয়দ আহমেদ, এস, এম, হাসেম, সাবের আহমেদ, এস, এম, নুরুন্নবী, পূর্নেন্দ কানুন গাে, আহসানউল্লা চৌধুরী, বখতিয়ার নুর সিদ্দিকী, এম, এস, হক, আবু তাহের মাসুদ, খােরসেদুল ইসলাম, মােঃ মুছা, মওলানা আহমেদুর রহমান, মােহাম্মদ শহীদুল্লা, শফিউল আলম, তপন দত্ত, শামসুজ্জামান হীরা, মাহবুবুল হক, মােহাম্মদ শাহ্নআলম সহ প্রমুখের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য।
রংপুরএকাত্তর সালের মার্চের শুরু থেকেই রংপুরের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তাল হয়ে উঠে। তবে তারও আগে অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারি রংপুর প্রেসক্লাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্র-যুবক জনতা ঐক্যবদ্ধ ভাবে তখন থেকেই পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। এই প্রস্তুতি পর্বের চূড়ান্ত পর্যায়ের শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে। এ সময় এ্যাডভােকেট নজরুল হক,
________________________________________
আজিজুর রহমান, মােহাম্মদ আযান, আবদুল হারেজ, সিদ্দিক হােসেনসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে সর্বস্তরের মানুষ সংগঠিত হয়। ৩ মার্চ রংপুর শহরে সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যানার যে বিশাল গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয় তা এ জেলার মানুষকে একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন কর। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী থেকে জনতার বিশাল মিছিলটি যখন দরদী সিনেমা হলের কাছে পৌছে তখন সে মিছিলে স্থানীয় অবাঙ্গালী বিহারিরা অত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। ঘটনাস্থলে শংকু নামে মিছিলের একজন কর্মী নিহত হয়। এই মিছিল থেকেই গুলিবদ্ধি শরিফুল নামের অপর আরেকজন কর্মী ১৭ মার্চ হাসপাতালে মারা যায় ।
এ জেলার নেতৃবৃন্দ প্রতিটি পাড়া-মহল্লার প্রতিরােধ কমিটি গঠন করেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় সংগঠিত নারকীয় হত্যাযজ্ঞের খবর ২৬ মার্চ সকালেই রংপুর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এদিনই রংপুর সেনানিবাস সেনানিবাস থেকে সশস্ত্র পাকিস্তানী সৈন্যরা শহরে নেমে পড়ে। প্রথমেই তারা আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ ও দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে এবং অনেককে ঘটনাস্থলে হত্যা করে।
২৮ মার্চ রংপুরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার মানুষ হাতে তৈরি অস্ত্র নিয়ে সেনানিবাস আক্রমন করে। স্বাধীনতাকামী সাধারণ জনগণের সঙ্গে এদিন রংপুরের মিঠাপুকুর অঞ্চল থেকে শতশত সাঁওতাল পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নেয়। এদিন বিকেলের মধ্যে সমগ্র ক্যান্টনমেন্ট এলাকা জনতা কর্তৃক ঘেরাও হয়ে যায় । উত্তেজিত পাকদস্যুরা এ সময় জনতার প্রতি গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে নিহত হয় অসংখ্য মানুষ । এদিনের জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে জানা যায় যে, ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত বাঙ্গালী সেনাদের সঙ্গে আগে থেকে আলােচনা করেই সেনানিবাস ঘেরাও করা হয়েছিল কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সেই আবেগপূর্ণ আলােচনার কোন সঙ্গতি না থাকায় গণমানুষের সেই প্রবল প্রতিরােধ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। | ২৮ মার্চ জনতার সেনানিবাস আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে সমস্ত রংপুর শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। একই সঙ্গে শুরু হয় পাকবাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অভিযান। গণহত্যা, অগ্নিসংযোেগ, নারী ধর্ষণের তান্ডবলীলা চলে এক টানা ৩ এপ্রিল পর্যন্ত। ৩ এপ্রিল শহরের রাস্তায় ২২ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গুলিকরে মারা হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন গােপালচন্দ্র, ক্ষিতিশ হালদার, উত্তম কুমার, হররেজ মিয়া, দুর্গাদাস, মােহাঃ মহররম ও রফিক আলী সহ আরাে কয়েকজন। | পাক বাহিনীর এই ব্যাপক হত্যালীলার পর থেকে রংপুর অঞ্চলের ছাত্র-যুবক জনতার একটি বিরাট অংশ ভারতে চলে যায়। আরেকটি অংশ জেলার ভেতর থেকে সংগঠিত হতে থাকে এবং সংঘবদ্ধভাবে তারা পাকবহিনী ও তার এদেশীয় দালাল রাজাকারদের বিরুদ্ধে শুরু করে স্বাধীন মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম।
________________________________________
রাজশাহী একাত্তরের মার্চ মাসের গোড়া থেকেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আন্দোলনের ঢেউ ওঠে বাংলার প্রতিটি জেলায়। রাজশাহী জেলার বিক্ষুব্ধ মানুষের ক্ষোভ ও সময় পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে বারুদের মত জ্বলে ওঠে। স্বাধীনতা প্রত্যাশী লক্ষ মানুষের গগন বিদারী শ্লোগানে মুখরিত মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে এগুনাের সময় পাক দস্যরা অতর্কিতে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলে আহত হয় অনেক। এই মিছিলে গুলিবিদ্ধ নজমুল হুদা তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত নিয়ে দেয়ালে লিখে ছিলেন। বীর বাঙ্গালী অস্ত্রধর স্বাধীন বাংলা কায়েম কর”।
রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ মার্চের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কয়েক হাজার সদস্যের এক বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে। পাশাপাশি ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণবাহিনী” । এরা পরস্পর স্বাধীনতার অভিন্ন উদ্দেশ্য সহযােগিতা ও মতামতের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরেই এ জেলার নেতৃবৃন্দ সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। শহরের পাড়ায় পাড়ায় সংগ্রাম কমিটির শাখা কমিটি গঠন করা হয়। আন্দোলনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্র-যুবকেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
শহরের মিয়াপাড়ায় অবস্থিত লাইব্রেরী মাঠে কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল দিয়ে “গণবাহিনী তাদের সামরিক প্রতিশক্ষণের কাজ শুরু করে। গণবাহিনী প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন সেকেন্দার আবু জাফর,আঃ মালেক চৌধুরী, মতিউর রহমান, শফিকুর রহমান সহ আরাে অনেকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটির রিকুট করা মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং এর কাজ শুরু হয় জেলার বিভিন্ন কলেজ ও স্কুল মাঠে। রাজশাহী কলেজ মাঠে স্থাপিত হয় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান প্রশিক্ষণ শিবির। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময় থেকে অবশ্য এ জেলার সকল কর্মকান্ড আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার নেতৃত্ব প্রদানকারীদের মধ্যে ছিলেন আনছার আলী, মহতাব উদ্দিন, সফিকুর রহমান সহ আরাে অনেক। রাজশাহীতে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র লীগের যৌথ উদ্দ্যেগে স্থানীয় সাঁওতালদের সংগঠিত করে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে এক বিশাল প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে তােলা হয়।
৫ মার্চ রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিশাল সমাবেশে পাক বাহিনী গুলি চালিয়ে অনেককে হতাহত করে। ৭ মার্চ সারারাত শহরের রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ৮ মার্চ সকাল বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হলে সর্বস্তরের মানুষ তাদের অফিস আদালত, ক্ষেত খামার, স্কুল কলেজ, কলকারখানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। জনতা আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চারিদিক মিছিলে মিটিংয়ে প্রকম্পিত করে তােলে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে গেলে পাক বাহিনী শহরে কার্ফ জারী করে। কিন্তু জনতার রুদ্ররােষে সকল প্রকার সান্ধ্য আইন বন্যার মত ভেসে যায়।
________________________________________
১০ মার্চ পর্যন্ত রাজশাহীতে একটানা কার্য চলে। কিন্তু তার মধ্যে দিয়েও জনতা তাদের আন্দোলনের কর্মসূচী চালিয়ে যায়। ১১ মার্চ আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান রাজশাহীতে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জনগণকে ব্যাখ্যা দেন। স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগমান ও সাফল্যজনক অবস্থানে পৌছে দেয়ার লক্ষ্যে এ জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরাও উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। আবদুল আজীজের নেতৃত্বে শিল্পীরা সংগঠিত, নাটক, আবৃত্তির মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন।
রাজশাহীতে ১৭ মার্চ স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সংগ্রাম কমিটির জেলা আহবায়ক নির্বাচিত হন আবদুল কুদুস এবং নগর আহবায়ক নিযুক্ত হন মােঃ শফিউদ্দিন। ১৯ মার্চ গঠিত হয় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ”। ইতিপূর্বে পাক-প্রশাসন থেকে দেয়া নির্দেশের ভিত্তিতে ১২ ও ১৩ মার্চ জনগণ তাদের লাইসেন্সকৃত বন্দুক থানায় জমা দিতে গেলে ছাত্র-যুবক-জনতা তাদের কাছ থেকে সেগুলাে কেড়ে নেয় এবং অনেকে তাদের অ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। এ ঘটনার যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর, মাহফুজ, মতিন, দুলাল প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়াও ছাত্র নেতৃবন্দ রাজশাহী সাইন্স ল্যাবরেটরী ও বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী থেকে বিস্ফোরক দ্রব্যে লুট করে তা দিয়ে প্রচুর বােমা তৈরি
| ২৩ মার্চ শহরে একটি ব্যতিক্রমধর্মী মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এদিনের বিশাল জঙ্গী মিছিলের অগ্রভাগে সাঁওতাল সম্প্রদায় তীর-ধনুকে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের মহড়া দেয়। একই দিন স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পে হাবিলদার আতাউরের নেতৃত্বে একদল সিপাহী পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায় ।
২৫ মার্চের গভীর রাতে রাজশাহী ইপিআর ক্যাম্পের ওয়ারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়ার কথা শােনা যায়। ক্যাম্পের বাঙ্গালী সিপাহীরা সেই ঘােষণা স্থানীয় জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। এ ঘটনার অল্পক্ষণের মধ্যেই শহরে পাকবাহিনী প্রবেশ করে ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু করে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকে গ্রেফতার করে। ২৭ মার্চ পাক দস্যরা রাজশাহী জেলা পুলিশ ক্যাম্প আক্রমন করে। এই আকশ্বিক হামলায় অসংখ্য বাঙ্গালী সিপাহী নিহত হয়। অনেকে অস্ত্রসহ বেরিয়ে এসে জনতার সঙ্গে যুক্ত হয়। শুরু হয় সিপাহী জনতার যৌথ সশস্ত্র সংগ্রাম ।
রাজশাহী জেলাতে স্বাধীনতার স্বপক্ষে আওয়ামী লীগের যারা সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে এ্যাডঃ মহসীন আলী, টুকু মহুরী, এ্যাডঃ আবদুল হাদী, মােহাঃ মনিরুজ্জামান, নজমুল হক, সরদার আমজাদ হােসেন, নুরুল হক, আবদুল হাকিম, মােস্তাফিজুর রহমান, মােহাম্মদ জাফরুল্লা, এ্যাডঃ আবদুস ছালাম অন্যতম। ন্যাপের আতাউর রহমান, এ্যাডঃ মহসীন প্রামানিক, এলাহী বক্স, গােলাম আরীফ, আধুনজি মােশারফ হােসেন, মােহাম্মদ মহসীন, আবদুল লতিফ, আবদুল গফফার, আবদুল হাফিজ,
________________________________________
প্রমুখ। ছাত্রলীগের মাহফুজুর রহমান, আবদুস সামাদ, শরীফ উদ্দিন, আবদুল কুদ্স, আবদুল করিম, মাহবুবুজ্জামানের নাম উল্লেখযােগ্য। ছাত্র ইউনিয়নের মতিউর রহমান, মালেক চৌধুরী, সেকেন্দার আবু জাফর, শফিকুর রহমান বাদশা, মােরশেদ কোরেশী, হাফিজুর রহমান টুকু, আবদুল লতিফ, মিজানুল হক মুকুল, রাহেনুল হক, আফজাল হােসেনের নাম উল্লেখযােগ্য। এছাড়াও রাজশাহী জেলাতে মহিলা মুক্তিযােদ্ধা বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন আলেয়া, হামিদা বেগম, চম্পা চৌধুরী, সাহিদা, ডলি, নাজমা, শামিম, সাইজু প্রমুখ।
বরিশাল বাংলার সাড়ে সাত কোটি অধিকার বঞ্চিত মানুষের প্রত্যাশার প্রতিধ্বনি প্রতিফলিত হয় ৭ মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কঠে। দশ লক্ষ মানুষের বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা বরিশালের মুক্তি প্রত্যাশিত বিপ্লবী জনতা শুনতে পায় ৮ মার্চ সকালে রেডিওতে । কেননা ৭ মার্চের জনসভার সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তানী সরকার তা প্রচার করতে দেয়নি। কাজেই পরদিন বেতারের বাঙ্গালী কর্মচারীদের চেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারিত হয়। রেডিওতে ভাষণ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে বরিশাল শহরে। বিপ্লবের আগুন কেবল শহরেই থেমে থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে জেলার প্রতিটি থানায়, গ্রামে, মহল্লায় ।
১ মার্চ বরিশাল অশ্বিনী কুমার মাঠে লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় । এই জনসভার পর পরই বরিশালে আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে গঠিত হয় “জেলা সংগ্রাম কমিটি”। কমিটির সদস্য ছিলেন আঃ রব সেরনিয়াবাত, আবদুল মালেক, নুরুল ইসলাম ম, আমির হােসেন আমু, মহিউদ্দিন আহমেদ। ৭ মার্চের পরে পুনরায় এই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে “সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির আহবায়ক নিযুক্ত হন মুজিবুর রহমান তালুকদার। শুরু হয় বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক কর্মকান্ড। মুক্তিযুদ্ধের সকল ক্ষেত্রেই এ জেলার ছাত্র-যুবকেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তারা বিভিন্ন অঞ্চলে ছােট ছােট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করে। এর পাশাপাশি সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে যায়। স্থানীয় সংস্কৃতিক কর্মীরাও বিভিন্ন ধরনের উদ্দীপনা মূলক সঙ্গীতের মাধ্যমে মানুষকে উদ্ভুদ্ধ করতে আত্মনিয়ােগ করেন। তাদের পরিবেশিত গণসঙ্গীত, নাটক, আবৃত্তি আন্দোলনে নতুন মাত্রা যােগ করে।
২৫ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমেদের বাসভবনে সংগ্রাম কমিটির
________________________________________
নেতৃবৃন্দ এক জরুরী বৈঠক মিলিত হন। এদিন রাতে ঢাকা থেকে প্রাপ্ত এক জরুরী তথ্যের ভিত্তিতে দ্বিতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম মধুর বাসভবনে। এই বৈঠকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছাড়াও জেলা প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ অংশ নেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মােতাবেক ভােররাতে সরকারি কর্মকর্তাদের সহযােগিতায় জেলা অস্ত্রাগার লুট করে জনতা সকল অস্ত্র গােলাবারুদ তাদের দখলে নিয়ে নেয়। | ২৬ মার্চ ভােরে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি স্বাধীনতার ঘােষণা বরিশাল সংগ্রাম কমিটির নিকট পৌছে। নেতৃবৃন্দ সেই ঘােষণা টাইপ করে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে জেলার প্রতিটি থানা সংগ্রাম কমিটির কাছে পৌছে দেন। এদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত নীতি নির্বাহী পর্ষদের এক জরুরী সভায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটি গঠিত হয় । বরিশাল জেলা পুলিশ সুপারের বাসভবনে অনুষ্ঠিত ঐ বৈঠকে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলকে মুক্ত এলাকা ঘােষণা করা হয়। এর পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের সকল কর্মকান্ড সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন দায়িত্ব বন্টন করে দেয়া হয় ।.মেজর জলিলকে এ সময় কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই সঙ্গে জেলার সকল অবসর প্রাপ্ত ছুটিতে থাকা সেনা, ইপিআর ও পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। | মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত বরিশাল জেলায় যে সকল নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে হাসান ইমাম চৌধুরী, এম, এ, জলিল, আমির হােসেন আমু, আবদুল মালেক, আলী আমজাদ, জামাল উদ্দিন আহমেদ, এম,এ, বারেক, গােলাম হােসেন, কাজী আজিজুল ইসলাম সহ আরাে অনেক নেতৃবৃন্দের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য। এ জেলার সংগ্রাম কমিটি প্রথমদিকে তাদের প্রধান কার্যালয়ে হিসেবে জেলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়কে ব্যবহার করে। সংগ্রাম কমিটির সরাসরি তত্ত্বাবধানে জেলার বেলপার্ক ও বিএমএ স্কুল মাঠে প্রধান দুটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যারা মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং প্রদান করেন তাদের মধ্যে ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, নুরুল হুদা, মেহেদী আলী ইমাম, নাসের, মাহবুব আলম বেগ, তাজুল ইসলাম সহ প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য হাতে অত্র তৈরির কাজে নিয়ােজিত ছিলেন এনায়েত হােসেন, মিন্টু বসু, চিত্ত হালদার, বেলালউদ্দিন, কবি শামসুল আলম, আবদুল, মাহবুব, সামসুদ্দিন খান ও হারুনার রশীদ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যুদ্ধের প্রথম দিকে বরিশাল জেলার কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন পৃথকভাবে কমিটি গঠন করেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন মােঃ নওশের, মাসুদ আহমেদ, নূরুল ইসলাম মুলি, এম, এ গফুর, মানবেন্দ্র বটব্যাল, আরজ আলী, মুজিবুর রহমান তালুকদার, শাহজাহান খান, আনােয়ার হােসেন সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
________________________________________
পাবনা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে বাঙ্গালীরা মনে করেছিলাে যে, ক্ষমতা দখলকারী পাকিস্তানী শাসকদের অপশাসন থেকে তারা মুক্তি পাবে। কিন্তু অবাঙ্গালী স্বৈরাচারী পাকিস্তানীরা জনতার সকল বৈধ দাবীকে উপেক্ষা করে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। এক পর্যায়ে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানী সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্থগিত ঘােষিত হলে বাংলার প্রতিটি অঞ্চলের মত পাবনার জনগণও উত্তাল বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। আসন্ন পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য শুরু হয় ব্যাপক প্রস্তুতি।
পাবনা জেলার সর্বস্তরের জনসাধারণ ১ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে একটানা অব্যাহত বিক্ষোভ চালিয়ে যায়। এবং ৭ মার্চ ঢাকায় আহুত জনসভার প্রতি তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। এবং সেদিন রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর জন্যে জনতার প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটে। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম” বঙ্গবন্ধুর এই আহবান এ জেলার জনতা এদিন সন্ধ্যার মধ্যেই টেলিফোনের মাধ্যমে পেয়ে যায়। নেতৃবৃন্দ জনতাকে সংগঠিত করে একটি ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। এর আগে ২ মার্চ আওয়ামী লীগ আহুত হরতালে সারা দেশের মত পাবনা জেলার অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, কলকারখানা সহ সবকিছু আঁচল হয়ে পড়ে। সারাদিন ধরে মিছিলে মিছিলে মুখরিত জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে থাকে বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর। | ৩ মার্চ শহরের পুলিশ লাইন মাঠে হাজার হাজার মানুষ বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত সমবেত হয়। এদিন উল্লসিত জনতার মুহুর্মুহু শ্লোগান ও করতালির মাঝে আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হােসেন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন। এবং আমজাদ হােসেনকে সভাপতি নির্বাচিত করে ৭ সদস্যের জেলা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আমিন উদ্দিন এমপি, আবদুর রব আমিনুল ইসলাম বাদশা, দেওয়ান মাহবুবুল হক, গােলাম আলী কাদেরী, আঃ ছাত্তার লালু। পাবনা জেলার স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য এই কমিটি সমগ্র জেলাকে মােট ৮টি বা অঞ্চলে ভাগ করেন। এবং ৮ টি শাখা কমিটি গঠন করেন। সংগ্রাম কমিটি জেলার পলিটেকনিক স্কুলে তাদের সদর দফতর স্থাপন করেন। এখান থেকে শুরু হয় তাদের ব্যাপক জনসংযােগ ও প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড। এ জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীরাও সংগ্রাম কর্মকান্ডকে গতিমুখী করার লক্ষ্যে উদ্দীপনামূলক সংগীত, নাটক সহ বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। | ১২ মার্চ থেকে পাবনা জেলা স্কুল মাঠে ও পুরাতন পলিটেকনিক মাঠ শুরু হয় ছাত্র-যুবক ও অগ্রহী জনতাকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রশিক্ষণ। প্রথম গ্রুপেই কয়েক হাজার সদস্য প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। জেলা শাসক নুরুল কাদের খান আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। একই সঙ্গে তিনি জেলা
________________________________________
পুলিশের সহায়তায় জেলার পুলিশ স্নাগার মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খুলে দেন। সংগৃহীত অত্র সংগ্রাম কমিটি এবং আন্দোলনরত জনগণের মনে নতুন মাত্রা যােগ করে।
২৫ মার্চের আগেই পাকিস্তানী সৈন্যরা পাবনা সার্কিট হাউজ, ডাক বাংলা সহ বিভিন্ন স্থানে ঘাঁটি গেড়ে সশস্ত্র অবস্থায় শক্ত অবস্থান নেয়। ২৫ মার্চের নির্মম পৈশাচিক হত্যাকান্ডের সঙ্গে সঙ্গে এখানে অবস্থানরত পাক দস্যুরাও স্থানীয় জনতার উপর তাদের জঘন্য হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সহ মুক্তিকামী মানুষের ঘর বাড়ি। হত্যা করে আমিন উদ্দিন এমপি, ডাঃ অমলেন্দু, সাইদ তালুকদার সহ বহু রাজনৈতিক ও ছাত্র-যুব নেতাকে। এ ঘটনার চারদিন পর ৩০ মার্চ পাবনা জেলায় গঠিত হয় বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিল” এই কাউন্সিল একটি স্থানীয় সরকারে পরিণত হয়। এই কমিটির সকল সিদ্ধান্ত জনগণ মেনে চলে। এবং চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে তারা এ জেলার জনতাকে সঙ্গে রেখে সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যান।
ময়মনসিংহ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ তথাকথিত পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলকারী অবাঙ্গালী স্বৈরাচারী | সেনাশাসক ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্ট কালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করলে ময়মনসিংহ জেলার সর্বস্তরের সংগ্রামী জনতা বিপ্লবের আগুনে জ্বলে ওঠে। ২ মার্চ এ জেলার মানুষ সর্বাত্মক হরতালে অংশগ্রহণ করে। সরকারি অফিস আদালতের কর্মচারীরা সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিলে চারিদিকে প্রকম্পিত করে তােলে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তার প্রতি। জনগণের ঘৃণা ও ক্ষোভ সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যায়।
৭ মার্চ ময়মনসিংহ জেলার মানুষ সারাদিন অধীর আগ্রহে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু পূর্ব ঘােষিত ভাষণ রেডিওতে প্রচারিত না হওয়ায় জেলার বিপ্লবী জনতা সব কিছু বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসে। মিছিলে মিটিংয়ে সমস্ত শহর যখন মুখরিত তখন টেলিফোনে খবর আসে যে, বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসভায় স্বাধীনতার আহবান জানিয়ে জনগণকে যেকোন পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। জেলার জনগণের মধ্যে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তারা জলন্ত বারুদের মত বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ সময় জনতা আওয়ামী লীগ অফিস ও জেলার নেতৃবৃন্দের বাড়ীতে জমায়েত হয় এবং পরবর্তী নির্দেশ প্রদানের জন্য নেতৃবৃন্দকে চাপ দিতে থাকে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ অফিসে সারারাত জনতার ভীড় লেগে থাকে। এ সময় নেতৃবৃন্দ প্রতিটি থানায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা নিজৰ বাহক মাধ্যমে পৌঁছে দেন। ৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে প্রচারিত হলে সমস্ত ময়মনসিংহ জেলা দাবানলের মত জ্বলে ওঠে।
________________________________________
৮ মার্চ থেকেই শুরু হয়ে যায় জনতার সর্বাত্বক প্রতিরােধ প্রস্তুতি। গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি”। সর্বসম্মতভাবে এ জেলার সংগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে যােগদানের আহবান জানালে তিনি ঢাকায় চলে যান এবং সেক্ষেত্রে ময়মনসিংহ জেলা সংগ্রাম কমিটির এক জরুরী সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে আওয়ামী লীগের জেলা সম্পাদক রফিক উদ্দিন ভুইয়াকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। কমিটি জেলার প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতির কাজ শুরু করেন।
ময়মনসিংহ জেলা ছাত্র লীগের উদ্দ্যোগে গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি” । এ কমিটির যারা সক্রিয় সদস্য ছিলেন তাদের মধ্যে নাজিমুদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম দুলাল, হাফিজুল হক, আঙ্গুর, মাহমুদ, কবির উদ্দিন, মুকুল, শামসুদ্দোহা, এরশাদুর রহমান, সামসুর রহমান সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের যৌথ নেতৃত্বে এ জেলায় মুক্তিযুদ্ধের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে ৮ মার্চ বিকেল থেকেই মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল মাঠের ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন শামসুল হক এমপি ও ডাঃ হাফিজ উদ্দিন। মার্চের শেষ দিকে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য রাইফেল দিয়ে। সহযােগিতা করেন জেলা পুলিশ সুপার সিরাজুল ইসলাম। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের যাবতীয় খরচ বহনের দায়িত্ব নেন জেলার সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। তারা স্ব উদ্দ্যোগে বাড়ী বাড়ী ঘুরে চাঁদা তুলে তা ট্রেনিং ক্যাম্পে জমা দিতেন। এক্ষেত্রে কেবল নগদ অর্থই নয়, জনতা চাল, ডাল, তরকারি, ঔয়ধ পত্র, কাপড় বিভিন্ন প্রকার সাহায্যেই মুক্তিযুদ্ধ শিবিরের জন্য। প্রদান করতেন। এক পর্যায়ে জনতার অনুদান এতই বেড়ে যায় যে, তা মুক্তিযােদ্ধাদের চাহিদার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশী হয়ে যায় । এ সকল অতিরিক্ত দ্রব্যে জেলা কলেজিয়েট কুলে গুদামজাত করে রাখা হয়। | ২৫ মার্চের পর এ জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার লোেক মুক্তিযুদ্ধে অংশ। গ্রহণের জন্য স্বেচ্ছায় এসে প্রশিক্ষণ শিবিরে ভীড় জমাতে থাকে। এ সময় সংগ্রাম কমিটির অস্থায়ী প্রধান কার্যালয় ছিলাে কমিটির চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ভূইয়ার বাসভবন। জেলা প্রশাসক হাসান আহমেদ, পিটিআই স্কুলের খন্দকার আঃ জব্বার, সামসুল হক, ও পুলিশ সুপার অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। | ময়মনসিংহ টাউন হল ময়দানে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন রফিক। উদ্দিন ভুইয়া। এখানেই পাকিস্তানী পতাকায় অগ্নিসংযােগ করেন ছাত্রলীগ নেতা নাজিম উদ্দিন। এ সময় জেলার কয়েকটি স্থানে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী দাঙ্গা বেধে যায়। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অনেকে হতাহত হয়। যুদ্ধের সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মত এখানেও টেলিফোন কর্মচারীরা বিভিন্ন ভাবে পাক প্রশাসনের গােপন খবর স্থানীয় সংগ্রাম কমিটিকে প্রদান করতেন। এদের সাহায্যেই এ জেলার ইপিআর বাহিনীকে নিরস্ত্র করার খবর নেতৃবৃন্দ জানতে পারেন এবং এ বিষয়ে ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে আলােচনা করে তাদের
________________________________________
যাবতীয় অ ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধারা দখল করে নেয়। টেলিফোনের মােহাম্মদ ফরহাদ ও মােহাম্মদ শাহজাহান এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। | পাক বাহিনী যাতে ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য জনতা ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরােধ সৃষ্টি করে। গফরগাঁ, গয়েশপুর, সাংস্কৃতিক কর্মীরাও মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অলকময় ও মিথুন দে প্রভৃতি। সাংস্কৃতিক কর্মীর উদ্যোগে জেলার বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের উদ্দীপনামূলক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ২৩ এপ্রিল পাক বাহিনী ময়মনসিংহ-ঢাকা সড়কের কয়েকটি স্থানে ব্যাপক প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। এক পর্যায়ে পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে। সংগ্রাম কমিটি এসময় হালুয়াঘাটে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
এ জেলার যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, রফিকউদ্দিন ভুইয়া, আশরাফ হােসেন আকন্দ, ইমান আলী, আনিসুর রহমান খান, আনােয়ারুল কাদির, নাজিমুদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ আহমেদ, নজরুল ইসলাম, আবুল হাসিম, আজিজুল হক, সৈয়দ আবদুস সুলতান, ইদরিস আলী, আবদুল খালেক, আবদুর রউফ, নুরুল ইসলাম, মােঃ মফিজ উদ্দিন, সামসুল হক, আলী আকবর, কমর উদ্দিন, আবুল মনসুর । মােস্তফা মতিন, কেতুমিয়া, আঃ হাকিম, মােঃ রেজা, আবদুল হাকিম সহ প্রমুখের নাম অন্যতম।
নড়াইল মার্চ মাসের গোড়া থেকেই নড়াইল জেলার সর্বত্র সংগ্রামের আগুন জ্বলে ওঠে। মুক্তিকামী মানুষের অসহযােগ আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে এ জেলার প্রতিটি অঞ্চলে। চেতনার বিস্ফোরণ ঘটে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যে। পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে তারা।
৪ মার্চ নড়াইলের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের এক জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনের কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই সময়ে গঠিত হয় নড়াইল জেলা “সগ্রাম কমিটি” এই কমিটির আহবায়ক নিযুক্ত হন খন্দকার আবদুল হাফিজ। কমিটির অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী লেঃ মতিউর রহমান, শাহেদ আলী খান, এ্যাডঃ বজলুর রহমান, এ্যাডঃ শরীফ আবদুল হাকিম,এ্যাডঃ ওয়ালিয়র রহমান, এখলাস উদ্দিন আহমেদ, এম সােলায়মান, এ্যাডঃ গাজি আলী করিম, বিএম মতিয়ার রহমান, শ,ম, আনােয়ারুজ্জামান, ওহিদুজ্জামান, আবদুস ছালাম, সরদার আঃ ছাত্তার,এ্যাড আবুল কালাম আজাদ, দেলােয়ার হােসেন, মাহবুবুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
ছাত্রনেতা ফজলুর রহমান জিন্নাকে আহবায়ক নিযুক্ত করে গঠিত হয় নড়াইল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এই কমিটিতে অন্যান্য যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সাইফুর রহমান, আবু
________________________________________
দাউদ, মােহাম্মদ হারুন, শরীফ মােশাররফ, শরিফ হমায়ুন কবীর, খায়রুজ্জামান, অমর শীল, বিভূতি ভূষণ, সিদ্দীক আহমেদ, কাজী আঃ হামিদ, গােলাম নবী, আবুল কালাম, আজীবর, শরীফ বাদশা প্রমুখ।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ণ বিবরণ নড়াইলের নেতৃবৃন্দ প্রথমে জানতে পারেন যশােরের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে টেলিফোনে। একই দিন বিশ্বের বিভিন্ন বেতার মাধ্যমেও ৭ মার্চের ভাষণের কথা প্রচার করা হয়। এবং সেসব বেতার ঘােষণার মাধ্যমেও এ জেলার জনগণ বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার কথা জানতে পারেন। এদিন রাতেই নড়াইল শহরে এবং পার্শ্ববর্তী লােহাগড়া, কালিয়া, বড়দিয়া, দিঘলিয়া সহ বিভিন্ন কেন্দ্রগুলােতে হাজার হাজার মানুষ জড়াে হয়ে যায়। এসব বিপ্লবী জনতা দা, সড়কি, বল্লম গ্রভৃতি হাতে তৈরি অস্ত্র সঙ্গে করে আনে।
৮ মার্চ থেকে নড়াইলের প্রতিটি থানা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ শুরু হয়ে যায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্র নেতারা ব্যাপক গণসংযােগ শুরু করেন। ছাত্র জনতাকে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য শুরু হয় ব্যাপক প্রস্তুতি। দলে দলে ছাত্র-যুবক-কৃষক প্রশিক্ষণ শিবিরে সমবেত হতে থাকে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য। ব্যাপক প্রস্তুতির পাশাপাশি প্রতিদিন চলতে থাকে সভা সমাবেশ ও মিছিল।
২৩ মার্চ নড়াইল চিত্রাবানী সিনেমা হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয় । খন্দকার আঃ হাফিজ এখানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখেন। সভাশেষে ছাত্র-জনতা মহাকুমা প্রশাসকের বাসভবনে গিয়ে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে ফেলে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয় । মহকুমা প্রশাসক ডঃ কামাল সিদ্দিকী জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে বেরিয়ে আসেন এবং এই অঞ্চলের সার্বিক মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২৫ শে মার্চের খবর যখন নড়াইলে পৌছে তথন এই অঞ্চলের সর্বত্র ব্যাপক শােকের ছায়া নেমে আসে। স নড়াইলকে মনে হয় একটি শােক সন্তপ্ত পরিবার। কিন্তু এ জেলার জনগণ শােককে শক্তিতে পরিণত করে পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীকে মােকাবেলার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করে। | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুর মােহাম্মদ মিয়া পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে নড়াইলে চলে আসেন এবং স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যুক্ত হলে আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার হয়। ২৩ মার্চ সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নড়াইল সরকারী অস্ত্রাগার ভেঙ্গে প্রচুর গােলাবারুদ সগ্রহ করা হয়। এই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এবং ছুটিতে থাকা সদস্যদের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ।
নড়াইলের প্রধান প্রধান প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি স্থাপিত হয়, লােহাগড়া স্কুল মাঠ, ইতনা হাইস্কুল মাঠ, দিঘলিয়া স্কুল মাঠ, কুমড়ি, বাগ্রাম, প্রভৃতি স্থানে। এসব স্থানে প্রশিক্ষকের
________________________________________
দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে লুৎফর বিশ্বাস, মাহবুব শিকদার নজীর মােল্লা, খােকা, আতিয়ার, আবুল কালাম আযাদ, শামসুর রহমান, আমীর হােসেন খান উল্লেখযােগ্য।
কক্সবাজার মার্চ মাসের গােড়া থেকেই এ জেলার জনগণ একটি অনিশ্চিত অবস্থার আশংকা করছিলাে। প্রতিদিন মিছিল মিটিং এর পাশাপাশি পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযােগ এবং প্রতিরােধের জন্য তৈরী হতে থাকে তারা।
৭ মার্চের গভীর রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে গর্জে ওঠে জনতার গগন বিদারী শ্লোগান, বীর বাঙ্গালী অস্ত্রধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর। কেননা ইতিমধ্যেই তারা জেনেগেছে যে, ঢাকার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে পাকিস্তানী দস্যু শাসক বাহিনীর বিরুদ্ধে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এখানকার নেতৃবৃন্দ এদিন রাতেই চট্টগ্রাম জেলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালােচনা করেন। | ৮ মার্চ থেকে অর্থাৎ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারের সকল শ্রেণীর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে। পাড়ায়-মহল্লায় শুরু হয়ে যায় সাংগঠনিক প্রকৃতি। তবে এর আগেই এ জেলার ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন স্বাধীনতা প্রেমী জনতা সকল সরকারী ভবন থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ফেলে তা পুড়িয়ে দেয়। এদিন শহীদ দৌলত ময়দানে জনতা পাক পতাকা পুড়িয়ে সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উড়ায়। | জেলার সর্বত্র জনতা প্রতিটি ইউনিয়ন, থানা, মহকুমা পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি গঠন শুরু করে। জেলার সর্বত্রই আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টিসহ বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। সংগ্রাম কমিটি খাদ্য, অর্থ, প্রশিক্ষণ, অত্র সংগ্রহ প্রভৃতি কাজের জন্য পৃথক পৃথক উপ-কমিটি গঠন করেন। এ জেলায় প্রথম দিকে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন পৃথক পৃথক ভাবে দুটি প্রশিক্ষণ শিবির খােলেন। পরবর্তীতে অবশ্য তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। | ২৫ মার্চ গভীর রাতে মুক্তিকামী জনতা এক ঐক্যবদ্ধ চেষ্টার মাধ্যমে জেলার ট্রেজারি থেকে অস্ত্র লুট করে আনে। জনতার এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘােষণা। করে স্থানীয় ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যরা বিশেষ করে ওয়ারলেস অপারেটর জোনাব আলী পাক বাহিনীর বহু গােপন খবরাখবর সংগ্রাম কমিটিকে প্রদান করে। | ছাত্র লীগের উদ্যোগে পিটিআই হােষ্টেল মাঠ, স্টেডিয়াম, ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বাহির ছড়া, বৌদ্ধ মন্দির সহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণ শিবির খােলা হয়। এখানে বাসের লাঠি ছিল প্রশিক্ষণের প্রধান অন্ত্র। এছাড়া সামান্য কিছু বন্দুক ও ছিল। বিমান বন্দর, রামু, পানছড়ি, আজিজনগর, ফাসি খালি সহ প্রভৃতি স্থানে জনতা সার্বক্ষণিক প্রতিরােধ বুহ্য তৈরি করে সেখানে অবস্থান নেয়।
________________________________________
২৬ মার্চ সকালে কক্সবাজারে ঢাকায় পাকবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের খবর পেীহলে স্থানীয় ইপিআর সদস্যরা পাকিস্তানী ইপিআর সদস্য সহ বহু অবাঙ্গালী বিহারী গ্রেফতার করে। এ সময় আওয়ামী লীগ নেতা আবছার কামাল চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি সর্বস্তরের জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে চূড়ান্ত সশস্ত্র সংগ্রাম শুরুর জন্য সর্বাত্মক ভাবে আত্মনিয়ােগ করেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে কামাল হােসেন চৌধুরী, গােলাম মােস্তফার নাম অন্যতম। এছাড়া শহীদ সুভাষ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে যেসকল প্রশিক্ষণ শিবির খােলা হয় তার মধ্যে চকোরিয়া, চিরিঙ্গা, কাকারা, দুলা হাজরা, কৈয়াবিল এর নাম উল্লেখযােগ্য। এসব স্থানে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন জমির উদ্দিন, মােজাম্মেল, সাহাব মিয়া, মতিউর রহমান, আবুল হােসেন সহ প্রমুখ।
মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার নেতৃত্বদানকারী সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন কামাল হােসেন চৌধুরী, নজরুল ইসলাম চৌধুরী কৃষ্ণ প্রসাদ বড়ুয়া, ছুরত আলম, মােজাম্মেল, জহিরুল ইসলাম, মােস্তাক আহমেদ, মােজাম্মেল হক, ওসমান, ছরােয়ার আলম চৌধুরী, ডাঃ সামসুদ্দিন, শামসুল আলম, শামসুল হুদা, জালাল, ফজল করিম, এম, এ,গনি, বাদশা মিয়া, রফিকুল্লা, খায়রুল্লা, মােস্তাক, অবিনাশ, নুর আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মােস্তাক আহমেদ, সুরেশ সেন, তৈয়ব উল্লা চৌধুরী, সুনিল দে, হাবিবুর রহমান, সাকের আহমেদ, সিরাজুল মােস্তফা, আহমদ উল্লা, আঃ হামিদ, মােহাম্মদ আলী, সুভাষ, ফজল করিম, ফয়জুল আজিম, জেকব, দেত, আমিন সহ আরাে অনেক নেতৃবৃন্দ।
হবিগঞ্জ মার্চ মাসের প্রথম তারিখে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘােষণার সাথে সাথে হবিগঞ্জ মহকুমার সর্বস্তরের মানুষ প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। স্থানীয় টাউন হল ময়দানে বিক্ষুব্ধ জনতা সমবেত হতে থাকে। তাৎক্ষণিক ভাবে জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে ছাত্র নেতৃবৃন্দ বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করে। এক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ সময় থেকে জেলার সর্বত্র সভা সমাবেশ চলতে থাকে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে স্থানীয় সরকারী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ছাত্র-যুবক-জনতাকে সংগঠিত করে সামরিক প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে রফিকুল হক নােমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পালন করেন।
মহকুমা প্রশাসক আকবর আলী খান মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সরকারী অস্ত্রাগার থেকে বেশ কিছু অ নেতৃবৃন্দের হাতে তুলে দেন। এসময় তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা সি আর
________________________________________
দত্ত মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করায় হবিগঞ্জ জেলার মুক্তি সংগ্রামে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। এবং সর্বস্তরের মানুষের মনে আন্দোলনের নতুন গতি লাভ করে।
৮ মার্চ সকালে হবিগঞ্জের জনসাধারণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ প্রদত্ত ভাষণ শুনতে পায়। এই ভাষণের সাথে সাথে গােটা শহর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে ওঠে। গঠিত হয় “হবিগঞ্জ সংগ্রাম কমিটি”। এই সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন এ্যাডঃ মােস্তফা আলী, কর্নেঃ এম, এ রব মওলানা আসাদ আলী, চৌধুরী আঃ হাই, সৈয়দ আফরােজ বখত, এ্যাডঃ আফছার আহমেদ, এ্যাডঃ জোনাব আলী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
এছাড়া ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন পৃথক পৃথক ভাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। তবে আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন ছিলাে । ছাত্র সংগঠন সমূহ জনতাকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন মহকুমার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত জনসভার শেষে অনুষ্ঠিত মিছিলের ভাষা ছিলাে অভিন্ন। যেমন “তােমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তােমার নেতা আমার নেতা, শেখ শেখ মুজিব, তােমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
হবিগঞ্জ মহকুমার অন্যান্য যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে মােহাঃ আলী টিপু, সুরুজ আলী, জবান উল্লা, তােরাব আলী, ডাঃ সালেহ উদ্দিন, মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, কিশাের বর্মন, শহীদ চৌধুরী শরীফ উল্লা, ফজলে নুর ইস,ত, জসিম উদ্দিন, আঃ মােত্তালিব, হােসেন আহমেদ হারুন, হীরেন দত্ত, মােহাম্মদ শাজাহান, মােঃ আলী টিপু প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
মাগুরা একাত্তরের ফেব্রুয়ারী থেকেই মাগুরা মহকুমার রাজনীতি সচেতন মানুষের মধ্যে আন্দোলন সম্পর্কে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারীতেই গঠিত হয় মাগুরা স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি। মহকুমা ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হকের নেতৃত্বে ঐ কমিটি মহকুমার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত আসন্ন আন্দোলন সম্পর্কে ব্যাপক গণসংযােগ শুরু করে। এই এ্যাকশন কমিটিতে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন শামসুর রহমান, মােস্তফা মাজেদ, আমিরুল হাসান, রােস্তম আলী, খসরু, গােলাম আম্বিয়া, জাহিদুল ইসলাম, আবু নাসের বাবলু সহ প্রমুখ। | ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর অসহযােগের খবর মাগুরাতে পৌছুলে প্রতিবাদে সােচ্চার বিক্ষুব্ধ জনতা পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নেয়। ৩ মার্চ স্থানীয় নােমনী মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডঃ আসাদুজ্জামান দীর্ঘ জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন এবং সভাশেষে হাজার হাজার জনতার
________________________________________
করতালির মধ্যে ষ্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটির আহবায়ক ছাত্রলীগ নেতা মুন্সি রেজাউল হক স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
৭ মার্চ মাগুরার জনগণ রেডিওর সামনে অপেক্ষা করে যখন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ শুনতে ব্যর্থ হয় তখন ঢাকা থেকে টেলিফোনে খবর পেীছে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের প্রতি স্বাধীনতার আহবান সহ সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। ৮ মার্চ মাগুরায় গঠিত হয় সগ্রাম কমিটি। সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা নিযুক্ত হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাডঃ সােহরাব হােসেন ও সৈয়দ আতর আলী। এ্যাডঃ আসাদুজ্জামানকে আহবায়ক নিযুক্ত করে গঠিত ঐ সংগ্রাম কমিটিতে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন নাসিরুল ইসলাম (আবুমিয়া), বেৰী সিদ্দিকী, সৈয়দ তৈয়বুর রহমান, সৈয়দ মাহবুবুল হক (বেনু মিয়া) খন্দঃ আবদুল মাৰুেদ, আকবর হােসেন মিয়া, আলতাফ হােসেন, আবুল খায়ের, আফছার উদ্দিন মিয়া, আঃ জলিল সর্দার, আবুল ফাত্তাহ। মহকুমা শাসক ওয়ালিউল ইসলাম এক পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। এস, ডিওর বাসভবন সগ্রাম কমিটির অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
মাগুরা নােমানী মাঠ সংগ্রাম কমিটির আরেকটি খােলা হয় আনসার ক্যাম্প ভবনে। একই সময় মহকুমার শ্রীপুর, শালিখা, মােহাম্মদপুর থানায় থানায় কমিটি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়। থানা কমিটিগুলাে মহকুমা সংগ্রাম কমিটির নির্দেশ মােতাবেক কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিভিন্ন থানায় যারা প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আঃ রশীদ বিশ্বাস, গােলাম রব্বানী, কাইয়ুম মিয়া, নজির মিয়া, নজরুল ইসলাম, আতিয়ার রহমান, আকবর হােসেন মিয়া, খন্দকার, সুজাত আলী, নবুয়ত আলী, কাজী ফয়জুর রহমান, অজিত অধিকারী, শংকর ভট্টাচার্য, আবুল হােসেন প্রমুখ।
সংগ্রাম কমিটি প্রথমেই মহকুমার অবসর প্রাপ্ত ও ছুটিতে থাকা সেনা, ইপিআর, পুলিশ ও আনহার সদস্যদের একত্রিত করেন। এ সকল সদস্যদের দিয়ে মহকুমার বিভিন্ন স্থানে ছাত্র-যুবক জনতাকে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়। এসকল ট্রেনিং ক্যাম্পগুলাের মধ্যে ছিলো নােমানী ময়দান, পারনান্দুয়ালী আম বাগান, কলেজ ময়দান। স্টুডেন্ট এ্যাকশন কমিটি প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য কাঠের ডামি রাইফেল তৈরি করে দেয়। প্রশিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন কামরুজ্জামান, জাহেদুল ইসলাম, ওয়াহেদ মিয়া, মিটুল খান, আবু নাসের বাবলু, কামরুজ্জামান চাঁদ প্রমুখ। ধুডেন্ট কমিটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিপুল পরিমান গােলাবরুদ তৈরি করে। সংগ্রাম কমিটির অস্ত্রাগার হিসেবে সােহরাব হােসেনের বাসভবন ব্যবহার করা হয়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ জনতা মাগুরা পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ গােলাবারুদ দখল করে। এ সকল অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাওয়ার পর জনতার মনােবল দিগুণ বেড়ে যায়। এসকল মুক্তিযােদ্ধাদের দিয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা
________________________________________
বুহ্য গড়ে তােলা হয়। মুক্তিযােদ্ধাও সংগ্রাম কমিটির সাহায্যার্থে স্থানীয় জনগণ তাদের সর্বাত্মক অর্থনৈতিক সহযােগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে।
নাটোর নাটোরের সংগ্রামী মানুষ ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের বিরুদ্ধে এক বিশাল জঙ্গী মিছিল বের করে। মিছিল থেকে পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারন করা হয়। নাটোরের ছাত্র নেতৃবৃন্দ এ সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নেতৃস্থানীয় এ সকল ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের আতিকুর রহমান, মহসীন, রেজা, রনজু, সেলিম, বাবুল মজিবর রহমান, এশারত আলী, অনামী বসাক, কামরুল ইসলাম, তােফাজ্জল, শেখর দত্ত, সামাদ ফকির, আঃ রউফ, মমতাজ, পিপলু, সাজেদুর রহমান, ফজলুর রহমান। ছাত্র ইউনিয়নের ক্ষিতিশ চৌধুরী, কাজী জালাল, মােশারফ হােসেন, চন্দন, হারুন, জালাল উদ্দিন, মনজুর আলম হাসু, আহমদ আলী সহ আরাে অনেকে।
৮ মার্চ সকালে রডিওতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। সারাদিন বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় । এদিনই স্থানীয় নেতৃবৃন্দের এক জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ঐ বৈঠকে নাটোর মহকুমা সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ঐ সভায় ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃবৃন্দও অংশ নেয়। তারা স্বাধীনতার পক্ষে তাদের মত ব্যক্ত করে। এদিন যাদের নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয় তাদের মধ্যে ছিলেন শংকর গৌবিন্দ চৌধুরী, সাইফুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, মাজেদুর রহমান খান, ডাঃ মােবারক হােসেন, আঃ ছালাম, রফিক সরকার, মমতাজ উদ্দিন, নবির উদ্দিন, নাসির উদ্দিন, শেখ আলাউদ্দিন, আছির উদ্দিন, আরশেদ আলী, রবু চৌধুরী, আনিসুল ইসলাম, মােতাহার হােসেন, জিল্লুর রহমান, ডাঃ আলাউদ্দিন, রমজান আলী প্রমুখ।
নাটোর সংগ্রাম কমিটি প্রথম নীচাবাজারের একটি বাড়িতে এবং পরে রিক্রিয়েশন ক্লাবে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করে। স্থানীয় রানী ভবানী মাঠে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। কাঠের ডামি রাইফেল ট্রেনিং এর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রশিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন মােজাম্মেল হক, ইউসুফ আলী, নাজমুল হক লাল, মেহের আলী এবং আরাে অনেকে।
২৫ মার্চ রাতে নাটোর সংগ্রাম কমিটি নাটোর বাের্ডিং নামক একটি হােটেলে এক জরুরী বৈঠক বসে। এই বৈঠকে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যে কোন উপায়ে পাক বাহিনীকে প্রতিরােধের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান। ২৬ মার্চ সকালে পুলিশের ওয়ারলেসে ঢাকায় পাক বাহিনীর মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের খবর পৌছায়। এদিন নাটোর টাউন পার্কে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় মহকুমার প্রত্যন্ত
________________________________________
এলাকা থেকে জনগণ লাঠি, তীর-ধনুক, দাকিরিচ, এবং স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে শহরে মিছিল করে সমবেত হয়।
২৮ মার্চ মহকুমা প্রশাসন আন্দোলনকারী জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। ২১ মার্চ সাজেদুর রহমানের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ জনতা নাটোর ট্রেজারী ভেঙ্গে প্রায় ৩০০ বিঘ্নি ধরনের অস্ত্র ও বিপুল পরিমান গােলাবারুদ হস্তগত করে। এ সকল অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা শহরের বিস্নি উপকণ্ঠ যেখান দিয়ে পাক সেনারা শহরে প্রবেশ করতে পারে সে সকল স্থানে অবস্থান নেয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা শহরে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখে।
সাতক্ষীরা ১ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত সাতক্ষীরা জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে একটানা আন্দোলন চালিয়ে যায়। ৭ মার্চ রাতে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এ অঞ্চলের মানুষ নানা রকম কথা শুনতে পায় । ৮ মার্চ সকালে রেডিওতে তারা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে পায়। মুহুর্তের মধ্যে মিছিলে মিছিলে সয়লাব হয়ে ওঠে সাতক্ষীরা শহর। এদিন রাতেই মহকুমা নেতৃবৃন্দ এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়ে “সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। আহবায়ক নিযুক্ত হন ইনতাজ আলী। কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন স, ম, আলাউদ্দিন, মােস্তাফিজুর রহমান, কাজী কামাল ছ, এস এম রুহুল আমিন, আবু নাছিম ময়না, শাজাহান মাষ্টার, মশির আহমেদ।
৮ মার্চ রাতেই সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন প্রকার জনসংযােগমূলক কাজ স্থাপন করে। ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যদের সঙ্গে গােপন যােগাযােগ স্থাপন করে আন্দোলনের পক্ষে তাদের সম্মতি পাওয়া যায়। এ ছাড়া নেতৃবৃন্দ প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যন্ত শাখা কমিটি গঠন করেন। এসব ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। | সাতক্ষীরা মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতা নির্বাচিত হন মােস্তাফিজুর রহমান। এই কমিটি প্রথমেই ভােমরা সীমান্তে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করলে সেখানে ব্যাপক ভিত্তিতে ট্রেনিংপ্রদান শুরু করে। প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোেদ্ধাদের জন্য খাবার ও অন্যান্য রসদ সামগ্রী গুদামজাত করে রাখার জন্য শেখ আবেদ আলী (হাসু) তার বাড়ির একটি বৃহৎ অংশ ছেড়ে দেন। এই এলাকার সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এতই সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে যে, সংগৃহীত খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী যশাের, খুলনা অঞ্চলের মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যেও তা বিলি করা হয়।
২৫ মার্চের আগেই সাতক্ষীরার জনতা কোর্টবিল্ডিং সহ প্রধান সরকারী ভবনের পতাকা নামিয়ে তা পুড়িয়ে ফেলে সেখানে স্বাধীন ঝংলার পতাকা ওড়ায়। পতাকা উত্তোলনে নেতৃত্ব দেন কামরুল ইসলাম খান। ২৬ মার্চ থেকেই সর্বাত্মকভাবে মুক্তিকামী মানুষ
________________________________________
একটি সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। স্থানীয় ভাবে সংগৃহীত বন্দুক দিয়ে গড়ে তােলা হয় বন্দুক বাহিনী।
২৮ মার্চ সংগ্রাম কমিটির এই সভায় ভারত থেকে অন্ত আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ২৯ মার্চ আলাউদ্দিন এমপি ছাত্র নেতা মােস্তাফিজুর রহমান, মশির আহমেদ ও মমতাজ উদ্দিন সহ আরাে কয়েক জন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে যায়।
এদিকে সামান্য অস্ত্র ও মনােবল সম্বল করে জনতা রসদ সংগ্রহ,বাংকার তৈরি, প্রশিক্ষণ, রাস্তা তৈরি, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট প্রতিরােধ বুহ্য তৈরি করা সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড চালিয়ে যায়। জনতার বিপুল সহযােগিতায় মুক্তি বাহিনী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সাতক্ষীরা তাদের দখলে রাখতে সমর্থ হয়।
ঝিনেদা ঝিনেদা মহকুমায় আন্দোলনের তীব্রতা লাভ করে অন্যান্য মফস্বল অঞ্চলের থেকে একটু আগে। কেননা বঙ্গবন্ধু ৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ঝিনেদা সফর করেন। এতেকরে জনতার মনে তীব্র গতির সঞ্চার করে। আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ পরবর্তী পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ব্যাপক গণসংযােগের মাধ্যমে জনমত গঠন করতে থাকে।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারীতেই ঝিনেদায় স্বেচ্ছাসবক বাহিনী গঠিত হয়। এই বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন এ্যাডঃ আমীর হোেসনে ও উপ-প্রধান নায়েব আলী সর্দার। একই সঙ্গে এ মহকুমার ৬ টি থানাতেও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয় । থানা সমূহের দায়িত্ব প্রাপ্তরা হলেন রহমত আলী মন্টু, রফিক দাদ রেজা, সেকেন্দার আলী, খায়রুল বারী লেবু, নুরুজ্জামান চৌধুরী, আবদুর রহমান মন্টু।
২ মার্চ সারা দেশের মত ঝিনেদাতেও সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয় এবং এদিনই গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ” এর প্রধান নিযুক্ত হন ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল হাই । ১৩ মার্চ শহরে প্রায় একলক্ষ মানুষের এক বিশাল মিছিল সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। এই মিছিলের নেতৃত্ব দেন আওয়ামী লীগের মহকুমা সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আঃ আজিজ। এবং এদিন আওয়ামী লীগ অফিসে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলেন ছাত্র নেতা আবদুল হাই।
৭ মার্চ জনতা দুপুর থেকেই বিভিন্ন স্থানে রেডিও সেটের সামনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শােনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই টেলিফোনে নেতৃবৃন্দ খবর পান যে, সামরিক সরকার রেডিওতে ভাষণ প্রচার হতে দেবেনা। এ খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে জয়বাংলা” ধ্বনিতে শহর কাঁপিয়ে তােলে।
১১ মার্চ গঠিত হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ। পরিষদের আহবায়ক হন এ কে এম আঃ আজিজ, এম পি। একই সাথে গঠিত হয় ৪টি সাব কমিটি। এসবের মধ্যে
________________________________________
অর্থনৈতিক কমিটি, খাদ্য কমিটি, সগ্রাম কমিটি, ও বােগাযােগ সাব কমিটি। সাব কমিটি প্রধান নিযুক্ত হন গােলাম মজিদ এম পি, মাহবুব উদ্দিন, নুরুনবী সিদ্দিকী, আবদুল মতিন।
২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবস পালন না করে মহকুমা সংগ্রাম কমিটি বাংলাদেশ দিবস’ পালন করে। ২৫ মার্চ রাতেই ঢাকায় পাক বাহিনীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের খবর ঝিনেদাতে পৌছে যায় টেলিফোনে ও ওয়ারলেসের মাধ্যমে। সংগ্রাম কমিটি গভীর রাতে জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মােতাবেক ঐ রাতেই এস ডি পিওর সহযােগিতার ট্রেজারী খুলে মুক্তিকামী জনতা প্রায় ৪০০ রাইফেল ও অন্যান্য অ হস্তগত করে। একই ভাবে এদিন রাতে অন্য ৫ টি থানাতেও জনতা থানার অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিজেদের দখলে নিয়ে যায়।
২৬ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান জনতার উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেয়। এ সময় বিপ্লবী জনতা পােষ্ট অফিস প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। মহকুমা পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন জ্বালাময়ী ভাষণের মাধ্যমে জনতাকে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য আহবান জানায়।
শুরু হয় জনতার প্রতিরােধ যুদ্ধ। তারা বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীর আগমন ঠেকাতে কালভার্ট উড়িয়ে দেয়, ব্যারিকেড তৈরি করে, গাছের গুড়ি রাস্তায় তােলে। একই সাথে সংগ্রাম কমিটি কেসি কলেজ, সদর থানা কেন্দ্রে মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে। মহকুমার অবসর প্রাপ্ত পুলিশ, নৌ, সেনা ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ প্রদানে এগিয়ে আসে। বাঁশের লাঠি, কাঠের ডামি রাইফেল প্রভৃতি দিয়ে প্রথম দিকে ট্রেনিং এর কাজ চলে।
ঝিনেদা মহকুমায় যারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যেও উমেদুল ইসলাম, দেবাশীষ বিশ্বাস, আঃ করিম, লুর রহমান, খাদেমুল ইসলাম, গােলাম রব্বানী, ডাঃ হেলাল উদ্দিন, আবদুল জলিল মিয়া, শুধাংসু সাহা, মােসারফ আলী, আজাহার বিশ্বাস, মতলেব কাজী, আঃ সােহান, এলাহি বিশ্বাস, খােরশেদ মােল্লা, হােসেন আলী মােল্লা, শফিউর রহমান, জোয়াফ আলী মল্লিক, এম এস রহমান, করিম উদ্দিন আহমেদ, আবদুল হালিম, সিরাজুল ইসলাম, মােশারফ হােসেন, সিরাজুল হক, মতিয়ার রহমান, নুরুল ইসলাম, আঃ গফুর, সাজেদুর রহমান, আফজাল হােসেন, তাহাজেদ মিয়া, লিচুমিয়া, সুনীল বসু, মােজাম্মেল হক, আবু সাঈদ, ফজলুলা, আনােয়ারুল ইসলাম, এহিয়া মােল্লা, গােঃ মহিউদ্দিন, মঈনুদ্দিন বশীর, সহিদুল আলম বকুল, গােলাম মােস্তফা, আনােয়ার হােসেন, মকবুল হােসেন, আঃ ছামাদ, নজরুল ইসলাম, হাফিজ ফরুক, আলীমুদ্দিন সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
শরীয়তপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ এদিন রাতেই শরীয়তপুর মহকুমার বিদেশী বেতার ও ওয়ারলেস মাধ্যমে পৌঁছে যায়। বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে
________________________________________
সঙ্গে মহকুমার প্রতিটি পাড়ামহল্লায় মানুষের মধ্যে প্রস্তুতি মূলক জাগরণের সৃষ্টি হয়। ঢাল, সড়কি, তীর, ধনুক প্রভৃতি নিয়ে তারা মহকুমার বিস্নি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সমবেত হয়।
১০ মার্চ চৌধুরী মজিবুর রহমানকে চেয়ারম্যান করে গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি” এই কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আলী আযম শিকদার, ফজল মাষ্টার, আঃ রাজ্জাক, জাফর আহমেদ, রমেশ চন্দ্র, সহিদ মন্ডল, আঃ ছাত্তার, আবদুল কাশেম মৃধা, মাষ্টার জালাল আহমেদ, আলী হােসেন খান, আলী হােসেন তালুকদার। এ কমিটি গঠনের আগে ৯ মার্চ আরেকটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিতে আহবায়ক নিযুক্ত হয়েছিলেন আসমত আলী খান ও সম্পাদক ছিলেন আবদুল মান্নান চুন্ন।
সংগ্রাম কমিটি অত্যন্ত দ্রুততার সাথে মহকুমার প্রতিটি থানায় মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেন। আনসার, পুলিশ, ইপিআর সদস্যরা প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসক ভিতরে ভিতরে সংগ্রাম কমিটিকে নানা ভাবে প্রেরনা যােগায়। সংগ্রাম কমিটি মার্চ মাসের শেষ দিকে এখানে একটি ভ্রাম্যমান রেডিও স্টেশন চালু করার চেষ্টা চালান। এই সময়ে বাংলার মুখ” নামক একটি পত্রিকা আমীর হােসেনের সম্পাদনায় মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র হিসেবে কাজ করে।
৮ মার্চ সংগ্রাম কমিটি ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এক জরুরী বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিষয়ে কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সভায় শরীয়তপুরের ৯ টি থানাকে ২ নং সেঙ্করের অধিনে রাখার কথা বলা হয়। যুদ্ধ হবে গেরিলা পদ্ধতিতে। যুদ্ধের সকল পর্যায়ে জনতাকে সংগে রাখার বিষয়টি অত্যধিক গুরুত্ব পায়। এখানে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন শওকত আলী, ইয়ার্ড মুজিবুর রহমান, আঃ মােতালেব, এম এ কাশেম, আসমত আলী, সারােয়ার হােসেন শাজাহান মােল্লা প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
পরবর্তীতে শরীয়তপুরকে ৫ টি অঞ্চলে ভাগ করে ৫ জন কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন ইদ্রিস আলী, পালং থানার দায়িত্বে, নড়িয়াতে ইউনুস আলী খান ও কামাল উদ্দিন, জজিরা থানায় আঃ রহমান খান, গােসাইর হাটে আলী আযম ফরিদি ও ইকবাল হােসেন বাদু, ভেদরগঞ্জে আঃ মান্নান। পরে ইউনুস আলীকে আঞ্চলিক কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ইয়ার্ড মুজিবর রহমান ও দিদারুল ইসলাম সম্মিলিত থানা তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন।
গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিটি গ্রুপে সদস্য ছিলেন ৪-৫ জন করে। স্টেনগান, রাইফেল ও গ্রেনেড ছাড়া মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান অ ছিলাে তাদের দেশপ্রেম ও মনােবল। এছাড়া জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন ছিলো মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান অত্র।
নীলফামারী সমগ্র দেশের মত নীলফামারী মহকুমার সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের ঘােষণার বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
________________________________________
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতারা জরুরী বৈঠকে বসে পরবর্তী কর্মসূচী এবং ব্যাপক আলােচনা করেন। আওয়ামী লীগ মহকুমা সভাপতি আফছার আলী আহমেদকে আহবায়ক করে গঠিত হয় মহকুমা সাম পরিষদ। এই কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন মােঃ আমিন, ডাঃ জিকরুল হক, আঃ রউফ, আজহারুল ইসলাম, আঃ রহমান চৌধুরী। এছাড়া ৬ টি থানার সংগ্রাম পরিষদের প্রধানরাও সংগ্রাম পরিষদের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন। এই কমিটির সঙ্গে আরাে সম্পৃক্ত ছিলেন খয়রাত হােসেন, আবুল কালাম, দবির উদ্দিন আহমেদ।
সংগ্রাম পরিষদ প্রথমেই ছাত্রলীগের সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। স্থানীয় টাউন ক্লাব চত্বরে প্রধান প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। লােকমান হােসেন ও কমান্ডার আলী হােসেন প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ছাত্র নেতারা এখানে একটি উল্লেখযােগ্য কাজ করেন-তাহলাে স্থানীয় স্বাধীনতা বিরােধীদের তালিকা তৈরি করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া। স্থানীয় ছাত্ররা হাতে অত্র তৈরির একটি মিনি কারখানাও তৈরি করে।
এ মহকুমার নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন প্রচারপত্র ও মাইকিংয়ের সাহায্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিদিন জনতাকে করণীয় বিষয় সম্পর্কে অবহিত করে। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে এখানে মূল নেতৃত্ব প্রদান করে ছাত্রলীগ মতিয়া গ্রুপ। সিপিবি নেতা কানু ঘােষের অবদনও ছিলাে উল্লেখযােগ্য।
শহরের ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য গঠিত হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। ১৫ মার্চ টাউন হল মাঠে বিশ হাজার মানুষের এক বিশাল লাঠি মিছিল অনুষ্ঠিত হয় । এই মিছিলে নেতৃত্ব দেন আফছার আলী আহমদ, খয়রাত হােসেন, দবির উদ্দিন, আবুল কালাম, রাহাত হােসেন, তরিকুল ইসলাম, জোনাব আলী, আমিনুল হক, দেলােয়ার হােসেন, শাহ আঃ হান্নান। এই সভায় জনতাকে পূর্ণ লড়াইয়ের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণের কথা বলা হয়।
নীলফামারীর পার্শ্ববর্তী শহর সৈয়দপুর। অবাঙ্গালী বিহারী অধ্যুষিত এই শহরের বাঙ্গালীর উপর বিহারীরা ২৩ মার্চ হামলা চালায়। অতর্কিত এই হামলায় ইউপি চেয়ারম্যান মাহতাব বেগসহ অনেককে তারা হত্যা করে। এই ঘটনার পর নীলফামারী থেকে সংগ্রাম পরিষদ আটক বাঙ্গালীদের উদ্ধারের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং তার সৈয়দপুর বিহারী এলাকা ঘেরাও করে। কয়েক লক্ষ সংগ্রামী জনতা কয়েকদিন পর্যন্ত এই শহর ঘেরাও করে রাখার পর তা দখল করে নেয়। স্থানীয় ইপিআর বাহিনীর সদস্যরাও মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের সঙ্গে যােগ দেয়। এসময় নীলফামারী ট্রেজারী থেকেও জনতা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র হস্তগত করে ।
এই দুটি ঘটনার পর এলাকার জনগণের মনােল বিপুল ভাবে বেড়ে যায়। স্বতঃস্ফুর্ততা ও অত্যন্ত দ্রুততার সাথে মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হতে থাকে এবং সেই
________________________________________
সাথে চলে চুড়ান্ত যুদ্ধের আয়ােজন। ৬ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা এই অঞ্চলে তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখে।
খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল খাগড়াছড়িতেও মানুষ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলে। এখানকার মানুষ প্রথম বঙ্গবর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের বিবরণ শুনতে পান বিদেশী বেতার মাধ্যমে। জনতা তাৎক্ষণিকভাবে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে। স্থানীয় নেতৃবৃন্দের তত্বাবধানে সর্বস্তরের জনতা ব্যাপক প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে থাকে। | ২৬ মার্চ দুপুর একটার দিকে এখানকার মানুষ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আওয়ামী লীগ নেতা। এম এ হান্নানের কঠে স্বাধীনতার ঘােষণা শুনতে পান। মেজর রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন আবদুল কাদের এই অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
২৭ এপ্রিল পাক বাহিনী খাগড়াছড়ি প্রবেশের চেষ্টা করলে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে এক ব্যাপক সংঘর্ষ ঘটে। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে ক্যাপ্টেন কাদের শহীদ হন। ২ মে পাক দস্যুরা খাগড়াছড়ি প্রবেশ করে।
খাগড়াছড়ি আওয়ামী লীগ সম্পাদক সুলতান আহমেদকে প্রধান করে এখানে সংগ্রাম। কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এখানে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে উকিল আহমেদ তালুকদার, বন বিক্রম ত্রিপুরা, সুবােধ বিকাশ ত্রিপুরা, নুর এলাহী বক্স, দোস্ত মােঃ চৌধুরী, সমর চক্রবর্তী, হেম রঞ্জন ত্রিপুরা, কারবারী বড়ুয়া, অশােক মিত্র, গােপাল কৃষ্ণ দেওয়ান, মনীন্দ্র ত্রিপুরা, ধর্মেন্দ্র বড়ুয়া, আঃ আজিজ, সুশিল চাকমা, মংমিং মারমা, রণজিৎ বর্মন, কালাচান্দ বর্মনের নাম অন্যতম।
গাইবান্ধা রাজধানী ঢাকায় ৩ মার্চ ‘৭১ দেশপ্রেমী আন্দোলনকামী নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ায়। এই খবর গাইবান্ধা শহরে পৌছুলে সেখানকার মানুষ উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। এরই মাঝে আসে ৭ মার্চ। এদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষনের জন্য সারাদেশের মত গাইবান্ধার জনগণও অপেক্ষা করতে থাকে।
১৮ মার্চ সকালে রেডিওতে জনগণ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শােনার পর এখানকার আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয় মিছিল মিটিং। এভাবেই আসে ২৩ মার্চ। টানটান উত্তেজনার মধ্যে এদিন গাইবান্ধা শহরে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে ফেলে সেখানে বাংলাদেশের পতাকা তােলা হয়। সেই পতাকা কেবল নির্দিষ্ট স্থান গুলােতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়ি, দােকান ও ছােটখাটো সকল প্রতিষ্ঠানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে দেখা যায়।
________________________________________
২৩ মার্চের ঐ পতাকা উত্তোলন কর্মসূচীতে নেতৃত্ব প্রদান করেন ছাত্রলীগ সভাপতি এম এন নবী লালু, মােহাম্মদ খালেদ নির্মলেন্দু বর্মন, সৈয়দ শামসুল আলম হিরু, নাজমুল আরেফীন প্রমুখ। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় গাইবান্ধা সংগ্রাম কমিটি। এই কমিটির সদস্য ছিলেন লুৎফর রহমান, এম এন এ, শাহ আলম হামিদ, সােলায়মান মন্ডল, শামসুল হক, আবু তালেব মিয়া, ডাঃ মফিজার রহমান, ওয়ালিয়র রহমান, জামালুর রহমান। এই কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে কাজ করেন তারা মিয়া, কিবরিয়া, হাফিজার রহমান, মতিউর রহমান, হাসান ইমাম টুলু।
২৫ মার্চ রাত্রি তিনটার সময় স্থানীয় পুলিশ ওয়ারলেস থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা | ঘােষণার বার্তাটি গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা ওয়ালির রহমান ও লুৎফর রহমান। বার্তাটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রকর্মীরা মাইকযােগে দ্রুত প্রচারে ব্যবস্থা করেন। মাইকিং এর নেতৃত্ব দেন আবু তালেব মিয়া।
২৬ মার্চ সকালে সর্বস্তরের বিপ্লবী জনতা গাইবান্ধা ট্রেজারি ভেঙ্গে কয়েকশ অস্ত্র নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। অন্য দখলের এই ঘটনায় নেতৃত্ব দেন হাসান ইমাম টুল। একই দিন স্থানীয় আনছার ক্যাম্প থেকেও বিপুল পরিমাণ অ উদ্ধার করে তা জনগণের মধ্যে বিলি করা হয়। ২৭ মার্চ থেকে স্থানীয় কলেজ মাঠে শুরু হয় মুক্তিযোেদ্ধা প্রশিক্ষণ কর্মসূচী । প্রশিক্ষণের জন্য থানা ভিত্তিতে সদস্য সংগ্রহ করা হয়। প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ৪০০ জন করে মােট ৪১ হাজার সদস্যকে পর্যায়ক্রমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ প্রদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন নৌ বাহিনীর কাজিউল ইসলাম, বিমান বাহিনীর আলতাফ, আজিমউদ্দিন, ক্যাপ্টেন আলতাফ প্রমুখ।
সংগ্রাম পরিষদ গাইবান্ধা কলেজকে তাদের প্রধান সেনা সদরে পরিণত করেন। নেতৃবৃন্দ এ সময় পাক বাহিনীকে প্রতিরােধের জন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়ােজন অনুভব করেন এবং সিদ্ধান্ত মােতাবেক তারা ভারত সীমান্তে গমন করেন।
এপ্রিলের শুরুতে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার আলতাফ তার অধীন (ঘােড়াঘাট) সৈন্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ যােগ দেন এবং অস্ত্রাগার থেকে সকল, অত্র মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বন্টন করে দেন। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গাইবান্ধা মুক্তিযােদ্ধারা পলাশবাড়ির হােসেনপুরে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি স্থাপন করে। এই প্রতিরােধে হাজার হাজার জনতা অংশ নেয়।
লালমনিরহাট ১৯৭১ সাল সমগ্র বাংলার পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মত জ্বলে ওঠে। সেই আগুনের শিখায় প্রজ্জলিত হয় লালমনিরহাট।১ মার্চ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত এখানে একটানা মিছিল, মিটিং, হরতাল পালিত হয়।
________________________________________
৭ মার্চের ঘােষণা এখানকার মানুষ এদিন রাতেই টেলিফোনের মাধ্যমে পেয়ে যায় । মুক্তিপাগল জনতা বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে হাজার হাজার সারিবদ্ধ হয়ে মহকুমা শহরে সমবেত হতে থাকে। সংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে প্রদানকারীদের মধ্যে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দেব, আবুল হােসেন, আঃ কাদের ভাসানী, আঃ কুদুস, শামসুল হক, আঃ কাদের, ফয়েজ আহমেদ, চুন, আবু তালেব, শামসুল হুদা বকসী, হযরত আলী, কাজী মােসলেম উদ্দিন প্রমুখ।
সংগ্রাম কমিটি তাদের প্রধান দায়িত্ব পালন করেন প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন আজিজুল হক। শহরের সাপটানা রােডে প্রাথমিক প্রশিক্ষণের কাজ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে এ সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে এগিয়ে আসেন মেজর নওয়াজেশ হােসেন, চিত্তরঞ্জন দেব, আবুল হােসেন। সংগ্রাম কমিটি বিভিন্ন ভাবে শহর থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র ও গােলা বারুদ সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে বেশ কিছু অৱ বিহারী এলাকা থেকে সংগ্রাম কমিটি জনতার সহযােগিতায় উদ্ধার করে। যদিও পরবর্তীতে পাক বাহিনীর আকস্মিক অভিযানে সেগুলাে মুক্তিযােদ্ধাদের বেহাত হয়ে যায়।
২৭ মার্চ স্থানীয় বিহারীদের সঙ্গে মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের এক সংঘর্ষে বহু বাঙ্গালী নিহত হন। এদিন প্রথম শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সৈনিক মােঃ শাজাহান। বিশ্বাসঘাতক বিহারী জিয়ারত আলী একটি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাকে হত্যা করে। লালমনিরহাটের দ্বিতীয় শহীদ মােঃ লুৎফর রহমানের হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত চারজন পাঞ্জাবী সেনাকে জনতা ধরে ফেলে এবং হত্যা করে।
এসব ঘটনার আগে ২৩ মার্চ থানারােডের শহীদ মিনারে জনতা পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে তা ভস্মীভূত করার পর সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ায়। পতাকা উত্তোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন মুলতঃ ছাত্ররা। এই পতাকাকে সামনে রেখে সমবেত ছাত্র-জনতা মুক্তি মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করে। এদিন পতাকাটি তৈরি করেন শামসুল আলম দুদু। পতাকা উত্তোলনকার ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন মাহবুবুর রহমান লাবলু, শহীদুল্লা, মতলুবুর রহমান, বসুনিয়া, মেজবাউদ্দিন, ইউসুফ আলী, মােঃ জিন্না, ইসহাক শিকদার, নাজিম উদ্দিন, গোলাম মাহবুব, শফিকুল ইসলাম, পিটু: হামিদুল হক, রুমী প্রমুখ।
| কিশােরগঞ্জ ৮ মার্চ থেকে কিশােরগঞ্জ মহকুমার সর্বস্তরের জনতা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণা মােতাবেক সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, সিপিবি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। | প্রথম থেকেই এখানকার নেতৃবৃন্দ মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দানের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন। সে অনুযায়ী তারা মহকুমা কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে কর্মতৎপরতা আর
________________________________________
করেন। শুরুতেই নেতৃবৃন্দ সহ, খাদ্য মজুত, হাতে অস্ত্র তৈরিসহ প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেন। এছাড়াও স্থানীয় পাকিস্তানী দালাল ও রাজাকার সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। | কিশােরগঞ্জ মহকুমায় যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা মােস্তাফিজুর রহমান, আবদুল কুদ্ছ, মহিউদ্দিন আহমেদ, আবদুল হাত্তার, আব্দুল হামিদ, শামসুল হক, গোলাপ মিয়া, নাসির উদ্দিন ফারুক, লিয়াকত হােসেন মানিক, আলফারুক ছানা, শওকত আহমেদ, মতিয়ার রহমান খান, ওয়াদুদ খন্দকার প্রমুখের অবদান উল্লেখযােগ্য।
ছাত্র নেতাদের মধ্যে আজিজুর রহমান, জামান উদ্দিন, কবির উদ্দিন ভূইয়া, ফজলুল হক, শাহবুদ্দিন ঠাকুর, এম এ আফজাল, মােস্তাফিজুর রহমান, সবির আহমেদ মানিক, মােজাম্মেল হক, মােঃ ফজলুর রহমান, গােলাম হায়দার চৌধুরী, ইফতেখার আহমেদ খসরু, বিমলাংশু রায় বাবলু, মােহাঃ শাহবুদ্দিন, ভূপেন্দ্র, ভৌমিক,দিলীপ ধর।
এছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের যেসব নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে নিজেদেরে সক্রিয় ভাবে কাজে লাগিয়ে ছিলেন তাদের মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট ফজলুল হক, শিক্ষক মতিউর রহমান, নীলােৎপল কর, রাজ্জাক ভুইয়া, নিবারণ চক্রবর্তী, নাজিম কবীর, মােশাররফ হােসেন মুখার্জী, কিবাশ মজুমদার, হাবিবুর রহমান মুক্তা, মিজানুর রহমান এবং ক্যাপ্টেন হায়দার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন হায়দারের নেতৃত্বে কিশােরগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়কের তারাঘাট সেতু, ভৈরব-ময়মনসিংহ এর রেলসেতু ধ্বংস করে পাকবাহিনীর আগম ঠেকানাে হয়।
কিশােরগঞ্জ ১০ মার্চ রথখােলা ময়দানে হাজার হাজার জনতার বিপুল হর্ষধ্বনি ও জয় বাংলা শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলেন আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডঃ আবদুল হামিদ। এ সময় ছাত্র লীগের তত্ত্বাবধানে আজিমউদ্দিন বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ আর হয় । লাঠি, রামদা, ডামি রাইফেল প্রভৃতি প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হত। প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন কামরুজ্জামান খসরু, সগীর আহমেদ, নুরুল ইসলাম খান পাঠান, আনােয়ার কামাল, কাজী মহসীন।
| একই সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ কিশােরগঞ্জ ষ্টেডিয়ামে আরেকটি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন করে। খায়রুল জাহানের নেতৃত্বে এই প্রশিক্ষণ শিবির আরাে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে রফিকুল হক, হারুনুর রশীদ, মাের্শেদুল হক, অজিত সরকার, আকবর হােসেন, সাইদুর রহমান মানিক, অশােক সরকার, আলম ফেরদৌস মানিক প্রমুখ।
নরসিংদি ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ শুরু থেকেই নরসিংদিতে স্বাধীনতা আন্দোলনের দৃঢ়ভিত্তি সুসংহত করে। ১২ মার্চ থেকেই তাদের নেতৃত্বে এখানে
________________________________________
সম্মিলিত জনতার বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র নেতাদের ভেতর যারা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন আজিজ আহমেদ, হারাধন সাহা, শামসুল হুদা বাহু, আলী আকবর, মতিন ভূইয়া, সুভাষ সাহা, নুরুল ইসলাম গেদু, মজিবর মিয়া, কার্তিক চ্যাটার্জি, রফিকুল ইসলাম, কাঞ্চন মিয়া, তফাজ্জল হােসেন ও আঃ হাই প্রমূখ।
৭ মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় নরসিংদির হাজার হাজার মানুষ যােগদান করেছিলাে। ঢাকার জনসভায় নরসিংদির হাজার হাজার মানুষ যােগদান করেছিলাে। ঢাকার জনসভায় যােগদান কারী ছাত্র-জনতা নরসিংদিতে ফিরে এলে সম্মিলিত মানুষের সংঘবদ্ধ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। মূলতঃ বঙ্গবন্ধুর ডাকে এখানকার মানুষ তাদের জীবন বাজি রেখে জনসভায় গৃহিত আন্দোলনের সকল কর্মসূচী বাস্তবায়নে ঝাপিয়ে পড়ে। | নরসিংদিতে যেসকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ স্বাধীনতার আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য অবদান রাখেন আহমাদুল কবীর (মনুমিয়া), মতিউর রহমান, মােসলে উদ্দিন ভূইয়া, ফায়েজ মাষ্টার, বিজয় চ্যাটার্জি, আবুল হাসিম মিয়া, শামসুল হক ভুইয়া, আঃ হাই, ফজলুল হক খন্দকার প্রমুখ। | ১২ মার্চ ৭১ নরসিংদি আওয়ামী লীগের উদ্দোগে যৌথ সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সদস্য ছিলেন মােসলে উদ্দিন ভুইয়া, আবুল হাসিম মিয়া, ডাঃ আলতাফ হােসেন, আতাউর রহমান, আজিজ আহমেদ, আলী আকবর, আদম আলী, মাষ্টার, সরােজ সাহা, হারাধন সাহা, হাবিবুর রহমান, কাজী হাতেম আলী, আমিরুল ইসলাম, আঃ রাজ্জাক, মেজর শামসুল হুদা, হাবিবুল্লা বাহার, আঃ রউফ, অধ্যাপক মােঃ ইউসুফ, মিজানুর রহমান প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটি গঠনের আগে ২ মার্চ নরসিংদি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৩ মার্চ শহরের বটতলা নামক স্থানে জনতার বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। দু’টি কমিটি গঠনের সঙ্গে সঙ্গে কমিটি সমূহ তাদের কর্মতৎপরতা শুরু করে।
২৫ মার্চ পাকিস্তানী দস্যুবাহিনীর পৈশাচিক হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার পর এখানকার মানুষ বারুদের মত প্রতিশােধের আগুনে জ্বলে ওঠে। তারা মুক্ত মাতৃভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে মতই একটি সার্বিক সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। এরই মাঝে ২৯ মার্চ ঢাকা থেকে কয়েজ হাজার বিদ্রোহী বাঙ্গালী ইপিআর, আনসার, পুলিশ নরসিংদিতে পেীছে। এতে জনতার মনােবল বিপুল ভাবে বেড়ে যায়। এসকল সৈনিকদের খাদ্য ও বাসস্থানের জন্য সংগ্রাম কমিটি ছাড়াও সর্বস্তরের জনতা এগিয়ে আসে। ডাকবাংলো, আলিজান জুটমিল, বাগবাড়ী, পালবাড়ী প্রভৃতি স্থানে তাদের জন্য ক্যাম্প স্থাপন করা হয়।
৫ এপ্রিল পাক বাহিনী এসব স্থানে ব্যাপক ভাবে বােমা বর্ষন করে। এতে প্রচুর ধ্বংস সাধিত হয়। মৃত্যু বরণ করে অসংখ্য মানুষ। এ ঘটনার পর নরসিংদি বাগবাড়ি ও পাবাড়ি নামক স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাক বাহিনীর এক মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত
________________________________________
হয়। মুক্তি যােদ্ধাদের পক্ষে যারা প্রধান ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে নৌ বাহিনীর সিরাজ উদ্দিন, মীর ইমাদুল হক, মােঃ ইমাম উদ্দিন, আঃ মান্নান মিয়া, আঃ হামিদ ভুইয়া, আক্তার হােসেন,মনির উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ রফিকুল ইসলাম, মােসলে উদ্দিন ভুইয়া, হাবিবুল্লা খায়ের, আতাউর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, শামসুল হুদা বাচ্চু, আঃ হাসিম মিয়া, আজিজ আহমেদ, মান্নান ভুইয়া, মজনু মৃধা, আওলাদ হােসেন, আঃ মান্নান খান, ফজলুল হক খন্দকার, শামসুল হক, গয়েশ মাষ্টার, বজলুর রহমান, শেখ শাহাবুদ্দিন, তারা মাষ্টার, আঃ হাকিম, এডঃ কফিল উদ্দিন, ইসলাম মাষ্টার, আবেদ আহমেদ, ইয়াকুব আলী
