You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার
(সম্ভবতঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন সাফল্যজনকভাবে তার কাজ সম্পন্ন করে।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।
সভায় অন্যান্য সিদ্ধান্তের মাঝে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।
১। সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির ষষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের সিদ্ধান্তসমূহ পর্যালােচনা করা হয় এবং অনুমােদন করা হয়।
সিদ্ধান্তের মাঝে যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি তা বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানানাে হয়।
যে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি তা নিম্নরূপ :
ক) ১নং সিদ্ধান্ত:
সামরিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান হচ্ছে কেন্দ্রীয় কাজ। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে হবে।
খ) ২নং সিদ্ধান্ত:
শুদ্ধি অভিযান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে হবে।
গ) ৩নং সিদ্ধান্ত:
ইহা এখনও সংঘটিত হয়নি। কাজেই এ সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
এ সিদ্ধান্তে (এর ফলে ভারত পূর্ব বাংলায় সৈন্য পাঠাতে অসুবিধায় পড়বে), নিম্নরূপ হবে। (এর ফলে ভারত পূর্ব বাংলায় ব্যাপকভাবে সামরিক শক্তি নিয়ােগে অসুবিধায় পড়বে)।
ঘ) ১০ নং সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে হবে।
ঙ) ১২নং সিদ্ধান্ত।
সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনী এবং জলিল-তাহেরদের সম্পর্কে বক্তব্য তৈরী করা স্থগিত থাকবে বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।
– জনগণের জন্য আহ্বান তৈরী করা যার মাঝে ঐক্যফ্রন্টের আহ্বান থাকবে। – ‘মুসলিম বাংলা প্রসঙ্গে বক্তব্য তৈরী করা। – পার্টির ইতিহাস প্রণয়ন করা। – আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর বক্তব্য তৈরী করা।
পৃষ্ঠা: ৪০৪

– কমপক্ষে ২ মাসে একবার সামরিক, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ইশতেহার প্রকাশ করা।
প্রভৃতি সিদ্ধান্ত কার্যকরী করা।
২। জাতীয় শত্রু খতম সংক্রান্ত।
– জাতীয় শত্রু খতমের পূর্বে জনমত সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্যে জাতীয় শত্রুর অপরাধনামা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত শাস্তি জনগণের মধ্যে প্রচার করা।
এর ফলে শত্রু জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে। জনগণ তাদের শত্রুদের চিনতে পারবে। খতমের পক্ষে বা প্রদত্ত শাস্তির পক্ষে জনমত সৃষ্টি হবে। শত্রু বাহিনী ভাল লােকদের খতম করে আমাদের কাঁধে দোষ চাপাতে পারবে না।
বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাস, ব্যক্তিগত কারণে খতম প্রভৃতি থেকে আমাদের কাজের পার্থক্য নির্ণিত হবে। কিছু শত্রু পালাবে, কিছু আত্মসমর্পণ করবে, কিছু নিষ্ক্রিয় হবে, কিছুসংখ্যক তৎপরতা চালিয়ে যাবে। ফলে শত্রু সংখ্যা কমবে। শত্রু পালিয়ে গেলেও আক্ষেপ করার কিছু নেই। কারণ এতে কাজের বাধা দূর হয় এবং ভবিষ্যতে তাকে পাওয়া যাবে।
-শত্রুদের শাস্তি নিম্নভাবে ভাগ করতে হবে।
ক. খতম খ. গ্রেফতার গ. জরিমানা ঘ. সতর্ক করা ঙ. সম্পত্তির অংশ বা গােটা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা চ. দৃষ্টি রাখা।
সর্বনিম্ন শাস্তি দিয়ে শুরু করতে হবে। জনগণ কর্তৃক ঘৃণীত, বহু অপরাধ করেছে, খতম ব্যতীত অন্যান্য শাস্তি প্রদান সত্বেও শােধরায়নি এরূপ শত্রুদের খতম করা এবং ব্যাপক প্রচার করা।
ফলে অনেক শত্রুই ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করবে, পলায়ন করবে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। এ ধরনের খতম আমরা উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরব।
– খতমের পূর্বে পুংখানুপুংখ বিচার-বিবেচনা করা এবং উচ্চস্তর কর্তৃক অনুমােদিত করে নেওয়া।
– লঘু অপরাধে খতম করলে খতমের সংখ্যা ব্যাপক হবে; শত্রুর প্রতিরােধ বৃদ্ধি পাবে। খতমের তাৎপর্য কমে যাবে। কমরেডদের সহনশীলতা ও বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা জন্মাবে না। ফলে দ্বিমত পােষণকারী, লঘু অপরাধ করেছে এইরূপ কমরেড, গেরিলা ও জনগণকে খতম করতে পারে। এভাবে কর্মীদের মাঝে সমরবাদের উদ্ভব হতে পারে।
– খতম যথাসম্ভব কম করা।
– বন্দীদের অত্যাচার না করা। বন্দীদের বা খতমের পূর্বে শত্রুদের নিকট থেকে খবর আদায় করা, স্বীকারােক্তি আদায় করার জন্য অথবা নিছক নির্যাতনের খাতিরে নির্যাতন না করা।
– সাধারণ পদ্ধতিতে খতম করা (অত্যাচার করে নয়)।
-শত্রুর উপর দৈহিক নির্যাতন, খতমে অস্বাভাবিক পদ্ধতির ব্যবহার শক্রর হিংস্রতা ও প্রতিরােধ বাড়ায়, আত্মসমর্পণের ইচ্ছা হ্রাস পায়।
উপরােক্ত পদক্ষেপসমূহ কার্যকরী করার অর্থ হচ্ছে শত্রুকে ছিন্নভিন্ন করার লক্ষ্য অর্জন করা।
৩। খতমের পরবর্তী পদক্ষেপসমূহঃ – ব্যাপক প্রচার করা।
পৃষ্ঠা: ৪০৫

– জনগণকে পার্টির সশস্ত্র ও গণসংগঠনে সংগঠিত করা।
– শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা।
উপরােক্ত পদক্ষেপসমূহ ব্যতীত খতম হবে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসমূলক কাজ। ইহা বিপ্লবের উপকারে আসবে না। পার্টি, সশস্ত্র বাহিনী ও গণসংগঠনে জনগণকে সংগঠিত করা এবং শত্রু সেনাবাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করার পথে জাতীয় শত্রুরা প্রতিবন্ধক, তাই তাদের। উৎখাত প্রয়ােজন। শুধু খতমের স্বার্থেই খতম নয়- এটা সর্বদা মনে রাখতে হবে।
৪। আমাদের গেরিলা গ্রুপসমূহকে একই সাথে সশস্ত্র প্রচার টিম হিসেবে গুরুত্বসহকারে ব্যবহার করা।
তারা চিকা, পােস্টার, লিফলেটিং করবে।
– রাতে গ্রামে হ্যান্ডমাইক, চুঙ্গা প্রভৃতি দিয়ে বক্তৃতার মাধ্যমে পার্টির লাইন প্রচার করা। পুলিশ ক্যাম্পের নিকট হাটে-বাজারেও প্রচার করা।
– প্রচারটিম সশস্ত্র হবে। পূর্বাহ্নেই অনুসন্ধান করা, স্কাউট রাখা, শত্রুর এ্যামবুশ সম্পর্কে সতর্ক থাকা। – সমগ্র পূর্ব বাংলা ব্যাপী গ্রামাঞ্চলে এইরূপ তৎপরতা চালানাে।
– প্রচারটিম সুযােগ পেলে জাতীয় শত্রু খতম করবে।
– প্রয়ােজনীয় আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ নেওয়া।
– ইলেকশন তৎপরতার প্রাক্কালে ট্রাফিক পুলিশ ও অন্যান্য উৎস থেকে হ্যান্ডমাইক সংগ্রহ করা, প্রয়ােজন হলে ক্রয় করা।
৫। অপারেশনের কমান্ডার হওয়ার যােগ্যতাসম্পন্ন একাধিক কমান্ডারদের একটি অপারেশনে ব্যবহার না করা। এক অপারেশনে যথাসম্ভব এক অঞ্চলের গেরিলাদেরই নেওয়া।
৬। বিভিন্ন রাজনৈতিক, দলগত, গােষ্ঠীগত এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযােগ বজায় রাখা। এর ফলে তাদের বিষয়ে অবগত হওয়া এবং তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মতামত জানানাে সম্ভব হবে।
– এ ধরনের সংযােগমূলক বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের না পাঠানাে। প্রয়ােজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা।
৭। বিপ্লবী সংবাদ প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, বিভিন্ন এলাকায় সামরিক তৎপরতা এবং জনসাধারণকে জানানাে যায় এইরূপ ঘটনাবলী “সংবাদ প্রতিষ্ঠানের জন্য এই শিরােনামায় পাঠানাে।
বিপ্লবী সংবাদ প্রতিষ্ঠানের সংবাদ প্রতিনিধি সংগ্রহ করা।
৮। আমাদের নীতি হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর ঐক্য। ইহা পার্টির মধ্যকার বিপ্লবীদের এবং বাইরের বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে সম্ভব। এ কারণে আমরা ঐক্যের সপক্ষে, বিভেদপন্থীবাদের বিপক্ষে।
আমাদের এই ঐক্যের লাইন আমাদের কর্মীদের মাঝে, সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণের মাঝে প্রচার করা।
৯। পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতিকেও ঐক্যবদ্ধ করা আমাদের একটি নীতি। বিভিন্ন
পৃষ্ঠা: ৪০৬

দেশপ্রেমিক শ্রেণী, স্তর, জাতিগত, ধর্মীয়, ভাষাগত সংখ্যালঘু, গােষ্ঠী ও ব্যক্তিদেরকে জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করা।
১০। খারাপ লােক, শত্ৰুচরদের সাথে বিভেদের নীতিতে দৃঢ় থাকা।
১১। পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদেরকে পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ করা ও তা বজায় রাখা আমাদের একটি মহান বিপ্লবী দায়িত্ব।
একইভাবে পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতিকে জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ করা আমাদের একটি মহান বিপ্লবী দায়িত্ব।
১২। ব্যুরাের অধীন অঞ্চল, এর অধীন উপঅঞ্চল, এর অধীন এলাকা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম-এ হবে সাংগঠনিক স্তরসমূহ।
১৩। নিম্নলিখিত মানদণ্ডসমূহ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতির জন্য প্রয়ােজন:
১. সার্বক্ষণিক কর্মী সর্বনিম্ন ৫ জন। ২. আঞ্চলিক কমিটি/যােগ্য পরিচালক থাকতে হবে। ৩. কমপক্ষে অর্ধেক অঞ্চলে কাজ থাকতে হবে। প্রায় থানায় সার্বক্ষণিক বা সক্রিয় কর্মী থাকতে হবে। ৪. অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে। ৫. অঞ্চলের সকল স্থানে প্রচার থাকতে হবে। ৬. জাতীয় শত্রু খতমের আত্মগত অবস্থা থাকবে। ৭. শ্রমিক-কৃষকের মাঝে কাজ থাকবে। ৮. উচ্চস্তর এসে কাজ পরিচালনা করতে পারে এইরূপ আশ্রয়স্থল থাকবে। ৯. যােগাযােগ কেন্দ্র ও কুরিয়ার থাকতে হবে। ১০. পার্টি বিরােধী তৎপরতা প্রতিরােধের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অঞ্চলসমূহকে নিম্নলিখিত লক্ষ্যসমূহ অর্জনের চেষ্টা চালাতে হবে
ক) গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করা। খ) বিস্তীর্ণ গেরিলা অঞ্চল গড়ে তােলা। গ) বিচ্ছিন্ন গেরিলা অঞ্চলসমূহের মাঝে সংযােগ সাধন করা। ঘ) সার্বক্ষণিক নিয়মিত গেরিলা গ্রুপ গঠন করা। ঙ) আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করা এবং তা রাখার ব্যবস্থা করা। চ) অঞ্চলের সকল স্থানে পার্টি সংগঠন গড়ে তােলা। ছ) স্থানীয় ভাল সার্বক্ষণিক কর্মী বের করা। জ) উচ্চস্তরকে অর্থ প্রদান করা। ঝ) ছাপানাের ব্যাপারে স্বাবলম্বী হওয়া। ঞ) চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা। ট) নারীদের মাঝে কাজ থাকবে। ঠ) বয়স্ক লােকদের মাঝে কাজ থাকবে। ড) পরিবহনের ব্যবস্থা থাকবে। ঢ) বেতার যােগাযােগ ব্যবস্থা থাকবে। ণ) ঘাটি এলাকা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থাকবে।
পৃষ্ঠা: ৪০৭

১৪। উপ-অঞ্চলের মানদণ্ড ও
ক. সর্বনিম্ন সার্বক্ষণিক কর্মী ১ জন।
খ. অন্যান্য মানদণ্ড অঞ্চলের অনুরূপ।
১৫। কমিটির বৈঠকে নিয়মিত সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করা।
১৬। জনগণের চাঁদা নির্ধারিত করে দেওয়া। তারা সামর্থ্য অনুযায়ী চাদা প্রদান করবেন। সামথ্যের কম চাদা প্রদান করলে বাকী অংশ লিখে রাখা এবং আদায় হবে বলে জানানাে।
১৭। রণনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এখন থেকেই পরিকল্পিতভাবে কর্মী প্রেরণ করা।
১৮। গ্রামে থাকা যায় এরূপ পেশা কর্মীদেরকে শিক্ষা দেওয়া।
যেমন- ফেরিওয়ালা, মুটে, হােমিও ডাক্তার, গ্রাম্য ডাক্তারী, কাঠমিস্ত্রি, ছাতি মেরামতকারী ইত্যাদি।
১৯। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে উদ্যোগহীন, অলস, ঢিলা, বােকা লােক সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা।
২০। সার্বক্ষণিক কর্মীদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রি করে অর্থ পার্টিতে জমা দেওয়া।
২১। কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের নিজস্ব পরিচিত জনের তালিকা দিতে বলা এবং তার মধ্য থেকে ভাল লােকদের লাইন দিতে বলা।
নিজ কর্মক্ষেত্রের বাইরে অন্যত্র পরিচিত জন থাকলে (যাদের লাইন দেওয়া যায় বা হয়েছে) তা উচ্চস্তরে পাঠানাে।
২২। মতাদর্শগতভাবে দৃঢ় কর্মীদের উচিত তাদের দেশপ্রেমিক আত্মীয়-স্বজনদের সাথে যােগাযােগ বজায় রাখা (সম্ভব হলে)।
২৩। যে সকল কর্মী প্রকাশিত বা ফেরার বা গুরুত্বপূর্ণ তারা অবশ্যই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনদের বাসস্থানে যাবে না বা অসতর্কভাবে দেখা করবে না। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক প্রশ্নে দেশপ্রেমিক পরিচিতজনকে বৈরী না করা। কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি দেখানাে।
২৪। বর্তমানে ঐক্যের লাইন সঠিক। অতীতে নয়া সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লাইন সঠিক ছিল। কারণ অতীতে তাদের সাথে সাংগঠনিক ঐক্যে গেলে আমরা তাদের দ্বারা গ্রাস হতাম। তাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রভাবকে সংগ্রাম করে আমাদের সঠিক লাইনের প্রতিষ্ঠা কঠিন হতাে।
২৫। দলিল সম্পর্কিত মতামত নিম্নভিত্তিতে দিতে হবে:
– দলিলে সমস্যা ও প্রশ্নাবলীর সমাধান রয়েছে কিনা।
– দলিলের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা। – দলিলের কাঠামাে কিরূপ।
– বিবিধ।
২৬। নতুন রিক্রুটদেরকে ও সহানুভূতিশীলদেরকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা উদাহরণসহ পড়ানাে।
পৃষ্ঠা: ৪০৮

২৭। কেন্দ্রীয় কাজ প্রসঙ্গে
প্রায় সকল পরিচালক/আহ্বায়কই কেন্দ্রীয় কাজ কার্যকরী করার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থেকেছে। ফলে কেন্দ্রীয় কাজ ব্যাহত হয়েছে।
এ কারণে পরিচালক/আহ্বায়ক নিজ নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কাজের চরিত্রানুযায়ী দক্ষ ও যােগ্যদের নিয়ে কেন্দ্রীয় কাজ বাস্তবায়ন গ্রুপ’ গঠন করবে, অন্যান্য কাজ পরিচালনার জন্য অন্যান্য কাজ পরিচালনা গ্রুপ গঠন করবে।
কর্মী স্বল্প হলে শেষের কাজ করার জন্য কমরেড নিয়ােগ।
প্রথম ক্ষেত্রে কর্মী কম হলে নিজেই পরিচালনা করা। পরিচালক/আহ্বায়ক অর্থাৎ কেন্দ্র যদি কেন্দ্রীয় কাজ বাস্তবায়নের জন্য ব্যস্ত থাকে তবেই সত্যিকারভাবে কেন্দ্রীয় কাজ আঁকড়ে ধরা এবং কাজ যথার্থই কেন্দ্রীয় কাজের মর্যাদা পায়।
২৮। প্রতিটি অঞ্চলেরই সুযােগ ও সামর্থ যথাযথ ব্যবহার করা হচেছ না। এর সদ্ব্যবহার করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের গণআন্দোলনের পথ অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন বিষয় কার্যকরী করার জন্য সকল কর্মী, সহানুভূতিশীল এবং জনগণকে লাগাতে হবে।
২৯। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করা হয়। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে চারভাগে ভাগ করা যায়। ভারতের দালাল অংশ। সােভিয়েটের দালাল অংশ। মার্কিনের দালাল অংশ। জাতীয় গণতন্ত্রী অংশ। আওয়ামী লীগকেও অনুরূপ চারভাগে ভাগ করা যায়।
আওয়ামী লীগস্থ জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশ খুবই দুর্বল এবং অসংগঠিত। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা আওয়ামী লীগস্থ ভারতের দালাল অংশের হাতে। তারা বাকী তিন অংশকে দাবিয়ে রেখে ক্ষমতা বহাল রাখতে চাচ্ছে।
মার্কিনের দালাল অংশ একইভাবে বাকী তিন অংশকে দাবিয়ে রেখে পূর্ব বাংলা দখল করতে চাচ্ছে।
মার্কিনের দালালরা সােভিয়েটের দালালদের উৎখাত করে শত্ৰু কমিয়ে ভারতের দালাল ও জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশকে দাবাবার চেষ্টা করছে।
সােভিয়েটের দালাল অংশও একইভাবে বাকি তিন অংশকে দাবিয়ে রেখে ক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছে।
একইভাবে সােভিয়েটের দালালরা মার্কিনের দালালদের উৎখাত করে শত্ৰু কমিয়ে ভারতের দালাল ও জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
একইভাবে জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশও বাকী তিন অংশকে দাবিয়ে রেখে ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম চালাচ্ছে।
ভারতের দালাল অংশ মার্কিন ও সােভিয়েটের দালালদের কামড়া-কামড়িকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে। তারা মার্কিনীদের খুশী করা ও সােভিয়েটের দালালদের দাবিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সােভিয়েটের দালালদের পিটুনি দিচ্ছে।
একইভাবে তারা মার্কিনীদের দালালদের এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক শক্তির কিছু অংশকে পিটিয়েছে।
পৃষ্ঠা: ৪০৯

পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশে রয়েছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা, কৃষক-শ্রমিক, ক্ষুদে বুর্জোয়া, জাতীয় বুর্জোয়া, জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ সমগ্র জাতি।
সর্বহারা বিপ্লবীদেরকে নিজেদের ঐক্য প্রতিষ্ঠা, সর্বহারা শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করা ও তা বজায় রাখা, কৃষক-শ্রমিক, ক্ষুদে বুর্জোয়া, জাতীয় বুর্জোয়াদের জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
এভাবে সর্বহারা শ্ৰেণীকে জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশকে দাবিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভারত, সােভিয়েট এবং মার্কিনের দালালদের ভূমিকা এক রকম এবং পরস্পর সহযােগিতা করে।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক অংশকেই বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণ সমর্থন করবে।
৩০। যে সকল এলাকায় ব্যাপক জনগণকে সংগঠিত করার জন্য কর্মীর অভাব রয়েছে সে সকল অঞ্চলে সাংগঠনিক টিম (সাংগঠনিক ও সামরিক সংগঠন করার মত কর্মী) তৈরী করে প্রেরণ করা। তাদেরকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনগণকে সংগঠিত করার দায়িত্ব প্রদান করা। তাদের সময়সীমাও নির্ধারণ করে দেওয়া।
এরা নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে নির্দিষ্ট অঞ্চলের পার্টি, গেরিলা ও গণসংগঠন তৈরী করে নির্দিষ্ট কমিটিকে বুঝিয়ে দেবে।
ঐ এলাকার কাজ শেষ হলে টিমকে অন্য এলাকায় পাঠাতে হবে। এভাবে কমস্বিল্পতা থাকলেও ব্যাপক এলাকায় সংগঠন গড়ে তােলা সম্ভব। এ ধরনের কাজ বর্তমানেই অনেক অঞ্চলে জরুরী হয়ে পড়ছে। এই ধরনের দক্ষ টিম বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে তােলা ও কাজে লাগানাে উচিত।
৩১। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় কর্মীরা কতখানি বাস্তবায়িত করতে পারবে তাও কঠোরভাবে বিবেচনা করা উচিত।
৩২। যৌন বিষয়ক শিক্ষা প্রদান করা যাতে যৌন বিকৃতি ও যৌন অপরাধ দূর করা ও এড়ানাে যায়।
– সম্ভাব্য বিষয় – সমকামীতা।
– ধর্ষণ
– গণিকাবৃত্তি
– ব্যবহারগত বিকৃতি
– প্রাক-বিবাহ সম্পর্ক
– গর্ভধারণ ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ
– বৈবাহিক নিয়ম।
– প্রেম ও বিবাহের বৈধতা
– যৌনের জৈবিক কারণসমূহ।
উপরােক্ত বিষয়সমূহের উপর দলিল প্রণয়ন।
৩৩। কেডার ইতিহাসে নিম্ন পয়েন্ট যুক্ত হবে।
– কোন এলাকায় কতদূর প্রকাশিত তা জানানাে।
৩৪। যােগাযােগ দেওয়ার সময় উক্ত যােগাযােগের বাড়ীতে/নিকটে জাতীয় শত্রু রয়েছে কিনা তা জানানাে।
পৃষ্ঠা: ৪১০

৩৫। গ্রেফতারকৃত বা শত্রু নিয়ন্ত্রণে থাকা কমরেড বেরিয়ে আসার পর অথবা বহুদিন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর যােগাযােগ হলে তাকে যাচাই করে কাজে লাগানাে উচিত।
৩৬। জনৈক কর্মীর বিষয়ে কর্মীদের নিকট মতামত চাওয়া। (পরিশিষ্ট-১)
৩৭। অযােগ্য লােকদের নিয়ে কোন প্রকার কমিটি গঠন না করা।
প্রয়ােজন হলে বিভিন্ন স্তরে শুধু পরিচালক দায়িত্ব পালন করবে। ইহা সর্বস্তরে (কেন্দ্রীয় কমিটিতেও) প্রযােজ্য। পরিচালক তার সুবিধামত পরামর্শদাতা, সাহায্যকারী গ্রুপ/ব্যক্তি নিয়ােগ করবে।
পরিচালক এদের সাহায্য ও পরামর্শ গ্রহণ করতেও পারেন, নাও পারেন।
৩৮। যতদিন শ্রেণী থাকবে ততদিন সর্বহারার বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এ কারণে কমরেডদের বুর্জোয়া দিক এবং বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হওয়ার শর্তসমূহের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে এবং সংগ্রাম করতে হবে।
একে অপরকে সহায়তা ও যাচাই করতে হবে।
এভাবে একতরফাবাদ (নিজে এবং কর্মীরা কোনদিন বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হবে না এ চিন্তা) বিরােধিতা করতে হবে।
৩৯। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংবাদ প্রতিষ্ঠান এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নিরাপত্তা বিভাগ গঠন করা হবে। এ সংক্রান্ত দলিলাদি অনুমােদিত হলাে।
৪০। জনগণের বিভিন্ন অংশকে জাতীয় মুক্তির জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের আহ্বান জানানাে।
সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের জন্য পৃথকভাবে আহ্বান জানানাে। ৪১। পার্টিতে যােগদানকারীদের প্রতি অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানাে।
৪২। ঐক্যের বক্তব্য মৌলিকভাবে ঠিক। ভাষাগত ও কাঠামােগত উন্নতি করে গ্রহণ করা হচ্ছে।
ঐক্যের লাইন বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রতিলিপিসহ বিভিন্ন গ্রুপকে আনুষ্ঠানিক পত্র প্রদান।
৪৩। অঞ্চলের মানদণ্ড অর্জনের জন্য আহ্বান জানানাে হচ্ছে। যে সকল অঞ্চল। ইতিমধ্যেই মানদণ্ড অর্জন করেছে তাদেরকে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করার আহ্বান জানানাে হচ্ছে।
৪৪। সমর্থক ও নিরপেক্ষ সামন্তবাদী, বুর্জোয়া ও আমলাদের সামর্থানুযায়ী চাদা ধার্য করে তা আদায় করা। দুনীতিপরায়ণ ক্ষুদে বুর্জোয়াদের প্রতিও ইহা প্রযােজ্য।
৪৫। কয়েকটি প্রশ্ন, সামরিক দলিল (সংশােধনীসহ), সাংগঠনিক কতিপয় পয়েন্ট, কর্মীস্বল্পতা দূর করার উপায় গৃহীত হলাে।
৪৬। কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে প্রধান কাজ অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য দায়িত্ব দিয়ে কমরেড নিয়ােগ করা।
৪৭। এখন থেকেই শ্রমের বিভাগ করা যাতে কর্মের উৎকর্ষতা বাড়ে। ৪৮। চক্রের অবশিষ্টাংশপ্রমাণিত সরকারী চরে পরিণত হয়েছে এবং তৎপরতা চালাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৪১১

এদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে এবং তাদেরকে ধ্বংস করতে হবে।
৪৯। জনগণের তথাকথিত নির্বাচনের প্রতি কোন আস্থা ও উৎসাহ নেই। আওয়ামী লীগ রক্ষী বাহিনী মােতায়েন, আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য পার্টির প্রার্থীদের অপহরণ, হুমকি প্রদর্শন, বন্দুকের ডগায় ভােট গ্রহণ প্রভৃতির মাধ্যমে নির্বাচনের প্রহসন করছে।
নির্বাচন হচ্ছে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা বজায় রাখার একটি প্রহসন মাত্র।
৫০। নির্বাচনের কাল থেকে বর্ষার সূচনা পর্যন্ত বাংলাদেশ পুতুল সরকার রণনৈতিক আক্রমণের স্তরে থাকবে। অর্থাৎ রক্ষী বাহিনী, পুলিশ ও অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা গ্রামসমূহ পরিষ্কার করার প্রচেষ্টা চালাবে।
এ আক্রমণের রূপ হচ্ছে ঘেরাও দমন, খোজ কর ধ্বংস কর ইত্যাদি। এ অবস্থায় আমাদের নীতি হচ্ছে রণনৈতিক প্রতিরক্ষা বা সংরক্ষণ অর্থাৎ নিজেদের লােক ও অস্ত্র টিকিয়ে রাখা, ঘেরাও দমন ব্যর্থ করা, কাজকে সংঘবদ্ধ করা। এ সময় বিকাশ কম হবে।
বর্ষাকালে বাংলাদেশ পুতুল সরকার রণনৈতিক প্রতিরক্ষা বা সংরক্ষণে যাবে অর্থাৎ তার লাভসমূহকে সুসংবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালাবে, সশস্ত্র বাহিনীসমূহ অভিযান শেষ করবে, পাহারা, চেকপােস্ট ব্যবস্থা করবে, আওয়ামী লীগ দালালদের পুনর্বাসন করবে, তাদের সংগঠিত ও সশস্ত্র করবে, প্রশাসন ব্যবস্থা চালু, সুসংবদ্ধ করবে।
এ সময় আমরা রণনৈতিক আক্রমণের স্তরে পৌছাব। বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে হবে, গেরিলা পার্টি বিকাশ করতে হবে।
বর্ষা শেষ হলেই এ স্তর শেষ হবে। বাংলাদেশ পুতুল সরকার পুনরায় শুকনার সময় তার রণনৈতিক আক্রমণ শুরু করবে।
আমাদেরকেও তখন রণনৈতিক আত্মরক্ষা বা সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ পার্টি, গেরিলা ও অস্ত্র রক্ষা করতে হবে, ঘেরাও দমন ভাঙ্গতে হবে।
কাজেই নির্বাচনের পর বাংলাদেশ পুতুল সরকারের রণনৈতিক আক্রমণ স্তিমিত হতে থাকবে এবং রণনৈতিক প্রতিরক্ষার স্তরে প্রবেশ করবে। বর্ষাকালেই আক্রমণে অর্জিত ফলসমূহকে সুসংবদ্ধ করতে হবে।
আমাদেরকেও ধীরে ধীরে রণনৈতিক আক্রমণের স্তরে বিকাশ লাভ করতে হবে যা চূড়ান্ত রূপ পাবে বর্ষাকালে।
রণনীতি সম্পর্কিত ধারণা পরিচালকদের একান্ত প্রয়ােজন যাতে তারা বিভিন্ন রণনৈতিক স্তরের উপযােগী সামরিক, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শগত কাজ নির্ণয় করা ও তা কার্যকরী করতে পারে।
বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের জন্য সর্বস্তর অবশ্যই প্রস্তুতি গ্রহণ ও তা সম্পন্ন করবে।
৫১। কর্মসূচী সংশােধিত আকারে গৃহীত হলাে।
৫২। হিসেব পরবর্তী সভায় পেশ করা হবে।
পৃষ্ঠা: ৪১২

জনৈক কমরেডকে কোন স্তরে রাখা উচিত
এ সম্পর্কে সমগ্র সংগঠন মতামত পেশ করুন
(ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩)
[প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য শহীদ-এর বিষয়ে এ নিবন্ধটি রচিত হয়েছিল প্রকাশক।]

এ কমরেড তার উজ্জ্বল ছাত্রজীবন ত্যাগ করে, অন্য পার্টির সাথে সম্পর্ক ছেদ করে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে যােগদান করেন। তার এ ভূমিকা প্রশংসনীয়।
সংগঠনের তখনকার অবস্থায় সংশােধনবাদকে তত্ত্বগতভাবে পরাজিত করা এবং বিপ্লবী লাইন প্রণয়ন করার জন্য তত্ত্বগত জ্ঞানের প্রাধান্য ছিল। উক্ত কমরেড তার তত্ত্বগত জ্ঞানের জন্য তখন প্রাধান্য পান।
তত্ত্ব প্রয়ােগ করা, রাজনৈতিক লাইন বাস্তবায়নের স্তরে উক্ত কমরেড অনেক বৈষয়িক কষ্ট সহ্য করেন।
তিনি অনেকদিন জেলে ছিলেন এবং কঠোর জীবন যাপন করেন। এ অবস্থায়ও তিনি পার্টির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন।
বর্তমানেও তিনি কষ্ট করছেন। তার তত্ত্বগত জ্ঞান রয়েছে। এখনাে তিনি পার্টির প্রতি আস্থাশীল।
এগুলাে তার ভালাে দিক। অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় উক্ত কমরেড নিম্নলিখিত সীমাবদ্ধতা ও ভুল-ত্রুটির প্রকাশ ঘটান:

দায়িত্ববােধ সংক্রান্ত
– একবার তিনি কয়েকমাস ধরে সংগঠনের সাথে কোন যােগাযােগ রাখতে ভুলে যান। পার্টি নেতৃত্ব নিজে তাকে খুঁজে বের করে।
– তাকে একটি এলাকা পরিচালনা এবং বিপ্লবী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রাখতে দেওয়া হয়। তিনি দুটো কাজই যথাযথভাবে পালন করেননি।
কাগজ-পত্রগুলাে অতিমাত্রায় নােংরা ও এলােমেলাে ছিল। কাগজগুলাে উদ্ধার করতে বহু সময় ব্যয় হয়।
– পরবর্তীকালে তাকে অন্য অঞ্চলে নিয়ােগ করা হয়, সেখানে কর্মী পরিচালনায় অযােগ্যতার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে সাহায্যকারী পদে নিয়ােগ করা হয় এবং কমরেড তাহেরকে পরিচালক নিয়ােগ করা হয়।
এ সময় উক্ত কমরেড কষ্টকর জীবন যাপন করে গ্রাম্য এলাকায় কাজ করেন, হারু বাবু খতমে অংশগ্রহণ করেন।
এ সময় তিনি ধরা পড়ে যান। কিন্তু এমন কোন খোজ তিনি রেখে যাননি যে তার ধরা পড়ার ঘটনা বুঝা যায়। ফলে তিনি নিখোঁজ বলে পরিগণিত হন।
পৃষ্ঠা: ৪১৩

-পঁচিশে মার্চের পর তিনি ভারতে গমন করেন। পেয়ারা বাগানে এসে তিনি যােগাযােগ করেন।
নেতৃত্ব পেয়ারা বাগান থেকে প্রত্যাহারের পর উক্ত কমরেডকে পেয়ারা বাগানের অবস্থা তদন্ত করে অতিসত্বর নেতৃত্বের নিকট রিপোের্ট করার জন্য পাঠানাে হয়।
তিনি অনুসন্ধান করে রিপাের্ট করার পরিবর্তে পেয়ারা বাগান থেকে একটি টুপ নিয়ে পাথরঘাটা, মঠবাড়িয়া অঞ্চলে চলে যান। প্রায় দুই মাস পরে তিনি নেতৃত্বের সাথে যােগাযােগ করেন। তিনি যদি তখন পাথরঘাটা, মঠবাড়িয়া না যেয়ে অনুসন্ধান ও রিপাের্ট করার দায়িত্ব পালন করতেন তবে তারেক-মুজিবের সমরবাদের উদ্ভব এবং ১নং ফ্রন্টের বাহিনীর বিপর্যয় ঠেকানাে, নেতৃত্বের পুনরায় যেয়ে ১নং ফ্রন্ট পরিচালনা করা সম্ভব হয়ে উঠত।
ফলে বরিশাল জেলায় পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের রণনৈতিক আক্রমণের পর তাদের বর্ষাকালীন রণনৈতিক সংরক্ষণের স্তরে আমাদের যে চমৎকার বিকাশ হয়েছিল। তা টিকিয়ে রাখা এবং বহু সৈন্য ও বিরাট মুক্ত এলাকা গড়া সম্ভব হত। সব চাইতে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে উক্ত কমরেড যখন অনুসন্ধানের জন্য বরিশাল যাচ্ছিলেন তখন পথিমধ্যে তার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়। তিনি ঐ বন্ধুর সাথে তখনই যুদ্ধ করার জন্য বাগেরহাট চলে যেতে চান। তার সাথে যে কমরেড ছিল সে তাকে নিবৃত্ত করে।
– ভুলে যাওয়া তার একটি অন্যতম সমস্যা। তিনি প্রায়ই বিভিন্ন বিষয় ভুলে যান। ফলে তার পক্ষে গুছিয়ে কাজ করা ও চলা সম্ভব হয় না।

নিরাপত্তা সংক্রান্ত
– উক্ত কমরেডের বাসস্থান অনেক কর্মী এমন কি সহানুভূতিশীলরাও চিনত। তিনি কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের সামনেই উচ্চস্বরে বাসার ঠিকানা বলে বেবী/রিক্সা ঠিক করতেন, ফলে তারা বাসস্থানের অবস্থান জেনে ফেলে।
– তিনি যে বাসস্থানে থাকতেন তা ফজলু চক্র চিনত, ফজলু চক্র বাসাটি কাজী চক্রের লােকজনদেরও চিনিয়ে দেয়। ফজলুর চক্রান্ত প্রকাশ হওয়ার পর পার্টির নেতৃত্ব উক্ত কমরেডকে অন্যত্র রেখে আসেন এবং উক্ত বাসস্থানে না থাকতে ও বাসস্থান বদলাতে বারংবার বলে আসেন। এরপরেও বিভিন্ন সময় উক্ত বাসায় না থাকার জন্য নেতৃত্ব তাকে বারবার বলেন।
কিন্তু উক্ত কথা ও নির্দেশ অগ্রাহ্য করে প্রায় দুইমাস ঐ বাসায় থাকেন, আরাে তিনচারজন কমরেড কাগজপত্র বাসায় রাখেন। এমন কি একটি স্টেন, রিভলবার, গুলি ও অন্যান্য দ্রব্য সেখানে আনেন।
শেষ পর্যন্ত পুলিশ ঐ বাসা রেইড করে তাকে এবং অপর এক কমরেডকে গ্রেফতার করে। অস্ত্রাদি এবং কাগজপত্র ও বাসার জিনিসপত্র খােয়া যায়।
সৌভাগ্যবশতঃ এক কমরেড বাইরে ছিলেন বলে গ্রেফতার হননি, অপর এক কমরেড বুদ্ধি দ্বারা বেঁচে যান।
এভাবে তিনি নিরাপত্তা সংক্রান্ত দায়িত্ব এবং উচ্চস্তরের কথা ও নির্দেশ উপেক্ষা করে নিজের কমরেডদের এবং পার্টির অস্ত্র ও দ্রব্যাদির নিরাপত্তা বিঘ্নিত করেন।
উক্ত কমরেড নিজে অর্থনৈতিক অপারেশনে অংশ গ্রহণের পরিকল্পনা করেছিলেন, যদিও তা নিষেধ ছিল।
পৃষ্ঠা: ৪১৪

– ফজলু চক্রকে আঞ্চলিক নেতৃত্ব সংস্থায় না নেওয়া এবং গ্রামাঞ্চলে নিয়ােগের জন্য নেতৃত্ব তাকে পত্র মারফত জানিয়েছিলেন। তিনি এ নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ফজলুকে গুরুত্বপূর্ণ শহরের দায়িত্ব প্রদান করেন। ফলে ফজলু উক্ত কমরেডের অজ্ঞাতে শহরে চক্রান্তমূলক কার্যাবলী চালাতে সক্ষম হয়।
– পরবর্তীকালে ফজলু চক্রের কার্যাবলী ধরা পড়লে ফজলু পলায়ন করে। তাকে খোজ করে পাওয়া যায়। তাকে আটকে রাখার জন্য (যাতে সে পালাতে না পারে) উক্ত কমরেডকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু উক্ত কমরেড ইহা যথাযথভাবে গুরুত্ব সহকারে কার্যকরী করেননি। ফলে ফজলুচক্র পালাতে সক্ষম হয়। এর পরিণতি হিসেবে চক্র খুলনায় ঘাঁটি গেড়ে বসা, পার্টির অস্ত্র ও জিনিসপত্র দখল, কমরেডদের প্রতারিত করা, খুলনার কাজ ক্ষতিগ্রস্ত করা, কিছুদিন পার্টি বিরােধী তৎপরতা চালাতে সক্ষম হয়।
ফজলু চক্রকে পাহারা দিয়ে আটকে রাখতে পারলে তখনই চক্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত।
ফজলু চক্রকে উক্ত কমরেডের বাসস্থানেই আটকে রাখা সম্ভব হত যদি উক্ত কমরেড সতর্ক হতেন। (ফজলু স্ত্রীসহ উক্ত কমরেডের বাসস্থানে থাকত)। ফজলুর চক্রান্ত প্রকাশ পেলে নেতৃত্ব উক্ত কমরেডের বাসস্থানে যে রিভলবার ছিল তা নিয়ে আসার জন্য পাঠায় (গােপনে)। উক্ত কমরেড হন্তদন্ত হয়ে খোঁজ করেন, (উহা ফজলু পূর্বাহ্নেই সরিয়ে ফেলেছিল) কিন্তু তিনি পাননি। তার কার্যকলাপ ফজলুর স্ত্রীর মনে সন্দেহের উদ্রেক করে, তিনি ফজলুর স্ত্রীকে অস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন, এমন কি অস্ত্র খোঁজের বিষয় ফজলুকে বলতে নিষেধ করে আসেন।
ফজলু স্ত্রীর নিকট থেকে সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীসহ পলায়ন করে। এভাবে তার অসতর্কতার জন্য তারা উক্ত কমরেডের বাসস্থান থেকে পালাতে পারে এবং একটি অস্ত্র দখল করতে সক্ষম হয়।
-লেনিন সােজা লােক ও বদমায়েশদের একই সাথে গাল দিয়েছেন। কারণ সােজা লােকেরা সহজেই বদমায়েশদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারে এবং তারা অজ্ঞাতসারেই বদমায়েশদের সহায়তা এবং বিপ্লবের ক্ষতি সাধন করতে পারে।
চক্রান্তকারীরাও উক্ত কমরেডকে ব্যবহার করা, তাকে মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা, তাদের পুতুল হিসেবে দাঁড় করানাের প্রচেষ্টা চালায়।
উক্ত কমরেড চক্র, চক্রের সাথে যুক্ত এবং পেটি বুর্জোয়াদের মতামত প্রতিফলিত করেন, অজ্ঞাতসারে কখনাে কখনাে তাদের মুখপাত্র হন।
চক্রের উদ্দেশ্য ছিল উক্ত কমরেডকে পুতুল হিসেবে দাঁড় করিয়ে তথাকথিত নেতৃস্থানীয় কমরেডদের বৈঠক আহ্বান করা, খতম, গুজব-অপবাদ, ভীতি প্রদর্শন এবং বন্দুকের ডগায় নেতৃত্ব দখল করা।
এ কারণে চক্র তাকে আক্রমণ করতাে না, তারা তাকে চালাতে পারবে বলে প্রকাশ্যে বলত।
উক্ত কমরেড সােজা হওয়ায় এ সকল ষড়যন্ত্র বুঝেননি।
এ কারণে উক্ত কমরেডকে সমালােচনা করে এ সময় কেন্দ্রীয় কমিটি উল্লেখ করে যে, কোন কোন সােজা কমরেড চক্রের খপ্পরে পড়তে পারেন।
পার্টি নেতৃত্বের সতর্কতার জন্য চক্রের এ পরিকল্পনা কার্যকরী হয়নি।
-তিনি জনৈক সহানুভূতিশীলের বাড়ীতে তার অনুমতি ব্যতীত এবং তাকে না জানিয়ে একটি স্টেন দুইমাস রাখেন। পরে উক্ত সহানুভূতিশীল এ বিষয়ে জানতে পেরে খুবই সন্ত্রস্ত হন।
পৃষ্ঠা: ৪১৫

– আমাদের স্টেন আছে ইহা দেখানাের জন্য তিনি দুইজন সহানুভূতিশীলের বাসায় স্টেন নিয়ে যান। এতে তারা খুবই ঘাবড়ে যায়।
এ সকল কারণে উক্ত অঞ্চলের সহানুভূতিশীলগণ তাদের বাসস্থান পার্টির কমরেডদের চিনাতে চান না।
– পূর্বেও তিনি এরূপ নিরাপত্তা বিঘ্নকারী কাজ করেন।
তিনি এবং অপর কয়েকজন কমরেড বােমা তৈরী করতে গেলে (বাসস্থানে এবং নেতৃস্থানীয় কর্মীর পক্ষে বােমা তৈরী করা উচিত নয়) দুর্ঘটনা ঘটে।
তিনি হকচকিয়ে যান; ফলে মূল্যবান ঠিকানা, লেখা, ডায়েরী দ্রব্যাদি নিয়ে আসতে পারেননি।
তিনি ইচ্ছে করলে কাগজপত্র ধ্বংস করে আসতে পারতেন, তাও তিনি করেননি। ফলে পুলিশ উক্ত ডায়েরী থেকে ঠিকানা উদ্ধার করে জনৈক সহানুভূতিশীলকে গ্রেফতার করে। তিনি বহুদিন জেলে কষ্ট করেন।
– উক্ত কমরেড কারাগার থেকে বহু সহানুভূতিশীলদের নামে চিঠি পাঠান, যার ফলে তারা নিরাপত্তার অভাব বােধ করেন।
এভাবে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
– উক্ত কমরেডের সাথে দেখা করতে যাওয়ার সময়েও একাধিক কমরেডকে পার্টি-নাম ধরে উচ্চস্বরে ডাকেন, ফলে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তােলেন।
লেনিন বলেছেন, পুলিশকে এড়িয়ে চলাও বিপ্লবীদের একটি যােগ্যতা। এজন্যে প্রয়ােজন কঠোরভাবে নিজে নিরাপত্তার নিয়মাবলী পালন করা এবং অন্যের দ্বারা তা পালন করানাে।
উপরােক্ত ঘটনাবলী থেকে দেখা যায় উক্ত কমরেড নিজের ও অপরের এবং সংগঠনের নিরাপত্তা পালনের ক্ষেত্রে চরম অযােগ্যতার পরিচয় দেন।

সাংগঠনিক ক্ষেত্র
কেন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত উক্ত কমরেডের পরিচালনাধীন ছয়জন সার্বক্ষণিক কর্মী ছিল। এদের মাঝে একজন বাদে সকলকেই কাজে লাগানাে যেত।
তিনি পরে আরাে একজন কর্মী সার্বক্ষণিক করেন।
অপর একজন কর্মীকে অন্য অঞ্চল থেকে বদলী করে তার পরিচালনাধীনে দেওয়া হয়। ইনি বাসায় থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারতেন।
এ থেকে দেখা যায় উক্ত কমরেডসহ আটজন কর্মী সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারতেন।
উচ্চস্তর তাকে প্রতিমাসে কমপক্ষে তিন থেকে চারশ’ টাকা প্রদান করতাে। স্থানীয়ভাবে দুই-তিন শ’ টাকা উঠত। অর্থ, কর্মী ও অন্যান্য সুবিধার দিক দিয়ে তার পরিচালনাধীন এলাকা সমগ্র সংগঠনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্থান পেয়েছে। কিন্তু উক্ত কমরেড কর্মী এবং উপরােক্ত সুযােগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন। দায়িত্ব ও কাজ বণ্টন করতে না পারার ফলে কর্মীরা কাজহীন থাকে। ফলে দু’জন কর্মী (একজন সার্বক্ষণিক, অপরজন বাসায় থেকে সার্বক্ষণিক কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন) সুবিধাবাদী হন।
পৃষ্ঠা: ৪১৬

তাদেরকে দুই-তিন মাস কোন কাজই দেওয়া হয়নি; ফলে তারা হতাশ হন এবং সুবিধাবাদী হন।
জনৈক কর্মী তার কর্মস্থল ত্যাগ করে অন্য অঞ্চলে চলে যান। তিনি তার নিকট থেকে দায়িত্ব বুঝে নেননি। ফলে উক্ত অঞ্চলের কাজ নষ্ট হয়। পরে নতুন পরিচালক যােগাযােগ করে দেখে সেখানকার কর্মীরা সুদীর্ঘদিন যােগাযােগ না পেয়ে পার্টির প্রতি আস্থা হারিয়েছে।
অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকার সাথে অনিয়মিতভাবে যােগাযােগ রাখা হত। শেষ পর্যন্ত তার গ্রেফতারের পর তিনি বহুবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও যােগাযােগ করার উপায় উল্লেখ করেননি।
স্থানীয় নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নিয়মিত বৈঠক হত না, তার গােটা কাজের আমলে মাত্র একবার বৈঠক হয়।
– কেন্দ্র থেকে প্রচুর দলিলপত্র উক্ত অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু তা কর্মীসহানুভূতিশীলদের নিকট পৌঁছানাে, তাদেরকে নিয়ে পড়া, তাদের মাধ্যমে বিতরণ করা হত না। তিনি দলিলপত্র বস্তাবন্দী করে নিজের আশ্রয়স্থলে রাখতেন।
তার গ্রেফতারের সময় পুলিশ প্রচুর দলিলপত্র পায়। আমরাও বিতরণ হয়নি এরূপ এক বস্তা দলিল পাই।
– তার এলাকার কর্মীদের সংগঠিত করা, নিয়মিত তাদের ক্লাস নেওয়া, নিরাপত্তা ও গােপনীয়তা শিক্ষা দেওয়া, যােগাযােগ রাখা, কাগজপত্র পৌঁছে দেওয়া ও তা নিয়ে আলােচনা করা, তাদের মান উন্নয়ন করা, তাদের মাধ্যমে নতুন যােগাযােগ করা, তাদের দায়িত্ব দেওয়া ও কাজে লাগানাে প্রভৃতি সংগঠনের সাধারণ কর্মপদ্ধতি উক্ত কমরেড কখনই কার্যকরী করেননি।
ফলে কর্মীরা উন্নত ও সংগঠিত হয়নি বরঞ্চ আস্তে আস্তে তারা কেটে পড়ে।
পরবর্তীকালে ভাল কর্মী নিয়ােগের পর উক্ত এলাকার কর্মীরা সংগঠনের উপরােক্ত কর্মপদ্ধতি দেখে বলে, “এ ধরনের কর্মপদ্ধতি রয়েছে এটা প্রথম জানলাম।”
ফলে স্থানীয় কর্মীরা কখনােই উন্নত হয়নি যা ঐ এলাকার কাজের বিকাশের জন্য একান্ত প্রয়ােজন ছিল।
পরবর্তীকালে ভাল পরিচালক নিয়ােগের পর স্থানীয় কর্মী বেরােয় (চার মাস পরিচালনার পর চারজন উন্নতমানের স্থানীয় কর্মী বেরােয়)। মােট সার্বক্ষণিক কর্মী ছিল প্রথমদিকে একজন, পরে স্থানীয় দু’জনসহ চারজন হয়।
বর্তমানে সমগ্র এলাকা সম্ভাবনাময় হিসেবে বিকাশ লাভ করছে। স্থানীয় কর্মী পাওয়ার ফলে কাজ বিকাশের ভিত্তি তৈরী হচ্ছে।
– উক্ত কমরেড সহানুভূতিশীলদের পরিচালনার ক্ষেত্রে পুরােপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তিনি সহানুভূতিশীলদের সাথে আলােচনা ও যােগাযােগ করার সময় অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায়ই যেতেন (পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা হচ্ছে সর্বহারার অভ্যাস যা তার ছিল , পক্ষান্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদীদের মত অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্নতা তার অভ্যাস ছিল)। এর ফলে সহানুভূতিশীলরা অস্বস্তি অনুভব করত এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে এরূপ মনে করতাে।
তিনি তাদের সাথেও একঘেঁয়ে নিজ খেয়াল খুশীমত আলাপ করতেন। এ কারণে অনেক সহানুভূতিশীল তাকে আকর্ষণীয় মনে করতাে না। এমনও মন্তব্য করতাে যে,
পৃষ্ঠা: ৪১৭

একে দিয়ে যােগাযােগ রাখলে সহানুভূতিশীলরা সরে পড়বে (বাস্তবেও অনেক ক্ষেত্রেই তাই হয়েছে)। এর ফলে তাদের মান উন্নত হয়নি।
– তিনি কার্যাবলী পরিচালনার ক্ষেত্রে কর্মীদেরকে সমাবেশিত করা, তাদের মতামত সংগ্রহ করা, তাদের প্রস্তাব নেওয়া প্রভৃতি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিসমূহ অনুসরণ করতেন না।
অন্যরা মতামত দিলে তা অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষা করতেন (বাসা বদলানােসহ অনেক ক্ষেত্রে)।
তিনি নিজ খেয়াল খুশীমত কাজ করতেন। এর ফলে কাজ বিকাশ লাভ করেনি, কর্মীদের উৎসাহ বাড়েনি এবং তিনি নিজে অন্ধ গলিতে আটকে পড়েন।

মতাদর্শগত
– তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে মুক্ত মনে সমালােচনা করা, যথাসময়ে সমালােচনা করেননি।
– এ কারণে কেন্দ্রীয় কমিটি তাকে একবার সমালােচনা করে মুক্ত মন না হওয়া এবং যথাসময়ে সমালােচনা না করার জন্য।
– তার উপরােক্ত ত্রুটি বিচ্যুতির উৎস হচ্ছে তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সমন্বয় না করার ফল। কারণ তত্ত্বগতভাবে তিনি উপরােক্ত বিষয়সমূহ অবহিত ছিলেন, কিন্তু তা তিনি প্রয়ােগ করেননি।
ইহা মতাদর্শগত ক্ষেত্রে গােড়ামীবাদের বহিঃপ্রকাশ। ইহা ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শেরও একটি বহিঃপ্রকাশ।
উক্ত কমরেড নিজস্ব অভিজ্ঞতার সারসংকলন হিসেবে প্রবন্ধ না লিখে তত্ত্বগত (নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলােকে নয়) প্রবন্ধ লেখেন। এ কারণেই তিনি নিজের ভুলক্রটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়াতে এবং অনুশীলনকে প্রতিনিয়ত উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেননি, বার বার একই ভুল করে গেছেন। ইহা গােড়ামীবাদী বিচ্যুতি।

উপসংহার
উপরােক্ত বিষয় অবগত হয়ে কর্মীদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, বর্তমান আঞ্চলিক পরিচালকদের মান প্রথম শ্রেণীর ধরা হলে তাদের পরবর্তী নীচু স্তরের কর্মীদের মান দ্বিতীয় শ্রেণীর ধরা হলে তাদের চাইতে উক্ত কমরেডের মান নীচু তবুও তাকে কেন তাহলে এত গুরুত্ব ও সুযােগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এর উত্তর নিম্নে প্রদান করা হচ্ছে। বিপ্লব ও পার্টি কতকগুলাে স্তরের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে।
আমাদের সংগঠন যখন বিপ্লবের প্রথম স্তরে ছিল তখন সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে তত্ত্বগত সংগ্রাম করা এবং বিপ্লবী লাইন নির্ণয় করা প্রধান কাজ ছিল। এ সময় তত্ত্বগত জ্ঞানটাই নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
এ সময় সম্পর্কে লেনিন বলেছেন, বিপ্লব করার জন্য যখন বিপ্লবী লাইন নির্ধারিত হয়নি তখন লাইন নির্ণয়ের জন্য তত্ত্বটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
পৃষ্ঠা: ৪১৮

আমাদের সংগঠনে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং বিপ্লবী লাইন নির্ণয়ের সময় তত্ত্বগত জ্ঞান সম্পন্ন কমরেডরা প্রাধান্য পেয়েছেন। উক্ত কমরেডও এ কারণেই প্রাধান্য পেয়েছেন।
১৯৭১ সালের পরবর্তীকালে সংগঠনের লাইন নির্ধারণের স্তর সম্পন্ন হয় এবং সংগঠনের লাইন বাস্তবায়নের স্তর প্রধান হয়ে পড়ে।
কিন্তু অস্থায়ীভাবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দিকে কিছু সময় লাইন নির্ধারণ পুনরায় প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু প্রয়ােগের, তত্ত্বের সাথে অনুশীলনের সমন্বয়ের দিক প্রাধান্য দেওয়ার জন্য কংগ্রেসে সর্বপ্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গােড়ামীবাদ পার্টির প্রধান বিপদ; ইহা ঘােষণা করে অনুশীলনে যুক্ত নয় এরূপ তত্ত্বের প্রাধান্যের পরিসমাপ্তি।
পরবর্তীকালের শুদ্ধি অভিযান এবং বর্তমানের গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযান অনুশীলনে যুক্ত নয় এরূপ তত্ত্বের প্রাধান্যকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার পদক্ষেপ।
কাজেই উক্ত কমরেডের প্রাধান্যের কারণ বিপ্লবের প্রথম স্তরের প্রয়ােজনীয়তা। বর্তমানের স্তরের যােগ্যতার মাপকাঠিতে তিনি অযােগ্য হয়ে পড়েছেন।
সংগঠনের ও বিপ্লবের পরবর্তী স্তর হচ্ছে সামরিক ক্ষেত্রের সমস্যার সমাধান। এক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে সক্ষম কমরেডরা তখন প্রাধান্য পাবেন।
এর পরবর্তী পর্যায়ে আসবে রাষ্ট্র পরিচালনা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্নকালীন সমস্যার সমাধান। এতে সক্ষম কমরেডরা তখন প্রাধান্য পাবেন। যারা পূর্বের স্তরে প্রাধান্য পেয়েছেন কিন্তু এ স্তরে অযােগ্য তারা স্বাভাবিকভাবেই অযােগ্য হয়ে পড়বেন, নতুন যােগ্যরা তাদের স্থান দখল করবে।
এরপরে আসবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক গঠনকার্য এবং সর্বহারার। সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনার স্তর। এ স্তরে প্রাধান্য পাবেন যারা এ স্তরে দায়িত্ব পালনে সক্ষম।
কাজেই বিপ্লব ও পার্টির স্তরের দায়িত্বাবলী নির্ণয় করবে কমরেডদের যােগ্যতার মাপকাঠি। যে স্তরে যারা যােগ্য তারাই সে স্তরে প্রাধান্য পাবেন। পরবর্তী স্তরের। যােগ্যতা না থাকলে তারা বাতিল হয়ে যাবেন। ইহা বিপ্লবের ও পার্টির অলংঘনীয় বস্তুগত নিয়ম।
চীনসহ পৃথিবীর সকল দেশেই এরূপ ঘটেছে।
এ কারণেই বিপ্লবের এক স্তরে যােগ্য থাকা কঠিন নয়, কঠিন হচ্ছে প্রতিটি স্তরের প্রয়ােজন অনুযায়ী নিজেকে যােগ্য রাখা, নিজেকে পরিবর্তন করা।
এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, “কিছু কালের জন্য যােগ্য থাকা কঠিন নয়, কঠিন হচ্ছে সারাজীবন যােগ্য থাকা।”
আমাদের কমরেডদের উচিত সারাজীবন যােগ্য থাকা।
আমরা যদি পার্টি ও বিপ্লবের বিভিন্ন স্তরের জন্য যােগ্য কর্মীদের বের করে যথাযথ স্থানে নিয়ােগ না করি, পুরােনাে স্তরের জন্য যােগ্য ছিল কিন্তু বর্তমান স্তরের জন্য অযােগ্য এরূপ কমরেডদের যদি না বদলাই তবে সংগঠনে আমলাতন্ত্র ঢুকবে এবং সংগঠনের গতি ও বিকাশ ব্যাহত হবে, সংগঠন স্থবির ও মৃত হবে।
নীতি নির্ধারণের জন্য এবং কর্মী পরিচালনার জন্য প্রয়ােজন তত্ত্ব ও অনুশীলনের সমন্বয় এবং একদিকে গােড়ামীবাদ অন্যদিকে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ পরিহার।
পৃষ্ঠা: ৪১৯

কাজেই উক্ত কমরেডের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়ােগ বজায় রাখার অর্থই হবে পার্টি গােড়ামীবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বজায় রাখা। ফলে পার্টি বাম বা দক্ষিণ বিচ্যুতি, সংশােধনবাদ ও সুবিধাবাদের শিকারে পরিণত হতে পারে। উক্ত কমরেড সােজা লােক, খারাপ লােকেরা এর সুযােগ নিতে পারে।
পক্ষান্তরে তার তত্ত্বগত জ্ঞানকে (একতরফা) ব্যবহার করা যায় কিন্তু পার্টির নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলবে না, খারাপ লােক তাকে ব্যবহার করতে পারবে না, নিরাপত্তা ও সাংগঠনিক দায়িত্ব নেই এরূপ স্থানে তাকে নিয়ােগ করা উচিত।
তাকে প্রাধান্য দেওয়ার অপর একটি কারণ হচ্ছে পার্টির অনভিজ্ঞতা।
বিশেষ জ্ঞান ব্যবহার করার ধারণা সংগঠনের ছিল না। অর্থাৎ যােগ্যতা না থাকলে কমিটিতে না নিয়ে যােগ্য ব্যক্তিকে পরিচালক নিয়ােগ করে দায়িত্ব পালন করানাে এবং বিশেষ জ্ঞান সম্পন্নদের জ্ঞান ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা পার্টির ছিল না।
কাজেই বিপ্লবের, পার্টির বিকাশের স্তর এবং সংগঠনের কর্মী নিয়ােগ ও ব্যবহারের অনভিজ্ঞতার কারণেই উক্ত কমরেড প্রাধান্য পান।
উক্ত কমরেডের ভাল ও শক্তিশালী দিকগুলাে ব্যবহার করতে হবে।
উক্ত কমরেডকে আহ্বান জানানাে হচ্ছে তিনি যেন নিজ যােগ্যতা, সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির দিকসমুহ ও তার মতাদর্শগত ভিত্তি উপলব্ধি করেন এবং সংশােধনে ব্রতী হন; এগুলাের বিবেচনার ভিত্তিতে সংগঠন প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করেন সংগঠনের প্রতি আস্থা বজায় রাখেন।
তার প্রতি সংগঠনের আস্থা এবং বিশ্বাস রয়েছে; তিনি যেন ইহা বজায় রাখেন।
পৃষ্ঠা: ৪২০

সাংগঠনিক কাজের উপর কতিপয় পয়েন্ট
[“সাংগঠনিক কাজের উপর কতিপয় পয়েন্ট” শীর্ষক দলিলটি ফেব্রুয়ারি, ‘৭৩-এ অনুষ্ঠিত প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল -প্রকাশক।]

০ গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা। এ শুদ্ধি অভিযানে নিম্ন বিষয়ে গুরুত্ব দেয়াঃ
– প্রয়ােগ/সমস্যা ব্যতীত তত্ত্ব আলােচনা না করা।
– দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কর্মপদ্ধতি রপ্ত করা।
এর বাস্তব বহিঃপ্রকাশ- “অনুসন্ধান ছাড়া কথা বলার অধিকার নেই” ইহা সকল কাজে প্রয়ােগ করা।
– প্রয়ােগের সাফল্যের ভিত্তিতে কর্মী মূল্যায়ন।
– সাংগঠনিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতৃত্বের যে সকল গােড়ামীবাদী ভুল হয়েছে তা সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করা।
– বৈদেশিক অভিজ্ঞতার অন্ধ অনুকরণ হুবহু প্রয়ােগ বিরােধিতা করা।
০ নিজেকে জান’ এ পদ্ধতি সকল কাজে ভালভাবে প্রয়ােগ করা। এ তত্ত্ব প্রয়ােগ করে সংগঠনের সাথে যুক্তদের
– কর্মী,
– গেরিলা,
– সহানুভূতিশীল,
– সমর্থক;
কর্মী, গেরিলাদের পুনরায়-
অগ্রসর,
– মাঝারী,
– পশ্চাদপদ;
সহানুভূতিশীলদের পুনরায়-
ভাল ও সক্রিয়,
– ভাল,
– সাধারণ;
এবং অগ্রসরদের ভাল ও খারাপ দিক এবং সামর্থ ও সীমাবদ্ধতার দিক খুঁজে বের করা।
এ বিভাগের ভিত্তিতে যােগ্য লােক যােগ্যস্থানে, কর্মীদের মান অনুযায়ী পরিচালক নিয়ােগ ও কাজে লাগানাে সম্ভব হবে।
– অগ্রসরদের দিয়ে মাঝারী ও পশ্চাদপদদের পরিচালনা করা।
– অগ্রসরদের দ্রুত উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা।
পৃষ্ঠা: ৪২১

– এদের মাঝ থেকে সার্বক্ষণিক ও দায়িত্বশীল কর্মী বের করা।
০ কর্মী ও গেরিলা এবং সহানুভূতিশীলদের সর্বদা কাজে লাগানাে।
০ কর্মী ও গেরিলাদের প্রতি শৃংখলা প্রয়ােগ করা যাতে তারা সুশৃংখল হয়।
০ নেতৃত্বকে সকল কাজের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
এজন্য পাঁচটি প্রবন্ধের পার্টির মধ্যকার ভুল চিন্তাধারার বিরােধিতার “সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত পরিচালনায় গণতান্ত্রিক জীবন সুনিশ্চিত করা” (৪১ পৃষ্ঠা)-র নীতি প্রয়ােগ করা।
০ নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত কার্যকরী হচ্ছে কিনা তা সর্বদা যাচাই করা।
যে স্তর বা কমরেডকে সিদ্ধান্ত বা নির্দেশ, দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়েছে তার নিকট থেকে উক্ত নির্দেশ, দায়িত্ব, প্রস্তাব কার্যকরী করা সম্পর্কে রিপোের্ট নেওয়া এবং তদারক করা।
উক্ত স্তর বা কমরেডের পরিচালনাধীন (নিম্নস্তর), কর্মীদের নিকট যেয়ে অনুসন্ধান করা ও রিপাের্টের যথার্থতা যাচাই করা।
০ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, নির্দেশ নেতৃত্বের কোন বিশেষ ইউনিটে কার্যকরী করা, বিন্দু ভেঙ্গে প্রবেশ করা, নেতৃত্বের নিজস্ব অভিজ্ঞতা অর্জন করা।
০ নেতৃত্বের পক্ষে উদারতাবাদ কঠোরভাবে পরিহার করা।
০ প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা, কাজের নিয়মবিধি বের করা। ভুলের পুনরাবৃত্তি কঠোরভাবে পরিহার করা।
০ কঠোরভাবে গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখা এবং কর্মী, গেরিলা ও সহানুভূতিশীলদের প্রতিনিয়ত এ বিষয়ে শিক্ষিত করে তােলা।
০ নিয়মিত নেতৃত্ব সংস্থার বৈঠকের ব্যবস্থা করা।
০ সাংগঠনিক কাজ পরিকল্পনাহীনভাবে বিকাশ না ঘটানাে। আমাদের কাজ হয়েছে। এরূপ অঞ্চলের সাথে সংযােগ সাধনের উদ্দেশ্যে, গেরিলাযুদ্ধের জন্য সহায়ক ভৌগলিক ও জনগণের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে কাজ বিস্তারের পরিকল্পনা করা।
০ নেতৃত্বের থাকার জন্য একাধিক আশ্রয়স্থল তৈরী করা যা খুব কম সংখ্যক লােক চিনবে।
০ একজন কুরিয়ার নিয়ােগ করা যে বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে এবং উচ্চস্তরের সাথে সংযােগ রক্ষা করবে।
০ সহকারী নেতৃত্ব গড়ে তােলা যে নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে কাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। ০ এক অঞ্চলে ঘেরাও দমন হলে গেরিলা ও পার্টি-কর্মীরা যাতে অন্য অঞ্চলে সরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
প্রয়ােজনবােধে এরূপ অঞ্চলে প্রচার তৎপরতা না চালানাে যাতে শত্ৰু বুঝতে ব্যর্থ হয় যে ঐ এলাকায় আমাদের কাজ বা আশ্রয়স্থল রয়েছে।
প্রয়ােজনবােধে এ সকল অঞ্চলে প্রকাশ্যে আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা কায়েম না। করা।
আমাদের লােকেরাই পরিচয় গােপন রেখে বিভিন্ন কর্মকর্তা হবে।
০ নিয়মিত চাঁদা সংগ্রহ করা, অর্থের হিসাব নেওয়া এবং অনুমােদন করা, উচ্চস্তরে পেশ করা।
পৃষ্ঠা: ৪২২

০ ব্যাপক প্রচার চালানাে। এ উদ্দেশ্যে চিকা ব্যবহার করা।
০ অসংগঠিত অঞ্চলের কাজ পরিচালনার জন্য প্রথমে পরিচালক নিয়ােগ করা, পরিচালক নতুন যােগাযােগ পরিচালনা করবে, তাদেরকে ধাপে ধাপে পাঠচক্রে, পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে নেতৃত্বগ্রুপ গঠন করবে।
এরপরে আঞ্চলিক নেতৃত্ব গ্রুপের নেতা/সম্পাদক এলাকা পরিচালনা, উচ্চস্তরে যােগাযােগ, রিপাের্ট পেশ এবং নির্দেশ গ্রহণের জন্য দায়িত্বে থাকবে।
পরিচালকের ভূমিকা এভাবে শেষ হয়ে যাবে।
০ সর্বক্ষেত্রে ভ্রষ্টদের পরিহার করা (বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় ক্ষেত্রে)।
০ “সাংগঠনিক কার্য প্রসঙ্গে” দলিল পাঠ ও প্রয়ােগ করা। এ দলিলের “পার্টিকমিটির নেতৃত্বের কতিপয় সমস্যা প্রসঙ্গে” দলিল বার বার পাঠ ও প্রয়ােগ করা।
০ কেন্দ্রীয় কমিটির ইশতেহারসমূহ ও সংবিধান পাঠ করা।
০ সংগঠনের দলিলাদি নিয়মিত পাঠ করা এবং বিভিন্ন স্তরে পড়ানাে এবং দলিলের উপর মন্তব্য সংগ্রহ করা।
০ সহানুভূতিশীলদেরও রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও মতাদর্শগত বিষয়ে অবহিত রাখা।

কোন বিষয়ের উপর আলােচনা করা, ক্লাশ নেওয়া ও সভা পরিচালনার পদ্ধতি
পরিচালক নিজের এবং আলােচনা, বৈঠক, সভায় অংশগ্রহণকারীদের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ করবেন এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
আমাদের পরিচালকদের কারাে কারাে তত্ত্বগতমান নীচু, কারাে কারাে তত্ত্বগত জ্ঞান অনুশীলনের সাথে যুক্ত নয়, ফলে অনেক সময়ই তারা আলােচনার সময় উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর যথাযথভাবে দিতে পারেন না। ফলে তারা কর্মীদের আস্থা হারান।
তারা আলােচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পূর্বাহ্নেই ভালভাবে জেনেশুনে নেন না। ফলে বিষয়বস্তু পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন না।
অংশগ্রহণকারীরাও পূর্বাহ্নেই প্রস্তুত হয়ে আসে না বলে তারা আলােচনায় যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না।
প্রস্তাব, রিপাের্ট ইত্যাদি সভায় পেশ করা হলে সাথে সাথে তা পাঠ করে ভালভাবে বিবেচনা ও পর্যালােচনা করা যায় না।
এ সকল কারণে আলােচনা, ক্লাস, বৈঠকের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে।
০ আলােচ্য বিষয়ক সূচী পূর্বেই অংশগ্রহণকারীদের জানিয়ে দেওয়া।
০ আলােচ্য বিষয়ের সাথে যুক্ত দলিলাদি, পুস্তক পাঠ করতে বলা।
০ আলােচ্য বিষয়ের উপর প্রশ্ন/প্রস্তাব/সমস্যা/রিপোের্ট/আলােচনা, ক্লাশ বা বৈঠকের কমপক্ষে এক বা দুইদিন পূর্বে পরিচালকের নিকট পেশ করা।১
০ পরিচালক আলােচ্য বিষয়ের উপর দলিলাদি এবং পেশকৃত প্রশ্ন/সমস্যা/প্রস্তাব/ রিপাের্ট পাঠ করবেন, এ সকলের সাথে জড়িত পুস্তক, দলিলাদি পড়াশুনা করবেন, উচ্চস্তরের নিকট থেকে পরামর্শ, সহায়তা গ্রহণ করবেন।
এভাবে সহজভাবে বুঝানাে এবং প্রশ্নসমূহের যথাযথ উত্তর প্রদানের ক্ষমতা অর্জন করা। প্রয়ােজনবােধে পয়েন্ট, উত্তর, প্রস্তাব লিখিতভাবে নিয়ে যাওয়া।
পৃষ্ঠা: ৪২৩

০ আলােচনা, ক্লাস, বৈঠকের আলােচনা আলােচ্যসূচীর মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা।
০ আলােচনা বৈঠকে অযথা উদ্ধৃতি না আওড়ানাে, অপ্রয়ােজনীয় প্রসঙ্গের অবতারণা করা, সহজভাবে বাস্তব জীবনের আলােকে আলােচনা করা যাতে কর্মীরা বুঝে।
০ সহজ ভাষায় স্পষ্টভাবে বক্তব্য পেশ করা, অস্পষ্টতা পরিহার করা, ভুল অর্থ হতে পারে এরূপ কথাবার্তা পরিহার করা।
০ সর্দাই লক্ষ্য রাখতে হবে কর্মীরা বুঝতে পারছে কিনা, তারা মনােযােগী কিনা এবং আলােচনায় তারা আকর্ষণ বােধ করছে কিনা।
০ একঘেয়ে, নিপ্রাণ, যান্ত্রিক আলােচনা, গোঁজামিল দেওয়া পরিহার করা। সংক্ষিপ্ত ও যথাযথভাবে বক্তব্য পেশ করা।
০ কোন বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান না থাকলে উত্তর প্রদান না করা। ঐ বিষয়ে পরে আলােচনার তারিখ দেওয়া। ভুল আলােচনা না করা, আবােল তাবেল কথাবার্তা না বলা, মিথ্যা না বলা।
এভাবে পরিচালক ও অংশগ্রহণকারী উভয়েই প্রস্তুতি নিয়ে আলােচনা, ক্লাস বা বৈঠকে যাবেন।
এর ফলে-
০ আলােচনা, ক্লাস বা বৈঠকের মান উন্নত হবে এবং ভাল ফল দেবে।
০ পরিচালক অযােগ্য হবে না।
০ পরিচালক ও কর্মী উভয়েরই মান উন্নত হবে।
কর্মীদের কি এবং কেন প্রশ্ন করা, প্রস্তাব পেশ করা, রিপাের্ট লেখার অভ্যাসের সৃষ্টি হবে।
০ পড়াশুনা সমস্যাভিত্তিক হবে।
…………………………………………………………………….
১. যিনি আলােচনা করবেন, ক্লাস নেবেন, সভা পরিচালনা করবেন।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৪২৪

কর্মীস্বল্পতা ও তা সমাধানের কতিপয় উপায়
[নিবন্ধটি ফেব্রুয়ারি, ‘৭৩-এ অনুষ্ঠিত প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল -প্রকাশক।]

প্রায় সকল অঞ্চলেই একই সমস্যা-কর্মীর তীব্র স্বল্পতা, পরিচালকগণ বারবার উচ্চস্তরে কর্মী চান।
পরিচালক বিভিন্ন এলাকায় যেয়ে যােগাযােগ করেন, ক্লাশ নেন। ফলে এক এক স্থানে যােগাযােগ অনেকদিন পরে হয়। ফলে কর্মীদের উন্নত করা এবং তাদের ভালভাবে কাজে লাগানাে সম্ভব হয় না।
কর্মীস্বল্পতা থাকায় নতুন যােগাযােগ করাও সম্ভব হয়ে উঠে না। এমতাবস্থায় নিম্নলিখিত পয়েন্টসমূহ কার্যকরী করে সমস্যার সমাধান করা যায়।
০ পরিচালক কুরিয়ার রাখবেন, যার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার সাথে নিয়মিত যােগাযােগ রাখবেন, দলিলপত্র পাঠাবেন, নির্দেশ, কতকগুলাে প্রশ্ন যার মাধ্যমে এলাকার অবস্থা জানা যায় তা লিখে পাঠাবেন।
কুরিয়ার এলাকার নেতৃত্বের সাথে যােগাযােগ করে কাগজপত্র দিবে, প্রশ্নসমূহের উত্তর ও রিপাের্ট নিয়ে আসবে।
এভাবে পরিচালক যেতে না পারলেও বিভিন্ন এলাকার সাথে নিয়মিত যােগাযােগ থাকবে এবং কর্মীদের কাজে লাগানাে যাবে।
কুরিয়ারের মাধ্যমে নতুন যােগাযােগ সমূহও করা যায় (যদি এ কাজের জন্য কর্মী পাওয়া যায়)।
০ যােগাযােগ কেন্দ্র গড়ে তােলা।
বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর পরিচালকের সাথে যােগাযােগ করা উচিত। তারা যােগাযােগ কেন্দ্রে এসে রিপাের্ট করবে।
কোন জরুরী সমস্যা হলেও তারা এসে যােগাযােগ কেন্দ্রের মাধ্যমে যােগাযােগ করতে পারে। পরিচালক যােগাযােগ কেন্দ্রের জন্য প্রত্যহ নির্দিষ্ট সময় লােক পাঠিয়ে খোঁজ নেবে।
০ বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করা।
– পরিচালক বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় কর্মীদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠকে মিলিত হতে পারেন।
সেখানে উচ্চস্তরের নির্দেশ, প্রেরিত দলিলাদি পাঠ এবং বুঝিয়ে দেওয়া, প্রয়ােগের পদ্ধতি নির্ণয় করে দেওয়া, তাদের কাজের পর্যালােচনা করা, ভুল বের করা, সফলতা তুলে ধরা, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করা, বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাশ নেওয়া।
এর মাধ্যমে কর্মীদের মানােন্নয়ন করা যায়।
পৃষ্ঠা: ৪২৫

০ বিভিন্ন এলাকার নেতৃস্থানীয় কর্মী, সম্ভাবনাময় কর্মী, অগ্রসর কর্মীদের দ্রুত উন্নয়নের জন্য বিশেষ ক্লাশ নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
যে যে বিষয়ে দুর্বল সে বিষয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়ে ক্লাশ নেওয়া। এ সকল ক্লাশের জন্য সর্বনিম্ন পাঠ্যসূচী প্রণয়ন করা।
০ বিভিন্ন লাইনে দক্ষদের এ সকল ক্লাশে তাদের দক্ষতা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।
ক্লাশের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে দক্ষ লােকদের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানাে তাদের দক্ষতা শিখিয়ে আসার জন্য।
০ কর্মীস্বল্পতা দূর করার জন্য ব্যাপক সংখ্যক কর্মী সার্বক্ষণিক করা। পরিচালককে উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক সংখ্যক কর্মীদের সার্বক্ষণিক করতে হবে।
রাজনৈতিকভাবে উন্নত বা স্বাধীনভাবে কাজ চালাতে দক্ষ না হলেও সার্বক্ষণিক করা। যায়।
কারণ, অনুশীলন ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তারা দক্ষ হয়ে উঠবে।
অনুশীলনই যােগ্যতার পরীক্ষাক্ষেত্র। কাজেই অনুশীলনে প্রেরণ করেই সার্বক্ষণিক কর্মীর যােগ্যতা মাপা যায়।
এছাড়া পুরুষ কর্মীরা চলে যেতে চাইলে বা অযােগ্যদের পাঠিয়ে দিতে হলে কোন সমস্যা হয় না, তারা বাড়ীতে যেয়ে উঠতে পারে।
মহিলাদের চলে এলে ফিরে যাওয়া অসুবিধাজনক হয় (যদি না পরিবার সহানুভূতিশীল হয়)। এ কারণে তাদের সার্বক্ষণিক করার পূর্বে অনেক বিবেচনা ও পর্যালােচনা করতে হবে। যােগ্যতা ভালভাবে যাচাই করতে হবে যাতে তাদেরকে বাড়ী পাঠাতে না হয়।
সার্বক্ষণিক কর্মী হতে ইচ্ছুক এরূপ কর্মীদের সাথে পরিচালকের কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে পারলে ভাল হয়। তাহলে কর্মীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যসমূহ লক্ষ্য করা যায়।
কারণ, সারা দিন, একাধারে অনেকদিন মানুষ অভিনয় করতে পারে না, তার চরিত্রের দিকসমূহ অবশ্যই প্রকাশ পাবে।
সার্বক্ষণিক করার পূর্বে কেডার ইতিহাস খুব ভালভাবে সংগ্রহ ও পর্যালােচনা করা।
০ সার্বক্ষণিক কর্মীদেরকে সহানুভূতিশীলদের বাসায় রাখার ব্যবস্থা করা যেখানে খাওয়া খরচ লাগবে না। এরূপ অবস্থা থাকলে সার্বক্ষণিক হওয়ার মান কিছুটা শিথিল করা যায়।
সংগঠনের অর্থে ভরণপােষণ করতে হলে মানদণ্ড কিছুটা শক্ত করা উচিত।
চাকুরী, লজিং ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পারলে মানদণ্ড শিথিল করেও কর্মীদের সার্বক্ষণিক করা যায়।
০ কিছুদিনের জন্য, কয়েক মাসের জন্যও সার্বক্ষণিক হতে ইচ্ছুক হলে করা উচিত এবং কাজে লাগানাে উচিত।
কারণ, কাজের প্রক্রিয়ায় এদের কেউ কেউ হয়তাে স্থায়ীভাবে সার্বক্ষণিক হবে।
০ সার্বক্ষণিক কর্মী ও নিরাপত্তার সমস্যা।
– সার্বক্ষণিক কর্মী শত্ৰুচর হয়ে সংগঠনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে।
– অসতর্কভাবে সংগঠনের গােপনীয়তা প্রকাশ করতে পারে।
– গ্রেফতার হলে অত্যাচারের মুখে গােপনীয়তা ফাঁস করতে পারে।
– সহানুভূতিশীলের বাড়ীতে যৌনসংক্রান্ত ও অন্যান্য (চুরি, ঝগড়াঝাটি ইত্যাদি) সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
পৃষ্ঠা: ৪২৬

– নির্দেশাদি পালন না করা, অর্থ আত্মসাৎ, চক্র, ষড়যন্ত্র করা, নেতা হতে ইচ্ছুক হওয়া প্রভৃতির সমস্যার সৃষ্টি করা।
– অস্ত্র ও পার্টির অন্যান্য সম্পদ ইত্যাদি দখল করা, ডাকাতি করা।
– অসুস্থ হয়ে পড়া।
০ সার্বক্ষণিক কর্মী বাড়ীতে চলে গেলে নিম্নলিখিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
– পার্টিসম্পদ নিয়ে যাওয়া।
– গােপনীয়তা ফাঁস করা।
– শক্রর চরে রূপান্তরিত হওয়া।
– সংগঠনের নামে কুৎসা রটনা করা ইত্যাদি। কাজেই এ সকল সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত।
এজন্য সার্বক্ষণিক কর্মীদের
– কেডার ইতিহাস দেখা।
– তাদের সংস্পর্শে থেকে চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ অনুধাবন করা।
– অন্যের রিপাের্ট ও কর্মীর নিজের রিপাের্টের উপর বিশ্বাস করে সার্বক্ষণিক না করা।
উপরােক্ত সমস্যাবলীর যথাযথ সমাধান করা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিশ্বাসঘাতক এবং খারাপ লােকদের সম্পর্কে আমাদের নীতি এবং উদাহরণসমূহ সার্বক্ষণিক এবং কর্মীদের পড়ানাে।
০ অনুন্নত নতুন কর্মীদেরকে রাজনৈতিক আলােচনার সহজ উপায় বাতলে দেওয়া প্রয়ােজন হলে দলিল পড়ে শােনাতে বলা (মুখে বলতে অক্ষম হলে), সহজভাবে সাংগঠনিক কাজ পরিচালনার উপায় শিখিয়ে দেওয়া, কোন কাজ প্রথমে ও পরে করতে হবে তা ঠিক করে দেওয়া।
০ সার্বক্ষণিকদের কাজ তদারক করা। তাদের ভুল-ভ্রান্তি দেখিয়ে দেওয়া, সফলতা তুলে ধরা।
০ সার্বক্ষণিকদের নিয়ে বৈঠক করা, অভিজ্ঞতার বিনিময় করা, ক্লাশ নেওয়া। এভাবে তাদের উন্নত করা।
০ কর্মীস্বল্পতা দূর করার জন্য পরিচালকের নিম্নলিখিত ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সংশােধন করা অপরিহার্য।
০ একতরফাবাদ বিরােধিতা করা।
সার্বক্ষণিক করার সময় পরিচালক শুধু সার্বক্ষণিক হতে ইচ্ছুকদের অনুন্নত দিকই দেখেন এবং একে চিরস্থায়ী বলে মনে করেন।
অনুন্নত এবং উন্নত হচ্ছে একটি দ্বন্দ্বের দুটো দিক। নির্দিষ্ট শর্তে অনুন্নতরাই উন্নততে রূপান্তরিত হয়।
অনুন্নতের মাঝে উন্নত নিহিত রয়েছে।
অনুশীলন ও অভিজ্ঞতার সারসংকলন, অনুশীলন এবং সময়ের ব্যবধানে অনুন্নতরাই উন্নত কর্মীতে রূপান্তরিত হবে। অবশ্য কেউ কেউ ঝরে পড়বে। কাজেই শুধু অনুন্নত দিকই দেখা কিন্তু এর মাঝেই যে উন্নতের সম্ভাবনা বিরাজমান তা না দেখা।
০ শুধু ক্ষতির দিকই দেখা লাভের দিক না দেখা।
পৃষ্ঠা: ৪২৭

সার্বক্ষণিক কর্মীদের নিয়ে যে সকল অসুবিধা হতে পারে এবং ক্ষতি হতে পারে সে দিককেই পরিচালক দেখেন।
কিন্তু ক্ষতি ও অসুবিধার মাঝে লাভ ও সুবিধার দিক রয়েছে।
কারণ সার্বক্ষণিকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ টিকে গেলে এবং উন্নত কর্মী হলে আমাদের ক্ষতির তুলনায় বহু লাভ ও সুবিধা হয়।
উপরন্তু কিছু ক্ষতি ব্যতীত লাভ করা, অসুবিধা ব্যতীত সুবিধা অর্জনের চিন্তা দ্বান্দ্বিকতা বিরােধী।
তবে আমাদের যাতে যথাসম্ভব কম ক্ষতি ও অসুবিধা হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতির চিন্তা করে রক্ষণশীল হওয়া হচ্ছে একতরফাবাদ।
০ আপেক্ষিকতাকে অস্বীকার করা, আধিবিদ্যক হওয়া।
অনুন্নত-এ অবস্থা পরিবর্তন সাপেক্ষ এবং অস্থায়ী মনে না করে পরিচালকগণ একে স্থায়ী মনে করেন। ফলে তারা আধিবিদ্যক হন।
অনুন্নত হচ্ছে আপেক্ষিক এবং পরিবর্তনশীল। অনুশীলন-সারসংকলন-অনুশীলন এবং সময়ের ব্যবধানে অনুন্নতরা উন্নত হয়, উন্নতরা আরাে উন্নত হয়, অনেক সময় পশ্চাদপদও হয়।
কাজেই পরিচালকদের আধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ পরিহার করতে হবে।
০ বস্তুর বিশেষত্বকে প্রতিফলিত না করা, গতিকে উপলব্ধি না করা।
– কর্মীদের মাঝে অগ্রসর, মাঝারী, পশ্চাদপদ এবং প্রত্যেকের যােগ্যতা ও সীমাবদ্ধতা, ভাল ও খারাপ দিক না বুঝা।
এর ফলে অগ্রসরদের খুঁজে বের করা, তাদেরকে আরাে অগ্রসর করে সার্বক্ষণিক করা, কর্মীদের যােগ্যতা অনুযায়ী কাজে লাগানাে এবং ভাল দিকের সদ্ব্যবহার করা হয় না।
ফলে কর্মীস্বল্পতা সর্বদাই থেকে যায়।
কর্মীদের বিকাশও গতিশীল। কেউ বিকাশের প্রক্রিয়ায় সার্বক্ষণিক হতে ইচ্ছুক হয়। পরিচালক বিকাশের এ গতি বুঝে না, তাকে সার্বক্ষণিক করে না। ফলে কর্মীরা পুনরায় পশ্চাদপদ হয়ে যায়।
বিকাশের গতি বুঝতে হবে, অগ্রসরদের আরাে অগ্রসর করতে হবে, সাহসের সাথে কর্মীদের সার্বক্ষণিক করতে হবে।
০ বস্তুবাদী হওয়া।
কেডারদের সার্বক্ষণিক করার পূর্বে যথাসম্ভব তার বিভিন্ন দিক যথাযথভাবে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করা।
অন্যের রিপাের্ট, কর্মীর মুখের কথা / লেখার উপর নির্ভর না করা।
ভালাে দিকই দেখা, খারাপ দিক না দেখা, আত্মগত কল্পনা করে অনেক কিছু ভাবা যা তার মাঝে আদৌ নেই, ইত্যাদি পরিহার করা।
এজন্য সার্বক্ষণিক হতে ইচ্ছুক কর্মীর সংস্পর্শে থাকা, ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা। অতীত ইতিহাস সংগ্রহ করা।
অতীত ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ অতীতের ভিত্তিতে বর্তমান গড়ে উঠেছে এবং অতীত ও বর্তমানের ভিত্তিতেই ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে।
কাজেই অতীত এবং বর্তমান যথাযথভাবে প্রতিফলিত করা উচিত।
পৃষ্ঠা: ৪২৮

এর ফলে শত্ৰুচর, খারাপ লােকদের সার্বক্ষণিক হওয়া ঠেকানাে সম্ভব হবে।
০ গােড়ামীবাদ পরিহার করা।
আমাদের অধিকাংশ পরিচালকই উপরােক্ত তত্ত্বসমূহ জানেন কিন্তু বাস্তব কাজে প্রয়ােগ করেন না, কর্মী-স্বল্পতায় ভুগেন।
ইহা তাদের গােড়ামীবাদী ভুল।
কাজেই পরিচালকদের গােড়ামীবাদ পরিহার করতে হবে, তত্ত্বকে বাস্তব অনুশীলনে প্রয়ােগ করতে হবে।

উপসংহার
স্বল্পতা এবং প্রাচুর্য একটি দ্বন্দ্বের দুটো দিক। নির্দিষ্ট শর্তে স্বল্পতাই প্রাচুর্যে রূপান্তরিত হয়।
এজন্য প্রয়ােজন ধৈর্যশীল হয়ে কাজ করা। ঘনবসতিপূর্ণ পূর্ব বাংলায় বহু কর্মী পাওয়া সম্ভব হবে, তাদেরকে অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় উন্নত করতে হবে, এভাবে। কর্মীস্বল্পতা কাটিয়ে তুলতে হবে।
অবশ্যই নেতৃস্থানীয় ও ভাল কেডার সর্বদাই সংখ্যায় অল্প হবে এবং তাদের অভাব থাকবে।
এ কারণে পরিকল্পিতভাবে ধৈর্যের সাথে এ ধরনের কেডার গড়ে তুলতে হবে এবং এদেরকে যত্ন সহকারে রক্ষা করতে হবে।
পূর্ব বাংলা একটি ক্ষুদ্র দেশ, জনবসতি ঘন। এখানে বিপ্লব করার জন্য অল্পসংখ্যক উন্নতমানের কেডারই যথেষ্ট।
এ উন্নত কেডারদের পরিচালনাধীন প্রয়ােজন ব্যাপক কার্য পরিচালনায় সক্ষম ব্যাপক সংখ্যক কেডার।
কাজেই সাহসের সাথে কেডার সংগ্রহ করতে হবে। শত্ৰুচর ও খারাপ লােকদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে হবে।
পরিচালকদের এ উদ্দেশ্যে কঠোরভাবে একতরফাবাদ, অধিবিদ্যা, গােড়ামীবাদ পরিহার করতে হবে এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হতে হবে।

কতকগুলাে মৌলিক ক্ষতির দিক ও অভ্যাসসমূহ
অলসতা, ঢিলেমী, নির্বুদ্ধিতা, নীচুতা, হিংসা, মাতব্বরী, হামবড়াভাব, মেজাজী, যৌন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভ্রষ্টতা, পশ্চাদপদতা, ভীরুতা, দোদুল্যমানতা, বেখেয়ালীপনা, খারাপ ব্যবহার, মিথ্যা বলা, ছেলেমী, বদ অভ্যাসসমূহ, অভিনয়, দু’মুখাে, প্রতারণা, ছলচাতুরী, ভাগ্যান্বেষী, আরাম-আয়েসের অভ্যাস, ভাল মানুষ সাজা, সমালােচনা সহ্য করতে না পারা, শিখতে অনিচ্ছুক ও অলসতা, দোষ স্বীকার না করা, বিভিন্ন প্রকার। লােভ ও লালসা প্রভৃতি।
পৃষ্ঠা: ৪২৯

নােটঃ
১। মানুষের চরিত্রের মৌলিক দিক ও অভ্যাসসমূহ সুদীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ায় শ্রেণীগত প্রভাবে গড়ে উঠে।
কেডার ইতিহাস, অতীত, বর্তমান, অন্যের রিপাের্ট, মৌখিক ও লিখিত প্রশ্ন, ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ প্রভৃতির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা। অনুসন্ধানপ্রাপ্ত এ সকল তথ্য পর্যালােচনা ও বিশ্লেষণ করে চরিত্রের মৌলিক দিক ও অভ্যাসমূহ বের করতে হবে। এ দিকসমূহের উপকারী, ক্ষতিকর এবং উপকারী বা ক্ষতিকর কোনটাই নয়- এ তিনভাগে ভাগ করতে হবে। ক্ষতিকর মৌলিক দিকসমূহ সুদীর্ঘদিন বজায় থাকবে এবং অনেকদিনের কঠোর ও কষ্টকর প্রচেষ্টার প্রক্রিয়ায় দূর করা সম্ভব। ক্ষতির দিকসমূহ সুদীর্ঘদিন থাকবে, তা দূর করা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য এবং এগুলাে সত্ত্বেও উপকারী দিকসমূহ আমাদের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কতখানি কাজে লাগানাে সম্ভব তা বিবেচনা করতে হবে, এর ভিত্তিতে কর্মী সংগ্রহ ও নিয়ােগ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপঃ ক. আতাউরের অনেক ভালাে দিক আছে কিন্তু বেখেয়ালীপনা তার চরিত্রের একটা মৌলিক খারাপ দিক। তাকে অনেকস্থানেই কাজে লাগানাে হয়েছিল কিন্তু সে হঠাৎ স্থান ত্যাগ করে। এর ফলে ঐ সকল স্থানের কাজের ক্ষতি হয়। এ থেকে দেখা যায় তার বিভিন্ন ভাল দিক থাকা সত্ত্বেও একটি মৌলিক খারাপ দিকের জন্য ভাল দিকগুলাে ব্যবহার করা যায় না। এ কারণে তাকে অন্য কর্মীর সাথে অস্থায়ীভাবে কাজে লাগানাে হচ্ছে যাতে সে হঠাৎ স্থান ত্যাগ করলেও এলাকা নেতৃত্বহীন না হয় এবং ক্ষতি না হয়। কোন কোন কর্মীর অনেক ভাল দিক থাকা সত্ত্বেও কোন কোন মৌলিক খারাপ দিকের জন্য বর্তমানে তাদেরকে কাজে লাগানাে সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় এ ধরনের কর্মী কাজে লাগিয়ে অনেক অসুবিধায় পড়তে হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ৪৩০

বিশেষ সামরিক অঞ্চলের আওতাধীন সেক্টর কমান্ডারদের সাথে বৈঠক শেষে প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমূহ।
[‘৭৩-এর বর্ষাকালীন আক্রমণের পূর্বে বৃহত্তর বরিশাল, ফরিদপুর এবং মুন্সিগঞ্জ জেলাকে নিয়ে বিশেষ সামরিক অঞ্চল গঠন করা হয়েছিল এবং তিনটি শাখাকে তিনটি সেক্টরে বিভক্ত করে তিনজন সেক্টর কমান্ডার নিয়ােগ করা হয়েছিল। এই সেক্টর কমান্ডারদের সাথে বৈঠক শেষে ‘৭৩-এর মাঝামাঝিতে এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

১। এ বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ও সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্য হচ্ছেঃ
– গ্রামসমূহ জাতীয় শত্রু মুক্ত করা।
– ব্যাপক প্রচার চালানাে।
– ব্যাপক সংগঠন গড়ে তােলা।
– অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান।
– বাজার, ফাঁড়ি শেষ পর্যন্ত কয়েকটি থানা শহর দখল করে ছেড়ে দেওয়া। বড় রকমের যুদ্ধ, শত্ৰু পরাজিত করা এবারকার লক্ষ্য নয়।
২। এ রণনৈতিক আক্রমণ চালাবার সময়
– বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোন ফাক না রেখে বিকাশ করতে হবে। ফঁাক থাকলে তা পূরণ করতে হবে।
– আশ্রয়স্থল গড়ে তুলতে হবে, অসংগঠিত থাকলে তা সংগঠিত করার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
– বিভিন্ন অঞ্চলের গেরিলারা যাতে একত্র হতে পারে তার সমস্যার সমাধান করতে হবে।
– রণনৈতিক এলাকায় কাজ বিকাশে সাহায্য (কর্মী, অস্ত্র, অর্থ দিয়ে) করে যেতে হবে, যাতে শীতকালীন আত্মরক্ষার সময় ঐ সকল অঞ্চলকে পশ্চাদভূমি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
– নৌ গেরিলা গড়ে তুলতে হবে।
– আন্তঃআঞ্চলিক ভাল যােগাযােগের জন্য বেতার ব্যবস্থা গড়ে তােলা।
৩। প্রচার ব্যবস্থাকে অতিমাত্রায় জোরদার করতে হবে। সশস্ত্র প্রচার টিমকে অতিমাত্রায় সক্রিয় করতে হবে।
পুলিশ, বিডিআর, রেজিমেন্ট, রক্ষীবাহিনীর মাঝেও ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।
এ প্রচারের উদ্দেশ্য হবে তাদেরকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, নিষ্ক্রিয় করা, আত্মসমর্পণে উদ্বুদ্ধ করা।
পৃষ্ঠা: ৪৩১

৪। ব্যাপকভাবে সার্বিক আক্রমণ শুরু করতে হবে।
জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করতে হবে (জাতীয় শত্রু খতমের জটিল অপারেশনের জন্য উচ্চস্তরের অনুমতি লাগবে), ছােট ফাঁড়ি, বাজার, কয়েকটি থানা দখল করতে হবে, এ্যামবুশ চালাতে হবে (এর জন্য উচ্চস্তরের অনুমতি লাগবে)।
গেরিলাদের ট্রেইন করার জন্য যে সকল অবস্থান আমরা দখল করব না সে সকল এলাকায় তৎপরতা চালানাে। এ বিষয় দেখতে হবে, যে সকল শক্ত অবস্থান দখল করা হবে তাতে যেন চাপ না আসে।
ট্রেইন পর্ব সম্পন্ন করে দুর্বল শক্ত অবস্থান দখল করা।
ট্রেইন করা প্রয়ােজন, আবার ট্রেইনকালে শত্রু অবস্থান দৃঢ় হয়, ফলে তা দখল করা ব্যাহত হয়; এ দ্বন্দ্ব উপরে বর্ণিত উপায়ে সমাধান করা।
৫। সার্বিক রণনৈতিক আক্রমণ শুরু করার জন্য- গেরিলা গ্রুপ গঠন।
– অস্ত্র বণ্টন (পরীক্ষিত না হলে পরীক্ষা করে)।
– ট্রেইন করা।
– যানবাহনের ব্যবস্থা করা।
– যােগাযােগ কেন্দ্র, কুরিয়ার ব্যবস্থা করা।
– নেতৃত্বের কেন্দ্র স্থাপন।
– চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

