You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

তারা সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার পরিবর্তে তাদের বিশ্বস্ত পদলেহী কুকুর হিসেবে প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপ করে। তারা পার্লামেন্টারি রাজনীতি করে, নির্বাচনে দাড়ায়, প্রকাশ্য পার্টি তৎপরতা চালায়, তােয়াহা প্রকাশ্যে চটকল ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে শ্রমিকদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
সভাপতি মাও-এর নেতৃত্বে বিশ্বের সর্বহারা বিপ্লবীদের আধুনিক সংশােধনবাদবিরােধী বিরাট তর্কযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় পূর্ব বাংলায় সভাপতি মাও-এর রচনাবলী আসে। এর ফলে সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মতাদর্শগত প্রস্তুতির সৃষ্টি হয়।
সংশােধনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি এবং এর নেতৃত্বে বিভিন্ন গণসংগঠনের সাধারণ সর্বহারা বিপ্লবীরা সংশােধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করে।
ছাত্র বিপ্লবীরা ছাত্র সংগঠনের সংশােধনবাদীদের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কাজী-রণাে-মেনন চক্র ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের সুযােগ গ্রহণ করে এবং ছাত্র ইউনিয়ন “মেনন গ্রুপ” গঠন করে।
এ সময়ে হক, তােয়াহা, বশির বিশ্বস্ততার সাথে সংশােধনবাদী লাইন অনুসরণ করছিল এবং তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ ছিল। ইহা প্রমাণ করে তারা ছাত্র বিপ্লবীদের চেয়েও পশ্চাদপদ ছিল।
কমিউনিস্টরা হচ্ছে সর্বহারার সবচাইতে অগ্রগামী যারা সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবী জনগণকে শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে। আধুনিক সংশােধনবাদবিরােধী সংগ্রামে সাধারণ ছাত্র বিপ্লবীদের নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে হক-তােয়াহাদের নেতৃত্ব দেয় ছাত্র বিপ্লবীরা। ইহা প্রমাণ করে, কমিউনিস্টদের অগ্রগামী চরিত্র তাদের ছিল না।
ইতিমধ্যে আধুনিক সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ বিপ্লবীদের বিদ্রোহ জোরদার হয়।
হক, তােয়াহা, বশির এ বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করে, নিজেদের পার্টি কর্তা হিসেবে গড়ে তােলা ও পার্টির ক্ষমতা দখলের জন্য নাম্বুদ্রিপদ-জ্যোতিবসুর অনুসরণে মার্কসবাদী পার্টি নামধারী সংশােধনবাদী উপদল গঠন করে এবং সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতারিত করে।
ইতিমধ্যে হক-তােয়াহা ছয় দফার বিরােধিতা করা এবং পূর্ব বাংলার উপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়নের বিরােধিতা না করার শর্তে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার প্রধান আওয়ানের সাথে বৈঠকে মিলিত হয় এবং আপােষ করে। এর ফলে তাদের উপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার করা হয়। এভাবে হুলিয়া প্রত্যাহারের বিনিময়ে পূর্ব বাংলার উপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়ন বিরােধিতা না করার। অঙ্গীকার করে তারা পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তারা ন্যাপকে বিভক্ত করে, কিন্তু তাদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপের দ্বারা প্রকাশ্যে ক্ষুদে বুর্জোয়া বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালায়, এমন কি ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মত প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যও হক-তােয়াহা প্রকাশ্যে প্রচার করে।
কৃষক সমিতিকেও একইভাবে বিভক্ত করে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অংশ দ্বারা তারা প্রকাশ্যে সংস্কারমূলক রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যায়।
এ সময় তারা সভাপতি মাও-এর চিন্তাধারাকে চীনের জাতীয় নেতার বক্তব্য বলে তা পাঠ ও প্রয়ােগের বিষয়ে কর্মীদেরকে নিরুৎসাহিত করে। তারা সময় হয়নি, সংগঠন হয়নি, প্রচার হয়নি ইত্যাদি যুক্তি দেখিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম ঠেকিয়ে রাখে।
ছাত্র এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের কৃষক শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়া, তাদের
পৃষ্ঠা: ২০১

নিকট থেকে পুনরায় শিক্ষা গ্রহণ করা, সশস্ত্র বিপ্লবে পােড় খাওয়া, মার্কসবাদ অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করে মতাদর্শগত পুনর্গঠনের সঠিক পথে পরিচালনার পরিবর্তে প্রকাশ্য মিটিং, মিছিল এবং অন্যান্য সংস্কারবাদী পথে পরিচালনা করে এবং তাদেরকে আরাে পাকাপােক্ত ক্ষুদে বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত করে।
তারা সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং একচেটিয়া পুঁজিবাদকে পূর্ব বাংলার শত্রু হিসেবে উল্লেখ করার সময় সকলকে এক ও অবিচ্ছিন্ন শক্তি বলে। তারা আরাে বলে দেশের প্রধান ও মৌলিক বিরােধ হলাে জনগণ এবং তিনশক্তির অবিভাজ্য প্রকাশ (অর্থাৎ-সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদের সাথে জনগণের দ্বন্দ্ব প্রধান ও মৌলিক দ্বন্দ্ব-লেখক), এই তিন শক্তির অবিচ্ছিন্ন সত্তাকে পৃথকভাবে বিচার করার অর্থই হলাে ইচ্ছাকৃত হােক আর অনিচ্ছাকৃতভাবেই হােক এদের স্বার্থের ওকালতি করা, এদের স্বার্থের সেবা করা (অর্থাৎ, প্রধান দ্বন্দ্ব খুঁজে বের করা, প্রধান শত্রু নির্ণয় করা হচ্ছে। শত্রুকে সেবা করা-লেখক)।
এ কথা বলে তারা প্রধান দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব, তা নির্ণয়ের গুরুত্বকে অস্বীকার করেছে। ইহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মৌলিক নীতিকে অস্বীকার করা এবং স্পষ্ট ভাববাদ। প্রধান দ্বন্দ্ব। নির্ণয় না করা, প্রধান শত্রু নির্ণয় না করা, সকল শত্রুকে সমভাবে বিচার করা ও আক্রমণ করার প্রকৃত অর্থ হলাে প্রধান শত্রুকে আড়াল করা ও তাকে বাঁচিয়ে দেওয়া, অর্থাৎ, সকলকে আক্রমণ করা গুটিকয়েককে রক্ষা করার জন্য।
ইহা প্রমাণ করে দর্শনের ক্ষেত্রে তারা পুরনাে ও আধুনিক সংশােধনবাদীদের মত অনুসরণ করে ভাববাদ ও অধিবিদ্যা।
পরবর্তীকালে তারা নিজেদেরকে ‘নকশাল’ হিসেবে জাহির করার জন্য সামন্তবাদের। সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু বলে নিজেদের পূর্বেকার বক্তব্যকে বিরােধিতা করে। এভাবে তারা নিজেদের গালে নিজেরাই চপেটাঘাত করে।
তারা ভারতের নকশালবাড়ীর কৃষক বিদ্রোহকে ন্যাপ অফিসে, ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে, প্রকাশ্য সভায় হঠকারী, সি.আই.এ-এর কার্যকলাপ বলে বিরােধিতা করে।
তারা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের উপর নির্ভরশীল প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ, যার সংস্কৃতি হলাে জাতীয় পরাধীনতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও সামন্তবাদী-তাকে বিপ্লবী হিসেবে তুলে ধরে এবং বিপ্লবীদেরকে মতদর্শগতভাবে নিরস্ত্র করে ফেলে। তারা পূর্ব বাংলার উপর পরিচালিত পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের জাতীয় নিপীড়ন ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্ব পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুদ্ধিজীবীদের হাতে তুলে দেয়। যার ফলে সাম্রাজ্যবাদীরা পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন ব্যবহারের সুযােগ পায়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পার্টির বিকাশ, সুসংবদ্ধতা ও বলশেভীকরণ, পার্টির নেতৃত্বে। প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলা, প্রধান ধরনের সংগ্রাম হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামকে গ্রহণ করা, সশস্ত্র সংগ্রামকে সেবার উদ্দেশ্যে গণসংগঠনের কাজকে পরিচালনা করার মত মৌলিক বিষয় তারা কার্যকরী করেনি।
ব্যক্তিগত জীবন ও নারীদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা বুর্জোয়া সমাজের ইতর রীতিকে প্রয়ােগ করে এবং জনগণের নিকট সর্বহারা বিপ্লবীদের সম্পর্কে কদর্য উদাহরণ সৃষ্টি করে।
এভাবে হক-তােয়াহা আধুনিক সংশােধনবাদের অনুরূপ কার্যকলাপ চালায়।
পৃষ্ঠা: ২০২

হক-তােয়াহাদের কার্যকলাপের ফলে সাধারণ কর্মীরা তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
এ বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করে দেবেন-বাসার, মতিন-আলাউদ্দিন, কাজী-রণাে বিশ্বাসঘাতক চক্র ঘােলা জলে মাছ শিকার করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপদল গঠন করে এবং নিজেদেরকে পার্টি কর্তা হিসেবে জাহির করে।
হক-তােয়াহারা মারাত্মকভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে এবং ধ্বংসােন্মুখ হয়।
এ সময় নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য তারা নকশালপন্থী বনে যায় এবং ভারতের বিশেষ অবস্থার জন্য প্রণীত রাজনৈতিক লাইনকে পূর্ব বাংলায় প্রয়ােগ করার চেষ্টা করে। নিজেদেরকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে, পূর্ব বাংলা ও ভারতের সর্বহারা ও জনগণকে প্রতারিত করার শেষ চেষ্টা করে। এভাবে তারা বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ’, অর্থাৎ, মার্কসবাদের আত্মাকে বাদ দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক লাইন পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থায় প্রয়ােগের চেষ্টা করে দর্শনের ক্ষেত্রে অধিবিদ্যক ও ভাববাদী ভুল করে। এর ফল হয় জুতাের মাপে পা কাটা, গােলাকার ছিদ্র পথে চারকোণা কাঠের টুকরাে লাগাবার মত।
তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে গ্রহণ না করে শ্রেণী দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে বর্তমানের রাজনৈতিক করণীয়কে বাদ দেয় এবং সমাজের স্তরকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে টেনে আনে; এভাবে তারা ট্রটস্কীবাদী ভুল করে। এর ফলে তারা পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় নিপীড়ন বিরােধী সংগ্রাম থেকে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
তারা “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনকে প্রথমে অস্বীকার করে। পরে এর বিরুদ্ধে জঘণ্য কুৎসা ও অপবাধ রটায়। এমন কি একে সি.আই.এ.-এর ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করে। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধেও তারা একই গুজব ও অপবাদ রটায়।
তারা ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতারিত করতে সক্ষম হয়। তাদের সমর্থনের সার্টিফিকেট দেখিয়ে এবং তাদের সুনামকে ব্যবহার করে বাইরের কারণের উপর নির্ভর করে নিজেদের কুকর্ম ঢাকতে চায় এবং বাঁচতে চায়।
পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব এমন তীব্র আকার ধারণ করে যে, তা সমাধানের জন্য যুদ্ধ শুরু হয়। পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা বাঙালী জাতির অস্তিত্বকে ধ্বংস করা, লক্ষ-কোটি জনগণকে খতম করে তাকে সংখ্যালঘুকে পরিণত করা, পূর্ব বাংলার শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্যকে ধ্বংস করার বর্বর। ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
এ সময় পাক সামরিক ফ্যাসিস্ট ও তাদের সহযােগীদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট ও তাদের সহযােগীরা প্রধান শত্রু হিসেবে সমগ্র বাঙালী জাতির সামনে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত হয়। তারা জনগণের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়, জাতীয় দ্বন্দ্বের সমাধান সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, জনগণ নিজেরাই জাতীয় শত্রু খতম শুরু করে।
এভাবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের নিয়ম অর্থাৎ, প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে দ্বন্দ্বসমূহের সমাধানের মাধ্যমে সমাজ অগ্রসর হয়, প্রধান দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে প্রধান শত্রু নির্ণিত হয়, প্রধান শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করা যায়, প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধান বিপ্লবের প্রধান দিক নির্ণয় করে, বিপ্লবের প্রতি বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা এবং
পৃষ্ঠা: ২০৩

ঐক্যফ্রন্টের সাধারণ ভিত্তি নির্ণয় করে-পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন কর্তৃক উত্থাপিত প্রভূতি তত্ত্বগত বিষয়ের সঠিকতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়।
এ সময় হক-তােয়াহা সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান বলে, শ্রেণী শত্রু হিসেবে জনগণকে খতম করে, এভাবে তাদের কার্যকলাপ পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের অনুশীলনের বিরুদ্ধে যায়।
ইহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী গণলাইনের কাজের সম্পূর্ণ বিপরীত মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক ব্যক্তি জনগণের অধিকাংশের অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন বামপন্থী হঠকারিতামূলক ট্রটস্কীবাদী কার্যকলাপ। তাদের বিশ্বাসঘাতক রাজনীতি থেকে উদ্ভূত হয় বিশ্বাসঘাতকতামূলক সাংগঠনিক পদক্ষেপসমূহ। তারা আওয়ামী লীগ এবং শ্রেণী শত্রুদের বিরােধিতার নামে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আঁতাত করে এবং পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট গােয়েন্দাদের খবর সরবরাহকারী হয় এবং রাজাকার হয়।
তারা ছয় দফা বিরােধিতা করবে এবং পূর্ব বাংলার উপর পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের জাতীয় নিপীড়নের বিরােধিতা করবে না-এ দাসখত লিখে দিয়ে গােয়েন্দা প্রধান আওয়ানের মাধ্যমে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আপােষ করে। এর ফলে তাদের উপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার হয়, তারা প্রকাশ্য কাজের সুযােগ পায়।
ইহা পুরােপুরি লিউ শাওচি ও সংশােধনবাদীদের যে কোন কিছুর বিনিময়ে বেঁচে থাকার তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ। তারা পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভূট্টো, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং অন্যান্য পদস্থ সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে বিভিন্ন সময় বৈঠকে মিলিত হয় এবং সংযােগ রাখে। এমন কি তারা নিয়াজী, ফরমান আলী ও তাদের চেলা-চামুণ্ডাদের সাথেও সংযােগ রাখে এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের স্বার্থ বিক্রী করে।
পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী, বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিরা যখন জেলনির্যাতন ভােগ করছে, ষড়যন্ত্র মামলার শিকারে পরিণত হয়েছে, তখন হক-তােয়াহাদের পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে দহরম-মহরম কি প্রমাণ করে না যে, আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের চেয়েও তারা অধঃপতিত? পূর্ব বাংলার জনগণ তাদেরকে পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালাল ব্যতীত আর কি বলবে?
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা এ সময় জেলে চরম নির্যাতন ভােগ করছিল, তাদেরকে বিচ্ছিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর সেলে একা রাখা হয়েছিল, তাদের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের থেকে বিশেষজ্ঞও আনা হয়েছিল, নেতৃস্থানীয় কর্মীদের গ্রেপ্তারের জন্য পুরস্কার ঘােষণা করা হয়েছিল, গ্রেপ্তারকৃতদের বিশ্বাসঘাতকতা করানাের জন্য প্রলােভন দেখানাে হয়েছিল।
এ সময় হক-তােয়াহা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতাে, ধরা পড়লেও তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হতাে, প্রকাশ্যে পত্রিকা-পুস্তিকা প্রকাশ ও বিক্রয় করতে পারতাে, তাদের ঘর-বাড়ী পােড়ানাে হয়নি। এমন কি তাদেরকে অস্ত্র প্রদান করা হয়। ইহা কি প্রমাণ করে না যে শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে শত্রুর সারিতে নেমেছিল অর্থাৎ, তারা শক্রর দালালে পরিণত হয়েছিল?
তারা “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন”-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, তার গঠন প্রকৃতি, নেতৃত্বের কারাে কারাে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে এমন সব তথ্য পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা সংস্থার নিকট প্রদান করে যা দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতক নূরুল হাসানের মাধ্যমে তারা জেনেছে।
পৃষ্ঠা: ২০৪

তারা ভারতে গঠিত বাংলাদেশ পুতুল সরকারের সাথেও লাইন রেখেছে এবং বর্তমানেও লাইন দিচ্ছে।
এদের, মতিনদের ও কাজী-রণােদের কার্যকলাপের কারণে জনগণের মাঝে ‘নকশাল’ সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। ‘ তারা পূর্ব বাংলার কৃষকের সাথে সামন্তবাদের দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব প্রমাণ করার জন্য। স্ট্যালিনের একটি উদ্ধৃতির শেষের অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে গােপন করে লিউ শাওচির মত কাজ করে।
হক লিখেছে, “জাতীয় প্রশ্ন হচ্ছে মূলতঃ কৃষক প্রশ্ন। এর পরের অংশটি হক ইচ্ছাকৃতভাবে গােপন করেছে।
স্ট্যালিনের পুরাে উদ্ধৃতিটি নিম্নে প্রদত্ত হলঃ “আমরা প্রায়ই বলে থাকি জাতীয় প্রশ্নের সারবস্তু হলাে কৃষক প্রশ্ন। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, জাতীয় প্রশ্ন কৃষক প্রশ্নের আওতায় পড়ে, কৃষক প্রশ্ন জাতীয় প্রশ্নের মত সমান ব্যাপ্তি বিশিষ্ট, কৃষক প্রশ্ন ও জাতীয় প্রশ্ন অভিন্ন। কোন প্রকার প্রমাণের প্রয়ােজনই হয় না যে জাতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাপ্তির দিক থেকে ব্যাপকতর এবং সারবস্তুর দিক দিয়ে অধিকতর সমৃদ্ধশালী।”
পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী প্রমাণ করেছে কৃষক প্রশ্ন, অর্থাৎ, শ্রেণী দ্বন্দ্ব পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন অর্থাৎ, জাতীয় দ্বন্দ্বের চেয়ে গৌণ ছিল। জাতীয় দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে সমগ্র বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সর্বহারাদের নেতৃত্ব না থাকায় বুর্জোয়া, সাম্রাজ্যবাদীরা ও সম্প্রসারণবাদীরা এর সুযােগ গ্রহণ করে এবং পূর্ব বাংলা দখল করে নেয়।
পূর্ব বাংলায় যখন জাতীয় সংগ্রাম প্রচণ্ড রূপ ধারণ করে তখন স্ট্যালিনের উদ্ধৃতির অংশ গােপন করে জাতীয় প্রশ্ন পরিত্যাগ করা কি সচেতনভাবে সর্বহারা শ্রেণী ও বাঙালী জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা নয়?
পক্ষান্তরে মহান গণচীন, চৌএনলাই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীফেংপি এবং অন্যান্যরা পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নের কথা স্বীকার করেছেন এবং বাইরের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই এর সমাধান পাকিস্তানের সরকার ও পূর্ব বাংলার জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা আরও বলেছেন, পূর্ব বাংলার জাতীয় সমস্যার সুযােগ নিয়েছে। সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা।
বর্তমানে তাদের কেউ কেউ বলছে পূর্ব বাংলা ভারতের উপনিবেশ, কেউ কেউ বলছে পূর্ব বাংলা সােভিয়েতের উপনিবেশ।
অতীতে তারা যুক্তি দেখিয়েছে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী পূর্ব বাংলার উপর উপনিবেশিক শােষণ চালাতে পারে না যেহেতু পাকিস্তান আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ।
ভারতও আধা উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী দেশ, ভারত পূর্ব বাংলায় তার উপনিবেশ কায়েম করেছে। তাদের যুক্তি যদি সঠিক হতাে তবে ভারতের পক্ষেও উপনিবেশ কায়েম করা যায় না।
হক-তােয়াহা এভাবে নিজেদের যুক্তিকে নিজেরাই খণ্ডন করেছে।
হক-তােয়াহা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দিয়ে সকল সমস্যার বিচার বিশ্লেষণ না করে ভাববাদ, অধিবিদ্যা এবং ঐতিহাসিক ভাববাদ দ্বারা সমস্যার বিচার করেছে। এবং প্রতি প্রশ্নে জনগণের ও সর্বহারাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
হক-তােয়াহা তাদের কর্মসূচীতে ২৬ পাতায় বিপ্লবের জন্য তিনটি অস্ত্র নিম্নভাবে উল্লেখ করেছে ?
পৃষ্ঠা: ২০৫

ক) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও-এর চিন্তাধারায় সুসজ্জিত একটি শক্তিশালী বিপ্লবী পার্টি গঠন, সর্বপ্রকার সুবিধাবাদ, দক্ষিণপন্থী ও বামপন্থী, বিশেষ করিয়া আধুনিক সংশােধনবাদের কবর রচনা করিয়াই এইরূপ পার্টি গড়িয়া তুলিতে হইবে।
খ) শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির নেতৃত্বে সমস্ত সাম্রাজ্যবাদ ও মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজি বিরােধী শ্রেণী সমূহের সমন্বয়ে গঠিত বিপ্লবী ঐক্যফ্রন্ট গঠন।
গ) গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী ঘাঁটি গঠন। কারণ শহরের তুলনায় গ্রাম হইল শত্রুর দুর্বল স্থান। গ্রামকে ভিত্তি করিয়াই শহর ঘেরাও এবং দখল এইভাবে গােটা দেশে বিপ্লব জয়যুক্ত করা।
ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সংশােধনবাদী নেতৃত্ব কর্তৃক অনুসৃত তিনটি করণীয় নিম্নরূপ :
১। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পতাকা
২। পার্টি গঠনের পতাকা
৩। ১৯৪৫-এর আগস্ট বিপ্লবের পতাকা
উপরােক্ত দুটো “করণীয় নিম্নে উল্লিখিত সভাপতি মাও-এর তিনটি করণীয়ের সাথে তুলনীয়ঃ
“সুশৃংখলিত, মার্কসবাদ-লেনিনবাদে সুসজ্জিত, আত্মসমালােচনার পদ্ধতি প্রয়ােগকারী ও জনগণের সাথে যুক্ত একটি পার্টি; এমন একটি পার্টির নেতৃত্বাধীন একটি সৈন্যবাহিনী; এমন একটি পার্টির নেতৃত্বে সকল বিপ্লবী শ্রেণী ও বিপ্লবী দলের একটি যুক্তফ্রন্ট-এই তিনটি হচ্ছে আমাদের শত্রুকে পরাজিত করার প্রধান অস্ত্র।”
হক-তােয়াহা ও ইন্দোনেশিয়ার সংশােধনবাদীরা সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে দিয়েছে।
এভাবে তারা সশস্ত্র সংগ্রামকে বিরােধিতা করেছে।
তারা সুশৃংখল, আত্মসমালােচনা, জনগণের সাথে যুক্ত। এর মত পার্টি গঠনের মৌলিক বিষয়সমূহ বাদ দিয়ে দিয়েছে।
হক চক্র ১৮/১২/৭১ তারিখের দলিলে তিনটি করণীয়কে উল্লেখ করেছে নিম্নভাবে ও ক) মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সজ্জিত সুদৃঢ় পার্টি; খ) পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী; গ) পার্টির নেতৃত্বাধীন প্রতিরােধের ঘাঁটি।
এখানে তারা ঐক্যফ্রন্ট যা বিপ্লবের বিজয়ের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র তা বাদ দিয়ে দিয়েছে।
পার্টি গঠনে এখানেও তারা সুশৃংখলিত, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা ও জনগণের সাথে যুক্ত-এর মত মৌলিক বিষয় বাদ দিয়েছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বের কথা তারা কখনও উল্লেখ করেনি। এভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলার উপর হামলা এবং পূর্ব বাংলা গ্রাস ও নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনাকে তারা কখনাে উল্লেখ না করে জনগণকে অপ্রস্তুত রাখে। “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” তার থিসিসে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করে।
ঘটনাবলী পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিশ্লেষণের সঠিকতা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ করেছে।
পৃষ্ঠা: ২০৬

তারা আমাদের ব্যঙ্গ করে বলেছে তাহলে বার্মার সাথে পূর্ব বাংলার দ্বন্দ্ব কেন মৌলিক হবে না। একথা বলে তারা সম্প্রসারণবাদের প্রকৃত শ্রেণী বিশ্লেষণ করতে এবং সম্প্রসারণবাদের অর্থ বুঝতে নিজেদের অক্ষমতা প্রমাণ করেছে। সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রথম দিকে তারা উল্লেখ করেনি। পরবর্তীকালে উল্লেখ করলেও পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব হিসেবে উল্লেখ না করে নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে জাহির করার উদ্দেশ্যে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদকে কিছু গাল দেয়।
পক্ষান্তরে, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রথম থেকেই তার থিসিসে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের জন্য দায়ী একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব বলে উল্লেখ করেছে। পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের প্রক্রিয়ায় ইহাও ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
হক-তােয়াহা-বশির এতদিনে কবরস্ত হতাে যদি না তারা ভারতের মার্কসবাদীলেনিনবাদীদের প্রতারিত করে তাদের সুনাম ও সমর্থন ব্যবহার করতে সক্ষম হতাে।
বস্তুর বিকাশের কারণ আভ্যন্তরীণ। ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের সুনাম ব্যবহার করেও তারা সুবিধা করতে পারেনি। কারণ সারবস্তুগতভাবে তারা বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল সংশােধনবাদী।
তারা মারাত্মকভাবে অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত, বিভক্ত এবং সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে। হক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নামধারী একটি উপদল গঠন করেছে। তােয়াহা মার্কসবাদীলেনিনবাদী নামধারী অপর একটি উপদল গঠন করেছে। তারা একে অপরকে মিথ্যাবাদী, বিভেদপন্থীবাদী, চক্রান্তকারী, সংশােধনবাদী বলে অভিযােগ ও পাল্টা অভিযােগ করছে এবং নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ আরও অধিকতর সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরছে।
এদের মধ্যকার বদরুদ্দিন-নজরুল-অমলসেন ‘সংহতি কেন্দ্র’ নামে অপর এক উপদল গঠন করেছে।
এভাবে শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের প্রবল ঝড়-তরঙ্গে তাদের মুখােস অনেকখানি উন্মােচিত হয়েছে। তাদের প্রতারণা সর্বহারা বিপ্লবীরা উপলব্ধি করেছেন। ভারতীয় সর্বহারা বিপ্লবীরাও অচিরেই তাদের প্রতারণা বুঝতে সক্ষম হবেন। পূর্ব বাংলার ও ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীরা তাদের ঝেড়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন।

মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চেবাদী
এরা মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। সাধারণ সর্বহারা। বিপ্লবী কর্মীদের, সংশােধনবাদ বিরােধী বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করে হক-তােয়াহাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে নয়া সংশােধনবাদী উপদল গঠন করে এবং সাধারণ কর্মী ও জনগণকে প্রতারিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।
হক-তােয়াহা নয়া সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ কর্মীদের বিরােধিতার সুযােগ গ্রহণ করার জন্য তারা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়। তারা পূর্ব বাংলাকে ধনতান্ত্রিক সমাজ বলে বিশ্লেষন করে এবং এ ভুল রাজনীতির পিছনে পার্টি কর্মী ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে।
এই বক্তব্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই উপসংহার টানা যায় যে, পূর্ব বাংলায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে, গ্রামে সামন্তবাদী শােষণ নেই বা গৌণ, সেখানে
পৃষ্ঠা: ২০৭

পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করেছে এবং প্রাধান্য পেয়েছে, দেশে সাম্রাজ্যবাদী শােষণ নেই, আমলাতান্ত্রিক পুঁজির শােষণ নেই। পূর্ব বাংলায় ধনতান্ত্রিক শােষণ প্রধান হলে তার সমাধান হিসেবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার কর্মসূচী গ্রহণের প্রশ্ন আসে।
ইহা হলাে সমাজের বর্তমান স্তরকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে সম্পন্ন করা। ইহা ট্রটস্কীবাদী ভুল। ইহা প্রমাণ করে-সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রয়ােগের পরিবর্তে আধুনিক ও পুরনাে সংশােধনবাদীদের মতাে তারা প্রয়ােগ করেছে ঐতিহাসিক ভাববাদ।
এই ভুল ও প্রতিক্রিয়াশীল ট্রটস্কীবাদী রাজনৈতিক লাইনে তারা একগুয়েভাবে লেগে। থাকে, শক্তিশালী দুর্গ ও উপদল গঠন করে, এই বক্তব্যে বিশ্বাসী দেবেন-বাসারদের। সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে উপদলের মধ্যে গােপনে জ্বণ উপদল গঠন করে।
হক-তােয়াহারা তাদেরকে বহিস্কার করে।
মতিন-আলাউদ্দিনরা তখনই শেষ হয়ে যেত যদি না দেবেন-বাসার তাদেরকে ছত্রছায়া দিত এবং হক-তােয়াহাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সাধারণ কর্মীদের মাঝে বিদ্রোহ হত।
মতিন-আলাউদ্দিনরা কৃষক সমিতি, ন্যাপ প্রভৃতি আঁকড়ে থাকে এবং প্রকাশ্য সংস্কারবাদী কার্যকলাপ চালায়।
তারা মাহবুবুল্লাহ, আ.কা.ম. ফজলুল হক, আমজাদ প্রভৃতি চেবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়।
তারা “ধনতান্ত্রিক শােষণ প্রধান”-এই ট্রটস্কীবাদী বক্তব্য আত্মসমালােচনা সহকারে বর্জন না করেই পূর্ব বাংলার সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের কথা অর্থাৎ, হক-তােয়াহাদের অনুরূপ কথা বলে এবং দেবেন-বাসারদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে “পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি” গঠন করে নিজেদের পার্টি-কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং নকশাল’ হিসেবে জাহির করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।
তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে গ্রহণ না করে শ্রেণী দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে বর্তমানের রাজনৈতিক করণীয়কে বাদ দেয় এবং সমাজের স্তরকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের করণীয়কে বর্তমানে টেনে আনে। এভাবে তারা ট্রটস্কীবাদী ভুল করে।
এর ফলে জাতীয় পতাকা তারা তুলে দেয় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীদের হাতে।
তারা হক-তােয়াহাদের অনুরূপ ভুল করে এবং দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পরিবর্তে অনুসরণ (করে) ভাববাদ ও অধিবিদ্যা, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিবর্তে ঐতিহাসিক ভাববাদ।
তাদের বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক লাইন থেকে উদ্ভূত হয় বিশ্বাসঘাতক সাংগঠনিক পদক্ষেপসমূহ।
পঁচিশে মার্চের পূর্বে ও পরে তারা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আঁতাত করে। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টরা তাদের গ্রেপ্তার হলে ছেড়ে দেয়, তাদের চলাফেরার সুযােগ দেয়, তাদের ওপর নির্যাতন পরিহার করে।
তারা গােপনে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সহযােগিতা করে। তারা শ্রেণী শত্রু খতমের নামে জনগণের বাড়ীতে ডাকাতি করে, তাদেরকে হত্যা করে। জনগণ
পৃষ্ঠা: ২০৮

তাদেরকে ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং তাদেরকে প্রতিরােধ করে ও তাদের কয়েকজনকে হত্যা করে। তাদের ঘরবাড়ী পুড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত ঐ এলাকা থেকে তারা উৎখাত হয়।
পঁচিশে মার্চের পর তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং দেবেন-বাসার ও মতিন-আলাউদ্দিন একে অপরকে বহিস্কার করে।
মতিন-আলাউদ্দিন নিজেদের শেষ রক্ষার জন্য মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নামধারী উপদল গঠন করে।
মতিনদের প্রকৃত কদর্য চেহারা অনেকখানি প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তারা মারাত্মকভাবে একঘরে হয়ে পড়েছে। তারা হক-তােয়াহাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদেরকে বাঁচাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
তারা পার্টি-কর্মীদের মধ্যে সামন্তবাদী পদ্ধতিতে আত্মীয়ের সম্পর্ক স্থাপন করে উপদল বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
তারা “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা ও অপবাদ রটিয়েছে। এমনকি সি.আই.এ.’র সাথে যুক্ত বলেছে।
পূর্ব বাংলার স্বাধীকার’, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রভৃতি কথা বলে তারা নিজেদেরকে জাতীয় নিপীড়ন বিরােধী, স্বাধীনতা সমর্থক হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করে এবং নিজেদের তাত্ত্বিক দেউলিয়াত্ত আরও পরিষ্কার করে।
জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার মধ্যেই জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা রয়েছে। কোনটা প্রধান তা নির্ণিত হবে সমাজে কোন দ্বন্দ্ব প্রধান তা দ্বারা। তারা সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু এবং সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব প্রভৃতি বলেছে, স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রধান। অতএব স্বাধীন অর্থাৎ, জাতীয় বিপ্লব গৌণ।
কাজেই ‘স্বাধীকার’, ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার দাবী তাদের প্রধান দ্বন্দ্ব এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামরিক লাইনের সম্পূর্ণ উল্টো ছিল।

দেবেন-বাসার ট্রটস্কী-চেবাদী
এরা মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিল। পরে সংশােধনবাদবিরােধী সাধারণ কর্মীদের বিদ্রোহের সুযােগ গ্রহণ করে হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নয়া সংশােধনবাদী উপদল গঠন করে।
এরা “পূর্ব বাংলায় ধনতান্ত্রিক শােষণ প্রধান”-এ প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্যের অনুসারী ছিল। এ বক্তব্যের জন্য তারা কখনও আত্মসমালােচনা করেনি।
পূর্ব বাংলার উপর জাতীয় নিপীড়নকে স্বীকার করেও তারা তত্ত্বগত দেউলিয়াত্বের কারণে সুবিধাবাদের সাথে আপােষ করে এৰং মতিন-আলাউদ্দিনদের ঐক্যে সুযােগ দেয় এবং তাদেরকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করে।
মাহবুবুল্লাহ-আমজাদ চেবাদীদেরকেও তারা ঐক্যের সুযােগ দেয়। এভাবে নীতিকে বিসর্জন দিয়ে সুবিধাবাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকেও সুবিধাবাদী বলে প্রমাণ করে।
মতিন-আলাউদ্দিনদের সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্ৰেণী শত্রু খতমের লাইন পুরােপুরি মেনে না নিয়ে তারা উপদলের মাঝে উপদল হিসেবে বিরাজ করে।
পৃষ্ঠা: ২০৯

ইহা প্রমাণ করে, তাদের মধ্যকার ঐক্য রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ঐক্য ছিল না, তাদের ঐক্য ছিল সুবিধাবাদের ভিত্তিতে।
ইহা প্রমাণ করে সর্বহারা শ্রেনীর রাজনৈতিক পার্টি সংক্রান্ত জ্ঞান তাদের আদৌ নেই।
শেষ পর্যন্ত তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পঁচিশে মার্চের পর ভারতে পলায়ন করে।
ভারতে তারা জ্যোতিবসু ও নামুদ্রিপদ সংশােধনবাদীদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয়। ইহা প্রমাণ করে সংশােধনবাদ ও সুবিধাবাদ সম্পর্কে তাদের আপােষের চরিত্রকে। আরও প্রমাণ করে, আত্মত্যাগ ও জনগণের উপর নির্ভরতার ভিত্তিতে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায় তাদের অক্ষমতাকে।
তারা কাজী-রণাে ষড়যন্ত্রকারী এবং মার্কসবাদী নামধারী কতগুলাে বুর্জোয়া উপদলের সাথে নীতিহীন ঐক্য স্থাপন করে এবং তথাকথিত “জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করে।
সর্বহারারা উপদলের অস্তিত্বকে কখনও স্বীকার করে না। বরঞ্চ এর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আপােষহীন সংগ্রাম করে। উপদলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অর্থ হচ্ছে মার্কসবাদের পার্টি সংক্রান্ত মৌলিক নীতিকে বিসর্জন দেয়া। এভাবে তারা মার্কসবাদের পার্টি সংক্রান্ত মৌলিক নীতিকে বিসর্জন দিয়েছে।
সমন্বয় কমিটি গঠন করে ঐক্যফ্রন্ট সংক্রান্ত তাদের অজ্ঞতার কথা প্রমাণ করেছে। পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রচণ্ড ফ্যাসিস্ট হামলা, জনগণের মহান প্রতিরােধ ও ভূমিকা, সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ এবং ছয় পাহাড়ের দালালদের প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ এ সময়কার প্রচণ্ড ঝড়তরঙ্গে তারা সম্পূর্ণ বিগড়ে যায় এবং তাদের প্রকৃত ক্ষুদে বুর্জোয়া চরিত্র প্রকাশ পায়।
তারা মহান চীনা সর্বহারা এবং ভারত ও অন্যান্য দেশের সর্বহারাদের সঠিক ভূমিকাকে বিরােধিতা করে।
তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী কুকুর ছয় পাহাড়ের দালালদের নেতৃত্বে প্রগতিবিরােধী প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধকে সমর্থন করে।
তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলা দখল স্বাগত জানায়; ভারতের তাবেদার বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে স্বাগত জানায়, প্রকাশ্যে চীনকে বিরােধিতা করে।
পূর্ব বাংলায় জাতীয় প্রশ্নে বৈদেশিক হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানায় এবং সত্যিকার সর্বহারাদের নেতৃত্বে জাতীয় সংগ্রাম ব্যাহতকারী, সর্বহারা বিপ্লবীদের হত্যাকারী, পূর্ব বাংলার জনগণ এবং বাঙালী জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টদের সমর্থন করে। এভাবে তারা পূর্ব বাংলায় সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের পদলেহী কুকুর ছয় পাহাড়ের দালালদের তল্পীবাহকে পরিণত হয় এবং পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তারা সশস্ত্র সংগ্রামকে বাদ দিয়ে পার্লামেন্টারী নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেয়, বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে স্বীকার করে, সম্প্রসারণবাদীদের স্বাগত জানায়, চীনকে বিরােধিতা করে, জ্যোতিবসু-নাম্বুদ্রিপদের অনুসরণে প্রকাশ্যে পার্টি গঠনের প্রতিক্রিয়াশীল জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়।
পৃষ্ঠা: ২১০

তারা এতদূর নাকে খত দেয় যে, দেবেন সিকদার ছয় পাহাড়ের দালালী, জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদী শাসন ও লুণ্ঠনের স্তম্ভ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ অর্থাৎ, মুজিববাদের সাথে একাত্ম ঘােষণা করে।
তারা শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্য কমিউনিস্ট পার্টি নামধারী বুর্জোয়া উপদল গঠন করে।
এভাবে তাদের সাথে যুক্ত আন্তরিকভাবে বিপ্লবীদেরকে ছয় পাহাড়ের দালাল। ফ্যাসিস্ট বাহিনীর সামনে প্রকাশ করে দেয় এবং তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে ফেলে।
তাদের এ সকল জঘন্য কার্যকলাপ তাদের কবরে যাওয়ার পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করেছে।
দেবেন-বাসার আমাদের সম্পর্কে বলে যে, আমাদের রাজনীতি ঠিক, কিন্তু আমরা জনগণের সাথে যুক্ত নই, আমরা ট্রটস্কীবাদী।
একথা বলে তারা প্রমাণ করছে যে, মার্কসবাদের ক-খ-গ সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞান নেই, তারা ভাববাদী।
যারা ট্রটস্কীবাদী তারা কখনও রাজনীতিতে ঠিক হতে পারে না। তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বদাই বিচ্যুতি ঘটাবে। কাজেই আমরা যদি ঐটস্কীবাদী হই তবে অবশ্যই আমরা রাজনীতিতে ঠিক হতে পারি না। এভাবে তারা নিজেরাই নিজেদের বক্তব্যকে খণ্ডন করছে।
সভাপতি মাও বলেছেন, “মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কোথা থেকে আসে? সেগুলাে কি আকাশ থেকে পড়ে? না। সেগুলাে কি নিজের মনে সহজাত? না। মানুষের নির্ভুল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সামাজিক অনুশীলন থেকেই আসে; সমাজের উৎপাদনের সংগ্রাম, শ্রেণী সংগ্রাম ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা-এই তিনটা অনুশীলন থেকেই সেগুলাে আসে।”
ইহাই ব্যক্ত হয়েছে সভাপতি মাও-এর দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কর্মপদ্ধতি গণলাইনের মাধ্যমে, “আমাদের পার্টির সমস্ত বাস্তব কাজকর্মে সমস্ত নির্ভুল চিন্তাধারার নেতৃত্ব অপরিহার্যভাবে হচ্ছে জনসাধারণের থেকে আসা এবং জনসাধারণের নিকট নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।”
আমরা জনসাধারণের সাথে যুক্ত হয়ে তাদের উৎপাদনের সংগ্রাম, শ্রেণী সংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মহান অনুশীলনের অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছি। তাকে সুব্যবস্থিত মতে রূপান্তরিত করেছি, (রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক এবং অন্যান্য লাইনে) তা পুনরায় জনসাধারণের নিকট গিয়ে কার্যকরী করেছি, এ প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে আমাদের সঠিক রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লাইন।
আমরা রাজনীতিতে ঠিক কিন্তু জনগণের সাথে যুক্ত নই-এ কথার অর্থ আমাদের সঠিক রাজনৈতিক লাইন আকাশ থেকে পড়েছে বা সহজাত। ইহা পরিষ্কার ভাববাদ; বস্তু থেকে চেতনা আসে’ এই বস্তুবাদী নীতির পরিপন্থী চেতনা সহজাত, বস্তুনির্ভরশীল নয়’-এই ভাববাদী তত্ত্ব।
তাদের এই বক্তব্য দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও গণলাইনের কাজের পদ্ধতির বিরােধী।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর সত্যিকার বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার জন্য “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন” প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর কারণ, পূর্ব বাংলায় যে সকল কমিউনিস্ট নামধারী বুর্জোয়া উপদল ছিল, তারা সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধি বা বিপ্লবী ছিল না; তারা বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী বুর্জোয়া উপদল ছিল।
দেবেন-বাসার আমাদের সঠিক বলেও আমাদের সাথে শর্তহীনভাবে যােগ না দিয়ে
পৃষ্ঠা: ২১১

বয়সকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বলছে, এখানে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি ছিল এবং তারা তার প্রতিনিধি। এটাকে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে নিজেদের মৃত্যু পরােয়ানা জারী করা।
একথা দ্বারা “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টিকে তারা বিরােধিতা করছে এবং বয়সের জোরে আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব দাবী করছে এবং আমাদেরকে তাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বলছে।
এভাবে তারা প্রমাণ করছে তারা ভাগ্যান্বেষী ও নেতৃত্বলােভী।
তারা তাদের কার্যকলাপ দ্বারাই নিজেদের মৃত্যু পরােয়ানা জারী করেছে, পূর্ব বাংলার জনগণ ও বিপ্লবীরা অচিরেই তাদেরকে চূড়ান্তভাবে কবরস্ত করবে। তাদের এ সকল জঘন্য কার্যকলাপ তাদের কবরে যাওয়ার পদক্ষেপকে ত্বরান্বিত করছে।

কাজী-রণাে-মেনন ষড়যন্ত্রকারী
এরা ব্যক্তিগত কোন্দলকে রাজনৈতিক রূপ দেয় এবং ছাত্র ইউনিয়নের বিপ্লবীদের প্রতারিত করে এবং ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করে তার নেতৃত্ব কজা করে।
তারা প্রথমে হক-তােয়াহাদের সাথে যুক্ত হয়, কিন্তু নেতৃত্ব ও ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব বাধলে তারা বিভিন্ন সংগঠনে নেতৃত্ব দখলের জন্য জঘন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়।
তারা মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে সভাপতি মাও-এর পাগলামী বলে উল্লেখ করে একে বিরােধিতা করে এবং লিউশাওচিকে সমর্থন করে।
এরা নকশালবাড়ীর মহান কৃষক বিদ্রোহকে বিরােধিতা করে এবং একে সি.আই.এ’র কারবার বলে উল্লেখ করে।
এরা মতিন-আলাউদ্দিনের সাথে যুক্ত হয় এবং তাদের সাথে কাজ করে। পরবর্তীকালে ক্ষমতার কারণে তারা সরে আসে। পুনরায় হক-তােয়াহাদের সাথে জড়িত হয়।
ইতিমধ্যে এরা ট্রেড ইউনিয়নের একাংশ, ছাত্র ইউনিয়নের একাংশ দখল করে।
তারা তাদের চক্রান্ত আরাে সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য কমিউনিস্ট সমন্বয় সাধন কমিটি গঠন করে।
রাজনীতি হিসেবে তারা উত্থাপন করে পূর্ব বাংলার উপর জাতীয় নিপীড়নকে বিজাতীয় শােষণ বলে। এভাবে শত্রুকে চিহ্নিত না করে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
শেষ পর্যন্ত নিজেদেরকে নকশাল হিসেবে জাহির করার জন্য কৃষকের সাথে সামন্ত বাদের দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব, শ্রেণী শত্রু খতমের কথা বলে।
এভাবে তারা হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনের অনুরূপ ভুল করে। তারা পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক হাজার একটা কুৎসা, অপবাদ ও গুজব রটনা করে, এমন কি একে সি.আই.এ’র এজেন্ট বলে প্রচার করে।
তারা পঁচিশে মার্চের পর ভারতে যায়, জাতীয় দ্বন্দ্বকে বিনা আত্মসমালােচনায় প্রধান দ্বন্দ্ব বলে, জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয় এবং জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটিতে যােগ দেয়। এভাবে তারা দেবেন-বাসারদের অনুরূপ কাজ করে।
তারা ছয় পাহাড়ের লেজুড়বৃত্তি করে, নিজেদের সাংগঠনিক স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দেয়, “মুক্তি বাহিনীতে যােগ দেয় এবং প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধ করে। তাদের নিজেদের কোন স্বতন্ত্র গেরিলা গ্রুপ ছিল না একথা তারা প্রকাশ্য বক্তব্যে স্বীকার করেছে।
পৃষ্ঠা: ২১২

তারা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের নিরস্ত্র ও খতম করার কাজে কয়েক স্থানে মুক্তি বাহিনী’র ফ্যাসিস্টদের সাথে শরীক হয়।
পূর্ব বাংলায় ভারতের উপনিবেশ স্থাপনকে তারা স্বাগত জানায়, পূর্ব বাংলার পুতুল সরকারকে তারা স্বাগত জানায়। তারা প্রকাশ্যে পার্টি তৎপরতা চালায়। ফলে তাদের সাথে যুক্ত খাটি বিপ্লবীরা বিপদগ্রস্থ হয়।
এরা ছয় পাহাড়ের দালালদের কর্তার নির্দেশে অস্ত্র জমা দেওয়া সমর্থন করে। এভাবে তাদের মধ্যকার সত্যিকার বিপ্লবীদের নিরস্ত্র করে। তারা প্রকাশ্যে চীনকে বিরােধিতা করে।
বর্তমানে তারা জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদের অনুসরণে প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট নামধারী বুর্জোয়া উপদল গঠনের পাঁয়তারা করছে।
তারা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার করেছে। মাহবুবুল্লাহও বর্তমানে কাজী-রণােদের মতাে কার্যকলাপ চালাচ্ছে।
পূর্ব বাংলায় দাঁড়কাক ও ময়ূরের গল্প রয়েছে। দাঁড়কাক নিজেকে ময়ূর সাজাবার জন্য ময়ূরের পালক গায়ে লাগায়। কিন্তু ময়ূরের ঠোকর লেগে তার সব পালক পড়ে যায় এবং প্রকৃত দাঁড়কাকের কালাে চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সে পালায়।
এ সকল বুর্জোয়াদের এজেন্ট বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী নেতৃত্ব মার্কসবাদের পালক লাগিয়ে নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে জাহির করা এবং সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণকে প্রতারিত করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রচণ্ড বিপ্লবী ঝড়তরঙ্গে তাদের পালক খসে পড়ে। তাদের প্রকৃত বুর্জোয়াদের প্রতিনিধির কদর্য চেহারা প্রকাশ হয়ে পড়ে।
হক-তােয়াহা-বশির নিজেদেরকে পূর্ব বাংলার লিউশাওচী-ক্রুশ্চোভ হিসেবে তুলে ধরেছে।
দেবেন-বাশার-কাজী-রণে নিজেদেরকে জ্যোতিবসু-নাম্বুদ্রিপদ হিসেবে তুলে ধরেছে। মতিন-আলাউদ্দিন ট্রটস্কী-চে হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করেছে।
সভাপতি মাও বলেছেন, “ধ্বংসােনুখ শত্রুকে তাড়া কর এবং চূড়ান্তভাবে ধ্বংস কর।” আমরা অবশ্যই এ ধ্বংসােনুখ শত্রুদেরকে তাড়া করে চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করব। এ সকল পুঁজিবাদের প্রতিনিধি কর্তাস্থানীয় বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ন্যায়সঙ্গত”-এ পতাকা উর্ধে তুলে ধরে বিদ্রোহ করব।
আসুন, আমরা সর্বহারা বিদ্রোহীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং পূর্ব বাংলার বিশেষ অনুশীলনে তার বিশেষ প্রয়ােগের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হই, সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার অনৈক্যকে দূর করি, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত, সুশৃংখলিত, সমালােচনা-আত্মসমালােচনার পদ্ধতি প্রয়ােগকারী, জনগণের সাথে যুক্ত, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী এবং এককেন্দ্রীক পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি গড়ে তুলি।
পৃষ্ঠা: ২১৩

সশস্ত্র বাহিনী দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ও পার্টি দিবস উদযাপন করুন,
বিপ্লবী কাজ জোরদার করুন!
(এপ্রিল, ১৯৭২)
[ “লালঝাণ্ডা/১”-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধ হিনেবে প্রকাশিত-প্রকাশক।]

৩০শে এপ্রিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র বাহিনী দিবস, ১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস, এবং ৩রা জুন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি দিবস।
এক বৎসর পূর্বে ৩০শে এপ্রিল কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রত্যক্ষ পরিচালনায় বরিশালের পেয়ারা বাগানে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে উঠে। এভাবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের ইতিহাসে, পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর ক্ষমতা দখলের সংগ্রামের ইতিহাসে এক নূতন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এভাবে পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সর্বপ্রথম নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলা, নিয়মিত বাহিনীর সাহায্যে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা, জনগণের মাঝে প্রচার করা, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, তাদের ভূমি ও অন্যান্য সমস্যার সমাধান করা, জাতীয় সংগ্রামের সাথে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের যথাযথ সমন্বয় সাধন করা, জনগণকে সশস্ত্র করে গ্রামরক্ষী বাহিনী, স্থানীয় গেরিলা গ্রুপ, নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলা, তাদেরকে কৃষক মুক্তি সমিতি, নারী মুক্তি সমিতি ও অন্যান্য গণসংগঠনে সংগঠিত করা, সেনাবাহিনীর মাঝে পার্টি-সংগঠন গড়ে তােলা, সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক কাজের সাথে সামরিক কাজের যথাযথ সমন্বয় করা, সেনাবাহিনীকে সম্প্রসারিত করা; ঘাটি এলাকা গঠন ও তা সম্প্রসারিত করা, অস্ত্র, খাদ্য, বস্ত্র, অর্থের সংস্থান করা, ঘেরাও-দমন জনিত সমস্যার সমাধান করা এবং সেনাবাহিনীর কমান্ড সমস্যা, সামগ্রিক এলাকায় পার্টি নেতৃত্বের সমস্যা, শত্রুর ঘেরাও-দমন অভিযান জনিত সমস্যা প্রভৃতি সশস্ত্র বিপ্লবের মৌলিক সমস্যার সমাধান করা হয়।
পার্টি এর ফলে সর্বাধিক মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করে যা বিপ্লব পরিচালনায় অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূর প্রসারী তাৎপর্য সম্পন্ন।
এ সকল সমস্যাবলীর যথাযথ সমাধান সম্ভব হয়েছে আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড সিরাজ সিকদারের সরাসরি নেতৃত্বে। তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতু চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনের সাথে সমন্বয় সাধন করেন এবং সাফল্যজনকভাবে উপরােক্ত সমস্যাবলীর সমাধান করেন এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের জন্য সুনাম বয়ে আনেন।
সভাপতি মাও বলেছেন, “বিপ্লবী পার্টি ছাড়া বিপ্লব হয় না।” তিনি আরাে বলেছেন, “জনগণের সশস্ত্র বাহিনী ব্যতীত জনগণের কিছুই নেই। কেবলমাত্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত, সমালােচনা-আত্মসমালােচনার পদ্ধতি প্রয়ােগকারী
পৃষ্ঠা: ২১৪

এবং জনগণের সাথে যুক্ত সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্বেই জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলা সম্ভব।
পূর্ব বাংলার মনি সিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী, পূর্ব বাংলার লিউশাওচী-ক্রুশ্চোভ হক-তােয়াহা, জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদ দেবেন-বাসার-কাজী-রণাে-বদরুদ্দীন-অমল, ট্রটস্কী-চেবাদী মতিন-আলাউদ্দিন এবং অন্যান্য বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলা ও জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার মত বিপ্লবের সর্বোচ্চ দায়িত্বের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
ফলে সুদীর্ঘদিন পূর্ব বাংলার জনগণের কিছুই ছিল না। পাক সামরিক ফ্যাসিবাদের চরমতম শােষণ ও নির্যাতন অসহায়ভাবে তাদেরকে ভােগ করতে হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সর্বহারা বিপ্লবীরা বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ৮ই জানুয়ারী ১৯৬৮ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত থেকেই পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন এবং সর্বহারা পার্টি সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি এবং এর নেতৃত্বাধীন জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সশস্ত্র বাহিনী গঠনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বকে আঁকড়ে ধরে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন বিপ্লবী অনুশীলনে লেগে থাকে এবং সাফল্য-বিপর্যয়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে অগ্রসর হয়। সংগঠন এমন সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় যে এক পর্যায়ে কমরেড সিরাজ সিকদার একাই থাকেন বিপ্লবের পতাকাকে উর্ধে তুলে ধরার জন্য। তিনি অটল থেকে বিপ্লবী অনুশীলন চালিয়ে যান।
অনুশীলনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে অনুশীলনের সাথে সমন্বিত করে কমরেড সিরাজ সিকদার পার্টির সঠিক রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত লাইন প্রণয়ন করেন।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন সঠিক লাইনে পরিচালিত হয়ে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় সংগঠন গড়ে উঠে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই পার্টির অধীন প্রধান ধরনের সংগঠন হিসেবে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার প্রতি মনােনিবেশ করে।
রাজনৈতিক কমিসারের নেতৃত্বে গেরিলা গ্রুপ, গেরিলা গ্রুপ পরিচালনার জন্য পার্টি কমিটির অধীন কমান্ড গড়ে তােলা হয়। গেরিলাদের রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদান করা হয়। লড়াই ছাড়াও তাদেরকে জনগণের মধ্যে প্রচার করা, তাদেরকে সংগঠিত করা, সশস্ত্র করা, তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম করা, তাদের মাঝে পার্টি সংগঠন গড়ে তােলা, তাদের মধ্য থেকে গেরিলা সংগ্রহ করার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিক্ষা প্রদান করা হয়।
এর ফলে গেরিলারা সর্বদাই পার্টির নেতৃত্বে অটল থেকে কার্য পরিচালনা করে। এই গেরিলা গ্রুপ সমূহের নেতৃত্বেই পাকিস্তান কাউন্সিল কেন্দ্র, মার্কিন তথ্য কেন্দ্র, বি.এন. আর- এ বােমাবর্ষণ করা হয় এবং ফটিকছড়িতে সর্বপ্রথম জাতীয় শত্রু খতম করা হয়।
১৯৭১-এর মার্চের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংগঠন সঠিক পথে অগ্রসর হয় এবং জনগণের প্রতি অহিংস অসহযােগের ভুল পথ পরিত্যাগ করে সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়।
পৃষ্ঠা: ২১৫

পঁচিশে মার্চের পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব, বিশেষ করে কমরেড সিরাজ সিকদার ভারতে পলায়ন না করে জনগণের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গ্রামে যান। কমরেড সিরাজ সিকদারের সরাসরি নেতৃত্বে বরিশালের পেয়ারা বাগানের মহান সংগ্রাম পরিচালিত হয়, আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে সঠিক পথে পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়, পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক, সামরিক , সাংগঠনিক ও অন্যান্য লাইন অনুশীলনের অগ্নি পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয় শর্তাবলীর উপস্থিতি কমরেড সিরাজ সিকদার সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের বৈঠকে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের কামানের গােলার শব্দের মাঝে পেয়ারা বাগানে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালের ৩রা জুন পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
পার্টি প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ দাবানলের মত বহু জেলায় বিস্তৃত হয়, সমগ্র পূর্ব বাংলার জনগণের নেতৃত্ব গ্রহণের মত অবস্থার শর্তসমূহ গড়ে উঠে।
এ সময় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের তাবেদার ছয় পাহাড়ের দালালরা ভারত থেকে সশস্ত্র হয়ে আসে এবং আমাদের পার্টি ভেঙ্গে দিয়ে, অস্ত্র জমা দিয়ে আমাদের কামানের খােরাক হতে বলে।
ইতিমধ্যে দেবেন-বাসার, কাজী-রণাে, বদরুদ্দীন-নজরুল এবং আরাে কয়েকটি বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী উপদল জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদের ছত্রছায়ায় তথাকথিত ‘সমন্বয় কমিটি গঠন করে। তারা আমাদেরকে প্রলুব্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ এবং তার তাবেদারদের বিরােধিতার নামে হক-ততায়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের সাথে আঁতাত করে এবং তাদের রাজাকারে পরিণত হয়।
মনি সিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা ছয় পাহাড়ের লেজুড়ে পরিণত হয়।
এ জটিল পরিস্থিতিতে কমরেড সিরাজ সিকদার সঠিকভাবে আহ্বান জানান আমাদের পার্টি ও গেরিলাদের স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে, স্বাধীনতা ও স্বতন্ত্রতা বিসর্জন দিয়ে কোন প্রকার ঐক্য না করতে। তিনি আওয়ামী লীগ ও মুক্তি বাহিনীর শ্রেণী বিশ্লেষণ করে তাদেরকে ছয় পাহাড়ের দালাল হিসেবে তুলে ধরেন এবং তাদের সাথে আলােচনায় সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন।
তিনি “সমন্বয় কমিটি গঠনের মার্কসবাদ বিরােধী পদক্ষেপের স্বরূপ তুলে ধরেন। এবং সমন্বয় কমিটিস্থ উপদলের সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতি উপদল ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের। নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি হক-তােয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিনদের বিশ্বাসঘাতক কার্যকলাপের স্বরূপও তুলে ধরেন।
এ সময় কমরেড সিরাজ সিকদার বিভিন্ন ফ্রন্টে ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টদের বিষয়ে কর্মীদের সতর্ক করেন, কর্ম পদ্ধতি পালটিয়ে জনগণের সাথে একীভূত হয়ে। গােপনভাবে কাজ করার নির্দেশ পাঠান।
পৃষ্ঠা: ২১৬

কিন্তু বিভিন্ন ফ্রন্টের কর্মীরা এ সকল গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ যথাযথভাবে পালনে ব্যর্থ হন। ফলে তাঁরা ছয় পাহাড়ের দালালদের শিকারে পরিণত হন। বিভিন্ন ঘাটি সমুহ হস্তচ্যুত হয়, বহু কর্মী ও গেরিলা প্রাণ হারায়, বহু অস্ত্র খােয়া যায়। আমাদের নেতৃত্বে। সঠিক পথে পরিচালিত জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ব্যাহত হয়।
এ জটিল পরিস্থিতিতে কমরেড সিরাজ সিকদার “বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে কয়েকটি দলিল” ১নং ও ২নং এবং “দেশপ্রেমিকের বেশে ছয় পাহাড়ের দালাল” প্রভৃতি দলিলে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্ট ও ছয় পাহাড়ের দালাল উভয়কে বিরােধিতা করা, গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, জনসমর্থনকে ব্যবহার করা, সুশৃংখল পশ্চাদপসরণের নির্ভুল নির্দেশ প্রদান করেন, যার ফলে এ জটিল পরিস্থিতিতেও কর্মীদের সঠিক রাজনৈতিক দিশা বজায় থাকে।
এ সময় মহান গণচীনের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবীদের মাঝে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। এ সকল দলিল এবং কমরেড সিরাজ সিকদার বিভিন্ন আলােচনার মাধ্যমে সভাপতি মাওয়ের পররাষ্ট্র নীতির সঠিকতা তুলে ধরেন। ফলে আমাদের সংগঠনে এ প্রশ্নে কোন বিভ্রান্তি দেখা দেয়নি।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলা আক্রমণ ও দখলের মত জটিল পরিস্থিতিতে কমরেড সিরাজ সিকদার সঠিকভাবে “অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন” দলিলের মাধ্যমে পরিস্থিতির সময়ােচিত বিশ্লেষণ দেন এবং বর্তমান করণীয় তুলে ধরেন।
আমাদের নীতিকে ঠিক রেখে কৌশলগত প্রচারের মাধ্যমে ব্যাপক জনগণকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করবার জন্য কমরেড সিরাজ সিকদার খােলা চিঠি প্রণয়ন করেন।
ইহা ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করে এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার পুতুল বাংলাদেশ সরকার বিরােধী সর্বপ্রথম প্রচার পত্র হিসেবে কাজ করে।
পূর্ব বাংলার সমাজের নূতন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পার্টি জরুরী ভিত্তিতে প্রথম জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। এর ফলে কর্মীরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করেন। কংগ্রেস পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করে তার কাজ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত করে।
কংগ্রেস উত্তর অতি অল্প সময়ের মাঝেই পার্টির কর্মীদের পুননিয়ােগ সাফল্যজনক ভাবে সমাপ্ত হয় এবং অনুশীলনে পার্টির নূতন রাজনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইন সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
ইতিমধ্যে কমরেড সিরাজ সিকদার “অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন” দলিল পরিবর্ধিত ও সংশােধিত আকারে রচনা করেন। ইহা ব্যাপক জনগণের মাঝে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। পূর্ব বাংলার জনগণের ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং ছয় পাহাড়ের দালাল বিরােধী সংগ্রামের ইহা একটি মহান ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কর্মসূচী।
পূর্ব বাংলার সমাজের জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নির্ভুল, ঐক্যবদ্ধ, এককেন্দ্রীক সর্বহারার রাজনৈতিক পার্টি হিসেবে বিকাশ লাভ করে।
পক্ষান্তরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা মারাত্মক সংকটে পতিত হয়, তারা নিঃসঙ্গ, অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত, বিভক্ত এবং দেউলিয়া।
পৃষ্ঠা: ২১৭

কমরেড সিরাজ সিকদার সর্বহারা বিপ্লবীদের প্রতি সময়ােচিত আহ্বান জানান বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য।
পূর্ব বাংলার পাকিস্তানে যােগদানের পরবর্তী বিশ বৎসরকাল বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ব্যতিরেকেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং পূর্ব বাংলার ও বিশ্বের বিপ্লব ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
কমরেড সিরাজ সিকদার তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, সর্বহারা বিপ্লবীদের বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন এবং পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব বাংলায় সর্ব প্রথম সঠিক রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লাইন এবং কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করেন।
তার সঠিক পরিচালনায় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন অসংখ্য প্রতিকূলতা কাটিয়ে অগ্রসর হয়। শ্রমিক আন্দোলন তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সমাপ্ত করে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি” প্রতিষ্ঠা করে।
পঁচিশে মার্চের পরবর্তীকালিন জটিল পরিস্থিতি, ভারত কর্তৃক পূর্ব বাংলা দখল করার ফলে উদ্ভূত গুরুতর সমস্যাবলী, অর্থাৎ এ সময়কার প্রচণ্ড ঝড়-তরঙ্গের মাঝেও পার্টি কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সঠিক পথে অগ্রসর হয় এবং অতিশয় মূল্যবান ও সুদূরপ্রসারী তাৎপর্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করে।
অতীত ও বর্তমানের সাফল্য, কঠোর প্রয়াশের পরিণতি হিসেবে সমগ্র পূর্ব বাংলায় গণভিত্তিক পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বিকাশ লাভের শর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টির প্রতিটি সফলতা ও বিজয় অর্জিত হয়েছে কমরেড সিরাজ সিকদার কর্তৃক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে সৃজনশীল প্রয়ােগের ফলে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস এবং পার্টি দিবসে সমগ্র পার্টির কর্মী, গেরিলা ও সহানুভুতিশীলরা আন্তরিকভাবে কমরেড সিরাজ সিকদারের দীর্ঘজীবন কামনা করেন, কমরেড সিরাজ সিকদার কর্তৃক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার অধিকতর সাফল্যজনক প্রয়ােগ কামনা করেন।
সমগ্র পার্টির কমরেডগণ কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে ঐক্য ও শৃংখলা জোরদার করবেন, পার্টির এক কেন্দ্রকে শক্তিশালী করবেন। তিনটি বৃহৎ শৃংখলা ও মনােযােগ দেবার আটটি ধারা দৃঢ়ভাবে পালন করবেন। সমগ্র পূর্ব বাংলা ব্যাপী গণভিত্তিক পার্টি গড়ে তুলবেন; সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন, সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করবেন। নিজেদের অধিকতর বিপ্লবীকরণ করবেন, আত্মবলিদানে নির্ভয় হয়ে সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে বিরাট বিজয় অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে কাজ করে যাবেন, শহীদ কমরেড ও জনগণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করবেন।
সমগ্র পার্টির কমরেডগণ মনােযােগের সাথে কমরেড সিরাজ সিকদারের রচনাবলী পাঠ ও প্রয়ােগ করবেন এবং তার নির্দেশ সমূহ দৃঢ়তার সাথে কার্যকরী করবেন।
পৃষ্ঠা: ২১৮

সমগ্র পার্টি অবশ্যই সশস্ত্র বাহিনী দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস এবং পার্টি দিবস উদযাপনের সময় উপরােক্ত লক্ষ্যসমূহ অর্জনের জন্য প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করবেন।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা-জিন্দাবাদ!।
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকুন-সভাপতি মাওসেতুঙ!
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ!
কমরেড সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ!
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকুন-কমরেড সিরাজ সিকদার!
পৃষ্ঠা: ২১৯

সংক্ষিপ্ত সংবাদ
(এপ্রিল, ১৯৭২)
[“লালঝাণ্ডা”/১-এ প্রকাশিত প্রকাশক।]

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ‘বতঃস্ফূর্তভাবে বিকাশ লাভ করছে।
ঢাকায় সম্প্রতি কিছুসংখ্যক বিপ্লবী পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে যােগাযােগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু যােগাযােগ করতে না পেরে নিজস্ব উদ্যোগেই তারা পার্টির বক্তব্য পােস্টার ও দেয়ালে লিখে প্রচার করতে থাকে। তারা ঠিক করে পার্টির বক্তব্যে তারা কাজ করে যাবে এবং একদিন না একদিন যােগযােগ হবেই। ঢাকায় তাদের পােস্টার দেখা যায়। পরে তাদের সাথে যােগাযােগ হয়।
কিছুদিন পর এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। হক-তােয়াহাদের সাথে যুক্ত ছিল এরূপ কিছু সংখ্যক বিপ্লবী আমাদের সাথে যােগাযােগ করার জন্য চেষ্টা চালায়, কিন্তু যােগাযােগ করতে না পেরে নিজেরাই পার্টির বক্তব্য অনুযায়ী কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা একাই প্রকাশ্য খােলাচিঠি সাইক্লো করে দেয়ালে লাগায় যােগাযােগ করার জন্য।
তাদের সাথেও যােগাযােগ হচ্ছে।
এভাবে বিভিন্ন স্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপ্লবীরা এগিয়ে আসছে সর্বহারা পার্টিতে যােগদানের জন্য।

* সম্প্রতি ভােলায় কুখ্যাত জাতীয় শত্রু জামাতে ইসলামীর পাণ্ডা ও ডাকাত সর্দার জেবল কেরাণী আমাদের কৃষক গেরিলাদের হাতে খতম হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জে কুখ্যাত জাতীয় শত্রু টাউট ইয়াসিন শেখ আমাদের গেরিলাদের হাতে খতম হয়েছে।
যশােহরে জনৈক কুখ্যাত জাতীয় শত্রু আমাদের গেরিলাদের হাতে খতম হয়েছে। এর বিষদ বিবরণ এখনও পৌঁছেনি।
বরিশালের দক্ষিন অঞ্চলে আমাদের গেরিলারা কয়েকটি বন্দুক জোর করে দখল করেছে।
পৃষ্ঠা: ২২০

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরী সার্কুলার
(সার্কুলার নং-৫, তাং-৩০/৪/৭২)

পার্টি, বিপ্লব, জনগণ বিরােধী কার্যকলাপকে দৃঢ়ভাবে বিরােধিতা করুন সম্প্রতি ফজলু-সুলতান পার্টির মধ্যে একটি চক্র গঠন করে এবং জঘন্য পার্টি, বিপ্লব ও জনগণ বিরােধী ষড়যন্ত্র ও কার্যকলাপ চালায়।
* তারা ষড়যন্ত্র করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কমরেডদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত পার্টির অর্থ চুরি করে আত্মসাৎ করার চেষ্টা চালায়।
ফজলু পার্টির বিশ্বাস ভঙ্গ করে, বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং পার্টির সভাপতি বা কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমতি ব্যতীত ২,০০০/- টাকা (দুই হাজার) পার্টির ফান্ড থেকে চুরি করে। এ জঘন্য অপরাধ তারা পার্টিকে রিপাের্ট করেনি। অর্থ চুরি করার উদ্দেশ্যঃ
১) অর্থনৈতিকভাবে পার্টিকে নিঃস্ব করে দেওয়া যাতে পার্টি সার্বক্ষণিক কর্মী চালাতে না পারে, প্রচার করতে না পারে এবং যােগাযােগ বজায় রাখতে না পারে অর্থাৎ পার্টির কাজ যাতে বন্ধ হয়ে যায়।
২) তারা যাতে অর্থ দ্বারা তাদের চক্রান্তমূলক কাজ করে যেতে পারে
৩) অর্থের কারণে যাতে পার্টি এ চক্রের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
৪) ইচ্ছা, খুশীমত পার্টির অর্থ অপব্যয় করা।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল পার্টির সকল অর্থ চুরি করা। কিন্তু পার্টির সতর্কতার কারণে তারা অধিক টাকা চুরি করতে ব্যর্থ হয়।
* ফজলু কমরেডদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পার্টির অস্ত্র গােপনে চক্রান্তমূলক উদ্দেশ্যে সরিয়ে রাখে।
* পার্টির একটি অর্থনৈতিক অপারেশনে ফজলুর অংশগ্রহণের কথা ছিল। সে এ অর্থ নিয়ে পলায়নের চেষ্টা করেছিল।
* ফজলু বিভিন্ন স্থানে পার্টির কমরেডদের নিকট নেতৃত্বের বিরুদ্ধে, কোন কোন কমরেডদের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যা অপবাদ, গুজব রটায় এবং তাদেরকে তা রিপাের্ট না করার জন্য বলে। এভাবে সে ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করে।
* তারা একজনের কাছে যা বলে তা অপরের কাছে অস্বীকার করে, মিথ্যা কথা বলে, অভিনয় করে, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, পুরােপুরি ক্রুশ্চোভের মত কাজ করে। এ ধরনের কার্যকলাপ তারা নতুন পার্টি কর্মী এবং সহানুভূতিশীলদের মাঝেও করে।
* কেন্দ্রীয় কমিটি, তার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মনগড়া বক্তব্য পেশ করে এবং কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার সভাপতির প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে এবং কর্মীদের মাঝে অনাস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করে।
* পার্টির সঠিক নীতি ও কর্মপদ্ধতি এবং কমরেড সিরাজ সিকদারের পরিচালনায়
পৃষ্ঠা: ২২১

পেয়ারা বাগানের মহান সংগ্রাম এবং কমরেডদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে কর্মীরা বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ফজলু এই জনপ্রিয়তা এবং সামন্তবাদী আত্মীয়তার সুযােগ নিয়ে পার্টির মধ্যকার সুবিধাবাদীদের ঐক্যবদ্ধ করে একটি উপদল গঠন করার জন্য এ ধরনের জঘন্য কার্যকলাপ চালাচ্ছে।
তাদের উদ্দেশ্য পুরােপুরি ব্যক্তিস্বার্থ, পার্টি-কর্তা, পার্টির নেতা হওয়া।
* তারা কোন এক অসুস্থ কর্মীর নিরাপত্তা পর্যন্ত বিঘ্নিত করে।
* তারা পার্টির শৃংখলা ভঙ্গ করে। কোন কোন কর্মীকে অবৈধভাবে ডেকে আনে, পত্র দেয়, চক্রান্তের জাল ছড়ায়, পরস্পরকে রক্ষা করে। এভাবে পার্টির মাঝে ফজলুসুলতান চক্র অপর একটি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। এভাবে তারা শত্রুর মতাে কার্যকলাপ করছে এবং প্রকৃত অর্থে শত্রুকে সহায়তা করছে।
* জনৈক কর্মী এসকল বিষয় অনুসন্ধান করতে গেলে ফজলু পলায়ন করে।
* পার্টির সকল কর্মী ও সহানুভূতিশীল এসকল চক্রান্ত ষড়যন্ত্র এবং উপদলীয় কার্যকলাপের বিরােধিতা করবেন এবং ফজলু-সুলতান চক্রের কার্যকলাপের সাথে জড়িয়ে পড়বেন না।
* সভাপতি মাও বলেছেন, “পার্টি ও জনগণের উপর আস্থা রাখ, এছাড়া কিছুই হবে।” পার্টির উপর আস্থা রাখার অর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার সভাপতি কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রতি আস্থা রাখা।
আপনারা অবশ্যই কমরেড সিরাজ সিকদারের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে ঐক্যকে আরাে দৃঢ় করবেন, সুবিধাবাদীদের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও উপদলীয় কার্যকলাপকে চূর্ণবিচূর্ণ করবেন।
* এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক শাস্তি স্বরূপ ফজলু-সুলতান চক্রকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সকল পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। তারা সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে পরিগণিত হবে না।
নতুন কর্মী, সহানুভূতিশীল সংগ্রহ করা, কর্মী, সহানুভূতিশীল পরিচালনা করা, যােগাযােগ করা, সাংগঠনিক ও সামরিক কাজে অংশগ্রহণ করা, পার্টির লােক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেওয়ার তাদের অধিকার বাতিল করা হচ্ছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কোন কর্মী, সহানুভূতিশীল বা নতুন কর্মী হতে ইচ্ছুক বিপ্লবীরা এই চক্রের সাথে কোন যােগাযােগ রাখবেন না। এদের মাধ্যমে সংগঠনের সাথে কোন যােগাযােগ হবে না। এদের কার্যকলাপ আরাে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
ফজলু-সুলতান চক্রের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে তার! যেন জামালপুরের সাদেকবেবী চক্রের পরিণাম, বরিশালে আবুল হাসান-শান্তিলাল চক্রের পরিণাম, পৃথিবীর সকল ষড়যন্ত্রকারী চক্রের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, চক্রান্ত ভেঙ্গে দিয়ে অর্থ-অস্ত্র পার্টির কাছে জমা দেয়, সমগ্র পার্টির নিকট নিজেদের অপরাধ সমূহের জন্য প্রকাশ্য আত্মসমালােচনা করে, পার্টির কাছে শাস্তি প্রার্থনা করে, নিজেদের সংশােধনের সুযােগ চায়।
সিরাজ সিকদার, সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
পৃষ্ঠা: ২২২

কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের
ইশতেহার
(৮ মে, ১৯৭২)

প্রথম অংশ
কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ৬ই মে, ১৯৭২ সাল শুরু হয় এবং ৭ই মে সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়। সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্য ও বিকল্প সদস্য উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সভায় সভাপতিত্ব করেন।
১) ফজলু-সুলতান চক্র সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত ৩০/৪/৭২ তারিখের ৫নং সার্কুলার কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক গৃহীত হয়।
২) ফজলু-সুলতান চক্র সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটি নিম্নলিখিত তথ্যাবলী সংগ্রহ করে।
* ফজলু-সুলতান চক্র খুলনায় কোন কোন কর্মীকে ভাওতা দিয়ে অসাংগঠনিকভাবে ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠকে শরিক করায়। ইহা সে স্থানীয় নেতৃত্বকে গােপন করে এবং বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের এই সভার বিষয়বস্তু গােপন রাখতে বলে।
* এ সভায় ফজলু চক্র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কোন কোন কমরেডের বিরুদ্ধে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এরূপ জঘন্য, অশ্লীল মিথ্যা অপবাদ, কুৎসা, গুজব রটায়।
* ফজলু-সুলতান চক্র জনৈক অসুস্থ কমরেডকে প্রথম ধরিয়ে দেয়া পরে হত্যার ষড়যন্ত্র করে।
* আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা কমরেড সিরাজ সিকদার, কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্য এবং পার্টির প্রতি বিশ্বস্ত এরূপ কিছু সংখ্যক কমরেডকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে যাতে তারা পার্টির ক্ষমতা দখল করতে পারে।
* ফজলু-সুলতান চক্রের পা চাটা কুকুর জাফর, রিজভী পার্টির অর্থ নিয়ে তাদের প্রভুদের নির্দেশে বিভিন্ন স্থানে যায়, দলত্যাগী সুবিধাবাদীদের সাথে যােগাযােগ করে অস্ত্র সরাবার চক্রান্ত করে।
* ফজলু-সুলতান চক্রের অপর এক পদলেহী কুকুর হামিদকে খারাপ উদ্দেশ্যে চক্রান্তকারীরা এখানে সেখানে পাঠায়।
ফজলু-সুলতান চক্র এবং সুবিধাবাদী ও ষড়যন্ত্রকারীরা কমরেড সিরাজ সিকদারকে সর্বাধিক আক্রমণ করেছে। তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে তার সাথে সংশ্লিষ্ট কমরেডদের জঘন্যভাবে আক্রমণ করেছে, এমনকি হত্যার চক্রান্ত করেছে।
‘শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল’-ইহা প্রমাণ করে চক্রান্তকারীদের ও সুবিধাবাদীদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ভূত প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সাচ্চা কর্মীরা নীতিতে দৃঢ় থেকেছেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারার পবিত্রতা রক্ষা করেছেন, পার্টিকে সুবিধাবাদী ও চক্রান্তকারীদের। পার্টিতে পরিণত করা থেকে রক্ষা করেছেন।
পৃষ্ঠা: ২২৩

অতি সত্ত্বর উপদল ও চক্র ভেঙ্গে দেওয়া এবং শর্তহীনভাবে উপদলীয় চক্রান্তমূলক ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যে লিপ্তদের বহিস্কারের নীতিতে অটল থেকে পার্টি নিম্নলিখিত প্রমাণিত চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, উপদল গঠনকারীদের চিরদিনের জন্য পার্টি থেকে বহিস্কার করেছে।
১) ফজলু ওরফে আহাদ (সেলিম শাহনেওয়াজ পৈত্রিক নাম)। ২) সুলতান ওরফে মাহমুদ ওরফে আকবর (মাহবুব পৈত্রিক নাম)। ৩) জাফর ওরফে কামাল (আজম পৈত্রিক নাম)। ৪) হামিদ (মহসিন পৈত্রিক নাম)। চক্রান্তকারীদের সাথে যুক্ত রিজভীকে পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এই সময় সে পার্টির লােক বলে পরিচয় দিতে পারবে না, লােক সংগ্রহ ও পরিচালনা করতে পারবে না। তার নিকট পার্টির গােপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। পার্টির সাথে যুক্ত কেউই কোন দ্রব্যাদি তাকে প্রদান করবেন না।
এদের সম্পর্কে আরও তথ্য লালঝাণ্ডাতে প্রকাশ করা হবে।
ফজলু-সুলতান চক্রের জঘন্যতম অপরাধ ও কার্যকলাপের জন্য তাদের নিজেদের বিবেক তাদের ক্ষমা করবে না, পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা এবং পূর্ব বাংলার সচেতন জনগণ কখনও তাদের ক্ষমা করবে না এবং যথােপযুক্ত শাস্তি প্রদান করবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি আরও অনুসন্ধান চালিয়ে যাবে এবং চক্রের সাথে যুক্তদের এবং সুবিধাবাদীদের যথােপযুক্ত শাস্তি বিধান করবে।
বর্তমানে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিকাশের চমৎকার অবস্থা বিরাজ করছে। সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী জাতীয় গণভিত্তিক পার্টি বিকাশের অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় এ চক্রান্তকারীদের শত্রুতামূলক কার্যকলাপের ফলে কিছুটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু চক্রান্তকারী ও সুবিধাবাদীদের মুখােশ উন্মােচিত হওয়ায় এবং তাদের বহিস্কারের মাধ্যমে পার্টি চূড়ান্ত বিশ্লেষণে শক্তিশালী হয়েছে।
ফজলু-সুলতান চক্রের উপদল গঠন, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত ও গুপ্তহত্যার মাধ্যমে পার্টির ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে।
ইহা সম্ভব হয়েছে পার্টি ও নেতৃত্বের সঠিক লাইন, নেতৃত্বের সতর্কতা, কর্মীদের আন্তরিকতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং নেতৃত্বের প্রতি অবিচলিত আস্থার কারণে।
কিন্তু সংগঠনের প্রতিকূলতা এখনও কেটে যায়নি। সংগঠনের কাছে প্রকাশ হয়নি এইরূপ সুবিধাবাদী, সুযােগ সন্ধানী, ষড়যন্ত্রকারী ও চক্রান্তকারীরা এই প্রতিকূল আবহাওয়ার সুযােগ গ্রহণ করে সুবিধা আদায় করা এবং নেতৃত্ব দখলের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।
কাজেই পার্টির বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং আভ্যন্তরীণ চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, অন্যদিকে সুবিধাবাদী এবং সুযােগ সন্ধানীদের বিরুদ্ধে দ্বিমুখী আক্রমণের বিরুদ্ধে সমগ্র পার্টিকে সতর্ক থাকতে হবে। এর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত আপােষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, “পানিতে পড়লেও সেখানে পাগলা কুকুরকে পিটানাের নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে।”
সমগ্র পার্টি কমরেড সিরাজ সিকদার ও তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে ঐক্যকে দৃঢ় করবেন, কমরেড সিরাজ সিকদার, তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কমিটির সাচ্চা বিপ্লবীদের রক্ষা করবেন, পার্টির ক্ষমতা যাতে সর্বদাই পরীক্ষিত খাটি বিপ্লবীদের হাতে থাকে তা নিশ্চিত করবেন।
পৃষ্ঠা: ২২৪

দ্বিতীয় অংশ
ছয় পাহাড়ের দালাল কর্তৃক বামপন্থী ও দেশপ্রেমিক জনগণবিরােধী শ্বেত সন্ত্রাস অচিরেই সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী তীব্র আকার ধারণ করবে।
এ সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশপ্রেমিক জনগণ ও বামপন্থীদের খুঁজে বের করা, অস্ত্র খোঁজা, লাল বই খোজা, সরকার বিরােধী প্রচারপত্র খুঁজে বের করা। তারা সর্বাধিক জোর দেবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীলদের খুঁজে বের করা ও খতম করা, অস্ত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি হস্তগত করার জন্য।
এ কারণে সমগ্র সংগঠনকে সতর্ক করা হচ্ছে।
প্রকাশ হয়ে পড়া কমরেড, সহানুভূতিশীল ও বন্ধুগণ, অন্যত্র সরে গােপনভাবে কাজ করবেন। প্রকাশ হয়ে পড়েননি এইরূপ কমরেড, গেরিলা, সহানুভূতিশীল ও বন্ধুগণ। অতিশয় সতর্কতার সাথে কাজ করবেন। গােপনীয়তা বিষয়ক দলিল পাঠ ও প্রয়ােগ করবেন। পুস্তক, অস্ত্র, দলিলাদি নিরাপদে রাখবেন।

তৃতীয় অংশ
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ৬ই মে শুরু হয় এবং ৭ই মে সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
সভায় সকল সদস্য, বিকল্প সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।
সভায় ফজলু-সুলতান সম্পর্কিত কেন্দ্রীয় কমিটির ৫নং সার্কুলার অনুমােদিত হলাে।
এ চক্রের সাথে জড়িত অন্যান্যদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া ও যথাযথ। শাস্তি প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এ সভায় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির যে সকল কর্মী ফজলু-সুলতান চক্রের গুজব, অপবাদ, অসাংগঠনিক কার্যকলাপ, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত জানামাত্র রিপাের্ট করেননি তাদেরকে সমালােচনা করা হয়। তারা এ ধরনের ত্রুটি ভবিষ্যতে পুনরায় করবেন না এবং যথাযথ আত্মসমালােচনা করবেন।
তারা যদি সময়মত রিপাের্ট করতেন তবে বহু পূর্বেই এ চক্রের কার্যকলাপ চূর্ণবিচূর্ণ করা সম্ভব হতাে।
সভায় সমগ্র পার্টিতে জরুরী ভিত্তিতে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং শুদ্ধি অভিযান সংক্রান্ত দলিল (পরিশিষ্ট-১) [এই পুস্তকের ২৩১ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য-প্রকাশক।] গৃহীত হয়।
পার্টির অভ্যন্তরে এখনও যে সকল ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদী, সুযােগ। সন্ধানী রয়েছে তারা ফজলু-সুলতান চক্র সৃষ্ট প্রতিকূল অবস্থার সুযােগ নেবার চেষ্টা করছে।
শুদ্ধি অভিযানের লক্ষ্য হবে চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতিগত ভুল সংশােধন করা, একই সাথে ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী এবং সুবিধাবাদী, সুযােগসন্ধানীদের অবশিষ্টাংশদের খুঁজে বের করা এবং তাদেরকে বাসি উপাদান হিসেবে বর্জন করা।
এজন্য সংগঠনের বর্তমান সাধারণ শ্লোগান হবে, বাসি উপাদান বর্জন কর, টাটকাটা গ্রহণ কর।
সচেতন হয়ে চক্রের সাথে কাজ করেননি, সুবিধাবাদী, সুযােগসন্ধানী হননি, না
পৃষ্ঠা: ২২৫