বাগেরহাট পাকিস্তানী অপশাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র বাংলায় উন্মাতাল দিনরাত্রি। প্রতিবাদে সােচ্চার বাঙ্গালীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। এরই মাঝে আসে ৭ মার্চ। এদিন ঢাকার তৎকালিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ জনতা বেতার মাধ্যমে সারাদিন অপেক্ষা করেও শুনতে পায়নি। | ৮ মার্চ সকালে ৭ মার্চের ভাষণ যখন রেডিওতে প্রচারিত হয় তখন উত্তাল তরঙ্গের মত জনতার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে বাগেরহাট মহকুমা শহর ও আওয়ামী লীগ অফিসে। সমবেত জনতার মুহুঃ মুহঃ শ্লোগানে মুখরিত হয় সমগ্র জনপদ।
৮ মার্চ গঠিত হয় বাগের হাট মহকুমা সংগ্রাম কমিটি। কমিটির আহবায়ক করা হয় মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডঃ শেখ আবদুর রহমানকে। সহযােগী আহবায়ক নিযুক্ত হন সৈয়দ ওজিয়র রহমান। কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন শেখ আমজাদ আলী, এম, সবুর, আঃ লতিফ খান, সৈয়দ শামসুল হক, মােহাঃ শাজাহান আলী, আঃ ছাত্তার খান, সর্দার আঃ জলিল, কামরুজ্জামান টুকু, গাজী আঃ জলিল, আতিয়ার রহমান, মীর শাখাওয়াত আলী, কানাই লাল বসু, মনসুর আহমেদ, আঃ গনী সরদার, অধ্যাপক মােয়াজ্জেম হােসেন, অনিল কুমার দেব সহ আরাে অনেকে।
সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ প্রথমেই মহকুমার ছাত্র-যুব সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে তাদের সামরিক প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করে। একই সময়ে মহকুমার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিরােধ বাহিনী নিযুক্ত করে। জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে নেতৃবৃন্দ এসময় ব্যাপক জনসংযােগ আরম্ভ করেন। ৯ মার্চ থেকে এখানে পুরােদমে প্রশিক্ষন শুরু হয়। বাগেরহাট বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠ, সরকারী বালিকা বিদ্যালয় মাঠ, পিসি কলেজ মাঠ ও আনসার ক্যাশ এলাকায় প্রধান প্রধান প্রশিক্ষন ক্যাম্পসমূহ স্থাপিত হয়। প্রশিক্ষনের দায়িত্বে ছিলেন আঃ লতিফ খান।
১৩ মার্চ ছাত্র নেতা ও যুব সম্প্রদায়ের উদ্যোগে মহকুমা সরকারি গারের তালা ভেঙ্গে প্রচুর পরিমান শত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করা হয়। ১৪ মার্চ শহরে একটি সশস্ত্র
________________________________________
জঙ্গী মিছিল বের হয়। এই মিছিলে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়। মিছিলকারীরা এক পর্যায়ে মহকুমা শাসকের অফিস থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এর পরপরই সমগ্র শহরে স্বাধীন বাংলার পতাকায় ছেয়ে যায়। আন্দোলনের এক পর্যায়ে মেজর জলিল ও ইয়ার্ড মুজিব বাগেরহাট এলে বিপ্লবী জনতার মধ্যে বিপুল জাগরণের সৃষ্টি হয়।
স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা ইয়ার্ড মুজিব ও কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে নাগেরবাড়ি নামক স্থানকে তাদের প্রধান গােপন ঘাঁটি হিসেবে বেছে নেয়। চিতলমারী ও কচুয়া নামক স্থানে মীর শাখাওয়াত আলী ও এম এ সবুরের নেতৃত্বে গড়ে তােলা হয় বিশাল গণবাহিনী। মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক ট্রেনার হিসেবে ক্যাপ্টেন মেহেদী ও অধ্যাপক মােয়াজ্জেম হােসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
৩১ মার্চের এক জরুরী গােপন বৈঠকে নেতৃবৃন্দ প্রশিক্ষণরত মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অংশকে উচ্চতর ট্রেনিং ও যুদ্ধাস্ত্রের জন্য ভারতে পাঠান এবং আরেকটি অংশ সুন্দর বনের গভীরে আস্তানা গেড়ে পাক বাহিনীকে মােকাবেলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে।
চুয়াডাঙ্গা বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন ৭ মার্চ। এই খবর খুব জোরের সাথেই চুয়াডাঙ্গার মানুষের মনে রেখাপাত করে। ৬ মার্চ রাতে সারা শহর এবং গ্রামে গ্রামে ছাত্র-জনতা প্রতিটি বাড়ির রেডিও সেটের সঙ্গে মাইকের চোঙ্গা লাগিয়ে দেয়। একই সাথে সকল রেডিও সেটের সামনে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘন্টা আগে থেকেই মানুষের ভিড় লেগে যায়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বেতার মাধ্যমে আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার হয়না। এতে তাৎক্ষণিক ভাবে মানুষের জঙ্গী মিছিল বেরােতে শুরু করে।
হাজার হাজার সমবেত জনতার উৎকণ্ঠার অবসান কয়ে এ সময় নেতৃবৃন্দ ঢাকায় টেলিফোনে যােগাযােগ করে জানতে পারেন যে, সামরিক সরকার রেডিওতে ভাষণ প্রচার করতে দেয়নি। এই খবর যখন মাইকে ঘােষণা করা হােল তখন জনতার উত্তেজনা এতই তীব্র আকার ধারণ করে, তার তাৎক্ষণিক ভাবেঢাকা রওনা হওয়ার জন্য নেন্দকে চাপ দিতে থাকে। ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ জয়বাংলা’ প্রভৃতি শ্লোগানে তখন আকাশ বাতাশ প্রকম্পিত হতে থাকে।
চুয়াডাঙ্গা মহকুমায় ২ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। অলিউজ্জামান কে আহবায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটিতে অন্যান্য যারা ছিলেন তারা হলেন আলী জাফর, সিদ্দিক জামান মন্টু, মােঃ মনিরুজ্জামান, গােলাম ছারােয়ার, আঃ ছালাম, জহিরুল হক মানিক, প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ছাত্রলীগ, ছাতৃ ইউনিয়ন (মতিয়া-মেনন) উভয় সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলাে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয় মহকুমা সংগ্রাম কমিটি। স্থানীয় আওয়ামী লীগ সভাপতি আসহাব উল হক এই কমিটির
________________________________________
প্রধান নির্বাচিত হন। সংগ্রাম কমিটিতে নীতি নির্ধারক হিসেবে মােট ৭জন সদস্য ছিলেন। তারা হলেন দোস্ত মােঃ আনহারী, ইউনুস আলী, মােহাঃ জাকারিয়া, আল্লা হাফিজ, মিছকিন আলী মিয়া, আবুল হাসেম। একই সময় গঠিত হয় মহকুমা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন ওবায়দুল হক জোয়ারদার। স্থানীয় সগ্রাম কমিটির বাইরেও যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সাহসী ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মােহাম্মদ আলী, আতিউর রহমান, আবদুল ওয়াদুদ সহ আরাে অনেকে।
৮ মার্চ থেকে মহকুমা সংগ্রাম কমিটি মহকুমার লাইসেন্সকৃত সকল বন্দুক সংগ্রহ করেন। সংগৃহীত বন্দুক, হাতে তৈরি অ ও লাঠি নিয়ে এদিন সর্বস্তরের মানুষ মিছিল বের করে। ৩ মার্চ বিকেলেই চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা প্রঙ্গণে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ওবায়দুল হক জোয়ারদার ও কাজী কামাল। এসময় আলম ডাঙ্গার স্টেশন পাড়ায় স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে স্থানীয় নেতা আবদুল হান্নান প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেন। প্রশিক্ষন কাজে ব্যবহৃত হয় কাঠের রাইফেল ও বাঁশের লাঠি । | ১০ মার্চ চুয়াডাঙ্গার অবাঙ্গালি মহকুমা শাসক ইকবাল চৌধুরী মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়। সংগ্রাম কমিটি প্রশাসন চালানাের জন্য হাবিবুর রসুলকে ভারপ্রাপ্ত মহকুমা প্রশাসক নিযুক্ত করে। স্থানীয় জনগণ তাদের সকল প্রকার আর্থিক সহযােগিতা নিয়ে সংগ্রাম কমিটির সাহায্যে এগিয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা এখানে পৌছুলে ২৬ মার্চ স্থানীয় চৌরাস্তা মােড়ে সর্বকালের বৃহৎ জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইং এর হাবিলদার মজিবর রহমান কোয়ার্টারের সমস্ত অবাঙ্গালী সৈন্যদের নির করে আটক করে। ২৬ মার্চ মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত হয় ‘দক্ষিণ পশ্চিম কমান্ড’ এবং চুয়াডাঙ্গাকে ‘অস্থায়ী রাজধানী ঘােষণা করা হয়। দক্ষিণ পশ্চিম কমান্ড ৩০ মার্চ কুষ্টিয়া শহরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আযম চৌধুরী, এর আগে চুয়াডাঙ্গায় ‘বাংলাদেশ রেডক্রস’ ও ‘জয়বাংলা টেলিফোন চালু করা হয়। ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘােষণা করা হয়।
পিরােজপুর ২ মার্চ পিরােজপুর মহকুমায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। যদিও এর আগে থেকেই এখানকার মানুষ ধারাবাহিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করে আসছিলাে। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা এই অঞ্চলের মানুষ এদিন রাতে বিদেশী বেতারে শুনতে পায়। অতিদ্রুত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার আহবান মানুষের মুখে মুখে পৌছে যায় প্রতিটি গ্রামে। বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত লাঠিহাতে মানুষ ছুটে আসে পিরােজপুর শহর
________________________________________
অভিমুখে। পিরােজপুর শহর এদিন হয়ে ওঠে মিছিলের শহর। অতিদ্রুত গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত গড়ে ওঠে সগ্রাম কমিটি। | পিরােজপুর মহকুমা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক নিযুক্ত হন এ্যাডঃ এনায়েত হােসেন খান। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন ডাঃ আবদুল হাই, ডাঃ মােজাহার উদ্দিন, নুরুল ইসলাম ভান্ডারি, এ্যাডঃ আলী হায়দার খান, ডাঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল প্রমুখ। এই কমিটি গঠনের পর থেকে মহকুমার সকল কার্যক্রম সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে পরিচালিত হয়। মহকুমা শাসক পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। সংগ্রাম কমিটি আবদুর রাজ্জাককে ভারপ্রাপ্ত মহকুমা প্রশাসক নিযুক্ত করে। স্থানীয় পুলিশ প্রধান ফয়েজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন।
এই মহকুমার ৭ টি থানা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগ্রাম কমিটি প্রশিক্ষন ক্যাম্প স্থাপন করে। দলে দলে ছাত্র-যুবক-জনতা এ সকল ক্যাম্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন গ্রহণে এগিয়ে আসে। এ সময় পাকিস্তান থেকে ছুটিতে আসা লেঃ জিয়াউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। | ২৩ মার্চ পিরােজপুরে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানাে হয়। ২৫ মার্চের রাত ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাদস্যদের অতর্কিতে বর্বরােচিত হামলার খবর এদিন গভীর রাতেই মহকুমার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই খবর প্রকাশের সাথে সাথে মানুষ গ্রাম, গঞ্জ, শহর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ঢাল, তলােয়ার, সড়কি, লাঠি, দা,কুড়াল প্রভৃতি নিয়ে সমবেত
জনতাকে তাৎক্ষণিকভাবে সংগঠিত করতে সংগ্রাম কমিটির নির্দেশে ছাত্র নেতা আবদুল মালেক খান আবু মাইক নিয়ে জনতাকে ২১ মার্চ ভােরে থানার সামনে হাজির থাকতে বলেন। এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেন। ভােরবেলা থানার সামনে হাজার হাজার মানুষ যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে সমবেত হয়। তারা নেতৃবৃন্দের কাছে অন্ত্রের দাবী জানাতে থাকে। বিকেলে টাউন হল মাঠ বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন জনতার একটি শ্লোগানই কেবল আকাশ বাতাশ কাপিয়ে তুলছিলাে; তাহলাে ‘বীর বাঙ্গালী অস্ত্রধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ এবং ‘জয় বাংলা’। | ২৬ মার্চ ছাত্র-জনতা যৌথ অভিযান চালিয়ে সরকারী অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে সকল অস্ত্রশস্ত্র তাদের দখলে নিয়ে নেয়। লেঃ জিয়াউদ্দিন ছাত্র যুবকদের একত্র করে তাদের গেরিলা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের ব্যবস্থা করেন সগ্রাম কমিট । সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে গঠিত হয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। এর নেতৃত্ব দেন বদিউল আলম চৌধুরী ও মফিজ উদ্দিন আহমেদ।
ন্যপের উদ্যোগেও এখানে পৃথকভাবে প্রশিক্ষন ক্যাম্প খােলা হয়। এ ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন ফজলুল হক। একই সময়ে ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের আরেকটি প্রশিক্ষন শিবির স্থাপিত হয় রাজার হাটে। নেতৃত্ব দেন এম এ মান্নান। পিরােজপুর মহিলা
________________________________________
মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য আলাদাভাবে স্থাপিত ট্রেনিং ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন জাহানারা দেওয়ান আলাে। | মুক্তিযােদ্ধার প্রশিক্ষন দানের জন্য অন্যান্য যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল আউয়াল, গাজী নুরুজ্জামান বাবুল, আবুল কালাম মহিউদ্দিন সহ প্রমুখ। এ সময় অন্য একদল উদ্যোগী যুবক ট্রেজারী ভেঙ্গে সমুদয় টাকা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দেয়। অমর সাহার সম্পাদনায় ধুমকেতু নামক একটি পত্রিকা তখন মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বৃদ্ধি করে। পিরােজপুর মহকুমার বিভিন্ন থানায় যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমেদ, সওগাতুল ইসলাম সগীর, শামসুল হক, ডাঃ মােজাহার উদ্দিন, জহুরুল হক লালমিয়া, মােঃ শহিদুল্লা, নূরুল ইসলাম ভান্ডারী, ডাঃ আঃ হাই, নিরােদ বিহারী নাগ, নিখিল হালদার, নূর মােহাম্মদ প্রমুখ।
রাজবাড়ী রাজবাড়ী মহকুমার সাধারণ মানুষ শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে আসছিলাে। ৭ মার্চের ভাষনের পর এখানে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত হয় সংগ্রাম কমিট। এই সংগ্রাম কমিটিকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথাঃ (ক) পলিটিক্যাল কাউন্সিল। এই কাউন্সিলেন প্রধান ছিলেন কাজী হেদায়েত হােসেন। (খ) ডিফেন্স কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের প্রধান নিযুক্ত হন ডাঃ এস এ মালেক। (গ) পাবলিক রিলেসন্স কাউন্সিল। এ কাউন্সিলের প্রধান নির্বাচিত হন ডাঃজলিলুর রহমান।
সংগ্রাম কমিটির অন্য যে সকল সদস্য ছিলেন তারা হলেন মােসলেম উদ্দিন মৃধা, আঃ ওয়াজেদ চৌধুরী, অমল কৃষ্ণ চক্রবর্তী, এম এ মােমেন বাচ্চু, কমল কৃষ্ণ গুহ প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি গঠিত হয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন এই পরিষদে যৌথভাবে কাজ করে। এই সংগঠনের নেতারা ১০ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলে মুজিব বিল্ডিং এ। পরবর্তীতে এই বিল্ডিং এর মালিক মুজিবুর রহমানকে বিহারীরা নৃসংশভাবে হত্যা করে।
৮ মার্চ থেকে মূলত রাজবাড়ীতে মুক্তিযোেদ্ধাদের প্রশিক্ষনের কাজ শুরু হয়। ডিফেন্স কাউন্সিলের দায়িত্বে এই প্রশিক্ষন চালু হয়। সেনা বাহিনীর আঃ বারী মন্ডল প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ডিফেন্স কাউন্সিল বিভিন্ন ভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করে তা প্রশিক্ষনরত যােদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। এ সময় মহকুমা প্রশাসক শাহ মােঃ ফরিদ পুলিশ রুমের সকল অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দেন।
রাজবাড়ীতে বসবাসকারী অসংখ্য বিহারী আন্দোলনের প্রথম দিকে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের কাছে এই মর্মে মুচলেকা প্রদান করে যে, তারা কোন ভাবেই মুক্তিযুদ্ধের দবিরােধিতা করবেনা এবং বাঙালীদের পক্ষে কাজ করবে। কিন্তু যখন পাক হানাদার
________________________________________
বাহিনী এখানে ঘাঁটি গাড়ে তখন এ সকল বিহারীরা ব্যাপকভাবে লুটপাট ও গণ হত্যায় নেমে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২১ এপ্রিল রাজবাড়ীতে পাক বাহিনীর সঙ্গে (গড়াই ব্রীজে) মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পাক দস্যুদের মারাত্মকভাবে হতাহত করে হটিয়ে দেয়।
গাজীপুর পাকিস্তান স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির পুঞ্জীভূত ক্ষোভের যে বিস্ফোরন ৭১ সালে ঘটেছিলাে তার ঢেউ গাজীপুরের মানুষকেও প্রবল ভাবে উদ্দীপ্ত করেছিলাে। এখানকার হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জনসভায় যােগ দিয়েছিলাে। ঢাকা থেকে ফিরেই সেদিন এখানকার নেতৃবৃন্দ বৈঠকে মিলিত হন। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের সঙ্গে সঙ্গেই গাজীপুরের জনতা একটি সংঘাতপূর্ণ অবস্থার আশংকা করছিলাে।
গাজীপুরে অবস্থিত দেশের দুটি বৃহৎ কারখানা গাজীপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরী ও সমরাস্ত্র কারখানার কর্মকর্তা কর্মচারীরাও শুরু থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ৮ মার্চ থেকেই এখানে মিছিল মিটিং এর তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আন্দোলনরত জনতাকে বিপুলভাবে নাড়া দেয়। জনতার সংগ্রাম ক্রমেই একটি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়।
৭ মার্চের পর পরই এখানে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিলাে। একটি হাইকমান্ড’ অন্যটি এ্যাকশন কমিটি’। হাই কমান্ডের সদস্য ছিলেন মােহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, মনীন্দ্রনাথ গােস্বামী, মােজাম্মেল হক, এম এ মােতালিব, নজরুল ইসলাম খান প্রমুখ এবং এ্যাকশন কমিটিতে ছিলেন মােঃ নজরুল ইসলাম, ডাঃ সাঈদ বক্স, মােঃ আয়েশ উদ্দিন, শহীদুল্লা বাছু, হারুন অর রশীদ,শহীদুর ইসলাম পাঠান, আবদুস ছাত্তার মিয়া, শেখ আবুল হােসেন সহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। | হাইকমান্ড ও এ্যাকশন কমিটির সদস্য ছাড়াও অন্যান্য যেসব নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে আহসানুল হক কাকুল, আঃ বারিক মিয়া, মােঃ হযরত আলী, আলিম উদ্দিন, মােঃ হাবিবুর রহমান, জামান হায়দার, মােঃ হাতেম আলী, আহমদ ফজলুর রহমান, মােহাম্মদ হাবিবুল্লা প্রমুখ। সংগ্রামী ছাত্র জনতা পাবলিক লাইব্রেরীর বটতলায় পাকিস্তানী পতাকায় অগ্নিসংযােগ করে। এতে প্রধান ভূমিকা রাখেন বিশিষ্ঠ ছাত্র নেতা শহীদুল্লা বাছু।
১৯ মার্চ সংঘটিত হয় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিকামী বাঙালীর প্রথম প্রতিরােধ যুদ্ধ। গাজীপুর-জয়দেবপুরের হাজার হাজার জনতা এদিন পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে এক বিশাল প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলাে। স্থানীয় ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালী সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে ঢাকা থেকে আসা পাক দস্যুদের আগমন ঠেকাতে জনতার সমাবেশ সেদিন
________________________________________
এক জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিলাে। পাঞ্জাবী ব্রিগেডিয়ার জাহান আলী জনতার ব্যারিকেডের মুখে বাধ্য হয়ে ঢাকা ফিরে যায়। ফিরে যাবার পথেও তারা অসংখ্য ব্যারিকেডের সম্মুখীন হয়। জয়দেবপুর রেলক্রসিং-এ এসে তারা প্রচন্ড প্রতিরােধের মুখােমুখি হলে পাক দস্যু নিল বাঙালীদের উপর গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে নিহত হন মনু মিয়া ও জিয়ারত নামে দুজন কর্মী। | প্রতিরােধ যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিদ্দিকুর রহমানের নেতৃত্বে ৫ জন বাঙালী সৈন্য ৫টি এস এমজি সহ জনতার সঙ্গে যােগ দেয়। ফলে শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গুলি বর্ষণ। পাক বাহিনী চান্দিনা নামক স্থানে জনতার ঘেরাও এর মধ্যে পড়ে যায়। এক পর্যায়ে হুরমত আলী নামক একজন যুবক পাক বাহিনীর এক সদস্যের অর কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করলে অন্যদিক থেকে আরেক দস্যর গুলিতে বীর মুক্তিযােদ্ধা হুরমত আলী প্রাণ হারায়। গাজীপুর-জয়দেবপুরের এই ঘটনা সমগ্র দেশকে বিপুলভাবে আন্দোলিত করে।
গাজীপুরের শ্রমিক শহর বলে পরিচিত টঙ্গিতে শ্রমিক কর্মচারীরা স্বাধীনতার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়াদিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলন অংশগ্রহণ করে। এখানকার ছাত্র নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক নেতারাও তাদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে এগিয়ে নেন। ৩ মার্চ টঙ্গিতে শ্রমিকদের এক বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। অলিমপিয়া, নিশাত, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, মেঘনা টেক্সটাইল সহ প্রভৃতি মিলের শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। | ৫ মার্চ শ্রমিকদের মিছিলে পাক বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে শহীদ হয় মােতালেব, ইস্রাফিল, রইছউদ্দিন সহ আরাে কয়েক জন। ৭ মার্চ টঙ্গি থেকে লাল ফিতা বাধা প্রায় কুড়ি হাজার শ্রমিকের বিশাল মিছিল পায়ে হেঁটে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় উপস্থিত হয়।
২৩ মার্চ এখানে খবর পৌছায় যে, পাক বাহিনী এগিয়ে আসছে। এ খবর আসার পর আঃ হাকিম মাষ্টারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জরুরী বৈঠকে টঙ্গী ব্রীজ ধ্বংস করে ফেলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে পাক বাহিনী আর এগুতে না পেরে বিমান বন্দর এলাকায় অবস্থান নেয়। ২৫ মার্চের মর্মান্তিক গণহত্যার পর শ্রমিক জনতা স্বাধীনতার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর আহবানে চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
| মৌলবীবাজার ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে মৌলবীবাজারে সারাদিন পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ২ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত এখানে একটানা হরতাল পালিত হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা আন্দোলনের পুরােভাগে নেতৃত্ব দেয়।
৭ মার্চ মানুষ সারাদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শােনার জন্য রেডিও সামনে করে অপেক্ষা করতে থাকে। তীব্র উত্তেজনার মধ্যে পার হয়ে যায় নির্ধারিত সময়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার
________________________________________
হয় না। জনতার দুঃশ্চিন্তা ক্রমে বাড়তে থাকে। এমন সময় বিবিসি থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাবণের ঘােষণা মানুষের সকল অপেক্ষার অবসান ঘটায়। শুরু হয় রাজনৈতিক নেতা-ছাত্র-জনতার সর্বাত্মক প্রস্তুতি। | আওয়ামী লীগ সভাপতি আবদুল মােত্তাকিম চৌধুরীর সভাপতিত্বে আজিজুর রহমানকে আহবায়ক নিযুক্ত করে গঠিত হয় সংগ্রাম কমিটি। কুলাউড়া থানার আলম বেডিং-এ বসে গঠিত কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন সৈয়দ আমজাদ আলী, তৈমুছ আলী, মির্জা আজিজ বেগ, আবদুল জব্বার, আলতাফুর রহমান, মােহাঃ ইলিয়াছ, তােয়াবুর রহিম প্রমুখ। প্রতি থানাতেও এ সময় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। | শ্রীমঙ্গল পৌরসভাতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে সেখান থেকে বিস্তারিত কার্যাদি পরিচালিত হয়। কন্ট্রোল রুমের নেতৃত্ব দেন মােঃ ইলিয়াছ এমএন এ মহকুমা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী আন্দোলনকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন আবদুল মালিক। সদস্য ছিলেন আরজু মিয়া, গাজী গােলাম ছারােয়ার প্রমুখ।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে জয়নাল হােসেন, নুরুল ইসলাম মুকতি, আঃ ওদুদ, দেওয়ান আঃ ওয়াহাব, সুজাউল করিম, সৈয়দ সিদ্দিকুর হাসান, হারুনার রশীদ, সুলেমান আলী, রফিক উদ্দিন চৌধুরী রানা, নাসির উদ্দিন চৌধুরী, আতাউর রহমান চৌধুরী, আঃ ওদুদ চৌধুরী, এম এ ছালাম, সিরাজুল হক, রেজা আহমেদ বেনজীর, গােলাম মােহিদ খান, আজমল আঃ চৌধুরী, শামসুন নাহার বেলা, মমতাজ আরা চৌধুরী। সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ, সৈয়দ বসারত আলী, হিরু মিয়া, অদ্বৈত সেন অধিকারী, সলিল শেখর দত্ত, মনবীর রায়, আঃ সৃকিত খান, পরিতােষ চক্রবর্তী, কাজী ফেরদৌস হােসেন, আঃ কুদ্স, কায়সার খান প্রমুখ।
১৯ মার্চ কয়েক হাজার জনতা পা বাহিনীর একটি কনভয় আটকে দেয়। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মােঠ ময়না মিয়া। ২২ মার্চ মহকুমার কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীরা মিছিল বের করে। বিভিন্ন গণসঙ্গীত ও আবৃত্তির মাধ্যমে তারা জনতাকে উদ্দীপ্ত করে। এক্ষেত্রে মুজিবুর রহমান, আজিজুল হক, সুজাউল করিম, নওরােজ আহমেদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২৩ মার্চ স্থানীয় চৌরাস্তায় দেওয়ান আঃ ওহাবের নেতৃত্বে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় কায়দে আজম জিন্নার ছবি ও পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে ফেলে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানাে হয়। পতাকা তােলেন ছাত্রলীগ নেতা মুজিবুর রহমান মুজিব। আনুষ্ঠানিক এই পতাকা তােলার পূর্বে গৌরপদ দেব কালু পতাকা পুড়িয়ে ছিলেন। ২৪ মার্চ ন্যাপের উদ্যোগে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বক্তব্য রাখেন মতিউর রহমান, গজনফর আলী, শকাতুল ওয়াহেদ।
২৫ মার্চ ঢাকার পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সঙ্গে মৌলবীবাজারেও ব্যাপক ধর পাকড় ও হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়। এর পাশাপাশি সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র নেতারা যুদ্ধের জন্য চুড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করেন। অনেকে উক্ত প্রশিক্ষণ ও অন্ত্রের জন্য ভারতে চলে যান।
________________________________________
মাদারীপুর মার্চ ১৯৭১। সমগ্র বাংলায় আন্দোলনের তীব্র উন্মাদনা। মুক্তির হায় উঞ্চেল জনতার প্রত্যাশার ফুরণ ঘটে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে মাদারীপুরের নেতৃবৃন্দ গঠন করেন সংগ্রাম কমিটি। আমজাদ হােসেন খানের বাড়ীতে এক বৈঠকে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মাদারীপুর সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক নিযুক্ত হন মৌলৰী আসমত আলী খান। কমিটির সদস্য ছিলেন ফণি ভূষণ মজুমদার, আবদুল মান্নান টুলু, ডাঃ এম এ কাশেম, আমজাদ হােসেন খান, মতিউর রহমান, নুরুল হক, ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম দানেশ, ডাঃ রকিব উদ্দিন আহমেদ, আবেদুর রেজা খান, এ টি এম নুরুল হক, মতিউর রহমান ভূইয়া,আঃ মান্নান শিকদার, আঃ খালেক প্রমুখ।
সংগ্রাম কমিটির বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে আঃ রব শিকদার,মােতালেব মিয়া, আঃ রব মুন্সি, আবুল ফজল মাষ্টার, মজিবর রহমান, সরদার লিয়াকত হােসেন, সারােয়ার মােল্লা, রেজা শাজাহান, তাজুল ইসলাম, নুরুল আলম বাবু, শওকত হাওলাদার, মৃণাল কান্তি বাড়ই প্রমুখ।
ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন শাজাহান খান, হাবিবুর রহমান আজাদ, হাবিবুর রহমান সূর্য, মাহবুব সাঈদ, খলিলুর রহমান খান, সিরাজুল ইসলাম বাচ্চু, হারুনর রশীদ মােল্লা, হারুনর রশীদ নীরু প্রমুখ। সংগ্রাম কমিটি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আগে স্থানীয় নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে পাকিস্তানী পতাকায় অগ্নিসংযােগ করে সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলা হয়। এখানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে বদিউজ্জামান, তাহের চৌধুরী, শাজাহান খান, খলিলুর রহমান খান প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য।
৭ মার্চ এর পর পরই মাদারীপুর কলেজ ময়দানে মুক্তিযােদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়। শিশু যুবা বৃদ্ধ পর্যন্ত এই প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নেয়। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রধান তত্বাবধায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন শওকত আলী, ইয়ার্ড মুজিব, আলমগীর হােসাইন প্রমুখ।
২৫ মার্চ ঢাকায় পাক হানাদার দস্যু বাহিনীর আক্রমণের খবর স্থানীয় পুলিশ ওয়ারলেসে এদিন রাতেই পৌছে যায়। তাছাড়া অনেকে ব্যক্তিগত টেলিফোনের মাধ্যমেও এখবর শুনতে পান। এই হামলার খবর ঐ রাতেই মাইকে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। শহরে এ খবর প্রচারের সাথে সাথে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং বিক্ষোভ মিছিল করে। জনতা ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কে প্রতিরােধ সৃষ্টি করে। কুমার নদীর ফেরী সরিয়ে ফেলা হয়। মাদারীপুর লঞ্চঘাটেও ব্যারিকেড দেয়াহয়।
২৬ মার্চ থেকে সংগ্রাম কমিটির স্থানীয় মিলন সিনেমা হলে তাদের কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে তাদের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করে। গার্লস স্কুলেও প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। বিভিন্নভাবে নেতৃবৃন্দ অস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহের চেষ্টা চালান। মহকুমা শাসক ও মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সরকারী অন্যগার খুলে দেন।
________________________________________
স্থানীয় জেলার অবঃ রশীদ খান মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা করার অপরাধে সপরিবারে নিহত হন। মুক্তিযােদ্ধারা এ সময় অনেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও অন্যের জন্য ভারতে চলে যায়। অনেকে দেশের ভিতর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
| নওগাঁ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভের পরেও যখন দেশ শাসনের অধিকার পেলনা মূলতঃ তখন থেকেই নওগাঁয় গণমানুষের আন্দোলন ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এরপর ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা, ২ মার্চের দেশব্যাপী হরতাল, সপ্তাহব্যাপী আন্দোলনের এক পর্যায়ে আসে ৭ মার্চ। এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে বাংলার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়।
২৬ মার্চ নওগাঁয় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। কমিটি সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুল জলিল, মােঃ বায়তুল্লা, এম, এ, রকিব, মাযহারুল হক পােনা প্রমুখ। এই পরিষদ ২৬ মার্চ থেকে নওগাঁ মহকুমার প্রশাসনিক কর্মকান্ড পরিচালনা করে। স্থানীয় কেজি স্কুল মাঠে ইপিআরদের সহযােগিতায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু হয়। স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মীদের তত্বাবধানে “রক্তশপথ” নামক একটি নাটক জনমনে ব্যাপক সাড়া জাগায়।
মেজর নজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে নওগাঁয় ছাত্র-জনতার একটি বিশাল প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালিত হয়। এ সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন জালাল হােসেন চৌধুরী, আবদুল মালেক, আখতার আহমেদ সিদ্দিকী, মােথলেসুর রহমান রাজা, আবু রেজা বিশু, আনিসুর রহমান, ময়নুল হক মুকুল, আঃ আজিজ, বেলাল হােসেন, আখতারুজ্জামান রনজু, আঃ ওয়াহাব, ময়নুল ইসলাম ময়েন, মােজাম্মেল হক, নার্গিস, টুকু, জাহাঙ্গীর আলম, নওশের, ইসলাম খান, মােয়াজ্জেম হােসেন প্রমুখ।
সংগ্রাম পরিষদ মহকুমার বিস্নি স্থানে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন । এসকল স্থানে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন দেওয়ান আজিজুর রহমান, আনােয়ার রহমান তালুকদার, ইমাজ উদ্দিন প্রামানিক, খন্দকার মকবুল হােসেন। এদের নেতৃত্বে বাদলগাছি, মান্দা, রানী নগরসহ প্রভৃতি স্থানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু হয়। সংগ্রাম কমিটির তত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন আওয়ামী লীগ নেতা আঃ জলিল। | আওয়ামী লীগ ছাড়াও ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে বালুর ঘাট পতিরামসহ আরাে দু’একটি স্থানে রিক্রটিং ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তােলা হয় । এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মীরাও আন্দোলনে পিছিয়ে ছিলেন না। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে তারা মানুষকে আন্দোলনমুখী করে তােলেন। সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে ছিলেন ময়নুল চৌধুরী রাজা, ভবেশ চ্যাটার্জি, প্রভাত চন্দ্র সরকার, আফরােজা
________________________________________
মামুন, সাহিদা, ফরিদা আকতার বানু, সেফাত রাব্বানী, খন্দকার মকবুল হােসেন প্রমুখ। মুক্তিযােদ্ধাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে জয় বাংলা’ নামক একটি পত্রিকাও এ সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বান্দরবন ৭ মার্চের পরপরই বান্দরবনে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। স্থানীয় নেতা কর্মীরা এ সময় মানুষকে সংগঠিত করতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। শহরের চিলড্রেন পার্কে অনুষ্ঠিত এক আলােচনা সভায় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ সভায় অং ও প্রু চৌধুরীকে আহবায়ক ও আঃ ওয়াহাবকে সাধারণ সম্পাদক করে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এছাড়া কমিটিতে আরাে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সুধাংশু চক্রবর্তী, মাহবুবুর রহমান, মংচামিয়ান, মােখলেসুর রহমান, শামসুল ইসলাম, শফিকুর রহমান, চুহা ৫ জিমি, মংশৈ মারমা সদস্য ছিলেন।
৭ মার্চের পর থেকে এই এলাকার মানুষ ব্যাপক মিছিল মিটিং ও সমাবেশের আয়ােজন করে। দেশের একটি অতি পশ্চাদপদ এলাকা ও উপজাতি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চল হলেও এলাকার মানুষের মনে স্বাধীনতার চেতনা তীব্রভাবে পরিলক্ষিত হয়। এই এলাকার মানুষ মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে বিরাট ভূমিকা রাখেন। কেননা এই দুর্গম অঞ্চলে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে সম্পূর্ণ একটি অজানা অঞ্চল। কাজেই স্থানীয় অধিবাসীদের সাহায্য তাদের উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছুতে সাহায্য করে।
এখানে যারা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন দেলােয়ার হােসেন দিলু, ভুবন ভট্টাচার্য, কবির আহমেদ, মুনির আহমেদ, সতীন্দ্র মজুমদার, শফিকুল ইসলাম। শামসুল ইসলাম, কিশোের, বীর বাহাদুর, সাধন দাশ, ইসলাম বেবী জনিবাৰু, মােখলেসুর রহমান, শফিকুর রহমান প্রমুখ।
মেহেরপুর মেহেরপুর মহকুমায় ৭ মার্চের পর পরই স্থানীয় নেত্রা-কর্মীবৃন্দ সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের প্রতি শুরু করেন। প্রথম দিকে এখানে দুটি কমিটি গঠিত হয়। (ক) স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। (খ) বন্দুক বাহিনী। উভয় বাহিনীই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে ব্যাপক জনযুদ্ধের প্রতি নেন। এ সময় মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহি চৌধুরী মুক্তিযােদ্ধাদের সকল প্রকার। সহযােগিতায় এগিয়ে আসেন এবং পরে নিজেই সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেন।
মেহেরপুর মহকুমায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ন্ত্রক। এই বাহিনীর। প্রধান ছিলেন এম এন এ ছহি উদ্দিন আহমেদ। কমিটির সঙ্গে আরাে যারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাদের মধ্যে নুরুল হক এমপি, ইসমাইল হােসেন, ইদ্রিস আলী, ডাঃ মহিউদ্দিন, আঃ মান্নান, হিসাব উদ্দিন, আহমেদ আলী, জালাল উদ্দিন, আবুল হায়াত, আবু আবদুল্লা, আবদুর।
________________________________________
রশীদ, খাদেমুল ইসলাম, আসকার আলী, ফকির মােহাম্মদ, আবদুল ওয়াহেদ, নুর মােহাম্মদ প্রমুখ।
বন্দুক বাহিনীর প্রধান ছিলেন সিরাজুল ইসলাম (পটল মিয়া)। সদস্য ছিলেন আতাউল হাকিম, নজরুল ইসলাম, শাহবাজ উদ্দিন লিজু, শাজাহান খান হাসেম আলী খান, বকুল পাল, শান্তি রায়, মেহেদি বিল্লাহ, আল আমীন, মিজানুর রহমান প্রমুখ।
উপরােক্ত দুটি কমিটিই সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয় এবং অন্ত্র, খাদ্য ও জনসংযােগ মূলক কাজে আত্মনিয়ােগ করে।
৭ মার্চের পরই মেহেরপুর মহকুমায় পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলা হয়। স্থানীয় ছাত্র-যুবক-জনতা ১০ মার্চ থেকে কোর্ট ময়দানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। অবসর প্রাপ্ত সেনা ও পুলিশ বাহিনীর লােকেরা প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য এগিয়ে আসে। প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে স্থানীয় পুলিশ ব্যারাকের সদস্যরাও এগিয়ে আসে।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে বন্দুক বাহিনী পাক বাহিনীর আগমন ঘটতে পারে সেই আশংকায় কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা সড়কে প্রতিরােধ ব্যুহ তৈরি করে। এর মাঝে আসে ২৫ মার্চ। রাজধানী ঢাকায় পাক বাহিনীর মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের খবর এখানে এসে পৌছলে মানুষ বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। এ সময় মহকুমা শাসক তৌফিক এলাহি চৌধুরী উন্নত অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে প্রচুর অ-গােলাবারুদ যােগাড় করেন। হাতে লেখা স্লিপ দিয়ে এখানে পাসপাের্ট ব্যবস্থা চালু হয়। ১৬ এপ্রিল পাক বাহিনী মেহেরপুরে প্রবেশের আগ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা নির্বিঘ্নে তাদের সকল কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে।
নেত্রকোনা ছাত্রলীগ ১ মার্চ পাকিস্তানী প্রশাসনের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাতে নেত্রকোনা শহরে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিল করে। একটানা সপ্তাহব্যাপী আন্দোলন শেষে আসে ৭ মার্চ। নেত্রকোনা থেকে এদিন কয়েক হাজার লােক ঢাকা গমন করে। ঢাকা থেকে এ সকল মানুষ ফিরে আসার সাথে সাথে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে।
৭ মার্চের পরপরই এখানে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ কর্তৃক গঠিত সংগ্রাম কমিটি ছাড়াও ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির উদ্যোগে পৃথক একটি কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ কর্তৃক গঠিত কমিটিতে ছিলেন আবদুল মােমিন, জুবেদ আলী, আঃ খালেক, এন আই খান, আব্বাছ আলী, আঃ মজিদ তারা, সাদির, উদ্দিন আহম্মদ, ফজলুর রহমান খান, আলী ওসমান তালুকদার, গাজী মােস্তফা, কে এম ফজলুল কাদের প্রমুখ।
ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট সমর্থিত কমিটিতে ছিলেন আজীজুল ইসলাম খান, ওয়াজেদ আলী, আবদুল মতিন, বিপিন গুন, লতিফা, এন মারাক, আঃ আহাদ খান, মনি বিশ্বাস, সৈয়দ গেদু মিয়া, আঃ শহীদ, শাহ আঃ মােতালেব, মনােজ কান্তি বিশ্বাস, হরিশংকর চৌধুরী,
________________________________________
আঃ আজিজ প্রমুখ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নেত্রকোনায় দু’টি কমিটি গঠন করা হলেও তাদের উদ্দেশ্য ছিল একই। এবং তারা পরস্পর সহযােগিতার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেডিওতে প্রচার না করার প্রতিবাদে এদিন প্রায় সারারাত ধরে ছাত্রলীগের উদ্যোগে প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। নেত্রকোনা ডিগ্রি কলেজের ছাত্ররা এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করে। ৭ মার্চ এর পর থেকেই এখানকার প্রতিটি থানা, ইউনিয়ন, হাট বাজার, পাড়া মহল্লায় মিছিল মিটিং অব্যাহত থাকে। ৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচারিত হলে গ্রামাঞ্চল থেকে দলে দলে মানুষ দা, সড়কি, লাঠি, বল্লম, ঢাল প্রভৃতি অৱ নিয়ে শহরে সমবেত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সংগ্রাম পরিষদ লিয়াজো কমিটি গঠন করে যােগাযােগের দৃঢ়ভিত তৈরী করেন। এই লিয়াজো কমিটিতে ছিলেন আঃ মােমেন, জুবেদ আলী, আঃ খালেক, সদির উদ্দিন প্রমুখ। এই কমিটি মুলতঃ ঢাকা-ময়মনসিং-নেত্রকোনার সঙ্গে যাবতীয় সংযোেগ রক্ষা করে।
নেত্রকোনা বালিকা বিদ্যালয় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপিত হয়। এখানে নেতৃত্ব দেন আঃ মজিদ তারা। এছাড়া কেন্দুয়া, দুর্গাপুর, চল্লিশা বাজারেও ট্রেনিং ক্যাম্প খােলা হয়। প্রশিক্ষক হিসেবে তখন দায়িত্ব পালন করেন কবীর উদ্দিন আহমেদ, আলী ওসমান তালুকদার, আমজাদ হােসেন, মঈন উদ্দিন প্রমুখ।
১২ এপ্রিল ছাত্র-জনতা নেত্রকোনা অস্ত্রাগার লুট করে সেখান থেকে প্রচুর গােলা বারুদ হস্তগত করে। এখানে নেতৃত্ব দেন ফজলুর রহমান খান, আলী ওসমান তালুকদার, শামসুদ্দোজা, মুজিবুর রহমান প্রমুখ। এ সময় মুক্তিযোেদ্ধারা সরকারি খাদ্য গুদাম ভেঙ্গে প্রচুর পরিমান খাদ্য তাদের আয়ত্বে নিয়ে বিজয়পুর মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে মজুদ রাখে। ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টি বায়রাউড়া সদনপুর, বালি নামক স্থানে তাদের ঘাটি গড়ে তােলে।
নেত্রকোনায় ছাত্রলীগের যে সকল নেতা ও কর্মী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন শামসুদ্দোহা, সাফায়েত আহমেদ খান, গােলাম এরশাদুর রহমান, মেহের আলী, আশরাফ আলী খান, গুলজার আহমেদ, খন্দকার আনিসুর রহমান, বাদল মজুমদার, হায়দার জাহান চৌধুরী, আলাউদ্দিন খান, আনােয়ার হােসেন ভূইয়া, আলতাফ হােসেন, শহিদ উদ্দিন প্রমুখ। এছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে ছিলেন মনজুরুল হক, নুরুল ইসলাম, মােজাম্মেল হক বাহু, রবীন্দ্র চক্রবর্তী, আলকাস উদ্দিন, ওয়াজেদ আলী, ব্রজগােপাল শংকর, মাহফিজ উদ্দিন, গােলাম রব্বানী, হাবিবুর রহমান সিদ্দিকী, দিলীপ দত্ত, আঃ বারী, ফজলুর রহমান, আঃ রশিদ ফকির প্রমুখ।
ঠাকুরগাঁ সমগ্র দেশের মত ঠাকুরগাঁ মহকুমাতেও ১ মার্চ থেকে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগুনের প্রতি শিখা ছড়িয়ে পড়ে ৭ মার্চ। এদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের খবর শােনার
________________________________________
সঙ্গে সঙ্গে এখানকার মানুষ একটি সশন্ত্র যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে শুরু করেন। এর আগে ৩ মার্চ শহরে সর্বস্তরের মানুষের একটি বিশাল জঙ্গী মিছিল শহর প্রদক্ষিন করে এবং বিকেলে স্থানীয় বড় মাঠ নামক স্থানে আওয়ামী লীগ নেতা আঃ লতিফ মােস্কারের নেতৃত্বে একটি বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় সিদ্ধান্ত মােতাবেক শত শত লােক ৭ মার্চের জনসভায় যােগদান করে। ঠাকুরগাঁ থেকে প্রায় ৪০০ মাইল দুরের জনসভায় জনতা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই যােগদান করে। | ৮ মার্চ আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টিও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন সমূহের উদ্যোগে ৭১ সদস্যের সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি আওয়ামী লীগের ফজলুল করিম এমপি। কমিটির বিশেষ সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আঃ লতিফ মােক্তার, সিরাজুল ইসলাম, ইকরামুল হক, কমর উদ্দিন আহমেদ, এফএ মােহাম্মদ হােসেন, নুরুল হক, বলরাম গুহ, কামরুল হােসেন, এহসানুল হক চৌধুরী, আলাভাই, রেজোনুল হক চৌধুরী, ডাঃ আঃ মালেক, আজিজুর রহমান খােকা, শেখ ফরিদ প্রমুখ। | সংগ্রাম কমিটি সমগ্র ঠাকুর গাকে চারটি উপ-আঞ্চলিক এলাকা গঠন করে চারজনের উপর দায়িত্ব ন্যাস্ত করেন। এরা হলেন ফজলুল করিম, সিরাজুল ইসলাম, কমর উদ্দিন আহমেদ, ইকরামুল হক। ঠাকুরগার দেবীগঞ্জ, আটোয়ারী, তেতুলিয়া, পীরগঞ্জ, রানীসংকেল, হরিপুর প্রভৃতি এলাকাকে মােট চারটি অংশে ভাগ করা হয়। | মুক্তিযুদ্ধকে সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য আরাে তিনটি কমিটি গঠন করা হয় । (ক) রাজনৈতিক কমিটি, (খ) সশস্ত্র বাহিনী গঠন কমিটি (গ) যােগাযােগ ও অস্ত্র সংগ্রহ কমিটি। তবে এই কমিটিকে মূল সংগ্রাম কমিটির নির্দেশ মােতাবেক কাজ চালাতে হােত। প্রথমেই সংগ্রাম কমিটি স্থানীয় বড় মাঠে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করে। এক্ষেত্রে ছাত্রনেতারা প্রধান ভূমিকা পালন করে। ঠাকুরগা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ইউসুফ আলী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম প্রশিক্ষক হিসেবে ট্রেনিং দেন। | ঠাকুরগাঁ ছাত্র সগ্রাম কমিটিতে যায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের মধ্যে আবুল কালাম আজাদ, আসগর আলী, রেজাউল করিম, জর্জি রহমান, আনসারুল হক জিন্না, মির্জা নুরুল ইসলাম, আফাজউদ্দিন, মােহাঃ আলী, বজলুর রহমান, খাজা নাজিমুদ্দিন, হামিদুর রহমান, আনিসুর রহমান, অমলেউদ্দিন বাচ্চু প্রমুখ ।
জয় বাংলা’ বাহিনীর প্রধান ছিলেন আসগর আলী। তার নেতৃত্বে ১৫ মার্চ প্রায় বিশ হাজার জনতার এক বিশাল জঙ্গী মিছিল মহকুমা শাসকের দফতর ঘেরাও করে। সেখানে তারা পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়। আওয়ামী লীগ কর্মী ফালু দর্জি নিজ খরচে প্রচুর সংখ্যক পতাকা তৈরি করে তা বিভিন্ন অঞ্চলে বিলি করে। প্রতিরােধ বাহিনী বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে ঠাকুরগাঁকে একটি বেষ্টনী অঞ্চলে পরিণত করে।
সংগ্রাম কমিটি মহকুমা সদর অফিসেই তাদের প্রথম কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শহরের বিভিন্ন এলাকায় মােট ১০টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন
________________________________________
করা হয়। বিভিন্ন স্থানে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে মির্জা বাবুল, আঃ রশীদ, শেখ ফরিদ, আঃ জব্বার মুহুরী, ফনি পালিত, এবং সুবেদার কাজিম উদ্দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ঠাকুরগাঁ থেকে সংগ্রামী বাংলা নামক একটি পত্রিকা বের করা হয়। পত্রিকাটির পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন সিরাজুল ইসলাম, ইমদাদুল হক, আঃ লতিফ প্রমুখ। এছাড়া কাজী মাজহারুল ইসলাম কর্তৃক একটি পত্রিকাও প্রকাশিত দহয়।
২৪ মার্চ ঢাকায় পাক বাহিনীর হত্যাকান্ড এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবরে ঠাকুরগাঁ যেন একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের আকার ধারণ করে। এবং তারা যে কোন উপায়ে মাতৃভূমি মুক্ত করার শপথ গ্রহণ করে।
রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভার খবর এদিন রাতেই ফেনীতে পৌছে। বঙ্গবন্ধুর আহবান ও অতি দ্রুতগতিতে মানুষের কাছে পৌছে যায়। রাস্তায় নেমে আসে সর্বস্তরের মানুষ। মিছিল-মিটিং সহ সর্বাত্মক আন্দোলনের প্রস্তুতি শুরু হয়। আওয়ামী লীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ এবং এসব দলের অঙ্গ সংগঠন সহ সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মীরা বিভিন্ন ভাবে সংগঠিত হতে শুরু করেন।
১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের ভাষণের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ মিছিল ছাড়াও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ২ মার্চ স্থানীয় ফেনী কলেজে সর্বস্তরের জনতার এক বিশাল • জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এবং এদিন ছাত্র নেতারা আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকিস্তানী চাঁদ তারা খচিত পতাকা নামিয়ে তা পুড়িয়ে ফেলে সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ায়। এরপর জনতা মহকুমা সদর অফিসের পতাকা নামিয়ে সেখানেও স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলে। | ৩ মার্চ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমদের নেতৃত্বে শহরের উকিল পাড়ার রফিকুল হকের বাড়ীতে স্বাধীনতাকামী নেতৃবৃন্দের এক গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার নেতৃবৃন্দ আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন করার সংকল্প ব্যক্ত করেন। এদিনের বৈঠকে অন্য যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে এ বি এম তালেব আলী, আবদুল মালেক, এম এস হদা, জয়নাল আবেদীন, রফিকুল হক, রুহুল আমিন, নুরুল হুদা, আবদুর রহমান, মােস্তফা হােসেন, একে শামসুল হক প্রমুখ।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম কমিটিতে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে এম এস হুদা, এবিএম তালেব আলী, নুরুল হুদা, রুহুল আমিন, আঃ মালেক, আব্দুর রহমান, এ কে এম শামসুল হক, মাহফুজুল হক, মােহাম্মদ ছিদাম, মাহবুবুল আলম, নূর ইসলাম হাজারী, ইউনুহ চৌধুরী, নুর মােহাম্মদ হাজারী, কাদের আহমেদ প্রমুখ। ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের মধ্যে জয়নাল হাজারী, জয়নাল আবেদীন,
________________________________________
জহির উদ্দিন বাবর, মােহাম্মদ মুছা, শামসুদ্দিন দুলাল, শ্যামল বিশ্বাস, জাহাঙ্গীর কবীর চৌধুরী, কাজী ফরিদ আহমেদ, আঃ কাদের, কাজী নুরুন নবী, আবুল কালাম, একরাম, আঃ আজীজ, কাজী বুলবুল, দিরাজ কান্তি সাহা, জামসেদ, খােন্দকার মােজাম্মেল, ফয়েজ আহমেদ, হান্নান, ফিরােজ মজুমদার প্রমুখ। সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম কমিটির প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন খাজা আহমেদ।
স্থানীয় ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বেও একটি সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন এ এস এম গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, মীর হােসেন মিরু, আক্রামুজ্জামান, জয়নাল আবেদীন জিয়াউদ্দিন চৌধুরী, আবু তাহের, মানিক মজুমদার প্রমুখ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, উপরােক্ত ৩টি সংগঠনই সব সময় তাদের পারস্পরিক আলােচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করেন।
সংগ্রাম কমিটি উদ্যোগী ছাত্র-যুবক-জনতাকে সংগঠিত করে ১০ মার্চ থেকে স্থানীয় পিটিআই মাঠ, পলিটেকনিক কলেজ প্রাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন ক্যাপ্টেন এনাম, মওলা, লেঃ আঃ রউফ সিদ্দিক আহমেদ, হাবিলদার কালামিয়া । প্রশিক্ষণরত মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে এ সময় ফেনী থানার দারােগা শামসুল হক ও মােহাম্মদ আলী গােপনে তাদের অস্ত্র প্রদান করেন। ট্রেনিংরক্ত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট) লিয়াজো অফিসার জহির উদ্দিন বাবর ও মাহফুজুল হক বিভিন্ন ভাবে বেশকিছু অস্ত্রের যােগাড় করেন। এবং এভাবেই ফেনীর সর্বস্তরের জনতা দেশ মাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধকে একটি সফল পরিনতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।
চাঁদপুর চাঁদপুর মহকুমার জনগণ ৭ মার্চের ভাষণের খবর টেলিফোনের মাধ্যমে পেয়ে যান। এ খবর প্রচারের সাথে সাথে সর্বস্তরের জনতা কালিবাড়ি মােড়ে সমবেত হতে থাকে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
| ৭ মার্চ থেকেই এখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগ নেতারা সংগ্রাম কমিটি গঠনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ অফিসে জরুরী বৈঠক করে। অন্যদিকে ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টি নেতারা খাজা সাহেবের বাসায় বৈঠক করে সংগ্রাম কমিটি সিদ্ধান্ত নেন। এখানে সভাপতিত্ব করেন ন্যাপ নেতা আবদুর রউফ। | আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এর সমন্বয়ে গঠিত সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারী, মােঃ আবদুর রব, আবদুল আউয়াল, মিজান চৌধুরী, আঃ করিম পাটোয়ারী, রাজা মিয়া, আবুল কাসেম চৌধুরী, হাফেজ হাবিবুর রহমান, এবি সিদ্দিকী, ওয়াজি উল্লাহ নওজোয়ান, ডাঃ আঃ সাত্তার, সেকেন্দার আলী মাষ্টার, আবু জাফর মাইনুদ্দিন, সােনা আখন্দ, আঃ রব, শেখ আমিনুল হক মাষ্টার, আঃ রব পিএসপি, মমিন
________________________________________
খান মাখন, ফজলুল হক তালুকদার, মুনির আহমেদ, আবেদ মনসুর, এম এ ওয়াহিদ, রবিউল আউয়াল কিরণ, হানিফ পাটোয়ারী, আবু তাহের দুলাল, চন্দন পােদ্দার সহ আরাে অনেকে।
ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়ন সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিটিতে ছিলেন সৈয়দ আঃ ছাত্তার, আঃ রউফ, জীবন কানাই চক্রবর্তী, ফজলুল হক সরকার, খাজা চৌধুরী, আঃ কাদের মাষ্টার, মাহবুবুল হক পাটোয়ারী, মওলানা আঃ লতিফ, শহিদুল্লা মাষ্টার, আঃ রহমান, মাহবুবুল বাশার কালু, অজিত সাহা, কায়কোবাদ চুন্ন প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ ২ এপ্রিল থেকে চাঁদপুর মহিলা কলেজে মাঠে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু করে। মহকুমার অবসরপ্রাপ্ত সেনা পুলিশ, নৌ আনহার বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। কলেজ মাঠ ছাড়াও সংগ্রাম কমিটি পাইকপাড়া, ফানিয়ালা উচ্চবিদ্যালয় মাঠ, গাজীপুর, ওগেরিয়া, ফরিদগঞ্জ সহ আরাে কয়েকটি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এছাড়া ন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয় রেলওয়ে কোয়াটার মাঠ। এখানে প্রশিক্ষক ছিলেন জীবন কানাই চক্রবর্তী ও শাহ মােঃ আতিক উল্লা।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা এখানে পৌছলে জনতার দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে এ মহকুমার সকল থানা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তাদের অস্ত্র তুলে দেয়। এবং তারাও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। ছাত্রলীগ সভাপতি ওয়াহিদ মিয়া তার সহকর্মী আবু তাহের দুলাল, চন্দন পােন্দার প্রমুখের সহযােগিতায় শহরের লাইসেন্সকৃত সকল অস্ত্র সংগ্রহ করে তা যুদ্ধের কাজে লাগায়। ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা তখন হাতে অস্ত্র তৈরি শুরু করে। অ তৈরিতে অংশ নেয় কালাম, খালেক, দ্বিজেন, রহমান, সুশীল। ছাত্রলীগও তখন হানিফ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে জ্ঞ তৈরি আরম্ভ করে। ৩ এপ্রিল বােমা তৈরিকালে ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন কর্মী নিহত হয়।
(ोगी মার্চের শুরু থেকেই ভােলা মহকুমায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জনতাকে সঙ্গে রেখে চলমান আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়। ১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে এখানে স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীসহ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ ভােলা কলেজ মাঠে এক সমাবেশ করে। সমাবেশ শেষে জনতার বিশাল জঙ্গী মিছিল সমগ্র শহর প্রদক্ষিণ করে। ছাত্র জনতার এই সমাবেশের নেতৃত্ব দেন ছালে আহম্মদ, ফজলুল কাদের চুন্ন, আবু তাহের, আনােয়ার হােসেন, ফরিদ হােসেন বাবুল প্রমুখ।
২মার্চ ভােলা চকবাজার মােড়ে দ্বিতীয় দিনেও মানুষের ঢল নামে। এদিনের সমাবেশে
________________________________________
| স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানােনা হয়। সেদিনের জনসভায় বিশেষ ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে ছিলেন ফজলুল কাদের, ছালে আহম্মদ, আঃ আজিজ ভূইয়া প্রমুখ। জনসভা শেষে এদিন জনতা মহকুমা শাসকের দফতর থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলে। এ সময় ভােলাতে পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিলাে।
৩ মার্চ থেকে ভােলায় প্রথম শুরু হয় ছাত্র জনতার সম্মিলিত ঐনিং।’ভােলা টাউন স্কুল | মাঠে অনুষ্ঠিত এই ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন নায়েক আবদুর রব, নায়েক আলী হােসেন, চান মিয়া, ডাঃ আবদুর রহমান প্রমুখ। এর পাশাপাশি মােল্লা বাড়ীতে নেতৃবৃন্দ প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য আগ্রহী মেয়েদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ওয়াহিদা রহমান, দেলােয়ার বেগম, রানী দেরনাথ, আমিরুন্নেছা, শাহনুর বেগম বুলু, নিরু, মনি, চায়না প্রমুখ।
৭ মার্চের ভাষণের পরপরই ভােলাতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই কমিটিতে ছিলেন তােফায়েল আহমেদ, রিয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ মােক্তার, শামসুদ্দিন আহমেদ মিয়া, মােতাহার উদ্দিন, মােশাররফ হােসেন শাজাহান, রেজায়ে করিম চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, ডাঃ আবদুল লতিফ, ডাঃ আজাহার উদ্দিন, শেখ মহিউদ্দিন প্রমুখ।
২৬ মার্চের স্বাধীন ঘােষণার খবর ভােলাতে পৌছুলে সাগর পাড়ের এই দ্বীপটিতে। যেন মানুষের ঢেউ. জেগে ওঠে। ২৭ মার্চ সম্মিলিত ছাত্র-জনতা স্থানীয় সরকারী ট্রেজারী ভেঙ্গে সকল অস্ত্র নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে নেয়। সংগঠিত হতে থাকে মুক্তিযােদ্ধারা। | ২৯ এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনীর দুটি জাহাজে হামলা চালায়। এদিন থেকে প্রতিদিনই ভােলা জাহাজ ঘাটে নদীর কুলে হাজার হাজার মানুষ পাকবাহিনীর আগমন প্রতিরােধের জন্য সমবেত থেকেছে। এরপর হঠাৎ করে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে সাময়িক ফাটল ধরে। এবং কোন কোন নেতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
পাশাপাশি মওলানা মাকসুদুর রহমান, রিয়াজুর রহমান, এ্যাডঃ মাকসুদুর রহমান, ইসহাক জমাদ্দার এ ঘটনার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পুনঃসংগঠিত করেন। ২৯ এপ্রিল ভােলায় ট্রেজারী ভাংতে গিয়ে দু’দল মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এবং সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রায় দশজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়। অদ্রুিতই অবশ্য জনগণ। এর রেশ কাটিয়ে ওঠে এবং সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য এক হন।
সুনামগঞ্জ ইয়াহিয়া খানের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জের ছাত্র সমাজ প্রথম জনতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরােধ আন্দোলনের ডাক দেয়। মার্চের শুরুতেই পুরাতন মহাবিদ্যালয়।
________________________________________
মাঠের প্রথম জনসমাবেশের নেতৃত্ব দেন ছাত্রনেতা সুজাত চৌধুরী, তালেব উদ্দিন আহমেদ, মুজিবুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রত্যক্ষ সহযােগিতা ছিলাে।
৩ মার্চ সুনামগঞ্জ মহকুমা সহ প্রায় সকল গ্রামগঞ্জের হাট বাজারে হরতাল পালিত হয়। এ সময় সুনামগঞ্জে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানাে হয়। ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে তখন উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন শফিকুল চৌধুরী, মুজিবুর রহমান চৌধুরী, সিরাজ উদ্দিন, তালেব উদ্দিন আহমেদ, আলী আসগর, মালেক হােসেন, মতিউর রহমান, আবু সুফিয়ান প্রমুখ।
ছাত্র ইউনিয়নও তখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংগঠনের মধ্যে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলাে তাদের মধ্যে হুমায়ুন কবীর চৌধুরী, গিয়াস উদ্দিন, সাইফুর রহমান সামসু, বেলায়েত হোসেন প্রমুখ। এখানে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানাের পর স্থানীয় অবাঙ্গালী ও পশ্চিমা পুলিশের সাথে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ ঘটে। এ ঘটনার পর থেকে পরিস্থিতি ছাত্র জনতার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং প্রতিদিন মিছিল মিটিং অব্যাহত থাকে। বিক্ষুব্ধ জনতা তখন ইয়াহিয়া খানের একটি প্রতীক মুর্তি তৈরি করে তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
৭ মার্চ থেকে ছাত্র-যুবক-জনতা সুনামগঞ্জের মাঠ, ঘাট, শহর, গ্রাম মিছিলে মিছিলে কাপিয়ে তােলে। ৮ মার্চ সকালে বেতারে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মাইকে প্রচার করার ব্যবস্থা হলে স্থানীয় প্রশাসন তা বন্ধ করে দেয়। এতে জনতা ব্যাপক রুদ্ররােষে ফেটে পড়ে। এর পর থেকে নেতৃবৃন্দর উদ্যোগে স্থানীয় জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শুরু হয় সামরিক প্রশিক্ষণ বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার মতিউর রহমান তখন প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২৩ মার্চ সুনামগঞ্জ পৌরসভা প্রাঙ্গনে সর্বদলীয় এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২৫ মার্চ স্থানীয় লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা জনমত’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। এতে মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের মনােভাব প্রতিফলিত হয়।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা এখানে পৌছুলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ব্যাপকভাবে তৎপর হয়ে ওঠেন। সুনামগঞ্জ থানার কর্মকর্তা মােখলেসুর রহমান ও আনসার কর্মকর্তা মােকাব্বির এর নেতৃত্বে মালদার আলী, শফিকুল চৌধুরী, মনােয়ার বথত সহ আরাে কয়েকজন অস্ত্রাগার ভেঙ্গে প্রচুর পরিমানে গােলাবারুদ হস্তগত করে। এসকল অত্র মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বন্টন করা হয়। খবর পেয়ে ২৭ মার্চ বাঙালি ক্যাপ্টেন মাহবুব আলমের নেতৃত্বে পাক সেনারা সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে এবং সমস্ত শহরে কার্ফ জারী করে।
________________________________________
দেওয়ান ওবায়দুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত মহকুমা সংগ্রাম কমিটির সদস্য ছিলেন আলতাফ উদ্দিন আহমেদ, আবদুস সামাদ আযাদ, আঃ হক, আঃ হেকিম, আঃ রউফ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, সামছু মিয়া চৌধুরী, আঃ জহর, হােসেন বখত, আলী ইউসুফ, আঃ কুদ প্রমুখ। নেতৃবৃন্দ মহকুমার প্রতিটি থানা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধেকে সংগঠিত করে কাংখিত লক্ষ্যে অর্জনের দিকে এগিয়ে যান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৭ মার্চের জনসভায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বাসভর্তি করে অসংখ্য মানুষ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যােগ দেন। রাতে ঢাকা থেকে জনতা এখানে ফিরে এলে জনসভার পূর্ণ বিবরণ জনগণ জানতে পারে এবং শ্লোগানে শ্লোগানে শহর প্রকম্পিত হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর আহবানের সঙ্গে সঙ্গে এখানে আওয়ামী লীগ নেতারা জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। এবং প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে আলােচনা করেন। এসময় যারা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন এ্যাডঃ আজম ভূঁইয়া, লুৎফুল হাই, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ।
রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি ছাত্র নেতারাও পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। হুমায়ুন কবীরকে আহবায়ক করে গঠিত কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আমানুল হক সেমু, কুতুব হােসেন, ওয়াহিদ খান লাভলু, মােহাঃ আবদুল লতিফ, ছারােয়ার জাহান সেন্টু, মােসলেম মিয়া প্রমুখ। তাছাড়া অন্যান্য ছাত্র নেতার মধ্যে ছিলেন জাহাঙ্গির ওসমান, আবদুল লতিফ প্রমুখ।
৯ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ মাঠে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয়। ১২ মার্চ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কুমিল্লার জেলা শাসক শামসুল হক ও জেলা পুলিশ প্রধান এ জেড এম সামসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হয় পাক বাহিনীকে প্রতিরােধ করার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মহকুমা শাসক রকিবউদ্দিনও উপস্থিত ছিলেন। নেতৃবৃন্দ প্রথমেই জেলার সকল অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের একত্র করে তাদের দিয়ে প্রতিরােধ বাহিনী তৈরি এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সরকারী কর্মকর্তাগণ তখন জেলা অস্ত্রাগার থেকে কয়েকশ অত্র নেতাদের হাতে তুলে দেন। এ সময় স্থানীয় টেক্সটাইল মিলের দারােয়ানদের কাছ থেকেও ৬ টি রাইফেল কেড়ে নেয়া হয়।
মেজর খালেদ মােশাররফ এর নেতৃত্বে তখন আজম ভূইয়া, লুৎফুল হাই সাহু, তাহের উদ্দিন সহ আরাে কয়েকজন স্থানীয় মডেল স্কুলে এক গােপন বৈঠকে মিলিত হয়ে ভারত থেকে অল্প সগ্রহের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌছান। এবং এদিন রাতেই কয়েকজন
________________________________________
ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। এ ঘটনার কয়েকদিন পরই প্রচুর পরিমান অস্ত্র নিয়ে নেতৃবৃন্দ ভারতের আগরতলা থেকে ফিরে আসেন।
| ২৬ মার্চ ভাের থেকেই অন্নদা বাের্ডিং মাঠে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হতে থাকেন। এবং এর পরপরই শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ। এখানে প্রায় দশহাজার লােক স্বেচ্ছায় সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এ সময় অবসরপ্রাপ্ত সেনা বাহিনীর সদস্য হামিদুর রহমানকে নিয়ে গঠিত হয় মহকুমা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। উপপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন কাজী আকতারুজ্জামান ও হাবিবুর রহমান হাবিব।
২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতারা সম্মিলিত ভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ মাঠে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বালার পতাকা ওড়ায়। ২৫ মার্চের আগেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাক বাহিনী ঘাটি স্থাপিত করে। ২৬ মার্চ ভাের রাত থেকেই এখানে তারা কার্টু দিয়ে সকলকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেয়।
পাক বাহিনীর কা¥ উপেক্ষা করে তখন জনতা রাস্তায় নেমে আসে। এ সময় ফুল হাই সাঙ্গু একটি হ্যান্ড মাইক দিয়ে জনতাকে মিছিলে অংশ নেয়ার জন্য আহবান জানায়। এ সময় ছাত্র জনতার বিশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। | ২৭ মার্চ পাক বাহিনীর দলে অবস্থানরত বাঙ্গালী অফিসার সাফায়েত জামিল, ক্যাপ্টেন গাফফার, লেঃ হারুন, লেঃ মাহবুবএর নেতৃত্বে সকল বাঙালী সিপাহীরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে মেনে নিয়ে বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালী কর্ণেল খিজির হায়াত সহ সকল সৈন্যদের গ্রেফতার করে। এ সময় ক্যাম্পের চার পাশ প্রায় ৫০ হাজার জনতা হাতে তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিলাে।
এই বিদ্রোহের খবর পেয়ে মেজর খালেদ মােশাররফ (৪র্থ বেঙ্গল রেজিঃ এর প্রধান) দ্রুত ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে আসেন এবং শাফাত জামিলের সঙ্গে মিলিত হন। এদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসেন বিডিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা।
২৮ মার্চ মােঃ শামসুদ্দিন নামক একজন টেকনিশিয়ানের নেতৃত্তে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন কেন্দ্রে একটি অস্থায়ী বেতার ষ্টেশন চালু করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন অধ্যাপক হারুন অর রশীদ। এখবর পেয়ে পাক সৈন্যরা ২৮ মার্চ ব্যাপক ভাবে বােমা বর্ষণ করতে থাকে। খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা তখন ভারত সীমান্তের তেলিয়াপাড়ায় তেলিয়াপাড়ায় ঘাটি স্থাপন করে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
নবাবগঞ্জ রাজধানী ঢাকা থেকে বহু দূরে অবস্থিত নবাবগঞ্জ মহকুমার নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে আন্দোলন পরিচালনা করেন। ৭ মার্চের ভাষণের ঘােষণা বিদেশী বেতার
________________________________________
মাধ্যমে শােনার সঙ্গে সঙ্গে নেতৃবৃন্দ পাক বাহিনীকে প্রতিরােধ করে বৈঠকে বসেন। সেরাজুল হক শনি মিয়া, ফজলুর রহমান মােক্তার, একরামুল হক, সুলতান ইসলাম সহ প্রমুখ নেতারা ব্যাপক অসহযােগ আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেন।
অপরদিকে ছাত্র নেতারা গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত প্রতিরােদ বাহিনী গড়ে তােলার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। শুরু হয় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। শহীদ মন্ডল নামক একজন যুবক তখন তার মুসলিম লীগ পিতার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে একটি নিজস্ব মুক্তিযােদ্ধা দল গড়ে তােলেন।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সভাপতি মঈন উদ্দিন মন্ডলের নেতৃত্বে ছাত্র নেতৃবৃন্দ সারাদিন মাথায় লাল ফিতা বেধে ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করতে থাকেন। অপরদিকে ছাত্রদের অপর একটি গ্রুপ গােলাম নবী, শরিফুল ইসলাম, এর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
| ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ একটি অজ্ঞাত বেতার থেকে শােনা য়। এদিন রাতে নবাবগঞ্জ থানার সকল অ মুক্তিযােদ্ধারা দখল করে নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে এখানে পূর্বে থেকে অবস্থানরত কিছু অবাঙ্গালী সৈন্য ঢাকায় পালিয়ে যায়। | ১১ অথবা ১২ মার্চ নবাবগঞ্জ সংগ্রাম গঠিত হয়। আহবায়ক নিযুক্ত হন মেসবাহুল হক। সদস্য ছিলেন রইসউদ্দিন আহমেদ, সেরাজুল হক, ওসমান গনি, গােলাম আরিফ টিপু, হামিদুর রহমান হেনা, একরামুল হক, খালেদ আলী মিয়া, মঈনউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নবাবগঞ্জে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছিলাে।
এপ্রিল মাসে স্থানীয় ইপিআর বাহিনী গােপনে যােগাযােগ করে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে অত্র তুলে দেয় । এত জনতার মনােবল অসম্ভব রকম বেড়ে যায়। সংগ্রাম কমিটি কি সাহায্য চায় এজন্য হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘিরে ধরে।
স্থানীয় হরিমােহন স্কুল ও কলেজ মাঠে প্রধান দুটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করা হয়। মেজর গিয়াস প্রধান প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করেন। এর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়। ১৫ এপ্রিল পাকবাহিনী এখানে বােমাবর্ষণ করে।
সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ এসময় মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে নিরাপদ অবস্থানে চলে যান। অনেকে ভারতের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান প্রশিক্ষণ ও উন্নত অস্ত্র-শস্ত্রের জন্য। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে যায় একটি সফল পরিসমাপ্তির দিকে।
নারায়ণগঞ্জ ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব অতি সামান্য। কাজেই সেখান থেকে ৭ মার্চের জনসভায় সকাল থেকেই হাজার হাজার মানুষ রেসকোর্সের জনসভায় যােগদান করে।৭
________________________________________
মার্চের জনসভায় যােগদানকারী জনতার ইন্তের প্রতিফলন ঘটে এদিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর কঠে। ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে নেতৃবৃন্দ জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। আওয়ামী লীগ, কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সবাই স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহবানে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের জন্য তৈরি হন।
নারায়নগঞ্জে যাদের নিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছিলাে তাদের মধ্যে ছিলেন এ কে এম শামসুজ্জোহা, আঃ ছাত্তার ভূঁইয়া, আফজাল হােসেন, সাজেদ আলী মাের, সাদত আলী শিকদার, গােলাম মােরশেদ ফারুকী, আলী আহমেদ চুনকা, বজলুর রহামন, খােকা মহিউদ্দিন, নিলু মল্লিক, খাজা মহিউদ্দিন, নাজিমুদ্দিন মাহমুদ, আনছার আলী, জানে আলম, মােবারক হোেসন, আবদুল হাই, আঃ ছাত্তার, তােফাজ্জেল হােসেন খান, এম এ আউয়াল, মােনায়েম, সিরাজুল ইসলাম, এস হােসেন, আফতাব উদ্দিন আহমেদ, কালু মিয়া, সাদাত আলীম শফিকুল ইসলাম, খবির আহমেদ, নুরু মিয়া চৌধুরী, তারা মিয়া প্রমুখ। | সংগ্রাম কমিটি গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই নেতৃবৃন্দ জনসংযােগ, অস্ত্র সংগ্রহ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি বিষয়ের প্রতি জোর দেন। এর পাশাপাশি প্রতিদিন চলতে থাকে মিছিল, মিটিং, গণসঙ্গীত প্রভৃতি। | ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকাতে যাদের সামনে বঙ্গবন্ধু পাক বাহিনীর আক্রমণের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জের কয়েকজন নেতাও ছিলেন।
কাজেই এদিন ঢাকা নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় ব্যাপক ব্যারিকেডের সৃষ্টি করা হয় এদিন সারারাত ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রাস্তায় মানুষের জটলা লক্ষ্য করা যায়। ফতুল্লায় জনতা ব্যাপক, প্রতিরােধের সৃষ্টি করে। এই প্রতিরােধ উপেক্ষা করে পাক বাহিনী ২৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করে।
স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা ও প্রতিরােধকারী জনতার ২৭ মার্চ মাসদাইর এ পাকবাহিনীর সঙ্গে এক ব্যাপক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে গেলে পাক বাহিনী ব্যাপকভাবে পার্শ্ববর্তী গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় এবং অসংখ্য মানুষ হত্যা করে।
এই ঘটনার আগে সংগ্রাম কমিটি নারায়ণগঞ্জ রহমত উল্লা মুসলিম ইনস্টিটিউটে তাদের কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। কিন্তু ২৬ মার্চের পরে তা সরিয়ে নেয়া হয় দেওভােগ সমাজ উন্নয়ন সংসদে। এখানে মফিজ উদ্দিনের বাড়ীতে নেতৃবৃন্দ অন্ত সংরক্ষিত রাখে। ২৬ মার্চের রাতে মুক্তিযােদ্ধারা একজন পুলিশ সিপাহীর সহযােগিতায় নারায়ণগঞ্জ কোর্ট থেকে পাকবাহিনী রক্ষিত বেশ কিছু অত্র হস্তগত করে। এই অস্ত্র বের করার জন্য কেৰীন বাবুর্চি হাসেম দেয়াল ভাংতে শাবল এনে দেয়।
ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ নারায়ণগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অত্যন্ত দৃঢ় ভূমিকা পালন করে। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন জয়নাল আবেদীন টুলু, দেলােয়ার হােসেন চুন্ন,
________________________________________
ফয়েজ আহমেদ প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি, প্রতিরােধ ও সর্বাত্বক যুদ্ধচলাকালীন সময়ে এখানকার বিভিন্ন মিল কারখানার শ্রমিকরা অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
পঞ্চগড় ১ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পঞ্চগড়ে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ২ ও ৩ মার্চ পঞ্চগড় সহ মহকুমার সকল থানা ও ইউনিয়নে হরতাল পালন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। ১৬ মার্চ পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত থাকে। | ৭ মার্চ সকাল থেকেই মানুষের স্বাভাবিক কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। কেননা তারা পূর্বেই আভাস পায় যে, এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এমন কিছু বলবেন যা বাঙালি জাতিকে তার কাংখিত লক্ষ্যে পৌছে দেবে। কাজেই জনতা সকাল থেকে রেডিও সেটের সামনে জড়াে হতে থাকে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেতারে প্রচার না হওয়ায় তাৎক্ষণিক ভাবে মিছিল বের করে এবং মিছিল ক্রমে বিশাল জনসভার রুপ ধারণ করে। রাতে বিভিন্ন বিদেশী বেতার থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল। বিবরণ প্রচারিত হলে জনতা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে ওঠে।
ভাষণের খবর প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চগড়, বােদা, দেবীগঞ্জ, আটোয়ারী প্রভৃতি থানার নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে পরিস্থিতি পর্যালােচনা করেন। এ সময় স্থানীয় প্রধান নেতাদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছিলাে। তা সত্বেও এখানে সংগ্রাম কমিটি, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
পঞ্চগড়ে মূলতঃ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে সগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তবে অন্যান্য স্বাধীনতাকামী দল সমূহ আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের আস্থা স্থাপন করে। তবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় সর্বদলীয় ভাবে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করে। ছাত্রনেতা নাজিম, রবি, লিয়াকত, রেজাউল, মিজানুর, রাজু ও শ্রমিক নেতা মূর্তজা প্রথম থেকেই আন্দোলনকে সংগঠিত করার জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। জনতা প্রতিদিন বিদেশী বেতার, বিশেষ করে বিবিসি ও আকাশ বাণীর খবরের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখতে।
২৭ মার্চ পঞ্চগড় শেরে বাংলা পার্কে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানাে হয়। নেতৃত্ব দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এদিক ছাত্রদের নেতৃত্বে স্থানীয় ইপিআর ক্যাম্পের সকল বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসে জনতার সঙ্গে সামিল হয়। এ সকল ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে পুলিশ, আনসার, মােজাহিদ বাহিনীর সদস্যরা ছাত্র-জনতাকে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে তারও আগে বােদা থানায় লতিফ মাষ্টারের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলা হয়।
________________________________________
স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন মওলানা ইদরিস আলী ও আনােয়ারুল ওয়ারেস। এই বাহিনী প্রশিক্ষণরত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রসদ সংগ্রহ ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। পঞ্চগড় মুন্সেফ কোর্ট তখন সংগ্রাম কমিটির কন্ট্রোল রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
২৯ মার্চ মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনী ও স্থানীয় অবাঙালীদের এক সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বহুলােক হতাহত হয়। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা মহকুমা সদর ও সকল থানা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়। এরপর নেতৃবৃন্দ পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে তেতুলিয়া সীমান্তের নিরাপদ এলাকা থেকে সংগঠিত হতে থাকে। তেতুলিয়া ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্ত ছিলাে।
৯ মার্চ মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনী ও স্থানীয় বাঙালীদের এক সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বহুলােক হতাহত হয়। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা মহকুমা সদর ওঁ সকল থানা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সমর্থ হয়। এরপর নেতৃবৃন্দ পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে তেতুলিয়া সীমান্তের নিরাপদ এলাকা থেকে সংগঠিত হতে থাকে। তেতুলিয়া ১১ ডিসেম্বর পর্যও মুক্ত ছিলাে।
৯ মার্চ এক বৈঠকে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করেন কৃষক নেতা আঃ রউফ। প্রস্তাব মােতাবেক সংগ্রাম কমিটির নেতা নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা ডাঃ আতাউর রহমান কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিলাে ৩১ জন। তাছাড়া সংগ্রাম পরিষদকে গাইড করার জন্য আঃ রউফ ও লুৎফর রহমানের উদ্যোগে বিপ্লবী পরিষদ নামে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন থানায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে ছিলেন মতিয়ার রহমান, হাবিবুর রহমান, ডাঃ আতাউর রহমান, আঃ রউফ, লুৎফর রহমান, আলম চৌধুরী, সােলায়মান, শামসুদ্দোহা, ফজলুল করীম, শফিউল আলম, এনামুল হক, স্বদেশ চন্দ্র রায়, তােফাজ্জল হক, আঃ মজিদ, রবিউল আলম, ফখরুদ্দিন আহমেদ, আঃ ছাত্তার, নাজিমুদ্দিন, খাদেমুল ইসলাম, আজিজার রহমান, লতিফ মাষ্টার, পােষ্ট মাষ্টার আঃ মান্নান, আঃ জব্বার, কাজী হাবিবুর রহমান, শফিউদ্দিন সিদ্দিকী, ফজলুল হক প্রমুখ।
মহকুমার বােদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে যারা প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে ফখরুল ইসলাম মানিক, ইউনুস খােকা, তরিকুল আলম, আব্বাস আলী, অনুপ কুমার, আঃ রহমান প্রামানিক, প্রফুল চন্দ্র ঘােষ প্রমুখ।
এপ্রিলে পাক বাহিনীর হাতে নিহত হয় কমান্ডার ফজলু, আঃ মান্নান, যতীন কম্পাউন্ডার সহ কয়েকজন। এই ঘটনার পর মুক্তি পাগল জনতা পূর্ণ উদ্যমে মাতৃভূমি স্বাধীন করার লক্ষ্যে সশস্ত্র ভাবে তৈরি হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয়।
________________________________________
রাঙ্গামাটি আন্দোলনের শুরু থেকেই রাঙ্গামাটি মহকুমায় ছাত্র সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পাকিস্তানীদের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এখানকার বিপ্লবী ছাত্র-জনতার প্রতিবাদী ভূমিকা তীব্র রূপ ধারন করে ১ মার্চ থেকে। ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমসি মনােভাব মানুষ শুরু থেকেই ভালভাবে গ্রহণ করেনি।
মার্চের প্রথম দিকেই এখানে উপজাতীয় ছাত্রদের নিয়ে ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এই পরিষদের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় পুরাতন খেলার মাঠে। এই সভায় ছাত্র বক্তারা আগে থেকেই পূর্বাভাস দিয়েছিলাে যে, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু একটি দিক নির্দেশনামূলক ঘােষণা দেবেন এবং ৭ মার্চের পর চূড়ান্ত কর্মসূচী ঘােষণা করা হবে।
৭ মার্চ রাঙ্গামাটির জনগণ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। নেতৃবৃন্দ এসময় ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। মহকুমা শাসক ও পুলিশ প্রধান তখন ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে তাদের সংহতি প্রকাশ করেন। এবং তারাই প্রথম ৭ মার্চ ভাষণের মূল বিবরণ ছাত্রদের অবহিত করেন। যদিও এ দু’জনের প্রতি নেতৃবৃন্দের পূর্ণ আস্থা ছিলােনা।
৮ মার্চ সকালে রাঙ্গামাটিতে স্বরণ কালের বৃহত্তম জঙ্গী মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। কে না মিছিলের কিছুক্ষণ পূর্বেই জনতা রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে পায়। মিছিল ?শষে নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দুর রহমানের বাসায় এক জরুরী বৈঠকে মিলি হন। সেই বৈঠকে ছিলেন কুতুব উদ্দিন, আতিকুর রহমান, শামসুল ইসলাম, রফিক উদ্দিন সিদ্দিকী এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দ। এবং এই আলােচনার প্রেক্ষিতে ৯ মার্চ গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। কমিটিতে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, ছাত্র লীগ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকেও সদস্য
| রাঙ্গামাটি সংগ্রাম পরিষদে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে গৌতম দেওয়ান, মাহবুবুর রহমান, এস এম কামাল, আবদুস শুকুর, রাজীব হাসান মামুন, ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, হিমাংশু বিকাশ খীসা, আবুল কালাম আযাদ, সুনিল কান্তি দে, মােঃ রুহুল আমিন, মােস্তফা কামাল উদ্দিন, প্রীতি কুমার চাকমা, অশােকমিত্র কামারী, রণ বিক্রম ত্রিপুরা, আবদুর রশীদ, আবুল কাশেম, ফিরােজ আহমেদ, দিলীপ কুমার দেব, স্নেহ রঞ্জন চাকমা অন্যতম।
| ১০ মার্চ থেকে সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রেখে আন্দোলন পরিচালনা করে। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে বিপুল সংখ্যক সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে। এদের
________________________________________
মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মহকুমা শাসক এইচটি ইমাম, এসডিপিও বজলুর রহমান, আঃ হামাদ, ডঃ আলতাফ, গােলাম আম্বিয়াঃ আঃ আলী প্রমুখ।
| ২০ মার্চ থেকে রাঙ্গামাটিতে ছাত্র যুবকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। তবে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা চট্টগ্রাম বেতার থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নানের কঠে প্রচারিত হলে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে তীব্র সাড়া পড়ে যায় এবং জনতা সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে ব্যাপক অত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয় । মহকুমা শাসক ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ভূমিক এসময় জনগণকে উৎসাহিত করে। স্থানীয় ষ্টেশন ক্লাব মাঠে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। ২৭ মার্চ থেকে এই সশস্ত্র প্রশিক্ষণ আরাে বেগবান