৬। অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা।
– জাতীয় শত্রুর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা।
– শাস্তি, জরিমানা আদায় করা,
– দখলকৃত দ্রব্য বিক্রয় করা,
– বাজার, শহর দখল করা,
-কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক, আত্মসমর্পণকারী শত্রুদের নিকট থেকে নিয়মিত চাঁদা নেওয়া।
– জনগণের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া।
৭। জনগণের প্রতি সকল অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানােঃ
– জমা নেওয়া।
– অপারেশন করে দখল করা।
৮। শাস্তিসমূহ প্রচার টিমের মাধ্যমে জানানাে।
কেবলমাত্র জনগণ কর্তৃক চরমভাবে ঘৃণিতদের ব্যতীত অন্যান্যদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ, তাদের বিষয় জনগণকে জানানাে। আত্মসমর্পণকারীদের নিকট থেকে অর্থ এবং অন্যান্য চাঁদা নেওয়া।
৯। গেরিলা কোম্পানী গড়ে তােলা।
পৃষ্ঠা: ৪৩২

কোম্পানীর মানুষের সংখ্যাঃ
০ প্রতি গেরিলাপ- ৫/৯ জন।
০ প্রতি প্লাটুন- ৫/৯x৩ = ১৫/ ২৭ জন।
০ প্রতি কোম্পানী-১৫/২৭ X ৩ = ৪৫/৮১ জন।
কোম্পানীর অস্ত্রঃ
০ প্রতি গেরিলা গ্রুপ
৩টা বা বেশি 303, ১টা S.L.R. বা G-3
০ প্রতি প্লাটুন- ১টা স্টেইন।
০ প্রতি কোম্পানী-১টা L.M.G. ১টা রিভলবার বা পিস্তল।
সর্বমােট অস্ত্রঃ
১। L.M.G.-১টা
২। রিভলবার বা পিস্তল-১টা।
৩। স্টেইন-১টা।
৪। S.L.R. বা G-৩-৯টা।
৫। 303-২৭টা।
পৃষ্ঠা: ৪৩৩

১০। গেরিলাদের ট্রেইন করার পদ্ধতি :
– অনভিজ্ঞ অঞ্চল থেকে কমান্ডার ও কমিশার এনে অভিজ্ঞদের সাথে রেখে অপারেশন করানাে।
– অস্ত্র বিষয়ক ট্রেনিং দেওয়া।
– সামরিক দলিল পড়ানাে।
– অনুসন্ধান, পরিকল্পনা, বাস্তব খতম, সারসংকলন, অপারেশন সিট তৈরী প্রভৃতি শিখানাে। কিছুদিন পর পর তাদেরকে ডেকে এনে বা নিজে গিয়ে সারসংকলন করা, গাইড করা।
১১। বর্তমানে প্লাটুন কমান্ডার হতে পারে এরূপ গেরিলাদের লস ঠেকানাে।
১২। পাঠ্যঃ গণযুদ্ধ, পার্টির সামরিক দলিল সকল কমান্ডার-কমিশারদের পড়ানাে।
এগুলাে ছাড়া সেক্টর, সাব সেক্টর, কোম্পানী কমান্ডারদের ছয়টি সামরিক প্রবন্ধের চীনা বিপ্লবী যুদ্ধের রণনীতির সমস্যা, জাপবিরােধী গেরিলা যুদ্ধের রণনীতির সমস্যা পড়ানাে।
১৩। সর্বোচ্চ পরিচালকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে গেরিলাদের উদ্দেশ্যে সার্কুলার প্রদান করা।
১৪। নিয়মিত গেরিলা দল গড়ে তােলা।
১৫। আন্তঃঅঞ্চল সমন্বিত কাজ পরিচালনার জন্য যােগ্য নেতৃত্ব গড়ে তােলা, আশ্রয়স্থল গড়ে তােলা।
১৬। রাজনৈতিকঃ
০ ফ্রন্টের নেতৃত্বে সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করছে ইহা প্রচার করা।
০ সর্বহারা পার্টি ফ্রন্টে যােগদান করেছে, অন্যান্যদের যােগদানের আহ্বান জানাননা।
০ ফ্রন্টের নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করা।
০ দেশীয় চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতির সুযােগ নেওয়ার চেষ্টা করছে মার্কিনের দালাল জাসদ।
জাসদের সমর্থক ও জনগণকে আমাদের প্রতি বিরূপ না করে জাসদের মুখােশ উন্মােচন করা।
– তারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা মেনে নিচ্ছে অর্থাৎ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের দাসত্ব বিশেষ করে ভারতের মার্কিন অংশের দাসত্ব মেনে নিতে চায়। বিদেশী, বিশেষ করে মার্কিন সহায়তায় পূর্ব বাংলা দখল করে তাকে মার্কিনের উপনিবেশে রূপান্তর করতে তারা ইচ্ছুক।
– তারা সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে।
– তাদের অধীনে দেশের অবস্থার কোন পরিবর্তন হবে না। এভাবে জনমত গড়ে তােলা। দলিল তৈরী করা।
পৃষ্ঠা: ৪৩৪

পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলীর সভাপতির ১নং সার্কুলার
(এপ্রিল, ১৯৭৩)

পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীকে একটি সামরিক কমান্ড থেকে পরিচালনার জন্য সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলী এবং সর্বোচ্চ অধিনায়ক নিয়ােগ করা হয়েছে।
সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক কর্তৃক পূর্ব বাংলাকে কতকগুলাে সামরিক সেকটরে ভাগ করা হয়েছে।
এ সকল সামরিক সেকটরের সেকটর কমান্ডার ও রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ করা হচ্ছে।
সেকটর কমান্ডারগণ নিজ সেকটরের সামরিক কার্য পরিচালনা করবেন।
সেকটর কমান্ডারগণ তার আওতাভুক্ত অঞ্চলকে কতগুলাে সাবসেকটরে ভাগ করবেন এবং সাবসেকটর কমান্ডার ও রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ করবেন।
ইহা সর্বোচ্চ অধিনায়কের ও রাজনৈতিক কমিশারের অনুমােদিত হতে হবে।
বর্তমানে যে কোন সামরিক সেকটরে বড় রকম অর্থনৈতিক বা সামরিক অপারেশন করতে হলে সর্বোচ্চ অধিনায়কের নিকট আবেদন করতে হবে এবং তার লিখিত অনুমতি লাগবে।
বর্তমানে সেকটরের আওতাভুক্ত অঞ্চলে যে কোন সামরিক / অর্থনৈতিক হামলার জন্য সেকটর কমান্ডারের লিখিত অনুমতি লাগবে।
বর্তমানে শত্রু রণনৈতিক আক্রমণের স্তরে রয়েছে আর আমরা রয়েছি রণনৈতিক আত্মরক্ষার স্তরে। বর্ষা শুরু হওয়া পর্যন্ত শক্রর রণনৈতিক আক্রমণ চলবে। বর্ষাকালে শত্রু রণনৈতিক আত্মরক্ষা বা সংরক্ষণের স্তরে প্রবেশ করবে, আর আমরা প্রবেশ করব রণনৈতিক আক্রমণ ও বিকাশের স্তরে। – কাজেই বর্ষাকালীন আমাদের রণনৈতিক আক্রমণ শুরু করার জন্য সেকটর কমান্ডারগণ নিম্নলিখিত প্রস্তুতিসমূহ বর্ষা শুরু হওয়ার পূর্বেই অর্থাৎ জৈষ্ঠ্য মাস শেষ হওয়ার পূর্বেই সম্পন্ন করবেনঃ
০ সাব-সেকটর কমান্ডার ও রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ;
০ গেরিলা গ্রুপসমূহ গঠন, কমান্ডার ও কমিশার নিয়োেগ;
০ কুরিয়ার ও যােগাযােগের উপায়, পরিবহন সমস্যার সমাধান;
০ সাব-সেকটরসমূহের মধ্যকার গ্যাপসমূহ দূর করা;১
০ অস্ত্র-শস্ত্র সতর্কভাবে রাখা ও সংগ্রহ করা, (কিনে, বিনিময়ে কর্মীদের নিকট থেকে সংগ্রহ করা) এবং প্রতি সাব-সেকটরে সরবরাহ করা;
…………………………………………………………………….
অঞ্চলসমূহের মধ্যকার ভৌগলিক ফাকসমূহ (অর্থাৎ, কতগুলাে গ্রাম বা থানা, ইউনিয়ন)
দূর করা।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৪৩৫

০ গেরিলা, কমিশার ও কমান্ডারদের মান উন্নয়ন করা;
– মতাদর্শগত মান-শুদ্ধি অভিযান সম্পন্ন করা;
– রাজনৈতিক মান;
– সাংগঠনিক মান;
– সামরিক মান;
০ সশস্ত্র প্রচার টিম নিয়ােগ করা;
প্রভৃতি কাজ বর্ষা শুরু হওয়ার পূর্বেই করতে হবে, যাতে বর্ষাকালে আমরা রণনৈতিক আক্রমণ করতে পারি।
বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কোন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
ভাল গেরিলা, কমিশার, কমান্ডার, অস্ত্র হারানাে, অঞ্চলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা প্রভৃতি থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে হবে।
সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সভাপতির দপ্তর
পৃষ্ঠা: ৪৩৬

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির অষ্টম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার
(সম্ভবতঃ এপ্রিল, ১৯৭৩)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির অষ্টম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন সাফল্যজনকভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সভাপতিত্ব করেন।
সভায় অন্যান্য সিদ্ধান্তের মাঝে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।
পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জাতীয় বিপ্লব প্রধান। এই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার জন্যে একটি সংগঠন প্রয়ােজন যা জাতীয় চরিত্র সম্পন্ন।
যেহেতু জাতি বিভিন্ন শ্রেণী, স্তর ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে গঠিত হয়, এ কারণে এদের প্রতিনিধি সম্বলিত সংগঠন হয়-সর্বত্রই জাতীয় চরিত্র সম্পন্ন হতে পারে।
পূর্ব বাংলার ভৌগলিক সীমারেখার মাঝে বসবাসকারী জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগণের মুক্তিও পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির সাথে জড়িত। এ কারণে পূর্ব বাংলার জাতীয় চরিত্র সম্পন্ন সংগঠনে এদের প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়ােজন এদের সংগ্রামকে সম্বলিত করার জন্য।
বর্তমান যুগে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ব্যতীত জাতির মধ্যকার বিভিন্ন শ্রেণী, স্তর এবং সংখ্যালঘু জনগণ নিজেদেরকে সংগঠিত করা ও নিজের মুক্তি আনয়ণ করতে পারে না।
এ কারণে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে একটি জাতীয় চরিত্র সম্পন্ন এবং ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের প্রতিনিধি রয়েছে এরূপ সংগঠন গড়ে তােলা এবং এর নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করা প্রয়ােজন।
এ জাতীয় চরিত্র সম্পন্ন সংগঠনের নাম পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট।
আমরা যদি পার্টি, ফ্রন্ট এবং দেশপ্রেমিক বাহিনী যথাযথভাবে পরিচালনা করতে পারি, তাহলে বিপ্লবে বিজয় অনিবার্য।
এ কারণে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে।
* নিম্নলিখিত গণসংগঠনসমূহ গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। এ সংগঠনসমূহ শত্রু এলাকায় গােপনভাবে এবং মুক্ত এলাকায় প্রকাশ্য-আধাপ্রকাশ্যভাবে কাজ করবে।
– শ্রমিক ও কর্মচারী মুক্তি সমিতি;
– ছাত্র-যুব মুক্তি সমিতি;
– ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুক্তি পরিষদ;
– দেশপ্রেমিক ওলেমা সমিতি;
– নারী, শিল্প-সংস্কৃতি, সংবাদপত্র ও সাহিত্য মুক্তি সমিতি;
পৃষ্ঠা: ৪৩৭

– দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সমিতি;
– কৃষক মুক্তি সমিতি;
– জাতিগত সংখ্যালঘু মুক্তি পরিষদ;
– জেলে, বেদে এবং অন্যান্য পেশাভিত্তিক সংগঠন গড়ে তােলা।
এ সকল গণসংগঠনসমূহ পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট কমরেডদের নিয়ােগ করা হয়। তারা প্রয়ােজনীয় কমিটি, গ্রুপ গঠন করবে, যথাযথ স্তরের অনুমতি নিয়ে।
প্রতি অঞ্চল জনগণকে উপরােক্ত গণসংগঠনসমূহে সংগঠিত করবে।
* পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলী গঠন করা হয়।
সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলীর সভাপতি এবং সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সর্বোচ্চ অধিনায়ক ও রাজনৈতিক কমিশার হিসেবে সিরাজ সিকদারকে নিযুক্ত করা হয়।
*(১) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, (২) পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী, (৩) শ্রমিক-কর্মচারী মুক্তি সমিতি, (৪) ছাত্র-যুব মুক্তি সমিতি, (৫) ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুক্তি পরিষদ, (৬) দেশপ্রেমিক ওলেমা সমিতি, (৭) নারী, শিল্প-সংস্কৃতি, সংবাদপত্র ও সাহিত্য মুক্তি সমিতি, (৮) দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সমিতি, (৯) কৃষক মুক্তি সমিতি, জাতিগত সংখ্যালঘু মুক্তি পরিষদ, জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদান করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
ফ্রন্টের উপরােক্ত সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে প্রতিনিধি ঠিক করা হয়।
* দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণীর স্বার্থমত কাজসমূহ পার্টি চালিয়ে যাবে ফ্রন্টের মধ্যে ও বাইরে। উদাহরণ স্বরূপ পার্টি ও তার লাইনসমূহ জনপ্রিয় করা, সরাসরি পার্টিতে লােক সংগ্রহ করা, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের মুখােশ উন্মােচন করা, সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করা অর্থাৎ শ্রেণীগত ঐক্য স্থাপন ও বজায় রাখা, পার্টি স্বাধীনতা ও উদ্যোগ নিয়ে ফ্রন্টের মধ্যে ও বাইরে কাজ করে যাবে।
অন্যান্য তথাকথিত মার্কসবাদীদের বিলুপ্তি, ফ্রন্টে অন্যান্য বামপন্থী বিপ্লবী / গ্রুপসমূহের যােগদানের পর ফ্রন্টের বাইরে পার্টির স্বতন্ত্র তৎপরতার প্রয়ােজন হবে না।
পার্টির বাইরে কমরেড সিরাজ সিকদারের নামে শ্লোগান পেশ করা স্থগিত থাকবে। ইহা পার্টির অভ্যন্তরস্থ শ্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
পার্টির নেতা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুকদের কমরেড সিরাজ সিকদারকে নেতা হিসেবে জানানাে যাবে।
অন্যান্য শ্লোগান পূর্বের মত অব্যাহত থাকবে।
*ফ্রন্টে যােগদানে ইচ্ছুকদের বিভিন্ন গণসংগঠনে রিক্রুট করা। সেখানে সক্রিয়দের জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে পার্টির নেতৃত্বের প্রয়ােজনীয়তা বুঝানাে, পার্টিতে যােগদানে ইচ্ছুকদের পাঠচক্রে সংগঠিত করা, এভাবে ফ্রন্টে পার্টির কাজ চালাতে হবে।
* পূর্ব বাংলার জাতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশপ্রেমিক বামপন্থী (গােপন ও প্রকাশ্য) গ্রুপসমূহকে ফ্রন্টে যােগদান করে তাদের জাতীয় সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানানাে।
* বিভিন্ন দেশপ্রেমিক শ্রেণী, স্তর, দল, গ্রুপ, ব্যক্তি এবং সংখ্যালঘু জনগণকে ফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানাে।
* বিভিন্ন অঞ্চলে ফ্রন্টের আঞ্চলিক কমিটি গঠন, ফ্রন্টের সংগঠনসমূহের জন্য লোক নিয়ােগ করা।
পৃষ্ঠা: ৪৩৮

একইভাবে উপঅঞ্চল ও নিম্নতর সংস্থায় কাজ হবে।
* জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির এবং সভাপতির নাম প্রস্তাব করা হয়। কেন্দ্রীয় কমিটিকে নিম্নলিখিত দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব করা হয়ঃ
১. ফ্রন্টের ঘােষণাপত্র প্রকাশ করা। ২. কর্মসূচী ও সংবিধান প্রণয়ন। ৩. জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করা এবং পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা। 8. অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি ফ্রন্টের কার্যাবলী চালাবে, কেন্দ্রীয় কমিটির সভা চলবে না এরূপ সময় সভাপতি ফ্রন্টের কাজ চালাবে। ৫. কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রয়ােজনীয় সদস্য অন্তর্ভূক্ত করতে পারবে (Co op.)।
* জনৈক কমরেড সম্পর্কিত দলিলের উপর বিভিন্ন স্তরের পরিচালক ও নেতৃস্থানীয় কর্মীদের মতামত হচ্ছে।
উক্ত কমরেডকে কোন নেতৃত্বস্থানীয় নীতি নির্ধারণী, নিরাপত্তা জনিত এবং সাংগঠনিক কাজ রয়েছে এরূপ পদে নিয়ােগ না করা।
উপরােক্ত মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত কমরেডকে কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলাে।
* সশস্ত্র বাহিনী দিবস (৩০শে এপ্রিল), আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস (১লা মে), পার্টি দিবস (পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা দিবস ৩রা জুন ১৯৭৩ সাল) উদযাপন করা।
এ সকল দিবস উদযাপন উপলক্ষে পার্টির ইতিহাস তাৎপর্য পর্যালােচনা করা। এ উপলক্ষে বিভিন্ন স্তর উদযাপনী সভা করবে।
পার্টি দিবস উপলক্ষে পার্টির বিগত সময়কালিন অভিজ্ঞতার সারসংকলন প্রকাশ করা।
* সংগঠনের সর্বত্রই একই অবস্থা বিরাজ করবে না। কোন এলাকা উন্নত, কোন এলাকা পশ্চাৎপদ, মাঝারী, কোন এলাকায় বিকাশ প্রধান, কোন এলাকায় সুসংবদ্ধকরণ প্রধান, কোন এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রাম প্রধান, কোন এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি, পশ্চাৎপসরণ প্রধান হতে পারে।
তবে প্রতিটি এলাকাই সাধারণ লাইনের সাথে সমন্বিত করে নিজ অবস্থা অনুযায়ী কাজ করবে।
ইহা কর্মীদের ক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। কিছু কর্মী হবে পশ্চাৎপদ। প্রতি কর্মীর ভাল ও শক্তিশালী দিক রয়েছে, কিছু খারাপ ও দুর্বল দিকও রয়েছে।
এটা চিন্তা না করে কাজ করা হচ্ছে একতরফাবাদ। এর ফলে কাজ হবে অন্ধভাবে এবং আমরা হবাে হতাশ।
* গুরুতর নিরাপত্তার সাথে জড়িতদের সুবিধাবাদী ও দলত্যাগী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নীতি হচ্ছে। – শেষ পর্যন্ত বুঝানাে এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা যাতে সে সুবিধাবাদী না হয়।
– এ সময়ের মাঝে নিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়া রােধ করার জন্য বিভিন্ন প্রস্তুতি নেওয়া।
– এ ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে, এরূপদের গুরুতর নিরাপত্তার সাথে জড়িত না করা।।
– সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও গুরুতর নিরাপত্তার সমস্যা হলে শত্রু এলাকায়
চরম শাস্তি প্রদান, মুক্ত এলাকায় আটক রাখা।
পৃষ্ঠা: ৪৩৯

* সামরিক ক্ষেত্রে অথনৈতিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে কেন্দ্রীয় কাজ।
এ সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য যে সকল অঞ্চল পদক্ষেপ নিয়েছে তাদেরকে প্রশংসা করা হচ্ছে।
এ সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার ক্ষেত্রে উক্ত অঞ্চলসমূহের ইতিবাচক ও নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা, এর নিয়মবিধি আবিষ্কার করা, সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত যাতে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারি।
* সশস্ত্র প্রচার টিম একটি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রচার চালায়। এতে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়।
সকল এলাকায় ইহা কার্যকরী করার আহ্বান জানানাে হচ্ছে।
* পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে নিম্নলিখিত শহীদ কমরেডদের মৃত্যু পরবর্তীকালীন পার্টির সদস্যপদ প্রদান করা হলােঃ
১। ক. তাহের ২। ক. বাতেন ৩। ক. পলাশ ৪। ক. নয়ন ৫। ক. জিল্লু ৬। ক. সাঈদ ৭। ক. শাহিন ৮। ক, আনিস ৯। ক, কুদুস ১০। ক. পিন্টু ১১। ক, রাজ্জাক ১২। ক. হিরু ১৩। ক, নজরুল।
আরাে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে শহীদদের সদস্যপদ প্রদান করা হবে।
* সিকিমে ভারতীয় হস্তক্ষেপ তাদের সম্প্রসারণবাদী চরিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে।
* টাকা বদলের সমস্যা বাংলাদেশ পুতুল সরকারের সংকটকে আরও গভীরতর করেছে। এ সংকটে জনগণের ক্ষোভ ও ঘৃণা তীব্রতর হচ্ছে।
এটা বাংলাদেশ পুতুল সরকারের বাংলাদেশকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিকট বিকিয়ে দেওয়ার বিশ্বাসঘাতক কাজকে আরাে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে।
* ক্ষুদে বুর্জোয়ারা হয় গােড়ামীবাদী অথবা সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী। এ কারণে তাদের চিন্তা ও কাজের পদ্ধতি হচ্ছে একতরফাবাদ, ভাসাভাসাভাব এবং আত্মগতভাব।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে তারা বিভেদপন্থীবাদী। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থাৎ শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে তারা হয় বামে ডানে দোদুল্যমান। লেখা-বলা ও পড়ার ক্ষেত্রে তারা হয় একঘেয়ে। উপরােক্ত বিষয়সমূহ হচ্ছে বুর্জোয়া মতাদর্শের বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ।
আমাদের কর্মীরা উপরােক্ত ভুলসমূহ করেন কিনা তা প্রতিটি কাজে যাচাই করে দেখবেন।
আমাদের কাজসমূহ উপরােক্ত ক্ষুদে বুর্জোয়া বহিঃপ্রকাশ দ্বারা পরিচালিত হলে আমরা বােকা ও পরাজিত হবাে এবং এগুলাে থেকে মুক্ত হলে আমরা বিচক্ষণ ও বিজয়ী হবাে।
* উচ্চস্তরের মতামত না পাওয়া পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিচালকদের মতামত পেশ করতে বিরত থাকতে হবে।
তারা উক্ত বিষয়ে নিজের কর্মী, সহানুভূতিশীল, জনগণের মতামত সংগ্রহ করে উচ্চস্তরে প্রেরণ করবেন।
নেতৃস্থানীয় কর্মী কোন কারণবশতঃ পার্টির সাথে সংযােগ হারিয়ে ফেললে তার এলাকা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে তার জন্যে পূর্বেই ব্যবস্থা করে রাখা।
নেতৃত্ব বিষয়ক এবং মানুষের সাথে সম্পর্ক বিষয়ক ক্লাশ নেওয়া।
পৃষ্ঠা: ৪৪০

নেতৃত্বদানে সক্ষম কর্মী গড়ে তােলার প্রতি খুবই মনােযােগী হওয়া উচিত। অতীতে সংগঠন এ বিষয়ে গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করেনি।
* আঞ্চলিক চাদা ছাড়াও প্রতি অঞ্চল তাদের সহানুভূতিশীলদের নিকট থেকে কেন্দ্র ও বিশেষ অঞ্চলের জন্যে চাদা সংগ্রহ করবে।
এ সংক্রান্ত আহ্বান ও কুপন গৃহীত হলাে।
* নীতি নির্ধারণ, কেডারদের কাজে লাগানাে ও তাদের মানােন্নয়ন করা পরিচালকের দায়িত্ব।
পরিচালক যদি খুব দৌড়াদৌড়ি করে, ব্যস্ততা দেখায় তবে বুঝতে হবে নেতৃত্ব অদক্ষ। এ প্রসঙ্গে নেতৃত্বের কতিপয় গাইড গৃহীত হলাে (পরিশিষ্ট-১)।
* নেতৃস্থানীয় এবং অন্যান্য কর্মীদের সময় ব্যবহারের শতকরা হিসাব উচ্চস্তরের নিকট জমা দেওয়া।
নিম্নলিখিত কাজগুলাে করা অবশ্যই প্রয়ােজনঃ
– পার্টিপ্রদত্ত দায়িত্ব পালন। – নিজে পড়া। – অন্যকে পড়ানাে। – লিখা। – চিন্তা করা। – ব্যায়াম ও শরীরচর্চা (হেঁটে বা সাইকেলে প্রােগ্রাম করা এর মাঝে অন্তর্ভূক্ত)। – আলাপ করা। – খাওয়া, বিশ্রাম, অবসর বিনােদন।
সর্বশেষ পয়েন্টটি বাদ দিয়ে বাকী পয়েন্টগুলাের জন্য যে সময় ব্যয় হয় তাকে ২৪ দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে পূরণ করা। এভাবে শতকরা হিসাব বের করা এবং ইহা ৫০% এর নীচে হওয়া উচিত নয়।
* সাধারণ স্বাস্থ্য, অসুস্থতা, চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করা।
* কেন্দ্রের দলিলপত্র মুদ্রণ, অর্থের প্রয়ােজন, নিরাপত্তা প্রভৃতি প্রয়ােজন মিটানাের পূর্বে এর অধীনস্থ এককের প্রয়ােজন মেটানাে চলবে না।
অধীনস্থ একক এ নিয়ম লংঘন করলে তা চিন্তার ক্ষেত্রে একতরফাবাদ এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদের প্রকাশ হবে।
* প্রতি অঞ্চলে হিসেবের জন্য নির্দিষ্ট কমরেডকে দায়িত্ব দেওয়া।
* একটি কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায় চিন্তার ক্ষেত্রে কি কি প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় তা বের করা এবং কাজটি করার পূর্বে বা প্রাক্কালে সেগুলাে দূর করার জন্যে সর্বপ্রথম মতাদর্শগত সংগ্রাম করা।
কোন কাজ সম্পাদনের জন্যে একটি বিষয়ের উপরেই সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া হচ্ছে একতরফাবাদের বহিঃপ্রকাশ। এর ফলে কাজ সফল হবে না।
চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করা সবচেয়ে প্রথম প্রয়ােজন। কেননা চিন্তা কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে।
* সাংগঠনিক কাজের স্তর নির্ণয় করা অর্থাৎ সংগঠনের বিকাশের স্তর প্রধান না সুসংবদ্ধতার স্তর, সশস্ত্র সংগ্রাম না সাংগঠনিক বিকাশ ও সুসংবদ্ধকরণ কোনটা প্রধান তা নির্ণয় করা, সে অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা।
পৃষ্ঠা: ৪৪১

নেতৃত্বদানে সক্ষম কর্মী গড়ে তােলার প্রতি খুবই মনােযােগী হওয়া উচিত। অতীতে সংগঠন এ বিষয়ে গুরুত্ব যথাযথভাবে উপলব্ধি করেনি।
* আঞ্চলিক চাদা ছাড়াও প্রতি অঞ্চল তাদের সহানুভূতিশীলদের নিকট থেকে কেন্দ্র ও বিশেষ অঞ্চলের জন্যে চাদা সংগ্রহ করবে।
এ সংক্রান্ত আহ্বান ও কুপন গৃহীত হলাে।
* নীতি নির্ধারণ, কেডারদের কাজে লাগানাে ও তাদের মানােন্নয়ন করা পরিচালকের দায়িত্ব।
পরিচালক যদি খুব দৌড়াদৌড়ি করে, ব্যস্ততা দেখায় তবে বুঝতে হবে নেতৃত্ব অদক্ষ। এ প্রসঙ্গে নেতৃত্বের কতিপয় গাইড গৃহীত হলাে (পরিশিষ্ট-১)।
* নেতৃস্থানীয় এবং অন্যান্য কর্মীদের সময় ব্যবহারের শতকরা হিসাব উচ্চস্তরের নিকট জমা দেওয়া।
নিম্নলিখিত কাজগুলাে করা অবশ্যই প্রয়ােজন ? – পার্টিপ্রদত্ত দায়িত্ব পালন। – নিজে পড়া। – অন্যকে পড়ানাে। – লিখা। – চিন্তা করা। – ব্যায়াম ও শরীরচর্চা (হেঁটে বা সাইকেলে প্রােগ্রাম করা এর মাঝে অন্তর্ভূক্ত)। – আলাপ করা। – খাওয়া, বিশ্রাম, অবসর বিনােদন।
সর্বশেষ পয়েন্টটি বাদ দিয়ে বাকী পয়েন্টগুলাের জন্য যে সময় ব্যয় হয় তাকে ২৪ দিয়ে ভাগ করে ১০০ দিয়ে পূরণ করা। এভাবে শতকরা হিসাব বের করা এবং ইহা ৫০% এর নীচে হওয়া উচিত নয়।
* সাধারণ স্বাস্থ্য, অসুস্থতা, চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করা।
* কেন্দ্রের দলিলপত্র মুদ্রণ, অর্থের প্রয়ােজন, নিরাপত্তা প্রভৃতি প্রয়ােজন মিটানাের পূর্বে এর অধীনস্থ এককের প্রয়ােজন মেটানাে চলবে না।
অধীনস্থ একক এ নিয়ম লংঘন করলে তা চিন্তার ক্ষেত্রে একতরফাবাদ এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদের প্রকাশ হবে।
* প্রতি অঞ্চলে হিসেবের জন্য নির্দিষ্ট কমরেডকে দায়িত্ব দেওয়া।
* একটি কাজ সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায় চিন্তার ক্ষেত্রে কি কি প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় তা বের করা এবং কাজটি করার পূর্বে বা প্রাক্কালে সেগুলাে দূর করার জন্যে সর্বপ্রথম মতাদর্শগত সংগ্রাম করা।
কোন কাজ সম্পাদনের জন্যে একটি বিষয়ের উপরেই সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে যাওয়া হচ্ছে একতরফাবাদের বহিঃপ্রকাশ। এর ফলে কাজ সফল হবে না।
চিন্তার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করা সবচেয়ে প্রথম প্রয়ােজন। কেননা চিন্তা কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে।
* সাংগঠনিক কাজের স্তর নির্ণয় করা অর্থাৎ সংগঠনের বিকাশের স্তর প্রধান না সুসংবদ্ধতার স্তর, সশস্ত্র সংগ্রাম না সাংগঠনিক বিকাশ ও সুসংবদ্ধকরণ কোনটা প্রধান তা নির্ণয় করা, সে অনুযায়ী কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা।
পৃষ্ঠা: ৪৪১

– কষ্টসহিষ্ণু; – পার্টির বর্তমান অস্ত্র-শস্ত্র সম্পর্কে মােটামুটি ধারণা আছে; – চিকিৎসা সম্পর্কে মােটামুটি ধারণা আছে; – যৌনশিক্ষার উপর মােটামুটি ধারণা আছে; – শারীরিকভাবে মােটামুটি সুস্থ; – সমালােচনা সহ্য করতে পারে; – উদারতাবাদী নয়; – ত্রুটি-বিচ্যুতি সমূহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে এবং সারাতে পারে; – প্রধান কাজ বের করতে পারে; – সময় মত প্রােগ্রাম করতে পারে; – সহানুভূতিশীল ও নিম্নস্তরের সাথে আলাপে ইমপ্রেসিভ; – পার্টির পূর্ণাঙ্গ সদস্য হতে হবে; – নীতিনির্ধারণ, কেডারদের কাজে লাগানাে এবং তাদের মানােন্নয়নে সক্ষম হতে হবে; – লিখিত বা মৌখিকভাবে প্রদত্ত ভাল প্রস্তাব, পরামর্শ, নির্দেশ গ্রহণ এবং তা কার্যকরী করার গুণসম্পন্ন; – শিখতে আগ্রহী;
* পাঠচক্র, কোষ ও সামরিক গ্রুপের মানদণ্ড নির্ণয় করা। বিভিন্ন স্তর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের জন্যে প্রয়ােজনীয় মানদণ্ড প্রস্তাব করবে।
* সফলতা ও বিফলতার জন্য আমরাই দায়ী। অঞ্চলের ভালমন্দের জন্য পরিচালক দায়ী।
* পুরােনাে সমাজের পিছুটানকে অতিক্রম করতে হলে প্রথম চিন্তার ক্ষেত্রে পরিষ্কার হওয়া, অসুবিধা দূর করতে লেগে থাকা আর অসুবিধা দূর করা।
এভাবে চিন্তা, অভ্যাস ও পুরােনাে সমাজের ক্রটিসমূহ দূর করা। * সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম ইশতেহার অনুমােদিত হলাে। * সভায় সভাপতির নির্দেশ ও সিদ্ধান্তসমূহ অনুমােদিত হলাে। * সভায় সদস্যরা সমালােচনা-আত্মসমালােচনা পরিচালনা করেন। * পরবর্তী সভার তারিখ নির্ধারণ করে সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।

পরিশিষ্ট-১
নেতৃত্বের কতিপয় গাইড১,
সার্বক্ষণিক কর্মী করার সময়
– অগ্রসর চরিত্রের কিনা?
– চেহারা, চালচলন, কথাবার্তা অগ্রসর চরিত্রের কিনা?
…………………………………………………………………….
১. এই দলিলটি ‘৭৪ সালে নির্বাচিত সাংগঠনিক রচনাবলী”-তে অন্তর্ভূক্ত করার সময় কিছু সংশােধন করা হয়েছিল। তবে এখানে ইশতেহারের সাথে প্রকাশিত মূল সংস্করণটিই ছাপানাে হলাে। এটি ডিসেম্বর, ‘৭৩-এ ইশতেহারসমূহের সংকলনে প্রকাশিত হয়েছিল- প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৪৪৩

– ইমপ্রেসিভ কিনা দেখা? অগ্রসর চরিত্রের না হলে সার্বক্ষণিক না করা।
* নেতৃত্বের কাজ
১. নীতি নির্ধারণঃ – সমস্যা বের করা ও তার সমাধান প্রদান করা; – সমস্যা বের করার জন্য রিপাের্ট নেওয়া, প্রশ্ন করা, বৈঠক দেওয়া; – সমস্যা নিয়ে দলিল-তত্ত্ব পড়া; – চিন্তা করা; – সমাধান বের করা; – সমাধান নিয়ে আলােচনা করা (প্রয়ােজন হলে সভার মাধ্যমে)।
২. নীতি বাস্তবায়িত করা / কর্মীদের কাজে লাগানােঃ – নির্দেশ প্রদান; – আলােচনা করে বুঝিয়ে দেওয়া; – বৈঠকের মাধ্যমে বুঝানাে।
৩. মানােন্নয়নঃ
শিক্ষা সম্মেলন, অভিজ্ঞতার সারসংকলন সভা (এর পূর্বে সংশ্লিষ্ট তত্ত্ব পড়ে আসতে বলা), দলিল পড়ার সভা, সাধারণ সভা করা।
৪. নীতি বাস্তবায়নের বিষয় অবগত হওয়াঃ – অনুসন্ধান; – এ সময়ে উত্থাপিত সমস্যার সমাধান প্রদান।
৫. পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাঃ – উন্নততর কর্মপদ্ধতি উদ্ভাবন, যােগ্য লােক বের করা ও নিয়ােগ করা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা।
৬. অভিজ্ঞতার সারসংকলনঃ – নির্দেশ, নীতি বাস্তবায়নের সফলতা, ভুল, সীমাবদ্ধতা বের করা এবং তা ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না করা।
* নেতৃত্বের প্রয়ােজন- কর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযােগ। এ জন্যে কুরিয়ার-যােগাযােগ কেন্দ্র প্রয়ােজন।
* কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের ভাল দিক প্রশংসা করা।
* সমালােচনার সমস্যার সমাধান।
* গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা যথাযথভাবে প্রয়ােগ।
– সিদ্ধান্তের পূর্বেই মতামত চাওয়া; – সিদ্ধান্ত প্রদানের সময় বুঝানাে; – ভাল প্রস্তাব থাকলে গ্রহণ; – সমালােচনা ও প্রস্তাব চাওয়া; – বিরুদ্ধ মতামত পেশ করতে দেওয়া; – পূর্ণ গণতন্ত্র কার্যকরী করা; – সিদ্ধান্ত, নির্দেশ দৃঢ়ভাবে কার্যকরী করা।
অপরিবর্তিত ক্ষুদে বুর্জোয়ারা নির্দেশ ও কেন্দ্রীকতাকে আমলাতান্ত্রিক, একনায়কত্বমূলক বলে।
পৃষ্ঠা: ৪৪৪

– বিজ্ঞানী ইত্যাদি।
* আলােচনার পদ্ধতি অনুসরণঃ – যার যার Interested বিষয় নিয়ে আলাপ করা, এর মাধ্যমে রাজনীতিতে যাওয়া; – ভাল শ্রোতা হওয়া, যত্নশীল হওয়া।
* নেতৃত্ব বিষয়ক পাঠ্যতালিকাঃ – সাংগঠনিক দলিলের নেতৃত্বের কতিপয় সমস্যা পড়া; – ‘বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা পড়া; – ‘কর্মীস্বল্পতা দূর করার কতিপয় উপায়’ পড়া; – কেডার; – পার্টি কমিটির নেতৃত্ব; উদ্ধৃতি। – আলােচনা। – সমালােচনা।
দলিল। – একটি কাজ করার উপায়;
* দ্বিমাসিক পরিকল্পনাঃ – জৈষ্ঠ্য মাস শেষ হওয়ার পূর্বেই সুসংবদ্ধকরণ শেষ করা; – মান উন্নয়ন করা, শুদ্ধি অভিযান শেষ করা; – নেতৃত্ব গ্রুপ তৈরী করা; – পাঠচক্র ও গেরিলা গ্রুপ তৈরী করা; – যােগাযােগ সম্পন্ন করা; – কুরিয়ার নিয়ােগ করা; – যােগাযােগ কেন্দ্র গড়া; – কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করা; – সদস্য/প্রার্থী সদস্য/ পাঠচক্র পদ প্রদান করা; ইত্যাদি।
* ক্ষুদে বুর্জোয়া বৈশিষ্ট্যসমূহ দূর না করলে নেতৃত্বক্ষমতা অর্জন করা সম্ভব নয়।

অষ্টম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহারের শেষে যুক্ত হলাে
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট নিম্নলিখিত শ্লোগানসমূহ প্রদান করবেঃ
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট-জিন্দাবাদ!
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী-জিন্দাবাদ!
এ জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের সভাপতি সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ!
ফ্রন্টের মধ্যে পার্টি কর্মীরা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ!
ফ্রন্টে যােগদানকারী অন্যান্য সংগঠনসমূহ-জিন্দাবাদ!
এবং অন্যান্য পার্টি শ্লোগান দেবে।
পৃষ্ঠা: ৪৪৬

অর্থনৈতিক অপারেশন সংক্রান্ত কতিপয় পয়েন্ট
(মে, ১৯৭৩)
[সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলীর দপ্তর থেকে এ দলিলটি প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

বড় রকমের অর্থনৈতিক অপারেশন হচ্ছে জটিল ধরনের কমান্ডাে বা গেরিলা হামলা।
‘আক্রমণ কর সরে পড়’ ধরনের অপারেশনের চাইতে এগুলাে জটিল। কারণ, এ সকল অপারেশনে প্রয়ােজন হয় আক্রমণ করে দখল করা, দ্রব্যাদি সংগ্রহের জন্য কিছুক্ষণ অবস্থান করা এবং দখলকৃত দ্রব্যাদি নিয়ে সরে আসা। এছাড়া অপারেশন হয় শত্রু এলাকার শহর অঞ্চলে যেখানে তাদের যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত। তারা শক্তিশালী, জনসমর্থন আমাদের পক্ষে কাজে লাগানাে কঠিন।
এ কারণে অপারেশন করতে হয় খুবই তড়িৎ বেগে।
এ ধরনের অপারেশনের জন্য প্রয়ােজন উন্নতমানের পরিকল্পনাবিদ, যানবাহন সমস্যার সমাধান, অংশগ্রহণকারীদের পরিকল্পনা কার্যকরী করা এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতি মােকাবেলা করার মতাে পেশাদারসুলভ (Professionalism) দক্ষতা ও বিচক্ষণতা এবং এগুলাে সমন্বিত করে অপারেশন পরিচালনা করার মতাে পরিচালক।
সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনার জন্য প্রয়ােজন আমাদের অবস্থা এবং লক্ষ্যবস্তুর পারিপার্শ্বিকতা, যাতায়াত ব্যবস্থা, শক্র ও জনগণের অবস্থা প্রভৃতির পুংখানুপুংখ অনুসন্ধান। এর ভিত্তিতে সকল দিক ও সম্ভাবনা বিবেচনা করে সফলতা প্রায় নিশ্চিত এরূপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
এর পর আসে গেরিলা, অস্ত্র, যানবাহন সংগ্রহ, গেরিলাদের মতাদর্শগত ট্রেনিং প্রদান ইত্যাদি।
সবশেষে আসে সকল প্রস্তুতি সমন্বিত করে অপারেশন করানাে।
এ সকল কাজ যথাযথভাবে করানাের মতাে কর্মীর এবং সুযােগের অভাব রয়েছে। এ কারণেই আত্মগত অবস্থার (আমাদের অবস্থা) সাথে বস্তুগত অবস্থার (অপারেশন লক্ষ্যবস্তু ও পারিপার্শ্বিকতা) সামঞ্জস্য হয় না। ফলে অনেক অপারেশন ব্যর্থ হয়।
০ উচ্চস্তরের মূল্যবান পরামর্শ কার্যকরী না করা, সহায়তা গ্রহণ না করা অপারেশন ব্যর্থতার একটি কারণ।
এ কারণে অপারেশনপূর্বে সম্ভাব্য সকলের নিকট থেকে বিভিন্ন দিক সম্পর্কে সাহায্য গ্রহণ করা, সহায়তা নেওয়া বিশেষ করে উচ্চস্তরের সহায়তা, পরামর্শ ও মতামত গ্রহণ করা।
০ ব্যাপক কাজ না হওয়ায় এবং পশ্চাদপদ অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে আমাদের কর্মীদের মধ্য থেকে প্রচুর সংখ্যক ড্রাইভার ও মেকানিক পাওয়া যায় না। ইহাও অপারেশন সফল না হওয়ার একটি কারণ।
পৃষ্ঠা: ৪৪৭

কাজেই পরিকল্পিতভাবে শহরে ড্রাইভিং শেখার জন্য কর্মীদের নিয়ােগ করতে হবে, ড্রাইভারদের মধ্যে কাজ করতে হবে।
০ ব্যাপক কাজ না হওয়ার ফলে অর্থনৈতিক লক্ষ্যবস্তুর ভিতর থেকে যথাযথ খবর পাওয়া সর্বদা সম্ভব হয় না।
০ অপারেশন নিকটবর্তী সংগঠন ও জনসমর্থন অনেক ক্ষেত্রেই কাজে লাগানাে হয়নি। ফলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
এ কারণে অপারেশনের পূর্বেই স্থানীয় সংগঠন ও জনসমর্থন কাজে লাগাবার ব্যবস্থা করতে হবে।
০ এক স্থানের গেরিলারা অপরিচিত অন্যস্থানে অপারেশন চালাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিপদগ্রস্ত হয়েছে।
এ কারণে স্থানীয় গেরিলাদের দিয়ে অপারেশন করানাে উচিত। বাইরের গেরিলাদের অংশগ্রহণ থাকলেও স্থানীয় গেরিলাদের নেয়া উচিত। বাইরের গেরিলাদের বেশ সময় নিয়ে স্থানীয় অবস্থার সাথে পরিচিত করে তােলা উচিত।
০ অনেক সময় অপারেশনে সব ভাল ও গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার, গেরিলা ও কমিশার নিয়ােগ করা হয়েছে বা নিয়ােগের পরিকল্পনা হয়েছিল।
অপারেশনে অংশগ্রহণকারীদের দ্বারা বা তাদের বিপদ হলে সংগঠনের কি কি ক্ষতি হতে পারে, কি কি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে তা চিন্তা বা বিবেচনা করা হয়নি।
প্রথমােক্ত কারণে কোন কোন এলাকায় এত ক্ষতি হয় যে পরে আর অপারেশন করার মতাে অবস্থা থাকে না।
কোন কোন পরিকল্পনায় এমন সব কমরেডদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল যে তাদের। বিপদ ঘটলে বিরাট অঞ্চলের সাংগঠনিক, সামরিক কাজ বন্ধ হয়ে যেত।
অপারেশনে অংশগ্রহণকারীদের বিপদ হওয়ার ফলে কোন কোন অঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এমন কি অন্যান্য অঞ্চলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
অস্ত্রের ক্ষেত্রেও অনেক সময় চিন্তা করা হয়নি এগুলাে হারালে কি হবে, যার ফলে পরে অপারেশন করার মত অবস্থা থাকেনি।
এ সকল কাজ হচ্ছে একতরফাবাদ দ্বারা পরিচালিত হবার ফল। ইহা হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী স্বার্থ, সমগ্র অবস্থা, সকল দিক চিন্তা না করে একতরফাভাবে শুধু অপারেশন করার কথাই চিন্তা করার পরিণতি।
০ পরিকল্পনা কতােখানি বাস্তবায়িত করতে গেরিলা, কমান্ডার, কমিশাররা সক্ষম তা বিবেচনা করতে পরিচালকের অক্ষমতা অনেক অপারেশন ব্যর্থতার কারণ।
০ অপারেশনকালে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কি করতে হবে তা কমান্ডাররা নির্ধারণ করতে পারে না, ফলে অপারেশন ব্যর্থ হয় এবং টুপ বিপদগ্রস্ত হয়।
০ একাধারে বারংবার অপারেশন ব্যর্থতা হতাশা আনে। এ কারণে সুদীর্ঘ সময় নিয়ে ভালভাবে প্রস্তুতিসহ সফলতা নিশ্চিত এরূপ অপারেশন করা উচিত। ব্যর্থতা যাতে বহু সময় ব্যবধানে হয় তা দেখা উচিত।
বড় অপারেশনের মাঝে ছােট ছােট সফল অপারেশন করা উচিত। এর ফলে মনােবল দৃঢ় থাকবে।
০ অপারেশনের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ, একত্রিত হওয়া, ট্রেনিং ও বিশেষ করে অপারেশনে অংশগ্রহণ, অপারেশন শেষে অস্ত্র ও দখলকৃত দ্রব্যাদি জমা নেওয়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকতা প্রচলিত করা।
পৃষ্ঠা: ৪৪৮

প্রথম ক্ষেত্রে পরিচালকের লিখিত অনুমতিপত্র লাগবে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে জমাকারীদের স্বাক্ষর লাগবে।
০ পরিচালক নিজে ও অংশগ্রহণকারীরা নির্দিষ্ট তত্ত্ব পড়ে সারসংকলন সভায় মিলিত হবে এবং অপারেশনের সারসংকলন করবে।
অপারেশন শিট উচ্চস্তরে পাঠাতে হবে।
০ পরবর্তী অপারেশনে সারসংকলন প্রাপ্ত পয়েন্টসমূহ কঠোরভাবে প্রয়ােগ করা।
০ সামরিক গ্রুপের গেরিলাদের কোন কোন অঞ্চলে সামরিক গ্রুপ বা সাংগঠনিক গ্রুপ পরিচালনা বা অন্যান্য সাংগঠনিক কাজে লাগানাে হয়নি। ফলে তাদের মানদণ্ড উন্নত হয়নি, সাংগঠনিক চেতনা ও বৈপ্লবিক দায়িত্ববােধ জন্মেনি, শৃঙ্খলা ও সমন্বয় সাধন করা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী করা, নিজেদের ও গেরিলাদের উন্নত করা, পরিচালনার জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
ফলে যদিও গেরিলা গ্রুপে ভাল ভাল কমরেড এসেছে কিন্তু তাদের কর্মক্ষমতা যথাযথভাবে কাজে লাগানাে হয়নি।
এটা সকল এলাকায় অবশ্যই পরিহার করতে হবে, গেরিলাদের সাংগঠনিক কাজে লাগাতে হবে।
সার্বক্ষণিক হতে ইচ্ছুক গেরিলাদের সার্বক্ষণিক করে অন্যত্র পাঠাতে হবে, অন্যথায় তারা সুবিধাবাদী ও পশ্চাদপদ হয়ে যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় কাজ, তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং অপারেশন সংক্রান্ত কতিপয় গাইড লাইন
“উচ্চস্তরের সংস্থার পক্ষে কাজের হাল্কা ও গুরু এবং মন্থর ও জরুরী প্রকৃতি নির্বিশেষে কোনটা কেন্দ্রীয় কাজ তার উল্লেখ না করে নিম্নস্তরের সংস্থাকে একই সময়ে অনেক কাজ করতে নির্দেশ প্রদান করা উচিত নয়। এমনি করলে নিম্নস্তরের কাজের বিন্যাস এলােমেলাে হবে এবং নির্ধারিত ফলও পাওয়া যাবে না।”
সভাপতি মাও আরাে বলেছেন, “যে কোন অঞ্চলে একই সময়ে অনেকগুলাে কেন্দ্রীয় কাজ থাকতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট সময়ে কেবলমাত্র একটা কেন্দ্রীয় কাজ থাকতে পারে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের কাজ পরিপূরক হিসেবে থাকতে পারে। তাই একটা অঞ্চলের মুখ্য পরিচালককে অবশ্যই সেখানকার সংগ্রামের ইতিহাস, সংগ্রামের অবস্থা বিবেচনা করে বিভিন্ন কাজকে উপযুক্ত স্থানে সাজিয়ে রাখতে হবে, নিজে কোন পরিকল্পনা তৈরী না করে শুধু উচ্চস্তরের নির্দেশানুসারে এক একটা কাজ করা উচিত নয়। এমনি করলে অসংখ্য কেন্দ্রীয় কাজ এলােমেলাে বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। প্রতিটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের ঐতিহাসিক অবস্থা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থানুসারে সমগ্র পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা করে প্রতিটি বিশেষ সময়ের জন্য কাজের ভারকেন্দ্র ও কাজের ক্রম সঠিকভাবে স্থির করা এবং তা অবিচলিতভাবে পালন করা যাতে নির্দিষ্ট ফলার্জন সুনিশ্চিত হয়; এটাই হচ্ছে নেতৃত্বের অন্যতম কৌশল।”১
কেন্দ্রীয় কাজ সাজানােই যথেষ্ট নয়, তা বাস্তবায়িত করার জন্য সভাপতি মাওয়ের নিম্নোক্ত নির্দেশ পালন করতে হবে।
“দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা উচিত। এর অর্থ যে, পার্টি কমিটি এর প্রধান কাজকে অবশ্যই শুধু ধরবে না বরং দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা উচিত। কোন জিনিস শুধুমাত্র দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে এবং লেশমাত্র শিথিল না করেই তাকে ধারণ করা যায়। ধরা, কিন্তু দৃঢ়ভাবে নয়, তার অর্থই হচ্ছে
পৃষ্ঠা: ৪৪৯

মােটেই না ধরা। স্বভাবতঃই খােলা হাতে কিছু ধারণ করা যায় না। হাতটা যখন মুঠো করা হয়, কিন্তু দৃঢ়ভাবে মুঠোবদ্ধ করা না হয়, তখন ধরার মতাে দেখা গেলেও আসলে কিছুই ধরা হয়নি। আমাদের কোন কোন কমরেডও প্রধান কাজকে ধরেন, কিন্তু তা দৃঢ় করে নয়। তাই কাজেও তারা ভাল করতে পারেন না। মােটেই না ধরলে চলবে না এবং ধরা দৃঢ় না হলেও চলবে না।”
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও নেতৃত্ব পার্টির বিভিন্ন নিম্নতর সংস্থার প্রধান কাজ নির্ধারণ করে দিয়েছে।
উদাহরণ স্বরূপঃ
সামরিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কাজ হচ্ছে অর্থনৈতিক অপারেশন। মতাদর্শগতসাংগঠনিক ক্ষেত্রে চক্রবিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের ও ছয় পাহাড়ের দালালদের মুখােশ উন্মােচন, প্রচার জোরদার ইত্যাদি।
নিম্নস্তরের করণীয় :
বিভিন্ন নিম্নস্তরের সংস্থায় নিজস্ব মতাদর্শগত, সাংগঠনিক, সামরিক, রাজনৈতিক ও অন্যান্য কাজ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ও জাতীয় শত্রু বা অর্থনৈতিক অপারেশনের পরিকল্পনা, প্রচার ইত্যাদি কাজ রয়েছে।
তাদেরকে উচ্চস্তর প্রদত্ত কেন্দ্রীয় কাজ এবং নিজেদের কাজসমূহ পর্যালােচনা করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় কাজ ঠিক রেখে নিজেদের কাজের ক্রম সাজাতে হবে।
উপরােক্ত বিষয়সমূহের আলােকে আমরা কয়েকটি অভিজ্ঞতা পর্যালােচনা করি।
সম্প্রতি আমাদের কোন এক অঞ্চলে দুটি জাতীয় শত্রু (ভাই) খতম ও তাদের নিকট থেকে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়।
সামরিক ক্ষেত্রে অথনৈতিক সমস্যার সমাধান কেন্দ্রীয় কাজ, এ নির্দেশের সাথে সঙ্গতি রেখে স্থানীয় কাজে অসুবিধা সৃষ্টিকারী উপরােক্ত জাতীয় শত্রুদুটো অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কিন্তু অপারেশনে যাওয়ার মুহূর্তে খবর পাওয়া যায় যে, জাতীয় শত্রু দু’জন বাড়ী নেই। তাই অপারেশন বাদ দেওয়া হয়। কারণ তাদের অনুপস্থিতিতে অপারেশন করলে পরে তাদের পেতে কষ্ট হবে।
তাদের অনুপস্থিতিতেও অপারেশন করলে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হতাে এবং দুটো অস্ত্র পাওয়া যেত।
অপারেশন বাদ দেওয়ার ফলে নিম্নলিখিত ভুল হয়।
শেষ মুহূর্তে অপারেশন বাদ দিয়ে সামরিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রধান কাজ তা ভুলে যাওয়া হয় এবং জাতীয় শত্রু খতমের কাজকে প্রধান কাজ বলে গণ্য করা হয়। পরিকল্পনায় যদিও অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান প্রাধান্য পায় কার্যতঃ তা গৌণ হয়।
কাজেই জাতীয় শক্র বাড়ীতে না থাকলেও অপারেশন করা, তাদের অস্ত্র ও মূল্যবান দ্রব্যাদি দখল করা উচিত ছিল।
এর ফলে পার্টির আর্থিক লাভ হতাে এবং অস্ত্র দখল হতাে। প্রধান কাজকে যথার্থই প্রাধান্য দেয়া হত।
অপর এক জাতীয় শত্রুকে অপারেশনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়। তার নিকট বেশ অর্থ রয়েছে এ খবর অনুসন্ধানের ভিত্তিতে পাওয়া যায়।
পৃষ্ঠা: ৪৫০

উক্ত অঞ্চলের নেতৃত্ব অধীনস্থ কর্মীদের অপারেশন করার দায়িত্ব দেন এবং অপারেশনে যাবে এরূপ গেরিলাদের একটা তালিকা তৈরী করে দেন। অধীনস্থ কর্মী ইচ্ছাখুশীমত অপারেশন করে এবং অর্থ আনতে ব্যর্থ হয় যদিও জাতীয় শত্রু খতম হয়।
এক্ষেত্রে উক্ত অঞ্চলের নেতৃত্বের উচিত ছিল নিজস্ব তত্ত্বাবধানে অপারেশন করানাে, যেহেতু ইহা কেন্দ্রীয় কাজের মাঝে (অর্থাৎ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের মাঝে) পড়ে।
এখানে উক্ত অঞ্চলের নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় কাজকে আঁকড়ে ধরেননি।
অপর এক ক্ষেত্রে একটি ব্যাংক অপারেশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এমন কি বাইরে থেকে গেরিলা আনানাে হয়। কিন্তু ম্যানেজারের অসুস্থতার কারণে অপারেশন। বাতিল করা হয়।
এক্ষেত্রে উচিত ছিল ম্যানেজারের সুস্থতা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এক্ষেত্রে কাজকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা হয়নি।
ফলে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও হয়নি। অর্থাৎ প্রধান সমস্যার সমাধান হয়নি। এর অর্থ হচ্ছে প্রধান সমস্যাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা হয়নি। অর্থাৎ প্রধান সমস্যাকে ধরা হয়নি।
০ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানকে সামরিক ক্ষেত্রে প্রধান কাজ হিসেবে আঁকড়ে ধরে গেরিলা, পার্টি-কমিটি, পাঠচক্রকে কাজ দিতে হবে, স্থানীয় সামরিক কাজকে সে অনুযায়ী সন্নিবেশিত করতে হবে, এ কাজের সাথে শুদ্ধি অভিযান ও চক্রবিরােধী সংগ্রাম সমন্বিত করতে হবে, প্রচার চালাতে হবে।
উদাহরণস্বরূপঃ গেরিলাদের অপারেশন পরিকল্পনার জন্য একত্র করা হলাে। অপারেশন পরিকল্পনার পূর্বে তাদেরকে কয়েক ঘণ্টা চক্রবিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান সংক্রান্ত ক্লাশ নেওয়া হলাে। এরপর অপারেশন বিষয়ক আলােচনা হলাে।
অপারেশনের মতাদর্শগত প্রস্তুতি হবে চক্রবিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান।
জাতীয় শক্রর অর্থ ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি এবং কৃষিজাত দ্রব্যাদি দখল করে আমরা পার্টিফান্ড গড়ব কি?
আমাদের কিছু কিছু কর্মী, পরিচালক ও বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের ধারণা রয়েছে যে, জাতীয় শত্রুর উপরােক্ত বিষয়াদি নিয়ে এলে জনগণ একে ডাকাতি বলে ভুল বুঝবে, রাজনৈতিক অপারেশন বলে বুঝবে না।
অথবা বিষয়াদি নিয়ে এলে তা জনগণের মাঝে বিতরণ করা উচিত যাতে জনগণ ভুল না বুঝে।
জনগণকে বিপ্লবে পরিচালনার জন্য প্রয়ােজন বিপ্লবী পার্টি। এ পার্টির কার্য পরিচালনার জন্য প্রয়ােজন অর্থ।
এ অর্থ আসবে প্রধানতঃ শত্রুদের নিকট থেকে (শত্রুদের অর্থ প্রকৃতপক্ষে জনগণের অর্থ যেহেতু তা জনগণ থেকে শােষিত ও লুণ্ঠিত)।
সরকারের অর্থও জনগণের অর্থ। কাজেই জনগণের মুক্তির জন্য এ অর্থ দখল ও ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত।
কাজেই শত্রুদের ধনসম্পদ ও অর্থ দখল করা এবং প্রথমে পার্টি পরিচালনার জন্য তা ব্যবহার করা ন্যায়সঙ্গত।
পৃষ্ঠা: ৪৫১

পার্টির প্রয়ােজনের বাইরে জাতীয় শত্রুর ধনসম্পদ জনসাধারণের মাঝে বিতরণ করা উচিত। কিন্তু পার্টির কার্য পরিচালনার প্রয়ােজনকে প্রাথমিক স্থান দিতে হবে। জাতীয় শত্রুর ভূমি বিনামূল্যে ক্ষেতমজুর, গরীব চাষীদের মাঝে বিতরণ করতে হবে।
গৌরনদী অঞ্চলে ১৯৭১ সালে কয়েক হাজার মন চাল ও গম পাওয়া গিয়েছিল। তা কমমূল্যে বিক্রয় করলে পার্টির ফান্ডের সমস্যার সমাধান হত।
কিন্তু তা জনসাধারণের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
জনসাধারণ যাতে ভুল না বুঝে তার জন্য পােস্টার, লিফলেট, চিকার মাধ্যমে প্রচার করা এবং জনসাধারণকে জানানাে উচিত যে এই এই অপারেশনে এই এই অর্থ ও সম্পদ পাওয়া গেছে তা পার্টির কার্য পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
জনসাধারণ চায় মুক্তি, তারা চায় বিপ্লব ও বিপ্লবী পার্টি। কাজেই তারা একে সমর্থন করবে।
উপরন্তু শত্রু যে প্রচার করে আমরা সি.আই.এ, অমুক-তমুক তাও ভ্রান্ত হবে। কারণ আমাদের ফান্ড আসে আমাদের প্রচেষ্টা দ্বারা, বিদেশ থেকে নয়।
আমরা জনসাধারণকে জানাতে পারি না এমন কাজ নেই। জনসাধারণ ডাকাতি ভাবরে এর অর্থ জনসাধারণের উপর আস্থা না থাকা।
বিপ্লবী পার্টির জন্য অর্থ প্রয়ােজন আর তা আসবে শক্রর সম্পদ দখল করে, এটা জনসাধারণের মাঝে প্রচার করলে জনসাধারণ বুঝবে।
সরকারী অর্থ ও সম্পদের বেলায়ও ইহা প্রযােজ্য।
কাজেই শত্রু ও সরকারী অর্থসম্পদ দখল করতে হবে এবং জনসাধারণকে জানাতে হবে যে, তাদেরকে বিপ্লবে পরিচালনার জন্য এ সম্পদ পার্টি ব্যবহার করছে।

পদ্ধতি :
০ আঞ্চলিক পরিচালক তার প্রতি কর্মীকে সার্কুলার মারফত জানিয়ে দেবে পার্টির অর্থের প্রয়ােজনীয়তা এবং ইহা সামরিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কাজ।
০ তাদেরকে এমন কি সহানুভূতিশীলদেরকেও জাতীয় শত্রু এবং সরকারী প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধান পাঠাতে বলতে হবে যেখানে অপারেশন হলে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়।
০ অনুসন্ধান আঞ্চলিক নেতৃত্ব পর্যালােচনা করবে এবং লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় করবে এবং ক্রম অনুযায়ী সাজাবে।

পরিকল্পনা প্রণয়ন, অপারেশন ও তার পরবর্তী কার্যাবলী
অপারেশন, গেরিলা গ্রুপ গঠন, অস্ত্র সংগ্রহ, অপারেশনে যাওয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা, অপারেশনে গেরিলা কমান্ডার, সহকমান্ডার, রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ, অপারেশনে কার কি ভূমিকা তা নির্ণয়, এ বিষয়ে গেরিলাদের সাথে আলােচনা, তাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া, খবর সরবরাহকারী নিয়ােগ এবং তাদের মাধ্যমে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খবর সংগ্রহ করা। সম্ভব হলে কমান্ডার, কমিশারদের অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু দেখানাে। অপারেশন গেরিলাদের অচেনা স্থানে হলে ঐ এলাকার সাথে পরিচিত এরূপ লােক বা স্থানীয় লােকের ব্যবস্থা করা, অপারেশন শেষে গেরিলারা কিভাবে চলে যাবে।
পৃষ্ঠা: ৪৫২

তা নির্ণয় করা, দখলকৃত দ্রব্যাদি জমা নেওয়া ও রাখার ব্যবস্থা করা, অস্ত্র রাখার ব্যবস্থা। করা, আহত বা মৃত হলে তাদের চিকিৎসা বা সরানাের ব্যবস্থা করা।
অপারেশনের তারিখ, মিলনস্থান এবং সময় নির্ণয় করা ইত্যাদি।
০ গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন নিজ তদারকিতে করা এবং আঁকড়ে ধরা।
০ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের সমস্যা থাকলে জাতীয় শত্রু থাক বা না থাক অপারেশন করা।
০ জাতীয় শত্রু পেলে তাও খতম করা।
০ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ক্রমাগত অপারেশন চালিয়ে যাওয়া।
০ কিছুটা ঝুঁকি নিতে হলে তাও নেওয়া।
০ যতদিন না বিভিন্ন গেরিলা গ্রুপ বা এলাকার নেতৃত্ব ভালভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হচ্ছে। ততদিন আঞ্চলিক নেতৃত্বের অনুমােদন ব্যতীত অপারেশন করতে না দেওয়া অর্থাৎ কেন্দ্রীকতা প্রয়ােগ করা।
০ দখলকৃত দ্রব্যাদি ঠিকমত জমা নেওয়া, অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি উচ্চস্তরে পাঠানেনা।
০ প্রয়ােজনবােধে অন্য অঞ্চল থেকে সর্ব প্রকার সহায়তা গ্রহণ করা।
০ প্রচারের ব্যবস্থা করা, অপারেশনের সময় পার্টি, কর্মসূচী ও নেতৃত্বের নামে শ্লোগান প্রদান করা। সম্ভব হলে চুঙ্গা বা হ্যান্ড মাইক ব্যবহার করা।
পরবর্তী সময়ে লিফলেট, পােস্টার ও চিকা ব্যবহার।
০ অপারেশনের প্রক্রিয়ায় শুদ্ধি অভিযান ও চক্রবিরােধী সংগ্রাম পরিচালনা করা।
০ অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে নীতিকে বিসর্জন দেওয়া কোন ক্রমেই অনুমােদনীয় নয়। অর্থাৎ কোন অবস্থায় জনগণের উপর হামলা করা চলবে না। এ ধরনের হামলা হলে পার্টির সুনাম নষ্ট হবে। জনগণের সাথে পার্টির সম্পর্ক ক্ষুন্ন হবে, কর্মীদের মাঝে শত্রু-মিত্র নির্ণয় না করে যত্রতত্র হামলার চরম ক্ষতিকর অভ্যাসের সৃষ্টি হবে, শক্রদের সুবিধা হবে।
১৯৭০-এর প্রথম দিকে বরিশালে এ ধরনের ঘটনা ঘটে যার ফলে পার্টির সুনাম নষ্ট হয়, পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
০ জাতীয় শত্রু খতমের পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু, গেরিলাদের অবস্থান, আশপাশ, যাতায়াত পথ, ম্যাপ এঁকে বুঝানাের অভ্যাস সৃষ্টি করা।
এ প্রক্রিয়ায় কম্পাস রিডিং শেখানাে। এগুলাে ভবিষ্যতের জন্য সহায়ক হবে।

অপারেশনের টুপ গঠনঃ
১। ভ্রষ্ট ছিল এ ধরনের লােক খুব সাহসী এ ধরনের ধারণা কারাে কারাে রয়েছে।
ভ্ৰষ্টরা মুখে বড় বড় কথা বলে। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে এরা সবচাইতে আগে পলায়ন করে, ভয় পায়, গেরিলাদের মনােবল ভেঙ্গে দেয়। এরা খুব ক্ষতিকর। অপারেশনে এদেরকে বর্জন করা উচিত।
অভিজ্ঞতায় আরাে দেখা গেছে যারা ভ্রষ্ট ছিল না তারাই গেরিলা হিসেবে ভাল হয়।
গেরিলাদের সাধারণতঃ সংগ্রহ করা উচিত বিশ্বস্ততা, উৎসাহ, পার্টিতে যােগদানের পূর্বেকার এবং পরবর্তীকালের কার্যাবলী পর্যালােচনা করে।
পৃষ্ঠা: ৪৫৩

২। গেরিলা ট্রপে পুরানাে বা একাধিক অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছে এরূপসহ কিছু। নতুন গেরিলা নেওয়া ভাল।
অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অভিজ্ঞদের নিলে ভাল হয়। প্রথমােক্ত ক্ষেত্রে নতুনরা অভিজ্ঞ হওয়ার সুযােগ পায়।
৩। যেখানে পুরানাে অভিজ্ঞ নেই সেখানে রাজনৈতিক মান, শ্রেণীভিত্তি, উৎসাহ, অতীত জীবন, পার্টিতে যােগদানের পরবর্তী সময়কালীন কার্যকলাপ পর্যালােচনা করে অপারেশন টুপ গঠন করতে হবে।
এরাই অপারেশনের মাধ্যমে অভিজ্ঞ হয়ে উঠবে।
০ অপারেশন টুপ গঠনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে অপারেশনসমূহ যেন ব্যক্তিনির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। কারও উপর অপারেশন নির্ভর হয়ে পড়লে এবং তার মতাদর্শগত মান নিম্ন হলে তার মাথা বিগড়ে যেতে পারে। সে নিজেকে কেউকেটা মাতব্বর ভাবতে পারে, তার মাঝে হামবড়া মনােভাব দেখা দিতে পারে। সে উদ্ধত হতে পারে। এ সকল খারাপ মনােভাব বেড়ে গিয়ে তার মাঝে পার্টি ও জনগণকে অবজ্ঞা, তাদের প্রতি অনাস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
এর পরিণতি হবে ফজলু চক্রের অনুরূপ মারাত্মক পরিণতি।
০ গেরিলা টুপে একজন কমান্ডার, একজন সহকারী কমান্ডার এবং একজন। রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ করা।
এদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া।
বড় রকমের অপারেশনে বহু গেরিলা প্রয়ােজন হতে পারে। তখন সমগ্র অপারেশনের মধ্যে বিভিন্ন দায়িত্বে দু’জন, তিনজন, পাঁচজন বা অধিক গেরিলা প্রয়ােজন হতে পারে। তখন প্রতি কাজের জন্য নির্দিষ্ট গেরিলাদের জন্য কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার ঠিক করা এবং সকল গেরিলাদের জন্য কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার, রাজনৈতিক কমিশার ঠিক করা।

কমান্ডাে টুপঃ
কমান্ডাে টুপ গঠন করে তাদেরকে অপারেশন করার জন্য কতকগুলাে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে দেওয়া যায়, এরা হাতের নিকট যে অস্ত্র পায় তাই দিয়ে অপারেশন করবে। কখনাে প্রয়ােজন হলে অস্ত্র ব্যতীত হাতে বা গামছা দিয়ে অপারেশন করবে।
এদেরকে রিভলবার, পিস্তল, চাকু, স্টেন, গ্রেনেড অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দেওয়া যায়।
বরিশালে ২নং ফ্রন্টে শুধু ব্লেড দিয়ে এ ধরনের একটি টুপ একটি পুলিশ ফাঁড়ি দখল করেছিল।
মেহেদীগঞ্জ এলাকায় এ ধরনের একটি ট্রুপ একটি লােহার ছাতি, পেনসিল ও চাকু দ্বারা থানা, রাজাকারদের সামনে দফাদার খতম করে।
সম্প্রতি এ ধরনের একটি টুপ কয়েকজন জাতীয় শত্রুকে খালি হাতে খতম করে।

বিশেষ টুপঃ
কখনাে কখনাে বিশেষ ট্রুপ গঠন করা যায় যাদেরকে দিনরাত্রি প্রস্তুত রাখা হয়। অপারেশনের জন্য।
পৃষ্ঠা: ৪৫৪

এ ধরনের টুপ প্রয়ােজন হয় যখন অপারেশন যে কোন সময় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এজন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক গেরিলাদের চব্বিশ ঘণ্টা থাকা, খাওয়া এবং অস্ত্রসহ একত্রে থাকার ব্যবস্থা করা যায়।
সম্প্রতি চক্রবিরােধী সামরিক তৎপরতায় এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। বিশেষ ট্রপের কাজ শেষ হয়ে গেলে তা ভেঙ্গে দেওয়া যায়।
০ কোন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে একটি স্টেনগান নিয়ে না যাওয়া। কারণ অনেক সময়ে স্টেন জ্যাম হয়ে যায়।
সম্প্রতি বরিশালে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটে এবং রিজভী বেঁচে যায়।
০ কমপক্ষে দুটো স্টেন ব্যবহার করা।
কোন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে দুটো হ্যান্ড গ্রেনেড ব্যবহার না করা। কারণ দুটোই ফাটতে না পারে।
সম্প্রতি অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে দুটো হ্যান্ড গ্রেনেডই ফাটেনি।
এজন্য অপারেশনের পূর্বে হ্যান্ড গ্রেনেডের ফিউজ রৌদ্রে শুকিয়ে নেওয়া উচিত (আগুনে নয়) এবং কমপক্ষে তিনটি হ্যান্ড গ্রেনেড নিয়ে যাওয়া উচিত।
০ দেশী বােমা তৈরী ও বহনের সময় অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা। দেশীয় বােমা এমন স্থানে তৈরী করা উচিত যেখানে জনগণ নেই।
একজন তৈরী করবে, যে অবশ্যই কোন নেতৃস্থানীয় কর্মী বা সম্ভাবনাময় কর্মী হবে না।
বহন করার সময়ও দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং নেতৃস্থানীয় বা সম্ভাবনাময় কর্মী বহন করবে না।
ক. শাহীনের মত সম্ভাবনাময় কর্মী হাত বােমা তৈরী করতে যেয়ে নিহত হন এবং আরাে কয়েকজন আহত হন।
এরূপ ঘটনা চট্টগ্রামেও একবার ঘটে।
০ জাতীয় শত্রুর ঘরের দরজা ভাঙ্গার জন্য কুড়াল বা শাবল ব্যবহার করা যায়। সিন্দুক ভাঙ্গার জন্য পাঁচ সেরী হাতুড়ী ও ছেনি (চিমটা দ্বারা ধরে) ব্যবহার করা যায়। একান্ত প্রয়ােজন হলে দরজা ভাঙ্গার জন্য হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করা যায়।
০ রিভলবার, পিস্তল, স্টেনগান, ব্রেটা প্রভৃতি ছােট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র অতিশয় যত্নের সাথে রাখা ও ব্যবহার করা উচিত। এগুলাে যেন কোন প্রকারেই হারানাে বা খােয়া না যায় তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
সকল ধরনের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বেলায় এটা প্রযােজ্য।

অপারেশন সংক্রান্ত কতিপয় অভিজ্ঞতা
“অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সামরিক ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কাজ।”
কেন্দ্রীয় কমিটির এ নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শত্রু নাগর মােল্লার অপারেশন সংক্রান্ত অনুসন্ধান, সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অনুসন্ধানের। ভিত্তিতে ট্রুপ তৈরী, ট্রপের কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার, রাজনৈতিক কমিশার, স্কাউট নিয়ােগ, টুপ সদস্যদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া, যাতায়াত, ট্রপের থাকার জায়গা, অস্ত্র সরাবার জায়গা ইত্যাদি ঠিক করে দেওয়া হয়। প্রথমবার প্রচেষ্টা চালান হয়। কিন্তু শত্রু না থাকায় ঘটনাস্থল থেকে টুপ ফিরে আসে (শত্রুর অনুপস্থিতিতে অর্থনৈতিক সমস্যার
পৃষ্ঠা: ৪৫৫

সমাধান হতাে না)। কয়েকদিন পরে আবার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অপারেশন। প্রক্রিয়ায় কতিপয় মারাত্মক ভুলত্রুটি ঘটে। যদিও শত্রু খতম হয়।
০ অপারেশন স্থানে গিয়ে অনেক বিলম্ব করা, সন্দেহজনকভাবে আলাপ-আলােচনা করা এবং ঘােরাফেরা করা, সিদ্ধান্ত নিতে দোদুল্যমানতা।
এর একটা কারণ ছিল অপারেশন পরিকল্পনায় শত্রুকে যেখানে পাওয়ার কথা ছিল। শত্রু সেখানে না থেকে অন্যত্র ছিল। দ্বিতীয় কারণ হলাে অপারেশন স্থানে অধিক লােকের ভীড় থাকা। উল্লেখ করা যেতে পারে অপারেশনটি ছিল একটি জনবহুল হাটে।
প্রথম সমস্যার সমাধান কমান্ডারের দ্রুত করা উচিত ছিল। এ ব্যাপারে সে বড়জোর সহকারী কমান্ডার অথবা রাজনৈতিক কমিশার উপস্থিত থাকলে তার সাহায্য নিতে পারে। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে বিলম্ব করা, গেরিলাদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কোন মতেই উচিত নয়।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হলে তৎক্ষণাত ঘটনাস্থল ত্যাগ করা এবং নিরাপদ স্থানে চলে এসে আলাপ-আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
অধিক লােকের ভীড়ের সমস্যার সমাধান যথাযথ কমান্ডের মাধ্যমে করা যেত। কাজেই প্রথম অবস্থায় শত্রুর অবস্থান স্কাউটের মাধ্যমে জেনে লােকের ভীড়কে ভয় করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্রমণ করা উচিত ছিল। বিলম্ব করার ফলে শত্ৰু হাতছাড়া হতে পারত, গেরিলা টুপ ডাকাত বলে ধরা পড়তে পারত। এক্ষেত্রে কমান্ডার নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর ফলেই দ্বিতীয়বার শত্রুকে যখন যথাস্থানে পাওয়া গেল তখন জনৈক গেরিলা কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষা না করেই আক্রমণ করে। এই গেরিলার সক্রিয়তা না থাকলে হয়ত শত্ৰু হাতছাড়া হতাে।
০ মূল কথা হলাে যে কোন অবস্থাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে দোদুল্যমানতা মারাত্মক বিপদের কারণ হতে পারে। দোদুল্যমানতা দেখা দিলেই ঘটনাস্থল দ্রুত ত্যাগ করা উচিত।
০ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে টুপ সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রেও কমান্ডার এবং সহকারী কমান্ডারের নির্দেশ দিতে ব্যর্থতাই এর কারণ।
কমান্ডারের উচিত ছিল আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে উচু গলায় কমান্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গেরিলাদের শত্রুর দোকান এবং ‘রাইসমিল’ সার্চ করতে বলা। অধিকন্তু কমান্ড যথাযথভাবে দিতে পারলে শত্রুকে জীবিত অবস্থায় আটক করে টাকা আদায় করা সম্ভব হতাে। কিন্তু যথাযথ কমান্ডের অভাবে এটা সম্ভব হয়নি। কমান্ডারের পরিবর্তে সহকারী কমান্ডার এ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান কেন্দ্রীয় কাজ’ এ নির্দেশ ভুলে গিয়েছিলেন।
দোকান এবং মিলের সার্চের দায়িত্ব পূর্বেই গেরিলাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, গেরিলারাও তা করতে ব্যর্থ হয়।
সামগ্রিকভাবে টুপ তার কেন্দ্রীয় কাজকে বাস্তবে প্রয়ােগ করতে পারেনি।
০ যথাযথ নির্দেশ প্রদান করতে না পারায় এবং অনেকটা স্বতঃস্ফূর্ত আক্রমণ করায় জনৈক গেরিলা অপ্রয়ােজনীয়ভাবে অনেক বুলেট খরচ করেন।
যেখানে ১টি বুলেটও প্রয়ােজন হতাে না সেখানে ৩৫টি বুলেট খরচ করেন। এটা সম্পূর্ণরূপে মিতব্যয়িতা এবং কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশের পরিপন্থী। কেন্দ্রীয় কমিটি একটি বুলেটও অপ্রয়ােজনীয়ভাবে নষ্ট করতে নিষেধ করেছে।
পৃষ্ঠা: ৪৫৬

০ এছাড়া জনৈক কমরেড অপ্রয়ােজনীয়ভাবে নির্দেশ ছাড়া একটি বুলেট নষ্ট করেন এবং আসার পথে আরাে একটি বুলেট নষ্ট করার পদক্ষেপ নেন।
কিন্তু জনৈক গেরিলার নির্দেশে তা থেকে বিরত হন। ফেরার পথে যেহেতু জনগণ কোন বাধার সৃষ্টি করেননি সেহেতু কোনরকম শব্দ করা অপ্রয়ােজনীয়। এরূপ করলে তা বিপদের কারণ হতে পারে। শব্দ লক্ষ্য করে শত্রু আমাদের অনুসরণ করতে পারে। তাই ফেরার পথে (Retreat) যথাসম্ভব নিঃশব্দে চলে আসা উচিত। এমন কি কোন আলাপ-আলােচনাও করা উচিত নয়; ভুলত্রুটি সম্পর্কেও আলােচনা করা উচিত নয়। নিরাপদ স্থানে এসে একত্রে বসে ভুলত্রুটি পর্যালােচনা এবং অন্যান্য বিষয় আলােচনা করা উচিত।
কমান্ডারের নির্দেশ ছাড়া এবং অপ্রয়ােজনীয়ভাবে বুলেট খরচ করার অর্থ হচ্ছে অস্ত্রের উপর বেশী প্রাধান্য দেওয়া অথবা রােমাঞ্চের বহিঃপ্রকাশ ঘটানাে। যুদ্ধক্ষেত্রে এ দুটোই মারাত্মক ক্ষতিকর।
অধিকন্তু উক্ত গেরিলার নিকটস্থ স্টেনগান প্রথম অবস্থায় যখন কাজ করছিল না তখন সে ঘাবড়িয়ে যায় যদিও স্টেনগান চালনার ব্যাপারে তার ট্রেনিং ছিল।
যুদ্ধক্ষেত্রে ঘাবড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হলাে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা। এজন্য মাথা সব সময় ঠাণ্ডা রাখা প্রয়ােজন। ম্যাগাজিনের স্প্রিং ঢিলে হয়ে যাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে এটা ঠিকভাবে কাজ করে না (এজন্য ম্যাগাজিনের বুলেট কাজের সময় ছাড়া অন্য সময় খুলে রাখা উচিত)। অনেক সময় বােল্টও ঠিকভাবে কাজ করে না। এ ধরনের অসুবিধার ক্ষেত্রে মাথা ঠাণ্ডা রেখে দ্রুত ম্যাগাজিন বদলানাে উচিত এবং বােল্ট আবার টানা প্রয়ােজন। এজন্য মনের দিক থেকে তৈরী থাকতে হবে। কিন্তু অস্ত্রের উপর বেশী প্রাধান্য দিলে কখনােই এটা করা সম্ভব হবে না বরং মাথা বিগড়ে যাবে।
০ পরিকল্পনায় নৌকায় যাওয়ার সময় নির্ণয় করা হয়নি। যার ফলে ট্রুপকে নৌকায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এ ব্যাপারে তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধানের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল।
০ এলাকার প্রথম অপারেশন এবং জাতীয় শত্রু সাফল্যজনকভাবে খতম, গেরিলাদের সময়মত উপস্থিত হওয়া, স্কাউটের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন, ঘটনাস্থলে বক্তৃতা, শ্লোগানের মাধ্যমে উপস্থিত জনগণকে পার্টির নেতৃত্ব ও বক্তব্য সম্পর্কে অবহিত করা, ব্যাপক জনসমর্থন পাওয়া এগুলাে হচ্ছে এ অপারেশনের ভাল দিক।
কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হওয়া, অধিক এবং অপ্রয়ােজনীয়ভাবে বুলেট খরচ হওয়ায় এ অপারেশনে আমাদের ক্ষতির দিক প্রধান।

অপর এক হামলার জন্য দুটি স্টেনগানসহ গেরিলা, গাইড ও স্কাউট নিয়ে একটি কমান্ডাে টুপ গঠন করা হয়। অপারেশনটি শহরের উপরে এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কার্যক্ষেত্রে কমান্ডােরা সাফল্যজনকভাবে হামলা করে। কিন্তু স্টেন থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে গুলি বের হলেও ব্রাশ হয়নি। প্রথম কমান্ডাের এ অসুবিধা ঘটায় প্রথম কমান্ডাে ঘাবড়িয়ে যায়। দ্বিতীয় কমান্ডাে স্টেন নিয়ে হামলা করে কিন্তু তার স্টেনে মােটেও গুলি
পৃষ্ঠা: ৪৫৭

বেরুচ্ছে না দেখে প্রথম কমান্ডাে আরাে ঘাবড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা। ছিল কমান্ডােদের অস্ত্রের দখল না থাকা, কৌশল পূর্ণাঙ্গরূপে না জানায় তারা ঘাবড়িয়ে যায়। তাদের উচিত ছিল ম্যাগজিন পরিবর্তন করা, বােল্ট বার বার টানা, সেফটিকেস ঠিকভাবে সেট করা।
০ সৌভাগ্যবশতঃ প্রথম পর্যায়েই শত্রু খতম হয়ে যায়। কিন্তু কমান্ডােদের মনে সন্দেহ থাকায় তারা নেতৃত্ব ও পার্টির নামে শ্লোগান দিতে ব্যর্থ হয়।
০ এ অপারেশনে দুটি হাতবােমা নিক্ষেপ করার নির্দেশ ছিল কিন্তু একটি হাতবােমা নিক্ষেপের পর তা ফাটেনি। দ্বিতীয়টি নিক্ষেপ করতে নির্দিষ্ট ব্যক্তি ব্যর্থ হয়। হাতবােমা বিস্ফোরণ না হওয়ার কারণ ড্যাম্প পড়ে যাওয়া। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে ব্যবহৃত হাতবােমা দু’একদিন পূর্বে তৈরী করা এবং ভালভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে নেওয়া প্রয়ােজন।
০ এ অপারেশনের গাইড অপারেশনের পরে কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে। যার ফলে নির্দিষ্ট পথে কমান্ডােদের নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলেও সে তা করেনি। সে কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে এবং কমান্ডােদের অপরিচিত ও অস্বাভাবিক পথে নিয়ে যায়। এ পথে এভাবে চলা যে কোন মুহূর্তে সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারত এবং কমান্ডােদের এ পথ সম্পর্কে ধারণা না থাকায় বিশেষ অবস্থায় নিজ দায়িত্বে সরে পড়তে হলে কমান্ডােরা বিপদে পড়ত।
এক্ষেত্রে গাইড নিয়ােগের ব্যাপারে সাহসী ও অভিজ্ঞ কর্মী নিয়ােগ করা প্রয়ােজন।
০ এ অপারেশনে সামগ্রিক ভুল হচ্ছে অপারেশনের পরবর্তী অবস্থা পরিকল্পনাকালে গভীরভাবে চিন্তা না করা।
শহর এলাকায় শক্র শক্তিশালী, এজন্য তারা সেখানে দ্রুত যােগাযােগ করা, শক্তি বৃদ্ধি করা, কাফুঁ দেওয়া, তল্লাসী চালানাে ইত্যাদি করতে পারে। কিন্তু এ অপারেশনে এদিকগুলি গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। চিন্তা না করার একটা কারণ ছিল স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্রের শত্রুর উপর তীব্র ঘৃণা, কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও উর্ধতন প্রশাসনযন্ত্র দ্রুত যােগাযােগ করে অতিরিক্ত শক্তি নিয়ােগ করে এবং কাফু জারী, ব্যাপক তল্লাসী চালানাে ও ধরপাকড় করতে সক্ষম হয় (এতে আমাদের সতর্কতার কারণে যদিও কোন ক্ষতি হয়নি)।
০ এজন্য শহর এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের বেলায় যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কাগজপত্র, অস্ত্র আগেই নিরাপদ স্থানে সরানাে উচিত। কিছুটা প্রকাশিত কর্মীদের বাইরে পাঠানাে উচিত এবং অপারেশন ট্রপের আশ্রয়স্থল শহরের উপকণ্ঠে করা উচিত। অস্ত্র বহনে অসুবিধা হলে শহরেই নিরাপদ আশ্রয়স্থানে মাটির নীচে রাখা উচিত, একান্ত অসুবিধা হলে পানিতে রেখে দেওয়া। এজন্য অপারেশনের পূর্বেই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়ােজন। বিশেষ করে থানা এবং মহকুমা পর্যায়ের শহরগুলােতে (যেখানে শত্রুর যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত) অবশ্যই এ পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত। বড় শহরে ব্যাপকভাবে না হলেও নির্দিষ্ট এলাকায় কাফু দিতে পারে, তল্লাসী চালাতে পারে। সে এলাকা থেকে নিরাপদ দূরবর্তী এলাকায় আশ্রয়স্থান এবং অস্ত্র, কাগজপত্র রাখার ব্যবস্থা করা উচিত।
০ গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে ভাল, দক্ষ ও সাহসী গেরিলাদের নিয়ােগ করা উচিত। দক্ষতা অর্জনের জন্য বিভিন্ন অস্ত্রের ট্রেনিং দেওয়া প্রয়ােজন।
পৃষ্ঠা: ৪৫৮

০ শহরে কমান্ডাে হামলা করে জাতীয় শত্রু খতম করা সুবিধাজনক। অপারেশন স্থান (একটি দুটি) ঠিক করে তার কাছাকাছি (দুই / তিন মিনিটের পথ) অস্থায়ী আশ্রয়স্থান ঠিক করা যেখানে কমান্ডােরা প্রস্তুতি নিয়ে সাময়িকভাবে অবস্থান করবে। স্কাউট এবং প্রয়ােজন হলে গাইড নিয়ােগ করা। এ ধরনের হামলায় স্কাউটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হয়। কমান্ডােদের খুব সাহসী হতে হবে। এ প্রক্রিয়া রাস্তার উপর চলমান অবস্থায়ও করা যায়। নির্দিষ্ট পথের নিশ্চিত খবর স্কাউট দিবে। তার উপর ভিত্তি করেই চলমান অবস্থায় কমান্ডােরা হামলা করবে। শত্রু কমান্ডােদের অপরিচিত হলে আগেই তা চিনিয়ে নিতে হবে। অপরিচিত স্থানে রাস্তা-ঘাট, আশ্রয়স্থল ভালভাবে চিনিয়ে নেওয়া প্রয়ােজন।
এ ধরনের হামলায় রিভলবার, চাদর মুড়ি দিয়ে স্টেনগান, চাকু ব্যবহার করা যায়। তবে বড় অস্ত্রসহ (স্টেনগান) অধিক সময় (পাঁচ মিনিটের বেশী) কমান্ডােদের লােকালয়ে অবস্থান করা উচিত নয়।

নােটঃ
১। উদ্ধৃতি, পৃঃ-২৫৮, সাংগঠনিক কার্য প্রসঙ্গে দলিল।
পৃষ্ঠা: ৪৫৯

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিজয় অনিবার্য
(জুন, ১৯৭৩)
[এ দলিলটি ১৯৭৩ সনে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি আকারে প্রকাশিত হয়েছিল –প্রকাশক।]

১.
১৯৭৩ সালের ৩রা জুন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তার প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বর্ষ অতিক্রম করছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এ দু’বছরে অর্জন করেছে অতিশয় মূল্যবান অভিজ্ঞতা, পার্টি গঠন, সশস্ত্র সংগ্রাম ও জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের সাথে জড়িত বহু মৌলিক সমস্যাবলীর সমাধান।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে আরাে অধিকতর সফলতার সাথে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অবস্থার সাথে। সমন্বিত করতে সক্ষম হয়েছে।
এ সময়ের মাঝে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিসশস্ত্র সংগ্রামের তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে;
জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সঠিকভাবে রাজনৈতিক লাইন নির্ণয়ের দক্ষতা অর্জন করেছে।
পার্টির মধ্যকার উপদলকে সাফল্যজনকভাবে পরাজিত ও ধ্বংস করার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে।
ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠনের পদ্ধতি আয়ত্ত করেছে; পার্টির মধ্যকার সংগ্রাম সঠিকভাবে পরিচালনার উপায় উপলব্ধি করেছে;
পার্টির বাইরের বিপ্লবীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার সঠিক পন্থার উদ্ভাবন করেছে। এভাবে শ্রেণীগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখার সমস্যার সমাধান করেছে।
পার্টি-বহির্ভূত জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করার জন্য ঐক্যফ্রন্টের লাইন কার্যকরী করার উপায় উদ্ভাবন করেছে। এভাবে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার সমস্যার সমাধান। করেছে;
সামরিক রণনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী কর্তব্য নির্ধারণ করতে পেরেছে;
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সুসংবদ্ধকরণ, মানােন্নয়ন, সহজ প্রশাসন, এককেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখা, বাসি উপাদান বর্জনের সমস্যার সমাধান করেছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এ সময়ের মাঝে বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিকাশের ইতিহাসে এই দু’বছর হচ্ছে সুবর্ণকাল।
পৃষ্ঠা: ৪৬০

২.
বিপ্লব করার জন্য প্রয়ােজন বিপ্লবী পার্টি। পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম বারবার ব্যর্থ হয়েছে বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বের অভাবে।
সুদীর্ঘ দুইশত বছরের সংগ্রামের ফলে বৃটিশেরা উৎখাত হলেও জনগণের জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম সফল হয়নি, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতি ও সামন্তবাদীরা পাকিস্তানের ক্ষমতা দখলের ফলে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে যায়।
পূর্ব বাংলার জনগণ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য বারংবার সংগ্রাম করে। লক্ষ লক্ষ জনগণ প্রাণ বিসর্জন দেয়। পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী। ও সামন্তবাদীরা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ডেকে এনে তাদের হাতে পূর্ব বাংলাকে তুলে দেয়।
এভাবে বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্ব না থাকায় জনগণের এ সকল সংগ্রাম ব্যর্থ হয়।
সুদীর্ঘকালের সংগ্রামের ইতিহাস প্রমাণ করছে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত অন্য কোন শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে জনগণের মুক্তি আসতে পারে না।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী হচ্ছে পূর্ব বাংলার সবচাইতে প্রগতিশীল বিকাশমান শ্ৰেণী, যার রয়েছে বিপ্লব করার বৈজ্ঞানিক তাত্ত্বিক ভিত্তি মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারা।
পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনগণ অতি আগ্রহের সাথে মার্কসবাদকে আঁকড়ে ধরে, নিজেদেরকে সর্বহারায় রূপান্তরের প্রচেষ্টা চালায়, সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি সংগঠিত করা এবং জনগণকে মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানের প্রচেষ্টা চালায়।
কিন্তু অসর্বহারা শ্রেণীর অপরিবর্তিত প্রতিনিধিরা সর্বহারাদের নেতৃত্ব দখল করে, সর্বহারা বিপ্লবী পার্টির পরিবর্তে সংশােধনবাদী-সংস্কারবাদী পার্টি গড়ে তােলে, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাদেরকে বিপথে পরিচালনা করে।
এ সকল সংশােধনবাদীদের উৎখাত করে সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬৮ সালের ৮ই জানুয়ারী “পূর্ব। বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” প্রতিষ্ঠা করে।
পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে এভাবে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।
অনভিজ্ঞ তরুণ বিপ্লবীরা পর্বতপ্রমাণ বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে বিপ্লবী অনুশীলনে লেগে থাকে, তত্ত্ব ও অনুশীলনের সমন্বয় সাধন করা এবং মার্কসবাদের সার্বজনীন সত্যকে আয়ত্ত করার প্রচেষ্টা চালায়।
তাদের শিশুসুলভ অনভিজ্ঞতা, অপরিপক্কতা, অভিজ্ঞতা ও পরিপক্কতায় রূপ লাভ করতে থাকে। এভাবে তারা সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার যােগ্যতা অর্জন করে।
মহান পেয়ারা বাগানে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কামানের গােলার শব্দের মাঝে ১৯৭১ সালের ৩রা জুন প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি”; সমাপ্ত হয় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভূমিকা।
পৃষ্ঠা: ৪৬১

এভাবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের।
পূর্ব বাংলার জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী পার্টির অনুপস্থিতি দূর করার লক্ষ্য সামনে রেখে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বিপ্লবী অনুশীলন চালিয়ে যায়।

৩.
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামকে জনগণের মুক্তির
একমাত্র পথ বলে গ্রহণ করে।
সশস্ত্র সংগ্রামকে পার্টির প্রধান ধরনের সংগ্রাম, সশস্ত্র বাহিনীকে পার্টির নেতৃত্বে প্রধান ধরনের
সংগঠন হিসেবে গড়ে তােলার লাইন গ্রহণ করে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বীরত্বের সাথে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি
সংগ্রাম পরিচালনা করে। একই সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী লীগ
ফ্যাসিস্টদের পূর্ব বাংলা দখলের চক্রান্তকে বিরােধিতা করে।
একদিকে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের, অন্যদিকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদারদের
প্রচণ্ড চাপের মুখেও পার্টি টিকে থাকে, অব্যাহতভাবে তৎপরতা চালিয়ে যায়।
বহু কর্মী, গেরিলা ও সহানুভূতিশীল এবং সমর্থক মহান আত্মবলিদানের মাধ্যমে এ
সময়কার সংগ্রামকে উজ্জ্বল করে গেছেন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ১৯৭১-এর
ডিসেম্বরে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলা দখল, পুতুল সরকার কায়েমের
পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে ও সঠিক রাজনৈতিক লাইন প্রণয়ন করে।
এ সময় পার্টি সাফল্যজনকভাবে তার প্রথম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করে এবং রাজনৈতিক লাইন প্রণয়ন করে।
পার্টি কংগ্রেসে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গােড়ামীবাদকে পার্টির প্রধান বিপদ হিসেবে।
কংগ্রেসে পার্টির নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়।
কংগ্রেসে কিছুসংখ্যক ভাগ্যান্বেষী, সুযােগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ করে।
অচিরেই তারা পার্টির অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের সুবিধাবাদীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে পার্টির ক্ষমতা দখল এবং পার্টিকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তারা পার্টির মাঝে উপদলীয় কার্যকলাপ চালায় এবং চক্র গঠন করে। এভাবে বিশ্বাসঘাতক ফজলু-সুলতান চক্রের উদ্ভব হয়।
পার্টির সঠিক লাইন, পার্টির নেতৃত্বের সতর্কতা, কর্মীদের আন্তরিকতার কারণে চক্র তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়।
চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব সমূলে উৎপাটিত করার জন্য পার্টি ব্যাপক মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করে। এ উদ্দেশ্যে কতিপয় বিষয়ের উপর শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়।
এভাবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের।
এ সময় পার্টি সাফল্যজনকভাবে তার প্রথম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করে এবং রাজনৈতিক লাইন প্রণয়ন করে।
পার্টি কংগ্রেসে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গােড়ামীবাদকে পার্টির প্রধান বিপদ হিসেবে।
এভাবে পার্টি মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনার মার্কসবাদী রীতি রপ্ত করে।
এভাবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে সূচনা হয় এক নতুন অধ্যায়ের।
পূর্ব বাংলার জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী পার্টির অনুপস্থিতি দূর করার লক্ষ্য সামনে রেখে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বিপ্লবী অনুশীলন চালিয়ে যায়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই সশস্ত্র সংগ্রামকে জনগণের মুক্তির একমাত্র পথ বলে গ্রহণ করে।
সশস্ত্র সংগ্রামকে পার্টির প্রধান ধরনের সংগ্রাম, সশস্ত্র বাহিনীকে পার্টির নেতৃত্বে প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে গড়ে তােলার লাইন গ্রহণ করে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বীরত্বের সাথে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনা করে। একই সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের পূর্ব বাংলা দখলের চক্রান্তকে বিরােধিতা করে।
একদিকে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের, অন্যদিকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদারদের প্রচণ্ড চাপের মুখেও পার্টি টিকে থাকে, অব্যাহতভাবে তৎপরতা চালিয়ে যায়।
বহু কর্মী, গেরিলা ও সহানুভূতিশীল এবং সমর্থক মহান আত্মবলিদানের মাধ্যমে এ সময়কার সংগ্রামকে উজ্জ্বল করে গেছেন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলা দখল, পুতুল সরকার কায়েমের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করে ও সঠিক রাজনৈতিক লাইন প্রণয়ন করে।
এ সময় পার্টি সাফল্যজনকভাবে তার প্রথম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করে এবং রাজনৈতিক লাইন প্রণয়ন করে।
পার্টি কংগ্রেসে সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে গােড়ামীবাদকে পার্টির প্রধান বিপদ হিসেবে।
কংগ্রেসে পার্টির নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়।
কংগ্রেসে কিছুসংখ্যক ভাগ্যান্বেষী, সুযােগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ করে। অচিরেই তারা পার্টির অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের সুবিধাবাদীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে পার্টির ক্ষমতা দখল এবং পার্টিকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তারা পার্টির মাঝে উপদলীয় কার্যকলাপ চালায় এবং চক্র গঠন করে। এভাবে বিশ্বাসঘাতক ফজলু-সুলতান চক্রের উদ্ভব হয়।
পার্টির সঠিক লাইন, পার্টির নেতৃত্বের সতর্কতা, কর্মীদের আন্তরিকতার কারণে চক্র তার উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হয়।
চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব সমূলে উৎপাটিত করার জন্য পার্টি ব্যাপক মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করে। এ উদ্দেশ্যে কতিপয় বিষয়ের উপর শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়।
এভাবে পার্টি মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনার মার্কসবাদী রীতি রপ্ত করে।
চক্রের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা, শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা পূর্ব বাংলার বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা।
পৃষ্ঠা: ৪৬২