বুঝে চক্রের সাথে যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু আন্তরিকভাবে অনুতপ্ত, সংশােধনের ইচ্ছুকদেরকে অবশ্যই সংশােধনের সুযােগ প্রদান করা হবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে রােগ সারিয়ে রােগীকে বাঁচানাে, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানাে এবং মতাদর্শগত স্পষ্টতা ও কমরেডদের ঐক্য অর্জন করা।
কেন্দ্রীয় কমিটির শুদ্ধি অভিযানের অগ্রগতির দ্রুত পর্যালােচনার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় কমিটির একটি বর্ধিত পূর্ণাঙ্গ সভা আহ্বান করা হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির জনৈক বিকল্প সদস্যকে কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এ সভায় জনৈক কমরেড সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য এক সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। এ অনুসন্ধান কমিটির রিপাের্টের সাথে ফজলু-সুলতান চক্রের বিভিন্ন গুজব, অপবাদ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি নিম্নলিখিত বিষয়ে আত্মসমালােচনা করেঃ
১) ফজলু সংগঠনে যােগদানের প্রথম থেকেই ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। তা জানা সত্ত্বেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তাকে নিয়ােগ করা। কংগ্রেসের সভাপতি মণ্ডলী কর্তৃক তাকে প্রদত্ত শর্ত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে তাকে প্রদত্ত শর্তসমূহ যথাসময়ে কর্মীদের জানানাে উচিত ছিল।
২) তার কর্মদক্ষতাই দেখা হয়েছে, কিন্তু মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক নিম্নমান বিবেচনা না করা।
৩) সুলতানের অতীতের ভ্রষ্ট জীবন জানা সত্ত্বেও তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করা, পার্টির অভ্যন্তরে তার ত্রুটি বিচ্যুতি তুলে না ধরা।
৪) কংগ্রেসে এদের ও অন্যান্যদের কেডার ইতিহাস যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব। হয়নি। এর কারণ কেডার ইতিহাস প্রণয়ন সময় সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এর জন্য শুদ্ধি অভিযান প্রয়ােজন।
প্রেসিডিয়ামের পক্ষ থেকে যে কেডার ইতিহাস দেয়া হয় তা সম্পূর্ণ ছিল না।
কারাে কারাে কিছু কিছু পয়েন্ট বাদ পড়েছে, কারাে কিছু পয়েন্ট অতিরিক্ত যুক্ত হয়েছে। ইহা তাড়াহুড়াে করে মৌখিকভাবে তৈরীর কারণে হয়েছে, ইচ্ছাকৃত নয়।
শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় কেডার ইতিহাস পেশ করার জন্য আহ্বান জানানাে হচ্ছে। পরবর্তী কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বিকল্প সদস্যরা নিজ নিজ কেডার ইতিহাস এবং তাদের পরিচালনাধীন কর্মীদের কেডার ইতিহাস পেশ করবেন।
কেন্দ্রীয় কমিটির এ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, সমগ্র পার্টির অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির হেফাজতে থাকবে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতি সদস্য, বিকল্প সদস্য নিজ নিজ আওতাধীন যে অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় অনুমােদন করিয়ে নেবেন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব প্রসঙ্গে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (পরিশিষ্ট-২) [এই পুস্তকের ২৩৩ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য-প্রকাশক]।
সভায় কয়েকটি দলিল প্রসঙ্গে গৃহীত সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ :
লালঝাণ্ডার সম্পাদকীয় সংশােধনীসহ গৃহীত হলাে। এ সম্পাদকীয়তে আত্মপ্রচারবাদ হয়নি।
পৃষ্ঠা: ২২৬

অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন প্রচারপত্রে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ রয়েছে, এ সমালােচনা সঠিক নয়। উপস্থাপনার ত্রুটির জন্য ভুল বুঝা হয়েছে। ইহা সংশােধিত আকারে অনুমােদিত হলাে।
ফজলু চক্রের সাথে মিনু (ফজলু চক্রের স্ত্রী) পার্টি পরিত্যাগ করে পলায়ন করেছে।
কেন্দ্রীয় কমিটির জনৈক সদস্যকে মুক্তমন হওয়া, সমালােচনা করতে সাহসী হওয়া এবং সময়মতাে সমালােচনা করার জন্য আহ্বান জানানাে হয়। তিনি এ ক্রটির জন্য আত্মসমালােচনা করেন এবং সংশােধন করবেন বলে জানান।
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের দেউলিয়াত্ব এবং পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সঠিকতা প্রমাণিত হওয়ার কারণে সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী গণভিত্তিক পার্টি হিসেবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিকাশের চমৎকার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমত অবস্থায় ফজলুসুলতান চক্রের জঘন্যতম পার্টি, জনগণ ও বিপ্লব বিরােধী কার্যকলাপের ফলে পার্টির কিছুটা প্রতিকুল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
কিন্তু চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং তাদেরকে বহিষ্কার করার মাধ্যমে খাটি বিপ্লবী কর্মীদের দৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত এবং পার্টি এ সংকট অচিরেই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যেই চক্রান্তকারীরা মারাত্মকভাবে নিঃসঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তারা সুবিধাবাদী দলত্যাগীদের নিয়ে কিছুদিন হৈ চৈ করতে পারে, গুজব, অপবাদ রটাতে পারে, আমাদের কাজে কোন এলাকায় ক্ষতি সাধন করতে পারে, এমন কি সর্বহারা পার্টির সুনামও ব্যবহার করতে পারে, সর্বহারা পার্টির নামে ডাকাত দল, প্রতারক দল গঠন করতে পারে, কিন্তু অচিরেই তাদের পরিণতি হবে আবুল হাসান, শান্তিলাল, সাদেক এবং দুনিয়ার অন্যান্য চক্রের অনুরূপ। তাদের চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হওয়া।
কাজেই খাটি বিপ্লবীরা এ অস্থায়ী প্রতিকুলতায় ঘাবড়ে যাবেন না। মন খারাপ করবেন না। চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারীদের সকল ধরনের কার্যকলাপ মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
আমাদের রয়েছে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ও সর্বহারা পার্টি, আমাদের লাইন সঠিক, জনগণের সাথে রয়েছে সংযােগ, কাজেই বিজয় আমাদের অনিবার্য।
কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তী সভার তারিখ নির্ধারণ করে সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
পৃষ্ঠা: ২২৭

কেন্দ্রীয় কমিটির শুদ্ধি অভিযান সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত
(মে, ১৯৭২)
তৃতীয় ইশতেহারের পরিশিষ্ট-১
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীগণ, সংগঠনের সকল স্তরে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান শুরু করুন।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সর্বস্তরে নিম্নলিখিত পাঁচটি বিষয়ে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এ শুদ্ধি অভিযানের উদ্দেশ্য হলাে এ পাঁচটি বিষয়ে ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি বর্জন করা।
শুদ্ধি অভিযানের পাঁচটি বিষয়
ক) গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা। খ) বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা। গ) ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক জীবন, ব্যক্তি স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থ। ঘ) শ্রেণী অনুসন্ধান ও পর্যালােচনা, গণলাইনের কর্মপদ্ধতি। ঙ) অভিজ্ঞতার সারসংকলন।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা ও সমালােচনা-আত্মসমালােচনা
একটি পার্টি বিপ্লবী কিনা তা প্রমাণিত হয় এ পার্টি এবং কর্মীরা যথাযথভাবে সমালােচনা-আত্মসমালােচনা পরিচালনা করে কিনা, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা প্রসঙ্গে তাদের সঠিক ধারণা রয়েছে কিনা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীদের উপরােক্ত বিষয়সমূহ সম্পর্কে ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি থাকায় সংগঠনের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। কাজেই এগুলাে দূর করে সঠিক চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি রপ্ত করা অতিমাত্রায় জরুরী হয়ে পড়েছে।
বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা এ বিষয়ক সঠিক ধারণা না থাকার অর্থ হবে পার্টি ও জনগণের উপর যথাযথ আস্থা থাকা। এর পরিণতি হবে সহজেই বিগড়ে যাওয়া, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদীদের খপ্পরে পড়া, তাদের দ্বারা প্রতারিত হওয়া।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির ইতিহাসে ফজলু-সুলতান চক্রের সৃষ্টি ও বিকাশ এ কারণেই সম্ভব হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ২২৮

বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত থাকলে সাধারণ কর্মীরা। প্রতারিত হতেন না, ফজলু-সুলতান চক্রের ধ্বংস ত্বরান্বিত হতাে।

ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক জীবন, ব্যক্তিস্বার্থ ও জনগণের স্বার্থ
রাজনৈতিক জীবনের সাথে ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্ক এবং ব্যক্তিস্বার্থের সাথে জনগণের স্বার্থের সম্পর্ক বিষয়ক সঠিক শ্রেণী দৃষ্টিকোণ ও কর্মপদ্ধতি বিপ্লবীদের জন্য একান্ত প্রয়ােজন। এর উপর নির্ভর করছে একজন বিপ্লবী থাকবেন না সুবিধাবাদী, সংশােধনবাদী হবেন।
এ সকল বিষয়ে সঠিক শ্রেণী দৃষ্টিকোণ এবং পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সংগঠনের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে এ সকল প্রশ্নে ভুল চিন্তাধারা ও পদক্ষেপ দূর করে সঠিক চিন্তাধারা ও পদক্ষেপ গ্রহণ অতিমাত্রায় জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যথায় সংগঠনের আরাে বিরাট ক্ষতি হবে।

শ্রেণী অনুসন্ধান ও পর্যালােচনা, গণলাইনের কর্মপদ্ধতি
ইহা হচ্ছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কর্মপদ্ধতি। ইহা ব্যতীত কার্য পরিচালনার অনিবার্য পরিণতি হবে সুবিধাবাদ অথবা অন্ধক্রিয়াবাদ। এর ফলে জনগণ বিপথে পরিচালিত হবেন এবং বিপ্লবের ক্ষতি হবে।
কাজেই ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি পরিহার করে শ্রেণী অনুসন্ধান ও পর্যালােচনা এবং গণলাইনের কর্মপদ্ধতি রপ্ত করা বিপ্লবী পার্টি এবং কর্মীদের জন্য একান্ত প্রয়ােজন।

অভিজ্ঞতার সারসংকলন
প্রতিনিয়ত কাজকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, নিজেদের কর্মদক্ষতার উৎকর্ষ সাধন। করা এবং কার্য পরিচালনার সাধারণ লাইন প্রণয়নের জন্য প্রতিনিয়ত জ্ঞানকে উন্নত পর্যায়ে নেওয়ার জন্য অভিজ্ঞতার সারসংকলন একান্ত প্রয়ােজন। ইহা মার্কসবাদী জ্ঞনতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর।
কাজেই এ বিষয়ক সঠিক ধারণা ও কর্মপদ্ধতি রপ্ত করা বিপ্লব, পার্টি ও তার কর্মীদের জন্য একান্ত প্রয়ােজন। উপরােক্ত পাঁচটি বিষয় সম্পর্কিত সঠিক ধারণা ও কর্মপদ্ধতি রপ্ত করতে পারলে আমাদের প্রতিটি কর্মী ভাল মার্কসবাদী বিপ্লবী কর্মী হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সুসংবদ্ধ, শক্তিশালী এবং নেতৃত্ব প্রদানকারী সংগঠন হিসেবে গড়ে উঠবে।

শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার উপায়
প্রথমে একটি অঞ্চলের নেতৃত্ব গ্রুপ বা নেতৃস্থানীয় কর্মীরা শুদ্ধি অভিযানের বিষয় সম্পর্কিত দলিল সমূহ পাঠ করবেন, পর্যালােচনা করবেন, এর ভিত্তিতে নিজেদের এবং সংগঠনের বিশেষ অভিজ্ঞতা পর্যালােচনা করবেন, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করবেন।
পৃষ্ঠা: ২২৯

সমালােচনা-আত্মসমালােচনা গুরুত্বহীন, হাসি-ঠাট্টা হিসেবে করলে চলবে না, গুরুত্ব সহকারে ন্যায়পরায়ণতার সাথে করতে হবে।
এরপরে নেতৃত্ব গ্রুপের সদস্যরা বা নেতৃস্থানীয় কর্মীরা তাদের পরিচালনাধীন কর্মীদের নিয়ে দলিলসমূহ পাঠ করবেন, অভিজ্ঞতার পর্যালােচনা করবেন এবং সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করবেন।
এ প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সমস্যাবলী নেতৃতুগ্রুপ বা কর্মীরা বৈঠকে মিলিত হয়ে পর্যালােচনা করবেন এবং এর সমাধান বের করে নিম্নস্তরে পৌঁছে দেবেন। এ প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে যতদিন না শুদ্ধি অভিযানের বিষয়গুলি সম্পর্কে সঠিক ধারণা জন্মে এবং কর্মীরা তা কাজে প্রয়ােগ করে।

উপসংহার
সংগঠনের সকল কর্মী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে উপরােক্ত বিষয় সম্পর্কে। ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি ভােলাই করে বর্জন করবেন, সঠিক চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি রপ্ত করবেন।
অন্যথায় আজ পূর্ব বাংলার বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানের যে গুরুদায়িত্ব সংগঠনের সামনে উপস্থিত তা পালন করা সম্ভব হবে না।
সকল স্তর শুদ্ধি অভিযান পরিচালনাকে অগ্রাধিকার দেবেন, গুরুত্ব সহকারে সময় নির্ধারণ করে শুদ্ধি অভিযানের কাজ চালাবেন এবং এর লক্ষ্য সমূহ অর্জন করবেন।

**
শুদ্ধি অভিযান সংক্রান্ত দলিল-প্রথমাংশ
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা পাঠ্য তালিকা
১. পাঁচটি প্রবন্ধঃ
– জনগণের সেবা,
– নর্মান বেথুনের স্মরণে,
– বােকা বুড়াে পাহাড় সরিয়েছিলেন,
– ভুল চিন্তাধারার সংশােধন,
– উদারতাবাদের বিরােধিতা।

২. উদ্ধৃতিঃ
– সমালােচনা-আত্মসমালােচনা,
– জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সঠিক মীমাংসা,
– অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যকার সম্পর্ক,
– ভুল চিন্তাধারার সংশােধন,
– কেডার, কমিউনিস্ট ইত্যাদি অধ্যায়।

৩. মতাদর্শগত পুনর্গঠন প্রসঙ্গে কয়েকটি দলিলঃ
– কমিউনিস্ট হওয়ার পাঁচটি মানদণ্ড,
পৃষ্ঠা: ২৩০

– উপদলবাদ ও সুবিধাবাদ প্রসঙ্গে,
– উপদলবাদের শ্রেণী বিশ্লেষণ,
– মতাদর্শগত পুনর্গঠনে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রয়ােগ।

৪. Four Essays on Philosophy:
– On Contradiction.
– Correct handling of contradictions among the People.

৫. Chairman Mao’s Speech at the Chinese National Confe rence on Propaganda work.
৬. সংবিধান।

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা
সংবিধান, শৃঙ্খলা, Correct handling of the Contradictions among the people ইত্যাদি।
* কর্মীদের গণতান্ত্রিক অধিকারঃ
০ প্রতিটি কর্মীর নিজস্তর, উচ্চস্তর বা কেন্দ্রীয় কমিটি বা তার সভাপতির নিকট প্রস্তাব, বক্তব্য, সমালােচনা পেশ করার অধিকার রয়েছে।
০ নিজস্ব মতামত পােষণ করার অধিকার রয়েছে, তা বারংবার পেশ করার অধিকার রয়েছে, কিন্তু এই মতামত কার্যকরী করার জন্য অসাংগঠনিক ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার অর্থাৎ চক্র গঠন, চক্রান্ত করা, ষড়যন্ত্র করার মাধ্যমে এ মতের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার অধিকার নেই।
* সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন
প্রতিটি কর্মীর ভােটের অধিকার রয়েছে। ভােটের মাধ্যমে সংখ্যাগুরুর মতামত কংগ্রেসে কার্যকরী হয়, কেন্দ্রীয় সংস্থা নির্বাচিত হয়, রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইন গৃহীত হয়।
সংখ্যালঘুর মতামত বাতিল হলে তাদেরকে সংখ্যাগুরুর মতামত মত কাজ করতে হবে। সেখানে কোন প্রকার নিমরাজী মনােভাব পােষণ করা চলবে না।

কেন্দ্রীকতা
* সমগ্র সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন।
কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত পালনে সংগঠনের সকল স্তর, সদস্য, সংগঠনের অধীনস্থ সংস্থাসমূহ বাধ্য।
* নিম্নস্তর উচ্চস্তরের অধীন
নিম্নস্তর উচ্চস্তরের সকল বিষয় (কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপন্থী নয় ) মানতে বাধ্য থাকবে।
পৃষ্ঠা: ২৩১

* ব্যক্তি সংগঠনের অধীন
ব্যক্তিস্বার্থ ও মতামত যাই হােক না কেন তা সংগঠনের সাধারণ স্বার্থ ও বক্তব্যের অধীন রাখতে হবে।
ফজলু-সুলতান চক্র সংখ্যাগুরুর অভিমত, এমন কি সভায় পেশ করা নিজস্ব মতামতকে, সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়নি। এভাবে তারা পার্টির গণতন্ত্র ভঙ্গ করে কেন্দ্রীকতাকে বিসর্জন দেয়। তারা পার্টির ক্ষমতা দখলের জন্য চক্র, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করে, গুজব, অপবাদ রটায়, তাদের পক্ষে জনমত সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়, গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তাদের অসততাই তাদের পতন ডেকে আনে।
কর্মীদের দায়িত্ব হলাে পার্টির গণতান্ত্রিক জীবনকে নিশ্চিত করা, কেন্দ্রীকতা মেনে ঢলা, গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতার পরিপন্থী ফজলু-সুলতান চক্রের অনুরূপ কার্যকলাপ সম্পর্কে আঁচ পাওয়া মাত্র উচ্চস্তরে রিপাের্ট করা যাতে এদের কার্যকলাপ অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা যায়, পার্টির ক্ষতি রােধ করা যায়।
পৃষ্ঠা: ২৩২

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত
(মে, ১৯৭২)
তৃতীয় ইশতেহারের পরিশিষ্ট-২
[এ নিবন্ধটি মে, ‘৭২-এ প্রকাশিত ‘লাল ঝাণ্ডা’র ২নং সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]

বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও ছয় পাহাড়ের দালালদের চেয়েও জঘন্যভাবে পার্টির অভ্যন্তরে ফজলু-সুলতান চক্রের নেতৃত্বে শ্ৰেণী শত্রুরা কমরেড সিরাজ সিকদার ও তার সঠিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জঘন্যতম মিথ্যা, কুৎসা, অপবাদ ও গুজব ছড়িয়েছে। এই প্রতিবিপ্লবী তৎপরতার সুযােগ গ্রহণ করে চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারীদের অবশিষ্টাংশ ও তাদের সহােদর ভাই সুবিধাবাদী, সুযােগ সন্ধানীরা কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্বকে আক্রমণ করছে।
এই অবস্থায় পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টির বিকাশের সাথে কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্বের ভূমিকা সম্পর্কে অবগত হওয়া পার্টি কর্মীদের আশু দায়িত্ব।
“একটি সর্বহারা শ্রেণীর পার্টির পক্ষে বিপ্লব পরিচালনায় সক্ষম হতে হলে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সার্বজনীন সত্যকে নিজ দেশের বিপ্লবের বাস্তব অনুশীলনের সঙ্গে সমন্বিত করতে হবে। এবং ঐ দেশের অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটি নির্ভুল লাইন প্রণয়ন ও কার্যকরী করতে হবে। লাইন নির্ভুল হলে দুর্বল শক্তি সবল হয়ে উঠতে পারে, সশস্ত্র শক্তি না থাকলে তা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে তাও অর্জিত হতে পারে। লাইন ভুল হলে বিপ্লব বিঘ্নিত হবে এবং পূর্বে অর্জিত ফলও খােয়া যাবে।”
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা ও তার বিকাশ, পূর্ব বাংলার জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তার অগ্রগতি, সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ, সর্বহারা পার্টিতে বিকাশ এবং আভ্যন্তরীণ ও বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে মতাদর্শগত, রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক ও অন্যান্য বিষয়ে সংগঠনের নির্ভুল লাইন ও কর্মপদ্ধতির কারণে।
নির্ভুল লাইন ও কর্মপদ্ধতি না থাকলে সংগঠন আজকের পর্যায়ে বিকাশ লাভ করতাে না। বহু পূর্বে সংগঠন শেষ হয়ে যেত।
এই নির্ভুল লাইন ও কর্মপদ্ধতি কমরেড সিরাজ সিকদার কর্তৃক মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে সৃজনশীলভাবে প্রয়ােগের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছে।
কমরেড সিরাজ সিকদার সংগঠনের বিকাশের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত জটিল সমস্যাবলীর কি কি সঠিক সমাধান দেন এবং সঠিক লাইন প্রণয়ন করেন তা ১নং লালঝাণ্ডার সম্পাদকীয়তে সংক্ষিপ্তভাবে প্রদত্ত হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ২৩৩

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিকাশের জন্য কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্ব অপরিহার্য।
কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্বকে সচেতনভাবে রক্ষা করা, জনপ্রিয় করা, সঠিক নেতৃত্বের বস্তুগত ভূমিকাকে স্বীকার করা একটি বিপ্লবী দায়িত্ব।
সচেতনভাবে নেতৃত্বকে রক্ষা করার অর্থ হচ্ছে নেতৃত্ব প্রকৃতই কি বিপ্লবের প্রতিটি প্রশ্নে সর্বহারার স্বার্থ রক্ষা করেছেন তা শ্রেণী সচেতনতার সাথে বুঝা।
সঠিক নেতৃত্বকে রক্ষা করা, জনপ্রিয় করা ও তার ভূমিকাকে স্বীকার করার অর্থ হচ্ছে পার্টির মাঝে এককেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, তা শক্তিশালী করা, তার উপর আস্থা স্থাপন করা, পার্টির কেন্দ্রকে ব্যাপক প্রভাবশালী ও ক্ষমতা সম্পন্ন করা, সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা, শত্রুকে ভীতসন্ত্রস্ত ও বিভক্ত করা। বিপ্লবের স্বার্থে এ সকল কাজ একান্ত অপরিহার্য।
কাজেই কমরেড সিরাজ সিকদার ও তার সঠিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার করা, অপবাদ-গুজব রটনা করা, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করা, তাকে হত্যা, উৎখাতের চক্রান্ত করা চরমতম প্রতিবিপ্লবী কাজ।
এর উদ্দেশ্য পার্টির কেন্দ্রকে ভেঙ্গে ফেলা, তার প্রতি কর্মীদের আস্থা নষ্ট করা, সংগঠনের শৃংখলা ভঙ্গ করা, পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থের চরমতম ক্ষতি সাধন করা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরে এ ধরনের প্রতিবিপ্লবী কাজ কখনও অনুমােদন করা যায় না।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সকল কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল এবং বিপ্লবী ও জনগণ কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন ঐক্যকে দৃঢ় করবেন।
ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীদের গুজব, অপবাদে বিভ্রান্ত হবেন না। এরা হচ্ছে শ্ৰেণী শত্রু। শ্ৰেণী শত্রুদের দ্বারা পার্টিকে ধ্বংস করার, একে দুর্বল করার চক্রান্তকে বিরােধিতা করবেন।
বহু ঘনিষ্ঠ ও জনপ্রিয় কমরেড ও গেরিলাদের রক্ত এবং পূর্ব বাংলার লক্ষ লক্ষ জনগণের রক্ত বৃথা যেতে দিবেন না। কমরেড সিরাজ সিকদার ও তার নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কমিটির উপর আস্থা হারাবেন না। এর উপর আস্থা হারাবার অর্থ হচ্ছে পার্টির উপর আস্থা হারানাে। পার্টির উপর আস্থা না থাকলে বিপ্লব করা যায় না।
কাজেই সংগঠনের বিকাশের প্রতিটি প্রশ্নে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে সংগঠনের সর্বস্তরে আলােচনা প্রয়ােজন যাতে কর্মীরা সচেতনভাবে নেতৃত্বের প্রতি, এক কেন্দ্রের প্রতি আস্থাশীল হন এবং এক কেন্দ্রকে মেনে চলেন। এ উদ্দেশ্যে সর্বস্তরে ১নং লালঝাণ্ডার সম্পাদকীয় মনােযােগের সাথে পাঠ ও পর্যালােচনা করা একান্ত প্রয়ােজন।

নােটঃ
সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের বিজয় দীর্ঘজীবী হােক, প্যারি কমিউন শতবার্ষিকী স্মরণে। বিদেশী ভাষা প্রকাশনালয়, পিকিং, পৃঃ- ১৭।
পৃষ্ঠা: ২৩৪

সমালােচনা-আত্মসমালােচনার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পয়েন্ট
(মে, ১৯৭২)

* পার্টির মাঝে সর্বদাই দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম থাকবে। ইহা সর্বহারা চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সাথে অসর্বহারা চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সংগ্রাম। ইহা পার্টির মধ্যকার শ্ৰেণী দ্বন্দ্বের প্রতিফলন।
* পার্টির মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধানের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হচ্ছে ঐক্য-সমালােচনাআত্মসমালােচনা-ঐক্য। ঐক্যের উদ্দেশ্য নিয়ে সমালােচনা-সংগ্রাম করা, যুক্তিসহ বুঝানাে, শিক্ষা প্রদান করা, আত্মসমালােচনা ও ক্রটি শােধরানাের মাধ্যমে দ্বন্দ্ব সমাধান করে নতুন ঐক্যে পৌঁছান।
ইহা পার্টির অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব সমাধানের পদ্ধতি।
* ‘রােগ সারিয়ে রােগীকে বাঁচানাে’, ‘অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানাে এবং মতাদর্শগতভাবে পরিষ্কার হওয়া ও কমরেডদের মধ্যকার ঐক্য প্রতিষ্ঠার দু’লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
কাজেই কমরেডদের গুরুত্বসহকারে সমালােচনা করা উচিত। কিন্তু একই সাথে তারা যাতে জেগে উঠেন, সংশােধিত হন তার জন্য সময় দেওয়া উচিত।
কাজেই প্রথমে অতিমাত্রায় সংগ্রাম করা, এক আঘাতেই খতম করার পদ্ধতি পরিহার করা উচিত।
অবশ্য কোন কমরেড যদি রােগকে গােপন করেন, বারংবার বুঝানাে ও শিক্ষা প্রদানের পরও ভুলে লেগে থাকেন, তা আরও বাড়িয়ে তােলেন, আজেবাজে ভিত্তিহীন গুজব ও অপবাদ রটান, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আঁটেন, চক্র-উপদল গঠন করেন, চিকিৎসার সাধ্যাতীত অবস্থায় পড়েন কেবলমাত্র তখন তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালিত হবে।
এ সকল ত্রুটি নিয়ে থাকতে পারে এরূপ স্তরে নামিয়ে দেওয়া, সকল পদ থেকে সরিয়ে পার্টির মাঝে রেখে যাচাই করে দেখা, সংগঠনের মধ্যে এ সকল ত্রুটি নিয়ে থাকা সম্ভব না হলে অধঃপতিত ব্যক্তি হিসেবে বের করে দেওয়া, সহানুভূতিশীলের পর্যায়ে নামিয়ে দেওয়া ইত্যাদি পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কেউ যদি চক্র গঠন, উপদল গঠন, শত্রুর সাথে যােগাযােগ করে তখন তাকে বহিষ্কার এবং অন্যান্য শাস্তি প্রদান করা যায়।
* বুর্জোয়া পদ্ধতি হলাে উদারতাবাদ প্রদর্শন করা, পার্টির অভ্যন্তরে নীতিহীন শান্তির পক্ষ নেওয়া, পরস্পরের দোষ-ক্রটি এড়িয়ে চলা, পরস্পরকে তােষামােদ করা, পরস্পরকে রক্ষা করা।
অপর এক বুর্জোয়া পদ্ধতি হলাে পিছনে সমালােচনা, গুজব, অপবাদ রটনা করা, আজেবাজে কথাবার্তা বলা, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করা, উপদল গঠন করা।
* কোন কমরেড বা স্তর সম্পর্কে সমালােচনা, মন্তব্য, অভিযােগ, বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট কমরেড বা স্তর বা তার ওপরের স্তরকে লিখিত বা মৌখিকভাবে না জানিয়ে, সমস্তরের
পৃষ্ঠা: ২৩৫

হলে সভায় না বলে (ক) অসৎ উদ্দেশ্য ব্যতীত অভ্যাসবশে উক্ত কমরেড বা স্তরের বা স্তরের পিছনে অন্য কমরেডের নিকট সমালােচনা, অভিযােগ, মন্তব্য পেশ করা, ভিত্তিহীন আজেবাজে কথাবার্তা, গুজব, অপবাদ, বিদ্রুপ করা (খ) বা অসৎ উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে উপরােক্ত কাজ করা, তখন ইহা ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের পর্যায়ে পড়বে।
এর উদ্দেশ্য হলাে কোন কমরেড বা স্তর সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করা, আস্থা কমিয়ে দেওয়া, হতাশার সৃষ্টি করা, কিছু লােককে দলে টেনে আনা, উপদল, চক্র সৃষ্টি করা, পার্টির মাঝে বিভিন্ন কেন্দ্র গড়ে তােলা, পার্টির ঐক্য বিনষ্ট করা, শত্রুকে সহায়তা করা, বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের ক্ষতি করা।
অভ্যাসবশতঃ একাজ করলেও উপরােক্ত ক্ষতিসমূহ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অসৎ উদ্দেশ্যে যারা একাজ করে তারা অনেক সময় যার সাথে আলাপ করেন তাকে গােপন রাখতে, রিপাের্ট না করতে বলেন।
তারা সাধারণতঃ সুবিধাবাদী, অসন্তুষ্টদের সাথে আলাপ করেন, তাদেরকে দলে টানতে চান।
সুবিধাবাদীরাই পার্টির মাঝে সকল প্রকার চক্র, উপদল, হতাশা, অনৈক্য, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, গুজব, অপবাদের উৎস।
এ ধরনের কার্যকলাপের টের পেলে সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্তরে রিপাের্ট করা উচিৎ।
কোন কমরেড বা স্তর সম্পর্কে তার পিছনে বলা কথাবার্তা, সমালােচনা, মন্তব্য, বিদ্রুপ, গুজব শুনে বিশ্বাস করা উচিৎ নয়। সভাপতি মাও বলেছেন, “এক পক্ষকে শুনলে আঁধারে ডুববেন, উভয় পক্ষকে জানলে আলােক উজ্জ্বল হবেন।”
এ অবস্থায় উচিৎ এ ধরনের কথাবার্তা যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে তাকে বা তার স্তরকে বা উচ্চস্তরকে জানিয়ে দেওয়া এবং সত্যতা যাচাই করা।
যে কমরেড পিছনে বলেন তাকে সমালােচনা করা উচিৎ। পিছনে বলা কথাবার্তা শুনে সমালােচনা করা উচিৎ নয়।
কোনক্রমেই নিষেধ বা গােপন রাখার অনুরােধ মেনে রিপাের্ট করা থেকে বিরত থাকা বা সমালােচনা না করা উচিৎ নয়। তাহলে তিনি চক্রান্তের অংশীদার হবেন।
* কমরেড বা স্তর সম্পর্কে সমালােচনা, বক্তব্য, মন্তব্য, অভিযােগ ঘটনা ঘটার সময় পেশ না করে কয়েকমাস পরে করা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেবে এতদিন কোন বক্তব্য পেশ না করে হঠাৎ করা হচ্ছে কেন?
অনেক কমরেড তার স্বার্থে আঘাত লাগার ফলে প্রতিশােধবাদের কারণে বানােয়াট ভিত্তিহীন অভিযােগ খাড়া করেন, অনেকদিন পূর্বে ঘটেছে তাই যাচাই করতে অসুবিধা-এ সুযােগ নেন।
এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, “সমালােচনা যথাসময়ে করা উচিৎ, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সমালােচনা করার শখ থাকা উচিৎ নয়।”
ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা উচিৎ।
* সমালােচনা গ্রহণ করতে না পারা:
কোন কোন কমরেড অন্যদের কাছে থেকে উদারতাবাদ, হালকা সমালােচনা, তােষামােদ করা আশা করেন।
পৃষ্ঠা: ২৩৬

“যা জানেন বলুন, যদি জানেন সবটাই বলুন, ভুল থাকলে শুধরে নিন, না থাকলে সতর্কবাণী হিসেবে গ্রহণ করুন, অনেকে সমালােচনা শুনার সময় এ মনােভাবকে গ্রহণ করতে পারেন না।
তারা অভিমান, কান্না-কাটি করেন, কেউ প্রতিশােধের ছুতা খোঁজেন। এগুলাে ব্যক্তিতাবাদ, অর্থাৎ ব্যক্তিস্বার্থ থেকে আসে।
অনেক সময় তারা সমালােচনার বিষয়বস্তুকে গ্রহণ না করে পদ্ধতিকে বিরােধিতা করার নামে সমালােচনা এড়িয়ে যান।
আবার অনেক সময় আমার সবই ভুল’ একথা বলে সমালােচনা এড়িয়ে যেতে চান।
কাজেই সমালােচনার পদ্ধতিকে বিরােধিতা করার সুযােগ যাতে কেউ না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিৎ। অর্থাৎ যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণাত্মকভাবে সমালােচনা করা উচিৎ।
* সমালােচনা বাস্তবভিত্তিক অর্থাৎ বাস্তবে যা ঘটেছে তাই হওয়া উচিৎ। ইচ্ছা খুশীমত কথাবার্তা বলা, ভাসাভাসাভাবে, একতরফাভাবে, আত্মগতভাবে সমালােচনা করা উচিৎ নয়।
সমালােচনার নামে যা-তা বলা, ইতরামী, স্বেচ্ছাচারী করা, গুজব, অপবাদ রটনা। করা উচিৎ নয়।
* কোন কমরেড সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট স্তর বা উচ্চস্তর কর্তৃক অনুমােদিত সমালােচনা, মন্তব্য যথাযথ অনুমতি থাকলে ঐ স্তরের আওতাধীন কর্মীরা শিক্ষার জন্য আলােচনা করতে পারেন।
কিন্তু অননুমােদিত ব্যক্তিবিশেষের মন্তব্য, সমালােচনা, তার নিজস্ব অভিমত, তিনি উহা। সংশ্লিষ্ট স্তর, উচ্চস্তর বা কমরেড ব্যতীত অন্য কারাে সাথে আলােচনা করতে পারেন না।
* কেউ দেখিয়ে না দিলেও নিজে নিজে ভুলের জন্য আত্মসমালােচনা করা এবং অন্যের সমালােচনা আহ্বান করা প্রমাণ করে যে, তিনি একজন ভাল কমরেড। আমাদের সর্বদা এরূপ হওয়া উচিৎ।
* ছিদ্রানুসন্ধান করা ও রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক স্বার্থের সাথে জড়িত না হলে ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ছিদ্রানুসন্ধান করা উচিৎ নয়। এর ফলে কোন কোন কমরেড সম্পর্কে সাধারণ কর্মীদের ধারণা খারাপ হয়ে পড়ে, সে নিজেও অতিসাবধানী ভদ্রলােক হয়ে যাবেন।
এগুলাে হচ্ছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা যা সমালােচনা-আত্মসমালােচনা বিষয়ক শুদ্ধি অভিযানের সময় আলােচিত হওয়া উচিৎ।
পৃষ্ঠা: ২৩৭

ফজলু-সুলতান বিশ্বাসঘাতক চক্র সম্পর্কে
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল, সমর্থক ও জনগণের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির
জরুরী বিবৃতি
(১৯ মে, ১৯৭২)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ৭ই মে ফজলু (পৈত্রিক নাম সেলিম শাহনেওয়াজ), সুলতান (পৈত্রিক নাম মাহবুব) চক্রকে নিম্নলিখিত অপরাধের কারণে চিরজীবনের জন্য পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি থেকে বহিস্কার করা হয়। অপরাধ সমূহ ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করা, গুজব-অপবাদ রটনা করা, গুপ্ত হত্যার পরিকল্পনা করা, অর্থ-অস্ত্র চুরি করা, পার্টির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা, কু-দেতা ঘটিয়ে পার্টির ক্ষমতা দখল করা ইত্যাদি।
বিশ্বাসঘাতক চক্রান্তকারী প্রতিবিপ্লবী ফজলু-সুলতান পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও তার কার্যাবলী ধ্বংস করার জঘন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র কিছু সংখ্যক পার্টি কর্মীকে প্রতারিত করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে খুলনায় পার্টি কর্মীর বাসস্থান দখল করে, পার্টির অর্থ, অস্ত্র, সাইক্লো মেশিন এবং অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি কবজা করে, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধিকে বন্দুকের ডগায় উৎখাত করে।
ফজলু-সুলতান চক্রের ইচ্ছা হচ্ছে কর্মীদের প্রতারিত করা, সামন্তবাদী আত্মীয়তার সম্পর্ক ও পার্টির সুনামের সুযােগ গ্রহণ করা, খুলনা অঞ্চলে একটি প্রতিক্রিয়াশীল দুর্গ গঠন করা, বরিশালের কুদুস মােল্লার মত যুদ্ধবাজ ও ডাকাত সাজা, সাচ্চা কর্মীদের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা ও অন্যান্য চক্রান্ত চালিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে কমরেড সিরাজ সিকদারকে খতম করা, একটা বােগাস’ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে নিজেরাই পার্টির কর্তা ব্যক্তি সাজা, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নাম ব্যবহার করে জনগণকে ভাওতা দেয়া, বিপ্লবের নামে প্রতারণা করা, সশস্ত্র সংগ্রামের নামে ডাকাতি করা।
চীনা পার্টির ইতিহাসে লং মার্চের সময় চেন কাও-তাে এইরূপ কাজ করে, সে বিশ হাজার লালসেনা ও পার্টির কর্মীকে প্রতারিত করে, সভাপতি মাও-এর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটিকে অস্বীকার করে, বােগাস’ কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে, নিজে পার্টির কর্তা সাজে। চেন কাও তাের পরিণতি কি? সে শেষ পর্যন্ত চিয়াং কাইশেকের গুপ্ত পুলিশ হয়। খাটি বিপ্লবী যারা প্রতারিত হয়েছিলেন তারা চেন কাও তাের প্রতারণা বুঝতে পেরে শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বাধীন পার্টিতে ফিরে আসেন।
ফজলু-সুলতান চক্র কি একই পরিণতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে না? ইতিমধ্যে তারা কাজী-মেনন চক্রের সাথে হাত মিলিয়েছে। তারা এ চক্রকে সর্বহারা পার্টি, তার নেতৃত্ব বিশেষ করে কমরেড সিরাজ সিকদারকে খতম বা অপসারণের জন্য মদদ জোগাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ২৩৮

তারা এই চক্রকে অস্ত্র, লােক অর্থাৎ সব কিছুই দিচ্ছে। এর অর্থ এই যে এই চক্র কাজীমেননদের মাধ্যমে ভারতের জ্যোতিবসু-নামুদ্রিপদ, তাদের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, ছয় পাহাড়ের১ দালাল, সাম্রাজ্যবাদ ও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতি দেশীয় আন্তর্জাতিক শক্রর দালালী করছে। তাদের এই দালালীর খবর কাজী-রণাে চক্রের পাণ্ডা মেনন-জামাল হায়দার আমাদের জনৈক সহানুভূতিশীলের নিকট প্রকাশ করেছে। বহু দিন পূর্ব থেকেই তারা চক্রান্ত করছে। কাজেই ফজলু-সুলতান চক্রের পরিণতি হচ্ছে চেন কাও তাের পরিণতি, অর্থাৎ ছয় পাহাড়ের দালালদের গুপ্ত পুলিশ হওয়া।
এই চক্রের কার্যকলাপের সাথে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কোন সংযােগ নেই। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির খাটি বিপ্লবী কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল এবং পূর্ব বাংলার জনগণ অবশ্যই এ চক্রের সংগঠন, বিপ্লব, জনগণ বিরােধী জঘন্যতম কার্যকলাপের জন্য এ চক্রকে যথাযথ শাস্তি বিধান করবেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের এজেন্টদের গুজব, অপবাদ, প্রতারণা ও মিষ্টি কথায় ভুলবেন না, কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। শত্রু যা করে তার বিরােধিতা করবেন। চক্রান্তকারীদের সাথে কোন সংশ্রব রাখবেন না। তাদেরকে কোন প্রকার সহায়তা করবেন না। তাদেরকে প্রশ্রয়ও দেবেন না, যথাযথ স্তর কর্তৃক অনুমােদিত নয় এইরূপ কোন ব্যক্তির সাথে আলাপ করবেন না।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন অল্প কয়েকজন কর্মী নিয়ে কাজ আরম্ভ করে, এমন অবস্থা হয়েছিল যে প্রকৃত পক্ষে একজন কর্মী অবশিষ্ট ছিলেন। কিন্তু লাইন সঠিক থাকায়। পার্টি বিকাশ লাভ করেছে। আজ সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারীরা চলে গেলেও খাটি বিপ্লবী কর্মীরা দৃঢ়ভাবে পার্টির কাজ করে যাবেন। পার্টি অবশ্যই অব্যাহত গতিতে বিকাশ লাভ করবে, অস্থায়ী অসুবিধা কেটে যাবে। অবশ্যই এর জন্য প্রয়ােজন হবে সঠিক লাইন ও তা প্রণয়নে সক্ষম নেতৃত্ব। কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির রয়েছে সঠিক লাইন প্রণয়নের ক্ষমতা।
ফজলু-সুলতান চক্র সর্বহারা পার্টির নাম নিয়ে, তার বক্তব্য চুরি করে নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছে। তারা সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্যকারী, প্রতিবিপ্লবী, মার্কসবাদী নয়; কাজেই তাদের পক্ষে সঠিক লাইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়। কাজেই তাদের পার্টি পরিচালনার ভাওতা অচিরেই প্রকাশ হয়ে পড়বে ও প্রকৃত প্রতিবিপ্লবী চেহারা বেরিয়ে পড়বে।
অতীতে মাহবুবউল্লা, আ.কা.ম. ফজলুল হক পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন নাম দিয়ে একটি সংগঠন করেছিল যার বক্তব্য ছিল পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের চুরি করা থিসিস। তারা এ বক্তব্য নিয়ে কিছুদিন কাজও করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সমস্যাবলীর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়ে দেবেনমতিনদের সাথে যােগ দেয়। ফজলু-সুলতান চক্রেরও একই পরিণতি হবে। তাদেরকেও শেষ পর্যন্ত কাজী বা অন্য কোন সংগঠনে যােগদান করতে হবে।
…………………………………………………………………….
১. নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে বিপ্লবের মৌলিক শত্রুগুলােকে কমরেড সিরাজ সিকদার সে সময়ে
জনগণের বুকের উপর চেপে বসা ছয়টি পাহাড় বলে চিহ্নিত করেছিলেন। এই ছয়টি পাহাড় হচ্ছে। (১) সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ (২) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ (৩) ভারতীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ (৪) ভারতীয় সামন্তবাদ (৫) পূর্ব বাংলার আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও (৬) পূর্ব বাংলার সামন্তবাদ প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ২৩৯

এ কারণে প্রতারিত কমরেডদের প্রতি আহ্বান আপনারা এ প্রতারকদের যথাযথ শাস্তি বিধান করে পার্টিতে ফিরে আসুন। নিজেদের আত্মত্যাগ ও কাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করে সফল করুন। শহীদ, মৃত কমরেড, গেরিলা, জনগণের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করুন।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ!
কমরেড সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ!
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন!
পৃষ্ঠা: ২৪০

চক্রের নিয়মবিধি আবিস্কার করুন,
চক্রকে বিরােধিতা করুন
(মে, ১৯৭২)

মার্কসবাদ আমাদের শিক্ষা দেয়, বস্তুর নিয়মবিধি আবিস্কার করে সে অনুযায়ী তাকে পরিবর্তন করা যায়।
একইভাবে চক্রের নিয়মবিধি আবিস্কার করে চক্রের বিরােধিতা করা, তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করা, তার পুনরাবৃত্তি রােধ করা যায়।
এর ফলে চক্র সম্পর্কিত জ্ঞান আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়, ইহা তখন নিজে নিজেই বিরাজ করে থেকে আমাদের জন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী সংগঠনসমূহে চক্র গঠনের ঘটনা, পূর্ব বাংলার ক্ষুদে বুর্জোয়া সংগঠন এবং মার্কসবাদী নামধারী বুর্জোয়া উপদলসমূহে চক্র গঠনের সংবাদ, ঘটনা ও পরিণতি আমরা জানতাম। আমাদের সংগঠনে হাজিপুরের সাদেক চক্র এবং আবুল হাসান-শান্তিলালের চক্র গঠনের ঘটনাও ঘটেছে।
কিন্তু এ সকল ঘটনার তাৎপর্য, ব্যাপ্তি খুব কম থাকায় চক্র সম্পর্কে একটা সাধারণ নিয়মবিধি আবিস্কার করা সম্ভব হয়নি।
ফজলু-সুলতান চক্রের কার্যকলাপ, তাৎপর্য, ব্যাপ্তি ও পরিণতি খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালােচনা করার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। এর ফলে এ ধরনের কার্যকলাপের। সাধারণ নিয়মবিধি নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে।

ব্যক্তিস্বার্থ সকল চক্রের মূল বিষয়
হাজিপুরের সাদেক দ্রুত একটা কিছু করে ফেলে দেশবরেণ্য নেতা এবং পার্টি কর্তা হওয়ার স্বপ্নে বিভাের হয়ে একটি চক্র গঠন করে হঠকারী কার্যকলাপ চালায়।
নাম-যশ, নেতা ও পার্টি-কর্তা হওয়াই তাদের চক্র গঠনের উদ্দেশ্য ছিল।
আবুল হাসান যৌন স্বেচ্ছাচার, অর্থ আত্মসাৎ, নেতা হওয়ার কারণে একটি চক্র গঠন করে।
ফজলু যৌন স্বার্থকে বিপ্লবী স্বার্থের অধীন না করে বিপ্লবী স্বার্থকে যৌন স্বার্থের অধীন করে, পার্টির পদ ও নাম-যশের জন্য কাজ করে। তাকে এর জন্য বিপ্লবে যােগদানের প্রথম থেকেই সমালােচনা করা হয়, শেষ পর্যন্ত পার্টি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তখন সে চক্র গঠন করে।
সুলতান যৌন স্বার্থকে বিপ্লবী স্বার্থের অধীন করতে ব্যর্থ হয় এবং পদের জন্য কাজ করে।
পদ থেকে নামিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে সে চক্র গঠন করে।
পৃষ্ঠা: ২৪১

কাজেই যৌনের স্বার্থ, পদের স্বার্থ, নাম-যশের স্বার্থ অর্থাৎ ব্যক্তিস্বার্থ অর্থাৎ বুর্জোয়া। শ্রেণীস্বার্থের কারণই চক্র গঠনের মূল কারণ।

চক্র গঠনের জন্য ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, মিথ্যা গুজব ছড়ানাে, অপবাদ রটানাে হয়
চক্র গঠকরা পার্টির অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব মীমাংসার ঐক্য-সমালােচনা-আত্মসমালােচনাঐক্যের গণতান্ত্রিক পথ পরিত্যাগ করে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, মিথ্যা গুজব ছড়ানাে, অপবাদ রটানাের পথ গ্রহণ করে। তারা সভায় বা সংশ্লিষ্ট কমরেড বা উচ্চস্তরকে কিছুই বলে না।
হাজিপুরের সাদেক পার্টি ও নেতৃত্ব সম্পর্কে আজে-বাজে ভিত্তিহীন মিথ্যা কথাবার্তা বলে, দলত্যাগীদের সাথে গােপনে চক্রান্ত করে, জনগণকে ভাওতা দেয়, নিজেদেরকে পার্টির কর্তা বলে জাহির করে।
আবুল হাসান মিথ্যার আশ্রয় নেয়, নিজেকে পার্টির কর্তা হিসেবে জাহির করে।
ফজলু পার্টির নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় কমিটি সম্পর্কে সভায় বা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের কিছু না। বলে বিভিন্ন কমরেডদের নিকট মিথ্যা ও ভিত্তিহীন, আজে-বাজে কথাবার্তা, গুজব ছড়ায়, তাদেরকে তা রিপোের্ট করতে নিষেধ করে, চক্রান্ত পাকায়, ষড়যন্ত্র করে, পার্টির অর্থ ও অস্ত্র চুরি করে।
সুলতান সামনা-সামনি বা সভায় কিছু না বলে একই কাজ করে।
এর কারণ গুজব-অপবাদ সভায় বা সংশ্লিষ্ট কমরেডদেরকে করলে তা টেকে না, যেহেতু সেগুলাে মিথ্যা, ভিত্তিহীন। কাজেই এগুলাে পিছনেই বলা যায়, সামনে নয়। এগুলাে রাতের দুর্গন্ধ বাতাস, দিনের আলােয় টেকে না। অর্থাৎ সত্যের সামনে টেকে না।

পার্টির মধ্যকার সুবিধাবাদীরা হলাে চক্র গঠনের ভিত্তি
হাজিপুরের সাদেক সুবিধাবাদী এবং দলত্যাগীদের সাথে লাইন দেয় ও চক্র গঠন করে। আবুল হাসান একইভাবে সুবিধাবাদীদের নিয়ে চক্র গঠন করে।
ফজলু যৌনস্বার্থের নিকট আত্মসমর্পণকারী, সুবিধাবাদী, অধঃপতিত সুলতানের সাথে লাইন দেয় ও চক্র করে, তারা পার্টির মাঝে এমন সব ব্যক্তিদের লাইন দেয় যাদেরকে তারা সুবিধাবাদী, ব্যক্তিগত বা অন্য কোন কারণে পার্টির প্রতি অসন্তুষ্ট বা পার্টি কর্তৃক সমালােচিত বলে মনে করে।
এভাবে সুবিধাবাদী, অধঃপতিত, দলত্যাগী, অসন্তুষ্টদেরকে নিয়ে চক্র গঠন করে, চক্র গঠকরা সাধারণ কর্মী ও জনগণকে প্রতারিত করে, নিজেদের পার্টি-কর্তা হিসেবে জাহির করে।

চক্র গঠকরা ক্রুশ্চোভের মত দু’মুখাে অভিনেতা
সাদেক পার্টির সাথে আলাপের বিশ্বস্ততা দেখায়, কিন্তু পিছনে চক্রান্ত করে।
ফজলু পার্টি, কমরেড ও নেতৃত্বের সাথে আলাপে নিপুণ অভিনেতার পরিচয় দেয়, এমন কি সিরাজ সিকদারের প্রশংসায় কবিতা লিখে আনে, কমরেড সিরাজ সিকদারকে
পৃষ্ঠা: ২৪২

যে বিরােধিতা করবে সে বিপ্লবী নয় এমনি কথা বলে, কিন্তু ইতিমধ্যেই সে কমরেড সিরাজ সিকদারের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যা অপবাদ ও গুজব ছড়িয়েছে।
সে কমরেডদের কাছে বিপ্লবী পত্র লিখতে বলে আর পলায়নের ষড়যন্ত্র করে, একজনের কাছে এক কথা অপরের কাছে তা অস্বীকার করে। সামনা-সামনি প্রশংসা করে পিছনে চরম শত্রুতা করে।
ফজলু-সুলতান চক্র কথায় চরম বিশ্বস্ততা দেখায়। এদের দ্বারা পার্টির কোন ক্ষতি হবে এমন চিন্তাও কারাে মনে উদয় হয়নি, তারা-যে পার্টি ত্যাগ করবে তা ঘূণাক্ষরেও বুঝা যায়নি, অথচ পশ্চাতে তারা ষড়যন্ত্র করে, পার্টির অর্থ ও অস্ত্র চুরি করে, চক্র গঠন করে, পলায়নের ষড়যন্ত্র করে।

চক্র গঠকরা পার্টির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে
চক্র গঠকরা পার্টির শৃঙ্খলা বিসর্জন দেয়, বিভিন্ন স্তরের সিদ্ধান্ত বিকৃত করে জাহির করে, গােপনীয়তা নষ্ট করে, স্তর বজায় রাখে না। তারা এগুলাে করে যাতে বিভিন্ন স্তর ও তার সম্পর্কে কর্মীদের ভুল ধারণা হয়, তাদের ওপর অনাস্থা আসে। কর্মী ও স্তরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।

চক্র গঠকরা ইতিহাস ও মার্কসবাদকে বিকৃত করে
ক্রুশ্চোভ সংশােধনবাদী ইতিহাস ও মার্কসবাদকে বিকৃত করে নিজেদের ক্ষমতা দখলকে ন্যায়সঙ্গত করার জন্য।
সে সােভিয়েট বিপ্লবে মহান স্ট্যালিনের ভূমিকাকে পুরােপুরি অস্বীকার করে, তার বিরুদ্ধে জঘন্যতম কুৎসা-অপবাদ রটায়, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সেকেলে হয়ে গেছে বলে তা বর্জন করে নিজস্ব প্রতিবিপ্লবী তত্ত্ব হাজির করে।
ফজলু চক্রও ইতিহাসকে বিকৃত করে, প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব রচনা করে, নিজের প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রকে ন্যায়সঙ্গত করার চেষ্টা চালায়।
সে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, মহান পেয়ারা বাগান ও সর্বহারা পার্টিতে কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিকাকে পুরােপুরি অস্বীকার করে, এভাবে ইতিহাসকে বিকৃত করে, কমরেড সিরাজ সিকদারের বিরুদ্ধে জঘন্যতম কুৎসা ও অপবাদ রটায়।
চক্র গঠকরা ষড়যন্ত্রের জাল বােনে, পরস্পরকে রক্ষা করে, পার্টির মাঝে অপর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে
সাদেক ও অন্যান্যদের কেউই একে অপরের কার্যকলাপ সম্পর্কে পার্টির নিকট রিপাের্ট করেনি, তারা পরস্পরকে রক্ষা করে।
আবুল হাসানদের মাঝেও কেউ রিপাের্ট করেনি।
ফজলু-সুলতান চক্র একে অপরের কার্যকলাপ সম্পর্কে রিপাের্ট করেনি, বরঞ্চ পরস্পরকে রক্ষা করেছে। ফজলু সুলতানের একটি চিঠি (তার সুবিধাবাদের প্রমাণ রয়েছে এরূপ) পার্টির নিকট জমা দেবার পরিবর্তে গায়েব করে দেয়।
ফজলু-সুলতান পার্টির শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, কোন কোন কর্মীকে অবৈধভাবে ডেকে আনে (যা কেন্দ্রীয় কমিটি পারে), অর্থ দেয়, চক্রান্তের লাইন দেয়, এভাবে পার্টির
পৃষ্ঠা: ২৪৩

মাঝে একমাত্র কেন্দ্র কেন্দ্রীয় কমিটি ব্যতীত অপর এক কেন্দ্র হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করে।
তারা একে অপরকে টেলিগ্রাম-পত্র মারফত খবর দেয়, তাদের বিরুদ্ধে পার্টির পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক করে। ফজলু-সুলতান চক্র বিশ্বাসঘাতক দলত্যাগী নুরুল হাসানকে ভাল বলে, তার বিরুদ্ধে পার্টির সিদ্ধান্তকে ভুল বলে।
এভাবে তারা বিশ্বাসঘাতক দলত্যাগী দিপু, মাহবুবকে লাইন দেয়। এভাবে তারা দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতকদের সারিতে নেমে যায়।
ঝানু চক্রান্তকারীরা গােপনে কাজ করে, পর্দার অন্তরালে কর্তা ব্যক্তি থাকে, ধীরে ধীরে সে চক্রান্তের জাল ছড়ায়, যেমন ক্রুশ্চোভ, লিউশাউচি। এরা অতিশয় গােপনীয়তার সাথে পর্দার অন্তরাল থেকে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে।
ক্রুশ্চোভ সাফল্য লাভ করে ক্ষমতা দখল করে। লিউশাউচির চক্র প্রকাশ হয়ে পড়ে, সে উৎখাত হয়।
আমাদের চক্রান্তকারীরা অতিশয় বুন্ধু। তাদের চক্রান্ত প্রকাশ হয়ে পড়ে। তারা ধরা পড়ে যায় সহজেই।

চক্র গঠকরা পার্টির সম্পত্তি আত্মসাৎ করে, পার্টির সুনাম ব্যবহার করে
চক্র গঠকরা চক্রের কাজ চালাবার জন্য পার্টির অর্থ, অস্ত্র এবং সম্পত্তি আত্মসাৎ করে, হিসেব ফাঁকি দেয়, অর্থ-অস্ত্র চুরি করে।
তারা পার্টির সুনাম ব্যবহার করে নিজেদের পার্টি-কর্তা হিসেবে জাহির করে, পার্টি ভাল কিন্তু নেতৃত্ব খারাপ, অতএব তারাই নেতা- এ ধরনের কথা বলে।
ফজলু-সুলতান পার্টিকে না জানিয়ে পার্টির বিশ্বাস ভঙ্গ করে, পার্টির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে পার্টির অর্থ চুরি করে। তাদের ইচ্ছা ছিল সমুদয় অর্থই চুরি করা। ফজলু পার্টির অপারেশনের অর্থ নিয়ে পলায়নের পরিকল্পনা করে।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল পার্টির অর্থ চুরি করে পার্টির কাজ বন্ধ করে দেওয়া, পার্টিকে তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করানাে এবং নিজেদের চক্রের কাজ চালিয়ে নেওয়া, নিজেদেরকে অর্থের বিনিময়ে পার্টির কর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

চক্র গঠকরা দুর্গ গঠন করে
চক্র গঠকরা নিজ নিজ এলাকায় কেন্দ্রীয় কমিটি ও পার্টি থেকে স্বতন্ত্র দুর্গ গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। তারা এমনভাবে কাজ করে যাতে কর্মীদের পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি প্রভৃতির ওপর আস্থা না জন্মায়, শুধু তাদের ওপর আস্থা জন্মে।
ফজলু খুলনায় এরূপ একটি দুর্গ গঠনের চেষ্টায় ছিল। এ উদ্দেশ্যে সে প্রচুর অস্ত্র, কর্মী চায়, ব্যক্তিগত নামে লিফলেট ছড়াতে চায়, পার্টিগত সুনামের সুযােগ গ্রহণ করে এবং সামন্তবাদী আত্মীয়তার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে লােক সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালায়।
কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক তাকে অন্যত্র বদলীর কথা সে বিরােধিতা করে, এমনকি জনৈক কর্মীর অধীনেও থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করে। অর্থাৎ, যেভাবেই হােক সে খুলনায় থাকার চেষ্টা করে।
পৃষ্ঠা: ২৪৪

কেন্দ্রীয় কমিটি যদি তাকে খুলনা থেকে অপসারণ না করতাে, তবে সে সমগ্র এলাকাটাকে একটি ছিদ্রহীন দুর্গে পরিণত করতে চাইত। কর্মীদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে, অপবাদ রটিয়ে, মিথ্যা বলে পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটি ও কোন কোন কমরেড সম্পর্কে অনাস্থা সৃষ্টি করে, তাদেরকে সে তার ব্যক্তিগত প্রভাবে রাখার চেষ্টা করতাে।
এ উদ্দেশ্যে সে সহায়তা গ্রহণ করতে সুবিধাবাদী, সুযােগ সন্ধানীদের। এ ধরনের দুর্গ গঠনের উদাহরণ হলাে পাবনার মতিন-আলাউদ্দিন যারা নিজেদের ব্যক্তিগত প্রভাবে দুর্গ গঠন করেছে। তােয়াহাদের ক্ষেত্রেও ইহা প্রযােজ্য, সেও ব্যক্তিগত প্রভাবে দুর্গ গঠন করেছে। অর্থাৎ যে দিকে মতিন সেদিকে ঐ এলাকা, যে দিকে তােয়াহা। সেদিকে ঐ এলাকা।
চীনের ইতিহাসে পেংচেন পিকিং পৌর এলাকায় একটি দুর্গ গঠন করেছিল। তাউচু দক্ষিণ চীনে দুর্গ স্থাপন করেছিল। কাজেই ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদীদের এ ধরনের দুর্গ গঠনের চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে।

চক্র সংগঠকরা নিজেদের দোষ অন্যের কাঁধে চাপায়, নিজেরা ভাল মানুষ সাজে
ফজলু-সুলতান চক্র সমস্ত দোষ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব ও অন্যান্য কমরেডদের উপর চাপায়। নিজেরা ভাল মানুষ সেজে থাকে।
তারা এমন ভাব দেখায় যে তারা রাজনীতি, মতাদর্শ নিয়ে সংগ্রাম করছে, তাদের কোন দোষ নেই, অন্যায়ভাবে তাদেরকে পদ থেকে নামানাে হয়েছে। এভাবে তারা ক্রুশ্চোভের মত আচরণ করে।

চক্রান্তকারীরা ও ষড়যন্ত্রকারীরা কমরেডদের গুপ্তহত্যা করে, ধরিয়ে দেয়
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের এজেন্ট হয়
ফজলু-সুলতান চক্র জনৈক অসুস্থ কমরেডকে সরকারের নিকট ধরিয়ে দিতে চায়, পরে তাকে গুপ্তহত্যা করার ষড়যন্ত্র করে।
তারা পার্টির নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং পার্টির সাচ্চা ‘বিপ্লবীদের হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে।
এভাবে পার্টি-ক্ষমতা দখলের জন্য তারা জঘন্যতম পন্থা গ্রহণ করতে দ্বিধা করেনি।
সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে পার্টির মধ্যকার চক্র কমরেড কিরােভকে (লেনিনগ্রাড পার্টি-নেতা) ১৯৩৪ সালে হত্যা করে।
বার্মার পার্টির ইতিহাসে সংশােধনবাদী চক্র সভাপতি থাকিন থান তুনকে ১৯৬৭ সালে হত্যা করে।
চীনা পার্টির ইতিহাসে চক্রান্তকারীরা বহু ক্ষেত্রে শত্রুর চরে পরিণত হয় এবং শত শত কমরেডকে ধরিয়ে দেয়।
লিন পিয়াও সভাপতি মাওকে হত্যা করার চক্রান্ত করেছিল।
এভাবে চক্রান্তকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের অনেকেই দেশী ও বৈদেশিক শত্রুর চরে পরিণত হয়।
পৃষ্ঠা: ২৪৫

চক্রান্তকারীদের পার্টি বিরােধী কার্যকলাপের সুযােগ গ্রহণ করে সুবিধাবাদীরা
ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারীদের পার্টি-বিরােধী কার্যকলাপের সুযােগ গ্রহণ করে কোন কোন সুবিধাবাদী পার্টি-কর্মী ব্যক্তিগত, পার্টির্গত সুযােগ-সুবিধা, নেতৃত্ব অর্জনের প্রচেষ্টা চালায়।
কেউ কেউ ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারীদের মতামতকে প্রতিফলিত করে এ মতামতকে রক্ষা করে।
শেষােক্তরা যদি সতর্ক না হন তবে তাদের পক্ষে খুবই সম্ভাবনা থাকে চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদীদের খপ্পরে পড়ার এবং তাদের একজন হওয়ার। কোন কোন সােজা। কমরেডদেরকে চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদীরা উস্কে দেয় তাদের হয়ে লড়ার জন্য। এভাবে কেউ কেউ চক্রান্তকারীদের শিকারে পরিণত হতে পারেন।

চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে পার্টির ক্ষমতা দখল
ফজলু-সুলতান চক্র জঘন্যতম মিথ্যা-গুজব-অপবাদ রটিয়ে পার্টি-নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় কমিটি এবং বিশ্বস্ত, সৎ কমরেডদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা, গুপ্তহত্যা, বাধা হয়ে দাঁড়াবে এমন কমরেডদের ধরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে দূর করা, অবশিষ্ট কমরেডদের কাউকে সুবিধা দিয়ে বা চাপ প্রয়ােগ করে বশে আনা, এরপর। তথাকথিত নেতৃস্থানীয় কর্মীদের বৈঠকের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে একটি প্রতিবিপ্লবী কু-দেতা ঘটিয়ে তাদের নির্দেশমত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে পার্টির ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল।
তারা প্রথমে সুবিধাবাদীদের লাইন দেয়, কিছু সাচ্চা কর্মীদের প্রতারিত করে।
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে তারা পার্টির অর্থ চুরি করে, যাতে কমরেড। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ও সাচ্চা বিপ্লবীদের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে তারা যাতে অবাধে সংগঠনের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে পারে, নেতৃত্ব, কেন্দ্রীয় কমিটি ও খাঁটি কমরেডদের সম্পর্কে অপবাদ-গুজব সর্বত্র ছড়াতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হয়। এ উদ্দেশ্যে তারা তাদের পদলেহীদের বিভিন্ন স্থানে পাঠায়।
তারা গুপ্তহত্যার তালিকা প্রণয়ন করে, তার পরিকল্পনা করে। তারা পরিকল্পনার পরবর্তী স্তর, নেতৃস্থানীয় কর্মীদের বৈঠকের দাবী জানায়।
নেতৃত্বের সতর্কতা, কমরেডদের আন্তরিকতা, নেতৃত্ব ও বিপ্লবের প্রতি কমরেডদের আস্থার জন্য তাদের চক্রান্ত ধরা পড়ে যায়। তাদের সকল প্রতিক্রিয়াশীল পরিকল্পনা তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ে। তাদের কেউ কেউ পলায়ন করে। কেউ কেউ নিজকে বাঁচাবার জন্য সাফাই গাইছে।
সােভিয়েট পার্টির ক্ষমতা ক্রুশ্চেভ একইভাবে দখল করে। তারা লেনিনগ্রাড পার্টিকমিটির কমরেড কিরােভকে ১৯৩৪ সালে গুপ্তভাবে হত্যা করে।
লিউ শাওচি প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। লিনপিয়াও একইভাবে ব্যর্থ হয়।
পৃষ্ঠা: ২৪৬

আমাদের চক্রান্তকারীরাও ব্যর্থ হয়েছে পার্টির ক্ষমতা দখল করতে। পক্ষান্তরে তারা হয়েছে কমরেড ও জনগণের নিকট ঘৃণিত, ধিকৃত।

ষড়যন্ত্রকারীরা, চক্রান্তকারীরা প্রকৃতপক্ষে সামন্তবাদ,
আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ বুর্জোয়া, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ,
মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ,
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট
ফজলু-সুলতান চক্র তাদের অনুসৃত জঘন্য উপায়ে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হলে সে-পার্টি কি বিপ্লবী থাকত? মােটেই না। ইহা দেশীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের স্বার্থরক্ষাকারীতে পরিণত হত।
ফজলু-সুলতান চক্র সুবিধাবাদী, দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতকদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। সাচ্চা ও খাটি কর্মীদের খতম বা উৎখাত করার চক্রান্ত করে। তারা নিজেরা হচ্ছে ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য প্রদানকারী। এর ফলে তাদের পার্টির সবাই ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য প্রদানকারীদের পার্টিতে পরিণত করতাে। অর্থাৎ, যৌন স্বেচ্ছাচার, নেতা, পদ, অর্থ, নাম ইত্যাদির জন্য তারা যা প্রয়ােজন তাই করতাে, অর্থাৎ মার্কসবাদ বা নীতি বলতে তাদের কিছুই থাকত না।
এর পরিণতি হত দেশীয়, আন্তর্জাতিক শত্রুর দালালী করা।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি হচ্ছে দেশীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের নিকট পহেলা নম্বরের বিপদ। বর্তমানে পার্টির বিকাশের চমৎকার অবস্থা বিরাজ করছে।
এ সময় ফজলু-সুলতান চক্রের পার্টিকে ধ্বংস করার কার্যকলাপ শক্রর জন্য সবচাইতে উৎকৃষ্ট উপহার ছাড়া আর কিছু নয়।

চক্র গঠকদের পতন অনিবার্য
ফজলু-সুলতান চক্রের সমস্ত অপরাধসমূহ কর্মীরা শেষ পর্যন্ত জেনে ফেলেছে, গােপন রাখা সম্ভব হয়নি।
সমস্ত কর্মীদের নিকট তারা চোর, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী বলে পরিচিত হয়েছে। তারা মিথ্যা ও গুল মেরেছে-এ কথা সকলের নিকট পরিষ্কার হয়ে গেছে। তারা নিজেরাই শেষ পর্যন্ত সংগঠন পরিত্যাগ করে পলায়ন করেছে।
সভাপতি মাও বলেছেন, “অসৎ মনােভাব পতন ডেকে আনে।” সাদেক চক্রের পতন তাদের অসৎ মনােভাবের জন্যই হয়েছে।
আবুল হাসান-শান্তিলালের পতন একই কারণে হয়েছে। ক্রুশ্চোভ-লিউশাউচির পতন একই কারণে হয়েছে। লিনপিয়াও-এর পতনও একই কারণে হয়েছে।
ফজলু-সুলতান চক্রের পতনও একই কারণে হবে। তারা অভিনয় করে, দু’মুখাে হয়ে ভাল মানুষ সাজতে চেয়েছে; কিন্তু সময় তাদের প্রকৃত কুৎসিত, প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র প্রকাশ করে দিয়েছে। সারা জীবন ধরে অভিনয় করা যায় না, প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ পাবেই পাবে।
ইতিহাস তখন তাদেরকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে, এভাবে সমাজের গতিধারায় প্রতিক্রিয়ার আবর্জনা, নােংরা কেটে পড়বে, খাঁটি ও প্রকৃত বিপ্লবীরা টিকে থাকবে সমাজের গতিধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
পৃষ্ঠা: ২৪৭

সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, অধঃপতিত ব্যক্তিদের বের করে দিয়ে পার্টি শক্তিশালী হয়
সাদেক, আবুল হাসান-শান্তিলাল চক্র নিজেরাই পার্টি থেকে বেরিয়ে যায়। ফজলু চক্রও স্বেচ্ছায় পার্টি থেকে পলায়ন করে।
এর ফলে পার্টির কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। কিছু কর্মী চলে গেছে। কোন কোন এলাকায় কাজ চক্রান্তকারীদের সংগঠন বিরােধী তৎপরতার জন্য ক্ষতি হয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে। সাধারণ কর্মীদের মাঝে কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে, শত্রুরা খুশী হয়েছে, এদের মাধ্যমে নতুন যােগাযােগ সমূহ হারিয়েছে।
কিন্তু এর একটা ভাল দিকও রয়েছে। এ সকল চক্রান্তকারীরা পার্টির কর্মীদের মাঝে হতাশা, দোদুল্যমানতা, অস্থিরতা সৃষ্টি করতাে। পার্টির শৃংখলা দুর্বল করে বা ভেঙ্গে দিয়ে অপর এক কেন্দ্র গঠন করতাে। পার্টির মাঝে টাইম বােমা হিসেবে থাকতাে। পার্টির মাঝে গুপ্তহত্যা, বিশ্বাসঘাতকতার কারণ হিসেবে বিরাজ করতাে, ভবিষ্যতের বিরাটাকার ক্ষতি ঘটাত।
স্ট্যালিন বলেছেন, এ ধরনের মিত্র নিয়ে লড়াই করার অর্থ হচ্ছে পার্টিকে দু’দিক থেকে গুলির মাঝে ফেলা; একদিকে বাইরের শত্রুর, অন্যদিকে ভিতরের শত্রুর। এর ফলে পার্টির পক্ষে বিজয় অর্জন করা অসম্ভব।
ফজলু-সুলতান চক্রের ঘটনা থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান নেতিবাচক উদাহরণ ও শিক্ষা পার্টি অর্জন করেছে। এর মূল্য অপরিসীম। ভবিষ্যতের চক্র, ষড়যন্ত্র, চক্রান্তকে সংগ্রাম করার জন্য এ অভিজ্ঞতার খুবই প্রয়ােজন।

চক্র গঠকদের ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত পরাজিত হলে
তাদের কেউ কেউ ঐক্যপন্থী হয়ে যায়,
গা বাঁচাবার জন্য ভাল মানুষের ভান করে
ফজলু-সুলতান চক্রের পার্টি ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় তারা খুব ঘাবড়ে গেছে। ফজলু চক্র পলায়ন করে। অন্যান্যদের মধ্যে কেউ কেউ ঐক্যপন্থী, গা বাঁচাবার জন্য ভাল মানুষের ভান ধরে। তারা পার্টির ঐক্য, পার্টির ভাল করার জন্য কুম্ভিরাশ্রু ফেলে।
এটা তাদের একটা প্রতারণা মাত্র। পার্টির চরম সর্বনাশ করার মত কার্যকলাপ করে তারা এখন পার্টি-স্বার্থ, পার্টি-ঐক্যের কথা বলে। কিরূপ ভাওতাবাজ হলে এরূপ করা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়।
তারা যে ঐক্য-স্বার্থের কথা বলে তা প্রকৃতপক্ষে হচ্ছে সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুযােগ সন্ধানী, উপদল গঠনকারী, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্রকারী, অর্থ-অস্ত্র আত্মসাৎকারী প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে পার্টির ঐক্য এবং এদের স্বার্থ রক্ষা করা।
অর্থাৎ, তারা এবারকার মত রেহাই চায়, পার্টির মাঝে থাকতে চায় যাতে পার্টিকে তারা আরাে নিপুণভাবে ধ্বংস করতে পারে, তারা আরেকটা সুযােগ চায়।
এ ধরনের চক্রান্তকারীরা পার্টির মধ্যে থাকার সুযােগ পেয়ে কমরেড কিরােভকে হত্যা করে। বার্মার কমরেড থাকিন থান তুনকে হত্যা করে।
এ কারণেই স্ট্যালিন বলেছেন, “পার্টির অভ্যন্তরের শত্রু এবং বাইরের শত্রুর দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে পার্টি কিছুই করতে পারে না।”
পৃষ্ঠা: ২৪৮

এমতাবস্থায় পার্টির দায়িত্ব হলাে ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদী ও ঘাতকদের সাথে পার্টির বিভেদের নীতেতে দৃঢ় থাকা, তাদেরকে শর্তহীনভাবে বহিস্কার করা, তাদেরকে আর সুযােগ না দেওয়া, পার্টির মাঝে লুক্কায়িতদের খুঁজে বের করা, তাদেরকে শাস্তি বিধান করা।
এভাবে পার্টির মহান দায়িত্ব হলাে সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, ঘাতকদের ও অধঃপতিতদের বহিস্কারের মাধ্যমে পার্টিকে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী করা, অর্থাৎ পাগলা কুকুর পানিতে পড়লেও তাকে পিটানাের নীতিতে দৃঢ় থাকা, এদের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া, এ প্রক্রিয়ায় খাটি বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করা।

উপসংহার
উপরােক্ত চক্রগুলাে থেকে যে নিয়মবিধি আবিষ্কার করা যায় তা অতিশয় মনোেযােগ সহকারে পার্টি-কর্মীরা পাঠ করবেন। এ সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে চক্র, ষড়যন্ত্র ও প্রতারণা করা। কাজেই এ সকল পদক্ষেপ গ্রহণে বিরত থাকবেন। ন্যায়পরায়ণ, অকপট ও মুক্তমন হবেন, পার্টির মধ্যকার গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পদ্ধতি অনুসরণ করবেন, ঐক্য-সমালােচনা-ঐক্য-এর মাধ্যমে দ্বন্দ্বের মীমাংসা করবেন, পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ, সুশৃংখল, এককেন্দ্রীক পার্টি হিসেবে গড়ে তুলবেন। যে কেউ শৃংখলাকে ভঙ্গ করে সে-ই শত্রুকে সহায়তা করে। কাজেই শৃংখলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকবেন। সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, চক্রগঠক, অভিনেতা ও দু’মুখখাদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।

নােটঃ
১। ক্যান্সার রােগ পৃথিবীতে বিরাজ করছে। আমরা চিন্তা করি বা না করি তা আছে, অর্থাৎ ক্যান্সার আমাদের চিন্তা থেকে স্বাধীনভাবে বিরাজ করছে। একে বলে বস্তু নিজে নিজেই বিরাজ করে। কিন্তু মানুষ গবেষণার মাধ্যমে ক্যান্সারের নিয়মবিধি, অর্থাৎ কিভাবে ইহা উৎপত্তি হয়, কিভাবে ভাল করা যায়, তা জানতে চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে মানুষ যখন সফল হবে তখন ক্যান্সার আমাদের জন্য বস্তুতে রূপান্তরিত হবে। বস্তুবাদীরা এই ধরনের রূপান্তরকে বিশ্বাস করে। ভাববাদীরা বলে প্রকৃতিকে জানা, তাকে বশে আনা, তাকে আমাদের জন্য বস্তুতে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়।
পৃষ্ঠা: ২৪৯

সম্পাদকীয়, লাল ঝাণ্ডা -২
(মে, ১৯৭২)
কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে ঐক্যকে দৃঢ় করুন, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদী, সুযােগসন্ধানীদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যান!

পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের কামানের গােলার শব্দের মাঝে গড়ে উঠে ৩রা জুন, ১৯৭১ সালে আমাদের প্রাণপ্রিয় “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।” কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণীত সঠিক লাইন এবং তা বাস্তবায়নে কর্মীদের মহান আত্মত্যাগ ও কঠোর প্রয়াসের। মাধ্যমে পার্টি সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী গণভিত্তিক পার্টি হিসেবে বিকাশ লাভের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ সময় পার্টির আভ্যন্তরীণ শ্ৰেণী শত্রু ফজলু-সুলতান চক্র পার্টির চরমতম ক্ষতিসাধনের জন্য পার্টির মাঝে গুজব-অপবাদ রটায়, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে। গুপ্ত হত্যার পরিকল্পনা করে, পার্টির কাজ বন্ধের জন্য অর্থ-অস্ত্র চুরি করে।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্রস্টোভের মত কু-দেতা (ষড়যন্ত্র করে হঠাৎ ক্ষমতা দখল) করে পার্টির ক্ষমতা দখল এবং পার্টিকে দেশীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের স্বার্থরক্ষাকারীদের পার্টিতে পরিণত করা।
তাদের কার্যকলাপ ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলার ও বিশ্বের বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের জন্য সবচাইতে উৎকৃষ্ট উপহার।
পার্টির নেতৃত্বের সতর্কতা, কর্মীদের আন্তরিকতা এবং পার্টি ও নেতৃত্বের প্রতি তাদের অবিচলিত আস্থার কারণে ফজলু-সুলতান চক্রের ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ব্যর্থ হয়। তাদের কেউ কেউ সচেতন বিপ্লবী কর্মীদের বিচারের ভয়ে পলায়ন করে, কেউ কেউ গা বাঁচানাের চেষ্টা করে।
ফজলু-সুলতান চক্র এবং তাদের সাথে যুক্তদের জঘন্যতম অপরাধের জন্য সকল কর্মী দারুণ রােষে ফেটে পড়ছেন। তারা এদের কঠোর শাস্তির দাবী জানাচ্ছেন।
ফজলু-সুলতান চক্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে, তারা লজ্জাকর পরাজয় বরণ করেছে। তাদের কেউ কেউ শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী-চক্রান্তকারী এবং সুবিধাবাদী-সুযােগসন্ধানীদের কেউ কেউ এখনও রয়ে গেছে। তারা ভাল মানুষ সেজে পার্টিতে থাকার চেষ্টা করছে।
আমরা অবশ্যই দুষ্ট লােকের মিষ্ট কথায় ভুলব না, পাগলা কুকুর পানিতে পড়লেও পিটানাের নীতিতে দৃঢ় থাকব। এদের মিষ্ট কথায় ভুলা, এদেরকে পানি থেকে উঠতে দেওয়া, এদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অর্থ হচ্ছে পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থের চরম ক্ষতি সাধন করা।
পৃষ্ঠা: ২৫০

কাজেই এদের সাথে বিভেদের নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে। এদের খুঁজে বের করা, অপরাধ নির্ণয় করা, শাস্তি বিধান করা, এদেরকে শর্তহীনভাবে বহিষ্কার করে পার্টিকে পরিষ্কার রাখার বিপ্লবী নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে।
ফজলু-সুলতান চক্রের প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা পরিচালনা সম্ভব হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক কর্মীর কোন কোন বিষয়ে ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি থাকার জন্য।
এ কারণে উপরােক্ত বিষয়গুলাে সম্পর্কে ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি সংশােধন করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে সমগ্র সংগঠনব্যাপী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
এ শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি সংশােধিত হবে, একই সাথে ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদী, সুযোগসন্ধানীদের অবশিষ্টাংশ এবং অসংশােধিত অপরিবর্তিত বাসী উপাদান বর্জিত হবে। এ প্রক্রিয়ায় টাটকা ও প্রাণপূর্ণ সক্রিয় নতুন উপাদান পার্টিতে গৃহীত হবে।
যারা আন্তরিকভাবে বিপ্লবী কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারীদের প্রতারণায় বিভ্রান্ত হয়েছেন, তাদেরকে যথেষ্ট সুযােগ প্রদান করতে হবে যাতে শিক্ষার মাধ্যমে রােগ থেকে তারা সেরে উঠেন, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়াতে পারেন।
ফজলু-সুলতান চক্রের এ সকল কার্যাবলীর শেকড় কোথায়?
সভাপতি মাও বলেছেন, “অতীত জান, তাহলে বর্তমান বলতে পারবে, অতীত বর্তমান জান, তাহলে ভবিষ্যত বলতে পারবে।” ফজলু-সুলতান চক্র এবং তাদের সাথে যুক্তদের শ্ৰেণী খারাপ, অতীতে তারা প্রত্যেকেই কমবেশী ভ্রষ্ট জীবন যাপন করেছে, তাদের প্রত্যেকেরই কমবেশী পদের লােভ, নেতৃত্বের লােভ, নাম যশের লােভ দেখা গেছে।
সুদীর্ঘদিন পার্টিতে থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদেরকে সংশােধন করতে পারেনি। বিভিন্ন পার্টির ইতিহাসে দেখা যায় কয়েক যুগ ধরেও এ ধরনের অনেকেই সংশােধিত হয়নি।
তাদের ভ্রষ্ট জীবন থেকে এসেছে নিজেদেরকে কেউকেটা মনে করা, চক্র গঠন করার সাহস। অসর্বহারা শ্রেণী ভিত্তি থেকে এসেছে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ, পদ-নেতৃত্ব, ক্ষমতা, নাম যশের লােভ।
ফজলু সামন্তবাদী শ্রেণী থেকে এসেছে। ছােট কাল থেকেই শিখে এসেছে অভিনয় করা, দু’মুখাে হওয়া। একই শ্রেণী ও পরিবেশ থেকে আগত সালমার সাথে তার হুবহু মিল রয়েছে। ফজলু-সালমা প্রতারণা, অভিনয়, দু’মুখাে ব্যবহারের উদাহরণ স্থাপন করে।
তাদের ভ্রষ্ট জীবন এবং কারাে কারাে ক্ষুদে বুর্জোয়া সামন্ত শ্রেণী ভিত্তি থেকে এসেছে অভিনয় করা, প্রতারণা করা, মিথ্যা বলা, দু’মুখাে হওয়ার খারাপ স্বভাব।
বুর্জোয়ারাও তাদের শ্রেণী স্বার্থে প্রতারণা করে, ভাওতা দেয়, দু’মুখাে হয়, মিথ্যা বলে। ইহা সকল শােষক শ্রেণীর শ্রমিক-কৃষক জনতাকে শােষণ করার সাধারণ কৌশল।
কাজেই পার্টির কর্মী সংগ্রহ ও নিয়ােগের সময় তাদের শ্রেণী ও অতীতের জীবন (বিশেষ করে ভ্রষ্ট ছিল কিনা তা), পদের লােভ, নেতৃত্ব-ক্ষমতার লােভ, নাম যশের লােভ এবং অন্যান্য ব্যক্তি স্বার্থ রয়েছে কিনা তা কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে।
অন্যথায় অসর্বহারা শ্রেণী থেকে আগত ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্যকারীরা ফজলু-সুলতান চক্রের মত পার্টির চরম ক্ষতি সাধন করবে।
পৃষ্ঠা: ২৫১

এ কারণে পার্টি কর্তৃক জরুরী ভিত্তিতে প্রতিটি কর্মীর কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
ফজলু-সুলতান চক্র পার্টির কিছুটা প্রতিকূলতা অস্থায়ীভাবে সৃষ্টি করেছে। কিন্তু খারাপ জিনিসও ভাল জিনিসে রূপান্তরিত করা যায়।
ফজলু-সুলতান চক্রকে বহিষ্কার করে পার্টি চূড়ান্ত বিশ্লেষণে শক্তিশালী হয়েছে। ফজলু-সুলতান চক্র থেকে পার্টি অর্জন করেছে একটি অতিশয় মূল্যবান অভিজ্ঞতা। ফজলু-সুলতান চক্র হচ্ছে আমাদের নেতিবাচক শিক্ষক। কাজেই তাদের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করা, তার নিয়মবিধি বের করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানাে একটি বিপ্লবী দায়িত্ব।
সমগ্র পার্টি শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় এবং সাধারণভাবে ফজলু-সুলতান চক্র সম্পর্কিত নেতিবাচক অভিজ্ঞতা পর্যালােচনা করবেন এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবেন।
ফজলু-সুলতান চক্রের আবির্ভার কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইহা পার্টি অভ্যন্তরে সর্বহারা শ্রেণী ও অসর্বহারা শ্রেণীর মধ্যকার শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি। ফজলুসুলতান চক্র এবং তাদের সাথে যুক্তদের বহিষ্কারের মাধ্যমেই এ সংগ্রাম শেষ হবে না। যতদিন পূর্ব বাংলার সমাজে শ্রেণী থাকবে ততদিন পার্টির অভ্যন্তরে শ্রেণী সংগ্রাম শেষ হবে না। পার্টির অভ্যন্তরে প্রতিটি প্রশ্নে দুধরনের মতামত আসবে-সর্বহারা ও অসর্বহারা। এর মাঝে সংগ্রাম চলবে, সর্বহারারা জিতবে না অসর্বহারারা জিতবে তা নির্ধারণের জন্য সংগ্রাম কখনও কখনও অতিশয় তীব্র আকার ধারণ করবে।
এ সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় অনিবার্যভাবেই কিছুসংখ্যক অসর্বহারারা অসংশােধিত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, তাদের কেউ কেউ তাদের ভুল মতামত কার্যকরী করার জন্য পদ, নেতৃত্বের জন্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করবে।
পার্টির মধ্যকার সর্বহারা বিপ্লবীদের দায়িত্ব হলাে পার্টির মধ্যকার সর্বহারা স্বার্থরক্ষাকারীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, অসর্বহারাদের ভুল লাইনকে পরাজিত করা, তাদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা, বাসী উপাদান বর্জন করা।
এভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের বিজয় হলে পার্টি বিপ্লবী থাকবে, অব্যাহত হবে(?), সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে ক্ষমতা দখল ও তা বজায় রাখার সংগ্রামে পার্টি নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে।
আর অসর্বহারাদের বিজয় হলে পার্টি অসর্বহারাদের পার্টিতে রূপান্তরিত হবে, পার্টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া ও শােষকদের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টিতে পরিণত হবে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতিনিধিত্ব করেন পার্টির মধ্যকার সর্বহারাদের। ইহা পার্টির মধ্যকার সর্বহারাদের একমাত্র কেন্দ্র। কাজেই প্রতিটি প্রশ্নে সচেতনভাবে বুঝে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটিকে রক্ষা করা, তা সমর্থন এবং তা যাতে অসর্বহারাদের উপর বিজয় অর্জন করে তা নিশ্চিত করা প্রতিটি বিপ্লবীর মহান দায়িত্ব।
কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন সকল কর্মী ঐক্য ও আস্থা দৃঢ় করবেন, অসর্বহারা চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবেন, প্রতিকুলতাকে অনুকুলতায় রূপান্তরিত করে অধিকতর বিজয় অর্জন করবেন।
পৃষ্ঠা: ২৫২

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিবৃতি
ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী ও সুবিধাবাদীদের নতুন আক্রমণকে প্রতিহত করুন
(৯ জুন, ১৯৭২)

ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারীদের চক্র গঠন, গুপ্ত হত্যা, অর্থ-অস্ত্র চুরি, অপবাদ-গুজব রটনার মাধ্যমে পার্টির ক্ষমতা দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় তারা নতুন পথ অবলম্বন করছে।
এখন তাদের কেউ কেউ গা বাঁচানাের জন্য, নিজেদেরকে রক্ষার জন্য সংগঠনের ঐক্যের পক্ষপাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বিভেদ ঠেকানাের জন্য কাজ করবে বলে উল্লেখ। করছে, তিলে তিলে যে সংগঠন গড়ে উঠেছে তারা তার মঙ্গল চায় বলে বলছে ইত্যাদি।
আহারে ঐক্যপন্থীরা! মাছের মায়ের পুত্র শােক!
সংগঠনের চরমতম ক্ষতিসাধনের চক্রান্ত করে এখন ঐক্যপন্থীর ভান করা। এটা আরেক প্রকারের প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবীদের সাথে যতই বিভেদ ঘটানাে যায় ততই মঙ্গলজনক। ইহা মার্কসবাদী।
তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অর্থ হচ্ছে ঘাতকের হাতে প্রাণ বিসর্জন, শত্রুর চরদের হাতে ধরা পড়া, পার্টির মধ্যে অস্থিরতা, অদৃঢ়তা, এককেন্দ্রহীনতা, শৃংখলা বিসর্জন দেওয়া, পার্টিকে সুবিধাবাদীদের পার্টিতে পরিণত করা, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় শত্রুদের সেবা করা।
“শত্রু যা সমর্থন করে আমরা তার বিরােধিতা করি, শত্রু যা বিরােধিতা করে আমরা তা সমর্থন করি”- শত্রু ও আমাদের শ্রেণী বিশ্লেষণ করে লাইন নির্বাচনের এ সহজ পদ্ধতি সভাপতি মাও শিখিয়েছেন।
কাজেই চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী শত্রুরা যা চায় আমরা তার বিরােধিতা করি। অর্থাৎ আমরা তাদের ঐক্যের লাইনকে বিরােধিতা করি, তাদের সাথে বিভেদের লাইনকে সমর্থন করি অর্থাৎ তাদেরকে চিরতরে পার্টি থেকে বহিষ্কার করা ও যথাযথ শাস্তি প্রদানের নীতিতে দৃঢ় থাকি।
লেনিন, স্ট্যালিন আমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন।
শর্তহীনভাবে চক্র ভেঙ্গে দেয়া এবং দ্রুতগতিতে তাদেরকে (চক্রের সাথে যুক্তদের) পার্টি থেকে বহিস্কার করার কথা লেনিন বলেছেন। স্ট্যালিন বলেছেন, “সুবিধাবাদীদেরকে বহিষ্কার করে পার্টি শক্তিশালী হয়। এদের থাকার অর্থ হচ্ছে পার্টিকে আভ্যন্তরীণ ও বাইরের শত্রুর সম্মুখীন হওয়া। এ অবস্থায় পার্টির পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। কাজেই সমগ্র পার্টি ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, উপদল গঠনকারী, অর্থ-অস্ত্র চোর, গুপ্ত হত্যার পরিকল্পনাকারী, গুজব অপবাদ রটনাকারী, সুবিধাবাদীদের নতুন আক্রমণের বিরুদ্ধে সজাগ থাকবেন।
পৃষ্ঠা: ২৫৩

তাদের সাথে ঐক্যের বক্তব্যকে তাদের সাথে আমাদের বিভেদের বক্তব্য দ্বারা সর্বহারার স্বার্থে বিরােধিতা করবেন। তাদের সাথে আমাদের বিভেদের অর্থাৎ তাদেরকে বহিষ্কার করা, যথাযথ শাস্তি বিধানের লাইনে, তাদের সাথে সর্বদা স্পষ্ট পার্থক্য বজায় রাখার লাইনে দৃঢ় থাকবেন।
তাদের নতুন আক্রমণ প্রতিহত করবেন। দুষ্ট লােকের মিষ্ট কথায় ভুলবেন না। ‘পাগলা কুকুর পানিতে পড়লেও পিটানাে’ -এ নীতিতে দৃঢ় থাকবেন, অন্যথায় কুকুরের প্রতি মায়া হলে সে পানি থেকে উঠে কামড়াবে। দুষ্ট লােকের মিষ্ট কথায় ভুললে সে চরম ক্ষতি করবে। কাজেই এদের নতুন আক্রমণের ভাওতায় পড়ার অর্থ পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে বিসর্জন দেয়া।
সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার ঐক্যকে আপনারা দৃঢ় করবেন, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্ত কারী, সুবিধাবাদীদের সাথে বিভেদের ও পার্থক্যের নীতিতে দৃঢ় থাকবেন।
কেন্দ্রীয় কমিটি,
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
পৃষ্ঠা: ২৫৪

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীল এবং পূর্ব বাংলার জনগণের উদ্দেশ্যে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির
বিশেষ ইশতেহার
(১০ জুন, ১৯৭২)

বিশ্বাসঘাতক, দলত্যাগী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী,
সুবিধাবাদী, অন্তর্ঘাতক, প্রতারক, উপদল গঠক

সেলিম শাহনেয়াজ ওরফে ফজলু খতম
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বীর গেরিলারা এই বিশ্বাসঘাতক চক্রকে খতম করে সর্বহারা পার্টির প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবস (৩রা জুন) উদযাপন করেছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি হচ্ছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র বিপ্লবী পার্টি।
কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণীত সঠিক লাইনে পরিচালিত হয়ে পার্টি বর্তমানে সমগ্র পূর্ব বাংলা ব্যাপী জাতীয় গণভিত্তিক পার্টি হিসেবে বিকাশ লাভের স্তরে পৌঁছেছে।
এর ফলে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে ধ্বংস করার জন্য শত্রুর হামলাও তীব্রতর হয়েছে। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক, ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে ধ্বংস করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এই সকল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রেণী ও জাতীয় শত্রুদের সাথে যােগসাজশে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির আভ্যন্তরীণ শ্রেণী শত্রু বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব দখল এবং পার্টিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চালায়।
সে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, পার্টি নেতৃত্ব ও সাচ্চা কমরেডদের বিরুদ্ধে জঘন্য অপবাদ, কুৎসা ও গুজব রটায়, অর্থ-অস্ত্র চুরি করে, কমরেড সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য সাচ্চা বিপ্লবীদের হত্যা করার সর্বাত্মক প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালায়; খুলনা এলাকায় সর্বহারা পার্টির সুনাম ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়াশীল দুর্গ গঠনের প্রচেষ্টা চালায়, উপদল গঠন করে নিজেদেরকে পার্টির মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়াশীল কেন্দ্র হিসেবে দাঁড় করায়; সুবিধাবাদী, দলত্যাগী ও বৈর ব্যক্তিদের একত্রিত করে সংগঠনের ভিতরে ও বাইরে বিভেদপন্থীমূলক সংগঠন বিরােধী তৎপরতা চালায়, পার্টিকর্মী, সহানুভূতিশীল এবং জনগণকে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করে পার্টির গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা পদদলিত করে পার্টির বিশ্বাস ভঙ্গ করে।
এভাবে সে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের বিরুদ্ধে এক হাজার একটি অপরাধ করে এবং পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের সবচাইতে বড় শত্রুতে পরিণত হয়।
পৃষ্ঠা: ২৫৫

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ফজলু চক্রকে তার জঘন্য অপরাধসমূহের শাস্তি স্বরূপ পার্টি থেকে তাকে চিরদিনের জন্য বহিষ্কার করে। এতে অনুতপ্ত না হয়ে সে আরাে জোরে সােরে তার প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালায়।
“লােভে পাপ, পাপে মৃত্যু”। বিভিন্ন প্রকার প্রতিবিপ্লবী স্বার্থের লােভে সে যে সকল পাপ অর্থাৎ অপরাধ করেছে, তা-ই তার মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করে।
ফজলু চক্র পূর্ব বাংলার কোন এক স্থানে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি বিরােধী তৎপরতা চালাতে গেলে সেখানকার পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বীর গেরিলারা নিজস্ব উদ্যোগে ৩রা জুন ফজলু চক্রকে দেশীয় অস্ত্রের সাহায্যে খতম করে। মৃত্যুর সময় কাপুরুষ ফজলু চক্র গেরিলাদের পায়ে ধরে প্রাণ ভিক্ষা চায়। কিন্তু শ্রেণী সচেতন গেরিলারা “পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ”, “কমরেড সিরাজ সিকদারজিন্দাবাদ” শ্লোগান দিতে দিতে তাকে খতম করে।
ফজলু চক্র কমরেড সিরাজ সিকদার এবং অন্যান্য সাচ্চা কমরেডদের খতমের। জঘন্য প্রতিবিপ্লবী চেষ্টা চালায়। কিন্তু পরের জন্য গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তে সে নিজেই পড়ে, সাচ্চা বিপ্লবীরাই তাকে খতম করে।
এইভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম প্রতিষ্ঠা দিবস পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের সবচাইতে বড় শত্রু খতমের মাধ্যমে উদযাপিত হয়।
ইহা পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের জন্য একটি বিরাট বিজয়। ইহা কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্বের জন্য একটি বিরাট বিজয়।
ইহা পূর্ব বাংলার ও বিশ্বের বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামের একটি বিরাট বিজয়।
ইহা ছয় পাহাড়ের দালাল, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রামের একটি বিরাট বিজয়।
ইহা বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের জন্য একটি বিরাট বিজয়।
ফজলু চক্রের সাথে যুক্ত অন্যান্যদের প্রতি আহ্বান জানানাে হচ্ছে, আপনারা অনতিবিলম্বে শর্তহীনভাবে পার্টির নিকট আত্মসমর্পণ করুন। অনতিবিলম্বে পার্টি, বিপ্লব ও জনগণ বিরােধী সকল প্রকার তৎপরতা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করুন। অন্যায়ভাবে দখলকৃত পার্টির অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি পার্টির নিকট ফেরত দিন। আপনাদের নিকটস্থ পার্টির যােগাযােগ সমূহ বুঝিয়ে দিন। আপনাদের অপরাধ স্বীকার করে পার্টির নিকট শাস্তি প্রার্থনা করুন। অন্যথায় আপনাদের পরিণতি হবে বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্রের অনুরূপ। কলঙ্কিত মৃত্যু আপনাদের জন্য অবধারিত।
ফজলু চক্রের উদ্ভব, বিকাশ ও পতন মাত্র দু’মাস সময়ের মধ্যে সংঘটিত হয়। ফজলু চক্রের উদ্ভবের ফলে পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের কাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ফজলু চক্র থেকে পার্টি মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যা পার্টিতে ফজলুর মত চক্রের পুনঃউদ্ভব ঠেকাতে সর্বদা সহায়তা করবে। ফজলু চক্র হচ্ছে ইতিহাসের অতিশয় মূল্যবান নেতিবাচক শিক্ষক। পার্টি-পদ, ক্ষমতা, নাম, যশ ও অন্যান্য ব্যক্তিস্বার্থে যারা পার্টি ও বিপ্লবে যােগদান করেছেন, তারা নিজেদের পরিবর্তনের জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাবেন, জনগণের নিঃস্বার্থ সেবক হবেন। অন্যথায় তাদের পরিণতি হচ্ছে ফজলু চক্রের পরিণতি।
পৃষ্ঠা: ২৫৬

পার্টির অভ্যন্তরস্থ শ্রেণী শত্রুদের প্রবল আক্রমণের বিরুদ্ধে যদিও আমরা বিরাট বিজয় অর্জন করেছি তবুও তাদের আক্রমণ এখনও শেষ হয়নি। এর সাথে রয়েছে বাইরের শত্রুদের প্রবল আক্রমণ। কাজেই আমাদের সতর্কতা কঠোরভাবে বজায় রাখতে হবে।
ফজলু চক্রের পতন হয়েছে, কিন্তু এর বিষাক্ত প্রভাবকে পুরােপুরি দূর করার জন্য কমরেডদের চিন্তাধারা এবং কর্মপদ্ধতির ক্ষেত্রে সুদীর্ঘ দিন শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে যেতে হবে।
ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, সুবিধাবাদীদের অবশিষ্টাংশকে খুঁজে বের করতে হবে, তাদেরকে যথাযথ শাস্তি বিধান করতে হবে, এই প্রক্রিয়ায় খাটি বিপ্লবী, সহানুভূতিশীল ও ব্যাপক জনগণের সাথে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা হচ্ছে কাগুজে বাঘ, কাজেই শেষ পর্যন্ত তাদের পরাজয় ও ধ্বংস অনিবার্য। তাদের স্থান হচ্ছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়।
বাকুনিন, বার্নেস্টাইন, কাউটস্কি, ক্রুশ্চেভ, লিউ শাওচি প্রতিক্রিয়াশীলরা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, ফজলু চক্রেরও অনুরূপ পরিণতি হয়েছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ইতিহাসের এ সকল ভিলেনদের বিরুদ্ধে জটিল সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় অবশ্যই বিজয় লাভ করবে ও পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করবে এবং কমিউনিজম বাস্তবায়িত করবে এবং নিজের ঐতিহাসিক ভূমিকা সম্পন্ন করবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মী, গেরিলা ও সহানুভূতিশীলদের মহান দায়িত্ব হলাে বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র খতমের ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করা, সর্বদা পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের শত্রুদের খতম করা; পার্টি, বিপ্লব ও জনগণকে রক্ষা করা।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ।
কমরেড সিরাজ সিকদার- জিন্দাবাদ।
চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী ও সুবিধাবাদীদের ধ্বংস অনিবার্য।
পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন।
পৃষ্ঠা: ২৫৭

হুমায়ুন কবীর প্রসঙ্গে বক্তব্য
(১০ জুন, ১৯৭২)
[এই নিবন্ধটি কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক “হুমায়ুন কবীর প্রসঙ্গে সর্বহারা পার্টির বক্তব্য-১” শিরােনামে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি পরবর্তীতে আগস্ট, ‘৭৪-এ প্রকাশিত উপদলবাদ বিরােধী সংগ্রামের দলিল সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]

হুমায়ুন কবীর পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে সুবিধাবাদ, ব্যক্তিস্বার্থ (স্ত্রী, পরিবার), চাকুরী ও পদের স্বার্থে সে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। বহুদিন তার সাথে যােগাযােগও বিচ্ছিন্ন থাকে।
বরিশালে সে একবার ধরা পড়ে, কিন্তু জেল থেকে সে বন্ড দিয়ে বেরিয়ে আসে, অর্থাৎ পাক-সামরিক দস্যুদের কাছে সে আত্মসমর্পণ করে।
২৫শে মার্চের পরবর্তী সময়ে সে সুদীর্ঘদিন পালিয়ে থাকে। পার্টি তার সাথে যােগাযােগ করে বার বার জাতি ও জনগণের এই সংকটজনক অবস্থায় বিপ্লবে। যােগদানের আহবান জানায়। শেষ পর্যন্ত সে এর শর্ত হিসেবে বিরাট অংকের ভাতা চায়। পার্টির বারংবার বুঝানাের ফলে সে কিছুটা তৎপরতায় অংশগ্রহণ করে। এটা সে করে আত্মপ্রচার ও দুঃসাহসী বীর হিসেবে নিজেকে জাহির করার জন্য।
ইতিমধ্যে তার ভাই ফিরােজ কবীর ওরফে তারেক চক্রান্ত করে একজন কমরেডকে হত্যা, সমরবাদী নীতি, বন্দুকের ডগায় নারীদের নিয়ে স্বেচ্ছাচার করার জন্য পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি কর্তৃক বহিস্কৃত হয়। হুমায়ুন কবীর এই বহিষ্কারকে শুধু যে মেনে নিতে পারেনি তাই নয়, পার্টির মতামতকে উপেক্ষা করে সে তার ভাই ও তার সামন্তবাদী বংশকে বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পত্রিকায় এবং বাংলা একাডেমীতে তার ভাইয়ের জীবনী (সত্যকে লুকিয়ে রেখে) ছাপাবার ব্যবস্থা করে।
সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ, নাম-যশ করার পুরােপুরি বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ সম্পন্ন হওয়ায় স্বভাবতঃই হুমায়ুন কবীরের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থের প্রাধান্য ছিল। তার ইচ্ছা ছিল R.S.P-এর নির্মল সেন ও প্রফেসর সিদ্দিকের মত চাকুরী ও বুর্জোয়া জীবনযাপন করে সর্বহারা পার্টির নেতা হওয়া এবং লেখক হিসেবে নিজকে জাহির করা। তার এই মনােভাব এবং তার ভাই ফিরােজ কবীর সংক্রান্ত পার্টির সিদ্ধান্ত তাকে প্ররােচিত করে ফজলু-সুলতান চক্রের সাথে যুক্ত হতে।
ফজলু চক্রের উদ্ভব ও বিকাশের একটা সময় পর্যন্ত হুমায়ুন কবীর পার্টি ও কমরেডদের ভাওতা দেয় এবং দেখায় যে সে এর সাথে যুক্ত না। ফজলু চক্র সংক্রান্ত প্রথম সার্কুলার পড়ে সে বলে, “পার্টি যখনই ভাল অবস্থায় আসে; তখনই কিছু লােক পার্টিকে ধ্বংস করতে আসে। ফজলু-সুলতান চক্রকে খতম করা উচিত। আমার বােনটা একটা খারাপ লােকের হাতে পড়েছে (তার বােন ফজলুর স্ত্রী)। তাকে (বােনকে) পেলে আমার কাছে ফেরত দিয়ে যাবেন। আপনারা কি করছেন? এখনাে তাদের খুঁজে বের করে খতম করছেন না কেন?”
এক দিকে সে এ ধরনের কথা বলেছে আর অন্যদিকে ফজলু চক্র ও নিজের বােনকে আশ্রয় দিয়েছে। পার্টি ও নেতৃত্ব বিরােধী অপপ্রচার ও জঘন্য ব্যক্তিগত কুৎসা সম্বলিত দলিলাদি লিখেছে, ছাপিয়েছে এবং বিতরণ করেছে, চক্রের প্রধান প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে কাজ করেছে। তার উদ্দেশ্য ছিল চক্রান্তকারীদের চর হিসেবে গােপনে পার্টির মধ্যে অবস্থান করা যাতে ফজলু চক্রের পতন হলেও সে পার্টির মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারে এবং পার্টির বিরাটাকার ক্ষতি সাধন করতে পারে। সে পার্টির প্রতি বিশ্বস্ততা দেখিয়েছে আর গােপনে ঢাকায় ফজলু চক্রের প্রধান হিসেবে কাজ করেছে। সাচ্চা বিপ্লবীদের খতমের জন্য প্রেরিত ফজলু চক্রের গুপ্তঘাতক দলের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছে। এভাবে সুদীর্ঘদিন সে পার্টির মাঝে গুপ্ত বিশ্বাসঘাতক হিসেবে বিরাজ করে। সে পুরােপুরি পার্টির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
এ সকলের কারণ হলাে R.S.P ও বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের মত বুর্জোয়া জীবনযাপন করা, ফজলু চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব দখল করে তাকে ধ্বংস করা, একে সুবিধাবাদী বুর্জোয়াদের লেজুড় ও প্রতিক্রিয়াশীল পার্টিতে পরিণত করা। তার এ সকল কাজ বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী, ছয় পাহাড়ের দালাল এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের সেবার শামিল।
তার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ পুতুল সরকার যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে, আজ পর্যন্ত কোন নিহত বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। উপরন্তু বাংলা একাডেমী ও অন্যান্য স্থানে সকলেই জানে সে বামপন্থী দল সর্বহারা পার্টির সাথে যুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে, সর্বহারা পার্টির একজন সাধারণ কর্মী লিফলেট বিতরণ করতে যেয়ে ধরা পড়লে তাকে শেখ-এর সামনে হাত ভাঙ্গা হয় এবং চরম নির্যাতন চালানাে হয়। বর্তমানে তাকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করা হয়েছে। অতীতে আমাদের কর্মী এমন কি সহানুভূতিশীলদের পেলেও খতম করা হয়েছে। বর্তমানেও এরূপ নির্দেশ রয়েছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ পুতুল সরকার ও ছয় পাহাড়ের দালালদের হুমায়ুন কবীরের প্রতি এই বিশেষ দরদের তাৎপর্য কি?
উল্লিখিত কারণসমূহের জন্য সর্বহারা পার্টি হুমায়ুন কবীরকে বিপ্লবী বা প্রগতিশীল বা দেশপ্রেমিকদের শিবিরভুক্ত করে না।
তার পার্টি, বিপ্লব ও জনগণ বিরােধী তৎপরতার অনুসন্ধান এখনাে শেষ হয়নি।
ফজলু চক্রে হুমায়ুন কবীরের ভূমিকা সংক্রান্ত দলিলাদির ফটোস্ট্যাট কপি কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের দেখানাে হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটি,
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।

নােটঃ
প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাতে যেয়ে হুমায়ুন কবীর পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির গেরিলাদের হাতে খতম হয়। হুমায়ুন কবীরের মৃত্যুর পর বাংলাদেশ সরকার যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছে তা পাক ফ্যাসিস্টদের হাতে নিহত কোন বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে নেয়নি। তার প্রতি সরকারের বিশেষ প্রীতি কি প্রমাণ করে না যে, সে সরকারের উঁচুদরের গােপন তাবেদার ছিল?
পৃষ্ঠা: ২৫৯

“পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী কমরেড ও সহানুভূতিশীল,
সিরাজ সিকদারের কাছ থেকে জবাব নিন” শিরােনামায়
(সম্ভবতঃ মে, ১৯৭২ সালে প্রকাশিত)
বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র কর্তৃক প্রচারিত পুস্তিকা সম্পর্কে
কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি
(জুন, ১৯৭২)
[ নােটঃ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ বৈঠকের পরই একটি জরুরী বৈঠক বসে (২৮/৩/৭২)। ফজলু চক্রের বিষয় বিবেচনা করার জন্য বৈঠক বসে। সেখানে ফজলু চক্রের ব্যক্তিস্বার্থ বিপ্লবী স্বার্থের অধীন করতে না পারার বিষয় বিবেচনা করা হয় এবং তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অবশ্য ছয় মাস পরে তাকে পুনরায় উক্তপদে গ্রহণ করা যায় কিনা তা বিবেচনা করার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। তাকে খুলনা থেকে বদলী করার সিদ্ধান্ত এবং এই ছয় মাস আঞ্চলিক কমিটির প্রধানের পদ প্রদান না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। খুলনা থেকে বদলী করা হয় এ কারণে যে, সে আত্মীয়ের মাঝে ব্যক্তিগত লাইনে কাজ করেছে, যারা রাজনীতি ও পাটির চেয়ে আত্মীয়তাকে বেশী দাম দেয়। এটা তার মাঝে নেতৃত্বের লােভ এবং দুর্গ গঠনের মনােভাবের জন্ম দিতে পারে। এভাবে তাকে কাজের পূর্ণ সুযােগ দেওয়া হয়। পার্টি তার বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র করেনি। এ সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ সকল সতর্কতা ও শাস্তিকে শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা, ভালভাবে নিঃস্বার্থ হয়ে কাজ করার পরিবর্তে ফজলু জোরে সােরে সুলতানের সাথে চক্রান্ত আঁটে, ক. আতাউর, ক. মুজিবকে এর মধ্যে টানার চেষ্টা করে। সে ক, কবীরকে এর মধ্যে টানার চেষ্টা করে। খুলনার দায়িত্বে নিযুক্ত কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিকে না জানিয়ে গােপনে কিছুসংখ্যক নূতন কর্মী, ভ্রষ্ট, পার্টির প্রতি পূর্বেই ব্যক্তিগত কারণে অসন্তুষ্ট (জাফর, হামিদ, মনসুর, রিজভী, বিপ্লব ও অন্যান্য)দের নিয়ে গােপন বৈঠক দেয় এবং জঘন্যতম অপবাদ, কুৎসা রটনা করে, তাদের রাজনৈতিক নিম্নমান, অসন্তুষ্টতার সুযােগ নেয়, পার্টি কর্মীদের হত্যা ও পার্টি-ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত করে। ফজলু চক্র তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার ভান করে তার প্রেমিকাকে নেয়ার জন্য আসে। এ সময় ক. সিরাজ সিকদার ও জনৈক অসুস্থ কমরেডকে খতমের জন্য হামিদকে নিয়ে আসে। এ সময় সে চরম অভিনয় করে, কিন্তু ক. সিরাজ সিকদারের সতর্কতার জন্য তাকে খতম করা সম্ভব হয়নি। এ সময় ফজল চক্র পার্টির দু’হাজার টাকা চুরি করে। সে তার স্ত্রী নিয়ে পলায়নের জন্য (পার্টি তার স্ত্রীকে চিটাগাং পাঠিয়েছিল এবং সেখানে ফজলুকে বদলী করা হয়েছিল) চিটাগাং যায়, সেখানে চক্রান্ত আঁটে। তখনই স্ত্রীকে নিয়ে খুলনায় পলায়নের পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু পার্টির ষাট হাজার টাকাসহ পলায়নের জন্য অপেক্ষা করে। ইতিমধ্যে তার কার্যাবলী কিছুটা প্রকাশ হয়ে পড়ে। তখন জনৈক কমরেড এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য চিটাগাং যান। সে উক্ত কমরেডের আগমনের খবর পেয়ে স্ত্রীসহ পলায়ন করে। কমরেডরা তাকে খুজে বের
পৃষ্ঠা: ২৬০

করলে সে আত্মসমালােচনা করে পার্টির নিকট আত্মসমর্পণ করার ভাওতা দেয়, কিন্তু গােপনে কাজী চক্রের সহায়তায় সেখান থেকে পলায়ন করে। সে পার্টির গণতন্ত্র অর্থাৎ সংখ্যাগুরুর মতামত, কংগ্রেসের মতামত পদদলিত করে, পার্টির মধ্যে থেকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংগ্রাম করার পদ্ধতি সম্পূর্ণ বাদ দেয়, পার্টির মধ্যে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করে, অপবাদ, গুজব রটায়, অর্থ-অস্ত্র চুরি করে, উপদল গঠন করে, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করে। এ সকল জঘন্য অপরাধের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে পার্টি থেকে চিরদিনের জন্য তাকে বহিষ্কার করে। সে পুনরায় খুলনা গিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে সেখানকার কিছুসংখ্যক কর্মীকে মিথ্যা বলে প্রতারিত করে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধিকে গ্রেফতার করে, তার নিকট থেকে অর্থ ও অন্যান্য দ্রব্য রেখে দেয়, তাকে হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রতারিতদের সকলে একমত না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। সে খুলনাস্থ পার্টির সকল সম্পদ দখল করে, আত্মীয়দের নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল দুর্গ গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। সে পার্টির নেতৃত্বের নামে জঘন্য অপবাদ ও কুৎসা রটায়, বর্তমানে সে পুর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নামে একটি প্রতিক্রিয়াশীল উপদল গঠন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে সে সাচ্চা কর্মীদের খতমের জন্য চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে। প্রমাণ পাওয়া গেছে এ সকলের পিছনে কাজী চক্রের হাত রয়েছে। পার্টি, বিপ্লব, জনগণ, দেশ ও জাতি এবং শহীদ কমরেডদের জন্য যার বিন্দুমাত্র দরদ আছে এ ধরনের জঘন্য কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ফজলু চক্র সম্প্রতি মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসাপূর্ণ একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেছে। এর জবাব নিমে প্রদত্ত হলাে।]

এ প্রচার পুস্তিকার উপসংহারে বলা হয়েছে, সুতরাং কমরেডগণ, আসুন আমরা সিরাজ সিকদারের সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, কুক্ষিগত নেতৃত্ব ও তার লেজুড় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি, ঘােষণা করি, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির লাইনের প্রতি আমরা অনুগত, কিন্তু তথাকথিত পার্টি প্রধান সিরাজ সিকদারের নেতৃত্ব আমরা মানি না।’
এখানে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির লাইনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা হয়েছে। এ প্রচারপত্র প্রণয়নকারীদের নিকট প্রশ্ন হচ্ছে সর্বহারা পার্টির যে লাইনের প্রতি তারা অনুগত তা কে প্রণয়ন করেছে? পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির ও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক ও অন্যান্য লাইন কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণয়ন করেছেন।
সঠিক লাইন হচ্ছে পার্টির প্রাণ। পার্টির বিকাশ ও বিজয় নির্ভর করে সঠিক লাইনের উপর।
লাইন ঠিক হলে ক্ষুদ্র শক্তি বড় হয়, সশস্ত্র শক্তি না থাকলে সশস্ত্র শক্তি গড়ে উঠে, রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে তা অর্জিত হয়। লাইন ভুল হলে অর্জিত ফলও খােয়া যায়।
কাজেই পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টির বিকাশ এবং বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছুনাে সম্ভব হয়েছে সঠিক লাইনের জন্য।
এরা কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণীত লাইনের প্রতি অনুগত, কিন্তু তাকেই বলছে সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব দখলকারী ইত্যাদি।
তাদের বক্তব্য থেকে পাওয়া যায় সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব দখলকারী অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল সিরাজ সিকদার সঠিক লাইন প্রণয়ন করেছে।
পৃষ্ঠা: ২৬১

স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠে একজন প্রতিক্রিয়াশীল কি সঠিক লাইন প্রণয়ন করতে পারে? একজন সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব দখলকারী ব্যক্তি অর্থাৎ একজন প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক এবং নেতৃত্ব দখলকারী প্রতিক্রিয়াশীল লাইন প্রণয়ন করতে পারে- সঠিক লাইন নয়।
সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব দখলকারী প্রতিক্রিয়াশীলরা যদি সঠিক লাইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হত তবে বাকুনিন, বার্নেস্টাইন (মার্কস-এঙ্গেলসের সময়) এবং অন্যান্য, ট্রটস্কী, বুখারিন, টিটো, ক্রুশ্চেভ, লিউ শাওচি, চেনতাওশিউ, লিলিশান, ওয়াংমিং, জ্যোতিবসু-নামুদ্ৰীপদ, ডাঙ্গে, পূর্ব বাংলার কাজী-রণাে, দেবেনবাসার, হক-তােহা, মতিন-আলাউদ্দিন, মােজাফ্ফর-মনিসিং এরা সকলেই সঠিক লাইন প্রণয়ন করতে সক্ষম হত। তাহলে আমাদের এবং বিশ্বের সর্বহারাদের সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারীদের থেকে বেরিয়ে আসা বা তাদেরকে নেতৃত্ব থেকে অপসারণ করা বা পৃথক সংগঠন করার প্রয়ােজন হত না।
কাজেই যিনি সঠিক লাইন বা পার্টির প্রাণ তা প্রণয়ন করেন তিনি কখনও ষড়যন্ত্রকারী, সুবিধাবাদী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব লােভী হতে পারেন না, তাকে অবশ্যই সৎ লােক হবে হবে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হতে হবে, সর্বহারার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ রপ্ত ও প্রয়ােগ করতে সক্ষম হতে হবে।
সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব দখলকারীদের বিশ্বদৃষ্টিকোণ হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া বিশ্ব দৃষ্টিকোণ, যার মৌলিক কথা হলাে ব্যক্তিস্বার্থ। তাদের দর্শন হচ্ছে ভাববাদ ও অধিবিদ্যা। তারা প্রতিটি সমস্যা বিচার করে ব্যক্তিস্বার্থ এবং ভাববাদঅধিবিদ্যা দিয়ে। এ কারণে তারা সর্বহারার উপকারের বুলি আওড়ালেও প্রকৃতপক্ষে তারা বুর্জোয়া এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বহারা ও জনগণের জন্য ভুল লাইন প্রণয়ন ও তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। তাদের চরম ক্ষতি সাধন করে।
এ ধরনের লােক পার্টির নেতা হলে পার্টি পদে পদে ভুল করে এবং পার্টি বুর্জোয়া পার্টিতে, সংশােধনবাদী পার্টিতে, বুর্জোয়াদের লেজুড় পার্টিতে পরিণত হয় বা ভেঙ্গে যায়।
রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরােপের অন্যান্য দেশ ও মঙ্গলিয়ায় সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারীরা, আমলাতান্ত্রিকরা পার্টির ক্ষমতা দখল করে বিশ্বাসঘাতক লাইন প্রণয়ন করে এবং পার্টি ও রাষ্ট্রকে বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত করে।
পাক-ভারত এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেখানে বিপ্লব হয়নি সেখানে এ ধরনের লােক পার্টির ক্ষমতায় থাকায় পার্টি বুর্জোয়া পার্টি, সংশােধনবাদী পার্টিতে পরিণত হয় এবং পার্টির বিকাশ ব্যাহত হয়।
পক্ষান্তরে কেবলমাত্র সৎ এবং প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এবং সর্বহারার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ সম্পন্ন কমরেডরাই সঠিক লাইন প্রণয়ন করতে পারেন।
কাজেই যেহেতু পার্টির লাইন সঠিক সেহেতু কমরেড সিরাজ সিকদার সৎ, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এবং সর্বহারার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ সম্পন্ন।
উপরােক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্বলােভী অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিশ্ব দৃষ্টিকোণ প্রতিক্রিয়াশীল, তারা পারে প্রতিক্রিয়াশীল ভুল লাইন প্রণয়ন করতে আর সর্বহারা ও সৎ, মার্কসবাদীলেনিনবাদীদের বিশ্ব দৃষ্টিকোণ হল সর্বহারা। তারা পারে সর্বহারা ও সঠিক লাইন প্রণয়ন করতে। প্রতিক্রিয়াশীলরা সঠিক লাইন প্রণয়ন করতে পারে না, সর্বহারারা প্রতিক্রিয়াশীল লাইন প্রণয়ন করতে পারে না।
পৃষ্ঠা: ২৬২

একে অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে মার্কসবাদের “ক-খ-গ”-কে অস্বীকার করা।
যেহেতু তারা লাইনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে সে কারণে যে কমরেড লাইন প্রণয়ন করেছেন এবং কংগ্রেস কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছেন তার প্রতি তাদের অনুগত হওয়া উচিত।
ইহা প্রমাণ করবে কমরেডরা সৎ ও আন্তরিক বিপ্লবী কিনা।
অপরাধীরা যেমন কিছু কু রেখে যায় যার ভিত্তিতে তারা ধরা পড়ে, তেমনি ‘লাইনের প্রতি অনুগত’ এ কু ধরিয়ে দিচ্ছে যে রাজনৈতিক, মতাদর্শগত, সাংগঠনিক বা অন্যকোন লাইনের দ্বিমতের কারণে নয়; ব্যক্তিগত পদ, ক্ষমতা, নেতা হওয়ার লােভে অর্থাৎ ব্যক্তিস্বার্থের কারণে ফজলু চক্র কমরেড সিরাজ সিকদারকে প্রতিক্রিয়াশীল ও আমলাতান্ত্রিক, সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী বলেছে, তার বিরুদ্ধে গুজব, অপবাদ রটাচ্ছে।
ব্যক্তিস্বার্থেই সে কমরেড সিরাজ সিকদার ও তার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের পরিবর্তে একে বিরােধিতার মত প্রতিবিপ্লবী কাজ করছে।
কিন্তু কমরেড সিরাজ সিকদারের লাইনের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেও কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বকে অমান্য করতে, তাকে সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক ও নেতৃত্ব লােভী বলতে পারে কারা?
যেহেতু কমরেড সিরাজ সিকদার সঠিক লাইন প্রণয়ন করেন এবং মার্কসবাদীলেনিনবাদী, স্বাভাবিকভাবেই তিনি উদারতাবাদী নন। তিনি ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্যকারী, নেতৃত্ব লােভী, ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারী, ভাববাদী, অধিবিদ্যক, সমরবাদী, পার্টির গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা ভঙ্গকারী, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী, পার্টির অভ্যন্তরস্থ ও বাইরের শ্রেণী ও জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।
এরাই কমরেড সিরাজ সিকদারকে সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব লােভী বলতে পারে, কোন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলতে পারে না।
অতীতেও ময়মনসিংহের হাজীপুরের সাদেক চক্র বলেছে, পার্টির লাইন সঠিক কিন্তু সিরাজ সিকদার খারাপ। সাদেক শেষ পর্যন্ত ছয় পাহাড়ের তাবেদার হয়। হক-তােহা, দেবেন-মতিন, কাজী-রণাে, মনিসিং-মােজাফফর, ছয় পাহাড়ের দালাল, তাদের প্রভু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, কমরেড সিরাজ সিকদারকে সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, আমলাতান্ত্রিক, নেতৃত্ব লােভী বলে।
কাজেই এ প্রচার পুস্তিকার প্রণেতাদের কথার সাথে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের কথার কোন তফাৎ নেই। তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের অনুচর মাত্র।
তাদের নিজেদের বক্তব্য নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ তুলে ধরেছে। তারা যে বিদ্রোহের আহ্বান করেছে তা হলাে বিপ্লবী ও সঠিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীদের, দলত্যাগী, সুবিধাবাদীদের বিদ্রোহের ডাক।
তাদের এ বিদ্রোহ হচ্ছে পার্টির সঠিক লাইনের বিরুদ্ধে, পার্টির বিরুদ্ধে, বিপ্লব ও জনগণের বিরুদ্ধে এবং পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের বিপ্লবের বিরুদ্ধে।
এ দলিল প্রণয়নকারীদের চরিত্র উপরােক্ত বিশ্লেষণের সাথে মেলে কিনা দেখা যাক।
এ দলিল প্রণয়ন করেছে বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র যে পুরােপুরি প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী।
পার্টিতে যােগদানের প্রথম থেকে ব্যক্তিস্বার্থের কারণে তাকে পার্টি কর্তৃক সমালােচনা করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে ব্যক্তিস্বার্থ বিপ্লবের স্বার্থের বশে রাখতে না
পৃষ্ঠা: ২৬৩

পারার কারণে এবং কমিউনিস্ট হওয়ার নিম্নতম যােগ্যতা না থাকার জন্য তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে নামিয়ে দেয়া এবং তাকে বদলী করা হয়। এ সকলই কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত।
কিন্তু সে পার্টি পদ, ক্ষমতার লােভে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত শুরু করে, অপবাদ ও গুজব রটায়, ব্যক্তিগত কুৎসা ছড়ায়, পার্টির অর্থ-অস্ত্র চুরি করে, কমরেড সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য সাচ্চা কমরেডদের গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র করে, পার্টির গণতন্ত্র কেন্দ্রীকতা ও শৃংখলাকে পদদলিত করে, কিছুসংখ্যক কর্মীকে প্রতারিত করে, খুলনার পার্টির অস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি দখল করে এবং প্রতিক্রিয়াশীল দুর্গ গঠন করে। এ সকল অভিযােগের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে তাকে তার কতিপয় সহচরদেরসহ চিরদিনের জন্য পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
তারা পার্টি, বিপ্লব, সর্বহারা ও জনগণের উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করার জন্য এ সকল কার্যকলাপ চালাচ্ছে এবং এখনও কমরেডদের হত্যা করার চক্রান্ত চালাচ্ছে।
এ হলাে তথাকথিত অগ্রগামী কর্মীদের দুষ্কর্ম এবং প্রকৃত চরিত্র।

১.
১৯৭০ সালে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক কর্মীদের দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে পার্টি নেতৃত্বের নাম বলা এবং প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমরেড সিরাজ সিকদারের নির্দেশে নয়। কয়েক বৎসরের অনুশীলন এ সিদ্ধান্তের সঠিকতা প্রমাণ করছে।
ক) এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কর্মীদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কে তােমাদের নেতা? খ) বিপ্লবী আর প্রতিবিপ্লবী সকলেই তাদের নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করে। কাজেই পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বকে জনপ্রিয় না করার কোন কারণ নেই। নেতৃত্ব আপেক্ষিক অর্থাৎ নেতৃত্ব যতদিন বিপ্লবী, সঠিক, ততদিনই নেতৃত্ব ক্ষমতায় থাকবে। ভুল ও বেঠিক হলে নেতৃত্ব আজ হােক কাল হােক অপসারিত হবে, তখন নতুন বিপ্লবী নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করতে হবে।
বিপ্লবী ও সঠিক নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করার সুবিধা নিম্নরূপঃ
পার্টির মধ্যে এককেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও সুদৃঢ়করণ ও কর্মীদের কেন্দ্রের প্রতি আস্থাশীল এবং কেন্দ্রকে প্রভাবশালী ক্ষমতাপূর্ণ করা, পার্টির মধ্যকার খাটি বিপ্লবী ও বাইরের বিপ্লবী ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক-শত্রুদের ভীতসন্ত্রস্ত এবং তাদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির সহায়ক।
পক্ষান্তরে পার্টির নেতৃত্বকে অপ্রিয় করা, কেন্দ্রকে দুর্বল করা, অপর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে বুর্জোয়াদের সহায়তা করা।
কমরেড সিরাজ সিকদারের জনপ্রিয়তায় ভীত কারা? হক-তােহা, মতিনআলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার, কাজী-বদরুদ্দীন, মনিসিং-মােজাফফর, ফজলু-সুলতান, ছয় পাহাড়ের দালাল এবং আন্তর্জাতিক শক্ররা।
পৃথিবীর সকল বিপ্লবীদের জনপ্রিয়তাই প্রতিক্রিয়াশীলদের ভীত করেছে। লেনিন
পৃষ্ঠা: ২৬৪

বলেছেন, “মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় শােষক শ্রেণী (এবং মার্কসবাদের মুখােশধারী তাদের দালালরা-লেখক) তাদেরকে সর্বদাই পাগলা কুত্তার মত খুঁজে বেড়িয়েছে, তাদের শিক্ষার প্রতি চরমতম ঘৃণা প্রদর্শন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জঘন্যতম মিথ্যে ও অপবাদের প্রচার অভিযান চালিয়েছে।”
কমরেড সিরাজ সিকদার বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও ষড়যন্ত্রকারী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রেণী ও জাতীয় শত্রুদের মুখােশ উন্মােচন করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে। সংগ্রাম পরিচালনা করছেন। কাজেই তাকে শত্রুদের দ্বারা সর্বদাই আক্রান্ত হতে হবে বৈকি।
এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল।
সম্প্রতি প্রকাশিত লাল ঝাণ্ডায় (১নং)১ বাস্তব ঘটনাই তুলে ধরা হয়েছে। পার্টির ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। এতে প্রত্যেকের ভূমিকা বস্তুগত এবং সুনির্দিষ্ট। পার্টির প্রতিটি ঘটনার সাথে নেতৃত্বের ভূমিকা জড়িত, যেহেতু নেতৃত্বই নির্ণয় করে পার্টির লাইন। কাজেই পার্টি দিবস, সশস্ত্র বাহিনী দিবস ও শ্রম দিবসে নেতৃত্বের ভূমিকা আলােচনায় আসা স্বাভাবিক।
এ কারণে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এ সম্পাদকীয়তে আত্মপ্রচার হয়নি বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং কিছু সংশােধনীসহ গৃহীত হয়।

২.
ক) পেয়ারা বাগানের মুক্তি বাহিনী আসলে আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনী ছিল না। প্রকৃতই সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বাধীন মুক্তি বাহিনী ছিল। ইহা ঐতিহাসিক সত্য।
এই মুক্তি বাহিনী গড়ে উঠে ৩০শে এপ্রিল।
২৮শে এপ্রিল আওয়ামী লীগ মুক্তি বাহিনী আমাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে, তাকে ছাঁটাই করা হয়, পুনর্গঠিত করা হয়, আমাদের পার্টির নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়, রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ করা হয়, গেরিলা গ্রুপে ভাগ করা হয়, প্রতি গেরিলা গ্রুপে আমাদের পার্টির কর্মীদের রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ করা হয়।
পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট বিরােধী ও অধঃপতিতদের বের করে দেওয়া হয়, অতি অল্পদিনের মাঝেই অধিকাংশ পুরােনাে ও খারাপ উপাদান বাদ দিয়ে স্থানীয় ও ভাল উপাদান গ্রহণ করা হয়।
প্রতি গেরিলা পার্টি, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং পার্টির রাজনৈতিক, সামরিক লাইন পালন করতাে।
এরপর এ বাহিনীকে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ বাহিনী বলার অর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগের দালালী করা।
২৮ এপ্রিলের বহু পূর্বেই অর্থাৎ এপ্রিলের প্রথম-দ্বিতীয় সপ্তাহে কমরেড সিরাজ সিকদার সরাসরি বরিশাল ও ঝালকাঠির পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঝালকাঠি পাক ফৌজ কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর তিনিই বিশ্লেষণ করে নির্ধারণ করেন আওয়ামী লীগ বাহিনীর চরম সংকটজনক সময় নির্দেশ দেন তাদেরকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বা বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করতে।
…………………………………………………………………….
১. ‘৭২ সালে প্রকাশিত ‘লাল ঝাণ্ডা’ পত্রিকার ১নং সংখ্যার সম্পাদকীয় নিবন্ধ। দেখুন, এই পুস্তকের পৃঃ ২১৪ -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ২৬৫

কমরেড সিরাজ সিকদারের লিখিত নির্দেশ ও নিয়ােগপত্র বহন করে নিয়ে যায় প্রচার পুস্তিকার উল্লিখিত দু’জন।
এ বাহিনী পুনর্গঠন, কমান্ড গঠন, তাদের গেরিলা গ্রুপে গঠন, গ্রামে নিয়ােগ, প্রভৃতি সমস্যাবলী কমরেড সিরাজ সিকদার নিজে সমাধান করেন।
এ সময় এবং পরে অনেক সময় ফজলু চক্র বলেছে, “আপনি. (সিরাজ সিকদার) থাকলে আমরা কয়েকটা গােলাগুলি করে যার যার বাড়ীতে চলে যেতাম।”
ফজলু বর্তমানে তার কথা পাল্টিয়ে, ইতিহাসকে পাল্টিয়ে নিজের ইচ্ছাখুশীমত কথাবার্তা বলছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কমরেড সিরাজ সিকদারকে হেয় করা।
কিন্তু ইতিহাস পাল্টানাে যায় না, ইতিহাস ইতিহাসই, সত্য সত্যই।
খ) জাতীয় শত্রুদের ভূমি ও সম্পত্তি গরীব চাষীদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়, এবং জনগণ আমাদের এ কর্মসূচীকে গ্রহণ করে।
এভাবে জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সমন্বয় সাধন করা হয়।
এ পরিকল্পনাই ব্যাপক আকারে কার্যকরী করা হয় পেয়ারা বাগান থেকে প্রত্যাহার করার পরবর্তীকালীন সংগ্রামে।
জনগণকে কৃষক, নারী ও অন্যান্য মুক্তি সমিতিতে গঠন করার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। এজন্য গনসংযােগ কমিটিও গঠন করা হয়েছিল।
এগুলাে ঐতিহাসিক সত্য।
ঘেরাও-দমন জনিত সমস্যার সমাধান করা হয়, গেরিলাদের বিভক্ত করে এক অংশকে গৌরনদী অঞ্চলে এবং অন্য অংশকে ঘেরাও বলয়ের বাইরে থাকার নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে। এর ফলে অধিকাংশ গেরিলা টিকে যায়।
এ সময় পেয়ারা বাগান থেকে কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রত্যাহারের প্রশ্নে একমাত্র কমরেড সিরাজ সিকদারই শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন প্রত্যাহার ঠিক হবে না। তিনিই ছিলেন প্রত্যাহারের বিপক্ষে।
কিন্তু ফ্রন্টের সকল নেতৃত্ব স্থানীয় গেরিলা ও কর্মী কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রত্যাহারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি তাদেরকে এ বিষয় বহুবার পুনরায় বিবেচনার জন্য বলেন।
এ সময় ফজলু বলেছিল, ‘আপনি বাঁচলে পার্টি ও বিপ্লব গড়ে উঠবে, কাজেই আপনার যাওয়া উচিত।
এভাবে সংখ্যাগুরুর মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে কমরেড সিরাজ সিকদার পেয়ারা বাগান থেকে প্রত্যাহার করেন, প্রাণের ভয়ে নয়।
এখন বুঝা যাচ্ছে ফজলু-তারেকের কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রত্যাহারের পক্ষে অভিমত পেশ করার কারণ।
ফজলু-তারেক কমরেড সিরাজ সিকদারের উপস্থিতিতে তাদের ইচ্ছা খুশীমত কার্যকলাপ করতে পারত না।
কমরেড সিরাজ সিকদারের অনুপস্থিতির সুযােগ নিয়ে ফজলু তার প্রেমিকাকে নিয়ে পলায়ন করে, তারেক-মুজিব ষড়যন্ত্র করে কমরেড ফারুক মজিদকে হত্যা করে, সমরবাদী হয়ে নেতা বনে যায়, ১নং ফ্রন্টের চরম ক্ষতিসাধন করে, নারীদের নিয়ে স্বেচ্ছাচার করে।
পৃষ্ঠা: ২৬৬

ফজলু দীর্ঘদিন পরে অর্থ, অস্ত্র, স্বর্ণ হারিয়ে পার্টির নিকট এসে যােগাযােগ করে।
পেয়ারা বাগানের বাইরে এসে কমরেড সিরাজ সিকদার কুরিয়ার পাঠিয়ে যােগাযােগ করা এবং পুনরায় সেখানে সরাসরি নেতৃত্ব প্রদানের প্রচেষ্টা চালান। কমরেড শহীদকে দ্রুত যােগাযােগ করে রিপাের্ট করতে বলা হয়। তিনি বহুদিন পরে যােগাযােগ ও রিপাের্ট করেন। কমরেড কবীরকে (পরবর্তীকালে প্রেরিত নেতা) বহুবার যাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। কমরেড কবীর বাস্তব অসুবিধার কারণে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেননি।
এগুলাে ঐতিহাসিক সত্য। পার্টির যে সম্পদ কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট ছিল তা দ্বারা পার্টির কার্য পরিচালনা করা হয়।
গ) পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে টেকনাফ থেকে আসার পর কমরেড সিরাজ সিকদার একমাত্র থাকেন বিপ্লবের প্রতি দৃঢ়। বাকী অনেকেই সুবিধাবাদী, দোদুল্যমান হন বা যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করেন।
এটাও ঐতিহাসিক সত্য। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে ফজলু চক্র তখনও যােগদান করেনি বলে তার পক্ষে ইহা না জানা স্বাভাবিক। কোন দিবস উদযাপনের প্রায় মাস খানেক পূর্বেই দলিলাদি প্রণয়ন ও ছাপানাে প্রয়ােজন যাতে নির্দিষ্ট দিনের পূর্বেই কমরেডদের নিকট পৌঁছে।
তাতেও অনেক সময় সর্বস্তরে পৌঁছায় না। পৃথিবীর সর্বস্থানেই এজন্য বহুদিন পূর্বেই দলিল প্রণয়ন করা হয়।
খাঁটি ও সাচ্চা কর্মী ও সহানুভূতিশীল ও বিপ্লবীরা বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বের দীর্ঘ। জীবন কামনা করেন। অল্প আয়ু বা মৃত্যু কামনা করে শত্রুরা, ফজলুর মত বৈর ব্যক্তিরা। এ সত্যের প্রতিফলন হয়েছে ১নং লাল ঝাণ্ডার সম্পাদকীয়তে।

৩.
ফজলু বিশ্বাসঘাতক চক্র সভাপতি মাওয়ের পবিত্র উক্তি ব্যবহার করার স্পর্ধা দেখিয়ে মিথ্যা কথা বলেছে। নিরাপত্তা বজায় রেখে বিপ্লবী কাজের জন্য সুবিধাজনক স্থানে কর্মস্থল পরিবর্তন করা বিপ্লবীদের দায়িত্ব।
কাজের সুবিধার্থে এবং পার্টির স্বার্থে কমরেড সিরাজ সিকদার ২৫শে মার্চের পর প্রয়ােজনীয় স্থানে যান, প্রাণ ভয়ে নয়। তিনি ভারতেও পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু কেন যাননি, এর উত্তর তাে ফজলু চক্র দেয়নি।
পার্টির যে মহান দায়িত্ব তার উপর প্রদত্ত ছিল তা তিনি যথাযথভাবে পালন করেন, পার্টির সম্পদ রক্ষা করেন, পার্টি কর্মীদের পশ্চাদপসরণের ব্যবস্থা করেন, এ গুরুতর পরিস্থিতিতে পার্টির লাইন প্রণয়ন করে কর্মীদের রাজনৈতিক দিশা বজায় রাখেন, শহরে কাজের ব্যবস্থা বজায় রাখেন, যে সকল স্থানে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেখানে। কুরিয়ার পাঠান, সঠিক লাইন ও নির্দেশ প্রেরণ করেন। এর ফলে পূর্ব বাংলায় একমাত্র আমাদের সংগঠনই তখন কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে সংগঠিত ছিল। এ অবস্থা সব সময় বজায় থাকে।
বরিশালের সুবিধাজনক বিপ্লবী পরিস্থিতি সদ্ব্যবহারের জন্য কমরেড সিরাজ সিকদার নিজ সিদ্ধান্তে সেখানে গমন করেন (এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে)। ফজলু-মুজিব তাকে পনের দিন পরে যেতে বলেছিল। কিন্তু তিনি তাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে পনের দিন পূর্বেই রওনা হন। পরে তারা বলেছিল আপনি পনের দিন পরে এলে কিছুই করতে পারতাম না, কেন যে পনের দিন পূর্বে আপনাকে আনলাম না!
পৃষ্ঠা: ২৬৭

কমরেড সিরাজ সিকদার বরিশাল জেলার সংগ্রামের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, বিন্দু ভেঙ্গে প্রবেশ করেন, তিনি পেয়ারা বাগানের এ মূল্যবান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংগঠনের রাজনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য সমস্যাবলীর যথাযথ সমাধান প্রদান করেন।
এগুলাে প্রতিফলিত হয়েছে তখনকার প্রণীত দলিলসমূহে। তিনি বিভিন্ন ফ্রন্টে যাওয়ার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন এবং উদ্যোগ নিয়ে পাবনা, টাঙ্গাইলে গমন করেন,। সেখানকার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করেন। অন্যান্য ফ্রন্ট বারংবার বলা সত্ত্বেও নিরাপত্তার কারণে ব্যবস্থা করতে পারেননি। এছাড়া সর্বদাই তিনি কেন্দ্রীয় দায়িত্ব ছাড়াও কোন না কোন আঞ্চলিক কমিটির পরিচালনায় ছিলেন।
ফজলু চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলাে গােপন করে মিথ্যা বলছে যে, তিনি জনগণের সাথে যুক্ত নন।
কমরেড সিরাজ সিকদার যে ধরনের জীবনযাপন করেন তা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং কমরেডদের অধিকাংশের ইচ্ছা মতই করেন।
কংগ্রেসে পেশ করা কোন প্রস্তাব কমরেড সিরাজ সিকদার বাতিল করেননি।
জনগণের সাথে যুক্ত না থাকলে কমরেড সিরাজ সিকদারের পক্ষে সঠিক লাইন (যার প্রতি ফজলু চক্র অনুগত) প্রণয়ন করা সম্ভব হত না। কেননা সঠিক লাইন আকাশ থেকে পড়ে না বা মনের মধ্যে সহজাত নয়। সঠিক লাইন আসে অনুশীলন থেকে, শ্রেণী সংগ্রামের সঠিক লাইন আসে শ্রেণী সংগ্রামের অনুশীলন থেকে, কাজেই কমরেড সিরাজ সিকদার অবশ্যই শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের অনুশীলন এবং জনসাধারণের সাথে যুক্ত ছিলেন।
পােশাক-আশাক, চেহারা দিয়ে বিপ্লবী কিনা তা নির্ণিত হয় না। নির্ণিত হয় সর্বহারার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ দিয়ে, অর্থাৎ, তিনি মতাদর্শগতভাবে সর্বহারা কিনা তাই দিয়ে।

৪.
ভুল দেখিয়ে দিলে এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের কারণে সুবিধাবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা সর্বদাই বিপ্লবীদের বিপ্লবের একনায়ক, আমলাতান্ত্রিক, সবজান্তা, পণ্ডিত বলে গালাগালি করে। ক. সিরাজ সিকদার কর্তৃক মাহবুবুল্লাহ, আ.কা.ম. ফজলুল হক, নুরুল হাসান, হক-তােহা, দেবেন-বাসার, কাজী-রণাে-বদরুদ্দীন এবং দলত্যাগী বেবী-আসাদ, সাদেক প্রভূতিদের চরিত্র উদঘাটিত হওয়ায় তারা কমরেড সিরাজ সিকদার সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলে।
ফজলু চক্রও তাদের অপর একজন হয়েছে মাত্র।
কমরেড সিরাজ সিকদারের রচনা তত্ত্ব থেকে শুরু করে তত্ত্বে রয়ে গেলে পার্টির সঠিক লাইন এলাে কোথা থেকে? সেগুলাে কি (যেমন থিসিস ও বিভিন্ন দলিলাদি) চীনা বইয়ে লেখা ছিল বা পিকিং রিভিউ-এ ছাপা ছিল, না ফজলু চক্রের মাথা থেকে এসেছে?
সংশােধনবাদীদের চরিত্র তুলে ধরায় ফজলু চক্রের এ মায়া কান্না কেন? প্রকৃতপক্ষে সে ইতিমধ্যেই কাজী-চক্রের পরিচালিত পুতুলে পরিণত হয়েছে। সমন্বয় কমিটির সংশােধনবাদীদের সাথে দহরম-মহরম করছে।
‘ছয় পাহাড়ের দালাল’ দলিল সম্পর্কে পূর্বেই বহুবার আলােচনা হয়েছে। এ দলিল পার্টির পত্রিকায় সাপলিমেন্ট হওয়ার কথা ছিল। এ সময় পার্টির পত্রিকা বের করা সম্ভব হওয়ায় ইহা পৃথকভাবে বের হয়।
পৃষ্ঠা: ২৬৮

শহরে দলিলটির প্রতিক্রিয়া ভাল হয়নি, কিন্তু যে সকল স্থানে বিশেষ করে গ্রামে যেখানে আমাদের গণসমর্থন রয়েছে, জনগণ আমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবগত সেখানে এর ভাল প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব অসুবিধার কারণে সেখানে বিতরণ করা সম্ভব হয়নি।
এছাড়া দলিলটির ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া ভাল হয়েছে, পার্টির কর্মী ও অনেক সহানুভূতিশীল বুঝতে পেরেছে ভারতের ও আওয়ামী লীগের ভূমিকা।
এর ফলে কর্মীদের মাঝে ভারতীয় দখল কায়েম হওয়ার পর রাজনৈতিক লাইন সম্পর্কে কোন দ্বিধা দেখা দেয়নি।
বর্তমানে দলিলটি খুবই সমাদৃত।
দলিলটিতে ভারতীয় আক্রমণের সম্ভাবনা প্রধাভাবে দেখানাে সম্ভব হয়নি পার্টির আন্তর্জাতিক যােগাযােগের অভাবে।
বহু বামপন্থী সহানুভূতিশীল এ দলিলে বর্ণিত সঠিক ভূমিকার কারণে সংগৃহীত হয়। স্বল্পকালীন দৃষ্টি থেকে দলিলটি ভাল হয়নি, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দলিলটি ভাল হয়েছে। দলিলটির দীর্ঘ প্রতিক্রিয়াও দেখা উচিত।
দলিল বা প্রচারপত্র লেখার অধিকার সকলেরই রয়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটিও প্রচারপত্র ছাপায় ও প্রকাশ করে। কিন্তু পার্টির কেন্দ্রের পক্ষে দলিল কেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত হবে, লাল ঝাণ্ডা কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র। কাজেই এখানে কেন্দ্র কর্তৃক অনুমােদিত বিষয়াদি ছাপানাে হয়।
বাকী অভিযােগ অমূলক।

৫. বেহিসাবী খরচ তদারক করার জন্য কোন কমরেডকে নিয়ে কোন হিসাব তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়নি। কমরেড সিরাজ সিকদারের পক্ষে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজের ফলে হিসেব তদারক করার সময়ের অভাব হয়। এ কারণে তিনি অনেক সময়। এ বিষয়ে কমরেডদের সহায়তা নেন। ফজলু কর্তৃক উল্লিখিত ব্যক্তিকে এরূপ অস্থায়ীভাবে সাহায্য করার কথা বলা হয়েছিল। পরে সে কাজ নিয়ে অন্যত্র চলে যায়।
কমরেড সিরাজ সিকদার বা তার সংশ্লিষ্ট কোন কমরেড হিসেব দেননি ইহা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
কংগ্রেসে পার্টির আয়-ব্যয়ের হিসেব নেওয়ার সমস্যা উত্থাপিত হয়নি।
বিপ্লবের জটিল অবস্থা, পশ্চাদপসরণ, জিনিসপত্র হারানাে প্রভৃতি কারণে প্রত্যেকের হিসেব পেশ করার মত অবস্থা ছিল না। কমরেডদের একে অপরের সততাকেই বিশ্বাস করা হয়।
কমরেড সিরাজ সিকদারের যদি তহবিল তছরুপের উদ্দেশ্য থাকত তবে তিনি বিপ্লবে যােগদান করতেন না, বুর্জোয়া জীবনে নিরাপদে বহু তহবিল তছরুপ করতে পারতেন (কারণ তিনি শিক্ষাগত যােগ্যতার দিক দিয়ে একজন ডিগ্রীধারী ইঞ্জিনিয়ার)। পার্টির তহবিলহীন অবস্থায় প্রায় অন্নহীনভাবে ভবিষ্যতের তহবিল তছরুপের আশায়। তিনি বিপ্লবী কাজ করেননি।
তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিপ্লবীদের এ বিশ্বাস রয়েছে।
পৃষ্ঠা: ২৬৯

ফজলু চক্রও কোনদিন এ অভিযােগ কোন সভায় বা মৌখিকভাবে উত্থাপন করেনি। কেবলমাত্র পার্টি ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ার পরই সে এ সকল অপবাদ রটায়।

৬.
নীতির প্রশ্নে কমরেড সিরাজ সিকদার দৃঢ়, কারাে প্রতি উদারতাবাদ করেন না এবং নীতিকে বিসর্জন দিয়ে তিনি কোন ধরনের সম্পর্ক রাখেন না।
একেই ফজলু চক্র তাচ্ছিল্য ও ঔদাসিন্য বলে আক্রমণ করেছে। যে সকল বিপ্লবী তার সাথে সর্বহারার অভিন্ন দৃষ্টিকোণের কারণে ঐক্যমত পােষণ করেন তাকেই সে মােসাহেব বলেছে।
তার মতে কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্য কমরেড সিরাজ সিকদারের মােসাহেব, কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল অন্যান্য সকল কর্মীরাই মােসাহেব। অর্থাৎ ফজলু চক্রের সাথে যারা একমত নয় তারাই সিরাজ সিকদারের মােসাহেব, তাদের খতম করা উচিত।
এটা স্বৈরতন্ত্র ছাড়া আর কি?
ক) মুজিব-তারেককে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির আহ্বায়ক কমিটি বহিষ্কার করে, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেসে তা অনুমােদিত হয়।
তারা ষড়যন্ত্র করে কমরেড মজিদ-ফারুককে হত্যা করে, সমরবাদী হয়ে উঠে, বন্দুকের নলের মুখে গেরিলা ও পার্টির কর্মীদের সন্ত্রস্ত রাখে, পার্টির কেন্দ্রকে অস্বীকার করে, নারীদের নিয়ে স্বেচ্ছাচার করে, বিনা অনুমতিতে বন্দুকের ডগায় বিয়ে করে, পার্টির সুনাম নষ্ট করে,পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের অনুরূপ কাজ করে। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সর্বহারা পার্টির গেরিলা ও কর্মীরাই মুজিব-তারেককে খতম করার পরিকল্পনা করছিল। তাদের জীবিত অবস্থায় বিচার সম্ভব হয়নি, কারণ তারা পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাতে মারা যায়।
অতীতেও তারেক চরম নারীঘটিত স্বেচ্ছাচার দেখায়, যা ফজলু পার্টির কাছে প্রকাশ করেনি। তার ইতিহাস না জানার কারণে পার্টির মাঝে সে গােপনে ঢুকে পড়ে।
ব্যক্তিস্বার্থে যারা এহেন জঘন্য কাজ, একজন কমরেডকে হত্যা (নির্মমভাবে পিটিয়ে, গলাটিপে) করতে পারে তাদের বহিষ্কার করার পদক্ষেপ যুক্তিযুক্ত। একজন। কমরেডকে অপর একজন কমরেড কখনাে হত্যা করতে পারে না।
মৃত্যু হচ্ছে বস্তুর রূপান্তর, জীবন্ত বস্তু থেকে জড় বস্তুতে রূপান্তর। কিন্তু মৃত্যু হলেও কাজকে মার্কসবাদীরা পর্যালােচনা করে। এ কারণেই মৃত্যুর পর পার্টির সদস্যপদ দেওয়া হয়। কাজেই মৃত্যুর পর এ সকল প্রতিক্রিয়াশীলরা যাতে বীর বলে চিত্রিত না হয় তার জন্য যথাযথ মূল্যায়ন করা প্রয়ােজন।
এ কারণেই তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।
ক্রুশ্চেভ মহান মার্কসবাদী-লেনিনবাদীকে মিথ্যা অজুহাতে বিচার করছে, আর বিপ্লবীরা (যদি পায়) অবশ্যই ক্রুশ্চেভ এবং তার মত সাঙ্গ-পাঙ্গদের মৃত্যুর পরও বিচার করবে।
ক্রুশ্চোভের বিচার চলছে। এখনও শেষ হয়নি। ক্রুশ্চেভ মৃত বলে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।
পৃষ্ঠা: ২৭০

ফজলু চক্র সকল সিদ্ধান্তে একমত পােষণ করেছে, বর্তমানে সে অন্যমত পােষণ। করছে। সভাপতি মাও বলছেন, “এক সভায় হা বলা পরে কথা পাল্টিয়ে না বলাে না।” ফজলু চক্র সর্বত্রই এভাবে কথা পাল্টিয়ে দু’মুখাে হয়েছে।
খ) মাসুমকে বহিষ্কার করা হয়নি। এটা মিথ্যা বানােয়াট কাহিনী। প্রচারপুস্তকে তার নামও উল্লেখ করা হয়েছে।
গ) কমরেড তাহের কমরেড সিরাজ সিকদারের ঘনিষ্ঠতম কমরেড ছিলেন, এ সম্পর্কে সকলেই অবগত। তার অবদান সর্বদাই স্বীকার করা হয়, বিভিন্ন প্রচারপত্রে শহীদদের তালিকায় তার নাম উল্লেখ করা হয় অনেক সময় প্রথমেই।
কমরেড এনায়েত সম্পর্কে পার্টির অনুসন্ধান চলছিল। তার বিরুদ্ধে ফজলু চক্রই অভিযােগ উত্থাপন করে (জেলে থাকাকালীন কার্যাবলীর) এবং চরমতম ঘৃণা প্রদর্শন করে। ফজলুর অধীনে এনায়েতকে নিয়ােগ করা হয়েছিল।
কিন্তু সে ঘৃণা ও প্রতিশােধকামিতার জন্য এনায়েতকে নিতে রাজী হয়নি।
তখন এনায়েতকে কমরেড তাহেরের অধীনে দেওয়া হয় এবং তাকে অনুসন্ধান চালাতে বলা হয়।
ফজলু এখন এনায়েতের দরদী সেজেছে। কি দু’মুখাে! শহীদদের সকলের নাম বিভিন্ন পুস্তিকায় সবসময় স্থানাভাবের কারণে দেওয়া সম্ভব নয়। এটাই কারণ।
কোন ইমেজ ভাঙ্গার জন্য নয়।
ঘ) পঁচিশে মার্চের পূর্বে সংগঠনের অবস্থা মারাত্মক রকম সংকটজনক অবস্থায় ছিল। চরম আর্থিক সংকট ও কর্মী স্বল্পতা ছিল। বরিশালের প্রায় সকল পুরােনাে কর্মী অন্যত্র চলে যায় বা গ্রেফতার হয়।
এ সময় সম্পূর্ণ নতুন কমরেড দিয়ে সেখানে যােগাযােগ স্থাপন করতে পাঠানাে ও কাজ চালানাে হয়।
স্থানীয় কর্মীদের অনেকের সাথেই তার যােগাযােগ ছিল না। জেলে যােগাযােগের কোন পদ্ধতিই কমরেডদের জানা ছিল না।
কমরেডদের অজ্ঞতা ও মারাত্মক কর্মী স্বল্পতার কারণে যােগাযােগ সম্ভব হয়নি। পঁচিশে মার্চের পর অধিকাংশ কমরেড জেল থেকে বেরিয়ে আসে। কর্মীর মুক্তির জন্য কোথায় যে অর্থ ব্যয় হয়নি এটা পার্টির নিকট অজানা।
ঢাকা জেলে যে সকল কমরেড ছিল তাদের সাথে যােগাযােগের ব্যবস্থা হয়েছিল এবং পত্রের মাধ্যমে যােগাযােগ করা হয়।
এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের চিকিৎসাধীন আহত কমরেডদের মুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ঙ) সুধীর নামক জনৈক ব্যক্তির বিষয় মুক্তির জন্য এক সহানুভূতিশীল কর্তৃক অর্থ চাওয়া হয়। সে বরিশালের কর্মী ছিল। বরিশালের নেতৃত্বের মতামত ব্যতীত কিভাবে কেন্দ্র টাকা দেয়? এ কারণে সুধীর সম্পর্কে বরিশালের নেতৃত্বের মতামত চাওয়া হয়। বরিশালের কর্মীরা এর সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত দেন, শেষ পর্যন্ত যখন বুঝা যায় সে। পার্টির সহানুভূতিশীলের পর্যায়ে পড়ে তখন তার জন্য অর্থ প্রদান করা হয়।
ফজলু চক্র সুধীরের জন্য অর্থ দিতে নিষেধ করেছিল। এ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
পৃষ্ঠা: ২৭১

চ) মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্বান্ত বিভিন্ন পরিবারের কথা কমরেড সিরাজ সিকদার কিভাবে জানবেন? যারা এ সকল এলাকার পরিচালক তাদেরকে রিপাের্ট করতে বলা হয়েছে, শহীদ ও নিখোঁজদের তালিকা পেশ করতে বার বার বলা হয়েছে, ছয় পাহাড়ের দালালদের হাতে শহীদদের পরিবারের নিকট শােকবাণী প্রেরণ করা হয়। পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হাতে নিহতদের পরিবারের শােকবাণী ছাপতে দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ছাপার দায়িত্বে নিযুক্ত কমরেডগণ ছাপার কাজ শেষ করতে পারেননি।
মজিদ, ফারুক, পণ্ডিত পরিবারে সাহায্যের অর্থ কমরেড মজিদের (খুলনার দায়িত্বে নিযুক্ত কমরেড) মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছিল, ফজলু চক্র তা জোর করে দখল করে (৩৫০ টাকা)।
প্রসঙ্গক্রমে কমরেড আতাউরের পরিবারে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়।
ছ) কমরেড তাহের ও কমরেড এনায়েতকে গণতন্ত্রমনার জন্য বিপদসংকুল স্থানে। পাঠানাে হয় যাতে তারা খতম হয়।
এ অভিযােগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। কমরেড তাহের স্বেচ্ছায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে চান, দূরবর্তী কোন জেলায় যেতে চান।
তখন কমরেড সিরাজ সিকদার ভাল সম্ভাবনাময় কাজ হয়েছে এবং ভবিষ্যতের জন্য সুবিধাজনক, কেন্দ্রের আশ্রয়স্থল তৈরী সম্ভব এমন এলাকায় তাকে দায়িত্ব দেন। তাকে গণতান্ত্রিক মনােভাবের জন্য পাঠানাে হয়েছে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারণ কমরেড তাহের এমন স্থানে ছিলেন যে প্রতি দুই ঘণ্টায় একবার কমরেড সিরাজ সিকদারের সাথে দেখা করতে পারতেন। কাজেই গণতান্ত্রিক মনােভাবের প্রকাশের কোন বাধাই ছিল না। বিপ্লবে আত্মবলিদান স্বাভাবিক। কিন্তু জনগণের জন্য কমরেড তাহের প্রাণ দিয়েছেন, তাই তার মৃত্যু মহান। ফজলু চক্রের আদর্শ তারেক-মুজিবের মত প্রতিক্রিয়াশীল মৃত্যু নয়।
জ) ফজলু বিশ্বাসঘাতক চক্র এখানে তার প্রকৃত মুখােশ উন্মােচন করেছে। অন্যান্য সংগঠনগুলাে কি? প্রকৃতপক্ষে তারা হচ্ছে মার্কসবাদের নামধারী বুর্জোয়া উপদল, প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠন যা সর্বহারাদের প্রতারিত করছে; দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের সহায়তা করছে।
তাদেরকে আক্রমণ করা তাদের মুখােশ উন্মােচন করা বিপ্লবী কাজ।
আর আমাদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক বা অন্য কোন ভুল থাকলে অবশ্যই আত্মসমালােচনা করতাম।
কিন্তু কোথায় আমাদের ভুল?
ফজলু চক্র একটিও রাজনৈতিক ভুল দেখাতে পারেনি। ফজলু চক্র তাদের আক্রমণে মন খারাপ করেছে।
ইতিমধ্যেই সে কাজী-রণাে-বদরুদ্দীন এবং অন্যান্য সংশােধনবাদীদের সাথে হাত মিলিয়েছে।
ঝ) ফজলু-সুলতান অর্থ-অস্ত্র চুরি করা, ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করা, গুজব-অপবাদ রটনা করা, গুপ্ত হত্যার ষড়যন্ত্র করা, উপদল গঠন করা প্রভৃতি অপরাধে বহিস্কৃত হয়। এদের সাথে যুক্ত থাকার কারনে হামিদ-জাফরকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ইহা কেন্দ্রীয় কমিটির
পৃষ্ঠা: ২৭২

পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত, কোন ব্যক্তি বিশেষের নয়।
হত্যার আদেশ নয়, আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার্থে পাল্টা আক্রমণের অধিকারের কথা সকলকে বলা হয়েছে।
কোন কর্মী সম্পর্কে তিনি (কমরেড সিরাজ সিকদার) বা কেন্দ্রীয় কমিটি আক্রোশের কারণে পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

৭.
ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে আহ্বায়ক কমিটির কোন নির্দেশই কমরেড সিরাজ সিকদার ভাঙ্গেননি। এটা মিথ্যা অপপ্রচার।
ক) সভাপতি মাও বলেছেন, “ব্যক্তিগত ব্যাপার যদি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভুল-ভ্রান্তির সাথে জড়িত না হয় তাহলে ছিদ্রানুসন্ধানের দরকার নেই।”
এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেছেন এ ধরনের সমালােচনা একবার যদি বিকাশ লাভ করে তাহলে পার্টির ভিতর মনােযােগ শুধু ছােটখাট ত্রুটির উপরেই কেন্দ্রীভূত হবে এবং প্রত্যেকেই ভুলে যাবেন পার্টির রাজনৈতিক কর্তব্য। এটা খুবই বিপজ্জনক।
রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক বা মতাদর্শগত ভূল-ভ্রান্তি দেখাতে না পেরে প্রতিক্রিয়াশীলদের চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী ফজলু চক্র ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বানােয়াট ও মিথ্যা কাহিনী ফেঁদে বসেছে। তাদের জঘন্য উদ্দেশ্য হলাে কর্মীদের দৃষ্টি রাজনীতি থেকে সরিয়ে ফেলা এবং ব্যক্তিগত ছিদ্রানুসন্ধানে নিয়ােগ করা যাতে তারা রাজনৈতিক কাজ বাদ দেয় এবং সংগঠন বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ে। এটা তাদের চক্রান্তের একটা অংশ।
কমরেড সিরাজ সিকদারের ব্যক্তিগত জীবন সংক্রান্ত বিষয়াদি পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিপ্লবী পরিষদ কর্তৃক অনুমােদিত। একজন সর্বহারা বিপ্লবী হিসেবে তিনি কখনও পার্টির নিকট মিথ্যা বলেননি।
ফজলু চক্র কোনকালে বিপ্লবী পরিষদের সদস্য ছিল না। কাজেই তার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বানােয়াট কাহিনী ব্যতীত আর কিছু বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
পার্টির অনুমতিসহ বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার কমরেডদের রয়েছে।
মতাদর্শগতভাবে সর্বহারাদের মধ্যে অনৈক্য বা বিচ্ছেদ হয় না এ কথা ফজলু চক্রের জানা উচিত।
একজনের জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বােঝা (বিশেষ করে বৈবাহিক ক্ষেত্রে) নেবে এমন লেজুড় সর্বহারা পার্টিতে কেউ নেই। উপরন্তু সর্বহারাদের বিবাহ হচ্ছে বিবাহ ইচ্ছুক নর-নারীর স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে। সামন্তবাদী পদ্ধতিতে চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে নয়।
খ) সর্বহারা বিপ্লবী পার্টিতে প্রত্যেককে পৃথকভাবে বিচার করা হয়। আত্মীয়তার সূত্র ধরে নয়। যে কারণে চীনা বা অন্য কোন পার্টিতে কোন কমরেডকে অমুকের স্ত্রী বা আত্মীয় হিসেবে বিচার করা হয় না।
ফজলু চক্র কর্তৃক অমুকের স্ত্রী এই এই করেছে বলার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে যার স্ত্রী তাকে আক্রমণ করা।
অর্থাৎ ক. সিরাজ সিকদারকে আক্রমণ ও হেয় করার জন্যই সে এ কাজ করেছে।
পৃষ্ঠা: ২৭৩

ফজলু চক্র কর্তৃক যে সকল শাড়ী বা গহনার কথা বলা হয়েছে তা পার্টির স্টোর। এখান থেকে কমরেডদের সর্বনিম্ন প্রয়ােজন অনুযায়ী শাড়ী বা অন্যান্য দ্রব্য প্রদত্ত হয়। এ প্রয়ােজন নির্ধারিত হয় কি পরিচয়ে, পরিবেশে কমরেডরা থাকে।
কমরেড সিরাজ সিকদারকে যদি কেউ প্রভাবান্বিত করেন বা পাইলট হিসেবে পরিচালনা করেন তবে তিনিই সর্বহারা পার্টির সঠিক লাইন ও পরিচালনার যােগ্য প্রকৃত লােক।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা তা নয়।
কমরেড তাহেরকে যথাযথ চিকিৎসা করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে তার বা তার পরিবারের কোন অভিযােগ ছিল না।
অসুস্থ কমরেডদের গুরুত্ব এবং পার্টির সামর্থ অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যয় করা হয়। এর বেশী কারাে জন্য করা হয়নি। সংগঠনের অর্থ সহানুভূতিশীল এমন কি ফজলু চক্রের নামেও রাখা হয়েছিল। কিন্তু ফজলু চক্র ব্যতীত আর কেউ চুরি করেনি।
গ) কমরেড সিরাজ সিকদার কসমেটিক ব্যবহার করেন, বুর্জোয়া মনােভাবের কারণে বুর্জোয়া হিসেবে থাকেন এ অভিযােগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তিনি যা কিছু করছেন তা কমরেডদের সামনেই বিপ্লবের ও নিরাপত্তার প্রয়ােজনেই করছেন।
বিপ্লব ও নিরাপত্তার প্রয়ােজনে বিভিন্ন বেশভূষা ও সাজগােজ ব্যবহার করা, বিভিন্ন স্থানে থাকা চলে।
খাদ্য ও অন্যান্য বিষয়ে ফজলু বিশ্বাসঘাতক চক্র সব সময়ই বলত, আপনার আরাে খাওয়া উচিত, স্বাস্থ্য ভাল করা উচিত ইত্যাদি। আপনার একটি গাড়ী দরকার এমন কথাও সে বলেছে।
কিন্তু ক. সিরাজ সিকদার তার ষড়যন্ত্রে পা দেননি। সর্বনিম্ন প্রয়ােজন অনুযায়ী সাধারণভাবেই তিনি চলেন।
ঘ) ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ক. সিরাজ সিকদার অনােনুমােদিত এবং অযৌক্তিক। পদক্ষেপ নেননি।
ঙ) ক. সিরাজ সিকদারের প্রতিটি কার্যকলাপে পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সংস্থার অনুমােদন প্রয়ােজন একথা ফজলু চক্র ইচ্ছাকৃতভাবে উল্লেখ করেনি যাতে তাকে স্বেচ্ছাচারী হিসেবে তুলে ধরা যায়।
ক. সিরাজ সিকদার কারাে প্রতি নিয়ােগে কোন পক্ষপাত দেখাননি।
যার সম্পর্কে অভিযােগ করা হয়েছে তাকে সার্বক্ষণিক করার সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৬৯ সালে ঢাকা জেলা কংগ্রেস, তাকে নেতৃত্ব সংস্থায় অর্থাৎ বিপ্লবী পরিষদে নেয় বিপ্লবী পরিষদ, বিপ্লবী পরিষদের পূর্ণাঙ্গ বর্ধিত অধিবেশন তাকে সংগঠনের গুরুদায়িত্ব দেয়। পেয়ারা বাগানে নেতৃস্থানীয় কর্মীসহ বর্ধিত বিপ্লবী পরিষদের বৈঠকে তাকে আহ্বায়ক কমিটির সদস্য পদ প্রদান করা হয়। সংগঠনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে নিয়ােগ করা হয়, কোন ব্যক্তি বিশেষের শুভেচ্ছার জন্য নয়।
ফজলু চক্রই উক্ত কমরেডের সবচাইতেই ভক্তের ভাব দেখায়। সর্বহারা পার্টির প্রথম কংগ্রেসে ফজলু চক্রই তার নাম কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য প্রস্তাব করে (১৯৭২ সাল, জানুয়ারী)। পক্ষান্তরে ক. সিরাজ সিকদার উক্ত কমরেডের নির্বাচনের পরেও অসুস্থতার কারণে তার সদস্য হওয়া উচিত হবে না বলে মত পেশ করেন। সভাপতিমণ্ডলী তার
পৃষ্ঠা: ২৭৪