পাকবাহিনী যাতে রাঙ্গামাটি শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রতিরােধ বাহিনী রাস্তায় বড় গাছের গুড়ি দিয়ে ও রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে ব্যারিকেড দেয়। ৩০ মার্চ হতে এখান থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও উন্নত অস্ত্রের জন্য স্থানীয় যুবকদের সংগঠিত করে ভারতে পাঠানাে হতে থাকে। ২ মার্চ মেজর জিয়া স্থানীয় ডাক বাংলােতে রাঙ্গামাটি সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। স্থানীয় জনগণ এসময় সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
১ মার্চ থেকে শেরপুর মহকুমায় একটানা আন্দোলনের অংশ হিসেবে হরতাল, মিছিল, মিটিং অব্যাহত থাকে। ৮ মার্চ সকলে ৭ মার্চের ভাষণ বেতারে প্রচারিত হলে হাজার হাজার মানুষ দল বেধে লাঠি, সড়কি, বল্লম, ঢাল প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে শহর কেন্দ্রে সমবেত হয়। নেতৃবৃন্দ জনতাকে শান্ত করে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা বলেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার প্রেক্ষিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়ে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেন। প্রস্তাব অনুসারে গঠিত সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির প্রধান নিযুক্ত হন আওয়ামী লীগ নেতা নিযাম উদ্দিন আহমেদ। কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সামাদ, আনিসুর রহমান, রবি নিয়ােগী, মােহাম্মদ মহসীন আলী, খন্দকার মজিবর রহমান, এমদাদুল হক হীরা, আবদুর রশীদ প্রমুখ। সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় শেরপুর আবাসিক ম্যাজিষ্ট্রেটের বাসভবনে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হন ছাত্রনেতা আমজাদ হােসেন, মােজাম্মেল হক, আঃ ওয়াদুদ, ফকির আক্তারুজ্জামান প্রমুখ। একই সময়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন আওয়ামী লীগ নেতা গােলাম মােস্তফা দুদু।
________________________________________
শেরপুর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয় তৎকালীন আড়াইলি বাড়ীর একটি ফাঁকা এলাকা ও রাঙ্গুনিয়ায় স্থানীয় থানা থেকে কয়েকটি বন্দুক ও হাতে তৈরি অস্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণের কাজ চলে। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে ছিলেন সেনা বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হােসেন আলী মিয়া, তালেব আলী, শমসের আলী প্রমুখ। এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে শত শত ছাত্র যুবক, শ্রমিক, চাষী অংশ নেয়।
সংগ্রাম কমিটি ব্যাপক জনমত গঠন ও একটি চূড়ান্ত সশস্ত্র যুদ্ধের বাস্তবতা অনুভব করে শেরপুর মহকুমার নকলা, নলিতা বাড়ী, শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতি থানাতে সংগ্রাম কমিটির শাখা কমিটি গঠন করে। শরীফ উদ্দিন, আব্দুল মান্নান ঝিনাইগাতীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। | ২৫ মার্চ রাতের পৈশাচিক হত্যাকান্ডের খবর এখানে পৌছে যায় ২৬ মার্চ সকালে। পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে এসময় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। রঘুনাথ বাজারের চৌরাস্তায় সমবেত হাজার হাজার মানুষের উদ্দেশে এসময় বক্তৃতা করেন সংগ্রাম পরিষদ নেতা খন্দকার মজিবুর রহমান, মহসীন আলী, আঃ রশীদ প্রমুখ। এ সময় সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার কপি পান।
শেরপুর সংগ্রাম কমিটি মার্চের শেষ দিকে ভারতীয় সীমান্তে যােগাযােগ স্থাপন করে মেঘালয়ের পাকাশিয়া ক্যাম্পের বি এস এফ এর সঙ্গে একটি বৈঠকে মিলিত হন। এই যােগাযােগের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কিছু অস্ত্র সাহায্য পাওয়া। এ ক্ষেত্রে সংগ্রাম কমিটির প্রধান পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন সুবেদার মেজর আঃ হাকিম। | শেরপুর মুক্তিযুদ্ধের জন্য আত্মদানে নিবেদিত প্রশিক্ষণকর্মীদের প্রথম ব্যাচে ছিলেন ফকির আকতারুজ্জামান, এমদাদুল হক লিপু, মােখলেসুর রহমান হিমু, তালাপ হােসেন ম, ফরিদুর রহমান ফনু, শহীদ বুলবুল, ফরিদুর রহমান ফরিদ, আঃ সােবহান, মমিনুল হক বেলাল প্রমুখ।
৭ মার্চের ভাষণের খবর ৮ মার্চ সকালে বেতারে প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরগুনার বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলে রাস্তাঘাট সয়লাব হয়ে যায়। স্থানীয় শেরে বাংলা সড়কে জনতা মাইকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করে। একই ভাবে মহকুমার প্রতিটি থানায় ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংগঠিত হতে শুরু করেন।
বরগুনায় মােট তিনবার সগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। প্রথম ইয়াহিয়া খানের ১ মার্চের ঘােষণায় জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার পর ৩ মার্চ একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির নেতা নিযুক্ত হন আওয়ামী লীগের মহকুমা সভাপতি আবদুল লতিফ
________________________________________
মাষ্টার ও আসমত আলী শিকদার। পুনরায় ৭মার্চের ভাষণের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে নেতৃবৃন্দ একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ এই কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এবং যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে জহুরুল ইসলাম, ফৌতিফ ফারাজীকে আহবায়ক ও যুগ্ম আহবায়ক করে গঠিত হয় তৃতীয় ও শেষ সংগ্রাম কমিটি। | বরগুনা মহকুমার মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে যারা এখানে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ভূমিকা রাখেন তাদের মধ্যে ছিলেন আঃ লতিফ মাষ্টার, রােসমত আলী, মালেক খান, মজিবুল হক, আসমত আলী, সিদ্দিকুর রহমান, আসমত আলী শিকদার, নুরুল ইসলাম শিকদার, আজাহার মাষ্টার, ইউনুস শরীফ, জহিরুল ইসলাম; মােকসেদ আহমেদ খান, বীরেন বঙ্গাল, আবদুল হামিদ, জ্ঞান রঞ্জন ঘােষ, আতাহার মিয়া, আতাহার আলী বিশ্বাস, সিদ্দিকুর রহমান, দলিল উদ্দিন, সুখ রঞ্জন, মীর আঃ কুদুস, জয়নাল আবেদীন খান, মােসলেম আলী শরীফ, সেকেন্দার হায়াত, নাসির তালুকদার, মিজান উদ্দিন তালুকদার, কবির মাতব্বর, আঃ হালিম, নাজেম আলী, হুমায়ুন কবীর হিরু, মান্নান মৃধা প্রমুখ।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন আসাদুল হক কায়সার, সিদ্দিকুর রহমান, জাহাঙ্গীর কবীর, কালা রশীদ, আলমগীর কবীর, টিও জাহাঙ্গীর, দিলীপ সাহা, দেলােয়ার হােসেন, নাজমুল আহসান দুলাল, আনােয়ার হােসেন মনােয়ার,এম নজরুল ইসলাম, জাফরুল হাসান ফরহাদ, আলতাফ হােসেন, মােহাম্মদ শাজাহান, সুখ রঞ্জন শীল প্রমুখ।
১৩ মার্চ থেকে বরগুনা বালিকা বিদ্যালয়ে সংগ্রাম কমিটির কন্ট্রোল রুম স্থাপন করে। এই স্থানটি একপর্যায়ে সকল কর্মকান্ডের মূল ঘটি বলে চিহ্নিত হয়। সংগ্রাম কমিটি এক পর্যায়ে সুষ্ঠুভাবে সবকিছু পরিচালনার স্বার্থে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, শৃঙ্খলা কমিটি, বিচার বিভাগ, ইত্যাদি উপ-কমিটি গঠন করেন। সংগ্রাম কমিটির কন্ট্রোল রুমে সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিলেন ইউনুস শরীফ, আজাহার মাষ্টার, জহুরুল ইসলাম, লতিফ ফারাজী প্রমুখ। এ সময় বরগুনার সকল লাইসেন্স প্রাপ্ত বন্দুক মালিকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি যে কোন সময় প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতাে। | ২৩ মার্চ এম এন এ রেসমত আলী খান প্রায় কুড়ি হাজার মানুষের একটি লাঠি মিছিলের নেতৃত্ব দিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে বরগুনা শহরে আসেন। মিছিলটি যখন শহরের মাঠ আসে তখন পাকিস্তানী পতাকায় অগ্নিসংযােগ করা হয়। এবং বরগুনা ক্লাবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাক উড়ানাে হয়। পতাকা উত্তেলন করেন সিরাজউদ্দিন আহমেদ ও আসমত আলী শিকদার।
২৬ মার্চ ভােরে প্রথম সংগ্রাম কমিটির নেতা নুরুল ইসলাম শিকদার বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা সম্পর্কিত টেলিগ্রাম পান। ২৭ মার্চ কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে
________________________________________
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে বেতার ঘােষণা থেকে প্রচার করা হচ্ছিলাে তাতে এখানকার জনতা বিপুল ভাবে উদ্দীপ্ত হয়। দলে দলে কৃষক, শ্রমিক, যুবক মুক্তিযুক্ত ট্রেনিং ক্যাম্পে নাম
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং প্রদানকারীদের মধ্যে ছিলেন আজাদুর রহমান, আবুল কাসেম, ফজলুর রহমান প্রমুখ। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান প্রশিক্ষণ ক্যাম্পগুলি স্থাপিত হয় বন্দর মাঠ, খাসকাচারী ময়দান, পশু হাসপাতাল মাঠসহ বিম্নি স্থানে।
সিরাজগঞ্জ ১ মার্চ থেকে একটানা আন্দোলন শেষে সারাদেশের মানুষ ৭ মার্চের জনসভা থেকে একটি দিক নির্দেশনামূলক ঘােষণা প্রত্যাশা করে এবং সিরাজগঞ্জ মহকুমার জনগণও তার বাইরে ছিলাে না। ফলে ৭ মার্চ এর জনসভায় বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে তাদের মনােভাবের প্রতিফলন ঘটে।
সিরাজগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য দুটি কমিটি গঠিত হয়। প্রথম কমিটি গঠন করা হয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে এবং অপরটি গঠিত হয় ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে। আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধানে গঠিত সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন মােতাহার হােসেন তালুকদার, দবীর উদ্দিন আহমেদ, আঃ মমিন তালুকদার, সৈয়দ হায়দার আলী, আনােয়ার হােসেন রতু, আমিনুল ইসলাম চৌধুরী, শহীদুল ইসলাম তালুকদার, আমীর হােসেন ভুলু, আঃ লতিফ মির্যা, ইসমাইল হােসেন, আ রউফ পাতা, গােলাম কিবরিয়া,সিরাজুল ইসলাম খান, বিমল কুমার দাস, ইসহাক আলী প্রমুখ।
ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ এর কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অমূল্য নাথ লাহিড়ী, সাইফুল ইসলাম, আবুল হােসেন, এ, এম, ইসহাক, রেজাউল করিম, হেদায়েতুল ইসলাম, আঃ কুদুস, ফজলুর রহমান, জাহিদুল ইসলাম, ভূপাল চন্দ্র সাহা, নির্মল কুমার বসাক, আঃ আজিজ প্রমুখ। | আওয়ামী লীগ ৮ মার্চ থেকে ষ্টেডিয়াম ও সিরাজগঞ্জ কলেজে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে। এদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ায়। স্থানীয় প্রশাসন এ সময় সংগ্রাম কমিটি ও মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক সহযােগিতা করে। বিশেষ করে মহকুমা প্রশাসক শামসুদ্দিন আহমেদ ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের লুৎফর রহমান অরুন দুটি ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তারা সংগ্রাম কমিটির সহায়তায় বিভিন্ন ভাবে বেশ কিছু অরে যােগাড় করে। প্রশিক্ষণ কালীন সময় এখানকার জনসাধারণ প্রতিদিন ক্যাম্পে চাল, ডাল, তরকারী ছাড়াও বিপুল পরিমাণ অর্থ সাহায্য দেয়। অপরদিকে ন্যাপ ও ছাত্র
________________________________________
ইউনিয়নের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপিত হয় ন্যাপ কার্যালয় মাঠে। ন্যাপকর্মিরা প্রশিক্ষণের জন্য তখন বেশ কিছু বন্দুকের যােগাড় করেন। তাছাড়া তারা হাত বােমা সহ বেশ কিছু অন্ত হাতে তৈরি করে।
২৫ মার্চের হত্যাকান্ডের খবর এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণা সিরাজগঞ্জে পৌছলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ ও ছাত্র লীগ কর্মীদের নিয়ে একটি প্রতিরােধ বাহিনী গঠন করে তাদের বাঘা বাড়ী ঘাটে নিয়ােজিত রাখা হয়। উদ্দেশ্য যাতে পাক বাহিনী সিরাজগঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে। এই বাহিনীর নেতৃত্ব দেন শামসুদ্দিন আহমেদ।
সিরাজগঞ্জে বেশ কিছু অবাঙ্গালী বিহারীদের বসবাস ছিলাে। তারা গােপনে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা ও পাকবাহিনীকে সকল প্রকার খবর প্রদান করতে থাকে। সংগ্রামী জনতা এই খবর পেলে অবাঙ্গালী এলাকায় আক্রমণ চালায়। এতে উভয় পক্ষের বহু লােক নিহত হয়। পরে বিহারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি নিরাপদ এলাকায় রাখা হয়। | ১৪ এপ্রিল পাক বাহিনী সিরাজগঞ্জে প্রবেশের চেষ্টা করলে তারা বাঘাবাড়ী ঘাটের ডাবাগানে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমনের সম্মুখীন হয়। মুক্তিযােদ্ধারা মরণপন যুদ্ধ করে এবং দশজন পাকসৈন্য হত্যা করে। এক পর্যায়ে পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা পিছনে হটে যায়। এখানে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়। ১৭ এপ্রিল পুনরায় পাক বাহিনীর সাথে বাঘাবাড়ী ঘাট-মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। একটানা দু’দিন যুদ্ধ চলার পর মুক্তিযােদ্ধারা উল্লাপাড়ার মটিনা ব্রীজে কৌশলগত অবস্থান নেয়। ২১ এপ্রিলে এখানে তৃতীয় দফার যুদ্ধে ৬৫ জন পাক সৈন্য নিহত হয়।
জয়পুরহাট জয়পুরহাট মহকুমায় ১ মার্চ থেকে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ৬ মার্চ পর্যন্ত এখানে হরতাল, মিছিল মিটিং অব্যাহতভাবে চলে। স্থানীয় শ্রমিকরা এ সময় সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল অসহযােগ আন্দোলনে অংশ নেয়। ৭ মার্চের ভাষণের পর বিশেষ করে ৮ মার্চ সকাল থেকে এখানে সকল মিল কারখানা, স্কুল, কলেজ, অফিস আদালত হেড়ে মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহবানে রাস্তায় নেমে আসে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত জয়পুরহাট সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন ডঃ মফিজ চৌধুরী, ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসনাত চৌধুরী, সরদার বেলাল হােসেন, মাহতাব উদ্দিন, ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ সাইদুর রহমান, খয়বর আলী মিয়া, মজিবুর রহমান, মােস্তফা আজিজ, গােলাম রসুল চৌধুরী প্রমুখ। ছাত্র সংগ্রাম কমিটিতে ছিলেন কে, এম, ইদরিস আলী, নিমউদ্দিন, আমজাদ
________________________________________
হােসেন, আনিসুর রহমান প্রমুখ। ছাত্র লীগ ছাড়াও তখন ছাত্র ইউনিয়ন যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয় জয়পুরহাট কলেজ প্রাঙ্গনে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস এবং ব্যাংক কর্মচারী সাকিল উদ্দিন মুক্তিযােদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। সংগ্রাম পরিষদ এ সময় সকল থানা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠন করে সশর প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন। জয়পুরহাট চিনিকল থেকে এ সময় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে নানা রকম সাহায্যে পাওয়া যেত। তারা গাড়ী, অ, ছাড়াও তাদের লােকবল দিয়ে সংগ্রাম কমিটিকে সাহায্যে করতেন।
জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থানা মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এখানে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ সহ সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি পরিচালনা করেন মেহের উদ্দিন চৌধুরী, আলাউদ্দিন মন্ডল, আজিজুর রহমান চৌধুরী, হায়দার চৌধুরী, মীর শহীদ মন্ডল, ওয়াজেদ আলী কামাল উদ্দিন মন্ডল, ডাঃ আমিনুর রহমান, শামসুল হুদা সরদার, জহির উদ্দিন, শামসুল চৌধুরী । এছাড়া উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন আঃ কাদের। চৌধুরী ও ডাঃ সাইফুর রহমান।
পাঁচ বিবি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ছিলেন আমিনুল হক বাবুল, জলিলুর রহমান, জহুরুল আলম, মােজাম্মেল আজিজ দুলাল, হামিদুর রহমান নান্ন, আঃ জলিল, আঃ রশীদ, নজরুল ইসলাম, লােকমান হােসেন, সুলতান মাহমুদ, আবু বকর, আলাউদ্দিন, রেজাউল চৌধুরী
| নেতৃবৃন্দ পাঁচ বিবি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রধান প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে। এখানে প্রায় পঞ্চাশ জন ইপিআর সদস্য প্রতিদিন প্রশিক্ষণ দিতেন। স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয় মাঠে স্থাপিত হয় ইপিআর ক্যাম্প। ট্রেনিং এর জন্য তীর-ধনুক, লাঠি, ডামি রাইফেল প্রভৃতি ব্যবহার করা হােত। এছাড়া সামান্য কিছু রাইফেল ও বন্দুক ব্যবহার করা
| ২৫ মার্চের পর সংগ্রাম কমিটি আঃ কাদের চৌধুরী ও হামিদুর রহমান নান্নকে ভারতে পাঠান অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। ডাঃ কাদের ভারতে গিয়ে পাক বাহিনীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের যে বর্ণনা দেন তা আকাশবাণী থেকে প্রচার করা হয়। তার এই বর্ণনা বিশ্বব্যাপী তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
মানিকগঞ্জ ঢাকার সঙ্গে সার্বক্ষনিক যােগাযােগ ছিলাে মানিকগঞ্জ মহকুমার। রেসকোর্সের ৭ মার্চের জনসভায় এখানকার হাজার হাজার মানুষ সকাল থেকে ঢাকায় আসতে থাকে। ৭
________________________________________
মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের ঘােষণার কথা সন্ধ্যার ভেতরেই জানতে পারে এখানকার মানুষ। তব্র উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে মহকুমা সদর সহ প্রতিটি থানায়। সারারাত ধরে চলে বিক্ষোভ মিছিল।
৮ মার্চ থেকে দেবেন্দ্র কলেজ প্রাঙ্গনে শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী। নেতৃত্ব দেন মােসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়া, খন্দকার মাযহারুল হক, আফতাব উদ্দিন বিশ্বাস। এদের সহযােগিতা করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা। এছাড়া আবুল কাশেম, রতন বিশ্বাস, তপন চৌধুরী আরশদ এর নেতৃত্বে হাবু মিয়ার বাড়ীতে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ দুটি স্থানে ২৫ মার্চ পর্যন্ত একটানা প্রশিক্ষণ চলে।
১০ মার্চ স্থানীয় বিডি হল থেকে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। নেতৃত্ব দেন আবুল কাশেম, তপন চৌধুরী, রতন বিশ্বাস, তুষার কান্তি সরকার। ২৩ মার্চ মানিকগঞ্জে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানাে হয়। মানিকগঞ্জে এ সময় বিভিন্ন অফিস আদালত ও বাসা বাড়ীতেও স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে দেখা যায় । পতাকা তৈরি ও বিতরনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এমদাদুল মােমেন খান ও হােসনেআরা।
২৫ মার্চ গভীর রাতে ঢাকায় পাক বাহিনীর হত্যাকান্ডের খবর অতি মানিকগঞ্জে | পৌছে যায়। এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিকভাবে এক জরুরী সভায় মিলিত হয়ে একটি ‘বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করেন। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন জামাল উদ্দিন, ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী, মােসলেম উদ্দিন খান হাবুমিয়া, খন্দকার মাযহারুল হক চানমিয়া, আফতাব উদ্দিন বিশ্বাস, সিদ্দিকুর রহমান, মীর আবুল খায়ের ঘটু, আনােয়ার আলী চৌধুরী, মফিজুল ইসলাম খান কামাল প্রমুখ। বিপ্লবী পরিষদের আহবায়ক নিযুক্ত হন আঃ হালিম চৌধুরী এবং বাকী অন্য সকলে সদস্য নির্বাচিত হন।
বিপ্লবী পরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে নেতৃবৃন্দ অতি জরুরী ভাবে জনসংযোেগ আরম্ভ করেন। এবং শহর থেকে সামান্য দূরে ইপিআরটিসির ডিপােতে কর্মরত অবসর প্রাপ্ত সেনা সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করে এক প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে তােলেন। এ সময় সেনাবাহিনীর সদস্য আবদুল ওয়াহাব মাকিগঞ্জে এসে বিপ্লবী পরিষদের সঙ্গে যােগ দেন। প্রতিরােধ বাহিনী সামান্য অস্ত্র এবং জনতাকে সঙ্গে রেখে নয়ারহাট, তরাঘাট, এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্যারিকেড দেয়া হয় এবং ফেরীঘাট থেকে সকল ফেরী সরিয়ে ফেলা হয় যাতে পাকসৈন্যরা পারাপারের ক্ষেত্রে সুবিধা করতে না পারে।
ছাত্র নেতৃবৃন্দ উদ্যোগ জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ ২৫ মার্চের ভােরে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্থানীয় ঐজারী ভেঙ্গে প্রচুর পরিমাণ গােলাবারুদ দখল করে নেয়। এ সকল অস্ত্র তাৎক্ষণিক ভাবে ছাত্র-জনতার মধ্যে বন্টন করা হয়। ২৬ মার্চ মহকুমা প্রশাসন নেতৃবৃন্দকে অৱ ফেরৎ দেয়ার জন্য বন্টন করা হয়। ২৬ মার্চ মহকুমা
________________________________________
প্রশাসন নেতৃবৃন্দকে অন্ত্র ফেরৎ দেয়ার জন্য চাপ প্রয়ােগ করে। জনতা এ সময় তীব্র ক্ষোভে জ্বলে ওঠে এবং যেকোন ভাবে প্রশাসনের মােকাবেলা করার দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করে। মহকুমা প্রশাসক বিপ্লবী পরিষদ নেতাদের হত্যার হুমকি দিলে ছাত্র-যুবকেরা পাল্টা এসডিও সহ অন্যান্য সকল কর্মকর্তাকে হত্যার হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে প্রশাসন বেশকিছু অস্ত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
২৬ মার্চ ছাত্র নেত্রী মনােয়ারা সুলতানের নেতৃত্বে একটি বিশাল মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। ২৭ মার্চ একটি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা দেশ শত্রুর হাত থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত সশস্ত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। তােবারক হােসেন লুলুর তত্ত্বাবধানে ২৬টি রাইফেল নিয়ে একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু করা হয়। একইভাবে মহকুমার পাট গ্রাম, নেসারগঞ্জ, সুতালরী, হরিরামপুর প্রভৃতি স্থানে প্রশিক্ষণ আরম্ভ হয়।
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশই হয়ে ওঠে একটি প্রশিক্ষণ শিবির-পাকিস্তানী শক্রদের কবল থেকে মাতৃভূমি উদ্ধারে দৃঢ় প্রত্যয়ী মুক্তিযােদ্ধাদের সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্র; যেখান থেকে বাঙালি জাতি তার আত্মপরিচয় আবিষ্কার করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
________________________________________
তৃতীয় অধ্যায় গণহত্যা ও নির্যাতন
২৫৭ ০ ৩৪৮
একাত্তরে পদার্পন। ইতিহাসে বর্ণবাদী আর আগ্রাসী রাজত্বের প্রভুত্ব বিস্তারী শাসক হিসেবে ইংরেজগণের অপনাম বিশ্বজোড়া। ইষ্ট ইন্ডিয়া নামক কোম্পানীর মাধ্যমে ব্যবসায়িক অজুহাতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সে দেশের ক্ষমতা দখল করাই ছিল ইংরেজ চরিত্রের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট।১৭০০ খৃষ্টাব্দের মােগল শাসনামলে প্রথম ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন ঘটে। এদেশে এসেও তারা তাদের নিয়মিত চরিত্রের ব্যতিক্রম ঘটায়নি। ১৯৫৭ খৃষ্টাব্দে মীরজাফরের মত কতিপয় এদেশীয় বিশ্বাস বিনাশীর সহযােগিতায় অবিভক্ত বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটিয়ে বংগদেশ তাদের শাসন ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত করে। মূলতঃ তখন থেকেই এদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার প্রশ্নে ইংরেজ বিরােধী চেতনা জাগ্রত হতে থাকে।
ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তাদের অপশাসনের বিরুদ্ধে এদেশীয় মানুষ পর্যায়ক্রমে আন্দোলন শুরু করে। এসব আন্দোলনের মধ্যে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ, ১৮৬০ সালের নীল বিদ্রোহ বা কৃষক বিদ্রোহ, ১৯০৫ সালের স্বদেশী আন্দোলন সহ ইত্যাদি বিশেষভাবে খ্যাত। পর্যায়ক্রমে এমনি অসংখ্য গণ-আন্দোলনের ফলে ইংরেজদের অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়ে। অবশেষে তারা ১৯৪৭ সালে এদেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।
দু’শাে বছরের ইংরেজ রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের পর বাংগালীরা ভেবেছিল নিজেদের ভাগ্য স্বহস্তে গড়ার সুযোেগ তারা এবার পেল। কিন্তু বৃটিশ সরকার অর্থাৎ ইংরেজ শাসকগণ এদেশ ত্যাগের আগে তাদের পরাজয়ের প্রতিশােধ হিসেবে বাংগালী জাতীয়তাবাদকে উপেক্ষা করে হিন্দু-মুসলিম দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভুয়া আদর্শের ধুয়া তুলে পাকিস্তানী নেতা মােহাম্মদ আলী জিন্নার মত কতিপয় লােভী, শঠ আর
________________________________________
প্রতারক রাজনীতিকের সহযােগিতায় চক্রান্তের মাধ্যমে নেতাজী সুভাষ বােসের অবিভক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে নস্যাতের মাধ্যমে তাকে দ্বি-খন্ডিত করে তার পূর্বাঞ্চল যা আজকের বাংলাদেশ তাকে হাজার হাজার মাইল দূরত্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলের, যে অঞ্চলের মানুষ হিংস্র, ভাষা ভিন্ন, বর্ণ অন্য, সংস্কৃতি আলাদা তার সংগে অংগির্ভূত করে ‘পাকিস্তান’ নামক একটি অস্থায়ী রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে একটি স্থায়ী বিরােধের ক্ষেত্র তৈরী করে রেখে যায়।
পাকিস্তান নামক তথাকথিত সেই খন্ডকালিন প্রহসনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ও বাঙালীজাতির জীবনে শুরু হয় হাতবদলের মাধ্যমে স্বাধীনতার নামে নতুন বন্দীদশা। উগ্র আঞ্চলিকতাবাদী আর কঠোর সাম্প্রদায়িক পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠি প্রথম থেকেই এদেশের মানুষের প্রতি শুরু করে তাদের নির্যাতনের শাসন আর লুণ্ঠনের শােধনকাল । অবাংগালী। পাকিস্তানীরা দেখলে বাংলাদেশকে তাদের তাবেদারীর ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে প্রথমেই বাঙালী জাতির ভাষা, সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতিকে বিলুপ্ত করা প্রয়ােজন। বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙালীদের সংগে শুরু হােল পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠির প্রথম মতবিরােধ।
সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তানীদের সঙ্গে বাঙালীদের মত বিরােধ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ১৯৪৮ থেকে ৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। ২১ শে ফেব্রুয়ারি ৫২ তে বুকের রক্ত ঢেলে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে যায় এদেশের বীর সন্তানেরা। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুরু হয় পরবর্তী সংগ্রাম। ৬৮-৬৯ এর ব্যাপক অসহযােগ আর গণ-অভ্যুত্থানের ফলে এলাে ৭০-এর সাধারণ নির্বাচন। বাঙালীরা শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগকে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠ ভােটে নির্বাচিত করল। কিন্তু তারা দেশ শাসনের অধিকার পেলনা। ফলে বাঙালীরা নতুন কর স্বপ্ন দেখে স্বাধীনতার।
৭ মার্চ ১৯৭১। ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স অর্থাৎ আজকের সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা মহান মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে স্বাধীনতার ঘােষণা দিলেন। বিশাল গণসমুদ্রের উত্তাল তরংগে সেই স্বাধীনতার ডাক ছড়িয়ে পড়ে বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে। ঘরে ঘরে প্রস্তুতি নিল সর্বস্তরের মানুষ। হায়েনার মত ক্ষিপ্র হয়ে উঠল বেনিয়া পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠি । একদিকে মুক্তির প্রবল স্পৃহায় উদ্বেল বাঙালী জাতি আর অন্যদিকে পশ্চিমা দস্যুদের দাবিয়ে রাখার ঘৃণ্য প্রস্তুতি।
২৫ মার্চ ১৯৭১। বিশ্বের ইতিহাসে এই দিন ধূন্যতম হিংস্রতায় চিহ্নিত সময় । পাকিস্তানী সেনা-দস্যুরা এদিন গভীর রাত্রের নিস্তব্ধতাকে ভেংগে বর্বর এক দানবীয় নিষ্ঠুরতায় সশন্ত্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাংগালীদের উপর। রাজধানী ঢাকাসহ সমগ্র দেশের উপর লেলিহান থাবা বিস্তার করে তারা নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। যে হত্যাকান্ড ছিল ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের গেস্টাপাে বাহিনীর নিধন যজ্ঞের
________________________________________
চেয়েও ভয়ংকর। ভিয়েতনামে আমেরিকা বাহিনী কর্তৃক সংগঠিত মাইলাই হত্যাকন্ডের চেয়েও নির্মম আর পাশবিক।
পাকিস্তানী সামরিক শাসক কুখ্যাত আইয়ুব খান, জল্লাদ ইয়াহিয়া খান আর মুখােসধারী রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টোর ত্রিপক্ষীয় বাঙালী হত্যাযজ্ঞের ষড়যন্ত্রকে মদদ যােগায় আগ্রাসনৰাণী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশ। সেই সংগে তাদের সহযােগিতা করে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামসহ এদেশে বসবাসকারী ভারত থেকে আগত বাঙ্গালী মুসলমানদর বৃহৎ অংশ এবং অবাংগালী বিহারী সম্প্রদায়। যারা রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী গঠনের মাধ্যমে মুক্তিকামী স্বদেশবাসীকে হত্যায় সহযােগিতা করে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
বাংগালীর জীবনে নেমে আসা ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ধ্বংসযজ্ঞ আর ভয়াবহ হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করে সমগ্র বিশ্ববাসী। অনিবার্য হয়ে ওঠা স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ বাঙালীরা শুরু করে সশস্ত্র সংগ্রাম। আওয়ামী লীগ আর সর্বদলীয় সংগ্রামী ছাত্র সমাজের নেতৃত্বে সংগঠিত স্বাধীনতাযুদ্ধকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন যােগায় বন্ধুরাষ্ট্র ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ। ভারতের তৎকালীন প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ব্রেজনেভ তাদের সরকার ও জনগণের সার্বাত্মক সহযােগিতা নিয়ে বাঙালীদের চরম দুঃসময়ে এগিয়ে আসে। দেশত্যাগী এক কোটি শরনার্থীকে ভারত ঐ সময় আশ্রয় দিয়ে তাদের খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করে। অবশেষে বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী জয় বাংলা’ শ্লোগানে উদ্দীপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয় আগ্রাসী শক্তি।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দীর্ঘ নয়মাসের যুদ্ধ শেষে এদিন দখলদার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সেনা প্রধান এ কে নিয়াজী প্রায় এক লক্ষ সৈন্যসহ আত্মসমর্পন করে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ নেতৃত্বের কাছে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত আত্মসমর্পন দলিলে স্বাক্ষর করেন মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর পক্ষে জেনারেল জগৎ সিং অরােরা এবং পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আমি আবদুল্লা খান নিয়াজী। | ২৫ মার্চ ৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ পর্যন্ত নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্বর পাকিস্তানী। দস্যুদের নিষ্ঠুর হােবলে বিধ্বস্ত হােল দেশ, বিনষ্ট হােল সম্পদ, ধ্বংস হােল রাস্তাঘাট, পুড়লাে ঘরবাড়ী, ধর্ষিতা হােল মা-বােন এবং সেই সংগে মৃত্যু বরণ কোরল এদেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষ।
পঁচিশে মার্চ যেভাবে শুরু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাজধানী ঢাকাসহ সমস্ত দেশের মানুষ এদিন আসন্ন এক আতংকের মধ্যে সময় কাটাতে থাকে। শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের আলােচনা ব্যর্থ হওয়ার খবর ইতিমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। একটা ভয়ার্ত থমথমে অবস্থা সর্বত্র। সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়, রাত্রি বাড়তে থাকে। নানা জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে রাত্রি
________________________________________
এগারােটার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে সারি সারি সামরিক কনভয় রাজধানীর ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা সমূহের দিকে যাত্রা করে। তারা অবস্থান নেয় নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে। রাত্রি বারােটা বেজে ওঠার সাথে সাথে পাকিস্তানী সৈন্যরা শুরু করে ইতিহাসের সেই ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টারসহ রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ট্যাংক, কামান, মেশিন গান থেকে শুরু করে অবিরাম ধারায় গােলাবর্ষণ। গগন বিদারী শব্দে প্রকম্পিত হতে থাকে চতুর্দিক। দিক বিদিক জ্ঞান শূন্য ভয়ার্ত মানুষের আর্ত চিৎকারের পাশাপাশি আকাশ হােয়া আগুনের লেলিহান শিখা। কি বিস্ময়কর সেই দৃশ্য, কি ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতা। কি আশ্চর্য সেই সময় । যে সময়ের মুখােমুখি হয়েছিল এ দেশের মানুষ।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালাে রাত্রির বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন সেদিন ঢাকায় কর্মরত একজন বাংগালী পুলিশ ইনসপেক্টর জনাব সালেহুজ্জামান। তিনি সেদিন সেইসব লােমহর্ষক ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় জনাব সালেহজ্জামান এক পাটুন ফোর্সসহ মীরপুর একনম্বর সেকশনে নিয়মিত টহলে ছিলেন। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই তিনি থমথমে ভীত সন্ত্রস্ত একটা ভাব মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করেছেন। রাত্রি প্রায় এগারােটার দিকে তার অয়ারলেস সেট সক্রিয় হয়ে ওঠে । অজানা কোন এক ষ্টেশন থেকে একজন বাঙালী সৈনিকের কণ্ঠস্বর শুনতে পান তিনি। ঐ সৈনিক জানান, ঢাকা সেনানিবাস থেকে মেশিনগান সজ্জিত ট্যাংক ও কামানবাহী সাজোয়া যানসহ ও পাক সৈন্যরা রাজধানীতে সদর্পে প্রবেশ করছে, বাঙালী সিপাহীরা তােমরা সাবধান হও”-এই ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে মেসেজ দেওয়া হয় পুলিশ ডিউটি উইথড্রন” এর কিছুক্ষণ পরই ঢাকার সর্বত্র আগুনের ফুলকি সেই সাথে অবিরাম গােলাগুলির শব্দ, চারদিক থেকে মানুষের চিৎকার আর্তনাদ ভেসে আসতে থাকে। প্রজ্জলিত আগুনের লেলিহান শিখা, মেশিনগান আর কামানের আকাশ ফাটা শব্দে সমস্ত শহর প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এ সময় তিনি শুনতে পান একজন পাকসৈন্য বলছে বাঙ্গালী সালা লােক, আজী আকার দেখাে-তােমরা কেতনা মা-বােহেন পাকসৈন্য বলছে”। একথা শােনার সংগে সংগে তিনি অয়ারলেস সেট বন্ধ করে থানা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় আত্মগােপন করেন।
২৬ মার্চের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এদিন মীরপুর ইপিআর ও পুলিম ক্যাম্পের সমস্ত বাঙালী সিপাহীদেরকে নিরস্ত্র করে পাক সৈন্যরা থানার সামনে জমায়েত করে। এসময় মিরপুরের বিহারীরা সর্বত্র এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। দলে দলে মাথায় লাল কাপড় বেঁধে তারা মেতে ওঠে মধ্যযুগীয় বীভৎস এক তান্ডবলীলায়। বাঙালীদের বাড়ী বাড়ী ঢুকে তারা লুট পাট করে। লুট পাট শেষে সেইসব বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। দানবের মত বিকট উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা প্রত্যেক বাড়ী থেকে বাঙালী শিশু, যুবা, বৃদ্ধ সকলকে ধরে এনে রাস্তায় ফেলে প্রকাশ্যে জবাই করে হত্যা করে। মেয়েদের উলঙ্গ করে রাস্তায় ফেলে প্রকাশ্যে ধর্ষণে লিপ্ত হয়। তাদেরকে চিৎ করে শুইয়ে জীবন্ত অবস্থায়
________________________________________
স্তন কেটে আলাদা করে। উপুড় করে শুইয়ে কারাে কারাে পাহার মাংস কেটে বিক্রি করে। যে সমস্ত মহিলারা আত্মরক্ষার জন্যে জোরাজুরি করে তাদেরকে কয়েকজনে ধরে জোর করে রাস্তায় চিৎ করে শুইয়ে দুদিকে পা টেনে ধরে যােনিপথে লােহার রড ঢুকিয়ে হত্যা করে। কারাে কারে হাত পেছনে বেঁধে গায়ে কেরােসিন ঢেলে পুড়িয়ে মারে। মায়েদের কোল থেকে শিশুদের টেনে হিচড়ে নিয়ে উপর দিকে ছুড়ে মেরে নিচ থেকে ছােরা উঁচিয়ে ধরে চোখের সামনে দ্বিখন্ডিত করে। সেই নির্মম মুহুর্তে যখন বাঙালীরা করুনার সংগে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে তখন বিহারীরা অধিক উল্লাসে অই-হাসিতে তাদের পৈচাশিকতাকে আরাে দ্বিগুন বাড়িয়ে তুলেছে।
সেদিনের ঘটনা প্রসংগে আরাে জানা যায় যে, একটি বাড়ী থেকে পিতা মাতা পুত্র কন্যা সবাইকে ধরে আনা হয়। তারপর তাদের সবাইকে সবার সামনে কাপড় খুলতে বলা হয়। এতে তারা আপত্তি করলে জোর করে তাদের পরনের কাপড় খুলে নেয়া হয় এবং ছেলেকে মায়ের সংগে ও পিতাকে মেয়ের সংগে ধর্ষণে লিপ্ত হতে বলা হয়। কিন্তু এতে তারা অস্বিকৃতি জানালে এক পর্যায়ে সবার সামনে পিতা-পুত্রকে টুকরাে টুকরাে করে কেটে মা-মেয়ে দু’জনকে দু’জনের চুলের সাথে বেঁধে উলংগ অবস্থায় বিহারীরা ধরে নিয়ে,
যায়।
এই ঘটনার পর সালেহজ্জামান আত্মগােপন অবস্থা থেকে পালিয়ে মিরপুর ছেড়ে চলে আসেন। পালিয়ে আসার সময় তিনি দেখতে পান আরেক মর্মান্তিক দৃশ্য । ট্রাক ভর্তি মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে যে সকল ট্রাক পাকসৈন্যদের হাতে ধরা পড়ছে তাদের ট্রাকের উপর দাড়ানাে অবস্থাতেই গায়ে বিস্ফোরক পাউডার ছড়িয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। পাক সৈন্যরা যে সকল ট্রাকে যুবতী মেয়েদের পাচ্ছে তাদেরকে মিলিটারী জীপে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, “সেইসব মেয়েদের করুণ চিৎকার আর আর্তনাদের কথা আজো আমি ভুলতে পারিনি” ।
কেবলই ধ্বংসযজ্ঞ, শুধুই বিভীষিকা ২৫ মার্চ রাতের নির্মম হত্যাযজ্ঞের আরেকজন প্রত্যক্ষদশী পুলিশ সুবেদার জনাব খলিলুর রহমান। তিনি ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে এক প্রকার বন্দীদশার মধ্যে থেকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন। সেসময় তিনি পাক বাহিনীর নৃসংশ বর্বরতাকে স্বচক্ষে দেখেছেন। কিন্তু কোন প্রতিবাদ কোরতে পারেননি। কেবল ঘটনার নীরব স্বাক্ষী হয়ে দেখেছেন সবকিছু। তার সেই অভিজ্ঞতার কথা এখানে তুলে ধরা হােল।
২৫ মার্চ অন্যান্য কয়েকজন সিপাহীসহ খলিলুর রহমানকে কোতয়ালী থানার দায়িত্বে দেওয়া হয়। এদিন থানায় প্রবেশ করেই তিনি দেখতে পান চাপ চাপ রক্তে সমস্ত মেঝে তেজাননা। দেয়াল বুলেটের আঘাতে ঝাঝরা হয়ে গেছে। থানা থেকে বেরিয়ে বুড়িগংগার দিকে এগুতে থাকেন তিনি, এসময় বুড়িগংগার পাড়ে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। এখানেই তিনি তার সহকর্মী পুলিশ সিপাহী আবু তাহেরের লাশ পােষাক পরা
________________________________________
অবস্থায় নদীতে ভাসলি। সহকর্মী আবু তাহেরের লাশ নদী থেকে তুলতে গেলে একজন পাকসৈন্য গর্জন করে উঠে তাকে বলে “শুয়াের কা বাচ্চা তােমকোজী পাড়া তা যায়, কোন্তাকা বাচ্চা, তােমকো ওভি সাথমে গুলি করেগা”। একথার পর তিনি লাশ তুলতে পারেননি। এরপর থানা বরাবর বুড়িগংগা লঞ্চঘাটের পাড়ে দাড়িয়ে দেখতে পান শত শত মানুষের ছিন্ন ভিন্ন লাশ নদীতে ভাসছে। তিনি বলেন, “বিভৎস সেই স্বাসরুদ্ধকর করুণ দৃশ্য আজো আমি ভুলতে পারিনি। সেইসব দৃশ্য আজো আমাকে শিহরিত করে তােলে” । যতদূর চোখ যায় বিস্তৃত জলরাশি জুড়ে শুধু মৃতদেহ আর মৃতদেহ ভাসছে। রাস্তা ঘাটে যত্রতত্র পড়ে আছে শিশু-কিশাের, যুবা, বৃদ্ধ নানা বয়সের নারী-পুরুষের সারি সারি বিকৃত লাশ। খলিলুর রহমান বলেন, সর্বত্রই তিনি মেয়েদের লাশ উলংগ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছেন। এক স্থানের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সেখানে বেশ কিছু যুবতী মেয়ের মৃতদেহ পড়েছিল, যাদের স্তন, যােনিপত, উরু প্রভৃতি স্থান ছিন্ন ভিন্ন হয়ে আছে। বর্বর পশুরা হত্যা করার আগে তাদের দেহ কুরে কুরে খেয়েছে। যথেচ্ছভাবে ধর্ষণ শেষে গুলিতে ঝাঁঝরা করে চলে গেছে। এক স্থানে বেশ কয়েকজন শিশুর লাশ তিনি দেখতে পান, তাদের মাথার দিকটাই শুধু থেথলানাে ছিলাে। তাদেরকে পা ধরে আহুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। মাঝে মধ্যে কিছু যুবকের লাশও তিনি দেখতে পেয়েছেন, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে শুধু বেয়ােনেটের আঘাতে। বেয়ােনেট চার্জ করে এদের বুক, পেট চিরে ফেলা হয়েছে। একস্থানে দু’জন যুবক পড়ে ছিলাে, তাদের পােষাক পরিচ্ছদ সবকিছু ঠিকঠাক, কেবল মাথার দিকটা চূর্ণ বিচূর্ণ করা হয়েছে। এদের সম্ভবত রাস্তায় চেপে ধরে রাইফেলের বাট দিয়ে সজোরে আধাত করে মাথা ফাটানাে হয়েছে। লক্ষীবাজার মােড়ে এসেও তিনি একই অবস্থা দেখতে পান। এখানে কয়েকজন যুবকের লাশ পড়েছিল যাদের বুক চিরে হৃৎপিন্ড বের করা হয়েছে সেই সংগে পায়ের গিঠ আর হাতের কবজি ভাংগা।
সদরঘাট টার্মিনালে এসেও তিনি সারি সারি মৃতদেহ দেখতে পান। টার্মিনালের পাটাতন জুড়ে পড়ে ছিল অসংখ্য মৃতদেহ। তখনাে রক্তে ভিজে চপচপ করছে। ২৫ মার্চ রাতের লঞ্চে তারা বিভিন্ন রুটের যাত্রী ছিল। উল্লেখ্য পঁচিশে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাক বাহিনী শহরের বিপ্ন স্থান থেকে মানুষ ধরে এনে এখানে জবাই করে পানিতে ফেলতো। স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই টার্মিনালে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করতাে। বিহারীরা লােক ধরে এনে এখানেই জবাই করে পানিতে ফেলতাে। স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত এই টার্মিনাল ছিল পাক দস্যুদের এবং তাদের সহযােগী রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনীর কশাইখানা।
সদর ঘাট টার্মিনাল থেকে পূর্ব দিকে কিছু দূরে এগিয়ে তিনি দেখতে পান একঝাক শকুন জটলা করে পড়ে থাকা কতকগুলাে মৃতদেহ নিয়ে টানা হেঁচড়া করছে। পূর্ব দিকের রাস্তা ধরে তিনি সােজা এগােতে থাকেন, এসময় দেখতে পান চার পাশে কোথাও মানুষ জনের চিহ্ন মাত্র নেই। চারিদিকে একটা থম থমে ভয়ার্ত পরিবেশ। কাকের একটানা
________________________________________
ডাক সেই পরিবেশকে আরাে ভারী করে তুলেছে। চারিদিকে আগুনে পােড়া আর গুলিতে ঝাঝরানাে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ী। তখনাে কিছু কিছু ঘর বাড়ী আগুনে জ্বলছে। পৌরসভার নিকটে এসে তিনি দেখতে পান এখানে কয়েকটি ময়লা ফেলার গাড়ী যার প্রতিটি মৃত মানুষের পাশে বােঝই। তখনাে নিচে ঝুপ করে পড়ে থাকা কিছু লাশ সুইপাররা টেনে হিচড়ে গাড়িতে তুলছে। পাশে দাঁড়ানাে একদল পাকসৈন্য। এখান থেকে তিনি ব্যাপটি মিশনের দিকে এগােতে থাকেন, রূপমহল সিনেমা হলের সামনে এসে দেখতে পান অসংখ্য মানুষের লাশ সুপীকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। বিভিন্ন বয়সের এইসব মানুষ পঁচিশের রাতে সিনেমা দেখতে এসেছিলাে। এখানে বেশ কিছু মেয়ে লােকের লাশও তিনি দেখতে পান যাদের শরীরে কোন কাপড় ছিল না। | মিশনারী অফিস, বাসষ্ট্যান্ড, কলেজিয়েট স্কুল, জজকোর্ট, পােপােৰু হাইস্কুল, ষ্টেট ব্যাংক বিল্ডিং, ঠাটারী বাজার, গােপী বাগ, নয়া বাজার, তাহের বাগ, টিপু সুলতান রােড, বগ্রাম রােড, গুলিস্তান সর্বত্র শুধু মানুষের মৃত দেহ। মৃত দেহ সয়লাব হয়ে আছে সমস্ত এলাকা। কোথাও কোথাও বাড়ীঘর আগুনে পুড়ছে। উচু উঁচু দালানগুলাের ফাক দিয়ে আগুন থেকে থেকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে। রায়সাহেব বাজার ব্রীজ পেরিয়ে নওয়াবপুর রােডে ঢুকেই তিনি একদল উৎসব মুখর বিহারীদের দেখতে পান। সেকি বিভ ৎস উল্লাস নৃত্য, উন্মত্ত লাফালাফি আর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে তারা, এদের সকলের হাতে অত্র। কয়েকজন বাঙালীকে এরা ধরে এনেছে এখানে, পেছনে হাত বাধা গায়ে কাপড় নেই। এদেরকে কেউ চড় মারছে, কেউ ছুটে এসে লাথি মারছে। বিভিন্ন প্রকার নির্যাতন চলছে তাদের উপর । একজনের পুরুষাঙ্গে ইট বেধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একজনকে রাস্তায় শুইয়ে তার উপর কয়েকজন পঁড়িয়ে নাচানাচি করছে। দাঁড়িয়ে থাকা একজনের পেটে হঠাৎ করে ছােরা বসিয়ে দিল একজন বিহারী । কি অসম্ভব বিশ্বয়কর সেই দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
পাকসেনারা এসব দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে হাত উচিয়ে রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। জনাব খলিল বলেন, তিনি এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে অগ্রসর হতে থাকেন। যেখানে তাদের জন্য আরাে ভয়ংকর দৃশ্য অপেক্ষা করছিল। একস্থানে আরেক দল বিহারী কয়েকটি শিশু তখনও জ্যান্ত ছিল। এসব বিহারীদের হাতে ছিল মাংস কাটা দা, সাবল, লােহার রড, কুড়াল, বন্দুক ও রাইফেল। দল বেধে এরা বাঙালীদের বাড়ী ঘরে আগুন লাগাচ্ছিল। সেই সাথে তারা লুট কর নিচ্ছিলাে বাঙালীদের সম্পদ। ঠাটারী বাজার ট্রাফিক সিগনালের কাছে এসে তিনি দেখতে পান হৃদয়বিদারক আরেক দৃশ্য। এখানে একজন। বাঙালী যুবকের পেটে বাঁশ ঢুকিয়ে তার মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা টাংগিয়ে রাখা হয়েছে। সেই দৃশ্য ঘিরে একদল বিহারী উল্লাস করছে। আরেকটু সামনে ঠিক ঠাটারী বাজারের মাঝখানে এসে তিনি দেখতে পান কয়েকজন বিহারী একজন যুবককে মাটিতে চেপে ধরে তার মলদার দিয়ে লােহার রড ঢুকানাের চেষ্টা করছে। যুবকটির সেকি চি কার, পানি পানি বলে আর্তনাদ করতেই একজন বিহারী তার মুখ বরাবর দাড়িয়ে প্রস্রাব। করে দিয়েহেলাে।
________________________________________
জনাব খলিলুর রহমান বলেন সেদিনের এই সব দৃশ্য তার পক্ষে দেখা সম্ভব হয়েছিলাে কেবলমাত্র পুলিশের পােষাক পরে কর্তব্য পালনরত অবস্থার কারণে। তিনি বলেন, এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় আমি গুলিস্তান দিয়ে বিজয় নগরের রাস্তা ধরে শান্তিনগর হয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চলে আসি। | রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালী সিপাহী যারা ২৫ মার্চের পর আটকা পড়েছিল তাদের মধ্যে ক্রমশই ভয়ভীতি হতাশা বেড়েই চলছিলাে। এসব বাঙালী সিপাহীদের মধ্যে থেকে প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে মুক্তিবাহিনীর চর বলে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হাড়গােড় ভেংগে ফেলা হত। কখনাে আবার সােজা ক্যান্টনমেন্টে চালান করে দিত। এসব বন্দীদের কেউ আর কোন দিন ফিরে আসেনি। এছাড়াও মাঝে মাঝে পাক সৈন্যরা বাঙালী সিপাহীদের লাইন করে দাঁড় করাতাে এবং তাদের মধ্যে থেকে যাকে সন্দেহ হতাে তাদেরকে বলতাে সালা বাহেন চোত, শুয়ােরকা বাচ্চা, মালাউনকা বাচ্চা,‘হিন্দুকা লাড়কা, তােমারা মুজিবর বাবা অডি কাহা হ্যায়, হারামী বাঙালীকা বাচ্চা, জয় বাংলা বলতা নেহি। ইয়ে সশালা মুক্তি হ্যায়, সব সালাকে এক গুনিছে খতম করদো”। তারপর তাদের লাথি মারতে মারতে ট্রাকে নিয়ে তুলতাে, এতে অন্যান্য বাঙালী সিপাহীরা ভয়ে কাঠ হয়ে যেত। কেননা প্রতিবাদের কোন উপায় ছিলনা তাদের। মৃত্যুর একটা কালাে ছায়া প্রতি মুহুর্তে গ্রাস করতাে তাদের। এখান থেকে পালানােরও কোন উপায় ছিলনা, ছুটিও পেতনা কেউ। সর্বক্ষণ পাঞ্জাবী সেনারা পাহারা দিয়ে রাখতাে। যখন ডিউটিতে পাঠানাে হােত তখন প্রতি দশজন অবাঙালীদের সংগে দুই/একজন করে বাঙালী সিপাইকে পাঠানাে হতাে। এই অবস্থায়ও যারা পালানাের চেষ্টা করতাে তাদেরকে নির্মম অত্যাচার করে হত্যা করা হােত । রাজার বাগ পুলিশ লাইনের পাক সেনারা প্রায় প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে স্কুল কলেজের মেয়েদের ধরে আনতাে, এদের অনেকের হাতেই বই খাতাপত্র থাকতাে। কখনও কখনও কোন মহল্লা ঘেরাও করে বাড়ী বাড়ী থেকে গৃহ বধুদের তুলে আনা হােত। ভয়ে বিহ্বল হয়ে যেত তারা। আতংকগ্রস্থ এসব মেয়েদের যখন ট্রাকে করে ধরে আনা হতাে তখন পুরাে লাইনে পাক সৈন্যদের মধ্যে হৈ-চৈ পড়ে যেত ।ট্রাক থেকেই তারা পছন্দমত মেয়েদের টেনে হিচড়ে নামাতাে। প্রকাশ্যে তারা এসব মেয়েদের গায়ের পােষাক, পরনের কাপড় খুলে ফেলতাে। কেউ কেউ গাছের আড়ালে কিংবা দেয়ালের পাশে ধর্ষণে লিপ্ত হােত। কুকুরের মত উম্মত্ত এসব হায়নার সামনে মেয়েদের সেই ব্যর্থ চিৎকারে বাঙালী সিপাহীরা দিশেহারা হয়ে যেত । যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের পর এসব মেয়েদের হেড কোয়ার্টারের চার তলায় নিয়ে রাখা হােত সম্পূর্ণ উলংগ অবস্থায় যাতে তারা আত্মহত্যা করতে না পারে। সেখানে তাদের সারিবদ্ধভাবে দাড় করিয়ে লােহার রডের সংগে চুলদিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখা হােত। রাতের বেলায় পুনরায় শুরু হােত তাদের উপর পৈচাশিক নির্যাতন। একেক জনের উপর পালাক্রমে ধর্ষণ কলতাে। অজ্ঞান হয়ে গেলেও কেউ রেহাই পেতনা। গভীর রাতে বাঙালী সিপাহীরা
________________________________________
শুনতে পেত সেইসব মেয়েদের করুন আর্তনাদ, অসহ্য চিৎকার। সেই চিৎকারে কোন কোন দিন সারা রাত্রি আর বাঙালী সিপাহীদের ঘুম হােত না।
পাক সৈন্যরা প্রতিদিন শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে যুবক ছেলেদের ধরে আনতাে। তারপর এদের প্রতি চালাতে বিভিন্ন উপায়ে অমানষিক নির্যাতন, কারাে চোখ তুলে নেয়া হােত, কারাে হাত পায়ের নখ ছিড়ে ফেলা হােত, কারাে পুরুষাংগ কেটে নেয়া হােত, কারাে হাত পায়ের গিট বাড়ি মেরে গুড়িয়ে ফেলা হােত, কারাে মুখে কাপড় বেঁধে গরম পানি ঢেলে দেয়া হােত । পাশাপাশি চলতে স্বীকারােক্তি আদায়ের চেষ্টা। রাত্রি গভীর হলে এদেরকে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাস টেনে হত্যা করা হােত। তারপর মৃত-অর্ধমৃত সবাইকে রাস্তার ম্যানহােলের ঢাকনা তুলে তার মধ্যে ফেলে দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হােত । এরপর পাক সৈন্যরা চলে যেত হেড কোয়ার্টারের চারতলায়। যেখানে মেয়েদের রাখা হােত। সারারাত ধরে তারা সেখানে মেয়েদের উপর অত্যাচার চালাতাে। যেসব মেয়েরা প্রতিবাদ জানাতে তাদেরকে উলংগ করে পা উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হােত । কারাে স্তন কেটে নেয়া হােত, কাউকে চিৎকরে শুইয়ে যােনি পথে রাইফেলের নল ঢুকিয়ে রেখে দেয়া হােত। এমনিভাবে বিভিন্ন উপায়ে চলতাে অত্যাচার। এইসব ঘটনা প্রসংগে খলিলুর রহমান বলেন, “একেক সময় আমাদের মনে হােত এ থেকে পরিত্রানের জন্য আত্মহত্যা করি”।
| ঢাকা নগরীঃ সর্বত্রই লাশের মিছিল বাঙালী জীবনে ঘটে যাওয়া একাত্তরের সেই ভয়াবহ সময়কে আরাে যারা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন, যারা একাত্তরের সেই ভয়ংকর ঘটনার সংগে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন এবং পাক বাহিনীর হত্যাকান্ড সেদিন কি নরকীয় পৈচাশিকতার সংগে সংগঠিত হয়েছিল, সেদিন মানুষের মৃতদেহ রাস্তা-ঘাটে বিকৃত অবস্থায় পড়েছিল এবং কিভাবে সেইসব লাশ অমানবিকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন তৎকালীন ঢাকা পৌরসভার একজন সুইপার ইন্সপেক্টর মােহাম্মদ সাহেব আলী।
২৫ মার্চের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে সাহেব আলী বলেন, সন্ধ্যা থেকেই এদিন রাস্তাঘাট ছিল থমথমে। যানবাহন গুলাে দ্রুত গন্তব্যস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাে, মাঝে মাঝে ছাত্র-জনতা মিলে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরিতে ব্যস্ত। রাত্রি এগারােটার দিকে ইংলিশ রােডে প্রতিরােধ তৈরিতে স্বতস্ফূর্ত একদল জনতার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, ঢাকা সেনানিবাস থেকে অসংখ্য সামরিক যানে করে সৈন্যরা রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে, সংগে রয়েছে ট্যাংক ও কামানবাহী ভারী যানবাহন। তাদের প্রতিরােধ করার জন্য জনতা ব্যারিকেড তৈরি করছে। এ সময় তিনি কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসেন। রাত্রি প্রায় বারােটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রাজারবাগ, মালিবাগ, পিলখানা, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটি প্রভৃতি এলাকা থেকে গােলাগুলি শুরু হয়। প্রচন্ড আওয়াজে এসময় সমস্ত ঢাকা শহর যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে। বিভিন্ন অঞ্চলে
________________________________________
| জ্বলে উঠতে থাকে আগুনের লেলিহান শিখা। থেকে থেকে মেশিনগানের একটানা বর্ষন। সুইপার কলােনির হাদের চিলেকোঠায় অবস্থান নিয়ে তিনি দেখতে পান শাখারী বাজার, তাঁতি বাজার, নয়া বাজার, বাবু বাজার, ইসলামপুর, মিটফোর্ড প্রভৃতি ঘন বসতিপূর্ণ। এলাকার ঘর বাড়ী গুলােতে আগুন ছড়িয়ে পড়ছিলাে।
২৬ মার্চ ভােরে সাহেব আলী বাবু বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে দেখতে পান ফঁাড়ির প্রবেশ পথে, এবং রুমের ভেতরে বারাে জন বাঙালী পুলিশ-এর লাশ পড়ে আছে। তাদের শরীর বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। মর্মান্তিক বীভৎস এ দৃশ্য দেখে তিনি একটা ঠেলাগাড়ি যােগাড় করে তাতে লাশগুলাে তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশ ঘরে নিয়ে রেখে আসেন। সেখান থেকে শাখারী বাজারে প্রবেশ করে পূর্বদিক দিয়ে জজ কোর্ট এলাকায় এসে দেখতে পান সেখানেও অনেকগুলাে মৃতদেহ এলােমেলাে অবস্থায় পড়ে আছে। গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া এ মৃতদেহগুলিও তিনি পুনরায় গাড়িতে করে মিটফোর্ডে রেখে আসেন।
| বেলা বেড়ে ওঠার সংগে সংগে এদিন কিছু কিছু লােকজন রাস্তাঘাটে দেখা যায় কিন্তু কিছুক্ষণ বাদে সৈন্যরা মাইকে ঘােষণা দিয়ে যায় যে, শহরে কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় কাউকে রাস্তায় দেখা গেলে গুলি করা হবে। যদিও ইতিমধ্যে টহলরত সৈন্যবাহী গাড়ী মাঝে মধ্যেই দেখা যাচ্ছিলাে। এই ঘােষণার পর পুনরায় রাস্তাঘাট ফাকা হয়ে যায়। বিকেলের দিকে তাঁতী বাজার, শাখারী বাজার, কোর্ট হাউজ ঐট, ইসলামপুর, মৌলবী বাজার, আগামসি লেন, ইংলিশ রােড, ওয়ারী, টিপু সুলতান রােড, বাংলা বাজার সহ পুরনাে ঢাকার চতুর্দিকে অসংখ্য সৈন্যবাহি গাড়ী ঢুকে পুরাে এলাকা ঘিরে ফেলে সমস্ত বাড়ী ঘরে আগুন লাগাতে শুরু করে। অস্ত্র হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পাক সৈন্যরা এসময় জলন্ত ঘর বাড়ী থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসা নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করছিলাে। একই সংগে তারা সমস্ত এলাকা জুড়ে এলােপাথাড়িভাবে মেশিনগানের গুলি বর্ষন করে যাচ্ছিলাে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ আরাে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। | ২৭ মার্চ সকালে পাক সৈন্যরা নওয়াবপুর, ইংলিশ রােড, নয়া বাজার, বংশাল রােড, কাজী আলাউদ্দীন রােড প্রভৃতি এলাকার রাস্তার দু’ধারে অবস্থিত দোকান ঘরগুলি জ্বালিয়ে দিতে আরম্ভ করে। সারাদিন কয়েক ট্রাক সৈন্য এই আগুন লাগানাের কাজ চালিয়ে যায় । সন্ধ্যার দিকে তারা পুরানাে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত হিন্দুদের মন্দিরগুলাে মর্টার নিক্ষেপ করে গুড়িয়ে দেয়। এসময় অরা বাড়ী বাড়ী লুটপাট ও অগ্নি সংযােগ করছিলাে সমানভাবে। পাক সৈন্যরা এদিন ঘরে ঘরে তল্লাসী দিয়ে প্রায় একশ যুবতী মেয়েকে ধরে ট্রাক বােঝাই করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। | ২৮ মার্চ রেডিওতে এক জরুরী ঘােষণার মাধ্যমে পাক সরকার সকল সরকারী কর্মচারীকে কাজে যােগদান করার নির্দেশ দেয়। এই ঘােষণার পর অন্যান্য সুইপারদের সংগে সাহেব আলীও পৌরসভায় গিয়ে রিপাের্ট করে। পৌরসভার অবাঙালী চেয়ারম্যান মেজর ছালামত আলী খান তাদেরকে শহরের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা লাশ সংগ্রহ করে
________________________________________
তা স্বামীবাগ আউট ফলে ও ধলপুর ময়লা ডিপােতে নিয়ে ফেলে আসতে বলে। রু হয় ট্রাক ভর্তি করে তাদের লাশ ফেলার পালা। প্রথমে একমাত্র মিটফোর্ড থেকেই তারা কয়েক টাক লাশ তুলে তা স্বামীবাগ আউট ফুলে ফেলে আসে। সাহেব আলী বলেন যেসব লাশ তারা সারাদিন তুলেছে তার মধ্যে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের লাশ তারা দেখেছে। এর মধ্যে মেয়েদের যত লাশ তারা তুলেছে তার মধ্যে বেশীর ভাগের শরীরেই কোন কাপড় ছিলনা। এসব মেয়েদের স্তন, উরু, যৌনাংগ, পেট, মুখ প্রভৃতি স্থান তারা ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় দেখেছে।
পরদেশী নামে একজন ডােম এদিন শাখারী পঠির এক বাড়ী থেকে অপূর্ব সুন্দরী একটি মেয়ের লাশ তুলে আনে। মেয়েটির স্তন ছিড়ে ফেলা হয়েছে। যৌনাংগ সম্পূর্ণভাবে থেথলানাে, মুখ, বাহু, উরু প্রভৃতি স্থানে রক্ত জমাট বাঁধা, তার সমস্ত শরীরে ছিল কামড়ের চিহ্ন, চোখ দুটি শুধু স্পষ্ট তাকানাে অবস্থায় ছিলাে। সাহেব আলী বলেন, আরমানীটোলার এক বাড়ীতে তারা দেখতে পান দশ-এগারাে বছরের স্বাস্থ্যবতী আরেকটি ফুটফুটে মেয়ে, টকটকে ফর্সা গায়ের রং। মেয়েটির সমস্ত শরীর আগাগােড়া ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে, সারা গায়ে জমাট বাঁধা রক্ত। কয়েক স্থানে মাংস খুবলে তুলে নেয়া হয়েছে। নরপশুরা মেয়েটিকে ধর্ষণ শেষে দু’দিক থেকে পা ধরে টেনে নাভী পর্যন্ত ছিড়ে ফেলেছে।
৩০ মর্চের ঘটনা প্রসংগে সাহেব আলী বলেন, এদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন মেজর জরুরী সংবাদ পাঠান যে, মৃত মানুষের পচা গন্ধে এলাকায় থাকা যাচ্ছেনা। অবিলম্বে এসব লাশ তুলে ফেলা হােক। এ পর্যন্ত তারা শুধু পুরনাে ঢাকাতেই লাশ তােলার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাে। এই সংবাদ পাওয়ার পর , পরদেশী, রণজি ২, মধুরাম, দুখিরামসহ আরাে কয়েকজন ডােম নিয়ে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। প্রথমে তারা রােকেয়া হলে প্রবেশ করে কিন্তু হলের কক্ষগুলােতে তেমন লাশ ছিলনা, কেননা ২৫ মার্চ রাতেই হলে অবস্থানরত সকল মেয়েকে পাক সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, এসময় তারা হলের চার তলার ছাদে গিয়ে দেখতে পায় সেখানে অনেকগুলাে ছাত্রীর লাশ হাদের চারদিকে ছড়ানাে অবস্থায় রয়েছে। তাদের শরীরের কোথাও কোন গুলির চিহ্ন ছিলনা। এসময় পাশে দাঁড়ানাে একজন পাক সৈন্যের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এদের শরীরের কোথাও গুলি বা আঘাতের চিহ্ন নেই, অথচ এরা মরলাে কিভাবে? এই প্রশ্নের জবাবে দস্যুটি হাসতে হাসতে জানায় এদেরকে আমরা উপভােগ করেছি, তারপর যৌনাংগে বেয়ােনেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছি। | সাহেব আলী বলেন, এইসব মেয়েদের কারাে পরনেই কোন প্রকার কাপড় ছিলনা। তাদের আশে পাশে দুই একটি সেলােয়ার কামিজ ছড়িয়ে ছিলাে। এসব মেয়েদের সমস্ত শরীর জুড়ে হিংস্র পাশবিকতার চিহ্ন ছিল। ভােলা ছাদে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে থাকা এসব ছাত্রিদের মৃতদেহ গুলাে একত্র করে তিনি চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। এরপর সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে এসে তিনি দেখতে পান হল কর্মচারীদের মৃত দেহগুলাে এ কয়েকদিন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ছাদে ছাড়ানাে অবস্থা থেকে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জন নারী-পুরুষের লাশ তুলে
________________________________________
আনা হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে তারা অধ্যাপকদের একটি কোয়ার্টারে প্রবেশ করেন, এখানে কয়েকজন শিক্ষক এবং তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের মৃতদেহ তুলে আনেন। তারা এখান থেকে জানতে পারেন, পঁচিশের রাতে মেয়েদের হলগুলাে ছাড়াও প্রফেসরদের কোয়ার্টারগুলাে থেকে বহু মেয়েকে পাকসৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে। তিনি জানান, এদিন ছেলেদের হলগুলাে থেকেও কয়েক ট্রাক লাশ তুলে তা স্বামীবাগ আউট ফলে নিয়ে ফেলে আসা হয়। ইকবাল হলের মর্মান্তিক দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন সেখানে বহু ছাত্রের লাশ পড়েছিলাে, তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যা করার পর পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। পােড়া বিকৃত লাশগুলাে সনাক্ত করার উপায় ছিল না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ ধরে ঢাকা পৌরসভার সুইপাররা কচুক্ষেত, ড্রাম ফ্যাক্টরী, শ্যামলী, আগার গাঁও, ধানমন্ডি, এ্যালিফেন্ট রােড, শাহবাগ, মগবাজার, মালিবাগ, শান্তিনগর, ফার্মগেট, বাংলা মটর, সেগুন বাগিচা প্রভৃতি এলাকা থেকে কয়েক শ ট্রাক লাশ তুলে তা স্বামী বাগ আউট ফলে নিয়ে ফেলে আসে। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় তাদের নতুন এক ধরনের লাশ সংগ্রহের পালা । এসময় প্রতিদিনই শহরের বিভিন্ন স্থানে হাত পা বাধা মৃত দেহ পড়ে থাকতে দেখা যেতাে। এইসব লাশের মধ্যে বেশীর ভাগই থাকতাে যুবক শ্রেণীর। যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিনই তারা শহর থেকে এ ধরণের লাশ সংগ্রহ করেছে। বহুল আলােচিত “রায়ের বাজার বধ্যভূমি এবং ইট খােলার মধ্যে থেকেই সুইপাররা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই হাজারের উপরে লাশ তুলে এনেছে। এই সব লাশের অধিকাংশ ভাগেরই চোখ তুলে ফেলা, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যেত। এই একই অবস্থার মধ্যে দিয়ে দুর্ভাগ্যের শিকার শত শত বাঙালীর মৃতদেহ সুইপাররা তুলে আনতে মীরপুর বিহারী কলােনী এবং তার পার্শ্ববর্তী ডােবা নালা থেকে।
মােহাম্মদ সাহেব আলী আরাে বলেন, পিলখানা, গনক টুলি, পাঠান টুলি, কলাবাগান, এয়ারপাের্ট, তেজগাঁও, রাজা বাজার, লেক সার্কাস, আজিমপুর, ঢাকেশ্বরী, ইস্কাটন, যাত্রাবাড়ী, পােস্তাগােলা প্রভৃতি অঞ্চলে থেকেও তারা শত শত লাশ তুলেছে। মােহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজের ভিতর থেকে প্রায়ই কিছু কিছু লাশ তারা তুলে আনতে যাদের দেহ থেকে মাথা বিন্নি থাকতে, চোখ উপড়ানাে, হদপিন্ড বের করা অবস্থায় পড়ে থাকা বহু মানুষের লাশও তারা এখানে পেয়েছে। মােহাম্মদপুরের স্থানীয় বিহারীরা নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে বাঙালীদের ধরে এনে রাত্রে এই ফিজিক্যালের কক্ষে নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে জবাই করে হত্যা করতাে। তিনি বলেন এসব লাশের মধ্যে তারা অসংখ্য মেয়ের লাশও পেয়েছে, তাদেরকে ধর্ষণ করে নিমর্মভাবে হত্যা করা হতাে। প্রায় সর্বত্রই মেয়েদের লাশের ক্ষেত্রে একই অবস্থা লক্ষ্য করেছে।
বাঙালী সিপাহীদের দুরবস্থা একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাকিস্তানী সৈন্যদের জমায়েত বৃদ্ধি পায়। সেই সংগে বাঙালী সিপাহীদের উপর অত্যাচারও বহুলাংশে বেড়ে
________________________________________
যায়। কথায় কথায় পাকিস্তানী সিপাহীর বাঙালী সিপাহীদের পায়ের বুট,বন্দুকেরবাট দিয়ে আঘাত করতাে। সব সময় চোখ রাংগিয়ে কথা বলতাে। শাসিয়ে শাসিয়ে বলতাে, “হারামি হিন্দুকা বাচ্চা, বেঈমান শালা লােক, হাম শােক আদমী নেহী মাংতা, জমিন মাতাে, তােমার বােহেন মাতাে”। কখনও কখনও তারা বাঙালী সিপাহীদের মালপত্র তুলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিত, গলা ধাক্কা দিয়ে তাদের কোয়ার্টার থেকে বের করে দিত। এক পর্যায়ে এইসব বাঙালী সিপাহীরা কোয়াটারে জায়গা না পেয়ে আস্তাবলের বারান্দায় আশ্রয়গ্রহণ করে। তবুও তাদের উপর অত্যাচার মােটেও কমে না, বরং ক্রমেই তা বেড়ে
পাক সৈন্যরা প্রতিদিন “ইয়ে শালা লােগ মুক্তি হ্যায়, মুক্তিকা চর হ্যায়” এইসব কথা। বলে শহরের বিভিন্ন মহল্লা থেকে বাঙালী যুবকদের ধরে আনতাে।’ ধরে আনার পর তাদের উপর প্রথম দফা অত্যাচার শেষে হেড কোয়ার্টারের চার তলার নির্যাতন কক্ষে নিয়ে তালা বন্ধ করে রাখা হােত। সারাদিনে তাদের একবারও খাবার দেয়া হােতনা। গভীর রাতে তাদের উপর নেমে আসতে অবর্ণনীয় নির্যাতন। এইভাবে কয়েক দিন নির্যাতন করার পর তাদেরকে ট্রাক ভর্তি করে ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হােত । ক্যান্টনমেন্টের মৃত্যুগুহা থেকে সেইসব যুবকেরা আর কোনদিন ফিরে আসতাে না। কেননা এইসব বাঙালী ছেলে-মেয়েদের বৃদ্ধ মা-বাবাকে পুলিশ লাইনের গেটে দিনের পর দিন মাসের পর মাস সন্তানদের অপেক্ষায় ভীতবিহ্বল অবস্থায় চোখে মুখে করুণ আর্তি নিয়ে বসে থাকতে দেখা যেত। অথচ তারা কোনদিন জানতে পারতােনা অনেক আগেই তাঁদের সন্তানেরা চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে চলে গেছে।
আবদুল কুদ্স নামে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর যিনি তৎকালিন সময়ে পাক সরকারের অধীনে আটকা পড়া অবস্থার প্রেক্ষিতে দায়িত্ব পালনে বাধ্য হন। পাকবাহিনীর নারী নির্যাতন প্রসংগে তিনি বলেন, প্রতিদিন গভীর রাত্রে তারা মেয়েদের আর্তনাদ শুনতে পেতেন। সারারাত ধরে রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টারের চারতলায় বন্দী মেয়েদের উপর অত্যাচার চালানাে হােত। তাদের বুক ফাটা চিৎকারে রাতে তারা ঘুমুতে পারতেন না। সহযােগিতা করার কোন সুযােগ কিংবা উপায় তাদের ছিলনা। তিনি জানান, তারাও এক প্রকার বন্দীদশার মধ্যে প্রতিমুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনতেন। প্রতিরাতে পাকিস্তানী নরপশুরা বন্দী মেয়েদের নিয়ে অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের বিকৃত যৌন লালসা চরিতার্থ করতাে। প্রতিদিন যেসব নতুন মেয়েদের ধরে আনা হােত তাদেরকে প্রথমে পাক সেনা অফিসারদের জন্য নির্ধারিত কক্ষে নিয়ে রাখা হােত। সেখানে তাদের সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে সেনা অফিসাররা মদ পান করতাে এবং যৌন পাশবিকতা চরিতার্থ করতাে। তারপর শুরু হােত তাদের উপর সাধারণ সিপাহীদের পালাক্রমে ধর্ষণ । এসময় চারতলার সিঁড়ি বারান্দা
প্রভৃতি স্থানে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা রাখা হােত। পুলিশ হেড কোয়ার্টারের চারতলা ভবনে | বাঙালী সিপাহীদের প্রবেশের অনুমতি ছিলনা।
________________________________________
মে মাসের শেষ ভাগে বােস্তান খাঁ নামক একজন পাঞ্জাবী অফিসার রাজার বাগ পুলিশ লাইনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুলিশ লাইনে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। এ সময় বাঙালী সিপাহীদের মধ্যে ভয়ভীতি আর মৃত্যুর আতংক নেমে আসে। সর্বক্ষণ তারা একটা ভীত সন্ত্রত অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়। এ সময় প্রায় প্রতিদিনই মুক্তিবাহিনীর ইনফর্মার সন্দেহে কাউকে না কাউকে আটক করে হাত পা বেঁধে নির্যাতন শেষে ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হােত। সার্জেন্ট মুর্তজা হােসেন, সুবেদার আবুল হােসেন এবং সুবেদার আবু হােসেন নামক তিনজনকে একদিন একই অজুহাতে এখান থেকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পাক বাহিনীর অত্যাচার প্রসংগে তারা জানান, ক্যান্টনমেন্টে প্রথমে তাদের হাতপা বেঁধে লাথি মেরে মেরে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সমস্ত শরীর রক্তাক্ত করে ফেলা হয়। অবশেষে তাদেরকে জীপের পিছনে বেঁধে গাড়ী চালিয়ে হত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এই অবস্থায় তারা এক অলৌকিক উপায়ে বেঁচে যান। মুক্তি পাওয়ার পর তারা পাক বাহিনীর বিভিন্ন প্রকার নির্যাতনের বিবরণ দেন।
যুদ্ধকালিন সময়ে যশাের ক্যান্টনম্যান্ট মৃত্যুগুহায় কয়েক মাস বন্দী জীবন কাটানাের পর বিস্ময়করভাবে বেঁচে যাওয়া একজন মুক্তিযােদ্ধা জনাব কাতিবুর রহমান, যিনি বর্তমানে (১৯৯০) সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক, তিনি পাক বাহিনীর নির্যাতন প্রসংগে বহু লােমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেন। তিনি জানান, লােহাগড়া উপজেলার কুমড়ি গ্রামের বিশিষ্ট মুক্তিযোেদ্ধা বেলায়েতকে কঠোর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়।’
ললামহর্ষক নারী ধর্ষনের বিচিত্ররূপ একাত্তরের পঁচিশে মার্চ রাতে হানাদার পাক সৈন্যরা যখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে বাঙালী সিপাহীদের উপর অতর্কিত আক্রমন চালায় তখন রাবেয়া খাতুন নামে একজন পরিচারিকা সেখানে কর্মরত ছিলেন। সেই বিভীষিকাময় রাত্রি থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ের যুদ্ধকালীন নয় মাস পাক বাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে বহু মর্মস্পর্শী ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। বিশেষ করে নারী নির্যাতন প্রসংগে তিনি বিশ্বয়কর সব ঘটনার কথা জানান।
২৫ মার্চ রাতে রাবেয়া খাতুন প্রতিদিনের মতই পুলিশ ব্যারাকের কেন্টিনে কর্মরত ছিলেন। সেদিন হঠাৎ করে গােলাগুলি শুরু হওয়ায় প্রথমে তারা হকচকিয়ে যায় । অবিরাম গােলাগুলির প্রচন্ড গর্জনে সারারাত ধরেই তারা কয়েকজন ব্যারাকের ভেতরে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে। এসময় বাঙালী সিপাহীরা আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছিলাে শত্রুদের বিরুদ্ধে। তীব্র প্রতিরােধ সত্বেও পাক সৈন্যদের মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের মুখে তারা এক পর্যায়ে ছত্রভংগ হয়ে যায়। তখন পাঞ্জাবী সেনারা ব্যারাকের চারদিকে আগুন ধরিয়ে দেয়। এসময় যেসব বাঙালী সিপাহী খানসেনাদের হাতে ধরা পড়ে তাদেরকে অবর্ণনীয় ভাবে চোখে মুখে বেয়ােনেট চার্জ করে হত্যা করে। বুটের লাথি আর রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করতে
________________________________________
করতে অনেককে একত্রে জড়ো করে একসংগে গুলী করে মারে। রাবেয়া খাতুন বলেন, এসময় তাকেও কেন্টিনের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনে। একজন খানসেনা তার শরীর থেকে কাপড় খুলে নেয়। বিবস্ত্র অবস্থায় টানতে টানতে তাকে পাশ্ববর্তী একটি রুমে নিয়ে অত্যাচার শুরু করে। পর্যায়ক্রমে কয়েকজন হানাদার পশু তার উপর ধর্ষণ চালায়। এক পর্যায়ে সে হাউ মাউ করে কেঁদে কেঁদে দস্যুদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চায়। করুণ মিনতি করে সে জানায়, আমাকে মেরােনা আমি তােমাদের সকল কাজকর্ম করে দেব। একথা বলার পর একজন্য সৈন্য তাকে বলে “ঠিক হ্যায় তােমকো ছােড় দিয়া জারাবাদ তােম বাহার নেহি নেকলেগা, হারওয়াকাত লাইনপর হাজির রহেগা”, একথা বলে তাকে ছেড়ে দেয়।
পাক সৈন্যরা রাজাকার ও দালালদের সহযােগিতায় রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ এবং শহরের অভিজাত এলাকা থেকে প্রতিদিনই রূপসী মহিলা, যুবতী ও কিশােরী মেয়েদের ধরে আনতাে। লাইনে আনার পর তাদেরকে ভাগ করে মিলিটারি ট্রাকে কিংবা জিপে করে বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হােত । রাবেয়া খাতুন বলেন, একদিন কেন্টিনে কর্মরত অবস্থায় সে দেখতে পায় পাঞ্জাবী সেনারা বিভিন্ন বয়সের প্রায় পঞ্চাশজন মেয়েকে ধরে এনে ব্যারাকের একটি কক্ষে রাখে, এদের অনেকের হাতেই বই, খাতা ছিলাে। সবার চোখ দিয়ে অবিরামভাবে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। কিছুক্ষণ পরে শুরু হােল তাদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন, একদল পাঞ্জাবীসেনা কুকুরের মত উম্মত্ত উল্লাসে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের উপর । প্রথমে জানােয়ারগুলাে সমস্ত মেয়েদের পরনের পােষাক খুলে বাইরে ফেলে দেয়। উলংগ অবস্থায় সবাইকে মাটিতে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেয়, যারা নির্দেশ অমান্য করে তাদেরকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে ধর্ষণে লিপ্ত হয়।
রাবেয়া খাতুন বলেন পাঞ্জাবী সেনারা যখন বাঙালী মেয়েদের উপর এই ঘূন্যতম উপায়ে নির্যাতন করে যাচ্ছিলাে তখন সে কাজের অজুহাতে জানালার পাশ দিয়ে যাতায়াত করে সবকিছু লক্ষ্য করে। মেয়েদের হাজারাে আহাজারি, কাকুতি মিনতি যেন তাদের উল্লাসকে আরাে বাড়িয়ে তােলে। এসব মেয়েদের পশ্চিমা পশুরা কেবল ধর্ষন করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদেরকে বিভিন্ন উপায়ে নির্যাতন করে। সেদিনের অত্যাচার শেষে সে দেখতে পায়, নরপশুরা মেয়েদের বাহ, স্তন, পেট, উরু, গাল, ঘাড়, কোমর, পিঠ প্রভৃতি স্থান থেকে কামড়ে মাংস তুলে ফেলেছে। প্রতিটি মেয়ের শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছিল। কয়েকটি মেয়ের স্তন পশুরা সম্পূর্ণভাবে ছিড়ে ফেলেছিলাে। কয়েকজনকে উপরে রডের সংগে চুল বেধে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। যােনি পথে বেয়ােনেট ঢুকিয়ে তলপেট নাভী পর্যন্ত চিরে ফেলে দু’জনকে হত্যা করেছিলাে । দুটি ছােট বালিকাকে সেদিন পাঞ্জাবী পশুরা রক্তাক্ত অবস্থায় বাইরে এনে দুদিক থেকে পা ধরে টেনে ছিড়ে ফেলেছিলাে।
বাঙালী মেয়েদের উপর এই বীভৎস কুৎসিত অত্যাচারে সাধারণ পাকসৈন্য থেকে শুরু করে সকল পর্দস্থ অফিসার পর্যন্ত একসংগে অংশ গ্রহণ করতাে। যেসব মেয়ে
________________________________________
আত্মরক্ষার্থে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে তাদেরকে জীবন্ত কেটে টুকরাে টুকরাে করে বস্তায় পুরে ফেলে দিতাে। এই সব দৃশ্য দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে অনেকে সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্বেও কেবল জীবনের মায়ায় পশুদের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতাে। কিন্তু তবুও তাদের কাছ থেকে জীবন নিয়ে কেউ ফিরে যেতে পারতাে না। এমনও ঘটনা ঘটেছে যে, কোন মেয়েকে পর্যায়ক্রমে একাধিক জনে ধর্ষন করে পরে তার স্তন ছুরি দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে মাংস কেটে নেয়া হােত। যােনি পথে ছুরি চালিয়ে বুক পর্যন্ত চিরে ফেলা হােত। এইসব ঘটনার সময় পশুরা আনন্দে ফেটে পড়তাে। এতে বােঝা যেত এসব ঘটনা তারা ঘটাত কেবল বিকৃত আনন্দ উপভােগ করার জন্য। এমনও দেখা গেছে যে, কখনও কখনও একসংগে অনেকগুলাে মেয়েকে সম্পূর্ণ বিবস্তু অবস্থায় সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হােত এবং সেখান থেকে পছন্দমত তাদেরকে টেনে নিয়ে যেত। রাতেও মেয়েদের সম্পূর্ণ উলংগ অবস্থায় রুমের ভেতর গাদাগাদি করে তালা দিয়ে রাখা হােত যাতে তারা গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারে।
পাক বাহিনীর বন্দী শিবির থেকে যে সব মেয়েরা পালানাের পথ খুঁজতে কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টা চালাতে তাদের প্রসংগে বলতে গিয়ে রাবেয়া খাতুন বলেন, প্রথমে শারীরিকভাবে নির্যাতন করার পরে তাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে সারারাত বুলিয়ে রাখা হতাে। এই ঝুলন্ত অবস্থায়ও মেয়েদের শরীর নিয়ে দস্যুরা উল্লাসনৃত্যে মেতে উঠতাে। মেয়েদের শরীরের বিশেষ অংশ গুলােতে আঘাত করতাে। বেয়ােনেট চালিয়ে সােজা এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলা হতাে। ঝুলন্ত অবস্থায় স্তন কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হতাে। কেউ আবার যােনি পথে রড ঢুকিয়ে দিত, ধারালাে চাকু দিয়ে পাছার মাংস চিরে ফেলা হতাে। কারাে স্তনে মুখ লাগিয়ে দুধের বোঁটা ছিড়ে নিতে নরপশুরা। এসময় যেসব মেয়েরা চি কার করতে কিংবা বাধা দিতাে তখন তাদের লােহার রড আগুনে পুড়িয়ে যােনি পথে ঢুকিয়ে হত্যা করা হতাে। প্রতিদিন এভাবে অসংখ্য মেয়েকে তারা বিভিন্ন কৌশল প্রয়ােগের মাধ্যমে হত্যা করতাে।
প্রতিদিন বন্দী মেয়েদের মলমূত্র পরিষ্কার করার দায়িত্ব ছিল রাবেয়া খাতুনের। প্রতিদিন ভােরে সে নির্যাতন কক্ষে প্রবেশ করে বহু মেয়েকে মৃত অবস্থায় দেখতে পেতাে। সৈন্যরা এসব মৃত মেয়েদের পায়ে লােহার হক গেঁথে টেনে ময়লার ডিপােতে কিংবা মানহালের মধ্যে ফেলে দিত। রাবেয়া খাতুন জানান, এসব মেয়েদের উপকারে আসা কারাে পক্ষেই সম্ভব হতােনা, কেননা সেখানে সর্বক্ষণ কড়া পাহারার ব্যবস্থা থাকতাে। তা সত্বেও সে কয়েকজন মেয়েকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। এর মধ্যে সিদ্ধেশরীর রানু নামের একটি মেয়ে ছিলাে।
দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত পাক বাহিনী ঢাকাসহ দেশব্যাপী নারী নির্যাতন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যায় । ১৬ ডিসেম্বর মিত্র ও মুক্তি বাহিনী বীরদর্পে ঢাকা শহরে প্রবেশের পর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং সেই সংগে হাজার হাজার বন্দী মানুষের সাথে রাবেয়া খাতুনও মুক্তি লাভ করে ।
________________________________________
যেভাবে গণহত্যা অভিযানের শুরু ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা অভিযানের ওপর একটি প্রত্যক্ষ বিবরণ ছাপা হয় বাংলার বাণী পত্রিকায়। তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব নাজিমুদ্দিন মানিকের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলােকে লিখিত বিবরণটি পত্রিকা থেকে সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হল।
২৪ মার্চ ১৯৭১। রাত সাড়ে এগারােটা। অবজারভার অফিসের সামনের রাস্তা। অসংখ্য মানুষের ছুটাছুটি, কেউ ইট আনছেন, কেউ গাছ টানছেন; কেউ মােটর মেরামত কারখানা থেকে পুরাতন ভাঙা গাড়িগুলাে রাস্তায় জড়াে করছেন। সবার মুখে এক কথা, ব্যারিকেড তৈরী করাে-ওদের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করা। বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিয়েছিলেন “আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তােমরা সব বন্ধ করে দেবে” । নাজিমুদ্দিন মানিক বলেন সেই নির্দেশ তিনি নিজেও অমান্য করতে পারেন নি। ওদের সাথে ধরাধরি করে ডি আই টির রাস্তায় গাছ ফেলে রাস্তায় মুখ বন্ধ করেছেন। | অফিসে ফিরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পান হায়েনাদের একটি কনভয় এসে থমকে দাড়িয়েছে দৈনিক পাকিস্তান অফিসের সামনে। কনভয়ের সামনে বিরাট ব্যারিকেড ওরা ডিংগাতে পারছিলােনা। ওলী খাওয়া শুয়ােরের মত ঘােৎ ঘােৎ করছে কনভয়ের গাড়ীগুলাে। আরােহী পাষন্ডরা গুলি ছুড়ছে চারপাশে। অনেক কষ্টে অনেকগুলাে ব্যারিকেড সরিয়ে পথ করে এগিয়ে গেলাে সার্কুলার রােড ধরে।
তিনি বলেন, সর্বত্র বিক্ষুব্ধ নিরবতা আর শহরের চারদিক ঘিরে অবিরাম বােমা বর্ষণ । মেশিন গান, স্টেনগান, এস, এল আর, চাইনিজ আটোমেটিকের একটানা শব্দ । মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে গুলি খাওয়া মুমূর্ষ নরনারীর আর্তনাদ। অফিসার সবাই হতবাক। কারাে মুখে কোন কথা নেই কেবল বােমার একটানা শব্দ শুনছেন। সে সময় তাদের মনে হচ্ছিলাে নিজেদের হৃৎপিন্ড নিজেরাই চিবিয়ে খাচ্ছেন। অসহায় সবাই কারাে কিছুই করার নেই তখন। | তার মনে পড়ে এদিন সন্ধ্যায় শেখ সাহেব ব্রফ করছিলেন সাংবাদিকদের । চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর, রাজশাহী প্রভৃতি স্থানে জল্লাদের হামলার খবরে গর্জে উঠেছিলেন বঙ্গ শার্দুল। এক বিবৃতি দিয়ে তিনি বললেন, ‘বাংলায় আগুন জ্বলছে, এ আগুন নেভানাের সাধ্য কারাে নেই। আমার মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে, সাবধান হও জল্লাদ” । শেখ সাহেবের বাড়ীতেই তারা খবর পেলেন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া, ভুঠো, টিক্কা, পীরজাদা,ফরমান আলী, হামিদখান, খাদিম হােসেন রাজা সহ প্রভৃতির গভর্ণর হাউসে মিটিং করেছে। গুরুত্বপূর্ণ শলাপরামর্শ করেছে এই নরদস্যরা। | সে রাতে আর কোন কাজ না হওয়ায় পত্রিকাও বের হলােনা পরদিন। সারারাত অফিসে আটকা থাকলেন সবাই। জল্লাদরা কারফিউ জারি করেছে। পরদিনও একই অবস্থা, তবে বােমার আওয়াজ কমেছে কিছুটা। কিন্তু গুলির আওয়াজ থামেনি। থামেনি
________________________________________
আবাল বৃদ্ধ বনিতার আর্তনাদ। স্থানে স্থানে আগুন জ্বলছে। স্বদেশেও যারা মােহাজীর সেসব মুজুর আর কুলিদের বস্তিগুলাে জ্বালিয়ে দিচ্ছে জল্লাদের দল।
২৬ মার্চ সকাল নটায় ঢাকা বেতার থেকে একজন উর্দুভাষী ভাঙা বাংলায় এলান করেন, “টিকা ঢাকা শহরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কার্য দিয়েছে ও ইত্যাদি ইত্যাদি আইন জারি করেছে। এই ঘােষণার কয়েক মিনিট পরই পাক বাহিনীর একজন অফিসার, মেজর সিদ্দিক সালিক এক পরােয়ানা হাত হাজির হলেন পূর্বদেশ অফিসে। তার দাবিগুলাে বাংলায় অনুবাদ করে ছাপাতে হবে। সংগে ষ্টেন ধারী তিন পাষন্ড সেনা। পরে সে প্রচার পত্র আর ছাপা হয়নি। এদিন অজানা এক ষ্টেশন থেকে তারা শুনতে পান “আমার সােনার বাংলা” গানটি একটানা বেজে চলেছে।
নাজিমুদ্দিন মানিক বলেন, ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত একটানা আটকা পড়েছিলাম পূর্বদেশ অফিসে। ২৬ মার্চ সকাল দশটার দিকে রেডিও থেকে জনৈক উর্দুভাষী সেই ভাঙা বাংলায় ঘােষণা করে যে, ১২ টা পর্যন্ত কারফিউ সিথিল করা হয়েছে। এই ঘােষণার পর আটকে পড়া মানুষেরা স্ব-স্ব গৃহের দিকে উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটলাে। রাস্তায় বেরিয়ে তিনি দেখলেন দখলদার বাহিনীর সৈন্যবাহী লরী আর জীপ ছাড়া আর কোন যানবাহনই নাই। নগরীর রাস্তাঘাট জনমানব শূন্য। মতিঝিল থেকে রায়ের বাজার দীর্ঘ কয়েক মাইলের মধ্যে কোন যানবাহন দেখতে পাওয়া গেলনা ।।
রাস্তায় ঘরেফেরা মানুষের সেকি উৰ্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলা। কারাে দিকে কারাে তাকাবার পর্যন্ত ফুরসত নাই। যে যার মত নিজের জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। থেকে থেকে পাষন্ড সেনাদের বিশাল গাড়ীগুলাে ছুটে চলছে রাস্তার দু পাশ কাঁপিয়ে । প্রতিটি গাড়ির উপর পজিশন নিয়ে বসে আছে চারদিক তাক করা হেলমেটধারী সৈনিকেরা মেশিনগান আর কামান সজ্জিত অবস্থায় । ওদের মহড়া দেখ আতংকিত অবস্থাতেও হাসি পেল তার। কার বিরুদ্ধে এই সতর্কতা । এদেশের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে শ্রেষ্ঠ সেনা বাহিনীর দাবিদারদের! তার কাছে হাস্যম্পদ বলে মনে হয়।
পত্রিকা অফিস থেকে বেরিয়ে উপােসী ক্লান্ত দেহটাকে নিয়ে তিনি যখন ন্যাশনাল কোচিং সেন্টারের কাছে এলেন তখন তার সংজ্ঞা লােপ পাবার অবস্থা। সেন্টারের সামনেই কয়েকটা মানুষের লাশ, গুলির আঘাতে বুক ঝাঝরা হয়ে গেছে। পাশেই ছিটকে পড়ে আছে কিছু নাড়িভুড়ি। দু-চোখ বন্ধ করে পাশ কাটাতে চাইলেন। পা এগুচ্ছেনা, থরথর করে কাঁপছে। সেই অবস্থায় এগিয়ে চললেন তিনি। বায়তুল মােকাররমের মােড়ে এসে আরাে দুজন বাঙালীর মৃতদেহ দেখলেন। জিপিওর গেটে দেখতে পেলেন পড়ে আছে এক ঝুড়ি নাড়িভুড়ি ও রক্ত। এই অবস্থায় মৃত লাশের মধ্যে দিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন, কেননা বাঁচার আকাংখায় সবাই তখন ভীত সন্ত্রস্ত। রাস্তায় পড়ে থাকা এই লাশগুলাে দেখার পরে তার অবচেতন মনে বার বারই ঐ দৃশ্যগুলাে ফুটে উঠতে থাকলাে। পুরানাে পল্টন মােড় হয়ে সচিবালয়ের ফুটপাতে উঠে এলেন তিনি। ক্যান্টন
________________________________________
রেষ্টুরেন্টের বিপরীতের ডাষ্টবিনে দেখলন আরাে কয়েকটি লাশ পড়ে আছে যা জল্লাদ বাহিনীর উন্মত্ত পাশবিক শক্তির শিকার। | প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে এগােতেই দেখতে পান ক্লাবের পশ্চিমে পাক পশুদের ছাউনি। রাস্তা জুড়ে জল্লাদের দল। বিপর্যস্ত আর আতংকগ্রস্থ অবস্থায় তিনি হাই কোর্টের সামনে দিয়ে রমনার রেসকোর্সের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। এ সময় তার মনে পড়ে ৭ মার্চের স্মৃতি। এই রেসকোর্সে দাড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা দিয়েছিলেন “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” তার চোখের সামনে ভেসে উঠলাে একটি বিরাট মঞ্চ। সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। লক্ষ লক্ষ মানুষের যেন এক মহা জনসমুদ্র। তিনি সেই সমুদ্রের মাঝ দিয়ে আজ হাঁটছেন, এসময় তার মনে পােড়ল সকালের বিবিসির খবরের কথা। বিবিসি বলেছে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, মুক্তিবাহিনী গঠিত হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধার গোপন বেতার থেকে স্বাধীনতার কথা ঘােষণা করেছে বিবিসি তারও উদ্ধৃতি দিয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা গােপন বেতার থেকে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে রয়েছেন। খবরটা শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অবশ্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই খবরটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। এটা করা হয়েছিল কেবল বাঙ্গালীদের মনােবল অটুট রাখা জন্য। | রেসকোর্স, হেড়ে শাহবাগ পেরিয়ে কাটাবন বস্তির পাশ দিয়ে এগােতে থাকেন তিনি। বস্তির চারপাশে চাপ চাপ রক্ত। এখানেও কয়েকটি ব্যারিকেড তিনি দেখতে পান। সামনের রাস্তায় নর্দমায় একটি রক্তের নহরও চোখে পড়ল ড্রেনে জমে থাকা রক্ত স্রোত থথ করছে। কত আদম সন্তানের বুকের রক্ত ঢেলে এই নহর সৃষ্টি করা হয়েছে কে জানে। কাঁটাবন বস্তির কতজন বীরবন্ধ সেদিন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন কি নাম তাদের? নিজের দেশে মােহাজের এসব বীর পুত্রদের পৈত্রিক ভিটেই বা কোথায় ছিল?