অচিরেই চক্র মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিকভাবে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়, তাদেরকে পার্টি থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা হয়। প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাতে যেয়ে তাদের কেউ কেউ খতম হয়।
চক্র গঠনের ফলে পার্টির বিকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষতি হয়, কিন্তু চক্রের উদ্ভবের ফলে পার্টি বিভিন্ন বিষয়ে অতিশয় মূল্যবান শিক্ষা অর্জন করেছে। চক্র হচ্ছে পার্টির নেতিবাচক শিক্ষক।
চক্র গঠন সম্ভব হয় গােড়ামীবাদীদের সাথে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদের সমন্বয়ের ফলে। পার্টি গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার প্রক্রিয়ায় পার্টি ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠনের বিষয়ে আরাে গভীরতর জ্ঞান অর্জন করে।
পার্টি ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার বহিঃপ্রকাশসমূহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করে এবং উপলব্ধি করে যে, ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত কর্মীদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন করাই হচ্ছে উপনিবেশিক-আধাউপনিবেশিক-সামন্তবাদী-আধাসামন্তবাদী দেশের বিপ্লবের মৌলিক সমস্যা।
এ প্রসঙ্গে পার্টি সঠিকভাবে নির্ণয় করে চিন্তার সাথে কর্মের, প্রতিভা-যােগ্যতার সাথে অনুশীলনের, বুদ্ধি-বিচক্ষণতার সাথে উৎপাদন পদ্ধতির সম্পর্ক। কর্ম থেকেই চিন্তার উদ্ভব, কিন্তু চিন্তা আবার কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনুশীলন প্রাথমিক, প্রতিভা, যােগ্যতা অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল, আবার যােগ্যতা, প্রতিভা অনুশীলনকে প্রভাবান্বিত করে। আগ্রহ, লেগে থাকা, একাগ্রতাই হচ্ছে প্রতিভা। উৎপাদনের পদ্ধতির উপর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা নির্ভরশীল, আবার বুদ্ধি-বিচক্ষণতা উৎপাদনের পদ্ধতি পরিবর্তনে সহায়ক।
এভাবে পার্টি চিন্তাধারা পরিবর্তন করার এবং কমীরীতিকে সংশােধন করার মাধ্যমে। উন্নততর কর্মপদ্ধতি চালু করা, কর্মীদের মানােন্নয়ন করা, যােগ্য প্রতিভাবান কর্মী সৃষ্টি করার সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি লাভ করে।
পার্টি আভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখা, সঠিকভাবে পার্টি-অভ্যন্তরস্থ সংগ্রাম পরিচালনা করা, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা পরিচালনার সমস্যার সমাধান করে।
পার্টি-অভ্যন্তরস্থ ঐক্য বজায় রাখার সাথে সাথে পার্টি-বহির্ভূত বিপ্লবীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে পার্টি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করে এবং সে অনুযায়ী প্রচেষ্টা চালায়।
এভাবে পার্টি-অভ্যন্তরস্থ সংগ্রাম পরিচালনা করা, আভ্যন্তরীণ ঐক্য বজায় রাখা, একই সাথে বাইরের বিপ্লবীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে শ্রেণীগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও তা বজায় রাখার উপায় উদ্ভাবন করে। পার্টি শ্রেণীগত ঐক্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেয়।
পূর্ব বাংলার জনগণের ব্যাপক অংশই দেশপ্রেমিক। এদের বিরাট অংশ হচ্ছে ক্ষুদে বুর্জোয়া। এরা পূর্ব বাংলার বিপ্লবের মৌলিক মিত্র। এদেরকে পার্টি-নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করার উপর বিপ্লবের বিজয় অর্জন নির্ভর করছে।
কাজেই এদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে প্রয়ােজনীয় সংগঠন গড়ে তােলা অপরিহার্য।
পূর্ব বাংলার ক্ষুদে বুর্জোয়া এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করা যায়-এরূপ সংগঠন হচ্ছে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট এবং তার সাথে যুক্ত সংগঠনসমূহ।
পৃষ্ঠা: ৪৬৩

পার্টি এভাবে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সমগ্র জনগণকে পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত করার জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এভাবে পার্টি পূর্ব বাংলার ক্ষুদে বুর্জোয়া এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণী, স্তর, জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালিত ও সংগঠিত করার সঠিক লাইন গ্রহণ করেছে।
এ সময় পার্টি সামরিক ক্ষেত্রেও মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পন্ন। সমস্যার সমাধান করে যা সশস্ত্র সংগ্রাম, পার্টি-বিকাশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
পার্টি জাতীয় শত্রু খতমের সাথে যুক্ত সমস্যাবলীর সমাধান করে, সশস্ত্র প্রচার টিমের মাধ্যমে গ্রাম্য প্রচারের অতিশয় কার্যকর পদ্ধতির উদ্ভাবন করে।
পার্টি সামরিক রণনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন এবং সে অনুযায়ী পার্টির মতাদর্শগত, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক ও সামরিক কাজ নির্ধারণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে।
পার্টি সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও বিরাট সাফল্য অর্জন করেছে। কর্মীদের মানােন্নয়ন ও কর্মীস্বল্পতা দূর করার মত পার্টি-বিকাশের মৌলিক সমস্যার সমাধান করা হয়েছে।
এ সময়ে পার্টি অর্জন করেছে বিপ্লবে কর্মী ও নেতৃত্বের ভূমিকা, পার্টি ও বিপ্লবের স্তরের সাথে নেতৃত্বের যােগ্যতার সম্পর্ক, পার্টির মাঝে এক কেন্দ্র বজায় রাখা ও তা শক্তিশালী করা, উন্নততর নেতৃত্ব সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ধারণাসমূহ।
পার্টির বিকাশের সাথে যুক্ত আনুষ্ঠানিকতা, শ্রমবিভাগ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সারসংকলন, সহজ প্রশাসন ব্যবস্থা পার্টির বিভিন্ন স্তর আয়ত্ত করছে।
পার্টিকে সাংগঠনিকভাবে সুসংবদ্ধ করার পূর্বে প্রয়ােজন মতাদর্শগতভাবে সুসংবদ্ধকরণ। মতাদর্শগত সুসংবদ্ধকরণের প্রক্রিয়া, বাসিটা বর্জন, টাটকাটা গ্রহণ, মানােন্নয়ন, কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই, এককসমূহ গঠন, সদস্য, প্রার্থীসদস্যপদ প্রদান প্রভৃতি সম্পন্ন করার মাধ্যমে সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণের পদ্ধতি পার্টি আয়ত্ত করছে।
সাংগঠনিক অনুশীলনের মাধ্যমে কাজের স্তর নির্ণয় করা (বিকাশ না সুসংবদ্ধকরণ, সশস্ত্র সংগ্রাম না প্রস্তুতি, পশ্চাদপসরণ ইত্যাদি), নিজেকে জানা এবং সে অনুযায়ী কর্মপন্থা স্থির করা, সামগ্রিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা, সে অনুযায়ী দ্বিমাসিক, ষান্মাসিক, বাৎসরিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা, পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করা, কর্মশক্তির যথাযথ ব্যবহার করা এবং আরাে বহু দৈনন্দিন রীতিনীতি ও কৌশল পার্টি শিখেছে।
কিন্তু সাংগঠনিক ক্ষেত্রে পার্টির অঞ্চলসমূহের পরিপূর্ণ ক্ষমতাকে ব্যবহার করা, সঠিকভাবে কার্য পরিচালনার মত যােগ্য নেতৃত্বের মারাত্মক অভাব রয়েছে।
পার্টিকে অবশ্যই এ অভাব কাটিয়ে তুলতে হবে।

৪.
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে, সঠিক রাজনৈতিক লাইন সঠিক সাংগঠনিক ও সামরিক লাইনে প্রকাশ পায়।
সঠিক রাজনৈতিক লাইন আকাশ থেকে পড়ে না বা সহজাত নয়। সঠিক রাজনৈতিক লাইনের উদ্ভব সঠিক মতাদর্শগত লাইন থেকে অর্থাৎ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ
পৃষ্ঠা: ৪৬৪

মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে সমন্বয়ের ফলে।
একটি সঠিক লাইন অবশ্যই ভুল লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিকাশ লাভ করে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সঠিক লাইনসমূহ পার্টির অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের ভুল লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিকাশ লাভ করেছে।
এ সকল ভুল লাইন হচ্ছে ডানপন্থী এবং আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডানপন্থী।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ডান লাইন এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে অতি বাম লাইনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সঠিক পথে অব্যাহতভাবে বিকাশ লাভ করে।
পার্টির বাইরে দক্ষিণপন্থী মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী, কাজী-রণণা এবং দেবেন-বাসার, আর আকৃতিগতভাবে বাম কিন্তু সারবস্তুগতভাবে ডান হক-তােয়াহা, মতিনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে পার্টি অগ্রসর হয়।
উপরােক্ত মার্কসবাদী নামধারী গ্রুপসমূহের অস্তিত্ব সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের ঐক্যের পথে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সর্বহারা বিপ্লবীদেরকে শ্রেণীগত ঐক্যের লাইন, জাতীয় ভিত্তিতে ঐক্যের জন্য জাতীয় ঐক্যের লাইন এবং সাধারণ কর্মীদের সাথে সংযােগের লাইন দিচ্ছে।
এ ত্রিমুখী নীতির ফলে কিছুসংখ্যক শত্ৰুচর ও সুবিধাবাদী ব্যতীত বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যুক্ত সাধারণ খাঁটি কর্মীরা অবশ্যই সর্বহারা পার্টির সাথে ঐক্যবদ্ধ হবেন।
কাজেই এ সকল গ্রুপের অস্তিত্ব খুবই সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে।
তবে যতদিন শত্রু এলাকা থাকবে ততদিন মার্কসবাদী নামধারী গ্রুপ সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। এমন কি কিছু কিছু গ্রুপ সরকারী পৃষ্ঠপােষকতায় জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু এ সকল গ্রুপ প্রতিনিয়ত উত্থাপিত সমস্যাবলীর সমাধান, কর্মীদের মানােন্নয়ন, লেগে থাকা ও লক্ষ্য অর্জন করার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে সক্ষম হবে না। ফলে তাদের সাধারণ কর্মীরা সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত হবে, শত্ৰুচর ও সুবিধাবাদীরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে ও ধ্বংস হবে।
পঁচিশে মার্চের পূর্বে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন অল্প কয়েকটি শহরের বুদ্ধিজীবীদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল। ইহা হচ্ছে পার্টি-বিকাশের প্রথম পর্যায়।

৫.
পঁচিশে মার্চের পরবর্তী সময় পার্টি গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, গ্রামের কাজ শহরের চাইতে বিস্তৃত হয়। পার্টি শহরের ও গ্রামের বুদ্ধিজীবীদের মাঝে প্রধানতঃ বিকাশ লাভ করে।
ইহা হচ্ছে পার্টি-বিকাশের দ্বিতীয় স্তর।
বর্তমানে পার্টি পূর্ব বাংলার প্রায় জেলাতেই বিস্তৃত হয়েছে। শহর ও গ্রামের বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে শ্রমিক ও কৃষকদের মাঝে পার্টি শেকড় গাড়ছে।
পৃষ্ঠা: ৪৬৫

অর্থাৎ পার্টি তার বিকাশের তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করছে। অচিরেই পার্টি সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে। শহরের ও গ্রামের শ্রমিক, কৃষক এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া জনগণের মাঝে শেকড় গাড়বে। এভাবে পার্টি জাতীয় ও গণভিত্তিক পার্টিতে পরিণত হবে।
অচিরেই পার্টির নেতৃত্বে বিস্তৃত অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে, বিরাটাকার গেরিলা অঞ্চল গড়ে উঠবে, কোন কোন এলাকায় ঘাঁটি গঠনের মত অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।
পার্টির চমৎকার প্রস্তুতি ও সূচনা বিরাটাকার সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে।
পঁচিশে মার্চের পূর্বেকার তুলনায় লােকজন ও অস্ত্রের দিক দিয়ে পার্টির বিকাশ হয়েছে কয়েক শত গুণ আর চিন্তার ক্ষেত্রে পার্টির বিকাশ হয়েছে কয়েক হাজার গুণ।

৬.
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে জনগণ আজ বিদ্রোহ উনুখ। তারা উপলব্ধি করেছে, তাদের রক্ত বৃথা গিয়েছে। তাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম অসমাপ্ত রয়েছে।
জনগণ আজ সঠিক নেতৃত্ব কামনা করে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি জনগণের এ মহান বিপ্লবী সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানের মত মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
জনগণকে, বর্ষাকালে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে রণনৈতিক আক্রমণে নেতৃত্ব প্রদানের চমৎকার প্রস্তুতি পার্টি অর্জন করেছে। পার্টির বিরাট সাফল্যে মাথা বিগড়ালে চলবে না, মাথা ঠিক রেখে অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে আরাে অধিকতর সফলতা অর্জন করতে হবে। জনগণের মুক্তির পথে এ সফলতা প্রস্তুতি মাত্র, কয়েক হাজার মাইলের পথের এক মাইলের মত। কাজেই অধ্যবসায়ী হয়ে সকল বাধা-বিঘ্ন দূর করে বিজয় অর্জনের জন্য লেগে থাকতে হবে।
আরাে অধিকতর সফলতা অর্জনের জন্য কর্মীদের চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করতে হবে এবং কর্মরীতিকে সংশােধন করতে হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির এ সকল সফলতা অর্জিত হয়েছে কমরেড সিরাজ সিকদার কর্তৃক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনের সমন্বয়ের ফলে প্রণীত সঠিক লাইন ও তা বাস্তবায়নে কর্মীদের লেগে থাকার ফলে।
সমগ্র পার্টির কর্মীগণ চিন্তাধারাকে পরিবর্তন এবং কর্মপদ্ধতিকে সংশােধন করবেন, কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন। পার্টি ও বিপ্লবের জন্য আরাে অধিকতর বিজয় আনয়ন করবেন।
পার্টি মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ক্ষেত্রের মৌলিক সমস্যাবলীর সমাধান করেছে। এখন প্রয়ােজন চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করা, কর্মপদ্ধতিকে সংশােধন করা এবং উপরিউক্ত লাইনসমূহ বাস্তবায়ন করা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে, লাইন সঠিক হলে ক্ষুদ্র শক্তি বিরাট হয়, সশস্ত্র বাহিনী না থাকলে তা গড়ে উঠে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির লাইন সঠিক, কাজেই রাজনৈতিক ক্ষমতাও অবশ্যই
পৃষ্ঠা: ৪৬৬

পার্টি একদিন দখল করতে সক্ষম হবে।
পক্ষান্তরে লাইন ভুল হলে পূর্বে অর্জিত ফলও খােয়া যায়। হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, মনিসিং-মােজাফরদের ক্ষেত্রে ইহা প্রযােজ্য।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সূচনাতেই পাকাপােক্ত ভিত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, ভাল প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।
প্রভাত বেলাই দিনের ছবি, ভাল প্রস্তুতি শুভ সমাপ্তির লক্ষণ। কাজেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিজয় অনিবার্য।
পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবসে শহীদ ও গ্রেফতারকৃত কমরেডদের জন্য শােক প্রকাশ করা হচ্ছে, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার শপথ গ্রহণ করছে সকল কর্মীগণ।
গ্রেফতারকৃতদের উদ্ধার করা এবং তাদের পুনরায় বিপ্লবী অনুশীলনে লাগাবার প্রতিজ্ঞা নিচ্ছে কমরেডরা।
পার্টি পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের দীর্ঘ জীবন কামনা করে, কামনা করে কমরেড সিরাজ সিকদারের দীর্ঘ জীবন।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ!
কমরেড সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ!
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা-জিন্দাবাদ!
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকুন-সভাপতি মাও!
পৃষ্ঠা: ৪৬৭

পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের ঘােষণাপত্র ও কর্মসূচী
(জুন, ১৯৭৩)
[এপ্রিল, ‘৭৩-এ জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট” গঠিত হয়। সম্মেলন শেষে ফ্রন্টের ঘােষণা ও কর্মসূচি প্রকাশিত হয় জুন, ‘৭৩-এ। অক্টোবর, ‘৭৪-এ এর দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়েছিল -প্রকাশক।]

পূর্ব বাংলার বিভিন্ন দেশপ্রেমিক শ্রেণী, স্তর, গােষ্ঠী, ব্যক্তি, দল, জাতিগত, ধর্মীয় এবং ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগণ অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচণ্ড সংগ্রাম শুরু করেছেন। জনগণ চান এমন একটি নেতৃত্ব যা তাদের সংগ্রামকে সঠিক পথে পরিচালনা করে বিজয় আনয়ন করতে সক্ষম।
তারা আরাে আশা করেন, এ নেতৃত্ব হবে এমন একটি সংগঠন যা পূর্ব বাংলার সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণী, স্তর, ব্যক্তি, গােষ্ঠী, দল, জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগণের প্রতিনিধি সম্বলিত।
জনগণের এ আশা-আকাঙ্খ বিবেচনা করে নিম্নলিখিত দেশপ্রেমিক সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এরূপ একটি সংগঠন গড়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়।
এ সংগঠনের নাম পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট রাখা হয়। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানকারী সংগঠনসমূহঃ
১। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। ২। পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী। ৩। পূর্ব বাংলার শ্রমিক ও কর্মচারী মুক্তি সমিতি। ৪। পূর্ব বাংলার কৃষক মুক্তি সমিতি। ৫। পূর্ব বাংলার ছাত্র-যুব মুক্তি পরিষদ। ৬। পূর্ব বাংলার নারী, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, সংবাদপত্র ও সাহিত্য মুক্তি সমিতি। ৭। পূর্ব বাংলার জাতিগত সংখ্যালঘু মুক্তি পরিষদ। ৮। পূর্ব বাংলার ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুক্তি পরিষদ। ৯। পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি সমিতি। ১০। পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক ওলেমা সমিতি। ১১। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন দেশপ্রেমিক গ্রুপ ও বামপন্থীদের প্রতিনিধি পরিষদ।
এ সকল দেশপ্রেমিক সংগঠনসমূহের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে ২০শে এপ্রিল, ১৯৭৩ সালে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট” গঠন করে।
পৃষ্ঠা: ৪৬৮

পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টকে সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী সংগঠিত করা এবং অস্থায়ীভাবে এর কার্য পরিচালনার জন্য একটি অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রতিনিধি জনাব সিরাজ সিকদারকে সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।

পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের ঘােষণাপত্র
১.
পূর্ব বাংলার জনগণ সর্বদাই সকল প্রকার বৈদেশিক হামলা ও শােষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং প্রতিরােধ চালিয়েছেন।
পূর্ব বাংলার জনগণের ইতিহাস হচ্ছে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস।
পূর্ব বাংলার জনগণ বৃটিশ উপনিবেশবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেন এবং পাকিস্তানে যােগদান করেন।
পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট শাসক গােষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণকে জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্র প্রদানের পরিবর্তে জাতীয় নিপীড়ন এবং শােষণ-লুণ্ঠন পরিচালনা করে।
পূর্ব বাংলার জনগণ প্রথম থেকেই পাকিস্তানের শাসক গােষ্ঠী বিরােধী সংগ্রাম পরিচালনা করেন।
১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণ বাংলা ভাষাকে বিলুপ্ত করার চক্রান্তকে নস্যাৎ করেন।
১৯৫৪ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সামরিক শাসন বিরােধী সংগ্রাম, ষাটের দশকের বিভিন্ন আন্দোলন করেন।
শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার জনগণ জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জনের জন্য ১৯৭১ সালে বিদ্রোহ করেন।
পূর্ব বাংলার জনগণ পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন, লক্ষ লক্ষ জনগণ প্রাণ হারান, তাদের ধন-সম্পত্তি বিনষ্ট হয়।
আওয়ামী লীগ ও তার তাবেদাররা পূর্ব বাংলার জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তারা মীরজাফরের মত গদীর লােভে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিকট পূর্ব বাংলাকে বিকিয়ে দেয়।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলা দখল এবং এখানে তার উপনিবেশ স্থাপনের জন্য সর্বদাই প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তারা আওয়ামী লীগ ও তার তাবেদারদের প্রদত্ত। সুযােগ গ্রহণ করে। তারা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সহায়তা ও সমর্থনে পূর্ব। বাংলা দখল করে নেয়। এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলায় তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে।
পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশ স্থাপনের একটি উদ্দেশ্য হলাে-পূর্ব বাংলার পাট, চা, চামড়া ও অন্যান্য কাঁচামাল, মাছ, মাংস, তরিতরকারী, চাল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য লুণ্ঠন করা, সাড়ে সাত কোটি জনগণের বাজার দখল করা, পূর্ব বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণ করা, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন করা, শিক্ষা-সংস্কৃতি বিনষ্ট করা, প্রশাসন ব্যবস্থা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা।
পৃষ্ঠা: ৪৬৯

ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলায় উপনিবেশ স্থাপনের অপর এক উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলার জনগণ, ভারতীয় জনগণ এবং নাগা-মিজো-কাশ্মীরীদের মুক্তি সংগ্রাম দাবিয়ে রাখা, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভুত্ব করা।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে সহায়তা ও সমর্থন করছে ভারতের উপর তার আধিপত্য জোরদার করা, পূর্ব বাংলা লুণ্ঠনের বখরা নেওয়া, পূর্ব বাংলায় সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা, ভারত মহাসাগর, দক্ষিণ এশিয়া এবং এশিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপন করার জন্য।
মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে পূর্ব বাংলা ও ভারতে তাদের কর্তৃত্ব স্থাপনের জন্য।

২.
আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকরা প্রকাশ্য ও গােপন চুক্তির মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের হাতে তুলে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা জনগণকে ধােকা দেওয়া এবং নিজেদের চরিত্র গােপন করার বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে তারা তথাকথিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছে, জাতীয় পরিষদ গঠন করেছে এবং জনগণের স্বার্থবিরােধী আইন প্রণয়ন করেছে।
কিন্তু জনগণ তাদের প্রতারণায় বিভান্ত হননি। তারা বুঝতে পেরেছেন, বাংলাদেশ’ সরকার ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পুতুল সরকার ব্যতীত কিছুই নয়।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের শােষণ ও লুণ্ঠন, তার তাবেদারদের শােষণ ও লুণ্ঠন, অরাজকতা, মুদ্রামান হ্রাস, কালােবাজারী, পাচার, রাহাজানি, হাইজ্যাক, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতির ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি, প্রশাসন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের চক্রান্তের ফলে পূর্ব বাংলার সামরিক বাহিনীর বিকাশ বন্ধ হয়েছে।
এভাবে পূর্ব বাংলাকে পরিপূর্ণরূপে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপর নির্ভরশীল করে ফেলা হয়েছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদারদের নির্মম শশাষণ ও লুণ্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ অর্ধাহারে, অনাহারে, কাপড়ের অভাবে দিন যাপন করছেন।
নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান উচ্চমূল্য, বেকারত্ব, যানবাহনের অভাব, জনগণের জীবনযাত্রার মান দ্রুত নামিয়ে দিয়েছে।
পূর্ব বাংলার জনগণ কখনও এত কষ্টকর জীবন যাপন করেননি। পক্ষান্তরে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের তাবেদার বিশ্বাসঘাতক দেশ বিক্রেতারা রাতারাতি অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়ে ভােগ-বিলাসে মত্ত রয়েছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদাররা পূর্ব বাংলার জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ধ্বংস করার জন্য নির্মম নির্যাতন চালাচ্ছে।
বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা জনগণকে দাবিয়ে রাখা ও তাদের উপর ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব চালাবার জন্য বিভিন্ন সশস্ত্র ভাড়াটে বাহিনী গঠন করেছে এবং জনগণের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৪৭০

ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন বাহিনীকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রক্ষী বাহিনী গঠন করেছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদারদের শােষণ ও লুণ্ঠন বিরােধী জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য বাংলাদেশ পুতুল সরকার হত্যা, গ্রেফতার, জেলজুলুম ও অন্যান্য ফ্যাসিস্ট তৎপরতা চালাচ্ছে।
তারা মিটিং, মিছিল,ধর্মঘট বানচাল করছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করছে, সরকার বিরােধী তৎপরতাকে নির্মূল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এভাবে তারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করছে।
পূর্ব বাংলার জনগণ আজ উপলব্ধি করেছেন আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা যে গণতন্ত্র কায়েম করেছে তা হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদারদের ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্র, তারা যে সমাজতন্ত্র কায়েম করেছে তা হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার এবং সােভিয়েট ও মার্কিন শােষকদের শােষণ ও লুণ্ঠন। তারা যে জাতীয়তাবাদের কথা বলে তা হচ্ছে জাতীয় পরাধীনতা, পূর্ব বাংলার জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণ এবং উর্দু ভাষাভাষীদের নির্মূল করা। তারা যে ধর্মনিরপেক্ষতা চায় তা হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের শােষণ ও লুণ্ঠনের পথে মুসলিম ধর্মের যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দাবিয়ে রাখা এবং দেশপ্রেমিক হিন্দু ও মুসলিম জনগণের ঐক্যকে বিনষ্ট করা।
মুজিববাদ হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ।

৩.
সমগ্র পূর্ব বাংলায় একটি বিস্ফোরণ উন্মুখ পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
জনগণ আজ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদারদের নির্মম শােষণ ও লুণ্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট অত্যাচার থেকে মুক্তি চান।
কতিপয় বিশ্বাসঘাতক ব্যতীত পূর্ব বাংলার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বিডিআর, পুলিশ বাহিনীও এ পুতুল সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট।
কতিপয় বিশ্বাসঘাতক ব্যতীত সরকারী, আধাসরকারী কর্মচারী, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্যে যুক্ত জনসাধারণও এ পুতুল সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ।
ছাত্র, শিক্ষক, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরাও এ সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ।
পূর্ব বাংলার শ্রমিক, কৃষক, ক্ষুদে চাকুরীজীবী, জেলে, কামার, কুমার এবং অন্যান্য পেশাধারী জনগণও এ সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ।
পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু, ধর্মীয়, ভাষাগত সংখ্যালঘু জনগণও এ ফ্যাসিস্ট সরকারের উপর বিক্ষুব্ধ।
অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণ, শ্ৰেণী, দল, ভাষা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এ সরকারের উপর বিক্ষুব্ধ।
এ পুতুল ফ্যাসিবাদী সরকার এবং তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উৎখাতের জন্য পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম চলছে।
জনগণের এ সংগ্রামকে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন সবচাইতে সময়ােপযােগী হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ৪৭১

পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেঃ
আপনারা শ্ৰেণী, স্তর, দল, মত, ভাষা, ধর্ম, জাতি নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদান করুন, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে উৎখাত করুন, জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন।
পূর্ব বাংলার শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে-আপনারা পূর্ব বাংলার সবচাইতে অগ্রগামী শ্রেণী, আপনাদের সংগ্রামী ঐতিহ্য অক্ষুন্ন রেখে পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জনের জন্য জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টে যােগদান করুন।
প্রকাশ্যে ও গােপনে কার্যরত পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক বামপন্থীদের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে-আপনারা পূর্ব বাংলার জনগণের অংশ। পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের সাথে আপনাদের সংগ্রাম সমন্বিত করার জন্য পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদান করুন।
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, কর্মী, সহানুভূতিশীল ও সমর্থক যারা পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও গনতন্ত্র অর্জন করতে ইচ্ছুক তাদেরকেও আহ্বান জানানাে হচ্ছে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
পূর্ব বাংলার সংগ্রামী কৃষক জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
পূর্ব বাংলার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বিডিআর, পুলিশ এবং অন্যান্য সশস্ত্র, আধা সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিকদের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক সরকারী, আধা সরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্পের সাথে জড়িতদের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে, জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
পূর্ব বাংলার ছাত্র-শিক্ষক, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য পেশাধারী জনগণের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
প্রাক্তন মুক্তি বাহিনী, সৈনিক, সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় সক্ষম দেশপ্রেমিকদের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
পূর্ব বাংলার নারীদের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
পূর্ব বাংলার জাতিগত সংখ্যালঘু, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যােগদানের জন্য।
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট রাজনৈতিক সংগ্রাম, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং প্রচার ও কূটনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার ‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারকে উৎখাত করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেছে।
পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামী ঐতিহ্য রয়েছে। তারা সর্বদাই শশাষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।
অতীতের ঐতিহ্যকে বজায় রেখে পূর্ব বাংলার জনগণ অবশ্যই সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে কঠোর সংগ্রামে লেগে থাকবেন, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার ‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারকে উৎখাত করে স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল, পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন।
পৃষ্ঠা: ৪৭২

পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নিম্নলিখিত কর্মসূচী বাস্তবায়িত করবে।

স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্রের কর্মসূচী

একটি বৃহত্তর ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক
শাসনব্যবস্থা কায়েম করা
– পূর্ব বাংলার ভুমি থেকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পরিপূর্ণরূপে উৎখাত করা, তাদের উপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত ও স্বাধীন করা।
পূর্ব বাংলাস্থ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের দখলদার সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, উপদেষ্টা, পরামর্শদাতা বা অন্য কোন ছদ্মবেশে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়ােজিত সামরিক বা বেসামরিক কর্মচারী, পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কার্যকলাপে নিয়ােজিত ভারতীয় নাগরিকদের উৎখাত করা।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলাস্থ সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের তাবেদার দালাল জাতীয় শত্রু এবং বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারকে পরিপূর্ণরূপে উৎখাত করা।
বাংলাদেশ’ পুতুল সরকার কর্তৃক প্রণীত জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিবাদী শাসনতন্ত্র এবং আইন বাতিল করা।
‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকার কর্তৃক ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সাথে স্বাক্ষরিত পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বার্থেিবরাধী চুক্তি বাতিল করা। বাংলাদেশ’ পুতুল সরকার কর্তৃক ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত গােপন চুক্তিসমূহ বাতিল করা।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের তাবেদার দালাল জাতীয় শত্রুদের মধ্যকার ঘৃণ্য জনগণ বিরােধীদের কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করা।
– সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে তার নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসমূহ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের পূর্ব বাংলা থেকে পরিপূর্ণরূপে উৎখাত করা।
তাদের সাথে সম্পাদিত সকল জাতীয় স্বার্থবিরােধী চুক্তি বাতিল করা।
পূর্ব বাংলাস্থ তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। – পূর্ব বাংলার ভূমিতে প্রকাশ্য বা গােপন বিদেশী সামরিক ঘাঁটির অবসান করা।
– সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং তার তাবেদার রাষ্ট্রসমূহ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্ব সাম্রাজ্যবাদের সামরিক বা বেসামরিক নাগরিক যারা পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বার্থবিরােধী কাজে লিপ্ত তাদেরকে উৎখাত করা।
– সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের গোড়া প্রতিনিধিদের কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা করা।
– পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মূলনীতির ভিত্তিতে অবাধ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, সার্বজনীন প্রত্যক্ষ গােপন ব্যালটের মাধ্যমে সত্যিকার গণতান্ত্রিক উপায়ে পূর্ব বাংলার জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। জাতীয় পরিষদ হবে পূর্ব বাংলার সর্বোচ্চ
পৃষ্ঠা: ৪৭৩

সংস্থা। এই পরিষদ পূর্ব বাংলার সমাজের সকল স্তরের মানুষের মৌলিক অধিকার ও আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন সম্বলিত বৃহত্তর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় কাঠামাে গঠনের গ্যারান্টিযুক্ত একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে।
– বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণী, জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘু, ধর্মীয় সম্প্রদায়, দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক দলসমূহ, জাতীয় মুক্তির সহকারী দেশপ্রেমিক ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর খাটি প্রতিনিধিদের সমবায়ে একটি যৌথ জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার গঠন।
– বৃহত্তর গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের স্বীকৃতি ও কায়েম, যথা-বাকস্বাধীনতা, সমাবেশের স্বাধীনতা, সমিতিবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা, ধর্মের স্বাধীনতা ও বিক্ষোভ প্রকাশের স্বাধীনতা।
– সকল নাগরিকের ব্যক্তিগত অধিকারের সুনিশ্চিত গ্যারান্টি দান, বাসস্থানের স্বাধীনতা, চিঠিপত্র ও যােগাযােগের গােপনীয়তা রক্ষা, চলাফেরার স্বাধীনতা, কর্ম ও বিশ্রামের অধিকার এবং শিক্ষার অধিকারের গ্যারান্টি প্রদান।
– নারী ও পুরুষের সমান অধিকার ও বাঙালী জাতি এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে সাম্য বিধান।
– দেশপ্রেমিক কার্যের জন্য ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার বাংলাদেশ’ পুতুল সরকার কর্তৃক আটক সকল বন্দীদের মুক্তি দান।
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার ‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকার কর্তৃক সৃষ্ট সকল প্রকার বন্দী শিবিরের বিলুপ্তি সাধন।
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারের নির্যাতনে যে সকল দেশপ্রেমিক ব্যক্তি বিদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা ও দেশে কাজ করার সুযােগ দান।
– পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। – ন্যায়সঙ্গতভাবে পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার সমস্যাবলীর সমাধান করা। – পূর্ব বাংলার সামুদ্রিক জলসীমা ২০০ নটিক্যাল মাইল।১
পর্যন্ত নির্ধারণ করা। এই জলসীমার মধ্যে মৎস্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ বৈদেশিক কোন শক্তি কর্তৃক লুণ্ঠন করা নিষিদ্ধ থাকবে।

মুক্ত মাতৃভূমির প্রতিষ্ঠা ও প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে শক্তিশালী পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী গড়ে তােলা
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং তার তাবেদার ‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারকে উৎখাতের জন্য গণযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়ােগ করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা।
– কৃষক, শ্রমিক ও দেশপ্রেমিকদের নিয়ে পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী (নিয়মিত বাহিনী, আঞ্চলিক বাহিনী, গেরিলা ও মিলিশিয়া এবং অন্যান্য বাহিনী) গড়ে তােলা।
তারা মাতৃভূমি ও জনগণের স্বার্থের প্রতি বিশেষ আনুগত্যশীল। পূর্ব বাংলার মুক্তি এবং পূর্ব বাংলাকে রক্ষার জন্য দেশের সমগ্র জনগণের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে সংগ্রাম করতে এবং এশিয়া তথা সারা বিশ্বে শান্তি রক্ষায় সক্রিয় সাহায্য দানে তারা হবে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
…………………………………………………………………….
নৌ-মাইল। ১ নটিক্যাল মাইল = ১৮৫২ মিটার প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৪৭৪

– গণযুদ্ধকে জোরদার করতে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদারদের পরাজিত করতে এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহতভাবে পরিচালনা করে তা চূড়ান্ত বিজয়ের পথে পরিচালনার জন্য দেশপ্রেমিক বাহিনীতে সংগ্রামের কর্মক্ষমতা ও গুণগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করানাে।
– সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর দেশপ্রেম, তাদের সংকল্প, শৃঙ্খলাবােধ জোরদার করার উদ্দেশ্যে এবং জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক কাজ জোরদার করা।
দেশপ্রেমিক বাহিনীর অফিসার ও সৈন্যদের ভােটদান করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। তারা ভূ-সম্পত্তির মালিক হতে পারেন এবং সাধারণ নাগরিকের সকল অধিকার ভােগ করতে পারেন।

একটি স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তােলা
এবং জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের শােষণ ও দাসত্বের অবসান করা।
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তাদের সহযােগী ও সমর্থক বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরদের পূর্ব বাংলাস্থ সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
-সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের শােষণের অবসান এবং তাদের পূর্ব বাংলাস্থ সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। তাদের দালালদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা।
– স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তােলা, জনগণকে সমৃদ্ধশালী ও দেশকে শক্তিশালী করার মানসে অর্থনৈতিক বিকাশ করা।
-আইনের মাধ্যমে নাগরিকদের সম্পত্তি ও উৎপাদন যন্ত্রের স্বত্বাধিকার সংরক্ষণ, পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট ও তাদের দালালদের দ্বারা উৎখাতকৃত ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের পুনর্বাসন করা। তাদের কাজকর্ম পুনরারম্ভ ও চালিয়ে যাওয়ার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দানের ব্যবস্থা করা। ভারতে যায়নি এ অজুহাতে দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের উৎখাত প্রতিহত করা। তাদেরকে যথাযথ সুযােগ প্রদান করা। বাংলাদেশ’ পুতুল সরকার কর্তৃক উৎখাতকৃত দেশপ্রেমিক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করা।
– পূর্ব বাংলায় স্বাধীনভাবে ভারী শিল্প, হালকা শিল্প ও কুটীর শিল্প গড়ে তােলা। এদেরকে বৈদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার হাত থেকে রক্ষা করা এবং বিদেশের উপর নির্ভরশীল হওয়ার বিরােধিতা করা।
– দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহ দান ও সংরক্ষণের অনুকূলে শুল্প ব্যবস্থা নির্ধারণ করা। চোরাকারবারী, কালােবাজারী, মহাজনী প্রথা, মুনাফাখােরদের জাতীয় স্বার্থবিরােধী কার্যকলাপ প্রতিহত করা।
– পূর্ব বাংলার শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের অনুপ্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবের বিরােধিতা করা।
– পূর্ব বাংলা থেকে ভারত ও অন্যান্য রাষ্ট্রে পুঁজি পাচার প্রতিহত করা।
– রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিগত মালিকানায় ফেরত দেওয়া প্রতিহত করা।
পৃষ্ঠা: ৪৭৫

– শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প, হস্তশিল্পের উন্নয়নে রাষ্ট্র শিল্প ব্যবস্থার সহিত সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতিদের উৎসাহিত করবে। জাতি গঠন ও জনকল্যাণ বিধানের সাহায্যকারী শিল্প। প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা।
– জেলেদের উপর পরিচালিত শােষণের অবসান করা। তাদের জীবনযাত্রা ও পেশার মানােন্নয়নের ব্যবস্থা করা।
– শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিক ও কর্মচারীদের অংশগ্রহণের অধিকার সংরক্ষণ।
– যােগাযােগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন।
– শহর, গ্রাম-সমভূমি ও পার্বত্য এলাকার মধ্যে অর্থনেতিক বিনিময়কে উৎসাহিত ও বৃদ্ধি করা। উত্তরবঙ্গসহ অন্যান্য অনুন্নত অঞ্চলসমূহের দ্রুত উন্নয়নের ব্যবস্থা করা।
– ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের স্বার্থের প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া। – একটি স্টেট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। – উৎপাদনে উৎসাহ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র অল্প সুদে ঋণদানের নীতি গ্রহণ করবে।
– কৃষি উৎপাদন পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা এবং উহার উন্নয়ন সাধন, কৃষিকার্য ও পশু পালনের উন্নয়ন, মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও তার উন্নয়নের ব্যবস্থা করা।
– ফারাক্কা বাঁধজনিত সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান করা, স্থায়ীভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেচব্যবস্থা, পােকা নিরােধ ও সার প্রদানের ব্যবস্থা করা, কৃষিকে আধুনিকীকরণ করা, রাষ্ট্র কৃষকদিগকে ঐক্যবদ্ধ হতে এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে, পরস্পরকে সাহায্য করতে উৎসাহিত করবে। গবাদি পশু, কৃষি সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি, বীজ, সার প্রভৃতি ক্রয়ে কৃষকদিগকে স্বল্পসুদে ঋণদান করবে।
– কৃষিকে জাতীয় অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে একে উন্নত করা।’
– কৃষিপণ্য বিক্রয়ের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা। খাদ্যদ্রব্যে দ্রুত আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্য অর্জন করা।
– চাল, মাছ, মাংস, ডিম, তরি-তরকারী ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের পাচার এবং উদ্বৃত্ত নয় এরূপ খাদ্যদ্রব্যের রপ্তানী বন্ধ করা।
– ভারত কর্তৃক পাট ও অন্যান্য কাঁচামাল ক্রয়ের অধিকার বাতিল করা। – গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভূতি ভারতে নিয়ে যাওয়া বন্ধ করা। -ভারতীয় বিদ্যুৎ, তৈল এবং কাঁচামালের উপর শিল্প প্রতিষ্ঠানকে নির্ভরশীল না করা।
– পারস্পরিক স্বার্থ ও সমতার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা রেখে সকল দেশের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে বৈদেশিক রাষ্ট্রসমূহের নিকট থেকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযােগিতা গ্রহণ করা।

খােদ কৃষকের হাতে জমি-এই নীতির ভিত্তিতে
ভূমি সংক্রান্ত কর্মসূচী বাস্তবায়ন
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের দালাল নৃশংস ঝুনা জমিদার এবং তাদের তাবেদার গােষ্ঠীর জমি বাজেয়াপ্ত করে ভূমিহীন এবং কম জমির মালিক কৃষকদের মধ্যে উহা বণ্টন।
পৃষ্ঠা: ৪৭৬

কৃষকদের মধ্যে বণ্টনকৃত জমির প্রতি তাদের স্বত্বাধিকারের স্বীকৃতি ও উহার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
-রাষ্ট্র ভূ-স্বামীদের নিকট থেকে এলাকা বিশেষে নির্দিষ্ট উচ্চতম সীমার অতিরিক্ত জমি ক্রয়ের ব্যবস্থা করবে। এ সকল জমি ভূমিহীন ও কম জমির মালিক কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। স্থানীয় পরিস্থিতি সাপেক্ষে জমি সংরক্ষণের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত হবে। ভূমিহীন ও কম জমির মালিক কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে জমি বণ্টন করা হবে। তাদের উপর কোন প্রকার বাধ্যতামূলক শর্তারােপ করা হবে না। যে সকল এলাকায় ভূমি সংস্কারের উপযুক্ত অবস্থা এখনও সৃষ্টি হয়নি তথায় জমির খাজনা হ্রাস করা হবে।
– ইজারাদারী, জোতদারী, মহাজনী ও সুদে বন্ধক সকল জমি, সম্পত্তি বিনা শর্তে পূর্বতন মালিকদের ফেরত দিতে হবে।
– অনুপস্থিত জমিদারদের জমি কৃষকদের নিকট চাষাবাদের জন্য ন্যাস্ত করা এবং তারা এ সকল জমির ফসল ভােগ করবে। পরবর্তীকালে ঐ সকল জমিদারদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক মনােভাব বিবেচনা করে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে।
– জমিদারদিগকে কৃষকদের সংগঠনে অথবা রাষ্ট্রকে জমি দানের সুযােগ দেওয়া হবে। কৃষক সংগঠন অথবা রাষ্ট্র ভূমিহীন কম জমির মালিক কৃষকদের মাঝে এই জমি বণ্টন করবে।
– শিল্পে ব্যবহার্য কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী এবং ফলের বাগানের মালিকদিগকে উৎসাহ দেওয়া হবে।
– মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগােডাসমূহের ভূমির ন্যায্য স্বত্বাধিকারের প্রতি মর্যাদা প্রদান করা।
– ন্যায্য ভিত্তিতে বারােয়াড়ী জমির পুনর্বণ্টন।
– যারা জমি উদ্ধার করবে তাদেরকে ঐ উদ্ধারকৃত আবাদী জমির স্বত্বাধিকার প্রদান করা হবে।
– যাদেরকে বন্দী শিবিরে গমনে বাধ্য করা হয়েছে তাদেরকে তাদের সাবেক গ্রামে ফিরে যাওয়ার সুযােগ দেওয়া হবে।
– যুদ্ধের ফলে যারা উদ্বাস্তু হয়েছেন, তারা ইচ্ছে করলে তাদের বর্তমান বাসস্থানে বাস করতে পারবেন। তাদের ভূসম্পত্তি ও শ্রমলব্ধ অন্যান্য সম্পত্তির মালিকানা লাভ করবেন। তাদেরকে উক্ত স্থানে বাস করে জীবিকা অর্জনে সাহায্য করা হবে। যারা নিজ জন্মস্থানে ফিরে আসতে চান, তাদের সাহায্যার্থে ব্যবস্থা গৃহীত হবে।

জাতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও শিক্ষার পদ্ধতি গড়ে তােলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন সাধন
সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ধরনের হীন মনােবৃত্তি সৃষ্টিকারী ও অধঃপতিত সংস্কৃতি এবং শিক্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। এ সংস্কৃতি আমাদের জনগণের সমৃদ্ধি ও দীর্ঘ ঐতিহ্য সম্পন্ন সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করছে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হবে।
পৃষ্ঠা: ৪৭৭

বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার উন্নয়ন করে উহা জাতি গঠন ও প্রতিরক্ষা কাজে নিয়ােজিত করা।
– বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামী ঐতিহ্য এবং পূর্ব বাংলার জনগণের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসের আলােকে জনসাধারণকে শিক্ষাদান, আমাদের জাতীয় সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, প্রথা সংরক্ষণ ও উন্নয়ন।
– জনসাধারণের সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন, নিরক্ষরতা দূর, আনুষঙ্গিক শিক্ষার উন্নয়ন, নয়া সাধারণ শিক্ষার বিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খােলা, বিজ্ঞান কর্মী, কারিগর ও দক্ষ শ্রমিক দল গড়ে তােলা এবং তাদেরকে উচ্চশিক্ষা, ট্রেনিং দানের জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালানাে।
– বাংলা ভাষাকে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ।
– শিক্ষা এবং কর্মজীবনে সকল ক্ষেত্রে ভাষাগত সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ ভাষা ব্যবহারের সুযােগ প্রদান করা।
দশম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা, ছাত্রদের শিক্ষা। বেতন হ্রস।
– গরীব ছাত্রদিগকে শিক্ষার বেতন হতে অব্যাহতি দান অথবা তাদের জন্য স্কলারশীপ-এর ব্যবস্থা করা।
– পরীক্ষাসমূহের পদ্ধতির সংস্কার সাধন করা। – শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ছাত্রদের অংশগ্রহণ।
– পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাহায্যকারী তরুণ ও শিশুদের, বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের পরিবারের সন্তান-সন্ততি ও মেধাবী তরুণদের শিক্ষিত করে। তুলতে এবং তাদের প্রতিভার যথাযথ বিকাশ সাধনের জন্য রাষ্ট্র সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য দান করবে।
– বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি গবেষণা কার্য পরিচালনা, সাহিত্য ও শিল্পে সৃজনশীল ভূমিকা গ্রহণ এবং সাংস্কৃতিক কর্মে অংশগ্রহণে প্রতিটি নাগরিকের অবাধ সুযােগ দান।
বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিকদিগকে উৎসাহিত করা এবং মাতৃভূমি ও জনগণের স্বার্থে তাদের গবেষণা, আবিষ্কার ও সৃজনশীল কাজ অব্যাহত রাখার উপযুক্ত সুযােগের ব্যবস্থা করা।
– যে সকল লেখক, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীকে তাদের দেশপ্রেমিক ভূমিকার জন্য নির্যাতন ভােগ করতে হয়েছে, তারা যেন তাদের সৃজনশীল কর্ম অব্যাহত রাখতে পারেন-এর সুযােগ সৃষ্টি করা।
-স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নয়ন এবং স্বাস্থ্য রক্ষার ও প্রতিষেধক ব্যবহারের আন্দোলন গড়ে তােলা। জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষা করা।
– মহামারী নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক শােষকরা যে সকল মারাত্মক রােগ রেখে গেছে। সেগুলি বিলােপের ব্যবস্থা করা।
– শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া আন্দোলনের বিকাশ সাধন।
– সমতা ও পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে বৈদেশিক রাষ্ট্রের সাথে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক স্থাপন করা।
পৃষ্ঠা: ৪৭৮

শ্রমিক, মজুর ও বেসামরিক কর্মচারীদের অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা করা
শ্রম আইন প্রণয়ন, আট ঘণ্টা শ্রম সময়ের প্রবর্তন, বিশ্রাম ও চিত্তবিনােদনের সুযােগ সৃষ্টি, যুক্তিসঙ্গত বেতন নির্ধারণ এবং বর্ধিত উৎপাদনের জন্য বােনাসের ব্যবস্থা করা। ট্রেড ইউনিয়ন, সমিতিবদ্ধ হওয়া, ধর্মঘট ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের অধিকার নিশ্চিত করা।
– শ্রমিক, মজদুর ও কর্মচারীদের জীবনযাত্রা ও চাকুরীর উন্নয়ন। – শিক্ষানবিশদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক প্রদানের নীতি গ্রহণ।
– শ্রমিক ও শহরের দরিদ্র জনসাধারণের জন্য চাকুরীর সংস্থান করা। বেকারত্বের অবসানের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানাে।
– রােগ, ব্যাধি, কর্মক্ষমতা লােপ, বার্ধক্য ও অবসর গ্রহণ প্রভৃতি কালে শ্রমিক, মজদুর ও কর্মচারীদের যত্ন, সাহায্যদান এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করা।
– মেহনতী মানুষের বাসস্থানে জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নয়ন।
– উভয় পক্ষের আলাপ-আলােচনা ও জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকারের মধ্যস্থতায় শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার বিরােধসমূহের মীমাংসা করা।
– শ্রমিক ও মজদুরদের প্রহার, তাদের বেতন হতে জরিমানা কেটে রাখা এবং অন্যায়ভাবে শ্রমিকদের চাকুরী হতে বহিষ্কার কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ করা।
– বেসামরিক কর্মচারীদের ভােটদান করার ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। তারা সাধারণ নাগরিকের সকল অধিকার ভােগ করতে পারেন।

নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা,
মাতা ও সন্তানদের রক্ষা করা
– জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে নারী সমাজের ভূমিকার সাথে যথাযথ সংগতি রেখে তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৃত্তিগত মানােন্নয়ন, পূর্ব বাংলার মহিলাদের বীরত্ব, শৌর্য ও জাতি সেবার ঐতিহ্যের বিকাশ সাধন।
– রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে।
– যে সকল মহিলা পুরুষের অনুরূপ কার্যে নিযুক্ত, তারা সমবেতন, সমমর্যাদা ও সমঅধিকার ভােগ করবেন।
– মহিলা শ্রমিক ও বেসামরিক কর্মচারী দুই মাসের জন্য মাতৃত্ব ছুটি লাভ করবেন। মহিলা কর্মীদের উৎকর্ষ বিধান, উপযুক্ত ট্রেনিং ও সক্রিয় সাহায্যদানের নীতি গ্রহণ। বিবাহ ও পরিবার সম্পর্কে প্রগতিশীল আইন প্রণয়ন।
– মাতা ও শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ, মাতৃসদন, শিশুমঙ্গল প্রতিষ্ঠান ও নার্সারী স্কুলের সংখ্যা বৃদ্ধি। – মহিলাদের স্বাস্থ্য ও মর্যাদাহানিকর সকল প্রকার সামাজিক দুর্নীতির অবসান।

শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা
– অক্ষম সৈন্যদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে যে সকল সৈনিক ও দেশপ্রেমিক বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করবেন তাদেরকে পুরস্কৃত করা।
পৃষ্ঠা: ৪৭৯

– মুক্তিসংগ্রামে সশস্ত্র বাহিনী অথবা অন্যান্য বিভাগ ও বিপ্লবী সংগঠনে যে সকল লােক শহীদ হবেন, যারা রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মবলিদান করেছেন, দেশের সমস্ত জনগণ তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তাদের স্মৃতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন।
– রাষ্ট্র ও জনগণ তাদের পরিবারবর্গের যত্ন নেবেন এবং সাহায্য দান করবেন।
– সশস্ত্র অথবা রাজনৈতিক সংগ্রামে যে সকল দেশপ্রেমিক অক্ষম হয়ে পড়বেন তাদের প্রতি যত্ন নেওয়া হবে এবং তাদেরকে সাহায্য দান করা হবে।
– বিপ্লবে যে সকল পরিবারের অবদান রয়েছে সমগ্র জাতি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তারা সমগ্র জাতিরই সাহায্য ও সহানুভূতি লাভ করবেন।

সামাজিক নিরাপত্তা বিধান,
জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ক্ষগ্রিস্তদের রিলিফ প্রদান
বাংলাদেশ’ ফ্যাসিস্ট সরকারের নীতি বিবর্জিত কাজের ফলে যে সকল ব্যক্তি ও পরিবারের চরম সর্বনাশ হয়েছে, তাদেরকে সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও দেশসেবার সুযােগ প্রদান করা।
– অনাথ, বৃদ্ধ, অক্ষম ব্যক্তিদের যত্ন নেয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বা শস্যহানির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় রিলিফ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারের ভাড়াটে সৈন্য ও পুলিশ ও বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যকার অক্ষম, যুদ্ধে নিহত, অসহায় পরিবারের বিষয় বিবেচনা করা।
ভারত থেকে বিতাড়িত বাঙালী, অবাঙালী, উদ্বাস্তুতের পুনর্বাসন, জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা এবং সামাজিক অধিকার প্রদান। ‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারের ভাড়াটে সৈন্য ও অফিসার এবং পূর্ব বাংলায় তাদের প্রশাসনিক বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে যারা জনগণের পক্ষ সমর্থন করবেন তাদের
প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করা ‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকার যে আমলা গােষ্ঠী সৃষ্টি করছে এবং তাদের দ্বারা প্রশাসন পরিচালনা করছে, তাদের মধ্যকার দালালদের উৎখাত করা। বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যে সকল ঘৃণ্য খুনীরা কাজ করছে তাদের কঠোর শাস্তি বিধান করা।
– বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারের ভাড়াটে সৈন্য, অফিসার এবং প্রশাসনিক কর্মচারীদের যাতে ন্যায়ের পথে দেশরক্ষা ও জাতি গঠনের কাজে জনসাধারণের সাথে সামিল হতে পারেন তার অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি করা।
– ভাড়াটে বাহিনী ও প্রশাসনিক বিভাগের যে সকল গ্রুপ, ইউনিট অথবা ব্যক্তি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করবেন তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে এবং দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত করা হবে। যারা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সহানুভূতি ও সমর্থন দান করছেন এবং যারা শাসক গােষ্ঠীর আদেশ পালনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছেন তাদের সকলকে যথাযথ মর্যাদা দান করা হবে।
– যারা ভাড়াটে বাহিনী ত্যাগ করে পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীতে যােগদানে আবেদন জানাবেন তাদেরকে স্বাগত জানানাে হবে। তারা সমব্যবহার লাভ করবেন।
পৃষ্ঠা: ৪৮০

-‘বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারের যে সকল কর্মকর্তা পূর্ব বাংলার মুক্তির পর জনগণ ও দেশের সেবার নিমিত্তে রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রে যােগ দিতে ইচ্ছুক তাঁরাও সমঅধিকার লাভ করবেন।
– বাংলাদেশ’ পুতুল সরকারের ভাড়াটে সৈন্যবাহিনী ও প্রশাসনিক বিভাগের যে সকল ব্যক্তি গণবিরােধী অপরাধে লিপ্ত ছিল, তারা যদি পরিশেষে নিজেদের। কার্যকলাপের জন্য আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত হয় তবে তাদের ক্ষমা প্রদর্শন করা হবে। যারা উত্তম কার্যাদি দ্বারা নিজেদের অপরাধ স্থলনের প্রয়াস পাবেন, তাদেরকে যথারীতি পুরস্কৃত করা হবে।
-ভাড়াটে বাহিনীর বন্দী অফিসার ও সৈন্যদের প্রতি মানবিক ব্যবহার ও অনুকম্পা প্রদর্শন করা হবে।
– ভারতীয় বা অন্য কোন বৈদেশিক রাষ্ট্রের বন্দী সৈনিকদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা হবে। এদের মধ্যকার যারা পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে সমর্থন করেন, সময় হলেই তাদেরকে নিজ নিজ পরিবারের নিকট ফিরে যেতে সাহায্য করা হবে।

প্রবাসী বাঙালীদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ
– প্রবাসী বাঙালীদের দেশপ্রেমমূলক কার্য এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে তাদের। মূল্যবান সাহায্যকে স্বাগত জানানাে হবে।
– তাদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করা।
– দেশ গঠনের জন্য প্রবাসী যে সকল বাঙালী দেশে ফিরে আসতে চাইবেন তাদের সাহায্য করা।

পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী বিদেশী নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ
– পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রামে স্থানীয় যে সকল বিদেশী নাগরিক সাহায্য করবেন তাদেরকে স্বাগত জানানাে হবে।
– পূর্ব বাংলায় বসবাসকারী সকল বিদেশী নাগরিকের পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি মর্যাদাশীল হতে হবে এবং তাদেরকে জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকারের আইনকানুন মেনে চলতে হবে।
– যে সকল বিদেশী নাগরিক বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তাদের এজেন্টদের এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের সহযােগিতা দান করেননি, যারা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হানিকর কিছু করবেন না, তাদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ। যে সকল বিদেশী মুক্তি সংগ্রামকে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সমর্থন দান করবেন, তাদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থের প্রতি যথাযথ লক্ষ্য রাখা।
– পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত বৈদেশিক এজেন্ট ও চরদের কঠোর শাস্তি বিধান।
পৃষ্ঠা: ৪৮১

পূর্ব বাংলার প্রজাতান্ত্রিক সরকার ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে নিম্নলিখিত নীতিমালা কার্যকরী করে ধর্মীয়, ভাষাগত ও জাতিগত নিপীড়নের অবসান করবে
– সকল প্রকার ধর্মীয় নিপীড়নের অবসান করা, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগণের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করা, তাদের আচার-অনুষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, প্যাগােডা, গির্জা রক্ষা করা, ক্ষতিগ্রস্তদের সংস্কার করা। ধর্মীয় নিপীড়ক দাঙ্গা, রায়টকারীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।
ব্যবসা, বাণিজ্য, চাকুরী, শিক্ষা, শিল্প, প্রতিরক্ষাসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অনুন্নত অঞ্চলের জন্য বিশেষ এলাকা গঠন করে দ্রুত উন্নয়নের ব্যবস্থা করা।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তাদের তাবেদারদের উৎখাত করা, একই সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাবেদারদের পূর্ব বাংলা দখলের চক্রান্ত বিরােধী সংগ্রামে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগণের ঐক্যকে দৃঢ় করা, জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্র অর্জনের সংগ্রামে তাদেরকে শরীক করা।
উর্দু ভাষাভাষী জনগণের উপর পরিচালিত নির্মম অত্যাচারের অবসান করা, তাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থা করা, নাগরিক অধিকার প্রদান করা, তাদের আচার-ব্যবহার ও সংস্কৃতি রক্ষা করা।
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণকে বিভক্ত করা ও শােষণ করার জন্য ব্যবহৃত সকল আইন, পদ্ধতি, নীতি ও কৌশল বাতিল করা, জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি অসম আচরণ এবং তাদেরকে ভয় দেখিয়ে কূটকৌশলে এবং বলপ্রয়ােগ করে বাসস্থান থেকে উৎখাত করাকে বিরােধিতা করা।
– বিভিন্ন ভ্রাতৃপ্রতিম জাতিসত্তার মধ্যকার এবং তাদের সাথে বাঙালী জাতির দীর্ঘদিনের একতা এবং পারস্পরিক সাহায্যের ঐতিহ্যকে বিকাশ করা, যাতে দেশকে রক্ষা এবং দেশ গঠনের কাজে সকলকে শরীক করা যায়।
চাকুরী, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে সকল জাতিসত্তার সমঅধিকার রয়েছে।
– জাতিগত সংখ্যালঘুদের যে সমস্ত জমি ও সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করা ও বন্দোবস্ত নেওয়া হয়েছে তা পূর্বতন মালিককে ফেরত দিতে হবে।
ইজারাদারী, জোতদারী ও মহাজনী সুদে বন্ধক সকল জমি, সম্পত্তি বিনাশর্তে পূর্বতন মালিকদের ফেরত দিতে হবে।
-সরকারী সংরক্ষিত বনাঞ্চলে বসবাসকারী মিয়া চাষীদের উপর ভূমিদাসসূলভ শােষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের অবসান ঘটাতে হবে।
– জাতিগত সংখ্যালঘু কৃষকদের মাঝে যে ভূমি চাষ করে সে-ই ভূমির মালিক’ এই কৃষিনীতির সুযােগ প্রদান করা।
-কাপ্তাই বাঁধের জল কৃষিকাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করে এলাকা প্লাবিত না করে বিশেষজ্ঞ দ্বারা স্থিরীকৃত এরূপ সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া।
পৃষ্ঠা: ৪৮২

– জাতিগত সংখ্যালঘু জেলেদের উপর ঠিকাদারী, সরকারী কর্মচারী ও তাদের তাবেদারদের শােষণ বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে মাছ ধরার জাল ও অন্যান্য। সরঞ্জাম ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ করতে হবে। ন্যায্যমূল্যে মৎস্য ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
– জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য উৎসাহিত করা, তাদের ভূমির উন্নতি সাধন করা, তাদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি এবং তাদের জীবন ধারণের মানকে উন্নত করা, যাতে তারা পূর্ব বাংলার জনগণের সাধারণ জীবন ধারণের মান পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
– জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিজেদের কথা ও লিখিত ভাষার (লিখিত ভাষা না থাকলে তার ব্যবস্থা করা) মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতি ও শিল্পকলার বিকাশ, তাদের নিজস্ব। আচার-অনুষ্ঠান বজায় রাখা বা পরিবর্তন করার অধিকার নিশ্চিত করা।
– জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে দ্রুত প্রশাসনিক কর্মচারী শিক্ষিত করা, যাতে তারা অল্প সময়ের মাঝে নিজেদের স্থানীয় বিষয় নিজেরাই পরিচালনা করতে পারে।
– জাতিগত সংখ্যালঘুদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়িত করা।
– স্বাধীন ও মুক্ত পূর্ব বাংলার মধ্যে বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য। স্বায়ত্বশাসিত এলাকা গঠন ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান, যাতে তাদের জাতিগত বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
– তাদের সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার রক্ষা করা।

শান্তি ও নিরপেক্ষতার বৈদেশিক নীতি
পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র শান্তি ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করবে। এই বৈদেশিক নীতিতে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার নিশ্চয়তা রয়েছে এবং ইহা বিশ্বশান্তির সহায়ক। এই বৈদেশিক নীতি নিম্নরূপ :
পরস্পরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শন, পরস্পরের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, পরস্পর অনাক্রমণ, পারস্পরিক সমতা ও স্বার্থ এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের ভিত্তিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে সকল দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন।
পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকাংশের আশা-আকাঙ্খর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার সম্পর্কের সমস্যার (পাকিস্তানের সাথে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, পাকিস্তানস্থ বাঙালীদের ফিরিয়ে আনা, পূর্ব বাংলার গণহত্যা ও ফ্যাসিস্ট ধ্বংসযজ্ঞের অপরাধে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী ও সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তি প্রদান, পূর্ব বাংলা থেকে গত ২৪ বছরে পাকিস্তানে যে পুঁজি ও মূল্যবান সম্পদ পাচার হয়েছে তা সুদসহ ফেরত আনা, বৈদেশিক ঋণ পরিশােধের সমস্যা, পূর্ব বাংলায় তারা যে নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন চালিয়েছে তার যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায় করা ইত্যাদি সমস্যা) সমাধান করা।
পৃষ্ঠা: ৪৮৩

পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যে সকল দেশ সাহায্য-সহযােগিতা ও সমর্থন দান করবেন তাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে মর্যাদা দান।
কোনরূপ রাজনৈতিক শর্ত জড়িত না থাকলে যে কোন দেশের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সাহায্য গ্রহণ।
কোনরূপ সামরিক চুক্তিতে জড়িত না হওয়া, পূর্ব বাংলায় কোনরূপ বিদেশী শক্তির কোনরূপ সামরিক বাহিনী অথবা সামরিক ঘাঁটির অস্তিত্ব না রাখা।
– পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে যে সকল দেশ সাহায্য-সহযােগিতা ও সহানুভূতি জানাবেন তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করা।
– ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বিরােধী সংগ্রামরত দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের সংগ্রাম, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশ, জাতি ও জনগণের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জ্ঞাপন।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, প্যালেস্টাইন এবং অন্যান্য দেশের জনগণের মহান সংগ্রামকে সমর্থন করা।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বিরােধী ভারতীয় জনগণের সংগ্রাম সমর্থন করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রো-আমেরিকানদের মৌলিক জাতীয় অধিকারের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সক্রিয় সমর্থন দান করা।
-বিশ্বশান্তি রক্ষার কাজে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পররাষ্ট্রলােভী সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠীকে প্রতিহত করতে এবং তাদের আক্রমণাত্মক সামরিক জোট ও বৈদেশিক সামরিক ঘাঁটি বিলােপের কাজে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
সকল আন্তর্জাতিক গণসংগঠন এবং ভারত, সােভিয়েট ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনতাসহ বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক জনসাধারণের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি ও সুদৃঢ় করার জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালানাে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণের সমর্থনে বিশ্বব্যাপী গণফ্রন্টের সম্প্রসারণ ও সুসংহতকরণের উদ্দেশ্যে কাজ করে যাওয়া।
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম শুধু যে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত বংশধরদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য পরিচালিত হচ্ছে তা নয়, সমগ্র বিশ্বের জনগণ যারা শান্তি, জাতীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য সংগ্রামরত তাদের স্বার্থও এর সাথে জড়িত। এই মহান গৌরবময় উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন।
এ ঐক্যকে অবশ্যই আরাে দৃঢ় ও সম্প্রসারিত করতে হবে।
যে সকল রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও প্রগতিশীল ব্যক্তি পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের কর্মসূচী সমর্থন করবেন, ফ্রন্ট আন্তরিকভাবে তাদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করবে এবং তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে প্রস্তুত।
পূর্ব বাংলার জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ও ফ্যাসিস্ট শাসকগােষ্ঠী যতই ঘৃণ্য, উন্মত্ত নৃশংস একগুয়ে কার্যকলাপ চালিয়ে যাক না কেন, তাদের পরাজয় অবধারিত।
আসুন, আমরা আমাদের মাতৃভূমির স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হই, এ একতাকে জোরদার
পৃষ্ঠা: ৪৮৪

করি, বিজয়ের পথে অগ্রসর হই, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার বিশ্বাসঘাতক ও ফ্যাসিবাদী শাসকগােষ্ঠীকে পরাজিত করি।
পূর্ব বাংলার জনগণের বিজয় অবধারিত। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উপরিউক্ত মহান কর্মসূচী অবশ্যই বাস্তবায়িত করবে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ও ফ্যাসিস্ট শাসক গােষ্ঠী ও তাদের প্রভুদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকান দেশসমূহের জনগণ, ভারতসােভিয়েট ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অবশ্যই পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য, সহানুভূতি ও সমর্থন দান করবেন।

আমাদের চূড়াম্ড বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
পৃষ্ঠা: ৪৮৫

১-ক উপব্যুরাের আওতাধীন অঞ্চলসমূহের আঞ্চলিক পরিচালকদের বৈঠকে ১নং ব্যুরাে পরিচালক কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবসমূহ
(দ্বিতীয় সপ্তাহ, জুন, ১৯৭৩)

* সাংগঠনিক
১. ১-ক উপব্যুরাের আওতাধীন অঞ্চলসমূহকে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের পশ্চাদভাগ হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
২. পশ্চাদভাগ হিসেবে যথাযথভাবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যেঃ
– কাজকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করতে হবে;
– কর্মীদের মানােন্নয়ন করে কিছুসংখ্যক দক্ষ কর্মী তৈরী করতে হবে;
– ব্যাপক ও বিস্তৃত এলাকায় শেলটার তৈরী করতে হবে।
– জিনিস-পত্র ও অস্ত্র-শস্ত্র রাখার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তৈরী করতে হবে;
– এমন কোন হামলা করা চলবে না যাতে অঞ্চলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় এবং আমাদের কাজ ব্যাহত হয়।
৩. ১-ক উষ্ণ ব্যুরাের আওতাধীন অঞ্চলসমূহে কাজ বিকাশের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে।
– যে সকল এলাকায় কাজ হয়েছে তার মধ্যে কতকগুলােকে আকড়ে ধরে উপঅঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। অন্য এলাকা সমূহেও যােগাযােগ রক্ষা করতে হবে;
– সমগ্র অঞ্চলকে উন্নত করার জন্য তাড়াহুড়া না করে সমগ্র অঞ্চল এক সঙ্গে না ধরে ১টা বা ২টা উপঅঞ্চলকে আঁকড়ে ধরে গড়ে তুলতে হবে, এভাবে ধাপে ধাপে সমগ্র অঞ্চলকে সুপরিকল্পিতভাবে উন্নত করতে হবে।
৪. কর্মীদের মানােনয়নের উদ্দেশ্যেঃ
– সক্রিয়, অগ্রসর কর্মীদের মধ্যে কয়েকজনকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ব্যক্তিগত গাইডেন্সে রেখে উন্নত করতে হবে।
– স্থানীয়ভাবে শিক্ষা সম্মেলন করতে হবে এবং বিশেষ ট্রেনিং-এর জন্য অন্য অঞ্চলে নেওয়া যাবে;
– সুনির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম অনুসারে কর্মীদের মানােন্নয়ন করতে হবে;
– কয়েকটি কেডার স্কুল তৈরী করতে হবে।
৫. ১-ক উপব্যুরাের আওতাধীন অঞ্চলসমূহে উন্নতমানের গাইড ও কুরিয়ার তৈরী করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৪৮৬

৬. যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।
৭. আগামী ৫/৬ মাস পর্যন্ত।
১-ক উপব্যুরাের কাজের প্রধান দিক হচ্ছে ব্যাপক বিস্তৃতি ও সুসংবদ্ধকরণ-সশস্ত্র সংগ্রাম নয়।
পরবর্তী শুকনাে ঋতুতে এসব অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে।
৮. বিশেষ সামরিক সার্কুলার উচ্চস্তরেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৯. ভবিষ্যতে আমাদের পরিবারসহ বেশ কিছু বাসস্থানের প্রয়ােজন হবে। এ উদ্দেশ্যে এখন থেকেই কিছু পরিবারকে ট্রেইন করতে হবে।
১০. বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তি বাহিনী সংসদে ঢুকে পড়তে হবে, নেতৃত্ব দখল করতে হবে।

* রাজনৈতিক
১১. রাজনীতি হচ্ছে সকল কাজের প্রাণসূত্র।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন থেকে আসে সঠিক সাংগঠনিক পদক্ষেপ।
আমাদের সব সময়ই রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নের উপর গুরুত্ব আরােপ করতে হবে।
তা না হলে আমাদের সাংগঠনিক পদক্ষেপসমূহ হবে অন্ধ ও অদূরদর্শী এবং অনিবার্যভাবেই আমরা প্রতিক্রিয়াশীলদের ফাঁদে আটকা পড়ব।
১২. পূর্ব বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দল ও তাদের তাবেদারদের পরে ‘জাসদই হচ্ছে আমাদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী।
পূর্ব বাংলার জনগণের প্রচণ্ড ভারত বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে ‘জাসদ ক্ষমতাকে দখল করতে চায় এবং মার্কিনের উপনিবেশ কায়েম করতে চায়।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ পুতুল সরকারের উপর মার্কিন প্রভাব ও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ এবং বিপ্লবী যুদ্ধের অনুপস্থিতি প্রভৃতির ফলেই জাসদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং বিকাশ লাভ করা সম্ভব হয়েছে।
‘জাসদ’ সম্পর্কে আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে এবং কেডার ও জনগণের কাছে জাসদের মুখােশ ভালভাবে উন্মােচিত করতে হবে।
১৩. ১৯৭১-এর সংগ্রামের সময় আওয়ামী লীগ যে ভূমিকা নিয়েছিল ভবিষ্যতে ‘জাসদও একই ভূমিকা নিতে পারে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীন ও আমেরিকার স্বাভাবিক সম্পর্কের ফলে ‘জাসদ হয়তাে এখন আমাদের বিরুদ্ধে কিছু বলছে না বা করছে না, কিন্তু ‘জাসদের’ শ্রেণী চরিত্র ও বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করলে ৩টি সম্ভাবনা বেরিয়ে আসেঃ
ক) ‘জাসদ’ খুব শক্তিশালী হয়ে আওয়ামী লীগকে উৎখাতের চেষ্টা করবে এবং একই সঙ্গে আমাদের বিরুদ্ধে খতম অভিযান চালাবে।
খ) ‘জাসদ দুর্বল, আওয়ামী লীগের পিটুনী খেয়ে আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
গ) ‘জাসদ’ দুর্বল, কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে আঁতাত করে একযােগে আমাদেরকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাবে।
পৃষ্ঠা: ৪৮৭

১৪. ‘জাসদ সম্পর্কে উপরােক্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নলিখিত সাংগঠনিক পদক্ষেপসমূহ নিতে হবে।
ক) কেডার ও জনগণের কাছে জাসদের মুখােশ ভালভাবে উন্মােচিত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বিশেষ রাজনৈতিক পাঠ্যসূচী হিসেবে নিম্ন দলিলাদি পড়তে হবে
– পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কয়েকটি কথা;
– ছাত্রলীগের রব গ্রুপের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন।
– সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব প্রসঙ্গে। খ) জাসদ থেকে যে সব লোেক রিক্রুট হবে তাদের সম্পর্কে।
– তাদেরকে জাসদের চরিত্র সম্পর্কে ভালভাবে বুঝতে হবে;
– ভালভাবে রাজনৈতিক মান উন্নত করতে হবে;
– তাদের গতিবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে;
– নেতৃস্থানীয়দের শেলটার চেনানাে চলবে না;
– গুরুত্বপূর্ণ যােগাযোেগসমূহ চেনাননা চলবে না;
– গুরুত্বপূর্ণ শেলটার ও অস্ত্রের শেলটার চেনানাে চলবে না;
– নিম্নস্তরে দীর্ঘদিন রেখে যাচাই করতে হবে।
১৫. তােয়াহারা বর্তমানে আমাদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করছে।
এটা প্রমাণ করে যে, তারা রাজনৈতিকভাবে দুর্বল ও দেউলিয়া হয়ে পড়েছে এবং রাজনৈতিক সমালােচনা করতে না পেরে ব্যক্তিগত কুৎসা ও ছিদ্রানুসন্ধানকে প্রাধান্য দিচ্ছে। ইহা তাদের দুর্বলতা ও দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করছে। অচিরেই তাদের কর্মীরাও এ সত্য উপলব্ধি করবেন।
১৬. বিপ্লবের জন্য প্রয়ােজন আলােড়নমূলক, উত্থান-পতনমূলক পরিবেশ (Turmoil)।
আলােড়নমূলক পরিবেশে বিপ্লবী শক্তিগুলাে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
উত্থান-পতনমূলক বা আলােড়নমূলক পরিবেশের সুযােগ গ্রহণ করার জন্য যে সংগঠন সর্বাপেক্ষা ভাল প্রস্তুতি নিতে পারে তার পক্ষেই ক্ষমতা দখল করা সম্ভব।
আমাদের দেশে বর্তমানে উত্থান-পতনমূলক বা আলােড়নমূলক পরিবেশ বিরাজ করছে। এ পরিবেশের পরিপূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করার জন্য আমাদের অবশ্যই ভালভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে।
* মতাদর্শগত ও চিন্তাধারাগত
১৭. মতাদর্শগত পুনর্গঠনের মৌলিক সমস্যা হচ্ছে সর্বহারা বিশ্ব দৃষ্টিকোণ অর্জন করার সমস্যা।
সর্বহারা বিশ্ব দৃষ্টিকোণ অর্জন করতে হলে- প্রতিটি সমস্যা সর্বহারা বিশ্বদৃষ্টিকোণ দ্বারা বিচার করা। – প্রতিটি কাজ সর্বহারা বিশ্বদৃষ্টিকোণ দ্বারা কার্যকরী করার অভ্যাস করতে হবে।
১৮. পরিবর্তন, প্রতিযােগিতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হচ্ছে বিকাশ। এগুলাে কার্যকরী না হলে আসবে স্থবিরতা ও আমলাতন্ত্র।
পৃষ্ঠা: ৪৮৮

এ কারণে কেডারদের মধ্যে, এলাকাসমূহের মধ্যে, অঞ্চলসমূহের মধ্যে প্রতিযােগিতার সৃষ্টি করতে হবে।
বাসীদের পরিবর্তন করতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যতীত কাজকে উন্নততর করা এবং উন্নততর ধারণা অর্জন করা সম্ভব নয়।
এ কারণে কাজকে উন্নততর করার জন্য আমাদের অবশ্যই সাহসিকতার সাথে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে।
১৯. প্রত্যেক কাজের জন্য প্রয়ােজন- সর্বপ্রথম মৌলিক নীতি (রণনীতি) ও পরিকল্পনা ঠিক করা। রণনীতিগত ধারণা ব্যতীত বর্তমান যুগে বিপ্লবী কাজ করা অসম্ভব।
কাজেই আমাদের অবশ্যই রণনীতিগত ধারণা অর্জন করতে হবে, প্রতিটি কাজ করার পূর্বে পরিকল্পনা করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৪৮৯

ক্ষুদে বুর্জোয়া, বুর্জোয়াদের সাথে আলােচনার পদ্ধতি
[রচনাটি ১৯৭৩ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির নবম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল -প্রকাশক।]

০ একটি কাজ করার উপায়
– এর জন্য কি কি কাজ করতে হবে তা বের করা। গুরুত্ব অনুযায়ী কাজগুলাের। ক্রম নির্ধারণ করা।
– এ কাজে চিন্তার ক্ষেত্রে কি কি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা বের করা এবং সেগুলাে দূর করার জন্য মতাদর্শগত শিক্ষা প্রদান করা।
যেমন-একটি সামরিক কাজের পূর্বে গেরিলা/পরিচালকের ভয়, বাইরের সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা, অনভিজ্ঞতা, বিভিন্ন বিষয়ের অভাব ইত্যাদি চিন্তার উদয় হতে পারে।
এগুলাে দূর করার জন্য মতাদর্শগত শিক্ষার ব্যবস্থা করা। এগুলাে ব্যক্তিস্বার্থ, একতরফাবাদ প্রভৃতি থেকে উদ্ভূত।
– অনুসন্ধান, পরিকল্পনার ক্ষেত্রে একতরফাবাদ, আত্মগতভাব, ভাসাভাসাভাব দূর করার জন্য ক্লাশ নিতে হবে।
এ মতাদর্শগত কাজকেই প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা চিন্তা কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে।
– মতাদর্শগত কাজকে প্রাধান্য দিয়ে গৌণ কাজগুলিকে একটি একটি করে সম্পন্ন। করা।
০ ক্ষুদে বুর্জোয়া, বুর্জোয়া এবং অন্যান্যদের সাথে আলােচনার পদ্ধতি
০ ক্ষুদে বুর্জোয়া, বুর্জোয়া চরিত্রের বহিঃপ্রকাশসমূহ, তাদের সংগ্রামের রূপসমূহ ভালভাবে জানা এবং সেগুলাে যাতে আলােচনায় অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় তা কঠোরভাবে লক্ষ্য রাখা।
০ দ্বান্দ্বিক আলােচনার পদ্ধতি রপ্ত করা।
০ প্রথমে ভাল শ্রোতা হওয়া, তার যে বিষয়ে আগ্রহ (Interest) রয়েছে তাই দিয়ে শুরু করা ও অগ্রসর হওয়া।
প্রথমেই দ্বিমত দিয়ে শুরু না করা।
০ যে সকল দিকের সাথে আমরা একমত তা বের করা এবং সেগুলাে উল্লেখ করা এবং প্রশংসা করা ও একমত পােষণ করা।
এগুলাে কাজে লাগানাে।
০ তাদের ভাল দিকগুলাের প্রশংসা করা, gppreciate করা।
০ তাদেরকে গুরুত্ব প্রদান করা এবং তাদের প্রতি আগ্রহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ করা। ০ দ্বিমতসমূহ বের করা।
পৃষ্ঠা: ৪৯০

০ প্রকাশভঙ্গির কারণে দ্বিমতসমূহ দূর করা। কোন বিষয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকলে মতামত না দেওয়া।
০ মৌলিক দ্বিমতসমূহ একটি একটি করে দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে দূর করা। এগুলাে নিয়ে বিতর্ক/ঝগড়া না করা।
০ কমপক্ষে সংযােগ রাখতে রাজী করানাে।
আলােচনা বিষয়ক অতিরিক্ত পয়েন্ট
১. আলােচনায় নমনীয় হওয়া। ২. পার্টি-লাইন সম্পর্কে ভাল জ্ঞান থাকা। ৩. মার্কসবাদ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান থাকা। ৪. কূটনৈতিক (Diplomgtic) আলােচনার পদ্ধতি জানা। ৫. উন্নতমানের কথা বলার পদ্ধতি (Improvement of Voice) রপ্ত করা। ৬. ইংরেজীতে কথা বলতে পারা। ৭. বাহ্যিক চালচলনে স্মার্ট হওয়া ও স্বাস্থ্য ভাল রাখা। ৮. বিনয়ী মধুর ব্যবহার করা, ভাল ভদ্রতা-ভব্যতা (Courtesy) জানা। ৯. যাদের সাথে আলাপ করবেন তাদের বক্তব্য ও কাজ সম্পর্কে ভালভাবে জানা। ১০. পার্টির মতামত ছাড়া নিজস্ব মতামত কদাচিৎও পেশ না করা এবং মাতব্বরী না করা। ১১. সুসংবদ্ধ আলােচনার জন্য পূর্বাহ্নেই আলােচ্যসূচী নির্ধারণ করে নেওয়া।
০ গণতান্ত্রিক উপায়ে কথা বলার পদ্ধতি
১. একজনের কথা বলার সময় মাঝখানে বলা উচিত নয়। তার বলা শেষ হলে বলা উচিত।
২. প্রশ্ন থাকলে নােট করে রেখে বলা শেষ হলে একটি একটি করে প্রশ্ন করা উচিত।
৩. বুঝতে না পারলে লিখে রেখে বলা শেষে উল্লেখ করা উচিত।
৪. কোন বিষয়ে বক্তা যদি বাদ দিল বলে মনে হয় তবে এইভাবে বক্তব্যের শেষে বিনয়ের সাথে উল্লেখ করা উচিত যে, বিষয়টা উল্লেখ করলে ভাল হয় বা এই বিষয়ে একটু বলেন।
৫. মনে রাখতে হবে যেন অহংকার প্রকাশ না পায়। ৬. মনােযােগের সাথে সকলের সকল বক্তব্য শােনা উচিত।
৭. কেউ একটা বক্তব্য বললে তার মুখের উপরে ভুল বলা উচিত নয়। তাকে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বলা উচিত যাতে সে বুঝতে পারে বিষয়টা সে ভুল বলেছে কিন্তু সে যেন মনক্ষুন্ন না হয়।
৮. অস্পষ্ট জ্ঞান নিয়ে তর্ক না করে স্পষ্টভাবে জানার জন্য প্রশ্ন করা উচিত। বা বিষয়টা সম্পর্কে জানার জন্য কোথায় কোথায় রেফারেন্স আছে জানতে চাওয়া উচিত।
পৃষ্ঠা: ৪৯১

সমালােচনা-আত্মসমালােচনা সংক্রান্ত কতিপয় পয়েন্ট
[রচনাটি জুন ‘৭৩-এ অনুষ্ঠিত প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির নবম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে গৃহীত হয়েছিল -প্রকাশক।]

সমালােচনার পদ্ধতি
০ অতীতে আমরা সমালােচনার সময় পার্টিকর্মী বা কমরেডদের পুরােপুরি কমিউনিস্ট মনে করতাম। এটা বাস্তবমুখী চিন্তা ছিল না। কারণ, পার্টির কর্মীরা পুরােপুরি কমিউনিস্ট নন।
০ পার্টির কর্মীদের মতাদর্শগত ক্ষেত্রকে দুইভাগে ভাগ করা যায়-সর্বহারা দিক, ক্ষুদে বুর্জোয়া দিক।
০ কাজেই কমরেডদের সমালােচনার সময় সর্বদাই মনে রাখতে হবে যাতে তাদের ক্ষুদে বুর্জোয়া দিক ক্ষুদে বুর্জোয়া সংগ্রামের রূপে প্রকাশ না পায় এবং আমাদের উদ্দেশ্য ও ঐক্যকে ব্যাহত না করে।
০ আমরা এমনভাবে সমালােচনা করব যাতে কমরেডদের ক্ষুদে বুর্জোয়া দিক ক্ষুদে বুর্জোয়া সংগ্রামের রূপ নিয়ে প্রকাশ না পায়।
ক্ষুদে বুর্জোয়াদের নিজেদের এবং জনগণের সাথে সংগ্রামের রূপ হচ্ছে বিভেদপন্থীবাদী। বিভেদপন্থীবাদ নিম্নভাবে প্রকাশ পায়ঃ
– রাগারাগি, ঝগড়া; – মান অভিমান; – কান্নাকাটি; – অসহযােগ; – অসন্তুষ্টতা; – মন খারাপ, হতাশ, নিরাশ; – দল ত্যাগ, চক্র, ষড়যন্ত্র করা, উপদল, দুর্গ গঠন করা, গুজব অপবাদ রটনা করা; – আত্মহত্যা করা; – বদমাইশী কৌশল অবলম্বন করা।
০ সর্বহারার নিজেদের এবং জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব/সংগ্রাম মীমাংসার পদ্ধতি হচ্ছে। ঐক্য-সমালােচনা-আত্মসমালােচনা-ঐক্য।
সমালােচনা করার পদ্ধতি
– ঐক্যঃ যে সকল দিকসমূহের সাথে একমত তা বের করা, তা উল্লেখ করা, প্রশংসা করা, ঐ সকল দিকের সাথে একমত পােষণ করা।
– একটি একটি করে সমালােচনার পয়েন্ট নিয়ে অগ্রসর হওয়া। প্রথমেই সমালােচনা
পৃষ্ঠা: ৪৯২

না করে ঐ ত্রুটির বিষয় নিয়ে মার্কসবাদ অধ্যয়ন করা (যাকে সমালােচনা করা হবে তাকে নিয়ে), আলােচনা করা, বুঝানাে, শুদ্ধি অভিযানের পদ্ধতি অনুসরণ করা।
– এ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি সম্পর্কে উপলব্ধি করার পর্যায় উপস্থিত হলে তাকে সমালােচনা করা, ক্রটি উল্লেখ করা, সংশােধনের প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করা, তার ত্রুটি সংশােধিত হলে বিপ্লব ও জনগণের উপকার হবে তা তুলে ধরা, তার মানােন্নয়ন ও ভালর জন্য বলা হচ্ছে তাও উল্লেখ করা।
– তাকে সংশােধনে সহায়তা করা।
সমালােচনা গ্রহণ করার পদ্ধতি
– কেউ সমালােচনা করলে সমালােচকের শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করা।
– সমালােচক উদারতাবাদী নয় তার প্রশংসা করা।
– সমালােচক আমার ভালর জন্য বলছে অর্থাৎ আমার ত্রুটি দূর হলে আমি জনগণের ভাল সেবক হবাে এ কারণে বলছে বলে সমালােচককে প্রশংসা করা।
– দোষ থাকলে বা ভুল হলে অকপটে স্বীকার করা, আত্ম-সমালােচনা করা, সংশােধনের আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে সংশােধন করা।
– দোষ না থাকলে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হওয়া।
সমালােচনা গ্রহণ করার পদ্ধতির উপর অতিরিক্ত পয়েন্টসমূহ
১. কেউ সমালােচনা করলে তা প্রত্যাখ্যান না করে গ্রহণ করা, অস্বীকার না করা। ২. সমালােচনা শুনে অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপানাে। ৩. যা বলা হলাে তা বিশ্লেষণ ও বিচার করা; দরকার হলে সময় নেওয়া বিচারবিশ্লেষণের জন্য। ৪. যে বিষয়ে বা কাজ সম্পর্কে বলা হলাে অনেক সময় মনে হয় যে কাজটা করিনি বা করার ইচ্ছাও ছিল না। এ অবস্থায় বুঝিয়ে বলতে বলা। ৫. আপনার সমালােচনার সাথে আমি একমত তবে কি কি ক্ষেত্রে এসব প্রকাশ পেল বুঝিয়ে বলুন- এ মনােভাব প্রকাশ করা। ৬. সমালােচনাকে অপমানজনক বা অসম্মানজনক মনে না করা। বিদ্রুপ করেছে এরূপ মনে না করা। ইত্যাদি চিন্তা করলে সমালােচনার বিষয়বস্তুর উপর চিন্তা থাকবে। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ভুলে যাবে এবং ত্রুটি সংশােধিত হবে না। ৭. সমালােচনা গ্রহণের সময় চার ধরনের একতরফাবাদের বিরােধিতা করাঃ ক) ফর্ম / পদ্ধতিকে আঁকড়ে ধরা; খ) অপমানজনক মনে করা; গ) নিজের প্রতি হতাশ হওয়া; ঘ) প্রতিশােধবাদী হওয়া। ৮. সমালােচনা যেই করুক তাকে অভিনন্দিত করা। ৯. ত্রুটি থাকলে আন্তরিকভাবে স্বীকার করা, আত্মসমালােচনা করা এবং সংশােধনের জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালানাে।
পৃষ্ঠা: ৪৯৩

১০. সংশােধনের জন্য অন্যের সহায়তা ও নিজস্ব প্রচেষ্টা প্রয়ােজন, এর মাঝে নিজস্ব প্রচেষ্টা প্রধান। নিজস্ব প্রচেষ্টা হলাে-বারংবার শিক্ষা, বিশ্লেষণ, সহায়তা গ্রহণ। এবং সংশােধনের জন্য শেষ পর্যন্ত অধ্যবসায়ের সাথে লেগে থাকা। ১১. ত্রুটির উৎস অতীত ও বর্তমানের মাঝে, বিশেষ করে অতীতের সমাজ জীবনের মাঝে নিহিত। তাই অতীত বর্তমানকে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে ক্ৰটির উৎস,। প্রকৃতি ও নিয়মবিধি আবিষ্কার করে তা সংশােধন করা সহজ হবে। ১২. ক্রটি অস্বীকার করা, পদ্ধতিকে দোষ দেওয়া, দোষ অন্যের কাঁধে চাপানাে, হতাশ হয়ে যাওয়া, প্রতিশােধবাদী হওয়া ইত্যাদি খারাপ। এতে অন্যদের ধারণা খারাপ হয়ে যাবে, অন্যের সাথে সম্পর্কের অবনতি হবে, নিজেরও অধঃপতন হবে। ১৩. সমালােচনাকে স্বাগত জানানাে। যুক্তি খাড়া না করা, ঐক্যের দিক খুঁজে বের করা। ১৪. সমালােচনা গ্রহণ করার পদ্ধতি যা জানেন বলুন, সবটাই বলুন, বক্তাকে দোষ দেবেন না, ভুল থাকলে সংশােধন করুন, ভুল না থাকলে সতর্ক হােন’, এ মনােভাবের সৃষ্টি করতে হবে। ১৫. যে বিষয়ে সমালােচনা হয়েছে তা সংশােধনের মাধ্যমে সমালােচকের সাথে ঐ বিষয়ে অনৈক্য দূর করা।
এভাবে আরাে উন্নততর ঐক্য অর্জন করা।
১৬. উপরােক্ত পদ্ধতিতে ঐক্যের উদ্দেশ্য নিয়ে সমালােচনা, শিক্ষা প্রদান, আত্মসমালােচনা, সংশােধনের মাধ্যমে ত্রুটি দূর করার ভিত্তিতে নতুন ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।
এভাবে ঐক্য-সমালােচনা-আত্মসমালােচনা-ঐক্যের লক্ষ্য অর্জন করা।
পৃষ্ঠা: ৪৯৪

১নং ব্যুরাের আওতাধীন অঞ্চলসমূহের পরিচালকদের সাথে ব্যুরাে পরিচালকের পঞ্চম বৈঠকে পরিচালক কর্তৃক অনুমােদিত সিদ্ধান্তসমূহ
(মধ্য, ১৯৭৩)

* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিজয় অনিবার্য’ দলিলটিতে পার্টির অতিশয় মূল্যবান। অভিজ্ঞতার সারসংকলন যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
দলিলটির মাধ্যমে বর্ণিত অভিজ্ঞতা বাস্তবায়িত করার জন্য সকল কমরেডদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
* চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করা এবং কর্মরীতিকে সংশােধন করা ও কমরেড সিরাজ। সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য একটি আন্দোলন পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে।
ইহা সমগ্র বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সময়ে চালিয়ে যেতে হবে এবং বিরাটাকার বিজয় আনয়ন করতে হবে।
চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করা বলতে বুঝায় ক্ষুদে বুর্জোয়া এবং অন্যান্য অসর্বহারা চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করা, সর্বহারার চিন্তাধারা রপ্ত করা।
কর্মপদ্ধতিকে সংশােধন করা বলতে বুঝায় ক্ষুদে বুর্জোয়া ও অন্যান্য অসর্বহারা কর্মপদ্ধতি সংশােধন করে সর্বহারার কর্মপদ্ধতি চালু করা।
কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে।
চিন্তাধারার পরিবর্তন ও কর্মরীতি সংশােধনের আন্দোলন পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির অষ্টম ইস্তেহারের ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশ, মতাদর্শগত দলিলের ২য় প্রবন্ধ, কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি, সভাপতি মাওয়ের উদ্ধৃতির চিন্তাধারার পদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি, দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে ইত্যাদি অধ্যয়ন করতে হবে।
* কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার আন্দোলন পরিচালনার। জন্য ১নং লাল ঝাণ্ডার সম্পাদকীয়, ২নং, ৩নং লাল ঝাণ্ডা, পরিশিষ্ট ১, ২, চক্রের জবাব, কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি-বিজয় অনিবার্য পাঠ করতে হবে।
* চিন্তাধারার পরিবর্তন ও কর্মপদ্ধতি সংশােধন করা গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযানের পরবর্তী পদক্ষেপ। এ শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে গােড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ দূর করার প্রক্রিয়ায় চিন্তাধারাকে পরিবর্তন ও কর্মপদ্ধতি সংশােধন করা সম্ভব।
এ কারণে গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযান ভালভাবে সম্পন্ন করতে হবে।
* গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযানের প্রাক্কালে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদকে বিরােধিতা করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৪৯৫

আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী নেতৃত্ব কোন অঞ্চলের কার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে না।
সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী কমরেডরা অভিজ্ঞতাকে তত্ত্বের সাহায্যে সারসংকলন করে , নিয়মবিধি বের করে সে অনুযায়ী কাজ করে না।
মস্তিষ্কহীন আনুষ্ঠানিকতা (brginless routinism), নিয়মকানুন, যান্ত্রিকতা দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা নিজেদের ও কর্মীদের মাননান্নয়ন করতে পারে না। নতুন ও পুরাতন-এর মধ্যকার দ্বন্দ্বের মাঝে পুরাতনকে প্রাধান্য দেয়, এভাবে রক্ষণশীল হয়। তারা আংশিক ও আপেক্ষিক সত্যকে চিরন্তন ও সার্বজনীন সত্য বলে মনে করে, তারা। দোষ স্বীকার ও আত্মসমালােচনা যথাযথভাবে করতে পারে না।
তারা গােড়ামীবাদের লেজুড়বৃত্তি করে বা তাদের ভয় করে, এড়িয়ে চলে।
* ক্ষুদে উৎপাদন ব্যবস্থায় সুদীর্ঘদিন কোন পরিবর্তন আসে না, এ কারণে মস্তিষ্ক পরিবর্তন না করার সাথে অভ্যস্থ হয়ে যায়। এ থেকে আসে রক্ষণশীলতা।
রক্ষণশীলতা হচ্ছে নতুন ও পুরাতন দিকের মধ্যকার দ্বন্দ্বের পুরাতনকে প্রাধান্য দেওয়া। গতিশীলতা হচ্ছে নতুন দিককে প্রাধান্য দেওয়া।
পুরাতন ও নতুন দিকের সংগ্রাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযােগিতায় নতুন দিক প্রাধান্য পায়, এ কারণে বিকাশ ও গতি হয়, পরিবর্তন আসে।
প্রতিযােগিতা ও পরিবর্তনই হচ্ছে জীবন। কাজেই নতুন ও পুরাতন দিকের মাঝে নতুন দিককে প্রাধান্য দেওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করা, গতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।
কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক, অঞ্চল, নেতৃত্বের মাঝে প্রতিযােগিতার সৃষ্টি করা উচিত, অযােগ্যদের বাতিল করা উচিত।
অন্যথায় আমলাতন্ত্র ও স্থবিরতা ঢুকবে। কোন কোন অঞ্চল এ তত্ত্ব প্রয়ােগ করে ভাল ফল পাচ্ছে। * বিকাশের সাথে সাথে শ্রম বিভাগ, আনুষ্ঠানিকতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়ােজন।
একটি ছােট মুদি দোকানের মালিক নিজেই পণ্য ক্রয় করে আনে, বিক্রি করে এবং হিসেব রাখে। কিন্তু এ দোকানটিই একটি আধুনিক বড় দোকানে রূপান্তরিত হলে প্রয়ােজন হবে একজন পণ্য কেনার দায়িত্বে নিযুক্ত লােক (Purchase Officer), হিসেব রক্ষক (Cashier), সেলসম্যান এবং পরিচালনার জন্য ম্যানেজার (এগুলাে হচ্ছে। শ্রমবিভাগ)। দোকান পরিচালনার জন্য প্রয়ােজন কতগুলি নিয়মকানুন ও আনুষ্ঠানিকতা, স্বাক্ষর, অনুমতি (পত্র আনুষ্ঠানিকতা); উন্নততর ক্রয়-বিক্রয়ের ও পরিচালনার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
কাজেই আমাদের সংগঠনও যেভাবে বিকাশ লাভ করছে তার সাথে যুক্ত করতে হবে প্রয়ােজনীয় শ্রমবিভাগ, আনুষ্ঠানিকতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এগুলাে কার্যকরী হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্য প্রার্থী সদস্যদের সর্বনিম্ন মান হচ্ছে সক্রিয় কর্মী।
* ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশসমূহ দূর না করলে নেতৃত্বে যােগ্যতা অর্জন, উন্নত মানবিক সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব নয়।
* উচ্চস্তরের সকল মৌখিক ও লিখিত নির্দেশ পরামর্শসমূহ অবশ্যই কঠোরভাবে কার্যকরী করতে হবে। মনে না থাকলে লিখে রাখতে হবে। এ ধরনের পরামর্শ, নির্দেশ
পৃষ্ঠা: ৪৯৬