প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং কংগ্রেস সদস্যদের এ প্রস্তাব গ্রহণের জন্য পাঠানাে হয়। কংগ্রেস সদস্যরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ক. সিরাজ সিকদারের স্বজনপ্রীতি থাকলে তিনি উক্ত কমরেডের নির্বাচনের বিরােধিতা করতেন না।
ফজলু চক্র উপরের বহু অভিযােগ কোন সভায় বা লিখিতভাবে বা মৌখিকভাবে। সমালােচনা কোনদিন করেনি। সে এখন মিথ্যা বলছে, সে সমালােচনা করেছে।
উচিয়াং-এর পুস্তক১ সম্পর্কে কমরেড সিরাজ সিকদার বলেছেন যে, পুস্তকখানি ১৯৩৪ সালে লেখা। এত সুদীর্ঘদিনের ব্যবধানে উচিয়াং-এর কি হয়েছে আমরা জানি না। উপরন্তু যেখানে মাওসেতুঙ কর্তৃক সমালােচনা-আত্মসমালােচনার সম্পর্কে সকল সমস্যার সমাধান লিখিত রয়েছে, সেখানে উচিয়াং-এর পুস্তক কর্মীদের পড়ানাে বা একে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে নেওয়া ঠিক হবে না। লিউ শাওচির ‘কিভাবে ভাল কমিউনিস্ট হওয়া যায়’ পুস্তক এককালে কমিউনিস্টরা পড়তেন। বর্তমানে লিউ’র আসল চরিত্র বুঝতে পারায় কেউ তা পড়েন না।
উচিয়াং-এর প্রকৃত অবস্থা না জেনে আমরা উক্ত পুস্তক সকল কর্মীকে কিভাবে পড়াই?
ফজলু চক্র কংগ্রেস সম্পর্কে সম্পূর্ণ বানােয়াট মিথ্যা কাহিনী বলেছে। কংগ্রেস এক সাথে বসে করা হয়নি নিরাপত্তার কারণে, অন্য কোন কারণে নয়। কমরেডগণ চিন্তা করুন, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সকল নেতৃস্থানীয় কর্মী এক সাথে বসেছেন, আর তা প্রকাশ হয়ে গেল, তাদেরকে শত্রু ঘেরাও করল, তাহলে কি অবস্থা হত? সংগঠন শেষ হয়ে যেত।
একমাত্র পার্টি ও বিপ্লবের শত্রু ব্যতীত আর কেউ এ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও একত্রে বসার দাবী জানাবে না। ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় সমগ্র কেন্দ্রীয় কমিটি একবার এরূপভাবে খতম হয়েছিল। এ সকল কথা বিবেচনা করে ক. সিরাজ সিকদার কংগ্রেস প্রতিনিধিদের গ্রুপে গ্রুপে ভাগ করে বসার প্রস্তাব দেন। এর কারণ নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলেও শুধু এক গ্রুপের নিরাপত্তাই বিঘ্নিত হবে, সকলের নয়।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য কংগ্রেসের পূর্বে আহ্বায়ক কমিটি কর্তৃক কংগ্রেস ব্যবস্থাপনা কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ কমিটির দায়িত্ব ছিল কংগ্রেসের স্থানের ও বৈঠকের ব্যবস্থা করা, নিমন্ত্রিত প্রতিনিধিদের নিকট নিমন্ত্রণ পৌঁছে দেওয়া, তাদের আসার ব্যবস্থা করা, থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা, কংগ্রেস সদস্যদের উপস্থিত হতে সহায়তা করা, কংগ্রেস শেষে কর্মীদের যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
কাজেই কংগ্রেস এক সাথে বসবে, না পৃথকভাবে গ্রুপে ভাগ হয়ে বসবে, কোথায় বসবে, কিভাবে বসবে, কে কোথায় থাকবে, কংগ্রেসে কিভাবে সদস্যরা যােগাযােগ করবেন তা নির্ণয় করেছে কংগ্রেস ব্যবস্থাপনা কমিটি, ক. সিরাজ সিকদার নয়।
এ কমিটি ক. সিরাজ সিকদারের প্রস্তাব গ্রহণ না করলেই পারত। অতএব পৃথক পৃথকভাবে গ্রুপে ভাগ হয়ে বসার ব্যবস্থা করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা কমিটির অর্থাৎ ফজলু-সুলতান চক্রের (যেহেতু তারা সংখ্যাগুরু ছিল অর্থাৎ তিন জনের কমিটির দুইজন ছিল তারা)।
…………………………………………………………………….
১. চীনের উচিয়াং-এর সমালােচনা-আত্মসমালােচনা সম্পর্কিত পুস্তকের কথা বলা হয়েছে। এটি বাংলাদেশে বাংলা অনুবাদ আকারে পাওয়া যেত -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ২৭৫

ফজলু চক্র কংগ্রেস ব্যবস্থাপনা কমিটির কথা ও তার দায়িত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে গােপন করে ক. সিরাজ সিকদার ও সাচ্চা কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের দোষ চাপিয়ে দিয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলাে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত বাতিল ও অস্বীকার করার মিথ্যা অজুহাত তৈরী করা।
কংগ্রেসে ফজলু চক্রের তার বক্তব্য পেশের পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল। উপরন্তু সে একজন গ্রুপ পরিচালক ছিল। প্রায় সকল গ্রুপে সে গিয়েছে, কর্মীদের সাথে। মিশেছে। কংগ্রেসের সকল সদস্যও তাকে অপরের সাথে মেলামেশার সুযােগ দিয়েছে।
গ্রুপসমূহের মতামত সর্বদাই জানানাে হত, এ নিয়ে ইশতেহার প্রকাশ করা হয়।
কেডার ইতিহাস মৌখিকভাবে প্রদত্ত হয়। ইহা সভাপতিমণ্ডলীর তখনকার মত অনুমােদিত ছিল।
এ সম্পর্কে কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় সভায় আত্মসমালােচনা করা হয় নিম্নভাবে।
কেডার ইতিহাস প্রণয়ন দীর্ঘদিনের প্রক্রিয়া যার জন্য প্রয়ােজন শুদ্ধি আন্দোলন। সময়াভাবে মৌখিকভাবে প্রদান করার ফলে পরিপূর্ণ ইতিহাস দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ফজলু চক্রের, সুলতান চক্রের পরিপূর্ণ কেডার ইতিহাস প্রদান করা সম্ভব হয়নি। এগুলাে সংগঠনের সীমাবদ্ধতা।
বাক স্বাধীনতা ছিল না বলা কংগ্রেস সদস্যদের অপমান করা ব্যতীত আর কিছু না। জনৈক কমরেডের মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কে প্রকৃত বিষয় হলাে নিম্নরূপঃ ফজলু-মনসুর উক্ত কমরেড সম্পর্কে খবর সংগ্রহ করে যে, সে ক. সিরাজ সিকদারকে খতম করতে চায়। এ তথ্য ফজলু সভাপতিমণ্ডলীর সভায় পেশ করে। ফজলুই মৃত্যুদণ্ড দাবী করে (ফজলু। চক্র অনেক সময় ক্ষুদ্র অপরাধে অনেকের মৃত্যুদণ্ড দাবী করেছে, উদাহরণ ঝালকাঠির জাহাঙ্গীর)। ক. সিরাজ সিকদার উক্ত কমরেডকে গ্রেফতার ও অনুসন্ধানের কথা বলেন, এ প্রস্তাব গৃহীত হয়।
ক. সিরাজ সিকদার পরে বিষয়টি গুরুত্বহীন দেখে গ্রেফতার বাতিল করে শুধু অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন (সে অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রকাশিত ২নং সার্কুলার দ্রষ্টব্য)।
কংগ্রেসে ক. সিরাজ সিকদার ও সভাপতিমণ্ডলীর বাকী সদস্যরা ষড়যন্ত্র আঁটছিলেন- ইহা ফজলু চক্র যদি জানত তবে কেন সে কংগ্রেস সদস্যদের জানাল না। এর কারণ হিসেবে সে বলে, ভয়ে জানায়নি।
এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা।
কংগ্রেসের সকল সদস্যকে না জানিয়ে বিনা বিচারে ক. সিরাজ সিকদার বা সভাপতিমণ্ডলী ফজলুকে কিছুই করতে পারত না।
উপরন্তু ফজলু চক্র ক. সিরাজ সিকদার কোথায় রয়েছেন তা জানত, অস্ত্র দখল করাও তার পক্ষে সম্ভব ছিল।
প্রকৃতপক্ষে সমস্ত বিষয়টি বানােয়াট কাহিনী, কর্মীদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে তৈরী।
মার্কসবাদীরা ষড়যন্ত্রকারী নয়, মুখ দেখে বা ভয়ে কর্মীরা ক. সিরাজ সিকদার বা কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব গ্রহণ করে না, সঠিকতার জন্যই করে। কমরেড সিরাজ সিকদার প্রায়ই বলেন, “নেতা হওয়ার জন্য আমরা বিপ্লব করছি না, জনগণের মুক্তির জন্য বিপ্লব করছি। এর জন্য ন্যায় ও সত্যকে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ। চিন্তাধারার নীতি ও পবিত্রতাকে এবং পার্টির পবিত্রতাকে রক্ষা করতে মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রাম
…………………………………………………………………….
২৭৬

করব। সঠিক ও অধিকতর যােগ্য বিপ্লবীর নেতৃত্ব স্বার্থহীনভাবে সবসময় গ্রহণ করবাে, প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিবিপ্লবীদের, ক্রুশ্চোভের মত খারাপ লােকদের, পার্টির ক্ষমতা দখলকে, পার্টি ও বিপ্লবকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রকে শেষ পর্যন্ত বিরােধিতা করব।”
কাজেই ফজলু চক্রের ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করা প্রয়ােজন হত না। নিঃস্বার্থ বিপ্লবী অনুশীলনে যােগ্যতর প্রমাণিত হলে ক. সিরাজ সিকদারসহ সকল খাঁটি বিপ্লবীরা ও জনগণ আনন্দের সাথে তার হাতে সমুদয় ক্ষমতা তুলে দিত।
কিন্তু সাপ গর্ত থেকে বেরুবেই। পদ, নেতৃত্ব, ক্ষমতার লােভ নিয়ে যারা বিপ্লবে আসে তাদের প্রকৃত কুৎসিত চেহারা প্রকাশ পাবেই পাবে। ফজলু চক্রের চেহারা দ্রুত প্রকাশ পেয়েছে। বিপ্লবী ও জনগণ অচিরেই তাদেরকে ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবে।
ফজল চক্র এতই নেতৃত্ব লােভী, পদ ও নাম-যশ লােভী যে, সর্বহারা পাটি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নামধারী প্রতিক্রিয়াশীল উপদল গঠন শেষ না করেই ‘সেলিম শাহনেওয়াজ-জিন্দাবাদ’ খুলনার দেওয়ালে লিখছে।
দেশীয় প্রবাদ আছে, “লােভে পাপ, পাপে মৃত্যু।” পার্টির ক্ষমতা ও নাম যশের লােভে যে পাপ হয়েছে, অর্থাৎ যে অপরাধ ফজলু করেছে তা তার কলঙ্কিত মৃত্যুকেই ত্বরান্বিত করছে।
ফজলু চক্র হবে ইতিহাসের কলঙ্কিত নেতিবাচক শিক্ষক। ফজলু চক্র শহীদদের কথা, বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের কথা তার কদর্য মুখে উচ্চারণ করে তাদের অপমান করেছে।
শহীদ কমরেড, বিপ্লব, পার্টি ও জনগণ, দেশ ও জাতির জন্য ফজলু চক্রের কিছু মাত্র দরদ থাকলে পার্টি যখন হু হু করে দেশব্যাপী বিকাশ লাভ করছিল তখন পার্টির নেতৃত্ব ও সাচ্চা কমরেডদের হত্যা করা, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ, গুজব, কুৎসা রটনা করা, কর্মী ও পার্টির প্রতি আস্থাশীলদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, তাদেরকে প্রতারিত করা, অর্থ চুরি করে পার্টির কাজ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা, অস্ত্র চুরি করে পার্টিকে হাতিয়ার শূন্য করা, ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করে উপদল গঠন করা, পার্টিকে ভেঙ্গে ফেলা বা দুর্বল করার প্রচেষ্টা চালানাে, পৃথক প্রতিক্রিয়াশীল দুর্গ গঠন করা, পার্টির গণতন্ত্র, কেন্দ্রীকতা, সংবিধানকে পদদলিত করার মত প্রতিবিপ্লবী কাজ সে কখনও করতাে না।
সে ভাল কমরেড হলে পার্টিকে শক্তিশালী করার কাজকে প্রাধান্য দিয়ে কমরেডদের ভুল-ক্রটিকে পার্টির মধ্যে থেকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আলােচনা ও সংগ্রামের সঠিক পথ গ্রহণ করতাে, পার্টির ঐক্যকে জোরদার করতাে।
ফজলু চক্র এ পথ গ্রহণ করেনি, কারণ এ সকল মিথ্যা অভিযােগ, গুজব, অপবাদ, কুৎসা, সত্যের সামনে টিকবে না, ফলে তার পক্ষে পার্টির নেতা হওয়া যাবে না, ক্ষমতা দখল করা যাবে না।
যাদেরকে তার চক্রে যােগদান করাতে চেয়েছিল এরূপ কেউ কেউ তাকে বলেছিল, তুমি সভায় সামনাসামনি তােমার বক্তব্য বল। সে আঁতকে উঠে এ প্রস্তাবে অসম্মতি জানিয়েছে।
মিথ্যা অপবাদ, গুজব, কুৎসা, হত্যা-ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকে মেনিফেস্টো (কর্মসূচী) করে কিছুদিন কিছুসংখ্যক লােককে প্রতারিত করা যায়, চিরদিন সবাইকে প্রতারিত করা যায় না।
রাজনৈতিক পার্টি গঠিত হয় রাজনীতির ভিত্তিতে। ফজলু চক্রের কোন রাজনীতি নেই। ক. সিরাজ সিকদার প্রণীত রাজনৈতিক ও অন্যান্য কর্মপদ্ধতিগত লাইন চুরি করে,
পৃষ্ঠা: ২৭৭

সর্বহারা পার্টির সুনাম ব্যবহার করে, সামন্তবাদী আত্মীয়তার সম্পর্কের উপর নির্ভর করে তারা অল্প কিছুদিন চলতে পারে।
কিন্তু শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের জটিল প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সমস্যাবলীর সমাধান দিতে না পেরে, রাজনীতি ও মতাদর্শ বর্জিত হয়ে তারা হাত মেলাবে হয় বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের সাথে (ইতিমধ্যে তারা কাজী চক্রের সাথে হাত মিলিয়েছে), বা গুপ্ত পুলিশ হয়ে সরকারের সাথে হাত মিলাবে বা ডাকাত দলে পরিণত হবে। তারা ক. সিরাজ সিকদারকে খতম করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা এ কাজের জন্য বাংলাদেশ সরকার থেকে পাবে বাহবাসহ বিরাট অংকের অর্থ। বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের প্রশংসা ও সহায়তা। আন্তর্জাতিক শত্রুদের পুরস্কার। তাদের কাজ ইতিমধ্যেই শত্রুদের বহু প্রশংসা পেয়েছে।
এভাবে তারা তাদের কাজ দ্বারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের দালালে পরিণত হয়েছে।
তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের দালাল।
তাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া ভাল। ইহা প্রমাণ করে ক. সিরাজ সিকদার এবং তার নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ও সাচ্চা বিপ্লবীরা প্রকৃতই বিপ্লবী।

পরিশিষ্ট -১
১) ফজলু ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের অধীন রাখবে এই শর্তে পুর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিমণ্ডলী তার নাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদের জন্য পেশ করে।
২) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বিতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ফজলু সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত (২৫/৩/৭২):
তাদেরকে (ফজলু ও তার স্ত্রী) নিম্নলিখিত সর্বনিম্ন ত্রুটি সংশােধনের আহ্বান জানানাে হচ্ছেঃ
মিনুর মুক্ত মনের অভাব, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা গ্রহণ না করা, জেদ, অভিমান, সমালােচনায় কান্নাকাটি, বিনয়ের অভাব, ছাত্র হওয়ার মনােভাবের অভাব, ভাগ্যান্বেষী মনােভাব ইত্যাদি।
আহাদ (ফজলু) ব্যক্তিগত বিষয়ে চিন্তায় অস্পষ্টতা। ব্যক্তিগত বিষয় স্বেচ্ছায় যথাযথ পরিমাণে বিপ্লবের অধীনে না আনা, আবেগ ইত্যাদি …..।
ফজলু ত্রুটিসমূহ সংশােধনের পূর্বে বিয়ের আবেদন জানালে ইহা প্রমাণ করবে যে, তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের অধীন রাখতে পারছেন না। তখন কমরেড সভাপতি নিম্নরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিয়ের অনুমতি দিতে পারেন।
ক) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ থেকে এবং আঞ্চলিক কমিটির প্রধানের পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান।
কমরেড আহাদকে সমালােচনা করেন, কমরেড হাকিম নিম্নলিখিত কারণেঃ
যৌন সম্পর্কিত বক্তব্যে (যৌনকে কি অস্বীকার করা যায়-ফজলুর বক্তব্য) এই বক্তব্য পেশ করা প্রয়ােজন ছিল যে যৌনকে বিপ্লবের স্বার্থের অধীনে রাখতে হবে। নিম্নস্তরে অসম্পূর্ণ বক্তব্য পেশ করা উচিত নয়।
…………………………………………………………………….
২৭৮

কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত স্বার্থকে দূর করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে, তাকে বজায়। রেখে নয় (ফজলুর বক্তব্য- কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকবে)।
নিম্নস্তরে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা উচিত নয়। সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ৩) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির জরুরী বৈঠক
(তারিখ ২৮/৩/৭২)ঃ
ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের অধীনে রাখতে না পারার পরিপ্রেক্ষিতে
ক) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হলাে (কমরেড ফজলুকে); ৬ মাস পরে এই বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা হবে।
খ) কেন্দ্রীয় কমিটির পরবর্তী নিম্নতর স্তরে প্রধান পদে নিয়ােগ করা হবে না, ৬ মাস পরে এই বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা হবে।
গ) ….. ক. ফজলুকে খুলনা থেকে প্রত্যাহার করে ক………….. অধীনে চট্টগ্রাম
নিয়ােগ করা হলাে।

পরিশিষ্ট-২
ফজলু গত এপ্রিলে নিম্নলিখিত কবিতাটি রচনা করে। একই সময়ে সে কমরেড সিরাজ সিকদার সহ সাচ্চা বিপ্লবীদের হত্যা, পার্টির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে। এ কবিতার মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় তার দু’মুখাে ও ভাওতাবাজী চরিত্র। কবিতার মূল পাণ্ডুলিপি গত ৩রা জুন পার্টি হস্তগত করেছে। কবিতাটি নীচে দেওয়া হলােঃ

কাগুজে বাঘ

পূর্ব বাংলার বীর জনগণ,
সংগ্রামে বলিদান নিশ্চয়,
তবু আজ চলে এসাে নির্ভয়।
প্রতিরােধের দুর্গ তুলি আয়রে সর্বহারা,
আমরা সকলে মিলেই গড়িব নতুন সমাজধারা।
সর্বহারারা মিলিছে, মিশিবে,
দেশপ্রেমিকরা আসিছে, আসিবে,
সর্বহারাদেরই পিছে।
তবু আজ ওরে
শুধু কেন ভাই সময় কাটাই মিছে?
নাই যার কিছু হারাবার ভাই,
তার চেয়ে আর সাহসী যে নাই।
অগ্রগামী সে শ্রেণীর নেতা
মোদের সিরাজ ভাই
তারই মহান আহ্বানে
চল যাই ওরে যাই।
তিনি বলেছেন-
পৃষ্ঠা: ২৭৯

“অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন!”
সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধরুন অস্ত্র ধরুন!!
হানাদারী অস্ত্রের ঝনঝনি দেখে
কেন কর মিছে ভয়?
দুর্জয় জনতার একতার কাছে
ওসব কিছুই নয়।
শােষকেরা সব দেখতে যতই
হােক না ভয়ঙ্কর।
জনতার মহান সংগ্রামে সব।
হয়ে যাবে একাকার।
জনতার রক্ত শােষণের কালে
সত্যিই ওরা বাঘ।
জাগুক জনতা, দেখুক বিস্ময়
ওরা যে কাগুজে বাঘ।

পরিশিষ্ট-৩
দেরীতে পাওয়া সংবাদে কেন্দ্রীয় কমিটি নিম্নলিখিত তথ্যাদি অবগত হয়েছেন-
১। বাংলাদেশ পুতুল সরকারের খাদ্যমন্ত্রী ফনীভূষন মজুমদারের সাথে ফজলু সুলতান চক্র ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করার জন্য তাদের পদলেহী জাফর (পৈত্রিক নাম আজম)-কে নিয়ােগ করেছে। জাফর একাধিকবার ফনী মজুমদারের সাথে সাক্ষাৎ করেছে।
২। কোন এক স্থানে আমাদের দু’জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করার জন্য তারা পুলিশে সংবাদ দেয়। সংবাদ পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী এ দু’জন কমরেডকে গ্রেপ্তার করে এবং অস্ত্র ও অর্থসহ বহু প্রচারপত্র ও দলিল কব্জা করে।১
৩। ষড়যন্ত্র করার জন্য সম্প্রতি ফজলু চক্র বরিশাল যায় এবং সেখানে সে ছয় পাহাড়ের দালাল সামসুর রহমান এমসিএ-র আশ্রয়ে থেকে বরিশালের সংগঠনে বিভেদ সৃষ্টি করা ও তা দখল করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।
…………………………………………………………………….
১. চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি শহীদের গ্রেফতারের ঘটনা এখানে বুঝানাে হয়েছে প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ২৮০

প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের বিদ্রোহ,
না বিপ্পবী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীলদের বিদ্রোহ
(১৯৭২)

– বিশ্বাসঘাতক ফজলু-সুলতান চক্র হৈ চৈ করছে কমরেড সিরাজ সিকদার ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছে, অন্যদেরও তাই করা উচিত। তারা জনগণের সেবক, তারা জনগণকে ভালবাসে, বিপ্লবকে ভালবাসে, তারা বিপ্লবী, কমিউনিস্ট ইত্যাদি।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে আমাদের নির্ণয় করা প্রয়ােজন কে বিপ্লবী, আর কে প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রকৃত ঘটনা কি?

সঠিক লাইন কেবলমাত্র সঠিক মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরাই প্রণয়ন করতে পারেন
ফজলু-সুলতান চক্র বলে সংগঠনের রাজনীতি ঠিক কিন্তু নেতৃত্ব প্রতিক্রিয়াশীল।
সংগঠনের সঠিক রাজনীতি এবং অন্যান্য সঠিক লাইন যার ভিত্তিতেই সংগঠন। বিকাশ লাভ করেছে, বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সংগঠনের নেতৃত্ব প্রণয়ন করেছেন, কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণয়ন করেছেন।
সংগঠনের রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইন ঠিক অর্থাৎ এ সকল ক্ষেত্রে কমরেড সিরাজ সিকদার ঠিক, তবুও তাদের মতে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল।
তারা কোন রাজনৈতিক, তাত্ত্বিক বা মতাদর্শগত প্রশ্নে কেন্দ্রীয় কমিটি বা কমরেড সিরাজ সিকদারের ভুল ধরতে পারেনি।
তারা তাদের ম্যানিফেস্টো হিসেবে গ্রহণ করেছে গুজব, অপবাদ, মিথ্যা বলা এবং ব্যক্তিগত কুৎসা।
রাজনৈতিক, মতাদর্শগত ও তত্ত্বগতভাবে আক্রমণ না করতে পেরে আদিকাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীলরা শেষ পর্যন্ত গুজব, অপবাদ, ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, ব্যক্তিগত কুৎসার আশ্রয় নিয়েছে। মার্কস-এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও অর্থাৎ সকলের বিরুদ্ধে এমন করা হয়েছিল।
প্রথম আন্তর্জাতিকে বাকুনিন মার্কসের বিশ্বাস অর্জনের জন্য লেখে, “আমি আপনার শিষ্য এবং এতে আমি গর্বিত।” পরে যখন প্রথম আন্তর্জাতিকের ক্ষমতা দখলের জন্য তার ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হলাে তখন সে মার্কসকে গাল দেয় এবং বলে, “একজন জার্মান এবং ইহুদি হিসেবে সে আগাগােড়া স্বেচ্ছাচারী এবং একনায়ক।”
দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকেও দলত্যাগী কাউটস্কি লেনিনকে গাল দেওয়ার জন্য একই ভাষা ব্যবহার করে। সে লেনিনকে নিন্দা করে “নিরীশ্বরবাদীদের আল্লাহ্” বলে। “সে
পৃষ্ঠা: ২৮১

মার্কসবাদকে শুধু একটি রাষ্ট্রীয় ধর্মেই পরিণত করেনি, মধ্যযুগীয় বা প্রাচ্য দেশীয় বিশ্বাসে পরিণত করেছে।”
তৃতীয় আন্তর্জাতিকে স্ট্যালিনকে ট্রটস্কী-টিটো “আমলাতান্ত্রিক, একনায়ক” বলে আক্রমণ করে।
ক্রুশ্চেভ প্রতি কথায় ও লেখায় স্ট্যালিনের প্রশংসা করে উদ্ধৃতি দেয়, এমন কি ‘মহান পিতা স্ট্যালিন’ হিসেবে স্ট্যালিনকে সম্বােধন করে, কিন্তু গােপনে স্ট্যালিনকে উৎখাত করার জন্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে। স্ট্যালিনকে ‘ডাকাত’, ‘খুনী’, ‘গুণ্ডা, ‘বদমাইশ’, ‘একনায়ক’, ‘ফ্যাসিস্ট’ অর্থাৎ, এমন কিছু অপবাদ নেই যা সে দেয়নি।
লিউ শাওচি এবং তাদের সাঙ্গোপাঙ্গো বিশ্বাসঘাতকরা সভাপতি মাওয়ের বিশ্বাস অর্জনের জন্য প্রতি কথায় ও লেখায় সভাপতি মাওয়ের উদ্ধৃতি দেয় ও প্রশংসা করে। কিন্তু গােপনে সভাপতি মাওকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যায়। লিনপিয়াও একই কাজ করে।
ফজলু-সুলতান চক্র কমরেড সিরাজ সিকদারকে প্রশংসা করে, তাকে বিরােধিতা করার অর্থ বিপ্লবকে বিরােধিতা করা প্রভৃতি বলে, তার প্রশংসায় কবিতা লেখে। কিন্তু ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত ব্যর্থ হলেই কমরেড সিরাজ সিকদারকে তারা বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমলাতান্ত্রিক, একনায়ক বলে তার বিরুদ্ধে ক্রুশ্চোভের মত জঘন্য কুৎসা রটায়।
এভাবে তারা তাদের গুরু ক্রুশ্চোভ, লিউ শাওচি, লিনপিয়াও এবং অন্যান্য পুরানাে ও আধুনিক সংশােধনবাদীদের পুরানাে কৌশল অবলম্বন করে রাজনৈতিক ও অন্যান্য। লাইনে কমরেড সিরাজ সিকদার সঠিক এ কথা স্বীকার করেও তাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে।

একজন কমরেড সঠিক রাজনৈতিক, সাংগঠনিক,
সামরিক লাইন প্রণয়ন করেন,
কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত জীবনে কি প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারেন?

সঠিক লাইন প্রণয়ন করা সম্ভব যদি একজন সর্বহারার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ অর্জন করে থাকেন এবং তা রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়ােগ করেন। ইহা প্রমাণ করে রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইন প্রণয়নের সময় তার সর্বহারা দিক প্রধান।
ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল, অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল বিশ্বদৃষ্টিকোণ প্রয়ােগ করেন, ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়াশীল দিক প্রধান।
একজন কর্মী ব্যক্তিগত জীবনযাপন করছেন অর্থাৎ তার পরিবার, ছেলে-মেয়ে রয়েছে, তার থাকা-খাওয়া, কথা-বার্তা, কমরেডদের সাথে মেলামেশা প্রাত্যহিক ব্যাপার; আবার রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও অন্যান্য সমস্যার সমাধানও তার প্রাত্যহিক ব্যাপার।
“রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইনে সর্বহারা, ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল”-এ তত্ত্ব সঠিক হলে প্রতিদিনের মধ্যে একই সাথে দুটো দিক প্রধান হয় অর্থাৎ রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমস্যা সমাধানের সময় সর্বহারা দিক, আবার ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীল দিক প্রধান হয়।
কিন্তু মার্কসবাদ আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, একজন কমরেডের এক সময়। এক দিক প্রধান হয় এবং তাই নির্ণয় করে কমরেড কি? তার প্রতিক্রিয়াশীল দিক প্রধান হলে সে প্রতিক্রিয়াশীল, আর বিপ্লবী দিক প্রধান হলে সে বিপ্লবী।
আর এ দিকসমূহের রূপান্তর অর্থাৎ সর্বহারা দিক প্রধান থেকে অপ্রধান এবং
পৃষ্ঠা: ২৮২

প্রতিক্রিয়াশীল দিক অপ্রধান থেকে প্রধানে রূপান্তর সময়সাপেক্ষ। এ পরিবর্তন একদিনের মাঝে কয়েকবার হতে পারে না। অর্থাৎ প্রতিদিন সকালে একটা প্রধান বিকেলে বা দুপুরে অন্যটা বা একসাথে দুটোই প্রধান হওয়া মাকর্সবাদ বিরােধী তত্ত্ব।
কাজেই একজন কমরেড যিনি রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সর্বহারা আর একই সময়ে ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারেন না। হয় তিনি একই সময়ে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল বা রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে সর্বহারা।
কাজেই কমরেড সিরাজ সিকদার রাজনৈতিক ও অন্যান্য লাইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সর্বহারা, একই সাথে ব্যক্তিগত জীবনে প্রতিক্রিয়াশীল হতে পারেন না। ব্যক্তিগত জীবনেও তার প্রধান দিক হচ্ছে সর্বহারা।
প্রধান দিক সর্বহারা হলেও রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে গৌণ। দিকের প্রকাশ ঘটতে পারে। এ কারণেই কমরেডদের ভুল হয়; পৃথিবীর এমন কোন বিপ্লবী নেই যিনি কিছু ভুল করেননি। কাজেই কমরেডদের বিচার করার সময় নির্ণয় করতে হবে কোন দিক তার প্রধান, সর্বহারা না অসর্বহারা। যার সর্বহারা দিক প্রধান সে সর্বহারা, যার প্রতিক্রিয়াশীল দিক প্রধান সে প্রতিক্রিয়াশীল। সর্বহারা দিক প্রধান এরূপ কমরেডকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা প্রতিক্রিয়াশীল ও শ্রেণী শত্রুদের কাজ।
কর্মীদের দিকসমূহের পর্যালােচনার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা সম্পর্কে সভাপতি মাও বলেছেন, “দুটি সীমারেখা স্পষ্ট করে অংকন করুন। প্রথমতঃ বিপ্লব না প্রতিবিপ্লব? ইয়েনান। সিয়ান (চিয়াং কাইশেকের কেন্দ্র- লেখক)? কেউ কেউ বুঝেন না যে এই সীমারেখা অবশ্যই স্পষ্টভাবে আঁকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ যখন তারা আমলাতন্ত্রের বিরােধিতা করেন তখন ইয়েনান সম্বন্ধে এমনি করে বলেন যে যেন সেখানে কিছুই ঠিক নয়, ইয়েনানের আমলাতন্ত্রবাদ ও সিয়ানের আমলাতন্ত্রবাদের মধ্যে পার্থক্য করেন না। এটা মূলতঃ ভুল।
দ্বিতীয়তঃ বিপ্লবী বাহিনীর ভেতরে ভুল ও নির্ভুলের মধ্যে, সাফল্য ও ত্রুটির মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানতে হবে এবং এ দুটোর কোনটা মুখ্য ও কোনটা গৌণ তা স্পষ্ট করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ সাফল্যের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ না শতকরা ৭০ ভাগ। কমিয়ে কিংবা বাড়িয়ে বললে চলবে না। ব্যক্তি : বিশেষের কাজের মৌলিক মল্যায়ন আমাদের অবশ্যই করতে হবে যে তার সাফল্য এবং ভুল শতকরা ৭০ ভাগ, না সাফল্য শতকরা ৭০ ভাগ এবং ভূল ৩০ ভাগ? যদি তার সাফল্যের পরিমাণ শতকরা ৭০ ভাগ হয় তা হলে তার কাজকে মৌলিকভাবে ইতিবাচক বলে স্বীকার করতে হবে। সাফল্য প্রধান কাজকে ভুল প্রধান কাজ বলা সম্পূর্ণরূপেই ভুল হবে। সমস্যা বিচার করতে গেলে এই দুইটি সীমারেখা টানতে অবশ্যই ভােলা উচিত নয়; বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের মধ্যকার সীমারেখা এবং সাফল্য ও ত্রুটির মধ্যকার সীমারেখা। যদি এই দুইটি সীমারেখাকে আমরা মনে রাখি তা হলে ভালভাবে কাজ করতে পারব, অন্যথায়, আমরা সমস্যার প্রকৃতিকে গুলিয়ে ফেলব। স্বভাবতই যদি এই সীমারেখা ভালভাবে আঁকতে হয়, তবে মনােযােগের সাথে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিটি বিষয়ের প্রতি আমাদের বিশ্লেষণ ও গবেষণার মনােভাব গ্রহণ করা উচিত।”
এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, “কোন লােককে অবিবেচিতভাবে সুবিধাবাদের লেবেল এঁটে দেওয়া অথবা তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানাের পদ্ধতি অবলম্বন করা ঠিক নয়।”
ফজলু-সুলতান চক্র মার্কসবাদী বিশ্লেষণের এ পদ্ধতি অবলম্বন না করে বিপ্লবী দিক প্রধান এরূপ কমরেডদেরও প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিহ্নিত করেছে।
পৃষ্ঠা: ২৮৩

ফজলু-সুলতান চক্র কি বিপ্লবী?
সভাপতি মাও বলেছেন, “সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবীদের জন্য কি কি গুণাবলী থাকা প্রয়ােজন।”
“তাদের এমন বিপ্লবী হতে হবে যারা মনে-প্রাণে (চীনের ও বিশ্বের বিপুল সংখ্যাধিক জনগণের সেবা করেন, কিন্তু ক্রুশ্চোভের মত নিজের দেশের ভেতরে মুষ্টিমেয় বুর্জোয়া শ্রেণীর বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত স্তরের সেবা করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীলদের স্বার্থের সেবা করা উচিত নয়।”
ফজলু-সুলতান চক্র জনগণের সেবার পরিবর্তে নিজেদের চক্রের, প্রেমিকার, পদের, ক্ষমতার সেবা করে শেষ পর্যন্ত চক্র গঠন করে, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, অর্থ-অস্ত্র চুরি করে, কর্মীদের প্রতারিত করে, খাঁটি বিপ্লবীদের গুপ্তহত্যার চক্রান্ত চালায়।
এভাবে সে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে দুর্বল ও ধ্বংস করার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালায়।
ইহা পূর্ব বাংলার এবং আন্তর্জাতিক শত্রু এবং বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের সবচাইতে ভালভাবে সেবা ছাড়া আর কি?
সভাপতি মাও বলেছেন, তাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার অনুসরণে আদর্শ হতে হবে, “জনসাধারণের থেকে আসা এবং জনসাধারণের মধ্যে যাওয়ার নেতৃত্বের পদ্ধতিকে অবশ্যই রপ্ত করতে হবে। কিন্তু ক্রুশ্চোভের মত গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে লংঘন করা, স্বেচ্ছাচারী হওয়া, কমরেডদের ওপর আকস্মিক হামলা চালানাে, যুক্তি না মানা অথবা ব্যক্তিবিশেষের স্বৈরতন্ত্র চালু করা চলবে না।”
ফজলু-সুলতান চক্র পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে সম্পূর্ণ পদদলিত করে নিজেদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়, স্বেচ্ছাচারিতা করে।
তারা কংগ্রেসে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার সভাপতিকে অমান্য করে, সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তকে অমান্য করে। এভাবে তারা গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে।
তারা পার্টির নিদের্শকে অমান্য করে। এভাবে তারা কেন্দ্রীকতাকে বিসর্জন দেয়।
তারা তাদের মতামত ও ইচ্ছাকে কার্যকরী করার জন্য সভায়, পার্টির নির্দিষ্ট স্তরে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিচালনার পরিবর্তে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, কোন দিন সমালােচনা না করে পদ থেকে নামিয়ে দেওয়ার কারণে হঠাৎ কমরেডদের হামলা করে, তাদের বিরুদ্ধে জঘন্যতম ব্যক্তিগত কুৎসা রটনা করে।
তাদের ইচ্ছা ছিল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে ব্যক্তিবিশেষের স্বৈরতন্ত্র চালু করা।
সভাপতি মাও বলেছেন, “ক্রুশ্চোভের মতাে মতলববাজ ও ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি অবশ্যই বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে, এ ধরনের খারাপ লােকদের পার্টির ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বকে কুক্ষিগত করতে বাধা দিতে হবে।”
ফজলু-সুলতান চক্র ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে দু’মুখাে হয়, মিথ্যা বলে, অভিনয় করে। এভাবে চরম মতলববাজ ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করে।
সভাপতি মাও বলেছেন, “তাদের অবশ্যই প্রকৃত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হতে হবে। কিন্তু ক্রুশ্চোভের মতাে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাইনবাের্ড ঝুলিয়ে সংশােধনবাদী হলে চলবে না।”
ফজলু-সুলতান চক্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাইনবাের্ড ঝুলিয়ে প্রকৃতপক্ষে সামন্ত বাদী, ক্ষুদে বুর্জোয়া ভ্রষ্ট রয়ে যায়। তাদের শ্রেণীই মার্কসবাদের আবরণে সংশােধনবাদ হিসেবে প্রকাশ পায়।
সভাপতি মাও বলেছেন, “একজন কমিউনিস্টের মুক্ত মন, বিশ্বস্ত ও সক্রিয় হতে হবে, বিপ্লবের স্বার্থকে নিজের প্রাণের চেয়েও উর্ধে স্থান দিতে হবে; তাকে সর্বদা এবং সর্বক্ষেত্রেই
পৃষ্ঠা: ২৮৪

সঠিক নীতিতে দৃঢ় থাকতে হবে এবং সমস্ত ভুল চিন্তাধারার ও আচরণের বিরুদ্ধে অক্লান্তভাবে সংগ্রাম করতে হবে, যাতে করে পার্টির যৌথ জীবন সুসংবদ্ধ এবং পার্টির ও জনগণের মধ্যকার সংযােগকে সুদৃঢ় করা যায়; ব্যক্তিবিশেষের চাইতে পার্টির ও জনসাধারণের সম্বন্ধে এবং নিজের চেয়ে অপরের সম্বন্ধে তাকে বেশী যত্নশীল হতে হবে। শুধু এমনি হলেই তাকে একজন কমিউনিস্ট বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।”
ফজলু-সুলতান চক্র মুক্তমন নয়, তারা তাদের মনের মধ্যকার খারাপ উদ্দেশ্য, চিন্তাধারা প্রকাশ করেনি।
তারা পার্টির বিশ্বস্ততা ভঙ্গ করে, অর্থ-অস্ত্র চুরি করে।
তারা ব্যক্তিগত প্রেম, চক্র গঠন ও পদের জন্য সক্রিয়তা দেখায়। কিন্তু পার্টি ও বিপ্লবের কাজে সক্রিয়তা দেখাবার পরিবর্তে পলায়ন করে।
বিপ্লবের স্বার্থকে নিজেদের প্রাণের চেয়েও উর্ধে স্থান দেওয়ার পরিবর্তে তারা প্রেমিকার স্বার্থ, যৌনস্বার্থ, পদের স্বার্থকে বিপ্লবের চেয়ে উর্ধে স্থান দেয়, নিজেদের জান বাঁচাবার জন্য, প্রেমিকার জন্য পলায়ন করে, সুবিধাবাদী হয়, পদের জন্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, শেষ পর্যন্ত উপদল গঠন করে নেতা সাজে।
সঠিক নীতি ও চিন্তাধারার পক্ষে দৃঢ় থাকার পরিবর্তে তারা নিজের ও অপরের সাথে উদারতাবাদী হয়।
ফজলু চক্র তারেকের ত্রুটি-বিচ্যুতি, সুলতানের ত্রুটি-বিচ্যুতি, ফজলু-সুলতান একে অপরের ত্রুটি-বিচ্যুতি ঢেকে রাখে। নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতি ঢেকে রাখে।
বিভিন্ন দলত্যাগী, সুবিধাবাদী, অসন্তুষ্ট উপাদানের সাথে সংযােগ করে তাদের নিয়ে উপদল গঠন করে, সুবিধাবাদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়।
তারা পার্টির যৌথ জীবনকে সুসংবদ্ধ এবং পার্টির ও জনগণের মধ্যকার সংযােগকে সুদৃঢ় করবার পরিবর্তে পার্টি-জীবনকে ভেঙ্গে ফেলা, পরস্পরকে সন্দেহ করা, পার্টি ও নেতৃত্বের প্রতি কর্মী ও জনগণের মাঝে অনাস্থা সৃষ্টির জন্য গুজব, অপবাদ, কুৎসা রটায়।
তারা তাদের প্রেমিকার প্রতি, নিজেদের নিরাপত্তা, পদের প্রতি বেশী যত্নশীল হয়। অন্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পরিবর্তে কমরেডদের (এমনকি মরণাপন্ন অসুস্থ কমরেডকেও) খতমের, ধরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে।
উপরােক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় ফজলু-সুলতান চক্র পুরােপুরি প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী।

ফজলু-সুলতান চক্র কি দেশপ্রেমিক?
ফজলু-সুলতান চক্র দেশপ্রেমিক হলে, জনগণ ও দেশের জন্য বিন্দুমাত্র ভালবাসা থাকলে একটি বিপ্লবী পার্টির সাচ্চা কমরেডদের হত্যা করা, ষড়যন্ত্র করা, অর্থ-অস্ত্র চুরি করা, পার্টি ও নেতৃত্বকে হেয় করার জন্য প্রতিবিপ্লবী কাজ করতাে না। তারা প্রতিবিপ্লবী প্রতিক্রিয়াশীল।
প্রতিবিপ্লবী, প্রতিক্রিয়াশীলরা যতই দেশপ্রেমের কথা বলুক না কেন প্রকৃতপক্ষে তারা দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক, জনগণের প্রতারক ও ঘাতক। তারা জনগণের সেবার নাম করে বিভ্রান্ত ও প্রতারণা, জনগণকে ভালবাসার নাম করে জনসাধারণের চরম ক্ষতি, দেশপ্রেমের নাম করে দেশদ্রোহিতা ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা, বিপ্লবের নাম করে প্রতিবিপ্লব ও দালালী (?)।
পৃষ্ঠা: ২৮৫

উপসংহার
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব এ সকল প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে আপােষ না করে, উদারতাবাদ না করে নীতিগত সংগ্রাম পরিচালনা করে নীতিতে দৃঢ় থাকেন।
ফজলু-সুলতান চক্র অনুতপ্ত ও নিজেদেরকে সংশােধনে ব্রতী না হয়ে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, শেষ পর্যন্ত পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়।
এ কারণে তারা নিজেদেরকে রক্ষা এবং কর্মী ও জনগণকে প্রতারিত করার জন্য বলে বেড়াচ্ছে তারা বিদ্রোহ করেছে।
তারা বিদ্রোহ করেছে ঠিকই। কিন্তু তাদের বিদ্রোহ হচ্ছে বিপ্লবী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে, বিপ্লবী পার্টির বিরুদ্ধে, পূর্ব বাংলার ও বিশ্বের বিপ্লবের বিরুদ্ধে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারার বিরুদ্ধে, পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবীদের বিদ্রোহ।
এ প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীদের বিদ্রোহ হচ্ছে তাদের কবরে যাওয়ার পদক্ষেপ, ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার অন্তিম যাত্রা।
অচিরেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা ও জনগণ তাদেরকে চূড়ান্তভাবে কবরস্ত করবেন এবং ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবেন।১

নােটঃ
ইতিমধ্যেই বিশ্বাসঘাতক ফজলু ও তার অপর এক সহযােগী প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা চালাতে থাকাকালীন অবস্থায় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির গেরিলাদের হাতে খতম হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ২৮৬

চক্রান্তকারীদের প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বকে বিরােধিতা করুন
(১৯৭২)
[ফজলু-সুলতান চক্র বিরােধী সংগ্রামের সময় চক্রান্তকারীদের প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বকে বিরােধিতা করুন’-এই শিরােনামে এ দলিলটি রচিত হয়েছিল -প্রকাশক।]

ফজলু-সুলতান চক্রের পার্টি, জনগণ ও বিপ্লব বিরােধী কার্যকলাপের ভিত্তি হিসেবে যে সকল প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব কাজ করছে তা হলােঃ কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে’, ‘যৌনকে কি অস্বীকার করা যায়?’, ‘আমি খুব জনপ্রিয়’, সমালােচনা সামনে করতে ভয় পাই’ ইত্যাদি। এগুলাে হলাে পুরােপুরি বুর্জোয়া তত্ত্ব যার সারবস্তু হলাে ব্যক্তিস্বার্থ।
আমাদের অবশ্যই এ সকল প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে।
কমিউনিস্ট মতাদর্শ জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। পক্ষান্তরে সকল শােষক। শ্রেণীর মতাদর্শ হলাে ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্র করে আবর্তিত। কমিউনিস্টদের কোন প্রকার ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না। তারা সম্পূর্ণরূপে জনগণের মুক্তির জন্য এবং পুরােপুরিই জনগণের স্বার্থের জন্য কাজ করে। জনগণের সেবাই ও জনগণের স্বার্থই তাদের সকল কাজের যাত্রাবিন্দু।
আমরা ক্ষুদে বুর্জোয়া, সামন্তবাদী ও বুর্জোয়া সমাজ থেকে আগত এবং এর দ্বারা ঘিরে আছি। স্বাভাবিকভাবেই আমরা বিভিন্ন আকৃতির ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে আসি ও প্রতিনিয়ত অর্জন করি।
কাজেই কমিউনিস্ট হওয়ার জন্য এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, একে প্রতিনিয়ত দূর করতে হবে, নিজেকে যাচাই করতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন বিচ্যুতি আমাদেরকে কলুষিত করবে। সভাপতি মাও বলেছেন, “ব্যক্তিস্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর, সংশােধনবাদকে বিরােধিতা কর।”
কোন প্রকার ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না-এরূপ হলাে আদর্শ কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টদের জন্য সর্বনিম্ন গুণ ব্যক্তিস্বার্থকে বিপ্লব ও জনগণের, পার্টির স্বার্থের অধীন করা।
কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে এ কথার অর্থ হলাে একে বজায় রাখা, একে পােষণ করা, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করা।
এর পরিণতি কি? এর পরিণতি হলাে পার্টি পদের জন্য লড়াই করা, কর্তা ব্যক্তি হওয়ার জন্য চক্রান্ত করা, উপদলীয় ষড়যন্ত্র করা, গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করা, শেষ পর্যন্ত পার্টির অর্থ-অস্ত্র চুরি করা, পার্টি, জনগণ ও বিপ্লব বিরােধী কাজ করা।
কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে এই ছিদ্র দিয়ে ফজলু-সুলতান চক্রের সকল ব্যক্তিস্বার্থ ঢুকে পড়েছে, ব্যক্তিস্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে, তারা প্রতিক্রিয়াশীলে রূপান্তরিত হয়েছে।
কাজেই কমিউনিস্টদের কোন ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না-এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল ব্যক্তিস্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করলে আমাদেরও পরিণতি হবে ফজলু-সুলতান চক্রের অনুরূপ।
পৃষ্ঠা: ২৮৭

ফজলু-সুলতান চক্র বলত যৌনকে কি অস্বীকার করা যায়? অর্থাৎ অপরিবর্তিত ক্ষুদে বুর্জোয়া মেয়ের সাথে প্রেমকে যৌন কারণে বাদ দেওয়া যায় না। যৌন কারণে তাকে বিয়ে করতে হবে। অর্থাৎ বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের ক্ষতি হবে জেনেও শুধু যৌন কারণে অপরিবর্তিত বুদ্ধিজীবী মেয়েদের বিয়ে করা, যৌনের কাছে আত্মসমর্পণ করা।
ইহা হলাে যৌন স্বার্থের নিকট বিপ্লব, জনগণ ও পার্টি স্বার্থকে অধীন করা।
ফজলু পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনে যােগদানের কিছুদিন পরে পাশ করলেই বিয়ে করা যাবে, এ কারণে সুবিধাবাদী হয়ে পরীক্ষা দেয়, ক্ষুদে বুর্জোয়াসুলভ পত্র লেখে, জেলে প্রেমিকার চিন্তায় বিভাের থাকে, জেল থেকে বেরিয়ে পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের সময় বিয়ের কাজ প্রাধান্য দেয়; ব্যক্তিস্বার্থে প্রেমিকাকে নিয়ে আসে, ফ্রন্টের দায়িত্ব ভুলে যেয়ে প্রেমিকার নিরাপত্তার জন্য নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে বাড়ীতে যায়, সেখানে প্রেমিকার জন্য ফ্রন্টের দায়িত্ব ভুলে থেকে যায়, অর্থ-অস্ত্র হারায়, পরে পার্টি তাকে কাজ দিলে সেখানে প্রেমিকার চিন্তায় কাজে অমনােযােগ প্রদর্শন করে, শেষ পর্যন্ত উক্ত দায়িত্ব থেকে অপসারণ চায়, প্রেমিকাকে আকাশ-কুসুম কল্পনা করে, শেষ পর্যন্ত প্রেমিকার চিন্তায় আত্মহত্যা করতে পদক্ষেপ নেয়, মানসিক বিকার জন্মায়, প্রেমিকার অভিযােগে পার্টির প্রতি অসন্তুষ্ট হয়।
সুলতান চক্র পার্টিতে যােগদানের পূর্বেকার ভ্রষ্ট জীবনের নারী সংক্রান্ত চরম স্বেচ্ছাচার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হওয়া, তা সংশােধন করা, অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে পার্টিতে এসেও নারীঘটিত দুর্ঘটনা ঘটায়, পার্টি তার বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে তাকে সতর্ক করে, এতে অনুতপ্ত না হয়ে একই ধরনের ঘটনা সে পুনরায় ঘটায়, ষড়যন্ত্র করে, মিথ্যা বলে, সুবিধাবাদীতে পরিণত হয়।
এভাবে ফজলু-সুলতান চক্র যৌনস্বার্থের নিকট বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে অধীন করে। এর পরিণতি কি?
এর পরিণতি হলাে সুলতান-ফজলুর চক্র গঠন, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চালানাে, পার্টির অর্থ চুরি, শেষ পর্যন্ত পার্টি, বিপ্লব, জনগণের স্বার্থের ক্ষতি করা।
প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের সারসংকলন ও সাধারণীকরণই হচ্ছে দর্শন। কাজেই সামাজিক ক্ষেত্রের প্রতিটি সংগ্রাম অনিবার্যভাবেই প্রতিফলিত হবে দর্শনের ক্ষেত্রে। কাজেই ফজলু-সুলতান চক্র সম্পর্কিত সংগ্রাম দর্শনের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে।
যৌনকে মার্কসবাদীরা অস্বীকার করে না, যেহেতু ইহা বস্তুগত বাস্তবতা, অর্থাৎ বস্তু নিজে নিজেই বিরাজ করছে।
কিন্তু বস্তুবাদী ও ভাববাদীদের পার্থক্য হলাে, বস্তুবাদীরা বস্তুকে স্বীকার করে, তার নিয়মবিধিকে আবিষ্কার করে তাকে রূপান্তরিত করে, আমাদের অধীনে নিয়ে আসে।
পক্ষান্তরে বস্তুকে ভাববাদীরা পুরােপুরি জানা ও তাকে আমাদের অধীনে আনা, তাকে বশে আনাকে অস্বীকার করে। তারা বলে বস্তু প্রকৃতির খেয়ালমত চলবে।
যৌন ক্ষেত্রে ইহা প্রয়ােগ করলে দাড়ায়, ভাববাদীরা বলে যৌনকে অস্বীকার করা যায়। আর বস্তুবাদীরা বলে যৌনকে অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু তার নিয়মবিধি জেনে তাকে আমাদের বশে, অধীনে আনা যায়।
অর্থাৎ বস্তু নিজে নিজেই বিরাজ করে, তাকে আমাদের জন্য বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায়।
কাজেই যৌনকে অস্বীকার (করা) যায় না; কিন্তু অবশ্যই তার নিয়মবিধি জেনে তাকে বিপ্লব, জনগণ ও পার্টির স্বার্থের অধীনে আনা উচিত।
কাজেই ফজলু-সুলতান চক্র ভাববাদী।
পৃষ্ঠা: ২৮৮

ফজলু বলত, আমি খুব জনপ্রিয়।
ফজলুর জনপ্রিয়তা হয়েছে পার্টির সঠিক রাজনীতি ও কর্মপদ্ধতি এবং তা প্রয়ােগের দ্বারা ও কমরেডদের আত্মত্যাগের ফলে।
এ জনপ্রিয়তা তার পরিবার-পরিজন, বা অন্য কোন কারণেই হয়নি। তার এ কথা ঐতিহাসিক বস্তুবাদ পরিপন্থী।
ইতিহাসের গতিধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কার্যকলাপই ‘বীর’ তৈরী করবে।
অর্থাৎ জনগণই হচ্ছে ইতিহাসের পরিচালক শক্তি। এ জনগণকে ইতিহাস পরিবর্তনে যারা নেতৃত্ব দেয় তারাই জনপ্রিয় হয়। পূর্ব বাংলার জনগণের ইতিহাস পরিবর্তনে সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব বর্তমানে সর্বহারা পার্টির ওপর ন্যস্ত। এই সর্বহারা পার্টি তার সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় সঠিক নেতা ও নেতৃত্ব গড়ে তুলবে যারা হবে জনপ্রিয়। কাজেই পার্টি এবং কমরেডদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোন ব্যক্তিবিশেষের জনপ্রিয়তার কোন অস্তিত্ব রয়েছে কি? এ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রচেষ্টা কোন উপকারে আসবে কি?
মােটেই আসবে না। এ কারণে সভাপতি মাও বলেছেন, “পার্টি ও জনগণের ওপর আস্থা রাখ, এ ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।”
কাজেই পার্টি, জনগণের বাইরে জনপ্রিয়তা থাকতেই পারে না। কাজেই ফজলু যে জনপ্রিয়তার কথা বলে তা হচ্ছে পার্টি, কমরেড ও জনগণের সংগ্রামের ফলশ্রুতি।
পার্টি, কমরেড ও জনগণের বাইরে তার কোন জনপ্রিয়তাই থাকবে না, থাকতে পারে না।
কাজেই যে জনপ্রিয়তার বড়াই করে ফজলু চক্র গঠনের সাহস করছে, পার্টির থেকে, এর সঠিক নীতি ও কর্মপদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সে জনপ্রিয়তা অচিরেই রূপান্তরিত হবে জনগণের ঘৃণায়, তার কার্যকলাপ হবে ডাকাত, ভাওতাবাজ, প্রতারকদের অনুরূপ।
কারণ, পার্টির সঠিক নীতি ও কর্মপদ্ধতির বাইরে দেশপ্রেমিকদের কাজ ব্যতীত অন্য সকল কাজই হবে ডাকাতি, ভাওতাবাজী, প্রতারণা।
ফজলু-সুলতান চক্র বলত, সমালােচনা করতে ভয় লাগে। তার প্রকৃত অর্থ হলাে তারা মুক্ত মনে অকপটে সকল মনের কথা প্রকাশ করতে ভয় পেত।
কারণ তাদের মধ্যকার ভুল চিন্তাধারা প্রকাশ হয়ে পড়বে, তা সমালােচিত হবে।
তারা আরাে মনে করতাে ভুল বক্তব্যের সমালােচনা হলে তাদের মান ক্ষয়ে যাবে, তাদের সম্পর্কে ধারণা খারাপ হয়ে যাবে। তারা উচ্চপদে থাকতে পারবে না।
তারা পদকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল। এ কারণেই অকপট, মুক্ত মনে সকল কথা বলতে পারেনি, সমালােচনার ভয়ে নয়।
তাদের এ সকল ভুল তত্ত্বের পরিণতি হলাে, কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে, এ কথা বলে তারা সকল ব্যক্তিস্বার্থকে বজায় রাখে। যৌনকে কি অস্বীকার করা যায়- এ কথা বলে যৌনের নিকট পার্টি, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে বিকিয়ে দেয়, আমি খুব জনপ্রিয়’-এ কথা বলে নিজেকে তারা কেউকেটা মনে করে, জনগণ ও পার্টির ওপর আস্থা হারায়। সমালােচনার ভয় করে বলে তারা কপট হয়, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে।
সকল বিষয়ের পরিণতি হিসেবে তারা চক্র গঠন করে, অর্থ চুরি করে, পার্টির কমরেডদেরকে গুপ্তহত্যার পরিকল্পনা করে, বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থের অধীন করে ফেলে এবং প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীতে রূপান্তরিত হয়।
পৃষ্ঠা: ২৮৯

চক্রবিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের সাথে
গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম যুক্ত করুন
(১৯৭২)
[ফজলু-সুলতান চক্রবিরােধী সংগ্রামের সময় পার্টির অভ্যন্তরে যে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হয় তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে মতাদর্শগত ক্ষেত্রে গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রামও যুক্ত করা হয়। পার্টির অভ্যন্তরে গােড়ামীবাদ বিরােধী এই সংগ্রামে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল -প্রকাশক।]

ভূমিকা
পূর্ব বাংলার সবৃহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে গােড়ামীবাদকে পার্টির প্রধান বিপদ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে চক্রবিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের সাথে গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির এ সিদ্ধান্ত ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ দূর করা এবং তাদেরকে মতাদর্শগতভাবে সর্বহারায় রূপান্তরিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনের সাথে সমন্বয় করা, পূর্ব বাংলার বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সমস্যাবলীর সমাধান প্রদান করা, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে সঠিক পথে পরিচালনা করা এবং বিপ্লবের বিজয় আনয়ন করার জন্য গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম একান্ত প্রয়ােজন। কাজেই পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির চক্রবিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের সাথে গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম যুক্ত করার সিদ্ধান্ত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এবং বিপ্লবের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পন্ন। এটা একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত।

মার্কসবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়া ও গােড়ামীবাদ
“মার্কসবাদী দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের দুটো স্পষ্টতম বৈশিষ্ট্য ও একটা হচ্ছে তার শ্রেণী প্রকৃতি, এটা প্রকাশ্যে ঘােষণা করে যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ সর্বহারা শ্রেণীর সেবা করে। অপরটা হচ্ছে এর বাস্তব প্রকৃতি, তত্ত্ব অনুশীলনের সেবা করে-এ সবের ওপরই গুরুত্ব আরােপ করে।”
এ থেকে পাওয়া যায় সকল তত্ত্বের ভিত্তি হচ্ছে অনুশীলন অর্থাৎ বস্তুর সাথে সংস্পর্শ। বস্তুর সাথে সংস্পর্শে গেলেই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, ত্বক, জিহ্বা) মাধ্যমে বস্তু মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। প্রথমে এটা হচ্ছে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান।
পৃষ্ঠা: ২৯০

ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের উৎস হচ্ছে বস্তু অর্থাৎ জ্ঞানের উৎস হচ্ছে বস্তু-এটা জ্ঞানের বস্তুবাদ।
এ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে সারসংকলন করে বস্তুর নিয়মবিধি বের করতে হবে, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে ধারণাত্মক জ্ঞানের স্তরে উন্নীত করতে হবে।
এটা জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা।
ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞানের পর্যায় পর্যন্ত হচ্ছে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার প্রথম স্তর।
মার্কসবাদের মতে গােটা জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় এ স্তর (ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞান পর্যন্ত যে স্তর) হচ্ছে কম গুরুত্বপূর্ণ স্তর।
“জ্ঞানের প্রক্রিয়া এখানেই (ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞান) শেষ নয়। যদি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়া ধারণাত্মক জ্ঞানের স্তরে থেমে থাকত তবে জ্ঞানের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হত। মার্কসবাদী দর্শনের মতে এটা কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
মার্কসবাদী দর্শনের মতে বাইরের বস্তুগত জগতের (সমাজের ও প্রকৃতির নিয়মবিধি বুঝা এবং তা বিশ্লেষন করতে পারাটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়; গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হচ্ছে বিশ্বকে পরিবর্তনে এ নিয়মবিধির জ্ঞানকে প্রয়ােগ করা।
মার্কস নিজেই বলেছেন, “দার্শনিকরা বিশ্বকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে একে পরিবর্তন করা।” জ্ঞানের সক্রিয় ভূমিকা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞানেই প্রকাশ পায় না, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটা অবশ্যই ধারণাত্মক জ্ঞান থেকে বিপ্লবী অনুশীলনে প্রকাশ পাবে।
বিশ্বের নিয়মবিধি যে জ্ঞান উপলব্ধি করেছে তা অবশ্যই বিশ্ব পরিবর্তনের অনুশীলনে প্রয়ােগ করতে হবে, অবশ্যই নতুনভাবে উৎপাদনের সংগ্রামে ও অনুশীলনে, বিপ্লবী শ্রেণী সংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রাম এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার অনুশীলনে প্রয়ােগ করতে হবে।
এ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় যে তত্ত্ব-প্লন-পরিকল্পনা অনুযায়ী বস্তুকে রূপান্তর করা যায় তা সঠিক। ঐ বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান তখন সম্পন্ন হয়।
এভাবে ধারণাত্মক জ্ঞান তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনার সঠিকতা যাচাই হয়।
বস্তুকে পরিবর্তন করতে যেয়ে যে সকল অসামঞ্জস্য দেখা দেয় তা পুনরায় সারসংকলন করে দূর করা, তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা রচনা করা, পুনরায় তা বস্তু পরিবর্তনে প্রয়ােগ করা।
এভাবে চলে সমাপ্তিহীন ঘূর্ণাবর্ত।
এভাবে অনুশীলন থেকে জ্ঞান, জ্ঞান থেকে অনুশীলন-এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নির্ভুল রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত লাইন গড়ে উঠবে।
এ সকলের একটিই উদ্দেশ্য-তা হচ্ছে পূর্ব বাংলার সমাজকে রূপান্তর করা, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম বাস্তবায়িত করা।
তত্ত্ব সৃষ্টি করার জন্য বিপ্লব করা হয় না; বিপ্লব করার জন্য, বিশ্বকে রূপান্তরিত করার জন্য নিয়মবিধি বের করা হয়, তত্ত্ব সৃষ্টি হয়।
গােড়ামীবাদীরা জ্ঞানের এ প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে। তত্ত্ব থেকে শুরু করে তত্ত্বেই রয়ে যায়।
পৃষ্ঠা: ২৯২

এভাবে তারা তত্ত্বের উৎস বস্তু অর্থাৎ জ্ঞানের বস্তুবাদ এবং অনুশীলনকে তত্ত্বের পর্যায়ে উন্নীত করা ও তত্ত্বকে অনুশীলনে প্রয়ােগ করা অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতাকে অস্বীকার করে।
গােড়ামীবাদীরা বস্তুকে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করে না, ফলে বস্তুর বিশেষত্বকেও তারা বুঝে না, অর্থাৎ, অন্যান্য বস্তুর সাথে এর সামঞ্জস্য, বিশেষ করে পার্থক্য যা বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞানের ভিত্তি, তা তারা অধ্যয়ন করে না।
অর্থাৎ, বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ অর্থাৎ মার্কসবাদের আত্মাকে তারা বাদ দেয়।
এভাবে তারা লেনিনের বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণের নিয়মকে লংঘন করে। তারা কখনােও তাদের মস্তিষ্ককে ব্যবহার করে না। এর পরিবর্তে তারা সারবস্তুহীন বাঁধাধরা গৎ ব্যবহার করে।
বস্তুর বিশেষত্ব না বুঝার ফলে গােড়ামীবাদীরা বুঝে না বিভিন্ন বিপ্লবে পরিস্থিতি ভিন্ন। হয়, ফলে দ্বন্দ্ব মীমাংসার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। উপরন্তু তারা একটা ফর্মুলা কল্পনা করে এবং এলােপাথাড়ী তা প্রয়ােগ করে। ফলে বিপ্লবে বিপর্যয় আসে এবং যা ভালভাবে সম্পন্ন করা যেত তা হ-য-ব-র-ল হয়ে যায়।
গােড়ামীবাদীরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে, আধিবিদ্যক ভাববাদী হয়। ফলে তারা পার্টির রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক লাইনে বিচ্যুতি ঘটায়, পার্টি ও বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে।
সভাপতি মাও বলেছেন, “ভাববাদ এবং যান্ত্রিক বস্তুবাদ, সুবিধাবাদ ও হঠকারিতাবাদ সব হচ্ছে আত্মগতের সাথে বস্তুগতের অসামঞ্জস্যতা, অনুশীলন থেকে জ্ঞানের বিচ্ছিন্নতার ফল।”
গােড়ামীবাদীরা বস্তুকে মস্কিষ্কে প্রতিফলিত করে না, তাই তাদের চেতনা (আত্মগত) বস্তুর (বস্তুগত) সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না, ফলে তারা বস্তু রূপান্তরের জন্য যে সমাধান দেয় তা বস্তুর নিয়মবিধির উপযােগী হয় না। ফলে তারা বামপন্থী হঠকারিতাবাদী (বস্তুর গতির চাইতে এগিয়ে থাকা) বা দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী (বস্তুর গতির পশ্চাতে থাকা) হিসেবে প্রকাশ পায়।
এ কারণে গােড়ামীবাদীরা হঠকারিতা-হতাশাবাদ, দক্ষিণপন্থী-সুবিধাবাদ প্রদর্শন করতে পারে, এমন কি শক্রর চরে রূপান্তরিত হতে পারে।
চীনা বিপ্লবে গােড়ামীবাদীরা তিনবার পার্টির নেতৃত্ব দখল করে এবং বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায়। এদের কেউ কেউ হতাশাবাদী এবং দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী হয়ে যায়; শেষ পর্যন্ত শক্রর চরে পরিণত হয়।
পূর্ব বাংলার হক-তােয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন পূর্ব বাংলার সামাজিক অবস্থা মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে, এর নিয়মবিধি বের না করে ভারতীয় সমাজের জন্য প্রণীত রণনীতি ও রণকৌশল অনুসরণ করে, বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায়, শেষ পর্যন্ত পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের দালালী করে।
এদের কেউ কেউ বর্তমানে বাংলাদেশ পতল সরকারের দালালী করছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মধ্যকার গােড়ামীবাদী কমরেডরা পার্টির ধারণাত্মক জ্ঞানকে-তত্ত্বকে অনুশীলনে প্রয়ােগ করেন না, বৈদেশিক অভিজ্ঞতা আমাদের পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা চিন্তা না করেই গ্রহণ করেন এবং অন্ধভাবে তা আমাদের সমস্যার ওপর চাপিয়ে দিতে চান।
পৃষ্ঠা: ২৯৩

গােড়ামীবাদ ও মার্কসবাদী তত্ত্ব
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন কর্তক অনুশীলনের ভিত্তিতে ঐতিহাসিক এবং বিপ্লবী বাস্তবতা থেকে টানা সাধারণ উপসংহার।
তারা সকলেই একে প্রাণহীন মন্ত্র বলে গ্রহণ করতে বার বার নিষেধ করেছেন।
সভাপতি মাও বলেছেন, “আমাদের কমরেডরা মার্কসবাদী তত্ত্বকে প্রাণহীন মন্ত্র বলে গ্রহণ করবে না। মার্কসবাদী তত্ত্বকে রপ্ত করা এবং প্রয়ােগ করা প্রয়ােজন, একমাত্র প্রয়ােগের উদ্দেশ্যেই রপ্ত করা।”
তিনি প্রয়ােগের উপর কতখানি গুরুত্ব দিয়েছেন তা বুঝা যায় নিম্ন বক্তব্য থেকে, “যদি আপনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিকোণ প্রয়ােগ করে একটি বা দু’টি বাস্তব সমস্যাকে ব্যাখ্যা করতে পারেন তাহলে আপনি প্রশংসার যােগ্য এবং আপনি কিছুটা সাফল্য অর্জন করেছেন বলে মনে করা যায়। যত বেশী ব্যাপক ও গভীরভাবে আপনি তা করেন, আপনার সাফল্য ততই বৃহত্তর হবে।”
কাজেই প্রয়ােগ বিবর্জিত তত্ত্বগত কচকচানি গােড়ামীবাদী বিচ্যুতির জন্ম দেবে। এটা পরিহার করে তত্ত্বকে সমস্যা-সমাধানে সৃজনশীল ভাবে প্রয়ােগ করতে হবে। সমস্যার ভিত্তিতে তত্ত্বগত আলােচনা ও অধ্যয়ন করতে হবে।
প্রয়ােগ বিবর্জিত তত্ত্ব সম্পর্কে সভাপতি মাও বলেছেন, “উদ্দেশ্যহীন তত্ত্ব কোন কাজে আসে না এবং তা মিথ্যা, তা পরিহার করা প্রয়ােজন। যারা উদ্দেশ্যহীন তত্ত্ব আওড়াতে পছন্দ করে তাদের প্রতি আমরা অবজ্ঞা ভরে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাব।”
তিনি আরাে বলেছেন, “বর্তমানেও কম লােক নেই যারা মনে করে মার্কসবাদীলেনিনবাদী লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি আয়ত্ব করলেই সর্বরােগের মহৌষধ হবে এবং সব অসুবিধা দূর হবে। এ সকল লােক শিশুসূলভ অজ্ঞতা দেখায় আমাদের উচিত তাদেরকে শিক্ষিত করে তােলা। এ সকল অজ্ঞ লােকই মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে ধর্মীয় মন্ত্র হিসেবে নেয়। আমরা তাদের মুখের ওপর বলব তােমাদের মন্ত্র হচ্ছে অপদার্থ।”
মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন বারবার বলেছেন, “মার্কসবাদী তত্ত্ব মন্ত্র নয়, অনুশীলনের পথ প্রদর্শক।”
মার্কসবাদী-লেনিনবাদী তত্ত্বকে কিভাবে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী অনুশীলনের সাথে সমন্বিত করতে হবে? সাধারণ ভাষায় বলা যায়, “নিশানার প্রতি শর নিক্ষেপ।” শর হচ্ছে তীর, নিশানা হচ্ছে লক্ষ্য। লক্ষ্যের প্রতি তীর নিক্ষেপ করতে হবে। নিশানার সাথে তীরের যে সম্পর্ক মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাথে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের একই সম্পর্ক।
কেউ কেউ লক্ষ্যহীনভাবে তীর ছোঁড়েন, এলােপাথাড়ী তীর ছোঁড়েন। এ ধরনের লােক বিপ্লবের ক্ষতিসাধন করতে পারেন।
কেউ কেউ তীরের গায়ে হাত বুলিয়ে বলতে ভালবাসেন, “কত সুন্দর তীর।” কিন্তু কখনাে তা প্রয়ােগ করতে ইচ্ছুক নন।
সমস্যাবলী সমাধানের জন্য যারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রয়ােগ না করে এলােপাথাড়ী, উদ্দেশ্যহীনভাবে মার্কসবাদর কথা বলেন তারা হচ্ছেন গােড়ামীবাদী। পাণ্ডিত্য জাহির করাই তাদের উদ্দেশ্য। আদৌ প্রয়ােগ না করে তত্ত্বের প্রশংসা করেন, চায়ের টেবিলে, ড্রয়িং রুমে তত্ত্ব ঝেড়ে মস্ত পাণ্ডিত্য দেখান, কাজ দূরের কথা সামান্য। সাহায্যও অনেক সময় করেন না। এরূপ বহু ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী পূর্ব বাংলায় রয়েছে।
এদের উভয়েরই বিপ্লবের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।
পৃষ্ঠা: ২৯৪

আমাদের পার্টিতে অনেক কমরেডই পার্টির রাজনৈতিক-সামরিক ও অন্যান্য লাইন সঠিক বলে আনন্দ পান, বারবার বলে বেড়ান, এ নিয়ে তর্ক করেন; কিন্তু এগুলাে প্রয়ােগ করে কাজ বাড়ান না, পার্টি-বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যান না।
পার্টির লাইন যত সঠিকই হােক না কেন তা প্রয়ােগ না করলে পার্টি ও বিপ্লবের কোন সমস্যার সমাধান হবে না।
কাজেই এ সকল কমরেডদের মনােভাব পাল্টাতে হবে, পার্টির লাইন প্রয়ােগ করতে লেগে থাকতে হবে শেষ পর্যন্ত।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের সাথে সমন্বিত করার অর্থ কি?
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি দ্বারা ইতিহাস ও বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত বাস্তব সমস্যাবলীর সঠিক বিশ্লেষণ প্রদান করা এবং পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক এবং অন্যান্য সমস্যাবলীর বৈজ্ঞানিক ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ প্রদান করা এবং সে অনুযায়ী পূর্ব বাংলাকে রূপান্তরিত করা।
এ ধরনের তত্ত্ববিদ হতে হলে একজনকে অবশ্যই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সারবস্তুকে রপ্ত করতে হবে, মার্কসবাদী অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি, পদ্ধতি এবং ঔপনিবেশিক-আধা ঔপনিবেশিক দেশ সম্পর্কে লেনিন-স্ট্যালিন-মাওসেতুঙের তত্ত্ব রপ্ত করতে হবে, তাকে সক্ষম হতে হবে সূক্ষ্মভাবে এবং বৈজ্ঞানিকভাবে পূর্ব বাংলার বাস্তব সমস্যাবলীর সমাধান করতে, এর নিয়মবিধি আবিষ্কার করতে এবং তা প্রয়ােগ করতে।
কেবলমাত্র পূর্ব বাংলার সমাজ পরিবর্তনের অনুশীলনে যুক্ত থাকলেই এটা সম্ভব।
কারণ পৃথিবীতে একটাই সত্যিকার তত্ত্ব রয়েছে যা বস্তুগত বাস্তবতা থেকে এসেছে এবং বস্তুগত বাস্তবতায় পরীক্ষিত। এ ছাড়া আর কিছুই তত্ত্ব নাম পাওয়ার যােগ্য নয়। অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার সমাজের বাস্তবতা এ সকল তত্ত্বে প্রতিফলিত হতে হবে এবং পূর্ব বাংলার সমাজ পরিবর্তনে প্রয়ােগের মাধ্যমে তা পরীক্ষিত হতে হবে। কাজেই পূর্ব বাংলার সামাজিক বিপ্লবের সমস্যাবলীর তত্ত্বগত সমাধান সম্ভব, পূর্ব বাংলার সমাজের বাস্তব অবস্থা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে অধ্যয়ন ও পর্যালােচনা করা, তার নিয়মবিধি বের করা এবং এ নিয়মবিধি অনুযায়ী পূর্ব বাংলার সমাজ পরিবর্তন করে তা যাচাই করার মাধ্যমে।
অনুশীলনের পরীক্ষায় সঠিক বলে প্রমাণিত অর্থাৎ, যে তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা পূর্ব বাংলার সমাজের নিয়মবিধির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা সঠিক।
কেবলমাত্র এ তত্ত্বই তখন পুরােপুরি তত্ত্বের পর্যায়ে পড়ে।
গােড়ামীবাদীরা মার্কসবাদের প্রয়ােগের গুরুত্বকে অস্বীকার করে, কতকগুলাে মার্কসবাদী তত্ত্ব মুখস্ত করে নিজেদেরকে মস্ত পণ্ডিত ঠাওরায়, লেজ ফুলিয়ে আকাশে তােলে।

গােড়ামীবাদ ও বৈদেশিক পার্টির অভিজ্ঞতা
গােড়ামীবাদীরা আমাদের দেশের সমস্যা পর্যালােচনা করে তার ভিত্তিতে রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ না করে অন্য পার্টির রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করে, আমাদের দেশের ওপর তা অন্ধভাবে চাপিয়ে দেয়, আমাদের দেশের সমস্যা সে অনুযায়ী সমাধান করতে চায়।
পৃষ্ঠা: ২৯৫

এভাবে তারা বস্তুকে তার বিশেষত্বসহ মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করে না, মার্কসবাদের আত্মা ‘বিশেষ অবস্থার বিশেষ বিশ্লেষণ’কে বাদ দেয়; বৈদেশিক পার্টির রণনীতিরণকৌশল অর্থাৎ তাদের দেশের জন্য রচিত তত্ত্ব-চেতনা অনুযায়ী আমাদের দেশ-বস্তুকে দেখে।
এভাবে তারা আমাদের দেশ সম্পর্কিত নয় এরূপ চেতনাকে দেয় প্রাথমিক স্থান, আমাদের দেশ বস্তুকে দেয় গৌণ স্থান।
এ কারণে গােড়ামীবাদীরা ভাববাদী।
হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার সকলেই এককালে সাম্রাজ্যবাদসামন্তবাদ-আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে এক ও অবিচ্ছিন্ন বলেছে এবং এই তিনটাকেই প্রধান শত্রু বলেছে।
(বর্তমানে হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন ভারত-সােভিয়েটকে যুক্তভাবে প্রধান শত্রু বলছে।
এভাবে তারা প্রধান শত্রু এবং প্রধান দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করছে।
পরবর্তীকালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-এর বক্তব্য অনুযায়ী তারা সামন্তবাদকে প্রধান শত্রু বলে এবং ভারতীয় সামাজিক অবস্থার জন্য প্রণীত রণনীতি ও রণকৌশল গ্রহণ করে।
ভারতীয় সমাজের বিশেষ অবস্থার জন্য প্রণীত রণনীতি ও রণকৌশল পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে হুবহু প্রয়ােগের অর্থ হচ্ছে পূর্ব বাংলার বিশেষত্বকে অস্বীকার করা।
অর্থাৎ জুতাের মাপে পা কাটা, গােলাকার ছিদ্র পথে চারকোণা কাঠ ঢুকানাে।
এর ফলে উপরােক্ত নয়া সংশােধনবাদীরা পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের সমস্যাবলীর সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়, এবং বুর্জোয়ারা পূর্ব বাংলায় প্রতিবিপ্লব ঘটাতে সমর্থ হয়।
হক-ততায়াহা, মতিন-আলাউদ্দিনরা গােড়ামীবাদী হতে হতে এরূপ অবস্থায় পৌঁছেছে যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাথে ভারতীয় পার্টির নেতার শিক্ষাকে পার্টির তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে।
তারা পূর্ব বাংলার সমস্যাবলীর বিশ্লেষণ দেওয়ার পরিবর্তে ভারতীয় পার্টির নেতা এবং রেডিও পিকিং-এর উদ্ধৃতি বিকৃত করে তা থেকে শুরু করে।
এভাবে তারা আমাদের সমস্যা-পরিস্থিতির বিশ্লেষণ থেকে উপসংহার টেনে তা ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টির উপসংহারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই করার পরিবর্তে ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টির উপসংহার থেকে শুরু করে (অর্থাৎ সংজ্ঞা থেকে শুরু করে)।
বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ লাইনে এদের সম্পর্কে বলা হয়েছে ?
“গােড়ামীবাদী ভুল হবে যদি কেউ যান্ত্রিকভাবে অন্য কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কৌশল অনুসরণ করে, অন্যের ইচ্ছার নিকট আত্মসমর্পণ করে, অথবা অন্য কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচী ও সিদ্ধান্তসমূহ কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই নিজের বলে গ্রহণ করে।”
হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন প্রভৃতি সকলেই ভারতীয় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নীতি ও কৌশল যান্ত্রিকভাবে অনুকরণ করছে, কোন প্রকার বিশ্লেষণ ছাড়াই তারা নিজের বলে গ্রহণ করেছে।
এভাবে তারা গােড়ামীবাদী ভুল করে পূর্ব বাংলার বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি করেছে।
এদের সম্পর্কে আরাে বলা হয়েছে, “…… এমন একটা পার্টি যা অন্যের কথা তােতা পাখির মতাে আওড়ায়, কোন বিশ্লেষণ ব্যতিরেকেই বিদেশী অভিজ্ঞতা অনুকরণ করে, বিদেশের
পৃষ্ঠা: ২৯৬

কোন ব্যক্তির বেটনের নির্দেশে এখানে-সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে, তা হলে সে পার্টি মার্কসবাদীলেনিনবাদী পার্টির পরিবর্তে সংশােধনবাদ ও গােড়ামীবাদের হ-য-ব-র-ল-তে পরিণত হয়।”
কাজেই হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, মনিসিং-মােজাফ্ফর (যারা প্রায়ই মস্কো-ভারত দৌড়াদৌড়ি করে নির্দেশ আনতে), কাজী-রণাে-অমল, দেবেন-বাসার (জ্যোতিবসুর নির্দেশ নেয়) এভাবে সংশােধনবাদী ও গােড়ামীবাদী হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসের রিপাের্ট (ক্রুশ্চোভ কর্তৃক সংশােধনবাদ এ রিপাের্টে প্রথম প্রণীত হয়) বিশ্লেষণ ছাড়াই গ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী কাজ করে।
তারা তাদের ভুল সংশােধনের পূর্বেই প্রতিক্রিয়াশীলদের হামলার মুখে পড়ে, কয়েক লক্ষ কমরেড প্রাণ হারায়, ইন্দোনেশীয় বিপ্লব ও পার্টির মারাত্মক ক্ষতি হয়।
পূর্ব ইউরােপের প্রায় সকল দেশের কমিউনস্ট পার্টি সােভিয়েট আধুনিক সংশােধনবাদীদের লাইন অন্ধভাবে গ্রহণ করে। ফলে সে সকল কমিউনিস্ট পার্টি সংশােধনবাদী হয়ে যায়, ঐ সকল দেশসমূহ সােভিয়েটের উপনিবেশ বা তার উপর নির্ভরশীল দেশে পরিণত হয়।
এনভার হােজার নেতৃত্বে আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্লেষণ করে ক্রুশ্চোভএর আধুনিক সংশােধনবাদী লাইন প্রত্যাখ্যান করে, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ফলে আলবেনিয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিরাজ করছে।
বার্মার কমিউনিস্ট পার্টি ক্রুশ্চোভের লাইন এমন কি লিউ শাওচির পরামর্শ বিশ্লেষণ করে প্রত্যাখ্যান করে, ফলে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবী রয়ে গেছে এবং বিপ্লব পরিচালনা করছে। আলবেনিয়ার এনভার হােজা, বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড থাকিন-থান-তুনের মহান বিপ্লবী ভূমিকার জন্য সভাপতি মাও তাদেরকে মহান মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বলে অভিনন্দিত করেছেন।১
সভাপতি মাও-এর নেতৃত্বে মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্রুশ্চোভের আধুনিক সংশােধনবাদী লাইন বিশ্লেষণ করে প্রত্যাখ্যান করে এবং এর বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বহারাদের সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে।
ফলে মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবী রয়ে গেছে এবং চীন সমাজতান্ত্রিক হিসেবে বিরাজ করছে।
কাজেই গােড়ামীবাদী হয়ে বৈদেশিক পার্টিকে অন্ধ অনুকরণ করা, বিদেশের পার্টির কর্মসূচী ও প্রস্তাব বিশ্লেষণ ছাড়াই অন্ধভাবে গ্রহণ করার অর্থ হচ্ছে সুবিধাবাদ ও সংশােধনবাদী হওয়া এবং পার্টি ও বিপ্লবের চরম ক্ষতি সাধন করা।
আমরা এ সকল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব, নিজের জন্য মাথা খাটিয়ে ভাবতে সক্ষম হব, দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ দ্বারা পূর্ব বাংলার সমাজের বিশ্লেষণ করব, গভীর অনুসন্ধান ও পর্যালােচনা চালিয়ে বিভিন্ন শ্রেণীর গতিধারা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করব, পূর্ব বাংলার সমাজের বিকাশের নিয়মাবলী আবিষ্কার করব, এর ভিত্তিতে, রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন করব, এভাবে সক্ষম হব মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্যকে পূর্ব বাংলায় বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে সমন্বয় সাধন করতে।
…………………………………………………………………….
‘৭৬ সালে মাও-মৃত্যুর পরবর্তীতে নতুন মতাদর্শগত মহাবিতর্কে হােসার নেতৃত্বে আলবেনীয় পার্টি এই ইতিবাচক অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়, মাওবাদের উপর আক্রমণ করে ও সংশােধনবাদে অধঃপতিত হয় -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ২৯৭

সভাপতি মাও বলেছেন, এটা সর্বদাই প্রয়ােজন বাস্তবতা থেকে শুরু করা। জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযােগ রক্ষা করা, প্রতিনিয়ত গণসংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা, এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন করা এবং তা প্রয়ােগ করা।
আমরা সর্বদা এ নীতিতে দৃঢ় থাকব।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি সর্বদাই স্বাধীনভাবে পূর্ব বাংলার সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণ করেছে, রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন করেছে, বৈদেশিক অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতির জন্য যা প্রয়ােজন তা গ্রহণ করেছে, অন্ধ অনুকরণ পরিহার করেছে।
এ কারণেই পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টি পূর্ব বাংলার সামাজিক বিকাশের নিয়মাবলী সঠিকভাবে নির্দেশ করতে সক্ষম হয়েছে, সঠিক রণনীতি ও রণকৌশল প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে, শ্রমিক আন্দোলন ও পার্টি অব্যাহতভাবে বিকাশ লাভ করেছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সকল কর্মী এ ঐতিহ্যকে বজায় রাখবেন, গােড়ামীবাদকে পরিহার করবেন।

গােড়ামীবাদ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ
সভাপতি মাও বলেছেন, “গােড়ামীবাদ এবং সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ হচ্ছে আত্মগতভাব (বস্তুকে যথাযথভাবে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে বস্তু সম্পর্কে মনগড়া ধারণা করা)। উভয়েই বিপরীত দিক থেকে উদ্ভূত।”
“সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ গােড়ামীবাদ থেকে পৃথক হলাে এটা পুস্তক থেকে শুরু না করে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে।”
সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান রয়েছে, অর্থাৎ তারা বস্তুর সংস্পর্শে রয়েছে, অনুশীলনে রয়েছে। তারা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে সারসংকলন করে ধারণাত্মক জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করে না, বস্তুর নিয়মবিধি বের করে না। সে অনুযায়ী বস্তুকে রূপান্তরিত করে না।
এভাবে তারা জ্ঞানকে প্রতিনিয়ত উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করে না। এ সকল কারণে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদের জ্ঞান একতরফা।
তারা তাদের একতরফা সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। তাকে মন্ত্র হিসেবে নেয়। তারা বিপ্লবী তত্ত্ব ব্যতীত বিপ্লব হয় না’- এ সত্যকে অস্বীকার করে; ফলে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অধ্যয়নকে গুরুত্বহীন মনে করে। তারা সারবস্তুহীন আনুষ্ঠানিকতা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা দ্বারা পূর্ণ থাকে, এটা তাদের কোন উপকারই করে না। এরূপ অবস্থায় তারা যদি ওপরে থেকে নির্দেশ দেয়, আধা অন্ধ থেকে নিজেদের বীর এবং নেতা মনে করে তবে বুঝতে হবে তারা প্রকৃতই সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী হয়েছে।
এভাবে গােড়ামীবাদী ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীরা বিপরীত দিক থেকে (একজন তত্ত্ব অপরজন অভিজ্ঞতা) শুরু করলেও চিন্তার ক্ষেত্রে তারা মূলতঃ এক। উভয়ই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সার্বজনীন সত্য এবং নিজ দেশের বিশেষ অনুশীলন এ দুটোকে পৃথক করে ফেলে, উভয়েই দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে লংঘন করে, আংশিক ও আপেক্ষিক সত্যকে সার্বজনীন সত্য বলে, এদের কারােরই চিন্তা বস্তুর সাথে। সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
পৃষ্ঠা: ২৯৮

সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীদের সীমাবদ্ধ ও সংকীর্ণ অভিজ্ঞতা থাকার কারণে সাধারণ প্রকৃতির সমস্যা সম্পর্কে তাদের স্বাধীন, স্পষ্ট ধারণা থাকে না। ফলে তারা গােড়ামীবাদের লেজুড়বৃত্তি করে।
“চীনা পার্টির ইতিহাস প্রমাণ করে গােড়ামীবাদীরা তাদের বিষ সমগ্র পার্টিতে ছড়াতে পারত না যদি সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদীরা তাদের সহযােগী না হত।”
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে ফজলু-সুলতান চক্র করতে সক্ষম হত না যদি প্রতারিত সাধারণ কমরেডরা সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী না হতেন।
হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার, এমন কি মনিসিং-মােজাফ্ফরদের সাধারণ কর্মীরা যদি সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদী না হতেন তবে তাদেরকে প্রতারণা করা সম্ভব হত না।
এ সকল গােড়ামীবাদ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রধান বিপদ।
কাজেই গােড়ামীবাদ পরিহার করার প্রাক্কালে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদকে বিরােধিতা করতে হবে। গােড়ামীবাদ পরিহার হলে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ মার্কসবাদের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

উপসংহার
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অধিকাংশ কর্মী ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী শ্রেণী উদ্ভূত। এরা পাঠ্যপুস্তক মুখস্ত করে পরীক্ষা পাশের অভ্যাস নিয়ে এসেছে। কোন দিন এ সকল বিদ্যা প্রয়ােগের প্রয়ােজন তাদের হয়নি।
পুরােনাে অভ্যাসমত মার্কসবাদী তত্ত্ব মুখস্ত করে এবং বুলি আওড়াতে পছন্দ করে। তারা পার্টির দলিলের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি ব্যবহার করে। একইভাবে তারা বিদেশের অভিজ্ঞতাও অন্ধভাবে পাঠ ও গ্রহণ করে।
এ উদ্দেশ্যে সকল ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী শ্রেণী উদ্ধৃত কমরেডদেরকে বুলি মুখস্ত করা, যত্রতত্র তা আওড়ানাের বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করে তত্ত্বকে প্রয়ােগ করতে এবং সমস্যা নিয়ে তত্ত্ব পড়তে উৎসাহিত করতে হবে।
বুর্জোয়া সমাজের প্রয়ােগ বিবর্জিত বােকা বানাবার শিক্ষা পদ্ধতির বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে। অনুশীলনের সাথে যুক্ত না করে তত্ত্ব পড়া। এটা বিপ্লবী তত্ত্ব অধ্যয়নে প্রয়ােগ করলে তার অনিবার্য পরিণতি গােড়ামীবাদ।
সভাপতি মাও বলেছেন, “বাস্তব উৎপাদনের পদ্ধতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের শুধু বইয়ের জ্ঞান রয়েছে কিন্তু ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অভাব রয়েছে এবং এ কারণে তাদের চিন্তার পদ্ধতি গােড়ামীবাদরূপে প্রকাশ পায়।”
কাজেই গােড়ামীবাদ ক্ষুদে বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের একটি অন্যতম মতাদর্শগত বহিঃপ্রকাশ। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে এটা প্রধান বিপদ।
কাজেই পার্টির বুদ্ধিজীবী শ্রেণী উদ্ভূত কর্মীদের গােড়ামীবাদ সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং একে পরিহার করতে হবে। পার্টির নির্দেশ, দলিল, অভিজ্ঞতা, লাইন নিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করা, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার বদঅভ্যাস পরিহার করে প্রতিনিয়ত তা প্রয়ােগ করতে হবে।
যাদের তত্ত্বগত জ্ঞান রয়েছে তাদেরকে অনুশীলনে নিয়ে যেতে হবে।
পৃষ্ঠা: ২৯৯

মার্কসবাদ এবং সংগঠনের লাইনের প্রয়ােগের দক্ষতার ওপর কর্মী মূল্যায়ন করতে হবে।
সকল স্তরের নেতৃত্বে গােড়ামীবাদের অনুপ্রবেশ রােধ করতে হবে।
বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বে অনুশীলন বিচ্ছিন্ন তত্ত্বগত জ্ঞান সম্পন্ন কমরেডদের প্রাধান্য ঠেকাতে হবে, তত্ত্ব ও অনুশীলনের সমন্বয় সাধনে সক্ষম কমরেডদের প্রাধান্য দিতে হবে।
অভিজ্ঞতা রয়েছে এরূপ কমরেডদেরকে তত্ত্বগত পড়াশুনা করার ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা তাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে সর্বদা সারসংকলন করতে পারেন, ধারণাত্মক জ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেন।
এভাবে প্রতিনিয়ত তারা যাতে জ্ঞানকে, তাদের কাজকে উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন।
পার্টির রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইনের সঠিকতার মতাদর্শগত ভিত্তি রয়েছে। এটা নির্ভর করছে বিভিন্ন লাইন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দ্বান্দ্বিক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লব ও জনগণের প্রয়ােজন থেকে শুরু হয়েছে কিনা।
কাজেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে পূর্ব। বাংলার সমস্যাবলী অধ্যয়ন ও তার সমাধান হিসেবে সঠিক লাইন প্রণয়ন করা এবং তা প্রয়ােগ করে সমাজকে রূপান্তরিত করা। কাজেই বিপ্লব, জনগণ ও পার্টির স্বার্থে আমাদেরকে তত্ত্বের সাথে অনুশীলনের সংযােগ এবং অনুশীলনের সাথে তত্ত্বের সংযােগ করতে হবে, গােড়ামীবাদ পরিহার করতে হবে, একই সাথে সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদকে ঠেকাতে হবে। তত্ত্ব অনুশীলনের সমন্বয়ের মার্কসবাদী প্রাণবন্ত রীতি রপ্ত করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৩০০

বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা
(১৯৭২)
[‘৭২ সালে পার্টির অভ্যন্তরে ফজলু-সুলতান তাদের প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থে পার্টির ক্ষমতা দখলের জন্য চক্র গঠন করে। তারা তাদের এ চক্রান্তের পথে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বকে সবচাইতে বড় বাধা হিসেবে নির্ধারণ করে। বাস্তবক্ষেত্রে কমরেড সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার প্রচেষ্টার পাশাপাশি তত্ত্বগতভাবেও তাঁর নেতৃত্বকে উৎখাত করার জন্য তারা সংগ্রাম চালায়। এই সময়ে পার্টি ও বিপ্লবে নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করে এ দলিলটি রচিত হয়েছিল। দলিলটি জুলাই, ‘৭২-এ প্রকাশিত ‘লালঝাণ্ডা’ ৩নং সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরে ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলী”তে এটি অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]

একটি পার্টির রয়েছে নেতৃত্ব ও কর্মী। নেতৃত্ব ও কর্মী হচ্ছে একটি দ্বন্দ্বের দুটো দিক।১ নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভূমিকা বিপ্লবে সুনির্দিষ্ট।

পার্টি-লাইন ও নেতৃত্ব
সভাপতি মাও বলেছেন, “পরিচালকদের নেতৃত্বের-লেখক) দায়িত্ব প্রধানতঃ দুটোঃ অভিমত পেশ করা ও কেডারদের কাজে লাগানাে।
“সমস্ত পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদি অভিমত পেশ করার আওতায় পড়ে।”২ অর্থাৎ, রাজনৈতিক, সামরিক, সাংগঠনিক, মতাদর্শগত ও কর্মপদ্ধতিগত এবং অন্যান্য লাইন নির্ধারণ করা ও তা বাস্তবায়নে কর্মীদের কাজে লাগানাে নেতৃত্বের দায়িত্ব। লাইন প্রণয়ন ও কর্মীদের কাজে লাগানাের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা হচ্ছে নির্ণায়ক।
একটি পার্টির বিকাশ ও বিজয় অর্জনের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচেছ সঠিক লাইন নির্ধারণ করা। লাইন সঠিক হলে ক্ষুদ্র শক্তি বিরাট হয়, সশস্ত্র বাহিনী না থাকলে তা গড়ে উঠে, রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলে তা অর্জিত হয়, কর্মী সংগৃহীত হয়, তারা আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ হয়, শৃংখলা পালন করে, কেন্দ্রের প্রতি অনুগত হয়।
লাইন ভুল হলে কর্মীরা আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ হয় না, শৃংখলা পালন করে না, শেষ পর্যন্ত তারা চলে যায়, পার্টির পূর্ব-অর্জিত ফলও খােয়া যায়।
লাইন সঠিক হলে কর্মীদের আত্মবলিদান ও রক্তপাত সফল হয়, আর লাইন ভুল হলে কর্মীদের আত্মবলিদান ও রক্তপাত বৃথা যায়। কাজেই সঠিক লাইন হচ্ছে পার্টির প্রাণ। মহান লেনিন সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির সঠিক লাইন রচনা করেন, পার্টি তা গ্রহণ ও কার্যকরী করে। ফলে সােভিয়েট ইউনিয়নে সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের আত্মত্যাগ সার্থক হয় (পরবর্তীকালে সােভিয়েট ইউনিয়নে সংশােধনবাদীদের ক্ষমতা দখলের ফলে এ আত্মত্যাগ বৃথা যায়)।
সভাপতি মাওসেতুঙ মহান চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঠিক লাইন প্রণয়ন করেন,
পৃষ্ঠা: ৩০১

পার্টি তা গ্রহণ ও বাস্তবায়িত করে; এভাবে চীনা বিপ্লব অব্যাহতভাবে বিজয় অর্জন করছে, কর্মী ও জনগণের আত্মত্যাগ ও রক্তপাত সার্থক হচ্ছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টির সঠিক লাইন কমরেড সিরাজ সিকদার প্রণয়ন করেন, সংগঠন তা গ্রহণ করে, কর্মীরা বাস্তবায়িত করে। এভাবে সংগঠনের বিজয় ও অগ্রগতি অব্যাহতভাবে অর্জিত হচ্ছে। কর্মী, গেরিলা, সহানুভূতিশীলদের আত্মত্যাগ ও রক্তপাত সার্থক হচ্ছে।
এ সঠিক লাইনের কারণেই শ্রমিক আন্দোলন বিকাশ লাভ করে, কর্মী সংগৃহীত হয়, তারা আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ হয়, শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের জটিল পরিস্থিতির মধ্যে শ্রমিক আন্দোলন টিকে থাকে ও বিকাশ লাভ করে, শেষ পর্যন্ত তার ঐতিহাসিক ভূমিকা সমাপ্ত করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠা করে।
সর্বহারা পার্টি আভ্যন্তরীণ ও বাইরের শ্রেণী ও জাতীয় শত্রুদের এবং তাদের চরদের মারাত্মক হামলার মুখেও সঠিক লাইনের কারণে টিকে আছে এবং অব্যাহতভাবে বিকাশ লাভ করছে।
এভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী জাতীয় গণভিত্তিক পার্টিতে বিকাশ লাভ করে এবং বিরাটাকার সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সূচনার স্তরে পৌঁছেছে।
পক্ষান্তরে হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার, কাজী-রণাে, মনিসিংমােজাফফর প্রভৃতি বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী নেতৃত্বের ভুল ও বিশ্বাসঘাতক লাইনের জন্য সাধারণ খাটি কর্মী ও বিপ্লবীদের সামনে তাদের মুখােশ উন্মােচিত হয়ে পড়েছে, কর্মীরা তাদের প্রতারণা বুঝতে পেরে সত্যিকার সর্বহারা পার্টিতে ব্যাপক সংখ্যায় যােগদান করছে। এভাবে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা মারাত্মকভাবে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে, তারা তাদের চূড়ান্ত ধ্বংসের স্তরে পৌঁছেছে। তাদের সাথে যুক্ত সাধারণ কর্মীদের রক্তপাত ও আত্মবলিদান ভুল পথে ব্যবহৃত হয়ে ব্যর্থ হচ্ছে।
১৯৪৭ সালের পূর্বেকার পাক-ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভুল ও বিশ্বাসঘাতক লাইনের জন্য লক্ষ লক্ষ সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণের আত্মত্যাগ বৃথা যায়, সাম্রাজ্যবাদের দালাল আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা পাক-ভারতের ক্ষমতা দখল করে।
ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ভুল লাইনের জন্য লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্ট ও জনগণ প্রাণ হারায়।
সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতক বুর্জোয়া লাইনের কারণে যে সােভিয়েট ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার জন্য কোটি কোটি সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তা সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত হয়, সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। ফলে কোটি কোটি সর্বহারা বিপ্লবী ও জনগণের আত্মবলিদান বৃথা যায়।
পার্টি-নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতক লাইনের জন্য পূর্ব ইউরােপের কয়েকটি দেশ৩ ও মঙ্গোলিয়ার পার্টি সংশােধনবাদী পার্টিতে রূপান্তরিত হয় এবং উক্ত দেশগুলাে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ বা তার উপর নির্ভরশীল দেশে পরিণত হয়।
এ কারণে সভাপতি মাও বলেছেন, “কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংশােধনবাদের আবির্ভাব সবচেয়ে বিপজ্জনক।” এর কারণ কেন্দ্রীয় কমিটি হচ্ছে সংগঠনের সর্বোচ্চ নেতৃত্বদাতা সংস্থা, সমগ্র সংগঠন এর অধীন। কাজেই কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংশােধনবাদের উদ্ভব ও তার প্রাধান্যের অর্থ হচ্ছে সমগ্র সংগঠন সংশােধনবাদী হয়ে যাওয়া।
পৃষ্ঠা: ৩০২

এ কারণেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রেণী ও জাতীয় শত্রুর চর, বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলরা সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবী পার্টিকে ধ্বংস করা, একে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টিতে পরিণত করার জন্য পার্টির নেতৃত্ব দখলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির অভ্যন্তরস্থ শ্রেনী শত্রু বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রেণী ও জাতীয় শক্র ও তাদের চর বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের যােগসাজশে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতৃত্ব দখলের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। তার উদ্দেশ্য ছিল নেতৃত্ব দখল করে বিশ্বাসঘাতক লাইন প্রণয়ন করা। পার্টির সকল কর্মীদের তা বাস্তবায়ন করতে লাগানাে, তাদের আত্মত্যাগকে বিপথে চালনা করা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রেণী ও জাতীয় শত্রু ও তাদের চর বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের সেবা করা।
সে কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্ব ও সঠিক লাইনের ভূমিকাকে অস্বীকার করে, কর্মীদের আত্মবলিদান ও রক্তপাতের কথা উল্লেখ করে তা তার জঘন্যতম স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালায়।
তার উদ্দেশ্য ছিল কর্মীরা যেন পার্টি ও বিপ্লবের জন্য কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্ব ও তার দ্বারা প্রণীত সঠিক লাইনের গুরুত্ব উপলব্ধি না করে, মূল্যহীন গৌন মনে করে, ফজলু চক্রের পার্টি-ক্ষমতা দখলের সাধারণ পরিকল্পনার শিকার হয়।
বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র গঠনের সময় কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করাকে বিরােধিতা করে। সঠিক নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করার অর্থ হচ্ছে পার্টির মাঝে এক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও তা শক্তিশালী করা, কেন্দ্রকে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন। করা, পার্টি কর্মী ও জনগণকে নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল ও অনুগত করা, শত্রুকে ভীতসন্ত্রস্ত করা এবং তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি করা।
ফজলু চক্রের উদ্দেশ্য ছিল এক কেন্দ্রকে ভাঙ্গা ও দুর্বল করা, তার প্রভাব ও ক্ষমতা হ্রাস করা, পার্টি-কর্মী ও জনগণকে নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীন করা ও শক্রদের সহায়তা করা।
সে নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করার বিরােধিতা করে এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপবাদ রটায়, সঠিক নেতৃত্ব ধ্বংস ও হেয় করার জন্য এক হাজার একটা প্রচেষ্টা চালায়। এমন কি হত্যার ষড়যন্ত্র চালায়। তার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল এ সকল কুকর্ম করে পার্টির ক্ষমতা দখল করা।

নেতৃত্বের নির্ভুল লাইন প্রণয়নের পদ্ধতি
নেতৃত্বের নির্ভুল লাইন গড়ে ওঠে বস্তু থেকে চেতনার, চেতনা থেকে বস্তুতে অর্থাৎ অনুশীলন থেকে জ্ঞানে, জ্ঞান থেকে অনুশীলনে অনেকবার পুনরাবৃত্তির পরেই। এ হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞান তত্ত্ব অর্থাৎ দ্বন্দ্ববাদী বস্তুবাদের জ্ঞান তত্ত্ব।
সভাপতি মাও একে আরাে বিশদভাবে “নেতৃত্বের পদ্ধতি সম্পর্কে কতিপয় সমস্যা” প্রবন্ধে আলােচনা করেছেন।
এখানে তিনি বলেছেন, “আমাদের পার্টির সমস্ত নির্ভুল নেতৃত্ব অপরিহার্যভাবেই হচ্ছে জনসাধারণ থেকে আসা ও জনসাধারণের মধ্যে যাওয়া। এর অর্থ হচ্ছে জনসাধারণের মতামত (ইতস্ততঃ ছড়ানাে ও অব্যবস্থিত) সংগ্রহ করে কেন্দ্রীভূত করা (গবেষণার মাধ্যমে তাদের কেন্দ্রীভূত ও সুব্যবস্থিত মতে রূপান্তরিত করা), তারপর তা নিয়ে জনসাধারণের কাছে প্রচার ও
পৃষ্ঠা: ৩০৩

ব্যাখ্যা করা, এই মত জনসাধারণের নিজস্ব মতে পরিণত করা যাতে জনসাধারণ এই মতকে কার্যকরী করেন, কাজে পরিণত করেন এবং জনসাধারণের কার্যক্রিয়ার ভিতর দিয়েই এই মত ভুল কি নির্ভুল তা যাচাই করে নেওয়া, পুনর্বার জনসাধারণের মতামত সংগ্রহ করা এবং তা জনসাধারণের কাছে গিয়ে কার্যকরী করা। আর এমনি চলে বারংবার, চলে সমাপ্তিহীন ঘূর্ণাবর্ত, ফলে প্রতিবারই এই মত হয়ে ওঠে আরাে বেশী নির্ভুল, আরাে বেশী প্রাণবন্ত, আরাে বেশী সমৃদ্ধ, এ হচ্ছে মার্কসবাদের জ্ঞান তত্ত্ব।”
এ থেকে আমরা নিম্নলিখিত জ্ঞানের প্রক্রিয়া পাইঃ
(ক) বস্তুর সাথে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান – অনুশীলন।
জনসাধারণের মতামত সংগ্রহ করা, অর্থাৎ বস্তুর সংস্পর্শে যাওয়া, বস্তুকে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করা, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান সংগ্রহ করা। এই জন্য প্রয়ােজন নেতৃত্বের বিন্দু ভেঙ্গে প্রবেশ করা, অর্থাৎ একটি ইউনিট বা এলাকায় নেতৃত্বের প্রতিটি সমস্যা সমাধান করা।
(খ) ধারণাত্মক জ্ঞান – তত্ত্বের পর্যায়।
এ স্তর হচ্ছে সংগৃহীত মতামতকে সুব্যবস্থিত মতে রূপান্তরিত করা, ধারণাত্মক জ্ঞান-তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন রচনা করা অর্থাৎ বস্তু-ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে চেতনা-ধারণাত্মক জ্ঞানের স্তরে উন্নীত করা।
(গ) বস্তুর সাথে সংস্পর্শ – অনুশীলন।
ধারণাত্মক জ্ঞান-চেতনা-তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন জনসাধারণের নিকট নিয়ে যাওয়া, তা কার্যকরী করা, অর্থাৎ ধারণাত্মক জ্ঞান-চেতনা-তত্ত্ব-প্লন-পরিকল্পনাসাধারণ লাইন অনুশীলনে প্রয়ােগ করা, তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন অনুযায়ী বস্তুকে রূপান্তরিত করতে লেগে থাকার মাধ্যমে তত্ত্ব-প্লন-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইনের সঠিকতা যাচাই করা।
এ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় যে ধারণাত্মক জ্ঞান-চেতনা-তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন অনুযায়ী বস্তুর রূপান্তর হয় তা সঠিক। ওই বস্তু সম্পর্কিত জ্ঞান ওই স্তরে সম্পূর্ণ হয়।
বস্তুর পরিবর্তন ও রূপান্তরের সাথে ধারণাত্মক জ্ঞান পুরােপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে অনুশীলন ও প্রয়ােগের প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান হয়, অভিজ্ঞতার সারসংকলন ও গবেষণার মাধ্যমে অসামঞ্জস্যসমূহ দূর করে নতুন তত্ত্ব-প্লন-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন অর্থাৎ ধারণাত্মক জ্ঞান প্রণয়ন করতে হবে, পুনরায় তা যাচাইয়ের জন্য অনুশীলনে প্রয়ােগ করতে হবে; বস্তুকে পরিবর্তন ও রূপান্তরিত করার জন্য প্রয়ােগ করতে হবে।
এভাবে বস্তু-অনুশীলন-ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান থেকে চেতনা-ধারণাত্মক জ্ঞান-তত্ত্ব-প্লনপরিকল্পনা-সাধারণ লাইন এবং চেতনা-ধারণাত্মক জ্ঞান-তত্ত্ব-প্লান-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন থেকে বস্তু-অনুশীলন-ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানে বারংবার আবর্তিত হয়ে সঠিক ও নির্ভুল লাইন গড়ে ওঠে। কর্মী পরিচালনার ক্ষেত্রেও গণ লাইনের কর্মপদ্ধতি প্রয়ােগ করতে হবে।
এ পদ্ধতি প্রয়ােগ না করলে নেতৃত্ব হবে আমলাতান্ত্রিক ও আত্মগত।
অর্থাৎ, আমলারা শুধু নির্দেশ দিয়ে যায়, তাদের নির্দেশের বাস্তব ভিত্তি না থাকায় তা হয় আত্মগত।
কাজেই নেতৃত্বের নির্ভুল লাইন আকাশ থেকে পড়ে না বা তা সহজাত নয়। ইহা অনুশীলন থেকেই আসে।
শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের নির্ভুল লাইন শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের অনুশীলন থেকেই আসে।
পৃষ্ঠা: ৩০৪

বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা ও ফজলু চক্র পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও কমরেড সিরাজ সিকদার জনগণের সাথে যুক্ত নয় কিন্তু পার্টির লাইন সঠিক একথা বলছে।
এর অর্থ হচ্ছে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সঠিক লাইন কমরেড সিরাজ সিকদারের সহজাত বা আকাশ থেকে পড়েছে। ইহা প্রমাণ করে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও ফজলু চক্র ভাববাদী।

মানুষের সৃজনশীল ভূমিকা
বাস্তব অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা, তা সারসংকলন করে সাধারণ পরিচালনার নির্ভুল লাইন প্রণয়ন ও প্রয়ােগ করা হচ্ছে মানুষের সৃজনশীল ভূমিকা।
ইহা মানুষে মানুষে তফাত হবে; অর্থাৎ, মানুষের যােগ্যতার তারতম্য হবে।
নেতৃত্বের এ সৃজনশীল ভূমিকা সর্বাধিক প্রয়ােজন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদমাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে বাস্তব অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা ও নির্ভুল লাইন প্রণয়ন ও তা প্রয়ােগ করার ক্ষমতাসম্পন্ন যােগ্য নেতৃত্ব বিপ্লবের জন্য অপরিহার্য।
এই সৃজনশীল ভূমিকার তারতম্যের জন্য কেউ হন মহান প্রতিভাবান, কেউ হন মহান মার্কসবাদী-লেনিনবাদী।
যােগ্যতার পার্থক্য অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন হলেও প্রত্যেকেই জনগণের নিঃস্বার্থ সেবক হবেন, যােগ্যতা বেশী হলেও জনগণের মাথায় চড়ে বসা লাটসাহেব হবার অধিকার কারাে নেই।
সভাপতি মাও নেতৃত্ব ও কর্মীদের শিখিয়েছেন, “আমাদের সবারই তার (নর্মান বেথুনের-লেখক) সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ ভাবমানস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এই ভাবমানস গ্রহণ করলে সকলেই জনগণের পক্ষে খুবই হিতকর হবেন। একজন মানুষের যােগ্যতা কম বা বেশী হতে পারে, কিন্তু এই ভাবমানস থাকলেই তিনি হতে পারেন মহাপ্রাণ লােক, প্রকৃত লােক, নৈতিক চরিত্র সম্পন্ন লােক, নীচ রুচি থেকে মুক্ত লােক ও জনগণের জন্য হিতকর লােক।”
বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র পার্টির নেতৃত্ব ও কমরেড সিরাজ সিকদারের সৃজনশীল ভুমিকাকে অস্বীকার করেছে, পার্টির বিকাশ ও বর্তমান স্তরে পৌঁছানােতে কমরেড সিরাজ সিকদারের কোন ভূমিকা নেই এ ধরনের কথা বলছে, যাতে তার নেতৃত্ব দখলের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করা যায়। নিজেকে সে সবচাইতে যােগ্য বলে মনে করেছে যে তাকে ছাড়া ‘পৃথিবী ঘুরা বন্ধ হয়ে যাবে’, জনগণের নিঃস্বার্থ সেবক হওয়ার পরিবর্তে সে পার্টি কমরেড ও জনগণের মাথায় চড়ে বসা লাটসাহেব হয়ে বসতে চেয়েছে, স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করার অলীক স্বপ্ন দেখেছে।

যৌথ নেতৃত্ব ও ব্যক্তি বিশেষের ভূমিকা
নেতৃত্ব গঠিত হয় পার্টির সবচাইতে অগ্রগামী কর্মীদের নিয়ে। বিপ্লবে নেতৃত্বের প্রত্যেকের বস্তুগত ভূমিকা রয়েছে।
নেতৃত্বের প্রতি সদস্যের যােগ্যতা বিকাশের পরিপূর্ণ সুযােগ নিশ্চিত করা, একই সাথে নেতৃত্বের মাঝে গণতান্ত্রিক জীবন বজায় রাখার মাধ্যমে যৌথ নেতৃত্বকে কার্যকরী করা, এভাবে ব্যক্তিগত ভূমিকা ও যৌথ নেতৃত্বের মধ্যে যথাযথ সামঞ্জস্য বিধান করা সর্বহারা বিপ্লবী ও নেতৃত্বের দায়িত্ব। সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নেতা গড়ে ওঠে। এ ধরনের
পৃষ্ঠা: ৩০৫

নেতা লাইন প্রণয়ন ও কেডারদের কাজে লাগানাের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের (উদাহরণ-কেন্দ্রীয় কমিটির) মাঝে প্রধান ভূমিকা পালন করে।
নেতৃত্ব সংস্থা এ ধরনের নেতার লাইন পর্যালােচনা ও বিবেচনা করে গ্রহণ করে, গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্ব কার্যকরী করে, সমগ্র পার্টি ও বিপ্লব বিজয় অর্জন করে।
সােভিয়েট ইউনিয়নে মহান লেনিন পার্টির লাইন ও কর্মীদের কাজে লাগানাের পদ্ধতি প্রণয়ন করেন, কেন্দ্রীয় কমিটি ও সমগ্র পার্টি ইহা পর্যালােচনা ও বিবেচনা করেন এবং গ্রহণ করেন, সমগ্র পার্টি কমরেডরা তা বাস্তবায়িত করেন।
এভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি মহান লেনিনের ব্যক্তিগত ভূমিকাকে পরিপূর্ণ বিকাশের সুযােগ প্রদান করে, একই সাথে গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্ব বজায় রাখে।
চীনে সভাপতি মাওসেতুঙ পার্টির লাইন ও কর্মপদ্ধতি রচনা করেন এবং পার্টি তা গ্রহণ করে ও বাস্তবায়িত করে। এভাবে সমগ্র চীন মুক্ত হয়।
আলবেনিয়ায় এনভার হােজা পার্টি লাইন ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করেন এবং পার্টি তা গ্রহণ ও বাস্তবায়িত করে, এভাবে সমগ্র আলবেনিয়া মুক্ত হয়। ভিয়েতনাম, কোরিয়ার ক্ষেত্রেও ইহা প্রযােজ্য।
প্রতিক্রিয়াশীল, সুবিধাবাদীদের ক্ষেত্রেও যৌথ নেতৃত্বের মাঝে ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকা প্রধান হয়ে দেখা দেয়।
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বেলায়ও দেখা যায় নেতৃত্বের মধ্যকার ব্যক্তিবিশেষ প্রতিক্রিয়াশীল ভুল লাইন ও কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করে এবং তা কাজে লাগায়। কাউটস্কী দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের নেতা হিসেবে তার প্রতিক্রিয়াশীল সংশােধনবাদী লাইন ও কর্মপদ্ধতি কাজে লাগায় ও কর্মীদের, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে প্রতারিত করে।
ক্রুশ্চোভ প্রতিক্রিয়াশীল সংশােধনবাদী লাইন প্রণয়ন ও তা কার্যকরী করে, সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রকে বুর্জোয়া পার্টি ও রাষ্ট্রে পরিণত করে, ব্রেজনেভ তার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে।
মনিসিং, মােজাফর, হক, তােয়াহা, বাসার, মতিন, কাজী প্রভৃতি বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা তাদের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব সংস্থায় প্রধান ভূমিকা পালন করে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন ও সর্বহারা পার্টিতে কমরেড সিরাজ সিকদার সঠিক লাইন প্রণয়ন করেন, বিপ্লবী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি এ সকল নির্ভুল লাইন গ্রহণ করে এবং সমগ্র পার্টি তা কার্যকরী করে। ফলে পার্টির বিজয় ও অগ্রগতি অব্যাহতভাবে অর্জিত হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক কমরেড সিরাজ সিকদারের রচিত লাইন পর্যালােচনা এবং তা গ্রহণ ও অনুমােদনের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্ব কার্যকরী হচ্ছে।
এভাবে পার্টির নির্ভুল লাইন প্রণয়ন ও কেডারদের কাজে লাগানাের ক্ষেত্রে যৌথ নেতৃত্বের মাঝে কমরেড সিরাজ সিকদার প্রধান ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে ধ্বংস করার সাম্প্রতিক চক্রান্তে ফজলু, সুলতান, হুমায়ুন কবির ইত্যাদির মাঝে প্রধান ভূমিকা পালন করে বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র।
ফজলু চক্র তার উত্তরসূরী (পূর্বসূরী ?) ক্রুশ্চোভ-লিউ শাওচির মত বিপ্লবী সঠিক নেতৃত্বের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ শূন্য হিসেবে দেখিয়েছে, ক্রুশ্চোভের অনুরূপ ক্রুশ্চোভ স্ট্যালিনের তথাকথিত ব্যক্তিতাবাদের (Personality Cult) বিরােধিতার নামে রাশিয়ার
পৃষ্ঠা: ৩০৬

বিপ্লবে স্ট্যালিনের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে চেয়েছে, তাকে প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে চিত্রিত করেছে যৌথ নেতৃত্বের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে নিজের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব ও স্বৈরাচার কায়েম করতে চেয়েছে, নেতৃত্বকে প্রতিক্রিয়াশীল বলে আখ্যায়িত করেছে, চক্র গঠন ও বিশ্বাসঘাতকতায় প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
এভাবে দেখা যায় বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী, প্রতিক্রিয়াশীল উভয় ক্ষেত্রেই যৌথ নেতৃত্বের মাঝে ব্যক্তিবিশেষ প্রধান ও কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

সঠিক নেতৃত্ব ও বিপ্লবের সৃষ্টি
সর্বহারা শ্রেণী বুর্জোয়া ও অন্যান্য শােষক-শ্রেণী বিরােধী শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় আজ হােক কাল হােক তার প্রতিনিধিত্বকারী বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি সৃষ্টি করে, এ রাজনৈতিক পার্টি পরিচালনায় যােগ্য নেতৃত্বও সৃষ্টি করে।
অর্থাৎ সঠিক রাজনৈতিক পার্টি ও নেতৃত্বের সৃষ্টি ইতিহাসের গতিধারার অনিবার্য পরিণতি।
অর্থাৎ চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ও মাওসেতুঙের সৃষ্টি কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, চীনা সমাজের শ্রেণী সংগ্রামের ও সামাজিক বিকাশের অনিবার্য পরিণতি।
কাজেই পূর্ব বাংলার সমাজের বিকাশের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর সঠিক রাজনৈতিক পার্টি ও নেতৃত্বের জন্ম লাভ করা।
সর্বহারা পার্টির নেতা কেন্দ্রীয় কমিটির হােক আর স্থানীয় কমিটির সদস্য হােক, জনগণের মধ্য থেকে শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে, তারা সীমাহীনভাবে জনগণের প্রতি অনুগত, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রয়েছে এবং জনগণের মতামতকে কেন্দ্রীভূত করা ও তা কার্যকরী করতে ভাল। এ ধরনের নেতা হচ্ছে সর্বহারার সত্যিকার প্রতিনিধি এবং জনগণ স্বীকৃত একটি সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক পরিপক্কতার লক্ষণ হলাে এ ধরনের নেতা থাকা। এখানেই থাকে সর্বহারার। উদ্দেশ্যের বিজয়ের আশা।
লেনিন সম্পূর্ণ সঠিকভাবেই বলেছেন, “ইতিহাসে কোন শ্রেণীই ক্ষমতা দখল করেনি তার রাজনৈতিক নেতাদের সৃষ্টি না করে …।” তিনি আরাে বলেছেন, “অভিজ্ঞ এবং সবচেয়ে শক্তিশালী পার্টি নেতৃত্বের ট্রেনিং খুবই দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল কাজ; কিন্তু এ ছাড়া সর্বহারার একনায়কত্ব’-এর ইচ্ছার ঐক্য শুধু কথাই থেকে যাবে।”৪ পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও তার। নেতৃত্ব এভাবে সর্বহারা ও জনগণের শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছে। ইহা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়।
সঠিক লাইন প্রণয়ন ও তা কার্যকরী করতে সক্ষম এবং ব্যাপক পার্টি কমরেড ও জনগণ দ্বারা স্বীকৃত কমরেড সিরাজ সিকদারের সঠিক নেতৃত্ব প্রমাণ করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক হয়ে উঠছে।
ফজলু চক্র এই ইতিহাসকে অস্বীকার করে শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামে সুবিধাবাদ ও ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নেতা হতে চেয়েছিল।
এভাবে সে ইতিহাসের গতিধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার পরিবর্তে ইতিহাসের ভিলেন হিসেবে এ গতিধারার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। অনিবার্যভাবেই সে বাকুনিন, বার্নেস্টাইন, কাউটস্কি, ক্রুশ্চেভ, লিউ শাওচির মত ইতিহাসের ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হয়।
পৃষ্ঠা: ৩০৭

নেতৃত্ব পরিবর্তনশীল
সভাপতি মাও বলেছেন, “একটি বিরাট সংগ্রামের প্রক্রিয়ার প্রাথমিক, মধ্যম ও চূড়ান্ত পর্যায়ে নেতৃত্ব গ্রুপের গঠন প্রকৃতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরিবর্তিত থাকে না বা থাকতে পারে না।” অর্থাৎ সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব প্রতিনিয়ত নিজেকে দু’ভাগে ভাগ করছে। কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় কর্মী সুবিধাবাদী, সংশােধনবাদী, অধঃপতিত, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্ত কারীতে পরিণত হয়ে পড়ছে বা নতুন এগিয়ে আসা কর্মীদের তুলনায় অযােগ্য হয়ে পড়ছে। ফলে সুবিধাবাদী, সংশােধনবাদী, অধঃপতিত, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্তকারী, অযােগ্য উপাদান বর্জিত হচ্ছে, তাদের স্থান দখল করছে নতুন তাজা রক্ত, যােগ্য কর্মী।
পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব অর্থাৎ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান বা সভাপতির বেলায়ও ইহা প্রযােজ্য। সভাপতি যদি প্রতিনিয়ত নিজের মধ্যকার দুই দিকের সংগ্রামকে আঁকড়ে না ধরেন, অসর্বহারা দিক সমূহকে সংগ্রাম করে বর্জন না করেন, অসর্বহারা দিককে প্রাধান্য পেতে দেন, শেষ পর্যন্ত তার মাঝে যদি অসর্বহারা দিক প্রাধান্য পায় তখন তার রাজনৈতিক ও অন্যান্য কার্য পরিচালিত হবে অসর্বহারার দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে ,ফলে সব। কিছুই হবে ভুল। অনিবার্যভাবেই পার্টির সর্বহারা ও খটি উপাদান তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করবে এবং সভাপতি সংশােধিত ও যােগ্য না হলে বর্জিত হবে।
চীন ও পৃথিবীর বহু দেশের সর্বহারা পার্টিতে বহুবার সভাপতি বা প্রধান সম্পাদক অসর্বহারায় রূপান্তরিত হওয়ার কারণে বর্জিত হয়েছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার। সাথে জড়িত অনেকেই বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় বর্জিত হয়। পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় সংস্থা বিপ্লবী পরিষদের বহু সদস্যও অযােগ্যতার কারণে বর্জিত হন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফজলু-সুলতান চক্র শ্ৰেণী শত্রু এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের সাথে যােগসাজশে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত করা, উপদল গঠন করার কারণে বর্জিত হয়।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরেও একই প্রক্রিয়া চলে, সর্বহারা পার্টির বিভিন্ন স্তরেও এ প্রক্রিয়া চলছে।
অর্থাৎ ‘বাসিটা বর্জন ও টাটকাটা গ্রহণের প্রক্রিয়া নেতৃত্বের বেলায়ও প্রযােজ্য হচ্ছে।

নেতৃত্ব ও কর্মীদের মূল্যায়ন
ক্রুশ্চোভের বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল লাইনের বিরােধিতা করতে যেয়ে চীনা। কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে, “চীনা কমিউনিস্ট পার্টি সর্বদাই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে স্ট্যালিনের ভাল ও খারাপ দিকের সামগ্রিক, বস্তুগত ও বাস্তবেই যা ঘটেছে সে ইতিহাসকে উত্থাপণের দাবী জানিয়েছে এবং ঐতিহাসিক ভাববাদের দ্বারা স্ট্যালিনকে আত্মগত, স্থূল মূল্যায়ন এবং তাঁকে পুরােপুরি অস্বীকার করাকে এবং ইতিহাসের বিকৃতি ও পরিবর্তনকে বিরােধিতা করেছে।”৫
এ থেকে পাওয়া যায়, আমরা নেতৃত্ব ও কর্মীর মূল্যায়ন ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে সামগ্রিক বস্তুগত ও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে করব। ইতিহাস যেভাবে ঘটেছে সেভাবেই তুলে ধরব।
সভাপতি মাও একে আরাে সংক্ষেপে বলেছেন, “দুটি সীমারেখা স্পষ্ট করে অংকন করুন। প্রথমতঃ বিপ্লব না প্রতিবিপ্লব? ইয়েনান না সিয়ান? কেউ কেউ বুঝেন না, এই
পৃষ্ঠা: ৩০৮

সীমারেখাকে অবশ্যই স্পষ্টভাবে আঁকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যখন তারা আমলাতন্ত্রবাদের বিরােধিতা করেন তখন ইয়েনান সম্পর্কে এমনি করে বলেন যেন সেখানে কিছুই ঠিক নয়; ইয়েনানের আমলাতন্ত্রবাদের ও সিয়ানের আমলাতন্ত্রবাদের মধ্যে তুলনা ও পার্থক্য করেন না, এটা মূলতঃ ভুল। দ্বিতীয়তঃ বিপ্লবী বাহিনীর ভুল ও নির্ভুলের মধ্যে, সাফল্য ও ত্রুটির মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানতে হবে এবং কোনটা মুখ্য কোনটা গৌণ তা স্পষ্ট করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ সাফল্যের পরিমাণ শতকরা ৩০ ভাগ না ৭০ ভাগ? কমিয়ে কিংবা বাড়িয়ে বললে চলবে না। ব্যক্তিবিশেষের কাজের মৌলিক মূল্যায়ন আমাদের অবশ্যই করতে হবে যে, তার সাফল্য শতকরা ৩০ ভাগ এবং ভুল শতকরা ৭০ ভাগ, না সাফল্য ৭০ ভাগ ও ভুল ৩০ ভাগ? যদি তার সাফল্যের পরিমাণ শতকরা ৭০ ভাগ হয় তাহলে তার কাজকে মৌলিকভাবে ইতিবাচক বলে স্বীকার করতে হবে। সাফল্য প্রধান কাজকে ভুল প্রধান কাজ বললে সম্পূর্ণরূপেই ভুল হবে। সমস্যা বিচার করতে গেলে এ দুটো সীমারেখা টানতে আমাদের কিছুতেই ভােলা উচিত নয়-বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লবের মধ্যকার সীমারেখা এবং সাফল্য ও ত্রুটির মধ্যকার সীমারেখা। যদি এ দুই সীমারেখাকে আমরা মনে রাখি, তাহলে ভালভাবে কাজ করতে পারব, অন্যথায় আমরা সমস্যার প্রকৃতিকে গুলিয়ে ফেলব। স্বভাবতঃই যদি এ সীমারেখা ভালভাবে আঁকতে হয়, তবে মনোেযােগের সঙ্গে গবেষণা ও বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিটি বিষয়ের প্রতি আমাদের বিশ্লেষণ ও গবেষণার মনােভাব গ্রহণ করা উচিত।”
নেতৃত্ব ও কর্মীদের ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে, এ সকল ভুল-ভ্রান্তির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সমালােচনা-আত্মসমালােচনার পদ্ধতিতে সংগ্রাম করতে হবে।
“আমাদের জোর দিতে হবে কি কি অবস্থায় ভুলগুলাে হয়েছে, ভুলের প্রকৃতি ও তার সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং মতাদর্শগত শেকড়সমূহকে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং এগুলাে করতে হবে ‘অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানোের’, ‘রােগ সারিয়ে রােগীকে বাঁচানাের জন্য যাতে মতাদর্শগত স্পষ্টতা ও কমরেডদের ঐক্যের দুটো লক্ষ্য অর্জিত হয়।” ৬
নেতৃত্ব ও কমরেডদের ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে, এই ব্যক্তিগত জীবনের ত্রুটিবিচ্যুতি যদি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভুল-ত্রুটির সাথে জড়িত না হয়, তবে ছিদ্রানুসন্ধানের প্রয়ােজন নেই, কারণ এর দ্বারা সংগঠন বিপজ্জনক অবস্থায় পড়বে, কর্মীরা ভুলে যাবে রাজনৈতিক দায়িত্ব, এটা শক্ররাই চায়।
বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র তার গুরু ক্রুশ্চোভের মত কমরেড সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য সাচ্চা কমরেডদের মূল্যায়ন করে ঐতিহাসিক ভাববাদ দ্বারা, ইতিহাস ও সত্যকে বিকৃত করে তার ইচ্ছানুযায়ী পাল্টায়, আত্মগতভাবে দোষ-ক্রটি, অপরাধ, মিথ্যা করে কমরেড সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য সাচ্চা কমরেডদের ওপর চাপিয়ে দেয়; গুজব, অপবাদ, বিশেষ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটায়, ক্রুশ্চোভের। অনুরূপ কমরেড সিরাজ সিকদারের ব্যক্তিতাবাদের বিরােধিতার নামে কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিকাকে পুরােপুরি অস্বীকার করে।
কাজেই আমাদেরকে নেতৃত্ব ও কমরেডদের মূল্যায়নে ক্রুশ্চোভ ও তার শিষ্য ফজলু চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া পদ্ধতির বিরােধিতা করতে হবে এবং মার্কসবাদী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

বিপ্লবে কর্মীদের ভূমিকা
কর্মীদের ভূমিকা সম্পর্কে সভাপতি মাও বলেছেন, “রাজনৈতিক লাইন নির্ধারিত হয়ে গেলে কেডাররাই হচ্ছে নির্ণায়ক উপাদান।”
পৃষ্ঠা: ৩০৯

অর্থাৎ পার্টির লাইন নির্ণীত হয়ে গেলে প্রয়ােজন কেডারদের, যারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে, আত্মবলিদানে নির্ভয় হয়ে, সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে পার্টির লাইন প্রয়ােগ করবেন এবং বিজয় অর্জনের জন্য সংগ্রাম করবেন।
পার্টির জনসাধারণের সাথে সংযােগ হচ্ছে কেডারদের মাধ্যমে এবং পার্টির লাইন। কার্যকরী হয় কেডারদের মাধ্যমে। এ কেডারদের কঠোর প্রয়াস, আত্মবলিদান ও রক্তপাত সার্থক হয়ে ওঠে যখন তা পার্টির সঠিক লাইন বাস্তবায়নের জন্য ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ পার্টির বিকাশ ও সফলতা অর্জিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের মুক্তি অর্জিত হয়। পার্টির লাইন ভুল হলে তাদের প্রয়াস, আত্মবলিদান ও রক্তপাত বৃথা যায়।
কাজেই কেডারদের প্রয়ােজন নিম্নলিখিত সর্বনিম্ন যােগ্যতা অর্জন করা, “কেডাররা পার্টির লাইন দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করেন কিনা, পার্টির শৃংখলা মানেন কিনা, জনসাধারণের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ আছে কিনা, স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম কিনা এবং তারা সক্রিয়, পরিশ্রমী ও নিঃস্বার্থ কিনা।”
কেডারদের দায়িত্ব হচ্ছে সর্বদা নেতৃত্বকে যাচাই করা, ভুল ও নির্ভুল নির্ণয়ের ক্ষমতা অর্জন করা, পার্টির লাইন নির্ণয়ে নেতৃত্বের ভূমিকাকে সচেতনভাবে উপলব্ধি করা, সঠিক নেতৃত্বকে মেনে চলা ও তাকে রক্ষা করা, শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করা, প্রতিনিয়ত নিজেদের কর্মক্ষমতাকে উন্নীত করা, অধিকতর জনসেবার দায়িত্ব গ্রহণে নিজেদেরকে সক্ষম করে তােলা।

কর্মীদের কাজে লাগানাের পদ্ধতি
সভাপতি মাও বলেছেন, প্রথম তাদের পথ নির্দেশ করা, এর অর্থ তাদের অবাধে কাজ করতে দেওয়া, যাতে করে তারা সাহসের সাথে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন, একই সময়ে তাদের সময়ােচিত নির্দেশ দেওয়া, যাতে করে পার্টির রাজনৈতিক লাইনে পরিচালিত হয়ে তারা তাদের সৃজনশীল উদ্যোগকে পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারেন।
দ্বিতীয়তঃ তাদের মান উন্নত করা। এর অর্থ অধ্যয়ন করার সুযােগ দেওয়া, তাদের শিক্ষাদান করা, যাতে করে তারা তত্ত্বগত ক্ষেত্রে ও কর্মক্ষমতার ক্ষেত্রে নিজেদেরকে উন্নত করতে পারেন।
তৃতীয়তঃ তাদের কাজকর্মের পরীক্ষা করে দেখা এবং তাদের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করা, তাদের সাফল্যকে সামনে এগিয়ে নিতে এবং ভুলকে শােধরাতে তাদেরকে সাহায্য করা; পরীক্ষা ছাড়া কাজের ভার দেওয়া, এবং শুধু মারাত্মক ভুল হলেই তার প্রতি মনােযােগ দেওয়াটা কেডারদের প্রতি যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি নয়।
চতুর্থতঃ যে সব কেডার ভুল করেছেন, সাধারণতঃ তাদের প্রতি বুঝিয়ে বলার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে এবং তাদেরকে ভুল শােধরাতে সাহায্য করতে হবে।
গুরুতর ভুল করেও যারা নির্দেশ মানে না, কেবলমাত্র তাদের প্রতিই সংগ্রামের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, ধৈর্য এখানে অপরিহার্য। কোন লােককে অবিবেচিতভাবে। ‘সুবিধাবাদের লেবেল আঁটা’ অথবা অবিবেচিতভাবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানাের পদ্ধতি অবলম্বন করা ঠিক নয়।
পঞ্চমতঃ তাদের অসুবিধায় সাহায্য করা, কেডাররা রােগ, জীবনযাত্রা বা পারিবারিক ও অন্যান্য কষ্টের ফলে অসুবিধায় পড়লে তাদের প্রতি যতটা সম্ভব মনােযােগের সঙ্গে যত্ম নিতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৩১০

কেডারদের কাজ পরীক্ষার সময় তারা যে স্তরের সে স্তরের মতামত সংগ্রহ করলেই চলবে না, কেডারদের অধীনস্থদের এমনকি সম্ভব হলে জনসাধারণের মতামতও সংগ্রহ করতে হবে। অর্থাৎ ওপর ও নিচ উভয় দিক থেকেই কেডারদের কাজকর্ম পরীক্ষা করতে হবে।

উপসংহার
“জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছেন বিশ্ব ইতিহাস সৃষ্টির পরিচালক শক্তি।” এ থেকে অন্য কিছু ভাবা হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাববাদ।
সভাপতি মাও আরাে বলেছেন, “জনসাধারণের এই সক্রিয়তাকে যথাযথভাবে সংগঠিত করার জন্য যদি একটা বলিষ্ঠ নেতৃত্ব গ্রুপ না থাকে তাহলে জনসাধারণের সক্রিয়তা দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকতে পারে না।”
এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন, “একটি বিপ্লবী পার্টি ব্যতীত বিপ্লব হয় না।” বিপ্লবী পার্টি হচ্ছে এ ধরনের নেতৃত্ব গ্রুপ, জনসাধারণের কার্যের নেতৃত্বের কেন্দ্রশক্তি। পার্টির ভূমিকা হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে শ্ৰেণী শত্রু (ও জাতীয় শত্রু-লেখক) বিরােধী সংগ্রামে পরিচালনা করা অর্থাৎ সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের শ্রেণী ও জাতীয়। শক্রবিরােধী সংগ্রামের নিয়মবিধি আবিষ্কার করে সে অনুযায়ী তাদেরকে পরিচালনা করা এবং এভাবে সমাজ ও দুনিয়াকে রূপান্তরিত করা।
পার্টির মধ্যকার নেতৃত্বের দায়িত্ব হলাে শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের নিয়মবিধি আবিষ্কার করা, সঠিক লাইন প্রণয়ন করা, এবং তা বাস্তবায়নে কেডারদের পরিচালনা করা। কেডারদের দায়িত্ব হচ্ছে নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়ে পার্টির লাইনকে বাস্তবায়িত করা, সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণকে শ্ৰেণী ও জাতীয় সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করা।
বিপ্লবী পার্টির কর্মীদের সক্রিয়তার জন্য প্রয়ােজন বিপ্লবী নেতৃত্ব। ইহা ব্যতীত পার্টির কর্মীদের সক্রিয়তা টিকে থাকে না বা উচ্চস্তরে উন্নত হতে পারে না, বিপ্লবী পার্টি হতে পারে না।
জনসাধারণ ও পার্টির মাঝে জনসাধারণকে পরিচালনা ও নেতৃত্ব প্রদানের প্রশ্নে পার্টি হচ্ছে প্রধান দিক, সমাজ ও দুনিয়াকে রূপান্তরিত করার প্রশ্নে জনসাধারণ হচ্ছে প্রধান দিক; আর পার্টির মধ্যকার নেতৃত্ব ও কর্মীদের মাঝে লাইন প্রণয়ন ও কর্মীদের কাজে লাগানাের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব হচ্ছে প্রধান দিক, পার্টির লাইন বাস্তবায়নে কর্মীরা হচ্ছে প্রধান দিক।

নােটঃ
১। সভাপতি মাও বলেছেন, “প্রতিটি পার্থক্যই হচ্ছে দ্বন্দ্ব।” নেতৃত্বের ও কর্মীদের মধ্যে স্তরের ও মানদণ্ডের পার্থক্য রয়েছে; এ কারণে নেতৃত্বের সাথে কর্মীদের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ দ্বন্দ্ব হচ্ছে জনগণের মধ্যকার দ্বন্দ্ব। কর্মীদের নিয়মবিধি আবিষ্কার করা এবং সে অনুযায়ী তাদের পরিচালনা করে যথাযথভাবে গণতন্ত্র ও কেন্দ্রীকতা এবং গণলাইনের কর্মপদ্ধতি প্রয়ােগ করে
পৃষ্ঠা: ৩১১

নেতৃত্বের পক্ষে এ দ্বন্দ্বকে অবৈরী রাখতে হবে। নেতৃত্বের সাথে কর্মীদের দ্বন্দ্ব বৈরী রূপ নিতে পারে। নেতৃত্ব বা তার এক অংশ যখন সংশােধনবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী হয় তখন সাধারণ কর্মীদের সাথে নেতৃত্বের বা নেতৃত্বের অংশের দ্বন্দ্ব বৈরী রূপ নিতে পারে। নেতৃত্ব বা তার অংশ তখন অপসারিত বা বর্জিত হয়।
২। মাও, উদ্ধৃতি ৩২৬ পৃষ্ঠা।
৩। বুলগেরিয়া, পােল্যান্ড, হাঙ্গেরী, চেকোস্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানী ইত্যাদি। যুগােস্লাভিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীল। 8
৪। Polemics On the General Line of International Communist Movement, P-132.
৫। Do P-119.
৬। Mao, Selected Works, Vol.-III, P-16.
পৃষ্ঠা: ৩১২

দুর্গ গঠকরা নিম্নলিখিত কাজ করে
[এ দলিলটি প্রণীত ও প্রকাশিত হয়েছিল ফজলু-সুলতান চক্রবিরােধী সংগ্রামের প্রক্রিয়ায়-১৯৭২ সালে প্রকাশক।]

১. এমন লােক নিয়ােগ করা যারা পুতুল হবে। ২. নিজেকে জনপ্রিয় করা (আত্মপ্রচারবাদ) আমি এই, আমি সেই। ৩. নিজের আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত লােকদের, তল্পিবাহকদের মধ্য থেকে রিক্রুট করা। ৪. পিঠে হাত বুলানাে, সমালােচনা না করা, উদারতাবাদ করা। ৫. খারাপ লােকদের রিক্রুট করা। ৬. স্বতন্ত্রতা, স্বাধীনতা দাবী করা। ৭. আমার এলাকায় ভাল কাজ হয়েছে ইহা প্রচার করা। ৮. উচ্চস্তরের সাথে নিজের পরিচালনাধীন কর্মীদের যােগাযােগ যাতে কম হয় সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৯. জিনিসপত্র বেশী নিতে চায় বিশেষ করে অস্ত্র, অর্থ। ১০. পার্টি ও নেতৃত্বকে জনপ্রিয় করার পরিবর্তে নিজেকে জনপ্রিয় করা। ১১. অল্প সল্প করে নেতৃত্ব বিরােধী কুৎসা, অপবাদ, গুজব রটায় এবং জনমত সৃষ্টি করা। ১২. নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিরক্তি, অনুযােগ প্রথমে প্রকাশ পায়। ১৩. নিজের এলাকা এবং নিজের স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থান দেয়। ১৪. পার্টির রাজনৈতিক লাইন যথাযথভাবে প্রচার করে না। ১৫. পার্টির দলিল বিতরণ না করা। ১৬. নিজে ও নিজের তৈরী সার্বক্ষণিক কর্মী বদলীর ব্যাপারে অনিচ্ছা প্রকাশ করা। ১৭. নিজেকে উচ্চস্তর হিসেবে (কেন্দ্রীয় কমিটি) জাহির করা। এবং কেউকেটা মনে করলে তা না ভাঙ্গানাে। ১৮. নিজে যে দুর্গ গঠক নয় এটা প্রমাণ করার জন্য অভিনয় করা, উচ্চস্তরকে তােষামােদ করা।
০ এ বিষয়ে উচ্চস্তরকে রিপাের্ট করতে নিষেধ করা।
০ গােপন বৈঠক দেয়।
০ কর্মীদের মাঝে ব্যক্তিবাদ দেখা দেয়।
পৃষ্ঠা: ৩১৩

এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে-
ইহা পার্টির মাঝেও প্রযােজ্য
(১৯৭২)

‘এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করে’-ইহা দ্বান্দ্বিকতার মৌলিক নিয়ম, ইহা মানব চিন্তাধারা, প্রকৃতি ও সমাজ অর্থাৎ সর্বত্র সার্বজনীনভাবে প্রযােজ্য।
পার্টি ও কমরেডদের বেলায়ও এই মৌলিক দ্বান্দ্বিক নিয়ম প্রযােজ্য।
পার্টির মাঝে কমরেডরা প্রতিটি প্রশ্নে দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিছু কিছু কমরেড সর্বহারা মতামত ও কর্মরীতি আঁকড়ে থাকেন, তার বিপরীত অন্যান্য কমরেড সর্বহারা মতামত ও কর্মরীতিকে পরিত্যাগ করেন। এই দুই লাইনের সংগ্রাম চলে। পার্টি বিপ্লবী থাকে যদি সর্বহারা বিপ্লবীদের লাইন বিজয় অর্জন করে এবং পার্টি তা গ্রহণ করে।
কমরেডদেরও দু’ভাগে ভাগ করা যায়, তার সর্বহারা দিক আর অসর্বহারা দিক। এ। দু’দিকের মাঝে সংগ্রাম চলে প্রতিনিয়ত। যে দিক প্রধান তাই নির্ণয় করে কমরেডটির প্রকৃত রূপকে।
যার বিপ্লবী দিক প্রধান সে বিপ্লবী, আর যার অবিপ্লবী দিক প্রধান সে অবিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী, সুবিধাবাদী।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মাঝে কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে কিনা, যৌনস্বার্থ বিপ্লবের স্বার্থের অধীন থাকবে না যৌনস্বার্থের অধীনে থাকবে বিপ্লবী স্বার্থ এ প্রশ্নে দুই লাইনের সংগ্রাম হয়।
ফজলু-সুলতান চক্র ‘কমিউনিস্টদের কিছুটা ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে’, ‘যৌনস্বার্থের অধীন থাকবে বিপ্লবী স্বার্থ’ প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব হাজির করে।
এর বিপরীতে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি কমিউনিস্টদের। কোন ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে না, যৌনস্বার্থ বিপ্লবী স্বার্থের অধীন থাকবে-এ সর্বহারার লাইন তুলে ধরেন এবং নীতির প্রশ্নে দৃঢ় থাকেন। এই দুই লাইনের সংগ্রাম চলে। কেন্দ্রীয় কমিটি ও পার্টি ফজলু-সুলতান চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করে।
এ তত্ত্বগত সংগ্রামে দেউলিয়া প্রমাণিত হয়ে অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে তারা কমিউনিস্টদের ব্যক্তিস্বার্থ থাকবে এ তত্ত্ব-মত (?), পার্টি-পদ, নেতৃতু, ক্ষমতার লােভে প্রতিক্রিয়াশীল সাংগঠনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করে, গুজব-অপবাদ রটায়, দু’মুখাে অভিনেতা সাজে, মিথ্যার আশ্রয় নেয়, চক্র গঠন করে, পার্টির অর্থ-অস্ত্র চুরি করে, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র করে, শেষ পর্যন্ত পার্টি থেকে পলায়ন করে।
তাদের এ শেষােক্ত পরিণতির কারণ তারা নিজেদের খারাপ দিক ও ভাল দিক, সর্বহারা দিক ও অসর্বহারা দিক বিশ্লেষণ করে খারাপ ও অসর্বহারা দিকের বিরুদ্ধে সজাগ থাকেনি, তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেনি, নিজেদেরকে যাচাই করেনি।
এভাবে তাদের মধ্যকার অসর্বহারা ও খারাপ দিক প্রাধান্য লাভ করে, তারা প্রতিক্রিয়াশীলে রূপান্তরিত হয় এবং পার্টি ও জনগণের ক্ষতি সাধন করে।
পৃষ্ঠা: ৩১৪

কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি যদি তাদের প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে তা মেনে নিতেন, তবে সমগ্র পার্টিতে সুবিধাবাদের ও ভুলের নিকট আত্মসমর্পণ করতে হত, পার্টি অচিরেই সুবিধাবাদী, যৌনস্বার্থকে প্রাধান্যপ্রদানকারী, ব্যক্তিস্বার্থ বজায়কারীদের পার্টিতে পরিণত হত, অর্থাৎ পার্টি আওয়ামী লীগের মত বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল পার্টিতে রূপান্তরিত হত। পার্টির এ পরিণতি হােক ইহা কোন কমরেড ও জনগণ চাইবেন না।
সভাপতি মাও বলেছেন, “একজন মানুষের ধমনী ও শিরা রয়েছে, হৃদপিন্ডের সাহায্যে তার সারা শরীরে রক্ত সঞ্চারিত হয়, আর ফুসফুসের সাহায্যে সে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, কার্বন-ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে, টাটকা অক্সিজেন গ্রহণ করে, অর্থাৎ বাসিটা বর্জন করে ও টাটকাটা গ্রহণ করে। একটা সর্বহারা শ্রেণীর পার্টি কেবলমাত্র বাসিটা বর্জন ও টাটকাটা গ্রহণ করেই সজীব ও প্রাণশক্তিতে ভরপুর হতে পারে। আবর্জনা পরিষ্কার না করলে, টাটকা রক্ত গ্রহণ না করলে পার্টি সতেজ হতে পারে না।”
অর্থাৎ সর্বদাই কিছু সংখ্যক কর্মী যারা নিজেদেরকে কঠোরভাবে যাচাই না করেন, নিজেদের অসর্বহারা ও খারাপ দিকসমূহের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না চালান, যারা স্বার্থের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করেন, সংশােধনবাদকে বিরােধিতা করার নীতিতে দৃঢ় না থাকেন, তাদের মধ্যকার অসর্বহারা দিক ধীরে ধীরে প্রাধান্য লাভ করতে পারে, ফলে তারা অসর্বহারা, পশ্চাদপদ কমরেড, বাসি কমরেড, এমন কি প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবীতে রূপান্তরিত হতে পারেন।
পার্টিকে অবশ্যই এ সকল বাসি উপাদান বাদ দিয়ে টাটকাটা গ্রহণ করে সর্বদাই প্রাণশক্তি বজায় রাখতে হবে।
এভাবে সর্বদাই পার্টি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সর্বহারা বিপ্লবী আর সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবীতে।
বস্তু বিকাশের এ বিভক্তিকরণের সাধারণ নিয়মকে মেনে চলতে হবে। সুবিধাবাদী, প্রতিবিপ্লবীদের থেকে সর্বদাই পৃথক থাকতে হবে। তাদেরকে বহিষ্কার করে দিয়ে সংগঠনের বিপ্লবী চরিত্র বজায় রাখতে হবে।
তাদের সাথে ঐক্যের নীতি, তাদেরকে পার্টির মাঝে রেখে সংশােধনের নীতি হলাে বস্তুর নিয়মের পরিপন্থী।
এর পরিণতি হলাে পার্টিকে আভ্যন্তরীণ ও বাইরের শত্রুর গােলার সম্মুখীন হওয়া। এ অবস্থায় পার্টির পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়।
এ কারণেই সুবিধাবাদীদের প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবীদের, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত কারীদের, উপদলীয় কার্যকলাপ পরিচালনাকারীদের বহিষ্কার করে, অধঃপতিত ব্যক্তিদের বের করে দিয়ে পার্টি শক্তিশালী হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ও পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই বাসি উপাদান বর্জনের এবং টাটকাটা গ্রহণের প্রক্রিয়া সর্বস্তরে চলে আসছে, এ কারণেই সংগঠন সর্বদাই প্রাণশক্তিতে ভরপুর রয়েছে।
পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী পরিষদের বহু সদস্যই বাসি উপাদান। হওয়ার কারণে বর্জিত হন। নতুন কর্মী তাদের স্থান দখল করেন। তাদের মধ্যেও কেউ কেউ বাসি হওয়ায় বর্জিত হন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে একই প্রক্রিয়া চলবে, ইহা পার্টির বিকাশের বস্তুগত নিয়ম।
পৃষ্ঠা: ৩১৫

চীনা পার্টির ইতিহাসে দেখা যায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি চেনতাওশিউ শেষ পর্যন্ত চিয়াং কাইশেকের গুপ্ত পুলিশে পরিণত হয়, গুরুত্বপূর্ণ নেতা চেনকাওতাে একইভাবে গুপ্ত পুলিশে পরিণত হয়। এ ধরনের আরাে অনেক ঘটনাই ঘটে।
পরবর্তীকালে লিউ শাওচি এবং আরাে বহু নেতা সংশােধনবাদীতে রূপান্তরিত হয়।
কাজেই কোন কর্মীর পক্ষেই সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী বা প্রতিবিপ্লবীতে রূপান্তরিত হওয়া বিচিত্র নয়।
কাজেই ফজলু-সুলতান চক্রের সুবিধাবাদী, চক্রান্তকারীতে রূপান্তর মােটেই আশ্চর্য ঘটনা নয়। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিপ্লবীদের মহান দায়িত্ব হলাে নিজেদের প্রতি এক নিজেকে দু’য়ে বিভক্ত করার তত্ত্ব প্রয়ােগ করা, প্রতিনিয়ত নিজেদের সর্বহারা ও অসর্বহারা দিক, ভাল ও খারাপ দিক খুঁজে বের করা, নিজেদের মধ্যকার অসর্বহারা ও খারাপ দিকগুলাের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, প্রতিনিয়ত কঠোরভাবে নিজেদের যাচাই করা, সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করা, আজীবন বিপ্লবী থাকার জন্য প্রচেষ্টা চালানাে, সুলতান-ফজলু চক্রের নেতিবাচক উদাহরণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
পৃষ্ঠা: ৩১৬

মতাদর্শ ও তার প্রকাশের ক্ষেত্রে
শ্ৰেণী বিশ্লেষণ এবং শ্রেণী সংগ্রাম আঁকড়ে ধরুন

ঔপনিবেশিক-আধাসামন্তবাদী পূর্ব বাংলার জনগণের অধিকাংশই ক্ষুদে বুর্জোয়া অর্থাৎ কৃষক (ক্ষেত মজুর, গরীব চাষী ও মাঝারী চাষী), বুদ্ধিজীবী, ক্ষুদে চাকুরীজীবী, দোকানদার, হস্তশিল্পী প্রভৃতি। এ শ্রেণী পূর্ব বাঙলা শ্রমিক আন্দোলনকে শুধু-যে ঘিরে আছে তা নয়; এর অধিকাংশ সদস্যই এ শ্রেণী থেকে আগত। অধিকন্তু পূর্ব বাংলার বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় শ্রমিক জনতা এবং শ্রমিক শ্রেণী থেকে আগত পার্টি সদস্যদেরও ক্ষুদে বুর্জোয়া ছাপ রয়েছে। এ কারণে এটা মােটেই আশ্চর্য নয় বরং অবশ্যম্ভাবী যে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ সংগঠনে বিভিন্ন রূপ নিয়ে প্রকাশ পাবে। এ ছাড়াও পার্টি-বহিস্থ ক্ষুদে বুর্জোয়া, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বড় বুর্জোয়াদের প্রভাব, বিপ্লবী জীবনের কঠোরতা সর্বহারা কর্মীদের চেতনায় ক্ষয় আনে এবং তাদের মাঝের বুর্জোয়া দিকের প্রাধান্য ঘটে এবং তারা সুবিধাবাদী হয়ে যায়।
অতএব যতদিন সমাজে শ্ৰেণী থাকবে ততদিন পার্টি ও কর্মীদের মাঝে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের সাথে সর্বহারার মতাদর্শ ও তার প্রকাশের শ্রেণী সং চলবে। অর্থাৎ পার্টি ও কর্মীরা সর্বহারা থাকবেন না বুর্জোয়া হবেন-এ সংগ্রাম যতদিন শ্ৰেণী থাকবে ততদিন চলবে। কখনাে কখনাে এই সংগ্রাম তীব্র হয়ে উঠবে এবং প্রকাশ্য শ্রেণী সংগ্রামে রূপ নেবে।
সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন যে, সর্বহারার অগ্রগামী কর্মীগণ যদি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের সাথে কিছু কিছু পার্টি সদস্যদের ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শের একটি দৃঢ় ও তীক্ষ পার্থক্যরেখা না টানেন এবং তাদের বিরুদ্ধে গুরুতররূপে কিন্তু যথাযথভাবে ও ধৈর্যের সাথে সংগ্রাম না করেন তবে অসম্ভব হবে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশগুলাে দূর করা। আরাে গুরুত্বপূর্ণ হলাে, এ সকল ক্ষুদে বুর্জোয়া সদস্যরা অবশ্যম্ভাবীভাবেই প্রচেষ্টা চালাবে সর্বহারার অগ্রগামী বাহিনীকে নিজস্ব প্রতিকৃতি অনুযায়ী পরিবর্তিত করতে (অর্থাৎ ক্ষুদে বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত করতে-লেখক) এবং পার্টি নেতৃত্ব দখল করতে। এভাবে তারা প্রচেষ্টা চালাবে পার্টি ও জনগণের উদ্দেশ্যের ক্ষতিসাধন করতে।
পার্টির বাইরে যতবেশী ক্ষুদে বুর্জোয়া থাকবে এবং পার্টির অভ্যন্তরে যতবেশী ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী উদ্ভূত সদস্য থাকবে তত কঠোরভাবে পার্টি অবশ্যই বজায় রাখবে সর্বহারা অগ্রগামী বাহিনী হিসেবে তার পবিত্রতা এবং সর্বহারার মতাদর্শ ও তার প্রকাশের সাথে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশের স্পষ্ট ও কঠোর পার্থক্যরেখা টানবে।
আমরা অবশ্যই প্রতিনিয়ত সভাপতি মাও-এর এই নির্দেশ পালন করব। পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীরা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের
পৃষ্ঠা: ৩১৭

অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে ঐতিহাসিকভাবে উপলব্ধি করেছে যে পূর্ব বাংলায় একটি বিপ্লবী সর্বহারার পার্টি প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখা নির্ভর করছে, কতখানি তারা সক্ষম হন পার্টি-অভ্যন্তরে ক্ষুদে বুর্জোয়া মতাদর্শ ও তার প্রকাশকে পার্টি-অভ্যন্তরে ও বাইরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদকে (আধুনিক সংশােধনবাদ, নয়া সংশােধনবাদ, ট্রটস্কিচেবাদ ইত্যাদি) সংগ্রাম করে দূর করতে।

মতাদর্শগত, চিন্তা, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্ষুদে বুর্জোয়া ও সর্বহারার প্রকাশসমূহঃ
ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী লাইন সর্বহারা শ্রেণী লাইন
(১) মতাদর্শগত ক্ষেত্রে
ব্যক্তিস্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা, জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত।
(২) চিন্তার ক্ষেত্রে
আত্মগতভাব (দার্শনিকভাবে আত্মগতভাব হচ্ছে ভাববাদ, অধিবিদ্যা ও যান্ত্রিক বস্তুবাদ)। এটা প্রকাশ পায়। (ক) একতরফাবাদ (খ) ভাসাভাসা ভাব (গ) দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ (ঘ) বামপন্থী হটকারিতা (ঙ) গােড়ামীবাদ (চ) সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ (ছ) লেখার ক্ষেত্রে একঘেঁয়ে লেখা।
দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ
(৩) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে
ডানে-বামে দোদুল্যমানতা, চরমে যাওয়ার মনােবৃত্তি, অধৈর্য প্রভৃতি। ডান ও বামকে সংগ্রাম করে চলা, আত্মগতের সাথে বস্তুগতের সামঞ্জস্য বিধান করা, বাস্তবনিষ্ঠ ও দূরদর্শী হওয়া।

(৪) সাংগঠনিক ক্ষেত্রে
উদারতাবাদ, উগ্রগণতন্ত্র, পিতৃতন্ত্র,। ব্যক্তিতাবাদ, আমলাতন্ত্র, দমননীতি, আধানৈরাজ্যবাদ, স্বাতন্ত্রবাদী করা, গিল্ড মনােভাব, শক্তিশালী দুর্গের মনােভাব, উপদলীয় সংঘাত, বিভেদপন্থীবাদ। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা

পৃষ্ঠা: ৩১৮

নােটঃ
আত্মগতভাবঃ
বস্তুকে মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে মনের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-কল্পনাকে বস্তু হিসেবে নেয়া। চিন্তা, ধ্যান, ধারণা বস্তুর যথাযথ প্রতিফলন না হয়ে বস্তুর সংশ্রবহীন হওয়া।
একতরফাবাদঃ
বিপরীতের একত্রে নিয়ম হচ্ছে বিশ্বের মৌলিক নিয়ম, অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুর মধ্যকার দ্বন্দ্বের দুটো দিক রয়েছে। যেমন কমরেডদের মধ্যে সর্বহারা দিক ও বুর্জোয়া দিক, ভাল ও মন্দ দিক; শক্তিশালী ও দুর্বল দিক রয়েছে, কিন্তু একতরফাবাদীরা শুধু একটি দিকই দেখেন অন্য দিকটি দেখেন না।
ভাসাভাসা ভাবঃ
বিশ্বের প্রতিটি বস্তুর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমূহের সংঘাতের জন্য গতিশীল। একটি বস্তুকে জানা বলতে তার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমূহ এবং অন্যান্য বস্তুর সাথে এর সম্পর্ককে জানা বুঝায়। কিন্তু ভাসাভাসাভাব হলাে এভাবে না জেনে বস্তুর বাইরেরটা, পরিলেখ, অবয়ব দেখে সন্তুষ্ট থাকা, কিন্তু বস্তুকে পুরােপুরি না জানা।
দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদঃ
প্রতিটি বস্তুই আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বসমূহের সংঘাতের জন্যই গতিশীল। বস্তুকে পরিবর্তনের জন্য যারা নিয়ােজিত তাদের অনেকের চিন্তাধারা বস্তুর বিকাশের গতির পশ্চাতে রয়ে যায়। এদের চিন্তাধারা সামাজিক অনুশীলন থেকে বিচ্ছিন্ন। তারা সমাজের রথচক্রকে নেতৃত্ব দিয়ে সম্মুখে নিয়ে যেতে পারে না, বরঞ্চ এর লেজুড়বৃত্তি করে, এটা দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযােগ করে, চেষ্টা করে একে পিছে টেনে আনতে বা বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিতে। উদাহরণ স্বরূপ, কোন এলাকায় কৃষকরা রাজনৈতিক কাজের ফলে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য এগিয়ে যেতে চায় কিন্তু ভারপ্রাপ্ত কমরেডগণ সময় হয়নি, অন্যান্য স্থানে সংগঠন হয়নি প্রভৃতি বলে কৃষকদের উদ্যম থামিয়ে দেন; এটা দক্ষিণপন্থী মনােভাবের প্রকাশ।
বামপন্থী হঠকারিতাবাদঃ
বামপন্থী হঠকারিতাবাদীর চিন্তাধারা বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ার স্তরকে অতিক্রম করে যায়। তারা তাদের আকাশ-কুসুম কল্পনাকে বাস্তব বলে ভাবে; এদের মধ্যে অনেকে ভবিষ্যতে যা হবে তা এখনই বাস্তবায়িত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। তারা সমাজের অধিকাংশ লােকের অনুশীলন থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং তাদের কাজে হঠকারিতার পরিচয় দেয়।
পৃষ্ঠা: ৩১৯

[প্রক্রিয়া বলতে বুঝায়- আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও বাইরের শর্ত যার জন্য বস্তু বিকাশ লাভ করে। এই বিকাশের কালে কোন কোন নতুন দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় আবার কোন কোন পুরনাে দ্বন্দ্ব মীমাংসা হয় এবং অনেক সময় বাইরের শর্তেরও পরিবর্তন হয়। এভাবে বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়া স্তরে বিভক্ত হয়।]
ডানপন্থী সুবিধাবাদ ও বামপন্থী হঠকারিতাবাদ হয় আত্মগতের সাথে বস্তুগতের সামঞ্জস্য বিধান না হওয়ার ফলে।
গােড়ামীবাদঃ
গােড়ামীবাদীরা বই-এর জ্ঞান অর্থাৎ, ধারণাত্মক জ্ঞান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে কিন্তু বাস্তব অনুশীলনে এই জ্ঞান যাচাই করে নেয় না, এভাবে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান অর্জন করে না।
সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদঃ
বাস্তব অনুশীলনের প্রাক্কালে যে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান হয় তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা এবং তার উপর নির্ভর করা, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে মার্কবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা দ্বারা সারসংকলন করে বস্তুর নিয়মবিধি বের করা, এভাবে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে তত্ত্ব, প্লান, পরিকল্পনার পর্যায়ে উন্নীত না করা।
গিল্ড মনােবৃত্তিঃ
নতুন ও কর্মক্ষম কর্মীদের ওপর দায়িত্বপূর্ণ কাজ না দিয়ে নেতৃত্ব সর্বদা কয়েকজনের হাতে কুক্ষিগত রাখা। অতীতে গিল্ড মাস্টাররা (ছােট হস্তশিল্প কারখানার মালিক) কখনাে গিল্ড শিক্ষানবিশদের গিল্ড মাস্টার হতে দিত না।
শক্তিশালী দুর্গের মনােভাবঃ
কোন বিভাগ বা সাংগঠনিক স্তর “নিম্নস্তর উচ্চস্তরের অধীন, অংশ সমগ্রের অধীন, ব্যক্তি সংগঠনের অধীন, সমগ্র সংগঠন কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন” এই কথাকে বাতিল করে দিয়ে শুধু নিজ ইউনিট, স্তর, বিভাগের কথা চিন্তা করে, নিজের তাবেদারদের দিয়ে একটি দুর্গ গঠন করে। এটা উপদলীয় কার্যকলাপের আওতায় পড়ে। এটা বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বার্থ থেকে উদ্ভূত।
আধানৈরাজ্যবাদঃ
পার্টি শৃংখলাকে অমান্য করা বা উপেক্ষা করার দৃষ্টিকোণ। “মানিনাকো কোন আইন, কোন নিয়ম-কানুন-শৃংখলা” এই মনােবৃত্তি।

নােটঃ উদারতাবাদ, উগ্রগণতন্ত্র, ব্যক্তিতাবাদ প্রভৃতি “পাঁচটি প্রবন্ধ”র শেষের দু’টি প্রবন্ধে রয়েছে। উপদলবাদ, বিভেদপন্থীবাদ মতাদর্শগত দলিলে দ্রষ্টব্য।
পৃষ্ঠা: ৩২০

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার
(৯ জুলাই, ১৯৭২)

কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ৮ই জুলাই, ১৯৭২ সালে শুরু হয় এবং ৯ই জুলাই সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় নিম্নলিখিত আলােচ্যসূচী গৃহীত হয় এবং সে অনুযায়ী সভা পরিচালিত হয়।
আলােচ্যসূচী ১) সাংগঠনিক, চক্র সংক্রান্ত, শুদ্ধি অভিযান। ২) রাজনৈতিক। ৩) সামরিক। ৪) অর্থনৈতিক। ৫) বিবিধ।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের সিদ্ধান্তসমূহ, তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইস্তেহার, কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতিসমূহ অনুমােদিত হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত “পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা” (২৯/৫/৭২) গৃহীত হয়। বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র এবং হুমায়ুন কবির সংক্রান্ত বক্তব্য অনুমােদিত হয়।
বিশ্বাসঘাতক ফজলু চক্র খতমে অংশগ্রহণকারী ও পরিচালকদের নিকট প্রদত্ত অভিনন্দনপত্র সংশােধিত আকারে গৃহীত হয়।
এ গেরিলাপ এবং পরিচালকদের যৌথভাবে বীরত্বের জন্য একটি স্বর্ণপদক (কাস্তে-হাতুড়ি খচিত) প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
চক্র সম্পর্কে নিম্নলিখিত তথ্য সংগৃহীত হয়।
১। বিশ্বাসঘাতক ফজলু পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বীর গেরিলাদের হাতে খতম হয়েছে।
এর নিকট থেকে উদ্ধারকৃত কাগজপত্র থেকে চক্র সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদঘাটিত হয়।
উদ্ধারকৃত কাগজের মাধ্যমে প্রমাণ পাওয়া যায় যে এ চক্রের সাথে কাজী চক্রের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। এ সকল কাগজপত্রের ফটোস্ট্যাট কপি কর্মী ও সহানুভূতিশীলদের দেখানাে হবে।
এর ফলে প্রমাণিত বিশ্বাসঘাতক ও অন্তর্ঘাতক এবং ফজলু চক্রের জনৈক সক্রিয় ও ঘনিষ্ঠ সহযােগীকে আমাদের গেরিলারা খতম করেছেন।
পৃষ্ঠা: ৩২১

এ খতমে অংশগ্রহণকারী বীর গেরিলা ও পরিচালকদের অভিনন্দন জানানাে হচ্ছে।
সম্প্রতি ঢাকা শহরে এ চক্রের অন্যতম সদস্য মনসুর, ইলিয়াস আমাদের জনৈক কমরেডকে রাস্তায় আটকিয়ে জনগণের নিকট বলে “এ ব্যক্তির নাম অমুক, এ সর্বহারা পার্টির কর্মী, নকশাল’, সিরাজ সিকদারের লোেক, চলুন, একে থানায় নিয়ে যাই, আমি সাক্ষ্য দেব” ইত্যাদি। কিন্তু জনগণ উক্ত কমরেডকে রক্ষা করেন, চক্রান্তকারীরা বেগতিক দেখে পলায়ন করে, জনগণ তাদের ধাওয়া করেন।
এ চক্রের অপর এক পাণ্ডা সুলতান বিভিন্ন স্থানে পার্টিবিরােধী অপপ্রচার চালায়, পার্টির কর্মীদের খতমের হুমকি দেয়।
তারা কাজী চক্র ও অন্যান্য সংশােধনবাদীদের সাথে হাত মিলিয়ে অপপ্রচার করছে। যে, “সর্বহারা পার্টি ভাগ হয়ে গেছে, তারা ব্যক্তিগত কুৎসা ছড়াচ্ছে। সম্প্রতি তারা ব্যক্তিগত কুৎসা, অপপ্রচার ও ইতিহাসকে বিকৃত করে একটি প্রতিক্রিয়াশীল দলিল” প্রকাশ করে।
কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক তাদের যে পরিণতির নির্দেশ করা হয়েছিল তারা সে পথেই অগ্রসর হয়েছে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুতুল সরকারের চরে পরিণত হয়েছে।
তাদের পুরােপুরি ধ্বংস অতি সত্বর সংঘটিত হতে বাধ্য। কাজেই কর্মীদেরকে চক্র সম্পর্কিত কঠোর সতর্কতা বজায় রেখে কাজ করতে হবে।
* পার্টি সাফল্যজনকভাবে চক্র বিরােধী মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করেছে। এই সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
শুদ্ধি অভিযানের সাথে চক্র বিরােধী সংগ্রামকে যুক্ত করতে হবে এবং চক্রকে শুদ্ধি অভিযানের নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
২নং লাল ঝাণ্ডা (মে, ১৯৭২) ও এর পরবর্তী লাল ঝাণ্ডা সমূহ, ফজলু চক্র কর্তৃক প্রকাশিত অপপ্রচার মূলক দলিলের জবাব, কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত দলিলসমূহ মনোেযােগ সহকারে পাঠ করার জন্য কর্মীদের আহ্বান জানানাে হচ্ছে।
অনুসন্ধানের ভিত্তিতে প্রমাণিত বিশ্বাসঘাতক, শত্ৰুচর এবং ফজলু চক্রের সহযােগী মনসুর, ইলিয়াস, রিজভী, সালমা, মিনুকে পার্টি থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা হচ্ছে।
পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে চক্রের সাথে যুক্ত অন্যান্যদের সম্পর্কে আরও অনুসন্ধান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটিকে পুনর্গঠিত করা হয়, জনৈক বিকল্প সদস্যকে পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করা হয়।
সভায় শুদ্ধি অভিযান সম্পর্কে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
চক্র বিরােধী মতাদর্শগত সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের অর্থ হচ্ছে মতাদর্শগত ও কর্মপদ্ধতিগত সুসংবদ্ধকরণ। এরপর সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণ করতে হবে।
চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানে নূতন কর্মী, সহানুভূতিশীল, সম্ভব হলে সমর্থক ও জনগণের মাঝে পােস্টার, লিফলেট, চিকার মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। উদাহরণ-
-পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে ভিতরের ও বাইরের শত্রুরা ধ্বংস করার চক্রান্ত। করছে-একে বিরােধিতা করুন।
…………………………………………………………………….
‘পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বিপ্লবী কর্মী ও সহানুভূতিশীলগণ সিরাজ সিকদারের নিকট থেকে জবাব নিন’। এ সম্পর্কে সর্বহারা পার্টির জবাব প্রকাশিত হয়েছে।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩২২