পুরনাে রেল লাইনের অর্থাৎ মহসিন হলের পেছনের বস্তিগুলাে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা হয়েছে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সবকিছু। কজন এখানে মরলাে কে জানে। এলিফ্যান্ট রােডের সংযােগ স্থলে তিনি দেখলেন পাষন্ডরা সেখানে টহল দিচ্ছে। হঠাৎ একটি বিক্ষুব্ধ কাঠ পেছন থেকে শুনতে পান, সে যেন স্পষ্ট বাংলায় বললাে, শালারা আমরাতাে গেছি, তােদের দিনও শেষ আর বেশী বাকী নাই”। বুঝলাম কোন বাঙালী নিজেকে বাঁচানাের জন্য ওদের সাথে টহলে এসেছে একান্ত অনিচ্ছায়, ওর কথাগুলাে তার পাঞ্জাবী সহকর্মীদের উদ্দেশ্য করেই। সেই বাঙালী সৈনিকটি আজ কোথায় কে জানে। | সাইন্স ল্যাবরেটরীর কাছে এসে তিনি শুনলেন পাশের বাড়ীতে কয়েকটি লাশ পড়ে আছে। বাড়ীর ভেতরে ঢুকে তাদের হত্যা করা হয়েছে। কার্য শিথিলের ঘােষণার পর তিনি দেখলেন রাস্তায় যেন মানুষের মিছিল নেমেছে। হাজার হাজার মানুষ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাচ্ছে। কারাে মুখে কোন কথা নেই। কোলে বাচ্চা, পিঠে বােচকা পােটলা, হাতে ধরা পুত্র কন্যা বা পত্নীর হাত। শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে সবাই। তাদের ধারণা গ্রামে
________________________________________
গেলে হয়তাে বাঁচা যাবে। কিন্তু পরে তাদের সেই ধারণা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। পাক দস্যুরা যুদ্ধের শেষের দিকে গ্রামেই ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়েছে বেশি। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মধ্যে ৩০ হাজা গ্রামকেই টিকা, ইয়াহিয়ার নরখাদকেরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে।
রায়ের বাজার নদীর ধারে গিয়ে তিনি দেখতে পান এক মর্মান্তিক দৃশ্য। প্রাণভয়ে মানুষ পালাচ্ছে। দুঃসময়ে মানুষ কত অসহায়, কত কষ্ট স্বীকার করতে পারে এটা তারই প্রতিচ্ছবি। কাধে, কোমরে, হাতে ছােট ছােট বাচ্চা, পােটলা পুটলীসহ এক কোমর পানি ভেংগে নদী পার হচ্ছে হাজার হাজার নরনারী। প্রাণ বাঁচানাের আকুল চেষ্টায় ইজ্জতের দিকে খেয়াল নেই কারো। যেসব গৃহ বধুদের সেদিন রাস্তায়, নদীতে এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখা গেছে তাদের অনেকেই হয়ত কোনদিন সূর্য পর্যন্ত দেখেছে কিনা সন্দেহ। অনভ্যস্ত পদে হাঁটতে গিয়ে তারা কত যে আছাড় পিছাড় খাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। কারাে পা ভাঁছে কারাে নথ উল্টে যাচ্ছে। কিন্তু তাতেও দ্রুক্ষেপ নেই। খেয়াল শুধু সামনে এগােবার।
বিকেল চারটা বাজার সংগে সংগে দস্যু হানাদাররা অলিগলিতে ঢুকতে শুরু করে। চারটে কয়েক মিনিটে তিনি নদীর কুলে গুলির আওয়াজ শুনতে পান। পরে জেনেছিলেন, যে সব মানুষ শহর ছেড়ে পালাচ্ছিল তাদেরকে পেছন থেকে গুলি করে মারা হয়েছে। কতজন সেদিন এখানে শহীদ হয়েছিল তার হিসাব কেউ কোনদিন জানবেনা। কোন ইতিহাসও তাদের কথা কেউ লিখবেনা।
সন্ধ্যায় ঘরে বসে নাজিমুদ্দিন মানিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ধরার চেষ্টা করে সফল হলেন। সেই প্রথম তিনি শুনতে পেলেন ঐ বেতারের খবর, সে কি উৎকণ্ঠা, সে কি উৎসাহ আর আনন্দ। ঘােষক ঘােষণা দিয়ে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ভােরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। তিনি নিরাপদে আছেন। মুক্তিবাহিনী শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরােধ চালিয়ে যাচ্ছে রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে, সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনছার বাহিনীর বাঙালী সিপাহী বিদ্রোহ ঘােষণা করে বীরত্বের সংগে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে রাত বেড়ে প্রায় ১১টা। তিনি জানান এ সময় তার বাসার সামনের বস্তিতে দস্যুরা প্রবেশ করে। বাড়ীগুলাে ছিলাে কুমাের আর রিক্সাওয়ালাদের। একজন রিক্সাওয়ালার ঘর থেকে দস্যুরা দু’জন তরুনীকে ধরে নিয়ে গেল। তিনি মনে মনে ভাবেন, মুসলিম ধর্মের ধ্বজাধারী ইয়াহিয়া, টিক্কা, ভুঠোর হানাদার বাহিনীর হাতে আজ এমনি কত মুসলমান নারীর ইজ্জত লুষ্ঠিত হবে কে জানে। কুমােরদের ঘরে ঢুকে ওরা সবাইকে টেনে টেনে ঘরের বাইরে আনে। এখানেও তারা দুজন গৃহ বধুকে ধর্ষন করে তাদের পিতা-স্বামীর সামনে। একজন জল্লাদ বহর দেড়েকের একটি দুধের বাচ্চাকে মায়ের বুক থেকে টেনে নিয়ে তার কচিবুকে সুতী বেয়ােনেট ঢুকিয়ে দেয় এবং সে অবস্থাতেই সবার সামনে কিছুক্ষণ বুলিয়ে রাখে। বাসার পেছনের চোরাগলি পথে দাঁড়িয়ে তিনি এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখছিলেন। কুমােরদের ঘরের
________________________________________
আংগীনায় ছিল তাদের হাড়ি পােড়ানাের বিশাল অগ্নি কুন্ড। এটা দেখে তারা সবাইকে জিজ্ঞেস করে ওটা কি? কুমােররা উর্দু জানেনা বলতেও পারে না-তা সত্ত্বেও তা বােঝাতে চেষ্টা করে, হুজুর এটা আমাদের হাড়ি-পাতিল পােড়ানাের কুন্ড। একবর্ণও বাংলা না জানা অথচ বাঙালী দরদের দাবিদার খানসেনারা চিৎকার করে বলতে লাগলাে, “সালালােক ঘরকা আন্দার এত বড় বাংকার বানায়া হ্যায়, কেতনা মুক্তি যােদ্ধা হ্যায় হিয়া, পার
তাও কেনা যায় তেরা ধর”। কুমাের যত বােঝাতে চেষ্টা করে ততই বাড়ে তাদের প্রতি নির্যাতন আর মারধাের।
তিনি চোরা পথে এসব দৃশ্য দেখছিলেন আর ভাবছিলেন যদি দস্যুরা তার বাসায় ঢােকে। বাসায় রয়েছে বৃদ্ধা নানু, ৪ বাচ্চা ও স্ত্রী। নানু সন্ধ্যা থেকেই কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। এসময় সবাইকে নিয়ে সেই চোরা পথে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি, উদ্দেশ্য যদি ওরা প্রবেশ করে তাহলে গেট ভাংগার আগেই চোরাপথে পেছনের এদোকাদা পুকুরে ‘নেমে যাবেন। অন্ততঃ বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে। আঁৰশেষে দস্যুরা আর তার বাসায় প্রবেশ করেনি।
| সেদিন জল্লাদেরা কয়েকশ’ মানুষকে রায়ের বাজারে হত্যা করেছিল। পটারী পাশে দাঁড় করিয়ে ।
তিনি ঠিক করলেন যে, রায়ের বাজার এলাকায় আর নয়। তিনি বেরিয়ে পড়লেন। যাবার পথে রায়ের বাজারের মােড়ে দেখতে পেলেন একটা গাড়ীতে দু’জন বিদেশী, ওরা তাকে কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে তা জানতে চাইলেন। তিনি রাতের ঘটনা তাদের জানালেন। এ দুজনই ছিল বৃটিশ সাংবাদিক। বিধ্বস্ত ঢাকাকে দেখতে বেরিয়েছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে হত্যাকান্ড বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তান বিরােধী যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিলাে এবং তীব্র প্রতিরােধের মাধ্যমে যে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলেছিল এদেশের মানুষ তার মুল নেতৃত্ব দিয়েছিলাে এদেশের ছাত্র সমাজ। এই ছাত্রসমাজের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সংগত কারণেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ছিলাে পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠির প্রথম থেকেই। আক্রমনের লক্ষ্যস্থল হিসেবে তারা এ স্থানকে বিবেচনা করেছে এবং সেই অনুযায়ী ২৫ মার্চ পাক বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় সহ তৎসংলগ্ন হলসমূহে আক্রমন চালায়। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান রেখেছিলাে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই কেবল নয় বরং সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষে কাছে তা এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রেরণা যােগাবে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান দুর্গ বলে পরিচিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল। পরবর্তীতে এই ইকবাল হলে পঁচিশে মার্চ পাক বাহিনীর আক্রমনের এবং ছাত্রদের
________________________________________
প্রতিরােধ সম্পর্কে দু’টি প্রতিবেদন ছাপা হয় দৈনিক আযাদ পত্রিকায়। প্রতিবেদন দুটির সংক্ষিপ্ত সার এখানে তুলে ধরা হল।
২৫ মার্চ একাত্তর । রাত্রি প্রায় ১ টা। পাক বাহিনী অক্টোপাশের মত ঘিরে ফেলে ইকবাল হলের চারিদিক। তারপর শুরু হলাে হানাদার বাহিনীর আক্রমন। অন্ধকারের বুক চিরে ছুটছে বুলেট। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের ভয়াল গর্জনে সমস্ত এলাকা কম্পমান। কামান, গ্রেনেট, মেশিন গান থেকে কেবলি আগুন বিস্ফোরিত হচ্ছে। ঘরের দেয়াল ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে অগ্নি কুন্ডুলি।
ইকবাল হলের ছাদে অবস্থানকারী তরুনেরা বীরদর্পে প্রতিরােধ চালিয়ে যাচ্ছে। থ্রী নট প্ৰী রাইফেলের আওয়াজ শত্রু বাহিনীর তীব্র আক্রমনের মুখে যেন, নিতান্তই অসহায়। শত্রুর আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমেই হিস হিস শব্দে ছড়িয়ে পড়ছে হলের ভেতর। এসেম্বলি হল ও পাঠাগারে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। পাশে রেল সড়কের বস্তিগুলাে জুলছে। সেই সাথে ওদিক থেকে ভেসে আসছে মৃত্যু যন্ত্রণাকাতর মানুষের আর্তনাদ-বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার। বিচিত্র এক ভৌতিক পরিবেশ চারদিকে। সারা নগরী যেন আগুনে জ্বলছে। সেই সংগে বিচিত্র ধরণের সব অস্ত্রশস্ত্রের গর্জনে পুরাে এলাকা হয়ে উঠেছে বিভীষিকাময় । হল গ্যারেজের ছাদে শুয়ে প্রতিরােধ করে যাচ্ছে জিনাত আলী, তারেক, আঃ রউফ ও তার ছােট ভাই জগন্নথের ছাত্র মােয়াজ্জেম। মৃত্যুর হিমশীতল অপেক্ষা নিয়ে লড়ে যাচ্ছে তারা, মাথার উপর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে যাচ্ছে বুলেটের মিছিল। এর মধ্যেও স্বাধীনতার মহান সৈনিক তারেক দায়িত্ব পালনে একনিষ্ঠ । গড়িয়ে গড়িয়ে সে ছাদের এপাশ ওপাশ করে শত্রুরা অবস্থান লক্ষ্য করছে। তথন শত্রুরা হলের ভেতর প্রবেশ করতে সাহস করেনি। দূরে দাঁড়িয়ে ঝাক ঝাক বুলেট ছুড়ছে। এর মধ্যে আলাের ঝলকানি দিয়ে শত্রু বাহিনীর ট্যাংক এসে থামে পলাশীর মােড়ে । বিকট শব্দে প্রকম্পিত করে ট্যাংক থেকে শুরু হয় গােলা বর্ষণ। এমন শব্দ এর আগে তারা শুনেনি কখনও। এসময় তাদের মনে হয় এই প্রবল অগ্নিঝড়ের গােলাগুলির আবেষ্টনির মধ্যে কি করবে মাত্র চারজন প্রতিরােধকারী তরুন। বেরিয়ে যাবারও কোন পথ নেই। মৃত্যু ওদের অক্টোপাশের মত ঘিরে ফেলেছে। | ইকবাল হলে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে রেল সড়কের বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে পশুরা। ঝাকে ঝাকে বস্তিবাসী মানুষ পাচিল ডিংগিয়ে পালানাের চেষ্টা করছে আর সেই সাথে শক্রর ঝাক ঝাক বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়ছে তারা। স্বদেশের মাটিতে ভিনদেশী হায়নার হাতে কি মর্মান্তিক এই মৃত্যু।
ক্রমেই মানুষের আর্তনাদ চিৎকার বাড়তে থাকে। মৃত্যুর যন্ত্রণাকাতর ধ্বনী বাতাসে কেবলই প্রতিধ্বনি হতে থাকে। ঢাকা নগরী যেন আজ এক রাক্ষস পুরী। পিশাচ দেবতার অর্চনা চলছে যেন এখানে। পশ্চিম পাকিস্তানী রাক্ষসদের সমারােহ নরমাংস ভােজনাে ৎসব। হিংস্রতার এক নজীর বিহীন ইতিহাস গড়ে তুলেছে তারা।
________________________________________
২৫ মার্চের ভয়াল বিভীষিকাময় কালরাতের অবসান হলাে। কিন্তু প্রতিদিনের মত আজ আর ভােরের পাখী দিগন্ত মুখরিত করে ছাব্বিশের প্রভাতকে স্বাগত জানালাে না। সকাল হলাে নিস্তব্ধ শশাকে মুহ্যমান শশান নগরীতে এক মৃত্যুপুরীর মত। কিন্তু বিভীষিকার অবসান হলােনা। বরং ইতিহাসের নজীর বিহীন হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নি সংযােগ, ধ্বংস আর অত্যাচার নিপীড়নের এখানেই শুরু হলাে।
২৬ মার্চ সান্ধ্য আইন জারি করেছে হানাদার বাহিনী সমস্ত দিন ধরে। কারন গতকাল যে হত্যাযজ্ঞ তারা চালিয়েছে তা জানাতে চায় না বিশ্ববাসীকে। ভাের হবার সাথে সাথে শােকে মুহ্যমান হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচাবার তাগিদে শহর ছেড়ে ছুটে যাচ্ছে গ্রামের দিকে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ইকবাল হল এবং তার আশে পাশে যারা। হত্যাযজ্ঞের পরও বেঁচে ছিলাে তারাও বেরিয়ে আসছে ফাক ফোকর দিয়ে । রাতে হানাদারেরা হলে প্রবেশ করে সমস্ত জ্বালিয়ে দিয়েছে। যাদের পেয়েছে তাদেরকে হত্যা করেছে নির্মম উপায়ে । হলের সামনে সবাইকে সারি দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাস টেনে তাতে পেট্রোল জ্বেলে অগ্নিসংযােগ করেছে। অথচ বড় বিস্ময়কর ভাবে বেঁচে গেছে তারেক, জিন্নাত, রফিক, মােয়াজ্জেম। গ্যারেজের ছাদেই তারা সারা রাত কাটিয়ে দিয়েছে। বেঁচে গেছে আর একটি ছেলে। বিচিত্র উপায়ে সে গায়ে লেপ জড়িয়ে দেয়ালের পাশে পড়ে ছিলাে। হানাদাররা অনেকবার তারপাশ দিয়ে খট খট শব্দে আসা যাওয়া করেছে। খুনের নেশায় মাতাল খুনিরা তা বুঝতে পারেনি। চম্পার মা রেল বস্তীর বাসিন্দা। তার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল দুজন ছাত্র। সে তাদের কথায় জড়িয়ে সারারাত দরজায় বসে পাহারা দিয়েছে। বেঁচে গিয়েছিলাে এ দুজন ছাত্র। কিন্তু বাঁচতে পারেনি ইয়ার্ড জলিল। চম্পার মায়ের সামনেই সে গুলি খেয়ে ছট ফট করে মরেছে। এই মৃত্যুর ছােবল থেকে বেঁচে রইলাে কেউ কেউ ভবিষ্যৎ-এর সাক্ষী হয়ে।
চম্পার মায়ের কাছ থেকে আরাে একটি ঘটনার কথা জানা যায়, ভােরের দিকে পাশের ঘর থেকে সে মা মা ডাক শুনতে পায়। চম্পার মা ভাবে মৃত্যু পথযাত্রী বােধ হয়। কাছে গিয়ে দেখতে পায় জীবিত দুটি ছেলে, তারা তাকে হা করে জীভ দেখায়, সে বুঝলাে ওরা পানি চায়। কিন্তু পানি আনার কিছুই নেই তখন। চম্পার মার মাতৃহৃদয় মােচড় দিয়ে ওঠে, সে কল চেপে আচঁল ডিজিয়ে ছেলে দুটির মুখে দেয়, তারা আঁচল থেকে পানি চুষে খেয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়, যাবার আগে তারা বলে যায়, তুমি আমাদের মা, যতদিন বেঁচে থাকবাে তােমার কথা মনে থাকবে। চম্পার মা জানেনা সেই ছেলে দুটি আজ বেঁচে আছে কিনা।
ইকবাল হল থেকে বেরােতেই সামনে ছিল খালেকের পান দোকান। খালেক রাতেই পালিয়ে গিয়েছিল। দোকানে ছিল তার কর্মচারী কিশাের ইউসুফ। বাইরে থেকে তালা দিয়ে সে ঘরের মধ্যেই ছিল। সারারাত সে হানাদার সেনাদের কথাবার্তা শুনেছে। ইকবাল হলের নৃসংশ হত্যাকান্ডের আরেক সাক্ষী এই ইউসুফ।
২৬ মার্চের ডােরে ইকবাল হলের যেখানেই দৃষ্টি পড়ে সেখানেই দেখা যায় শুধু লাশ আর লাশ। এদেশের বীর সন্তানদের লাশ। দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রথম
________________________________________
সারিতেই তারা শহীদের স্থান দখল করে নিল। এখান থেকেই শুরু হলাে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল আক্রমন । সেইসাথে পাকবাহিনীর হত্যাকান্ডের যাত্রা।
ক্যান্টনমেন্টে বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতা। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় তিনশাে কিলােমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত বাংলাদেশের সীমান্ত শহর যশাের। নানা দিক থেকে এ জেলার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দেশের একটি অন্যতম প্রধান সেনাশিবির অবস্থিত এবং সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে যশােরের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের শুরুতে অর্থাৎ ২৫ মার্চের পরপরই যশাের ক্যান্টনমেন্টের বিশাল সৈন্যবাহিনীর সংগে যশােরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত হাজার হাজার ছাত্র জনতা সার্বিক প্রতিরােধ সৃষ্টি করে যে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাে তা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। যুদ্ধের পুরাে নমাস পাকবাহিনী বৃহত্তর যশােরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চালিয়েছে তাদের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষন আর জ্বালাও পােড়াও অভিযান। পাশাপাশি এই অঞ্চলের বীর মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিহত করেছে হানাদার বাহিনীর আগ্রাসী তৎপরতা।
যুদ্ধকালিন সময়ে যশােরে পাক বাহিনীর হাতে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন এবং তাদের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষম করেছেন এমন কয়েকজনের বর্ণনা এখানে তুলে ধরা হলাে। ডাঃ আহাদ আলী খান তাদেরই একজন। স্থানীয় এই বিশিষ্ট চিকিৎসককে পাক বাহিনী গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে তিনি সহ্য করেন অবর্ণনীয় অত্যাচার।
একাত্তরের ১৭ জুলাই পাক সৈন্যরা ডাঃ আহাদ আলী খানকে তার চেম্বার থেকে গ্রেফতার করে। স্থানীয় সার্কিট হাউসে নিয়ে যশাের ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। প্রথমে তার উপর শারীরিক নির্যাতন চালানাে হয়। নির্যাতনের ফলে তার জ্ঞান হারিয়ে যায়। এক সময় জ্ঞান ফিরলে একজন মেজরের সামনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর রাতে একটি হােয় খুপরি ঘরে রাখা হয় এবং সেখানে তাকে কোন খাবার দেয়া হয়না। এমনকি পানিও না। বাথরুমে যেতে চাইলেও তাকে মারধাের করা হয়। | ১৮ জুলাই একজন মেজর তাকে বলে যেহেতু তুমি খুরশিদ আনােয়ারের মেয়েকে চিকিৎসা করেছিলে সেহেতু তােমাকে একেবারে মেরে ফেলা হবেনা। সন্ধ্যায় তাকে একমুঠো পচা ভাত দেয়া হয় এবং সেই সাথে মাত্র দুই আউন্স পানি। ১৯ তারিখেও একই অবস্থা। ২০ জুলাই পুনরায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একজন মেজরের কাছে হাজির করা হয়। এই জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে প্রচন্ড মারধাের করা হয় । ৩১ জুলাই পর্যন্ত তাকে নিয়মিত দুবেলা মারধাের করা হতাে। প্রতিদিন মাত্র পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হতাে পায়খানা, প্রসাব ও গােসল প্রভৃতি কাজের জন্য। সময়ের হের ফের হলে পেছন থেকে শুরু হতাে বেত মারা। প্রতিদিন খাবার পানি বরাদ্দ মাত্র দুই আউন্স। অতিরিক্ত
________________________________________
পানি চাইলে দস্যুরা দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে দিতাে। এ সময় অন্যান্য যারা ছিল তাদের মধ্যে নড়াইল কলেজের অধ্যক্ষ মােয়াজ্জেম হােসেন, ডাঃ মাহবুবুর রহমান, আজিজুল হক, বদরুল আলমের নাম উল্লেখযােগ্য।
ক্যান্টনমেন্টে থাকাকালীন সময়ে তিনি প্রতিদিন দেখতে পেতেন রাত্রি ৯টার দিকে বশীদের মধ্যে থেকে দশ পনেরাে জন করে চোখে কালাে কাপড় বেধে নিয়ে যাওয়া হােত এবং তাদেরকে জবাই করে হত্যা করা হতাে। দিনের বেলা সন্দেহ ভাজন লােকদের ধরে এনে পা উপরে বেধে ঝুলন্ত অবস্থায় পিটিয়ে হত্যা করা হতাে। এইসব বন্দীদের মলদ্বার দিয়ে বেয়ােনেট ঢুকিয়ে দেয়া হতাে। আবার অনেককে তথ্য আদায়ের নামে পেছন দিয়ে বরফ খন্ড ঢুকিয়ে দিত। এধরণের অমানবিক অত্যাচারের নির্মম শিকার ছিলেন বাগআচড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সবার সামনেই পাক সৈন্যরা বিভিন্ন কৌশলে প্রতিদিন বন্দীদের নির্যাতন চালাতাে। অনেক সময় এই নির্যাতন কালিন সময়েই অনেকে মৃত্যুবরন করতাে। নির্যাতনের একটি কৌশল ছিলাে। বন্দীদের ঝুলন্ত অবস্থায় বেঁধে ইলেকট্রিক সক প্রয়ােগ করা এবং হাত পায়ের নখে লৌহ শলাকা ঢুকিয়ে দেয়া।
বিভিন্ন সময়ে সৈন্যরা বাইরে থেকে মেয়েদের ধরে আনতাে। এসব মেয়েদের কারাে কারাে সংগে কচি দুধের বাচ্চাও থাকতাে। এইসব শিশুকে সৈন্যরা মায়ের বুকে বসিয়ে বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করতাে। তারপর সেই সব মায়েদের উপর ধর্ষণে লিপ্ত হতাে পশুরা। কখনও কখনও পাকবাহিনী বন্দীদের কাছ থেকে জোর করে “পাকিস্তানে ভালাে আছি” একথা বলিয়ে তা রেকর্ড করতাে, তারপর দেখা যেত সেই বন্দীকে তখনি হত্যা করতাে। কোন কোন বন্দীকে সৈন্যরা হাত পা বেঁধে ছাদের উপর তুলে নিয়ে সােজা নিচে ছেড়ে দিতাে। আবার কখনাে দেখা যেত কাউকে শারিরীকভাবে নির্যাতন না করে ধারালাে অস্ত্র দিয়ে শরীর থেকে হাত কিংবা পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। যেসব পাকিস্তান অফিসার এই অমানবিক কর্মকান্ডে সিপাহীদের উৎসাহ যােগাতে তাদের মধ্যে কর্নেল সামস্ ও মেজর বেলায়েতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। এই দুই পাক পাষন্ড অফিসার আবার মেয়েদের উপরও বিভিন্ন কৌশলে অত্যাচার চালাতাে। এরা স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধরে ধর্ষন করতাে। প্রতিদিনই ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে এবং শহরে আকশ্বিক অভিযান চালিয়ে বহু মেয়েকে এরা ধরে আনতাে। ধরে ধর্ষন করতাে।
মহেশপুরের ধ্বংসলীলা, ধর্ষন ও হত্যাকান্ড প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ চুরাশী পূর্ব অবিভক্ত বৃহত্তর যশাের জেলার একটি মহকুমা ছিলাে ঝিনেদা যা বর্তমানে একটি জেলা। এ জেলার একেবারে সীমান্ত ঘেষা একটি উপজেলার নাম মহেশপুর । এই উপজেলার একজন অধিবাসী দেবশীষ দাস। যিনি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে তার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। এখানে তার কথা তুলে ধরা হলাে।
________________________________________
মহেশপুর থানা থেকে হাসপাতালের দূরত্ব মাত্র কোয়াটার মাইল। এখান থেকে একটি কাঁচা রাস্তা বর্ডার পর্যন্ত গিয়েছে। হাসপাতালটি পূর্ব পশ্চিমে লম্বা। হাসপাতালের সামনে একটি খেলার মাঠ, পূর্বে মুচিবাড়ী, পশ্চিমে বাজার, উত্তরে সরকারী রাস্তা এবং ঐ রাস্তার উপরে পুল, পুলের নীচে নদী। ‘৭১ সালে পাকসেনারা যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে কালীগঞ্জ, কোটচাঁদপুর ও খালিশপুর হয়ে মহেশপুরে চলে আসে। এখানে এসে তারা। হাসপাতালে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং সৈন্যদের কিছু অংশ থানায় অবস্থান নেয়। এখানে ঘাঁটি স্থাপনের পরপরই তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী ও হিন্দুদের বাড়ী ঘর। জ্বালিয়ে দিতে আরম্ভ করে। এই কাজে সহযােগিতা করে স্থানীয় মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামীর লােকজন। বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দেয়া ছাড়াও তারা বাড়ী বাড়ী থেকে মালামাল লুট করে। এসময় তারা যাকে সামনে পায় তাকেই হত্যা করে। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাকীরা ঘর বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকে। পাক সৈন্যরা হাসপাতালের একটি কক্ষে আটক রেখে নির্যাতন চালাতাে। মহেশপুরে পাক সৈন্যদের প্লাটুন কমান্ডার ছিলাে মেজর আনিছ খান। সৈন্যরা মহেশপুর, কোট চাঁদপুর, কালীগঞ্জ বারােবাজার, খালিশপুর, চৌগাছা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে লােকজন ধরে আনতাে। ধৃত লােকদের অনেককে সংগে সংগে গুলি করে মারা হােত। আবার কাউকে নির্যাতন কক্ষে বন্দী করে রাখা হতাে। সেখান থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েক জন করে বের করে নিয়ে হাসপাতাল থেকে সামান্য দূরে তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে তারপর তার মধ্যে তাদেরকে দাঁড়করিয়ে গুলি করতাে। তারপর অর্ধমৃত অবস্থায় তাদের মাটি চাপা দিয় রাখা হতাে। আবার কোন কোন দিন বন্দীদের ‘গর্তের মধ্যে চিৎ করে শুইয়ে সােজা জবাই করা হতাে। কখনাে বেয়ােনেট চার্জ করে মারা হতাে।
পাক বাহিনীর এই জ্বালাও পােড়াও অভিযানে সহযােগিতা করতে স্থানীয় দালাল ও রাজাকার বাহিনী। যেদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে অধিক সংখ্যায় মানুষ ধরে আনা হতাে, সেদিন বন্দীদের দিয়ে একটি বৃহৎ গর্ত খােড়ানাে হতাে। তারপর সেই গর্তে তাদের লাইন ধরে শুইয়ে তার উপর বাবলার কাটা বিছিয়ে জীবন্ত অবস্থায় তাদের মাটি চাপা দেয়া হতাে। পাক সৈন্যরা আরাে যেসব অভিনব উপায়ে মানুষ হত্যা করতাে তার মধ্যে একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যেদিন তারা শক্ত সমর্থ যুবকদের ধরে আনুতে সেদিন হাসপাতালের ভেতর রেখে তাদের শরীর থেকে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত শুষে বের করে নিত এবং যতক্ষণ না তারা মৃত্যুবরন করতাে ততক্ষণ সেখানে ফেলে রাখা হতাে।
পাকবাহিনী বিভিন্ন গ্রাম থেকে জামাত ও রাজাকার সহকর্মীদের সহযােগিতায় কিশােরী, যুবতী ও গৃহবধুদের ধরে আনতাে। এইসব মেয়েদের উপর তারা বিভিন্ন কৌশলে পাশবিক অত্যাচার চালাতাে। একদিন ভারতগামি একদল শরনার্থীকে হত্যা করে তাদের মধ্যে থেকে প্রায় ১৫ জন যুবতী-কিশােরী মেয়েকে তাদের পরনের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলংগ অবস্থায় কয়েক মাইল হাঁটিয়ে মহেশপুর নিয়ে আসে। এখানে এইসব মেয়েদের তারা যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত আটকে রেখে ধর্ষন করে।
________________________________________
প্রতিদিন মুক্তিবাহিনী কিংবা তাদের সহচর হিসেবে যাদের সন্দেহ করে ধরে আনা হতাে তাদের সবাই থাকত যুবক শ্রেণীর দীর্ঘ সময় ধরে এইসব যুবকদের উপর নির্যাতন করা হতাে। কারাে হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলা হতাে। কারাে নখের ভেতর খেজুরের কাটা ঢুকিয়ে দেয়া হতাে। কারাে চোখের ভেতর লােহার পেরেক বসিয়ে দেয় হতাে। তারপর এইসব যুবকদের জীবন্ত অবস্থায় হাত পা বেঁধে কখনও বা বস্তায় পুরে নদীতে ফেলে দেয়া হতাে। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস ধরে পাক সেনারা এইভাবে এ অঞ্চলের সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে।
চৌগাছা থানাতেও ক্যাম্প স্থাপন করে পাক পশুরা দালালদের সহায়তায় একই উপায়ে মানুষ হত্যা করেছে, নারী ধর্ষন চালিয়েছে। এখানকার ডাক বাংলােতে ছিল পাক বাহিনীর ক্যাম্প। বাংলাের পেছনে বন্দীদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে তার ভেতরে এক সংগে ২০/২৫ জন করে মেরে পুতে রাখতে।
একমাত্র বাংলাের পেছনেই সৈন্যরা এরকম প্রায় ৮০/৯০ টি গর্তে মানুষ হত্যা করে পুতে রেখেছিল। সে গর্তগুলাে ১৬ ডিসেম্বরের পর আবিষ্কৃত হয়। একদিন এখানে ১০/১৫ জন মুক্তিযােদ্ধাকে ধরে আনা হয়। এই ছেলেদের সমস্ত রাত ধরে পিটিয়ে পরদিন সকাল বেলা প্রকাশ্য রাস্তার উপর গাহে পা উপরে বেঁধে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত বুলিয়ে রাখা হয়। চৌগাছা থানাটি সীমান্ত এলাকা থাকায় প্রতিদিন এখানে যেসব মনুষ ধরা পড়ে মৃত্যু বরণ করতাে তার বেশীর ভাগই থাকতাে ভারতগামী শরনার্থীদের।
যশাের ক্যান্টনমেন্টে নারী নির্যাতন যশাের ক্যান্টনমেন্টের পার্শ্ববর্তী মনােহরপুর গ্রামের আমীর হােসেন মুক্তিবাহিনীর তথ্য সরবরাহের কাজ করতেন। একারণে ধরা পড়ে চারমাস হানাদারদের শিবিরে কাটাবার পর সৌভাগ্যক্রমে ছাড়া পান। ছাড়া পাবার পর আমীর হােসেনের কাছ থেকে জানা যায় ক্যান্টনমেন্টের অসংখ্য হত্যাযজ্ঞের কাহিনী। তিনি বলেন, সেভেন ফিন্ড এমবুলেন্সের ওসি লেঃ কর্ণেল আঃ হাইয়ের লাশ হত্যার দুদিন পর আনা হয় সি, এম, এইচ এ। তার লাশ পাওয়া যায় গ্যারিসন সিনেমা হল সংলগ্ন পশ্চিম দিকের তালতলায়। তার পেটে সতেরােটি বুলেটের চিহ্ন ছিল। এই কোম্পানীর কোয়াটার মাষ্টার ক্যাপ্টেন শেখের ভাগ্যেও একই পরিণতি ঘটেছিল।
আমীর হােসেন আরাে জানালেন, সি, এম, এইচ-এর নার্সিংটাফ হাবিলদার আঃ খালেক এবং তার সঙ্গী যহর আলী ও অন্য একজন সুবেদার এম, আই রুমে ঔষধ আনতে যাওয়ার পথে রানওয়ের নিকটবর্তী দোকানগুলাের কাছে খান সেনারা তাদের গুলি করে হত্যা করে। এসময় তারা ক্যান্টনমেন্ট মসজিদের ইমামকেও গুলি করে মারে। হত্যার আগে দস্যুরা ইমাম সাহেবকে কৌতুক করে কলেমা পড়তে বলে। তখন জনৈক দস্যু মুখ বিকৃত করে বলে “শালা গাদ্দার মওলানা কলেমাভী পড়নে নৈহী সাতা”।
________________________________________
পাক বাহিনী হত্যার জন্য বাঙালীদের ধরে এনে প্রথমে আই এম আই অতঃপর সেখান থেকে ৬১৪ এম আই ইউ এবং পরে ৪০৯ জি এইচ কিউতে পাঠিয়ে দিত । ৬১৪ এম আই ইউতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বন্দীদের কঠোর নির্যাতন চালানাে হতাে। এম, ই এসের একজন কর্মচারী হারেস উদ্দিন জানান, ৩০ মার্চ তিনি গ্রেফতার হন। ১৪ দিন ধরে ক্যন্টনমেন্টে রেখে পাক জল্লাদের তার উপর অমানষিক নির্যাতন চালায়। তার কাছ থেকে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত তৎকালীন সামরিক বাহিনীর বাঙালী অফিসার কর্মচারীদের স্ত্রী কন্যাদের একটি বন্দী শিবিরের সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি জানান, ৫৫ নং ফিল্ড রেজিমেন্টের আর্টিলারির ফ্যামিলি কোয়াটারে ১২ থেকে ৪৬ বছর বয়স পর্যন্ত ২৫৫ জন মেয়েকে আটকে রেখে প্রতি রাতে অসংখ্য পাক দস্যু তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাতাে। তার শেলটি কাছাকাছি হওয়ায় প্রতি রাতে তিনি মেয়েদের আর্তচি ৎকার শুনতে পেতেন। সেই সাথে বর্বর পাক দস্যদের পৈচাশিক হাসি ভেসে আসতো। সব কিছু মিলেমিশে এক মর্ম বিদারী অবস্থার সৃষ্টি হতাে।
প্রতিদিন বিকেলে একজন সুবেদার এসে বন্দী মেয়েদের একটি তালিকা প্রস্তুত করতো। সন্ধ্যা হলে কে কোথায় যাবে সে অনুযায়ী তাদের উক্ত লিষ্ট অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানে মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেয়া হতাে। কখনও কখনও আপন খেয়াল খুশীতে বাইরের কোন মেয়েকে এনে শুরু কোরত ধর্ষন। পাহারারত কুকুরের দল পালাক্রমে একজনকেই উপর্যপুরী অত্যাচার করতাে। একদিন একটি মেয়েকে পর পর পনেরজন পও অত্যাচার চালানাের পরে সে মৃত্যুবরণ করে। অজ্ঞান অবস্থাতেও পশুরা তাকে ধর্ষন করে। জনাব হারেছকে চৌদ্দদিন পরে যশাের কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর সে ঐ মহিলা বন্দী শিবির সম্পর্কে আর কিছু জানেনা। অপর একটি মহিলা শিবিরের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। ২৫ সেপ্টম্বর জেলখানা থেকে জরুরী জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে পুনরায় ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়। এসময় তাকে এফ, আই, ইউতে রেখে কঠোরভাবে অত্যাচার করা হয়। সেখানে তিনি ১২ নং ব্যারাকের ১০ নং রুমে প্রায় পঞ্চাশজন মহিলাকে দেখতে পান। হারেছ উদ্দিন আরাে বলেন বন্দী শিবিরে মেয়েদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা হতাে। প্রথম ভাগে থাকতাে কিশােরী, দ্বিতীয় ভাগে থাকতাে যুবতী এবং তৃতীয় ভাগে থাকতাে গৃহ বধু বা মধ্য বয়সী মহিলারা। তিনি স্কুল কলেজের কিশােরী ও যুবতী মেয়েদের প্রতিদিন বিমানে করে ঢাকায় পাঠাতে দেখেছেন। দখলদাররা ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে আন্ডার গ্রাউন্ড সেল তৈরী করেছিল। যশাের পতনের পর এমনি দুটি সেল থেকে কয়েকশ বন্দীকে উদ্ধার করা হয়। সবাই জীবিত থাকলেও অসম্ভব নির্যাতনের ফলে তাদের মধ্যে কোন প্রাণ ছিলনা।
আলাে বাতাস ও খাদ্যহীন অবস্থায় এসব কংকালসার মানুষ কেবল এক রাশ যন্ত্রণার বােঝা বহন করছিল। এসময় ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন কক্ষ থেকে কয়েকশ মহিলাকে উদ্ধার করা হয় যারা যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শত্রুদের পাশবিকতার শিকার হয়েছে।
________________________________________
| কুষ্টিয়ায় রাজাকারের কন্যা যেভাবে ধর্ষিত হােল
কুষ্টিয়া জেলার দারিক গ্রামের একজন অধিবাসী চিনিবাস সরকার। তিনি ‘৭১ সালে বন্দী হয়েছিলেন পাক বাহিনীর হাতে । কিভাবে তিনি ধরা পড়েছিলেন এবং কি করেই বেঁচে গিয়েছিলেন পাক বাহিনীর হাত থেকে সেই লােমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।
একাত্তর সালের সেপ্টম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন পাকবাহিনী রাজাকারুসহ দারিক গ্রাম ঘেরাও করে। ঘেরাও করার পর সমস্ত গ্রামময় মানুষের ছােটাছুটি আরু হয়ে যায় । কিন্তু গ্রামটি সব দিক থেকে শত্রু বেষ্টিত থাকায় বেশীর ভাগ মানুষই পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়ে। পাকবাহিনী বন্দী সবাইকে একত্র করে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে “শালা মালাউন কা বাচ্চা, মুক্তিবাহিনী কো খানা খিলাও” । কিন্তু একথা গ্রামবাসী অস্বীকার করে। অস্বীকার করার সাথে সাথে ব্রাস টেনে হত্যা করা হয় প্রথম ধাপেই প্রায় একশ জনকে। তারপর বাদবাকী সবাইকে মাটিতে চিৎ করে শােয়ানাে হয়। এসময় রাজাকারেরা বন্দীদের বুকের উপর দাঁড়িয়ে বুট দিয়ে পাড়াতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে নদীর কুলে নিয়ে এক একজন করে জবাই করে নদীতে ফেলতে থাকে। সব শেষে চিনিবাস সরকারের পালা, একজন হানাদার ছুরিটা একেবার তার গলায় বসিয়ে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান একটা নৌকা যাচ্ছিল, নৌকার মাঝি তাকে দেখতে পায় এবং নদীর অপর পাড়ে নামিয়ে দিয়ে যায়। এখানে এসে তিনি জানতে পারেন পাক পশুরা তাদের গ্রামটি সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়ে গেছে এবং গ্রাম থেকে কিশােরী, যুবতী, গৃহবধুসহ দুইশ জনকে ধরে খন্দকার নূরুল ইসলাম, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার বাটিয়ামারা গ্রামের অধিবাসী। তিনিও হানাদার পাক দস্যুদের বর্বরতার কথা জানিয়েছেন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি বলেন, একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা এসে বাটিয়া গ্রামে আশ্রয় নেয়। এই অঞ্চলে পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিলাে কুমারখালী থানা কাউন্সিলে আর রাজাকারদের ক্যাম্প ছিলাে রেল স্টেশনে। মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা যখন এখানে এসে খুব ভােরে খেতে বসেছে ঠিক তখনই আচমকা প্রায় দুইশ রাজাকার ও পাকসেনা পুরাে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। সেই সঙ্গে পূর্ব খবর অনুযায়ী নির্দিষ্ট বাড়িটির চারপাশেও তারা অবস্থান নেয়। শুরু হয় বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ। এই অতর্কিত হামলায় অপ্রস্তুত মুক্তিযােদ্ধারা একে বারেই দিশেহারা হয়ে পড়ে। প্রস্তুতি নেবার আগেই পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যায় তারা। হানাদার সৈন্যরা তাদেরকে পিঠ মােড়া করে বেধে বুকে পিঠে বেয়ােনেট চার্জ করতে করতে নিয়ে যায় । থানা ক্যাম্পে নিয়ে তাদের সারাদিন কঠোর নির্যাতনের পরে রাত্রি ৯ টার দিকে থানা কাউন্সিলের পূর্বপাশের আম বাগানে গর্ত করে সেখানে তাদের চোখ তুলে ফেলে বুক থেকে পেট পর্যন্ত ফেড়ে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে চলে যায়।
পরদিম পাকসৈন্যরা আবার বাটিয়ামারা গ্রামে হামলা করে। এদিন গ্রামের সমস্ত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দিয়ে যায়। গ্রামে যাকে পায় তাকেই নির্মম ভাবে হত্যা
________________________________________
করে এবং প্রায় ৫০ জন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। এসব মেয়েদের থানা কাউন্সিলে আটক রেখে দীর্ঘদিন অত্যাচার করা হয়-এদের কেউ কেউ ১৬ ডিসেম্বর জীবিত অবস্থায় ছাড়া পায়। নুরুল ইসলাম আরাে জানান, তাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম কল্যাণপুর। এই গ্রামেও পাক বাহিনী ব্যাপক ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। গ্রামটিকে দস্যরা সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে। গ্রামের গৃহবধু থেকে বালিকা পর্যন্ত সবাইকে ধরে নিয়ে যায়। এই গ্রামে তারা বাড়ির পুরুষদের সামনে মেয়েদের ধর্ষন করে। শিশুদের পৈচাশিকভাবে হত্যা করা হয়। জানা যায় এখানে নরপশুরা কয়েকটি শিশুকে বাবা মায়ের সামনে জ্বলন্ত ঘরের ভেতর ছুড়ে দিয়ে পুড়িয়ে মারে। এখানকার থানা কাউন্সিলের ডাক বাংলােতে অবস্থানকারী মেজর ও কেন্টেনদের জন্য প্রতিদিন নতুন মেয়ে সরবরাহের দায়িত্ব ছিল স্থানীয় জামাত মুসলিম লীগের লােকদের। তারা রাজাকারদের সহযােগিতায় প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে হামলা করে সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে মেজর ও ক্যাপ্টেনকে উপঢৌকন দিত । বাংলাের পাশেই | একটা কচুরি পানা ভর্তি পুকুর ছিল। এই পুকুরে প্রতি দিনই দু-একটি মেয়ের লাশ ভাসতে দেখা যেত। | পাক বাহিনীর নারী ধর্ষন সম্পর্কে এখানে একটি চমৎকার ঘটনা ঘটে। একদিন | মিলিটারীরা মেজরের জন্য সুন্দরী মেয়ের খোঁজে বের হয় স্থানীয় রাজাকার কমান্ডারকে
সঙ্গে নিয়ে। সমস্ত গ্রাম প্রদক্ষিণ করে তারা কোন সুন্দরী মেয়ের সন্ধান না পেয়ে অবশেষে রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে আসে। এখানে এসে সৈন্যরা উক্ত রাজাকারের ঘরে তার ষােড়শী কন্যাকে দেখতে পায়। রাজাকারের বাড়িতে সৈন্যরা হৈ হুল্লোড় করে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তাকে ঘরের খুটির সঙ্গে বেঁধে রেখে তার স্ত্রী, বােনসহ বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের ধর্ষন করে। যাবার সময় সৈন্যরা রাজাকারের কন্যাটিকে মেজরের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পর মেয়েটির মৃতদেহ ছুরি পানা ভর্তি পুকুরে ভাসতে দেখা যায়। এই ঘটনায় উক্ত রাজাকার পাগল হয়ে যায়।
এই ঘটনা থেকে বােঝা যায় যে, পাক সৈন্যদের হাত থেকে এদেশে তাদের পরম আত্মীয় জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি কিংবা রাজাকার কারাে পরিবারের
স্ত্রী, মা, বােন, কেউই রেহাই পায়নি। এ থেকে স্পষ্ট যে, পশ্চিমা হানাদারদের একমাত্র | উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী নিধন অর্থাৎ বাঙালী মাত্রই শত্রু।
বরিশালে পীরের সহযােগিতায় গণহত্যা স্বাধীনতা সগ্রাম চলাকালিন সময়ে সমগ্র বরিশাল জেলায় দুইলক্ষ মানুষ পাক বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়। পাক বাহিনী ভােলা, পটুয়াখালী, পিরােজপুর, ঝালকাঠিসহ বৃহত্তর বরিশালের বিস্তির্ণ এলাকা জুড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়া হয়। লুঠ করে নেয়া হয় সাধারণ মানুষের ধনসম্পদ। ইজ্বত কেড়ে নেয়া হয় শত শত মা-বােনের।
________________________________________
বরিশালের বিভিন্ন মাসায় পাক বাহিনী তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। এইসব মাদ্রাসার মধ্যে মেয়েদেরকে আটক করে দিনের পর দিন তাদের ধর্ষন করা হতাে।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পাক সেনারা পিরােজপুর দখল করে নেয়। শহরে প্রবেশ করে তারা প্রথমে স্থানীয় দালালদের সহযােগিতায় ব্যাপকভাবে লুট পাট আরু করে এবং প্রথম ধাপেই কয়েকশ লােককে গুলি করে হত্যা করে। পিরােজপুর পাকবাহিনী আসার পর স্থানীয় জামাত ও মুসলিম লীগের সহযােগিতায় একটি দালাল গােষ্ঠি সৃষ্টি করা হয় । তাদের কাজ ছিল খান সেনাদের জন্য মেয়ে সগ্রহ করা, বিভিন্ন অঞ্চলে লুটতরাজ করা, সন্দেহ ভাজন মানুষজনকে ধরে এনে হত্যা করা, স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের। লােকজনদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়া প্রভৃতি।
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে সমগ্র বরিশাল অঞ্চলে পাক বাহিনীর অত্যাচার অসম্ভবভাবে বেড়ে যায়। এসময় একমাত্র পিরােজপুর জেটি ঘাটেই প্রতিদিন একশত লােককে জবাই করে জেটিতে ফেলা হতাে। প্রথম দিকে লােক ধরে এনে এক সংগে দাঁড় করিয়ে সবাইকে হত্যা করে নদীতে ফেলা হতাে। তৃতীয় পর্বে সারা দিন ও রাত্রি পর্যন্ত ধরে আনা সব মানুষকে একত্রে ভাের রাত্রে হত্যা করা হতাে। গুলি করে হত্যা করার আগে এসকল লােককে ভীষনভাবে প্রহার করা হতাে। বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে সর্বাংগের মাংস তুলে ফেলা হতাে। কারাে কারাে চোখ তুলে নেয়া হতাে। মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে যে সকল যুবকদের ধরে আনা হতাে তাদেরকে পা দুদিক থেকে টেনে ধরে মাঝখানে কুড়াল দিয়ে অথবা দা দিয়ে কুপিয়ে দু-ভাগ করে ফেলা হতাে। শান্তি কমিটির সহায়তায় রাজাকার বাহিনী সেই সংগে জ্বালাও পােড়াও অভিযান চালায়। এসময় তারা গ্রাম থেকে বহু মেয়েকে ধরে আনতে এবং পূর্ব শত্রুতার জের হিসেবে চিহ্নিত পরিবারগুলােকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিত। | ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী উপেন দত্ত বলেন, আমি ২৫ মার্চের পর থেকে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাই এবং ২৫শে জুন শহরে ফিরে আসি কেননা স্থানীয় শান্তি কমিটির লােকজন আমার পরিচিত ছিল এবং তারা আমাকে ফিরে আসতে বলেছিলাে কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি গ্রেফতার হই । রাজাকাররা আমাকে গ্রেফতার করে পাক বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায় । সেখানে আমাকে নানা রকম প্রশ্নের মাধ্যমে রাইফেলের বাট দিয়ে মারতে থাকে। খানসেনারা আমাকে মুক্তিবাহিনীর লােক বলে আখ্যায়িত করে। দীর্ঘ দুই ঘন্টা লাঠি এবং বুটের আঘাতে আমার সমস্ত শরীর রক্তাক্ত হয়ে যায় । একাধারে তিনদিন আমার উপর। অত্যাচার চলতে থাকে। এসময় আমার সংগে আরাে বহু বন্দী ছিলাে তাদেরকে একই ভাবে নির্যাতন করা হতাে। | একদিন হলার হাট লঞ্চ থেকে আশরাফ নামে একটি ছেলেকে মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহ করে ধরে আনে। পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন লােহার রড পুড়িয়ে নিজ হাতে ছেলেটির শরীরের বিভিন্ন অংশে চেপে ধরে। এতে ছেলেটির শরীর দু-একদিনে পচে দুর্গন্ধ হয়ে যায় এরপরও তার উপর প্রতিনিয়ত অত্যাচার চলতাে। একদিন পাক বাহিনীর ক্যান্টেন
________________________________________
আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার সংগে আমি উর্দুতে কথা বলায় এবং কয়েকজন পদস্থ পাঞ্জাবীর নাম বলায় এবং সেই সাথে ব্যবসায়িক সূত্রে কিছু পাঞ্জাবীর সংগে আমার সখ্যতা রয়েছে জানানাের পর আমাকে ছেড়ে দেয়।
পরের দিন জানতে পারি গত রাত্রে বহু লােককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমি দৌড়ে নদীর ঘাটে যাই এবং দেখতে পাই গতকালও আমি যাদের সংগে একত্রে বন্দী জীবন কাটিয়েছি তাদের সবার লাশ নদীর কুলে পড়ে আছে। একটু দূরে আশরাফ নামের সেই ছেলেটির লাশও দেখতে পেলাম। আমি আশরাফের লাশ তুলে নিজ হাতে তার বাবা মায়ের কাছে পৌছে দেই। এসময় মুক্তিযােদ্ধাদের সংগে নিয়মিত আমার খবর আদান-প্রদান চলতে থাকে। আর্মি ক্যাম্পে কঠোর নির্যাতন চালানাের ফলে শরীর থেকে মাংস আলাদা হয়ে যেত। বন্দীদের পায়খানার ভেতর আটকে রাখা হতাে এবং নির্যাতনের সময় বাইরে আনা হােত। ক্যাম্পের সামনে ধৃত বাঙালীদের হাত পা বেঁধে শুন্যে তুলে আছড়িয়ে মারা হতাে। মুক্তিযােদ্ধা কিংবা মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে যেসব লােককে ধরে আনা হােত তাদেরকে কী বস্তায় পরে মুখ বেঁধে সেই অবস্থায় বেয়ােনেট চাক্ত করে নদীতে ফেলে দিত। কয়েকজনকে একসংগে পায়ে দড়ি দিয়ে জীপের পেছনে বেঁধে সমস্ত শহরময় ঘােরানাে হােত যতক্ষণ না তারা মৃত্যুবরণ কোরতাে। প্রথম অবস্থায় বন্দীদের ক্যাম্পের সামনে বাদাম গাছের সংগে পা উপরে বেঁধে ৰুলিয়ে রাখা হতাে। আমাকেও কপিকল করে উল্টো ভাবে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এই ঝুলন্ত অবস্থায়ও বন্দীদের উপর অত্যাচার চলতাে। পাক বাহিনীর চেয়ে রাজাকার ও শান্তি কমিটির অত্যাচার ছিল আরাে বেশী। পাক বাহিনী যাদেরকে অত্যাচার করে ছেড়ে দিত রাজাকাররা তাদের পুনরায় ধরে নিয়ে জবাই করে হত্যা করতো। এরা স্থানীয় লােকদের চিনতাে সেই অনুসারে পূর্ব শত্রুতার জের কিংবা আওয়ামী লীগ করার অপরাধে সেই সব বাড়ী থেকে মেয়েদের ধরে আনতাে। ধরে আনা মেয়েদের উপর কম পক্ষে চার-পাঁচ হাজার লােককে হত্যা করে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এখানে প্রতিদিন যাত্রীবাহি লঞ্চে তল্লাসী করে যুবতী মেয়েদের নামিয়ে রাখা হতাে। একদিন এক বৃদ্ধলােকের কন্যা ও পুত্রবধুকে নামিয়ে নিলে সেদিন সে সমস্ত শহরে পাগলের মত ছুটে বেড়ায়।
উষা রানী মল্লিক। বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি থানার জলুঘাট গ্রামে বাড়ী। তিনি দেখেছেন একাত্তরে পাক বাহিনীর বিভৎস বর্বরতা। তিনি বলেন ২২ শে শ্রবন পাক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী স্বরূপকাঠিতে এসে প্রথমেই ১৪ জন লােককে হত্যা করে চারিদিকে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। জলুঘাটে তারা ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকাররা প্রতিদিন পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে প্রবেশ করে লুটতরাজ করতাে সেই সাথে যুবতী মেয়েদের ধরে আনতে। কোন বাড়ীতে যুবক ছেলে দেখলে তাকে হত্যা করে রেখে আসতাে। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে একদিন পাকবাহিনী জলুঘাট গ্রাম আক্রমণ করে। উষা রানী বাড়ীর পেছনে লুকিয়ে থেকে সব কিছু লক্ষ্য করেন। পাশের বাড়ীর দুইজন মহিলাকে তারা ধরে ফেলে এবং জোর করে ঘরের ভিতরে নিয়ে যায়। মহিলাদের কোলের বাচ্চা
________________________________________
দুটিকে তারা বাইরে আছাড় মেরে ফেলে দিয়ে তাদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ফেলে। ঘরের ভিতর থেকে মেয়ে দুটির চিৎকার ভেসে আসে। প্রত্যেকের উপর কয়েক জন করে পাক সেনা ধর্ষন চালায়। তিনি বলেন, সৈন্যরা চলে গেলে আমরা ঘরে প্রবেশ করে দেখি মেয়ে দুটি অজ্ঞান অবস্থায় রাত ভাবে পড়ে আছে। সারা শরীরে ক্ষত চিহ্ন, শরীরে কাপড়ের লেশমাত্র নেই। এদিন পাক সৈন্যরা গ্রামে ব্যাপক হত্যা যজ্ঞ চালিয়ে ফেরার সময় অনেকগুলাে মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রামের হারাধন ভৌমিকের সামনে তার দুইটি ছেলেকে হত্যা করে তার তিনটি যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়।
পাক বাহিনী স্বরূপ কাঠিতে এসে শর্ষিনার পীর সাহেবের বাড়ীতে আস্তানা গাড়ে। এখান থেকে তারা প্রতিদিন হত্যা ধর্ষন আর জ্বালাও পােড়াও অভিযান চালাতাে। পাক বাহিনী বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, মুক্তিবাহিনী, ছাত্রলীগ ও হিন্দুদের বিষয়ে বেশী খোজ খবর নিত এবং সন্দেহ ভাজন প্রত্যেককে তারা হত্যা করতো। একদিন ভাগিরথী ও মন্টু নামের দুটি ছেলে মেয়েকে মুক্তিবাহিনীর চর সন্দেহে সৈন্যরা তাদেরকে জীপের পেছনে বেঁধে সমস্ত শহর ঘুরিয়ে বেড়িয়েছিল যতক্ষণ তারা জীবিত ছিল। ইসলামের দোহাই দিয়ে পাক সৈন্যরা এদেশের পীর সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপােষকতায় এমনি অবাধ নারী নির্যাতন আর হত্যালীলা চালিয়েছে।
| চট্টগ্রামঃ লক্ষ লক্ষ মানুষের ভারতে আশ্রয় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালিন সময়ে সমগ্র চট্টগ্রাম এলাকা জুড়ে চালায় নৃসংশ বর্বরতা। সাতকানিয়া, লােহাগড়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, পটিয়া, বােয়ালখালী, পাহাড়তলী প্রভৃতি অঞ্চলে চালিয়ে ছিল ব্যাপক ধ্বংস লীলা। ধর্ষন আর হত্যাকান্ডের প্রেতপুরিতে পরিণত করেছিল তারা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা।
পাশাপাশি বীর মুক্তিযােদ্ধারাও প্রতিহত করে চলেছিল হানাদার বাহিনীর আগ্রাসী তৎপরতা। ১৪ আগষ্ট পাকিস্তান দিবস বানচাল করার জন্য একদল গেরিলা মুক্তিযােদ্ধা কালুরঘাট রেলস্টেশনে মাইন পেতে রাখে। রাত্রি চারটার সময় পাক বাহিনীর সৈন্য বােঝাই একটি ট্রেন স্টেশনে পৌছামাত্রই কয়েকশ সৈন্যসহ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। ট্রেনের ইঞ্জিন লাইন থেকে ছিটকে পার্শ্ববর্তী খাদে পড়ে। পাক বাহিনীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতে মুক্তিযােদ্ধারা সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে এমনি হাজারাে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাতে পাক বাহিনীর পতন অনিবার্য হয়ে উঠে।
সন্তোষ কুমার, চট্টগ্রাম জেলার বােয়ালখালী থানার পশ্চিম শাকপুরা গ্রামের অধিবাসী। তিনি পাক বাহিনীর একটি লােমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। দেখেছেন পাক সেনাদের রক্ত নিয়ে হােলিখেলা। সেই সংগে নারী নির্যাতনের নৃসংশ উল্লাস। অগ্নি সংযােগের বিত এস ঘটনা। সেদিনের কথা মনে হােলে আজো তার গা ছম ছম করে ওঠে। যারা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছিলাে, যারা তাদের চোখের সামনে মা-বােন স্ত্রীদের
________________________________________
ইজ্জত লুট করেছিলাে, যারা সম্পদ কেড়ে নিয়েছিলাে, যারা চোখের সামনে তাদের সন্তানদের বুকে ছুরি চালিয়েছিল সেই সব রাজাকার দালালেরা কি করে আজো এই স্বাধীন বাংলার বুকে বসবাস করছে।
২০ এপ্রিল এর ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, খুব ভােরে সূর্য ওঠার আগে আমাদের গ্রামে পাক সৈন্যরা অভিযান চালায়। প্রতিদিনের মত এদিনও সারারাত পাহারা শেষে আমি ভােরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ হৈচৈ আর চেঁচামেচির শব্দে আমার ঘুম ভেংগে যায়। চেয়ে দেখি যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। আমিও বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেলাম। সারাদিন ধরে চলল আমাদের পশ্চিম শাকপুরাসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জুড়ে পাক বাহিনীর অত্যাচার। প্রতিটি বাড়ী তারা অগ্নি সংযােগ করে। আগুন লাগানাের আগে রাজাকারেরা লুট করে নেয় প্রতিটি রাড়ী থেকে মূল্যবান জিনিষপত্র। গরু ভর্তি গােয়ালে আগুন জ্বালিয়ে তাদের পুড়িয়ে মারে খুব ভােরে অগ্নি সংযােগের ফলে অসংখ্য শিশু। জীবন্ত দয় হয়। গ্রামের যুবক, বৃদ্ধ, শিশু-কিশাের সবার উপর চলে অবর্ণনীয় নির্যাতন। বৃদ্ধ পিতার সামনে পুত্রকে হত্যা করা হয়। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষন করা হয়। মায়ের বুক থেকে শিশু সন্তানকে কেড়ে নিয়ে আছড়িয়ে মারা হয়। বিকেল পাঁচটার দিকে সৈন্যরা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল, যাবার আগে গ্রামের অনেক গৃহবধু আর যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়।
সৈন্যরা চলে যাবার পর আমরা পার্শ্ববর্তী আত্মগােপন অবস্থান থেকে গ্রামে এলাম। সমস্ত ঘর বাড়ী জ্বলছে। চারপাশে পড়ে আছে অসংখ্য মৃতদেহ। কেউ কেউ তথনাে জীবিত ছিল। আমাদের কারাে মুখে কথা ছিলনা। আহতদের কিভাবে চিকিৎসা করব সে শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কোন কোন বাড়ীতে ৫/৭ টি করে মৃত লাশ পড়ে আছে। এদিন আমাদের কারাে কান্নার শক্তিও ছিলনা। চারিদিকে কেবল ছড়িয়ে আছে আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও গ্রামবাসীর লাশ। রাস্তায়, নর্দমায়, প্রাংগনে সর্বত্রই শুধু মৃত মানুষের সারি। কি ভয়ংকর সেই হত্যাযজ্ঞ। মৃত স্বামীর দিকে পাথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্ত্রী, সন্তানের দিকে নিঃপলক তাকিয়ে আছে মা, স্ত্রী স্বামীকে ডেকে তুলতে পারেনি, পিতা তার সন্তানকে জাগানাের সময় পায়নি। নিমেষেই যেন ঘটে যায় রােজ কিয়ামত।
পাক বাহিনী এদিন আমাদের গ্রামের ৩/৪ শত লােককে হত্যা করে। মৃত লাশগুলিকে একত্র করে গর্ত খুঁড়ে একেক গর্তে ১৫/২০ জন করে মাটি চাপা দিয়ে রাখি। আমার এসময় মনে পড়ে সত্তুরের ঘুর্নিঝড়ের কথা, হাতিয়া, সন্দিপ, রামগতি এলাকায় মৃত্যুবরন করে হাজার হাজার মানুষ, যা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ঘটেছিল। তাতে মানুষের কোন হাত ছিলনা। অথচ আজ মানুষের প্রতি মানুষের একি পাশবিকতা, একি অত্যাচার। বেঁচে থাকার জন্য আমাদের আর কিছুই রইলােনা। ২৩এপ্রিল আমরা শরণার্থী হয়ে ভারতের পথে পা বাড়ালাম।
________________________________________
পাহাড়তলি রেলষ্টেশনের হিসাব রক্ষক মােঃ শামসুল হক। হত্যাযজ্ঞের আরেক স্বাক্ষী। শামসুল হক তার জবানবন্দীতে বলেন ১০ নভেম্বর রমজান মাস। এদিন পাহাড়তলীতে চলে হানাদার বাহিনীরঅকল্পনীয় বর্বরতা। পাক সেনারা সেদিন যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোন নজীর নেই। এদিন খুব ভােরে পাক সেনারা ওয়ারলেস কলােনী, রেলওয়ে কলােনী, পাঞ্জাবী লাইন সহ প্রভৃতি কলােনী থেকে সকল বয়সের নারী পুরুষকে একত্র করে বাইরে এনে জড়ো করে। পিঠ মােড়া করে বেঁধে যুবক, যুবতী, বৃদ্ধ সবাইকে পাহাড়ের উপর নিয়ে যায়। এখানে মেয়েদের আলাদা করে নিয়ে অন্য সবাইকে পাহাড়ের ঢালে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায় তারপর মেশিনগানের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষ করে দেয় কয়েকশ মানুষের জীবন। সেদিন এ হত্যাকান্ড বাস্তবায়িত করার জন্য সহযােগিতা করে স্থানীয় জামাতে ইসলামী, পিডিপি ও মুসলিম লীগের লােকজন। এই হত্যাকান্ড শেষে যে সকল তরুনী ও গৃহ বধুদের আলাদা করে রাখা হয়েছিল তাদেরকে পাক সৈন্য, রাজাকার, জামাত ও মুসলিম লীগের লােকেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে বহু নারী ও যুবতী মেয়ের লাশ পাহাড়ের জংগলে। পড়ে থাকতে দেখা যায় ।
নােয়াখালীতে হত্যা, ধর্ষন ও নির্যাতন দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে একাত্তরের স্বশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল নােয়াখালী জেলার আপামর জনসাধারণ। অস্ত্র হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল তারা পাক বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে। সংগত কারণেই নােয়াখালী জেলায় সংগঠিত হয়েছিল ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ, সেই সাথে লুঠতরাজ, নারী ধর্ষন, অগ্নি সংযােগ আর গণহত্যা।
আজিজা খাতুন, নােয়াখালী জেলার দক্ষিণ খান গ্রামের এক দরিদ্র ঘরের মেয়ে। একাত্তরের নভেম্বর মাসে সে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। আমরা আজিজা খাতুনের কাছ থেকে তার বন্দী জীবনের দুঃখময় বেদনার কথা শুনি। সে জানায়, একদিন জমিতে কাজ করার সময় আমার পিতা পাক বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায়। সংসারে কঠোর দুঃখ নেমে আসে। ইতিমধ্যে আমাদের অঞ্চলে পাক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচার অসম্ভব রকম বৃদ্ধি পায়। এসময় আমাদের গ্রাম এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমূহের বহু মানুষ ভারতে চলে যায়। আমরা ভারতে যেতে পারিনি।
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে স্থানীয় রাজাকারদের সহযােগিতায় পাক বাহিনী আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে। হঠাৎ আক্রমনের কারণে আমরা পালাতে পারিনি। আমি ভয়ে ঘরের মাচার নিচে আত্মগােপন করি। কিন্তু রাজাকারেরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে আমাকে বের করে। আমি ভয়ে কাঁপতে থাকি। অন্যদিকে সৈন্যরা আমাকে দেখে উৎসাহিত হয়ে ওঠে। আমি চিৎকার করতে থাকি এবং সৈন্যদের পা জড়িয়ে শত কাকুতি জানাতে থাকি। আমি দরিদ্র ঘরের মেয়ে আপনাদের বােন, আমাকে কলংকিত করবেন না।
________________________________________
একই ভাবে আমার মাও তাদের প্রতি জোড় হাতে আমার প্রাণ ভিক্ষা চায়। কিন্তু পিশাচেরা আমার মাকে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। কয়েকজন সৈন্য পর্যায়ক্রমে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পাক সৈন্যরা আমাকে বন্দী রেখে দিনের পর দিন ধর্ষন করতে থাকে। একদিন আটক অবস্থা থেকে পালিয়ে আসি। দেশ স্বাধীন হলে ওসমান আলী নামে যে রাজাকার আমাকে পাক সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়েছিল মুক্তিযােদ্ধারা তাকে হত্যা করে।
মােঃ আবুল কাসেম । নােয়াখালী জেলার রায়পুর থানার উত্তর দেওয়াপুর গ্রামের অধিবাসী। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। পাক হানাদার বাহিনী ভাদ্র মাসের দিকে আমাদের রায়পুর আলিয়া মাদ্রাসায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এছাড়া রাজাকার প্রশিক্ষণের জন্য একটি কেন্দ্রও ভােলা হয়। এখান থেকে রাজাকারেরা প্রতিদিন আশপাশের গ্রামে লুট পাট, অগ্নি সংযােগ, মেয়েদের ধরে আনা, চাঁদা তােলা প্রভৃতি ধরণের কার্যক্রম চালাতে থাকে। তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে।
আমি রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ি এবং তাদের অনেকেই আমার পরিচিত ছিল। একজন রাজাকার আমার হাত পিঠ মােড়া করে বেঁধে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায় । পাকবাহিনী আমার চোখ বেঁধে একটি ঘরের মধ্যে বেত দিয়ে পিটাতে থাকে এবং জিজ্ঞাসা করে তােমাদের মুক্তিবাহিনীর দল কোথায়? বিভিন্ন প্রশ্ন করেও তারা আশানুরূপ উত্তর না পাওয়ায় আমাকে কঠোরভাবে অত্যাচার করতে থাকে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। দ্বিতীয় দিনে জ্ঞান ফিরলে একজন রাজাকার আমার হাতের রগ চাকু দিয়ে কেটে দেয় এবং আমি সংগে সংগে অজ্ঞান হয়ে যাই। তৃতীয় দিনে আমাকে জেলা সদরে পাঠানাের জন্য আমার নাকের ভেতর দ্রি করে সুতলী দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। এমতাবস্থায় আমার বাড়ী থেকে কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে ছাড়িয়ে নেয়া হয়।
পাকবাহিনী নােয়াখালী জেলার সােনাগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, সুধারাম, লক্ষীপুর, রায়পুর, বেগমগঞ্জ, ফেনী প্রভৃতি অঞ্চলে অবর্ণনীয়ভাবে ব্যাপক ধ্বংস লীলার মধ্যে দিয়ে মানুষের ক্ষতিসাধন করে। গণহত্যা নারী ধর্ষন লুটতরাজ অগ্নি সংযােগ প্রভৃতি ছিল তাদের নিত্য দিনের কর্মকান্ড, সৈন্যরা ফেনী জেলার কাছাড় গ্রামের মসজিদে নামাজ পড়া অবস্থায় একদিন ভােরে একদল মুসল্পীকে হত্যা করে। একই সময়ে মঠবাড়ীয়ার হাবিব উল্লাহর পরিবারের পুরুষ সদস্যদের হত্যা করে বাড়ীর মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। | পাক সৈন্যরা লক্ষীপুর থানার লতীফপুর গ্রামে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হামলা চালায়। তারা এই গ্রামের প্রায় দেড়শজন লােককে হত্যা করে। এদিন তারা চান্দিয়া, দেয়ানাথপুর প্রভৃতি গ্রাম থেকে অনেক যুবতী ও কিশােরী মেয়ে ধরে নিয়ে যায়। দেয়ানাথপুর গ্রামের আহছান উল্লাহর গর্ভবতী স্ত্রী সৈন্যদের ধর্ষনে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করে।
________________________________________
সিলেট হাসপাতালে গণহত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সিলেট জেলার রয়েছে গৌরবময় অবদান। এদেশের মুক্তিযুদ্ধে সিলেটের সেই সংগ্রামী ভুমিকা নতুন প্রজন্মের জন্য এক সঠিক দিক নির্দেশনা। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানের মত সিলেটের জনগণও দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করে সহ্য করেছিলাে অসহনীয় দুঃখকষ্ট। যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসে এ জেলার হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলাে। ভিটে মাটি ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলাে।
| ২৬ মার্চ সকালে পাকবাহিনী সিলেট শহরে কার্ফ জারি করে। কার্যকালিন সময়ে তারা বাড়ী বাড়ী ঢুকে তল্লাশীর নামে যুবক ছেলে মেয়েকে ধরে নিতে থাকে। বিভিন্ন অজুহাতে যাকে তাকে ধরে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। তৎকালিন ন্যাশনাল ব্যাংকের কয়েকজন পাহারাদার পুলিশকে হত্যা করে তারা তাদের অস্ত্র নিয়ে নেয় এবং সেই সাথে ব্যাংকের ভল্ট থেকে সমস্ত টাকা লুট করে নেয়। এদিন পাক বাহিনী শহর থেকে প্রায় একশ লােককে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। যারা আর কোন দিন ফিরে আসেনি।
| ২৫ মার্চ দেশে জুড়ে পাক বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের কয়েক দিন পর পাক দস্যুরা সিলেটের বিয়ানী বাজারে আসে। এখানে তারা সমস্ত এলাকায় এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এবং প্রায় দুইশ লােককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে এইসব লােককে থানার পাশে অবস্থিত টিলার উপর নিয়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে মেশিনগানের সাহায্যে হত্যা করে। এদিনের ঘটনা প্রসংগে বিয়ানী বাজারের সিরাজুল ইসলাম নামক একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এদিন পাকসৈন্যরা ১৭২ জন লােককে হত্যা করে। এর মধ্যে সুপাতলা গ্রামের মনােরঞ্জন ধরের পরিবারেরই কেবল ১৩ জন সদস্য ছিল। এতে পুরাে পরিবারটি নিশ্চিন্ন হয়ে যায় এছাড়া সেইদিন পাকবাহিনী প্রায় পঞ্চাশজন যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে যায়। এদেরকে পাক বাহিনী দীর্ঘদিন আটকে রেখে ধর্ষন করে। স্বাধীনতার পর এদের মধ্যে কেউ কেউ জীবিত অবস্থায় ছাড়া পায়। | বাংলাদেশে গণ হত্যার যে বর্বরােচিত ও নৃশংতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলাে পাক বাহিনী তা সারা বিশ্বের কোন মুক্তি সংগ্রামেই ঘটেনি। বাঙালীদের জীবনে যে এমন নৃশংসতা নেমে আসতে পারে তা এদেশের মানুষ আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল। ২১ মার্চ সিলেটের চিকিৎসা মহা বিদ্যালয়ের ডাঃ সামসুদ্দিন আহমদ এক ছাত্র সমাবেশে সেকথাই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “শুধু শ্লোগান আর মিছিল সগ্রাম নয়, তােমরা ইমার্জেন্সী মেডিক্যাল ফাষ্ট এইড স্কোয়ার্ড গঠন করে ব্যাপক রক্তক্ষয়ের জন্য প্রস্তুত থাক”। তার সেদিনের সেই কথা সত্যি প্রমানিত হলাে। পাক বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। পহেলা এপ্রিল ‘৭১ সিলেট শহর শত্রু কবলিত হয়। ২৫ মার্চের কালাে রাতের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেংগল রেজিমেন্ট, ইপি আর, আনছার, পুলিশ, ছাত্র জনতা সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে প্রতিরােধ বাহিনী গঠন করে শত্রুর উপর আঘাত হানতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যেই মুক্তিয়ােদ্ধারা সিলেট শহর, বিয়ানী বাজার, জাকিগঞ্জ,
________________________________________
মৌলবীবাজার, সুনামগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে পাকবাহিনীকে হঠিয়ে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ৩ এপ্রিল ছাত্র-জনতা সিলেট শহরে বিজয় উল্লাসে মেতে ওঠে। এসময় হানাদার পাকবাহিনী বিমান বন্দর এলাকায় অবস্থান নিয়ে সংগঠিত হতে থাকে।
৮ এপ্রিল পাক বাহিনী পুনঃ সংগঠিত হবার পর শুরু হয় বিমান হামলা। সারা শহরে বৃষ্টির মত গুলি বর্ষিত হতে থাকে। শত শত মানুষ নিহত হয়। আহতের হিসাব অগণিত। পাশাপাশি হানাদার বাহিনীর স্থল বাহিনীও সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর। শহর ছেড়ে মানুষ পালিয়ে যায়। ৯ এপ্রিল জনশূন্য সিলেট পাকবাহিনী পুণঃখল করে এবং সিলেট মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে। বিশ্বের সকল মানবিক আইনকে উপেক্ষা করে ঘাতক বাহিনী আহত চিকিৎসাধীন সকল বাঙ্গালীকে হত্যা করে। এই ঘটনার পর মুক্তিযােদ্ধারাও থেমে রইলাে না। তারাও সংগঠিত হয়ে শক্রর প্রতি তীব্র আঘাত হানতে থাকে।
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ২৫ মার্চের কালােরাতে জল্লাদ ইয়াহিয়ার দখলদার হানাদার বাহিনী যে সমস্ত ক্যান্টনমেন্টে সবচেয়ে বেশী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, ময়নামতি তার মধ্যে অন্যতম। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে যে সমস্ত বাংগালী সামরিক অফিসার ও জোয়ান আটকা, পড়েছিলাে তাদের মধ্যে প্রায় কেউই বেরিয়ে আসতে পারেনি। | বাংগালী সামরিক অফিসারদের পত্নীরা কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, কিন্তু তারাও বন্দী অবস্থায় থাকায় প্রকৃত ঘটনার কথা বেশী জানতে পারেন নি। কাজেই অনেক ক্ষেত্রেই ময়নামতির ঘটনা সম্পর্কে জনগণকে জনশ্রুতির উপর নির্ভর করতে হয়েছে। ময়নামতিতে নর পিশাচরা যে নারকীয় হত্যালীলা চালিয়েছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী দু’জনার কাছ থেকে আমরা সেখানকার ঘটনার বিবরণ পেয়েছি। এ দুজনের মধ্যে একজন সাবেক পাকিস্তানী গােলন্দাজ বাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান এবং অপর জন ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের বেসামরিক কর্মচারী রমনীমােহন শীল যিনি ক্যান্টনমেন্টে ক্ষৌর কর্ম করতেন। প্রথমােক্ত লেফটেন্যান্ট ইমাম বেঁচেছেন সম্পূর্ণ অলৌকিকভাবে।
২৯ মার্চ লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান হানাদার বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে আরাে সামরিক অফিসারদের সংগে একটি ঘরে বন্দী করে রেখেছিলেন। ৩০ মার্চ বিকাল চারটার সময় একজন হানাদার সৈন্য ঘরে ঢুকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে এই তিনজন অফিসারের উপর গুলি চালায়। লেফটেন্যান্ট ইমামুজ্জামান সংগী অপর দু’জন অফিসার সংগে সংগেই প্রাণ হারান। তার গায়েও গুলি লাগে এবং তিনি মনে করেন যে, তার মৃত্যু হতে যাচ্ছে। গুলি করে সৈন্যটি বেরিয়ে যাওয়ার পর সেখানে একজন সামরিক অফিসার হত্যালীলা তদারক করতে আসে।
________________________________________
এই সময় ইমামুজ্জামান মরার ভান করে পড়ে থাকেন। অফিসারটি তাকে দেখতে এসে বলে “ঠিক হ্যায় বাংগালী লােক থতম হাে গিয়া’। লেফটেন্যান্ট ইমাম ও অন্যান্যরা যে ঘরে ছিলেন তার বাইরে সেন্ট্রি পাহারা দিতে থাকে। ইমাম দেখেন যে, তিনি নড়াচড়া করতে পারছেন। হাতে, চোখের পাশে এবং কাঁধে গুলি লাগলেও আশ্চর্যভাবে ইমাম উঠে দাঁড়ালেন। বিস্ময়াভিভূত ইমাম দেখলেন শুধু উঠে দাঁড়ানােই নয়, তিনি হাঁটতেও পারছেন’। মুহুর্তে সংকল্প ঠিক করলেন ইমাম, যিনি কাবুলের সামরিক একাডেমীতে পাঞ্জাবী ইন্সপেক্টরদের বাংগালী দাবিয়ে রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও তার ব্যাচে ৪র্থ স্থান লাভ করে কমিশন পেয়েছিলেন। তিনি ঠিক করলেন পালাতে হবে, বেরিয়ে যেতে হবে এই ” নরকপুরি থেকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে মৃত সহকর্মীদের দিকে আরেকবার তাকিয়ে ইমাম পিছনের জানালার কাছে গেলেন। জানালা খােলার শব্দ হলো, সচকিত হয়ে গেল প্রহরী। মুহূর্ত বিলম্ব না করে বাইরে লাফ দিলেন তিনি। ধপ করে আওয়াজ হওয়ায় লাশ প্রহরারত প্রহরী,ভাবল ভূত দেখছে, চিৎকার করে উঠল সে। ইমাম গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়ে চললেন অন্ধকারে।
এর মধ্যে গুলি হতে থাকল কিন্তু ভাগ্য ভালাে ইমামের, একটা গুলিও তার গায়ে লাগেনি। কখনাে দৌড়ে, কখনাে হেঁটে, কখনাে ক্রলিং করে ইমাম বেরিয়ে এলেন অন্ধকার মৃত্যুপুরী থেকে। সকালের আলােয় তিনি দেখলেন এক বুক সহানুভূতি নিয়ে তাকে ঘিরে গ্রাম বাংলার অনেক মানুষ। যেন মায়ের কোলে ফিরলেন আহত ইমাম। তিনি যত্ন পেলেন, পেলেন সেবা শুশ্রুষা। তারপর সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলেন ভারতে। দেশের আরাে অনেক মুক্তিযােদ্ধার সংগে যােগ দিতে।
ইমাম জানালেন, বন্দী অবস্থায় তিনি ঘরের জানালা দিয়ে বহু বাংগালীকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন। এক জায়গায় বাংগালী ছেলের ভলিবল খেলছিল, তিনি দেখলেন একটি হানাদার সৈন্য সেখানে গিয়ে গুলি চালিয়ে সবাইকে হত্যা করল । ইমাম তাদের আর্তচীৎকার শুনেছেন এবং গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে দেখেছেন। | ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে হত্যাযজ্ঞ চলার সময় লেঃ কর্ণেল মালিক ছিল ৫৩ নং আর্টিলারী অ্যাডভাইজার । ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে হত্যাযজ্ঞ সেই সংগঠিত করেছিল। মূলতঃ তার নির্দেশেই চলে হত্যাযজ্ঞ। এছাড়া মেজর সুলতান, ক্যাপ্টেন জাহিদ জামান, মেজর মােহাম্মদ ইয়াসিন খােকার যে পশু নিজ হাতে গুলি করে মেজর আনােয়ারুল ইসলাম, লেফটেন্যান্ট সালাহউদ্দিন এবং সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান সিরাজী সহ আরাে অনেক অফিসারকে হত্যা করেছে। ক্যাপ্টেন ইফতেখার হায়দারের নেতৃত্বে কুমিল্লা পুলিশ লাইনে হামলা চালানাে হয়। লেঃ কর্ণেল মালিকের নেতৃত্বে ২৯ মার্চ কুমিল্লা শহরে গােলাবর্ষণ শুরু করা হয়। ক্যাপ্টেন আগাবােথারি ও সুবেদার মেজর সুলতান এবং আরাে অনেক হানাদার নরপিশাচ নারকীয় উল্লাসে মেতে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায় বলে ইমাম জানান।
________________________________________
সুবেদার মেজর ফয়েজ সুলতান সম্পর্কে লেফটেন্যান্ট ইমাম বলেন যে এই নরপত ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম সহ বহু লােককে হত্যা করেছে। পাগলা কুকুরের মত এই নরখাদক ক্যান্টনমেন্টে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত এবং বাংগালী.দেখলেই গুলি করে হত্যা করতাে।
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে যে সমস্ত শহীদ বাংগালী সামরিক অফিসারের কথা তিনি বলেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন, লেঃ কর্ণেল জাহাংগীর, লেঃ কর্ণেল আনােয়ারুল ইসলাম, মেজর খালেক, মেজর শহিদুজ্জামান, ক্যাপ্টেন হুদা, ক্যাপ্টেন বদরুল আলম, লেফটেন্যান্ট ফারুক, লেফটেন্যান্ট এনামুল হক, লেফটেন্যান্ট তুর্কে (ডাক নাম), ক্যাপ্টেন আইয়ুব আলী, লেঃ সালাউদ্দিন, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আতিকুর রহমান, সেকেন্ড লেঃ হারুনুর রশিদ, ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন সিদ্দিক প্রমুখ।
রমনীমােহনের জবানবন্দীতে ময়মনামতির মর্মান্তিক কাহিনীর আরাে কিছু অংশ তুলে ধরা হলাে। মার্চের ২৯ তারিখে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে বাংগালী অফিসার বেসামরিক কর্মচারীসহ প্রায় তিনশত লােককে বিগ্রেড হেডকোয়ার্টারের তিনটি কামরায় আটক করে রাখে। বিকাল সাড়ে তিনটায় ৪০ নং ফিল্ড এম্বুলেন্স ইউনিটে কিছু গােলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় । তারপরই আমরা দেখতে পাই ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন এলাকা থেকে সমস্ত বাংগালী অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারীকে বিগ্রেড হেড কোয়ার্টারে নিয়ে জমা করতে থাকে এবং এই সঙ্গে আমাকেও আমার সরকারী বাসগৃহ থেকে ধরে নিয়ে আসে।
তিনি বলেন, বেসামরিক, সামরিক সব বিভাগের সাধারণ ব্যক্তিদেরকেও আটক করা হয়। ৪০ নং এম্বুলেন্স এর ফিল্ড কমাক্তি অফিসার লেঃ কর্ণেল জাহাঙ্গীর সহ অন্যান্য অফিসারদের এনে আমাদের সঙ্গে আটক করে। পরের দিন দুপুরে প্রশাসনিক জেঃ সিঃ ওঃ সুবেদার আকবর খান লেঃ কর্ণেল জাহাঙ্গীর-এর গায়ের জামা খুলে তা দিয়ে তার চোখ বেঁধে ফেলে। তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
তার উত্তরে জল্লাদদ্বয় তাকে ইস্পাহানী স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে বলে জানায়। তারপর তাকে ব্রিগেড অফিস প্রাঙ্গনের আনুমানিক ২৫ গজ দক্ষিণে একটি গর্তের পার্শ্বে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। তাকে এইভাবে গুলি করে হত্যার দৃশ্য আমরা সকল বন্দী ও ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের ব্রিগেডিয়ার থেকে শুরু করে সকল স্টাফ অফিসার নিজ নিজ কক্ষে বসে অবলােকন করি। এর পরপরই ১ মার্চে অবসর প্রাপ্ত সিলেটের অধিবাসী মেজর হাসিব এবং শিক্ষা বিভাগের ক্যাপ্টেন মকবুলকে নিয়ে একই ভাবে পর পর গুলি করে হত্যা করা হয়। ইত্যবসরে ক্যান্টনমেন্টে মুজাহিদ বাহিনীর অফিসার ক্যাপ্টেন মস্তাজ এসে উক্ত জাদয়কে শাসিয়ে বলে যে একজন একজন করে এইভাবে হত্যা করলে সময়ে কুলােবেনা, কারণ তিনশত বন্দী বাংগালীকে হত্যা করতে হবে। ক্যাপ্টেনের ধমক খেয়ে এরপর প্রতি চারজন অফিসারকে এক একটি দড়িতে বেঁধে নিয়ে একই জায়গায় হত্যা করতে থাকে। পরে অন্যান্য সকলকে একেক দড়িতে ১৪ জন করে বেঁধে হত্যা করে। এর মধ্যে কর্ণেল জাহাঙ্গীর, ইয়াকুব আলী, মেজর হাসিব, লেঃ বাতেন, ইঞ্জিনিয়ার্সের
________________________________________
একজন ক্যাপ্টেন, ব্রিগেডিয়ারের সহকারী নায়েব সুবেদার সহ ১৫ জনকে আমি চিনতে পারি। এভাবে সকা পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালানাের পর-১২ জন বেসামরিক লােক থেকে যায়। সন্ধ্যার ঠিক পরপরই একটি পাঞ্জাবী আমাকে বলে যে, “তুমি ঘাবড়িও না তােমার কিছু করা হবে না ব্রিগেডিয়ার সাহেব বলেছেন। | রমনী শীল জানান তার সঙ্গে যে ১২ জন বেসামরিক লােক ছিল তারা হচ্ছেন ইস্পাহানী হাই স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষের দুই পুত্র, চারজন নর সুন্দর ও ছয়জন ঝাড়ুদার । সেই কালাে রাত্রি কিভাবে তারা কাটিয়েছেন তার বর্ণনা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। একদিন তােরে মুজাহিদ বাহিনীর সেই জল্লাদ ক্যাপ্টেন মস্তাজ এসে এই বন্দী ১২ জনের সবাইকে বিগ্রেডের কর্মচারী বলে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, এবং নিজ নিজ কাজে যােগ দেওয়ার জন্য হুকুম দেয়। সে সময় সহকারী অধ্যক্ষের দুই ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে যখন জানতে পারে যে, তারা ব্রিগেডের কর্মচারী নন, তখনই তাদেরকে ঐ গর্তের পার্শ্বে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রমনী শীল জানান যে, সারুদিন চোখের সামনে শত শত বাংগালী হত্যার দৃশ্য দেখা এবং সেই সঙ্গে কালাে রাত্রিটি অতিবাহিত করা যতটা অসহনিয় ছিল তার চাইতে কঠিন ও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ালাে যখন তাকে নিয়মিত জল্লাদের দাড়ি কাটার নির্দেশ দেওয়া হলাে।
অশ্রুসিক্ত রমনী শীল আরাে জানান যে, তিনি শুধু ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের বিপরীত। দিকে ২৪ নং এফ, এফ রেজিমেন্টের কোয়ার্টার গার্ড, ক্যান্টনমেন্ট এর বিভিন্ন ইউনিট হতে জমাকৃত কয়েকশত বাংগালীকে ফতেহ মােহাম্মদ ষ্টেডিয়ামের দক্ষিণ প্রান্তে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন। এই কাহিনী বলতে গিয়ে রমনী শীল কখনাে হু হু করে। কেঁদে ফেলেছেন, আবার কখনাে চুপচাপ থ’ হয়ে গেছেন। তিনি গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বরেন, “বােধ হয় এসব দেখার জন্যই আমি শত শত মৃত্যুর মাঝেও’ বেঁচে ছিলাম”। আমার বাসা ও ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের মাঝামাঝি জায়গাতেই লেঃ কর্ণেল জাহাঙ্গীর সহ ১৪ জন অফিসার ও শতাধিক অন্যান্য বাংগালীকে একটি গর্তে মাটি চাপা দিতে দেখি। ঐ সব লােককে মাটি চাপা দেওয়ার সময় গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে কয়েকজন নর খাদককে ক্ষের কর্ম করতে হয়।
সেখান থেকে দেখতে পাই ফতেহ মােহাম্মদ স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশের গর্তে নিক্ষিপ্ত কয়েকশত মৃতদেহের উপর পেট্রোল দিয়ে অগ্নিসংযােগ করা হচ্ছে। পরে বুলডােজারের সাহায্য গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়। রমনী শীল বলেন, সে সব মৃত দেহের কংকাল আমি এখনাে মাটি খুড়ে তুলে দিতে পারব। আড়াই দিন অনাহারে থাকার পর রমনী শীল তার বাসায় পৌছার সময় দেখতে পান একটি বৃহদাকার ট্রাক ভর্তি মৃতদেহ শহর থেকে ফতেহ মােহাম্মদ স্টেডিয়ামের দক্ষিণ পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ট্রাকটি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় সমস্ত রাস্তাটি রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল । এপ্রিল মাস থেকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক বাহিনীর গােয়েন্দা বিভাগ এফ, আই ওতে কাজ করার সময় যে দৃশ্য দেখেছেন তার বর্ণনা প্রসঙ্গে রমনী শীল বলেন, এফ, আই ওর
________________________________________
অত্যাচার থেকে ব্রিগেড অফিসের সামনের হত্যাকাণ্ড অনেক ভাল ছিল। মেজর সেলিমের এফ আইও ইউনিটে যাদেরকে একবার নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে খুব কম লােকই ফিরে এসেছে। বন্দীদের সেখানে চোখ তুলে কয়েকদিন ফেলে রাখা হতাে।
আগষ্ট মাসে রমনী শীল সি, এম, এইচ, এ বদলী হন। সেখানে তার বাসগৃহের পাশেই হানাদার সৈন্যদের লাশ কবর দেওয়া হত। এই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে রমনী শীল উৎসাহব্যাঞ্জক কণ্ঠে বলেন, সারাদিন কাজ করেছি আর সন্ধ্যায় ঘরে বসে পাক হানাদারদের কবরের সংখ্যা গুনেছি। লক্ষ্য করতাম দিন দিন তাদের কবরের সংখ্যা বাড়ছে। রাতে এ সমস্ত কবর খনন করা হত। এ দৃশ্য মনে আশার আলাে নিয়ে আসত। মনে মনে ভাবতাম, যে নির্যাতন ও রক্তক্ষয় দেখেছি, তা বৃথা যায়নি। প্রতিশােধ নেওয়া হচ্ছে। তা নাহলে শত শত পাক সেনা কিভাবে লাশে পরিণত হয়?
চারদিকে শুধু কংকাল আর কোল টিকা, নিয়াজী, ফরমান আলীর নরপশুরা ঠান্ডা মাথায় বাঙালী নিধনের পৈশাচিকতায় ইহুদী হত্যাযজ্ঞের নায়ক আইকম্যানকেও হার মানিয়েছে। জল্লাদ পাক বাহিনী যে কি নির্মম, কি বর্বর আর পাষন্ড ছিল তা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের হাজার হাজার বাঙালীর কংকাল, সামরিক বেসামরিক পােশাক, খসে পড়া মাথার খুলি, হাত পা বাঁধা অবস্থায় বিকৃত লাশ, নিজ চোখে না দেখলে অনুমান করাও সম্ভব নয়।
ময়নামতিতে হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চের পর থেকে যে হিংস্রতা আর বর্বরতার প্রমাণ রেখে গেছে তা কেবল আজকের মানুষই শুধু নয়, ভবিষ্যতের মানুষও তা শুনে ঘৃণায় আর ভয়ে শিউরে উঠবে। গােটা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টই ছিল একটি কসাইখানা। কসাই হিল হানাদার বাহিনী আর তাদের দালালরা। সেখানে তারা খুন করেছে হাজার হাজার বাঙালীকে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকাটা পাহাড়ি অঞ্চল। উচু নিচু, কোথাও কিছুটা সমতল ভূমি যা ঘন কাশবনে ভরা।
এখানে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষর দেখা যায় তা যেমন ভয়ংকর তেমনি মর্মবিদারক। চারিদিকে কংকাল আর কংকাল। মনসুর আলী দীর্ঘ দিন ধরে এখানে জুতা মেরামতের কাজ করতাে, বাঙালী নিধন পর্বের সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী। সে জানায় এখানে আমী এডুকেশন কোরের ক্যাপ্টেন মকবুলসহ মােট ২৪ জনের লাশ একটা গর্তে চাপা দেওয়া হয়। মনসুর অসংখ্য গর্তে দেখলাে। যে সব গর্ত হতে শশয়াল প্রতিদিন লাশ টেনে বের করেছে। সে সব গর্ত থেকে ভেসে আসতাে পুঁতি গন্ধ। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি মাঠ। সেখানে সৈন্যবাহী হেলিকপ্টার উঠানামা করতাে।
ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণে আরাে একটি মাঠ। কিছুটা নীচু এই মাঠের সমস্ত জায়গা জুড়ে রয়েছে গর্তের পর গর্ত। প্রতিটি গর্তেই অসংখ্য কংকাল আর মাঠে ছড়িয়ে রয়েছে শত শত অসহায় বাঙালীর হাড় আর মাথার খুলি। কোথাও পড়ে রয়েছে খসে পড়া মাথার
________________________________________
| চুল। পূর্বদিকে বিরাট তিনটি ডােবা দেখালাে মনসুর আলী। দেখলেই বােঝা যায় সেখানে মাটি কেটে আবার চাপা দেয়া হয়েছে। কয়েক হাজার মানুষের লাশ এখানে চাপা দেয়া হয়েছে বলে সে জানালো।
২৯ মার্চ বিকেল চারটার দিকে ব্রিগেড অফিসার পাশে একটি কুল গাছের নিচে বাঙ্গালী সামরিক অফিসারদের ওলী করে নির্মমতাবে হত্যা করা হয়। প্রথমে একজন করে ও পরে তাড়াতাড়ি নিধন যজ্ঞ সমাধানের জন্য সারি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ঐকুল গাছের নিচে নিয়ে বন্দীদের গুলী করে হত্যা করা হয়। পরদিন ভাের বেলা তাদের মাটি চাপা দেয়া হয়। ঐদিন অন্ততঃ তিনশতেরও বেশী লােককে খুন করা হয়েছে। মনসুরের সাথে যারা বন্দী। ছিল তাদের মধ্যে অতি আবশ্যক কাজ সমাধানের জন্য দু’চারজনকে রেখে বাকি সবাইকে ৩০ মার্চ খুন করা হয় । ময়নামতিতে সকল জঘন্যতম পৈশাচিক হত্যাকান্ড সংগঠিত হয় ব্রিগেডিয়ার শফির নেতৃত্বে। হত্যাযজ্ঞে তার সহযােগী ছিল কর্ণেল খিজির হায়াত খান, আর্টিলারীর লেফটেন্যান্ট মীর, মেজর সুলতান আহমেদ, ক্যাপ্টেন বােখারী, ক্যাপ্টেন জাবেদ ইকবাল, লেফটেন্যান্ট কর্ণেল বাকি, সিকিউরিটি বিভাগের মেজর সেলিম, মেজর মােস্তফা, মেজর সিদ্দিকী ও ক্যাপ্টেন কবির। এই নরপশুদের পৈশাচিকতায় সহযােগিতা করে কুমিল্লা ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের প্রিন্সিপাল অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এম, কে, আমীন ও কুমিল্লা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বাঙালী ম্যানেজার আলীম।
মনসুর আলী জানিয়েছে যে ১১৭ নং ব্রিগেডের খান সেনারা বহু তরুণী, যুবতী এমনকি কোলে নবজাতকসহ মহিলাদেরকেও ক্যান্টনমেন্টে ধরে এনেছে। এদের ভাগ্যে করুণ পরিণতি ঘটেছে সামরিক ছাউনীর পাশে দ্বিতলে ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের উপরের সব কয়টি কক্ষে ৯ মাস ধরে নির্যাতিত মহিলারা বন্দী ছিলেন। তাদের আর্ত চীৎকার আশপাশের লােকজন প্রতিদিন শুনতে পেত। মিত্র বাহিনী কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে কয়েকশ লাঞ্চিতা মহিলাকে উদ্ধার করে বলে কোতােয়ালী পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর বজলুর রহমান জানিয়েছেন। ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলের শিক্ষক মােহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের অবাঙালী শিক্ষকদের কাছ থেকে শুনেছেন এখানে ত্রিশ হাজার বাঙালীকে নিধন করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে ছাত্র হত্যা কাহিনী ২৭ মার্চ হানাদার বাহিনীর গাড়ীর শব্দে নারায়ণগঞ্জের শান্ত পরিবেশ ভেংগে গেল। শহরের জামতলায় সহযােদ্ধাদের নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা মােশাররফ হােসেন মাশা প্রস্তুত হয়েই ছিলাে। ওদের রাইফেল গর্জে ওঠে। হানাদার বাহিনী থমকে দাঁড়াল। দুদিন ধরে। যুদ্ধ চলে। ২৯ মার্চ হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করে। মর্টারের গর্জনে, ট্যাংকের
________________________________________
নিনাদে ভীত সন্ত্র শহরবাসী পালাতে থাকে শহর ছেড়ে। এ দিনের জনকোলাহল মুখর শহরে নেমে এলাে মৃত্যুর বিভীষিকাময় শীতল নীরবতা।
তখন সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। হানাদার বাহিনীর গাড়ীগুলাে ঘুহে এদিক ওদিক। ছাত্র নেতা মাশা ছাত্রলীগ কার্যালয়ে গােপনে সহকর্মীদের নিয়ে ভাবছে কি করা যায় ।
এমন সময় নারায়ণগঞ্জের জনৈক কুখ্যাত দালালের ইংগিতে হানাদার বাহিনী সেখানে প্রবেশ করে ওদের আক্রমণ করলাে। হানাদার বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে মাশা ঢলে পড়ে। তার বুকের রক্তে ভিজে যায় কার্যালয়ের কক্ষতল। আহত মাশা বুক চেপে ছুটে যায় ওর মা বাবার কাছে। বলে, ডাক্তার ডাকো-বাঁচবাে, আমাকে বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ভাই-বােনকে। কিন্তু কোথায় ডাক্তার? শহরে তখন ভীতির রাজত্ব, চারদিকে তখন আর্ত মানুষের মরণ হাহাকার। বিনা চিকিৎসায় রাত ১ টায় এই তরুণ দেশ প্রেমিক মাতৃভূমির মুক্তির সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে যায়।
মাশা আজ আমাদের মধ্যে নেই কিন্তু কি জানতাে এমনি করে ওকে বিদায় নিতে হবে ওর এত প্রিয় বাংলাদেশ থেকে। ও কি ভেবেছিলাে ওরা নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়বে ওদেরই ভিক্ষা করে আনা অস্ত্র নিয়ে। হানাদার বাহিনী ওদের উপর আক্রমণ চালালে বীরের মতােই তাদের আটকাতে গিয়েছিল ছাত্রলীগের আরেক সাহসী তরুণ চিত্ত। গর্জে উঠলাে হানাদার বাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্র। চিত্ত ঢলে পড়লাে ওদের টান বাজারের ছাত্রলীগের কার্যালয়ের কক্ষতলে। হানাদার বাহিনী একটি গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, পরপর চারটি গুলি করেছে, তারপর মৃতদেহটি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে তার মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছিলাে। | ২৭ মার্চ শনিবার, হানাদার বাহিনীর ৫০ টি ট্রাক ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দিকে যাত্রা করে। দীর্ঘ ১০ মাইল পথের দু’ধারে হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসলীলা চালাতে চালাতে তারা অগ্রসর হয়। কামানের গােলা আর শেল নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে একাকার করে মানুষের ঘর বাড়ী। অবশেষে নারায়ণগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে এসে তারা প্রচন্ড প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। এখানে হানাদান দস্যুরা নিরীহ নিল মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ে হত্যা করেছিল অসংখ্য মানুষ।
পাকবাহিনীর কেরানীগঞ্জ ধ্বংসযজ্ঞ ২ এপ্রিল উনিশশাে একাত্তর। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পৃথিবীর ঘূন্যতম পশুদের আক্রমণে ঝরে গেল শত শত প্রাণ। লুষ্ঠিত হলাে কেরানীগঞ্জ, ছাই হয়ে গেল গ্রামের পর গ্রাম। ধর্ষিতা হলাে কেরানীগঞ্জের অসংখ্য মা-বােন। রক্তের বন্যা বয়ে গেলে প্রতিটি গ্রামে।
২৫ মার্চের কালাে রাত্রিতে বর্বর পাকবাহিনী যখন আক্রমণ চালায় ঢাকা নগরীতে, যখন নরপশুরা মর্টার আর মেশিনগানের টিমরােলার চালায় তখন নগরবাসীদের হাহাকার