যথাযথভাবে কার্যকরী না করার ফলে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, কোন কোন কর্মী নিজের, অন্য কমরেডদের ও অঞ্চলের বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
* কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থকদের দলিল প্রদানের সময় তাদের প্রয়ােজন ও মান অনুযায়ী দলিল, পুস্তক দেওয়া এবং পড়ানাে উচিত।
দলিল দেওয়া ও পড়ানাের সময় একটি পরিকল্পনা ও ক্রমঅনুযায়ী অগ্রসর হওয়া উচিত, নীচু প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চস্তরে যাওয়া উচিত। এ পরিকল্পনা পরিচালকের ঠিক করে দেওয়া উচিত।
* কোন একটি শহরে প্রচার টিম সাফল্যজনক প্রচার তৎপরতা চালিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। প্রয়ােজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে প্রচার টিম চড়ুই পাখির মত হঠাৎ উপস্থিত হয়ে প্রচার চালিয়ে সরে পড়তে পারে। এ ধরনের প্রচারটিম সকল শহরেই চালানাে সম্ভব।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের বিশেষ করে সার্বক্ষণিক কর্মীদের শারীরিক ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
এ কারণে তাদেরকে স্বাস্থ্যরক্ষা করতে হবে, খাদ্য গ্রহণে খাদ্যপ্রাণ (Vitamin)। এবং প্রােটিন গ্রহণ করতে হবে।১
সিগারেট খাওয়া কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া এবং শারীরিক ক্ষতির একটি অন্যতম কারণ। এ কারণে সিগারেট খাওয়া কমানাে বা পরিহার করা উচিত।
* পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করার সিদ্ধান্ত খুবই সময়ােপযােগী হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানানাে হচ্ছে।
* জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের চাঁদার রশিদ পেশ করা হচ্ছে।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সকল ইশতেহারসমূহ একসাথে প্রকাশ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অষ্টম ইশতেহার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ইস্তেহারের সকল সিদ্ধান্ত সকল অঞ্চল অবশ্যই বাস্তবায়িত করবে।
…………………………………………………………………….
১. নােটঃ
নিম্নলিখিত খাদ্যপ্রাণ ও ঔষধ গ্রহণ করা উচিত-
প্রতিদিন- ভাের – দুপুর- রাত
Vitamin B Complex- ১ – ১ – ১
” A – ১- X – ১
” C – ১ – ১ – ১
Iron Tab. – ১ – X – ১
or Multi Vitamin – ১ – X – ১
কলেরা, টাইফয়েড, বসন্ত ভ্যাকসিন নেয়া।
শুধু ভাত, ডাল, রুটি, আলু যারা খান তারা দুটো ডিম, দু’গ্লাস দুধ, যে কোন ধরনের মাংস, শাকের সিদ্ধ পানি খাবেন। গ্লাসে করে গরম পানি খাওয়া।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৪৯৭

বিভিন্ন কমরেডের সাথে বৈঠকে
প্রদত্ত সিদ্ধান্তের অংশবিশেষ
[১৯৭৩ সালের বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের প্রারম্ভে এ দলিলটি রচিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সাধারণ কর্মসূচী নিম্নরূপঃ
১। অস্ত্র দখল কর, অর্থ সংগ্রহ কর। ২। নিয়মিত, স্থানীয় বাহিনী গড়ে তােল। ৩। ব্যাপক প্রচার জোরদার কর। ৪। স্থানীয় শত্রুদের উৎখাত কর। ৫। জনগণকে সংগঠিত কর। ৬। সশস্ত্র ও গণসংগ্রাম সমন্বিত কর। ৭। গ্রামসমূহ মুক্ত কর।
০ জনগণকে সংগঠিত করঃ
– স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম করা।
– গ্রাম পরিচালনা কমিটি গঠন করা।
– বিভিন্ন ফ্রন্ট সংগঠন গড়ে তােলা।
০ কৃষক মুক্তি সমিতি।
০ শ্রমিক মুক্তি সমিতি।
০ স্থানীয় গেরিলা বাহিনী।
০ নারী মুক্তি সমিতি।
০ শিশু মুক্তি সমিতি।
০ যুব মুক্তি সমিতি। …
… ইত্যাদি।
(এ সকল সংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে গ্রাম পরিচালনা কমিটি গঠন করা)।
০ কৃষক, যুবক, গেরিলা সংগঠন হচ্ছে মৌলিক শক্তি; মূলতঃ এদের প্রতিনিধি নিয়ে গ্রাম পরিচালনা কমিটি গঠন।
০ অতীত ইতিহাস ও শ্রেণীভিত্তি পর্যালােচনার ভিত্তিতে এ সকল গণসংগঠনের সবচেয়ে সক্রিয় ও অগ্রগামীদের নিয়ে গ্রাম পার্টি কমিটি গড়ে তােলা।
পার্টি কমিটির সদস্য হবে ৭/৯/১১ (?) জন, একজন সভাপতি/সম্পাদক।
০ পার্টি রিক্রুটমেন্টের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করতে হবে।
০ শত্রু এলাকায় গােপনভাবে এবং মুক্ত এলাকায় প্রকাশ্যভাবে গ্রাম পরিচালনা কমিটি গঠন করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৪৯৮

০ গ্রাম পরিচালনা কমিটির সভ্য হবে ৫/৭/৯ জন, সভাপতি একজন।
০ বৃদ্ধদের জন্য আলাদা বৃদ্ধ মুক্তি সমিতি গঠন করতে হবে।

গ্রাম পরিচালনা কমিটি সমূহের কাজঃ
০ সাধ্য অনুযায়ী প্রত্যেকের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করবে।
০ জাতীয় শত্রুদের ভূমি বিতরণ করবে।
০ আশ্রয়স্থল তৈরী করবে।
০ স্থানীয় প্রশাসন চালাবে (শিক্ষা, বিচার, প্রতিরক্ষা, চিকিৎসা, গেরিলা সংগ্রহ)।
০ স্থানীয় প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করবে।
০ সশস্ত্র সংগ্রামকে সর্বোতভাবে সাহায্য করবে। গণসংগ্রামের জন্য জনগণকে সমাবেশিত করবে।
০ কমিটি গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠন করতে হবে।
০ কমিটিতে যারা সদস্য হবে তাদেরকে আগেই তাদের করণীয় সম্পর্কে বলে দিতে হবে।
০ গ্রাম থেকে ফঁাড়ি প্রত্যাহারের ফলে শত্রুর সামরিক শূন্যতার সুযােগ ভালভাবে ব্যবহার করতে হবে। জনগণকে ব্যাপকভাবে সংগঠিত করতে হবে।
০ জনগণকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে সমাবেশ করতে হবে।
– প্রতিদ্বন্দ্বীদের উৎখাত করার জন্য জনগণ দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে মিছিল করানাে, শ্লোগান দেওয়া।
০ এভাবে গণসংগ্রাম করা।
০ শক্রদের বিরুদ্ধেও এভাবে গণসংগ্রাম করা।
০ এলাকাভিত্তিক কর্মী ও গেরিলাদের Target ও কর্তব্য স্থির করে দেওয়া। সময়সীমা ঠিক করে দেওয়া।
০ নিয়মিত সশস্ত্র দলের সাথে – প্রচার দল, – সাংগঠনিক দল, – স্থানীয় স্কাউট গ্রুপ নেওয়া।
০ সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে গণসংগ্রাম সমন্বিত করা। গণসংগ্রাম সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার জন্য ভিয়েতনাম পুস্তকটি পড়বে।
সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে গণসংগ্রামের সংযােগ ব্যতীত বিপ্লব বিজয় অর্জন করতে পারে না।
পৃষ্ঠা: ৪৯৯

কতিপয় সামরিক পয়েন্ট
[রচনাটি ১৯৭৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে প্রকাশিত হয়। পরে আগস্ট ‘৭৪-এ প্রকাশিত ক. সিরাজ সিকদারের নির্বাচিত সামরিক রচনাবলীর সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]

১। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের দু’ধরনের ঝোঁকের বিরােধিতা করতে হবে।
বাম ঝোঁক-যা বাস্তব বাধাবিপত্তি সমূহ খুব ছােট করে দেখে।
ডান ঝোক-যা বাস্তব বাধাবিপত্তি সমূহকে অতিরঞ্জিত করে দেখে।
সামরিক পরিকল্পনা করার সময় আমাদেরকে এ দু’ধরনের ঝোঁকের বিরােধিতা করতে হবে।
২। আমাদের সামরিক পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে বাস্তব অবস্থার বিবেচনার সাথে, আত্মগত অবস্থার বিবেচনা সংগতিপূর্ণ হয়। অর্থাৎ বস্তুগত অবস্থার সাথে আত্মগত অবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে।
৩। কোন সামরিক পরিকল্পনা করার পূর্বে আমাদের অবস্থা এবং শত্রুর অবস্থা ভালভাবে বিবেচনা করতে হবে।
এ বিবেচনা করার ক্ষেত্রে আত্মগতভাব, ভাসাভাসাভাব, একতরফাবাদ পরিহার করতে হবে এবং যা বস্তুগত তাই বিবেচনা করতে হবে।
এ সময় বাম ও ডান ঝোকের প্রতিও সতর্ক থাকতে হবে।
৪। আমাদের অবস্থা হচ্ছে, আমাদের সবল দিক ও দুর্বল দিকসমূহ। শত্রুর অবস্থা হচ্ছে, শত্রুর সবল দিক ও দুর্বল দিকসমূহ।
একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে দু’দুটি অবস্থা মােটামুটি অপরিবর্তনীয় বলে বিবেচনা করতে হবে।
এ দু’টি অবস্থার দ্বারা নির্ধারিত সীমা আমরা লংঘন করতে পারি না, কিন্তু এ সীমার মধ্যে থেকেই উত্তমরূপে যুদ্ধ পরিচালনা করে আমাদের বিজয় অর্জন করতে হবে।
৫। কোন সামরিক অপারেশনের পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে যাতে – শত্রু তার সবল দিকসমূহ ব্যবহারের সুযােগ না পায়। – শক্রর দুর্বল দিকসমূহ যাতে আমরা পুরােপুরি ব্যবহার করতে পারি। – আমাদের সবল দিকসমূহ যাতে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়।
– আমাদের দুর্বল দিকসমূহ যাতে আমাদের উদ্দেশ্য সাধনে কোন প্রকার বাধার সৃষ্টি না করে এবং আমাদের দুর্বল দিকসমূহ যাতে শত্ৰু ব্যবহার করতে না পারে।
৬। আমাদের সামরিক বিকাশের বর্তমান পর্যায়ে সামরিক অপারেশনের প্যাটার্ন হওয়া উচিত কমান্ডাে আক্রমণ অর্থাৎ
– অতর্কিতে আক্রমণ।
– অত্যন্ত স্বল্প সময়সীমার আক্রমণ।
পৃষ্ঠা: ৫০০

আক্রমণের আগমুহূর্ত পর্যন্ত কঠোরভাবে গােপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। গােপনীয়তা ফাঁস হয়ে পড়লে অপারেশন বাতিল করতে হবে।
কারণ গােপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়লে, শত্রু প্রস্তুত হয়ে থাকবে, অতর্কিতে তাকে আক্রমণ করা যাবে না, অল্প সময়ের মাঝে তাকে আত্মসমর্পণ করানাে যাবে না, তার সাথে লড়তে হবে অবস্থান যুদ্ধের মত।
এক্ষেত্রে অস্ত্র ও ট্রেনিং-এর দুর্বলতার কারণে শত্রুকে পরাজিত করা খুবই কষ্টকর হবে।
উপরন্তু আমাদের অস্ত্র ও লােক ক্ষয় হতে পারে। এক্ষেত্রে শত্রু আমাদের দুর্বলতা ব্যবহারের সুযােগ পাবে। এক্ষেত্রে অপারেশন অবশ্যই বাতিল করতে হবে।
– কমান্ডাে আক্রমণের জন্য ক্ষুদ্র, সাহসী ও তড়িৎগতি সম্পন্ন টুপ হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকরী।
– অতর্কিতে আক্রমণ, অল্প সময়সীমার আক্রমণ ও ক্ষুদ্র-সাহসী এবং কার্যকরী টুপ ব্যবহার করার ফলে আমাদের দুর্বল দিকসমূহ শত্রু ব্যবহার করতে পারবে না, শত্রু নিজের সবল দিকসমূহও ব্যবহার করতে পারবে না। পক্ষান্তরে আমরা আমাদের সবল দিক ও শক্রর দুর্বল দিক (অপ্রস্তুত অবস্থা, ভীতি প্রভৃতি) ব্যবহার করে আমাদের উদ্দেশ্য সাধন করতে সক্ষম হবাে।
এ ধরনের আক্রমণে শত্রু হতবুদ্ধি ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বে। কোথাও কোথাও শত্রু তার অস্ত্র ব্যবহারের সুযােগ পায়নি।
৭। সামরিক বিভাগের লােকদের অবশ্যই সাহসী ও বিচক্ষণ হতে হবে।
– অনুসন্ধান, প্লন-পরিকল্পনা, জিনিসপত্র ও গেরিলা একত্রীকরণ, শেষ মুহূর্তের অনুমতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বিচক্ষণতা হচ্ছে প্রধান দিক।
– অপারেশন চলাকালীন সময় সাহস হচ্ছে প্রধান দিক।
বিচক্ষণতা বাড়াবার উপায় হচ্ছে সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর উপর যথাসম্ভব বেশী চিন্তা করা, লােকের সাথে বিশেষ করে অভিজ্ঞ লােকের সাথে পরামর্শ করা।
সাহস বাড়াবার উপায় হচ্ছে মতাদর্শগতভাবে উন্নত করা।
৮। বর্তমান পর্যায়ে আমাদের সামরিক লক্ষবস্তু সমূহকে মােটামুটি তিনভাগে ভাগ করা যায়।
– আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু, যার জন্য যুদ্ধের প্রয়ােজন। যেমন-থানা, ফাড়ি ইত্যাদি।
– দখলের লক্ষ্যবস্তু ও যার জন্য সাধারণতঃ যুদ্ধের প্রয়ােজন হয় না- ব্যাংক, দোকান প্রভৃতি।
– ঠেকানাের লক্ষ্যবস্তুঃ এখানে যুদ্ধের প্রয়ােজন হয়।
৯। যেহেতু আমাদের সামরিক পরিচালক, কমান্ডার এবং গেরিলারা অনভিজ্ঞ সেহেতু বর্তমান পর্যায়ে আমাদের একটি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বিশিষ্ট শক্ত অবস্থান অপারেশন করা উচিত।
কারণ দুই-তিনটি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বিশিষ্ট শত্রু অবস্থানের অপারেশন হচ্ছে। জটিল এবং বর্তমান পর্যায়ে আমাদের পক্ষে সফলতার সাথে জটিল অপারেশন করা সকল স্থানে সম্ভব নয়।
সাটুরিয়া থানায় সফল আক্রমণের মাধ্যমে আমরা একাধিক লক্ষ্যসম্পন্ন অবস্থান দখল করতে সক্ষম হই।
পৃষ্ঠা: ৫০১

যে সকল অঞ্চলে সামরিক অপারেশনের অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা সাটুরিয়ার অভিজ্ঞতা প্রয়ােগ করে একাধিক লক্ষ্যবস্তুসম্পন্ন শক্ত অবস্থান আক্রমণ করতে পারে।
একাধিক লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে প্রধান ও গৌণ লক্ষ্যবস্তু নির্ণয় করতে হবে। সে অনুযায়ী আমাদের শক্তি নিয়ােগ করতে হবে। বিভিন্ন আক্রমণকারী ইউনিট সমূহের মাঝে যথাযথভাবে সমন্বয় রক্ষা করতে হবে।
১০। কোন অপারেশন ট্রুপকে সাধারণতঃ তিনভাগে ভাগ করতে হবে ?
ক) আক্রমণকারী ট্রুপ। খ) রিজার্ভ টুপ। গ) বহনকারী টুপ।
বিশেষ অবস্থায় বহনকারী ট্রপ রিজার্ভের অনুরূপ ব্যবহার করতে হবে।
যদি কোন অপারেশনে ঠেকানাের লক্ষ্যবস্তু থাকে তাহলে পুনরায় আক্রমণকারী টুপকেঃ
– মূল আক্রমণকারী টুপ এবং
– ঠেকানাে ট্রুপে ভাগ করতে হবে।
১১। কোন অবস্থানেই একটি অস্ত্র ও একজন গেরিলা নিয়ােগ করা উচিত নয়। কারণ একটি অস্ত্র জাম হয়ে যেতে পারে, তার ফলে অপারেশনে বিপর্যয় আসতে পারে।
এমনও হয়েছে যে এক সাথে দুই তিনটি অস্ত্রও জাম হয়ে গেছে এবং অপারেশন বাতিল করতে হয়েছে বা টুপ বিপদগ্রস্ত হয়েছে।
১২। অপারেশন করার পর বক্তৃতা ও শ্লোগান প্রদান করার মাধ্যমে জনগণকে আমাদের উদ্দেশ্য বুঝানাে। সরকারী ও শত্রুর সম্পদ যা আমরা আনতে পারব না তা জনগণের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া, আহত ও আত্মসমর্পণকারী শত্রুদের সাথে ভাল ব্যবহার। করা, তাদেরকে আমাদের উদ্দেশ্য বুঝানাে, আমাদের নিজেদের আহত / নিহতদের নিয়ে আসা, জনগণের নিকট থেকে চাঁদা তােলা, দখলকৃত দ্রব্যাদি নিয়ে আসা প্রভৃতি শত্রুর সাহায্য আসার পূর্বেই সম্পন্ন করে নিরাপদে সরে আসতে হবে।
১৩। আমাদের মত দেশ যেখানে গেরিলা যুদ্ধ চালাবার জন্য ভৌগলিক সুবিধা কম সেখানে যদি সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে গণসংগ্রাম সমন্বিত করা না হয় তবে সামরিক তৎপরতা টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে।
কাজেই গণসংগ্রামের বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে এবং এ কাজের জন্য লােক নিয়ােগ ও ট্রেইন করতে হবে।
১৪। আমাদের সামরিক তৎপরতা শুরু হলে, একটা পর্যায়ের পর শত্রু গ্রাম এলাকা থেকে সকল ফাড়িসমূহ প্রত্যাহার করে।
এ সময় গ্রাম এলাকায় যে সামরিক ও রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয় তার সম্পূর্ণ সুযােগ নিতে হবে।
ঐ সকল এলাকায় আমাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করে জনগণকে দ্রুত আমাদের নেতৃত্বে সংগঠিত করে ফেলা উচিত।
১৫। আমাদের সামরিক তৎপরতা চলার পর শত্রু এলাকায় প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
এতে ভয় পাবার কিছু নেই, কারণ প্রচণ্ড চাপের পরই শত্রু সম্পূর্ণ ঢিলে দেয়।
কাজেই আমরা যদি ধৈর্য ধরে চাপের সময়টা সহ্য করতে পারি তবে পুনরায় আমরা আমাদের উদ্যোগ ক্ষমতা ফিরে পাব।
পৃষ্ঠা: ৫০২

১৬। অপারেশনের সময়ঃ
– বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয় সাধন করা।
– শেষ মুহূর্তের অনুসন্ধান।
– নতুন উত্থাপিত সমস্যার সমাধান।
– শেষ মুহূর্তে অনুমতি প্রদান।
প্রভৃতি অতিমাত্রায় গুরুত্ব সম্পন্ন কাজগুলাে যথাযথভাবে করার জন্য অপারেশন পরিচালকের অপারেশন স্থানের নিকটে অবস্থান করা উচিত।
১৭। কোন অপারেশন প্রথমবারেই সফল হবে এরূপ মনে করা উচিত নয়। আমাদের ধরে নেয়া উচিত যে একটা অপারেশন কমপক্ষে ২/৩ বারে সফল হবে। এর ফলে কোন কারণবশতঃ অপারেশন প্রথমবার ব্যর্থ হলে হতাশা আসবে না।
১৮। কোন অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা উচিত এবং একবার অপারেশন সফল না হলে ২/৩ বার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
কোন অপারেশন প্রথমবারে ব্যর্থ হলে অপারেশনের পরিকল্পনা প্রকাশিত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রথমবার সফল না হলেও অপারেশন পরিকল্পনা যাতে প্রকাশিত না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে এবং এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ গােপনীয়তার বিষয়ে ট্রেইন করতে হবে।
১৯। প্রতিটি আক্রমণের শেষে উত্তমরূপে সারসংকলন করা উচিত।
সারসংকলন করলে আমরা ভুলের পুনরাবৃত্তি রােধ করতে পারব এবং আমাদের ক্ষতি কম হবে।
সারসংকলন না করে পরবর্তী আক্রমণ করা উচিত নয়।
২০। যথেষ্ট পরিমাণ বাস্তব কারণ না থাকলে কোন অপারেশন বাতিল করা উচিত নয়। কোন অপারেশন বাতিল করতে হলে কারণসমূহ সংশ্লিষ্টদের ভালভাবে বুঝাতে হবে।
২১। অপারেশনে লক্ষ্যবস্তু সতর্কতার সাথে ঠিক করা উচিত। এমন কোন লক্ষ্যবস্তু ঠিক করা উচিত না যা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। লক্ষ্যবস্তু বারংবার ঠিক করা এবং বাতিল করা উচিত নয়। সর্বদা মনে রাখা উচিত বারংবার ব্যর্থতা হতাশা আনে।
২২। অপারেশনে টুপ এমনভাবে নির্বাচন করা উচিত যাতে ট্রপের কোন ক্ষতি হলে। সাংগঠনিক কাজ ও নিরাপত্তা যথাসম্ভব কম বিঘ্নিত হয়।
২৩। অপারেশন চলাকালীন কেউ আহত বা নিহত হলে তা সামলানাের দায়িত্ব রিজার্ভ বাহিনীর। আক্রমণকারী ট্রপ তার আক্রমণ চালিয়ে যাবে।
২৪। আক্রমণের সময় সর্বদা শ্লোগান ব্যবহার করা উচিত। এতে আমাদের সাহস বাড়ে এবং শত্রুর মনে ভীতি সঞ্চার হয়।
২৫। আক্রমণের পর দখলকৃত এলাকা খুব ভালভাবে খোঁজ করা উচিত যাতে কোন জিনিসপত্র থেকে না যায়।
২৬। আক্রমণের এলাকা, পশ্চাদবর্তী এলাকা, সমন্বিত এলাকা, সমন্বিত কমান্ড, ভৌগলিকভাবে একনাগাড়ে কাজ, শহরে ও গ্রামে ভাল কাজ প্রভৃতি বুদ্ধি প্রয়ােগ করা উচিত।
২৭। আমাদের সামরিক তৎপরতার পর শত্রু যে শ্বেতসন্ত্রাস চালায় তার বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সকল গণসংগ্রাম হয় তাকে আমাদের নেতৃত্বে অবশ্যই সংগঠিত গণসংগ্রামের রূপ দিতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫০৩

এভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে গণসংগ্রামকে সমন্বিত করতে হবে। সশস্ত্র সংগ্রামে সমগ্র জনগণকে অংশগ্রহণ করানাের লক্ষ্য এভাবে অর্জিত হবে।
এভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম সমগ্র জনগণের সংগ্রামে রূপ লাভ করবে যা হবে অপরাজেয়।
কেবলমাত্র এভাবেই জনযুদ্ধ পরিচালনা করা যাবে।
২৮। জনগণের মধ্যে কাজ করতে সক্ষম এবং গণসংগ্রাম পরিচালনা করতে সক্ষম এরূপ পার্টি-কেডার তৈরী করতে হবে।
২৯। শক্রর সামরিক ও প্রশাসনিক শূন্যতার সুযােগ নিয়ে জাতীয় শত্রুর জমি বিতরণের পদক্ষেপ নিতে হবে।
এর ফলে বিপ্লবের আর্থিক ও বৈষয়িক লাভের সম্বন্ধে জনগণ অবহিত হবেন এবং বিপ্লবের প্রতি অতিমাত্রায় আস্থা স্থাপন করবেন।
৩০। আমাদের সামরিক তৎপরতার পর জনগণ আমাদেরকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক গ্রামাঞ্চল থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতে হবে।
শ্রেণী হিসেবে চাঁদা নির্ধারণ করে দিতে হবে। চাঁদা সংগ্রহের জন্য স্থানীয় কর্মীদের নিয়ােগ করতে হবে। এ পদ্ধতিতে স্থানীয়ভাবে আর্থিক স্বাবলম্বী হতে হবে।
৩১। প্রতি অঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহকারী তৈরী করতে হবে।
যেমন অঞ্চল পরিচালকের সাংগঠনিক সহকারী, সামরিক সহকারী ইত্যাদি তৈরী করতে হবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহকারী কেডার তৈরী করলে কোন অবস্থায়ই নেতৃত্বের শূন্যতা থাকবে না।
ফলে আমাদের সংগঠন অপ্রতিহতভাবে বিকাশ লাভ করবে।
পৃষ্ঠা: ৫০৪

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির নবম অধিবেশনের ইশতেহার
(সম্ভবতঃ জুন, ১৯৭৩)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নবম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন সাফল্যজনকভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সভাপতিত্ব করেন।
১) সভায় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অষ্টম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার পর্যালােচনা করা হয় এবং তা সংশােধনী ও সংযােজনীসহ গৃহীত হয়।
অষ্টম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়িত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানাে হয়।
২) সভায় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিজয় অনিবার্য” দলিলটি পর্যালােচনা করা হয়।
ইহা সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার সারসংকলন সম্বলিত একটি ঐতিহাসিক দলিল। এ দলিলের বিষয়বস্তুসমূহ প্রয়ােগের জন্য সর্বস্তরের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। সভায় দলিলটি গৃহীত হয়।
৩) বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ চালাবার জন্য সংগঠনের মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে বা হচ্ছে।
সভায় ইহা পর্যালােচনা করা হয়।
কয়েকটি বিষয়ের উপর শুদ্ধি অভিযান, চক্রবিরােধী সংগ্রাম, গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম, শিক্ষা সম্মেলনের মাধ্যমে কর্মীদের মতাদর্শগত প্রস্তুতি অর্জিত হয়েছে। এ মতাদর্শগত সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়ার জন্য চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করা, কর্মরীতিকে সংশােধন করা এবং কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণের আন্দোলন সমগ্র বর্ষাকালীন আক্রমণের সময় চালিয়ে যেতে হবে।
আমাদের সঠিক রাজনৈতিক লাইন, জনগণের উঁচু চেতনা, তাদের সরকার বিরােধী জঙ্গী মনােভাব, জনগণ থেকে শত্রুর বিচ্ছিন্নতা, শত্রুর নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, আন্তর্জাতিকভাবে ভারত, সােভিয়েটের নিঃসঙ্গতা ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের লাইন, আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যের লাইন, বিভিন্ন। আকৃতির সংশােধনবাদী ও সংস্কারবাদীদের দেউলিয়াত্ব, ব্যাপক প্রচার আমাদের চমৎকার রাজনৈতিক প্রস্তুতির সৃষ্টি করেছে।
উপদলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং তা ধ্বংস করা, এককেন্দ্রকে শক্তিশালী করা, বাসিটা বর্জন টাটকাটা গ্রহণ, সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণ, কর্মীস্বল্পতা দূর করা, জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন, একনাগারে বিস্তৃত অঞ্চলে কাজ, শহরে-গ্রামে কাজ, গােপন কর্মপদ্ধতি, প্রকাশ্য কাজের সাথে গােপন কাজের সমন্বয়, উন্নততর পদ্ধতিতে সংগঠন চালাবার
পৃষ্ঠা: ৫০৫

বুদ্ধিসমূহ চমৎকার প্রস্তুতির সৃষ্টি করেছে।
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলী গঠন, বিভিন্ন। সেকটারে বিভাগ, সামরিক গঠন (Formation), বিভিন্ন অঞ্চলে অভিজ্ঞ সামরিক নেতৃত্বের উপস্থিতি, রণনৈতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন, অস্ত্র এবং গেরিলাদের উপস্থিতি, সশস্ত্র প্রচার টিম ও গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদির মাধ্যমে প্রকাশিত সামরিক চিন্তাধারা সমূহ চমৎকার সামরিক প্রস্তুতির সৃষ্টি করেছে।
৪) পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলীর সভাপতির সার্কুলার, বিশেষ সামরিক অঞ্চলের পরিচালকদের সাথে বৈঠক শেষে কমরেড শাহীন আলম প্রদত্ত সিদ্ধান্ত, ১নং ব্যুরাে পরিচালক কর্তৃক অনুমােদিত ৫ম সিদ্ধান্ত, ১-ক উপব্যুরাের সাথে ১নং ব্যুরাে পরিচালকের বৈঠক শেষে তার প্রদত্ত সিদ্ধান্ত, অর্থনৈতিক অপারেশন সংক্রান্ত কতিপয় পয়েন্ট গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
এগুলাে গৃহীত হয়।
সভায় জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের কর্মসূচী ও ঘােষণাপত্র এবং প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তসমূহ অনুমােদিত হয়।
৫) সভায় সদস্য / প্রার্থী সদস্যপদের জন্য আবেদনের আহ্বান গৃহীত হয়। এ আবেদন পেশের সময়সীমা আরও দুমাস বাড়িয়ে দেওয়া হয় (অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট ১৯৭৩ সাল)।
৬) সভায় নিম্নলিখিত দলিলসমূহ গৃহীত হয়ঃ
– একটি কাজ করার উপায়।
– সমালােচনা-আত্মসমালােচনা সংক্রান্ত কতিপয় পয়েন্ট।
– ঐক্য প্রসঙ্গে (সাইক্লো)। – সংবাদ বুলেটিন (সাইক্লো)।
সর্বহারা পার্টির চাঁদার রশীদ অসম্পূর্ণ। চাঁদার রশীদের বিপরীত পৃষ্ঠায় লেখনীসহ পুনর্মুদ্রণ বা হাতে লিখে সংশােধন করতে হবে।
৭) সশস্ত্র প্রচার টিম সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত একটি ঐতিহাসিক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বলে সর্বত্র সমাদৃত হচ্ছে। সশস্ত্র প্রচার টিমের তৎপরতা পূর্ব বাংলার সর্বত্র চালাবার জন্য আহ্বান জানানাে হচ্ছে।
৮) সভায় সভাপতি কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশ, নিয়ােগ, সিদ্ধান্তসমূহ অনুমােদিত হয়।
৯) সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
১০) পরবর্তী সভার তারিখ ঠিক করে সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে সম্পন্ন হয়।
পৃষ্ঠা: ৫০৬

বিশেষ সামরিক অঞ্চলের সেকটর কমান্ডারদের সাথে বৈঠক শেষে অনুমােদিত সিদ্ধান্তসমূহ
(মধ্য/শেষ, ১৯৭৩)

০ বৈঠকে পূর্ব বাংলার সামরিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করা হয়। (পরিশিষ্ট-১)
এ পরিপ্রেক্ষিতে ভােলায় উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য জনৈক কমরেডকে সমালােচনা করা হয়। (পরিশিষ্ট-২)।
০ আমাদের সামরিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করা হয় এবং ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার মত আমাদের প্রস্তুতি অর্জিত হয়েছে বলে জানা যায়।
১নং সেকটরভূক্ত সকল অঞ্চলে ব্যাপক সামরিক তৎপরতা শুরু করার জন্য আহ্বান জানানাে হচ্ছে। অনুমতি সংক্রান্ত নিয়মাবলী পূর্বের মত।
বর্তমানে আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে সামরিক কাজ।
এটা করার সময় একতরফাবাদী ভুল হতে পারে অর্থাৎ সমগ্র দিক বিবেচনা না করা, গৌণ কাজসমূহ বাদ দেওয়া বা কম গুরুত্ব দেওয়া, শুধু প্রধান কাজ করা প্রভৃতি হতে পারে।
এটা হলে আমাদের আশানুরূপ লাভ হবে না বরঞ্চ ক্ষতি হতে পারে, সমগ্র গৌণ কাজের সফলতা প্রধান কাজের সফলতার সাথে যুক্ত, দ্বিতীয়তঃ সামরিক সফলতা অর্থহীন হবে যদি তার ফলসমূহ গৌণ কাজের মাধ্যমে ধরে রাখতে না পারা যায়।
পেয়ারা বাগান, ২নং ফ্রন্টে সামরিক কাজের মাধ্যমে ধরে রাখা হয়নি। ফলে আশানুরূপ ফল লাভ, কর্মী, স্থানীয় কাজ, শেল্টার, অর্থ অর্জিত হয়নি। এ ভুলের পুনরাবৃত্তি হলে চলবে না।

গৌণ কাজ হচ্ছেঃ
– সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য এলাকা নির্বাচন;
– সাংগঠনিক কাজ।
– প্রচার;
– যােগাযােগ পদ্ধতি;
– অর্থ;
– অনুসন্ধান;
– মানােন্নয়ন সারসংকলন;
– অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ ও সংরক্ষণ;
– ব্যাপক শেল্টার গড়ে তােলা;
পৃষ্ঠা: ৫০৭

সামরিক কাজ প্রধান হলেও মতাদর্শগত কাজকে এর চেয়ে প্রাধান্য দিতে হবে যেহেতু চিন্তা কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে।
এ কারণে সমগ্র কাজে চিন্তাধারাকে পরিবর্তন ও কর্মরীতিকে সংশােধন এবং কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণের মতাদর্শগত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
০ সমগ্র অঞ্চলের মধ্যে আমাদের কাজ, শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের অবস্থা, ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য এক বা একাধিক অঞ্চল আঁকড়ে ধরতে হবে।
০ সাংগঠনিক কাজ পরিচালনার জন্য স্থানীয় সাংগঠনিক টিম/গ্রুপ/কমিটি গড়ে তােলা যারা সাংগঠনিক দায়িত্বাদি পালন করবে, সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়ােজিত কমরেডদের সাথে সাংগঠনিক কাজ সমন্বিত করবে।
সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে বিস্তৃত অঞ্চলের জনগণ পার্টিতে যােগদান করতে ইচ্ছুক হবেন। সাংগঠনিক টিমের মাধ্যমে তাদের সংগঠিত করা।
এরা স্থানীয় প্রচার, যােগাযােগ, অর্থ, মানােন্নয়ন, জাতীয় শত্রু খতম (নিয়মিত বাহিনীর জন্য শেলটার) অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত কমরেডদের জন্য শেলটার ব্যবস্থা, অনুসন্ধান প্রভৃতি কাজ করবে।
যে সকল অঞ্চলে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলা হবে/গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে নেতৃস্থানীয় কর্মী ব্যাপৃত থাকবে সেখানে এ ব্যবস্থা প্রয়ােজন।
সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপ-অঞ্চল, এলাকার কাজ সুসংবদ্ধ করা, সশস্ত্র সংগ্রাম করার জন্য অঞ্চলভুক্ত কম গুরুত্বপুর্ণ এলাকা, সশস্ত্র সংগ্রাম চলবে না এরূপ এলাকা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কর্মী, গেরিলা প্রত্যাহার করা। প্রত্যাহারকৃত এলাকার জন্য কম গুরুত্বপুর্ণ কমরেড নিয়ােগ করা।
– নিয়মিত বাহিনী নিজের মধ্যে ও বাইরে জনগণের মাঝে সাংগঠনিক কাজ করবে।
– প্রচার স্থানীয় বাহিনী ও নিয়মিত বাহিনী উভয়েই পরিচালনা করবে। সশস্ত্র প্রচারটিমের ব্যাপক তৎপরতা চালাতে হবে।
– যােগাযােগ পদ্ধতি উন্নত করা, কুরিয়ার স্থানীয় ও নিয়মিত উভয়ের জন্য নিয়ােগ, যােগাযােগ কেন্দ্র গড়ে তােলা, নিয়মিত কেন্দ্রের সাথে যােগাযােগ রাখা।
কুরিয়ার ও কেন্দ্র একাধিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রতি অঞ্চলের জন্য যােগাযােগ কেন্দ্র ও কুরিয়ার হলে ভাল হয়। কোন অবস্থায়ই যেন নিজেদের মধ্যে ও উচ্চস্তরের সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন না হয়। ওয়ারলেস, ওয়াকিটকির মাধ্যমে আন্তঃসেকটর যােগাযােগ ব্যবস্থা গড়ে তােলা।
– অর্থ ও মূল্যবান সম্পদ, দখলকৃত এবং সহানুভূতিশীল প্রদত্ত অর্থ ও সম্পদ উচ্চস্তরে জমা দেওয়া।
– অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্য অর্জন করা।
– নিয়মিত বাহিনীর ও স্থানীয় কাজের কর্মী ও গেরিলাদের মানােন্নয়ন করা, শিক্ষা সম্মেলন, সারসংকলন সভা প্রভৃতি করা উচিত।
তাদের কার্যাবলী এবং সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে না এরূপ অঞ্চলের কার্যাবলী তদারক করা এবং উপরের কাজগুলাে করার জন্য কর্মী নিয়ােগ করা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা।
এর ফলে সমগ্র সংগঠন এবং সশস্ত্র সংগঠনের উপর যথাযথ নজর থাকবে।
পৃষ্ঠা: ৫০৮

অস্ত্রশস্ত্র দখল করা ও সংরক্ষণ করা উচিত।
– ব্যাপক শেলটার গড়ে তােলা উচিত।’
০ ক. সিরাজ সিকদারের সাথে বিশেষ সামরিক অঞ্চলের সেকটর কামান্ডারদের বৈঠক শেষে ১নং সিদ্ধান্ত সমূহ, ১-ক উপব্যুরাের সাথে ব্যুরাে পরিচালকের বৈঠক শেষে সিদ্ধান্তসমূহ, সামরিক অপারেশন সংক্রান্ত কতিপয় গাইড অবশ্যই প্রয়ােগ করতে হবে।
সামরিক কাজে একতরফাবাদী ভুল যাতে না হয় সে বিষয়ে খুবই সতর্ক হতে হবে। একতরফাবাদী ভুলের ফলে সামরিক কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
উদাহরণস্বরূপ পেয়ারা বাগান থেকে প্রত্যাহার না হলে কি কি লাভ হবে তা বিবেচনা করা হয়নি, এর ফলে প্রত্যাহার না হলে যে সকল ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটত তা ঘটেনি।
নিম্নলিখিত দিকসমূহ এবং তাদের মধ্যকার সম্পর্ক সামরিক কার্যাবলী পরিচালনার সময় খেয়াল রাখতে হবে।
১। জাতীয় শত্রু খতম করা বা শত্রু ঘাঁটি দখল করা বা উভয়ই করা। ২। গৌণ কাজের সাথে সামরিক কাজের সম্পর্ক। ৩। গেরিলা অঞ্চল রাখা না ঘাঁটি গঠনের পক্ষে। ৪। প্রত্যাহার হতে হবে না টিকে থাকতে হবে। ৫। ট্রেনিংস্থল, আক্রমণস্থল, আশ্রয়স্থল। ৬। স্থানীয় কাজ, নিয়মিত বাহিনীর কাজ। ৭। প্রকাশ হয়ে পড়া কর্মী ও অপ্রকাশিত কর্মী। ৮। নেতৃস্থানীয় কর্মী রাখা না রাখা। ৯। বর্ষাকালীন আক্রমণ না শীতকালীন আত্মরক্ষা। ১০। শত্রুর ঘেরাও দমন আর আমাদের আত্মরক্ষার পদ্ধতি। ১১। আভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকতা, জাতীয় শত্রুদের দ্বারা খবর প্রকাশ, শত্রুদের নিকট থেকে আমাদের খবর সংগ্রহ। ১২। অপারেশনে গেরিলা, অস্ত্র হারালে, শেলটার প্রকাশিত হলে কি কি সমস্যা। ১৩। অপারেশনে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গেরিলা নিয়ােগ বা এক অঞ্চল থেকে গেরিলা নিয়ােগ। ১৪। নিয়মিত বাহিনী ও স্থানীয় কাজ। ১৫। স্থানীয় সামরিক কাজ ও অন্যান্য কাজ। ১৬। মতাদর্শগত কাজ, মানােন্নয়ন এবং সামরিক কাজ। ১৭। চিকিৎসার সমস্যা। ১৮। সকল আশ্রয়স্থল ব্যবহার করা বা কিছু রাখা। ১৯। অপারেশনে বর্তমান লাভ, ভবিষ্যত ক্ষতি বা বর্তমান ক্ষতি, ভবিষ্যত লাভ। ২০। আর্থিক লাভ না ক্ষতি, অস্ত্রের লাভ না ক্ষতি, জাতীয় শত্রু খতমে কি কি লাভ-ক্ষতি। ২১। উচ্চস্তর, সমস্তর ও নিম্নস্তরের সাথে যােগাযােগ থাকবে না ব্যাহত হবে। ২২। ক্যাম্প করে থাকা না বিচ্ছিন্ন থাকা। ২৩। এ্যামবুশ করা, কমান্ডাে রেইড করা, না সম্মুখ আক্রমণ করা। ২৪। দিনে আক্রমণ না রাতে আক্রমণ। সন্ধ্যায়, গভীর রাতে না ভাের রাতে আক্রমণ।
পৃষ্ঠা: ৫০৯

২৫। অনুসন্ধান করে আক্রমণ না অনুসন্ধান ছাড়াই আক্রমণ। ২৬। প্রচণ্ড শক্তচাপ ও টিকে থাকা না প্রত্যাহার। ২৭। অস্ত্রাদি রাখা না নিয়ে যাওয়া। ২৮। শ্রমবিভাগ করা না নিজে সব কাজ করা। ২৯। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমস্যা। ৩০। অস্ত্র ও মূল্যবান সম্পদ দখল/সংগ্রহ/সংরক্ষণ এবং সামরিক কাজ। ৩১। প্রচার ও সামরিক কাজ। ৩২। সাংগঠনিক কাজ ও সামরিক কাজ। ৩৩। সার্বক্ষণিক নারীদের নেওয়া বা না নেওয়ার সমস্যা। ৩৪। সবাইকে সার্বক্ষণিক করা না কাউকে কাউকে অসার্বক্ষণিক রাখা।

সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহও গৃহীত হয়ঃ
০ সাব-সেকটর বহির্ভূত সামরিক এলাকা সরাসরি সেকটর কমান্ডার কর্তৃক পরিচালিত হবে।
প্রয়ােজনবােধে এ এলাকাকে অন্য Sub-Sector-এর অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। অথবা বিকাশ করে Sub-Sector করা হবে।
০ বিশেষ সামরিক অঞ্চলের পরিচালকের নিকট সেকটর, সাব-সেকটরের মানচিত্র পাঠাতে হবে।
মানচিত্রে নিম্নলিখিত চিহ্নগুলাে থাকবেঃ
১-লাল-ভাল কাজ। ২-হলুদ-কিছু কিছু কাজ আছে। ৩-সবুজ-লক্ষ্যবস্তু। ৪-চিহ্ন থাকবে না-কাজ নেই, লক্ষ্য নেই। ৫-বিকাশের লক্ষ্য। ৬-শত্রুর অবস্থান, প্রধান পথ, খাল।
মানচিত্র হাতে এঁকে তৈরী করতে হবে (না পাওয়া গেলে) গ্রাম পর্যন্ত। প্রত্যেক কমান্ডারের নিকট নিজ নিজ আওতাধীন ও যে এলাকার সাথে তার সমন্বয় হবে তার মানচিত্র থাকতে হবে।
০ উন্নতমানের যােগাযােগ ব্যবস্থা প্রথম প্রয়ােজন।
দ্বিতীয় প্রয়ােজন উন্নত প্রচার। এরপর প্রয়ােজন সংগঠন গড়ে তােলা। চতুর্থ প্রয়ােজন সশস্ত্র সংগ্রাম।
০ শত্রুকে ভীত সন্ত্রস্ত করার জন্য ডামী (Dummy) অস্ত্র তৈরী করা।
০ প্রতিটি সাব-সেকটরে মেডিক্যাল টিম (Medical team) এবং প্রাথমিক চিকিৎসা (First gid) শিক্ষা দেওয়া, সামরিক ও সাংগঠনিক কাজে অদক্ষ লােকদের নিয়ে মেডিক্যাল টিম করা এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিটি গেরিলা গ্রুপে একজন করে বেয়ার ফুটেড (Bgre-foofed) ডাক্তার অন্তর্ভূক্ত করা।
০ ফিউজ নেই এরকম হ্যান্ড গ্রেনেড সংরক্ষণ করা এবং ব্যবহারবিধি উচ্চস্তর থেকে জেনে নেওয়া।
পৃষ্ঠা: ৫১০

০ মাঝি এবং বিভিন্ন ধরনের নৌকার মাঝে কাজ গুরুত্বসহকারে বিকাশ করা। এজন্য বিশেষ লােক নিয়ােগ করা।
০ লক্ষ্যবস্তুসমূহকে প্রকৃত নামে পরিচয় না দেওয়া। এগুলাের নামকরণ করে দেওয়া (যেমন x, y ইত্যাদি)।
০ শত্রুর ছােটখাট ঘাঁটি দখলের জন্য কমান্ডাে হামলার পদ্ধতি প্রয়ােগ।
০ ক্ষতি হলেও যাতে কাজ বিঘ্নিত না হয় তার ব্যবস্থা রাখা। অর্থাৎ নির্ণায়ক ধরনের কাজ না করা।
০ স্থানীয় প্রশাসন (গ্রাম পরিচালনা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি এবং এর উপরিস্তর) ও গণসংগঠনগুলাে (কৃষক মুক্তি, নারী মুক্তি, ছাত্র-যুব মুক্তি সমিতি ইত্যাদি) গড়ে তােলা।
০ ফ্রন্টের নামে সংগ্রাম চালানাে এবং ফ্রন্ট কমিটিগুলাে গড়ে তােলা।
০ বিশেষ সামরিক অঞ্চলের মধ্যে সাব-সেকটর সমূহ অনুমােদিত হলাে।
০ খাদ্য গ্রহণ, দাওয়াত গ্রহণ, আশ্রয়স্থলে থাকার বিষয়ে গেরিলাদের অতিশয় সতর্ক হতে হবে।
দাওয়াত খেয়ে এবং শক্রর ফাঁদ পাতা আশ্রয়স্থলে আমাদের বহু গেরিলা ও ভাল কর্মী প্রাণ হারিয়েছে।
ঐক্য সংক্রান্ত আলােচনার ক্ষেত্রেও খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে অসতর্ক হওয়ার ফলে আমাদের অনেক ভাল কর্মী প্রাণ হারিয়েছে। ০ সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে শেষ হয়।

পরিশিষ্ট-১
পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির উপর কতিপয় মন্তব্য

বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বিরােধী প্রচণ্ড গণঅসন্তোষের সুযােগে পূর্ব বাংলার কোন কোন স্থানে স্বতঃস্ফূর্ত বা কিছুটা সংগঠিত সশস্ত্র তৎপরতা চলছে।
জনগণের চেতনাকে ব্যবহার করার মত আমাদের নেতৃত্বে ব্যাপক সংগঠন ও সশস্ত্র সংগ্রাম না থাকার ফলেই এগুলাে হচ্ছে। এটা আমাদের দুর্বলতারই প্রকাশ।
যারা এ ধরনের তৎপরতা চালাচ্ছে তাদের কেউ কেউ মুসলিম বাংলার’ গেরিলা বলে দাবী করছে। এরা জাসদের কর্মী। এদের তৎপরতা ও মুসলিম বাংলার বক্তব্য চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করছে জাসদ মার্কিনের দালাল।
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের তৎপরতায় ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই।
সরকার বিরােধী বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা যত বৃদ্ধি পায়, পরিস্থিতি যত গরম ও ঘােলাটে হয়, আলােড়ন বৃদ্ধি পায় ততই আমাদের সুবিধা।
পঁচিশে মার্চের পরবর্তী সময় বিপ্লবের জন্য সুবিধাজনক অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছিল।
পৃষ্ঠা: ৫১১

আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া ব্যক্তি, গ্রুপ, মুসলিম বাংলাওয়ালা জাসদ বা বুর্জোয়াদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, অসংগঠিত সশস্ত্র তৎপরতা টিকে থাকা বা বিজয় অর্জন করতে পারে না।
ভৌগলিকভাবে ভারত পরিবেষ্টিত পূর্ব বাংলায় ভারতবিরােধী তৎপরতায় বৈদেশিক সাহায্য আসা প্রায় অসম্ভব।
কাজেই উপরােক্ত গ্ৰপসমূহের সশস্ত্র তৎপরতা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় মুসলিম বাংলা, জাসদ বা বুর্জোয়াদের পক্ষে ভারত বিরােধী সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে ভারত ও তার দালালদের পরাজিত করে পূর্ব বাংলার ক্ষমতা দখলের ভবিষ্যত অন্ধকার।
কাজেই তাদের সৃষ্ট সশস্ত্র তৎপরতার ব্যর্থতার ফলে তাদের মধ্যকার দেশপ্রেমিকরা আমাদের সাথে যােগদান করবে।
কাজেই ক্ষমতা দখলের জন্য অন্য পথ গ্রহণ করা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। সে পথ হচ্ছে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের পথ।
ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের অংশ হিসেবে সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে ভারত বাংলাদেশ একযােগে সােভিয়েটের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসে বা বাংলাদেশ ভারত-সােভিয়েটের প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে মার্কিনের তাবেদারে পরিণত হয় বা রাষ্ট্রক্ষমতায় মার্কিনীদের স্বার্থরক্ষাকারীদের ভাগ প্রদান করা হয়।
এর অর্থ হচ্ছে ভারত-পূর্ব বাংলায় মার্কিনের শােষণ ও লুণ্ঠন নিশ্চিত করা, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ করা।
এ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হতে পারে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বাধানাে, বাংলাদেশে রায়ট, অভ্যুত্থান, সামরিক কুদেতা ঘটানাে।
এ সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সফল হতে হলে পূর্ব বাংলায় ভারতীয় তাবেদার বাহিনী বিশেষ করে রক্ষীবাহিনী ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত করতে হবে।
এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে ব্যাপক যুদ্ধ। পঁচিশে মার্চের পরবর্তী অবস্থার মত পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি।
কাজেই ব্যাপক যুদ্ধ, রক্তপাত, গােলযােগ ব্যতীত মার্কিনের তাবেদারদের পূর্ব বাংলায় ক্ষমতা দখল করা সম্ভব নয়।
এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হলে পূর্ব বাংলার ব্যাপক অঞ্চলে আমাদের সশস্ত্র তৎপরতা জোরদার হবে, বিরাট অঞ্চল আমাদের দখলকৃত এলাকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
পঁচিশে মার্চের সময় আমাদের ভাল প্রস্তুতি ছিল না তবুও আমাদের বিরাট বিকাশ হয়। বর্তমানে আমাদের চমৎকার প্রস্তুতির কারণে অকল্পনীয় বিকাশ হবে।
মার্কিনীদের ষড়যন্ত্রের এটা হবে উৎকৃষ্ট জবাব। ষড়যন্ত্রের অন্য পন্থা হতে পারে নিম্নরূপ।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নিক্সন-ব্রেজনেভ আলােচনার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় সােভিয়েটমার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা আঁতাতে রূপ লাভ করতে পারে।
এর ফলস্বরূপ পূর্ব বাংলা-ভারতে মার্কিন দালালদের রাষ্ট্রক্ষমতায় ভাগ লাভ, পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশ আঁতাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে মার্কিনীদের সৃষ্ট সশস্ত্র তৎপরতার অবসান হবে, মার্কিনী।
পৃষ্ঠা: ৫১২

দালালদের মুখােশ উন্মোচিত হবে। দেশপ্রেমিক জনগণ ও গেরিলারা তাদের ভাওতা বুঝতে পেরে সরে পড়বে।
তাদের অনেকেই সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত হবে।
মার্কিন, ভারত ও সােভিয়েট আঁতাত শক্রজোটের ঐক্য ও শক্তি বাড়াবে সন্দেহ নেই কিন্তু পূর্ব বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবে না, মুখােশধারী শত্রু থাকবে না। এক্ষেত্রে আমাদের সুবিধা অর্জিত হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিই আন্তর্জাতিক সাহায্য ব্যতিরেকেই জনগণের উপর নির্ভর করে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করতে সক্ষম।
কাজেই সাম্রাজ্যবাদের দালাল ব্যতীত অন্য যারাই সশস্ত্র তৎপরতা চালাক না কেন আজ হােক, কাল হােক তাদেরকে আমাদের সাথে আসতে হবে বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে হবে।
কাজেই আমাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যাপকভাবে শুরু করা এবং তাকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। একইসাথে সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে এইরূপ বিভিন্ন গ্রুপের প্রকৃত চরিত্র বিশেষ করে মুসলিম বাংলাওয়ালাদের (জাসদ) মুখােশ উন্মােচন করা, আমাদের প্রতি তাদের শত্রুতামূলক তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া, তাদের মধ্যকার খাটি দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

নােটঃ
– মার্কিনীরা গণপ্রজাতন্ত্রী উত্তর ইয়েমেনের উৎখাতকৃত সামন্তবাদীদের দ্বারা সৌদি এরাবিয়ার
মাধ্যমে সুদীর্ঘদিন সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়েছে।
-ইরাকের কুর্দ উপজাতীয়দের দ্বারা ইরাক সরকার বিরােধী সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়েছে। মার্কিনের নির্দেশে ইরান এ বিষয়ে সহায়তা করছে। এ সকল ক্ষেত্রে মার্কিনের সহায়তার কারণে সশস্ত্র তৎপরতা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাইরে থেকে সাহায্য প্রদান করার মত সুযােগ মার্কিনের নেই (বার্মা বর্ডার ভারত কর্তৃক বন্ধ করা সম্ভব, সাগর থেকেও সাহায্য করা সম্ভব নয়)। কাজেই পূর্ব বাংলায় সুদীর্ঘদিন মার্কিনের সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা সম্ভব নয়।

পরিশিষ্ট-২
একটি এলাকায় কাজ করার সময় আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের খুঁজে বের করতে হবে, অতীতে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বর্তমানে মিত্র, ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে এদেরকেও খুঁজে বের করতে হবে।
এদের সাথে শক্রদের সংযােগ হলে কি কি অবস্থার উদ্ভব হতে পারে তাও বিবেচনা করতে হবে।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের মিত্রতার সম্পর্কে আনতে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
মিত্রতার সম্পর্কে এলে বা না এলে তারা যাতে কোন অবস্থাতেই (শত্রুর সাথে সংযােগ হােক আর না হােক) আমাদের স্বাধীনতা ও উদ্যোগ ব্যাহত করতে না পারে, ক্ষতি সাধন করতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
কুদুস মােল্লা, নিজাম প্রভৃতি আমাদের হাতের মুঠোয় ছিল। এরাই পরে শক্রদের
পৃষ্ঠা: ৫১৩

সাথে হাত মিলিয়ে আমাদেরকে উৎখাত করে।
এ সম্ভাবনা চিন্তা করে এদের সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে) আমাদের ক্ষতি খুব কম হতাে।
সম্প্রতি ভােলার সিদ্দিক আমাদের উদ্যোগ ও স্বাধীনতা ব্যাহত করছে যদিও এক সময় সে আমাদের হাতের মুঠোয় ছিল।

ব্যবস্থাসমূহঃ
– তাদের দ্বারা কি কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে তা বের করা।
– তাদের প্রকৃত চরিত্র তুলে ধরা।
– তাদের দ্বারা সৃষ্ট পরিস্থিতির মােকাবেলার ব্যবস্থা করা।
– তাদের মাঝে অনুপ্রবেশ করানাে।
– গতিবিধির উপর নজর রাখা।
– বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ব্যবহার বা সৃষ্টি করা যাতে তারা মিত্রতায় না এলে উৎখাত হয়।
– তাদের উদ্দেশ্য ব্যাহত করা।
– তাদের ভেতরকার ঘৃণীতদের খতম করা।
পৃষ্ঠা: ৫১৪

বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ের সারসংকলন
(আগস্ট, ১৯৭৩)

১। বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং আমাদের আত্মগত অবস্থার সাথে পুরােপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ইহা মার্কসবাদী সামরিক রণনীতি ও রণকৌশলের একটি চমৎকার প্রয়ােগ। পার্টি ও বিপ্লবের ইতিহাসে ইহা একটি ঐতিহাসিক, সুদূরপ্রসারী, তাৎপর্যসম্পন্ন এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
২। বাস্তব অবস্থা অনুযায়ী দেখা যায় এ রণনৈতিক আক্রমণের মাধ্যমে নিম্নলিখিত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়িত করা সম্ভবঃ
– অস্ত্র ও অর্থ দখল করা।
– দেশপ্রেমিক বাহিনীর নিয়মিত ও স্থানীয় বাহিনী গড়ে তােলা।
– ব্যাপক প্রচার চালানাে।
– স্থানীয় শত্রুদের উৎখাত করা।
– জনগণকে সংগঠিত করা।
– সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে গণসংগ্রামের সমন্বয় সাধন করা।
– জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম করা।
– গ্রামসমূহ মুক্ত করা।
৩। রণনৈতিক আক্রমণের সফলতার জন্য নেতৃত্বকে জনগণের সাথে সংযােগ করা।
সেকটর কমান্ডারগণ তার আওতাধীন সেকটরের একটি অংশে যেয়ে নিজ পরিচালনায় উপরােক্ত লক্ষ্যগুলাে বাস্তবায়িত করবেন, তার ভিত্তিতে সমস্ত সেকটর পরিচালনা করবেন।
সেকটর কমান্ডার তার আওতাধীন সেকটরের ঐ অংশে যেতে পারেন যেখানে ভাল কাজ রয়েছে অর্থাৎ গেরিলা, কর্মী, শেলটার, অস্ত্র ও লক্ষ্যবস্তু আছে।
সেকটর কমান্ডারের সরাসরি পরিচালনা সহায়ক হবে তখনই যখন সেকটর কমান্ডার ভীরুতা, রক্ষণশীলতা এবং একতরফাবাদ থেকে মুক্ত হবেন। সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা কার্যকরী করার জন্য মার্কসবাদ প্রয়ােগে সক্ষম হবেন।
পক্ষান্তরে সেকটর কমান্ডার ভীতু, রক্ষণশীল ও একতরফাবাদী ও সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কার্যকরী করার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ প্রয়ােগে অক্ষম হলে উপকারের পরিবর্তে অপকার হবে, স্থানীয় উদ্যোগ ব্যাহত হবে, কর্মীদের মনােবল নষ্ট হবে, কোন সামরিক তৎপরতা বিকাশ লাভ করবে না।
৪। যথাযথ পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে গেরিলাদের সাহস থাকলে ফাড়ি বা থানা দখল করা খুবই সহজ।
পৃষ্ঠা: ৫১৫

৫। বর্তমান পর্যায়ে থানা বা ফাড়ি দখলের জন্য কমান্ডাে আক্রমণের রূপই হচ্ছে যথাযথ।
পুলিশ, রক্ষীবাহিনী প্রভৃতিদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় না দিয়ে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে হঠাৎ আক্রমণ বা গুলি বর্ষণ করতে করতে ঢুকে পড়া-এ ধরনের পদ্ধতি হওয়া উচিত আক্রমণের কৌশল।
থানা বা ফাড়ির চারদিকে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ করা উচিত নয়। এতে দখল করা সম্ভব হবে না। উলটো লােক ও অস্ত্র খােয়া যাবে।
৬। আমাদের ও শত্রু অবস্থার যথাযথ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে চিন্তার ক্ষেত্রে সাহস অর্জন করা।
আমরা ন্যায় যুদ্ধ করছি, ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করছি। তারা অন্যায় যুদ্ধ করছে, অন্যায়কে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
জনগণ আমাদের সমর্থন করে। জনগণ তাদের সমর্থন করে না।
আমরা প্রস্তুতি নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করছি। তারা অপ্রস্তুত অবস্থায় হঠাৎ আত্মরক্ষা করছে।
আমরা আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি দৃঢ়। আমরা নিঃস্বার্থভাবে জনগণের জন্য তারা কাজ করছি। পক্ষান্তরে তারা সরকারকে সমর্থন করে না। পেটের দায়ে নিজের জন্য কাজ করছে।
আমাদের মনােবল উঁচু, আমরা সাহসী। তাদের মনােবল নীচু, তারা ভীতু।

এ সকল কারণে অস্ত্র ও লােকবল যদিও তাদের আমাদের চাইতে বেশী, কিন্তু তবুও তারা আমাদের চাইতে নিকৃষ্ট।
৭। লক্ষ্যবস্তুর বিশ্লেষণ এবং ক্রমনির্ধারণঃ
লক্ষ্যবস্তুসমূহকে বিশ্লেষণ করা যায়-আক্রমণ, ঠেকানাে এবং দখলের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে।
উদাহরণস্বরূপ-আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল লৌহজং থানা, সি.আই.অফিস এবং ব্যাংক। এর মাঝে সি.আই. অফিস ছিল ঠেকানাের লক্ষ্যবস্তু এবং থানা ও ব্যাংক ছিল দখলের লক্ষ্যবস্তু।
সার্বিকভাবে তিনটি লক্ষ্যবস্তুর মাঝে প্রধান ছিল থানা। এর কারণ এর অস্তিত্ব ও টিকে থাকার উপর ঠেকানাের ও দখলের দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তুর অস্তিত্ব ও টিকে থাকা নির্ভরশীল।
দখলের লক্ষ্যবস্তুর মাঝে প্রধান ছিল থানা এবং গৌণ বা দ্বিতীয় স্থানে ছিল ব্যাংক।
উপরােক্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী আমরা আমাদের বাহিনীকে প্রধান (১নং) এবং গৌণ (২নং) এবং রিজার্ভ বাহিনীতে ভাগ করি। প্রধান গ্রুপে সাহসী, অভিজ্ঞ এবং ভাল গেরিলা এবং অস্ত্র নেওয়া হয় এবং সবচাইতে শক্তিশালী করা হয়।
বিশেষ অবস্থা মােকাবেলার জন্য রিজার্ভ গ্রুপ গঠন করা হয়।
প্রধান লক্ষ্যবস্তু, আক্রমণ ও দখলের জন্য প্রধান গ্রুপ ও রিজার্ভ এবং ঠেকানাের জন্য গৌণ বা ২নং গ্রুপ নিয়ােগ করা হয়।
পৃষ্ঠা: ৫১৬

প্রধান গ্রুপ থানা দখল করে ব্যাংক দখল করবে বলে স্থির করা হয়। বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে সংযােগের ব্যবস্থা রাখা হয়।
আমাদের অনভিজ্ঞতার কারণে আমরা প্রধান লক্ষ্যবস্তু আক্রমণ ও দখল এবং দ্বিতীয়টি (সি.আই. অফিস) ঠেকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করি।
অর্থাৎ শক্তিশালী একটি শত্রু অবস্থান আক্রমণ ও দখলের পরিকল্পনা করি।
কাজেই প্রাথমিক পর্যায়ে একটি শক্ত অবস্থান আক্রমণ ও দখলের পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। অভিজ্ঞ হয়ে উঠলে একাধিক শত্রু অবস্থান একবারে আক্রমণ ও দখলের পরিকল্পনা করা উচিত।
দখলকৃত দ্রব্যাদি স্থানান্তরের জন্য বহনকারী গ্রুপ গঠন হয়েছিল।
৮। কাজের ক্রমনির্ধারণ করতে হবেঃ
প্রধান কাজ ও গৌণ কাজ নির্ধারণ করতে হবে। একই সময় একতরফাবাদী ভুল এড়াতে হবে। অর্থাৎ প্রধান কাজ করতে যেয়ে গৌণ কাজ বাদ দিলে বা অবহেলা করলে চলবে না।
লৌহজং-এ প্রধান কাজ ছিল থানা দখল, দ্বিতীয় গৌণ কাজ ছিল সি.আই’র অফিস ঠেকানাে, তৃতীয় গৌণ কাজ ছিল ব্যাংক দখল।
প্রধান কাজের জন্য প্রধান গ্রুপ ও রিজার্ভ নিয়ােগ করা হয়। দ্বিতীয় কাজের জন্য দ্বিতীয় গ্রুপ নিয়ােগ করা হয়। তৃতীয়ের জন্য প্রধান বাহিনী নিয়ােগ করা হয়।
প্রধান কাজ সাফল্যজনকভাবে হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় কাজ প্রধান হয়ে আসে। দ্বিতীয় কাজ সাফল্যজনকভাবে হওয়ার ফলে তৃতীয় কাজ এবং দখলের দিক দিয়ে দ্বিতীয় কাজ প্রধান হয় অর্থাৎ ব্যাংক দখল করা প্রধান হয়।
এভাবে পর্যায়ক্রমে প্রধান কাজের পরে গৌণ কাজগুলাে প্রধান হয়।
প্রধান কাজ হওয়ার পর দখলকৃত অস্ত্র ও গােলাবারুদ সরানাের পদক্ষেপ নেওয়া। হয়। কারণ দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাজে সেগুলাে ব্যবহারের প্রয়ােজন হয়নি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় কাজে প্রয়ােজন হলে সেগুলাে ব্যবহার করা হতাে।
প্রধান কাজের সময় গৌণ কাজগুলাে বাদ দেয়া হয়নি যে কারণে আমাদের আর্থিক লাভ হয় এবং আর্থিক সংকট অনেকটা কমে।
প্রধান কাজের সময় গৌণ কাজ ব্যাংক দখল বাদ দিলে আমাদের লাভ অনেক কম। হতাে বা দ্বিতীয় কাজ বাদ দিলে শত্রু সেখান থেকে এগিয়ে এসে থানার সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ করলে আমাদের অসুবিধা হতাে।
এভাবে একতরফাবাদ এড়ানাে হয়।
৯। আক্রমণের সময় সামগ্রিক পরিচালক রিজার্ভ বাহিনীতে বা কাছাকাছি অবস্থান। করবে যাতে কোন পরিবর্তিত পরিস্থিতির যথাযথ সমাধান প্রদান করা যায়।
১০। সামগ্রিক অপারেশনেও আমাদের কাজগুলাে নির্ধারণ করা, প্রধান ও গৌণ কাজ ঠিক করা, পর্যায়ক্রমে কোনটার পর কোনটা প্রধান হবে তা নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়ােজন।
সাধারণতঃ একটি অপারেশনে নিম্নলিখিত কাজগুলাে করতে হয়ঃ
– অনুসন্ধান (আমাদের ও শত্রুদের)।
– পরিকল্পনা প্রণয়ন, পরামর্শ গ্রহণ, অনুমােদন (উচ্চ ও সমস্তরের)।
– পরিকল্পনাভিত্তিক অস্ত্র, গেরিলা, যানবাহন সংগ্রহ, টুপ গঠন।
পৃষ্ঠা: ৫১৭

– পরিকল্পনাভিত্তিক মতাদর্শগত ও সামরিক ট্রেনিং।
– আক্রমণের জন্য সমাবেশ ও রওয়ানা হওয়া।
– শেষ মুহূর্তের অনুসন্ধান ও অনুমােদন।
– আক্রমণ।
– দখলকৃত দ্রব্যাদি, আহত ও নিহত এবং গ্রেফতারকৃতদের সরানাে।
– গেরিলাদের সরে আসা।
– নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ, দখলকৃত দ্রব্যাদি, আহত, নিহত ও গ্রেফতারকৃতদের নিরাপদে রাখা।
– সারসংকলন।
এ সকল কাজ একটি একটি করে প্রধান হয়ে আসবে, এগুলাের যেকোন একটি সুষ্ঠুভাবে না হলে সামগ্রিক অপারেশন ঠিক হবে না।
উদাহরণস্বরূপ, বৈদ্যের বাজারে অপারেশনে দখলকৃত দ্রব্যাদি সরানাে এবং গেরিলাদের সরে আসার পরিকল্পনা যথাযথ না হওয়ায় অপারেশন দখল পর্যায় পর্যন্ত। সফল হওয়া সত্ত্বেও অপারেশন ব্যর্থ হয়, দখলকৃত দ্রব্যাদি খােয়া যায়, কয়েকজন গেরিলা প্রাণ হারায়।
অন্য এক ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তের অনুসন্ধান ও অনুমতি প্রদানের পর্যায়ে ঠিক না হওয়ায় নিশ্চিত অপারেশন হয়নি।
আক্রমণের জন্য সমাবেশ ও রওয়ানা হওয়ার প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন গ্রুপ, অস্ত্র ও যানবাহনের যথাযথ সমন্বয় না হওয়ায় অনেক অপারেশন হয়নি।
১১। অঞ্চলের অপারেশনের জন্য আন্তঃসেকটর বা সাবসেকটর সমন্বয় প্রয়ােজন।
ইতিমধ্যেই এ ধরনের আন্তঃসেকটর সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে অস্ত্র, গেরিলা, যানবাহন, অর্থ, অনুসন্ধান, মেনুভারিং প্রভৃতি বিষয়ে পরস্পর সহযােগিতা করা যায়।
এটা আরাে সুবিধাজনক হবে ওয়্যারলেস কানেকশান গড়ে উঠলে।
১২। সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার কতকগুলাে অঞ্চলে আমরা লড়াই এবং পশ্চাদভূমি হিসেবে ঠিক করেছি তেমন একটি সেকটরেও লড়াই এবং পশ্চাদভূমির অঞ্চল ঠিক করে কাজ করতে হবে যাতে আশ্রয়, শেলটার এবং টিকে থাকার সমস্যা সৃষ্টি না হয়।
১৩। আমাদের ও শত্রুদের অবস্থার বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে সাহসী ছােট কমান্ডাে টুপ (গেরিলা গ্রুপ) সুবিধাজনক।
ছােট গ্রুপকে পরিচালনা করা, আশ্রয় দেওয়া, গােপনে সমাবেশ করা, ট্রেনিং প্রদান করা, চলাফেরা, অতর্কিতে আক্রমণ করা, সরে পড়া প্রভৃতি ক্ষেত্রে সুবিধাজনক।
১৪। এক অঞ্চলে বিরাটাকার গেরিলা যুদ্ধ করার পরিবর্তে বর্তমানে গেরিলাযুদ্ধ বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার সার্বিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
গেরিলা যুদ্ধের বিস্তৃতিই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।
বিস্তৃত অঞ্চলে গেরিলাযুদ্ধ ছড়িয়ে দিলে শত্ৰুচাপ এক অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হওয়ার পরিবর্তে ছড়িয়ে পড়বে, আমাদের স্থানীয় গেরিলারা সক্রিয় হবে, পার্টির বিকাশ বৃদ্ধি পাবে। জনগণের গণঅসন্তোষকে কাজে লাগানাে যাবে। বিভিন্ন অঞ্চলে অস্ত্র ও অর্থের অভাব কমে যাবে।
গেরিলা যুদ্ধকে বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সাহসী গেরিলা, কমান্ডার ও পরিচালক নিয়ে ভ্রাম্যমান কমান্ডাে ইউনিট গঠন করা। এরা বিভিন্ন
পৃষ্ঠা: ৫১৮

অঞ্চলে স্থানীয় গেরিলাদের নিয়ে অপারেশন করবে। দখলকৃত অস্ত্র দিয়ে আসবে। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় গেরিলারা ট্রেইন হবে, অস্ত্র ব্যাপকভাবে স্থানান্তর প্রয়ােজন হবে না।
১৫। সংগঠন থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন সামরিক দলিল, ক. সিরাজ সিকদার প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমূহ প্রয়ােগ প্রয়ােজন।
১৬। জনগণের লড়াইয়ের মনােবল, গেরিলাদের লড়াইয়ের আকাক্সক্ষা ও উদ্যোগকে সাহসের সাথে কাজে লাগাতে হবে, রণনৈতিক আক্রমণের লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে হবে।
১৭। লৌহজং ও জাবড়ার অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে এবং তা প্রয়ােগ করতে হবে। ইতিমধ্যেই ময়মনসিংহ ও বরিশালে এ অভিজ্ঞতা প্রয়ােগের সুফল অর্জিত হয়েছে।
লৌহজং ও জাবড়ায় আক্রমণের যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে তা ক্রমাগত সফলতা আনয়ন করছে।
পক্ষান্তরে অন্যান্য বিচ্ছিন্ন গ্রুপসমূহ অবস্থান নিয়ে গুলি বর্ষণ করে। ফলে তারা দখল করতে ব্যর্থ হয়।
কাজেই আমাদের ইতিবাচক ও অন্যান্যদের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে, সফলতাকে নিশ্চিত করতে হবে।
১৮। উপরােক্ত পয়েন্টসমূহ এবং নিজেদের বিচক্ষণতার সাহায্যে আত্মগত ও বস্তুগত অবস্থার নিয়মবিধি আবিষ্কার করতে হবে, আত্মগত ও বস্তুগতের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে, অপারেশনের সফলতা নিশ্চিত করতে হবে।
১৯। বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের পরিকল্পনা ও তার বাস্তব প্রয়ােগ আমাদের চমৎকার অবস্থার সৃষ্টি করেছে এবং বিরাটাকার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বিশেষ করে নিয়মিত বাহিনীর সাহায্যে আন্তঃআঞ্চলিক সমন্বিত গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান, দেশীয়-আন্তর্জাতিক বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির সম্ভাবনার উদ্ভব হয়েছে।
জনগণ, সহানুভূতিশীল, কর্মী ও গেরিলাদের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং আশার সৃষ্টি হয়েছে।
বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ সফল করার জন্য আমাদেরকে কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের বিজয়-দীর্ঘজীবী হােক!
সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলীর দপ্তর,
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী।
পৃষ্ঠা: ৫১৯

পার্টির অভ্যন্তরে শাস্তি প্রদান সম্পর্কে সার্কুলার
(দ্বিতীয় সপ্তাহ, আগস্ট, ১৯৭৩)

নিম্নলিখিত অপরাধসমূহের যে কোন একটি প্রমাণিত হলে অপরাধীকে চরম শাস্তি প্রদান করা যাবে। এ ধারা সাব সেকটর কমান্ডারগণ কার্যকরী করতে পারবেন নিম্নভাবে।
– অপরাধ সংক্রান্ত অনুসন্ধান, সাক্ষ্য গ্রহণ, প্রমাণ। – সম্ভব হলে উচ্চস্তরের অনুমতি নেয়া।
– যে ক্ষেত্রে হাতছাড়া হতে পারে সেই ক্ষেত্রে উচ্চস্তরের অনুমতির প্রয়ােজন নেই, তবে এ বিষয়ে অবশ্যই যথাশীঘ্র সম্ভব উচ্চস্তরের অনুমােদন নিতে হবে।
– যদি অপরাধী না পালিয়ে আমাদের হেফাজতে থাকতে রাজী হয়ে উচ্চস্তরের। নিকট আপীল করে (পালিয়ে গেলে গুরুতর নিরাপত্তাজনিত সমস্যা রয়েছে এইরূপ অপরাধী, হেফাজতে রাখার মতাে বাস্তব অবস্থা না থাকলে এ ধারা প্রযােজ্য নয়) তবে চরম শাস্তি না দিয়ে উচ্চস্তরের নিকট বিষয়টি পাঠাতে হবে (অপরাধীকে নিরাপদ হেফাজতে রেখে) এ ক্ষেত্রে উচ্চস্তরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

অপরাধসমূহঃ ১. পার্টির অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্য আত্মসাৎ। ২. পার্টির অস্ত্র নিয়ে ডাকাতি করা। ৩. নারী ধর্ষণ ও অপহরণ। ৪. পার্টির অস্ত্র আত্মসাৎ। ৫. শত্রুর চর হয়ে কাজ করা এবং বিশ্বাসঘাতকতা করা। ৬. ধরিয়ে দেওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে খতম করা বা করানাে। ৭. চক্রের অপরাধসমূহ।
পৃষ্ঠা: ৫২০

“গণযুদ্ধের পটভূমি” শীর্ষক কবিতা সংকলনের ভূমিকা
(অক্টোবর, ১৯৭৩)

সাহিত্য-শিল্পকলা মতাদর্শগত ক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত। ইহা মানুষের চিন্তাধারাকে প্রভাবান্বিত করে এবং কর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে।
বিপ্লব আর প্রতিবিপ্লব উভয়ের জন্য প্রথম প্রয়ােজন জনমত সৃষ্টি করা।
প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প-সংস্কৃতি প্রতিবিপ্লব ঘটানাে এবং প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে।
প্রতিক্রিয়াশীল বিষয়বস্তু ও উচ্চমানের শিল্পরূপের সাহিত্য-সংস্কৃতি সবচাইতে বিপদজনক। রবীন্দ্র সাহিত্য তার প্রমাণ।
পূর্ব বাংলায় সর্বহারার দৃষ্টিকোণ দিয়ে সঠিক এবং উচ্চমানের শিল্পরূপ সম্পন্ন জাতীয় গণতান্ত্রিক শিল্প-সংস্কৃতি (সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী শিল্প-সংস্কৃতি) গড়ে উঠেনি।
এ ধরনের শিল্প-সংস্কৃতি গড়ে তােলার সময় আমাদেরকে শুধু শ্রেণী সংগ্রামকে তুলে ধরলেই চলবে না, কারণ তা বুর্জোয়া এমন কি বড় বুর্জোয়াদের নিকটও গ্রহণীয়।
শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব (বর্তমানে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব), ইহা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি, এর নেতৃত্বে সশস্ত্র ও অন্যান্য সংগ্রাম এবং সর্বহারাদের শ্রেণী সংগ্রাম পরিচালনার বৈজ্ঞানিক তাত্ত্বিক ভিত্তি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা ও তার প্রয়ােগ-অনুশীলন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হতে হবে। তখনই এ ধরনের শিল্প-সংস্কৃতির বিষয়বস্তু সর্বহারার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে সঠিক বলে বিবেচিত হবে।
এভাবে সুকান্তের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে হবে।
সাহিত্য-সংস্কৃতিকে শুধু বিষয়বস্তুর দিক দিয়েই ঠিক হলে চলবে না। ব্যাপক কেডার, সৈনিক, সহানুভূতিশীল, সমর্থক এবং জনগণ কর্তৃক গ্রহণীয় ও সমাদৃত এরূপ শিল্পরূপ সম্পন্ন হতে হবে।
এভাবে আধুনিক সাহিত্য-কবিতা-শিল্পকলার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে হবে। বিপ্লবী বিষয়বস্তু ও উচ্চমানের শিল্পরূপের (জনগণ কর্তৃক গ্রহণীয় ও সমাদৃত) একাত্মতা সম্পন্ন সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি পূর্ব বাংলার বিপ্লবে মতাদর্শগত প্রস্তুতির সৃষ্টি করবে, বিপ্লবের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করবে এবং জনগণকে বিপ্লবী কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে।
বিপ্লবী শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে চীন-ইন্দোনেশিয়া-ভারত এবং অন্যান্য দেশে ভ্রাতৃপ্রতিম কমরেডগণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
আমাদেরকেও পূর্ব বাংলায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হচ্ছে-কারণ বাংলা সাহিত্যে আমাদের সঠিক পথ দেখাবার মত কোন উত্তরসূরী নেই।
পৃষ্ঠা: ৫২১

এ কারণে আমাদের বিষয়বস্তু ও শিল্পরূপে দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। কিন্তু আমরা গুরত্ব দেবাে বিষয়বস্তু অর্থাৎ রাজনীতিতে, আর অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠবে নিখুঁত শিল্পরূপ।
দেশের এবং বিদেশের অতীত-বর্তমান সাহিত্য শিল্পকলাকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং সৃজনশীলভাবে সেগুলাে থেকে শিখতে হবে, অন্ধভাবে নয়।
সর্বহারার দৃষ্টিকোণ দিয়ে সঠিক, একই সাথে আমাদের কেডার, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক এবং জনগণ গ্রহণ করবে, বিপ্লবে প্রেরণা পান-এরূপ শিল্পসাহিত্য সার্থক বলে বিবেচিত হবে। কাজেই শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে জনগণের সেবার মনােভাবের সার্থক প্রয়ােগ হবে সর্বহারার দৃষ্টিকোণ দিয়ে সঠিক, জনগণের গ্রহণীয় এবং প্রেরণাদায়ক শিল্প-সাহিত্য গড়ে তােলা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি যেমন রচনা করছে বিপ্লবী কাজের নূতন ইতিহাস, বিপ্লবী প্রবন্ধের নূতন রীতি, তেমনি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সত্যিকার বিপ্লবী এবং নিখুঁত শিল্পরূপ সম্পন্ন জনগণ সমাদৃত শিল্প-সাহিত্যের সম্পূর্ণ নূতন পথ গড়ে তােলার।
আমাদের এ প্রচেষ্টা তখনই সফল হবে যখন কমরেড, গেরিলা-জনগণের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে আমাদের গান, কবিতা, তাদের আসরে আলােচিত হবে আমাদের শিল্পসাহিত্য, আত্মত্যাগে তাদের করবে উদ্বুদ্ধ, পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লব করা, পুরানাে দুনিয়া ভেঙ্গে চুরমার করা, বিপ্লবী রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখার পক্ষে জনগণকে মতাদর্শগতভাবে তৈরী করবে, তাদেরকে বিপ্লবী কর্মে উদ্বুদ্ধ করবে। তখনই। সার্থক হবে সাহিত্য-শিল্পকলার ক্ষেত্রে আমাদের জনগণের সেবার মনােভাব।
পৃষ্ঠা: ৫২২

সুকান্ত প্রসঙ্গে
(অক্টোবর, ১৯৭৩)
[এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যটি কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণীত “গণযুদ্ধের পটভূমি” শীর্ষক কবিতা সংকলনের ভূমিকার পরে যুক্ত করা হয়েছিল। কবিতা সংকলনটি অক্টোবর, ‘৭৩-এ প্রকাশিত হয় -প্রকাশক।]

সুকান্তের কবিতা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল শেখ মুজিব পাঠ করে, প্রশংসা করে। সংশােধনবাদীরাও একে সমাদর করে। এর কারণ শ্রেণী সংগ্রাম বুর্জোয়া এমনকি বড় বুর্জোয়াদের নিকটও গ্রহণীয় (লেনিন)।
সুকান্ত শ্রেণী সংগ্রামের কথাই বলেছেন। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি সর্বহারার একনায়কত্ব (বর্তমানে ও তখন জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব যা সর্বহারার একনায়কত্বের একটি রূপ) প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি তার কবিতায় নেই।
সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রাম পরিচালনার বৈজ্ঞানিক তাত্ত্বিক ভিত্তি মার্কসবাদলেনিনবাদ (বর্তমানে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা) এবং শ্রেণী সংগ্রাম পরিচালনার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি তার কবিতায় অনুপস্থিত।
জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র এবং অন্যান্য সংগ্রামের বিপ্লবী অনুশীলন সুকান্তের কবিতায় প্রতিফলিত হয়নি।
এগুলাে হচ্ছে সুকান্তের সীমাবদ্ধতা। এ কারণে বুর্জোয়া এমনকি বড় বুর্জোয়াদের নিকটও সুকান্ত গ্রহণীয়। পূর্ব বাংলার ইন্দু সাহার ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযােজ্য।

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দশম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার
(শেষার্ধ, ১৯৭৩)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দশম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন সাফল্যজনকভাবে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।
সভায় “মহান বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা। হয়। বর্তমানের দায়িত্ব এবং ভবিষ্যতে শক্রর রণনৈতিক আক্রমণ ও আমাদের। রণনৈতিক আত্মরক্ষার দিকসমুহ নির্ণয় করা হয়।
১. ‘মহান বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ সংক্রান্তঃ
– বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির একটি ঐতিহাসিক সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পন্ন, যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।
– এ সিদ্ধান্ত আমাদের আত্মগত অবস্থা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বস্তুগত অবস্থার সাথে পুরােপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, এ কারণে এ সিদ্ধান্তের লক্ষ্যসমূহ সাফল্যের সাথে বাস্তবায়িত করা সম্ভবপর হয়।
– এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সংগঠনে পরবর্তী বিকাশের জন্য একান্ত প্রয়ােজন ছিল।
– বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন মার্কসবাদী সামরিক লাইন পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থায় প্রয়ােগের চমৎকার নিদর্শন।
– এ পরিকল্পনা এবং এর সাফল্যজনক বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্টি বিপ্লবী যুদ্ধের নিয়মবিধি আরাে অধিকতর রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
– এ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন আরাে প্রমাণ করছে যে পার্টি তত্ত্বগত এবং অনুশীলনের ক্ষেত্রে সামরিক লাইনে পূর্বেকার বহু সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠেছে এবং নতুন সমস্যার যথাযথ সমাধান করেছে।
– একনাগাড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে কাজ।
– শহরে ও গ্রামে ভাল কাজ।
– কাজের প্রধান দিক গ্রাম।
– আক্রমণের এলাকা ও পশ্চাদবর্তী এলাকা (Rear Ared)।
– বিপ্লবী সাহসকে প্রাধান্য দিয়ে শত্রুর ঘাঁটি দখল। এভাবে বিপ্লবী যুদ্ধকে নতুন পর্যায়ে উন্নীত করা (জাতীয় শত্রু খতম থেকে শত্রুর অবস্থান আক্রমণ ও দখলের পর্যায়) এবং পুরােপুরি নতুন রণকৌশলের সৃষ্টি করা।
—অর্থ, অস্ত্র সমস্যার সমাধান করা।
– ব্যাপকভাবে কর্মী সংগ্রহ করা।
– দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা।
পৃষ্ঠা: ৫২৪

– তথাকথিত মুসলিম বাংলা এবং জাসদের প্রভাবকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা।
– পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সত্যিকার সর্বহারা বিপ্লবীদের নেতৃত্ব সৃষ্টির পথে বিরাট অগ্রগতি সাধন করা।
– সুসংবদ্ধকরণের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামের সম্পর্ক আবিষ্কার করা।
– পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনগণের মাঝে ব্যাপক প্রচার এবং গণভিত্তিক পার্টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট অগ্রগতি সাধন।
– পার্টি ও নেতৃত্বের প্রতি কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক ও জনগণের দৃঢ়তর আস্থা সৃষ্টি।
– বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্রের অবশিষ্টাংশ এবং বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের প্রতি দাঁতভাঙ্গা জবাব প্রদান করা।
– সংশােধনবাদীদের প্রভাব কাটিয়ে ফেলা এবং তাদের পুরােপুরি ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করা।
– আগামী সংগ্রামের জন্য বিরাট অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা।
– বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্টি উপরােক্ত সাফল্যসমুহ অর্জন করেছে।
এগুলাে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে পার্টির সঠিক লাইন এবং তা বাস্তবায়নে কর্মীদের দৃঢ় প্রচেষ্টা, পার্টির মধ্যকার কঠোর শৃংখলা ও লৌহকঠিন ঐক্য, পার্টির মধ্যকার এককেন্দ ও তার প্রতি কর্মীদের অবিচল আস্থা, উপদলবাদ ও বাম এবং ডান বিচ্যুতি বিরােধী পার্টির দৃঢ় নীতি ভিত্তিক সংগ্রাম, অসর্বহারা মতাদর্শের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান এবং এর প্রক্রিয়ায় সুসংবদ্ধকরণের মাধ্যমে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে প্রদত্ত কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিতে (১৯৭৩ সালের ৩রা জুন) যথাযথই উল্লেখ করা হয়েছিল “১৯৭২ ও ১৯৭৩ সাল এ দু’বছর পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিকাশের সুবর্ণকাল।”
পার্টি যে সকল ভবিষ্যতবাণী করেছে তা সকলই বাস্তবায়িত হয়েছে, এভাবে সঠিক ভবিষ্যতদ্রষ্টা হিসেবে পার্টি অধিকতর আস্থা অর্জন করেছে।
২. আমাদের সফলতা বিরাট, কিন্তু সফলতায় আত্মতুষ্টি এলে চলবে না, অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও মাতব্বরীর বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে, বিনয়ী ও পরিশ্রমী হতে হবে, পার্টির লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। বােকা বুড়াের মত লেগে থাকতে হবে। শত্রুকে ছােট করে দেখা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দেখা, অতি আশাবাদী মূল্যায়ণ প্রভৃতি থেকে হটকারী কার্যকলাপ করা, অসতর্কতা প্রভৃতি অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
রণনীতিগতভাবে শত্রুকে কাগুজে বাঘ হিসেবে দেখতে হবে, কিন্তু বাস্তব লড়াইয়ে তাকে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।
শত্রুর শীতকালীন রণনৈতিক আক্রমণজনিত অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে হবে। আরাে বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতি আগামী বর্ষার পূর্বেই সম্পন্ন করতে হবে।
বর্ষাকালের তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে। অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কেডারদের মানােন্নয়ন ও রক্ষা করতে হবে।
অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কেডার যারা নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে সক্ষম, এরূপ কেডাররাই হচ্ছে সংগঠনের জন্য নির্ণায়ক।
অর্থ না থাকলে বা যে কোন ধরনের প্রতিকূল অবস্থার উদ্ভব হলেও নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে সক্ষম এরূপ কেডার থাকলে পার্টির পক্ষে সকল বাধা-বিঘ্ন
পৃষ্ঠা: ৫২৫

অতিক্রম করা বা সবকিছু গড়ে তােলা সম্ভব।
৩. শত্রুর শীতকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ও আমাদের রণনৈতিক আত্মরক্ষা সংক্রান্তঃ
– শত্রু শীতকালীন আক্রমণ চালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে, ইতিমধ্যেই কোথাও কোথাও আক্রমণ শুরু করেছে, অচিরেই তারা সমগ্র পূর্ব বাংলায় শুরু করবে।
– শক্রর রণনৈতিক আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামসমূহ থেকে আমাদের উৎখাত করা, দালালদের পুনর্বাসন করা, তাদের প্রশাসন কায়েম করা।
– শক্রর রণনৈতিক আক্রমণের সময় আমাদের রণনৈতিক আত্মরক্ষার লাইন গ্রহণ করতে হবে।
এই আত্মরক্ষা হবে সক্রিয় আত্মরক্ষা অর্থাৎ নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতিতে শত্রুকে প্রতিআক্রমণ করা। নিষ্ক্রিয় প্রতিরক্ষা পলায়নবাদ বা সবজায়গায় শত্রুকে ঠেকাবার পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজেদেরকে ধ্বংস করা নয়।
– রণনৈতিক আত্মরক্ষার সময় আমাদেরকে সুসংবদ্ধকরণের কাজ করতে হবে। বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে, যে সকল স্থানে। সুসংবদ্ধকরণের কাজ ভাল ছিল সেখানে সশস্ত্র সংগ্রামের কাজও ভাল বিকাশ লাভ করেছে।
পক্ষান্তরে যে সকল স্থানে সুসংবদ্ধকরণ ভাল ছিল না, সে সকল স্থানে সশস্ত্র সংগ্রামও ভাল বিকাশ লাভ করেনি।
কাজেই আগামী বর্ষায় আরাে বিরাটাকারে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে যদি সংগঠনকে ভালভাবে সুসংবদ্ধ করা যায়।
অতীতের সুসংবদ্ধকরণের ফলে আমরা যে বিকাশের লক্ষ্য অর্জন করেছি, পুনরায় এ বিকাশকে সুসংবদ্ধকরণ না করে অব্যাহত গতিতে বিকাশ চালিয়ে গেলে লাভের পরিবর্তে আমাদের ক্ষতি হবে, বিকাশের তুলনায় মান কম হবে, শৃংখলা দুর্বল হবে, ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের বিভিন্ন প্রকাশ প্রাধান্য লাভ করবে এবং সুফল কুফলে রূপান্তরিত হবে এবং সংগঠন বিপর্যয়গ্রস্ত হবে।
আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রতি পদক্ষেপেই সুসংবদ্ধ করে অগ্রসর হওয়া, তাহলে আমাদেরকে কেউই ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না।
এই রণনৈতিক আত্মরক্ষার সময় একতরফাবাদী ভুল এড়াতে হবে অর্থাৎ শুধুই আত্মরক্ষা আক্রমণ নয়, শুধুই আক্রমণ আত্মরক্ষা নয়, বা শুধুই মানােন্নয়ন লড়াই নয় অথবা শুধুই লড়াই মানােন্নয়ন নয়, এ ধরনের ঝোককে এড়াতে হবে।
সুসংবদ্ধকরণ ও লড়াইয়ের জন্য এলাকা, কর্মী এমনভাবে ভাগ করতে হবে যাতে সশস্ত্র সংগ্রাম বা মানােন্নয়ন কোনটাই পুরােপুরি ব্যাহত না হয়।
উদাহরণস্বরূপঃ
একটি অঞ্চলের মধ্যকার এক উপঅঞ্চলে মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণ চলল, তখন অন্য উপঅঞ্চলে যেখানে সুসংবদ্ধকরণ অপেক্ষাকৃত ভাল সেখানে লড়াই চলল।
অনুরূপভাবে কর্মীদের মধ্যকার এক অংশের মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণ চলল, আরেক অংশ লড়াই ও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করল।
এভাবে পর্যায়ক্রমে সকল অঞ্চল ও কর্মীদের মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণ করা এবং একই সাথে লড়াইও চালিয়ে যাওয়া।
– এ সময়ে জিনিস-পত্র নিরাপদে রাখতে হবে;
– কর্মীদের নিরাপদে রাখতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫২৬

কর্মী স্থানান্তর ও দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করতে হবে (প্রয়ােজন মত)।
৪. পার্টির সাধারণ লাইন হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, জনগণকে জাগরিত ও সংগঠিত করা, পার্টির বিকাশ সাধন ও সুসংবদ্ধকরণ করা।
এ সাধারণ লাইন প্রতিটি কর্মীর অবশ্যই জানতে হবে, তা হলে কর্মীরা ভবিষ্যতের দিশা হারাবেন না, একই সঙ্গে পার্টির বিশেষ লাইনকেও রপ্ত করতে হবে, তাহলে। বর্তমানের কাজ নির্ভুলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
এভাবে আমরা বাস্তবনিষ্ঠ ও দূরদর্শী হতে পারব। পার্টির বিশেষ লাইন হচ্ছে।
– পর্যায়ক্রমে সকল অঞ্চল ও কর্মীদের মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধ করা, এভাবে সমগ্র পার্টিকে সুসংবদ্ধ করা;
– সুসংবদ্ধকরণের সাথে সাথে সামরিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া;
– আমাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাসমূহ সংগঠিত করা;
– গণসংগ্রাম পরিচালনা করা।
৫. গণসংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের যে শূন্যতা রয়েছে তা যদি আমরা পূরণ করতে সক্ষম হই তবে
– আমরা জনগণের সাথে পুরােপুরি একাত্ম হতে পারব; জনগণকে ব্যাপকভাবে আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হবাে;
জনগণকে সংগঠিত ও জাগরিত করতে হলে প্রকাশ্য রাজনৈতিক পার্টির প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে বলে অনেকের মাঝে যে ধারণা রয়েছে তা দূর করা। এভাবে আমাদের নেতৃত্বে পরিচালিত নয় এরূপ প্রকাশ্য সংগঠনসমূহের অস্তিত্বের বিলােপ করা।
– আমাদের বহু কেডারকে কাজে লাগানাে;
প্রভৃতি লক্ষ্য অর্জন করতে আমরা সক্ষম হবাে।
৬. সশস্ত্র সংগ্রাম, গণসংগ্রাম এবং মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের লক্ষ্যসমূহ আমরা যদি অর্জন করতে পারি, তবে আমরা বিপ্লবের মূল পথে উপনীত হতে পারব। এর পরে প্রয়ােজন হবে শুধু সেই পথ ধরে এগিয়ে চলা।
৭. শীতকালীন রণনৈতিক আত্মরক্ষার সময় নিম্নলিখিত অতিরিক্ত লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে হবে।
– পরিকল্পিতভাবে যে সকল স্থানে কাজ হয়নি সেখানে কর্মী প্রেরণ;
– ভাল পরিচালক, কেডার ও কমান্ডার গড়ে তােলা;
– শক্রর যােগাযােগ পথের দুই পাশে ভাল কাজ গড়ে তােলা;
– সকল ক্ষেত্রে পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়া;
– ভৌগলিক ফাকসমূহ দূর করা।
৮. বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমনের সময়কালীন পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকা পর্যালােচনা করা হয়ঃ
– নেতৃত্ব সংগঠনের বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সাধারণ লাইন প্রণয়ন করেন;
– সাধারণ লাইন বিশেষ এলাকায় প্রয়ােগ করেন;
– এভাবে বিন্দু ভেঙ্গে প্রবেশের মাধ্যমে সাধারণ লাইন বাস্তবায়নে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন;
– এ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অন্যান্য অঞ্চলে সাধারণ লাইন বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ
পৃষ্ঠা: ৫২৭

গাইডেন্স প্রদান করেন এবং প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন;
এভাবে নীতি নির্ধারণ ও কেডারদের কাজে লাগানাের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব সাফল্যের সাথে মার্কসবাদী নেতৃত্বের পদ্ধতি প্রয়ােগ করেন।
৯. সভায় পার্টির অর্থনৈতিক অবস্থা পর্যালােচনা করা হয়ঃ
– বর্তমানে অর্থনৈতিক সমস্যা পার্টির কেন্দ্রীয় সমস্যা নয়;
– গ্রামের সশস্ত্র তৎপরতাই অর্থনেতিক সমস্যা সমাধানের প্রকৃত উপায়;
– সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে গেলে অর্থনৈতিক সমস্যার উদ্ভব হবে না।
১০. সভায় চমৎকার আন্তর্জাতিক বিপ্লবী পরিস্থিতির পর্যালােচনা করা হয়ঃ
– চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সফল দশম কংগ্রেসকে পার্টি আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানায়।
কমরেড মাওসেতুঙ-এর চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচনকে আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানায়।
লিন পিয়াও চক্রের ধ্বংস চীনা বিপ্লব ও বিশ্ব বিপ্লবের মহান বিজয়।
– চিলির আলেন্দে সরকারকে উৎখাত করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পার্টি নিন্দা জ্ঞাপন করছে;
– চিলির ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করা সম্ভব নয়;
চিলির জনগণ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহী কুকুর ফ্যাসিস্ট জান্তা বিরােধী যে মহান, বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করছে পার্টি তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।
পার্টি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে চিলির বীর জনগণ জাতীয় মুক্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্য অব্যাহতভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।
– মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্যের না যুদ্ধ না শান্তির অস্বস্তিকর পরিবেশ ও মধ্যপ্রাচ্যকে শােষণ ও লুণ্ঠনের চক্রান্ত শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরাইলী আগ্রাসীদের বিরুদ্ধে ন্যায়যুদ্ধ শুরু করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের এই ন্যায়যুদ্ধকে পার্টি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এবং তাদের বিজয় কামনা করে।
– গিনি বিসাউ প্রজাতন্ত্রের জন্মকে পার্টি স্বাগত জানায়।
১১. পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সংবিধান থেকে লিন পিয়াও সংক্রান্ত প্যারাগ্রাফটি পুরােপুরি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১২. সভায় কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার সভাপতি কর্তৃক প্রকাশিত ও রচিত সকল দলিল, সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ গৃহীত হয়।
কমরেড শাহীন আলম প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।
১৩. সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
১৪. সভায় সমালােচনা-আত্মসমালােচনা পরিচালনা করা হয় এবং পরবর্তী সভার সময় নির্ধারণ করে সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
পৃষ্ঠা: ৫২৮