বিশ্বাসঘাতক ফজলু-সুলতান চক্র কাজী-অমল চক্রের যােগসাজশে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে ধ্বংস এবং কমরেড সিরাজ সিকদার ও অন্যান্য সাচ্চা কমরেডদের খতম করার চক্রান্ত করছে।
-ফজলু-সুলতান চক্র বাংলাদেশ পুতুল সরকারের চরে পরিণত হয়েছে। -পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে চক্র বিরােধী শুদ্ধি অভিযান চলছে। একে সফল করুন। -পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ। -কমরেড সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ। * শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় নিম্নভাবে সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণ করতে হবে
১) শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় কর্মীদের কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করতে হবে, বাসি উপাদান বর্জন করতে হবে, খারাপ উপাদান যাতে পার্টিতে ঢুকতে না পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
২) কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন বিভিন্ন স্তরে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে হবে।
৩) সদস্য, প্রার্থী সদস্যপদ প্রদান করতে হবে।
৪) কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন বিভিন্ন স্তরে কংগ্রেস অনুষ্ঠান করে পুর্ণাঙ্গ কমিটি নির্বাচন করতে হবে।
সভায় কেডার ইতিহাসের বিষয় অবেদনপত্র সহ অতিরিক্ত পয়েন্ট১ সমূহ গৃহীত হয়। এ অতিরিক্ত পয়েন্টসমূহ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
সভায় শুদ্ধি অভিযানের অগ্রগতি পর্যালােচনা করা হয়। শুদ্ধি অভিযান অধিকাংশ স্থানেই শুরু হয়েছে। বাকী এলাকায় অচিরেই শুরু করতে হবে। শুদ্ধি অভিযান অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।
সভায় কমরেডদের হিসেব প্রদানের জন্য একটি ফর্ম২ প্রণয়ন করা হয়। প্রতি দুই মাসে ফর্ম অনুযায়ী প্রত্যেক আঞ্চলিক কমিটির হিসেব উচ্চস্তরে পাঠাতে হবে।
খরচের শিরােনামা নির্ণিত না থাকায় এ সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের হিসেব অনুমােদন করা সম্ভব হয়নি।
সভায় ছয় পাহাড়ের দালালদের ফ্যাসিস্ট শ্বেত সন্ত্রাসের কারণে কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে দলিলাদি প্রকাশনা ও বিতরণের মারাত্মক অসুবিধা পর্যালােচনা করা হয়। এ কারণে প্রতিটি আঞ্চলিক কমিটির নিকট আহ্বান জানানাে হচ্ছে তারা যেন স্থানীয় ভিত্তিতে দলিলাদি পুনঃমুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সভায় কমরেড কবীরের পত্রাবলী পর্যালােচনা করা হয় এবং তার জবাব৩ কক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
* সভায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করা হয় এবং নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
– ‘পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি প্রসংগে কয়েকটি কথা দলিলটি সঠিক। ইহা বিশ্লেষণ করে লেখা প্রয়ােজন।
……………………………………………………………………
১. পরিশিষ্ট- ১ দ্রষ্টব্য।
২. পরিশিষ্ট- ২ দ্রষ্টব্য।
৩. পরিশিষ্ট-৩ দ্রষ্টব্য। (এই দলিলটি এই রচনা সমগ্রের ৩৩৩ পৃষ্ঠায় দেখুন -প্রকাশক।)
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩২৩

ছয় পাহাড়ের দালাল ফ্যাসিস্টরা শ্বেত সন্ত্রাস শুরু করেছে। কালােবাজারী আর মজুতদারী দমনের নামে সত্যিকার বামপন্থী ও দেশপ্রেমিকদের বিশেষ করে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিকে দমন করার ফ্যাসিস্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সান্ধ্য আইন জারী ও তল্লাসী চালানাে প্রমাণ করেছে যে, জনগণ ছয় পাহাড়ের দালালদের সাথে সহযােগিতা করছে না। অর্থাৎ তাদের জনসমর্থন খুবই কমে গেছে। ইহা তাদের মারাত্মক দুর্বলতারই প্রকাশ।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির রাজনৈতিক লাইন অনুশীলনে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের দেউলিয়াত্ব দ্রুত প্রমাণিত হচ্ছে।
সম্প্রতি তােয়াহা চক্র আমাদেরকে একখানি পত্র দেয়। এতে তারা কাজী-অমল চক্র, মতিন-আলাউদ্দিন চক্র, হক চক্র ও দেবেন-বাসার চক্রকে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখে “তথাকথিত সমন্বয় কমিটি”র” অনুরূপ আওয়ামী লীগ বিরােধী যৌথ কার্যক্রম গ্রহণের আহ্বান জানায়। তারা আমাদেরকেও এতে শরীক হতে বলে।
উপদলের অস্তিত্ব বজায় রেখে মার্কসবাদীরা কোন ঐক্য করে না। মার্কসবাদীলেনিনবাদী আন্তরিক বিপ্লবীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা এবং পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনে তার প্রয়ােগের ভিত্তিতে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টিতে সাংগঠনিকভাবে যােগদান করে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ নীতির ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সর্বদাই বৈঠকে বসতে এবং ঐক্যবদ্ধ হতে প্রস্তুত।
কিন্তু উপদলের অস্তিত্ব বজায় রেখে ঐক্য প্রতিষ্ঠা মার্কসবাদ বিরােধী বলে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এ ধরনের ঐক্যে শরিক হতে পারে না।
পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক জনগণের উদ্দেশ্যে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের আহ্বান সহ একটি কর্মসূচী প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
* সভায় সামরিক পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ঘাঁটি এলাকা গঠনের লক্ষ্য সামনে রেখে সমগ্র পূর্ব বাংলা ব্যাপী জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে হবে। এ উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ পালন করতে হবেঃ
১) গ্রাম ও শহরে গােপনে কাজ বিকাশ করা।
২) প্রধানতঃ ক্ষেত মজুর-গরীব চাষীদের মধ্য থেকে গেরিলা সংগ্রহ করা। তাদেরকে পার্টি লাইনে শিক্ষা প্রদান করা যাতে পার্টির নেতৃত্ব গেরিলারা গ্রহণ করেন। অর্থাৎ বন্দুক যাতে পার্টির অধীন থাকে।
৩) বুদ্ধিজীবীদের পাঠচক্রে সংগঠিত করা, তাদের মাঝে উৎসাহীদের গেরিলা গ্রুপে নেওয়া।
৪) তিনটি বৃহৎ শৃঙ্খলা ও মনােযােগ দেবার আটটি ধারা গেরিলারা অবশ্যই পালন করবেন।
৫) গেরিলারা যথাযথ অনুসন্ধান এবং পার্টি কমিটির অনুমতির ভিত্তিতে অপারেশন করবেন। দখলকৃত দ্রব্যাদি পার্টির নিকট জমা দিতে হবে।
…………………………………………………………………….
দেবেন-বাসার, কাজী-রণাে, অমল-বদরুদ্দীন, হাতিয়ার গ্রুপ প্রভৃতি ভারতে বসে জ্যোতি বসুর ছত্রছায়ায় একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করেছিল।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩২৪

৬) দেশীয় অস্ত্র, স্থানীয়ভাবে পাওয়া অস্ত্র ও ব্যবহার করা যায়। তবে অপ্রয়ােজনীয়ভাবে একটিও বুলেট নষ্ট করা কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে।
৭) কাজ বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে। আশেপাশের বাজার ও শহর সমূহেও কাজ সম্প্রসারিত করতে হবে। যাতে ঐ এলাকা শত্রু বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে না পারে।
৮) ব্যাপকভাবে প্রচার করতে হবে।
৯) গেরিলা গ্রুপ বাড়িয়ে তুলতে হবে। গেরিলা গ্রুপে রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ করতে হবে।
এর পরবর্তী সমস্যাবলী সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কয়েকটি দলিল’ অধ্যয়ন ও প্রয়ােগ করতে হবে।
এর পরবর্তী সমস্যাবলীর জন্য সভাপতি মাওয়ের ‘জাপ বিরােধী গেরিলা যুদ্ধের রণনীতিগত সমস্যাবলী’ অধ্যয়ন ও পূর্ব বাংলার বিশেষ অবস্থায় তা প্রয়ােগ করতে হবে।
সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

পরিশিষ্ট-১
কেডার ইতিহাসের জন্য অতিরিক্ত তথ্য
আবেদনপত্র পূরণ করার মাধ্যমে তথ্যাদি ছাড়াও নিম্নলিখিত অতিরিক্ত তথ্যাদি প্রয়ােজন।
১) সামন্তবাদী শ্রেণী উদ্ভূত কিনা?
২) একমাতৃক না বহুমাতৃক পরিবারে পালিত?
৩) ভ্রষ্ট জীবন যাপন করেছে কিনা?
[যৌন সংক্রান্ত, চুরি, ডাকাতি, খুন, বদমাইশি, নেশা, গ্যাঙ্গের সাথে যুক্ত, দালালি, ঠিকাদারী (ছােট), ভিক্ষাবৃত্তি, গণিকাবৃত্তি, টাউটারী, চোরাকারবারী, ফটকাবাজী, প্রতারণা, ঘুষ গ্রহণ, তহবিল তসরূপ, জালিয়াতি, অপহরণ, গুণ্ডামি ইত্যাদি]
৪) দু’মুখাে কিনা? মিথ্যা কথা বলে কিনা?
৫) অতীতে ষড়যন্ত্র চক্রান্ত করেছে কিনা, বা এর সাথে যুক্ত ছিল কিনা? প্রতারণা করেছে কিনা?
৬) উপদল গঠন, চক্র গঠন করেছে কিনা, বা এর সাথে যুক্ত ছিল কিনা?
৭) ব্যক্তিগত বা অন্য কোন কারণে পার্টির বা নেতৃত্বের প্রতি অসন্তুষ্ট কিনা? নেতৃত্বের লােভ, পদের লােভ, নাম-যশের লােভ, ক্ষমতার লােভে পার্টিতে যােগদান করেছে কিনা?
৮) দুর্গ গঠনের ইতিহাস রয়েছে কিনা? ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিপ্লবের স্বার্থের বশে রাখতে ইচ্ছুক কিনা?
৯) সমালােচনা-আত্মসমালােচনা, বিশেষ করে আত্মসমালােচনা করে কিনা? মুক্তমন কিনা?
১০) তার চাইতে স্বতন্ত্র মত পােষণকারী বিরােধিতা করেছিল কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয়েছিল এরূপ লােকের সাথে কাজ করতে ইচ্ছুক কিনা?
পৃষ্ঠা: ৩২৫

১১) শৃঙ্খলা পালন করে কিনা?
১২) পার্টির অভ্যন্তরে বা বাইরে কারাে সাথে ব্যক্তিগত প্রেম আছে কিনা? থাকলে তার সম্পর্কিত তথ্যাবলী।
১৩) আত্মপ্রচারবাদ, হামবড়াভাব রয়েছে কিনা? ১৪) যৌথ জীবন যাপনে সক্ষম কিনা?
পৃষ্ঠা: ৩২৬

সার্বক্ষণিক হবার আবেদনপত্র
(শিরােনামটি আমাদের দেওয়া- প্রকাশক।]

পরিচালক,
……………………..
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি
আমি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে একজন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যােগদান করার জন্য আবেদন করছি।
নিজ সংক্রান্ত এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় তথ্যাদি পেশ করছি। আমি নিম্ন পয়েন্টসমূহ মেনে চলবাে।
আমার আবেদন মঞ্জুর করার জন্য আবেদন করছি।
…………….
স্বাক্ষর
তাং

১। তিনটি বৃহৎ শৃঙ্খলা, মনােযােগ দেবার আটটি ধারা এবং সংগঠনের অন্যান্য শৃঙ্খলা, নির্দেশ, সিদ্ধান্ত মেনে চলবাে।
২। গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা দলিল মেনে চলবাে।
৩। বিভিন্ন অপরাধ সংক্রান্ত পাটির ধারা মেনে চলবাে।
৪। আত্মীয়-স্বজন সংক্রান্ত ধারা মেনে চলবাে।
৫। যৌন বা অন্য কোন প্রকার ভ্রষ্টতার সাথে যুক্ত হবে না বা অন্যকে প্ররােচিত করবাে না।
৬। নিজে পার্টির অগােচরে পলায়ন/ দলত্যাগ করবাে না, অন্যকে পলায়ন, দলত্যাগ, সুবিধাবাদী হতে প্ররােচিত করবাে না। আত্মহত্যার পদক্ষেপ নেবাে না বা অন্যকে প্ররােচিত করবাে না।
৭। শক্রর চরমতম অত্যাচার ও নির্যাতন বা প্রলােভনের মুখে পার্টি, স্তর ও কমরেডদের গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা বিঘ্ন করবাে না; শত্রুর নিকট আত্মসমর্পন করবাে। এ ধরনের কাজ করলে অপরাধ অনুযায়ী চরম শাস্তি সহ বিভিন্ন শাস্তি গ্রহণ করবাে।
৮। সুবিধাবাদ বা অন্য কোন কারণে অসার্বক্ষণিক হতে হলে পার্টির নিকট আবেদন
পৃষ্ঠা: ৩২৭

করতে হবে এবং পার্টির সিদ্ধান্ত মােতাবেক অসার্বক্ষণিক হতে হবে।
হঠাৎ কর্মস্থল থেকে পলায়ন বা এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, অনুমতি ব্যতীত অসার্বক্ষণিক হলে পার্টির কাজ ও নিরাপত্তার বিঘ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ পার্টি গ্রহণ করতে পারবে।
৯। পার্টি কোন প্রকার কারণ না দেখিয়েই এক মাসের সময়সীমা দিয়ে অসার্বক্ষণিক করে দিতে পারবে। প্রথমে কমপক্ষে এক মাস অস্থায়ী সার্বক্ষণিক হিসেবে থাকতে হবে। এ সময়কার মূল্যায়নের ভিত্তিতে সার্বক্ষণিক স্থায়ী করা হবে বা বাতিল করা হবে।
১০। কোন প্রকার মানসিক অসুস্থতা বর্তমানে নেই এবং অতীতেও ছিল না।
১২।১ কোন প্রকার দীর্ঘস্থায়ী জটিল শারীরিক অসুস্থতা নেই, শারীরিকভাবে অক্ষম।
১৩। নিকটতম আত্মীয়দের ঠিকানা এবং তাদের মনােভাব, তাদের মধ্যকার এক/একাধিক লােকের ঠিকানা উল্লেখ করা যারা গ্রেফতার হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণে সাহায্য করবে।
১৪। কোন্ এলাকায় কতদূর প্রকাশিত।
১৫। চেহারাগত এমন বিশেষত্ব আছে কি যাতে সাধারণ বাঙালী জনগণের মাঝে থেকে কাজ করতে অসুবিধা হবে?।
১৬। সুপারিশকারীর স্বাক্ষর/পরিচয়/মন্তব্য।
১৭। অনুসন্ধানকারীর স্বাক্ষর/পরিচয়/মন্তব্য।
১৮। মানােন্নয়নকারীর স্বাক্ষর/পরিচয়/মন্তব্য।
১৯। কি কি আবেদনপত্র পূরণ করেছে তা যুক্ত হবে।
…………………………………………………………………….
১. এখানে সম্ভবতঃ ক্রমিক নং ১১ হবে, নতুবা ১১ নং পয়েন্টটি পাণ্ডুলিপি থেকে বাদ পড়েছে-প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩২৮

গুরুতর নিরাপত্তার সাথে যুক্ত হবার আবেদনপত্র

পরিচালক,
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি,
আমি পার্টির নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত মেনে চলার ভিত্তিতে স্বেচ্ছায় পার্টির গুরুতর নিরাপত্তার সাথে জড়িত হচ্ছি।
১। গুরুতর নিরাপত্তার সাথে জড়িতদের সুবিধাবাদী ও দলত্যাগী হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির নীতি ও
– শেষ পর্যন্ত বুঝানাে এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা যাতে সে সুবিধাবাদী না। হয়।
– এ সময়ের মাঝে নিরাপত্তা বিঘ্ন হওয়া রােধ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া।
– এ ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে এরূপদের গুরুতর নিরাপত্তার সাথে যুক্ত না করা বা তাদের নিজেদেরও যুক্ত না হওয়া।
– সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও গুরুতর নিরাপত্তার সমস্যা হলে শত্রু এলাকায় চরম শাস্তি এবং মুক্ত এলাকায় আটক রাখা।
২। নিজে পার্টির অগােচরে পলায়ন, দলত্যাগ করবাে না; অন্যকে পলায়ন, দলত্যাগ বা সুবিধাবাদী হতে প্ররােচিত, সহায়তা করবাে না। নিজে আত্মহত্যার পদক্ষেপ নেবাে না বা অন্যকে প্ররােচিত করবাে না।
৩। গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা দলিল মেনে চলবাে।
৪। তিনটি বৃহৎ শৃঙ্খলা ও মনােযােগ দেবার আটটি ধারা এবং সংগঠনের অন্যান্য শৃঙ্খলা মেনে চলবাে।
৫। বিভিন্ন অপরাধ সংক্রান্ত পার্টির ধারা মেনে চলবাে।
৬। আত্মীয়-স্বজন সংক্রান্ত ধারা মেনে চলবাে।
৭। যৌন বা অন্য কোন প্রকার ভ্রষ্টতার সাথে যুক্ত হবে না বা অন্যকে প্ররােচিত করবাে না।
৮। শত্রুর চরম অত্যাচার, নির্যাতন বা প্রলােভনের মুখে পার্টি, স্তর ও কমরেডদের গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা বিঘ্ন করবাে না; শত্রুর নিকট আত্মসমর্পন করবাে না। এ ধরনের কাজ করলে অপরাধ অনুযায়ী চরম শাস্তি সহ বিভিন্ন শাস্তি গ্রহণ করবাে।
৯। কোন প্রকার মানসিক অসুস্থতা নেই (অতীতেও হয়নি), গুরুতর রূপে অসুস্থ নই এবং দীর্ঘস্থায়ী জটিল রােগ নেই।
১০। নিকটতম আত্মীয়দের ঠিকানা এবং তাদের মনােভাব, আইনসঙ্গত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহায়তা করতে পারে এরূপ এক বা একাধিক ঠিকানা।
১১। কোন এলাকায় কতদূর প্রকাশিত।
পৃষ্ঠা: ৩২৯

১২। সুপারিশকারীর স্বাক্ষর/সাংগঠনিক পরিচয়/মন্তব্য।
১৩। অনুসন্ধানকারীর স্বাক্ষর/পরিচয়/মন্তব্য।
১৪। মানােন্নয়নকারীর স্বাক্ষর/পরিচয়/মন্তব্য।
১৫। কি কি আবেদনপত্র পূরণ করেছে।
স্বাক্ষর
তাং
পৃষ্ঠা: ৩৩০

আঞ্চলিক মাসিক রিপাের্ট

নিম্ন শিরােনামায় রিপোর্ট পাঠাতে হবেঃ
১। সাংগঠনিক, ২। রাজনৈতিক, ৩। সামরিক,। ৪। মতাদর্শগত, ৫। অর্থনৈতিক, ৬। প্রচার, ৭। প্রাপ্ত দলিল, প্রকাশিত/প্রচারকৃত দলিলের বিবরণ, মতামত, প্রতিক্রিয়া, প্রস্তাব, ৮। নিরাপত্তা, ৯। সমস্যা, মতামত, প্রস্তাব, সমালােচনা, প্রয়ােজন, ১০। বিবিধ।

১। সাংগঠনিকঃ
ভৌগােলিক অবস্থানভিত্তিক (ম্যাপসহ) সাংগঠনিক তৎপরতার রিপাের্ট :
– গ্রাম, ইউনিয়ন, থানা, এলাকা/উপ-এলাকা, উপ-অঞ্চল ভিত্তিক রিপাের্ট।
– সার্বক্ষণিক (আবেদনকৃত, পরীক্ষামূলক, স্থায়ী)।
– একক।
– সক্রিয়।
– সহানুভূতিশীল।
– শেল্টার ইত্যাদির পরিমাণ।
– অগ্রগতি/বিপর্যয়।
– পরিকল্পনা।
– সারসংকলন।
– অঞ্চল পরিচালকের সাথে অধীনস্ত আঞ্চলিক এককের বৈঠকের বিবরণ।
– উচ্চস্তরের সাথে সংযােগের বিবরণ।
– পূর্ববর্তী রিপাের্টের তুলনায় পরবর্তী রিপাের্টে বৃদ্ধি বা কমতির পরিমাণ।

২। রাজনৈতিকঃ
– শক্রর তৎপরতা।
– অন্যান্য সংগঠনের তৎপরতা।
– আমাদের তৎপরতা।
– জনগণের শ্রেণীভিত্তিক অবস্থা।

৩। সামরিকঃ
– শক্রর সামরিক কার্যক্রম।
পৃষ্ঠা: ৩৩১

– আমাদের সামরিক কাজ।
– সামরিক লক্ষ্য।
– অস্ত্রাদির অবস্থা।
– সারসংকলন, অপারেশন শিট ইত্যাদি।

৪। মতাদর্শগতঃ
– কর্মীদের মতাদর্শগত সমস্যা।
– মানােন্নয়ন সমস্যার বিবরণ।
– সারসংকলন।

৫। অর্থনৈতিকঃ
– অর্থনৈতিক অবস্থা ও হিসেব।

৬। প্রচারঃ
– বিভিন্ন প্রচারমূলক তৎপরতার বিবরণ।
– সারসংকলন।

৭। নিরাপত্তাঃ
– বাইরের এবং আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সমস্যা, সমাধান ইত্যাদি; সারসংকলন।

– কেন্দ্রীয় দপ্তর,
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি।
পৃষ্ঠা: ৩৩২

কমরেড কবীরের পত্রাবলীর জবাব-১
(জুলাই, ১৯৭২)

(কমরেড কবীর ১৯৭২ সালে বেশ কিছু বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীতে সারসংকলনমূলক বক্তব্য ও প্রস্তাব পেশ করেছিলেন পার্টিতে। সেটাকে খণ্ডন ও বিরােধিতা করে এ নিবন্ধটি রচনা করেছিলেন কমরেড সিরাজ সিকদার, যা ‘৭২ সালে লাল ঝাণ্ডা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। রচনাটি ‘৭৪ সালে প্রকাশিত “নির্বাচিত মতাদর্শগত রচনাবলী”তে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল -প্রকাশক।]

সভাপতি মাও আমাদের শিখিয়েছেন, কমরেডদের বলতে দেওয়া উচিত। তারপর তাদের ভুল থাকলে তা উল্লেখ করা উচিত, যাতে তারা সংশােধিত হয়।
কমরেড কবীরকে কেন্দ্রীয় কমিটি তার বক্তব্য পেশের সুযােগ দিয়েছে। তার ভূলসমূহ, যা এ সকল বক্তব্য এবং তার কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তার সমালােচনা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ ভুল জমা হতে হতে এক পর্যায়ে তা মারাত্মক পরিণতির সৃষ্টি করতে পারে।
এই সমালােচনা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুটো মনােভাব রয়েছে। একটা হচ্ছে এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং ভুল সংশােধন করা, অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যতের ভুল এড়ানাের মনােভাব। ইহা হচ্ছে সৎ কমরেড, ভাল কমরেড, মার্কসবাদীলেনিনবাদী কমরেডের মনােভাব।
পক্ষান্তরে সমালােচনা আন্তরিকভাবে গ্রহণ না করা, ফজলু চক্রের মত বাইরে দেখানাে ও ভাল মানুষ সাজার জন্য আত্মসমালােচনা করা, নিজের ভুল লাইন বাস্তবায়নের জন্য ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত করা, গুজব-অপবাদ রটনা করা, উপদল গঠন করা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের চরে পরিণত হয়ে গুপ্ত হত্যা, ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা প্রভূতি হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবীদের মনােভাব।
কেন্দ্রীয় কমিটি আশা করে কমরেড কবীর প্রথমােক্ত মনােভাব গ্রহণ করবেন এবং শেষােক্ত বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল মনােভাব গ্রহণ করবেন না।
শেষােক্ত মনােভাব গ্রহণের পরিণতি হচ্ছে ফজলু চক্রের ইতিহাসের পরিণতি।
পেয়ারা বাগানে নিয়ােগের পর থেকেই কমরেড কবীরের মধ্যে গােড়ামীবাদ ধরা পড়ে। বিভিন্ন রিপাের্ট ও অনুশীলনের মাধ্যমে এগুলাে প্রকাশ পায়।
আওয়ামী লীগ ও পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের দ্বিমুখী প্রচণ্ড চাপের মুখে এ গােড়ামীবাদ হতাশাবাদ হিসেবে প্রকাশ পায়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত তার বক্তব্যে এই হতাশাবাদ ও দক্ষিণপন্থী মনােভাব প্রকাশ পায় “পার্টির বিরাট ব্যর্থতা, আগাগােড়া পার্টি বামপন্থী বিচ্যুতি করেছে” প্রভৃতি বক্তব্যের মাধ্যমে। সামরিক ও অন্যান্য লাইনের গােড়ামীবাদী বিশ্লেষণের ফলেই তিনি এই উপসংহারে পৌঁছেন। কংগ্রেসে তাকে সমালােচনা করা হয়, গােড়ামীবাদকে পার্টির প্রধান বিপদ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পৃষ্ঠা: ৩৩৩

কমরেড কবীরকে গােড়ামীবাদ পরিহার করার উদ্দেশ্যে কৃষক-শ্রমিকের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য নিয়ােগ করা হয়, লেবাস পরিবর্তন করার জন্য নয়, গােড়ামীবাদী চিন্তাধারা পরিহার করার জন্য।

গােড়ামীবাদ কি?
গগাড়ামীবাদ হচ্ছে চিন্তাধারার পদ্ধতি যা তত্ত্ব থেকে শুরু করে এবং তত্ত্বেই রয়ে। যায়। গােড়ামীবাদীরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে। গােড়ামীবাদীরা বস্তু থেকে শুরু না করে, বিশেষ অবস্থা থেকে শুরু না করে, তত্ত্ব থেকে। বিদেশী অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে, বিদেশের বিশেষ অবস্থার সমাধান নিজ দেশের সমস্যার উপর অন্ধভাবে চাপিয়ে দেয়।
দার্শনিকভাবে গােড়ামীবাদীরা কি? বস্তুর সংস্পর্শে গেলে অর্থাৎ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তু মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়। প্রথমে ইহা হচ্ছে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান।
কাজেই সকল জ্ঞানের উৎস হচ্ছে বস্তু, ইহা হচ্ছে জ্ঞানের বস্তুবাদ।
প্রতিটি বস্তুর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ কারণেই সেগুলাের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। যেমন-করিম, রহিম, আবুল প্রত্যেকেরই পৃথক অস্তিত্ব রয়েছে, এ কারণে তাদের চেনা যায়। কোন পার্থক্য না থাকলে চেনা সম্ভব হত না।
তেমনি বিভিন্ন দেশ, সে সকল দেশসমূহের বিপ্লবের সমস্যাবলী, দেশসমূহের পার্টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ কারণেই তাদের প্রত্যেকের পৃথক অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা পূর্ব বাংলাই, ভারত নয়; পূর্ব বাংলার বিপ্লব ও সর্বহারা পার্টি, ভারতীয় বিপ্লব ও পার্টি এক নয়।
একে বলে দ্বন্দ্বের বিশেষত্ব।
গােড়ামীবাদীরা বস্তুকে তার এই বিশেষত্বসহ প্রতিফলিত করে না, বস্তু থেকে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান অর্জন করে না। এ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সাহায্যে সারসংকলন করে ধারণাত্বক জ্ঞান-তত্ত্ব-প্লন-পরিকল্পনা-সাধারণ লাইন রচনা করে না অর্থাৎ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে উন্নত স্তরে উন্নীত করে না, জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতাকে১ অনুসরণ করে না। গােড়ামীবাদীরা তত্ত্ব, ধারণা অর্থাৎ পূর্ব থেকে তৈরী ধারণা, তত্ত্ব থেকে শুরু করে, সে অনুযায়ী বস্তুকে দেখে এবং বস্তুর রূপান্তরের সমস্যার সমাধান দিতে যায়।
অর্থাৎ চেতনাকে তারা দেয় প্রাধান্য, চেতনাকে বস্তু হিসেবে দেখে ঐ বস্তু সম্পর্কিত নয় এরূপ চেতনা দিয়ে বস্তুর রূপান্তরের সমাধান দিতে চায়। ইহা ভাববাদ।২ এভাবে গােড়ামীবাদীরা বস্তু থেকে চেতনায় না যেয়ে তারা চেতনা থেকে বস্তুতে যায়, চেতনা অনুযায়ী বস্তুকে দেখে। তাদের মতে বস্তু হচ্ছে কতগুলি চেতনার সমষ্টি (Complex of senses)!
ইহা হচ্ছে ভাববাদ, এ কারণে গােড়ামীবাদীরা ভাববাদী। বস্তু-চেতনা-বস্তু অর্থাৎ অনুশীলন-জ্ঞান-অনুশীলনের পরিবর্তে তারা চেতনা- (বস্তু থেকে না নিয়ে ফমূলা, উদ্ধৃতি থেকে নেওয়া) বস্তু এই পথ অনুসরণ করে।
এভাবে তারা নদীকে উৎসহীন, গাছকে শিকড়হীন ভাবার অনুরূপ চেতনার উৎস বস্তু একথা অস্বীকার করে।
পৃষ্ঠা: ৩৩৪

এভাবে গােড়ামীবাদীরা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে পরিপূর্ণ বিসর্জন দেয়, ভাববাদী ও অধিবিদ্যক হয়।
গােড়ামীবাদীরা কতগুলাে তত্ত্ব, ফর্মূলা মুখস্থ করে তা আওড়ায়, নিজেদেরকে মস্ত পণ্ডিত মনে করে, লেজ ফুলিয়ে আকাশে তুলে, তত্ত্ব না জানা কমরেডদের বুলি আউড়ে তাক লাগিয়ে দেয়।
ফলে তাদের মধ্যে নেতৃত্ব লােভ, সবজান্তা পণ্ডিত মনােভাবের সৃষ্টি হয়। চীনা পার্টি এ ধরনের গােড়ামীবাদীদের দ্বারা বহুবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পূর্ব বাংলার ও ভারতের বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি করেছে সকল গােড়ামীবাদীরা।
সভাপতি মাও বলেছেন, “তত্ত্ব অনুশীলন সমন্বয় সাধন করতে না পেরে (গােড়ামীবাদী হয়ে-লেখক) চীনের বহু কমিউনিস্ট সংশােধনবাদী হয়ে গেছে।”
কমরেড কবীরকে পেয়ারা বাগানে নিয়ােগের সময় একটি গাইড লাইন দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রিপাের্ট প্রদানের সময় গাইড লাইন প্রয়ােগের কোন উল্লেখ না করে তিনি কতগুলাে উদ্ধৃতি ভরে রিপাের্ট পাঠান।
পরবর্তীকালে পেয়ারা বাগান থেকে ২নং ফ্রন্টের পশ্চাদপসরণের সময়কালীন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে রিপাের্টে বিশদভাবে উল্লেখ না করে সমস্ত রিপাের্ট কমরেড আসাদকে নিয়ে লেখেন।
এ সময় বস্তুগত অবস্থা অর্থাৎ আমাদের অবস্থা, জনগণের অবস্থা, শত্রুর অবস্থা, উত্থাপিত সমস্যাবলী, তার সমাধান, কেন্দ্র প্রদত্ত নির্দেশ প্রয়ােগের ফল প্রভৃতি মস্তিষ্কে প্রতিফলিত না করে কতগুলাে উদ্ধৃতি, গৌণ বিষয় দ্বারা রিপোের্ট পূর্ণ করে পাঠান। এভাবে তার মধ্যকার গােড়ামীবাদ ধরা পড়ে।
গােড়ামীবাদীরা সামগ্রিক পরিস্থিতি অর্থাৎ বস্তুর মধ্যকার দ্বন্দ্বসমূহ, প্রধান দ্বন্দ্ব, দ্বন্দ্বের প্রধান দিক, বাইরের শর্ত অর্থাৎ অন্য বস্তুর সাথে এর সম্পর্ক, তার অবস্থান মস্তিষ্কে প্রতিফলিত করে না। ফলে তারা হয় একতরফাবাদী এবং হতাশাগ্রস্ত।
পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের ও ছয় পাহাড়ের দালালদের প্রচণ্ড চাপে কমরেড মাসুমের নিকট থাকাকালীন কমরেড কবীর হতাশ হয়ে পড়েন, “চীন-বার্মা-ভারতের বিপ্লবীদের সাথে যােগাযােগ করে অস্ত্র আনা এবং তার সাহায্যে কৃষকদের সশস্ত্র করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই” এমনি কথা বলেন।
তাকে মাথা ঠাণ্ডা রেখে বস্তুকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করা ও গােড়ামীবাদ পরিহার করার পরামর্শ দিয়ে কমরেড সিরাজ সিকদার পত্র দেন।
পরবর্তীকালে কমরেড কবীর কংগ্রেস রিপাের্টে আমাদের বিরাট সফলতাকে বিরাট ব্যর্থতা, পার্টির সঠিক সামরিক, রাজনৈতিক লাইনকে আগাগােড়া বামপন্থী হঠকারী লাইন বলে উল্লেখ করেন, ২নং ফ্রন্টের অবস্থার বিশেষত্ব মাথায় প্রতিফলিত না করে চিং কিয়াং পর্বতমালায় সভাপতি মাও যে রণনীতি গ্রহণ করেছেন তা প্রয়ােগ না করার কারণে সকল ভুল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।৩
কংগ্রেসে কমরেড কবীরের বড় বড় তত্ত্ব ও কথা তত্ত্ব না জানা কমরেডদের তাক লাগিয়ে দেয়, না বুঝে তারা কেউ কেউ একে সমর্থন করেন। এভাবে তত্ত্ব না জানা কমরেডরা গােড়ামীবাদের লেজুড়বৃত্তি করেন।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে চেন তাও শিউ এ ধরনের গােড়ামীবাদী ছিল, শেষ পর্যন্ত ১৯২৭ সালে চিয়াং কাইশেকের প্রচণ্ড হামলায় সে বিপ্লবের প্রতি হতাশ হয়ে যায় এবং
পৃষ্ঠা: ৩৩৫

দক্ষিণপন্থী হিসেবে প্রকাশ পায়। ট্রটস্কীবাদী হয়ে চিয়াংয়ের এজেন্টে পরিণত হয়।
এ ধরনের গােড়ামীবাদী লিলিশান ও অন্যান্যরা চীনা পার্টির নেতৃত্বে একাধিকবার অধিষ্ঠিত হয় এবং বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায়, চিংকিয়াং ঘাটি এলাকা হাতছাড়া হয়, লক্ষ লক্ষ কমরেড প্রাণ হারায়, লংমার্চ করতে হয়।
কমরেড কবীরের রিপাের্ট কংগ্রেসে গ্রহণ করার অর্থ হতাে পার্টি দক্ষিণপন্থী ও হতাশাবাদী পার্টিতে পরিণত হওয়া। এবং পার্টি অনিবার্যভাবেই বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হতাে।
এ কারণে গােড়ামীবাদীদের কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক কোন স্তরের নেতৃত্বেই রাখা উচিত নয়। তারা বিপ্লবের জটিল অবস্থায় হতাশ হয়ে দক্ষিণপন্থী হন বা বামপন্থী হঠকারিতা করে বিপ্লবের চরম ক্ষতি সাধন করেন।
এ কারণেই ৪নং জেলা আহ্বায়ক কমিটি গঠনের দায়িত্ব কমরেড সিরাজ সিকদারের নিকট এলে তিনি কমরেড কবীরকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করেননি।
কমরেড কবীর প্রথমে তার এলাকা ও কমরেড ঝিনুকের এলাকা নিয়ে যুক্ত এলাকা গঠনের জন্য খুবই উৎসাহ প্রদর্শন করেন। কমরেড সিরাজ সিকদার তাদেরকে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে রিপাের্ট করতে বলেন। কিন্তু কমরেড কবীর কমরেড সিরাজ সিকদারকে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দিতে বলেন। কমরেড সিরাজ সিকদার কমরেড কবীরকে সদস্য এবং অন্য এক কমরেডকে আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করে দেন।
কিন্তু কমরেড কবীর এ কমিটি গঠনের পর তার এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে সরাসরি কেন্দ্রের অধীন আনতে বলেন। কমরেড ঝিনুকের কেডার ইতিহাস ঠিক নয় এ অভিযােগ আনেন, কমরেড সিরাজ সিকদার অন্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন, অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদারের ঘনিষ্ঠ কাউকে কমরেড কবীর সমালােচনা করেছে এ কারণে কমরেড সিরাজ সিকদার প্রতিশােধবাদী হয়ে কমরেড কবীরকে আহ্বায়ক করেননি এ ধরনের মনােভাবের প্রকাশ করেন।
আহ্বায়ক কমিটির মধ্যে থাকলেও যার যার এলাকায় স্বতন্ত্র কাজ হবে এ মনােভাব (যা দুর্গ গঠনের মনােভাব), বিভিন্ন কাজে আহ্বায়কের অনুমতি গ্রহণের প্রয়ােজন অনুভব করা, গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাচ্ছিল্য, অসহযােগ প্রদর্শন করেন।
কমরেড কবীর প্রায়ই বলেন অনেকের তাত্ত্বিকমান নীচু, অর্থাৎ তার তুলনায় নীচু, অতএব তাকে উঁচু পদে নিয়ােগ করা উচিত; এমন ভাব তার মাঝে প্রকাশ পায়।
সম্প্রতি কমরেড কবীর কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন বিভিন্ন দলিল লেখার জন্য একটি লেখক বাের্ড৪ গঠনের প্রস্তাব দেন এবং সিনিয়র কমরেডদের তাতে নিতে বলেন। অর্থাৎ তাকেও যাতে নেওয়া হয় ইহা প্রচ্ছন্নভাবে বলা হয়েছে।
এভাবে দেখা যায় কমরেড কবীরের মাঝে পদের, নেতৃত্বের লােভ বর্তমান।
ফজলু চক্র চেয়েছিল কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বকে পুরােপুরি প্রতিক্রিয়াশীল বলে তাকে ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মাধ্যমে উৎখাত করা।
কমরেড কবীরের লেখক সংঘ গঠনের কথা বলার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ করা, খর্ব করা অথবা কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিকাকে সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া। তার এ মনােভাব প্রকাশ পেয়েছে তার লেখায় “আপনার (সিরাজ সিকদার) পক্ষে এত কিছু লেখা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়তঃ পার্টির পক্ষে এক ব্যক্তি নির্ভরশীল ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়া ঠিক নয়। কেন্দ্রীয় কমিটির ভূমিকাকেও তিনি এ কথার মাধ্যমে
পৃষ্ঠা: ৩৩৬

অস্বীকার করেছেন। ক্রুশ্চোভ যৌথ নেতৃত্বের কথা এবং স্ট্যালিনের তথাকথিত ব্যক্তিতাবাদ বিরােধীতার কথা বলে স্ট্যালিনকে উৎখাত করেছে।
লিউ শাওচি সভাপতি মাওয়ের রচনাবলীর ব্যাপক প্রচার এবং তার চিন্তাধারার প্রচার ও প্রয়ােগের এক হাজার একটি বাধা সৃষ্টি করে, যাতে জনগণ সভাপতি মাওয়ের চিন্তাধারার সাথে পরিচিত না হন, তিনি যাতে ব্যাপক পার্টি কমরেড ও জনগণের আস্থা ও তাদের জনপ্রিয়তা অর্জন না করেন। এর কারণ, তাহলে তাকে উৎখাত করে নেতৃত্ব দখল করা সহজ হবে।
কমরেড কবীরও এ সকল কথা বলে কি নিজের অজ্ঞাতে লিউ শাওচির মনােভাব প্রকাশ করছেন না? অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদারের ভূমিকা যত কম জানানাে যায়, তাঁর জনপ্রিয়তা যাতে কম হয়, তার উপর কর্মীদের আস্থা কম হয় এবং তাকে যাতে সহজেই উৎখাত করে নেতৃত্ব দখল করা যায়, এ মনােভাব প্রকাশ কি হয়নি কমরেড কবীরের বক্তব্যে?
সভাপতি মাও বলেছেন, “বিপ্লবী আর প্রতিবিপ্লবী হােক ক্ষমতা দখলের পূর্বে প্রয়ােজন জনমত সৃষ্টি করা।”
কমরেড সিরাজ সিকদারের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার অর্থ হচ্ছে বিপ্লবী নেতৃত্বের পক্ষে, পার্টির বিপ্লবী নেতৃত্বের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পক্ষে এবং প্রতিক্রিয়াশীল, প্রতিবিপ্লবী ও খারাপ লােকদের বিপক্ষে জনমত সৃষ্টি করা।
ক্রুশ্চোভ-লিউ শাওচি, তাদের শিষ্য ফজলু এ কারণেই বিপ্লবী নেতৃত্বের জনপ্রিয়তার বিপক্ষে, তাকে হ্রাস করতে, তাকে খর্ব করতে সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালায়। বিপ্লবী নেতৃত্বের জনপ্রিয়তায় প্রতিক্রিয়াশীলদের গা জ্বালা করে। কমরেড কবীরের কথার মধ্যে এ মনােভাবের প্রকাশ ঘটেছে।
আমাদের সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে এবং সভাপতি মাও বলেছেন, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও যৌথ নেতৃত্বের দুটোই বজায় রাখতে হবে।
একটাকে অতিরিক্ত জোর দিয়ে অন্যটাকে খর্ব করা ঠিক নয়।
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীরা ও প্রতিক্রিয়াশীলরা বিপ্লবী নেতৃত্বের ব্যক্তিগত উদ্যোগকে বিরােধিতা করে এবং যৌথ নেতৃত্বের উপর জোর দেওয়ার নামে প্রকৃতপক্ষে বিপ্লবী নেতৃত্বকে উৎখাত করে প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা দখল করে। সেখানে পুনরায় তারা প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপে ব্যক্তি বিশেষের প্রধান ভূমিকা ও স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে, গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্বকে বিসর্জন দেয়।
ক্রুশ্চেভ যৌথ নেতৃত্বের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র ও যৌথ নেতৃত্বকে বিসর্জন দেয়, স্বৈরতন্ত্র কায়েম করে। ফজলু চক্রও তাই চেয়েছিল।
পক্ষান্তরে বিপ্লবী নেতৃত্ব ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগের পূর্ণ বিকাশের সুযােগ দেয়, যৌথ নেতৃত্ব ও গণতন্ত্র বজায় রাখে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে কমরেড সিরাজ সিকদারের ব্যক্তিগত উদ্যোগের পরিপূর্ণ সুযােগ প্রদান করা হচ্ছে, একই সাথে কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার নির্দেশ, প্রস্তাব পেশ, আলােচনা, পর্যালােচনা, সংশােধন ও সংযােজন ও অন্যান্যদের প্রস্তাব পেশ ও বিবেচনা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনুমােদনের মাধ্যমে যৌথ নেতৃত্ব ও গণতন্ত্র কার্যকরী হচ্ছে। কমরেড কবীর কমরেড সিরাজ সিকদারের ও তার সাথে যুক্ত কমরেডদের রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও মতাদর্শগত ভুল-ভ্রান্তির বিষয় উল্লেখ না করে
পৃষ্ঠা: ৩৩৭

এ সকল বাস্তব অবস্থাকে বাদ দিয়ে কমরেড কবীর কতগুলাে মন্ত্রের মত দলিল প্রণয়নের কথা বলে সংগঠনের ও সমাজের বাস্তবতাকে বাদ দিয়েছেন।
কমরেড কবীর লিখেছেন, “তারা (অর্থাৎ সাধারণ কমরেডরা) জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে মুজিববাদের মত কমরেড সিরাজ সিকদারের মস্তিষ্কপ্রসূত বলে মনে করে।”
আমাদের সকল কমরেড, এমনকি অনেক জনগণও জানেন, মুজিববাদ মুজিবের মস্তিষ্ক প্রসূত নয়,ইহা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সৃষ্টি। ইহা জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ।
পক্ষান্তরে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল (বর্তমান পর্যন্ত) কমরেড সিরাজ সিকদারের মস্তিষ্কপ্রসূত (বস্তু থেকে চেতনা, চেতনা থেকে বস্তুতে প্রয়ােগের ভিত্তিতে)। কমরেডরা যদি এই চিন্তা করেন, ইহা নেতৃত্বের প্রতি আস্থার পরিচায়ক এবং ইহা সত্যের প্রতিফলন। এর মধ্যে অন্ধ ক্রিয়াবাদের প্রকাশ কোথায়?
প্রকৃতপক্ষে ক. কবীর বােঝাতে চেয়েছেন, যে সকল কমরেড ক. সিরাজ সিকদারকে জিন্দাবাদ দেন, কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রতি আস্থাশীল তারা অন্ধক্রিয়াবাদী। তারা অন্ধভাবে কাজ করে ইত্যাদি। অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদারকে জনপ্রিয় করা উচিত নয়।
এ সকল কথা ফজলু চক্রের কথারই প্রতিধ্বনি মাত্র। কমরেড কবীর এক স্থানে লিখেছেন আমাদের তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির তত্ত্বগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে কি?
পূর্ব বাংলার বিপ্লবের প্রশ্নে, পার্টির বিকাশের প্রশ্নে এমন কোন সমস্যা উত্থাপিত হয়েছে কি যার তত্ত্বগত সমাধান পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি দিতে পারেনি? পার্টি প্রতিটি উত্থাপিত সমস্যার সমাধান দিয়েছে। কমরেড কবীর চোখ বুজে রয়েছেন, পার্টির। বিকাশের পর্যায়ে উত্থাপিত সমস্যাবলীর সমাধান দেখতে পান না, তাই একথা বলেছেন। এ মনগড়া সীমাবদ্ধতা আবিষ্কারের অর্থ হচ্ছে নেতৃত্ব ও কেন্দ্রীয় কমিটির। অক্ষমতা ও অযােগ্যতা প্রমাণ করা।
নেতৃত্বের শূন্যতা ও নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী সম্পর্কে কমরেড কবীর পুরােপুরি গােড়ামীবাদী মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নেতৃত্বের শূন্যতা দূর করা, উত্তরাধিকারী তৈরীর জন্য “Board of Writers গঠন এবং তত্ত্বগত গবেষণা, লেখাপড়া, বিপ্লবের বিভিন্ন প্রশ্নে তাত্ত্বিক গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখা” প্রভৃতি পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরাে বলেছেন, শুধু অনুশীলনই যথেষ্ট নয়, মূল প্রশ্ন হচ্ছে অনুশীলনের অভিজ্ঞতার সার সংকলন করে তাকে তাত্ত্বিক পর্যায়ে উন্নীত করা।
তার এ সকল উক্তি লিউ শাওচির ‘ঘরের মধ্যে বই পড়ে ভাল কমিউনিস্ট হওয়ার অনুরূপ।
জ্ঞানের মৌলিক প্রশ্ন অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে তাত্ত্বিক পর্যায়ে উন্নীত করা নয়, ইহা জ্ঞানের প্রক্রিয়ার অর্ধেক এবং কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জ্ঞানের মূল সমস্যা হলাে তত্ত্বকে অনুশীলনে প্রয়ােগ করা, তত্ত্বকে বস্তু পরিবর্তনে প্রয়ােগ করা, সে অনুযায়ী বস্তুকে রূপান্তরিত করে যাচাই করা। এ প্রয়ােগের প্রক্রিয়া হচ্ছে জ্ঞানের প্রক্রিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তর, মূল সমস্যা জ্ঞান ভুল কি নির্ভুল তা নির্ণয় হয় এ স্তরে। কাজেই মূল প্রশ্ন প্রয়ােগ, অনুশীলনে তত্ত্বকে যাচাই করা, বস্তুকে রূপান্তর করা। ক. কবীর এই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞান তত্ত্বকে উল্টে ফেলেছেন।
মার্কস বলেছেন, “দার্শনিকরা এতদিন শুধু দুনিয়াকে বিশ্লেষণ করেছে, কিন্তু প্রধান সমস্যা হচ্ছে দুনিয়াকে রূপান্তর করা। কাজেই তত্ত্ব প্রণয়নের জন্য বিপ্লব করা হয় না, ইহা
পৃষ্ঠা: ৩৩৯

বিপ্লবের মূল প্রশ্ন নয়। দুনিয়াকে পরিবর্তন করাই হচ্ছে বিপ্লবের মূল প্রশ্ন। সর্বহারারা তত্ত্ব সৃষ্টির জন্য বিপ্লব করে না, সমাজ ও দুনিয়াকে পরিবর্তন করার জন্য বিপ্লব করে।
ক. কবীরের কথায় প্রকাশ পায় বিপ্লব করা হচ্ছে অনুশীলনকে তাত্ত্বিক পর্যায়ে। উন্নীত করার জন্য। তার এ কথা সম্পূর্ণ মার্কসবাদ বিরােধী। ইহা গােড়ামীবাদ।
কমরেডদের ট্রেনিং ও উত্তরাধিকারীদের লালন-পালনের শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি গবেষণা নয় [যা প্রতিক্রিয়াশীল একাডেমিশিয়ান, বিশেষজ্ঞ, সংশােধনবাদী তেরী করে]। শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হচ্ছে প্রত্যেককে বিপ্লবী অনুশীলনের মহান গণসংগ্রামে নিয়ােগ করা, অনুশীলনে সৃজনশীলতার বিকাশের পূর্ণ সুযােগ দেওয়া। এখান থেকে বেরিয়ে আসবে কমরেড, যারা তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে সমন্বিত করতে সক্ষম। সৃজনশীলভাবে মার্কসবাদ প্রয়ােগ করে বিপ্লবের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম।
কমরেড কবীর লিখেছেন, “পার্টি বিয়ােগ সিরাজ সিকদার= প্রায় ০”। এ সমীকরণ ঠিক নয়। আমাদের ভাবা উচিত নয়, “কাউকে ব্যতীত পৃথিবী ঘােরা বন্ধ হয়ে যাবে।” অর্থাৎ কমরেড সিরাজ সিকদার ব্যতীত পূর্ব বাংলার বিপ্লব বন্ধ হয়ে যাবে, পার্টি ধ্বংস হয়ে যাবে এ ধারণা সম্পূর্ণ মার্কসবাদ বিরােধী।
পূর্ব বাংলার সমাজের গতিধারার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে বিপ্লবী পার্টি ও নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। কমরেড সিরাজ সিকদারের অনুপস্থিতিতে আন্তরিক বিপ্লবীরা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তাদের যােগ্যতা মত পার্টি ও বিপ্লব পরিচালনা করবেন।
ক. কবীর নেতৃত্ব ও উত্তরাধিকারীর প্রশ্নে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের পরিবর্তে ঐতিহাসিক ভাববাদ অর্থাৎ ব্যক্তি বিশেষ ব্যতীত সামাজিক পরিবর্তন ও বিপ্লব হবে না, শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রাম থেকে নয়-লেখক বাের্ড’, চার দেওয়ালের মাঝ থেকে বেরিয়ে আসবে উত্তরাধিকারীরা—এ সকল তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন।
প্রথমে তিনি কমরেড সিরাজ সিকদারের অবদান সম্পূর্ণ অস্বীকার করতে চেয়েছেন, পরে সিরাজ সিকদার ব্যতীত পার্টি শূন্য বলে নিজ বক্তব্যকে নিজেই খণ্ডন করেছেন। তার এই পরস্পর বিরােধী দুটো বক্তব্যই ভুল।
তিনি লিউ শাওচির মত প্রবন্ধ রচনা, গবেষণাগারের চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে ভাল কমিউনিস্ট হওয়ার মনােভাবের প্রকাশ করেছেন।
কমরেড সিরাজ সিকদারের উত্তরাধিকারী বেরিয়ে আসবে গণ সংগ্রামের প্রক্রিয়ায়, লেখক বাের্ডের মাধ্যমে নয়। লেনিন, স্ট্যালিন, মাওসেতুঙ এরা লেখক বাের্ড থেকে বেরিয়ে আসেননি।
কমরেড সিরাজ সিকদারও কোন লেখক বাের্ড থেকে বেরিয়ে আসেননি। এরা সকলেই শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের ঝড়তরঙ্গের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছেন।
লেখক বাের্ড থেকে বেরিয়ে আসে কাউটস্কি, বার্নেস্টাইন, কুশ্চেভ, লিউ শাওচি, হক-তােয়াহা, দেবেন-মতিন, কাজী-রণাে ও অন্যান্য সংশােধনবাদীরা।
কাজেই কমরেডদের সৃজনশীলতা বিকাশের ক্ষেত্রে কমরেড সিরাজ সিকদারের উদ্যোগের অভাব রয়েছে, কমরেড কবীরের এ অভিযােগ সম্পূর্ণ ভুল। তবে গােড়ামীবাদী উদ্যোগ বিকাশের ক্ষেত্রে কমরেড সিরাজ সিকদারের প্রকৃতই বিরােধিতা রয়েছে।
সভাপতি মাও বলেছেন, “একটি সত্যিকার তত্ত্ব রয়েছে যা অনুশীলন থেকে আসে এবং অনুশীলনে পরীক্ষিত।” এ ধরনের তত্ত্ব সম্বলিত দলিল যে কেউ প্রণয়ন করলে পার্টি তা গ্রহণ করবে। কাজেই দলিল প্রকাশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র নেই এ অভিযােগের অর্থ হচ্ছে। কেন ক. কবীরের দলিল প্রকাশ করা হয় না।
পৃষ্ঠা: ৩৪০

ক. কবীর দুটো দলিল লিখেছিলেন যা তত্ত্ব থেকে শুরু করে তত্ত্বেই রয়ে যায়। অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করা, তার সারসংকলন করে সাধারণ নিয়ম রচনা করে এবং তা প্রয়ােগ করে যাচাই না করেই তিনি দলিল লেখেন।
তাকে বলা হয়েছিল, “তুমি নিজেই এ তত্ত্বগুলি প্রয়ােগের মাধ্যমে যাচাই করে পাঠাও।”
বিভিন্ন দলিল প্রকাশ সম্পর্কে ক. কবীর গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটাবার কথা বলেছেন। অর্থাৎ তাকেও কেন সুযােগ দেওয়া হয় না এ কথাই তিনি বলতে চেয়েছেন। এ অভিযোেগ তিনি কমরেড তাহের ও কমরেড শহীদের বরাত দিয়েও করেছেন।
পার্টির পক্ষে দলিল কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক অনুমােদিত, লাল ঝাণ্ডার জন্য লাল ঝাণ্ডার সম্পাদক মণ্ডলীর অনুমােদিত হতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ দলিল প্রকাশ করতে পারেন, কিন্তু পার্টির নামে নয়। কমরেড কবীর গােড়ামীবাদী দলিল না। ছাপানোেয় বিক্ষুব্ধ।
দলিল প্রকাশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র দাবী করেন, লেখক বাের্ড গঠন করতে চান ইত্যাদি।
কমরেড কবীর সম্প্রতি কাজের রিপাের্ট করতে যেয়ে কৃষকের মাঝে কৃষক হয়ে কাজের পার্টি লাইনের সঠিকতা, জাতীয় শত্রু খতমের লাইনের সঠিকতা উল্লেখ করেও পুলিশ ফাঁড়ি [৭৮ জনের] আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। জাতীয় শত্রু খতম না করে এ ধরনের হামলায় যাওয়া হচ্ছে হঠকারিতাবাদ।
এভাবে গােড়ামীবাদীরা সহজে বামপন্থী বিচ্যুতি ঘটায় ও হঠকারিতা করে।
এর পরিণতি হিসেবে হতাশা ও পলায়নবাদের আশ্রয় নেয়, শেষ পর্যন্ত তারা দক্ষিণপন্থী হয়ে যায়। গােড়ামীবাদীরা তত্ত্ব না জানা কমরেডদের বড় বড় তত্ত্ব বলে তাক লাগিয়ে দেয়। এর ফলে তত্ত্ব না জানা কমরেডরা তাদের লেজুড়বৃত্তি করে। এভাবে ইহা পার্টির মাঝে মারাত্মক বিপদ হিসেবে দেখা দেয়।
পেয়ারা বাগানের পর ক. কবীর বিপ্লবের প্রতি পলায়নবাদের আশ্রয় নেন, হতাশ হয়ে পড়েন, শেষ পর্যন্ত দক্ষিণপন্থী হন এবং পার্টির সফলতাকে চরম বিফলতা বলেন, পার্টির সঠিক লাইনকে বামপন্থী হঠকারিতা বলে আক্রমণ করেন।
বামপন্থী হঠকারিতাবাদ-পলায়নবাদ-দক্ষিণপন্থী হতাশাবাদ এই গােড়ামীবাদী সাইকেলে পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা রয়েছে ক. কবীরের মাঝে। সম্প্রতি সামরিক ক্ষেত্রে পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণে তার বামপন্থী হঠকারিতা প্রকাশ পেয়েছে।
প্রতিটি লেখা-কথা-কাজের মাধ্যমে একজনের বিশ্ব দৃষ্টিকোণের প্রতিফলন ঘটে। কাজেই নিজের প্রকৃত স্বরূপ গােপন রাখা সম্ভব নয়।
ক. কবীর তার লেখা-কথা-কাজের মাধ্যমে তার বিশ্ব দৃষ্টিকোণ প্রকাশ করেছেন। তিনি গােড়ামীবাদী তাই ভাববাদী, অধিবিদ্যক। এ থেকে এসেছে নিজেকে তত্ত্ববাগীশ মনে করার মনােভাব এবং নেতৃত্বের যােগ্য মনে করা, নেতৃত্বের, পদের লােভ।
উপসংহার আসে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, জ্ঞাতে হােক অজ্ঞাতে হােক বিশ্লেষণ হয় বিশ্ব দৃষ্টিকোণের ভিত্তিতে। পৃথিবীতে মৌলিকভাবে সর্বহারা ও বুর্জোয়া এ দুটি বিশ্ব দৃষ্টিকোণ রয়েছে।
কাজেই উপসংহারের অভিন্নতা অর্থাৎ একই উপসংহার প্রমাণ করে বিশ্ব দৃষ্টিকোণের অভিন্নতা।

বিভিন্ন প্রশ্নে ফজলু চক্রের উপসংহারের সাথে ক. কবীরের উপসংহারের মিল প্রমাণ। করছে তাদের বিশ্ব দৃষ্টিকোণের অভিন্নতাকে। অর্থাৎ তাদের উভয়েরই বিশ্ব দৃষ্টিকোণ।
পৃষ্ঠা: ৩৪১

হচ্ছে ভাববাদ ও অধিবিদ্যা যা ব্যক্তি স্বার্থকে (নেতৃত্ব, পদ, নাম-যশের লােভ ও অন্যান্য ব্যক্তি স্বার্থ) কেন্দ্র করে আবর্তিত।
কমরেড কবীরের অতীতের প্রতিক্রিয়াশীল ভ্রষ্ট জীবন এবং ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী ভিত্তি এবং উপরােক্ত ক্রটিসমূহ এক্ষেত্রে খুবই মারাত্মক।
কাজেই বিপ্লব, পার্টি ও জনগণের স্বার্থে কমরেড কবীরকে নিজের সম্পর্কে এবং কমরেডদের তার সম্পর্কে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। অন্যথায় বিপ্লবের যে কোন চরম ক্ষতিসাধন তিনি করতে পারেন।
[অসমাপ্ত]

নােট :
১। জ্ঞানের দ্বান্দ্বিকতা হচ্ছে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে ধারণাত্মক জ্ঞানে উন্নীত করা এবং ধারণাত্মকজ্ঞানকে বিপ্লবী অনুশীলনে প্রয়ােগ করা। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে ধারণাত্মক জ্ঞানে উন্নীত করা হচ্ছে গােটা জ্ঞানের প্রথম স্তর এবং কম গুরুত্বপূর্ণ স্তর। ধারণাত্মক জ্ঞানকে বিপ্লবী অনুশীলনে প্রয়ােগ করা, এ দ্বারা বস্তুকে রূপান্তর করতে লেগে থাকার মাধ্যমে এ জ্ঞানকে যাচাই করা হচ্ছে গােটা জ্ঞানের প্রক্রিয়ার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ স্তর।
২। ভাববাদীরা চেতনাকে দেয় প্রথম স্থান। চেতনাকে বস্তু হিসেবে দেখে। একটি গাছ মনের মধ্যে চিন্তা হলাে তাই বাইরে গাছটি দেখলাম। পক্ষান্তরে বস্তুবাদীরা বস্তুকে দেয় প্রথম স্থান, আর চেতনা হচ্ছে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুর মস্তিষ্কে প্রতিফলন। চেতনায় থাক বা না থাক বস্তু বিরাজ করছে। এর অর্থ হচ্ছে মানুষ চিন্তা করুক বা না করুক গাছ রয়েছে, গাছ সম্পর্কিত চিন্তা বা ধারণা গাছ দেখার পর হয়, অর্থাৎ চোখ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে গাছ মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয় তখন গাছ দেখা হয়, গাছ সম্পর্কিত ধারণা বা চেতনা হয়।
৩। প্রচণ্ড চাপের মুখে আমাদের গেরিলাদের বিভক্ত করা, ছড়িয়ে দেওয়া এবং শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে বহু গেরিলা ও কর্মী বেঁচে যায়। পক্ষান্তরে কমরেড কবীরের তত্ত্ব প্রয়ােগ করার অর্থ হলাে আমাদের দুর্বল গেরিলাদের একত্র করা, ছয় পাহাড়ের দালালদের মােকাবেলা করা, শেষ পর্যন্ত খতম হয়ে যাওয়া।
৪। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যকার ব্যক্তি বিশেষের দলিল প্রণয়ন সম্ভব না হলে তখন লেখক বাের্ড গঠন করা হবে। যেমন History of the C.P.S.U.(B) প্রণয়নের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। চীনে বর্তমানে অনেক কারখানা ও বিপ্লবী কমিটির অধীন লেখক গ্রুপ রয়েছে। এদের কাজ সম্পাদকমণ্ডলীর মত বহু তথ্য সংগ্রহ করা, গবেষণা করা। ব্যক্তিবিশেষের পক্ষে অসম্ভব বলে এগুলাে করা হয়েছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির বর্তমান স্তরে কেন্দ্রীয় কমিটির এমন কোন সমস্যা নেই, দ্বিতীয়তঃ উদ্বৃত্ত কর্মী নেই যে লেখক বাের্ড গঠন করা যায়। বর্তমানে এ প্রস্তাব সম্পূর্ণ অবাস্তব।
পৃষ্ঠা: ৩৪২

সম্পাদকীয়, লাল ঝাণ্ডা/৩
(জুলাই, ১৯৭২)
চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টিতে প্রতিদিনই সমগ্র সংগঠন ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে, গভীরতর হচ্ছে।
চক্র বিরােধী সংগ্রামে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি মতাদর্শগত ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে বিরাট বিজয় অর্জন করেছে।
চক্রের মতাদর্শগত ভিত্তি লাল ঝাণ্ডায় ও অন্যান্য দলিলে তুলে ধরা হচ্ছে; চক্র বিরােধী মতাদর্শগত সংগ্রাম জোরদার হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে চক্রান্তকারীরা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ পুতুল সরকারের চরে; দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের চরে পরিণত হয়েছে। তাদের এই পরিণতি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি পূর্বেই নির্দেশ করেছিল।
সাংগঠনিক ভাবে চক্রান্তকারীদের বহিষ্কার করা হয়েছে। সংগঠনের অভ্যন্তরে ও বাহিরে তাদের সাথে যুক্তদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।
চক্রান্তকারীদের অপরাধের গুরুত্বের ভিত্তিতে বিশ্বাসঘাতক ফজলু ও তার এক সহযােগীকে আমাদের বীর গেরিলারা দৈহিক ভাবে নির্মূল করেছেন।
এগুলাে হচ্ছে শত্রু বিরােধী সংগ্রামের বিরাট বিজয়। পূর্ব বাংলার ইতিহাসে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি সর্ব প্রথম এ ধরনের আলােড়ন সৃষ্টিকারী তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সৃষ্টি করেছে। বিপ্লবীদের জন্য ইহা আনন্দের সংবাদ, পক্ষান্তরে বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও দেশীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের জন্য মারাত্মক দুঃখের সংবাদ।
চক্রান্তকারীরা ফ্যাসিস্ট বাংলাদেশ সরকারের চর হিসেবে কমরেডদের ধরিয়ে দেওয়া ও তাদের হত্যার প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এটা তাদের মৃত্যু শয্যার শেষ সংগ্রাম।
কাজেই সমগ্র পার্টিকে অবশ্যই সতর্কতা বজায় রেখে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। চক্র বিরােধী সংগ্রামকে আরাে বিস্তৃত করতে হবে।
চক্রান্তকারীদের সাথে মতাদর্শগত ভাবে এক হয়ে নেতৃত্ব না পাওয়ার কারণে যারা চক্রে যায়নি, ভাগ্যান্বেষী, নেতৃত্ব ও পদ-লােভী, নাম-যশলােভী, চক্ৰসৃষ্ট প্রতিকূলতার সুযােগ সন্ধানীদেরও উন্মােচিত করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে সমালােচনা, সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে এবং তাদেরকে রূপান্তর করতে হবে।
চক্র বিরােধী সংগ্রামকে শুদ্ধি অভিযানের সাথে সম্পর্কিত করতে হবে। চক্রকে শুদ্ধি অভিযানের নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় মতাদর্শগত সংগ্রামই হচ্ছে প্রধান দিক। সমগ্র সংগঠনে এই মতাদর্শগত সংগ্রামই হচ্ছে প্রধান কাজ।
পার্টির বিজয় ও টিকে থাকা, পার্টির অন্যান্য কাজ, সশস্ত্র সংগ্রাম, নতুন কর্মী। বাড়ানাে; সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণের সফলতা নির্ভর করছে চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের সাফল্যের উপর এবং বিশেষ করে মতাদর্শগত সংগ্রামের সাফল্যের উপর।
এ সংগ্রামে সফল না হওয়ার অর্থ হচ্ছে পার্টি সুবিধাবাদী, ষড়যন্ত্রকারী, চক্রান্ত কারীদের, অপরিবর্তিত ক্ষুদে বুর্জোয়া, নেতৃত্ব পদলােভীদের পার্টিতে পরিণত হওয়া—অর্থাৎ পার্টি দেশীয়-আন্তর্জাতিক শত্রুদের চরে পরিণত হওয়া।
কাজেই চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কাজ। অবশ্য এ কেন্দ্রীয় কাজ সম্পাদন করার সময় অন্যান্য কাজও চালিয়ে যেতে হবে। বিশেষ করে
পৃষ্ঠা: ৩৪৩

সশস্ত্র সংগ্রাম সমগ্র পূর্ব বাংলা ব্যাপী শুরু করার লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে হবে।
চক্র বিরােধী সংগ্রামে ও শুদ্ধি অভিযানে নূতন কর্মী, সহানুভূতিশীল, সমর্থক, সম্ভব হলে জনগণকেও শরীক করাতে হবে, যাতে তারাও এতে অংশ গ্রহণ করেন।
এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতি, চক্রের মুখােস তাদের নিকটও উদঘাটিত হয়, তারাও যাতে পার্টির সুবিধা-অসুবিধা-সংগ্রামের সাথে একাত্ম হতে পারেন, তারাও যাতে অগ্রগামী চিন্তাধারা ও কর্ম পদ্ধতি রপ্ত করে বিপ্লবী কাজে অধিকতর প্রেরণা লাভ করেন।
মার্কসবাদীরা ষড়যন্ত্র করে না। কাজেই আমাদের সংগ্রাম জনগণকে না জানানাের কোন কারণ নেই। জনগণকে জানানােয় বরঞ্চ আমাদের আন্তরিকতাই প্রমাণ করবে; জনগণ আমাদের প্রতি অধিকতর আস্থাশীল হবেন। এ কারণে পােষ্টার, চিকা, লিফলেটের মাধ্যমে ও অন্যান্য গােপন পদ্ধতিতে চক্র বিরােধী সংগ্রাম এবং শুদ্ধি অভিযানের বিষয় জনগণকে জানাতে হবে।
চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযানের প্রক্রিয়ায় কেডার ইতিহাস: প্রণয়ন, বাসিটা বর্জন, টাটকাটা গ্রহণ, সদস্য, প্রার্থী সদস্য পদ প্রদান, কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনস্থ স্তর সমূহে কংগ্রেস অনুষ্ঠান করা হচ্ছে সাংগঠনিক সুসংবদ্ধকরণের লক্ষ্য।
চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ইতিহাসে নূতন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কমরেডদের মতাদর্শগত মান উন্নত করে অধিকতর বিপ্লবী প্রেরণার সৃষ্টি করেছে।
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের সংগঠনে এ ধরনের বিপ্লবী পদক্ষেপ কোনদিন গ্রহণ করা হয়নি। এখানেই বিপ্লবী আর অবিপ্লবী পার্টির মধ্যকার পার্থক্য।
চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে পার্টির মধ্যকার ও বাইরের মিথ্যার সাথে সত্যের প্রকাশ্য লড়াই, ভুলের সাথে সঠিকতার লড়াই, মার্কসবাদ- লেনিনবাদমাও সেতুঙ চিন্তাধারার সাথে সংশােধনবাদ, অসর্বহারা মতাদর্শের লড়াই, সর্বহারাদের সাথে অসর্বহারাদের তীব্র শ্রেণী সংগ্রাম।
এ লড়াইয়ের মাধ্যমে পার্টিকে বিজয় অর্জন করতে হবে, সত্যকে বিজয় অর্জন করতে হবে, সর্বহারা বিপ্লবীদের বিজয় অর্জন করতে হবে।
এ প্রকার কঠোর ও জটিল সংগ্রামের আকাবাকা পথ ব্যতীত সহজ পথে বিজয় অর্জনের কোন পথ নেই। পৃথিবীর মহান কোন কিছুই কঠোর সংগ্রাম ছাড়া বিজয় অর্জন করেনি।
কাজেই সমগ্র পার্টিকে পার্টির মধ্যকার একমাত্র সর্বহারাদের কেন্দ্র কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন ঐক্যকে দৃঢ় করতে হবে; বােকা বুড়াের মত লেগে থাকতে হবে সংগ্রামে, আত্মবলিদানে নির্ভয় হয়ে সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে চক্র বিরােধী সংগ্রাম এবং শুদ্ধি অভিযানে বিজয় অর্জন করতে হবে; পার্টি বিপ্লব ও জনগণের স্বার্থকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতে হবে, চক্রান্তকারীদের চূড়ান্তভাবে কবরস্থ করতে হবে, ভুল চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির সংশােধন করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৪৪

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার
(২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২)

কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ১৫ই সেপ্টেম্বর শুরু হয় এবং ১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ সালে সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।
সভায় নিম্নলিখিত আলােচ্যসূচী গৃহীত হয় এবং সে অনুযায়ী সভা পরিচালিত হয়।

আলােচ্যসূচীঃ
১. রাজনৈতিক ২. সাংগঠনিক ৩. মতাদর্শগত ৪. সামরিক ৫. অর্থনৈতিক ৬. বিবিধ।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার, কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত দলিলাদি এবং সভাপতির নির্দেশসমূহ অনুমাদিত হয়।
সভায় সংগঠনের সামরিক ও অর্থনৈতিক বিষয় পর্যালােচনা করা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সামরিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে কেন্দ্রীয় বা প্রধান কাজ।
সভায় আরাে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সম্ভাবনাময় অঞ্চলে জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা করতে হবে এবং যে সকল স্থানে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়েছে সেখানে তা জোরদার করতে হবে।
এ উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি নেতৃস্থানীয় কমরেডদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করে এবং গেরিলা যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরা ও তা জনপ্রিয় করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সংগঠনের মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালােচনা করা হয় এবং নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
শুদ্ধি অভিযান ও চক্র বিরােধী সংগ্রাম হচ্ছে এ সকল ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কাজ। গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রামকে এর সাথে যুক্ত করতে হবে।

প্রকাশ্য ও গণসংগঠনে কাজঃ
পার্টি পরিচিতি গােপন রেখে প্রকাশ্য, আধা প্রকাশ্য কাজ করা যায়। এর উদ্দেশ্য হবে কর্মী সংগ্রহ করা, সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করা, শত্রুর সাথে জনগণের দ্বন্দ্ব। তীব্রতর করা, শত্রুদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করা।
গণসংগঠন প্রধান ধরনের গণসংগঠন হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী।
প্রকাশ্য, আধাপ্রকাশ্য এবং গণসংগঠনের কাজের উদ্দেশ্য হবে সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করা, কর্মী সংগ্রহ করা ইত্যাদি।
পৃষ্ঠা: ৩৪৫

শত্রু এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত কাজঃ
প্রতিক্রিয়াশীলরা যে সকল ট্রেড ইউনিয়ন দখল করেছে সেখানে পাল্টা ট্রেড ইউনিয়ন বা কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন না করা। এ সকল ক্ষেত্রে পার্টি পরিচিতি গােপন রেখে অনুপ্রবেশ করা এবং পূর্বে উল্লিখিত লক্ষ্য বাস্তবায়িত করা।
যেখানে প্রতিক্রিয়াশীলরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করেনি, সেখানে পার্টির কর্মীদের নেতৃত্বে (পার্টি পরিচিতি গােপন রেখে) ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা।
স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে অসুবিধা হলে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হওয়া।
প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজকে গােপন ও সশস্ত্র সংগ্রাম-এর সাথে যথাযথভাবে সমন্বিত করতে হবে, গােপন কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রাম হবে প্রধান কাজের পদ্ধতি।
মুক্ত অঞ্চলে প্রকাশ্য গণসংগঠন করতে হবে।
আধামুক্ত অঞ্চল বা অস্থায়ী মুক্তাঞ্চলে প্রকাশ্য, আধাপ্রকাশ্য ও গােপন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

* অধিবেশনে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ঃ
পূর্ব বাংলার জনগণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালালদের বিরুদ্ধে মারাত্মভাবে বিক্ষুব্ধ।
তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছয় পাহাড়ের দালালদের খতম করছে। জনগণের এ স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামকে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে।
বিভিন্ন স্থানে পার্টির নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বহারা বিপ্লবীরা কাজ করছে। তাদের সাথে যােগাযােগ করে তাদেরকে পার্টির নেতৃত্বে সংগঠিত করা উচিত। এ প্রসঙ্গে প্রকাশিত দলিল অনুযায়ী কাজ করতে হবে (পরিশিষ্ট-১ দ্রষ্টব্য)।
কাজী-অমল, দেবেন-বাসার এবং অন্যান্য নয়া সংশােধনবাদীরা ভাসানীর নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেছে এবং বিরােধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের পরিণতি ভারতের জ্যোতি বসুদের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন ঐক্য ফ্রন্টের চাইতেও খারাপ হবে। এদের পতন অনিবার্য।
ইহা জনগণকে বিভ্রান্ত করা ব্যতীত আর কিছুই নয়।
এদের দ্বারা পরিচালিত প্রকাশ্য গণসংগ্রামকে (উদাহরণ ভূখা মিছিল ইত্যাদি) এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালাল বিরােধী প্রচারণাকে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য ব্যবহার করতে হবে।
বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের এবং তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের মুখােশ উন্মােচিত করতে হবে।
হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন নয়া সংশােধনবাদীদের ভুল রাজনৈতিক, সাংগঠনিক, সামরিক ও অন্যান্য লাইন কর্মীদের সামনে উন্মােচিত হচ্ছে।
এদের কর্মীরা শৃঙ্খলা পালন করে না, ইচ্ছা-খুশী মত ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে।
এরা পার্টির চাইতে কর্মীদেরকে ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল করে তােলে, ব্যক্তিগত এলাকা গড়ে তােলে।
পৃষ্ঠা: ৩৪৬

এ কারণে এরা এক একজন এক একটি দুর্গ গঠন করে (পাবনা-মতিনের দুর্গ, নােয়াখালী-তােয়াহার দুর্গ, যশাের-হকের দুর্গ ইত্যাদি)।
– এদের কোন সাংগঠনিক স্তর নেই।
– কর্মীদের মাঝে ব্যক্তিতাবাদ রয়েছে।
– সংগঠন কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে সংগঠিত নয়।
– এরা সমালােচনা-আত্মসমালােচনা করে না।
– এদের গােপন কার্য-পদ্ধতি নেই।
ইহা প্রমাণ করে ভুল রাজনৈতিক লাইন অবশ্যই ভুল সাংগঠনিক লাইনে প্রকাশ পায়। এদের পতন অনিবার্য।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী ও তাদের সংগঠনসমূহ ইতিমধ্যেই ছয় পাহাড়ের দালালদের ‘বি’ টিম হিসেবে জনগণের সামনে পরিচিত হয়েছে। জনগণ থেকে এরা দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এদের পতন অনিবার্য।
পূর্ব বাংলার জনগণের ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও ছয় পাহাড়ের দালাল বিরােধী প্রচণ্ড গণঅসন্তোষের সুযােগ নিয়ে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা পূর্ব বাংলায় তাদের দালালদের সহযােগিতায় প্রতিবিপ্লবী ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করছে। এ উদ্দেশ্যে তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-রায়ট বাধানাের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
এ সকলের উদ্দেশ্য হলাে পূর্ব বাংলায় মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের উপনিবেশ স্থাপন করা। আমাদের সতর্কতা জোরদার করতে হবে, এ ষড়যন্ত্রকে উদঘাটিত করতে হবে (পরিশিষ্ট-২ দ্রষ্টব্য), শক্রদের মধ্যকার (মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী ও তার দালালদের সাথে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার দালালদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব) দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করতে হবে, এ দ্বন্দ্বের ফলে সৃষ্ট সংকটের সুযােগ গ্রহণ করতে হবে।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সুবিধাজনক বিপ্লবী পরিস্থিতিতে আমাদের বিপ্লবী তৎপরতা জোরদার করতে হবে।
‘বাংলাদেশকে জাতিসংঘে প্রবেশের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করে চীন সঠিক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
চীনের এ ভেটো প্রদানকে ছয় পাহাড়ের দালাল ও তার প্রভুরা চীন বিরােধী এবং কমিউনিস্ট বিরােধী জনমত সৃষ্টির জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর অপর উদ্দেশ্য হলাে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানাে এবং বামপন্থী খতম করা।

* বিবিধ আলােচনাসূচীতে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়ঃ
সংগঠনের অর্থনৈতিক হিসাব (জুলাই-আগস্ট, ১৯৭২) মােটামুটি পর্যালােচনা করা হয় এবং গৃহীত হয়।
কোন লিফলেট বা দলিল বিতরণের পূর্বে ছাপানাে কপি যথাযথ স্তর কর্তৃক অনুমােদিত হতে হবে। কেডার ইতিহাসের অতিরিক্ত পয়েন্টসমূহে “দীর্ঘস্থায়ী ও দুরারােগ্য এবং মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি রয়েছে কিনা” এ পয়েন্ট যুক্ত হবে।
দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত পার্টির অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায়-বিবাহ ইচ্ছুক নর ও
পৃষ্ঠা: ৩৪৭

নারী কমরেডগণ মােটামুটি সুদীর্ঘ দিন সঠিকভাবে পরস্পরকে বুঝা ও যাচাই করার জন্য ঘনিষ্টভাবে জীবন যাপন করা উচিত।
ইহা যথাযথ স্তর কর্তৃক অনুমােদিত হবে।
এ ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই বহাল থাকলে দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক ভুল ও বিপর্যয় এড়ানাে সম্ভব হতাে।
সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পরবর্তী সভার তারিখ নির্ধারণ করে সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।

পরিশিষ্ট-১।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে যােগাযােগ হয়নি কিন্তু নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পার্টির লাইনে কাজ করছেন এরূপ বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে সর্বহারা পার্টির আহ্বান
(আগস্ট, ১৯৭২)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সাথে যােগাযােগ হয়নি এরূপ বহু বিপ্লবী পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে সর্বহারা পার্টির লাইনে ও পার্টির নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছেন।
আপনাদের কারাে কারাে সাথে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির যােগাযােগ হয়েছে, কারাে কারাে সাথে যােগাযােগ হচ্ছে। আবার আপনাদের কেউ কেউ পােস্টার, লিফলেটের মাধ্যমে পার্টির সাথে যােগাযােগের আবেদন জানাচ্ছেন। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি আপনাদেরকে নিম্নলিখিত বিপ্লবী দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছে।
১) আপনারা পার্টির লাইনে গােপনভাবে (underground) নিরাপত্তা বজায় রেখে কাজ করে যান।
২) শত্রুর চর নয় এরূপ ব্যক্তিদেরকে পাঠচক্র, গেরিলা গ্রুপে সংগঠিত করুন। তাদেরকে পাঁচটি প্রবন্ধ, গণযুদ্ধ, উদ্ধৃতি, তিনটি বৃহৎ শৃংখলা, মনােযােগ দেবার আটটি ধারা পড়ান। তারা তিনটি বৃহৎ শৃংখলা ও মনােযােগ দেবার আটটি ধারা অবশ্যই পালন করবেন।
৩) পার্টির সাথে দ্রুত যােগাযােগের চেষ্টা করুন।
৪) পার্টির সাথে যােগাযােগের পূর্বে এবং পার্টির যথাযথ অনুমতি ব্যতীত খতম বা হামলা করবেন না। তবে আত্মরক্ষার্থে প্রমাণিত ও জনগণ কর্তৃক ঘৃণিত শক্রদের খতম করা যায়।
ব্যক্তিগত শত্রুতা উদ্ধারের জন্য কোন রকম খতম বা হামলা চরম অপরাধ বলে পরিগণিত হবে।
৫) পার্টির অনুমতি ব্যতীত স্বতঃস্ফূর্তভাবে খতম বা হামলার কুফল নিম্নরূপ :
এর সুযােগ গ্রহণ করে সরকার এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুর চরেরা সর্বহারা পার্টির নামে দেশপ্রেমিক নিরীহ লােকদের খতম ও হামলা করতে পারে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মনে পার্টি সম্পর্কে ভীতি ও বিরূপ ধারণা জন্মানাে এবং জনগণ থেকে
পৃষ্ঠা: ৩৪৮

পার্টিকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। ভারতের গােয়েন্দা বিভাগ ও সাম্রাজ্যবাদের চরেরা সর্বহারা বিপ্লবীদের নামে ব্যাপকভাবে এরূপ জঘন্য কাজ করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের সর্বহারা বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা, তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা ! এর ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। কাজেই স্বতঃস্ফূর্ত হামলা, খতম সম্পূর্ণ অননুমােদনীয়। সর্বহারা বিপ্লবীরা এরূপ জঘন্য প্রতিবিপ্লবী কার্যকলাপকে বিরােধিতা করবেন। তাদের অপরাধ জনগণের সামনে তুলে ধরবেন, তাদের যথাযথ শাস্তি দিবেন।
৬) আপনাদের নিকটস্থ অস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি গােপনে রেখে দিন।
৭) পার্টির সাথে যােগাযােগ করে অস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি এবং আপনাদের কার্যাবলী, যােগাযােগ ও কর্মীদের পার্টির নিকট বুঝিয়ে দিন।
পার্টিতে সাংগঠনিকভাবে যােগদান করুন।
৮) পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির কর্মীরা খুবই সতর্কতা অবলম্বন করবেন, যথাযথ অনুসন্ধান করবেন, যাতে এ প্রক্রিয়ায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রু চরেরা পার্টিতে ঢুকে পড়ে।

পরিশিষ্ট-২
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ছাত্রলীগের রব-গ্রুপের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন (আগস্ট, ১৯৭২। সংশােধিত ও পুনঃমুদ্রিত সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ )

১) আপনারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলেন এবং মার্কসবাদ মানেন একথাও বলেন। মার্কসবাদ শিক্ষা দেয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মৌলিক বিষয় হলাে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তা রক্ষা করা। কিন্তু আপনারা সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলেন না (মনি সিং-মােজাফফর চক্রও বলে না)। সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা না করার অর্থ হলাে সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা। যেহেতু আপনাদের সমাজতন্ত্র সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে না সেহেতু ইহা সামন্তবাদ, আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালালদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করবে ও তাদের শােষণ ও লুণ্ঠন কায়েম করবে।
এর অর্থ হচ্ছে ভারত ও সােভিয়েটের তাবেদাররা মুজিববাদের নামে যে শােষণ ও লুণ্ঠন করছে এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করেছে, এর পরিবর্তে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারদের শােষণ ও লুণ্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব কায়েম করা।
এ কারণেই সর্বহারার একনায়কত্ব ব্যতীত সমাজতন্ত্র হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ।
২) আপনারা মার্কসবাদ মানেন, মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় যে, জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করতে হয়। পূর্ব বাংলায় কি জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে?
পৃষ্ঠা: ৩৪৯

পূর্ব বাংলায় জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে, এখানে সাম্রাজ্যবাদের দালালদের শােষণ এবং জমিদারদের শােষণ বিদ্যমান।
জনগণ চায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের উৎখাত করে জাতীয় বিপ্লব সম্পন্ন করতে, স্বাধীন, সার্বভৌম পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে এবং জোতদার-জমিদারদের উৎখাত করে গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে।
আপনারা গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার কথার পরিবর্তে সমাজতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে তাদের বর্তমানের প্রকৃত শত্রু ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের আড়াল করছেন। ইহা প্রকৃতপক্ষে শত্রুর তাবেদারী ব্যতীত আর কিছুই নয়। এ কারণেই আপনারা ভারতীয় সমপ্রসারণবাদের প্রশ্নে নীরব।
৩) মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় যে, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না করে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে ট্রটস্কীবাদ। বর্তমান বিশ্বে ট্রটস্কীবাদীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পরিচালিত। আপনাদের সমাজতন্ত্রের কথা কি প্রমাণ করে না যে, আপনারা ট্রটস্কীবাদী এবং এ কারণে আপনারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পরিচালিত?
৪) আপনারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের কথা বলেন। কিন্তু মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারায় সুসজ্জিত সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত এর কোনটাই সম্ভব নয়। তার প্রমাণ হলাে পূর্ব বাংলার বুর্জোয়ারা তথাকথিত সামাজিক বিপ্লবের কথা, শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে পূর্ব বাংলাকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছে। এভাবে তারা সামাজিক বিপ্লবের নামে সামাজিক প্রতিবিপ্লব ঘটায়, শ্রেণী সংগ্রামের নামে শ্রেণী ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা করে। একইভাবে আপনারাও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সামাজিক বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রামের নামে প্রকৃত পক্ষে পূর্ব বাংলাকে মার্কিনের উপনিবেশে পরিণত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এভাবে সামাজিক প্রতিবিপ্লব, শ্রেণী ও জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।
৫) আপনারা শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী শত্রু খতমের কথা বলেন।
বর্তমানে পূর্ব বাংলার জনগণের দাবী হচ্ছে জাতীয় সংগ্রাম করা (পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সসাভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীন করা), জাতীয় শত্রু খতম করা (ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালদের জাতীয় শত্রু হিসেবে খতম করা)।
শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্ৰেণী শত্রু খতমের নামে আপনারা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় শত্রুদের বাঁচিয়ে দিচ্ছেন। ইহা কি জাতীয় শত্রুদের তাবেদারী নয়?
আপনারা কেউ কেউ শ্রেণী শত্রু হিসেবে পূর্ব বাংলার প্রকৃত বামপন্থীদের (যাদেরকে চীনের দালাল বলা হয়) চিহ্নিত করেন। বর্তমানে আপনারা প্রকৃত বামপন্থী দেশপ্রেমিক কর্মীদের (আমাদের সহ অন্যান্যদের) তালিকা প্রণয়ন করছেন এবং নিজেরা বা মুজিববাদীদের সহায়তায় ধরিয়ে দিচ্ছেন বা খতম করছেন।
৬) শ্রেণী সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সামাজিক বিপ্লবের কথা বললেও আপনারা মার্কসবাদী বা বিপ্লবী নন, ইহা লেনিনের নিম্নলিখিত উদ্ধৃতিটিই প্রমাণ করছে-
“এটা প্রায়ই বলা এবং লেখা হয় যে মার্কসের তত্ত্বের সারবস্তু হলাে শ্রেণী সংগ্রাম, এটা সত্য নয়। এ মিথ্যা থেকে প্রায়ই বেরিয়ে আসে মার্কসবাদের সুবিধাবাদী বিকৃতি, একে মিথ্যা
পৃষ্ঠা: ৩৫০

করে বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় করে তােলা। কারণ শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব মার্ক কর্তৃক সৃষ্ট নয়। মার্কসের পূর্বে বুর্জোয়ারাই ইহা সৃষ্টি করেছে। সাধারণভাবে ইহা বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয়। যারা শুধু শ্রেণী সংগ্রামকে স্বীকার করে তারা এখনও মার্কসবাদী হয়নি, তারা এখনও বুর্জোয়া চিন্তা এবং বুর্জোয়া রাজনীতির আওতায় রয়ে গেছে। মার্কসবাদকে শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বে সীমাবদ্ধ রাখার অর্থ হলাে মার্কসবাদকে খর্ব করা, বিকৃত করা, বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় এরূপ বিষয়ে রূপান্তরিত করা। কেবলমাত্র সে-ই একজন মার্কসবাদী যে শ্রেণী সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে প্রসারিত করে। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদী এবং সাধারণ ক্ষুদে বুর্জোয়া (বড় বুর্জোয়াদেরও) মধ্যকার পার্থক্য।”১
এ থেকে পাওয়া যায় শ্রেণী সংগ্রামের কথা বললেই মার্কসবাদী বা বিপ্লবী হওয়া যায় না। ইহা বড় বুর্জোয়া এমন কি সাম্রাজ্যবাদের দালালরাও বলতে পারে।
৭) আপনারা তথাকথিত সরকার বিরােধিতা এবং প্রগতি মার্কা বক্তব্য ও শ্লোগানের পিছনে আন্তরিক কর্মীদের আকৃষ্ট করে ভুল পথে পরিচালনা করছেন। এভাবে তাদেরকে মুজিববাদের শিকারে পরিণত করছেন। ইতিমধ্যে জাসদ ও তার সাথে যুক্ত সংগঠনসমূহের বহু কর্মী মুজিববাদীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন বা জেল জুলুম নির্যাতন ভােগ করছেন।
ইহা কি আন্তরিক দেশপ্রেমিক কর্মীদের জন্য ফাদ তৈরী করা নয়?
৮) আপনারা প্রকাশ্যে মুসলিম বাংলার বিরােধিতা করেন কিন্তু গােপনে কর্মীদের মাধ্যমে মুসলিম বাংলার প্রচার করে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করছেন, এভাবে মার্কিনের ষড়যন্ত্র মত কাজ করছেন।
প্রকৃতপক্ষেই আপনারা যদি মার্কসবাদ মানেন, সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত না হন, জনগণের সেবক হন তাহলে উপরােক্ত ভুল বক্তব্য ও কর্মপদ্ধতিসমূহ সংশােধন করে সত্যিকার সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হােন এবং জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। ইহা কায়েম সম্ভব জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গণযুদ্ধ সূচনা ও পরিচালনা করে। এই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করতে হবে।

মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা-জিন্দাবাদ!
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ!
কমরেড সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ!