________________________________________
আর্তনাদ আর করুণ চিৎকারে কেরানীগঞ্জবাসী শুধু আশ্চর্য ও বিমূঢ়ই হয়নি, প্রতিবাদ তুলেছিল, দলে দলে এসে জমায়েত হয়েছিলাে নদীর ঘাটে, মুখে ছিলাে তাদের দৃঢ়তার ছাপ। মনে ছিলাে নতুন শপথ। ওপারের প্রতিটি গুলি প্রতিধ্বনি হয়েছিলাে নদীর এপারের গভীর রাতের নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে। | পঁচিশে মার্চের কালাে রাত্রি পেরিয়ে ভাের হলাে। নগরবাসীরা প্রাণ ভয়ে নগরী ছেড়ে কেরানীগঞ্জের গ্রামে এসে ভীড় করতে লাগলাে । গন্তব্যস্থল ঠিক নেই, সম্পূর্ণ অচেনা গ্রাম, টাকা পয়সা জিনিষপত্র কিছুই নেই সাথে। শুধু একটু ঠাই, একটু বাচার প্রচেষ্টা। ২৬ মার্চের পরে নগরীর প্রায় সমস্ত লােক বুড়িগংগা পেরিয়ে চলে এলাে কেরানীগঞ্জে। যে যেভাবে পেরেছে ছুটে এসেছে। প্রায় প্রত্যেকেই স্বজন বিঘ্নি। আবাল বৃদ্ধ বনিতা প্রত্যেকেই চলে এলেন কেরানীগঞ্জে। প্রত্যেককে আপন করে নিল কেরানীগঞ্জের মানুষ। অবশেষে নেমে এলো বিভীষিকাময় সেই ২ এপ্রিল। ঘৃন্য পশুরা শহর থেকে দৃষ্টি ফেরালাে কেরানীগঞ্জের দিকে। | ২ এপ্রিলের আগের রাতে কেরানীগঞ্জের অনেক স্থানে শােনা গেলাে এক চাপা গুঞ্জন-মিলিটারি আসতে পারে। অবশেষে তাই সত্যি হলাে। কেরানীগঞ্জের মানুষ যখন ঘুমে অচেতন তখন হঠাৎ শােনা গেলাে মেশিনগান আর মর্টারের শব্দ। অনেকে লাফিয়ে উঠলাে ঘুম থেকে। যে যেখানে পারলাে ছুটাছুটি করতে লাগলাে। শুরু হলাে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। চারিদিকে কেবল চীৎকার, শুধু প্রাণ বাঁচানাের আকুল চেষ্টা। পশুরা রাত্রি ভর প্রস্তুতি নিয়ে কেরানীগঞ্জকে ঘিরে রেখেছিলাে। ক্ষেতের মধ্যে নালা কেটে যখন তারা অবস্থান নেয় কেরানীগঞ্জবাসী তখন ঘুমে অচেতন। ঝােপ, ঝড়, পুকুর, ঘরের ছাদ যে যেখানে পারলে সবাই আত্মগােপন করলাে। কিন্তু খুনী টিক্কার কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার বশীর রেহাই দেয়নি কাউকে। গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিলাে। মেশিনগান আর টমিগানের প্রচন্ড আওয়াজে সকলেই বিচলিত। চলল জিনজিরা, সুভাড্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নের লােকদের উপর গুলী, অগ্নিসংযােগ, লুঠন। ধর্ষিতা হলাে কেরানীগঞ্জের অসংখ্য মা-বােনেরা। প্রত্যেকটি ঘর আক্রান্ত হলাে তিনটি ইউনিয়নের। হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটলাে এক রক্তাক্ত কাহিনীর মধ্যে। প্রতি গ্রাম থেকে খবর এলাে অসংখ্য মৃত্যুর। রক্তে রঞ্জিত শত শত লাশ, পিতার বুকে জড়ানাে শিশুর লাশ, মার কোল থেকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়া শিশুর বিকৃত বিভৎস লাশ, বর্বর পিশাচের দল রক্তের নদী বইয়ে গেলাে অসংখ্য লাশ। এমন কোন বাড়ী নেই, যে বাড়ী ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। সেদিন পড়ে থাকা লাশের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আপন জনকে খুঁজে ফিরেছে কেরানীগঞ্জের মানুষ। খানসেনারা প্রত্যেক গ্রামে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করেছে। শহর থেকে আসা অনেক অপরিচিত লােকরা লাশ কবর দিয়েছে এখানকার লােকেরা। | মােন্দাইল সড়কের সামনের পুকুর পাড়ে দস্যুরা এক স্থানেই ষাটজন লােককে হত্যা করে। কালিনুদীর এক বাড়ীতে বর্বর বাহিনী পাশবিক অত্যাচার করতে গিয়ে এগারজন মহিলাকে হত্যা করে। খােলা মাঠ ও গ্রাম দিয়ে যখন গ্রামবাসী ছুটাছুটি করে প্রাণ ভয়ে
________________________________________
তখন খান সেনারা চালিয়েছে ব্রাশ ফায়ার। বহু লাশ এখানে সেখানে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে ছিল। ইতস্তত বিকৃত বিভৎস বহু লাশ দেখে সংজ্ঞাহীন হয়েছে এখানকার মানুষ। মেয়েকে পিতার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া, ভাইকে বােনের সামনে মারা, সন্তান সম্ভবা মাকে ছেলের সামনে হত্যা প্রভৃতি করুণ দৃশ্য দেখার অবিজ্ঞতা নিয়ে আজো বেঁচে আছে। কেরানীগঞ্জের মানুষ।
জল্লাদরা স্বামীর লাশটাও দেখতে দিলনা বিপ্লবী বাংলার বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। সর্বত্র অসহযােগ। রাস্তায় রাস্তায় বীর জনতার মিছিলের পদভারে বন্দর নগরী প্রকম্পিত । বিপ্লব আর বিদ্রোহ দশদিক মুখরিত। সংগ্রামী উদ্দীপনার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলছিলাে বীর চট্টলার অধিবাসীরা। সংগ্রাম মুখর সে নগরীর লাখাে পরিবারের একটি নাসিরউদ্দিন আহমদের পরিবার। | ২৫ মার্চ খানসেনারা নেকড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়লাে নিরস্ত্র বাংগালীদের উপর। এক পৈশাচিক নরহত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলাে তারা। বাঙালীর রক্তে হােলি খেললল দস্যু সেনারা। মিসেস কামরুন নাহার আহমদ স্বচক্ষে দেখলেন এই হত্যাযজ্ঞ। সেই বিভৎস দিনগুলাের বর্ণনা দিতে লাগলেন তিনি, হত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞের এক লােমহর্ষক বিবরণ। কামরুন নাহার আহমেদ বললেন, আমরা থাকতাম পাহাড়তলী রেলওয়ে কলােনীতে। রেলের অবাঙালী কর্মচারীর সংখ্যাই বেশী ছিল সেখানে। ২৫ মার্চের আগে আমরা তাদের রক্ষা করেছি। কিন্তু ২৫ মার্চের ঘটনা প্রবাহ ঘুরে গেল। তারা হামলা চালালাে আমাদের উপর। লুটতরাজ, হত্যা আর নারী নির্যাতন চললে নির্বিচার ভাবে। ২৭ মার্চ দস্যু বাহিনী শুরু করলে বােমা বর্ষণ। হােসেন গ্লাস ফ্যাক্টরী, ম্যাডিকেল কলেজ ও কালুর। ঘাট প্রভৃতি এলাকায়।
৩১ মার্চ খান সেনাদের পুরাপুরি দখলে চলে গেল চট্টগ্রাম নগরী। শুরু হলাে বাঙালী নিধন। ২ এপ্রিল আমরা বাসা ছেড়ে পাশের এক বাড়ীতের আশ্রয় নিলাম। খান সেনারা আর অবাণীরা আমার স্বামীকে খুঁজতে লাগল। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে গােপনে কাজ করতেন।
এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা সেখানেই থাকি। ৫ তারিখে আমরা জানালা দিয়ে দেখলাম আমাদের প্রতিবেশী রেলের চীফ ইঞ্জিনিয়ার মােজাম্মেল চৌধুরী, একাউন্টস অফিসার আবদুল হামিদ, এল, আর খান এবং তাদের পরিবারের মােট ১১ জনকে রাস্তায় জবাই করে হত্যা করা হলাে। সকাল ১১ টায় এই হত্যালীলা দেখে আমরা আঁতকে উঠলাম। সেদিনই পালিয়ে গিয়ে উঠলাম ২০ নং চৌধুরী নাজির আহমদ রােডে ডাঃ সামসুল আলমের বাড়ীতে। সে স্থানও নিরাপদ ছিল না। তাই ডাক্তার সাহেবের পরামর্শে পালালাম তার ডাবুয়ার্গ এর বাড়ীতে। ১১ মে পর্যন্ত সেখানে আমরা থাকি। মিসেস কামরুন বলেন, এই ১১ মে আমাদের জীবনে নেমে আসে দুঃখের অমানিশা।
________________________________________
নগদ অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় আমার স্বামী একটি চেক ভাংগানাের জন্য ডাক্তার সাহেবের ছেলেকে পাঠান চট্টগ্রাম।
রেলওয়ে বিল্ডিং এর ন্যাশনাল ব্যাংকের শাখা অফিসে তার একাউন্ট ছিল। কিন্তু সেখানকার কর্মচারীরা সবাই ছিল অবাঙালী। চেকের দস্তখত দেখে তারা ছেলেটিকে আমার স্বামীর খোঁজ দিতে বলে। কিন্তু চেকের ব্যাকডেট এর অজুহাত দেখিয়ে ছেলেটি কিছু জানতে অস্বীকার করলে তারা রেলওয়ে ওয়াচ এন্ড ওয়ার্ড এর অবাঙালী অফিসার ওয়াসীকে ডেকে আনে। ওয়াসী তখন ছেলেটিকে ও তার বাবা ডাঃ সামসুল আলমকে ধরে সেনাবাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের অকথ্য অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে আমার স্বামীর সন্ধান বের করে। তারপর দুজন খান সেনাকে সংগে নিয়ে ওয়াসী রাউজানের ডাবুয়া গ্রামে ডাক্তার সাহেবের বাড়ীতের গিয়ে হাজির হয়। তারা আমার সামনে থেকে আমার স্বামীকে নিয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হয়। তাদের সংগে ডাক্তার সাহেব ও তার ছেলেও ছিল।পথে সাত্তার ব্রিজের কাছে বাস থামিয়ে খান সেনারা আমার স্বামীকে নামিয়ে খানিক দূরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই গুলীর শব্দ পান ডাক্তার সাহেব। মিনিট দশেকের মধ্যে খানসেনারা ফিরে আসে এবং ডাক্তার সাহেবকে চট্টগ্রাম নিয়ে ছেড়ে দেয়।
আমার স্বামীকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে ডাক্তার সাহেব আমাকে জানান। মিসেস কামরুন নাহার তারপর এসে উঠলেন ঢাকাতে। অনেক। অনুসন্ধান করেও স্বামীর সন্ধান পাননি। দস্যু সেনাদের হাতে নাসিরউদ্দিন শহীদ হয়েছেন। জীবন দিয়ে নাসিরউদ্দিন মূল্য দিলেন তার দেশ প্রেমের ।।
মিসেস কামরুন নাহারের একটিমাত্র আক্ষেপ জল্লাদরা স্বামীর লাশটাও তাকে দেখতে দিলনা। রাস্তায় নিয়ে না মেরে তাকে যদি তার সামনেই হত্যা করত তাহলে অন্তত নিজ হাতে তিনি স্বামীর লাশটা কবর দিতে পারতেন।
নৃশংস বর্বরতার রেকর্ড ভাগীরথীকে ওরা জীবন্ত জীপে বেঁধে শহরের রাস্তায় টেনে হিচড়ে হত্যা করেছে। দস্যুরা হয়তাে পরখ করতে চেয়েছিলাে ওরা কতখানি নৃশংস হতে পারে। এক্ষেত্রে তারা বর্বরতার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অষ্টাদশী ভাগীরথী ছিলাে বরিশাল জেলার পিরােজপুর থানার বাঘমারা কদমতলার এক বিধবা। বিয়ের এক বছর পর তাকে বরণ করে নিতে হয় বৈধব্য।
স্বামীর বিয়ােগ ব্যথা তার তখনও কাটেনি। এরই মধ্যে দেশে নেমে এলাে ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনী। মে মাসের এক বিকেলে ওরা চড়াও হলাে ভাগীরথীর গ্রামে। হত্যা করলে যাকে যেখানে যেভাবে পেল। এ নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের মধ্যে ভাগীরথীকে ওরা মারে, ওর দেহলাবণ্য দস্যুদের মনে লালসা জাগিয়েছিল। ওকে ট্রাকে তুলে নিয়ে এ পিরােজপুর। তারপর ক্যাম্পে রুেখে তার উপর চালানাে হলাে হিংস্র পাশবিক অত্যাচার ।
________________________________________
ভাগীরথী এ পরিস্থিতিতে মৃত্যুকেই একমাত্র পরিত্রাণের উপায় ভাবতে লাগলাে। ভাবতে ভাবতে এক সময় এল নতুন চিন্তা-হ্যাঁ মৃত্যুই যদি বশ করতে হয়, ওদেরই রেহাই দেব কেন? ভাগীরথী কৌশলের আশ্রয় নিলাে এবার। এখন আর অবাধ্য মেয়ে নয় দস্তুর মতাে খানদের খুশী করতে শুরু করলাে। ওদের আস্থা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলাে। বেশীদিন লাগলাে না, অল্প দিনেই নারী লােলুপ ইয়াহিয়া বাহিনী ওর প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করল। আর এই সুযােগে ভাগীরথী ওদের কাছ থেকে জেনে নিতে শুরু করলাে পাকবাহিনীর সব গােপন তথ্য। এক পর্যায়ে বিশ্বাসভাজন ভাগীরথীকে ওরা নিজেদের ঘরেও যেতে দিল। আর কোন বাধা নেই। ভাগীরথী এখন নিয়মিত সামরিক ক্যাশে যায় আবার ফিরে আসে নিজ গ্রামে। এরই মধ্যে চতুরা ভাগীরথী তার মূল লক্ষ্য অর্জনের পথেও এগিয়ে গেল অনেকখানি। গােপনে মুক্তি বাহিনীর সাথে গড়ে তুলল ঘনিষ্ট মােগাযােগ।
এরপরই এলাে আসল সুযােগ । জুন মাসের মাঝামাঝি একদিন ভাগীরথী খান সেনাদের নিমন্ত্রণ করলাে তাঁর নিজ গ্রামে। এদিকে মুক্তিবাহিনীকে তৈরী রাখা হলাে যথারীতি । ৪৫ জন খানসেনা সেদিন বাঘমারা কদমতলা এসেছিলাে, কিন্তু তার মধ্যে ৪/৫ জন ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছিলাে।
এরপর আর ভাগীরথী ওদের ক্যাম্পে যায়নি। ওরাও বুঝেছে, এটা তারই কীর্তি। তা হুকুম দিল জীবিত অথবা মৃত ভাগীরথীকে যে ধরিয়ে দিতে পারবে তাকে নগদ একহাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। কিন্তু ভাগীরতী তখনও জানতােনা ওর জন্য আরও দুঃসহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। একদিন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লাে ভাগীরথী। তাকে নিয়ে এলাে পিরােজপুর সামরিক ক্যাম্পে। খান সেনারা এবার ভাগীরথীর উপর তাদের হিংস্রতার পরীক্ষার আয়ােজন করলাে। এক হাটবারে তাকে শহরের রাস্তায় এনে দাঁড় করানাে হলাে জনবহুল চৌমাথায়। সেখানে প্রকাশ্যে তার শাড়ী খুলে ফেললাে কয়েকজন খান সেনা। তারপর দড়ি দিয়ে দু’পা জিপে বেঁধে শহরের রাস্তায় টেনে নিয়ে বেড়ালাে মহা উৎসবে। ঘন্টা খানেক পরিক্রমার পর আবার যখন ফিরে এলাে সেই চৌমাথায় তখন ওর প্রাণের স্পন্দন থেমে গেছে। ভাগীরথী এমনি ভাবে মিশে গেল বাংলার ধুলিকণার সাথে। কেবল ভাগীরথী নয় আরও বহু মুক্তিযােদ্ধাকে ওরা এমনি করে পিরােজপুর শহরে হত্যা করেছে।
রমনা পার্কের বধ্যভূমি রমনা পার্কের উত্তর পূর্ব কোনটা ছিল পাক সামরিক চক্রের বধ্যভূমি। রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত রমনা পার্কের পুরাে জায়গাটাই প্রায় জুড়ে রয়েছে নানা বর্ণের বাগান বিলাসের রঙিন কুঞ্জ।
এই পার্কের বড় বড় গর্তে এবং পাশের উচু নীচু স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে নরকঙ্কালের অস্থি এবং মাথার খুলি। এখানকার অনেকেই জানিয়েছে যে, পশুরা অসংখ্য মানুষ ট্রাকে করে প্রেসিডেন্ট হাউসের মধ্যে নিয়ে হত্যা করার পর গর্তের মধ্যে পুতে রাখতাে।
৩০৪
________________________________________
বৃষ্টির পানিতে গর্তগুলাে যখন ভরে যেতো তখন পানির সাথে আধপচা লাশ এবং ফুল কলেজের বই ভেসে উঠতাে। এসব লাশের মধ্যে বহু মহিলার লাশও দেখা যেত। রমনাপার্কের বধ্যভূমিতে হতভাগ্য ভাইবোেনদের যে সমাধিস্থল রচিত হয়েছিলাে আজ তার চিহ্ন মাত্র নেই।
এরা সেই হতভাগ্য যারা অসহযােগ আন্দোলনের সময় শুধু দেশ প্রেমের শপথ নিয়ে শূন্য হাতে রুখে দাঁড়িয়েছিল জল্লাদ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে।
সাভারের কয়েকটি হত্যাকাহিনী। একাত্তরে কতজীবন অকালে ঝরে পড়েছে কে তার হিসাব রেখেছে। বাংলার হাটে মাঠে ঘাটে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য নরকঙ্কাল যা একত্র করলে হয়ে উঠবে এক কঙ্কালের পাহাড়। | বর্বরদের পৈশাচিক নৃত্যশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু স্বজন হারানাের হাহাকার শেষ হয়নি। এমনি এক অভাগিনী স্বামী হারা সাভারের হরিপদ মজুমদারের স্ত্রী। শুভ্র বসনে বসেছিলেন। হরিপদ বাবুর কথা জিজ্ঞাসা করা হলাে, কোন ভাষা নেই তার মুখে। মুন্সিগঞ্জের কেওয়াড় গ্রামের পাশে একটি খাল আছে। সেই খালের পাশে আজো বহু নরকঙ্কাল ছড়িয়ে রয়েছে। এরই মাঝে মিশে রয়েছে হরিপদ মজুমদারের মৃতদেহটি। হরিপদ মজুমদারের বয়স হয়েছিল ৩৫ বৎসর। কর্মজীবন শুরু হয়েছিলাে মাত্র।
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দিলেন সকল কলকারখানা বন্ধ। তাই কাজে যােগ দেননি। তারপর ২৫ মার্চ নিয়ে এলাে বাংলার বুকে তমসাচ্ছন্ন এক বিভীষিকাময় রাত । দিকে দিকে আগুন আর কান্নার রােল। হরিপদ মজুমদার পালালেন। স্থান নিলেন মুন্সিগঞ্জের কেওড়ার গ্রামে। কিন্তু মৃত্যুর সাথে এত সংগ্রাম করেও বাঁচতে পারেনি। ১৪ মে নেমে এলাে জীবনের শেষ পরিণতি হরিপদ মজুমদার সহ আরও ২১ টি নিস্পাপ প্রাণের। পাক মেজর জাভেদ আক্তারের পরিচালনায় গ্রাম ঘেরাও করা হলাে। এরা ২২ জন ধরা পড়লো । খালের পাড়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করান হলাে। তারপর নৃশংস অত্যাচার। তাদের হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী চীৎকারের মধ্যে দিয়ে শেষ হলাে সবকটি জীবন।
৮ ই ডিসেম্বর ভাের রাত। অন্যদের সাথে নির্মলও তখন ঘুমিয়ে। হঠাৎ বাইরের বিকট আওয়াজে সকলেরই ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দাঁড়াতেই দেখা গেল চারদিকে কুখ্যাত আলবদর পাকবাহিনীর দল তাদের দিকে অস্ত্র নিশানা করে দাড়িয়ে হিংস্র দৃষ্টিতে আপাদমস্তক অবলােকন করছে।
তারপর নির্মল সহ অন্যান্য কয়েকজনকে পাশেই এক বদ্ধ ভূমিতে নিয়ে যাওয়া হলাে। কিছুক্ষণ পর কয়েকটি গুলির আওয়াজ এবং সংগে সংগে হৃদয় বিদারক চী কার। তারপর গভীর নীরবতা, সবশেষ । ছেলের এমন মৃত্যু কাহিনী বলতে বলতে এক
________________________________________
সময় নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। সাভারের আরেক সন্তান হারা পিতা বীরেন্দ্র রায়। ছেলের ছবি বুকে ধরে আজো তিনি হাউমাউ করে কাঁদেন।
ঢাকার দুলীচাদ ফার্ম থেকে নির্মল রায়ের সাথে যারা জীবনের শেষ সংগী হয়েছিলেন তাদের একজন হলেন সূর্যকান্ত রায়। সূর্যকান্ত রায়ের স্ত্রীর বিলাপে আজো প্রতিবেশীদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
উমেশ চন্দ্র সাহা। বয়স ২৮ বৎসর। সংসারের দারিদ্রকে কাটিয়ে উঠতে ম্যাট্রিক পাশ করার পরই সংসারের হাল ধরেছিল। একই দিনে জয় গােপাল সাহা, মতিলাল সাহা সবাইকে বর্বরদের হাতে আত্মহুতি দিতে হয়েছিল, দিনটি ছিলাে ৮ ডিসেম্বরের কালােরাত ।
রংপুর জেলাটাই যেন বধ্যভূমি “আবার গােলযােগ হলে আমাদের পালানাের জায়গা আছে। ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেবাে, বেঁচে যাবাে,ভাই, আপনারা যাবেন কোথায়? আপনাদের যে আর কোন পথ রইল
।” সহকর্মীদের জন্য অকৃত্রিম সমবেদনায় সহকারী অধ্যাপক রেজাউল হককে এই কথাগুলাে বলেছিলেন বরিশাল জেলার অধিবাসী অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী, ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে। আইয়ুবের যােগ্য উত্তরসুরি রক্তপিপাসু নয়া সামরিক শাসক ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারীকে কেন্দ্র করেই তাদের মধ্যে কথা হচ্ছিলাে।
কিন্তু না। অধিকারী পালাতে পারেন নি। বাঁচাতেও পারেন নি তার প্রাণ। সৌভাগ্ৰক্রমে অধ্যাপক রেজাউল হক আজো বেঁচে আছেন। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীর আক্রমণ শুরুর পর অধ্যাপক অধিকারী পালিয়ে ছিলেন। গাইবান্ধা মহকুমার সুন্দরগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যাওয়ার সময় অপর সহকর্মী অধ্যাপক আবুল কাশেমকে বলেছেন টাকা পয়সা নেওয়ার জন্য কেউ যদি মেরে ফেলে তাদের হাতে মরতেও রাজী আছি। কিন্তু বর্বর খানসেনাদের হাতে নয় । বেতন নেওয়ার জন্য রংপুরে এসেছিলেন। কিন্তু বেতন নিয়ে আর ফিরে যেতে পারেন নি। ৩০ এপ্রিল। রংপুর কারমাইকেল কলেজের ২ মাইল দক্ষিণ পূর্বে দমদমার পুলের নীচে তার অপর তিন সহকর্মী রসায়নের লেকচারার কুমিল্লার কালিচাদ রায় ও তার পিতা দর্শনের লেকচারার বরিশালের সুনিল বরণ চক্রবর্তী ও গণিতের লেকচারার বরিশালের চিত্তরঞ্জন রায়ের সাথে তিনি খুনি পাক সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারান।
রংপুর কারমাইকেল কলেজের উর্দু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শাহ মােহাম্মদ সােলায়মান দিনাজপুরে তার গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ী থেকেই সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তার আর কোন খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। রসায়নের লেকচারার কুড়িগ্রাম মহকুমার নাগেশ্বরীর অধিবাসী জনাব আবদুর রহমান মে মাসের শেষদিকে কাজে যােগ দেওয়ার জন্য রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু তার কাজে যােগ দেওয়া আর হয়নি। খানসেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন রংপুর শহরের জনাৰ ইয়াকুব
________________________________________
মাহফুজ আলী। এপ্রিল মাসের গােড়ার দিকে রংপুরের শ্মশান ঘাটে তার সাথে আরাে ১০ জনকে হত্যা করা হয় ঐদিন।
পাক সেনাদের আত্মসর্মপনের মুহূর্তে ১২ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে কোন এক সময়ে রংপুরের রাজনৈতিক কর্মী রংপুর জেলা ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট শ্ৰী শিবেন মুখার্জীকেও হত্যা করা হয়েছে। শেষদিকে তিনি দিনাজপুর জেলে ছিলেন। ১১ ডিসেম্বর তাকে মুক্তি দেওয়ার নাম করে দিনাজপুর জেল থেকে বের করে আনা হয়। তারপর শিবেন বাবুর আর খোঁজ মেলেনি।
গােটা জেলায় প্রতিটি শহরে, মহকুমা, থানার আনাচে কানাচে, কত যে বধ্যভূমি আছে তার অন্ত নাই। বিশ, পঁচিশ, পঞ্চাশ নয়, যেখানে শতশত এমনকি হাজার হাজার লােককে মেরেছে এমন বধ্যভূমিগুলির মধ্যে রয়েছে রংপুর শহর ও সদর মহকুমার নবিরহাট, জাফরগঞ্জ পুল, নিশবেতগঞ্জ, শশান ঘাট (রংপুর শহরের কাছে), সাহেবগঞ্জ এবং রংপুর শহরের মর্ডান সিনেমা হলের পিছনে এবং দেবিপুর, এসব এলাকায় এখনাে অসংখ্য মানুষের হাড়গােড় পড়ে আছ। রংপুর শহরের উপকণ্ঠে কুকুরণের বিলে বহু মানুষকে হত্যা করার পর পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধা শহরের হেলাল পার্ক, লালমনিরহাট শহর এবং সৈয়দপুর হাজার হাজার নির অসহায় মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এইসব হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছে বিহারী সম্প্রদায়। এসব এলাকা থেকে বহু ঘরের মা, বােনদের ধরে এনে পাশবিক লালসা চরিতার্থ করে হত্যা করা হয়েছে। | রংপুর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত উত্তম নামক স্থানের রিক্সাচালক আহাবউদ্দিন মর্ডান সিনেমা হলের পিছনে একদিনের হত্যাকান্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বরেন, নভেম্বর মাসের ৮ তারিখে আমি যখন রংপুর রেল ষ্টেশনে আমার রিক্সার খোঁজে যাই তখন জুম্মাপাড়া নিবাসী পাকবাহিনীর জনৈক বাঙালী দালাল আমাকে ন্যাপের কর্মী ও দুষ্কৃতকার মুক্তি ফৌজ বলে পাকবাহিনীকে জানায়। তখন পাকবাহিনীর জোয়ানরা আমাকে আটক করে রংপুর মর্ডাণ হলে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে ১৪ দিন আটক রাখে। আটক অবস্থায় পাঞ্জাবী পুলিশ আমার দু’হাত বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে আমাকে অমানুষিক অত্যাচার করে। ১৩ দিন পর আমাকে ও আমার সাথে আটক ১৩ জনকে যথাক্রমে লালমণিরহাটের দুটি মেয়ে জিমকি, মালেকা, গাইবান্ধার আলী হােসেন, ফারুক, পলাশবাড়ীর আশরাফ আলী, রংপুর উপশহরের রিক্সাচালক আলী ও অন্যান্য সবাইকে রাত ১০টার সময় মডার্ণ হলের পিছনে নিয়ে যায়। আমার সামনে পাঞ্জাবীরা পরপর পাঁচজনকে যথাক্রমে জিমকি, মালেকা, আলী হােসেন সহ অন্য এক জনকে জবাই কের হত্যা করে। তখন আমি অন্ধকারের সুযােগ নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পাশের জংগলে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করি এবং পরে সুযােগ বুঝে পালিয়ে যাই।
সে আরাে জানায় যখন আমি মডার্ণ হলে আটকা ছিলাম তখন সেখানে ৩৪০ জন লোেক ছিল। তাদের উপর যে অমানুষিক অত্যাচার চালানাে হয়েছে তা বর্ণনা করা যায় না।
________________________________________
এখানে বহু মেয়েকে রাখা হতাে এবং রাতে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে তাদের ধর্ষণ করা হতাে।
আমার ভাইকে হত্যা করাে না আমার আকবর হােসেন মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্বার আক্রমনে পলায়নপর পাকিস্তানী বর্বর জল্লাদের হাতে ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় নিহত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মুক্ত হওয়ার ঠিক আগের দিন নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার তিনি। আগরতলা থেকে নভেম্বর মাসে তিনি তার গ্রাম সরাইলে ফিরে আসেন। সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীকে প্রয়ােজনীয় সংবাদ সরবরাহের উদ্দেশ্যে। রাতের বেলায় হিংস্র পাকিস্তানী পশুরা অতর্কিতে তার গ্রামের বাড়ী ঘিরে ফেলে।
তাঁর ছােট ভাই সৈয়দ আফজাল হােসেন (যিনি গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন) তাকেও আকবর হােসেনের সাথে গ্রেফতার করা হয়। ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখে যখন উভয়কে চোখ বাঁধা অবস্থায় হত্যা করার উদ্দেশ্যে বধ্য ভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আকবর হােসেনের ছােট ভাই আফজাল হােসেন জল্লাদের কাছে অনুনয় করে বলেন, “আমাকে হত্যা কর। আমি নিজে মুক্তি বাহিনীর সদস্য স্বীকার করছি। আমার ভাইকে তােমরা হত্যা করােনা, সে নির্দোষ । আমি ছেলে মানুষ ও অবিবাহিত। আমাকে মেরে ফেলা হলে কারাে কোন ক্ষতি হবে না। আমার ভাই বিবাহিত তিনটি শিশু সন্তানের পিতা। নিস্পাপ শিশুদেরকে এতিম করবেন না। ওদেরকে দেখাশুনা করার মতাে কেউ আর পৃথিবীতে নেই। তার সে আকুল আবেদনের জবাবে গর্জে উঠলাে মেশিনগান । অন্যান্য আরাে ৪০ জনের সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দুই ভাই এর নশ্বর দেহ। একই মায়ের দুছেলে একই মুহুর্তে জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু ঢেলে বাংলার স্বাধীনতাকে তরান্বিত করে গেল। আকবর হােসেন ঢাকা হাইকোর্ট এর এডভােকেট ও কুল্লিা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের সদস্য ও মগবাজার আওয়ামী লীগ ইউনিট এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
কংকালের মিছিল এখানে একাত্তরে বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহাংগন যেন হয়ে উঠেছিল এক একটা বধ্যভূমি, প্রতিটি ভিটা এক একটা শহীদ মিনার। পল্লীর শ্যামল দিগন্ত আজো বেদনায় মলিন। মাটি আর ঘাসে এখনাে লেগে আছে শহীদের রক্ত। নরসিংদী শহরের অদূরে নরসিংদী তারা রাস্তায় ভাটারা পুলটি ছিল হানাদার জল্লাদের একটি বধ্যভূমি | নরপিশাচরা সেই সেতুটিকে নির্যাতন কেন্দ্র আর নরহত্যার ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল।
হায়েনার দল ও তার সহযােগিরা পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে তরুণ, তরুণী, ছেলে, বুড়ো নির্বিচারে সকলকে ধরে নিয়ে আসতাে এখানে।ওদের উপর চালাতে নির্যাতন। নির্যাতনের পর্ব শেষ হলে তাদের হত্যা করে লাশগুলাে পুলের নিচে মাটি চাপা দিয়ে রাখা
________________________________________
হতাে। এই পুলের চারিদিকে বহু নরকংকাল ও মাথার খুলি আজও ছড়িয়ে আছে। পাক বাহিনীর নিঠুর নির্যাতন ও পাইকারী নর হত্যার এইসব ভয়ংকর কাহিনী নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা একান্ত প্রয়ােজন। অনুসন্ধান চালিয়ে ইতিমধ্যেই খাটরাে পুলের আশেপাশের পতিত জমি থেকে বহু নরকংকাল উদ্ধার করা হয়েছে।
সেখের চরের জনৈক সমাজকর্মী জানান যে, বিভিন্ন এলাকা থেকে যুবতীদের ধরে এনে হানাদার পাক সেনারা নরসিংদী টেলিফোন একচেঞ্জে আটকে রেখে পাশবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতাে। যারা নর পশুদের কাছে আত্মসমর্পণ করতাে না তাদের কঠোরভাবে হত্যা করা হতাে। মৃতদেহের উপর পাশবিক যৌনাচার চালিয়ে লাশগুলাে ফেলে দেওয়া হতাে। তিনি আরাে বলেন এই একচেঞ্জের মধ্যে নরপশুরা ক্যম্প খুলেছিলাে। এখান থেকে পশুরা দালালদের সাহায্যে বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে বাঙালী মেয়েদের ধরে আনতাে। তার পর তাদের উপর বর্বর অত্যাচার, নির্যাতন শেষে তাদের এই খাটরা পুলের কাছে এনে হত্যা করতাে। পাঁচদোলা পুল ও খাটরা পুল ছাড়াও আরাে কয়েকটি বধ্যভূমি রয়েছে নরসিংদীতে । সেগুলাে হাট ভাঙা, বাদুয়ার চর, রেলপুল প্রভৃতি। এসব বধ্যভূমিতে বাঙালী লাঞ্চিতা ধর্ষিতা মা-বােনদের বিদেহী আত্মা আজো হাহাকার করে ফিরছে। বাংলার মানুষদের হত্যা করে, তাদের বসত বাড়ি জ্বালিয়ে সম্পত্তি লুট করে কৃষকদের গবাদি পশু জবাই করে, মাঠের ফসল বিনষ্ট করেই এসব নর পশুরা ক্ষান্ত হয়নি, তাদের ধ্বংস যজ্ঞ থেকে রক্ষা পায়নি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, এমনকি সমজিদ, মন্দির, গীর্জাও। কেজিগুপ্ত হাই স্কুলটি পশুর অগ্নিসংযােগে ভস্মীভূত করে। এই স্কুলের সন্নিকটে অবস্থিত পাঁচদোলা পুল। এখানেও ছিল নরপশুদের একটি ক্যাম্প। নরপশুরা নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালাতাে এখান থেকে। মাঝে মাঝে মুক্তি বাহিনী পাকসেনাদের আক্রমন করে উপযুক্ত প্রতিশােধ গ্রহণ করতো। অতর্কিত আক্রমনের জন্য মুক্তি সেনা স্কুলটিকে ব্যবহার করতাে বর্ম হিসেবে। তাই পাকসেনারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে অগ্নিসংযোেগ করে।
সিরাজগঞ্জের কিছু হত্যা কাহিনী এখানকার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে পাকিস্তানীদের নৃশংস নরমেধ যজ্ঞের কাহিনী আজ রূপকথার মতাে মনে হয়। প্রতিদিন তরুণ যুবক ছেলেদের ধরে এনে লঞ্চ ঘাটে জবাই করতাে আর নদীর বুকে ছুঁড়ে ফেলে দিত । সিরাজগঞ্জের সাবজেলটি ঠিক এমনি জবাই থানার কাজে ব্যবহৃত হতাে।
এপ্রিল মাসে হানাদাররা সিরাজগঞ্জে প্রবেশের পর থেকে নয় মাস ধরে দিনের পর দিন এখানে চালিয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। গ্রাম গ্রামান্তরের মানুষ হতভাগ্যদের আর্তনাদে শিউরে উঠেছে। সিরাজগঞ্জের জবাইখানা গুলােতে কমপক্ষে কয়েক হাজার লােক মারা পড়েছে। যে নদী বন্দর ২৫ মার্চের আগে অহরহ কর্মব্যস্ত থাকতে ২৭এপ্রিলের পর তা এক জনমানবহীন প্রেতপুরীতে পরিণত হয়।
________________________________________
বার্তা প্রতিষ্ঠান বি এস এস এর প্রতিনিধি সিরাজগঞ্জের আওয়ামী লীগ,ন্যাপ, মুক্তিবাহিনী আর মুজিববাহিনীর বহু নেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তারা জানান যে ২৭ এপ্রিল থেকে পাঁচ দিনে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কম করে ৫ শত লােককে হত্যা করেছে। আজ এসব কথা লিখতে বসে বরইতলা গ্রামটির কথা মনে পড়ে গেল। গাজীপুর থানার এই গ্রামে নভেম্বরে পাকসেনাদের হামলা হয়। মাত্র একটি দিনের নারকীয় হত্যাকান্ড। অথচ এই একটি দিনে নারী পুরুষ ও শিশু মিলে ৫শ লােককে জল্লাদরা হত্যা করে। কমপক্ষে ২ শ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এরও আগে মে মাসে সিরাজগঞ্জ থানার বাবাতীতে হত্যা করা হয় একসংগে ১৭০ জনকে। বারইতলা আর বাবতী এই দুজায়গাতেই মুক্তিবাহিনী বীর বিক্রমে শত্রুকে বাধা দিয়েছে।
এভাবে নরহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ আর অগ্নিসংযােগের অমানুষিক স্মৃতি বুকে করে বেঁচে আছে তামাই, রাজাপুর, সাঈদাবাদ, সিংলাবড়ী প্রভৃতি গ্রামের মানুষ।
চট্টগ্রামের দামপাড়া বধ্যভূমি চৗগ্রামের দামপাড়া গরীবুল্লা শাহর মাজারের পার্শ্বে একটি লােমহর্ষক বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। ৩০ মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম পর্যন্ত এই বধ্যভূমিতে বর্বর পাক বাহিনী কয়েক হাজার লােককে হত্যা করেছে। পার্শ্ববর্তী দোকানদার নাসির আহমদ ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই হত্যাযজ্ঞ স্বচক্ষে দেখেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি তার দোকানেই ছিলেন। নাসির আহমদ বলেছেন ৩০ মার্চ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রত্যহ সন্ধ্যায় কড়া মিলিটারী পাহারায় পাঁচ থেকে ছয় ট্রাক লােক নিয়ে আসা। হতাে। এই হতভাগ্যদের চোখ পাড় দিয়ে বাঁধা থাকতাে। তাদের বধ্যভূমিতে নামিয়ে দিয়ে ট্রাকগুলি চলে যেতাে। তারপর অন্য একদল মিলিটারী ট্রাক নিয়ে বধ্যভূমিতে এসে লাশগুলি ট্রাকে বােঝাই করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেত। লসির আহম্মেদ আরাে বলেছেন যে, নিয়মিত এই হত্যাযজ্ঞের শুরুতে লাশ পুতবার জন্য বধ্যভূমির পাশে গর্ত খনন করা হােত ধরে আনা লােকদের দিয়ে। মাত্র কয়েক দিনের লাশে এই গভীর গর্ত ভর্তি হয়ে গেলে সদ্য মরা লাশ গুলােকে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা হতাে। তাঁর মতে এই গর্তে কমপক্ষে পাঁচ হাজার নরকঙ্কাল রয়েছে। এই লােমহর্ষক বধ্যভূমিটি ছিল চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা।
রেলওয়ে পাের্ট ট্রাষ্ট এবং অন্যান্য অফিসের যেসব হতভাগ্য অফিসার নিখোজ হয়েছেন, তাঁদের অনেককেই এই বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়েছে। নাসির আহমদের মতে বর্বর পাকবাহিনী এই বধ্যভূমিতে কয়েক হাজার লােককে হত্যা করেছে। তিনি বলেছেন যে, নিয়মিত এই হত্যাযজ্ঞের শুরুতে চোখ বাঁধা অবস্থায় বধ্যভূমিতে আনা এক দল লােককে গুলি করে হত্যা করলে গুলির আওয়াজ লাইন করে পড়ানাে অন্যদল মৃত্যু ভয়ে চীৎকার করতাে বলে পরে রাইফেলে সাইলের লাগিয়ে গুলি করে মারার পদ্ধতি
________________________________________
প্রবর্তিত হয়। এই লােম হর্ষক হত্যাকান্ডের আরেক সাক্ষী গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের দারােয়ান আব্দুল জব্বার।
বাংলার পথে পথে বধ্যভূমি বরিশাল, পটুয়াখালী, আশুগঞ্জ, কুষ্টিয়া এবং চট্টগ্রাম সহ প্রভৃতি স্থানে বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব বধ্যভূমিতে হানাদার ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে। বরিশাল, পটুয়ালী, যশাের অঞ্চলের কয়েকটি এলাকাতেই পাক হানাদার বাহিনী কয়েক লক্ষ লােক হত্যা করেছে। এসব অঞ্চলের অনেক স্থানে আজো নরকঙ্কাল ও মানুষের হাড় পড়ে আছে। সারাদেশে। হানাদার বাহিনী পরিকল্পিত উপায়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় ।
শহর থেকে একটু গ্রামের দিকে এগুলেই দেখা যাবে পণ্ডবাহিনীর হিটলারী কার্যকলাপের চিহ্ন। বরিশাল শহরে কীর্তন খােলার তীরে অবস্থিত ওয়াপদা কলােনী, সি, এস, ডি, গােডাউন ও ষ্টেডিয়ামের নিকটে পশু পাকবাহিনী বাঙালীদের হত্যা করতাে। এই সকল এলাকায় নদীর তীরে এখনও মানুষের মাথার খুলি এবং হাড় দেখতে পাওয়া যায় । বরিশাল মেডিকেল কলেজের কতিপয় ছাত্র আলবদর বাহিনীর সদস্য ছিল। ঐ সকল বদর সদস্যরা বহু বাঙালীকে জবাই করে হত্যা করে। দেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ঝালকাঠি একটি প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ঝালকাঠি বন্দরে পশু বাহিনী পেট্রোলের সাহায্যে আগুন ধরিয়ে বাঙালীদের দোকানপাট পুড়িয়ে দেয় । এই বন্দরে কমপক্ষে বিশ কোটি টাকার সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়। ঝালকাঠি সদরে আটঘর, করিয়ানার পেয়ারা বাগানে মুক্তিযােদ্ধারা সুদৃঢ় প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলাে। একারণে পাকবাহিনী ঐ এলাকায় একদিনের অভিযানে কয়েক শ লােককে হত্যা করে।
পাক বাহিনী পেয়ারা বাগান কেটে পরিষ্কার করার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে শত শত লােককে বলপূর্বক ধরে আনে এবং তাদেরকে দিয়ে পেয়ারা বাগান কেটে পরিষ্কার করাতে থাকে। তারপর তাদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয় । এই এলাকায় দালাল ব্যতীত অন্য কোন নিরীহ বাঙালীর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। কাউখালী, বরিশালের আর একটি প্রধান বন্দর। এই বন্দর হানাদারদের সম্পূর্ণভাবে জ্বালিয়ে দেয় ও গ্রামে গ্রামে ঢুকে নিরীহ বাঙালীদের হত্যা করে। পিরােজপুর মহকুমা শহরে নদীর তীরে যে স্থানে বাঙালীদের দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতাে সেই জায়গায় রক্তের জোয়ার বইতাে। পিরােজপুর হানাদার বাহিনী কর্তৃক দখল হওয়ার পর সেখানে যত যুবক ছিল তাদের অধিকাংশকে হত্যা করা হয়। রাজাপুর, বানারিপাড়া, মঠবাড়িয়া, স্বরূপকাঠি এবং অন্যান্য এলাকায় হানাদার বাহিনী শান্তি কমিটির সহযােগিতায় বিপুল সংখ্যক বাঙালীকে হত্যা করে। পটুয়াখালী শহরেই কয়েক হাজার বাঙালীকে হত্যা করা হয়। পটুয়াখালী জেলার অন্যান্য এলাকায় যে সব নিরীহ লােকদের হত্যা করা হয় তার প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হলে মােট হত্যার সংখ্যা আরাে বৃদ্ধি পাবে।
________________________________________
কুষ্টিয়া থেকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার একটি খবরে জানা যায় যে, পাকিস্তানী সেনা এবং তাদের যােগসাজশকারীরা একমাত্র কুষ্টিয়া শহরে ন’মাসে প্রায় চল্লিশ হাজার লােককে হত্যা করেছে। নিহতদের সংখ্যা বলতে গিয়ে গণ পরিষদের সদস্য জনাব আজিজুর রহমান আক্কাস এক বিবৃতিতে বলেন যে, যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই হচ্ছে ১৫ থেকে ৩৫ বছরের কিশাের ও যুবক। | পূর্বদেশের ভৈরব সংবাদদাতা মেহেদী হাসান বিশে ডিসেম্বর ‘৭১ আশুগঞ্জে গিয়েছিলেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলার বাস্তব চিত্র দেখতে। তিনি জানান, আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর চরে যা দেখলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা কিছুতেই সব নয়। সেদিন আশুগঞ্জের বালুচরে দাঁড়িয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম স্তুপীকৃত মানুষের লাশ দেখে। খান সেনারা আত্মসমর্পণের পূর্বে এই সমস্ত লােকদের হত্যা করে। আশুগঞ্জ ভৈরববাসীদের কাছে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল মৃত্যুপুরী। ভৈরব শহরের কলােককে যে ধরে নিয়ে আশুগঞ্জের এই বধ্যভূমিতে হত্যা করেছে তার হিসেব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
রাজশাহীর গর্তে গর্তে নরকঙ্কাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে ষ্টেশনের দক্ষিণ পাশে নরকঙ্কাল ভর্তি বহু গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে। দৈনিক আজাদের প্রতিনিধি ও রাজশাহী জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারী মােহাম্মদ আবু সাঈদকে হত্যার পর বর্বর বাহিনী জনাব আবু সাঈদকে ধরে নিয়ে যায়। এই দালালদের মধ্যে তৎকালীন দৈনিক সংগ্রামের স্থানীয় প্রতিনিধিও ছিল। জনাব সাঈদকে সার্কিট হাউসে নিয়ে যায় এবং সেখান থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে প্রায় এক সপ্তাহ আটক রাখা হয়। এরপর ৫ জুলাই অপর ১৫ জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সাথে জনাব সাঈদকে জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সবার সামনে দিনাজপুরের জনৈক রেলওয়ে কর্মচারীকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। বর্বর পাকবাহিনী মৃত দেহটি রেলওয়ে স্টেশনের দিকে বয়ে নিতে বন্দীদের বাধ্য করে। ষ্টেশনের পাশে একটি বাবলা গাছের নীচে একটি গর্ত করা হয়। এরপর তাদের সকলকে জোর করে গর্তের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিয়ে সমস্ত শরীর ঝাঝরা করে অর্ধমৃত অবস্থায় গর্তের মধ্যে চাপা দেওয়া হয়। কিন্তু এদের মধ্যে রাজশাহী জিলা ইন্সটিটিউটের পিয়ন আব্দুল কাদের, শ্যামপুরের রুপবান মিঞা পরস্পরের সাহায্যে গর্তের মধ্য থেকে কোন রকমে উঠে ভারতে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর এদের কাছ থেকেই এই ললামহর্ষক কাহিনী জানা গেছে।
স্বাধীনতার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, তৎসংলগ্ন ইটখােলা, রাজাকার ক্যাম্প, বােয়ালিয়া প্রভৃতি স্থানে এ ধরনের শত শত গর্তের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এছাড়া পাক বাহিনী আত্মসমর্পনের পর নিহত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ছাত্রসহ বহু বুদ্ধিজীবীর লাশ উদ্ধার করা হয়। শহরের পার্শ্ববর্তী গ্রাম সমূহের হাজার হাজার বাঙালীকে
________________________________________
বর্বর পাকবাহিনী নৃশংসভাবে হত্যা করে লম্বা গর্তের মধ্যে পুঁতে রাখে। এদেরকে গলা কেটে হত্যা করা হােত বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণীতে জানা গেছে।
| ধামরাই আজ শ্মশান এপ্রিলের প্রথম দিকে ধামরাইয়ে প্রবেশ করে পাক ফৌজের একটি দল। স্থানীয় দলালদের সাহায্যে সােনাদানা টাকা পয়সা ও মূল্যবান আসবাবপত্র লুট করে। এখানে বাংলার বিখ্যাত একটি রুথে আগুন লাগায় । পুড়ে ছাই হয়ে গেল একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। পাকবাহিনী এ ঐতিহাসিক রথটিকে নিশ্চিহ্ন করে থেমে যায়নি। এখানকার বহুলােককে গ্রেফতার করে তাদের কঠোর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করেছে। পাক হানাদারদের সাথে জুটেছিল বাংলার কতিপয় দৃণ্য নরপিশাচ । তারাই পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতাে হালদারদের। এখানেও তাদের পথ দেখিয়েছিল কতিপয় এদেশী মােহাম্মদী বেগ। ধামরাইয়ে নিহত হতভাগ্য বাঙালীদের মধ্যে ছিলেন ধামরাই স্কুলের শিক্ষক দীনেশ বাবুর তৃতীয় ছেলে হাবুল। জগন্নাথ কলেজের বাণিজ্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। বাবার সংগেই বাড়ীতে হিল সে। ৯ই এপ্রিল বেলা ১২টা। হঠাৎ করে সে দেখতে পায় লােকজন প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে। অদৃষ্টে যা আছে তা খন্ডাবে কে। সেদিনও পাকবাহিনীকে পথ চিনিয়ে ছিলাে ঘরের শত্রু বিভীষণ।
বাংলার মাটিতে ছিল অসংখ্য মীরজাফর আর জগৎশেঠ। এই মীরজাফর, জগৎশেঠের বংশধররাই পরবর্তীকালের রাজাকার আলবদর। যাদের সহযােগিতায় ধ্বংস হােল ধামরাইয়ের কয়েকটি গ্রাম আর শত শত মানুষ। ওসমান, আলী, হায়দার, এনায়েত, আবুবক্কর, আতিয়ার, পলাশ, বদরুল, চিনু বণিক, বৃদ্ধ সূত্রধর, গণেশ পাল, গয়ারাজবংশী, পরেশধর, কিনুকাহার সহ বহু লােককে পাকবাহিনী ধামরাই থেকে ৩/৪ মাইল দূরবর্তী কালামপুর বাজারে নিয়ে যায়। সবার চোখ বাঁধা। বাজারের পাশে কালামপুর আতাউর রহমান হাইস্কুলের মাঠ। মাঠের পাশ দিয়ে একটা খাল নদীতে গিয়ে পড়েছে। বাজার থেকে স্কুলে আসতে একটি কালভার্ট। উপরে সিমেন্টের আস্তরণ নেই। বাঁশ নিয়ে সকো বেঁধে লােক যাতায়াত করার মত ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। কালভার্টের নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করান হলাে এদের সবাইকে। পুরােভাগে দীনেশ রায় এবং তার পিছনে পুত্র হাবুল। তারপরের দৃশ্য ভয়ানক আর বীভৎস। গর্জে উঠল মেশিনগান মাত্র কয়েক মুহুর্তের আর্তনাদ। সবাই শেষ বারের মত ঘুমিয়ে পড়ল চিরন্দ্রিায় ।
হাজিপয়ে হত্যাযজ্ঞ ওনারী ধর্ষণ কুমিল্লা জেলার হাজিগঞ্জ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা হতে প্রতিদিন বর্বর পাক বাহিনীর হাতে নিহত মানুষের কংকাল ভর্তি অন্ধকুপ” পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই উদ্যাটিত
________________________________________
হচ্ছে নারকীয় বর্বরতার ভয়াল স্বাক্ষর। ডাকাতিয়া নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত মাকিমাবাদের জলাভূমিতে প্রায় তিনশ মাথার খুলি এবং মানুষের হাড় বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার একজন প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে, বর্বর হানাদাররা এ অঞ্চলে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এলাকাকে কেমন করে ধ্বংস করেছে তার অনেক কাহিনী। এখন পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় হামিদা জুট মিলকে বর্বর পাক পরা ৩ হাজার বাঙালী নিধনের বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত করেছিল। মিলের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে বাঙালী যুবকদের এখানে ধরে এনে সারারাত পাকপশুরা নির্যাতন চালাত। তারপর তাদের হাত, পা একসাথে বেঁধে মৃত বা অর্ধমৃত অবস্থায় অবস্থায় ডাকাতিয়া নদীতে ফেলে দিত।
হাজীগঞ্জের জনাব হাতেম আলী, আবদুস সােবহান এবং ৭৫ বৎসর বয়স্ক একজন বৃদ্ধ প্রতিনিধিকে আরাে অনেক চাঞ্চল্যকর কাহিনীর কথা জানান। হাজীগঞ্জের লুটপাট, অগ্নিসংযোেগ এবং নারী নির্যাতন কাহিনীর অন্ত নেই। একমাত্র বারকুল গ্রামেই বর্বর বাহিনী ১২০ জন মানুষকে একদিনে খুন করেছে। অনেক বালিকাকে পাশবিক অত্যাচার করেছে এবং দালালদের সহযােগিতায় ৪ মে গ্রামটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই থানার এমন কোন গ্রাম নেই যেখানে অগ্নি সংযোেগ লুট এবং নারী নির্যাতন করা হয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ মুজাফফরগঞ্জে এই বর্বরতা চরম রূপ নিয়েছিল। এখানে এক বাড়িতে কয়েকজন রাজাকার সেই বাড়ি আক্রমন করে ৩৭ জন লােককে হত্যা করে এবং বাড়ীর কিশােরী যুবতী গৃহবধুসহ মােট ৮ জনকে ধরে নিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা কর । ৪ দিন পর তাদের মৃতদেহ পাশের একটি খালে ভাসতে দেখা যায়।
কিশােরগঞ্জের ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ কিশােরগঞ্জে বর্বর হানাদার বাহিনীর অধিনায়ক মেজর ইফতেখার সম্পর্কে দু’একটি তথ্য দৈনিক বাংলার ২৪ জানুয়ারি ১৭২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এই জঘন্য পশুর পাশবিকতা কিশােরগঞ্জে ভয়াল বিভীষিকা ও ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছিলাে।
১৯৭১ সনের জুলাই মাসের শেষের দিকে এই নরপিশাচ কিশােরগঞ্জে আসে। সেখানে এসেই শুরু হলাে তার নরমেধযজ্ঞ। প্রত্যেকদিন ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, এমনকি আরও বেশী করে তােক ধরে ধরে এনে মারতে শুরু করলাে। এক পর্যায়ে মানুষ ঘরবাড়ী ছেড়ে পালাতে শুরু করলাে। এখানে হিন্দুরা প্রাণ ভয়ে মুসলমান হতেও শুরু করে। গণহত্যার পরিধি বিস্তৃত করার জন্য নর-শয়তানরা শান্তি কমিটির মাধ্যমে সবাইকে আহবান করল এই বলে যে, নির্দোষ কোন লােককে কোন রকম হয়রানি করা হবে না। সবাই যেন নির্বিঘ্নে নিজ নিজ কাজ শুরু করে। শয়তান দলের এই কপটতায় অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে শহরে ফিরে এসে ভয়ে ভয়ে নিজ নিজ কাজ শুরু করে। ইফতেখার তখন এক ফরমান জারী করল যাতে বলা হােল যে, সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কেউ
________________________________________
ধর্মান্তরিত হতে পারবে না। আর হিন্দুদের ধুতি পরে থাকতে হবে। এই ভাবে নরপিশাচ তার হত্যাযজ্ঞ বিস্তৃত করার প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করলাে। তারপর শুরু হল গণহত্যা। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা ঘেরাও করে শতশত মানুষ ধরে এনে সারিবদ্ধভাবে হত্যা করতে থাকলে সে। এক সময় ভয়ার্ত মৃত্যুপুরিতে পরিণত হলাে কিশােরগঞ্জ।
গচিহাটা রেলষ্টেশনের সন্নিকটে ধুলদিয়া রেলওয়ে পুলের উপর লাইন করে দাঁড় করিয়ে জল্লাদরা গুলি করে হত্যা করে বহু মানুষ। একদিন গুলি করার সময় কাজল নামের একটি ছেলে লাফ দিয়ে নীচের পানিতে পড়ে যায়। রাত্রের অন্ধকারের সুযােগে ডুব সাঁতার দিয়ে অনেকদূর গিয়ে ডাঙ্গায় উঠে পাড়ি জমায় সীমান্তের ওপারে । কাজল ফিরে এলাে একদিন কিন্তু তার গােটা পরিবার এখান হয়ে গেছে ততদিনে। শুন্য ভিটায় ঘর বেঁধেছে একরাশ হাহাকার।
ইফতেখার একরাতে জনৈক অশ্বিনী বাবুকে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে আসে। বন্দুকের নলের মুখে অশ্বিনী বাবুকে দিয়ে দুই ছেলের কাছে চিঠি লেখায় ওদের কিশােরগঞ্জে আসার জন্য। দুছেলেই জল্লাদের ফাঁদে পা দেয়। দুটো ছেলেকেই পিতার সম্মুখে হত্যা করে অশ্বিনী বাবুকে ছেড়ে দেয়।
পাকুন্দিয়া থানার মেডিকেল অফিসার নিহত হলেন নরপিশাচ ইফতেখারের হাতে। তার তিন মেয়ের দু’জন গ্রাজুয়েট। একজন কলেজছাত্রী। একরাতে ওদের ধরে। এনেছিলাে শয়তান ইফতেখার। তাদের আর কোন খবর পাওয়া যায়নি।
| এই নরাধম কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে, কত নারী যে নিধন করেছে, কত হতভাগিনীকে উম্মাদে পর্যবসিত করেছে তার সীমা নেই। তার কবল থেকে কেউ রক্ষা পায়নি, হিন্দু কি মুসলমান কেউই। তার পাশব প্রবৃত্তির লেলিহান শিখায় যে সকল স্বামীহারা, পিতৃহারা, মাতৃহারা, হতভাগিনী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদেরকে ধরে ধরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে মহকুমার বিভিন্ন ক্যাম্পে। পশু পশ্চিমা হানাদার কুখ্যাত রাজাকার, মুজাহিদ, আলবদর বাহিনীর কমান্ডার এবং স্বঘােষিত অফিসার ইনচার্জদের হাতে।
ইফতেখার লুণ্ঠন চালিয়েছে নির্বিচারে। নিজে গ্রহণ করেছে নগদ স্বর্ণালংকার প্রভৃতি মূল্যবান জিনিষ, আর তার অনুচরদের দিয়েছে বাকী সমস্ত মালামাল। এছাড়া তথাকথিত শান্তি কমিটির যােগ সাজশে যাকে তাকে ধরে আটক করে শান্তি কমিটির মাধ্যমে মােটা অংকের নগদ অর্থের বিনিময়ে দু’একজনকে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক সময় টাকা গ্রহণ করেও সে ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। তথাকথিত শান্তি কমিটি টাকা আদায়ের সময় নিজেদের অংশ আলাদা করে আদায় করেছে।
হিন্দুরা প্রাণভয়ে মুসলমান হয়েও এই নরপিশাচ-এর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তাদের হত্যা করা হয়েছে। বল্লভ সাহা নামক একজন হিন্দু ব্যবসায়ী প্রাণ ভয়ে সপরিবারে মুসলমান হয়। তাকেও হত্যা করা হয়। নরপিশাচ ইফতেখার দীর্ঘ নয় মাস এক ত্রাস ও বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়ে কিশােরগঞ্জকে শ্মশানে পরিণত করে।
________________________________________
কুমিল্লায় গণহত্যার স্বরূপ বিভিন্ন সূত্রের খবর থেকে জানা গেছে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী এবং তাদের অনুগত চররা যুদ্ধের নয় মাস ধরে কুমিল্লা শহরে ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে কমঙ্গক্ষে ২০,০০০ লােককে হত্যা করে। হাজার হাজার বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং অগণিত পরিবারকে গৃহহারা করে। দখলদার বাহিনী বাংলাদেশ ভারতের সীমান্তের ৩ মাইলের মধ্যে সমস্ত সম্পত্তি এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।
এসব এলাকার মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং আখাউড়া সব চাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ। জেলার প্রায় সকল হাট বাজার লুট ও ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ সম্পূর্ণ রূপে নির্ধারণ করার কাজ সম্পন্ন হলে হত্যা এবং ধ্বংসের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের অনুচররা বিভিন্ন হাটবাজার, ঘরবাড়ি, রেল এবং বাসা থেকে বহু যুবককে ধরে এনে অজ্ঞাত জায়গায় নিয়ে যায়। তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরে তাদের কেউ আর ফিরে আসেনি।
বিএসএস-এর প্রতিনিধির কাছে একজন প্রত্যক্ষদর্শী জল্লাদ বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এপ্রিল মাসের ৮ তারিখে তাদের বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশী চালান হয় এবং ২৩ বৎসর বয়স্ক যুবক বাসেতকে হত্যা করা হয়। তার বাড়ি লুট করে সমস্ত কিছু সার্কিট হাউসে নিয়ে যায় এবং তাকেও ধরে নিয়ে যায় । সার্কিট হাউসে আরাে ১২ জনকে ঐ সময় ধরে আনা হয় এবং সারারাত তাদের আটক রাখা হয়। পরদিন সকালে চোখ এবং হাত বেঁধে ট্রাকে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি গুদাম ঘরে তাদের নিয়ে চোখ খুলে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি বহু হতভাগ্যকে পা, হাত, বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। যাদের কারাে কারাে চোখ তুলে ফেলা হয়েছে।
লােন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকান্ড রাজশাহী হতে বাসসের খবরে প্রকাশ দীর্ঘ নয় মাস পাকবাহিনীর অত্যাচারের জ্বলন্ত দৃষ্ঠান্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৮ জন শিক্ষকসহ কর্মচারী হত্যা। পাক বাহিনীর হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জিনিষপত্র নষ্ট হয়েছে তার মূল্যের পরিমান কয়েক কোটি টাকা। এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ঢুকে বিভিন্ন হল এবং ষ্টাফ কোয়ার্টারে ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রথমেই বর্বর বাহিনী শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়।
পরে জোহা হলসহ অন্যান্য অনেক হল সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। সকল হল, ষ্টাফ কোয়ার্টার ও অন্যান্য কর্মচারীর বাসা এমনকি লাইব্রেরী ও ল্যাবরেটরী পর্যন্ত হানাদার
________________________________________
বাহিনী লুটপাট করে। বইপত্র পুড়িয়ে দেয়। পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান ডঃ হােসেন, অর্থনীতি বিভাগের প্রধান এবং অন্যান্য পদস্থ কর্মচারী হানাদার বাহিনীর নানা প্রকার চাঞ্চল্যকর কাহিনী বর্ণনা করেন। এপ্রিল মাসের ১৪, ১৫ এবং ২৫ তারিখে যথাক্রমে অংক বিভাগের প্রফেসর শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার এবং মনস্তত্ব বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর জনাব মীর আবদুল কাইয়ুমকে বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে হর্তা করা হয়। বর্বরতা কি ধরনের নিষ্ঠুর ছিল ওখানে তার এক নজীর পাওয়া যায়। একজন অধ্যাপককে হত্যা করার পর তার মেয়েকে একজন মিলিটারী অফিসারের সাথে বাস করতে বাধ্য করার দৃষ্টান্ত থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পিওন আবুল বাসার জানায় যে, কেবলমাত্র জোহা হলের নিকটেই প্রায় ৩ হাজার লােককে হত্যা করে গর্তে পুঁতে রাখে পাকবাহিনী।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় যে,তৎকালীন উপাচার্য জনাব সাজ্জাদ হােসেন ৩০ জন অধ্যাপক এবং দু’জন অফিসারকে হত্যার একটি তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। একে ৪ টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিলাে। প্রথম শাস্তি মৃত্যুবরণ, ২য় কারাবণ, ৩য় পদ হতে অপসারণ, ৪র্থ বেত্রাঘাত।
নাটোরের ছাতনীতে পাক বাহিনীর বর্বরতা বংগবন্ধুর আহবানে সমগ্র বাংলার মানুষ যেমন সাড়া দিয়েছিল তেমনি ছাতনীর মানুষও সমস্বরে শ্লোগান দিয়েছিলােঃ শােষকের মুখে লাথি মারাে বাংলাদেশকে স্বাধীন করাে। সমগ্র বাংলার ধ্বংসের সংগে হাতনীর ধ্বংস অনিবার্য হয়ে পড়ে। ভাবশী গ্রামের বহু লােককে হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে গায়ের চামড়া উঠিয়ে হত্যা করেছে। ছাতনীর হত্যা কান্ডের প্রত্যক্ষদশী যুবক আবুল বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের দু’মাস পর্যন্ত আমরা এদিক সেদিক পালিয়ে ছিলাম।
আমাদের লাঠি শােটা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হতাে, কখন হয়তাে নরপিশাচ অবাঙালী জল্লাদের দল গ্রামে ঢুকে পড়ে। তারা তিনবার লুটপাটের জন্য এগিয়ে আসে। হালাকুর বংশধররা তিনদিন পর সশস্ত্র হয়ে ছাতনী গ্রাম আক্রমণ করতে আসে। গ্রামের মানুষ একত্রে খােদার নামে লাঠি শােটা নিয়ে দলে দলে তাদের তাড়া করে। হানাদার বাহিনী বিভ্রান্ত হয়ে পিছু হঠেছে। কিন্তু অবাঙালী পাকিস্তানী কুলাংগার জল্লাদ হাফেজ আব্দুর রহমান এ পরাজয়কে অপমান মনে করে। তাই প্রতিশােধ নেবার ইচ্ছা প্রবল হলাে তার। খুনের নেশায় এই জল্লাদ পথ খুঁজতে থাকে সর্বক্ষণ। একদিন সে ধুরিয়ার মসজিদ থেকে টেনে বের করলাে ১০৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ সৈয়দ আলী মুন্সিকে। ১৫ জ্যৈষ্ঠ সৈয়দ আলী মুলীর লাশ দেখলাে ছাতনীর মানুষ। এর পরের ঘটনা পরিকল্পিত। ছাতনীর বয়ােবৃদ্ধ ৮২ বৎসরের নলীনিকান্ত বললেন ওরা যখন রাতে এসে ছাতনী দিঘীর পাড়ে জমা হয় রাত তখন প্রায় দুটো। সকাল পাঁচটার দিকে গা ঘিরে ফেলে। ঘরে ঘরে তল্লাশী করে সবাইকে বের করে হাত পিছনে বেঁধে একসাথে করেছিলাে। মায়ের কোল থেকে কেড়ে শিশুকেও হত্যা করতে ছাড়েনি। বৃদ্ধ বলছিলেন, ডাক্তার মনিরুদ্দিনের তিন ভাইকে
________________________________________
একত্রে ওরা হত্যা করে। রুদ্ধ কষ্ঠে বৃদ্ধ নলীনিকান্ত বললেন, পিশাচরা মেয়েদের উপর জঘন্য উপায়ে অত্যাচার চালায় ও অনেককে ধরে নিয়ে যায়। এই গ্রামের আরেকজন যুবক আবুল কাশেম। অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে বেঁচেছে সে। বললঃ যখন আমি বুকে হেঁটে জমির পাশ দিয়ে হানাদারদের চোখের বাইরে যাচ্ছিলাম, তখন কয়েকজন যুবতীকে বিবস্ত্র অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। একস্থানে দেখলাম বহু লোেক পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় মরে পড়ে আছে। ওরা সংখ্যায় ছিলাে কমপক্ষে ২৫০ জনের মতাে। অবাঙালীরা এদিন ছাতনীর সমস্ত লুট করেছে, ঘরে ঘরে তন্ন তন্ন করে পুরুষদের হত্যা করেছে। মেয়েদের ধরে নিয়েছে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে কেড়ে নিয়ে আছড়ে মেরেছে।
আবুল কালাম বললেন, গ্রামের যে এলাকায় বেশী লােক হত্যা, নারী নির্যাতন হয়েছে সেদিকের এক ধানের জমিতে পানির মধ্যে নিজেকে আড়াল রেখে সবকিছু দেখেছেন তিনি। অবাঙালীরা অল্প কিছু দূরেই এক মহিলার কোলের শিশুকে ফেলে পাড়িয়ে মারে। হানাদার বাহিনীর একজন জমির উপরে এক মহিলাকে ফেলে ধর্ষন করে। চারিদিকে গুলির শব্দ আর আর্তনাদ। ভাের পাঁচটা থেকে ন’টা। অত্যাচার, হত্যা, পাশবিকতার তান্ডবলীলা চললাে, হাহাকার, আর্তচিৎকারে সব একাকার হলাে, ছাতনীর মাঠে মাঠে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালাে ৪৪১ জনে। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ, মধ্যবয়সী। শতাব্দীর অভিশাপ মুসলিম কলঙ্ক পাকিস্তানী বর্বর শাসকেরা নাটোরে ছাতনীকে আরেক মাইলাই-এ পরিণত করে গেছে।
লাকসাম সিগারেট ফ্যাক্টরী হত্যাকান্ড লাকসাম জংশনে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে দৃষ্টি মেলে ধরতে দেয়াল ঘেরা সুবিশাল এলাকা জুড়ে কালাে রংমাখা যে দ্বিতল প্রাসাদটি দেখা যাবে সেটি একটি সিগারেট ফ্যাক্টরী। কিন্তু তার নাম যাই থাকুক না কেন লাকসামবাসীরা এটাকে একাত্তরের হত্যাপুরী বলেই জানে। নয় মাসে এই ফ্যাক্টরীর বিভিন্ন ককে, বিভিন্ন সেলে যে অত্যাচার নারী ধর্ষন এবং নির্বিচারে গণহত্যা চলেছিলাে তার নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দিনে রাতে যখন তখন লাকসাম থানার বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে হানা দিয়ে গ্রাম বাংলার নিরীহ নারী পুরুষদের ধরে এনে এবং লাকসাম জংশনে অপেক্ষমান ট্রেন থেকে যুবক যুবতীদের ছিনিয়ে এনে এই হত্যাপুরীতে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বর্বর খানসেনারা বিনষ্ট করেছে অগণিত মা, বােনের ইজ্জত । বধ করেছে হাজার হাজার ট্রেন যাত্রী। গ্রাম থেকে পল্লীর কুলবধুদেরকে ছিনিয়ে এনে ওদের উলংগ করে কারখানার ছাদের উপরে উঠিয়ে দু’হাত উপরে তুলে দাঁড় করিয়ে রাখা হতাে।কারখানা অনতিদূরে যাত্রীবাহী ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের ঐ ছাদের উপর দৃষ্টিপাত করতে নির্দেশ দেয়া হতাে। এমনিভাবে সারাদিন বন্দী মা-বােনদের বেইজ্জতি করে রাতে কারখানার বিভিন্ন কোঠায় নিয়ে মেজর গার্দিজি ও তার দোসররা চালাতে পাশবিক অত্যাচার। ঐ সব মেয়েদের মদ পানে বাধ্য করা হতাে। চাবুকের আঘাতে এবং
________________________________________
পাশবিক অত্যাচারে রাত্রির গভীরতা ভেঙে প্রায়ই ভেসে আসততা মা বােনদের বুকফাটা করুন আর্তনাদ। কিন্তু মদ্যপায়ী নরপশুদের অট্টহাসিতে সবকিছু চাপা পড়ে যেত। অনেক মা-বােনকে ঘটনা স্থলেই মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে আর যারা নামে মাত্র বেঁচে থাকত তাদের সংজ্ঞাহীন দেহ রাতের আঁধারে কারখানার বিভিন্ন কোনায় পুতে ফেলা হতাে।
১ ফেব্রুয়ারি ‘৭২ লাকসামের এম, সি, এ জনাব আব্দুল আউয়াল ও থানার সেকেন্ড অফিসার এবং জন কয়েক প্রত্যক্ষদর্শী কারখানাটি দেখতে গিয়েছিলেন। কারখানাটিতে ঢুকতেই ভেসে আসে পর্চা গন্ধ। কারখানার যেখানে যে কক্ষে ঘুরেছেন তারা প্রতি কক্ষেই পেয়েছেন ধ্বংসের স্বাক্ষর। ভিতরে ঢুকতেই দু’টি পেয়ারা গাছ এবং একটি কাঁঠাল গাছ। গাছ তিনটির প্রত্যেক ডালে তখনাে ঝুলে আছে হত্যার দৃষ্টান্ত প্রতীক বহু রশি । জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, এ গাছ তিনটিতে যে সমস্ত রশি এখনাে ৰূলে রয়েছে সে সমস্ত রশিতে অসংখ্য নারী পুরুষকে ঝুলিয়ে রেখে চাবুকের প্রহারে নিস্তেজ করা। হত। বলা বাহুল্য, ঘরের চিলেকোঠায় আগে থকেই লুঠ করা খেজুরের গুড় বা মিষ্টি দ্রব্য ছিটিয়ে অজস্র পিপড়ে জড়াে করে রাখা হতাে। তারপর সেই পিপড়ের ভিড়ে সংজ্ঞাহীন দেহ ফেলে রাখা হতাে। সারারাত বিষাক্ত পিপড়ের দংশনে অনেককেই সেই চিলেকোঠায় নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এমনিভাবে প্রাথমিক নির্যাতন শেষে অনেককে চোখ বেঁধে লাইনে দাঁড় করানাে হতাে তারপর গর্জে উঠতাে হয়েনাদের অন্ত। নিমেষে ভুলুষ্ঠিত হতাে অগণিত প্রাণ । একটু এগিয়ে গেলে একটি পুকুর। পুকুরের পশ্চিম পাড়ে দুটি আম গাছ। এ গাছেও বহু রশি ঝুলছে আর গাছের নীচে আগাছায় ভরা স্থানগুলােতে বহু গর্তের সন্ধান পাওয়া যায়। | জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানান ঐসব পেয়ারা কাঁঠাল এবং আম গাছের নীচের আগাছা ভরা জমি খুঁড়লেই বের হয়ে পড়বে অসংখ্য নর-কঙ্কাল। আর এক প্রত্যক্ষদশী পুকুরের পূর্ব পাড়ের একটি ভরাট গর্তের চিহ্ন দেখিয়ে জানালেন যে, একজন মুক্তিযােদ্ধাকে বেঁধে এই গর্তে জীবিত ফেলে দিয়ে মাটি চাপা দিতে তিনি দেখেছেন। এম, সি, এ আউয়াল এ খবরটি বহু লােকের মুখে শুনেছেন বলে জানান।
সেকেন্ড অফিসার আগেই শুনেছিলেন যে, কারখানার ভেতরে ইলেকট্রিক হিট দিয়ে লােক মারা হতাে। তাঁর নেতৃত্বে সে রুমটি খুঁজে পাওয়া গেল। সেখানে একটা সুইচ বাের্ড আর অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। সে ঘরটির পাশেই বেশ কিছু সামরিক ও বেসামরিক লােকের পােশাক। এখানে বাঙালী সামরিক ও বেসামরিক লােকদের উলংগ করে ইলেকট্রিক হিট দিয়ে মারা হতাে। সারাটা কারখানা জুড়ে একই অবস্থা। সর্বত্রই দেখা যায়, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে অনেক কাগজপত্র, খান সেনাদের ব্যক্তিগত চিঠি ও পারিবারিক ফটো। লাকসাম রেলওয়ে হাসপাতাল এর মালী মনিন্দ্র, চন্দ্র, উপেন্দ্র চন্দ্র, ও শ্রীরাম চন্দ্র মালীকে কয়েক মাস ধরে কারখানায় খান সেনাদের কাজ করতে হয়েছে বলে অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তারা।
________________________________________
মনিন্দ্র চন্দ্র জানিয়েছেন যে, এখানের অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ দেখে সে ভীত হয়ে অনেক বারই পালাতে চেয়েছিল কিন্তু সুযােগ মেলেনি। মনিন্দ্র চন্দ্র আরাে জানিয়েছেন যে, প্রতি রাতেই দলে দলে লােকদের চোখ বেঁধে জংশনের দক্ষিণের পূর্ব দিকে বেলতলায় নিয়ে যেয়ে ব্রাশ মেরে হত্যা করা হতাে।
মনীন্দ্র চন্দ্রের ও তার সংগীদের নির্দেশিত গর্তগুলি খুঁড়লে আজও অসংখ্য প্রমাণ মিলবে বলে তারা জানান। লাকসামের ডাঃ মকবুল আহমদ, আব্দুর রহিম ও আব্দুল মমিন এক সাক্ষাৎকারে জানালেন যে, পাক-সেনাদের কুখ্যাত মেজর মুজাফফর হাসান গার্দিজি, ক্যাপ্টেন ওবায়দুর রহমান, সুবেদার মুস্তফা খান ও রেলওয়ে পুলিশ বাকাওয়ালীর নেতৃত্বে স্থানীয় কতিপয় দালালের বােগ সাজশে লাকসামে কয়েক হাজার লােকের প্রাণনাশ ঘটে। লাকসাম থানার আওয়ামী লীগ কর্মী অর্পা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জনাব আলী আশরাফকে এবং লাকসামের বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল খালেক ও খসরুকে এই হত্যাপুরীতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
চাঁদপুরের বিভীষিকাময় দিনগুলি চাঁদপুরবাসী দীর্ঘ ৯ মাসের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলাের কথা আজও ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারেনি নরঘাতক পিচাশ পাঞ্জাবী মেজর তৈমুর ও তার দোসর সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের শওকতের অত্যাচারের কথা। তাদের বিভৎস নারকীয় তান্ডবে বহু মা-বােন। কিশােরীরাও এদের লালসার কামনা থেকে বাঁচতে পারেনি। কিন্তু এখানেই লােকের প্রাণ নিয়েছে এরা। ইট ও পাথর ছুঁড়ে এখানে হত্যা করা হােত মুক্তিযােদ্ধাদের।
হাত পা বেধে জ্যান্ত মানুষগুলােকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলত। পেরেক দিয়ে চোখ উঠিয়ে নিত। হাতুড়ি দিয়ে দাঁত ভেঙে দিত। মাথা নিচু করে পা বেঁধে বুলিয়ে রাখতাে। হত্যা ছিলাে তার কাছে আনন্দদায়ক। এই ঘৃণ্য চরিত্রহীন শয়তানের একান্ত প্রিয় ছিল নারী ও সুর। নারীদের দেখলে সে পাগলা কুকুরের মতাে ঝাপিয়ে পড়তাে। মুক্তিবাহিনীর সহায়ক ও আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে নিরীহ লােকদের মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেছে প্রতিদিন।
অগ্নিদখ দোকান পাট ও ঘরবাড়িগুলাে জংগী মেজর মামুদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই ছিলাে লুটেরাদের নায়ক। তারই নির্দেশে পুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রখ্যাত বাণিজ্য কেন্দ্র পুরানাে বাজারের লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ। ৭১ এর এপ্রিল থেকে শুরু হয় চাঁদপুরে জল্লাদ বাহিনীর নযজ্ঞ।
একদিন সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে দুটি স্যাবার জেট চাঁদপুরবাসীকে আতংকিত করে তােলে। শুরু হয় একটানা ৪০ মিনিট গুলিবর্ষণ । আকাশ হেরে যায় ধোয়ায় । চারিদিকে ধ্বণিত হয় হতভাগ্যদের আর্তচীৎকার। হতাহত হয় প্রায় ৫০০ লােক। আর তারই সাথে বুটে চলে নিরীহ মানুষের কাফেলা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। পরদিন সন্ধ্যায় মেজর
________________________________________
ইফতেখারের নেতৃত্বে ৫০০ সৈন্য ও অ বােঝাই ৭৮ টি ছােট বড় সামরিক যান চাঁদপুরে প্রবেশ করে। কুমিল্লা থেকে চাঁদপুরে আসার পথে রাস্তার দু’ধারে তারা নির্বিবাদে গুলি চালায়। চাঁদপুর এসে টেকনিক্যাল স্কুলে আস্তানা গড়ে। পরদিন সকালেই তারা বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। গুড়িয়ে দেয় পার্শ্ববর্তি গ্রামের ঘরবাড়ি। এরপরে ছুটে যায় শহরের ভিতরে। কয়েক ঘন্টা টহল দিয়ে এরা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় কাউকে বেয়নেট দিয়ে কাউকে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন চাঁদপুর কলেজে হানাদার পশুরা ৫ জন ছাত্রকে হত্যা করে।
১০ এপ্রিল থেকে শুরু হয় এদের কারফিউ-এর পালা। কারফিউ-এর সঠিক সময়সীমা এরা জনসাধারণের কাছে গােপন রাখতাে। আর এ সুযােগে তাদের স্বয়ংক্রীয় রাইফেলগুলাে সক্রিয় হয়ে নিধনযজ্ঞে মেতে উঠতাে। সেদিনই তারা ডিনামাইট দিয়ে শহরের কয়েকটি এলাকার ঘরবাড়ি উড়িয়ে দেয়। শুধু তারাই নয় কুখ্যাত আলবদর, আল শামস, রাজাকার ও দালাল কমিটির সদস্যদের অকথ্য নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে শান্তিপ্রিয় জনসাধারণ। এরা কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। জুলুম আর অত্যাচারই ছিল শান্তিবাহিনীর শান্তির প্রধান ধর্ম । এরাই অধিকাংশ সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। সুষ্ঠন করেছে শহরের ব্যবসা অধ্যুষিত এলাকার ঘরগুলাে। দরজা জানালা পর্যন্ত খুলে দিয়েছে এরা। তারপর তাতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
এদের ইংগিতেই প্রাণ হারিয়েছে এখানকার দশ হাজার নিরীহ লােক। মেঘনা তীরবর্তী চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকা ছিল খুনীদের কষাইখানা। একবার কাউকে সেখানে নিয়ে গেলে আর কোনদিন খোজ পাওয়া যেতনা। এ এলাকা ছিল চাঁদপুর বাসীর আতংকের স্থান। প্রয়ােজনেও কেউ সেই এলাকায় যেতে সাহস পেতনা। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ওরা নির্মমভাবে বন্দীদের চাবুক দিয়ে পিটিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে সেখানে সিগারেটের আগুন লাগিয়ে দিত, পরে হাত পা বেঁধে দেয়ালের মধ্যে দু’চারদিন আবদ্ধ করে রাখতাে। এরপরও যদি প্রাণ না যেত তাহলে ফেলে দিত নদীতে।
এছাড়া পানিতে দাঁড় করিয়েও গুলি করা হত। এমনি পরিকল্পিতভাবে হত্যালীলা চালিয়ে এখানে হাজার হাজার লােককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হানাদার বাহিনীর এরূপ অসংখ্য বর্বরােচিত ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে চাদপুর রেলওয়ে স্টেশন।
দিনাজপুরে হত্যা লুঠন ধর্ষন অগ্নিসংযােগ দক্ষিণ-পূর্বে পলির সমতট, উত্তর-পশ্চিমে শালবন। করতােয়া, মহানন্দা, কাঞ্চন পূর্ণভবা নদীর স্বচ্ছ সলিলে সতত অবগাহমান দিনাজপুর। কাঞ্চন পূর্ণতবার তীরে তীরে একদিন ছিল সরল অনাড়ম্বর মাটির মানুষ সাঁওতালদের আদিবাস। রংপুর থেকে সৈয়দপুর। সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুর ৪৫ মাইল। আবার দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগাঁ ৩৫ মাইল। সৈয়দপুর শহরের বড় বড় পাটের গদীগুলাে গুদামঘরগুলাে শুন্য খা খা করছে। রেললাইন পেরিয়ে শহরের পশ্চিম প্রান্তে কাঁচা বাড়ীতে নেইই-অধিকাংশ পাকা পােস্তা
________________________________________
ইটের বাড়িগুলাে ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে। দিনাজপুর পর্যন্ত পথের দু’ধারে শত শত বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দিনাজপুর শহরে পাঁচ, ছয় মাইলের মধ্যে গ্রামগুলােতে ধ্বংসযজ্ঞ আরাে ব্যাপক। | নেই, কিছুই নেই। মানুষের বসতি ছিল তার চিহ্ন মাত্র নেই। পাখিদের কলকাকলি নেই। হিলি থেকে তেতুলিয়া দু’শ মাইলের বেশী সীমান্ত এলাকার অভ্যন্তরে অধিকাংশ স্থানে কোন জনবসতি নেই। কমপক্ষে তিন লক্ষ পরিবার এখানে ছিন্নমূল সর্বহারা । বাংলাদেশের সর্ব উত্তর প্রান্তের এই জেলাটি বােধহয় খান সেনাদের হাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
দিনাজপুর এলাকার ডেপুটি কমিশনার বললেন, আপনি যদি দিনাজপুর এলাকায় যান, তাহলে আপনার মনে হবে আপনি আফ্রিকার সাহারার কোন এলাকায় গিয়েছেন। এ জেলার পচাগড় ও অম্বর থানায় প্রচন্ড লড়াই হয়েছে। দিনাজপুর থেকে ঠাকুরগা যেতে সড়কের ডান ধারে রয়েছে ছােট ছােট শালগাছের বন। সারাটি পথ বরাবর বনের মাঝে মাঝে বাংকার। হত্যা আর নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন, আর অগ্নিসংযােগ। যেখানেই যাই, সেখানে একই কথা। সব হারানাে মানুষগুলাের একই বিলাপ, অভিন্ন কাহিনী । দিনাজপুর শহরে খুব কম বাড়ি আছে যা লুষ্ঠিত হয়নি। অসংখ্য ঘর বাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পার্বতীপুরে খানসেনা ও তাদের দালালেরা জাহাজের ইঞ্জিনের বয়লারে জ্যান্ত মানুষকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ওরা রাতের বেলা রেষ্ট হাউসে বন্দী মেয়েদের নিয়ে আসতাে। চালাতে পাশবিক অত্যাচার। ইরিগেশন বিভাগের ওয়ার্কশপের পিছনে খান সেনারা বহু লােককে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে বীরগঞ্চ থানার পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টর জনাব ফজলুর রহমানকে, দেবীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আবদুল কাদেরকে, পার্বতীপুর থানার থার্ড অফিসার আমিনুদ্দিনকে , পচাগড়ের এস, এই, আবদুর রশীদকে, এস, অই মকবুল হােসেন এবং আরাে বহু পুলিশ কর্মচারীকে।
পার্বতীপুর হলদি বাড়ি পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার তােজাম্মেল হােসেন বললেন, পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর আসার পথে রেল সেতুর কাছে ২০০ জন লােকের কংকাল পাওয়া গেছে। বীরগঞ্জ থানার ঘােড়াবন্ধ গ্রামের জনৈক প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক বললেন, নভেম্বর মাসে তার এক আত্মীয়ের ঘরে ঢুকে দস্যরা পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছে। ডিসেম্বরের ১ তারিখে খানসেনারা হয়হাটি গ্রামের জনৈকা চার সন্তানের জননীর ওপর তাদের পাশবিক ক্ষুধা চরিতার্থ করে হত্যা করেছে।
বগুড়ায় পাকবাহিনীর হত্যাকান্ড বগুড়ার অতীত ইতিহাস বুকে নিয়ে এক সাধু আজও বেঁচে আছেন। পাক দস্যুদের জঘন্য নৃশংসতা সম্পর্কে যুগােল কিলাের গােস্বামী বললেন, আমার তিনভাই তখন খেতে
________________________________________
বসেছিল। হঠাৎ সেই মুহুর্তেই বাড়ির ভিতর ঢুকলাে কয়েকজন অবাঙালী। ওরা আমার ভাইদের খেতে দেয়নি। এসেই ভাইদের হাত বেঁধে ফেলল। বৃদ্ধ বলেই বােধহয় আমাকে ওদের সংগে নেয়নি। কিন্তু আমার ভাইয়েরা আর ফিরে আসেনি। একদিন এক ধাঙড় এসে আমাকে জানালাে, পাক সেনারা রাস্তার ধারের গর্তে আমার ভাইদের পুতে রেখেছে। সাধুবাবা বললেন ওরা আমাকেও ছাড়েনি। মাঝে মাঝেই পাকসেনারা আশ্রমে প্রবেশ করতাে। আমার সামনে বন্দুক ধরে বলতাে, “টাকা কাহা-টাকা দো”। এই দেখুন আমার পিঠে রড দিয়ে মেরেছে। একদিন ওরা আমাকে মন্দিরের সামনে দাঁড় করিয়ে বললাে, কুয়া কাহা হায়”? আমি ভেবেছিলাম ওরা এবার আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে বললো, বুড়া তােম কলেমা পড়”।
আশ্রমের পূর্বদিকের বাগান দেখিয়ে সাধু বললেন, ওখানে একটা কুপ আছে। ওখান থেকে প্রতিদিনই করুণ কান্নার আওয়াজ আমি শুনেছি। একদিন এক ছােট শিশু চীৎকার করছিল। ঐ ছেলেটিকে জবাই করে কুপের এঁধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমি প্রায় প্রতিদিনই এরকম চীৎকার শুনেছি। বাগানের একটি ঘরের দেয়ালে দেয়ালে মানুষের রক্ত লেগে আছে। কুপে নরকঙ্কাল আর মাথার খুলি এখনাে দেখা যায়। কত নিরপরাধ, নিস্পাপ মানুষ এখানে জল্লাদের হাতে বলি হয়েছে কে তার হিসাব দিতে পারে।
“তখন জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। রাত্রিবেলা শুয়ে আছি। হঠাৎ ইন্টার ক্লাশ ওয়েটিং রুম থেকে ভেসে এলাে করুণ আর্তনাদ । আমাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে কে যেন চীৎকার করছিলাে। একটু পরেই থেমে গেল। বুঝলাম সে আর নেই।” কথাগুলাে বগুড়া রেলওয়ে একজন পদস্থ বাঙালী কর্মচারী। দস্যুদের আর কি নৃশংসতা দেখেছেন? উত্তরে তিনি জানালেন, “কি দেখি নাই বলুন! ওরা সব করেছে। বাঙালীরা তাদের মালপত্র ঐনে উঠালাে। তারপর কাজ শেষে শুরু হলাে অমানষিক অত্যাচার। মিলিটারীরা তাদের ওরাগনের পিছনে নিয়ে দু’পা সামনে করে পায়ের সংগে মাথা লাগিয়ে বসিয়ে রাখলাে। তারপর কয়েকজন উঠলাে তাদের পিঠের উপর। জীবন্ত মানুষের হাড়গুলাে এভাবে ভেঙ্গে দিল। এরপর তাদের যথারীতি হত্যা করা হলাে। পাকদস্যুরা এই রেল স্টেশনের আশে পাশে অহরহই মানুষদের এমনি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতাে।”
তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় বাঙালী কর্মচারীদের ওরা ক্ষমা করে নাই। যারা সরতে পারেনি, তাদের মৃত্যু ছিলাে ওদের হাতে। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন, একদিন মেজর জাকী সামরিক হেড কোয়ার্টারে তাকে ডাকলাে। তারপর পাশের রুম থেকে রক্তমাখা কাপড় পরিহিত একজন বাঙালীকে ডেকে আনলেন। তার হাত বাঁধা ছিল এবং মুখ ছিল রুমাল দিয়ে বাঁধা। আমাকে মেজর বললাে-দেখাে। আমি মেজর জাকীর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি বটে কিন্তু শেষের দিকে ও বগুড়া রেলওয়ের সমস্ত বাঙালী কর্মচারীদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলাে। বগুড় ছাড়ার পূর্বে ওদের ষড়যন্ত্র ফাঁস হওয়ায় আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু রেলষ্টেশনের বধ্যভূমিতে হারিয়ে যাওয়া
________________________________________
ভাইয়েরা আর আসবে না। রেলষ্টেশনের সুইপার দীন জমাদার সতর্কতার ইংগিত দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু এই বৃদ্ধের সাতটি মাস কেটে গেছে ষ্টেশনের আশেপাশের মৃত বাঙালীদের কবর দিতেই। দশীন জমাদার ছিলেন বগুড়া রেলওয়ে ষ্টেশনের একজন সুইপার। বয়স ৭০ বছরের বেশী। এই বৃদ্ধ সাতটি মাস কাটিয়েছেন পাকদস্যুদের হত্যা করা বাঙালীদের লাশ সরাতে। দস্যুদের হত্যাযজ্ঞের সে এক নীরক সাক্ষী। তিনি জানান, বাঙালীদের লাশ সরাতে। তিনি জানান, মুক্তিযােদ্ধা আর ইন্ডিয়ান সৈন্য আমাদের রক্ষা করল, হুজুর—-*।
রেলওয়ের দুতলা একটি বাড়ি ব্যবহার করতাে কসাইখানা হিসেবে। নিরীহ বাঙালীদের পাকদস্যু আর তার সহযােগীরা ধরে আনতে, তারপর এই বাড়িতে হত্যা করা হতাে। বাড়ির সংলগ্ন এক বৃহৎ কুপে হত্যা করার পর মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হতাে। বাড়ির আউট কিচেনে সবচেয়ে বেশি লােক হত্যা করা হতাে বলে ধারণা করা হয়। কারণ এখান থেকে কুপটি মাত্র ২০ গজ দূরে। বাড়িটার চারিদিকে ঘাস আর জংগল প্রায় ভর্তি ছিল। পাকবাহিনী সেগুলাে পরিষ্কার করতাে না। কারণ জংগলের মাঝে এই রকম একটি বাড়িতে তাদের বাঙালী নিধনের নেশা খুবই বেড়ে যেত। শুধু তাই নয় বর্বর পাকসেনারা এই বাড়িটাতে মদ খেয়ে জুয়ার আসা বসাতে। দিনে রাতে তারা এখানে আসর জমাতাে। রক্তের নেশায় বর্বর পণ্ড হন্যে হয়ে বাঙালীদের খুঁজে আনতাে। দশীন জমাদার জানান আমার হাতেই কমপক্ষে চার-পাঁচ শত লাশ এই কুয়ায় ফেলেছি। জল্লাদরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হুজুর, আমি কি করি। আমি লাশ গুলি পুঁতে রাখতে চাইতাম কিন্তু ওরা দেয় নাই। ওরা আমাকে বলতে ‘তু শালা হিন্দু হ্যায়, এইসে দরদ কিউ লাগতা। প্রথমে বন্দীকে ধরে তারপর হাত বেঁধে মুখের ভিতর কাপড় গুঁজে দিত। তারপর হত্যা করতে চাকু মেরে না হয় বজাই করে। কাউকে আবার পিছন দিক থেকে ঘাড়ে ছুরি বসিয়ে জবাই করতাে। কত বাঙালী কাঁদতে হজুর, কি করবাে। মিলিটারীরা খুশি মতাে মানুষকে গুলি করতাে। বাংলাের পূর্বদিকের মাঠটা কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। বগুড়া শত্রুমুক্ত হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এই বাঙলােতে কোন বাঙালী আসতে পারেনি। এই বাঙলাের প্রতি ঘরের মেঝে আর দেয়ালে মানুষের রক্তে ভেজা বহু কাপড় জামা ইত্যাদি রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল। বাংলাের উপর তলার হাউজে বর্বরতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায়। এই হাউজটি ছিল সম্পূর্ণ মানুষের রক্তে ভরা। রক্তগুলাে জমা হয়ে ক্রমশঃ জমাট বেঁধে যায়। কোদাল দিয়ে মাটি কাটার মত জমাট বাঁধা রক্ত কেটে এই হাউজ পরিষ্কার করা হয়েছে। জবাই করা মানুষের রক্তস্রোত দেখার জন্যই বােধ হয় ওরা হাউজে জমা করতাে। রক্ত দেখেই হয়তাে রক্তপানের তৃষ্ণা জল্লাদদের বাড়তাে বেশি। বগুড়া রেলষ্টেশন আর ষ্টেশন সংলগ্ন রেল লাইনের আশেপাশে কত নিরীহ বাঙালীকে পাকসেনা আর তার সহযােগীরা হত্যা করেছে তার হিসেব নেই।
________________________________________
খুলনায় পাকবাহিনীর নরমেধযজ্ঞ খুলনায় শহরের হেলিপাের্টে ও ফরেষ্ট ঘাটে বাঙালীদের যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হতাে তা দেখে খুলনার তৎকালীন জেলা জজ হার্টফেল করে মারা যান। হেলিপাের্ট, জজকোর্টের সামনে এবং সার্কিট হাউস সংলগ্ন মাঠে বাঙালীদের প্রকাশ্যে দিবালােকে ছাগল ঝােলা করে পা উপরে মাথা নীচে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হতাে। আর এই অবস্থায় বেয়ােনেট দিয়ে খোচাননা হতাে। যতক্ষণ না মারা যায় ততক্ষণ চলতাে এই নির্যাতন। যার কাছ থেকে কোন স্বীকারােক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হতাে তাকে ঐভাবে অত্যাচার করার পর অজ্ঞান হয়ে পড়লে নামানাে হতাে, জ্ঞান ফিরলে আবার ঝুলানাে হতাে।
| একদিন সকালের ঘটনা। হেলিপাের্টে লুংগি ও গেঞ্জি পরা একজন বাঙালীর শরীরের বিভিন্ন গিরায় কাঠের রােলার দিয়ে দু’জন সেনা পিটাচ্ছে আর অন্যরা তা উপভােগ করছে। লােকটি চিৎকার করছে আর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তারপর তার দু’পায়ে দড়ি বেঁধে মাথা নীচে দিয়ে বুলানাে হলাে। পরনে থাকলে শুধু জাংগিয়া । চললাে চাবুকের বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির সাথে সাথে তার দেহটি মুচড়ে উঠতে লাগলাে । ঐ ঝুলন্ত অবস্থাতেই সে হাত দিয়ে বাধা দিচ্ছিল। কিন্তু পরে আর তার হাতে সে জোর রইল না। কিন্তু চাবুকের বাড়ি চললাে অব্যাহত ভাবে। প্রতিদিন এইভাবে শেষ হতে অসংখ্য বাঙালীর জীবন। সারাদিন এইভাবে চলতাে একের পর এক হত্যাকান্ড।
রাতের বেলায় জজকোর্টের পিছনে ফরেষ্ট ঘাটে বাঙালীদের এনে জবাই করে হত্যা করা হতাে এবং দেহগুলাের পেট চীরে নদীতে ফেলা হতাে। ঘাটটি আবার জজ সাহেবের বাড়ির ঠিক পেছনেই । রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে সেই মৃত্যু পথযাত্রী বাঙালীদের করুণ আর্তনাদ জজসাহেবের কানে পৌছতাে। দিনে হেলিপাের্টে ও রাতে ফরেষ্ট ঘাটের এই সব হত্যাযজ্ঞ সহ্য করতে না পেরে জজ সাহেব তকালীন ভারপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকে অনুরােধ করেছিলেন যে বিচারালয়ের সামনে যেন এধরনের কাজ না হয়। তার উত্তরে তিনি পান মৃত্যুর শাসানি। এরপর তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন।
আর একটি বধ্যভূমি ছিল গল্লামারী । খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড়মাইল। হেলিপাের্ট, ফরেষ্ট ঘাট, কাষ্টমসঘাট প্রভৃতি জায়গা প্রথমে বাঙালীদের হত্যার জন্য বেছে নিলেও পরে বর্বর পাকবাহিনী গল্লামারীকেই তাদের নৃশংসতার উপযুক্ত স্থান বলে বেছে নিয়েছিলেন। সারাদিন ধরে শহর ও গ্রাম থেকে বাঙালীদের ধরে এনে জেল খানা, হেলিপাের্ট ও ইউ, এফ, ডি ক্লাবে জমায়েত করা হতাে। তারপর রাত হলে সেই সব হতভাগ্য নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীদের পেছনে হাত্য বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অত্র দিয়ে ব্রাশ করে মারতাে, রাত দেহে লুটিয়ে পড়তাে হতভাগ্যরা। হত্যার আগে ট্রাক ভরে যখন তাদের নিয়ে যাওয়া হতাে তখন সেই সব নিরুপায় মানুষের আর্তনাদ রাস্তার আশে পাশের সবাই শুনতাে। জানালা, দরজার ফাঁক দিয়ে যারা এইসব দৃশ্য দেখতে তাদের সবাইকেও ধরে এনে একসঙ্গে হত্যা করা হতাে। হানাদার বাহিনী
________________________________________
প্রতিরাতে কমকরেও শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করতাে। দিনের বেলায় তাদের লাশ জোয়ারের পানিতে ভেসে আসতাে।
অনেকে তাদের আপনজনের লাশকে সনাক্ত করলেও সেখান থেকে তাকে উঠিয়ে নিতে পারেনি। কেননা বর্বরেরা জানতে পারলে তাকেও হত্যা করবে। কিছুদিন জল্লাদরা ঠিক করলাে গুলি করে আর হত্যা নয়। অন্য পন্থা। শুরু করলাে জবাই করে হত্যা। এরপর ঘটলাে চরম নিষ্ঠুরতার । রাতের বদলে দিনের বেলাকে বেছে নিলাে হায়ানারা। সকলের চোখের সামনে পিঠমােড়া দেওয়া ট্রাক ভর্তি বাঙালীদেরে নিয়ে যাওয়া হতাে। তার ঘন্টাখানেক পর শূন্য ট্রাক ফিরে আসতাে। গল্লামারিতে পড়ে থাকে কিছুক্ষণ আগে নিয়ে যাওয়া সেই সব মানুষের শীতল দেহগুলি। খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল থেকে দুই ট্রাক অসংখ্য লাশ পড়ে আছে, কুকুরে খাচ্ছে আর দূরে কয়েকটি কুকুর বসে হাঁফাচ্ছে। মানুষ খেয়ে তাদের উদর অতিমাত্রায় পূর্ণ । ভাবতেও অবাক লাগে মানুষকেও কুকুরে টেনে ছিড়ে খেয়েছে।
চট্টগ্রামের বিশটি বধ্যভূমি চট্টগ্রাম শহর ও শহরতলী এলাকাসহ জেলার আরাে ৯টি থানাতে হানাদার খান সেনারা সর্বমােট ২০ টি বধ্যভূমিতে বাঙালী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। শহর ও শহরতলী এলাকায় ১০ টি বধ্যভূমির মধ্যে আটটিতে গড়ে পাঁচ হাজার করে বাঙালী হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া পাের্ট এলাকা এবং নেভী ব্যারাক এলাকাতে দীর্ঘ ৯ মাস ব্যাপি মানুষ হত্যা করা কি হারে কর্ণফুলি নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে, তার কোন হদিস খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। এসব। বধ্যভূমি থেকে বাঙালী হত্যার সঠিক সংখ্যা হয়তাে কোনদিন পাওয়া যাবেনা।
তবে সরকার যদি ব্যাপক অনুসন্ধান ও তথ্য সংগ্রহের জন্য এগিয়ে আসেন তাহলে হত্যাযজ্ঞের ব্যাপকতা সহ একটা আনুমানিক সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবেন। কেবল মাত্র চট্টগ্রাম শহরে নিহত লােকের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। বিভিন্ন থানা মিলিয়ে এ সংখ্যা অন্ততঃ তিন লাখে দাঁড়াবে। শহরে ও শহরতলীর আমবাগান, ওয়ারলেস কলােনী, শেরশাহ কলােনী ও ফয়েজলেক সহ গােটা পাহাড়তলী এলাকাতে এখনাে হাজার হাজার বাঙালীর খুলি পাওয়া যাবে। এছাড়া, চাঁদগাঁও, লালখান বাজার, হালিশহর, কালুরঘাট, পাের্টকলােনী, ক্যান্টনমেন্ট ও সার্কিট হাউসে হাজার হাজার লােককে ধরে নিয়ে হত্যা করা
মিরেশ্বরাই, সীতাকুন্ড, রাউজান, পটিয়া, সাতকানিয়া ও বাঁশখালীর বনাঞ্চলেও হাজার হাজার বাঙালী হত্যা করা হয়েছে। বেসরকারী উদ্যোগে এ সমস্ত এলাকার রিপাের্ট সংগ্রহ অনেকটা কঠিনকাজে। বিভিন্ন অঞ্চলে এখনাে বহু নরকঙ্কাল হড়িয়ে আছে। শহরের ওয়ারলেস কলােনী, ঝাউতলা ও নাছিরাবাদের পাহাড়ী এলাকাগুলােতে বহু নরকঙ্কালের অস্তিত্ব আজো পাওয়া যাবে।
________________________________________
সীতাকুন্ডের শিবনাথ পাহাড়ে কয়েক হাজার বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছে। মিরেশ্বরাইয়ের ওয়ারলেস এলাকাতে মানুষ জবাই করার স্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিলাে। রাস্তার বাস, ট্রেন থেকে হাজার হাজার লােককে ধরে এনে আটক করে রাখা হতাে এবং প্রতিদিন রাতে তাদের জবাই করে হত্যা করা হতাে। এ সমস্ত এলাকাতে অসংখ্য গণকবর আজো দেখতে পাওয়া যায়। মানুষের পরিহিত কাপড়চোপড়, জুতা, স্যান্ডেল ইত্যাদি ঐ সব গণকবরে মিশে আছে। স্থানীয় জনসাধারণের ধারনা মতে শুধু মিরেশ্বরাই ও সীতাকুন্ডের বধ্যভূমিগুলােতে ৫০ হাজার লােককে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া রাউজান, পটিয়া ও বাঁশখালী ইত্যাদি থানাতেও প্রায় অনুরূপ হারে গণহত্যা চালানাে হয়েছে।
চাঁদপুরে পাকবাহিনীর হত্যালীলা। কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর ও তার আশেপাশে বর্বর বাহিনীর নৃশংসতার বহু তথ্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। কেবল মাত্র চাঁদপুরেই দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযােগী রাজাকার, মােজাহিদ বাহিনীর হায়েনারা ২৫ হাজার বাঙালীকে হত্যা করে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। এই বন্দর শহরটিতে আলবদর বাহিনী, পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পনের আগে পরিকল্পিতভাবে বহু বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রহত্যায় মেতে উঠে।
ডাঃ মজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, চাঁদপুর পুরানাে বাজারস্থিত নুরীয়া হাইস্কুলে আলবদর বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে ঐ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। লুটতরাজ ও নির্বিচারে হত্যা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। একদিন আলবদর বাহিনী গ্রাম থেকে আগত একজন নিরীহ বাঙালীকে মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে প্রকাশ্য বাজারে গুলি করে হত্যা করে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কিংবা যুবকদের পেলেই তারা ধরে নিয়ে যেত এবং তাদের কাউকেই পুণরায় ফিরতে দেখা যায়নি বলে তিনি জানান।
দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পনের পূর্ব মুহুর্তে ফ্যাসিষ্ট আলবদরবাহিনী পরিকল্পিত উপায়ে বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করে। চাঁদপুর টেলিফোনের সহকালী ইঞ্জিনিয়ার জনাব সায়েদুল হক আলবদর বাহিনীর তৎপরতার কথা বলতে গিয়ে তারা কি করে তার দু’জন কর্মীকে হত্যা করেছে এবং তিনি কি করে তাদের মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বেচে যান সেকথা জানান। ৭ ডিসেম্বর টেলিফোন সুপারভাইজার জনাব আব্দুল খালেক ও অপারেটর জনাব মাের্শেদুর রহমান শহরের উপকণ্ঠের একগ্রাম থেকে ফেরার পথে আলবদর বাহিনী তাদের ধরে এনে হত্যা করে। এদিন নিহতদের মধ্যে ছিলেন এসিসট্যান্ট ম্যালেরিয়া সুপারিনটেনডেন্ট জনাব জোয়ারদার মতিউর রহমান, ষ্টোরকিপার জনাব মাকসুদুর রহমান, মেকানিক জনাব কবীর আহমদ, ম্যালেরিয়া ইন্সপেক্টর জনাব সফিউদ্দিন আহমেদ ও দু’জন সুপার ভাইজার বজলুর রহমান ও ইদ্রিস মিয়া ও কৃষি বিভাগের একজন প্রােজেক্ট অফিসার জনাব ফয়েজ আহমেদ। নিহতদের মধ্যে ওয়াপদার দুজন মেকানিক নাজিমুদ্দীন ও মাহফুজুল হক ও ছিলেন।
________________________________________
দখলদারবাহিনী ও তাদের সহযােগী এদেশের জারজ সন্তানেরা যে নারকীয় হত্যাকান্ড চালায় তার চাক্ষুস সাক্ষী রেলওয়ে হাসপাতালের সেনিটারী এসিসট্যান্ট জনাব ফজলুল বারী। এপ্রিল মাসে চাঁদপুর দখলদার বাহিনীর কবলে পতিত হওয়ার পরও তিনি হাসপাতালের কাজে নিযুক্ত থাকায় বর্বর বাহিনীর নৃশংতার সাক্ষী হয়ে আছেন। রেলষ্টেশনের অফিস সমূহ ও রেষ্টহাউসে দখলদার পাকবাহিনীর ক্যাম্প করা হয় । শান্তিবাহিনীর সহযােগীতায় এই সমস্ত নরপশু চাঁদপুর পুরান বাজার ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে হত্যা, লুট, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযােগের মাধ্যমে এক নারকীয় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। এসময় শান্তিবাহিনীর সক্রিয় সহযােগিতায় বন্দর শহরের প্রায় সকল দোকানপাট লুঠতরাজ হয়। নির্বিচারে গণহত্যা ও ধর্ষনের ঘটনা এসময় বাড়তে থাকে। রেল, বাস, রাস্তাঘাট, নৌকা ও বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে হানা দিয়ে নিরপরাধ বাঙীদের ধরে এনে তাদের ক্যাম্প সংলগ্ন নির্যাতন কক্ষে অমানষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হতাে। কর্পোরেশনের গুদামের পেছনেই তাদের হত্যা করে ২০/৩০ জনকে একসাথে লােহার তারে গেঁথে নদীতে ফেলে দিত। যেদিন মৃতের সংখ্যা বেশী হতাে সেদিন ডােমদের। তলব করা হতাে।
রেলের ডােম ছনুয়া ও গয়া প্রসাদ বলেন, গভীর রাতে এসে পাকবাহিনীর সােক তাদের কোয়ার্টার থেকে ধরে নিয়ে যেত। ষ্টেশনের ওয়েটিং রুমে জি, আর, পি, হাজতে অথবা আক্কাস আলী হাই স্কুলে রক্তাক্ত মৃত্যুর স্বপ দেখিয়ে বলতাে “ইয়ে জলদী সাফ করাে”। মৃতদেহ বয়ে নিয়ে নদীতে ফেলতে হতাে এবং ভাের হবার পূর্বেই নির্যাতন কক্ষের স্থান পরিষ্কার করে ফেলতে হতাে। ডােম গয়াপ্রসাদ জানান, “চোখের সামনে কত বহিনে যে ইজ্জত নষ্ট করেছে তা বলতে পারুম না বাবু”।
সৈয়দপুর বাঙালী নিধন অভিযান দু’সন্তানের জননী বেগম সুরাইয়া রহমান। তিনি ছিলেন সৈয়দপুরের তদানীন্তন হাউজিং এন্ড সেটেলমেন্ট বিভাগের মহকুমা ইঞ্জিনিয়ার শহীদ ফজলুর রহমানের স্ত্রী। অশ্রুসজল চোখে বেগম সুরাইয়া রহমান তার স্বামী, দেবর ও ভাগনের নির্মম হত্যাকান্ডের ঘটনা বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, ৭১ সালের ১ এপ্রিল, আমার ব্যক্তিগত জীবনের শহীদ দিবস। এদিন বিকেলে প্রায় বিশজন হানাদার পাকিস্তানী সৈন্য আঁমাদের বাঙালীপুরস্থ বাসভবনের আসে। তারা আমাদের বাইরে নিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করালাে। আমার তিন বছরের কন্যা রুমা তখন ওর আব্দুর কোলে। আমার স্বামীর গলায় ঝােলানাে কোরান শরীফ ছুড়ে ফেলে দিয়ে তারা বলল, “কেয়া তােম জয় বাংলা বােলতা? তােম আওয়ামী লীগকা সাথ হ্যায়”। এই বলে তারা আমার স্বামী, দেবর এম, বি, বি, এর ছাত্র রফিকুল ইসলাম, ভাগনে এস, এস, সি পরীক্ষার্থী আনােগান হােসেন, বাসার মালী রুহুল আমীনকে ধরে নিয়ে যায়। ছােট মেয়েটি তখন তার আব্দুর কোলে মিশে ছিল। আমি তাকে জোর করে নামালাম।
________________________________________
হাউজিং এন্ড সেটেলমেন্ট বিভাগের ড্রাইভার অবাঙালী আবিদ হােসেন সৈন্যদের সাথে এসেছিল। সেই হানাদরদের সব খবর দিত। বেগম সুরাইয়া রহমান তাঁর সুখের নীড় ভাঙার কাহিনী বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি বললেন, ওদেরকে নিয়ে যাবার সামান্য পরেই আমি গুলীর শব্দ শুনি। তবুও আমরা সবাই তাদের আগমণের প্রতিক্ষা করছিলাম। | দিনগড়িয়ে সন্ধ্যা হলে স্থানীয় সেনাক্যাম্পের মেজর গুল, মেজর জাভেদ, ক্যাপ্টেন বখতিয়ার, কর্ণেল শফি সৈন্যসহ এসে আমাদের ছাদের উপর মেশিনগান বসালাে। উত্তেজনা, অশান্তি আর দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে রাত কাটালাম। ২ এপ্রিল ১৯৭১। আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে যাবার পর দ্বিতীয় দিন । ডাইভার আবিদ জানতাে আমার স্বামী, দেবর, ভাগনের ভাগ্যে কি ঘটেছিলাে। সে ঐ দিন কয়েকজন বিহারীকে নিয়ে এসে আমাদের বাসা লুঠ করে নিয়ে গেল। বাসায় প্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকার জিনিসপত্রের সব কিছু নিয়ে গেল। পরে হানাদার সৈন্যবাহিনী ঐদিনই আমাদের সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুলে নিয়ে গেলাে। সেখানে শুধু মহিলা আর মহিলা । কমপক্ষে ৬০০ থেকে ৭০০জন। সবাই এক একটা কাহিনীর প্রতিকৃতি, জীবন্ত সাক্ষী। সেখানে আমরা হানাদার সৈন্যদের পৈচাশিকতা দেখেছি। এরপর আমাদের স্থানীয় দারুল উলুম মাদ্রাসায় নিয়ে রাখা হয়। এখানে দু’মাস আটক রেখে নির্যাতন করার পর অনেককে ছেড়ে দেয়।
গাইবান্ধায় আছড়িয়ে মানুষ হত্যা গাইবান্ধা ইমারজেন্সী ফোর্স এর কর্মরত সুবেদার আবদুর রাজ্জাক। তিনি কান সেনাদের বিচারের মহড়া দেখেছেন। একাত্তরের মে মাসের মাঝামাঝি । রান্নার খড়িতে ঘাটতি পড়েছে। মেজর আফজাল ডেকে পাঠালাে। জ্বালানী কাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। তখন রাত ৮টা। রাজাক বললেন সে সুবেদারের নাম এখন মনে নেই। সে আফজালের ঘর থেকে দু’জন লােককে বের করে নিয়ে এলেন। সুবেদারকে শুধালাম “কেয়া ভাইয়া। ইন দোজনক বিচার হাে গিয়া থা”।থান সুবেদারে জবাব “তােমহারা সামনে হােগা তুম দেখাে”। ওদের দুজনকে মাঠ দাঁড় করাবো সিপাইকে হুকুম দিল এন লােগকো খরচা কর দো।” | লােক দু’টোকে পিছন ফিরে চোখ বন্ধ করতে বলা হলাে। পরপর চারটে গুলি। কাটা মুরগীর মত ছটফট করতে করতে ওরা মারা গেল। তারপর তাদের গর্তে ফেলে মাটি চাপা দেয়া হলাে। হেলাল পার্কে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের গাদাগাদি করে পুঁতে রাখা হােত । অনেককে গুলী খরচ না করে ইটের উপর আছড়ে মারা হয়েছে। চীৎকার করতাে বলে অনেককে পশুরা ইলেকট্রিক সক দিয়ে হত্যা করতাে।
হেলাল পার্ক সংলগ্ন ওয়াপদা রােডের মুকুল ও শাহিন ছিল কলেজের ছাত্র। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে বলে তার ধরা হয়েছিল ৬ অক্টোবর। শাহীন
________________________________________
জানালাে, “ওরা প্রথমে আমাকে সিকিউরিটি অফিসারের কাছে নিয়ে গেল। আমি মুক্ত এলাকায় যাতায়াত করার কথা স্বীকার করি। স্বীকার না করার উপায় ছিলনা। ওদের লােকেরা আমার যাতায়াতের সঠিক খবর রাখতাে। মেজর ছিলনা তাই আমাকে একঘন্টার জন্য ছেড়ে দেওয়া হলাে। বলা হল, যদি না ফিরি তবে আমার বংশে বাতি দেবার মতও কাউকে রাখা হবে না । অগ্যতা ১ ঘন্টা পর ফিরতে হলাে। মেজরের জিজ্ঞাসাবাদের পর কফিল শাহের গুদাম ঘরে হাত আর চোখ বেঁধে শুরু হলাে নির্যাতন। সেই ঘরে বিমান বাহিনী থেকে আগত একজন মুক্তিযােদ্ধা রক্তাক্ত ও উলংগ অবস্থায় বাঁধা ছিল। শাহীন জানায়, দলে দলে লােক ধরে নিয়ে তাদের উপর চালানাে হয়েছিল অকথ্য অত্যাচার।
পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর মাহমুদ, বালুচ রেজিমেন্টের মেজর আফজাল, লেফটেন্যান্ট নেওয়াজ গাইবান্ধার সকল হত্যুকান্ড ও নারী ধর্ষণের জন্য দায়ী। মেজর শেরখান, মহসীন মীর্জা কত মেয়ের সতীত্ব হরণ করেছে তার কোন হিসেব নেই। ভরতথলিতে পুরাতন ফুলছড়ি ঘাট ও নয়া ঘাটের মধ্যবর্তী স্থানে বহু লােককে খান সেনারা হত্যা করেছে। বগুড়া জেলার শরিফাকান্দী থানার লােকদেরও এখানে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। নলডাংগার আওয়ামী লীগ নেতা একরামউদ্দীন, রংপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রী বিজয়চন্দ্র মৈত্র, তার দু’ছেলে এবং গফুর নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। সুন্দরগঞ্জে একদিন সভার কথা বলে ডেকে এনে চেয়ারম্যান সহ ১৩ জনকে হত্যা করা হয়। একটি পরিবারের তিনজনকে দাওয়াত দিয়ে ক্যাম্পে ডেকে এনে হত্যা করা হয়েছে মুক্তিসেনাদের সহায়তা করার অপরাধে।
খুলনায় পাকবাহিনীর বিভীষিকা খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থলে রেলষ্টেশন ও রেল লাইনের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল বাঙালী নিধনের একটি খাঁটি। জল্লাদ সৈন্যরা খুলনা রেলষ্টেশন এলাকাতে বহু বাঙালীকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা ট্রেনের যাত্রী। প্রথমে তাদের সর্বস্ব লুট করা হতাে। তারপর হত্যা করা হতাে এবং সেই সব মূত দেহগুলির পেট চিরে নদীতে ফেলে দেয়া হতাে যাতে করে লাশ নদীর গভীরে তলিয়ে যায়।
রেলষ্টেশন ও টীমার ঘাট এলাকায় সকল মুটে শ্রমিকরাও তাদের হাতে মারা গিয়েছে। রেলকলােনী এলাকাতে প্রাধান্য ছিল পাকসেনাদের সহযােগী বিহারীদের। ঐ সময়ে রেলকলােনী এলাকাতে দিনে বা রাতে যখনই কোন বাঙালী গিয়েছে, সে আর ফেরেনি। এখানে প্রত্যেককে হত্যা করে পুঁতে রাখা হতাে। বহিরাগত লঞ্চ-ীমারের যাত্রীরাই হয়েছে তাদের প্রধান শিকার। কলােনীতে বসবাসকারী বাঙালী রেলকর্মচারীও হয়েছে
________________________________________
তাদের শিকার। লুষ্ঠিত হয়েছে তাদের গৃহসামগ্রী। এই এলাকা থেকে শত শত গলিত মৃত দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। ঐ এলাকায় আশিয়ানী হােটলের সামনে একটা ডােবা আছে। ঐ ডােবার ভেতরেও নিক্ষি হয়েছে শত শত বাঙালীর লাশ। খুলনা থানার দারােগা কাশেমকেও এখানে হত্যা করে ফেলে দেয়া হয়েছিল। ডিসেম্বরের কথা, যুদ্ধ চলছে সমস্ত দেশে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে বাঙালীদের হত্যা করে ভর্তি করা হয়ে রেল রােডের একটি গুদাম। খুলনায় বিমান হামলা চলাকালীন সময়ে পথের লােকজন রেলরােড কলােনীতে আশ্রয় নিলেই বিহারীরা সেখান | থেকে তাদের ধরে নিয়ে ঐ গুদামে হত্যা করতাে। কেউ ভাবতে পারতাে না যে | রেলরােডের মত একটি ব্যাস্ত সড়কে এই ধরণের একটি গুদাম রয়েছে, যেখানে
প্রতিদিনই বাঙালীদের লাশ বােঝাই হচ্ছে। ষ্টেশনরােডে ঐ সময় কেরােসিন বিক্রি হতাে। | কেরােসিনের তীব্র অভাব ছিলাে তখন। তাই সুদূর গ্রামাঞ্চলে থেকে ক্রেতারা এসে তাের থেকে লাইন দিত। কিন্তু বিমান হামলার সাইরেন বাজলেই তারা আত্মরক্ষার্থে আশেপাশে আশ্রয় নিত। তারা জানতাে না, যেখানে তারা আশ্রয় নিচ্ছে সেখানে বাঙালীদের জন্য রয়েছে মরণ ফাঁদ। তাদের কাছ থেকে টাকা পয়সা কেড়ে নিয়ে হত্যা করা হতাে। | তারপর ফেলা হতাে ঐ গুদামে। অবাঙালী বাজার পাহারাদারদের সহায়তায় বর্বর সেনারা | বাঙালীদের অর্থ লুণ্ঠন করে হত্যা করতাে। পাহারদাররা পাথঘাটে, বাজারে, ব্যাংকে সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঘুরে বেড়াতাে। ঐ সব জায়গায় কোন বাঙালীর কাছে টাকা দেখলেই তাকে মুক্তিবাহিনী বলে ধরে আনতাে হেলিপাের্টে অবস্থানরত জল্লাদ সেনাদের ক্যাম্পে। সেখানে সর্বস্ব লুট করে তারপর তাকে মেরে ফেলা হত। এ ধরনের হত্যা প্রতিদিন। ঘটেছে। এসব ধৃতদের অনেককেই মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে সিলিং-এ ঝুলিয়ে চাবুক মেরে হত্যা করা হতাে।
নওগাঁয় বর্বর পাকিস্তানীদের হত্যাযজ্ঞ নওগাঁ শহরে ঢুকলেই দেখতে পাবেন তাজ সিনেমা হলটি, যেটি দস্যু বাহিনীর হাতে বিধ্বস্ত হয়েছিলাে। এর দক্ষিণে দেখা যাবে অসংখ্য বাঙালীর কঙ্কাল যা ৰূপীকৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সামান্য দূরে একটি পুরানাে পাকা কূপ। পানীয় জলের জন্য কৃপটি এলাকার মানুষ ব্যবহার করতাে। এখন এই কূপটি কেবল গলিত ও বিকৃত লাশে ভর্তি, পানির চিহ্ন মাত্র নেই। শবদেহ রক্তের সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে। একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে দু’টি বড় টিনের ঘর। ঘরের ভিতরে ঝুলে আছে বহু দড়ি। নীচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জুতাে, জামা, প্যান্ট ও অন্যান্য পােশাক পরিচ্ছদ। শত শত মানুষের ব্যবহৃত কাপড়। মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত এবং সে রক্তের বিকৃতি কুপ পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়। এর চারপাশে দেখা যায় বহু নিহত ব্যখিন্ডিত মাথা। বিম্ভি শরীর গুলাে কুপের
________________________________________
মধ্যে ফেলা হয়েছে। সনাক্ত করার কোন উপায় নেই। তাজসিনেমার নিকটবর্তী পুরানাে পশু হাসপাতালটি অতিক্রম করে উত্তর দিকে কিছুদূর গেলেই দেখা যাবে বাঁয়ে একটি মসজিদ। তার পাশেই রয়েছে একটি দালান বাড়ি। এখানে থাকতাে ইদ্রিস বিহারী। প্রতি বৎসর খাজা মঈনউদ্দীন চিশতীর মৃত্যু বার্ষিকী পালনের নাম করে তিনদিন ধরে এই বিহারীর বাড়িতে ওরস চলতাে। কিন্তু এখন তার বাড়ির ভেতরে কেউ গেলেই চমকে উঠবেন। দেখতে পাবেন ঘরের ভেতর হত্যার চিহ্ন। একটি ঘরে অনেকগুলাে দড়ি ঝুলে আছে। মেঝেতে রয়েছে অসংখ্য ছােপ। জানালা, দেয়াল সর্বত্র রক্ত ছড়িয়ে আছে। জানা গেছে উক্ত বিহারী খান সেনাদের সহযােগিতায় বাঙালীদের ধরে এনে জবাই করে তাদের রক্ত তার দরজা ও জানালা রাঙিয়ে দিত। সে বলতাে আলতা দিয়ে সাজানাে হয়েছে। এ নারকীয় দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আর খান সেনারা তখন • উল্লাসে মেতে উঠতাে। ইদ্রিসের বাড়ির ভিতর কাঁচা কুপটি মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে, যেথানে কত বাঙালীর জীবন নির্মমভাবে নির্বাপিত করেছে এখানে তারই একটি ক্ষুদ্র চিত্র তুলে ধরা হলাে।
মানিকগঞ্জের একটি বধ্যভূমি মানিকগঞ্জ মহকুমার সাটুরিয়া থানায় একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। সাটুরিয়া হাটের কাছে মােঃ মনােয়ার হােসেন নামে জনৈক ব্যক্তির পরিত্যাক্ত বাড়ির ভিটা খনন করে বহু কংকাল সেখানে উদ্ধার হয়েছে। এ থেকে পাক সৈন্যদের মর্মান্তিক নৃশংসতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। কংকালগুলাের হাত পা দড়ি দিয়ে বাধা ও চোখ মুখ কাপড় দিয়ে জড়ানাে এবং মুখের ভিতর কাপড় খুঁজে দেয়া। এ ছাড়া বহু কঙ্কাল মস্তকবিহীন অবস্থায় পাওয়া গেছে। স্থানীয় রাজাকার দালালদের সহযােগিতায় পাকসৈন্যরা শত শত মানুষকে এভাবে হত্যা করেছে। মেয়েদের ধর্ষণ করেছে এবং মানুষের ঘরবাড়ি টাকা লুট করে নিয়েছে।
যুদ্ধের নয় মাসে এখানে বানিয়টি গ্রাম থেকে হরিদাস সাহা, অতুল সাহা, নিতাইচন্দ্র সাহা, রাধু ঘােষ, আওলাদ হােসেন, গাংগুটিয়া গ্রাম থেকে সুধীর রায়, কালুরায়, ডাঃ বিজয় সাহা, মৃণাল কান্তি রায়, কমলপুর থেকে মুক্তার আলী, পারাগ্রাম থেকে কালুমিয়া, কাউনারা থেকে হালিম ফকির, আমতা থেকে যিতিন্দ্র কর্মকার, নয়াপাড়া থেকে শ্যাম সাহা, হাজিপুর থেকে হযরত কে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। চর সাটুরিয়ার নারায়ণ বাবুর স্ত্রী আভারানী কে পশুরা ধর্ষণ করে হত্যা করে। যতীন কর্মকারের ১৫ বৎসরের নাতিকে চোখ উপড়ে ফেলে হত্যা করে। এমনি ভাবে ওরা কত হতভাগ্য মানুষকে যে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তার সঠিক পরিসংখ্যান হয়তাে কোনদিন পাওয়া যাবে । শুধুনদস্যুদের অত্যাচারের বিভীষিকাময় স্মৃতি বাঙালীরা চিরকাল বহন করে যাবে।
________________________________________
ভােলা ওয়াপদা কলােনীতে হত্যাকান্ড ভােলায় বর্বর পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকান্ডের নায়ক নরপশু ক্যাপ্টেন মুনির হােসেন ও সুবেদার সিদ্দিক। তাদের গণহত্যা আর জঘন্য পাশবিকতার যে বিভীষিকার সৃষ্টি করেছিল তা অবর্ণনীয়। জুন মাসের প্রথম দিকে এই নর পশুরা ভােলা শহরে আসে। এখানে এসে তারা মাইক্রোফোনে ঘােষণা করতে থাকে যে, আপনাদের কোন ভয় নাই প্রত্যেকে কাজকর্ম করে যান। আর হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলা হতাে আপনারা গ্রাম ও চরাঞ্চল হতে প্রত্যেকে শহরে নিজ বাড়িতে ফিরে আসুন। প্রেসিডেন্ট আপনাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। নির্দেশিত সময়ের মধ্যে ফিরে না এলে বিনা বিচারে গুলী করে হত্যা করা হবে।
এ আহবান আর জল্লাদ ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমার অন্তরালে ছিলাে নারী ধর্ষণ, অর্থ সংগ্রহ, লুটতরাজ এবং নরহত্যার পরিকল্পনা কিন্তু নিরীহ মানুষ তা বুঝতে পারেনি। সহজে তারা এ ফাঁদে ধরা দিয়েছিলাে। প্রথমত যে পরিবারে সুন্দরী মেয়ে ছিলাে তার অভিভাবককে শান্তি কমিটির পান্ডা রাজাকার দিয়ে সামরিক বাহিনীর দফতর ওয়াপদা কলােনীতে ডাকা হতাে। ডাকার পুর্বেই তার বাড়ি ঘরের চারিদিকে পলায়ন পথে রাজাকার আর দালালরা সাধারণভাবে ঘুরাফেরা করতে যেন কেউ পালিয়ে যেতে না পারে। উপায়ন্তর না দেখে তাদের মরণপুরী ওয়াপদা কলােনীতে যেতে হতাে। সেখানে নরপশুরা বুকে বন্দুক ধরে জিজ্ঞাসা করতে ভারত সে তােমহারা লাড়কা গিয়া, আওর মুক্তিবাহিনীকো হামারা খবর পৌহাততা। এমনি করে আটকিয়ে দালালদের মাধ্যমে টাকা, তারপর মেয়ে দাবী করতাে। এ দু’টির একটিকে পুরােন করতেই হবে। যারা এ দাবী পুরােন করতে অস্বীকার করতে তারা নরপশুদের বেয়নেটের আঘাতে মৃত্যু বরন করতাে। এভাবে যারা ধরা পড়তাে কেবল তারাই জানতাে তা ছিল কত ভয়াবহ। এ হত্যাকান্ড ও পাশবিকতার প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াপদার এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার মােহাম্মদ খালেদ, টেকনিক্যাল অফিসার সিরাজুল ইসলাম, সাবডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার আবু তাহের ও মনসুর আলী এবং সহকারী ইঞ্জিনিয়ার ওয়াহিদ উদ্দীন।
সাহেদ হােসেন ও আব্দুর রব নামে দু’জন লােক ৪ মে ‘৭১ হতে ওয়াপদা কলােনীর একটি ঘরে অন্তরীণ অবস্থায় ছিলেন। কলােনীতে নরপিশাচ ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী আর পদলেহী দালালদের পাশবিকতা ও নরহত্যার ঘটনা যে কত লােমহর্ষক ও মারাত্মক ছিল তারা তা বর্ণনা করে বলেন, আমরা প্রতি মুহুর্তে মৃত্যুর সময় গুণছিলাম। ড্রাইভার আতাহারের বীভৎস মৃত্যুকাহিনী বলতে গিয়ে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার জনাব খালেদ বাকরুদ্ধ হয়ে যান। তিনি শুধু বললেন আমি ওকে বাঁচাতে পারলাম না। আমি জানতাম যদিও হয়তাে আমরা কেউই বাঁচবাে না। মেজর জেহানজেব খান নিজে তাকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করে। আমরা তখন নিশ্চিত মৃত্যুর কথাই ভেবেছিলাম। এমন কোন রাত ছিলনা যে রাতে নরপশুরা দশ বার জনকে হত্যা না করেছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতাে আর উল্লাসে ফেটে পড়তাে। এ সময় মেয়েদের উলংগ করে বেঁধে রাখা হতাে।
________________________________________
কলােনীর রেষ্ট হাউস হিল পাশবিকতার কেন্দ্রস্থল। রাতের পর রাত কত মেয়ের যে সর্বনাশ তারা করেছে, কত নারী যে সব হারিয়েছে, কত হতভাগিনী যে উম্মদে পরিণত হয়েছে তার সীমা নেই। মনিরের নেতৃত্বে লুঠন চলেছে নির্বিচারে। নিজে গ্রহণ করেছে স্বর্ণ, নগদ টাকা প্রভৃতি মূল্যবান জিনিষ, আর তার অনুচরদের দিয়েছে বাকী মালামাল। প্রতিদিন মুক্তিযোেদ্ধা বলে যাকে তাকে আটক করে, শান্তি বাহিনী মােটা অংকের নগদ অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছে। অনেক সময় টাকা গ্রহণ করেও তাকে হত্যা করেছে। দুলার হাটের মােহাম্মদ উল্লাহ কন্ট্রাক্টর তাদের একজন। চরফ্যাশানেও শান্তি কমিটি প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটাতাে। এমনি করে সমগ্র মহকুমায় হিংস্র নখর বিস্তার করে পাশবিকতা আর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলাে পাকিস্তানী পশুরা।
পটুয়াখালীর জেলখানার বধ্যভূমি পাকিস্তানী বাহিনী ২৬ এপ্রিল পটুয়াখালী শহর কজা করার পর ৯ মাসে ঠান্ডা মাথায় তাদের দালালদের সহযােগিতায় হাজার হাজার বাঙালীকে হত্যা করেছে। নিহত ব্যাক্তিদের কাউকে গুলি করে নদীতে ফেলে দিয়েছে, কাউকে জীবন্ত অবস্থায় গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি পটুয়াখালী জেলের অভ্যন্তরে একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেখানে বহু গণ কবরের খোঁজ পাওয়া গেছে। কয়েকটি কবরে মাটি খুঁড়ে বহু নর কঙ্কাল পাওয়া গেছে। প্রতিটি গর্তে তিন থেকে চার জন, কোথাও বা তার বেশী মানুষকে হত্যা করে এক সঙ্গে পুতে রাখা হয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের কঙ্কালে বুলেটের ছিদ্র স্পষ্ট দেখা যায়। | মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে বহু পুলিশের লােকও রয়েছে যা পােষাক দেখে সনাক্ত করা গেছে। এখানে একদিন কম্যুনিষ্ট নেতা হরিলাল দাসগুপ্ত, পাথরঘাটার সি, ও সহ নাম না জানা আরাে বহু লােককে লাইন করে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এসকল মানুষকে যখন লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হতাে তখন বুলেট মানুষের শরীর ভেদ করে দেয়ালে এসে আঘাত করতাে। জেল খানার অদূরে বসবাসকারী মানুষেরা জানিয়েছে যে, যখন সারিবদ্ধ মানুষকে গুলি করা হতাে তখন মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর বহুলােকের করুণ চি কার আর আর্তনাদ তারা শুনতে পেতেন। পটুয়াখালীর বিভিন্ন স্থানে পাক সৈন্যরা লােক ধরে নিয়ে পানিতে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ করে হত্যা করতে যাতে সহজে মৃত দেহগুলি পানিতে ভেসে যায়। এ প্রক্রিয়ায় হত্যা কান্ড গুলির নেতৃত্ব দিত মেজর পারভেজ খান।
ময়মনসিংহে খানসেনাদের বর্বরতা ময়মনসিংহ শহর ও শহরতলী এলাকাসহ জেলার ৭ টি থানাতে পাক হানাদার বাহিনী আনুমানিক ২০টি বধ্যভূমিতে ৰঙালী নিধনযজ্ঞ চালিয়েছে। শহর এলাকায় পাঁচটি বধ্যভূমিতে কয়েক হাজার নরকঙ্কালের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ডাক বাংলাের
________________________________________
কেওয়াটখালী, বড় বাজার, নিউমার্কেট ও কালীবাড়ি, বধ্যভূমিগুলি অন্যতম। শহরের সাহেব আলী রােডের একটি পুকুরে বাক্সভর্তি অসংখ্য খন্ডিত মাথার খুলি পাওয়া গেছে। পাক সেনারা ময়মনসিংহ শহর থেকে পালিয়ে যাওয়ার আগে বন্দীদের দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে তা বাক্সে ভর্তি করে পুকুরে ডুবিয়ে রাখে। ময়মনসিংহ শত্রুমুক্ত হবার পরপর শহরের বাসিন্দারা কালিবাড়ি, বড়বাজার, নিউমার্কেট প্রভৃতি এলাকা থেকে বহু কঙ্কাল, নরমুন্ড উদ্ধার করে। গর্ত থেকে বহু লাশ সংগ্রহ করে তা সমাধিস্থ করে।
ময়মনসিংহের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পারে অসংখ্য মরদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। জানা গেছে বিভিন্ন এলাকা থেকে লােকজন ধরে নিয়ে নদী তীরে গুলী করে হত্যা করা হতাে। ঐ সৰ লাশের কিছু পানিতে ভেসে যেত, কিছু। সেখানেই পড়ে থাকতাে আবার কিছু গর্ত করে পুতে ফেলা হতাে। অমৃতগঞ্জের ফজর ও চর আলমগীরের মফিজ নামক চর এলাকার দুজন বাসিন্দা জানায় ৯ মাস ব্যাপী যুদ্ধে তারা ব্রহ্মপুত্র নদে গলাকাটা ও হাত পা বাঁধা অবস্থায় শত শত নারী পুরুষের লাশ ভেসে যেতে দেখেছে। যার হিসেব হয়তাে কোন কালেই পাওয়া যাবে না ।
অগ্নিদ লুষ্ঠিত ধর্ষিতা কাশিয়াবাড়ি স্বাধীনতা আন্দোলনের একপর্যায়ে বর্বর পাকবাহিনী অত্যাচারের তান্ডবলীলা চালাতে ঘােড় ঘাটে এসে আস্তানা গেড়ে বসে। পাশ্ববর্তী গায়ের লােকে জানতে পারলাে শীঘ্রই পাক পশুরা আশে পাশের গ্রাম গুলােতে বিভীষিকাময় রাজত্বের সৃষ্টি করবে। কদিনের মধ্যে ঘোড়াঘাট সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে অত্যাচারের তান্ডব লীলা শুরু হলাে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছাই করতে লাগলাে । পুরুষদের হত্যা ও মা-বােনদের ধরে নিয়ে যেতে লাগলাে। মানুষ ধরে ধরে গুলী করে পাখি শিকারের মতাে মারতে লাগলাে। ঘরের জিনিস পত্র লুটতরাজ করে নিয়ে যেতে লাগলাে। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়লাে। অত্যাচারের বীভৎস হাওয়া কাশিয়াবাড়িতেও একদিন ধাক্কা দিল।
ঘােড়াঘাটে ছিল একটি অবাঙালী কলােনী। ওই অবাঙালী বিহারী কলােনীর দুষ্কৃতকারীরা পাকবাহিনীর সাহায্যে সমর্থন পেয়ে রাইফেল এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দিতে লাগলাে কাশিয়াবাড়ি। হারেস মিয়া বাড়ি থেকে পালায়নি, কেননা তার বিশ্বাস ছিল পাক বাহিনী কাউকে মারবে না। শান্তি কমিটির সভাতে সে আশ্বাসই বক্তারা দিয়েছিলাে। কিন্তু হারেস মিয়া জানতাে না ওদের কথার উপর বিশ্বাস করে বাঁচবার কারাে উপায় নেই। কাশিয়াবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সেক্রেটারী হারেস মিয়াকে পাকপশুরা জবাই করে হত্যা করেছিলাে। একইসঙ্গে জবাই করেছে স্কুলের শিক্ষক গােলজার মিয়াসহ আরাে অনেককে। ধর্ষন করেছে ফুলবানু, গিরিবালাহ বহু মহিলাকে। ৭ মাসের গর্ভবতী ফুলবানুর উপর পর্যায়ক্রমে পশুগুলাে ধর্ষন চালালে ফুলবানু সেদিনই মারা যায় । গিরিবালাকে ধর্ষন শেষে খুটির সাথে বেঁধে বেয়ােনেট দিয়ে স্তন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে হত্যা
________________________________________
করে। আগুন লাগিয়ে সমস্ত গ্রামটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে যায় পশুরা।
যারা পালাতে পারেনি তাদের চারদিকে থেকে ঘিরে ফেলে। প্রায় ৭ শ’ লােককে স্কুলের মাঠে ধরে নিয়ে বেরােনেট দিয়ে বেদম ভাবে প্রহার শুরু করে। “তােমহারা গাঁও মে মুক্তি ফৌজ হ্যায়। তােমহারা গাঁওহে গােলিকা আওয়াজ শােনা থা। আওর হামরা পাছ ইনফরমেশন হ্যায়।” একথা বলে বেছে বেছে যুবকদের হত্যা করা হলাে। এর কদিনবাদেই এ গায়ে তথাকথিত শান্তি কমিটির তরফ থেকে মিটিং করতে এলাে জামাতে ইসলাম আর মুসলীম লীগের লােকেরা। তারা আশ্বাস দিয়ে গেলাে এ গাঁয়ের লােকদের, “আপনারা পালাবেন না কোথাও। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আপনাদের ধ্বংস করতে আসেনি। আপনাদের মঙ্গলস্বার্থেই তারা এসেছে। গায়ের সরল নিরীহ লােকগুলাে তাদের এবারও বিশ্বাস করলাে।
এবার থেকে হয়তাে অত্যাচারের পালা শেষ হবে। দেশে শান্তি আসবে। কিন্তু যা তাদের সামনে অপেক্ষা করছিল একদিন আগেও তারা তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু যেদিন তারা বুঝলাে সেদিন আত্মরক্ষার কোন পথই তাদের সামনে থাকলাে না। ১১ জুন কাশিয়াবাড়ির মানুষ দেখলাে কয়েকশ পাকসেনা তাদের গায়ের দিকে এগিয়ে আসছে। আতংক ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামটায় । মেয়ে-পুরুষ, বুড়াে, জোয়ান যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। তাড়া খাওয়া হরিনের মতাে কোনদিক না তাকিয়ে পালাচ্ছে সবাই। কেউ কেউ নদীর মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতরে ওপারে পালাতে থাকে। আবার অনেকে ধান আর পাটের ক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। শিশুর কান্না থামাতে মাকে পাগল হতে হয়। সবাই আত্ম গােপনে ব্যস্ত।
প্রতিরােধের উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও এই হিংস্র পশুগুলােকে বাঁধা দেয়ার সাহস পায়নি কাশিয়াবাড়ির অসহায় মানুষেরা। এই আক্রমনে ভীত হয়ে পড়লাে গায়ের মানুষ। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্মিভূত করে দিল সমস্ত গ্রামটি। সেই বিরান ভূমিতে নরপশুদের হাত থেকে জীবনমৃত অবস্থায় বেঁচে রইলাে যারা তারা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার প্রস্তুতি নিল।
ভৈরবের নৃশংস হত্যাকান্ড ‘৭১-এর এপ্রিল থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ মাসে বর্বর পাকবাহিনীর দস্যুরা ভৈরবে ত্রাস আর বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়েছিল। হানাদার পশুদের হত্যাযজ্ঞের ফলে ভৈরব, আশুগঞ্জ এলাকায় শত শত মা হয়েছে বিধবা, পিতা হারিয়েছেন স্ত্রী, পুত্র, কনা। ১৫ এপ্রিল পাকবাহিনীর ছাত্রী সেনারা ভৈরবের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চারশ নিরপরাধ লােককে গুলি করে হত্যা করে। ঐ দিন ইব্রাহিমপুরের আলগড়ার মাঠেই ২৫০ জন লােককে হত্যা করা হয়। | ভৈরব ব্রীজের কাছে রেললাইনের উপর দাঁড় করিয়ে এদিন পঁচিশ জনকে গুলি করে।
________________________________________
রহমান, পৌরসভার সহসভাপতি মসলন্দ আলী এবং ভৈরব ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি আলহাজ হাফিজউদ্দিনকে ধরে নিয়ে যায়। ইফতেখার নিজ হাতে হত্যা করে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, মােহন বাঁশি কলেজের ছাত্র লােকমান, স্কুলের ছাত্র সেলিম, সমাজকর্মী সাত্তার, ভিখারী আওয়াল, মুজিব বাহিনীর তরুণ যােদ্ধা ফরহাদ আলী ও আখতার মিয়াকে। জল্লাদ ইয়াহিয়া সৈন্যরা ভৈরব ব্রীজের নিকট চলন্ত রেলগাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের ধরে নিয়ে যেত নিকটস্থ কলােনীতে। সেখানে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে বেয়ােনেট দিয়ে বুক চিরে মেঘনার প্রবল স্রোতে ভাসিয়ে দিত। ১৫ মে বর্বর মেজর ইফতেখার বাজিতপুর এবং নিকলী থানা ঘেরাও করে প্রায় দেড়শ জনকে ধরে আনে। তাদের মধ্যে ৩৫ জন যুবতী মেয়ে ছিল যাদেরকে পাশবিক অত্যাচারের শিকার হিসাবে আটক রাখা হয়। বাকি লােকদের আশুগঞ্জের মেঘনার চরে গুলী করে হত্যা করা হয়। ১৫ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা সাতদিন ধরে বর্বর পাকবাহিনীর দস্যরা ভৈরব অঞ্চলের রানী বাজার, চকবাজার, মরিচপায়, কলেজ রােড, মসজিদ সহ বন্দরের সর্বত্র লুটপাট ও অগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটায়। ফলে কোটি কোটি টাকার সম্পদসহ অসংখ্য গুদাম এবং দালান কোটা পুড়ে ছাই হয়ে যায় । ভৈরব বাজার সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়।
| ফেনীতে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা ২৩ এপ্রিল পাকহানাদাররা ফেনী মহকুমায় প্রবেশ করে সর্বপ্রথম দরবেশ আব্দুল কাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। তারা ফেনী শহরে প্রবেশকালে দেওয়ানগঞ্জ, আমতলী ও শহরতলী বিভিন্ন স্থানে প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। এসব স্থানে তারা কয়েকশ লােককে হত্যা করে। দেওয়ানগঞ্জের ট্রাংকরােডের পার্শ্বে একটি জবাই খানা তৈরী করা হয় যেখানে প্রতিদিন বহুলােককে হত্যা করা হতাে। শহর উপকণ্ঠে একটি সরকারী ভবন সংলগ্ন বধ্যভূমিতে শত শত দেশ প্রেমিক বাঙালীকে এনে হত্যা করা হয়। | একই সময়ে বর্বরেরা মার্চেন্ট সমিতির কর্মকর্তা আব্দুস সাত্তারসহ আট জনকে মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে এক সঙ্গে বেঁধে গুলী করে হত্যা করে। ফেনী কলেজের পার্শ্ববর্তী একটি বধ্যভূমিতে পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে বহু লােককে ধরে এনে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী একজন রেলকর্মীর কাছ থেকে এ সংবাদ জানা গেছে। এছাড়া ধুমঘাট। রেলওয়ে পুলের পাশে প্রতিদিন বহু লােককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। ষ্টেশনের অদূরে এক বাঙালী লােকের বাড়িতে তিনটি যুবতী মেয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। হানাদারেরা ঐ পরিবারের সকলকে হত্যা করে ঐ মেয়ে তিনটিকে নিয়ে যায় পরে তাদের লাশ পাওয়া যায়। পাক বর্বরেরা ধূল গ্রাম এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে ৩ শতাধিক লােককে হত্যা করে সেই সাথে সমগ্র গ্রামটি জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে। ফেনী রেলস্টেশনের পিছনের ডােবায় বহু মানুষকে হত্যা করে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ফেনী মহকুমা থেকে প্রায় দেড় লাখ নরনারী শরনার্থী হয়ে ভারতে পাড়ি জমায়। পাকহানাদারদের সহায়তায় এগিয়ে
________________________________________
এসেছিলাে কুখ্যাত মহকুমা প্রশাসক বেলাল আহমদ খান। ফেনীতে সে ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা ও লুণ্ঠনকাজে নেতৃত্ব দিয়েছিল। স্থানীয় দালালেরা ব্যক্তিগত শত্রুতার বশবর্তী হয়ে বহু বিশিষ্ট লােককে হত্যা এবং তাদের বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দেয়। রাজাকার ও বদর বাহিনীর শয়তানেরাও বহু লােককে হত্যা করে। ফেনী এলাকার খাল বিল আর নদী সর্বত্রই নরকংকালের স্তুপ জমে ওঠে।
মৌলভীবাজার মনুব্রীজে গণহত্যা পাকিস্তান হানাদার বাহিনী মৌলবীবাজার মহকুমার বিভিন্ন স্থানে যে হত্যাকান্ড চালিয়েছিল সেসব বধ্যভূমি ক্রমে আবিষ্কার করা হচ্ছে। এ ধরণের একটি বধ্যভূমি শেরপুর জেটি। সেখান ৯ মাসে প্রায় দুই হাজার লােককে হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ কুশিয়ারা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। শেরপুরে হানাদার বাহিনীর একটি ঘাঁটি ছিলাে । সেখান থেকে তারা নৌ ও সড়ক পথে বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাতাে। শেরপুর তিনবার মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ফলে পার্শ্ববর্তী গ্রাম হালােরখানা, শেরপুর, ব্রাহ্মণগ্রাম, কলরগাঁও, আয়েনপুর, নতুনবস্তি, মােবারকপুর ও কাসুরপুর জনশুন্য হয়ে পড়ে।
শেরপুরে পাকবাহিনীর শক্ত নৌঘাঁটিও ছিলাে। এখান থেকে তারা নরহত্যা সহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালাতাে। তারা জাহাজ ও গানবােট থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে গুলীবর্ষন করতাে। তারা বিভিন্নস্থানে হামলা চালিয়ে হত্যা ও মহিলাদের ধরে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে
১৪ মে হানাদার সৈন্যরা মৌলবীবাজারের মনুব্রীজের উপর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ ধরে এনে প্রকাশ্যে গুলী করে হত্যা করে। স্থানীয় অধিবাসীরা এ হত্যাকান্ডের নারকীয়তা আজো ভুলতে পারেনি । হানাদার জল্লাদ বাহিনী মিটিংয়ের নামে সমস্ত থানাবাসীকে ব্রীজে সমবেত হবার নির্দেশ দেয়। ভয়ে আতংকিত প্রায় একহাজার লােক সেখানে হাজির হলে তাদের ব্রীজের উপর দাঁড় করিয়ে গুলী করে হত্যা করে এবং পরে তাদের লাশ পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। শেরপুর জেটি থেকে হানাদার বাহিনীর দালাল রাজাকাররা প্রতিদিন মানুষ হত্যা করে। এখান প্রায় ১ হাজার লােককে হত্যা করা হয়। প্রতিদিন বহু লাশ কুশিয়ারা নদীতে ভাসতে দেখা যেত। বরুরা চা বাগানের পশ্চিমে আচেরাতে আর একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া যায়। শ্রীমংগল কলেজের পূর্বদিকে এই বধ্যভূমিটি বন্দী মুক্তিযােদ্ধাদের কঠোর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হতাে। এখানে ৪৩ জন চা বাগান শ্রমিককেও হত্যা করা হয় এবং তাদের মৃতদেহগুলাে একসাথে একটি গর্তে কবর দেয়া হয় । সাধুবাবাতে আর একটি বধ্যভূমি আবিষ্কার হয়েছে। যেখানে ৫০ জন হতভাগ্যকে অর্ধমৃত অবস্থায় একটি গর্তে মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করে। এই মর্মান্তিক ঘটনা থেকে চারজন বেঁচে যায় এবং পরবর্তীতে তারা এই ঘটনার বর্ণনা দেয়।
________________________________________
আর একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে কুলাউড়া রেল ক্রসিংএ। এখানে একটি করে ৪০ টি কঙ্কাল পাওয়া গেছে। জল্লাদদের আর একটি বধ্যভূমি ছিলাে মৌলবীজার কোর্ট। এখানে প্রতিদিন গ্রাম থেকে আগত লোেকদের হত্যা করে তারপর মৃতদেহ গুলি গর্তে পুতে রাখা হতাে। বারবাড়ীতে অনুরূপ একটি বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে কত তােক হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি।
গােপালপুর সুগার মিলের কসাইখানা স্থানীয় অবাঙালীদের সহযােগিতায় পাকবাহিনী দুটি দলে বিভক্ত হয়ে ঢুকেছিলাে মিলের অভ্যন্তরে, অপর দলটি একই সঙ্গে প্রবেশ করে মিলের কলােনীতে। প্রথম দলটি মিলে। ঢুকে মিলের প্রশাসক জনাব আজিম, প্রশাসনিক অফিসার জনাব শহিদুল্লা, একাউনট্যান্ট জনাব সাইফুদ্দীন আহমদ, ইক্ষু সুপারিনটেনডেন্ট জনাব গুলজার হােসেন তালুকদার, সহকারী একাউনট্যান্ট জনাব হান্নান ভূইয়া কৃষি অফিসার জনাব কিবরিয়া, সহকারী ইক্ষু উন্নয়ন অফিসার ও ষ্টেনােগ্রাফার জনাব রউফসহ তিনশরও বেশি কর্মচারী ও শ্রমিককে মিলের পুকুর পাড়ে নিয়ে লাইন করে দাঁড় করায়। তারপর গুলী করে হত্যা করে। গােপালপুরে এই হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলাে পাকবাহিনীর সামরিক অফিসার মেজর শেরওয়ানী, ক্যাপ্টেন মােখতার ও মেজর উইলিয়ামস ।।
এদের মধ্যে প্রথম দুজন থাকতাে নাটোরে আর তৃতীয় জন থাকতাে ঈশ্বরদীতে । মিলের অবাঙালী কর্মচারীদের যােগসাজশের কথা বলতে গিয়ে মিসেস আজিম জানালেন, ২৫ মার্চের পর থেকেই এখানে অবাঙালীদের উৎপাত বেড়ে গিয়েছিল। তারা বাঙালীদের বাড়ি ঘর দখল, লুটপাট এবং যুবকদের হত্যা করতে থাকে।
মিসেস আজিম বলেন, স্থানীয় দালাল ও বিহারীদের অত্যাচার বর্ণনা করা যায় না। হানাদার সৈন্যরা তিন’শ বাঙালীকে হত্যা করার পর মিল ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় দালালেরা আত্মীয়স্বজনের লাশের কাছে যেতে দেয়নি। এসব হতভাগ্যের লাশ তারা গর্ত করে সেগুলােকে মাটি চাপা দিয়ে রাখে। এর আগে মৃত দেহ থেকে ঘড়ি, আংটি, কলম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য লুটপাট করে। এদের ভয়াবহ অত্যাচারের ফলে মিল অঞ্চলের বাঙালীরা সব কিছুরা মায়া ত্যাগ করে কেবল প্রাণ হাতে করে চলে যেতে বাধ্য হয়। মিসেস আজিম তার ছােট ভাই ও সন্তানদের সঙ্গে মিল এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। মিসেস আজিম আরাে জানান, আজিম সাহেব গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের মিলের গাড়ি ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন এবং সাহায্য করতে চেষ্ট করেছেন নানাভাবে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের প্রথম অবস্থায় হানাদার বাহিনীর মেজর আসলাম গােপালপুরে নিহত হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে।
তাই মিলে হত্যাকান্ড চালাবার আগে হানাদাররা জানতে চেয়েছিলাে আসলামকে কারা। মেরেছে। মিলের নিরীহ কর্মচারীদের বাঁচাবার আশায় রিজার্ভ বাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট আজিম বলেছিলাে, আমি মেরেছি, আমাকে ধরে নিয়ে চল তােমরা, কিন্তু নিরীহ কর্মচারীদের তােমরা মেরােনা। কিন্তু দয়া বলে কোন বন্ধু ছিলনা পশুদের অন্তরে।
________________________________________
তাই মেশিনগান চালিয়ে পাইকারীভাবে হত্যা করে পৈশাচিকতার দৃষ্টান্ত রেখে গেছে তারা গােপালপুরের বুকে। যে পুকুরটিতে নরপশুরা হতভাগ্য মানুষের লাশ ফেলেছিল গােপালপুরের জনগণ সে পুকুরটির নাম দিয়েছিল শহীদ সাগর।
এসিড ঢেলে মুক্তিযােদ্ধা হত্যা পাবনা দখলের পর পাকসেনারা অগ্রসর হলাে দাড়িয়ার দিকে। স্থানটি কুষ্টিয়া, ঈশ্বরদী ও রাজশাহীর রাস্তার সংযােগস্থল। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা অস্ত্র নিয়ে লুকিয়ে ছিলাে দাসুড়িয়াতে এক গােপন জায়গায়। এক পর্যায়ে আক্রমণ চালালাে হানাদারদের লক্ষ্য করে। কিন্তু সমস্ত দাসুড়িয়া ঘিরে ফেললাে খান সেনারা। খুঁজে বার করলাে মুক্তিযােদ্ধাদের। ৯ এপ্রিলের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করা যায় না। প্রথমে এসিড ঢেলে দিল তাদের চোখে মুখে তারপর বেয়ােনেটের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে হত্যা করা হলাে তাদের। কিন্তু দুঃখ হয় এ মুক্তিযােদ্ধারা দেখে যেতে পারেন নি স্বাধীনতা। তাদের আত্মত্যাগের সফলতা।
পীর দরবেশও কসাইদের থেকে রেহাই পায়নি কইবুল্লা। উত্তর বাংলায় তার হাজার হাজার মুরীদ। তার ছােট আরও তিন ভাই । সবসময় আসা যাওয়া শত শত দর্শনার্থীর। কোরান পাঠ, মৌলুদ পাঠ, ওয়াজ নসিহত আর নামাজ এক স্বর্গীয় পবিত্রতায় ভরে থাকতাে বাড়ি সারাক্ষণ। | পীর পরিবারের এক যুবক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পঁচিশে মার্চের পর সে ভারতে পালিয়ে যায় ও ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হয়। খবর পায় মিলিটারীরা। রমজান মাস, সেহেরী সেরে ইবাদতে মগ্ন হয়েছেন পীরবাবা। এক ভাই কোরান তেলওয়াৎ করছিলেন-হঠাৎ বাড়ি ঘিরে ফেললে সামরিক জান্তারা,তারপর গুলি। একে একে চারভাইকে মাথায় গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করলাে। সেই সাথে হত্যা করা হলাে আরও ১১ জনকে। বড় হুজুরও ত্যাগ করলেন শেষ নিঃশ্বাস । হাতে তার তসবীহ ধরা। অন্য এক ভাই কেবল খেতে বসেছিলাে সামনে তাতের থালা। হাতের ভাত হাতেই রয়ে গেল। একজন গড়িয়ে পড়েছে ওজুর ঘটির ওপর। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। পরদিন সকালের দৃশ্য আরও মর্মান্তিক, আর হৃদয় বিদারক । পীর-বাড়িতে সৃষ্টি হলাে কারবালার হাহাকার। দোলনায় ঘুমিয়ে ছিলাে একটি শিশু, একজন খানসেনা কয়েকবার গুলি চালায় ঘুমন্ত বাচ্চাটার উপর।
| গােপালগঞ্জে নারকীয় তান্ডব গােপালগঞ্জ সিও ডেভেলেপমেন্ট অফিস ছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের শক্ত ঘাঁটি। এ ঘটির নায়ক হিল ক্যাপ্টেন ফয়েজ মােহাম্মদ ও ক্যাপ্টেন সেলিম। পাকজল্লাদের
________________________________________
গােপালগঞ্জের এইস্থানে কসাইখানা তৈরী করেছিল। মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, গােলজার চৌধুরী সহ অসংখ্য মানুষ এখানে দেশ মাতৃকার মুক্তিসংগ্রামে প্রাণ দিয়েছে। এখানে জল্লাদেরা কাকে কোথায় কখন হত্যা করেছে সব ঘটনা মানুষ জানতে পারেনি। রাতের অন্ধকারে যেমন পাক জল্লাদের ২৫ মার্চ ঝাপিয়ে পড়েছিলাে ঠিক তেমনি ৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ আঘাতে দিশেহারা হয়ে গােপালগঞ্জের ক্যাম্প ছেড়ে এই নরদস্যরা পালিয়ে যায় । | ক্যাপ্টেন ফয়েজ ও সেলিমের কক্ষ থেকে মেয়েদের হাতের চুড়ি, শাড়ী, ব্লাউজ দেখে অনেকেই চোখের পানি মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু শহীদের সংখ্যা কেউ নিরুপন করতে পারেনি। ক্যাম্পের সামনে ইটের স্তুপে খুলি, হাড়, ক্যাম্পের সামনে খােলা জায়গায় খুলি ও হাড়ের স্তুপ,ক্যাম্পের সামনের নদীতে জেলেদের জালে জড়িয়ে মাথার খুলি আর মানুষের কংকাল উঠে আসছে।
আখাউড়ার দু’টি গ্রামে গণহত্যা | জুন মাসের মাঝামাঝি সময় দু’জন মুক্তযােদ্ধা রেকি করার উদ্দেশ্য নিয়ে গংগাসাগর এলাকায় আসে। এবং তানন্দাইল গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। জানা যায় প্রাথমিক রেকির পর মুক্তাঞ্চলে তাঁদের কেন্দ্রে চলে যাবার পরিবর্তে তাঁরা একটি মেশিনগান নিয়েই শতাধিক পাঞ্জাবী সেনারা ছাউনি সরাসরি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। এবং সে অনুযায়ী দালাল মুক্তিযােদ্ধাদের আগমন ও অবস্থান সম্বন্ধে তার সামরিক প্রভুদের সংবাদ দেয়। খানসেনারা তৎক্ষনাৎ আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নেয় এবং মুক্তিযােদ্ধা দু’জনকে চতুর্দিক থেকে। ঘিরে ফেলে। বেষ্টনীতে পড়ে অস্ত্র নিয়ে পালানাে অসুবিধাজনক মনে করে তারা এল, এম, জি-টি গংগাসাগরেরর জলে ফেলে খান পশুদের চোখে ধুলাে দিয়ে বেষ্টনী ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসে। এদিকে সে রাতেই অকুতােভয় দু’জন আবার পাঞ্জাবীদের ছাউনি এলাকায় প্রবেশ করে এবং সন্তর্পণে তাদের এল, এম, জি উঠিয়ে নিয়ে আসে। ঐ স্থানীয় দলালের মাধ্যমে খবরও খান সেনারা পেল । আরাে জানানাে হলাে এই অত্র তানমান্দাইল অথবা ভাঙাইলে কারাে ঘরে রেখে মুক্তিযোেদ্ধা দু’জন পালিয়ে গেছে। এল,এম, জি উদ্ধারের জন্য শুরু হলাে পাক জল্লাদের তানমান্দাইল ও ভাঙাইল গ্রাম অপারেশন। পাক বর্বররা মুক্তিযােদ্ধা কিংবা অস্ব কিছুরই সন্ধান পেলনা। তবে তাদের আমানুষিক অত্যাচার থেকে রক্ষা পেলাে না এই দুই গ্রামের মানুষ। শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সবাই জল্লাদদের উন্মুক্ত শিকারে পরিণত হলাে। অকথ্য নির্যাতনের জন্য তারা উভয় গ্রামের কয়েকশ লােককে ধরে নিয়ে আসে এবং জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের হত্যা করে গংগাসাগরের পশ্চিম পাড়ের তিনটি গণ কবরে পুতে রাখে। নিহত-(১) আব্দুল গণি (২) রিয়াজ উদ্দীন (৩) মাধব মিয়া (৪) মুসলিম মিয়া (৫) কমল মিয়া (৬) আবুল বাসার (৭) আব্দুল খালেক (৮) তারা মিয়া (১) আবুল ফয়েজ (১০) আবুল হাসেম (১১) ওমর আলী (১২)
সালু মিয়া (১৩) গােলাম কাদের সহ অনেকের বিরুদ্ধে স্থানীয় দালালরা মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সহযােগিতার অভিযােগ আনে।
গাজীপুর অন্ত্র কারখানার কর্মচারী হত্যা গাজীপুর অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর থেকে পাকবাহিনী বাঙালী অফিসারদের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। একদিন সকল অফিসারদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে মেশিন গানের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানাে হয়। এ সময় তাদের পরিবারের সদস্যদের কান্নাকাটি ও অনুরােধে তাদের সে সময়ের জন্য ক্ষমা করে দেয়া হয়। তখন গাজীপুর অস্ত্রাগারের আবাসিক পরিচালক বিগ্রেডিয়ার করিমুল্লাহ কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট থেকে হেলিকপ্টার যােগে সেখানে আসে এবং পাকবাহিনীর সাথে গােপন আলােচনায় বসে । ঐ সময় বাঙালী অফিসারদের নিজ নিজ কোয়ার্টারে চলে যেতে নির্দেশ দেওয়া হয়। পরের দিন ৩০ শে। মার্চ রাজাকারদের সহযােগিতায় পাকবাহিনী পুনরায় বাঙালী অফিসারদের কোয়াটারে তল্লাশী করার অজুহাতে তাদের মালপত্র লুট করে নেয়।
হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক বাঙালী অফিসার তাদের পরিবারসহ গাজীপুর ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে।৩ এপ্রিল ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ ৬ জন অফিসারকে পাকবাহিনীর তত্বাবধানে ঢাকা যাবার নির্দশ দেয়। এই ৬ জন অফিসার ছিলেন ওয়ার্কস ম্যানেজার জনাব এ, কে মাহবুব চৌধুরী, ডাঃ মেজর নঈমুল ইসলাম, মাষ্টার মােঃ কুদুস, ওয়েলফেয়ার অফিসার মাহবুব রহমান ও আরাে দুজন অফিসার। এই সমস্ত অফিসার ও তাঁদের পরিবারদের একটি বাসে এবং দু’টি জীপ গাড়িতে করে নিয়ে আসা হয়। বাসে বিহারী এবং পাকবাহিনী বাঙালীদের পাহারা দিচ্ছিল। গাড়ীগুলাে যখন কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে পৌছে তখন ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাহ, ওয়াহেদ নামে একজন পাঞ্জাবী অফিসারকে নামিয়ে বাস থেকে নিজের গাড়িতে তুলে নেয়। জনাব মাহবুব চৌধুরী তখন ব্রিগেডিয়ার কোন জবাব না দিয়ে গাড়ি নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট কোয়ার্টারের দিকে চলে যায় । আর বাসটি তখন পাকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ঢাকার দিকে চলতে থাকে।
ঢাকার এম, এন, এ হােষ্টেলে এসে বাসটি থামলে পাকবাহিনী সকলকে নীচে নামার আদেশ দেয়। বাসের বিহারীরা মােহাম্মদপুরে চলে যায়। অন্যান্য অবাঙালীরা বিমান বন্দরের দিকে যায়। এ সময় পাক সেনা বাঙালীদের হােষ্টেলের ভেতরে যেতে নির্দেশ দেয়। এই সব অফিসারের পরিবারবর্গ তখন হােষ্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। একটি নির্জন কক্ষে আফিসারদের নিয়ে যাওয়া হয়। জোহরের নামাজের সময় শেষ হয়ে আসছে দেখে তারা পানির অভাবে বিনা অঙ্কুতেই নামাজ আদায় করে নেন। নামাজ শেষ হতেই একজন সিপাই হেড মাষ্টার সাহেবের পেন দিয়ে প্রত্যেক অফিসারের পরিচয় লিখে নেয় । সন্দেহের সৃষ্টি হওয়ায় অফিসারগণ উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। হেডমাষ্টারকে বাইরে গিয়ে অপেক্ষারত পরিবারের লােকজনদের সান্তনা দেবার জন্য পাঠান হলাে। হেডমাষ্টার সাহেব তখন একজন সিপাহীর সাথে বাইরে এলেন। সকলকে সান্তনা দিয়ে তিনি আবার ফিরে
এলেন, বর্বর সেনারা তাকে আবার বাইরে যাবার নির্দেশ দেয়। তিনি যখন চলে আসছিলেন তখন দেখতে পান যে সিপাহীরা বাঙালী অফিসারদের সারি দিয়ে দাঁড় করাচ্ছে। তারপর হায়েনার দল বাঙালী অফিসারদের উপর নির্মমভাবে গুলি চালায়। একই সময় বাইরে অপেক্ষারত বাঙালী অফিসারদের পরিবারবর্গ এই গুলির শব্দ শুনতে পান। কিন্তু তখনও তারা জানেনা যে তাদের প্রিয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে।
রাজশাহীতে দস্যু বাহিনীর বর্বরতা ইয়াহিয়া হানাদার দস্যু বাহিনী রাজশাহীতে যে গণহত্যা, ধর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তার একটি প্রাথমিক জরিপ রিপাের্ট বের হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকগণ সপ্তাহব্যাপী এক জরিপের মাধ্যমে বহু ঘটনা উদঘাটন করেছেন।
তাঁরা পাঁচটি গ্রাম থেকে এ ব্যাপারে বহু তথ্য সংগ্রহ করেছেন। গগণবাড়িয়ার জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে তারা জানান পবিত্র রমজান মাসের এক রাতে হানাদার বাহিনী তাদের গ্রামে ঢুকে ২৫ জন যুবককে গুলি করে হত্যা করে। ঐ ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বেঁচে যায়। ১৯৭১ সালের মে মাসে জুগিসশাে গ্রামে হানাদার বাহিনী শান্তিকমিটি গঠনের নামে ১৭ জন গ্রামবাসীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে মেশিন গানের গুলিতে হত্যা করে। এখানে ইয়াহিয়া খানের বর্বর সৈন্যরা ২১৪ জনের উপর নির্যাতন চালায়। প্রায় ১৪৫ জন মহিলাকে ধর্ষণ ও নানাভাবে নির্যাতন করে। পাক সৈন্যরা এ অঞ্চলের ৫৫ জন তরুনীকে ধরে নিয়ে যায়।
এসব গ্রামের প্রায় ৫০০ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং প্রায় ২০০০ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পাকবাহিনী যে সব ঘড়বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে তাতে লাখ লাখ টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী রাজশাহী মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে যারা সেদিন মৃত্যু বরণ করেছিলেন তাদের মধ্যে নুরুন্নবী, আমজাদ, কাজল, সাইফুল, কাউয়ুম, মান্নান, মােস্তফা, মনসুর, সিরাজ ও সামসুল অন্যতম।
ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে হত্যালীলা ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার বুকে পাস্তিানী সৈন্য বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের খবর যখন ঝিনাইদহ পৌছালাে তখন সেখানকার জনসাধারণের সাথে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক কর্মচারীরাও দেশের জন্য সংগ্রাম করার বলিষ্ঠ শপথ নেন। অধ্যাপক গােলাম জ্বিলানী, অধ্যাপক আব্দুল হাশিম খান ও অধ্যাপক শফিকুলার নেতৃত্বে ক্যাডেট কলেজ প্রতিরক্ষাদল গঠন করা হয় এবং ঝিনাইদহের এস, ডি, পি ও জনাব মাহবুব উদ্দীন এর। সাথে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়। ৩০ মার্চ গভীর রাতে কুষ্টিয়া থেকে পাকবাহিনীর ২৫
________________________________________
বেলুচ রেজিমেন্টের ১ কোম্পানী সৈন্য ঝিনাইদহে তাদের হিস্ৰ নখরাঘাতের জন্য মারণাত্রে সজ্জিত হয়ে সদর্পে এগুচ্ছিল। তখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের এই বীরেরা তাদের গতি প্রতিহত করে।
১ এপ্রিল পুনরায় যশাের থেকে পাক সৈন্যরা নতুন করে ঝিনাইদহ দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সেদিনও ঝিনাইদহের হয় মাইল দূরে বিষয়খালীতে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ গড়ে তুলে তাদের পর্যদস্ত করে, তাতেও ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক কর্মচারীদের ব্যাপক অবদান ছিলাে । শুধু যুদ্ধ করাই নয়, নতুনদের যুদ্ধে শিক্ষা দেওয়া, সংবাদ সরবরাহ, মুক্তিবাহিনীর রসদ যােগানাের দায়িত্বও নেয় এ কলেজের কর্মচারীরা। ৫ শ মুক্তিযােদ্ধার খাবার তৈরীর ভারও ছিল তাদের উপর। এদিকে হানাদার বাহিনী বিভিন্নস্থানে প্রতিরােধের সম্মুখীন হওয়ায় প্রতিদিনই বিমানযােগে যশােরে প্রচুর গোলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ও নতুন সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। এ সময় এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীকে ক্লোজ করে নেওয়া হয়। অরক্ষিত ঝিনাইদহে পাকবাহিনী বীরদর্পে প্রবেশ করে ১৬ এপ্রিল।
১৮ এপ্রিল। অধ্যক্ষ জনাব রহমান, অধ্যাপক হালিম খান, বাবুচী আবুল ফজল ও হসপিটাল এ্যাটেনড্যান্ট শামসুল আলম ছাড়া কলেজে আর কেউ নাই। চারদিকে খা খা করছে। একটা থমথমে ভাব। মাঝে মাঝে নীরবতা ভেঙে ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া সড়কে দ্রুতগামী আর্মি গাড়ীর আওয়াজ । একটা অমঙ্গলের ছাপ যেন চারদিকে বিরাজ করছে। সবেমাত্র অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান ও অধ্যাপক হালিম খান দুপুরে খাবার খেয়ে অধ্যক্ষের বাংলাের উপর তলায় বিশ্রামের জন্য গেছেন এমন সময় ১নং গেট ভেঙে কয়েকটি আমি ট্রাক কলেজ গ্রাউন্ডে ঢুকে পড়ে এবং অধ্যক্ষের বাংলাের দিকে এগিয়ে যায়। এই দলটি এসেছিল কুষ্টিয়া থেকে। এদের অধিনায়ক ছিল ১২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ইকবাল। এই নরপিশাচের আদেশে জোওয়ানরা অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান, অধ্যাপক হালিম খান ও বাবুর্চী আবুল ফজলকে ঘর থেকে বের করে গেটের বাইরে নিয়ে যায়। হানাদার বাহিনীর সাথে ছিল তাদের চর কয়েকজন বিহারী । এদের মধ্যে সব চাইতে জঘন্য ছিল ঝিনাইদহের টমেটো নামে কুখ্যাত একজন বিহারী । এই নরপিশাচ অধ্যক্ষ কর্ণেল রহমান ও অধ্যাপক হালিম খানের নামে তার পরিবারবর্গ নিধনের মিথ্যে অপবাদ দেয়। আর মিথ্যে অপবাদের উপর ভিত্তি করেই ক্যাপ্টেন ইকবাল তার অনুচরদের হাতে ছেড়ে দেয় অধ্যাপক হালিম খানকে। অধ্যক্ষের বাংলাের পেছন দিকে এরা অসহায় হালিম খানকে বেয়ােনেট আর তলােয়ারের নির্মম আঘাতের মাধ্যমে হত্যা করে।
এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন ইকবালের সাথে অধ্যক্ষ কর্ণেলের কথা কাটাকাটি হয়। অধ্যক্ষ কর্ণেল বলেন “আমিও আর্মি অফিসার, আমাকে এভাবে মারা অন্যায়। আমার অপরাধের বিচার একমাত্র সামরিক আদালতেই করতে পারে। তাছাড়া আমি একজন কর্ণেল, একজন ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে প্রাপ্য মর্যাদা আমাকে দেওয়া হচ্ছে না কেন?”
________________________________________
কিন্তু এরই নরপিশাচদের কাছে সকল যুক্তিই বৃথা। তার কাছ থেকে ঘড়ি টাকা চাবি সব কেড়ে নেওয়া হলাে। সৈন্যরা কলেজের মূল্যবান জিনিষপত্র ট্রাকে তুলে যখন উল্লাস করতে করতে ২নং গেট দিয়ে বের হচ্ছিল সে সময় তাদের নজর পড়ে গেটে কর্তব্যরত মাশী সারের উপর। তাকে ধরে নিয়ে ড্রেনের পাশে দাঁড় করিয়ে পরপর দুটি গুলি করে হত্যা করে। গুলি দু’টো তার দেহ ভেদ করে দেয়ালে বিদ্ধ হয়। তার দেহ গড়িয়ে পড়ে ড্রেনের মধ্যে। এরপর তারা খুঁজতে থাকে কে কোথায় আছে। হতভাগ্য চৌকিদার মইজীকে ধরে নিয়ে কুষ্টিয়া সড়কের পূলের তলায় দাঁড় করিয়ে গুলি করে।
ভারতের পথে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ইছামতীর তীরে সারি সারি নৌকা নােঙর করছে প্রতিদিন। কিন্তু ঐ সব নৌকায় যারা আসছে তারা কোথায় পাড়ি দেবে তা জানে না এই সব মানুষ তাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে এসেছে। পেছনে খান সেনা আর তাদের দালালদের অত্যাচারের স্মৃতি, সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। ভারতের তীরে এসে যখন নৌকা ভিড়ছে তখন পায়ের তলার শক্ত মাটি একমাত্র এদের আশা। প্রতিদিন বৃদ্ধ, পৌঢ়, নারী, যুবক ও শিশুর জীবন দিনরাত ইছামতির দোলায় দুলছে। নৌকার মধ্যেই তাদের সংসার। দলে দলে তারা হাসনাবাদের মাটিতে নামছে। কিন্তু সেখানে বা অদূর টাকীর শিবিরে কোথাও ঠাই নাই। নতুন করে রেজিস্ট্রশন হচ্ছে না। হাসনাবাদে নদীর তীর থেকে বােঝা মাথায় মানুষের সারি এগিয়ে যাচ্ছে। ওরা শুনেছে বারাসতে নাকি নতুন রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে। সেখানে যাবে।
হাঁটবে কতদূর জিজ্ঞেস করতেই বলে আর কী করা বাবু, নৌকায় আর কদ্দিন কাটে। ছিল সের কয়েক চাল। তাই এক বেলা খেয়ে পাঁচ সাতদিন চলেছে, শুনছি ক্যাম্পে নাকি চাল-ডাল দিচ্ছে। –ঠিক জানাে তাে যে বারাসতে গেলে জায়গা পাবে? —তা ঠিক জানিনা। যাই, দেখি যদি-না পাই তবে না খেয়েই মরব। মরণ যদি কপালে থাকে এ পারেই মরব।
সবাই যে হাঁটা পথ নিয়েছে তা নয়। যারা খোঁজ খবর রাখে তারা কাছের রেল ষ্টেশন থেকে হাসনাবাদ-বারাসত ট্রেনে চেপে বসেছে। ফলে ট্রেনে ভীড় খুব। কিন্তু সেও অজানার উদ্দেশ্যেই পাড়ি। কারণ এতদিন পায়ের নীচে মাটি ন থক মাথার উপর নৌকার দুই ছিলাে । যাওয়ার আগে নৌকাগুলাে ওরা জলের দরে স্থানীয় লােকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ইংরেজি জানলে ওরা বলতে পারতাে -“উই হ্যাভ বারনট আওয়ার বােটস”। বারাসতে বা অন্য কোথাও ঠাই না পেলে ফিরে আসার সংগতি সত্যিই ওদের নেই। নৌকাতে দুর্যোগের সময় ওরা একটা আড়ালে থাকতে পেরেছিলাে। দুইয়ের উপর মাদুর, চাদর, ছেড়া কাঁথা দিয়ে ছিদ্র ঢাকার ব্যবস্থা করেছিল। এদিকে টাকী বাসষ্ট্যান্ডের কাছে যারা রয়েছে তাদের মাথার উপর ছাউনি বলতে গাছের ডাল । এখানে ওখানে বই
________________________________________
পরিবার গাছতলায় দিন আষ্টেক ধরে রয়েছে, বর্ষা মধ্যে ঐভাবেই কাটছে। জলে গা ভিজছে, যা সামান্য জামাকাপড় আছে তাও ভিজছে, মাদুর-চাদর সবই ভিজছে। কাপড় আবার গায়েই শুকোচ্ছে। কথা কম্বল দিনের মধ্যে আর শুকোয়নি। তার ওপরেই শুতে হচ্ছে, কারণ মাটিতে আরাে ভিজে কাদা-কাদা। সবচেয়ে কষ্ট হােট হােট বাচ্চাগুলাের
সাংবাদিকরা এগোতেই পরিবৃত হয়ে যায়। তারা কি সরকার থেকে এসেছে? কারণ ওদের এখনও টিকেট হয়নি। টিকেট না হলে তাে কিছুই পাবে না। অথচ মেডিকেল হয়ে গেছে কলের ইনজেকশন আর বসন্তের টীকা দুই-ই। সঙ্গে রয়েছে সেই কাগ। কিন্তু টকীঃ কোন ক্যাম্পেই আর নতুন লােক নেওয়া হচ্ছে না।
…মাদের একটা টিকেট করায়ে দ্যান বাবু। অন্ততঃ কয়েক দিনের চাল ডাল | তারপর যেখানে বেন সেখানেই যাবাে।
“¢ ৫. দেওয়ার ক্ষমতা থাকলে তখুনিই দিতাম বৈকি ওরা ক’দিনের ১.ডল পেলে তারপর যদি অন্য কোথাও চালান হতে চায়, সে ও তাে খুব ভালাে কথা। গাছতল ছেড়ে যেকোন মাথা গােজবার ঠাই-ই ওদের কাছে প্রিয়তর। যখন বাংলাদেশের ভিটে খাতে পেরেছে; এখন ভারতের গাছতলাটার জন্যই বা মায়া কিসের?
…কিন্তু দেশে ফিরবে না? | দেশে আর ফিরবে না কোথায় ফিরবে? যা কিছু ছিল লুটে নিয়েছে। যখন লুটে নিলাে ৩ারপরও তো ছিলো। কিছুদিন । লুট পাটে বাধা দিতে গিয়ে মার খেয়েছে। হারাধন মণ্ডলের হাটু আর কোমরে এখনও বল্লমের দগদগে ঘা । তবুও ছিলাে, কিন্তু যখন ঘরে আগুন দিলে, মেয়েদের ধরে টানতে লাগল, ছেলেদের ধরে কাটতে থাগলাে, তখন কি আর থাকা চলে? ..কিন্তু যদি আওয়ামী লীগ সরকার করে ফিরবে না?
–তা হলে ফেরা যায়, কিন্তু কোথায় আওয়ামী লীগ বাবু? এখন তাে সবাই মুসলিম লীগ । আরাে খানিক এগিয়ে বাঁ দিকে একটি ক্যাম্প। সামনে মারােয়াড়ি রিলিফ সােসাইটির নিশান। এই ক্যাম্পে সব মিলিয়ে মানুষের সংখ্যা প্রায় সাতাশ হাজার। হিন্দু-মুসলমান-খৃষ্টান সবাই আছে এখানে। বেশির ভাগ যশাের-খুলনা জেলার। তাদের অধিকাংশ চাষবাসে জড়িত ছিল। একজন বল্লো, তার জমি ছিল ৬২ বিঘে এখন সঙ্গে আছে শুধু খাজনার রশিদ । দলিল সঙ্গে করে আনতে পারেনি তবে রশিদটা রেখেছে। যদি কখনও ফেরে তবে দাবি করতে পারবে জমিটা-এই রকম আশা এখনও বুকের ভেতর।
এখানে মাথাপিছু ৪০০ গ্রাম চাল ১০০ গ্রাম ডাল আর ১০০ গ্রাম আলু-পেয়াজ । দুদিনের রিলিফ এক সঙ্গে বিলি করে মারােয়াড়ি রিলিফ সােসাইটি। পানীয় জলের জন্য
________________________________________
একটা পুকুর আর গােটা কয়েক নলকুপ। সরকারী কর্মচারীদের উপর চাপ খুব, কিন্তু এখনও ঐ শিবিরে কোন বড় রকম রোগ দেখা দেয় নি এই য রক্ষা এই ক্যাম্পের জমিটাও একটু উঁচু ফলে জল দাঁড়াতে পারে না। তবে স্বাস্থ্য রক্ষার বন্দোবস্ত এমন নয় যে খুব নিশ্চিন্তে থাকা যায়। জ্বালানির অভাব। তাই খিচুড়ি ফুটিয়ে নেওয়াই রেওয়াজ। শিবিরে প্রথম ক’দিন অনেকের কাছে বিপদের অনেকটা পথ অর্ধাহারে-অনাহায়ে হেঁটে এসে অনেকেই প্রথমে লােভের বসে অনেকটা খেয়ে ফেলে। পেট এই অনিয়ম সহ্য করতে পারে না।
সরকারী কর্মীরা যথেষ্ট করেছেন, তবু সমস্য থেকেই যায় পরাণ মণ্ডলের রেশন কার্ড হারিয়ে গেছে মাথা খুঁড়লেও কি আর খুঁজে পাবে? সরকারী কেরাণী বাবুর পা ধরে পড়েছে, তা আমার কার্ড করিয়ে দেন বলে কন্নর সংক্ষে অফিসের বাইরে এক বুড়ির কান্নার অবশ্য অনেক তফাৎ। তার বিশেষ জ্ঞান আছে বঞ্চে মনে হল ন একবার করে বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ডুকরে কেঁদে উঠছে চে’ দুটে’ প্রয় ঠলে বেরিয়ে এসে আর কি । বুড়িকে ঘিরে ক্যাম্পেরই কতাে লােক ভিড় করেছে। অন্যরা ওকে ক্যাম্পে দিয়ে চলে গেছে। বুড়িকে দেখার কেউ নেই । ওখানেই শুচ্ছে। ওখানেই যা পারে খাচ্ছে এবং মলমূত্র ত্যাগ করছে। ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত অফিসার একটি হতাশসূচক আওয়াক্ত করে বললেন, একে নিয়ে কী করি বলুন তো? | বুড়ির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দেখি ওদিকে একটি ছেলে পান বেঁচছে (জার থেকে কিন্তু পান, চুন, সুপারি কিনে ঝুড়ি নিয়ে বসে গেছে। কত বিক্রি হয়। সামান্য “আজ তাে মাত্র ১৫ পয়সা বেঁচলাম। পানওয়ালা ছেলেটি হেসে উঠেছিলে-কেমন যেন •রুদ্ধেগে হাসি। ক্যাম্পের সবার মুখে অবশ্য সেই নিরুদ্বেগ নেই। প্রায় সকলেই ঠিক করে ফেলেছে দেশে ফেরা আর নয় ক্যাম্পে অনেকেরই ভাবন, এরপর সরকার কোথায় পাঠাবেন? কিছু কিছু লােক যে বাংলার বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা ওরা শুনেছে তবে যেখানেই পাঠান বাবু ভারতের মধ্যে পাঠালেই যাব। সরকার আমাদের জন্য এত করছেন, খেতে দিচ্ছেন পরতে দিচ্ছেন, আমরা কথা শুনব বৈকি।
ক্যাম্পের বাইরে ছোটখাটো জটলা ক্যাম্পে জায়গার খেছে অনেকে এসেছে স্কুল কলেজ পরিত্যক্ত বাড়ি সবাই এখন শরনার্থী শিবির। কিছু লােক বারাসতের পথে থেমেছে শুনছি, এই ক্যাম্প থেকে নাকি কাল আরাে টিকেট দেবে আরে না, এখানে নতুন লােক নেওয়া বন্ধ । চল, চল বারাসতেই শেষ চেষ্টা! ওরা যাণে অবশ্যই, ক’জন বারাসত পৌছবে জানি না। পৌছলে হয়তাে শিবিরে জায়গা পাবে । অনেকে তার আগেই এদিক ওদিকে ছড়িয়ে পড়বে। কোন পরিত্যাক্ত বাড়িতে, অথবা কোনাে বাড়ির দাওয়ায় আশ্রয়। কিংবা হয়তো গাছ তলায়। তারপর পঞ্চম বা রােগে মৃত্যু। অথবা কোন অসৎ সঙ্গে পড়তেই বা বাধা কোথায়?
________________________________________
রাস্তার দু’ধারে লাখ লাখ লােক বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত এগিয়ে চলেছে। এদের সামনে অনিশ্চিত আগামী । মাতৃভূমি ছেড়ে যারা শেষ আশায় বুক বেঁধে হাঁটতে শুরু করেছে তাদের গন্তব্যের শেষ কোথায়। কোন অজানা ভবিষ্যতে? ফেরার পথে পর্যবেক্ষকের মুখে কথা সরে না। কঠিন আর ভয়ংকর এ অভিজ্ঞতা। বেনাপােল সীমান্তে এসে দেখা যায় রাস্তার দু’ধারে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়। মাঝখানে দুই বাংলার সীমান্ত রেখা। এপাশে পশ্চিম ও পাশে পূর্ব । দুধারের প্রবল জনতরঙ্গে সীমান্ত বুঝি ভেঙে যায় যায় ।
________________________________________
চতুর্থ অধ্যায় সশস্ত্র যুদ্ধ ৩৪৯ ০ ৪০৮
আমরা – এই ভুখভের বাঙ্গালীরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে এক সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। পরাধীনতার শৃখল ভাঙ্গতে ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীর রক্ত ঝরাতে হয়েছিল। ‘৭১ সালের মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিল এক উত্তাল যুদ্ধ ক্ষেত্র। পাকিস্তানী দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল সেই সময়ের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ।
বাংলার সংগ্রামী জনতা কিভাবে সেদিন পাক দস্যু বাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল এই অধ্যায় দেশব্যাপী সংগঠিত সেইসব ভয়াবহ ও লােমহর্ষক যুদ্ধের কিছু খন্ড খন্ড চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন জেলায় সংগঠিত সেদিনের সশস্ত্র সংগ্রামের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা কোনক্রমেই পূর্ণাঙ্গ নয়। একটি অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা মাত্র। যা থেকে পাঠকবৃন্দ ১৯৭১ সালের যুদ্ধ দিনের ভয়াবহ বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারবেন।
একাত্তরের ২০ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর চীমার গােয়ালন্দ ঘাটে পৌছে। এতে ফরিদপুরবাসীরা স্বাভাবিকভাবেই আতংকগ্রস্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে সামান্য কিছু হাল্কা অন্ত এবং স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ নিয়ে ফরিদপুরের দামাল ছেলেরা ফরিদপুর-গােয়ালন্দ সড়ক অবরােধের চেষ্টা করে। সড়কের কয়েকটি অংশ কেটে যােগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং গাছের শুড়ি ফেলে প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলে। হানাদার বাহিনীর শক্তির কাছে এ প্রতিরােধ ব্যবস্থা ছিল খুবই সামান্য। হানাদার বাহিনী কামানের গােলাবর্ষণ করতে করতে এগুতে থাকে শহরের দিকে। মুক্তিযােদ্ধারা গােলাবর্ষণ থেকে রক্ষা পেতে অবস্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং হানাদার বাহিনী ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে।
সেপ্টেম্বর মাসে পাক বাহিনী চাঁদেরহাট গ্রামে ঢুকে অত্যাচার শুরু করে। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড র আবদুল আজিজ মােলা একটি রাইফেল, ঢ৯ সড়কি, বল্লমসহ
________________________________________
গ্রামের কয়েক হাজার লােক নিয়ে হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ২৪ জন খানসেনা হত্যা করে। প্রতিশােধ নিতে ৫/৭ দিন পর শতাধিক পাকসেনা চাদেরহাট গ্রামে ঢুকে প্রতিটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় বাড়ি ছেড়ে পলায়নরতদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করা হয়।
হানাদার বাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় ১৬১টি মানব সন্তানের বুক। শুকনাে ডােবায় রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল সেদিন। এ ছাড়া প্রায় প্রতিরাতেই হানাদার বহিনী গ্রাম থেকে নিরীহ মানুষ ধরে আনত শহরে। ফরিদপুর স্টেডিয়ামের অন্ধকোঠায় দিনভর অত্যাচার করা হতাে এদের ওপর । রাতে সবার কোমরে রশি বেঁধে নিয়ে যাওয়া। হতাে হাসরা সেতুর ওপর। ব্রাশ ফায়ারে বুক ঝাঁঝরা করে ফেলে দেয়া হতাে নদীতে । স্টেডিয়ামে দৈহিক নির্যাতনকালে অনেকেই মারা যেত। এদেরকে ষ্টেডিয়ামের মধ্যেই পুঁতে ফেলা হতো।
ফরিদপুরের সাবসেক্টর কমান্ডার নুর মােহাম্মদ-এর নেতৃত্বে আগষ্টের শেষের দিকে একদিন মাঝ রাতে ভাটিয়াপাড়! ওয়ারলেস স্টেশন আক্রমণ করা হয়। অয়ারলেস ষ্টেশনটিতে প্রায় ৫০ জন পাকসেনা এবং তাদের সহযােগী রাজাকার পাহারায় ছিল। লড়াই চলে পরদিন ভাের ৬টা পর্যন্ত ঐ যুদ্ধে মুজিব বাহিনীর ইসমত কাদির গামাসহ ১২৪ জন মুক্তিযােদ্ধা অংশ নেন। এতে ১৯ জন খানসেনা এবং ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ নিহত হয়নি যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা একটি মর্টার, ৪টি এসএমজি, ৫৬টি ৩০৩ রাইফেল, ২৬টি এসএলআর ব্যবহার করে। যুদ্ধের সংবাদ পেয়ে পাক বিমান বাহিনীর একটি স্যার জেট বিমান ঐ এলাকার আক্রমণ চালায়। কিন্তু তার আগেই মুক্তিযােদ্ধারা এলাকা ত্যাগ করে নিরাপদ অবস্থানে চলে যায়।
৯ ডিসেম্বর বােয়ালমারী থানার নতুবদিয়া বাজার ক্যাম্প আক্রমণের জন্য হানাদার বাহিনীর একটি দল আসছে জানতে পেরে মাত্র ৩৩জন মুক্তিযােদ্ধা এগিয়ে আসে করিমপুর সেতুর দিকে। দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা দু’দিক থেকে সাঁড়াসি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। এর একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন আলফাডাঙ্গা থানার হেমায়েত উদ্দিন তালুকদার এবং অপর দলের নেতৃত্ব দেন ফরিদপুর শহরের কাজী সালাউদ্দিন ধােপাডাঙ্গা, চাঁদপুর এলাকায় বেলা ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দু’শতাধিক হানাদার সেনার বিরুদ্ধে একনাগাড়ে যুদ্ধ চলে , যুদ্ধে কাজী সালাউদ্দিন শহীদ হওয়ায় ঐ মুহুর্তে দলের নেতৃত্ব দেন ডাঃ এমরান মজুমদার। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর মেজর মফিসহ ৪৯ জন পাকসেনা এবং ১১ জন মুক্তিযোেদ্ধা নিহত হয়। এ যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৭ জন হচ্ছেনঃ +: সালাউদ্দিন, নওফেল, ওহাব, মজিবর, অাউয়া সােহরাব ও আনেল যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি ২” মটর, ২টি এএমজি, ৩ ও এল, একটি পিস্তল, একটি বন্দুক ও ৫টি নট প্র রাইফেল । এই যুদ্ধে অংশ নেন
ম নে হেমায়েত উদ্দিন তালুকদার,
________________________________________
ডাঃ এমরান মজুমদার, শামসুদ্দিন আহমেদ, আমিনু রহমান ফরিদ, ইদ্রিস মােলা, আতাহার হােসেন খান, কাজী ফরিদউদ্দিন, মেজর মাহতাব, নায়েক দেলােয়ার, আলী আকবর, সােহরাব হােসেন, মােবারক মােল্লা প্রমুখ। | ফরিদপুর স্টেডিয়ামে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ‘পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’ নামে কয়েকটি কোম্পানী গঠন করা হয়। প্রায় ৫ হাজার নারী-পুরুষ এই পশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে। শামসুদ্দিন আহমেদ, আমিনুর রহমান ফরিদ, নওফেল (শহীদ), সালাউদ্দিন (শহীদ), আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ, মােকাররম হােসেন, নাজমুল হাসান নসরু, সৈয়দ কবিরুল আলম, শাহরিয়ার কর্মী, মালেক, এমরান মজুমদার (ডাঃ রুন), বদরুল হােসেন, গেম হেলালী প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে পুরাে কোম্পানী ভারত থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসে। | হানাদার বাহিনী যখন ফরিদপুর শহরে অত্যাচার চালাচ্ছিল, তখন ছাত্ররা আবু ফয় শাহনেওয়াজ-এর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পােষ্টার এটে দেয়। হানাদার সরকারের অধীনে যাতে কেউ এস, এস, সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে সে জন্যে হানাদার বাহিনীর টহল উপেক্ষা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষায় অংশ না নেয়ার জন্য পরীক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের অনুরােধ জানায়।
হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করার জন্য ফরিদপুর শহর এবং শহরতলির একাধিক এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। এ সময় কুমার নদের ওপর বাখুন্ডা সেতুসহ কয়েকটি সেতু ধ্বংস করে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় । মােকাররম হােসেন, শাহনেওয়াজ, মাসুদ হক, মিরােজ হায়দার, হাফিজ, ফারুখ প্রমুখের নেতৃত্বে ফরিদপুর শহরে বেশ কয়েকবার হামলা চালানাে হয়। বিভিন্ন সড়ক ও সেতুতে পাহারারত রাজাকারদের নিরস্ত্র কৰে তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের আওতায় আনা হয়। এ সময় অম্বিকাপুরে হানাদার বাহিনীর সাথ লড়াইয়ে বেশ ক’জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হয়।
ফরিদপুর শহরতলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হয় শ্ৰামদী মাতুব্বর ঘাটে । যশাের থেকে পালিয়ে আসা হানাদার বাহিনীর কয়েক হাজার সেনা ও রাজবাড়ী থেকে পালিয়ে আসা বিহারীদের সাথে তুমুল লড়াই হয়। ৩ দিনব্যাপী এ লড়াইয়ে অগণিত পাকসেনা ও বিহারী মারা যায়। লড়াইয়ে মােকাররম হােসেন ও আবুল ফয়েজ শাহনেওয়াজ গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা পালন করেন। | ফরিদপুরের পাংশা থানার খবিরুজ্জামান ভারতে গমন সুইসাইড স্কোয়াড বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেয়ার পর তাকে জুনিয়ার ইন্ট্রাকটর নিযুক্ত করা হয় । | ১২ অক্টোবর খবির দু’ সহযােগী হাফিজ ও সামাদকে নিয়ে টেকেরহাট পৌছে। ওরা কুমার নদে নেমে আসে গভীর রাতে । ঘাটে বাঁধা ফেরি, লঞ্চ আর গানবােটই ছিল ওদের লক্ষ্যবস্তু। এগুলােতে ছিল হানাদার বাহিনী। এসব নৌযানের সাহায্যে গ্রাম-গঞ্জে চালানাে হতে অত্যাচার। হানাদার বাহিনী অন্তহাতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল কুমার নদের চারদিকে।
________________________________________
অতি সাবধানে লক্ষ্য বস্তুর কাছাকাছি যেতেই খবিরের এক বন্ধুর মাইন ভুলবশতঃ আগেই বিফোরিত হয়। ভীতসন্ত্রস্ত হানাদার বাহিনী বেপরােয়া গুলি ছুড়তে থাকে। হাফিজ ও সামাদ নিরাপদে সরে যেতে সক্ষম হলেও খবির পিছনে থেকে যায়। মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার বুক। | পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যখন তুমুল লড়াই চলছে, সেই মুহুর্তে এগিয়ে আসেন খলিলপুরের এক সাহসী মা-সারথী বালা। তিনি ক্যাম্পে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের বলেন, বাবা তােমরা দেশকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করছে। আমি একজন বিধবা মা, কি দিয়ে তােমাদের সাহায্য করবাে? আমার দু’টি পুত্রসন্তান রয়েছে এ দুজনকে তােমাদের হাতে তুলে দিলাম। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমি আমার সন্তানদের মুখ দেখতে চাই না।
মমিন খার হাট-পদ্মা চরের এক বৃদ্ধ এলেন ক্যাম্পে। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ৪টি কলা দিয়ে বলেন, “বাবা আমার তাে কিছুই নেই, কি দিয়ে সাহায্য করবে তােমাদের। কলা চারটি খেলে আমি খুব খুশী হব ।
২৫ এপ্রিল হানাদার পাকবাহিনী ট্রেনযােগে সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। দীর্ঘ একমাসের প্রতিরােধে পাকবাহিনীকে চরম মুল্য দিতে হয়েছে। ২৫ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী তাদের সীমিত
সদ এবং স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত এবং তৈরি করা নিম্নমানের আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে পাক বাহিনীকে বীরত্বের সাথে মােকাবেলা করে। দীর্ঘ একমাসের প্রতিরােধে মুক্তিবাহিনীর রসদ ফুরিয়ে যায় । ২৪ এপ্রিল রাতে মুক্তিবাহিনী তাদের সব প্রতিরােধ প্রত্যাহার করে। এর ফলে হানাদার বাহিনী ২৫ এপ্রিল ভাের রাতে প্রতিরােধ ছাড়াই খুব সহজে সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে।
সিরাজগঞ্জে মুক্তিবাহিনী তিনটি নামে হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুক্তিবাহিনীর দলগুলাে হলাে ‘ফ্রিডম ফাইটার’, মুজিব বাহিনী’ এবং ‘পলাশডাঙ্গা যুব শিবির’। তিনটি বাহিনীতেই সকল পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। প্রথম দুটি দলের মুক্তিযােদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং যুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় অর ও রসদ পায়। পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের মুক্তিযােদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তারা বিভিন্ন থানা এবং রাজাকারদের ক্যাম্পে হামলা করে প্রয়ােজনীয় অন্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করে।
পাকবাহিনী সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে নৃশংস তান্ডবলীলা শুরু করে। তাদের বিভীষিকাময় পৈশাচিকতা স্বরণ করে মানুষ আজো আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। ভাের রাতে পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করেই বাড়িঘরে আগুন দিতে শুরু করে। অনেকে নিজ নিজ
________________________________________
বাড়িতে অবস্থান করছিলাে। পাকবাহিনী এদেরকে নির্বিচারে হত্যা করে। এইদিন শহরে। প্রায় ৪শ’ মানুষ হানাদার বাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়।
পাক বাহিনীকে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ (এখন ছাত্র শিবির), ছাত্র ফেডারেশন এবং কতিপয় অবাঙ্গালী তাদেরকে স্বাগত জানায়। এইসব মহল পাকবাহিনীর সহায়তায় শহরে লুটতরাজ চালায়। পাকবাহিনী স্বাধীনতা বিরােধী এইসব চক্রের সহযােগিতায় বাগবাটি এবং নরিয়া মধ্যপাড়া গ্রামে হামলা করে প্রায় ৭/৮ শ’ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে। এসময় গ্রাম দুটোতে ভয়াবহ দৃশ্যের অবতারণা হয়। গ্রাম থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে ক্যাম্পে এনে দিনের পর দিন পালাক্রমে ধর্ষণ করে। অনেকে বাঁচার জন্য মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলাে। অনেকে নামাজ পড়তে বসেছিলাে। কেউ পবিত্র কোরান পড়ছিলাে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। তারা পবিত্র কোরানকে পায়ে পিষে সবাইকে হত্যা করে বেরিয়ে যায়।
মুক্তিযােদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য স্বাধীনতা বিরােধীর অঙ্গীকার করে। এই লক্ষ্যে শান্তি কমিটি গঠন করে, কেউ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দায়িত্ব পালন করে। অনেকে রাজাকার, আলবদর এবং মিলিশিয়ায় ভর্তি হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের মােকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে গুরুত্বপূর্ণ রেল ও সড়ক সেতু পাহারার দায়িত্ব পালন করে।
দীর্ঘ ৮ মাস সিরাজগঞ্জবাসী পাকবাহিনী ও তার দোসরদের ভয়ে সবসময় আতঙ্কগ্রস্ত থেকেছে। প্রতিটি রাত ছিলাে ভয়ার্ত বিভীষিকাময়-সন্ধ্যা হলেই মানুষ ভয়ে কুকড়ে যেত। বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংস হত্যাকান্ড দেখে মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তাে। মনে হতাে আজ রাত বুঝি তাদের জীবনে শেষ রাত।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। মুজিব বাহিনীর একটি দল এই গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। দালালদের মাধ্যমে খবর পেয়ে সিরাজগঞ্জ, কাজিপুর এবং রায়গঞ্জ থেকে পাক বাহিনীর শক্তিশালী দল রাত ১১ টায় তিন দিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেলে। রাত প্রায় ১ টার দিকে মুজিব বাহিনী শত্রুর অবস্থান টের পায়। অবস্থা বেগতিক দেখে একজন জীবনের ঝুকি নিয়ে শত্রুর অবস্থান ভেদ করে বাইরে আস কয়েক মাইল দূরে মুক্তিযোেদ্ধাদের অপর একটি শক্তিশালী দল অবস্থান করছিল। মুজিব বাহিনীর সদস্য তাদের খবর দেয়। খবর পেয়ে তারা দ্রুত বরইতলি গ্রামে আসে এবং পাকবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। ভাের হবার সাথে সাথে মুক্তিবাহনীর সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়। বেলা দুটো পর্যন্ত গুলি বিনিময় চলে। এ সময় মুজিব বাহিনীর বিলাল নিহত হয়। অপর দিকে পাকবাহিনীর ৫০ জন মারা যায়। মুক্তিবাহিনী চলে যাবার পর হানাদার বাহিনী গ্রামের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা শুরু করে। প্রায় আড়াই শ’ মানুষ সেদিন। খুন হয়। যাবার সময় তারা পুরাে গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়ে যায় ।
বেলকুচি থানায় পাকবাহিনীর শক্তিশালী ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিতে ঢুকে পড়ে। ৩৫ জন পাকসেনা, রাজাকার ও মিলিশিয়াকে আটক করে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি।
________________________________________
নাগাদ ঘটনাটি ঘটে। এর আগে মুক্তিবাহিনী দু’বার ক্যাম্পে হামলা করে। দু’বারের হামলায় পাকবাহিনীর ক্ষতি করা সম্ভব হয়নি। পরিস্থিতি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয় তারা এক সাথে ক্যাম্প আক্রমন করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গভীর রাতে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পের ৪/৫শ’ গজ দূরে অবস্থান নেয়। ফজরের নামাজের সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী একযােগে ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে। হানাদার বাহিনী কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই বন্দি হয়। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে এই দুঃসাধ্য ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। ধৃত পাকবাহিনী ও তার দোসরদের পরে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী কাজিপুরে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে তিনবার আক্রমণ করে। প্রথম হামলায় উভয় পক্ষে বেশকিছু হতাহত হয়। ১৫ দিন পর মুক্তিবাহিনী আবারাে হামলা করে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। এই সংঘর্ষে ৩জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং ৯ জন পাক সেনা মারা যায় । এক মাস পর মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পটির ওপর প্রচন্ড আক্রমণ করে। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সংঘর্ষে ৫জন মুক্তিযােদ্ধা ও ৪০ জন শত্রু সেনা নিহত হয়। প্রচন্ড আক্রমণে টিকতে না পেরে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়।
| সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন স্থানসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যুক্ত করতে গিয়ে সিরাজগঞ্জের যেসব বীর সন্তানেরা শহীদ হয়েছে তারা হলাে সিরাজগঞ্জ সদর থানার শহীদ আহসানউল। হাবিব, শহীদ আবুল কালাম আজাদ, শহীদ সাহেব আলী, শহীদ সুলতান মাহমুদ, শহীদ জাফর আলী, শহীদ আব্দুস সামাদ সরকার, শহীদ রতন, শহীদ রফিকুল ইসলাম এবং শহীদ শুকুর মাহমুদ।
কামারখন্দ থানায় শহীদ ওয়াজেদ আলী সিপাহী, শহীদ ইয়াকুব হােসেন মন্ডল, শহীদ সােলায়মান আলী আকন্দ, শহীদ সুরুজ্জামান সরকার, শহীদ আব্দুস সামাদ সরকার, শহীদ মাজেদ আলী সরকার।
তাড়াশ থানার-শহীদ মাহতাব উদ্দীন খান, শহীদ শাহজান আলী এবং শহীদ ওসমান গনি। চৌহালী থানায়-শহীদ সুরুজ আলী, শহীদ ফজলুল হক, শহীদ শাহজাহান সরকার, শহীদ ওয়ারেশ আলী এবং শহীদ শাহজান আলী মােল্লা।
বেলকুচি থানায়-শহীদ মােজাফফর হােসেন, শহীদ আবু বক্কর সিদ্দিকী, শহীদ শাহজান আলী, শহীদ তােফাজ্জল হােসেন, শহীদ নজরুল ইসলাম এবং শহীদ আব্দুর রহমান। | উল্লাপড়া থানায়-শহীদ ওমর আলী, শহীদ নেফাক্ত প্রমানিক, শহীদ হােসেন আলী প্রমানিক এবং শহীদ হায়দার আলী।
কাজিপুর থানায়-শহীদ জমসের আলী, শহীদ আব্দুর রাজ্জাক মল্লিক, শহীদ আব্দুল মজিদ সরকার, শহীদ শাহজান প্রামানিক, শহীদ চান মিয়া, শহীদ সােরাব হােসেন, শহীদ আলী, শহীদ সােলায়মান হােসেন, শহীদ আব্দুস সামাদ, শহীদ দিলশাদ হােসেন, শহীদ রবিলাল দাশ, শহীদ সমশের আলী এবং শহীদ ইজ্জত আলী।
________________________________________
শাহজাদপুর থানায়-শহীদ আবু বক্কর, শহীদ নরুল ইসলাম, শহীদ তােজাম্মেল হক, শহীদ জয়না আবেদীন, শহীদ আমিরুল ইসলাম, শহীদ নুরুল হক, শহীদ আলাউদ্দীন মন্ডল এবং শহীদ ল্যান্স নায়েক জিন্তুর রহমান।
তিন ৬ এপ্রিল স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকেরা পাক সেনাদের দুর্গ সৈয়দপুর শহর আক্রমণ করতে যায়। এরা প্রথমে সৈয়দপুর শহর থেকে ৮ মাইল দূরে টেক্সটাইলের কাছে ব্যারিকেড দিয়ে অবস্থান নেয়। উদ্দেশ্যঃ সেখান থেকে আক্রমণ চালানাে কিন্তু এ খবর পাক সেনাদের কাছে চলে যায়। পাকবাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এ আক্রমণ চালায় ৭ এপ্রিল এবং ব্যারিকেড ভেদ করে পাক বাহিনী ঢুকে পড়ে নীলফামারী শহরে । কিন্ত শহরবাসী পাক বাহিনীকে আক্রমণের পরিবর্তে নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে পড়েছে, এই খবর শুনে যে যেখানে ছিলাে ক্ষণিকের মধ্যে সর্বস্ব ফেলে শহর ত্যাগ করে ।
এপ্রিলের শেষের দিকে বিন্নি দিক থেকে এসে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ একত্রিত হন ডোমার থানার চিলহাটি এলাকায়। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয় লড়াইয়ের, মুক্তিযােদ্ধা দল গঠনে যুবকদের উদ্বুদ্ধকরণের।
৭ এপ্রিলের পর থেকে পাক বাহিনী ও তার দোসরর! নীলফামারী এবং সৈয়দপুরসহ গােটা জেলাবাসীর ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালাতে থাকে। শহরের উচ্চ শিক্ষিত, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগামী ছাত্রীদের তারা খোঁজখবর নিত তাদের লােকজনদের দিয়ে এবং কার নাম করে চলত তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার। একদিন দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে পাশবিক অত্যাচার করে হত্যা করা হয়।
সৈয়দপুর ছিল অবাঙ্গালী প্রধান শহর। এই শহর ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চেই পাক সেনারা দখলে নিয়ে নেয়। ১৩ জুন একদিনে এই শহরে হত্যা করা হয়েছে ৩শ’ ৩৮ জন বাঙালিকে। এই হত্যাকান্ডটি সংঘটিত করা হয় মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে। সকলকে ভারতে পৌছে দেয়া হবে। এই বলে ট্রেনে উঠানো হয়। ট্রেনটিকে সৈয়দপুর রেল স্টেশন থেকে উত্তরপাশে গােলাহাট এলাকায় ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করিয়ে সকলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ডাঃ ইয়াকুব আলী, ডাঃ বদিউজ্জামান, ডাঃ শামসুল হক ও তুলশীরাম আগরওয়ালাকেও হত্যা করা হয় । থানা শহর সৈয়দপুরেই হত্যা করা হয় ৬ শতাধিক ব্যক্তিকে।