১নং ব্যুরাের আওতাধীন পরিচালকদের সাথে ষষ্ঠ বৈঠক শেষে ব্যুরাে পরিচালক প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমুহ
(শেষাংশ, ১৯৭৩)

১) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দশম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন দলিল।
এ দলিলের লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং আরাে বিরাটাকার বিজয় আনয়ন করতে হবে।
২) এ ইস্তেহারে শীতকালীন রণনৈতিক আত্মরক্ষার সময় সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত রয়েছে।
এ সুসংবদ্ধকরণের মাধ্যমে আমরা বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সাফল্যসমূহ ধরে রাখতে সক্ষম হবাে এবং পরবর্তী বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের জন্য চমৎকার প্রস্তুতি অর্জন করতে সক্ষম হবাে।
এ কারণে এ সুসংবদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ।
সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণের জন্য প্রথমে প্রয়ােজন মতাদর্শগত সুসংবদ্ধকরণ। এ মতাদর্শগত সুসংবদ্ধকরণের লক্ষ্য হচ্ছে অসর্বহারা বিশেষ করে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার বহিঃপ্রকাশসমুহ দূর করা, সর্বহারার মতাদর্শ দ্বারা কর্মীদের সুসজ্জিত করা।
বর্তমানে সংগঠনে অসর্বহারা মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশ নিম্ন ক্ষেত্রসমূহে ঘটছেঃ
আন্ত-আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, উচ্চস্তর ও নিম্নস্তরের সম্পর্ক, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা, এককেন্দ্র, কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বের এবং শৃংখলার ক্ষেত্রে, কমরেড ও জনগণের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, সমালােচনা-আত্মসমালােচনার ক্ষেত্রে।
উপরােক্ত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে যে সকল বিচ্যুতি প্রকাশ পায় তা ক্ষুদে বুর্জোয়া। মতাদর্শের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বহিঃপ্রকাশ বিভেদপন্থীবাদ ও উপদলবাদের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত।
এগুলাে ব্যক্তিতাবাদেরই বহিঃপ্রকাশ।
এ ছাড়াও সামরিক ক্ষেত্রে অতি বাম, অতি ডান বিচ্যুতি, চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে আত্মগতভাব, একতরফাবাদ, ভাসাভাসাভাব, যান্ত্রিকতা (Mechanism) এবং অনমনীয়তা (Rigidity)১ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ডানে বামে দোদুল্যমানতা প্রভৃতি বহিঃপ্রকাশও কর্মীদের মাঝে রয়েছে।
ইহা ব্যতীত গােড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদের বহিঃপ্রকাশও কর্মীদের মাঝে রয়েছে।
…………………………………………………………………….
১. বস্তু গতিশীল, পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত বিকাশলাভ করছে এবং পরিবর্তিত হচ্ছে। এ কারণে গতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি ও কৌশল এবং কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। যান্ত্রিকতা ও অনমনীয়তা পরিহার করতে হবে। যান্ত্রিকতা ও অনমনীয়তা বস্তুর গতির সাথে খাপ খায় না, তাই তা ভুল। ইহা আত্মগতভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৫২৯

উপরােক্ত বিচ্যুতিসমূহ হচ্ছে ক্ষুদে বুর্জোয়া ব্যক্তিতাবাদী মতাদর্শের বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ।
উপরােক্ত মতাদর্শগত বিচ্যুতি সমূহের বিরুদ্ধে দৃঢ় ও কঠোর সংগ্রাম পরিচালনার জন্য অতীতের অভিজ্ঞতাসমূহ কাজে লাগাতে হবে। সর্বস্তরে চক্রবিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান, গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম, চিন্তাধারার পরিবর্তন ও কর্মরীতি সংশােধন এবং কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণের আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়াও বিশেষ বিশেষ বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য সমস্যাভিত্তিক পড়াশুনাসংগ্রাম-সমালােচনা ও রূপান্তরের আন্দোলন চালাতে হবে।
এ মতাদর্শগত সংগ্রাম চালাতে হবে কেডার সম্মেলনে, মানােন্নয়ন সভায়। এ মতাদর্শগত সংগ্রাম শীতকালীন আত্মরক্ষাকালীন সময়ের মাঝেই শেষ করতে হবে।
(৩) আন্ত-আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিকতাবাদের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়।
কোন কোন অঞ্চল নিজ আঞ্চলিক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, নিজ অঞ্চলকে উন্নত মনে করে, অন্যদের অনুন্নত-হেয় মনে করে, অন্যদের সম্পর্কে শুধু অভিযােগ করে।
এটা আঞ্চলিকতাবাদ, স্ববিভাগীয়বাদ।
এটা ব্যক্তিতাবাদের বহিঃপ্রকাশ। এতে ঐক্য বিনষ্ট হয়, বিপ্লবের ক্ষতি হয় এবং সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে ক্ষুদ্র স্বার্থকে, অংশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
আন্ত-আঞ্চলিক সম্পর্ক মার্কসবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে তােলা উচিত। এ জন্য নিজের চেয়ে অপরের প্রতি যত্নশীল হও এবং শিক্ষা প্রদানে ও গ্রহণে অতৃপ্ত হও’ এ নীতি প্রয়ােগ করতে হবে।
অর্থ, অস্ত্র, বৈষয়িক দ্রব্যাদি বণ্টনে, মানােন্নয়নে, কেডার নিয়ােগ প্রভৃতির ক্ষেত্রে প্রতি অঞ্চল অন্য অঞ্চলের প্রতি, নিজের চেয়ে অপরের প্রতি বেশী যত্নশীল হলে আন্তআঞ্চলিক সম্পর্ক উন্নত ও দৃঢ়তর হবে, আঞ্চলিকতাবাদ ও উপদলবাদ দূর হবে।
এক অঞ্চলের কর্মীদের নিম্নমান, আর্থিক সংকট, বৈষয়িক অসুবিধার বিষয় অভিযােগ না এনে তা সমাধানের বিষয়ে সহায়তা করা উচিত।
এভাবে আন্ত-আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিযােগ কমে যাবে। তবে প্রতিটি অঞ্চলের সচেষ্ট হতে হবে সকল বিষয়ে সাবলম্বী হওয়ার জন্য।
(৪) উচ্চস্তর ও নিম্নস্তরের সম্পর্ক, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা, এককেন্দ্র ও কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব এবং শৃঙ্খলা সংক্রান্ত।
সংগঠনে সাধারণভাবে উচ্চস্তর ও নিম্নস্তরের সম্পর্ক ভাল, শৃংখলা উন্নত, এককেন্দ্র শক্তিশালী, একীভূত নেতৃত্ব ভাল, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে।
কিন্তু তবুও কোন কোন ক্ষেত্রে কেন্দ্রীকতাকে অবহেলা করা, শৃংখলাকে ঢিলে দেওয়া হয় এবং উগ্র গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ রয়েছে।
আমাদেরকে শৃংখলা উন্নত করতে হবে, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতার ধারাগুলাে সর্বস্তরে পালন করতে হবেঃ
– সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন;
– নিম্নস্তর উচ্চস্তরের অধীন;
– সমগ্র সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন;
– ব্যক্তি সংগঠনের অধীন।
পৃষ্ঠা: ৫৩০

এ ছাড়াও তিনটি বৃহৎ শৃংখলা ও মনােযােগের আটটি ধারাও কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
তিনটি বৃহৎ শৃংখলা নিম্নরূপ :
১। সকল কার্যক্রিয়ায় আদেশ মেনে চলুন; ২। জনসাধারণের কাছ থেকে একটি সূচ কিংবা সুতােও নেবেন না; ৩। দখলকৃত সমস্ত জিনিস জমা দিন। মনােযােগ দেবার আটটি ধারা নিম্নরূপঃ ১। ভদ্রভাবে কথা বলুন; ২। ন্যায্যমূল্যে কেনাবেচা করুন; ৩। ধার করা প্রতিটি জিনিস ফেরত দিন; ৪। কোন জিনিস নষ্ট করলে তার ক্ষতিপূরণ করুন; ৫। লােককে মারবেন না, গাল দেবেন না। ৬। ফসল নষ্ট করবেন না। ৭। নারীদের সাথে অশােভন ব্যবহার করবেন না; ৮। বন্দী সৈন্যদের সাথে দুর্ব্যবহার করবেন না।
উচ্চস্তর নিম্নস্তরের সম্পর্ক উন্নত ও সৌহার্দমূলক হতে হবে। উচ্চস্তর গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা প্রয়ােগে নিপুণ হবে, নিম্নস্তরের অবস্থা অবগত হবে, তাদের মানােন্নয়নে, সমস্যা সমাধানে, তদারকীতে ও পরিচালনায় নিপুণ হতে হবে।
নিম্নস্তর উচ্চস্তর প্রদত্ত দায়িত্ব ও নির্দেশ পালনে নিপুণ হবে; উচ্চস্তরকে সস্নেহে তত্ত্বাবধান করবে।
আমাদের উন্নত শৃংখলা এবং কর্মীদের ভাল ব্যবহার ইতিমধ্যেই জনগণের প্রশংসা পেয়েছে। তবে কোথাও কোথাও দখলকৃত দ্রব্যাদি আত্মসাৎ, অস্ত্রের অসৎ ব্যবহার হয়েছে।
এ সকল করলে কেন্দ্রীয় কমিটি উপরােক্ত শৃংখলা ভঙ্গের অপরাধ সংক্রান্ত শাস্তির ধারা নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইতিমধ্যেই দু’ক্ষেত্রে পার্টি ও জনগণ বিরােধী পার্টি সম্পদ আত্মসাৎকারী, অন্যায়ভাবে অস্ত্র ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
ইহা কর্মী ও জনগণের দাবীতে সার্কুলার মােতাবেক কার্যকরী হয়েছে। বৈষয়িক দ্রব্যাদি বণ্টনের ক্ষেত্রে উগ্র গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার মাধ্যমে বুঝাতে হবে যে, বৈষয়িক দ্রব্যাদি আত্মগত প্রয়ােজন এবং বস্তুগত সামর্থ দ্বারা নির্ধারিত হয়, নিরঙ্কুশ সমানাধিকার এখানে কার্যকরী নয়।
অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক দ্রব্যাদি বণ্টনে ব্যক্তিগত কারণে উদার বা উচ্চস্তরের জন্য উদার কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে অনুদার এ ধরনের চক্রের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য পরিহার করতে হবে।
এক কেন্দ্র এবং কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বকে রক্ষা ও জোরদার করতে হবে। একে দুর্বল করা বা হেয় করার সকল কার্যকলাপ (জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে) অবশ্যই দূর করতে হবে। উচ্চস্তরের সামনে তােষামােদ করা, পিছনে সমালােচনা করা, কান কথা বলা, গুজবঅপবাদ রটনা করা, প্রভৃতি চক্রের অনুরূপ কার্যকলাপ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে, যে কেউ শৃংখলা লংঘন করে সে-ই শত্রুকে সাহায্য করে।
পৃষ্ঠা: ৫৩১

কর্মীদের সাংস্কৃতিক ও ব্যবহারগত দিক এবং জনগণের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়া-সামন্তবাদী ব্যক্তিতাবাদের ঝোক প্রকাশ পায়।
আমাদেরকে সর্বহারার উন্নত সংস্কৃতি ও ব্যবহার-রীতি রপ্ত করতে হবে; কেডার ও জনগণের সাথে উন্নত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
আমাদেরকে বিনয়ী, নম্র হতে হবে, নিজের চেয়ে অপরের প্রতি যত্নশীল হতে হবে, আত্মসমালােচনা চালাতে সাহসী হতে হবে; আমলাতান্ত্রিক ব্যবহার, রুক্ষতা, মেজাজ, আন্তরিকতার অভাব, ব্যক্তিস্বার্থের কারণে খারাপ ব্যবহার দূর করতে হবে।
নারী, শিশু, নবাগত, অসুস্থদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। চলাফেরা, দৈনন্দিন জীবনে সুশৃংখল, নিয়মতান্ত্রিক ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
৫) সমালােচনা-আত্মসমালােচনার শুভ রীতি সংগঠনে নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে এখনও অশুভ রীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। সামনা সামনি তােষামােদ করা বা কিছু না বলে পিছনে সমালােচনা করা, কান কথা বলা, গুজব, বিদ্রুপ ছড়ানাে, গুরুত্ব সহকারে আত্মসমালােচনা না করা, সংশােধনে ব্রতী হওয়ার পরিবর্তে হাল্কাভাবে বিষয়টিকে নেওয়ার অশুভ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সমালােচনা-আত্মসমালােচনা যথাযথ পদ্ধতিতে চালাতে হবে, একে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করতে হবে।
যারা সমালােচনা গ্রহণ করে না তারা হয় উদ্ধত। যারা সমালােচনা গ্রহণ করে তারা হয় বিনয়ী।
যাদের মাঝে ব্যক্তিস্বার্থ রয়েছে, নিজেদেরকে যারা কেউকেটা মনে করে, বুর্জোয়া আত্মসম্মানবােধের কথা চিন্তা করে তারা সমালােচনা অপমানকর মনে করে; সমালােচনা এড়াতে চায়।
অসর্বহারা মতাদর্শ দূর করার পদ্ধতি হচ্ছে সমালােচনা-আত্মসমালােচনা এবং ক্রটি শুধরে দেওয়া।
সমালােচনা-আত্মসমালােচনা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে করা উচিত।
সমালােচনা আহ্বানে, আত্মসমালােচনা পরিচালনায় এবং ত্রুটি সংশােধনে নির্ভিক হতে হবে।
প্রতিটি মানােন্নয়ন সভায়, কেডার সম্মেলনে সমালােচনা-আত্মসমালােচনা পরিচালনা করতে হবে।
সামনে তােষামােদ, পিছনে সমালােচনা, অসাংগঠনিক সমালােচনা, কান কথা প্রভৃতি পরিহার করতে হবে। এ ধরনের কাজ চক্রের অনুরূপ কাজ।
যারাই সর্বহারা হতে ইচ্ছুক তাদেরকেই সমালােচনা-আত্মসমালােচনা ও শােধরানাের পদ্ধতি রপ্ত করতে হবে।
৬) ইহা ব্যতীত অন্যান্য ব্যক্তিস্বার্থের বহিঃপ্রকাশও দূর করতে হবে। নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া, স্ত্রী/প্রেমিকার স্বার্থকে দেখা, তাদের প্রতি যত্নশীল হওয়া, উচ্চস্তরের প্রতি যত্নশীল হওয়া কিন্তু অন্যের প্রতি যত্নশীল না হওয়া প্রভৃতি চক্রের অনুরূপ ব্যবহার অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
৭) কর্মীদের বিশেষ করে পরিচালকদের বাস্তবনিষ্ঠ ও দূরদর্শী হতে হবে।
এর জন্য সাধারণ লাইন ও বিশেষ লাইন, রণনীতি ও রণকৌশল ভালভাবে রপ্ত করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৩২

রণকৌশল ও বিশেষ লাইন রপ্ত ও প্রয়ােগের মাধ্যমে বাস্তবনিষ্ঠতা আসবে।
কিন্তু সাধারণ লাইন ও রণনীতির ক্ষেত্রে অজ্ঞ হলে কর্মীরা ভবিষ্যতের দিশা হারিয়ে ফেলবে, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হবে না; অনিবার্যভাবেই তারা সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদের ভুল করবে।
আবার শুধু রণনীতি বা সাধারণ লাইন নিয়ে ব্যস্ত থাকা কিন্তু তা বাস্তবায়িত করার জন্য বিশেষ লাইন, রণকৌশল রপ্ত ও প্রয়ােগ না করলে কর্মীরা গােড়ামীবাদের ভুল করবে।
আমাদেরকে রণনীতি ও রণকৌশলে, সাধারণ লাইন ও বিশেষ লাইনের সমন্বয় সাধন করতে হবে; গােড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ পরিহার করতে হবে, বাস্তবনিষ্ঠ ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হতে হবে।
বিপ্লবের মৌলিক সমস্যাই হচ্ছে প্রতিটি প্রশ্নে সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল, সাধারণ ও বিশেষ লাইন নির্ধারণ এবং তার বাস্তবায়ন।
৮) বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপ বা স্তরের বৈশিষ্ট্যসমূহ বের করতে হবে এবং তা সমাধান করতে হবে। এভাবে পরবর্তী স্তরে প্রবেশ করতে হবে।
স্তরগত সমস্যার সমাধান ব্যতীত পরবর্তী স্তরে প্রবেশ করা যায় না, গতি বন্ধ হয়ে যায়, স্থবিরতা আসে, সংগঠন ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ধ্বংস হয়।
গতিই হচ্ছে জীবন, স্থবিরতা হচ্ছে মৃত্যু।
প্রতিটি স্তরগত প্রয়ােজনের সাথে আমাদের মান খাপ খাওয়াতে হবে। অন্যথায় আমরা ঐ স্তরের অযােগ্য হয়ে পড়ব।
বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের পূর্বেকার সংগঠনের স্তরগত সমস্যা ছিল
মতাদর্শগত ক্ষেত্রে চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান, সামরিক ক্ষেত্রে জাতীয় শত্রুর খতমের স্তর থেকে শত্রু অবস্থান দখল, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান; সাংগঠনিক ক্ষেত্রে মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণ; রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্তরগত লাইন নির্ধারণ ইত্যাদি।
এ সকল স্তরগত বিশেষ সমস্যাবলীর সমাধানে পার্টি সক্ষম হয়েছে, যার ফলে পার্টি বর্তমানের স্তরে প্রবেশ করেছে।
এ স্তরের মতাদর্শগত সমস্যা হচ্ছে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশ দূর করা, সামরিক ক্ষেত্রে রণনৈতিক আত্মরক্ষা, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বজায় রাখা, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণ এবং জনগণকে সংগঠিত করা; রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণসংগ্রামের সূচনা ও জোরদার করা।
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, একই সাথে আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রেণী ঐক্যের লাইনে অব্যাহতভাবে কার্য চালিয়ে যাওয়া।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের তাবেদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আরাে তীব্রতর করা; একই সাথে সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয় ঐক্যের কাজ (জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের কাজ) জোরদার করা ইত্যাদি।
এভাবে সংগঠন পার্টি ও বিপ্লবের প্রতিটি স্তরের সমস্যার যথাযথ সমাধান দিয়ে অব্যাহত গতিতে বিকাশ লাভ করছে। এ কারণেই আমাদের সংগঠন হচ্ছে প্রাণবন্ত ও গতিশীল।
পৃষ্ঠা: ৫৩৩

এ সংক্রান্ত দ্বন্দ্বের বিশেষতু চ্যাপ্টার অধ্যয়ন করতে হবে।
৯) বর্তমানে আমাদের শক্তিকে কাজে লাগানাের জন্য উন্নততর নেতৃত্ব ও কর্মপদ্ধতি প্রয়ােজন।
বর্তমানে আমাদের শ্লোগান হচ্ছে-আমাদের প্রথম প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব, আমাদের দ্বিতীয় প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব, আমাদের তৃতীয় প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব।
পূর্ব বাংলার ক্ষুদে উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতৃত্ব প্রদানের প্রয়ােজন হয় না। এ কারণে নেতৃত্ব দানের ক্ষমতাসম্পন্ন লােকেরও সংকট।
আমাদেরকে উন্নততর নেতৃত্ব সম্পর্কিত মার্কসবাদী পদ্ধতি প্রয়ােগ করে উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট নেতৃত্বস্বল্পতা দূর করতে হবে; নেতৃত্বের কলাকৌশল কর্মীদের বিশেষ করে সম্ভাবনাময়দের শিখাতে হবে। নেতৃত্ব সম্পর্কিত দলিলাদি পাঠ ও প্রয়ােগ করতে হবে। এভাবে নেতৃত্বের সংকট দূর করতে হবে।
উন্নততর নেতৃত্বের জন্য বুদ্ধি ও স্মরণশক্তির একান্ত প্রয়ােজন।
বুদ্ধি হচ্ছে রণনীতি ও রণকৌশলের যথাযথ সমন্বয়, প্রধান ও গৌণ দ্বন্দ্বের যথাযথ সমন্বয় সাধন করা এবং চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে একতরফাবাদ, ভাসাভাসাভাব ও আত্মগতভাবের বহিঃপ্রকাশ না থাকা।
কাজেই উপরােক্ত পদ্ধতিতে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ সাধন করতে হবে। স্মৃতিশক্তিকেও অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় বাড়াতে হবে।
১০) পূর্ব বাংলার ক্ষুদ্র ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক সমবিকাশ, জনগণের সাংস্কৃতিক সমমান, চরিত্রগত মিল প্রভৃতি পূর্ব বংলার বিপ্লবে কতগুলাে বিশেষ বৈশিষ্ট আনয়ন করবে।
এর মাঝে একটি হবে সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে উচ্চমানের গণসংগ্রামের সমন্বয়। পূর্ব বাংলার এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য গণসংগ্রাম অ্যুত্থানে রূপ নেবে।
পূর্ব বাংলার জনগণের আবেগ প্রবণতার দিককে নাড়া দিতে হবে, আমাদেরকে আবেগপূর্ণ লেখা ও বক্তৃতা দানে সক্ষম হতে হবে, জনগণের আবেগকে সঠিক পথে ব্যবহার করতে পারদর্শী হতে হবে।
১১) বিপ্লবের জন্য প্রয়ােজন ধৈর্য ও কষ্টসহিষ্ণুতা, ‘সবুরে মেওয়া ফলে এটা সর্বদাই মনে রাখতে হবে।
১২) কোন পদে নিয়ােগের পূর্বে উক্ত পদের কাজ সংক্রান্ত ট্রেনিং দিয়ে নিয়ােগ করতে হবে। দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্ধারণ করে দেওয়া, এগুলাে কার্যকরী হচ্ছে কিনা তা। সর্বদা তদারক করা। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর সারসংকলন, মানােন্নয়ন, ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা।
১৩) কর্মীদেরকে পাঁচটি প্রবন্ধ, গণযুদ্ধ ও উদ্ধৃতি পাঠ করাতে হবে।
১৪) হরতাল সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পার্টির একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সর্বস্তর এ সিদ্ধান্ত কে স্বাগত জানাচ্ছে। হরতালকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য সকল স্তরের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে।
হরতাল বাস্তবায়নের সময় সংগঠনের নিরাপত্তা ও গােপনীয়তা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে।
১৫) বিভিন্ন এলাকায় প্রয়ােজনীয় জিনিসের তালিকা প্রয়ােজন সংক্রান্ত’ ফাইলে রাখতে হবে। জিনিসপত্র পেলে ফাইল অনুযায়ী বিতরণ করা।
পৃষ্ঠা: ৫৩৪

১৬) নিরাপত্তা ফাইল রাখা। পরিচালক নিজে এ ফাইল রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর এক কপি উচ্চস্তরে পাঠাতে হবে।এ ফাইলে দলত্যাগী, সুবিধাবাদী, বৈর ব্যক্তি, সন্দেহজনক ব্যক্তি, শক্রদের তালিকা ও কার্যকলাপের বিবরণ রাখা।
১৭) সাংগঠনিক ক্ষেত্রে ১নং অঞ্চলের কাঠামাে ও কর্মপদ্ধতি প্রয়ােগ করা।
১৮। অনুসন্ধান সংক্রান্তঃ
অনুসন্ধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে সার্বিক বাস্তব অবস্থা অবগত হওয়া এবং উচ্চস্তরকে তা জানানাে।
ক্ষমতাপ্রাপ্ত অনুসন্ধানলব্ধ সমস্যাবলীর সমাধান প্রদান।
সার্বিক অবস্থা বলতে বুঝায় সাংগঠনিক, রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, সামরিক, অর্থনৈতিক, ভৌগলিক, প্রেস-প্রিন্টিং, প্রচার, আশ্রয়স্থল, শত্রু-মিত্র ও জনগণের অবস্থা।
অনুসন্ধান হলাে এগুলাের বাস্তব অবস্থার প্রতিফলন। একজন কর্মীর ক্ষেত্রে বাস্তব অবস্থা কি?
– তার ইতিহাস – সে কিভাবে পার্টিতে যােগ দিল। – কেন যােগ দিল – কার মাধ্যমে। – শ্রেণী ভিত্তি – পারিবারিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ও পরিবেশ – যােগদানের পরবর্তীকালে কোথায় কি কি কাজ করেছে – কার কার সংস্পর্শে ছিল। – কি কি ধরনের দায়িত্ব পালন করেছে। – তার সম্পর্কে উচ্চস্তর, সমস্তর, নিম্নস্তর, সহানুভূতিশীল ও জনগণের মতামত – তার বর্তমান অবস্থা। – ভাল দিক, খারাপ দিক, সীমাবদ্ধতা এবং তার অন্যান্য মৌলিক দিকসমুহ – তার মান, স্তর – সদস্য/প্রার্থী সদস্য/ পাঠচক্র না গ্রুপ – শৃংখলা, নিরাপত্তা সংক্রান্ত তার অবস্থা
এর সাথে কেডার ইতিহাস, অতিরিক্ত পয়েন্ট, কেন্দ্রীয় কমিটির সার্কুলার ভিত্তিক অনুসন্ধান যুক্ত করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৩৫

এলাকা বা অঞ্চলের সার্বিক অবস্থা কি?
– ভৌগলিক অবস্থান
– পার্টি বিকাশের ইতিহাস
– কর্মীদের সংখ্যা ও মান
– কেন্দ্রীয় কমিটির সার্কুলার ভিত্তিক অন্যান্য তথ্যাবলী।
অনুসন্ধানকারীকে বাস্তবনিষ্ঠ ও বিনয়ী হতে হবে। হামবড়াভাব, আত্মপ্রচারবাদ, গােপনীয়তা ফাঁস করা, নিজেকে কেউকেটা, পণ্ডিত হিসেবে জাহির করা ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। তাকে স্বজনপ্রীতি ও প্রতিশােধবাদ থেকে মুক্ত হতে হবে। তাকে অপ্রয়ােজনীয় কথাবার্তা ও তত্ত্ব জাহির থেকে বিরত থাকতে হবে, ভাবগম্ভীর ও প্রাণবন্ত হতে হবে।
অনুসন্ধানকারী সম্পর্কে ভাল ধারনা না হলে যে স্তর থেকে অনুসন্ধানকারী প্রেরিত হয়েছে সে স্তর সম্পর্কে ধারণা খারাপ হবে।
এ কারণে অনুসন্ধানকারী উচ্চস্তরের প্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই ভাল হতে হবে, এদের কারণে উচ্চস্তর সম্পর্কে নিম্নস্তরের সম্পর্কের অবনতি যাতে না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
এদেরকে হতে হবে আদর্শস্থানীয়।
ব্যাপক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে যথাযথ কেডার ইতিহাস তৈরী ও যাচাই করতে হবে। নিয়মিত এ ধরনের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
প্রতিটি নতুন যােগাযােগের জন্য ফরম পূরণ করতে হবে এবং কেডার ইতিহাস রাখতে হবে।
উপরের পয়েন্টগুলােকে অতিমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে হবে।
এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে শত্ৰুচর, খারাপ লােকদের পার্টিতে অনুপ্রবেশ ঠেকানাে যাবে।
১৯) প্রতি অপারেশনে পতাকা উত্তোলন করতে হবে।
২০) সামরিক ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা (ডান বিচ্যুতি) ও দোদুল্যমানতা পরিত্যাগ করে সামরিক তৎপরতা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং উন্নততর পর্যায়ে উন্নীত করতে হবে।
২১) শীতের মৌসুমে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা বজায় রাখতে হবে এবং যাদের স্বাবলম্বীতা নেই তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে হবে।
২২) সামরিক রণনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে শক্তির ভারসাম্য আমাদের অনুকূলে আনতে হবে।
২৩) অপারেশনের পূর্বে গেরিলাদের নিকট আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দিয়ে তাদেরকে বিপ্লবী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
২৪) উচ্চস্তর প্রদত্ত দায়িত্বসমূহ যথাযথভাবে পালন করতে হবে। পরামর্শ, নির্দেশসমূহ যথাযথভাবে প্রয়ােগ করতে হবে।
এর ফলে বহু বিপর্যয় ঠেকানাে যাবে।
উচ্চস্তরের নির্দেশ-পরামর্শ যথাযথভাবে পালন করার ক্ষেত্রে কোন পক্ষ গড়িমসি করলে বা বাধা সৃষ্টি করলে সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিষয় উচ্চস্তরকে অবহিত করা।
পৃষ্ঠা: ৫৩৬

২৫) ভারী অস্ত্রাদি সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালানাে।
২৬) সামরিক লক্ষ্যবস্তু নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত পয়েন্টসমূহের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখা-
– এমন সাংগঠনিক কাজ থাকতে হবে যেখানে নিরাপদে গেরিলারা থাকতে পারে, চলাফেরা করা ও অনুসন্ধান চালাতে পারে।
– আক্রমণের জন্য একত্রিত হওয়ার এবং শেষ মুহূর্তের অনুমতির স্থান থাকতে হবে।
– অপারেশন শেষে আশ্রয় নেওয়ার স্থান থাকতে হবে।
– প্রাপ্ত লাভসমূহ ধরে রাখার অবস্থা থাকতে হবে।
– গােপনীয়তা ও নিরাপত্তার সমস্যা নেই।
– হামলার ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে উন্নততর পর্যায়ে যাওয়া উচিত।
– কেবল ফাঁড়ি বা থানা দখল নয়, সাথে সাথে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান, জাতীয় শত্রু উৎখাত অভিযান চালাতে হবে।
২৭) আন্ত-আঞ্চলিক বেতার সংযােগ স্থাপন করতে হবে।
২৮) সামরিক পরিকল্পনায় আমাদের ফায়ারিং লাইনে গেরিলা নিয়ােগ না করা।
পৃষ্ঠা: ৫৩৭

১-গ উপব্যুরাের আওতাধীন অঞ্চলসমূহের পরিচালকদের সাথে ব্যুরাে পরিচালকের বৈঠক শেষে। ব্যুরাে পরিচালক কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ
(ডিসেম্বর, ১৯৭৩)

১) আমাদের কাজের লক্ষ্য হচ্ছে।
– গ্রামে ঘাঁটি গঠন করা,
গ্রামসমূহ মুক্ত করা,
– শহর ঘেরাও করা,
– শেষ পর্যন্ত শহর দখল করা।
বর্তমানে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞ লােক গড়ে উঠছে, অস্ত্র দখল হচ্ছে, গ্রামসমূহ থেকে জাতীয় শত্রু উৎখাত হচ্ছে, শত্রুর ছােট ছােট অবস্থান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে আমরা সক্ষম হচ্ছি। কাজের ব্যাপক বিস্তৃতি হয়েছে, শহরে ও গ্রামে ভাল কাজ হচ্ছে, গণসংগ্রামের মাধ্যমে গণসমর্থনকে কাজে লাগাবার পদ্ধতি রপ্ত হচ্ছে, কর্মীদের মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের পদ্ধতি কর্মীরা আয়ত্ব করছে, অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে, দেশপ্রেমিক ও বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করার পদ্ধতি প্রয়ােগ হচ্ছে। এভাবে আমাদের সংগঠনের চমৎকার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই বর্তমানে আমাদেরকে ঘাটি এলাকা গড়ে তােলার লক্ষ্য সামনে রেখে সংগঠনের চমৎকার অবস্থাকে কাজে লাগাতে হবে এবং কাজ করতে হবে।
সমভূমিতে ভ্রাম্যমান ঘাঁটি এলাকা এবং জাতীয় শত্রুমুক্ত বিস্তীর্ণ গেরিলা অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে।
রণনৈতিক সুবিধাজনক স্থানে স্থায়ী ঘাঁটি এলাকা গড়ে তুলতে হবে।
এ উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির দশম ইশতেহার, ১নং ব্যুরাের ষষ্ঠ সিদ্ধান্তের লক্ষ্যসমুহ কার্যকরী করতে হবে।
ঘাঁটি এলাকার লক্ষ্য বাস্তবায়িত হলে বিপ্লবের বিরাট অগ্রগতি সাধিত হবে।
২) দশম ইশতেহার, ১নং ব্যুরাের ষষ্ঠ প্রস্তাব গুরুত্বসহকারে পাঠ ও প্রয়ােগ করতে হবে। এর ভিত্তিতেই সুসংবদ্ধকরণ চালাতে হবে।
৩) ২৬শে মার্চ, ১৯৭৪ সাল সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী হরতাল পালনের প্রস্তাব করা হচ্ছে।
হরতালের কারণ-
-জাতীয় পরাধীনতা দিবস পালন।
– রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে।
– রক্ষীবাহিনী উৎখাতের জন্য।
পৃষ্ঠা: ৫৩৮

প্রস্তাবিত হরতালের বিষয়ে এখন থেকেই জনগণের মাঝে প্রচার চালাতে হবে। হরতাল সংক্রান্ত সারসংকলন প্রয়ােগ করতে হবে।১
৪) অর্থনৈতিক অপারেশন সংক্রান্তঃ
আমাদের প্রয়ােজন, ক্ষমতা এবং বাস্তব অবস্থা দ্বারা অপারেশন নির্ধারিত হবে। অর্থনৈতিক অপারেশনে যে সকল বিপর্যয় ঘটেছে তার মূল কারণ ছিল পরিকল্পনার ক্রটি।
৫) দায়িত্বে নিযুক্ত হলে তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে, কোন কমিটির সদস্য হলে সদস্যের ভূমিকা ঠিকভাবে পালন করা, সম্ভব না হলে দায়িত্ব গ্রহণ না করা বা সদস্য না হওয়া।
৬) অপারেশনঃ
– যে কোন অপারেশনের পর “অপারেশন সিট পূরণ করা।
– অপারেশনের নির্ণায়ক হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা।
– অপারেশনের স্তরসমূহ নির্ধারণ করে দেওয়া, এবং তা কঠোরভাবে পালন করতে বলা, কোন কোন স্তর পালন করা না হলে অপারেশন বাতিল হবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া।
– কোন লক্ষ্যবস্তুর অপারেশন করার মত শর্তসমূহ উপস্থিত না থাকলে পরিকল্পিতভাবে তা তৈরী করা।
প্রতি অঞ্চল তার আওতাভূক্ত অপারেশন টার্গেটসমূহ বিশ্লেষণ করে রাখবে এবং প্রয়ােজনীয় শর্তসমূহ তৈরী করার জন্য এখন থেকেই কাজ করবে।
– বর্তমানে অর্থনৈতিক অপারেশনকে প্রাধান্য দেওয়া। সম্ভব হলে সামরিক লক্ষ্যবস্তুসহ, সামরিক লক্ষ্যবস্তু ঠেকিয়ে বা শুধু অর্থনৈতিক লক্ষ্যবস্তু। চেষ্টা করতে হবে গ্রামের উপর নির্ভর করে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা।
– ‘পচা শামুকে পা কাটে’ অর্থাৎ যথাযথ গুরুত্ব না দিলে ছােট অপারেশনেও বিরাট বিপর্যয় ঘটতে পারে।
– পরিকল্পনা কার্যকরী করার মত লােক আছে, কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়নের লােকের অভাব রয়েছে।
– ভ্রষ্টদের রিক্রুট না করা।
– সামরিক হামলার উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।
– দখলকৃত দ্রব্যাদি ও অস্ত্র সংক্রান্ত নিয়মবিধি কঠোরভাবে কার্যকরী করা।
– অপারেশনে জনসমর্থনকে কাজে লাগাবার বিষয় বিবেচনা করা। জনসমর্থন উদ্দেশ্যহীন হবে যদি তাকে কাজে না লাগানাে হয়।
– দিনের বেলায় অপারেশন খুবই জটিল। এ কারণে এতে অতিমাত্রায় মনােযােগ দিতে হবে।
– অপারেশনপূর্বেকার, অপারেশনকালীন, অপারেশনপরবর্তী স্তরসমূহ অতিশয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে পরিকল্পনা করতে হবে।
– অপারেশনের উল্লিখিত স্তরগুলাে সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত সামগ্রিক অপারেশন পরিচালক উত্থাপিত সমস্যাবলী সমাধান করতে পারেন এইরূপ দূরত্বে অবস্থান করবেন।
…………………………………………………………………….
১. এ সিদ্ধান্ত পরে বাতিল করা হয়।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৫৩৯

– অপারেশনসহ সকল ক্ষেত্রে কর্মীদের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এই যত্নশীলতা নির্ভুল লাইন ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তব অবস্থার সাথে সংগতি রেখে তা কার্যকরী করার মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।
– প্রতি অঞ্চলে সচল বাহিনীর ইউনিট গড়ে তােলা, যারা সমগ্র পূর্ব বাংলায় গেরিলা তৎপরতা চালাতে সক্ষম।
৭) সংগঠনের দলিলসমূহ বারংবার গুরুত্বসহকারে অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করা।
৮) গােপন কর্মপদ্ধতি ও শৃংখলাকে আরাে জোরদার করতে হবে। সঠিক গােপন কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করার জন্য শক্রর ব্যাপক চাপের মুখেও আমাদের ক্ষতি কম হচ্ছে।
৯) আন্তর্জাতিক-
বিপ্লবের জন্য একটি পার্টিকে প্রধানতঃ নির্ভর করতে হবে নিজের মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইন সঠিকভাবে প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন এবং জনগণের উপর অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ ভিত্তির উপর।
শুধু আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্থাৎ শর্তের উপর নির্ভর করে বিপ্লব করা যায় না। উপরন্তু নিজের ভুল থাকলে অর্থাৎ ভিত্তি ঠিক না হলে আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্থাৎ শর্ত কোন কাজেই আসে না, উপরন্তু তা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি চীনের সমর্থন ভারতীয় পার্টির ভুলের কারণে কোন কাজেই আসেনি। একইভাবে হক-তােয়াহাদের প্রতি ভারতীয় পার্টির সমর্থন হকতােয়াহাদের ভুলের কারণে কোন কাজেই আসেনি।
হক-তােয়াহারা ভারতীয় পার্টির সমর্থনের সার্টিফিকেট দেখিয়ে বিপ্লবীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ সার্টিফিকেটও শেষ পর্যন্ত তাদের বিপর্যয় ঠেকাতে পারেনি।
আমরা তখনই বলেছি হক-তােয়াহাদের সমর্থন করা ভারতীয় পার্টির একটি আত্মগত ভুল পদক্ষেপ।
আমরা এ সমর্থনে বিগড়ে না যেয়ে দৃঢ়ভাবে আমাদের সঠিক লাইনে কাজ চালিয়ে যাই এবং অব্যাহতভাবে বিজয় অর্জন করি।
বর্তমানে যারা ভুল তাদের প্রতি কোন কারণে (আমাদের তরফ থেকে যােগাযােগ করতে না পারা এবং ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টির আত্মগত ভুলের কারণে) আন্তর্জাতিক মর্যাদা রয়েছে (চীনসহ) এইরূপ ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টির সমর্থন এলে তাতে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। দৃঢ়ভাবে আমাদের সঠিক লাইনে কাজ করে যেতে হবে। এবং ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিসমূহের ভুল ভাঙ্গাবার প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে তারা সঠিক লাইনকে সমর্থন করে।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীদের প্রতি আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন ভিয়েতনাম পার্টির সমর্থন এর প্রমাণ। এ সমর্থন বিপ্লবে কোন সহায়তা করার পরিবর্তে বিপ্লব বিঘ্ন করছে।
আমাদের সঠিক পার্টির প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন বিশেষ করে ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিসমূহের সমর্থন পাবার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
১০) জনৈক কমরেড প্রসঙ্গে’ দলিলটি পাঠ ও পর্যালােচনা করা হয় এবং মতামত দেওয়া হয়।
১১) ফেব্রুয়ারীর মাঝে সদস্য/প্রার্থী সদস্য ফর্ম (যারা পূরণ করেননি) পূরণ করে জমা দিতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৪০

সর্বনিম্ন মানদণ্ডঃ
– সক্রিয় কর্মী,
– কমপক্ষে ৬ মাস কাজ করেছে,
– বয়স সর্বনিম্ন ১৬ বৎসর।
১২) ১৬ই ডিসেম্বর হরতাল সংক্রান্তঃ
১৬ই ডিসেম্বরের হরতাল আহ্বান একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন সিদ্ধান্ত। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্টি অর্জন করেছে গণসংগ্রাম পরিচালনার মহান অভিজ্ঞতা, ব্যাপক গণসমর্থন, পার্টির অভূতপূর্ব প্রচার, সংশােধনবাদীদের দাঁতভাঙ্গা জবাব।
কেন্দ্রীয় ভিত্তিক হরতালের অভিজ্ঞতার সারসংকলন প্রদান করা হবে।
বরিশাল, মাদারীপুরে পূর্ণাঙ্গ হরতাল পালন এবং ঢাকা-টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন অংশে আংশিক হরতাল পালনের জন্য উপরােক্ত জেলাসমূহের কমরেড ও জনগণকে অভিনন্দন জানানাে হচ্ছে।
১৩) প্রতি অঞ্চলে কমপক্ষে একজন অনুসন্ধানকারী নিয়ােগ করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৪১

জনৈক কমরেড প্রসঙ্গে
(ডিসেম্বর, ১৯৭৩)
[১৯৭৩ সালে কমরেড ঝিনুক কিছু লাইনগত ভিন্নমত ও বক্তব্য পার্টিতে উত্থাপন করেন। তার বক্তব্যকে খণ্ডন ও বিরােধিতা করে কমরেড সিরাজ সিকদার এই নিবন্ধটি রচনা করেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ডিসেম্বর ‘৭৩-এ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

লাইন সঠিক হলে দুর্বল শক্তি সবল হয়ে উঠতে পারে, সশস্ত্র শক্তি না থাকলে তা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলেও তা অর্জিত হতে পারে। লাইন ভুল হলে বিপ্লব বিঘ্নিত হবে এবং পূর্বঅর্জিত ফলও খােয়া যাবে।
সঠিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ না থাকাটা হচ্ছে আত্মা না থাকার সমান।
সঠিক রাজনৈতিক লাইন সঠিক সামরিক ও সাংগঠনিক লাইনে প্রকাশ পায়।
একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির যে কোন কার্যকলাপই হলাে নীতি পালন করা।
নীতি ও কৌশলই হলাে পার্টির প্রাণ।

১.
জনৈক কমরেড বলেন, আমাদের বিজয় হচ্ছে শক্তিশালী ও যথাযথ কৌশলগত লাইনের জন্য। এজন্য আমাদের রাজনৈতিক লাইনকে নির্ভুল বলতে পারি না। তার এ বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে মার্কসবাদ পরিপন্থী এবং মার্কসবাদের ক-খ-গ না বুঝার প্রমাণ।
কৌশলগত ও রণনৈতিক লাইন পরস্পর যুক্ত ও নির্ভরশীল। কৌশলগত লাইন। হচ্ছে রণনৈতিক লাইন বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া/স্তর। রণনৈতিক লাইনের সঠিকতার উপর নির্ভর করছে কৌশলগত লাইনের সঠিকতা। আবার কৌশলগত লাইনের সঠিকতা ও সাফল্যজনক বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করছে রণনৈতিক লাইনের বিজয়।
মূল লাইন ভুল হলে তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বা স্তরগত কার্যক্রম অর্থাৎ কৌশলগত লাইন ভুল হতে বাধ্য। তা কখনাে শক্তিশালী ও সঠিক হতে পারে না এবং তা বিজয় আনয়ন করতে পারে না।

রাজনীতি কি?
রাজনীতি হচ্ছে এক শ্রেণীর অন্য শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অর্থাৎ শ্রেণী সংগ্রাম। এ কারণে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যকার সকল সংগ্রাম হচ্ছে রাজনৈতিক সংগ্রাম।
এ কারণে সামরিক, সাংগঠনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এমন কি মতাদর্শগত সংগ্রামও শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে পড়ে এবং এদিক দিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামের আওতায় পড়ে।
এ কারণেই রাজনীতি-শ্রেণী সংগ্রাম হচ্ছে সকল কাজের প্রাণবিন্দু। এ কারণেই রাজনৈতিক লাইনের ভুল ও নির্ভুলতার উপর অন্যান্য লাইনের
পৃষ্ঠা: ৫৪২

সামরিক, সাংগঠনিক, মতাদর্শগত ও অন্যান্য লাইনের (রণনৈতিক ও রণকৌশলগত)। ভুল ও নির্ভুলতা নির্ভর করে।
উপরন্তু একটি রাজনৈতিক পার্টির প্রাণ অর্থাৎ মৌলিক শ্রেণী সংগ্রামের লাইন অর্থাৎ রাজনৈতিক লাইনের উপর নির্ভর করছে কেডার ও জনগণকে জাগরিত, একত্রিত ও কাজে লাগানাে এবং তাদের আত্মবলিদানের ভিত্তি।
রাজনৈতিক লাইনের ভুল থাকলে কখনাে পার্টি বিকাশ লাভ ও বিজয় অর্জন করতে পারে না। পার্টির বিকাশ ব্যাহত হয়, বিজয় খােয়া যায়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সঠিক রাজনৈতিক লাইন নিয়ে জন্মলাভ করে, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বিকাশ লাভ করে এবং শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করে। উক্ত কমরেড আমাদের অতীতের রাজনৈতিক লাইনের নির্ভুলতার জন্যই পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলেন, কোন কৌশলগত কারণে নয় নিশ্চয়ই। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তার সঠিক রাজনৈতিক লাইনের জন্যই পাক সামরিক ফ্যাসিস্ট ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে প্রতিরােধ সংগ্রাম চালায়। একমাত্র পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিই এ সময়কার মারাত্মক প্রতিকুলতার মাঝে টিকে থাকে।
পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তার সঠিক রাজনৈতিক লাইনের কারণেই বিকাশ লাভ করে, চক্র ও উপদলবাদের বিরুদ্ধে সাফল্যের সাথে সংগ্রাম করে বিজয় অর্জন করে, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী হয় এবং সাংগঠনিক সুসংবদ্ধতা অর্জন করে এবং মহান বর্ষাকালীন রণনেতিক আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সঠিক রাজনৈতিক লাইনের কারণেই বর্তমানে সবচাইতে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি হিসেবে ব্যাপক জনগণের, এমন কি শত্রুর নিকটও স্বীকৃতি পেয়েছে। পার্টি পূর্ব বাংলার সকল জেলায় বিকাশ লাভ করছে এবং জাতীয় গণভিত্তিক পার্টি হিসেবে গড়ে উঠছে।
সামরিক ক্ষেত্রে পার্টি অর্জন করেছে ঐতিহাসিক সাফল্য।
পূর্ব বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম একটি বামপন্থী সংগঠনের উপর জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস গড়ে উঠেছে।
পূর্ব বাংলার ইতিহাসে এই প্রথম বাঙালী ও পাহাড়ী জাতিসত্তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে উঠেছে।
পার্টির এ সকল ঐতিহাসিক সাফল্যসমূহ অর্জিত হয়েছে পার্টির সঠিক রাজনৈতিক লাইন এবং তা দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য লাইনের জন্য।
এ সঠিকতা বাস্তব অনুশীলনের অগ্নি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।
পক্ষান্তরে বাস্তব অনুশীলন প্রমাণ করছে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইন ভুল এবং তারা প্রতিনিয়ত বিভক্ত ও ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে এবং লয় পেয়ে যাচ্ছে।
পার্টির রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইনের সঠিকতা এবং বিজয়ের উপর ব্যাপক কর্মী, গেরিলা ও সহানুভূতিশীল এমন কি জনগণও আস্থাশীল।
উক্ত কমরেড বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সাফল্যের জন্য অভিনন্দনপত্র লেখেন কিন্তু রাজনৈতিক লাইন ভুল বলেন।
পৃষ্ঠা: ৫৪৩

সামরিক লাইন নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক লাইন দ্বারা এবং রাজনৈতিক লাইনকে সেবা করে।
আমাদের রাজনৈতিক লাইন সঠিক না হলে আমাদের সামরিক লাইন ঠিক হতে পারত না।
কাজেই উক্ত কমরেডের অভিনন্দন সঠিক রাজনৈতিক লাইনেরই প্রাপ্য।

২.
‘ভুল রাজনৈতিক লাইন বিজয় অর্জন করতে পারে’- এ বক্তব্য প্রমাণ করতে যেয়ে উক্ত কমরেড কিউবার উদাহরণ দিয়েছেন।
কিন্তু এই উদাহরণ তার নিজের বক্তব্যকেই খণ্ডন করে। কিউবার রাজনৈতিক লাইন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লাইন ভুল ছিল না। তাদের যুদ্ধ পরিচালনার পদ্ধতি হয়েছে বামঝোকা বুর্জোয়াদের মত।
বিপ্লব উত্তরকালে দেশীয়-আন্তর্জাতিক শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাদের ভুল রয়েছে। এ ভুল তাদের বিজয়কে ব্যাহত করেছে, বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনাকে জোরদার করেছে।
এছাড়া আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের লাইন হিসেবে গ্রহণের জন্য তারা যে সকল তত্ত্ব দেয়-বিপ্লব রপ্তানী করা, বিপ্লব পরিচালনার জন্য বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বের প্রয়ােজনীয়তা অস্বীকার করা, জনগণের উপর নির্ভর না করেই বিপ্লব করা, সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামের প্রয়ােজনীয়তাকে অস্বীকার করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের ভুল রয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী কিউবার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্ব বিপ্লবের একটি মহান বিজয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে কিউবার ভুল হয়েছে।
উক্ত কমরেড বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণে ব্যর্থ হন, কিউবার জাতীয় গণতান্ত্রিক স্তরের মহান বিজয়কে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে) এ বিজয়কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ বলে আক্রমণ করেন এবং এ কারণে এ বিজয় না হলে তিনি খুশী হতেন এমন সাম্রাজ্যবাদীদের অনুরূপ যুক্তি তােলেন।
একই যুক্তি ধরে তিনি বলেন আমাদের ভুল লাইনের বিজয় হলে আন্তর্জাতিক সর্বহারা আন্দোলনে বিভ্রান্তি হবে, অতএব আমাদের বিজয় হওয়া উচিত নয়।
এটা পার্টির কোন সদস্য, সহানুভূতিশীল, এমন কি সমর্থক জনগণও কামনা করেন না।
এটা কেবলমাত্র শত্রু শ্রেণীভুক্ত প্রতিবিপ্লবীদেরই কামনা। তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি উক্ত কমরেডকে শত্রু শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিদের অনুরূপ কামনায় প্ররােচিত করেছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীন ও ভিয়েতনামের পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির তথাকথিত ভুল লাইনের বিজয় হলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে এরূপ মতপার্থক্য সৃষ্টি হবে।
বর্তমান কমিউনিস্ট আন্দোলনে কোন কোন ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টি সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামকে প্রয়ােজন বলে মনে করছেন না। এটা তাদের দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি।
পক্ষান্তরে মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সর্বহারা দৃঢ়তায় অটল থেকে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সংশােধনবাদ বিরােধী মহান সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৫৪৪

আমাদের পার্টি ও বিশ্বের সর্বহারা বিপ্লবীরা এ সংগ্রামকে সমর্থন করে এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের পবিত্রতা রক্ষার জন্য চীনা পার্টির নিকট কৃতজ্ঞ।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভিয়েতনাম ও চীনা পার্টির পার্থক্য হচ্ছে আধুনিক সংশােধনবাদের প্রশ্নে চীনা ও ভিয়েতনাম পার্টির পার্থক্যের পরিণতি।
এ পার্থক্য বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের ফলে সৃষ্টি হয়নি, এটা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশােধনবাদকে বিরােধিতা করা হবে কি হবে না এ থেকে সৃষ্টি হয়েছে।
উপরন্তু পূর্ব বাংলার বিপ্লবের মৌলিক লাইন ও কৌশল পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে মার্কসবাদের বিশেষ প্রয়ােগের ভিত্তিতেই রচিত হবে, বাইরের কোন পার্টির বা। দেশ দ্বারা নির্ধারিত হবে না। কাজেই পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যে লাইন পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি আনয়ন করবে তাকেই ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিসমূহ সমর্থন করবে। ইহা তাদের মাঝে কোন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে না।
আমাদের লাইনের বিজয়, বিপ্লবের বিজয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে, এ কথা বলার অর্থ হচ্ছে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদকে অস্বীকার করা, ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিসমূহের পূর্ব বাংলার বিপ্লবে হস্তক্ষেপের ভুল তত্ত্বকে স্বীকার করা।

৩.
উক্ত কমরেড মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়ােগ এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ নিয়মও জানেন না।
উপরন্তু একটি দেশ কতগুলাে দেশের স্বীকৃতি পেলেই স্বাধীন (… ?)। তার প্রমাণ। হচ্ছে মঙ্গোলিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং অন্যান্য পূর্ব ইউরােপীয় দেশ। এ সকল দেশের সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু মঙ্গোলিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া হচ্ছে সােভিয়েটের উপনিবেশ, অন্যান্যগুলাে তার উপর নির্ভরশীল দেশ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই বক্তব্য প্রযােজ্য।
উক্ত কমরেড বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতের নয়া উপনিবেশ।
নয়া উপনিবেশের উদ্ভব হয় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। এ ধরনের উপনিবেশবাদীরা তাবেদার সরকার, পুঁজি প্রভৃতির মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
এটা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের মধ্যকার সম্পর্কের একটি রূপ।
পূর্ব বাংলাকে ভারতের নয়া উপনিবেশ বলার অর্থ হচ্ছে ভারতকে সাম্রাজ্যবাদের সমপর্যায়ভূক্ত করা।
এটা বাস্তব অবস্থার সাথে সম্পূর্ণরূপে অসঙ্গতিপূর্ণ। ভারত হচ্ছে একটি আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ যার সম্প্রসারণবাদী চরিত্র রয়েছে।
পূর্ব বাংলা ভারতের নয়া উপনিবেশ-এ ভুল লাইন থেকে উদ্ভব হয়েছে অন্যান্য ভুল লাইন ও কৌশল যার পরিণতি বিপর্যয় ও ধ্বংস।
পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক লাইন-পূর্ব বাংলা ভারতের উপনিবেশ, পূর্ব বাংলা ও ভারতের বাস্তব অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার উপর উপনিবেশিক শােষণ ও নিয়ন্ত্রণ গােপন করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৫৪৫

উক্ত কমরেড ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের এ চাতুরীতে বিভ্রান্ত হয়েছেন; এর সাথে যুক্ত হয়েছে তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি। যার পরিণতি হিসেবে পূর্ব বাংলাকে তিনি ভারতের নয়া উপনিবেশ বলেছেন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সঠিক রাজনৈতিক লাইন ও তা থেকে নির্ধারিত অন্যান্য লাইন ইতিমধ্যেই পার্টির সকল কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক এমন কি ব্যাপক জনগণের দ্বারা গৃহীত হয়েছে। পার্টির সঠিক লাইন ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পন্ন বিজয় আনয়ন করেছে।
একমাত্র উক্ত কমরেডই এর ব্যতিক্রম। উক্ত কমরেড বলেছেন বর্তমান যুগে উপনিবেশের তত্ত্ব হাস্যস্পদ।
এ যুগে উপনিবেশের তত্ত্ব হাস্যস্পদ অর্থাৎ বর্তমান যুগে উপনিবেশ হতে পারে না। অর্থাৎ কোন জাতি বা দেশকে পদানত করতে পারে এরূপ সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ বা প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠী পৃথিবীতে নেই।
এ তত্ত্ব বিশ্বের বর্তমান অবস্থার সাথে সম্পূর্ণরূপে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও হাস্যস্পদ কল্পনাবাদীদের তত্ত্ব।
বিশ্বে এখনাে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, পুরােনাে উপনিবেশবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল শাসক গােষ্ঠী বিদ্যমান, উপনিবেশ ও নির্ভরশীল দেশ বিদ্যমান।
উক্ত কমরেডের এ তত্ত্ব বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের “আধা-উপনিবেশের উপনিবেশ হয় না” তত্ত্বের অনুরূপ বস্তা পচা মাল।
বর্তমান যুগে উপনিবেশের তত্ত্ব যদি হাস্যস্পদ হয় তবে সর্বহারা পার্টির সকল লাইন, এর বিজয় এবং এতে আস্থাশীল কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক ও জনগণ হাস্যস্পদ। অর্থাৎ সকলেই হাস্যস্পদ, একমাত্র উক্ত কমরেডই হচ্ছে বিজ্ঞ। নিজের বিজ্ঞতার প্রমাণ হিসেবে জাহির করেছেন নিম্ন যুক্তি-শ্রমিক আন্দোলনের সময় কমরেড সিরাজ সিকদারের যে মানদণ্ড ছিল তা অনেকেই অর্জন করেছে অর্থাৎ তিনিও অর্জন করেছেন।

৪. নিজেকে একমাত্র বিজ্ঞ, ঠিক ও যােগ্য মনে করা এবং অন্য সকল কমরেডকে হাস্যস্পদ মনে করার উৎস কোথায়?
এ মনােভাবের উৎস ক্ষুদে বুর্জোয়াদের গােড়ামীবাদের মাঝে নিহিত।
গােড়ামীবাদীরা জনগণ থেকে আসা জনগণের নিকট নিয়ে যাওয়ার বস্তুবাদী কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে না। কতগুলাে তত্ত্ব ও পুস্তক এবং মার্কসবাদের বুলি মুখস্থ করে, নিজেদেরকে মস্ত পণ্ডিত মনে করে, লেজ ফুলিয়ে আকাশে তােলে, কমরেড ও জনগণকে হেয়, অজ্ঞ ও হাস্যস্পদ মনে করে। এভাবে জনগণ থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
উক্ত কমরেড জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নিজের মারাত্মক ভুল লাইন আঁকড়ে ধরেন, কমরেড ও জনগণ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন, বিভিন্ন লাইন-এমন কি রাজনৈতিক লাইনে মতপার্থক্য পােষণ করেন বলে সামরিক কাজ অন্যকে দিতে বলেন, এভাবে পার্টি থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।
পৃষ্ঠা: ৫৪৬

এছাড়াও উক্ত কমরেডের গােড়ামীবাদী বিচ্যুতি-অপ্রয়ােজনীয়ভাবে বিরাট বিরাট দলিল লেখা, তা সর্বস্তরে পড়ানাে এবং পেশ করতে বলা, (যাতে সকলেই তার পাণ্ডিত্যে তাক লাগে), সাধারণ প্রশ্ন বুঝতে না চেয়ে গেড়া পাকানাে, নিজেকে সঠিক যােগ্য মনে করা, অন্যদের হাস্যস্পদ ও অযােগ্য মনে করার মাঝে প্রকাশ পায়।
উক্ত কমরেড ফজলু-সুলতান চক্রের অনুরূপ ক. সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্বের জনপ্রিয়তাকে পছন্দ করেন না। এতে ঐক্য বিনষ্ট হবে এ অজুহাত দেখিয়ে সঠিক নেতৃত্বকে জনগণ ও সর্বহারা বিপ্লবীদের নিকট গােপন রাখতে চান।
উক্ত কমরেডের সামন্ত শ্রেণী ভিত্তি, গােড়ামীবাদী বিচ্যুতি, অন্যান্য ত্রুটি এবং নিজের ভুল লাইন ও তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি খুবই বিপজ্জনক।
সমগ্র পার্টিকে অবশ্যই এ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আশা করা হচ্ছে উক্ত কমরেড উপরােক্ত বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুলসমূহ বিচার করবেন, নিজেকে সংশােধনে ব্রতী হবেন এবং সংশােধন করে জনগণের মুক্তির জন্য শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাবেন।

নােটঃ
রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল না করে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে ইতালির কমিউনিস্ট
পার্টির প্রধান তােগলিয়াত্তি (মৃত)। আধুনিক সংশােধনবাদীরা তােগলিয়াত্তির তত্ত্বমালা দ্বারাই মূলতঃ পরিচালিত।
পৃষ্ঠা: ৫৪৭

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির একাদশ অধিবেশনের ইশতেহার
(প্রথমার্ধ, ১৯৭৪)

১. শত্রুর আত্মসমর্পণ ও জনগণের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ সংক্রান্তঃ
শক্র সংক্রান্তঃ
নিম্নলিখিত শর্তসমূহ পালন করলে শত্রুর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করা যায়।
১) আমাদের বিরুদ্ধে তৎপরতা (প্রকাশ্যে/গােপনে) চালানাে থেকে বিরত থাকবে। ২) জনগণের চরম ঘৃণার সৃষ্টি হতে পারে এইরূপ কাজ থেকে বিরত থাকবে। ৩) শত্রুর তৎপরতা সম্পর্কে নিয়মিত খবর সরবরাহ করবে। ৪) আমাদেরকে নিয়মিত চাঁদা ও অন্যান্য সাহায্য দেবে। ৫) তার আওতাধীন অস্ত্র-শস্ত্র জমা দেবে। ৬) ব্যাপক হারে শত্রুদের আত্মসমর্পণ করানাে উচিত, যাতে শক্র কমানাে যায়। ৭) শত্রুর মধ্যকার দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে এবং শক্রর সহায়তায় অপর শত্রুকে উৎখাত করা যায়।
* জনগণ সংক্রান্তঃ
১) জনগণ সাধ্য অনুযায়ী চাঁদা প্রদান করবে। ২) প্রতি গ্রামের প্রতি পরিবার থেকে চাঁদা সংগ্রহ করতে হবে। ৩) ভারতে গমনেচ্ছুক জনগণকে না যেতে আহ্বান জানানাে। গমনেচ্ছুক শত্রুশ্রেণীভুক্তদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
২. সামরিকঃ
* জাতীয় শত্রুদের খতম ও সশস্ত্র প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে গেরিলাদের ট্রেইন করতে হবে।
গেরিলাদের সামরিক সংগঠনভুক্ত করতে হবে।
* ডাকাত নির্মূল এবং সামাজিক দুর্নীতি ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরােধী (সংস্কৃতি হেডিং দ্রষ্টব্য) তৎপরতা পরিচালনা করে ব্যাপক জনগণকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসতে হবে।
* সাদা পােষাকধারী গােয়েন্দা ও রক্ষীদের তৎপরতা প্রতিহত করতে হবে।
৩. পার্টি কেডার সংক্রান্তঃ
* কর্মী, গেরিলা বা সহানুভূতিশীলদের মধ্যে ভাড়াটে মনােভাবের সৃষ্টি হতে পারে এমন কোন কাজ করা উচিত নয়।
পৃষ্ঠা: ৫৪৮

পার্টির কোন কর্মীর উপর নির্ভরশীল আত্মীয়-স্বজন পার্টির অভ্যন্তরে এলেও তাদের দায়িত্ব পার্টি গ্রহণ করতে পারে।
এরূপ ক্ষেত্রে উক্ত কমরেড শহীদ বা গ্রেফতারকৃত হলেও ইহা প্রযােজ্য।
* মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে উন্নততর নেতৃত্ব গড়ে তােলা।এ প্রসঙ্গে নেতৃত্ব বিষয়ক পাঠ্যসূচী সম্ভাবনাময় কর্মীদের তালিকা তৈরী করে পড়ানাে এবং পরিকল্পিতভাবে তাদেরকে নেতৃত্ব প্রদানের বিষয়ে ট্রেইন করে তােলা।
নেতৃত্ব ট্রেইন করার বিষয় পরিচালকের উচিত তার আওতাধীন কর্মীদেরকে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করতে দেওয়া (পরিচালকের উপর নির্ভরশীল করে গড়ে তােলা উচিত নয়)।
* মতামত, বক্তব্য, সমালােচনা, প্রস্তাব পেশের ক্ষেত্রে সংগঠনের স্তরসমূহই অনুমােদিত চ্যানেল (নিজের পরিচালক বা তার পরবর্তী উচ্চস্তরসমূহ বা সরাসরি কেন্দ্রীয় কমিটি)।
অনুমােদিত চ্যানেলের বাইরে বক্তব্য বা মতামত পেশ করা হচ্ছে পার্টির শৃঙ্খলা বিরােধী এবং চক্রের অনুরূপ কাজ।
উপরােক্ত কাজের জন্য চ্যানেল বহির্ভূত কোন মাধ্যম দাবী করা উচিত নয়। সর্বহারা শ্ৰেণী বুর্জোয়াদের মত উকিল বা ঐ ধরনের কোন মাধ্যম উচ্চস্তর-নিম্নস্তর সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাখতে পারে না। উচ্চস্তরের নিকট বক্তব্য পেশ করা যায় না, সব কথা। বলতে পারি না, মাধ্যম থাকা উচিত, উচ্চস্তরের সামনে গেলে সব কথা ভুলে যাই, মুক্ত মন হতে পারি না। এগুলি সামন্ত পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক সম্পর্ক এবং নিজকে উচ্চস্তরের নিকট ভাল মানুষ সাজাবার আকাঙ্খ থেকে (তার কথাবার্তায় ক্রটি প্রকাশ পেলে উচ্চস্তরের ধারণা খারাপ হতে পারে এটি চিন্তা করে) উদ্ভূত চিন্তা ও অভ্যাস। ইহা সর্বহারা চিন্তা ও অভ্যাসের পরিপন্থী। এই ক্রটি কর্মীরা প্রচেষ্টা চালিয়ে দূর করবেন এবং উচ্চস্তরের বা যথাযথ চ্যানেলের নিকট মুক্ত মনে নিজের বক্তব্য, প্রস্তাব, সমালােচনা, সমস্যা পুরােপুরি তুলে ধরতে সাহসী হবেন।
উচ্চস্তরের উচিত নিম্নস্তরকে বক্তব্য পেশ করতে উদ্বুদ্ধ করা এবং তাদের উল্লিখিত ত্রুটি দূর করতে তাদেরকে সচেতন করে তােলা।
* কোন সমস্যা, প্রস্তাব, সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার মনােভাব হচ্ছে সুবিধাবাদী মনোেভাব। শ্রেণী সংগ্রামে কোন নিরপেক্ষতা নেই। হয় সর্বহারার পক্ষ, নয় বুর্জোয়া পক্ষ অবলম্বন করা। সুতরাং প্রতিটি প্রশ্নে আমাদেরকে অবশ্যই একটি পক্ষ অবলম্বন করতে হবে।
* পার্টির অভ্যন্তরে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের ভিত্তিতে ক্ষুদে দলবাদের মনােভাব ও কার্যকলাপের বিরােধিতা করতে হবে। ইহা পার্টির মধ্যে উপদল ও চক্রের সৃষ্টি করে ও স্তরভঙ্গ করে। ইহা ক্ষুদে উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে আসা একটি ক্রটি।
৪. সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেঃ
বর্তমান মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে সংগঠনের অভ্যন্তরস্থ কর্মীদের অসর্বহারা সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহার দূর করা। ইহা সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণের জন্য প্রয়ােজন।
প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামী লীগ সরকার ও তার প্রভুরা পরিকল্পিতভাবে পূর্ব বাংলায় প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির বন্যার সৃষ্টি করছে, পূর্ব বাংলার জনগণ এবং আমাদের পার্টিকর্মীদের আচ্ছন্ন করে ফেলার জন্য। কাজেই পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে প্রতিক্রিয়াশীল
পৃষ্ঠা: ৫৪৯

সংস্কৃতি বিরােধী ব্যাপক সংগ্রাম শুরু করা অপরিহার্য। অন্যথায় পার্টি-কর্মী এবং জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির প্রভাব থেকে রক্ষা করা অসম্ভব হবে।
এই সংগ্রাম প্রতিনিয়তই চালাতে হবে।
সংগঠনের অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট সংস্কৃতি এবং জনগণের মধ্যে, পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি (ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ এবং আমলা পুঁজি বিরােধী) চালু করতে হবে।
আমাদের নিয়ন্ত্রিত বা আমাদের তৎপরতা পরিচালনা করা যায় এরূপ গ্রামাঞ্চলে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে
– ডাকাত নির্মূল,
– চোর উৎখাত,
– জুয়া বন্ধ,
– মদ, গাজাসহ সকল প্রকার নেশা বন্ধ করা,
– গণিকালয়সহ অন্যান্য সকল প্রকার যৌনভ্রষ্টতা বন্ধ করা,
– সুদখােরদের শােষণ নিয়ন্ত্রিত করা।
শহরে প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিরােধী জনমত সৃষ্টি করা, প্রতিক্রিয়াশীল শিল্প, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনার বিরােধিতা করা। সাহিত্য, শিল্প, চলচ্চিত্র, পত্রিকা, ম্যাগাজিন প্রভৃতিতে যৌনতা ও অশ্লীলতার (পর্ণোগ্রাফী) বিরােধিতা করা, যৌন সংক্রান্ত ভ্রষ্টতা ও উশৃংখলতার বিরােধিতা, মদ, গাঁজাসহ বিভিন্ন নেশা ও জুয়া খেলা বিরােধিতা করা। একই সময়ে নারী স্বাধীনতার পক্ষে প্রচার চালানাে।
উল্লিখিত বিষয়সমূহ কার্যকরী করার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরােধী আন্দোলন পরিচালনার সময় বাম বিচ্যুতি পরিহার করা (স্কুল, কলেজ পােড়ানাে, মূর্তি, মনুমেন্ট ভাঙ্গা, নারী স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটানাে)।
পার্টির অভ্যন্তরেও অসর্বহারা ও প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরােধী সংগ্রাম আরাে কঠোরভাবে পরিচালনা করা এবং সর্বহারার সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহারের প্রবর্তন করা।
সর্বস্তরে ও সকল এলাকায় প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি বিরােধী এই আন্দোলন গুরুত্ব সহকারে পরিচালনা করতে হবে।
* পার্টি কেডাররা পরস্পর দেখা-সাক্ষাতের সময় বা অবসর যাপনের সময় আচ্ছা, বিকৃত ও অশ্লীল হাস্যকৌতুক করা, ব্যক্তিগত বিষয় (নিজের বা অপরের) আলাপ করা বা আজেবাজে গল্প করা থেকে বিরত থাকবেন।
অবসর যাপনের সময় অভিজ্ঞতা বিনিময়, পড়াশুনা, দলিলাদি নিয়ে আলােচনা, পুস্তক, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিষয়ে মতামত বিনিময়, দেশীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা করা উচিত।
পৃষ্ঠা: ৫৫০

আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় পয়েন্ট
(ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪)
সম্প্রতি আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত অসাবধানতার জন্য একজন ভাল কমরেড দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন।
এ কারণে অস্ত্র সংক্রান্ত নিয়মবিধি রচনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নিয়মবিধি নিম্নরূপ :
১। কোন আগ্নেয়াস্ত্র কোন কমরেড/গেরিলা/জনগণের দিকে তাক না করা, ট্রিগার টেপা।
২। অস্ত্র হস্তান্তরের সময় নল যেন কোন কমরেড/গেরিলা/জনগণের দিকে না থাকে।
৩। যুদ্ধরত অবস্থা ছাড়া চেম্বারে গুলি না রাখা।
৪। যুদ্ধ শেষে চেম্বার খালি করা।
৫। যুদ্ধরত অবস্থা ব্যতীত সেফটিকেস ডাউন রাখা।
৬। বেয়নেট প্রাকটিস/এরূপ সময় যখন অস্ত্র নিয়ে মুখােমুখি অনুশীলন করতে হয় তখন চেম্বার খালি কিনা তা চেক করা, ম্যাগাজিন খুলে রাখা।
৭। বিস্ফোরণ ঘটতে পারে এরূপ দ্রব্যাদি নিরাপদ দূরত্বে/স্থানে রাখা।
৮। অপ্রয়ােজনীয়ভাবে একটি গুলিও নষ্ট না করা।
৯। অস্ত্র নিয়মিত পরিষ্কার রাখা।
১০। প্রাণের বিনিময়েও অস্ত্র রক্ষা করা।
গেরিলারা উপরােক্ত নিয়মবিধি পালন করছে কিনা তা কমান্ডার ভালভাবে চেক করবে।
প্রতি গেরিলা, কমান্ডার এ সার্কুলারের পয়েন্টসমূহ অভ্যাসে পরিণত করবে।
সর্বোচ্চ পরিচালকমণ্ডলী,
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী।
পৃষ্ঠা: ৫৫১

সামরিক শিক্ষা গ্রহণ সংক্রান্ত সার্কুলার
(ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সকল কমরেড মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরনের সময় সামরিক লাইনেও শিক্ষা গ্রহণ করবেন, অস্ত্র চালনা শিখবেন।
প্রতি অঞ্চল এ নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি,
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
পৃষ্ঠা: ৫৫২

সামরিক সংগঠন সম্পর্কিত সার্কুলার
(ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৪)

পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীকে সামরিক সংগঠনে সংগঠিত করতে হবে।
১। গেরিলাদের গেরিলা গ্রুপে সংগঠিত করতে হবে। গেরিলা গ্রুপে সদস্য সংখ্যা তিন অথবা পাঁচ অথবা সাত অথবা নয় জন।
এর মাঝে-
কমান্ডার- ১ জন
সহকারী কমান্ডার- ১ জন
বাকীরা সদস্য।
২। তিনটি গেরিলা গ্রুপ নিয়ে একটি প্লাটুন গঠিত হবে। প্লাটুনের একটি কমান্ড স্টাফ থাকবে।
রাজনৈতিক কমিশার- ১ জন।
কমান্ডার- ১ জন।
সহকারী কমান্ডার- ১ জন।
কুরিয়ার- ৩ জন।
৩। তিনটি প্লাটুন ও একটি মেডিকেল গ্রুপ নিয়ে একটি কোম্পানী গড়ে তুলতে হবে।
কোম্পানী কমান্ড স্টাফ নিম্নরূপঃ
কোম্পানী রাজনৈতিক কমিশার- ১ জন।
কোম্পানী কমান্ডার- ১ জন।
কোম্পানী সহকারী কমান্ডার- ১ জন।
কুরিয়ার- ৪ জন।
কোম্পানী পার্টি শাখা কমিটি গড়ে তােলা।
সম্পাদক- ১ জন।
সহ-সম্পাদক- ১ জন।
বাকীরা সদস্য।
কোম্পানী কমিশার পার্টি কমিটির সম্পাদক হতে পারে।
৪। প্লাটুন/কোম্পানী তিনটির অধিক একক নিয়ে গড়ে উঠতে পারে।
৫। গেরিলা গ্রুপ, প্লাটুন, কোম্পানীগুলােকে ট্রেইন ও সশস্ত্র করা। এদেরকে উন্নত, মাঝারী, পশ্চাদপদ এ তিন ভাগে ভাগ করা।
৬। বর্ষাকাল শুরু হওয়ার পূর্বেই উপরােক্ত কাজ সম্পন্ন করা।
সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলী,
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী।

পৃষ্ঠা: ৫৫৩

পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার কতিপয় সমস্যা
(৩০ এপ্রিল, ১৯৭৪)
[পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে এর সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলীর বিবৃতি হিসেবে দলিলটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটি “৩০শে এপ্রিলের বিবৃতি” নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত -প্রকাশক।]

১. ভূমিকা
১৯৭১ সালের ৩০শে এপ্রিল বরিশালের পেয়ারা বাগান (বরিশাল সদর, বানারীপাড়া, ঝালকাঠি, কাউখালি, স্বরূপকাঠি থানার সীমান্তবর্তী আটঘর, কুড়িয়ানা, ভীমরুলী, ডুমুরিয়া এবং অন্যান্য গ্রাম) পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে।
এভাবে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বহারা বিপ্লবীদের নেতৃত্বে একটি নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে।
কমরেড সিরাজ সিকদারের সরাসরি পরিচালনায় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ বাহিনী গড়ে উঠে। এ সশস্ত্র বাহিনী এমন একটি সময় গড়ে উঠে যখন পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রচণ্ড রণনৈতিক আক্রমণের মুখে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের সকল প্রতিরােধ ভেঙ্গে পড়ে, তারা পূর্ব বাংলার জনগণকে অসহায় অবস্থায় রেখে গা বাঁচানাের জন্য ভারতে পলায়ন করে।
পূর্ব বাংলায় পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রতিরােধ করার মতাে কোন শক্তিই তখন অবশিষ্ট ছিল না।
এ সময় পেয়ারা বাগানের মুক্তি বাহিনী বীরত্বের সাথে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে এবং পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিরােধ গড়ে তােলে, বিশাল এলাকা মুক্ত করে ঘাটি এলাকা স্থাপন করে, সশস্ত্র সংগ্রাম, জনগণকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করে, জনগণের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনে।
এ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় ৩রা জুন, ১৯৭১ সাল গড়ে উঠে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে পেয়ারা বাগানে সশস্ত্র তৎপরতার ঐতিহ্য অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী।
পূর্ব বাংলার শত্রুদের পরাজিত ও ধ্বংস করে পূর্ব বাংলার জনগণকে মুক্ত করার জন্য সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী সশস্ত্র সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৫৫৪

এ প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়েছে অতিশয় মূল্যবান অভিজ্ঞতা যা আমাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রাম, পার্টি গড়ে তােলা ও জনগণকে পরিচালনা করতে সক্ষম করে তুলছে। ২. জনগণের সশস্ত্র বাহিনী।
গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ, পূর্ব বাংলার জনগণের উপর নির্মম শােষণ ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। তারা পূর্ব বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক, পূর্ব বাংলার রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সংস্কৃতি তাদের দখলে।
পূর্ব বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থার উপর থেকে এদের মালিকানা উৎখাত করে জনগণ নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
জনগণের এ প্রচেষ্টায় বাধা দিচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকরা। তারা উপরিকাঠামাে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা জনগণকে দাবিয়ে রাখছে, নিজেদেরকে রক্ষা করছে।
কাজেই আমাদেরকে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হচ্ছে উপরিকাঠামাের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ রাষ্ট্র ও তার প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে।
কাজেই সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত করে পুরানাে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে। জনগণের স্বার্থরক্ষা এবং শত্রুদের দাবিয়ে রাখার জন্য নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র, তার প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।
এভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে।
এ নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে জনগণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন-সম্পর্ক কায়েম করতে হবে।
প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থরক্ষাকারী সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত ও ধ্বংস করে পুরানাে রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য প্রয়ােজন একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী।
যেহেতু আমাদের কোন সশস্ত্র বাহিনী নেই, তাই উদ্ভব হয় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার সমস্যা।
জনগণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদনের সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের উৎখাত করতে হবে।
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তবাদকে উৎখাত করতে হবে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে জাতীয় বিপ্লব প্রধান। কারণ দল, মত, জাতি, ধর্ম ও শ্রেণী নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার সকল জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতকদের উৎখাত চান।
এ কারণে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী যুদ্ধের বর্তমান রূপ হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ।
এ জাতীয় বিপ্লব এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যসমূহ ধাপে ধাপে পূরণ করতে হবে।
সামন্তদের উৎখাত, তাদের ভূমি ক্ষেতমজুর-গরীব চাষীদের মাঝে বিতরণ, দেশপ্রেমিক সামন্তদের সুদ-বর্গা হ্রাস, নির্দিষ্ট সীমার অধিক ভূমি বিতরণ ইত্যাদি ভূমি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৫৪

এ প্রক্রিয়ায় অর্জিত হয়েছে অতিশয় মূল্যবান অভিজ্ঞতা যা আমাদেরকে সশস্ত্র সংগ্রাম, পার্টি গড়ে তােলা ও জনগণকে পরিচালনা করতে সক্ষম করে তুলছে।

২. জনগণের সশস্ত্র বাহিনী
গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ, পূর্ব বাংলার জনগণের উপর নির্মম শােষণ ও নিপীড়ন চালাচ্ছে। তারা পূর্ব বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক, পূর্ব বাংলার রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সংস্কৃতি তাদের দখলে।
পূর্ব বাংলার উৎপাদন ব্যবস্থার উপর থেকে এদের মালিকানা উৎখাত করে জনগণ নিজেদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চায় ।
জনগণের এ প্রচেষ্টায় বাধা দিচ্ছে উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকরা। তারা উপরিকাঠামাে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা জনগণকে দাবিয়ে রাখছে, নিজেদেরকে রক্ষা করছে।
কাজেই আমাদেরকে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হচ্ছে উপরিকাঠামাের বিরুদ্ধে প্রধানতঃ রাষ্ট্র ও তার প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে।
কাজেই সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত করে পুরানাে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে। জনগণের স্বার্থরক্ষা এবং শত্রুদের দাবিয়ে রাখার জন্য নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র, তার প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।
এভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে হবে।
এ নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্যে জনগণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদন-সম্পর্ক কায়েম করতে হবে।
প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থরক্ষাকারী সশস্ত্র বাহিনীকে পরাজিত ও ধ্বংস করে পুরানাে রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার জন্য প্রয়ােজন একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী।
যেহেতু আমাদের কোন সশস্ত্র বাহিনী নেই, তাই উদ্ভব হয় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার সমস্যা।
জনগণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ উৎপাদনের সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের উৎখাত করতে হবে।
গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তবাদকে উৎখাত করতে হবে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে জাতীয় বিপ্লব প্রধান। কারণ দল, মত, জাতি, ধর্ম ও শ্রেণী নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার সকল জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতকদের উৎখাত চান।
এ কারণে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী যুদ্ধের বর্তমান রূপ হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ।
এ জাতীয় বিপ্লব এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যসমূহ ধাপে ধাপে পূরণ করতে হবে।
সামন্তদের উৎখাত, তাদের ভূমি ক্ষেতমজুর-গরীব চাষীদের মাঝে বিতরণ, দেশপ্রেমিক সামন্তদের সুদ-বর্গা হ্রাস, নির্দিষ্ট সীমার অধিক ভূমি বিতরণ ইত্যাদি ভূমি সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৫৫

এর ফলে গ্রামের কৃষক সাধারণকে বিপ্লবের পক্ষে টেনে আনা ও পরিচালনা করা সম্ভব হবে।
এভাবে জাতীয় বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমন্বয় সাধন করতে হবে।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা পার্লামেন্টারী নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার কথা বলছে। এভাবে তারা জনগণ ও সর্বহারা বিপ্লবীদের ধােকা দিচ্ছে, প্রতিক্রিয়াশীলদের টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
নয়া সংশােধনবাদীরা সময় হয়নি, সংগঠন হয়নি ইত্যাদি অজুহাতে সশস্ত্র বাহিনী গঠনের বিরােধিতা করে এসেছে। তারা বামপন্থী হটকারী লাইন বা ডানপন্থী সুবিধাবাদী লাইন অনুসরণ করে সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়াকে বিঘ্ন করেছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে এবং পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত সর্বহারা বিপ্লবীরা বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম পরিচালনা করে। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রতি সর্বদাই যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করে।

৩. পূর্ব বাংলার বিপ্লবী যুদ্ধ ও
বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা
পূর্ব বাংলার বিপ্লবের শত্রু হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ এবং তাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা।
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের উপর নির্ভর করে ১৯৭১-এ সশস্ত্র প্রতিরােধ চালায়। সশস্ত্র প্রতিরােধ ভেঙ্গে গেলে তারা ভারতে পলায়ন করে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ও গদির লােভে মীরজাফরের মত পূর্ব বাংলাকে তারা ভারতের নিকট বন্ধক দেয়।
ভারতীয় বাহিনী পাক সামরিক দস্যুদের পরাজিত করে পূর্ব বাংলা দখল করে এবং এখানে তার উপনিবেশ কায়েম করে। তারা আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা পুতুল সরকার গঠন করে।
এ থেকে দেখা যায় কোন কোন ঐতিহাসিক মুহূর্তে বুর্জোয়া শ্রেণী জাতীয় প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থপরতা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবের কারণে বিপ্লবী যুদ্ধকে পূর্ণ বিজয়ের পথে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনিচ্ছুক ও অক্ষম।
কৃষক ও ক্ষুদে বুর্জোয়া জনগণ সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী যুদ্ধে যােগদান করতে এবং সে যুদ্ধকে পূর্ণ বিজয় পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। তারাই হচ্ছে বিপ্লবী যুদ্ধের প্রধান শক্তি। কিন্তু ক্ষুদে উৎপাদনের বৈশিষ্ট্যের কারণে তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টি গণ্ডিবদ্ধ (আবার কিছু সংখ্যক বেকার জনসাধারণের নৈরাজ্যবাদী ভাবধারা আছে)।
চিন্তা ও কাজের ক্ষেত্রে তারা একতরফাবাদ, ভাসাভাসা ভাব এবং আত্মগত ভাব দ্বারা পরিচালিত।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা হয় ডানে বামে দোদুল্যমান। সামরিক ক্ষেত্রে তারা হয়। রক্ষণশীল বা হঠকারী।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে তারা হয় বিভেদপন্থী ও উপদলবাদী।
পৃষ্ঠা: ৫৫৬

কাজেই এদের নেতৃত্বে বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা ও তাকে জয়যুক্ত করা কখনােই সম্ভব নয়। তারা বিপ্লবী যুদ্ধের নির্ভুল পরিচালক হতে পারে না।
এ কারণে যে যুগে সর্বহারা শ্রেণী রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে ইতিমধ্যেই আত্মপ্রকাশ করেছে, সে যুগে বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব অনিবার্যরূপেই এসে পড়ে সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টির কাঁধে। এ সময় কোন যুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণী ও তার। রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বের অভাব ঘটলে অথবা সেই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গেলে সে যুদ্ধ অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হবে।
কারণ পূর্ব বাংলার সমাজের সকল স্তর ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুধুমাত্র সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টিই হচ্ছে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা থেকে সবচেয়ে মুক্ত; রাজনীতিগতভাবে তারাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী দূরদৃষ্টি সম্পন্ন; সবচেয়ে বেশী সংগঠিত আর দুনিয়ার অগ্রগামী সর্বহারা শ্রেণী ও রাজনৈতিক পার্টিগুলাের অভিজ্ঞতাকে তারা সবচাইতে বিনয়ের সাথে গ্রহণ করতে এবং সেই অভিজ্ঞতাকে নিজেদের কার্যে প্রয়ােগ করতে সক্ষম।
তাই কেবলমাত্র সর্বহারা শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টিই কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া ও বুর্জোয়া শ্রেণীর সংকীর্ণতা, বেকার জনসাধারণের ধ্বংসাত্মকতাকে আর বুর্জোয়া শ্রেণীর দোটানা মনােভাব ও শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবার মনােবলের অভাবকে অতিক্রম করতে পারে (অবশ্যই যদি পার্টির নীতিতে ভুল না হয়) এবং বিপ্লব ও যুদ্ধকে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টিকে আভ্যন্তরীণ ক্ষুদে বুর্জোয়াদের মতাদর্শগত পুনর্গঠন চালানাে এবং সংশােধনবাদী ও শত্ৰুচরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, বাইরের ক্ষুদে বুর্জোয়া, বুর্জোয়া এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে’।
সর্বহারা শ্ৰেণীর রাজনৈতিক পার্টিকে নিজ নেতৃত্বে অন্যান্য শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করতে হবে, জাতিভিত্তিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একই সাথে অন্যান্য শ্রেণীর অক্ষমতা, অদৃঢ়তা, বিপ্লব পরিচালনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এরূপ অন্যান্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রাম করতে হবে।
সঠিক রাজনৈতিক লাইন যার ভিত্তিতে ব্যাপক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগ্রামে পরিচালনা করা যায় তা হচ্ছে মৌলিক গুরুত্ব সম্পন্ন।
শুধু রাজনৈতিক লাইন নয়, সামরিক, সাংগঠনিক, মতাদর্শগত ও অন্যান্য লাইনও সঠিক হতে হবে।
লাইন সঠিক হলে ক্ষুদ্র শক্তি বড় হয়, সশস্ত্র শক্তি না থাকলে তা গড়ে উঠে, রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে তা অর্জিত হয়। লাইন ভুল হলে পূর্ব অর্জিত ফল খােয়া যায়।
কাজেই সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টিকে সক্ষম হতে হবে রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক, মতাদর্শগত ও অন্যান্য লাইন সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে এবং তা বাস্তবায়নে কেডার, সৈনিক ও জনগণকে পরিচালনা করতে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি জনগণকে সমাবেশিত ও তাদের উপর নির্ভর করে জাতীয় বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা করছে।
এ কারণে এ যুদ্ধ হচ্ছে গণযুদ্ধ।
একমাত্র পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি গণযুদ্ধ পরিচালনা করে শত্রুদের পরাজিত ও ধ্বংস করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করতে সক্ষম।
পৃষ্ঠা: ৫৫৭

৪. পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী হচ্ছে
সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের বাহিনী
শ্ৰেণী সমাজে প্রতিটি সংগঠনই একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর সেবা করে। সশস্ত্র সংগঠনও একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর স্বার্থের সেবা করে।
সমাজের শ্রেণী বিভাগের পর রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনীর উদ্ভব হয় ক্ষমতাসীন শ্রেণীকে টিকিয়ে রাখার জন্য।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বি.ডি.আর, রক্ষী ও পুলিশ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও তার প্রভুদের টিকিয়ে রাখা।
প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী নিজেদের রক্ষা করা এবং জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য যে রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলছে তাকে পরাজিত ও ধ্বংস করা এবং সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েম ও রক্ষা করা এবং শত্রুদের দাবিয়ে রাখাই সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য।
কাজেই সশস্ত্র বাহিনী একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টির অধীনে থাকে, তাদের স্বার্থের সেবা করে।
শ্রেণীর উর্ধে, রাজনীতির উর্ধে কোন সশস্ত্র বাহিনী থাকতে পারে না।
সশস্ত্র বাহিনী সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতিরেকেই গড়ে তুললে তা কি জনগণের স্বার্থের সেবা করতে পারে?
সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে না তুললে অনিবার্যভাবেই সশস্ত্র বাহিনী তার সদস্যদের শ্রেণীভিত্তিকেই সেবা করবে।
সশস্ত্র বাহিনীতে সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব না থাকায় সেখানে ঢুকে পড়বে আমলা বুর্জোয়া, সামন্ত, ক্ষুদে বুর্জোয়া এবং তাদের শ্রেণী পরিবর্তনেরও কোন প্রয়ােজন হবে না।’
ফলে এ বাহিনী আমলা বুর্জোয়া, সামন্ত, ক্ষুদে বুর্জোয়াদের স্বার্থ রক্ষা করবে, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে না।
এ বাহিনী হবে প্রতিক্রিয়াশীল সমরবাদী বাহিনী।
পক্ষান্তরে আমাদের বাহিনী সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে, সদস্যরা সর্বহারায় রূপান্তরিত হচ্ছে; পার্টি সশস্ত্র বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে ও পরিচালিত করছে।
বর্তমান যুগে কেবলমাত্র সর্বহারা শ্ৰেণীই জনগণের স্বার্থরক্ষা করতে সক্ষম, তাদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত ও মুক্ত করতে সক্ষম।
এ কারণে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র বাহিনী সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে।
সৈন্যবাহিনীতে রাজনৈতিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা, কোম্পানী পর্যায়ে পার্টি শাখা প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ, প্রতিটি সেনাবাহিনী স্থানীয় সংগঠনের অধীন ইত্যাদির মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে পার্টি-নেতৃত্ব প্রদান করা, বন্দুক পার্টির অধীন, পার্টি বন্দুকের অধীন নয়-এ নীতি কার্যকরী করা হচ্ছে।

৫. পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থা ও
বিপ্লবী যুদ্ধের নীতি ও কৌশল
পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এরূপ সকল নীতি ও কৌশল
পৃষ্ঠা: ৫৫৮

ব্যর্থ হতে বাধ্য।
কোন বৈদেশিক অভিজ্ঞতা বা আমাদের বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় তা অন্ধভাবে হুবহু প্রয়ােগ করলে ব্যর্থ হতে বাধ্য।
পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থা কি?
পূর্ব বাংলা একটি ক্ষুদ্র দেশ, জঙ্গলাকীর্ণ পার্বত্যভূমি খুবই কম, নদীমাতৃক সমভূমিই বেশী। ভৌগলিকভাবে পূর্ব বাংলা ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত, সমুদ্রও ভারত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ ছাড়া আমাদের সাহায্য করতে পারে এরূপ দেশের সাথে পূর্ব বাংলার কোন সীমান্ত নেই।
জনগণের রয়েছে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অভিন্নতা। অর্থনৈতিকভাবে পূর্ব বাংলা সমবিকশিত। জনগণ বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তার প্রভুদের উৎখাত চান।
বিভিন্ন বেসামরিক বাহিনী ছাড়াও বাংলাদেশ পুতুল সরকারের রয়েছে পুলিশ, বি.ডি.আর, রক্ষী এবং সেনাবাহিনী। এদেরকে সহায়তা করার জন্য রয়েছে ভারতীয় বাহিনী, সােভিয়েট এবং সম্ভবতঃ মার্কিন বাহিনীও।
পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার জনগণকে মুক্ত করার ও রক্ষা করার মত কোন শক্তিশালী বাহিনী আমাদের নেই।
শক্রদের উৎখাতের জন্য জনগণের রয়েছে দৃঢ় মনােবল। এখানেই নিহিত আছে শূন্য থেকে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার ভিত্তি।
আমাদের গেরিলা বাহিনী শূন্য থেকে গড়ে উঠেছে, তারা অনভিজ্ঞ, নতুন। তাদের অস্ত্র-শস্ত্র স্বল্প, নিয়মিত সরবরাহ নেই, তাদের ট্রেনিং নেই।
পক্ষান্তরে শত্রুসেনা অভিজ্ঞ, ট্রেনিংপ্রাপ্ত, সংখ্যায় তারা বেশী, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তা রয়েছে তাদের পিছনে। পূর্ব বাংলার ভৌগলিক সুবিধা তাদের পক্ষে।
তাদের সাহায্য করার জন্য রয়েছে ভারতীয় বাহিনী, সােভিয়েট ও সম্ভবতঃ মার্কিন বাহিনী।
কাজেই শত্রু প্রবল, আমরা দুর্বল। এ কারণে শত্রুকে পরাজিত করতে সুদীর্ঘদিন যুদ্ধ চালাতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় আমাদের দুর্বল শক্তি সবল শক্তিতে রূপান্তরিত হবে, পক্ষান্তরে শত্রুর সবল শক্তি দুর্বল শক্তিতে রূপান্তরিত হবে, তারা পরাজিত ও ধ্বংস হবে।
এ কারণে আমাদের যুদ্ধের রণনীতি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। কিন্তু বাস্তব যুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা যদি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের নীতি গ্রহণ করি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা শত্রুর সাথে লড়াই করি তবে শত্রু সহজেই শক্তি সমাবেশ করে আমাদেরকে ধ্বংস করতে সক্ষম হবে।
কাজেই বাস্তব যুদ্ধ ও লড়াই হতে হবে দ্রুত নিষ্পত্তিকর যুদ্ধ, অর্থাৎ অতি অল্প সময়ের মাঝে আমাদের লড়াই শেষ করতে হবে যাতে শত্রু তার শক্তি সমাবেশ করার সময় না পায়।
এ দ্রুত নিষ্পত্তিকর যুদ্ধ সাধারণতঃ অতর্কিত হামলার রূপ গ্রহণ করবে। এর ফলে শত্রু তার শক্তি, উৎকৃষ্টতা ব্যবহার করতে পারবে না। সে অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকবে, এমন কি সে অস্ত্র ব্যবহারও করতে সক্ষম হবে না।
উদাহরণ স্বরূপ, ১৯৭৩-এর বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সময় আমাদের অতর্কিত আক্রমণ ও দ্রুত নিষ্পত্তির লড়াইয়ের কৌশলের কারণে বহু থানা ও ফাঁড়ি দখল করা সম্ভব হয়। অনেক ক্ষেত্রে শত্রু অস্ত্র ব্যবহারেরও সুযােগ পায়নি।
আমাদের রণনীতি হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাঝে দ্রুত নিষ্পত্তির লড়াই করা।
আমাদের শক্তি দুর্বল, শক্রশক্তি প্রবল, সে যেখানেই আমাদের খোঁজ পায় সেখানেই তার শক্তি সমাবেশ করে আমাদেরকে আক্রমণ করে।
পৃষ্ঠা: ৫৫৯