…………………………………………………………………….
১. Lenin on Proletarian Revolution and proletarian Dictatorship, Foreign Language Press, Peking, 1960. Page-9.
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩৫১

সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব প্রসঙ্গে
(অক্টোবর, ১৯৭২)

১. ভূমিকা
ছয় পাহাড়ের দালাল প্রতিক্রিয়াশীল আওয়ামী লীগ মুজিববাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।
মনিসিং-মােজাফ্ফর সংশােধনবাদী, কাজী-রণাে-অমলসেন, দেবেন-বাসারও সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, একই সাথে মুজিববাদী সমাজতন্ত্রের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করছে।
রব গ্রুপ (বর্তমানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।
মওলানা ভাসানী ইসলামিক সমাজতন্ত্রের কথা বলছে। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরাও সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা ও তাদের তাবেদার সংশােধনবাদীরাও সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।
এ সকল বিভিন্ন আকৃতির তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের কথাবার্তা ও কার্যকলাপ জনগণের মাঝে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। জনগণের অনেকেই এর ফলে প্রতারিত হচ্ছে।
কাজেই দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সত্যিকার সমাজতন্ত্র এবং মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা, মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের ভাওতা উদঘাটন করে জনগণের সামনে তাদের প্রকৃত বিশ্বাসঘাতক দালালীর চেহারা তুলে ধরা জরুরী প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে।

২. সমাজতন্ত্রের উদ্ভব
ইউরােপে সামন্তবাদী সমাজের মাঝে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা জন্মলাভ করে। এই নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার বিকাশ সামন্তবাদ কর্তৃক প্রতিনিয়ত বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং এক পর্যায়ে সামন্তবাদ উৎখাত ব্যতীত এর বিকাশ অসম্ভব হয়ে উঠে।
তখনই সামন্ততন্ত্র উৎখাতের জন্য বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিক ও মালিক (অর্থাৎ বুর্জোয়ার) সৃষ্টি হয়।
শ্রমিকদের চরম দুঃখ-দুর্দশা সামন্তবাদের দ্রুত পতন এবং ক্ষুদে বুর্জোয়াদের ভেঙ্গে পড়ার প্রক্রিয়ায় প্রথম সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের উদ্ভব হয়।
পৃষ্ঠা: ৩৫২

এভাবে ক্ষুদে বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র, সামন্তবাদী সমাজতন্ত্র, সামন্ত সম্রান্তীয় সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়। এরপর আসে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা।
এরা শ্রমিক এবং সমাজের দরিদ্রদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে, এটা খারাপ এ কথা বলে, কেউ কেউ পুরােনাে সমাজ ভালাে এমনি বলে। এ অবস্থার প্রতিকার করার জন্য কেউ কেউ আকাশ কুসুম পরিকল্পনা করে। কিন্তু এরা কেউই সমাজের এ অবস্থার উদ্ভবের কারণ, এর সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে পারেনি।
কার্ল মার্কসই সর্বপ্রথম সামাজিক বিকাশের নিয়মাবলী আবিষ্কার করেন, কাল্পনিক সমাজতন্ত্র এবং অন্যান্য সমাজতন্ত্রের ভুল উঘাটন করেন এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের সৃষ্টি করেন।
মার্কস ও এঙ্গেলস সারা জীবন কাল্পনিক ও অন্যান্য সকল প্রকার মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে আপােসহীন সংগ্রাম করেন, এ সকল তথাকথিত সমাজতন্ত্রের তত্ত্বকে পরাজিত ও কবরস্ত করেন।

৩. সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি
মার্কসের পূর্বেকার সমাজতন্ত্রীদের সমাজতন্ত্র কাল্পনিক ও অবাস্তব হয়েছে, তার কারণ তখনও আধুনিক শিল্প-কারখানা ও শ্রমিক শ্রেণী বিকাশ লাভ করেনি। শ্রমিক শ্ৰেণী তখনাে পুঁজিবাদের সারবস্তু বুঝেনি, পুঁজিপতি ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যকার শােষণের সম্পর্ক এবং নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব তারা বুঝেনি।
শ্রমিক শ্রেণী তখন মেশিন-পত্র ভেঙ্গে ফেলত এবং স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম করতাে।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে এঙ্গেলস বলেছেন, “এই ঐতিহাসিক অবস্থা সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাদের নিয়ন্ত্রিত করেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অপরিপক্কতা এবং অপরিপক্ক শ্রেণীর অবস্থা (শ্রমিক শ্রেণী-লেখক) সাথে খাপ খায় অপরিপক্ক তত্ত্ব (অর্থাৎ কাল্পনিক ও অবাস্তব সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব- লেখক)।” ১
“পুঁজিবাদের বিকাশ ও সামন্ততন্ত্রের উপর বিজয়, বিজ্ঞানের বিকাশ, শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠিত ও সচেতন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণী পুঁজিবাদী সমাজের সারবস্তু বুঝতে পারে, শ্রেণীগুলাের মধ্যকার শােষণের সম্পর্ক এবং নিজের ঐতিহাসিক দায়িত্ব উপলব্ধি করে। মার্কস ও এঙ্গেলস একে সারসংকলন করেন এবং মার্কসবাদের জন্ম দেন।” ২
মার্কস-এঙ্গেলস কাল্পনিক সমাজতন্ত্র এবং অন্যান্য বিভিন্ন আকৃতির অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের বিজয় প্রতিষ্ঠা করেন।
মার্কসবাদ সমস্ত বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির একমাত্র পথপ্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গৃহীত হয়।
বুর্জোয়া ও তাদের চররা মার্কসবাদকে সরাসরি সংগ্রামে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়ে মার্কসবাদী বনে যায় এবং বুর্জোয়াদের স্বার্থে একে বিকৃত ও সংশােধন করার প্রচেষ্টা চালায়। কমিউনিস্ট আন্দোলনে এরাই সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদী বলে পরিচিত।
সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের তথাকথিত সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস সংগ্রাম করেন।
এঙ্গেলসের মৃত্যুর পর সংশােধনবাদীরা প্রায় সকল দেশের শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব দখল করে, সে সকল পার্টিকে বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষাকারী পার্টিতে পরিণত করে।
পৃষ্ঠা: ৩৫৩

মহান লেনিন বুর্জোয়াদের দালাল সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে আপােসহীন সংগ্রাম করেন, মার্কসীয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিকৃতিসমূহ উৎখাত করেন, মার্কসবাদকে রক্ষা ও প্রতিষ্ঠা করেন।
মার্কস পুঁজিবাদের বিকাশের যুগের সমস্যাবলীর সমাধান করেন। পুঁজিবাদ বিকাশ লাভ করে সর্বোচ্চ বিকাশের স্তর সাম্রাজ্যবাদে পৌঁছে। মহান লেনিন এ যুগের সামাজিক বিকাশের নিয়মাবলী আবিষ্কার করেন, সামাজিক বিপ্লবের সমস্যাবলীর সমাধান করেন এবং সর্বপ্রথম সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে রাশিয়ায় বল প্রয়ােগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন, সর্বহারার একনায়কত্ব কায়েম করেন, পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথমে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন।
এভাবে লেনিন মার্কসবাদকে রক্ষা করেন ও বিকাশ ঘটান এবং লেনিনবাদের স্তরে উন্নীত করেন।
লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিন সুবিধাবাদী ও সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পবিত্রতাকে রক্ষা করেন, অনুন্নত কৃষি প্রধান সােভিয়েট ইউনিয়নকে আধুনিক শিল্পপ্রধান সােভিয়েট ইউনিয়নে রূপান্তরিত করেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদকে কবরস্ত করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মহান গণচীনে সভাপতি মাওসেতুঙের নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করে। এশিয়ায় উত্তর কোরিয়া, উত্তর ভিয়েতনাম, ইউরােপের আলবেনিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, যুগােশ্লোভিয়া, হাঙ্গেরী, পােল্যান্ড, পূর্ব জার্মানী প্রভৃতি দেশে সর্বহারা শ্রেণী ক্ষমতা দখল করে। ‘ এভাবে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ জনগণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পথ গ্রহণ করেন।
স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চোভের নেতৃত্বে আধুনিক সংশােধনবাদীরা৩ কু-দেতা ঘটিয়ে সােভিয়েট ইউনিয়নের ক্ষমতা দখল করে, সােভিয়েট সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে, দেশে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে, ফ্যাসিবাদী নির্যাতন চালায়, সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টিকে বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট পার্টিতে পরিণত করে।
সােভিয়েট সংশােধনবাদীরা বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা করার প্রতিবিপ্লবী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এ সকল দেশের অনেকগুলােতেই তারা পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা এবং তাদেরকে নিজের উপনিবেশে বা নির্ভরশীল দেশে৪ পরিণত করতে সক্ষম হয়।
তারা বিশ্বের খাটি সমাজতন্ত্রী দেশসমূহকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুবিধাবাদী, সংশােধনবাদী ও বুর্জোয়াদের তথাকথিত সমাজতন্ত্রের ভাওতাকে সহায়তা ও রক্ষা করছে।
সভাপতি মাওসেতুঙ আধুনিক সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের মার্কসবাদলেনিনবাদের সংশােধন ও বিকৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে রক্ষা করেন, সাম্রাজ্যবাদের পতনের যুগ এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী যুগের বিপ্লবের সমস্যার সমাধান করেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে মাওসেতুঙ চিন্তাধারার পর্যায়ে উন্নীত করেন।
এ কারণে বর্তমান যুগে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র হতে পারে না।
পৃষ্ঠা: ৩৫৪

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও পথের বিজয় অর্জনের ফলে এ তত্ত্ব ও পথ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, শ্রমিক-কৃষক-জনগণ একে নিজেদের মুক্তির একমাত্র পথ বলে গ্রহণ করেছে।
সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও পথের জনপ্রিয়তার সুযােগ গ্রহণ করার জন্য সমাজতন্ত্রীর সাজ গ্রহণ করেছে শােষক শ্রেণী ও দালালরা, তারা সমাজতন্ত্রের লেবেল এঁটে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ চালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা ছয় দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে, পরে স্বাধীনতা আনয়ণের নামে দেশকে করে পরাধীন। এর পরে তাদের আর কোন কর্মসূচী নেই।
সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তা এবং নিজেদের কর্মসূচীহীনতার কারণে তারা সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ে জনগণকে প্রতারিত করা এবং নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
তারা জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদ অর্থাৎ মুজিববাদের মাধ্যমে তথাকথিত সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে। “মার্কস যদি মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, লেনিন যদি লেনিনবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, মাওসেতুঙ যদি মাওবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তবে কেন মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না এবং এর মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করা যাবে না”-আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা এ ধরনের উদ্ভট যুক্তি পেশ করে।
এভাবে মুজিববাদীরা সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার সুযােগ গ্রহণ করে সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে সত্যিকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
মনিসিং-মােজাফ্ফর সংশােধনবাদীরা মুজিববাদী সমাজতন্ত্রের ভাওতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও তার মুখােশ উন্মােচন করার পরিবর্তে এর সাথে একাত্মতা ঘােষণা করছে।
হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসার, কাজী-রণা সুদীর্ঘ দিন ক্ষুদে বুর্জোয়া সামন্তবাদী সমাজতন্ত্রী মওলানা ভাসানীর ইসলামিক সমাজতন্ত্রের মুখােশ উন্মােচন করার পরিবর্তে তার লেজুড়বৃত্তি করেছে। তাদের কেউ কেউ মুজিববাদের সাথেও একাত্মতা ঘােষণা করছে।
রব গ্রুপ মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ না করেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে ভাওতা দিচ্ছে।
এভাবে তারা আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের জনপ্রিয়হীনতা এবং সমাজতন্ত্রের জনপ্রিয়তার সুযােগ গ্রহণ করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলে ক্ষমতা দখল করা এবং সত্যিকার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে ঠেকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
১৯৫৭ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সম্মেলন, ১৯৬০ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত ৮০-পার্টির প্রতিনিধিদের সম্মেলনে গৃহীত ঘােষণাপত্রে এ ধরনের সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আপােষহীন সংগ্রাম পরিচালনার আহ্বান রয়েছে।
আধুনিক সংশােধনবাদী এবং অন্যান্য সংশােধনবাদীরা এ সকল তথাকথিত বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্রাজ্যবাদের দালাল সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম না করে তাদের রক্ষা করছে ও তাদের লেজুড়বৃত্তি করছে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।
পৃষ্ঠা: ৩৫৫

এ সকল তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের তত্ত্বগত ভিত্তি হচ্ছে জনগণকে প্রতারণা করা, সমাজতন্ত্রের লেবেলের আড়ালে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শােষকদের শােষণ ও লুণ্ঠন ন্যায়সঙ্গত করা, তা টিকিয়ে রাখা এবং সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব সম্পর্কে জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা, জনগণের নিকট তা অপ্রিয় করে তােলা, দেশীয়-আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্থ করা।

৪. সামাজিক স্তর ও বিপ্লব
মার্কসবাদ শিক্ষা দেয় সমাজ তার বিকাশের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী অগ্রসর হয়। সমাজ আদি সাম্যবাদী সমাজ থেকে দাস সমাজে, দাস সমাজ থেকে সামন্তবাদী সমাজে, সামন্তবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজে, পুঁজিবাদী সমাজ থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ থেকে কমিউনিস্ট সমাজে, কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিনিয়ত কমিউনিজমের উচ্চতর স্তরে বিকাশ লাভ করে।
সামাজিক বিকাশের এই নিয়ম অনুযায়ী সামাজিক বিপ্লবও সংগঠিত হয়।
পূর্ব বাংলার সমাজ সামাজিক বিকাশের যে স্তরে রয়েছে সে অনুযায়ী বিপ্লব পরিচালিত হবে ইহা মানুষের ইচ্ছার বাইরে বস্তুগত নিয়ম।
পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শশাষণ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শােষণ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের ও তাদের দালালদের শােষণ এবং সামন্তবাদীদের অবশিষ্টাংশের শােষণ বর্তমান।
এ কারণে পূর্ব বাংলা হচ্ছে উপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী দেশ অর্থাৎ পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
পূর্ব বাংলার সমাজকে পুঁজিবাদী সামাজিক স্তরে পৌঁছাতে হলে জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সামন্তবাদকে উৎখাত করতে হবে। অর্থাৎ অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পন্ন করতে হবে।
এ কারণে পূর্ব বাংলার সমাজের বর্তমান উপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী স্তরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিপ্লব হচ্ছে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।
এ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে বৈদেশিক শােষণের অবসান অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বাজারে বৈদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান এবং সামন্তবাদের অবসানের মাধ্যমে বুর্জোয়া বিকাশের শর্ত সৃষ্টি হবে।
এ কারণে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলাে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব যার লক্ষ্য হলাে পুঁজিবাদ বিকাশে শর্ত সৃষ্টি করা অর্থাৎ সমাজকে পুঁজিবাদী সমাজের স্তরে উন্নীত করা। এ পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব (জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শােষকদের সাথে জাতীয় দ্বন্দ্ব এবং দেশীয় সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব সমাধান হয়, ফলে দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব প্রধান হয়)।
এ পুঁজিবাদী সামাজিক স্তরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
এ কারণে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব (পুঁজিবাদকে উৎখাত করার বিপ্লব) সূচনা ও পরিচালনা করা যায়।
পৃষ্ঠা: ৩৫৬

সভাপতি মাও বলেছেন, “গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এটা হলাে দু’টি ভিন্ন প্রকৃতির বিপ্লবী প্রক্রিয়া, শুধুমাত্র প্রথম বিপ্লবী প্রক্রিয়াকে শেষ করেই দ্বিতীয়টাকে সম্পন্ন করা সম্ভব।” ৫
অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করা যায়। একটি দালানের একতলা পার হয়ে দোতলায় উঠা যায়।
পূর্ব বাংলার ছয় পাহাড়ের দালাল বুর্জোয়ারা মুজিববাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে। এর প্রকৃত তাৎপর্য কি?
পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শােষণ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শােষণ এবং আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদী শােষণ বর্তমান।
এগুলাে উৎখাত না করে সমাজতন্ত্রের কথা বলে ছয় পাহাড়ের দালালরা প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলার পরাধীনতা এবং সামন্তবাদী চরিত্রকে টিকিয়ে রাখছে, ছয় পাহাড়ের দালালী করছে।
রব গ্রুপ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।
তারা পুর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার পরিবর্তে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে মুজিববাদীদের উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে চাচ্ছে এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশ স্থাপন, ভারতের মার্কিন সমর্থক অংশের। শােষণ টিকিয়ে রাখা এবং পূর্ব বাংলার সামন্তবাদীদের শােষণ বজায় রাখতে চাচ্ছে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার কথা ট্রটস্কিবাদী বিচ্যুতি। ট্রটস্কিবাদীরা বর্তমান যুগে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক পরিচালিত। কাজেই পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন না করে সমাজতন্ত্রের কথা বলে রব গ্রুপ প্রমাণ করছে তারা ট্রটস্কিবাদী এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত।
পূর্ব বাংলা ভারতের উপনিবেশ। এখানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের শােষণ বর্তমান। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তাদের দালালদের উৎখাত করা, একই সাথে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার সংগ্রাম অর্থাৎ জাতীয় সংগ্রাম বর্তমানে পূর্ব বাংলার প্রধান সংগ্রাম। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জাতীয় ও গণতান্ত্রিক এই দুই দিকের মধ্যে প্রধান দিক হচ্ছে জাতীয় বিপ্লব।
পূর্ব বাংলার শ্রমিক-কৃষক-ক্ষুদে বুর্জোয়া জনগণ দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া ও দেশপ্রেমিক সামন্তবাদীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় সংগ্রাম করছে। ফলে কৃষকের সাথে দেশপ্রেমিক সামন্তবাদীদের এবং শ্রমিকের সাথে দেশপ্রেমিক বুর্জোয়াদের শ্রেণী সংগ্রাম গৌণ হয়েছে, এ সকল শ্রেণী সমূহের মধ্যে ঐক্য প্রাধান্য পেয়েছে (পাক সামরিক ফ্যাসিস্ট বিরােধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সময় পূর্ব বাংলার বিভিন্ন দেশপ্রেমিক শ্রেণী ও স্তরসমূহের মধ্যে যেরূপ ঐক্য প্রাধান্য পেয়েছিল)।
কাজেই শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলে রব গ্রুপ প্রকৃত পক্ষে পূর্ব বাংলার জাতীয় সংগ্রামকে বিরােধিতা করছে, জনগণের দৃষ্টি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ থেকে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতির ঐক্যকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৩৫৭

এভাবে রব গ্রুপ শ্রেণী সংগ্রামের নামে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখা অর্থাৎ পূর্ব বাংলাকে পরাধীন রাখার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
মনিসিং-মােজাফ্ফর আধুনিক সংশােধনবাদীরা এবং তাদের প্রভু সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা মুজিববাদের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রকে সমর্থন করছে।
অর্থাৎ পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে এ কথা তারা স্বীকার করছে।
এর অর্থ হচ্ছে পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের উপনিবেশিক শােষণ নেই, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী শােষণ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শােষণ নেই এবং অভ্যন্তরে সামন্তবাদী শােষণ নেই।
ইহা প্রমাণ করে তারা বৈদেশিক শােষক এবং তাদের দেশীয় দালাল ও সামন্তবাদীদের দালালী করছে। তারা জাতীয় বিশ্বাসঘাতক এবং সামন্তবাদের তল্পিবাহক।
এ কারণে তারা আওয়ামী লীগের দালাল। জনগণ সঠিকভাবেই তাদেরকে ‘বি’ টিম বলে আখ্যায়িত করে।
কাজী-রণাে এবং দেবেন-বাসার সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ মুজিববাদের সাথে অর্থাৎ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার তত্ত্বকেই মেনে নিয়েছে (যদিও বর্তমানে তারা জাতীয় গণতানিত্রক বিপ্লব সম্পন্ন না হওয়ার কথা বলছে)।

৫. জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সংগ্রামের পদ্ধতি
জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শান্তিপূর্ণ উপায়ে না বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে হবে এ নিয়ে মার্কসবাদের আবির্ভাবের সময় থেকেই সুবিধাবাদী, সংশােধনবাদী সাম্রাজ্যবাদের তাবেদারদের সাথে সর্বহারা বিপ্লবীদের জীবন-মরণ সংগ্রাম চলেছে।
সাম্রাজ্যবাদের দালাল বুর্জোয়ারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপােষ করে শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালনার কথা বলে।
পাক ভারতের বুর্জোয়ারা বৃটিশ উপনিবেশবাদীদের সাথে আপােস করে অহিংস পথে দেশ স্বাধীন করার (প্রকৃতপক্ষে নতুন করে পরাধীন করার কথা বলে।
এর পরিণতি হয় স্বাধীনতার পরিবর্তে নতুন করে পরাধীনতা, উপনিবেশের পরিবর্তে পাক-ভারত হয় নয়া উপনিবেশ বা আধা উপনিবেশ।
সংশােধনবাদীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পার্লামেন্টের মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার কথা বলে।
পক্ষান্তরে মার্কসবাদীরা বলে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে ছাড়া সম্ভব নয়।
সভাপতি মাও বলেছেন, “বিপ্লব ও বিপ্লবী যুদ্ধ শ্রেণী সমাজে অবশ্যম্ভাবী এবং তাদের ব্যতীত সামাজিক বিকাশের দ্রুত অতিক্ৰমণ সম্পন্ন করা এবং প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণীকে উৎখাত করা অসম্ভব; অতএব জনগণের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা অসম্ভব।” ৬
সংশােধনবাদীরা বিপ্লবী যুদ্ধকে পরিহার করে বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হয়। মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়ার নির্বাচনী কাঠামাের অধীনে।
পৃষ্ঠা: ৩৫৮

নির্বাচনের কানাগলিপথে অগ্রসর হয়। এ পথে দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হলে তারা অহিংসঅসহযােগের ভুল পথ গ্রহণ করে, শেষ পর্যন্ত পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের প্রচণ্ড সামরিক হামলার মুখে ভারতে পলায়ন করে।
ভারতে তারা জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে, তারা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহী কুকুরে পরিণত হয় এবং ভাড়াটে বাহিনীতে রূপান্তরিত হয়, পূর্ব বাংলাকে তারা ভারতের নিকট বিকিয়ে দেয়।
শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে ডেকে এনে পূর্ব বাংলাকে তার হাতে তুলে দেয়।
এভাবে সােভিয়েট আধুনিক সংশােধনবাদী এবং তার দালাল মনিসিং-মােজাফ্ফর সংশােধনবাদীদের শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব করার তত্ত্ব সম্পূর্ণ দেউলিয়া বলে প্রমাণিত হয়। শান্তিপূর্ণ উপায়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব দূরের কথা জাতীয় প্রতিবিপ্লবও ঘটানাে পূর্ব বাংলার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি (অর্থাৎ ভারত কর্তৃক শান্তিপূর্ণভাবে পূর্ব বাংলা দখল সম্ভব হয়নি)।
বর্তমানে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পার্লামেন্টের মাধ্যমে তথাকথিত সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
আধুনিক সংশােধনবাদীরা পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বা পার্লামেন্ট ও বাইরের গণসংগ্রামের চাপের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সমাজতন্ত্র আনয়ন বা রাষ্ট্রের কাঠামােগত পরিবর্তন। করে সমাজতন্ত্র আনয়নের রঙিন স্বপ্ন দেখছে।
প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠী বুদ্ধ নয়, তারা হাঁটু গেড়ে হাত জোড় করে কখনও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।
তাদের সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা শেষ পর্যন্ত প্রচেষ্টা চালাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। এ উদ্দেশ্যে তারাই প্রথম বল প্রয়ােগ করবে।
কাজেই সর্বহারার আর কোন পথ নেই এই সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রকে চূর্ণবিচূর্ণ করা, প্রথমতঃ সামরিক বাহিনীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করা ব্যতীত।
ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি সুকর্ণের মাধ্যমে (বুর্জোয়ার মাধ্যমে) জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা দখলের সংশােধনবাদী পথ অনুসরণ করেছিল।
তার পরিণতি হিসেবে কয়েক লক্ষ কমিউনিস্ট এবং দেশপ্রেমিক বিপ্লবী প্রাণ হারায়, ইন্দোনেশীয় বিপ্লবের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
আধুনিক সংশােধনবাদীরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং বুর্জোয়াদের মাধ্যমে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এমন কি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করার কথা। বলে সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, সর্বহারা শ্ৰেণীকে অপ্রস্তুত রাখছে, বুর্জোয়াদের টিকিয়ে রাখছে। আধুনিক সংশােধনবাদীরা প্রকৃতপক্ষে বুর্জোয়াদের দালালী করছে।
রব গ্রুপ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের কথা বলছে কিন্তু পার্লামেন্টারী নির্বাচনের কানাগলি পথে অগ্রসর হচ্ছে। এরা সশস্ত্র সংগ্রামকে অস্বীকার করছে।
কাজী-রণাে, অমল সেন, দেবেন-বাসাররা সশস্ত্র সংগ্রামকে বিরােধিতা করছে,
পৃষ্ঠা: ৩৫৯

মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলছে, নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রাম করার দাসখত দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের জোয়ালবদ্ধ হয়েছে।
এ সকল সংশােধনবাদী ও বিশ্বাসঘাতকদের পথ বর্জন করে পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই মহান সশস্ত্র সংগ্রাম গণযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে, গ্রাম দখল করে শহর ঘেরাও করতে হবে, শেষ পর্যন্ত শহর দখল করে সমগ্র পূর্ব বাংলা মুক্ত করতে হবে।
পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত হলেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সম্ভাবনার সৃষ্টি হবে।
জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সম্পন্ন হওয়ার অর্থ হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মালিকানা প্রধানতঃ সর্বহারা শ্রেণী অর্জন করেছে। শক্তির ভারসাম্য সর্বহারার পক্ষে এসেছে, ফলে। বুর্জোয়ারা বাধ্য হবে সর্বহারা শ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী মেনে নিতে।
কাজেই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব অর্জন করা অব্যাহতভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনার জন্য অপরিহার্য।
চীন, উত্তর কোরিয়া, উত্তর ভিয়েতনামে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আভ্যন্তরীণ বুর্জোয়াদের সাথে সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতিরেকেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিচালনা সম্ভব হয় (কোরিয়া বাইরের সাম্রাজ্যবাদী হামলার মােকাবেলা করে, ভিয়েতনাম এখনও হামলার মােকাবেলা করছে)।

৬. শ্রেণী সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও
সর্বহারার একনায়কত্ব
মার্কসবাদের জন্মলগ্ন থেকেই সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও তা টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন নিয়ে মার্কসবাদীদের সাথে সংশােধনবাদী, সুবিধাবাদী ও বুর্জোয়াদের জীবণ মরণ সংগ্রাম চলে। সর্বহারার একনায়কত্বের প্রশ্ন নিয়ে পূর্ব বাংলার মার্কসবাদীলেনিনবাদীদের সাথে সংশােধনবাদী, সুবিধাবাদী, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের দালালদের প্রচণ্ড সংগ্রাম চলছে।
রব গ্রুপ শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে। কিন্তু তারা সর্বহারার একনায়কত্বের কথা বলছে না।
মুজিববাদীরা সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে বলে দাবী করছে, কিন্তু সর্বহারার একনায়কত্বের কথা বলছে না।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী, কাজী-রণাে-অমলসেন, দেবেন-বাসার সংশােধনবাদীরা সর্বহারার একনায়কত্বকে বাদ দিয়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলছে।
মওলানা ভাসানীও সর্বহারার একনায়কত্বের কথা বলছে না।
সােভিয়েট আধুনিক সংশােধনবাদীদের নেতৃত্বে বিশ্বের আধুনিক সংশােধনবাদীরা সর্বহারার একনায়কত্বকে বিসর্জন দিয়েছে।
এ সকল তথাকথিত সমাজতন্ত্রীরা যতই শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের গলাবাজি করুক না কেন এদের সমাজতন্ত্র হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখা।
পৃষ্ঠা: ৩৬০

এর কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণী কর্তৃক একনায়কত্ব না হলে অবশ্যই বুর্জোয়া বা প্রতিক্রিয়াশীলদের একনায়কত্বমূলক হবে।
এ কারণেই লেনিন বলেছেন, “এটা প্রায় বলা এবং লেখা হয় যে মার্কসের তত্ত্বের সারবস্তু হলাে শ্রেণী সংগ্রাম, এটা সত্য নয়। এ মিথ্যা থেকে প্রায়ই বেরিয়ে আসে মার্কসবাদের সুবিধাবাদী বিকৃতি, একে মিথ্যা করে বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় করে তােলা। কারণ শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব মার্ক কর্তৃক সৃষ্ট নয়। মার্কসের পূর্বে বুর্জোয়ারাই ইহা সৃষ্টি করেছে। সাধারণভাবে ইহা বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয়। যারা শুধু শ্রেণী সংগ্রামকে স্বীকার করে তারা এখনও মার্কসবাদী হয়নি। তারা এখনও বুর্জোয়া চিন্তা এবং বুর্জোয়া রাজনীতির আওতায় রয়ে গেছে। মার্কসবাদকে শ্ৰেণী সংগ্রামের তত্ত্বে সীমাবদ্ধ রাখার অর্থ হলাে মার্কসবাদকে খর্ব করা, বুর্জোয়াদের নিকট গ্রহণীয় এরূপ বিষয়ে রূপান্তরিত করা। কেবলমাত্র সে-ই একজন মার্কসবাদী যে শ্রেণী সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে প্রসারিত করে। এটাই হচ্ছে মার্কসবাদী এবং সাধারণ ক্ষুদে বুর্জোয়া (বড় বুর্জোয়াও)-দের মধ্যকার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।” ৮
মার্কস নিজেই বলেছেন, “আধুনিক সমাজে শ্ৰেণী বা তাদের মধ্যকার সংগ্রামের অস্তিত্ব আবিষ্কারের জন্য আমার কোন কৃতিত্ব প্রাপ্য নয়। আমার বহু পূর্বেই বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা শ্ৰেণীসমূহের সংগ্রামের ইতিহাসের বিকাশ সম্পর্কে বর্ণনা করেছে, বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা শ্ৰেণীসমূহের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ দিয়েছে। আমার নতুন অবদান হচ্ছে যে আমি প্রমাণ করেছিঃ
(১) শ্রেণী সমূহের অস্তিত্ব উৎপাদনের বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরের সাথে জড়িত। (২) শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য গতি হবে সর্বহারার একনায়কত্বে। (৩) এই একনায়কত্ব হচ্ছে সকল শ্রেণীকে বিলুপ্ত করার এবং শ্রেণীহীন সমাজে প্রবেশ করার উত্তরণ মাত্র।”
কাজেই শ্রেণী সংগ্রামের কথা বললেই মার্কসবাদী হওয়া যায় না। শ্রেণী সংগ্রামের স্বীকৃতিকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের স্বীকৃতিতে প্রসারিত করতে হবে।
সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের মতবাদ কাল্পনিক এবং বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রের সাথে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মৌলিক পার্থক্য রেখা টানছে।
কাজেই রব গ্রুপ শ্রেণী সংগ্রাম, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বললেও তারা সমাজতন্ত্রীর বেশে মার্কিনের দালাল, মুজিববাদীরা সমাজতন্ত্রীর বেশে ছয় পাহাড়ের দালাল।
ভাসানী ইসলামিক সমাজতন্ত্রের নামে ক্ষুদে বুর্জোয়া সামন্তবাদী সমাজতন্ত্রী।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা ও তাদের প্রভু সােভিয়েট আধুনিক সংশােধনবাদীরা, কাজী-রণাে-অমলসেন, দেবেন-বাসাররা সর্বহারার একনায়কত্বকে বিসর্জন দিয়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলে প্রমাণ করছে তারা মার্কসবাদীর বেশে সংশােধনবাদী।

৭. জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়ে রাষ্ট্রের চরিত্র
রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণী কর্তৃক অন্য শ্রেণী দাবিয়ে রাখার যন্ত্র মাত্র। অর্থাৎ শ্রেণী নিপীড়নের যন্ত্র।
শ্ৰেণী সমাজের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। এক শ্রেণী অন্য শ্রেণীর উপর একনায়কত্ব পরিচালনার যন্ত্র হচ্ছে রাষ্ট্র।
পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রের মালিক হলাে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক
পৃষ্ঠা: ৩৬১

সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলার সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের প্রতিনিধিরা। এরাও রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর ফ্যাসিস্ট একনায়কতু পরিচালনা করছে।
এ রাষ্ট্রকে মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা জাতীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে স্বাগত জানাচ্ছে। এমন কি তারা মুজিববাদের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রের ভাওতাকে এবং সংবিধানকে স্বাগত জানাচ্ছে।
আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীদের প্রতিনিধিরা সামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে শােষণ ও লুণ্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব পরিচালনা করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে বলে মনিসিং-মােজাফ্ফর সংশােধনবাদীরা বিশ্বাস করছে।
মার্কসবাদকে এরা কতখানি বিসর্জন দিয়েছে!
জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রধানতঃ সেনাবাহিনীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র, প্রধানতঃ সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে হবে এবং জনগণের যৌথ গণতান্ত্রিক একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে।
পূর্ব বাংলার এই নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র বৈদেশিক শােষকদের দালাল এবং সামন্তবাদীদের দাবিয়ে রাখার এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ব্যবহৃত হবে।
জনগণের এই যৌথ গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব হবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণীর যৌথ একনায়কত্ব।
এই যৌথ একনায়কত্বের কারণ হলাে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় কৃষক, ক্ষুদে বুর্জোয়া এমন কি জাতীয় বুর্জোয়ারাও অশগ্রহণ করে।
এ কারণে এ একনায়কত্বকে সভাপতি মাও বলেছেন, জনগনের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব।
জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব জনগণের মাঝে গণতন্ত্র নিশ্চিত করে, শত্রুদের উপর একনায়কত্ব পরিচালনা করে।
জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রমাণ করছে ইহা সর্বহারার একনায়কত্বের একটি রূপ।
পক্ষান্তরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র হবে সর্বহারার একনায়কত্বমূলক।

৮. শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব ও
সর্বহারার একনায়কত্বে সর্বহারা শ্রেণীর ভূমিকা
রব গ্রুপ শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লবের কথা বলছে। কিন্তু সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বের কথা বলছে না।
বর্তমান যুগে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ব্যতীত শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব সঠিক পথে পরিচালনা ও সম্পন্ন করা শুধু-যে অসম্ভব তাই নয়, শ্ৰেণী আপােস ও সামাজিক প্রতিবিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের পর বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়। কারণ বুর্জোয়ারা শ্রেণীগতভাবে দুর্বল, এ কারণে তারা সহজেই সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা ক্রীত হয়ে তাদের তাবেদারে পরিণত হয় এবং দোদুল্যমানতা দেখায়।
পাক-ভারতের বুর্জোয়ারা স্বাধীনতা আন্দোলন করে, কিন্তু বৃটিশের সাথে আপোেস
পৃষ্ঠা: ৩৬২

করে স্বাধীনতা আনয়ন করলেও বৃটিশ ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করে, তাদের পরােক্ষ লুণ্ঠন ও শােষণ বজায় রাখে।
এভাবে সরাসরি উপনিবেশ থেকে পাক-ভারত আধা উপনিবেশে পরিণত হয়।
সামন্তবাদের সাথেও তারা আপােস করে এবং তাকে টিকিয়ে রাখে। এ কারণে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসমাপ্ত রয়ে যায়।
এ কারণে বর্তমান যুগে বুর্জোয়া নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের নিজেদের বিকাশের জন্য অপরিহার্য জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবও সম্পন্ন করতে পারে না।
পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া নেতৃত্ব জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অর্থাৎ সামাজিক বিপ্লব পরিচালনা করতে যেয়ে সামাজিক প্রতিবিপ্লব ঘটায়, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের নিকট নিজেদের বাজার লিখে দিয়ে নিজেদের বিকাশের পথে কুড়ােল মারে, নিজেদের শ্রেণীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
এর কারণ কি? কারণ নিজেদের শ্রেণীগত দুর্বলতা।
তারা টাটা-রমলা-বিরালার সমান হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভয়ে কখনও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের অভ্যর্থনা জানাত না।
কাজেই বর্তমান যুগে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ব্যতীত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
শ্রেণী ও জাতীয় সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপ হচ্ছে শ্রেণী ও জাতীয় যুদ্ধ।
ইহাও সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ব্যতীত সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে না। বুর্জোয়া নেতৃত্বে শ্রেণী ও জাতীয় আপােস অথবা শ্রেণী ও জাতীয় প্রতিবিপ্লবী যুদ্ধে। পরিণতি লাভ করে।
আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের হামলা মােকাবেলার কোন পরিকল্পনাই করেনি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা ভুল পথে কিছুটা প্রতিরােধ চালায়। শেষ পর্যন্ত তাও ভেঙ্গে পড়লে তারা আত্মরক্ষার্থে ভারতে পলায়ন করে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের কামানের খােরাকে পরিণত হয়। যুদ্ধকে প্রতিবিপ্লবী জাতীয় পরাধীনতার যুদ্ধে পরিণত করে। তারা সর্বদাই এ যুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বের শুধু যে বিরােধিতাই করেছে তাই নয় এমন কি তাদেরকে খতম করার কাজকে প্রাধান্য দিয়েছে।
এভাবে লক্ষ লক্ষ জনগণের রক্তের বিনিময়ে পরিচালিত যুদ্ধ ব্যর্থ হয়। এ কারণেই সভাপতি মাও বলেছেন (বর্তমান যুগে)“… … যে কোন বিপ্লবী যুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণী ও …. (তার রাজনৈতিক পার্টির লেখক) নেতৃত্বের অভাব ঘটলে অথবা সেই নেতৃত্বের বিরুদ্ধে গেলে সে যুদ্ধ অনিবার্যভাবেই ব্যর্থ হবে।” ১০
“শ্রেণী সংগ্রাম, শ্রেণী ও জাতীয় যুদ্ধ, সামাজিক বিপ্লব ও সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব অপরিহার্য কারণ কেবলমাত্র সর্বহারা শ্ৰেণীই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী দূরদর্শী, নিঃস্বার্থ এবং চূড়ান্তভাবে বিপ্লব চালাতে সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সমগ্র বিপ্লবের ইতিহাস প্রমাণ করে, শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব ছাড়া বিপ্লব ব্যর্থ হয় আর শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব থাকলেই বিপ্লব জয়লাভ করে।” ১১
তিনি আরও বলেছেন, “…… শুধুমাত্র সর্বহারা শ্ৰেণী … ও (সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টি- লেখক) হচ্ছে সংকীর্ণতা ও স্বার্থপরতা থেকে সবচেয়ে মুক্ত, রাজনীতিগতভাবে তারাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী দরদষ্টি সম্পন্ন ও সবচেয়ে বেশী সংগঠিত, আর দুনিয়ার অগ্রগামী সর্বহারা শেণী ও তার রাজনৈতিক পার্টিগুলাের অভিজ্ঞতাকে তারা সবচেয়ে বেশী বিনয়ের সংগে গ্রহণ করতে এবং সে অভিজ্ঞতাকে নিজেদের কার্যে প্রয়ােগ করতে পারে। তাই কেবলমাত্র সর্বহারা শ্রেণী ও কমিউনিস্ট পার্টিই কৃষক, শহুরে ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্ব দিতে
পৃষ্ঠা: ৩৬৩

পারে, কৃষক ও ক্ষুদে বুর্জোয়াদের সংকীর্ণতাকে, বেকারদের ধ্বংসাত্মকতাকে অতিক্রম করতে পারে। আর বুর্জোয়া শ্রেণীর দোটানা মনােভাবকেও, শেষ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবার মনােবলের অভাবকেও অতিক্রম করতে পারে (অবশ্য যদি কমিউনিস্ট পার্টির নীতিতে ভুল না হয়) এবং বিপ্লব ও যুদ্ধ বিজয়ের পথে এগিয়ে নিতে পারে।” ১২
সর্বহারার নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অবশ্যই পরিচালিত হতে হবে। ইহা বর্তমান যুগের সামাজিক বিকাশের একটি ইচ্ছামুক্ত বস্তুগত নিয়ম।
সর্বহারার নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সভাপতি মাও নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন (এর বিপরীতে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে জাতীয় গণতান্ত্রিক। বিপ্লব হলাে পুরােনাে গণতান্ত্রিক বিপ্লব যার পরিণতি হচ্ছে উপনিবেশিক বা আধা উপনিবেশিক, সামন্তবাদী বা আধা সামন্তবাদী দেশ)।
এ বিপ্লবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলাে সামাজিক বিকাশের গতি বজায় থাকা অর্থাৎ পরিপূর্ণরূপে সম্প্রসারণবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী, সাম্রাজ্যবাদী শােষণ। এবং সামন্তবাদী শােষণের অবসান অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হওয়া।
এ.বিপ্লব সম্পন্ন করেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করা সম্ভব।
অন্য কথায়, “সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব সমগ্র বিপ্লবের (জাতীয় গণতান্ত্রিক-লেখক) চেহারাটাই পাল্টে দেয়, শ্ৰেণীসমূহকে নতুনভাবে সন্নিবেশিত করে; কৃষকদের বিপ্লবে প্রচণ্ড জোয়ার আনে, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরােধী বিপ্লবে সম্পূর্ণতা আনে, গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণের সম্ভাবনার সৃষ্টি করে।” ১৩
এভাবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সর্বহারার বিপ্লবের সাথে যুক্ত করে।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা সামাজিক বিপ্লবের নিয়মকে সংশােধন করে বলে, “উৎপাদক শক্তি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী যথেষ্ট পরিমাণে বিকাশ লাভ না করা পর্যন্ত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব মেনে নিতে হবে।”
এ কারণেই তারা স্বেচ্ছায় পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের হাতে তুলে দেয়। এ প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব থেকেই আসে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের নেতৃত্ব মেনে চলা অর্থাৎ তাদের লেজুড়বৃত্তি করার বিশ্বাসঘাতক যুক্তি।
‘উৎপাদক শক্তির যথেষ্ট বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করা যায় না’ এ যুক্তি দেখিয়ে মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট জাতীয় বিশ্বাসঘাতক সরকারের লেজুড়বৃত্তি করছে, তাদেরকে উৎপাদক শক্তি অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী সৃষ্টি করার সুযােগ দিচ্ছে।
কি বিশ্বাসঘাতক যুক্তি!
ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট বা বৈদেশিক শােষণ ও লুণ্ঠন বজায় রাখছে, পূর্ব বাংলাকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছে, সামন্তবাদী শােষণ জিইয়ে রেখেছে অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব অসম্পন্ন রেখেছে, পূর্ব বাংলাকে নূতন করে উপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী পূর্ব বাংলায় রূপান্তরিত করেছে। কাজেই এখানে বুর্জোয়া বিকাশ এবং এর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণীর বিকাশ কি করে সম্ভব?
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে করতে মার্কসবাদের ক খ গ-ও ভুলে গেছে।
সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত ও সম্পন্ন জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে
পৃষ্ঠা: ৩৬৪

রাষ্ট্র হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণীর যৌথ একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্র। ইহা সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বেরই একটি রূপ।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্র হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্র।
সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব পরিচালনার জন্য সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব অপরিহার্য। সভাপতি মাও বলেছেন, জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের জন্য সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব প্রয়ােজন। ১৪
“সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব সর্বহারা শ্ৰেণীর রাজনৈতিক পার্টির মাধ্যমে প্রদত্ত হয়। এ রাজনৈতিক পার্টি গঠিত হয় সর্বহারা শ্রেণীর সবচাইতে অগ্রগামী ব্যক্তিদের দ্বারা, ইহা হবে একটি সজীব প্রাণশক্তিতে ভরপুর অগ্রগামী সংগঠন যা সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবী জনগণকে শ্ৰেণী (এবং জাতীয়- লেখক) শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরিচালনায় সক্ষম।” ১৫
এ পার্টির পথ প্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা।
রব গ্রুপ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে পরিচালিত সর্বহারা শ্ৰেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব করা এবং সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে।
সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব করা ও সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলার অর্থ হচ্ছে বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বে সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব করা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
এভাবে রব গ্রুপ সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব বাদ দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বের কথা বলছে, এর পরিণতি হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের নামে শ্রেণী আপােস, সামাজিক বিপ্লবের নামে সামাজিক প্রতিবিপ্লব এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার তাবেদারদের শােষণ ও লুণ্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
মনিসিং-মমাজাফফর সংশােধনবাদীরা এবং কাজী-রণাে-অমলসেন, দেবেন-বাসার এবং দেশীয়-আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংশােধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা মার্কসবাদলেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে পরিচালিত সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির নেতৃত্ব ব্যতীত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব, শ্রেণী সংগ্রাম, সামাজিক বিপ্লব করা, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশীয় আন্তর্জাতিক শশাষণ ও লুণ্ঠন এবং ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বকে সহায়তা করছে।
পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী প্রমাণ করছে পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির সংগ্রামে। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার ভিত্তিতে পরিচালিত সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক পার্টির পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীলদের নেতৃত্বের পরিণতি হচ্ছে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের অনুরূপ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা, ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, দেশীয় আন্তর্জাতিক শােষণ ও লুণ্ঠনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

৯. জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অর্থনীতি
জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছে বৈদেশিক বুর্জোয়াদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আভ্যন্তরীণ সামন্তবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূর করে বুর্জোয়া বিকাশের শর্ত সৃষ্টির বিপ্লব।
এ কারণে এ বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত মালিকানা রক্ষা করা হবে এবং বৈদেশিক
পৃষ্ঠা: ৩৬৫

পুঁজি, বিদেশের সাথে যুক্ত পুঁজি রাষ্ট্রীয়করণ করতে হবে এবং সামন্তবাদকে পুরােপুরি উৎখাত করে ভূমিহীন কৃষকের মাঝে ভূমি বিতরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ পুতুল সরকার সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, কিন্তু এখনও জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবই সম্পন্ন করেনি।
তারা কোন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি এবং তাদের সাথে যুক্ত পুঁজিকে বাজেয়াপ্ত করেনি। তারা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি অবাধে অনুপ্রবেশ করতে দিচ্ছে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী লুণ্ঠন বজায় রাখছে, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন চলতে দিচ্ছে, তারা সামন্তবাদকে উৎখাত করেনি।
এভাবে পূর্ব বাংলা উপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী রয়ে গেছে (মনিসিং-মােজাফর বিশ্বাসঘাতকরা একে অস্বীকার করছে)।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে ভূমিকে সমবায় প্রথা, শেষ পর্যন্ত কমিউনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে সামাজিক মালিকানায় রূপান্তরিত করা হয়।
উৎপাদন (কল-কারখানা, শিল্প) এবং বণ্টন (দোকান, পাইকারী, খুচরা) এবং পরিবহনসহ সকল বিষয় ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা হয়।
মানুষ তার সাধ্যমত কাজ করে, কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পায়।
এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ কর্তৃক মানুষ শােষণ অর্থাৎ শ্রমিক-কৃষকের উদ্বৃত্ত শ্রম মালিকের পকেটস্ত হওয়া বাতিল হয়।
শ্রমিক-কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য কর্মচারীরা তাদের শ্রম দ্বারা তৈরী উদ্বৃত্ত মূল্যের এক অংশ পায়, বাকী অংশ রাষ্ট্র ব্যবহার করে তাদের কল্যাণে সমাজের উন্নতির মূলধন হিসেবে।
পূর্ব বাংলার ছয় পাহাড়ের দালালরা সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলছে, কিন্তু সর্বস্তরে ব্যক্তিমালিকানা এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ব কল-কারখানায় আমলাদের মালিকানা, বিদেশী পুঁজির মালিকানা বজায় রেখেছে।
কাজেই অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এ সরকার সমাজতন্ত্রী দূরের কথা জাতীয় গণতন্ত্রীও নয়।

১০. জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি
জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় সর্বহারা শ্ৰেণীকে অবশ্যই বিপ্লবের নেতৃত্ব অর্জন করতে হবে, বুর্জোয়াদের দোদুল্যমানতাকে তুলে ধরতে হবে, তাদের সাথে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করতে হবে। নিজের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখতে হবে, কোন অবস্থায় বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হলে চলবে না।
বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হওয়ার অর্থ হবে বুর্জোয়াদের স্বার্থের সেবা করা, বিপ্লবের ক্ষতি করা, সর্বহারা ও জনগণের রক্তপাতকে বৃথা যেতে দেওয়া।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা নিজেদের স্বতন্ত্র ভূমিকা বিসর্জন দিয়ে, বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিণত হয়।
ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব বুর্জোয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে, স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্রতা বিসর্জন দেয়। এর পরিণতি হিসেবে তাদের লক্ষ লক্ষ কমরেডকে প্রাণ দিতে হয়।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরাও কি একইভাবে বুর্জোয়াদের লেজুড় হয়ে নিজেদের কবর রচনা করছে না?
পৃষ্ঠা: ৩৬৬

সর্বহারা শ্রেণী অবশ্যই কৃষক-শ্রমিক মৈত্রী গড়ে তুলবে, ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করবে, বুর্জোয়াদের সাথে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতি গ্রহণ করবে।
এ কারণে তাদেরকে গ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে হবে, কৃষকদের শত্রু সামন্তবাদীদের উৎখাত করে কৃষকদের মুক্ত করতে হবে, তাদেরকে এভাবে সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে।
সমাজতান্ত্রিক সমাজে বুর্জোয়াদের পুনরায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল ঠেকানাে প্রধান সমস্যা।
এ কারণে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত শ্রেণী সংগ্রাম চালাতে হবে, সর্বহারার একনায়কত্বকে জোরদার করতে হবে।
সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের অধীন সর্বহারার সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনা করতে হবে।

১১. সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম
মুজিববাদী ও রব গ্রুপ সমাজতন্ত্র, শ্রেণীহীন সমাজ প্রভৃতির কথা বলে। সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম থাকবে।
এ কারণে সমাজতান্ত্রিক সমাজে সর্বহারার একনায়কত্ব হবে রাষ্ট্রের চরিত্র। সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজম উত্তরন পর্যন্ত এ একনায়কত্ব ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকবে। সমগ্র বিশ্বে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা উৎখাতের পর রাষ্ট্রের বিলােপ সাধন সম্ভব। কাজেই কেবলমাত্র কমিউনিস্ট সমাজই হচ্ছে শ্রেণীহীন-শােষণহীন।
মুজিববাদীরা বলছে বর্তমানেই পূর্ব বাংলা শ্ৰেণীহীন হয়েছে যেহেতু পাক সামরিক ফ্যাসিস্টরা সবাইকে সর্বহারা করেছে।
শ্রেণীহীন হলে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, জেল ও রাষ্ট্র রয়েছে কেন?
এগুলাে রয়েছে ধনীদের সম্পত্তি রক্ষার জন্য, বিদেশী শােষকদের রক্ষার জন্য। ইহা। প্রমাণ করে পূর্ব বাংলায় শ্রেণী রয়েছে।
এই শ্রেণীকে বিলােপ করার জন্য, বিপ্লবী সর্বহারার একনায়কতু প্রয়ােজন। এ কথা না বলে রব গ্রুপ, আওয়ামী লীগ জনগণকে ভাওতা দিচ্ছে মাত্র।
শ্ৰেণীহীন সমাজে পৌছার জন্য অবশ্যই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে। সর্বহারা একনায়কত্বের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা ও সম্পন্ন করতে হবে। এর পরেই শ্রেণীহীন সমাজ অর্থাৎ কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

১২. জনগণের বিজয় অবশ্যম্ভাবী
প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রের বুলি দ্বারা জনগণকে প্রতারিত এবং চিরস্থায়ীভাবে তাদেরকে শােষণ ও লুণ্ঠন করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
কিন্তু জনগণ তাদের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা আজ হােক কাল হােক বুঝতে সক্ষম হবে এবং তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে।
পাক-ভারতের জনসাধারণ বৃটিশ উপনিবেশিক শাসকগােষ্ঠীর নির্মম শােষণ ও লুণ্ঠনকে মেনে নেয়নি, তারা এর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ চালিয়েছে।
শেষ পর্যন্ত বৃটিশ দস্যুরা উৎখাত হয়। পূর্ব বাংলার জনগণ বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যুদের উপর নির্ভরশীল হিন্দু ধর্মাবলম্বী
পৃষ্ঠা: ৩৬৭

জমিদার-জোতদারদের মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীল অংশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিশেষ করে ধর্মীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, শেষ পর্যন্ত এরা উৎখাত হয়। এ সকল নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানে যােগদান করে।
কিন্তু পাকিস্তানের অবাঙ্গালী শাসকগােষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবাধ বিকাশ ঘটতে দেওয়ার পরিবর্তে জাতিগত নিপীড়ন চালায় এবং পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করে।
পূর্ব বাংলার জনগণ এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
পাকিস্তানের স্বাধীনতা আনয়নকারী রাজনৈতিক পার্টি মুসলিম লীগ এবং এর নেতা জিন্নাহ এককালে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে ছিল, তারা ক্রমে জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে জনসমর্থন পাকিস্তানের পক্ষে থাকায় ভারত পূর্ব বাংলা বা পাকিস্তান দখল করতে ব্যর্থ হয়।
পূর্ব বাংলার এই জনগণই জাতীয় অধিকার লাভের জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন করার পরিবর্তে একে বিরােধিতা করে। তারা জাতীয় মুক্তির জন্য সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করে।
‘পৃথিবীর কোন শক্তিই পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না’-পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের এই দম্ভোক্তি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়।
পূর্ব বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের মিস্টি কথায় বিশ্বাস করে, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের প্রতারণায় ভুলে তাকে মিত্র বলে অভ্যর্থনা করে।
কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের বিশ্বাসঘাতকতা ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের প্রতারণা বুঝতে পেরেছে, জনগণ এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে।
কাজেই এদের উৎখাত অনিবার্য।
বিপ্লব-পূর্ব সােভিয়েট ইউনিয়নে বারােটিরও অধিক পার্টি ছিল যারা নিজেদেরকে সমাজতন্ত্রী বলে দাবী করতাে। কিন্তু জনগণ এ সকল সমাজতন্ত্রীদের কথা-বার্তা ও কার্যকলাপ বিচার বিশ্লেষণ করে, জনগণের মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম কিনা তা বিবেচনা করে, শেষ পর্যন্ত তাদেরকে বর্জন করে।
মহান নেতা লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টিকে তারা মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হিসেবে নির্ণয় করে এবং তার নেতৃত্ব গ্রহণ করে।
পূর্ব বাংলার জনগণও আজ বিভিন্ন আকৃতির প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রী ও সংশােধনবাদীদের কথা ও কার্যকলাপকে পর্যালােচনা করছে, মুক্তি সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সমস্যাবলীর সঠিক সমাধান দিতে সক্ষম কিনা তা তারা যাচাই করে দেখছে।
এভাবে তারা আজ হােক কাল হােক মেকী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীদের ও বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের বর্জন করবে এবং সত্যিকার সমাজতন্ত্রী ও বিপ্লবীদের গ্রহণ করবে।
পূর্ব বাংলার জনগণ মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদী বিশ্বাসঘাতক চক্রের ‘বি’ টীমের চরিত্র অর্থাৎ আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের দালালীর চরিত্র বুঝতে পেরেছে। তাদের পতনও নির্ধারিত হয়ে গেছে।
রব গ্রুপের বক্তব্য তারা বুঝে উঠতে শুরু করেছে এবং সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় তাদের প্রকৃত মার্কিনের দালালীর চরিত্র এবং আওয়ামী লীগের অনুরূপ চরিত্র জনগণ বুঝতে সক্ষম হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৬৮

এদেরও পতন অনিবার্য।
কাজী-রণাে-অমল সেন, দেবেন-বাসারদের (…?) চরিত্রও জনগণ বুঝে ফেলেছে। তাদের পতনও অনিবার্য। হক-তােয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে চিত্রিত করার এক হাজার একটা প্রচেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু সমাজের গতিধারার প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত ঝড়-তরঙ্গে তাদের মুখােশ উন্মােচিত হচ্ছে, তাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হচ্ছে। জনগণ ও তাদের কেডাররা তাদেরকে পরিত্যাগ করছে। নিজেদেরকে বিপ্লবী হিসেবে চিত্রিত করার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে তারা বারংবার বিভক্ত হয়ে একে অপরকে আক্রমণ করে নিজে খাঁটি বিপ্লবী সাজার ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।
তাদের পতন অনিবার্য।
কাজেই জনগণ, কেবলমাত্র জনগণই হচ্ছে বিশ্ব ইতিহাসের পরিচালক শক্তি। জনগণ বুন্ধু বা বােকা নয়। অনেক সময় তারাই আমাদের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান, আমরাই তাদের তুলনায় অনেক সময় ছেলেমানুষ ও হাস্যস্পদ।
বর্তমান যুগে জনগণ চায় বিপ্লব, দেশ চায় স্বাধীনতা, জাতি চায় মুক্তি।
কাজেই জনগণকে বােকা ভেবে নিজেদেরকে অতিশয় চালাক মনে করে যারা গালভরা বুলি ঝেড়ে বিপ্লবীর মুখােশ পরে জনগণকে প্রতারণা করছে, জনগণের সাথে। বিশ্বাসঘাতকতা করছে তাদের পতন অতীতের প্রতিক্রিয়াশীলদের তুলনায় অতি দ্রুত হবে।
কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলরা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবে না। গােলােযােগ সৃষ্টি করা, ব্যর্থ হওয়া, আবার গােলােযােগ সৃষ্টি করা, ব্যর্থ হওয়া, ধ্বংসের আগ পর্যন্ত-এ নিয়ম অনুযায়ী তারা মৃত্যু পর্যন্ত প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা ও গোেলােযােগ করে যাবে। এ কারণে জনগণের মুক্তির সংগ্রামে আসবে বিপর্যয়, পরাজয়, এ কারণে জনগণের মুক্তির পথ হচ্ছে আঁকাবাকা, কষ্টকর।
“কিন্তু ইতিহাসের নিয়ম অনুযায়ী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবশেষে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বদলাবেই, এটা মানুষের ইচ্ছামুক্ত বাস্তব নিয়ম। প্রতিক্রিয়াশীলরা ইতিহাসের রথচক্রের গতি রােধ করার জন্য যত অপচেষ্টাই করুক না কেন, আগে বা পরে বিপ্লব অবশ্যই ঘটবে এবং তা অনিবার্যভাবেই বিজয় লাভ করবে।” ১৬
প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীরা সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ে কিছুসংখ্যক লােককে কিছু দিনের জন্য প্রতারিত করতে পারবে, কিন্তু সমগ্র জনগণকে চিরদিনের জন্য ধােকা দিতে পারবে না।
সভাপতি মাও বলেছেন, “আজ থেকে শুরু করে পরবর্তী ৫০ থেকে ১০০ বছর, অথবা তার কম বা বেশী সময়টা হচ্ছে বিশ্বের সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মহান যুগ ও একটি বিশ্ব কাঁপানাে যুগ; যার সংগে পূর্ববর্তী কোন ঐতিহাসিক যুগের তুলনা হতে পারে না, এমন একটি যুগে বাস করে আমাদেরকে পূর্ববর্তী যুগগুলাের সংগ্রামের রূপ থেকে অনেক পৃথক বৈশিষ্টপূর্ণ মহান সংগ্রাম চালানাের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।” ১৭
সভাপতি আরাে বলেছেন, “বর্তমান যুগের প্রধান প্রবণতা হচ্ছে বিপ্লব।” ১৮
পূর্ব বাংলা ও বিশ্বের ঘটনাবলী সভাপতি মাওয়ের এই মহান উপসংহারের সঠিকতাই প্রমাণ করছে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হবে, তাদের মুখােশ উন্মােচিত করতে হবে এবং তাদেরকে চূড়ান্তভাবে কবরস্ত করতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৬৯

জনগণকে তাদের মুক্তির পথে পরিচালিত করতে হবে, অব্যাহতভাবে বিপ্লব পরিচালনা করে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সূচনা ও পরিচালনা করতে হবে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে কমিউনিজম বাস্তবায়িত করতে হবে।

নােটঃ
১. Karl Marks, Selected Works, Vol-1, P-155, Second English Edition, Foreign Language Publishing House, Moscow, 1946.
২. Mao Tse-tung. Four Essays on Philosophy. P-9.
৩। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে বুর্জোয়া শ্রেণী রয়েছে। বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহও বর্তমান। সমাজতান্ত্রিক দেশের আভ্যন্তরীণ বুর্জোয়া এবং বাইরের সাম্রাজ্যবাদ প্রতিনিয়ত কমিউনিস্টদের বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত করা এবং বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিদের পার্টিতে অনুপ্রবেশ করানাের প্রচেষ্টা চালায়। এর ফলে কমিউনিস্টদের কেউ কেউ বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হয়। এবং বুর্জোয়া সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিরা পার্টিতে অনুপ্রবেশ করে। এরা মার্কসবাদের মুখােশ পরে। পার্টির মাঝে টাইম বােমা হিসেবে বিরাজ করে এবং পরে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, কু-দেতা প্রভৃতির মাধ্যমে পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা চালায়। এরাই আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে আধুনিক সংশােধনবাদী বলে পরিচিত। এদের পার্টি ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করার উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টিকে বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট পার্টিতে পরিণত করা, সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে উৎখাত করে পুঁজিবাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বুর্জোয়া ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করা।
৪। পােল্যান্ড, হাঙ্গেরী, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানী, মঙ্গোলিয়া ইত্যাদি। ৫। মাওসেতুঙ, উদ্ধৃতি, পৃ-২৭ I
৬। Mao Tse-tung, Four Essays on Philosophy, P-69.
৭। ইতালীর সংশােধনবাদী নেতা তােগলিয়াত্তির তত্ত্ব।
৮। Lenin, State and Revolution, P-40.
৯। DO. P-40.
১০। মাওসেতুঙ, ছয়টি সামরিক প্রবন্ধ, পৃ-২৫।
১১। মাওসেতুঙ, উদ্ধৃতি, পৃ-৪৪।
১২। মাওসেতুঙ, ছয়টি সামরিক প্রবন্ধ, পৃ-২৫।
১৩। মাওসেতুঙ, উদ্ধৃতি, পৃ-৪৪।
১৪। মাওসেতুঙ, উদ্ধৃতি, পৃ-৪৪।
১৫। মাওসেতুঙ
১৬। মাওসেতুঙ, উদ্ধৃতি, পৃ-২৬।
১৭। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নবম জাতীয় কংগ্রেসে প্রদত্ত রিপাের্ট, পৃ-১৪৪।
১৮। ঐ
পৃষ্ঠা: ৩৭০

মওলানা ভাসানীর যুক্তবাংলা প্রসঙ্গে
(অক্টোবর, ১৯৭২)

১.
মওলানা ভাসানী সম্প্রতি পূর্ব বাংলা, পশ্চিম বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা নিয়ে যুক্তবাংলা গঠনের দাবী উত্থাপন করেছেন।
এ পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নিম্নলিখিত বক্তব্য পেশ করা হচ্ছে।
পূর্ব বাংলার সমাজের বর্তমান সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উৎখাত করে পূর্ব বাংলার উপর তাদের উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনের অবসান ঘটানাে, একই সাথে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের শােষণ উৎখাত করা এবং তাদের দালাল ছয় পাহাড়ের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করা, এজন্য জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গণযুদ্ধ শুরু করা।
পূর্ব বাংলার জনগণ এ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগ, তার পদলেহী কুকুর মস্কোপন্থীদের মধ্যকার ঘৃণ্য দস্যুদের খতম করছে।
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট, তাবেদার সরকার এবং তাদের প্রভুদের থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানাের অর্থ হচ্ছে তাদেরকে বাঁচিয়ে দেওয়া।
কাজেই বর্তমানে যুক্তবাংলার কথা বলার অর্থ হলাে এ মহান সংগ্রাম থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যত্র সরানাে। (… ?)।

২.
পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণ নিজেদের মুক্তির জন্য নিজেরাই সংগ্রাম করবেন। তাদের উপরে পরিচালিত জাতীয় ও অন্যান্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা নিজেরাই লড়বেন, নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন। ইহা তাদের পবিত্র ও অলংঘনীয় অধিকার।
পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরাসহ ভারতের সকল নিপীড়িত জাতি এবং জনগণের ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শাসকগােষ্ঠীবিরােধী ন্যায্য সংগ্রাম আমরা সমর্থন করি, তাদের। সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে আমরা আমাদের একই শত্রু এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্র ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে ধ্বংস করব।
পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণ ভারতের সাথে থাকবেন, না বিচ্ছিন্ন থাকবেন তা নির্ণয় করার অধিকার আমাদের নেই। এটা তারাই নির্ধারণ করবেন।

৩.
ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া প্রভৃতি দেশের জনগনের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ণয় করার অধিকার হরণ করে তা নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা। তারা বিশ্ব জনগণের ভাগ্য নির্ধারণেরও ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৩৭১

সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীরা একইভাবে বিশ্বের জনগণের ভাগ্যনিয়ন্ত্রণের ভূমিকা নিচ্ছে। ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরাও পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার নিয়েছে।
এ সকলের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন দেশ, জাতি ও জনগণকে পদানত করা, লুণ্ঠন ও শশাষণ করা, জাতীয় মুক্তি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজম প্রতিহত করা।
ইহা পুরােনাে ও নয়া উপনিবেশবাদীদের এবং সম্প্রসারণবাদীদের সাধারণ কর্মপদ্ধতি।
মওলানা ভাসানী যুক্তবাংলার কথা বলে পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্ব নিয়েছেন।
ইহা কি পুরােনাে ও নয়া উপনিবেশবাদী এবং সম্প্রসারণবাদীদের অনুরূপ। কার্যকলাপ নয়?
পূর্ব বাংলার জনগণ কখনও এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ করবেন না।

৪.
যুক্তবাংলার দাবী পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরার জনগণের দৃষ্টি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শাসকগােষ্ঠী বিরােধী মহান সংগ্রাম থেকে সরিয়ে আনারও একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
কাজেই এ দাবী ভারত ও পূর্ব বাংলার জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম ও সংগ্রামী মৈত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ব্যতীত আর কিছুই নয়।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা এ ধরনের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিল আইয়ুবী আমলে।
বর্তমানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব এবং পূর্ব বাংলার ও ভারতের বিপ্লব নস্যাৎ করার জন্য এ পরিকল্পনা পুনরুজ্জীবিত করা তাদের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়।
বিভ্রান্তিকর রাজনীতিক মওলানা ভাসানীর পক্ষে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া। অস্বাভাবিক নয়।

৫.
“একটি জাতি হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে বিকশিত স্থীয় মানবগােষ্ঠী যা গঠিত হয় সাধারণ ভাষা, ভৌগলিক এলাকা, অর্থনৈতিক জীবন এবং মানসিক প্রকৃতি যা সাধারণ সংস্কৃতিতে রূপ লাভ করেছে এ সকলের ভিত্তিতে।” ২
পূর্ব বাংলা (বৃটিশ উপনিবেশিক দস্যুদের শাসনকালে যা পূর্ব বঙ্গ ছিল) ছিল। কলিকাতার পশ্চাদভূমি, বৃটিশ সমর্থক হিন্দু ধর্মাবলম্বী জমিদার, জোতদার ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা এখানকার জনগণ ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিপীড়িত হয়েছে।
পূর্ব বাংলার জনগণ পুঁজিবাদের বিকাশের প্রক্রিয়ায় ১৯০৫ সালে পূর্ব বঙ্গের পৃথক প্রদেশ স্থাপন অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে সমর্থন করে।
পরবর্তীকালে তারা পাকিস্তানের পক্ষে ভােট প্রদান করে।
পাকিস্তানে যােগদানের পরবর্তী সময় পূর্ব বাংলার জনগণ সাধারণ ভাষা, ভৌগলিক এলাকা, অর্থনৈতিক জীবন ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে বিকাশ লাভ
পৃষ্ঠা: ৩৭২

করে, নিজেদের জাতীয় বিকাশের অন্তরায় দূর করার জন্য সংগ্রাম করে যা বিকাশ লাভ করে সশস্ত্র জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে।
কাজেই ঐতিহাসিকভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ একটি পৃথক মানবগােষ্ঠীতে বিকাশ লাভ করে যার রয়েছে সাধারণ ভাষা, ভৌগলিক এলাকা, অর্থনৈতিক জীবন ও সংস্কৃতি।
এ কারণে পূর্ব বাংলার জনগণ ঐতিহাসিকভাবে একটি সম্পূর্ণ জাতিতে বিকাশ লাভ করেছে।
কাজেই যুক্তবাংলা না হলে পূর্ব বাংলার জনগণ অর্ধেক জাতি বা বিচ্ছিন্ন জাতি রয়ে যায়; এ বক্তব্য মার্কসবাদ বিরােধী।
পূর্ব বাংলার জনগণ জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের জাতীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করেন।
এ মহান সংগ্রাম বুর্জোয়া নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতায় বিপথে পরিচালিত হয়। কিন্তু এতে লক্ষ লক্ষ জনগণ অংশগ্রহণ করেন ও আত্মবলিদান করেন। এত মহান ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরও যারা বুঝাতে চান পূর্ব বাংলার জনগণ একটি জাতি নয়, অর্ধেক জাতি, যুক্ত না হলে পূর্ব বাংলার জনগণ জাতিগতভাবে দ্বিখণ্ডিত থাকবে, তারা সম্পূর্ণরূপে কল্পনার রাজ্যে বাস করেন।
পূর্ব বাংলার জনগণ কখনও নিজেদেরকে অর্ধেক জাতি বা খণ্ডিত জাতি হিসেবে মনে করেননি। তাহলে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের সময় যুক্তবাংলার দাবী পেশ করতেন।
মওলানা ভাসানীর যুক্তবাংলার দাবী জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও কাল্পনিক।

৬.
পূর্ব বাংলার জনগণ নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে স্বাধীনতা ও উদ্যোগ নিজেদের হাতে রেখে নিজেদের মুক্তির জন্য নিজেরাই লড়াই করবেন এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ বিরােধী সংগ্রামরত বিভিন্ন জাতি ও জনগণের সংগ্রামের সাথে একাত্ম হবেন। একই সাথে তাদের হয়ে মনস্থির করার সম্প্রসারণবাদী, বৃহৎ জাতিসূলভ অপরাধমূলক কার্যকলাপকে বিরােধিতা করবেন।
ভারতের বিভিন্ন জাতি (পশ্চিম বঙ্গসহ) ও জনগণ নিজেদের শক্তির উপর নির্ভর করে স্বাধীনতা ও উদ্যোগ নিজেদের হাতে রেখে নিজেরাই মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবেন, এ প্রক্রিয়ায় তারাই স্থির করবেন তারা ঐক্যবদ্ধ ভারতে থাকবেন না বিচ্ছিন্ন হবেন।
আমরা তাদের মুক্তির সংগ্রামকে সমর্থন করি।

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ
কমরেড সিরাজ সিকদার-জিন্দাবাদ
পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন
যুক্তবাংলার দাবী পূর্ব বাংলা ও ভারতীয় বিপ্লব বিরােধী দাবী
স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল পূর্ব বাংলার প্রজাতন্ত্র কায়েম করুন।

নােটঃ
১। Bengsam, অর্থাৎ, বাংলা ও আসাম নিয়ে “বেঙ্গসাম”।
২। J. V. Stalin, Marxism & The National Question, P-16.
পৃষ্ঠা: ৩৭৩

ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের দেয় সংবিধান প্রসঙ্গে
(অক্টোবর, ১৯৭২)

পূর্ব বাংলার বর্তমান সংবিধান প্রণয়নকারীরা হচ্ছে দেশবিক্রেতা, বিশ্বাসঘাতক ও মীরজাফর। পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য সংবিধান প্রণয়নের কোন অধিকার তাদের নেই।
* তথাকথিত গণপরিষদ সদস্যরা ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সামরিক দস্যুর নির্বাচনী কাঠামাের নির্দেশ (L.E.O) মেনে নিয়ে নির্বাচিত হয়েছে।
নির্বাচনী কাঠামাের নির্দেশের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানী সংহতি মেনে চলার কথা। কাজেই এরা পাকিস্তানের সংহতি মেনে নির্বাচিত হয়েছে।
এ কারণে পাকিস্তানের সংহতি মেনে নির্বাচিত ব্যক্তিরা কিভাবে বিচ্ছিন্ন পূর্ব বাংলার সংবিধান তৈরী করতে পারে! পূর্ব বাংলার সংবিধান তৈরীর জন্য তারা নির্বাচিত নয়।
* এ সকল তথাকথিত গণপরিষদ সদস্যরা পাক-সামরিক ফ্যাসিস্টদের নিকট পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিল, এ উদ্দেশ্যে তারা বারংবার আপােষ বৈঠক করে। পূর্ব বাংলার বীর জনগণ তাদের এ ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেয়।
* এ সকল তথাকথিত গণপ্রতিনিধিরা পাক সামরিক ফ্যাসিস্টদের চরম নির্যাতনের মুখে পূর্ব বাংলার জনগণকে অসহায়ভাবে রেখে ভারতে পলায়ন করে।
তারা ক্ষমতা ও গদির লােভে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নিকট পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়, পূর্ব বাংলাকে ভারতের নিকট পরাধীন করার দাসখত লিখে দেয়, পূর্ব বাংলায় তাদের ডেকে আনে।
এভাবে তারা পূর্ব বাংলাকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করে। এর ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র নীতি অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সকল ক্ষেত্রে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা নিয়ন্ত্রণ ও লুণ্ঠন কায়েম করেছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের পূর্ব বাংলায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ, মনিসিং-মােজাফফর মস্কোপন্থী, অন্যান্যদের পূর্ব বাংলার জনগণের জন্য সংবিধান প্রণয়নের কোনাে অধিকার নেই। তারা দেশদ্রোহীতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও মীরজাফরীর অপরাধে অপরাধী।
* তারা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পূর্ব বাংলায় শােষণ ও লুণ্ঠন করা ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সুযােগ দিয়েছে।
* তারা যে শােষণ ও লুণ্ঠনের রাজত্ব স্থাপন করেছে তার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ আজ অন্নহীন, বস্ত্রহীন অবস্থায় চরমতম নির্যাতনের ও লুণ্ঠনের মধ্যে দিনযাপন করছেন।
* পূর্ব বাংলার বীর জনগণ এ নতুন উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এ সকল দেশবিক্রেতা, বিশ্বাসঘাতক ও মীরজাফরদের বিচার করে চরম শাস্তি প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
পৃষ্ঠা: ৩৭৪

কাজেই এ সকল তথাকথিত গণপরিষদ সদস্য যারা জনগণের নিকট লুটপাট সমিতির সদস্য বলে পরিচিত, দেশবিক্রেতা এবং মীরজাফর তাদের সংবিধান তৈরীর কোন অধিকার নেই।
এ সংবিধান হচ্ছে পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশ বজায় রাখা এবং সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ-মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শােষণ বজায় রাখা এবং পূর্ব বাংলায় তাদের দালাল ও সামন্তবাদী শােষণ ও লুণ্ঠন বজায় রাখা ন্যায়সঙ্গত করা এবং জনগণের উপর ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব চালিয়ে যাবার কালাে দলিল।
এ সংবিধানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠন অবসানের কোন কথা নেই।
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্র, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সকল ক্ষেত্রের উপর ভারতীয় শােষণ ও লুণ্ঠনের অবসানের কোন কথা নেই।
অর্থাৎ এ সংবিধানে এ উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। একে ন্যায়সঙ্গত করা হয়েছে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের শােষণ ও লুণ্ঠন, তাদের সামরিক ঘাঁটি বিলােপের কোন কথা নেই।
অর্থাৎ একে তারা ন্যায়সঙ্গত করেছে।
এ কালাে দলিলে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষাকারী পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী মহল, কালােবাজারী আমলাদের উৎখাতের কোন কথা নেই। দেশের সামন্তবাদীদের পরিপূর্ণ উৎখাত করে যে জমি চাষ করে, সে-ই জমির মালিক’ এ ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ সামন্তবাদ বিলােপ করা হয়নি।
এ সংবিধানে জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের উপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়নের অবসান এবং তাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কোন কথা নেই।
এ সংবিধানে উর্দুভাষাভাষী জনগণের উপর পরিচালিত নিপীড়নের অবসানের কোন কথা নেই।
এ সংবিধানে পূর্ব বাংলার অনুন্নত অঞ্চলের বিশেষ করে উত্তর বঙ্গের দ্রুত উন্নয়নের ব্যবস্থা নেই।
সমাজতন্ত্র ও জনগণের মুক্তি শােষণহীন সমাজ কায়েমের গালভরা বুলির আড়ালে এ সংবিধান হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলায় তাদের দালাল ও সামন্তবাদীদের প্রণীত শাসনতন্ত্র।
এদের অধিকার রক্ষা করা অর্থাৎ শােষণ ও লুণ্ঠন এবং জনগণের উপর একনায়কত্ব পরিচালনার জন্য ইহা একটি কালাে দলিল।
এ শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে মুজিববাদ অর্থাৎ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদকে।
এ সংবিধানে যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ছয় পাহাড়ের শােষন ও লুণ্ঠন, যে জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা এবং উর্দু ভাষাভাষি
পৃষ্ঠা: ৩৭৫

কাজেই এ সকল তথাকথিত গণপরিষদ সদস্য যারা জনগণের নিকট লুটপাট সমিতির সদস্য বলে পরিচিত, দেশবিক্রেতা এবং মীরজাফর তাদের সংবিধান তৈরীর কোন অধিকার নেই।
এ সংবিধান হচ্ছে পূর্ব বাংলায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশ বজায় রাখা এবং সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ-মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শােষণ বজায় রাখা এবং পূর্ব বাংলায় তাদের দালাল ও সামন্তবাদী শােষণ ও লুণ্ঠন বজায় রাখা ন্যায়সঙ্গত করা এবং জনগণের উপর ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব চালিয়ে যাবার কালাে দলিল।
এ সংবিধানে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠন অবসানের কোন কথা নেই।
পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক-বেসামরিক ক্ষেত্র, শিক্ষা, শিল্প, সংস্কৃতি, আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক অর্থাৎ পূর্ব বাংলার সকল ক্ষেত্রের উপর ভারতীয় শােষণ ও লুণ্ঠনের অবসানের কোন কথা নেই।
অর্থাৎ এ সংবিধানে এ উপনিবেশিক শােষণ ও লুণ্ঠনকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। একে ন্যায়সঙ্গত করা হয়েছে।
সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের শােষণ ও লুণ্ঠন, তাদের সামরিক ঘাঁটি বিলােপের কোন কথা নেই।
অর্থাৎ একে তারা ন্যায়সঙ্গত করেছে।
এ কালাে দলিলে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষাকারী পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী মহল, কালােবাজারী আমলাদের উৎখাতের কোন কথা নেই। দেশের সামন্তবাদীদের পরিপূর্ণ উৎখাত করে যে জমি চাষ করে, সে-ই জমির মালিক’ এ ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ সামন্তবাদ বিলােপ করা হয়নি।
এ সংবিধানে জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের উপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়নের অবসান এবং তাদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানের কোন কথা নেই।
এ সংবিধানে উর্দুভাষাভাষী জনগণের উপর পরিচালিত নিপীড়নের অবসানের কোন কথা নেই।
এ সংবিধানে পূর্ব বাংলার অনুন্নত অঞ্চলের বিশেষ করে উত্তর বঙ্গের দ্রুত উন্নয়নের ব্যবস্থা নেই।
সমাজতন্ত্র ও জনগণের মুক্তি শােষণহীন সমাজ কায়েমের গালভরা বুলির আড়ালে এ সংবিধান হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ এবং পূর্ব বাংলায় তাদের দালাল ও সামন্তবাদীদের প্রণীত শাসনতন্ত্র।
এদের অধিকার রক্ষা করা অর্থাৎ শােষণ ও লুণ্ঠন এবং জনগণের উপর একনায়কত্ব পরিচালনার জন্য ইহা একটি কালাে দলিল।
এ শাসনতন্ত্রে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে মুজিববাদ অর্থাৎ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা ও ফ্যাসিবাদকে।
এ সংবিধানে যে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব, যে সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে ছয় পাহাড়ের শােষন ও লুণ্ঠন, যে জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা এবং উর্দু ভাষাভাষি
পৃষ্ঠা: ৩৭৫

ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর জাতীয় নিপীড়ন, যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগণের উপর ধর্মীয় নিপীড়ন পরিচালনা।
জনগণ যাতে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে এবং তাদেরকে ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিতে দাবিয়ে রাখা যায় তার জন্য এ কালাে দলিলে রয়েছে সামরিক, আধা-সামরিক এবং বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ব্যবস্থা অর্থাৎ সামরিক, আধাসামরিক, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হচ্ছে জনগণের উপর ফ্যাসিস্ট একনায়কত্ব পরিচালনার হাতিয়ার।
পার্লামেন্ট ও বিচারালয় হচ্ছে এ ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বকে ন্যায়সঙ্গত করার স্থান বিশেষ।
কাজেই এ সংবিধান উপনিবেশিক-আধা সামন্তবাদী পূর্ব বাংলার ছয় পাহাড়ের দালাল শাসক শ্রেণীর জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ফ্যাসিস্ট একনায়কত্বমূলক শাসনতন্ত্র।
ফ্যাসিস্ট আইয়ুবের উৎখাতের সাথে সাথে তার কুখ্যাত শাসনতন্ত্রের পতন হয়েছে।
ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার তাবেদার আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টদের উৎখাতের সাথে সাথে এ জাতীয় বিশ্বাসঘাতক ও ফ্যাসিবাদী শাসনতন্ত্রও উৎখাত হবে এবং জনগণ নিজেরাই জাতীয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অধিকার সম্বলিত সত্যিকার শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন।
পৃষ্ঠা: ৩৭৬

নির্বাচন প্রসঙ্গে
(অক্টোবর, ১৯৭২)

পূর্ব বাংলার মীরজাফর ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ তথাকথিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা ফ্যাসিবাদী জাতীয় বিশ্বাসঘাতক দলিল তথাকথিত শাসনতন্ত্র অনুমােদনের পর গণপরিষদ ভেঙ্গে দেওয়া, অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন এবং নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
গণপরিষদ ভেঙ্গে দেওয়া ও নির্বাচন প্রদানের কারণ
ছয় পাহাড়ের দালাল আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট সরকার বিরােধী গণঅসন্তোষ প্রচণ্ড রােষে ফেটে পড়ছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পর্যায়ে দ্রুত উন্নীত হচ্ছে।
এ নির্বাচনের ভাওতা দিয়ে জনগণকে পার্লামেন্টারী নির্বাচনের কানাগলিপথে আটকে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
* আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্টরা দ্রুত জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
দ্রুত নির্বাচন না দিলে তারা মােটেই ভােট পাবে না। এ ভয়ে তারা নির্বাচন দিচ্ছে।
* মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীর দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে।
ছাত্র লীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ প্রভৃতি এ দ্বন্দ্বের কারণে বিভক্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও এ দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। আওয়ামী লীগের মাঝে এ দ্বন্দ্বের প্রধান দিক হচ্ছে সােভিয়েট-ভারতের দালালরা।
এরা পূর্ব বাংলাকে ভারতের উপনিবেশ হিসেবে বজায় রাখা এবং সােভিয়েটের লুণ্ঠন ক্ষেত্র হিসেবে টিকিয়ে রাখতে চায়।
পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের মধ্যকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের দালালরা পূর্ব বাংলাকে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশে পরিণত করতে চায়।
এই দুই শিবিরের মধ্যকার কামড়াকামড়ি এবং তথাকথিত গণপরিষদ সদস্যদের মারাত্মক জনপ্রিয়তাহীনতাই গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচন প্রদানের কারণ।
এই দুই শিবিরের দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হচ্ছে নির্বাচনেও।
নির্বাচনকে একপক্ষ অন্যপক্ষের উপর প্রাধান্য বিস্তারের উপায় অর্থাৎ অপর পক্ষকে নির্বাচনে হারিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখলের উপায় হিসেবে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্র করছে।
এভাবে চূড়ান্ত বিশ্লেষণে নির্বাচন তাদের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত তীব্রতর করবে।
* এ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে তারা বিরােধী দলসমূহের উপর ফ্যাসিবাদী দমন
পৃষ্ঠা: ৩৭৭

তীব্রতর করেছে। এর কারণ নিজেদের ক্ষমতাচ্যুত হবার ভয়।
এর পরিণতি হিসেবে তারা দেশের মধ্যে ব্যাপক ধরপাকড় ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করার। ফ্যাসিবাদী পাঁয়তারা করছে।
আওয়ামী লীগ ছয় পাহাড়ের দালালদের ‘সি’ ও ‘ডি’ টিম কাজী-রণাে, দেবেনবাসার প্রভৃতি চক্র এ উপনিবেশিক সামন্তবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীন ভাসানীর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণের পাঁয়তারা করছে, তারা প্রকাশ্যে সশস্ত্র সংগ্রামকে বিরােধিতা করছে।
এভাবে তারা তাদের প্রকৃত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের দালালীর চরিত্র তুলে ধরেছে।
* মনিসিং-মােজাফফর মস্কোপন্থী সংশােধনবাদীরা এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ছয় পাহাড়ের দালালদের ‘বি’ টিম হিসেবে আরাে স্পষ্টভাবে পরিচিত করে তুলবে।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এবং অন্যান্য সাচ্চা বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিকরা এ নির্বাচনের প্রহসনকে বিরােধিতা করবেন, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম জোরদার করবেন।
পৃষ্ঠা: ৩৭৮

প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির ষষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার
(৯ ডিসেম্বর, ১৯৭২)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির ষষ্ঠ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন ৬ই ডিসেম্বর শুরু হয় এবং সাফল্যজনকভাবে ৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭২ সাল শেষ হয়।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি।
সভায় কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের সিদ্ধান্তসমূহ, দেশীয় আন্তর্জাতিক অবস্থা, সংগঠনের রাজনৈতিক, সামরিক, মতাদর্শগত, সাংগঠনিক অবস্থা পর্যালােচনা করা হয় এবং নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
১) সামরিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হচ্ছে কেন্দ্রীয় কাজ-এ সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে গৃহীত হয়। ইহা বর্তমানেও কেন্দ্রীয় কাজ। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার পক্ষে কেন্দ্রীয় কাজ, তা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা এবং অপারেশন সংক্রান্ত কতিপয় গাইড লাইন দলিল খুবই সহায়ক হয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করার জন্য সংগঠনের সর্বস্তরে প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে।
এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে লেগে থাকতে হবে। আঞ্চলিক ও বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বকে সম্ভাবনাময় অঞ্চলে কাজ আঁকড়ে ধরতে হবে। নিজ পরিচালনায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে হবে, বিন্দু ভেঙ্গে প্রবেশ করতে হবে, অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে বিভিন্ন ইউনিটকে পরিচালনা করতে হবে।
জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ সূচনার প্রস্তাব বরিশাল জেলায় কার্যকরী হয়েছে এবং অন্যান্য অঞ্চলে শুরু করার প্রচেষ্টা চলছে। এ উদ্দেশ্যে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের দায়িত্ব পুনর্বণ্টন এবং অন্যান্য সাংগঠনিক পদক্ষেপ সঠিক হয়েছে।
২) মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে চক্র বিরােধী সংগ্রাম ও শুদ্ধি অভিযান খুবই ভাল ফল দিয়েছে, কর্মীদের চেতনা উন্নত করেছে। এর সাথে গােড়ামীবাদ বিরােধী সংগ্রাম যুক্ত করার সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযান শুরু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ উদ্দেশ্যে গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযানের পাঠ্যসূচী অধ্যয়ন করা এবং এর আলােকে সর্বস্তরে গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযানের পাঠ্যসূচী অনুমােদিত হলাে।
৩) পূর্ব বাংলায় সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তাদের দালালদের সাথে মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ৩৭৯

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম বাংলা’ ‘যুক্ত বাংলা’ দাবী উত্থাপন করছে, সাম্প্রদায়িক রায়ট, দাঙ্গা বাধাবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
মার্কিনের দালাল রব গ্রুপ (বর্তমানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) প্রাক্তন সামরিক কর্মচারী, মুক্তি বাহিনী, সামরিক বাহিনীর অসন্তুষ্ট অংশের সাথে সংযােগ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ছাত্র, শ্রমিক এবং জনগণকে নিজেদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা অর্থনৈতিক ঋণ, রিলিফ প্রভৃতির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করছে।
তারা সামরিক কু-দেতা, রায়ট-দাঙ্গা, ছাত্র-শ্রমিক অসন্তোষ, অর্থনৈতিক চাপ, পাক-ভারত যুদ্ধের (এর ফলে ভারত পূর্ব বাংলায় সৈন্য পাঠাতে অসুবিধায় পড়বে) প্রভৃতি একযােগে বা একাধিক বিষয় ব্যবহার করে পূর্ব বাংলায় নিজের উপনিবেশ স্থাপনের চক্রান্ত চালাচ্ছে।
সামরিক কু-দেতা চূর্ণ করার জন্য ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ ও তাদের দালাল পুতুল সরকারের অনুগত বাহিনীর হস্তক্ষেপ, শহরসমূহে সশস্ত্র সংঘর্ষ এবং পরিণতি হিসেবে গ্রামসমূহ শহর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।
শক্রদের মধ্যে কামড়াকামড়ির ফলে উদ্ভূত এ অবস্থায় কি কি করতে হবে তার। পরিকল্পনা প্রতিটি স্তর করে রাখবেঃ
* ব্যাপক জাতীয় শত্রুর তালিকা প্রণয়ন।
* ব্যাপক জাতীয় শত্রু খতম ও নিমূল।
* স্থানীয় অস্ত্র দখল।
* থানাসমূহ দখল ও নিরস্ত্রীকরণ।
* অর্থ সমস্যার সমাধান।
* গেরিলা ও প্রতিরােধ চালাবার প্রস্তুতি গ্রহণ।
* কর্মী একত্রীকরণ।
* উচ্চস্তর, সমস্তর ও নিম্নস্তরের মধ্যেকার যােগাযােগের সমস্যা।
নির্বাচন নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের পক্ষে নির্বাচনে পরাজিত হবার সম্ভাবনাই অধিক। এ অবস্থায় এদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণিত হবে।
কিন্তু ইতিহাসের মঞ্চ থেকে বিদায় নেবার পূর্বে তারা মুজিববাদের বিরুদ্ধে প্রচার করে মুজিববাদীদের মুখােশ উন্মােচনে সহায়তা করছে।
কাজেই শত্রুদের মধ্যকার সশস্ত্র সংঘর্ষ আমাদের চমৎকার পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। সশস্ত্র সংঘর্ষ না হলেও আমাদের সাধারণ কাজের লাইন অনুযায়ী অগ্রসর হতে হবে।
এক্ষেত্রে আমাদের লাভ হলাে শত্রু নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করে নিজেদের মুখােশ উন্মােচিত করছে এবং নিজেদের দুর্বল করছে।
শ্রেণী সংগ্রাম মানুষের ইচ্ছামুক্ত বস্তুগত নিয়ম। ইহাই তার প্রমাণ।
৪) দলিল প্রকাশ ও বিনিময় প্রসঙ্গেঃ
* কোন দলিল বিতরণের পূর্বে ছাপানাে কপি যথাযথ স্তর কর্তৃক অনুমােদিত হতে হবে।
* এক স্তরের প্রকাশিত দলিল পরবর্তী উচ্চস্তর কর্তৃক অনুমােদনের জন্য পাঠাতে হবে।
* পুনরায় মুদ্রিত করতে হলে পরবর্তী উচ্চস্তরের অনুমােদন লাগবে।
পৃষ্ঠা: ৩৮০

* সকল স্তর প্রকাশিত দলিলের প্রতিলিপি কেন্দ্রীয় কমিটির নিকট পাঠাবে।
* প্রতিস্তর দলিল পরবর্তী উচ্চস্তরে পাঠাবে। উচ্চস্তর যােগ্য বিবেচনা করলে অন্যান্য অঞ্চলে পাঠাবে। এক অঞ্চলে প্রকাশিত দলিল অন্য অঞ্চলে পাঠাবে না (উচ্চস্তরের অনুমতি ব্যতীত)।
* কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় কমিটি বা পার্টি নেতৃত্বের প্রণীত দলিল সর্বস্তরে বিতরণ ও প্রচার করা যাবে।
* এক অঞ্চলের দলিল অন্য অঞ্চলে পুনর্মুদ্রণ ও প্রচার বা পাঠ করতে হলে পরবর্তী উচ্চস্তরের অনুমতি লাগবে।
* এক অঞ্চলের দলিল অন্য অঞ্চলে যেভাবেই হােক গেলে তা কিভাবে পাওয়া গেল তা এবং দলিল পরিচালক পরবর্তী উচ্চস্তরে পাঠিয়ে দেবে।
* ব্যক্তিগত উদ্যোগে (নিজের অর্থে) যে কেউ দলিল প্রণয়ন করতে এবং মুদ্রণ করতে পারে। কর্মীরা তা পড়বে কিনা এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত লাগবে।
৫) এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে কর্মী বদলী, বিনিময়, দ্রব্যাদি আনা-নেওয়া ইত্যাদি যথাযথ স্তরের মাধ্যমে করতে হবে। যথাযথ স্তর ব্যতীত কারাে নির্দেশে পত্রের কারণে উপরােক্ত কাজ না করা।
বিশেষ অবস্থায় আন্ত-আঞ্চলিক সহযােগিতা করতে হবে। এ বিষয়ে উচ্চস্তরকে অবহিত রাখতে হবে।
৬) যথাযথ স্তরের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন কর্মী অন্য অঞ্চলে কাজ করতে গেলে সেখানকার পরিচালক কাজ করার অনুমতি প্রদান করবেন না।
তাকে যথাযথ স্তরের লিখিত বক্তব্য আনতে বলতে হবে। এ বিষয়ে উচ্চস্তরে জানাতে হবে।
বিভিন্ন স্তরের এক কেন্দ্রকে শক্তিশালী করা, ভুল বক্তব্য, চক্রের বক্তব্য ছড়িয়ে পড়া, পুনরায় ছাপা হওয়া প্রভৃতি ঠেকানাে, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ঠেকানাের জন্য উপরােক্ত (৪, ৫, ৬) সিদ্ধান্তসমূহ সহায়ক হবে।
৭) প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজ, গােপন পার্টি ও সশস্ত্র সংগ্রামের কাজ।
পার্টি পরিচিতি গােপন রেখে প্রকাশ্য, আধা প্রকাশ্য কাজ করা যায়। এর উদ্দেশ্য হবে কর্মী সংগ্রহ করা, শত্রুর সাথে জনগণের দ্বন্দ্ব তীব্রতর করা, শত্রুদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করা।

গণসংগঠন
প্রধান ধরনের গণসংগঠন হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী।
প্রকাশ্য, আধা প্রকাশ্য এবং গণসংগঠনের কাজের উদ্দেশ্য হবে সশস্ত্র সংগ্রামকে সহায়তা করা, কর্মী সংগ্রহ করা।
শত্রু এলাকায় ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত কাজঃ
প্রতিক্রিয়াশীলরা যে সকল ট্রেড ইউনিয়ন দখল করেছে সেখানে পাল্টা ট্রেড ইউনিয়ন বা কেন্দ্রীয় ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গড়ে না তােলা। এ সকল ক্ষেত্রে পার্টি পরিচিতি গােপন রেখে অনুপ্রবেশ করা এবং পূর্বে উল্লিখিত লক্ষ্য বাস্তবায়িত করা।
পৃষ্ঠা: ৩৮১

যেখানে প্রতিক্রিয়াশীলরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করেনি সেখানে পার্টির কর্মীদের নেতৃত্বে (পার্টি পরিচিতি গােপন রেখে) ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা।
স্বতন্ত্রভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে অসুবিধা হলে কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়নে যুক্ত হওয়া।
প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজকে গােপন পার্টি কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রামের সাথে যথাযথভাবে সমন্বিত করতে হবে, গােপন কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রাম হবে প্রধান কাজের পদ্ধতি।
মুক্ত অঞ্চলে প্রকাশ্য গণসংগঠন করতে হবে।
আধা মুক্ত অঞ্চলে বা অস্থায়ী মুক্তাঞ্চলে প্রকাশ্য, আধা প্রকাশ্য ও গােপন সংগঠন , গড়ে তুলতে হবে।
আওয়ামী লীগ, মস্কোপন্থী ও অন্যান্যদের নিয়ন্ত্রিত গণসংগঠন, এমন কি প্রতিক্রিয়াশীল গণ এবং আধা-সামরিক, সামরিক সংগঠনে অনুপ্রবেশ করা, সেখান থেকে সংগৃহীত কর্মীদের সেখানেই রেখে দেওয়ার মাধ্যমে অনুপ্রবেশ করতে হবে।
এ ধরনের অনুপ্রবেশের কৌশল খুবই সহায়ক হচ্ছে। ইহা চালিয়ে যেতে হবে।
প্রকাশ্য-আধাপ্রকাশ্য ও গণসংগঠনে কাজ করা এবং বিভিন্ন গণসংগঠনে অনুপ্রবেশ করার কাজ হচ্ছে পার্টি ও সশস্ত্র সংগ্রামের সহায়ক এবং অধীন।
পার্টির প্রধান ধরনের সংগ্রাম হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম। পার্টি কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রামের মাঝে পার্টি কাজ প্রধান।
পার্টি কাজ, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজের মধ্যে প্রথমটি প্রধান, দ্বিতীয়টি গৌণ।
পার্টি কাজকে যারা গৌণ করে বা বাদ দেয় সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রাধান্য দেয় তারা চে-বাদী।
পার্টি ও সশস্ত্র সংগ্রামকে যারা গৌণ করে বা বাদ দেয়, প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজকে প্রাধান্য দেয় তারা দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী ও সংশােধনবাদী।
যারা পার্টি ও সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজ বাদ দিয়ে দেয় তারা বামপন্থী সুবিধাবাদী।
গােপন পার্টি কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রামকে প্রাধান্য দিতে হবে, প্রকাশ্য কাজের সুযােগ। ব্যবহার করতে হবে, বিভিন্ন গণসংগঠনে ঢুকে পড়তে হবে, গণসংগঠনে কাজ করতে হবে।
শত্রু অঞ্চলে পার্টি কাজ গােপনভাবে করতে হবে, মুক্ত অঞ্চলে এবং পার্টির অধীন সেনাবাহিনীর মাঝে পার্টির কাজ প্রকাশ্যে করতে হবে।
পূর্ব বাংলা ক্ষুদ্র এলাকা, ঘনবসতিপূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে সমবিকশিত, সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ (ভারত ও চীনের সামাজিক অবস্থা থেকে এ সকল কারণে পৃথক), এ কারণে এখানে কোন রাজনৈতিক ঘটনা দ্রুত অধিকাংশ জনগণকে সমাবেশিত করে। ফলে গণসংগ্রাম অ্যুত্থানে রূপ নেয়।
এ কারণেই ছাত্ররা সামাজিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এ কারণে শক্তিশালী ছাত্র ও অন্যান্য গণসংগঠন গড়ে তােলা উচিত যাতে গণঅভ্যুত্থানকে সশস্ত্র সংগ্রামের সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

৮) বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী প্রসঙ্গেঃ
সম্প্রতি মতিন-আলাউদ্দিন নয়া সংশােধনবাদীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মতিনআলাউদ্দিনদের বিরুদ্ধে তাদের অপর অংশ কর্তৃক যে সকল অভিযােগ আনা হয়েছে তার
পৃষ্ঠা: ৩৮২

অনেকগুলাে (?) পূর্বেই আমরা করেছি। এভাবে আমাদের বক্তব্য সঠিক বলে প্রমাণিত হচ্ছে।
তাদের বিভক্তিকরণ তাদের দেউলিয়াত্ব দ্রুততর করেছে।
হক-তােয়াহার সাধারণ কর্মীরা নেতৃত্বের প্রতি চরমভাবে আস্থা হারিয়েছে। সাধারণ কর্মীরা তাদেরকে বর্জন করছে এবং বিপ্লবী লাইনে কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কাজী-রণাে, দেবেন-বাসাররা বিভ্রান্তিকর রাজনীতিক মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নির্বাচনের পাঁয়তারা করছে।
মনিসিং-মােজাফফর সংশােধনবাদীরা নিজেদেরকে সরকার বিরােধী হিসেবে চিত্রিত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
৯) চাকমা, মগসহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের আঞ্চলিক স্বায়তুশাসনের সংগ্রাম সমর্থন করা, তাদের উপর পরিচালিত জাতীয় নিপীড়ন বন্ধ করা, তাদের জাতীয় নিপীড়ন বিরােধী সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘােষণা সম্বলিত চিকা, পপাস্টার মারা।
১০) আঞ্চলিক পরিচালকগণ একটি ডাইরীতে তার আওতাধীন কর্মীসহানুভূতিশীল, সমর্থকদের অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে গৃহীত তথ্যাদি লিখে রাখবে যাতে ভবিষ্যতে কেডারদের জানা সহজ হয়।
১১) প্রতি ২ মাসে কমপক্ষে একবার সার্বক্ষণিক কর্মী হওয়ার আবেদন করার জন্য আহ্বান জানানাে, যাতে সার্বক্ষণিক কর্মী হতে ইচ্ছুক কর্মীদের খোঁজ পাওয়া যায় এবং তাদের থেকে যােগ্যদের বের করা যায়।
১২) নিম্নলিখিত দলিলসমূহ প্রকাশ করাঃ
* “পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন” ধরনের জনগণের জন্য আহ্বান তৈরী করা।
* সামরিক-আধাসামরিক বাহিনী এবং জলিল-তাহেরদের ভূমিকা সম্পর্কে বক্তব্য তৈরী করা।
* মুসলিম বাংলা প্রসঙ্গে বক্তব্য তৈরী করা।
* সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা এবং সামরিক অভিজ্ঞতার সারসংকলন করে দুটো দলিল প্রণয়ন করা।
* পার্টির ইতিহাস প্রণয়ন করা।
* আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির উপর একটি দলিল প্রণয়ন করা।
* একটি সামরিক রাজনৈতিক ইশতেহার প্রতি দু’মাসে কমপক্ষে একবার কেন্দ্র কর্তৃক জনগণের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা।
১৩) উচ্চস্তরে প্রেরিত দ্রব্য তালিকাসহ প্রেরণ করতে হবে। প্রাপ্ত দ্রব্যের সাথে তালিকা মিলিয়ে দেখে প্রাপক তালিকায় ‘বুঝে পেলাম’ লিখে স্বাক্ষর দেবে। প্রেরক এ কাগজ বুঝে নেবে। এর ফলে দ্রব্যাদি আত্মসাৎ হবে না।
১৪) প্রকাশিত দলিলঃ
* রব গ্রুপ পুনর্মুদ্রণের সময় হেডিং-এ রব গ্রুপ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) লিখতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৮৩

এ দলিলে রব গ্রুপের মুখোেশ চমৎকারভাবে উন্মােচিত হয়েছে। ইহা তাদের কর্মীদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি করছে, সাচ্চা কর্মীদেরকে আমাদের সাথে যােগদানে প্রেরণা দিচ্ছে, গোঁড়াদের মাঝে ক্রোধের সঞ্চার করছে।
ইহার ব্যাপক বিতরণ প্রয়ােজন।
* “বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কয়েকটি দলিল”-এ বর্তমান পরিস্থিতি পরিষ্কার করা হয়েছে।
কতিপয় সংশােধনীসহ দলিলটি গৃহীত হয়।
* “সমাজতন্ত্র, শ্রেণী সংগ্রাম ও সামাজিক বিপ্লব প্রসঙ্গে” দলিলে উপরােক্ত বিষয়সমূহ সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করছে, জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সাথে যুক্ত বিভিন্ন প্রশ্নের বিষদ ও সহজবােধ্য বিশ্লেষণ রয়েছে।
ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও চমৎকার দলিল। এ সম্পর্কে বিভিন্ন সংশােধনী ও প্রস্তাব গৃহীত হলাে।
* কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক সংশােধিত কর্মসূচী পাঠ, পর্যালােচনা এবং এর উপর মন্তব্য পেশ করার জন্য সর্বস্তরে প্রেরণ করা।
১৫) কেন্দ্রীয় কমিটির পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের দাম্পত্য জীবন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পার্টির মাঝে সীমাবদ্ধ পরিসরে কার্যকরী করতে হবে।
১৬) বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদীদের সাথে যুক্ত আন্তরিকভাবে বিপ্লবীদের মতাদর্শগত ও সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ করার পরিকল্পনা গৃহীত হলাে। ইহা সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে মতামত সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করা হবে।
১৮)১ সভাপতি কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশাদি, সিদ্ধান্ত, প্রকাশিত দলিলাদি অনুমােদিত হলাে।
১৯) পঞ্চম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের ইশতেহার ও সিদ্ধান্ত বর্তমান সভায় পরিবর্তন ও পরিবর্ধনসহ গৃহীত হলাে।
সভায় সকল সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
কেন্দ্রীয় কমিটির সপ্তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের তারিখ নির্ধারণ করে সভার কাজ সাফল্যজনকভাবে সমাপ্ত হয়।
…………………………………………………………………….
১. পাণ্ডুলিপিতে ১৭নং পয়েন্টটি নেই। এ পয়েন্টটি হাতে লেখা মূল পাণ্ডুলিপি থেকে ছাপার সময়
বাদ পড়েছিল, নতুবা লেখার সময় ক্রটি ঘটেছিল। আমরা এখানে ছাপানাে পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী ছাপালাম -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩৮৪

সামরিক ক্ষেত্রে কতিপয় গাইড লাইন
(ডিসেম্বর, ১৯৭২)

১। ব্রাশ ফায়ার করা যায় এরূপ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র (স্টেন, ব্রেটা, এল.এম.জি, পিস্তল) সংক্রান্তঃ
|আমরা অনেকগুলাে ব্রাশ ফায়ার করা যায় এরূপ অস্ত্রাদি হারিয়েছি। কাজেই এ সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
০ গ্রামে রাতে জাতীয় শক্র অপারেশনে স্টেন, ব্রেটা বা এল.এম.জি. ব্যবহার না করা। দেশীয় অস্ত্র দ্বারা অপারেশন করা, প্রয়ােজনবােধে রাইফেল ব্যবহার করা।
০ পুলিশ, সামরিক বাহিনীকে অল্প দূর থেকে এ্যামবুশ করার জন্য এ ধরনের অস্ত্র খুবই সহায়ক। কাজেই এ ধরনের হামলার জন্য এগুলাে রেখে দিতে হবে।
০ শহরে গ্রামে কমান্ডাে হামলার জন্য সীমিত সংখ্যায় ব্যবহার করা। ০ রাখা, স্থানান্তরে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করা।
০ নেতৃস্থানীয় ও সম্ভাবনাময় কর্মীদের দিয়ে অস্ত্রাদি একস্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তর না করা।
০ কোন প্রকার গাফিলতির জন্য এ ধরনের অস্ত্র খােয়া গেলে শাস্তি প্রদান করা।
০ কমান্ডার/কমিশার অপারেশনের সময় প্রয়ােজন বােধে নিরাপত্তার জন্য স্টেন, ব্রেটা, পিস্তল সঙ্গে রাখতে পারেন। তিনি উহা নিজ হেফাজতে সতর্কতার সাথে রাখবেন যাতে তা খােয়া না যায়। অপ্রয়ােজনীয়ভাবে একটিও গুলি খরচ করবেন না।
০ যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে এবং গুরুত্ব না বুঝার ফলে এগুলাে খােয়া যাচ্ছে এবং অস্ত্রের উপর অতি নির্ভরতা জন্মাচ্ছে।
২। শহর ও গ্রামাঞ্চলে অস্ত্রের অনুসন্ধান করা, সম্ভব হলে অপারেশন করে তা সংগ্রহ করা, ক্রয় করা।
৩। গেরিলা অপারেশনের সময় (অর্থাৎ পরিকল্পনা কার্যকরী করার সময়) কমান্ডার নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে।
অপারেশন প্রাক্কালে কমিশার/পরিচালকের সাথে কমান্ডারের যােগাযােগ করার ব্যবস্থার অভাবে কমান্ডার তার ভূমিকা পালনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে।
ফলে অপারেশন হয়নি, পুরােপুরি সফল হয়নি অথবা টুপ বিপদে পড়েছে।
কমান্ডার, পরিচালক/কমিশারের সাথে সংযােগ রাখতে পারে তার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজনে যাতে কমান্ডার বাস্তব অবস্থা জানতে পারে ও নির্দেশ নিতে পারে।
এ ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে অনেক অপারেশনে ব্যর্থতা ঠেকানাে সম্ভব হবে।
এ কারণে কমান্ডার যাতে কমিশার/পরিচালকের সাথে সংযােগ রাখতে পারে তার জন্য ‘ওয়াকিটকি, ওয়্যারল্যাসের ব্যবস্থা করার প্রচেষ্টা চালানাে।
পৃষ্ঠা: ৩৮৫

অপর পদ্ধতি হচ্ছে অপারেশনের মাধ্যমে কমান্ডারদের অভিজ্ঞ করে তােলা, শিক্ষা প্রদান করা যাতে কমান্ডার অপারেশনকালে উত্থাপিত নতুন সমস্যাবলীর সমাধান ঠাণ্ডা মাথায় দিতে পারে।
৪। অনেক সময় কমান্ডার অপারেশন প্রাক্কালে তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়। এ কারণে সহকারী কমান্ডার ঠিক করে দেওয়া প্রয়ােজন। কমান্ডার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সহকারী কমান্ডার টুপ পরিচালনা করবে, কমান্ড দেবে।
সহকারী কমান্ডারও দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে গেরিলাদের মাঝে যে কেউ কমান্ড গ্রহণ করে ট্রুপকে পরিচালনা করবে এবং নির্দেশ দেবে।
এ ব্যবস্থা অপারেশন পরিকল্পনাকালে গেরিলাদের ভালভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে, যাতে কমান্ড সমস্যা না উঠে।
এক সাথে সকলেই কমান্ড না দেয় সে বিষয়েও সতর্ক করতে হবে, অর্থাৎ কমান্ডার ব্যর্থ হলে সহকারী কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার ব্যর্থ হলে যে কোন গেরিলা কমান্ড দেবে- এই নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৮৬

শহর ও গ্রামে বাস্তব সামরিক অপারেশনের কতিপয় কৌশলগত দিক
(ডিসেম্বর, ১৯৭২)
[এ দলিলটির প্রচার পার্টির মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল -প্রকাশক।]

০ অপারেশন পূর্বেকার দায়িত্ব।
০ অপারেশনকালীন দায়িত্ব।
০ অপারেশন পরবর্তীকালীন দায়িত্ব।
০ উপসংহার।

অপারেশন পূর্বেকার দায়িত্ব
১। অনুসন্ধানঃ
অনুসন্ধানের সফলতার উপর অপারেশনের সাফল্য, কর্মীদের নিরাপত্তা অনেকখানি নির্ভর করে।
অনুসন্ধান ভুল বা অসম্পূর্ণ হলে পরিকল্পনা ঠিক হবে না। অপারেশন কার্যকরী করার প্রাক্কালে কর্মীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, অপারেশন ব্যর্থ হতে পারে।
০ সাধারণতঃ জাতীয় শত্রু ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর তালিকা আমাদের কর্মী ও সহানুভূতিশীলরা তথ্যসহ প্রেরণ করে।
কখনাে ব্যক্তিগত শত্রুতা এবং অল্প অপরাধ বা আদৌ জাতীয় শত্রু নয় এরূপ ব্যক্তিও শত্রু তালিকাভূক্ত হয়ে যেতে পারে।
অনুসন্ধানের অন্যতম লক্ষ্য হবে প্রকৃতই জাতীয় শত্রু বা তাদের প্রতিষ্ঠান কিনা তা কঠোরভাবে যাচাই করা।
০ প্রাথমিক অনুসন্ধান আমাদের সাধারণ অবস্থার আলােকে করতে হবে। এমন লক্ষ্যবস্তু অনুসন্ধান করে সময় নষ্ট করা উচিত নয় যা আমাদের ক্ষমতার বাইরে।
০ প্রাথমিক অনুসন্ধান সম্পন্ন হলে লক্ষ্যবস্তু সমূহ আমাদের বাস্তব অবস্থার আলােকে পর্যালােচনা করা।
এর ভিত্তিতে লক্ষ্য স্থির করা।
০ চূড়ান্ত অনুসন্ধান করা।
এ ক্ষেত্রে একাধিক কমরেড দ্বারা অনুসন্ধান করানাে, তাদেরকে ম্যাপসহ পরিকল্পনা পেশ করতে বলা।
ম্যাপে অপারেশন লক্ষ্যবস্তুর খুটিনাটি সহ সবকিছু এবং আশেপাশের অবস্থা, আসা ও চলে যাওয়ার পথসমূহ থাকবে।
০ অনুসন্ধানের ভিত্তিতে লক্ষ্যবস্তু অনুমােদন করা।
পৃষ্ঠা: ৩৮৭

০ অপারেশন করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া যাতে লক্ষ্যবস্তুর কোন পরিবর্তন শেষ মুহূর্তে বিবেচনা করা যায়।
২। পরিকল্পনাঃ
অনুসন্ধান ও নিম্নলিখিত সমস্যার ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা।
গেরিলাদের সংখ্যা, অস্ত্র, গেরিলাদের অবস্থান, যাতায়াত নির্ধারণ করা। তারিখ, সময় নির্ধারণ করা।
৩। অস্ত্র সংগ্রহ ও সরবরাহঃ
অস্ত্র বহন করা ও পৌঁছে দেওয়া বা তৈরী করার কাজে সম্ভাবনাময় কর্মী, গেরিলা নিয়ােগ না করা।
অস্ত্র তৈরী করতে যেয়ে সম্ভাবনাময় ও গুরুত্বপূর্ণ কমরেড শাহীন১ নিহত হয়।
অস্ত্র অনেক সময় অপারেশনের আগের দিন গেরিলাদের দেওয়া হয় বা অপারেশনের পূর্বে দেওয়া হয়।
অপারেশনের পরে অস্ত্র নিয়ে নেওয়া হয়। দেওয়া ও নেওয়ার সময় অস্ত্র ও গােলাবারুদের হিসেব রাখা যাতে কোন কিছুরই অপব্যবহার না হয়।
অনির্ভরশীল লােকের নিকট অস্ত্র না রাখা। এ ধরনের লােকের নিকট অস্ত্র রাখায় এরা অস্ত্র কয়েক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করেছে। কয়েক ক্ষেত্রে অস্ত্র খােয়া গেছে।
অস্ত্র যারা রাখবে ও সরবরাহ করবে তারা খুবই নির্ভরশীল ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন। কমরেড হবে। তারা যেভাবেই হােক অস্ত্র রক্ষা করবে।
৪। গেরিলা সংগ্রহঃ
০ সম্ভাবনাময় কর্মী যথাসম্ভব না নেওয়া।
০ ধরা পড়লে বা নিহত হলে এলাকার সামগ্রিক কাজে ক্ষতি হবে এমন কমরেডদের নেওয়া।
০ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিযুক্ত কমরেডদের না নেওয়া।
০ ভ্রষ্টদের ও সন্দেহজনক ব্যক্তিদের অপারেশনে যথাসম্ভব কম নেওয়া।
০ অর্থনৈতিক অপারেশনে, শক্রর অর্থ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি দখল করার দায়িত্ব ভ্রষ্টদের উপর না দেওয়া।
০ বিশ্বস্ত, শৃঙ্খলা ও নির্দেশ পালন করে, আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধদের নেওয়া।
০ কমান্ডার, সহকারী কমান্ডার নিয়ােগ করা।
০ রাজনৈতিক কমিশার নিয়ােগ করা।
০ কুরিয়ার নিয়ােগ করা যে ট্রপের খবরাখবর পরিচালক/কমিশারের নিকট দেবে। ওয়াকিটকি বা ওয়্যারলেস এর নিকট থাকবে।
০ গেরিলাদের অবস্থান, দায়িত্ব ও অস্ত্র নির্ণয়।
৫। অপারেশনে গেরিলা নিয়ােগের পূর্বে সম্ভাব্য সকল পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে নেওয়াঃ
০ সময়মত আসে কিনা তা যাচাই করার জন্য পরীক্ষামূলকভাবে একত্রিত করা।
০ অস্ত্রের দায়িত্বে নিযুক্ত কমরেড সময়মত আসে কিনা তা দেখা।
…………………………………………………………………….
১. কমরেড শাহীন ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পার্টির নেতৃত্বাধীন ২নং ফ্রন্ট এরিয়ার সামরিক প্রধান ছিলেন এবং সে সময়ে বােমা তৈরীকালে একজন সহকর্মীসহ দুর্ঘটনায় নিহত হন -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩৮৮

০ সম্ভব হলে মেকী অপারেশনের ব্যবস্থা করা এবং গেরিলাদের যাচাই করা।
০ মৌখিকভাবে প্রশ্ন করা ও দেখা।
০ অতীতের কার্যাবলী সংগ্রহ ও পর্যালােচনা করা।
০ অতীতের সামরিক অভিজ্ঞতা বিবেচনা করা।
৬। যথাসম্ভব কম গেরিলা নিয়ে অপারেশন টুপ গঠন করা। বেশী গেরিলা নিয়ে ট্রুপ গঠন। করলে তা পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও চলে আসার মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। শহরে টুপ অবশ্যই ছােট হবে। ৭। গেরিলাদের একত্রিত হওয়াঃ
০ একত্রিত হওয়ার স্থান ও সময় নির্ণয়।
০ গােপনীয়তা বজায় রাখার জন্য একত্রিত হওয়ার স্থান না জানিয়ে এক একজনকে পৃথক পৃথকভাবে বিভিন্ন স্থানে প্রােগ্রাম দিয়ে মিলনস্থানে নিয়ে আসা।
০ মিলনস্থান, বৈঠকের স্থান এমন জায়গায় হলে ভাল হয় যা প্রকাশ হয়ে পড়লেও কোন ক্ষতি হবে না।
এ কারণে কর্মী বা সহানুভূতিশীলদের বাসা না হলে ভাল হয়।
০ সময়মত গেরিলারা একত্র হবে, অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে এবং যানবাহন প্রস্তুত করতে হবে।
এ সকল কাজে দায়িত্বপূর্ণ কমরেড নিয়ােগ করতে হবে।
৮। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় অপারেশনে অংশগ্রহণকারী গেরিলাদের নিয়ে বসলে ভাল হয়। এর ফলে তাদের মতামত ও প্রস্তাব পাওয়া যায়।
পরিকল্পনা ভালভাবে গেরিলাদের বুঝিয়ে দেওয়া।
তাদের দায়িত্ব ভালভাবে বুঝিয়ে দেওয়া।
৯। অপারেশনে দুর্ঘটনাসমূহঃ
০ অপারেশনের ব্যর্থতার ফলে উদ্ভূত সমস্যা পর্যালােচনা করা।
০ ধরা পড়লে কি কি করতে হবে তা ঠিক করে দেওয়া।
০ আহতদের নিয়ে আসা, রাখা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করে রাখা।
০ নিহতদের নিয়ে আসা ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করে রাখা।
০ গ্রেফতারকৃতদের সাথে যােগাযােগ করা ও মুক্ত করা এবং গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত সমস্যাবলী সমাধানের ব্যবস্থা রাখা।
০ আহত, নিহত, গ্রেফতারকৃতদের পরিবারে সাহায্যের ব্যবস্থা বিবেচনা।
০ আহত, নিহত ও গ্রেফতারকৃতদের কারণে উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধান বিবেচনা করা।
১০। অপারেশনের সময়সীমাঃ
অপারেশনের সময়সীমা নির্ধারণ করা অর্থাৎ কত সময়ব্যাপী অপারেশন চলবে তা নির্ধারণ করা।
বিশেষ করে শহরে এ ধরনের সময়সীমা অবশ্যই কয়েক মিনিটের বেশী হবে না, অন্যথায় বিপদে পড়তে হবে।
বিদ্যুৎবেগে অপারেশন করে চলে আসতে হবে। কোন মতেই অপারেশন প্রলম্বিত করা চলবে না।
পৃষ্ঠা: ৩৮৯

১১। অনুমতিঃ
আঞ্চলিক নেতা/পরিচালকের লিখিত অনুমতি ব্যতীত কোন অপারেশন হবে না। লিখিত সার্কুলার দিয়ে ইহা কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া এবং কঠোরভাবে এ নিয়ম কার্যকরী করা।
কারণ-
০ ব্যক্তিগত স্বার্থে অপারেশন হতে পারে।
০ শত্রু-মিত্র নির্ণয় না করেই হামলা হতে পারে।
০ যথাযথ অনুসন্ধান, পরিকল্পনা না হওয়ায় অস্ত্র ও কর্মী খােয়া যেতে পারে।
০ অস্ত্র ও মূল্যবান দ্রব্যাদি আত্মসাৎ করতে পারে।
০ পাটির সুনাম নষ্ট হতে পারে। জনগণের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।
১২। শত্রুর সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ, আমাদের গেরিলাদের সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ, জনগণের সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ, প্রকৃতির সম্ভাব্য সকল পরিবর্তন চিন্তা করে বের করা এবং গেরিলাদের তা বুঝিয়ে দেওয়া; কি কি করতে হবে তা বাতলে দেওয়া।
সকল সম্ভাবনা চিন্তা না করার ফলে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
০ সম্ভব হলে অপারেশনের রিহার্সেল করা।
১৩। শহরে আক্রমণের জন্য পিস্তল ব্যবহার করা যায় (ঠিকমতাে গুলি বেরােয় এবং ভাল সই হয়)। গ্রামে আত্মরক্ষার্থে রিভলবার ব্যবহার করা যায়।
১৪। শহরে অপারেশন করার সময় এমনভাবে করা যাতে বাইরের লােক টের না পায়।
১৫। দখলকৃত দ্রব্যাদির একাধিক স্থান পরিবর্তনের ব্যবস্থা করা।
১৬। অপারেশনের পূর্বে গাড়ী ও অন্যান্য যানবাহনের নাম্বার প্লেট পাল্টানাে। চালক চালিয়ে দেখবে যাতে সে যানবাহনের নিয়মবিধি বােঝে।
জ্বালানী পূর্ণ করে নেয়া।
১৭। প্রাকৃতিক অবস্থার বিবেচনাঃ
দিন বা রাত, দিন রাতের কোন সময়, অন্ধকার রাত না চাঁদনী রাত, বৃষ্টি না শুকনা, কোন অবস্থা অপারেশনের জন্য ভাল বিবেচনা করা।
১৮। অর্থনৈতিকঃ
বাজারের উঠানামা, অর্থের যাতায়াত ভালভাবে লক্ষ্য করা।
১৯। অস্ত্রঃ
০ প্রত্যেককে অস্ত্রের ব্যবহার শিখিয়ে দেওয়া।
০ অস্ত্র, গােলাবারুদ ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখে নেওয়া।
০ একাধিক অস্ত্র নেওয়া যাতে একটা বিকল হলে সচল অস্ত্র থাকে।
২০। অবস্থানঃ
০ অপারেশনে গেরিলাদের অবস্থানের ত্রুটির জন্য শত্রু পালাতে পারে।
০ নিজেদের কর্মরি ক্ষতি হতে পারে।
০ অপারেশন ব্যর্থ হতে পারে।
০ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে গুরুত্বপূর্ণ লােক দেওয়া !
পৃষ্ঠা: ৩৯০

২১। নিরাপত্তা ও গােপনীয়তা প্রসঙ্গেঃ
০ অপ্রয়ােজনীয়ভাবে এক টুপ অন্য টুপকে না চেনাননা।
০ অপারেশনের তারিখ, সময় পূর্বাহ্নে না জানানাে। গেরিলাদের নির্দিষ্ট দিনে অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে আসতে বলা।
০ গেরিলাদের পরস্পরের বাড়ী না চেনানাে। পরিচালক কুরিয়ারের মাধ্যমে গেরিলাদের একত্র করবে।
০ অপারেশন বিষয়ক কোন তথ্য অপারেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ প্রকাশ করবে না।
০ নিরাপত্তার কারণে কোন কোন অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু গেরিলাদের না জানানাে, অপারেশনের পূর্বক্ষণে জানানাে।
০ অপারেশন ব্যর্থ হয়েছে বা গেরিলাদের জানানাে হয়েছে অথচ অপারেশন হয়নি। এরূপ লক্ষ্যবস্তুতে বহুদিন পর অপারেশন করা যায়।
২২। গ্রামে বা শহরে অনেক সময় ভয় দেখানাের জন্য শব্দ করতে হয়। এক্ষেত্রে বাজী ব্যবহার করা যায়।
২৩। শহরে পরিকল্পিতভাবে গাড়ী ড্রাইভার, বেবীটেক্সী ড্রাইভার সংগ্রহ করা, রিকসা, ঠেলা, গরুর গাড়ী চালক, ঘােড়ার গাড়ী চালক, ট্রাক, বাস ড্রাইভারও যােগাড় করা উচিত। কর্মীদের তা চালাতে শিখানাে। এভাবে শহরে যানবাহনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান করা।
জেলে, নৌকা মাঝি, লঞ্চ, জাহাজ শ্রমিকদের মাঝে কাজ করা উচিত, আন্তঃজেলা যানবাহনের সমস্যার সমাধানের জন্য।
২৪। নতুনদের অভিজ্ঞ করে তােলার জন্য তাদেরকে কম গুরুত্বপূর্ণ ও সহজ অপারেশন ও অবস্থানে নিয়ােগ করা। অভিজ্ঞদের সাথে নতুনদের নিয়ােগ করা।
২৫। একই অপারেশনে পরস্পর বৈর ভাবাপন্ন কর্মী ব্যবহার না করা।
২৬। গেরিলাদের কারাে কারাে মাঝে হামবড়াভাব, সমরবাদ দেখা দিতে পারে, শৃঙ্খলা, নির্দেশ পালনে ঢিলে দিতে পারে।
শিক্ষার মাধ্যমে এগুলাে দূর করার প্রচেষ্টা চালানাে। অসংশােধিতদের যথাযথ শাস্তি বিধান করা।
শৃঙ্খলা লংঘনকারীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান।
২৭। অপারেশন ট্রপের জন্য বিশেষ রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ক্লাশের ব্যবস্থা করা যাতে তারা আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ হয়, শৃঙ্খলা ও নির্দেশ পালনে আদর্শ হয়, গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখে।
২৮। অপারেশনকালে কমান্ডার নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে, তা কমান্ডারকে বুঝিয়ে দেওয়া। অর্থাৎ কর্মীদের বাঁচামরা, অপারেশনের সাফল্য তার উপর নির্ভরশীল-এ গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করা।
০ কমান্ডারদের জন্য বিশেষ ক্লাশ নেওয়া, তাদের পরিবর্তনশীল অবস্থা বিশ্লেষণ করে সমাধান বের করতে শেখানাে।
০ গেরিলাদের থেকে কমান্ডার হতে যােগ্য এরূপ গেরিলা প্রতিনিয়ত বের করা।
০ কমান্ডার হতে পারে এরূপ কর্মীদের অনুশীলনে দক্ষ করে তােলা।
পৃষ্ঠা: ৩৯১

০ ব্যক্তি বিশেষের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে না পড়া।
০ অপারেশনে যথাযথ কমান্ডার ঠিক করা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ এবং অপারেশনের জন্য নির্ণায়ক।
২৯। অপারেশনের জন্য গেরিলা যথাযথভাবে সংগৃহীত না হলে অপারেশনের ব্যর্থতা এবং কর্মীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
৩০। বিশেষ অবস্থার মােকাবেলার জন্য কমান্ডাে টুপ, বিশেষ টুপ গঠন করা যায়। ক্রমে ক্রমে সার্বক্ষণিক টুপ গঠন করা উচিত।
চক্রবিরােধী সংগ্রামের সময় বিশেষ টুপ গঠন করা হয়েছিল। অস্থায়ীভাবে এরা সার্বক্ষণিক ছিল এবং একস্থানে থাকত।
গেরিলাদের বাসস্থান চেনে এরূপ দু’জন কমরেড পালাক্রমে তথ্যকেন্দ্রে চব্বিশ ঘণ্টা থাকত। চক্রের সংবাদদাতারা তথ্যকেন্দ্রে খবর দিত। এরা চক্রের সম্ভাব্য যাতায়াত স্থান, বাসস্থান ও মিলনস্থানের আশেপাশে অবস্থান করতাে। চক্রের দেখা পেলে সঙ্গে সঙ্গে এসে তথ্যকেন্দ্রে রিপাের্ট করতাে।
তথ্যকেন্দ্রের কমরেড তৎক্ষণাৎ গেরিলাদের উক্ত খবর সরবরাহকারীর সাথে সংযােগ করে দিত।
এভাবে অতি অল্প সময়ের মাঝে গেরিলারা হামলাস্থলে উপস্থিত হতে পারত এবং অপারেশন চালাতে পারত।
চক্ররা মানুষ, তাই সচল এবং সতর্ক। কাজেই তাদেরকে মােকাবেলার জন্য উপরােক্ত পদ্ধতি খুবই সুবিধাজনক ছিল।
এ বিশেষ ট্রপের প্রয়ােজনীয়তা শেষ হলে তা ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
এ পদ্ধতি অন্যান্য অবস্থায়ও ব্যবহার করা যায়।
৩১। কমান্ডাে টুপঃ
টুপ সদস্যগণ অসার্বক্ষণিক হতে পারেন। এদেরকে ছােট অস্ত্র দিয়ে একাধিক লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে অপারেশনের দায়িত্ব দিতে হবে।
তারা সুবিধামত অপারেশন করে রিপাের্ট করবে। ৩২। পরিচালক/নেতা নিম্নলিখিত বিষয়ের সময়মত সমন্বয় সাধন করবেনঃ
০ গেরিলাদের সমাবেশ।
০ অস্ত্রের ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় বিষয়ের সরবরাহ।
০ যাতায়াত ব্যবস্থার সমাবেশ।
০ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অনুসন্ধানকারীর রিপাের্ট।
এ সকল বিষয়ের সময়মত ও যথাযথ সমন্বয় না হলে অপারেশন সম্ভব হবে না। যেমন- গেরিলারা এলাে, কমান্ডার এলাে না বা সব গেরিলা এলাে না, অস্ত্র এলাে না বা দেরী করে এলাে, সবকিছুই সমাবেশ হলাে কিন্তু যানবাহন এলাে না বা শেষ অনুসন্ধানের খবর এলাে না, এমন অবস্থায় অপারেশন বাতিল হয়।
০ উপরােক্ত বিষয়সমূহের সময়মত ও যথাযথ সমন্বয় করে অপারেশনের শেষ ও চূড়ান্ত অনুমতি প্রদান করা এবং টুপকে অপারেশনে পাঠানাে।
০ উপরােক্ত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন হলেও অপারেশন করা যায় কিনা। তা ভালভাবে বিবেচনা না করে অপারেশন বাতিল না করা।
পৃষ্ঠা: ৩৯২

দু’জন গেরিলা আসেনি বলে একটি অপারেশন প্রথমবার বাতিল করা হয়। এদের ছাড়াও অপারেশন করা সম্ভব ছিল।
পরের বার ঐ দু’জন বাদেই অপারেশন করা হয়। কিন্তু পূর্বদিন অপারেশন বাতিল না হলে আমরা চল্লিশ হাজার টাকা অধিক পেতাম।

অপারেশনকালীন দায়িত্ব
১। অপারেশন লক্ষ্যবস্তুর কোন পরিবর্তন দেখে অপারেশন করা হবে কি হবে না তা বিবেচনা করার সমস্যা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গেই টুপ প্রত্যাহার করে চলে আসা।
সন্দেহজনক ঘােরাফেরা, আলাপ-আলােচনা, দেরী করা উচিত নয়। কারণ অস্ত্রশস্ত্র প্রকাশ হয়ে যেতে পারে, লােকজনের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে, শক্র খবর পেয়ে যেতে পারে। ফলে সমগ্র টুপই বিপদে পড়তে পারে।
সম্প্রতি এ কারণেই একটি ট্রপ বিপদে পড়ে, অস্ত্র ও কর্মী খােয়া যায়।১
শহরে ইহা কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে।
২। গেরিলারা পরিকল্পনা মােতাবেক অবস্থান নিয়েছে, অপারেশন লক্ষ্যবস্তুও মােটামুটি পরিকল্পনামত রয়েছে দেখে অপারেশন শুরুর সংকেত প্রদান করা।
৩। অপারেশন শুরুর ও শেষের জন্য সংকেত প্রদান করা। ইহা মুখে বা বাঁশির সাহায্যে দেয়া যায়। কখনাে গ্রামে গুলির সাহায্যে দেয়া যায়।
সময়মত সংকেত বা নির্দেশ না দিলেঃ
– শত্রু হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।
– শত্রু আক্রমণ করতে পারে।
– কর্মী খােয়া যেতে পারে।
– অপারেশন ব্যর্থ হতে পারে। অনেক অপারেশনে ব্যর্থতা এ কারণে হয়।
৪। অপারেশনকালে পরিস্থিতির পরিবর্তন অনুযায়ী টুপ ও গেরিলাদের নির্দেশ দিতে হবে।
৫। অপারেশনকালে জাতীয় শত্রুর বাড়ী তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান করতে হবে। জাতীয় শত্রু পালিয়ে থাকতে পারে, তার সম্পদ লুকিয়ে রাখতে পারে।
৬। গ্রামে পার্টি ও নেতৃত্বের নামে শ্লোগান প্রদান, সম্ভব হলে জনগণকে একত্রিত করে বক্তৃতা প্রদান করা যায়।
৭। আত্মরক্ষার প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। এর জন্য ৬নং পয়েন্ট গ্রহণ করা যায় কারণ জনগণ আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল; তাই আমাদের বাধা দেবে না।
৮। অপারেশন পরিকল্পনা কার্যকরী করা।
৯। কমান্ডার অপারেশনকালে নির্দেশ প্রদান ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে সহকারী কমান্ডার নির্দেশ প্রদান ও অন্যান্য দায়িত্ব পালন করবে।
সহকারী কমান্ডারও ব্যর্থ হলে গেরিলাদের যে কেউ কমান্ডারের দায়িত্ব নিজ উদ্যোগে পালন করতে পারে।
১০। সম্ভব হলে পরিচালক একজন অনুসন্ধানকারী রেখে অপারেশন পর্যবেক্ষণ করাবে।
১১। ওয়াকিটকি বা ওয়্যারল্যাস থাকলে ডুপের কুরিয়ার অপারেশনের ধারাবিবরণী, সমস্যা, কমান্ডারের বক্তব্য পরিচালকের নিকট জানাবে এবং পরিচালক যথাযথ নির্দেশ পাঠাবে।
…………………………………………………………………….
১. ১৯৭২ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার বেতকা অপারেশনের বিপর্যয়কে এখানে বুঝানাে হয়েছে -প্রকাশক।
…………………………………………………………………….
পৃষ্ঠা: ৩৯৩

অপারেশন পরবর্তীকালীন দায়িত্ব
১। অপারেশন শেষে চলে আসা
– প্রত্যেকের চলে আসার পথ ঠিক করে দেওয়া।
– চলে আসার কালে সম্ভাব্য পরিস্থিতি ও তার সমাধান বাতলে দেওয়া। চলে আসার কালের ভুলের জন্য অনেক কমরেড ধরা পড়েছে।
২। দখলকৃত দ্রব্যাদি ও অস্ত্রাদি নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে জমা দেওয়া। তালিকা ও সম্ভব হলে স্বাক্ষরসহ জমা নেওয়া। দখলকৃত দ্রব্যাদির স্থান পরিবর্তন।
৩। সনাক্ত করা যায় এরূপ দখলকৃত জিনিসপত্র নিয়ে বাইরে চলাফেরা না করা। অপারেশনে ব্যবহৃত যানবাহনে বাইরে না ঘােরা।
৪। আহত/মৃতদের সমস্যার সমাধান।
০ গ্রেফতারকৃতদের সমস্যার সমাধান।
০ অভিজ্ঞতার সারসংকলন।
০ উচ্চস্তরে মূল্যবান দ্রব্যাদি, রিপাের্ট ও সারসংকলন পাঠানাে।
৫। প্রচার করা।

উপসংহার
একটি অপারেশন জটিল কাজ, বহু বিষয়ের যথাযথ সমন্বয় প্রয়ােজন। অপারেশনের মাধ্যমে এর নিয়মবিধি জানতে হবে এবং অধিকতর সফলতার সাথে অপারেশন করতে হবে।
কমান্ডার, গেরিলাগণ সাহসী ও বিচক্ষণ হবেন, সৃজনশীলভাবে অপারেশন সংক্রান্ত সমস্যাবলীর সমাধান করবেন। অপারেশনসমূহ সফলতার সাথে করবেন, ক্রমে ক্রমে জটিলতর অপারেশন করার যােগ্যতা অর্জন করবেন।

পরিশিষ্ট-২
জাতীয় শত্রু
০ জনগণ কর্তক ঘনীত ছয় পাহাড়ের দালাল সরকারের চোখ-কান।
০ পার্টি-জনগণ বিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত জনগণ ঘৃনীত প্রতিক্রিয়াশীল।
০ অমার্জনীয় অপরাধ করেছে এরূপ সরকারী/আধাসরকারী, সামরিক/আধাসামরিক
কর্মচারী।
০ জনগণ কর্তৃক ঘৃনীত ডাকাত, লুটেরা, খুনী, দাঙ্গাকারী।
০ পাক দস্যুদের প্রাক্তন দালাল যারা জনগণ কর্তৃক ঘৃনীত এবং বর্তমানেও অত্যাচারী।
০ দলত্যাগী ও বহিস্কৃতদের মাঝে বিশ্বাসঘাতক, পার্টি, বিপ্লব, জনগণ বিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত বৈর ব্যক্তি।
০ প্রকাশ্য/গােপন শত্ৰুচর।
০ সরকারী-আধাসরকারী সম্পদও জাতীয় শত্রু সম্পদ বলে পরিগণিত হবে।
পৃষ্ঠা: ৩৯৪

পূর্ব বাংলার আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যে
ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ১নং বিবৃতি
(ডিসেম্বর, ১৯৭২। প্রচারের জন্য গৃহীত ১৯৭৩)

পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার ঐক্যের পরিকল্পনা
পূর্ব বাংলার জনগণ, সর্বহারা শ্রেণী এবং আন্তরিকভাবে বিপ্লবীরা সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার অনৈক্য, বারংবার বিভক্তিতে খুবই দুঃখিত।
তারা বিপ্লবীদের ঐক্য চান। জনগণ, সর্বহারা শ্রেণী ও বিপ্লবীদের আন্তরিক আকাঙ্খর সাথে আমরাও একাত্মতা ঘােষণা করি। পূর্ব বাংলার বর্তমান বিপ্লবী পরিস্থিতিতে এ ঐক্য আরাে অধিক প্রয়ােজন।
এ কারণে সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিকল্পনা পেশ করা হচ্ছে।
আমরা আশা করি আন্তরিকভাবে বিপ্লবীরা এ পরিকল্পনা বিবেচনা করবেন এবং ঐক্যের প্রচেষ্টায় সাড়া দিবেন।
আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে সর্বহারা বিপ্লবীদের ঐক্য সর্বহারা শ্রেণী ও জনগণের ঐক্যের মৌলিক শর্ত এবং বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের সফলতার পূর্বশর্ত।

সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যকার ঐক্যের ভিত্তি নিম্নরূপ
* পূর্ব বাংলার বিপ্লবের পথ প্রদর্শক তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারা গ্রহণ।
* পূর্ব বাংলার বিপ্লবের বিশেষ অনুশীলনের সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার বিশেষ প্রয়ােগের নীতি স্বীকার করা।
* সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশােধনবাদী এবং অন্যান্য বিভিন্ন আকৃতির সংশােধনবাদী ও সুবিধাবাদীদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিরােধিতা করা।
* মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং সম্প্রসারণবাদকে বিরােধিতা করা।

মার্কসবাদের মৌলিক বিষয় হচ্ছে অনুশীলন। মার্কসবাদের মৌলিক নীতিসমূহকে বজায় রেখে অনুশীলনের ভিত্তিতে মার্কসবাদীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একটিই রাজনৈতিক পার্টি হতে পারে।
পৃষ্ঠা: ৩৯৫

একটি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক পার্টি হতে পারে না। এ কারণে পূর্ব বাংলায়ও সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী একাধিক পার্টি হতে পারে না।
অতএব, একাধিক পার্টির অস্তিত্ব বিলােপ করে একটি পার্টি গড়ে তােলা। আন্তরিকভাবে সর্বহারা বিপ্লবীদের বিপ্লবী দায়িত্ব।
এ দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুকরা হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর সাথে বিশ্বাসঘাতক।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নে বিতর্ক বজায় রেখেও নিম্নভাবে ঐক্য সম্ভব।
হক, আমজাদ গ্রুপসমুহ সােভিয়েটের ও ভারতের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান বলেন। তারা বলেন, পূর্ব বাংলা রাশিয়ার উপনিবেশ, ভারত তা তদারক করছে।
জনাব তােহা বলেন, পূর্ব বাংলা ভারত-রাশিয়া উভয়েরই উপনিবেশ। ভারতরাশিয়া উভয়ের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব।
মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্বকে প্রধান বলেন। এদের মতে পূর্ব বাংলা আধা উপনিবেশ। ” পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে। এ থেকে আসে পূর্ব বাংলা ভারতের উপনিবেশ।
এ বিশ্লেষণ থেকে সামরিক ক্ষেত্রে সর্বহারা পার্টির লাইন হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করা। এ জাতীয় শত্রুরা একই সাথে জনগণ কর্তৃক ঘৃণীত এবং সরকারের চোখ-কান।
হক, তােহা, আমজাদের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গৃহীত সামরিক লাইন হচ্ছে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ, এবং স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলাযুদ্ধ সূচনা করা।
কাজেই জাতীয় শত্রু নির্ণয়ের প্রশ্নে অর্থাৎ সামরিক লাইনে হক, তােহা, আমজাদের সাথে সর্বহারা পার্টির পার্থক্য নেই। তারা যাদেরকে জাতীয় শত্রু বলেন, সর্বহারা পার্টিও তাদেরকে জাতীয় শত্রু বলে। কাজেই সামরিক লাইন ও অনুশীলনের বর্তমান মুহুর্তে “জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তযুদ্ধ শুরু কর”- এ শ্লোগানের ভিত্তিতে হক, তােয়াহা, আমজাদ গ্রুপের সাথে সর্বহারা পার্টির ঐক্য সম্ভব। এ জাতীয় শত্রু খতমের প্রক্রিয়ায় পুলিশ, বিডিআর, রক্ষী বাহিনী, ভারতীয় বাহিনী প্রভৃতিদের ঘেরাও দমনের বিরুদ্ধে গণযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়ােগে সর্বহারা বিপ্লবীদের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতে পারে না।
কাজেই গ্রাম মুক্ত করা, গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা এবং ঘাটি এলাকা গঠন প্রভৃতি সামরিক অনুশীলন অর্থাৎ সশস্ত্র সংগ্রাম আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করতে পারি।
এ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হবে ভারত-রাশিয়া উভয়ে, না শুধুমাত্র ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ প্রধান শত্রু।
উপরােক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় জাতীয় শত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তির গেরিলা যুদ্ধ সূচনা থেকে ঘাটি এলাকা গঠনের পর্যায় পর্যন্ত প্রধান দ্বন্দ্বের প্রশ্নে আভ্যন্তরীণ বিতর্ক বজায় রেখেও অনুশীলনের ভিত্তিতে আমাদের ঐক্য বজায় রেখে কাজ করা সম্ভব।
সাংগঠনিক ঐক্য সাংগঠনিক ঐক্যের পূর্বে প্রয়ােজন মতাদর্শগত ঐক্য।
পৃষ্ঠা: ৩৯৬

মতাদর্শগত ঐক্য না হলে সাংগঠনিক ঐক্য টিকতে পারে না। তার প্রমাণ হচ্ছে হক-তােয়াহা-মতিন-আলাউদ্দিন, দেবেন-বাসারদের বিভক্ত হয়ে পড়া, হক-তােয়াহাদের বিভক্ত হয়ে পড়া, মতিন-আমজাদদের বিভক্ত হয়ে পড়া। কাজেই সাংগঠনিক ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে মতাদর্শগত ঐক্য।
এ ঐক্য প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে ঐক্যে ইচ্ছুক বিপ্লবীরা একে অপরকে কমরেডসুলভ সমালােচনা ও নিজেরা আত্মসমালােচনা করবেন।
প্রকাশ্য সমালােচনা পরিহার করবেন এবং ঐক্য বিষয়ক কাজকে প্রাধান্য দিবেন, ঐক্য ব্যাহত হয় এরূপ কার্য পরিহার করবেন।
ঐক্যে ইচ্ছুক নয় কিন্তু আন্তরিকভাবে বিপ্লবীদের সাথেও সংযােগ স্থাপন করা, তাদেরকে ঐক্যের পক্ষে বুঝানাে, ধীরে ধীরে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
কেবলমাত্র ঐক্যে অনিচ্ছুক প্রমাণিত শত্ৰুচরদেরই প্রকাশ্যে মুখােশ উন্মােচন করা।
মতাদর্শগত ঐক্যের উদ্দেশ্যে বিভেদপন্থীবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, উপদলবাদ ও গােড়ামীবাদ বিরােধী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা। এ শুদ্ধি অভিযান পরিচালনায় ঐক্যে ইচ্ছুক একে অপরকে সহায়তা করা এবং একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা।
এ প্রক্রিয়ায় বিভেদপন্থীবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, উপদলবাদ এবং গােড়ামীবাদ মুক্ত কমরেডগণ সাংগঠনিকভাবে ঐক্যের পদক্ষেপ নিবেন।
এ প্রক্রিয়ায় ঐক্যে ইচ্ছুক আন্তরিক বিপ্লবীদের কেডার ইতিহাস সংগ্রহ করা এবং সাংগঠনিকভাবে ঐক্যের সময় তা বিবেচনা করা। এর ফলে এজেন্ট ও খারাপ লােকদের অনুপ্রবেশ ব্যাহত হবে। ঐ ঐক্যের সাংগঠনিক লাইন হচ্ছে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা।
পূর্ব বাংলার বর্তমান ও অতীত রাজনৈতিক প্রশ্ন
রাজনৈতিক প্রশ্নে বিতর্কমূলক বিষয়ে অনুশীলন প্রমাণ ব্যতীত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত থাকা। কারণ অনুশীলনসিদ্ধ নয় এরূপ প্রশ্নে তত্ত্ব থেকে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে ঐক্য বিনষ্ট হবে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঐক্যমতে পৌঁছানাে সম্ভব এরূপ বিষয়সমূহ খুঁজে বের করা, বিতর্কিত বিষয়সমুহ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার মৌলিক নীতি ও অনুশীলনের ভিত্তিতে একটি একটি করে ঐক্যে পৌঁছানাে।
পূর্ব বাংলার অতীত রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সম্পর্কেও বিতর্কমূলক প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত থাকা।

মতিন-আলাউদ্দিন প্রসঙ্গে
এরা সামন্তবাদের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্বকে প্রধান বলেন। শ্রেণী শত্রু খতমের মাধ্যমে গেরিলাযুদ্ধ চালাতে চান।
শ্ৰেণী শত্রু হিসেবে জনগণ কর্তৃক ঘৃণীত সরকারের চোখ-কান যদি খতম করা হয় তবে সর্বহারা পার্টির জাতীয় শত্রু খতমের লাইনের সাথে সামরিক অনুশীলনে এর কোন পার্থক্য নেই।
পৃষ্ঠা: ৩৯৭

শ্রেণী শত্রু না জাতীয় শত্রু এ প্রশ্নে সর্বহারারা বিভক্ত না হয়েও সামরিক অনুশীলনে নিম্নোক্ত সাধারণ শ্লোগান নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
গ্রামসমূহকে প্রতিক্রিয়াশীলদের কজা থেকে মুক্ত কর।’
এ কজা ভাঙ্গার প্রক্রিয়ায় পুলিশ, বিডিআর, রক্ষী বাহিনী, সেনাবাহিনী এলে তাদের বিরুদ্ধে গণযুদ্ধের রণনীতি ও রণকৌশল প্রয়ােগে কোন দ্বিমত সর্বহারা বিপ্লবীদের থাকতে পারে না।
এ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হবে পূর্ব বাংলার প্রধান দ্বন্দ্ব।
কাজেই প্রধান দ্বন্দ্বের প্রশ্নে বিভক্ত না হয়ে আভ্যন্তরীণ বিতর্ক চালিয়েও সামরিক অনুশীলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা সম্ভব।

দেবেন-বাসার প্রসঙ্গে
এরা প্রকাশ্য ও গণসংগঠনের কাজ করতে চান। এ পরিপ্রেক্ষিতে সর্বহারা পার্টির বিরােধ নেই।
তবে গােপন পার্টি কাজ ও সশস্ত্র সংগ্রাম প্রধান কাজ।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারাকে তাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা, সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে আধুনিক সংশােধনবাদকে বিরােধিতা করা, ভ্রাতৃপ্রতীম পার্টিসমূহ সম্পর্কে প্রকাশ্যে সমালােচনা না করা, দেশীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বিতর্কমূলক বিষয়ে প্রকাশ্যে মতামত পেশ না করা, সাংগঠনিক ও মতাদর্শগত ক্ষেত্রে বিভেদপন্থীবাদ, উপদলবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ, গােড়ামীবাদ, কর্মপদ্ধতির ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ও গৌণ কাজের সম্পর্কের উপর শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার ভিত্তিতে ভুল চিন্তাধারা ও ভুল কর্মপদ্ধতি পরিহার করে সাংগঠনিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব।
সাংগঠনিক লাইন হবে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা। অনুশীলন প্রমাণিত নয় এরূপ বিষয়ে তত্ত্বগত বিতর্ক করেই সিদ্ধান্ত না নেওয়া যাতে ঐক্য বিনষ্ট না হয়।

উপসংহার
দেশীয় আন্তর্জাতিক অনুশীলনে প্রমাণিত নয় এরূপ প্রশ্নে তত্ত্বগত বিতর্ক করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা বা বিভক্ত হওয়া বা বিভক্ত থাকা উচিত নয়।
পার্টির নেতৃত্বে প্রধান ধরনের সংগঠন হচ্ছে সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রধান ধরনের সংগ্রাম হচ্ছে সশস্ত্র সংগ্রাম।
উপনিবেশিক বা আধা-উপনিবেশিক, সামন্তবাদী বা আধা-সামন্তবাদী দেশে গ্রামসমূহ মুক্ত করা, ঘাটি এলাকা গঠন করা, গ্রাম দখল করে শহর ঘেরাও করা এবং শেষ পর্যন্ত শহরসমূহ দখল করা হচ্ছে বিপ্লবের মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
কাজেই প্রধান ধরনের সংগঠন গড়ে তােলা, প্রধান ধরনের সংগ্রাম এবং বিপ্লবের। মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহের ক্ষেত্রে আমাদের অনুশীলনে ঐক্য সম্ভব। অর্থাৎ ঐক্যের দিকই হচ্ছে প্রধান, অনৈক্যের দিক গৌণ। কাজেই রাজনৈতিক বা অন্যান্য ক্ষেত্রে বিতর্ক চালিয়ে যেয়েও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা সম্ভব।
আমরা আশা করি আন্তরিক বিপ্লবীরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওসেতুঙ চিন্তাধারার সার্বজনীন সত্য এবং অনুশীলনের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবেন।
পৃষ্ঠা: ৩৯৮

বিভিন্ন প্রশ্নে বিতর্কের জন্য বিভক্ত হয়ে পার্টির অধীন প্রধান সংগঠন (সশস্ত্র বাহিনী), প্রধান ধরনের সংগ্রাম সশস্ত্র সংগ্রাম এবং ঘাটি এলাকা গঠনের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা উচিত নয়। কারণ জনগণের গণবাহিনী ছাড়া কিছুই নেই এবং ঘাটি এলাকা প্রতিষ্ঠা হচ্ছে বিপ্লবের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ঘাটি এলাকায়ই বিভিন্ন প্রশ্নে বিতর্ক করা, গবেষণা এবং সমাধান করা শ্রেয় হবে।
পূর্ব বাংলার ও বিশ্বের সর্বহারা শ্রেণী, জনগণ ও বিপ্লবের স্বার্থে আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।
পৃষ্ঠা: ৩৯৯

পূর্ব বাংলা কি সােভিয়েটের উপনিবেশ, না ভারত-সােভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ, না ভারতের উপনিবেশ—এ বিষয়ে হক-আমজাদ ও তােয়াহাদের নিকট কয়েকটি প্রশ্ন
(জানুয়ারি, ১৯৭৩)

১। হক গ্রুপ ও আমজাদ গ্রুপ বলে পূর্ব বাংলা সােভিয়েটের উপনিবেশ। ভারত তা তদারক করছে।
সকলেই জানেন, মনিসিং-সালাম কমিউনিস্ট পার্টি, মােজাফফর ন্যাপ প্রভৃতি হচ্ছে। মস্কোপন্থী, অর্থাৎ, মস্কোর সবচাইতে বিশ্বস্ত দালাল। পূর্ব বাংলার পুতুল সরকার এদের দ্বারা গঠিত না হয়ে গঠিত হয়েছে আওয়ামী লীগের দ্বারা। এই আওয়ামী লীগ কিছুদিন পূর্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালী করেছে। বর্তমানেও এর এক অংশ (মার্কিনের) দালালী করছে। সােভিয়েটের উপনিবেশে তার বিশ্বস্ত দালাল মস্কোপন্থীদের দ্বারা পুতুল সরকার গঠিত না হয়ে গঠিত হলাে আওয়ামী লীগ দ্বারা। ইহা কিভাবে সম্ভব?
২। কেউ কেউ বলতে পারেন আওয়ামী লীগ জনপ্রিয়, তাই তাদের দ্বারা সরকার গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ জনপ্রিয় হলেও একজন মস্কোপন্থী মন্ত্রীও কেন গ্রহণ করা হলাে না? প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য, মস্কোপন্থীরা সর্বদাই মন্ত্রীসভায় তাদের প্রতিনিধির দাবী করছে।
বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার জনপ্রিয়তা পুরােপুরি হারিয়েছে। এ অবস্থায় কেন সােভিয়েট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগকে সরিয়ে তার দালাল মস্কোপন্থীদের ক্ষমতায় বসায়।
(পূর্ব ইউরােপের উপনিবেশগুলােতে যা সে প্রায়ই করে থাকে)?
৩। সম্প্রতি মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগ প্রণীত সংবিধানে স্বাক্ষর করেনি, আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ চাচ্ছে, আওয়ামী লীগ বিরােধী প্রচারণা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগও পাল্টা তাদের পিটুনী দিচ্ছে।
এ সকল ঘটনাবলী কি প্রমাণ করে না যে, সােভিয়েট ইউনিয়ন তার দালাল মস্কোপন্থীদের দ্বারা পূর্ব বাংলার ক্ষমতা দখল অথবা পূর্ব বাংলার ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে? পূর্ব বাংলা যদি সােভিয়েটের উপনিবেশই হতাে তবে সােভিয়েটের অঙ্গুলী হেলনেই পুতুল সরকার পরিবর্তিত হতাে। ক্ষমতার জন্য মস্কোপন্থীদের আওয়ামী লীগের সাথে কামড়া-কামড়ি করতে হতাে না (মার্কিনের উপনিবেশ ভিয়েতনামে মার্কিনের অঙ্গুলী হেলনেই পুতুল সরকার পরিবর্তিত হয়)।
৪। কেউ কেউ বলতে পারেন সােভিয়েটের উপনিবেশিক শােষণ মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। কাজেই তার পরিবর্তনের প্রয়ােজন কি? আওয়ামী লীগ সােভিয়েটের উপনিবেশিক শােষণ মেনে নিলেও সােভিয়েট ইউনিয়ন তার বিশ্বস্ত ও নির্ভশীল দালাল মস্কোপন্থীদেরকে কেন পুতুল সরকারের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত করল না,
পৃষ্ঠা: ৪০০

অথবা আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থীদের নিয়ে একটি সােভিয়েটের দালাল পার্টি তৈরী ও তাদের দ্বারা একটি নতুন পুতুল সরকার গঠন করল না?
বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মস্কোপন্থীদের নিয়ে তথাকথিত ‘গণসংহতি কমিটি গঠিত হয়েছে জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দাবিয়ে রাখার জন্য।
অতীতে রাজাকার-আলবদর যেরূপ পাক সামরিক দস্যুদের দালালী করেছে তেমনি বর্তমানে মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগের দালালী করছে। এ সকল তথাকথিত কমিটি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতেই রয়েছে। মস্কোপন্থীরা এর ভাগ পায়নি। তারা আওয়ামী লীগের পুতুল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে মাত্র।
৫। সােভিয়েটের উপনিবেশ পূর্ব বাংলা, ভারত তা তদারক করছে অর্থাৎ, ভারত। সােভিয়েটের নির্দেশে চলছে। এর অর্থ কি এ নয় যে ভারত সােভিয়েটের উপনিবেশে পরিণত হয়েছে? ভারত সরকার সােভিয়েটের পুতুল সরকার? কিন্তু প্রকৃত বিষয় হচ্ছে, ভারত একটি আধা-উপনিবেশিক দেশ। ভারত যদি সােভিয়েটের উপনিবেশ হতাে তা হলে ভারতের মস্কোপন্থীরাই ভারতের সরকার গঠন করতাে অথবা সরকারের অংশীদার হতাে।
৬। জনাব তােয়াহা বলেন, পূর্ব বাংলা ভারত-সােভিয়েটের উপনিবেশ। একটি দেশ দুটি দেশের উপনিবেশ কীভাবে হতে পারে?
একটি দেশের দুটি অঞ্চল যদি দুই উপনিবেশিক শক্তির দখলে থাকে তাহলেই এটা হতে পারে। একটি উপনিবেশিক শক্তি কর্তৃক দখলকৃত অঞ্চলে বৈদেশিক শােষকরা লুণ্ঠনের বখরা বসাতে পারে (অঞ্চল দখল না করেও)। যেমন, মার্কিনের উপনিবেশ ভিয়েতনামে জাপানী সাম্রাজ্যবাদীরা লুণ্ঠনের বখরা বসিয়েছে। কাজেই পূর্ব বাংলা একই সাথে দুই শক্তির উপনিবেশ হতে পারে না। একটি শক্তির উপনিবেশ পূর্ব বাংলায় অন্য। শক্তি লুণ্ঠনের বখরা নিচ্ছে।
৭। পূর্ব বাংলা ভারত-সােভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ হলে বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে অবশ্যই উভয়ের নিকট দায়ী থাকতে হবে। একটি সরকার একইসাথে দুই উপনিবেশিক শক্তির নিকট কীভাবে দায়ী থাকে?
৮। পূর্ব বাংলা ভারত ও সােভিয়েটের উপনিবেশ। ভারত হচ্ছে একটি আধা-উপনিবেশিক আধা-সামন্তবাদী দেশ। এই আধা-উপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী। দেশের উপনিবেশ হচ্ছে পূর্ব বাংলা। জনাব তােয়াহার বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, আধা-উপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী দেশের উপনিবেশ থাকতে পারে। এভাবে জনাব তােয়াহা তার অতীত বক্তব্য “আধা-সামন্তবাদী, আধা-উপনিবেশিক দেশের উপনিবেশ। থাকতে পারে না”-কে খণ্ডন করেছেন।
৯। বাংলাদেশ ভারত ও সােভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ- প্রমাণ করে ভারত ও সােভিয়েট ইউনিয়ন সমপর্যায়ের দেশ। অর্থাৎ, ভারতও সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশ। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে-ভারত একটি আধা-উপনিবেশিক, আধা-সামন্তবাদী দেশ। একে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের সমপর্যায়ভূক্ত করা হচ্ছে চরমতম ভুল।
১০। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, একইসাথে দুটি দ্বন্দ্ব প্রধান হতে
পৃষ্ঠা: ৪০১

পারে না; একটি প্রধান হবে, অপরটি গৌণ হবে। কাজেই ভারত সােভিয়েট উভয়েই প্রধান দ্বন্দ্ব, প্রধান শত্রু বা উভয়েরই উপনিবেশ পূর্ব বাংলা হতে পারে না।
অবশ্যই একটি প্রধান দ্বন্দ্ব, একটি প্রধান শত্রু এবং পূর্ব বাংলা একটি দেশের উপনিবেশ হবে। কাজেই “পূর্ব বাংলা ভারত-সােভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ, উভয়ের সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব, উভয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের প্রধান। শত্রু”-এ বক্তব্য মার্কসবাদ পরিপন্থী।
১১। উপরােক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, পূর্ব বাংলা সােভিয়েতের উপনিবেশ-এ বক্তব্য ভুল; পূর্ব বাংলা ভারত ও সােভিয়েট উভয়ের উপনিবেশ-এ বক্তব্যও ভুল।
প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলা হচ্ছে ভারতের উপনিবেশ যেখানে সােভিয়েট ইউনিয়ন এবং মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীরা লুটের ভাগ বসিয়েছে।
* *

সংযােজনীঃ (অক্টোবর ১৯৭৩)
সম্প্রতি তােয়াহারা তাদের বক্তব্য (“পূর্ব বাংলা ভারত-সােভিয়েটের উপনিবেশ”) পাল্টিয়ে বলছেন, “পূর্ব বাংলা সােভিয়েটের নয়া উপনিবেশ এবং ভারতের আশ্রিত রাজ্য।”
নয়া উপনিবেশবাদ ও তার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে লি-ডুয়ান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী ভিয়েতনামী জনগণের সুদীর্ঘ দিনের সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে যেয়ে বলেন, “নয়া উপনিবেশবাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নয়া-উপনিবেশে সাম্রাজ্যবাদীরা সরাসরি প্রশাসন ব্যবস্থা চালায় না। এর পরিবর্তে তারা দেশীয়দের দ্বারা সরকার পরিচালনা করে। এ দেশীয়রা সামন্তবাদ ও দেশীয় বুর্জোয়ার (ComprQdor Bourgeous)স্বার্থরক্ষা করে এবং একটি জাতীয় গণতান্ত্রিক বেশ নেয়।” (Le DUqn-The Vietnamese Revolution, Fundamental Problems of Essential Task, Page-24} উপরােক্ত ভিয়েতনামী অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় পূর্ব বাংলাকে সােভিয়েটের নয়া উপনিবেশ বলতে বুঝায়, পূর্ব বাংলা সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের এমন উপনিবেশ যা তারা নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের তাবেদার আওয়ামী লীগ পুতুল সরকারের মাধ্যমে (নিজেরা সরাসরি নয়)।
পূর্ব বাংলার বাস্তব অবস্থা প্রমাণ করেছে, পূর্ব বাংলা সােভিয়েটের নয়া উপনিবেশ নয় বা বাংলাদেশ সরকার সােভিয়েট নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার নয়। সিকিম, ভূটান ভারতের আশ্রিত রাজ্য। সম্প্রতিকালের সিকিমের ঘটনা প্রমাণ করেছে আশ্রিত রাজ্যের স্বাধীন সত্তা নেই। সিকিম ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন।
উপরে বর্ণিত আশ্রিত রাজ্যসমূহের সরকার হচ্ছে ভারতের নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার।
এ নিয়ন্ত্রণ থেকে আশ্রিত রাজ্যসমূহ মুক্তি চায়। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়।
এখানে দেখা যায়, পূর্ব বাংলাকে ভারতের আশ্রিত রাজ্য বললে বুঝায় পূর্ব বাংলা ভারতের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশ এবং বাংলাদেশ সরকার ভারতের নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার।
উপরােক্ত বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, পূর্ব বাংলাকে একই সময়ে সােভিয়েটের নয়া
পৃষ্ঠা: ৪০২

উপনিবেশ এবং ভারতের আশ্রিত রাজ্য বললে বুঝায় পূর্ব বাংলা একই সময়ে সােভিয়েটেরও নিয়ন্ত্রিত, ভারতেরও নিয়ন্ত্রিত; বাংলাদেশ সরকার একই সময়ে সােভিয়েট ও ভারত উভয়েরই নিয়ন্ত্রিত পুতুল সরকার। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, একটি দেশ একই সময়ে দুটো দেশের দ্বারা উপনিবেশের অনুরূপ নিয়ন্ত্রিত এবং একটি সরকার। একই সাথে দুটো দেশের পুতুল সরকার কীভাবে হয়?
সােভিয়েটের নয়া-উপনিবেশ হিসেবে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং প্রধান সংগ্রাম সােভিয়েটের বিরুদ্ধে, আবার আশ্রিত রাজ্য হিসেবে প্রধান দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম ভারতের বিরুদ্ধে।
এ থেকে দেখা যায়, তােয়াহা সাহেবের বক্তব্য মতে দুই দ্বন্দ্ব ও দুই শত্রু প্রধান হয়।
তােয়াহা সাহেবের এ বক্তব্য মার্কসবাদের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত তত্ত্বসমূহের সাথে পুরােপুরি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং ভুল। পূর্ব বাংলা একই সাথে সােভিয়েটের নয়া-উপনিবেশ এবং ভারতের আশ্রিত রাজ্য হতে পারে না।
প্রকৃত পক্ষে পূর্ব বাংলা হচ্ছে ভারতের উপনিবেশ যেখানে সােভিয়েট সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মার্কিনের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের শােষণ বর্তমান।

কমরেড সিরাজ সিকদার জিন্দাবাদ।
পূর্ব বাংলার সর্বহারারা-ঐক্যবদ্ধ হােন।
পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করুন।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি-জিন্দাবাদ।
পৃষ্ঠা: ৪০৩

Previous                         Next

error: <b>Alert:</b> Due to Copyright Issues the Content is protected !!