নীলফামারী সরকারী কলেজের ছাত্রাবাসে পাক সেনারা ক্যাম্প করে। সেখানেই একটি কক্ষে নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়। লােকদের ধরে এনে সেখানে চালাননা হতাে অমানবিক নির্যাতন। এই কেন্দ্রে নির্যাতনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের গণকবর রুয়েছে এই কলেজেরই পিছনে। নির্যাতনের তীব্রতা ছিল ১৯৭১ সালের ৮ই এপ্রিল থেকে
________________________________________
এরই মধ্যে এই এলাকার যুবকরা প্রশিক্ষণশেষে আক্রমণ চালাতে শুরু করে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে এলাকায় ঢােকে। এসব দল ও উপদলের নেতৃত্ব দেন মহিয়ার রহমান, দেলােয়ার হােসেন বুলবুল, জয়নাল আবেদীন ফজলুল হক, আনছারুল আলম ছানু, শহিদ গােলাম কিবরিয়া, তবিবুল ইসলাম, শাহজান সরকার, শাহজান আলী বুলবুল প্রমুখ। এরা ডােমার, ডিমলা ও জলঢাকা এলাকার বিভিন্ন জায়গায় লড়াই করে। এ লড়াই চলাকালে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে গােপনে শহরের খবরাখবর পৌছে দিত রিকশাওয়ালা শামু ও আকবর।
ডিমলার টুনিরহাট এলাকায় সেপ্টেম্বর মাসে পাক সেনাদের একটি ক্যাম্পে আক্রমণ করতে গিয়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন ১৩ জন মুক্তিযােদ্ধা। এদের মধ্যে কেবল আমজাদ হােসেনের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয় এবং সেখানে পশ্চিম সাতনাই গ্রামে তাকে
চার ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী মংলা থেকে গানবােট নিয়ে ডেমারপুল হয়ে বাগেরহাট শহরে প্রবেশ করে। পথে হানাদার পাকসেনাদের সামনে যারা পড়েছে তাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে।
পচাদীঘির পারে বাংকারে লুকিয়ে থাকা একজন মুক্তিযােদ্ধ! ৩০৩ রাইফল দিয়ে হানাদারদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বাগেরহাট শহরে হানাদারদের প্রবশের আগেই মুক্তিযােদ্ধারা নাগেরবাড়ী থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। মেজর জলিল, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমানসহ অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধা এর কয়েকদিন আগেই বাগেরহাট শহর ত্যাগ করে। পাকসেনারা শহরে অগ্নিসংযােগ আর হত্যার মধ্য দিয়ে এক বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করে। মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতৃবন্দ হানাদার পাকসেনাদের শহরে স্বাগত জানায় এবং বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহে অগ্নিসংযােগ এবং লুটতরাজে সহায়তা করে।
দীর্ঘ ৮ মাস বাগেরহাট শহরে চলে হানাদার পাকসেন, পঞ্জাৰী পুলিশ, রাজাকার, আল-বদর, জামায়াত আর মুসলিম লীগের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোেগ আর প্রতিদিন ডাকবাংলাের ঘাটে, বাগেরহাট ক্লাবে মুক্তিবাহিনীর নামে ধরে আনা হতাে গ্রামের সাধারণ মানুষদের। কখনাে গুলি এবং কখনাে জবাই করে হত্যা করা হতো এসব হতভাগ্যদের। আকিজদ্দীন, সিরাজ মাস্টার, মজিদ কসাই-এদের নামে আতঙ্কিত হতাে বাগেরহাটবাসী। জল্লাদ নামে খ্যাত সিরাজ মাষ্টার এবং আকিদ্দীন কান্দাপাড়া বাজারে রাস্তার ওপর একই পরিবারের পিতা-পুত্র ভাইসহ ১৮ জনকে জবাই করে। এই
ত্যাকান্ডের কথা আজো কান্দাপাড়ার মানুষ স্বরণ করে।
________________________________________
বাগেরহাটের মধ্যে মূলত শহীদ অধ্যাপক মােয়াজ্জাম হােসেন, শহীদ হাবিবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম খােকন, ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযােদ্ধারা পাকহানাদার এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদরদের সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা রাখেন।
পানি ঘাটের যুক্ত, দেবীর বাজারের যুদ্ধ, মুক্ষাইটের যুদ্ধ, মাধবকাঠির যুদ্ধ এবং বাগেরহাট থানা আক্রমণসহ তৎকালীন রাজাকার প্রধান রজ্জব আলী ফকিরকে হত্যার জন্য মুক্তিবাহিনীর অভিযান আজো ইতিহাস হয়ে আছে।
বাগেরহাটবাসীর মনে স্মরণীয় হয়ে আছে পানিঘাটের যুদ্ধ স্মরণীয় হয়ে আছে মাধবকাঠি এবং মৃন্দাইটের যুদ্ধ। এসব যুদ্ধে পাকসেনারা বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। মুক্ষাইটের যুদ্ধে ইসমাইল হােসেন হানাদারদের কাছ থেকে মেশিনগান কেড়ে রাখে । যুদ্ধে ৫ জন হানাদার নিহত হয়। দু’রাত একদিন ধরে যুদ্ধ চলে মাধবকাঠি গ্রামে রাজাকারদের এই অবস্থানে আঘাত হানতে মুক্তিযােদ্ধাদের চারটি দল অংশ নেয়। এর হলাে খােকন বাহিনী, চিতলমারীর শের আলী মােল্লার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা, তাজুল ইসলামের বাহিনী ও শামসু বাহিনী। শের আলী মােল্লার নেতৃত্বে চিতলমারী থানার গােটা এলাকা ৮ মাস মুক্তিবাহিনীরা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলাে । | “আমি বুড়াে মানুষ-গলাটা এগিয়ে দে তােরও মরতে কষ্ট হবে না, আমারও কষ্ট হবে।
“-স্বাধীনতাযুদ্ধের সেই দিনগুলােতে পাক হানাদারদের দোসর মুক্তিযুদ্ধবিরােধী জল্লাদ আকিজদ্দীর এই কথাগুলাে আজো গেরহাটের সবাইকে স্বরণ করিয়ে দেয় একাত্তরের ভয়াবহতা। | বাগেরহাটের রাজাকার প্রধান রজ্জব আলী ফকিরের জল্লাদ বাহিনীর মধ্যে সিরাও মাষ্টার, আকিজদ্দীন এবং মজিদ কসাইয়ের মধ্যে আকিদ্দীন ছিল সবচেয়ে বৃদ্ধ । স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এই তিন প্লাদ গ্রাম থেকে ধরে আনা যুবকদের গলা কেটে জবাই করে হত্যা করতো। পরে সাধারণ ক্ষমায় তিনজনই বেরিয়ে আসে জেলখানা হতে ।
পচি

পাচ একাত্তরের ৬ জুলাই ১১ নম্বর সেক্টরের নাজমুল কোম্পানি শেরপুর অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর ধ্বংসলীলা প্রতিহত এবং সীমান্ত এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে কাটাখালী ব্রীজ ও তিনআনী ফেরি’ অপারেশন করে ।
১১ নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন নাজমুল আহসান। জুনের শেষদিকে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়কদের এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শেরপুর হতে ঝিনাইগাতি, নালিতাবাড়ী এবং সীমান্ত সড়ক যােগাযােগ রক্ষাকারী কাটাখ্যলী ব্রীজ ও তিনআনী ফেরি ধ্বংসের দায়িত্ব অর্পিত হলো কোম্পানি কমান্ডার নাজমুল আহসানের নেতৃত্বে ১ নং কোম্পানির ওপর।
________________________________________
৪ জুলাই বেলা দেড়টা, ডালু ক্যাম্পের কমান্ডার নাজমুলের বাঁশির বেজে ওঠ। যুৎতে সকলে সারিবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করে নির্দেশ শােনার জন্য। দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বললেন, এই মুহুর্তে যারা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তারা অন লাইনে দাঁড়াও’। মাষ্টার জিয়াউল হক, মাষ্টার আবু সাঈদ, আবদুর রহমান, আব্দুল হালিম উকিল, মােস্তাফিজুর রহমান মুকুল, লিয়াকত, মােজাফফর, মােফাজ্জল, আলী হােসেন, রজব আলী, ওয়াহাবসহ বিশ জন মুক্তিযােদ্ধা আলাদা দাঁড়ালেন। তাদের কর্মসূচী অবহিত করে ১০ মিনিটে প্রস্তুতির নির্দেশ দেন। এরই মাঝে আঃ গণিসহ হালুয়াঘাটের আরও ৩৩ জন মুক্তিযােদ্ধা নাজমুলের অপারেশন টীমে অংশ নেন।
৫৪ জন মুক্তিসেনা পরিকল্পনা অনুসারে ডাল ক্যাম্প হতে যাত্রা শুরু করে। ৫ জুলাই অধিনায়ক নাজমূল দলটি ভাগ করে গণির নেতৃত্বে ৩৩ জনকে তিনআনী ফেরি ধ্বংসের কাকে পাঠিয়ে নি৮ে ২০ কে সঙ্গে নিয়ে কাটাখল। ব্রঙ ধ্বংসে লক্ষ্যে নৌকাযােগে অগ্রসর হন
ব্র প্রহরায় দু’টি সেট্রিপােষ্টে নিয়ােজিত রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ্য করে নাজমুল পলকে দুভাগ করে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে ব্রীজ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার নির্দেশ দেন উভয় পক্ষে শুরু হয় ব্যাপক গুলিবিনিময়। পিছু হটতে থাকে রাজাকাররা। এমন সময় নাজমুল কয়েকজন যােদ্ধা সাথী নিয়ে ব্রীজের নীচে এক্সপ্লোসিত স্থাপন করে সকলের নিরাপদ অবস্থান লক্ষ্য করে ডেটোনেটরে আগুন ধরালেন। ঠিক সেই মুহূর্তে শুনাগেল তিনখানী রি রংসের আওয়াজ। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকসেনাদের জীগ ছুটে যাচ্ছে তিনআনীর দিকে ঠিক এই সময় বিকট শব্দে ভেঙ্গে পড়ল কাটাখালী ব্রী। তখন রাত পােহাতে অল্পকি। সূর্য উঠার আগেই গাঢাকা দিতে হবে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দুটি দলই উপস্থিত হলাে রাঙ্গামাটি গ্রামের কৃষক নঈমুদ্দিনের বাড়িতে।
৬ জুলাই একই গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার জালাল মিৰি আত্মগােপনকারীদের অবস্থান টের পেয়ে নিকটস্থ পাকসেনা ক্যাশে খবর দেয়। কিছুক্ষণ পরেই হানাদার বাহিনী তিন দিক থকে বাড়িটি ঘিরে ফেলে। পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকায় অধিনায়ক সকলকে প্রস্তুত হয়ে বিল সাঁতরিয়ে শত্রুপক্ষের রেঞ্জের বাহিরে পৌছার নির্দেশ দেন। | সেই মুহুর্তে উভয় পক্ষে শুরু হােল গুলিবর্ষণ | সহযােদ্ধাদের সাহস যুগিয়ে চলেন অধিনায়ক নাজমুল একটি গুলি লাগল মাষ্টার আবু সাঈদের বাম হাতে। আরও একটি লাগল জব্বার মাষ্টারের মাথায়। মাস্টার জিয়াউল হককে আহত সাঈদ মাষ্টারের সহযােগিতার নির্দেশ দিয়ে নাজমুল কোমরের গামছা খুলে বেঁধে দিলেন সহযােদ্ধার গুলিবিদ্ধ মাথা । তারপর পুনরায় অভয়বাণী উচ্চারণ শেষ না হতেই শত্রুপক্ষের এলএমজি’র এক ঝাঁক বুলেট ঝাঝরা করে দিল নাজমুলের বুক। নাজমুলের মৃতদেহ উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এসে নিহত হন চাচাত ভাই মােফাজ্জল। গুলিবিদ্ধ হয়ে হারিয়ে গে সর্বকনিষ্ঠ নাজমুলের ভ্রাতুপুত্র আলী হােসেন।
________________________________________
পাকবাহিনী বগুড়া শহরে ঢুকে ২৩ এপ্রিল। আকাশে কয়েকবার পাক জঙ্গী বিমান উড়ে এসে চর দেবার পরপরই সংগ্রামী জনতা প্রতিরােধ অবস্থান থেকে চলে যেতে শুরু করে। এরপর শহরতলি মুরাইলে বিমান হামলার পর বগুড়ার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পাকবাহিনীর হাতে পুরােপুরিভাবে। শহরের আশেপাশের গ্রামগুলাে থেকেও মানুষ প্রাণভরে পালিয়ে যেতে শুরু করে নিরাপদ দূরত্বে।
সশ্রাম কমিটির সদস্যরা রাস্তার উপর যে ব্যরিকেড সৃষ্টি করে পাকবাহিনী তা সরিয়ে শহরে প্রবেশ করে। স্বাধীনতাবিরােধী শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে পাকবাহিনী জনমানবশূন্য শহরের বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট চালায়। আগুন লাগাতে শুরু করে দোকানপাট ঘরবাড়িতে। | ৬ ডিসেম্বর রাজাকার মতিউর রহমান, জাবেদ আলী ও ওসমান মওলানার প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় একদল পাকবাহিনী,ঘিরে ফেলে রামশহরের একটি পাড়া। মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগী বলে গুলি করে মারা হলাে আপন ৩ ভাই মােঃ আব্দুস সালাম, মােঃ বেলায়েত হােসেন ও খলিলুর রহমানকে। এদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য মােঃ জাহেদুর রহমান, দবির উদ্দিন, মােঃ আজগর আলী, মােহন্দ্রদ হাবিবুর রহমান, মােঃ মজিবর রহমান, মােঃ বুলু মিয়া, মােঃ হায়দার আলী ও মাঃ মােকসেদ আলীকেও একইভাবে গুলি করে মারা হলাে। সদর থানার রামশহরে এদের কবরগুলাে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে স্মৃতি। | রাজাকার চান, লাল ও তােতা একদল পাকবাহিনীকে নিয়ে নান্দিয়ার পাড়ায় গিয়ে লুট করে নেয় ঘরবাড়ি, ধর্ষণ করে মধ্যবয়সী দুই মহিলাকে প্রকাশ্যেই । ঘটনার পর মুক্তিযােদ্ধারা ঐ ৩ জন রাজাকারের বাড়ী ঘর আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পালিয়ে যায় রাজাকার চান, লাল ও তােতা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে। | ১ এপ্রিল একদল মুক্তিযােদ্ধা অতর্কিতে ঘিরে ফেললাে আড়িয়া বাজারে অবস্থিত পাকবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি। বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলির পর পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ আটক করা হয় ৮ জনকে। আটকের পর এদের আনার সময় বাংকার থেকে গুলি করে লুকিয়ে থাকা একজন পাক সেনা। গুলিতে মারা যায় মুক্তিযােদ্ধা মাসুদ। | সেপ্টেম্বরে তৎকালীন বগুড়ার খানপুরে (বর্তমানে জয়পুরহাট) পাকবাহিনী ১৪ জন মুক্তিযােদ্ধাকে আটক করে। তাদের কয়েকদিন দৈহিক নির্যাতনের পর হত্যা করে একটি বটগাছে ঝুলিয়ে রাখে। এই ঘটনার কিছুদিন পরেই হিলি সীমান্তেই সম্মুখযুদ্ধে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সদস্য মারা যায়। কিছুদিন পর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধারা পুনরায় হিলি সীমান্তে পাকবাহিনীর ঐ শক্ত ঘাঁটির উপর সাঁড়াশি হামলা চালিয়ে ঘাটি দখল করে। ঐ ঘাঁটির পতন হবার পর বগুড়ায় অবস্থানকারী পাকবাহিনীর সদস্যরা মনােবল হারাতে শুরু করে। পাকবাহিনীর একটি বড় অংশ পিছু হটে বগুড়ার দিকে চলে যায়।
________________________________________
১০ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধারা একযােগে মহাস্থান গড় এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। প্রায় দু’দিন যুদ্ধ চলার পর পাকবাহিনী পিছু হটতে শুরু করে। পাকবাহিনীর এ শক্ত ঘাঁটির পতন ঘটাতে মিত্রবাহিনীকে কয়েক দফা বিমান হামলা চালাতে হয়েছে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর ভাগ হয়ে যাওয়া দুটি অংশ এরপর জেলার পূর্বাংশ ও দক্ষিণাংশ দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে। বগুড়া শহর ঘিরে ফেলা হয় উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে। | ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৬ তারিখে বগুড়া মুক্ত হওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাদলা, রমেশ্বরপুর, মহাস্থানসহ বিভিন্ন এলাকায় খন্ড খন্ড যুদ্ধ হয়েছে অনেক। ১৪ ডিসেম্বর শহরতলির বনানীতে দীর্ঘস্থায়ী এক যুদ্ধে পাকবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য মারা যায় । এই যুদ্ধে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর ৩ জন মারা যায়। | ১৫ ডিসেম্বর সকাল থেকেই পাকবাহিনীর পিছু হটে আসা সদস্যরা একত্রিত হতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর থেকেই মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। সন্ধ্যার আগেই পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড পার্কে সমবেত হতে থাকে। অস্ত্র জমা করা হয় জেলা স্কুল মাঠে। আত্মসমর্পণ করা পাকবাহিনীর সদস্যদের মােহাম্মদ আলী হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থানে রাখা
সাত ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করেছে এই খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গা ইপিআর ক্যাম্পের হাবিলদার মেজর মজিবর রহমান কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশের অপেক্ষা না করেই চুয়াডাঙ্গাস্থ উইং হেড কোয়াটারের সমস্ত অবাঙ্গালী সেনাদের কৌশলে আটক করেন এবং অস্ত্রাগার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনেন। | ২৬ মার্চ ভােরে কুষ্টিয়া থেকে চুয়াডাঙ্গায় এসে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথ পরামর্শ করে ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলার পতাকা তােলেন এবং বাঙ্গালী সেনাদের পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ গ্রহণের শপথ নেন। ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গায় তিনি পশ্চিম কমান্ড নামে একটি কমিটি গঠন করেন ও সকল আনসার,মােজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবকদের একত্রিত হতে নির্দেশ দেন। ২৭ মার্চ অবাঙ্গালী ক্যাপ্টেন সাদেক চুয়াডাঙ্গা ইপিআর উইং-এর আওতাধীন মাসলিয়া বিওপিতে গিয়ে বাঙ্গালী সেনাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে দু’পক্ষের গুলি বিনিময় হয়। কিন্তু বাঙ্গালী সেনাদের সঙ্গে পেরে না উঠ পাকসেনারা পিছু হটতে শুরু করে। এদিকে যাদবপুর বিওপি’র বাঙ্গালী সেনারা পাকিস্তানী সেনাদের গতিরােধ করেন। ফলে দু’পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সাদেক নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধা সিপাই আশরাফ শহীদ হন। এটিই হচ্ছে চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ।
________________________________________
এরপরে চুয়াডাঙ্গা থেকে পরিচালিত ‘দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের সাথে ৩০ মার্চ কুষ্টিয়া মুক্তি এবং বিষয়খালী যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিপুল বিজয় অর্জিত হয়। মার্চের ৭ তারিখ থেকে শুরু করে পাকবাহিনীর প্রবেশের পূর্বদিন পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটি জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই সময় পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুক্তিসেনাদের খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব পালনসহ অন্ত্র সংগ্রহ ও বহির্বিশ্বের সাথে যােগাযােগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সংগ্রাম কমিটি। কিন্তু পাকবাহিনী যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিমান বাহিনীর সহায়তায় ঝিনাইদহ হয়ে চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে আধুনিক অস্ত্রের অভাবে মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
৩ এপ্রিল থেকে চুয়াডাঙ্গা শহরের উপর যে বিমান হামলা শুরু হয়েছিল তা ১৬ এপ্রিল তীব্রতর করে ঝিনাইদহ হয়ে পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশের সময় যাদেরকে দেখতে পায় তাদেরই গুলি করে হত্যা করে। তারা শরৎগঞ্জ বাজারে নিরীহ মানুষদের উপর নির্বিচারে গুলি করে ৭০/৮০ জনকে হত্যা করে। ডিগেদহ বাজারে তাদের গুলিতে একই দিনে ৩০ জন মারা যায়।
বিমান হামলা সম্পর্কে ১৬ এপ্রিলের “টাইমস অব ইন্ডিয়া” পত্রিকায় বলা হয়েছে “ঐদিন সকাল সাড়ে ৯টায় আধঘন্টা ধরে স্যার জেট চুয়াডাঙ্গা শহরের উপর বােমা ফেলে। কমপক্ষে ২০টি নাপাম বােমা বর্ষণ কল্প হয়। ফলে বেসামরিক বনাদি, ঘরবাড়ি, কুল, ব্যাংক, নতুন তৈরি হাসপাতাল, আওয়ামী লীগ অফিস প্রভৃতি ধূলিসাৎ হয়ে যায় । জেট থেকে ক্রমাগত গুলি ছোেড়া হয়। তাতে কমপক্ষে ১৫০ জন অসামরিক লােক প্রাণ হারায়।” পাকবাহিনী চুয়াডাঙ্গা প্রবেশের সময় চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কের পার্শ্বের প্রায় সকল বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, যুবতী মেয়েদের ধরে নেয়। শুধুমাত্র ১৫ ও ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ সড়কের দশমাইল, শরৎগঞ্জ, ডিঙ্গেদহ ও চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রায় ২ শতাধিক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। তারা চুয়াডাঙ্গা শহরের প্রায় ৫০ ভাগ ঘর-বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং দোকানপাট লুট করে। তাদের এই কুকর্মে সহায়তা করে স্থানীয় বিহারীরাসহ জামাত ও মুসলিম লীগের লােকেরা।
পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গায় প্রবেশ করলে এখানকার ছাত্র ফুকরা দ্রুত ভারত চলে যায় এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। চুয়াডাঙ্গ সদর থানা, আলমডাঙ্গা, দামুড়হুদা, জীবন নগর থানা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে অত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। প্রশিক্ষণ শেষে তারা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং গেরিলা হামলাসহ সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করে। এর মধ্যে দামুড়হুদা থানা আক্রমণ, গাংনী থানা আক্রমণ, নাটাদহের সম্মুখ যুদ্ধ, আলমডাঙ্গা, হেমায়েতপুর, মধুখালী, ধােপাখালি, বলদিয়া, অনন্তপুর, চাঁদপুর, খাসকওড়া, শৈলকুপা, কালুপােল, খেজুরতলা, শিয়েলমারী, নীলমনিগঞ্জ, পার্বতিপুর, নাগদা, পাইকপাড়া, গােকুলখালী, জীবননগর যুদ্ধ অন্যতম।
নভেম্বর থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পাক বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা গ্রামাঞ্চলে যেয়ে বাড়ি-ঘরে আগুন লাগানাে, লুট করাসহ জামাতে ইসলাম ও
________________________________________
মুসলিম লীগের দালালদের সাহায্যে মা-বােনদের উপর যে অত্যাচার শুরু করেছিল তার ফলে মুক্তিযোেদ্ধাদরে আক্রমণ আরও তীব্রতর হয়। সে কারণে পাকবাহিনী গ্রামাঞ্চলের কর্তৃত্ব ছেড়ে শহরে এসে অবস্থান নিতে শুরু করে।.২৬ নভেম্বর জীবননগর সদর থেকে পাকবাহিনী পিছু হটলে জীবননগর ও দর্শনায় বেসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা সদর বাদে সমগ্র জেলায় কর্তৃত্বভার গ্রহণ করে। ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পাকবাহিনী মাথাভাঙ্গার ব্রীজের একাংশ ভেঙ্গে দিয়ে ৭ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার দিকে রওনা হলে সমগ্র চুয়াডাঙ্গা সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে পড়ে। ১১ ডিসেম্বর থেকে এখানে বেসামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়।
গণহত্যাকারী পাকবাহিনীর কবল থেকে চুয়াডাঙ্গা মুক্ত হলে মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের বাঁধভাঙ্গা আনন্দ ম্লান হয়ে যায়-শহরের প্রায় চারপাশে অসংখ্য গণকবরের সন্ধান পাবার পর। ঐসব গণকবরে হাজার হাজার মানুষের মৃতদেহ, মা-বােনদের ছিন্ন শাড়ি মানুষের আনন্দকে ম্লান কর দেয়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাক-বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের সংবাদে চুয়াডাঙ্গার মানুষ জয় বাংলা’ শ্লোগানে চারদিক মুখরিত করে ফেলে। | ২৬ মার্চ হতে চুয়াডাঙ্গায় দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের প্রধান দপ্তর কাজ শুরু করে। তাছাড়া চুয়াডাঙ্গা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী হওয়ায় এই শহরকে নিরাপদ রাখা জরুরী হয়ে পড়ে। ফলে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী সংগ্রাম কমিটির নেতা দক্ষিণ-পশ্চিম কমান্ডের প্রধান উপদেষ্টা ডাঃ আসহাব -উল-হক ও এডভােকেট ইউনুস আলীর সাথে পরামর্শক্রমে কুষ্টিয়া শহর আক্রমণের পরিকল্পনা নেন। কুষ্টিয়া শহর তখন পাকসেনাদের দখলে। সে কারণে কুষ্টিয়া পুনর্দখল করা জরুরী ছিল। ২৯ মার্চ মুক্তিযােদ্ধারা ভাের ৪টায় কুষ্টিয়া আক্রমণে পরিকল্পনা নিয়ে ২৮ মার্চ সকলেই বিভিন্ন পথ দিয়ে কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিসেনা চুয়াডাঙ্গা-পােড়াদাহ কাঁচা রাস্তা দিয়ে কুষ্টিয়ার নিকটবর্তী পােড়াদহে অবস্থান নেয়। সুবেদার মুজাফফরের নেতৃত্বে অপর একটি দল কুষ্টিয়া সার্কিট হাউজের খুব কাছাকাছি অবস্থান করে নির্ধারিত সময়ে আক্রমণ করবে-এমন পরিকল্পনা থাকলেও তিনি দল নিয়ে যথাসময়ে পৌছতে না পারায় আক্রমণের সময় ২৪ ঘন্টা পিছিয়ে ৩০মার্চ ডােরে নির্ধারিত হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ মার্চ ভাের ৪টায় তিনদিক থেকে কুষ্টিয়া আক্রমণ করা হয়। আক্রমণের সময় পূর্ব পরিকল্পনা মােতাবেক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও গ্রামের জনসাধাণ “জয় বাংলা” ধ্বনি দিতে থাকে এবং টিন বাজাতে থাকে। এতে পাকসেনারা মনে করে হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা শ্লোগান দিচ্ছে। ফলে তাদের মনােবল ভেঙ্গে যায় ও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রায় এক ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর পাকসেনারা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালাতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা পুলিশ লাইন ও অয়ার্লেস কেন্দ্রের ভিতরে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের খতম করে। পালাবার সময় অনেক সৈন্য নিহত হয়। এই যুদ্ধের পর
________________________________________
কুষ্টিয়া শহরের মধ্যে শুধুমাত্র পাকসেনাদর সদর দপ্তর তাদের দখলে থাকে। এরপর মুক্তিযােদ্ধারা পাকসেনাদের সদর দপ্তর ঘিরে ফেলে এবং একই ভাবে “জয় বাংলা” ধ্বনি অব্যাহত রাখে। ৩১ মার্চ ভােরে গুলি বিনিময়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে পাক সেনারা প্রাণ বাঁচাতে জীপ ও গাড়িতে করে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে তীব্র গতিতে ঝিনাইদহের দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু গাড়াগঞ্জ পুলের কাছে গর্ত খুড়ে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা ফাঁদে পড়ে মেজর সােয়েবসহ বহু পাকসেনার মৃত্যু হয়।
| আট
১৬ এপ্রিল পাকহানাদার বাহিনী তিন দিক থেকে ঝিনাইদহের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। ঝিনাইদহ-যশোের সড়কের বিষয়খালিতে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। কিন্তু হানাদার বাহিনীর ভারী অস্ত্র ও কামানের গােলার মুখে অল্পক্ষণের মধ্যেই সে প্রতিরােধব্যুহ ভেঙ্গে পড়ে। বেলা ১১টার দিকে ঝিনাইদহ থেকে একদল স্বেচ্ছাসেবক তরুণকে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যের জন্য বিষয়খালিতে পাঠানাে হয়। বিষয়খালির পথে চতুলিয়ার মােড়ে স্বেচ্ছাসেবকদের দু’টি ট্রাকই হানাদার বাহিনীর সামনে পড়ে যায় এবং হানাদারদের নিক্ষিপ্ত গােলার আঘাতে ট্রাক দু’টি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় । ৩৯ জন স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে ৩০ জনই ঘটনাস্থলে নিহত হয়।
১২টার দিকে কামানের গােলা বর্ষণ করতে করতে হানাদার বাহিনী যশােরে প্রবেশ করে। হানাদারদের গােলার আঘাতে শহরের অসংখ্য দোকানপাট ও বাড়িঘর পুড়ে যায় । শহরে ঢুকেই হানাদাররা বাটার মােড় থেকে পােস্ট অফিসের মােড় পর্যন্ত দোকানপাট আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পাক হানাদার ও তাদের সহযােগী বিহারী এবং স্বাধীনতাবিরােধী জমাত, মুসলিম লীগ, পিডিপি ও সুযােগসন্ধানী লােকজনে ছেয়ে যায় সারা শহর। শুরু হয় অবাধ লুটপাট, অগ্নিসংযােগ ও হত্যাকান্ড। নিহত হন মহকুমা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আব্দুল গফুর, গােলাম মহীউদ্দিন, সাংবাদিক শেখ হাবিবুর রহমান, ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল মিয়া,রবীন্দ্রনাথ বসুসহ আরাে বেশ কয়েকজন। শহরের সাধারণ নরনারী ভয়ে শহর ছেড়ে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সরকারী বিদ্যালয়, পি,টি, আই ভকেশনাল ট্রেনিং স্কুল, পানি উন্নয়ন বিভাগ ও থানায় হানাদার বাহিনী তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৬ এপ্রিল সকালেই জেলার মহেশপুর, কোর্টচাদপুর ও কালীগঞ্জ থানা পতন ঘটে, দুপুরে ঝিনাইদহ এবং ঐদিন বিকেলের মধ্যেই জেলার অপর দুটো থানা হরিণাকুন্ডু ও শৈলকুপা হানাদারদের দখলে চলে যায়।
ঝিনাইদহের পতনের সাথে সাথে প্রতিরােধ সংগ্রামের প্রাথমিক পর্যায়ের অবসান ঘটে,শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের নবতর অধ্যায়। মুষুিদ্ধের নেতৃত্বদানকারী মহকুমা ও থানা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, মুজাহিদ ও আনসার বাহিনীর সদস্য, যারা প্রতিরােধ সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তারাও অন্ত্র ও রসদ সংগ্রহের আশায় ভারতে গমন করে। বিশ্ববিদ্যালয় ও
________________________________________
স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজার হাজার তরুণ জীবনকে বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয় এবং ট্রেনিং ও অন্ত্রের আশায় সীমান্ত পাড়ি দেয়। আবার কিছু বেপরােয়া অসীম সাহসী যুবক ভারতে না গিয়ে গ্রামাঞ্চলের দিকে সরে গিয়ে স্থানীয়ভাবে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তােলে এবং মাঝে-মধ্যে হানাদার সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসরদের উপর গেরিলা প্রক্রিয়ায় হামলা চালাতে থাকে। | এপ্রিল মাসের শেষভাগে মহকুমা ও থানা পর্যায়ে গঠিত হয় শান্তি কমিটি, মে মাসের প্রথম দিকে আলবদর এবং মে মাসের মাঝামাঝি গিয়ে গঠিত হয় রাজাকার বাহিনী। জামাত, মুসলিম লীগ ও পিডিবি’র সদস্যরা ছাড়াও যােগ দেয় সুযােগসন্ধানী কিছু লােক। এরা দেশের মধ্যে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ ও ন্যাপসহ স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি ও মুক্তিযােদ্ধাদরে খুঁজতে থাকে, ব্যাপকভাবে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও নারী ধর্ষণে লিপ্ত হয়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর চরম আঘাত আসে। গ্রামের পর গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। সম্পদ লুষ্ঠিত হয় বিভিন্নস্থানে নারী ধর্ষণের মত দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। মেয়েদের বিভিন্ন স্থান থেকে রাজাকারদের সহায়তায় ধরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতনের পর নির্মমভাবে হত্যা করে গর্তে পুতে রাখে।
মে, জুন, জুলুই-তিন মাস লড়াইয়ের কিছুটা ভাটা পড়ে, মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণও অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। ভারতে ও দেশের ভেতরে স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গােলাম মােস্তফা, দবীর উদ্দিন জোয়ৰ্দ্দার, বকুল, বছির, রহমত আলী মন্ট, বিশারত,মশিউর, আলম, সােনা মােল্যা প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধার নেতৃত্বে মাঝে মধ্যে ঝিনাইদহ, কোর্টচাঁদপুর, কালীগঞ্জ ও শৈলকুপা এলাকায় গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে হানাদার সেনা ও তাদের সহযােগী আলবদর – রাজাকারদের ব্ৰিত রাখে।
আগষ্টের মাঝামাঝি থেকে জেলার সর্বত্র মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ভারতে এবং স্থানীয়ভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত কয়েক সহস্রাধিক তরুণ অসীম সাহস ও বুদ্ধিবলে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে হানাদার সেনা ও তাদের সহযােগী রাজাকার-আলবদরদের ধ্বংস করতে থাকে। এ সময় হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য গেরিলাযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
আলফাপুরের যুদ্ধঃ শৈলকুপা থানা সদর থেকে ১১/১২ মাইল পূর্বে আবাইপুর গ্রামের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাটি ছিল। ২৯ আগষ্ট খবর আসে মাগুরা থেকে শ্রীপুর হয়ে এবং ঝিনাইদহ থকে শৈলকুপা হয়ে হানাদার বাহিনী আসছে। তাড়াহুড়া করে মুক্তিযােদ্ধারা নদী পার হয়ে আলফাপুরে ওয়াপদা ড্রেনেজ ক্যানেলের মাথায় পরিখা খনন করে যুদ্ধের জন্য অবস্থান নেয়। ঝিনাইদহ থেকে আসা হানাদার সেনা ও তাদের সহযােগীরা ভাের রাতে আবাইপুর পৌছে। ঘাটিতে মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আবাইপুর ও পার্শ্ববর্তী মীগ্রামের বাড়িঘরে আগুন লাগায়, বেপরােয়া লুটতরাজ করে। ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামবাসী যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। ৩০ আগষ্ট ১২ টার দিকে হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযােগী আলবদরু-রাজাকাররা নদী পার হয়ে ড্রেনেজ ক্যানেল
________________________________________
ধরে এগিয়ে যাওয়ার সময় ক্যানেলের অপর পাড়ে পরিখার মধ্যে অবস্থান নেয়া মুক্তিযােদ্ধারা একযােগে তাদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রথম আঘাতেই রাজাকার-আলবদরুসহ শতাধিক হানাদার সেনা নিহত হয়। অতর্কিত আক্রমণে হতবিহ্বল হানাদার সেনারা দ্রুত পিছু হটে অবস্থান নেয় এবং পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে শৈলকুপা সদর থেকে আরও হানাদার সেনা গিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। যুদ্ধ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হানাদার সেনারা হেভি মেশিনগান ও মর্টার ব্যবহার করে। তবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় মুক্তিযযাদ্ধারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে নদী পার হয়ে নৌকাযােগে ফরিদপুরের কলিমােহরে আশ্রয় নেয়। বেশি কিছু অন্ত, হেলমেট, আমি কার্ড মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে আসে। মুক্তিযোেদ্ধা রহমত আলী মন্টুর নেতৃত্বে আলফাপুরের যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকজন হলেনঃ ওস্তাদ বিশারত আলী, দবীর উদ্দিন জোয়ার্দার, কামরুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম চাঁদ, আব্দুল করিম, আব্দুস সাত্তার, সাজেদুর রহমান, ফরিদ রেজা, শমসের, বারিক, কওছার, আলম, সূর্য , রান্ন, প্রমুখ।
শৈলকুপা থানা সদর থেকে ১৪ মাইল পূর্বে আবাইপুরের কুমিড়াদহ গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন ঘাঁটিতে দেড় শ’ মুক্তিযোেদ্ধা ছিল। ১৩ অক্টোবর দুপুরের দিকে খবর আসে হানাদার সেনারা শ্রীপুর থানার খামারপাড়ায় বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে, লুটতরাজ করছে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হল প্রতিরােধের। শ্রীপুর-শৈলকুপা সড়কের পাশে.পরিখা খনন করে তিনটি দলে ভাগ হয়ে অবস্থান নেয় শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা। এয়ারম্যান মজিবর রহমানের নেতৃত্বে তিনটি দলের কমান্ডার ছিলেন শহীদ নজরুল, মনােয়ার হােসেন ও গােলাম রইস। বিকেল থেকে ভােররাত পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা এ্যামবুস করে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের খবর পৌছে যায় হানাদার সেনাদের কাছে। রাতের অন্ধকারে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের ঘিরে ফেলে তিনদিক থেকে সার্চ লাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ শুরু করে। অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযযাদ্ধারা অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে সারারাত ধরে যুদ্ধ করে। নজরুল, আলিমুদ্দিন, ইয়ারুদ্দিন, ইউসুফ, ইমারত, আবুল হােসেন, আবু তালেব, দিদার হােসেন, মধুশেখ, আবু জাফর শহীদুল, সুফিয়ান ও তলে জর্দারসহ ৪১ জন মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের সহযােগী এ যুদ্ধে নিহত হয়। হানাদার বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট মারা যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল তার মধ্যে সােনা মােল্যা, ওস্তাদ বিশারত, আব্দুল হাই, আবুল কাসেম, মজনু, লাডুডু রওশন, হায়দার, আবুল, দবীর উদ্দিন জোয়ার্দার ও প্রফেসর আহম্মদ আলীর নাম উল্লেখযােগ্য।
অক্টোবর মাসের শেষদিকে আলমডাঙ্গা শংকরদি গ্রামের মাঠের মধ্যে হানদার সেনাদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের এক সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ৬/৭ ঘন্টা স্থায়ী এ যুদ্ধে ২০/২৫ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযোেদ্ধা সদরউদ্দিনসহ ১০/১৫ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন সুবেদার হায়দার ও মুক্তিযােদ্ধা মশিউর রহমান।
________________________________________
এক্সপ্লোসিভ দিয়ে কুমার নদের উপর শৈলকুপার কুমার ব্রীজের একাংশ মুক্তিযােদ্ধারা উড়িয়ে দেয়। পাহারারত হানাদার সৈন্য বেষ্টিত কুমারব্রীজ ধ্বংসের কাজে অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেন মুক্তিযােদ্ধা কাজী আশরাফুল আলম ও মশিউর রহমান।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকেই ঝিনাইদহে গেরিলাযুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে পর্যদস্ত হয়ে হানাদার সৈন্যও তাদের সহযােগীরা গ্রাম ছেড়ে শহর এলাকায় গুটিয়ে আসতে থাকে। এদিকে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ডিসেম্বর মাসের ৪ তারিখে জেলার সীমান্ত থানা মহেশপুরসহ কোটচাঁদপুর ও কালীগঞ্জ থানা মিত্র বাহিনীর দখলে আসে। ঐদিন রাতেই হাবিলদার আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ৭০ জন মুক্তিযােদ্ধা হরিনাকুন্ডু থানা আক্রমণ করে এবং মাত্র আধঘন্টা যুদ্ধের পরই থানা মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ঝিনাইদহে পৌছে। ঝিনাইদহ শহরের পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে হানাদার বাহিনীর দুটো প্রতিরােধব্যুহ ছিল। বাড়িবাথান থেকে কোড়াড়া হয়ে গয়েশপুর পর্যন্ত ১ কিলােমিটার এলাকা জুড়ে প্রথম প্রতিরােধব্যুহ এবং ঝিনাইদহ-যশাের সড়কের পুলিশ লাইন থেকে চুয়াডাঙ্গা সড়কের আনসার ক্যাম্প পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রতিরােধব্যুহ।
প্রথম প্রতিরােধব্যুহ থেকে প্রায় ১ কিলােমিটার পশ্চিমে গােয়ালবাড়ি গ্রামে অর্ধ শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা আগে থেকে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল, এর ঠিক পেছনেই ছিল মিত্রবাহিনী । ৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর ট্যাংকবহর পাগলাকানাই সড়কের বালিয়াকান্দা ব্রীজ পার হতে গেলে হানাদার বাহিনীর ট্যাংক বিধ্বংসী কামানের গােলার আঘাতে দু’টি ট্যাংক সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হয় দেড় শতাধিক ভারতীয় মিত্রসেনা। দুপুরের দিকে বিমান বাহিনীর কভারিং-এ থেকে পবহাটি ও উদয়পুরের মাঠ বিমান থেকে প্যারাস্যুটের সাহায্যে মিত্র সেনা নামানাে হয়। বিমান থেকে এ সময় দুটো বােমা ফেলা হয় এবং দুর্ভাগ্যক্রমে দুটি বােমাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মিত্র বাহিনীর তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী পিছু হটে শৈলকুপা ও মাগুরার দিকে পালিয়ে যায়। ঝিনাইদহ মিত্রবাহিনীর দখলে আসে।
| ঝিনাইদহ শহরের পতনের পরদিন ৭ ডিসেম্বর সকাল থেকেই দলে দলে মুক্তিযােদ্ধারা শৈলকুপায় সমবেত হতে থাকে। তারা ৪টি দলে ভাগ হয়ে থানার চারপাশে অবস্থান নেয় । দক্ষিণে করিপুর এলাকায় অবস্থান নেয় আবু মােহাম্মদ, সােনা মােল্যা ও গােলাম মােস্তফার দল, পূর্বে খালকুল এলাকায় রহমত আলী মন্টু, উত্তরে বিশারত ওস্তাদ ও জোহার দল এবং পশ্চিমে অবস্থান নেয় আশরাফুল আলম ও দবিরউদ্দিন জোয়ার্দ্দারের। দল। ৪টা থেকে শুরু হয় একযােগে আক্রমণ । একটানা ২৮ ঘন্ট যুদ্ধের পর ৮ ডিসেম্বর থানা মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। থানায় অবস্থানরত ক্যাপ্টেন জুবেরি রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যায়। বহু পাকসেনা রাজাকার-আলবদর মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়।
________________________________________
बन्न ২৩ এপ্রিল পাক সেনাদের বিরাট কনভয় বিনা বাধায় মাগুরা আসে। তারা শহরে প্রবেশ
করে পার্শ্ববর্তী পারনান্দুয়ালী গ্রামে মাগুরা-কামারখালী সড়কের ওপর অবস্থান নেয়। এখানে বাগবাড়িয়ার লালু পাগলা জয় বাংলা বলে এগিয়ে গেলে পাক সেনারা তাকে সাথে সাথে গুলিতে হত্যা করে। পরদিন শহরের বিভিন্ন স্থানে পাকসেনারা ক্যাম্প করে। বিকেলে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসজ্জিত গাড়ি ভর্তি পাকসেনা শহরের নতুন বাজার এলাকায় ব্যবসায়ী অবনী মােহন সাহা, পঞ্চানন সাহা ও সুধীর কুমার সাহার গুদামে অগ্নিসংযােগ করে। এপ্রিলের ২৪ তারিখ থেকে হানাদার বাহিনী মাগুরা শহরে পি,টি,আই, মাইক্রোওয়েভ সেন্টার, ভকেশনাল ইন্সটিটিউট, নিউকোর্ট বিল্ডিং, এস, ডি. ও ভবন প্রভৃতি স্থানে শক্তিশালী ক্যাম্প স্থাপন করে। এদের প্রধান অফিসার ওয়াপদা ডাক বাংলােয় অবস্থান নেয়। অতিদ্রুত গঠিত হয় শান্তি কমিটি, রাজাকার ও আলবদর বাহিনী। শহরের দন্ড বিল্ডিং ও গােন্ডেন ফার্মেসী থেকে শান্তি কমিটির কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। শহরে রাজাকারদের ক্যাম্প হয় থানার পাশে যজ্ঞেশ্বর রাম তারক দত্তের বিশাল দ্বিতল ভবনে, নােমানী ময়দানে, আনসার ক্যাম্পে, জেলা পরিষদ বাংলােয়। এছাড়া শহরের বাইরে মহম্মদপুর, শ্রীপুর, শালিখা থানার বিভিন্ন স্থানেও রাজাকার, রেঞ্জার পুলিশদের ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এদের সহযােগিতায় মাগুরার সর্বত্র নির্বিচারে হত্যা লুট অগ্নিসংযোেগ চলতে থাকে। | রাজাকার ক্যাম্পের নীচতলায় কয়েকটি কক্ষ এবং জেলা পরিষদ বাংলাে ছিল নির্যাতন কেন্দ্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ বা সহায়তার অপরাধে এখানে ধরে এনে নির্যাতন করা হত। পরে গভীর রাতে তাদের মাগুরা-কামাখালী সড়কের পারনান্দুয়ালী ক্যানালের ধারে নিয়ে গুলি করে খালের পানিতে ফেলে দিত। শহরের পি,টি,আই হিল পাক সেনাদের নির্যাতন কেন্দ্র। নির্যাতন ও হত্যার পর পি,টি,আই ভবনের পেছনে লাশ পুঁতে রাখতাে। | শ্রীপুর থানার শ্রীকোল ইউপি চেয়ারম্যান আকবর হােসেন মিয়া মাগুরা সংগ্রাম কমিটির কাছ থেকে পাওয়া ৭টি রাইফেল ১টি অয়ারলেস সেট নিয়ে শ্রীপুরে মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করতে থাকেন। অনেক যুবক, পুলিশ, ই,পি,আর তার সাথে যােগ দেন।
অনেক রাজাকার সশস্ত্র অবস্থায় স্বেচ্ছায় শ্রীপুর বাহিনী প্রধানের কাছে আত্মসমর্পন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে। মাগুরা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া জেলা পর্যন্ত শ্রীপুর বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা ছিল। এ সময় আকবর হােসেনের নেতৃত্বে শ্রীপুর বাহিনী ফরিদপুরের বালিয়াকান্দি থানা, ওয়ারলেস কেন্দ্র, রামদিয়া-সােনাপুর, মাগুরার বিনােদপুর, নােমানী আনছার ক্যাম্প, বরিশাট, মাশলিয়া, আলফাপুর, সরাইনগর ক্যানাল, শীগ্রাম মান্দারতলা, খামারপাড়া, নাকোল বাজার, ওয়াপদা সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে পাক সেনা, রেজার পুলিশ ও রাজাকারদের ওপর সফল হামলা, সম্মুখযুদ্ধে হতাহত করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। মণ্ডরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও রাজবাড়ীর পাক সেনারা এ বাহিনীর ভয়ে তটস্থ ছিল। শ্রীপুর বাহিনীর অন্যান্য যােদ্ধা ছিলেন মােল্লা নবুয়ত আলী,
________________________________________
সুজায়েত খােন্দকার, নাজায়েত আলী, কাজী ফয়জুর রহমান, নুরুল ইসলাম (কাজী), আঃ রহিম জোয়ার্দার নাকোলের আঃ আজিজ, কাশিয়ানির নানু মিয়া, হাবিলদার শাহজাহান, সার্জেন্ট কামরুজ্জামান, বেলনগরের আলম, টুপিপাড়ার সিরাজুল ইসলাম এডভােকেট, নাসিমুজ্জামান মিনু, আলিয়ার হাফিজ মাস্টার, মাইলের মাকু মিয়া, আমতৈলর শহীদ মুকুল, কমান্ডার আয়েনউদ্দিন,এনামুল কবির (বারশিয়া), আনারুদ্দিন (শ্রীকোল), সােনাতুন্দীর আনােয়ার হােসেন, আঃ ওয়াহাব (টুপিপাড়া) কমান্ডার নুরুল হুদা পন্টু (মাগুরা), সাইদুর রাব্বি (পাল্লা), ডেপুটি কমান্ডার আবু ইছাক (মাগুরা) এই বাহিনীর বিভিন্ন অস্থায়ী ক্যাম্পে ১ হাজারেরও বেশী মুক্তিযােদ্ধা ছিল।
ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মাগুরার মহম্মদপুরের নহাটা গ্রামের গােলাম ইয়াকুব দেশে ফিরে আসেন। সাথে ছিলেন ময়মনসিংহের অসীম সাহা, যশােরের দেলােয়ার ও গরীব হােসেন, শ্রীপুরের পরিতােষসহ ১০ জন মুক্তিযােদ্ধা। তাদের আয় ছিল ৭টি -রাশিয়ান এস, এল, আর, ১টি এস, এম,জি, ৩টি রাইফেল। নহাটা এসেই ইয়াকুব মিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন। এ পর্যায়ে একদিন নৌকাযােগে শ’খানেক পাকসেনা নহাটা বাজারে আসছে খবর পেয়ে বাজারের পার্শ্ববর্তী স্কুলের দোতলায় ও তহশীল অফিসে ইয়াকুব বাহিনী অবস্থান নেয়। নৌকা ছেড়ে পাক সেনারা রেঞ্জের মধ্য আসলে ইয়াকুৰ বাহিনী একবােগে ব্ৰাগৰ্কায়ার ক করে। ঘটনার আকস্মিকতায় পাক সেনারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। কিছু বুৰে উঠতে না উঠতেই ৩০/৩৫ জন পাক সেনা লুটিয়ে পড়ে। পাক সেনারা রাস্তার পাশেই পজিশন নিয়ে সারাদিন গুলি বিনিময় করে। সন্ধ্যায় ইয়াকুব বাহিনী নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। রাতে ৪০/৫০ জন পাক সেনা নিকটস্থ ইন্দুপুর গােরস্থানে আশ্রয় নেয়। খবর পেয়ে পরদিন ভােরে ইয়াকুব বাহিনী সেখানে হামলা করে কয়েকজন পাক সেনা খতম করে। পরবর্তীতে মহম্মদপুরের জয়রামপুর গ্রামে এই বাহিনী পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সারাদিন যুদ্ধ করে ৫১টি আগ্নেয়াস্ত্র হস্তগত এবং ২৭ জন পাক সেনা খতম করতে সক্ষম হয়। এখানে মুক্তিযােদ্ধা মহম্মদপুরের আমির হােসেন শহীদ হন। এ যুদ্ধে এডভোকেট আবুল খায়ের সৈয়দ আবু আসাদ টোকন, শওকত খান, জামালউদ্দিন, রফিকুল ইসলাম, দু’সহােদর আহসুদ ও মহম্মদ প্রমুখ জীবন বাজি রেখে বিশেষ সাহসিকতার পরিচয় দেন। ইয়াকুব বাহিনী পার্শ্ববর্তী ফরিদপুরের বােয়ালমারী, নড়াইলের লােহাগড়ার বিভিন্ন সেনাছাউনী ও রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ক্যাম্প ধ্বংস ও অন্ত্র গােলাবারুদ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়। | মাগুরার মহম্মদপুর টি,টি,ডি,সি ভবনে দুশরও বেশি রাজাকার ও রেঞ্জার পুলিশ ছিল। গােলাম ইয়াকুব, কমল সিদ্দিকী, এডভােকেট আবুল খায়ের এবং নুর মােস্তফার নেতৃত্বাধীন পৃথক ৪টি মুক্তিবাহিনী গ্রুপ উক্ত ভবনে যৌথ হামলার পরিকল্পনা করে। একদিন শেষ রাতে চারদিক থেকে একযােগে সেখানে হামলা চালায়। দুর্ভেদ্য ভবনে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় শক্রদের পরাস্ত করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ওয়্যারলেস ম্যাসেজ পেয়ে সকাল ৮টার দিকে পাক সেনারা বিমানে এসে আকাশ থেকে গুলি চালাতে
________________________________________
শুরু করে। ইয়াকুব বাহিনীর মােহাম্মদ শেষ আঘাত হানতে এগিয়ে যেতেই বিমানের গুলিতে আহত হয়। তাই আহম্মদ তাকে সরিয়ে আনতে গেলে বিমানের ব্রাশ ফায়ারে একই স্থানে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় শহীদ হন আহম্মদ ও মােহদ।
খােন্দকার আঃ মাজেদ ও কাজী আবু ইউসুফের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা মাগুরা সদর থানার বিঘ্নি স্থানে পাকসেনা ও রাজাকারদের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়। এর মধ্যে আরালিয়া-শ্রীমন্তপুর, রাউতড়া, ইছাখাদা, বরইচারাসহ বিস্নিস্থানে পাক সেনা, মিলিশিয়া, রেজার পুলিশ ও রাজাকারদের ওপর হামলা, সম্মুখযুদ্ধ এবং তাদের হতাহত করে অস্ত্র গােলাবারুদ হস্তগত করতে এ বাহিনী সক্ষম হয়। এ দু’জনের সাথে দল পরিচালনায় মােঃ শহীদুল্লাহ জিকুমিয়া, আঃ হাই চৌধুরী, সাইফুল আলম চমক, জহরুল আলম, কাজী নুরুজ্জামান, শহীদ আঃ আজিজ, শহীদ আঃ রউফ, আঃ রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ছিল ২শ’রও বেশি। এদের মধ্যে ঝিনাইদহের শৈলকুপার কামান্না গ্রামে একরাতে পাক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ঘুমন্ত অবস্থায় ২৭ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়।
মাগুরার ভায়না গ্রামের খান আলী রেজা, মাগুরা শহরের মুরারী মােহন বিশ্বাস, মনােয়ার রেজা, বাঁশী, সনৎ অধিকারী, প্রমথ মন্ডল, নৃপেন, হুমায়ুন কবির ঢাকাইয়া, থানাপাড়ার মােশাররফ খান মুসা, আঃ মজিদ খান, পাল্লার ছালাম চেয়ারম্যান, পারনান্দুয়ালীর শহীদুল্লাহ ও লুর রহমান লুতু, শ্রীপুরের এডভােকেট কাজী মুনির ওরফে আকু, নিজনান্দুয়ালীর রশীদ মেম্বর, মালেক,কাজী সিদ্দিক প্রমুখ শহর ও শহরতলিতে ব্যাপক ঝটিকা অভিযান চালায়। কখনও একক বা যৌথভাবে এরা শত্রুদের অবস্থানে আকস্মিক গ্রেনেড চার্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র,সেতু, ফেরি, নৌযান, জীপ কনভয় এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহের ক্ষতি সাধনের পাশাপাশি দখলদার বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ, অস্ত্র ও গােলাবারুদ আদান প্রদান কাজে অবদান রাখে ।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাক সেনারা মধুমতী নদীর ওপারে অবস্থান নিলে ওপারে | যেয়ে পাকসেনাদের অবস্থান গােলা বারুদ ইত্যাদির গােপন খবর সংগ্রহকালে হুমায়ুন কবির ঢাকাইয়া এবং ইকুমির জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে কাজ সমাধা করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। শহরে কয়েকটি সফল অভিযানের পর খান আলী রেজা ১ ডিসেম্বর ভােরে মাগুরা শহরে সশস্ত্র অবস্থায় রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে। পাক সেনাদের প্রচন্ড নির্যাতনের এক পর্যায়ে সুকৌশলে দৌড়ে শহরের পার্শ্ববর্তী নবগঙ্গা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। | মুক্তিযুদ্ধের ৮ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম, এ মঞ্জুর ‘ঈগল কোম্পানী” নামে একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। মাগুরা জেলার শ্রীপুরের ক্যাপ্টেন এ, টি, এম, এ ওহাব এ কোম্পানীর প্রধান হয়ে ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর সদলবলে বাংলাদেশে প্রবেশ
________________________________________
করেন। মাগুরা, ঝিনাইদহ ও রাজবাড়ী অঞ্চল এ কোম্পানীর অধীন ছিল। দর্শনা, ঝিনাইদহ, শৈলকুপা, কামান্না, মীলগ্রাম, বরিশাট, দারিয়াপুর, কমলাপুর প্রভৃতি স্থানে ঈগল কোম্পানী স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় কৃতিত্বের সাথে পাক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। মিত্র বাহিনী মাগুরায় আসলে তাদের সাথে যৌথ আক্রমণে কামারখালীতে অবস্থানকারী পাক সেনাদের বিপর্যস্ত করে তােলে। পরে ঈগল কোম্পানীর সহায়তায় মিত্র বাহিনী মধুমতী নদী পার হয়ে পাক সেনাদের ফরিদপুরের দিকে ধাওয়া করে।
৮ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে গানশীপে করে পাকসেনাদের একটি দল চাঁদপুরে প্রবেশের চেষ্টা করলে জনতা ইট, কাঠ, পাথর, বাঁশ, নিয়ে মেঘনা তীরে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। তবে শক্রর প্রবল গােলাবর্ষণের মুখে জনতা বেশিক্ষণ অবস্থান করতে পারেনি। এই ঘটনার কিছুক্ষণ পর মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে ৯৬টি যানবােঝাই সৈন্যের বহর আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে সড়কপথে চাঁদপুর আসার পথে হাজীগঞ্জে প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। ঐসব স্থানে রাস্তা ও পুলের মাঝামাঝি অংশ কেটে ফেলে মুক্তিকামী জনতা হানাদারদের পথ রােধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু হানাদাররা আশপাশের বাড়িঘর থেকে লােকজনদের ধরে এনে জোর করে মাটি ফেলে লােহার পাত, কাঠ বিছিয়ে পুলগুলাে যান পারাপারের উপযােগী করে তােলে।
৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনী চাঁদপুরে যে নারকীয় বর্বরতা চালিয়েছে সে কথা মনে করে মানুষ এখনাে শিউরে উঠে। পিতামাতা, ভাইবােনের সামনে যুবতীদের ধর্ষণ, হত্যা, অত্যাচার, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ, জীবন্ত কবর দেয়া, হাতপা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়া, শরীরে গরম স্যাকা দেয়া, অন্ধকার, আলাে-বাতাসহীন কক্ষে আটকে রেখে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা ইত্যাদি নানাভাবে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা চাঁদপুরের মুক্তিকামী জনতার ওপর অত্যাচার করেছে। চাঁদপুরের নুরিয়া হাইস্কুল, কারিগরি উচ্চ বিদ্যালয়, রেলওয়ে রেষ্ট হাউস, আক্কাস আলী উচ্চ বিদ্যালয়, হাজীগঞ্জের হামিদিয়া জুট মিল,খােদাই বিল, মতলবের ডিগ্রী কলেজ, শাহরাস্তির চিতশীবাজার, নরেনপুর, ফরিদগঞ্জের ডাকবাংলাে চত্বর, কচুয়ার রহিমানগর ও বঙ্গবন্ধু কলেজ মাঠ, হাইমচর বাজার ছিল হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়নের মূল কেন্দ্র।
চাঁদপুর ম্যালেরিয়া বিভাগের মতিউর রহমান জোয়ারদার, মাকসুদুর রহমান, কবীর আহম্মদ, সফিউদ্দীন আহমেদ, বজলুর রহমান, ইদ্রিস মিয়া, কৃষি বিভাগের ফয়েজ আহমেদ, ওয়াপদার নাজিমুদ্দীন ও মাহফুজুল হককে ধরে নিয়ে যায় এবং হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে নদীতে নিক্ষেপ করে। এভাবে তারা অগণিত মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালিয়েছে। হাজার হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে।
________________________________________
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযােগী হিসেবে চাঁদপুরে কাজ করেছে স্থানীয় কিছু দালাল। রাজাকার, আলবদর, আল শামস, মােজাহিদ বাহিনী। শান্তি কমিটি গঠন করে দালালরা পাকিস্তানী বর্বরদের সহযােগিতা করেছে। চাঁদপুরের কুখ্যাত কয়েকজন দালাল হচ্ছে হাজীগঞ্জের মকিমাবাদ এলাকার বাছু, ফরিদগঞ্জের মওলানা আঃ মান্নান, মতলবের এম এ সালাম হাজীগঞ্জের আনােয়ার হােসেন মিয়া, চাঁদপুরের নাসির ভূঁইয়া, ফরিদগঞ্জের আহমেদ উল্লাহ, চাঁদপুরের হাবিবুল্লাহ চোকদার, আয়াতুল্লাহ প্রমুখ।
চাঁদপুরে দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে ৫৮টি লড়াই সংঘটিত হয়। শাহরাস্তি থানার নরেনপুরের লড়াইটি এর মধ্যে অন্যতম। মে মাসে ঐ লড়াইটি সংঘটিত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা যখন জানতে পারল যে, নরেনপুরে বাজার ক্যাম্পে হানাদাররা মা-বােনদের ধরে এনে নির্যাতন চালাচ্ছে তখন তারা ক্যাম্পটিতে আক্রমণ চালানাের পরিকল্পনা নেয়। প্রায় ৪শ’ মুক্তিযােদ্ধা পরিকল্পনা মােতাবেক ঐ ক্যাম্পের ওপর গভীর রাতে চারদিক থেকে আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনীও আক্রমণের প্রতিউত্তরে দিল মুহুর্মুহু গােলাবর্ষণ করে। দু’দিন দুরাতত্র লড়াই স্থায়ী হয়। | শাহরাস্তি থানার চিতশী বাজারে আরাে একটি বড় লড়াই হয়। হানাদাররা ২৮জন যুবতীকে তাদের ক্যাম্পে ধরেএনে আটকে রেখে ধর্ষণ করছে এই খবর পেয়ে সুবেদার আঃ রবের নেতৃত্বে মুক্তিযোেদ্ধাদের ৫০ জনের একটি দল রাত ১টার দিকে চারদিক থেকে ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ চালালে হানাদারদের ক্যাম্পে আগুন ধরে যায়। একপর্যায়ে হানাদাররা তাদের অবস্থান ছেড়ে নদীপথে পালাবার চেষ্টা করে।
পাকবাহিনী যেমন চাঁদপুরে তান্ডবলীলা চালিয়েছে তেমনি তাদের প্রতিরােধের সম্মুখীনও হতে হয়েছে। শাহরাস্তির ঠাকুর বাজার, নরেনপুর, চিতশী, ফরিদগঞ্জের গাজীপুর, ধানুয়া, গাজিপুর, কড়ইতলী শাহপুর, রূপসায়, মতলবের বিভিন্ন স্থানে, কচুয়ার সচার, রহিমানগরে, হাজীগঞ্জের রাজারগাঁও, নাসিরকোর্ট, হাজীগঞ্জ বাজার, বলাখালে এবং চাঁদপুরের ইতলী, বাগড়া, বাবুরহাট, পুরান বাজার ও মেঘনা, ডাকাতিয়া নদীতে শক্ররা প্রবল প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধের মুখে তারা পরাজয় মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। স্থলপথের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধের মুখে প্রায় ১ হাজার পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ হস্তগত হয় । | ৭১ সালের ১৪ আগষ্ট থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ২৫ সদস্যের চাঁদপুর নৌ-কমান্ডাে দলটি পাকসেনাদের সরঞ্জামবাহী ১০টি নৌযান, কয়েকস্থানের রেলপথ ও ১টি তেলের ডিপাে উড়িয়ে দেয় । ষাটনল থেকে হাইমচর পর্যন্ত চাঁদপুরের নদী ছিল নৌ-কমান্ডােদের পুরােপুরি নিয়ন্ত্রণে নৌ-পথে চলাচলকারী শত্রুপক্ষের নৌ-যানসমূহে লিমপেট সংযুক্ত মাইন লাগিয়ে দিয়ে নৌ-কমান্ডােরা সেগুলােকে ডুবিয়ে দিতাে। ২৬ অক্টোবর রাতে হাইমচরের বৈশরহাটে ৩ হাজার টন গমবাহী, ৩০ অক্টোবর রাতে ১২ হাজার টন ক্যাপাসিটিসম্পন্ন জাহাজ ‘লােরাম চাঁদপুরের লন্ডনঘাটে ২ নভেম্বর সৈন্যবাহী
________________________________________
জাহাজ এম, ভি শামী, ৫ নভেম্বর হাইমচরের টেগেরহাটে আরেকটি সৈন্যবাহী জাহাজ, ৯ নভেম্বর মৈশাদীতে সৈন্যবাহী একটি ট্রেন, ১১ নভেম্বর একলাশপুরে খাদ্যবাহী জাহাজ এমডি গফুর’ ও এম,ডি ‘টাগ’, ৭ নভেম্বর মােহনপুরে সৈন্যবাহী জাহাজ ‘লিলি’তে মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এগুলাে উড়িয়ে দেয়া হয়। স্কুল, রেল ও নৌ-পথে এভাবে প্রতিরােধ গড়ে তােলার মাধ্যমে পাকবাহিনীকে চাঁদপুর থেকে বিতাড়িত করা হয়। | চাঁদপুরে মুক্তিযুদ্ধে ডাঃ মিসেস বদরুন নাহার চৌধুরীর ভূমিকা মুক্তিযােদ্ধাদের স্মৃতিতে অম্লান। প্রচন্ড সাহসী ঐ মুক্তিযােদ্ধা চিকিৎসক রাতের আঁধারে বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে বেড়াতেন এবং অসুস্থ ও যুদ্ধাহতদের চিকিৎসা করতেন।
চাঁদপুরবাসী যেসব বীর সন্তানদের কাছে ঋণী যাদের দেশাত্মবােধের কারণে চাঁদপুর হানাদারমুক্ত হয়েছিল তাদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হােল। এডভােকেট সিরাজুল ইসলাম পাটোয়ারী, আঃ রব, আবু জাফর মাঈনুদ্দীন, শহীদ জাভেদ, শহীদ আবুল কালাম, শহীদ খালেক, শহীদ সুশীল, শহীদ শংকর, ফ্লাইট লেঃ এ,বি সিদ্দিকী, মমিনউল্লাহ পাটোয়ারী, আঃ করিম পাটোয়ারী, এডভােকেট আঃ আউয়াল,বি, এম কলিমুল্লাহ, শাহ মােঃ আতিকউল্লাহ, অজিত সাহা, চন্দন পােদ্দার, সুবেদার আবদুর রব, জহিরুল হক পাঠান, হানিফ পাটোয়ারী, এডভােকেট আবুল ফজল, জহিরউদ্দীন বাবর, নায়েক আলী আকবর, ওয়াহিদুর রহমান, দুলাল পাটোয়ারী,অধ্যাপক শামসুদ্দীন আহমেদ, দিদারুল ইসলাম পাটোয়ারী, ডাঃ আঃ ছাত্তার, এম, এ, ওয়াদুদ, মাকসুদ হায়দার চৌধুরী, সুবল চন্দ্র দাস, কোব্বাত মিয়া, মুনির আহমেদ, রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, তােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মরহুম রাজা মিয়া, আবেদ মনসুর, ফ্লাইট সার্জেন্ট আনােয়ার হােসেন, ডাঃ বদরুন নাহার চৌধুরী, কবির আহম্মদ, লােকমান হােসেন পাটোয়ারী,আঃ হামিদ মাষ্টার, আবুল কালাম আজাদ, সিরাজুল হক, মােমিন খান মাখন, এডভােকেট আঃ রহমান, মরহুম সােনা আখন্দ, আবদুল্লা সরকার, ফজলুল হক তালুকদার, হারুন-অর-রশীদ চৌধুরী, মরহুম আনােয়ার হােসেন আরিফ, মরহুম রবিউল আউয়াল কিরণ, মুনসুর আহমেদ, আবু তাহের দুলাল, জীবন কানাই চক্রবর্তী, নিত্য সাহা, মজিবুর রহমান স্বপন, সফিকুর রহমান, নায়েক আলী আকবর, জয়নাল আবেদীন,লেঃ দিদারুল আলম, মাহবুব পাটোয়ারী, কাদের মাষ্টার, নূর মােহাম্মদ বকাউল, শহীদ সিপাহী আবুল হােসেন, মওলানা আঃ লতিফ, সিপাহী আঃ করিম, খলিলুর রহমান, শাহ আলম, চাকতি, মহিউদ্দীন পাটোয়ারী, রুস্তম প্রমুখ।
এগার ২৬ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ আসার পথে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ করে। এই প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হয় পাগলা থেকে চাষাড়া রেল লাইন পর্যন্ত। ২৮ মার্চ সকাল থেকে হানাদার বাহিনী শক্তিবৃদ্ধি করে চাষাঢ়া রেল ক্রসিং থেকে ভারী কামানের গােলা ছেড়ে। কামানের গােলার আঘাতে শহরের অনেক বাড়ি-ঘর বিধস্ত হয়।
________________________________________
দুপুরের পর থেকেই নারায়ণগঞ্জ থানার বাঙালি পুলিশ কর্মকর্তাদের দিয়ে পাক বাহিনী ম্যাগাফোন ও মাইকে শহরবাসীর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন নির্দেশ জারি করে। বিকেল তিনটায় নারায়ণগঞ্জ শহরের বাড়ির মালিকদের থানায় হাজির হতে বলে। বাড়ি মালিকরা থানায় গেলে হানাদাররা স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে ফেলে, রাস্তায় দেয়া ব্যারিকেড সরিয়ে নিতে বলে। তা না হলে ৩শ’ গজের মধ্যে যে সমস্ত বাড়ি-ঘর আছে সেগুলাে জ্বালিয়ে দেবে বলে হুমকি দেয়।
হানাদাররা বিকেল থেকেই গান পাউডার ছিটিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের কন্ট্রোল রুম রহমতউল্লাহ মুসলিম ইন্সটিটিউট জ্বালিয়ে দেয়। দেওভোেগ সমাজ উন্নয়ন সংসদ, দেওভােগের কাটা কাপড়ের মার্কেট ও ব্যবসায়ী মফিজদ্দিন আহমেদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে কয়েকজন মারা যায়।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ক্রমান্বয়ে লঞ্চ টার্মিনাল ঘাট,টি, এন্ড টি অফিস, নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুল, নায়ণগঞ্জ ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব ও তােলারাম কলেজে অবস্থান নেয়।
সালদা নদীর তীরে বেলুচ রেজিমেন্টের ১৭ জনকে যে অপারেশনে হত্যা করা হয়, সে, অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন কর্ণেল খালেদ মােশাররফ। ক্যাপ্টেন গফফার এই অপারেশন পরিচালনা করেন। পরবর্তীতে আরেকটি অপারেশনে গিয়ে পূর্ব সীমান্ত এলাকা পর্যবেক্ষণ করার সময় একটি স্পিলন্টার এসে আচমকা খালেদ মােশাররফের কপালে আঘাত করে।
মুক্তিযুদ্ধে আড়াইহাজারে শহীদ মুজুর, নারায়ণগঞ্জের সিরাজুল ইসলাম সিরাজ, মাহফুজুর রহমান, তমিজউদ্দিন রিজভী, ফয়েজ ভাই, বাছু, রাসু,মমাঃ গিয়াসউদ্দিন জয়নাল, রতন, ইসমাইল, কমল মােহাম্মদ আলী উল্লেখযােগ্য অবদান রাখে।
সেপ্টেম্বর মাসে শহরের ৪নং ডি,আই,টি, এলাকায় মুক্তিযােদ্ধা মাহফুজুর রহমান ও শফিউদ্দিন পাক হানাদার বাহিনীর একজন সিপাইর মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে এবং তার অত্র ছিনিয়ে নেয়। অক্টোবর মাসের শেষ দিকে বাবুরাইল মসজিদের সামনে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার গুলজারের ছােট ভাই ও তার একজন সঙ্গীকে হত্যা করা হয়। দুঃসাহসী মুক্তিযােদ্ধা রব, মাহফুজুর রহমান, জানে আলম,ফয়েজ আহমেদসহ অনন্যরা এই হামলা চালায়। একই মাসে বাবুরাইলের কুখ্যাত রাজাকার মুনিরকে রব প্রকাশ্যে হত্যা করে। কালিরবাজার, নারায়ণগঞ্জ থানা, চাষাঢ়া গােল চত্বর, মন্ডলপাড় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা হানাদার বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে দিতে সাহায্য করে। সে সময় পুলিশ সার্জেন্ট আমিনুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ থানা থেকে প্রচুর বুলেট সরবরাহ করে।
মুযুিদ্ধের ১ মাসে সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আদমজীনগর, হাজীগঞ্জ ইউনিয়ন, ডি এভডি’র ফতুল্লা, জালকুড়ি, আদমজী সড়কের পার্শ্ববর্তী গােদনাইল শিল্পাঞ্চলের বিরাট এলাকা জুড়ে
ন্যাপ,সিপিবি ছাত্র ইউনিয়ন ও ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রে সমন্বয়ে গঠিত যৌথ মুক্তিবাহিনী উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে।
১১ নভেম্বর বেতিয়ারা যুদ্ধে ৯ জন শহীদ হন। গােদনাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র শহিদউল্লাহ সাইদ ও এস, এস সি’র ছাত্র আওলাদ হােসেন ছিল সর্ব কনিষ্ঠ। এছাড়া সিপিবি নে আবদুল খালেক মােলা, প্রকৌশলী আলী হােসেন, যুদ্ধাহত মহিউদ্দিন আহমেদ, আশেক আলী মাস্টার, খােরশেদ আলম, কামাল হােসেন, আবদুল মতিন, আবদুল হামিদ মােল্লা, মহিউদ্দিন মােল্লা, নুরুল ইসলাম সরদার, আবদুল মালেক, আলী হােসেন (২), শাহাবুদ্দিন, এহসান কবীর, রমজান,মীর মােশাররফ হােসেন, আবদুস সােবহান, সিরাজুল ইসলাম, আবদুল আজিজ, নিজাম, হযরত আলী, আবদুর রহমান, এম, এ খালেক, মােখলেসুর রহমান সাহা ও সিপিবি’র নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটির সম্পাদক মীর মােঃ আমানউল্লাহ উল্লেখযােগ্য অবদারন রাখেন।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঢাকায় আক্রমণ করার পর থেকেই নারায়ণগঞ্জের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে বন্দরে অবস্থান করে। নারায়ণগঞ্জ ও বন্দরের অধিকাংশ নেতা নাট্যশিল্পী এস, এম ফারুকের বাড়িতে আশ্রয় নেন এবং ওখান থেকেই বিভিন্ন নির্দেশ প্রদান করতে থাকেন।
হানাদার বাহিনী নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক লুটতরাজ ও গণহত্যা শেষে ৪ এপ্রিল ডােরে বন্দরে প্রবেশ করে। বন্দরে প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অন্যতম সংগঠন সিরাজদ্দৌলা ক্লাব, এস, এম, ফারুকের বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিভিন্ন বাড়ি থেকে ৪০ জনকে ধরে এনে সিরাজদ্দৌলা ক্লাবের দক্ষিণ দিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে ও পরে লাশগুলােতে আগুন লাগিয়ে দেয়। নিহতদের মধ্যে মমতাজ মাষ্টার, শামস, রেজাউল ইসলাম বাবুল উল্লেখযােগ্য।
পাক বাহিনী পরে ফেব্রিক কোম্পানিতে’ স্থায়ীভাবে আস্তানা গাড়ে। দিনের বেলা নবীগঞ্জ থেকে মদনগঞ্জ পর্যন্ত হানাদাররা টহল দিতাে। যখন যাকে খুশি ফেব্রিক কোম্পানীতে তুলে এনে গুলি করে হত্যা করতাে। পরে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিতাে। এখানে হত্যা করা হয় অনেকের সঙ্গে ঢালী মাষ্টার, আবদুস সালাম মুন্সী ও শফি চেয়ারম্যানকে হত্যা করার আগে ঢালী মাষ্টার ও আবদুস সালাম মুন্সীকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও ক্ষত-বিক্ষত করে সারা বন্দরের রাস্তায় ঘােরায়। এই নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের কথা এলাকাবাসী আজও মনে করে শিউরে উঠে। মে মাসে হানাদার বাহিনী সােনারগাঁয় প্রবেশ করে। তৎকালীন সি ও অফিসে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প করে সােনারগাঁয়ের এগারটি ইউনিয়নে পযায়ক্রমে অত্যাচার, নির্যাতন, লুটতরাজ ও গণহত্যা চালায়।
উবগঞ্জে ক্যাম্প করার পর পরই হানাদার বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যায়। মেঘনা ঘাট, কাঁচপুর ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াতকারী যানবাহন থামিয়ে তা থেকে নামিয়ে রাখা হােত। কিশােরী, যুবতী ও গৃহবধূদের। পরে তাদের ঢাকায় নেয়া হােত
________________________________________
উপভােগ করার জন্য। মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকার মঈনউদ্দিনকে হত্যা করে। রাজাকারদের সার্বিক সহযােগিতা করে কে, এস, পি নেতা তৎকালীন মন্ত্রী এস, এম সােলায়মান।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগষ্টকে বানচাল করে দেয়ার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা সংকল্প নেয়। ১৩ আগষ্ট মুক্তিযােদ্ধারা সােনারগাঁয়ে সেতুর নিচে মাইন পুঁতে রাখে। গভীর রাতে হানাদাররা ঐ সেতু অতিক্রম করার সময় মাইন বিফোরিত হয়। এতে কয়েকজন পাকসেনা হতাহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ২৩ অক্টোবর বিকেল থেকে রাতে প্রায় বারােটা পর্যন্ত আমিনপুর ইউনিয়নের পেতারবাড়ির পুল, সােনারগাঁ পার্ক, দৌলারবাগ এলাকায় প্রায় সাত ঘন্টাব্যাপী সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মুক্তিবাহিনী গ্রেনেড, রাইফেল, এল, এম, জি ও দুইঞ্চি মর্টার ব্যবহার করে।
এ ঘটনার পর পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী ২৪ অক্টোবর সকালে আরাে শক্তি সঞ্চয় করে সােনারগাঁয়ের নিরীহ জনসাধারণের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। সম্মানদি, গােয়ালদি, পিরােজপুর, চিলারবাগ, সাদিপুর ওজঙ্গলবাড়ি গ্রাম ঘেরাও করে কয়েক হাজার বাড়িঘরে অগ্নি সংযােগ করে, লুটপাট চালায় এবং নারী নির্যাতন করে। এই হামলায় মুক্তিযােদ্ধা মজনুসহ কমপক্ষে দশজন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়।
এপ্রিল মাসে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী রূপগঞ্জের কাঞ্চন ইউনিয়নের নবারুণ জুট মিলে এসে অবস্থান নেয়। সে সময় কোন প্রতিরােধ হয়নি। আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এম, এন, এ এডভােকেট আবদুর রাজ্জাক, কাজী শাহাবুদ্দিন এমপি, এ, এডভােকেট আবদুল হারিজ মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিভিন্ন এলাকায় গােপন তৎপরতায় লিপ্ত হন। পরবর্তী পর্যায়ে এডভােকেট আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী শাহাবুদ্দিন ভারতে চলে যান। এরপর এডভােকেট আবদুল হারিজ রূপগঞ্জ থানায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বিভিন্ন ইউনিয়নে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোেদ্ধাদের সংগঠিত করেন। এ ছাড়া কাঞ্চনের গােলজার হােসেন, এ, কে, এম হাসমত আলী সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনা করেন।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মাঝে মাঝে নবারুণ জুট মিল থেকে বাজারে আসে। ইনফরমারের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে মে মাসের শেষ দিকে হানাদারদের আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়া হয়। | মুক্তিযােদ্ধা নুরু মিয়া চৌধুরী বাছুর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর সহযােগিদের নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভারত থেকে সদ্য ট্রেনিং নিয়ে আসা একটি মুক্তিযােদ্ধা দল খবর পায় রাজাকার কমান্ডার গুলজার হােসেন শহরের জামতলায় একটি বাড়িতে অবস্থান করছে। সেখানে হিন্দু-মুসলমান অনেক যুবতীকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হচ্ছে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল, রতন ও অপর একজন মধ্যরাতে হামলা করে। রাতে মুক্তিযােদ্ধারা জামতলার একটি বাড়িতে অবস্থান করে। মুক্তিযােদ্ধাদের ইনফরমার বসির জানায়, ১৯৭১ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সুলতান মােজর জামতলায় থাকে।
________________________________________
মুক্তিযােদ্ধা জয়নাল ও রতন সকাল হলে অপারেশন করার জন্য ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কসংলগ্ন জামতলার উত্তর দিকে যাওয়ার সময় দেখতে পায় সুলতান মাের ও শান্তি বাহিনীর একজন সদস্য রাস্তা অতিক্রম করছে। মুক্তিযােদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে হত্যা করে জামতলার দক্ষিণ দিক দিয়ে সরে পড়ে।
বরগুনা শহর পাক বাহিনীর দখলে আসে ১৪ মে। ২৬ এপ্রিল বরগুনার ত ৎকালীন জেলা সদর পটুয়াখালী দখলের সময় মুক্তিযােদ্ধারা শহর ত্যাগ করে। ১৫ মে তারা পাথরঘাটার বিষখালী নদীর তীরে গণহত্যা চালায়। পটুয়াখালীর ডি এম এল এ মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে হানাদার বাহিনী শত শত লােককে গুলি করে বিষখালী নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বিষখালী তখন রক্তের নদীতে পরিণত হয়। পাক বাহিনী ব্যবসায়ী লক্ষণ দাস, তার ছেলে কৃষ্ণ দাস, অরুণ দাস স্বপন ও তপন দাসকে ধরে নিয়ে যায়। হানাদার ও রাজাকর বাহিনী গােপন ষড়যন্ত্র করে শহরে ধুম্রজাল সৃষ্টি করে। একমাত্র বর্ণ হিন্দু ছাড়া কাউকে কিছু বলা হবে না। এই ঘােষণা দিয়ে পাক বাহিনী পটুয়াখালী চলে যায়। আশ্বাস পেয়ে অনেকেই তখন শহরে আসছিল,বিশেষ করে গরীব হিন্দু ও আওয়ামী শীগ সসৰ্থকরা। এমতাবস্থায় ২৬ ক্যাপ্টেন শাফায়াতের নেতৃত্বে মাত্র ৪ জন পাক সেনা স্পীড বােট নিয়ে গােপনে বরগুনা আসে । ঐদিন রাতেই শাস্তি কমিটি ও রাজাকারদের নিয়ে সে বৈঠক করে এবং পরদিন ভাের রাত থেকেই তারা যৌথভাবে অপারেশন শুরু করে। আওয়ামী লীগ সমর্থক ও হিন্দুদের ধরে আনে সিএন্ডবি ডাক বাংলাের আর্মি ক্যাম্পে। দলে দলে নারী পুরুষ সে সময় পালানাের চেষ্টা করে। শান্তি কমিটির লােকেরা এ সুযোেগই খুঁজছিল। তারা বৃষ্টির মধ্যে ঘেরাও দিয়ে তাদের ধরে গরু-ছাগলের মতাে বেঁধে জেলখানায় নিয়ে আসে। সেদিন সন্ধ্যয় বরগুনা জেলখানায় আটক অসংখ্য নারী-পুরুষের আর্ত চিৎকারে কারাগার কেঁপে ওঠে। এখানে রাতভর পাক বাহিনী ও রাজাকাররা গণধর্ষণ চালায়। | প্রত্যক্ষদর্শী ফারুক জানায়, জেলখানায় আটক অনেক মেয়েকে হানাদার ক্যাম্পে ধর্ষণের পর যখন আবার জেলখানায় ফেরত নিয়ে আসে তখন জেলখানার ইট বিছানাে রাস্তা রক্তে লাল হয়ে যায়, অনেকে মারা যায়। পরদিন ১১ বছর বয়সী একটি সুন্দরী মেয়েকে পাক সেনারা ধরে নিতে গেলে সে দৌড়ে প্রাণ বাঁচাতে একজন জেল পুলিশকে জাপটে ধরে।
২৮ মে মেজর নাদের পারভেজ বরগুনায় আসে। তার নির্দেশে পাক বাহিনী জেলখানায় গণহত্যা চালায় । ঐদিন বরগুনা জেলা স্কুলে প্রথম ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজানাে হয়। সাথে সাথে প্রচন্ড গুলির শপে কেপে ওঠ বরগুনা শহর। এভাবে বেশ কয়েকবার গুলি করে হানাদাররা চলে যায়। শান্তি কমিটির লােকজন এসে গুলিতে মৃত-অর্ধমৃতদের
________________________________________
| জেলখানার পশ্চিম-দক্ষিণ পাশে নির্মিত গণকবরে মাটি চাপা দেয়। এভাবে প্রথম দিন ৫৫ জন, পরের দিন ৩৬ জনকে গুলি করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক বাহিনীর হাতে বরগুনায় যারা নিহত হয়েছেনঃ সদরঃ সিদ্দিকুর রহমান পনু, আব্দুর রশিদ, ডাঃ কৃষ্ণকান্ত, অজিত কর্মকার, ধৈর্যধর দেবনাথ, কামিনী কুমার দাস, গােরা চান, নির্মল চন্দ্র নাথ, মধু শীল, বিনােদ নাথ, সুকুমার দাস, কানাই দাস, রবিন দাস, চিন্তাহরণ সাহা, কৃষণ চন্দ্র সাহা, সুনীল কুমার নাথ, কানাই লাল নাথ, বলরাম বণিক, হরণাথ কর্মকার,বাদল চন্দ্র নাথ, সুভাষ চন্দ্র, বেচু, বলরাম, সুকুমার কর্মকার, সুনীল নাথ, অমূল্য কর্মকার, আবু তাহের, সুনীল চন্দ্র কর্মকার, মদন মােহন নাথ, মধসূদন নাথ, সতীশ চন্দ্র নাথ, নগেন্দ্র চন্দ্র, বৈদ্যনাথ সাহা, নিশিকান্ত মিস্ত্রী, শংকর কর্মকার, নগেন্দ্র নাথ কর্মকার, অক্ষয় কর্মকার, মানিক চন্দ্র, যুবরাজ সাহা, জগদীশ শীল, রজনীকান্ত শীল, গৌরাঙ্গ চন্দ্র নাথ, কৃষ্ণ তালুকদার, বলত নাথ, নিরঞ্জন শীল, মানিক কর্মকার, নরেশ চন্দ্র ব্রহ্মচারী, মীর মােশাররফ হােসেন, লেহাজ উদ্দীন ফজলুল হক, নাসির উদ্দিন, কাঞ্চন মাঝি, কাদের, সানু, দেলােয়ার হােসেন ননী, কালীকান্ত হাওলাদার, নিখিল রঞ্জন গুহ, বলাই মল্লিক, আজিজ সিকদার, আফসের আলী মুসল্লী, ইসমাইল, আশ্রাফ আলী, মীর ইদ্রিস, মুজাহার আলী খাঁ, হরেণ কুমার, ছাত্তার খাঁ, তৈয়ব আলী, আব্দুল হামিদ মােল্লা, আফজাল আলী, মুজিবুর রহমান, ছােবহান তালুকদার, ছােবহান, চাদ মিয়া, রশিদ, মােহাম্মদ হানিফ। | পাথরঘাটাঃ ইপিআর আলাউদ্দিন, বাকেন্দা, মােহাম্মদ আতিকুল্লাহ, এস আই আব্দুল মজিদ, সিপাহী আড়ি মিয়া, সিপাহী জাহা বর, আব্দুল মালেক মাস্টার, মুজিবুর রহমান কনক, লক্ষণ চন্দ্র দাস, দিলীপ কুমার দাস, চিত্তরঞ্জন হালদার, বিনােদ গাইন, নূরুল ইসলাম, ইন্দ্রমােহন, দীনবনু হাওলাদার, ডাঃ সামাদ জমাদ্দার, আকুল মােত্তালিব, মহিয়ার রহমান, যাদব গাইন, কেশব গাইন, রামচন্দ্র গাইন, প্রহলাদ মিস্ত্রী, নাথরাম মিস্ত্রী, বিশ্বেশ্বর সিকদার, সতীশ স্টাচার্য, আলী আকবর, মােবারক, মেনােরঞ্জন ব্যাপারী, অশ্বিনী কুমার। বালা, চন্দ্রকান্ত হাজরা, নিত্যানন্দ ব্যাপারী আনন্দ কুমার হাং, লক্ষণ কান্ত হাং, নিরােদ। ব্যাপারী, কুনিয়া গ্রামে ১০ অক্টোবর সুবেদার জামান দালালদের সহযােগিতায় হত্যা করে। নায়েক আব্দুল হাকিম সিকদার, আব্দুল মােতালিব, আব্দুর রশিদ মােল্লা, নায়েক আব্দুল হাকিম, আবু সাইদ হাওলাদার, মধুরা নাথ মিন্ত্রী, কর্মধর মিস্ত্রী, মনােহর মিস্ত্রী, হােসেন আলী, আবুল হােসেন গােলদার, শরৎ চন্দ্র মন্ডল, হােসেন, ফজলুল হক তালুকদার, হাবিবুর রহমান, আব্দুল হাকিম, প্রিয়নাথ গােমস্তা, মণিন্দ্রনাথ, বিশ্বেশ্বর মাঝি, আঃ গনি হাং, সুরেন্দ্র অধিকারী, আবুল কাশেম, অনন্ত মােহন, এস্তাজ খাঁ, রতন খাঁ, আকবর আলী। গাজী, শৈলেন্দ্র নাথ রায়, আলী আকবর, আব্দুল গনি, ইসমাইল, মালেক, রশীদ মােল্লা, হামিদ, মজিবুল হজ, শাহাজাহান, ইউসুফ, সুলতান আহাম্মেদ, আব্দুস সালাম, আনােয়ার হােসেন, আলতাফ হােসেন, গণেশ চন্দ্র সাহা, মতিয়ুর রহমান, জুলমত খা, সুবােধ চন্দ্র,
________________________________________
লক্ষণ চন্দ্র শীল, নির্মল কুমার কর্মকার, উজ্জল খাঁ, গােলাম আলতাফ হাং, আতাহার
| আমতলীঃ নাসির উদ্দিন, হাবিলদার আব্দুল বারেক, নায়েক আলতাফ হােসেন, কালী কান্ত গােস্বামী, খন্দকার এজনসানুল হক, নুরুল ইসলাম, ফাতেমা বিবি, হাছন আলী, মােহাম্মদ হাওলাদার, নগেন্দ্র ধুপি, সাফেজ উদ্দিন, নূরুল হক খলিফা।
বেতাগীঃ মােস্তাফিজুল করিম, আব্দুর কাদের, সনৎ কুমার, মােবারক হােসেন, আফাজউদ্দিন, হাসেম আলী, এনছে আলী, শ্রীজ্ঞান ক্ষেপা, আমির আলী মল্লিক, কার্তিক চন্দ্র সরকার, রহিম খাঁ, হাজি ইসলাম উদ্দিন, আব্দুল খালেক, মাহাবুবুর রহমান খাঁ। | বামনাঃ আলমগীর হােসেন মােল্লা, শরিফুল ইসলাম, রশিদখা, আব্দুল রব, হযরত আলী, আজিজুর রহমান প্রমুখ ।
৫ মে পাক হানাদার বাহিনী জল, স্থল ও আকাশ পথে একযােগে হামলা চালিয়ে কক্সবাজার প্রবেশ করে। কক্সবাজার জেলা সংগ্রাম কমিটি, ছাত্র যুব বিগ্রেডের পক্ষ থেকে সড়ক পথে বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরােধের চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম কালুরঘাট যুদ্ধে বাঙালি সেনা, বিডিআর সদস্য ও মুক্তিযােদ্ধাদের পতনের পর কক্সবাজার পালিয়ে আসা তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, মীর শওকত আশীর কাছ থেকে পাক সেনাদের ভারী অস্ত্রসজ্জার কথা শােনার পর প্রতিরােধের চিন্তা বাদ দেয়া হয়। তারা মুক্তিযোেদ্ধাদের নিরুৎসাহিত করে। জিয়াউর রহমানের অগ্রবর্তী দলের ৪ জন সদস্যকে চকরিয়ায় পাক দোসর সন্দেহে মেরে ফেলা হয়। কারণ তাদের কথাবার্তা, গতিবিধি ছিল সন্দেহজনক। জিয়াউর রহমান পরে কক্সবাজার গিয়ে তাদের খোঁজ নিয়ে মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়েন। অগ্রবর্তী এই বাহিনীতে বিহারীর ছেলেরাও ছিল।
পাক সেনারা জল ও স্থল উভয় পথেই ভারী অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ, অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ, হত্যা করতে করতে এগােয় এবং কক্সবাজার শহরে পৌছে। প্রতিরােধে ব্যর্থ হয়ে সংগ্রাম কমিটি, ছাত্র যুব ব্রিগেড ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা-কর্মীরা গা ঢাকা দেয়। বেশিরভাগই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র তৎকালীন বার্মার আরাকান বর্তমান মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। সাথে ছিল হাজার হাজার সাধারণ নরনারী শিশু। আশ্রয় নেয়া লোেকজন হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেলেও বার্মা সামরিক জান্তা ওরােহিঙ্গাদের নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়।
পাক বাহিনী শহরে আগমনের সাথে সাথে তাদের দোসর জামাত, ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা-কর্মীরা, উল্লাসে ফেটে পড়ে। এরা গঠন করে শান্তি কমিটি, রাজাকার – আলবদর বাহিনী।
________________________________________
তারা পাক বাহিনীকে কক্সবাজার জেলার আনাচে কানাচে নিয়ে যেতে থাকে এবং অগ্নি সংযােগ, হত্যা, লুট, ধর্ষণ কাজে সহায়তা করে। দেশীয় দোসরদের অনেকে এসব কাজে অংশ নেয়। ফলে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযােদ্ধা ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকদের ওপর চরম আঘাত আসে। কক্সবাজার সী বিচ রেষ্ট হাউসে খােলা হয় কেন্দ্রীয় নির্যাতন কেন্দ্র ও তার সম্মুখে সমুদ্র সৈকতে একটি বধ্যভূমির সৃষ্টি করা হয়। ঐ নির্যাতন কেন্দ্রে শত শত নারী পুরুষকে এনে অমানুষিক নির্যাতন করে বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতাে। নারীদের ধর্ষণের পর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হতাে।
৮ মাসে পাক সেনা ও তাদের দোসরদের হাতে কক্সবাজার জেলার শত শত নারী-পুরুষ নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলাে শহীদ আব্দুল হামিদ, সুভাষ দাস, ফরহাদ, সুবেদার মেজর লতিফ, নায়েক জোনাব আলী, এডভােকেট জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরী, মােহাম্মদ ইলিয়াস মাষ্টার, সতীশ মহাজন, মহেশখালী কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মােহাম্মদ শরীফ, পন্টু দাশ, আহমদ সােলায়মান, অজিত পাল, স্বপন চক্রবর্তী, এডভােকেট দেবেন্দু চক্রবর্তী, শামসুল ইসলাম, শশাংক বড়ুয়া, যামিনী বড়ুয়া, কামিনী বড়ুয়া, জাফর আলম, নির্মল বড়ুয়া, জুতো বড়ুয়া, মােহাম্মদ আলী, মােহাম্মদ এজাহার, ক্যাপ্টেন মকবুল আহমদ, গােলাম কাদের, আবুল কালাম,আবু জাফর, শাহ আলম, বশির আহমদ প্রমুখ।
জেলার মুক্তি পাগল অনেকে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন পুলিন বিহারী শর্মা, আহমদ উল্লাহ, লকিয়ত উল্লাহ, মনিন্দ্র লাল দে, বাচা মিয়া, নূরুল হক, সালেহ আহমদ, সুধাংশু শীল, ভােলানাথ দাস, রঞ্জিত শীল, সুবেদার মনির আহমদ , নুরুল ইসলাম, আবদুস সালাম, ইব্রাহীম, আমীর হামজা, সৈয়দ নুর, মােহাম্মদ হােসেন, মৃত আবদুস শুকর, কামাল উদ্দিন, ধনঞ্জয় ধর, তেজেন্দ্র দে, নূর মােহাম্মদ, আনােয়ার হােসেন, ফিরােজ আহমদ, বজল মিয়া, জাফর আলম, রমজান আলী, তাহের উদ্দীন,নুরুল আমিন, নূর হােসাইন, শাহাদাত হােসাইন,নূর বকস্, আলী আহমদ, আক্তার আহমদ, এস কামাল উদ্দিন, মােহাম্মদ ইউসুফ, শ্ৰীমন্ত কুমার চন্দ্র, মােহাম্মদ আলী, সরােয়ার আহমদ, সাধন চন্দ্র দাস, অনিল কুমার নাথ, অজিত কুমার নাথ, ধনঞ্জয় নাথ, অনিল কুমার নাথ, অনন্ত কুমার নাথ, কৃষ্ণ মােহন দে, সন্তোষ কুমার দাশ, প্রিয়তােষ দাশ, রায়মােহন, বীরেন্দ্র, জয়নাল আবেদীন, নজির আহমদ, মােহাম্মদ জুহা, মােহাম্মদ আরশাদুল হক।
যারা ভারতে যেতে পারেনি তারাও বসে ছিল না । তৎকালীন যুবনেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কামাল হােসেন চৌধুরী বার্মা থেকে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কাছে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বার্মায় আশ্রয় গ্রহনকারী বাঙালিদের সাহায্য করার জন্য চিঠি লিখেছিলেন ১৭ অক্টোবর।
________________________________________
সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আবদুস সােবহান আগষ্টের প্রথম দিকে সেনাবাহিনী, বিডিআর ও অন্যান্য ১৬ জন সদস্য নিয়ে বার্মা থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করে। দেশের অভ্যন্তরে আসার পর মুক্তিকামী অনেক যুবক ঐ দলের সাথে যােগ দেয়। স্বল্প সংখ্যক অব ও গােলাবারুদ নিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও বিভিন্ন স্থানে অপারেশন চালিয়ে তারা অত্র সংগ্রহ করে। দলটি ঈদগড় বড়বিল এলাকায় ক্যাম্প গড়ে তােলে।
সেখান থেকে জোয়ারিয়ানালা, ঈদগাঁও, লামা থানা, ডুলাহাজারা ইত্যাদি এলাকায় রাকাজারদের বিরুদ্ধে অপারেশন চালায়। এসব অপারেশনে তাদের হাতে অনেক রাজাকার নিহত হয়। পরে দলটি ১৫০ জনের শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তারা তারি স্ত্র সজ্জিত পাক বাহিনীর মােকাবেলা করে। সে সময় তাদের ক্যাম্প ভস্মীভূত হয় এবং পাক সেনাদের হাতে সেখানে একজন মুরাং নিহত হয়। এ দলে অন্যান্যদের মধ্যে ছিল সুরত আলম, নুরুল ইসলাম, বাঙালি, সিরাজুল হক, রেজা, ফিরােজ, সৈয়দ আহমদ, লাল মিয়া, ছগির আহমদ আব্দুর রশিদ, সৈয়দ আমহদ, গুরা মিয়া, বাবুল, ফরিদ আলম, আবু আহামদ, মােজাফফর আহমদ,নুরুল হক, রমেশ বড়ুয়া, দুদু মিয়া, পরিমল, আয়ুব বাঙালি, জিনু বড়ুয়া, নজির, হাবিলদার আবদুল জলিল, নায়েক ফয়েজ আহমদ, নায়েক আবদুল কাদের, লেন্স নায়েক আবদুস সালাম, নুরুল ইসলাম গাজী, আবুল খালেক, এম, এ ওয়াহাব রাজা, সােলতান আহমদ, রেজাউল করিম, মনজুর, মােহাম্মদ হােসেন,ছগির আহমদ, বদিউল আলম ও আরাে অনেকে।
| এছাড়া স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে ও বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল যে হাত্র যুবকরা তারা হলাে শাহনেয়াজ চৌধুরী, দিদারুল আলম, সাদাৎ, ডাঃ সাইফুদ্দিন খালেদ ফরাজী, এজাজুল ওমর চৌধুরী, জালাল আহমদ, প্রিয়তােষ পাল পিন্টু, নুরুল হুদা বাছু, রাজা মিয়া, আবু তাহের, আলম, পরিমল, আবদুল হামিদ, শামসের বেলাল, নূরুল আমিন, নুরুল আবসার, মােহাম্মদ আলী, মনজুরুল হক, মােহাম্মদ সেলিম, আল মামুন, কাদের, জালাল আহমদ, মুজিবর রহমান, আক্তার নেয়াজ বাবুল, লক্ষণ দাস, মােজাম্মেল ফরাজী, আবুল কালাম, বেলার, ফরিদ, মাবুদ, সিরাজ, সাইফুল্লাহ, মমতাজ, শাহ আলম, জালাল, ওবায়দুল হক, আবদুর রশিদ, আবুল কাসেম, শামসুল আলম, ফরিদুল আলম, নুরুল ইসলাম, সিরাজ, হারুনর রশিদ, সৈকত, আবদুর রহিম, ফজল করিম, সৈয়দ আলম, তােফায়েল, আব্বাস, কফিল, মনসুর, শাহজাহান, আবদুল হাই, কাসেম, সেলিম, জাহাঙ্গীর, জুলফিকার আলী, আবদুর রহমান, কাসেম, আহমদ শরীফ, শফিউল আলম, মােজাফফর, শামসুল হুদা, খায়রুল আলম মজনু, সিরাজুল হক, সিব্বির আহমদ, আনােয়ার হােসেন বাঙালি, আবদুল কাদের আফেন্দী, আদম জাহান, শামসুল আলম, গিয়াস উদ্দিন, জাফর আলম, নাজিম উদ্দিন, লিয়াকত, মােহাম্মদ হােসেন ইব্রাহীম, আলতাফ উদ্দিন, রাজ্জাক, আজিজুর রহমান, দিলীপ দাস, মােহাম্মদ আলী, ইকবালসহ আরাে অনেকে।
________________________________________
ভারতীয় বিমান বাহিনীর বােমা হামলার পর হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা এলাকা ছেড়ে আত্মগােপন করতে থাকে।
পালিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে বেশ ক’জন পাক সেনা ও পরে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে কিছু কিছু রাজাকার-আলবদর নিহত হয়। ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনী সমুদ্র পথে কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করে।