অর্থাৎ শত্রু রণনৈতিক আক্রমণের স্তরে রয়েছে। আর আমরা রয়েছি রণনৈতিক আত্মরক্ষার স্তরে, নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখা ও বিকাশ সাধনের স্তরে।
কিন্তু আমাদের বাস্তব হামলার রূপ হচ্ছে আক্রমণাত্মক। অর্থাৎ শত্রুদের আমরাই আক্রমণ করি, শত্ৰু আত্মরক্ষায় থাকে।
নিছক আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করলে শক্তিশালী শত্রুর দ্বারা আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।
অবশ্য শত্রুর কোন অংশকে ঠেকিয়ে রাখা, বিচ্ছিন্ন শত্রুকে ঘিরে রাখা ইত্যাদির জন্য আমরা কৌশলগত আত্মরক্ষাত্মক পদক্ষেপ নেই।
কাজেই আমাদের রণনীতি হচ্ছে রণনৈতিক আত্মরক্ষার মাঝে আক্রমণ চালানাে।
শত্রু অধিকৃত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। সে যে কোন স্থানে শক্তি সমাবেশ করে আমাদেরকে আক্রমণ করতে পারে।
অর্থাৎ শত্রু রণনৈতিক বহিলাইনে রয়েছে। পক্ষান্তরে আমরা আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করছি। অর্থাৎআমরা রণনৈতিক অন্তর্লাইনে লড়ছি।
বাস্তব হামলায় আমরা করি আক্রমণ অর্থাৎ বহিলাইনে তৎপরতা চালাই, যদিও আমাদের বহিলাইনের ঘেরাও বলয় ছােট (একটি থানা, ফাড়ি বা ছােট চলমান ইউনিট)।
কাজেই আমরা অন্তর্লাইনের মাঝে বহিলাইনে লড়াই করছি। আমাদের যুদ্ধের নীতি হচ্ছেঃ
রণনৈতিক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মাঝে দ্রুত নিষ্পত্তির লড়াই করা, রণনৈতিক আত্মরক্ষার মাঝে আক্রমণাত্মক লড়াই করা, অন্তর্লাইনের মাঝে বহিলাইনের লড়াই করা।
এ যুদ্ধ আমাদের ততদিন চালাতে হবে যতদিন শত্রু তার রণনৈতিক আক্রমণ – চালাতে অক্ষম হয়ে পড়বে। শত্রু রণনৈতিক আত্মরক্ষার স্তরে পৌঁছাবে আর আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে রণনৈতিক আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত ও উৎখাত করতে সক্ষম হবাে।
রণনৈতিক আত্মরক্ষার স্তর থেকে দেশব্যাপী রণনৈতিক আক্রমণ পরিচালনার স্তরে পৌঁছাবার সময়টা হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের সবচাইতে কঠিন, নির্মম ও দীর্ঘদিনের স্তর।

৬. পেয়ারা বাগানের অভিজ্ঞতা
ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, বি.ডি.আর এবং পুলিশের বিদ্রোহ ও জনগণের গণআন্দোলনের ফলে ১৯৭১-এর মার্চে পাক সামরিক বাহিনী কিছুদিনের জন্য আতরক্ষামলক অবস্থায় পতিত হয় (ঢাকা ব্যতীত)।
তারা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আটকে পড়ে। অচিরেই তারা প্রতিআক্রমণ চালিয়ে। ক্যান্টনমেন্টের ঘেরাও ভেঙ্গে ফেলে এবং সমগ্র পূর্ব বাংলায় তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য রণনৈতিক আক্রমণ চালায়।
আওয়ামী লীগ ও তার নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন বিদ্রোহী বাহিনী এ আক্রমণের মুখে কৌশলগত প্রতিরক্ষার লাইন না নিয়ে বাস্তব যুদ্ধে নিষ্ক্রিয় আত্মরক্ষার লাইন নেয়। তারা অবস্থান নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়, শত্রুকে শহরে-বন্দরে ঠেকায়। অনভিজ্ঞ, সংখ্যা ও সরবরাহ স্বল্পতা এবং কৌশলগত নিম্নমানের জন্য তারা পরাজিত হয়, ছিন্নভিন্ন। হয় এবং পলায়ন করে।
পাক বাহিনীর রণনৈতিক আক্রমণ তখন শহর সমূহ দখলের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে তার আক্রমণ পৌঁছেনি।
এ সময় পেয়ারা বাগানে আমাদের বাহিনী গঠন করা হয় এবং বাহিনীকে পুনর্গঠন,
পৃষ্ঠা: ৫৬০

রিক্রুট, ট্রেনিং, অস্ত্র উদ্ধার, জাতীয় শত্রু খতম, জনগণকে জাগরিত ও সংগঠিত করার কাজ চালানাে হয়।
পাক সামরিক দস্যুরা গ্রাম পর্যন্ত তাদের আক্রমণ বিস্তৃত করে। কোথাও প্রতিরােধ থাকায় ব্যাপক শক্তি সমাবেশ করে পেয়ারা বাগানের উপর প্রচণ্ড ঘেরাও দমন চালায়। প্রচণ্ড ঘেরাও দমনের মুখে আমাদেরকে পেয়ারা বাগান থেকে সরে আসতে হয়।
জুন মাসের শেষ নাগাদ পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের রণনৈতিক আক্রমণ চলে। এর মাঝে বর্ষা শুরু হয়ে যাওয়ায় তারা রণনৈতিক আক্রমণ শেষ করে অর্জিত ফল ধরে রাখার জন্য রণনৈতিক সংরক্ষণের স্তরে পৌঁছে।
পেয়ারা বাগান থেকে প্রত্যাহার করা বাহিনীর এক অংশ গৌরনদী অঞ্চলে বর্ষাকালে। বিরাটাকার গেরিলা যুদ্ধের সূচনা করে। অন্য অংশ পেয়ারা বাগানের আশেপাশেই গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়।
এ বর্ষাকালেই পেয়ারা বাগানের অভিজ্ঞতা প্রয়ােগ করে বরিশাল, ফরিদপুর, পটুয়াখালী, পাবনা, ঢাকা, টাঙ্গাইলে আমাদের গেরিলা যুদ্ধের বিকাশ ঘটে।
১৯৭১-এর অক্টোবরে ভারত প্রত্যাগত আওয়ামী বাহিনীর উপস্থিতির ফলে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ও আভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতকদের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
বিশ্বাসঘাতক আওয়ামী বাহিনী জনগণের এক অংশের সমর্থনকে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। তারা আমাদের সাথে অবস্থানকারী আওয়ামী সুবিধাবাদী, ভ্রষ্টদের হাত করে আমাদের কর্মী ও গেরিলাদের অসতর্কতার সুযােগে ব্যাপক অঞ্চলে গেরিলাদের বিপদগ্রস্ত করে।
এভাবে পাক বাহিনী যে বিপর্যয় ঘটাতে পারেনি আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা তাই ঘটে। আমাদের বহু কমরেড ও গেরিলা প্রাণ হারায়, ব্যাপক অঞ্চল হাতছাড়া হয়।
পেয়ারা বাগান ও পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে-শর রণনৈতিক আত্মরক্ষার সময়, প্রাকৃতিক কারণে বর্ষাকালে শত্রু যে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। তখনই আমাদের রণনৈতিক আক্রমণ পরিচালনা করা উচিত। এ সময়ই আমাদের যুদ্ধের ও সংগঠনের বিকাশ হয়।
– শত্রুর শুকনাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সময় আমাদের রণনৈতিক আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে হবে। প্রচণ্ড চাপ আসবে। আমাদের বিকাশ কম হবে। আমাদের এলাকা সংকুচিত হবে।
শত্রুর ঘেরাও দমন অভিযান ভেঙ্গে ফেলা বা তা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য একনাগাড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাজ হওয়ার প্রয়ােজনঃ আক্রমণের এলাকা, আশ্রয় এলাকা প্রয়ােজন, শহরে-গ্রামে ভাল কাজ প্রয়ােজন।
অন্যথায় প্রচণ্ড ঘেরাও-দমন অভিযানের মুখে বিচ্ছিন্ন পকেটের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
শত্রুর ঘেরাও দমন স্থানীয় দালাল, খবর সরবরাহকারী না পেলে সফল করা কষ্টকর। এ কারণে জাতীয় শত্রু সরকারের চোখ ও কান উৎখাত করা দরকার।
জাতীয় শত্রু খতমের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। ব্যাপক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে চরম ঘৃণ্য ও মৃত্যুদণ্ড পেতে পারে এরূপ অল্পসংখ্যক শত্রু খতম করা, তাও যথাযথ স্তর থেকে অনুমােদন করিয়ে নেওয়া। ব্যাপক জাতীয় শত্রুদের আত্মসমর্পণ করানাে উচিত।
পৃষ্ঠা: ৫৬১

শত্রুর ঘেরাওদমনের মুখে কতখানি টিকে থাকা সম্ভব তা বিবেচনা করে সামরিক তৎপরতা চালানাে উচিত।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমস্যা, আভ্যন্তরীণ বিশ্বাসঘাতক, ভ্রষ্টদের সমস্যা সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে এবং প্রয়ােজনীয় সতর্কতা ও পদক্ষেপ নিয়ে রাখতে হবে।

৭. বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ও
আমাদের অভিজ্ঞতা
পূর্ব বাংলার প্রাকৃতিক অবস্থার সাথে শত্রুর রণনৈতিক আক্রমণ ও রণনৈতিক সংরক্ষণ অনেকখানি জড়িত।
সাধারণতঃ শীতকালেই তারা রণনৈতিক আক্রমণ শুরু করে এবং বর্ষার প্রারম্ভেই এ আক্রমণ শেষ করে। বর্ষাকালে সৈন্য সমাবেশ, চলাফেরার অসুবিধার কারণে শত্রু পূর্ববর্তী আক্রমণের ফল ধরে রাখার জন্য রণনৈতিক সংরক্ষণের স্তরে থাকে।
এ অবস্থা অপরিবর্তনীয় নয়।
শক্র সামগ্রিকভাবে যেহেতু রণনৈতিক আক্রমণের পর্যায়ে রয়েছে সে কারণে বর্ষাকালেও কোন এলাকায় প্রয়ােজন হলে ঘেরাও দমন চালাতে পারে। গত বর্ষায় সুন্দরবনের কম্বিং অপারেশন তার প্রমাণ।
পাক বাহিনী তার রণনৈতিক আক্রমণ বর্ষার পূর্বেই শেষ করে।
ভারতীয় বাহিনী তার রণনৈতিক আক্রমণ শুকনাে কালেই শুরু করে এবং বর্ষার পূর্বেই শেষ করে।
এ অবস্থা বিবেচনা করে আমরা বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সময় আমাদের সশস্ত্র তৎপরতাকে জাতীয় শত্রু খতমের পর্যায় থেকে থানা, ফাড়ি দখলের পর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
এ আক্রমণের সময় পূর্ব অভিজ্ঞতা ব্যাপকভাবে কাজে লাগানাে হয়। আক্রমণের এলাকা, আশ্রয় এলাকা, একনাগাড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে কাজ, শহরে-গ্রামে ভাল কাজ ইত্যাদি।
শত্রুকে প্রস্তুতির সুযােগ না দিয়ে অতর্কিত আক্রমণ করা, সাহসকে প্রাধান্য দিয়ে শত্রুর অবস্থান দখল করা, ছােট ছােট গ্রুপ ব্যবহার করা প্রভৃতির মাধ্যমে আমরা বহু থানা ও ফঁাড়ি দখল করতে সক্ষম হই।
এভাবে বহু অস্ত্র সংগৃহীত হয়, অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়, আমাদের বিরাট বিকাশ হয়।

৮. সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণ ও
সশস্ত্র সংগ্রাম
আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে, যে সকল স্থানে সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণ ভাল ছিল সেখানে সশস্ত্র সংগ্রাম ভাল বিকাশ লাভ করেছে এবং এ প্রক্রিয়ায় অর্জিত ফলসমূহও ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
পক্ষান্তরে যে সকল স্থানে সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণ ভাল ছিল না সেখানে সশস্ত্র সংগ্রাম ভাল বিকাশ লাভ করেনি বা অর্জিত ফলও ধরে রাখা যায়নি।
সুসংবদ্ধকরণের লক্ষ্য হচ্ছে কর্মী ও গেরিলাদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক,
পৃষ্ঠা: ৫৬২

মতাদর্শগত ও সাংস্কৃতিক মানােন্নয়ন। এ প্রক্রিয়ায় কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই করা, ভ্রষ্ট, সুবিধাবাদী, অধঃপতিত শত্ৰুচরদের খুঁজে বের করে অপসারিত করা, শৃংখলা ও নিরাপত্তা জোরদার করা।
১৯৭৩-এর বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের পূর্বে শীতকালীন সুসংবদ্ধকরণের; সময় চক্রবিরােধী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় ভ্রষ্ট, খারাপ ও বাসি উপাদান অপসারিত হয়, ভাল ও তাজা উপাদান। সংগৃহীত হয়, তাদের মান উন্নত হয়।
যে সকল অঞ্চলে এ সুসংবদ্ধকরণের কাজ ভাল চলে সে সকল স্থানে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ভাল বিকাশ লাভ করে।
১৯৭৩-এর বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের ফলে অর্জিত বিরাট বিকাশ ধরে রাখার জন্য শুকনােকালে মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণ পরিচালনা করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় কর্মীদের মানােন্নয়ন, কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই এবং খারাপ উপাদান অপসারণের কাজ চলছে।
এ পদক্ষেপ দ্রুত যেখানে গ্রহণ করা হয়নি সেখানেই বিপর্যয় ঘটেছে, ভ্রষ্ট বা শত্রুদের হাতে অস্ত্র চলে গেছে; পার্টি কর্মীরা প্রাণ হারিয়েছে, এলাকায় প্রচণ্ড চাপ ও বিপর্যয় হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, মুন্সিগঞ্জে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সময় রিক্রুটের ক্ষেত্রে সতর্ক না হওয়ার ফলে কিছু ভ্রষ্ট ও অধঃপতিত ব্যক্তি ঢুকে পড়ে যারা পরে ডাকাতি, পত্র দিয়ে অর্থ সংগ্রহ করা, শেষ পর্যন্ত স্থানীয় কর্মীদের হত্যা করে অস্ত্র দখলের ষড়যন্ত্র চালায়।
পার্টি এদের তৎপরতাকে ধ্বংস করে দেয়।
কুমিল্লার মতলব এলাকার কর্মীদের কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই না করার ফলে ভ্রষ্ট, ডাকাতরা পার্টিতে অনুপ্রবেশ করে। তারা অস্ত্র আত্মসাৎ করার জন্য কয়েকজন কর্মী ও গেরিলাদের হত্যা করে।
ফরিদপুরের ভ্ৰষ্টরা অস্ত্র আত্মসাৎ করে। গােপনীয়তা-নিরাপত্তা বজায় না থাকার ফলে অস্ত্র খােয়া যায়, কাজে বিপর্যয় আসে।
বর্তমানে মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের যে কাজ চলছে তা ভালভাবে সম্পন্ন করতে হবে। বাসী, খারাপ এবং শত্ৰুচরদের অপসারিত করতে হবে, আসন্ন বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ভালভাবে পরিচালনা করার জন্য।

৯. সাংগঠনিক কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রামের সম্পর্ক
এবং অসম বিকাশ
আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তােলা ও বিকাশ সাধনের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে ভাল সাংগঠনিক কাজ।
সাংগঠনিক কাজের মাধ্যমে গেরিলা রিক্রুট হয়। শেলটার গড়ে উঠে, লক্ষ্যবস্তুর অনুসন্ধান পাওয়া যায়। আক্রমণের পূর্বে সমাবেশ এবং পরে সরে পড়া সম্ভব হয়।
সুশৃংখল, গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় আছে এরূপ সাংগঠনিক কাজ শূন্য থেকে গেরিলা গড়ে তােলার জন্য অপরিহার্য।
পার্টি কাজের মাধ্যমে গেরিলা রিক্রুট করা, তাদের কোর ইতিহাস যাচাই, এককভুক্ত করা, শৃংখলা, গােপনীয়তা, নিরাপত্তা এবং পার্টি লাইনে শিক্ষিত করা, সশস্ত্র
পৃষ্ঠা: ৫৬৩

প্রচার ও জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে ট্রেইন করা, এভাবে উচ্চতর সামরিক তৎপরতার জন্য প্রস্তুত করা ইত্যাদি কাজ সাংগঠনিক কাজের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে সকল অঞ্চলে, অঞ্চলের মধ্যে সকল উপ-অঞ্চলে, আবার উপঅঞ্চলের মধ্যে সকল এলাকায় ভাল কাজ থাকে না।
কাজের বিকাশ ও সুসংবদ্ধতার বিচারে অঞ্চলগুলােকে উন্নত, মাঝারি ও। পশ্চাদপদতে ভাগ করা যায়। উপ-অঞ্চল, এলাকার ক্ষেত্রেও ইহা প্রযােজ্য।
একইভাবে সামরিক তৎপরতার দিক দিয়ে অগ্রসর, মাঝারি, পশ্চাদপদ এই তিনভাগে অঞ্চল, উপ-অঞ্চল এবং এলাকাসমূহকে ভাগ করা যায়।
সাংগঠনিক কাজের ক্ষেত্রে অগ্রসর অঞ্চল, উপ-অঞ্চল এবং এলাকাগুলােকে আঁকড়ে ধরতে হবে। উন্নত অঞ্চল থেকে কর্মী বের করে মাঝারি, অনুন্নত স্থানে প্রেরণ; অনুন্নত, মাঝারী স্থান থেকে কর্মী এনে ট্রেইন করা, আশ্রয়স্থান ইত্যাদির কাজে ব্যবহার করতে হবে।
সামরিক তৎপরতা পরিচালনার সময় সামগ্রিক কাজের ক্ষেত্রে উক্ত স্থানের ভূমিকা, উক্ত স্থানে সম্ভাব্য শত্রু চাপের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ একটি স্থান, সমগ্র অঞ্চল, উপ-অঞ্চল বা এলাকার কাজের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। স্বভাবতঃই সেখানে প্রচণ্ড সামরিক তৎপরতা চালালে শত্রু চাপে সেখান থেকে উৎখাত হতে হবে। ফলে সামগ্রিক কাজের ক্ষতি হবে।
কোন এলাকায় ভাল সাংগঠনিক ও সশস্ত্র তৎপরতা শত্রুর প্রবল চাপে বা আভ্যন্তরীণ শত্রুদের অন্তর্ঘাতী কাজে হ্রাস পেতে পারে বা তৎপরতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
পূর্ব বাংলা ক্ষুদ্র দেশ, শত্রু দ্রুত সমবেশিত হতে পারে। সমতল ভূমি এবং শত্রুর পক্ষে বৈদেশিক সহায়তা লাভ সম্ভব ইত্যাদি কারণ থেকে দেখা যায়-বিচ্ছিন্ন পকেট হিসেবে সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা করলে তাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।
পূর্ব বাংলার এক/একাধিক জেলায়ও ভাল সশস্ত্র তৎপরতা চালালে তাও টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
পূর্ব বাংলার সকল জেলায় গেরিলা তৎপরতা চালাতে হবে। যােগাযােগ পথে শত্রুদের হয়রানি করতে হবে। সমভূমিতে, পাহাড়ে গেরিলা তৎপরতা চালাতে হবে, শহরে গ্রামে শত্রুকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
এভাবে শত্রু সর্বত্রই আক্রান্ত হয়ে তার সৈন্যবাহিনীকে বিভক্ত করতে, পাহারামূলক তৎপরতায় নিয়ােজিত করতে বাধ্য হবে। বিভিন্ন এলাকায় ঘেরাও দমনের জন্য তার সচল বাহিনীর সংখ্যাল্পতা দেখা দেবে।
এভাবে আভ্যন্তরীণ বহু গ্রামাঞ্চলে ঘাটি এলাকা গড়ে উঠবে।

১০. গেরিলা বাহিনী বিকাশের প্রথম পর্যায়
এবং উদ্যোগ-নমনীয়তা-পরিকল্পনা
আমাদের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে গেরিলা বাহিনীর বিকাশের প্রথম পর্যায় হচ্ছেগেরিলা বাহিনী শূন্য থেকে গড়ে উঠছে। তারা অনিয়মিত, তাদের রয়েছে অভিজ্ঞতার অভাব, সংখ্যাল্পতা, অস্ত্রস্বল্পতা। এ সকল কারণে চলমান শত্রুকে ঘিরে ফেলে খতম করতে তারা সক্ষম নয়।
গেরিলা বাহিনীর বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে-গেরিলা বাহিনীর অভিজ্ঞতা, সংখ্যা
পৃষ্ঠা: ৫৬৪

প্রাচুর্যতা, অস্ত্রপ্রাচুর্যতা এবং নিয়মিত চরিত্রের হয়েছে। চলমান শত্রুকে ঘিরে ফেলে তারা খতম করতে সক্ষম।
কোথাও কোথাও আমাদের গেরিলা বাহিনীর বিকাশের প্রথম পর্যায় চলছে। আবার কোথাও কোথাও আমরা বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করছি।
গেরিলা বাহিনীর বিকাশের প্রথম পর্যায়ে আমরা উদ্যোগ অর্থাৎ কার্যকলাপের স্বাধীনতা বজায় রাখছি গােপন কর্মপদ্ধতি ও সরে পড়ার মাধ্যমে।
একটি অপারেশন শেষে শত্রুর ঘেরাও দমন থেকে বাঁচার জন্য গেরিলারা নিজ নিজ শেলটারে চলে যায় (গােপন কর্মপদ্ধতির কারণে সে অপ্রকাশিত), প্রকাশিত গেরিলারা ঘেরাও দমন হবে না এরূপ এলাকায় আশ্রয় নেয়।
অপ্রকাশিত গেরিলাদের পক্ষে ঘেরাও দমনের মুখে টিকে থাকা অসুবিধাজনক হলে তারাও নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে।
এভাবে বর্তমানে উদ্যোগ বজায় রাখার মুখ্য পদ্ধতি হচ্ছে সরে পড়া।
এ কারণে আমাদের কাজ হওয়া প্রয়ােজন একনাগাড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে, গােপনীয়তা, নিরাপত্তা, শৃংখলা হওয়া উচিত কঠোর। শহরে, গ্রামে ভাল কাজ হওয়া উচিত।
এ ছাড়া আশ্রয় এলাকা, আক্রমণ এলাকা ভাগ করে সামরিক কাজ করা উচিত যাতে শত্ৰু বুঝতেই না পারে কোথায় আমাদের অবস্থান।
এ পদ্ধতিতে উদ্যোগ বজায় রাখা প্রয়ােজন; গেরিলারা যখন নতুন, অনভিজ্ঞ, সংখ্যায় কম, অস্ত্র কম এবং শত্রুর ঘেরাও দমনকারী ইউনিটকে ঘিরে ফেলে ধ্বংস করতে তারা অক্ষম।
উদ্যোগের মূর্ত প্রকাশ হচ্ছে নমনীয়তা।
নমনীয়তা প্রকাশ পায় গেরিলাদের একত্রিত করা, ছড়িয়ে দেওয়া ও স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে।
গােপন কর্মপদ্ধতির কারণে কোন অপারেশন পরিচালনার জন্য গেরিলারা গােপন শেলটারে গােগাপনে একত্রিত হতে সক্ষম হয়।
একইভাবে আক্রমণ শেষে গেরিলারা সরে পড়ে আশ্রয় গ্রহণ করে।
প্রচণ্ড চাপের মুখে গেরিলারা প্রয়ােজনীয় স্থান পরিবর্তন করে অর্থাৎ অন্য এলাকায় আশ্রয় নেয় বা কাজ করে। পরে চাপ কমে গেলে তারা ফিরে আসে।
অন্য অঞ্চলে অভিজ্ঞ গেরিলা পাঠিয়ে গেরিলাযুদ্ধ শুরু করার জন্য গেরিলাদের ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
গেরিলাদের ছড়িয়ে থাকার কারণ হচ্ছে শেলটার, খাদ্য, অর্থ, অস্ত্রের স্বল্পতা, অনিয়মিত চরিত্র, শত্রুর খবর সংগ্রহের চ্যানেলের গ্রামে উপস্থিতি এবং শক্রর ঘেরাও ভেঙ্গে ফেলার অক্ষমতা ইত্যাদি।
ব্যাপক চাপের মুখে স্থান পরিবর্তনের পূর্বে অস্ত্রশস্ত্র নিরাপদে রাখা, স্থানীয় কাজের সাথে সংযােগ রাখার ব্যবস্থা রাখা, নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে অস্ত্র আত্মসাৎ বা অপব্যবহার, খােয়া যাওয়ার সমস্যা যাতে উদ্ভব না হয় তার ব্যবস্থা রাখা।
প্রাথমিক বা অন্য যে কোন স্তরে পরিকল্পনা ব্যতীত গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা, তা টিকিয়ে রাখা ও বিকাশ ঘটানাে সম্ভব নয়।
ঘেরাও দমন ও আভ্যন্তরীণ শত্রুদের অন্তর্ঘাতী কাজ থেকে টিকে থাকা, অস্ত্র গেরিলা সংগ্রহ, ট্রেনিং-মানােন্নয়ন; অর্থ, খাদ্য, শেলটারের ব্যবস্থা, গেরিলাদের
পৃষ্ঠা: ৫৬৫

নিয়মিতকরণ; বিস্তৃত অঞ্চলে কাজ, ইত্যাদি সমস্যার ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে অগ্রসর হতে হবে।
বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাজ গড়ে তুলতে হবে যাতে বিকল্প আশ্রয়স্থল গড়ে উঠে। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য শক্রর দুর্বল অবস্থান আক্রমণ করে দখল করা বা দুর্বল চলমান শত্রুকে ঘিরে ফেলে খতম করা, জাতীয় শত্রু খতম ও আত্মসমর্পণ করানাের মাধ্যমে শত্রুর খবর সংগ্রহের ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলা, সশস্ত্র প্রচার টিমের মাধ্যমে ব্যাপক জনমত গড়া, এ প্রক্রিয়ায় গেরিলাদের ট্রেইন করা। গ্রামভিত্তিক চাঁদা সংগ্রহ, শেলটারের ব্যবস্থা করা, নিয়মিত গেরিলা গড়ে তােলা ইত্যাদি কাজ হচ্ছে গেরিলা বাহিনী বিকাশের প্রথম পর্যায়ের লক্ষ্য।

১১. গেরিলা বাহিনী বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়
এবং উদ্যোগ-নমনীয়তা-পরিকল্পনা
সরে পড়ার মাধ্যমে উদ্যোগ বজায় রাখার পদ্ধতি চিরদিন অনুসরণ করলে শত্রুর ঘেরাও দমন কখনই ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব হবে না। জনগণের আস্থা নষ্ট হবে, সচল বাহিনী ও ঘাটি এলাকা গড়ে উঠবে না, শেষ পর্যন্ত আমরা ধ্বংস হবাে।
সরে পড়ার মাধ্যমে উদ্যোগ বজায় রাখাকে আক্রমণের মাধ্যমে উদ্যোগ বজায় রাখায় রূপান্তরিত করতে হবে।
এটা কিভাবে সম্ভব?
শত্রুর ঘেরাও দমনকারী ইউনিটের পুরােটাই (ছােট ও দুর্বল হলে) বা তার অংশকে অতর্কিতে ঘিরে ফেলে ধ্বংস করা। এভাবে শত্রুকে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা, তার ঘেরাও দমন অভিযান ভেঙ্গে ফেলার মাধ্যমে উদ্যোগ বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ চলমান। শত্রুকে অতর্কিতে ঘিরে ফেলে খতম করা।
এটা এ্যামবুশ যুদ্ধ বলেও পরিচিত।
এভাবে পাঁচ বা দশ জনের একটি ইউনিট ধ্বংস হয়ে গেলে শত্রু আরাে বড় ইউনিট পাঠাবে। শত্রুর পক্ষে সমগ্র পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে বড় বড় ইউনিট পাঠিয়ে ঘেরাও দমন চালানাে সম্ভব নয়। তার সংখ্যাল্পতা দেখা দেবে।
ফলে বহুগ্রাম যেখানে শত্রু যেতে পারে না তা আমাদের ঘাঁটি এলাকায় রূপান্তরিত হবে।
চলমান শত্রু ইউনিটকে ঘিরে ফেলে খতম করার জন্য প্রয়ােজন হবে দ্রুত একত্রিত হওয়া, ছড়িয়ে পড়া ও স্থান পরিবর্তনের।
এটা সম্ভব হবে নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে যারা কাছাকাছি অবস্থান করে দ্রুত একত্রিত হতে পারে।
শত্রুর ঘেরাও দমন অভিযান আর আমাদের পাল্টা ঘেরাও দমন অভিযান চালিয়ে শক্রর দুর্বল ইউনিটকে খতম করা, এ করাত প্যাটার্নের যুদ্ধ গেরিলা যুদ্ধের রণনৈতিক আত্মরক্ষার সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত চলবে।
কাজেই আমাদের গেরিলাদের এ যুদ্ধে অতিমাত্রায় পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে, আর এটাই হবে আমাদের আক্রমণের প্রধান রূপ।
শত্রুর দুর্বল ইউনিট ঘিরে ফেলে খতম করা বা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র লাভের জন্য এসময় আমাদেরকে তরঙ্গমালার মত আক্রমণ করতে হবে এবং কিছু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৬৬

এ কারণে ব্যাপক হারে গেরিলা সংগ্রহ করতে হবে যাতে ক্ষয়ক্ষতি হলেও আমাদের যুদ্ধের প্রয়াসে কোন বিঘ্ন না হয়।
তবে ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যই সর্বনিম্ন করতে হবে।
এ স্তরেও শক্রর দুর্বল অবস্থান অতর্কিতে আক্রমণ করে দখল করা, এভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করার পদ্ধতি চালিয়ে যেতে হবে।
এ স্তরে শক্রর ঘেরাও দমন ভাঙ্গা সম্ভব না হলে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এ অবস্থায় উদ্যোগ পুনরায় অর্জনের জন্য সরে পড়তে হবে।
সরে পড়ার সময় একসাথে বা বিভক্ত হয়ে বা শত্রুকে ঠেকানাের জন্য ছােট গ্রুপ রেখে সরে পড়তে হবে।
সরে পড়ার প্রাক্কালে পুনরায় একত্রিত হওয়া, বিভিন্ন ইউনিটের কাজ ঠিক করে দিতে হবে।
এছাড়া জনগণের মাঝে প্রচার ও তাদেরকে সংগঠিত করা, রসদপত্রের স্বল্পতা, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধের বিস্তৃতির জন্য গেরিলা বাহিনীকে অংশে বিভক্ত করে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়ােজন হয়।
তবে শত্রুর ঘেরাও দমন ভেঙ্গে ফেলার জন্য একত্রীকরণ অবশ্যই প্রয়ােজন যাতে আমাদের ব্যাপক শক্তি শত্রুর একটি দুর্বল ইউনিট ধ্বংসের জন্য প্রয়ােগ করা যায়। অর্থাৎ প্রতিটি লড়াইয়ে আমরা যেন চূড়ান্ত উৎকৃষ্টতা অর্জন করতে পারি।
সচল গেরিলা বাহিনীকে একটি শক্ত ইউনিট ধ্বংস করে দ্রুত অপর একটি ইউনিট ধ্বংস করা এভাবে একনাগাড়ে শত্রুর বহু ইউনিট ধ্বংসের দিকে ট্রেইন করতে হবে।
শত্রুর চলমান ইউনিটকে ঘিরে ফেলে খতমের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব পরিকল্পনা মাফিক কাজ করার ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ শত্রুর দুর্বল ইউনিটকে খুঁজে বের করা ও তাকে নির্মূল করার জন্য ভৌগলিকভাবে ও জনসমর্থনের দিক দিয়ে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে এসে তাকে খতম করতে হবে। অর্থাৎ তাকে ফাঁদে ফেলতে হবে।
প্রতিটি লড়াই আমরাই নির্ধারণ করতে সক্ষম হই। এভাবে যুদ্ধ চালাবার চেষ্টা করতে হবে।
শত্রুর দুর্বল ইউনিট খুঁজে বের করা, তাকে ফাঁদে ফেলার জন্য বিস্তৃত অঞ্চল প্রয়ােজন যাতে গেরিলারা শত্রু সম্পর্কে তথ্য লাভের এবং তাকে প্রলুব্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে আনতে সক্ষম হয়।
এ স্তরে গেরিলা পরিচালকের পরিকল্পনা মাফিক গেরিলা তৎপরতা ছড়িয়ে দিয়ে অঞ্চলের বিস্তৃতি বাড়ানাে, ফাঁকসমূহ পূরণ, অস্ত্র-খাদ্য-অর্থ ও অন্যান্য সরবরাহ সংগ্রহ, প্রাথমিক খবর প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে তােলা, স্থানীয় গেরিলা বাহিনী গঠন, নিয়মিত বাহিনী বৃদ্ধি, জনগণকে সংগঠিত ও তাদেরকে গণসংগ্রামে পরিচালনা এবং সশস্ত্র তৎপরতায় অংশগ্রহণ করানাে ইত্যাদি কাজ করতে হবে।
এগুলাে পরিকল্পনার আওতায় পড়ে।

১২. গেরিলা সংগ্রহ ও নিয়মিত বাহিনী গঠন
প্রাথমিক পর্যায়ে সাংগঠনিক কাজের মাধ্যমে সংগৃহীত কর্মীদের মধ্য থেকেই গেরিলা রিক্রুট হয়।
পৃষ্ঠা: ৫৬৭

কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাইয়ের মাধ্যমে শত্রুর চর, ভ্রষ্ট ও শত্রু শ্রেণীর লােকদের গেরিলা হিসেবে অনুপ্রবেশ ঠেকানাে হয়।
গেরিলাদের প্রথমে সশস্ত্র প্রচার টিম ও জাতীয় শত্রু খতম অপারেশনে পাঠানাে হয়।
সশস্ত্র প্রচার টিমের তৎপরতার মাধ্যমে রাত্রিকালীন চলাচল, অস্ত্র সংক্রান্ত ট্রেনিং, অনুসন্ধান, প্রচার, জনগণকে জাগরিত করা ইত্যাদি কাজে গেরিলাদের অভিজ্ঞ ও যাচাই করা হয়।
জাতীয় শত্রু খতম হচ্ছে ছােট আকারের গেরিলা অপারেশন। এর মাধ্যমে অনুসন্ধান, পরিকল্পনা, সমাবেশ, বাস্তব হামলা, সরে আসা, জটিল পরিস্থিতির মােকাবেলায় গেরিলাদের অভিজ্ঞ ও যাচাই করা হয়।
গেরিলাদের মান উন্নত ও মতাদর্শগত পুনর্গঠন করার জন্য ক্লাশ নেওয়া হয়।
এভাবে একটি জেলার বিভিন্ন মহকুমা, মহকুমাস্থ থানা এবং থানার আওতাধীন। ইউনিয়ন ও গ্রামে সাংগঠনিক কাজের মাধ্যমে সামরিক লােকদের রিক্রুট করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে অনভিজ্ঞদের অভিজ্ঞ গেরিলাদের সাথে অপারেশনে দিয়ে বা অভিজ্ঞ গেরিলা পরিচালকদের সাথে দিয়ে অভিজ্ঞ করা হয়।
বর্তমানে গেরিলা যুদ্ধকে দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য গেরিলাদের সেকসন, প্লাটুন ও কোম্পানীভুক্ত করা। এ সকল ইউনিট সচল হলে ব্যাটেলিয়ন ও ব্রিগেড গড়ে তােলা সম্ভব হবে।
গেরিলারা প্রথমে অসার্বক্ষণিক হিসেবে কাজ করে, গেরিলা তৎপরতা ও স্থানীয় সাংগঠনিক কাজের বিকাশের প্রক্রিয়ায় তারা সার্বক্ষণিক হয়।
বর্তমানে কৃষকদের মাঝে কাজ ছড়িয়ে পড়ায় বহু কৃষক গেরিলা হিসেবে রিক্রুট হচ্ছে। নিয়মিতকরণ ও ভরণপােষনের সমস্যার সমাধান হলে গেরিলা বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যই হবে-কৃষক।
পেয়ারা বাগানে ও অন্যান্য ফ্রন্ট এলাকায় আমাদের যে নিয়মিত বাহিনী গঠন করা হয়েছিল তাদের সদস্যদের অনেকেই ছিল কৃষক।
১৯৭৩-এর বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণে সচল বাহিনী গড়ে উঠে। অন্যান্য অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এ বাহিনীকে বিভিন্নস্থানে সাংগঠনিক কাজের সাথে যুক্ত করে পাঠানাে হয়।
সচল বাহিনী গঠনের সমস্যা হচ্ছে গেরিলা সংগ্রহ, অস্ত্র, অর্থ, খাদ্য ও শেলটারের সমস্যা।
বর্তমানে পূর্ব বাংলায় প্রচুর গেরিলা সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে; শত্রুর দুর্বল অবস্থান দখল বা দুর্বল চলমান ইউনিট ঘিরে ফেলে অস্ত্র সংগ্রহ করা, জাতীয় শত্রু উৎখাত এবং গ্রামভিত্তিক চাঁদা তােলা জনমত বিপ্লবের পক্ষে সংগঠিত করার মাধ্যমে অর্থ-খাদ্য ও শেলটার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব।
এভাবে সকল সমস্যা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব।
সচল বাহিনীকে শক্রর দুর্বল চলমান ইউনিটকে ঘিরে ফেলে খতম করার জন্য দ্রুত একত্রীকরণ প্রয়ােজন।
এ কারণে তাদের ক্যাম্পিং করে অবস্থান করতে হবে। কাছাকাছি কয়েকটি বাড়ীতে তারা অবস্থান করতে পারে।
পেয়ারা বাগান ও অন্যান্য ফ্রন্টে এবং গত বর্ষায় সচল বাহিনী জনগণের বাড়ীতে ক্যাম্পিং করে অবস্থান করতাে।
পৃষ্ঠা: ৫৬৮

সচল বাহিনীর টিকে থাকা ও বিকাশের জন্য স্থানীয় সাংগঠনিক কাজ ভাল হতে হবে। শেলটার, শক্রর গতিবিধি, জনগণের সহযােগিতা লাভ, শত্রুদের উৎখাত করা ইত্যাদি কাজ স্থানীয় সংগঠনের সাহায্য ব্যতীত সম্ভব নয়।
সচল এবং নিয়মিত বাহিনী টিকে থাকা ও বিকাশ লাভের জন্য গ্রামের অসার্বক্ষণিক গেরিলাদের নিয়ে স্থানীয় গ্রাম্য আত্মরক্ষা বাহিনী, একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যে তৎপরতা চালানাের জন্য নিয়মিত আঞ্চলিক বাহিনী গড়ে তুলতে হবে।
আত্মরক্ষা বাহিনী আঞ্চলিক নিয়মিত বাহিনীতে থাকাকালীন ট্রেনিং, যাচাই ও মানােন্নয়নের মাধ্যমে ভাল উপাদান বেরিয়ে আসবে।
এদেরকে নিয়মিত কেন্দ্রীয় বাহিনীতে নিতে হবে। এভাবে নিয়মিত কেন্দ্রীয় বাহিনী অভিজ্ঞ ও ভাল গেরিলাদের দ্বারা গঠন করা সম্ভব হবে।
গ্রাম্য আত্মরক্ষা বাহিনী ও আঞ্চলিক বাহিনী এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী হচ্ছে ডান হাত বাম হাতের মত। একটাকে বাদ দিয়ে অপরটা চলতে পারে না।
সচল বাহিনীতে রাজনৈতিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা, কোম্পানীতে পার্টি-শাখা গঠন, বিভিন্ন স্তরে রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ ইত্যাদির মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ট্রেইন করা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে।
গেরিলা বাহিনীর নিয়মিতকরণের সাথে কমান্ডার, কেডারদের ও সৈনিকদের রাজনৈতিক ও সামরিক ট্রেনিং প্রদানের জন্য বিভিন্ন স্তরের স্কুলের ব্যবস্থা করতে হবে।
কখনও কখনও বড় শত্রুকে ধ্বংস করা বা বড় ঘেরাও দমন ভেঙ্গে ফেলা অথবা প্রচণ্ড চাপের মুখে সরে পড়ার জন্য আন্তঃ-অঞ্চল, আন্তঃ-উপঅঞ্চল সমন্বয় প্রয়ােজন।
এ সমন্বয়ের ফলে একাধিক অঞ্চল বা উপ-অঞ্চলের গেরিলাদের সমাবেশ করা যাবে বা এক অঞ্চল, উপ-অঞ্চলের গেরিলারা অন্য অঞ্চল, উপ-অঞ্চলে সরে পড়তে পারবে। _ এ কারণে বিভিন্ন অঞ্চল ও উপ-অঞ্চলের মধ্যকার ফাকসমূহ দূর করতে হবে এবং বিভিন্ন অঞ্চল ও উপ-অঞ্চলের মধ্যে ভাল সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে।

১৩. ঘাঁটি এলাকার সমস্যা
একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন, তা টিকিয়ে রাখা ও শক্তিশালী করা এবং শেষ পর্যন্ত এর সহায়তায় শক্রদের পরাজিত করার জন্য ঘাটি এলাকা অপরিহার্য। ঘাটি এলাকা হচ্ছে রণনৈতিক এলাকা যার উপর নির্ভর করে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়।
পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থা বিবেচনা করে ঘাটি এলাকা গঠনের সমস্যার সমাধান করতে হবে। খুলনার দক্ষিণাংশ, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের কিয়দংশ ব্যতীত সমগ্র পূর্ব বাংলাই সমভূমি, নদীমাতৃক; পর্বত ও গভীর অরণ্য বর্জিত। কাজেই এখানে ঘাঁটি এলাকা গঠনের সমস্যা হচ্ছে সমভূমিতে ঘাঁটি এলাকা গঠনের সমস্যা।
জঙ্গলাকীর্ণ ও পার্বত্য অঞ্চলে ঘাটি এলাকা গড়ে তােলার দিকে আমরা প্রথম থেকেই গুরুত্ব প্রদান করেছি। এ সকল স্থানের দুর্গমতা এবং সরকারের সাথে সংযােগ কম থাকার কারণে এগুলাে স্বাভাবিক ঘাঁটি হিসেবে বিরাজ করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরে জনগণকে সংগঠিত করে ঘাটি এলাকা গড়ার প্রচেষ্টা চলছে।
পার্বত্য এলাকায় ঘাটি গঠনের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে নিকটবর্তী বাঙালী এলাকায় কাজ হওয়া যাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাজকে শত্রু বিচ্ছিন্ন করে নির্মূল করতে না পারে।
পৃষ্ঠা: ৫৬৯

এ দিকে গুরুত্ব আরােপ করা হচ্ছে। জঙ্গলাকীর্ণ দক্ষিণাঞ্চলে কাজের বিস্তৃতি ঘটানাে উচিত। ঘাটি এলাকা গঠনের দিক দিয়ে উপরােক্ত স্থানগুলাে খুবই সুবিধাজনক।
নদী মােহনা ও চরাঞ্চল ও ঘাঁটি গঠনের দিক দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর গুরুত্ব সম্পন্ন। স্থানীয় ডাকাত ও শত্রুদের উৎখাত করে ঘাঁটি এলাকা গঠন ও নৌ গেরিলা গড়ে তােলা উচিত।
ঘাঁটি এলাকার মৌলিক সমস্যা হচ্ছে একটি শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী গঠন, শত্রুর পরাজয় এবং জনগণকে সংগঠিত করা।
আমাদের ঘাঁটি এলাকা গেরিলা তৎপরতার প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠে।
প্রথমে গেরিলা অঞ্চল অর্থাৎ শক্রর নিয়ন্ত্রণ আছে আবার আমাদের তৎপরতাও। রয়েছে এরূপ অঞ্চল হিসেবে বিরাজ করে।
জনগণ ঘৃণীত চরম অত্যাচারী সরকারী চরদের খতম করা এবং অন্যান্যদের আত্মসমর্পণ করানাের মাধ্যমে গ্রামের জনগণকে প্রতিক্রিয়াশীলদের কব্জা থেকে মুক্ত করা হয়।
এ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক জনগণকে জাগরিত করা, গেরিলা সংগঠিত করা, অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়।
শক্র ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে এলাকায় প্রবেশে ভয় পায়।
বর্তমানে ব্যাপক গেরিলা অঞ্চল গড়ে তােলা, তাকে বিস্তৃত করা, সশস্ত্র বাহিনী গঠনের বিরাট তৎপরতা চলছে।
শত্রুর দুর্বল অবস্থান দখল, চলমান শত্রুকে ঘেরাও করে খতম করার তৎপরতা ব্যাপকভাবে অচিরেই শুরু হবে।
শত্রুর চলমান ইউনিটকে ঘিরে ফেলে ধ্বংস করার প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে চালু করা এবং আমাদের ইউনিটসমূহকে এ বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে।
এর সাথে যুক্ত করতে হবে অতর্কিতে দুর্বল শত্রু-অবস্থান দখল করা, গুরুত্বপূর্ণ শত্রু অবস্থান দখলের জন্য তরঙ্গমালার মত আক্রমণের পদ্ধতি।
ঘাটি এলাকা গঠনের জন্য সকল জেলায়, শহরে, গ্রামে, যােগাযােগ পথে, পাহাড়েসমভূমিতে গেরিলা তৎপরতা চালাতে হবে, শত্রু সৈন্যকে বিভক্ত করে ফেলতে হবে।
এভাবে শত্রু বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে ঘেরাও দমন চালাতে অক্ষম হয়ে পড়বে এবং আমাদের ঘাটি এলাকা গড়ে উঠবে।
শত্রুর শক্তিশালী অবস্থানের নিকটস্থ (বড় শহর, যাতায়াত পথ, শিল্পনগর) অঞ্চলগুলাে সুদীর্ঘদিন ধরে গেরিলা অঞ্চল হিসেবে বিরাজ করবে। এ সকল এলাকার শত্রুদেরকে আমাদের নিকট আত্মসমর্পণ করতে, আমাদের সাথে সহযােগিতা করতে বাধ্য করতে হবে।

১৪. বিপ্লবী যুদ্ধ ও গণসংগ্রাম
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা বাঙালী দ্বারা বাঙালী দমনের নীতি গ্রহণ করেছে; রক্ষী, সেনাবাহিনী, বি.ডি.আর, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী সংগঠিত করেছে।
বাঙালীর দ্বারা গঠিত পূর্ব বাংলার এ সকল বাহিনীকে যুদ্ধ থেকে বিরত করা, তাদের মনােবল ভেঙ্গে দেওয়া, তাদের নিষ্ক্রিয় করা বা দলে টেনে আনার জন্য গণসংগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
পৃষ্ঠা: ৫৭০

উপরন্তু গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় ব্যাপক জনগণকে জাগরিত করা, শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত করা সম্ভব।
পূর্ব বাংলার বিশেষত্ব-ক্ষুদ্র দেশ, ঘনবসতি, অর্থনৈতিকভাবে সমবিকশিত, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অভিন্নতার কারণে গণসংগ্রাম অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
১৯৫২ সালের গণসংগ্রাম, ১৯৬৯ সালের গণসংগ্রাম, ১৯৭১ সালের গণসংগ্রাম এর প্রমাণ।
কাজেই উচ্চ পর্যায়ের গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় অভ্যুত্থান সংগঠিত করা। এভাবে শত্রুর এলাকা খর্ব করা, আমাদের এলাকা বাড়ানাে, সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলা সম্ভব।
গণসংগ্রামের জন্য গ্রামের কৃষক, যুবক, নারী, বুদ্ধিজীবীদের মাঝে কাজ প্রয়ােজন, বিশেষভাবে নারীদের মাঝে ভাল কাজ প্রয়ােজন।
সশস্ত্র সংগ্রামের বিকাশের প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ যুবকই এ কাজে ব্যস্ত থাকবে। কাজেই গ্রাম্য নারীরাই গ্রামে থাকবে গণসংগ্রাম পরিচালনার জন্য।
উপরন্তু নারীদের মিছিল, মিটিং, ঘেরাও অবস্থানের উপর শত্রুর দমনমূলক তৎপরতা সমগ্র এলাকার জনগণকে বিপ্লবের পক্ষে নিয়ে আসবে, শত্রুর বিরুদ্ধে ঘৃণা তীব্রতর করবে।
এ ছাড়া নারীদের সংগ্রাম ভাড়াটে বাহিনী এবং জনগণের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে।
উপরন্তু নারীরা সমাজের সবচাইতে পশ্চাদগামী অংশ। গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় তাদেরকে জাগরিত করা গেলে বিপ্লবের বিজয় নিশ্চিত হবে।
শহরে গরীব জনসাধারণ, শ্রমিক, ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, নারী এবং বিভিন্ন পেশাধারীদের মাঝে কাজ করতে হবে। তাদের দ্বারা পরিচালিত স্বতঃস্ফূর্ত গণসংগ্রামকে দেশব্যাপী সমন্বিত গণসংগ্রামে রূপ দিতে হবে।
বিভিন্ন দাবীদাওয়া, অত্যাচার, নির্যাতনের প্রতিবাদে গণসংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।
এ গণসংগ্রাম আমাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে তা গােপন থাকবে। গণসংগ্রামকারীরা হচ্ছে আইন অনুগত সাধারণ নাগরিক।

১৫. পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থা
ও আত্মনির্ভরশীলতা
পূর্ব বাংলা ভৌগলিকভাবে ভারত পরিবেষ্টিত, বঙ্গোপসাগরও ভারত নিয়ন্ত্রিত। বার্মার সাথে সীমান্ত রয়েছে, তাও ‘বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ হচ্ছে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের অন্যতম শত্রু। উপরন্তু সেখানে বিপ্লবী তৎপরতা শক্তিশালী নয়। কাজেই পূর্ব বাংলায় ভারত বিরােধী তৎপরতায় কোন সহায়তা লাভ করার সম্ভাবনা কম (জনগণের সমর্থন ব্যতীত)।
বার্মার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য।
উপরন্তু পূর্ব বাংলার সাথে সাধারণ সীমান্ত রয়েছে এবং আমাদেরকে সহায়তা (ট্রেনিং, অস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে) করতে পারে এরূপ কোন দেশের অস্তিত্ব নেই।
কাজেই পূর্ব বাংলার বিপ্লবকে আত্মনির্ভরশীলতা ও জনগণের উপর নির্ভর করে বিজয় অর্জন করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৭১

অস্ত্র-ট্রেনিংসহ সকল বিষয়েই আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, জনগণের উপর নির্ভর করতে হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ব্যতীত বুর্জোয়া বা অন্য কোন শ্রেণীর পক্ষে আত্মনির্ভরশীলতা ও জনগণের উপর নির্ভর করে বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
১৯৭১-এ বুর্জোয়ারা ভারতে আশ্রয় নেয় এবং ভারতীয় পুতুলে পরিণত হয়, দেশকে বিক্রি করে।
অতীতে সুভাষ বােসও পরনির্ভরশীলতার পথ অনুসরণ করে, জাপানের পুতুলে পরিণত হয়।
পূর্ব বাংলার সীমান্তে এমন কোন দেশ নেই যেখানে বুর্জোয়ারা আশ্রয় নিতে পারে বা সেখানে থেকে ভারত বিরােধী সংগ্রাম চালাতে পারে বা সাহায্য পেতে পারে।
এ কারণে পূর্ব বাংলায় বুর্জোয়াদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
পূর্ব বাংলার সর্বহারাদের পূর্ব বাংলার বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আত্মনির্ভরশীলতা ও জনগণের উপর নির্ভর করার লাইন গ্রহণ করতে হবে।
চীন বা অন্য কোন ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের অস্ত্র ছাড়া বা সমর্থন ছাড়া বিপ্লব করা যাবে এ ধরনের পরনির্ভরশীলতার মানসিকতাকে দূর করতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ সহ বিশ্বের সকল দেশ, জনগণ ও জাতির সমর্থন আমরা কামনা করি, আমরা তাদের সংগ্রামকে সমর্থন করি।
কিন্তু বিপ্লব করার জন্য আমাদেরকে নির্ভর করতে হবে নিজেদের শক্তি ও জনগণের উপর।

১৬. বিভিন্ন গ্রুপের সশস্ত্র তৎপরতার ভবিষ্যৎ
পূর্ব বাংলার ক্ষুদে উৎপাদন ব্যবস্থার বিকেন্দ্রিকতা, এবং আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাতের পক্ষে জনসমর্থনের কারণে বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম ও তৎপরতার সৃষ্টি হতে পারে।
এ ধরনের সশস্ত্র তৎপরতা সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা দ্বারা পরিচালিত সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টির পরিচালনাধীন আনতে হবে। অন্যথায় এ সকল তৎপরতা ধ্বংস ও নির্মূল হতে বাধ্য।
মার্কসবাদী নেতৃত্ব গ্রহণ না করলে এ সকল গ্রুপ শত্রু-মিত্র নির্ণয়, শত্রু ও নিজেদের অবস্থা বিবেচনা করে যথাযথ সামরিক, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক, নিরাপত্তা, শৃংখলা সংক্রান্ত ও অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হবে। ফলে তারা পরাজিত ও ধ্বংস হবে।
এ সকল গ্রুপের সৎ ও দেশপ্রেমিকদের উচিত সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, নিজেদের আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমকে সার্থক করা।
নিজেদেরকে মার্কসবাদী দাবী করে এরূপ কতগুলাে গ্রুপের সশস্ত্র তৎপরতা চলছে।
তাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইন দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং পূর্ব বাংলার বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
তাদের রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ ঠিক না হওয়ায় শত্রু মিত্র নির্ণয়, প্রধান শত্রু ও গৌণ শত্রু নির্ধারণ, রিক্রুটমেন্ট, জনগণকে সমাবেশিত ও পরিচালিত করার ক্ষেত্রে তাদের ভুল হচ্ছে।
শত্রু-মিত্র, প্রধান ও গৌণ শত্রু নির্ধারণে ভুল হওয়ায় সামরিক ক্ষেত্রে তারা এমন
পৃষ্ঠা: ৫৭২

সব পদক্ষেপ নেয় যার ফলে মাঝারী চাষী, ধনী চাষী, সামন্তদের, দেশপ্রেমিক অংশের সাথে মিত্রতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে বৈরিতা সৃষ্টি করেছে।
গেরিলা বাহিনীর বিকাশের পর্যায়, ঘেরাও, দমন ও তা থেকে আত্মরক্ষার উপায়, উদ্যোগ বজায় রাখার পদ্ধতি, একনাগাড়ে বিস্তৃত অঞ্চলে কাজ, শহরে গ্রামে ভাল কাজ, বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ, শীতকালীন আত্মরক্ষা, মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণ ইত্যাদি বিষয় যা শূন্য থেকে গেরিলা গড়ে তােলা ও বিকাশ সাধনের জন্য গ্রামাঞ্চলে পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার অপরিহার্যতা তারা বিবেচনা করেনি। বিচ্ছিন্ন পকেট গড়ে তােলে।
ফলে তাদের বিচ্ছিন্ন পকেটসমূহ শত্রু সহজেই ঘিরে ফেলে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।
এ থেকে দেখা যায় সর্বহারা সঠিক বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত গেরিলা যুদ্ধ টিকে থাকা, বিকাশ সাধন ও বিজয় অর্জন করতে পারে না।

১৭. উপসংহার
পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নির্ভুল পরিচালনায় পার্টির নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলা, বিকাশ সাধন এবং শেষ পর্যন্ত এর সাহায্যে শত্রুদের পরাজিত ও ধ্বংস করা সম্ভব।
একটি বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি ‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এ বাহিনী গঠনের সাথে যুক্ত বহু মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান হয়েছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা দ্বারা পরিচালিত হয়ে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও সামরিক এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সঠিক লাইন নির্ধারণ করতে, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে, এর দ্বারা শত্রুকে পরাজিত ও ধ্বংস করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অবশ্যই সক্ষম হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।
পৃষ্ঠা: ৫৭৩

জনাব বারীর বক্তব্যের উপর কতিপয় বক্তব্য
(সম্ভবতঃ ১৯৭৪)

টীকা
উৎপাদনের ব্যবস্থার (Mode of Production) উপর সমাজের উপরিকাঠামাে (Superstructure) দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি, চেতনা (উপরিকাঠামাে) সামাজিক ভিত্তি উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে উৎপাদন সম্পর্ক ও উৎপাদক শক্তির দ্বন্দ্ব। উৎপাদক শক্তি প্রতিনিয়ত বিকাশ লাভ করে। উৎপাদক শক্তির বিকাশের সাথে উৎপাদন সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে, উৎপাদন সম্পর্ক পরিবর্তনের প্রয়ােজন হয় যাতে উৎপাদন শক্তি ও উৎপাদনের সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকরা উপরিকাঠামােও নিয়ন্ত্রণ করে। তারা পুরানাে উৎপাদন ব্যবস্থা (যা তাদের জন্য সুবিধাজনক) টিকিয়ে রাখার জন্য উপরিকাঠামােকে উৎপাদক শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। এ কারণে উৎপাদন সম্পর্ক পরিবর্তনের সংগ্রাম পরিচালিত হয় উপরিকাঠামাের বিরুদ্ধে, প্রধানতঃ রাষ্ট্র ও তার প্রধান উপাদান সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে। এ সংগ্রামের ফলে পুরনাে উৎপাদন সম্পর্ক ও উপরিকাঠামাে পরিবর্তিত হয়, নতুন উৎপাদন সম্পর্ক ও উপরিকাঠামাে প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে সমাজ প্রতিনিয়ত বিকাশ লাভ করছে। কাজেই উপরিকাঠামাের চেতনা-সংগ্রাম চিন্তাধারার উৎস খুঁজতে হবে সমাজের ভিত উৎপাদন ব্যবস্থার মাঝে, সম্পত্তির মালিকানার সম্পর্কের মাঝে ! ইহা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাধারণ শিক্ষা।

কয়েকটি উদ্ধৃতিঃ
“সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা যেরূপ, সেরূপ হবে সমাজ, এর ধারণা, চিড়, এর রাজনৈতিক মতবাদ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ।” “সমাজের ইতিহাসের সূত্র মানুষের মনের মাঝে খুঁজলে হবে না, ধারণা ও চিড়র মাঝে খুঁজলে হবে না। খুঁজতে হবে একটি ঐতিহাসিক যুগে সমাজে কী উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল তার মাঝে। অবশ্যই খুঁজতে হবে সমাজের অর্থনৈতিক জীবনের মাঝে।” “উৎপাদন ব্যবস্থা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে সাধারণভাবে নির্ণয় করে।” “মানুষের চেতনা তার সামাজিক অস্থিকে নির্ণয় করে না। সামাজিক অস্রি তার চেতনাকে নির্ণয় করে।”
-স্ট্যালিন,
ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ।
পৃষ্ঠা: ৫৭৪

জনাব বারী হক-তােয়াহাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বর্তমানে তিনি একটি পৃথক গ্রুপ হিসেবে বিরাজ করছেন। তিনি দাবী করেন সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যের জন্য তিনি চেষ্টা করছেন।
তিনি একটি বক্তব্য তৈরী করেছেন। তার উপর কতিপয় মন্তব্যঃ
বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা মুসলিম ধর্মাবলম্বী সামন্তদের উৎখাত করে পাক-ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।
এভাবে তারা পাক-ভারতের সমাজের উপরিকাঠামাে দখল করে।
বৃটিশরা মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের উৎখাত করে পাক-ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।
বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা উৎপাদন ব্যবস্থায় ও উপরিকাঠামােতে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য বজায় রাখে, এক ধর্মাবলম্বী দালালদের উপর নির্ভর করে অন্য ধর্মাবলম্বী জনগণের উপর ধর্মীয় নিপীড়ন চালায়।
এর উদ্দেশ্য ছিল সাম্প্রদায়িক মনােভাব সৃষ্টি করা, দাঙ্গা-রায়ট বাধানাে, জনগণকে অনৈক্যবদ্ধ রাখা এবং তাদের উপর শােষণ ও শাসন পরিচালনা সহজতর করা।
ইহা বৃটিশদের প্রতিক্রিয়াশীল “ভাগ কর, শাসন কর” নীতি বলে পরিচিত।
উৎপাদন ব্যবস্থায় ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য ও নিপীড়নের অবসান করার এবং যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা উপরিকাঠামােতে সংগ্রাম পরিচালনা করে।
এর ফলস্বরূপ উপরিকাঠামােতে ধর্মীয় নিপীড়ন বিরােধী চিন্তা ও সংগ্রামের উদ্ভব হয়।
সর্বহারার নেতৃত্ব না থাকায় জনগণের ধর্মীয় নিপীড়ন বিরােধী সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করে পাক-ভারতের আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা। তারা জনগণকে ধর্মীয় নিপীড়নের মূল কারণ বৃটিশ উপনিবেশবাদ ও তার দালালদের বিরুদ্ধে পরিচালনা
করে সাম্প্রদায়িকতা, রায়ট, দাঙ্গার দিকে পরিচালনা করে।
ফলে রায়ট-দাঙ্গার উদ্ভব হয়, জনগণের মাঝে অবৈর ধর্মীয় দ্বন্দ্ব বৈর রূপ ধারণ করে।
সর্বহারার নেতৃত্বে পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হলে ধর্মীয় নিপীড়নকারী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে (বৃটিশ উপনিবেশবাদ ও তার দালাল প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ত ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতিদের) সংগ্রাম পরিচালিত হতাে এবং ধর্মীয় নিপীড়নের অবসানের ভিত্তিতে অখণ্ড পাক-ভারত গঠিত হতাে। ভাষাভিত্তিক জাতীয় বিকাশের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রদান করা হতাে।
কাজেই উপরিকাঠামাে, চেতনায় দ্বিজাতি তত্ত্বের (হিন্দু-মুসলিম ধর্মের ভিত্তিতে দুই জাতি এ তত্ত্ব) উদ্ভবের কারণ উৎপাদনের ব্যবস্থায় ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য ও নিপীড়নের মাঝে নিহিত।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাক-ভারতের বিভক্তির জন্য শুধু প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। কারণ, প্রতিক্রিয়াশীলরা তাদের নিয়মমত প্রতিক্রিয়াশীল কাজ করে যাবে।
দোষ হচ্ছে পাক-ভারতের সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির ব্যর্থতারও। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা এবং এ বিপ্লবের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়।
পূর্ব বাংলার বাঙালী-বিহারী সংঘাত একই কারণে ঘটে। পূর্ব বাংলার উৎপাদন
পৃষ্ঠা: ৫৭৫

ব্যবস্থায় অবাঙালীরা প্রাধান্য অর্জন করে। এটা সম্ভব হয় পূর্ব বাংলা তথা পাকিস্তানের উপরিকাঠামাে তাদের হাতে থাকায়।
পূর্ব বাংলার জনগণ উপরিকাঠামােতে সংগ্রাম করে উৎপাদন ব্যবস্থায় নিজেদের সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টির জন্য।
জনগণের এ সংগ্রামে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব না থাকায় বুর্জোয়ারা এ সংগ্রামের নেতৃত্ব দখল করে এবং একে বিপথে পরিচালনা করে।
ফলে ভাষাভিত্তিক বাঙালী বিহারী দাঙ্গা-রায়ট বাধে, জনগণের মধ্যকার অবৈর ভাষাভিত্তিক দ্বন্দ্ব বৈর রূপ লাভ করে; বহু জনগণ প্রাণ হারায়, ধনসম্পত্তি বিনষ্ট হয়, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীলদের সুবিধা হয়।
কাজেই বাঙালী-বিহারী সংঘাতের কারণ নিহিত আছে উৎপাদন ব্যবস্থার মাঝে।
অর্থাৎ, সাম্প্রদায়িকতা, দ্বিজাতি তত্ত্ব, বাঙালী-বিহারী দাঙ্গা প্রভৃতির কারণ শুধু ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত-চেতনা-বাইরের কারণ বললে আধিবিদ্যক ভুল হবে। এর ভিত্তি ছিল উৎপাদন ব্যবস্থার পার্থক্য বৈষম্য ও নিপীড়নের মাঝে।
উৎপাদন ব্যবস্থায় কোন বৈষম্য, নিপীড়ন না থাকলে ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত পার্থক্য উপরিকাঠামাের রাষ্ট্র, রাজনীতিতে কোন বৈষম্য সৃষ্টি করে না। ফলে কোন সমস্যার উদ্ভব হয় না।
চীন, কোরিয়া, উত্তর ভিয়েতনাম তার প্রমাণ।
জনাব বারী দ্বিজাতি তত্ত্ব সাম্প্রদায়িকতার উৎস চেতনা-ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মাঝে দেখেছেন। কিন্তু চেতনার উৎস বস্তু, ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের ভিত্তি সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার বৈষম্য, নিপীড়নকে, সমাজের শ্রেণীবিভাগকে অস্বীকার করেছেন।
এভাবে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে বিসর্জন দিয়েছেন। আধিবিদ্যক দৃষ্টিকোণ দিয়ে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিক ভাববাদী হয়েছেন।
সাম্প্রদায়িকতা দূর করার বিষয়ে সর্বহারাদের কর্মসূচী হচ্ছে উপরিকাঠামাে ও সামাজিক ভিত্তিতে ধর্মীয় নিপীড়নও বৈষম্যের অবসান, ধর্মীয় সমতা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা।
* ধর্ম হচ্ছে উপরিকাঠামাের অঙ্গ। এর উৎপত্তির কারণ হচ্ছে পশ্চাদপদ উৎপাদন ব্যবস্থা।
ধর্মীয় পার্থক্য দূর করা সম্ভব ধর্মের পুরােপুরি অবসানের সাথে সাথে। এটা সম্ভব বৈজ্ঞানিক উৎপাদন ব্যবস্থা এবং বৈজ্ঞানিক উপরিকাঠামাে সৃষ্টির মাধ্যমে। সমাজতন্ত্রের। উচ্চতর পর্যায়ে যখন বৈজ্ঞানিক উৎপাদন ব্যবস্থা ও উপরিকাঠামাে গড়ে উঠবে তখনই এটা সম্ভব।
মানুষের চিন্তাধারা পরিবর্তনে সময় প্রয়ােজন। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত ধর্মীয় চেতনার অস্তিত্ব উপরিকাঠামােতে থাকবে, যদিও উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে।
এ কারণে সমাজতান্ত্রিক সমাজেও ধর্মীয় অধিকার রয়েছে।
উন্নত পুঁজিবাদী ইউরােপেও এখনাে ধর্ম ও ধর্মীয় সংঘাত রয়েছে, উত্তর আয়ারল্যান্ডে ধর্মীয় এবং নিপীড়ন বিরােধী সংগ্রাম চলছে।
ইহা প্রমাণ করে বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থায়ও ধর্মীয় নিপীড়ন চলে। কাজেই ধর্মীয় পার্থক্যের ভিত্তিতে বৈরীতা জন্মলাভ করতে পারে উৎপাদন পদ্ধতি, উপরিকাঠামােতে বৈষম্য নিপীড়ন থাকলে এবং পার্থক্যকে ব্যবহার করার মত প্রতিক্রিয়াশীল উপস্থিতির ফলে।
পৃষ্ঠা: ৫৭৬

কাজেই সকল ধর্মীয় নিপীড়নের অবসান এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের উৎখাত হলেই সাম্প্রদায়িকতা দূর করা সম্ভব।
এ থেকে দেখা যায়, “যুক্ত বাংলা কায়েম না করে সাম্প্রদায়িকতা পূর্ব বাংলা থেকে দূর করা অসম্ভব, সাম্প্রদায়িকতা দূর করার জন্য যুক্তবাংলা গঠনের প্রয়ােজন”-এ তত্ত্ব ভুল।
সাম্প্রদায়িকতা দূর করার জন্য প্রয়ােজন হলাে পূর্ব বাংলার প্রতিক্রিয়াশীলদের উৎখাত করে সর্বহারাদের ক্ষমতা দখল করা।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ক্ষমতা দখল হলে কি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় নিপীড়ন থাকবে?
অথবা, ভারতের সর্বহারা শ্রেণী যখন ভারতের ক্ষমতা দখল করবে তখন কি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় নিপীড়ন থাকবে?
মার্কসবাদ সম্বন্ধে যার সামান্য জ্ঞান রয়েছে তিনিও বলবেন এরূপ অবস্থায় পূর্ব বাংলা বা ভারত কোথাও ধর্মীয় নিপীড়ন থাকবে না।
দুই বাংলা পৃথক থাকুক আর একত্রিত হােক সাম্প্রদায়িকতার অস্তিত্বের মৌলিক কারণ সর্বহারা শ্রেণী রাজনৈতিক ক্ষমতায় নেই।
কাজেই “দুই বাংলা পৃথকিকরণ বজায় রেখে কোন অঞ্চল থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা এক অবান্তর চিন্তা”-এ বক্তব্য ভুল।
* জনাব বারী লক্ষ্য করলেই দেখতে পেতেন ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে ফিলিপাইনের মুসলিম জনগণ সশস্ত্র সংগ্রাম করছে।
কাজেই, ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে সশস্ত্র সংগ্রাম, পৃথক হওয়া, দাঙ্গা-রায়ট ঘটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। কাজেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানে যােগদান করে থাকলে জনগণকে দোষী করা কি ঠিক হবে?
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী পূর্ব বাংলার ক্ষমতা দখল করার মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করবে।
দুই বাংলা একত্রিত না হলেও বিপ্লব অব্যাহত গতিতে (না থেমে) পরিচালিত হবে।
এর প্রমাণ উত্তর ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া। একত্রীকরণ না হওয়া সত্ত্বেও তারা বিপ্লব অব্যাহতভাবে চালিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করেছে।
কাজেই, “জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য দুই বাংলার একত্রীকরণ প্রয়ােজন”-এ বক্তব্য ঠিক নয়।
* “দুই বাংলার কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা দরকার”-এ বক্তব্যও ভুল।
প্রথমতঃ পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্টদের পৃথক কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা অসর্বহারা বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী কাজ।
কারণ মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী ভারতীয় ভৌগলিক সীমারেখার মাঝে একটিই পার্টি হতে পারে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারাদের উচিত হবে পূর্ব বাংলার ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী সর্বহারাদের নিয়ে একটিই পার্টি গঠন করা; ভারত, বার্মা প্রভৃতি দেশের সর্বহারা পার্টির সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম সহযােগিতা করা, কিন্তু তাদের সাথে যােগদান না করা।
পৃষ্ঠা: ৫৭৭

যােগদান করার অর্থ হবে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে ক্ষতিগ্রস্থ করা।
কেবলমাত্র কমিউনিস্ট সমাজেই রাষ্ট্রীয় সীমানা থাকবে না। তখনই রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে পৃথক পার্টি গঠনের প্রয়ােজনীয়তা থাকবে না, শ্রেণী থাকবে না এবং পার্টিও থাকবে না।
কাজেই, বর্তমানে যুক্ত বাংলা পার্টি গঠনের প্রস্তাব পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ক্ষতিসাধন করার প্রস্তাব।
একথা চিন্তা করেই দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্টগণ পৃথক পার্টি গঠন করে (Peoples Revolutionary Party of South Vietnam) ft fecoa116H 719 করছে, যদিও তারা মাতৃভূমির পুনরেকত্রীকরণের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
* সমগ্র বাংলা বৃটিশদের একটি প্রদেশ ছিল। এর পূর্বে মােগল ও পাঠানদের সময়েও বাংলা তাদের শাসনাধীন ছিল।
মােগল আমলে বা বৃটিশ আমলে বাংলা একটি পৃথক রাষ্ট্র বা দেশ ছিল না। বৃটিশদের দখলের পূর্বে সমগ্র ভারত ছিল পৃথক রাষ্ট্র।
পক্ষান্তরে জাপান দখল করে কোরিয়া (বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিনের নিয়ন্ত্রণে) এবং ফ্রান্স দখল করে ভিয়েতনাম (বর্তমানে দক্ষিণ ভিয়েতনামের কিছু অংশ মার্কিনের নিয়ন্ত্রণে) যাদের পৃথক রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ছিল।
স্বাভাবিকভাবেই কোরিয়া ও ভিয়েতনামের জনগণ মাতৃভূমির মুক্তি চেয়েছে। বর্তমানে খণ্ডিত মাতৃভূমির একত্রীকরণের জন্য সংগ্রাম করছে।
কাজেই, ভিয়েতনাম, কোরিয়ার উদাহরণ তুলনা করলে সমগ্র পাক-ভারতের সংযুক্তি দাবী করা যুক্তিসঙ্গত; শুধু যুক্ত বাংলা নয়।
বৃটিশ আমলে মাতৃভূমি বলতে বুঝাতে সমগ্র পাক-ভারত। কাজেই মাতৃভূমির পুনরেকত্রিকরণ বলতে সমগ্র পাক-ভারত উপমহাদেশের একত্রীকরণ দাবী করা বুঝায়।
বৃটিশ আমলে সমগ্র পাক-ভারতের জনগণ বৃটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। তার প্রমাণ ১৮৫৭ সালের সংগ্রাম, অনুশীলন, যুগান্তর, সূর্যসেনের সংগ্রাম; এমন কি সুভাষ বােসও স্বাধীন বাংলার জন্য সংগ্রাম করেনি।
কাজেই মাতৃভূমির একত্রীকরণ বলতে পাক-ভারতের একত্রীকরণ না বুঝিয়ে দুই বাংলার একত্রীকরণ বুঝানাে ঠিক নয়।
ইহাও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ।
* জনাব বারী বলেছেন, “দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রভাবে ভারতের প্রায় প্রত্যেকটি জাতি সাম্প্রদায়িকভাবে হিন্দু মুসলিম দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।”
তাহলে দ্বিজাতি তত্ত্ব ধ্বংস করার কর্মসূচী থাকলে শুধু বাঙালীদের জন্য যুক্ত জাতি গঠনের পরিকল্পনা কেন? সমগ্র পাক-ভারতের সকল খণ্ডিত জাতির পুনরেকত্রীকরণের কর্মসূচী প্রদান করা, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত পাক-ভারতের (বর্তমানে দ্বিখণ্ডিত) অবসান করে অখণ্ড পাক-ভারত গঠনই এ তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এর পরিবর্তে শুধু বাঙালী জাতির কথা চিন্তা করা হচ্ছে “আমি বাঙালী তাই বাঙালীর কথা চিন্তা করি”-এ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বহিঃপ্রকাশ যা আন্তর্জাতিকতাবাদের বিরােধী।
পৃষ্ঠা: ৫৭৮

উপরন্তু একটি সমাধান মার্কসবাদী তত্ত্ব বলে তখনই পরিগণিত হবে যখন একই ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রেও তা প্রযােজ্য।
জনাব বারীর “দ্বিজাতি তত্ত্বের অবসানের তত্ত্ব অন্যান্য খণ্ডিত জাতির ক্ষেত্রে প্রযােজ্য নয় বলে তা মার্কসবাদ নয়।
* হিন্দুপ্রধান পশ্চিম বাংলার সাথে পূর্ব বাংলার একত্রীকরণের কথা বললে পূর্ব বাংলার হিন্দু জনসাধারণকে দলে টানা যাবে-এ ধারণা থেকে তত্ত্ব বলার অর্থ হবে হিন্দু জনসাধারণের দেশপ্রেমকে খাটো করা, তাদেরকে সাম্প্রদায়িক মনােভাবাপন্ন মনে করা।
হিন্দু জনসাধারণসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি সর্বহারাদের কর্মসূচী হওয়া উচিত সকল ক্ষেত্রে ধর্মীয় নিপীড়ন ও বৈষম্যের অবসান, ধর্মীয় সমতা কায়েম। এ ভিত্তিতেই তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করা উচিত।
কিন্তু যুক্তবাংলার কথা বলে তাদের দলে টানার অর্থ হচ্ছে সুবিধাবাদের জন্য তত্ত্ব তৈরী করা।
এটা হচ্ছে তত্ত্বের ক্ষেত্রে সুবিধাবাদ।
* উক্ত কমরেডগণ অতীতে জাতীয়তাবাদকে (পূর্ব বাংলার জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা) বিরােধিতা করেছেন। বর্তমানে যুক্ত বাংলা চাচ্ছেন। এভাবে তারা জাতীয়তাবাদবিরােধী থেকে অতিজাতীয়তাবাদী হয়ে গেছেন।
এটা হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়াদের ডানে বামে রূপান্তরের প্রমাণ। কাজেই রাজনৈতিক লাইন নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তারা এখনাে ক্ষুদে বুর্জোয়া রয়েছেন। খতমের ক্ষেত্রে, চারু মজুমদারের ক্ষেত্রেও তারা একই কাজ করেছেন। অতীতে তারা অতি খতম করেছেন; বর্তমানে মােটেই খতম করতে ইচ্ছুক নন। চারু মজুমদারকে অতিজিন্দাবাদ দিয়েছেন; বর্তমানে অতিমুর্দাবাদ দেন।
* জনাব বারী প্রশ্ন তুলেছেন, “আমাদের বিপ্লবের বর্তমান স্তর হচ্ছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর-এ বক্তব্য কি সঠিক?”
এ প্রশ্ন উত্থাপনের অর্থ হচ্ছে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের চরিত্র যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক তা না বুঝা। এই না বুঝার মাঝেই নিহিত রয়েছে তাদের যুক্ত বাংলার বক্তব্যের বীজ।
জাতি গঠিত হয় বুর্জোয়া উৎপাদনের পদ্ধতির বিকাশের প্রক্রিয়ায়। সামন্তবাদী যুগে জাতি গঠিত হয় না। বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থায় পণ্য দ্রব্য উৎপাদন ও বিনিময়ের সুবিধার্থে ভাষাভিত্তিক জাতি গঠিত হয়।
এই বুর্জোয়া উৎপাদন পদ্ধতির বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয় বলেই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালিত হয়।
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য দুটি-
জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে বৈদেশিক শােষকদের উৎখাত এবং বৈদেশিক শােষণের ভিত্তি সামন্তবাদকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাত করা। এজন্য ইহা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে পরিচিত।
এ বিপ্লবের লক্ষ্য হচ্ছে বুর্জোয়া উৎপাদন পদ্ধতির প্রাধান্য স্থাপন। ইউরােপে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় ভাষাভিত্তিক জাতি, জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র (প্রায় ক্ষেত্রেই) গঠিত হয় বহু পূর্বে।
পাক-ভারত উপমহাদেশ, এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদী
পৃষ্ঠা: ৫৭৯

উপনিবেশবাদীদের শােষণ-লুণ্ঠন ও নিয়ন্ত্রণের ফলে বুর্জোয়া উৎপাদন পদ্ধতি বিকাশ লাভ করেনি। ভাষাভিত্তিক জাতি, জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হতে পারেনি।
এ কারণেই এ সকল এলাকায় জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করতে হবে। বিভিন্ন জাতি রয়েছে এরূপ এলাকার জন্য জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রদানের (জাতীয় বিকাশ অব্যাহতভাবে চলার সুযােগ প্রদানের জন্য) কর্মসূচী গ্রহণ, ধর্মীয় ভাষাগত দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য ধর্মীয় ভাষাগত নিপীড়ন অবসানের এবং ধর্মীয়, ভাষাগত সাম্য বিধানের কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে।
এগুলাে হচ্ছে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য।
* প্রত্যক্ষ উপনিবেশের সংজ্ঞায় জনাব বারী বলেছেন, “যখন কোন সাম্রাজ্যবাদ কোন অনুন্নত দেশকে স্বীয় সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বে এনে সেই দেশের সামন্তবাদী ও দালাল বুর্জোয়াদের সাথে আঁতাত করে সেই দেশের শাসন ক্ষমতাকে পরিচালনা করে অথবা পুতুল সরকারের মাধ্যমে শাসন ক্ষমতাকে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ করে তখন সেই দেশকে বলা হয় সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ।”
জনাব বারী অন্যত্র বলেছেন, “ভারতীয় বাহিনী পূর্ব বাংলা দখল করে, পূর্ব বাংলার উপর। ভারতীয় দাসত্ব চেপে বসে। শেখ মুজিব ও তার দল দিয়ে পুতুল সরকার গঠন করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।”
পূর্বের বর্ণিত উপনিবেশের সংজ্ঞার সাথে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের কার্যকলাপে কোন তফাৎ নেই। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী না হয়েও একই ধরনের কাজ করছে! সম্প্রতি সিকিমেও করেছে।
কাজেই জনাব বারীর সংজ্ঞা অনুযায়ীই পূর্ব বাংলা ভারতের উপনিবেশ, যদিও ভারত একটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ নয়, সম্প্রসারণবাদী দেশ।
কিন্তু জনাব বারী পূর্ব বাংলাকে ভারতের উপনিবেশ না বলে আশ্রিত রাজ্য বলছেন কেন?
কোন দেশ সাম্রাজ্যবাদ না হলেও উপনিবেশ কায়েম করতে পারে, এ বক্তব্য তিনি জ্ঞাতে স্বীকার করতে চান না (যদিও বক্তব্যের মাধ্যমে স্বীকার করেন) কারণ, সর্বহারা পার্টির বক্তব্যকে তাহলে স্বীকার করতে হয়। তাই তিনি আশ্রিত রাজ্য বলে দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নিয়েছেন।
* পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি পূর্ব বাংলায় মার্কিন ও সােভিয়েটের শােষণ ও লুণ্ঠন এবং তাদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে স্বীকার করে এবং মার্কিন ও সােভিয়েটের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব মৌলিক দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করেছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি তার বক্তব্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য নিম্নলিখিত দ্বন্দ্বসমুহ দায়ীঃ
১। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব। ২। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব। ৩। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব। ৪। মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তার দালালদের সাথে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের দ্বন্দ্ব।
পৃষ্ঠা: ৫৮০

৫। পূর্ব বাংলার সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনতার দ্বন্দ্ব। ৬। পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব।
এরপরেও মার্কিন সােভিয়েটের শােষণ, লুণ্ঠন, নিয়ন্ত্রণের বিরােধিতা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি করে না বা তদের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে স্বীকার করে না এটা বলা সত্যের অপলাপ ব্যতীত আর কিছুই নয়।
* বাংলাদেশ পুতুল সরকার ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের স্বার্থরক্ষা করে, এটা সকলেই স্বীকার করেন।
এরা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের স্বার্থ রক্ষা করছে। পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ সরকার পরিচালনা করছে; জাতীয় বুর্জোয়া, ক্ষুদে বুর্জোয়া বা অন্যান্য দেশপ্রেমিকরা নয়।
কাজেই বাংলাদেশ পুতুল সরকার ছয় পাহাড়ের স্বার্থ রক্ষা করছে। যেহেতু বাংলাদেশ পুতুল সরকার ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের স্বার্থ রক্ষা করছে, সেহেতু সে ভারতীয় সামন্তবাদের স্বার্থেরও সেবা করছে।
বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে ছয় পাহাড়ের প্রতিনিধি বলে পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক শ্রেণীসমূহ থেকে পৃথক করা হয়েছে। এ বক্তব্য সঠিক।
* মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যখন পূর্ব বাংলার বিপ্লবের মিত্র হবে তখনই তাকে উৎখাত করে তার সাথে মিত্রতার সম্পর্ক পাতানাে হবে।
তারা এখনাে আমাদের মিত্র হয়নি, নিজেদের স্বার্থে বাংলাদেশ দখল করে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে মাত্র।
কাজেই বর্তমানে তাকে উৎখাত না করার কোন কারণ নেই। কাজেই তাকে উৎখাত করার সর্বহারা পার্টির বক্তব্য সঠিক।
* জনাব বারী উপসংহারে বলেছেন, “তাদের (পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের) সকল প্রকার সংকীর্ণতা, একপেশে ও গােড়ামীবাদ পরিহার করে খােলা মন হতে হবে এবং ঐক্যের ইচ্ছা নিয়ে পরস্পরের সাথে মত বিনিময় করতে হবে। …
আবার বলি, পূর্ব বাংলার বিপ্লব সফল করতে হলে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টদের ঐক্য দরকার … … … …।”
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যের জন্য যে পরিকল্পনা পেশ করেছে তার সাথে জনাব বারীর ঐক্যের বক্তব্য সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কাজেই, জনাব বারী যদি তার কথার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে থাকেন, তাহলে তার প্রতিশ্রুতি মােতাবেক পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে ঐক্যের কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত।
আশা করা হচ্ছে, জনাব বারী ঐক্যের কার্যক্রম গ্রহণ করবেন, গ্রুপ হিসেবে বিরাজ পরিত্যাগ করবেন।
গ্রুপ হিসেবে বিরাজের অভ্যাস খারাপ। এটা উপদলবাদ, নেতাবাদ, বিভেদপন্থীবাদ, দুর্গের মনােভাবের জন্ম দিতে পারে এবং তার জোরদার হতে পারে।
পৃষ্ঠা: ৫৮১

নােট :
উৎপাদক শক্তি (Productive Forces)ঃ উৎপাদনের যন্ত্রাদি, যার দ্বারা বৈষয়িক মূল্যসম্পন্ন বস্তু (খাদ্য, কাপড়-চোপড়, পাদুকা, ঘরবাড়ি, চিকিৎসা সামগ্রী ইত্যাদি) তৈরী হয় এবং জনগণ, যারা নির্দিষ্ট উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও শ্রমের দক্ষতার কারণে এ সকল যন্ত্রাদি চালায়, বৈষয়িক দ্রব্যাদি উৎপাদন করে-সম্মিলিতভাবে গঠন করে সমাজের উৎপাদিকা শক্তি (জনগণ ও যন্ত্রাদি)। উৎপাদিকা শক্তির সবচাইতে সচল অংশ হলাে জনগণ।
উৎপাদন সম্পর্ক (Relation of Production) : উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় মানুষের পরস্পরের মাঝে যে সম্পর্ক হয়-তা-ই হচ্ছে উৎপাদনের সম্পর্ক। উৎপাদনের সম্পর্ক শােষণের হতে পারে, আবার শােষণহীন হতে পারে। দাস-সমাজ থেকে বুর্জোয়া সমাজ পর্যন্ত উৎপাদনের সম্পর্ক হচ্ছে শােষণের সম্পর্ক। সমাজতান্ত্রিক সমাজ, কমিউনিস্ট সমাজ হচ্ছে শােষণহীন উৎপাদন সম্পর্কের সমাজ।
সামাজিক ভিত্তি (Basis of Society) : উৎপাদক শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক মিলে হয় উৎপাদনের ব্যবস্থা (Mode of Production)। এটাই হচ্ছে সমাজের ভিত্তি।
সমাজের উপরিকাঠামাে (Superstructure of Society) : রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সংস্কৃতি ইত্যাদি।
পৃষ্ঠা: ৫৮২

“পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির উপদলবাদ বিরােধী ঐতিহাসিক সংগ্রাম” শীর্ষক রচনা সংকলনের ভূমিকা
(আগস্ট, ১৯৭৪)

সভাপতি মাও সেতুঙ বলেছেন, “ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা মনোেযােগ দাবী করে।”
অভিজ্ঞতার সারসংকলনের মাধ্যমে নিয়মবিধি আবিষ্কার করা যায় এবং ভবিষ্যতের সমস্যার সমাধান করা যায়।
যতদিন সমাজে শ্রেণী থাকবে ততদিন শ্রেণী সংগ্রাম শেষ হবে না। সমাজের এ শ্ৰেণী সংগ্রাম সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টিতে প্রতিফলিত হবে দুই লাইনের সংগ্রাম অর্থাৎ সর্বহারা ও বুর্জোয়াদের মধ্যকার সংগ্রাম হিসেবে।
এ সংগ্রাম চলবে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে।
পার্টির অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিনিধিরা সর্বদাই পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে পার্টি ও রাষ্ট্রকে বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করতে মরণপণ প্রচেষ্টা চালাবে।
সর্বহারারাও অনিবার্যভাবেই মরণপণ সংগ্রাম চালাবে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিজেদের হাতে রাখতে, বুর্জোয়াদের পরাজিত ও ধ্বংস করতে।
এ সংগ্রাম কখনও কখনও তীব্র শ্রেণী সংগ্রামে রূপলাভ করবে। বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রকাশ্য ও গােপন উভয় পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চালাবে এবং অনিবার্যভাবেই ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করবে। গুজব, অপবাদ-কুৎসা রটাবে, উপদল ও চক্র গঠন করবে।
আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে শ্রেণী সমাজে এ ধরনের ঘটনা আকষ্মিক কিছু নয়, শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি।
ক্রুশ্চেভ, লিউ শাওচি, লিনপিয়াও প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীলদের উদ্ভব উপরােক্ত উপসংহারকেই প্রমাণ করছে।
ক্রুশ্চোভ ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়, লিউ-লিন আংশিকভাবে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত পরাজিত ও ধ্বংস হয়।
সভাপতি মাওসেতুঙের নেতৃত্বে সর্বহারা বিপ্লবীরা লিউ শাওচি, লিন পিয়াও প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল ঠেকাতে সমর্থ হয়।
এটা বিশ্বের সর্বহারা বিপ্লবীদের জন্য মহান বিজয় ও শিক্ষা। পূর্ব বাংলার সর্বহারা। পার্টিতে ফজলু-সুলতান বিশ্বাসঘাতক চক্র পার্টির ক্ষমতা দখল এবং কমরেড সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য সাচ্চা বিপ্লবীদের খতম করার উন্মত্ত প্রচেষ্টা চালায়, তারা ষড়যন্ত্র – চক্রান্ত করে, সুবিধাবাদী, দলত্যাগী, অধঃপতিতদের নিয়ে চক্র-উপদল গঠন করে।
কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি এবং আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীরা ফজলু-সুলতান চক্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় নীতিভিত্তিক সংগ্রাম পরিচালনা করে এবং
পৃষ্ঠা: ৫৮৩

তাদেরকে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে পুরােপুরি পরাজিত ও ধ্বংস করে।
তাদের কেউ কেউ প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাতে যেয়ে সর্বহারা বিপ্লবীদের হাতে খতম হয়।
চক্রের প্রভাব সমূলে উৎপাটিত করার জন্য পার্টিব্যাপী মতাদর্শগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম উপদলবাদ বিরােধী সংগ্রাম সঠিকভাবে পরিচালনা করে বিজয় অর্জন করে এবং অতিশয় মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
কিন্তু এ সংগ্রামই শেষ নয়। যতদিন সমাজে শ্রেণী আছে ততদিন পার্টির মধ্যকার ও বাইরের বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলরা প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালাবে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের জন্য।
অনিবার্যভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদেরও সর্বদা জীবনমরণ সংগ্রাম চালাতে হবে বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজিত ও ধ্বংস করা এবং সর্বহারাদের হাতে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা রাখার জন্য।
এ সংগ্রামের বিজয়ের উপর নির্ভর করবে পার্টি বিপ্লবী থাকবে কিনা, রাষ্ট্র সর্বহারাদের থাকবে কিনা।
এ সকল সংগ্রামে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির উপদলবাদ বিরােধী সংগ্রামের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা খুবই সহায়ক হবে।
কাজেই সমগ্র পার্টিকে মনােযােগের সাথে তাৎপর্যসম্পন্ন অতিশয় মূল্যবান অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, দেশীয় আন্তর্জাতিক সর্বহারাদের বুর্জোয়া বিরােধী সংগ্রাম অর্থাৎ, দুই লাইনের জটিল আঁকাবাঁকা জীবন-মরণ সংগ্রাম থেকে শিখতে হবে। বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে সর্বদা সংগ্রাম চালিয়ে তাদেরকে পরাজিত ও ধ্বংস করতে হবে। পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা সর্বদা যাতে সর্বহারা বিপ্লবীদের হাতে থাকে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
এভাবে দেশ, জাতি ও জনগণের মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহতভাবে বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে হবে।

নােটঃ
ফজলু-সুলতান বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী এবং দলত্যাগী, সুবিধাবাদী এবং অধঃপতিত, ভ্রষ্টদের নিয়ে চক্র গঠন করে এবং কমরেড সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য সাচ্চা বিপ্লবীদের হত্যা করা ও পার্টির ক্ষমতা দখলের জন্য প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালায়।
তাদের এ সকল জঘন্য প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা মাত্র দু’মাস স্থায়ী হয়।
ফজলু প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাতে যেয়ে বিপ্লবীদের হাতে খতম হয়।
ফজলু চক্রের অপর এক পাণ্ডা প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন কবীরও প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাতে যেয়ে খতম হয়।
চক্রের সাথে যুক্ত অন্যান্যদের চিরদিনের জন্য পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
চক্রের অবশিষ্টাংশ বর্তমানে সরকারী চরে পরিণত হয়েছে এবং সর্বহারা পার্টি (মার্কসবাদীলেনিনবাদী) নাম দিয়ে জনগণ ও বিপ্লবীদের প্রতারিত করার প্রতিবিপ্লবী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
তাদের এ প্রচেষ্টাও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য। অচিরেই তারা ফজলুর মত ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৮৪

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার
(মধ্য, ১৯৭৪)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সভাপতিত্ব করেন।
সভায় অন্যান্য সিদ্ধান্তের মধ্যে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়। সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সভা সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।

১. হরতাল সংক্রান্তঃ
১৯৭৪ সালের ১৬ই জুন অর্ধদিবস হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত একটি চমৎকার সময়ােচিত সিদ্ধান্ত।
পূর্ব বাংলার বহু জেলা, মহকুমা, থানা শহর এমন কি গ্রামাঞ্চলেও হরতাল পালিত হয়েছে।
এ হরতাল আহ্বানের উদ্দেশ্যসমূহঃ
– পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করা, রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করা, সশস্ত্র বাহিনীর চাপ গ্রাম থেকে কমিয়ে শহরে ও যােগাযােগ পথে নিয়ে আসা, শত্রুদের হয়রানী করা ইত্যাদি উদ্দেশ্য চমৎকারভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে।
পূর্ব বাংলার বিদ্রোহােনুখ জনগণকে পরিচালনার ক্ষেত্রে জাসদসহ তথাকথিত বিভিন্ন বিরােধী দলের পুরােপুরি ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ এবং আমাদের পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হরতাল বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।
বিপ্লব বা প্রতিবিপ্লবের জন্য প্রথমে প্রয়ােজন জনমত সৃষ্টি করা। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিপ্লবের পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
ব্যাপক কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক, জনগণ এমনকি আমাদের সমর্থক গণতান্ত্রিক বিরােধী দলীয়রাও এ অগ্রগতিকে স্বীকার করেন।
হরতাল শত্রুমহলে মারাত্মক ত্রাসের সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরকে হতভম্ব করে দিয়েছে। তারা মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য। তাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
হরতালের ফলে অর্জিত আমাদের বিরাট সাফল্যে মাথা বিগড়ালে চলবে না।
এটা আমাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। আমাদেরকে দৃঢ়ভাবে ব্যাপক জনগণকে আমাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করা, সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলা এবং বিরাটাকার গণসংগ্রাম গড়ে তােলার এবং শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্য সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৫৮৫

হরতালের ফলে সৃষ্ট জোয়ার ধরে রাখা এবং আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের চরমতম অত্যাচার থেকে মুক্তির আকাঙ্খায় বিদ্রোহােন্মুখ জনতাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দৃঢ়ভাবে। কাজ করে যেতে হবে।
হক, তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনদের মধ্যকার সত্যিকার বিপ্লবী কর্মী, সহানুভূতিশীলদেরও এ হরতালের সফলতা আমাদের দিকে টেনে আনছে। কোথাও কোথাও তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সমর্থন করেছে।
এ হরতালের ফলে ব্যাপক গণসংগ্রাম পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা পার্টি অর্জন করেছে যা ভবিষ্যতে ব্যাপক গণসংগ্রাম পরিচালনায় খুবই সহায়ক হবে।
– হরতালের ফলে আমাদের ক্ষয়-ক্ষতি খুবই সামান্য, পক্ষান্তরে আমাদের লাভ হয়েছে অভূতপূর্ব।
– হরতাল বাস্তবায়নের জন্য প্রচার এবং সশস্ত্র তৎপরতা প্রয়ােজন।
প্রচারের ক্ষেত্রে চিকা, পােস্টার, লিফলেট, মিছিল, পিকেটিং ইত্যাদি পন্থা অনুসরণ করা যায়।
পত্র মারফত যানবাহন বন্ধের আহ্বান জানানাে যায়।
– যােগাযােগ, পরিবহন ব্যবস্থা বানচাল করা।
– হরতাল বাস্তবায়নের জন্য সশস্ত্র তৎপরতা চালানাে। প্রয়ােজন হলে সশস্ত্র তৎপরতা হরতালের দিন চালানাে।
– অর্থের সংস্থান করা।
১৯৭৩-এর ১৬ই ডিসেম্বর হরতালের তুলনায় ১৬ই জুন ১৯৭৪ সাল-এর হরতাল অনেকগুণ সফল হয়েছে।

২.
হরতালের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে-
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শ্রমিক অঞ্চলে শক্তিশালী কাজ হলে পূর্ব বাংলার গণসংগ্রাম অভুত্থানে রূপ প্রদান করা যায়।
এ কারণে শ্রমিক এলাকায় কাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা প্রয়ােজন। শ্রমিকদের মাঝে কাজের সাথে গ্রামে কৃষকদের মাঝে কাজকে জোরদার করতে হবে। যাতে শ্রমিকদের সাথে কৃষকরাও গণসংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে।
আমাদের পার্টি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি। কাজেই শ্রমিকদের নেতৃত্ব অর্জন করা এবং শ্রমিকদের অগ্রগামী প্রতিনিধিদের পার্টিতে নিয়ে আসার জন্য শ্রমিকদের মাঝে কাজ খুবই প্রয়ােজন।
সর্বহারা পার্টিকে সত্যিকার শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির রূপ দেওয়ার জন্য এ পদক্ষেপ একান্ত অপরিহার্য।
কাজেই পার্টি-কর্মীরা শ্রমিকদের মাঝে কাজে বিশেষ গুরুত্ব দিবেন। এটা করতে যেয়ে গ্রামের কৃষকের মাঝে কাজ এবং সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার প্রক্রিয়াকে বিঘ্ন করা চলবে না।

৩. যৌথ অভিযান সংক্রান্তঃ
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা রক্ষী-পুলিশ দ্বারা আমাদের তৎপরতা দমনে ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনী নিয়ােগ করেছে এবং যৌথ অভিযান পরিচালনা করছে।
পৃষ্ঠা: ৫৮৬

এ যৌথ অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের নির্মূল করা, আমাদের। বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ব্যাহত করা।
১৬ই জুনের সফল হরতাল এ যৌথ অভিযানের একটি উপযুক্ত জবাব।
যৌথ অভিযানের দ্বারা শত্রু আমাদেরকে ধ্বংস দূরের কথা দুর্বল করতেও সক্ষম হয়নি। উপরন্তু আমাদের বিকাশ এবং অগ্রগতি দ্রুততর হচ্ছে।
জনগণ উপলব্ধি করেছে যৌথ অভিযান কালােবাজারী, মজুতদারী, রাহাজানী, কালাে টাকার মালিক আওয়ামী পাণ্ডাদের গা-ও স্পর্শ করেনি দেশের চরম আর্থিক সংকটের কোন পরিবর্তন হয়নি।
উপরন্তু সশস্ত্র বাহিনী দুর্নীতিবাজ এবং আওয়ামী লীগারদের রক্ষক হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। আমাদেরকে দাবিয়ে রাখাই বর্তমানে তাদের একমাত্র কাজ হয়েছে। এভাবে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের আস্থা হারাচ্ছে।
সেনা বাহিনী আমাদের রাজনৈতিক প্রচারের সম্মুখীন হচ্ছে, ফলে তাদের মধ্যকার দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল অংশ বিপ্লবের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
এদের অনেকেই আজ হােক, কাল হােক বিপ্লবে যােগদান করবে।
উপরন্তু যৌথ বাহিনীর দেশপ্রেমিকরা প্রকৃত সমাজবিরােধী-আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের কিছু করতে না পেরে মারাত্মকভাবে বিক্ষুব্ধ।
ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের নির্দেশ পালনে তারা বাধ্য, এ কারণে তাদের তৎপরতার বিরুদ্ধে সতর্কতা বজায় রাখতে হবে।
সশস্ত্র বাহিনীর যে সকল অফিসার ও সাধারণ সৈনিকেরা আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের যােগসাজশে আমাদের বিরুদ্ধে তৎপরতা এবং অত্যাচার চালাচ্ছে তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
আমাদেরকে দমনে যৌথ বাহিনীর ব্যর্থতা ভারতীয় বাহিনীকে ডেকে আনবে যা বিপ্লবকে আরাে ত্বরান্বিত করবে।