চৌদ্দ ভারী অত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকবাহিনী মেহেরপুর শহর দখলের উদ্দেশ্যে ১৬ এপ্রিল এ জেলায় প্রবেশ করে। সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ তখন বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠাআয়ােজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পরদিন ১৭ এপ্রিল বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। শপথ অনুষ্ঠানের খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং পাকবাহিনীর কাছেও পৌঁছে যায়। ঐদিনই পাকবাহিনী মেহেরপুরে পুনরায় প্রবেশ করে। শপথ গ্রহণ স্থান অথাৎ মুজিবনগরের কারনে মেহেরপুর জেলা পাক বাহিনীর কাছে বিশেষ টার্গেটে পরিণত হয়। | ১৬ এপ্রিল পাকবাহিনী প্রবেশের দিন থেকে ডিসেম্বরে বিজয় আসা পর্যন্ত জেলার ছাত্র, যুবক, আনসার, বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, সাংবাদিক, নাট্যকার, রাজনৈতিক নেতা, কৃষকসহ সর্বস্তরের মানুষ প্রতিরােধ যুদ্ধে নেমে পড়ে। এদের মধ্যে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প পরিচালনা, যােগাযােগ রক্ষা করার দায়িত্বও পালন করে।
১৭ এপ্রিল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়ােজন চলছিল অখ্যাত সীমান্তবর্তী বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে। ১৬ এপ্রিল রাতেই শপথ অনুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হয়। পাশের বাড়ি থেকে আনা হয়েছিল চৌকি, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল। এ সময় বৈদ্যনাথতলায় হাজির ছিলেন মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গার মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠকবৃন্দ। শপথ অনুষ্ঠান প্রস্তুতিতে যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী, মহিউদ্দীন আহমদ, ইদ্রিস আলী, ইসমাইল হােসেন প্রমুখ। শপথ অনুষ্ঠানে পাকবাহিনীর কাকডাউন’ করার আশংকা ছিল। যথাসম্ভব নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। ১৭ এপ্রিল ১০টা থেকে দু’ঘন্টার মধ্যেই শপথ অনুষ্ঠান শেষ হয়। | শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়ােজনে “বৈদ্যনাথতলা সীমান্ত সংগ্রাম কমিটির অবদান ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ভবেরপাড়া সীমান্ত চৌকিটি মুক্তিযুদ্ধের রসদ সংগ্রহের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।
মুজিবনগর আমবাগানে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে গার্ড অব অনার দানকারী সদস্যদের মধ্যে স্থানীয় যারা ছিলেন তারা হলেনঃ মেহের খা, মফিজ দফাদার, নজরুল, সাহেব আলী, হামদেল এবং স্থানীয় আনসার ও চৌকিদার। শপথ অণুষ্ঠানে
________________________________________
কোরান তেলােয়াত করেন গৌরীনগরের বাকের আলী, জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনকারীদের নেতৃত্বে ছিলেন দারিয়াপুর গ্রামের আসাদুল হক ও ভবেরপাড়ার পিন্টু বিশ্বাস। শপথ অনুষ্ঠান আয়ােজনে সহযােগিতায় ছিলেন ভবেরপাড়ার মমিন চৌধুরী, আইয়ুব হােসেন, মানিকনগরের দোয়াজউদ্দীন প্রমুখ। ব্যানার লেখা, ফুলের তৈরির কাজে সহযােগিতা দেন স্থানীয় ক্যাথলিক চার্চের সিটার তেরেজীনার নেতৃত্বে মিশন এতিমখানার ছাত্র-ছাত্রীরা।
১৭ এপ্রিল বিকেলেই পাকবাহিনী ভবেরপাড়া গ্রামে হামলা চালায়। তারা গ্রামবাসীদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। ঐদিনই মুজিবনগর সংলগ্ন ভবেরপাড়া গ্রামের রফিকুল ও দলু খার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। পাকবাহিনী মেহেরপুর শহর ছাড়াও মুজিবনগর সংলগ্ন মানিকনগর ও নাটুদহে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং এলাকায় নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে যায়।
এরপর প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু হয়। প্রতিরােধ যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে মেহেরপুরের যােদ্ধারা সক্রিয় ভূমিকা রাখে। যারা সশস্ত্রযুদ্ধে সহযােগিতা দেন তাদের মধ্যে ছিলেনঃ কূটনৈতিক কাজকর্মে অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, মুক্তিযােদ্ধাদের পরিচালনা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় হাশেম আলী খান, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জল্লাদের দরবার অনুষ্ঠানের প্রসেনজিৎ বােস, সাংবাদিকতায় ইদ্রিস আলী, ননীগােপাল ভট্টাচার্য প্রমুখ।
মেহেরপুরের বিভিন্ন স্থানে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের ৫টি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এসব যুদ্ধে বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। জুলাই মাসে মেহেরপুর শহরে পাকবাহিনীর ক্যাম্পে গ্রেনেড হামলা ও শহরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করতে এসে পাকবাহিনীর হাতে শহীদ হন মুক্তিযােদ্ধা আব্দুর রফিক। সদর থানার বাগােয়াল গ্রামে সম্মুখযুদ্ধে পাকবাহিনীর একটি জীপসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ যুদ্ধে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। পাকবাহিনী এ গ্রামের কয়েক ব্যক্তিকে হত্যা করে। ২১ সেপ্টেম্বর সােনাপুর গ্রামে সম্মুখযুদ্ধে রবিউল ও আরমান নামের দু’জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। সােনাপুর গ্রামের নিরীহ লােকজনের ওপার পাকবাহিনী নির্যাতন চালায়। এ ছাড়াও বুড়িপােতা, মুজিবনগর, সাহেবনগর, কামুলি, ইছাখালীতে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর লড়াই হয়।
স্বাধীনতাযুদ্ধকালে গােটা মেহেরপুর শহরই ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। স্থানীয় সরকারী কলেজের পেছনের মাঠ ছিল পাকবাহিনীর সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি । এছাড়াও জেলা প্রশাসন কার্যালয় চত্বরে, ওয়াপদা মােড়, বাসষ্ট্যান্ড এলাকা, গােরস্থানপাড়া প্রভৃতি জায়গায়ও নির্যাতন কেন্দ্র ও বধ্যভূমি করা হয়েছিল। নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল ছিল নারী নির্যাতন কেন্দ্র। চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশাের এলাকা থেকে লােকজন ধরে এনে মেহেরপুরের এসব নির্যাতন কেন্দ্রে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হতাে। মেহেরপুর শহর মুক্ত হলে শহরেই ৫টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। মহকুমা প্রশাসন চত্তরের গণকবরে গােরীপুর গ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যা করার পর পুঁতে রাখা হয়েছিল। শহর সংলগ্ন কালাচাদপুরেও পাকবাহিনীর আরেকটি নির্যাতন শিবির ছিল । স্বাধীনতার পর শহরের গণকবর ও বধ্যভূমি থেকে শত শত মানুষের মাথার খুলি, হাড়গােড় উদ্ধার করে একটি কেন্দ্রীয় গণকবরে সমাহিত করা হয়েছিলাে।
________________________________________
পনের পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছিল নড়াইলের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত প্রশিক্ষণ শিবিরে। মুক্তিপাগল বাঙ্গালীদের দেয়া হচ্ছিল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এমন সময় ১৩ এপ্রিল যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইলে প্রবেশ করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায়। লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করে সংগ্রাম কমিটির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে। জামাত ও মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা পাক সেনাদের সহযােগিতা যােগায় হত্যা, নারী ধর্ষণ ও লুটপাটে।
সদর থানার তুলরামপুর গ্রামের জামাত নেতা মওলানা সােলায়মানের নেতৃত্বে পীস কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে পাকসেনারা নড়াইল শহরে স্থায়ী ঘঁটি করে। মে মাসে মওলানা সােলায়মানকে চেয়ারম্যান করে নড়াইল মহকুমা পীস কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এই কমিটি গঠন করা হয়।
মহকুমা পীস কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন ভাইস চেয়ারম্যান এডঃ খায়রুজ্জামান, সেক্রেটারি মােক্তার হারুনর রশীদ খান (হারুন মােজর), জয়েন্ট সেক্রেটারি ডাঃ আবুল হােসেন, সদস্য-মওঃ আশরাফ আলী (জামীল ডাঙ্গা), ওয়াজেদ আলী (পুরুলিয়া), ডাঃ হব্বত মােল্যা (শমুলিয়া), মােঃ কুদুস খান (পেড়লী) মােঃ সদর উদ্দীন (তুলরামপুর) প্রমূখ।
পীস কমিটির নেতৃত্বে সশস্ত্র রাজাকার ও আলবদর বাহিন গঠন করে নড়াইলের বিভিন্ন স্থান থেকে মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে যুবকদের ধরে এনে নড়াইল জেলা পরিষদ ডাকবাংলােয় আটক রেখে অভিনব পদ্ধতিতে চলতে এদের বিচার বিচার শেষে পীস কমিটির চেয়ারম্যান মওঃ সােলায়মান দন্ডাদেশ দিতেন লালকালিতে ঋীঝইওঝ
ঝগঝৗ’ লিখে। এই দন্ডাদেশ পালনের জন্য সদর থানার কাগজিপাড়া গ্রামের মােরেজ, বরাশুলা গ্রামের ওমর এবং পেড়লী গ্রামের ১ ব্যক্তিকে জল্লাদ নিয়ােগ করা হয়। জল্লাদের গভীর রাতে দেওয়ানী আদালতের নিকটে লঞ্চঘাটের পন্টুনে নিয়ে শাস্তিপ্রাপ্তদের জবাই করে ঝীঝইওঝ’ করে দিত। এভাবে প্রায় ৫ হাজার লােককে হত্যা করা হয়েছে। ‘
সংগ্রাম কমিটির নেতা-কর্মীসহ স্বাধীনতাকামী লােকেরা গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে চলে যান। অনেকে দেশে থেকেই মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধের জন্য তৈরি হন।
নৌকাযােগে ভারতে যাওয়ার সময় গােবরা খাল থেকে কালিয়ার আওয়ামী লীগ নেতা আঃ সালামকে রাজাকাররা ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এ সময় সরদার আঃ সাত্তার, মরহুম এখলাস উদ্দীন সহ ৫ জন আওয়ামী লীগ নেতা পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন।
২৩ মে ভাটিয়াপাড়া থেকে হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত গানবােট নিয়ে লােহাগড়া থানার ইনা গ্রামে সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। নৃশংসভাবে হত্যা করে ৫৮
________________________________________
জনকে। ২৪ মে একই ভাবে ২টি গানবােটে শতাধিক পাকসেনা গাজীরহাট ও ভােসবাগ গ্রামে আক্রমণ চালায়। ভীত সন্ত্রস্ত নারী-পুরুষ মাঠের ভিতর দিয়ে যখন দৌড়াচ্ছিল হানাদার বাহিনী পেছন থেকে গুলি করে তাদের হত্যা করে। | পাক হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি মহকুমার সর্বত্র উগ্র বামপন্থী সশস্ত্র ক্যাডাররা ‘নকশাল’ নামে পরিচিত হয়ে শ্রেণীশত্রু খতমের নামে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হত্যা করতে থাকে। পাক বাহিনীর সহযােগী দালালদের অনেককেও এই নকশাল সদস্যরা হত্যা করে। এরা নড়াইলের কুমড়ি, পেড়লী, লাহুড়িয়া এবং মাগুরার পুলুম এলাকায় সংঘবদ্ধ হয়ে মুক্তিযােদ্ধা বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি খন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত তারা মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট পরাজিত হয়। | লােহাগড়ার বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত এসব খন্ডযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন ইউনুস, খোকন, মাহমুদ, রাজ্জাক, গােপালগঞ্জের হেমায়েত বাহিনীর হেমায়েত, কবির, কামরুল, মতিয়ার রহমান, বাদশা প্রমুখ এবং কালিয়ায় নেতৃত্ব দেন দারােগা শামসুর রহমান, আমীর হােসেন, নজীর হােসেন, কলাবাড়িয়ার আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ। ‘নকশাল’ মুক্ত হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা পাকহানাদার বাহিনীর সাথে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে।
জুনের মাঝামাঝি সময়ে মহকুমা পীস কমিটির চেয়ারম্যান মওলানা সােলায়মান রাজাকার বাহিনী নিয়ে তুলারামপুর থেকে ৯জনকে ধরে আনে। এরা হলেনঃ আতিয়ার রহমান তরফদার, রফিকুল ইসলাম তরফদার, মাহতাবউদ্দীন তরফদার, আব্দুস সালাম তরফদার, মােকাম মােল্যা, কাইজার মােল্যা, মকবুল হােসেন সিকদার, আলতাফ হােসেন এবং চাচড়া গ্রামের ফয়জুর রহমান। অকথ্য নির্যাতনের পরে এদের রূপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বাের্ডের নিকট তাদের দিয়ে গর্ত খুঁড়িয়ে সেই গর্তেই মাটি চাপা দেয়া হয়।
৯ জুলাই বীর মুক্তিযােদ্ধারা কালিয়া থানা রাজাকার ক্যাম্পে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে ‘পীস কমিটির অন্যতম নেতা খলিল মােল্লার ভাই ও কয়েকজন আত্মীয়সহ ৯ জন রাজাকারকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। ১০ ও ১১ জুলাই হানাদার বাহিনী কালিয়ায় দু’দফা আক্রমণ চালিয়ে ৫জন নিরপরাধ লােককে ধরে নিয়ে হত্যা করে। অপর দিকে ৯ জুলাই গভীর রাতে রাজাকার বাহিনী নড়াইল থেকে ট্রাক যােগে চাঁচুড়ি বাজারের নিকট লক্ষীপুর গ্রামের জিন্দার আলী খার বাড়িতে হানা দেয়। জিন্দার আলী এবং তার পরিবারের অন্যান্য লােকজন বন্দুক নিয়ে রাজাকারদের সাথে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে কয়েক জন রাজাকার নিহত হলে তারা পিছু হটে যায়।
জুন সাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর বীর যােদ্ধারা খন্ড খন্ড দলে বিভিন্ন পথে নড়াইল প্রবেশ করতে থাকে। এই যােদ্ধাদের নেতৃত্ব দেয়ার লক্ষ্যে মুক্তিবাহিনীর নড়াইল থানা কমান্ডার হিসেবে উজির আলী, লােহাগড়া থানায় মােক্তার হােসেন এবং কালিয়া থানার ওমর ফারুককে নিয়ােগ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর
________________________________________
নড়াইল মহকুমা কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কমল সিদ্দিকী এবং সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শামসুর রহমান। | মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নড়াইল থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, লােহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান এবং কালিয়া থানায় সরদার আব্দুল মজিদকে কমান্ডার নিয়োেগ করা হয়।
কয়েকজন রাজনৈতিক উপদেষ্টাকে ভারতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে নড়াইলে পাঠনাে হয়। এদের মধ্যে ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আতিয়ার রহমান, মহিয়ার রহমান বাদশা প্রমুখ প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নেন।
সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যােদ্ধারা মহকুমার লােহাগড়া থানা মাকড়াইল, লাহুড়িয়া, কালিয়া থানার কলাবাড়িয়া ও খড়রিয়া গ্রামে মুক্তিবাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্পসহ বিভিন্ন গ্রামে খন্ড খন্ড দলে সমবেত হতে থাকে। এরকম একটি মুক্তিযােদ্ধা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে নড়াইলে আসার পথে ৫ সেপ্টেম্বর যশােরের গোলাহাটি গ্রামে পাকবাহিনীর সাথে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় বীরশ্রেষ্ঠ নূর মহম্মদের। যুদ্ধে নূর মহম্মদ শহীদ হন।
গ্রামাঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে হানাদার বাহিনীর তৎপরতা নড়াইল শহর এবং লােহাগড়া ও কালিয়া থানা সদরে সীমিত হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় নভেম্বর মাসেই মূলতঃ ৩টি থানা সদর ছাড়া নড়াইলের গ্রামাঞ্চল হানদার মুক্ত হয়।
২১ নভেম্বর কমান্ডার আবুল কালাম আজাদ ও কমান্ডার ওমর ফারুকের নেতৃত্বে। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর যযাদ্ধারা কালিয়া পাকবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করে। ৪দিন একটানা যুদ্ধের পর ৫০ জন পাক রেঞ্জার ও ২ শতাধিক রাজাকার মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। এ যুদ্ধে মুজিব বাহিনীর ১ জন ও মুক্তিবাহিনীর ৩ জন যােদ্ধা নিহত হয়। ২৪ নভেম্বর কালিয়া থানা সম্পূর্ণভাবে শক্র মুক্ত হয়।
সম্মিলিত মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগণ লােহাগড়া থানার পাকহানাদার বাহিনীকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু হানাদার বাহিনী এ নির্দেশ অমান্য করলে ৭ ডিসেম্বর সূর্য ওঠার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা লােহাগড়া আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে লােহাগড়া থানার রাজাকার কমান্ডার আশরাফসহ ৭ জন রাজাকার নিহত হয়। | লােহাগড়া মুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনী এগােতে থাকে নড়াইল শহর মুক্ত করার লক্ষ্যে। পাকবাহিনীর মূল ঘাঁটি ছিল রূপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বাের্ডের ডাকবাংলােয়। এখানে ছিল পাক রেঞ্জার বাহিনী, ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণে পুলিশ ফাঁড়িতে ছিল পাক পুলিশের রিজার্ভ ফোর্স ও রাজাকারদের যৌথ অবস্থান, এবং নড়াইল জেলা পরিষদ ডাকবাংলাে ও গার্লস স্কুলের স্টাফ কোয়াটার্স ছিল রাজাকারদের অবস্থান।
________________________________________
| ৭ ডিসেম্বরে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল ফজলুর রহমান জিন্নাহর নেতৃত্বে রূপগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে রিজার্ভ ফোর্স ও রাজাকারদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তখন নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষক সিদ্দিক আহমেদ বিনা রক্তপাতে রিজার্ভ ফোর্স ও রাজাকরদের আত্মসমর্পণ করানাের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করার অনুরােধ জানিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাক বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে ওপর সাঁড়াশি হামলা চালালে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সিদ্দিক আহমেদের এই বিশ্বাসঘাতকতায় নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র জয়পুর গ্রামের তরুণ মুক্তিযােদ্ধা মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং নৃশংসভাবে নিহত হয়। রাজাকাররা মিজানুরের হাত পা বেঁধে জীবন্ত বাঁশে ঝুলিয়ে শহর দিয়ে উল্লাস করেছিল। এই অত্যাচারের খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিশােধের নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠে। লােহাগড়া ও কালিয়ার মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সকল কমান্ডারদের পুনরায় সংগঠিত করে আক্রমণের পরিকল্পনা জানিয়ে দেয়া হল।
১ ডিসেম্বর কমান্ডার আমীর হােসেন, উজির আলী, নজীর হােসেন, শরীফ হুমায়ুন কবীর, ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আঃ হাই বিশ্বাস, সেলিমসহ অন্যান্য কমান্ডারদের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী রূপগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীর ওপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। অপর দিকে চিত্রা নদীর পূর্ব পার থেকে কমান্ডার শরীফ খসরুজ্জামান ও মােক্তার হােসেন সহ অন্যান্য কমান্ডারদের নেতৃত্বে পাকবাহিনীর ওপর সর্বাত্মক হামলা চালানাে হয়। সারাদিন একটানা যুদ্ধের পর সন্ধ্যার দিকে হানাদার বাহিনী পিছু হটতে থাকে। যুদ্ধ। জয়ের আনন্দে বাগডাঙ্গা গ্রামের তরুণ যােদ্ধা মহিয়ার রহমান ‘জয় বাংলা’ বলে বাংকার। ছেড়ে লাফিয়ে উঠলে হানাদারদের বুলেটের আঘাতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হয়।
রাত ৯টার দিকে চিত্রা নদীর পূর্ব পারে অবস্থানকারী মুক্তিযােদ্ধারা নদী পার হয়ে শহরে প্রবেশ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেয়। রাত ১০ টার পর রূপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বাের্ডের ডাকবাংলােয় পাক রেঞ্জারদের ঘটি ছাড়া সমগ্র শহর মুক্তিবাহিনীর পদানত হয় । সমগ্র শহর মুখরিত হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে। ঐ রাতেই তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আমজাদ আলী খান ও তার অফিসের হেড ক্লার্ক মােঃ এয়াহিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে ও নিহত হয়। কিন্তু মহকুমার সেকেন্ড অফিসার এ,টি, এম গিয়াসউদ্দীন পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে।
১০ ডিসেম্বর রূপগঞ্জ পানি উন্নয়ন বাের্ডের ডাকবাংলােয় অবস্থানরত পাক রেঞ্জার বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগন নির্দেশ দেন। কিন্তু রেঞ্জার বাহিনী এ নির্দেশ অমান্য করে মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পরাজয় অবধারিত জেনে রেজার বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে এবং নড়াইল হানাদার মুক্ত হয়।
________________________________________
| ষােল একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী সড়ক পথে মাদারীপুর শহরে প্রবেশ করে। এ সময় এলাকা হেড়ে যেতে বাধ্য হন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ। প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে মুক্তিযোেদ্ধারাও হানাদার বাহিনীকে প্রতিরােধ করতে ব্যর্থ হয়। মে মাসের শেষ সপ্তাহে ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গােলা-বারুদ নিয়ে মাদারীপুরে প্রবেশ করে। শুরু হয় পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধ।
হানাদার বাহিনী মাদারীপুর শহরে প্রবেশের পর এ, আর হাওলাদার জুট মিলে তাদের ঘাটি তৈরি করে। হানাদার বাহিনী মাদারীপুর অবস্থানকালে প্রতিদিন অসংখ্য নিরীহ মানুষকে ধরে আনে। তাদের ওপর সারাদিন পাক বাহিনী বিভিন্ন কায়দায় অমানুষিক নির্যাতন চালাত। পরে হাওলাদার জুট মিলের পিছনে আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে অবস্থিত জেটিতে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করত । অনেককে হত্যা করে মিলের অভ্যন্তরেই মাটি চাপা দিত।
আনােয়ার ফরাজী ছিলেন মাদারীপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। একাত্তরের জুলাই মাসে স্থানীয় রাজাকার বাবলু, নানু ও শাহেদ আলী মাদারীপুর শহর থেকে তাকে আটক করে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। হানাদার বাহিনী দীর্ঘ দু’মাস তাকে হাওলাদার জুট মিলের কোয়ার্টারে আটকে রেখে অকথ্য নির্যাতন চালায়। রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হয়। আনােয়ার ফরাজীর সাথে আরও প্রায় দুশ যুবকের ওপর একই কায়দায় নির্যাতন করা হয়। দু’শ যুবকের মধ্যে ৯/১০ জন বাদে বাকি সবাইকে পাক বাহিনী আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা
দীর্ঘ প্রায় ৮মাস হানাদার বাহিনী মাদারীপুর অবস্থানকালে স্থানীয় রাজাকার -আলবদরদের সহায়তায় মাদারীপুরের সর্বত্র যে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় মাদারীপুরবাসীর স্মৃতিতে আজও তা স্পষ্ট। পাকবাহিনী ৮ মাসে মাদারীপুরে শত শত ঘরবাড়ি লুটপাট করেছে। জ্বালিয়ে দিয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। হত্যা করেছে অসংখ্যা নিরীহ মানুষকে।
হানাদার বাহিনীকে সহযােগিতা করার জন্য গঠন করা হয় পীস কমিটি”। সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আবদুর রহমান হাওলাদার ও খােন্দকার আবদুল হামিদ। অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন মহিউদ্দিন খােন্দকার, জাহাঙ্গীর উকিল, গােলাপ গান প্রমুখ।
একাত্তরের ২৪ এপ্রিল পাক বাহিনী মাদারীপুর শহরে প্রবেশের পর মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত মাদারীপুর শহর ও আশপাশের এলাকা পাক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা
________________________________________
মাদারীপুরে ফিরতে শুরু করলে পাক বাহিনী প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় এবং বিস্নি স্থানে পিছু হটতে বাধ্য হয়। | মে মাসের পর থেকেই পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনার জন্য রাজৈর থানার কমলাপুর, কলাবাড়ী, বাজিতপুর, আগ্রাম এবং সদর থানার কলাগাছিয়া, পাখুল্লা ও কেন্দুয়াকে ঘিরে মাদারীপুর অঞ্চলের মুবািহিনীর হেড কোয়ার্টার গড়ে তােলা হয় । মাদারীপুর মহকুমা মুক্তিযুদ্ধের সময় ২নং সেক্টরের আওতায় ছিল। যার সেক্টর প্রধান ছিল খালেদ মােশাররফ।
মাদারীপুর পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন স্থানে যে লড়াই হয় তার মধ্যে সমাদ্দারের যুদ্ধ, সিদ্দিক খােলার যুদ্ধ, কলাবাড়ীর যুদ্ধ, বেলগ্রামের যুদ্ধ, কালকিনি ও শিবচর থানা অপারেশন উল্লেখযােগ্য। | মাদারীপুরের আঞ্চলিক কমান্ডার আলমগীর হােসাইনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধারা ৭ ডিসেম্বর শিবচরের উদ্দেশ্যে কমলাপুর ক্যাম্প থেকে যাত্রা করে। কিন্তু কলাবাড়ীর নিকট পৌছামাত্র বাস ও জীপ ভর্তি একদল পাকিস্তানী সৈন্য তাদের দলটিকে দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলে ক্রস ফায়ার শুরু করে। এ অবস্থায় মৃত্যু অবধারিত জেনে মুক্তিযােদ্ধারা রাস্তার পার্শ্ববর্তী খালে আশ্রয় নিয়ে প্রাণপণে গুলি চালাতে শুরু করে। পরবর্তীতে গুলির শব্দ শুনে কমলাপুর ক্যাম্প থেকে আরও মুক্তিযোেদ্ধা বের হয়ে আলমগীর হােসাইনের দলটির সাথে যােগ দিয়ে পাক বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। ওই যুদ্ধে পাক বাহিনীর ১৩ জন সেনা নিহত হয়।
হানাদার পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর হাতে সর্বত্র নাস্তানাবুদ হওয়ার পর মাদারীপুর শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কের সমাদ্দার ব্রীজের পূর্ব পাশে আগে থেকেই এন্টি ট্যাংক মইন পুঁতে রেখেছিল। পলায়নপর পাক বাহিনীর একটি বাস সমাদ্দার ব্রীজে ওঠা মাত্রই মাইন বিফোরিত হলে বাসটি বিধ্বস্ত হয়। ফলে ওই ব্রীজ দিয়ে হানাদার বাহিনীর অন্য কোন যান পার হতে পারেনি। মুক্তিযােদ্ধাদের এই আকস্মিক আক্রমণে হতভম্ব হানাদার বাহিনী সমাদ্দার ব্রীজের পাশেই পূর্বে খননকৃত বাংকারে অবস্থান গ্রহণ করে। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা হানাদার বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ৮ ও ৯ ডিসেম্বর দু’পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ চলার পর ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। হানাদার বাহিনীকে বাংকার থেকে উৎখাতের জন্য বাংকারের ভেতর হ্যান্ড গ্রেনেড আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। মুক্তিবাহিনীর এই সাঁড়াশি আক্রমণে হানাদার বাহিনী পর্যদস্ত হয়ে পড়লে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয় । কিন্তু ওরা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে বলে জানায়।
যুদ্ধবিরতি চলাকালে হানাদার বাহিনীর মেজর এ, এস খটক মুক্তিবাহিনীর সাথে আলােচনার প্রস্তাব রাখে। মুক্তিবাহিনী তাদের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণকারী আলবদর
গলাম ।
________________________________________
বাহিনীর একজন সদস্যকে আলােচনার জন্য পাঠায়। যখনই সে হানাদার বাহিনীর বাংকারের কাছে যায় ঠিক তখন হানাদার বাহিনী তাকে আক্রমণ করে। শুরু হয় আবার তুমুল যুদ্ধ। ১০ ডিসেম্বর অতিবাহিত হয়ে ১১ তারিখেও যুদ্ধ চলে। হানাদার বাহিনীর গােলাবারুদ ফুরিয়ে আসলে মেজর খটক নতুন করে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব রাখে। মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীকে অ সমর্পণের নির্দেশ প্রদান করে। হানাদার বাহিনী ১১ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় একযােগে আত্বসমর্পণ করে মুক্তিবাহিনীর নিকট। অবসান হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের। শত্রু মুক্ত হয় মাদারীপুর মহকুমা।
সমাদ্দারের ঐ ঐতিহাসিক যুদ্ধে পাক বাহিনীর বহু সেনা নিহত হয় এবং একজন মেজরসহ মােট ২৭ জন সেনা মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে লড়াই করার সময় ১০ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর গুলিতে নিহত হয় কিশাের মুক্তিযােদ্ধা সরােয়ার হােসেন বাচ্চু।
মাদারীপুরের বিভিন্ন স্থানসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গিয়ে মাদারীপুরের যেসব বীর সন্তান শহীদ হয়েছেন তারা হলেনঃ মাদারীপুর সদর থানার সরােয়ার হােসেন বাচ্চু, হাবিবুর রহমান সূর্য, হারুন, মাহবুব সাঈদ, বদিউজ্জামান বদু, মফিজুর রহমান বাদল, একরামউদ্দিন, আহমেদ, মান্নান, মহসিন মাস্টার, শাজাহান, নূর ইসলাম, সাত্তার, ইয়াকুব, আলাউদ্দিন, জালালউদ্দিন, নূর ইসলাম মিয়া, নকিবউদ্দিন, মজিবর, সামাদ, মানিক, শরীফ, তােরাবউদ্দিন ভূঁইয়া, আবুল হােসেন ও খবির; কালকিনি থানার আয়নাল, গিয়াস, এমদাদ, অনিল, সিরাজ, বিরাট চন্দ্র বাইন, শাহজাহান, খলিফা, জাহাঙ্গীর ও হােসেন ধন; শিবচর থানার মােতাহার, মােস্তফা, খালেক, জাহাঙ্গীর, আজিজ, নূর ইসলাম, তােরফান, রেজাউল খান, জাহাঙ্গীর মাতবর, মালেক ও ছালাম এবং রাজৈর থানার আবদুল বারী, বিজয় মৃধা, মানিক, শাজাহান, সালাম শেখ, মােকসেদ, শামসুদ্দিন, আওলাদ, রাজ্জাক, ছবরউদ্দিন, সােনামুদ্দিন, সাইদুর ও শেখ শাহজাহানসহ আরও অনেক মুক্তিযােদ্ধা।
সতের ১৯ এপ্রিল সকাল থেকেই শােনা যাচ্ছিল গােলাগুলির শব্দ। প্রথমে শহরবাসী ধারণা করেছিল সংগ্রাম কমিটির সাথে পাকবাহিনীর কোথাও যুক্ত হচ্ছে। গােলাগুলির শব্দ ক্রমশঃ শহরের নিকটবর্তী হলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয় যে, পাকবাহিনী গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে নবাবগঞ্জ শহরের দিকে আসছে। নির্বিঘ্নেইশহরে প্রবেশ করে পাকবাহিনী।
১৫ এপ্রিল এ অঞ্চলে পাক বাহিনীর বিমান হামলার পর সংগ্রাম কমিটি ভারতে চলে যায়। ১৬ এপ্রিল থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত সংগ্রাম কমিটি পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য কোন ভূমিকা নিতে পারেনি। কারণ পাকবাহিনীকে প্রতিরােধের জন্য সংগ্রাম কমিটির
________________________________________
=
হাতে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাগুলি ছিল না। ফলে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দ ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।
১৯ এপ্রিল পাকবাহিনী তাদের স্থানীয় বাঙালি দোসরদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে। এই দলালদের সহায়তায় স্বাধীনতার পক্ষে যাদের ভূমিকা ছিল তাদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা সংগ্রহ করে। পরবর্তী ৯ মাস যুদ্ধকালীন সময়ে স্বাধীনতাকামী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ওপর বিন্নি ধরনের অত্যাচার চালায়। ২০ এপ্রিল পাকবাহিনী শহরের বাড়িঘর ও দোকানপাটে বিস্ফোরক ব্যবহার করে জ্বালিয়ে দেয়।
দুপুরের দিকে পাকবাহিনীর একটি স্কোয়ার্ড এসে প্রবেশ করে ইসলামপুরের ডাঃ মমতাজ হােসেনের ঘরে। মুক্তিযােদ্ধার ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করছে এই সন্দেহে পাকবাহিনী বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল ডাঃ মমতাজ হােসেন ও তার মেয়ে লীনা ও হ্যাপিকে। ২৯ এপ্রিল শহরের সেরাজউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে ঢুকে তাকে চেয়ারে বসিয়ে হত্যা করে। তার অপরাধ ছিল তিনি একজন বাঙালি পুলিশকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
নবাবগঞ্জ কৃষি ব্যাংকের ড্রাইভার হাসিমকে তারা হত্যা করেছিল পৈশাচিক কায়দায়। হাসিমকে ধরে আনা হয়েছিল পাকবাহিনীর কোর্ট ক্যাম্পে। লাঠি আর ডান্ডা দিয়ে ৩/৪ জন মিলে পিটিয়ে তাকে অজ্ঞান করে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। তার অপরাধ ছিল সে সংগ্রাম কমিটির যােদ্ধাদের খাবার পরিবহনে জীপ চালিয়ে সহযােগিতা করেছিল। | হত্যা করেছিল নবাবগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক মনিরুল হককে, শিবগঞ্জের লােকমান খাঁকে, রাজারামপুরের এহসান আলী মাষ্টারকে, কমলাকান্তপুরের আফতাব ডাক্তারকে, মসজিদ পাড়ার আবুলকে, ফকির পাড়ার জাহাঙ্গীর সহ অগণিত লােককে হত্যা করে গঞ্জরা গানের নানা কুতুবুল আলমের স্ত্রী ও ৪টি নিস্পাপ সন্তানকে।
বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে এসে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছে নবাবগঞ্জ ইপিআর ক্যাম্পে, শশানঘাটে, রেহাইচরে, কাশিমপুরে, রহনপুর হাইস্কুলের পেছনে পূণর্ভবা নদীর ধারে, রহনপুর বােয়ালিয়া গ্রামে, কালুপুরে, দোরশিয়া গ্রামে, গােমস্তাপুর বাজারে।
হত্যার সাথে সাথে তারা বহু মানুষের উপর দৈহিক অত্যাচার করে নানা পাশবিক কায়দায়। তাদের এ সকল অত্যাচারের স্থান ছিল তৎকালীন ট্রেজারি ও বর্তমানে এজি অফিস। যাকে তাদের সন্দেহ হয়েছে এবং দালালেরা যাদের চিহ্নিত করেছে তাদের ধরে নিয়ে এসে ডান্ডা পেটা করা হতাে ওই ঘরে। মলদ্বারে রােলার ঢুকানাে হতাে, সুচ ফুটানাে হতাে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে, নাকে মুখে গরম পানি ঢালা হতাে। আর্তনাদ করে উঠতে বন্দীরা।
________________________________________
এখানে পীস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী লতিফ হােসেন, সেক্রেটারী ছিলেন জামাতে ইসলামীর স্থানীয় আমীর এডঃ তৈয়ব আলী,সদস্য-শেরখান, প্রাক্তন সংসদ সদস্য পিডিপি নেতা মমতাজ উদ্দিন, গােলাম রসুল ও রমজান আলী। এদের চেয়েও ভয়ঙ্কর হিল পাক বাহিনীর ইনফরমাররা। এদের মধ্যে ছিল বনবাসী মান্নান, শাহজাহান ফকির, রুহুল কমান্ডার। পীস কমিটি গঠিত হয় পাকবাহিনী আসার ৩/৪ দিন পরে এবং সপ্তাহ খানেকের মধ্যে প্রায় সব থানায় পীস কমিটির শাখা গড়ে ওঠে। তৈরি হয় আলবদর বাহিনী, রাজাকার বাহিনী, পাক গার্ড বাহিনী। | পীস কমিটির কাজ ছিল পাকবাহিনীর তাঁবেদারি করা। পাক বাহিনী যখন যা চইতে সেটা তারা করতে বধ্যা হতো। তাদের অফিস ছিল লতিফ হােসেনের বাড়ি। পীস কমিটির কিছু লােক ও পাকবাহিনীর বাঙালি ইনফরমাররাই ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও জঘন্য প্রকৃতির। এদের ইনফরমেশনে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ঝরে গেছে।
এদিকে মুক্তিবাহিনী ১৪ আগষ্টে বােমা মেরে নবাবগঞ্জ-রাজশাহী সড়কের ব্রীজ ধ্বংস করে দেয়। এছাড়া কলাবাড়ীর লড়াই, রাধাকান্তপুরের লড়াই, দাদন চক কলেজের লড়াই হয়েছিল যুদ্ধের প্রায় শেষের দিকে। | তকালীন নবাবগঞ্জ মহকুমার ৪টি থানা থেকে প্রায় দশ হাজার যুবক ও ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। থানাগুলাে হচ্ছে নবাবগঞ্জ, শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর ও ভােলাহাট ।
পাক রেজিমেন্টের মেজর সেরােয়ানী মাঝে মাঝে এসডিও’র চেম্বারে এসে বসতেন সাথে থাকতে পীস কমিট ও ইনফরমার-এর সদস্যরা। ইপিআর বাহিনীর মেজর ছিল ইসহাক ইউনুস ও ক্যাপ্টেন ছিল ইকবাল, পাঞ্জাব পুলিশ অফিসার ছিল চীমা খান। দীর্ঘদেহী চীমা খান ছিল সে সময় নাবাবগঞ্জের ত্রাস। এরা কোন বন্দীকে নিয়ে সিদ্ধান্তহনিতায় ভুগলে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হতাে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে। সেখানে কঠোর নির্যাতনে বন্দীদের হত্যা করা হতাে।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে নবাবগঞ্জের শামসুল হক, এন্তাজ আলী, নজরুল ইসলাম, মইনুল হক, সাইদুর রহমান, নবুয়াত আলী, আব্দুল হাই, এমদাদুল হক, আজিজুল হক, আলতাফ হােসেন, শাহলাল, মােস্তফা, মােজাফফর,সাইফুল ইসলাম।
শিবগঞ্জ থানার মাহতাব উদ্দিন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল লতিফ, মঞ্জুর আলী, নেফাউল হক, ফজলুর রহমান, মফিজুল ইসলাম, কুবল আলী, আনিসুর রহমান, আবদুস সাত্তার, ইলিয়াস আহমেদ, ইয়াসিন আলী, আব্দুল করিম, দাউদ হােসেন, নুরুজ্জামান, হাবিবুর রহমান, আবদুল মান্নান, মতিউর রহমান, আব্দুস সালাম, সাবেদ আলী, হাবিবুর রহমান, মজিবুল হক, ইসহাক মিয়া।
গােমস্তাপুর থানার শমসের আলী, ওয়াজেদ আলী, তাজাম্মুল হক, উসমান আলী, হাসেন আলী, সুলতান আলী, মােস্তফা, আশরাফুল হক, আন্তার রহমান, আবদুর রাজ্জাক,
________________________________________
মাজেদ আলী, আবদুস সাত্তার, আমিনুর রহমান, তৈমূর রহমান, চরণ উরাও, সাইমুদ্দিন শেখ, সাজ্জাদ আলী এমাজউদ্দিন, তাহির হােসেন, মিন্টু শেখ।
নবাবগঞ্জ এলাকায় সর্বশেষ যুদ্ধ হয় ১৪ ডিসেম্বর এবং নবাবগঞ্জ শহর হানাদার মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন এবং তার ইচ্ছা অনুযায়ী ঐহিতাসিক গৌড় নগরীর সােনা মসজিদে তাকে কবরস্থ করা হয়।
पाठीव्र
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে শরীয়তপুরে প্রথম পাকবাহিনী ঢােকে। পাকবাহিনী যখন ঢােকে তখন সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কোন মুক্তিযোেদ্ধা এ জেলায় প্রবেশ করেনি। পাকবাহিনী শরীয়তপুর প্রবেশ করার পর ২নং সেক্টর থেকে পর্যায়ক্রমে কয়েক ব্যাচ মুক্তিযােদ্ধা সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে শরীয়তপুরে ফিরে আসে এবং শরীয়তপুরের-৫টি থানার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান নেয় ।
২২ মে থেকে পাকবাহিনী শরীয়তপুরে তাদের দোসরদের সহায়তায় নির্যাতন নিপীড়ন, নারী ধর্ষণ, হত্যা ও ঘরবাড়ি এবং হাট-বাজারে অগ্নিসংযােগ শুরু কর। ওই দিনই পাকবাহিনীর একটি দল শরীয়তপুরের পালং থানার মধ্যপাড়া গ্রামে আক্রমণ চালায়। এবং ৩০ জন পুরুষ এবং ৫০ জন গৃহবধুও যুবতীকে ধরে নিয়ে যায়। পরে মধ্যপাড়া গ্রামের একটি পরিত্যক্ত ঘর ও মন্দিরে নিয়ে মহিলাদের পালাক্রমে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে। বন্দী মহিলা ও পুরুষদেরকে পাকবাহিনী মাদারীপুর এ, আর হাওলাদার জুট মিলস সংলগ্ন ক্যাম্পে নিয়ে আটক রেখে নির্যাতন করে হত্যা করে। গ্রামের শখীদাসকে ঘরের ভেতর আটকে রেখে বাইরে থেকে ঘরে অগ্নিসংযােগ করে পুড়িয়ে মারে।
পাকবাহিনী শরীয়তপুরের ভেদেরগঞ্জ থানার বিভিন্ন গ্রাম থেকে বহু গৃহবধু ও যুবতীকে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ ও নির্যাতন করে। ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর সব মহিলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই সময় পাকবাহিনীর সহযােগীরা হাটবাজারসহ বহু মুক্তিযােদ্ধার বাড়ি লুট করে। পাকবাহিনীর ভয়ে আতংকিত শত শত গ্রামবাসী নিজ নিজ ঘরবাড়ি সহায় সম্বল ফেলে রেখে নৌকায় আশ্রয় নেয়।
পাকবাহিনী আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীর বাড়ি, নড়িয়া ও ভােজেশ্বর বাজার পেট্রোল দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। পূর্ব নড়িয়া গ্রামের নাছিমা বেগমকে ঘরের ভেতর আটকে রেখে বাইরে থেকে অগ্নিসংযােগ করলে সে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। লােন সিংহ গ্রামে ঢুকে মুক্তিযােদ্ধা সন্দেহে ৮ জন পুরুষ ও মহিলাকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে।
পাকবাহিনীর একটি লঞ্চ জাজিরা থানার লাউখােলা বাজারের নিকট পদ্মা নদীতে থামিয়ে একদল পাকবাহিনী ওই থানার রাঢ়ীপাড়া, দক্ষিণ বাইকশা ও নমপাড়া ঢুকে গ্রামগুলাে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পাকবাহিনীর এসব নির্যাতন, হত্যা ও অগ্নিসংযােগ কাজে সহযােগিতা করেন রাজাকার, আলবদর ও পাকবাহিনীর দালাল।
________________________________________
শরীয়তপুরে পাকবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য লড়াই হয় তেদেরগঞ্জ থানায়।
১৯ জুলাই একদল মুক্তিযােদ্ধা ভেদরগঞ্জ থানায় এক ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ১০ জন মুক্তিযােদ্ধা পাকবাহিনীর গুলিতে শহীদ হয়। নিহত মুক্তিযােদ্ধা আকাসের নামানুসারে ‘আকাস ফোর্স’ নামে একটি বাহিনী গঠন করা হয়। মাদারীপুরের শিবচর ও কালকিনিসহ প্রায় ৭টি থানার মুক্তিযােদ্ধরা তাদের কমান্ডারের নেতৃত্বে মর্টার, লাইট মেশিন গান, নগান, রাইফেল রকেট ল্যালারস্ ও গ্রেনেড নিয়ে পুনরায় ভেদেরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। ওই যুদ্ধে প্রায় ২শত্যধিক মুক্তিযােদ্ধা অংশ গ্রহণ করে। পাকবাহিনীর পক্ষে এই যুদ্ধে ইপিআর, আলবদর, রাজাকার ও পুলিশ অংশগ্রহন করে। তাদের অস্ত্র ছিল চাইনীজ রাইফেল, পিস্তল, লাইট মেশিন গান ও ষ্টেনগান। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষ থেকে প্রথম দু-ইঞ্চি মর্টার চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে যায়। গুলির শব্দে গ্রামের জনপদ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। গ্রামবাসীরা ওই সময় মুক্তিযােদ্ধাদের স্বতঃস্ফুর্তভাবে সহযােগিতা করে। পাকবাহিনী ও তাদের সহযােগীরা মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে পরাজয় বরণ করে। তাদের প্রায় ১ শতাধিক লােক হতাহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিযােদ্ধার পক্ষে ২৫ জনের মতাে শহীদ হয়। আক্রমণ সফল হবার পর মুক্তিযােদ্ধারা তেদেরগঞ্জ থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উডজন করে।
শরীয়তপুরের অন্যান্য থানা অপারেশনের আগেই নড়িয়া থানার আঃ হকের নেতৃত্বে গঠন করা হয় ডিফেন্স প্লাটুন। ওই প্লাটুন প্রথম সীমান্তে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে এবং পরে শরীয়তপুরের মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যুক্ত হয়। এছাড়া পাকবাহিনীর যাতায়াত পথ অবরুদ্ধ করে বিশেষ করে কালভার্ট ও সেতু ধ্বংস করার লক্ষ্যে নড়িয়ার মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে গঠন করা হয় একটি বিফোরক গ্রুপ। এই গ্রুপ কৃতিত্বের সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে।
৭ অক্টোবর পালং থানার রাজগঞ্জের কীর্তিনাশা নদী দিয়ে পাকবাহিনীর একটি লঞ্চ মাদারীপুর অভিমুখে যাত্রা করলে অ্যাম্বুশ থেকে মােঃ আবুল কাশেম মৃধার নেতৃত্বে একদল মুক্তিযােদ্ধা ওই লঞ্চে লাইট মেশিনগান ও এন, আর, গান চালিয়ে লঞ্চের ছাদ উড়িয়ে দেয়। এতে ৬জন পাকসৈন্য নিহত হয়।
নড়িয়া থানার ঘড়িষার বাজারে পিস কমিটির এক সভা চলাকালে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে কয়েকজন আহত হয়। পরে পাকবাহিনী ঘড়িষার বাজারে ঢুকে অগ্নিসংযােগ করে এবং ইউনুস মাৰি নামে এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করে। এর আগে মুক্তিযােদ্ধা সাইদুর রহমান, আবুল হাসেম ও হারুন-অর-রশীদ মেলাঘর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নড়িয়া আসার পথে নৌকায় নদী পার হতে গিয়ে পাকবাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে নিহত হয়।
পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ চালিয়ে শরীয়তপুরের অন্যান্য থানাও তাদের দখলে নিয়ে আসে। ১৬ ডিসেম্বরের আগেই পাকবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে এক প্রচন্ড যুদ্ধের পর মুক্তিযােদ্ধারা মাইকে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে রাত ৮টার দিকে পাকবাহিনীর কমান্ডার মেজর খটক তার দলবল নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার খলিলুর রহমানের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
डैनि । ৪ মে কর্নেল আতিক মালিকের নেতৃত্বে পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করে। সাথে ছিল ক্যাপ্টেন এজাজ। পিরােজপুর শহরের প্রবেশদ্বার হুলারহাট বন্দরে পাক বাহিনী পৌছলে তাদের অভ্যর্থনা জানায় মুসলিমলীগ আর জামাতের নেতৃবৃন্দ। হুলারহাটে সিদ্ধান্ত হয় প্রথম অপারেশনের। হুলারহাট থেকে পিরােজপুরে প্রবেশের পথে পাক বাহিনী প্রথম তান্ডব চালায় কৃষ্ণনগর গ্রামে। পুড়িয়ে দেয় বহু বাড়িঘর । তারপরে তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পার্শ্ববর্তী মাছিমপুর গ্রামে।
পাকবাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে-এ খবরটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে খবরটি পৌছার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা তড়িঘড়ি করে শহর থেকে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে আত্মগােপন করে। তাদের হাতে বড় ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল না যা দিয়ে তারা শত্রুর মােকাবেলা করবে।
সেনাবাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে-এ খবর শুনে মুসলিম লীগ ও জামাত কর্মীদের মধ্যে শক্তি সঞ্চার হয়। এতদিন চুপ হয়ে থাকা জামাত-মুসলীম লীগরা স্বস্তি ফিরে পায়। তারা রাজাকার এবং আলবদর বাহিনী গঠন করে। শান্তি কমিটির কাজ পুরােদমে শুরু হয়।
রাজাকারদের সক্রিয় সহযােগিতায় পাকবাহিনী শুরু করে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ । সংগ্রাম কমিটির প্রধান এনায়েত হােসেন খান এমএনএ, সদস্য ডাঃ আঃ হাই এমপিএ, ডাঃ ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল এমপিএ, এডভােকেট আলী হায়দার খান, ছাতনেত্রা এম, এ মান্নান, এবিএম সিদ্দিক প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য ভারতে যান। সংগ্রাম কমিটির প্রতিরক্ষা প্রধান লেঃ জিয়াউদ্দিন তার বিরাট বাহিনী নিয়ে সুন্দরবনে যান। শ্রমিক নেতা আজিজুল হক সিকদার শ্রমিকদের সংগঠিত করে গােপনে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করেন।
পাকবাহিনীর ৮ মাস অবস্থানকালে মহকুমার ৭টি থানায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। পিরােজপুর মহকুমায় পাকবাহিনী আর তাদের দোসরদের হাতে অন্তত ৩০ হাজার দেশপ্রেমিক নিহত হয়। ৫ হাজার মা-বােন ধর্ষিত হয় ।
তাদের হাতে তৎকালীন এসডিও আঃ রাজ্জাক, এসডিপিও ফায়জুর রহমান ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান নিহত হন। দূর্নীতি দমন বিভাগের দাবােগা ধীরেন্দ্র মহাজনকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
________________________________________
রাজাকারদের হাতে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ফজলুল হক খােকন, বিধান চন্দ্র হালদার মন্টু, পূর্ণেন্দু, বাছু, সেলিম ও প্রবীর নির্মমভাবে নিহত হয়। নিহত হয় ছাত্রলীগ সভাপতি ওমর ফারুক, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা পংকজ কর্মকার, আসাদ, অনিল ও দুলাল। ১০ জুন হত্যা করা হয় মঠবাড়িয়ার কৃতীছাত্র গণপতি হালদারকে।
গণপতির সাথে একই দিন মঠবাড়িয়া কলেজের ভিপি আনােয়ারুল কাদির, জিয়াউজ্জামান, মােস্তফা, সুধীর, মালেক, রঞ্জন, অমল, ধীরেন ও শামসুল হককে পিরােজপুরের বলেশ্বর ঘাটে হত্যা করা হয়। মঠবাড়িয়া থানার ওসি আঃ সামাদ এদের। গ্রেফতার করে পিরােজপুরে পাঠায়।
১১ মে কাউখালী লঞ্চঘাটে পিরােজপুর কলেজের ছাত্র মােক্তাদিরুল ইসলামকে হাত ভেঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কেউন্দিয়ার নূরুল মমিনকে হত্যা করার সময় তার ছােট বােন এ দৃশ্য দেখে মারা যান। কাউখালীর সুভাষ চন্দ্র দত্তকে ও কালু মহাজনকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কলার দেয়ানিয়ার জহির উদ্দিনকে জীপের পেছনে বেঁধে হত্যা করা হয়।
তেজদাসকাঠি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে খালের তীরে একসাথে ২০ জনকে হত্যা করা হয়। স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পেছনে একটি ডােবায় ৪০০ জনকে হত্যা করে পুঁতে রাখা হয়। সােহাগদল গ্রামে একই বাড়ির ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় । দৈহারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সতীশ শেখর রায়ের বাড়ির সম্মুখে ১৭ জনকে হত্যা করা হয়। বারবাক গ্রামের অঞ্জলী কর্মকারকে হতা-পা বেঁধে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। স্বরূপকাঠি থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কাজী শামসুল হককে হত্যা করা হয় ১০ জুন। কাজি শামসুল হকের হত্যার বিরুদ্ধে শর্ষিনার পীরের বিরুদ্ধে হত্যা ও দালালির মামলা দায়ের করা হয় স্বাধীনতার পর।
এছাড়াও রাজাকার, আলবদর ও পাকসেনাদের হাতে নিহত হন শতীন্দ্র কর্মকার, অহিন্দ্র কর্মকার, দেবু, প্রতুল কর্মকার, মতিলাল সাহা, নির্মল দাস, বিমল দাস, প্রফুল্ল রঞ্জন মুখার্জী, অতুল চন্দ্র মুখার্জী, রণেন্দ্র নারায়ণ মুখার্জী, মানিক সাহা, রণ সাহা প্রমুখ। জুজখােলা গ্রামের ইউনুস আলী মেম্বরের পরিবারের ১৪ জনকেও হত্যা করা হয় নির্মমভাবে।
পিরােজপুর শহরের বলেশ্বর নদীঘাটের একটি সিড়ির ওপর দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হতাে দেশ প্রেমিকদের।হলারহাটের নদীঘাট আর কাউখালীর নদীঘাটেও চলত হত্যাযজ্ঞ।
রাজাকাররা সেনা অফিসারদের জন্য মেয়েদের এন দিত। এসময় স্থানীয় ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ফতােয়া দেন সংখ্যালঘুদের মালামাল নেয়া হালাল’। ফলে এক শ্রেণীর লুটেরা মহকুমাব্যাপী সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে লুটতরাজ চালায়। শহরের অধিকাংশ সংখ্যালঘুর বাড়িঘর লুট করা হয়। অগ্নিসংযােগ করা হয়। আবার অনেক বাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
blitar
। এns।
________________________________________
পাকহানাদার বাহিনীকে এসব কাজে সহায়তা করে তৎকালীন শান্তি কমিটির সভাপতি সাবেক মুসলিম লীগ মন্ত্রী খান বাহাদুর সৈয়দ আফজাল, সাবেক সংসদ সদস্য সরদার সুলতান মাহামুদ, শরিকতলা ইউপি চেয়ারম্যান আশ্রাব আলী সিকদার, আঃ আজিজ মল্লিক, এডভােকেট আঃ মান্নান, দেলােয়ার হােসেন, মানিক খন্দকার, জিন্নাত আলী মােজার, আজিজুল হক মােক্তার, সৈয়দ সালেহ আহমেদ, আঃ জব্বার ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক মােকাররম হােসেন ও হারুন-অর রশীদ প্রমুখ।
পিরােজপুর মহকুমা মূলতঃ নদীনালা বেষ্টিত। ফলে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় এখানে ব্যাপক যুদ্ধ না হলেও মঠবাড়িয়া, কাউখালী, স্বরূপকাঠির বেশ ক’টি যুদ্ধ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এসব যুদ্ধে কয়েকশ’ পাকসেনা মারা যায়।
তুষখালীর যুদ্ধ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের অন্যতম একটি সফল লড়াই। পাকসেনারা শহরে প্রবেশ করলে লেঃ জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বিরাট দল পিরােজপুর জেলার শেষ সীমানার অপর পাড়ে সুন্দরবনে আস্তানা গাড়ে। এখান থেকেই তারা লড়াই চালায়।
এক সময় মুক্তিযোেদ্ধাদের তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিলে তারা সিদ্ধান্ত নেয় মঠবাড়িয়া থানার তুষখালীর খাদ্য গুদাম আক্রমণের।
১৫ অক্টোবর গভীররাতে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল আক্রমণ চালায় খাদ্যগুদামে। গুদাম পাহারায় ছিল সাড়ে ৩শ’ রাজাকার। অতর্কিত হামলায় রাজাকাররা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং আত্মসমর্পণ করে। সুন্দরবনে পিরােজপুর, ভান্ডারিয়া, মঠবাড়িয়া, শরণখােলা, মােরলগঞ্জের অন্তত ১৪ হাজার মুক্তিযােদ্ধা ছিলাে।
সেপ্টেম্বর মাসের যুদ্ধ ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এ সময় বড়মাছুয়া, সাপলেজা, হােট মাহুয়া, চরদোয়ানী, বগী, তাকালবাড়িয়া, সাউথখালি, শরণখােলা, সুপতি, শেলা ও জিউধারা এলাকায় টহলরত পাকবাহিনীর লঞ্চ ও গানবােটের ওপর হামলা চালানাে হয় । ১২ দিন ধরে চলে এ যুদ্ধ। মূল নেতৃত্বে থাকেন লেঃ জিয়াউদ্দিন। ১২ দিনের লড়াইয়ে অন্তত ১শ’ সেনা নিহত হয়। হাবিলদার আলাউদ্দিন ৬০/৭০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে পাকবাহিনীর মােকাবেলা করে নিহত হন। নেভাল ওয়ারেন্ট অফিসার আঃ গফফারও কৃতিত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। এসব যুদ্ধে শামসুল আলম তালুকদার, শহীদুল আলম বাদল, হাবিলদার সােহরাব সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
এখানে আর একটি উল্লেখযােগ্য লড়াই ছিল রকেট স্টিমার হামলা। ৮শ’ জনের পাঞ্জাবী সেনার একটি দল রকেটবােগে খুলনা যাওয়ার পথে মুক্তিযােদ্ধারা গামছা পরে তাতে আক্রমণ চালালে ৭০ জন পাকসেনা আহত হয়। লেঃ জিয়ার নেতৃত্বে মংলা পােটে থাকা ১৮টি জাহাজের ওপরও লিমপ্যাড মাইন দিয়ে আক্রমন চালানাে হয়। মুক্তিযােদ্বারা পিরােজপুর, শরণখোলা, মঠবাড়িয়া থানা আক্রমণ করে ছিনিয়ে নেয়।
________________________________________
স্বরূপকাঠির শর্ষিনা শরীফে মুক্তিযোেদ্ধাদের হামলা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ২৫ নভেম্বর চাখার কলেজের ছাত্র কাজী মতিয়ার রহমানের নেতৃত্বে শর্ষিনায় অবস্থানরত আলবদর বাহিনীর ঘাঁটির ওপর হামলা চালানাে হয়। ২ দিন ধরে চলে লড়াই। লড়াইয়ে মতিয়ার রহমান, হারুন ও মধু শহীদ হন। | জাহাঙ্গীর বাহাদুরের নেতৃত্বে ১৪ আগস্ট ইন্দেরহাটে আক্রমণ চালানাে হয়। এতে ১৭ জন পাকসেনা খতম হয়। জাহাঙ্গীর বাহাদুরের নেতৃত্বে স্বরূপকাঠি ও নাজিরপুর থানা আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র হস্তগত করা হয়।
কুড়িয়ানার পেয়ারা ক্ষেত প্রসিদ্ধ। এই পেয়ারা ক্ষেতে আশ্রয় নেয় সিরাজ সিকদার তার নকশাল বাহিনী নিয়ে। খবর পৌছে পাকসেনাদের কাছে। দ্রুত চলে আসে তারা। সর্বহারারা আত্মগােপন করে। পাকসেনারা পেয়ারা ক্ষেত কেটে উজাড় করে দেয় ।
কমান্ডার আঃ আজিজের নেতৃত্বে ভান্ডারিয়া থানা আক্রমণ করে অন্ত নেয়া হয়। এ সময় আনসার কমান্ডার আজাইর বিশ্বাস গ্রেনেড মেরে থানায় অবস্থানরতদের অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করেন।
কাউখালীর কেউন্দিয়ার যুজও উল্লেখযােগ্য। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক হাবিবুর রহমান আঃ হাই পনা ও সুলতান কাজীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে একটি মুক্তিবাহিনী । ৯ই আগষ্ট তারা কাউখালী থানা আক্রমণ করে ছিনিয়ে নেয়। পাকবাহিনীর সদস্যরা কেউন্দিয়ায় গেলে মুক্তিযােদ্ধারা চারদিক থেকে পাকসেনাদের ঘিরে ফেললে ১৭জন পাক সেনাসহ ৩০ জন মারা যায়।
৩০ এপ্রিল পাকবাহিনী গােপালগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে নৃশংস তান্ডবলীলা চালায়। শহরে প্রবেশ করেই তারা বাড়িঘরে আগুন দিতে শুরু করে। হানাদারবাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, সিরাজুল হক এর বাড়ি, চৌরঙ্গী আবদুল লতিফের বাসভবন, চৌরঙ্গী রােড ও স্বর্ণপষ্টির দোকানপাট পুড়িয়ে ছারখার করে। | পাকবাহিনী যেদিন গােপালপত্রে প্রবেশ করে সেদিন-ই রাতে স্থানীয় মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রস, ছাত্র ফেডারেশন এবং কতিপয় ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার ও সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে হানাদার বাহিনীর কর্মকর্তাদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার আহবান জানানাে হয় এবং পরে এই লক্ষ্যে শহরে ও বিন্নি স্থানে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। | পাকবাহিনীকে সাহায্যকারী রাজাকারদের ক্যাম্পের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হিল থানা পরিষদের ক্যান্টনমেন্টসংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প ও কোটালীপাড়া থানার কাকডাঙ্গা-গােপালপুর মাদ্রাসায় রাজাকার ক্যাম্প ও ভাটিয়াপাড়ার রাজাকার ক্যাম্প। পাকবাহিনী গােপালগঞ্জে প্রবেশের পর পরই স্থানীয় দোসরদের সহযােগিতায় বিভিন্ন স্থানে পােড়নীতি অভিযান পরিচালনা করে। ৭ মে হানাদার বাহিনী মানিকহারে হামলা করে এবং প্রথম প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। ক্যান্টেন হালিম ও ক্যাপ্টেন মিলুর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা
________________________________________
তাদেরকে প্রতিরােধ করে এবং সম্মুখ যুদ্ধ হয় এ সময় মনি সিকদার ও অন্য একজন মুক্তিযােদ্ধা শাহাদাৎ বরণ করেন। এরপর পাকবাহিনী কেকানিয়া, ঘােড়াদাইড়, পাইককান্দি প্রভৃতি গ্রামে ব্যাপক অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট চালায়। এ সময় ঘােড়াদাইড়ে একজন এবং কেকানিয়ায় ইউনুস, আবুল, বালাসহ আরাে অনেকে শহীদ হন। ফলে লুৎফর রহমান বাজুসহ মুক্তিযােদ্ধারা পালিয়ে নদীর ওপারের গ্রামে চলে যায়। পরের দিন ভােরে লঞ্চযােগে পাকবাহিনী ঐ গ্রামে হামলা করে।
১১ মে কামরুল ইসলাম রইস, আবুল হাশেম সমাদ্দার প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ভারতে চলে যান এবং আওয়ামী সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এসব নেতার উদ্যোগে ভারতে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় প্রবেশের পরই মূলত গােপালগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের লড়াই নতুন গতি পায়।
ক্যাপ্টেন জালাল আহমেদের নেতৃত্বে ১৯ মে গােপলগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম অভিযান শুরু হয়। এই দিন মুক্তিযােদ্ধারা শহরে ট্রেজারী ভেঙ্গে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে নেয় এবং পাকবাহিনীর সহযােগী কাফু,আবসার উদ্দিন ও অবদুল মজিদকে হত্যা করে।
১০ মে মডেল স্কুল রােডের শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে হানাদারবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। ১৪ মে পাকবাহিনী কোটালীপাড়া থানার-উত্তর এলাকার গ্রামগুলােতে হামলা চালায়। পাকবাহিনী অভিযান চালিয়ে রাধাগঞ্জ, খেজুরবাড়ী, বরুয়া, গাছবাড়ি, কলাবাড়ী প্রভৃতি গ্রামের দুই শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং কলাবাড়ী গ্রামের বয়ােবৃদ্ধ মতিলাল
ড়ৈ, তরণীকান্ত বালাসহ দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশুকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ সময় সুভাষ সরকার ও রতিকান্ত সরকার নামে দু’জন মুক্তিযােদ্ধা তীর-ধনুক দিয়ে হানাদার বাহিনীকে হামলা করলে তাদেরকে পৈশাচিকভাবে মারা হয়।
২২ মে হানাদার বাহিনী সদর থানার ডালনিয়া, দুর্গাপুর, বাঘজুড়ি, ডােমরাশুর, কাটোরবাড়ি, মালিগাতা প্রভৃতি গ্রামে আগুন দিয়ে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় এবং লুটপাট ও হত্যাযজ্ঞ চালায় । ঐদিন ঐসব গ্রামের কমপক্ষে ৫০ জন সাধারণ লােককে হানাদারবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। পরে ডালনিয়া গ্রামের একটি ডােবা পুকুরের কচুরিপানার ভিতর থেকে ১২টি লাশ উদ্ধার করা হয়। দখলদার বাহিনীর সদস্যরা ২৪ জুন গােপীনাথপুর থেকে রঘুনাথপুর যাওয়ার পথে ফিরােজ খাঁ, কিবরিয়া খা, মােতালেব সরদার ও ডালনিয়া গ্রামের শচীন্দ্রনাথ বৈদ্যকে ধরে এনে ক্যান্টনমেন্টের বধ্যভূমিতে নির্মমতাক্তেহত্যা করে।
গােপালগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি বাহিনী বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মুজিব বাহিনী (বি,এল,এফ), মুক্তিবাহিনী (এফ,এফ) ও হেমায়েত বাহিনী। মুজিববাহিনীর নেতৃত্ব দেন ইসমাত কাদির গামা, ভারতে প্রশিক্ষিত মুক্তি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন লুৎফর রহমান বাহু, কমান্ডার এমদাদুল হক চৌধুরী, কমান্ডার মনি রায় প্রমুখ। এছাড়া কোটালীপাড়া থানার জহরেরকান্দি মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষিত বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন হেমায়েত উদ্দিন। এই বাহিনী হেমায়েত বাহিনী নামেই পরিচিত ছিল। ক্যাপ্টেন
________________________________________
হালিম, ক্যাপ্টেন মিলু ও ক্যাপ্টেন শিহাবুদ্দিনের নেতৃত্বেও আলাদা আলাদা বাহিনী মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে।
পাকহানাদার বাহিনীর একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট ছিল কাশিয়ানী থানার ভাটিয়াপাড়া ওয়ারলেস স্টেশনে। এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াই হয় পাকবাহিনীর এই ক্যাম্প দখল নিয়ে। আগস্ট মাসের শেষের দিকে সবত ২৩ আগস্ট ফরিদপুরের দিক থেকে ক্যাপ্টেন বাবুলের নেতৃত্বে এবং গােপালগঞ্জের দিক থেকে ক্যাপ্টেন ইসমত কাদির গামা ও ক্যান্টন হেমায়েতের যৌথ নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা মধ্যরাতে ওয়ারলেস ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এ সময় ওয়ারলেস স্টেশনটিতে কমপক্ষে ৫০ জন পাকসেনা ও তাদের সহযােগী শতাধিক রাজাকার ছিল। একটানা পনের ঘন্টা লড়াই চলে। লড়াই-এ মুজিব বাহিনীর ইসমাত কাদির গামাসহ ১২৪ জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা একটি মর্টার, ৪টি এসএমজি, ৫৬টি ৩০৩ রাইফেল, ২৬টি এসএলআর প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করে। যুদ্ধে ১৯ জন খানসেনা এবং ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা মিন্টুসহ যুদ্ধে সাধুহাটির জয়নাল ও রামদিয়া কলেজের ছাত্র ইয়াসির শহীদ হন। পাকবাহিনীকে সাহায্য করতে বিমানবাহিনীর একটি সেভার জেট থেকেও গুলিবর্ষণ করা হয়। অবশ্য এর আগেই মুক্তিযােদ্ধারা এলাকা ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়।
১৪ অক্টোবর কোটালীপাড়া থানার রাজপুর গ্রামে লড়াই চলে খানসেনা ও মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে। মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন হেমায়েত-বাহিনীর কমান্ডার ক্যাপ্টেন হেমায়েত উদ্দিন ও তার সহকারী বীর মুক্তিযােদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞ। গানবােটে থান-সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের রাজাপুরের অবস্থানের ওপর হামলা চালালে সরাসরি যুদ্ধ। বেঁধে যায়। যুদ্ধে ইব্রাহিম নামক একজন মুক্তিযােদ্ধা ও ২ জন খানসেনা মারা যায় । পাকবাহিনীর গুলিতে ক্যাপ্টেন হেমায়েতের চোয়াল ঝাঝরা হয়ে যায় এবং অল্পের জন্য তিনি বেঁচে যান। অক্টোবরের শেষের দিকে ক্যাপ্টেন শিহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে ফুকরায় টহলরত পাকবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। প্রায় ৬ ঘন্টার এ যুদ্ধে ফুকরার রবিউল, বাহিরবাগের ইমামউদ্দিনসহ তিনজন মুক্তিযােদ্ধা ও প্রায় ৪০ জন নিরীহ গ্রামবাসী শহীদ হন। | এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটে অক্টোবরের ১২ অথবা ১৩ তারিখে। ক্যাপ্টেন হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা পাকবাহিনীর খাদ্য সরবরাহকারী একটি কার্গো ছিনিয়ে আনে কোটালীপাড়ার কলাবাড়ী গ্রামে। খবর পেয়ে মানিকদে ও বাঁশবাড়িয়া থেকে বিপুল সংখ্যক পাকসেনা মুক্তিযােদ্ধাদের কলাবাড়ী গ্রামের অবস্থানের ওপর হামলা করে। মুক্তিবাহিনী পালিয়ে গেলে শুরু হয় বন্যাপ্লাবিত গ্রামবাসীর ওপর নির্মম অত্যাচার। একই দিনে প্রায় ২৫০ জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে চোখ, হাত-পা বেঁধে বেয়ােনেট চার্জ করে উদ্ধারকৃত কার্গো থেকে নদীতে ফেলে দিয়ে পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে।
________________________________________
মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল লতিফ এ এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করেন। একসময় পাকসেনারা তার নিজ গ্রাম ঘােষেরচর আক্রমণ করে এবং ব্যাপক অগ্নিসংযোেগ, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পর্যায়ক্রমে তার সহােদর ভাই আসাদ, আবদুল হাই, ভাইপাে মনিরকে ধরে এনে বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে হানাদার বাহিনীর জল্লাদরা। জুলাইয়ের শেষ দিকে একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী নিয়ে ভারত থেকে এলাকায় ফেরার পথে যশােরের কোন এক স্থানে পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে আবদুল লতিফ শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের আরেক বীর সেনানী ওয়ালিউর রহমান লেবু ছিলেন কমিউনিষ্ট পার্টি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলাবাহিনীর ৮ ও ৯ নং সেক্টরের প্রধান সমন্বয়কারী ।
গােপালগঞ্জে জয়বাংলা পুকুর বা ‘৭১-এর বধ্যভূমি’ হচ্ছে এক স্মৃতিবিধুর স্থান। শত শত মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালির আত্মাহুতির নীরব সাক্ষী এই জয়বাংলা পুকুর। পাকবাহিনী বিন্নি স্থান থেকে মুক্তিযােদ্ধা ও মুেিদ্ধর সমর্থকদের ধরে এনে সদর থানা পরিষদ সংলগ্ন তাদের ক্যান্টনমেষ্ট্রের পাশের পুকুরপাড়ে বেয়ােনেট চার্জ করে কিংবা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফলে এটি একাত্তরের এক বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। বিশি মুক্তিযােদ্ধা গােবরার গুলজার হােসেন চৌধুরী ও চান মিয়া চৌধুরী রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে এই বধ্যভূমিতে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের। গােপালগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধে কাশিয়ানীর শীধাম উড়াকান্দি ছিল ৮ নং সেক্টরের অধীনে গােপালগঞ্জ অঞ্চলের মুক্তিযোেদ্ধাদের হেড কোয়ার্টার। ফরিদপুরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন বাবুল আক্তারের অস্থায়ী দপ্তরও ছিল এই ওড়াকান্দি ধামে। এছাড়া গেপীনাথপুর, মাহকালি, কোটালীপাড়ার জহরের কান্দিতে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাশ ছিল। জহরের কান্দির মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের পরিচালক ছিলেন প্রাক্তন সংসদ সদস্য লক্ষ্মীকান্ত বল এবং প্রশিক্ষক ছিলেন জাবেদ আলী ও সাদেক ফকির। এসব ক্যাশে যেসব মুক্তিযােদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর কমান্ডার বিভিন্ন সময়ে পাকবাহিনীর সাথে সমুখ যুদ্ধে কিংবা গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তারা হলেন কমান্ডার ইসমত কাদির গামা, সুর রহমান বাছু, এমদাদুল হক চৌধুরী, ক্যাপ্টেন শিহাবুদ্দিন, ক্যাপ্টেন মিলু, ক্যাপ্টেন হালিম (পেয়ারা), ক্যাপ্টেন জালাল, ক্যাপ্টেন হেমায়েত, ক্যাপ্টেন আবদুর রহমান, মীর নওশের আলী, সােবহান মিয়া, কমান্ডারঅনি রায় প্রমুখ।
একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বত্র একইভাবে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ চালিয়ে
১৭৫৭ সাল থেকে বাঙালি জাতি বিদেশী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের সূচনা করেছিলাে তার সফল সমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাঙালি জাতি খুঁজে পায় তার সঠিক পরিচয়।
________________________________________
छ । ১.বগত সংক্রান্ত সরকারি দলিল ১৯০৫ ২২ বেল ও আসাম সেটে ১৯০৫ ৩. বাতরুণ সংক্রান্ত সরকারি দলিল, ডিসেম্বর ১৯১১ ৪. ইণ্ডিয়া গেজেট, ডিসে ১১১১ ৫. পাকিস্তান মুভমেন্ট, হিৱিক ডকুমেন্ট, মার্চ ১৯৪০ ৬. মুসলিম পলিটি ইন বেঙ্গল, সেপ্টেম্বর ১৯৪১ ৭. দি টসম্যান, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪১ ৮, পাকিস্তান প্রস্তাব ওফকুল হক, জুন ১৯৪২ ৯. বুদ্ধির মুক্তি ও রেনেসাঁ আন্দোলনের কাগজপত্র, ১৯৪৩ ১০. বেট্রসপেকশন, এপ্রিল ১৯৪৬ ১১. দি ইস্যুশন অব ইন্ডিয়া এক পাকিস্তান, মে ১৯৪৬ ১২. মর্নিং নিউ, ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ ১৩. মনি নিউ, ২১ এপ্রিল ১৯৪৭ ১৪.বুক ইনটু দি মিরর, ৮ মে ১৯৪৭ ১৫, সাপ্তাহিক মিল্লাত, ৯ মে ১৯৪৭ ১৬, জিন্না শীসে এত গভর্নর জেনারেল অব পাকিস্তান, আপ১৯৪৭ ১৭, পাকিস্তান সেশনটুপাকিস্তান, আগষ্ট ১৯৪৭ ১৮. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কাগজপত্র সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ১৯. পাকিস্তান তমু মজলিসের কাগজপত্র, ফের ১৯৪৭ ২০. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কাগজপত্র, ১৯৪৭ ২১. পাকিস্তান গণপরিষদেরাগ , ১৯৪৮ ২২. সাহিন বেলাল, ৪ মার্চ ১৯৪৭ ২৩. পূর্ববাংলায় আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, মার্চ ১৯৪৭ ২৪.এসশি ব্যস্থাপসঅরফাগজপত্র, ১৯৪৮ ২৫. শহীদুল্লাহ আর , ডিসেম্বর ১৯৪৮ ২৬. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কাগজপত্র, ১৯৪১ ২৭, সাহিৰু মাত্র নও, ১৪ আগষ্ট ১৯৪১ ২৮, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাগজপত্র, ১৯৪১ ১, পাকিস্তান গণপরিষদের পত্র নভেম্বর, ১৯৫০ ৩০, গণতান্ত্রিক ফেডারেশনের কাপনভেম্বর ১৯৫০ ৩১. পাকিস্তান গণপরিষদের কাগজপত্র ৭ নভেম্বর ১৯৫০ ৩২. পাকিস্তান গণপরিষদেকাগজপত্র ২১ হতে ১৯৫০ ৩৩, পূর্ব পাকিান যুবলীগের পত্র ১৭মার্চ ১৯৫১ ৪.সাহিনও বাহার ধুলাই ১৯৫১ ৩৫. সাহিকমাহ নও তাই ১৯৫১ ৩৬. পূর্ব পাকিস্তানব্যবস্থাপক সভার কর্মবিরণী ১৯৫১ ৩৭, দৈনিক আযাদ ২৮ জানুয়ারি ১৯৫১ ৩৮. একুশের সংকলন ক্ৰেয়ারী ১৯৫২ ৩১. দৈনিক আযাদ ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ ৪০. সাহিক নও বাহার ১৯৫২ ৪১.পাকিস্তান প্রচার বিগের কাগজপত্র ১৯৫২ ৪২. পূর্ব পাকিস্তান ফুবলীগের কাগজপত্র ১৯৫২ ৪৩, পাকিস্তান গনপরিষদের কাগজপত্র ১৯৫২
________________________________________
৪৪. সর্বদলীয় রাষ্ট্র কর্মপরিষদেৱকাগজপত্র ১৯৫২ ৪৫. ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের কাগজপত্র মে ১৯৫২ ৪৬, বিচার বিভাগের কাগজপ ২৭ মে ১৯৫২ ৪৭, পাকিস্তান গণপরিষদের কাগজপত্র ১২ ডিসেম্বর ১৯৫২ ৪৮, পাকিস্তান গণপরিষদের কাগজপত্র ২২ ডিসেম্বর ১৯৫২ ৪১. পাকিস্তান গণপরিষদের কাগপত্র ৭অক্টোবর ১৯৫২ ৫০. যুন্ট সংক্রান্ত কাগজপত্র ক্ৰেয়ারি ১৯৫২ ৫১. যুফ্রন্ট সংক্রান্ত কাগজপত্র মার্চ ১৯৫৪ ৫২. দৈমিকআপ এপ্রল ১৯৫১ ৫৩, আওয়ামী মুসলিম লীগের কাগজপত্র ১৯৫৪ ৫৪, সাহিত্য সঙ্কেলন কমিটির কাগজপত্র এপ্রিল ১৯৫৪ ৫৫. দি ডন ৮ মে ১৯৫৪ ৫৬. দি ডন ১১ মে ১৯৫৪ ৫৭, সৈনিক অবজারভার ২৫ মে ১৯৫৪ ৫৮. দৈনিক অবজারভার ২৬ মে ১৯৫৪ ৫১. দৈনিক অবজারভার ৩১ মে ১৯৫৪ ৬০. দৈনিক বজারভার ২৫ অক্টোবর ১৯৫৪ ৬১. যুঞ্জন্টের কাগজপত্র ১০ এপ্রিল ১৯৫৫ ৬২. রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সমাবেশ সংক্রান্ত দলিল, এপ্রিল ১৯৫৫ ৬৩, আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র, মে ১৯৫৫ ৬৪. অবজারভার ১কুন ১৯৫৫ ৬৫. অবজারভার ৬ জুন ১৯৫৫ ৬৬, অবজারভার ৭ জুন ১৯৫৫ ৬৭, অবজারচার ১ জুন ১৯৫৫ ৬৮, অবজারভার ১১ জুলাই ১৯৫৫ ৬৯. গণপরিষদের কাগজপত্র, আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ ৭০. সরকারি কাগজপত্র, ১৯৫৫ ৭১. অবজারলর ২৪ অক্টোবর ১৯৫৫ ৭২, গণপরিষদের কাগজপত্র, ১৯৫৬ ৭৩, দৈনিক সংবাদ ১৬ জানুয়ারী ১৯৫৬ ৭৪. গণপরিষদের কাগজপত্র,১৯৫৬ ৭৫, আওয়ামীলীগের প্রচার, আগষ্ট ১৯৫৬ ৭৬, জারতার ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ ৭৭, সরকারি প্রচার বিভাগের কাগজপত্র অক্টোবর ১৯৫৬ ৭৮, গণপরিষদের কাগজপত্র, অক্টোবর ১৯৫৬ ৭১. অবজারতার ১১ অক্টোবর ১৯৫৬ ৮০, সসানীর লিফলেট, ১৩ জানুয়ারী ১৯৫৭ ৮১, কাগমারী সম্মেলন সংক্রান্ত কাগজপত্র, ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ ৮২, সংবাদ ৬-৮ ব্রুেয়ারি ১৯৫৭
৩, আযাদ ১২ শ্রেয়ারি ১৯৫৭ ৮৪. তাসনীয় লিফলেট, ২৬ মার্চ ১৯৫৭ ৮৫.সদে ২৬ জুলাই ১৯৫৭ ৮৬. সাহিক সৈনিক ২৮ নতে ১৯৫৭ ৮৭. পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার কাগজপত্র, এপ্রিল ১৯৫৭
________________________________________
৮৮, সরকারি কাগজপত্র, ৪ জানুয়ারি ১৯৫৮ ৮৯, সরকারি কাগজপত্র, ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ ৯০. ডকুমেন্ট এণ্ড দি শীচেস অনাদি কনস্টিটিউশন অব পাকিস্তান, অক্টোবর ১৯৫৮ ৯১. অবরতার ২৮ অক্টোবর ১৯৫৮ ১২ সামরিক আইন ঘােষণার সরকারি কাগজপত্র, ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ ৯৩, ভাসানীকে গ্রেফতার সক্রোন্ত কাগজপত্র, ১০ অক্টোবর ১৯৫৮ ৯৪. অবজারভার ১৩ অক্টোবর ১৯৫৮ ৯৫, পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সরকারি চিঠি, ২১ মে ১৯৫৯ ৯৬, নির্বাচন সংক্রান্ত সরকারি আদেশ, ৬ আগষ্ট ১৯৫৯ ৯৭, অবজারভার ২৭ অক্টোবর ১৯৫৯ ৯৮. গােপন প্রতিবেদন ১৯৫৯ ৯৯, ইউনিয়ন পরিষদ সংক্রান্ত সরকারি প্রতিবেদন, ১ ব্রুেয়ারি ১৯৬০ ১০০. সরকারি প্রতিবেদন ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ ১০১. সরকারি গােপন প্রতিবেদন ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ ১০২ শাসনতান্ত্রিক কমিশনের রিপাের্ট, ২৯ এপ্রিল ১৯৬১ ১০৩, ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে সরকারি প্রতিবেদন, ২৩ জুন ১৯৬১ ১০৪, অবজারভার ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬১ ১০৫, অবজারভার ৩১ জানুয়ারী ১৯৬১ ১০৬. অবজার৭শ্রেয়ারি ১৯৬২ ১০৭, স্ব দফতরের প্রতিবেদন, ১৪ ক্ৰেয়ারি ১৯৬২ ১০৮. সরকারি প্রতিবেদন ১৪ কেয়ারি ১৯৬২ ১০৯, সরকারি চিঠি ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬২ ১১০. আযম খানের কাগজপত্র, ৭জানু ১৯৬২ ১১১. আযম খানের কাগজপত্র ১৬ জুন ১৯৬২ ১১২, অবজারভার ৮ জুন ১৯৬২ ১১৩. সরকারি পুস্তিকা, মার্চ ১৯৬২ ১১৪, অবজারভার ২৫ জুন ১৯৬২ ১১৫, সরকারি রাজনৈতিক দলৰিধি, ১৫ জুলাই ১৯৬২ ১১৬, অবজারভর ১৮ সেক্ষে ১৯৬২ ১১৭, অবজারভার ২৮ সেটে ১৯৬২ ১১৮, অবজারভার ২৮ ডিসেম্বর ১৯৬২ ১১৯.ত্রিসমাজের প্রচারপত্র, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৩ ১২০, অবকার ৩ সেটে ১৯৬৩ ১২১, অবজারভার ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ ১২২. সামী মুত্র সমাজের প্রচারপত্র, সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ ১২৩, ইত্তেফাক ১৭ জানুয়ারি ১৯৬৪ ১২৪. নির্বাচন কর্ম পরিষদের প্রচারপত্র, মার্চ ১৯৬৪ ১২৫, আযাদ ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪। ১২৬, ন্যাশনাল আওয়ামী পারিণতিকা,অক্টোবর ১৯৬৪ ১২৭, সংযুক্ত বিরােধী দলের প্রচারপত্র নভেম্বর ১৯৬৪ ১২৮. কৃষক সমিতির প্রচারপত্র, নভেম্বর ১৯৬৪ ১২৯. সংগ্রামী ছাত্র সমাজের প্রচারপত্র, ডিসেম্বর ১৯৬৪ ১৩০. সংযুক্ত বিরােধী দলের কাগজপত্র, ডিসেম্বর ১৯৬৪ ১৩১. সরকারি কাগজপত্র, জানুয়ারি ১৯৮৫
________________________________________
১৩২. ন্যাপের কাগজপত্র ৫ ১১৬৫ ১৩৩, আওয়ামীলীগের কাগজপত্র, ক্ৰেয়ারি ১৯৬৬ ১৩৪, সংবাদ১জুন ১৯৬৬ ১৩৫, অবজারভার ১৮ জুন ১৯৬৬ ১৩৬, আবার ৩১ মার্চ ১৯৬৬ ১৩৭, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাগজপ, ২৫ ১৯৬৭ ১৩৮, দৈনিক পাকিস্তান ২৮- ১৯৬৭ ১৩৯, দৈনিক পাকিস্তান ১৪ আগষ্ট ১৯৬৭ ১৪০, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুতি, সেন্টের ১৯৬৭ ১৪১. ন্যাপের পুস্তিকা, ৩০ নভেম্বর ১৯৬৭ ১৪২ দৈনিক পাকিস্তান ৭নুয়ারী ১৯৬৮ ১৪৩. দৈনিক পাকিস্তান ১৮ জানুয়ারি ১৯৬৮ ১৪৪, সরকারি কাগজপত্র, ২৯ জুন ১৯৬৮ ১৪৫, আগরতলা মামলার কাগজপত্র, জুন ১৯৬৮ ১৪৬. দৈনিক পাকিস্তান ৪ জুলাই ১৯৬৮ ১৪৭:দৈনিক পাকিস্তান ১৩ আগস্ট ১৯৬৮ ১৪৮, দৈনিক পাকিস্তান সেটের ১৯৬৮ ১৪৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংগঠনের প্রচার পুস্তিকা, ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ ১৫০. দৈনিক পাকিস্তান ১১ অক্টোবর ১৯৬৮ ১৫১.দৈনিক পাকিস্তান ২৭ নভেম্বর ১৯৬৮ ১৫২ শ্রমিক সংবাদ ২ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ১৫৩, দৈনিক সংবাদ ২ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ১৫৪. অবজারভার ৭ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ১৫৫. দৈনিক পাকিস্তান ৮ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ১৫৬, দৈনিক পাকিস্তান ১৪ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ১৫৭, আযাদ ২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৮ ১৫৮.দৈনিক পাকিস্তান ১নুয়ারি ১৯৬৯ ১৫৯. লেখক কমিটির প্রচারপত্র, ১৪ জানুয়ারি ১৯৬৯ ১৬০, আযাদ ১৫ জানুয়ারি ১৯৬১ ১৬১, ছাত্র সমাজের প্রচার, নুয়ারি ১৯৬১ ১৬২ দৈনিক পাকিস্তানের ১৮ এনুয়ারি ১৯৬৯ ১৬. দৈনিক পাকিস্তান ১৯নুয়ারি ১৯৬৯ ১৬৪, সংবাদ ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯। ১৬৫. দৈনিক পাকিস্তান ২১ জানুয়ারি ১৯৬১ ১৬৬, সংবাদ ২১ জানুয়ারি ১৯৬১ ১৬৭, সংগ্রামী ছাত্র সমাজের প্রচারপত্র, ব্রুেয়ারি ১৯৬১ ১৬৮.দৈনিক পাকিস্তান ৭য়ােরি ১৯৬২ ১৬১. সংবাদ ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ১৭০.সৈনিক পাকিস্তানকেয়ারি ১৯৬১ ১৭১. ইত্তেফাক ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ ১৭২. ইত্তেফাক ১৭ কেয়ারি ১৯৬১ ১৭৩, ইত্তেফাক ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ১৭৪.দৈনিক পাকিস্তান ২২ কেয়ারি ১৯৬৯ ১৭৫, দৈনিক পাকিস্তান ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
________________________________________
১৬. দৈনিক পাকিস্তান ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ১৭৭, আওয়ামীলীগের পুস্তিকা, ১০ মার্চ ১৯৬১ ১৭৮ ইত্তেফাক ১৪ মার্চ ১৯৬১ ১৭৯, ইত্তেফাক ২৬ মার্চ ১৯৬৯ ১৮০. কমিউনি বিপ্লবীদের প্রচারপত্র, এপ্রিল ১৯৬৯ ১৮১. মােজাফফর ন্যাপের কাগজপত্র, এপ্রিল ১৯৬১ ১৮২. ছাত্র সমাজের বক্তব্য, আগস্ট ১৯৬১ ১৮৩, আওয়ামী লীগের কাগজপত্র, ১আগ১৯৬১ ১৮৪. পূর্বদেশ ১৬ নভেম্বর ১৯৬৯ ১৮৫, দি ডন ২১ নভেম্বর ১৯৬১ ১৮৬, ছাত্র সমাজের ব্য , নভেম্বর ১৯৬৯ ১৮৭, পূর্বদেশ ৩০ নভেম্বর ১৯৬৯ ১৮৮, ছাত্র ইউনিয়নের কাগজপত্র, ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ ১৮৯, পূর্বদেশ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ ১৯০. পূর্বদেশ ২২ মার্চ ১৯৭০ ১৯১. মর্নিং নিউজ ২৯ মার্চ ১৯৭০ ১৯২ পূর্বদেশ ৩০ মার্চ ১৯৭০ ১৯৩, মর্নিং নিউজ ৩১ মার্চ ১৯৭০ ১৯৪, ইত্তেফাক ১,২, ৩ এপ্রিল ১৯৭০ ১৯৫, ছাত্রলীগের কাগজপত্র, ৫ এপ্রিল ১৯৭০ ১৯৬, ছাত্র ইউনিয়নের কাগজপত্র, ১২ এপ্রিল ১৯৭০ ১৯৭, শ্রমিক ফেডারেশনের কাগজপত্র, ১৭ এপ্রিল ১৯৭০ ১৯৮, দি ডন ১৬ আগস্ট ১৯৭০ ১৯১, ছাত্র লীগের কাগজপত্র, ২৩ জুলাই ১৯৭০ ২০০, দি ডন ২১ দুলাই ১৯৭০ ২০১. ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাগজপত্র, ৫ আগষ্ট ১৯৭০ ২০২ দি ডন ১৬ আগষ্ট ১৯৭০ ২০৩, ছাত্র সংগঠনসমূহের যৌথ প্রচারপত্র, ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ ২০৪, গের সার্কুলার,১৭ সেন্টের ১৯৭০ ২০৫, সাদিক ফোরাম, ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ ২০৬, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কাগজপত্র ২০৭, দি পিপলস ১৮অক্টাবর ১৯৭০ ২০৮, এপিপি ২৮ অক্টোবর ১৯৭০ ২০৯, এপিপি ৫নভে ১৯৭০ ২১০, সাপ্তাহিক লেন ১৯৭০ ২১১. পুসেন ২০ কে১১৭ ২১২ মর্নি মিউকে ১৯৭০ ২১৩, মর্নিং নিউ২৮ন ১৯৭০ ২১৪. সসানীর প্রচারপত্র, ১৯৭০ ২১৫, আওয়ামী লীগের প্রচার,১ডিসেম্বর ১৯৭০ ২১৬, সিজন ১১ ডিসেম্বর ১৯৭০ ২১৭, জিয়ার ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭০ ২১৮. টাইফস ২১ ডিসেম্বর ১১ ২১৯, অসারতায় ২২ ডিসে ১৯৭০
________________________________________
২২০. মুজাহিদ সংগঠনের পুস্তিকা, ১ ডিসেম্বর ১৯৭১ ২২১. ইত্তেফাক ৪ জানুয়ারী ১৯৭১ ২২২. অবজারভার ৪ জানুয়ারী ১৯৭১ ২২৩. শ্রমিক আন্দোলনের কাগজপত্র, ৮ জানুয়ারী ১৯৭১ ২২৪, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কাগজপত্র ১৪ জানুয়ারি ১৯৭১ ২২৫, টাইমস ৩১ জানুয়ারি ১৯৭১ ২২৬, অবজারভার ৬ কেয়ারি ১৯৭১ ২২৭, দি ডন ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২২৮, টাইমস ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২২৯, কৃষক সমাজবাদী দলের প্রচারপত্র, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২৩০, দি ডন ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২৩১, ইত্তেফাক ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২৩২ অবজারভার ১৭ কেয়ারি ১৯৭১ ১৩৩, দি ডন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ | ২৩৪ মর্নিং নিউজ ১৮ ক্ৰেয়ারি ১৯৭১
২৩৫, ছাত্র ইউনিয়নের কাগজপত্র, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২৩৬, ছাত্রলীগের প্রচারপত্র, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২৩৭, সংগ্রাম ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ ২৩৮. কমিউনিষ্ট পার্টির কাগজপত্র, ২৫ ব্রুেয়ারি ১৯৭১ ২৩৯, দি ডন ১ মার্চ ১৯৭১ ২৪০ মর্নিং নিউজ ২ মার্চ ১৯৭১ ২৪১. দি পিপল ২ মার্চ ১৯৭১ ২৪২, শ্রমিক আন্দোলনের প্রচারপত্র, ২ মার্চ ১৯৭১ ২৪৩, ছাত্রীগের কাগজপত্র, ৩ মার্চ ১৯৭১ ২৪৪. দি পিপল ৩ মার্চ ১৯৭১ ২৪৫ দি ডন ৪ মার্চ ১৯৭১ ২৪৬, দি ডন ৫ মার্চ ১৯৭১ ২৪৭, দি ডন ৬ মার্চ ১৯৭১ ২৪৮, সাপ্তাহিক স্বরাজ ৬ মার্চ ১৯৭১ ২৪৯, দি ডন ৭ মার্চ ১৯৭১ ২৫০, প্রতিরােধ ৬ মার্চ ১৯৭১ ২৫১. মর্নিং নিউজ ৭ মার্চ ১৯৭১ ২৫২, কমিউনিষ্ট বিপ্লবীদের কাগজপত্র, ৭ মার্চ ১৯৭১ ২৫৩, মােজাফফর ন্যাপের কাগজপত্র, ৭ মার্চ ১৯৭১ ২৫৪, জয় বাংলা ৭ পত্রিকা ৭ মার্চ ১৯৭১ ২৫৫. দি ডন ৮ মার্চ ১৯৭১ ২৫৬, ফরােয়ার্ড ব্লকের পত্র, ৮ মার্চ ১৯৭১ ২৫৭, একটি বেনামী লিফলেট, ৮ মার্চ ১৯৭১ ২৫৮, ছাত্রলীগের কাগজপত্র, ৮ মার্চ ১৯৭১ ২৫৯, কমিউনিষ্ট পার্টির কাগজপত্র, ১ মার্চ ১৯৭১ ২৬০, ভাসানীর প্রচারপত্র, ১ মার্চ ১৯৭১ ২৬১, দৈনিক পাকিস্তান ৯ মার্চ ১৯৭১ ২৬২ কমিউনিষ্ট পার্টি (এম, এল) এর কাগজপত্র ১ মার্চ ১৯৭১ ২৬৩, ইত্তেফাক ১০ মার্চ
________________________________________
২৬৪, দৈনিক পাকিস্তান ১০ মার্চ ১৯৭১ ২৬৫. দি ডন ১০ মার্চ ১৯৭১ ২৬৬, দি পিপল ১০ মার্চ ১৯৭১ ২৬৭, দি ডন ১১ মার্চ ১৯৭১ ২৬৮, ছাত্র ইউনিয়নের কাগজপত্র, ১১ মার্চ ১৯৭১ ২৬১. লি ডন ১৪ মার্চ ১৯৭১ ২৭০, দৈনিক পাকিস্তান ১৫ মার্চ ১৯৭১ ২৭১. পূর্বদেশ ১৫ মার্চ ১৯৭১ ২৭২, দি ভন ১৬ মার্চ ১৯৭১ ২৭৩, টাইমস ১৬ মার্চ ১৯৭১ ২৭৪. দি পিপল ১৭ মার্চ ১৯৭১ ২৭৫ পূর্বদেশ ১৮ মার্চ ১৯৭১ ২৭৬, দি উন ১৯ মার্চ ১৯৭১ ২৭৭. পূর্বদেশ ১৯ মার্চ ১৯৭১ ২৭৮ দি পিপল ২০ মার্চ ১৯৭১ ২৭৯ পূর্বদেশ ২১ মার্চ ১৯৭১ ২৮. দি উন ২১ মার্চ ১৯৭১ ২৮১ পূর্বদেশ ১২ মার্চ ১৯৭১ ২৮২, সাপ্তাহিক স্বরাজ ২২ মার্চ ১৯৭১ ২৮৩, দৈনিক পাকিস্তান ২২ মার্চ ১৯৭১ ২৮৪, সংগ্রাম ২২ মার্চ ১৯৭১ ২৮৫. পূর্বদেশ ২৩ মার্চ ১৯৭১ ২৮৬, টাইমস ২৩ মার্চ ১৯৭১ ২৮৭, পূর্বদেশ ২৪ মার্চ ১৯৭১ ২৮৮ দি পিপল ২৪ মার্চ ১৯৭১ ২৮৯. দৈনিক পাকিস্তান ২৪ মার্চ ১৯৭১ ২৯০, দি ডন ২৫ মার্চ ১৯৭১ ২১১, দি পিপলস ২৫ মার্চ ১৯৭১ ২১২, টাইমস ২৫ মার্চ ১৯৭১ ২৯৩, টেলিগ্রাম ২৩ মার্চ ১৯৭১ ২৯৪, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুজের দলিলপত্র, ১৯৮১ ২৯৫, বাংলার বাণী বিশেষ সংখ্যা ১৯৭১, ২৯৬. দৈনিক আজান ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ১৯৭, দৈনিক আজাদ ৮ মার্চ ১৯৭২ ২৯৮. দৈনিক বাংলা ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ২৯৯ দৈনিক ইত্তেফাক ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩০০, দৈনিক ইত্তেফাক ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩০১. দৈনিক বাংলা ৩ এপ্রিল ১৯৭২ ৩০২, দৈনিক আজাদ ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩০৩, দৈনিক বাংলা ৯ ক্ৰেয়ারি ১৯৭২ ৩০৪. দৈনিক সংবাদ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩০৫. দৈনিক বাংলা ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩০৬. দৈনিক ইত্তেফাক ২২ কেয়ারি ১৯৭২ ৩০৭, দৈনিক সংবাদ ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
০৮. দৈনিক আজাদ ২ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩০১, দৈনিক বাংলা ৩ কেয়ারি ১৯৭২। ৩১০, দৈনিক পূর্বদেশ৪ ক্ৰেয়ারি ১৯৭২ ৩১১.দৈনিক বাংলা ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩১২ দৈনিক বাংলা ৫ ক্ৰেয়ারি ১৯৭২ ৩১৩. দৈনিক বাংলা ৫ ফেব্রয়ারি ১৯৭২ ৩১৪, দৈনিক সংবাদ ৬ ব্রুেয়ারি ১৯৭২ ৩১৫. দৈনিক পূর্বদেশ ৬ কেয়ারি ১৯৭২ ৩১৬. দৈনিক বাংলা ৭কেয়ারি ১৯৭২ ৩১৭. দৈনিক বাংলা ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩১৮, দৈনিক বাংলা ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩১৯. দৈনিক সংবাদ ১৩ কেয়ারি ১৯৭২ ৩২০, দৈনিক সংবাদ ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩২১. দৈনিক বাংলা ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। ৩২২. দৈনিক পূর্বদেশ ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩২৩. দৈনিক বাংলা ১৬ কেয়ারি ১৯৭২। ৩২৪, দৈনিক পূর্বদেশ ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩২৫, দৈনিক বাংলা ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩২৬, দৈনিক বাংলা ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩২৭, দৈনিক পূর্বদেশ ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ২৮, দৈনিক বাংলা ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩২৯. দৈনিক আজাদ ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ ৩০. দৈনিক সংবাদ ২৬ ক্ৰেয়ারি ১৯৭২ ৩৩১ দৈনিক বাংলা ২৬ ক্ৰেয়ারি ১৯৭২ ৩৩২. দৈনিক সংবাদ ২ মার্চ ১৯৭২
৩৩. দৈনিক আজাদ ১১ মার্চ ১৯৭২ ৩৩৪, দৈনিক বাংলা ২০ মার্চ ১৯৭২ ৩৩৫, দৈনিক পূর্বদেশ ৮ এপ্রিল ১৯৭২ ৩৩৬, দৈনিক পূর্বদেশ ১০ মে ১৯৭২ ৩৩৭, দৈনিক পূর্বদেশ ২২ মে ১৯৭২ ৩৩৮.দৈনিক বাংলার বাণী বিশেষ সংখ্যা ১৯৭২ ৩৩৯. যুগান্তর ৩ এপ্রিল ১৯৭২ ৩৪০. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রঃ তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৮৪ ৩৪১. যশােহর জেলার ইতিহাসঃ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৮৯ ৩৪২, একাত্তরের গণহত্যা ও নারি নির্যাতন,১৯৯২ ৩৪৩, স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি, ১৯৯৫ ৩৪৪. যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতি, ১৯৯৫ ৩৪৫, দৈনিক আজরে কাগ, ১৯৯৩-৯৫ ৩৪৬, দৈনিক সংবাদ, ১৯৮০-৯৫ ৩৪৭. দৈনিক আলআমিন ১৯১৫-১৬ ৩৪৮. দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৯০-১৬ ৩৪৯. দৈনিক বাংলার বাণী ১৯১২-১৬ ৩৫০, দৈনিক জনক ১৯৯৪-৯৬

Previous