৪. বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণঃ
আমাদেরকে দৃঢ়তার সাথে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে, নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গঠন এবং অতর্কিতে চলমান শত্রুকে ঘিরে ফেলে খতম করার যুদ্ধে (এ্যামবুশ যুদ্ধে) পারদর্শী হতে হবে।
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর বিবৃতি মনােযােগের সাথে পাঠ ও প্রয়ােগ করতে হবে।
শহরে, যােগাযােগ পথে শত্রুকে হয়রানীমূলক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।
আমাদের বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সফলতা ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছে, যৌথ অভিযান আমাদের রণনৈতিক আক্রমণ থামাতে সক্ষম নয়।

৫.
শত্রুর যৌথ অভিযানের চাপের মুখে আমাদের মধ্যকার অপ্রকাশিত টাউট, ভ্রষ্ট, সুবিধাবাদীদের কেউ কেউ শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণ করে, এভাবে সাভার, মতলবে আমাদের কিছু ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
এ সকল স্থানে জাতীয় শত্রুরা এ অবস্থার সুযােগ নিয়ে এবং আত্মীয়স্বজনদের হুমকি দিয়ে অদৃঢ় কর্মীদের আত্মসমর্পণ করায়।
পৃষ্ঠা: ৫৮৭

এ ঘটনা থেকে পার্টি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অর্জন করেছে।
– গুরুত্বপূর্ণ কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, শেলটার খুব ভালভাবে যাচাই হওয়া প্রয়ােজন যাতে ভ্রষ্ট, টাউট, সুবিধাবাদী শত্ৰুচর অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
-বারংবার অনুসন্ধান সংগঠনকে টিকিয়ে রাখার জন্য অপরিহার্য।
– স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মী-গেরিলাদের বদলী করা। গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থানীয় কর্মী না রাখা। প্রকাশিত শত্রুর চাপ রয়েছে এরূপ অদৃঢ় কর্মীদের তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সংযােগ করতে না দেওয়া। এর ফলে আত্মীয়-স্বজনদের প্রভাব এড়ানাে যায় এবং কর্মীদের দুর্গ, উপদল গঠন ইত্যাদি ঠেকানাে যায়।
– গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম্য এলাকা উপ-আঞ্চলিক এবং আঞ্চলিক নেতৃত্বের সরাসরি পরিচালনাধীন থাকা উচিত।
গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গােটা উপ-অঞ্চল এমনকি অঞ্চলের জন্যও নির্ণায়ক হয়।
খারাপ পরিচালক, ভ্রষ্ট, সুবিধাবাদী, শত্ৰুচর, গুরুত্বহীন অনভিজ্ঞদের দ্বারা এ ধরনের গ্রাম্য এলাকা পরিচালিত হলে বিরাট বিপর্যয় হতে পারে।
মতলব, সাভারের বিপর্যয় এর প্রমাণ। উপরন্তু আমাদের সংগঠনের অতীতের অবস্থা এবং বর্তমান অবস্থা মূলগতভাবে পৃথক।
অতীতে আমাদের শহরকেন্দ্রিক কাজ ছিল, শহর থেকে কর্মী বের করে গ্রামে কাজ গড়ে তােলা ছিল প্রধান দিক।
বর্তমানে গ্রামে কাজ বিস্তার লাভ করেছে। অস্ত্র, গেরিলা, কর্মী, অর্থের এবং পরবর্তী বিকাশের দিক দিয়ে গ্রাম প্রাধান্য পাচ্ছে।
এ কারণে পরিচালকদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রামাঞ্চল আঁকড়ে ধরতে হবে।
শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণ করার অর্থ হচ্ছে শত্রুশ্রেণীভুক্ত হওয়া। আত্মসমর্পণে প্ররােচিত করাও শত্রুর সাথে সহযােগিতা করার সামিল।
আত্মসমর্পন করে আমাদের ক্ষতি সাধন করেছে, পার্টির অস্ত্র-সম্পদ শত্রুর নিকট দিয়ে দিয়েছে, কর্মীদের ধরিয়েছে এরূপ ব্যক্তিদের চরম শাস্তি প্রদান করতে হবে। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
আত্মসমর্পণকারী এবং আত্মসমর্পণে প্ররােচনাকারীদেরও প্রাপ্য শাস্তি প্রদান করতে হবে।
কর্মী এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে হবে।
কারাে কারাে সম্ভাব্য আত্মসমর্পণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়ােজনীয় নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। টাউট ভ্রষ্ট আধিক্য এলাকায় কাজের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক হওয়া যাতে টাউট ভ্ৰষ্টরা অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
বিপ্লব পরিত্যাগ এবং পুরানাে শ্রেণীতে ফিরে যাওয়া, শত্রুর সহযােগী হওয়া, দোদুল্যমান ক্ষুদে বুর্জোয়া, টাউট, ভ্রষ্ট, সুবিধাবাদীদের চরিত্র।
কাজেই শ্রেণী সমাজে উপরােক্তদের শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণের ঘটনা স্বাভাবিক। এতে ঘাবড়াবার কারণ নেই।
সংশােধনবাদীরাও এক ধরনের আত্মসমর্পণকারী। শত্রুর চাপ এবং বুর্জোয়াদের প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পণকারীরাই হচ্ছে সংশােধনবাদী সুবিধাবাদী।
পৃষ্ঠা: ৫৮৮

– গ্রামাঞ্চলে টাউট জাতীয় শত্রুদের খতম খুবই প্রয়ােজন অন্যথায় তারা কর্মীদের আত্মসমর্পণ করানাের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়।

৭.
জাতীয় শক্রর মূল্যবান দ্রব্যাদি ব্যতীত সাধারণ দ্রব্যাদি দখল না করা। এতে গেরিলাদের মধ্যে জনগণের মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।

৮. পার্টির সম্পদ সংক্রান্তঃ
পার্টির সম্পদ হচ্ছে পার্টি ও জনগণের সম্পদ। ইহা পার্টি ও জনগণের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে।
পার্টির সম্পদ আত্মসাৎ করা, ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের অনুরূপ স্বজনপ্রীতিমূলক কাজ।
এ ধরনের কাজ কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে। এ ধরনের অপরাধকারীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করতে হবে।

৯.
শহরে ও গ্রামে সংস্কারমূলক সংগঠন গড়ে তােলা।
এর ফলে কর্মীদের কাজে লাগানাে, যাচাই, জনসংযােগ এবং পরিচয়ের সুবিধা
অর্জিত হবে।

১০. সশস্ত্র বাহিনীর মাঝে কাজ ও
বর্তমানে সশস্ত্র বাহিনীর বিরাট অংশই ভারত ও আওয়ামী লীগের প্রতি বিক্ষুব্ধ। উপরন্তু পূর্ব বাংলা ও পাক-ভারতের ইতিহাস থেকে দেখা যায় সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন। সময়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।
কাজেই সশস্ত্র বাহিনীর মাঝে কাজ করা উচিত, এদেরকে বিদ্রোহ করা বা সৈন্যবাহিনী ত্যাগ করে আমাদের সাথে যােগদান করতে উৎসাহিত করা উচিত।
এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের বাঙালী দিয়ে বাঙালী দমনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিতে হবে।

১১. পাকিস্তানের স্বীকৃতিঃ
পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশ সরকারের ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে যােগদান পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের স্বার্থের উপর একটি আঘাত।
পাকিস্তানের স্বীকৃতি পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অবস্থার মৌলিক কোন পরিবর্তন ঘটায়নি।
পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব বাংলাকে তার অংশ হিসেবে দাবী পরিত্যাগ হকদের রাজনৈতিক বক্তব্য- অর্থাৎ, নয়া পাকিস্তান গড়ার বক্তব্যের চরম ভুল প্রমাণ করছে।
পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সাথে ভারতীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটানাে, পাকিস্তান ও মার্কিনীদের প্রভাব বৃদ্ধি করা।
তৈলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলাের সাথে সম্পর্ক বৈর করতে সাহস পায়নি বলে ভারত গা জ্বালা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলাকে মুসলিম দেশসমূহের সম্মেলনে যােগদান করতে দিয়েছে।
পৃষ্ঠা: ৫৮৯

১২. ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণঃ
ভারতের পারমাণবিক বিস্ফোরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেকে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা গড়ে তােলা ও আনবিক ব্লাকমেইলের মাধ্যমে তা সংরক্ষণ করা, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে প্রভুত্ব করা।
এ পদক্ষেপের ফলে ভারত বৃহৎ শক্তি, পশ্চিম ইউরােপ ও জাপান এবং ‘বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের অধিকতর বিরােধিতার সম্মুখীন হবে।
উপরন্তু ভারতের চরম সংকটাপন্ন অর্থনীতি আরাে সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে যা আভ্যন্তরীণ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।
এ আনবিক বিস্ফোরণ- ‘ভারত বৃহৎ শক্তি হতে ইচ্ছুক এবং উপনিবেশ বজায় রেখে নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা সৃষ্টি করতে চায় আমাদের এ বক্তব্যের সঠিকতা প্রমাণ করে।

১৩.
নিয়মিত পার্টির পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
পার্টির মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক, ঐক্য ও শিক্ষা এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে পত্রিকা একান্ত প্রয়ােজন।
পত্রিকা প্রকাশের জন্য সকল অঞ্চলকে অর্থনৈতিক সহায়তা করতে আহ্বান জানানাে হচ্ছে।

১৪.
৩রা জুন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির তৃতীয় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী যথাযােগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপিত হয়।

১৫.
বর্তমানে আওয়ামী সরকারের ব্যর্থতা এবং চরম আর্থিক সংকট মার্কিনের নেতৃত্বে। তার তাবেদারদের সাথে ভারত-সােভিয়েটের তাবেদারদের দ্বন্দ্ব তীব্রতর করছে।
কাজেই মার্কিনের নেতৃত্বে তার তাবেদাররা ভারত-সােভিয়েট বিরােধী কু-দেতার মাধ্যমে বা চক্রান্তের মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের প্রচেষ্টা চালাতে পারে।
এ অবস্থায় ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং পূর্ব বাংলায় ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে।
এমত অবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্বেকার অধিবেশনের সিদ্ধান্ত মােতাবেক ব্যাপক সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে আমাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে। (কেন্দ্রীয় কমিটির ৬ষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার দ্রষ্টব্য)।
কিছু মন্ত্রী-আমলা পরিবর্তন, কালােবাজারী মহাজন দমনের নামে বিপ্লবীদের। প্রকাশ্যে খতম, আওয়ামী লীগের সংকটজনক পরিস্থিতির কোন উন্নতি করবে না, উপরন্তু জনগণের উপর সন্ত্রাস বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।

১৬.
পূর্ব বাংলা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সমপ্রসারণবাদীদের দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দু।
ইহা হচ্ছে প্রতিক্রিয়ার দুর্বলতম লিংক। কাজেই দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লবের কেন্দ্র হচ্ছে পূর্ব বাংলা।
পৃষ্ঠা: ৫৯০

যেমন প্রথম মহাযুদ্ধের সময় রাশিয়া ছিল ইউরােপের দ্বন্দ্বসমূহের কেন্দ্র এবং সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম লিংক।
কাজেই পূর্ব বাংলার বিপ্লবের এ চমৎকার পরিস্থিতিতে সর্বশক্তি নিয়ােগ করে কাজের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে আমাদের বিরাট বিরাট পদক্ষেপে বিপ্লবের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

১৭.
আমাদের নেতৃত্বে মধ্যবর্তী শ্রেণীসমূহকে ব্যাপক সংখ্যায় ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। (দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া, সামন্ত, ধর্মীয় গােষ্ঠী, সরকারী কর্মচারী, গণতান্ত্রিক বিরােধী ইত্যাদি)।

১৮.
একাদশ ইশতেহার এবং ১-গ উপব্যুরাের দলিল অনুমােদিত হলাে।

১৯.
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কর্তৃক প্রদত্ত সিদ্ধান্তসমুহ, সর্বোচ্চ পরিচালক মণ্ডলী কর্তৃক প্রকাশিত সামরিক দলিল গৃহীত হলাে।

২০.
সদস্য/প্রার্থী সদস্য পদের জন্য তালিকা প্রতি অঞ্চল প্রেরণ করবে। কেডার ইতিহাস যাচাই করে পাঠাতে হবে (ইতিমধ্যে যাদের পাঠানাে হয়নি)। যাদের কেডার ইতিহাস পাঠানাে হয়েছে তাদের সম্পর্কে সর্বশেষ মন্তব্য পাঠাতে হবে। অঞ্চল পরিচালক এ মন্তব্য দিবেন।

২১.
ফ্রন্টের লাইনে কাজ চালিয়ে যাওয়া। ফ্রন্টের কর্মসূচী, চাদার বই এবং সদস্যপদপত্র ছাপানাে। যথাযথ সময়ে ফ্রন্টের অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করা।
২২. নারীদের মাঝে কাজঃ
গণসংগ্রাম পরিচালনা, পার্টির কাজ পরিচালনা এবং সর্বোপরি বিপ্লবের জন্য নারীদের মাঝে কাজ একান্ত প্রয়ােজন।
ভ্রষ্ট নারীদের পরিহার করা। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীদেরকে এবং তাদের মাঝে যারা কাজ করবে তাদের শিক্ষাদান, প্রেম-বিয়ে সংক্রান্ত পার্টির সিদ্ধান্ত ভালভাবে তাদেরকে অবহিত করা।

২৩.
সার্বক্ষণিক করার ক্ষেত্রে অনুশীলনকে প্রাধান্য দেওয়া, দূরারােগ্য ব্যাধিতে গুরুতর অসুস্থ্য এবং কর্মক্ষম নয় ও মানসিকভাবে অসুস্থদের সার্বক্ষণিক না করা।
এ ছাড়া সার্বক্ষণিক করার ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ নিয়মবিধি প্রয়ােগ করা।
সার্বক্ষণিক করার ক্ষেত্রে খুব ভালভাবে যাচাই করা যাতে শত্ৰুচর, ভ্রষ্ট, টাউটরা অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
পৃষ্ঠা: ৫৯১

পাঠ্যসূচী
(মধ্য, ১৯৭৪)

উচ্চতর পাঠ্যসূচী
Lenin :
1. Karl Marx 2. Three sources and three components of Marxism. 3. State and Revolution. 4. Two tactics of Social Democracy in the Democratic Revolution. 5. Marxism and Revisionism. 6. Lenin’s fight against Revisionism and opportunism. 7. Leftwing communism an infentile disorder. 8. Lenin on National Question. 9. Materialism and Emperio Criticism.

Marx & Engles :
0 Communist Menifesto.

Engles :
0 Ludwig Feuerbach.
0 Socialism-Utopian and Scientific.

Stalin :
O Foundation of Leninism.
O Dialectical and Historical Materialism.

Mao:
O Five Essays on Philosophy.
O উদ্ধৃতি, গণযুদ্ধ, পাঁচটি প্রবন্ধ।
O Mao Tse-tung On Art and Literature.
O ছয়টি সামরিক প্রবন্ধ।
O Our study and the current situation.
পৃষ্ঠা: ৫৯২

O Appendix : Resolution on certain Questions in the History of our Party. O How to differentiate the Classes in the rural area. (Vol-1) O The tasks of the Chinese Communist Party in the period of
resistance to Japan. O The role of the Chinese communist Party in the National war. (Vol.- ii) O The question of independence and initiative within the United Front. O The May 4th Movement. (Vol.-ii) O The Orientation of the youth movement. Do O Introducing the Communist. -Do O Recruit large number of intelectuals. -Do O Chinese revolution and the Chinese Communist Party. -Do O On new democracy. -Do O Rectify the party’s style of work. (Vol.- iii) O Some question councerning methods of leadership. – Do O On Coalition Government (Vol.-iii) O On setting up a system of reports. (Vol.- iv) O On strengthening the party committee system. -Do O Methods of work of party committees. -Do. O On the peoples Democratic dictatorship. -Do O The bankruptcy of the idealist conception of history. -Do O পার্টি সংগঠন। O History of the C.P.S.U. Bolshevic (short course). O Polemic on the general lines of international communist move ment. O (1) People of Indonesia unite and fight to overthrow the facist regime. (2) Statement by the political bureau of the central committee of the Indonesian Communist Party. (Excerpts) (3) Self-criticism by the political bureau of the central committee of the Indonesian Communist Party. (Excerpts) O চীনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লব সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ও প্রবন্ধসমূহ। O লিন-কনফুসিয়াস বিরােধী সিদ্ধান্ত ও প্রবন্ধসমূহ। O পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির দলিলসমূহ।
পৃষ্ঠা: ৫৯৩

নেতৃত্ব বিষয়ক পাঠ্যসূচী
– বর্তমানে আমাদের সংগঠনে প্রথম প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব; দ্বিতীয় প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব; তৃতীয় প্রয়ােজন উন্নত নেতৃত্ব।
– যােগ্য নেতৃত্বের সমস্যা মূলতঃ মতাদর্শগত পুনর্গঠনের সমস্যা।
– আমাদেরকে উন্নত নেতৃত্ব সম্পর্কিত মার্কসবাদী পদ্ধতি প্রয়ােগ করে উৎপাদন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট নেতৃত্বস্বল্পতা দূর করতে হবে, নেতৃত্বের কলাকৌশল কর্মীদের বিশেষ করে সম্ভাবনাময়দের শেখাতে হবে। নেতৃত্ব সম্পর্কিত দলিলাদি পাঠ ও প্রয়ােগ করতে হবে।
এভাবে নেতৃত্বের সংকট দূর করতে হবে।
– এ কারণে মানােন্নয়ন ও সুসংবদ্ধকরণের সময় নেতৃত্ব সংকট সমাধানের পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।
* সভাপতি মাওয়ের পাঁচটি প্রবন্ধ
– পার্টির ভেতরকার ভুল চিন্তাধারা সংশােধন করা প্রসঙ্গে।
– উদারতাবাদ বিরােধিতা।
* উদ্ধৃতি – পার্টি কমিটির নেতৃত্ব। – জনসাধারণের লাইন। – কেডার। – চিন্তাধারার পদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি। – অধ্যয়ন। – অনুসন্ধান ও পর্যালােচনা। – সমালােচনা-আত্মসমালােচনা। – জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের মীমাংসা। * কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠন। * লাল ঝাণ্ডা। – বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা। * সাংগঠনিক কার্যপ্রসঙ্গে দলিল। – নেতৃত্বের পদ্ধতি এবং অন্যান্য প্রবন্ধ। * মতাদর্শগত পুনর্গঠন সংক্রান্ত কতিপয় রচনা (দলিল)। * ইশতেহারসমুহ (কেন্দ্রীয় কমিটি ও ব্যুরাে)। * ইহা ব্যতীত সাংগঠনিক কাজের উপর প্রকাশিত অন্যান্য দলিল। * সমালােচনা-আত্মসমালােচনা সংক্রান্ত কতিপয় পয়েন্ট। * একটি কাজ করার উপায়, ক্ষুদে বুর্জোয়া বুর্জোয়াদের সাথে আলােচনার পদ্ধতি, গণতান্ত্রিক উপায়ে কথা বলার পদ্ধতি। * নেতৃত্বের কতিপয় গাইড।
পৃষ্ঠা: ৫৯৪

* সাংগঠনিক কাজের উপর কতিপয় গাইড। * কমীস্বল্পতা ও তা সমাধানের কতিপয় উপায়।

সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচী
১। মার্কসবাদের মৌলিক বিষয়। ২। মতাদর্শগত। ৩। রাজনৈতিক। ৪। সাংগঠনিক। ৫। সামরিক। ৬। সাংস্কৃতিক।

১। মার্কসবাদের মৌলিক বিষয়ঃ
ক) দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ- ক. স্ট্যালিন। খ) কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম, চিন্তাধারার পদ্ধতি ও কর্মপদ্ধতি – উদ্ধৃতি। গ) কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস।

২। মতাদর্শগতঃ
ক) পাঁচটি প্রবন্ধ- মাওসেতুঙ। খ) সমালােচনা-আত্মসমালােচনা- উদ্ধৃতি। গ) নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলী- সিরাজ সিকদার। ঘ) কমিউনিস্ট, কেডার উদ্ধৃতি।

৩। রাজনৈতিকঃ
ক) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিজয় অনিবার্য। খ) শ্রেণী অনুসন্ধানের উপায়। (সাইক্লো)। গ) পূর্ব বাংলার সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণ। (সাইক্লো)। ঘ) পূর্ব বাংলা কি ভারতের উপনিবেশ? ঙ) বিপ্লবীদের ঐক্য প্রসঙ্গে। চ) ফ্রন্টের কর্মসূচী। ছ) সংবাদ বুলেটিনসমূহ। জ) সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব প্রসঙ্গে। ঝ) অসমাপ্ত বিপ্লব সমাপ্ত করুন। ঞ) বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ প্রসঙ্গে। ট) ইশতেহারসমূহ। ঠ) জনগণের ভেতরকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসা- উদ্ধৃতি।
পৃষ্ঠা: ৫৯৫

৪. সাংগঠনিকঃ
ক) সাংগঠনিক রচনাবলী। খ) ইশতেহারসমূহ। গ) শৃঙ্খলা -উদ্ধৃতি। ঘ) প্রেম-বিবাহ সংক্রান্ত সাকুলার।
৫। সামরিকঃ
ক) ৩০শে এপ্রিলের বিবৃতি। খ) ইশতেহারসমূহের সামরিক পয়েন্ট। গ) গণযুদ্ধ – সভাপতি মাওসেতুঙ।

৬। সাংস্কৃতিকঃ
ক) সংস্কৃতি ও শিল্পকলা – উদ্ধৃতি। খ) নয়াগণতন্ত্র সম্পর্কে প্রবন্ধের সাংস্কৃতিক অধ্যায়। গ) গণযুদ্ধের পটভূমি কবিতার ভূমিকা ও পর্যালােচনা। ঘ) একাদশ ইশতেহার। ঙ) শরৎচন্দ্রের বিষয় আলােচনা।

মানােন্নয়ন সংক্রান্ত
১। মার্কসবাদের মৌলিক বিষয়ঃ
১) দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ- স্ট্যালিন। ২) উদ্ধৃতি [কমিউনিস্ট পার্টি, শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম, চিন্তাধারার পদ্ধতি, কর্মপদ্ধতি]। ৩) Where from correct ideas come 8) On contradiction- Mao-Tse-tung ৫) On Practice – Mao-Tse-tung
৬) কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার- মার্কস-এঙ্গেলস।

২। মতাদর্শগতঃ
৭) পাঁচটি প্রবন্ধ – মাওসেতুঙ ৮) পরিশিষ্ট-১ – লাল ঝাণ্ডা ৯) চক্র বিরােধী ও গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম লাল ঝাণ্ডা ও অন্যান্য দলিল ১০) ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রকাশ। ১১) বিভেদপন্থীবাদ ১২) কমিউনিস্ট হবার পাঁচটি মানদণ্ড ১৩) মতাদর্শগত পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়ােগ ১৪) সমালােচনা-আত্মসমালােচনার কতিপয় পয়েন্ট
পৃষ্ঠা: ৫৯৬

৩। রাজনৈতিকঃ
১৫) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিজয় অনিবার্য। ১৬) শ্রেণী বিশ্লেষণের উপায় ও বিশ্লেষণ। ১৭) পূর্ব বাংলা কি ভারতের উপনিবেশ? ১৮) বিপ্লবীদের ঐক্য। ১৯) সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব প্রসঙ্গে। ২০) ফ্রন্টের কর্মসূচী। ২১) দেশপ্রেমিকের বেশে ছয় পাহাড়ের দালাল। ২২) সংবাদ বুলেটিন।

৪। সাংগঠনিকঃ
২৩) একটি কাজ করার উপায়। ২৪) নেতৃত্বের কতিপয় গাইড লাইন। ২৫) কর্মীস্বল্পতা ও তা দূর করার উপায়। ২৬) নেতৃত্বের পদ্ধতি। ২৭) সাংগঠনিক কার্য প্রসঙ্গে, গােপনীয়তা নিরাপত্তা সংক্রান্ত। ২৮) উদ্ধৃতি-পার্টি কমিটির নেতৃত্ব, শৃঙ্খলা। ২৯) ১নং ব্যুরাের ষষ্ঠ ইশতেহার। ৩০) ১নং ব্যুরাের ১০ম ইশতেহার। ৩১) ১-গ উপব্যুরাের ইশতেহার। ৩২) গ্রেপ্তার হলে কি করবেন।

৫। সামরিকঃ
৩৩) সেকটর কমান্ডারদের সাথে ক. শাহীন আলমের বৈঠক। ৩৪) বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ। ৩৫) কতিপয় সামরিক পয়েন্ট। ৩৬) শহরে ও গ্রামে সামরিক হামলায় কতিপয় কৌশলগত দিক। ৩৭) ছয়টি সামরিক প্রবন্ধের প্রথম দুটি প্রবন্ধ। ৩৮) গণযুদ্ধ।

৬। নেতৃত্ব বিষয়ক পাঠ্যসূচী।
৭। সাংস্কৃতিক আন্দোলন।
পৃষ্ঠা: ৫৯৭

সম্পাদকীয়, স্ফুলিঙ্গ
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[সেপ্টেম্বর, ‘৭৪-এ “স্ফুলিঙ্গ প্রথম প্রকাশিত হয়। তার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধ আকারে নিচের রচনাটি মুদ্রিত হয় -প্রকাশক।]

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর মুখপত্র হিসেবে “স্ফুলিঙ্গ প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে।
পার্টি, ফ্রন্ট ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত এবং অনুশীলনগত সমস্যাবলীর সমাধান আসবে স্ফুলিঙ্গের মাধ্যমে। ইহা কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও পরিচালনা এবং এককেন্দ্র বজায় রাখতে বিশেষভাবে সহায়তা করবে।
ফ্রন্ট ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর নেতৃতু বিন্দু হচ্ছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
পার্টির বর্তমান সমস্যা হচ্ছে, কর্মীদের তাত্ত্বিক মান উন্নত করা এবং মতাদর্শগতভাবে অধিকতরভাবে সর্বহারায় রূপান্তরিত করা যাতে তারা পার্টি, সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী ও ফ্রন্টের লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়িত এবং দেশ, জাতি ও জনগণকে পরিচালনার পর্বত প্রমাণ কাজ কাঁধে নিতে সক্ষম হয়।
পূর্ব বাংলায় বর্তমানে চরমতম সংকটজনক অবস্থা বিরাজ করছে। জনগণ চায় বিপ্লব, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের এই মুহূর্তে উৎখাত এবং এ সংকট থেকে আশু মুক্তি।
এ কারণে জনগণকে পরিচালনার মত উত্তম জননেতা পার্টি, ফ্রন্ট ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর প্রধানতম প্রয়ােজন। আর এটা মিটানাের জন্য দরকার কর্মীদের তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক মান উন্নত করা, মতাদর্শগতভাবে পুনর্গঠিত হওয়া, নেতৃত্বদানের যােগ্যতা অর্জন করা। কাজেই ব্যাপক কর্মীদের তাত্ত্বিক মান উন্নত করা, বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের তাত্ত্বিক মান উন্নত করার জন্য মার্কসবাদ অধ্যয়ন কর, একে উত্তমরূপে রপ্ত কর’-আন্দোলন চালাতে হবে যাতে কর্মীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত হয়, প্রতিটি বিষয় মার্কসবাদী বিশ্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে এবং সঠিক সমাধান বের করতে পারে।
এভাবে সমাজের অগ্রগামী শ্রেণীর-সর্বহারা শ্রেণীর চিন্তাধারা কর্মীরা একবার আয়ত্ব করলে তা বস্তুগত শক্তিতে রূপান্তর হবে যা পূর্ব বাংলার সমাজ ও বিশ্বকে রূপান্তর করবে।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক শত্রুদের পতন ঘনিয়ে আসার কারণে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে নিজেদেরকে রক্ষা ও আমাদেরকে ধ্বংস করার জন্য। শত্রুর এ প্রচণ্ড ফ্যাসিবাদী হামলা ও চাপের মুখে অনুন্নত মানের দোদুল্যমান ক্ষুদে বুর্জোয়াদের কেউ কেউ
পৃষ্ঠা: ৫৯৮

আত্মসমর্পণ করতে পারে। দলত্যাগ, পলায়ন করতে পারে। এটা ঠেকানাের জন্যও ব্যাপক মানােন্নয়ন প্রয়ােজন।
এ মানােন্নয়নের সাথে সাথে আমাদের রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লক্ষ্যসমূহ, প্রধান কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
আমাদেরকে সময় ও লক্ষ্য স্থির করে মাননান্নয়ন চালিয়ে যেতে হবে এবং বিভিন্ন স্তরের জন্য বিভিন্ন পাঠ্য তালিকা, অধ্যয়ন গ্রুপ, লেখক গ্রুপ, শিক্ষাদাতা গ্রুপ গঠন করতে হবে, মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও উত্তমরূপে রপ্ত করার একটি প্রাণবন্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এ অধ্যয়ন আন্দোলনের একটি লক্ষ্য হবে দেশীয়-আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ ও ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ বিরােধী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া যাতে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ সম্পর্কে কর্মীরা স্পষ্ট হন এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে বর্জন এবং মার্কসবাদের সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে সমন্বিত করতে পারেন।
শত্রুর প্রচণ্ড চাপের মুখেও আমাদের বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ অব্যাহত গতিতে বিকাশ লাভ করছে। মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও রপ্তকরণের আন্দোলনের ফলে এ বিজয় আরাে বিরাট হবে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিজয় একটা গুণগত বিজয় আনয়ন করবে।
পূর্ব বাংলার জনগণ চরমতম দুঃখ কষ্টে দিন যাপন করছে। প্রতিটি কর্মী, গেরিলা ও সহানুভূতিশীল ও জনগণকে দিনকে আঁকড়ে ধরতে হবে, ঘণ্টাকে আঁকড়ে ধরতে হবে, বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করতে হবে। জনগণকে অতি সত্বর তাদের দুঃখকষ্ট থেকে মুক্ত করতে দুর্বার গতিতে সঠিক লাইনে এগিয়ে যেতে হবে।
বিজয় আমাদের অনিবার্য।
আসুন, আমরা মার্কসবাদ গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করি, একে উত্তমরূপে রপ্ত করি। জনগণের মুক্তিকে ত্বরান্বিত করি।
পৃষ্ঠা: ৫৯৯

অনুসন্ধানের গুরুত্ব
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[নিবন্ধটি “স্ফুলিঙ্গ” ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বাদশ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইস্তেহারে অনুসন্ধানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য যথাযথভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা ও বিকাশ সাধনের জন্য অনুসন্ধান একান্ত প্রয়ােজন।
আমাদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক লাইন সঠিক হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ অনুসন্ধানের অভাবে কয়েক স্থানে বিপর্যয় ঘটেছে, সংগঠনের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
সাভার, মতলবের ঘটনা এর প্রমাণ।

অনুসন্ধানের দার্শনিক তাৎপর্য
আমরা মার্কসবাদী। আমাদের দর্শন হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী হওয়ার অর্থ হচ্ছে আমাদের চেতনা হবে মস্তিষ্কে বস্তুর প্রতিফলন। এ চেতনা দ্বারা বস্তুকে রূপান্তরিত করতে হবে।
বস্তু অনুযায়ী চেতনা-চিন্তা হতে হলে বস্তুকে যথাযথভাবে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করতে হবে, আর এর একমাত্র উপায় হচ্ছে অনুসন্ধান। কেবলমাত্র অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্থাৎ বস্তুর সংস্পর্শের মাধ্যমে বস্তুর বাইরের রূপ এবং আভ্যন্তরীণ নিয়মবিধি ও অন্যান্য বস্তুর সাথে এর সম্পর্ক অবগত হওয়া যায়।
কাজেই বস্তুবাদী হতে হলে আমাদেরকে সভাপতি মাও-এর কথা “অনুসন্ধান ছাড়া কথা বলার অধিকার নেই” এটা সর্বদা মনে রাখতে হবে।

ক্ষুদে বুর্জোয়ারা অনুসন্ধানবিমুখ
ক্ষুদে বুর্জোয়ারা ক্ষুদে উৎপাদনের সাথে জড়িত। এ কারণে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ। তাই তারা হয় একতরফাবাদী, ভাসাভাসা ও আত্মগত (একতরফাবাদ ও ভাসাভাসাভাব হচ্ছে আত্মগতভাব)। দার্শনিকভাবে ইহা হচ্ছে ভাববাদ। আত্মগতবাদীরা বস্তুকে পুরােপুরি মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করে না, এর সাথে কল্পনা (চেতনা) যুক্ত করে, আন্দাজে কথা বলে।
তােয়াহা-মতিন অনুসন্ধান না করে আমাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন আজে-বাজে গুজব রটনা করেছে, আত্মগতভাবের আশ্রয় নিয়েছে।
হক-তােয়াহা-মতিন পূর্ব বাংলার বাস্তব অবস্থা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে আত্মগতভাবে রাজনৈতিক, সামরিক লাইন রচনা করেছে।
ফলে পদে পদে তারা ভুল করেছে, তারা বিপর্যস্ত হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ৬০০

আমাদের সংগঠনে বাস্তব কাজে অনেক কর্মী আত্মগতভাব, একতরফা, ভাসাভাসাভাব দ্বারা পরিচালিত হন, ফলে তারা ভুলভ্রান্তি করেন।

সাংগঠনিক, সামরিক, মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনুসন্ধানের প্রয়ােজনীয়তা
শত্রু সর্বদাই আমাদেরকে ধ্বংস করতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের শক্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের এ অপচেষ্টা জোরদার হবে, তারা মরিয়া হয়ে উঠবে।
শত্রুরা তাদের চর আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করাবে। সংশােধনবাদী, সুবিধাবাদী, খারাপ উপাদান, ভ্ৰষ্টরা আমাদের মধ্যে ঢুকে পড়ার প্রচেষ্টা চালাবে।
এদের উপস্থিতিতে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে , সংগঠন বিপর্যস্ত হবে, পার্টির অপূরণীয় ক্ষতি হবে, পার্টির নেতৃত্ব এদের হাতে চলে গেলে পার্টি ও বিপ্লব ব্যাহত হবে।
কাজেই সংগঠন টিকিয়ে রাখা ও বিকাশ সাধনের জন্য অনুসন্ধান অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক ক্ষেত্রে লক্ষ্য নির্ধারণ, গেরিলা রিক্রুট, অস্ত্র রাখা, শেলটার, শত্রুর দুর্বল অবস্থান বের করা ইত্যাদির জন্য অনুসন্ধান প্রাথমিক গুরুতুসম্পন্ন।
কর্মীদের মানােন্নয়ন, যাচাইয়ের জন্য তাদের মতাদর্শগত অবস্থা অনুসন্ধান প্রয়ােজন।
সাংগঠনিক কার্য পরিচালনা, কর্মী বের করা, সমস্যার সমাধান, বিভেদপন্থীবাদউপদল গঠন ঠেকানাে, কর্মীদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঠেকানাে, নিরাপত্তা ইত্যাদির জন্যও অনুসন্ধান একান্ত প্রয়ােজন।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন ও দ্বন্দ্বসমূহ নির্ণয়, এবং আমাদের রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণের জন্যও অনুসন্ধান একান্ত প্রয়ােজন।

কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই
রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ হয়ে গেলে কর্মীরাই হচ্ছে নির্ণায়ক।
ভাল অগ্রসর বিশ্বস্ত সম্ভাবনাময় কর্মী বের করা, শত্ৰুচর টাউট ভ্রষ্টদের সংগঠনে অনুপ্রবেশ ঠেকানাের জন্য কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই একান্ত প্রয়ােজন।
কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই যথাযথ না হওয়ার ফলে খারাপ উপাদান পার্টিতে অনুপ্রবেশ করে, মতলব ও সাভারের কাজ এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুন্সিগঞ্জে অনুপ্রবেশকারী কয়েকজনকে বের করা হয়, এবং শাস্তি বিধান করা হয়। ফলে মুন্সিগঞ্জের সংগঠন টিকে থাকে।
কর্মীরা নিজেরা যে কেডার ইতিহাস দেয় তার উপর নির্ভর করলে (…..?) হবে।
কর্মী, শেলটার, গেরিলাদের কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করতে হবে, তার পরিচিত সহানুভূতিশীল এবং সে জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছে এরূপ স্থানের জনগণের নিকট থেকে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কেডার ইতিহাস যাচাই করতে হবে।
অন্যথায় শত্ৰুচর, টাউট, ভ্রষ্টদের হাতে নিজেদের প্রাণ খােয়া যাবে, অস্ত্র খারাপ লােকদের হাতে যাবে, সংগঠন বিনষ্ট হবে।
সাভার, মতলবের ঘটনা এর প্রমাণ।
প্রতিটি নূতন যােগাযােগ, শেলটার যাচাই করতে হবে, তারপরে আনুষ্ঠানিকভাবে এককভূক্ত করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬০১

বাইরে যােগাযােগ দেওয়ার সময় বা বাইরে থেকে যােগাযােগ পাওয়ার সময় ইহা কঠোরভাবে পালন করতে হবে।
গেরিলা, অস্ত্র এবং বসা-থাকা শেলটারের জন্য এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে কার্যকরী করতে হবে।
এতে কর্মী, গেরিলা, শেলটার সংগ্রহ ধীরগতিতে হবে ঠিকই কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা হবে জোরদার, শত্রু আমাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।
কারণ আজ পর্যন্ত আমাদের সকল ক্ষতির জন্য দায়ী হচ্ছে আভ্যন্তরীণ খারাপ উপাদান।
বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠনের ইতিহাসও এ সত্য প্রমাণ করে।

অলসতা অনুসন্ধানের শত্রু
সভাপতি মাও বলেছেন, ‘অলসতা ভাববাদ ও অধিবিদ্যার গর্তে নিক্ষেপ করবে। অনুসন্ধান করা, প্রকৃত অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য কষ্টকর প্রচেষ্টা প্রয়ােজন। কারণ শত্রুরা চেষ্টা করবে হাজারাে উপায়ে আমাদেরকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য।
কাজেই অলসতা পরিহার করতে হবে। প্রতিটি কেডার, যােগাযােগ, শেলটারের বিষয় অনুসন্ধান করতে হবে, শত্ৰুচরদের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করতে হবে, সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা ও অব্যাহত বিকাশ বজায় রাখতে হবে।
প্রতিনিয়ত কর্মীদের কাজ অনুসন্ধান ও যাচাই করতে হবে। এর মাধ্যমেই অগ্রসর কর্মীদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
বর্তমান কর্মী স্বল্পতার সময় এ পদ্ধতিতে কর্মী বের করা, তাদের মানােন্নয়ন করার মাধ্যমে কর্মীস্বল্পতা দূর করতে হবে।
বর্তমান সামরিক বিকাশের লক্ষ্যসমূহ অর্জন করতে হলে ভাল অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লক্ষ্যবস্তু, গেরিলা এবং শেলটার ঠিক করতে হবে, অস্ত্র সংগ্রহ করা ও নিয়মিত গেরিলা গড়ে তােলার লক্ষ্য হাসিল করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬০২

পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল স্ফুলিঙ্গের ১নং সংখ্যায়-প্রকাশক।]

সামন্ত ক্ষুদে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের চাকমা জাতিসত্তার মধ্যে একটি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলে আসছে। তারা শােষক ও শােষিত বাঙালীদের মধ্যে কোন পার্থক্য রেখা টানে না, সকল বাঙালীকেই শত্রু মনে করে।
তাদের মুক্তির জন্য বাঙালীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়ােজনীয়তাকে তারা বিরােধিতা করে।
তারা পাহাড়ী জাতিসত্তার শােষক-শােষিতের মধ্যকার কোন পার্থক্য করে না।
তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জাতিসত্তার জন্য স্বায়ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি না দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন, কখনাে কখনাে বিচ্ছিন্নতা দাবী করে।
এ দাবীর অর্থ হচ্ছে কিছুটা ক্ষুদে বুর্জোয়া আলােকপ্রাপ্ত সংখ্যাধিক চাকমা জাতিসত্তার ক্ষমতা দখল এবং অন্যান্য জাতিসত্তার উপর তাদের কর্তৃত্ব ও নিপীড়ন।
চাকমা জাতিসত্তার এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীরা মার্কসবাদের কথাও কখনাে কখনাে বলে, কেউ কেউ নিজেদেরকে মার্কসবাদী দাবী করে।
কিন্তু মার্কসবাদের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট আন্তর্জাতিকতাবাদ ‘বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণী এক হও’, একটি দেশের ভৌগলিক সীমার মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর একটিই রাজনৈতিক পার্টি- কমিউনিস্ট পার্টি হতে পারে, জাতীয়তাভিত্তিক কমিউনিস্টরা বিভক্ত হতে পারে , জাতীয় সমস্যা হচ্ছে মূলতঃ শ্রেণী সমস্যা, ইত্যাদি তারা স্বীকার করে না।
এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের কোন রাজনৈতিক কর্মসূচী, সামরিক, সাংগঠনিক ও বাস্তব কাজের লাইন নেই।
পাক বাহিনীর পরিত্যাক্ত অস্ত্র, প্রাক্তন রাজাকার, সামন্ত বুদ্ধিজীবী, EPCAF দ্বারা তারা একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়েছে।
এর সাহায্যে তারা গ্রাম থেকে জোরপূর্বক অর্থ সংগ্রহ, কোথাও কোথাও ডাকাত দমন, ডাকাতি করা, সামন্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের রক্ষা ইত্যাদি কাজ করে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে কিছুদিন পূর্বে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা বন্দুক দেখিয়ে জনগণকে তাদের প্রতিনিধিদের ভােটদানে বাধ্য করে।
এদের সংগঠন হচ্ছে “জনসংহতি” ও P.L.A. বা (শান্তি বাহিনী); কোথাও তারা “জংলী” নামে পরিচিত।
সরকার বিরােধী তাদের কোন তৎপরতা নেই। তাদের উপর জনগণের আস্থা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৬০৩

পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কাজ দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিকাশ লাভ করছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নিপীড়িত বাঙালী-পাহাড়ীদের ঐক্যের পক্ষপাতি এবং পাহাড়ী-বাঙালীদের সমঅধিকার, পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের প্রত্যেকের জন্য স্বায়ত্বশাসনের পক্ষপাতি।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি পাহাড়ী জনগণকে সংগঠিত করা এবং তাদের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও তার পাহাড়ী তাবেদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাচ্ছে।
বিশেষ করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি পাহাড়ী ঝুমিয়া চাষী এবং শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কাজ দ্রুত বিকাশ লাভ করেছে। ১৯৭৩ সালে চন্দ্রঘােনা থানা দখল, এ বছর পারােয়া ফাঁড়ি দখল, ঝুমিয়া কৃষকদের রিজার্ভ ফরেস্টে ঝুম কাটার আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে পাহাড়ী জনগণের সংগ্রাম এগিয়ে চলছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে সংগ্রাম ব্যাপক পাহাড়ী জনগণ ও পাহাড়ী বুদ্ধিজীবীদের সহানুভূতি ও আস্থা অর্জন করেছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি জনসংহতি, P.L.A. প্রভৃতিদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার জন্য বারংবার প্রস্তাব দেয় এবং প্রচেষ্টা চালায়।
মানবেন্দ্র লারমার সাথেও আলাপ হয়।
কিন্তু তারা তাদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে থাকে, নিপীড়িত পাহাড়ী-বাঙালী ঐক্যের পক্ষে তারা সাড়া দেয়নি।
সম্প্রতি তারা পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের দ্রুত বিকাশে শংকিত হয়ে কিছুসংখ্যক কর্মীকে আটক করে, তাদের উপর নির্যাতন চালায়, সর্বহারা পার্টি করতে পারবে না বলে কারাে কারাে আত্মীয়-স্বজনের নিকট থেকে বন্দুকের মুখে বন্ড নেয়। তারা আমাদের অন্যান্য এলাকাস্থ কর্মীদের আক্রমণ ও হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে। সর্বহারা পার্টির কর্মী ও বাঙালী পেলেই তারা খতম করবে এ ধরনের কথা প্রচার করে।
এ সকল ঘটনা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের ফ্যাসিবাদী প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
এরা যদি গণতন্ত্ৰীমনা বুর্জোয়াও হতাে তবে দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক কাজের স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করে আমাদের কাজে হস্তক্ষেপ করতাে না।
কিন্তু তারা একদলীয় একনায়কত্ব, মাতব্বরী ও ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের চরিত্রের সাথে আমাদের দেশের এবং অন্যান্য দেশের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের কোন পার্থক্য আছে কি?
আওয়ামী লীগ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা বাঙালী বিহারীদের মধ্যকার শােষক-শােষিতদের কোন পার্থক্য করেনি, সকল বিহারীকে শত্রু মনে করেছে। অন্যান্যদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করেছে।
পৃষ্ঠা: ৬০৪

এরা শেষ পর্যন্ত ভারতের কাছে নিজেদের দাসখত লিখে দিয়েছে। পাহাড়ী জাতিসত্তার মুক্তি (… ?)।
একইভাবে ভারতের নাগা-মিজো প্রভৃতি জাতিসত্তার মধ্যকার সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী অংশ প্রতিক্রিয়াশীলদের নিকট আত্মসমর্পণ করে তাদের পুতুল হিসেবে। কাজ করছে।
কাজেই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীরা আজ হােক কাল হােক জাতীয় নিপীড়নকারীদের নিকট আত্মসমর্পণ করে, জনগণের মুক্তি আনতে পারে না।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপের গতিধারা প্রমাণ করছে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিসত্তাসমূহের মুক্তি আনতে পারে না, উপরন্তু তারা আমাদের আক্রমণ করে আওয়ামী লীগ বিশ্বাসঘাতক ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করছে। হয় তারা ইতিমধ্যেই ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলিয়েছে বা অদূর ভবিষ্যতে তারা হাত মিলাবে।
আমাদের আক্রমণ তাদের পতনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।
অস্ত্রের জোরে তারা পাহাড়ী জনগণকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না, বাঙালী-পাহাড়ী ঐক্যে তারা ফাটল ধরাতে পারবে না। বরঞ্চ অচিরেই তারা নিজেরাই উৎখাত হবে, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
পৃষ্ঠা: ৬০৫

বাংলা সাহিত্যের জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক-শরৎচন্দ্র
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[এ নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় স্ফুলিঙ্গ’-এর ১নং সংখ্যায়। এই অসমাপ্ত রচনাটির বাকি অংশ প্রকাশের আগেই কমরেড সিরাজ সিকদার শহীদ হন -প্রকাশক।]

বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক হিসেবে কাকে আমরা তুলে ধরতে পারি? এটা সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক বলতে আমরা বুঝি এমন সাহিত্যিক যিনি আপােষহীনভাবে সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদকে বিরােধিতা করেছেন।
বাংলা সাহিত্যে শরৎচন্দ্রই হচ্ছেন জনপ্রিয় জাতীয় গণতান্ত্রিক লেখক।
তিনি তৎকালীন বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের আপােষহীনভাবে বিরােধিতা করেছেন, এবং তাদেরকে উৎখাতের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথকে তুলে ধরেছেন, একে প্রশংসা করেছেন।
বিপ্লবীদের তিনি আন্তরিকতার সাথে তাদের পক্ষ নিয়ে চিত্রিত করেছেন। (শরৎচন্দ্র মার্কসবাদী ছিলেন না। এ কারণে সশস্ত্র সংগ্রামকে জনগণের সাথে যুক্ত, ঘাটি এলাকা গঠন, কৃষকদের অংশগ্রহণ, সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব ইত্যাদি তুলে ধরতে পারেননি)।
ভারতের তখনকার বৃটিশদের দালাল রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যিকদের (গান্ধীর অহিংস পথ, রবীন্দ্রনাথ) অহিংস পথ সশস্ত্র সংগ্রামের বিরােধিতা, বিপ্লবীদের ব্যর্থতা ও খারাপ হিসেবে চিত্রিত করার বিপরীতে শরৎচন্দ্রের লেখা একটি বলিষ্ঠ জবাব ছিল। এ কারণে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ বৃটিশদের দ্বারা বাজারে প্রকাশ নিষিদ্ধ ছিল।
সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদের টিকে থাকার ভিত্তি এবং কৃষক-জনগণকে শােষণের হাতিয়ার। শরৎচন্দ্র সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণা, আচার-অনুষ্ঠান, সামন্ত-জমিদারদের নিষ্ঠুর শােষণ ও লুণ্ঠনকে এবং জনগণের সামন্ত বিরােধী মনােভাবকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
অবিভক্ত ভারতে সামন্তবাদীদের শােষণের একটি রূপ ছিল মুসলিম জনগণের উপর নিষ্ঠুর ধর্মীয় নিপীড়ন।
শরৎচন্দ্রই একমাত্র লেখক যিনি একে মর্মস্পর্শীভাবে চিত্রিত করেছেন। সামন্তবাদের অবক্ষয়, কৃষকদের ভূমি থেকে উৎখাত এবং শ্রমিকে রূপান্তরের সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে তুলে ধরেছেন। শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পটি এ কারণে ঐতিহাসিক রচনা।
পাক-ভারত উপমহাদেশের বিভক্তির কারণ এখানেই পাওয়া যায়। শরৎচন্দ্র সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ দ্বারা নিপীড়িতা, নির্যাতিতা নারীদের দুঃখ
পৃষ্ঠা: ৬০৬

বেদনাকে মর্মস্পর্শী রূপ দিয়েছেন, নিপীড়িতা নারীদের সমর্থন করেছেন।
তিনি সামন্তবাদী ধ্যান-ধারণাকে ভেঙ্গে ফেলা, নারী-পুরুষের সমঅধিকার, সমাজের হস্তক্ষেপ ব্যতীত নরনারীদের স্বেচ্ছাভিত্তিক সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে সর্বদাই দৃঢ় থেকেছেন।
আচার অনুষ্ঠান নয়, নরনারীদের ভালবাসাই হচ্ছে সম্পর্কের ভিত্তি এটা তিনি তুলে ধরেছেন।
ভারতের তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রতি শরৎচন্দ্রের এ সকল ধ্যান-ধারণা একটা বিরাট বিদ্রোহ হিসেবে কাজ করেছে।
এ কারণে ভারতে সামন্তবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদীরা কখনােই তাকে পছন্দ করেনি।
শরৎচন্দ্রকে এ কারণেই সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল ভারতের বর্তমান আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শাসক গােষ্ঠী এবং তাদের উপর নির্ভরশীল বুদ্ধিজীবীরা বিরােধিতা করেছে।
বর্তমানে তারা তাদের বিরােধিতার রূপ পরিবর্তন করে বলছে শরৎচন্ত্র পুরােনাে হয়ে গেছে ইত্যাদি।
‘পুরােনাে হয়ে গেছে’ বলে তারা তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যিক যারা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল সাহিত্যিক শিল্পীদের তুলে ধরছে।
এভাবে তারা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করছে।
সাহিত্য-শিল্পকলা হচ্ছে উপরিকাঠামাের অঙ্গ। ইহা মানুষের মতাদর্শকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাজেই ভারত এবং বাংলাদেশে সাহিত্য শিল্পকলার মাধ্যমে উপরিকাঠামাের মতাদর্শগত ক্ষেত্রে সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করে তাদের টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে।
কিন্তু আপামর জনসাধারণ এ অপচেষ্টার বিপক্ষে। এ কারণে এখনাে আধুনিক প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের চেয়ে শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা এবং তার পাঠকসংখ্যা বেশী।
(অসম্পূর্ণ)
পৃষ্ঠা: ৬০৭

কমরেড রফিকের বীরত্বপূর্ণ আত্মবলিদানে
ক. সিরাজ সিকদারের শােকবাণী
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[এই শােক বাণীটি স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

ক. রফিক পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বীর যােদ্ধা ছিলেন। গত বৎসর এবং এবারকার বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণে তিনি বীরত্ব দেখিয়েছেন। পার্টি প্রদত্ত দায়িত্ব দ্বিধাহীনভাবে পালন করেছেন। দেশ, জাতি, জনগণ ও সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তির স্বার্থে আত্মবলিদানে নির্ভিকভাবে শক্রর উপর ঝাপিয়ে পড়তে তিনি কখনাে পিছপা হননি।
তার মত সম্ভাবনাময় গেরিলা কমান্ডারের অকাল মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত।
ক. রফিক জনগণের সেবা করে বীরত্বপূর্ণ মৃত্যুবরণ করেছেন, তার মৃত্যু হিমালয় পর্বতের চেয়েও ভারী।
ক, রফিকের এবং অন্যান্য শহীদ কমরেডদের মহান দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে দৃঢ়ভাবে শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়তে হবে, শত্রুকে পরাজিত ও ধ্বংস করতে হবে, দেশ, জাতি, জনগণ এবং সর্বহারাদের মুক্তি আনতে হবে।
এভাবে ক. রফিক ও অন্যান্য শহীদদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে, তাদের আত্মত্যাগকে সার্থক করে তুলতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬০৮

অঞ্চল পরিচালক এবং গুরুত্বপূর্ণ কমরেডদের সাথে প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির বৈঠক শেষে প্রকাশিত
ইশতেহার
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)

সভায় অঞ্চল পরিচালক ও গুরুত্বপূর্ণ কমরেডগণ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সাংগঠনিক, মতাদর্শগত ও তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সামরিক এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনা হয়।
সভায় সভাপতি প্রদত্ত রিপাের্ট কমরেডরা পর্যালােচনা করেন এবং তা গ্রহণ করেন। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালােচনা করা হয়।
অনুশীলনের সাথে যুক্ত পরীক্ষিত এবং নূতন সম্ভাবনাময় বহু কর্মী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে যুক্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।
এদেরকে মানােন্নয়ন এবং তাত্ত্বিক হিসেবে গড়ে তােলার পদ্ধতি ঠিক করা হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পুনর্গঠন করা হয় এবং কেন্দ্রীয় সংস্থা ও তার পরিচালনার বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রদান করা হয়।
সভায় মতাদর্শগত ও তাত্ত্বিক, সামরিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত অনুমােদিত হয়।

তাত্ত্বিক ও মতাদর্শগত
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে ব্যাপক নতুন কর্মী বিভিন্ন স্তরে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে। অনুশীলনের সাথে যুক্ত এবং পরীক্ষিত এরূপ পুরানাে কর্মীও রয়েছে।
অনুশীলনের সাথে যুক্ত ও পরীক্ষিত সম্ভাবনাময় এবং নতুন কর্মীদের মানােন্নয়ন, বিশেষ করে তাত্ত্বিক মানােন্নয়ন ও তাত্ত্বিক সৃষ্টি সংগঠনের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
অনুশীলনে যুক্ত নয় এরূপ তত্ত্বজানা গােড়ামীবাদীদের প্রাধান্য অপসারণের জন্য সংগঠনে গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম পরিচালনা করা হয়েছে। এর ফলে গােড়ামীবাদ ধিকৃত হয়েছে।
গােড়ামীবাদ পরিহার করে আমরা যদি তত্ত্ব অধ্যয়ন এবং তাত্ত্বিক মানােন্নয়ন, অনুশীলনের সাথে যুক্ত তাত্ত্বিক গড়ে না তুলি তবে সংগঠনে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদের প্রাধান্য পাবে এবং সংগঠন বিপ্লব পরিচালনা করতে ব্যর্থ হবে। কাজেই তাত্ত্বিক মানােন্নয়ন ও তাত্ত্বিক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মার্কসবাদ উত্তমরূপে অধ্যয়ন ও রপ্ত করণের আন্দোলন চালাতে হবে; বিশেষ করে অনুশীলনের সাথে যুক্ত এবং পরীক্ষিত, সম্ভাবনাময় এবং নূতন সম্ভাবনাময়দের গুরুত্ব সহকারে স্তর অনুযায়ী তত্ত্ব অধ্যয়ন ও রপ্ত করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬০৯

এ তত্ত্ব অধ্যয়নের উদ্দেশ্য হবে সংশােধনবাদী ও ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শকে সংগ্রাম ও পরিহার করা, পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থার সাথে মার্কসবাদের সমন্বয় সাধন করা।
ছ’মাসের মাঝে এ আন্দোলন পরিচালনার প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচী কর্মীদের পাঠ করানাে সম্পন্ন করা।
এ উদ্দেশ্যে অধ্যয়ন ও লেখক গ্রুপ তৈরী করা। এরা মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও তা। আলােচনা, লেখা ইত্যাদির দায়িত্ব নেবে।

সামরিক
সামরিক ক্ষেত্রে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ আরাে জোরদার করতে হবে।
শত্রুর চাপ বৃদ্ধি এবং আমাদের ব্যাপক কর্মী রদবদলের ফলে বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ বিকাশ ধীরগতিতে চলছে।
বর্তমানে রদবদল সম্পূর্ণ হয়েছে। শত্রুর চাপ হ্রাস পেয়েছে। কাজেই রণনৈতিক আক্রমণ জোরদার এবং ৩০শে এপ্রিলের বিবৃতির লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যেতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের অপারেশনে অংশগ্রহণ না করা, সম্ভাবনাময় গেরিলা কমান্ডার, পরিচালকদের রক্ষা করার নীতি বজায় রাখতে হবে।
অঞ্চলভিত্তিক সামরিক অপারেশন টার্গেট লিস্ট বিশ্লেষণ সহ তেরী করে ক্রমান্বয়ে জটিলতর অপারেশনের দিকে যেতে হবে। ফলে বিপর্যয় কম হবে। সামরিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অপারেশন চালিয়ে যেতে হবে।
জাতীয় শত্রুর আত্মসমর্পণ গ্রহণ করা, গ্রামভিত্তিক চাদা গ্রহণ কার্যকরী করতে হবে। এভাবে প্রতি উপঅঞ্চল , অঞ্চলকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে।
জাতীয় শত্রু খতম চালিয়ে গ্রামকে মুক্ত, অপারেশন পূর্বে স্থানীয় জনমত তৈরী ইত্যাদি করতে হবে।
গ্রেপ্তারকৃত কমরেডদের মুক্তির জন্য আইনগত ও অন্যান্য পদ্ধতি অবলম্বন করে তাদের যথাসম্ভব শীঘ্র মুক্ত করতে হবে।
এবারকার বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণে শহীদ কমরেডদের জন্য শােক জ্ঞাপন করা হচ্ছে।
শহীদ ও গ্রেপ্তারকৃতদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়ভাবে বিপ্লবী কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

রাজনৈতিক
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতিশয় চমৎকার।
আওয়ামী লীগ ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ইতিহাসের নির্মমতম শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলা আজ চরমতম আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছে। সাম্প্রতিক বন্যা এ সংকটকে আরাে তীব্রতর করছে। ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চাকুরির সংকট পূর্ব বাংলার জনগণকে ইতিহাসের সবচাইতে খারাপ। অবস্থায় ফেলেছে।
জনগণ চায় বিপ্লব, দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি।
পৃষ্ঠা: ৬১০

আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক পুতুল সরকার ও তার প্রভুদের উপর জনগণ চরমভাবে বিক্ষুব্ধ, তারা বিদ্রোহ উন্মুখ। তারা অতিসত্ত্বর আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে স্বাধীনতা, শান্তি, গণতন্ত্র চান; খেয়ে পরে বাঁচতে চান।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের লেজুড় মনি-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা জনগণের নিকট পুরােপুরি দালাল হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। তাদের ভাঙ্গন ও পতন চলছে।
জনগণকে পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকাশ্য দলসমূহ সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
হক-তােয়াহা-মতিন প্রভৃতিও জনগণকে পরিচালনার সম্পূর্ণ অক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং জনগণের আস্থা হারিয়েছে। তাদেরও পতন এবং ভাঙ্গন চলছে।
পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ব্যাপক জনসমর্থন অর্জন করেছে, পার্টির প্রতি জনগণের আস্থা দৃঢ়তর হচ্ছে।
একমাত্র পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিই পূর্ব বাংলার মুক্তি আনতে সক্ষম-জনগণের মাঝে এ ধারণা দৃঢ়তর হচ্ছে।
জনগণ বিভিন্ন স্থানে নিজেরাই আমাদের সাথে সহযােগিতা করতে এগিয়ে আসছে। আমাদের পরিচয় পেলে নিরাপদে সরে পড়ায় সহযােগিতা করছে। তারা আমাদেরকে তাদের মুক্তিদাতা বলে গ্রহণ করছে। তারা দ্রুত আমাদের (… ?) করছে।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ মারাত্মক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংকটে পতিত হয়েছে।
সে নিজেকে একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পায়তারায় একটি আনবিক বােমা ফাটিয়েছে। এর সাহায্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আনবিক ব্লাকমেইল করা, প্রতিবেশী দেশসমূহে নিয়ন্ত্রণ, হস্তক্ষেপ করা, দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা তৈরীর প্রয়াস চালাচ্ছে।
ইতিমধ্যেই সে পূর্ব বাংলায় উপনিবেশ কায়েম করেছে, সিকিমকে গ্রাস করে সেখানে উপনিবেশিক শােষণ কায়েম করেছে।
তার এ সকল জঘন্য কার্যকলাপে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ সহায়তা ও সমর্থন জোগাচ্ছে।
ভারতীয় জনগণ, পূর্ব বাংলার জনগণ, সিকিমের জনগণ, দক্ষিণ এশিয়ার জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে উৎখাতের জন্য সংগ্রাম জোরদার করছে। উপরন্তু মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা এবং পুঁজিবাদী পশ্চিম ইউরােপ ও জাপান, দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে ভারত সােভিয়েটের সাথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মুসলিম বিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্ব দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিয়ন্ত্রণকে বিরােধিতা করছে। এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ব্যাপকতর প্রতিরােধ ও বিরােধিতার সম্মুখীন হয়েছে যা তার পতনকে দ্রুততর করছে।
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির একক বিরােধী শক্তি হিসেবে বিকাশ পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের বিভিন্ন ভারত-সােভিয়েট বিরােধী মহলকে আমাদের সাথে সহযােগিতা করতে উদ্বুদ্ধ করছে।
পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরে ভারত-সােভিয়েট বিরােধী বিভিন্ন মহল আমাদের সাথে সংযােগ করছে।
দেশের বাইরের ও বিভিন্ন মহলের সাথে সংযােগ স্থাপনের প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৬১১

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের নমনীয় লাইন ভারত-সােভিয়েট বিরােধী শক্তিসমূহের সংযােগ ও সহায়তাকে সম্ভব করে তুলেছে।
এ অবস্থায় আমাদের শক্তিকে আরাে বাড়াতে হবে, স্বাধীনতা ও উদ্যোগ আমাদের হাতে বজায় রাখতে হবে, দেশব্যাপী জনগণকে আমাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে গণসংগ্রামকে জোরদার করতে হবে।
আমাদের নিজস্ব ঐক্য, শক্তি, দেশীয়-আন্তর্জাতিক সহায়তা ডেকে আনবে এবং সম্ভব করে তুলবে।
এ কারণে আমাদের ঐক্য ও শক্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি একান্ত প্রয়ােজন।
একই পথে (?) সাথে সর্বদা আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের কু’দেতা-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে।
এরূপ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাব্য ভারতীয় হস্তক্ষেপ এবং পঁচিশে মার্চের মত অবস্থার উদ্ভব হলে স্থিতির পূর্ণ সুযােগ গ্রহণের জন্য আমাদেরকে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬১২

১৬ই জুনের ঐতিহাসিক হরতালের রিপাের্ট
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[এ রিপাের্টটি স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

১৬ই জুন অর্ধদিবস হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত কর্মী, সহানুভূতিশীলদের ব্যাপক সাড়া লাভ করে।
প্রতি অঞ্চলের কর্মীরা হরতালের বিষয় চিকা, পােস্টার, লিফলেট, সশস্ত্র, নিরস্ত্র মিছিলের পদক্ষেপ নেয়।
বরিশালে এরূপ একটি মিছিলের সময় প্রতিমন্ত্রী মঞ্জুর মটর আটকা পড়ে।
পােস্টার তুলে ফেলা, দেয়াল লিখন মুছে ফেলার জন্য সরকার পুলিশদের ব্যবহার করে। কোথাও কোথাও আওয়ামী গুণ্ডাবাহিনী এ কাজ করে।
হরতালের জন্য সশস্ত্র তৎপরতা পরিচালনা, রাস্তা ও যােগাযােগ ব্যবস্থা বানচালের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
ঢাকাসহ প্রায় জেলায়ই আওয়ামী লীগ ও তার সহযােগী সংগঠন এবং মস্কোপন্থীদের বিভিন্ন অফিসে গেরিলারা বীরত্বের সাথে হাতবােমা, মলােটভ ককটেল নিক্ষেপ করে।
ঢাকায় মীরপুর তিতাস গ্যাস স্টেশন উড়িয়ে দেওয়া হয়, রেলওয়ে স্টেশনে হামলা চালানাে হয়। শ্রীমতি এবং অন্যান্য অশ্লীল পত্রিকা এবং প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা অফিসে বােমাবর্ষণ করা হয়।
ভারতীয় বিমান অফিস বােমা বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ পূর্ব বাংলার প্রায় জেলায় এই তৎপরতা চলে।
১৫ই জুন রাতে বরিশাল ঝালকাঠি রােড কেটে ফেলা হয় এবং টেলিফোন লাইন উপড়ে ফেলা হয়।
ফরিদপুরে একস্থানে রাস্তা কাটতে যেয়ে সেনাবাহিনীর সাথে গুলি বিনিময় হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সেনাবাহিনী এলােপাথাড়ী গুলি বর্ষণ করে পলায়ন করে।
১৫ই জুন রাতে খুলনা-যশােরে ব্যাপক বােমাবর্ষণ করা হয়।
যশাের-খুলনায় হক-তােয়াহা এবং অন্যান্যদের সাথে যুক্ত আন্তরিক বিপ্লবীরা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন।
ঐদিন ময়মনসিংহে একটি রেলস্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়।
জয়দেবপুরের রেল লাইনেরও ক্ষতিসাধন করা হয়। ফলে রেল যােগাযােগ বহুক্ষণ বিচ্ছিন্ন ছিল।
ঐদিন কয়েকটি তহশিল অফিস ধ্বংস করা হয়।
১৬ই জুন হরতাল বানচাল করার জন্য বরিশালে কয়েকশত রিক্সাচালককে রাতে থানায় আটকে রাখা হয়।
পৃষ্ঠা: ৬১৩

পরদিন তাদেরকে রিক্সাসহ শহরে পাঠানাে হয়। কিন্তু রিক্সা চালকগণ রিক্সা নিয়ে বাড়ী চলে যায় বা চাকার পাম্প ছেড়ে বসে থাকে।
বরিশালে ১৬ই জুন শত সহস্র লােক রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং রক্ষীদের বিরুদ্ধে কর্মতৎপর গেরিলাদের বােমার শব্দে হাততালি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে।
রক্ষীরা শহরে দোকানপাট খােলার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা সকলেই তা বন্ধ করে রাখে।
গেরিলাদের তৎপরতার মুখে শেষ পর্যন্ত রক্ষীরা ভয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তারা সেদিন আর ক্যাম্প থেকে বেরােয়নি।
বরিশালে পূর্ণাঙ্গ হরতাল পালিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে হরতালের প্রচারের কারণে ভি.ভি. গিরির চন্দ্রঘােনা কাগজকল পরিদর্শন বাতিল হয়। সে কাপ্তাই রাস্তা দিয়ে না যেয়ে হেলিকপ্টারে যেতে বাধ্য হয়।
ফরিদপুর, রাজশাহী, ঝালকাঠি, খুলনা, যশাের, সুনামগঞ্জে পূর্ণাঙ্গ এবং আংশিকভাবে পূর্ব বাংলার বহু জেলায়ই হরতাল পালিত হয়।
এ ছাড়া বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে বহু হাটবাজার বন্ধ থাকে।
১৬ই জুনের হরতালের সাফল্যজনক বাস্তবায়ন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির পক্ষে বিরাট প্রচার হয়েছে।
‘বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা এবং বিদেশের প্রচারমাধ্যম আমাদের তৎপরতা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়।
১৬ই জুনের হরতাল ভি. ভি. গিরির ঢাকা উপস্থিতির একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হিসেবে কাজ করে; এ কারণে হরতাল বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।
১৬ই জুনের হরতাল বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য বিরাট সহায়ক হিসেবে কাজ করবে।
ভাসানী ন্যাপের নেতৃত্বে ছয় পার্টির ঐক্যফ্রন্টের ৩০শে জুনের কর্মসূচীর ব্যর্থতা এবং তাদের ডাকা ৫ই জুলাই হরতালের ব্যর্থতা একক বিরােধী শক্তি হিসেবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে দাঁড় করিয়েছে।
এভাবে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে যে শূন্যতা বিরাজ করছিল তা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি পূরণ করছে।
হক-তােয়াহা-মতিনদের সাথে যুক্ত বহু কর্মীই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদেরকে সহায়তা করে।
তারা ১৬ই জুনের হরতালকে বিরাট অগ্রগতি বলে আখ্যায়িত করে।
বিভিন্ন গণতন্ত্ৰীমনা বিরােধী শক্তিও ১৬ই জুনকে আমাদের বিরাট অগ্রগতি বলে স্বীকার করে।
পৃষ্ঠা: ৬১৪

১৯৭৪-এর বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের অগ্রগতি
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[এ রিপাের্টটি স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ সাফল্যজনকভাবে শুরু হয় সাভারের শিমুলিয়া ফাড়ি আক্রমণ ও দখলের মাধ্যমে।
এবার বর্ষাকালীন আক্রমণ গত বছরের তুলনায় একমাস আগেই শুরু হয়েছে। শিমুলিয়া দখলের ফলে বেশ কিছুসংখ্যক অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাওয়া যায়। ১৯৭৪-এর জুন মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পারােয়া ফাড়ি দখল করা হয়। এ আক্রমণ আমাদের পার্বত্য গেরিলারা পরিচালনা করে।
প্রকাশ্য দিনের বেলায় আক্রমণ করে দুঃসাহসী গেরিলারা ক্যাম্পটি দখল করে নেয়।
এতে ১৬টি রাইফেল, ৪টি S.L.R. এবং ১টি L.M.G.-সহ প্রচুর গােলাবারুদ দখল হয়।
পরদিন ঐ এলাকায় পুলিশ-বি.ডি.আর গেলে ওৎ পেতে থাকা গেরিলাদের আক্রমণের মুখে পড়ে তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসে।
বহুদিন পর্যন্ত পুলিশ, বি.ডি.আর, রক্ষী বা সেনাবাহিনী সেখানে যায়নি।
এ আক্রমনের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের জনসাধারণের মাঝে বিপুল সাড়া জেগেছে এবং সরকার ও তার ভাড়াটে বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে।
জুলাই মাসে বরিশালের বাবুগঞ্জ থানা আমাদের দুঃসাহসী গেরিলাদের আক্রমণের নিকট আত্মসমর্পণ করে
গেরিলারা থানার সমুদয় অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে নিরাপদে সরে আসে।
আমাদের গেরিলারা সাফল্যজনক হামলা চালিয়ে সিলেটের ধর্মপাশা থানা, ঢাকার আঁটি পুলিশ ফাড়ি আক্রমণ করে এবং থানা ও ফাঁড়ির পতন ঘটে। গেরিলারা সমুদয়। অস্ত্র দখল করে নেয়।
১৯৭৩ সালের বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণের সময় আমাদেরকে মােকাবেলা করতে হয়েছে শুধু পুলিশ বাহিনীকে।
এবারকার বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ ব্যাহত করার জন্য আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা যৌথ অভিযানের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী, বি.ডি.আর, রক্ষীকে পুলিশের সাথে নিয়ােগ করেছে।
শত্রু চাপের এরূপ কয়েকগুণ বৃদ্ধিতে কোথাও কোথাও আমাদের কিছুটা ক্ষতি সত্ত্বেও বর্ষাকালীন রণনৈতিক আক্রমণ অব্যাহত গতিতে চলছে।
পৃষ্ঠা: ৬১৫

আমাদের কর্মী ও গেরিলারা ক্ষতি ও বিপর্যয়কে দৃঢ়তার সাথে অতিক্রম করে জাতীয় শত্রু খতম, থানা-ফাঁড়ি দখল ইত্যাদি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। এভাবে আমরা নিয়মিত বাহিনী গঠন, মুক্তাঞ্চল গড়ে তােলার দিকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছি।
এটা বাংলাদেশ পুতুল সরকারের তথাকথিত যৌথ অভিযানের প্রতি আমাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব।
বাংলাদেশ পুতুল সরকার তার সকল প্রকার বাহিনী নিয়ােগ করেও আমাদের তৎপরতা ও বিকাশ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের আর কোন বাহিনী নেই যা আমাদের। বিরুদ্ধে নিয়ােগ করতে পারে।
কাজেই আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের নিজেদের ও তাদের প্রভুদের রক্ষার জন্য শেষ পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনীকে ডেকে আনতে হবে।
পূর্ব বাংলার মাটিতে উপনিবেশবাদী ভারতীয় বাহিনীর তৎপরতা পূর্ব বাংলার সকল জনগণকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ডেকে আনবে।
এর ফলে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের পতন আরাে ত্বরান্বিত হবে।
পৃষ্ঠা: ৬১৬

বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটি সমীক্ষা
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[এ নিবন্ধটি স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

আওয়ামী সরকার হৈ চৈ করে প্রচার করেছে বিরাট পরিবর্তন আসন্ন, দুর্নীতির অবসান হবে, জনগণের দুঃখ-দুর্দশার অবসান হবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র রেখে বা প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার গঠন করে জনগণের কোন উপকার সাধন করতে পারে কি?
আওয়ামী লীগ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক পার্টি, যা পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও মার্কিন-সােভিয়েটের স্বার্থ রক্ষা করে।
কাজেই পার্লামেন্টারী প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার যা-ই হােক না কেন-আওয়ামী লীগ যতক্ষণ ক্ষমতায় আছে ততক্ষণ প্রতিক্রিয়াশীল আমলা পুঁজি, সামন্তবাদ, ভারত এবং সােভিয়েট-মার্কিনের স্বার্থ রক্ষা পাবে, জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বৃদ্ধি পাবে, যত গালভরা বুলিই আওয়ামী লীগ বলুক না কেন জনগণের অবস্থার কোন পরিবর্তন সাধিত হবে না।
উপরন্তু পার্লামেন্টারী হােক বা প্রেসিডেন্সিয়াল হােক পূর্ব বাংলার গণতন্ত্র রয়েছে মুষ্টিমেয় আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও তাদের চরদের জন্য এবং ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের। উপর চলছে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব।
কাজেই কি পদ্ধতির সরকার হলাে তাতে জনগণের কোন কিছু আসে যায় না, সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলাে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্ষমতা, শ্রেণী নিপীড়নের ক্ষমতা (রাষ্ট্রযন্ত্র) কোন্ শ্রেণীর হাতে।
যেহেতু রাষ্ট্রক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে সেহেতু যে পদ্ধতির সরকারই হােক না কেন এ সরকার আওয়ামী লীগের স্বার্থ রক্ষা করবে, জনগণের উপর নির্যাতন চলবে।
উপরন্তু একনায়কত্ব কোন নিয়ম দ্বারা বাধা নয়। কাজেই যে পদ্ধতির সরকার হােক আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা জনগণের উপর প্রয়ােজনীয় ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব চালাবে।
সম্প্রতি ফায়ারিং স্কোয়াড গঠন, সংক্ষিপ্ত বিচারে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এটা জনগণের উপর নির্যাতন জোরদার করার একটি পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছু নয়।
কারণ সকল প্রকৃত অপরাধী, দুস্কৃতকারী হলাে আওয়ামী লীগাররা। কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াড তাদের গা স্পর্শ করবে না।
তবে ফায়ারিং স্কোয়াড কাদের গা স্পর্শ করবে?
স্বাভাবিকভাবেই ফায়ারিং স্কোয়াডের শিকার হবে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা, যারা জনগণের মুক্তি, তাদের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকুরী, বাসস্থান, শান্তি, নিরাপত্তা, প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য লড়ছে।
পৃষ্ঠা: ৬১৭

বিপ্লবী ও জনগণের উপর নির্যাতনের এ নবতর পর্যায় বিপ্লবকে আরাে ত্বরান্বিত করবে, ব্যাপকভাবে জনগণকে বিপ্লবে শরীক করবে।
মাও বলেছিলেন, “জাপান নির্যাতন চালিয়েছিল বলে চীনে বিপ্লব ত্বরান্বিত হয়েছে।” পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রেও ইহা প্রযােজ্য।
ব্যাপকতর নির্যাতন ব্যাপকতর প্রতিরােধের জন্ম দেবে, শেষ পর্যন্ত যা আওয়ামী লীগকে কবরস্থ করবে।
সামরিক বাহিনী ‘কুদেতা’র মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে পরিস্থিতির কোন পরিবর্তন হতে পারে কি? _ সামরিক বাহিনী নিজস্ব শক্তিতে ক্ষমতায় যেতে সাহস করবে না ভারতের হস্তক্ষেপের ভয়ে।
কারণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সেনাবাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী লড়ে বিজয় লাভ করতে সক্ষম হবে না।
সামরিক বাহিনী কোন উপায়ে ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী দালালরা ব্যাপকভাবে মার খাবে এবং তাদের অস্তিত্ব ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।
দ্বিতীয়তঃ সামরিক বাহিনীকে ভারতীয় হস্তক্ষেপের মােকাবেলা করতে হবে। ফলে দেশময় যুদ্ধের অবস্থা, ২৫শে মার্চ, ১৯৭১-এর পরবর্তী অবস্থার উদ্ভব হতে পারে।
ভারতকে মােকাবেলা এবং আভ্যন্তরীণ আমলাদেরকে মােকাবেলা করা সামরিক বাহিনীর দ্বারা সম্ভব হবে না, এটা চমৎকার অবস্থার সৃষ্টি করবে।
বৈদেশিক হস্তক্ষেপের সাহায্যে (মার্কিন সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় টিকে গেলেও জনগণের কোন পরিবর্তন হবে না। কারণ সামরিক বাহিনীর উচ্চ আমলারা (অফিসাররা) আমলা পুঁজি ও সামন্তদের সাথে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত।
ফলে সামরিক বাহিনীর দ্বারাও বাংলাদেশের জনগণের কোন উপকার হবে না।
পাকিস্তানের আয়ুব-ইয়াহিয়া আমল, বার্মার নেউইন সরকারের (তথাকথিত সমাজতন্ত্র কায়েমের দাবীদার) ব্যর্থতা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সামরিক একনায়কদের ব্যর্থতা (এর) প্রমাণ।
কাজেই পূর্ব বাংলার মুক্তি, জনগণের উপকার সম্ভব একমাত্র সর্বহারা শ্রেণী কর্তৃক পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে।
আর এ সর্বহারা শ্রেণীকে পরিচালিত হতে হবে মার্কস-লেনিন-মাওসেতুঙ নির্দেশিত বৈজ্ঞানিক পথে।
পৃষ্ঠা: ৬১৮

বন্যা, খরা ও পূর্ব বাংলার খাদ্য সমস্যা সমাধানের উপায়
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[এ নিবন্ধটি “স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

সম্প্রতি বন্যায় পূর্ব বাংলার প্রায় জেলাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনগণ, গবাদিপশু, খাদ্যশস্য, ঘরবাড়ী ও ধন-সম্পত্তির ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
বর্ষাকালে বন্যা, আর শুকনার সময় খরা, খাদ্যশস্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি পূর্ব বাংলার জনজীবনকে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।
জনগণ এ সকল সমস্যা থেকে আশু মুক্তি চান, খেয়ে-পরে তারা শান্তিতে বাঁচতে চান।
পূর্ব বাংলার বন্যা, খরা এবং খাদ্য সমস্যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারীদের সাথে জড়িত। বর্তমানে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রক্ষমতা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিনিধি আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের হাতে। পূর্ব বাংলার কৃষক শ্রমিক জনগণ এদের শােষণ-লুণ্ঠন ও নির্যাতনে চরমতম আর্থিক সংকটে পড়েছেন।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ, খরা রােধের এবং খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়ােজন ব্যাপক জনগণকে নিজেদের উদ্যোগে কাজে লাগানাে। কিন্তু জনগণের সাথে সরকারের সম্পর্ক হচ্ছে শােষণ-লুণ্ঠন-নির্যাতনের। এ কারণে জনগণকে সমাবেশিত করে কাজে লাগানাে এ সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।
উপরন্তু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা তাদের দেশের বন্যা পূর্ব বাংলায় চাপিয়ে দিচ্ছে এবং শুকনার সময় ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি আটকে রেখে পূর্ব বাংলায় খরা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ পুতুল সরকার তার প্রভু ভারতের এহেন পূর্ব বাংলা বিরােধী কার্যকলাপের কোন বিরােধিতাই করছে না।
কৃষকদের উপর আমলা পুঁজি, সামন্তবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নির্মম শােষণ-লুণ্ঠনের ফলে কৃষকেরা উৎপাদনে উৎসাহ পাচ্ছে না। কালােবাজারী, ভারতে চোরাকারবারী, মহাজনী, মজুতদারী ইত্যাদির কারণে খাদ্য সমস্যা আরাে প্রকট হয়েছে।
কাজেই পূর্ব বাংলার বন্যা-খরা ও খাদ্য সমস্যা সমাধান সম্ভব পূর্ব বাংলার গণবিরােধী বিশ্বাসঘাতক সরকারকে উৎখাত করে জনগণের সরকার কায়েম করার মাধ্যমে।
সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক-সৈনিক ও দেশপ্রেমিকদের সরকার ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদকে উৎখাত করে কৃষক শ্রমিক জনগণের রাষ্ট্রক্ষমতা কায়েম করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬১৯

ফলে জনগণ নিজেরাই হবেন রাষ্ট্রের মালিক।
তারা একত্রিত হয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে যুক্ত হয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণ, জলাশয় নির্মাণ, খাল-নদী খননের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, খরা সমস্যার সমাধান করবে এবং কমিউন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে খাদ্য সমস্যার সমাধান করবে।
ফারাক্কা সমস্যা, ভারতের বন্যা সমস্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি মানতে ভারতকে বাধ্য করতে হবে।
চীন ও ভিয়েতনামে এভাবে গণসরকার কায়েমের মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে বন্যা, খরা, খাদ্য সমস্যার সমাধান করেছে।
একই পথে আমাদের পক্ষেও সম্ভব হবে বন্যা, খরা ও খাদ্য সমস্যার সমাধান করা।
মনি-মােজাফফর সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতকরা বন্যা, খরা ও খাদ্য সমস্যার মূল কারণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিনিধিদের পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং তাদের নজিরবিহীন শােষণ ও লুণ্ঠন-এ সত্যকে স্বীকার করে না।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে উপরিউক্ত প্রতিক্রিয়াশীলদের উৎখাত করে জনগণের ক্ষমতা দখলের বিপ্লবী কর্মসূচী না নিয়ে মনি-মােজাফফর সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতকরা নিছক সংস্কারমূলক কাজ এবং আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের লেজুড়বৃত্তি করছে।
কাজেই পূর্ব বাংলার বন্যা, খরা ও খাদ্য সমস্যার সমাধান সম্ভব বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে জনগণের সরকার কায়েমের মাধ্যমে।
পৃষ্ঠা: ৬২০

হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতিদের বিরাট তাত্ত্বিক পরাজয়
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[এ নিবন্ধটি স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতি সকলেই “আধাউপনিবেশের উপনিবেশ হয় না, কেবলমাত্র সাম্রাজ্যবাদ ব্যতীত কেহ উপনিবেশিক শােষণ চালাতে পারে ”-বলে উল্লেখ করেছে।
এটা তাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক লাইন ছিল। এ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই তাদের রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লাইন গড়ে উঠেছে। এটা তাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে।
হক-তােয়াহাদের এ তত্ত্বকে কাজী, আমজাদ, বারী, আয়ুব রেজা এবং ফজলু চক্রের অবশিষ্টাংশ আমাদের আক্রমণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
এ তত্ত্ব দ্বারা তারা “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা। পার্টিকে বিরােধিতা করেছে, বর্তমানেও বিরােধিতা করছে।
পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি, সাম্রাজ্যবাদ ছাড়াও আধাউপনিবেশিক দেশ উপনিবেশ কায়েম এবং উপনিবেশিক শােষণ করতে পারে বলে উল্লেখ করে।
এ প্রশ্ন নিয়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিরাট তাত্ত্বিক বিতর্ক চলে।
“আধা-উপনিবেশিক দেশও উপনিবেশ কায়েম এবং উপনিবেশিক শােষণ করতে পারে” হক-তােয়াহাদের মতে আমাদের এ সঠিক তত্ত্ব নাকি সাম্রাজ্যবাদকে গৌণ করে ফেলে। এ কারণে তারা আমাদেরকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বলত।
“আধা-উপনিবেশের উপনিবেশ হতে পারে না”-এ তত্ত্ব থেকে হক-তােয়াহারা পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের পূর্ব বাংলার উপর পরিচালিত উপনিবেশিক শােষণকে অস্বীকার করছে।
বর্তমানেও এ তত্ত্বের কারণে তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ কর্তৃক পূর্ব বাংলার উপর পরিচালিত উপনিবেশিক শােষণকে অস্বীকার করছে।
হক সাহেব পূর্ব বাংলাকে সােভিয়েটের উপনিবেশ এবং ভারত তা তদারক করছে বলে উল্লেখ করছে।
তােয়াহা সাহেব পূর্ব বাংলাকে ভারতের আশ্রিত রাজ্য, সােভিয়েটের নয়া উপনিবেশ বলছে। আর মতিনরা বলছে “আধাউপনিবেশিক, আধাসামন্তবাদী পূর্ব বাংলা।”
এভাবে “আধাউপনিবেশের উপনিবেশ হতে পারে না”-এ তত্ত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে তারা প্রধান দ্বন্দ্ব এবং প্রধান শত্রু নির্ণয়ে ভুল করছে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, কর্মীদের ভুলপথে পরিচালনা করছে, দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নিয়ে কর্মীদের হতাশ করছে।
পৃষ্ঠা: ৬২১

সম্প্রতি চীনের ‘পিপলস ডেইলী’তে প্রকাশিত একটি ভাষ্যে (রেডিও পিকিং প্রচারিত ৩/৭/৭৪) সিকিমকে ভারতের উপনিবেশ, ভারত সিকিমে উপনিবেশিক শােষণ চালাচ্ছে, উনবিংশ শতাব্দীর বৃটিশদের অনুরূপ ভারত উপনিবেশিক সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।
হক-তােয়াহা যাকে আশ্রিত রাজ্য বলেছে ভাষ্যকার তাকে উপনিবেশ বলেছেন। ভারত একটি আধাউপনিবেশিক-আধাসামন্তবাদী দেশ।
উপরােক্ত ভাষ্য থেকে দেখা যায়, ভারত আধাউপনিবেশিক দেশ হয়েও উপনিবেশ কায়েম এবং উপনিবেশিক শােষণ চালাতে সক্ষম।
উপরােক্ত ভাষ্য হক-তােয়াহাদের “আধা-উপনিবেশের উপনিবেশ হয় না-তত্ত্বের চরম ভ্রান্তি প্রমাণ করেছে; পক্ষান্তরে, আমাদের তাত্ত্বিক সঠিকতা প্রমাণ করেছে।
ইহা হক-তােয়াহা-মতিনদের বিরাট পরাজয় এবং আমাদের একটি বিরাট বিজয়।
হক-তােয়াহারা যে তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল তার ভ্রান্তি, পক্ষান্তরে আমাদের তাত্ত্বিক সঠিকতা প্রমাণ হয়েছে।
আমরা আশা করি, হক-তােয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন ইত্যাদি গ্রুপগুলাের মধ্যকার আন্তরিক বিপ্লবীরা উপরােক্ত তাত্ত্বিক বিতর্কের ফলাফল উপলব্ধি করবেন এবং সঠিক তাত্ত্বিক লাইন দ্বারা পরিচালিত সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হবেন।

সিকিমে ভারতের সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে চীনের পিপলস ডেইলী একটি ভাষ্য প্রকাশ করেছে। ভাষ্যটির পূর্ণপাঠ নিম্নরূপঃ
সম্প্রতি সিকিমে পূর্ণ জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জোর দাবী উঠেছে। এই দাবী ভারত সরকারের কাছে মােটেই গ্রহণযােগ্য নয়। সিকিমকে ভারতের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং ভারতের মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ভারত সরকার এখন সিকিমের রাজাকে সমস্ত ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টায় লিপ্ত। ভারত সরকারের এ আচরণের মধ্য দিয়ে তার সম্প্রসারণবাদী কুৎসিত চেহারা আর একবার প্রকাশিত হয়ে উঠেছে। অবশ্য এতে সিকিমের জনগণের মধ্যে প্রতিরােধের একটি দুর্জয় দুর্গ গড়ে উঠেছে।
এ বছরের এপ্রিল মাসে সিকিমে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারত সরকারের পরিচালনায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বলে সিকিমের ভারতপন্থীরা জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। ৩০শে জুন তারিখে ভারত সরকার এই জাতীয় পরিষদের মাধ্যমে একটি খসড়া শাসনতন্ত্র উপস্থিত করে। এ শাসনতন্ত্র অনুযায়ী রাজা একজন শিখণ্ডী রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে থাকবেন মাত্র। সিকিমের রাজা স্বাধীনতা ও স্বীয়স্বাতন্ত্রের পক্ষপাতি। কিন্তু ভারত সরকার সংস্কার সাধনের নামে সিকিমকে একটি তাবেদার রাজ্যে পরিণত করতে চায়। ভারত সরকার রচিত শাসনতন্ত্রের বিধানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। যে, ভারতের নির্বাচিত একজন তথাকথিত প্রধান প্রশাসক সিকিমের সব ক্ষমতার অধিকারী হবে। খসড়া শাসনতন্ত্রে খােলাখুলিভাবে বলা হয়েছে যে, সিকিম সরকার
পৃষ্ঠা: ৬২২

ভারতের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং সিকিমের উন্নয়ন পরিকল্পনা ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের কাজকর্মের আওতাভুক্ত থাকবে। বাস্তবে এর। অর্থ হলাে, সিকিমের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অধিকার কুক্ষিগত করা এবং সিকিমকে ভারতের একটি উপনিবেশে পরিণত করা।
সিকিমের রাজা ভারতের এই প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ, নির্লজ্জ নিয়ন্ত্রণ ও বলিষ্ঠ চাপ। প্রতিরােধ করার চেষ্টা করছেন। তিনি ভারত কর্তৃক সিকিমের গ্রাস করার বিরােধিতা করা এবং সিকিমের আলাদা অস্তিত্ব, রাজনৈতিক মর্যাদা বজায় রাখার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। নয়া দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক বৈঠকের পর তিনি তার একজন সহকারীর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন যে তিনি ভারতের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবেন না। তার ন্যায়সঙ্গত মনােভাব সিকিমের জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে।
সিকিমের বিরুদ্ধে ভারতের এই ধরনের নগ্ন সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপে বিশ্বের সকল ন্যায়বিচারকামী দেশ ও জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি, আর জনগণ চায় বিপ্লব-এটাই হলাে বর্তমান দুনিয়ার একটি অপ্রতিরােধ্য স্রোত।
তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ওশেনিয়ার বহু উপনিবেশিক, আশ্রিত এবং পরাধীন দেশ সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের নিগঢ় থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে।
কিন্তু শুধু ভারতই স্বাধীনতা অর্জনের পরও বৃটেনের উনবিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবাদী নীতি অনুসরণ করে সিকিমকে নিজের অধীন রাজ্য হিসেবে গ্রহণ করে তার উপর উপনিবেশবাদী শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার সিকিমে সৈন্যবাহিনী মােতায়েত করে পররাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিসহ সিকিমের সমস্ত আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। তা নয়, বরং এখন সে সিকিমের রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিকিমকে সম্পূর্ণরূপে পদানত করার অপচেষ্টা করছে। ভারত সরকার নির্লজ্জভাবে সিকিমের সার্বভৌমত্ব পদদলিত করে পুরােপুরি উপনিবেশবাদী সম্প্রসারণ চালাচ্ছে। তাদের এই হীন কার্যকলাপের সঙ্গে বর্তমান দুনিয়ার গতিস্রোতের কোন মিল নেই।
এঙ্গেলস বলেছেন, “বিশ্বে এমন কোন লােক নেই যাদেরকে কোন একটি জাতিকে নির্যাতন করে শাস্তি ভােগ করতে হয়নি।”
ইতিহাস প্রমাণ করেছে এবং প্রমাণ করবে যে, কোন জাতিকে উৎপীড়ন করার নীতি সেই নিপীড়িত জাতির মধ্যে প্রতিরােধ সংগ্রামেরই জন্ম দেয় মাত্র।
সিকিমের জনগণের বিরুদ্ধে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের এইসব অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে সৃষ্ট কুফল তাকেই ভােগ করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬২৩

লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মহান সংগ্রাম
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)
[লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রাম ছিল মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অংশ। আলােচ্য প্রবন্ধে কমরেড সিরাজ সিকদার লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রামের বিষয়কে আলােচনা করেছেন। স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় এই দলিলটি প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]।

সভাপতি মাওসেতুঙ-এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী মহান সংগ্রাম পরিচালনা করছে। এ সংগ্রামে চীনের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষকসৈনিক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করছে।
লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রাম সংশােধনবাদী, পুঁজিবাদী পথগামীদের চীনের ক্ষমতা দখল, সমাজতান্ত্রিক চীনে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সর্বহারার একনায়কত্ব উৎখাত করে বুর্জোয়া একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা, চীনকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠন ক্ষেত্রে পরিণত করার চক্রান্তকে নস্যাৎ করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।
চীনের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতারক, অন্তর্ঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক দু’মুখাে লিনপিয়াও কনফুসিয়াসবাদকে তার ক্ষমতা দখল ও পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতাদর্শগত অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে ওয়াংমিং-লিউ শাওচি ইত্যাদি দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতকরাও মার্কসবাদ-সর্বহারাদের বিরােধিতা করার জন্য কনফুসিয়াসবাদকে মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
দু’মুখাে প্রতারক লিনপিয়াও মাওসেতুঙ জিন্দাবাদ ব্যতীত কথা বলত না এবং উদ্ধৃতি হাতে ব্যতীত বের হতাে না। সেও ওয়াংমিং-লিউ শাওচির অন্ধ কানাগলিপথ অনুসরণ করে।
শ্ৰেণী সমাজে মার্কসবাদী মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে বা প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে, এর মাঝামাঝি কিছু নেই।
এ কারণে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে দেখা যায় সংশােধনবাদী বার্নেস্টাইন, কাউটস্কি, ক্রুশ্চেভ, তােগলেয়াত্তি, ব্রেজনেভ মার্কসবাদের নামে বুর্জোয়া। মতাদর্শ গ্রহণ করেছে এবং এর দ্বারা মার্কসবাদের বিরােধিতা করছে।
মার্কসবাদের বিরােধিতা করার জন্য লিনপিয়াও চীন ও বিশ্বের সংশােধনবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের অনুরূপ চীনের প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ কনফুসিয়াসবাদকে গ্রহণ করে।
এ কারণে লিনপিয়াও বিরােধী সংগ্রাম, লিনপিয়াও-এর প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রামের সাথে যুক্ত। এই মতাদর্শগত সংগ্রাম বাদ দিলে লিনপিয়াও বিরােধী সংগ্রাম অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, এ সংগ্রামের আত্মাকেই বাদ দেওয়া হবে।
পৃষ্ঠা: ৬২৪

লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মহান সংগ্রাম
(সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)

[লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রাম ছিল মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অংশ। আলােচ্য প্রবন্ধে কমরেড সিরাজ সিকদার লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রামের বিষয়কে আলােচনা করেছেন। স্ফুলিঙ্গ ১নং সংখ্যায় এই দলিলটি প্রকাশিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

সভাপতি মাওসেতুঙ-এর নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী মহান সংগ্রাম পরিচালনা করছে। এ সংগ্রামে চীনের ব্যাপক শ্রমিক-কৃষকসৈনিক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা অংশগ্রহণ করছে।
লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রাম সংশােধনবাদী, পুঁজিবাদী পথগামীদের চীনের ক্ষমতা দখল, সমাজতান্ত্রিক চীনে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সর্বহারার একনায়কত্ব উৎখাত করে বুর্জোয়া একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা, চীনকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের লুণ্ঠন ক্ষেত্রে পরিণত করার চক্রান্তকে নস্যাৎ করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে।
চীনের ইতিহাসের অন্যতম প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতারক, অন্তর্ঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী, বিশ্বাসঘাতক দু’মুখাে লিনপিয়াও কনফুসিয়াসবাদকে তার ক্ষমতা দখল ও পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতাদর্শগত অস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে ওয়াংমিং-লিউ শাওচি ইত্যাদি দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতকরাও মার্কসবাদ-সর্বহারাদের বিরােধিতা করার জন্য কনফুসিয়াসবাদকে মতাদর্শগত হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
দু’মুখাে প্রতারক লিনপিয়াও মাওসেতুঙ জিন্দাবাদ ব্যতীত কথা বলত না এবং উদ্ধৃতি হাতে ব্যতীত বের হতাে না। সেও ওয়াংমিং-লিউ শাওচির অন্ধ কানাগলিপথ অনুসরণ করে।
শ্ৰেণী সমাজে মার্কসবাদী মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে বা প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ গ্রহণ করতে হবে, এর মাঝামাঝি কিছু নেই।
এ কারণে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে দেখা যায় সংশােধনবাদী বার্নেস্টাইন, কাউটস্কি, ক্রুশ্চেভ, তােগলেয়াত্তি, ব্রেজনেভ মার্কসবাদের নামে বুর্জোয়া। মতাদর্শ গ্রহণ করেছে এবং এর দ্বারা মার্কসবাদের বিরােধিতা করছে।
মার্কসবাদের বিরােধিতা করার জন্য লিনপিয়াও চীন ও বিশ্বের সংশােধনবাদী প্রতিক্রিয়াশীলদের অনুরূপ চীনের প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ কনফুসিয়াসবাদকে গ্রহণ করে।
এ কারণে লিনপিয়াও বিরােধী সংগ্রাম, লিনপিয়াও-এর প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রামের সাথে যুক্ত। এই মতাদর্শগত সংগ্রাম বাদ দিলে লিনপিয়াও বিরােধী সংগ্রাম অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে, এ সংগ্রামের আত্মাকেই বাদ দেওয়া হবে।
পৃষ্ঠা: ৬২৪

এ কারণেই চীনে লিনপিয়াও বিরােধী সংগ্রামের সাথে কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রাম যুক্ত হয়েছে।
আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে কনফুসিয়াস জীবিত ছিল। এ সময় চীনের সমাজে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হচ্ছিল। চীনের দাস সমাজ ভেঙ্গে পড়ছিল এবং সামন্তবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল।
কনফুসিয়াস দাস সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে মত প্রচার করে এবং তখনকার জন্য প্রগতিশীল সমাজ ব্যবস্থা সামন্তবাদকে বিরােধিতা করে।
আচার-অনুষ্ঠান পুনঃপ্রবর্তন, লুপ্ত বংশধারা ও পদ পুনরায় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মাধ্যমে সে দাস সমাজ পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
কনফুসিয়াস অবশ্য সমাজের গতিধারা রােধ করতে ব্যর্থ হয়। চীনে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মালিকদের প্রগতিশীল ভূমিকা শেষ হয়ে গেলে তারা সামন্তবাদ টিকিয়ে রাখা এবং কৃষকদের দাবিয়ে রাখার জন্য কনফুসিয়াসবাদ গ্রহণ করে।
চীনে পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশের কালে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের সহযােগী আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদীরা চীনের জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য কনফুসিয়াসবাদকে গ্রহণ করে।
লিনপিয়াও-এর শ্রেণীভিত্তি হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ, সেও এই মতাদর্শ থেকে মুক্ত ছিল না।
মার্কসবাদ, সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম বিরােধিতা করার জন্য সেও এই প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শ গ্রহণ করে এবং পার্টির মাঝে একজন লুক্কায়িত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিরাজ করে, পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের সুবিধাজনক সময়ের অপেক্ষা করে।
লিনপিয়াও কনফুসিয়াসের ‘নিজেকে সংযত কর, আচার-অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রবর্তন কর’-এ প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব তুলে ধরে নবম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় অধিবেশনে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের জন্য ষড়যন্ত্র করে। সে বলে রাষ্ট্র রয়েছে, অতএব রাষ্ট্রপতি থাকতে হবে অর্থাৎ সে চীনের রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেষ্টা করে।
অনুশীলনই প্রতিভার সৃষ্টি করে। ব্যক্তি নয় জনগণই সমাজ বিকাশের মৌলিক পরিচালিকা শক্তি, লিনপিয়াও এই ঐতিহাসিক বস্তুবাদী সত্যকে অস্বীকার করে, কনফুসিয়াসের সহজাত প্রতিভার, ব্যক্তি বিশেষই সমাজ পরিবর্তনের কারণ ইত্যাদি ভাববাদী তত্ত্ব প্রচার করে, নিজেকে ও তার পরিবারকে প্রতিভাবান মহামানব হিসেবে তুলে ধরে। এভাবে ক্ষমতা দখলের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও লিন রাজবংশ কায়েমের ষড়যন্ত্র করে।
লিনপিয়াও মনে করতাে শ্রমিক কৃষক জনগণ ভাত-রুটি ইত্যাদির কথা চিন্তা করবে, আর বুদ্ধিজীবীরা তাদের উপর মাতব্বরী করবে। সে বুদ্ধিজীবীদের গ্রামে যাওয়া, শ্রমিক-কৃষকের সাথে একীভূত হয়ে সর্বহারায় রূপান্তরের মহান প্রক্রিয়াকে (… ?) হিসেবে চিহ্নিত করে ও বিরােধিতা করে।
লিনপিয়াও কনফুসিয়াসের মধ্যপন্থী তত্ত্বের অনুকরণ করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামে বাম-বিচ্যুতি হয়েছে বলে বিরােধিতা করে।
সভাপতি মাও বলেছেন, একটি ভুলকে সঠিক করতে হলে সাধারণ সীমারেখা অতিক্রম
পৃষ্ঠা: ৬২৫

করতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে মধ্যপন্থা অবলম্বন করা যায় না। দৃঢ়ভাবে শ্রমিক কৃষক জনগণের পক্ষে থাকতে হবে, প্রতিক্রিয়াশীলদের উপর কঠোরভাবে একনায়কত্ব চালাতে হবে।
লিনপিয়াও কনফুসিয়াসের বদান্যতা, আনুগত্যের তত্ত্ব প্রচার করতাে। সে বদান্যতার কথা বলত, কিন্তু সর্বহারা শ্রেণী ও তার মহান নেতা সভাপতি মাওয়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা পােষণ করতাে। সে ‘Out line of the Project 571′ তৈরী করে সভাপতি মাওকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তার বদান্যতা হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল, সামন্ত, আমলা বুর্জোয়া ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য।
লিনপিয়াও-এর আনুগত্যের তত্ত্ব ছিল লিন ও তার রাজবংশের প্রতি আনুগত্যের তত্ত্ব, চীনের প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতি আনুগত্যের তত্ত্ব, নারী-সন্তানদের স্বামী-পিতামাতাবংশের প্রতি আনুগত্য, সর্বহারা শ্ৰেণী, পার্টি, সভাপতি মাও এবং জনগণ ও মার্কসবাদের প্রতি আনুগত্য নয়।
লিনপিয়াও-এর এ সকল তত্ত্বের উদ্দেশ্য ছিল সংশােধনবাদী বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীলদের টিকিয়ে রাখা, তাদের দ্বারা ক্ষমতা দখল করা, সােভিয়েট সংশােধনবাদীদের কোলে আশ্রয় নেয়া, চীনকে সােভিয়েটের উপনিবেশে পরিণত করা।
লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস ও তার শিষ্য মেনসাস বিরােধী সংগ্রাম চীনের উপরিকাঠামাের প্রতিক্রিয়াশীল, সংশােধনবাদী মতাদর্শের বিরুদ্ধে একটি মহান সংগ্রাম, এ সংগ্রাম দ্বারা উপরিকাঠামাের যে সকল অংশ সংশােধনবাদী বুর্জোয়াদের দখলে রয়েছে তাদের উৎখাতের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হবে এবং তারা উৎখাত হবে। ফলে সর্বহারার একনায়কত্ব দৃঢ়তর হবে। এ সংগ্রাম জনগণের মতাদর্শগত উন্নতি করবে। সর্বহারার অগ্রগামী চিন্তাধারা দ্বারা তারা সুসজ্জিত হবেন। ইহা বস্তুগত শক্তি হয়ে সমাজ ও দুনিয়ার রূপান্তর ত্বরান্বিত করবে। ফলে চীনের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, উৎপাদন শক্তির বিকাশ ত্বরান্বিত হবে।
লিনপিয়াও ও কনফুসিয়াস বিরােধী সংগ্রাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও বিশ্বের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কোরিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে কনফুসিয়াসের প্রভাব রয়েছে। চীনের এ সংগ্রাম এ প্রভাব দূরীকরণে সহায়তা করবে।
বিশ্বের আধুনিক সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামে ইহা বিরাট বিজয়। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশােধনবাদীদের এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের ও প্রতিক্রিয়াশীলদের চীনে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শােষণ ও লুণ্ঠন পরিচালনার রঙিন স্বপ্ন এ সংগ্রামের ফলে ধলিসাৎ হয়েছে।
এটা বিশ্ব বিপ্লবের একটি বিরাট বিজয়।
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ এবং পার্টির অভ্যন্তরস্থ অপরিবর্তিত বুর্জোয়া প্রতিনিধিদের ক্ষমতা দখল প্রতিহত করার ক্ষেত্রে চীনের এ মহান সংগ্রাম বিরাট উদাহরণ হিসেবে কাজ করবে।
পৃষ্ঠা: ৬২৬

পূর্ব বাংলার নিপীড়িত জনগণের উদ্দেশ্যে সিরাজ সিকদার,
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর জরুরী আহ্বান
[কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ১৯৭৪ সালের ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর ঢাকাসহ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেছিল। সে উপলক্ষে হরতালের আহ্বান সম্বলিত এই প্রচারপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রকাশক।]
(ডিসেম্বর, ১৯৭৪)

বাঙালী জাতি এবং পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন!! আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে দুর্ভিক্ষপীড়িত জনগণকে বাঁচান! ১৫ ও ১৬ই ডিসেম্বর অর্ধদিবস হরতাল পালন করুন! খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, চাকুরী, বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন! শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র কায়েম করুন!

আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিষ্ঠুর শােষণ ও লুণ্ঠনের ফলে পূর্ব বাংলায় আজ ইতিহাসের চরমতম সংকটের সৃষ্টি হয়েছে।
সমগ্র দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। শহরে গ্রামে রাজপথে টারমিনালে স্টেশনে ক্ষুধার্ত নগ্ন মানুষের ভীড়। একমুঠো ভাতের জন্য, একটি রুটির জন্য তাদের হাহাকারে পূর্ব বাংলার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে। প্রতিদিন শত শত বাংলার সন্তান না খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। লক্ষ লক্ষ জনগণ মৃত্যুর প্রহর গুণছে। খাদ্যাভাব অপুষ্টির কারণে লক্ষ লক্ষ শিশু অন্ধ ও পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। সমগ্র জাতির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ছে, কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বাঙালী জাতি ও জনগণের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
পক্ষান্তরে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা কালােবাজারী, রাহাজানি, মজুদদারী, লাইসেন্স-পারমিটের দৌলতে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে। এ নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতকরা এখনও ভারতে খাদ্য পাচার করছে, কালােবাজারী, মজুদদারী, চোরাকারবারী করে প্রতিদিনই খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের দাম বাড়াচ্ছে। এভাবে তারা। কালাে টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়ছে।
জাতি ও জনগণের প্রতি এদের বিন্দুমাত্র মমতা নেই, এদের বিন্দুমাত্র দেশপ্রেম নেই
পৃষ্ঠা: ৬২৭

এ বিশ্বাসঘাতকরা বিশ টাকা মণ দরে চাল, দশ টাকা মণ দরে গম দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর আজ তিনশত টাকারও অধিক দরে চাল, দুইশত টাকারও অধিক দরে গম বিক্রি হচ্ছে।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা এ সংকটের জন্য দোষ দিচ্ছে বন্যাকে, আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধিকে, ইয়াহিয়ার হামলাকে। বন্যা, আন্তর্জাতিক মূল্য বৃদ্ধি এর আগেও ঘটেছে, তদুপরি পাকিস্তানের শােষণ ও লুণ্ঠন থাকা সত্ত্বেও এ অবস্থা কখনাে হয়নি।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিষ্ঠুরতম শােষণ ও লুণ্ঠনই তার জন্য দায়ী।
দেশের এ চরমতম সংকটজনক অবস্থা পূর্ব বাংলার প্রতিটি জনগণের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের বিরুদ্ধে চরমতম ঘৃণা ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
পূর্ব বাংলার জনগণের উপর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের এ নিষ্ঠুর শােষণ, লুণ্ঠন ও নির্যাতনের পাহাড় চেপে বসে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর কালাে দিবস থেকে। ঐদিন ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী বাহিনী আওয়ামী মীরজাফরদের সহায়তায় ঢাকাসহ পূর্ব বাংলা দখল করে নেয়।
ঐদিন থেকেই পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশ কায়েম হয়।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তাদের প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের শােষণ, লুণ্ঠন এবং নির্যাতন চিরদিন পূর্ব বাংলার জনগণ মুখ বুজে সহ্য করবেন না।
ইতিমধ্যেই পূর্ব বাংলার ছাত্র-বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক থেকে চাকুরীজীবী, সেনাবাহিনী, শ্রমিক-কৃষক অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা প্রতিবাদ মিছিল, কোথাও কোথাও খাদ্য লুট, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের খতম করছেন।
পূর্ব বাংলার বীর জনগণ ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে নূরুল আমিন সরকারকে উৎখাত করেন।
১৯৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইউব খাকে উৎখাত করেন।
১৯৭১-এর মার্চের মহান গণঅভ্যুত্থান এবং সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ইয়াহিয়া সামরিক ফ্যাসিস্টদের উৎখাত করেন।
দুর্ভিক্ষপীড়িত, লাঞ্ছিত-নিপীড়িত পূর্ব বাংলার জনগণের প্রচণ্ড গণঅসন্তোষের অবশ্যই বিস্ফোরণ ঘটবে এবং আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে কবরস্থ করবে।

পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, সেনাবাহিনী, বি.ডি.আর, পুলিশ, বিভিন্ন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল, গােষ্ঠী, ব্যক্তি এবং পূর্ব বাংলার সকল জনগণের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানাচ্ছি –
আপনারা অতীতের গৌরবময় সংগ্রামী ঐতিহ্য অনুসরণ করে এগিয়ে আসুন, বাঙালী জাতি ও পূর্ব বাংলার জনগণকে বাঁচান। প্রকাশ্য বা গােপনে আপনারা নিজ নিজ এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন এবং নিম্নলিখিত দায়িত্ব পালন করুন।
– কমিটির নেতৃত্বে সকল দেশপ্রেমিক জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করুন।
– খাদ্যদ্রব্যসহ সকল জিনিসের ভারতে পাচার বন্ধ করুন। পাচার হচ্ছে এরূপ দ্রব্য দখল করে জনগণের মাঝে বিনামূল্যে বিলিয়ে দিন।
পৃষ্ঠা: ৬২৮

– মজুতদারী, কালােবাজারী, চোরাকারবারী, মুনাফাখােরদের খাদ্যসহ নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য দখল করে জনগণের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করুন। এদেরকে শাস্তি বিধান করুন।
– সরকারী গুদাম, খাদ্য দখল করে বিনামূল্যে ক্ষুধার্তদের মাঝে বিতরণ করুন।
– স্বচ্ছল অবস্থাসম্পন্নদের থেকে চাদা, সাহায্য সংগ্রহ করে ক্ষুধার্তদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করুন।
– টাউট আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক, আত্মসাৎকারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনগণের মাঝে বিতরণ করুন, ঘৃণ্যদের চরম শাস্তি দিন।
– ভুখা মিছিল, প্রতিবাদ সভা, ঘেরাও, ধর্মঘট, হরতাল, অভ্যুত্থান, সশস্ত্র সংগ্রাম জোরদার করুন।
– সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করুন।

১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ঢাকাসহ পূর্ব বাংলা দখল এবং পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ কায়েমের প্রতিবাদে ১৫ ও ১৬ই ডিসেম্বর হরতাল পালন করুন!
– অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, যানবাহন, হাট-বাজার ইত্যাদি অর্ধদিবস বন্ধ রাখুন।
– মিটিং, মিছিল, হরতাল, ঘেরাও, বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, এবং সশস্ত্র সংগ্রামের। সমন্বয়ের মাধ্যমে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক, দেশপ্রেমিকদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করুন।

জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিম্নলিখিত কর্মসূচী বাস্তবায়িত করুনঃ
১। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের উৎখাত করা, তাদের কালাে টাকা ও সম্পত্তি জাতীয়করণ করা, তাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা। তাদের মধ্যকার ঘৃণ্য খুনীদের চরম শাস্তি প্রদান করা।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের দ্বারা বন্দী সকল দেশপ্রেমিকদের মুক্তি প্রদান, তাদের দেশ সেবার সুযােগ প্রদান।
কালােবাজারী, মজুতদারী, মহাজনী, চোরাকারবারী, মুনাফাখখারদের কঠোর হস্তে দমন করা। এদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। মারাত্মক অপরাধীদের চরম শাস্তি প্রদান করা।
সীমান্ত সীল করা, ভারতে পাচার কঠোর হস্তে দমন করা। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সাথে স্বাক্ষরিত জাতীয় স্বার্থ বিরােধী সকল প্রকার প্রকাশ্য, গােপন চুক্তি বাতিল করা। বিভিন্ন যৌথ কমিটি বাতিল করা।
সােভিয়েট-মার্কিনের সাথে স্বাক্ষরিত সকল অসম জাতীয় স্বার্থবিরােধী চুক্তি বাতিল করা। বেরুবাড়ীসহ ভারতকে প্রদত্ত পূর্ব বাংলার সমগ্র ভূখণ্ড ফেরত আনা, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব কঠোরভাবে বজায় রাখা।
২। বাক-স্বাধীনতা, ভােট প্রদানের স্বাধীনতা, সমাবেশ ও রাজনৈতিক কাজের স্বাধীনতা, মিটিং-মিছিলের স্বাধীনতা, পত্রিকা ও প্রকাশনার স্বাধীনতা প্রদান করা।
সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে একটি জাতীয় পরিষদ নির্বাচন করা। এ জাতীয় পরিষদ সংবিধান প্রণয়ন করবে।
পৃষ্ঠা: ৬২৯

সরকার এ জাতীয় পরিষদের নিকট দায়ী থাকবে।
৩। দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ, অনাহারে মৃত্যু ঠেকানাের জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ।
৪। ভূমি সংস্কার করা, নির্দিষ্ট সীমার অতিরিক্ত জমি বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে বিতরণ করা, জাতীয় বিশ্বাসঘাতকদের ভূমি বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে বিতরণ।
ব্যাপক জনগণকে সমাবেশিত করে বন্যা ও খরা সমস্যার সমাধান করা।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ফারাক্কা সমস্যার সমাধান করতে বাধ্য করা।
প্রতি ইঞ্চি অনাবাদী জমিতে আবাদের ব্যবস্থা করা, খাদ্যদ্রব্যের অপচয়, মজুতদারী, চোরাকারবারী বন্ধ করা।
কৃষি ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করা। এভাবে খাদ্য সমস্যার সমাধান করা।
৫। শিল্প কারখানায় আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের ও দালালদের কার্যকলাপ বেআইনী ঘােষণা করা ও কঠোরভাবে বন্ধ করা।
– পূর্ব বাংলার শিল্প-কারখানা পরিচালনার জন্য শ্রমিক, কারিগরি ও প্রশাসকদের সমন্বয়ে সুষ্ঠু পরিচালনা নিশ্চিত করা। অপচয়, শিল্প-কারখানার সম্পদ আত্মসাৎ, চোরাকারবারী, কাজে ফাঁকি ইত্যাদি বন্ধ করা।
ব্যাপক শিল্পায়ন করা। কুটীর শিল্প ও হস্তশিল্প এবং ক্ষুদ্র শিল্পকে রক্ষা করা ও সহায়তা করা। দেশপ্রেমিক শিল্পপতিদের রক্ষা করা।
এভাবে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের দিক দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হওয়া। পর্যায়ক্রমে মূল্য কমিয়ে আনা।
৬। আমদানী-রফতানী বাণিজ্য জাতীয়করণ করা। ইহা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করা। আমদানী-রফতানীর ক্ষেত্রে দেশীয় প্রয়ােজনকে প্রাধান্য দেওয়া। আমদানী-রফতানী ও বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থা চালু করা। বিদেশী মুদ্রা পাচারকারী, চোরাকারবারী, কালােবাজারী ও দুর্নীতিবাজদের কঠোর হস্তে দমন করা।
৭। কালাে টাকা ও সম্পদ রাষ্ট্রীয়করণ, বিদেশী শােষণ ও লুণ্ঠনের অবসান, চোরাকারবারী, পাচার, মহাজনী-মজুতদারীসহ সকল প্রকার সামাজিক দুর্নীতির অবসান, কৃষি ও শিল্পের ব্যাপক উৎপাদন বৃদ্ধি ও আধুনিকীকরণ, পণ্যদ্রব্যের সুষ্ঠু বাজারজাত করা, বেকারত্বের অবসান, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক আহরণ, দেশীয় দ্রব্যের ব্যবহার, বৈদেশিক আমদানী কঠোরভাবে হ্রাস করা, বৈদেশিক রপ্তানী বৃদ্ধি ইত্যাদির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি দ্রুত হ্রাস করা। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে তােলা।
৮। মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য সত্যিকারের জনগণের স্বার্থের সেবক হিসেবে বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীকে পুনর্গঠন করা। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, রক্ষীবাহিনী এবং অন্যান্য প্রাইভেট প্রকাশ্য ও গুপ্ত বাহিনী, গণবিরােধী বাহিনীসমূহকে বেআইনী করা। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের অস্ত্রধারী দলসমূহের ডাকাতি এবং অন্যান্য নির্যাতন বন্ধ করা।
এ ধরনের বাহিনীর ঘৃণ্যদের চরম শাস্তি দেওয়া। সেনাবাহিনী কৃষি, শিল্প, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকবে,
পৃষ্ঠা: ৬৩০

উৎপাদনে অংশগ্রহণ করবে।
তারা আঞ্চলিক অখণ্ডতা, জাতীয় সার্বভৌমত্ব কঠোরভাবে রক্ষা করবে। সীমান্ত বন্ধ রাখবে, রাষ্ট্রবিরােধীদের দমন করবে।
সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করার জন্য রাজনৈতিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা, অগণতান্ত্রিক নিয়মকানুন বাতিল করা। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করবে।
৯। শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের নেতৃত্ব বাতিল করা। সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি এবং জাতীয় স্বার্থ বিরােধী ও অশ্লীল সংস্কৃতি বে-আইনী করা।
জাতীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও শিক্ষার পদ্ধতি গড়ে তােলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন সাধন করা।
১০। শ্রমিক-মজুর ও বেসামরিক কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের চাহিদা পূরণ করা।
১১। নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা, মাতা ও সন্তানদের রক্ষা করা।
১২। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের হাতে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা, তাদের পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করা, আহতদের চিকিৎসা, শারীরিক অক্ষমদের পুনর্বাসন করা।
১৩। সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের রিলিফ প্রদান।
১৪। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের প্রশাসনের সাথে যুক্ত সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মচারীদের দেশ সেবার সুযােগ প্রদান করা, যুদ্ধবন্দীদের প্রতি সদয় আচরণ করা।
১৫। প্রবাসী বাঙালীদের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ করা।
১৬। পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বিদেশী নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণ।
১৭। পূর্ব বাংলার জাতিগত সংখ্যালঘুদের পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রীয় সীমার মাঝে স্বায়ত্তশাসন প্রদান, তাদেরকে দ্রুত উন্নতির ব্যবস্থা করা, বাঙালী শােষকদের অত্যাচার বন্ধ করা।
ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। ধর্মীয়, ভাষাগত সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করা।
ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগত বিভেদ সৃষ্টিকারী, নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা।
১৮। শান্তি ও নিরপেক্ষতার বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, প্যালেস্টাইনসহ বিশ্বের নিপীড়িত দেশ ও জাতিসমূহের মুক্তি সংগ্রাম সমর্থন করা।
বাঙালী জাতি ও জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। তাই সকল দেশপ্রেমিক জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে- বাঙালী জাতি ও জনগণকে বাঁচানাে।
আসুন, আমরা আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও শান্তি আনয়ন করি, ক্ষুধার অবসান করি, চাকুরী, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা বিধান করি, পূর্ব বাংলার জনগণকে বাঁচাই।
দলমত নির্বিশেষে প্রকাশ্যে ও গােপনে কর্মরত সকল দেশপ্রেমিক বিরােধী রাজনৈতিক দল, গ্রুপ, গােষ্ঠী ও ব্যক্তির নিকট আমরা আবেদন জানাচ্ছি। আপনারা পূর্ব
পৃষ্ঠা: ৬৩১

বাংলার জনগণের এ চরমতম সংকটজনক মুহূর্তে আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হােন, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলার জনগণের বাঁচানাের কাজে শরীক হােন!
* আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উৎখাত করুন। * বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে উৎখাত করুন। জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করুন। * খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা, চাকুরী, বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন, শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র কায়েম করুন। * বাঙালী জাতি ও জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন – তাদেরকে বাঁচান। * সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন, দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করুন, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের উৎখাত করুন। * বেরুবাড়ী ফিরিয়ে আনুন, ফারাক্কা সমস্যা সমাধানে ভারতকে বাধ্য করুন। * মজুতদারী, চোরাকারবারী, কালােবাজারী, মহাজন, মুনাফাখখার, লাইসেন্স-পারমিটধারী, কালাে টাকার মালিক আওয়ামী দুস্কৃতিকারীদের উৎখাত করুন।
১৫ ও ১৬ই ডিসেম্বর কালাে দিনে অর্ধদিবস হরতাল পালন করুন! ) অফিস-আদালত, কল-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, হাট-বাজার
ইত্যাদি উভয় দিন অর্ধদিবস বন্ধ রাখুন!
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুজিফ্রন্ট-জিন্দাবাদ।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ।
পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী-জিন্দাবাদ!
সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ!
পৃষ্ঠা: ৬৩২

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির এয়ােদশ ইশতেহার
(ডিসেম্বর, ১৯৭৪)

১. হরতাল সংক্রান্তঃ
বাঙালী জাতি ও পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। ১৬ই ডিসেম্বর কালাে দিবসে ভারতীয় বাহিনীর ঢাকা দখল এবং আওয়ামী পুতুল সরকার কায়েম এর জন্য দায়ী। আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উৎখাত করুন; দুর্ভিক্ষ-ক্ষুধার অবসান করুন; খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকুরী, বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন; শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র কায়েম করুন।
সিরাজ সিকদার, জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট, সর্বহারা পার্টি, সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনীর উপরােক্ত আহ্বানের ভিত্তিতে ১৫ ও ১৬ই ডিসেম্বর অর্ধদিবস হরতাল পালনের ডাক অত্যন্ত সময়ােপযােগী এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পন্ন হয়েছে।
এ হরতালের আহ্বান বাস্তবায়িত করার জন্য সমগ্র পূর্ব বাংলার ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক বিপুল উৎসাহের সাথে বিপদকে তুচ্ছ করে বিভিন্ন কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করেন।
এ হরতাল বাস্তবায়নের জন্য সমগ্র পূর্ব বাংলায় শত্রুর উপর সার্বিক হামলা ও সমন্বিত আঘাত হানা হয় এবং শত্রুকে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করা হয়।
বহু স্থানেই শক্রর যােগাযােগ ব্যবস্থা বিকল করা হয়; শত্রুর প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানাে হয়; শত্রুকে সর্বত্র হয়রানি করা হয়।
বহু জেলা, মহকুমা, থানা, শহর এবং হাট-বাজারে হরতাল পালিত হয়, পূর্ব বাংলায় প্রায় সমগ্র পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকে। হরতাল বাস্তবায়নের কার্যক্রমের এবং হরতালের সাফল্যে ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও জনগণ অত্যন্ত আনন্দিত ও উৎসাহিত হন, বিপ্লবী জোশে তারা ফেটে পড়েছেন।
হরতালের ফলে বিরাট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার লেজুড়সমূহ এবং তাদের প্রভুরা মারাত্মকভাবে ভীতসন্ত্রস্ত এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। তারা নিজেদের কবরস্থ হওয়ার বিভীষিকা দেখছে।
অল্প কিছুদিনের মাঝেই আমাদের ধ্বংস করা হবে। “সিরাজ সিকদারসহ সকলেই আমাদের হাতের মুঠায়”১- শত্রুর এ সকল আস্ফালন সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
শত্রু আমাদের কর্মীদের গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যা করে কর্মীদের মনােবল
…………………………………………………………………….
১. বক্তব্যটি কমরেড সিরাজ সিকদারের মূল লেখায় অনেকটা এভাবেই ছিল। তাঁর শহীদ হবার পর
তৎকালীন রাজনৈতিক প্রয়ােজনে সে সময়কার পার্টি-কেন্দ্র অ.স.স, এখানে কিছু সংশােধনী এনেছিল। এ সংকলনে মূল রচনার বক্তব্যের ধরনেই বাক্য দেয়া হলাে প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৬৩৩

ভাঙ্গার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে-তাও ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে।
বিশেষ করে শক্রর প্রচণ্ডতম চাপের স্থান ঢাকায় হরতাল সংক্রান্ত যে ব্যাপক তৎপরতা চালানাে সম্ভব হয়েছে তা প্রমাণ করছে আমাদের সংগঠনের ব্যাপক কর্মীরা খুবই সক্রিয়, উৎসাহী ও কর্মক্ষম।
১৫ ও ১৬ই ডিসেম্বর হরতাল আমাদের একটি বিরাট বিজয়।
এ হরতালের সফলতা জনগণের নিকট প্রমাণ করছে
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করা এবং জনগণের মুক্তি আনা একমাত্র সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বেই সম্ভব।
* হরতাল প্রমাণ করছে, সশস্ত্র ও গণসংগ্রামের সমন্বয়ের নীতি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পন্ন সিদ্ধান্ত। পার্টির নেতৃত্বে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, বিপ্লব ও পার্টির পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার (যা বিপ্লবের জন্য প্রথম প্রয়ােজন) ক্ষেত্রে গণসংগ্রাম অত্যন্ত উপযােগী।
পূর্ব বাংলার বাস্তব অবস্থার (ক্ষুদ্র দেশ, ঘন বসতি, ভাষাগত-সাংস্কৃতিক অভিন্নতা, অর্থনৈতিক সমবিকাশ ইত্যাদি) সাথে এ গণসংগ্রামের লাইন খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
* এ হরতালে আমাদের খুবই সামান্য ক্ষতি হয়েছে। এ থেকে দেখা যায় যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা পালন করলে প্রচণ্ড চাপের মুখেও ক্ষতি এড়ানাে সম্ভব।
* এ হরতালের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়নিম্নস্তরের অবমূল্যায়ন করা হয়।
সবকিছু একজনে করা, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির কারণে নিম্নস্তরের উদ্যোগ ব্যাহত হয়।
নিম্নস্তরের উদ্যোগকে জাগাতে হবে। উদ্যোগকে কাজে লাগাতে হবে। তাদেরকে গাইড-লাইনের ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সাহসিকতার সাথে তাদেরকে ব্যবহার করতে হবে।
এভাবে ব্যাপক কর্মীদের কাজে লাগানাে, পরীক্ষা-যাচাই এবং কর্মীর স্বল্পতা, কাজের স্বল্পতা এড়ানাে যায়।
* গােপনে থেকেও গণসংগ্রাম পরিচালনার সফলতা জাসদ, ভাসানী ন্যাপ, জাফরমেনন-হালিমদের পিপলস পার্টি ইত্যাদিদের অস্তিত্ব অপ্রয়ােজনীয় বলে প্রমাণ করেছে।
* এ হরতালের সফলতা হক-তােয়াহা, মতিনদের কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক এবং অন্যান্য বামপন্থীদেরকে আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
* এ হরতালের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে, শহর এলাকায় সাফল্যজনক হরতাল বা এ ধরনের গণসংগ্রামের জন্য শহরের প্রতি পাড়া, শিল্প, শিক্ষা, সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ, শহরের বাইরের অঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম, জেলার সংলগ্ন অন্য জেলায় সশস্ত্র কাজ প্রয়ােজন।
হরতালের কয়েকদিন পূর্ব থেকেই বিভিন্ন উপায়ে (সশস্ত্র মিছিল, পপাস্টার, লিফলেট, দেওয়াল লিখন ও অন্যান্য) ব্যাপক প্রচার ও সশস্ত্র তৎপরতা প্রয়ােজন। এমন কি হরতালের দিনও হরতাল বাস্তবায়নের জন্য সশস্ত্র তৎপরতা প্রয়ােজন।
* হরতালের বিরাট সাফল্যে মাথা বিগড়ালে চলবে না। শত্রুর প্রচণ্ড চাপের মুখে কঠোর সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। কর্মী, গেরিলা বিশেষ করে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের রক্ষা করতে হবে।
হরতালের ফলে সৃষ্ট জনসমর্থন ও জোয়ারকে ধরে রাখার জন্য ব্যাপক জনগণকে
পৃষ্ঠা: ৬৩৪

সংগঠিত করতে হবে। ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক সংগ্রহ করতে হবে।
সংগঠনের সাধারণ লক্ষ্যসমূহ দ্রুত বাস্তবায়িত করতে হবে।

২. হরতালের পরবর্তী লক্ষ্যঃ
ক) আন্তঃঅঞ্চল, আন্তঃউপঅঞ্চল, আন্তঃএলাকার নিয়ােগ-বদলী দ্রুত সম্পূর্ণ করা।
খ) যে সকল অঞ্চলে মানােন্নয়ন সংক্রান্ত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি, সে সকল অঞ্চল এ কাজকে অগ্রাধিকার দেবে এবং মানােন্নয়ন দ্রুত সম্পন্ন করবে।
শিক্ষা শিবির স্থাপন, ব্যাচে ব্যাচে কেডারদের মানােন্নয়ন করতে হবে। এ সময় কেডার ইতিহাস সংগ্রহ ও যাচাই করতে হবে এবং উচ্চস্তরে পাঠাতে হবে।
সদস্য/প্রার্থীসদস্য পদের জন্য যারা আবেদন করেছে তাদের তালিকা, যারা আবেদন করতে ইচ্ছুক তাদের আবেদনপত্র পাঠাতে হবে।
গ) শক্রর চাপে এলাকা বা অঞ্চলে বিপর্যয় সংঘটিত হয়- কেডার, গেরিলা, অস্ত্র, গুরুত্বপূর্ণ সহানুভূতিশীল হারানাে বা লস (loss) ঠেকাতে হবে তাদের প্রত্যাহারের মাধ্যমে।
প্রধানতঃ কেডার হারানােই অন্যতম বিপর্যয়। এদের মাধ্যমেই নিম্নস্তর, গেরিলা, কর্মী, সহানুভূতিশীল ও সমর্থক এবং জনগণের সাথে সংযােগ বজায় থাকে- পার্টির লাইন বাস্তবায়িত হয়।
এদের হারানাের সংখ্যা এ কারণেই বেশী।
এ কারণে এদেরকে গােপনীয়তা, নিরাপত্তা, সতর্কতা এবং কর্মপদ্ধতির উপর ভাল ট্রেনিং দিতে হবে যাতে লস কম হয়।
উপরন্তু ব্যাপক সংখ্যায় এ ধরনের কেডার-এলাকা পরিচালক-গেরিলা পরিচালক গড়ে তােলা উচিত।
এজন্য শুধু এ ধরনের কেডার তৈরীর জন্য বিশেষ মানােন্নয়ন ও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা। এবং প্রতি অঞ্চলে রিজার্ভ গড়ে তােলা এবং মাঝারী, অনুন্নত অঞ্চলে প্রেরণ করতে হবে।
পার্টি ও সেনাবাহিনীতে এ ধরনের রিক্রুটমেন্ট হচ্ছে সেনাবাহিনীর অফিসার’ রিক্রুটমেন্টের অনুরূপ।
একটি সেনাবাহিনীতে ভাল অফিসার প্রয়ােজন উত্তম পরিচালনার জন্য। বর্তমানে আমাদের ব্যাপক কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও সমর্থক রয়েছে। তাদের নেতৃত্ব প্রদান ও পরিচালনার জন্য কেডার’ অর্থাৎ অফিসার র্যাঙ্কে ব্যাপক কর্মী সংগ্রহ, ট্রেনিংবাছাই-নিয়ােগ প্রয়ােজন।
এ কারণে সরাসরি এলাকা পরিচালক, উপ-এলাকা পরিচালক, গেরিলা পরিচালকের জন্য কেডার ইতিহাসসহ আবেদনপত্র আহ্বান করতে হবে (সার্বক্ষণিকঅসার্বক্ষণিক নির্বিশেষে)।
কেডার ইতিহাস যাচাই-এর ভিত্তিতে আবেদনকারীদের আবেদন মঞ্জুর করে ট্রেনিং ও মানােন্নয়ন করতে হবে।

ট্রেনিং-মাননান্নয়ন নিম্ন বিষয়ে হবেঃ
একজন এলাকা, উপ-এলাকা এবং গেরিলা পরিচালকের কাজ, সংগঠনের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক, মতাদর্শগত বিষয়।
পাঠ্যসূচী এবং সংগঠন প্রকাশিত সামরিক, সাংগঠনিক, চক্র বিরােধী দলিল, ইশতেহার এবং অন্যান্য দলিল ও মার্কসবাদী পুস্তকের ভিত্তিতে মানােন্নয়ন করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬৩৫

মানােন্নয়ন ও ট্রেনিং-এর ভিত্তিতে কেডারদের কাজে লাগাতে হবে এবং তাদের যাচাই করতে হবে।
এভাবে কর্মীস্বল্পতা দূর করতে হবে।
ঘ) আমাদের অঞ্চলসমূহকে অগ্রসর, মাঝারী ও পশ্চাদপদ এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
পশ্চাদপদের দায়িত্ব হচ্ছে মাঝারী বা অগ্রসরদের সমকক্ষতা অর্জন করা। মাঝারীদের দায়িত্ব হচ্ছে অগ্রসরদের ধরা বা তাদের ছাড়িয়ে যাওয়া।
অগ্রসরদের দায়িত্ব হচ্ছে আরও অগ্রসর হওয়া।
অগ্রসরদের দায়িত্ব হচ্ছেঃ
অঞ্চল, এলাকা, অন্য অঞ্চলের মধ্যকার ফাকসমূহ দূর করা, গ্রামভিত্তিক কাজ বিকাশ করা, ব্যাপক গ্রাম জাতীয় শত্রু মুক্ত করা, গ্রাম পরিচালনা কমিটি গঠন করা, গ্রামভিত্তিক চাঁদা সংগ্রহ করা, টাউট-জাতীয় শত্রুদের আত্মসমর্পণ করানাে, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বজায় রাখা এবং উচ্চস্তরকে অধিকতর সাহায্য করা ও প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিভিন্ন উপদলবাদীদের সমস্যার সমাধান করা, অন্তর্ঘাতক ও অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করা, অস্ত্রাদি রক্ষা ও ঠিকঠাক রাখা, প্রতি উপঅঞ্চল, এলাকা, উপ-এলাকাকে জাতীয় শত্রু খতমে স্বাবলম্বী করে তােলা, শিক্ষা শিবির চালু করা, এলাকা, উপ-এলাকা, গেরিলা পরিচালকদের রিজার্ভ গড়ে তােলা এবং অনুন্নত ও মাঝারী অঞ্চলে প্রেরণ; মানােন্নয়ন ও ট্রেনিং সম্পন্ন করা; আঞ্চলিক ও স্থানীয় নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলা; গণসংগ্রাম চালানাে; সশস্ত্র ও নিরস্ত্র প্রচার টিম এবং অন্যান্য প্রচার তৎপরতা জোরদার করা, আঞ্চলিক নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করা।

মাঝারী অঞ্চলসমূহ নিম্নলিখিত কাজ করবেঃ
জাতীয় শত্রু খতম করা, সশস্ত্র প্রচার টিম ও অন্যান্য উপায়ে ব্যাপক প্রচার। চালানাে, টাউট ও জাতীয় শত্রুর আত্মসমর্পণ, গ্রাম ভিত্তিক চাঁদা সংগ্রহ, কর্মীসহানুভূতিশীলদের চাঁদা নিয়মিতকরণ, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন, শিক্ষা শিবির পরিচালনার মাধ্যমে মানােন্নয়ন করা, একাধিক বিশেষ এলাকা আঁকড়ে ধরে কাজকে দ্রুত উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, গ্যাপসমূহ পূরণ, কাজের সফলতা আনা, বিপর্যয় এড়ানাে, উন্নত অঞ্চলের সমকক্ষতা অর্জন বা তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া।
পশ্চাদপদ অঞ্চলে সকল সংযােগ স্থাপন ও উদ্ধার, সক্রিয় কর্মীদের মানােন্নয়ন, এভাবে সার্বক্ষণিক বাড়ানাে; অন্য অঞ্চল থেকে কর্মী এনে নিয়ােগ; ব্যাপক পােস্টার, লিফলেট, দেওয়াল লিখন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করা। শেলটার গড়ে তােলা, একটা বিশেষ এলাকা গড়ে তােলা, সশস্ত্র প্রচার, জাতীয় শত্রু খতমের পদক্ষেপ নেওয়া, এভাবে ক্রমাগত বিশেষ এলাকা গঠন ও কাজ বিকাশ করা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন, বিপর্যয় এড়ানাে, মাঝারী অঞ্চলের মান অর্জনের চেষ্টা করবে।
ঙ) একটি অঞ্চলে এক বা একাধিক বিশেষ এলাকা আঁকড়ে ধরে দ্রুত কাজের বিকাশ ঘটাতে হবে।
ভাল কাজ, শেলটার আছে, কর্মী জিনিস একত্র করা সম্ভব, বিস্তৃতি রয়েছে এরূপ এলাকাকে বিশেষ এলাকা হিসেবে আঁকড়ে ধরা যায়।
বিশেষ এলাকায় কর্মী, গেরিলা সমাবেশ করা, বিশেষ এলাকাকে কেন্দ্র করে
পৃষ্ঠা: ৫৩৬

পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ব্যাপক লাইন দেওয়া, সশস্ত্র প্রচার চালানাে, জাতীয় শত্রু খতম করা, জাতীয় শত্ৰু-টাউট আত্মসমর্পণ করানাে ইত্যাদি তৎপরতা চালানাে।
এভাবে কাজের বিকাশ করা। এ বিকাশ হওয়া উচিত কাজের গ্যাপ পূরণের লক্ষ্য সামনে রেখে।
আক্রমণের স্থল, আশ্রয়স্থল ইত্যাদি বিবেচনা করে কাজ করা উচিত যাতে নিরাপত্তা বজায় থাকে।
এ বিশেষ এলাকা সংক্রান্ত কাজের মাধ্যমে কর্মীদের বাস্তব ট্রেনিং-এর জন্য অন্য এলাকা, উপ-অঞ্চল থেকে কর্মী সমাবেশ করা।
বাস্তব ট্রেনিং-এর সাথে মানােন্নয়ন চালানাে। এভাবে বিশেষ এলাকা গঠন করে কাজের সফলতা আনয়ন ও বিকাশ সাধন করা।
চ) প্রতি অঞ্চলে আঞ্চলিক পরিচালককে সম্পাদক করে তিন বা পাঁচ বা ততােধিক বেজোড় সংখ্যক সদস্য নিয়ে একটি আঞ্চলিক নেতৃত্ব গ্রুপ গড়ে তােলা।
যেখানে বাস্তব অবস্থা বিরাজ করে এবং পরীক্ষিত কর্মী রয়েছে সেখানেই ইহা প্রযােজ্য। উপ-অঞ্চল, এলাকা, সম্ভব হলে উপ-এলাকা ভিত্তিক নেতৃত্ব গ্রুপ গড়ে তােলা।
নেতৃস্থানীয় কর্মীদের বৈঠকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এ নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করা। ইহা উচ্চস্তরের অনুমােদনের জন্য পেশ করা।
এ নেতৃত্ব গ্রুপ গঠন করার পর প্রতি স্তর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব গ্রুপের বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। নেতৃত্ব গ্রুপের বৈঠকের বাইরে সম্পাদক প্রদত্ত সিদ্ধান্ত নেতৃত্ব গ্রুপের বৈঠকে অনুমােদন করিয়ে নিতে পারে।
এ সকল সিদ্ধান্ত উচ্চস্তরে রিপাের্ট করতে হবে।
ছ) একটি এলাকার কাজের সূচনা, বিকাশ, শত্রুর চাপ, বিপর্যয়, কাজ পুনরুদ্ধার, বিকাশ, পুনরায় শত্রুর চাপ, বিপর্যয়-কাজ পুনরুদ্ধার, বিকাশ এই সাইকেলে এগিয়ে চলে।
কাজেই শত্রুর চাপ-বিপর্যয় বিপ্লবে স্বাভাবিক, আবার কাজ পুনরুদ্ধার-বিকাশও স্বাভাবিক। এভাবেই শেষ পর্যন্ত শত্রুকে পরাজিত ও ধ্বংস করা সম্ভব।
এছাড়া দেখা যায় কোন অঞ্চলে বিকাশ আবার অন্য অঞ্চলে বিপর্যয়, অঞ্চলের মাঝে কোন এলাকায় বিকাশ আবার কোন এলাকায় বিপর্যয় এভাবে কাজ অগ্রসর হয়।
বিপ্লবের এই আঁকাবাঁকা, উত্থান-পতন, বিপর্যয়-বিকাশ অর্থাৎ আমাদের মত দেশে বিপ্লবের এই অসম বিকাশের (uneven development) নিয়ম অনুযায়ী আমাদের চিন্তা ও কর্মকে পরিচালিত করতে হবে।

৩. শক্রর শীতকালীন রণনৈতিক আক্রমণ প্রসঙ্গেঃ
শত্রু শীতকালীন রণনৈতিক আক্রমণ শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই শত্রু তার চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী কম্বিং এবং শ্বেতসন্ত্রাস শুরু করেছে। মুন্সিগঞ্জে শত্রু আমাদের কর্মী, সহানুভূতিশীলদের নির্মমভাবে হত্যা করে গ্রামের রাস্তায় ফেলে রেখেছে। তারা শত শত জনগণকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করছে।
অন্যান্য অঞ্চলেও তারা একই তৎপরতা চালাচ্ছে বা চালাবার চেষ্টা করছে। শত্রুর শীতকালীন হামলার মুখে রণনৈতিক আত্মরক্ষার লাইন গ্রহণ করতে হবে।
* অস্ত্র-কর্মী-গেরিলা রক্ষা করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬৩৭

* আভ্যন্তরীণ অন্তর্ঘাতক, অনুপ্রবেশকারী শত্ৰুচর, সুবিধাবাদী, দোদুল্যমানদের বিচ্ছিন্ন করতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
* ব্যাপক মানােন্নয়ন ও ট্রেনিং সম্পন্ন করতে হবে।
* কাজের বিস্তৃতি বাড়াতে হবে। গ্যাপসমূহ পূরণ করতে হবে।
* বিশেষ এলাকা, আক্রমণ এলাকা, পশ্চাদপদ এলাকা নির্ধারণ করে কাজকে দ্রুত এগিয়ে নিতে হবে।
* ব্যাপক প্রচার জোরদার করতে হবে।
* গণসংগ্রাম জোরদার করতে হবে।
* শক্রর ছােট ছােট ইউনিটকে এ্যামবুশ করতে হবে। বিচ্ছিন্ন থানা, ফাঁড়ি দখল করতে হবে। শত্রুর দৃষ্টি সরানাের জন্য হামলা চালাতে হবে।
* জনগণের নিকটস্থ আগ্নেয়াস্ত্র জমা নিতে হবে।
* শহর এলাকায়, যােগাযােগ পথে, শক্রর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে, অর্থনৈতিক ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাতে হবে। এ সকল স্থানে শত্রুকে আটকে ফেলতে হবে।
* শক্রর চাপ মাঝারী ও পশ্চাদপদ অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে শক্রশক্তিকে বিভক্ত করতে হবে।
* শক্রর শীতকালীন আক্রমণকে ব্যর্থ করে দিতে হবে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি যাতে সর্বনিম্ন হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্যসমূহ অর্জনে দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে।

৪.
সর্বহারা শ্রেনীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টির উপস্থিতি শত্রু-শিবিরে এবং সংশােধনবাদী, নয়া-সংশােধনবাদী, সুবিধাবাদীদের মাঝে সংঘাত, ভাঙ্গন, পুনর্গঠন, পুনরায় ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের পতন ডেকে আনে।
সম্প্রতি মনি-মােজাফফর সংশােধনবাদীদের মাঝে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। মতিনআলাউদ্দিনরা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। হক-তােয়াহাদের মাঝেও অন্তদ্বন্দ্ব চলছে।
আওয়ামী লীগের মাঝে এবং আওয়ামী লীগের সাথে তার অঙ্গদলের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়েছে।
কাজী জাফর-মেনন তাদের অপকর্মের জন্য ন্যাপ থেকে বহিস্কৃত হয়েছে।
হক-তােয়াহা, মতিন যারা একে অপরকে সংশােধনবাদী প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে গালাগালি করেছে, একে অপরকে বহিষ্কার করেছে, তারা নিজেদেরকে রক্ষার জন্য পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে।
কাজী-মেনন-মােজাফফর ন্যাপের হালিম মিলে জ্যোতি বসু মার্কা দল তৈরী করছে।
এইভাবে সর্বহারা পার্টির উপস্থিতি বিভিন্ন ভাঙ্গন-পুনর্গঠন-ভাঙ্গন-পতনের প্রক্রিয়াকে তুরান্বিত করছে।

৫.
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকরা আমাদের উপর সর্বাত্মক চাপ দিচ্ছে। তারা আমাদেরকে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। আমাদেরকে দাবিয়ে রাখতে
৬৩৮

পারলে তারা নির্বিবাদে বহু বছর শােষণ লুণ্ঠন চালাতে পারবে বলে চিন্তা করে।
প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল জাসদ হচ্ছে ভারত-মার্কিনের দালাল এবং আওয়ামী লীগের সাথে গােপন আঁতাতযুক্ত, বিপ্লবীদের বিপথগামী, নিষ্ক্রিয় ও নির্মূল করার ফাঁদ। কাজেই আওয়ামী লীগ জাসদ থেকে নিরাপদ।
ভাসানী ন্যাপ-আতাউর রহমান দ্বারা আওয়ামী লীগ উৎখাত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কাজী জাফর-মেনন-ক্যাপ্টেন হালিম ভারতের জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের সাথে লাইন রেখে চলছে। কাজেই এদের দ্বারা আওয়ামী লীগের ভয় নেই।
হক-তােয়াহা, মতিনদের সংশােধনবাদী নেতৃত্ব প্রতিনিয়ত ভুল লাইন অনুসরণ করার ফলে অন্তঃদ্বন্দ্বে জর্জরিত। বারংবার বিভক্ত এবং জনগণের আস্থাহীন। এদের থেকে আওয়ামী লীগের ভয় নেই।
কাজেই আওয়ামী লীগের সত্যিকার প্রতিদ্বন্দ্বী আমরা ব্যতীত আর কেউ নেই। এ কারণে আওয়ামী লীগ তার সকল চাপ আমাদের উপর কেন্দ্রীভূত করেছে।
এ কারণে আমাদের সতর্কতা বাড়াতে হবে। শত্রুর চাপের মুখেও টিকে থাকতে ও বিকাশ লাভ করতে হবে এবং আসন্ন ঝড়ের নেতৃত্ব দিতে হবে।
অসতর্ক, শত্রুদের এড়াতে সক্ষম নয়, পুরােনাে পরিস্থিতির উপযােগী, পুরােনাে কর্মপদ্ধতি একগুঁয়েভাবে অনুসরণ করে এ ধরনের কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ বিপজ্জনক এলাকা থেকে সরিয়ে দিতে হবে বা বসিয়ে রাখতে হবে।

৬.
হক-তােয়াহা-মতিনদের উপদলীয় অস্তিত্ব পূর্ব বাংলার বিপ্লবী প্রয়ােজনের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের অস্তিত্ব সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে বিভক্ত করে, তাদের অনুসৃত ভুল লাইন আন্তরিকভাবে বিপ্লবী কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও জনগণকে বিপথগামী-প্রতারিত করে। তাদের আত্মত্যাগকে অর্থহীন করে। এ সকল উপদলের ছত্রছায়ায় শত্ৰুচর, টাউট, ডাকাত, সুবিধাবাদীরা জনগণের উপর নির্যাতন করে, সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে এক হাজার একটা কুৎসা রটনা করে, কর্মীদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক পদক্ষেপ নেয়।
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক, মনি-মােজাফফর, পাহাড়ী সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীসহ দেশী-বিদেশী সকল প্রতিক্রিয়াশীলরা এ সকল উপদলের অস্তিত্বের উল্লেখ করে জনগণ বিপ্লবীদের হতাশ করা এবং নিজেদের টিকে থাকার যৌক্তিকতা দেখায়।
এ সকল উপদলের সাথে যুক্ত আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এ সকল উপদলের ছত্রছায়ায় কর্মরত ডাকাত, টাউট, শত্ৰুচর এবং পরিকল্পিতভাবে অসৎ উদ্দেশ্যে সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে অপপ্রচার-কুৎসা রটনাকারী এরূপ সক্রিয় প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখােশ উন্মােচন, তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
সর্বহারা বিপ্লবীদের সাথে ঐক্যে অনিচছুকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, তাদের বিচ্ছিন্ন করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৬৩৯

৭.
সম্প্রতি জাসদ, কাজী জাফর-মেনন ইত্যাদিরা বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য সর্বদলীয় সরকার কায়েমের কথা বলছে।
তাদের এ প্রস্তাব জনগণের কোন উপকারে আসবে না, ইহা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রস্তাব। পূর্ব বাংলার জনগণের এ চরমতম সংকটজনক অবস্থার জন্য দায়ী ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের নিষ্ঠুরতম শােষণ ও লুণ্ঠন। কাজেই জনগণকে এ সংকট থেকে উদ্ধারের উপায় হলাে
আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, একই সাথে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করা, পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক এবং দেশপ্রেমিক নাগরিকদের জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করা।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার হবে গণতান্ত্রিক একনায়কত্বমূলক – জনগণের জন্য গণতন্ত্র এবং শত্রুদের উপর একনায়কত্ব।
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের কর্মসূচী, ১৫ ও ১৬ই ডিসেম্বর হরতাল পালনের আহ্বানে প্রদত্ত কর্মসূচীতে এ সংকট থেকে উদ্ধারের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী প্রদান করা হয়েছে।
উপরােক্ত কর্মসূচী বাস্তবায়ন এবং এভাবে জনগণকে সংকট থেকে উদ্ধার ও বাঁচানাে সম্ভব হবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাত করে।
কাজেই জাসদ, কাজী জাফর এবং অন্যান্যদের বক্তব্য সর্বদলীয় সরকার (মনি, মােজাফফর, আওয়ামী লীগ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ ভারতীয় দালাল সহ) কায়েমের প্রস্তাব প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় শােষণ ও লুণ্ঠন বজায় রাখা, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক, মনিমােজাফ্ফরদের সাথে মিলে শােষণ-লুণ্ঠনের বস্তা নেওয়া, হালুয়া-রুটির ভাগ পাওয়া।

পরিশিষ্ট-১
মনি-মােজাফফর ভাঙ্গন প্রসঙ্গে
মনি সিং-মােজাফফরদের নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যকার সাম্প্রতিক ভাঙ্গন সংশােধনবাদী রাজনীতির চরমতম দেউলিয়াত্বের পরিণতি।
মনি সিং-মােজাফফর মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাথে পুরােপুরি বিশ্বাসঘাতকতা করে। ছােট-বড় নির্বিশেষে দেশীয়-আন্তর্জাতিক প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ দালালীর লাইন গ্রহণ করে এবং দেশ, জাতি ও জনগণের স্বাধীনতা, বিপ্লব, মুক্তি বিরােধী চরমতম প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করে।
তাদের এহেন বিশ্বাসঘাতক কার্যকলাপের ফলে ব্যাপক কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক তাদের পরিত্যাগ করে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
ক্যাপ্টেন হালিম এবং অন্যান্যদের বিদ্রোহ এরূপ একটি ঘটনা। ক্যাপ্টেন হালিমের
পৃষ্ঠা: ৬৪০

বক্তব্য ও কার্যকলাপ, শেষ পর্যন্ত কাজী জাফর-মেনন চক্রের সাথে যােগদান প্রমাণ করে তারা মতাদর্শের ভিত্তিতে রাজনৈতিকভাবে বিদ্রোহ করেনি, তারা এখনও অন্য আকৃতিতে মনি-মােজাফ্ফরদের বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি ও মতাদর্শ অনুসরণ করছে।
তাদের বিভক্তি হচ্ছে সাংগঠনিক বিভক্তি অর্থাৎ আলাদা হয়ে পৃথক সংগঠনে যােগদান, মতাদর্শগত-রাজনৈতিক বিভক্তি নয়।
ক্যাপ্টেন হালিম মনি-মােজাফ্ফরদের মত শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারী উপায়ে সরকারের উৎখাত চান। শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্লামেন্টারী নির্বাচনের মাধ্যমে কখনাে বুর্জোয়াদের উৎখাত করা যায় না, বরঞ্চ পার্লামেন্টারী নির্বাচনের কথা বলে জনগণকে পার্লামেন্টারী নির্বাচনের কানাগলি পথে আটকে রাখা হয়। এটা বুর্জোয়াদের জন্য সুবিধাজনক-এ কারণেই বুর্জোয়ারা এটা অনুমােদন করে।
এভাবে কাজী চক্রের সাথে গলা মিলিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের কথা বলে তিনি প্রমাণ করেছেন তিনি এখনও সংশােধনবাদী লাইন অনুসরণ করছেন।
তিনি আওয়ামী লীগকে বিরােধিতা করেন বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু কাজীচক্র প্রকাশ্যে (সম্প্রতি কাজীচক্র শেখ মনির সঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করে) এবং গােপনে আওয়ামী লীগের সাথে সংযুক্ত (বামপন্থীদের ও জনগণকে ধােকা দেওয়ার জন্য)। ভারতের কংগ্রেসের সাথে সি.পি.এম-এর যেরূপ প্রকাশ্য ও গােপন সম্পর্ক রয়েছে, কাজী-মেননদের আওয়ামী লীগের সাথে অনুরূপ সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই তাদের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি কীভাবে আওয়ামী বিরােধী হন? তিনি চীনের সমর্থক বলে উল্লেখ করেন, অথচ কাজীচক্র কট্টর চীনবিরােধী এবং প্রকাশ্যে চীনকে নিন্দা ও বিরােধিতা করেছে।
প্রকৃতপক্ষে কাজীচক্র হচ্ছে আওয়ামী লীগকে টিকিয়ে রাখার একটি প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান যার উদ্দেশ্য বামপন্থী ও জনগণকে প্রতারণা করা। ভারতে কংগ্রেস জ্যোতিবসু ও নাম্বুদ্রিপদের সি.পি.এম.-কে এভাবেই টিকিয়ে রেখেছে।
উপরােক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় কাজীচক্রের সাথে যােগদান করে ক্যাপ্টেন হালিম প্রমাণ করেন তিনি সংশােধনবাদী রাজনীতি ভিন্ন আকৃতিতে অনুসরণ করেছেন। আপাতঃদৃষ্টিতে তা ভারত, সােভিয়েট ও আওয়ামী বিরােধী হলেও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তা আওয়ামী লীগ, ভারত ও সােভিয়েট স্বার্থরক্ষাকারী।
এদের প্রতারণার ফানুস অদূর ভবিষ্যতেই ফেটে পড়বে এবং সাচ্চা কর্মী ও জনগণ তাদেরকে বস্তাপচা মাল হিসেবে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে।
সুবিধাবাদ ও সংশােধনবাদের ভিত্তিতে কাজী চক্রের সাতে হালিমদের সাংগঠনিক ঐক্য অদূর ভবিষ্যতে ভেঙ্গে পড়বে। পরস্পরের অন্তর্দ্বন্দ্বে তারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।’
মনি-মােজাফ্ফরদের এ ভাঙ্গন, কর্মীদের বিদ্রোহ তাদের মরণঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। অদূর ভবিষ্যতেই গুটিকতক দালাল ব্যতীত তাদের সাথে আর কেহ থাকবে না।

পরিশিষ্ট-২
প্রকাশ্য সংগঠনসমূহের ঐক্য-তৎপরতা বাঙালী জাতি ও পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। জনগণ অনতিবিলম্বে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের উৎখাত চান। এবং অন্ন, বস্ত্র, চাকুরী, বাসস্থান, শিক্ষা,
পৃষ্ঠা: ৬৪১

শান্তি, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র চান, তারা মানুষের মত বাঁচতে চান।
জনগণের এ চরমতম সংকটজনক সময়ে যার সামান্যতম সচেতনতা ও দেশপ্রেম রয়েছে তিনিই চাইবেন আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের উৎখাতের জন্য দল-মত নির্বিশেষে প্রকাশ্য ও গােপনে কর্মরত, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র সংগ্রামরত সকল দেশপ্রেমিকদের ঐক্য।
দেশপ্রেমিকদের এ ঐক্যের নিম্নতম ভিত্তি হচ্ছে আওয়ামী বিশ্বাসঘাতকদের ও তার প্রভুদের উৎখাত এবং জনগণের অন্ন, বস্ত্র, চাকুরী, বাসস্থানের ব্যবস্থা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, শান্তি কায়েমের মত মৌলিক বিষয় সম্বলিত ব্যাপক কর্মসূচী।
উপরন্তু ঐক্য হবে দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের মধ্যে যারা আন্তরিকভাবে উপরােক্ত কর্মসূচী কায়েমের জন্য কাজ করে যেতে ইচ্ছুক।
পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট, সর্বহারা পার্টি ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী উপরােক্ত নীতির ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের ঐক্যের জন্য বারংবার আহ্বান জানিয়ে এসেছে এবং কাজ করে যাচ্ছে। দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের উপরােক্ত ভিত্তিতে সকল প্রকার প্রচেষ্টা গ্রহণকে স্বাগত জানায়।
কিন্তু সম্প্রতি দেখা যায় জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্র কায়েম, অন্ন, বস্ত্র, চাকুরী, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদির সুনির্দিষ্ট ও ব্যাপক কর্মসূচী ব্যতিরেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপসমূহ তথাকথিত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রচেষ্টা, পুরনাে দল ভেঙ্গে দিয়ে নতুন দল গঠন ইত্যাদি তৎপরতা চালাচ্ছে।
এ ধরনের তৎপরতা দেশপ্রেমিক আর দেশদ্রোহী, প্রকাশ্য বা গােপন শত্ৰুচর, বিপ্লবী বা সুবিধাবাদী ইত্যাদির মধ্যে কোন পার্থক্য করা হচ্ছে না। এমন কি সশস্ত্র জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ পরিচালনা করছে এরূপ শক্তিসমূহকেও ঐক্য-প্রচেষ্টা থেকে দূরে রাখার। ষড়যন্ত্র চলছে।
তাদের প্রচেষ্টা দেখে মনে হয় তড়িঘড়ি একটা ঐক্য দাঁড়া করে জনগণকে ধোঁকা দেয়া এবং যেনতেন ঐক্য করেই ক্ষমতা দখল করা ও হালুয়া-রুটি লুট করে ভাগবাটোয়ারা করা।
এ সকল ঐক্য-উদ্যোক্তারা পূর্ব বাংলার বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে। তারা উপলব্ধি করছে না ১৯৬৯-এর পূর্বের অবস্থা যখন আট-নেতা নয়-নেতার বিবৃতি, ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদির মাধ্যমেই ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে।
বর্তমানে তথাকথিত নেতাদের প্রতি জনগণের আস্থা নেই, ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার মত ছাত্র সংগঠন নেই। ১৯৭১-এ গণআন্দোলন গড়ে তােলার মত সংগঠন আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ ও শ্রমিক লীগ ছিল। সে ধরনের সংগঠন বর্তমানে কারাে নেই। উপরন্তু আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা তাদের ফ্যাসিস্ট বাহিনী দ্বারা জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য সর্বদাই সচেষ্ট।
অন্যদিকে পূর্ব বাংলার ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে ও শহরে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি অন্যতম সংগঠিত শক্তি হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। কাজেই কোন গণআন্দোলন সর্বহারা পার্টি ব্যতিরেকে গড়ে তােলা সম্ভব হয়ে উঠবে না।
যে সকল শক্তি ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তাদের অনেকেই প্রকাশ্যে-গােপনে আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে যুক্ত। কাজেই এরা (যে) ঐক্য
পৃষ্ঠা: ৬৪২

গড়ে তুলবে তার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণ ও দেশপ্রেমিকদের ভাওতা দেয়া, আওয়ামী বিশ্বাসঘাতক ও তার প্রভুদের টিকিয়ে রাখা। উপরন্তু ভারতকে হটিয়ে দিয়ে মার্কিনকে বসাতে চায় এরূপ শক্তিও ঐক্যের প্রচেষ্টা করছে।
কাজেই সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের ঐক্য নয়, জনগণকে বিভ্রান্ত করার মত বিভিন্ন শক্তি যারা দেশীয়-আন্তর্জাতিক শােষকের সাথে যুক্ত তারা তথাকথিত ঐক্যের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
জাসদ ঐক্যের কথা বলে ঐক্যের প্রচেষ্টাকে বানচাল করার জন্য একলা চলার নীতি অনুসরণ করছে। অতীতেও সে একই ধরনের কাজ করেছে। এভাবে সে নিজেকে ঐক্যবিরােধী প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থরক্ষাকারী শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। . এ সকল প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য শত্ৰুচর এবং বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের তথাকথিত ঐক্য জনগণের কোন উপকারেই আসবে না। উপরন্তু এ ধরনের ঐক্য ব্যাপকতর ভাঙ্গনের জন্ম দেবে।
সশস্ত্র ও গণসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় এ সকল প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য শত্ৰুচর এবং স্বার্থান্বেষী মহলের প্রকৃত চরিত্র জনগণের সামনে প্রকাশিত হবে, সত্যিকার দেশপ্রেমিক ও জনগণ তাদেরকে বর্জন করবে এবং এভাবে সশস্ত্র গণসংগ্রামের প্রবল ঝড়-তরঙ্গের মধ্য দিয়ে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক শক্তিসমূহের প্রকৃত ঐক্য গড়ে উঠবে।
ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে এভাবেই দেশপ্রেমিকদের ঐক্য গড়ে উঠেছিল। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট, সর্বহারা পার্টি ও সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী এ ধরনের ঐক্য গড়ে তােলার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পরিশিষ্ট-৩
দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, সিকিম, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং বার্মাকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া গঠিত।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ, জনসংখ্যা ও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ইহা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্ব লাভ করেছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এই দুই বৃহৎ শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, একই সাথে এদেশসমূহে শােষন-লুণ্ঠন অব্যাহত রাখা, জনগণের বিপ্লবী ক্ষমতা দখল প্রতিহত করার জন্য সহযােগিতা করছে। দক্ষিণ এশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে ভারতের উপর নির্ভর করার (জন্য) দুই বৃহৎ শক্তি প্রথম থেকেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা দুই বৃহৎ শক্তির কাঁধে ভর করে নিজেকে বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজস্ব প্রভাবাধীন এলাকা তৈরী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহকে নিয়ন্ত্রণ ও তাদের উপর কর্তৃত্ব করা, তাদেরকে শােষণ-লুণ্ঠন করার চেষ্টা করে আসছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার
পৃষ্ঠা: ৬৪৩

অর্জনের সংগ্রামের সুযােগ গ্রহণ করে এবং সােভিয়েটের সহায়তায় পাকিস্তানকে বিভক্ত করে পূর্ব বাংলায় নিজস্ব উপনিবেশ কায়েম করে। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা নিজেকে বৃহৎ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহকে আণবিক ব্লাকমেইল করার জন্য আণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়।
সে উন্মত্তভাবে সিকিমকে গ্রাস করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলােকে চাপ প্রয়ােগ ও ভাওতা দিয়ে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে ভারতকে সহায়তা করার সােভিয়েট উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে সােভিয়েট কর্তৃত্ব কায়েম করা।
কিন্তু বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ভারতীয় অভিলাষের ফলে সােভিয়েটের দক্ষিণ এশিয়ায় কর্তৃত্ব স্থাপন ও প্রভাব বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়ে পড়েছে।
উপরন্তু ভারতীয় অর্থনীতির চরমতম সংকটজনক অবস্থা থেকে ভারতকে উদ্ধারে সহায়তা করার মত আর্থিক সংগতি সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেই।
এ অবস্থার সুযােগ নেয়ার জন্য এগিয়ে আসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ভারতকে বৃহৎ শক্তি হিসেবে স্বীকার করে প্রভাবাধীন এলাকাকে মেনে নিয়ে ভারতকে মার্কিনের প্রভাবে নিয়ে আসার জন্য মার্কিনীরা সচেষ্ট হয়।
মার্কিন খাদ্য, পুঁজিবাদী ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের আর্থিক সাহায্য দ্বারা ভারতকে সংকট থেকে উদ্ধার করার ভিত্তিতে ভারতকে মার্কিনের প্রভাবে নিয়ে আসার চেষ্টা চলে। মার্কিনের এ প্রচেষ্টায় ভারতের সম্মতি ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
মার্কিনের এ প্রচেষ্টার অপর লক্ষ্য হলাে দক্ষিণ এশিয়ার পুলিশম্যান হিসেবে ভারতকে ব্যবহার করা [বিরাট দেশ, বিপুল জনসংখ্যা ও সম্পদ], এশিয়ান দিয়ে এশিয়ান পিটানাে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিপ্লব ঠেকাতে মার্কিন সৈন্যের সরাসরি উপস্থিতি এর ফলে প্রযােজ্য হবে না।
এ কারণেই মার্কিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফর করে।
পূর্বেও আমাদের সংগঠন উল্লেখ করেছে মার্কিনীরা ভারত-বাংলাদেশ উভয়কেই, এটা না হলে শুধু বাংলাদেশকে প্রভাবাধীনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করছে।
বর্তমান মার্কিন নীতির ফলে ভারত-বাংলাদেশ উভয়কেই মার্কিন প্রভাবে নিয়ে আসার সম্ভাবনা জোরদার হচ্ছে।
এ কারণে ভারত-বাংলাদেশ মার্কিনপন্থীদের মন্ত্রীসভায় বিভিন্ন পদে বসায় ও রুশপন্থী বলে কিছু সংখ্যককে বিতাড়িত করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় ও পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব বজায় রাখার জন্য এবং সােভিয়েট নৌবহরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মার্কিনীরা দিয়াগাে গার্সিয়াতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে।
মার্কিন, ইউরােপ ও পশ্চিম এশিয়ার সহায়তায় নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে ভারতকে কাশ্মীর প্রশ্নে ও পূর্ব বাংলার প্রশ্নে এবং পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ প্রশ্নে পাকিস্তানের সাথে আপােস করতে হবে। অথবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এ সকল প্রশ্নে ভারতীয় কর্তৃত্ব মেনে নিলে (তাদের বৃহত্তর স্বার্থে) পাকিস্তান বাধ্য হবে সােভিয়েটের সাথে নতুন সম্পর্ক স্থাপনে বা চীনের সাথে ব্যাপকভাবে সম্পর্ক দৃঢ়তর করতে।
পৃষ্ঠা: ৬৪৪

ইতিমধ্যেই ভুট্টোর মস্কো সফর, কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতের প্রতি সােভিয়েটের শর্তহীন সমর্থন প্রত্যাহার ইত্যাদি সােভিয়েটের নূতন নীতি ও মিত্র খুঁজে বের করার চেষ্টার স্বাক্ষর।
দক্ষিণ এশিয়া নিয়ন্ত্রণে বৃহৎ শক্তির এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চললেও আমাদের প্রধান শত্রু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ- এ পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকছে।
উপরন্তু পূর্ব বাংলার জনগণের বিপ্লবী ক্ষমতা দখলের লড়াই প্রতিহত করার প্রশ্নে সােভিয়েট-মার্কিন প্রচেষ্টার সমন্বয় যা অতীতে ঘটেছে-বর্তমানেও ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুই বৃহৎ শক্তি সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং উপ বৃহৎ শক্তি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ দক্ষিণ এশিয়াকে শােষণ ও লুণ্ঠন, নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যত অপচেষ্টাই করুক না কেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ, জাতি ও জনগণ বিপ্লবের মাধ্যমে তা নস্যাৎ করে দেবে।

পরিশিষ্ট-৪
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বর্তমান বিশ্বকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এই দুই বৃহৎ শক্তি হচ্ছে প্রথম বিশ্ব।
পশ্চিম ইউরােপ, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্ব।
এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশসমূহ হচ্ছে তৃতীয় বিশ্ব। চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ইত্যাদি উন্নয়নশীল সমাজতান্ত্রিক দেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভূক্ত।
সােভিয়েট ইউনিয়নে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পূর্ব-ইউরােপ ও মঙ্গোলিয়ায় সােভিয়েট নিয়ন্ত্রণ থাকায় সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অস্তিত্ব নেই।
চীন, আলবেনিয়া, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, রুমানিয়া ইত্যাদি সমাজতান্ত্রিক দেশের অস্তিত্ব রয়েছে।
এই তিন বিশ্ব পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত ও দ্বন্দ্বপূর্ণ।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বকে নিজেদের মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং আবার সহযােগিতাও করছে।
তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দিকটাই প্রধান। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্ব তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র।
পশ্চিম ইউরােপ ও জাপান, মার্কিন ও সােভিয়েট এই দুই বৃহৎ শক্তির সাথে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উপনীত।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদী বিশ্ব
পৃষ্ঠা: ৬৪৫

মারাত্মক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পতিত হয়েছে। তারা এ সংকট একে অপরের কাধে, নিজেদের জনগণের কাঁধে এবং তৃতীয় বিশ্বের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। এর ফলে তারা সর্বত্র আরাে ব্যাপক প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়েছে।
তৃতীয় বিশ্বভুক্ত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশসমূহ। সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জোরদার করছে।
ভিয়েতনাম, কম্বােডিয়া, লাওসের জনগণের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রামের বিজয়, প্যালেস্টাইন ও আরব জনগণের ইসরাইলী ইহুদী জাতীয়তাবাদ বিরােধী সংগ্রাম, আরব জনগণের তৈলকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংগ্রাম, এ্যাঙ্গোলামােজাম্বিক-গিনি বিসাউর জনগণের সংগ্রামের বিজয়, লাতিন আমেরিকার জনগণের সামুদ্রিক জলসীমা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃতির জন্য সংগ্রাম ও তৃতীয় বিশ্বভূক্ত দেশসমূহের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম প্রমাণ করছে তৃতীয় বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে গৌরবময় ভূমিকা পালন করছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাচ্চা বিপ্লবীরা বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার সর্বহারা রাজনৈতিক পার্টি গড়ে তুলছে।
সভাপতি মাও সঠিকভাবে বলেছেন, বর্তমান বিশ্বে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে।
এটা খারাপ নয়, ভাল। এ বিশৃঙ্খলা বিপ্লবের জন্ম দেবে। শৃঙ্খলা শর্ত হিসেবে কাজ করছে।
দুই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার দূরভিসন্ধির কারণে বিশ্বে বিশ্বযুদ্ধের আশংকা বিদ্যমান।
বিশেষ করে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক চীনকে অতর্কিতে আক্রমণ করার সম্ভাবনা বিদ্যমান। সে চীন সীমানায় একগুয়েভাবে বিপুল সৈন্য মােতায়েন করছে।
এ কারণে বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী, জনগণের সতর্ক থাকতে হবে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ বাধাবার পায়তারার বিরুদ্ধে।
তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী সংগ্রাম বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকাবে বা বিশ্বযুদ্ধ বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করবে।
কিন্তু বিপ্লবই হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের প্রধান প্রবণতা। বিশ্বের দেশসমূহ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি, জনগণ চায় বিপ্লব।
পৃষ্ঠা: ৬৪৬

পরিশিষ্ট
মেকং দুহিতা মুক্তির গান শােনায়
“ নারীদের সম্পূর্ণ বন্ধনমুক্তি ব্যতীত সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।”
– হাে চি মিন

মানব সমাজের বিকাশের ধারা অনুসন্ধান করলে দেখা যায় নারীকে মানুষ হিসাবে আমরা সঠিক মূল্যায়ন করতে সক্ষম হইনি। আমরা আদিম সমাজে কখনাে তাকে দেখেছি দেবী হিসাবে, তাকে দিয়েছি দেবতার সম্মান। তাকে সরিয়ে রেখেছি তার স্বাভাবিক সুস্থ মানব জীবন থেকে। আবার কখনাে কখনাে দেখেছি নিতান্তই ভােগ্য সামগ্রী হিসাবে। যার উৎকটতম অভিব্যক্তি আজ দেখতে পাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য ধনতান্ত্রিক দেশে। কিন্তু কখনাে তাঁকে ভাবতে পারিনি একজন পুরুষের সমকক্ষ হিসাবে, একটি সাধারণ সুস্থ জীবনের অধিকারী হিসাবে।
ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে সমাজ জীবনে কি অর্থনীতিতে-এক কথায় সমাজের সমস্ত কাজেই তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। নারীর যােগ্যতাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা এ নিয়মের পরিবর্তন করেছে। সেখানে নারী ও পুরুষ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অংশীদার। আজ তাই দেখতে পাই ভিয়েতনামের নারীরা পুরুষের মতই সমস্ত সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে পুরানাে সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে এগিয়ে চলেছে-রচনা করছে নয়া ইতিহাস।

সামন্ততান্ত্রিক যুগে
সামন্ততান্ত্রিক যুগে নারী সর্বদা অপরের উপর নির্ভর করে থাকত, তাদের ভাগ্যও নির্ভর করতাে যার উপর নির্ভরশীল তার ভাগ্যের উপর। সামন্তযুগীয় আদর্শে বলা হতাে নারী দুর্বল ও অসহায় এবং পুরুষের ছত্রছায়ায়ই তাদের জীবন যাপন করতে হতাে। কনফুসিয়াস বলেছেন-“সাধারণ মানুষ ও নারী অজ্ঞ, তাদের সহজাত প্রকৃতি নােংরা এবং শিক্ষা লাভ করা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য।”
একটি মেয়ে জন্মগ্রহণ করার পর সে কেবল পিতার স্নেহের পরশটুকুই পেত, কিন্তু বংশ অথবা কুল রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সে কারণেই একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করলেই বলা হতাে বংশধর’, কিন্তু দশটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলেও সে কথা বলা হতাে না। কনফুসিয়াস বলেছেন, “নীতিগতভাবেই বাড়ীর বাইরে যাওয়া তার নিষেধ। তার স্থান শুধুমাত্র রান্নাঘরে।” সে সময় শিক্ষা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হতাে, প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণে তাদের অধিকার ছিল না এবং এমনভাবেই তারা বড় হতাে যা তাদের চিন্তাশক্তির অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে দিত। মূলতঃ তিনটি সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যেই তাদের জীবনকে নির্ভরশীল করে রাখা হতাে, যেমন, প্রথম জীবনে পিতার উপর, বিবাহের পর স্বামীর উপর এবং স্বামীর মৃত্যুর পর বড় ছেলের উপর।
সে সময় নারীকে তার সাথী বেছে নেবার স্বাধীনতা দেওয়া হতাে না। কনফুসিয়াস
পৃষ্ঠা: ৬৪৭

আদর্শে নারীর বিবাহের স্বাধীনতাকে অপরাধ বলে ঘােষণা করা হতাে। বলা হতাে যুবকযুবতী একসাথে মেলামেশা করতে পারবে না। কোন যুবতীই নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করতে পারবে না, তাকে পিতা-মাতার ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে হবে এবং সেই সময় যুবতীকে টাকা, মূল্যবান গহনা ও অন্যান্য জিনিসের সাহায্যে বিনিময় করা হতাে। এটাই ছিল আইনসিদ্ধ।
সামন্তযুগে বহুবিবাহ বা অল্প বয়সে বিবাহ করা আইনসিদ্ধ ছিল। একজন ধনী ব্যক্তি তার অল্প বয়সী পুত্রের জন্য অপেক্ষাকৃত বড় মেয়েই ঘরে নিয়ে আসত; কারণ চাকর অপেক্ষা কম খরচ হতাে- অর্থাৎ ঐ মেয়েকে চাকরের মতই সারা বাড়ীর কাজ করতে হতাে। গরীব কৃষকদের জমিতে চাষ করার জন্য কিছু কিছু টাকা ধার দেওয়ার পরিবর্তে তাদের ঘরের সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে আসত এবং পরবর্তীকালে বিনা মাইনেতে তাদের চাকরের কাজ করতে হতাে। এই ধরণের শােষিত জীবন ধারণ করতে তাদের বাধ্য থাকতে হতাে।
একজন পুরুষ তার নিজের সন্তুষ্টির জন্য একাধিক স্ত্রীলােক নিয়ে আসতে পারতাে। তথাপি বিবাহিত স্ত্রীকে তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে হতাে। নচেৎ জনসমক্ষে তার কুৎসা রটনা করা হতাে। অথচ অবিশ্বস্ত স্বামীর কোন শাস্তি দেওয়া হতাে না। এ ছাড়া সন্তানহীনাকে নিজের বিবাহিতা স্ত্রী নয় বলে পরিত্যাগ করা হতাে। অবিবাহিতা স্ত্রীর নিজের সন্তানও তাকে মা বলে ডাকতে পারতাে না (যদিও প্রথম স্ত্রীকে মা বলতে হতাে), বড় বােন বলে ডাকতে হতাে, এবং তার পরিচয়ও হারিয়ে যেত- বাড়ীশুদ্ধ সকলেই দ্বিতীয় বােন, তৃতীয় বােন ইত্যাদি এইভাবেই পরিচিত করতাে।
সপ্তদশ শতকে ভিয়েতনামের সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যখন নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে ক্রমশঃ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পড়ে, তখনও সেই সমাজে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। সে সময় রাজা এবং সামন্ত প্রভুরা আরাে দুর্নীতিগ্রস্ত ও নীতিভ্রষ্ট হয়ে পড়লাে। তখন ম্যান্ডারিন (Mandarin) ও স্থানীয় ক্ষমতালিলুর দল সুযােগ বুঝে ক্ষমতা দখল করে এবং সাধারণ মানুষের উপর অন্যায় শােষণ শুরু করে। সর্বত্র। বিশৃংখলা ও নিরাপত্তাহীন অবস্থা বিরাজ করতে থাকে। নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার ও লুটতরাজ শুরু হয়।
এভাবেই ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় ধনতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। যাদের অর্থ আছে তারা সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী হয়। নারীকে তখন ভােগের সামগ্রী হিসাবে। দেখা হতাে, যথেচ্ছভাবে তাদের অপমান করা হতাে। নিষ্ঠুর সমাজ ব্যবস্থা সুন্দরী যুবতীদের প্রতিভার অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতাে, তাদের যথেচ্ছভাবে বিক্রি করা হতাে এবং কঠিন জীবন যাপন করতে হতাে। ভাগ্যের উপর দোহাই দিয়ে তারা বলতাে, “সৃষ্টিকর্তা তুমি আমাদের উপর এত নিষ্ঠুর কেন?”
যাহােক, ভিয়েতনামের নারীরা কিন্তু এই সামন্তযুগীয় সমাজ ব্যবস্থাকে নীরবে সহ্য করতাে না, গরীব কৃষকদের মধ্যে নারীই ছিল মূল শক্তি। বহু প্রয়ােজনীয় কাজ তাদের করতে হতাে। মাঠে মাঠে তারা তাদের স্বামীদের পাশে দাঁড়িয়ে চাষের কাজ করতাে। কৃষক জমিতে চাষ করতাে আর তার স্ত্রী বীজ বপন করতাে। এইভাবেই তারা পুরুষের কাজের দায়িত্ব সমানভাবে ভাগ করে নিত। এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সমস্ত কষ্টকে দূর করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতাে এবং পুরানাে সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলবার চেষ্টা করতাে। সমস্ত রকম দুঃখ, কষ্ট, অভাব-অভিযােগ এবং
পৃষ্ঠা: ৬৪৮

অভিজ্ঞতা তারা সমানভাবে ভাগ করে নিত। কথিত আছে, একজন ভিয়েতনামের নারী তার স্বামীকে বলেছিল, “যদি পাহাড়ে উঠতে হয় আমি তােমাকে অনুসরণ করবাে, আমাদের পথে আমরা একসাথে যাবাে, একসাথে খাবাে।”
নারী নিঃস্বার্থভাবে তার ভালবাসা স্বামী-পুত্রকে দিত। তাদের জন্য সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ত্যাগ স্বীকার করতে তারা প্রস্তুত থাকতাে। দায়িত্বজ্ঞান ছিল তাদের ভীষণ। যে- কোন দুঃখজনক ঘটনা ঘটুক না কেন তারা স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে অথবা একাকী শিশু পুত্রকে রক্ষা করতাে। স্বামী যুদ্ধে গেলে বাড়ির সমস্ত কিছুই রক্ষা করতে হতাে স্ত্রীকে।
আক্রমণকারীরা যখন আসতাে সমস্ত উৎপাদনের ও বাড়ীর কাজের দায়িত্ব নারী নিত। এমনকি শত্রুপক্ষ এগিয়ে গেলে তার বিরুদ্ধে লড়াই পর্যন্ত করতাে। চীনের সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে ট্রাও ট্রাক (Trung truc) ও ট্রং হি (Trong hi) দুই বােন যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ট্রাঙ ট্রাক এই বিদ্রোহে তার স্বামীর অত্যাচারীর প্রতিশােধ নিয়েছিলেন এবং পিতৃভূমির ঋণ শােধ করেছিলেন। ঐ দুই জাতীয় বীর নারী আগামী দিনের বংশধরদের কাছে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছিল।
আনহােয়া প্রদেশের এক বৃদ্ধা নারী ক্রিউ থি ত্রিন (True thi trien) তার ভাইকে বলেছিল, “আমি ঝড়ের বুকে আরােহণ করবাে, ঢেউকে বশ করতে চাই, হাঙর মারতে চাই, শত্রুকে বিতাড়িত করে দেশকে বাঁচাতে চাই। আমি যে সমস্ত নারী অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে নীরবে সহ্য করে, তাদের মত হতে চাই না।” এই বৃদ্ধা তার ভাইয়ের সাথে কয়েক সহস্র সহকর্মী নিয়ে লড়াই করে চীন সামন্ত প্রভুদের বিতাড়িত করেছিলেন। কিন্তু শত্রুপক্ষ আরও অধিক শক্তি সঞ্চয় করে পুনরায় যখন আক্রমণ করে তখন দীর্ঘ ছয় মাস শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে আত্মসমর্পণ না করে জীবন দেন।
অষ্টাদশ ও উনিশ শতকে কৃষক সংগ্রাম-এর সাথে সাথে নারীদের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লড়াই বিস্তার লাভ করে, তারা দুর্বল সামন্তযুগীয় ব্যবস্থাকে চূর্ণ করে। এই সংগ্রামে নারী এক বিরাট ভূমিকা পালন করে। বুই থি জুয়ান (Bui thi Zuan) ইসক কৃষক বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী ছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে নগুয়েন প্রভুদের বিতাড়িত করতে এবং নগুয়েন ও ত্রিন প্রভুরা যে দক্ষিণ ভিয়েতনামকে বিভক্ত করেছিল, তাকে মুক্ত করার জন্য লড়াই করে জীবন দিয়েছিলেন।
উনিশ শতকে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীরা যখন ভিয়েতনাম আক্রমণ করে, তখন ভিয়েতনামের নারীরাই পিতৃভূমি বিপন্ন বলে আওয়াজ তুলেছিলেন। ইতিহাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা শিক্ষালাভ করেছিলেন যে শত্রু যদি দেশকে আক্রমণ করে তাহলে তাকে প্রতিরােধ করতে হবে।
ইতিহাসকে স্মরণ করেই তারা ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান। তুসাে (Tu-so) যখন দেখতে পেলেন যে, বিশ্বাসঘাতক তার স্বামীকে হত্যা করেছে, তখন তিনি নিজেই ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলেন। ট্রাঙ ট্রাকের মতই স্বামীর হত্যাকারীর প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য ও দেশের জন্য তিনি লড়াই করেন। কিন্তু তখন শত্রুর সঙ্গে এঁটে উঠা সম্ভব ছিল না তাই দেশ ত্যাগ করলেন।
ভিয়েতনামের জনগণ ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সে সময় প্রচণ্ড লড়াই করেছিল, কিন্তু যেহেতু বাস্তব অবস্থা পক্ষে ছিল না, তাই দেশপ্রেম থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে জয়লাভ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া সে সময় যারা নেতৃত্বে ছিল তাদের অধিকাংশই ছিল
পৃষ্ঠা: ৬৪৯

সামন্ত শ্রেণীর এবং তাদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবার ভয়ে তারা কৃষক শ্ৰেণীকে এই যুদ্ধে সংগঠিত করতে পারেনি।
বুর্জোয়া এবং ক্ষুদে বুর্জোয়ারাও সে সময় রেহাই পায়নি। ফলে বুর্জোয়া নারী আন্দোলন নারী জাতির স্বাধীনতার আন্দোলনকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন থেকে পৃথক করে দিল। শহরের স্ত্রীলােকদের ধনতান্ত্রিক সভ্যতার প্রলােভন দেখাতে শুরু করলাে, ফলে সমাজ দুর্নীতিতে ভরে যেতে থাকে। এদিকে যেমন বুর্জোয়া সংস্কারের ফলে অবিবাহিত মাতার সন্তানকে প্রকাশ্যে ঘৃণা করা হতাে, অপরদিকে ম্যান্ডারিনরা কিন্তু উচ্চপদের লােভে তাদের নারীকে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের নিকট সমর্পণ করতাে।
প্রকৃতপক্ষে কোন নারীই নির্দয়তার হাত থেকে রেহাই পেত না। শহরেরই হােক বা গ্রামেরই হােক বা বাড়ীতে হােক সর্বত্র তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার করা হতাে। যদি কোন নারী লেফটেনেন্টকে সঙ্গদানে অসম্মতি জানাত তাহলে তাকে মাটিতে ফেলে অত্যাচার করে অর্ধমৃত করা হতাে অথবা কোন অফিসার যদি কোন যুবতীকে ধর্ষণ করতাে, তাহলেও কোর্টের বিচারে তাকে রেহাই দেওয়া হতাে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর কিছু বুর্জোয়া ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আওয়াজ তুলল। বহু নারীই তাদের আহ্বানে সাড়া দিল।
কিন্তু যেহেতু এটা ছিল কেবলমাত্র “সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আন্দোলন, সে কারণে এ আন্দোলন ব্যর্থ হলাে। কিন্তু বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বিপ্লব ব্যর্থ হলেও ক্ষুদে বুর্জোয়ারা নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলাে। বহু জঙ্গী নারী সংগ্রামের সাথী হলাে, কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হলাে। কারণ তারাও বুর্জোয়া-সামন্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক বন্ধনে জড়িয়ে পড়লাে। তারা শ্রমিক-কৃষককে সংগঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি সামন্ত প্রভু এবং ধনতান্ত্রিক শােষণে জর্জরিত সাধারণ মানুষকে পর্যন্ত তারা ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি।
কিন্তু ভিয়েতনামের নারীরা তথাপি সাহসিকতার সাথে অনুসন্ধান করে চলল, কে তাদের মুক্তি আন্দোলনের সঠিক পথ দেখাবে। যদিও কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে তথাপি এ পথ থেকে কেউ তাদের বিরত করতে পারেনি।
শ্রমিক শ্রেণীর পতাকাতলে ১৯৩০ সালে ইন্দোচীনের কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তি আন্দোলনের পথ ঘুরিয়ে দিল। ভিয়েতনামের নারীরা নতুন পথের সন্ধান পেলেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত আই.সি.পি. (I.C.P)-ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টি শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল নারী বিপ্লবের একটি মুখ্য দায়িত্ব পালন করে। যেহেতু ভিয়েতনামের নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিল যে, বুর্জোয়ারা উপনিবেশবাদ বা সামন্ত শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারছে না- ক্ষুদে বুর্জোয়ারাও এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে অক্ষম, সেহেতু তারা শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে “জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
অপরদিকে শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি জানে যে নারীদের সহযােগিতা ব্যতীত কোন বিপ্লবেই জয়লাভ করা যায় না। সেজন্যই ইন্দোচীনের কমিউনিস্ট পার্টি নারী সমস্যাকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসাবেই বিবেচনা করে এবং পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় (১৯৩০ সালে) নারী-পুরুষ সকলকেই বিপ্লবের সমান অংশীদার বলে। ঘােষণা করা হয়। পরের বছরই ১৯৩১ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির সকলে। একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, “ভিয়েতনামের নির্যাতিত নারীরাই সমাজের মূল
পৃষ্ঠা: ৬৫০

অঙ্গ, যেহেতু বিপ্লবী আদর্শ তাদের আছে, সেহেতু সংগ্রামের ক্ষেত্রে তারা নিশ্চয়ই অংশগ্রহণ করবে।” পার্টির বৃহত্তম গণসংগঠনের মধ্যে নারী সমিতি” অন্যতম একটা প্রধান সংগঠন হিসাবে জন্মলাভ করে (ফেব্রুয়ারী, ১৯৩০)।
নারীরা শুনতে পেল নগুয়েন আই কুয়েক (প্রেসিডেন্ট হাে চি মিন)-এর ভাষণ, “শােষিত ও নির্যাতিত ভাই-বােনেরা, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে নিজেদের সংঘবদ্ধ কর, যৌথভাবে আন্দোলন কর।” নারীরা মার্কসবাদের শিক্ষায় নিজেদের শিক্ষিত করে তুলল; ১৯৪৫ সালের আগষ্টে তারা ফরাসী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে এবং আজও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
মার্কসবাদের সত্যের নিকট বুর্জোয়া আদর্শ ম্লান হয়ে যায়। নারীরা দৃঢ়চিত্তে রুখে দাড়ায় সমস্ত অত্যাচারের বিরুদ্ধে; পুরানাে সমাজব্যবস্থা ভেঙে চুরমার করে শত্রুর মুখােমুখি দাড়ায়; প্রয়ােজনে জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করে। তারা বলতাে, ‘শত্রু এগিয়ে এলেই তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবে, লড়াই করবে। তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা বুঝেছে যে, দাসত্ব থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগত সুখ, স্বপ্ন সবই মােহ- সুখের জন্য প্রয়ােজন ‘সংগ্রাম।
পার্টিকে যখন বেআইনী ঘােষণা করা হয়, তখন বহু নারী পার্টিতে যােগদান করে এবং চেষ্টা করে কীভাবে জাতিকে অপমান ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করা যায়। ভিন্ন। প্রদেশের একজন ছাত্রী মিন থাই ( Min thi) প্রথম এগিয়ে এসে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। বহু বাধাবিপত্তি এবং অত্যাচার সত্ত্বেও এই নারী বিভিন্ন কলে-কারখানায় শ্রমিকদের জাতীয় চেতনা বাড়াতে সক্ষম হয়, এবং তাদের মনে বিপ্লবের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে। বহু নিপীড়ন সত্ত্বেও শক্রর কাছে একটি কথাও সে বলেনি। তাকে যখন প্রশ্ন করা হয়, “কারা তােমার কমরেড? কে তােমার স্বামী? তােমার শিশুপত্র কোথায়?” অত্যন্ত ঘৃণায় সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, কোন কথাই বলেনি। তাকে হত্যা করে যখন বন্দীশালা থেকে বাইরে নিয়ে আসা হয়, তখন জল্লাদেরা দেখতে পায়, নিজের রক্ত দিয়ে দেয়ালের উপর কয়েকটি কথা লিখা আছে, “কারাগার আমার স্কুল, বন্দীরা আমার সাথী, তরবারিই হচ্ছে। আমার শিশুপুত্র এবং বন্দুক আমার স্বামী।”
দেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তির জন্য কমরেড মিন থাই জীবন দিলেন বটে, কিন্তু জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সাথীদের নিকট রেখে গেলেন নতুন সুর।
১৯৪১-৪২ সালে ভিয়েতমিন মুক্তি ফ্রন্টের আহ্বানে বহু কৃষক নারী ফরাসী এবং জাপানীদের বিতাড়িত করার জন্য গেরিলা বাহিনীতে যােগ দিল। এই সময় কমরেড হা। কিউ (Ha que) (বর্তমানে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যা এবং ভিয়েতনাম মহিলা কমিটির সহ-সভানেত্রী] একটি গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। মাত্র ২১ বৎসর বয়সে তিনি থাই বিন রাজ্য কমিটির সদস্য হন এবং তার সমস্ত কমরেডরা যখন গ্রেপ্তার হন তখন তিনি নিজেই বিপ্লব পরিচালনার নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেন এবং তার পরিচালনায় ব্যাক গিয়াং প্রদেশের ক্রিড়নক সরকারের পতন ঘটে।
মেকং অঞ্চলের একটি গ্রামের একজন বৃদ্ধা নারী যখন এক বস্তা চাল লুকিয়ে রাখছিল, তখন সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলে এবং বুঝতে তাদের অসুবিধা হয় না যে, এ চাল নিশ্চয়ই গেরিলাদের জন্য লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। তারা তখন সেই বৃদ্ধাকে রাইফেল। দিয়ে আঘাত করে জিজ্ঞাসা করলাে, “ কোথায় তারা?” বৃদ্ধা নারী নির্ভয়ে বললাে, “ওহে দস্যুরা আমি বৃদ্ধা, রাইফেল তাই বহন করতে পারি না, কিন্তু আমার ছেলে এবং
পৃষ্ঠা: ৬৫১

গ্রামে আমার যে মানুষ আছে ওরা তােমাদের হত্যা করবে।”
লক্ষ লক্ষ নারী সমস্ত ত্যাগ স্বীকার করে সক্রিয়ভাবে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে এবং ফরাসী সাম্রাজ্যবাদীদের বিতাড়িত করে উত্তর ভিয়েতনামকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে তুলে, কিন্তু যে লড়াই তারা শুরু করেছিল দুই ভিয়েতনামকে যুক্ত করার জন্য সেই সমস্যা আজও রয়ে গেছে। দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুতুল সরকারের সহযােগিতায় আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরা দক্ষিণ ভিয়েতনামের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার জন্য সেখানে বিষাক্ত গ্যাসবােমা নিক্ষেপ করে চলেছে, কিন্তু দক্ষিণ ভিয়েতনামের নারীরা বেছে নিয়েছে-‘হয় মৃত্যু-না হয় সংগ্রাম।’ তাই দেশের সমস্ত জনগণের সাথে এক হয়ে তারা ইয়াংকি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে এবং চিৎকার করে বলছে, আমাদের একমাত্র মুক্তি হচ্ছে দেশের সমস্ত জনগণকে সংঘবদ্ধ করা; তাদের সাথে একত্রিত হয়ে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও তার ক্রিড়নক সরকারকে পরাজিত করা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। তারা বিশ্বের নারী সমাজকে আহ্বান করে বলছে, “ যখন কোন দেশে সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ ঘটে বা সাম্রাজ্যবাদ ও তার ক্রিড়নক সরকার দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তােলে, তখন একমাত্র কাজ হচ্ছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানাে; দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করা- সে যত বড় শক্তিধরই হােক না কেন।”
পৃষ্ঠা: ৬৫২

———X———

Previous